পেট সেমেটারি – স্টিফেন কিং
অনুবাদ : রাইসুল আরেফিন
বাতি প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২০
প্রচ্ছদ : ডিলান
উৎসর্গ :
জীবনের প্রথম অনুবাদটি উৎসর্গ করছি আমার মা’কে….
কারণ ছোটবেলায় পড়া ফাঁকি দিয়ে গল্পের বই পড়লে মা কখনো বকেনি।
Book Content
পর্ব-১
অধ্যায় ১
লুইস ক্রিড তার বাবাকে হারিয়েছে তিন বছর বয়সে, আর দাদাকে তো দেখার সৌভাগ্যই হয়নি। মাঝ বয়সে এসে বাবার মত একজন মানুষ পাবে, তা সে কল্পনাতেও ভাবেনি। কিন্তু ঘটল ঠিক তাই…যদিও সে লোকটিকে নিজের বন্ধু বলে থাকে। যে লোকটির তার বাবা হওয়া উচিত ছিল, তাকে মাঝবয়সে এসে পেলে আর কী-ই বা ডাকা যায়? লোকটির সাথে লুইসের প্রথম দেখা হয় সেদিন, যেদিন বিকেলে সে তার নতুন সাদা বাড়িতে ওঠে। সাথে ছিল তার স্ত্রী, ছেলে এবং মেয়ে। আর ছিল উইনস্টন চার্চিল, ওরফে চার্চ। চার্চ তার মেয়ের বিড়াল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে একটি বাড়ি খোঁজার কাজ বিশ্ববিদ্যালয়েরই ঠিক করে দেয়া অনুসন্ধান কমিটি করেছে গদাই লস্করি চালে। একটি “খাসা” বাড়ি খুঁজে বের করতে যেন তাদের কালঘাম ছুটে গেছে।
ক্রিড পরিবারের সবাই বিরক্ত। গেজ হৈচৈ, কামড়া-কামড়ি করে হুলুস্থুল করছে। সে ঘুমাবে না, রাচেল যতই তাকে ঘুমপাড়ানি গান শোনাক না কেন। তাকে রুটিনের বাইরে বাড়তি দুধও দেয়া হয়েছে। গেজ শিশু হলেও নিজের দুধ খাবার রুটিন খুব ভালোভাবে জানে, এমন কি হয়তো তার মায়ের চাইতেও ভালো জানে। কিন্তু সে দুধ খাওয়ার সময় মাকে নিজের নতুন দাঁতগুলো দিয়ে বিচ্ছিরিভাবে কামড়ে দিচ্ছে। নিজের শহর শিকাগো থেকে মেইনে বাসা বদলানোটা ভালো হলো না মন্দ হলো সেই বিষয়ে রাচেল এখনো শতভাগ নিশ্চিত না। সে হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ে। মায়ের দেখাদেখি আইলিনও কান্নায় যোগ দেয়। স্টেশন ওয়াগনটার পেছনে চার্চ অস্থির হয়ে ছোটাছুটি করছে, যেমনটা সে গত তিনদিনের ভ্রমণের পুরোটা সময় জুড়ে করছে। খাঁচার ভেতরে বন্দি চার্চের মরা কান্নায় ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে সাড়ে সর্বনাশ হয়েছে। মাথা খেয়ে ফেলছে বিড়ালটা।
লুইসের নিজেরই কাঁদতে মন চাচ্ছিল। বুনো একটি আইডিয়া তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। আইডিয়াটি তার বেশ পছন্দও হচ্ছে। আইডিয়াটি হচ্ছে, সে সবাইকে বলবে তারা ব্যাঙ্গর টাউনে ফিরে মুভিং ট্রাকের জন্যে অপেক্ষা করবে। আর তার পরিবারের তিন রত্নকে গাড়ি থেকে নামিয়েই সে গাড়ির স্পিড তুলে পালিয়ে যাবে, একবারও পেছনে না ফিরে। সে দক্ষিণ দিকে ড্রাইভ করে অর্ল্যান্ডো, ফ্লোরিডা পর্যন্ত যাবে। সেখানে গিয়ে ডিজনি ল্যান্ডে মেডিকেল অফিসারের চাকরি নেবে, ছদ্মনামে। অবশ্য পথে সে একবার গাড়ি থামিয়ে বজ্জাত বিড়ালটাকে বাইরে ছুড়ে ফেলবে।
একটুবাদেই, একটা লম্বা বাঁক নেয়ার পর বাড়িটা দেখা যায়। বাড়িটা আগে শুধু লুইস দেখেছে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেছে দেয়া সাতটা বাড়ি দেখে এ বাড়িটাই তার পছন্দ হয়েছে। বাড়িটা বেশ বড়, ইংলিশ ঔপনিবেশ আমলে তৈরি। তবে নতুন করে অনেক কাজ করা হয়েছে বসবাসের জন্য। দেয়ালের কাজ, ইনসুলেশনের কাজ নতুন করে করা হয়েছে। বাড়ি গরম রাখার খরচ যথেষ্ট বেশি হলেও তা সহনীয়। নিচতলায় তিনটি আর ওপরতলায় চারটি রুম। সাথে একটা বড় শেড আছে যেটায় পরে আরও রুম করা যাবে। বাড়ির চারদিক ঘিরে বেশ বড়সড় চমৎকার একটা উঠোন। আগস্টের গরমেও উঠোন সবুজ হয়ে আছে।
বাড়ির পেছনে বাচ্চাদের খেলার জন্য বিশাল মাঠ। আর ওই মাঠের পেছনে দুচোখ যদ্দুর যায় তদ্দুর পর্যন্ত বন-জঙ্গল। বাড়ির সীমানা একদম সরকারি খাস জমি ঘেঁসে। বাড়ির রিয়েন্টর বলেছে অদূর ভবিষ্যতে আশেপাশে অন্য কোন স্থাপনা নির্মাণেরও সম্ভাবনা নেই। মিকমেক ইন্ডিয়ানদের অবশিষ্ট বংশধরেরা আট হাজার একর জমি দাবি করছে লাডলো এবং তার পূর্ব দিকের শহরগুলোতে। কিন্তু সেই জমির মামলা এমন কচ্ছপের গতিতে এগুচ্ছে যেন তা জীবনেও শেষ হবে না।
রাচেল কান্না থামিয়ে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো “এটাই?”
“এটাই,” লুইস বলল। তার দুশ্চিন্তা না, হয়তো ভয় লাগছে। কিন্তু আসলে সে আতঙ্কিত। তাদের জীবনের বারোটা বছর এই বাড়ির পেছনে বন্ধক রেখেছে সে। সেটা পরিশোধ হতে হতে আইলিনের বয়স হয়ে যাবে সতেরো।
সে ঢোক গিলল।
পেট সেমিটারি
“আমার তো দেখে ভালোই লাগছে,” রাচেলের কোথায় লুইসের মন থেকে একটা বড় পাথর নেমে গেল। রাচেলের একাগ্র দৃষ্টিই তাকে বলে দিচ্ছে কথাটা সে নিছক ঠাট্টা করে বলেনি। বাড়ির পিচঢালা ড্রাইভওয়েতে মোড় নিতে নিতে সে দেখলো রাচেলের দৃষ্টি বাড়ির কালো জানালাগুলোর ওপর ছুঁয়ে যাচ্ছে। হয়তো ও এখনই ভাবছে কী রঙের পর্দা সে জানালায় টাঙাবে, আলমারির ওপরে কেমন রেক্সিন বিছাবে, আর খোদাই জানে আর কোন বিচিত্র ভাবনা!
“বাবা?” এলি পেছন থেকে ডাকে। সেও কান্না বন্ধ করেছে। এমনকি গেজও হৈচৈ থামিয়ে দিয়েছে। লুইস এই নীরবতা খুব উপভোগ করছে।
“কী, মামনি?”
রিয়ারভিউ আয়নায় সে দেখলো, রাচেলের কালচে স্বর্ণকেশের নিচের চোখজোড়া বাড়িটাকে, সামনের খোলা উঠানকে, বামের বাড়িটার ছাদকে আর জঙ্গল পর্যন্ত বিস্তীর্ণ মাঠটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।
এটাই কি আমাদের বাড়ি?” আইলিন জিজ্ঞেস করে।
“এখনো না, তবে শিগগিরই হতে যাচ্ছে, মামনি।”
“হুররে!” এলি চেঁচিয়ে উঠে কান ফাটিয়ে দেয় তার। লুইস যদিও মাঝে মাঝে এলিকে নিয়ে বিরক্ত হয়, তবুও সে তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নিল, মেয়েকে নিয়ে সে ডিজনি ওয়ার্ল্ডে যাবে।
শেডের সামনে পার্ক করে ওয়াগনটার ইঞ্জিন অফ করে দিল লুইস। ইঞ্জিন ‘টিক’ করে শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেল। শিকাগোর কোলাহল, স্টেট স্ট্রিটের ছোটাছুটির পর এখানকার নীরবতাটা বেশ গভীর মনে হচ্ছে। বেলা শেষের এই আরামদায়ক নীরবতার মাঝেই একটা পাখি মিষ্টি করে গেয়ে উঠলো।
“আমাদের বাড়ি,” বাড়িটার দিকে তাকিয়ে থেকে রাচেল নরম গলায় বলল।
“বাড়ি,” রাচেলের কোল থেকে গেজ বলল।
লুইস এবং রাচেল চট করে একে অপরের দিকে তাকায়। রিয়ারভিউ মিররে আইলিনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।
“তুমি কী….. “ও কী…”
“এটা কী হলো?”
তারা সবাই একসাথে বলে ওঠে এবং পরমুহূর্তেই একসাথে হাসতে শুরু করে। গেজ কিছু খেয়াল করে না, সে শুধু তার আঙুল চুষে যাচ্ছে। সে একমাস আগে “মা” বলতে শিখেছে, আর “বাআআ” অথবা ঐ জাতীয় কিছু বলার চেষ্টা করছে। সেটা লুইসের অভিলাষী মনের জল্পনাও হতে পারে।
কিন্তু, কাকতালীয় হোক বা বাকিদের দেখাদেখি হোক, এটা ছিল একটি পূর্ণ শব্দ। বাড়ি।
লুইস তার স্ত্রীর কোল থেকে গেজকে ছো মেরে তুলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে।
লাডলোতে তাদের আগমন ঠিক এভাবেই।
অধ্যায় ২
লুইসের কাছে সেই মুহূর্তটা সবসময় মায়াবী মনে হয়, হয়তো মুহূর্তটাতে আসলেই মায়া করার মত কিছু আছে। তবে তার প্রধান কারণ দিনের বাকি বিকেলটা কাটে খুব ঝামেলায়। পরের তিন ঘন্টায় না ছিল শান্তির ছিটেফোঁটা, না ছিল কোন জাদু বা মায়ার দেখা।
লুইস খুব সাবধানে বাড়ির চাবিটা একটা ছোট ম্যানিলা খামে ভরে উঠিয়ে রেখেছিল (আমাদের লুইস ক্রিড খুব গোছালো শ্রেনীর লোক)। চাবি ভরে খামের ওপর লিখেছিল ‘লাডলো বাড়ির চাবি, প্রাপ্তি জুন ২৯।” খামটা যে সে গাড়ির গ্লাভস কম্পার্টমেন্টে রেখেছে, তা তার স্পষ্ট মনে আছে। কিন্তু খামটা এখন সেখানে নেই।
যখন সে ক্রমশ বাড়তে থাকা বিরক্তি নিয়ে চাবিটা গরুখোঁজা করছে, রাচেল তখন গেজকে কোলে তুলে আইলিনের পিছু পিছু হাঁটছিল। সে যখন গাড়ির সিটের নিচে তৃতীয়বারের মতো খুঁজে চলছে, তার মেয়ের চিৎকার তার কানে আসে।
“লুইস!” রাচেল ডাকল। “আইলিন হাঁটু কেটে ফেলেছে।”
আইলিন টায়ারের দোলনা থেকে পড়ে গেছে আর ওর হাঁটু গিয়ে পড়েছে একটা কোণা বেরিয়ে থাকা পাথরের ওপর। কাটাটা গভীর না, কিন্তু আইলিনের চিৎকার শুনে লুইসের মনে হচ্ছে (একটু নির্দয়ভাবেই) কেউ ওর পুরো পা কেটে বাদ দিয়েছে। লুইস রাস্তার ওপাশের বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে সেটার বসার ঘরে বাতি জ্বলছে।
“এলি, থামো। যথেষ্ট হয়েছে!” লুইস বলল। “ওই বাড়ির লোকেরা ভাববে এখানে কাউকে খুন করা হচ্ছে।”
“ব্যথা করে তো!”
লুইস তার বাড়ন্ত রাগ চেপে ওয়াগনটাতে ফিরে যায়। চাবিগুলো পাওয়া না গেলেও ফার্স্ট এইড কিটটা গ্লাভ কম্পার্টমেন্টেই পাওয়া গেল। সেটা নিয়ে ফিরে আসে লুইস। আইলিন সেটা দেখে আগের চাইতেও ভীষণভাবে চিৎকার করতে শুরু করে।
“না! ঐটা লাগালে জ্বলে…আমি ঐটা দেব না, বাবা! না!”
“আইলিন, এটা একটা কাটাছেঁড়ার মলম। আর এটা লাগালে জ্বলবে না!”
“একটু সাহস করো, মামনি,” রাচেল বলল। “এটা লাগালে একটুও—”
“না-না-না-না-না।”
“চুপ করো! না হলে একটা থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব,” লুইস ধমকে ওঠে।
“ও খুব ক্লান্ত, লু,” রাচেল মৃদু স্বরে বলল।
“আমার নিজের তো খুউব চাঙ্গা লাগছে! ভালো করে ওর পা চেপে ধরো।”
রাচেল গেজকে নামিয়ে রেখে আইলিনের পা’টা চেপে ধরলে লুইস মারকিউরোক্রোম মলম লাগিয়ে দেয়, ওদিকে আইলিন মৃগীরোগির মতো চিৎকার করতে থাকে।
“ওই বাড়ির সামনের বারান্দায় কেউ একজন বেরিয়ে এসেছে,” রাচেল বলে। সে গেজকে কোলে তুলে নেয়। গেজ ঘাসের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে চলে যাচ্ছিল।
“চমৎকার” লুইস বিড়বিড় করে বলল।
“লু, ও?”
“ক্লান্ত, জানি।” সে ওষুধের মুখ লাগিয়ে তার মেয়ের দিকে গম্ভীরভাবে
তাকায়।
“শেষ। একটুও ব্যথা পাওনি এলি, স্বীকার করো।”
“পাচ্ছি! সত্যি পাচ্ছি! ব্যথা-”
মেয়েটাকে চড় মারার জন্যে তার হাত নিশপিশ করতে থাকে।
“চাবি পেয়েছো?” রাচেল জিজ্ঞেস করল।
“এখনো পাইনি,” ফার্স্টএইড কিটটা খটাস করে বন্ধ করে লুইস বলে, “আমি দেখছি।”
এবার গেজ চিৎকার করতে শুরু করে। সে শুধু অস্থির হয়ে কান্না করছে না, রীতিমত বুকফাটা আর্তনাদ করছে রাচেলের কোলে মোচড়াতে মোচড়াতে।
“ওর কী হলো?” ওকে লুইসের দিকে অন্ধের মত ঠেলে দিয়ে রাচেল চেঁচিয়ে উঠলো। ডাক্তার বিয়ে করার একটা সুবিধা হলো যখনি মনে হবে বাচ্চা মরে যাচ্ছে, তখনি বাচ্চাকে স্বামীর হাতে গছিয়ে দেয়া যায়, লুইস ভাবে। “লুইস, কি…
বাবুটা ভয়ে তার ঘাড় খাবলে খাবলে ধরছে। লুইস ওকে ঝাটকা মেরে ঘুরিয়ে দেখল ওর ঘাড়ের একটা জায়গা পুতির মতো ফুলে উঠেছে। তাছাড়া ওর জাম্পারের ফিতায় কিছু একটা লেগে আছে, যা ঝাপসা আর দুর্বলভাবে মোচড়ামুচড়ি করছে।
আইলিন এতক্ষণে একটু শান্ত হয়েছিল। কিন্তু ও আবারো চেঁচিয়ে ওঠে, “মৌমাছি! মৌমাছি! মৌমাছিইইইই!” সে লাফিয়ে পিছিয়ে যায় এবং আবার সেই একই পাথরে হোঁচট খেয়ে উল্টো দিকে ধাম করে পড়ে যায়। পড়ে গিয়ে ব্যথা আর ভয়ের মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় ও ভাইয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে চিৎকার করতে শুরু করে।
আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, লুইস বিস্মিত হয়ে ভাবল। উই ই ই ই!
“কিছু করো লুইস! দেখো না কিছু করতে পার কি না?”
“হুলটা বের করতে হবে,” ওদের পেছন থেকে একটা ধীর কণ্ঠ বলল। “তাছাড়া কাজ হবে না। হুলটা বের করে বেকিং সোডা লাগিয়ে দিলেই ফোলা কমে যাবে।” কিন্তু কণ্ঠটা এতো ভারি আর আঞ্চলিক টানে ভরা ছিল যে, লুইসের ক্লান্ত, বিভ্রান্ত মন কিছুই বুঝতে পারল না।
সে মাথা ঘুরিয়ে একজন সত্তুরের ঘরের (সুস্থ এবং শক্তসামর্থ্য) বুড়োকে ঘাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। লোকটার গায়ে শার্টের ওপর কাঁধের বেল্ট দিয়ে পা পর্যন্ত লম্বা পোশাক পরা। শার্টের কলারের ফাঁক দিয়ে তার ঘাড়ের ভাজ পড়া কোঁকড়ানো চামড়া উঁকি দিচ্ছে। তার মুখের চামড়া রোদে পোড়া, তিনি একটি ফিল্টার ছাড়া বিড়ি টানছিলেন। লুইস দেখলো লোকটা সহজেই তার বুড়ো আঙুল আর তজর্নির মাঝখানে পিষে হাতের বিড়িটা নিভিয়ে ফেললেন। বৃদ্ধ তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে কুটিলভাবে হাসলেন, হাসিটা লুইস এক নজরেই পছন্দ করে ফেলে। কাউকে চট করে পছন্দ করে ফেলার মানুষ সে না।
“তোমার কাজ তোমাকে শেখানোর জন্যে বলছি না, ডাক্তার,” তিনি বললেন। এভাবেই জাডসন ক্র্যান্ডালের সাথে লুইসের প্রথম পরিচয়। এই সেই লোক, যেই লোকটার উচিত ছিল লুইসের বাবা হওয়া।
অধ্যায় ৩
রাস্তার ওপাশ থেকে তিনি ওদের আসতে দেখে রাস্তা পেরিয়ে চলে আসেন। তাদের হযবরল অবস্থা দেখে ভেবেছেন হয়তো তিনি তাদের কোনো সাহায্য করতে পারবেন।
লুইস বাবুকে ধরে রাখা অবস্থায় ক্র্যান্ডাল এগিয়ে এসে বাবুর ঘাড়ের ফোলা দেখলেন। এরপর তিনি নিজের খড়ির মতো, কোচকানো চামড়া মোড়ানো হাত কাজে লাগিয়ে দিলেন। রাচেল ব্যাপারটায় বাঁধা দেয়ার জন্যে মুখ খুললে তার হাতটা খুব আনাড়ি মনে হচ্ছিল আর সেটা আকারে অনেকটা গেজের হাতের সমান। কিন্তু কিছু বলার আগেই বুড়োর আঙুলগুলো কাজটা মিটমাট করে ফেলে, ঠিক যেভাবে কেউ তাসের খেলা দেখায় বা ম্যাজিশিয়ান পয়সার ভেলকি দেখায়। আর মৌমাছির হুলটা তার তালুর মধ্যে পড়ে থাকে।
“হুম, বেশ বড়,” তিনি মন্তব্য করলেন। “প্রথম পুরস্কার না পেলেও বিশেষ পুরস্কার পাওয়ার মতো বড় হুলটা।” লুইস গলা ফাটিয়ে হাসে বুড়োর রসিকতায়।
ক্র্যান্ডাল লুইসের দিকে তাকিয়ে নিজের সেই কুটিল হাসিটা হাসলেন। “খুব শান্তশিষ্ট ও, তাই না?” আইলিনকে ইঙ্গিত করে বললেন তিনি।
“মা, উনি কী বললেন?” আইলিন জিজ্ঞেস করলে রাচেলও হাসিতে ফেটে পড়ে। ব্যাপারটা খুব অভদ্রের মতো হলেও কেন যেন চমৎকার শোনালো। ক্র্যান্ডালও চেস্টারফিল্ডের প্যাকেট থেকে একটা বিড়ি নিয়ে নিজের ঠোঁটের কোনায় দিয়ে তাদের হাসাহাসিতে হৃষ্টচিত্তে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সায় দিলেন। এমনকি গেজও হুলের ব্যথা সত্ত্বেও শব্দ করে খিলখিল করে উঠে। তার বুড়ো আঙুল দিয়ে একটা ম্যাচের কাঠি ফস করে জ্বালিয়ে ফেললেন। বুড়োদের বেশ ভালো ট্রিকস জানা আছে, লুইস ভাবে। ছোট ছোট ট্রিকস, তবে সেগুলোর মধ্যে কিছু ট্রিকস আসলেই দারুণ।
সে হাসি বন্ধ করে তার এক হাত বাড়িয়ে দেয়, যে হাতে গেজ পাছা দিয়ে বসে ছিল না। গেজের ডায়াপার একদম স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। “আপনার সাথে দেখা হওয়ায় খুব খুশি হলাম, মিস্টার-”
“জাড ক্র্যান্ডাল,” তিনি হাত ঝাকাতে ঝাঁকাতে বললেন। “তুমিই তাহলে সেই ডাক্তার, না কি?”
“হ্যাঁ। লুইস ক্রিড। এ আমার স্ত্রী রাচেল, ও আমার মেয়ে এলি, আর মৌমাছির হুল খাওয়া পিচ্চিটা গেজ।”
“তোমাদের সবার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো হলো।”
“আমি আসলে ঠিক ইচ্ছে করে হাসিনি…মানে আমরা ঠিক বুঝে হাসিনি…আসলে আমরা…একটু ক্লান্ত।”
নিজেকে ঠিকভাবে প্রকাশ করতে না পারে সে আবারো মুখ চেপে হেসে ওঠে। খুবই ক্লান্ত লাগছে তার।
ক্র্যান্ডাল মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলেন, “অবশ্যই।” তিনি রাচেলের দিকে তাকালেন। “মিসেস ক্রিড, তুমি তোমার বাবু আর কন্যাকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবে একটু? একটা রুমালে বেকিং সোডা দিয়ে ফোলা জায়গাটায় লাগিয়ে দেয়া দরকার। আমার স্ত্রীও তোমাদের সাথে পরিচিত হতে চায়। ও খুব একটা বের হয় না বাসা থেকে। বাতের ব্যথায় গত দু তিন বছর ধরেই এ অবস্থা।”
রাচেল লুইসের দিকে তাকালে সে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি দেয়।
“তাহলে তো খুবই ভালো হয়, মিস্টার ক্র্যান্ডাল।”
“ওহ, আমাকে জাড বললেই হবে,” তিনি বললেন।
হঠাৎ একটা জোরালো হর্ন বাজে। ক্রমেই মৃদু হতে থাকা ইঞ্জিনের শব্দ পাওয়া যায়, এর পর পরই একটা নীল মালবাহী ট্রাক ড্রাইভওয়েতে মোড় নিয়ে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে।
“ওহ খোদা, বাড়ির চাবি তো পাচ্ছি না,” লুইস বলল।
“সমস্যা নেই।” ক্র্যান্ডাল বললেন। “আমার কাছে তোমাদের বাড়ির চাবির এক সেট আছে। মিস্টার আর মিসেস ক্লিভল্যান্ড, যারা এখানে তোমাদের আগে থাকতো, আমাকে এক সেট চাবি দিয়েছিল, তাও প্রায় চোদ্দ- পনের বছর আগে। তারা অনেকদিন ছিলেন এখানে। জোন ক্লিভল্যান্ড আমার বৌয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন। তিনি দুই বছর আগে মারা যান। আর বিল অরিংটনের বৃদ্ধাশ্রমে চলে যায়। আমি চাবির সেটটা নিয়ে আসছি। এমনিতেও ওগুলো এখন থেকে তোমাদেরই।”
“আপনি খুব উপকার করলেন, মি. ক্র্যান্ডাল,” রাচেল বলল।
“একদমই না,” তিনি বললেন। “আমাদের আশেপাশে কমবয়েসি লোকজন পাওয়ার জন্যে আমরা দুই বুড়ো বুড়ি অধীর আগ্রহের সাথে অপেক্ষা করছিলাম। তুমি শুধু বাচ্চারা রাস্তার আশেপাশে যায় কি না খুব খেয়াল রাখবে, মিসেস ক্রিড। এই রাস্তাটায় বড় বড় ট্রাক দিনরাত চলে।”
বাড়ি বদলে দেয়ার শ্রমিকরা ট্যাক্সি থেকে হুড়োহুড়ি করে নেমে শব্দ করে ট্যাক্সির দরজা লাগিয়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসে।
এলি ঘুরতে ঘুরতে সামান্য দূরে চলে গিয়েছিল। সে বলল, “বাবা, এটা কী?”
লুইস শ্রমিকদের সাথে কথাবার্তা বলছিল। মেয়ের কথা শুনে সে পেছনে ফিরে তাকায়। মাঠের অপর প্রান্তে যেখানে বাড়ির উঠানের সীমানা শেষ, গ্রীষ্মের বড় বড় ঘাস সেখানটা দখল করে নিলেও মসৃণ করে ঘাস কাটা একটা চার ফুটের মতো রাস্তা তৈরি করা আছে। রাস্তাটা মাঠ পেরিয়ে একেবেঁকে পাহাড়ে গিয়ে উঠেছে, কিছু জংলী আগাছা আর বার্চার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে।
“দেখে তো রাস্তা-টাস্তা মনে হচ্ছে,” লুইস বলল।
“ঠিক তাই,” ক্র্যান্ডাল মুচকি হেসে বললেন।
“ এটার ব্যাপারে তোমাকে একসময় বলব মামনি। এখন আমার সাথে চল, গিয়ে তোমার ভাইয়ের চিকিৎসা করি।”
“আচ্ছা।” এলি বলেই আবার একটু আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করল: “বেকিং সোডা লাগালে কি খুব জ্বলে?”
অধ্যায় ৪
ক্র্যান্ডাল চাবি নিয়ে আসতে আসতে লুইস তার চাবি খুঁজে পায়। সেই গ্লাভ কম্পার্টমেন্টের ওপরের দিকের একটা ফোকর দিয়ে ছোট খামটা পেছনের তারের জঞ্জালের মাঝে পড়ে গিয়েছিল। সে কায়দা করে খামটা সেখান থেকে বের করে শ্রমিকদের ভেতরে ঢুকতে দিয়েছে। ক্র্যান্ডাল তাকে বাড়তি চাবির ঝোপাটা দেয়। চাবিগুলো লাগানো ছিল একটা পুরনো বিবর্ণ রিঙে। লুইস উনাকে ধন্যবাদ দিয়ে শ্রমিকদের বাক্স, ড্রেসার, আর টেবিলগুলো ভেতরে ঢোকানো দেখতে দেখতে অন্যমনস্কভাবে চাবিটা নিজের পকেটে চালান করে দেয়। এসব মালামাল তারা তাদের দশ বছরের বিবাহিত জীবনে একটু একটু করে সংগ্রহ করেছে। জিনিসগুলোকে এভাবে, মানে তাদের চিরচেনা জায়গার বাইরে দেখে একদম গুরুত্বহীন মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা চিন্তা করে হঠাৎ বিষাদ আর হতাশায় তার মনটা বিষণ্ন হয়ে ওঠে। সে ভাবে একেই হয়ত লোকে হোমসিকনেস বলে।
“শিকড় উপড়ে তুলে নতুন করে লাগানো,” ক্র্যান্ডাল হঠাৎ একপাশ থেকে বলে উঠলে সে চমকে ওঠে।
“আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি আমার অনুভূতিটা বুঝতে পারছেন,” সে বলল।
“আসলে না।” ক্র্যান্ডাল বিড়ি জ্বালালেন। শেষ বিকেলের ছায়ায় ম্যাচের কাঠিটা পপ করে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠলো। “রাস্তার ওপারের বাড়িটা আমার বাবা করেছিলেন। সেখানে তার স্ত্রী এবং বাচ্চাকে নিয়ে আসেন, বাচ্চাটা আমি, যার জন্ম ঠিক ১৯০০ সালে।”
“তাহলে আপনার বয়স…”
“তিরাশি।” ক্র্যান্ডাল এ কথা বললে লুইসের খুব ভালো লাগলো, কারণ তিনি বলেননি, তার বয়স ৮৩ হলেও তিনি এখনো মনে একদম তরুণ। বুড়োদের এই বুলিটা সে সসম্মানে ঘৃণা করে।
“আপনাকে দেখলে এতো বয়স মনে হয় না।”
ক্র্যান্ডাল দুই কাঁধ উঁচু করলেন। “যাই হোক, আমি জন্মের পর থেকে এখানেই থেকেছি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আর্মিতে যোগ দিয়েছিলাম। তবে ইউরোপে যুদ্ধক্ষেত্রের সবচাইতে কাছাকাছি যেখানে আমি গিয়েছিলাম সেটা হলো আমেরিকারই বায়ন, নিউ জার্সি। ১৯১৭ সালেও ওই জায়গাটা ছিল জঘন্য। আমি এ জায়গায় ফিরতে পেরেই খুশি। এরপর আমি নরমাকে বিয়ে করলাম, রেলে একটা চাকরি জুটিয়ে এখানেই থেকে গেলাম। তবে এখানেই লাডলোতে অনেক ‘লাইফ’ দেখেছি আমি, সত্যিই।”
হাতে বক্স স্প্রিংটা নিয়ে শ্রমিকেরা শেডের প্রবেশমুখে থামল। স্প্রিংটা তাদের বড় ডাবল বেডের জাজিমের নিচে থাকে, যেটায় সে আর রাচেল শোয়। “এটা কোথায় রাখবো মিস্টার ক্রিড?”
“ওপর তলায়। এক মিনিট, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।” সে তাদের দিকে এগিয়ে যেতে নিয়ে দাড়িয়ে ক্র্যান্ডালের দিকে পেছন ফিরে চাইল।
“তুমি যাও।” ক্র্যান্ডাল হেসে বললেন। “আমি গিয়ে দেখি তোমার পরিবারের বাকিদের কী অবস্থা। ওদের আর কষ্ট না দিয়ে বরং পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাসা বদল করা হাড়ভাঙা খাটুনির কাজ। আমি নয়টার দিকে আমার বাসার সামনের বারান্দায় বসে বিয়ার খাই। গরমের সময় চারদিকে রাত নামতে দেখা উপভোগ করি আমি। মাঝে মাঝে নরমাও বসে আমার সাথে। তোমার ইচ্ছে হলে চলে এসো।”
“দেখি, আসতেও পারি,” লুইস বলল যদিও তার যাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। গেলে দেখা যাবে বারান্দায় বসে নরমার বাতের চিকিৎসা (বিনামূল্যে) করা লাগছে।
লুইস ক্র্যান্ডালকে পছন্দ করেছিল, পছন্দ করেছিল তার কুটিল মুচকি হাসি, তার দুঃখের কুটিল হাসি, তার চটজলদি কথার পদ্ধতি, তার ভাষার ইয়াংকি টান, যা ক্ষ্যাত শোনাতো না বরং গম্ভীর লাগত। ভালো লোক, তবে ডাক্তাররা দ্রুতই মানুষের মধ্যে ধূর্ততা খুঁজে পায়, লুইস ভাবে। হতাশার কথা হলো, আগে অথবা পরে, ডাক্তারদের খুব কাছের বন্ধুরাও ফ্রি চিকিৎসা চেয়ে বসে। আর বুড়োদের বেলায় তো এর কোনো শেষই নেই।
“তবে আমার জন্যে অপেক্ষা করে জেগে থাকবেন না, খুব কঠিন একটা দিন গেল আমাদের।” সে বলল।
“তোমার আসার জন্যে ইনভাইটেশন কার্ড লাগবে না, মাথায় ঢুকিয়ে নাও।” ক্র্যান্ডাল বললেন। তার কুটিল হাসিতে একটা ব্যাপার ছিল যা দেখে লুইসের মনে হলো, তিনি বোধহয় লুইসের মনের গোপন কথা বুঝে গিয়েছেন।
সে শ্রমিকদের কাছে যাওয়ার আগে কিছুক্ষণ বুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্র্যান্ডাল সহজভাবে হেঁটে গেলেন, যেন তার বয়স আশি নয়, বরং ষাট। লুইস আচমকা প্রথমবারের মতো লোকটার প্রতি ভাললাগা অনুভব করল।
অধ্যায় ৫
নয়টার মধ্যে শ্রমিকরা সবাই চলে যায়। এলি এবং গেজ দুজনেই চরম ক্লান্ত হয়ে এখন যার যার নতুন রুমে ঘুমোচ্ছে। গেজ ঘুমোচ্ছে তার বেবি বিছানায়, যেটার চারদিকে কাঠের খাচার মতো ঘের লাগানো। আর এলি ঘুমোচ্ছে মেঝেতে পাতা একটা তোষকের ওপর যার চারপাশে ঘিরে আছে বাক্সের পাহাড়। ওর কোটি কোটি রং পেন্সিল, যার কিছু আস্ত, কিছু অর্ধেক ব্যাবহার করা, কিছু ভোঁতা; ওর সেসিমি স্ট্রিটের কিছু পোস্টার; ওর কিছু ছবির বই; ওর কাপড়-চোপড়; আর ঈশ্বর জানে আরও কত কী। আর বরাবরের মতো চার্চও ওর সাথেই আছে। বেড়ালটা ঘুমের মধ্যেই চাপা কণ্ঠে গোঁ গোঁ করছে। হুলো বেড়ালটা আদুরে পুরর পুরর শব্দ করতে না পারলেও এই নকল গোঁ গোঁ শব্দ দিয়েই ওই কাজ চালায়।
কিছুক্ষণ আগে রাচেল গেজকে কোলে নিয়ে বাড়িময় অস্থির হয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। লুইস যেসব জায়গায় শ্রমিকদের জিনিসপত্র রাখতে বলেছিল সেসব তার পছন্দ না হাওয়ায় সেগুলো আবার সাজিয়েছে। সে শ্রমিকদের চেকটা হারায়নি, আর বকশিশ দেয়ার জন্যে রাখা পাঁচটা ১০ ডলারের সাথে সেটা তখনো তার পকেটেই ছিল। অবশেষে ভ্যান থেকে শ্রমিকেরা সব মাল বাড়ির ভেতর পৌঁছে দেয়া শেষ করলে সে চেক আর টাকা দুটোই তাদের হাতে দেয়। তারা ধন্যবাদ দিলে তার জবাবে মাথা ঝাঁকিয়ে তাদের প্রাপ্তি বিলে সই করে দেয়। এরপর সে সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ট্রাকটার ফিরে যাওয়া দেখে। শ্রমিকেরা হয়তো ব্যাঙ্গরে নেমে বিয়ার গিলে আজকের দিনের ইতি টানবে। এই মুহূর্তে বিয়ার পেটে পড়লে বেশ লাগবে। সেটা তাকে ক্র্যান্ডালের নিমন্ত্রণের কথা আবারো মনে করিয়ে দেয়।
সে আর রাচেল কিচেন টেবিলে বসে আছে। সে দেখতে পায় রাচেলের চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। “এই তুমি, হ্যাঁ তোমাকেই বলছি!” লুইস বলে। “যাও, শুয়ে পড় আর দেরি না করে।
“ডাক্তারের আদেশ?” রাচেল স্মিত হেসে জিজ্ঞেস করে।
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা,” সে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে। “আমি অসম্ভব ক্লান্ত। আর গেজ তো আজ রাতে জ্বালাবেই, আমাদেরও জাগাবে। তুমি আসছো?”
সে খানিকটা ইতস্তত করে। “না, এখনই না। স্ট্রিটের ওপারের বুড়ো। “ “মফস্বল এলাকায় এরকম স্ট্রিটকে রোড বলে। অথবা জাডসন ক্র্যান্ডালের উচ্চারণে বললে রাড।
“আচ্ছা, রাডের ওপারে। উনি আমাকে বিয়ারের দাওয়াত দিয়েছেন। মনে হচ্ছে উনার দাওয়াত আমি গ্রহণ করব। আমি ক্লান্ত, তবে অস্থির লাগছে। তাই এখনই ঘুমাবো না।”
রাচেল মৃদু হাসে। “দাওয়াতে গিয়ে দেখবে নরমা ক্র্যান্ডাল তোমাকে তার কোথায় কোথায় ব্যথা আর তিনি কেমন জাজিমে ঘুমান সেসব বলছেন।”
লুইস হাসে আর ভাবে, ব্যাপারটা কী হাস্যকর, ভয়ঙ্কর যে বউরা কিছুদিন যেতে না যেতেই স্বামীদের মন পড়ে ফেলতে পারে।
“আমাদের বিপদে তিনি আমাদের পাশে দাড়িয়েছিলেন,” সে বলল। “আমারো তাকে কিছু সাহায্য করা উচিত বলেই আমার মনে হচ্ছে।”
“আগেকার দিনের বিনিময় প্রথা?”
সে কাঁধ ঝাঁকালো। সে যে ক্র্যান্ডালকে অল্পতেই পছন্দ করে ফেলেছে ব্যাপারটা সে স্ত্রীকে বলতে চাচ্ছে না, কিভাবে বলবে তা-ও বুঝতে পারছে না।
“ওনার স্ত্রীটা কেমন?”
“খুব মিষ্টি স্বভাবের মহিলা,” রাচেল বলে। “ গেজ ওনার কোলে একদম দিঘীর শান্ত জলের মত বসে ছিল। আমি অবাক হয়েছি কারণ এমনিতেই ওর দিনটা খুব খারাপ গেছে, আর তুমি তো জানোই ও চমৎকার পরিস্থিতিতেও অল্প সময়ে নতুন লোকদের পছন্দ করে না। তাছাড়া ওনার একটা পুতুল উনি এলিকে খেলতে দিয়েছিলেন।”
“ ওর বাতের ব্যথা কেমন দেখলে?”
“বেশ খারাপ।”
“হুইল চেয়ারে?”
“না…তবে তিনি খুব ধীরে নড়াচড়া করেন। আর ওনার আঙুলগুলো…” রাচেল তার আঙুলগুলো বড়শির মতো বাঁকা করে পাখির থাবার মতো ভঙ্গি করে বোঝায়। লুইস মাথা ঝাঁকায়। “যাই হোক, দেরি করবে না, লু। অচেনা বাড়িতে আমার গা ছমছম করে।”
“বেশিদিন অচেনা থাকবে না,” লুইস কথাটা বলে তাকে চুম্বন করে।
অধ্যায় ৬
বাসায় ফেরার পর লুইসের নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। সেখানে কেউ তাকে নরমা ক্র্যান্ডালের অসুখ পরীক্ষা করে দেখতে বলেনি। যখন সে রোড (রোড, সে নিজেকে মনে করিয়ে মৃদু হাসে) পার হয়ে ও বাড়ি যায় ততক্ষণে ভদ্রমহিলা ঘুমিয়ে পড়েছেন। সামনের ঘেরা বারান্দার জাল জাল স্ক্রিনের ভেতর দিয়ে জাডকে দেখা যাচ্ছিল অস্পষ্ট ছায়ামূর্তির মতো। মেঝেতে বিছানো পুরনো লিনোলিয়ামের ওপর রকিং চেয়ারের আরামদায়ক ক্যাচক্যাচ শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। লুইস স্ক্রিন দরজায় নক করলে দরজাটা অমায়িকভাবে সেটার ফ্রেমের মধ্যে কেঁপে ওঠে। ক্র্যান্ডালের সিগারেটটা গ্রীষ্মের রাতের আধারে মস্ত একটা লাল জোনাকির মতো জ্বলজ্বল করছে। একটা রেডিও থেকে রেডসক্স টিমের খেলার ধারাভাষ্যের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। সবকিছু মিলে লুইসের নিজের বাড়ি ফেরার অদ্ভুত একটা অনুভূতি তৈরি হয়।
“ডাক্তার,” ক্র্যান্ডাল বললেন। “আমি ভেবেছিলাম তুমিই হবে।”
“বিয়ারের দাওয়াতটা মিছেমিছি দেননি তো?” লুইস ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলে।
“ওহ! বিয়ারের ব্যাপারে আমি কখনো মিথ্যা বলি না।” ক্র্যান্ডাল বললেন। “যে বিয়ার নিয়ে মিথ্যা বলে তার শত্রু বাড়ে। বসো ডাক্তার। আমি তোমার কথা ভেবেই কিছু বাড়তি বরফ দিয়েছিলাম, বিয়ার বেশি সময় ধরে ঠান্ডা রাখতে।”
সরু হলেও বেশ লম্বা বারান্দাটা বেতের চেয়ার আর সোফা দিয়ে সাজানো। লুইস সেগুলোর একটায় গা এলিয়ে দেয়। তবে সেটা যে এতই আরামদায়ক হবে সে ভাবেনি। ওর বামে একটা বরফের কিউব ভরা বালতিতে কয়েক ক্যান ব্ল্যাক লেবেল। সে একটা নেয়।
“থ্যাংক ইউ,” বলে সে ক্যানটা খোলে। দুই ঢোক গিলেই তার প্রাণটা জুড়িয়ে যায়।
“আরে খাও খাও,” ক্র্যান্ডাল বলল। “আশা করি এখানে তোমার ভালোই লাগবে।”
“চিয়ার্স,” লুইস বলে।
“বিস্কিট খাবে নাকি? বাসায় খুব ভালো মানের ইঁদুরের টুকরোও আছে।”
“কিসের টুকরা?”
“ইঁদুর চিজের টুকরো।” ক্র্যান্ডাল বলে বেশ মজা পান।
“ধন্যবাদ, তবে বিয়ারেই চলবে আমার।”
“তাহলে বাদ দেই।” ক্র্যান্ডাল তৃপ্তির ঢেকুর তুলেন।
“আপনার স্ত্রী শুয়ে পড়েছে না কি?” ক্র্যান্ডালের কিছুক্ষণ আগে দরজা খোলার ভঙ্গি দেখে লুইস জিজ্ঞেস করলো।
“হুম। ও মাঝে মাঝে আমার সাথে বসে, কখনও আগেই শুয়ে পড়ে।”
“ওনার বাতের ব্যথা খুব বেশি তাই না?”
“এমন কোনো রোগি দেখছো যার কম ব্যথা?” ক্র্যান্ডাল জিজ্ঞেস করল।
লুইস মাথা নাড়ে।
“আমার মনে হয় ওর ব্যথাটা ও সহ্য করতে পারে।” ক্র্যান্ডাল বললেন। “ওর এ নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। আমার বুড়ি খুকি খুব ভালো।” তার কণ্ঠে গাঢ় আবেগ। সামনের রুট-১৫ দিয়ে একটা তরলবাহী ট্যাংকার ট্রাক গুঞ্জন করতে করতে চলে যায়। ট্রাকটা এতো বড় আর লম্বা যে কয়েক মুহূর্তের জন্যে রাস্তার ওপাশে নিজের বাড়িটা লুইসের চোখের আড়াল হয়ে যায়। প্রায় মুছে যাওয়া দিনের শেষ আলোয় ট্রাকের গায়ে অরিনকো লেখাটা পড়া গেল।
“বিশাল ট্রাক,” লুইস মন্তব্য করল।
অরিনকো কারখানাটা অরিংটনের পাশেই।” ক্র্যান্ডাল বললেন। “রাসায়নিক সার কারখানা। রাতভর এগুলি আসা যাওয়া করে। আরো আছে; তেলের ট্যাঙ্কার, ময়লার ট্রাক, আর সেসব লোকজনের গাড়ি, যারা ব্যাঙ্গর বা ব্রুয়ারে দিনে কাজ করতে গিয়ে রাতে ফেরে।” তিনি তার মাথা নাড়লেন। “লাডলোর এই একটা ব্যাপার আমি আর একদমই পছন্দ করি না। এই বালের রাস্তাটা। শান্তি নষ্ট। দিন রাত চলছে তো চলছেই। প্রায়ই নরমার ঘুম ভেঙে যায়। মাঝে মধ্যে আমার ঘুমই ভেঙে যায়, যেই আমি কি না মরা কুত্তার মতো ঘুমাই।”
লুইস শিকাগোর কনস্ট্যান্ট রোড পেরিয়ে ভেবেছিল মেইনের এই অদ্ভুত জায়গাটা ভয়ঙ্কর নির্জন। সে ক্র্যান্ডালের কথায় সায় দিয়ে শুধু মাথা ঝাকায়।
“একদিন আরবরা তেল দেয়া বন্ধ করে দেবে। তখন এই আজাইরা রাস্তাটার ঠিক মাঝখানে আফ্রিকান ভায়োলেটের চাষ করা যাবে।” ক্র্যান্ডাল বললেন।
“হয়তো ঠিকই বলেছেন।” লুইস ওর ক্যানটা কাত করে ধরতেই বুঝতে পারে সেটা খালি।
ক্র্যান্ডাল হেসে উঠলেন। “আরেকটা মেরে দাও, ডাক্তার।”
লুইস ইতস্তত করে বলল, “ঠিক আছে, তবে এই শেষ। যেতে হবে আমাকে।
“তা তো অবশ্যই। বাড়ি বদল করা বিরাট যন্ত্রণা, কি বল?”
“ঠিক,” লুইস সম্মতি জানায়, এবং কিছুক্ষণের জন্যে তারা একদম নীরব হয়ে বসে থাকে। নীরবতাটা আরামদায়ক ছিল, যেন তারা বহুদিনের পরিচিত। এটা এমন একটা অনুভূতি যেটা লুইস বইয়ে পড়লেও আগে কখনো অনুভব করেনি। কিছুক্ষণ আগের ফ্রি চিকিৎসা নিয়ে তার ভাবনার জন্যে এখন তার লজ্জা লাগছে।
সামনের রাস্তা দিয়ে একটা সেমি ট্রাক গর্জন করতে করতে দূরে ছুটে যায়, সেটার লাইটগুলো আকাশের তারার মতো মিটমিট করতে থাকে।
“খুব বড় রাস্তা এটা।” ক্র্যান্ডাল দুশ্চিন্তার সাথে বলেন, আনমনে, তারপর তিনি লুইসের দিকে ফিরেন। তার মুখে অদ্ভুত একটা মৃদু হাসি। তিনি নিজের হাসি মুখে একটা চেস্টারফিল্ড বিড়ি ঠুকে, বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ম্যাচ জ্বালালেন।
তোমার পিচ্চি মেয়েটা যে পথটার কথা বলছিল তোমার মনে আছে?”
লুইস প্রথমে মনে করতে পারছিল না; এলি সারাদিন হাজারো ব্যাপারে কথা বলতে বলতে অবশেষে বিছানায় গিয়ে ক্ষান্ত হয়েছে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে সেই ঘাস ছেটে বানানো পথটার কথা, যেটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পাহাড়ের ওপর চলে গেছে।
“হ্যাঁ, মনে আছে। আপনি ওকে কথা দিয়েছেন যে ওটার ব্যাপারে ওকে একসময় বলবেন।”
“কথা দিয়েছি এবং আমি সে কথা রাখবো।” ক্র্যান্ডাল বললেন। “পথটা বনের মধ্যে দিয়ে প্রায় দেড় মাইল পর্যন্ত গেছে। রুট-১৫ আর মিডল ড্রাইভের স্থানীয় বাচ্চাকাচ্চারা রাস্তাটা দেখাশোনা করে কারণ ওরাই আসলে রাস্তাটা ব্যবহার করে। বাচ্চাকাচ্চারা আসে আর যায়… আমি যখন ছোট ছিলাম তখনকার চাইতে এখন মানুষ বাড়িঘর বদলায় খুব বেশি; আগে লোকে একটা জায়গা বেছে নিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যেতো। তবে ছোটরা একে অপরকে রাস্তাটার ব্যাপারে জানিয়ে দেয় বলেই আমার ধারণা, আর প্রতি গ্রীষ্মে তাদের কয়েকজন মিলে রাস্তার আগাছা সাফ করে। পুরো গ্রীষ্ম জুড়েই ওরা রাস্তাটা সাফ রাখে। শহরের বড়দের অনেকেই ওখানে কী আছে জানে না। অবশ্য অনেকেই জানে, তবে একটা বড় অংশই জানে না কিন্তু আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে ছোটরা সবাই জানে।
“কী আছে ওখানে?”
“পেট সেমেটারি,” ক্র্যান্ডাল বললেন।
“পোষা প্রাণীদের গোরস্থান,” লুইস অবাক হয়ে বলে।
“ব্যাপারটা যতটা অস্বাভাবিক শোনায় আসলে ততটা না,” রকিং চেয়ারে দুলতে দুলতে বিড়িতে টান দিয়ে ক্র্যান্ডাল বললেন। “সব দোষ ওই রাস্তাটার। রাস্তাটা প্রচুর জানোয়ার গিলে খায়। বেশির ভাগই কুকুর বেড়াল, তবে আরো জিনিস আছে। রাইডার পরিবারের বাচ্চাদের একটা পোষা রেকুন ঐ রকম একটা অরিনকো ট্রাকের নিচে পিষে মরে। সেটা ছিল…হুম…’৭৩ এ, অথবা তারও আগে। রাজ্য সরকার যখন রেকুন বা পোষা ভোঁদড় পর্যন্ত পালা নিষিদ্ধ করল, তার আগে তো অবশ্যই।”
“সরকার এটা কেন করলো?”
“জলাতঙ্ক,” ক্র্যান্ডাল বললেন।” মেইন শহরে এখন জলাতঙ্কের খুব ভয়। কয়েক বছর আগে রাজ্যের ভেতরের দিকে সেন্ট বার্নার্ড জাতের একটা বিরাট কুকুরের জলাতঙ্ক হয়। কুকুরটা চারজন মানুষকে খুন করে। খুব মাতামাতি হয়েছিল ঘটনাটা নিয়ে। কুকুরটাকে ওর মালিক ভ্যাক্সিন দেয়নি যদি ওর মালিকেরা ওটাকে ভ্যাক্সিন দেয়াতো তাহলে এরকম হতো না। তবে রেকুন অথবা ভোঁদড়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। তুমি বছরে দু’বার করে ভ্যাক্সিন দিলেও মাঝে মধ্যে তাতে কাজ হয় না। তবে রাইডারদের বাচ্চাদের রেকুনটা খুব ভদ্র ছিল। নাদুস নুদুস রেকুনটা হেলতে দুলতে তোমার একদম কাছে চলে আসবে আর কুকুরের মতো মুখ চেটে দেবে। ওদের বাবা এক পশু ডাক্তারকে দিয়ে অপারেশন করিয়ে ওটার হাতের নখ ভেতর থেকে ফেলে দেন চিরদিনের জন্যে আর ডিম্বাশয় সরিয়ে ফেলেন যাতে বাচ্চা না দেয়। ওই অপারেশনে নিশ্চয়ই রাজ্যের টাকা খরচ যায় তার!”
“রাইডার লোকটা ব্যাঙ্গর শহরে আইবিএম-এ চাকরি করতো। তারা কলোরাডোতে চলে যায় বছর পাঁচেক আগে…ছয় বছরও হতে পারে। এখন বাচ্চাগুলোর ড্রাইভিং শেখার বয়স হয়ে গেছে ভাবলেই অবাক লাগে। রেকুনটার মৃত্যুতে ওরা একদম ভেঙে পড়েছিল। মেটি রাইডার এত লম্বা সময় ধরে কেঁদেছিল যে ছেলেটির মা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমার বিশ্বাস ও এতো দিনে ঠিকই মানিয়ে নিয়েছে, কিন্তু মনে ঠিকই রেখেছে। প্রিয় পোষা প্রাণী মারা গেলে ছোটরা কখনো ভুলে না।”
লুইসের এলির কথা মনে পড়ে যায়। আজকে রাতে এলিকে সে শেষ দেখেছে ওর নতুন রুমে বিছানায় ঘুমিয়ে থাকতে আর ওর বিছানায় পায়ের কাছে চার্চ পুরর্ পুরর্ করছে।
“আমার মেয়েটার একটা বিড়াল আছে,” সে বলল। “উইনস্টন চার্চিল আমরা ছোট করে চার্চ ডাকি।”
“চার্চেরটা ফেলে দিয়েছো না কি আছে?”
“বুঝতে পারিনি কী বললেন…” লুইস বৃদ্ধের কথার আগা মাথা কিছুই ধরতে পারে না।
“ওর বীচি আছে না ফেলে দিয়েছো?”
“না,” লুইস বলল, “ওরটা ফেলে দেইনি।”
তবে চার্চকে নিয়ে শিকাগোতেও কিছু সমস্যা হয়েছে। রাচেল চাচ্ছিল বিড়ালটাকে পশু ডাক্তার দিয়ে খাসি করিয়ে ফেলতে; এমন কি ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্টও করা হয়েছিল। লুইসই সেটা বাতিল করে। তবে এখনো তার মাথায় আসে না ঠিক কেন সে সেটা বাতিল করেছিল। অনেকে বোকার মতো বলতে পারে সে ওই হুলো বিড়ালটার মধ্যে নিজের পৌরুষত্বের ছায়া দেখেছিল বা পাশের বাড়ির মুটকি মহিলার ময়লার পোটলা ঠিকঠাকভাবে না রাখার দায়ে বিড়ালটাকে খোজা করাটা সে একদম মেনে নিতে পারছিল না। ওই সিদ্ধান্তের পেছনে এসব কারণেরও কিছুটা অবদান ছিল, তবে আসল কারণটা ছিল ভিন্ন। ওই কাজটা করলে বিড়ালটার মধ্যে থেকে একটা জিনিস নষ্ট হয়ে যেত যেটা সে নিজে খুব মূল্যায়ন করে, সেটা হচ্ছে বিড়ালটার সবুজ চোখে “মারা খাও” মার্কা কঠিন চাহনিটা। শেষে সে রাচেলকে বুঝায় তারা মফস্বল এলাকায় চলে যাচ্ছে, সেখানে ওকে নিয়ে আর সমস্যা হবে না। আর এখন জাডসন ক্র্যান্ডাল তাকে বলছে এখানে বসবাস করা মানে রুট ১৫’র সাথে মানিয়ে চলা, আর তাই তাকে জিজ্ঞেস করছে তার বিড়ালের বীচি ফেলা হয়েছে কি না। ডক্টর ক্রিড, দেখো জীবন কিভাবে বিদ্রূপ করছে তোমার সাথে, এই বিদ্রূপ ভিটামিনের মতোই উপকারী
“আমি তোমার জায়গায় হলে ওটাকে খাসি করিয়ে আনতাম,” বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনীর মধ্যে সিগারেটটা পিষে ফেলতে ফেলতে ক্র্যান্ডাল বললেন। খাসি করা বেড়াল বেশি ঘোরাঘুরি করে না। তবে বিড়ালটা যদি সারাদিন রাস্তার এপাশ ওপাশ করে, তাহলে একদিন হয়তো ঘটনা ঘটে যাবে আর শেষে ওটার জায়গা হবে রাইডার বাচ্চাদের রেকুন, পিচ্চি টিমি ডিসলারের স্পেনিয়্যাল কুকুর আর মিসুস ব্রাডলির টিয়ার সাথে। টিয়াটা যদিও রাস্তায় চাপা খেয়ে মরেনি, এমনিতেই একদিন ওপরের দিকে পা তুলে পটল তুলেছিল।”
“ব্যাপারটা ভেবে দেখবো,” লুইস বলল।
“ভাবো,” বলে ক্র্যান্ডাল উঠে দাঁড়ালো। “তোমার বিয়ারের কী অবস্থা?
আমি যাই, এক স্লাইস মিস্টার র্যাট খেয়েই নেই।”
“বিয়ার শেষ,” লুইসও উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, “আমারো যেতে হবে। কালকে একটা বিশেষ দিন।”
“কালকে বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করছো?”
লুইস মাথা নাড়ে। “ছাত্রছাত্রিরা আসতে আসতে আরো দু সপ্তাহ। তবে তারা আসার আগেই আমার কাজ বুঝে নেয়া উচিত, কী বলেন?”
“হ্যা। তুমি যদি দরকারের সময় কোথায় কি আছে হাতড়ে মরো তাহলে বিপদ হবে।” ক্র্যান্ডাল হাত বাড়িয়ে দিলে লুইস সেটা ধরে মৃদুভাবে ঝাঁকায়। সে মনে মনে ভাবে বুড়োদের হাড্ডিতে অল্পতেই ব্যথা লাগে।
“যে কোনো দিন বিকেলে চলে এসো,” তিনি বললেন। “তোমার সাথে নরমার পরিচয় করিয়ে দিবো। ও তোমাকে পছন্দ করবে।”
“আচ্ছা আসবো,” লুইস বলে। “আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগল।”
“আমারো। জায়গাটা ভালোই লাগবে তোমার। হয়তো বেশ কিছুদিন থেকেও যাবে।”
“আমারও তাই ইচ্ছে।”
লুইস জাডের বাড়ির হিজিবিজি নকশা করা বাঁধানো পথ দিয়ে সড়কটার কাছে হেটে আসার পর দাড়িয়ে যায়। তার সামনে সড়কটা দিয়ে একটা ট্রাক আর তার পেছনে ৫টা গাড়ি লাইন ধরে বাক্সপোর্টের দিকে চলে যায়। তারপর সে তার হাত তুলে স্যালুটের মতো করে রোড (রাড, সে নিজেকে আবারো মনে করিয়ে দিল) পেরিয়ে তার নতুন বাসায় ঢুকে পড়ে।
বাসায় ঘুমের গুঞ্জনের নিস্তব্ধতা। এলিকে দেখা গেল একফোঁটাও নড়েনি আগের জায়গা থেকে, গেজ ঘুমাচ্ছিল তার বেড় দেয়া শিশু বিছানায়, তার চিরচেনা ঘুমের পজিশনে; ঈগল পাখির মতো দুহাত দুপাশে ছড়িয়ে, দুধের ফিডারটি একদম নাগালেই। লুইস সেখানে কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়িয়ে তার ছেলের দিকে চেয়ে থাকে। ছেলের জন্যে তীব্র মমতায় তার মন দ্রবীভূত হয়, আবেগটা এতো তীব্র যে সেটাকে প্রায় বিপজ্জনক লাগছিল। সে ভাবে এর কারণ হতে পারে তাদের আগের বাড়ির প্রতি, আশেপাশের মানুষগুলো আর চেনা জায়গাগুলোর প্রতি গভীর টান। মাইলের পর মাইল পাড়ি দেয়ায় সেগুলো যেন তাদের মন থেকে এমনভাবে হারিয়ে গিয়েছে যেন পূর্বে তাদের কোন অস্তিত্বও ছিল না। বাচ্চা কাচ্চারা আসে আর যায়…এখন মানুষ বাড়িঘর বদলায় খুব বেশি; আগে লোকে একটা জায়গা বেছে নিয়ে সেখানেই স্থায়ী হয়ে যেতো। কথাটা ঠিকই।
সে তার ছেলের কাছে এগিয়ে যায়, আর যেহেতু আশেপাশে দেখার কেউ নেই, এমনকি রাচেলও না, বিছানার চারপাশের বারের ফাক দিয়ে সে বাবুর আঙুলগুলিতে চুমু খেয়ে সেগুলি গেজের গালে মৃদু চেপে আদর করে দেয়। গেজ ঘুমের মাঝেই কোঁ কোঁ করে পাশ ফেরে।
“ঘুমাও বাবা,” লুইস বলল।
***
সে নিঃশব্দে জামা ছেড়ে তার বিছানার অর্ধেকে অংশে শুয়ে পড়ে। বিছানা বলতে আপাতত দুটো সিঙ্গেল জাজিম মেঝেতে ঠেলে একসাথে করা। সে অনুভব করল যে সারাদিনের টনটনে চাপ তাকে ছেড়ে যাচ্ছে। রাচেল নড়ে না। রুমের মধ্যে খোলা বক্সগুলো ভূতুড়েভাবে স্তুপ করা। ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সে নিজের কনুইয়ে ভর দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। রুমটা তাদের বাড়ির সামনের দিকে, তাই সে এখান থেকে রাস্তার ওপারে ক্র্যান্ডালদের বাড়িটা দেখতে পাচ্ছে। বাইরে গাঢ় অন্ধকারে কোনো ছায়ামূর্তিও দেখা যাচ্ছে না, হয়তো পূর্ণিমা হলে দেখা যেতো, তবে সে একটা সিগারেটের আগুনের বিন্দু দেখতে পাচ্ছিল। এখনো জেগে আছে, সে ভাবে, তিনি হয়তো অনেক রাত অবধি জাগবেন। বুড়োদের ঘুম হয় না, হয়তো তারা জেগে জেগে পাহারা দেয়।
কিসের পাহারা দেয়?
লুইস ভাবতে ভাবতেই ঘুমের অতলে তলিয়ে যায়। স্বপ্নে দেখলো, সে ডিজনিল্যাণ্ডে একটা রেড ক্রসের চিহ্নওয়ালা ভ্যান গাড়ি চালাচ্ছে। গেজ তার পাশে বসে আছে যার বয়স হবে কমপক্ষে দশ। গাড়ির সামনে ড্যাশবোর্ডে বসে থাকা চার্চ লুইসের দিকে তার উজ্জ্বল সবুজ চোখে তাকিয়ে আছে। আর ১৮৯০-এর ট্রেন স্টেশনের পাশের মেইন স্ট্রিটে মিকি মাউস তাকে ঘিরে থাকা বাচ্চাদের সাথে হ্যান্ডশেক করছে। তার মস্ত বড় কার্টুনিশ গ্লাভসগুলো বাচ্চাদের ছোট্ট হাতগুলোকে যেন গিলে গিলে খাচ্ছে।
অধ্যায় ৭
পরের দুই সপ্তাহ ক্রিড পরিবারের খুব ব্যস্ততার মাঝে কাটে। ধীরে ধীরে লুইস তার নতুন চাকরিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে দশ হাজার শিক্ষার্থী, যাদের অনেকেই মাদক আর মদে আসক্ত, কেউ যৌন রোগে আক্রান্ত, কেউ ফলাফল নিয়ে উদ্বিগ্ন, আবার কেউ প্রথমবারের মতো বাড়ি ছেড়ে আসার কারণে বিষণ্ন; অনেকে, বিশেষ করে ছাত্রিরা ক্ষুধা মন্দায় ভুগছে…এরা সবাই যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে একত্রিত হয়, তখন সেখানে ডাক্তার হিসেবে যতটুকু অভ্যস্ত হওয়া যায় আর কি। আর লুইস যখন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান মেডিকেল অফিসার হিসেবে তার দায়িত্ব বুঝে নিতে থাকে, রাচেল বাড়িটার হাল ধরে।
গেজ নতুন বাসায় অভ্যস্ত হওয়ার বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কিছুদিনের জন্যে তার রাতে দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠার রুটিনটা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যায়। তবে দ্বিতীয় সপ্তাহের মাঝে এসে সে আবারো এক ঘুমে রাত কাবার করে দিতে শুরু করে। তবে এলি, নতুন জায়গায় নতুন স্কুল শুরু করার ভাবনায় সবসময়ই উত্তেজিত হয়ে আছে। সে অল্পতেই হাসতে হাসতে প্রায় ফিট হয়ে যাচ্ছে, আবার সামান্য কারণেই রেগে মেগে আগুন হয়ে যাচ্ছে। রাচেল লুইসকে বলেছে এলি যখন দেখবে ওর নতুন স্কুল ওর কল্পনার মতো কোনো নরকের গর্ত না, ও ঠিক হয়ে যাবে। লুইসের ধারণা রাচেলের কথাই ঠিক। কারণ এলি একদম শুরু থেকেই খুব মিষ্টি একটা মেয়ে।
বিকেলে জাড ক্র্যান্ডালের সাথে বিয়ার পান করাটা তার একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যখন গেজের ঘুমের সমস্যা দূর হয়, তখন লুইস দু-তিন রাত পরপর নিজেও সিক্স প্যাক নিয়ে জাডদের বাড়িতে হাজির হতে শুরু করে। নরমা ক্র্যান্ডালের সাথেও তার পরিচয় হয়। খুবই মিষ্টি স্বভাবের মহিলা। তিনি গিট ফোলানো বাতের ব্যথায় আক্রান্ত জঘন্য রকমের গিট্ ফোলানো বাতের ব্যথা, যা কি না বয়সকালের যা কিছু ভালো, তার অনেককিছুই বিষাদ করে দেয়—তবে এই ব্যাপারে তার মনোভাব বেশ ভালো। উনি কিছুতেই বাতের ব্যথার কাছে আত্মসমর্পণ করবেন না; কোনো সাদা পতাকা তিনি ওড়াবেন না। যা হয় হোক। লুইস ভাবল তার সামনে হয়তো আরো পাঁচ থেকে সাত বছর কার্যক্ষম বছর রয়েছে, যদিও সেগুলো খুব আরামের হবে না।
সে নিজের তৈরি করা নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজে থেকেই গরজ দেখিয়ে মহিলার অসুখ পরীক্ষা করে দেখে। এরপর ওনার ডাক্তারের দেয়া প্রেসক্রিপশনগুলো একত্রে গুছিয়ে ফাইল বানালো এবং পড়ে দেখলো যে সব ঠিকঠাকই আছে। তার নিজের একটু হতাশাই লাগে যে সেখানে তার আর কিছু করার বা পরামর্শ দেয়ার মতো কোনো সুযোগই ছিল না। ওনার চিকিৎসক ডা: ওয়েব্রিজ সব ঠিকভাবেই দেখাশোনা করছেন, যতটুকু নরমা ক্র্যান্ডালের মত রোগির জন্যে করা সম্ভব। হয়তো হঠাৎ কোন ব্রেকথ্র হয়ে তার রোগ ভালোর দিকে গেলেও যেতে পারে, তবে সেটার ওপর তো আর ভরসা করলে চলে না। এসব মেনে নিতে শিখতে হয়, নাহলে তোমার শেষ পরিণতি হবে কোনো ছোট্ট রুমের চার দেয়ালের ভেতরে, যেখান থেকে মোমের রং পেন্সিল দিয়ে তুমি বাসায় চিঠি লিখে যাবে।
রাচেল উনাকে বেশ পছন্দ করেছে। তারা তাদের বন্ধুত্ব অফিসিয়ালি সিলমোহর করে তাদের রান্নার রেসিপি দেয়া-নেয়া করে, যেমনটা ছোট বাচ্চারা তাদের প্রিয় খেলোয়াড়ের ছবির কার্ড লেনদেন করার মাধ্যমে করে থাকে। এই লেনদেন শুরু হয় নরমা ক্র্যান্ডালের আপেলের পিঠা আর রাচেলের গরুর গোশতের রেসিপি দিয়ে। নরমা ক্রিডদের দুই বাচ্চাকেই খুব পছন্দ করলেন, বিশেষ করে এলিকে। তার মতে এলি বড় হয়ে দেখতে হবে রূপকথার রূপসীদের মতো। লুইস সেদিন রাতে রাচেলকে বিছানায় বলেছিল, অন্ততঃপক্ষে উনি বলেন নাই যে এলি বড়ো হলে অনেক মিষ্টি একটা রেকুনের মতো হবে। রাচেল এমনভাবে হাসলো যে সে হাসতে হাসতে সশব্দে বায়ু ছাড়ে। আর তারপর দুজনে মিলে যেভাবে গলা ফাটিয়ে হেসে উঠে তাতে পাশের রুমে ঘুমন্ত গেজ জেগে ওঠে কেঁদে।
এলির স্কুলের প্রথম দিন চলে আসে। লুইস ততদিনে তার হাসপাতাল এবং চিকিৎসা সেবাগুলোর দায়িত্ব বেশ ভালোভাবে গুছিয়ে এনেছে। তাই সে দিনটা ছুটি নিয়ে নেয়। তাছাড়া হাসপাতাল এখন গড়ের মাঠ, সর্বশেষ রোগি যে কি না স্টুডেন্ট ইউনিয়নের সিঁড়িতে পা ভেঙেছিল, গত সপ্তাহেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পায়।
লুইস লনে গজকে কোলে নিয়ে রাচেলের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, যখন মস্ত হলুদ বাসটা হেলতে দুলতে তাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়। বাসের সামনের দরজা খুলে গেলে মধ্য সেপ্টেম্বরের বাতাসে বাচ্চাদের কলরব আর হৈচৈয়ের আওয়াজ ভেসে আসে।
এলি তাদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে করুণভাবে তাকায়, যেন বাবা- মাকে সে জিজ্ঞেস করতে চায় এই অবশ্যাম্ভাবী প্রক্রিয়াটা কি কোন ভাবেই বন্ধ করা যায় না? হয়তো তার বাবা-মার মুখভঙ্গিতে সে যা দেখলো তাতেই সে উপলব্ধি করলো তা আর সম্ভব নয় এবং আজকের দিন থেকে যা ঘটতে যাচ্ছে তা সবই মেনে নিতে হবে-ঠিক যেমন নিজের বাতের ব্যথা নরমা ক্র্যান্ডালকে মেনে নিতে হয়েছে।
এলি তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে বাসের সিঁড়িতে ওঠে। ড্রাগনের নিশ্বাসের মতো শব্দ করে বাসের দরজাটা লেগে যায়। বাসটা চলতে শুরু করলে রাচেল কান্নায় ফেটে পড়ে।
“কেঁদো না, ঈশ্বরের দোহাই লাগে,” লুইস বলে। সে নিজেও দাঁত চেপে নিজের কান্না চেপে রেখেছে। “সবে তো দিনের মাত্র অর্ধেকটা গেছে।”
“অর্ধেক দিনই যথেষ্ট,” রাচেল ঝাড়ি দিয়ে আরো প্রবল বেগে কাঁদতে থাকে। লুইস তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে। গেজ নিজের দুই হাত দিয়ে দুজনের গলা জড়িয়ে ধরে। সাধারণত রাচেল কাঁদলে গেজও কাঁদে। তবে আজ গেজ কাঁদলো না। সে আমাদের দুজনকেই সম্পূর্ণ নিজের করে পেয়েছে, লুইস ভাবলো, এবং সে এটা খুব ভালো করেই জানে।
***
তারা এলির ফেরার জন্যে চিন্তিতভাবে অপেক্ষা করছে, প্রচুর কফি গিলছে আর জল্পনা করছে কিভাবে এলির প্রথম দিনটা যাচ্ছে। লুইস পেছনের রুমে যায়, যেটা তার অফিস হবে। সেখানে সে করার কিছু না পেয়ে কিছু কাগজের স্তুপ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় উদ্দেশ্যহীনভাবে নড়াচড়া করতে থাকে। রাচেল সময় হওয়ার অনেক আগেই লাঞ্চ শুরু করে দেয়।
সোয়া দশটার দিকে ফোন বেজে উঠলে রাচেল ছো মেরে রিসিভার তুলে নেয়, দ্বিতীয়বার রিং হওয়ার সুযোগ না দিয়েই। রুদ্ধশ্বাসে সে বলে, “হ্যালো?” লুইস কিচেন আর তার অফিসের মাঝখানের ডোরওয়েতে দাড়িয়ে ভাবে অবশ্যই এলির শিক্ষকের ফোন হবে। তিনি ফোন দিয়েছেন এটা জানাতে যে, এলির দ্বারা স্কুল সম্ভব না; পাবলিক এজুকেশন ব্যবস্থা ওকে হজম করতে না পেরে উগরে দিয়েছে। কিন্তু দেখা গেল আসলে এরকম কিছুই না, নরমা ফোন দিয়েছেন। তিনি বললেন, জাড তাদের সবশেষ কিছু ভুট্টা ক্ষেত থেকে তুলে এনেছে এবং ওরা চাইলে কিছু নিজেদের জন্যেও নিতে পারে। লুইস একটা বাজারের ব্যাগ নিয়ে যায় আর জাডকে বকে কেন সে তাকে ভুট্টা তোলায় সাহায্য করার জন্যে ডাকেনি।
“বাল মার্কা জিনিসগুলো এমনিতেও কোনো কাজে লাগে না,” জাড বলেন।
“অন্তত আমি কাছে থাকলে এসব নোংরা কথা বলবে না,” নরমা বলেন। তিনি আগেকার দিনের একটা কোকাকোলার ট্রেতে করে আইসড টি নিয়ে সামনের বারান্দায় বেরিয়ে আসলেন।
“সরি, মহামান্য বুড়ি।”
“সে এক ফোঁটাও সরি না।” নরমা লুইসকে বললেন। এরপর বসতে গিয়ে ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন।
“এলিকে স্কুলবাসে উঠতে দেখলাম,” জাড একটা বিড়ি ধরাতে ধরাতে বলেন।
“ও মানিয়ে নিতে পারবে,” নরমা বললেন। “প্রায় সব বাচ্চারাই পারে।”
প্রায়, লুইস বিষাদের সাথে ভাবে।
***
তবে এলির স্কুল জীবনের প্রথম দিন ভালোই কেটেছে। সে দুপুরে তার নতুন স্কুল ইউনিফর্ম নাচাতে নাচাতে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বাড়ি ফেরে (যদিও তার হাঁটুতে একটা নতুন আচড়ের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে)। ওর হাতে একটা ছবি, যেটায় দুইটা পিচ্চিকে দেখা যাচ্ছে যারা একটা স্টিলের ওভারব্রিজের ওপর দিয়ে পাশাপাশি হেটে যাচ্ছে। এলির একটা জুতোর ফিতে খোলা, একটা চুলের ফিতে নিখোঁজ। “আমরা আজকে ‘ওল্ড ম্যাকডোনাল্ড’ গানটা গেয়েছি! বাবা! মা! আমরা ‘ওল্ড ম্যাকডোনাল্ড’ গেয়েছি, ঠিক ক্র্যাস্টেয়ার্স স্ট্রিট স্কুলের মতো!”
রাচেল লুইসের দিকে তাকায়, যে কি না জানালার পাশে গেজকে কোলে নিয়ে বসে আছে। বাবুর তখন ঘুম ঘুম অবস্থা। রাচেলের চাহনিতে একটা বিষাদ ছিল, যদিও সে খুব দ্রুত তার নজর ফিরিয়ে নেয় তবুও লুইস বুঝতে পারে এবং লুইস হঠাৎ মারাত্মক আতঙ্কিত বোধ করে। আমরা বুড়িয়ে যাচ্ছি। এটা আসলেই সত্য। আমাদের বেলায় এর কোনো ব্যতিক্রম হবে না। রাচেল বুড়িয়ে যাচ্ছে…এবং আমরাও।
এলি লুইসের দিকে ছুটে আসে এবং তাকে একই সাথে তার আঁকা ছবি, নতুন করে ছিলে যাওয়া হাঁটু, ‘ওল্ড ম্যাকডোনাল্ড’ আর মিসেস বেরিমেনের ব্যাপারে বলতে শুরু করল। চার্চ ওর দুপায়ের ফাঁক দিয়ে বারবার পাক খাচ্ছিল আর সশব্দে পুরর্ পুরর্ করছে আর এলিও প্রায় দৈবক্রমেই ওকে পায়ের নিচে মাড়িয়ে দিচ্ছে না।
“স্,” লুইস ওকে থামিয়ে চুমু খায়। গেজর তার বোনের এতসব উত্তেজনার কোনো হুশ নেই, সে বাবার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। “আমি বাবুকে শুইয়ে দিয়ে এসে সব শুনছি মামনি।”
সে গেজকে নিয়ে সেপ্টেম্বরের হেলে থাকা রোদের ভেতর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগে। সিঁড়ি ভেঙে অর্ধেক ওঠার পর এক অজানা আতঙ্ক আর চারদিকের অন্ধকার ওকে এমনভাবে ঘিরে ধরে যে ও একদম ঠায় দাঁড়িয়ে যায় আর চারদিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে হঠাৎ তার সাথে কী হলো এটা। সে গেজকে আরো দৃঢ়ভাবে আকড়ে ধরলে গেজ অস্বস্তিতে নড়ে চড়ে ওঠে। লুইসের হাত আর পিঠের লোম একদম খাড়া হয়ে যায়।
ব্যাপারটা কী? সে আতঙ্কিত এবং হতবাক হয়ে ভাবে। তার মাথার তালুতে শীত লাগছে এবং সে তার চোখের পেছনে এড্রেনালিনের ঢেউ টের পাচ্ছে। প্রচন্ড ভয়ে মানুষের চোখ ভালোভাবে কাজ করে না, সে জানে। ওই অবস্থায় চোখগুলো যে শুধু বড় বড় হয়ে যায় তাই নয়, রক্তচাপ বেড়ে যাওয়ায় খুলিতে তরলের বাড়তি চাপে চোখগুলো বাইরের দিকে ঠিকরে বেরিয়ে আসে। হয়েছেটা কী এখানে? ভৌতিক কিছু? ওহ ঈশ্বর! আমার মনে হচ্ছে কেউ গা ঘেসে চলে গেল। যেন আরেকটু হলেই তাকে চোখে দেখতে পেতাম।
নিচতলার কাছের দরজাটা প্রচন্ড জোরে চৌকাঠের সাথে বাড়ি খায় লুইস ক্রিড লাফিয়ে ওঠে প্রায় চিৎকার করে ওঠে এবং পরক্ষণেই হেসে উঠে। এগুলো সাধারণ সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার-স্যাপার যেগুলো মানুষ মাঝে মাঝে অনুভব করে, এর চাইতে কিছু বেশিও না আবার কিছু কমও না। ক্ষনিকের অনুভূতি। এগুলি মাঝে মাঝে হয়, এটুকুই। স্ক্রুজ জেকব মার্লির আত্মাকে কী বলেছিল? তুমি একটা অল্প সিদ্ধ আলুর চাইতে বেশি কিছু না। বরং তোমার চাইতে বেশি ভয় ঐটিতেই। চার্লস ডিকেন্স নিজেও হয়তো জানতেন না যে তিনি কতটা সঠিক বলেছিলেন-শরীরতাত্ত্বিক এবং মনস্তাত্বিক উভয়ভাবেই। ভূত বলতে কিছু নেই, অন্তত তার অভিজ্ঞতায়। সে তার পেশাদারি জীবনে অন্তত দুই ডজন মানুষকে মৃত ঘোষণা করেছে, কিন্তু মৃতদেহ থেকে আত্মার প্রস্থানের মতো কিছুই সে অনুভব করেনি।
সে গেজকে ওর রুমে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। ছেলের গায়ে কম্বল টেনে দিতে গেলে তার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে এবং হঠাৎই তার কার্ল চাচার “শোরুম”-এর কথা মনে পড়ে যায়। ওই ‘শোরুম’-এ কোনো নতুন গাড়ি বা ডিশওয়াসার ছিল না। সেখানে ছিল শুধু কফিন। তার সেই চাচা ছিলেন মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থাকারী ব্যক্তি। একজন আন্ডারটেকার।
আজব! কিসে এতো ভয় পাচ্ছ? এসব কিছুই না। এসব ফালতু জিনিস ভাবা বাদ দাও।
সে তার ছেলেকে চুমু খেয়ে নিচতলায় যায় তার মেয়ের স্কুলে প্রথম দিনের গল্প শোনার জন্যে।
অধ্যায় ৮
পরের শনিবার আসতে আসতে এলি তার জীবনের স্কুলের প্রথম সপ্তাহ পার করে ফেলে। আর লুইসের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরুর সময়ও একদম ঘনিয়ে আসে।
ক্রিড পরিবারের সবাই তাদের বাড়ির সামনের উঠোনে ঘাসের ওপর বসে ছিল যখন জাড ক্র্যান্ডাল রাস্তা পেরিয়ে তাদের কাছে আসে। এলি তার সাইকেল থেকে নেমে আইসড টি খাচ্ছে। গেজ ঘাসের ওপর হামাগুড়ি দিচ্ছে, পোকামাকড় পরীক্ষা করছে এবং তাদের মধ্যে থেকে হয়তো কিছু গিলেও ফেলছে; গেজ কোত্থেকে নিজের প্রোটিন সংগ্রহ করে সেই ব্যাপারে সে খুব উদার।
“জাড,” লুইস উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে।” আপনার জন্যে একটা চেয়ার নিয়ে আসি।”
“লাগবে না।” জাডের পরনে ছিল জিন্স আর শার্ট, আর এক জোড়া সবুজ বুট। উনি এলির দিকে তাকালেন। “ওই পথটা কোথায় যায় দেখতে চাও, এলি?”
“হ্যাঁ!” এলি বলেই সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। কৌতুহলে ওর চোখ চকচক করছে। “স্কুলের জর্জ বাক আমাকে বলেছে ঐটা পেট সেমেটারি। আমি আম্মুকে বলেছি কিন্তু আম্মু বলছে আপনার জন্যে অপেক্ষা করতে। কারণ আপনি জায়গাটা ভালোভাবে চেনেন।”
“হ্যাঁ, চিনি বৈকি,” জাড বললেন। “তোমার বাবা মা রাজি থাকলে আমরা ঐ দিকে হাঁটতে যেতে পারি। তবে তোমার বুট জুতো লাগবে, ওখানকার মাটি জায়গায় জায়গায় কাদা হয়ে থাকে।”
এলি ছুটে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।
জাড ওর দিকে স্নেহভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। “তুমিও আসতে পারো, লুইস।”
“আমি যাবো,” লুইস বলে। সে রাচেলের দিকে তাকায়। “তুমি যাবে?”
“গেজকে কী করবো? মাইল খানেক পথ হবে মনে হচ্ছে।”
“ওকে পিঠে গেরিপ্যাকে করে চালান করে দেয়া যায় আমাদের সাথে।”
রাচেল হাসে। “আচ্ছা মিস্টার…পিঠে করে চালান করবে তুমি, আমি না।”
***
দশ মিনিটের মধ্যেই গেজ বাদে বাকিরা পায়ে বুট চাপিয়ে রওনা হয়ে যায়। গেজ লুইসের পিঠে গেরিপ্যাকে চেপে লুইসের ঘাড়ের ওপর দিয়ে চারদিক চোখ বড় বড় করে দেখছে। এলি ফুল তুলতে তুলতে আর প্রজাপতির পিছু পিছু ছুটে সবার থেকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে।
পেছনের মাঠের ঘাসগুলো ছিল কোমর সমান, আর এখন তার সাথে যোগ হয়েছে নানান গুল্ম আর শেষ গ্রীষ্মের জঙ্গলের চিরচেনা গুনগুন গান যা প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে আসে। তবে আজকের বাতাসে শরতের কোনো ছিটেফোটা নেই; সূর্যটায় এখনো আগস্টের তেজ, যদিও দুই সপ্তাহ আগেই ক্যালেন্ডারে আগস্ট পেরিয়ে গেছে। তারা যখন ঘাস কেটে বানানো রাস্তাটা দিয়ে সাবধানে হেটে হেটে প্রথম টিলাটার মাথায় ওঠে, ততক্ষণে লুইসের বগল ঘামে ভিজে ওঠেছে।
জাড থামলেন। প্রথমে লুইস ভেবেছিল বৃদ্ধ মনে হয় হাঁপিয়ে গেছেন। কিন্তু তার পরই সে তার পেছনের দৃশ্যের দিকে খেয়াল করে।
“এখানে দাঁড়ালে বেশ ভালো ভিউ দেখা যায়,” দাঁতের ফাঁকে একটা ঘাসের ডগা চিবুতে চিবুতে জাড বললেন। লুইসের মনে হলো এরকম উক্তি সে আগে কখনো শোনেনি।
“অসাধারণ,” রাচেল মৃদু কণ্ঠে বলে লুইসের দিকে কিছুটা অভিযোগের সুরে তাকালো। “তুমি এই জায়গাটার ব্যাপারে আগে বলোনি কেন?”
“কারণ আমি নিজেই জানতাম না,” লুইস একটু লজ্জিত কণ্ঠে বলে। তারা এখনো তাদের সম্পত্তির সীমানা পেরোয়নি; আসলে এখানে চড়ার সময়ই পায়নি আজ পর্যন্ত।
এলি অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। এখন সেও ফিরে এসে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। চার্চ এলির গোড়ালিতে আদুরেভাবে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছে।
টিলাটা তেমন উঁচু না, তবে তাতে কিছু যায় আসে না। পূর্বদিকে গভীর জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না, তবে পশ্চিমে তাকালে দূরে নিচের জায়গাটাকে স্বর্ণময় এবং কোন শেষ গ্রীষ্মের স্বপ্নের অংশ বলে মনে হয়। সবকিছুই স্থির, নীরব আর ঝাপসা। এমনকি নিস্তব্ধতা ভাঙার জন্যে রাস্তার কোন অরিনকো ট্যাঙ্কারও নেই।
তারা সবাই নদী উপত্যকার দিকেই চেয়ে ছিল; নদীর নাম পেনবস্কট। ওই নদী দিয়েই আগেকার দিনের কাঠ ব্যবসায়িরা গাছের গুড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যেত, উত্তরপূর্ব দিক থেকে ব্যাঙ্গর আর ডেরিতে। তবে এই জায়গাটা ব্যাঙ্গরের দক্ষিণে আর ডেরির সামান্য উত্তরে। প্রশস্থ নদীটা বেশ শান্তভাবে বয়ে চলছে, মনে হয় যেন কোনো গভীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে আছে। লুইস দূরের হ্যাম্পটন আর উইন্টারপোর্ট দেখে চিনতে পারে। আর নদীর সমান্তরালে বয়ে চলা রুট ১৫-কেও সাপের মতো একে বেঁকে প্রায় বাকস্পোর্ট পর্যন্ত দেখতে পায় লুইস। তারা নদীর ওপারে সবুজ শ্যামলিমা, রাস্তা আর মাঠ দেখতে পায়। সবুজের শামিয়ানা ভেদ করে নর্থ লাডলো চার্চের মিনার দেখা যাচ্ছে আর ডানে তাকিয়ে লুইস এলির স্কুলের লাল দালান দেখতে পায়।
মাথার ওপরে সাদা মেঘ ধূসর জিন্স রঙের দিগন্তপানে ভেসে চলছে। আর চারদিকে অগণিত শেষ গ্রীষ্মের কটা রঙের মাঠ।
“এরকম দৃশ্যকে অসাধারণ না বলাটা ফৌজদারি অপরাধ,” অবশেষে লুইস বলে।
“এটাকে আগেকার দিনে লোকে সুন্দর টিলা বলতো,” জাড বললেন। তিনি তার ঠোঁটের কোনায় একটা সিগারেট ঠেসে দিলেও সেটা জ্বালালেন না। “কিছু লোকে এখনো বলে। তবে কমবয়সি লোকজন সবাই শহরের দিকে চলে যাওয়ায় এ জায়গাটা বেশিরভাগ লোকেই চেনে না। আমার মনে হয় না খুব বেশি মানুষ এখানে আর ঘুরতে আসে। টিলাটা ছোট বলে মনে হয় যে এখান থেকে তেমন কিছু দেখা যাবে না। তবে দেখতেই পাচ্ছ-” তিনি তার হাত দিয়ে চারদিকে ইশারা করে চুপ করে গেলেন।
“এখান থেকে চারদিকের সবকিছু দেখা যায়,” রাচেল মৃদু, বিমোহিত কণ্ঠে বলে। সে লুইসের দিকে তাকায়। “এই জায়গাটা কি আমাদের?”
লুইসের উত্তর দেয়ার আগেই জাড বললেন, “একদম। এটা ওই বাড়ির সীমানারই অংশ।”
দুটো অবশ্য এক জিনিস না, লুইস ভাবে।
***
জঙ্গলের ভেতর তুলনামূলক ঠান্ডা, তাপমাত্রা অন্তত আট-দশ ডিগ্রী কম। পথটা এখনো বেশ প্রশস্থ, কিছুদূর পর পর টব বা কফির ডিব্বায় ফুল রেখে চিহ্ন দেয়া (ফুলগুলো বেশির ভাগই বাসি)। ঝাউ গাছের সুচালো পাতা পথে বিছানো। তারা যখন প্রায় সিকি মাইল পাড়ি দিয়েছে এবং টিলার নিচের দিকে নামছে তখন জাড এলিকে পেছন থেকে ডাকলেন।
এই জায়গাটা ছোট মেয়েদের হাঁটার জন্যে বেশ ভালো। তবে তুমি আমাকে কথা দাও, তুমি এখানে আসলে কখনো এই পথ ছেড়ে যাবে না।”
“কথা দিলাম,” এলি সাথে সাথেই উত্তর দেয়। “কিন্তু কেন?”
তিনি বিশ্রামরত লুইসের দিকে তাকালেন। ঝাউ আর দেবদারু গাছের ছায়ার নিচেও গেজকে পিঠে বয়ে নিয়ে চলা বেশ শক্ত কাজ। “তুমি জানো আমরা এখন কোথায় আছি?” জাড লুইসকে জিজ্ঞেস করলেন।
লুইস কিছু উত্তর চিন্তা করে সেসব বাতিল করে দিলো: লাডলো, লাডলো, নর্থ বাড়ির পেছনে। সে মাথা নাড়ে।
জাড় তার বুড়ো আঙুল কাঁধের ওপর তুলে পেছনদিকে নির্দেশ করে বলল, “শহরটা ঐ দিকে। আর এইদিকে জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই নেই, তাও অন্তত পঞ্চাশ মাইল জুড়ে। এটাকে লোকে নর্থ লাডলোর জঙ্গল বলে, তবে অরিঙটনেও কিছু অংশ আছে এটার, তারপর চলে গেছে একদম রকফোর্ড পর্যন্ত। এটার সীমানা শেষ হয়েছে ওই সরকারি জমিতে গিয়ে, যেটার সম্পর্কে তোমাকে বলেছিলাম; যে জমিগুলো ইন্ডিয়ানরা ফেরত চায়। ব্যাপারটা বেশ মজার যে তোমার বিদ্যুতের বাতি, ক্যাবল টিভি আর টেলিফোনওয়ালা বাড়িটা একটা বনের সীমানায়।” তিনি এলির দিকে ফিরে তাকালেন। “এই জঙ্গলে একদম উল্টোপাল্টা ঘোরাঘুরি করবে না। এই জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেললে ঈশ্বরই জানেন কী হবে।”
“আচ্ছা, মিস্টার ক্র্যান্ডাল।” এলি বেশ মুগ্ধ হয়েছে, এমন কি কিছুটা অবাকও হয়েছে। কিন্তু লুইস খেয়াল করল ও একবিন্দু ভয়ও পায়নি। রাচেল জাডের দিকে উৎকণ্ঠিতভাবে তাকিয়ে আছে আর লুইসের নিজেরও কিছুটা দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সে ভাবলো, জঙ্গলের ভীতি হয়ত শহুরেদের অনেকটা সহজাত বৈশিষ্ট্য। বিশ বছর আগে স্কাউটিংয়ে লুইস শেষবারের মতো কোনো কম্পাস ছুঁয়ে দেখেছিল। আর নর্থ ষ্টার বা গাছের গায়ে কোন পাশে শ্যাওলা পড়েছে দেখে দিক চেনাটা তার কাছে ছোট বেলায় শেখা নানান রকমের গিট্ দেয়া শিক্ষার মতই অস্পষ্ট।
জাড ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। “তবে এই জঙ্গলে ১৯৩৪- এর পর থেকে কেউ হারায়নি, অন্তত স্থানীয় কেউ না। শেষ যে লোকটা হারিয়েছিল তার নাম উইল জেপসন-কারো কিছু যায় আসেনি তাতে। আমার মনে হয় উইল তখন এদিককার সবচাইতে বড় মাতাল।”
“স্থানীয় কেউ হারিয়ে যায়নি বললেন, তবে কি স্থানীয় না এমন কেউ—” রাচেল অস্বাভাবিক স্বরে বলে আর লুইস যেন ওর মনের কথাটা বুঝতে পারে: আমরা স্থানীয় না। অন্তত পক্ষে এখনো না।
জাড থেমে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় জানান। “দুই-তিন বছর পর পর দুই-একজন পর্যটক যে জঙ্গলে হারিয়ে যায় না, তা না। তারা ভাবে, রাস্তার এতো কাছেই তাদের হারিয়ে যাওয়ার কোনো ভয় নেই। তবে হারিয়ে যাওয়া সবাইকেই পাওয়া গেছে শেষ পর্যন্ত, তুমি অস্থির হয়ো না।
“এখানে মুস হরিণ আছে?” রাচেল শঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলে লুইস মুচকি হাসে। রাচেল যদি অস্থির হয়, তাহলে সে কোমর বেঁধেই অস্থির হয়।
“হুম, মাঝে মধ্যে দুয়েকটা দেখা যায়, তবে ওরা কোনো ঝামেলা করে না। ওদের মেটিং সিজন আসলে একটু উৎপাত করে তবে অন্য সময় তারা ভদ্রলোক। ওই সময়টা বাদে অন্য সময় তারা শুধুমাত্র ম্যাসাচুসেটস’র লোকজন পেলে দাবড়ানি দেয়। জানি না ওরা কেন এমন করে, তবে এমনটাই দেখেছি সব সময়।” লুইস ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বুড়ো মজা করছে কি না, কারণ জাডকে দেখে সিরিয়াসই মনে হচ্ছে। “বার বার দেখেছি এমনটা। বিভিন্ন লোককে দেখেছি গাছের মাথায় চড়ে চিৎকার করে করে মুস হরিণের পালের কথা বলতে, যাদের এক একটা না কি মিনি ট্রাকের সমান। আর ঐসব দৌড়ানি খাওয়া লোকদের মধ্যে একটাই মিল, তারা সবাই ম্যাসাচুসেটসের। মনে হয় মুস হরিণগুলো লোকজনের গায়ে ম্যাসাচুসেটস’র গন্ধ পায়। আমি চাই কোনো পশু বিশেষজ্ঞ ব্যাপারটা নিয়ে একটা রিসার্চ পেপার লিখুক, তবে মনে হয় না কেউ কাজটা করবে।”
“মেটিং সিজন কী, মা?” এলি জিজ্ঞেস করে।
“কিছু না,” রাচেল বলে। “তুমি এখানে বড়দের ছাড়া একদম আসবে না, ঠিক আছে এলি?” রাচেল লুইসের দিকে এক কদম এগিয়ে যায়।
জাডকে দেখে মনে হলো তিনি কষ্ট পেয়েছেন। “আমি তোমাদের ভয় ধরিয়ে দিতে চাইনি, তোমাকেও না তোমার মেয়েকেও না। এই জঙ্গলে ভয়ের কিছু নেই। এই পথটা চমৎকার; বসন্তে জায়গাটা পোকামাকড়ে কিলবিল করে আর সারা বছরই কাদায় পিচ্ছিল হয়ে থাকে-‘৫৫ সন বাদে, আমার দেখা সবচেয়ে খরার মৌসুম সেটাই। এমনকি এখানে বিষাক্ত আইভি বা বিষাক্ত ওক গাছও নেই, যেগুলো তুমি বাচ্চাদের স্কুলের মাঠের পেছন দিকেই পেতে পারো। আর এলি, ওইসব থেকে একশো হাত দূরে থাকবে, যদি না তোমার জীবনের তিন সপ্তাহ সময় স্টার্চ বাথ নিয়ে শেষ করতে না চাও।”
এলি তার মুখে হাত চেপে হেসে উঠলো 1
“এই পথটা নিরাপদ,” জাড আন্তরিকভাবেই রাচেলকে বললেন। কিন্তু রাচেলকে দেখে মনে হচ্ছে না সে তার আশ্বাসে ভরসা পাচ্ছে। “কারণ, আমি বাজি ধরে বলতে পারি পথটা গেজও অনুসরণ করতে পারবে, আর শহরের বাচ্চারা যে এখানে প্রায়ই আসে তাতো তোমাদের আগেই বলেছি। তারা পথটাকে দেখাশোনা করে, আর তারা এটা করে নিজে থেকেই। আমি সত্যই চাই না এলি এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত হোক।” তিনি এলির দিকে ঝুঁকে চোখ টিপলেন। “ব্যাপারটা জীবনের আরও অনেক কিছুর মতই এলি। সঠিক পথ ধরে চললে সব ঠিক। আর পথ থকে সরে গেলে দেখা যাবে তুমি পথ হারিয়ে ফেলেছ, যদি তোমার ভাগ্য খারাপ থাকে। আর তোমাকে খোঁজার জন্যে তখন এখানে সার্চ পার্টি পাঠাতে হবে।”
***
তারা এগিয়ে চলে। বেবি ক্যারিয়ারের ওজনে লুইসের পিঠে খিল ধরে গেছে। গেজ হরদম লুইসের চুল ধরে টানছে অথবা উৎফুল্ল হয়ে তার কোমরে লাথি মারছে। মশারা তার কাঁধ আর মুখের চারপাশে উড়ছে আর অসহ্য পিন্ পিনন শব্দ করে চলছে। পথটা নিচের দিকে বক্রাকারভাবে নেমে গেছে। কখনও বড় দেবদারু গাছের কারণে বেঁকেছে, কখনও কাটাঝোপের পাশ কাটিয়ে গিয়েছে। ওদের এখন কাদা ভেঙে হাঁটতে হচ্ছে, লুইসের বুট কাদা আর পানিতে পচপচ্ করে এগিয়ে চলছে। একসময় জলা মতন একটা জায়গা এলে তারা পানির ওপরে থাকা ঘাসের বড় বড় আটির ওপর পা ফেলে এগিয়ে যায়। এটাই পথের সবচাইতে বন্ধুর অংশ। আবার তারা পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলে গাছপালাও আগের মত বেড়ে যায়। গেজের ওজন যেন জাদুর বলে দশ পাউন্ড বেড়ে গেছে, আর একই জাদুতে দিনের তাপমাত্রাও দশ ডিগ্রি বেড়ে যায়। লুইসের মুখ বেয়ে ঘাম ঝরতে থাকে।
“কী অবস্থা তোমার?” রাচেল জিজ্ঞেস করে। “ওকে আমার কাছে দেবে নাকি কিছুক্ষণের জন্যে?”
“না। আমিই পারব।” সে বলে। সে আসলেই পারবে তবে তার হৃৎপিণ্ড দ্রুতগতিতে তার বুকের খাচায় ধাক্কা দিচ্ছে। সে নিজে শারীরিক কসরত করার চাইতে অন্যদের তা প্রেসক্রাইব করতে বেশি অভ্যস্ত।
জাড এলির পাশে হাঁটছেন। ওর টিয়া রঙের টাইট্স আর লাল জামা ছায়াময় সবুজ-পিঙ্গলের বিষণ্নতার মাঝে উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
“লু, উনি কি আসলেই জানেন আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?” রাচেল নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে, তার কণ্ঠে দুশ্চিন্তা।
“অবশ্যই,” লুইস বলে।
জাড় ঘাড় ঘুরিয়ে উৎসাহের সাথে বললেন, “আর বেশি পথ বাকি নেই…তুমি চলতে পারছ তো, লুইস?”
ওরে ঈশ্বর, লুইস ভাবে, লোকটার বয়স আশি পেরিয়েছে, অথচ একটুও হাঁপায়নি।
“আমি ঠিক আছি,” সে একটু চড়া গলায় উত্তর দেয়। সে যদি হাঁপাতে হাঁপাতে হার্টফেল করার মত অবস্থায় থাকত, তাহলেও হয়ত তার আত্মসম্মান তাকে একই উত্তর দিতে বাধ্য করত। সে শুকনো করে হেসে পিঠের গেরিপ্যাকের স্ট্রাপ একটু টাইট করে এগিয়ে চলে।
তারা দ্বিতীয় টিলাটিতে ওঠার পর পথটা ঢালু হয়ে এক মানুষ সমান লম্বা ঝোঁপঝাঁড়ের মাঝে দিয়ে নেমে যায়। পথটা ক্রমশ সরু হতে থাকে, আর তার একটু পরেই লুইস দেখতে পায় এলি আর জাড বোর্ডের তৈরি একটা জীর্ণ অর্ধবৃত্তাকার খিলানের নিচে দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছে। ওটার গায়ে কালো কালিতে অনেকটা মুছে যাওয়া লেখাটা কোন রকমে পড়া যাচ্ছে: পেট সেমিটারি।
লুইস আর রাচেল একে অপরের সাথে খুশিমনে চোখাচোখি করে। তারা দুজন সেই খিলানের নিচে এসে পাশাপাশি দাঁড়ায় এবং আপনাথেকেই একে অপরের হাত চেপে ধরে, যেন তারা বর আর কনে, এখানে বিয়ে করতে এসেছে।
সেদিন দ্বিতীয়বারের মত বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ে লুইস ক্রিড।
এ জায়গাটায় আগের মত পাইনের সুচারু পাতা ছেয়ে নেই। চল্লিশ ফিটের মত ব্যাসের একটা বৃত্তাকার জায়গার ঘাস ছেটে পরিস্কার করা। জায়গাটার তিনদিকে ঘন ঝোঁপঝাঁড়ের জঙ্গল, আর আরেকদিকে ঝড়ে উপড়ে পড়া অনেকগুলো মরা গাছের বিরাট স্তূপ, যেটা দেখতে অশুভ এবং বিপজ্জনক। কোন পুরুষ মানুষ ওই ধ্বংসস্তূপ ভেদ করে যেতে চাইলে বা ওটার ওপর উঠতে গেলে তার উচিত হবে লোহার আন্ডারওয়ার পড়ে নেয়া, নাহলে পা ফসকে পড়ে গিয়ে পুরুষত্ব গলে যাওয়ার ভাল সম্ভাবনা আছে, লুইস মনে মনে ভাবে। সাফ করা জায়গাটা নানান রকম স্মৃতিফলকে ঠাসা। সেগুলো দেখে খুব স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, সেসব আনাড়ি বাচ্চাদের হাতে বানানো। বাচ্চারা হাতের কাছে যা পেয়েছে-বাক্সের টুকরো, বাতিল কাঠের টুকরো, পিটিয়ে সোজা করা টিনের টুকরো ইত্যাদি দিয়ে এগুলো তৈরি করেছে। জায়গাটার চারদিকের জঙ্গলগুলো এত ঘন যে প্রত্যেকটা উদ্ভিদ তার নিজস্ব জায়গা আর সূর্যের আলোর জন্যে প্রতিযোগিতা করছে। কিন্তু এর মাঝেই আনাড়ি হাতের ফলকগুলো যেন জায়গাটার গুরত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। আর জঙ্গলের পরিবেশ জায়গাটায় গভীর অসামান্যতা যোগ করেছে, যা খ্রিস্টীয় না, বরং পেগান।
“চমৎকার জায়গা,” রাচেল বলে, তবে বোঝা গেল না সে মনের কথা বলেছে কি না।
“ওয়াও!” এলি চেচিয়ে ওঠে।
লুইস গেজকে পিঠ থেকে নামিয়ে বেবি ক্যারিয়ার থেকে বের করে ঘাসের ওপর ছেড়ে দেয়। লুইসের পিঠ যেন মুক্তির নিশ্বাস ছাড়ে।
এলি একটার পর একটা স্মৃতিফলকের দিকে ছুটে যাচ্ছে আর প্রতিটি দেখেই আনন্দে চিৎকার করছে। লুইস ওর পিছে পিছে যায় আর রাচেল বাবুর দিকে চোখ রাখে। জাড একটা পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে পা ভাজ করে বসে পড়েন আর বিড়ি টানতে থাকেন।
লুইস খেয়াল করে জায়গাটা দেখে। জায়গাটা দেখলে শুধু গোছানো মনে হয় তা না, জায়গাটায় আসলেই একটা প্যাটার্ন আছে। সূর্যের চারপাশে যেমন গ্রহগুলো বৃত্তাকার অক্ষে ঘোরে, সেরকম অনেকগুলো অক্ষ বরাবর কবরের ফলকগুলো পোতা।
স্মাকি নামের বেড়ালটা ছিল প্রভুভক্ত-একটা ফলক বলছে। হাতের লেখায় শিশু শিশু ভাব থাকলেও বোঝা যাচ্ছে, লেখাটা খুবই যত্ন করে লেখা। তার নিচেই লেখা, ১৯৭১-১৯৭৪। লুইস বৃত্তগুলোর মধ্যে সবচাইতে বাইরের বৃত্তে একটা প্রাকৃতিক স্লেট পাথরের ফলক দেখতে পায়। সেটার গায়েও একটা নাম, অনেকটা মুছে গেলেও লাল কালির লেখাটা স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। বিফার, আর তার নিচেই একটা ছড়া লেখা :
বিফার বিফার, অ্যা হেলুভা স্নিফার
আনটিল হি ডাইড হি মেইড আস রিচার।
“বিফার হচ্ছে ডেস্লারদের পোষা ককার জাতের স্পেনিয়্যাল কুকুর,” জাড বলল। তিনি তার জুতার হিল দিয়ে মাটিতে একটা ছোট গর্ত করে সেটায় সিগারেটের ছাই ফেলছিলেন। “গত বছর একটা ময়লার ট্রাকের নিচে চাপা পড়েছিল। ছড়াটা কিন্ত বেশ, তাই না?”
“আসলেই,” লুইস সম্মতি জানায়।
কিছু কবরে ফুল দেয়া, যেগুলোর কিছু তাজা, কিছু পুরনো আর কিছু একদমই পচে গেছে। ফলকগুলোর মধ্যে অর্ধেকের গায়ের কালি বা পেন্সিলের লিখা কিছুটা বা একদমই পড়া যায় না। আর বাকি অর্ধেকের গায়ে কিছুই লেখা নেই। লুইস ভাবল এসব ফলকের গায়ে হয়তো চক বা মোমের রঙপেন্সিল দিয়ে লেখা ছিল।
“আম্মু!” এলি চেচিয়ে ওঠে। “এখানে একটা গোল্ড ফিশ! দেখে যাও!”
“দেখা লাগবে না,” রাচেল বললে লুইস তার দিকে এক নজর দেখে। রাচেল সবচাইতে বাইরের বৃত্তের ওপাশে চরম অস্বস্তি নিয়ে একা একা দাঁড়িয়ে আছে। এই রকম একটা জায়গায় এসেও ও আপসেট হয়ে পড়েছে, লুইস ভাবে। ও মৃত্যু ব্যাপারটাকে কখনোই সহজে নিতে পারে না, খুব সম্ভবত ওর বোনের মৃত্যুর কারণে। আবার ভাবল, কেউই হয়তো একদম সহজভাবে মৃত্যু ব্যাপারটাকে নিতে পারে না। রাচেলের বোন ছোট থাকতে মারা যায়, আর লুইস বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই বুঝে নেয় ওই ঘটনা নিয়ে রাচেলকে না ঘাটাতে। ওর বোনের নাম ছিল জেলডা আর তার মৃত্যু হয়েছিল মেরুদণ্ডের মেনিনজাইটিস রোগে। দীর্ঘ দিন এই প্রাণঘাতী রোগে ভুগে ওর বোন মারা যায়, যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। সে সময় রাচেল ছিল তার বয়ঃসন্ধিতে আর তাই ও ছিল অত্যন্ত অনুভূতি প্রবণ। আর রাচেল যে ব্যাপারটা ভুলে থাকতে চায়, তাতে লুইস কোন দোষ দেয় না তাকে।
লুইস রাচেলকে চোখ টিপে দিলে রাচেল জবাবে কৃতজ্ঞতাভরা মুচকি হাসি ফেরত দেয়।
লুইস ওপরের দিকে তাকায়। জায়গাটা প্রাকৃতিকভাবেই ফাঁকা। সে ভাবল, ফাঁকা বলেই রোদের আলো মাটি পর্যন্ত পৌঁছে। আর সে জন্যেই এখানকার ঘাসগুলো বেশ সতেজ। তারপরেও, পরিচর্যা বা পানি দেয়া ছাড়া এরকম সম্ভব না। তার মানে বাচ্চারা বোতলের পর বোতল পানি ঢেলেছে এখানে অথবা ইন্ডিয়ান পাম্প কাঁধে বয়ে এনেছে, যেগুলোর একেকটার ওজন ওর নিজের পিঠে গেরিপ্যাকে বসা গেজের চাইতেও বেশি হবে। ছোট ছোট বাচ্চারা তাদের ছোট ছোট শরীর দিয়ে এসব কাজ কিভাবে করেছে, তা ভেবে লুইস বিস্মিত হয়। তাছাড়া এরকম একটা কাজ বাচ্চারা এত লম্বা সময় ধরে চালু রেখেছে, সেটাই বা কম কী। ওর নিজের ছোটবেলায় কোন কাজের উৎসাহ উদ্দীপনা খুব অল্প সময়েই বাতাসে কর্পূরের মত উবে যেত। আর এলির বাবা হিসেবেও সে একই জিনিস দেখেছে এলির মধ্যে।
যত ভেতরে যাওয়া হলো, কবরগুলি ততো পুরনো হতে থাকে। আর সাথে সাথে লেখা পড়া যায় এমন ফলকের সংখ্যাও কমতে থাকে। তবে যেগুলো পড়া যাচ্ছে সেগুলো দেখে বোঝা যায় কবরগুলো বহু আগের।
একটা স্মারকে লেখা-ট্রিক্সি, হাইওয়েতে মৃত্যু, সেপ্টেম্বর ১৫, ১৯৬৮। একই বৃত্তে আরেকটা বেশ বড় বোর্ড মাটিতে ঠেসে পোঁতা। বারবার শীতে জমে জমে জিনিসটা দুমড়ে গেছে আর এক কোনার একটা অংশ একদমই মুচড়ে গেছে। তবুও লুইস পড়তে পারে : আমাদের পোষাপ্রাণী মার্তার স্মরনে,
মৃত্যু: ১ মার্চ, ১৯৬৫।
সামনের সারিতে একটাতে লেখা : জেনারেল প্যাটন, মৃত্যু: ১৯৫৮ (আমাদের সুবোধ কুকুর!-কথাটা আবার খুব বড় বড় অক্ষরে লেখা)। আরেকটাতে লেখা পলিনিশিয়া (এটা একটা টিয়া হবে, লুইস ভাবলো), যে কি না তার শেষ কথা ‘পোজ একটা ক্র্যাকার চায়’ বলেছিল ১৯৫৩ সালের গ্রীষ্মে। পরের দুই সারিতে একদম কিছুই পড়ার মত অবস্থায় নেই। তারপর আরেকটা ফলক পাওয়া গেল যেটা এখনো বৃত্তের কেন্দ্র থেকে বেশ দূরে তবে পড়া যায়। বেলে পাথরের ফলকটার গায়ে কোন রকমে খোদাই করে লেখা : ‘হ্যানা ছিল এ পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা কুকুর, ১৯২৯-১৯৩৯। বেলেপাথর তুলনামূলক নরম পাথর আর তাই সেটার গায়ের খোদাই করা লেখাগুলোর ক্ষয়ে ক্ষয়ে করুণ অবস্থা হয়ে গেছে। লুইস ভাবতেও পারছে না যে, একটা বাচ্চার কত পরিশ্রম আর সময়ের ফলাফল ওই পাথরের ফলকটার গায়ের খোদাই করা নয়টি শব্দ। পোষা প্রাণীর প্রতি বাচ্চাদের ভালবাসা আর তাদের হারানোর শোকের তীব্রতা লুইসকে আবারো বিস্মিত করে। নিজের সন্তান বা পিতামাতা মারা গেলেও তো এতো কিছু করে না।
“বাপরে! এগুলো তো অনেক আগের,” সে এদিকে হেঁটে আসতে থাকা জাডকে বলে।
জাড মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানান। “এদিকে এসো লুইস, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।”
তারা হাঁটতে হাঁটতে কেন্দ্র থেকে তিন নাম্বার সারিতে চলে আসে। পেছনের এলোমেলো করে কোনমতে বৃত্তাকার অক্ষে থাকা কবরগুলোর তুলনায় এখানকার কবরগুলো একদম সঠিকমাপে বৃত্তাকারে সাজানো। জাড মাটিতে পড়ে থাকা একটা ছোট স্লেট পাথরের পাশে এসে থামলেন। সাবধানে হাঁটু গেড়ে বসে ফলকটা সোজা করে দিলেন বৃদ্ধ।
“ফলকটাতে কিছু লেখা ছিল,” জাড বললেন। “আমি নিজের হাতে খোদাই করে লিখেছিলাম, তবে ক্ষয় হয়ে গেছে। আমার প্রথম কুকুরটাকে এখানে কবর দিয়েছিলাম। স্পট। ও বুড়ো হয়ে মারা যায়, সেটা ১৯১৪ সালের কথা, যে বছর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।”
এই পোষা প্রাণীর কবরস্থানটা যে অনেক মানুষের কবরস্থানের চাইতেও বেশি পুরনো, ব্যাপারটা ভেবে লুইস চমকে ওঠে। ও একেবারে কেন্দ্রের দিকে হেটে যায় এবং যেতে যেতে ফলকগুলো ভালো করে দেখে। একটা ফলকও পড়ার মত অবস্থায় নেই, আর তার মধ্যে আবার অনেকগুলোকে উদ্ভিদেরা ইচ্ছেমত গ্রাস করে নিচ্ছে। এ জায়গাটার ঘাস বেশ বড়। লুইস সেখান থেকে এক মুঠো ঘাস টেনে তুলে ফেলতে গেলে নিচের মাটি বাধা দিয়ে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে। ঘাস তোলা ন্যাড়া জায়গাটায় কানা গুবরে পোকা কিলবিল করছে। তার গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। ও ভাবে, জীব-জানোয়ারের গোরস্তান ব্যাপারটা খুব একটা ভালো লাগছে না।
“জায়গাটা কত বছরের পুরনো?”
“কে জানে। অন্তত আমি জানি না,” জাড তার প্যান্টের পকেটে নিজের হাত দুটো ঢুকিয়ে বললেন। “তবে স্পট মারা যাওয়ার আগে থেকেই জায়গাটা আছে, বুঝতেই পারছো। আমার তখন বন্ধু-বান্ধবের অভাব নেই। ওরা আমাকে সাহায্য করেছিল ওর জন্যে কবর খুঁড়তে। এখানে কবর খোঁড়া ছেলে খেলা না, মাটি খুবই শক্ত আর পাথুরে, সহজে উঠতে চায় না। আমিও ওদের বেলায় সাহায্য করেছি, বহুবার।” তিনি বেশ কয়েক জায়গায় তার তর্জনিটা তাক করে দেখালেন। “ওই যে ওখানে আছে পিটের কুকুরটা যদি আমার ঠিকঠাক মনে থাকে, আর ওখানটায় পাশাপাশি তিনটা কবরে আছে আলবিওনের ৩টা বিড়াল।
“বুড়ো ফ্রিটচি রেসের কবুতর পালতেন। তার কুকুর একবার একটা কবুতর মেরে ফেললে আমি, এ্যাল প্রোটলি আর কার্ল হান্নাহ মিলে ওখানটায় সেটাকে কবর দিয়েছিলাম।” তিনি থেমে কিছু একটা ভাবলেন। “আমার দলের মধ্যে কেবল আমিই বাকি আছি, বুঝলে? আমার গ্যাংয়ের আর কেউ বাকি নেই।”
লুইস কিছু না বলে পকেটে হাত ঢুকিয়ে কবরগুলো দেখতে থাকলো।
“জায়গাটা পাথুরে,” জাড় বললেন। “এমনিতেও জায়গাটা লাশ পোতা ছাড়া অন্য কাজের যোগ্য না, অন্তত আমার তাই ধারনা।”
অদূরেই গেজ কান্না শুরু করে। রাচেল ওকে কোলে করে লুইসের কাছে নিয়ে আসে। “ওর খিদে পেয়েছে,” রাচেল বলে। “আমাদের যাওয়া উচিত।” প্লিজ লুইস, চলো এখান থেকে, লুইসকে ওর চোখগুলো বলছে।
“আচ্ছা,” লুইস বলে গ্যারিপ্যাকটা আবারো নিজের পিঠে চাপিয়ে নিয়ে রাচেলের দিকে পিঠ ফিরিয়ে দাঁড়ায়, যাতে রাচেল সেখানে গেজকে বসিয়ে দিতে পারে। “এলি! এই এলি, কোথায় গেলে মামনি?”
“ঐতো ওখানে ও,” রাচেল মরা ডালপালার মস্ত স্তুপটার দিকে আঙুল তাক করে বলে। এলি স্তুপটাতে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওর কাছে হয়তো জিনিসটাকে স্কুলের মাঙ্কিবারের জারজ খালাতো ভাই বলে মনে হয়েছে।
“ওহ! ওখান থেকে নেমে এসো!” জাড আতঙ্কিত কণ্ঠে বললেন। “ভুলভাল জায়গায় তোমার পা পড়লে নিচের মরা ডাল সরে যেতে পারে, আর তাতে তোমার ঠ্যাংটাও ভাঙবে।”
এলি লাফিয়ে নামে। “আউ!” ওদের দিকে কোমর ডলতে ডলতে ও এগিয়ে আসে। সেখানকার চামড়া কেটে না গেলেও কিছুটা ছিলে গেছে। তবে একটা শক্ত মরা ডালে লেগে ওর স্কিন টাইট পাজামা ছিঁড়ে গেছে।
“দেখলে তো?” আদুরে ভঙ্গিতে ওর চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে জাড বললেন। “পুরনো গাছপালার স্তুপ খুবই বিপজ্জনক। যারা জঙ্গলের সাথে খুব অভ্যস্ত, তারাও না পারতে এসবে চড়ে না। মরা গাছের গুড়ি আর ডালপালার জঞ্জাল পড়ে থাকতে থাকতে খুব হিংস্র হয়ে ওঠে। তক্কে তক্কে থাকে কামড়ে দেয়ার জন্যে।”
“সত্যি?” এলি জিজ্ঞেস করে।
“সত্যি। গাছের গুড়ি আর ডালপালাগুলো এখান-সেখান থেকে পাহাড়ি ঢলে ভেসে এসে খড়ের গাদার মত স্তুপ হয়ে আছে। উল্টোপাল্টা জায়গায় পা দিয়েছো কী অমনি সব হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়বে।”
“আব্বু, সত্যি?”
“হ্যাঁ, মামনি।”
“ইয়াক,” ও স্তুপটার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে। “তুই আমার প্যান্ট ছিঁড়েছিস বজ্জাত মড়া গাছের দল!”
বাকি তিনজনই হেসে ওঠে। হাসলো না শুধু মরা গাছের স্তূপটা। সেটা খোলা আকাশের নিচে চুপচাপ বসে আছে, যেমনটা আছে যুগের পর যুগ ধরে। মরা গাছের স্তুপটাকে দেখে লুইসের সেটাকে কোন দানবের কঙ্কালের হাড়গোড়ের মত মনে হচ্ছে, যেটাকে কোন এক বীর যোদ্ধা কপালগুণে খুন করে এখানে ফেলে রেখে গেছে। হয়তো কোন ড্রাগনের কঙ্কাল, জঞ্জালের মত পড়ে আছে এই গোরস্তানে।
তখনো লুইসের মনে হচ্ছিল যে স্তুপটার ওপাশে হয়তো কিছু একটা আছে। সেটা আর গোরস্তানের প্রাচীর হিসেবেই কী এই স্তুপটা? জাড ক্র্যান্ডাল বলেছেন স্তূপটার ওপাশে জঙ্গল, যেটাকে রেড ইন্ডিয়ানদের জঙ্গল বলে। সে জায়গা আর এখানকার মাঝে যেন এটা একটা দেয়াল। প্রকৃতির খেয়াল কি এতো বেশি পরিকল্পিত হয়? এটা-
হঠাৎ গেজ তার এক কান টেনে মুচড়ে ধরে আর আনন্দে চেঁড়চাতে থাকে। লুইস স্তুপটার কথা একদমই ভুলে যায়। সময় হয়েছে, বাড়ি ফেরার।
অধ্যায় ৯
এলি পরদিন বিমর্ষ মুখে লুইসের কাছে আসে। সে তার স্টাডিতে একটা মডেল নিয়ে কাজ করছিল। মডেলটা একটা ১৯১৭ রোলস রয়েসের, যেটার মোট ছয়শো আশিটা আলাদা পার্টস, সেসবের মধ্যে আবার পঞ্চাশটা হচ্ছে মুভিং পার্টস। জিনিসটা জোড়া দেয়ার কাজ প্রায় শেষের দিকে। সে গাড়িটার ড্রাইভিং সিটে ড্রাইভারের ইউনিফর্ম পরা একজন মানুষকে কল্পনার চোখে দেখতে পাচ্ছে। ড্রাইভারটা আবার উনিশ শতকের ঘোড়া গাড়ির চালকদের সরাসরি বংশধর। সে বসে আছে রাজকীয় কায়দায়।
তার দশ বছর বয়স থেকেই মডেলের পাগলামো। এই বিষয়ে তার হাতে খড়ি হয়েছিল একটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের ট্যাঙ্ক দিয়ে, যেটা তার আঙ্কেল কার্ল তাকে কিনে দিয়েছিলেন। এরপর সে প্লেনের অনেকগুলো মডেল নিয়ে কাজ করেছে। কৈশোরে আর প্রথম যৌবনে সে আরো বড় বড় এবং আরো ভালো ভালো মডেলের দিকে ঝুঁকে পড়ে। একবার তার ‘বোতলের ভেতরে জাহাজ’ পর্ব চলেছে, আরেকবার যুদ্ধাস্ত্রের পর্ব চলেছে। আরেক পর্বে সে এমন সব বাস্তব দেখতে পিস্তল বানাতো, সেগুলো দেখলে বিশ্বাসই হতো না সেগুলোর ট্রিগার টিপে দিলে গুলি বেরিয়ে আসবে না। কোল্ট, উয়িনচেস্টার এমন কি একটা বান্টলাইন স্পেশাল। আর গত পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলছে ক্রুজ জাহাজের পর্ব। লুসিটানিয়া এবং টাইটানিকের দুটো মডেল তার ইউনিভার্সিটি অফিসের শোভা বর্ধন করছে। আর আন্দ্রে ডোরিয়ার মডেলটি, যেটি সে শিকাগো ছেড়ে আশার আগে দিয়ে শেষ করেছে, সেটা ভাসছে ফায়ার প্লেসের ওপরের একটা তাকে। আর বর্তমানে তার মাথায় ক্লাসিক গাড়ির ভূত চেপেছে। আর যদি সবকিছু আগের মতই চলে, তাহলে এই ভূত আগামী চার-পাঁচ বছরে নামার কথা না। রাচেল তার স্বামীর উল্লেখ করার মত এই একটি মাত্র শখকে ‘আজাইরা’ বলেই মনে করে। বিয়ের দশ বছর পরেও তার মনে একটা ক্ষীণ আশা আছে তার স্বামী হয়তো একদিন এসব ছেলেমানুষী ছেড়ে দিবে। হয়তো রাচেলের এই মনোভাবের জন্যে তার বাবা কিছুটা দায়ি। এখনো রাচেলের বাবা ভাবেন তার মেয়েকে তার কাছ থেকে যে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে সে একটা অপদার্থ, আস্ত বজ্জাত।
হয়তো, সে ভাবে, হয়তো রাচেলের কথাই ঠিক। হয়তো আমি একদিন ঘুম থেকে উঠে আমার সব মডেল স্তূপ করে রেখে গ্লাইডিং করতে শুরু করবো নতুন শখ হিসেবে।
এলিকে খুব গম্ভীর মনে হচ্ছে।
রবিবারের চার্চের ঘন্টা দূর থেকে বাতাসে ভেসে আসছে। চার্চ তার প্রার্থনাকারীদের আহবান জানাচ্ছে।
“হাই, আব্বু,” ও বলে।
“হ্যালো, মামনি। কি হয়েছে?”
“ওহ, কিছু না,” ও বলে, কিন্তু ওর চেহারা বলছে আসলে অনেক কিছু হয়েছে। এবং সেসব ভালো কিছু না। ওর সদ্য ধোয়া চুল কাঁধের ওপর ছড়িয়ে আছে। রুমের আলোতে ওর চুল বাদামী থেকে বেশি সোনালী বলেই মনে হচ্ছে। যদিও বড় হলে ওর চুল বাদামীই হবে। ও একটা নতুন জামা পড়ে আছে। লুইসের মনে হলো এলি প্রতি রোববারেই নতুন জামা পড়ে থাকে, যদিও তারা কেউই এদিনে চার্চে যায় না।
“তুমি ওটা কী বানাচ্ছ বাবা?”
সযত্নে আঠা দিয়ে একটা মাডগার্ড লাগাতে লাগাতে লুইস বলে, “এটা দেখ,” সাবধানে এলির হাতে একটা হাব ক্যাপ তুলে দিয়ে লুইস বলে, “এই পাশাপাশি R-গুলো দেখতে পাচ্ছো? খুব সূক্ষ্ম ডিটেইল, তাই না? আমরা থ্যাঙ্কসগিভিংয়ে যদি প্লেনে চড়ে শাইটাউন যাই, আর বিমানটা যদি হয় L- 1011, তাহলে বিমানের জেট ইঞ্জিনের দিকে তাকালেই তুমি এই ‘R’গুলো দেখতে পাবে।”
“এটা হাব-ক্যাপ। তাতে কী যায় আসে?”
“আরে কী বলছো,” সে বলে। “রোলস রয়েসের এটাকে বলে হুইল কাভারিং। তোমার যদি রোলস রয়েস কেনার মত টাকা থাকে তাহলে খুব বুক ফুলিয়ে চলতে পারবে। দুই মিলিয়ন ডলার কামানোর পর আমি নিজে একটা কিনবো। রোলস রয়েস কর্নিস। ওই গাড়িতে উঠে গেজের বমি পেলে সে একেবারে খাটি চামড়ার সিট কভার বমি দিয়ে ভাসিয়ে দিতে পারবে।” আর, ভালো কথা, এলি, তুমি আসলে কি বলতে চাও সত্যি সত্যি বলবে? এলিকে সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলে সে কিছুই বলবে না। ও নিজেকে কখনোই সম্পূর্নভাবে প্রকাশ করতে চায় না কারো আছে, কিছু জিনিস নিজের ভেতরে চেপে রাখাই ওর পছন্দ। আর এলির এই স্বভাবটা লুইস খুব পছন্দ করে।
“আমরা কি বড়লোক, বাবা?”
“না, মামনি,” সে উত্তর দেয়, “তবে আমরা না খেয়ে মরার মত ফকিরও না।”
“স্কুলের মাইকেল বার্ন বলেছে যে সব ডাক্তারেরাই নাকি বড়লোক।”
“আচ্ছা তাহলে তুমি ওকে বলে দিবে, অনেক ডাক্তারই বড়লোক হয় ঠিক, তবে সেটা ২০ বছর ডাক্তারি করার পরে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারে কাজ করে কেউ বড়লোক হয় না। বড়লোক হয় বিশেষজ্ঞ ডাক্তারেরা। গাইনোকোলজিস্ট, অর্থোপেডিস্ট অথবা নিউরোলোজিস্ট। তারা রাতারাতি বড়লোক হয়ে যায়। আর আমার মত তৃনমূল ডাক্তারের বড়লোক হতে অনেক সময় লাগে।
“তাহলে তুমি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হচ্ছো না কেন বাবা?”
লুইসের মাথায় আবারো তার মডেলগুলোর ভাবনা চলে আসে। তার মনে পড়ে একদিন তার হঠাৎ করেই আর যুদ্ধবিমান নিয়ে কাজ করতে ইচ্ছে করছিল না। আবার একইভাবে সে টাইগার ট্যাঙ্ক আর মেশিনগান স্টেশান বানাতে বানাতেও বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল, আবার একদিন হঠাৎ করেই তার মনে হলো যে বোতলের ভেতর মডেল বানানো এক্কেবারে আহাম্মকি। আর তার মধ্যে এসব পরিবর্তন হয়েছিল রাতারাতি। এরপর সে ভাবে, তার পুরো জীবনটা বাচ্চাদের পায়ের হ্যামার টো পরীক্ষা করতে কেমন লাগবে, অথবা মহিলাদের যোনির ভেতর তার স্পেশালিস্ট আঙুল ঢুকিয়ে কোন রোগ খুঁজতেও বা কেমন লাগবে?
“আমার বিশেষজ্ঞ ডাক্তার হতে ইচ্ছে করে না, মামনি,” সে বলে।
চার্চ লুইসের অফিসে এসে ঢুকলো। এরপর সে থেমে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষন করে তার উজ্জ্বল সবুজ চোখগুলো দিয়ে। সে লাফ দিয়ে জানালার দেয়ালে উঠে ঘুমোনোর জন্যে শুয়ে পড়ে।
এলি চার্চের দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়, যেটা লুইসের কাছে অস্বাভাবিক ঠেকে। সাধারণত এলি চার্চের দিকে এতো গদগদ আদরে তাকায়, যেটা দেখলে একটু বিরক্তই লাগে। এলি ঘুরে ঘুরে অফিসটা দেখতে থাকে আর প্রায় স্বাভাবিক গলায় বলে, “বাপরে, পেট সেমেটারিতে অনেক কবর, তাই না বাবা?”
এই তো আসল কথা বেরিয়েছে এতক্ষণে, লুইস ভাবে। সে এলির দিকে না তাকিয়ে তার রলস রয়েসের মডেলের গায়ের কেরেজ ল্যাম্পটা জোড়া দিতে থাকে। “হুম,” লুইস বলে। “কমসে কম একশো’র বেশি কবর আছে ওখানে।”
“আব্বু, পোষা প্রাণীরা কেন তাদের মালিকদের সমান বাঁচে না?”
“শোন, কিছু কিছু প্রাণী আছে যারা মানুষের সমানই বাঁচে, আবার কিছু কিছু মানুষের চাইতেও বেশি বাঁচে। যেমন ধরো, হাতি অনেক দিন বাঁচে তারপর কিছু সামুদ্রিক কচ্ছপ আছে যেগুলো এতো বুড়ো যে তাদের বয়স কত সেটাও কেউ জানে না…অথবা হয়তো জানে, কিন্তু বিশ্বাস করতে পারে না।”
এলি কথাটা মানতে পারে না। “হাতি আর সামুদ্রিক কচ্ছপ তো আর কেউ পোষে না। পোষা প্রাণীরা একদমই বেশি দিন বাঁচে না। মাইকেল বার্ন বলেছে মানুষের এক বছর কুকুরের নয় বছরের সমান।”
“সাত বছর,” লুইস ভুলটা ঠিক করে দেয়। “মামনি, আমি বুঝতে পারছি তুমি কি বলতে চাইছো, এবং সেটা কিছুটা ঠিকও। একটা বারো বছর বয়েসি কুকুর আসলেই একটা বুড়ো কুকুর। মেটাবলিজম বলে একটা ব্যাপার আছে। মেটাবলিজমের একটা কাজ হচ্ছে শরীরের ঘড়ি হিসেবে কাজ করা। মেটাবলিজম অন্য কাজও করে-যেমন অনেক মানুষ আছে অনেক খায়, কিন্তু মোটা হয় না, যেমন তোমার মা। আবার অনেকে আছে অল্পতেই মুটিয়ে যায়, যেমন আমি। এর কারণ আমাদের মেটাবলিজম আলাদা। তবে শরীরের ঘড়ি হিসেবে কাজ করা মেটাবলিজমের সবচাইতে গুরত্বপূর্ণ একটা কাজ। কুকুরের মেটাবলিজম অনেক দ্রুত চলে। সেই তুলনায় মানুষেরটা বেশ ধীর। মানুষেরা অধিকাংশই এজন্যে সত্তর-বাহাত্তর বছর বাচে। আর মা, এটা খুব লম্বা একটা সময়।”
এলিকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। সে মনে মনে দোয়া করলো যেনো সে নিজে কথাটা যতটুকু বিশ্বাস নিয়ে বলেছে সেটা যেন তার চাইতে বেশি বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে এলির কাছে। তার বয়স এখন পঁয়ত্রিশ আর তার মনে হচ্ছে যে এই বছরগুলো চোখের নিমিষেই পেরিয়ে গেছে। “আর সামুদ্রিক কচ্ছপ, ওদের মেটাবলিজম—”
“বিড়ালের মেটাবলিজম কেমন, বাবা?” এলি জিজ্ঞেস করে আবারো চার্চের দিকে তাকায়।
“আচ্ছা। বিড়াল প্রায় কুকুরের সমান বাঁচে,” সে বলে। “অন্তত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।” কথাটা ডাহা মিথ্যা কথা এবং সে তা খুব ভালো করেই জানে। বিড়ালের স্বভাব খুব সহিংস এবং তারা প্রায়ই মর্মান্তিকভাবে পটল তুলে। তার একটা বড় কারণ বিড়াল মানুষের দৃষ্টি সীমার নিচে দিয়ে চলাচল করে, এবং একারণে প্রচুর দুর্ঘটনা ঘটে। আর এই যে চার্চ। যে প্রতি রাতে তার মেয়ের বিছানায় ঘুমোয়, যে ছোট থাকতে সুতোর বল নিয়ে খেলতে গিয়ে সুতোয় প্যাঁচ খেয়ে অবস্থা কাহিল করতো। চার্চ বাচ্চা থাকতে খুব কিউট ছিল। সেই
চার্চকেই সে সেদিন দেখেছে একটা ডানা ভাঙা অসহায় পাখির ওপর হামলা করার জন্যে ওৎ পেতে থাকতে। সেসময় চার্চের সবুজ চোখগুলো কী জ্বলজ্বলই না করছিল, কৌতূহল আর-হ্যাঁ, লুইস ভুল দেখেনি-শীতল আনন্দে। ও সাধারণত শিকারের জন্যে ওৎ পেতে থাকলেও শিকারকে একদম মেরে ফেলে না। তবে একবার পাশের বাড়ির চিপা গলিতে আটকে যাওয়া একটা ইঁদুরের বারোটা বাজিয়ে ইহলীলা সাঙ্গ করে দেয়। সেটার অবস্থা এতটাই বীভৎস হয়েছিল তা দেখে গেজকে নিয়ে ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা রাচেল বাথরুমে ছুটে গিয়ে বমি করে ভাসিয়ে দিয়েছিল। সহিংস জীবন এবং সহিংস মরন। হয়তো কোন কুকুর তাদের সুবিধা মত বাগে পেয়ে ফালাফালা করে ফেলে। কুকুরেরা বিড়ালের মত খেলার ছলে আটকে রেখে ছেড়ে দেয় না। অথবা অন্য কোন হুলো বিড়াল তার খেল খতম করে দেয়, বা কোন বিষাক্ত টোপ গিলে মরন বা গাড়ি চাপা পড়ে পরলোক গমন। বিড়াল হচ্ছে গ্যাংস্টার প্রাণী। তারা কোন নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা করে না এবং সহিংস জীবন যাপন করে। তাদের মৃত্যুটাও তাই অনেক সময় সেভাবেই ঘটে। এবং তাদের অনেকের ক্ষেত্রে সেই ঘটনা বুড়ো হবার আগেই ঘটে যায়।
তবে এসব কথা নিজের পাঁচ বছরের মেয়েকে বলা যায় না, যে প্রথম বারের মত মৃত্যু ব্যাপারটাকে বুঝতে চেষ্টা করছে।
“আমি বলতে চাচ্ছি,” সে বলে, চার্চের বয়স এখন মাত্র তিন। আর তোমার বয়স পাঁচ। তুমি যখন হাই স্কুলে পড়বে তখনো হয়তো ও বেঁচে থাকবে। আর সেটা অনেক লম্বা সময় পরের কথা।”
“আমার কাছে সেটা লম্বা সময় বলে মনে হচ্ছে না,” এলি কাঁপা কাঁপা গলায় বলে। “মোটেই না।”
লুইস কাজ করার অভিনয়ে ক্ষান্ত দিয়ে এলিকে তার দিকে আসার জন্যে ইশারা করে। এলি তার কোলে এসে বসে। বিমর্ষতার কারণে এলিকে আরো মায়াবতী লাগছে। মেয়ের সৌন্দর্য দেখে লুইস আবারো অবাক হয়। ওর গায়ের রংটা একটু পোড়া, কিছুটা লোভেন্টাইন। টনি বেন্টন নামে লুইসের এক কলিগ ওকে ইন্ডিয়ান প্রিন্সেস বলে ডাকতো।
“মামনি,” সে বলে, “আমার যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে আমি চার্চকে একশ বছর বাঁচিয়ে রাখতাম। কিন্তু সেই ক্ষমতা আমার নেই, মা।”
“তাহলে কার আছে?” ও জিজ্ঞেস করে এবং পরে নিজে নিজেই বলে ওঠে, “মনে হয় ঈশ্বরের।”
লুইসের হাসি পায়, কিন্তু সে তা চেপে রাখে। ব্যাপারটা মোটেই হাসির কিছু না।
“ঈশ্বর অথবা অন্য কেউ,” সে বলে, “দেহের ঘড়ি একসময় বন্ধ হয়ে যায়, আমি শুধু সেটুকুই বলতে পারি। এই ব্যাপারে কোন রকমের গ্যারান্টি নেই, মামনি।”
“চার্চ মরতে পারে না!” হঠাৎ ও ছলছল চোখে কেঁদে বলে ওঠে। “চার্চ কক্ষনো মরতে পারে না! ও আমার বিড়াল! ও ঈশ্বরের বিড়াল না। ঈশ্বর তার নিজের বিড়াল নিয়ে যা খুশি করুক। চাইলে উনি সব বুড়ো বিড়াল মেরে ফেলুক। কিন্তু চার্চ তো ঈশ্বরের বিড়াল না, ও আমার বিড়াল!”
রান্নাঘরে পায়ের শব্দ পাওয়া গেল এবং সেখানে রাচেলকে কিছুটা হতচকিত অবস্থায় দেখা গেল। এলি লুইসের বুকে মুখ গুজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। মৃত্যুর বিভীষিকা সম্পর্কে সে জানতে পেরেছে। মৃত্যুর ব্যাপারে আর কিছু করা না গেলেও কান্না করা যায়।
“এলি,” লুইস এলিকে কোলে দোলাতে দোলাতে বলে, “এলি, এলি, চার্চ তো বেঁচে আছে; ওইতো ও ওখানে ঘুমোচ্ছে।”
“কিন্তু ও তো যে কোন সময় মরে যেতে পারে,” ও কাঁদতে কাঁদতে বলে।
লুইস এলিকে জড়িয়ে ধরে দোল দিতে থাকে। তার বিশ্বাস এলি কাদছে কারণ, মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, মৃত্যু কোন যুক্তি মানে না, এবং মৃত্যু সুনিশ্চিত ভাবেই অনিশ্চিত। মানুষের ইশারা থেকে উপসংহার টানার সাংঘাতিক সুন্দর ক্ষমতা আছে। আর সেটাও এলির দুঃখ পাবার পেছনের একটা কারণ। যেহেতু পেট সেমেটারিতে অতগুলো মৃত প্রাণীর কবর আছে, তার মানে নিশ্চয়ই চার্চও মরে যেতে পারে। (যে কোন সময়!) এবং এটা যদি চার্চের সাথে ঘটতে পারে তাহলে সেটা হয়তো তার বাবা, মা এবং ছোট ভাইয়ের বেলাতেও ঘটতে পারে। ওর কাছে মৃত্যুর ধারণা অস্পষ্ট তবে পেট সেমেটারি একদম আসল।
সেখানকার পুরনো ফলকগুলো যে সত্যটা ধারণ করে, তা একটা শিশুও বুঝতে পারবে।
এই অবস্থায় মিথ্যা বললেই সহজ হতো, ঠিক যেমনটা সে একটু আগে হুলো বিড়ালের গড় আয়ু সম্পর্কে বলেছে। তবে এক সময় এসব মিথ্যা বাচ্চারা ধরতে পারে এবং বাবা মাকে বাচ্চারা পেরেন্টিং-এর রিপোর্ট কার্ডে একটা F বসিয়ে দেয়। লুইসের নিজের মাও তাকে একবার এরকম একটা মিথ্যে বলেছিলেন। তার প্রশ্নটা ছিল বাচ্চা কিভাবে হয়, বাচ্চাদের খুব সাধারন একটা প্রশ্ন। ওর মা ওকে বলেছিলেন মায়েরা বাচ্চা চাইলে তারা মাঠের শিশির ভেজা ঘাসের ওপর বাচ্চা কুড়িয়ে পেতেন। যদিও মিথ্যেটা তখন তার কোন ক্ষতি করেনি, কিন্তু তার পরেও সে তার মায়ের এই মিথ্যেটা বলার অপরাধ কখনোই মাফ করতে পারেনি। অথবা সে হয়তো নিজেকেই ক্ষমা করতে পারেনি এমন একটা আজগুবি কথা বিশ্বাস করে ফেলার জন্যে।
“মামনি,” লুইস বলে, “জীবন এমনই মা। আর মৃত্যুটা জীবনেরই একটা অংশ।”
“খুব পঁচা অংশ,” ও চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। “এটা খুবই পঁচা একটা অংশ।”
এর কোন জবাব লুইসের কাছে নেই। ও কাঁদতে থাকে। কান্না করুক। কাঁদতে কাঁদতে একসময় ওর কান্না বন্ধ হবে। মৃত্যুকে মেনে নেয়ার জন্যে এটাই প্রথম ধাপ। মৃত্যু খুব অপ্রিয়, কিন্তু একে রোখার কোন পথ নেই। সকলকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে।
সে এলিকে জড়িয়ে ধরে রেখে দূর থেকে ভেসে আসা চার্চের ঘন্টা শুনতে থাকে। এলির কান্না বন্ধ হবার কিছুক্ষণ পর লুইস বুঝতে পারে চার্চের মত এলিও ঘুমিয়ে পড়েছে।
ওকে ওর বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিচ তলায় কিচেনে নেমে আসে সে, যেখানে রাচেল খুব জোরে জোরে কেক বানানোর খামির নাড়ছে। লুইস রাচেলকে এলির ঘুমিয়ে পড়ার কথাটা বলে। সে এও বলে যে এরকম সকাল বেলায় তো এলি কখনো ঘুমোয় না।
“না,” রাচেল খামিরের বোলটা ঠাস করে টেবিলের ওপর রেখে বলল। ও এই সময় ঘুমায় না; তবে গত রাতের বেশির ভাগ সময় ও জেগে ছিল। আমি ওকে অনেক রাত পর্যন্ত বিছানায় এপাশ ওপাশ করেতে শুনেছি। আর চার্চ রাত তিনটার দিকে বাড়ির বাইরে যাওয়ার জন্যে চেচামেচি শুরু করেছিল। এলি খুব অস্থির হয়ে থাকলে চার্চ এরকম করে।”
“ও কেন রাতে-?”
“ওহ! কারণটা তুমি খুব ভালো করেই জানো!” রাচেল রাগান্বিত কণ্ঠে বলে। “ওই বালের পেট সেমেটারিতে ঘোরাঘুরির জন্যে! ব্যাপারটা ওর শিশু মনে খুব আঘাত করেছে, লু। এটা ওর দেখা প্রথম কবরস্থান। আর জিনিসটা ওকে খুব…খুব আঘাত করেছে। আর সেজন্যে তোমার বন্ধু জাডকে অসংখ্য ধন্যবাদ!”
ও, এখন সে আমার বন্ধু হয়ে গেছে, লুইস কিছুটা অবাক আর বিস্মিত হয়ে ভাবে।
“রাচেল-”
“আর আমি চাই না ওখানে এলি আর কখনো যাক।”
“রাচেল, জাড পথটার ব্যাপারে যা বলেছেন তা জেনেই বলেছেন।”
“সমস্যাটা রাস্তায় না এবং তা তুমি জানো, লুইস ক্রিড।” রাচেল বলে। সে আবারো খামিরের বোলটা তুলে নিয়ে আগের চাইতেও জোরালোভাবে খামির ঘুটতে থাকে। “সমস্যাটা ওই জায়গাটার। বাচ্চাদের জন্যে জায়গাটা ভালো না। বাচ্চাদের ওই রকম একটা জায়গায় যাওয়া, কবরস্থানের দেখাশোনা করা, রাস্তার দেখাশোনা করা… পুরোটাই খুব খুব বিশ্রী। এই শহরের বাচ্চাদের কী রোগে ধরেছে আমি জানি না, কিন্তু সেই রোগে আমি এলিকে আক্রান্ত হতে দিবো না।”
লুইস হতভম্ব হয়ে রাচেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। যখন প্রতি বছর বন্ধুদের ডিভোর্সের খবর পায় তখন লুইস তার বিয়ে টিকে থাকার কারণ বলে একটা জিনিসকেই সন্দেহ করতো-সেটা হচ্ছে একটা বিশেষ রহস্যকে সম্মান করা। তার মাঝে মাঝে মনে হয় বিয়ে বলতে আসলে কিছু নেই, মিলন বলে কিছু নেই। প্রত্যেকেই একা। এটাই হচ্ছে রহস্যটা। কেউ ভাবতে পারে সে তার সঙ্গিকে পুরোপুরি চিনে ফেলেছে, কিন্তু সে ভুলের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। তাকেও সময়ে সময়ে তার সঙ্গির এমন কিছু ব্যাপারের মুখোমুখি হতে হবে যে তার মনে হবে সে তার সঙ্গির মনের কিছুই বুঝতে পারছে না। সে আবিষ্কার করে তার আর তার সঙ্গির মাঝখানে হয়তো কোন দেয়াল আছে, বা কোন গভীর গিরিখাদ আছে। তখন সে তার সঙ্গিকে চিনতেই পারবে না। সঙ্গির কোন বিশ্বাস বা ব্যবহার তার কাছে এতোটাই অদ্ভুত কিসিমের মনে হবে যে তখন হয়তো সঙ্গিকে তার সাইকো বলে মনে হবে। অন্তত লুইসের বেলায় এমন হয়। আর এসব ব্যাপারে খুব ভেবে চিন্তে প্রতিক্রিয়া জানানো উচিত। মনের শান্তির কথা বিবেচনা করে এসব ব্যাপারে একদম রাগারাগি না করাই বুদ্ধির কাজ।
“এটা স্রেফ একটা পেট সেমেটারি,” সে বলে।
“এলি ওখানে যেভাবে কাঁদছিল,” রাচেল তার খামির লাগা চামচটা দিয়ে লুইসের অফিসের দিকে তাক করে বলে, “তাতে কি তোমার এখনো মনে হচ্ছে যে জায়গাটা এলির কাছে স্রেফ একটা পেট সেমেটারি? ব্যাপারটা নিশ্চয়ই ওর মনে একটা স্থায়ী ক্ষত রেখে যাবে। ও আর কখনো ওই ফালতু জায়গাটায় যাবে না, লু। সমস্যা ওই রাস্তার না, সমস্যা ওই জায়গাটার। দেখলে তো ও ভাবছে যে চার্চ মরে যাবে।”
লুইসের হঠাৎ মনে হয়, সে এখনো এলির সাথেই কথা বলছে। যেন এলি হঠাৎ লম্বা হয়ে গেছে, মায়ের জামা কাপড় গায়ে দিয়েছে আর মুখে লাগিয়েছে একদম রাচেলের মুখের মতন দেখতে একটা মাস্ক। এমন কি ওদের কথা বলের ভাব-ভঙ্গিও একই রকম-বাইরে বাইরে রাগ দেখাচ্ছে কিন্তু ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে।
সে বিষয়টা এড়িয়ে গেল, সেই রহস্যটাকে সম্মান জানিয়ে। তার মনে হচ্ছে রাচেল নিজের দুই চোখ চেপে ধরে আছে সত্যটা না দেখার জন্যে।
“রাচেল,” সে বলে, “চার্চ কিন্তু আসলেই মরে যাবে।”
রাচেল তার দিকে কটমট করে তাকায়। “আমি সেটা বোঝাইনি,” রাচেল কাটা কাটা গলায় বলে। “চার্চ তো এখনি মরে যাচ্ছে না, তাই না? আজ ও না, কালও না, কিংবা পরশু।”
“কেউ তা নিশ্চিতভাবে বলতে—”
“অবশ্যই নিশ্চিতভাবে বলা যায়!” রাচেল চিৎকার করে বলে ওঠে। “আমরা তো চার্চের কোন যত্নআত্তির কমতি করছি না, যে ও মরে যাবে! ও মরবে না, এই বাসায় কেউ মরবে না! তাহলে কেন তুমি মেয়েটাকে এমন একটা ব্যাপার বলে কষ্ট দিচ্ছো যেটা বোঝার মত অর্ধেক বয়সও ওর হয়নি?”
“রাচেল, শোন।”
“কিন্তু রাচেলের শোনার কোন ইচ্ছেই নেই। সে তার মত বলেই গেল। ‘এমনিতেই মৃত্যুর সাথে মানিয়ে নেয়া অনেক কষ্টের-হোক সেটা কোন পোষা জীব, বন্ধু বা আত্মীয়ের মৃত্যু-আর সেই মৃত্যুর মত ব্যাপারটাকে নিয়ে একটা টুরিস্ট স্পট বানানো- বনের মধ্যে মরা জানোয়ারের জন্যে বাগান বানানো -” তার চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে শুরু করে।
“রাচেল,” লুইস রাচেলের দুকাঁধে তার দুহাত রেখে বলে। রাচেল কাঁধ ঝাঁকিয়ে তার হাত দুটো সরিয়ে দেয়।
“বাদ দাও,” রাচেল বলে, “তুমি কি করে বুঝবে আমি কী বলতে চাইছি…”
লুইস দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, “আমার মনে হচ্ছে আমি কোন চোরা দরজা দিয়ে ইলেক্ট্রিক মিক্সারের ভেতর পড়ে গেছি,” লুইস রাচেলকে একটু হাসানোর আশায় কৌতুক করে বলে। কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি। রাচেল শুধু তার দিকে তার জ্বলতে থাকা কালো চোখে তাকিয়ে আছে। বাপরে, রাচেল আজ ক্ষেপে গেছে, লুইস ভাবে, শুধু অভিমান নয় এটা। চূড়ান্তভাবে ক্ষেপেছে। “রাচেল,” সে বলে উঠে, এবং এরপর কিছু না ভেবেই জিজ্ঞেস করে বসে, “কাল রাতে তোমার ঘুম কেমন হয়েছে?”
“বাহ! চমৎকার!” অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাচেল ঘৃণা ভরা কণ্ঠে বলে-তবে রাচেলের মুখ ফিরিয়ে নেয়ার আগেই এক মুহূর্তের জন্যে লুইস ওর চোখের আহত দৃষ্টিটা দেখতে পায়। “খুবই চমৎকার বলেছো। খুবই চমৎকার। তুমি কখনই বদলাবে না লুইস। কিছু ঘটলেই সেটার দোষ রাচেলকে না দিলে তোমার পেটের ভাত হজম হয় না, তাই না? সব কিছুই স্রেফ রাচেলের আবেগের ফল।”
“এটা ঠিক না, রাচেল, “
“তাই?” রাচেল খামিরের বোলটা টেবিলের ওপর প্রায় আছাড় দিয়ে রেখে বলে। এরপর সে একটা কেকের ছাঁচে তেল ঢালতে লাগলো দুই ঠোঁট চেপে।
লুইস এবার স্বাভাবিক গলায় বলে, “একটা বাচ্চা মৃত্যু সম্পর্কে জানবে এটাই স্বাভাবিক, রাচেল। এমনকি আমার মনে হয় বাচ্চাদের এই ব্যাপারে সঠিক ধারণা থাকাটা জরুরিও। এলির কান্নাকাটি আমার কাছে স্বাভাবিকই লেগেছে। এটার মধ্যে-”
“ওহ! খুব স্বাভাবিক,” বিদ্রুপের সুরে বলে রাচেল, “এটা এতোই স্বাভাবিক যে এলি তার সুস্থ সবল বিড়ালের মরে যাবার ভয়ে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে-”
“চুপ করো,” লুইস বলে, “তোমার কথার যে কোন আগা মাথা নেই তুমি সেটা বুঝতে পারছো না?”
“আমি এ ব্যাপারে আর কোন কথা বলতে চাই না।”
“তুমি না চাইলেও বলতে হবে,” রাগান্বিত কণ্ঠে লুইস বলে।
“এলি আর কখনো ওই ফালতু জায়গাটায় যাচ্ছে না, ব্যাস।”
“এলি জানে মানুষের বাচ্চা কিভাবে হয়। এটা আমরা ওকে গত বছরই বলেছি। তুমি হয়তো ভুলে গেছো আমরা ঠিক করেছিলাম, বাচ্চাদের জানা উচিত মানুষের জন্ম কিভাবে হয়।”
“সেটার সাথে এটার কোন সম্পর্ক-”
“আছে, সম্পর্ক আছে।” সে কঠিন গলায় বলে। “এলির সাথে কথা বলার সময় আমার মনে পড়েছিল আমার মা কিভাবে মানুষের বাচ্চা হয় সে ব্যাপারে আমাকে একটা গাঁজাখুড়ি কেচ্ছা শুনিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মিথ্যা কথাটা আমি এখনো ভুলিনি, কখনো ভুলবোও না। আমার বিশ্বাস বাচ্চারা তাদের বাবা-মায়ের বলা মিথ্যাগুলো কখনোই ভুলে না।”
“বাচ্চারা কোথা থেকে আসে সেই প্রশ্নের সাথে ওই বালের পেট সেমেটারির কোন সম্পর্ক নেই!” রাচেল ক্ষিপ্র কন্ঠে জবাব দেয়। তার চোখ বলছে তাকে যতই বোঝানো হোক, সে বুঝতে চাইছে না।
তবুও লুইস চেষ্টা করে।
“এলি জানে কিভাবে জীবনের শুরু হয়। আর পেট সেমেটারি জীবনের শেষের সাথে সম্পর্কিত। এই ব্যাপারে ওর কৌতুহল খুবই স্বাভাবিক। আর মৃত্যু জিনিসটা জীবনের সব চাইতে স্বাভাবিক।”
“চুপ কর!” রাচেল চেচিয়ে উঠে-সত্যিকার অর্থেই চেঁচিয়ে ওঠে। লুইস চমকে ওঠে আর এতে ওর কনুইতে ধাক্কা লেগে টেবিলে রাখা ময়দার প্যাকেটটা মেঝেতে পড়ে গিয়ে ফেটে যায়। কিচেনের মেঝেতে ময়দা বিশ্রীভাবে ছড়িয়ে পড়ে, আর বাতাসে উড়তে থাকা ময়দা সাদা মেঘের মত ভাসতে থাকে।
“ ধুর বাল!” সে চরম বিরক্তি নিয়ে বলে।
ওপরতলা থেকে গেজের কান্নার শব্দ ভেসে আসে।
ওহ, চমৎকার!” রাচেল কাঁদতে কাঁদতে বলে। “বাবুকেও ঘুমোতে দিলে না। ঝগড়াঝাটি ছাড়া খুব শান্তিপূর্ণ একটা ছুটির সকালের জন্যে তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ।”
লুইস রাচেলের বাহুতে তার হাত রাখলে সে চমকে ওঠে। “আচ্ছা শোন,” লুইস বলে, “আমি একজন ডাক্তার। আমি জানি যে যেকোন জীবের যেকোন সময় যেকোন রকমের খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে। ওর বিড়ালের যে কোন সময় লিউকেমিয়া বা ডিফথেরিয়া হতে পারে, বিড়ালের ক্ষেত্রে এসব খুব কমন ব্যাপার। আবার চার্চ রাস্তায় গাড়িচাপা পড়েই মারা পড়তে পারে। এখন আমাকে এটা বলো যে, যদি চার্চের এ রকম খারাপ কিছু হয়, তাহলে সেই ব্যাপারটা তুমি নিজে এলিকে বোঝাবে তো?”
“ছাড় আমাকে,” রাচেল প্রায় হিসিয়ে ওঠে। ওর চোখে আতঙ্ক এবং বেদনার ছাপ। ওর অভিব্যক্তি জানান দিচ্ছে, আমি এই ব্যাপারে কথা বলতে চাই না, আর তুমি আমাকে জোর করে কথা বলাতেও পারবে না। “আমাকে যেতে দাও, গেজ ওর ক্রিব থেকে পড়ে গেল কি না-”
“ওই কথাটা তোমাকেই বলতে হবে,” লুইস বলে। “আচ্ছা তুমি ওকে বলে দিও যে ভদ্রলোকেরা এসব জিনিস নিয়ে কথা বলে না। এসব কথা তারা কবর দিয়ে রাখে—উপ্স! কবর শব্দ তো আবার বলা নিষেধ।”
“আই হেট ইউ!” রাচেল কেঁদে উঠে নিজেকে লুইসের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়।
রাচেলের জন্যে লুইসের বেশ খারাপ লাগতে শুরু করে। সে রাচেলকে আবারো জড়িয়ে ধরতে চায়। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে।
“রাচেল-”
রাচেল ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ও আরো কাতর হয়ে কাঁদতে শুরু করে। “আমাকে একা থাকতে দাও।” রাচেল চলে যাবার সময় কিচেনের দরজায় থেমে পেছন ঘুরে। “আমি এই ব্যাপারে আর একটা কথাও শুনতে চাই না আর। তুমি এলির সাথে এসব নিয়ে কিছু বলবে না, ব্যস। মনে থাকে যেন। মৃত্যুর মধ্যে স্বাভাবিক কিছু নেই। কিচ্ছুই নেই। ডাক্তার হিসেবে তোমার সেটা আরো ভালো করে জানার কথা।”
রাচেল আবারো ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যায়, লুইসকে কিচেনে একা ফেলে। কিচেনটা এখনো তাদের তপ্ত স্বরে কাঁপছে। সে ভাঁড়ার ঘর থেকে একটা ঝাড়ু নিয়ে এসে জায়গাটা পরিস্কার করতে করতে তার আর রাচেলের সদ্য শেষ হওয়া আলাপের কথা ভাবে। মৃত্যুর মত একটা ব্যাপারে তাদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে যে এতো ফারাক সেটা এতোদিন কেন প্রকাশ পায়নি সেটা ভেবেই সে কূল পায় না। ডাক্তার হিসেবে সে জানে জন্মের পর মৃত্যুর মত স্বাভাবিক ঘটনা মানুষের জীবনে আর একটিও নেই। কেউ স্কুলে যেতে পারে, নাও পারে; কেউ চোখে দেখতে পারে, নাও পারে, কিন্তু মরতে তাকে হবেই হবে। মৃত্যু কাউকেই ছেড়ে দিবে না। মানুষের জীবনটা একটা ঘড়ির মত, আর এই ঘড়ি টিক টিক করতে করতে এক সময় না এক সময় ক্ষয় হতে বাধ্য। সাগরের কচ্ছপের জীবনেও এক সময় মৃত্যু ঠিকই ছোবল মারে, আর বাকি সব প্রাণীর মতই।
“জেলডা,” লুইস উচ্চস্বরে বলে ওঠে। “হায় ঈশ্বর! তিনিই জানেন, জেন্ডার মৃত্যুতে রাচেলের অবস্থা কতটা খারাপ হয়েছিল।”
প্রশ্নটা হচ্ছে লুইস কি মেনে নেবে না কি এই ব্যাপারে কিছু করবে?
অধ্যায় ১০
“আশা করি এলি ব্যাপারটা নিয়ে একদম ভেঙে পড়েনি,” জাড ক্র্যান্ডাল বলেন। লুইস আবারো ভাবলো, বুড়োর একটা খুব অদ্ভুত এবং কিছুটা বিরক্তিকর ক্ষমতা আছে। কারো ক্ষতস্থান খুঁজে বের করে ফেলার ক্ষমতা।
সে, জাড এবং নরমা বিকেলের ঠান্ডা হাওয়ায় ক্র্যান্ডালদের বারান্দায় বসে আছে। বিয়ারের বদলে আজ তারা পান করছে আইসড টি। সামনে রাস্তায় সপ্তাহের ছুটিতে বাড়ি ফেরা মানুষের গাড়ির ভিড়। আগামীকাল থেকে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ পুরোদমে শুরু হবে। কাল থেকেই ক্যাম্পাসের হলে আর অরিঙ্কোর ফ্লাটগুলোয় শিক্ষার্থীরা ফিরতে শুরু করবে এবং আগামী এক বছর ধরে সকাল ৮টার ক্লাস আর অখাদ্য-কুখাদ্য খাবারের কথা চিন্তা করে কপাল চাপড়াবে। রাচেল আজ সারাটা দিন তার সাথে ঠান্ডা-না শুধু ঠান্ডা না, বরং বরফ শীতল আচরণ করেছে। আর সে এটাও ভালো করেই জানে যে, সে বাসায় ফিরে দেখবে রাচেল এর মধ্যেই শুয়ে পড়েছে। রাচেল আজ শোবে বিছানায় নিজের দিকের একদম কোণ ঘেঁসে, যেন আরেকটু হলেই নিচে পড়ে যাবে। আজ লুইসের বিছানার সীমানা হবে পুরো বিছানার তিন-চতুর্থাংশ, যেটাকে তার কাছে লাগবে বিরান কোন মরুভূমির মত।
“আমি বলছিলাম, আমি আশা করি-”
“সরি,” লুইস বলে। “একটা জিনিস ভাবছিলাম। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে এলি একটু আপসেট হয়েছে। কিন্তু আপনি তা কী করে বুঝলেন?”
“অনেক তো দেখলাম জীবনে,” জাড তার স্ত্রীর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে তার দিকে মুচকি হেসে বললেন, “কি বলো, বউ?”
“গন্ডায় গন্ডায়,” নরমা ক্র্যান্ডাল বলেন। “ আমরা দুজনেই বাচ্চাদের অনেক পছন্দ করি।”
“অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, ওই পেট সেমেটারিটাই বাচ্চাদের মৃত্যুর সাথে প্রথমবারের মত পরিচয় করিয়ে দেয়।” জাড বললেন। “ওরা যখন টিভিতে কাউকে গুলি খেয়ে পেট চেপে ধরে কার্প মাছের মত তাপড়াতে তড়পাতে মরতে দেখে, ওরা কিন্তু বুঝে যায় যে সেটা অভিনয়। সেটার তুলনায় ওই পাহাড়ের ওপরের পেট সেমেটারিটা অনেক অনেক বেশি বাস্তব, তাইনা?”
লুইস মাথা ঝাঁকায়। সেটা আমার বউকে গিয়ে বলুন, সে মনে মনে বলে।
“অনেক বাচ্চাই ব্যাপারটাকে স্বাভাবিকভাবে নেয় তবে অনেকের ক্ষেত্রেই…যেন ওরা তাদের প্যান্টের পকেটে করে ব্যাপারটা বাসায় নিয়ে আসে আর পরে এক সময় সেটা পকেট থেকে বের করে নেড়ে চেড়ে দেখে। বেশিরভাগেরই কিছু হয়না। তবে দুই-এক জনের…নরমা, তোমার হলওয়ে ছেলেটার কথা মনে আছে?”
নরমা মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালেন, তাতে তার হাতের আইসড টির গ্লাসের বরফগুলো কড়কড় শব্দ করে উঠলো। তার চশমাটা চেইন দিয়ে বুকে ঝোলানো ছিল এবং সামনের রাস্তায় চলতে থাকা একটা গাড়ির হেডলাইটের আলোতে সেটা হীরের মত ঝকমকিয়ে ওঠে। “ও রাতে খুব খারাপ খারাপ দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল,” নরমা বললেন। “কবর থেকে লাশ উঠে এসে ওকে খামচে ধরতে চাইছে এইরকম কিছু আর কি। এর কিছুদিন পরই ছেলেটার পোষা কুকুরটা মারা যায়। কুকুরটা কিভাবে মারা যায় কেউ ধরতে পারেনি। তবে লোকজনের ধারনা কেউ বিষ মাখা টোপ খাইয়ে কুকুরটাকে মেরে ফেলেছে, তাই না জাড?”
“হুম,” জাড মাথা ঝাকালেন। “অন্তত বেশিরভাগ লোকজন তাই মনে করে। সেটা ১৯২৫ সালের কথা। বিলি হলওয়ের বয়স তখন বড়জোর দশ। ও বড় হয়ে স্টেট সিনেটর হয়। পরে ইউ.এস. হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভের জন্যে নির্বাচন করে, কিন্তু হেরে যায়। সেটা কোরিয়া যুদ্ধের কিছু আগের ঘটনা।”
“ও আর ওর বন্ধুরা মিলে কুকুরটার জন্যে ফিউনারেলের ব্যবস্থা করেছিল,” নরমা স্মৃতিচারণ করে বলেন। “কুকুরটা একটা সাধারণ মন্ট্রিয়েল জাতের কুকুর হলেও ছেলেটা কুকুরটাকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসতো। ওর দুঃস্বপ্নের কথা বিবেচনা করে ওর বাবা-মা অবশ্য প্রথমে কুকুরের জন্য শেষকৃত্য অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করেছিলেন। তবে শেষে দেখা যায় ওর নতুন করে কোন সমস্য হয়নি। কুকুরটার জন্যে দুটো বড় বড় ছেলে মিলে একটা কফিনও বানিয়ে দিয়েছিল, মনে আছে তোমার, জাড?”
জাড মাথা ঝাঁকান। “ডিন আর ডানা হল,” তিনি বলেন। “ওরা দুজনে আর বিলির এক দোস্ত-নামটা ঠিক মনে নেই, তবে এটুকু মনে আছে যে বাওয়িদের ছেলে। তোমার বাওয়িদের কথা মনে আছে নরমা? ওই যে যারা মিডল ড্রাইভের একটা বাড়িতে থাকতো?”
“হ্যাঁ!” নরমা খুব উত্তেজনার সাথে বলেন, যেন ঘটনাটা মাত্র গতকালের। হয়তো নরমার কাছে ব্যাপারটা আসলেই তেমনটাই মনে হচ্ছে। “বাওয়িদের ছেলেই। এলান অথবা বার্ট-”
“অথবা ক্যান্ডালও হতে পারে,” জাড মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন। “কে কে কফিনটা বয়ে নিয়ে যাবে তা নিয়ে ওরা তুমুল ঝগড়া লেগে যায়। কুকুরটা ছিল একদম ছোট, তাই কফিনও ছোট আর সেটা বেশি হলে দুজন মিলে বইতে পারবে। হল ছেলেরা বলল যেহেতু কফিনটা ওরাই বানিয়েছে, তারপর আবার তারা দুজন জমজ ভাই, তাই কফিন বহন করার হক তাদেরই বেশি। বিলি বলল তারা দুজন তো বোসারকে চেনেই না। বোসার হলো কুকুরটার নাম। বোসারকে যারা চেনেই না তারা কিভাবে তার কফিন বহন করার দাবি করতে পারে? ‘আমার বাবা বলেছেন বন্ধুরাই কফিন বয়ে নিয়ে যাবার হকদার, কোন কাঠমিস্ত্রী না।” এটা ছিল বিলির যুক্তি।” জাড আর নরমা এক সাথে শব্দ করে হেসে ওঠেন। লুইসের মুখেও একটু শুকনো হাসি ফুটে ওঠে।
“ওরা প্রায় মারামারিই লাগিয়ে দিয়েছিল। আর তখনি বিলির বোন একটা মোটা এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা বই হাতে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে,” জাড বলেন। “তাদের বাবা ওই সময় এই এলাকার একমাত্র ডাক্তার আর ওই রকম একটা বই কেনার সামর্থ্য একমাত্র তারই ছিল।”
“ওদের বাড়িতেই এই এলাকার প্রথম ইলেক্ট্রিক বাতি জ্বলে।” নরমা ফাঁকে বলেন।
“যাই হোক,” জাড আবারো বলতে শুরু করলেন। “বিলির আট বছরের বোন রাজকন্যার মত চুল দোলাতে দোলাতে, স্কার্টের কাপড় ওড়াতে ওড়াতে বইটা নিয়ে ওদের মাঝে এসে হাজির হয়। ততক্ষণে জমজ ভাইদের সাথে বিলি আর সম্ভবত বেন ক্যান্ডাল প্রায় মারামারি লাগিয়ে দিয়েছে।
লুইস প্রথমে খিল খিল করে হেসে ওঠে। এরপর সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। সে বুঝতে পারে রাচেলের সাথে ঝগড়া করার কারণে তৈরি হওয়া গুমোট ভাবটা তার আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে।
“ওর ছোট বোন এসে বলল, ‘এদিকে দেখ; আর সবাই ঝগড়া থামিয়ে ওর দিকে তাকায়। বিশ্বাস করো লুইস, মেয়েটা বইটার ‘ফিউনারেল’ অধ্যায়টা বের করে রাণী ভিক্টোরিয়ার ফিউনারেলের একটা ছবি দেখায়। ছবিতে দেখা যায় দুপাশে অন্তত চল্লিশজন করে লোক রাণী ভিক্টোরিয়ার কফিনটা কাঁধে তুলে নিয়ে আছে। তাদের কেউ ঘামছে, কেউ মুখ কুঁচকে ফেলেছে। আর তাদের পাশেই ফিউনারেলের কালো পোশাক পরে আরো লোক দাঁড়িয়ে আছে, বদলি হিসেবে। মেয়েটার নাম ম্যান্ডি। ম্যান্ডি ছবিটা দেখিয়ে বলল, স্টেট ফিউনারেলে যত খুশি ততো লোক অংশগ্রহন করতে পারে! বইতে তাই লেখা আছে!”
“এতেই ঝামেলা মিটে গেল?” লুইস জিজ্ঞেস করে।
“হুম। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল যে বিশটার মত পিচ্চি ওই কুকুরের ফিউনারেল অনুষ্ঠানে অংশগ্রহন করে। ফিউনারেলের সময় ম্যান্ডি সবগুলো বাচ্চাকে ওই ছবিটার মত করে লাইন ধরে দাঁড় করায়। তবে তাদের মাথায় লম্বা টুপি আর গলায় মালা ছিল না। ম্যান্ডি তার বদলে সবার হাতে একটা করে বুনো ফুল ধরিয়ে দেয়। এই ম্যান্ডি মেয়েটা ইউ.এস. সিনেট নির্বাচনে যখন হেরে গিয়েছিল আমি তখন বুঝেছিলাম আমাদের দেশ একটা রত্ন থেকে বঞ্চিত হলো।” তিনি হাসতে হাসতে তার মাথা ঝাঁকালেন। “যাই হোক, সেদিন থেকেই বিলির দুঃস্বপ্নের শুভ সমাপ্তি।”
লুইসের আবারো রাচেলের হিস্টেরিক আচরণের কথা মনে পড়ে যায়।
“এলি মানিয়ে নিতে পারবে।” নরমা নড়ে চড়ে বসে বলেন। “তুমি নিশ্চয়ই ভাবো আমরা হয়তো দুজনে সারাক্ষণ মৃত্যু নিয়ে ভাবি। হয়তো ভাবাটাই স্বাভাবিক। তাবে জানো কি, আমাদের মধ্যে মৃত্যু চিন্তাটা এখনো সেভাবে ঢুকতে পারেনি।”
“আরে না। এসব ভাববো কেন?” লুইস বলে।
“যাই হোক, মৃত্যু জিনিসটা নিয়ে ভাবা খারাপ কিছু না। ইদানিং টিভিতে প্রায়ই দেখি মৃত্যুর দৃশ্য সেন্সর করে দেয়া হচ্ছে। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে কেউ ভাবতেও চায় না, কথাও বলতে চায় না। আর অনেকে আছে ফিউনারেলে গিয়েও লাশের মুখ দেখতে চায় না। অনেকের ধারনা এসব জিনিস বাচ্চাদের মনে আঘাত দিতে পারে। সব মিলিয়ে মনে হয় মানুষ যেন মৃত্যুকে ভুলে থাকতেই পছন্দ করে।”
“আর সেই একই টিভিতে সেসব জিনিস দেখাচ্ছে যেসব জিনিস মানুষ তাদের শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে করে,” জাড বললেন। এক জেনারেশন থেকে আরেক জেনারেশনের দূরত্বটা কত অদ্ভুত, তাইনা?”
“হুম,” লুইস বলে।
“আমাদের সময়টা এরকম ছিল না,” জাড অনেকটা ক্ষমা প্রার্থনা করার সুরে বলেন। “আমারা মৃত্যুকে এভাবে ভুলে থাকতে চাইতাম না। আমরা বিশ্বযুদ্ধের পরে ফ্লুয়ের মহামারী রূপ দেখেছি, প্রসূতি মায়ের মৃত্যু, শিশুদের ইনফেকশনে মৃত্যু, এমনকি জ্বরে ভুগেও বহু লোককে মরতে দেখেছি; এসব জ্বর এখনকার ডাক্তারেরা তুড়ি মেরে ভালো করে ফেলে। আমি যখন যুবক ছিলাম তখন কারো ক্যান্সার হয়েছে মানে তার অবধারিত মৃত্যু পরওয়ানা রেডি হয়ে গেছে, এখনকার মত কেমোথেরাপি তো আর ছিল না। দুটো বিশ্বযুদ্ধ, খুন, আত্মহত্যা…”
তিনি একটু চুপ করে গেলেন।
“মৃত্যুকে আমরা বন্ধু এবং শত্রুর মত দু’ভাবেই চিনেছি,” এরপর নীরবতা ভেঙে তিনি বললেন। “আমার ভাই পিট মারা গিয়েছিল অ্যাপেন্ডিক্স ফেটে গিয়ে, ১৯১২ সালে। ওর বয়স তখন চোদ্দ আর ও এলাকার সবার মধ্যে সবচাইতে ভালো বেসবল খেলতো। সে সময় মৃত্যুকে জানার জন্যে কলেজে যাওয়ার প্রয়োজন পরতো না। মৃত্যু তখন মাঝে মাঝেই অনাহূত অতিথির মত বাসায় এসে হাজির হতো এবং সবার সাথে খাবার টেবিলে বসে ডিনারও করতো আর মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হলে পাছায় কষে লাথি মারতো।”আমার আশেপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট
নরমা তার ‘মার্জিত’ ভাষার কোন প্রতিবাদ না করে মাথা ঝাকান। লুইস উঠে দাড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে। “আমি যাই,” সে বলে, “ কাল অনেক ঝামেলার দিন।”
“কাল থেকেই খাঁটুনি শুরু, না কি?” জাড়ও দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন। জাড দেখলেন নরমাও দাঁড়াতে চাইছেন, তাই তিনি তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন। চোখ মুখ কুঁচকে নরমা উঠে দাঁড়ালেন।
“আজকে ব্যথা খুব বেশি?” লুইস জিজ্ঞেস করে।
“খুব বেশি না,” নরমা উত্তর দেন।
“গরম কিছুর সেক দিয়ে ঘুমোতে যাবেন।”
“দেব। সব সময়ই দেই। আর লুইস…এলিকে নিয়ে বেশি দুশ্চিন্তা করো না। ও ওর নতুন বন্ধুদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে আর ওই জায়গাটা নিয়ে ভাববার কোন ফুসরতই পাবে না। একদিন হয়তো দেখা যাবে এলির বন্ধুরা ওকে নিয়েই জায়গাটার আগাছা পরিস্কার করতে বা ফুলের গাছ লাগাতে যাবে। বাচ্চারা ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর এরকমই করে।”
আমার বউকে গিয়ে বলেন সেটা।
“কাল রাতে সুযোগ পেলে এসে বলে যেও কাজের প্রথম দিন কেমন লাগলো।” জাড বলেন। “ক্রিবেজও খেলবো। গো-হারা হারার জন্যে দাওয়াত রইলো।”
“তাই? তাহলে হয়তো আপনাকে প্রথমে বিয়ার খাইয়ে মাতাল করে নেব,” লুইস কৌতুক করে বলে। “এরপর দেখা যাবে কে কাকে খেলায় নাকানি চুবানি খাওয়ায়।”
“ডাক্তার,” জাড গম্ভীর গলায় বললেন, “যেদিন তোমার কাছে ক্ৰিবেজ খেলায় আমি নাকানি চুবানি খাবো, সেদিন তোমার মত হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে আমি নিজের চিকিৎসা করাব, বুঝলে?”
সবার হাসির মাঝেই রাস্তা পেরিয়ে নিজের বাসার দিকে রওনা হলো সে। চারদিকে গ্রীষ্মের রাত।
রাচেল বাবুকে নিয়ে বিছানায় নিজের পাশের এক কোণায় কুকুরকুন্ডলী হয়ে শুয়ে আছে। লুইস ভাবে, রাচেল এসব মনে রাখবে না-আগেও তাদের সম্পর্কে শীতলতা এসেছে, ঝগড়া হয়েছে, তবে এবারেরটাই সবচাইতে নিকৃষ্ট। তার একই সাথে রাগ, অভিমান আর কষ্টের একটা মিশ্র অনুভূতি হয়। তার ইচ্ছে হচ্ছে তাদের মধ্যের ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলতে কিন্তু সে বুঝতে পারে না সেটা কিভাবে সম্ভব বা কার প্রথমে ‘সরি’ বলা উচিত। আগেও তাদের মাঝে ঝগড়া হয়েছে, তবে এবারের মত তিক্ত পর্যায়ে কখনোই সেই ঝগড়া যায়নি। এরকম আঘাত তাদের সম্পর্কের অবকাঠামোতে ঘুন ধরিয়ে দেয়ার জন্যে খুব বেশি দরকার নেই, তা লুইস বোঝে। তার বন্ধুরা প্রায়ই তাকে ফোন দিয়ে বলে ‘অন্য কারো কাছ থেকে শোনার আগে তোর আমার কাছ থেকেই শোনা উচিত মনে করলাম লু। আমার আর ম্যাগির ডিভোর্স হচ্ছে…’ এবার হয়তো বন্ধুদের ডিভোর্সের খবর পাওয়ার বদলে নিজের ডিভোর্সের খবর দেয়া লাগবে তার।
সে কাপড় ছেড়ে সকাল ছয়টার এলার্ম সেট করে। এরপর সে গোসল করে, শেভ করে। দাঁত মাজার আগে সে একটা গ্যাস্ট্রিকের ঔষধ চিবিয়ে খায়। নরমার আইসড টি খেয়ে অথবা রাচেলকে ওভাবে শুয়ে থাকতে দেখে তার পেটে এসিডিটি হয়ে গেছে। সীমানাই সব কিছুর নির্ধারক, কলেজের কোন কোর্সে সে যেন পড়েছিল?
এরপর সে শুতে যায় কিন্তু তার ঘুম আসে না। কিছু একটা মনে খচখচ করছে। পাশেই রাচেল আর গেজের সম্মিলিত শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সেই শব্দ শুনতে শুনতে তার মাথায় গতকাল আর আজকের ঘটনাগুলো ঘুরপাক খেতে থাকে।
দুনিয়ার সেরা কুকুর ছিল হ্যানা…মার্তা আমাদের পোষা খোরগোশ…
এলির ক্ষেপে ওঠা। চার্চ কক্ষনো মরবে না! ঈশ্বর তার নিজের বিড়াল নিয়ে যা খুশি করুক! রাচেলও কম ক্ষেপলো না। একজন ডাক্তার হিসেবে তোমার জানা উচিত…নরমা ক্র্যান্ডালের কথা, আজকাল লোকে মৃত্যুকে ভুলে থাকতে চায়…আর জাডের যুগ যুগের পুরনো কন্ঠের নিশ্চিতভাবে বলা, মৃত্যু সবার সাথে খাবার টেবিলে বসে ডিনারও করতো আর মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হলে পাছায় কষে লাথি মারতো।
আর জাডের কন্ঠটা তার মায়ের কন্ঠের সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। তার মা তাকে চার বছর বয়েসে যৌনতা সম্পর্কে মিথ্যে বলেছিলেন, কিন্তু মৃত্যু নিয়ে সত্য কথাই বলেছিলেন, যখন লুইসের কাজিন রুখি একটা ফালতু গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে নিহত হয়। একটা বাচ্চা ছেলে একটা ট্রাকের ভেতরে চাবি ঝোলানো দেখতে পেয়ে সেটা স্টার্ট করে চালাতে শুরু করে। কিন্তু এরপর বালক আবিষ্কার করে, সে গাড়ি চালাতে জানে না। বালকের ট্রাকটা লুইসের আঙ্কেল কার্লের গাড়িতে গিয়ে আঘাত করে। গাড়িটা একদম দুমড়ে মুচড়ে যায়। রুথি ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আর ওই বজ্জাত ছেলেটার গায়ে কিছু কাটাছেড়া ছাড়া কোন ক্ষতিই হয়নি বলতে গেলে। ‘ও মরতে পারে না,’ লুইস তার মায়ের দেয়া দুঃসংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিল। সে কথাগুলো শুনলেও তার মানে বের করতে পারছিল না। ‘এসব কী বলছো যে রুথ মারা গেছে? কিসব ফালতু কথা বলছো, মা?’ পরে সে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘রুথকে কে কবর দেবে?’ কারণ রুথের বাবা, মানে লুইসের আঙ্কেল কার্ল নিজেই একজন আন্ডারটেকার। তার কাজই মানুষের কবর দেয়া নিয়ে। তাই সে ভাবতেও পারেনি সেই কাজটা আঙ্কেল কার্ল তার নিজের মেয়ের জন্যেও করতে পারেন। লুইসের মনে সেদিন এই প্রশ্নটাই ধাঁধার মত ঘুরপাক খাচ্ছিল। ধাঁধাটা হলো শহরের একমাত্র নাপিতের চুল কে কেটে দেয়?
“আমার মনে হয় তোমার আঙ্কেল কার্লের ব্যবসার বন্ধু ডন ডোনাহে কাজটা করবে।” লুইসের মা বলেছিলেন। ওনার চোখগুলো ছিল লাল টকটকে আর তাকে দুশ্চিন্তার ভারে অসুস্থ অসুস্থ লাগছিল। ‘কিন্তু লুইস…ছোট রুথি…আমি ভাবতেও পারছি না ও কি কষ্টটাই না পেয়ে গেছে…ওর জন্যে আমার সাথে প্রার্থনা করো লুইস, ঠিক আছে? রুথির জন্যে আমার সাথে প্রার্থনা করো। আমাকে সাহায্য করো লুইস।”
এরপর তারা মা ছেলে মিলে কিচেনের মেঝেতে হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করে। আর এই প্রার্থনাই তাকে ব্যাপারটাকে আরো ভালো করে বুঝতে সাহায্য করে। যেহেতু তার মা রুথির আত্মার জন্যে প্রার্থনা করছেন, তার মানে হচ্ছে রুথির দেহটা আর নেই। চোখ বন্ধ করে প্রার্থনারত অবস্থায় লুইস দেখতে পায় রুথি তার পচতে থাকা দেহটা নিয়ে লুইসের তেরোতম জন্মদিনে উপস্থিত হয়েছে। রুথের পচতে থাকা চোখ দুটো তাদের কোটর থেকে বেরিয়ে এসে গালের ওপর ঝুলে পড়েছে আর তার লাল চুলে নীল রঙের কিছু ময়লা লেগে আছে। এই বীভৎস দৃশ্য তার মনে শুধু যে আতঙ্ক সৃষ্টি করে তা না। সে রুথির জন্যে এক রকম ভালোবাসাও অনুভব করে।
সে তার জীবনে পাওয়া সবচাইতে তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে, “ও মরতে পারে না! আম্মু, ও মরতে পারে না, আমি ওকে খুব পছন্দ করি, মা!”
ওর মায়ের জবাব ছিল, “ও আর নেই। আমি সরি, কিন্তু ও আসলেই আর আমাদের মাঝে নেই। রুথি আসলেই আমাদের ছেড়ে চিরদিনের মত চলে গেছে।”
যে মরে গেছে সে তো চিরতরে চলেই গেছে-আর কী চাই তোমার? লুইস ভেবে কেঁপে ওঠে।
হঠাৎ সে বুঝতে পারে কেন তার নতুন চাকরির আগের রাতে ঘুম আসছে না। তার একটা কাজ বাকি আছে।
বিছানা থেকে উঠে সিঁড়ির দিকে যেতে গিয়ে হঠাৎ এলির রুমের দিকে মোড় নেয়। এলি বিছানায় মুখ হা করে ঘুমোচ্ছে। কি প্রশান্তই না লাগছে ওর মুখটা। এলির পরনে ছোট হয়ে যাওয়া নীল রং এর একটা বেবি ডল পায়জামা। ওহ ঈশ্বর! এলি তোমার পাজামাটা তো ফেটে যাচ্ছে, লুইস মনে মনে বলে। চার্চ এলির দু পায়ের ফাঁকে মরার মত ঘুমোচ্ছে।
নিচতলার টেলিফোনের পাশে একটা বুলেটিন বোর্ডে অনেক রশিদ, বিল আর ম্যাসেজ পিন দিয়ে সাটা। বোর্ডের ওপর রাচেলের গোটা গোটা হাতের লেখা, “যেসব কাজ কিছুদিন ঝুলিয়ে রাখা যায়।” লুইস টেলিফোন বুকটা থেকে একটা নাম্বার বের করে একটা কাগজে নাম্বারটা লিখে ফেলে। নাম্বারের নিচে লিখলো: ‘কুয়েন্টিন এল. জুলেন্ডার, ডি ভি এম-চার্চের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্যে ফোন কর-জুলেন্ডার নিজে পশু খাসি না করলেও অন্য কাউকে রেফার করবেন।”
সে নিজের লেখা নোটটার দিকে তাকিয়ে ভাবে এখনই চার্চকে খোজা করা ঠিক হবে কি না। তবে চার্চকে খাসি করা যে আসলেই দরকার সে তা জানে। এতো ঝগড়াঝাটির মধ্য দিয়ে যেন অন্তত ফলপ্রসু কিছু একটা হয়। আজকের দিনে কোন এক সময় তার অবচেতন মনে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে, তার সচেতন মনের অগোচরে। লুইস আসলেই চায় না যে চার্চ তাদের বাড়ির সামনের বিপজ্জনক রাস্তাটার ওপর বেশি ঘোরাঘুরি করুক, অন্তত সেটা বন্ধ করার উপায় যেহেতু একটা আছে।
পুরনো কিছু ভাবনা আবারো তার মনে উঁকি দেয়। চার্চকে খাসি করা হলে সে এই বয়সেই মুটিয়ে একটা অথর্ব হুলো বেড়ালে পরিণত হবে। আশে পাশে কি ঘটছে সে ব্যাপারে ওর আর কোন আগ্রহ থাকবে না, খাওয়ার সময় খাবারের বাটিতে খাবার পেলেই তার চলবে। লুইস চায় না চার্চ তেমনটা হয়ে যাক। চার্চের বুনো স্বভাবটা সে আসলেই ভালোবাসে।
বাইরের রাস্তা দিয়ে একটা ভারি ট্রাক গমগম করতে করতে চলে যায় আর তাতেই লুইস তার সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করে ফেলে। সে পিন দিয়ে কাগজটা বোর্ডে সেটে দিয়ে বিছানায় ফিরে যায়।
অধ্যায় ১১
পরদিন নাস্তার সময় এলি বুলেটিন বোর্ডে লুইসের ম্যাসেজটা দেখতে পেয়ে জিজ্ঞেস করে সেটার মানে কী।
“এর মানে চার্চের ছোট্ট একটা অপারেশন হতে যাচ্ছে,” লুইস বলে। “অপারেশনের পরে হয়তো ওকে এক রাত ভেটের কাছে থাকতে হবে। এরপর ও ফিরে এলে ওর বাইরে ঘোরাঘুরির স্বভাব একদম কমে যাবে।”
“রাস্তাটাও আর বেশি পারাপার হবে না?” এলি জিজ্ঞেস করে।
এলির বয়স পাঁচ হতে পারে, তবে সে দুয়ে দুয়ে চার মিলিয়ে নিতে পারে-লুইস ভাবে।
“হ্যা, রাস্তার ওপরও আর বেশি যাবে না,” লুইস সম্মতি জানিয়ে বলে। “ইয়েই!,” এলি খুশি হয়ে বলে আর সেখানেই এই বিষয়ের সমাপ্তি I
লুইস ভেবেছিল চার্চ একরাত বাইরে থাকবে তা শুনে এলি হয়তো উৎপাত শুরু করবে, অবুঝের মত গো ধরবে। কিন্তু এলি এরকম কিছুই করলো না দেখে লুইস বেশ অবাক হয়। আর লুইস এটাও বুঝতে পারে এলি আসলেই চার্চকে নিয়ে মারাত্মক দুশ্চিন্তা করছে। হয়তো রাচেল এলির ব্যাপারে যা বলেছে তা একদম ভুল নয়।
গেজকে নাস্তা খাওয়াতে থাকা রাচেলও তার দিকে কৃতজ্ঞতাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। তা দেখে লুইসের মনে হলো তার বুক থেকে একটা পাথর নেমে গেছে। রাচেলের চোখ বলছে গতকালের ঝামেলাটা এখানেই কবর দেয়া হলো। চিরতরে; লুইস প্রার্থনা করে।
কিছুক্ষণ পরে যখন এলির হলুদ স্কুল বাসটা এসে তাকে নিয়ে চলে গেল, রাচেল তার কাছে আসে। রাচেল দুহাতে লুইসের কাঁধ জড়িয়ে ধরে ওকে চুম্বন করে। “খুব ভালো করেছো,” রাচেল বলে, “আর আমি সরি যে তোমার সাথে জঘন্য ব্যাবহার করেছি।”
লুইসও রাচেলকে চুমু খায়। তবে একটা জিনিস তার মনে খচখচ করতে থাকে। আর ‘আমি সরি যে তোমার সাথে জঘন্য ব্যবহার করেছি,’ এই কথাটা রাচেলের কাছ থেকে লুইসের প্রথম শোনা নয়। সে এই কথাটা বহুবার শুনেছে। যা চায় তা আদায় করে নেবার পরই রাচেল এটা বলে।
গেজ হাঁটিহাঁটি করে হেলতে দুলতে সামনের দরজার কাছে গিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলে উঠলো, “বাস…এলি-বাস।”
“ও খুব দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে,” লুইস বলল।
রাচেল সায় দিলো। “আমি যতটা চাই তার চেয়েও দ্রুত বড় হয়ে যাচ্ছে।”
“তবে ডায়াপার ছাড়া পর্যন্ত ওকে বড় হতে দাও, এরপর ওই বয়সে ওকে যতদিন ইচ্ছে আটকে রেখো।”
রাচেল হাসে। ওদের মধ্যকার সব ঝামেলা একদম ঢুকে গেছে। রাচেল একটু পেছনে গিয়ে ওর টাইটা একটু ঠিক করে ওর পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলায়।
“ড্রেসটা পাশ না ফেল?” লুইস জিজ্ঞেস করে।
“তোমাকে চমৎকার লাগছে।”
“কেমন চমৎকার? বছরে দু লক্ষ ডলার কামানো হার্ট সার্জনের মত চমৎকার?”
“নাহ, স্রেফ বুড়ো লুইস ক্রিডের মতই,” রাচেল বলে হাসে। “রক অ্যান্ড রোল ভক্ত।”
লুইস তার ঘড়ির দিকে তাকায়। “এই রক অ্যান্ড রোল ভক্তকে এখন জুতো পরে অফিসে যেতে হবে,” বলল সে।
“নার্ভাস?”
“হুম, কিছুটা।”
“নার্ভাস হবার কিছু নেই।” রাচেল বলে। “শিক্ষার্থীদের সর্দিজ্বরের ঔষধ, কাঁটাছেড়ার ব্যান্ডেজ আর মেয়েদের বার্থ কন্ট্রোল পিল দেয়ার জন্যে ওরা তোমাকে বছরে ৬৭ হাজার ডলার দেবে।”
“পাছার ফোঁড়া আর কৃমির কথা ভুলে গেছো,” মুচকি হেসে লুইস বলে।
“তোমার প্রথম দিনটা আশা করি ভালই কাটবে,” বলে রাচেল আবারো তাকে লম্বা চুমু খায়। “আর ভুলে যেও না, তুমি এখন সেখানকার বস, কোন দ্বিতীয় বর্ষের ইন্টার্ন ডাক্তার নও।”
“ওকে ডাক্তারসাহেবা,” সে বিনীতভাবে বললে দুজনেই হেসে ওঠে। লুইসের একবার মনে হচ্ছিল ও জিজ্ঞেস করে, ‘এতো কিছুর পেছনের কারণ কি জেন্ডার মৃত্যু, রাচেল? ও কিভাবে মারা গিয়েছিল?’ তবে সে তেমন কিছুই জিজ্ঞেস করে না; এখনো সময় হয়নি। ডাক্তার হিসেবে সে দুই-একটা বিষয় জানে। সে জানে জন্মের মত মৃত্যুও একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আবার এটাও জানে যে কোন আধা শুকানো ঘায়ে গুতোগুতি করতে নেই।
তাই সে কিছু জিজ্ঞেস না করে রাচেলকে আবারো চুমু খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।
দিনের শুরুটা ভালোই হলো। মেইনে এখন পুরোদস্তুর গ্রীষ্মের রূপ। পরিস্কার নীল আকাশ আর বাহাত্তর ডিগ্রী তাপমাত্রা। ড্রাইভওয়েতে গাড়ি বের করতে করতে সে ভাবে ঝরা পাতার সৌন্দর্যের সময় এখনো আসছে না কেন?
সে তাদের হোন্ডা সিভিক গাড়িটা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ঘোরায়। এটা তাদের দু নম্বর গাড়ি। রাচেল আজই ভেটকে ফোন করে চার্চকে ফিক্স করার ব্যবস্থা করবে। তাতেই হয়তো পেট সেমেটারি নিয়ে তৈরি হওয়া সকল ঝামেলাকে তারা পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারবে। সেপ্টেম্বরের এই রকম একটা চমৎকার সকালে মৃত্যুর মত বিরস একটা বিষয় নিয়ে ভাবার কোন মানেই হয় না।
লুইস গাড়ির রেডিও ছেড়ে স্টেশান পাল্টে পাল্টে নিজের পছন্দের একটা গান খুঁজে বের করে। সে গানটার সাথে সাথে হেড়ে গলায় গাইতে শুরু করে। তার গানের গলা জঘন্য হলেও সে বেশ আনন্দ পাচ্ছে।
অধ্যায় ১২
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকেই লুইস রাস্তায় অসহনীয় ট্রাফিকের পাল্লায় পড়ে। রাস্তায় গাড়ি, বাইক আর জগিং করতে থাকা লোকজনে গিজগিজ করছে। এরইমধ্যে বাইক আর জগারদের তার গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগা থেকে বাঁচাতে বেশ কয়েকবার হার্ড ব্রেক কষতে বাধ্য হয়েছে সে। সোল্ডার বেল্টটা ভালো করে লক করে নিয়ে বিরক্তি নিয়ে হর্ন বাজাচ্ছে। জগার আর বাইকারদের লুইস কখনোই পছন্দ করে না। তারা রাস্তায় নামার আগে তাদের কান্ডজ্ঞানটা বাসায় ফ্রিজে রেখে আসে। যেহেতু তারা বাইক চালাচ্ছে সেহেতু তাদের কোন দায়িত্ব নেই, সব দায়িত্ব গাড়িওয়ালাদের। শত হোক, তারা তো এক্সারসাইজ করছে। তাদেরই একজন লুইসকে মধ্য-আঙ্গুলি দেখিয়ে দিলো। লুইস একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি চালিয়ে যায়।
ইনফার্মারির পার্কিং লটে অ্যাম্বুলেন্সটা নেই। নতুন অফিসে প্রথম দিনেই গোড়ায় গলদ। ইনফার্মারিটা যেকোন অসুখ বা অ্যাক্সিডেন্টের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্যে উপযোগী। এখানে রোগ নির্নয়ের যন্ত্রপাতি ভরা তিনটি রুম, আর পনের বেড সম্বলিত দুটি ওয়ার্ড আছে। কিন্তু এখানে অপারেশান থিয়েটার তো দূরের কথা, ওই জাতীয় কিছুর খালাতো ভাইও নেই। কোন বড় অ্যাক্সিডেন্টের ক্ষেত্রে ওই অ্যাম্বুলেন্সটাই একমাত্র ভরসা। সেটাতে করেই রোগিকে ইস্টার্ন মেইন মেডিকেল সেন্টারে পাঠানো হয়। এখানকার সহযোগী ফিজিশিয়ান স্টিভ মাস্টারটন ওকে গত দু-বছরের লগ দেখিয়েছে। ওই সময়ে মাত্র আটত্রিশবার অ্যাম্বুলেন্সটা ব্যাবহার করা হয়েছে রোগিকে বড় কোন হাসপাতালে পাঠানোর কাজে। দশহাজার শিক্ষার্থী সহ মোট সতেরহাজার জনসংখ্যার তুলনায় সংখ্যাটা অবশ্য নেহায়েত খারাপ না।
আর সেখানে তার অফিসের প্রথম দিনই অ্যাম্বুলেন্সটা জায়গা মত নেই। তবে কি বড় কোন অ্যাক্সিডেন্টের পেশেন্টকে নিয়ে অন্য কোন হাসপাতালে গেছে সেটা?
সে নতুন ‘রিজার্ভ ফর ডা. ক্রিড’ লেখা স্পটে নিজের গাড়িটা পার্ক করে দ্রুত অফিসের দিকে গেল।
চার্লটনকে সামনে পেয়ে গেল সে। চার্লটন ধূসর চুলের পঞ্চাশোর্ধ ছোটখাট এক মহিলা। একটা জিন্স আর টপ পরা মেয়ের গায়ের তাপমাত্রা মাপছে। মেয়েটার গায়ের তাজা সানবার্ন লুইসের চোখ এড়ালো না।
“গুড মর্নিং, জোয়ান,” লুইস বলে। “অ্যাম্বুলেন্সটা কোথায়?”
“আহা কী ঝামেলা, দেখুন তো,” চার্লটন তরুণীর মুখ থেকে থার্মোমিটার বের করে রিডিং দেখতে দেখতে বলল। “স্টিভ মাস্টারটন আজ সকালে এসে দেখে অ্যাম্বুলেন্সটা নষ্ট। সেটা ঠিক করতে পাঠানো হয়েছে।”
“চমৎকার!” সার্কাস্টিকভাবে লুইস বললেও মনে মনে একটু খুশিই হয়। অন্তত কোন গুরুতর রোগিকে নিয়ে তো অ্যাম্বুলেন্সটাকে যেতে হয়নি। “আমরা অ্যাম্বুলেন্সটা ফিরে পাবো কখন?”
জোয়ান চার্লটন মৃদু হেসে বলে, “আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ঠিক করার লাইনের দৈঘ্য সম্পর্কে যদ্দুর জানি তাতে মনে হয় ১৫ ডিসেম্বরে ক্রিসমাস রিবনে মুড়ে গাড়িটা ফেরত দেবে ওরা।” এরপর রোগি তরুণীর দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমার হাফ ডিগ্রি জ্বর হয়েছে। দুটো অ্যাসপিরিন খাবে আর মদের বার এবং অন্ধকার গলি থেকে দূরে থাকবে।”
মেয়েটা লুইসের দিকে একটা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি দিয়ে বেড থেকে নেমে বাইরে চলে গেল।
“নতুন সেমিস্টারের প্রথম কাস্টমার,” চার্লটন থার্মোমিটারটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল।
“অবশ্য তা নিয়ে আপনাকে খুব একটা খুশি মনে হচ্ছে না।”
“এরা কে কেমন আমি সব বুঝি,” বলল সে। “এদের এক টাইপ হচ্ছে অ্যাথলেট। তারা ফাটা হাড়, ফোলা পা নিয়েও মাঠে খেলতে নামতে চায়, কারণ তা না করলে নাকি তাদের দল তাকে নিয়ে হতাশ হয়ে পড়বে, তাদের জায়গা হবে সাইড বেঞ্চে। তাদের সুপারম্যান হতে হবে, কিন্তু তাতে যে তাদের ভবিষ্যতের ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই। আর এক শ্রেণী আছে এই মেয়ের মত মিস হাফ ডিগ্রি জ্বর। তারা একেক জন ননীর পুতুল।” লুইসকে ইশারা করে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। লুইস সানবার্নওয়ালা মেয়েটিকে দেখতে পেল ছাত্রি হলের দিকে হেঁটে যাচ্ছে। মেয়েটি পরীক্ষার হল থেকে জ্বরের ছুঁতো দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল। সে এমনভাবে হাঁটছে যেন সে খুব দূর্বল, ঠিকঠাক হাঁটতেও পারছে না।
“বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য নিয়ে অতিসচেতন শিক্ষার্থী,” চার্লটন থার্মমিটারটা স্টেরালাইজারে রেখে বলল। “এই মেয়ে বছরে অন্তত দুই ডজন বার এখানে আসবে। তার প্রিলি পরীক্ষা যত ঘনিয়ে আসে এখানে তার হাজিরাও তত বেড়ে যায়। ফাইনাল পরীক্ষার আগে তার মনে হবে টাইফয়েড বা নিউমোনিয়া হয়েছে, না-হলে অন্তত ব্রংকাইটিস। সে চার-পাঁচটা পরীক্ষা কামাই দেবে, বেছে বেছে যেসব বিষয়ের শিক্ষক একটু গাধা টাইপের সেসব পরীক্ষা। সেসব পরীক্ষা পরবর্তীতে তুলনামুলক সহজ প্রশ্নে মেকাপ পরীক্ষার মাধ্যমে পুষিয়ে নেবে। আবার এরা যখন জানতে পারে ফাইনাল বা প্রিলিতে রচনামূলকের পরিবর্তে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা হবে, তাদের অসুস্থ হবার সম্ভাবনা আরো কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।”
“বাপরে। আপনি তো ওদের চামড়া খুলে মনের কথা সব জেনে নিয়েছেন,” লুইস একটু অবাক হয়ে বলল।
“এসব মাথায় রাখবেন না। আমিও রাখি না,” বলে লুইসকে একটা চোখ টিপে দিলো।
“স্টিভ কোথায়?”
“আপনার অফিসে। বিভিন্ন মেইলের রিপ্লাই দিচ্ছে আর অসংখ্য ফালতু ফাইলপত্র সামলানোর চেষ্টা করছে,” বলল সে।
তার রুমে গেল লুইস।
***
সেদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা সে মনে করতে চায় না বা সেটা সহ্য করতে পারে না। সেদিনের দুঃস্বপ্ন শুরু হয় যখন ভিক্টর পাস্কো নামের একটা মুমূর্ষ রোগিকে সকাল ১০টার দিকে ইনফার্মারিতে নিয়ে আসা হয়। এর আগে সব ঠিকঠাকই ছিল। লুইসের অফিসে পৌঁছানোর আধ ঘন্টা পর, ৯টার দিকে দুজন মেয়ে নার্স এসে উপস্থিত হয়। লুইস প্রথমে তাদের প্রত্যেককে ডোনাট আর কফি অফার করে। এরপরের পনেরো মিনিট ধরে মেয়ে দুটিকে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়। তাদের ম্যানেজ করার দায়িত্বটা বুঝে নেন চার্লটন। চার্লটন যখন মেয়েদুটোকে লুইসের রুম থেকে নিয়ে যাচ্ছিল তখন লুইস শুনলো সে তাদের বলছে, “তোমাদের কারো মানুষের বমি বা গুয়ে অ্যালার্জি আছে? এখানে এগুলো প্রচুর দেখবে কিন্তু।”
ওহ্ ঈশ্বর!” লুইস নিজের চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল। তবে সে মিটিমিটি হাসছে। সে জানে, চার্লটনের মত একজন দজ্জাল মহিলার প্রয়োজন আছে এখানে।
লুইস একটা নীল ফর্ম পূরন করতে শুরু করে। খুবই বিরক্তিকর কাজ যখন ভাবছে যে এই ফালতু কাজটা করতে হলে অন্তত তার আগে তাকে এক কাপ কফি গেলা লাগবে, তখনই সে ওয়েটিং রুম থেকে চিৎকার শুনতে পায়। “লুইস! এদিকে আসুন। এখানে খুবই খারাপ অবস্থা!”
মাস্টারটনের গলায় স্পষ্ট আতঙ্ক। সে সেই আতঙ্কের পরিপ্রেক্ষিতে তার চেয়ার থেকে উঠে সেদিকে এমনভাবে ছুটে যায় যেন সে এতক্ষণ এরকম একটা চিৎকারের জন্যেই অপেক্ষা করছিল।
মাস্টারটনের চিৎকারের উৎপত্তিস্থল থেকে আরেকটি আর্তচিৎকার শোনা গেল। এরপরই একটা ঠাস করে চড়ের আওয়াজ এবং চার্লটনের রাগান্বিত গলা, “নিজেকে ঠিক কর, না হলে এখান থেকে এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও।”
লুইস ছুটে ওয়েটিং রুমে ঢুকে। আর ঢুকে প্রথমেই যা দেখতে পেল তা হচ্ছে রক্ত। রক্তে মেঝে ভেসে যাচ্ছে। একটা নার্স মেয়ে কাঁদছে আর আরেকজন প্রবল আতঙ্কে নিজের মুখ চেপে ধরে আছে। মাস্টারটন হাঁটু গেড়ে বসে মুমুর্ষ ছেলেটার মাথা ধরে আছেন। ছেলেটা মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে নিথর হয়ে পড়ে আছে।
স্টিভ লুইসের দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে চাইছে, কিন্তু তার মুখ দিয়ে কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না।
লোকজন মেডিকেল সেন্টারের কাচের দরজার সামনে ভিড় জমাচ্ছে।
কাচে আলোর রিফ্লেকশন থেকে বাঁচার জন্যে কেউ কেউ নিজেদের হাত দুটোকে কাপের মত গোল করে কাচের ওপর রেখে তার ভেতর দিয়ে তাকাচ্ছে। মুমুর্ষ ছেলেটাকে দেখা তাদের চাই-ই চাই। ব্যাপারটা দেখে লুইসের অবচেতন মন লুইসের ছোটবেলার সাদৃশ্যপূর্ণ একটা ঘটনা স্মৃতির পাতা থেকে খুঁজে বের করে আনে। তার বয়স তখন ছয়। তার মা কাজে বের হবার একটু আগের ঘটনা। সে টিভিতে টুডে শো নামে একটা প্রোগ্রাম দেখছিল। প্রোগ্রামটা হচ্ছিল একটা স্টুডিওতে যেটার এক পাশের দেয়াল কাচের। কাচের ওদিকে উৎসুক জনতার ভিড়। তারা স্টুডিওর ভেতরের অতি পরিচিত মুখগুলো দেখার জন্যে আগ্রহী।
লুইস খেয়াল করলো উৎসুক জনতা মেডিকেল সেন্টারের জানালা দিয়েও উঁকি ঝুঁকি মারতে শুরু করেছে। দরজাটার ব্যাপারে কিছু না করা গেলেও-
“জানালার পর্দাগুলো টেনে দাও,” লুইস চিৎকার করা নার্স মেয়েটিকে ধমকের সুরে বলে।
মেয়েটা তাও নড়ে না। চার্লটন আবারো মেয়েটার গালে চড় মারলে তার সম্বিত ফিরে আসে। “যা বলছে করো, মেয়ে!”
মেয়েটা ঝাঁকি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জানালার সবুজ পর্দাটা টেনে দেয়। আর চার্লটন এবং মাস্টারটন দরজা থেকে ছেলেটাকে যতটুকু সম্ভব আড়াল করে বসা যায়, সেভাবে বসে।
“স্ট্রেচার আনবো, ডাক্তার?” চার্লটন জিজ্ঞেস করলেন।
“লাগলে নিয়ে আসুন,” লুইস মাস্টারটনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে বলল।
“আমি এখনো পেশেন্টকে দেখার সুযোগই পেলাম না।”
“যাও, নিয়ে এসো,” যে মেয়েটা পর্দা লাগিয়েছে চার্লটন সেই মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বললেন। মেয়েটি আবারো আতঙ্কে তার দুহাত দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরেছে। সে চার্লটনের দিকে তাকায় এবং তার মুখ দিয়ে অস্ফুটে কিছু শব্দ বেরিয়ে আসে, “ওহ, ইয়ে…”
“ওহ! ইয়ে! যাও এক্ষুনি নিয়ে এসো,” চার্লটন এতো কিছুর মধ্যেও মেয়েটিকে ভেঙ্গাতে ছাড়লেন না। এরপর তিনি মেয়েটাকে হালকা চাপড় দিয়ে স্ট্রেচার আনতে পাঠালেন।
লুইস বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে তার প্রথম কাস্টমারের ওপর ঝুঁকে পড়লো।
ছেলেটা যুবক, বয়স বিশের মত হবে। ছেলেটাকে ডায়াগনোসিস করতে তার তিন সেকেন্ড সময় লাগলো। এই সময়ে করা তার একমাত্র ডায়াগনোসিস হচ্ছে ছেলেটার বাঁচার কোন আশা নেই। মাথার অর্ধেক থেতলে গেছে, ঘাড় ভেঙে গেছে আর ডান কাঁধের কলার বোন বেরিয়ে এসেছে। তার মাথা থেকে রক্ত আর হলদে পুঁজের মিশ্রণের মত একটা তরল পদার্থ মেঝের কার্পেটে গড়িয়ে পড়ছে। লুইস ছেলেটার ভাঙা খুলির ফাঁকা দিয়ে ধূসর মস্তিস্ক দেখতে পাচ্ছে। ব্যাপারটা অনেকটা ভাঙা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে দেখার মত। তার মস্তিস্কে তখনো পালস হচ্ছিল। তার মাথায় প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটারের মত একটা ফোকরের সৃষ্টি হয়েছে। ছেলেটার মাথার ভেতর কোন বাচ্চা থাকলে হয়তো সে ওই ফোকর দিয়ে সেটা প্রসবও করতে পারবে, পুরাণের দেবতা জিউস যেভাবে তার কপাল থেকে বাচ্চা প্রসব করে সেভাবে। সে যে এখনো বেঁচে আছে সেটাই আশ্চর্যের বিষয়। লুইস তার মাথার ভেতর জাড ক্র্যান্ডালের কথা শুনতে পায়। তিনি বলছেন, ‘ইচ্ছে হলে পাছায় কষে লাথি মারতো’ আর তার মায়ের কন্ঠ, ‘যে মরে গেছে সে তো চিরতরে চলেই গেছে।” হঠাৎ তার পাগলের মত হেসে উঠতে ইচ্ছে হলো।
“অ্যাম্বুলেন্স স্টার্ট করতে বলো,” সে উদ্বিগ্ন কন্ঠে মাস্টারটনকে বলে। “আমাদের এক্ষুনি ওকে—”
“লুইস, অ্যাম্বুলেন্স তো -”
“ওহ, ঈশ্বর!” লুইস হতাশায় নিজের কপালে হাত রেখে বলে। এরপর সে চার্লটনের দিকে ফিরে বলে, “জোয়ান, এরকম পরিস্থিতিতে আপনারা কী করেন? ক্যাম্পাস সিকিউরিটিতে খবর দেন নাকি ইএমএমসি’তে?”
জোয়ানের মুখে হতাশার ছাপ। তাকে এরকম আপসেট হতে আগে কখনোই দেখেনি লুইস। তবে তিনি বেশ দৃঢ় গলায় জবাব দিলেন, “জানি না ডাক্তার। এরকম পরিস্থিতিতে জীবনেও আমাকে পড়তে হয়নি।”
লুইস খুব দ্রুত চিন্তা করে। “ক্যাম্পাস পুলিশে খবর দিন। ইএমএমসির অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে বসে থাকা ঠিক হবে না। পুলিশের গাড়িতে অন্তত সাইরেন আছে। জোয়ান, আপনি ব্যবস্থা করুন গিয়ে।”
জোয়ান উঠে চলে গেলেন। কিন্তু তার চলে যাওয়ার আগেই লুইস জোয়ানের চোখের সহমর্মিতার দৃষ্টিটা দেখতে পায়। এই পেশিবহুল, রোদে পোড়া চামড়ার ছেলেটির হয়তো গ্রীষ্মে রাস্তার কন্সট্রাকশনের কাজ বা বাড়ি রং এর কাজ অথবা কাউকে টেনিস শিখিয়ে এমনটা হয়েছে। কিন্তু ছেলেটার এখন যে অবস্থা তাতে তারা যত চেষ্টাই করুক না কেন বা বাইরে রাস্তায় যদি তাদের অ্যাম্বুলেন্সটা ঠিকও থাকতো তাহলেও তার বাঁচার কোন আশা ছিল না।
কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে মৃতপ্রায় ছেলেটা নড়ে চড়ে ওঠে। তার চোখের পাতা কেঁপে উঠে খুলে যায়। তার চোখে নীল মনির চারদিকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। ছেলেটার চোখ দুটো শূন্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে, তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সে কিছু দেখতে পারছে না। ছেলেটা তার মাথা নাড়তে চাইলে লুইস মাথাটা চেপে ধরে, কারণ ছেলেটার ঘাড় ভেঙে গেছে। তার মাথা থেতলে গেলেও ব্যথার অনুভূতি এখনো আছে।
ওর খুলির ফোকর…ওহ ঈশ্বর…
“ওর কী হয়েছিল?” লুইস স্টিভকে জিজ্ঞেস করে যদিও সে জানে পরিস্থিতি বিচারে প্রশ্নটা আহাম্মকের মত শোনাচ্ছে। উৎসুক জনতার প্রশ্নের মত। তবে ছেলেটার মাথার অবস্থা বলে দিচ্ছে, সে আসলে উৎসুক জনতার চাইতে বেশি কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না। “ওকে কি পুলিশের লোক নিয়ে এসেছে?”
“না কিছু শিক্ষার্থী চাদরে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছে। আসলে কী হয়েছিল কিছুই জানি না।”
কী হয়েছিল জানতে না পারলেও কি করতে হবে সেটা ঠিক করা লুইসের কর্তব্য। “বেরিয়ে গিয়ে ওদেরকে খুঁজে বের করুন। ওরা যেন কাছাকাছি থাকে তবে ওদের অন্যদিকে নিয়ে যান। আমি চাই না ওরা এই জিনিস আরও দেখুক, যথেষ্ট দেখেছে ওরা।”
মাস্টারটন যেন এখান থেকে সরতে পেরে একটু স্বস্তি পেল। সে দরজা খুলে বাইরে গেল এবং এরপর বাইরে থেকে তার বকবকানির শব্দ আসতে থাকে। লুইস পুলিশের সাইরেন শুনতে পায়। ক্যম্পাস সিকিউরিটি চলে এসেছে তাহলে। লুইস হাফ ছেড়ে বাঁচে।
মুমুর্ষ ছেলেটা গলা দিয়ে ঘর্ঘর্ শব্দ বেরুচ্ছে। সে কথা বলতে চাচ্ছে তবে কিছু অস্পষ্ট ধ্বনি ছাড়া কিছুই তার মুখ দিয়ে বেরুচ্ছে না।
লুইস তার দিকে ঝুঁকে বলে, “সব ঠিক হয়ে যাবে…সব ঠিক হয়ে যাবে।” যদিও লুইস জানত কিছুই ঠিক হয়ে যাবে না। হঠাৎ রাচেল আর এলির কথা মনে পরে গেলে লুইসের পেটটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে তার মুখে এক হাত চেপে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে চাওয়া একটা ঢেকুর আটকায়।
“ক্যা…” ছেলেটি বলল। “গ্যা…’
লুইস চারদিকে তাকিয়ে দেখে মৃতপ্রায় ছেলেটির সাথে এই মুহূর্তে সে ছাড়া আর কেউ নেই। সে শুনতে পায় চার্লটন নার্সদের চেঁচিয়ে বলছেন যে স্ট্রেচারটা দুই নাম্বার রুমে আছে। লুইস ভাবে, ওই নার্সেরা দুই নাম্বার রুমের চাইতে ঘোড়ার ডিম ভাল চিনবে, কারণ আজ ওই নার্সদেরও এখানে প্রথম দিন। তারা মেডিকেল জীবন খুব কঠিনভাবেভাবে শুরু করল। মেঝের কার্পেটে ছেলেটার থেতলানো মাথার চারদিকে একটা ভেজা, স্যাঁতসেঁতে বেগুনি বৃত্ত তৈরি হয়েছে। তবে ছেলেটার মাথার ছিদ্র দিয়ে তরলের প্রবাহ আপাতত বন্ধ হয়েছে।
“পেট সেমিটারিটা,” ছেলেটা কর্কশ গলায় বলে উঠলো…আর তার মুখে একটা রহস্যজনক হাসি ফুটে উঠেছে।
লুইস তার নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। ছেলেটার দিকে তাকিয়ে সে নিজেকে বোঝাল ছেলেটা আগের মতই অস্ফুট কিছু শব্দ করেছে কিন্তু তার নিজের অবচেতন মন সেটাকে তার চেনা কিছু মনে করে নিয়েছে। তবে তার এই ভাবনা যে ভুল, তা সে মুহূর্তখানিক পরেই বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়। আতঙ্কের একটা শিহরণ তার সারা শরীর বেয়ে ঢেউয়ের মত বয়ে যায়।
“কী বললে তুমি? “ লুইস বিড়বিড় করে।
এবার কথা বলতে শেখা টিয়া পাখির মত পরিস্কার গলায় ছেলেটা বলে, “ওটা আসল কবরস্থান না।” তার রক্ত জমাট বাধা চোখে রাজ্যের শূন্যতা আর মুখটা মরা কার্প মাছের মত হা হয়ে আছে।
লুইসের শরীরে আবারো কাঁটা দিয়ে ওঠে। আতঙ্কে তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তার ইচ্ছে হয় মেঝেতে পড়ে থাকা মাথা থেতলানো লাশটাকে ফেলে দৌড়ে পালাতে। তার ধর্ম কর্ম নিয়ে তেমন কোন জ্ঞান নেই। কোন কুসংস্কারেও সে বিশ্বাস করে না। সে এরকম একটা ঘটনার জন্যে একদমই প্রস্তুত ছিল না।
দৌড়ে পালানোর প্রবল ইচ্ছা দমন করে সে ছেলেটার দিকে আরও ঝুঁকে আবারো জিজ্ঞেস করে, “কী বললে তুমি?”
মৃত মানুষটার মুখের বাঁকা হাসি…খুব ভয়ংকর ব্যাপারটা।
“মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে, লুইস।” মৃতপ্রায় লোকটা ফিসফিসিয়ে বলে। “মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়…আর সেটা সে যত্ন করে রাখে।”
লুইস নিজের নাম শোনার পর আর কিছুই মনোযোগ দিয়ে শোনে না। ওহ ঈশ্বর! ছেলেটা আমার নাম ধরে ডাকছে!
“কে তুমি?” লুইস কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে। “কে তুমি?”
“ইন্ডিয়ান, আমার মাছ নিয়ে এসো।”
“তুমি কিভাবে আমার নাম-‘
“দূরে থেকো, আমাদের। জানো -”
“তুমি-”
“ক্যা,” যুবক বলে আর লুইস যেন মৃত্যু, বেদনা আর হারানো ছন্দের মিশ্র গন্ধ পেল তার নিশ্বাস।
“কি?” লুইসের তাকে ঝাঁকি দিয়ে জিজ্ঞেস করার জিদ চেপে বলে।
“গ্যা আ আ আ -”
লাল জিম শর্টস পড়া ছেলেটার সারা শরীর কাঁপতে শুরু করে। এরপর হঠাৎ তার শরীরের সবগুলো পেশী শক্ত হয়ে একদম নিথর হয়ে যায়। তার চোখগুলোর শূন্যতা এক মুহূর্তের জন্যে লোপ পায় আর সে লুইসের চোখের দিকে তাকায়। কিন্তু এর পরমুহূর্তেই যেন একসঙ্গে সব হারিয়ে গেল। সেখানে একটা কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। লুইস ভাবে, ছেলেটা অবশ্যই আবার কথা বলে উঠবে। এরপর ছেলেটির চোখগুলোতে আবারো শূন্যতা ফিরে আসে…আর চকচক করতে থাকে। ছেলেটা মরে গেছে।
লুইস পিছিয়ে বসে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে চপচপ করছে। সে চোখে অন্ধকার দেখতে থাকে আর তার চারপাশের দুনিয়া দুলতে শুরু করে। কি হচ্ছে বুঝতে পেরে সে নিজের বাম হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনির নখ দিয়ে দাঁতের মাড়ি এমন জোড়ে চেপে ধরে যে রক্ত বেরিয়ে আসে।
কয়েক মুহূর্ত পর তার দুনিয়া আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে।
অধ্যায় ১৩
একটু পরেই রুমটা লোকজনে ভরে যায়, যেন তারা সকলেই মঞ্চ নাটকের অভিনেতা, পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসার সংকেতের জন্যে অপেক্ষা করছিল। ব্যাপারটা লুইসের অবাস্তববোধ আরও বাড়িয়ে দেয়-সবকিছু এরকম অবাস্তব লাগাটা সে তার সাইকোলজি কোর্সে পড়েছে, তবে আগে কখনো বাস্তবে অনুভব করেনি। ব্যাপারটা ওকে একদম ভড়কে দেয়। সে ভাবলো, কেউ এলএসডি ড্রাগ নিলে হয়তো এমনি অনুভব করে।
ঠিক যেন শুধুমাত্র আমার উদ্দেশ্যে করা একটি নাটক। প্রথমে সবাই রুম ছেড়ে আমাকে মৃতপ্রায় ভবিষ্যত বক্তার কাছে একদম একা রেখে গেল, যাতে করে সে আমাকে কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে, আর যখনি তার দম ফুরালো, হুট করে সবাই ফিরে এল।
নার্স দুজন হার্ড স্ট্রেচারের দুপাশে ধরে ছুটতে ছুটতে এলো। এই স্ট্রেচারটা তারা মেরুদন্ডে বা ঘাড়ে আঘাত পাওয়া রোগিদের জন্যে ব্যবহার করে। তাদের পেছন পেছন আসতে আসতে জোয়ান চার্লটন বললেন পুলিশ আসছে। ছেলেটা জগিং করতে গিয়ে গাড়ির সাথে ধাক্কা খেয়েছে। লুইসের ওইসব জগারদের কথা মনে পড়ে গেল যারা সকালেই তার গাড়ির সামনে দৌড়ে এসে পড়েছিল। কথাটা মনে পড়ে তার পেটে মোচড় দিয়ে ওঠে।
চার্লটনের পেছন পেছন ঢুকে মাস্টার্টন, তার সাথে দুজন পুলিশ। “লুইস যারা পাস্কোকে এখানে নিয়ে এসেছে তারা…” সে থেমে ধারালো গলায় জিজ্ঞেস করলো, “লুইস, তুমি ঠিক আছ?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছি,” বলে সে উঠে দাঁড়ালো। তার মাথা আবারো চক্কর দিয়ে উঠলে সে চারদিক হাতড়ায়, তবে পরমুহূর্তেই ভাল লাগতে থাকে। “ওর নাম তাহলে পাস্কো?”
ক্যাম্পাস পুলিশদের একজন বলল, “ওর সাথে জগিং করছিল একটি মেয়ে, সে বলল ওর নাম ভিক্টর পাস্কো।”
লুইস তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দুই মিনিট বিয়োগ করলো। যে রুমটায় পাস্কোকে বয়ে আনা ছেলে-মেয়েগুলোকে মাস্টার্টন রেখে এসেছিল, সেখান থেকে একটি মেয়ের বুকফাটা কান্না ভেসে আসছে। ভার্সিটিতে ফিরে আসায় স্বাগতম তোমাকে, সে মনে মনে বলে। নতুন সেমিস্টারের জন্যে শুভকামনা রইলো। “মিস্টার পাস্কো দশটা নয়ে মারা গেছেন,” লুইস বলল।
পুলিশদের মধ্যে একজন হাতের পেছনে মুখ মুছলো।
মাস্টার্টন আবারো জিজ্ঞেস করলো, “তুমি আসলেই ঠিক আছো লুইস? তোমাকে অসুস্থ লাগছে।”
লুইস জবাব দিতে কেবল মুখ খুলেছে, তখন হঠাৎ নার্সদের মধ্যে একজন হাতের স্ট্রেচার ফেলে দৌড়ে বের হয়ে কোলের কাপড়ের ওপর বমি করতে শুরু করে। একটা ফোন কর্কশভাবে বাজতে শুরু করলো। কাঁদতে থাকা মেয়েটি এবার চিৎকার করে বিলাপের সুরে মৃত ছেলেটির নাম বারবার আওড়াতে লাগলো, ভিক! ভিক! ভিক!” সব মিলিয়ে যেন একটা পাগলা গারদ। বিশৃঙ্খলার চুড়ান্ত। পুলিশদের একজন একটা চাদর চাইলো ছেলেটিকে ঢেকে দেয়ার জন্যে। চার্লটন বললেন তিনি জানেন না তার সেটা দেয়ার এখতিয়ার আছে কি না। আর লুইস মরিস সেন্ডাকের একটা লাইন ভাবতে লাগলো, তাহলে কেওস শুরু হয়ে যাক!
আবারো কুৎসিত হাসিটা তার গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইলে সে অনেক কষ্টে নিজেকে থামায়। এই পাস্কো ছেলেটা কি আসলেই পেট সেমেটারির কথা বলল? সে কি আসলেই তার নাম বলেছে?
ভাবনাগুলো তার মাথায় জট পাকিয়ে দিচ্ছে। তবে তার মস্তিষ্ক এখনই তাকে অদ্ভুত ব্যাপারটার অস্বাভাবিকতা থেকে রক্ষা করতে চাইছে। সে যা শুনেছে অবশ্যই তা তার শোনার ভুল। ছেলেটা অন্য কিছু বলেছে (আদৌ যদি কিছু বলে থাকে), তবে তার বিক্ষিপ্ত মন সেগুলোকে ভুল ব্যাখ্যা করেছে। আসলেই হয়তো পাস্কো কিছু অবোধ্য শব্দ উচ্চারণ করেছে, সে প্রথমে যেমনটা ভেবেছিল।
লুইস নিজেকে ফিরে পেতে চেষ্টা করে। সেই লুইসকে, যাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তেপ্পান্নজন আবেদনকারীর মধ্যে থেকে বেছে নিয়েছে। এখানে সব গোলমাল পাকিয়ে গেছে, কিন্তু নেতৃত্ব দেয়ার মত কেউ নেই।
“স্টিভ, ওই মেয়েটাকে একটা ট্রাঙ্কুলাইজার ইঞ্জেকশন দাও,” সে বলল এবং বলা মাত্রই তার ভাল লাগতে শুরু করে। তার মনে হয় সে কোন রকেটে করে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং অল্পের জন্য একটা গ্রহাণুর সাথে সংঘর্ষ এড়ানো গেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে গ্রহাণুটা হচ্ছে পাস্কোর কথা বলে ওঠা। লুইসের কাজ এখানের দায়িত্ব নেয়া, আর সে তাই করবে।
“জোয়ান, পুলিশের লোকটিকে একটা চাদরের ব্যবস্থা করে দিন”
“ডক্টর, চাদরগুলো আমরা এখনো ইনভেন্টরিতে -”
“তবুও দিন। তারপর ওই নার্সকে দেখুন।” সে অপর নার্স মেয়েটির দিকে তাকায়। মেয়েটি সম্মোহিতের ন্যায় পাস্কোর লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। “নার্স!” লুইস কর্কশ গলায় বলে এবং তাতে মেয়েটি নজর ঝাটকা মেরে সরে গেল।
“হুম… কি?”
“ওই মেয়েটির নাম কী?”
“কোন মেয়ে?”
“যে বমি করলো,” লুইস আরো কর্কশভাবে বলে। “জু-জু-জুডি। জুডি লেসিও।”
“আর তোমার নাম?”
“কার্লা।” এবার মেয়েটিকে কিছুটা স্বাভাবিক শোনায়।
“কার্লা, জুডির কী হয়েছে দেখো। আর চাদরটা নিয়ে এসো। এক্সামিনিং রুম ১-এর আলমারিতে অনেকগুলো চাদর আছে। সবাই যাও। প্লিজ সবাই পেশাদার ব্যবহার করুন।”
সবাই কাজে লেগে পড়ে। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাশের রুমের মেয়েটির কান্নার আওয়াজ থেমে গেল। রিং বন্ধ হয়ে যাওয়া ফোনটায় আবারো রিং হচ্ছে। লুইস রিসিভার না তুলেই হোল্ড বাটন চেপে দেয়।
বয়স্ক পুলিশটিকে লুইসের তুলনামূলক সুস্থির মনে হলো তাই লুইস তার সাথে কথা বলে। “কাকে কাকে ব্যপারটা জানাতে হবে? আমাকে একটি লিস্ট দিতে পারেন?”
পুলিশ লোকটি মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “এরকম ঘটনা গত ছয় বছরে একবারো দেখিনি। খুব বাজেভাবে সেমিস্টারটা শুরু হলো।”
“হুম,” লুইস বলে। সে ফোনটা তুলে নিয়ে হোল্ড বাটনটা উঠিয়ে দেয়। “হ্যালো, কে?” একটি উত্তেজিত কন্ঠ শোনা গেলে লুইস ফোনটা কেটে দেয়। সে তার ফোন কলগুলো করতে শুরু করলো।
অধ্যায় ১৪
লুইস এবং রিচার্ড ইরভিং, ক্যাম্পাস সিকিউরিটির প্রধান মিলে প্রেসের সামনে স্টেটমেন্ট দেয়ার পরে পরিস্থিতি শান্ত হতে হতে বিকেল ৪টা বেজে যায়। ভিক্টর পাস্কো নামের ছেলেটা তার দুই বন্ধুর সাথে জগিং করছিল, তাদের একজন তার হবু বউ। লেঞ্জিল ওমেন্স জিমনেসিয়াম থেকে ক্যাম্পাস সেন্টারের দিকে আসা একটি দ্রুতগতির প্রাইভেট কার তাকে আঘাত করে, ঠেলেঠুলে একটি গাছের সাথে ধাক্কা দেয়। গাড়িটি চালাচ্ছিলেন ট্রিমন্ট উইদারস। পাস্কোকে তার বন্ধুসহ আরো দুই পথচারি একটি চাদরে জড়িয়ে ইনফার্মারিতে নিয়ে আসে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই মারা যায় সে। উইদারস পুলিশের কাস্টডিতে আছে। তার বিরুদ্ধে মাতাল অবস্থায় গাড়ি চালানো, বেপরোয়া গাড়ি চালানো এবং গাড়ি দিয়ে মানুষ হত্যার অভিযোগ আনা হচ্ছে।
ক্যাম্পাস পত্রিকার সম্পাদক জিজ্ঞেস করলেন পাস্কো মাথার আঘাতেই মারা গিয়েছে কি না। লুইসের সেই ভাঙা জানালার কথা মনে পড়ে যায়, যেটা দিয়ে সে পাস্কোর মাথার ভেতরের ব্রেইন দেখতে পাচ্ছিল। তবে সে বলল, মৃত্যুর কারণটা সে ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারের জন্যেই ছেড়ে দিচ্ছে। সম্পাদক আবার জিজ্ঞেস করলেন যে, যেই চারজন মিলে তাকে চাদরে পেচিয়ে ইনফার্মারিতে নিয়ে এসেছিল, তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে পাস্কোর মৃত্যুর জন্য কোন অংশে দায়ি কি না।
“না,” লুইস জবাব দেয়। “একদমই না। দুঃখের বিষয় পাস্কোর আঘাতই তার মৃত্যুর জন্যে দায়ি।”
আরো কিছু প্রশ্ন হয়েছিল, তবে লুইসের এই উত্তরটাই বলতে গেলে প্রেস কনফারেন্সের ইতি টানে। স্টিভ মাস্টার্টন প্রেস কনফারেন্সের পরপরই বাড়ি চলে গিয়েছে-নিজেকে সন্ধ্যার খবরে দেখার জন্যে, লুইস ভাবে। সে এখন তার অফিসে বসে আছে, সারাদিনের কাজগুলো গোছানোর চেষ্টা করছে। অথবা স্বাভাবিক রুটিন অনুসরণ করে দিনের ঘটনাগুলি ভুলতে চাইছে কিছুটা। সে এবং চার্লটন মিলে ‘ফ্রন্ট ফাইল’-এর কার্ডগুলো দেখছে। কার্ডগুলো সেসব শিক্ষার্থীদের, যারা নানা রকম অসুখ-বিসুখ নিয়ে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন চালিয়ে যাচ্ছে। তেইশজনের ডায়াবেটিস, পনের জনের মৃগি, চৌদ্দজনের দুই পা পঙ্গু আরো আছে লিউকেমিয়ার রোগি, বিকলাঙ্গ, অন্ধ, দুজন বধির এবং একজন সিকেল-সেল এনেমিয়ার রোগি, যা সে আগে কখনো দেখেনি পর্যন্ত।
দুপুরের সবচাইতে বাজে ঘটনা বোধ হয় ঘটে স্টিভের চলে যাওয়ার পরপর। চার্লটন একটা পিঙ্ক মেমো লুইসের ডেস্কে রাখে যাতে লেখা, ব্যাঙ্গর কার্পেট কোম্পানির লোক আগামীকাল ৯টায় আসবে।
“কার্পেট?” সে জিজ্ঞেস করেছিল।
“আমাদের কার্পেটটা বদলাতেই হবে,” তিনি ক্ষমার সুরে বললেন। “যে দাগ লেগেছে সেটা কোন ভাবেই উঠবে না।”
অবশ্যই উঠবে না। লুইস গিয়ে ডিসপেন্সারি থেকে নিয়ে একটা টুইনাল ট্যাবলেট খেয়ে নিলো, যেটাকে ওর মেডিকেল কলেজের রুমমেট টুনাল বলতো। “টুনারভিল ট্রলিতে চেপে বস, লুইস।” সে বলতো, “তোর ভেতরে কিছু আত্মবিশ্বাস ঢুকিয়ে দেই।” লুইস বেশির ভাগ সময়ই রুপকথার টুনারভিলে বেড়াতে যাওয়ার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করতো। তার সেই রুমমেট টুনারভিল ট্রলিতে চেপে তার তৃতীয় সেমিস্টারে একদম ভিয়েতনাম চলে যায়, মেডিকেল কোরের সৈনিক হিসেবে। লুইস মাঝে মাঝে সেখানে তাকে কল্পনা করতো, গাজা খেয়ে চোখ লাল করে জঙ্গলে দৌড়াচ্ছে।
কিন্তু তার আজ সেই টুনারভিলের টিকিট একটা নিতেই হলো। কারণ সে বোর্ডে লাগানো সেই কার্পেটের পিঙ্ক স্লিপটির দিকে একদন্ডও তাকাতে পারছিল না।
হেড নার্স মিসেস বেইলিংস এসে যখন তাকে খোঁচা দিয়ে বললেন, “লুইস, আপনার ফোন, এক নাম্বার লাইনে,” তখন সে ঘোরের মধ্যে আছে।
লুইস তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৫:৩০ বাজে। আরো দেড় ঘন্টা আগেই তার এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা।
“ওকে, ন্যান্সি। থ্যাঙ্কস।”
ফোন তুলে এক নাম্বার লাইন টিপে দিলো সে। “হাই রাচেল। আমি একটু—”
“লুইস, তুমি ঠিক আছো?”
“হ্যাঁ, ঠিক আছি।”
“আমি খবরটা শুনেছি, লু। আই এম সরি।” সে কয়েক মুহূর্তের জন্যে থামলো। “রেডিওর খবরে শুনলাম। তোমার কথাও ছিল, প্রশ্নোত্তর পর্বটা। তুমি সব ভালো ভাবেই বলেছো।”
“তাই? ভালোই তাহলে।”
“সত্যি তুমি ঠিক আছো?”
“হ্যা রাচেল, আমি ঠিক আছি।”
“বাসায় এসো,” সে বলল।
“আসছি,” সে বলল। তার কাছে বাড়িতে যাওয়ার কথাটা খুব মধুর শোনালো।
অধ্যায় ১৫
বাসায় ঢুকে দরজায় রাচেলকে দেখে লুইসের মুখ হা হয়ে যায়। ও সেসব সেক্সি পোশাক পরে ছিল যেগুলো লুইস পছন্দ করে।
“তোমাকে খুব সুন্দর লাগছে বউ,” সে বলে। “বাচ্চারা কোথায়?”
“মিসি ডেন্ড্রিজ ওদের নিয়ে গেছেন। সাড়ে আটটা পর্যন্ত আমরা বাসায় একা…আমাদের হাতে সময় আছে আড়াই ঘন্টা। ভাবলাম সময়টা কাজে লাগাই।” স্বামী-স্ত্রী মিলে গোসলখানায় পরের সময়টুকুর ভালই সদ্ব্যবহার করে। তাদের স্বামী-স্ত্রীর ‘সময়ের উত্তম ব্যবহারের’ প্রথম রাউন্ডের পর রাচেল লুইসকে গরুর একটা স্পেশাল ডিস খেতে দেয়। লুইস পাস্কোর মাথার ভেতর থেকে উকি দেয়া ঘিলু দেখে ভেবেছিল আগামী হ্যালোইনের আগে তার আর ক্ষুধা লাগবে না। অথচ সে এক প্লেট খাবার শেষ করে আরেক প্লেট খেয়ে নিল।
খাওয়ার পর রাচেল লুইসের হাত ধরে দোতলায় বেড রুমে নিয়ে যায় দ্বিতীয় ইনিংসের জন্যে। “চলো দেখি তুমি আমার জন্যে আর কি কি করতে পারো।” রাচেল বলে।
পরবর্তীতে লুইস যখন বাচ্চাদের আনতে মিসি ডেন্ড্রিজের বাসায় যায়, তিনি দুর্ঘটনাটির ব্যাপারে জানতে চাইলেন। সে ঘটনাটা তাকে এতো সংক্ষেপে বলল যে তার চাইতে বেশি তথ্য তিনি পরদিনের পত্রিকাতেই পাবেন। ঘটনাটা নিয়ে কথা বলতে চাইছিল না সে। তবে বাচ্চাদের বেবিসিট করার জন্য মিসি কোন পয়সা নিতে রাজি হন না। সে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকেই যতটুকু না বললেই নয়, ঠিক ততটুকুই বলল। তার সাহায্যেই আজ রাচেলের সাথে একটা সুন্দর সময় কেটেছে।
গেজ ফেরার পথে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর এলিও ঘন ঘন হাই তুলতে থাকে, তার চোখ ঘুমে লাল হয়ে আছে। বাসায় ফিরে সে গেজকে ফ্রেশ ডায়াপার পরিয়ে ক্রিবে শুইয়ে দেয়। এর পর সে কিছুক্ষণ এলিকে বিছানায় গল্পের বই পড়ে শোনায়। এলি বরাবরের মত ‘হোয়্যার দ্য ওয়াইল্ড
থিঙ্গস আর’ পড়ে শোনাতে বায়না ধরে। তবে লুইস তাকে ‘দ্য ক্যাট ইন দ্য হ্যাট’ বইটা শুনতে রাজি করায়। কয়েক মিনিটের মাথায় এলি ঘুমে কাঁদা হয়ে গেলে রাচেল ওকে ঘুমের মাঝেই ঠিকঠাক করে শুইয়ে দেয়।
লুইস নিচতলায় নেমে দেখে রাচেল দুধের গ্লাস হাতে লিভিং রুমে বসে আছে। তার কোলে একটা ডরোথি সয়ারের রহস্য উপন্যাস।
“লুইস তুমি সত্যিই ঠিক আছো?”
“একদম ঠিক আছি বউ,” সে উত্তরে বলে। “সব কিছুর জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ।”
রাচেল মিষ্টি করে হাসে। “তুমি কি জাডের বাসায় আড্ডা দিতে যাবে?” সে মাথা নাড়ে। “আজ না। আমি আজকের মত ফুরিয়ে গেছি।”
“সেজন্যে কি আমি দায়ি?”
“ঠিক ধরেছো।”
“তাহলে এক গ্লাস দুধ খেয়ে শুতে চলো।”
লুইস ভেবেছিল সহজে তার ঘুম আসবে না, যেমনটা ইন্টার্নি লাইফে হতো। খুব কঠিন জীবন ছিল সেসময়। কিন্তু সে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সারাদিনের শ্রান্তি তাকে আরামদায়কভাবে জেঁকে ধরে। নরম বিছানায় তার শরীর যেন একদম মাখনের মত গলে গেল। সে কোথাও পড়েছে একজন মানুষের ঘুমাতে গড়ে সাত মিনিট সময় লাগে। এ সময়ের মধ্যেই মানুষের শরীরের সবগুলো সুইচ অফ হয়ে যায়। সাত মিনিট, এর মধ্যেই সচেতন আর
অবচেতন মন অদল-বদল হয়ে যায়।
অবচেতনে পৌঁছানোর খানিক আগে সে যেনো বহু দূর থেকে রাচেলের গলা শুনতে পেল… “পরশু?”
“হুমম?”
“পশু ডাক্তার চার্চকে পরশু নিয়ে যেতে বলেছে।”
“ওহ।” চার্চ, তোর ধন শেষ বারের মত উপভোগ করে নে। তার পরেই তার চেতনা তাকে ছেড়ে কোন গভীর গর্তে তলিয়ে যায়।
অধ্যায় ১৬
গভীর রাতে একটা জোরালো শব্দে লুইসের ঘুম ভেঙে যায়। শব্দটা এতো জোরালো ছিল যে লুইস বিছানায় ধড়মড়িয়ে বসে পড়ে। তার আশঙ্কা হয় এলি হয়তো খাট থেকে পড়ে গেছে। কিন্তু আকাশের মেঘ সরে গেলে চাঁদের আবছা আলোয় সে দেখতে পায় ভিক্টর পাস্কো তার রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আওয়াজটা ছিল পাস্কোর সজোরে দরজা খোলার শব্দ।
তার মাথার বাম দিকটা হা হয়ে আছে আর মুখে বেশ কয়েকটি জমাট বাধা রক্তের ধারা। কাঁধের হাড় বেরিয়ে আছে। তার মুখে হাসি।
“চলো ডাক্তার,” সে বলে। “আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে।”
লুইস চারদিকে তাকিয়ে দেখলো। তার স্ত্রী গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। এরপর সে আবার পাস্কোর দিকে তাকায়। ছেলেটা মরে গেছে কিন্তু, কিভাবে যেনো আবার মরেওনি। তা সত্ত্বেও লুইসের কোন ভয় লাগে না। ভয় না লাগার কারণটাও সে সাথে সাথে বুঝতে পারে।
এটা একটা স্বপ্ন, সে ভাবে। মৃতরা ফিরে আসে না, এটা ফিজিওলজিক্যালি অসম্ভব। এই ছেলেটার লাশ এখন ব্যাঙ্গরের ময়নাতদন্ত ড্রয়ারে সংরক্ষণ করা আছে ময়নাতদন্তের নকশা সহ-দেহের সামনের দিকে Y-এর মত একটা সেলাই। ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার হয়তো তার ব্রেনের টিস্যু স্যাম্পল রেখে ব্রেনটা তার চেস্ট ক্যাভিটিতে ঢুকিয়ে দিয়েছে আর মাথার ফাঁকা জায়গাটা কাগজ দিয়ে ভরে দিয়েছে। ব্রেনটা তার ভাঙা খুলিতে জায়গামতো বসানোর চাইতে এই কাজটা অনেক সহজ। তার কার্ল চাচা-হতভাগী রুখির বাবা তাকে বলেছিলেন যে ময়নাতদন্তকারী ডাক্তাররা এসব করে থাকে। এটা ছাড়াও আরও অনেক কথাই তাকে তার চাচা বলেছিল যেগুলো রাচেল শুনলে
আতঙ্কে ওর রাতের ঘুম হারাম হয়ে যেত। পাস্কো এখানে থাকতে পারে না-নো ওয়ে, বেবি। পাস্কোকে মর্গের ফ্রিজে বুড়ো আঙুলে ট্যাগ পড়িয়ে লক করে রাখা হয়েছে। আর ও কোনভাবেই সকালের সেই লাল জগিং হাফ প্যান্ট পড়ে নেই।
কিন্তু তবুও পাস্কোর কথা শোনার জন্যে সে এক রকমের প্রবল তাড়না অনুভব করছে। পাস্কোর চোখ তার দিকে।
সে তার গায়ের চাদর সরিয়ে মেঝেতে পা রেখে উঠে বসে। সে তার পায়ের তলায় পাপোশের রোয়াগুলোর খোঁচা অনুভব করতে পারছে। স্বপ্নটা বড়ই বাস্তব মনে হয় তার কাছে। এতটাই বাস্তব যে পাস্কো উল্টো দিকে ফিরে সিঁড়ি বেয়ে নামার আগ পর্যন্ত সে নড়ল না। সে পাস্কোকে অনুসরণ করার জন্যে তাড়না অনুভব করছে। তবে স্বপ্নের মধ্যেও সে চায় না কোন লাশ তাকে স্পর্শ করুক।
কিন্তু সে তার পিছু নেয়।
তারা একে একে লিভিং রুম, ডাইনিং রুম এবং কিচেন পার হয়। লুইস ভেবেছিল পাস্কো কিচেন থেকে গ্যারেজের দরজাটা লক ঘুরিয়ে, ছিটকিনি টেনে খুলবে। কিন্তু পাস্কো এরকম কিছুই করে না। সে স্বাভাবিকভাবে হেঁটে কাঠের দরজা ভেদ করে ওপাশে চলে যায়। এটা দেখে লুইস বিস্মিত হয়ে ভাবে, আচ্ছা! দরজা ভেদ করে যাওয়া এতো সোজা? এ তো যে কেউ পারবে!
সে নিজেও এভাবে বের হতে গিয়ে দরজার শক্ত কাঠে ধাক্কা খায়। লুইস বাস্তববাদী মানুষ, এমনকি তার স্বপ্নের মাঝেও। সে লক ঘুরিয়ে ছিটকিনি তুলেই দরজা খুলে গ্যারেজে ঢুকলো। কিন্তু পাস্কো সেখানে ছিল না। স্বপ্নের চরিত্রদের পরিণতি প্রায়ই এমন হয়, আর তাদের অবস্থানেরও। এক দৃশ্যে দেখা যাবে তুমি কোন সুন্দরি মেয়েকে আদর করছো, পরমুহূর্তেই দেখা যাবে বিল্ডিঙের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ছো। হয়তো স্বপ্নের দ্বিতীয় দৃশ্য শুরু হয়ে গেছে তাই সে পাস্কোকে দেখতে পাচ্ছে না আর।
তবে লুইস গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে চাঁদের আলোয় সেই জঙ্গলের পথের মুখে পাস্কোকে আবার দেখতে পেলো।
আতঙ্ক এবার লুইসের মনে ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। তার ওখানে যেতে ইচ্ছে করছে না। সে দাঁড়িয়ে থাকে।
পাস্কো ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়। চাঁদের আলোয় তার চোখ দুটো রুপালী মনে হচ্ছে। ওই চোখের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে উপায় নেই। হয়তো স্বপ্নটাই হচ্ছে সম্মোহনের স্বপ্ন…নিজের ইচ্ছে মত কিছু না করতে পারার স্বপ্ন, ঠিক যেমন আজ খুব চাইলেও সে পাস্কোকে বাঁচাতে পারেনি। বিশ বছর ডাক্তারি শিখেও তা কোন কাজে আসে না যখন মাথা ফাঁক হয়ে ঘিলু বের হয়ে যাওয়া কোন রোগিকে আনা হয়। এসব ক্ষেত্রে ডাক্তার যে কথা, নাপিত আর মুচিও একই কথা।
এসব ভাবতে ভাবতেই লুইস ওই পথ ধরে পাস্কোর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে।
তার স্বপ্নটা একদমই ভাল লাগছে না। স্বপ্নটা খুব বেশি বাস্তব। এটা কেমন স্বপ্ন, যেখানে ও পাপোশের রোয়ার খোঁচা অনুভব করতে পারে, কাঠের বন্ধ দরজা ভেদ করে বের হতে পারে না? এখন আবার সে তার পায়ে ঘাসের ঠান্ডা শিশির অনুভব করতে পারছে। তার গায়ে শর্টস ছাড়া কোন পোশাক নেই কিন্তু তাই বলে স্বপ্নের মধ্যেও তার ঠান্ডা লাগতে হবে? আর পাইন গাছের নিচে আসলে সে পায়ের তলায় মাটিতে ছড়িয়ে থাকা পাইনের সুচারু পাতার খোঁচাও অনুভব করতে থাকে। প্রয়োজনের চাইতে বড্ড বেশি বাস্তব স্বপ্নটা।
চিন্তার কিছু নেই। তুমি তোমার বেডরুমে শুয়ে আছো। যতই বাস্তব মনে হোক, এটা স্বপ্নই। কাল সকালেই এটাকে হাস্যকর মনে হবে। তখন তোমার জাগ্রত মন ঠিকই স্বপ্নের ফাঁকগুলো খুঁজে বের করতে পারবে।
বাহুতে একটা শুকনো ডালের সাথে বেশ ভালোভাবে খোঁচা খেয়ে লুইস চোখ মুখ কুচকে ফেলে। সামনে পাস্কোকে একটা চলমান ছায়ার মত লাগছে। আর তখন লুইসের মনে আতঙ্ক বেশ জোরালোভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। আমি একটা লাশের পেছন পেছন হাঁটছি আর সে আমাকে পেট সেমিটারির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এবং এটা বাস্তব, কোন স্বপ্ন না। ওহ ঈশ্বর, এটা বাস্তব।
তারা জঙ্গলঘেরা পাহাড়টায় পৌঁছে গেছে। এখানে এসে পথটা অলসভাবে সর্পিল বাঁক নিয়ে ঝোঁপঝাঁড়ের ভেতর গিয়ে পড়েছে। পায়ের নিচের থকথকে কাঁদামাটিতে তার পা আটকে যাচ্ছে। পা তুলতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে আর পা তোলার সময় বিশ্রী ফচফচ শব্দ হচ্ছে।
সে নিজেকে জোর করে বোঝায়, এটা একটা স্বপ্ন মাত্র।
তারা পেট সেমিটারির খোলা জায়গাটায় পৌঁছে গেছে। আকাশের মেঘ সরে গিয়ে চাঁদ দেখা দিয়েছে। চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় জায়গাটা ভেসে যাচ্ছে। এই আলোতেই পেট সেমিটারির আনাড়ি হাতের তৈরি ফলকগুলো পরিস্কার দেখা যাচ্ছে।
“আমাদের বিড়াল পাস্কো স্মাকি, প্রভুভক্ত ছিল সে’ লেখা ফলকটার কাছে থেমে ঘুরে লুইসের দিকে ফিরে দাঁড়ায়। লুইসের মনে আতঙ্ক আর ভয় পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে-তার মনে হয় আতঙ্ক বাড়তে বাড়তে তার হৃৎপিণ্ডটাই হয়তো চাপ না নিতে পেরে ফেটেই যাবে। পাস্কো তার রক্তাক্ত ঠোঁটে মুচকি মুচকি হাসছে। তার রোদে পোড়া তামাটে চামড়া চাঁদের রুপালি আলোয় কাফনে মোড়া ফ্যাকাসে লাশের মত মনে হচ্ছে।
পাস্কো তার এক হাত তুলে একদিকে ইশারা করে। লুইস সেদিকে তাকিয়ে গুঙিয়ে ওঠে। সে তার চোখ বড় বড় করে হাতের আঙ্গুলের গাঁট কামরে ধরে। লুইস বুঝতে পারে আতঙ্কে তার চোখ ভিজে গেছে।
জাড ক্র্যান্ডাল এলিকে অনেক পুরনো যে মরা গাছের ধ্বংসস্তূপের ব্যাপারে সাবধান করেছিল, সেগুলো অসংখ্য হাড়ের স্তূপে রুপান্তরিত হয়ে নড়াচড়া করছে। হাড়গুলো মোচড়ামুচড়ি করছে এবং নানান রকমের হাড়ে রুপান্তরিত হচ্ছে—মানুষের উরুর লম্বা হাড়, বুকের পাজর, আবার মানুষ এবং অন্যান্য পশুর হাসতে থাকা মাথার খুলি।
জিনিসটা কিলবিল করছে।
পাস্কো এবার তার দিকে হেঁটে আসতে শুরু করে। চাঁদের আলোতেও বোঝা যাচ্ছে তার রক্তাক্ত মুখ বেশ গম্ভীর হয়ে আছে। এবার লুইসের অবশিষ্ট সচেতন মন একটা কথাই ভাবতে থাকে, জেগে উঠো লুইস। প্রয়োজনে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে নিজেকে জাগাও। রাচেল, এলি, গেজ বা পুরো এলাকার মানুষ জেগে উঠুক তোমার চিৎকারে। জেগে-ওঠো-জেগে-ওঠো-জেগে-ওঠো- 607637-30511
কিন্তু তার গলা দিয়ে নির্গত বাতাসের ফিসফিসানি ছাড়া কিছুই বের হয় না। বাচ্চারা শিস্ দেয়া শিখতে গিয়ে যেরকম আনাড়ি শব্দ করে ঠিক তেমন একটা আওয়াজ বের হলো।
“এই দরজা খুললে খুব খারাপ হবে,” পাস্কো লুইসের দিকে তাকিয়ে বলল। লুইস হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে। লুইস পাস্কোর মুখের অভিপ্রায় দেখে প্রথমে সমবেদনা ভেবে ভুল করেছিল; তার চেহারায় আছে এক রকমের ভয়ঙ্কর দৃঢ়তা। সে এখনো হাত উঠিয়ে ধ্বংসস্তূপের দিকে পয়েন্ট করে আছে। “স্তুপটার ওপাশে কখনো যাবে না, তোমার যতোই ইচ্ছে হোক না কেন। এই দেয়াল তৈরি করা হয়েছে অতিক্রম না করার জন্যে। খুব ভাল করে শুনে রাখো ডাক্তার, ওখানে এমন অশুভ শক্তি আছে যা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। শক্তিটা অনেক পুরনো আর ক্ষতি করার জন্যে সর্বদা ক্ষুধার্ত।”
লুইস আবারো চিৎকার করতে চাইলো কিন্তু এবারো ওর গলা দিয়ে বাতাস ছাড়া কিছুই বের হয় না।
“আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে এসেছি,” পাস্কো বলে। “তোমার এবং তোমার ভালবাসার সবকিছুর সর্বনাশ খুবই কাছে, ডাক্তার।” সে লুইসের এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে যে লুইস তার গায়ে মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছে।
পাস্কো তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়।
হাড়ের মোচড়ামুচড়ির মৃদু কিন্তু ভয়ঙ্কর শব্দ শোনা যেতে থাকে।
লুইস পাস্কোর বাড়িয়ে দেয়া হাতটা থেকে চট করে দূরে সরতে চাইলে সে খানিকটা ভারসাম্য হারিয়ে শুন্যে হাতড়াতে থাকে। তার হাতের সাথে ধাক্কা লেগে সেমিটারির একটা স্মারক উল্টে মাটিতে পড়ে যায়।
পাস্কো তার মুখের কাছে মুখ নামিয়ে বলে, “ডাক্তার, মনে রেখো।”
লুইস চিৎকার করতে চেষ্টা করে আর তার সমগ্র পৃথিবী দুলে ওঠে—কিন্তু এখনো সে হাড়ের সাথে হাড়ের কিলবিল শব্দ শুনতে পায়।
অধ্যায় ১৭
একজন মানুষের ঘুমোতে গড়ে সাত মিনিট লাগে, তবে হ্যান্ডস হিউম্যান ফিজিওলজি অনুসারে, একই মানুষের ঘুম থেকে বের হতে পনের থেকে বিশ মিনিট লাগে। ব্যাপারটা এমন যে ঘুমকে যদি একটা জলাশয়ের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে সেই জলাশয়ে ডুব দিতে যত সময় লাগবে, ডুব থেকে ভেসে উঠতে আরো বেশি সময় লাগবে। ঘুম থেকে জেগে ওঠার সময় মানুষ ধাপে ধাপে জাগে, গভীর ঘুম থেকে হালকা ঘুমে। হালকা ঘুমের শেষ পর্যায়ে মানুষ শব্দ শোনে, এমনকি প্রশ্নেরও উত্তর দেয়, তবে পরে তা মনে থাকে না…মনে পড়লেও তা বিচ্ছিন্ন স্বপ্ন হিসেবে মনে পড়ে।
লুইস হাড়ের মটমট শব্দ শুনছিল, তবে সেই শব্দটা ক্রমশ জোরালো আর ধাতব শব্দে বদলে যেতে থাকে। একটা কিছু বাড়ি খাওয়ার শব্দ হলো, এরপর একটি চিৎকার, এবং আরও কিছু ধাতব শব্দ …কিছু কি গড়াচ্ছে? তাই তো, তার বিক্ষিপ্ত মন সায় দেয়। হাড়গুলো গড়াচ্ছে।
সে তার মেয়ের চিৎকার শোনে, “ধরো গেজ! ধরো!”
এরপরই সে গেজের আনন্দভরা চিৎকার শুনতে পায় এবং চোখ খুলে নিজের বেডরুমের সিলিং দেখতে পেলো।
লুইস নিজেকে স্থির রেখে বাস্তবতার সবটুকু নিজের মধ্যে স্বাগতম জানায়।
পুরোটাই একটা স্বপ্ন, যতই ভয়ঙ্কর হোক, যতই বাস্তব মনে হোক। তার মনের ভেতরের মনের গভীরে থাকা একটি ফসিল মাত্র।
ধাতব শব্দটা আবার শোনা গেল। গেজ তার খেলনা গাড়িগুলো নিয়ে খেলছে।
“গেজ! ধরো গেজ!”
“ধরো! ধরো!,” গেজ চেঁচিয়ে ওঠে। “ধরো! ধরো!-ধরো! ধরো!”
থপ-থপ-থপ। গেজের ছোট্ট পায়ের দৌড়ানোর আওয়াজ পাওয়া যায়। এলি আর গেজ খিলখিল করে হাসছে।
লুইস তার ডানে তাকিয়ে দেখলো বিছানার সেদিকটা খালি। বাইরে সূর্য ওঠেছে, নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা বেজে গেছে। রাচেল তাকে একটু বেশি ঘুমাতে দিয়েছে, হয়তো ইচ্ছা করেই।
অন্যদিন হলে লুইস একটু বিরক্ত হতো, তবে আজ হলো না। সে একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বাস্তব জগৎটাকে উপভোগ করতে থাকে।
রাচেল উচ্চস্বরে ডাকে, “এলি নেমে এসে টিফিন নাও, স্কুল বাস এসে গেছে।”
“আসছি!” এরপর এলির পায়ের তুলনামূলক জোরালো থপথপ শব্দ। “গেজ, তোমার গাড়ি নাও, আমাকে স্কুলে যেতে হবে।”
গেজ এরপর চিৎকার করে কিছু বলতে চেষ্টা করে। পরিস্কারভাবে যেসব শব্দ শোনা গেল সেগুলো হচ্ছে, “গেজ, গাড়ি, ধরো।” তবে সে কী বুঝাতে চাইছে তা একদম পরিস্কার, “এলি থাকুক। শিক্ষা ব্যবস্থা একদিনের জন্যে চুলোয় যাক।”
আবার রাচেলের গলা শোনা গেল, “নামার আগে বাবাকে ঝাঁকি দিয়ে এসো, এলি।”
এলি ওর চুলের বেণী দোলাতে দোলাতে রুমে ঢুকে।
“আমি জেগে আছি মা,” সে বলল। “গিয়ে বাস ধরো।”
“আচ্ছা বাবা।” এলি এগিয়ে এসে তার বাবার গালে চুমু খেয়ে সিঁড়ির দিকে ছুটলো।
বাস্তবতার রেশে স্বপ্নটা মিলিয়ে যেতে শুরু করে।
“গেজ!,” সে চিৎকার করে ডাকে। “আব্বুকে একটা চুমু দিয়ে যাও।” গেজ পাত্তা দেয় না। সে এলির পেছন পেছন নিচে নামছে আর গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, “ ধরো! ধরো ধরো ধরো!”
নিচ থেকে রাচেল বলল, “লুইস, তুমি উঠেছ?”
“হ্যাঁ,” সে উঠে বসে উত্তর দিলো।
“বললাম তো উঠেছে!” এলি বলে। “আমি গেলাম, বাই!” দরজা লাগার
শব্দের পরপরই গেজের রাগান্বিত চিৎকার শোনা গেল।
“ডিম কটা খাবে? একটা না দুটো?” রাচেল নিচ থেকে জিজ্ঞেস করে।
লুইস গায়ের কম্বল সরিয়ে মেঝেতে পাপোশের ওপর পা রাখে। রাচেলের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়েও নিজের পায়ের দিকে তাকালে তার কথাগুলো গলাতেই মরে যায়।
তার পা কাদা আর পাইন গাছের সূক্ষ্ম পাতায় মাখামাখি হয়ে আছে।
এক লাফে তার হৃৎপিন্ড গলার কাছে চলে আসে। হকচকিয়ে গিয়ে তার জিভে কামড় লেগে যায়। কম্বলটা বিছানা থেকে একদম সরিয়ে ফেলে সে চোখ বড় বড় করে দেখে, বিছানায় তার পায়ের জায়গাটাতে কাদা আর পাইন গাছের পাতা মাখামাখি হয়ে আছে।
“লুইস?”
সে তার হাঁটুতেও কিছু পাইনের পাতা লেগে থাকতে দেখে। সে হঠাৎ তার বাহুতে তাকিয়ে দেখে একটা সদ্য ছুঁলে যাওয়া ক্ষত, ঠিক যেখানে স্বপ্নের মধ্যে সে মরা ডালের খোঁচা খেয়েছিল।
আমি চিৎকার করব।
তার ভেতর থেকে একটি চিৎকার দলা পাকিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়। তার বাস্তবতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। আসল বাস্তবতা হচ্ছে তার পায়ে আর বিছানায় লেগে থাকা কাঁদা আর পাইন গাছের পাতা, তার বাহুতে ছুঁলে যাওয়া
আমি পাগল হয়ে যাব। প্রথমে আমি চিৎকার করব এরপর পাগল হয়ে নেংটো হয়ে ঘুরে বেড়াব। তাহলে এসব নিয়ে আমাকে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
“লুইস?” রাচেল এবার সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসছে। “তুমি আবার ঘুমিয়ে পড়লে না কি?”
সে নিজেকে ধাতস্ত করতে চেষ্টা করে, যেমনটা সে করেছিল পাস্কোকে চাদরে মুড়িয়ে তার ইনফার্মারিতে নিয়ে আসার পর। সে আবারো নিজের সাথে জয়ী হয়। সে চায় না রাচেল তাকে এভাবে দেখুক, পায়ে কাদা মাখা, বিছানায় কাদা মাখা, কম্বল মেঝেতে ফেলা।
“আমি জেগে আছি,” সে উৎসাহী কন্ঠে বলে। হঠাৎ কামড় লেগে তার জিভ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে।
“একটা ডিম না দুটো?” রাচেল সিঁড়ি বেয়ে ওঠা থামিয়ে দিয়েছে। ধন্যবাদ ঈশ্বর।
“দুটো,” সে জবাব দেয় কোন রকম চিন্তা না করেই। “স্ক্রাম্বলড।”
“বেশ,” রাচেল সিড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে।
স্বস্তিতে সে কিছুক্ষনের জন্যে চোখ বন্ধ করে ফেললে অন্ধকারে সে পাস্কোর রুপালী চোখ জোড়া দেখতে পায়। আর কিছু না ভেবে লুইস দ্রুত কাজে লেগে পড়ে। বিছানার চাদরটা একটানে তুলে ফেলে সে। কম্বলটা ঠিকই আছে। চাদরটা দলা পাকিয়ে ময়লা কাপড়ের ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলে। এরপর প্রায় ছুটে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দেয়। শাওয়ারের পানি এতই গরম যে তার মনে হয় চামড়া পুড়ে যাবে। পা থেকে খুব ভাল করে ময়লাগুলো ধুয়ে ফেলে সে।
কিছুটা শান্ত হয়ে গা মুছতে মুছতে ভাবে, খুনের আলামত লুকিয়ে ফেলার পর খুনিদের হয়তো এ রকমই লাগে। গা মুছতে মুছতেই হাসতে শুরু করে সে। তার হাসি যেন থামতেই চায় না।
“কী ব্যাপার?” রাচেল নিচ থেকে বলল। “এতো হাসি কিসের জন্যে?”
“একটা জোক মনে পড়ে গেছে,” লুইস ওপর থেকে বলল। তার ভয়ও লাগছে কিন্তু হাসিও বন্ধ করতে পারছে না। তার পেটের ভেতর থেকে দমকে দমকে হাসি বেরিয়ে আসছে। কাঁদামাখা চাদরটা ময়লার ঝুরিতে ফেলা সবচাইতে বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে, সে ভাবে। মিসি ডেন্ডিজ সপ্তাহে পাঁচ দিন এসে তাদের বাসা পরিস্কার করেন, নোংরা কাপড়-চোপড় ওয়াশিং মেশিনে ধুয়ে দেন। রাচেল এই চাদরটি আবার কখনো বিছানায় পাতার আগে আর দেখবেই না। যখন দেখবে তখন এটা হবে ঝকঝকে পরিস্কার একটা বিছানার চাদর। তবে মিসি হয়তো চাদরে কাদার ব্যাপারটা রাচেলকে বলতে পারে, আবার নাও পারে। কারণ সে হয়তো ভাববে রাচেল আর লুইস হয়তো কোন অদ্ভুত সেক্স গেম খেলেছে বিছানার ওপর। অনেকে সেক্স গেমে গায়ে রং ব্যবহার করে, মিসি ভাববে লুইসরা হয়তো রং এর বদলে কাদা মেখেছে।
এটা ভেবে লুইস আরো ভীষণভাবে হাসতে থাকে।
সে যখন জামা পড়তে থাকে তার হাসি বন্ধ হয়। তার ভালো লাগতে শুরু করে। সে ভাল করে তাকিয়ে দেখে রুমটা পুরোপুরি স্বাভাবিক লাগছে, শুধুমাত্র চাদরহীন খাটটি ছাড়া। সে বিষ সরিয়ে ফেলতে পেরেছে। হয়তো ‘প্রমাণ’ শব্দটা বেশি যৌক্তিক ছিল, তবে তার মনে এগুলোকে বিষই মনে হচ্ছে।
লোকজন হয়তো এভাবেই ব্যাখ্যাতীত ঘটনাগুলো হজম করে, লুইস ভাবে। যখন কেউ তার বাড়ির পেছনের আকাশে পরিস্কারভাবে ফ্লায়িং সসার দেখে, বা আকাশ থেকে পড়া মাছের বৃষ্টি দেখে অথবা রাতের আঁধারে কেউ খাটের নিচ থেকে পা টেনে ধরলে ঘটনাগুলোকে হয়তো এভাবেই হজম করতে
চেষ্টা করে। কেউ পাগলের মত হাসে, কেউ পাগলের মত কাঁদে। কিন্তু দেখা যায় যে এসব আতঙ্ক অনেক সময় হজমের অযোগ্য। তখন এই আতঙ্কগুলোকে গিলে ফেলা পয়সার মত পায়ুপথ দিয়ে আস্তই বের করে দিতে হয়।
গেজ তার বেবি চেয়ারে বসে কোকো বেয়ার খাচ্ছিল। খাওয়ার পাশাপাশি সে টেবিলটাও কোকো বেয়ার দিয়ে নকশা করছে। তাছাড়া একই জিনিস দিয়ে সে মাথায় শ্যাম্পু এবং মুখে ফেসিয়াল করতেও বেশ ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছে।
রাচেল কিচেন থেকে ডিম এবং কফি নিয়ে বেরিয়ে এলো। “অস্থির জোকসটা কী ছিল লুইস? তুমি তো ওপরতলায় পাগলের মত হাসছিলে। আমি তো ভয় পেয়ে গেছি।”
লুইস কী বলবে ভাবতে ভাবতেই সে গত সপ্তাহের একটা কাহিনি বলতে শুরু করে। লুইস গত সপ্তাহে টেইলরের দোকানে গিয়ে দেখতে পায় ইহুদি টেইলর লোকটি তার পোষা টিয়া পাখিটি নিয়ে এসেছে যেটা একটা কথাই বলতে পারে। “এরিয়াল শেরন গু খায়।”
সে বলা শেষ করতে করতে রাচেলও হাসিতে ভেঙে পড়ে, এমনকি গেজও।
যাক, আমাদের নায়ক তাহলে প্রমানগুলো ধামাচাপা দিতে পেরেছে। ময়লা বিছানার চাদর এবং বাথরুমের উন্মত্ত হাসি। আমাদের নায়ক এখন সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর জন্যে পত্রিকা পড়বে অন্তত পত্রিকা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকবে।
লুইস পত্রিকা খুলে চোখের সামনে মেলে ধরে।
সে স্বস্তি নিয়ে ভাবে, যাক ঘটনাটা আপাতত কবর দেয়া গেছে, এবং সেটা এভাবেই থাকবে। যদি কোনদিন কোন ক্যাম্প ফায়ারে সবাই তাদের জানা ব্যাখ্যাতীত ঘটনা বলতে শুরু করে, তাহলে হয়তো সে এটাকে তখন কবর খুড়ে বের করবে, তার আগে নয়।
সে তার নাস্তা খেয়ে রাচেল আর গেজকে চুমু খেয়ে বিদায় নেয়। সব ঠিকঠাক। বাইরে চমৎকার সকাল। গ্যারেজ থেকে গাড়ী বের করে রওনা হবার সময় সে মাঠের সেই পথটার দিকে তাকায়। ওখানেও সব ঠিক আছে। লুইস তুমি পাস করেছো।
শুরুতে সবকিছুই ঠিক ছিল। তবে প্রায় দশ মাইল ড্রাইভ করার পর তার গায়ে প্রচন্ড কাপুনি হতে থাকলে সে সিং’স চাইনিজ রেস্টুরেন্টের পার্কিং লটে গাড়ি থামাতে বাধ্য হয়। রেস্টুরেন্টটা থেকে ই.এম হাসপাতাল খুব একটা দূরে নয়, যেখানে পাস্কোর লাশ রাখা আছে। ঠিক, ই.এম হাসপাতালে, সিংস চাইনিজে না। ভিক্টর পাস্কো আর কখনই কোন চাইনিজ রেস্টুরেন্টে থাই সুপ খেতে যাবে না, হা-হা।
কাঁপতে কাঁপতে তার শরীর কোকড়াতে শুরু করে। লুইস একই সাথে হতাশ এবং আতঙ্কিত বোধ করে। কোন ভৌতিক জিনিসের ভয় দিনের আলোয় লাগে না। তার ভয় হয় তার মাথার তারগুলো ছিড়ে যাচ্ছে। বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যাচ্ছে সে।
“আর না,” সে বলে। “প্লিজ, আর না।”
সে হাতড়ে হাতড়ে রেডিওতে গান ছেড়ে দেয়। পছন্দের একটা গান পুরোটা শেষ করে তার মনে হয় সে আবারো ড্রাইভ করতে পারবে।
সে মেডিকেল সেন্টারে পৌঁছে চার্লটনকে হ্যালো বলেই বাথরুমে ঢুকে যায়। কারণ তার ধারণা তাকে উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে। কিন্তু আসলে তা নয়, শুধু তার চোখের ভেতর একটা শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। সে তার চোখমুখে পানি দিয়ে, মুখ মুছে, চুল আঁচড়ে অফিস রুমে যায়।
লুইস অফিস রুমে ঢুকে দেখলো সেখানে স্টিভ মাস্টারটন আর ভারতীয় ডাক্তার সুরেন্দ্র হারদু বসে কফি খাচ্ছে।
“সুপ্রভাত, লু,” স্টিভ বলে।
“সুপ্রভাত।”
“দোয়া কর যেন আজকের সুপ্রভাত গতকালকের মত কুপ্রভাত না হয়,” হারদু বলে।
“ঠিক। তুমি তো অনেক কিছু মিস করেছো।”
“সুরেন্দ্র নিজেও অনেক কিছুর মুখোমুখি হয়েছে গত রাতে,” মাস্টারটন বলল। “ওকে বলো, সুরেন্দ্র।”
হারদু মুচকি হাসতে হাসতে নিজের চশমাটা মুছতে থাকে। “কাল রাত ১টার দিকে দুটি ছেলে তাদের এক মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে আসে। মেয়েটি প্রচন্ড মাতাল হলেও তাকে বেশ খুশি খুশি লাগছিল। তার এক উরুতে বেশ ভালোভাবে কেটে গেছে। আমি তাকে বললাম যে অন্তত চারটা সেলাই লাগবে, ক্ষতচিহ্ন দীর্ঘস্থায়ী হবে না। সে বলল, ‘যত ইচ্ছা সেলাই মারুন।” আমি তাই সেলাই দিতে তার দিকে ঝুঁকে-
হারদু ঝুঁকে দেখালো। লুইস কী হতে যাচ্ছে তা আঁচ করতে পেরে মুখ টিপে হাসতে শুরু করে।
“আর আমি যেই সেলাই শুরু করলাম সে তার পেটের অমৃত জিনিসগুলো আমার মাথার ওপর উগরে দিলো।”
মাস্টারটন হাসিতে ভেঙে পরে, সাথে লুইসও। হারদু মুখ টিপে হাসে, যেনো সে এই জিনিস জীবনে বহুবার দেখেছে।
“সুরেন্দ্র, তুমি কখন থেকে ডিউটিতে আছো?” হাসি থামলে লুইস জিজ্ঞস করে।
“মাঝরাত থেকে। ভাবলাম তোমাদের হ্যালো বলে যাই।”
“আচ্ছা, হ্যালো,” লুইস তার হাত নেড়ে নেড়ে বলল। “এখন বাসায় গিয়ে ঘুম দাও।”
“ইয়েস, স্যার!” সুরেন্দ্র বিদায় নিয়ে চলে যায়।
সুরেন্দ্র চলে গেলে ওরা দুজন আবারো প্রচন্ড হাসিতে ফেটে পড়ে। লুইসের হাসতে এত ভালো খুব কমই লেগেছে। সবকিছু স্বাভাবিক মনে হতে থাকে তার।
“আজ থেকে ওষুধ কম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভরা আসা শুরু করবে।” স্টিভ বলল।
লুইস মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। বেলা দশটা থেকে তারা আসা শুরু করে। ওই রিপ্রেজেন্টেটিভরা প্রায়ই তাদের লাঞ্চের ব্যবস্থা করে।
“একটা কথা শুনে রাখো বস,” স্টিভ বলল। “আমি জানি না শিকাগোতে কেমন ছিল…তবে এখানকার রিপ্রেজেন্টেটিভরা খুবই দিল দরিয়া। তারা প্রায় সব রকম আবদারেই রাজি হয়ে যায়। ফ্রি এক্সপ্রেস হান্টিং ট্রিপ থেকে ফ্রি সমুদ্রপারের লাক্সারিয়াস হোটেলে ফ্যামিলি ট্যুর পর্যন্ত। এক লোক তো আমাকে একটা বাতাস দিয়ে ফোলানো যায় এমন সেক্স ডল দিতে চেয়েছিল। আমাকেই! যেখানে আমি সামান্য একজন পি.এ! তারা তাদের ওষুধ বিক্রীর জন্য হেন কিছু নাই যে করবে না।”
“ওই পুতুলটা নিলেই তো পারতে।”
“নাহ, পুতুলটা ছিল লালচুলো। লাল চুল ভালো লাগে না।”
যাই হোক, আমি সুরেন্দ্রর সাথে একমত। আজকের দিনটা কালকের মতো না হলেই হলো।
অধ্যায় ১৮
দমটা বেজে গেলেও যখন ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভ না আসে, লুইস একটু হতাশই হয়। সে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টার অফিসে ফোন দিয়ে পাস্কোর রেকর্ডগুলো তার কাছে পাঠিয়ে দিতে বলে। লুইস ফোন রাখতেই রিপ্রেজেন্টেটিভ হাজির হয়। সে তাকে কিছু দিতে চেষ্টা না করে বরং ডিসকাউন্টে ফুটবল ম্যাচের টিকিট কিনতে অফার করে।
“না,” লুইস বলে।
“আমিও তাই ভেবেছিলাম,” লোকটি হতাশা নিয়ে বলে সেখান থেকে চলে যায়।
দুপুরে লুইস বেয়ার’স ডেন রেস্টুরেন্ট থেকে একটা টুনা মাছের স্যান্ডউইচ কিনে নিয়ে আসে। অফিসে বসে পাস্কোর রেকর্ডে চোখ বুলাতে বুলাতে জিনিসটা পেটে চালান করে দেয় সে। তার ধারণা পাস্কোর সাথে তার নিজের অথবা পেট সেমিটেরিটার কোন সম্পর্ক আছে। সে ভাবছে তার সাথে যা ঘটেছে তার নিশ্চয়ই কোন ব্যাখ্যা আছে। হয়তো পাস্কো লাডলোতেই বড় হয়েছে আর হয়তো সে তার কোন পোষা কুকুর বা বিড়াল পেট সেমিটেরিতে কবর দিয়েছে। লুইস সচেতনভাবে ব্যাপারটা ধরতে না পারলেও তার অবচেতন মন হয়তো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তার সাথে এই বিশ্রী খেলা খেলছে।
কিন্তু লুইস এরকম কোন সম্পর্ক খুঁজে পায় না রেকর্ডে। পাস্কো বেড়ে উঠেছে বার্গেনফিল্ডে আর এখানে সে তড়িৎ কৌশলে পড়াশোনা করে। লুইস তার নিজের সাথে বা পেট সেমেটারির সাথে পাস্কোর কোন সম্পর্কের নাম গন্ধও খুঁজে পায় না।
সে তার খাওয়া শেষ করে মর্গে ফোন দেয়। নিজের পরিচয় দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনাদের ওখানে ভিক্টর পাস্কো নামে আমাদের এক ছাত্রের লাশ-”
“নেই,” ফোনের অপর পাশ থেকে উত্তর এলো।
লুইস হতবিহব্বল হয়ে পড়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য। পরে সে কোনমতে বলে, “কী?!?”
“গত রাতেই ওর লাশ বিমানে করে ওর বাবা-মার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আপনি কি ভেবেছেন? সে মেলা দেখতে গেছে?”
“না,” লুইস বলে। “অবশ্যই না। মানে…” মানে কী? কী সব আবোল তাবোল বলছে ভেবে নিজেকে কষে একটা ধমক দেয় লুইস। ঘটনাটাকে একদম কবর দিয়ে দিতে হবে। জিনিসটা নিয়ে ভেবে ভেবে মাথাটাই যাচ্ছে। “লাশ খুব দ্রুত নিয়ে গেল মনে হচ্ছে,” সে কিছু বলা দরকার তাই বলে।
“গতকাল দুপুরেই লাশের অটপ্সি শেষ। ততক্ষণে তার বাবা সব ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। আমার ধারণা রাত দুটোর আগেই লাশ নিউইয়র্ক পৌঁছে গেছে।”
“ওহ। তাহলে তো-”
“যদি না তাকে ভুল করে অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়ে থাকে,” ফোনের ওপাশের ক্লার্ক বলে। “এরকম হয়, বুঝলেন? এক লোক ফিশিং ট্রিপে জঙ্গলের অনেক ভেতরে গিয়ে মারা পড়েছিল। তার সাথের বন্ধুরা তাকে জঙ্গলের ভেতর থেকে বের করতে দুইদিন লাগিয়ে দেয়। ততক্ষনে লাশ ফুলে গিয়েছে। তারপরেও সবাই বিমানের ওপর ভরসা করে লাশ তার বাড়ি গ্রান্ড ফলসে পাঠাতে বিমানে তুলে দেয়। কিন্তু কোন এক গাধা প্যাঁচ লাগিয়ে ফেলে। লাশটা প্রথমে মায়ামি যায়, তারপর ডেস মইন্সে তারপর ফার্গোতে। যতক্ষণে কারো মাথায় গন্ডগোলটা বোঝার মত বুদ্ধি গজায় ততক্ষনে লাশ ফুলে পঁচে কালো হয়ে গিয়েছে। আর লাশের গন্ধ হয়েছিল পচা শূকরের রোস্টের মত, অন্তত সে রকমই শুনেছি। ছয়জন ব্যাগেজ বয় এই মারাত্বক গন্ধে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।”
এরপর ওপাশ থেকে হাসির শব্দ আসে।
লুইস তার চোখ বন্ধ করে এবং বলে, “আচ্ছা, আপনাকে ধন্যবাদ- ‘ “আপনি চাইলে ময়নাতদন্তকারী ডাক্তারের নাম্বার আপনাকে দিতে পারি।”
“না, লাগবে না।” লুইস বলে।
সে টেলিফোনটা রেখে দেয়। লুইস, তুমি স্বপ্ন দেখে থাকো আর যাই দেখে থাকো, পাস্কোর লাশ ততক্ষণে দেশের অন্য এক রাজ্যের কোন এক ফিউনারেল হোমে পড়ে ছিল। ঘটনাটা এখানেই কবর দাও।
বাড়িতে ফেরার সময় সে ঘটনাটা নিয়ে আরো চিন্তা করে এবং নিজের কাছে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য একটি বিশ্লেষণ দাঁড় করায়।
পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে এক রকমের স্লিপ ওয়াকিং। আর এটা ঘটার কারণ হলো তার চাকরি পুরোদমে শুরু হওয়ার প্রথম দিনেই তার হাতে একজন শিক্ষার্থী প্রচন্ড আঘাত নিয়ে আসে এবং তার জন্যে সে কিছুই করতে পারেনি।
এতে সব কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। স্বপ্নটা মাত্রাতিরিক্ত বাস্তব মনে হয়েছে, কারণ স্বপ্নটা আসলেই অনেকটুকু বাস্তব ছিল। এজন্যেই তার পাপোশের রোয়ায় পায়ের ছোঁয়া, পায়ে ঘাসের ঠান্ডা শিশিরের স্পর্শ, বাহুতে মড়া ডালের খোঁচা সবই বাস্তব লেগেছে। এজন্যেই পাস্কো দরজার মধ্যে দিয়ে যেতে পারলেও সে নিজে পারেনি।
সে একটা দৃশ্যের কল্পনা করে, মাঝরাতে বন্ধ দরজা দিয়ে বের হতে চাইছে সেটা রাচেল দেখলে কী ভাবতো? ভাবনাটা তার মুখে হাসি ফোটায়।
সে স্বপ্নে পাস্কোর সাথে পেট সেমিটারিতে যাওয়ার কারণটাও ভেবে ফেলল। সেখানে সে গিয়েছে কারণ সম্প্রতি পেট সেমিটারিকে নিয়ে তার আরেকটি বেদনাদায়ক স্মৃতি আছে। তার সাথে তার স্ত্রীর ঝগড়ার কারণ ছিল এই পেট সেমিটারি। সেখানে গিয়েই তার মেয়ের মৃত্যুর সাথে প্রথম পরিচয় হয়। তার অবচেতন মন ঘটনাটা ভোলেনি।
ভাগ্য ভালো যে আমি ঠিকঠাক ফিরতে পেরেছি। আমার তো ফেরার কথা কিছু মনেই নেই। মনে হয় অটোপাইলটে ফিরে এসেছি।
ভাগ্যটা নেহাত ভাল যে পেরেছিল। না হলে তার ঘুম ভাঙতো পেট সেমিটারিতে, স্মাক নামের বিড়ালটার কবরের পাশে, শিশিরে কাদায় মাখামাখি হয়ে। ভয়ে তার তো পাতলা পায়খানা শুরু হতোই, আর তার স্ত্রীর কী হতো সেটা বলাই বাহুল্য।
যাক, আপাতত বাঁচা গেছে। ঘটনাটা ভুলে যাও, লুইস, সে স্বস্তির সাথে ভাবে। হুম, তবে পাস্কো মারা যাওয়ার আগে আমাকে কী বলে গেল? তার মন খচখচ করে উঠে, কিন্তু লুইস সেটাকে চুপ করিয়ে দেয়।
***
সেদিন বিকেলে রাচেলকে হাঁটতে বের হবার কথা বলে সে পেট সেমিটারিতে হাজির হয়। সেখানে পৌঁছেই তার ডেজা ভ্যু’র অনুভূতি হয়। সে যে এখানে এসেছে, তাতে তার মনে আর কোন সন্দেহ থাকে না : ‘বিড়ালের নাম স্মাক’ লেখা স্মৃতিফলকটা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। লুইসের স্বপ্নে এই ফলকটিই তার হাতে লেগে উপড়ে পড়ে যায়। লুইস আনমনে ফলকটা ঠিক করে দিয়ে সেই মরা গাছগুলোর ধ্বংসস্তূপের কাছে যায়।
তার একদম ভাল লাগছে না। কাল রাতের মরা ফ্যাকাশে ডালগুলোর মোচড়ামুচড়ির কথা মনে পড়ে তার পেট হালকা একটা মোচড় দেয়। সে মনে জোর খাটিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা মরা ডাল স্পর্শ করতেই ডালটা হুড়মুড় করে ভূপাতিত হয়। ডালটা লুইসের পায়ের ওপর পড়ার আগেই সে লাফিয়ে সরে যায়।
সে ধ্বংসস্তূপটার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত হেঁটে যায়। এটার দুপাশের কোন দিক দিয়েই অপর পাশে যাওয়ার উপায় নেই। দুদিকেই বিষাক্ত পয়জন আইভির ঝোঁপ আর কাঁটা গাছে ভরা। কেউ এসব ডিঙ্গিয়ে ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করবে না, অন্তত যদি তার মাথায় ঘিলু বলে কিছু থাকে।
লুইস স্তূপটার মাঝামাঝি এসে দাঁড়ায়। পকেটে হাত ঢুকিয়ে সে জিনিসটা দেখতে থাকে।
তুমি ওটার ওপর চড়ে বসতে চাইছো না তো?
নো বস। ওই বালের ধ্বংসস্তূপের ওপর চড়ে কী হবে?
যাক, আমাকে তো চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলে লু। জিনিসটা ঠেং ভেঙে নিজের ইনফার্মারিতে ভর্তি হওয়ার জন্য বেশ ভাল ব্যবস্থা।
একদম ঠিক! তাছাড়া চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে।
নিজের সিদ্ধান্তের ব্যপারে সে যখন নিশ্চিত, তখন সে হঠাৎ করেই স্তুপটার গা বেয়ে উঠতে থাকে।
সে যখন প্রায় অর্ধেক উঠে গেছে তখন তার পায়ের নিচের ডালগুলো আলগা হয়ে বিপজ্জনকভাবে নড়তে আরম্ভ করে। সে থেমে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই যখন আবারো ডালগুলো নড়তে আরম্ভ করে, লুইস পড়িমরি করে কোন রকমে সেখান থেকে নেমে আসে।
কোন রকম দুর্ঘটনা ছাড়াই সে নিচে নেমে আসতে পারে। নেমে প্যান্টে হাত ঝেড়ে সে হাতে লেগে থাকা মরা ডালের ছাল বাকলের গুড়োগুলো ফেলে দেয়। এরপর সে হেঁটে পথটার মাথায় চলে আসে, যেটি তাকে পৌঁছে দিবে তার বাড়িতে, তার সন্তানদের কাছে, চার্চের কাছে, যেই চার্চ তার পৌরুষত্বের শেষ দিনটি কাটাচ্ছে।
সে ফিরে যাবার আগে জায়গাটা আরেকবার দেখে নেয়। হঠাৎ করেই ভূমির ওপরে কুয়াশার আবির্ভাব হয়েছে। কুয়াশার দল স্মারকগুলোর ওপরে ভেসে ভেসে পাঁক খাচ্ছে।
শুধু কি এই?
লুইস ধ্বংসস্তূপটায় উঠে এক মুহূর্তের জন্য ওপাশে তাকাতে পেরেছিল। সে শপথ করে বলতে পারে সে ওপাশে একটা পথ দেখেছে।
তাতে তোমার কী লুইস? নিজের কাজে যাও।
ওকে বস।
লুইস ঘুরে নিজের বাড়ির পথ ধরে।
সেদিন রাতে রাচেল বিছানায় যাওয়ার ঘন্টাখানেক পরেও সে জেগে থাকে। সে তার পূর্বে পড়া কিছু মেডিকেল জার্নালে চোখ বুলাতে থাকে। সে স্বীকার করতে না চাইলেও সে আসলে ঘুমোতে যেতে ভয় পাচ্ছে। তার আগে কখনো ঘুমের মধ্যে হাঁটার অভ্যাস ছিল না। আরেকবার না ঘটা পর্যন্ত বলা যাচ্ছে না এরকম আবারো হবে না।
সে রাচেলকে খাটে উঠতে শুনলো। রাচেল সেখান থেকে নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, “এই, তুমি আসছো?”
“এখনি আসছি,” সে টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বলে।
সেদিন রাতে তার মস্তিষ্ক যন্ত্রের কাজ বন্ধ করতে সাত মিনিটের চাইতে অনেক বেশি সময় লাগে। পাশে রাচেলের লম্বা নিশ্বাসের শব্দ শুনতে শুনতে তার কাছে গতরাতের ভিক্টর পাস্কোর চেহারাটা বেশি বাস্তব বলে মনে হতে থাকে। সে চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায় দরজাটা ধাম করে খুলে যাচ্ছে আর আমাদের স্পেশাল গেস্ট ভিক্টর পাস্কো দরজার ওপাশে জগিং শর্টস পরে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেহারা ফ্যাকাসে আর কাঁধের হাড় বেরিয়ে আছে।
সে ঘুমে তলিয়ে যেতে লাগলে তার মনে হতে থাকে পেট সেমিটারিতে জেগে উঠলে কেমন লাগবে। সেখানে জেগে উঠে চাঁদের আলোয় জায়গাটা কেমন রহস্যময় লাগবে এবং সেখান থেকে পথটা ধরে বাড়ি ফিরে আসতে কেমন লাগবে, এসব ভাবনা তাকে অগভীর ঘুম থেকে ঝাটকা মেরে টেনে তোলে।
অবশেষে মাঝরাতের দিকে চোরের মত, নিদ্রা তার দেহে প্রবেশ করে
এবং সে এক ঘুমে রাত পার করে দেয়। রাতে সে কোন স্বপ্ন দেখে না। সকাল সাড়ে সাতটায়, জানালায় হেমন্তের ঠান্ডা বৃষ্টির শব্দে তার ঘুম ভাঙে। জেগে উঠে সে ভয়ে ভয়ে গায়ের ওপর থেকে চাদর সরায়। মেঝে আর বিছানায় কোন ময়লার দাগ নেই। তার পায়েও কাদার কোন ছিটেফোঁটা নেই।
গোসল করার সময় সে শিস দিতে থাকে।
অধ্যায় ১৯
রাচেল গেজকে মিসি ডেন্ড্রিজের কাছে রেখে ভেটের কাছে চার্চকে দিয়ে আসে। সেদিন রাতে এলি চার্চের জন্যে বেশ উৎপাত করে। সে রাত এগারটা পর্যন্ত জেগে থাকে। তার কথা, সে চার্চকে ছাড়া ঘুমাতে পারবে না এবং একটু পর পর গ্লাসের পর গ্লাস পানি চাইতে থাকে। শেষে বিছানা ভেজানোর দোহাই দিয়ে লুইস বলে ও আর পানি খেতে পারবে না। আর এর ফলে এলি এমন দুর্বার ক্রোধে কান্না শুরু করে যে লুইস আর রাচেল একে অপরের দিকে হতাশা নিয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।
“ওর চার্চকে নিয়ে ভয় হচ্ছে,” রাচেল বলে। “নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যাবে।”
এই ভলিউমে ও বেশিক্ষণ চিৎকার করতে পারবে না,” লুইস বলে। “অন্তত সেটাই আশা করি।”
তার কথাই ঠিক। কিছুক্ষণ পরেই এলির কর্কশ চিৎকার ফোঁপানি আর গোঙানিতে পরিণত হয়। এবং অবশেষে আসে নীরবতা। লুইস ওর ঘরে গিয়ে দেখে, ও ফ্লোরে শুয়ে আছে চার্চের ক্যাট-বেডটা জড়িয়ে ধরে, যেটাতে চার্চ আদৌ কখনো ঘুমাতে প্রসন্ন হয়েছে কি না সন্দেহ।
সে সেটাকে এলির হাত থেকে ছাড়িয়ে এলিকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। সে এলির কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ওর কপালে চুমু খেল। লুইস আবেগে তাড়িত হয়ে রাচেলের ছোট্ট অফিস রুমটা থেকে একটা কাগজ নিয়ে তাতে বড় বড় করে লিখে-আমি কাল ফিরে আসছি, ভালোবাসা, চার্চ-নোটটা চার্চের ক্যাট বেডের কুশনের সাথে পিন দিয়ে লাগিয়ে দেয় সে। এরপর নিজের রুমে রাচেলের কাছে যায়। তারা তাদের স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসার পর্ব চুকিয়ে একে অপরের বাহুডোরে ঘুমিয়ে পড়ে।
লুইসের অফিসের কাজ পুরোদমে শুরু হবার পর প্রথম শুক্রবারে চার্চ ফিরে আসে। এলি তাকে ফিরে পেয়ে বেশ খাতির যত্ন করে। ও নিজের হাতখরচের টাকা দিয়ে চার্চের জন্যে ক্যাট-ট্রিট কিনে আনে, আর গেজ চার্চকে ধরতে চাইলে ও গেজকে প্রায় চড় মেরে বসে। গেজ তাতে খুব কাতর হয়ে কাঁদতে থাকে। তার কাছে এলির তিরষ্কার আর ঈশ্বরের তিরষ্কার একই কথা।
চার্চকে দেখে লুইসের মন খারাপ হয়। চার্চের মধ্যে তার চিরচেনা বুনো আর কু-স্বভাবগুলো অনেকটাই হারিয়ে গেছে। তার বখাটে ছেলেদের মত হাঁটার ভঙ্গি আর নেই, সে এখন হেলেদুলে হাটে। এলি চার্চকে হাতে করে খাইয়ে দিতে চাইলেও লুইস বাধা দেয় না। চার্চ বদলে গেছে। হয়তো ভালই হয়েছে যে চার্চ বদলে গেছে।
তবে ব্যাপারটা রাচেল বা এলি কারোরই চোখে পড়লো না।
অধ্যায় ২০
গ্রীষ্ম চলে গেছে। গাছে পিত রং আসতে চাইলে গাছেরা প্রথমে হৈচৈ করলেও অবশেষে তারা তাদের নিয়তি মেনে নিয়ে ফ্যাকাসে রং ধারণ করেছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি একবার খুব একচোট বৃষ্টি হবার পর গাছের পাতা ঝরতে আরম্ভ করে। এলি স্কুল থেকে প্রায় প্রতিদিনই হ্যালোইনের নানান রকম সাজসজ্জায় বোঝাই হয়ে বাসায় ফিরতে থাকে আর গেজকে এক স্কন্ধকাটা ঘোড়া সওয়ারির গল্প বলে মজা দিতে থাকে। সেদিন বিকেলে গেজ সারাক্ষণ ‘কনকাটা কনকাটা’ বলে বকবক করছিল। সেটা শুনে রাচেলের হাসি থামতেই চায় না। শরতের শুরুটা ক্রিড ফ্যামিলির ভালই কাটছে।
লুইসের অফিসও ভালই যাচ্ছে। কাজের চাপ থাকলেও লুইসের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজটা বেশ ভালোই লাগছে। সেখানে কাজের পাশাপাশি সে বিভিন্ন মেডিকেল কনফারেন্সেও অংশ নিতে থাকে।
রাতের খাবারের পর বাচ্চাদের সময় দেয়া এবং এরপর জাড ক্র্যান্ডালের সাথে বিয়ারের বোতল হাতে আড্ডা দেয়াটা বাসায় ফিরে তার রোজকার রুটিন। মিসি মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের দেখলে রাচেলও তাদের সাথে বসে আর মাঝেমধ্যে নরমাও তাদের সাথে যোগ দেয়। তবে অধিকাংশ সময় শুধু লুইস আর জাডই থাকতো আড্ডায়। লুইসের লোকটাকে বেশ পছন্দ হয়েছে। তিনি লাডলোর তিনশত বছরের ইতিহাস ফরফর করে বলে দিতে পারেন, যেনো তিনি এই পুরোটা সময় নিজের দুচোখে দেখেছেন। তিনি অনেক কথা বলেন কিন্তু কখনো তাকে লুইসের বিরক্তিকর মনে হয়নি। তবে জাডের কথা শুনে সে রাচেলকে মুখে হাত চেপে হাই তুলতে দেখেছে।
বেশিরভাগ রাতে দশটার আগেই সে রাস্তা পেরিয়ে নিজের বাসায় ফেরে। আর বাসায় ফিরে সে আর রাচেল তাদের স্বামী-স্ত্রীর ভালোবাসায় মেতে উঠতো। তাদের বিয়ের প্রথম বছরের পর থেকে আর কখনই তারা এতো ঘন ঘন মিলিত হয়নি। রাচেলের ধারণা এর কারণ এখানকার অবিরাম বের হতে থাকা কুয়ার টাটকা পানি; লুইসের ধারণা মেইনের হাওয়া বাতাস।
সেমিস্টারের প্রথম দিনে ভিক্টর পাস্কোর মৃত্যুর ঘটনা শিক্ষার্থীদের কাছে এবং তার কাছে অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। তার বিশ্বাস পাস্কোর বাবা মার শোকও আর তীব্রভাবে নেই। লুইস ভিক্টর পাস্কোর বাবার সাথে ফোনে কথা বলেছে। ভদ্রলোক একটি ব্যাপারেই নিশ্চিত হতে চাইছিলেন, যে তার ছেলের চিকিৎসায় কারো কোন ত্রুটি ছিল কি না। লুইস বলে তারা সবাই তাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য। সেদিনের হট্টগোল, কার্পেটের দাগ বা তার ছেলেকে যে প্রায় মৃত অবস্থায় ইনফার্মারিতে আনা হয়েছিল, লুইস সেগুলোর কিছুই বলে না। তবে লুইস ওগুলো কখনোই ভুলবে না। তবে যাদের কাছে পাস্কোর ঘটনা একটি নিছক দুর্ঘটনা, তারা পাস্কোকে প্রায় ভুলেই গেছে।
সেই স্বপ্ন আর স্লিপ ওয়ার্কিংয়ের ঘটনাটা লুইসের মনে আছে। তবে এখন সেগুলোর প্রতি তার অনুভূতি এমন যে সেগুলো অন্য কারো সাথে ঘটেছে বা সেগুলো সে কোন টিভি প্রোগ্রামে দেখেছে।
আর, মৃত্যুর আগমুহূর্তে পাস্কো যে কথাগুলো বলেছিল কিংবা বলেনি, সেসব নিয়ে সে একদমই ভাবে না।
হ্যালোইনের রাতে প্রচন্ড ঠান্ডা পড়ে। লুইস আর এলি ক্র্যান্ডালদের বাসা থেকে তাদের হ্যালোইনের ট্রিক-অর-ট্রিট শুরু করে। এলি তার ডাইনি ঝাড়ুতে চড়ে ক্র্যান্ডালদের কিচেনে ঘুরে ঘুরে দৌড়াতে থাকে। তা দেখে নরমা বলেন, “কি সুন্দর লাগছে দেখেছো?”
জাড মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে একটা সিগারেট ধরান। “আমি ভেবেছিলাম তুমি গেজকেও হ্যালোইনের পোশাক পরিয়ে নিয়ে আসবে।”
তাদের অবশ্য গেজকে সাথে আনার পরিকল্পনা ছিল, বিশেষ করে রাচেলের এ ব্যাপারে অত্যন্ত আগ্রহ ছিল। সে আর মিসি ডেন্ডিজ মিলে গেজের জন্যে একটা পোকার কস্টিউমও বানিয়েছিল। কিন্তু গেজের হঠাৎ মারাত্নক ঠান্ডা লেগে গেছে। তার বুকের শব্দ শুনে আর বাইরের তাপমাত্রা দেখে সে তার বাইরে যাওয়া নাকচ করে দেয়। রাচেল হতাশ হলেও তার সিদ্ধান্তে সম্মতি জানায়।
এলি গেজকে তার নিজের ভাগের চকলেট থেকে কিছু দেয়ার প্রমিজ করে। তবে গেজের কারণে তার শোক প্রকাশের আতিশায্যে লুইসের সন্দেহ হয় আসলে এলি ভেতরে ভেতরে খুশিই হয়েছে। কারণ গেজ তার সাথে থাকলে ওরা অনেক ধীর হয়ে যেতো… অথবা গেজ হয়তো আকর্ষণের কিছু অংশ চুরি করে নিত।
“আহারে,” এলি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এমনভাবে বলেছিল, যেন গেজের প্রাণঘাতী ক্যান্সার হয়েছে। গেজ কি মিস করছে তা বুঝতে না পেরে টিভির সামনে বুদ হয়ে আছে। তার পাশে শুয়ে চার্চ ঘুমাচ্ছে।
“এলি ডাইনি,” কোন রকম মনোযোগ ছাড়াই গেজ জবাব দিয়েছিল। বলেই সে আবার টিভি দেখতে শুরু করেছিল।
“আহারে,” এলি আবারো একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে বললে লুইস কুমিরের কান্নার কথা ভেবে মুচকি হাসে। এলি তার হাত ধরে টানতে থাকে। “চলো বাবা, চলো বাবা-চলো।”
“গেজের খুব কাশি হয়েছে,” লুইস জাডকে বলে।
“হুম, কপাল খারাপ,” নরমা বলেন। “যাক সামনের বার আরো বুঝতে শিখবে ও। এলি, তোমার ব্যাগটা এদিকে আনো…উপস!”
নরমা একটা আপেল আর একটা চকলেট বার নিয়েছিলেন এলিকে দেয়ার জন্য, কিন্তু দুটোই তিনি হাত থেকে ফেলে দিয়েছেন। বৃদ্ধার হাতের চামড়া এতো কুচকে গেছে যে তা দেখে লুইস চমকে যায়। সে নিচু হয়ে তার দিকে গড়িয়ে আসা আপেলটা তোলে। জাড চকলেট বারটা তুলে এলির ব্যাগে দেয়।
“আমি তোমাকে আরেকটা আপেল এনে দিচ্ছি,” নরমা বলেন। “এটাতে দাগ পড়ে যাবে।”
“সমস্যা নেই,” লুইস আপেলটা এলির ব্যাগে রাখার চেষ্টা করতে করতে বলে।
“আমি দাগওয়ালা আপেল নেবো না, বাবা,” এলি বলে। ও তার বাবার দিকে এমনভাবে তাকায় যেন তার বাবা পাগল হয়ে গেছে। “দাগ পড়া আপেল…ইয়াক!”
“এলি! অভদ্রের মত কথা বলছো কেন?” লুইস বলে।
“সত্য বলার জন্যে ওকে বকো না, লুইস।” নরমা বলেন। “শুধু বাচ্চারাই পুরো সত্যটা বলে। এটাই বাচ্চাদের সৌন্দর্য। দাগ পড়া আপেল আসলেই ইয়াক।”
“থ্যাঙ্ক ইউ মিসেস ক্র্যান্ডাল,” এলি বাবার দিকে বিজয়ের দৃষ্টিতে তাকায়।
“ইউ আর ওয়েলকাম, সোনামনি,” নরমা বলেন।
জাড তাদের বিদায় দিতে পোর্চে নিয়ে আসেন। আরো দুটো পিচ্চি ভূত এদিকেই আসছে। এলি তার ক্লাসমেটদের চিনতে পেরে ওদের নিয়ে কিচেনে ফিরে যায়। পোর্চে কিছুক্ষণের জন্যে লুইস আর জাড একা হয়ে যায়।
“ওনার আর্থাইটিস তো খুব বেড়ে গেছে,” লুইস বলে।
জাড মাথা ঝাঁকান, “হুম। প্রতি শরতে আর শীতে ওর অসুখ অনেক বেড়ে যায়। তবে এবারের মতো আগে কখনো এতোটা বাড়েনি।”
“ডাক্তার কী বলছে?”
“কিছুই না। বলবে কিভাবে? নরমা ডাক্তারের কাছে যেতে রাজি হচ্ছে না।”
“কেন? যাচ্ছেন না কেন?”
জাড লুইসের দিকে তাকালেন। জাডের চেহারায় হতাশা।
“ব্যাপারটা বলার সময় নির্বাচন হয়তো ভালো হচ্ছে না। তবে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে কিছু চাওয়ার জন্যে হয়তো কোন সময়ই ভালো সময় না। ডাক্তার, ওকে একটু দেখবে তুমি?”
কিচেন থেকে ভূতের বুউউ আর এলির খিক খিক খিক শব্দ আসছে।
“নরমার আর কোন সমস্যা হয়েছে?” লুইস জিজ্ঞেস করে। “উনি কি অন্য কিছুর ভয় করছেন?”
“ওর বুকে ব্যথা হচ্ছে।” জাড নিচু গলায় বলল। “সে ডক্টর ওয়েব্রিজের কাছে আর যেতে রাজি হচ্ছে না। আমি একটু দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।”
“নরমার দুশ্চিন্তা হচ্ছে না?
জাড় ইতস্তত করে। “আমার ধারণা ও ভয় পাচ্ছে আর এজন্যেই ডাক্তারের কাছে যেতে চাচ্ছে না। ওর সবচেয়ে পুরনো বান্ধবীদের একজন, বেটি কোস্লাও মাত্র গত মাসে ই.এম.এম.সি-তে মারা গেছে। ক্যান্সার। ওদের দুজনের বয়স একই। ও খুব ভয় পেয়ে গেছে।”
“আমি ওনাকে অত্যন্ত আনন্দের সাথেই দেখবো,” লুইস বলে। “কোন সমস্যা নেই।”
“ধন্যবাদ, লুইস,” জাড কৃতজ্ঞ কণ্ঠে বলেন। “আমরা যদি কোন এক রাতে ওকে দুজন মিলে চাপাচাপি করি, তাহলে মনে হয়-”
জাড থেমে গেল। তিনি মাথা উঁচু করে বুঝতে চেষ্টা করলেন ভেতরে কী হচ্ছে।
এরপর কিভাবে কী হলো ভাবতে গেলে লুইসের সবকিছু ঘোলাটে মনে হয়। তার মনে আছে জাডের চেহারা স্বাভাবিক থেকে হঠাৎ খুব আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায়।
কিচেন থেকে পিচ্চি ভূতদের ‘বুউউ-হুউউ’ শব্দ আসছিল। হঠাৎ সেই শব্দ পরিবর্তন হয়ে আর্তচিৎকারে পরিণত হয়ে যায়।
“ওওওওও ওওওওও-”
“বাবা!” আতঙ্কিত কণ্ঠে এলি চিৎকার করে ওঠে। “বাবা! মিসেস ক্র্যান্ডাল পড়ে গেছেন!”
“ওহ খোদা,” জাড প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন
এলি দৌড়ে পোর্চে বেরিয়ে আসে। ওর এক হাতে ঝাড়ু। ওর গায়ের ডাইনি কস্টিউমটা ওর দৌড়ের সাথে সাথে দুলছে। ওর চোখে মুখে আতঙ্ক।
ওর পিছে পিছে বাকি দুই পিচ্চি ভূতও চিৎকার করতে করতে দৌড়ে বেরিয়ে আসে।
জাড একরকম ঝাঁপ দিয়েই দরজার ভেতর ঢুকে যায়। এই বয়সে এমন ক্ষিপ্রতা বেশ অবাক করার মতোই। সে তার স্ত্রীর নাম ধরে ডাকছে।
লুইস নিচু হয়ে এলির কাঁধে হাত রেখে বলে, “পোর্চে দাঁড়িয়ে থাকো এলি। কোথাও যাবে না, বুঝেছো?”
“বাবা, আমার ভয় লাগছে,” এলি মৃদু স্বরে বলে।
ভূত দুটো তাদের পাশ কাটিয়ে গুলির বেগে বেড়িয়ে যায়। তারা ‘মা-মা’ করে চিৎকার করছে।
লুইস দৌড়ে কিচেনের দিকে যায় এলিকে অগ্রাহ্য করে, যে তাকে পেছন থেকে ডাকছে।
নরমা মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আপেল আর ছোট ছোট চকলেট বারের মধ্যে পড়ে আছেন। মনে হচ্ছে পড়ে যাবার সময় তার হাত লেগে এসব রাখা বোলটা উল্টে গেছে। বোলটা কাছেই পড়ে আছে, যেটাকে একটা ফ্লাইং সসারের মত লাগছে দেখতে। জাড তার স্ত্রীর এক হাতে মালিশ করছেন। তিনি লুইসের দিকে কাতর দৃষ্টিতে তাকালেন।
“সাহায্য করো লুইস,” সে বলে। “ওকে ধর। আমার মনে হয় ও মরে যাচ্ছে।”
“একদিকে সরে যান।” লুইস বলে।
আবারো পাস্কোর ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে, ভাবনাটা লুইসের মনে উঁকি দিতেই সে তা ঝেড়ে ফেলে দেয়।
লুইস নরমার পালস চেক করে দেখে পালস খুব মৃদু, তবে খুব দ্রুত চলছে। কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের লক্ষণ।
লুইস ওনার জামা খুলে দেয়। তিনি ভেতরে একটা গোলাপি সেমিজ পড়ে আছেন। লুইস তার মাথা একদিকে সরিয়ে দিয়ে সি.পি.আর দেয়া শুরু করে।
“জাড, আমার কথা মন দিয়ে শুনুন,” সে বলে।
“হ্যাঁ। বলো লুইস,” জাড বলেন।
“এলিকে নিয়ে যান,” সে বলে। “সাবধানে রাস্তা পার হবেন, রাস্তার দুদিকে তাকিয়ে। রাচেলকে বলবেন কী হয়েছে। আর বলবেন আমার ব্যাগটা দিতে। স্টাডির ব্যাগটা না, ওপর তলার শেলফের ব্যাগটা। আর ব্যাঙ্গর মেডকুতে ফোন দিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলবেন।”
“বাকস্পোর্টেরটা কাছে হবে,” জাড বলেন।
“ব্যাঙ্গরেরটা দ্রুত আসবে। যান। আর আপনি কল করবেন না। রাচেলকে কল করতে বলবেন। আমার ব্যাগটা খুব জরুরি।” রাচেল যখন জানবে এখানে কী হয়েছে আমার মনে হয় না ও নিজে ব্যাগ নিয়ে এখানে আসবে, লুইস ভাবে।
জাড় চলে গেলেন। সে বাইরের কাচের স্ক্রিন ডোরটা বন্ধ হবার শব্দ পায়। সে নরমা ক্র্যান্ডাল আর ঘড়ির টিক টকের সাথে একা হয়ে পড়ে।
নরমা হঠাৎ শব্দ করে একটা লম্বা শ্বাস নেন আর তার চোখের পাতাগুলো কাঁপতে শুরু করে। আর লুইসের মন একটি সুনিশ্চিত আশঙ্কায় ভরে ওঠে।
উনি চোখ খুলবেন। ওহ খোদা, উনি এক্ষুনি চোখ খুলে পেট সেমেটারি নিয়ে কথা বলতে শুরু করবেন।
তবে তিনি চোখ খুলে লুইসের দিকে তাকালেন। তিনি লুইসকে চিনতে পারলেন। এরপরই তিনি আবার চোখ বন্ধ করে ফেললেন। লুইসের খুব লজ্জা লাগে। সে তো এরকম ছিল না। তবে সাথে সাথে তার উদ্বেগেরও নিরসন হয়। নরমার চোখে ব্যথার ছাপ থাকলেও নিদারুণ যন্ত্রণার কোন চিহ্ন নেই। তার ধারণা বড় কিছু থেকে হয়তো তিনি বেঁচে গেলেন।
লুইস নিজে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর ঘামছে। টিভি প্যারামেডিকরা ছাড়া আর কেউ হয়তো সিপিআর তাদের মত এত সহজে দিতে পারে না। অবিচলিতভাবে ক্লোজ চেস্ট ম্যাসাজ করতে প্রচুর ক্যালরি পুড়ে। তার বাহু আর কাঁধের জয়েন্টগুলো আগামীকাল নিশ্চিতভাবেই ব্যথা করবে।
“আমি কোন সাহায্য করতে পারি?”
লুইস মাথা ঘুরিয়ে তাকায়। প্যান্ট আর বাদামি সোয়েটার পরা একজন মহিলা দরজার কাছে দাড়িয়ে আছে। সে এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বুকের কাছে ধরে আছে। পিচ্চি ভূতগুলোর মা হবেন হয়তো।
“না,” বলে আবার পরক্ষণেই সে বলল, “হ্যাঁ। একটা কাপড় ভিজিয়ে পানি ঝেড়ে আনুন। এনে ওনার কপালের ওপর রাখুন।
মহিলাটি কাজে লেগে যায়। লুইস নিচে তাকিয়ে দেখলো নরমা চোখ খুলে তাকিয়েছেন।
“লুইস, আমি পড়ে গিয়েছিলাম,” তিনি বিড়বিড় করে বললেন। “মনে হয় অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।”
“আপনার হার্টে কোন সমস্যা হয়েছিল,” লুইস বলে। “তবে সিরিয়াস কিছু মনে হয় না। এখন রিলাক্স করুন আর চুপ করে থাকুন।
লুইস সামান্য বিশ্রাম নিয়ে আবার নরমার পালস নিলো। তার বিট খুব দ্রুত চলছে। অনেকটা মোর্স কোডের মত। তার কিছু বিট রেগুলার হচ্ছে আর তার পরই কয়েকটা খুব জোরালো বিট দিচ্ছে, এর পর আবার রেগুলার। বিট-বিট-বিট, ধাম-ধাম-ধাম, বিট-বিট-বিট। জিনিসটা খারাপ তবে কার্ডিয়াক এরিথমিয়া থেকে কিছুটা ভালো।
মহিলাটি ভেজা কাপড় এনে নরমার মাথায় দিয়ে আর কি করবে বুঝতে না পেরে সরে দাঁড়ায়। তখনই জাড লুইসের ব্যাগ নিয়ে রুমে প্রবেশ করেন।
“লুইস?”
“উনি ঠিক হয়ে যাবেন,” লুইস জাডের দিকে তাকিয়ে নরমাকে শোনানোর উদ্দেশ্যে বলে। “মেডকু আসছে?”
“তোমার বউ তাদের ফোন করছে,” জাড বললেন। “আমি দেরি না করে চলে এসেছি।”
“হাসপাতাল…না,” নরমা বিড়বিড় করে বললেন।
“হাসপাতাল…হ্যা,” লুইস বলল। পাঁচ দিনের অবজারভেশন, মেডিকেশন, আর তারপরই ভদ্র মেয়ের মত বাসায় ফিরে আসবেন। আর অন্য কিছু বললে এই সবগুলো আপেল আপনাকে গেলাবো, একদম বিচি সহ।”
তিনি দুর্বলভাবে হেসে চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
লুইস তার ব্যাগ খুলে ভেতরে হাতড়ে আইসোডিলের কৌটাটা বের করে। সেটা ঝাঁকিয়ে একটি পিল বের করে দুই আঙুলের ডগায় টিপে ধরে।
“নরমা, আমাকে শুনতে পারছেন?”
“হুম।”
“আপনার মুখ খুলুন। ট্রিক-অর-ট্রিট। আপনি আপনার ট্রিক দেখিয়েছেন, এখন আপনার ট্রিটের জন্যে মুখ খুলুন। আমি আপনার জিভের নিচে একটা ছোট পিল রাখব। এটাকে নিজে থেকে গলে যেতে দিবেন। একটু তিতা লাগতে পারে, ওকে?”
তিনি তার মুখ খুললেন। বাধানো দাঁতের পাটির বাসি গন্ধ তার নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে এলে তার জন্যে লুইসের খুব মায়া হয়। তার মনে হয় এক সময় তিনি ষোড়শী বালিকা ছিলেন। তার দিকে এলাকার কত পুরুষ হয়তো মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো আর তখন তার দাঁতগুলোও ছিল আসল। আর এখন তিনি বাধানো দাঁত নিয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আপেল আর চকলেট বারের মধ্যে পড়ে আছেন।
পিলের ওপর জিভ রাখতেই তিনি চোখ মুখ কুচকে ফেলেন। পিলটা বেশ ভালই তেতো। তবে তিনি ভিক্টর পাস্কোর মত সাহায্যের আওতার বাইরে নন। হয়তো এ যাত্রায় বেঁচেই গেলেন। তার হাত বাতাসে হাতড়াতে থাকলে জাড হাতটা নরমভাবে ধরলেন।
লুইস উঠে দাড়িয়ে উল্টানো বোলটা নিয়ে সেটাতে মেঝেতে পড়ে থাকা ট্রিটগুলো তুলতে থাকে। পিচ্চি ভূতদের মা, যিনি নিজেকে সামনের রাস্তার মিসেস বাডিংগার বলে পরিচয় দিলেন, তিনিও লুইসকে সাহায্য করলেন। এরপর তিনি বললেন তিনি তার বাচ্চাদের কাছে গাড়িতে ফিরে যাচ্ছেন। তার বাচ্চারা বেশ ভয় পেয়েছে।
“আপনার সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ মিসেস বাডিংগার,” লুইস বলে। “আমি তেমন কিছুই করিনি। খোদাকে ধন্যবাদ আপনি এখানে ছিলেন, ড. ক্রিড।”
লুইস একটু বিব্রত হয়ে তাকে হাত নেড়ে বিদায় দেয়।
“আসলেই। আজকে তুমি না থাকলে যে কী হতো…” তিনি লুইসের চোখে চোখ রাখলেন। তার চোখে স্থিরতা, জাড আবারো নিজের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। “খুব বড় একটা উপকার করলে। তোমার কাছে আমি ঋণী হয়ে রইলাম, লুইস।”
“বাদ দিন তো,” সে একটা আপেল নিয়ে খেতে শুরু করে। আপেলটা এতই মিষ্টি যে তার জিবের টেস্ট বাডগুলোতে খিল ধরে যায়…তবে এই অনুভূতিটা খুব একটা খারাপ না। আজকের খেলায় তুমি জিতেছ, লু, সে ভাবতে ভাবতে আপেলটার ওপর হামলে পড়ে। সে বুভুক্ষের মত আপেলটা খতম করলো।
“আমি সত্যি বলছি। তোমার ঋণ শোধ করার মত না। তবে কখনো যদি তোমার কোন সাহায্য লাগে, তুমি সবার আগে আমাকে বলবে।”
“আচ্ছা,” লুইস বলে। “সহিহ বলেছেন।
***
বিশ মিনিট পর অ্যাম্বুলেন্স আসে। লুইস যখন বাইরে দাড়িয়ে নরমাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা দেখছিল, সে দেখতে পেল তাদের বাসার জানালায় দাড়িয়ে রাচেলও এদিকেই তাকিয়ে আছে। লুইস রাচেলকে লক্ষ্য করে হাত নাড়লে রাচেল শুধু একটা হাত তুলে জবাব দেয়।
লুইস আর জাড একসাথে দাড়িয়ে অ্যাম্বুলেন্সের চলে যাওয়া দেখে, অ্যাম্বুলেন্সটার সাইরেন বন্ধ তবে লাইট ফ্লাশ করছে।
“আমি তাহলে হাসপাতালে যাই,” জাড বলেন।
“এখন গেলেও ওরা রোগির সাথে দেখা করতে দিবে না। ওরা ওনার ওপর টেস্ট চালিয়ে ইন্টেন্সিভ কেয়ারে রাখবে। প্রথম বারো ঘন্টা রোগির সাথে কাউকে দেখা করতে দিবে না।”
“ও কি ভালো হয়ে যাবে, লুইস?”
লুইস কাঁধ ঝাকায়। “কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে না। এটা একটা হার্ট অ্যাটাক ছিল। তবে আমার ধারনা উনি ভালো হয়ে যাবেন। আর ওষুধ খাওয়ার কারণে হয়তো আগের চাইতেও ভাল থাকবেন।”
“হুম,” জাড একটা সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বললেন।
লুইস তার হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে একটু অবাকই হলো। আটটা বাজতে আরো দশ মিনিট। তবে তার মনে হচ্ছে অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে। “জাড, আমি যাই, এলি যাতে ট্রিক অর ট্রিটিং করতে পারে।”
“শিওর, যাও।” জাড বললেন। “ওকে বলো যাতে যত বেশি সম্ভব ট্রিট সংগ্রহ করে।”
“আচ্ছা, বলবো,” লুইস বলে।
***
লুইস বাসায় গিয়ে দেখে এলি তার ডাইনির কস্টিউম পরে বসে আছে। রাচেল ওকে ওটা খুলে রাতের জামা পরার ব্যাপারে পটাতে গিয়ে বিফল হলো। এলি গো ধরে আছে। ওর মনে ক্ষীণ আশা যে তার যেই খেলাটি নরমার হার্ট এটাকের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে, তা হয়তো আবার শুরু করা যাবে।
“এখন গেলে ওর অনেক রাত হয়ে যাবে, লুইস।”
“আমরা গাড়ি নিয়ে যাব,” লুইস বলে। “প্লিজ রাচেল, ও এই দিনটার জন্যে মাস খানেক ধরে অপেক্ষা করে আছে।
“আচ্ছা বাবা…” রাচেল মুচকি হাসে। এলি তা দেখতে পেয়ে তার কোট আনতে কোট ক্লজেটের দিকে দৌড়ে যায়। “নরমা ঠিক আছেন?”
“হুম, এখন মোটামুটি ভালই অবস্থা।” কথাটা বলে তার খুব ভাল লাগলো। সে খুব ক্লান্ত, কিন্তু তার পরেও খুব ভাল লাগলো। “হার্ট অ্যাটাকটা ছোট ছিল। এখন থেকে খুব সাবধানে থাকতে হবে। তবে বয়স পচাত্তর হলে সাবধান হলেও হয়তো যা হবার তা রোধ করা যাবে না।”
“ভাগ্য ভালো যে তুমি সেখানে ছিলে। খোদা হাতে ধরে তাকে সাহায্য পাঠিয়েছেন।”
লুইস মুচকি হাসে। এলি ফিরে আসলে সে বলে, “তুমি রেডি, ডাইনি হেজেল?”
“আমি রেডি,” সে উত্তর দেয়। “চলো চলো-চলো!”
***
ঘন্টা খানেক পর যখন লুইস তাদের অভিযানের ইতি ঘোষনা করে তখন এলি প্রতিবাদ জানায়। তবে তার প্রতিবাদের তেমন তেজ ছিল না কারণ সে নিজেও এর মধ্যে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সে এর মধ্যেই হাফ ব্যাগ ক্যান্ডি জোগাড় করে ফেলেছে। বাসায় ফেরার পথে এলি লুইসকে একটা কথা বলে চমকে দেয়, “বাবা আমার জন্যেই কি মিসেস ক্র্যান্ডাল হার্ট অ্যাটাক করেছেন? আমি দাগওয়ালা আপেল নিতে চাইনি বলে?”
লুইস এলির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবে, বাচ্চারা এসব কুসংস্কারের ভাবনা কোথায় পায়।
স্টে অন অ্যা ক্র্যাক, ব্রেক ইওর মাদার’স ব্যাক।
লাড্স মি, লাড্স মি নট।
ড্যাডি’স স্টমাক, ড্যাডি’স হেড,
স্মাইল অ্যাট মিডনাইট, ড্যাডিস ডেড।
এসব ভাবতে ভাবতে তার আবার বাচ্চাদের করা পেট সেমিটারির সেই আনাড়ি বৃত্তগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। সে হাসতে চাইলেও পারলো না।
“না, মামনি,” সে বলে। “তুমি যখন ভেতরে ওই দুই ভূতের সাথে-”
“ওরা ভূত না তো, ওরা দুজন তো বাডিংগার জমজ।”
“আচ্ছা। তুমি যখন ভেতরে ওদের সাথে ছিলে তখন আমাকে মিস্টার ক্র্যান্ডাল বলছিলেন যে তার স্ত্রীর বুকে ব্যথার সমস্যা দেখা দিয়েছে। আসলে তো তোমার জন্যেই আজ তিনি বড় ক্ষতি থেকে বেঁচে গেলেন।”
এবার এলির চমকানোর পালা। সে অবাক হয়ে লুইসের দিকে তাকায়। লুইস নড করে। “মামনি, তার ওই সময় একজন ডাক্তারের প্রয়োজন ছিল। আর আমি একজন ডাক্তার। আর আমি সেসময় সেখানে ছিলাম কারণ আজ তোমার ট্রিক অর ট্রিটিং এর রাত।”
এলি বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে মাথা ঝাকায়। “তবে উনি বেশি দিন বাঁচবেন না।” এলি গম্ভীর হয়ে বলে। “যাদের হার্ট অ্যাটাক হয় তারা মরে যায়। আর বেঁচে গেলেও কিছুদিন পরেই আবার আরেকটা অ্যাটাক হয়, তারপর আবার হয় আর হতে হতে এক সময়…বুম!”
“আর তুমি এই জ্ঞানের কথা কোত্থেকে জানলে, জানতে পারি?” লুইস জিজ্ঞেস করে। জবাবে এলি কিছু না বলে শুধু কাঁধ তুলল।
গাড়ি থেকে নেমে এলি লুইসকে ওর ক্যান্ডির ব্যাগ বহন করতে দেয়-বিশ্বাসের প্রায় চূড়ান্ত চিহ্ন। লুইস তার মেয়ের মন নিয়ে ভেবে কূল পায় না। এলি চার্চের মৃত্যুর কথা ভেবে প্রায় হিস্টেরিক হয়ে পড়েছিল। আর আজ যখন তার নানীর মত নরমা ক্র্যান্ডাল প্রায় মরেই যাচ্ছিলেন, সেটা সে খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। আর সে কী বলল? হতে হতে এক সময় … বুম!”
কিচেন ফাঁকা হলেও লুইস ওপরতলা থেকে রাচেলের চলাফেরার শব্দ পাচ্ছে। লুইস এলির ক্যান্ডির ব্যাগটা রেখে বলল, “এই রকম হবে তা ভাবা ঠিক না। নরমার অ্যাটাকটা খুব ছোট ছিল আর আমি সাথে সাথে তার প্রয়োজনীয় ট্রিটমেন্ট দিয়েছি। আশা করি তার হার্টে তেমন কোন ক্ষতি হয়নি।”
ওহ, আমি জানি,” এলি হাসি মুখে সম্মতি জানায়। “তবে উনি তো বুড়ো হয়ে গেছেন। কিছুদিন পর উনি এমনিতেই মারা যাবেন। মিস্টার ক্র্যান্ডালও। বাবা, ঘুমুতে যাওয়ার আগে আমি একটা আপেল খেতে পারি?”
“না,” সে নিজের মেয়ের দিকে চিন্তিত মুখে তাকিয়ে বলে। “ওপরে গিয়ে ব্রাশ করে নাও মামনি।”
কেউ কি আসলেই বাচ্চাদের বোঝে? সে ভাবে।
লুইস আর রাচেল যখন তাদের বাড়ির সব কাজ শেষ করে তাদের পাশাপাশি লাগানো টুইন বেডে শুয়ে ছিল তখন রাচেল নরম গলায় জিজ্ঞেস করে, “এলি কি খুব আঘাত পেয়েছে? ও কি আপসেট?”
না, সে ভাবে। ও জানে বুড়ো মানুষের সাথে মাঝে মাঝে এরকম হয়-ই। ঠিক যেমনি ও জানে কেউ দড়িলাফ খেলার সময় তেরো নাম্বার লাফে পড়ে যাওয়া মানে তার বেস্ট ফ্রেন্ড মরে যাবে, ঠিক যেমনি ও জানে কেউ ঘাসফড়িং ধরার পর সেটা থুতু ফেললে সেটাকে ছেড়ে দিতে হয়…ঠিক যেমনি ও জানে পেট সেমিট্রিতে বৃত্তাকার লাইনে কবরগুলো খুঁড়তে হয়।
“নাহ,” সে বলে। ও নিজেকে ভালই সামলে নিয়েছে। চলো ঘুমিয়ে পড়ি, আচ্ছা?”
সেরাতে ওরা যখন নিজেদের বাসায় ঘুমিয়ে আছে আর জাড ক্র্যান্ডাল যখন তার বাসায় জেগে বসে আছে, বাইরে খুব ঠান্ডা পড়ে। রাতের ঠান্ডা বাতাসে গাছের অবশিষ্ট পাতাগুলোও ঝরে গেল।
বাতাসের শব্দে লুইসের ঘুম ভেঙে গেলে সে ধড়মড়িয়ে হাতের কনুইয়ে ভর দিয়ে জেগে উঠে। সিঁড়ি থেকে পায়ের আওয়াজ আসছে… ধীর, টেনে টেনে হাঁটার শব্দ। পাস্কো ফিরে এসেছে। সে ভেবে দেখলো দুই মাস হয়ে গেছে সেই ঘটনার। এখন দরজা খুললেই সে পচতে থাকা বিভীষিকা চাক্ষুস দেখতে পাবে। পাস্কোর গায়ে থাকবে কাঁদায় মাখামাখি জগিং শর্টস, তার গায়ে থাকবে মাংস খসে পরা গর্ত, তার মাথার ব্রেইন পচে এতোদিনে পেস্ট হয়ে গেছে। শুধু তার চোখগুলো হবে জীবন্ত…নারকীয়ভাবে উজ্জ্বল আর জীবন্ত। এবার পাস্কো কোন কথা বলবে না, তার কন্ঠনালী এতো দিনে পচে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার চোখগুলো…চোখগুলো লুইসকে ডেকে নিয়ে যাবে।
“না,” সে বড় নিশ্বাস ছেড়ে বলে, এবং পায়ের শব্দ থেমে যায়।
সে উঠে দাড়িয়ে দরজার কাছে যায়। উত্তেজনায় আর আশঙ্কায় সে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে আছে, তার মাংসপেশিগুলো টানটান হয়ে আছে। সে দরজা খোলার জন্যে দরজা ধরে টান মারে। পাস্কো ওপাশেই থাকবে। তার পচাগলা মৃতদেহ নিয়ে তার জন্যে দাড়িয়ে থাকবে।
কিছুই নেই। দরজার ওপাশটা একদম শূন্য এবং নীরব। বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দই নেই। সে তার বিছানায় ফিরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
অধ্যায় ২১
পরদিন লুইস ইএমএমসি’র ইনটেনসিভ কেয়ারে ফোন করে নরমার খোঁজ নিল। নরমার অবস্থা তখনো আশঙ্কাজনক বলে ধরা হচ্ছে সেখানে, যেটা হার্ট অ্যাটাকের পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টার জন্যে সাধারণ কার্যপ্রণালী। তবে লুইস নরমার ডাক্তার ওয়েব্রিজের কাছ থেকে আরো উৎসাহমূলক জবাব পায়। “আমি এটাকে ছোটখাট মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশনও বলবো না।” সে বলে। “কোন ক্ষত চিহ্ন নেই, সে ক্ষেত্রে আপনার অবদান অনেক, ড. ক্রিড।”
পরের সপ্তাহে লুইস এক তোড়া ফুল নিয়ে নরমার সাথে দেখা করতে গেল। ওনাকে ইন্টেন্সিভ কেয়ার থেকে একটি সেমি প্রাইভেট রুমে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, এটা একটা ভালো লক্ষণ। জাড তার সাথেই ছিলেন।
নরমা ফুল পেয়ে উচ্ছসিত হলেন। তিনি জাডকে নির্দেশনা দিয়ে দিয়ে ফুলগুলো ফুলদানিতে পানি দিয়ে রাখলেন, ঠিক তার মনের মত করে।
“নানী বেশ ভালোই আছে, আগের চাইতেও ভাল,” জাড তৃতীয়বারের মত নরমার নির্দেশনা অনুযায়ী ফুলগুলো সাজিয়ে শুকনো গলায় বললেন।
“বেশি চালাকি করো না, জাডসন।” নরমা বলেন।
“নো, ম্যাম।”
এরপর নরমা লুইসের দিকে তাকালেন। “জাড আমাকে সব বলেছে, কিভাবে তুমি আমাকে ওই মুহূর্তেই ট্রিটমেন্ট দিয়েছো,” তিনি অনেকটা লজ্জিত গলায় বললেন। “জাড বলেছে তুমি আমার জীবন বাঁচিয়েছ।”
অপ্রস্তুত হয়ে লুইস বলে, “উনি বাড়িয়ে বলেছেন।”
“উনি একটুও বাড়িয়ে বলেননি,” জাড বলেন। তিনি তেরছা চোখে লুইসের দিকে তাকালেন, তার মুখ হাসি হাসি। “তোমার মা কি তোমাকে কারো ধন্যবাদ গ্রহন করতে শেখায় নি?”
নরমা তখন কিছু বলেছিল কি না লুইসের ঠিক মনে নেই। তবে তার এটা মনে আছে যে তিনি আগে কখনো বলেছিলেন বিনয় হচ্ছে অহংকারের অর্ধেক পাপ।
“নরমা,” সে বলে, “আপনার জন্য যা করেছি আমি খুশি মনেই করেছি।”
“তুমি খুব ভালো ছেলে, লুইস,” নরমা বলেন। “এখন এই বুড়োকে নিয়ে বাইরে যাও, যাতে সে তোমাকে এক গ্লাস বিয়ার কিনে খাওয়াতে পারে। আমার ঘুম পাচ্ছে, আর এই লোকটা থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুক্তি চাই।”
জাড উৎসাহের সাথে উঠে দাঁড়ালেন। “ওরে বাপরে! বলে কী বুড়ি! চলো লুইস, এখানে আর এক মুহূর্তও না, সে তার মত পরিবর্তনের আগেই ভাগি আমরা।”
***
“থ্যাঙ্কস গিভিং’ এর আগের সপ্তাহে প্রথম তুষার পড়ে। বাইশে নভেম্বর আরো চার ইঞ্চি তুষার পড়ে। তবে ছুটির দিন শুরু হবার আগের দিন ঠান্ডা থাকলেও আকাশ পরিস্কার হয়ে যায়। লুইস তার পরিবারের সবাইকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে যায়। এলিরা তাদের নানা বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছে, শিকাগোতে।
“এটা ঠিক না,” এ মাসের শুরুতে বেড়াতে যাওয়ার আলোচনা শুরু হবার পর থেকে রাচেল বিশতম বারের মত বলে। থ্যাঙ্কস গিভিং’ এর দিন তুমি বাসায় একা একা বসে থাকবে আর আমরা শিকাগোতে আনন্দ করবো, ব্যাপারটা আমার একদম পছন্দ হচ্ছে না। এই দিনটা পরিবারের সাথে উদযাপন করার দিন, লুইস।”
“আমি বাসায় বসে একা একা ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবো না,” লুইস বলে। “জাড আর নরমা আমাকে ওদের বাসায় টার্কির জন্যে দাওয়াত দেবে। আরে, আমার নিজেরি তো অপরাধী অপরাধী লাগছে। আমার এসব দিন এমনিতেও বিশেষ কিছু মনে হয় না। দুপুরে কোন ফুটবল ম্যাচ দেখতে দেখতে বিয়ার গিলে সাতটার দিকেই ঘুমিয়ে পড়ি, আর পরের দিন ঘুম থেকে উঠে মনে হয় আমার মাথার ভেতর কেউ ঢোল পেটাচ্ছে। আমার শুধু তোমাদের পাঠিয়ে দিতে খারাপ লাগছে।”
“আমরা তো ভালোই থাকবো,” রাচেল বলে। “ফার্স্ট ক্লাসে চড়ে যাচ্ছি, আমার তো নিজেকে প্রিন্সেস মনে হচ্ছে। আর গেজ তো পুরো ফ্লাইট ঘুমিয়েই কাটাবে।”
“দোয়া কর যেন ঘুমিয়ে থাকে বিচ্ছু মিয়া,” লুইস বললে তারা দুজনেই একসাথে হেসে ওঠে।
লাউড স্পিকারে ফ্লাইট ঘোষনা করলে এলি লাফালাফি শুরু করে। “ওটা আমাদের ফ্লাইট, মা চলো-চলো চলো-চলো। পরে ওরা আমাদের রেখেই চলে যাবে।”
“না, যাবে না,” রাচেল বলে। সে তার এক হাতে তিনটি বোর্ডিং টিকেট মুঠ করে ধরে আছে। রাচেল একটা পশমি কোট পড়ে আছে, নকল পশমের কোট। নকল হোক আর যাই হোক, রাচেলকে খুব সুন্দর লাগছে।
রাচেল হয়তো লুইসের চোখে কিছু দেখতে পায়, কারণ সে সাথে সাথে ওকে জড়িয়ে ধরে। ওদের দুজনের মাঝে পড়ে গেজ প্রায় ভর্তা হবার জোগাড়, তবে গেজ রাগ করলো না।
“লুইস ক্রিড, আই লাভ ইউ,” সে বলে।
“আম্মুউউ,” এলি বলে, অস্থির হয়ে। “চলো-চলো–চ-”
“আরে বাবা আচ্ছা,” রাচেল বলে। “ভালোভাবে থেকো, আর একদম দুষ্টুমি করবে না, লুইস।”
“আচ্ছা,” লুইস মুচকি হেসে বলে। “আমি সাবধানে থাকবো। তোমার বাড়ির সবাইকে আমার হয়ে শুভেচ্ছা দিও।”
ওহ, তুমি!” রাচেল বলেই নাক কুচকে ফেলে। রাচেল বোকা না, ও জানে লুইসের না যাওয়ার আসল কারণ কি। “খুব ফা-নিইই”
সে তাদের সিঁড়ি দিয়ে প্লেনে উঠতে আর আগামী এক সপ্তাহের জন্য অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখে। ওর এখনি হোমসিক আর একা লাগতে শুরু করে তাদের জন্যে।
সত্যটা খুব সহজ। রাচেলের বাবা-মা, মিষ্টার এবং মিসেস আরউইন গোল্ডম্যান একদম শুরু থেকেই লুইসকে পছন্দ করেন না। প্রথমত সে তাদের মত সম্ভ্রান্ত পরিবারের কেউ না। আরো মন্দ ব্যাপার হচ্ছে লুইস মেডিকেলে পড়ার সময় তাদের মেয়ের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিল, যেখান থেকে তার পাস করার মত যোগ্যতাই নেই।
লুইস এগুলো সব মেনে নিতে পারতো, আদতে মেনেও নিয়েছিল। কিন্তু তার পর এমন কিছু ঘটে যেটা রাচেল জানে না এবং কখনোও জানবে না…অন্তত লুইসের কাছ থেকে তো নয়ই। আরউইন গোল্ডম্যান লুইসের মেডিকেল কলেজের সমস্ত খরচ দিতে চেয়েছিলেন। আর এই স্কলারশিপের (গোল্ডম্যানের নিজের ব্যবহার করা শব্দ) দাম হচ্ছে, লুইসকে ঠিক ওই মুহূর্তে রাচেলের সাথে এনগেজমেন্ট ভেঙে দিতে হবে।
লুইসকে যখন এই নাটকীয় ঘুষের (কোদালকে কোদাল বলাই শ্রেয়) প্রস্তাব দেয়া হয় তখন সময়টা লুইসের অনুকূলে ছিল না। অবশ্য এসব প্রস্তাব অনুকূল অবস্থায় দেয়া হয়ও না। একে সে প্রচন্ড ক্লান্ত ছিল। সপ্তাহে আঠারো ঘন্টা ক্লাস করছিল, বিশ ঘন্টা বইয়ের পেছনে আরো পনেরো ঘন্টা একটা পিজা জয়েন্টে ওয়েটারি করে যাচ্ছিল। সে খুব নার্ভাসও ছিল। মিষ্টার গোল্ডউইন যখন তাকে তার স্টাডিতে সিগারের দাওয়াতে ডেকে পাঠান, তখন সে আসলেই খুব ভয়ে ভয়ে ছিল। তার আশঙ্কা হচ্ছিল যে তিনি যেকোন সময় বলে বসবেন, “লুইস তুমি আমার মেয়ের সাথে শুয়ে বেড়াচ্ছ, আমি সেটা জেনে গেছি।”
যখন মি. গোল্ডম্যান তার অবিশ্বাস্য অফারটি করেন, এমনকি কোটের পকেট থেকে চেকবইটাও বের করেন, লুইস তখন ক্ষোভে ফেটে পড়ে, তাকে যা-তা শুনিয়ে দেয়। সে বলে, তার মত নিচু মনের মানুষ সে আগে কখনো দেখেনি, যে কি না আর কাউকে মানুষই মনে করে না। সে একজন নির্বোধ হারামজাদা। তবে অনেক দিন পর লুইস স্বীকার করে যে, তার ক্রোধের এই অংশটা অনেকটাই ছিল তার সেই দুশ্চিন্তার ভার নেমে যাওয়ার বহিঃপ্রকাশ।
এরপর দুজনেরই মুখের লাগাম ছুটে যায়, একপর্যায়ে গোল্ডম্যান তাকে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। আরো বলেন, যদি তিনি লুইসকে আর কখনো তার বাড়ির ধারেকাছেও দেখেন তাহলে ওকে কুকুরের মত গুলি করে মারবেন। লুইস তাকে বলে, তিনি তার চেকবইটা তার পাছার ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে পারেন। গোল্ডম্যান জবাবে বলেন, রাস্তার গরু-ছাগলের মধ্যে লুইসের চাইতে বেশি যোগ্যতা দেখেছেন তিনি। পাল্টা সে বলে, তিনি যেন তার ব্যাংক আমেরিকা কার্ডটাও চেকবইয়ের পাশাপাশি পাছার ভেতর জায়গা করে দেন।
মোটকথা জামাই শ্বশুড়ের শুরুটা হয় প্রচন্ড ঠোকাঠুকির মধ্য দিয়ে।
শেষে রাচেল তাদের দুজনের মাঝে মিটমাট করায়, তারা প্রত্যেকে নিজেদের পাপের জন্য মুখে ঠিকই ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে ভেতরে ভেতরে এখনো কেউ কাউকে দেখতে পারে না। তাদের রম্য নাটকের সেখানেই আপাত ইতি হয় এবং আমার আজ-থেকে-কোন-মেয়ে-নেই এরকম নাটকও তাদের দেখতে হয় না। তবে লুইসের কাছে নিজের মেয়েকে বিয়ে দেয়ার চাইতে তিনি যে রুপকথার কোন দৈত্যকে জামাই হিসেবে বেশি পছন্দ করতেন তা বুঝতে লুইসের কখনই বেগ পেতে হয়নি। তাদের বিয়ের দিন পুরোটা সময় তিনি নিজের মুখটা হাড়ির মত করে রেখেছিলেন। গোল্ডউইনদের পক্ষ থেকে রাচেলের বিয়ের গিফট ছিল চিনে মাটির ডিনার সেট আর একটা মাইক্রোওয়েভ ওভেন। গিফট হিসেবে কোন টাকা তিনি দেননি। লুইসের মেডিকেল পড়াশোনার পুরোটা সময় রাচেল একটা গহনার দোকানে ক্লার্কের চাকরি করেছে। আর তখন থেকে এখন পর্যন্ত রাচেল জানে লুইস আর তার পরিবারের মধ্যে কিছুটা চাপা ক্ষোভ আছে, বিশেষ করে লুইস আর তার বাবার মাঝে।
লুইস চাইলে তাদের সাথে যেতেই পারতো, তবে ইউনিভার্সিটি সিডিউলের কারণে রাচেল আর বাচ্চাদের তিনদিন আগেই তাকে ফিরে আসতে হতো। সেটা তেমন কোন বড় সমস্যা না। অন্য দিকে তার শ্বশুড় রাবন আর শ্বাশুড়ি সুয়োরাণীর সাথে চারদিন কাটানো আসলেই তার জন্যে অনেক বড় সমস্যা।
বাচ্চা হবার পরে অবশ্য রাচেলের বাবা-মা অনেকটাই গলেছেন, নাতি- নাতনী হলে সাধারণত যা হয়ে থাকে। আর লুইস নিজেও হয়তো তাদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলাতে পারবে, সেদিনের ঘটনা ভুলে যাওয়ার অভিনয় করে। সে যে অভিনয় করছে সেটা রাচেলের বাবা বুঝতে পারলেও হয়তো কিছু আসতো যেতো না। তবে আসলে সে তাদের সাথে পুনর্মিলনীতে সামিল হতে চাইছিল না। দশ বছর অনেক লম্বা সময়, তবে রাচেলের বাবার স্টাডির সেদিনের ঘটনা ভোলার জন্য যথেস্ট লম্বা নয়। সে আর রাচেল যে দিনগুলো-মোট পাঁচদিন-তার চিপা অ্যাপার্টমেন্টে কাটিয়েছিল সেগুলো রাচেলের বাবা টের না পাওয়ায় সে হাফ ছেড়ে বেঁচেছিল, তবে সেদিনের ঘটনায় তার শ্বশুড়ের প্রতি যেই অশ্রদ্ধা তার মনে জন্ম নিয়েছিল তা দশ বছর পরেও বহাল তবিয়তে আছে।
সে যেতেই পারতো। কিন্তু নিজে না গিয়ে তার শ্বশুরকে একটা মেসেজসহ তার মেয়ে আর নাতি-নাতনীকে পাঠালো
ডেল্টা ৭২৭ চলতে শুরু করে এবং নাকটা ঘোরায়। বিমানের একটা জানালার পাশে সে এলিকে দেখতে পায়, ও তাকে লক্ষ্য করে অত্যন্ত উৎসাহের সাথে হাত নাড়ছে। সে হাসে এবং হাত নেড়ে জবাব দেয়। এরপর কেউ-রাচেল বা এলি-গেজকে জানালার পাশে ধরে। লুইসকে দেখেই হোক অথবা এলিকে নকল করেই হোক, গেজও হাত নাড়তে থাকে।
“আমার ফ্যামিলিকে ভালোভাবে নিয়ে যাও,” সে বিড়বিড় করে বলে এবং এরপর নিজের কোটের চেইন লাগিয়ে পার্কিং লটে চলে আসে। সে গাড়িতে ওঠার আগেই জেট বিমানটাকে আকাশে সশব্দে উড়ে যেতে দেখে।
তার এর মাঝেই একা একা লাগতে শুরু করেছে এবং হাস্যকরভাবে তার কান্না পাচ্ছে। লুইস আবারো সেটাকে লক্ষ্য করে হাত নাড়ায়।
সেদিন রাতে ক্র্যান্ডালদের বাড়িতে আড্ডা দিয়ে ফেরার সময়ও তার খুব খারাপ লাগছিল। সেদিন রাতে সে আর ক্র্যান্ডালরা ক্র্যান্ডালদের কিচেনে বসে আড্ডা দেয়। শীতের কারণে পোর্চে বসা আর সম্ভব না।
জাড ঘর গরম করার মারলেক স্টোভের আঁচ খুব বাড়িয়ে দেন এবং ওরা সবাই সেটাকে ঘিরে বসে। জাড সেরাতে মিকমেক ইন্ডিয়ানদের গল্প বলেন, কিভাবে তারা দুইশত বছর আগে এখানে ব্রিটিশদের আস্তানা গড়ার স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ করে দেয়। সে সময় মিকমেকরা খুব ভয়ঙ্কর ছিল। এবং এখনো অনেকেই তাদের ভয়ঙ্কর মনে করে।
সবকিছু মিলিয়ে বিকেলটা খারাপ ছিল না। তবে শূন্য বাসার কথা ভেবে লুইসের কিছুই ভালো লাগছিল না।
সে যখন রাস্তার ওপর মচমচে বরফের আস্তর মাড়িয়ে বাসায় ফিরছিল, তাদের বাসার ফোন রিং হবার শব্দ শুনতে পায়। সে ছুটতে শুরু করে, সামনের দরজা দিয়ে ঢুকে লিভিং রুম দৌড়ে পার হয় এবং ছোটার সময় তার গায়ে লেগে তাদের ম্যাগাজিন স্ট্যান্ডটা ভূপাতিত হয়। আর মসৃণ লিনেলিয়াম বিছানো কিচেনের বাকি অংশটা সে বরফমাখা জুতো দিয়ে পিছলে পিছলে গিয়ে ফোনটা ছো মেরে তুলে নেয়।
“হ্যালো?”
“লুইস?” রাচেলের কন্ঠ। “আমরা পৌঁছে গেছি। পথে কোন ঝামেলা হয়নি।”
“গ্রেট!” বলে সে একটা চেয়ারে বসে পড়ে রাচেলের সাথে কথা বলার জন্য। সে ভাবে, ইস! তুমি যদি এখানে থাকতে।
অধ্যায় ২২
ক্র্যান্ডালদের বাসায় থ্যাঙ্কস গিভিং ডিনারটা বেশ ভালোই হয়। সেই পাঠ চুকিয়ে ভরপেটে লুইস যখন বাসায় ফিরে তখন তার বেশ ঘুম পাচ্ছিল। সে নিজের বেডরুমে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা উপভোগ করে শুয়ে পড়ে। ঘড়িতে তিনটার মতো বাজে, বাইরে তখনো শীতের পাতলা রোদ।
একটু ঘুমিয়ে নেই, ভেবে সে খুব দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ে। বেডরুমের টেলিফোন এক্সটেনশনটা বেজে উঠলে ওর ঘুম ভেঙে যায়। ততক্ষনে অন্ধকার নেমে এসেছে। সে বাড়ির চারদিকে বাতাসের শো শো শব্দ শুনতে পারছে। সে হাতড়ে ফোনটা খামচে ধরে কানের কাছে নেয়।
“হ্যালো,” সে বলে। তার ধারণা রাচেল তাকে আবারো থ্যাঙ্কস গিভিং- এর শুভেচ্ছা জানাতে সুদূর শিকাগো থেকে ফোন করেছে। রাচেল প্ৰথমে কথা বলবে, বলে ফোন এলির কাছে দিলে ও কথা বলবে, এরপর ফোন গেজের কাছে দিলে সে আবোল তাবোল কিছু শব্দ করবে। আর সে কিভাবে পারলো ফুটবল ম্যাচ মিস করে পুরো সময়টা ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে….
তবে ফোনের ওপাশে রাচেল ছিল না, ছিল জাড ক্র্যান্ডাল। “লুইস? তোমার একটা ছোটখাট ঝামেলা হয়েছে।”
সে বিছানায় বসে চোখ ডলতে ডলতে বলল, “জাড, কী হয়েছে?”
“আমাদের উঠোনে একটা বিড়াল মরে পড়ে আছে,” জাড বললেন। “আমার ধারণা এটা তোমার মেয়ের বিড়াল।”
“চার্চ?” লুইস জিজ্ঞেস করে। হঠাৎ তার পেটের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে। “আপনি শিওর ওটা চার্চ?”
“না, আমি একশভাগ শিওর না,” জাড বললেন। “তবে দেখে তোমার মেয়ের বিড়ালই মনে হচ্ছে।”
“ওহ। ওহ শিট। আমি আসছি।”
“ঠিক আছে, লুইস।”
সে ফোন রেখে মিনিট খানেক সময় চুপচাপ বসে থাকে। তারপর সে বাথরুম ব্যবহার করে জুতো পড়ে নিচতলায় নেমে আসে।
হয়তো ওটা চার্চ না। জাড তো বললেন উনি শতভাগ নিশ্চিত না। বালের বিড়ালটাতো এখন নিচতলা থেকে ওপরতলাতেও যেতে চায় না, যদি না কেউ ওকে বয়ে নিয়ে যায়…তাহলে কেন বিড়ালটা মরার জন্যে ওই রাস্তাটা ক্রস করতে যাবে?
তবে তার মন বলছিল ওটা চার্চই…আর আজ যখন এলি লুইসের কাছে ওর বিড়ালের কথা জানতে চাইবে, সে কি উত্তর দেবে?
সে রাচেলকে কী বলেছিল তা মনে পড়ে গেল। আমি জানি যে যেকোন প্রাণী যেকোন মুহূর্তে মরে যেতে পারে। একজন ডাক্তার হিসেবে আমি জানি…যদি চার্চের এরকম খারাপ কিছু হয়, তাহলে সেই ব্যাপারটা তুমি নিজে এলিকে বোঝাবে তো?”
তার এক পোকার খেলার বন্ধুর কথা মনে আছে। সেই বন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করেছিল যে সে কিভাবে নগ্ন মহিলা রোগিদের দেখে উত্তেজিত না হয়ে পারে? সে যেহেতু তার স্ত্রীকে দেখে উত্তেজিত হয়, তাহলে অন্য নগ্ন নারীদের দেখেও তো তার উত্তেজিত হবার কথা। লুইস তাকে বোঝাতে চেয়েছিল যে দুটো সম্পূর্ণ দুরকম। রোগি দেখার সময় রোগিকে সে যৌনসঙ্গি হিসেবে ভাবে না। সে হয়তো তার বুক দেখে, অথবা তার উরু বা তার যোনি, কিন্তু সেই রোগি তো তার সামনে রানি হেলেনের মত সেক্সি পোজ দিয়ে বসে থাকে না। এবং তার বাকি শরীর তো ঢাকাই থাকে। তাছাড়া সেখানে একজন নার্স উপস্থিত থাকে, যার অন্যতম কারণ হচ্ছে ডাক্তারের রেপুটেশন রক্ষা করা। কিন্তু তার বন্ধু তার কথা মানতে নারাজ। তার বন্ধুর মতে নারীর বুক তো নারীর বুকই, হয় লুইসের সারাদিন উত্তেজিত থাকার কথা আর নাহলে তার কখনই উত্তেজিত হবার কথা না। লুইস জবাবে শুধু বলেছিল যে নিজের বউয়ের বুক আর রোগির বুক এক না, আলাদা।
ঠিক যেমন তোমার পরিবার অন্য সবার চাইতে আলাদা, সে ভাবে। চার্চ মরতে পারে না কারণ যেভাবেই হোক, চার্চ তাদের পরিবারের বৃত্তের ভেতর ঢুকে গেছে।
কিছু মনে করো না, মাথা ঠান্ডা রাখো।
তবে চার্চের মৃত্যুর কথা ভেবে এলি যেভাবে হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল তা ভেবে লুইসের পেটের ভেতর আবার পাক দিয়ে ওঠে।
বালের বিড়াল…কী দরকার ছিল আমাদের বিড়াল পালার? মরেই যখন যাবে এতো কসরত করে খাসি করার কি দরকার ছিল?
“চার্চ?” লুইস গলা উঁচু করে ডাকে কিন্তু কোন সাড়া পায় না। নিস্তব্ধতার মাঝে শুধু ফার্নেসের পয়সা পোড়ানোর মটমট শব্দ। চার্চ তার দিনের বেশির ভাগ সময় লিভিং রুমের সোফায় শুয়ে বসে কাটাতো, সেখানেও সে নেই। সে রুম গরম করার কোন রেডিয়েটরের ওপরেও রাজকীয় ভঙ্গিতে শুয়ে নেই। লুইস চার্চের খাবারের ডিশটা ঝাঁকিয়ে শব্দ করে, যেটার আওয়াজ চাৰ্চ শুনতে পেলে যে ছুটে আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন বিড়াল দৌড়ে এলো না. আর হয়তো কখনই আসবে না।
গায়ে কোট চাপিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে কী মনে করে আবার ফিরে এলো। সে হাঁটু গেড়ে বসে সিঙ্কের নিচের কাপবোর্ডটা খোলে। সেখানে দুরকমের পলিথিন ব্যাগ ছিল, বাসার ময়লা জমানোর সাদা ছোট ব্যাগ আর বাইরে গার্বেজ ক্যানের জন্যে বড় কালো ব্যাগ। সে কালো ব্যাগগুলো থেকে একটা নিয়ে নেয়। বিচি ফেলার পর থেকে চার্চের ওজন বেশ বেড়ে গেছে।
পলিথিন ব্যাগটা কোটের পকেটে ঢুকিয়ে সে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে।
সাড়ে পাঁচটার মত বাজে। গোধূলির শেষ আলোটাও মিলিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে বিষণ্ণতা বিরাজমান। গত সূর্যাস্তের স্মৃতি হিসেবে নদীর ওপারে কমলা আলোর আভা এখনো দেখা যাচ্ছে। রুট ১৫ দিয়ে ঠান্ডা বাতাস এসে তার গাল অবশ করে দিচ্ছে এবং তার নিশ্বাসের সাথে বের হাওয়া সাদা বাষ্প খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে কেঁপে ওঠে, তবে ঠান্ডার কারণে না। চারদিকের নির্জনতার অনুভূতি তাকে কাঁপিয়ে দেয়। অনুভূতিটা বেশ জোরালো আর ছোঁয়াচে। অজ্ঞাত জিনিসটা কোন উপমা দিয়েই প্রকাশ করা যাবে না। শুধু অস্পৃষ্ট জিনিসটা অনুভব করতে পেরেছে সে।
রাস্তার ওপাশে ডাফল কোটে মোড়া জাডকে দেখতে পায় সে। জাডের পশমের পাড় লাগানো হুডের ছায়ায় তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। নিজের জমাট বাধা উঠোনে দাঁড়ানো জাডকে মূর্তির মত লাগছে, যেন সন্ধ্যালোকের ছবিতে আরেকটি মৃত বস্তু।
লুইস রাস্তা পার হতে শুরু করলে জাড এগিয়ে এসে তাকে পিছিয়ে যেতে ইশারা করতে থাকে। জাড চিৎকার করে কিছু বলছে কিন্তু বাতাসের গর্জনে লুইস কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। লুইস পিছিয়ে যায় এবং উপলব্ধি করতে পারে হঠাৎই যেন বাতাসের গর্জন আরো জোরালো এবং ধারালো হয়ে উঠেছে। এর মুহূর্ত পরেই একটা হর্ন পো-পো করে উঠে এবং একটা মস্ত অরিঙ্কো ট্রাক গর্জন করতে করতে লুইসের এতো কাছে দিয়ে চলে যায় যে তার প্যান্ট এবং জ্যাকেটে বাতাসের ঝাপ্টা লাগে। আরেকটু হলেই সে ওই নরকের দূতের সামনে পড়ে যাচ্ছিল।
এবার সে রাস্তা পার হবার আগে রাস্তার দুদিকেই দেখে নেয়। সন্ধ্যালোকে শুধু ট্যাঙ্কারের টেইল লাইটগুলো দেখা যাচ্ছিল।
“আজ তো আরেকটু হলেই তোমাকে ট্রাকটা খেয়ে দিয়েছিল,” জাড বলেন। “আরেকটু সাবধান হও, লুইস।” এতো কাছ থেকেও লুইস জাডের চেহারা দেখতে পাচ্ছে না। তার অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি হয় যে তার সামনের মানুষটা যে কেউ হতে পারে…যে কেউ।
“নরমা কোথায়?” লুইস জাডের পায়ের কাছে হাত পা ছড়িয়ে পড়ে থাকা পশমের পোটলার দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করে।
“ও থ্যাঙ্কস গিভিং চার্চ সার্ভিস এ্যাটেন্ড করতে গেছে।” বাতাসে জাডের মাথার হুডটা নড়ে গেলে লুইস দেখে যে সেটা আসলেই জাড ক্র্যান্ডাল-তিনি ছাড়া আর কেই বা হতে পারতো? আজব…, “সব বান্ধবীরা এক হয়ে আড্ডা দেয়ার ফন্দি আর কী। রাতে খেয়ে আসবে,” জাড বলেন।
লুইস হাঁটু গেড়ে বসে, বিড়ালটাকে পরীক্ষা করার জন্যে। এটা যেন চাৰ্চ না হয়, সে গ্লাভস পড়া আঙুল দিয়ে বিড়ালটার ঘাড় তার দিকে ফেরাতে ফেরাতে ঐকান্তকতার সাথে কামনা করে। এটা যেন অন্য কারো বিড়াল হয়।
জাডের ধারণা যেন ভুল হয়।
কিন্তু এটা চার্চই। বিড়ালটার দেহ কোন রকম বিকৃত হয়নি বা গায়ে বড় রকমের কোন ক্ষতের চিহ্ন নেই; সে রুট ১৫তে চলাচলকারী কোন বড় ট্রাকের নিচে চাপা খায়নি (থ্যাঙ্কস গিভিং এর ছুটিতে ওই অরিংকো ট্রাকটা রাস্তায় করছেটা কী, সে বিক্ষিপ্তভাবে চিন্তা করে।)। চার্চের চোখগুলো আধা খোলা, সেগুলো সবুজ মার্বেলের মত চকচক করছে। একটা চিকন রক্তের ধারা ওর খোলা মুখ থেকে বের হয়ে এসেছে। রক্তের পরিমাণ বেশি না তবে তার বুকের কাছের সাদা ফুটকিটা রাঙ্গিয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট।
“তোমাদেরটা, লুইস?”
“হুম,
চার্চ,” সে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সম্মতি জানায়।
সে প্রথমবারের মত উপলব্ধি করলো যে সে চার্চকে ভালোবাসে, হয়তো এলির মত তীব্রভাবে না-তার নিজের মত করে। খোজা করার পর চার্চ বদলে গেছে, সে এখন তার মোটা দেহ নিয়ে হেলে দুলে হাটে। তার যাতায়াতের গণ্ডি এলির বিছানা, সোফা আর তার খাবারের ডিশ এবং কদাচিৎ ঘরের বাইরে। তবে লুইসের কাছে মৃত চার্চকে আগের চার্চের মত লাগছে। তার সুচারু দাঁত বিছানো রক্তাক্ত মুখটা হিংস্রভাবে দাঁত খিচিয়ে আছে। তার চোখেও প্রচন্ড ক্ষিপ্রতা। চার্চ যেন তার খোজা জীবনের অবসানের পরে তার পূর্বের ক্ষিপ্রতা ফিরে পেয়েছে।
“এটা চার্চ, কোন সন্দেহ নেই। এলিকে যে এই কথা কিভাবে বলবো আমার মাথায় আসছে না।”
হঠাৎ তার মাথায় একটা আইডিয়া আসে। সে চার্চকে পেট সেমিট্রিতে কবর দিয়ে দেবে, কোন স্টুপিড স্মৃতিফলক ছাড়াই। আজ সে এলিকে এই ব্যাপারে কিছুই বলবে না, আর আগামীকাল এলি চার্চের কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে সে সারাদিন চার্চকে দেখেনি। এর পরের দিন সে ইঙ্গিত দেবে চার্চ হয়তো হারিয়ে গেছে। বিড়ালরা এরকম প্রায়ই করে। এলি কষ্ট পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই তবে চার্চের মৃত্যু সংবাদ থেকে অনেক কমই পাবে। আর রাচেল…আর এতে করে তাকে রাচেলের মৃত্যু বিষয়টা নিয়ে বিধ্বংসী প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখিও হতে হবে না।
কাপুরুষ, তার মনের এক কোণে উচ্চারিত হতে থাকে।
হ্যাঁ…এ ব্যাপারে কোন বিতর্ক নেই। তবে এই ঝামেলায় কে জড়ায়?
“এলি ওকে খুব ভালোবাসে, না?” জাড বলেন।
“হ্যাঁ,” লুইস অন্যমনস্কভাবে জবাব দেয়। সে লুইসের মাথাটা আবারো নাড়ায়। চার্চের দেহ শক্ত হয়ে যেতে শুরু করেছে, তবে সেই তুলনায় তার মাথাটা খুব সহজেই ঘোরানো যাচ্ছে। ভাঙা ঘাড়। এটা দেখে লুইস বুঝে নেয় কি ঘটেছে। চার্চ রাস্তা পেরোচ্ছিল-খোদা জানেন কী কারণে আর কোন ট্রাক তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশে ছুড়ে ফেলে। ধাক্কায় তার ঘাড় ভেঙে যায় অথবা শক্ত বরফে ছিটকে পড়ে…ঘটনাটা যেভাবেই ঘটুক, শেষ কথা চাৰ্চ মারা গেছে।
লুইস তার অনুমানের কথা জাডকে বলতে গেলে সে দেখে জাডের খেয়াল এদিকে নেই। তিনি দিগন্তে গোধূলির কমলা রেখার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার মাথার হুড খানিকটা নেমে আসায় লুইস তার মুখখানা দেখতে পায়। তার চেহারায় দুশ্চিন্তা আর কঠোরতার ছাপ।
লুইস তার পকেট থেকে সাদা গার্বেজ পলিথিন ব্যাগটা বের করে শক্ত করে ধরে ভাজ খোলে, যাতে বাতাসের ঝাপ্টায় সেটা উড়ে চলে না যায়। পলিথিনটা বাতাসের ঝাপ্টার ফরফর শব্দ শুরু করলে জাড তার সম্বিত ফিরে পেয়ে বর্তমানে ফিরে আসেন।
এলি খুব ভালবাসে বিড়ালটাকে, বুঝতে পারছি।” জাড বললেন। এই মরা জিনিসটাকে এলি ভালোবাসে, কথাটা লুইসের কানে খুব অতিপ্রাকৃত মনে হয়। চারদিকের নির্জনতা, গোধূলির আধো অন্ধকার, মরা বেড়াল সবকিছু মিলিয়ে যেন একটা ভুতূড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।
জমে যাওয়া বরফ থেকে সে চার্চের লেজ ধরে তুলতে চাইলে চার্চের শরীর ফরফর শব্দ করে ওঠে, কারণ চার্চের শরীর বরফের সাথে জমে লেগে গিয়েছে। পলিথিন ব্যাগটার মুখ খুলে সেটাতে চার্চকে ঢুকাতে গেলে সে টের পায় চার্চের ওজন অনেক বেড়ে গেছে, যেন মৃত্যু চার্চের শরীরে ভৌত পদার্থের মত জেঁকে বসেছে। ওহ খোদা, চার্চকে তো বালুর বস্তার মত মনে হচ্ছে।
জাড ব্যাগটার অন্য পাশে ধরলে লুইস চার্চকে সেটার ভেতর ভরে দেয় এবং ওজনদার মরা জিনিসটা হাত থেকে নামাতে পেরে সে বাঁচে।
“ওকে এখন কী করবে?” জাড জিজ্ঞেস করলেন।
“আজকে গ্যারেজে রাখব মনে হয়,” লুইস বলে। “কাল সকালে কবর দিবো।”
“পেট সেমিটারিতে?”
“মনে হয়,” লুইস কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে।
“এলিকে বলবে?”
“আমার…আমার একটু ভাবা লাগবে…”
জাড কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন এবং এরপর মনে হলো তিনি কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন। “এখানে দুই-এক মিনিট দাঁড়াও, লুইস।”
জাড আর কিছু না বলেই নিজের বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। তার মনে একবারও উদয় হলো না যে এই বিশ্রী রাতে লুইস হয়তো আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা চাইছে না। তিনি অবিচলভাবে হেঁটে গেলেন, যা তার বয়সি বৃদ্ধের জন্য অস্বাভাবিক কিছু না। আর লুইসেরও আসলে বলার মত কিছু ছিল না। সে তখন নিজের মধ্যে নেই। সে সন্তুষ্ট মনে জাডকে যেতে দেখে।
দরজা বন্ধ হবার ক্লিক শুনলে সে বাতাসে মুখ তুলে তাকায়। চার্চের লাশ ভরা ব্যাগটা বাতাসে ফরফর করছে।
সন্তুষ্ট।
হ্যা, ঠিক তাই। মেইনে আসার পর এই প্রথম তার মনে হলো সে তার নিজের জায়গায় আছে। এই শীতের রাতে দিনের আলোর শেষ রেখা মিলিয়ে যাবার আগে সে একাকী দাড়িয়ে আছে, মনে কষ্ট নিয়ে। তারপরও তার এক রকম অদ্ভুত উত্তেজনা বোধ হচ্ছে, যে রকমটা সে তার ছোটবেলার পর আর কখনো অনুভব করেনি।
এখানে কিছু ঘটতে যাচ্ছে বন্ধু…খুব অদ্ভুত কিছু।
সে ওপরের দিকে তাকিয়ে ক্রমশ কালো হতে থাকা আকাশে মিটমিটে তারা দেখতে পায়।
এভাবে ঠিক কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, তা সে বলতে পারবে না। তবে সেটা মিনিট আর সেকেন্ডের কাটায় খুব বেশি হবে না হয়তো। এরপর জাডের পোর্চে একটা আলোর উৎস ঝাঁকি দিয়ে জ্বলে উঠে। লুইস দেখতে পায় আলোর উৎসের পেছনে জাড। তিনি তার এক হাতে একটি চার ব্যাটারির ফ্লাশ লাইট ধরে আছেন। লুইসের কিছুক্ষণের জন্যে মনে হলো জাডের আরেক হাতে একটি ইংরেজি X… পরক্ষণেই সে বুঝতে পারলো সেটা আসলে আড়াআড়িভাবে ধরা একটা মাটি খোঁড়ার কুড়াল আর একটা বেলচা।
তিনি বেলচাটা লুইসের হাতে দিলে সে তার খালি হাতে সেটা ধরে।
“জাড, আপনি কী করতে চাচ্ছেন খোলাসা করুন তো। এই রাতের বেলা ওকে কবর দেয়ার তো প্রয়োজন নেই।”
“আছে। এবং আজ রাতেই।” জাডের চেহারা ফ্লাশলাইটের উজ্বল বৃত্তের পেছনে হারিয়ে গেছে।
“জাড, চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। রাত নেমে গেছে। আর যা ঠান্ডা—”
“আরে চলো,” জাড বলেন। “ঝামেলাটা আজই শেষ করে ফেলি।” সে মাথা নেড়ে তার যুক্তিগুলো আবারো বলতে চাইলে সেসব তার নিজের আছেই অর্থহীন বলে মনে হয়।
“কালকে করি। এখন তো কিছু দেখতেই—”
“তোমার মেয়ে বিড়ালটাকে ভালোবাসে?”
“হ্যাঁ, তবে…”
জাডের কোমল কণ্ঠে অযৌক্তিক কথাগুলোকে কোন এক অদ্ভুত কারণে খুব যৌক্তিক মনে হতে থাকে : “তুমি তোমার মেয়েকে ভালোবাসো?”
“অবশ্যই বাসি, ও আমার মেয়ে-”
“তাহলে চলো।”
লুইস গেল।
সে রাতে পেট সেমিটারিতে যাওয়ার পথে লুইস আরো বেশ কয়েকবার জাডের সাথে কথা বলতে চায়, কিন্তু জাড কোন উত্তর দেন না। লুইস হাল ছেড়ে দেয়। আর সেই অদ্ভুত ভালোলাগা অনুভূতিটা এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতেও বিরাজমান থাকে। সবকিছু মিলিয়েই যেন এই ভালোলাগাটা। এক হাতে চার্চের ব্যাগ আর আরেক হাতে বেলচা ধরে থাকতে তার পেশিগুলোতে যে ব্যথা হচ্ছে, সেটাও এই ভালোলাগার একটা অংশ। মারাত্নক ঠান্ডা বাতাস লুইসের অনাবৃত গায়ের চামড়া অবশ করে দিচ্ছে; সেটিও ওই ভালোলাগারই একটা অংশ। অনুভূতিটা চারদিকের গাছপালায় বাতাসের সাথে ঘুরপাক খাচ্ছে। জাডের হাতের দুলতে থাকা ফ্লাশ লাইটের আলোটাও এর একটি অংশ। লুইস একটা অনুপ্রবেশকারী, অনস্বীকার্য, চুম্বকীয় কিন্তু অতি গোপন উপস্থিতির টের পাচ্ছে। গুপ্ত, কিন্তু খুব অন্ধকার কিছু।
জঙ্গলের ভেতরে তেমন বরফ নেই। তাদের ছায়ারা তাদের অনেক আগেই ত্যাগ করেছে। তারা পেট সেমিটারিতে চলে এসেছে।
“এখানে বিশ্রাম নাও একটু,” জাড বলেলেন। লুইস তার হাতের ব্যাগটা নিচে রাখে। কপালের ঘাম মুছলো সে। এখানে বিশ্রাম নেবো? কিন্তু তারা তো পেট সেমিটারিতে চলেই এসেছে। জাড পাতলা বরফের ওপর বসে নিজের দুহাতের ভেতর মুখ গুজে দিলেন। তার হাতের ফ্লাশ লাইটের আলোকচ্ছটার লক্ষ্যহীন নড়াচড়ায় সে সেমিট্রির স্মৃতিফলকগুলো দেখতে পাচ্ছে।
“জাড, আপনি ঠিক আছেন?”
“হ্যাঁ। একটু হাপিয়ে গেছি আর কি।”
লুইস তার পাশে বসে হাফ ডজন বারের মত লম্বা লম্বা শ্বাস নেয়। “জানেন?,” সে বলে, “আমার এতো ভালো লাগছে যে মনে হচ্ছে গত পাঁচ-ছয় বছরেরও কখনো আমার এতো ভালো লাগেনি। নিজের মেয়ের বিড়ালকে কবর দিতে এসে এরকম কথা বলছি শুনে হয়তো আমাকে পাগল মনে হবে, তবে এটাই সত্য। জাড, আমার বেশ ভালো লাগছে।”
জাড নিজেও কিছুক্ষণ লম্বা লম্বা শ্বাস নিলেন। “হুম, জানি,” তিনি বললেন। “কখনো কখনো এরকম হয়। তোমার কখন ভালো লাগবে তা তো আর তোমার হাতে নেই, বা অন্য কারো হাতেও নেই। আর এর পেছনে এই জায়গাটার হাত আছে, তবে তুমি হয়তো তা বিশ্বাস করতে চাইবে না। যেমন হেরোইন আসক্তদের কিন্তু হেরোইন নিতে খুব ভালো লাগে, কিন্তু তলে তলে কিন্তু আসলে সেটা তার মধ্যে বিষ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। তাদের দেহেও বিষক্রিয়া হচ্ছে এবং তাদের চিন্তা করার শক্তিতেও। এই জায়গাটাও সেরকম, আর সাবধান লুইস, এই কথাটা কখনো ভুলবে না। আমি প্রার্থনা করি যে আমি ঠিক কাজটাই করছি, কিন্তু তা আসলেই আমি নিশ্চিত হয়ে জানি না। আমার বুদ্ধি মাঝে মাঝে কাজ করে না, হয়তো ভীমরতি হয়েছে।”
“আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“এই জায়গাটার এক রকমের শক্তি আছে। এখানে এতো বেশি না সেই শক্তিটা, তবে আমরা যেখানে যাচ্ছি…”
“জাড-”
“চলো,” জাড বলেই দাড়িয়ে গেলেন। তার ফ্লাশলাইটের আলোকচ্ছটা সেই মরা গাছের ধ্বংসস্তূপের ওপর গিয়ে পড়েছে। জাড সেদিকেই হেঁটে যাচ্ছেন। লুইসের হঠাৎ সেই স্লিপ ওয়াকিং’ এর কথা মনে পড়ে যায়। স্বপ্নে পাস্কো যেনো তাকে কী বলেছিল?
ওপাশে কখনো যাবে না, তোমার যতোই ইচ্ছে হোক না কেন। এই দেয়াল তৈরি করা হয়েছে অতিক্রম না করার জন্যে।
তবে আজ রাতে সেই সতর্কবার্তাটি অনেক অনেক বছর আগের কিছু বলে মনে হচ্ছে লুইসের কাছে। লুইসের খুব ভালো লাগছে এবং প্রাণবন্ত বোধ হচ্ছে। সে এই অবস্থায় যে কোন কিছুর সাথে মানিয়ে নেয়ার জন্যে প্রস্তুত। তার মনে হচ্ছে এটাও হয়তো একটি স্বপ্ন
এরপর জাড তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। জাডের মাথার হুডটাকে মনে হচ্ছে সেটা একটুকরো অন্ধকার জড়িয়ে আছে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে লুইসের মনে হয় পাস্কোই তার সামনে দাড়িয়ে আছে। গায়ে বরফ শীতল পানির ঝাপ্টার মত তার পূর্বের সেই ভয় ফিরে আসে।
“জাড,” সে বলে, “আমরা তো স্তুপটার ওপর উঠতে পারবো না। দেখা যাবে দুজনেই পা ভেঙেছি আর এরপর বাড়ি ফিরতে না পেরে ঠান্ডায় জমে মারা যাবো।”
“শুধু আমাকে অনুসরণ করো,” জাড বললেন। “আমাকে অনুসরণ করো আর নিচের দিকে একদম তাকাবে না, লুইস। আগুপিছু করবে না, নিচেও তাকাবে না। আমি রাস্তা চিনি। তবে আমাদের খুব দ্রুত যেতে হবে।”
লুইসের মনে হতে থাকে সে স্বপ্ন দেখছে। সে হয়তো বিকেলের ঘুম থেকে এখনো জাগেইনি। আমি জেগে থাকলে নিশ্চয়ই ওই মরা ডালের স্তূপটায় চড়তে যাওয়ার মতো পাগলামি করতাম না। এটা তো মদ খেয়ে মাতাল হয়ে অংক পরীক্ষা দেয়ার মতো। আমি অবশ্যই স্বপ্ন দেখছি।
জাড স্তুপটার মাঝখান থেকে একটু বামে সরে গেলেন। তার ফ্লাশের তীব্র আলোর বৃত্ত মরা ডাল(হাড়)গুলোর ওপর পড়ছে। জাড একটুও না থেমে, সে সঠিক জায়গায় আছে কি না সে ব্যাপারে কোন রকম নিশ্চিত না হয়ে হঠাৎ করেই ধ্বংসস্তুপটার ওপর উঠতে শুরু করলেন। তিনি কোন রকম ঝুঁকে উঠতে শুরু করেন নি, যেমনটা কেউ কোন ঢালু জায়গায় উঠতে গেলে করে। তিনি স্তূপটার গায়ে এমনভাবে উঠেতে শুরু করলেন যেন তিনি কোন সাধারণ সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন। তিনি এমনভাবে হাঁটছেন যেন তিনি নিশ্চিতভাবে জানেন তার পরের পা ঠিক কোথায় ফেলতে হবে।
লুইস ঠিক একইভাবে তাকে অনুসরন করে।
সে কোথায় পা ফেলবে তা দেখার জন্যে নিচে তাকায় না। তার মনে হতে থাকে সে না চাইলে এই স্তূপটা কোনভাবেই তার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। কেউ মদ খেয়ে চুর হয়ে নিশ্চিন্তে গাড়ি চালাচ্ছে, কারণ সে জানে তার কাছে সেইন্ট লুইসের মাদুলি আছে, এটা ঠিক ওইরকম একটা নির্বোধ ভাবনা।
কিন্তু এটা কাজ করছে।
ডাল ভাঙার কোন কর্কশ মটমট শব্দ হচ্ছে না, কোন ফাঁকা জায়গায় পা ঢুকে যাচ্ছে না। বেকায়দায় পা পড়লে শুকনো ডালের ধারালো খোঁচায় পায়ের বারোটা বেজে যাবে। তার লোফার জুতো এরকম জায়গায় ওঠার জন্যে মোটেও উপযুক্ত নয়, তবুও মরা ডালে জন্মানো অনেক আগের শুকনো শ্যাওলাতেও তার পা পিছলে যাচ্ছে না। মাতাল হাওয়া তাদের চারপাশের দেবদারু গাছের ডালপালার সহযোগিতায় গান গেয়ে যাচ্ছে।
সে এই দেখলো জাড স্তুপটার একদম চূড়ায় দাড়িয়ে আছেন, আর তার পরেই দেখে তিনি নিচে নামতে শুরু করেছেন। প্রথমে তার পা অদৃশ্য হয়, তার পর হাতগুলো, এর পর কোমর। জাডের হাতের ফ্লাশের আলো কখনো মরা ডালপালাগুলোর ওপর পড়ছে, কখনো এই প্রতিবন্ধকের ওপাশের গাছের ডালের ওপর গিয়ে পড়ছে। এটা আসলে একটা প্রতিবন্ধকই, অন্য কিছু ভান করে লাভ কি?
লুইস নিজেও একদম চূড়ায় পৌঁছে কয়েক মুহূর্তের জন্যে দাড়িয়ে যায়। তার ডান পা আছে একটা পঁয়ত্রিশ ডিগ্রী কোণে পড়ে থাকা পুরনো গাছের গুড়ির ওপর আর বাম পা আছে নরম কিছুর ওপর পুরনো দেবদারু গাছের ডালের স্তূপ? সে দেখার জন্যে নিচে তাকায় না। শুধু ডান হাতের চার্চের লাশের ব্যাগটার সাথে বাম হাতের তুলনামূলক হালকা বেলচাটা অদল বদল করে নেয়। সে মুখ তুলে তাকালে বাতাসের অবিরাম প্রবাহ তার মুখ ঘেসে ঘেসে যেতে থাকে। বাতাসের প্রবাহটা প্রচন্ড ঠান্ডা, পরিস্কার… আর অবিরাম।
সে খুব স্বাভাবিকভাবে হাঁটছে। একবার মানুষের কব্জির মত মোটা একটা ডাল তার পায়ের নিচে কর্কশ শব্দে ভেঙে যায়, কিন্তু তার মনে কোন দুশ্চিন্তা হয় না-তার হড়কে যাওয়া পা তিন-চার ইঞ্চি নিচেই আরেকটা মোটা ডালের ওপর গিয়ে থামে। কিন্তু লুইস একদমই টাল হারায় না। সে ভাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় চারদিকে ছুটতে থাকা বুলেটের মধ্যে পরিখার ওপর দিয়ে সেনারা এভাবেই হয়তো মার্চ করে যেত। জিনিসটা পাগলামি মনে হলেও খুব উত্তেজক।
নিজেও স্তুপটা থেকে নামতে শুরু করে সে, জাডের ফ্লাশ লাইটের উজ্জ্বল বৃত্তটি তাক করে। জাড সেখানে তার জন্যে দাড়িয়ে আছে। এরপর সে নিচে পৌঁছে যায় আর প্রবল উত্তেজনা তার ভেতরে কয়লার মধ্যে পড়া দাহ্য তেলের মত জ্বলে উঠে।
“চলে এসেছি!” সে চিৎকার করে। সে বেলচাটা নিচে রেখে জাডের কাঁধ চাপড়ে দেয়। তার মনে পড়ে সে ছোটবেলায় একবার জাহাজের মাস্তুলের মত দুলতে থাকা একটা লম্বা আপেল গাছের চূড়ায় উঠেছিল। সে এরপরে গত বিশ বছর যাবত কখনই এতো প্রানবন্ত অনুভব করেনি। “জাড, আমরা চলে এসেছি!”
“তুমি কী ভেবেছিলে? আমরা আসতে পারবো না?”
লুইস কিছু বলার জন্যে মুখ খোলে শুধু আসতে পারবো না? আমি ভেবেছিলাম এখানেই আজ আমরা পটল তুলবো!-কিন্তু সে তার মুখ বন্ধ করে ফেলে। জাড স্তুপটায় ওঠার পর থেকে সে কোন প্রশ্ন করেনি। আর এখন সে ফিরে যাওয়া নিয়েও কোন দুশ্চিন্তা করছে না।
“ঠিক তা না,” লুইস বলে।
“চলো এগোই। আরো বেশ কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। তিন মাইলের মত।”
তারা হাঁটে। বাস্তবিকই পথটা চলছে তো চলছেই। কিছু কিছু জায়গায় মনে হচ্ছে পথটা বেশ চওড়া, যদিও চলন্ত টর্চের আলোয় ভালো করে কিছু বোঝা যাচ্ছে না; লুইসের মনে হচ্ছে গাছেরা তাদের চলার জন্যে পাশে চেপে জায়গা করে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে লুইস ওপরে তাকালে গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দেয়া তারাদের দেখতে পায়। একবার তাদের পথের সামনে কিছু নড়ে উঠে। সেখানে লাইট ফেললে শুধু দুটো সবুজ চোখে আলোর প্রতিফলন দেখা যায়, এবং পরমুহূর্তেই সেটা গায়েব হয়ে যায়।
মাঝে মাঝে পথটা এতো সরু হয়ে পড়ে যে লুইসের কোটে ঝোঁপঝাঁড়ের শুকনো আঙুলগুলো খোঁচা দিতে থাকে। সে তার হাতের ব্যাগ আর বেলচাটা বার বার অদল-বদল করে কিন্তু তার দু কাঁধে এখন টনটনে ব্যথা করছে। তার হাঁটা একটা ছন্দের মধ্যে পড়ে গেছে, যেনো তাকে বশ করা হয়েছে। জায়গাটার শক্তি আছে, ঠিক, এবং সে তা অনুভব করতে পারছে। হাইস্কুলের শেষ বর্ষের কথা মনে পড়ে যায় তার। একবার সে আর তার বান্ধবী এবং আরো কিছু কাপল মিলে গ্রামের দিকে বেড়াতে গিয়েছিল। তারা চলতে চলতে একটা পাওয়ার স্টেশনের পাশে একটা রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে হাজির হয়। যদিও তাদের পরিকল্পনা ছিল সেখানে কিছু সময় কাটানো কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরেই তার বান্ধবী বলে তার ফিলিং করা দাঁতগুলোতে ব্যথা হচ্ছে, তাই সে বাসায় যেতে চায়। কিংবা সেখানে না থেকে অন্তত অন্য কোথাও যেতে চায়। জায়গাটা থেকে চলে যেতে পেরে লুইসও যে খুশি হয়নি তা নয়। পাওয়ার স্টেশনের চারদিকের পরিবেশ তাকে নার্ভাস এবং একই সাথে সতর্ক করে দিচ্ছিল। এই জায়গার অনুভূতিটাও অনেকটা তেমন, কিন্তু আরো জোরালো। জোরালো কিন্তু একদমই অপ্রীতিকর না। এটা-
জাড একটা ঢালু জায়গার সামনে থেমে গেলেন। লুইস তার গায়ের ওপর গিয়ে ধাক্কা খায়।
জাড তার দিকে ঘুরলেন। “আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে প্রায় চলে এসেছি,” তিনি শান্ত গলায় বললেন। “সামনের জায়গাটাও ওই সুপটার মত-স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে হবে। আমাকে অনুসরণ করো আর নিচে তাকাবে না। তুমি টের পাচ্ছো আমরা যে পাহাড়ের নিচের দিকে নামছি?”
“হ্যাঁ, পাচ্ছি।”
এই জলাভূমির মত জায়গাটাকে মিকমেকরা ঈশ্বরের জলা বলতো। যেসব চামড়া ব্যবসায়িরা এর ভেতর দিয়ে যাতায়াত করতো তারা এটাকে বলতো মড়ার জলা, আর তাদের মধ্যে বেশির ভাগ লোকই এখান থেকে বেরুবার পর আর জীবনেও এই পথ মাড়ায়নি।
“এখানে কি চোরাবালি আছে?”
“আছে তো বটেই; অভাব নেই! আমরা এটাকে সিলিকা স্যান্ড বলতাম। তবে হয়তো আরো ভালো কোন নাম আছে।”
জাড তার দিকে তাকায়, এবং মুহূর্তের জন্য লুইসের মনে হয় সে জাডের
চোখে উজ্জ্বল কিছুর প্রতিবিম্ব দেখতে পায় এবং জাডের চেহারা শক্ত হয়ে যায়।
জাড তার ফ্লাশলাইটটা অন্যদিকে সরায় এবং তখন জাডের চেহারার শক্ত ভাবটা চলে যায়।
“এই পথে অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখা যায় লুইস। এখানকার বাতাস ভারি… তুলনামূলক ইলেকট্রিক্যাল…বা কিছু একটা।”
লুইস চমকে ওঠে।
“কী হয়েছে?” জাড জিজ্ঞেস করেন।
“কিছু না,” লুইস সেই পাওয়ার প্লান্টের রাতের কথা ভাবতে ভাবতে বলে।
“তোমার সেইন্ট এলমোর আগুন চোখে পড়তে পারে, যেটাকে নাবিকরা ফু-লাইট বলতো। এটা অদ্ভুত অদ্ভুত আকার আকৃতি তৈরি করে, কিন্তু এটা আসলে ইলেকট্রিক্যাল চার্জের খেলা ছাড়া কিছুই না। যদি এরকম কোন অদ্ভুত কিছু তোমার চোখে পড়লে ভয় লাগে, তাহলে অন্যদিকে তাকাবে। তুমি হয়তো কিছু শব্দ শুনতে পাবে, মানুষের গলার মত। কিন্তু ওসব কিছু না। ওগুলো লুন হাঁসের ডাক, শুনতে মানুষের হাসির মত। হাঁসগুলো থাকে দক্ষিণে। কিন্তু এখানে শব্দ অনেক দূর ভেসে আসে। খুব মজার ব্যাপার।”
“লুন হাঁস?” লুইস অবিশ্বাসের কন্ঠে বলে। “তাও বছরের এই সময়ে, এই ঠান্ডার মধ্যে?”
“ও হ্যাঁ,” জাড এতো নরমভাবে বললেন, লুইস তার মনের কথা কিছুই আচ করতে পারে না। তার বুড়ো লোকটার চেহারাটা দেখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, যদি তা দেখে কিছু বুঝতে পারে।
“জাড, আমরা আসলে যাচ্ছিটা কোথায়? পেট সেমিটারি পেরিয়ে কোন জঙ্গলে যাচ্ছি? আমার তো মাথায় কিছুই ঢুকছে না।”
“
“সেখানে গিয়ে আমি তোমাকে বলবো,” জাড ঘুরে দাঁড়ালেন। “ঘন ঘাসের গুচ্ছগুলোর ওপর দেখে দেখে পা ফেলো।”
তারা আবার হাঁটতে শুরু করে। জলার মধ্যে তারা এক উঁচু শুকনো থেকে অন্য শুকনো জায়গায় পা দিয়ে সাবধানে হেঁটে যাচ্ছে। লুইস এবারো নিচে তাকাচ্ছে না। কোন একভাবে তার পা সঠিক জায়গাটাই খুঁজে নিচ্ছে। সে মাত্র একবার পা পিছলেছে, এবং তাতে তার পায়ের নিচের অংশ পাতলা বরফের আবরণ ভেদ করে বরফ শীতল পানিতে ঢুকে যায়। সে পা টেনে বের করে জাডের লাইটের পেছন পেছন অনুসরণ করতে থাকে। জঙ্গলের ভেতর ভেসে বেড়ানো ফ্লাশ লাইটের আলোতে লুইসের ছোটবেলার পড়া জলদস্যুদের গল্পের কথা মনে পড়ে যায়। বদ লোকেরা চাঁদের আধারে সোনার মোহরের বাক্স পুতে ফেলতে যাচ্ছে…আর অবশ্যই তাদের মধ্যে একজনের পরিনতি হবে সেই বাক্সের সাথেই মাটির তলে, বুকে একটা বুলেট নিয়ে। কারণ জলদস্যুরা বিশ্বাস করে তাদের মৃত সাথী তাদের সম্পদকে পাহারা দেবে।
যদিও আমরা কোন মোহর পুঁততে আসিনি, এসেছি আমার মেয়ের মরা বেড়ালকে পুঁততে।
তার প্রচন্ড হাসি পায় কিন্তু সে তা কষ্ট করে চেপে রাখে।
সে কোন মানুষের গলার আওয়াজ শুনতে পায়নি, অথবা কোন সেইন্ট এলমোস ফায়ারও দেখতে পায়নি। হাফ ডজনবার ঘন ঘাসের গুচ্ছে পা ফেলার পর নিচে তাকিয়ে দেখতে পায় তার পায়ের পাতা থেকে উরু পর্যন্ত মসৃণ, ঘোলা কুয়াশায় ঢাকা পড়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে সে পৃথিবীর সবচাইতে পাতলা বরফের ওপর দিয়ে হেটে চলেছে।
লুইস শপথ করে বলতে পারে, এখানকার বাতাসে একটা হালকা আলোর আভা আছে, আর বাতাসটা তুলনামূলক উষ্ণ। জাড কাঁধে কুড়ালটা নিয়ে তার সামনে সামনে হেঁটে যাচ্ছেন। সেটা দেখে লুইসের আবারো গুপ্তধন লুকিয়ে রাখতে যাওয়ার মত একটা ভ্রম হয়।
তার মধ্যে এখনো উত্তেজনাটা কাজ করছে আর সে হঠাৎ ভাবে রাচেল হয়তো তাকে বার বার ফোনে চেষ্টা করছে আর ফোনটা বার বার বেরসিকের মত বেজেই যাচ্ছে। যদি-
সে আবারো প্রায় জাডের ওপর গিয়ে পড়েছিল। বৃদ্ধ রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেছেন। তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে তার এক পাশে তাকিয়ে আছেন। তার মুখ শক্ত হয়ে গেছে।
“জাড়, কী হয়ে-’ “স্!”
লুইস চুপ করে চারদিকে তাকাতে থাকে। এখানে ভূপৃষ্ঠের ওপরের কুয়াশা বেশ পাতলা, তবে এখনো সে তার জুতো দেখতে পাচ্ছে না। এরপর সে ঝোঁপঝাঁড়ের নড়াচড়া আর ডাল ভাঙার শব্দ শুনতে পায়। ওখানে কিছু নড়ছে-বড় কিছু।
সে জাডকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল এটা মুজ হরিণ কি না, (যদিও তার মনে প্রথমে আশঙ্কা ছিল ভালুক), কিন্তু সে থেমে যায়। এখানে শব্দ অনেক দূর পর্যন্ত ভেসে যায়, জাড বলেছিলেন।
জাডের দেখাদেখি আপনা থেকেই তার মাথা সেদিকে ঘুরে যায়। শব্দটা প্রথমে মনে হয়েছিল বেশ দূরে, তার পরে খুব কাছে; জিনিসটা দূরে সরে যাচ্ছে আবার খুব বিপজ্জনকভাবে কাছে চলে আসছে। লুইস টের পায় তার কপালের ঘাম গড়াতে গড়াতে গালে এসে পড়ছে। সে চার্চের ব্যাগটা হাত বদল করে। তার হাত ঘেমে গেছে, আর ঘামে পিচ্ছিল হাত থেকে পলিথিনের ব্যাগটা পিছলে যেতে চাচ্ছে। এখন ওই জিনিসটাকে এতো কাছে মনে হচ্ছে, যে লুইস ভাবে এখনি বুঝি সে সেটা দেখতে পাবে।
এখন সে আর ভালুকের কথা ভাবছে না।
সে যে কিসের কথা ভাবছে নিজেও জানে না।
এর পরেই জিনিসটা সরে যায় এবং একদম উধাও হয়ে যায়।
জাডকে জিজ্ঞেস করতে আবার মুখ খুলে সে। ওটা কী ছিল? কথাটা যখন প্রায় তার কন্ঠে চলে এসেছে সে আবারো থামতে বাধ্য হলো। আঁধারের ভেতর থেকে একটা খুনখুনে উন্মত্ত হাসি চারদিক বিদীর্ণ করে দেয়। আত্মা কাঁপানো অট্টহাসির শব্দ ওঠা নামা করছে চক্রাকারে। লুইসের মনে হয় তার শরীরের প্রতিটি জয়েন্ট জমে গেছে আর তার ওজনও কয়েক গুন বেড়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে সে যদি এখন পালানোর জন্যে দৌড়ায় তাহলে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে নিচের কুয়াশার মধ্যে হারিয়ে যাবে।
হাসিটা বাড়তে থাকে, এরপর একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে সেটা খিক-খিক হাসিতে পরিণত হয়; পাথুরে পাহাড়ের গা বেয়ে ভঙ্গুর পাথরের টুকরো পড়তে থাকলে যেমন আওয়াজ হয় অনেকটা সেরকম আওয়াজে। হাসির শব্দটা বাড়তে বাড়তে চিৎকারের মত শোনা যায়। এরপর সেটা পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং মনে হয় কেউ কাঁদছে। আর এরপরেই সেটা একদম থেমে যায়।
আশেপাশে কোন এক জায়গায় পানি পড়ার টপটপ শব্দ আর চারদিকে বাতাসের গর্জন ছাড়া কোন শব্দ নেই। হঠাৎ করেই নিস্তব্ধ হয়ে পড়েছে জায়গাটা।
লুইসের সারা গা কাঁপতে থাকে। তার গায়ের পেশিগুলো, বিশেষ করে তলপেটের পেশি-শিরশির করতে থাকে। শরীরের পেশিগুলো আক্ষরিক অর্থেই কাঁপছে। তার মুখ শুকিয়ে একদম কাঠ হয়ে গেছে। কিন্তু এতো কিছুর পরও অদ্ভুতভাবে তার সেই উত্তেজনাটা রয়েই গেছে।
“খোদা! এটা কী ছিল?” সে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে।
জাড় তার দিকে ঘুরে তাকালে আবছা আলোয় তাকে দেখে লুইসের মনে হয় তার বয়স বেড়ে একশো বিশ হয়ে গেছে। তার চোখের সেই উজ্জ্বলতাটা আর নেই। তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ আর চোখে পরিস্কার আতঙ্ক। কিন্তু তিনি যখন কথা বললেন তার কন্ঠ বেশ স্বাভাবিক শোনালো। “কোন লুন হাঁস হবে,” তিনি বললেন। “চলো, আমরা প্রায় চলে এসেছি।”
তারা চলতে থাকে। এক মুহূর্তে লুইসের মনে হয় তারা একটা খোলা জায়গায় চলে এসেছে। চারদিকের বাতাসের সেই হালকা আভাটা একদম মিয়মাণ হয়ে এসেছে। তার পায়ের নিচে বরফে জমা শক্ত ছোট ছোট ঘাস। সেগুলো প্রতি পদক্ষেপে কাচের মত ভেঙে যাচ্ছে। তার পরেই তারা আবার
ঘন গাছের জঙ্গলে প্রবেশ করে। সে দেবদারু গাছের সুগন্ধ পাচ্ছে আর পায়ের নিচে পাইনের সুচারু পাতার অস্তিত্বও টের পাচ্ছে। মাঝে মাঝে সে ডাল পালার খোঁচা বা ঘষা খাচ্ছে।
লুইস তার দিক এবং সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। কিন্তু তারপরও সে বুঝতে পারে যে কিছুক্ষণ পরেই জাড থেমে ওর দিকে ফেরেন।
“এখান থেকে পাথরে কাটা সিঁড়ি,” জাড বললেন। “বেয়াল্লিশ অথবা চুয়াল্লিশটা ধাপ, আমার ঠিক মনে নেই। শ্রেফ আমাকে অনুসরণ করো। এটার ওপরে উঠলেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাব।”
পাথরের ধাপগুলো বেশ চওড়া। তবে তার ওপরে আলগা মাটির আস্তর খসে খসে পড়তে থাকে, যা তাকে নার্ভাস করে দিচ্ছে।
বারো.. তেরো…চোদ্দ
এখানকার বরফ শীতল বাতাস তার গালে সুইয়ের মত বিধছে। আমরা কি গাছের মাথার চাইতেও উচুতে উঠে এসেছি? সে ভাবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে অসংখ্য তারা দেখতে পায়, আঁধার রাতে সেগুলো ঠান্ডা বাতির মত মিটমিট করছে। তার জীবনে আগে কখনো আকাশের তারাদের দেখে নিজেকে এতো ছোট, এতো নগন্য, এতো অর্থহীন মনে হয়নি। সে নিজেকে সেই প্রাচীন প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করে-ওখানে কি কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব আছে?-আর প্রশ্নটা তার মনে ভাবনার উদ্রেক না ঘটিয়ে একটা বিশ্রী শীতল অনুভূতির জন্ম দেয়, যেন সে নিজেকে জিজ্ঞস করেছে যে, কিলবিল করতে থাকা পোকা খেতে তার কেমন লাগবে।
ছাব্বিশ…সাতাশ… আঠাশ
এসব খনন করেছেই বা কারা? ইন্ডিয়ানরা? মিকমেকরা? তারা কি খননের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে জানতো? জাডকে জিজ্ঞেস করে দেখতে হবে। এসব চিন্তা করতে করতে তার হঠাৎ করেই একটু আগের সেই ছোটাছুটি করতে থাকা জিনিসটার কথা মনে পড়ে। তার এক পা হোঁচট খেলে সে পাশের খসখসে পাথুরে দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নেয়।
“তুমি ঠিক আছো?” জাড মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করেন।
“ঠিক আছি,” সে জবাব দেয়, কিন্তু সে হাঁপিয়ে গেছে আর চার্চের ওজনে তার হাতের পেশি টনটন করছে।
বেয়াল্লিশ…তেতাল্লিশ… চুয়াল্লিশ
“পয়তাল্লিশ,” জাড বললেন। “একদমই মনে করতে পারছিলাম না। গত বারো বছরে একবারো আসা হয়নি এখানে এবং মনে হয় না আর কখনো আসা হবে। নাও… হাত ধরো।”
তিনি লুইসের হাত ধরে টেনে তাকে শেষ ধাপটায় উঠতে সাহায্য করলেন।
“চলে এসেছি,” জাড বললেন।
লুইস চারদিকে তাকিয়ে দেখে। সে তারার আলোয় মোটামোটি ভালোই দেখতে পাচ্ছে। জায়গাটা পাথুরে আর চারদিকে প্রচুর ছোট ছোট পাথর বিছানো। এই ঢালু পাথুরে প্লেটটা ভূমির বুক থেকে জিভের মত বের হয়ে আছে। অন্যদিকে তাকিয়ে সে তাদের পেছনে ফেলে আসা জঙ্গলের গাছগুলোর মাথা দেখতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে তারা কোন অদ্ভূত পাহাড়ের সমতল চূড়ায় উঠে এসেছে। এই এলাকায় এরকম প্রাকৃতিক অস্বাভাবিকতা খুব একটা দেখা যায় না। এরিজোনা বা নিউ মেক্সিকোতে হয়তো প্রচুর দেখা যায় এরকম জায়গা। আর অদ্ভুতভাবেই এই পাহাড় চূড়াটা-বা ছোট পর্বতের চূড়াটা বা যাই বলি না কেন-একদমই ছোলা। মানে কোন গাছপালা নেই। সূর্যের আলোয় এখানে বরফ জমতে পারেনি। জাডের দিকে ফিরলে সে দেখতে পায় শুকনো ঘাসের মাথাগুলো ঠান্ডা বাতাসে দুলছে। ঠান্ডা বাতাস তার গালেও চুমু খেয়ে খেয়ে যাচ্ছে। সামনে ভূমি আরো উঁচু এবং সেখানে গাছপালাও আছে। তার মনে হচ্ছে এই সমতল জায়গাটা ইন্ডিয়ানরা যন্ত্রপাতির সাহায্যে খোদাই করেছে।
“চলো,” জাড তাকে ডেকে পচিশ গজের মত এগিয়ে নিয়ে গেলেন, গাছে ঢাকা উঁচু জায়গাটার দিকে। এখানে বাতাসের বেগ বেশ জোরালো। লুইস গাছগুলোর নিচে কিছু অন্ধকার আকৃতি দেখতে পেলো। এই দেবদারু গাছগুলোর মত বয়স্ক আর বিরাট দেবদারু গাছ সে তার জীবনে দেখেনি। এই উঁচু, নির্জন জায়গাটার বৈশিষ্ট্য শূন্যতা, তবে এখানকার শূন্যতাটা যেন কাঁপছে।
সেই অন্ধকার আকৃতিগুলো এক একটা শিলাস্তম্ভ।
“মিকমেকরা এই পাহাড়ের চূড়া কেটে এই জায়গাটা বানিয়েছে,” জাড বললেন। “মায়ানরা কিভাবে তাদের পিরামিডগুলো বানিয়েছে সেটা যেমন কেউ জানে না, এটিও মিকমেকরা কিভাবে করেছে তাও কেউ জানে না। আর মিকমেকরাও নিজেদের ভুলে গেছে, ঠিক যেমনটা মায়ানরাও নিজেদের ভুলে বসে আছে।”
“কেন? ওরা এটা কেন করেছিল?”
“এটা ওদের কবরস্থান ছিল,” জাড বললেন। “আমি তোমাকে এখানে এনেছি যাতে তুমি এলির বিড়ালটা এখানে কবর দিতে পারো। মিকমেকরা মানুষ আর পোষা প্রাণীদের মধ্যে তফাত করত না, মালিকের কবরের পাশেই তাদের পোষা প্রাণীদের কবর দিতো।”
জাডের কথায় লুইসের প্রাচীন মিসরীয়দের কথা মনে পড়ে গেল। তারা আরেক ধাপ এগিয়ে ছিল। তারা রাজবংশের মৃত ব্যক্তির পোষা প্রাণীদের গলা কেটে তাদের সাথেই কবর দিতো, যাতে মৃত ব্যক্তির সাথে তাদের পোষা প্রাণীরাও পরকালে একই সাথে যেতে পারে। সে একবার এক ফারাও’ এর মৃত মেয়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার ব্যাপারে পড়েছিল। সেখানে লেখা আছে সেই রাজকন্যার মৃত্যুতে দশ হাজারেরও বেশি গৃহপালিত পশুকে জবাই করা হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ছয়শো শুয়োর আর দু’হাজার ময়ূর। শুয়োরগুলোর গায়ে গোলাপ ফুলের আতর দেয়া হয়েছিল জবাই করার আগে, কারণ সেই মৃত রাজকন্যার প্রিয় খোশবু ছিল গোলাপের গন্ধ।
আর তারাও পিরামিড বানিয়েছে। কেউ নিশ্চিত করে জানে না মায়ানরা কেন তাদের পিরামিডগুলো বানিয়েছে। কেউ বলে দিক হিসেব করার জন্য বা সময় পরিমাপের জন্য। তবে সবাই জানে মিসরের পিরামিডগুলো কিসের জন্যে…সেসব হচ্ছে এক একটা কবর, পৃথিবীর কবরের সবচাইতে বড় স্মৃতিফলক মিসরের পিরামিডগুলো। এখানে শায়িত আছে রামেস দ্বিতীয়, খুবই বাধ্য ছিল সে, লুইস ভাবতে ভাবতে ফিক করে হেসে দেয়।
জাড কোন রকম অবাক না হয়েই তার দিকে তাকান।
“যাও, চার্চকে কবর দাও,” তিনি বললেন। “আমি একটা সিগারেট টানবো। আমি তোমাকে সাহায্য করতাম, কিন্তু তোমার নিজেরই এটা করা লাগবে। যার যার মৃতকে সে সে কবর দিবে, এটাই তখনকার নিয়ম ছিল।”
“জাড, এসবের মানে কী? আমাকে আপনি এখানে কেন নিয়ে এসেছেন?”
“কারণ তুমি নরমার জীবন বাঁচিয়েছিলে।” জাড বললেন। লুইসের কাছে তার কণ্ঠে আন্তরিকতার কোন অভাব আছে বলে মনে হয় না- আর লুইস বুঝতে পারছে জাড নিজেও বিশ্বাস করেন যে তিনি সত্যি বলছেন-কিন্তু লুইসের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে জোরালোভাবে বলতে থাকে তিনি মিথ্যা বলছেন…অথবা তার কাছে কেউ মিথ্যা বলেছে এবং তিনি সেই মিথ্যাকে সত্য ভেবেই তাকে বলেছেন। সে জাডের চোখে যে চাউনি দেখেছে, সেটিকে চিনতে পেরেছে অথবা তার মনে হচ্ছে সে চিনতে পেরেছে।
তবে এখানে ওসব গুরুত্বহীন মনে হচ্ছে। তার চাইতে বরং তার কাছে অবিরাম বইতে থাকা বাতাসকে বেশি গুরত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে, যা তার কপাল থেকে চুলগুলোকে ঠেলে পেছনে নিয়ে যাচ্ছে।
জাড একটা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে বসলেন। এরপর তার দুহাত একটা সদ্য জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠির চারদিকে গোল করে ধরে একটা বিড়ি জ্বাললেন। “শুরু করার আগে একটু জিরিয়ে নেবে নাকি?”
“না, লাগবে না,” লুইস বলে। সে চাইলে প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করতে পারে কিন্তু এখন সেসব তার কাছে অর্থহীন মনে হচ্ছে। তার একবার মন বলছে যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না, আবার মনে হচ্ছে এটাই ঠিক। তার মনে আরেকটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। “আমি কি আসলেই এখানে গর্ত খুঁড়তে পারবো? মাটি তো খুব পাতলা মনে হচ্ছে।” লুইস মাথা নেড়ে ইশারা করে ওদিকটা দেখায়, যেখানে মাটির ভেতর থেকে পাথর মাথা বের করে আছে।
জাড ধীরে ধীরে তার মাথা নেড়ে সায় জানালেন। “পারবে,” তিনি বললেন। “মাটির স্তর পাতলা সেটা ঠিক, তবে যেখানে ঘাস জন্মানোর মত মাটি আছে, সেখানে তুমি কবরও দিতে পারবে, লুইস। আর এখানে লোকে অনেক আগে থেকেই কবর দিয়ে আসছে। যদিও কবর খোঁড়াটা খুব একটা সহজও হবে না।”
জাডের কথা ঠিক। এখানকার মাটি খুবই শক্ত আর পাথুরে। কিছুক্ষণ পরেই সে বুঝতে পারে চার্চকে কবর দেয়ার মত গর্ত খুঁড়তে হলে শুধু বেলচা দিয়ে কাজ হবে না। এরপর সে প্রথমে কুঠারটা দিয়ে কিছু মাটি আলগা করে নিয়ে সেই মাটি বেলচা দিয়ে সরাতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার হাত ব্যথা হয়ে যায়। তার শরীরের তাপমাত্রাও আবার বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। কিন্তু তারপরও সে ভালো করে কাজটা করার একরকম অদ্ভুত অনুপ্রেরণা অনুভব করতে থাকে। সে অস্ফুটভাবে গুন গুন করতে শুরু করে, যেমনটা সে কোন ক্ষত সেলাই করার সময় প্রায়ই করে। মাঝে মাঝে কুঠারটা কোন পাথরকে এতো জোরে আঘাত করছে যে তাতে আগুনের ফুল্কি দেখা যাচ্ছে আর সেই ধাক্কার শিহরন কুঠারের কাঠের হাতল বেয়ে তার হাত পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে। সে টের পাচ্ছে তার হাতে ফোসকা পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু সে তা গ্রাহ্যই করলো না, যদিও অন্যান্য ডাক্তারদের মত সে নিজের হাত নিয়ে বিশেষ যত্নবান। তাকে ঘিরে বাতাস গান গাইতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর পাথর ফেলার শব্দ পেলে মাথা ঘুরিয়ে দেখে জাড তার খুঁড়ে বের করা পাথরগুলোর মধ্যে বড় বড় পাথরগুলো আলাদা করে একটা স্তুপ বানাচ্ছেন।
“তোমার স্মৃতিস্তম্ভের জন্যে,” জাড লুইসকে তাকাতে দেখে বললেন।
“ওহ,” বলেই লুইস আবার তার কাজে লেগে পড়ে।
সে কবরটা তিনফুট লম্বা আর দুইফুট চওড়া করে খুড়লো-কোন বিড়ালয়ের জন্যে বেশ রাজকীয় ব্যবস্থা, সে ভাবে আর যখন এটা প্ৰায় ত্ৰিশ ইঞ্চির মত গভীর হলো এবং প্রতি কোপের সাথে আগুনের ফুল্কি হতে লাগলো, সে বেলচা আর কুঠারটা পাশে ছুড়ে ফেলে জাডকে জিজ্ঞেস করে জিনিসটা ঠিক আছে কি না।
জাড উঠে দাঁড়িয়ে একটু চোখ বুলিয়েই বললেন, “আমার কাছে তো ঠিকই লাগছে। আর আমার কাছে যেমনই লাগুক, তোমার কাছে ঠিক মনে হচ্ছে কি না সেটাই গুরত্বপূর্ণ।”
“আমরা এখানে কেন এসেছি আমাকে বলবেন?”
জাড একটু মুচকি হাসলেন। “মিকমেকরা বিশ্বাস করতো এই পাহাড়ে জাদু আছে,” তিনি বললেন। “তাদের বিশ্বাস ছিল এই পুরো জঙ্গলেই জাদু আছে। তারা এই জায়গাটা তৈরি করে এখানে তাদের মৃতদের কবর দিতো, সবকিছু থেকে দূরে। অন্য গোত্রের লোকেরা এই জায়গাটা এড়িয়ে চলতো-পেনবস্কটরা বলতো এই জঙ্গল ভূত প্রেতে ভরা। পরে চামড়া শিকারীরা প্রায় একই কথা বলতো। আমার ধারণা তারা ঈশ্বরের জলাতে সেইন্ট এলমোর আগুন দেখে ভূত ভেবে ভয় পেয়েছিল।”
জাড মিটিমিটি হাসলেন আর লুইস ভাবে, আপনি নিজে সেরকমটা ভাবেন না।
“পরবর্তীতে মিকমেকরাও এখানে আসা বন্ধ করে দেয়। তাদের মধ্যে একজন দাবি করে সে নাকি এখানে একটা উয়িন্ডিগো দেখেছে আর তাতে এখানকার মাটি অপবিত্র হয়ে গেছে। তারা নিজেদের মধ্যে এটা নিয়ে অনেক দেন-দরবার করে…যে রকমটা আমি শুনেছি। তবে আমি ছোটবেলায় এটা শুনেছি মাতাল স্টেনি বি.’র মুখে। তার পুরো নাম স্টানলি বুকার্ড। কিছু না জেনে বানিয়ে বানিয়ে বলার একটা অভ্যাস তার ছিল।”
লুইস জানতো যে উয়িন্ডিগো হচ্ছে এক রকমের আত্মা। “আপনি কি মনে করেন এখানকার মাটি অপবিত্র হয়ে গেছে?”
জাড হাসলেন অন্তত তার ঠোটগুলো বেঁকে যায়। “আমি মনে করি এ জায়গাটা খুবই বিপজ্জনক,” তিনি নরম গলায় বললেন, “তবে পোষা কুকুর- বিড়াল বা খরগোশের জন্যে না। তোমার বিড়ালটাকে কবর দিতে পারো এখানে, কোন সমস্যা নেই, লুইস।”
লুইস পলিথিন ব্যাগটা তার খোঁড়া গর্তের মধ্যে রেখে ধীরে ধীরে গর্তটা আলগা মাটি দিয়ে ভরতে শুরু করে। তার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে আর খুব ঠান্ডা লাগছে। পলিথিনের ব্যাগটার ওপর ঝুরঝুরে মাটি পড়ার বিমর্ষ শব্দ হচ্ছে। তার যদিও এখানে আসা নিয়ে কোন অনুশোচনা নেই, তবে তার সেই উত্তেজনায় ভাটা পড়েছে। সে মনে মনে এই অ্যাডভেঞ্চারের ইতি টানতে চাচ্ছে। তাদের ফিরে যাওয়ার জন্যে অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।
পলিথিনের ফরফর শব্দ কিছুক্ষণ পরেই মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়-এখন শুধু মাটি পড়ার থপ থপ শব্দ হচ্ছে। সে খুঁড়ে তোলা মাটির শেষ অংশটুকুও বেলচা দিয়ে গর্তের ওপর ফেলে। তার আন্ডারটেকার আঙ্কেল বলেছিলেন যে মুর্দার জন্যে খোঁড়া গর্ত ভর্তি করার জন্যে কখনই যথেষ্ট মাটি থাকে না। সে জাডের দিকে তাকায়।
“এবার শিলাস্তম্ভটা,” জাড বললেন।
“জাড, আমি খুব ক্লান্ত আর-”
এটা তোমার মেয়ের বেড়াল,” জাড নরমভাবে বললেও তার কণ্ঠে কোন নমনীয়তা ছিল না। “তোমার মেয়ে নিশ্চয়ই চাইতো তুমি এই কাজটা ঠিকভাবে কর।”
লুইস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “সেটা ঠিকই বলেছেন।”
পরবর্তী দশ মিনিট ধরে সে জাডের একটি একটি করে তুলে দেয়া পাথর একটির ওপর আরেকটি রেখে চার্চের কবরের ওপর একটি কৌনিক আকৃতির শিলাস্তম্ভ তৈরি করে।
আশেপাশের স্তম্ভগুলোর সাথে সাথে জিনিসটাকে মাথা উঁচু করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তার মনে এক রকম ক্লান্তিকর আনন্দ অনুভূত হয়। সে ভাবে এলি হয়তো এটা কখনোই দেখবে না। এই জঙ্গল আর চোরাবালি সমৃদ্ধ জলার মধ্যে দিয়ে এলিকে এখানে নিয়ে আসার কথা শুনলে রাচেলের মাথার সব চুল পেকে যাবে। তবে তার কাছে জিনিসটাকে একদম পারফেক্ট লাগছে।
“বেশিরভাগ স্তম্ভই পড়ে গেছে,” সে দাড়িয়ে নিজের প্যান্টের হাঁটুর কাছ থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে বলে। সে চারদিক এখন আরো পরিস্কারভাবে দেখতে পাচ্ছে। চারদিকে অনেক পাথর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তবে লুইস যেন তার স্তম্ভে নিজের খোঁড়া পাথর ছাড়া অন্য কিছু না ব্যবহার করে, জাড সেই ব্যাপারে খেয়াল রেখেছিলেন।
“হ্যা,” জাড বললেন। “বলেছিলাম তোমাকে, জায়গাটা খুব পুরনো। “ “আমাদের কাজ শেষ এখানে?”
“হুম।” তিনি লুইসের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, “লুইস, তুমি খুব ভালোভাবে কাজটা করেছো, আমি জানতাম তুমি তাই করবে। এখন চলো ফিরে যাই।”
“জাড-” সে আবার বলতে শুরু করে, কিন্তু জাড ততক্ষণে কুঠারটা তুলে নিয়ে ধাপগুলোর দিকে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছেন। তাকে ধরার জন্যে লুইসকে বেশ লম্বা লম্বা পা ফেলতে হয়। সে একবার পেছনে তাকায়, কিন্তু তার তৈরি করা শিলাস্তম্ভটাকে আর দেখতে পায় না। সেটা ছায়ার মধ্যে হারিয়ে গেছে।
আমরা আবার সিনেমাটা উল্টো দিক থেকে চালু করলাম, লুইস জঙ্গল থেকে তার বাড়ির পেছনের মাঠে বেরিয়ে ক্লান্ত হয়ে ভাবে। কত সময় গিয়েছে তার কোন বোধ নেই, সে বিকেলে ঘুমুতে যাওয়ার আগে হাতের ঘড়ি খুলে রেখেছে আর সেটা এখনো তার বিছানার পাশেই থাকার কথা। সে শুধু জানে সে চরম ক্লান্ত আর একদম ছিবড়ে হয়ে গেছে। ১৫ বছর আগে হাই স্কুলে থাকতে সে শিকাগোর আবর্জনা ডিসপোজাল ক্রুতে কাজ করেছিল। সেখানে তার প্রথম দিনের হাড়ভাঙা খাটুনির পর তার যেমন লেগেছিল, এতদিন পরে আজকে আবার সেদিনের মত শ্রান্ত লাগছে।
তারা যেভাবে গিয়েছে ঠিক সেভাবেই আবার ফিরে এসেছে, কিন্তু তার পথের ভ্রমণের খুব কম জিনিসই মনে আছে। সে মরা গাছের স্তুপটির ওপর পা হড়কেছিল, কিন্তু জাড তাকে শক্ত করে ধরে ফেলেন। তার কয়েক মুহূর্ত পরেই তারা স্মাক দ্য ক্যাট, ট্রিক্সি, আমাদের পোষাপ্রাণী মার্তাদের চিরনিদ্রার স্থানটি ক্লান্তভাবে হেঁটে পেরোয়, যেখানে আগেরবার লুইসের সাথে শুধু জাডই ছিল না, তার পুরো পরিবারও ছিল।
সে ক্লান্তভাবে ভিক্টর পাস্কোর সতর্কবাণীর কথা ভেবেছে, কিন্তু কোন এক কারণে সেই স্বপ্নের সাথে আজ রাতের ভ্রমণের কোন যোগাযোগ সে খুঁজে পায়নি। সে এটাও ভেবে দেখেছে যে আজ রাতে তাদের অ্যাডভেঞ্চারটা বেশ বিপদে ঘেরা ছিল। প্রায় ঘোরের মধ্যে থেকে মাটি খুড়ে হাতে ফোসকা ফেলে দেয়া সেই বিপদগুলোর মধ্যে ছোট্ট একটা। সে ওই স্তূপের ওপর মারা পরতে পারতো। তাদের দুজনেই মারা পরতে পারতো। পরিস্কার মাথায় এসব কাজ করাও তো বেশ বিপজ্জনক, যেখানে সে ছিল এক রকম ঘোরের মাঝে। অবশ্য তার বর্তমান ক্লান্তিকর অবস্থায় সে সব কিছুর দোষ তার পরিবারের প্রিয় বিড়ালের মৃত্যুর ওপর চাপাতে চাইছে।
অনেকটা সময় পরে তারা তাদের বাড়ির কাছে পৌঁছে যায়।
তারা চুপচাপ হেটে লুইসদের ড্রাইভওয়েতে এসে থামে। বাতাস এখনো শোঁ শোঁ করে বইছে। লুইস কোন কথা না বলেই জাডকে বেলচাটা ফেরত দিলো।
“আমি বরং চলি,” জাড অবশেষে বললেন। “ওর বান্ধবীদের ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাবার সময় হয়ে গেছে। এসে আমাকে না দেখলে কি না কি ভাববে।”
“আপনার কাছে ঘড়ি আছে?” লুইস জিজ্ঞেস করে। নরমা এখনো ফেরেনি শুনে সে খুব অবাক হয়। তার শরীরের ক্লান্ত পেশিগুলো তাকে বলছে এতক্ষণে মাঝরাত হয়ে গেছে।
“অবশ্যই,” জাড বলেন। “আমার গায়ে যতক্ষণ জামা আছে, আমার ঘড়িও ততক্ষণ আছে।”
তিনি তার পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে ঝাকি দিয়ে সেটার কভার সরিয়ে ফেললেন।
“সাড়ে আটটা,” তিনি বলে আবার ঝাঁকি দিয়ে ঘড়ির কাভারটা বন্ধ করে ফেললেন।
“সাড়ে আটটা?” লুইস বোকার মত বলে। “মোটে?”
“তুমি কী ভেবেছিলে?” জাড জিজ্ঞেস করলেন।
“আরো বেশি,” লুইস বলল।
“কালকে দেখা হবে, লুইস।” জাড বলে তার বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলেন।
এরপর তিনি থেমে লুইসের দিকে ফিরলেন, তার চোখে প্রশ্ন।
“জাড, আজ রাতে আমরা কী করলাম?”
“কেন? তোমার মেয়ের বেড়ালকে কবর দিয়েছি।”
“আর কিছু না?”
“আর কিছুই না,” জাড বললেন। “তুমি ভালো লোক, কিন্তু বড্ড বেশি প্রশ্ন করো। কারো হৃদয়ে কোন কিছু ঠিক মনে হলে মাঝে মাঝে সেটা করতে হয়। কিন্তু সেটা করার পরে তার মনে যদি সেটা সম্পর্কে নানান প্রশ্ন খোঁচাতে থাকে, অনেকটা বদ হজমের মত, তাহলে সে ধরে নেয় সে ভুল করেছে। তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি?”
“হ্যাঁ,” লুইস উত্তর দেয়। সে ভাবে জাড আবার তার মনের ভাবনা পড়ে ফেলছে।
“তবে তাদের হৃদয়কে শুরুতেই প্রশ্ন করার আগে সেসব খোঁচাতে থাকা প্রশ্নগুলিকেই পাল্টা প্রশ্ন করা উচিত।” জাড তার দিকে ঘনিষ্ঠভাবে তাকিয়ে বললেন। “তোমার কী মনে হয় লুইস?”
“আমার মনে হয় আপনার কথাই ঠিক।” লুইস জবাবে বলে।
“আর মানুষের হৃদয়ে যা আছে তাকে প্রশ্ন করেও লাভ নেই, না কি আছে?”
“আচ্ছা–”
“না,” লুইস মেনে নিয়েছে ধরে নিয়ে তিনি স্বাভাবিকভাবেই বললেন। “কোন লাভ নেই।” জাডের শান্ত গলার কঠোরতায় লুইসের শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে। তিনি এরপর বললেন, “কিছু কথা থাকে অতি গোপন। মহিলারা নাকি গোপন রাখার ব্যাপারে ওস্তাদ, তবে যে কোন বুদ্ধিমতী মহিলাই বলবে তারা কোনদিন কোন পার্টনারের মনের ভেতরে কি আছে তা বুঝতে পারে না। মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে, অনেকটা মিকমেকদের কবরস্থানের মাটির মত। মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়…আর সেটা সে যত্ন করে রাখে।”
“জাড়-”
“প্রশ্ন করো না, লুইস। যা হয়ে গেছে তা মেনে নাও আর তোমার হৃদয়কে অনুসরণ করো।”
“কিন্তু–”
“কিন্তু না। যা হয়ে গেছে তা মেনে নাও আর তোমার হৃদয়ের কথার অনুসরণ করো। আজকের পরিপ্রেক্ষিতে আমারা সঠিক কাজটাই করেছি…অন্তত আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি যে, আমরা যেন ঠিক কাজটাই করেছি। আবার অন্য কোন পরিপ্রেক্ষিতে হয়তো এই কাজটাই মারাত্নক রকমের ভুল হতো।”
“আচ্ছা, আপনি আমার একটা প্রশ্নের অন্তত উত্তর দিন।”
“আগে প্রশ্ন শুনি, তারপর দেখা যাবে।”
“আপনি ওই জায়গাটা সম্পর্কে জানলেন কী করে?” ফেরার পথেও এই প্রশ্নটা লুইসের মনে আরেকবার উকি দিয়েছিল। সে আরো সন্দেহ করেছিল যে জাড নিজেই হয়তো আংশিক মিকমেক, যদিও তিনি দেখতে একদমই মিকমেকদের মত না। তিনি দেখতে একদম শতভাগ এংলো।
“কেন? স্টেনি বি.’র কাছ থেকে,” তিনি অবাক হয়ে বললেন।
“সে আপনাকে এমনিই বলেছিল?”
“না,” জাড বললেন। “এরকম জায়গা সম্পর্কে কেউ এমনি এমনি কাউকে বলে না। আমার বয়স যখন দশ তখন আমি আমার কুকুর স্পটকে সেখানে কবর দিয়েছিলাম। সে একটা খরগোশ তাড়া করতে গিয়ে কাঁটাতারে লেগে জখম হয়। ওই যখমে ইনফেকশন হয়ে ও মারা যায়।”
জাডের এই কথায় লুইসের একটু খটকা লাগে। জাড তাকে আগে কিছু একটা বলেছিলেন যেটার সাথে এই কথা খাপ খাচ্ছে না। কিন্তু সে এতটাই ক্লান্ত যে, সেসব নিয়ে চিন্তা করার মত মানসিক শক্তি তার নেই। জাড আর কিছু বললেন না, শুধু নিজের দুর্বোধ্য চোখ দিয়ে লুইসের দিকে তাকালেন।
“গুড নাইট, জাড,” লুইস বলে।
“গুড নাইট।”
বৃদ্ধ তার মাটি খোঁড়ার কুঠার আর বেলচা নিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেলেন। “থ্যাঙ্কস!” লুইস গলা উচু করে বলে।
জাড ঘুরলেন না, শুধু নিজের হাত উঁচু করে ইশারা করলেন যে তিনি শুনেছেন।
আর লুইসের বাসায় হঠাৎ করেই তাদের ফোনটা বাজতে শুরু করে।
লুইস দৌড়াতে শুরু করে। তার ঊরু আর কোমরের ব্যথায় সে চোখ মুখ কুচকে ফেললেও দৌড় থামায় না। কিন্তু সে যখন কিচেনে পৌঁছে, ততক্ষণে ফোনটা ছয়-সাত বার রিং হয়েছে। সে যখন ফোনে হাত রাখে, ফোনের রিং বন্ধ হয়ে যায়। তারপরও সে ফোনটা তুলে নিয়ে হ্যালো বলল কিন্তু সে ফোনের হাম্ম্…ছাড়া কিছুই শুনতে পেলো না।
রাচেলের ফোন ছিল, সে ভাবে। আমি ওকে কল ব্যাক করবো।
কিন্তু হঠাৎ করেই কাজটাকে তার কাছে অত্যন্ত ক্লান্তিকর বলে মনে হয়। ফোন দিলে প্রথমে ওর শ্বাশুড়ি বা চেকবুকওয়ালা শ্বশুড় ফোন ধরবে। তারপর তাদের সাথে কিছুক্ষণ নাচানাচির পর তারা ফোন রাচেলকে দিবে…এরপর এলিকে। শিকাগোতে সময় একঘন্টা পিছিয়ে, তাই এলি অবশ্যই জেগে আছে আর এলি তাকে চার্চের কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলবে না।
চার্চ খুব ভালো আছে। শুধু একটা দ্রুতগামী অরিংকো ট্রাকের ধাক্কা খেয়েছে। আমি শিওর যে ট্রাকটা অরিংকো ট্রাকই, কারণ অন্য ট্রাক হলে নাটকীয়তা জমবে না, বুঝতে পারছো কী বলছি? পারছো না? আচ্ছা বাদ দাও। ট্রাকের ধাক্কায় ও মারা গেছে তবে ওর শরীরে তেমন কোন ক্ষত চিহ্ন নেই। জাড আর আমি ওকে মিকমেকদের গোরস্থানে কবর দিয়ে এসেছি। জায়গাটা পেট সেমিট্রির একটা বর্ধিত অংশের মত। ওখানে যাওয়ার রাস্তাটা খুব ভালো, মামনি। একদিন আমি তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবো, চার্চের স্মৃতিফলকে, থুক্কু-শিলাস্তম্ভে ফুল দিতে। তবে অবশ্যই তা হবে সেখানের সবগুলো চোরাবালি জমে যাবার আর সব ভালুকেরা শীতনিদ্রায় যাবার পর।
সে ফোনটা রেখে সিঙ্কের কাছে গিয়ে সেটা গরম পানি দিয়ে ভর্তি করে। তারপর সে তার জামা খুলে সেই পানিতে ধোয়। সে এই শীতের ভেতরেও শুওরের মত ঘেমেছে। আর তার গা থেকে একদম শুয়োরের মতই গন্ধ বের হচ্ছে।
রেফ্রিজারেটরে কিছু থেকে যাওয়া মিটলোফ ছিল। লুইস সেখান থেকে একটা পাতলা টুকরো কেটে নিয়ে এক স্লাইস পাউরুটির ওপর রাখলো। তার ওপর দিলো বারমুডা পেঁয়াজের মোটা মোটা দুই স্লাইস। সে জিনিসটাকে কেচাপ দিয়ে গোসল করানোর আগে বেশ কিছুক্ষণ জিনিসটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর সে জিনিসটাকে আরেকটা পাউরুটির পিস দিয়ে চাপা দেয়। যদি রাচেল আর এলি জিনিসটা দেখতো তাহলে তারা দুজনেই তাদের নাক একই ভঙ্গিমায় কুঁচকে ফেলতো—ইয়াক।
মেয়েরা, তোমরা মিস করলে এটা, তোমাদেরই লস, লুইস অত্যন্ত আনন্দিত মনে ভাবে আর নিজের তৈরি করা স্যান্ডউইচটার ওপর হামলে পড়ে। চমৎকার স্বাদ। কনফুসিয়াস বলেছেন, যার গায়ে শুয়োরের গন্ধ, সে খায় নেকড়ের মতো, সে হাসতে হাসতে ভাবে। সে গলা দিয়ে স্যান্ডউইচটা নামানোর জন্যে দুধের বোতল থেকে সরাসরি মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে দুধ পান করে। এটা দেখলেও রাচেল ভয়ঙ্করভাবে চোখ কুঁচকে তাকাতো। এরপর সে ওপরতলায় গিয়ে কাপড় ছেড়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার গায়ের ব্যথা এখন কমে হালকা টিপটিপ বেদনায় রুপান্তরিত হয়েছে, যা সামান্য আরামদায়কও বটে।
সে তার ঘড়িটা যেখানে রেখেছিল, সেখানেই আছে। ঘড়িটা নিয়ে দেখে নয়টা বাজতে দশ মিনিট বাকি। অবিশ্বাস্য।
বাতি নিভিয়ে বিছানায় নিজের পাশে শুয়ে পড়ে, ঘুমিয়ে যায়।
ভোর ৩টার দিকে উঠেই সোজা বাথরুমে যায় সে। বাথরুমে গিয়ে উজ্জ্বল ফ্লোরোসেন্ট বাতির নিচে চোখ পিটপিট করতে করতে দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে জাডের কথার গরমিলটা তার মাথায় আসে। তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে যায়।
আজ রাতে জাড বলেছেন যে তার কুকুর স্পট মারা গেছে যখন তার বয়স ছিল দশ বছর-মরচে ধরা কাঁটাতারে লেগে ঘা হয়ে মারা যায় স্পট। কিন্তু এই বছরের গ্রীষ্মের শেষের দিকে তারা সবাই যেদিন পেট সেমিটারিতে ঘুরতে গিয়েছিল, সেদিন তিনি বলেছিলেন তার কুকুর বৃদ্ধ হয়ে মারা যায় এবং তিনি সেটাকে পেট সেমিটারিতে কবর দেন। এমনকি তিনি তার কুকুরের কবরের স্মৃতিফলকটাও তাদের দেখিয়েছিলেন, যদিও সেটার গায়ে কী লেখা
আছে তা পড়া যায় না।
লুইস টয়লেট ফ্লাশ করে বাতি নিভিয়ে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে। আরেকটা খটকা লাগছে তার কাছে-এবং মুহূর্তখানেক পরেই তার সেটা মনে পড়ে।
জাড বলেছিলেন তার এবং এই শতাব্দীর জন্ম একই বছরে। আর সেদিন পেট সেমিট্রিতে তিনি বলেছিলেন তার কুকুরটা মারা যায় যে বছর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। তার মানে তার বয়স ছিল চৌদ্দ, যখন তার কুকুর মারা যায়, যদি তিনি যুদ্ধ শুরু বলতে ইউরোপে যুদ্ধের সূচনার কথা বুঝিয়ে থাকেন।
আর যদি তিনি যুদ্ধ শুরু বলতে সেই যুদ্ধে আমেরিকার যোগদানকে বোঝান তাহলে তখন তার বয়স হবে সতেরো।
কিন্তু আজ রাতে তিনি বললেন তার কুকুরটা মারা গিয়েছিল তার বয়স যখন ১০।
তিনি একজন বৃদ্ধ লোক আর তার মত লোকেরা অনেক কিছুই গুলিয়ে ফেলেন, সে অস্বস্তি নিয়ে ভাবে। তিনি নিজেই বলছিলেন তিনি আর আগের মত সব কিছু মনে রাখতে পারেন না-মাঝে মধ্যেই তাকে লোকের নাম- ঠিকানা মনে করতে স্মৃতি হাতড়ে বেড়াতে হয়, যেসব তিনি আগে অনর্গল বলতে পারতেন। এমনকি উনি সারাদিন কী কী কাজ করবেন সেটা রাতের বেলা ঠিক করে রাখলে পরদিন সকালে তা ভুলে যান। তবে জাডের বয়স হিসেবে তিনি ভালোই আছেন। তার বয়সে ভীমরতি স্বাভাবিক ব্যাপার; অবশ্য জাডের ক্ষত্রে ভীমরতি না বলে ভুলো মন বললে বেশি সঠিক হবে। তার মত একজন বৃদ্ধের জন্যে সত্তর বছর আগে ঠিক কবে তার কুকুর মারা গিয়েছিল বা কিভাবে মারা গিয়েছিল তা মনে করতে না পারার মধ্যে আশ্চর্যের কিছু নেই। ভুলে যাও এসব, লুইস।
কিন্তু এবার সহজে তার ঘুম আসলো না; সে খালি বাড়ি আর সেটার চারদিকে বইতে থাকা শোঁ শোঁ বাতাসের শব্দের ব্যাপারে সচেতন মনে বেশ কিছুক্ষণ জেগে থাকে।
এক সময় সে কিছু টের না পেয়েই ঘুমে ডুব দিলো। তবে ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে তার মনে হয় সে বাইরের সিঁড়িতে কারো পায়ের শব্দ পাচ্ছে। সে ভাবে, চলে যাও, পাস্কো, চলে যাও। যা হয়েছে তা হয়েই গেছে, যা মরেছে তা মরেই গেছে-আর পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যায়।
বছর শেষ হতে হতে যদিও আরো অনেক অদ্ভুত এবং ব্যাখ্যাতীত ঘটনা ঘটে, লুইস আর কখনই ভিক্টর পাস্কোকে দেখে না, না স্বপ্নে না স্লিপ ওয়াকিংয়ে।
অধ্যায় ২৩
সকাল নয়টায় তার ঘুম ভাঙে। রুমের পূর্বদিকের জানালাগুলোতে সূর্যের আলো এসে খেলা করছে। টেলিফোনটা বাজছে। সে ছোঁ মেরে টেলিফোনটা তুলে নেয়। “হ্যালো?”
“হাই!” রাচেল বলে। “ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম না কি? তাহলেই খুশি হবো।”
“তুই আমার ঘুম ভাঙ্গিয়েছিস, কুত্তি,” সে হাসতে হাসতে বলে।
“ছি, মুখের ভাষা শুনলে গোসল করতে মনে চায়,” রাচেল বলে। “কাল রাতে তোমাকে ফোন দিয়েছিলাম। তুমি কি জাডদের বাসায় ছিলে?”
সে জবাব দেয়ার আগে মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্যে ইতস্তত করে। “হ্যাঁ,” বলে সে। “বিয়ারের জন্যে গেছিলাম। নরমা কোথায় যেন থ্যাঙ্কস গিভিংয়ের দাওয়াতে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম তোমাকে ফোন দিব, কিন্তু…জানই তো।”
রাচেল লুইসকে তার বাবা-মার খবর দেয়, যেটা লুইসের না শুনলেও চলতো। তবে যখন শুনলো তার চেকবুকওয়ালা শ্বশুড় মশাইয়ের মাথার স্টেডিয়াম আরো দ্রুত গতিতে বাড়ছে, সে মনে মনে পৈশাচিক আনন্দ পেল।
“গেজের সাথে কথা বলবে?”
“দাও,” লুইস মুচকি হেসে বলে। “দেখো আবার আগেরবারের মত যেন ফোন না রেখে দেয়।”
ফোনের ওপাশ থেকে লুইস শুনতে পায় রাচেল গেজকে হাই, বাবা বলার জন্যে অনেক কায়দা কসরত করছে।
শেষে গেজ বলল, “হাই ডাডা।”
“হাই, গেজ” লুইস উৎফুল্লভাবে বলে। কেমন আছেন আপনি? জীবন চলে কেমন? আপনি দাদার তামাক টানার পাইপের র্যাক আবারো টেনে ফেলে দিয়েছেন? ফেললে আমি খুব খুশি হব। আর পারলে তার কালেক্ট করা ডাকটিকিটগুলোও ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেবেন।”
গেজ আনন্দিত চিত্তে ত্রিশ সেকেন্ডের মত আবোল তাবোল বলে। আবোল তাবোলের মাঝখানে তার ক্রমবর্ধমান ভোকাবুলারির কিছু শব্দ শুনতে পাওয়া গেল-মা, এলি, নানা, নানু, গাড়ি আর গু।
অবশেষে রাচেল গেজের হাত থেকে ফোনটা ছিনিয়ে নেয়, গেজের ক্রোধকে উপেক্ষা করে। লুইসও হাফ ছেড়ে বাঁচে। সে তার ছেলেকে পাগলের মত ভালোবাসে, তবে দুই বছরের বাচ্চার সাথে ফোনে কথোপোকথন চালিয়ে যাওয়া আর বদ্ধ পাগলের সাথে দাবা খেলতে যাওয়া একই কথা। তুমি যে চালই দাও, সে তা উপেক্ষা করে তার নিজের মত করে যা ইচ্ছা চাল দিবে।
“ওদিকে কেমন চলছে?” রাচেল জিজ্ঞেস করে।
খারাপ না,” লুইস এইবার কোন রকম ইতস্তত না করেই বলে। সে জানে যে সে যখন মিথ্যা করে বলেছিল সে জাডের বাসায় ছিল, সে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এখন আর এখান থেকে ফেরার পথ নেই। যা মিথ্যা এখন আরো অনেক বাচ্চা মিথ্যার জন্ম দিবে। তার হঠাৎ জাড ক্র্যান্ডালের কথাটা মনে পড়ে যায়, মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে, লুইস। মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়…আর সেটা সে যত্ন করে রাখে। “সত্য বলতে গেলে একরকম বোরিং সময় কাটিয়েছি কাল। মিস ইউ।”
“তুমি বলতে চাইছো যে তুমি এসব সার্কাস থেকে দূরে থেকে ছুটি উপভোগ করছো না?”
“ওহ, আমার নির্জনতা ভালই লাগে,” সে বলে, “তবে জানো কী, প্ৰথম ২৪ ঘন্টার পর একা একা থাকতে কেমন অদ্ভুত লাগে।”
“আমি বাবার সাথে কথা বলবো,” লুইস ব্যাকগ্রাউন্ডে এলির গলা শুনতে পায়।
“লুইস? এলি কথা বলবে।”
“দাও ওকে।”
এলি প্রায় পাঁচমিনিট ধরে লুইসের সাথে কথা বলে। ও প্রথমে বকবক করলো ওর নানীর কিনে দেয়া পুতুলটার ব্যাপারে। তারপর বলল যে ওর নানা ওকে স্টক ইয়ার্ডে নিয়ে গিয়েছিলেন। “বাবা, ওদের গায়ে কী গন্ধ,” এলি বলে। লুইস মনে মনে বলে, তোমার নানাও কোন গোলাপের কলি না, মামনি। এলি কিভাবে তার নানিকে রুটি বানাতে সাহায্য করেছে তাও বলে। তার পর বলে গেজ কিভাবে তার ডায়াপার চেঞ্জ করার সময় ছুটে পালিয়ে নানার স্টাডি রুমের দরজায় হাগু করে দিয়েছে (সাবাশ! লুইস মনে মনে বলে আর একটা হাসির রেখা তার মুখের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যায়)।
লুইস ভেবেছিল সে হয়তো এ যাত্রায় বেঁচে গেছে, অন্তত আজ সকালের জন্যে। সে যখন এলিকে তার মাকে ডেকে দেয়ার কথা বলতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই এলি তাকে জিজ্ঞেস করে, “চার্চ কেমন আছে বাবা? ও আমাকে মিস করে?”
লুইসের মুখ থেকে হাসি উবে যায় কিন্তু সে সাথে সাথেই উত্তর দেয়,
একদম শান্ত স্বাভাবিক গলায়ঃ “ও ভালই আছে। গতকাল রাতে ওকে বেঁচে যাওয়া বিফ স্টু খেতে দিয়েছিলাম। ওর খাওয়ার পর ওকে ঘরের বাইরে যেতে দিয়েছি। এরপর থেকে ওকে আর দেখিনি। তবে মাত্রতো ঘুম থেকে উঠলাম।”
তুমি প্রথম শ্রেনীর একজন খুনি হতে পারবে লুইস, ঠান্ডা মাথার খুনি। ডাক্তার ক্রিড, মৃত ব্যাক্তিকে শেষ কখন দেখেছেন? রাতে খাবার সময়। সে বিফ স্টু খায় ডিনারে। এরপর থেকে তাকে আর দেখিনি।
“আচ্ছা। চার্চকে আমার হয়ে চুমো খেয়ো, বাবা।”
“ইয়াক, নিজের বিড়ালকে নিজে চুমু খাও ইচ্ছে হলে,” লুইস বললে এলি খিকখিক করে হেসে উঠে।
“মার সাথে আবার কথা বলবে, বাবা?”
“হ্যাঁ, দাও।”
সে রাচেলের সাথে আরো কয়েক মিনিট কথা বলে তবে চার্চের ব্যাপারে কিছু বলে না তারা। তারা একে অপরকে “লাভ ইউ” বলে আর তারপর লুইস
ফোন রেখে দেয়।
“বাপরে,” সে শূন্য রুমে বলে ওঠে আর এর সবচাইতে খারাপ ব্যাপারটা হচ্ছে তার একফোঁটাও খারাপ লাগছে না বা অনুশোচনা বোধ হচ্ছে না।
অধ্যায় ২৪
সাড়ে নয়টার দিকে স্টিভ মাস্টার্টন ফোন দিয়ে লুইসকে জিজ্ঞেস করে লুইস র্যাকেট খেলবে কি না-র্যাকেট কোর্ট পুরো ফাঁকা, চাইলে তারা সারাদিন খেলতে পারবে, সে খুব উৎফুল্ল কন্ঠে বলে।
লুইস তার কন্ঠের আনন্দের কারণটা বুঝতে পারছে। ইউনিভার্সিটি চলার সময় র্যাকেট খেলার জন্যে সিরিয়াল পেতে দুইদিন লেগে যায়। কিন্তু তারপরেও সে রাজি হলো না। সে স্টিভকে বলে সে ম্যাগাজিন অফ কলেজ মেডিসিনের জন্যে একটা আর্টিকেল লিখবে, তাই খেলতে পারবে না।
“তুমি শিওর তো?” স্টিভ জিজ্ঞেস করে। “খেলাধুলা বাদ দিয়ে সারাদিন কাজ কাজ করলে মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে যায়, জানো তো?”
“জানি। আচ্ছা দেখি।”
“রাজি হয়ে যাও,” বলে স্টিভ ফোন রেখে দেয়। লুইস এবার অবশ্য অর্ধেক মিথ্যা বলেছে। কারণ সে আসলেই ঐ আর্টিকেলটা নিয়ে কাজ করতে চায়, যদিও তার খেলতে না চাওয়ার আসল কারণ গতকালের অ্যাডভেঞ্চারের কারণে তার পুরো শরীর ব্যথা। বিড়ালটাকে বইতে গিয়ে তার দুই কাঁধই ব্যথা হয়ে আছে। তার পিঠ ব্যথা করছে আর পায়ের পেশিগুলো গিটারের তারের মত টনটনে হয়ে আছে। খোদা জানে সে কিভাবে ভেবেছিল তার শরীর মোটামুটি ফিট আছে। আজ স্টিভের সাথে র্যাকেট খেলতে গেলে তাকে খুব কিউট দেখাতো, বাতের ব্যারামে ভোগা বুড়োদের মত নড়াচড়া করতো সে।
বুড়োদের কথা ভেবে তার মনে পড়ে গেল কাল রাতের ভ্রমণে সে একা যায়নি, তার সাথে একজন আশি বছরের বুড়োও গিয়েছিলেন। সে ভাবে, জাডের শরীরেও কি এরকম ব্যথা হচ্ছে?
ঘন্টাখানেক ধরে আর্টিকেল লিখতে চেষ্টা করে কিন্তু কাজ খুব একটা এগোয় না। একাকিত্ব আর নির্জনতা তার নার্ভে চেপে বসে। সে তাই কাজে ইস্তফা দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরোয়।
জাড আর নরমা বাসায় ছিলেন না কিন্তু তাদের দরজায় একটা খাম পিন দিয়ে আটকানো ছিল। খামের ওপর লুইসের নাম লিখা। সে খামটা নিয়ে ঢাকনা খুলে একটা চিঠি পায়।
লুইস,
আমি এবং আমার মাননীয় স্ত্রী শপিংয়ের জন্যে বাকস্পোর্ট যাচ্ছি। তাছাড়া সেখানে এম্পোরিয়ামের একটা ড্রেসারে মাননীয়ার চোখ পড়েছে প্রায় শত বছর আগে। সেটাও দেখতে হবে। আমরা সেখানেই লাঞ্চ সেরে নেব আর আমাদের ফিরতে ফিরতে বিকেল হবে। রাতে বিয়ারের জন্যে চলে এসো।
তোমার ফ্যামিলি তোমারই ফ্যামিলি, তাই আমি তাতে মাতব্বরি করতে চাই না। কিন্তু এলি যদি আমার মেয়ে হতো তাহলে ওকে আমি এখনই চার্চের খবরটা দিতাম না। শুধু শুধু ওর বেড়ানোটা মাটি করে কী লাভ? আর আমি তোমার জায়গায় হলে আমাদের গতরাতের ব্যাপারেও কারো সাথে আলাপ করতাম না, বিশেষ করে নর্থ লাডলোর কারো সাথে। এখানকার কেউ কেউ মিকমেকদের গোরস্থানটার কথা জানে আর এই শহরেরই কেউ কেউ তাদের পোষা প্রাণীদের সেখানে কবরও দিয়েছে…যেটাকে তুমি পেট সেমিটারির আরেকটা অংশ বলতে পারো। বিশ্বাস করবে কি না জানি না, ওখানে একটা ষাড় পর্যন্ত কবর দেয়া হয়েছিল। স্টেক পোল রোডের জ্যাক ম্যাকভার্ন তার প্রাইজ পাওয়া ষাড় হ্যানরাট্টিকে মিকমেকদের গোরস্থানে কবর দিয়েছিলেন, ১৯৬৭ বা ৬৮ তে। হা হা! তিনি আমাকে বলেছিলেন তিনি আর তার দুই ছেলে মিলে ষাড়টাকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেখান পর্যন্ত। আমার সেটা শুনে হাসতে হাসতে দম বন্ধ হবার অবস্থা! এখানকার লোকজন ঐ জায়গাটা নিয়ে কথা বলা পছন্দ করে না, আর তারা এটাও চায় না ‘বাইরের’ কেউ ঐ জায়গাটার ব্যাপারে জানুক। এটার কারণ এটা না যে মিকমেকদের গোরস্থান নিয়ে তিনশো বছরের পুরনো কুসংস্কার আছে। এর কারণ তারা এসবে বিশ্বাস করে এবং তাদের ধারণা ‘বাইরের’ কেউ ব্যাপারগুলো বুঝবে না এবং তাদের নিয়ে হাসাহাসি করবে। এসবের কোন আগা-মাথা আছে? হয়তো নেই, কিন্তু প্লিজ তুমি তোমার মুখ বন্ধ রাখবে।
আমি তোমাকে আরো খুলে বলবো, হয়তো আজ রাতেই। আর আমার ধারনা ততক্ষনে তুমি নিজেই আরো ভালো করে বুঝতে পারবে।
জাড়।
পুনশ্চ-এই চিঠিতে কী লেখা আছে নরমা জানে না। আমি ওকে অন্য কিছু বলেছি। আমার স্ত্রীকে আমাদের আটান্ন বছরের বিবাহিত জীবনে অনেক মিথ্যেই বলেছি, আমার ধারণা, প্রায় সব পুরুষই তাদের স্ত্রীদেরকে দু-একটা মিছে কথা বলে। তবে অনেকেই সেসবের জন্যে লজ্জিত নয়, কারণ মিথ্যেগুলোর দরকার ছিল।
যাই হোক, রাতে চলে এসো, আজ খুব করে বিয়ার খাওয়া হবে।
জে।
লুইস পোর্চের সিঁড়িতে দাড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এলিকে চার্চের কথা বলো না-সে বলেনি। সেখানে আরো পশু কবর দেয়া হয়েছে? তিনশো বছরের পুরনো কুসংস্কার?…ততক্ষনে তুমি নিজেই আরো ভালো করে বুঝতে পারবে।
সে এই লাইনটা আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে আর নিজের মনকে গতরাতে তার কার্যকলাপ নিয়ে প্রথমবারের মতো ভাবতে দেয়। স্মৃতিটা কিছুটা ফিকে হয়ে এসেছে, তার মনে হচ্ছে সে কোন স্বপ্নের কথা ভাবছে, বা শক্তিশালী মাদকে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় করা কিছুর কথা ভাবছে। তার গতরাতের মরা গাছের স্তুপটার ওপর ওঠার কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে সেখানকার বাতাসে হালকা আলোর আভা আর সেখানে দশ বা বিশ ডিগ্রী বেশি গরম লাগার ব্যাপারটা। তবে সবটাই কেমন ঝাপসা ঝাপসা, ডাক্তার এনেসথেসিয়া দেয়ার পর যেমনটা হয়…প্রায় সব পুরুষই তাদের স্ত্রীদের মাঝে মধ্যে দুই-একটা মিছে কথা বলে।
স্ত্রীদের পাশাপাশি নিজের মেয়েকেও, লুইস ভাবে। জাড যেন আজ সকালে লুইসের মাথায় কী ঘুরপাক খেয়েছে তার সবই জেনে গেছেন, ব্যাপারটা খুব ভূতুড়ে লাগে লুইসের কাছে।
ধীরে ধীরে সে চিঠিটা আগের মত ভাঁজ করে খামে ঢুকায়। চিঠিটা লেখা হয়েছে দাগ টানা কাগজে, বাচ্চারা যেসব কাগজে লিখে। সে খামটা তার প্যান্টের পেছনের পকেটে রেখে নিজের বাসার দিকে রওনা হয়।
অধ্যায় ২৫
দুপুর এগারোটার দিকে চার্চ ফিরে আসে। লুইস গ্যারেজে একটা বেশ উচ্চাভিলাষী শেলফ বানানোর কাজ করছিল। এটা তার শখের প্রজেক্ট এবং এটা সে প্রায় গত ছয় সপ্তাহ ধরে করছে। সে গ্যারেজের সব বিপজ্জনক জিনিস-পাতি, যেমন এন্টি ফ্রিজ, উইন্ডশিল্ড ধোয়ার লিকুইড, ধারালো যন্ত্রপাতি ইত্যাদি এই শেলফে রাখবে, যাতে এসব গেজের নাগালের বাইরে থাকে। সে একটা পেরেক ঠুকছিল যখন চার্চ তার লেজ উঁচু করে হাঁটতে হাঁটতে গ্যারেজে ঢুকে। লুইসের হাত থেকে হাতুড়ি খসে পড়লো না বা সে তার আঙুলেও হাতুড়ির বাড়ি মারলো না। তার হৃদয় চমকে গেছে কিন্তু লাফ মারেনি। তার পেটে একটা গরম ধাতব তার আচমকা জ্বলে উঠে আবার নিভে গেল, যেমন বাতির ফিলামেন্টের তার হঠাৎ অতি উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়। সে পরে চিন্তা করে দেখেছে আসলে সে সারাদিন চার্চের ফেরার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। যেন তার অবচেতন মন ঠিকই জানতো যে গতরাতে তারা মিকমেকদের গোরস্থানে যা করেছে তা চার্চকে ফিরিয়ে আনার জন্যেই করেছে।
সে সাবধানে হাতুড়িটা নামিয়ে রাখে আর মুখে কামড়ে ধরে থাকা কয়েকটা তারকাটা ধীরে সুস্থে নামিয়ে রাখে। সে চার্চের কাছে গিয়ে তাকে উঁচু করে ধরে।
বেঁচে থাকা চার্চের ওজন, সে একরকম অসুস্থ এবং আনন্দদায়ক উত্তেজনা নিয়ে ভাবে। ও ট্রাকের ধাক্কা খাওয়ার আগের ওজনে ফিরে গেছে। ওকে ওই পলিথিন ব্যাগটায় অনেক ভারি মনে হচ্ছিল। মরে গিয়ে ওর ওজন বেড়ে গিয়েছিল।
এবার তার হৃৎপিন্ড প্রায় লাফিয়ে ওঠে।
চার্চ কান দুটো পেছনের দিকে নিয়ে চুপ হয়ে আছে। লুইস তাকে ধরে থাকলেও সে কোন রকম রা করছে না। লুইস চার্চকে নিয়ে বাইরের সিঁড়িতে বসে, রোদের মধ্যে। তখন চার্চ ছুটতে চাইলেও লুইস তাকে নিজের কোলে বসিয়ে রাখে। লুইস তার হৃৎপিন্ডের দ্রুতগতি টের পাচ্ছে।
সে চার্চের ঘাড়ের পশমগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলো। গতকাল চার্চের ভাঙা ঘাড় খুব সহজেই ঘোরানো যাচ্ছিল, যেন সেখানে কোন হাড় ছিল না। তবে এখন সে ঘাড়ের মোটা রগ আর মাংসপেশি ছাড়া কিছুই টের পাচ্ছে না। সে চার্চকে দুহাতে উঁচু করে ধরে ওর নাকের দিকে তাকায়। কিন্তু সে যা দেখে তাতে চমকে গিয়ে সে চার্চকে হাত থেকে ফেলে দেয়। সে তার হাত দিয়ে নিজের চোখমুখ ঢেকে ফেলে। তার চারদিকে পৃথিবী ঘুরছে—মদ খেয়ে বমি করার ঠিক আগমুহূর্তে যেমন লাগে।
চার্চের নাকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে আর তার লম্বা গোফে গতকালের সেই পলিথিনের চিকন দুটো ফালি আটকে আছে।
আমি তোমাকে আরো খুলে বলবো, হয়তো আজ রাতেই। আর আমার ধারনা ততক্ষনে তুমি নিজেই আরো ভালো করে বুঝতে পারবে…
ওহ খোদা! সে যতটুকু জানতে চায় তার চাইতে বেশি এর মধ্যেই জেনে গেছে।
অনেক বুঝে ফেলেছি, লুইস ভাবে, আর বেশি বুঝলে আমাকে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে পাগলা গারদে পাঠাবে সবাই।
***
লুইস চার্চকে ঘরে ঢুকতে দিয়ে চার্চের নীল খাবারের বোলটা খুঁজে বের করে এবং একটি টুনা-এন্ড-লিভার ক্যাট ডিনারের কৌটা খুলে। সে যখন কৌটার ভেতর থেকে জঘন্য থকথকে জিনিসটা চামচ দিয়ে বের করতে থাকে, তখন চার্চ পুর্র্ পুর্র্ করতে করতে তার পায়ের চারদিকে ঘুরে ঘুরে গা ঘষতে থাকে। সে টের পায় চার্চের স্পর্শে তার গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেছে এবং দাঁতে দাঁত চেপে সে চার্চকে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়ার তীব্র বাসনা থেকে নিজেকে বিরত রাখে। চার্চের গায়ের নরম পশমের ছোঁয়ায় তার গা গুলাতে থাকে। তার মনে হয় সে আর জীবনেও চার্চকে স্পর্শ করতে চাইবে না।
নিচু হয়ে সে খাবারের বোলটা মেঝেতে রাখতে গেলে চার্চ তার পাশ দিয়ে ছুটে যায় সেটার দিকে। লুইস শপথ করে বলতে পারবে সে চার্চের গা থেকে মাটির বাসি গন্ধ পেয়েছে-যেন চার্চের গায়ের লোমে মাটি লেগে আছে।
পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ালটাকে খেতে দেখে। খেতে খেতে চার্চ অদ্ভুত রকমের চপ-চপ-চপ শব্দ করতে থাকে। সে আগে খাওয়ার সময় এমন করতো কখনো? হয়তো করতো কিন্তু লুইস কখনো খেয়াল করেনি। হতে পারে। তবে যেটাই হোক, শব্দটা খুব বিশ্রী। এলি শুনলে বলতো, ইয়াক।
হঠাৎ লুইস ঘুরে দোতলায় যাবার জন্যে সিঁড়ি বাইতে শুরু করে। সে যখন দোতলায় পৌঁছে, সে তখন রীতিমত দৌড়াচ্ছে। সে দ্রুত তার গায়ের জামা কাপড় খুলে সেগুলো ময়লা কাপড়ের ঝুড়িতে ছুঁড়ে ফেলে গায়ের শেষ সুতোটি পর্যন্ত, যদিও সে আজ সকালেই এই পরিস্কার কাপড়গুলো পড়েছিল। এরপর সে বাথটাবে গরম পানি নেয়, যতটুকু গরম সে সহ্য করতে পারে এবং সেখানে ঝাপিয়ে পড়ে।
তার চারদিকে থেকে বাষ্প উড়ছে এবং সে তার দেহের প্রতিটি পেশিতে গরম পানির আরাম অনুভব করতে পারছে। আরামদায়ক গোসলে তার মাথার জটও খুলতে শুরু করে। পানি যখন ঠান্ডা হতে শুরু করে, তার ঘুম ঘুম লাগে এবং সুস্থ বোধ হতে থাকে।
বালের বিড়ালটা ফিরে এসেছে…আসলেই এসেছে, বড় কোন ঘটনা না। আসলে পুরোটাই একটা নিছক ভুল বোঝাবুঝি। কাল চার্চকে দেখে তার মনেই হয়নি যে বিড়ালটা ট্রাকের ধাক্কায় পটল তুলেছে।
রাস্তায় মড়া কুকুর বিড়াল তো সে কম দেখিনি। সেসবের শরীর থেতলে যায়, নাড়ি-ভুড়ি ফেটে চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়।
তার কাছে এখন সবকিছু পরিস্কার হয়ে যায়। চার্চ ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে মরেনি, তবে বেহুশ হয়ে গিয়েছিল। সে যে চার্চকে মিকমেকদের গোরস্থানে বয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেটা অজ্ঞান চার্চ ছিল, মৃত চার্চ না। লোকে বলে বিড়ালের নয়টা জীবন আছে, তাই না? ভাগ্য ভালো সে এলিকে কিছু বলেনি, বেচারি শুধু শুধু কষ্ট পেত। তবে এলি কখনোই জানবে না তার বিড়াল মৃত্যুর কতটা কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।
কিন্তু ওর মুখে আর গলার পশমে রক্ত, ওর মাথা যেভাবে বাধাহীনভাবে ঘুরছিল…
সে একজন মানুষের ডাক্তার, কোন পশু ডাক্তার না। সে একটা ভুল ডায়াগনোসিস করেছে, আর কিছু না। আর ভালো করে পরীক্ষা করার মত কোন অবস্থাও গতকাল ছিল না। ফ্রিজিং টেম্পারেচারে, সন্ধ্যার শেষ আলোতে, জাডের উঠোনের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে আর কতটুকু ভালো ভাবেই বা ডেডবডি পরীক্ষা করা যায়? তাছাড়া সে হাতে গ্লাভস পড়ে ছিল। এমনও হতে পারে-
একটা মোটাসোটা, কদাকার ছায়া বাথরুমের টাইলস করা দেয়ালে ভেসে উঠলো, অনেকটা ড্রাগনের মাথা বা সাপের মাথা যেভাবে আড়াল থেকে ভেসে উঠে। কিছু একটা তার নগ্ন কাঁধে হালকা স্পর্শ করে পিছলে চলে গেল। লুইস তাতে ধড়মড়িয়ে উঠে বসে এবং তাতে বাথটাবের পানি ছলকে উঠে বাইরে পরে বাথরুমের মেঝে ভিজিয়ে দেয়। হঠাৎ স্পর্শে তার শরীর শক্ত হয়ে গেছে। সে ঘার ঘুরিয়ে তার মেয়ের বেড়ালের হলদে-সবুজ চোখ জোড়ার দিকে তাকায়। বিড়ালটা টয়লেটের সিটের ওপর বসে আছে।
চার্চ মাতালের মত সামনে পিছে ঝুঁকছে। ওকে দেখে লুইসের সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠে আর একটা চিৎকার তার চেপে থাকা দাঁতের গোড়ায় এসে থেমে যায়। চার্চ আগে কখনই এভাবে দুলতো না-সাপের মত নিজের শিকারকে সম্মোহিত করা দুলুনি তাকে খাসি করার আগেও না, পরেও না। তার মাথায় আরেকটা ধারনা খেলা করতে লাগে। হতে পারে এটা অন্য আরেকটা বেড়াল। দেখতে একদম চার্চের মত কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিড়াল। বিড়ালটা ঘুরতে ঘুরতে তাদের গ্যারেজে এসে পড়েছে এবং সে তাকে এলির বিড়াল ভেবে ভেতরে নিয়ে এসেছে। আর আসল চার্চ এখনো মিকমেকদের গোরস্থানে তার তৈরি সেই শিলাস্তম্ভটার নিচে মাটিচাপা অবস্থায় আছে। কিন্তু বিড়ালটার গায়ের দাগগুলো একদম চার্চের সাথে মিলে যায়…সেই একই দাগওয়ালা কান… সেই একই আহত থাবা, যেটাকে দেখলে মনে হয় কেউ চিবিয়ে দিয়েছে। চার্চ ছোট থাকতে এলি একবার ভুলে ওর ওই থাবাটা দরজায় বাড়ি খাইয়েছিল।
এটা চার্চই, কোন সন্দেহ নেই।
“যা ভাগ,” লুইস কর্কশভাবে হিসিয়ে ওঠে
চার্চ আরো কয়েক মুহূর্ত তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কোন এক কারণে চার্চের চোখগুলো তার কাছে অন্য রকম লাগছে, সে একদম হলফ করে বলতে পারে। এরপর চার্চ লাফিয়ে টয়লেটের সিট থেকে নিচে নামে। কিন্তু বিড়ালদের লাফিয়ে নামার মধ্যে যেমন একরকমের পটুতা থাকে, সেই লাফে তার কিছুই ছিল না। সে লাফিয়ে নেমে স্থির থাকতে না পেরে নিয়ন্ত্রণহীন বাসের মত হেলতে দুলতে এগিয়ে গিয়ে বাথটাবের সাথে ধাক্কা খায়। এরপর সে বাথরুম থেকে চলে যায়।
লুইস বাথটাব থেকে বেরিয়ে দ্রুত গা মুছে নেয়। সে যখন জামা গায়ে দিচ্ছিল তখন বাড়ীর নিস্তব্ধতা চুরমার করে দিয়ে ফোনটা বেরসিকের মত বেজে উঠে। লুইস চমকে প্রায় লাফিয়ে ওঠে। এক অজানা আতঙ্কে তার চোখগুলো বড় বড় হয়ে গেছে আর সে ঘুরে দাড়িয়ে নিজের হাত দুটো ওপরে মেলে ধরে আত্মরক্ষার্থে। সে এরপর সম্বিত ফিরে পেয়ে ধীরে ধীরে নিজের হাত দুটো নামিয়ে নেয়। তার হৃৎপিন্ড খুব দ্রুত চলছে। সে তার পেশিতে এড্রেনালিনের আধিক্য টের পাচ্ছে।
স্টিভ মাস্টারটন ফোন করেছে, লুইস র্যাকেট খেলবে কি না জানার জন্যে। লুইস রাজি হয়ে বলল যে সে এক ঘন্টার মধ্যে সেখানে হাজির হবে। তার হাতে সময় একদমই নেই, আর র্যাকেট খেলার কোন ইচ্ছেও তার নেই। কিন্তু তার বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়া দরকার। সে বিড়ালটার কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইছে। বিড়ালটার এখানে থাকা কোন ভাবেই সম্ভব না। কিন্তু তারপরেও সেটা এ বাড়িতেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
লুইস তড়িঘড়ি করে গায়ে একটা শার্ট আর শর্টস চাপিয়ে দ্রুত সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকে।
চার্চ সিঁড়ির একদম নিচ থেকে চার নাম্বার ধাপে শুয়ে ছিল। ওকে মাড়িয়ে দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে লুইস ওকে খেয়াল করে এবং সে প্রায় পা হড়কে পড়েই যাচ্ছিল। সে সিঁড়ির পাশের রেলিং ধরে নিজেকে সামলে নেয়। এখান থেকে পড়লে খুব ভালোভাবেই চোট পেতে পারতো সে।
সে সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকে। তার হৃৎপিন্ড খুব দ্রুত চলছে আর শরীরে এড্রেনালিন বেড়ে গেছে।
চার্চ উঠে আড়মোড়া ভাঙে, ওটাকে দেখে মনে হচ্ছে সে লুইসের দিকে তাকিয়ে মুখ টিপে হাসছে।
লুইস চলে যায় সেখান থেকে। তার বিড়ালটাকে বাসার বাইরে রেখে যাওয়া উচিত ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে সে মরা বিড়ালটাকে একদমই স্পর্শ করতে চাচ্ছে না।
অধ্যায় ২৬
জাড একটা ম্যাচের কাঠি দিয়ে নিজের সিগারেটটা জ্বালানোর পর কাঠিটাকে ঝাঁকিয়ে নিভিয়ে একটা এ্যাশট্রেতে ছুঁড়ে ফেললেন।
“হুম, স্টানলি বুকার্ডই আমাকে ওই জায়গাটার কথা বলেছিল।” তিনি থেমে চিন্তা করতে লাগলেন।
তাদের সামনে টেবিলে বিয়ারের গ্লাস রাখা আছে, যেগুলো তারা প্রায় ছুয়েও দেখেনি। লুইস স্টিভের সাথে হালকা ডিনার করে এসেছে। পেটে কিছু খাবার পড়ায় তার এখন আগের চাইতে বেশ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে সে আবার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাচ্ছে। তবে বাসায় চার্চ ঘোরাঘুরি করছে বলে সেখানে ফিরে যাওয়ার জন্যে সে কোন রকম চিন্তিত না।আমার আশেপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট
নরমা তাদের সাথে কিছুক্ষণ বসেছিলেন। তিনি টিভি দেখার সাথে সাথে একটা কাপড়ে সুই সুতোর কাজ করছিলেন। তিনি সুই সুতো দিয়ে কাপড়টার মধ্যে একটা বাড়ির পেছনে সূর্যাস্তের দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে চাচ্ছেন। বাড়িটার ছাদের ক্রুশটি নিম্নগামী নিস্তেজ সূর্যের গায়ে আবছায়ার মত দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেছেন যে তিনি সেটা বিক্রির জন্যে করছেন। ক্রিসমাসের আগের সপ্তাহে চার্চে মেলার মত হয়, খুব বড় করে। সেখানে বিক্রি করবেন এটা। লুইস ভালো করে দেখলো তিনি খুব সুন্দর এবং সাবলীলভাবে কাপড়ে সুই চালাচ্ছেন। আজকে তার বাতের ব্যথা নেই তেমন একটা। লুইস ভাবে এটা হয়তো আবহাওয়ার কারণে। বাইরে ঠান্ডা হলেও বায়ু খুবই শুষ্ক। তিনি তার হার্ট অ্যাটাক থেকে ভালোভাবেই সেরে উঠেছেন। তবে মস্তিষ্ক সংক্রান্ত জটিলতায় মারা যাওয়ার দশ সপ্তাহ আগের এই দিনে তাকে দেখে লুইসের মনে হয় ওনার বয়স কয়েক বছর কমে গিয়েছে। লুইসের মনে হলো সে তার ভেতরের কিশোরীকে দেখতে পাচ্ছে।
পৌনে দশটার দিকে নরমা তাদের রেখে শুভরাত্রি জানিয়ে উঠে গেলেন। লুইস আর জাড পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু জাড চুপ করে আছেন। তিনি সিগারেটের ধোয়া ছেড়ে গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছেন সেই ধোঁয়া কোথায় উড়ে যাচ্ছে, অনেকটা বাচ্চারা যেভাবে উড়তে থাকা গ্যাস বেলুনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
“স্টানি বি..” লুইস নীরবতা ভেঙে বলে।
জাড চোখ পিটপিট করে যেন নিজের মাঝে ফিরে এলেন। “লাডলোর সবাই তাকে স্টানি বি. বলেই চিনতো। ১৯১০, যে বছর আমার কুকুর স্পট মারা যায়—মানে প্রথম বারের জন্য মারা যায় ততদিনে স্টানি বেশ বুড়িয়ে গেছিলেন আর তার মাথাও সামান্য থেকে একটু বেশিই বিগড়ে গিয়েছিল। ওই সময় অনেকেই মিকমেকদের গোরস্থানটা চিনতেন, কিন্তু আমি ওটা সম্পর্কে জানি ওই স্টানির কাছেই। তিনি জেনেছিলেন তার বাবার কাছ থেকে। তার পরিবার ছিল একদম ভেজালহীন কানাডিয়ান।”
জাড একটু হেসে তার বিয়ারে চুমুক দিলেন।
“তার ভাঙা ভাঙা ইংরেজি বলা আমার এখনো কানে বাজে। তিনি আমাকে রুট-১৫’র পাশের একটা আস্তাবলের পাশে বসে থাকতে দেখে কথা বলতে এগিয়ে এসেছিলেন। স্পট তখনো মরেনি কিন্তু তার শেষ সময় চলে এসেছিল। আমার বাবা আমাকে হাস-মুরগির খাবার চেক করে দেখার জন্যে বাড়ির বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। একটা গরুর জন্যে ব্লাকবোর্ড যতটা গুরত্বপূর্ণ, আমাদের জন্যেও হাস-মুরগির খাবার ততটাই গুরত্বপূর্ণ। আর আমি ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম আমার বাবা কেন আমাকে বাড়ির বাইরে পাঠাচ্ছিলেন।
“উনি কুকুরটাকে কষ্ট থেকে বাঁচাতে মেরে ফেলতে চাইছিলেন?”
“তিনি জানতেন আমি স্পটকে কতটা ভালোবাসি। তাই তিনি চাননি আমি বাসায় থাকি যখন তিনি সেটা করেন। আমি মুরগির খাবারের জন্যে গেলে দোকানদার যখন আমার জন্যে সেটা বস্তায় ভরে দিচ্ছিলেন আমি তখন সেখানকার একটা পাথরের উপর বসে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি।”
জাড মুচকি হাসতে হাসতে মৃদুভাবে তার মাথা ঝাকান।
“আর তখনই স্টানি এসে হাজির হন,” তিনি বললেন। “শহরের অর্ধেক মানুষ ভাবতো সে মাটির মানুষ আর অর্ধেক ভাবতো সে ভয়ঙ্কর লোক। তার দাদা আঠারো শতাব্দীর শুরুর দিকে পশু শিকার করে চামড়া বিক্রির কারবার করতেন। তিনি একটা বিরাট লাল ওয়াগন গাড়ি চালাতেন যেটার গায়ে অনেকগুলো ক্রুশ আঁকা ছিল, একজন আদর্শ খ্রিস্টানের যা করা উচিত। তিনি ছিলেন এমন ক্রিশ্চিয়ান যে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে মানুষকে ধর্ম আর পরকালের জ্ঞান দিতেন। আবার তার গাড়ির ওপর পেগান ইন্ডিয়ানদের চিহ্নও ছিল। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে, যত গোত্রের ইন্ডিয়ান আছে সবাই একটি বৃহৎ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত-ইসরায়েলের হারিয়ে যাওয়া গোত্র, যেটির কথা বাইবেলে বলা আছে। তিনি বিশ্বাস করতেন সব ইন্ডিয়ানরাই নরকে যাবে, কিন্তু তিনি এটাও বিশ্বাস করতেন যে তাদের যাদু ঠিকই কাজ করে। কারণ তার মতে তারাও আসলে এক রকমের খ্রিস্টানই, সেটা যত অদ্ভুতই শোনাক না কেন।
“অন্যান্য চামড়া শিকারী আর ব্যবসায়িরা যখন সুবিধা করতে না পেরে পশ্চিমে চলে গিয়েছিল, স্টানির দাদা তখনো মিকমেকদের সাথে চামড়ার কারবার চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তার কারণ তিনি মিকমেকদের ভালো দাম দিতেন আর পুরো বাইবেল ছিল তার মুখস্ত। মিকমেকরা তার মুখ থেকে বাইবেলের কথা শুনতে খুব ভালোবাসতো।”
জাড চুপ হয়ে গেলেন দেখেও লুইস কিছু না জিজ্ঞেস করে অপেক্ষা করে। “মিকমেকরা স্টানলির দাদাকে ওই গোরস্থানটার কথা বলেছিল, সেখানে তারা আর কাউকে কবর দেয় না কারণ একটা উইন্ডিগো গোরস্থানটার মাটি অপবিত্র করে ফেলেছিল। তারাই তাকে ওই ঈশ্বরের জলা আর ওই পাহাড় কেটে বানানো সিঁড়িটার কথাও বলে।”
“আর এই উইন্ডিগোর গল্প, এটা সেই সময় দেশের এই উত্তরাঞ্চলের সবখানেই শোনা যেত। এই গল্পটা সৃষ্টি করার বিশেষ প্রয়োজন ছিল, ঠিক যেই কারণে কিছু কিছু খ্রিস্টান গল্পও তৈরি করা হয়েছে। নরমা হয়তো আমাকে এটা বলতে শুনলে নাস্তিক বলে ঝাড়ি দিবে কিন্তু এটাই সত্য। সে সময় শীতে এই উত্তরাঞ্চলের ইন্ডিয়ানদের মাঝে খাদ্যের বিকট অভাব দেখা দিত। পরিস্থিতি মাঝে মাঝে এতোটাই খারাপ হতো যে তাদের হয় না খেয়ে মরা লাগবে অথবা অন্য কিছু।”
“ক্যানাবলিজম?”
জাড কাঁধ ঝাঁকান। “হতে পারে। এমন হতে পারে আর কোন উপায় না পেয়ে তারা অচল কোন বৃদ্ধকে বেছে নিত। এর পর অন্তত কিছু সময়ের জন্যে তারা সিদ্ধ মাংস খেয়ে জীবন বাঁচাতে পারতো। তবে এই কাজকে হালাল করার জন্যে তারা একটা গল্প বানায়। তারা বলে যে একটি উইন্ডিগো তাদের গ্রামে এসে তাদের ঘুমন্ত অবস্থায় ছুঁয়ে দিয়ে গেছে। আর উইন্ডিগো তাদেরই ছুতো যাদের সে মানুষের মাংসের স্বাদ আস্বাদন করাতে চাইতো।”
লুইস মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। “বলে না, শয়তান আমাদের দিয়ে অকাজ করিয়ে নিয়েছে? অনেকটা ঐ রকম ব্যাপার।”
“হুম। আমার ধারণা আমাদের এখানকার মিকমেকরাও সেরকম কোন পরিস্থিতিতে পড়ে। আর এরপর তারা নিজেদের মধ্যে থেকে হয়তো দু-চার জনকে বা ডজনখানেক লোককে কেটেকুটে খেয়ে নিয়ে তাদের হাড়গোড় ওই গোরস্থানে পুঁতে ফেলে।
“এবং এর পর তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে সেখানকার মাটি অপবিত্র হয়ে গেছে,” লুইস বিড়বিড় করে বলে।
“আচ্ছা আসল কথায় ফিরে আসি। আমি যেখানে ছিলাম তার কাছেই স্টানি মদ জোগাড় করতে এসেছিলেন। আমার সাথে যখন তার দেখা হয় ততক্ষণে তিনি হাফ মাতাল। তার দাদা যখন মারা যান তখন নাকি তার সম্পদের পরিমান এক মিলিয়ন ডলারের মত ছিল, লোকমুখে শোনা। কিন্তু স্টানি ছিল নগন্য একজন পাপোশ ব্যবসায়ি। সে আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার কী হয়েছে, কেন কাঁদছি আমি। আমি সব কিছু খুলে বললে তিনি বললেন এই সমস্যার সমাধান তিনি জানেন, কিন্তু আমাকে অনেক সাহসিকতা দেখাতে হবে।”
“আমি বললাম যে আমি স্পটকে সুস্থ করে তোলার জন্যে যে কোন কিছু করতে পারি, কিছুর পরোয়া করি না আমি। তারপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি কোন ভালো ভেটকে চিনেন কি না যে স্পটকে সারিয়ে তুলবে। ‘আমি? আমি কোন ভেটকে চিনি না, না আমাকে কোন ভেট চিনে।” স্টানি বলেছিলেন। ‘কিন্তু আমি জানি কিভাবে তোমার কুকুরকে ঠিক করা যাবে। তুমি বাসায় যাও। গিয়ে তোমার বাবাকে বলো যাতে কুকুরটাকে একটা বস্তায় ভরে দেয়। তারপর তুমি সেটাকে পেট সেমিটারির ওই মরা গাছগুলোর স্তুপের কাছে রাখবে। কবর দিবে না কিন্তু, শুধু ওখানে রাখবে। ঠিক আছে?’
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা করে লাভ কি হবে? স্টেনি উত্তর না দিয়ে বললেন আমি যাতে রাতে জেগে থাকি। তিনি মাঝরাতের দিকে আমার জানালাতে পাথর ছুঁড়ে মারলে আমি যাতে বেরিয়ে আসি। তখন গভীর রাত, বুঝলে? কিন্তু তুমি যদি আমার কথা ভুলে যাও, তাহলে আমিও তোমার কথা ভুলে যাব। আর তা করলে ওই কুকুর জাহান্নামে যাক, আমার কিছু যায় আসে না।”
জাড লুইসের দিকে তাকিয়ে আরেকটা সিগারেট জ্বালালেন।
“স্টেনি যেভাবে বললেন আমি সেভাবেই করলাম। বাসায় ফিরে যাওয়ার পর বাবা বললেন, তিনি স্পটের মাথায় গুলি করে তাকে তার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিয়েছেন। আমার নিজ থেকে পেট সেমেটারির কথা কিছু বলা লাগলো না। আমার বাবাই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আমার কী মনে হয়, স্পট কি চাইতো আমি তাকে পেট সেমিটারিতে কবর দেই? আমি বললাম, ‘মনে হয় চাইতো,’। এরপর আমি স্পটের বস্তা নিয়ে পেট সেমিটারিতে রেখে আসি } আমার বাবা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আমার কোন সাহায্য লাগবে কি না, আমি না করি কারণ আমার স্টানির কথা মনে ছিল।”
“আমি সে রাত জেগে কাটাই। আমার মনে হচ্ছিল অনন্তকালের জন্যে বলছে, জেগে আছি, কিন্তু রাত একদমই আগাতে চাইছে না। জানোই তো ছোটবেলার সময় অন্যরকম, অনেক লম্বা মনে হয়। আমার যখন মনে হয় আমি অনেকক্ষণ যাবত জেগে আছি, কিছুক্ষণ পরে ভোর হবে হয়তো, তখন আমি ঘড়িতে তাকিয়ে দেখি কাটা দশটা থেকে মাত্র এগারোটায় গিয়ে পৌঁছেছে। কয়েকবার আমি প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম, কিন্তু প্রত্যেকবারই আমি এমনভাবে ধরমড়িয়ে জেগে উঠি যেন কেউ আমাকে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলছে, ‘ওঠো জাড! ওঠো!’ যেন কেউ চাইছিল যেন আমি জেগে থাকি।”
লুইস তার কথায় ভুরু উঁচু করে তাকালে জাড কাঁধ তুলল।
“নিচতলার ঘড়িতে যখন বারোটা বাজার ঘন্টা বাজে, আমি তখন উঠে পড়ে জামা কাপড় গায়ে দিয়ে রেডি হয়ে বসে থাকি। সে রাতে বেশ জোছনা ছিল, আর চাঁদের আলো আমার জানালা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করছিল। এরপর আমি সাড়ে বারোটার ঘন্টা শুনলাম এবং তার পরে একটার। কিন্তু স্টেনির টিকিটিরও কোন খোজ নেই। আমি ভাবলাম বুড়ো হয়তো গাধার মত ভুলে বসে আছে। আমি যেই বিরক্ত হয়ে জামা কাপড় খুলে শোবার চিন্তা করছি ঠিক তখনি জানালার কাচে এসে এতো জোরে দুটো নুড়ি পাথরের ঢিল পড়ে যে আমার মনে হয় জানালার গ্লাস হয়তো ভেঙে পড়বে। তবে না ভাঙলেও গ্লাসে একটা ফাটল দেখা দেয় যেটা আমি পরদিন সকালে আবিষ্কার করি, আর আমার মা আবিষ্কার করেন পরের বছর শীতের সময়। ততদিনে তিনি ভেবেছেন যে ঠান্ডায় হয়তো গ্লাসটা ফেটে গেছে।”
“আমি প্রায় উড়ে জানালাটার কাছে যাই। জানালার পাল্লাটা তুলতে গেলে সেটা খুব জোরে ক্যাচক্যাচ করে ওঠে, ঠিক যেমনটা হওয়া উচিত যখন কোন দশ বছরের বাচ্চা মাঝরাতে বাড়ি থেকে লুকিয়ে বের হতে চায়—”
লুইস হাসে। যদিও সে যখন দশ বছরের বালক ছিল সে কখনো মাঝরাতে বাড়ি থেকে পালিয়ে বের হয়নি। কিন্তু সে যদি ওরকমভাবে পালাতে চাইতো তাহলে সে নিশ্চিত যে তার রুমের জানালাও এভাবেই শব্দ করে প্রতিবাদ জানাতো।
“আমি ভাবলাম আমার বাসার লোকেরা হয়তো বাসায় চোর ঢুকেছে ভেবে হুলস্থুল করবে, কিন্তু আমার হৃৎপিন্ড স্বাভাবিক গতিতে ফিরে এলে আমার কানে নিচতলা থেকে বাবার করাত দিয়ে কাঠ কাটার মত নাক ডাকার শব্দ আসে। আমি জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখি স্টানি আমাদের ড্রাইভওয়েতে দাড়িয়ে আছে। সে হালকা হালকা দুলছিল, যেন চারদিকে খুব বাতাস। কিন্তু আসলে তখন বাতাসের কোন ছিটেফোঁটাও ছিল না। আমি তার আশা একদম ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু সে এমন মাতাল অবস্থাতে আসলো…সে কোন মতে জেগে ছিল, যেমনটা কোন পাতলা পায়খানা করতে করতে হালুয়া টাইট হওয়া পেঁচা রাতের বেলায় জেগে থাকে। সে নিচ থেকে চিৎকার করে বলে (যদিও আমার বিশ্বাস সে ভাবছিল যে সে ফিসফিস করে বলছে) ‘পিচ্চি, তুমি নিচে নামবে না কি আমি তোমাকে নিতে ওপরে আসবো?’
“আমি তাকে ‘শুস্!’ করে থামতে বলি। তখন ভয়ে আমারই পাতলা পায়খানা হবার জোগাড়। আমি ভয়ে আছি আমার বাপ ঘুম থেকে উঠে এসে পিটিয়ে আমার পাছার চামড়া তুলে নেবেন। ‘কী বললে তুমি?’ স্টানি আগের চাইতেও জোরালো গলায় বলে। যদি আমার বাবা মা বাসার রাস্তার দিকটায় থাকতেন তাহলে সেদিন আর রক্ষা ছিল না। কিন্তু তারা থাকতেন উল্টো দিকে, রিভারভিউ পাশটায় যেখানে এখন আমি আর নরমা থাকি, তাই সেদিন বেঁচে যাই।”
“আমার বিশ্বাস তারপর আপনি বুলেটের বেগে সিঁড়ি ভেঙে নামলেন, তাই না?” লুইস বলে। “বাসায় আর বিয়ার আছে, জাড?” লুইস এরই মধ্যে তার অন্যদিনের চাইতে দুই বোতল বেশি গিলে ফেলেছে। কিন্তু আজ তার কাছে এটা কোন ব্যাপার বলে মনে হলো না। বরং তার মনে হচ্ছে আজ বেশি খাওয়াটাই ঠিক আছে।
“আছে। কোথায় রাখি তা তো জানোই, নিয়ে এসো।” জাড বলে আরেকটা সিগারেট ধরালেন। লুইস ফিরে আসা পর্যন্ত তিনি অপেক্ষা করলেন। “না, আমার সিঁড়ি দিয়ে নামার মত দুঃসাহস ছিল না, কারণ সিঁড়িটা আমার বাবা-মার রুমের পাশে। আমি জানালার পাশের আইভির লতা বেয়ে বেয়ে নামি, যত তাড়াতাড়ি পেরেছিলাম। ভয়ে আমার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছিল। তবে জানো কি, মাঝরাতে স্টানির সাথে পেট সেমিটারিতে যাওয়ার চাইতে আমি আমার বাবাকে বেশি ভয় পাচ্ছিলাম।”
জাড় তার জলন্ত সিগারেটের পাছাটা এ্যাশট্রেতে পিষে ফেললেন।
“আমরা একসাথে পেট সেমিটারিতে গেলাম। যাওয়ার পথে সে ডজন খানেকবার আছাড় খায়। সে তার নিজের ভেতর ছিল না, তার গায়ের গন্ধটা এমন ছিল যেন সে ভুট্টার মটকির ভেতর থেকে উঠে এসেছে। একবার তো সে এমনভাবে পড়ে যায় যে একটা লাঠি আরেকটু এদিক সেদিক হলেই তার গলায় ঢুকে যেতো। আমারা সেখানে পৌঁছানোর পর আমার ধারণা ছিল সে গর্ত খোঁড়ার জন্যে আমার দিকে তার হাতের বেলচা আর কুঠারটা ছুঁড়ে দিয়ে সেখানেই বেহুশ হয়ে পড়ে থাকবে।
কিন্তু সে যেন তখন একটু ভদ্রস্থ হয়ে ওঠে। সে বলে, আমাদের এই মরা গাছের স্তূপটা পেরিয়ে জঙ্গলের আরো ভেতরে যেতে হবে, সেখানে আরেকটা গোরস্থান আছে। আমি তার দিকে একবার তাকাই, দেখি সে কোন মতে দু পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এর পর আমি আমি সেই স্তুপটার দিকে তাকাই। তারপর বলি ‘আপনি এই অবস্থায় ওইটায় চড়তে পারবেন না, ঘাড় ভেঙে মরবেন শেষে।”
সে বললো, ‘আমার ঘাড় ভাঙবে না, তোমার ঘাড়েরও কিছু হবে না। আমি হাঁটতে পারবো, আর তুমি নিজেও তোমার কুত্তা নিয়ে উঠতে পারবে।” সে ঠিকই বলেছিল। সে সিল্কের মত মসৃণভাবে স্তুপটার ওপর উঠে গেল, এবং একবারের জন্যেও নিচে তাকিয়ে দেখল না। আর আমিও স্পটকে টেনে তুললাম। আমার ওজন তখন ছিল ৯০ পাউন্ডের মত আর স্পটের ওজন ৩৫ পাউন্ডের মত। পরদিন অবশ্য আমার শরীর ব্যথা হয়ে গেছিল। তোমার আজ কেমন লাগছে, লুইস?”
লুইস জবাব না দিয়ে শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।
“আমরা হাঁটছি তো হাঁটছি, হাঁটা আর শেষ হয় না। এক পর্যায়ে মনে হতে থাকে আমরা অনন্ত কালের জন্যে হাঁটছি, আর এই হাঁটা কখনো শেষও হবে না। সেসময় জঙ্গলটা আরো ভূতুড়ে ছিল। গাছের ওপর থেকে অনেক পাখি ডাকছিল আর কোনটা কী পাখি কিছুই চিনতে পারছিলাম না। কিছু জন্তু জানোয়ারও নড়াচড়া করছিল, বেশিরভাগই হরিণ। সে সময় ওখানে মুস হরিণ, ভালুক আর বন বেড়ালও ছিল। আমি স্পটের বস্তা টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম। কিছুক্ষণ পর আমার অদ্ভুতভাবে মনে হলো যে আমার সামনে স্টানি না, হাঁটছে একজন ইন্ডিয়ান। আর সেই ইন্ডিয়ান হয়তো একটু পরে আমার দিকে ফিরলে আমি তার ভালুকের চর্বি দিয়ে বানানো কালি মাখা মুখটা দেখতে পাবো, দেখতে পাবো তার গায়ে চামড়ার বেল্ট দিয়ে বাধা পাথরের স্লেট থেকে বানানো টমাহক কুঠার। আর এরপর সে আমার ঘাড়ে চেপে ধরে এক কোপে আমার খুলির ওপরের অর্ধেক চুলসহ নামিয়ে নিয়ে আসবে। স্টানি আর আগের মত দুলছে না বা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছে না। সে ওপরের দিকে তাকিয়ে একদম সহজভাবে হেটে চলছে, যার কারণে আমার তাকে ইন্ডিয়ান মনে হচ্ছিল। তবে যখন আমরা ঈশ্বরের জলাতে পৌঁছালাম, সে আমার দিকে ফিরলো কথা বলার জন্যে। লোকটা স্টানিই ছিল, তবে সে কেন হঠাৎ করে মাতলামি বন্ধ করে ভদ্র হয়ে গেল তা আমি বুঝতে পারি তাকে দেখে। সে বেশ ভয় পেয়েছে এবং ভয়ের কারণেই তার মাতলামি ছুটে গেছে।
সে আমাকে সেসব কথাই বলেছিল, যেগুলো আমি তোমাকে গত রাতে বলেছি। ওই সেইন্ট এলমোর আগুন আর লুন হাঁসদের ব্যাপারে। বলেছিল কিছু দেখলে যেন আমি উল্টো-পাল্টা কিছু মনে না করি। সবচাইতে গুরুত্ব দিয়ে বললেন যে যদি কেউ আমার সাথে কথা বলতে চায় তাহলে যেন আমি কোন উত্তর না দেই। এরপর আমরা জলা দিয়ে হাঁটতে শুরু করি। এবং জানো লুইস, সে রাতে আমি সত্যই একটা জিনিস দেখেছিলাম। আমি তোমাকে বলবো না কি দেখেছিলাম তবে এটুকু বলি যে এর পর আমি সেখানে আরো পাঁচ বার গিয়েছি, কিন্তু ঐ রকম জিনিস আর একবারো দেখিনি। আর দেখার সম্ভাবনাও নেই, কারণ গতকালের মিকমেকদের গোরস্থানে যাত্রাই ছিল আমার শেষ যাত্রা।”
আমি সত্যি বসে বসে এইসব শুনছি? লুইস নিজেকে জিজ্ঞেস করে। তার মনে হচ্ছে সে নিজের সাথে কথা বলছে। তিন বোতল বিয়ার তাকে বেশ আলাপচারী করে তুলেছে, অন্তত তার নিজের কাছে। আমি এখানে বসে বসে নিশ্চয়ই উইন্ডিগোর কথা, জন্তু কবর দিলে তার জীবিত হয়ে ফিরে আসার কথা বিশ্বাস করছি না…বালের বিড়ালটা ট্রাকের বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিল, আর কিছু না। এই বুড়ো যা বলছে তা সব তার ভীমরতি।
কিন্তু লুইস মনের গভীরে জানতো এটা জাডের ভীমরতি না। আর এই ‘জানা’ থেকে সে তিন বোতল বিয়ার খেয়েও মুক্তি পাবে না, এমনকি ত্রিশ বোতলেও না।
চার্চ মরে গিয়েছিল, সেটা প্রথম সমস্যা; সে মরে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে এটা দ্বিতীয় সমস্যা; আবার সে আর আগের মত নেই, তার ভেতর একটা মৌলিক পরিবর্তন এসেছে, সেটা তৃতীয় সমস্যা। কিছু একটা হয়েছে। জাড এটাকে তার ঋণ পরিশোধ হিসেবে দেখেছে কিন্তু মিকমেক গোরস্থানের মাটিতে যেই ঔষধ পাওয়া যায় তা হয়তো খুব একটা ভালো ঔষধ না আর লুইস জাডের চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে যেটা তাকে বলছে যে এটা জাড নিজেও জানে। লুইস গতরাতেও জাডের চোখে কিছু দেখেছিল-চঞ্চল, আনন্দে ভরা কিছু। তার গতকালের একটা ভাবনার কথা মনে পড়ে যায়। সে জাডের চোখের ওই দৃষ্টি দেখে ভেবেছিল তাকে আর তার মেয়ের বিড়ালকে মিকমেকদের গোরস্থানে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ জাডের নিজের ছিল না।
জাডের নিজের না হলে কার সিদ্ধান্ত? তার মন তাকে জিজ্ঞেস করে। আর যেহেতু লুইস এই প্রশ্নের উত্তর জানতো না তাই সে অস্বস্তিকর প্রশ্নটা মস্তিষ্ক থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।
“আমি স্পটকে কবর দিয়ে তার ওপর একটা শিলাস্তম্ভ তৈরি করি আমার কাজ যখন শেষ হয়, স্টানি ততক্ষনে ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে গেছে। আমি তাকে প্রচন্ড রকমভাবে ঝাঁকিয়ে ঘুম থেকে উঠাই। কিন্তু আমরা যতক্ষণে ওই চুয়াল্লিশ টা ধাপ বেয়ে -”
“পয়তাল্লিশটা,” লুইস বিড়বিড় করে বলে।
জাড মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়। “ঠিক, পয়তাল্লিশটা, তাই না? পয়তাল্লিশটা। আমরা যতক্ষণে ওই পয়তাল্লিশটা ধাপ বেয়ে নিচে নেমেছি ততক্ষনে স্টানি আবার এমনভাবে হাঁটতে শুরু করে যেন সে একদমই মাতাল না। আমরা ওই জলা পেরিয়ে, মরা গাছের স্তুপ পেরিয়ে যখন আমার বাসার নিচে ফিরে আসি তখন আমার মনে হয় সব মিলিয়ে আমাদের দশ ঘন্টার মত সময় গিয়েছে। কিন্তু তখনো চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল, অথচ আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম মাঝ রাতের পরে।
“এখন কী হবে?’ আমি স্টানিকে জিজ্ঞেস করি।
“এখন অপেক্ষা করে দেখ কী হয়,’ স্টানি বলেই হেটে চলে যেতে লাগলেন, আগের মত দুলতে দুলতে। দেখা গেল আমার কুকুর স্পট স্টানি থেকে দুই বছর বেশি বেঁচে ছিল। বুড়োর লিভার নষ্ট হয়ে গেছিল। একদিন দুইটা বাচ্চা ছেলে তাকে রাস্তার ওপর মরে লাঠির মত শক্ত হয়ে যাওয়া অবস্থায় খুঁজে পায়।”
“আর আমি সে রাতে সুবোধ বালকের মত আইভি লতা বেয়ে আমার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ি। বালিশে মাথা লাগার সাথে সাথেই আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন আমি অনেক দেরি পর্যন্ত ঘুমাই। আমার মায়ের ডাকাডাকিতে আমার ঘুম ভাঙে। আমার বাবা রেলরোডে কাজ করে তাই তিনি ভোর বেলা কাজে চলে যান।” জাড থেমে একটু চিন্তা করলেন। “আমার মা শুধু আমাকে ডাকছিলেন না, লুইস। উনি আমার নাম ধরে চিৎকার করছিলেন।
জাড উঠে ফ্রিজ থেকে একটা বিয়ারের বোতল বের করে টোস্টার আর রুটির বাক্সের নিচের ড্রয়ারের হ্যাণ্ডেলে চাপ দিয়ে সেটার মুখ খুললেন। মাথার ওপরের হলুদ আলোতে তার চেহারাও হলুদ দেখাচ্ছে; নিকোটিনের রং। তিনি অর্ধেক বোতল বিয়ার এক নিশ্বাসে গিলে ফেলে গুলির মত শব্দ করে ঢেঁকুর তুললেন। এরপর তিনি নরমা যে রুমে ঘুমাচ্ছে সেই রুমের দিকে তাকিয়ে আবার লুইসের দিকে ফিরলেন।
“এই জিনিসটা নিয়ে কথা বলা আমার জন্যে একটু কঠিন, তিনি বললেন। “আমি আমার মনে এই ব্যাপারটা নিয়ে অসংখ্যবার ভেবেছি কিন্তু কক্ষনো কারো সাথে কোন আলোচনা করিনি। অন্যরা জানতো কী হয়েছে, কিন্তু এটা নিয়ে কেউ আমার সাথে কোন কথা বলতে আসেনি। অনেকটা সেক্সের বিষয় মানুষ যেভাবে এড়িয়ে চলে। লুইস তোমাকে এটা বলে রাখি, তোমার বেড়ালটা আর আগের বেড়াল নেই। এটা বিপজ্জনক কিছু না কিন্তু সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা বেড়াল। তোমার কী মনে হয়েছে?’
লুইসের মনে পড়ে গেল চার্চের সেই ‘অন্যরকম’ আচরণগুলো, কিভাবে চার্চ টয়লেটের সিটের ওপর দুলছিল, কী অদ্ভুতভাবে সে টয়লেটের সিটটা থেকে লাফিয়ে পড়লো, কী আনাড়িভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে বাথটাবের সাথে ধাক্কা খেল; কিভাবে চার্চ নিজের হলদে-সবুজ চোখগুলো দিয়ে তার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল।
এরপর সে মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায়।
“আমি নিচে গিয়ে দেখলাম আমার মা স্টোররুমের এক কোণে দাড়িয়ে আছেন। মেঝেতে অনেকগুলো সাদা পর্দা এলোমেলোভাবে পড়ে ছিল, যেগুলো আমার মা ওখান থেকে আনতে গিয়েছিলেন। আর রুমের দরজায় স্পট দাঁড়িয়ে ছিল, আমার স্পট। স্পটের সারা শরীর ধুলোবালিতে মাখামাখি হয়ে ছিল, আর ওর পাগুলো পানির ওপর দিয়ে আসার কারণে ধুয়ে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল। ওর পেটের কাছের চামড়া বিশ্রীভাবে কুচকে গিয়েছিল। ও গর্জন বা গরগর কিছুই করছিল না, শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল। কিন্তু ওই আমার মাকে রুমের কোণায় পিছিয়ে যেতে বাধ্য করেছে, সেটা ও চাক আর না চাক। মা একদম আতঙ্কিত অবস্থায় ছিলেন, লুইস। তুমি তোমার মা- বাবাকে কেমন চোখে দেখতে আমি জানি না, কিন্তু আমি আমার বাবা-মাকে সবচাইতে বেশি ভালোবাসতাম। আমি নিজের মাকে এমন একটা পরিস্থিতিতে ফেলেছি ভেবে স্পটের ফিরে আসাতেও আমি কোন আনন্দ পাচ্ছিলাম না। এবং জানো কি? আমি সেখানে স্পটকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তেমন আশ্চর্যও হইনি।”
“আমি জানি অনুভূতিটা কেমন,” লুইস বলে। “আজ সকালে যখন চার্চকে দেখলাম, আমার মনে হয়েছিল এটাই-” সে এক মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। স্বাভাবিক? এই শব্দটাই তার মনে এসেছিল, কিন্তু এই শব্দটা বলাটা ঠিক মনে হলো না তার কাছে। “মনে হয়েছিল যে এমনটাই হবার কথা ছিল।”
“হুম,” জাড বললেন। তিনি আরেকটা সিগারেট ধরালেন। লুইস দেখলো তার হাত হালকা হালকা কাঁপছে। “যখন আমার মা আমাকে সেখানে রাতের পোশাক পড়া অবস্থায় দাড়িয়ে থাকতে দেখলেন তিনি আমাকে চিৎকার করে বলেন, ‘তোর কুকুর সামলা! এটাকে খেতে দে, এটার ক্ষিদা লেগেছে! তাড়াতাড়ি এটাকে বাইরে নিয়ে যা, পর্দাগুলোকে নোংরা করার আগেই!”
“ঝাড়ি খেয়ে আমি ওকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে ওর জন্যে কিছু বেঁচে যাওয়া খাবার যোগাড় করি। ওকে যখন আমি ডাকি ও সাড়া দেয় না, যেন ও নিজের নাম ভুলে গেছে। এটা দেখে আমি প্রায় ধরেই নিয়েছিলাম এটা আমার স্পট না, বাইরের কোন নেড়ি কুকুর হবে যেটা দেখতে একদম স্পটের মত, আর কিছু না—”
“হ্যাঁ! একদম তাই!” লুইস অবাক হয়ে বলে।
জাড মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানান। “তবে দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার যখন ডাকলাম, ও আসলো। ও একরকম ঝাঁকি দিয়ে আমার দিকে এলো। আর যখন আমি ওকে বারান্দায় যেতে দিলাম ও প্রায় দৌড়ে দরজা পার হলো আর ওপাশে গিয়ে প্রায় হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল। ও অবশ্য খাবারগুলো খায়; একদম রাক্ষসের মত খায়। ততক্ষণে আমার আতঙ্ক কেটে গেছে আর কি হয়েছে তা বুঝতে আরম্ভ করি। আমি হাঁটু গেড়ে বসে ওকে জড়িয়ে ধরি, আমি ওকে ফিরে পেয়ে যারপরনাই খুশি। আর ও জিভ দিয়ে আমার গাল চেটে দেয়, আর…”
জাড কেঁপে উঠলেন। বোতলের বাকি বিয়ারটুকু তিনি শেষ করলেন।
“লুইস, ওর জিভ ছিল একদম ঠান্ডা। গালে মড়া মাছ ডললে যেমন লাগে, ওর চেটে দেয়াও আমার কাছে তেমন লেগেছিল।”
এরপর কয়েক মুহূর্তের জন্যে ওরা দুজনেই চুপ করে থাকে। এরপর লুইস নীরবতা ভেঙে বলে, “তারপর বলুন।”
“ওর খাওয়া শেষ হলে আমি আমাদের পেছনের বারান্দার নিচ থেকে একটা পুরনো বড় বোল বের করলাম, যেটাতে আমরা স্পটকে গোসল করাই। স্পট গোসল করতে কখনই পছন্দ করতো না, ওকে গোসল করাতে আমার আর বাবার দুজনের দরকার হতো। আর ওকে গোসল করাতে গিয়ে আমার আর আমার বাবার দুজনেরই জামা কাপড় ভিজে একাকার হয়ে যেত। রেগে গিয়ে আমার বাবা স্পটকে শাপ-শাপান্ত করতেন আর স্পট লজ্জায় কুঁকড়ে যেত, কুকুররা যেমন করে আর কি। আর প্রায় সময় গোসল শেষ হওয়া মাত্র স্পট মাটিতে গড়াগড়ি খেত। আর ধুলো বোঝাই শরীর নিয়ে আমার মার শুকোতে দেয়া কাপড়ের দড়ির কাছে গিয়ে গা ঝারা দিয়ে পরিস্কার কাপড়গুলোর বারোটা বাজাতো। আর আমার মা তো সেই রকম ক্ষেপে গিয়ে আমাদের বাপ-বেটা দুজনকেই ইচ্ছে মত ঝাড়তেন আর বলতেন এই বদের হাড্ডি কুকুরটাকে তিনি গুলি করে মারবেন।”
“কিন্তু সেদিন গোসল করানোর সময় স্পট কোন ঝামেলাই করে না। ও চুপচাপ বোলের পানির মধ্যে বসে তাকে গোসল করাতে দিল। আর ব্যাপারটা আমার একদমই পছন্দ হয়নি। আমার মনে হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল…আমি কোন লাশকে গোসল করাচ্ছি। গোসল শেষ করে আমি একটা পুরনো টাওয়েল দিয়ে ওর গা মুছে দেই। যেখানটাতে ওর কাঁটাতার লেগে ঘা হয়েছিল সেটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম—জায়গাটায় কোন পশম ছিল না। কোন ঘা শুকিয়ে যাওয়ার পাঁচ বছর পর জায়গাটা যেমন দেখা যায়, স্পটের ঘায়ের জায়গাটাও তেমন দেখা যাচ্ছিল।”
লুইস মাথা ঝাঁকায়। তার পেশায় সে এরকমটা অহরহ দেখে। ঘায়ের গর্তগুলো কখনোই পুরোপুরি ভরাট হয় না। এই চিন্তা করতে গিয়ে তার আন্ডারটেকার চাচার কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন কবর খোঁড়ার পর আবার ভরাট করার সময় কখনই পুরোপুরি ভরাট করার জন্যে পর্যাপ্ত মাটি থাকে না।
“এরপর আমি ওর মাথা পরীক্ষা করে দেখলাম। সেখানে এরকমই আরেকটা পুরনো ক্ষতের চিহ্ন ছিল কিন্তু সেখানে নতুন করে পশম গজিয়েছে। এটা ছিল ওর কানের কাছে।”
“আপনার বাবা ওকে যেখানে গুলি করেছিলেন?”
জাড মাথা ঝাঁকান।
“কোন মানুষ বা পশুর মাথায় গুলি করলেই যে সে একশোভাগ নিশ্চিতভাবে মারা যাবে, তা কিন্তু না। এরকম অনেকে অথর্ব হয়ে বেঁচে আছে যারা আত্মহত্যা করার জন্যে নিজের মাথায় গুলি চালিয়েছিল। কিন্তু গুলি তাদের ব্রেনে আঘাত না করে অনেকটা প্যারাবোলিক পথে ঘুরে মাথার আরেকপাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমি নিজে এরকম একটা কেস দেখেছি। লোকটা নিজের কানের নিচে গুলি করে সুইসাইড করে। সে মারা গিয়েছিল কারণ বুলেটটা তার ব্রেনকে আঘাত না করে পাশ কাটিয়ে গেলেও মাথার আরেক পাশে গিয়ে জাগুলার ভেইন কেটে ফেলে। আর মাথার ভেতরে ওই বুলেটের গতিপথ ছিল একদম গ্রামের রাস্তার ম্যাপের মত।”
জাড মাথা ঝাঁকিয়ে মুচকি হাসলেন। “এরকমটা যে হতে পারে তা আমি নরমার একটা ম্যাগাজিনে পড়েছি। কিন্তু আমার বাবা যেহেতু বলেছিলেন স্পট মারা গিয়েছিল, সেহেতু স্পট অবশ্যই মারাই গিয়েছিল, কোন সন্দেহ নেই।”
“আচ্ছা,” লুইস বলে। “আপনি যদি বলেন ঘটনা এভাবে ঘটেছিল, তাহলে এভাবেই ঘটেছিল।”
“তোমার মেয়ের বেড়াল কি মরেনি?”
“আমি তো ভেবেছিলাম ও মারাই গেছে,” লুইস বলে।
“শুধু ভেবেছিলে বললে হবে না, তুমি একজন ডাক্তার।”
“আপনি এমনভাবে বলছেন ‘লুইস তোমাকে ঈশ্বরের মত সব জানতে হবে, কারণ তুমি ডাক্তার।” আমি কোন ঈশ্বর না। তাছাড়া তখন খুব অন্ধকার-”
“অবশ্যই অন্ধকার ছিল এবং চার্চের মাথা বল বেয়ারিংয়ের মত চারদিকে ঘুরছিল। তারপর তুমি যখন তাকে বরফ থেকে টেনে তুললে, তখন এমন ফরফর করে আওয়াজ হলো, যেন তুমি দেয়ালের গা থেকে আঠা দিয়ে লাগানো কোন পোস্টার খুলছো। জীবিত জিনিস এরকম করে না। বরফের ওপর কোন জীবিত জিনিস থাকলে সেটা গায়ের তাপে তার নিচের বরফ গলাতেই থাকে, যতক্ষণ তার জীবন থাকে। গলা বরফ জমতে শুরু করে তার মরার পরে শরীর ঠান্ডা হবার পর।”
পাশের ঘর থেকে ঘড়িতে সাড়ে দশটার ঘন্টার আওয়াজ আসে।
“আপনার বাবা বাসায় এসে আপনার কুকুরকে দেখে কী বললেন?” লুইস জিজ্ঞেস করে।
“আমি ড্রাইভওয়ের মাটিতে বসে মার্বেল খেলছিলাম। বাবার হাতে শক্ত মার খাওয়ার আগে আমার সব সময় যেমন লাগতো তখনো ঠিক তেমন লাগছিল। আমি ওখান থেকেই দেখলাম আমার বাবা গেট দিয়ে বাসায় ঢুকছে। তার পরনে তার কাজের বিব পোশাক। দেখেছো এরকম জামা?”
লুইস মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানায় আর হাতের উল্টোদিক দিয়ে নিজের হাই ওঠা ঢাকে।
“দেরি হয়ে যাচ্ছে, না?” জাড বললেন। “তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে।” ‘খুব একটা দেরি হয়নি। অন্যদিনের চাইতে বেশি বিয়ার গিলে ফেলেছি তাই একটু ক্লান্ত লাগছে। আপনি আপনার মত করে বলুন, আমি পুরোটা শুনতে চাই।”
“আমার বাবার টিফিন নেয়ার জন্যে টিনের একটা বাক্স ছিল,” জাড বললেন। “উনি ওই খালি টিনের বাক্সটা দুলাতে দুলাতে শিস্ বাজাতে বাজাতে গেট দিয়ে ঢুকলেন। তখন চারদিক প্রায় অন্ধকার হয়ে এসেছে, তবে তিনি আমাকে দেখলেন। দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাই জাডসন! কী খবর?’ যেমনটা তিনি সবসময় জিজ্ঞেস করেন, তারপর বললেন, ‘তোমার মা–’
তিনি এটুকুই বলতে পারলেন আর তখনি স্পট অন্ধকার থেকে বেড়িয়ে এলো। অন্যদিন বাবা ফিরে এলে স্পট আনন্দে তার ওপর গিয়ে লাফিয়ে পড়তো। কিন্তু সেদিন সে লেজ নাড়িয়ে ধীরে ধীরে তার দিকে হেঁটে যেতে লাগলো। আমার বাবা তার হাত থেকে বাক্সটা ফেলে দিয়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি স্পটের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। আর স্পট যখন আসলেই বাবার ওপর ওর সামনের দুই পা তুলে দিলো, আমার বাবা সেগুলো দুহাতে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন, যেভাবে একসাথে নাচার সময় মহিলা সঙ্গির হাত ধরতে হয়। তিনি কুকুরটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘ওকে গোসল করাতে হবে জাড। ওকে যে মাটির নিচে কবর দিয়েছিলে সেই মাটির গন্ধ এখনো ওর গায়ে।” বলেই তিনি বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।
“আপনি তখন কী করলেন?” লুইস জিজ্ঞেস করে।
“ওকে আবার গোসল করালাম। এবারো সে বোলের মধ্যে চুপচাপ বসে থাকলো গোসলের সময়টা। এরপর আমি যখন বাসায় ঢুকলাম ততক্ষনে আমার মা শুয়ে পড়েছেন, যদিও তখন মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। আমার বাবা আমাকে বললেন, ‘তোমার সাথে আমার কথা আছে, জাডকিন।” আমি বাবার সামনে গিয়ে বসলাম আর বাবা প্রথমবারের মত আমার সাথে বড় মানুষের মত কথা বললেন।”
জাড ক্র্যান্ডাল দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। “আমি আগে ভাবতাম আমার বাবা আমার সাথে এভাবে কথা বললে আমার হয়তো খুব ভালো লাগবে। কিন্তু সেদিনের সেই কথার মধ্যে ভালোলাগার ছিটেফোঁটাও ছিল না, লুইস। দুই আয়নার মাঝখানে দাঁড়ালে যেমন লাগে আমার ঠিক তেমন লাগছিল। একটা আয়নার ভেতর আরেক আয়নায় তোমাকে দেখবে, তার ভেতর আরেক আয়নায়ও তুমি নিজেকেই দেখবে, এভাবে আয়না আর আয়নার গর্তে তুমি হারিয়ে যাবে। আমি জানি না এই একই আলাপ আরো কতোবার হয়েছে, শুধু চরিত্রগুলো বদল করে…আর এই কথাটাও প্রথম বাবার সাথে সেক্স নিয়ে আলাপের মতই।”
“আপনার বাবা তাহলে সব জানতেন?”
“হ্যাঁ। ‘তোমাকে ওখানে কে নিয়ে গেছে, জাড?’ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি স্টানির নাম বলে দেই। বাবা শুধু মাথা ঝাকালেন, তিনি আসলে তাকেই সন্দেহ করেছিলেন। আমি পরে জানতে পারি ওই সময়ে লাডলোতে ছয় অথবা আটজন ওই গোরস্থানটার কথা জানতেন। তবে তাদের মধ্যে শুধু স্টানির পক্ষেই আমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার মত পাগলামি করা সম্ভব ছিল।”
“আপনি তাকে জিজ্ঞেস করেননি, তিনি নিজে কেন আপনাকে সেখানে নিয়ে যাননি?”
“করেছিলাম। ওই লম্বা আলাপের মাঝেই তাকে আমি এই প্রশ্নটা করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন যে ওটা খুব খারাপ একটা জায়গা। এটা আদতে পশুর মালিকের কোন উপকার করে না, না করে সেই প্রাণীটার। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন স্পট যেরকম হয়ে গেছে সেরকম স্পটকে আমি পছন্দ করি কি না। আর জানো কি লুইস, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে আমার সবচাইতে কষ্ট হয়েছে…আর এটা গুরত্বপূর্ণ যে আমার তখন কেমন লেগেছিল আমি সেটা তোমাকে বলি, কারণ তুমি এক সময় না এক সময় আমাকে ঠিকই জিজ্ঞেস করবে যদি এতে কোন উপকার না হয় তাহলে আমি কেন তোমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
লুইস মাথা ঝাঁকায়। এলি এসে যখন চার্চকে এভাবে দেখবে তখন ও কী ভাববে? এই চিন্তাটাই আজ তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল যখন সে স্টিভ মাস্টারটনের সাথে দুপুরে র্যাকেট খেলছিল।
“হয়তো আমি এটা করেছি কারণ আমি মনে করি বাচ্চাদের বোঝা উচিত, মাঝে মাঝে কিছু মরে গেলে সেটাকে সেভাবে রাখাই মঙ্গলের,” জাড বললেন। “এই জিনিসটা তোমার এলি জানে না আর আমার ধারণা এলি এটা জানে না কারণ তোমার স্ত্রীও সেটা জানে না। আর তোমার যদি মনে হয় আমি ভুল বলছি তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই এই ব্যাপারে।”
লুইস কিছু বলতে গিয়ে তার মুখ খুলে আবার বন্ধ করে ফেলে।
জাড বলতে থাকেন, এবার খুব ধীরে ধীরে। তিনি একটা শব্দের পর আরেকটা শব্দে যাচ্ছেন, ঠিক যেমনটা তারা গত রাতে ঈশ্বরের জলায় এক শুকনো জায়গা থেকে আরেক শুকনো জায়গায় পা ফেলেছিল।
“আমি এরকমটা বছরের পর বছর দেখে আসছি,” তিনি বললেন। “আমি মনে হয় তোমাকে বলেছি লেস্টার মরগান তার পুরষ্কার জেতা ষাঁড়টাকে সেখানে গোর দিয়েছিল। কালো ষাঁড়টার নাম ছিল হ্যানরাট্টি। ষাঁড়ের জন্যে বেশ অদ্ভুত নাম, ঠিক?
শরীরের ভেতরের এক রকম ইনফেকশনে সেটা মারা যায় আর লেস্টার একটা স্লেজে করে সেই মরা ষাড়টাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। সে কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করেছিল তা আমি জানি না-কিভাবে সে ওই মরা গাছের স্তূপের ওপর ওটাকে তুলেছিল তাও জানি না। লোকজন বলে যে কেউ মন থেকে কিছু করতে চাইলে সে অবশ্যই সফল হয়। তবে যতক্ষণ আমরা ওই গোরস্থানটার ব্যাপারে বলছি, এই কথাটা একদম সত্য।
যাই হোক, হ্যানরাট্টি ফিরে আসে তবে লেস্টার তাকে দুই সপ্তাহের মাথায় গুলি করে মেরে ফেলে। ষাঁড়টা খুব বিগড়ে গেছিল-বিগড়ে গেছিল মানে চরমভাবেই বিগড়ে গেছিল। তবে এরকম আর কোন পশুর সাথে হতে আমি শুনিনি। বেশিরভাগ পশুই উল্টো আরো বোকা হয়ে যায়, একটু ধীর…একটু একটু…”
“একটু একটু মৃত?”
“হুম,” জাড বললেন। “একটু একটু মৃত। যেন তারা দূরে কোথাও চলে গিয়েছিল…তারপর সেখান থেকে ফিরে এসেছে…কিন্তু পুরোটা আসেনি। তবে তোমার মেয়ে সেটা জানছে না। ও জানতে পারবে না যে ওর বেড়াল ট্রাকের ধাক্কা খেয়ে অক্কা পেয়েছিল তারপর আবার ফিরে এসেছে। এখন তুমি বলতে পারো যে, কাউকে কী শিখতে হবে তা তাকে না বলে দিলে সে কিভাবে সেটা শিখবে? তবে…”
“তবে কখনো কখনো ঠিকই শেখানো যায়,” লুইস বিড়বিড় করে নিজেকেই যেন বলে।
“হ্যাঁ, কখনো কখনো যায়,” জাড সম্মতি জানালেন। “হয়তো সে শিখতে পারবে মৃত্যু আসলে কী। শিখতে পারবে মৃত্যু মানে কষ্টের সমাপ্তি আর সুন্দর সুন্দর স্মৃতির সূচনা। জীবনের সমাপ্তি নয় শুধু, কষ্টেরও সমাপ্তি। তুমি এসব তাকে বলবে না, সে নিজে থেকেই শিখে যাবে।”
“ও যদি আমার মত হয় তাহলে ও ওর বেড়ালকে ভালোবেসেই যাবে। এটা বদমায়েশি করবে না, কামড়াবে না বা এই জাতীয় কিছুই করবে না। ও ওর বেড়ালকে ভালোবেসেই যাবে। তবে এক সময় সে পরিবর্তনটা ঠিকই ধরতে পারবে আর নিজের মত করে একটা উপসংহার তৈরি করে নিবে…আর অবশেষে যখন এটা মরে যাবে, সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলবে।”
“আর এজন্যেই আপনি আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছেন,” লুইস বলে। তার এখন আগের থেকে ভালো লাগছে। সে একটা ব্যাখ্যা পেয়েছে। ব্যাখ্যাটা যুক্তির চাইতে মনের সংবেদনশীলতার ওপর বেশি নির্ভর করছে, তবে সে ভেবে দেখলো বর্তমান পরিস্থিতিতে সে তা মেনে নিতে পারছে। আর এর মানে সে গতকাল জাডের মুখে দেখা অভিব্যক্তিটা ভুলে যেতে পারবে, সেই চঞ্চল উল্লাসের অভিব্যক্তিটি। “আচ্ছা, তাহলে-”
লুইসকে চমকে দিয়ে জাড হঠাৎ দুহাত দিয়ে তার মুখ ঢেকে ফেলেন। লুইস প্রথমে ভেবেছিল জাড হয়তো হঠাৎ কোন তীব্র ব্যথা অনুভব করছেন। লুইস তার চেয়ার থেকে প্রায় উঠে দাঁড়িয়েছে এমন মুহূর্তে সে খেয়াল করলো বৃদ্ধের বুক আক্ষেপ পীড়িতভাবে ওঠানামা করছে এবং সে বুঝতে পারলো বৃদ্ধ আসলে কান্না থামানোর চেষ্টা করছেন।
“এজন্যেই…কিন্তু আবার এজন্যে না,” জাড বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন। “আমি এই কাজটা করেছি সেই একই কারণে যে কারণে স্টানি এই কাজ করেছিল এবং লেস্টার মরগানও একই কাজ করেছিল। লেস্টার লিন্ডা লেভেস্ককে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল, লিন্ডার কুকুর গাড়ি চাপা পড়ে মারা যাবার পর। সে এটা করেছিল নিজের ষাঁড়কে গুলি করে সেটার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেবার পর, কারণ সেটা মাঠে বাচ্চাদের পাগলের মত তাড়া করে বেড়াতো। কিন্তু তারপরেও সে তাই করেছিল যা গতকাল আমি করেছি, লুইস,” জাড প্রায় আর্তনাদ করে ওঠেন, “তুমি কি কিছু বুঝতে পারছো না?”
“আপনি এসব কী বলছেন?” লুইস চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করে।
“লেস্টার আর স্টানি এটা যে কারণে করেছিল, আমিও গতকাল তা ঠিক একই কারণে করেছি, লুইস। এই কাজটা আমরা করেছি, কারণ এটা আমাদের পেয়ে বসেছিল। ওই গোরস্থানটা একটা গোপন জায়গা, আর এর গোপনীয়তা তুমি অন্যদের জানাতে চাইবে। আর তখন তুমি এটা কাউকে জানানোর জন্যে উপযুক্ত কারণ খুঁজে নিবে। এরপর…” জাড তার মুখ থেকে হাত সরিয়ে লুইসের দিকে চাইলো। তার চোখে ছিল প্রাচীন বন্যতা। “এরপর তুমি সেটা করবেই। তুমি নিজেই সেটার পেছনে যুক্তি দাঁড় করাবে… এবং সেই যুক্তিগুলো তোমার কাছে খুব ঠিক মনে হবে, তবে আসল কথা তুমি সেটা করতে চাও। অথবা তুমি সেটা করতে বাধ্য। আমার বাবা আমাকে সেখানে নিয়ে যাননি কারণ তিনি ওই জায়গার ব্যাপারে শুনেছিলেন, কিন্তু নিজে কখনো সেখানে যাননি। কিন্তু স্টানি আগে সেখানে গিয়েছিল…তাই সে আমাকেও নিয়ে গেছে। আর তারপর সত্তর বছর কেটে গেল…এরপর একদিন আমিই…”
জাড় মাথা নাড়লেন আর তার হাতের পিঠে মুখ চেপে ধরে শুকনোভাবে কাশলেন।
“শোন, লুইস,” তিনি বললেন। “আমার জানামতে লেস্টারের ষাঁড় ছাড়া আর কোন পশুই চূড়ান্ত বদ হয়ে যায়নি পেট সেমিটারি থেকে ফেরার পর। মিসেস লাভেস্কির ছোট্ট কুকুরটা একবার এক ডাক পিয়নকে কামড়ে দিয়েছিল আর…আরো কিছু কিছু কথা শুনেছি যে ফিরে আসা পশুরা দু-একটা উল্টাপাল্টা কাজ করেছে…কিন্তু আমার স্পট সব সময়ই খুব ভালো কুকুর ছিল। কিন্তু ওর গা থেকে সবসময় মাটির গন্ধ বের হত, আমি যতবারই ওকে গোসল করাই না কেন, কিন্তু ও সব সময় ভদ্র আচরণ করতো। তবে আমার মা এর পর থেকে ওকে আর কখনই স্পর্শ করেননি। আর লুইস, আজ রাতে যদি তুমি তোমার ফিরে আসা বেড়ালকে আবার মেরে ফেলতে চাও, আমি একটা কথাও বলবো না।
“ওই জায়গাটা…ওই জায়গাটা যদি একবার তোমার ওপর প্রভাব বিস্তার করে ফেলে…তুমি সুন্দর সুন্দর যুক্তি উদ্ভাবন করতে শুরু করবে… আমার ভুল হতে পারে, লেস্টার আর স্টানিরও ভুল হতে পারে। আমি কোন ঈশ্বর না। কিন্তু মৃতকে ফিরিয়ে আনা? এই কাজটা করে আমরা ঈশ্বর ঈশ্বর খেলতে পারি, তাই না?”
লুইস আবার তার মুখ খুলে বন্ধ করে ফেলে। সে যা বলতে চাচ্ছিল তা তার কাছে নিষ্ঠুর শোনায়। জাড, আমি কি এই বালের বিড়ালটাকে আরেকবার মেরে ফেলার জন্য এতো কিছু করেছি!
জাড তার বোতলের বাকি বিয়ারটুকু খালি করে পাশে রাখা আগের খালি বোতলগুলোর সাথে রাখেন। “আমার এটুকুই বলার ছিল,” তিনি বললেন। “আর কিছু বলার নেই।
“আমি আপনাকে আরেকটা প্রশ্ন করতে পারি?” লুইস জিজ্ঞস করে। “করো,” জাড বললেন।
লুইস বলল, “ওখানে কেউ কখনো কোন মানুষ কবর দিয়েছে?”
কথাটা শুনে আচমকা জাডের হাত ঝাঁকি দিয়ে উঠলো আর তাতে দুইটা বিয়ারের খালি বোতল মেঝেতে পড়ে গেলে তাদের মধ্যে একটি ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
“ওহ খোদা!” তিনি লুইসকে বললেন। “এই কাজ কে করতে যাবে? এরকম কথা ভুলেও মুখে নিও না, লুইস!”
“আমি শুধু জানার জন্যে জানতে চাইছি,” লুইস অস্বস্তির সাথে বলে।
“কিছু জিনিস জেনে কোন উপকার হয়না,” জাড বললেন। লুইসের কাছে জাডকে প্রথমবারের মত প্রচন্ড বৃদ্ধ আর দুর্বল মনে হলো, যেন তিনি তার নিজের জন্যে খোঁড়া কবরের সামনে দাড়িয়ে আছেন।
পরে বাসায় গিয়ে যখন লুইস বিষয়টা নিয়ে আবার ভাবলো তখন জাডের চেহারায় আরেকটা জিনিস ছিল বলে তার মনে হয়।
জাডকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি মিথ্যা বলছেন।
অধ্যায় ২৭
লুইস নিজেদের গ্যারেজে পৌঁছানোর আগে টের পায়নি যে সে নেশায় মাতাল হয়ে গেছে।
বাইরে তারা এবং চাঁদের আলোয় সে পথ চলে। আলোতে ছায়া পড়ছে না কিন্তু চারদিক মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। গ্যারেজে ঢুকে সে একদম অন্ধ হয়ে যায়। গ্যারেজের বাতির সুইচটা কোথায় কিছুতেই মনে করতে পারছে না। সে আঁধারে খুব সাবধানে পা ফেলে এগুতে থাকে। এক পা এক পা করে আগায় সে। আশঙ্কা করছে এলির সাইকেল বা গেজের খেলনা কুমিরে পা হড়কে পড়ে তার হয়তো আজ এখানেই ভূপাতিত হতে হবে।
বিড়ালটা কই? সে কি বিড়ালটাকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়েছিল?
সে ভুল পথে এগিয়ে একটা দেয়ালের সামনে গিয়ে ঠেকে। হাতের তালুকে একটা চোখা জিনিস খোঁচা দিলে অন্ধকারের উদ্দেশ্যে “বাল!” বলে চেঁচিয়ে ওঠে। কিন্তু পরমুহূর্তেই বুঝতে পারে তার চিৎকারটা রাগের না, বরং ভয়ের। এবার সে গ্যারেজের ভেতর একদমই দিশা হারিয়ে ফেলে। লাইট সুইচটা কোথায় আছে এটা জানে না শুধু তা নয়, বরং এখন সে কিছুই ঠাহর করতে পারছে না। কিচেনের দরজাটা কোথায় সেই দিশাও তার আর নেই।
সে আবার হাঁটতে শুরু করে, খোঁচা খাওয়া হাতের তালুটা এখনো জ্বলছে। অন্ধদের হয়তো এমনি লাগে সব সময়, সে ভাবে। তার ছয় বছর আগে প্রেগনেন্ট রাচেলের সাথে যাওয়া স্টিভ ওয়ান্ডারের কনসার্টের কথা মনে পড়ে যায়। ছয় বছর হয়ে গেছে? তার কাছে অসম্ভব মনে হয়। দুইজন লোক ওয়ান্ডারকে ধরে মেঝেতে পড়ে থাকা সাপের মত কেবলগুলোকে ডিঙ্গিয়ে তার সিন্থেসাইজারের কাছে পৌঁছে দেয়। আর পরবর্তীতে সে যখন তার সহশিল্পীর সাথে নাচার জন্যে উঠে দাঁড়ায়, সেই সহশিল্পী মহিলা তাকে ধরে ধরে একটা ফাঁকা জায়গায় নিয়ে আসে। সে ভালোই নেচেছিল, লুইসের মনে আছে কিন্তু তাকে ঠিকই নাচার জায়গায় ধরে ধরে নিতে হয়েছিল।
কেউ আমার হাত ধরে কিচেন পর্যন্ত এগিয়ে দিলে কেমন হয়? সে ভাবে…এবং পরক্ষণেই কেঁপে ওঠে
আসলেই যদি অন্ধকার থেকে একটা হাত বের হয়ে তাকে পথ দেখাতে শুরু করে তাহলে…সে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেই যাবে তো করেই যাবে।
থমকে দাঁড়ালো সে, তার হৃৎপিন্ড লাফাচ্ছে। “এসব বাল ছাল বন্ধ কর, সে নিজেকে ধমক দেয়। কাম অন, কাম অন-ওই বালের বিড়ালটা কই?”
এরপর সে আসলেই দড়াম করে ধাক্কা খেল, তাদের স্টেশান ওয়াগন গাড়িটার বাম্পারের সাথে খুব বাজেভাবে। তার হাঁটু থেকে ব্যথার একটা ঢেউ তার সারা শরীরে ভেসে গেল এবং ব্যথায় তার চোখে পানি চলে আসলো। সে তার পা তুলে আঘাতের জায়গাটা চেপে ধরে বক পাখির মত এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে এখন সে বুঝতে পারছে কোথায় আছে, সে গ্যারেজের ভেতরে তার দিশা ফিরে পেয়েছে। তাছাড়া অন্ধকারে তার দেখার ক্ষমতাও চলে আসছে ধীরে ধীরে। সে বিড়ালটাকে বাড়ির ভেতরেই রেখে গিয়েছিল, তার মনে পড়ে। বিড়ালটাকে স্পর্শ করতে চায়নি বলে ওটাকে বের করা হয়নি আর-
আর ঠিক তখনি সে তার গোড়ালিতে চার্চের উষ্ণ, লোমশ দেহের ঘর্ষণ অনুভব করতে পারে। আর পরমুহূর্তে তার হাঁটুর নিচে চার্চের সাপের মত জঘন্য লোমশ লেজের স্পর্শ পায়। এবার লুইস নিজেকে শান্ত রাখতে পারে না। তার বুক চিড়ে একটা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ বেরিয়ে আসে।
অধ্যায় ২৮
“বাবা!” এলি আনন্দে চিৎকার করে ওঠে।
এলি জেটওয়ে থেকে তার দিকে দৌড়ে আসতে থাকে। ও বাড়ি ফেরা যাত্রীদের মাঝে দিয়ে এঁকে বেঁকে দৌড়াচ্ছে, অনেকটা গোল্লাছুট খেলায় দৌড়ানোর মত করে। তবে বেশিরভাগ যাত্রীই ওকে হাসতে হাসতে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্যে জায়গা করে দিচ্ছে। এতো মানুষের মাঝে এলির ব্যগ্রতা দেখে সে একটু বিব্রত বোধ করলেও তার মুখে চওড়া একটা হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
রাচেল গেজকে কোলে করে হেঁটে আসছিল। এলিকে চিৎকার করতে দেখে গেজও লুইসকে দেখে ফেলে। “আবুউউ” গেজও আনন্দের আতিশায্যে চিৎকার করে ওঠে আর রাচেলের কোলে মোচড়ামুচড়ি শুরু করে। রাচেল ক্লান্তভাবে হেসে গেজকে নিচে ছেড়ে দিলে সে এলির পেছন পেছন ছুটতে আরম্ভ করে। “আবুউউ! আবুউউ!”
লুইস লক্ষ্য করে গেজের গায়ের জাম্পারটা সে আগে কখনো দেখেনি। গেজের নানার কর্ম হবে, লুইস ভাবে। পর মুহূর্তেই এলি লুইসের ওপর লাফিয়ে উঠে জড়িয়ে ধরে। “হাই, বাবা!” ও বলতে বলতে লুইসের গাল টিপে দেয়।
“হাই, সোনামনি,” বলে লুইস নিচু হয়ে গেজকেও তুলে নেয়। সে দুজনকেই বুকে জড়িয়ে ধরে। “তোমাদের অনেক মিস করেছি, সোনা।”
রাচেল এক হাতে ট্রাভেল ব্যাগ, আর আরেক হাতে গেজের ডায়াপারের ব্যাগ ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে এগিয়ে আসে। ডায়াপারের ব্যাগে লেখা ‘খুব জলদি আমি বড় হয়ে যাবো।” ডায়াপার ব্যাগের গায়ের এই রসটা ডায়াপারে হাগা- মুতা করা বাবুর চাইতে তাদের বাবা-মাকে বেশি উদ্দেশ্য করে লেখা।
লুইস তার দুই বাচ্চার মাঝখানে জায়গা করে নিয়ে রাচেলের গালে চুমু খায়। “হাই!”
“হাই, জানু,” রাচেল মুচকি হেসে বলল।
“খুব ক্লান্ত লাগছে তোমাকে।”
“আর বলো না। বস্টন পর্যন্ত ভালোই এসেছি। তারপর ভালোভাবেই প্লেন চেঞ্জ করে নতুন প্লেনে উঠলাম। কিন্তু প্লেন যখন আকাশে উঠলো গেজ জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে বলল, ‘সুন্দর, সুন্দর’, আর তারপরই বমি করে সারা গা ভাসিয়ে দিলো।”
“ওহ খোদা!”
“আমি তখন টয়লেটে গিয়ে ওর জামা কাপড় চেঞ্জ করে দিয়েছি,” রাচেল বলল। “আমার মনে হয় না কোন ভাইরাস বা ওরকম কিছু। মনে হয় ও এয়ার সিক হয়ে পড়েছিল।”
“বাসায় চলো,” লুইস বলে। “আমি স্টোভে চিলি রেখে এসেছি।”
“চিলি! চিলি!” এলি লুইসের কানের কাছে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে। “চিওয়ি! চিওয়ি!” এবার গেজ লুইসের আরেক কানে চেঁচিয়ে ওঠে। অন্ততপক্ষে লুইসের দুই কান এখন সমানভাবে ঝিমঝিম করছে।
“বাবা, চার্চ কেমন আছে?” এলিকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিলে এলি জিজ্ঞেস করে। লুইস এই প্রশ্নটার জন্যে প্রস্তুত ছিল কিন্তু এলির চিন্তিত মুখ আর ওর গাঢ় নীল দুচোখের মাঝের দুশ্চিন্তার রেখার জন্যে না। লুইস ভুরু কুচকে রাচেলের দিকে তাকালো।
“ও একদিন ঘুম থেকে চিৎকার করে জেগে উঠেছিল,” রাচেল শান্তভাবে বলে। “ও একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছে।”
“আমি স্বপ্নে দেখেছি চার্চ গাড়ি চাপা পড়েছে,” এলি বলে।
“থ্যাঙ্কস গিভিং’ এর পর বেশি বেশি টার্কি স্যান্ডউইচ খাবার ফল,” রাচেল বলে। “ওর আবার ডায়রিয়াও হয়েছিল। ওর দুশ্চিন্তা দূর করো লুইস। আমি আর এয়ারপোর্টে এক মুহূর্তও থাকতে চাই না। এই কদিনে এতো এয়ারপোর্ট আর এয়ারপোর্ট দেখেছি যে আগামী পাঁচ বছরে আর কোন এয়ারপোর্ট না দেখলেও আমার চলে যাবে।”
“কেন সোনা? চার্চ একদম ঠিক আছে মামনি।” লুইস ধীরে ধীরে বলে।
হুম, চার্চ ভালোই আছে। সে সারাদিন ঘরের মধ্যে কিলবিল করে বেড়ায় আর আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়, যেন ও এমন কিছু দেখেছে যাতে ওর যেটুকু বিড়াল বুদ্ধি ছিল, তাও নাই হয়ে গেছে। ও চমৎকার আছে। আমি ওকে রাতের বেলা ঝাড়ুর পাছা দিয়ে ঠেলে ঠেলে বাড়ির বাইরে পাঠাই, কারণ আমার ওকে ছুঁতে ঘেন্না লাগে। আর সেদিন সকালে আমি দরজা খুলে দেখি সে একটা ইঁদুর ধরে নিয়ে এসেছে আর সেটার নাড়িভুড়ি খুবলে বের করে চিবিয়ে চিবিয়ে ব্রেকফাস্ট করছে। ওইদিন আমি নিজে আর ব্রেকফাস্ট করতে পারিনি। এসব বাদ দিলে-
“ও খুব ভালোই আছে।”
“ওহ,” এলি বলল আর ওর দুচোখের মাঝের কুচকানো অংশটা আবার মোলায়েম হয়ে গেল। “ওহ, তাহলে তো ভালই। আমি একদম নিশ্চিত ছিলাম যে চার্চ মারা গেছে।”
“তাই না কি?” লুইস জিজ্ঞেস করে মুচকি হাসে। “স্বপ্ন খুব অদ্ভুত, তাই না?”
“চপ্ন!,” গেজ চিৎকার করে ওঠে। গেজ তার টিয়াপাখি স্তরে পৌঁছে গেছে, যেটা লুইস এলির বিকাশের ক্ষেত্রেও দেখেছে। “চচচপ্ন!” গেজ লুইসের চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়।
ওরা যখন পার্কিং লটে ওদের গাড়ির কাছে পৌঁছালো, তখন গেজ অদ্ভুত ঢেকুর তোলার মত করে বলতে লাগলো, “সুন্দর, সুন্দর,” এবার সে বমি করে লুইসের সারা গা ভাসিয়ে দেয়। লুইস আজ প্লেন সংবর্ধনা উপলক্ষে নতুন একটা জামা পড়েছিল, সেটার শ্রাদ্ধ হয়ে গেল। আর গেজ হয়তো ধরে নিয়েছে বমি করার সিগনাল হিসেবে ‘সুন্দর’ চমৎকার একটি শব্দ।
দেখা গেল গেজ আসলেই ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত।
ওরা সতেরো মাইল ড্রাইভ করে বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে গেজ ভালোভাবেই জ্বরের লক্ষন প্রকাশ করতে লাগলো আর অসুখে ঝিমাতে লাগলো। লুইস গাড়িটা উল্টো করে গ্যারেজে ঢোকানোর সময় চোখের কোন দিয়ে দেখলো চার্চ গ্যারেজের দেয়ালের পাশ দিয়ে লেজ উঠিয়ে হেলে দুলে হেঁটে যাচ্ছে আর অদ্ভুত চোখে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। পরমুহূর্তেই ও দিনের মিলিয়ে যেতে থাকা আলোতে মিশে গেল আর লুইস একটা মরা ইঁদুর দেখতে পেলো টায়ারের স্তূপের পাশে। গ্যারেজের বিষন্ন আলোতে ইঁদুরটার নাড়িভুড়ি লাল টকটকে লাগছে।
লুইস দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে ইচ্ছে করে টায়ারের স্তুপটার সাথে ধাক্কা খেয়ে টায়ারগুলো এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ফেলে ইঁদুরটাকে ঢেকে ফেলল। “উউপস্!”
“তুমি একটা বোকা, বাবা,” এলি মমতামাখা গলায় বলে।
“একদম ঠিক,” লুইস অতি উৎসাহের সাথে বলে। তার ইচ্ছে হচ্ছিল সেও ‘সুন্দর, সুন্দর’ বলে তার পেটের সব মালামাল চারদিকে উগড়ে দেয়। চার্চের উৎকট পুণরুত্থানের আগে লুইস তাকে একবার একটা ইঁদুর মারতে দেখেছিল। সে মাঝে মাঝে ইঁদুর ধরে খেলা করতো, যেই নিষ্ঠুর খেলা বিড়াল সম্প্রদায় খেলে থাকে, তবে সে, রাচেল বা এলি কেউ না কেউ সেই খেলা শেষ হবার আগেই ব্যাঘাত ঘটাতো। আর সেটাও চার্চকে খোজা করার আগে। খোজা করার পর সাধারণত বিড়ালরা ইঁদুরের দিকে ফিরেও তাকায় না, যতক্ষণ তাদের পেটে খাবার থাকে।
“তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দিবাস্বপ্ন দেখবে নাকি গেজকে নিতে একটু সাহায্য করবে?” রাচেল জিজ্ঞেস করে। “মঙ্গল গ্রহ থেকে ফিরে এসো, ডাঃ ক্রিড, পৃথিবীর লোকজনের তোমার সাহায্য প্রয়োজন।” রাচেলকে খুব ক্লান্ত আরেকটু বিরক্ত শোনালো।
“সরি, বউ,” লুইস বলল। সে ঘুরে গেজকে কোলে নিলো। গেজের শরীর চুলার কয়লার মত গরম।
সে রাতে ওরা শুধু তিনজন লুইসের বিখ্যাত চিলি খায় আর সে সময়টা জ্বরে পীড়িত গেজ লিভিং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভিতে কার্টুন দেখতে দেখতে বোতলে ভরা চিকেন ব্রথ পান করে।
ডিনারের পর এলি গ্যারেজের দরজা খুলে চার্চকে ডাকে। রাচেল তাদের জিনিসপত্র ট্রাভেল ব্যাগ থেকে বের করে যথাস্থানে গুছিয়ে রাখছিল আর লুইস কিচেনে প্লেটগুলো ধুয়ে রাখছিল। এলির ডাক শুনে লুইস মনে মনে চাইছিল যেন চার্চ না আসে। কিন্তু চার্চ আসলো এবং একদম সাথে সাথেই আসলো তার নতুন হেলে দুলে হাঁটার ভঙ্গিতে, যেন-যেন-বিড়ালটা দরজার সামনেই কিলবিল করছিল। হ্যা, কিলবিল। ঠিক এই শব্দটাই তার মনে উদয় হলো।
“চার্চ!,” এলি চিৎকার করে ওঠে। “হাই, চার্চ!” ও বিড়ালটাকে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে। লুইস তার ধোয়াধুয়ি থামিয়ে রেখে চোখের কোন দিয়ে এলিকে দেখে। সে দেখে, এলির খুশি মুখটা ধীরে ধীরে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছে। বিড়ালটা এলির হাতে শান্তভাবে ঝুলে আছে। চার্চ নিজের কান দুটো চোখা করে পেছনের দিকে টেনে নিয়ে এক দৃষ্টিতে এলির চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
অনন্তকাল পরে-অন্তত লুইসের কাছে সেরকমই মনে হলো-এলি চার্চকে নামিয়ে রাখে। চার্চ এলির দিকে একবারও ফিরে না তাকিয়ে ডাইনিংরুমের দিকে চলে গেল। মিস্টার নেংটি ইঁদুরের যম, লুইস এলোমেলোভাবে চিন্তা করে।
সে আন্তরিকভাবেই সেই রাতের কথা মনে করতে চাইলো, কিন্তু সেসব এখন অনেক প্রাচীন কিছু বলে মনে হচ্ছে। সেদিনের সবকিছু কেমন যেন ধূসর আর বহুদূরের কিছু বলে মনে হচ্ছে, যেমনটা ভিক্টর পাস্কোর বীভৎস
মৃত্যুকেও মনে হয়। তার শুধু সেদিনের মাতাল হাওয়া, জঙ্গল আর তার বাড়ির পেছনের মাঠটাতে তুষারের শুভ্র আভার কথা মনে পড়ছে, ব্যস এটুকুই।
“বাবা?” এলি চাপা গলায় বলল।
“কী, এলি?”
“চার্চের গায়ে কেমন যেন একটা গন্ধ।”
“তাই না কি?” লুইস জিজ্ঞেস করে। সে খুব সাবধানে নিজের গলা স্বাভাবিক রাখে।
“হ্যাঁ!” এলি হতাশা মাখা গলায় বলে। “সত্যি বলছি! আগে কখনোই ওর গায়ে এমন গন্ধ ছিল না।”
“হুম, এমন হতে পারে ও কোন নোংরা জিনিসের ওপর গড়াগড়ি খেয়েছে, সোনামনি,” লুইস বলে। “এই গন্ধ চলে যাবে।”
“যেতেই হবে,” এলি বয়স্ক মহিলাদের মত করে বলে। তারপর ও হেঁটে চলে যায়।
লুইস তার কাজ শেষ করে সিঙ্কের ছিপি খুলে দিল। সিঙ্কের পাইপ দিয়ে বিশ্রী চোষণের শব্দ করে ফেনিল পানি ঘুরতে ঘুরতে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে আর লুইস বাইরের অন্ধকার রাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
পানি চলে যাওয়ার শব্দ শেষ হলে সে বাইরের তীব্র শীত বয়ে নিয়ে আসা
মাতাল হাওয়ার শব্দ শুনতে পায় এবং তার বোকার মত প্রচন্ড ভয় হতে থাকে, অন্ধকার ঘরে খুটখাট শব্দ হলে সেই শব্দের উৎস কি বুঝতে না পারলে যেমন আতঙ্ক লাগে সেরকম আতঙ্ক।
“১০৩!” রাচেল জিজ্ঞেস করে। “তুমি শিওর লু?”
“এটা ভাইরাস জ্বর,” লুইস বলে। রাচেলের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছে ১০৩ ডিগ্রী তাপমাত্রার জন্যে সে দায়ি। রাচেলের ঝাঝালো স্বরে লুইস নিজেকে বিরক্ত হতে দিলো না। রাচেল খুবই ক্লান্ত। সে আজ দেশের আরেক প্রান্ত থেকে দুটো বাচ্চাকে নিয়ে জার্নি করে এসেছে, আর এখন রাত এগারোটা বাজলেও ঘুমোতে পারেনি। এলি নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। গেজ তাদের বিছানাতে জ্বরে অর্ধচেতন অবস্থায় শুয়ে আছে।
লুইস গেজকে ঘন্টাখানেক আগে লিকুইপিরিন ড্রপ দিয়েছে। “কাল সকালের মধ্যে অ্যাসপিরিন ওর জ্বর নামিয়ে আনবে।”
“তুমি ওকে এম্পিসিলিন বা ওইরকম কিছু দিবে না?”
লুইস ধৈর্য সহকারে বলল, “ওর ফ্লু হলে দিতাম। কিন্তু তা হয়নি। ওর ভাইরাস জ্বর হয়েছে। আর ওই জিনিস ভাইরাস জ্বরে কোন কাজের না। বরং সেটা ওকে অস্থির করে তুলবে আর শরীর থেকে পানি বের করে দিবে।”
“তুমি শিওর তো এটা ভাইরাস জ্বর?”
“আচ্ছা, তুমি চাইলে আর কারো মতামত নিতে পারো, আমার কোন আপত্তি নেই।” লুইস হঠাৎ রেগে গিয়ে বলে।
“আমার সাথে চিৎকার করছো কেন?” রাচেল চিৎকার করে বলে।
“আমি চিৎকার করিনি!” লুইস পাল্টা চিৎকার করে বলে।
“করেছো,” রাচেল বলতে শুরু করে, “অবশ্য-শ-শ–” এর পর তার মুখ কাঁপতে শুরু করলে সে দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে। লুইস রাচেলের চোখের নিচে কালি দেখতে পায়। দেখে খুব খারাপ আর লজ্জিত অনুভব হয় তার।
“আমি সরি,” সে বলে রাচেলের পাশে বসে। “খোদাই জানে আমার কি হয়েছে। আমারই ভুল, আমি মাফ চাইছি, রাচেল।”
“তাই না কি? তোমার আবার ভুল হয় না কি কখনো?” রাচেল বিদ্রুপের হাসি হেসে বলে। “জার্নিতে যারপরনাই ধকল গেছে আমাদের সবার। তারপর সবসময় ভয়ে ভয়ে ছিলাম তুমি গেজের ড্রেসের ড্রয়ার খুললে বাড়ি মাথায় তুলবে। আমার কথাটা এখনি বলা উচিত, যখন তুমি আমার জন্যে সরি ফিল করছো।”
“বাড়ি মাথায় তোলার মত কি হয়েছে?’
রাচেল আবারো বিদ্রুপের মুচকি হাসি হাসে। “আমার বাবা-মা মিলে ওকে দশটা নতুন জামা কিনে দিয়েছে। আজ ওকে যেই ড্রেসে দেখেছিলে সেটাও একটা।”
“হুম, আমি খেয়াল করেছিলাম ওর গায়ে নতুন জামা।”
“আমিও খেয়াল করেছি যে তুমি খেয়াল করেছো।” রাচেল জবাব দিয়ে এমনভাবে চোখ ট্যারা করে তাকালো যে লুইস হেসে দিলো, যদিও তার হাসতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। “আর এলির জন্যে ছয়টা নতুন জামা।”
“ছয়টা!” সে নিজের চিৎকার করার তাড়না চাপা দিয়ে বলল। সে নিজের ভতরে প্রচন্ড ক্ষোভ অনুভব করে, যেটা সে ব্যাখ্যা করতে পারবে না। “কেন, রাচেল? তুমি কেন উনাদের এসব করতে দিলে? আমাদের এসব কোন দরকার…আমারা নিজেরাই কিনতে….”
লুইস থামে। তার ভেতরের প্রচন্ড ক্ষোভ তার কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। এলির বিড়ালকে পলিথিন ব্যাগে ভরে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হেটে যাওয়ার দৃশ্যটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। আর সেই সময় ওই বুড়ো বজ্জাতটা নিজের বিশ্বখ্যাত চেকবই আর বিশ্বখ্যাত ফাউন্টেন পেন দিয়ে তার মেয়ের ভালোবাসা কিনতে ব্যস্ত ছিল।
তার হঠাৎ করে চিৎকার করে বলতে মন চাইলো, সে তোমার মেয়েকে ছয়টা জামা কিনে দিয়েছে, খুব মহৎ কাজ করে ফেলেছে। আর আমি সেই সময় তোমার মেয়ের মরা বিড়ালকে বাঁচিয়ে এনেছি। তো এলিকে কে বেশি ভালোবাসে?
সে চিৎকারটা মনের ভেতরেই মরে যেতে দিল। এরকম কথা সে কখনই বলবে না। কখনই না।
রাচেল লুইসের কাঁধ স্পর্শ করে। “লুইস, তুমি একটু বোঝার চেষ্টা করো, প্লিজ। ওনারা বাচ্চাদের খুবই ভালোবাসেন। তাছাড়া খুব একটা দেখতেও পান না কালে ভদ্রে ছাড়া। তাছাড়া আমার বাবা আর মা দুজনে মিলে কিনেছেন এগুলো, বাবা একা না। আর লুইস, আমার বাবা অনেক বদলে গেছে, তুমি এখন তাকে আর চিনবেই না।”
“আমি ঠিকই চিনব,” লুইস বিড়বিড় করে বলে।
“প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো লু। এতে তো তোমার খারাপ লাগার কিছু নেই।”
লুইস রাচেলের দিকে দীর্ঘ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। “আছে,” অবশেষে সে বলে। “হয়তো খারাপ লাগা উচিত না, কিন্তু লাগছে।”
রাচেল কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই এলি নিজের রুম থেকে ডাকতে থাকে, “বাবা! মা!”
রাচেল উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু লুইস তাকে টেনে বলল, “তুমি গেজের কাছে থাকো, আমি দেখছি।” লুইস সমস্যাটা আঁচ করতে পারছে। কিন্তু সে তো বিড়ালটাকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়েছিল। এলি শুতে যাওয়ার পর সে বিড়ালটাকে খাবারের বাটির চারদিকে ঘুরঘুর করতে দেখে সে ওটাকে বাইরে বের করে দেয়। সে একদমই চায় না চার্চ আর এলির সাথে ঘুমাক, একদমই না। চার্চ এলির খাটে ঘুমাচ্ছে ভাবলেই তার গা শিউরে উঠছে।
এলি বুঝে যাবে চার্চের কিছু হয়েছে আর আগের চার্চই ভালো ছিল।
সে চার্চকে বের করে দিয়েছিল। কিন্তু সে এলির রুমে গিয়ে দেখতে পায় এলি বিছানায় বসে বসে ঝিমাচ্ছে। আরো দেখতে পায় বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে রাজকীয় কায়দায় শুয়ে থাকা চার্চের অবয়ব। পাশের হলওয়ের লাইটের আলো চার্চের চোখে পড়ায় সেগুলো জ্বলজ্বল করছে।
“বাবা, চার্চকে বের করে দাও,” এলি প্রায় যন্ত্রণা মিশ্রিত কণ্ঠে বলে। “ওর গায়ে বিশ্রী গন্ধ।”
“স্, মামনি, শুয়ে পড়ো,” বলে লুইস নিজের নিরুদ্বেগ কণ্ঠ শুনে নিজেই অবাক হয়ে যায়। এতে তার স্লিপ ওয়াকিং ঘটনার পরের সকালের একটা স্মৃতি মনে পড়ে গেল; ভিক্টর পাস্কো মারা যাওয়ার পরের দিনের। সেদিন সে কোন রকমে ইনফার্মারিতে পৌঁছে বাথরুমের আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নিজের মানসিক অবস্থার কারণে সে ভেবেছিল তাকে আয়নায় জঘন্য দেখাবে। কিন্তু আয়নায় নিজেকে তার একদম স্বাভাবিক লেগেছে। সে ভেবেছিল আশে পাশে হয়তো অসংখ্য মানুষ আছে যারা ভেতরে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব গোপনীয়তা নিয়ে স্বাভাবিক মুখে সবার সাথে মিশে আছে।
এলি ঠিক বলছে। চার্চের গায়ের গন্ধে তার নিজেরই গা গুলিয়ে আসছে। সে মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে নিতে বিড়ালটাকে ধরে নিচতলায় নিয়ে আসে। এর চাইতে খারাপ গন্ধ আছে; গুয়ের গন্ধ এর চাইতে বেশি খারাপ, ঘায়ের পচা মাংসের গন্ধও আরো অনেক বেশি খারাপ।
কিন্তু চার্চের গায়ের গন্ধও গা গুলিয়ে ওঠার জন্যে যথেষ্ট। আর এই বিড়ালটা বাসায় ঢুকলোই বা কী করে? সে বিড়ালটাকে বাইরে বের করে দিয়েছিল। বাসার বাকি সবাই যখন দোতলায়, লুইস সুযোগ বুঝে ঝাড়ুর মাথা দিয়ে ঠেলে ঠেলে ওটাকে বাইরে বের করে দিয়েছিল। চার্চ ফিরে আসার পর আজ প্রথম লুইস তাকে নিজের হাত দিয়ে স্পর্শ করলো। তার বাহুতে চার্চের উষ্ণ দেহটাকে একটা বিরতি নিতে থাকা সুপ্ত ব্যাধি বলে মনে হতে থাকে। কোন চিপা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিলি হারামজাদা? লুইস ভাবে।
লুইসের পাস্কোকে নিয়ে দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল, কিভাবে সে দরজার ভেতর দিয়েই আরেক পাশে চলে গিয়েছিল।
হয়তো চার্চ কোন চিপা খুঁজে পায়নি, বরং ভূতের মত দরজা ভেদ করেই চলে এসেছে।
“শয়তানের বাচ্চা,” লুইস কর্কশভাবে ফিসফিস করে বলে।
লুইস প্রায় নিশ্চিত হয়ে ভেবেছিল যে চার্চ তার বাহু থেকে ছোটার জন্যে মোচড়ামুচড়ি শুরু করবে আর ওকে খামচে দেবে। কিন্তু চার্চ সেরকম কিছুই না করে আহাম্মকের মত বসে থেকে নিজের দেহ থেকে তাপ বিকিরণ করতে থাকে আর অদ্ভুত দৃষ্টিতে লুইসের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন ও লুইসের মনের ভেতরের সব কিছু পড়তে পারছে।
সে দরজা খুলে চার্চকে গ্যারেজের মধ্য সজোরে ছুড়ে মারে। “যা ভাগ হারামজাদা,” সে বলে। “গিয়ে আরো ইঁদুর মেরে খা।”
চার্চ আনাড়িভাবে মাটিতে ল্যান্ড করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এরপর লুইসের দিকে নিজের সবুজাভ চোখ দিয়ে একটা ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে মাতালের মত হেলতে দুলতে হেঁটে চলে যায়।
লুইস সিঙ্কে গিয়ে নিজের হাতগুলো এমনভাবে ডলে ডলে বার বার ধোয় যেন সে কোন অপারেশনের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।
এই কাজটা আমরা করেছি, কারণ এটা আমাদের পেয়ে বসেছিল…উপযুক্ত কারণ খুঁজে নিবে…তুমি নিজেই সেটার পেছনে যুক্তি দাঁড় করাবে…এবং সেই যুক্তিগুলো তোমার কাছে খুব ঠিক মনে হবে…তুমি সেটা করতে বাধ্য।
না, সে জাডকে দোষী করতে পারলো না। সে তার নিজের ইচ্ছেতেই সেখানে গিয়েছে আর তাই সে জাডকে দোষী করতে পারে না।
সে পানির ট্যাপ বন্ধ করে তোয়ালে দিয়ে নিজেকে মুছতে শুরু করে; হঠাৎ সে মোছা থামিয়ে জানালায় বাইরের অন্ধকারের দৃশ্যের দিকে তাকায়।
এর মানে কি জায়গাটা আমাকেও পেয়ে বসবে? বাকিদের মত?
না, আমি যদি নিজে থেকে না চাই, তাহলে না।
সে তোয়ালেটা র্যাকের ওপর রেখে ওপরে গেল।
***
রাচেল বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। ওর চিবুক পর্যন্ত চাদর টানা আর পাশেই গেজ শুয়ে ছিল। সে অপরাধীর চোখে লুইসের দিকে তাকালো। ওকে আমাদের কাছে রাখি? শুধু আজকের জন্যে। ও কাছে থাকলে আমার ভালো লাগবে। জ্বরে ওর গা পুড়ে যাচ্ছে।
“সমস্যা নেই।” লুইস বলে। “আমি লিভিং রুমে গিয়ে সোফায় বিছানা করে শুচ্ছি।”
“তুমি সত্যি রাগ করবে না?”
এতে গেজের কোন ক্ষতি হবে না আর তোমারও ভালো লাগবে।” সে থেমে হাসে। “তবে তোমাকে গেজের ভাইরাস পেয়ে বসবে মোটামুটি নিশ্চিত থাকো। তবে মনে হয় না তাতে তোমার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হবে, তাই না?”
রাচেল জবাবে হেসে মাথা নাড়ে। “এলি ডাকছিল কেন?”
“চার্চ। ও চার্চকে ওর রুম থেকে বের করে দিতে বলছিল। “তাই নাকি? আজ সূর্য কোন দিকে উঠলো?”
“আমিও অবাক হয়েছি,” লুইস বলে। “চার্চের গায়ে নাকি ও বিশ্রী গন্ধ পাচ্ছে। কথা ঠিক, আমিও গন্ধ পেয়েছি। বিড়ালটা মনে হয় নোংরা কিছুর মধ্যে গড়াগড়ি খেয়ে এসেছে।”
“এ কেমন হলো?” রাচেল বিছানায় নিজের পাশে গিয়ে শুতে শুতে বলে। ‘বেড়াতে যাওয়ার পর ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ও তোমাকে আর চার্চকে সমানভাবে মিস করেছে।”
“বলো কী!” লুইস বলে। সে নিচু হয়ে রাচেলের কপালে চুমু খায়। “ঘুমাও, বউ।”
“আই লাভ ইউ, লু। তোমাকে খুব মিস করেছি এ কদিন। আর সোফায় শোয়ানোর জন্যে দুঃখিত।
“সমস্যা নেই,” লুইস বলে ঘরের বাতি নিভিয়ে দেয়।
***
সে নিচে নেমে সোফার কুশনগুলো স্তুপ করে বিছানা পাতে। সে জানে আজ তার সারা রাতই পিঠের নিচে সোফার স্প্রিং বর্শার মত খোঁচাখুচি করবে। ফ্রন্ট হলের ক্লজেট থেকে মোটা দুইটা কম্বল এনে সোফার ওপর বিছিয়ে দিলো, নিজের পিঠ বাঁচাতে। জামা কাপড় খুলতে শুরু করেও থেমে যায় সে।
তুমি কি ভাবছো চার্চ আবারো ঢুকে পড়েছে? তাহলে একটু চারদিক ঘুরে দেখো। এতে কোন ক্ষতি হবে না, তুমি যেমন রাচেলকে বলে আসলে, অথচ কিছু লাভ হতে পারে। আর দরজাগুলোর ছিটকিনি ভালো করে লাগানো হয়েছে কি না দেখে আসলে তোমাকে নিশ্চয়ই ভাইরাস জ্বরেও ধরবে না।
সে নিচতলাটা ভালো করে ঘুরে ঘুরে দেখলো আর দরজা জানালার ছিটকিনিগুলোও চেক করলো। এবার সে আর ভুল করেনি। চার্চকে কোথাও দেখা গেল না।
“বজ্জাত বিড়াল,” সে বলে। “দেখি আজ কিভাবে ঢুকিস, হারামজাদা।” আর মনে মনে সে কামনা করে শীতে যেন চার্চের বিচি জমে যায়। অবশ্য, চার্চের এখন আর জমে যাবার মত কোন বিচি অবশিষ্ট নেই।
বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়তেই তার পিঠে সোফার স্প্রিংয়ের খোঁচা লাগে। আজ স্প্রিংয়ের খচখচানিতে সে ঘুমোতেই পারবেনা ভাবতে ভাবতে ঘুমে তলিয়ে গেল। সে সোফার ওপর খুব অস্বস্তিকরভাবে শুয়েছিল, কিন্তু যখন জেগে ওঠলো সে নিজেকে আবার মিকমেকদের গোরস্থানে আবিষ্কার করে। তবে এবার তার সাথে কেউ নেই। এবার সে নিজ হাতে চার্চকে খুন করে কোন এক অদ্ভুত কারণে আবার তাকে ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছে। এটা কেন চাচ্ছে সেটা খোদাই জানে, সে জানে না। এবার অবশ্য সে গভীর গর্ত করে চার্চকে কবর দিয়েছে আর এতো নিচ থেকে চার্চ বের হয়ে আসতে পারবে না। চার্চের কান্নার শব্দ কবরের ঝুরঝুরে মাটির ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে আসছে, কান্নার শব্দটা অনেকটা মানব শিশুর কান্নার শব্দের মত। শব্দের সাথে সাথে মাটির ভেতর থেকে বীভৎস মাংস পচা গন্ধও ভুরভুর করে বেরিয়ে আসছে। কটু গন্ধে শ্বাস নিতে গিয়ে লুইসের মনে হয় তার বুকের ওপর কেউ পাথর চাপা দিয়েছে। ভয়ংকর কান্না…আর্তনাদ…
কান্নার শব্দ চলতেই থাকে…আর তার বুকের ভারটাও …
“লুইস!” রাচেল অধীর গলায় তাকে ডাকছে। “লুইস, তাড়াতাড়ি এসো!”
রাচেলের গলা শুনে শুধু অধীর না, বরং আতঙ্কিত মনে হয় লুইসের কাছে। কান্নার শব্দটা আটকে আটকে যাচ্ছে, যেন তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। পরমুহূর্তেই লুইস বুঝতে পারে গেজ কান্না করছে।
সে নিজের চোখ খুলেই দেখলো দুটি সবুজ চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে, খুব বেশি হলে তার নিজের চোখ থেকে চার-পাঁচ ইঞ্চি দূর হতে। চার্চ তার বুকের ওপর কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছে। এটার গা থেকে কটু গন্ধ ভেসে ভেসে লুইসের একদম ভেতরে এসে ঢুকছে। চার্চ পুর্র্ পুর্র্ করছে।
লুইসের গলা চিড়ে একটা আতঙ্ক ভরা চিৎকার বেরিয়ে আসে। সে তার হাত এলোপাতাড়িভাবে ছুঁড়ে চার্চকে বুকের ওপর থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে লাফিয়ে পরে চার্চ হেলে দুলে চলে যায়।
ওহ খোদা! শয়তানটা আমার ওপর উঠে বসে ছিল! একদম আমার বুকের ওপর!
একটা জ্যান্ত মাকড়শা তার মুখের মধ্যে ঢুকে গেলেও তার এতো ঘৃণা লাগতো না।
“লুইস!”
গায়ের ওপর থেকে কম্বল ঠেলে সরিয়ে কিছুটা ঘুমের ঘোর নিয়েই দ্রুতপদে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তাদের বেডরুম থেকে হালকা আলো আসছে। সেই আলোয় সে দেখতে পায় সিঁড়ির মাথায় রাচেল তার নাইট গাউন পড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
“লুইস, ও আবার বমি করছে… বমি করতে করতে ওর দম বন্ধ হয়ে আসছে…আমার খুব ভয় করছে।”
“আমি দেখছি,” সে সিঁড়িতে উঠতে উঠতে বলে। তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, বজ্জাতটা আবার ঢুকে পড়েছে। যেভাবেই হোক, এটা আবার ঢুকে পড়েছে। মনে হয় সেলারের কোন জানালা ভাঙা। আসলে, সেলারের ভাঙা জানালা দিয়েই এটা ঢুকেছে, আর কোন রাস্তা নেই। কাল অফিস থেকে ফিরেই আমি চেক করবো…নাহ, অফিস যাওয়ার আগেই-
গেজ কান্না থামিয়ে দম বন্ধ হয়ে আসা গার্গলের মত শব্দ করতে থাকে।
“লুইস!” রাচেল চিৎকার করে উঠে।
লুইস দ্রুত পা চালায়। গেজ তাদের বিছানায় লুইসের পাশটায় শুয়ে আছে। ওই পাশে বিছিয়ে রাখা একটা পুরনো তোয়ালের ওপর ওর মুখ থেকে বমি বেরিয়ে আসছে। ও বমি করছে, কিন্তু যথেষ্ট না। বমি ওর মুখের বা গলার কাছে আটকে যাচ্ছে আর এতে করে ওর প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে, আর এতে করে ওর কান্নাও আটকে গেছে।
লুইস গেজের দুই বগলের নিচে ধরে ওকে কোলে তুলে নিয়ে গেজের মাথা নিজের কাঁধের ওপর রাখে। গেজের গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এবার লুইস পেছনের দিকে ঝাঁকি দিয়ে ঝুঁকে পড়লো, গেজকে সহ। গেজের ঘাড়ে মটকা ফোটার মত একটা আওয়াজ হয় এবং পর মুহূর্তেই গেজ সজোরে ঢেকুর তোলার মত একটা শব্দ করে বমি উগড়ে দেয়। বমিতে তারল্যের চাইতে কাঠিন্যের বৈশিষ্ট্যই বেশি। পরমুহূর্তেই লুইসের কানে গেজের সবেগে কান্নার মধুর ধ্বনি সঙ্গিতের মত বেজে ওঠে। অক্সিজেনের পর্যাপ্ত যোগান ছাড়া এতো উচ্চস্বরে কাঁদা যায় না।
রাচেল হঠাৎ বিছানায় বসে পড়ে। তার সারা শরীর প্রচন্ডভাবে কাঁপছে ও আরেকটু হলে মরেই যাচ্ছিল! ওহ খোদা! আরেকটু হলেই দম আ-আ- আ-ওহ মাই গড!”
লুইস তার ছেলেকে কোলে নিয়ে ঘরের মধ্যে হাঁটতে থাকে। গেজের তীক্ষ্ণ কান্না ইতিমধ্যেই কমে এসেছে; সে এরমধ্যেই প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে।
“আটানব্বই ভাগ চান্স ছিল ও নিজেই গলা পরিস্কার করে ফেলবে। আমি শুধু ওকে একটু সাহায্য করেছি।”
“কিন্তু…কিন্তু ও খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেছিল।” রাচেল লুইসের দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে। “আরেকটু হলেই আজ…ও মৃত্যুর খুব কাছে চলে গেছিল…”
হঠাৎ লুইসের সেদিন বিকেলে রাচেলের সাথে ঝগড়ার কথা মনে পড়ে গেল। রাচেল তাকে কিচেনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ও মরবে না। এই বাসায় কেউ মরবে না…
“বউ,” লুইস বলে, “আমরা সবাই মৃত্যুর খুব কাছাকাছি, প্রতি মুহূর্তেই।”
.
বুকের দুধ খেয়ে গেজের আরেক দফা বমি হয়। গেজ আবার মাঝরাতে জেগে গিয়েছিল, রাচেল বলল। লুইসের ঘুমোতে যাওয়ার দেড় ঘন্টা পরের ঘটনা। গেজ তার ক্ষুধার কান্না কেঁদে জেগে উঠলে রাচেল তাকে বুকের দুধ খেতে দেয়। দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে রাচেল কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না। তার ঘন্টাখানেক পর আবারো বমি করতে করতে গেজের দম বন্ধ হবার মত অবস্থা হয়।
ওকে আপাতত আর দুধ দেয়া যাবে না, লুইস বললে রাচেল খুব সহজভাবে মেনে নেয়। দুধ বন্ধ।
লুইস যখন নিচে নামে তখন রাত প্রায় পৌনে দুটো। নেমে সে প্রায় পনেরো মিনিট ধরে চার্চকে খোঁজে। খুজতে খুজতে সে কিচেনের সাথে বেসমেন্টের দরজাটা সামান্য খোলা পায়, আর এরকমই সে আশা করেছিল। তার মায়ের একটা কথা তার মনে পড়ে গেল। তিনি একটা বিড়ালের সম্পর্কে বলেছিলেন যেটা নিজে নিজে দরজা খোলার ব্যাপারে বেশ পটু হয়ে উঠেছিল। বিড়ালটা দরজার হাতলের পাশে কিছুতে চড়ে হাতলটাতে থাবা চালাতে থাকতো, যতক্ষণ না দরজা খুলে যায়। বিড়ালদের জন্যে খুব কিউট একটা ট্রিক, কিন্তু লুইস চার্চকে এই ট্রিক খেলার সুযোগ থেকে একদম বঞ্চিত করতে চায়। আর সেলারের দরজাতে একটা লকও আছে। লুইস চার্চকে সেলারের স্টোভের নিচে আবিষ্কার করে আর কোন রকম ভনিতা না করে সামনের দরজা দিয়ে ছুড়ে ওকে বাইরে ফেলে দেয়। আর তার সোফার বিছানায় যাওয়ার আগে সে সেলারের দরজাটা আবারো বন্ধ করে।
আর এবার সে দরজার ছিটকিনিটাও মেরে দেয়।
অধ্যায় ২৯
পরদিন সকাল হতে হতে গেজের শরীরের তাপমাত্রা প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসে। ওর গাল ফেটে গেলেও ওকে বেশ প্রাণবন্ত লাগছে। আর এক সপ্তাহের ব্যবধানেই তার আবোল তাবোল বলা এক রকম লাইনে চলে এসেছে; এখন ওকে যা বলা হয় ও সেটাই নকল করার চেষ্টা করে। আর তা দেখে এলি ওকে দিয়ে যা বলাতে চাচ্ছে তা হচ্ছে, গু।
“গেজ, বলো কাচা গু,” এলি ওটমিল খেতে খেতে বলে।
“কাচা-গু,” গেজ সিরিয়াল খেতে খেতে আনন্দের সাথে বলে। লুইস তাকে কম চিনি দিয়ে খাওয়ার শর্তে সিরিয়াল খাওয়াতে মত দিয়েছে। তবে গেজ যথারীতি তার সিরিয়াল খাওয়ার চাইতে তা দিয়ে শ্যাম্পু করতেই বেশি আনন্দ পাচ্ছে।
এলি হাসিতে ভেঙে পড়লো।
“গেজ, বলো আমি গু খাই,” এলি বলে।
“গু খাই,” গেজ নিজের খাবার লেপ্টে থাকা মুখে গম্ভীর হয়ে বলে। “কাচা গু খাই।”
এবার এলির সাথে সাথে লুইসও হাসিতে ফেটে পড়ে। না হেসে উপায় কি?
তবে রাচেল এতো খুশি হলো না। “ওকে বাজে কথা শেখাচ্ছ কেন তোমরা?” সে বলে। “গেজ, পচা কথা বলে না।”
“গু খাই-গু খাই-গু খাই,” গেজ মনের সুখে গান ধরে। এলি মুখে হাত চাপা দিয়ে নিজের হাসি থামায়। লুইস খেয়াল করলো রাচেলও প্রায় হেসে ফেলেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের হাসি থামিয়ে ফেলল। প্রায় নির্ঘুম ক্লান্তিকর একটা রাত কাটানোর পরও রাচেলকে বেশ সতেজ দেখাচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে লুইসের বুকের ওপর থেকে যেন একটা ছোট পাথর নেমে যায়।
“সুন্দর,” গেজ তার বমি করার পাসওয়ার্ড বলেই এতক্ষণে যা খেয়েছিল তার প্রায় সবটা তার সিরিয়ালের বোলের ওপর উগড়ে দিল।
“ইয়াক থুহ্!” এলি চিৎকার করতে করতে খাবার টেবিল থেকে ছুটে পালিয়ে যায়।
লুইস এবার অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ে। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে এসেছে। রাচেল আর গেজ তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তার মাথার সব তারগুলো একদম ছিড়ে গেছে।
“পাগল হয়ে গেলে নাকি?” রাচেল বলে।
না, লুইস মনে মনে বলে। আমি আরো আগেই পাগল হয়ে গেছি। তবে এখন মনে হচ্ছে আমি ভালো হয়ে যাব। একদম ভালো।
অধ্যায় ৩০
সপ্তাহখানেক পরে গেজের ভাইরাস জ্বর সেরে যায়। কিন্তু এর পরের সপ্তাহেই আবার ও ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হয়। ওর থেকে এলি আর রাচেলও আক্রান্ত হয়, ক্রিসমাসের আগে আগে। ওরা তিনজন পাল্লা দিয়ে কাশে আর কাশতে কাশতে বৃদ্ধ কুকুরের মত হাঁপায়। লুইসের সাথে অবশ্য এই রোগের জীবাণু বিশেষ সুবিধা করতে পারে না আর এজন্য রাচেল ওর ওপর যেন একটু অভিমানও করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ সপ্তাহটা খুব ঝামেলার মধ্যে কাটে লুইস আর তার কলিগদের। ফ্লু ছড়িয়ে না পড়লেও প্রচুর ব্রঙ্কাইটিস, মাম্পস আর নিউমোনিয়ার পেশেন্ট আসে তাদের কাছে। আর ক্রিসমাসের আগে ক্লাস শেষ হবার দুদিন আগে ছয়জন গোঙাতে থাকা মাতাল ছাত্রকে তাদের বন্ধুরা ধরাধরি করে ইনফার্মারিতে নিয়ে আসে। তাদের নিয়ে আসার পর একদম হযবরল অবস্থা তৈরি হয় যার সাথে পাস্কোর ঘটনার অনেকটা সাদৃশ্য আছে। এই ছয় স্টুপিড মাতাল অবস্থায় পাহাড়ের ওপর থেকে একসাথে একটা স্লেজে চড়ে নিচে নেমে আসতে যায়। খুব মজা। এমনকি এদের একজন নাকি সবার পিছনের জনের ঘাড়ের ওপর বসে ছিল। পাহাড় বেয়ে নামতে নামতে স্লেজটা বেশ ভালো গতি অর্জন করে আর নিচে এসে একটা সাজিয়ে রাখা আমেরিকান সিভিল ওয়ারের কামানের ওপর পড়ে। এবং এতে তাদের সম্মিলিত অর্জন হচ্ছে দুটি ভাঙা হাত, একটি ভাঙা কব্জি, সর্বমোট সাতটি ভাঙা পাজর, একজনের মাথায় প্রচন্ড আঘাত আর অসংখ্য কালশিটে। শুধু যে ছেলেটা আরেকজনের ঘাড়ে চড়ে নামছিল সে অক্ষত অবস্থায় আছে। সে তার কপালের জোরে উড়ে গিয়ে পুরু তুষারের ওপর গিয়ে পড়ে। এতোগুলো আহাম্মক ছাত্রের চিকিৎসা করা কোন সহজ কাজ না, আর লুইস তাদের চিকিৎসা করার সময় খুব ভালোভাবেই তাদের বকাবকি করেছে। তবে পরে যখন রাচেলকে এই ঘটনার কথা বলে সে আবার হাসতে হাসতে চোখে পানি এনে ফেলে। রাচেল তার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে ভাবছিল এতে এতো হাসার কী আছে। তবে লুইস তাকে বলতে পারলো না যে এটা একটা বেকুবের মতো অ্যাক্সিডেন্ট ছিল আর তারা আহত হলেও সবাই প্ৰাণ নিয়ে ফিরে গেছে। তার হাসিটা ছিল অনেকটা হাফ ছেড়ে বাঁচার হাসি, বিজয়ের হাসি। আজ সে জিতেছে। লুইস ৬, মৃত্যু ০।
তার নিজের পরিবারের গণ-কাশির সমস্যা ক্রিসমাসের সপ্তাহ খানেক আগেই সেরে যায় আর এলির স্কুলও ষোল তারিখে ছুটি হয়ে যায়। আর তারা চারজন মিলে একসাথে ক্রিসমাস কাটানোর জন্যে প্রস্তুত হয়। এই বাসায় প্রথম যেদিন সবাই এসে উঠে সেদিন বাড়িটাকে খুব অদ্ভুত লাগছিল লুইসের, খুব অচেনা লাগছিল। সেদিনেরই কত স্মৃতি; এলির পা কেটে ফেলা, গেজের গায়ে মৌমাছির হুল…তবে এখন বাড়িটাকে একদম নিজেদের বাড়ি মনে হয়।
ক্রিসমাসের আগের রাতে বাচ্চারা শুতে গেলে লুইস আর রাচেল চোরের মত তাদের এ্যাটিকে গিয়ে ওঠে। সেখান থেকে তারা দুজন হাত ভরে গিফ্ট নিয়ে নিচতলায় ক্রিসমাস গাছের নিচে সাজিয়ে রাখে। গেজের জন্যে নানান রকম খেলনা গাড়ি, কারণ সে ইদানিং গাড়ি নিয়ে খেলার মাঝে অত্যাধিক আনন্দ আবিষ্কার করেছে। আর এলির জন্যে বারবি আর কেন্ পুতুল, তিন চাকার একটা সাইকেল, পুতুলের কাপড় এবং আরো অনেক কিছু।
ওরা দুজন ক্রিসমাস ট্রির পাশে গা ঘেষে বসে জিনিসগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে। খুব আহামরি কিছু না হলেও এরকম আনন্দদায়ক বিকেল লুইস আগে কখনো কাটিয়েছে বলে মনে করতে পারে না। ফায়ার প্লেসের আগুন কমে আসলে তাদের একজন উঠে মাঝে মাঝে একটা করে চাড়া কাঠ দিয়ে আসছে।
এর মধ্যে উইনিস্টন চার্চিল একবার লুইসের গা ঘেষে যেতে চাইলে সে বিড়ালটাকে একরকম অরুচি নিয়ে ঠেলে সরিয়ে দেয়। চার্চের গায়ের দুর্গন্ধ সে একদমই সহ্য করতে পারে না, আর এর জন্যে শুধু গন্ধটাই দায়ি না। তার কাছে জায়গা না পেয়ে চার্চ রাচেলের পায়ের কাছে গিয়ে বসতে চায়। কিন্তু রাচেলও “যা ভাগ!” বলে ওকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। লুইস লক্ষ্য করলো রাচেল যে হাত দিয়ে চার্চকে ঠেলে দিয়েছে তা পায়জামার ওপর ঘষছে, যেমনটা হাতে খুব নোংরা কিছু লাগলে কেউ ঘষে। রাচেলকে দেখে লুইসের মনে হলো সে যে হাত ঘষছে সেটা সে নিজেও জানে না।
চার্চ হেলতে দুলতে ফায়ার প্লেসের কাছে গিয়ে আগুনের সামনে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে। চার্চ তার নিজের স্টাইল হারিয়ে ফেলেছে সেদিনই, যেদিন সে ফিরে এসেছিল। তবে চার্চের মধ্যে আরেকটা বড় রকমের পরিবর্তন হয়েছে আর সেটা ধরতে লুইসের মাস খানেক লেগে গেছে। সেটা হচ্ছে চার্চ এখন আর পুর্র্…পুর্র্ করে না। আগে চার্চ ঘুমোতে গেলে মেশিনের মত এই আওয়াজ করতো। আর এখন সে ঘুমায় নিশব্দে, পাথরের মত। মৃতের মত।
না, লুইস একটা ব্যতিক্রম ঘটনা মনে করতে পারে। সেদিন রাতে সোফায় ঘুমানোর সময় দুঃস্বপ্ন দেখে সে যখন জেগে উঠে চোখের সামনে চার্চকে দেখেছিল, চার্চ তখন পুর্র্… পুর্র্… করছিল।
জাড ক্র্যান্ডাল তাকে যেমন বলেছিলেন তা অনেকটা ঠিক, সেটা তিনি বিশ্বাস করেই বলে থাকেন আর অনুমান করেই বলে থাকেন না কেন। চার্চ একদম বিগড়ে গেছে তা বলা যায় না। লুইস তাদের সেলারে একটা ভাঙা জানালা খুঁজে পেয়েছে, ফার্নেসের পেছনে। আর সেটা ঠিক করানোতে তার বাসা গরম করার জন্যে কম পয়সা খরচ হবে। চার্চ সেটা আবিষ্কার না করলে লুইসের হয়তো সেটা খুঁজে পেতে অনেক সপ্তাহ, মাস বা বছরও লেগে যেতে পারতো। সেভাবে চিন্তা করলে লুইসের চার্চকে ধন্যবাদ দেয়া উচিত।
এলি এখন চার্চকে নিজের সাথে ঘুমোতে দেয় না, এটা ঠিক। তবে ও যখন সোফায় বসে টিভি দেখে, চার্চ মাঝে মাঝে ওর কোলে এসে বসলে ও ওকে বসতে দেয়। তবে কিছুক্ষণ পরেই ওকে সরিয়ে দিয়ে বলে, “যাও চার্চ, তোমার গায়ে গন্ধ।” এলি চার্চকে নিয়মিত খেতে দিত আর সেটা ভালোবেসেই দিত। আর গেজও মাঝে মাঝে আদর করে চার্চের লেজ নিয়ে খেলা করতে ভুলেনি। এরকম সময় চার্চ রেডিয়েটরের নিচে পালিয়ে যেত, যেখানে গেজ ওর নাগাল পাবে না।
চার্চ বিড়াল না হয়ে কুকুর হলে হয়তো আরো বেশি পরিবর্তন দেখা যেত, লুইস ভাবে। আর বিড়ালরা এমনিতেই স্বাধীনচেতা প্রাণী। স্বাধীন আর অদ্ভুত। লুইসকে এটা অবাক করে না যে, প্রাচীন মিসরীয় রাজারাণীরা চাইতেন তাদের মৃত্যুর পর তাদের বিড়ালগুলোকেও মমি করে তাদের সাথে কবর দেয়া হোক, যাতে করে তাদের পোষা বিড়াল তাদের আত্মাকে পথ দেখিয়ে স্বর্গে নিয়ে যেতে পারে।
“ব্যাট-সাইকেলটার কী অবস্থা, ওস্তাদ?” রাচেল জিজ্ঞেস করে।
সে ব্যাট-সাইকেলটা উঁচু করে বলল, “টা-ডা!”
“ওগুলো কী?” রাচেল প্লাস্টিক পার্টসে ভরা একটা পলিথিনের ব্যাগ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“বাড়তি পার্টস,” লুইস দোষীভাবে বলে।
“এগুলোয় আছাড় খেয়ে ঘাড় ভাঙবে তো ওদের,” রাচেল বলে।
“সরিয়ে ফেলবো তার আগেই। আর ঘাড় এতো আগে ভাঙবে না। ওদের দশ-বারো বছর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো, তার পর স্কেটবোর্ড নিয়ে কাবিলতি দেখাতে গিয়ে ঘাড় ভাঙবে।”
“ছি, লুইস! এভাবে নির্দয়ের মতো বলতে পারলে!”
লুইস দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভাঙে আর ওর একটা হাড় মট্ করে ওঠে। “সব খেলনা সেট করা শেষ।”
“গত বছরের কথা মনে আছে?” বলেই রাচেল হিহি করে হাসতে থাকে। লুইসও মুচকি হাসে। গত বছর তারা এতো খেলনা কিনেছিল যে সেগুলো সেট আপ করার ক্লান্তিকর কাজ করতে রাত প্রায় চারটা বেজে গেছিল। কিন্তু দেখা গেল যে ক্রিসমাসের দিন দুপুর না হতে হতেই বাচ্চারা কেউই তাদের খেলনাগুলো দিয়ে খেলছে না, তাদের পছন্দ হয়নি সেসব। সেই খেলনাগুলো দিয়ে খেলার চাইতে তারা খেলনাগুলোর বাক্স দিয়ে খেলতেই বেশি মজা পাচ্ছিল।
“ইয়াক!” লুইস এলিকে নকল করে বলে।
“আচ্ছা। বেড়ে চলো,” রাচেল বলে। “তোমাকে আগে আগেই একটা গিফট দেই।”
“ভদ্র মহিলা,” লুইস বলে, “এটা আমার নিজেরই।”
“স্বপ্ন দেখতে থাকো,” রাচেল হাসতে হাসতে বলল আর হাসার সময় তাকে অনেকটা এলির মত দেখায়…কিছুটা গেজের মতোও।
“এক মিনিট,” সে বলে। “আমার আরেকটা ছোট্ট কাজ বাকি আছে।” সে দ্রুত তাদের ক্লজেট থেকে নিজের একটা বুট জুতা বের করলো। এরপর জুতোটা নিয়ে ফিরে এসে ফায়ার প্লেসের গ্লাসের পাল্লাটা সরিয়ে ফেলে।
“লুইস, কী করছো-”
“এখনি দেখতে পাবে।”
ফায়ার প্লেসের আগুন কমে এসেছে। ফায়ার প্লেসের এক কোনায় আগুন নিভে গেছে আর বেশ পুরুভাবে ছাই জমে আছে। লুইস বুট জুতোটা দিয়ে ছাইয়ের ওপর গভীরভাবে জুতোর ছাপ ফেলল। এরপর জুতোর সাথে লেগে থাকা ছাই দিয়ে সে আরো কয়েকটা ছাপ ফায়ার প্লেসের বাইরেও ফেলল।
“শেষ,” লুইস জুতোটা ক্লজেটে রেখে এসে বলে।
“কাল সকালে সান্টা ক্লজ এসেছে ভেবে এলির মাথা খারাপ হয়ে যাবে,” রাচেল হিহি করে হাসতে হাসতে বলে।
সপ্তাহখানেক আগে এলি স্কুলে একটা গুজব শুনতে পেয়েছে যে, সান্টা ক্লজ বলে কিছু নেই, বাবা-মায়েরাই আসলে সান্টা ক্লজ। আর ওর এই সন্দেহ আরো জোরদার হয়েছে বেঙ্গর শপিং মলে এক দোকানে খেতে যাবার পর। সেখানে একজন রোগাপটকা সান্টা বসে ছিলেন। তিনি তার নকল দাড়ি খুলে সামনে রেখেছিলেন যাতে করে তিনি তার মস্ত বার্গারটা খেতে পারেন। সান্টা বার্গার খাচ্ছেন এই ব্যাপারটা এলি মেনে নিতে পারছে না, এই ব্যাপারটা তাকে সান্টার খুলে রাখা নকল দাড়িটা থেকেও বেশি খোঁচাচ্ছে। রাচেল ওকে বুঝিয়েছিল যে এই সান্টা আসল সান্টা না, ইনি শুধু প্রধান সান্টার একজন সহকারী মাত্র। প্রধান সান্টা বাচ্চা-কাচ্চাদের নানান আবদারের চিঠি পড়তে এতো ব্যস্ত যে এখানে বার্গার খেতে আসার মত সময় তার হাতে একদমই নেই।
লুইস ফায়ার প্লেসের কাচের পাল্লাটা সাবধানে লাগিয়ে দেয়। পায়ের ছাপগুলো দেখলে মনে হবে সান্টা ফায়ার প্লেস দিয়ে নেমে ক্রিসমাস গাছটার কাছে হেঁটে গিয়েছেন। ভাওতাবাজিটা বেশ ভালো হয়েছে একটা খুঁত ছাড়া, সেটা হচ্ছে দু পায়ের ছাপই বাম পায়ের বুটের। তবে লুইসের ধারনা এটা এলির মত পাঁচ বছরের বাচ্চা কিছুতেই টের পাবে না।
“লুইস ক্রিড, আই লাভ ইউ,” রাচেল বলে লুইসকে চুমু খায়।
“তুমি একজন মহামানবকে বিয়ে করেছো বউ,” লুইস হেসে হেসে বলে। “আমার সাথে লেগে থাকো, আমি তোমাকে সুপারস্টার বানিয়ে দিব।”
তারা সিঁড়ির কাছে গেলে লুইস রাচেলকে ইশারা করে টিভির সামনে এলির বিছিয়ে রাখা কার্ডবোর্ডের টেবিলের দিকে। টেবিলের ওপর একটা বাটিতে কয়েকটা ওটমিল কুকি আর রিং-ডিং। টেবিলে এক ক্যান বিয়ারও আছে। সান্টা, আপনার জন্যে,” একটা কাগজে এলির হাতের বড় বড় অক্ষরে লেখা। “কুকি খাবে না রিং ডিং?” লুইস জিজ্ঞেস করে।
“রিং-ডিং,” রাচেল বলে এক কামড়ে সেটার অর্ধেক খেয়ে নেয়। লুইস বিয়ারের ক্যানটা খোলে।
এই সময় বিয়ার গিললে আমার নিশ্চিত গ্যাস্ট্রিক হবে,” লুইস বলে। “ঢং করো না তো,” রাচেল বলে। “কিছুই হবে না।”
লুইস বিয়ারের ক্যানটা রেখে নিজের বুকে এমনভাবে হাতড়াতে থাকে যেন সে কিছু খুঁজে পাচ্ছে না-যদিও সে আজ সন্ধ্যার পর থেকে বুকপকেটে রাখা অল্প ওজনের জিনিসটার কথা একবারও ভোলেনি।
“নাও,” লুইস বলে। “মাঝরাত পেরিয়ে গেছে, এখন খুলতে পারো এটা। ম্যারি ক্রিসমাস, বউ।”
রাচেল সিলভার কাগজে মোড়া, নীল ফিতা দিয়ে বাধা ছোট বক্সটা নেড়ে চেড়ে দেখে। “লুইস, কী এটা?”
লুইস কাঁধ তুলল। “সাবান…বা শ্যাম্পু স্যাম্পল। আসলে ভুলে গেছি।” সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রাচেল বাক্সটা খোলে। ভেতরের জিনিসটা উকি দিতেই তার মুখ হা হয়ে যায়। ভেতরে একটা সোনার চেইন।
“হুম?” লুইস অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করে। সে এই প্রথম কোন জাতের অর্নামেন্ট কিনে দিচ্ছে রাচেলকে, আর তাই সে বেশ উদ্বিগ্ন। “পছন্দ হয়েছে?”
রাচেল চেইনটা বের করে আনে। চেনের সাথে একটা নীলকান্তমণি ঝুলছে। সেটা ঝকমক করছে আর যেন চারদিকে নীল আলো বিকিরণ করছে। “লুইস, এতো সুন্দর জিনিসটা-” লুইস খেয়াল করে রাচেল কাঁদছে। আহা, এমন করো না তো,” সে বলে। “গলায় পড়োতো দেখি।”
“লুইস, আমাদের এসব কেনার সামর্থ্য নেই-তুমি-”
“স্… আমি গত ক্রিসমাসের পর থেকেই জমাচ্ছিলাম, কোন রকমে হয়ে গেছে। আর তুমি যা ভাবছো দাম অতো বেশিও না।”
“কত পরেছে?”
“আমি আমার জীবন থাকতে এই কথা তোমাকে বলব না, রাচেল,” লুইস গম্ভীর হয়ে বলে। “এমনকি চাইনিজ আর্মি আমাকে পিটিয়েও এর দাম জানতে পারবে না। মাত্র দুই হাজার ডলার।”
“দুই হাজার ডলার-!” রাচেল লুইসকে এতো জোরে জড়িয়ে ধরলো তাতে সে আরেকটু হলে সিঁড়ি থেকে পড়েই যাচ্ছিল। “তুমি পাগল নাকি!”
পড়ে দেখো,” সে আবারো বলে।
রাচেল হারটা পড়ে। লুইস হারটার হুক লাগিয়ে দিতে সাহায্য করে। তারপর রাচেল তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।
“ওয়াও! রাচেল, রূপের জ্বালায় তো আমার চোখ পুড়ে যাচ্ছে!”
“হয়েছে। এখন আমি ওপরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঢং করবো। আর আজ সব খুলে ফেললেও এটা আমি গলা থেকে খুলছি না।” বলেই লুইসকে চোখ টিপে দেয় রাচেল।
“আচ্ছা ম্যাডাম। আপনি যান। আমি আপদ বিদেয় করে আসছি।” চার্চের দিকে ইশারা করে লুইস বলে।
লুইস চার্চকে দুহাতে ধরে কিচেন থেকে গ্যারেজের দরজাটার কাছে নিয়ে যায়। এখন চার্চকে ধরার বদলে সে আর ঝাড়ু ব্যবহার করে না। এতো কিছুর পরেও সে বদলে যাওয়া চার্চে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে হয়তো। সে দরজা খুললে ঠান্ডা বাতাসের একটা জোরালো ঝাপটা তার গায়ে এসে লাগে।
“যাও চার্চ, ম্যারি ক্রিস-”
লুইস থমকে যায়। দরজার সামনের পাপোশে একটা মাথা থেতলানো কাক পড়ে আছে। কাকটির একটি ডানা ছেড়া কাগজের মত পাশেই পড়ে আছে। চার্চ কোন বিলম্ব না করেই লুইসের হাত থেকে মোচড়ামুচড়ি করে নিজেকে ছুটিয়ে নিয়ে লাশটা শুকতে শুরু করে। লুইস দেখলো চার্চ তার কানগুলো পেছনে নিয়ে মাথাটা চোখা করে ফেলেছে। আর দেখতে না দেখতেই চার্চ কাকটার মাথা থেকে একটা চোখ খুবলে বের করে নেয়।
চার্চ স্ট্রাইকস এগেইন, লুইস ঘৃণায় তার মাথা ঘুরিয়ে ফেলে-কিন্তু ঘোরানোর আগেই সে কাকটার শূন্য কোটরটা দেখে ফেলে। এই জিনিসে আমার কিছু হবে না। এর চাইতে ঢের বীভৎস জিনিস আমি দেখেছি। যেমন ভিক্টর পাস্কোর মাথার ভেতর দিয়ে ওর ব্রেন আমার দিকে উকি দিচ্ছিল। এই জিনিসের চাইতে সেটা হাজার গুনে বীভৎস-
কিন্তু তবুও তার গা গুলিয়ে বমি আসে। তার যৌন উত্তেজনার পোকাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল, সেটা নিমেষেই নিস্তেজ হয়ে গেল। ইয়া খোদা! কাকটা আকারে প্রায় চার্চের সমান। কাকটার অসাবধানতায় চার্চ চোরা-গোপ্তা হামলা করেছে নিশ্চয়। এই বীভৎস জিনিসটা সরিয়ে ফেলতে হবে। ক্রিসমাসের দিন সকালে উঠে কেউ এই জিনিস দেখতে চাইবে না। আর এটা সরানোর দায়িত্ব লুইসের নিজেরই, আর কারো না। এই জিনিসটা তার অবচেতন মন ঠিক করে নিয়েছে যেদিন তার পরিবারের সবাই ফিরে আসে আর সে টায়ারের স্তূপটা ফেলে দিয়ে খুবলে খাওয়া ইঁদুরটাকে লুকিয়ে ফেলছিল।
মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে, লুইস।
এই ভাবনাটা এতো বাস্তব মনে হয় লুইসের কাছে যে সে ঝটকা দিয়ে ওঠে, যেন জাড মাত্রই তার ঘাড়ের ওপর থেকে তাকে কথাটা বললেন।
মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়, আর সেটা সে যত্ন করে রাখে।
চার্চ এখনো মরা কাকটার ওপর লোভীর মত ঝুঁকে আছে। এখন সে কাকটার বাকি ডানার ওপর হামলা করছে। ডানাটা কামড়ে ধরে একবার ডানে টানছে, একবার বামে। ডান-বাম-ডান…পাখিটা এমনিতেই মরে কাঠ হয়ে আছে, এখন চার্চ এটাকে খেলে আর ক্ষতিই বা কি-লুইস হঠাৎ করেই চার্চকে একটা লাথি মেরে বসে। চার্চ লাথি খেয়ে লাফিয়ে সরে গিয়ে লুইসের দিকে তার বিশ্রী হলদে-সবুজ চোখগুলো দিয়ে তাকিয়ে আবার পরমুহূর্তেই হেঁটে চলে যায়। “আমাকে খা, হারামজাদা।” লুইস বিড়ালের মতই হিসিয়ে হিসিয়ে বলে।
“লুইস?” ওপর থেকে রাচেল ডাকে। “কী ব্যাপার?”
“কিছু না, আসছি,” লুইস জবাব দেয়। শুধু একটা ঝামেলা শেষ করে আসছি, রাচেল, বুঝলে? এটা আমাকেই করতে হবে কারণ এটার জন্যে আমিই দায়ি। সে হাতড়ে হাতড়ে গ্যারেজের বাতির সুইচটা জ্বেলে দেয়। সে দ্রুত কিচেনে গিয়ে একটা পলিথিন ব্যাগ আর গ্যারেজের সেলফ থেকে বেলচাটা নামায়। বেলচা দিয়ে সে প্রথমে মরা কাকটা ব্যাগে ঢোকায়। এরপর সে কাকটার ছেঁড়া ডানাটাও পলিথিনে চালান করে পলিথিনের মুখটা শক্ত করে বেঁধে দেয়। এরপর গ্যারেজে রাখা ডাস্টবিনে পলিথিনটা ফেলল। এর মধ্যেই প্রচন্ড শীতে তার অনাবৃত হাঁটু প্রায় বোধহীন হয়ে পড়েছে।
চার্চ গ্যারেজের খোলা দিকটায় দাঁড়িয়ে আছে। লুইস তাকে দেখে বেলচাটা তুলে একটা আক্রমণাত্মক ভঙ্গি করলে চার্চ সেখান থেকে লেজ গুটিয়ে পালায়।
সেই রাতের সেক্স বেশ ভালই হয়, কিন্তু লুইসের ঘুম আসতে চায় না। সাধারাণত ভাল সেক্সের পর লুইস খুব সহজেই ঘুমে তলিয়ে যায়। সে ক্রিসমাসের আগের রাতের নিস্তব্ধ অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে পাশে ঘুমিয়ে থাকা রাচেলের লম্বা লম্বা গভীর শ্বাসের শব্দ শুনছে। তার মাথায় মরা কাকটার কথা ঘুরপাক খাচ্ছে-তার জন্যে চার্চের ক্রিসমাস প্রেজেন্ট।
আমার কথা মাথায় রেখো ডঃ ক্রিড। আমি মরে গিয়ে আবার বেঁচে উঠেছি। আমি পুরো চক্র ঘুরে এসেছি তবে ফিরে আসার সময় আমার পুর বক্স নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তার বদলে আমি শিকার করার অভ্যাস নিয়ে ফিরে এসেছি। আমি তোমাকে বলতে চাই, মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায় আর সেটা সে যত্ন করে রাখে। ভুলে যাবে না, তোমার হৃদয়ে এখন আমার ছোট্ট ঘটনাও তোমাকে যত্ন করে রাখতে হবে। তোমার হৃদয়ে তোমার স্ত্রী, ছেলে আর মেয়ের পাশে আমাকেও জায়গা করে দিতে হবে, অনন্তকালের জন্যে। মনে রাখবে…তোমার মনের বাগানের যত্ন নেয়ার দায়িত্ব তোমারই।
একসময় লুইস ঘুমিয়ে পড়ে।
অধ্যায় ৩১
ক্রিড পরিবারের শীত চলে গেল। লুইসের ভুয়া পায়ের ছাপের কারণে সান্টা ক্লজের ওপর এলির বিশ্বাস আবার ফিরে এসেছে-হোক সেটা কিছু দিন বা কয়েক বছরের জন্যে। গেজ খুব চমকপ্রদভাবে তার উপহারগুলোর র্যাপিং খুলছিল আর মাঝে মাঝে র্যাপিং কাগজের থেকে টুকরো টুকরো ছিড়ে নিয়ে মুখে পুড়ে দিচ্ছিল। এবং এই বছরও দুপুর হবার আগেই বাচ্চারা এই সিদ্ধান্তে আসলো যে তাদের খেলনাগুলো থেকে সেগুলোর বক্সগুলো দিয়ে খেলতেই বেশি মজা।
নিউ ইয়ার ইভে ক্র্যান্ডালরা লুইসদের বাসায় দাওয়াতে আসেন, সেদিন রাচেল তার বিখ্যাত এগনগ রান্না করে খাওয়ায়। লুইস সেদিন মনের অজান্তেই নরমাকে দুচোখ দিয়ে পরীক্ষা করতে শুরু করে। নরমাকে অদ্ভুত রকমের ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল, যেরকমটা লুইস আগেও দেখেছে। তার দাদি এইরকম দেখলে বলতেন নরমা ‘ফেইল’ করতে শুরু করেছে। অবশ্য অবস্থা বিচার করলে ফেইল শব্দটা বেশ মানানসই। হঠাৎ করেই যেন নরমার হাত আর্থাইটিসে ফুলে গেছে আর মেছতার মত দাগে ভরে গেছে। তার মাথার চুলও কমে গেছে। তারা রাত দশটার দিকে নিজেদের বাসায় ফিরে যায় আর ক্রিড ফ্যামিলি তাদের টিভির সামনে বসে নিউইয়র্কের নতুন বছর উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা দেখে। ক্রিডদের বাসায় নরমার এই শেষ আসা।
লুইসের সেমিস্টার ব্রেকের সময়টায় খুব বৃষ্টি হয়। যদিও বাসা গরম করার খরচ কমে যাওয়ায় সে কৃতজ্ঞ ছিল তারপরও এই আবহাওয়াটা তার বড্ড বিষন্ন মনে হয়। সে এই সময়ে ঘরের জন্যে বেশ কিছু জিনিস বানিয়ে ফেলল; কয়েকটা বুকসেলফ, রাচেলের জন্যে কাপবোর্ড আর স্টাডিতে বসে নিজের জন্যে একটা মডেল পোর্শ। তেইশে জানুয়ারি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পুনরায় ক্লাস শুরু হয়, সে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই নিজের কাজে ফিরে যায়।
ক্লাস শুরুর সপ্তাহ খানেক পরই বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্লু ছড়িয়ে পরে। আর এতে তার কাজের চাপ এতো বেড়ে যায় যে সে প্রায় দিনই দশ থেকে বারো ঘন্টা করে কাজ করতে শুরু করে। দিনের শেষে সে একদম শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতো…কিন্তু তারপরো সে বেশ ফুরফুরে মেজাজে ছিল।
একজন নার্স লুইসকে বলল তার বাসা থেকে ফোন এসেছে। লুইস একটি ছেলের ভাঙা হাত চেক করছিল যে কি না বার বার জিজ্ঞেস করছে সে আসছে সিজনে বেসবল খেলতে পারবে কি না।
লুইস তার অফিসে গিয়ে ফোন ধরে। রাচেল কাঁদছিল আর এতে লুইস বিপদের গন্ধ পায়। এলির কিছু হলো না তো? ও কি স্লেজ থেকে পড়ে হাত ভেঙে ফেলেছে বা মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে? সে ভয়ে ভয়ে সেদিনের স্লেজ
থেকে পড়ে হাড়-গোড় ভাঙা ছাত্রদের কথা ভাবে।
“বাচ্চাদের কিছু হয়নি তো?” সে জিজ্ঞেস করে। “রাচেল?”
“না, না,” রাচেল বলে। “বাচ্চাদের কিছু হয়নি…নরমা ক্র্যান্ডাল…লু। তিনি আজ সকালে মারা গেছেন, আটটার দিকে। জাড এসেছিলেন তোমাকে খুঁজতে, আমি বললাম তুমি আধা ঘন্টা আগে বের হয়ে গেছো। ওহ লু! ওনাকে যে কেমন অসুস্থ আর দুর্বল দেখাচ্ছিল…মনে হচ্ছিল উনি হারিয়ে গেছেন। ভাগ্য ভালো যে এলি স্কুলে চলে গেছে আর গেজের বোঝার মত বয়সই হয়নি।”
লুইস ভুরু কুঁচকে ফেলে। এরকম একটা খারাপ সংবাদ শোনার পরও সে রাচেলের প্রতিক্রিয়ায় বিরক্ত না হয়ে পারে না। রাচেল কোনভাবেই মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না অথবা নিতেই চায় না। তার মনে মৃত্যু এমন একটা ভয়ঙ্কর সিক্রেট যেটা বাচ্চাদের কোনভাবেই জানতে দেয়া যাবে না। বড়রা যেভাবে বাচ্চাদের কাছে ‘সেক্স’ নিয়ে লুকোচুরি করে, রাচেল মনে করে, বাচ্চাদের সাথে মৃত্যুর ব্যাপারেও একই রকম লুকাছাপা করতে হবে।
“ওহ খোদা,” লুইস বলে। “হার্ট অ্যাটাক?”
“আমি ঠিক জানি না,” রাচেল বলে। তার কান্না থেমে গেলেও সে এখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কথা বলছে। “তুমি আসতে পারবে, লুইস? তুমি ওনার বন্ধু আর আমার মনে হয় এখন তোমার তার পাশে থাকা উচিত।”
তুমি ওনার বন্ধু।
আসলেই, আমি উনার বন্ধু, লুইস একটু অবাক হয়ে ভাবে। আমি কখনো চিন্তাই করিনি আমার একজন আশি বছরের দোস্ত থাকবে, কিন্তু বাস্তবতা সেটাই। আর তাদের সম্পর্কের কথা চিন্তা করে সে ভাবে তাদের মাঝে বন্ধুত্ব হয়ে বেশ ভালই হয়েছে। আর এই কথাটা হয়তো জাড তার আগেই বুঝতে পেরেছিলেন তাই তিনি লুইসের প্রয়োজনে তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মরা ইঁদুর, মরা কাক বা বিশ্রী গন্ধ, যাই হোক, লুইস এখন মনে করে সেদিন রাতে জাডের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। আর সেটা ভুল হলেও জাড সেটা করেছিলেন তার দায়িত্ববোধ থেকেই। এখন জাডের প্রয়োজনে তার যতটুকু করা সম্ভব সে করবে, আর তার জন্যে যদি তার নরমার ফিউনারেলে জাডের বেস্টম্যান হতে হয় তাতেও তার কোন আপত্তি নেই।
“আমি এক্ষুনি আসছি,” লুইস বলেই ফোন রেখে দেয়।
অধ্যায় ৩২
নরমার হার্ট অ্যাটাক হয়নি। তিনি স্ট্রোক করে মারা গেছেন। ব্যাপারটা ঘটে গেছে খুব দ্রুত আর সম্ভবত কম কষ্টদায়কভাবেই। লুইসের কাছ থেকে স্টিভ মাস্টারটন ব্যাপারটা শুনে বলে, নরমার বয়েসি একজনের জন্যে এভাবে মরে যাওয়া খারাপ কিছু না।
রাচেল লুইসের সাথে এই ব্যাপারে কোন কথা বলতে চাইছে না এবং সে লুইসকেও এই ব্যাপারে তাকে কিছু বলতে দিচ্ছে না।
এলি কিছুটা আপসেট হলেও তার চাইতে বেশি অবাক আর কৌতূহলী হয়ে উঠেছে। লুইসের মতে এটা ছয় বছরের বাচ্চার প্রতিক্রিয়া হিসেবে ঠিকই আছে। এলি তার কাছে জানতে চেয়েছে নরমা মারা যাওয়ার সময় তার চোখ খোলা ছিল না কি বন্ধ ছিল। লুইস বলেছিল সে তা জানে না।
জাডকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি তার মন বেশ শক্ত রেখেছেন এই বিবেচনায় যে তার ষাট বছরেরও বেশি সময়ের বিছানার সঙ্গি আর নেই। আজ তাকে দেখে একজন প্রকৃত তিরাশি বছর বয়সি বৃদ্ধ বলেই মনে হচ্ছে। তিনি কিচেনের টেবিলে বসে আছেন, তার এক হাতে একটি সিগারেট আর সামনে একটি বিয়ারের বোতল। তিনি শূন্য দৃষ্টিতে লিভিং রুমের দিকে তাকিয়ে আছেন।
লুইসকে দেখে তিনি বললেন, “ও চলে গেছে, লুইস।” তিনি সেটা এমনভাবে বললেন যেন এই ব্যাপারে হয়তো এখনো কোন সন্দেহ আছে। এরপরেই তার ঠোট কাঁপতে থাকে আর তিনি তার এক বাহু দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে ফেলেন। লুইস এগিয়ে গিয়ে তার কাঁধে নিজের এক হাত রেখে তাকে সমবেদনা জানায়। জাড এবার কাঁদতে শুরু করেন।
“কাঁদুন একটু,” লুইস বলে। “মনটা হালকা হবে। আর নরমা যদি জানতে পারে যে আপনি কাঁদেননি, তাহলেই হয়তো রাগ করে বসতে পারেন।” লুইসের নিজের চোখেও পানি চলে আসে। জাড তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে লুইসও তাকে জড়িয়ে ধরে।
জাড মিনিট দশেকের মত কাঁদলেন। এরপর কান্না থামিয়ে তিনি নরমার কথা বলতে লাগলেন। লুইস জাডের কথা খুব মনোযোগ দিয়ে শুনে, একজন বন্ধু এবং একই সাথে একজন ডাক্তার হিসেবে। সে খেয়াল করলো যে জাড এখনো নরমার কথাগুলো বর্তমান কাল হিসেবে বলছেন। তবে সব শুনে লুইসের মনে হয় না জাড নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছেন বা ওরকম কিছু। লুইস জানে বুড়ো কাপলদের জন্যে একই সাথে-এক মাসের ব্যবধানে, সপ্তাহের ব্যবধানে এমন কি একই দিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া বিরল কিছু না। অনেকেই এই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেন না বা আগে চলে যাওয়া সঙ্গির পেছনে না পড়ে যাওয়ার জন্যে দেরি করতে চান না। লুইস ভাবে, জাড মারাত্নক শোকে থাকলেও তার নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে। নিউ ইয়ার ইভের রাতে নরমার গায়ে যেন মরনের ছায়া দেখতে পাচ্ছিল লুইস, জাডের ব্যাপারে তার এরকম কিছুই মনে হচ্ছে না।
জাড উঠে ফ্রিজ থেকে লুইসের জন্যে একটা বিয়ার এনে দেয়, তার চেহারা এখনো কাঁদার কারণে লাল হয়ে আছে।
“বিয়ারের জন্যে একটু সকাল সকাল হয়ে গেল,” তিনি লুইসের দিকে বোতলটা বাড়িয়ে দিয়ে বলেন। “তবে পৃথিবীর কোথাও না কোথাও রাত নেমে গেছে। আর এই অবস্থায়…”
“আর বলতে হবে না,” বলে লুইস বোতলটা নিয়ে ছিপি খুলে। এরপর সে জাডের দিকে তাকিয়ে বলে, “আমরা কি নরমার স্মৃতিতে পান করবো?”
“তা না করে উপায় কী?” জাড বলেন। “তুমি যদি নরমাকে ষোল বছর বয়সে দেখতে…তোমার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতো। ও বললে স্বয়ং ইবলিশও মদ খাওয়া ছেড়ে দিত। ভাগ্য ভালো যে ও আমাকে কখনোই তা করতে বলেনি।”
লুইস মাথা ঝাঁকায় এবং তার বিয়ার উঁচু করে বলে, “নরমার স্মৃতিতে, “ জাড তার নিজের বোতল লুইসের বোতলের সাথে আলতো করে টোকা দেয়। তার চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়লেও তিনি হাসছেন। “সে যেখানে গিয়েছে আশা করি সেখানে কোন বাতের ব্যথা নেই।”
“আমেন,” লুইস বলে এবং তারা একই সাথে পান করে।
লুইস এই প্রথমবারের মত জাডকে হালকা থেকে একটু বেশি মাতাল হতে দেখলো কিন্তু এই অবস্থায়ও তিনি পুরো সজ্ঞানে আছেন। তিনি পূর্বের নানান স্মৃতি আর মজার মজার কাহিনি স্মরণ করলেন। আর তার মাঝে মাঝে তিনি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েও যা বলছেন তাতে লুইস অবাক না হয়ে পারে না। রাচেল যদি কোনদিন সকালে সিরিয়াল আর আঙুর দিয়ে নাস্তা করে হঠাৎ করে মরে যায়, তাহলে সে হয়তো জাড যেমন আছেন তার অর্ধেক স্বাভাবিক ও থাকতে পারবে না।
জাড ব্রুকিং-স্মিথ সৎকার কোম্পানির অফিসে ফোন দিয়ে ফোনে যতটুকু ব্যবস্থা করা যায় তা করলেন। তিনি একে একে ফোনে নানান প্রশ্নের জবাব দিয়ে গেলেন। হ্যা, তিনি চান তার স্ত্রীকে সুগন্ধি দেয়া হবে; হ্যা, তিনি চান নরমাকে যেন তার দেয়া জামা পরানো হয়; না, তিনি চান না মরচুয়ারি থেকে ফিতাওয়ালা কোন জুতো ব্যবহার করা হোক। ওর চুল ধুয়ে দেয়ার মত কেউ আছে? তিনি জিজ্ঞেস করেন। নরমা গত সোমবার শেষ চুল ধুয়েছিলেন, তাই তার চুল ধোয়া প্রয়োজন। লুইস এই প্রশ্নের উত্তর জানতো, কারণ তার চাচা এই কারবারে ছিল। উত্তরটা হলো এই ফিউনারেল সার্ভিসের অংশ হিসেবে নরমাকে এমনিতেই গোসল দেয়া হবে। জাড ফোনে উত্তর শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে ধন্যবাদ বলে আবারো শুনতে লাগলেন। হ্যা, তিনি চান তার স্ত্রীর মৃতদেহ কসমেটিকস দিয়ে সাজানো হোক কিন্তু তিনি চান খুব হালকাভাবে তার স্ত্রীকে সাজানো হোক, কারণ সবাই এমনিতেই জানবে তিনি মৃত। আরো কথা হলো ফিউনারেলের দিন কফিনের ডালা বন্ধ থাকলেও আগের দিন ভিজিটিং আওয়ারে কফিনের ডালা খোলা থাকবে সবার দেখার জন্যে। তাকে কবর দেয়া হবে মাউন্ট হোপ সেমেটারিতে যেখানে তিনি ১৯৫১’তে কবরের জন্যে প্লট কিনে রেখেছেন। তিনি হাতে জমির কাগজটা নিয়ে ফোনে বললেন যে কবরের প্লট নাম্বার হচ্ছে ঐ-১০১। আর তিনি পরে লুইসকে বলেন যে তার নিজের জন্যে বরাদ্দ আছে প্লট নাম্বার ঐ-১০২।
তিনি ফোন রেখে লুইসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমার দেখা সবচাইতে সুন্দর সেমেটারি আমাদের ব্যাঙ্গোরের সেমেটারিটাই। আরেকটা বিয়ার নাও, এসব ঝামেলা শেষ করতে আরেকটু সময় লাগবে।”
লুইস না করতে যাচ্ছিল, তার এর মধ্যেই সামান্য মাতাল মাতাল লাগছে। কিন্তু হঠাৎ করেই তার চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো; জাড নরমাকে একটা চাদরে পেচিয়ে জঙ্গলের ভেতরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, মিকমেকদের গোরস্থানটার দিকে।
দৃশ্যটা কল্পনা হলেও সেটা লুইসকে বেশ আঘাত করে, সে আর কোন কথা না বলে ফ্রিজ থেকে আরেকটা বিয়ার আনতে উঠে যায়। জাড তার দিকে নড করে আবার ফোন ডায়াল করতে থাকেন। সেদিন দুপুরে লুইস নিজের বাসায় লাঞ্চ করতে ফিরে যাওয়ার আগেই জাড ক্র্যান্ডাল তার স্ত্রীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতার অনেকটাই ঠিকঠাক করে ফেলেন। তিনি এতো দৃঢ়তার সাথে সব ব্যবস্থা করলেন দেখে তার প্রতি লুইসের সম্মান আরো বেড়ে যায়। এরপর তিনি একটা পুরনো ফোনবুক বের করে খুঁজে খুঁজে নরমার এবং তার নিজের জীবিত আত্মীয়দের ফোন করে সবকিছু জানান। আর ফোনের মাঝখানে মাঝখানে তিনি লুইসের সাথে পুরনো নানান ঘটনার স্মৃতি রোমন্থন করেন।
সব মিলিয়ে বৃদ্ধের প্রতি লুইস গভীর শ্রদ্ধা অনুভব করে।… আর ভালোবাসাও।
হ্যা, তার মন বলল, সে বুড়োকে ভালোবাসে।
এলি সেদিন রাতে চুমু খেতে নেমে এসে লুইসকে জিজ্ঞেস করলো মিসেস ক্র্যান্ডাল বেহেস্তে যাবেন কি না। এলি ফিসফিসিয়ে প্রশ্নটা করে, যেন ও বুঝতে পারছে ওদের কথা আর কেউ না শুনলেই ভালো হবে। রাচেল তখন আগামীকাল জাডের বাসায় নিয়ে যাওয়ার জন্যে কিচেনে চিকেন পাই রান্নায় ব্যস্ত।
রাস্তার ওপারে জাড ক্র্যান্ডালের বাড়ির সবগুলো বাতি জ্বলছে। তার বাড়ির সামনের রাস্তায় দুদিকেই প্রায় একশো ফিট জায়গা নিয়ে অনেকগুলো গাড়ি দাঁড় করানো। যদিও অফিসিয়াল ভিজিটিং আওয়ার আগামীকাল, তবুও অনেকেই আজই জাড ক্র্যান্ডালকে সমবেদনা জানাতে এবং নরমার অন্তহীন যাত্রাকে শুভকামনা জানাতে এসেছেন। দুই বাড়ির মাঝখান দিয়ে খুব ঠান্ডা হাওয়া বয়ে চলছে। রাস্তাতে কালো বরফ জমেছে। মেইনের সবচাইতে ঠান্ডা আবহাওয়া তাদের ওপর চেপে বসেছে।
“আসলে আমি ঠিক জানি না মামনি,” লুইস এলিকে তার কোলে বসিয়ে বলে। টিভিতে একটা গোলাগুলির দৃশ্য চলছে। একজন মানুষ হঠাৎ ঘুরে গিয়ে মাটিতে পরে গেলেন। লুইস অস্বস্তি নিয়ে ভাবে এলি হয়তো যিশু, মুসা অথবা সেইন্ট পলের চাইতে রোনাল্ড ম্যাকডোনাল্ড, স্পাইডারম্যান আর বার্গার কিং সম্পর্কেই বেশি জানে। তার কারণ এলির মা একজন ইহুদি, যে নিজের ধর্ম একদমই চর্চা করে না; আর তার বাবা এককালে মেথডিস্ট হলেও এখন নির্দিষ্ট কিছুতেই বিশ্বাস করে না। এলির বয়স ছয় হলেও লুইসের মনে হয় এসব জিনিস তাকে আরো অনেক আগেই তাদের বলা উচিত ছিল।
কিন্তু এলি তার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যে তার কিছু না বললেই নয়। “মরার পর মানুষের কি হয় তা একেক জন একেক রকম বিশ্বাস করে, মামনি,” লুইস বলে। “কেউ ভাবে মানুষ মরে যাওয়ার পর হয় বেহেস্তে যায় অথবা নরকে যায়। আবার কেউ বিশ্বাস করে মানুষ মরে গেলে আবার ছোট বাচ্চা হয়ে-”
“ওহ, পুনর্জন্ম। অড্রি রোজ মুভিতে এমন হয়।
“তুমি তো ওই মুভি দেখোনি!” রাচেল যদি জানতে পারে এলি অড্রি রোজ দেখেছে তাহলে ওর স্ট্রোক হয়ে যাবে, লুইস ভাবে।
“স্কুলে মেরি আমাকে বলেছে,” এলি বলে। মেরি এলির স্বঘোষিত বেস্ট ফ্রেন্ড। মেয়েটা দেখতে খুবই রোগা পাতলা আর নোংরা; ওকে দেখলে মনে হয় ওর কিছুদিনের মধ্যেই কুষ্ঠ হবে অথবা পেট ফেটে কৃমি বেরিয়ে আসবে। লুইস আর রাচেল দুজনেই তাদের মেয়ের এই বন্ধুত্বে উৎসাহ দেয় তবে সেদিন মেরি ওদের বাসা থেকে যাওয়ার পর রাচেল লুইসকে বলেছিল যে এই মেয়েটি যাওয়ার পর তার এলির মাথায় উকুন আছে কি না খুঁজে দেখতে মন খচখচ করে। কথাটা শুনে লুইস হেসে মাথা ঝাঁকিয়েছিল।
“মেরির মা ওকে সবকিছু দেখতে দেয়,” এলির কন্ঠে অভিযোগের একটা সুর আছে যেটা লুইস এড়িয়ে যায়।
“যাক, তাহলে তুমি পুনর্জন্ম কী তা জানো। খ্রিস্টানরা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর বেহেস্ত আর নরকে। তাছাড়া তারা লিম্বো আর পার্গেটরি নামক দুটো জায়গাতেও বিশ্বাস করে। আর হিন্দু এবং বৌদ্ধরা নির্ভানাতে।
কিচেনে রাচেলের ছায়া স্থির হয়ে আছে। সে সব কান পেতে শুনছে।
লুইস আরো ধীরে ধীরে বলতে থাকে।
“এরকম আরো অনেক কিছুর কথাই মানুষ বিশ্বাস করে। তবে তারা কেউই নিজের চোখে এসব দেখেনি। তারা তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে এসব জায়গার কথা না দেখেও বিশ্বাস করে। তুমি জানো তো ধর্মবিশ্বাস কি?”
“আচ্ছা…”
“এই যে আমরা চেয়ারে বসে আছি। আমরা যদি বলি এই চেয়ারটা কালও এখানেই থাকবে তাহলে এর মানে আমরা বিশ্বাস করি চেয়ারটা কালও এখানেই থাকবে, যদিও আমরা সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কিন্তু যেসব মানুষ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, তারা বিশ্বাস করে তাদের ঈশ্বর যা বলবেন তাই হতে বাধ্য; যদি ঈশ্বর বলেন এই চেয়ারটা আগামী একশো বছর ধরে এখানেই থাকবে, তাহলে ঐসব বিশ্বাসীরা তাই মেনে নিবে। তবে আমার কথা ধরো, আমি যেকোন একদল লোকের কথা বিশ্বাস করি না। হয় মৃত্যুর পরে আমাদের আত্মা বেঁচে থাকবে, তাহলে আসলে অনেক কিছুই হতে পারে। আর যদি
মৃত্যুর সাথে সাথে সব শেষ হয়ে যায়, তাহলে সেখানেই সমাপ্তি।” “একবারে ঘুমিয়ে যাওয়ার মত?”
লুইস কিছুক্ষণ ভেবে বলল, “হ্যাঁ, এরকম হতে পারে।”
“তুমি কিসে বিশ্বাস করো বাবা?”
দেয়ালের ছায়াটা নড়ে আবার স্থির হয়ে গেল।
লুইস তার মেডিকেলে পড়াশোনার সময় থেকেই বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পর আর কিছু নেই, মৃত্যুই সমাপ্তি। সে অনেককে মৃত্যুশয্যায় দেখেছে এবং তার চোখের সামনেই অনেককে শেষ নিশ্বাস নিতে দেখেছে। কিন্তু তার কখনই মনে হয়নি তার পাশ দিয়ে কোন আত্মা উড়ে গেছে বা তার গা ঘেষে চলে গেছে; কিন্তু ভিক্টর পাস্কোর বেলায় কি তার একদম সেই জিনিসটিই হয়নি? অনেকে মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ফিরে এসে বলে তারা নাকি নানান অদ্ভুত অদ্ভুত জিনিস দেখেছে। লুইসের সাইকোলজির শিক্ষক বলেছিলেন মানুষ মৃত্যুর কাছে চলে আসলে সে প্রচন্ড মানসিক স্ট্রেস থেকে এসব দেখে; লুইস তার শিক্ষকের সাথে একমত হয়েছিল। তাছাড়া তার এক হোস্টেলের বন্ধু বলেছিল যে এই যুগে বাইবেল অচল, কারণ এতে অলৌকিক ঘটনার ছড়াছড়ি; আর লুইস তার সাথেও একমত হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে লুইস অন্যদের যুক্তি মেনে নিয়ে সে কট্টর নাস্তিকতা থেকে এক ধাপ পিছিয়ে এসেছে। সে আর তার আরেক বন্ধু তাকে বলেছিল, “যিশু খৃষ্টের হাতে লেজারাসের বেঁচে ওঠা খুব অদ্ভুত। কিন্তু আমি আরো অদ্ভুত জিনিস দেখেছি। অনেক সময় মায়ের পেটে যখন জমজ বাচ্চা আসে, এক বাচ্চা আরেক বাচ্চাকে খুব ছোট থাকতেই গিলে ফেলে। আর সেই খেয়ে ফেলা ভাইকে হজম করলেও তার দাঁতগুলো সে হজম করতে পারে না। সেই দাঁতগুলো তার শরীরের নানান অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে গিয়ে জমা হয় আর তা হয়তো বিশ-ত্রিশ বছর পর এক্স-রেতে ধরা পড়ে। ধরা পড়ে যে সে তার নিজের ভাইকে মায়ের পেটে থাকতেই খেয়ে ফেলেছে। এই জিনিস আমি বিশ্বাস করতে পারলে পুনর্জন্মে বিশ্বাস করা কঠিন কিছু না।”
কিন্তু লুইস নিজে কখনই পুনর্জন্মে বিশ্বাস করতো না। অন্তত চার্চের ফিরে আসার আগে।
“মামনি, আমি বিশ্বাস করি মৃত্যুর পরও আমাদের আত্মা বেঁচে থাকে। তবে কিভাবে থাকে, কোথায় থাকে সেসব ব্যাপারে আমি কারো কথা বিশ্বাস করি না। এমন হতে পারে যে যেটা বিশ্বাস করে মৃত্যুর পর সে সেভাবেই থাকবে। তবে আমি বিশ্বাস করি আমাদের আত্মা বেঁচে থাকে আর মিসেস ক্র্যান্ডালও এমন জায়গায় আছেন যেখানে তিনি খুব ভাল আছেন।”
“তুমি তাহলে এটায় বিশ্বাস করো,” এলি বলল। এটা কোন প্রশ্ন ছিল না, তবে এলি এতে খুশি হয়েছে বোঝা গেল।
লুইস অপ্রস্তুত হয়ে মুচকি হেসে বলে, “আমি এটাও বিশ্বাস করি তোমার বিছানায় যাওয়ার সময় হয়ে গেছে, আরো প্রায় দশ মিনিট আগে।”
সে তার মেয়েকে চুমু খায়। একবার ঠোঁটে, একবার নাকে।
“বাবা, পশু পাখিদের আত্মাও কি মরার পর বেঁচে থাকে?”
“হ্যাঁ, থাকে,” আর কিছু চিন্তা না করেই সে প্রায় বলেই ফেলেছিল, বিশেষ করে বিড়ালরা। কথাগুলো তার ঠোঁটে চলে এসেছিল আর সে টের পেল তার শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছে।
“আচ্ছা,” এলি বলে বাবার কোল থেকে নেমে গেল। “আম্মুকে কিস করতে হবে।”
“আচ্ছা, যাও।”
লুইস তাকিয়ে তাকিয়ে ওর চলে যাওয়া দেখছে। ডাইনিং রুমের দরজার কাছে গিয়ে ও লুইসের দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, “সেদিন আমি চার্চ মরে যাবে ভেবে খুব গাধার মত কান্না করেছি তাই না বাবা?
“না মা, তুমি মোটেও গাধার মত কিছু করনি।”
“এখন যদি ও মারা যায়, আমি তাহলে মেনে নিতে পারবো,” ও বলে নিজের কথা শুনে নিজেই যেন একটু অবাক হয়ে গেল। তারপর সে আবার নিজের সাথেই একমত হয়ে বলে, “আমি পারবো, অবশ্যই পারবো।” বলেই ও রাচেলকে খুঁজতে চলে গেল।
***
সেদিন বিছানায় রাচেল বলে, “আমি এলির সাথে তোমার কথা শুনেছি।”
“তুমি কি এতে রাগ করেছো?” লুইস বলে। সে ঠিক করেছে এটা নিয়ে লুকোছাপা না করে সরাসরি কথা বলবে।
“না,” রাচেল ইতস্তত করে বলে। “না, লুইস, এরকম কিছু না। আমার এসব ব্যাপারে…ভয় লাগে। আর তুমি জানো আমি ভয় পেলে রক্ষণাত্মক হয়ে যাই।”
লুইস বুঝতে পারছে রাচেল নিজের সাথে প্রায় যুদ্ধ করে তার সাথে কথাগুলো বলছে। সে হঠাৎ করেই সাবধান হয়ে গেল; এলির সাথে যত সাবধানে বলেছে তার চাইতেও বেশি সাবধান। তার মনে হলো সে মাইন পোঁতা মাঠের মধ্যে দিয়ে হাঁটছে, একটু ভুল জায়গায় পা দিলেই সর্বনাশ।
“কিসের ভয়? মরে যাবার?”
“আমার নিজের মরে যাওয়া নিয়ে না,” সে উত্তর দেয়। “আমি নিজের মৃত্যু নিয়ে ভাবি না বললেই চলে। তবে ছোটবেলায় খুব ভয় পেতাম। রাতে ঘুমুতে পারতাম না ভয়ে। ঘুমের মধ্যে মনস্টার নিয়ে নানান স্বপ্ন দেখতাম আর সেই মনস্টারগুলো দেখতে হতো আমার বোন জেন্ডার মত।”
যাক! এতো দিন পর! আমাদের বিয়ের এতোদিন পর সে এই ব্যাপারে তার মুখ খুলছে।
“তুমি তোমার বোনের ব্যাপারে কখনই কিছু বলনি আমাকে,” সে বলে।
রাচেল হেসে লুইসের মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, “তুমি খুব ভালো লুইস। আমি ওর ব্যাপারে কখনই কথা বলি না। আমি ওকে একদম ভুলে থাকতে চেষ্টা করি।”
“আমি ধরে নিয়েছি এই নিয়ে কথা না বলার পেছনে নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে।”
“হ্যাঁ। আছে।”
“আমি এটুকু জানি যে সে স্পাইনাল মেনিনজাইটিসে মারা গেছে।”
“হ্যাঁ, স্পাইনাল মেনিনজাইটিসে।” রাচেল বলে। “আমাদের বাসায় ওর কোন ছবি রাখা হয় না।”
“তোমার বাবার স্টাডিতে একটা মেয়ের ছবি দেখেছি।”
“ও, হ্যাঁ। ওইটার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমার মাও হয়তো এখনো তার ওয়ালেটে জেল্ডার ছবি রাখেন। ও আমার চাইতে দুই বছরের বড় ছিল। ওর অসুখ হবার পর ওকে আমাদের পেছনের বেডরুমে রাখা হতো, অনেকটা নোংরা সিক্রেটের মত। ও পেছনের বেড রুমে পড়েই মৃত্যুর প্রহর গুনছিল, আর পুরো ব্যাপারটা ছিল একটা নোংরা সিক্রেট-ও সব সময়ই ছিল একটা নোংরা সিক্রেট!”
হঠাৎ রাচেল ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। তার বাড়ন্ত কান্না দেখে রাচেল হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে কি না ভেবে লুইস ভয় পায়। সে রাচেলের কাঁধে সান্ত্বনার হাত রাখলে রাচেল ঝটকা মেরে তার কাঁধ সরিয়ে নেয়।
“এমন করবে না,” রাচেল বলে। “আমাকে থামিও না লুইস। আমি আজ বলার মত শক্তি সঞ্চয় করেছি; আর এটা আমি একবারই বলবো, আর কখনো এটা নিয়ে কোন কথা আমি বলবো না। আর খুব সম্ভবত আজ রাতে আমার ঘুমও হবে না।”
“এতো খারাপ ছিল ব্যাপারটা?” লুইস প্রশ্নের উত্তর জেনেও জিজ্ঞেস করে। সে মৃত্যু নিয়ে রাচেলের অদ্ভুত আচরণের কারণটা এখন কিছু কিছু বুঝতে পারছে। তার হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে রাচেল কখনোই তার সাথে কোন ফিউনারেলে যায়নি। এমনকি এ্যাল লকের ফিউনারেলেও না—ছেলেটা লুইসের সাথে মেডিকেলে পড়তো এবং প্রায়ই তাদের বাসায় আসতো। সে বাসের সাথে মোটর সাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যায়। রাচেল তাকে বেশ পছন্দ করতো কিন্তু তার ফিউনারেলেও ও যায়নি।
ফিউনারেলের দিন হঠাৎ রাচেল অসুস্থ হয়ে পড়ে, লুইসের মনে পড়ে যায়। ফ্লু জাতীয় কিছু। দেখে বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছিল। কিন্তু পরের দিনই আবার ও ঠিক হয়ে গেল।
শেষকৃত্যের পর ও সুস্থ হয়ে গেল, লুইস নিজেকে সংশোধন করে নেয়। লুইস ওই সময়ও ভেবেছিল রাচেলের অসুস্থতা তার মানসিক চাপের কারণে হয়ে থাকতে পারে।
“তুমি কল্পনাও করতে পারবে না লুইস। ও আমাদের চোখের সামনে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু কারোই করার কিচ্ছু ছিল না। ও সব সময় ব্যথায় কাতর হয়ে থাকতো। ব্যথায় ওর শরীর কুঁকড়ে যেত,
কাঁধ উঁচু হয়ে মাথা নিচু হয়ে আসতো, আর ওকে দেখলে মনে হত ও কোন মাস্ক পরে আছে। ওর হাতগুলো পাখির হাতের মত হয়ে গেছিল শুকিয়ে। আমার মাঝে মাঝে ওকে খাইয়ে দেয়া লাগতো, ব্যাপারটা আমি ঘৃণা করলেও আমি কখনো তা নিয়ে কোন ঝামেলা করিনি। ওর ব্যথা যখন অনেক বেশি বেড়ে যায় ডাক্তাররা ওকে নানান রকম ড্রাগস দিতে শুরু করে; প্রথম দিকে কম পাওয়ারের দিলেও পরে হাই পাওয়ারের। ও যদি বেঁচে যেত তাহলে ওইসব হাই পাওয়ারের ড্রাগসে ও আসক্ত হয়ে পড়তো। কিন্তু সবাই জানতো যে ও বাঁচবে না…আর এজন্যেই ও আমাদের সবার মাঝে একটা সিক্রেট হয়ে ছিল। কারণ আমরা চাইতাম ও মরে যাক। লুইস আমরা মনে প্রাণে চাইতাম ও মারা যাক; এজন্যে না যে তাতে করে ওর যন্ত্রণার অবসান হবে। আমরা চাইতাম ও মরে যাক কারণ এতে করে আমরা বাকিরা যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাব…কারণ ও দেখতে দানবের মত হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন…আর ও মানসিক দিক দিয়েও দানব হয়ে যাচ্ছিল…ওহ খোদা, আমি জানি এটা শুনতে কেমন অমানবিক শোনাচ্ছে…”
রাচেল দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলে।
লুইস ওর গায়ে হাত রেখে বলে, “রাচেল, এটা একদমই অমানবিক শোনাচ্ছে না।”
“শোনাচ্ছে!” সে উচ্চস্বরে বলে। “আমি জানি এটা কেমন শোনাচ্ছে।”
এটা শুধু সত্যের মত শোনাচ্ছে,” সে বলে। “দীর্ঘ সময় ধরে জটিল রোগে ভোগা রোগিরা প্রায়ই খিটখিটে মেজাজের দানবে পরিণত হয়। লম্বা সময় ধরে রোগে ভোগা কেউ ফেরেশতার মত আচরণ করে গল্প উপন্যাসে, বাস্তবে না। বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে যখন তাদের পাছার চামড়া ঘা হয়ে যেতে শুরু করে তাদের অনেকেই নিজেদের মেজাজের ওপর নিয়ন্ত্রণ অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলে। তারা যে এটা ইচ্ছে করে করে তা না, কিন্তু এতে তার পাশের মানুষেরা ঠিকই কষ্ট পায়।”
রাচেল তার দিকে বিস্মিত হয়ে তাকায়, যেন ও আশার আলো খুঁজে পেয়েছে লুইসের কথায়। কিন্তু পরক্ষণেই ওর চেহারায় অবিশ্বাসের ছায়া পড়ে। “তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলছো।”
লুইস গম্ভীর হয়ে হাসে। “তোমাকে বই খুলে দেখালে তুমি বিশ্বাস করবে? তাছাড়া সুইসাইড পরিসংখ্যানের কথা চিন্তা কর। কোন পরিবারের জটিল রোগে ভোগা সদস্যকে বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করলে তার মৃত্যুর পরের ছয় মাসে সেই পরিবারের কারো সুইসাইডের সম্ভাবনা প্রায় আকাশ ছোঁয়া।”
“সুইসাইড!”
“হুম, কেউ ঘুমের ঔষধ খায়, কেউ গুলি করে নিজের মাথার ঘিলু বের করে দেয়, কেউ বা সিলিং ফ্যানে ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়ে। তারা মানসিকভাবে একদম বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের হতাশা…বেদনা…বিতৃষ্ণা…তারা মনে করে তারা খুন করেছে, তাই তারা পৃথিবীকে বিদায় জানায়।”
রাচেলের মুখ থেকে উদ্বেগের কালো ছায়া ধীরে ধীরে দূর হয়ে যায়। “ও খুব খিটখিটে হয়ে গিয়েছিল। ও যা বলতো তা না হলেই হুলুস্থুল করতো। আর আমি বুঝতে পারতাম ওর বুক ঘৃণায় ভরে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে ও ইচ্ছে করে বিছানায় পেশাব করে দিত। আমার মা ওকে জিজ্ঞেস করতেন ওকে বাথরুমে নিয়ে যাবেন কিনা; আর পরে যখন ও আর বাথরুমে যেতে পারতো না তখন বেড পেন এনে দিবেন কি না… ও বলতো লাগবে না…আর এরপর ও পেশাব করে বিছানা ভাসিয়ে দিত যাতে করে আমার অথবা আম্মুর বিছানা বদলানো লাগে…ও বলতো এটা ভুলে হয়ে গেছে…কিন্তু ওর মুখের মিটিমিটি হাসি দেখলেই তুমি বুঝতে পারবে ও ইচ্ছা করেই কাজটা করেছে…আমাদের কষ্ট দেয়ার জন্যে। রুমটা পেশাব আর ওর ওষুধের গন্ধে ভুরভুর করতো। আমি রাতে মাঝে মাঝে জেগে উঠলে…এখনো…আমার মনে হয় যে আমি জেল্ডার রুমের ওই ওষুধের গন্ধ পাচ্ছি…আর ভেবে উঠি ও কি এখনো…এখনো মরেনি?”
রাচেল থেমে দম নিতে থাকে। লুইস রাচেলের হাত ধরলে ও লুইসের আঙুলগুলো খুব শক্ত করে চেপে ধরে।
“আমরা যখন ওর গায়ের জামা চেঞ্জ করে দিতাম, আমরা দেখতে পেতাম ওর পিঠ কিভাবে কুচকে যাচ্ছিল। শেষের দিকে, লুইস…শেষের দিকে অবস্থা এতো খারাপ হয় যে ওর পাছার মাংস প্রায় ওর কোমরের ওপর চলে আসে।”
রাচেলের চোখে খুব ভয়ের একটা ছায়া পড়ে, যেন ও কোন ভয়ঙ্কর কিছু মনে করেছে।
“আর মাঝে মাঝে ও আমাকে ছুঁয়ে দিত…ওর পাখির থাবার মত হাতগুলো দিয়ে…আর মাঝে মাঝে আমি প্রায় চিৎকার করে উঠতাম আর ওকে বলতাম…বলতাম ও যেন এটা আর না করে…একবার আমি ওকে সুপ খাওয়ানোর সময় ও আমার মুখে হাত ছুঁইয়ে দেয় আর গরম স্যুপ পড়ে আমার হাত পুড়ে যায় আর সেবার আমি সত্যই আমার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠি…আমি কাঁদতে কাঁদতেই ওর মুখের মিটিমিটি হাসি দেখতে পাচ্ছিলাম।”
“একদম শেষের দিকে ওর ওষুধগুলো কাজ করা বন্ধ করে দেয়। তখন ও সবসময় চিৎকার করতে থাকতো ব্যথায়। ওর ওই অবস্থা দেখতে দেখতে ও আগে কেমন ছিল তা আমি একদম মনে করতে পারতাম না…আমাদের মাও পারতেন না। তখন ও একটা জিঘাংসাপূর্ণ, নোংরা, চিৎকার করতে থাকা জিনিসে পরিণত হয়… আমাদের নোংরা গোপনীয়তায়।”
রাচেল শব্দ করে ঢোক গিলে।
“আমার বাবা মা কেউ বাসায় ছিলেন না… যখন… মানে যখন ও…” রাচেল অনেক চেষ্টা করে কথাটা শেষ করে।
“যখন ও মারা যায়। তখন আমার বাবা মা কেউ বাসায় ছিলেন না, ওর সাথে শুধু আমি একা ছিলাম। ওই সময় ইহুদিদের পাস ওভারের সময় চলছিল তাই বাবা-মা তাদের কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবেন। আমি কিচেনে বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলাম…ম্যাগাজিনের পাতার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আর কি…আর অপেক্ষা করছিলাম কখন জেল্ডাকে আবার ঔষধ দেয়ার সময় হবে, কারণ ও ব্যথায় চিৎকার করছিল…বাবা-মা বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকেই ওর চিৎকার শুরু হয়। ওর চিৎকারে আমি পড়তে পারছিলাম না। আর এর পরেই…এর পরেই হঠাৎ করেই ওর চিৎকার একদম বন্ধ হয়ে যায়। লুইস আমার বয়স তখন আট। আমি প্রতি রাতে দুস্বপ্ন দেখতাম…আমি ভাবতাম জেন্ডা আমকে ঘৃণা করে কারণ আমার পিঠ ওর মত বেঁকে যায়নি, কারণ আমি সব সময় ব্যথায় চিৎকার করি না…কারণ আমি হাঁটতে পারি, কারণ আমি বেঁচে থাকবো…আমার এরকম ধারণা হতে শুরু করে যে জেন্ডা আমাকে খুন করতে চায়। তবে আজ রাতেও আমি বলবো, আমার ওরকম চিন্তার পুরোটাই আমার কল্পনা থেকে হয়নি। আমি জানি ও আমাকে ঘৃণা করতো। তবে আমি এটা ভাবি না যে ও আমাকে আসলেই খুন করতো, তবে আমি এটা বিশ্বাস করি, ওর যদি ক্ষমতা থাকতো, ও আমার শরীর থেকে আমাকে বের করে দিয়ে নিজে দখল করার রূপকথার মতো, তাহলে ও সেটা করতো। ওর চিৎকার বন্ধ হয়ে গেলে আমি দেখতে যাই সবকিছু ঠিক আছে কি না, ও বিছানা থেকে পড়ে গেছে কিনা…কিন্তু আমি সেখানে গিয়ে যা দেখি তাতে আমার মনে হয় ও ওর নিজের জিভ গিলে ফেলেছে আর ও দম বন্ধ হয়ে নিশ্বাস নেয়ার জন্যে হাসফাঁস করছে। লুইস”-রাচেলের গলার স্বর আবার উঁচু হয়ে আসে, বাচ্চাদের অভিমানে কাঁদার মত, যেন ও ওর চোখের সামনে সব দেখতে পাচ্ছে–“লুইস, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না যে আমি কী করবো! আমার বয়স তখন মাত্র আট!”
“ওই বয়সে তোমার কিছু বোঝার কথাও না,” লুইস বলে। সে রাচেলের কাছে এগিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। রাচেলও ওকে খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে, যেন ওর নৌকা ডুবে গেছে আর লুইস পানিতে ডুবতে থাকা অবস্থায় বাঁচাতে এসেছে। “তোমাকে এজন্যে কি কেউ কিছু বলেছিল?… বকেছিল তোমাকে?”
“না,” সে বলে, “কেউ আমাকে দোষ দেয়নি। কিন্তু যা হয়েছিল তা তো কেউ বদলে দিতে পারেনি। ও আসলে নিজের জিভ গিলে ফেলেনি। ও একটা অদ্ভুত শব্দ করতে থাকে… আমার ঠিক মনে নেই-গাআআআ-এরকম কিছু একটা—”
রাচেলের গাআআআ শব্দ শুনে লুইসের ভিক্টর পাস্কোর কথা মনে পড়ে গেল। ও আরো শক্ত করে রাচেলকে জড়িয়ে ধরে।
“-আর ওর গাল দিয়ে থুতু গড়িয়ে পরছিল-”
“রাচেল, থাক। আর বলা লাগবে না,” লুইস বলে। তার নিজের গলাও আর স্বাভাবিক নেই।
“আমি বলতে চাই,” রাচেল জেদী গলায় বলে। “আমি ব্যাখ্যা দিচ্ছি কেন আমি নরমার ফিউনারেলে যেতে পারবো না, প্রথমত। আর দ্বিতীয়ত কেন আমি সেদিন তোমার সাথে আহাম্মকের মত ঝগড়া করলাম-”
“আমি সেদিনের কথা ভুলে গেছি, বাদ দাও।”
“আমি ভুলিনি। আমার মনে আছে লুইস, যেমন আমার মনে আছে কিভাবে আমার বোন জেল্ডা দম বন্ধ হয়ে মারা যায়, ১৯৬৫ সালের ১৪ এপ্রিলে।”
এরপর বেশ কিছুক্ষণ ওরা চুপ করে থাকে। রুমে নীরবতা নেমে আসে।
“আমি ওকে ওর পেটের ওপর শুইয়ে দিয়ে ওর পিঠে হাত দিয়ে দুম-দাম করে মারতে থাকি,” রাচেল অবশেষে নীরবতা ভেঙে বলে। “এটা ছাড়া আর কিছু করার কথা আমার আট বছর বয়সী ব্রেনে আসেনি। ও ওর পাগুলো দিয়ে বিছানায় ক্রমাগত লাথি মারছিল…আমার মনে আছে তখন একটা পাদের মত শব্দ হয়েছিল…আমি ভেবেছিলাম ও পাদ দিয়েছে বা আমি…কিন্তু আসলে ওটা ওকে উল্টো করে শোয়ানোর সময় আমার জামার বগলের সেলাই ছিড়ে যাওয়ার শব্দ ছিল…এরপর…এরপর ওর খিচুনি শুরু হয়…আমি খেয়াল করলাম ওর মুখ বালিশের ওপর পরে আরো দম বন্ধ হয়ে গেছে…আমি ভয় পেলাম সবাই বাসায় এসে বলবে আমি জেন্ডাকে বালিশে মুখে চেপে মেরে ফেলেছি…ওরা বলবে আমি ওকে ঘৃণা করতাম, যেটা সত্য…ওরা বলবে আমি চাইতাম ও মরে যাক, এটাও সত্য। জানো লুইস? ওর শরীরে যখন ভয়ঙ্করভাবে খিচুনি শুরু হয় আমার মনে প্রথম যে কথাটা এসেছিল সেটা হচ্ছে, ওহ! এবার তাহলে জেন্ডা মরবে আর আমাদের কষ্টের অবসান হবে। আমি ওকে আবার উল্টিয়ে আগের মত শুইয়ে দিলাম। লুইস, ওর মুখ একদম কালো হয়ে গিয়েছিল…ওর চোখগুলো বেরিয়ে আসছিল আর গলা একদম ফুলে গিয়েছিল। এর পরপরই ও মারা যায়। আমি খাটের কাছ থেকে পিছিয়ে যাই। আমি রুমের বাইরে যেতে চাচ্ছিলাম কিন্তু আমি দেয়ালে ধাক্কা খাই আর তাতে দেয়ালে টাঙ্গানো একটা ফ্রেমে বাধানো ছবি ফ্লোরে পড়ে যায়—ছবিটা ছিল ওজ, মহান এবং ভয়ঙ্কর-এর। ওর অসুখের আগে ও ওজের গল্পগুলো খুব পছন্দ করতো আর তাই ও অসুস্থ হবার পর আমার মা তারই একটা ছবি বাঁধাই করে এই রুমে টাঙ্গিয়ে দিয়েছিলেন। ছবির ফ্রেমটা নিচে পড়ে খুব জোরে শব্দ করে ভেঙে যায় আর আমি চিৎকার করতে শুরু করি…আমি চিৎকার করি কারণ আমি জানতাম ও মারা গেছে আর ভেবেছিলাম যে ওর ভূত আমাকে ধরার জন্যে এসেছে… আর আমি জানতাম ও বেঁচে থাকতে আমাকে খুব ঘৃণা করতো আর ওর ভূতও যে আমার ক্ষতি করতে চাইবে তাতেও আমার মনে কোন সন্দেহ ছিল না। তাই আমি চিৎকার করতে থাকি…আমি চিৎকার করতে করতে বাসা থেকে বেরিয়ে সামনের রাস্তায় নেমে আসি…আমার চিৎকার শুনে আমাদের প্রতিবেশীরা বাইরে বেরিয়ে আসে…তারা আমাকে রাস্তায় হাতা ছেঁড়া জামা পড়ে চিৎকার করতে করতে ছুটতে দেখে। আমি চিৎকার করছিলাম জেন্ডা মরে গেছে! জেন্ডা মরে গেছে! আমার ধারণা তারা ভাবছিলেন আমি কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করছিলাম…কিন্তু লুইস জানো? আমার এখন মনে হয় আমি হাসতে হাসতে চিৎকার করছিলাম।”
“ পরিস্থিতির কারণে এমন হতেই পারে,” লুইস বলল।
“তুমি আমাকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যে বলছো লুইস, আমি জানি,” রাচেল এমনভাবে বলে যেন সে এই ব্যাপারে একদম নিশ্চিত। লুইস ভাবলো এটা নিয়ে আর ঘাটানো উচিত হবে না। সে ভাবে রাচেল হয়তো অবশেষে তার বিভীষিকাময় স্মৃতি থেকে মুক্তি পাবে, পুরো মুক্তি না পেলেও অনেকটাই হালকা হতে পারবে সে। তার বোনের অসুস্থতার সময় তার মানসিক অবস্থার জন্যে নিজেকে সে যেভাবে দোষী ভাবতো তা থেকে তার মুক্তি মিলবে হয়তো, কিন্তু শেষের এই ঘটনাটা মনে হয় না সে কখনই একদম ভুলতে পারবে। লুইস কোন সাইক্রিয়াটিস্ট না কিন্তু সে জানে মানুষের মনের গভীরে এমন অনেক ঘটনা, দুর্ঘটনা বাসা বেধে থাকে আর তারা মাঝে মাঝে মাথা চারা দিয়ে উঠে মানুষকে কষ্ট দেয়। রাচেল আজ তার মনের ভেতরের এমন অনেক জিনিস বের করে এনেছে, অনেকটা পচে যাওয়া দাঁত তোলার মত করে। সব বের করে আনলেও হয়তো মাঝে মাঝে তার স্বপ্নে সেসব স্মৃতি উঁকি দিয়ে যাবে। তারপরও লুইসের খুব ভালো লাগছে কারণ রাচেল আজ তার ভেতরের জমে থাকা অনেক বিষাক্ত স্মৃতি বের করতে পেরেছে।
সে বসে বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, আমি বুঝেই বলছি। তোমার অবস্থায় আট বছরের একটা মেয়ের জন্যে এমন আচরণ একদমই অস্বাভাবিক না। আর তোমার বাবা-মাকে আরো বেশি অপছন্দ করার মত আরেকটা কারণও আমি আজ পেয়ে গেলাম। ওই রকম অবস্থায় তোমার বোনের কাছে শুধু তোমাকে একা রেখে যাওয়া কোনভাবেই আমি মেনে নিতে পারছি না। কোনভাবেই না।”
রাচেল সেই ঘটনার সময় যেমন শিশু ছিল সেরকম শিশুর মত করেই বলল, “ওই সময় পাসওভারের সময় চলছিল লুইস-”
“পাসওভারের সময় চলুক আর বিশ্বযুদ্ধই হোক না কেন—” লুইস কর্কশভাবে কথাটা বললে রাচেল একটু সরে যায়। রাচেলের মুখটা দেখে লুইসের সেই পাস্কোর মৃত্যুর সকালের একজন নার্সের কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটা সেদিনের পর থেকে আর ইনফার্মারিতে আসেনি। লুইস এজন্যে তাকে কোন দোষও দেয় না।
জেন্ডার জন্যে নার্স রাখতে পারেনি তারা? ওই রকম পরিস্থিতিতে অবশ্যই একজন নার্স পাশে থাকা জরুরি। তাদের বাইরে বেড়াতে যেতে হবে, কিন্তু নার্স রাখবেন না। তার কী দরকার? তাদের তো একটা আট বছরের মেয়ে আছে। তাকেই তারা রেখে গেলেন তার মুমূর্ষু বোনকে দেখভাল করার জন্যে, যে কি না জটিল রোগে ভুগে ততদিনে প্রায় ক্লিনিক্যালি ইনসেনিটির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মিসেস গোল্ডম্যানের সেদিন তার মেয়ের পেশাবের গন্ধ একদম সহ্য হচ্ছিল না, তাই তিনি তার আট বছরের মেয়েকে মুমূর্ষু রোগির দায়িত্ব দিয়ে বাইরে হাওয়া খেতে গেলেন। এখন বুঝতে পারছি কেন তারা রাচেলকে প্রতি বছর ভার্মন্টে ছয় সপ্তাহের জন্যে ক্যাম্পিং করতে পাঠাতেন; তার মৃতপ্রায় বোনের দুর্গন্ধ ভোলার জন্যে নয় তো আর কিসের জন্যে? গেজের জন্যে দশ রকমের জামা, এলির জন্যে ছয়টা ড্রেস…আমার মেয়ের থেকে দূরে থাকো লুইস, তাহলে তোমার মেডিকেলে পড়ার সব খরচ আমি এক্ষুনি চেকে লিখে দিচ্ছি…তো ওই বালের চেক বই তখন কোথায় ছিল, যখন নার্সের অভাবে নিজের আট বছরের মেয়েকে মুমূর্ষু রোগির দেখভাল করতে দিয়ে গেছিলে, হারামজাদা?
লুইস বিছানা থেকে উঠে যায়।
“কোথায় যাচ্ছো তুমি?” রাচেল প্রায় আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“তোমার জন্যে একটা ভ্যালিয়াম আনতে।”
“তুমি জানো আমি এসব ঘুমের ওষুধ-”
“আজ রাতে তোমার একটা লাগবে,” সে বলে।
***
রাচেল ঔষধ খেয়ে লুইসকে বাকিটা বলে। বাকি সময়টা ওর গলা বেশ স্বাভাবিক ছিল; ঘুমের ঔষধে কাজ হয়েছে।
পাশের বাসার প্রতিবেশী রাচেলকে একটা গাছের পেছনে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখেন। ও “জেন্ডা মরে গেছে! জেন্ডা মরে গেছে!” বলে অনবরত চিৎকার করে যাচ্ছিল। রাচেলের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল। ওর গায়ের জামা রক্তে মাখামাখি হয়ে যায়। ঐ প্রতিবেশী রাচেলকে তার বাসার ভেতরে নিয়ে গিয়ে নাকের রক্তপাত বন্ধ করে অ্যাম্বুলেন্সের জন্যে খবর দেন। রাচেলকে অনেক্ষণ যাবত চেষ্টা করে শান্ত করার পর ও বলতে পারে ওর বা-মা কোথায় আছে। তারা ছিলেন শহরের আরেক মাথায় রাচেলের বাবার এক বন্ধুর বাসায়।
সেদিন সন্ধ্যার মধ্যেই গোল্ডম্যানদের বাসার অনেক পরিবর্তন ঘটে 1 জেন্ডা চিরতরে সেখান থেকে চলে গেছে। ওর রুমটাতে ধুয়ে মুছে সাফ করে সুগন্ধি ছিটিয়ে দেয়া হয়। রুমের সব আসবাব ফেলে দেয়া হয়। রুমটা একদম ফাঁকা করে ফেলা হয়। এরপর অনেক পরে ডরি গোল্ডম্যান ওই রুমটাকে তার সেলাইয়ের রুম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন।
সেদিন রাতেই রাচেল প্রথম দুঃস্বপ্ন দেখে। দুঃস্বপ্ন দেখে সে যখন মাঝরাতে চিৎকার করে তার মাকে ডাকতে থাকে সে আবিষ্কার করে সে বিছানা থেকে উঠতে পারছে না। তার পিঠে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করে সে। সে জেল্ডাকে নড়াতে গিয়ে পিঠে টান খেয়েছিল। ওই মুহূর্তের উত্তেজনার এড্রিনালিনের আধিক্যে সে তার ছোট্ট শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জেল্ডাকে নড়াতে গিয়ে নিজের জামার হাতার কাপড় ছিঁড়ে ফেলে।
জেল্ডাকে দম বন্ধ হওয়া থেকে বাঁচাতে গিয়ে রাচেল তার পিঠে চোট খেয়েছে; বড়ই মহৎ কাজ। সবাই তাই ভাবলেও রাচেল নিজে অন্যকিছু ভাবছিল। তার বিশ্বাস ছিল তার পিঠের ব্যথা কবরবাসী জেন্ডার প্রতিশোধ। জেল্ডা জানতো যে সে মরে যাওয়ায় রাচেল খুশি হয়েছে। ও আরো জানতো যে রাচেল যখন “জেন্ডা মরে গেছে! জেন্ডা মরে গেছে!” চিৎকার করতে করতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সে আসলে কাঁদছিল না, সে হাসছিল। জেল্ডা জানতো রাচেল তাকে খুন করেছে তাই সে রাচেলকে তার মেনিনজাইটিস রোগ দিয়ে গিয়েছে; আর খুব শীঘ্রই রাচেলের পিঠও জেল্ডার মত বাঁকা হয়ে যাবে আর ধীরে ধীরে সেও জেল্ডার মত মনস্টারে পরিণত হবে, ওর হাতও পাখির থাবার মত হয়ে যাবে। আর আরো কিছুদিন পর সেও জেন্ডার মত ব্যথায় চিৎকার করতে থাকবে। সেও বিছানা ভিজাতে শুরু করবে, আর শেষে নিজের জিভ গিলে ফেলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবে।
রাচেলের এই বিশ্বাস কেউ দূর করতে পারে না; না তার বাবা-মা, না ডাঃ মুরায়, যিনি রাচেলের পিঠের মাংসপেশিতে টান লাগা ছাড়া আর কিছুই হয়নি বলে ঘোষনা দেন। এরপর তিনি খুব কঠিন গলায় ( লুইসের ধারনা খুব নির্দয়ের মত) রাচেলকে বলেন তার এইসব নাটক বন্ধ করতে। তার বাব-মা এমনিতেই তার বোনের মৃত্যুতে প্রচন্ড শোকে আছে। তাদের মনোযোগ পাওয়ার জন্যে তার এই শিশুতোষ নাটক সেই মুহূর্তেই বন্ধ করতে বলেন তিনি। অবশেষে যখন ওর পিঠের ব্যথা কমে গেল রাচেল তার বিশ্বাস পরিবর্তন করতে পারলো। পরের কয়েক মাস ( লুইসের ধারনা কয়েক বছর ) ধরে রাচেল তার বোনের মৃত্যুর দৃশ্য দুঃস্বপ্নে দেখে রাতে চিৎকার করতে করতে জেগে উঠতো। উঠেই সে সাথে সাথে তার পিঠে হাত দিয়ে দেখতো সেটা বাঁকা হয়ে গিয়েছে কি না। আর এসব স্বপ্ন দেখার পর তার মনে হতো তখনি তার রুমের ক্লজেটের দরজা ধাম করে খুলে যাবে আর সেখান থেকে জেল্ডা বেরিয়ে আসবে; তার নীল মুখ আর দুমড়ানো-মুচড়ানো দেহ নিয়ে, তার চোখগুলো একদম সাদা আর কাকের থাবায় পরিণত হয়ে যাওয়া হাতগুলো নিয়ে…তাকে খুন করতে, প্রতিশোধ নিতে।
সেই থেকে জেল্ডার বা অন্য কারোর শেষকৃত্যে যায়নি রাচেল।
“তুমি এসব আমাকে যদি আগে বলতে,” লুইস বলে, “তাহলে আমার অনেক কিছু বুঝতেই বেশ সুবিধা হতো।”
“লুইস আমি পারিনি,” রাচেল বলে, “আমি ছোট থেকেই এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে সামান্য ভয় পাই।”
সামান্য ভয় পাও, লুইস ভাবে, ভালোই বলেছো।
“আমি নিজেকে বোঝাতে পারি না…আমি জানি যে তুমি যখন বলো মৃত্যু একদম স্বাভাবিক একটা ঘটনা, তুমি ঠিকই বলো। কিন্তু শুধু আমি জানি কী চলে…আমার মনের ভেতর…”
“হুম,” লুইস বলে।
“সেদিন যখন এলিকে মৃত্যুর ব্যাপারে বলার জন্যে তোমার সাথে ঝগড়া করেছিলাম…আমি বুঝতে পারছিলাম যে তুমি ভুল কিছু করনি, কিন্তু আমি নিজের ওপর একদম নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছিলাম…আমি সরি, লুইস।”
“সরি বলার কিছু নেই,” সে রাচেলের চুলে বিলি কেটে বলে। “আমার এখন একটু হালকা লাগছে…মনে হচ্ছে আমি আমার দেহ থেকে বিষাক্ত কোন অংশ কেটে বাদ দিয়েছি।”
“হয়তো তুমি তাই করেছো এইমাত্র, বেবি।”
রাচেলের চোখ ঘুমে লেগে আসে এবং সে আবার চোখ খুলে।
ধীরে ধীরে সে বলে, “এজন্যে আমার বাবা-মাকে তুমি প্লিজ দোষী করো না। তাদের জন্যে ওই সময়টা খুব খারাপ গিয়েছে। জেন্ডার চিকিৎসার খরচ টানতে টানতে আমার বাবার প্রায় দেউলিয়া হবার অবস্থা হয়েছিল। আমার মাও আধ-পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু জানো, জেন্ডার মৃত্যুর পর আবার সব ঠিকঠাক হয়ে যায়। যেন জেল্ডার মৃত্যু আমাদের কপাল খুলে যাওয়ার জন্যে সংকেত ছিল। আমার বাবা বড় একটা লোন পেয়ে যান ব্যবসা বড় করার জন্যে। আর এরপর তাকে আর কখনো পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আর আমার মনে হয় তারা আমার ব্যাপারে এতো বেশি সাবধানী, কারণ আমি ছাড়া তাদের আর কেউ নেই—”
“এটা তাদের অনুশোচনা,” লুইস বলে।
“হতে পারে। আর আমি যদি নরমার ফিউনারেলের দিন অসুস্থ হয়ে পড়ি তাহলে প্লিজ আমার ওপর রাগ করো না তুমি।”
“আমি রাগ করবো না, বউ।” সে বলে চুপ করে যায়। এরপর সে রাচেলের হাত ধরে জিজ্ঞেস করে, “আমি এলিকে নিয়ে যেতে পারি?”
রাচেলের হাত তার হাতের মধ্যে শক্ত হয়ে যায়।” ওহ, লুইস, আমি জানি না,” সে বলে। “ও এখনো অনেক ছোট আর-
“রাচেল, মানুষ কিভাবে পৃথিবীতে আসে সেটা এলি আরো এক বছর আগে থেকেই জানে।” সে তাকে আবারো মনে করিয়ে দেয়।
রাচেল বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এরপর সে সিলিং-এর দিকে ঠোট চেপে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলে, “তোমার যদি ভালো মনে হয়…তোমার যদি মনে হয় ওর কোন ক্ষতি হবে না তাহলে-‘
“এদিকে এসো, রাচেল,” সে রাচেলকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আর মাঝরাতে যখন ঘুমের ওষুধের প্রভাব কেটে গেলে রাচেল দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে উঠে, লুইস তার গায়ে হাত বুলিয়ে দেয় আর কানে কানে বলে সব ঠিক আছে। রাচেল আবারো ঘুমিয়ে পড়ে।
অধ্যায় ৩৩
এলি নরমার ফিউনারেলে একটা সুন্দর নেভিব্লু জামা পড়ে এসেছে। নতুন কেনা জামাতে তাকে ছোট্ট পরীর মত লাগছে। এলি আগেও কয়েকবার চার্চে গিয়েছে তবে এই প্রথম কোন ফিউনারেলে এসেছে। ও একদম চুপচাপ হয়ে লুইসের পাশে বসে আছে। যখন জাড তার সাথে কথা বলতে আসে তখনো ও কিছু বলেনি। জাড আজ ব্ল্যাক সুট আর পালিশ করা শু পড়ে এসেছেন। লুইস তাকে আগে কখনো এরকম মার্জিত পোষাকে দেখেনি। তিনি এলির কাছে এসে নিচু হয়ে ওকে চুমু খেয়ে বলেন, “তুমি আসায় খুব খুশি হয়েছি আমি। আমার বিশ্বাস নরমাও খুব খুশি হয়েছে।”
এলি শুধু তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে ছিল।
চার্চের মেথডিস্ট মিনিস্টার বাইবেল পড়া শেষ করে সবার জন্যে ঈশ্বরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এরপর বললেন, “কফিন বহনকারীরা এগিয়ে আসুন।”
লুইস তার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ালে এলি খুব শক্ত করে তার হাত টেনে ধরে। তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। “বাবা!” ও ফিসফিস করে বলে। “কোথায় যাচ্ছো?”
“মা, আমি নরমার কফিন বহনকারীদের একজন,” লুইস আবার তার জায়গায় বসে বলে। সে এলির কাঁধে হাত রেখে বলে, “তার মানে আমি নরমার কফিন বয়ে নিতে সাহায্য করবো। বেশি সময় লাগবে না আমার, মামনি।”
“আমি তোমাকে যদি খুঁজে না পাই?”
লুইস সামনে তাকিয়ে দেখলো বাকি তিনজন কফিন বহনকারী এর মধ্যেই সামনে কফিনের কাছে চলে গিয়েছে। বাকি লোকজন চার্চ থেকে বের হচ্ছে, অনেকেই কাঁদছে
“আমি তোমাকে চার্চের সামনের সিঁড়িতে খুঁজে নেব। তুমে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকো, মামনি। ঠিক আছে?”
“আচ্ছা। শুধু আমার কথা ভুলে যেও না।”
“ভুলবো না।”
সে উঠে দাঁড়ালে এলি আবার তার হাত টেনে ধরে।
“বাবা?”
“কী, মামনি?”
ওনাকে সাবধানে নিয়ে যেও, ফেলে দিও না।” এলি ফিসফিস করে বলে।
লুইস সামনে গিয়ে বাকিদের সাথে যোগ দেয়। তাদের মধ্যে একজন নরমার ভাই আর দুইজন জাডের দূরবর্তী আত্মীয়। ফ্যামিলি সার্কেলের মধ্যে একজন বাইরের মানুষ হয়ে লুইসের একটু অস্বস্তি লাগছে।
“আপনাদের সাথে দেখা হয়ে ভালো হলো,” লুইস তাদের বললে তারা নড করে।
“এলি ঠিক আছে?” জাড এলিকে নড করে লুইসকে জিজ্ঞেস করে। ও দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছে।
একদম-তবে ও ভয় পাচ্ছে আমি না হাওয়ায় মিলিয়ে যাই, সে ভাবে।
“আছে মনে হয়,” লুইস বলে তার একহাত এলিকে উদ্দেশ্য করে নাড়ে, এলিও জবাবে নিজের হাত নাড়ে। এরপর সে তার নেভিব্লু ড্রেস দোলাতে দোলাতে বাইরে চলে যায়। ওই মুহূর্তে এলিকে লুইসের একদম বড় মানুষের মত মনে হয়।
“সবাই রেডি?” নরমার ভাই জিজ্ঞেস করেন।
লুইস গিয়ে কফিনের পেছনের বাম দিকে ধরে। এরপর চারজন একসাথে কফিনটা তুলে ধীরে ধীরে আগায়। ঠান্ডায় রাস্তায় বরফ জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। কেউ একজন বুদ্ধি করে রাস্তার ওপর ছাই ছড়িয়ে দিয়েছে যাতে রাস্তার পিচ্ছিলতা কমে আসে। ফিউনারেলের পরিচালক আর তার ছেলে তাদের পাশে পাশে আসছিল। কেউ ক্লান্ত হয়ে পড়লে বা পিছলে পড়লে এগিয়ে আসার অপেক্ষায়।
তারা যখন কফিনটা ক্যাডিলাক গাড়িটায় ঢুকায়, জাড তাদের পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখে।
“গুডবাই, নরমা,” তিনি বলে একটা সিগারেট জ্বালালেন। “কিছুদিনের মধ্যেই আবার দেখা হবে, ওল্ড গার্ল।” লুইস জাডের কাঁধে হাত রাখে।
লুইস আরো কিছুক্ষণ পরে এলির কাছে ফিরে যায়। তারা তাদের স্টেশান ওয়াগনের কাছে হেঁটে যায় পাশাপাশি। লুইস এলির একহাত ধরে রাখে যাতে ও পিচ্ছিল রাস্তায় পিছলে না পড়ে যায়। চারদিকে গাড়িগুলোর ইঞ্জিন একটার পর একটা গর্জন করে চালু হতে থাকে।
“সবাই গাড়ির হেডলাইট জ্বালাচ্ছে কেন?” এলি জিজ্ঞেস করে। “বাবা, সবাই এই দিনের বেলা গাড়ির লাইট জ্বালাচ্ছে কেন?”
“তারা এটা করে,” লুইস বলতে শুরু করে নিজের গলা শক্ত হয়ে যাওয়া টের পায়। “মৃতকে সম্মান জানানোর জন্যে, মামনি।” সে নিজেও গাড়ির হেডলাইট জ্বেলে দেয়। “চলো।”
লুইস ভাবছিল, নরমার কবর আগামী বসন্তের আগে খোঁড়া হবে না। এতো দিন তিনি একটা ফ্রিজারে-এমন সময় এলি হঠাৎ কান্নায় ফেটে পড়ে।
লুইস একটু অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। “এলি, কি হয়েছে?”
“ওনার কুকি আর খাওয়া হবে না,” এলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে। “উনি পৃথিবীর বেস্ট ওটমিল কুকি বানাতেন বাবা। উনি এখন আর ওগুলো বানাতে পারবেন না, কারণ উনি মরে গেছেন। বাবা, মানুষের মরে যেতে হয় কেন?”
“আমি ঠিক জানি না মামনি,” লুইস বলে। “হয়তো নতুন মানুষের জন্যে জায়গা করে দেয়ার জন্যে। ছোট ছোট মানুষের জন্যে, যেমন তুমি আর তোমার ভাই গেজ।”
“আমি কক্ষনো বিয়ে করবো না বা সেক্স করব না আর বাচ্চা নেব না!” এলি আগের চাইতেও কাতর হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে। “ওগুলো করলে আমার সাথেও নরমার মত এমন হবে! আমি তা চাই না!”
“কিন্তু এতে তাদের যন্ত্রণারও অবসান হয়,” লুইস মৃদু গলায় বলে। “আর আমি ডাক্তার হিসেবে এরকম প্রচুর যন্ত্রণাকাতর মানুষ দেখি, যাদের জন্যে বেঁচে থাকাটাই একটা অভিশাপ। আর আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিটা নিয়েছি কারণ এখানের রোগিরা প্রায় সবাই যুবক বয়সের। এরা মাঝে মধ্যে রোগে ভুগে…কিন্তু বুড়ো মানুষদের মত কমই ভোগে।”
সে একটু থামে।
“বিশ্বাস করো আর না করো, মামনি, মানুষেরা যখন বুড়ো হয়ে যায়, তাদের কাছে মৃত্যু কোন ভয়ের বিষয় না, যেমনটা তোমার কাছে লাগছে। আর তোমার বুড়ো হতে আরো অনেক বছর বাকি আছে।”
এলি আরো কিছুক্ষণ কাঁদল, এরপর কিছুক্ষণ ফোঁপালো, এরপর থামল। বাসায় পৌঁছানোর আগেই সে লুইসকে জিজ্ঞেস করে যে ও গাড়ির রেডিও শুনতে পারবে কি না। লুইস হ্যাঁ বলে আর ও রেডিও ঘোরাতে ঘোরাতে ওর একটা প্রিয় গান পেয়ে যায় আর নিজেই গানের সাথে সাথে গাইতে থাকে।
বাসায় পৌঁছে ও রাচেলের কাছে গিয়ে ফিউনারেলের গল্প শোনাতে থাকে। রাচেল সেসব মনযোগ দিয়ে শোনে, আর এলিকে সান্ত্বনাও জানায় মাঝে মাঝে…কিন্তু লুইসের মনে হয় রাচেলের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে আর খুব চিন্তিতও লাগছে।
এরপর এলি তাকে জিজ্ঞেস করে সে ওটমিল কুকি বানাতে পারে কি না। রাচেল তার হাতের সুই সুতো রেখে সটান হয়ে উঠে দাঁড়ায়, যেন সে এলির এই কথাটার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। “হ্যাঁ,” সে বলে। “তুমি বানাতে চাও?”
“ইয়েই!” এলি চিৎকার করে ওঠে আনন্দে। “সত্যি, মা?”
“হুম, যদি তোমার বাবা গেজকে ঘন্টাখানেকের জন্যে দেখে তাহলে।”
“আমি একশভাগ রাজি আছি,” লুইস বলে। “এবং আনন্দের সাথেই। লুইস বিকেলবেলা একটা মেডিকেল জার্নাল পড়ে কাটায়। একসময় রাচেল সিঁড়ির মাঝখানে নেমে বলল, “তুমি আসছো, লু?”
“আরেকটু সময় লাগবে,” সে রাচেলের দিকে তাকিয়ে বলে। “সব ঠিক আছে?”
“ওরা ঘুমিয়ে গেছে, দুজনেই।”
লুইস আবারো রাচেলের দিকে তাকালো। “ওরা তো ঘুমিয়েছে। তুমি না।”
“আমি ঠিক আছি। বই পড়ছিলাম।”
“তুমি ঠিক আছো? সত্যি?”
“হ্যাঁ,” রাচেল বলে মুচকি হাসে। “আই লাভ ইউ, লুইস।”
“লাভ ইউ টু, বেবি।”
লুইস আবার তার সামনে রাখা জার্নালে চোখ রাখে।
“তোমরা যখন বাইরে ছিলে তখন চার্চ একটা মড়া ইঁদুর নিয়ে এসেছিল,”
রাচেল বলে হাসতে চেষ্টা করে। “খুব বিশ্রী অবস্থা, ইয়াক।”
“ওহ খোদা! রাচেল, আমি সরি।” সে আশা করে সে মনে মনে যতটা অনুশোচনা বোধ করছে সেটা যেন তার কথার স্বরে প্রকাশ না পায়।
রাচেল সিঁড়িতে বসে পড়ে। তার মুখ থেকে সে মেকাপ মুছে ফেলেছে, তার কপাল চকচক করছে। আর চুলগুলো রাবার ব্যান্ড দিয়ে পনিটেল করে বেধে রেখেছে। ওকে একদম বাচ্চাদের মত লাগছে দেখতে। “আমি পরিস্কার করে ফেলেছি,” ও বলে, “তবে জানো, স্টুপিড বিড়ালটাকে ঝাড়ুর ডাণ্ডা দিয়ে পিটিয়ে ঐ মরা ইঁদুরের কাছ থেকে সরাতে হয়েছে। চার্চ আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় ফুলিয়ে গর্জন করছিল…ও আগে কখনো আমার সাথে গর্জন করেনি। বিড়ালটা বদলে গেছে…ওর কোন অসুখ হয়নি তো? তোমার কী মনে হয়?”
“আমার এরকম কিছু মনে হয় না। তবে তুমি চাইলে আমি ওকে ভেটের কাছে নিয়ে যেতে পারি।”
“থাক, লাগবে না,” রাচেল বলে লুইসের দিকে দৃষ্টির সবকটি আবরণ সরিয়ে তাকায়। “কিন্তু তুমি ওপরে আসবে? আমি শুধু…আমি জানি তুমি কাজ করছো, কিন্তু…”
“অবশ্যই,” সে বলে এতো দ্রুত উঠে দাঁড়ায় যেন সে যা করছিল তা কোন জরুরি কিছুই ছিল না; অথচ কাজটা বেশ জরুরি। ইঁদুরটাকে তো এক রকম সে নিজেই বাসায় নিয়ে এসেছে তাই না? চার্চ যে ইঁদুরটাকে নিয়ে এসেছিল সেটাকে চার্চ নিশ্চয়ই বীভৎসভাবে মেরেই নিয়ে এসেছিল; ইঁদুরটার নাড়ি ভুড়ি হয়তো বেরিয়ে এসেছিল, হয়তো মাথা ছিল না, হয়তো চামড়া খুবলে উঠিয়ে নিয়েছিল চার্চ। হ্যা, ইঁদুরটাকে লুইসই এনেছে। ওটা তারই ইঁদুর।
“চলো বিছানায় যাই,” সে বাতি নিভাতে নিভাতে বলে। সে এবং রাচেল সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি ওঠে, সে রাচেলকে তার ডানহাত দিয়ে আগলে ধরে। সে বিছানায় রাচেলকে খুব আদর করে কিন্তু সেই মুহূর্তেও তার মাথায় নানান চিন্তা ঘুরপাক খেতে থাকে। সে চার্চের কথা ভাবে, যে আগে তার মেয়ের বিড়াল থাকলেও এখন চার্চ তার নিজের বিড়াল। সে ভাবে চার্চ এখন কি করছে, কিসের পেছনে ওৎ পেতে আছে বা কিসের নাড়িভুড়ি খুবলে বের করে আনছে। বাইরে শীতের হাওয়ার গোঙানি শোনা যাচ্ছে। সে ভাবে অনেক মাইল দূরে নরমা ক্র্যান্ডাল তার শেষ বাসস্থান কালো কফিনটায় শুয়ে আছেন, যিনি কিছুদিন আগেও তার ছেলে মেয়ের জন্যে নিজ হাতে উলের টুপি বুনে দিয়েছিলেন। ফিউনারেল হোমের লোকেরা তাকে সাজানোর জন্যে তার গাল চাপায় যে সাদা তুলো গুজে দিয়েছেন তাও হয়তো এতক্ষণে কালো হতে শুরু করেছে।
অধ্যায় ৩৪
এলির ছয় বছর হলো। ও সেদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরল মাথায় কাগজের টুপি পড়ে আর তার বন্ধুদের হাতে আঁকা তার কয়েকটি ছবি নিয়ে; সেসব ছবির মধ্যে সবচাইতে ভালোটিতে ওকে একটা ভদ্র কাকতাড়ুয়ার মত দেখাচ্ছে। ফ্লুয়ের মহামারী চলে গেছে। এর মধ্যে লুইসের দুজন ছাত্রকে তার ইনফার্মারি থেকে ব্যাঙ্গর হসপিটালে পাঠাতে হয়েছে। আর সুরেন্দ্র একজন ছাত্রের জীবন বাঁচিয়েছে, যার ইনফার্মারিতে ভর্তি হবার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রচন্ড খিঁচুনি হতে থাকে।
রাচেলের এ অ্যান্ড পি দোকানের একটা সোনালি চুলের ব্যাগ বয়ের জন্যে হালকা ক্রাশ তৈরি হয়েছে, যেটা সে-রাতে লুইসকে বলছিল সে, “ওই ছেলেটার প্যান্টের সামনেটা কিভাবে যে ফুলে থাকে…না দেখলে বিশ্বাস করবে না।”
“ও হয়তো ভাব মারার জন্যে ওখানে টয়লেট টিস্যু গুঁজে রাখে। তুমি ভালো করে টিপে দিয়ে দেখতে পারো,” লুইস বলে। “যদি ও চিৎকার করে ওঠে তাহলে বুঝবে আসলেই কিছু আছে।” শুনে হাসতে হাসতে রাচেলের চোখে পানি চলে আসে।
ফেব্রুয়ারির শূন্যের নিচের তাপমাত্রার আবহাওয়া মার্চে বদলে গেল। মার্চে কিছুদিন অদল বদল করে বৃষ্টি আর হিম শীতল আবহাওয়া চলতে থাকে। জাড ক্র্যান্ডালের প্রথম পর্যায়ের শোকের তীব্রতা কমে এসেছে। সাইকিয়াট্রিস্টদের মতে এই শোক আপনজনের মৃত্যুর তিন দিন পর শুরু হয়ে চার থেকে ছয় সপ্তাহ জারি থাকে, তীব্র শীতের মত। সময় মানুষের মনের ক্ষত ধীরে ধীরে শুকিয়ে দেয়। প্রথম পর্যায়ের শোকের তীব্রতা ধীরে ধীরে কমে আসে। আরো সময়ের ব্যবধানে সেই শোক বেদনায় পরিণত হয়। আরো সময়ের সাথে সেটা স্মৃতিচারণে পরিণত হয়-এই পুরো প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিকভাবে শেষ হতে ছয় মাস থেকে তিন বছর পর্যন্ত লাগতে পারে। গেজের প্রথম চুলকাটার দিন চলে এলো। লুইস যখন দেখলো তার ছেলের চুল ব্লন্ড না হয়ে কালো হচ্ছে, সে তা নিয়ে কৌতুক করে নিজেও একটু শোক পালন করলো মনে মনে।
এরপর বসন্ত এলো। বসন্ত এলো থাকার জন্যে।
অধ্যায় ৩৫
লুইস ক্রিডের বিশ্বাস তার জীবনের শেষ অতি আনন্দের দিন ছিল মার্চ ২৪, ১৯৮৪। এর কয়েক সপ্তাহ পরেই তার জীবনে চরম বেদনার শীতলতা নেমে আসে। তার ধারণা, ওসব বেদনাদায়ক ঘটনা না ঘটলেও সে সেই দিনটার কথা সবসময়ই মনে রাখতো। মানুষের জীবনে খুশির দিন-একদম বিশুদ্ধ খুশির দিন-খুব একটা এমনিতেও আসে না। একজন সাধারন মানুষের জীবনে হয়তো টর্চ দিয়ে খুঁজলেও ত্রিশদিনের বেশি নির্ভেজাল আনন্দের দিন খুঁজে পাওয়া যাবে না। লুইসের মনে হয়, ঈশ্বর তার অসীম জ্ঞান নিয়ে মানুষকে আনন্দ থেকে বেদনা দিয়ে পরীক্ষা করতেই বেশি ভালোবাসেন।
দিনটি ছিল রোববার। রাচেল আর এলি দুপুরে বাজার করতে যায় আর গেজকে দেখাশোনার দায়িত্ব পড়ে তার ওপর। তারা জাডের সাথে জাডের পুরনো পিকাপে চড়ে গেছে। তাদের নিজেদের গাড়ি ঠিকই আছে তবে বুড়ো তাদের সাথে কিছু সময় কাটাতে বেশ পছন্দ করবেন ভেবেই এই ব্যবস্থা। রাচেল লুইসকে জিজ্ঞেস করেছিল গেজকে দেখাশোনা করতে তার কোন সমস্যা আছে কি না। সে খুশি মনেই বলে কোন সমস্যা নেই। মন থেকেই সে চাইছিল রাচেল একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসুক; শীতে তেমন একটা বাইরে যাওয়ার সুযোগ পায়নি ও।
গেজ বেলা দুটোর দিকে জেগে ওঠে এবং উঠেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে এই মহাজগতের ব্যাপারে সে মহাবিরক্ত। লুইস নানান কায়দা কসরত করে তাকে খুশি করার চেষ্টা করে কিন্তু সবই বিফলে যায়। তার ওপর গেজ পায়খানা করে দেয়, এবং সে পায়খানার আয়তন আশ্চর্যজনক। লুইস সেই বিরাট পায়খানার ওপর একটা নীল মার্বেল দেখতে পায়, এলির মার্বেল। লুইস মনে মনে ঠিক করে এলির মার্বেল সব বাসা থেকে ফেলে দিতে হবে। সিদ্ধান্তটা খুবই প্রশংসনীয়, কিন্তু তাতে গেজের বিরক্ত মেজাজ একদমই পরিবর্তন হয় না।
লুইস বাইরে বসন্তের বাতাসের আনাগোনা শুনতে পায় আর পাশের মাঠে মেঘের ছায়া আর রোদের লুকোচুরি দেখতে পায়। ওর হঠাৎ সেই ঘুড়িটার কথা মনে পড়ে যায়, যেটা সে পাঁচ-ছয় সপ্তাহ আগে ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পথে ঝোঁকের বসে কিনে ফেলে।
“গেজ!” সে বলে। গেজ সোফার নিচে একটা মোমের রংপেন্সিল পেয়ে সেটা দিয়ে এলির একটা গল্পের বইয়ের ওপর শিল্পচর্চা করছিল। এতে যে তার আর তার বোনের মধ্যে সৌহার্দের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়া হচ্ছে, লুইস তা ভেবে মুচকি হাসে। এলি যদি এটা নিয়ে বেশি ঘ্যান ঘ্যান করে তাহলে লুইস তাকে গেজের হাগুর মধ্যে পাওয়া মার্বেলের কথা মনে করিয়ে দিবে।
“কী!” গেজ জ্ঞানীর মত জবাব দেয়। ও অল্প বয়সে এখন ভালই কথা বলতে শিখে গেছে। লুইস প্রায় নিশ্চিত গেজ বড় হয়ে মেধাবি হবে।
“বাইরে যাবে?”
“বাইরে যাব!” গেজ খুব আনন্দের সাথে উত্তর দেয়। “বাইরে যাব। আমার নিক্সগুলো কই, বাবা?”
গেজ আসলে যেটা বলল সেটা হচ্ছেঃ আমা নিক্স গু কৈ, বাবা? আর এটার শুদ্ধ রূপ হবেঃ আমার জুতোগুলো কোথায়, বাবা? গেজের কথা শুনে লুইসের প্রায়ই অবাক লাগে। এর কারণ এটা না যে এসব খুব কিউট, এর কারণ বাচ্চারা কথা বলে বিদেশিদের মত করে, যারা ভাষাটা এখনো রপ্ত করতে পারেনি, তাই আবোল তাবোল বলে। বাচ্চারা মানুষের পক্ষে সম্ভব সব রকমের শব্দ করতে পারে… আরবদের টান, জার্মান বর্ণমালার মোটা মোটা স্বরবর্ণ, অস্ট্রেলিয়ার বুশ জংলিদের করা শব্দ, সব। কিন্তু তারা তাদের মাতৃভাষা শিখতে শিখতে সেসব ভুলে যায়। লুইস ভাবে শৈশব শুধু শেখার সময়ই না, ভোলারও সময়।
গেজের নিক্সগুলো অবশেষে খুঁজে পাওয়া গেল, সোফার নিচে। লুইস এখন মোটামুটি বিশ্বাস করে যেসব বাসায় ছোট বাচ্চা কাচ্চা আছে সেসব বাসার সোফার নিচটা একটা ব্লাক হোলে পরিণত হয়ে আশেপাশে যা আছে সব টেনে নেয়; রংপেন্সিল থেকে শুরু করে সিসেমি স্ট্রিটের ম্যাগাজিন, যেটার পাতায় আবার খাবার লেপ্টে আছে।
গেজের জ্যাকেটটা অবশ্য সোফার নিচে ছিল না। এটা সে সিঁড়ির রেলিঙে পায়। গেজের রেড সক্স ক্যাপটা খুঁজে পেতে ওর সবচাইতে কষ্ট হয় আর এই ক্যাপ ছাড়া গেজ বাসা থেকে বের হবেই না। আর এর কারণ ক্যাপটা ঠিক জায়গাতেই ছিল-ক্লজেটে। ওই জায়গায় স্বাভাবিকভাবেই সে সবার শেষে খুঁজতে যায়।
“কৈ যাই, বাবা?” গেজ তার বাবাকে নিজের হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে।
“আমাদের প্রতিবেশীর মাঠে,” সে বলে। “চলো, ঘুড়ি ওড়াবো।”
“গুররি?” গেজ দ্বিধা নিয়ে বলে।
“হুম, ঘুড়ি। খুব মজার।” লুইস বলে। “এক মিনিট, পিচ্চি।”
তারা দুজনে গ্যারেজে আসার পর লুইস স্টোরেজ ক্লজেট থেকে ঘুড়ির ব্যাগটা বের করে।
“এতা কী বাবা?” গেজ এমনভাবে ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে থাকে যেন সেটার ভিতর অজানা দেশের না জানি কী লুকিয়ে আছে।
“ঘুড়ি, বাবা।” লুইস বলে। ঘুড়িটা বের করে সেটার ভাঁজ খোলে সে। ঘুড়িটা প্রায় পাঁচ-ছয় ফুটের মত লম্বা এবং বানানো হয়েছে শকুনের আকৃতিতে।
“পাকি!” গেজ চেচিয়ে ওঠে। “পাকি, বাবা! পাকি!”
“হুম বাবা, পাখি।”
সে ঘুড়িটা রেখে পাঁচশো ফুট লম্বা সুতোর রিলটা খুঁজতে থাকে যেটা সে ঘুড়িটার সাথেই কিনেছে। সে ঘাড় ঘুরিয়ে গেজের দিকে ফিরে বলে, “তোমার খুব পছন্দ হবে, বুড়ো খোকা।”
গেজ ঘুড়ি ওড়ানোটা খুব পছন্দ করে।
তারা ঘুড়িটা নিয়ে তাদের প্রতিবেশী মিসেস ভিন্টনের মাঠে যায়। লুইস প্রথম চেষ্টাতেই ঘুড়িটা আকাশে উড়িয়ে ফেলে, যদিও সে শেষবারের মত আকাশে ঘুড়ি উড়িয়েছিল…কবে?…তার বয়স যখন বারো? উনিশ বছর আগে? বাব্বাহ!
তাদের প্রতিবেশী মিসেস ভিন্টনের বয়স জাডের সমান কিন্তু তিনি জাডের চাইতে অনেক বেশি বুড়িয়ে গেছেন। এই মাঠটার এক মাথায় তার বাসা, আর আরেক দিকে জঙ্গলার সীমারেখা যেখান দিয়ে এগোলে প্রথমে পড়বে পেট সেমেটারি আর এরপর মিকমেকদের গোরস্থান। তিনি তার বাসা থেকে খুব কমই বের হন এখন।
“গুরি উরচে, বাবা!” গেজ চেঁচায়।
“আবার জিগায়! দেখো কত দূরে যায়!” লুইসও হাসতে হাসতে চেঁচিয়ে জবাব দেয়। সে একহাতে সুতোর রিলটা ধরে আছে আর আরেক হাতে সুতোটা। ঘুড়িটা এতো জোরের সাথে সুতো টেনে নিচ্ছে যে সে টের পাচ্ছে তার সুতো ধরা হাতের চামড়া সুতোর ঘর্ষণে প্রায় পুড়ে যাচ্ছে। “শকুনটা দেখো গেজ! আজকে ও আকাশের রাজা!”
“রাজাআআ! গেজ চেঁচিয়ে উঠে উচ্চস্বরে হাসে। আকাশের একটা মেঘের পাঁজার পেছন থেকে হঠাৎ সূর্যটা উঁকি দেয় এবং তাতে চারপাশের তাপমাত্রা যেন একলাফে পাঁচ ডিগ্রীর মত বেড়ে গেল। তারা দুজনে মার্চের ক্ষণস্থায়ী উষ্ণতায় দাঁড়িয়ে আকাশে শকুনটার দিকে তাকিয়ে থাকে। শকুনটা তার প্লাস্টিকের ডানা মেলে নীল আকাশ বেয়ে তরতর করে আরো ওপরে উঠে যায়। লুইসের ইচ্ছে হচ্ছে ঘুড়িটার কাছে উঠে যেতে; ছোটবেলার মতো। ইচ্ছে হতো ঘুড়িটার সাথে ভেসে ভেসে পৃথিবীর আসল আকৃতি দেখতে, প্রকৃতি দেখতে, দিগন্তরেখার ওপারে কি আছে তা দেখতে।
“গেজ, দেখো কী সুন্দর উড়ছে!” লুইস হেসে হেসে বলে।
গেজ পেছনের দিকে বাঁকা হয়ে মাথা তুলে ঘুড়িটাকে উড়তে দেখছে। ও এতো ঝুঁকে পড়েছে যে লুইসের ভয় হচ্ছে ও উল্টে পড়ে ব্যথা পাবে। ওর মুখে প্রশস্থ হাসি।
লুইস গেজের কাছে গিয়ে গেজকে তার একহাত বাড়িয়ে দিতে বলে। গেজ না তাকিয়েই তার হাত বাড়িয়ে দেয়, সে বাতাসে মাঠের একপাশ থেকে আরেকপাশে উড়তে থাকা ঘুড়িটা থেকে তার চোখ সরাতে পারছে না। ঘুড়িটার সাথে সাথে মাঠের ঘাসে সেটার ছায়াও ছোটাছুটি করছে।
লুইস ঘুড়িটার সুতো গেজের হাতের সাথে পেঁচিয়ে দিলে ও নিচে তাকায়। সুতোর টানে তাকে বেশ অবাক মনে হচ্ছে।
“কী!” সে বলে।
“ওটা তুমি ওড়াচ্ছ এখন,” লুইস বলে। “আকাশের রাজার সুতো এখন তোমার হাতে, তুমিই এখন রাজা। এখন ঘুড়িটা তোমার।”
“গেজ ওড়াচ্ছে?” গেজ বিশ্বাস না করতে পেরে নিশ্চিত হবার জন্যে নিজেকেই জিজ্ঞেস করে। সে কৌতুহলী হয়ে সুতোটায় টান দিলে ঘুড়িটা নড়ে ওঠে। সে এবার আরো জোরে টান দেয় আর ঘুড়িটা একটা গোত্তা খেয়ে আবার উড়তে থাকে। লুইস আর গেজ একসাথে হেসে ওঠে। গেজ তার খালি হাত বাড়িয়ে দিয়ে হাতড়াতে থাকলে লুইস সেটা নিজের হাতে ধরে। তারা পিতা-পুত্র হাত ধরাধরি করে মিসেস ভিন্টনের মাঠে দাঁড়িয়ে উড়ন্ত ঘুড়িটাকে দেখতে থাকে।
ছেলের সাথে এই মুহূর্তটা লুইস সবসময় মনে রেখেছে। লুইস যেমন কল্পনা করতো সে ঘুড়িটার সাথে উড়ে উড়ে আকাশ থেকে সব দেখছে, তেমনি তার ইচ্ছে হতে থাকে গেজের চোখে সবকিছু দেখতে। গেজের ছোট্ট দেহের বড় বড় চোখগুলো দিয়ে কোটি কোটি মাইল দূরের ঘুড়িটাকে দেখতে, তার পাশে দাড়িয়ে থাকা দানবীয় মানুষটাকে দেখতে।
“ঘুড়ি উড়ছে!” গেজ চেঁচিয়ে উঠলে লুইস তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে তার গালে চুমো খায়। তার ছোট্ট গালে লাল গোলাপ ফুটে ওঠে।
“আই লাভ ইউ, গেজ,” সে বলে। এটা একান্তই তাদের নিজেদের মুহূর্ত।
আর গেজ, যার হাতে আর মাত্র দুই মাস আয়ু আছে, সে খিল খিল করে হাসতে থাকে আর চেঁচাতে থাকে, “ঘুড়ি উড়ছে! ঘুড়ি উড়ছে, বাবা!”
এলি আর তার মা যখন ফিরে আসে তখনও তাদের ঘুড়ি আকাশে। তারা দুজনে মিলে ঘুড়ি এতো ওপরে উড়িয়েছে যে তাদের সুতো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। ঘুড়ির শকুনের আকৃতি এখন আর বোঝা যাচ্ছে না, ঘুড়িটাকে দেখে মনে হচ্ছে আকাশের মধ্যে একটা ছোট্ট কালো বিন্দু।
লুইস ওদের দুজনকে পেয়ে আরো খুশি হয়। এলি তার হাত থেকে সুতোর রিলটা ফেলে দিলে গেজ আনন্দে হেসে ওঠে। রিলটা পড়ে গেলে সেটা মাঠের ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। রিলের সুতো যখন প্ৰায় শেষ হয়ে খুলে যাবে যাবে করছে তখন এলি সেটাকে ধরে ফেলে। তাদের দুজন আসার পরে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে যায় তবে বিশ মিনিট পর রাচেল যখন বলে গেজের যথেষ্ঠ বাইরে থাকা হয়েছে, তার খুব একটা কষ্ট লাগে না। রাচেলের মনে হচ্ছে গেজ বাইরে আরো বেশি সময় ধরে থাকলে ওর বুকে ঠান্ডা লেগে যাবে।
অগত্যা লুইস সুতো টেনে টেনে ঘুড়িটাকে নামিয়ে আনতে থাকে। ঘুড়িটা প্রতি মুহূর্তে নিচে নামতে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অবশেষে ধরা দেয়। লুইস শকুনটাকে বগলদাবা করে নিয়ে গ্যারেজের স্টোরেজ ক্লজেটে বন্দি করে রাখে। সেদিন রাতে গেজ হট ডগ আর বিনস খায়, অন্যদিনের চাইতে অনেক বেশি। রাচেল যখন গেজকে ঘুমের পোশাক পড়িয়ে দিচ্ছিল লুইস এলিকে একটু পাশে নিয়ে গিয়ে তার মার্বেলগুলোর ব্যাপারে সাবধান করে দেয়। অন্যদিন হলে এলির সাথে এইরকম আলাপ ধমকাধমকিতে গিয়ে শেষ হয় কারণ এলিকে কোন অপরাধের কথা বললে সে নানান অপমানসূচক কথা বলে আর খোঁড়া যুক্তি দিয়ে একগুঁয়ের মত আত্মপক্ষ সমর্থন করতে থাকে। তবে আজকের দিনের সেই মধুর স্মৃতির জন্যে তার মেজাজ খুব ভালো ছিল আর এলিও সহজেই তার কথা মেনে নিয়ে বলে সে তার মার্বেলগুলোর ব্যাপারে আরো সচেতন হবে। এরপর এলি নিচতলায় নেমে যায় টিভিতে সাড়ে আটটায় তার প্রিয় শো দেখার জন্যে। যাক, একটা সমস্যা কমানো গেছে, লুইস ভাবে। কিন্তু সে জানে না যে মার্বেলগুলো কোন সমস্যা না, এমনকি বাইরের ঠান্ডাও কোন সমস্যা না। সমস্যা হতে যাচ্ছে অরিংকো কম্পানির একটা বিশাল ট্রাক, সমস্যা হতে যাচ্ছে তাদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা…যেটার ব্যাপারে জাড ক্র্যান্ডাল তাকে প্রথম দিনেই সাবধান করেছিল।
***
গেজকে বিছানায় শুইয়ে দেয়ার মিনিট পনেরো পরে লুইস ওপরে যায়। গেজ চুপচাপ শুয়ে থাকলেও ও জেগেই ছিল। ও সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ফিডারের দুধের শেষ অংশটা চুষে চুষে খাচ্ছে।
লুইস গেজের একপা তুলে ধরে চুমু খেয়ে আবার নামিয়ে রাখে। “গুড নাইট, গেজ,” সে বলে।
“ঘুড়ি উড়ছে, বাবা,” গেজ বলে।
“আসলেই উড়েছে, তাই না?” লুইস বলে এবং কোন কারণ ছাড়াই তার চোখে পানি এসে যায়। “একদম আকাশের সীমানা পর্যন্ত উড়েছে, বাবাই।”
“ঘুড়ি উড়ছে,” গেজ বলে। “কাশ পর্যন্ত।
গেজ ওপাশ হয়ে শুয়ে মুহূর্তের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে।
লুইস সেখান থেকে চলে যাবার আগে দরজার কাছে গিয়ে পিছনে ফিরে তাকিয়ে ক্লজেটের দরজার ফাঁক দিয়ে দুটো হলদে-সবুজ, অশরীরি চোখ দেখতে পায়। চোখগুলো তার দিকেই তাকিয়ে আছে। ক্লজেটের দরজাটা সামান্য একটু ফাঁক করা ছিল। তার হৃৎপিন্ড লাফ মেরে গলার কাছে চলে আসে আর মুখে আতঙ্কের তীব্র ছাপ ফুটে ওঠে।
সে ক্লজেটের দরজা খুলতে খুলতে ভাবে নিশ্চয়ই এটা জেল্ডা… দরজা খুললেই সে তার কালো জিভ লকলক করে তার ওপর ঝাপিয়ে পড়বে। কিন্তু আসলে এ চার্চ ছাড়া আর কেউ না। চার্চ তাকে দেখতে পেয়ে এমনভাবে ধারালো দাঁত বের করে হিসিয়ে ওঠলো যেটা শুধু হরর মুভিতেই দেখা যায়।
“যা, ভাগ এখান থেকে,” লুইস ফিসফিস করে বলে।
চার্চ নড়ে না। লুইস গেজের পড়ে থাকা খেলনাগুলোর মধ্যে হাতে যেটা উঠে সেটা দিয়েই ছুঁড়ে মারার ভঙ্গি করে চার্চকে ভয় দেখায়। চার্চ একটুও না নড়ে আবার তার দিকে হিসিয়ে ওঠে। এবার লুইসের মাথায় আগুন চড়ে যায়। এবার সে ভয় দেখানোর ছলে বা খেলার ছলে না, বরং আঘাত করার নিয়তেই খেলনাটা গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ছুঁড়ে মারে। সে প্রচন্ড ক্ষেপে গেছে। চার্চের আচরণে মনে হচ্ছে তার ছেলের রুমের ক্লজেটে কিলবিল করার অধিকার চার্চের আছে।
খেলনাটা গিয়ে চার্চের মাথায় আঘাত করে। চার্চ ক্যাক করে আওয়াজ করে ক্লজেট থেকে লাফিয়ে পড়ে পড়িমড়ি করে ছুটে পালায়। পালানোর সময় আনাড়িভাবে বেশ কয়েক জায়গায় ধাক্কা খায় বিড়ালটা।
গেজ নড়ে উঠে কিছু বিড়বিড় করে আবার চুপ হয়ে যায়।
“লুইস?” রাচেল নিচ থেকে ভয়ার্ত গলায় ডেকে ওঠে। “গেজ বিছানা থেকে পড়ে গেছে নাকি?”
“না, ও ঠিক আছে। চার্চ ধাক্কা দিয়ে ওর কয়েকটা খেলনা ফেলে দিয়েছে।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
লুইসের এরকম মনে হচ্ছে-যেন গেজের গায়ের ওপর কোন সাপ কিলবিল করছিল বা ওর গায়ের ওপর কোন মরে ফুলে যাওয়া ধেড়ে ইঁদুর পড়ে ছিল। লুইস জানে তার চিন্তাটা অযৌক্তিক, কিন্তু তারপরও বিড়ালটা যখন ওর দিকে তাকিয়ে হিসিয়ে ওঠে…আচ্ছা, সে কি আসলেই ভয় পাচ্ছিল ক্লজেটের ভেতর জেল্ডা বসে আছে?
সে গেজের ক্লজেটের দরজা চাপিয়ে দেয়। দরজার পাল্লার সাথে সাথে গেজের কতগুলো খেলনাও ক্লজেটের ভেতর ঢুকে যায়। সে দরজা চাপিয়ে দেয়ার পর কি একটা ভেবে পাল্লাটির ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়।
এরপর সে গেজের পাশে এসে দাঁড়ায়। গেজ লাথি দিয়ে তার কম্বল গা থেকে ফেলে দিয়েছে। লুইস কম্বলটা টেনে দিয়ে সেখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে গেজের দিকে তাকিয়ে থাকে, দীর্ঘ সময়ের জন্যে।
পর্ব-২
অধ্যায় ৩৬
মানুষের আতঙ্কের কোন শেষ আছে মনে করাটা ভুল। অন্যদিকে, আঁধার যখন বাড়তে থাকে, এক রকম এক্সপোনেন্সিয়াল ইফেক্ট বা ভ্রম তৈরি হয়-এক আতঙ্ক থেকে আরো আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, এক শয়তান আরো শয়তানের জন্ম দেয় এবং শেষে সবকিছু গভীর অন্ধকারে ডুবে যায়। আর সবচাইতে ভয়াবহ প্ৰশ্ন হচ্ছে নিজের মাথা ঠিক রেখে মানুষের মন এর কতটুকু সহ্য করতে পারে? এবং এক পর্যায়ে এর সবকিছুই হাস্যকর মনে হতে থাকে। এই পর্যায়ে মানুষের মাথা ঠিক থাকে অথবা তার মনের সুপ্ত রসবোধ জেগে ওঠে।
সতেরোই মে-তে তার ছেলের ফিউনারেলে লুইস ক্রিডের মনেও হয়তো এরকম চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সে তখনো যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতে পারছিল বা চেষ্টা করছিল। কিন্তু সেটা আর সম্ভব হয় না যখন তার শ্বশুড় মাতাল হয়ে তার সাথে মারামারি লাগায়। এবং এর ফলে রাচেলের নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণের যে শেষ বিন্দুটা বাকি ছিল, রাচেল সেটাও হারায়। সেদিনের বিশ্রী কান্ডগুলোর উপসংহার হয় পাগলের মত চিৎকার করতে থাকা রাচেলকে সেখান থেকে টেনে বের করে এবং ঘুমের ওষুধ দিয়ে শান্ত করার মাধ্যমে।
রাচেলকে সেদিন হয়তো সেই মুষ্টিযুদ্ধ দেখা লাগতো না যদি সেটা বিকেলের ভিজিটিং আওয়ারে না ঘটে সকালের ভিজিটিং আওয়ারে ঘটতো, কারণ সে সকালে সেখানে উপস্থিত ছিল না। তার সেখানে আসার মত অবস্থা ছিল না। সে সময়টা রাচেল জাড ক্র্যান্ডাল এবং স্টিভ মাস্টারটনের সাথে বাসায় বসে ছিল। লুইস জানে না জাড ক্র্যান্ডাল আর স্টিভ মাস্টারটন পাশে না থাকলে সে কিভাবে বিগত আটচল্লিশ ঘন্টা পার করতো।
লুইসের নিজের কোন সিদ্ধান্ত নেয়ার মত অবস্থা ছিল না, এমনকি রাচেলের দুর্দশা কমানোর জন্যে তাকে কিছু শট দেয়ার কথাও সে ভাবতে পারছিল না। স্টিভ মাস্টারটন খুব দ্রুত তাদের বাসায় চলে আসায় লুইস এবং তার পরিবারের অনেক উপকার হয়েছে। লুইস খেয়ালও করেনি যে রাচেল সকালের ভিজিটিং আওয়ারে যাওয়ার জন্যে তার ঘরে পড়ার কোট চাপিয়ে বসে আছে এবং কোটের বোতামগুলো ভুলভাবে লাগানো। ওর চুল এলোমেলো হয়ে আছে, শূন্য চোখগুলো যেন কোন জীবন্ত কঙ্কালের খুলির কোটর থেকে বেরিয়ে আসছে। ও খাবার টেবিলে বসে বাটার না দিয়েই শুকনো টোস্ট চিবুচ্ছিল এবং মাঝে মাঝে অস্ফুটে আবোল তাবোল বকছিল। একপর্যায়ে ও হঠাৎ করে বলে ওঠে, “লু, তুমি যে ক্যারাভানটা কিনতে চেয়েছিলে…” লুইস রাচেলকে ক্যারাভান কেনার কথা শেষ বলেছিল ১৯৮১ সালে।
লুইস মাথা নেড়ে নিজের ব্রেকফাস্ট খেতে থাকে। সে এক বাটি কোকা বেয়ার খাচ্ছিল; গেজের প্রিয় নাস্তা। খুব বিস্বাদ লাগলেও সে খাবারটা ইচ্ছে করেই খাচ্ছে। সে তার সবচাইতে ভালো স্যুটটা পড়ে আছে। ফিউনারেলে পড়ার জন্যে তার কোন কালো কোট নেই, তবে এই কোটটা গাড় ছাই রঙের। সে শেভ করেছে, গোসল করেছে, চুল আঁচড়েছে। তাকে ভালো দেখালেও সে গভীর শোকে আচ্ছন্ন।
এলির পরনে ছিল একটা ব্লু জিন্স আর হলুদ জামা। ও ব্রেকফাস্টের টেবিলে গেজের একটা ছবি নিয়ে এসেছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে গেজ এবং এলি বরফে স্লেজ নিয়ে খেলছে। গেজ স্লেজে বসে আছে আর এলি ওকে টানছে। এলি ঘাড় ঘুড়িয়ে গেজের দিকে তাকিয়ে আছে আর গেজও ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। ছবিটা রাচেল তুলেছিল একটা এস.এক্স – ৭০ ক্যামেরা দিয়ে, যেটা লুইস এবং বাচ্চারা তাকে তার জন্মদিনে উপহার দিয়েছিল।
এলি ছবিটা নিয়ে বসে আছে তবে কোন কথা বলছে না।
লুইসের পাশে তার স্ত্রী এবং মেয়ে কে কী করছে তার দিকে কোন খেয়াল তার নেই। সে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছে এবং তার মনে অ্যাক্সিডেন্টের দৃশ্যটা বারবার চলচ্চিত্রের মত চলছে। কিন্তু সেই মনের চলচ্চিত্রের শেষটা বাস্তবের চাইতে ভিন্ন। সেই চলচ্চিত্রে লুইস আরো অনেক দ্রুত গেজকে বাঁচাতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া গেজ শুধু কথা না শোনার জন্যে অনেকগুলো বকা খায়।
স্টিভই রাচেল এবং এলির অবস্থাটা বুঝতে পারে। সে রাচেলকে এই অবস্থায় সকালের ভিজিটিং-এ যেতে নিষেধ করে। এমনিতেও সেখানে গেজকে দেখা যাবে না, কারণ কফিনের ডালা বন্ধ থাকবে। যদি ডালা খোলা থাকতো তাহলে হয়তো সকলে চিৎকার করতে করতে সেখান থেকে ছুটে পালাবে- হয়তো সে নিজেও। স্টিভ এলিকেও যেতে নিষেধ করলে রাচেল তার বিরোধীতা করে; এলি শুধু তার আর গেজের ছবিটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে ছিল।
স্টিভই রাচেলকে তার দরকারি ওষুধ দেয় এবং এলিকে এক চামচ রঙহীন তরল খেতে দেয়। এলিকে যেকোন ঔষধ খাওয়াতে গেলে সে সাধারণত বেশ ঝামেলা করে, খেতে চায় না, খেলেও চোখ মুখ কুঁচকে বমি করার মত অবস্থা করে; কিন্তু আজ সে কোন ঝামেলা ছাড়াই তা খেয়ে নেয়, চোখ মুখ কোঁচকানো ছাড়াই। সকাল দশটার মধ্যেই সে নিজের বিছানায় ঘুমে কাঁদা হয়ে যায়, তখনো তার হাতে গেজের ছবিটা আঁকড়ে ধরা। রাচেল টেলিভিশনের সামনে বসে ‘হুইল অফ ফরচুন’ দেখছে। সে স্টিভের প্রশ্নের জবাব ধীরে ধীরে দিচ্ছে। ও অনেকটা নেশাগ্রস্তের মত হয়ে গেছে তবে তার চেহারার সেই উন্মাদনার ছায়া, যেটা দেখে স্টিভ ভয় পেয়ে গিয়েছিল, সেটা আর নেই।
বলার অপেক্ষা রাখে না জাডই ফিউনারেলের ব্যবস্থাপনার বিষয়গুলো দেখছেন। তিনি তিন মাস আগে নিজের স্ত্রীর ফিউনারেলের সময় যেভাবে ঠান্ডা মাথায় সবকিছুর ব্যবস্থা করেছিলেন ঠিক সেভাবেই আবারো সব ব্যবস্থা করছেন। কিন্তু লুইস যখন ফিউনারেল হোমের জন্যে রওনা হচ্ছিল তখন স্টিভ মাস্টারটনই তাকে পাশে ডেকে নেয়।
“আমি ব্যাপারটা দেখবো যাতে রাচেল বিকেলের ভিজিটিং আওয়ারে সেখানে উপস্থিত থাকতে পারে; যদি ওর সেরকম অবস্থা থাকে,” সে লুইসকে বলে।
“ওকে।”
“ততক্ষণে ওষুধের প্রভাব কমে যাবে। আর মিস্টার ক্র্যান্ডাল বলেছেন বিকেলের ভিজিটিং আওয়ারে তিনি বাসায় এলির সাথে থাকবেন—”
“হুম।”
“-আর মনোপলি বা ওইরকম কিছু খেলবেন ওর সাথে-”
“আচ্ছা।”
“কিন্তু”
“ওকে।”
স্টিভ থেমে গেল। তারা গ্যারেজে দাঁড়িয়ে আছে, চার্চের আস্তানা, যেখানে চার্চ মরা পাখি আর ইঁদুর নিয়ে আসতো। যেগুলোর জন্যে দায়ি লুইস নিজে। বাইরে মে মাসের রোদ, তার মধ্যে ড্রাইভওয়েতে একটা রবিন পাখি খুব ব্যস্তভাবে ছোটাছুটি করছে যেন ওর খুব জরুরি কাজ আছে কোথাও। কে জানে? হয়তো আছে।
“লুইস?” স্টিভ বলে। “নিজেকে সামলাও।”
লুইস জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্টিভের দিকে তাকায়। স্টিভ যা বলেছে তার বেশিরভাগই সে শুনেও শোনেনি। সে ভাবছিল, আরেকটু দ্রুত দৌড়ালেই সে হয়তো গেজকে বাঁচাতে পারতো।
“আমার মনে হয় না তুমি খেয়াল করেছো,” স্টিভ বলে, “কিন্তু এলি কথা বলছে না। আর রাচেল এতোটা শক খেয়েছে যে ওর সময়ের হিসেবও হযবরল হয়ে গেছে।”
“হ্যা!” লুইস বলে। সে জোর দিয়ে বলে, কিন্তু কেন বলে সে নিজেও জানে না।
স্টিভ লুইসের কাঁধে হাত রাখে। “লু,” সে বলে, “ওদের এখন তোমাকে সব চাইতে বেশি প্রয়োজন। বন্ধু, আমি তোমার স্ত্রীকে ওষুধ দিতে পারি, কিন্তু দেখো…লুইস, প্লিজ…ওহ খোদা, কী যে একটা বিশ্রী অবস্থা তৈরি হয়েছে!”
লুইস অবাক হয়ে দেখলো স্টিভ কাঁদতে শুরু করেছে। “শিওর,” লুইস বলে। কিন্তু তার মনে সে তখনো দেখছে যে গেজ লন থেকে ছুটে রাস্তাটার দিকে যাচ্ছে। তারা চিৎকার করে ওকে থামতে বলছে, কিন্তু ও থামছে না-ইদানিং সে একটা খেলা শিখেছে, বাবা-মার কাছ থেকে ছুটে পালানো—ওরাও ওর পেছন পেছন ছুটছে। লুইস দ্রুতই রাচেলকে পিছে ফেলে দেয় কিন্তু ততক্ষণে গেজ অনেক এগিয়ে গেছে। গেজ হাসছে, সে তার বাবার কাছ থেকে ছুটে পালাচ্ছে-এটাই তার খেলা আর লুইস তার আর গেজের মাঝের ব্যবধান কমিয়ে আনছে, কিন্তু খুব ধীরে। গেজ লনের হালকা ঢালু পথ বেয়ে দৌড়ে নামছে, রুট ১৫র দিকে, আর লুইস মনে প্রানে প্রার্থনা করছে যাতে গেজ পা হড়কে পড়ে যায় বাচ্চারা যখন খুব জোড়ে দৌড়ায় ওরা প্রায় সব সময়ই হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়, কারণ পায়ের ওপর তাদের পাকাপোক্ত নিয়ন্ত্রণ থাকেনা। লুইস ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে যাতে গেজ পড়ে যায়, ও ব্যথা পেলে পাক, পা ভাঙলে ভাঙুক, মাথা ফাটলে ফাটুক, তারপরও যেন ও পড়ে যায়, কারণ সে একটা দশ চাকার মস্ত ট্রাকের ছুটে আসার গমগম শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ও তখন চিৎকার করে গেজের নাম ধরে ডাকে আর তার বিশ্বাস ও ওর নাম শুনে থামতে চেষ্টাও করেছিল। গেজ সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল যে তার খেলা শেষ, কারণ এটা যদি খেলাই হতো তাহলে তার বাবা-মা তার নাম ধরে চিৎকার করতো না। ও থামতে চেষ্টা করে আর ততক্ষণে ট্রাকের গমগমে শব্দটা গর্জনে রুপ নিয়েছে। এবার লুইস প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে এগুতে থাকে এবং তার বিশ্বাস তার আঙুলের মাথাটা গেজের জ্যাকেটে ঘষাও খেয়েছিল, কিন্তু গেজের গতি তাকে ঠেলে রাস্তার ওপর নিয়ে যায়। আর ট্রাকটা বজ্রপাতের ন্যায় ধেয়ে আসে, ট্রাকের চকচকে বডিতে রোদ ঝকমক করছে, ড্রাইভার সেটার ব্রেক চেপে ধরেছে আর বিকট শব্দে হর্ন দিচ্ছে…আর সেটা ছিল গত শনিবার, তিন দিন আগে।
“আমি ঠিক আছি,” সে স্টিভকে বলে। “আমার এখন যাওয়া উচিত।”
“তুমি প্লিজ নিজেকে সামলাও, ওদের সাহায্য করো,” স্টিভ জ্যাকেটের হাতায় চোখ মুছে বলে। “এতে তোমার নিজের সাহায্যও হবে। তোমাদের তিনজনের একসাথে এই সময়টার মোকাবেলা করতে হবে লুইস। এছাড়া আর দ্বিতীয় কোন উপায় নেই।”
“ঠিক,” লুইস সম্মতি জানায়। তার মনে সেদিনের ঘটনা আবারো ঘুরপাক খেতে থাকে, শুধু এবারে সে লাফিয়ে দুই ফিট এগিয়ে গিয়ে গেজকে ধরতে পেরেছে এবং বর্তমানে যা হচ্ছে তার কিছুই ঘটেনি।
একই সময়ে পূর্বদিকের রুমটাতে এলি জাড ক্র্যান্ডালের সাথে মনোপলি খেলছে, কোনরকম মনোযোগ ছাড়াই-সে লক্ষ্যহীনভাবে তার মনোপলি মার্কার নাড়ছে। এক হাতে মনোপলির ডাইস ঝাঁকাচ্ছে আর আরেক হাতে তার আর গেজের সেই ছবিটা ধরে আছে সে।
স্টিভ মাস্টারটন সিদ্ধান্ত দেয় দুপুরে রাচেল গেজের ফিউনারেলের ভিজিটিং আওয়ারে যেতে পারবে; যে সিদ্ধান্তের জন্যে তার পরবর্তীতে অনুশোচনা হয়।
রাচেলের বাবা-মা সকালেই ব্যাঙ্গরে বিমানে করে চলে এসেছেন। তারা উঠেছেন হলিডে ইন হোটেলে। মিস্টার গোল্ডউইন দুপুর নাগাদ চারবার ফোন করেছেন তার মেয়ের সাথে কথা বলার জন্যে। স্টিভ তাকে কঠিন থেকে কঠিনতরভাবে ফিরিয়ে দিয়েছে। চতুর্থবারে সে বৃদ্ধকে একরকম ধমক দিয়েই বলে তাকে তার মেয়ের সাথে কথা বলতে দেয়া হবে না। মিস্টার গোল্ডম্যান বলেন নরকের সব কুকুর মিলেও তাকে তার মেয়ের সাথে কথা বলা থেকে আটকে রাখতে পারবে না। স্টিভ বলে রাচেলের কিছু একা সময় প্রয়োজন, তার ছেলের ফিউনারেলে যোগ দেয়ার আগে। আর সে নরকের সকল কুকুরের কথা জানে না কিন্তু সে স্টিভ নামের এক আইরিশ আমেরিকান ডক্টর অ্যাসিস্ট্যান্টের কথা জানে যে রাচেলের সাথে কাউকে কথা বলতে দেবে না; যতক্ষণ না সে নিজের ইচ্ছেয় সবার সাথে দেখা করে। এরপর আত্মীয়- স্বজনরা যা ভালো বুঝবে তাই করবে, কিন্তু তার আগে না।
বৃদ্ধ তাকে গালাগাল দিয়ে ঠাস করে ফোন রেখে দেয়। স্টিভ ভেবেছিল গোল্ডম্যানরা হয়তো দুপুরের ভিজিটিং আওয়ারে যাওয়ার চিন্তা বাদ দিবে, কিন্তু দেখা গেল তারা আসলে অপেক্ষা করার সিদ্ধান্তই নিয়েছিল। দুপুরের আগে রাচেলকে দেখে মনে হলো ওর বেশ উন্নতি হয়েছে। অন্তত সে বুঝতে পারছিল সে কোন টাইমফ্রেমে আছে। ও কিচেনে গিয়ে দেখলো যে স্যান্ডউইচ বানানোর কিছু আছে কি না, কারণ অনুষ্ঠানের পর কেউ কেউ হয়তো বাসায় আসবে, তাই না? সে স্টিভকে জিজ্ঞেস করে।
স্টিভ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
ফ্রিজে বাটারবল টার্কি ছাড়া কিছু ছিল না, রাচেল সেটাই ওভেনে চড়িয়ে দেয়। স্টিভ কয়েক মিনিট পর কিচেনে গিয়ে দেখে রাচেল ওভেনের টার্কির দিকে তাকিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।
“রাচেল?”
ও স্টিভের দিকে তাকায়। “গেজ টার্কির সাদা মাংস খুব পছন্দ করতো। আমার মাত্র মনে হলো যে ও আর কখনো টার্কির মাংস খাবে না।”
স্টিভ রাচেলকে ওপরতলায় পাঠায় ড্রেস-আপের জন্যে; যেটা ওর মানসিক অবস্থা বোঝার জন্যে একটা টেস্টও বটে। কিন্তু ও যখন একটা কালো জামা গায়ে দিয়ে আর একটা কালো পার্স হাতে নিয়ে নেমে এলো তখন স্টিভের মনে হলো রাচেল আসলেই ফিউনারেলের অনুষ্ঠানে যেতে পারবে এবং জাডও তার সাথে সম্মতি জানায়।
স্টিভ রাচেলকে ড্রাইভ করে শহরে ফিউনারেল অনুষ্ঠানে নিয়ে আসে। সে সুরেন্দ্র হারদুর সাথে লবিতে দাঁড়িয়ে রাচেলকে তার ছেলের ফুলে ঢাকা কফিনের দিকে প্রেতাত্মার মত এগিয়ে যেতে দেখে।
“কি অবস্থা, স্টিভ?” সুরেন্দ্র নিচু গলায় জিজ্ঞেস করে।
“বালের অবস্থা,” স্টিভ নিচু গলায় কর্কশভাবে বলে। “তুমি কী রকম হবে ভেবেছিলে?”
“বালের অবস্থাই ভেবেছিলাম।”
ঝামেলা শুরু হয় যখন গোল্ডম্যান তার মেয়ে জামাইয়ের সাথে হ্যান্ডশেক করতে অস্বীকার করলেন।
বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয় স্বজনদের দেখে লুইস তার শোকের জাল থেকে কিছুটা বেরিয়ে এসেছিল। ও খেয়াল করতে শুরু করেছে ওর চারদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে। সে এখন একটা ভোতা শোকের মধ্যে আছে যেটা ফিউনারেল হোমের পরিচালকদের চেনা এবং কাস্টমারের এই অবস্থাটা তারা নিজেদের লাভের জন্যে যতটুকু পারেন ব্যাবহার করে নেন। লুইস দাবার ঘোড়ার মতো
এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে।
পূর্বের রুমের বাইরে একটা ছোট হলঘর আছে যেখানে লোকজন ইজি চেয়ারে বসে সিগারেট ফুকতে পারে। চেয়ারগুলোর দুর্দশা দেখলে মনে হয় সেগুলো কোন দেউলিয়া হয়ে সব বিক্রি করা মেন্স ক্লাব থেকে কেনা। ভিউইং রুমের দিকের দরজার পাশে একটা ফলক ঝোলানো যেটাতে লেখা : গাজে উইলিয়াম ক্রিড। পুরো ভবনটা বেশ বড়। এই দালানের অপর দিকেই আরেকটা হলঘর আছে যেটার দরজার পাশের ফলকে লেখা : আলবের্তা বুরনাম নিডি। ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে কফিনের শো রুম, সেখানে থরে থরে নানান ডিজাইন এবং দামের কফিন সাজিয়ে রাখা।
গেজ মারা যাওয়ার পরদিন লুইস জাডের সাথে এখানে এসেছিল। তারা গ্রাউন্ড ফ্লোরে নামলে লুইস কফিনের শোরুমে না গিয়ে একটা হলওয়ে ধরে সোজা হেটে একটা সাদা দরজার সামনে চলে আসে। জাড আর ফিউনারেল ডিরেক্টর উভয়েই দ্রুত বলে উঠে,” ওদিকে না,” এবং লুইস তাদের কথা শুনে ফিরে আসে। লুইস জানতো ওই সাদা দরজার ওপাশে কি আছে, তার আঙ্কেল একজন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ব্যবস্থাপনার ঠিকাদার ছিলেন।
গেজের কফিনটা লুইসই পছন্দ করেছে; আমেরিকান ক্যাসকেট কোম্পানির রোজউডের একটা ডিজাইন, যেটার নাম ‘চির বিশ্রাম’। কফিনের গায়ে গোলাপী রঙের সিল্কের লাইন আছে। ফিউনারেল পরিচালক পাকা ব্যবসায়ির মত বলেন, লুইস দারুণ একটা কফিন পছন্দ করেছে তবে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন যে গোলাপীর বদলে নীল লাইনের ডিজাইন তার কাছে নেই। এরপর তিনি লুইসকে জিজ্ঞেস করেন সে ফিউনারেলের খরচ কিভাবে পরিশোধ করতে চায় সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কি না। যদি না নিয়ে থাকে তাহলে তারা তার অফিসে বসে তাদের অফার করা তিনটি জনপ্রিয় প্ল্যান নিয়ে কথা বলতে পারেন।
লুইসের মনে একটা কন্ঠ বলে উঠে : আমি গেজের কফিন সাশ্রয়ী অফারে কিনতে পেরেছি, হুররে!
মোহাচ্ছন্নের মত বলেছিল সে, “সব খরচ আমার ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পে করবো।”
“আচ্ছা।” পরিচালক বলেন।
কফিনটা লম্বায় চার ফুটের বেশি হবে না; বামন সাইজের কফিন। কিন্তু এর দাম ধরা হয়েছে ছয়শ ডলারেরও বেশি। কফিনটা এখন একটা কাঠের ফ্রেমের ওপর রাখা, তবে সেটার ওপর এতো ফুল দেয়া হয়েছে যে ফুল ছাড়া তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লুইসের কফিনটার কাছে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না, ফুলের গন্ধে ওর বমি আসছে।
এখান থেকে হলঘরে যাওয়ার করিডোরের মুখে একটা স্ট্যান্ডে একটা চামড়ায় বাধানো খাতা রাখা আছে; আর স্ট্যান্ডের সাথে চেন দিয়ে একটা কলমও বেঁধে রাখা আছে। ফিউনারেল ডিরেক্টর লুইসকে এই জায়গায় অবস্থান করতে বলেছেন যাতে সে তার আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুদের ‘স্বাগতম’ জানাতে পারে।
তার বন্ধু-বান্ধব আর আত্মীয়েরা সেই খাতায় তাদের ঠিকানা সহ নাম লিখে রাখবে। এই প্রথার ফায়দাটা কী লুইসের সেটা কখনোই মাথায় ঢোকেনি; এখন এটা নিয়ে সে কোন প্রশ্নও করলো না। তার ধারণা ফিউনারেল শেষ হয়ে গেলে ফিউনারেল হোমের পক্ষ থেকে খাতাটা তাদের দিয়ে দেয়া হবে। এটা তার কাছে পাগলামি ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। বাসার কোন ভুলে যাওয়া স্থানে তার স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিন, কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন, মেডিকেল কলেজের বার্ষিক ম্যাগাজিন পড়ে আছে; এমনকি তাদের বিয়েরও একটা বই আছে, যেটার চামড়ার মলাটের ওপর আমার বিয়ের দিন স্ট্যাম্প করে লেখা আছে। বইয়ের শুরুর ছবিটায় রাচেল তার বিয়ের পোশাক গায়ে দিচ্ছে এবং তার মা তাকে সাহায্য করছে, আর শেষের ছবিটা তাদের হানিমুনের সময় থাকা হোটেলের দরজার। বন্ধ দরজাটার সামনে দেখা যাচ্ছে তাদের দুই পাটি জুতো। এলির একটা বেবি এ্যালবামও আছে তাদের। সেখানে একটা পাতায় লেখা ‘আমার প্রথম হেয়ার কাট’ আর সাথে স্কচটেপ দিয়ে এটে দেয়া কিছু চুল; আরেক পৃষ্ঠায় লেখা ‘উপস!’ আর সাথে একটা ছবি, যেটাতে দেখা যাচ্ছে এলি আছাড় খেয়ে তার পাছার ওপর পড়ে যাচ্ছে-সবটাই ভীষন কিউট।
আর এখন তাদের কালেকশনে সেসব বইয়ের সাথে আরেকটি বই যোগ হতে যাচ্ছে। এটাকে কী বলে যেনো?
লুইস স্ট্যান্ডের পাশে অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে পার্টি শুরু হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কী বলে এটাকে? আমার মৃত্যু ম্যাগাজিন? ফিউনারেল অটোগ্রাফস? গেজকে মাটিতে পোঁতা দিবস?
সে খাতাটা বন্ধ করে দেখলো তাদের বিয়ের এলবামের মত এটির মলাটও চামড়ায় বাধানো কিন্তু তফাতটা হচ্ছে এর গায়ে কিছুই লেখা নেই।
ক্রিডদের বাড়ির পরিচারিকা মিসি ডেন্ডিজ সকালে সবার আগে চলে এসেছিলেন। নরম মনের মিসি ডেন্ডিজ বহুবার তাদের বাচ্চাদের দেখাশোনা করেছেন রাচেলের অনুরোধে। লুইসের মনে পড়ে যায় যেদিন ভিক্টর পাস্কো মারা গিয়েছিল সেদিনও মিসি গেজ আর এলিকে দেখাশোনা করার জন্যে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর এই ফুরসতে সেদিন রাচেল তার সাথে দুবার…একবার বাথটাবে আরেকবার বেডরুমে।
মিসি কাঁদছিল, অঝোরে। আর লুইসের নির্লিপ্ত শান্ত চেহারা দেখে তার কান্নার পরিমাণ আরো বেড়ে গেল। তিনি লুইসকে জড়িয়ে ধরার জন্যে প্রায় হাতড়াতে লাগলেন। লুইসও তাকে জড়িয়ে ধরে। লুইস ভাবে, এরকমই হওয়ার কথা ছিল; যে একজনের মানবিক বোধ আরেকজনকে স্পর্শ করবে, তার তীব্র শোককে হালকা করবে…
“আমি খুবই সরি,” মিসি বলেন। “এতো মিষ্টি একটা মাসুম বাচ্চা…আমি যে ওকে কতো ভালোবাসতাম, লুইস। আমি খুব দুঃখিত। ওই রোডটা খুনি। আর আমি আশা করি ওই ট্রাকের ড্রাইভারকে ওরা সারা জীবন জেলে পচিয়ে মারবে। এতো জোরে কেউ ট্রাক চালায়? অতো মিষ্টি ছেলেটা, এতো চালাক…খোদাই জানেন কেন তিনি ওকেই নিয়ে গেলেন; আমরা সেটা কোনদিনই বুঝবো না। আমি খুব দুঃখিত।”
লুইস তাকে জরিয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলো। সে টের পেলো মিসির চোখের জলে তার শার্টের কলার ভিজে গেছে। তিনি রাচেলের খোঁজ করলে লুইস বলল রাচেল বাসায় বিশ্রাম নিচ্ছে। তিনি প্রমিজ করলেন যে তিনি বাসায় গিয়ে রাচেলকে দেখে আসবেন। মিসি আরো বললেন তিনি যেকোন সময় এলিকে দেখার জন্যে রাজি আছেন, যতবার তাদের প্রয়োজন হয়। লুইস তাকে ধন্যবাদ জানালো।
তিনি চলে যাচ্ছিলেন; তার চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। তিনি কফিনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন যখন লুইস তাকে পেছন থেকে ডাকলো। ফিউনারেল পরিচালক, যার নামটাও লুইসের মনে পড়ছে না; সে বলেছে সবাইকে দিয়ে ওই খাতাটা সাইন করাতে এবং লুইস সেটা করেই ছাড়বে।
অতিথি, প্লিজ সাইন করুন, সে ভাবে আর এ চিন্তা করে সে প্রায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছিল।
মিসির দুঃখ ভরা চোখগুলো তার সেই হাসির বেগ দূর করে দেয়।
“মিসি, আপনি এই খাতায় একটা সাইন করবেন?” সে জিজ্ঞেস করে এবং তার মনে হলো আরেকটা কথা যোগ করা প্রয়োজন; “রাচেলের জন্যে।”
“অবশ্যই,” তিনি বলেন। হঠাৎ করেই লুইসের মনে হলো সে জানে মিসি এক্ষুনি কী বলতে যাচ্ছেন এবং কোন এক কারণে সে সেই কথাটার প্রতি তীব্র ঘৃণা বোধ করতে থাকে। কিন্তু তবুও কথাটা তাকে শুনতেই হবে, কোন মুক্তি নেই। শুধু একবার নয়, আজকের দিনে হয়তো শত শত বার এই কথায় তার হৃদয় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হবে, কিন্তু সামাজিকতা রক্ষার খাতিরে এটা তাকে হজম করতে হবে।
“খোদাকে ধন্যবাদ যে ও বেশি কষ্ট পায়নি, লুইস। অন্তত পক্ষে যা ঘটার চোখের পলকেই ঘটে গেছে।”
হুম, একদম চোখের পলকেই, সে মিসিকে বলবে বলে ভাবে- আহ, শুনলে মিসির চেহারাটা আবার কুঁকড়ে যাবে, সে কথাটা মিসিকে শুনিয়ে দেবার জন্যে লুইসের মুখ নিশপিশ করছে। এক নিমিষেই, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আর এজন্যেই কফিনের মুখ খোলা হচ্ছে না ফিউনারেলে, কারণ ওকে দেখলে আপনার মাথা নষ্ট হয়ে যাবে। অন্য লাশদের যেমন মেকাপ পাউডার দিয়ে পুতুল সাজিয়ে কফিনে শুইয়ে রাখা হয়, সেরকমটা গেজের ক্ষেত্রে সম্ভব না; কারণ দুনিয়ার সব মেকাপ ব্যবহার করেও ওকে এমনভাবে মানুষের সামনে দেখানো যাবে না যাতে তাদের রাতে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন না হয়। একদম বিদ্যুৎ বেগে সব ঘটে গেছে মিসি ডিয়ার। এই মুহূর্তে ও রাস্তার ওপর ছিল আর পরের মুহূর্তেই ও পড়ে ছিল রিঙ্গারদের বাড়ির সামনের রাস্তায়। ট্রাকটা ওকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলে; মেরে ফেলার পর ওকে টেনে হিচড়ে প্রায় একশো গজ দূরে নিয়ে যায়; পুরো একটা ফুটবল মাঠের থেকেও বেশি দূরত্বে। মিসি, আমি ওর পেছনে পেছনে পাগলের মত দৌড়াচ্ছিলাম, ওর নাম ধরে চিৎকার করতে করতে। আর আমি মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যাতে ও বেঁচে থাকে। আমি দশ গজ দৌড়ানোর পর ওর বেসবলের ক্যাপ রাস্তার ওপর পড়ে থাকতে দেখলাম, বিশ গজ পর পেলাম ওর স্টার ওয়ার্স স্নিকার্স। যখন চল্লিশ গজ দৌড়ালাম, ততক্ষনে ট্রাকটা রাস্তার ওপর থেকে ছিটকে পড়ে রিঙ্গারদের বার্নের পেছনের মাঠের ওপর ছুরির ফলার মত ঢুকে গিয়েছে। লোকজন তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে উঁকি ঝুকি দিচ্ছে আর আমি পাগলের মত ওর নাম ধরে চিৎকার করতে করতে ছুটছিলাম। পঞ্চাশ গজ পৌঁছানোর পর রাস্তার ওপর গেজের গায়ের জাম্পারটা পেলাম, উল্টানো অবস্থায় আর সত্তর গজ পর পেলাম গেজের আরেক পাটি জুতো আর এর পর পেলাম গেজকে।
হঠাৎ করেই লুইসের পৃথিবী ধূসর হয়ে আসে। তার চোখের সামনে থেকে সব কিছু হারিয়ে যায়। সে তার হাতের তালুতে খাতা রাখা স্ট্যান্ডটা অনুভব করতে পারছিল হালকা হালকা, ব্যস এটুকুই।
“লুইস?” মিসির কন্ঠ। অনেক দূর থেকে ভেসে আসা রহস্যজনক কন্ঠটা তার কানে বাজতে থাকে।
“লুইস?” এবার কাছ থেকে। একটু আতঙ্ক মিশ্রিত কণ্ঠে।
লুইসের পৃথিবী ঘুরতে ঘুরতে তার চোখের সামনে এসে পড়ে।
“তুমি ঠিক আছো?”
লুইস মৃদু হাসে। “আছি,” সে বলে। “আমি ঠিক আছি।”
মিসি তার নিজের এবং তার স্বামীর হয়ে সাইন করলেন-মিস্টার এন্ড মিসেস ডেভিড ডেন্ড্রিজ-সাথে তিনি তাদের ঠিকানাও লিখলেন-রুরাল বক্স ৬৭, ওল্ড বাকস্পোর্ট রোড-তিনি লুইসের দিকে তাকিয়ে চট করে চোখ নামিয়ে নিলেন, যেন যেই রোডে গেজ মারা গিয়েছে সেই রোডে তার ঠিকানা হওয়াটা একটা অপরাধ।
“ভালো থেকো, লুইস,” তিনি ফিসফিস করে বলেন।
মিসির হাজবেন্ড লুইসের সাথে হ্যান্ডশেক করে বিড়বিড় করে কিছু বলে, আর তার গলার পুরুষালী কণ্ঠমণি ওঠানামা করে কিন্তু লুইস কিছুই শুনতে পায় না। তারপর সে তার স্ত্রীর পিছে পিছে কফিনটার দিকে এগিয়ে যায়, যেটা তৈরি করা হয়েছে ওহাইওতে, যেখানে গেজ কখনো যায়নি, না সেখানে তাকে কেউ চেনে।
***
ডেন্ডিজদের পর বাকিরা আসতে শুরু করে। লুইস তাদেরকে রিসিভ করলো আর তারা লুইসকে আলিঙ্গন করলো,তার সাথে হ্যান্ডশেক করলো, তার কাছে চোখের জল ফেলল। তার শার্টের কলার এবং তার ধূসর কোটের হাতার ওপরের অংশ কিছুক্ষণের মধ্যেই বেশ ভিজে গেল। ফুলের গন্ধ ধীরে ধীরে এদিকেও আসতে শুরু করে এবং চারদিকে ফিউনারেলের গন্ধ ছড়িয়ে দেয়। এই ঘ্রাণের সাথে সে একদম ছোটবেলা থেকেই পরিচিত। গেজের কষ্ট না পেয়ে দ্রুত মৃত্যু কথাটা সে শুনলো বত্রিশ বার, তার নিজের হিসেবে। খোদা তার বিস্ময়গুলো রহস্যজনকভাবে ঘটান, এটা সে শুনলো পচিশ বার। ও এখন বেহেশতে ফেরেশতাদের সাথে খেলছে, এটা সে শুনলো সর্বমোট বারো বার।
লুইসের অসহ্য লাগছে। এই কথাগুলোর যা কিছু আবেদন ছিল, বার বার শোনার কারণে তাও আর অবশিষ্ট নেই। কথাগুলো ওকে যতবার বলা হচ্ছে সেগুলো শেল হয়ে তার হৃদয়ের তত গভীরে গিয়ে আঘাত করছে। যতক্ষণে তার শ্বশুরড়-শ্বাশুড়ি এসে উপস্থিত হন ততক্ষনে অনেকটা মারমুখি মেজাজে ছিল।
লুইসের মাথায় প্রথম ভাবনা যেটা এলো সেটা হচ্ছে-রাচেল যা বলেছিল সেটাই ঠিক। তার শ্বশুড় আসলেই অনেক বুড়িয়ে গেছে। তার বয়স কত? আটান্ন, ঊনষাট? কিন্তু আজ তাকে দেখে মনে হচ্ছে তার বয়স অন্তত সত্তর। তাকে হাস্যকরভাবে ইজরায়েলের প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের মত লাগছে, মাথায় মস্ত টাক আর চোখে বেমানান চশমা। রাচেল থ্যাঙ্কস গিভিং ট্রিপ থেকে ফিরে বলেছিল তার বাবা বুড়িয়ে গিয়েছেন, কিন্তু এতোটা লুইস ভাবেনি। ঠিকই আছে, সে ভাবে, হয়তো তিনি তখন এতো বুড়িয়ে যাননি এখন যেমনটা লাগছে। কারণ তখনো তার দুটো নাতি-নাতনিই বেঁচে ছিল।
লুইসের শ্বাশুড়ি ডোরি হেঁটে তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার মুখ কালো জাল জাল কাপড়ের আচ্ছাদনে ঢাকা। তার চুলে নীল রঙের শেড, যেটা এই সময়কার ধনী বয়ষ্ক মহিলারা বেশ পছন্দ করে। লুইস কালো জালের নিচে ওনার চোখের চিকচিক করতে থাকা পানি দেখতে পাচ্ছে।
হঠাৎ তার মনে হলো সে আগের ঝামেলা সব ভুলে যাবে। হঠাৎ করেই যেন তাদের মধ্যের আগের সেই বোঝার ভার লুইসের কাছে অসহ্য মনে হতে থাকে।
“আরউইন, ডোরি,” সে মৃদু স্বরে বলে। “আসার জন্যে আপনাদের অনেক ধন্যবাদ।”
লুইস তার দুই হাতই সামনে বাড়িয়ে দেয়। এক হাত শ্বশুড়ের সাথে হ্যান্ডশেক করার জন্য বাড়িয়ে দেয়ার মত করে আর একই সাথে আরেক হাত তার শ্বাশুড়িকে আলিঙ্গন করাতে আহ্বান করার মত করে। অথবা দুজনকেই একসাথে জড়িয়ে ধরার মত করে। সে প্রথমবারের মত তার চোখ দিয়ে পানি ঝরা টের পায়। তার হঠাৎ ধারণা হলো তারা তার এবং তাদের মাঝের যে দেয়ালটা আছে, সেটা সরিয়ে ফেলবেন। গেজ মরে গিয়ে অন্তত এটুকু উপকার করে যাবে। ঘটনাটা যেন কোন রোমান্টিক নভেলের কাহিনির মত হবে, যে কারো মৃত্যুতে শোকের সাথে সাথে অনেকের মাঝে বোঝাপড়াও হবে।
ডোরি তার দিকে এগিয়ে আসছে, এবং হয়তো তিনি লুইসের দিকে তার নিজের হাতও বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তিনি কিছু বললেন, “ওহ, লুইস …,” এতোটুকু লুইস বুঝতে পারলো, বাকিটা না-এবং তখনই গোল্ডম্যান তার স্ত্রীকে পেছনে টেনে নিলেন। কয়েক মুহূর্তের জন্যে তারা তিনজন এমনভাবে দাঁড়িয়ে গেল যেটা হয়তো শুধু তারা তিনজন ছাড়া আর কেউ খেয়াল করেনি। হয়তো ফিউনারেল পরিচালকের চোখে পড়েছে, লুইস ভাবে, কারণ এরকম কিছু হলে তার আঙ্কেল কার্লের চোখেও নিশ্চয়ই পড়তো। লুইস তার হাত বাড়িয়ে আছে আর আরউইন এবং ডোরি কাপড়ের দোকানের কাপড় পরানো পুতুলের মত দাঁড়িয়ে আছে।
লুইস চেয়ে দেখলো তার শ্বশুড়ের চোখে কোন পানি নেই; বরং তার চোখ ঘৃণায় জ্বলজ্বল করছে। সে কী ভেবেছে আমি তাকে ক্ষেপানোর জন্যে গেজকে মেরে ফেলেছি? তিনি তার চোখগুলো দিয়ে লুইসকে মেপে দেখছিলেন, লুইসের মাঝে সেই ছোটলোকটাকে খুঁজছেন যে তার মেয়েকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছে এবং এই দুর্ভাগ্য এনে দিয়েছে। এরপর ওনার চোখ লুইসের পাশে সরে গেল-গেজের কফিনের দিকে-এবং এরপর তার চোখ কিছুটা শীতল হলো।
লুইস তারপরেও শেষ চেষ্টা করে। “আরউইন,” সে বলে। “ডোরি। প্লিজ। আমাদের এই জিনিসটা একসাথে অতিক্রম করতে হবে।”
“লুইস,” ডোরি আবারো বলেন-লুইসের মনে হয় তিনি বেশ দয়ার্দ্র কন্ঠেই বলেন-এবং পরমুহূর্তেই তারা হেঁটে লুইসের পাশ থেকে সরে যান। আরউইন গোল্ডম্যান হয়তো তার স্ত্রীকে একরকম টেনেই নিয়ে যাচ্ছেন; তিনি ডানে বায়ে কোনদিকেই তাকাচ্ছেন না, লুইসের দিকে তো নয়ই। তারা কফিনের দিকে এগিয়ে গেলেন এবং গোল্ডম্যান তার পকেট থেকে একটা ছোট্ট কালো তালু টুপি হাতড়ে বের করলেন।
আপনারা খাতায় সাইন করেননি, লুইস ভাবে। তার ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে ঘৃণা বেরিয়ে আসে। সে ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে।
একসময় সকালের অনুষ্ঠান শেষ হয়। লুইস বাসায় ফোন করে। জাড ফোন ধরে জিজ্ঞেস করে কেমন হলো অনুষ্ঠান। “ভালো,” লুইস বলে। সে জাডকে জিজ্ঞেস করে স্টিভের সাথে কথা বলা যাবে কি না।
“ও যদি নিজে নিজে পোশাক পরে রেডি হতে পারে তাহলে আমি ওকে দুপুরের ভিজিটিং আওয়ারে যেতে দিব,” স্টিভ বলে। “ঠিক আছে?”
“আচ্ছা,” লুইস বলে।
“তোমার কী অবস্থা, লু? কোন ফাজলামি না, সত্যি করে বলো।”
“আছি আর কী,” লুইস বলে। “মানিয়ে নিচ্ছি।” আমি সবাইকে দিয়ে খাতায় সাইন করিয়েছি, শুধু আমার শ্বশুড় শাশুড়ি ছাড়া। তারা সাইন করবে না।
“আচ্ছা,” স্টিভ বলে। “তাহলে লাঞ্চে দেখা হচ্ছে?”
লাঞ্চ। লাঞ্চে দেখা। ব্যাপারটাকে লুইসের এতো অচেনা মনে হচ্ছে যেন সেটা সে কোন সায়েন্স ফিকশান মুভিতে দেখেছে কিশোর থাকতে। লেফটেনেন্ট এব্যেলসান, এই গ্রহের অধিবাসীদের একটা অদ্ভুত রীতি আছে। যখন তাদের কারো বাচ্চা মারা যায়, তখন তারা লাঞ্চে একে অপরের সাথে দেখা করে। আমি জানি ব্যাপারটা কত অদ্ভুত আর বর্বর, কিন্তু কি আর করা-এই গ্রহ এখনো টেরাফর্মড করা হয়নি।
“শিওর,” লুইস বলে। “সকাল আর দুপুরের ভিজিটিং আওয়ারের ফাঁকে যাওয়ার জন্যে কোন রেস্টুরেন্টটা ভালো হবে, স্টিভ?”
“
“টেক ইট ইজি, লু,” স্টিভ বলে। লুইসের মনে হলো না স্টিভ খোঁচা খেয়ে রাগ করেছে। এমন উন্মত্ত অবস্থাতেও লুইসের মনে হলো সে অনেক পরিস্কারভাবে লোকজনদের বুঝতে পারছে। হয়তো এটা একটা ভ্রম, কিন্তু তার কাছে সেরকম মনে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে তার মনে হচ্ছে স্টিভ ভাবছে যে লুইসের এই খোঁচা মেরে কথা বলাও তার আগের নির্লিপ্ততা থেকে ভালো।
“চিন্তা করো না,” সে স্টিভকে বলে। “বেঞ্জামিনে গেলে কেমন হয়?”
“শিওর,” স্টিভ বলে। “বেঞ্জামিনে গেলেই হবে।”
লুইস ফিউনারেল পরিচালকের অফিস রুম থেকে ফোন করেছিল। সে যখন ফোন রেখে বের হয় তখন দেখে যে হলরুম পুরো খালি, শুধু একদম সামনের সারিতে আরউইন আর ডোরি গোল্ডম্যান মাথা নিচু করে বসে আছে। তাদের দেখে লুইসের মনে হলো তারা অনন্তকালের জন্য এখানে বসে থাকবে।
বেঞ্জামিনে যাওয়াটা ভালো সিধান্ত ছিল। এখানকার লোকজন সকাল সকাল লাঞ্চ করে ফেলে। বেলা একটা হতে হতেই জায়গাটা বেশ ফাঁকা মনে হচ্ছে। স্টিভ আর রাচেলের সাথে জাডও এসেছেন। তারা চারজন ফ্রাইড চিকেন অর্ডার করে। এক সময় রাচেল বাথরুমে গিয়ে এতো দেরি করে যে স্টিভ নার্ভাস হয়ে পড়ে। স্টিভ আরেকটু হলেই কোন ওয়েট্রেসকে বলতে যাচ্ছিল বাথরুমে গিয়ে রাচেল ঠিক আছে কি না চেক করার জন্যে, আর তখনই রাচেল ফিরে আসে লাল চোখ নিয়ে
লুইস তার চিকেন নিয়ে নাড়াচাড়া করে আর প্রচুর বিয়ার গিলতে থাকে। জাডও লুইসের সাথে পাল্লা দিয়ে বিয়ার গিলতে থাকেন, কোন কথা না বলে।
চারজন তাদের খাবার প্রায় কিছুই খায়নি। লুইস তার অতিপ্রাকৃত ক্ষমতাবলে দেখতে পেল তাদের মোটা ওয়েট্রেস মেয়েটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছে খাবারে কোন সমস্যা আছে কি না। কিন্তু সে যখন রাচেলের লাল চোখ দেখলো তখন ভাবলো সেটা জিজ্ঞেস করা হয়তো ঠিক হবে না। এরপর কফি খেতে খেতে রাচেল হঠাৎ এমন অকপটে একটা কথা বলে উঠে যাতে সবাই শকড় হয়-বিশেষ করে লুইস, যার প্রচুর বিয়ার খাবার ফলে অবশেষে একটু ঘুম আসছে। “আমি ওর কাপড়গুলো সালভেশন আর্মি সংস্থার মাধ্যমে দান করে দিব।”
“তাই?” স্টিভ কয়েক মুহূর্ত পরে বলে।
“হুম,” রাচেল বলে। “ওর সব জাম্পারগুলো…প্যান্টগুলো…শার্টগুলো কেউ এগুলো পেলে খুশি হবে। ওগুলো প্রায় সবগুলোই ভালো অবস্থায় আছে। শুধু সেদিন যেগুলো পড়া ছিল সেগুলো বাদে। ওগুলো…নষ্ট হয়ে গেছে।”
কথার শেষ শব্দগুলো বলতে গিয়ে রাচেলের গলা ধরে আসছে। ও কফি খেতে চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। একটু পরেই ও দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করে।
এরপর এক অদ্ভুত মুহূর্ত শুরু হয়। সবাই যেন লুইসের কাছ থেকে কিছু আশা করছে। তার সুপার পাওয়ার, যেটা সে সারাদিন ধরে অনুভব করছে, সেটা তাকে আগের চাইতেও অনেক জোরালোভাবে বলছে সবাই তার কাছে কী চাইছে। এমনকি ওয়েট্রেস মেয়েটাও তার কাছ থেকে কিছু আশা করছে। মুহূর্তখানেক সময় সে বিভ্রান্ত অবস্থায় থেকে এরপর বুঝতে পারে কী হয়েছে। তারা চাচ্ছে সে তার স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিক।
কিন্তু সে তা করতে পারলো না। সে তা করতে চাচ্ছে আর সে জানে সেটা করা তার দায়িত্বও। কিন্তু তারপরও সে তা করতে পারল না। কারণ তাদের বিড়ালটা। ওই হতচ্ছাড়া বিড়ালটা। চার্চ, যে ইঁদুর শিকার করে নাড়িভুড়ি বের করে ফেলে, যে পাখি ধরে মাথা খুবলে ছিড়ে নেয়। লুইস যখন এগুলো দেখতে পায় সে বিনা প্রতিবাদে সেগুলো পরিস্কার করে। কারণ ওসবের জন্যে তো লুইস নিজেই দায়ি। কিন্তু গেজের জন্যেও কি তার সে রাতে মিকমেকদের গোরস্থানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দায়ি?
সে তার আঙুলগুলো দেখে। দেখতে পায় তার আঙুলগুলো গেজের জ্যাকেটের গায়ে ঘষা খাচ্ছে। এরপর গেজের জ্যাকেট আর নেই। গেজ ও আর নেই।
লুইস তার কফি কাপের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং তার স্ত্রীকে তার পাশে কাতর হয়ে কাঁদতে দেয়। সে রাচেলকে কোন সান্ত্বনা দেয় না।
কয়েক মুহূর্ত পরে-ঘড়ির হিসেবে খুব অল্প সময় হলেও বাস্তবে তাদের জন্যে তা ছিল অত্যন্ত দীর্ঘ-স্টিভ রাচেলকে নম্রভাবে জড়িয়ে ধরে। স্টিভ রাগান্বিতভাবে লুইসের দিকে তাকিয়ে আছে। লুইস জাডের দিকে তাকায় সমর্থনের জন্যে, কিন্তু তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, লজ্জায়। লুইস তার কাছ থেকে কোন সাহায্য পেল না।
অধ্যায় ৩৭
“আমি জানতাম এরকম কিছু একটাই হবে,” আরউইন গোল্ডম্যান বললেন। ঝামেলার শুরু সেখান থেকেই। “ও যখন তোমাকে বিয়ে করেছিল আমি তখনই বলেছিলাম, ‘তুমি কষ্ট পাবে। যতটুকু সহ্য করতে পারবে তার চাইতে আরো বেশি কষ্ট পাবে,’…আমি বলেছিলাম। এখন দেখো…কী ঘটলো।”
লুইস ধীরে ধীরে তার শ্বশুড়ের দিকে তাকায়। তাকে তার কালো টুপিতে অদ্ভুত লাগছে। এরপর সে নিজ থেকে পুরো রুম খুঁজে দেখলো রাচেল আছে কি না। এই বেলা সেই খাতাসহ স্ট্যান্ডের পাশে দাঁড়ানোর দায়িত্ব ছিল রাচেলের। কিন্তু রাচেল সেখানে নেই।
দুপুরের সেশনে ভীড় তুলনামূলক কম হয়েছে। শুরুর আধ ঘন্টা পর থেকে লুইস প্রথম সারিতে গিয়ে বসে আছে, একদম অসাড় হয়ে। কিছুই তাকে স্পর্শ করছে না। সে শুধু টের পাচ্ছে তার ঘুম পাচ্ছে; আর ফুলের অসহ্য গন্ধ। ঘুম পাওয়ার কারণ হয়তো কিছুক্ষণ আগে বিয়ার গেলা। ঘুম পাওয়াতে হয়তো ভালই হয়েছে। হয়তো টানা ষোল ঘন্টা ঘুমোলে সে
রাচলকে সান্ত্বনা দেয়ার মত অবস্থায় যেতে পারবে।
লুইস আরো কিছুক্ষণ সময় মাথা নিচু করে নিজের হাতগুলো দেখতে থাকে। লাঞ্চ থেকে ফিরে দুপুরের সেশনে যখন গোল্ডম্যানদের দেখতে না পেয়ে লুইস একটু খুশিই হয়েছিল; কিন্তু তার বোঝা উচিত ছিল গোল্ডম্যানদের একেবারে চলে যাওয়াটা হয়তো তার জন্যে একটু বেশিই উচ্চাভিলাসী ছিল।
“রাচেল কোথায়?” লুইস জিজ্ঞেস করে।
“ওর মায়ের সাথে। যেখানে ওর থাকা উচিত।” গোল্ডম্যান অনেকটা বিজয়ীর ভঙ্গীতে বললেন। তার মুখ থেকে ভুরভুর করে মদের গন্ধ বেরুচ্ছে। তিনি লুইসের সামনে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন যেন তিনি উকিল আর লুইস নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত আসামী। উনার পা কাঁপছে।
“আপনি ওকে কী বলেছেন?” ঝামেলার গন্ধ পেয়ে লুইস বলে। ও বুঝতে পারছে গোল্ডম্যান রাচেলকে কিছু বলেছেন। সেটা লুইস তার চেহারা দেখেই বুঝতে পারছে।
“যা সত্য তাই বলেছি। বলেছি বাবা-মায়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করলে কী হয়। আমি বলেছি-”
“আপনি সত্যি এসব বলেছেন?” লুইস অবিশ্বাসের সাথে বলে। “আপনি আসলেই এটা বলেননি, রাইট?”
“অবশ্যই বলেছি। আরো বলেছি,” আরউইন বলেন। “আমি জানতাম এরকমই কিছু একটা ঘটবে। আমি যেদিন তোমাকে দেখেছি সেদিনই বুঝেছি তুমি কেমন লোক।” তিনি লুইসের দিকে আরো ঝুঁকে এলেন আর তার মুখ থেকে মদের গন্ধ লুইসের নাকে এসে ধাক্কা মারে। “আমি একদম তোমার ভেতরটা দেখতে পেয়েছিলাম, হাতুড়ে ডাক্তার। তুমি আমার মেয়েকে ফুসলে বিয়ে করে কাজের মেয়ে বানিয়েছ। আর এখন ওর বাচ্চাকে তুমি রাস্তায় মরতে দিয়েছো…কুকুরের মত।”
বেশিরভাগ কথাই লুইসের মাথার ওপর দিয়ে গেল। সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না এই বেকুব বেঁটে লোকটা…”আপনি এসব ওকে বলেছেন?” সে আবারো বলে। “আপনি এসব বলেছেন?”
“আমি চাই তুমি নরকে পচে মর!” গোল্ডম্যান বলেন এবং রুমের বাকি চোখগুলো তার দিকে ঘুরে যায়। গোল্ডম্যানের রক্তিম বাদামি চোখগুলো দিয়ে পানি ঝরতে শুরু করে। তার টাকমাথা ফ্লোরোসেন্ট লাইটের আলোয় চকচক করছে। “তুমি আমার চমৎকার মেয়েটিকে একটা কাজের মেয়ে বানিয়েছো…ওর ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছো তুমি…আর আমার নাতিকে রাস্তায় মরতে দিয়েছো তুমি।”
তার গলার আওয়াজ উঁচু হতে হতে গর্জনের মত শোনা যায়।
“কই ছিলে তুমি? ও যখন রাস্তার ওপর খেলছিল তুমি কি তখন বাল ছিঁড়ছিলে? নিজের ছাইপাশ মেডিকেল আর্টিকেল নিয়ে ভাবছিলে? কি করছিলে তুমি তখন? ফাউলের ফাউল! ফালতু লোক! খুনী! খু—”
লুইস হঠাৎ খেয়াল করে তার হাত ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। সে দেখলো তার কোটের হাতা থেকে তার মুষ্টি বেরিয়ে আসছে। সেই মুষ্টি তার শ্বশুড়ের মুখে গিয়ে মিলিত হয়। সে টের পেল তার মুষ্টির নিচে তার শ্বশুড়ের ঠোট পিষে যাচ্ছে। এতে তার কোন আত্মতুষ্টি হচ্ছে না। তার শ্বশুড়ের ঠোঁটের নিচে লুইস ওনার দাঁতের পাটি অনুভব করতে পারছে।
গোল্ডম্যান হুমড়ি খেয়ে পিছিয়ে গেলেন। তার একহাত গেজের কফিনে লেগে সেটিকে কাত করে দিলো। ধাক্কায় কফিনের ওপর রাখা একটা ফুলদানি পড়ে গিয়ে বিকট শব্দে ভেঙে চৌচির হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। একটা চিৎকার শোনা গেল।
চিৎকার করেছে রাচেল। তার মা তাকে আটকে রাখার চেষ্টা করছে আর সে ছোটার জন্যে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। সেখানে যে দশ-পনেরোজন ছিল, প্রায় সবাই ভয় আর লজ্জায় থতমত খেয়ে গেছে। স্টিভ জাডকে নিয়ে লাডলোতে ফিরে গেছে আর লুইসের মনে হলো তাতে বেশ ভালো হয়েছে। এই দৃশ্যটা সে জাডকে দেখাতে চাচ্ছিল না।
“আমার বাবাকে মেরো না!” রাচেলের চিৎকার শোনা গেল। “লুইস, আমার বাবাকে মেরো না!”
“বুড়োদের মারতে খুব ওস্তাদ, তাই না?” পেটমোটা চেকের মালিক আরউইন গোল্ডম্যান খেকিয়ে ওঠলেন। তিনি রক্তাক্ত মুখে হাসছেন। বুড়োদের মারতে ওস্তাদ, তাই না? আমি অবাক হইনি, শুয়োরের বাচ্চা। আমি একদমই অবাক হইনি।”
লুইস তার দিকে ঘুরলে তিনি লুইসের কাঁধে একটা ঘুষি বসিয়ে দেন। ঘুষিটা তিনি সুবিধামতো মারতে পারেননি। কিন্তু লুইস এটার জন্যে একদমই প্রস্তুত ছিল না। ব্যথায় সে অসাড় হয়ে গেল। পরবর্তী দুই ঘন্টা সে ব্যথার চোটে ঢোক গিলতে পারেনি। সে একপাশে এক হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে বসে পড়ে।
প্রথমে ফুলদানিটা, এরপর আমাকে… সাবাস! লুইস হাসতে চায় কিন্তু তার গলা দিয়ে কোকানো ছাড়া কিছুই বের হয় না।
রাচেল আবারো চিৎকার করে ওঠে।
আরউইন গোল্ডম্যান লুইসের দিকে এগিয়ে এসে ওর কিডনির ওপর একটা কষে লাথি বসিয়ে দিলেন। তীব্র যন্ত্রণায় লুইস চোখে অন্ধকার দেখে। সে কার্পেটে হাত দিয়ে নিজেকে ফ্লোরে ভূপাতিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। “বুড়োদের সাথেও তো পারিসনে হারামজাদা!” গোল্ডম্যান কর্কশ গলায় চিৎকার করে উঠলেন। তিনি আবারো লাথি কষালেন। তবে এবার কিডনি মিস করলেন। লাথি গিয়ে লাগলো লুইসের পাছার ওপরের অংশে। লুইস ব্যথায় ঘোঁৎ করে ওঠে। এবার সে সত্যই ফ্লোরের ওপর পড়ে যায়। তার থুতনি মেঝেতে ধাক্কা লেগে জিভে কামড় লেগে যায়।
“উচিত শিক্ষা!” গোল্ডম্যান চিৎকার করে ওঠলেন। “আরো আগেই পাছায় লাথি মারা দরকার ছিল, হারামজাদা। যেদিন তোকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই তোর পাছায় লাথি মেরে কুত্তার মত খেদানো দরকার ছিল।” তিনি আবারো লাথি মারলেন, এবার দুই পাছায় একসাথে। গোল্ডম্যান ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাসছিলেন। লুইস প্রথমবারের মত খেয়াল করলো গোল্ডম্যান শেভ করে আসেননি-শোকের চিহ্ন। ফিউনারেল ডিরেক্টর তাদের দিকে ছুটে আসছে। রাচেল তার মায়ের হাত থেকে ছুটে চিৎকার করতে করতে তাদের দিকে ছুটে আসছে।
লুইস কোনরকমে উঠে বসে। তার শ্বশুড় আবারো তাকে লক্ষ্য করে লাথি মারে। কিন্তু এবার সে বুড়োর জুতো ধরে ফেলে আর গায়ের সব শক্তি দিয়ে পেছনে ঠেলে দেয়।
গর্জন করতে করতে গোল্ডম্যান একরকম উড়ে চলে গেলেন, ভারসাম্য পাওয়ার জন্যে এলোমেলোভাবে হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে। তিনি গেজের ‘চিরস্থায়ী বিশ্রাম’ কফিনের ওপর গিয়ে পড়লেন, যেটা তৈরি হয়েছে ওহাইওতে এবং মোটেই সস্তা না।
পেটমোটা ময়লার বস্তাটা আমার ছেলের কফিনের ওপর গিয়ে পড়েছে, লুইস ঘোরের মধ্যেই ভাবে। কফিনটা তার নিচের ফ্রেম থেকে বিকট আওয়াজ করে নিচে পড়ে। প্রথমে বাম দিকটা পড়ে, এরপর ডান দিক। কফিনের ছিটকিনি ভেঙে গেছে। এতো চিৎকার, গোল্ডম্যানের এতো তর্জন-গর্জনের মধ্যেও লুইস ঠিকই তার ছেলের কফিনের ছিটকিনি খুলে আসার আওয়াজ শুনতে পায়।
কফিন থেকে অবশ্য উৎসুক জনতার নির্লজ্জভাবে চেয়ে দেখার জন্যে গেজের থেতলানো লাশটা বেরিয়ে এলো না। তবে লুইস জানে যে গেজের লাশ কফিন থেকে বেরিয়ে আসেনি কারণ কফিনটা পাশ হয়ে পড়েনি, যেটা খুব সহজেই হতে পারতো। তবে কফিনটা পড়ার পর যখন ছিটকিনি ভেঙে ডালা খুলে এসেছিল কিছু সময়ের জন্যে, লুইস কফিনের ভেতরে তার ছেলের ধূসর কোটের রং দেখতে পায়। আরো দেখতে পায় হালকা গোলাপি রঙের কিছু, হয়তো গেজের হাতের তালু।
ফ্লোরে বসে নিজের দুহাতে মুখ গুজে লুইস কাঁদতে শুরু করে। সে তার শ্বশুড়ের প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে, আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে এম.এক্স মিসাইলের প্রতি, গ্লোবাল ওয়ার্মিং’এ পৃথিবীর মৃত্যুর প্রতি। এই মুহূর্তে লুইসের মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। হঠাৎ করেই, কোন কারণ ছাড়াই তার চোখের সামনে একটা ছবি ভেসে ওঠেঃ গেজ নকল মিকি মাউসের কান পড়ে ডিজনিল্যান্ডে হাসি মুখে আরেক বড় মিকি মাউসের সাথে হাত মেলাচ্ছে। সে ছবিটা খুব পরিস্কারভাবে দেখলো।
কফিনের জায়গাটায় এখন একটা হযবরল অবস্থা। কফিন মাটিতে পড়ে আছে। কফিনের সাপোর্টের ফ্রেমগুলো কোনটা উল্টে গেছে, কোনটা কাত হয়ে আছে। ফুলগুলোর মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে গোল্ডম্যান পড়ে আছেন, ক্রন্দনরত অবস্থায়। ফুলদানিগুলো থেকে পানি গড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। ফুলগুলো অনেকগুলোই ভেঙে গেছে; ভেঙে গিয়ে সেগুলো থেকে আরো বেশি গন্ধ ছড়াচ্ছে।
রাচেল চিৎকার করেই যাচ্ছে, করেই যাচ্ছে।
রাচেলকে থামানোর জন্যে লুইস কিছুই করতে পারে না। গেজ আর মিকি মাউসের ছবিটা ফিকে হয়ে আসছে; এবার সে ডিজনিল্যান্ডের মাইকে ঘোষনা শুনতে পেলো একটু পরে আতশবাজির শো হবে; এরপর তার চোখের সামনে থেকে ছবিটা সরে যায়। সে নিজের হাতে মুখ গুজে সেখানে বসে থাকে। সে চায়না কেউ তার চোখের পানি দেখুক, তার লজ্জা দেখুক, তার হতাশা দেখুক, তার দুর্দশা দেখুক, আর তার এই জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাওয়ার কাপুরুষতা দেখুক।
ফিউনারেল পরিচালক এবং ডোরি ধরাধরি করে চিৎকাররত রাচেলকে সেখান থেকে নিয়ে যায়। ওকে নিয়ে যে রুমে রাখা হয় সেটা রাখাই হয়েছে এরকম অবস্থার জন্যে; যারা শোকে উন্মত্ত হয়ে যায় বিশেষ করে তাদের জন্যে। সেখানে গিয়ে রাচেল একদম পাথরের মত চুপ হয়ে যায়। লুইসের অবস্থা কিছুটা টলমলে হলেও সে নিজেকে নিয়ন্ত্রনে রেখেছে। সে এবার নিজেই রাচেলকে ঘুমের ওষুধ দেয় আর বাকিদের বলে তাদের দুজনকে একটু একা থাকতে দিতে।
বাসায় ফিরে লুইস রাচেলকে বেডে নিয়ে যায় এবং আরেকটা ঘুমের ওষুধ দেয়। সে রাচেলকে বিছানায় শুইয়ে গলা পর্যন্ত চাদরে ঢেকে দেয়। এরপর রাচেলের ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “রাচেল, আমি সরি…আমি যদি পারতাম তাহলে পৃথিবীর যেকোন কিছুর বদলে যা ঘটেছে তা ফিরিয়ে নিতাম।”
“আচ্ছা,” রাচেল ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলে। এরপর ঘুরে খাটের নিজের পাশে পাশ ফিরিয়ে শোয়, লুইস থেকে দূরে সরে।
লুইস বলতে চাচ্ছিল তুমি ঠিক আছো? কিন্তু নিজের মনের ভেতর কথাটা শুনেই সে কথাটার অসাড়তা টের পেল। এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার কোন মানে হয় না। তাই সে অবশেষে জিজ্ঞেস করে, “কতটা খারাপ লাগছে?”
“খুব খারাপ, লুইস,” সে জবাব দেয়। এরপর সে একটা কথা বলে যেটা শুনে মনে হয় রাচেল হাসছিল। “সত্যি করে বলতে গেলে, জঘন্য।”
লুইসের হয়তো আরো কিছু বলা বা করার দরকার ছিল, কিন্তু সে তা করতে পারলো না।
সে বাতি নিভিয়ে সেখান থেকে চলে এলো। সে বুঝতে পারছে তার মেয়েকে সান্তনা দেয়ার মত অবস্থাও তার নেই।
এলির রুমের ছায়াঘেরা পরিবেশ দেখে লুইসের হঠাৎ মনে হলো এলির রুমে যে আছে সে আসলে গেজ। আর যা ঘটছে সব কিছুই হচ্ছে একটা দুঃস্বপ্নের অংশ, ভিক্টর পাস্কোর সেই স্বপ্নের মত। তার ক্লান্ত মন কয়েক মুহূর্তের জন্যে তা বিশ্বাসও করে নিল। রুমের ছায়াগুলো তাকে এরকম অদ্ভুত চিন্তা করতে প্ররোচিত করছে। রুমে ছায়া ছাড়া আর আছে টিভির বাড়তে কমতে থাকা উজ্জ্বলতা। টিভিটা জাড এলির রুমে রেখে গিয়েছে সময় কাটানোর জন্যে।
অবশ্যই এটা গেজ না, এটা এলিই। এখন এলি শুধু তার ভাইয়ের ছবি হাতে ধরে আছে তা না, ও তার ভাইয়ের নাম ছাপা ছোট্ট ক্যানভাসের চেয়ারটায় বসে আছে। রাচেল আর লুইস চিঠিতে অর্ডার করে পরিবারের চারজনের জন্যে চারটা চেয়ার আনিয়েছিল, প্রত্যেকটার পেছনে নিজেদের নাম ছাপা। এলি গেজের রুম থেকে চেয়ারটা নিজের রুমে নিয়ে এসেছে।
গেজের চেয়ারে এলি খুব চাপাচাপি করে বসেছে। চেয়ারের নিচের অংশ বিপদজনকভাবে ঝুলে পড়েছে। সে গেজের ছবি বুকে নিয়ে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে যেখানে একটা মুভি চলছে।
“এলি,” লুইস টিভি অফ করে দিয়ে বলে, “শোবার সময় হয়েছে।”
এলি কায়দা কসরত করে পিচ্চি চেয়ারটা থেকে বেরিয়ে এসে চেয়ারটাকে ভাঁজ করলো। দেখা যাচ্ছে ও হয়তো চেয়ারটা সাথে নিয়ে ঘুমানোর পরিকল্পনা করছে।
লুইস চেয়ারের ব্যাপারে কিছু বলবে কি না ভেবে একটু ইতস্তত করে সেই চিন্তা বাদ দিল। “তুমি কি চাও আমি তোমাকে শুইয়ে দিই, মামনি?”
“হ্যা, বাবা,” ও বলে।
“তুমি কি…তুমি কি আজ রাতে তোমার আম্মুর সাথে ঘুমোতে চাও?”
“নাহ, থ্যাঙ্কস।”
“তুমি শিওর?”
এলি মুচকি হাসে। “হুম, মা গায়ের চাদর টেনে নেয় ঘুমের মধ্যে।
“ জবাবে লুইসও মুচকি হাসে। “আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে।”
গেজের চেয়ারটা বিছানায় নেয়ার বদলে এলি সেটাকে বিছানার মাথার দিকে মেলে দিল। লুইসের মনে একটা অদ্ভুত চিন্তা আসলো-এলির রুমটাকে পৃথিবীর সবচাইতে ক্ষুদে সাইকিয়াট্রিস্টের রুম বলে মনে হতে লাগলো।
এলি গেজ আর তার ছবিটা বালিশের নিচে রেখে জামা বদলে বাথরুমে গেল দাঁত ব্রাশ করার জন্যে। এরপর ফিরে এসে ছবিটা বের করে ও সেটাকে নিয়ে শুতে গেল।
লুইস এলির পাশে বসে বলল, “মামনি, আমরা যদি একে অপরকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরি তাহলে এই শোক আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো।”
প্রত্যেকটা শব্দ যেন লুইসের গায়ে হুল ফুটিয়ে দিল। লুইস এটুকু বলেই বড্ড ক্লান্ত অনুভব করতে থাকে।
“আমি অনেক ভালোভাবে দোয়া করবো,” এলি বলে, “যাতে খোদা গেজকে ফিরিয়ে দেন।
“এলি-”
“খোদা চাইলেই ওকে ফিরিয়ে দিতে পারেন,” এলি বলে। “খোদা চাইলে সব করতে পারেন।”
“এলি, ঈশ্বরের ক্ষমতা থাকলেও ঈশ্বর এরকম কিছুই করেন না, “ লুইস ইতস্তত করে বলে আর তার মনের পর্দায় সে চার্চকে দেখতে পায়, টয়লেটের বন্ধ সিটে বসে তার দিকে ওই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকতে।
“উনি এরকম করেন তো,” এলি বলে। রবিবারের ধর্ম স্কুলের শিক্ষক আমাদের লেজারাসের কথা বলেছেন। সে মরে গিয়েছিল আর যিশু তাকে পুনরায় বাঁচিয়ে তোলেন। যিশু বলেছিলেন, ‘লেজারাস, উঠে এসো, কারণ আমাদের শিক্ষক বলেছেন যিশু যদি শুধু ‘উঠে এসো’ বলতেন তাহলে ওই কবরস্থানের সব মরা উঠে আসতো।”
“মামনি, সেটা অনেক অনেক আগের কথা।”
“আমি গেজের জন্যে সবকিছু রেডি রাখবো,” ও বলে। “আমার কাছে ওর ছবি থাকবে আর আমি ওর চেয়ারটাও ব্যবহার করবো-
“এলি, তুমি গেজের চেয়ারে বসতে পারবে না,” লুইস এলির উষ্ণ হাত ধরে বলে; এলির হয়তো জ্বর আসছে। “তুমি বসলে পিচ্চি চেয়ারটা ভেঙে যাবে।”
“ঈশ্বর এটাকে ভাঙতে দিবেন না,” এলি কোমল গলায় বললেও লুইস ওর চোখের নিচের বাদামি কালি দেখতে পায়। মেয়েকে এভাবে দেখে লুইসের হৃদয়টা ভেঙে যায়, সে ওর চেহারা থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। হয়তো চেয়ারটা ভেঙে গেলেই ভালো হবে, তাহলে হয়তো এলির চোখ খুলতে পারে।
“আমি সব সময় ওর ছবি আমার সাথে রাখবো আর ওর চেয়ারে বসবো,” সে বলে। “আমি ওর ব্রেকফাস্টও খাবো।” এলি আর গেজের দুরকম সিরিয়াল আছে ব্রেকফাস্টের জন্যে। এলি একবার গেজের সিরিয়াল খেয়ে বলেছিল সেটা খেতে নাকের ময়লার মত। এলির সিরিয়াল শেষ হয়ে গেলেও ও গেজের সিরিয়াল ছুঁয়ে দেখতো না, সেদিন সে সিদ্ধ ডিম দিয়ে নাস্তা করতো বা কিছুই খেত না। “আমি ওর সিরিয়াল ঘৃণা করলেও খাবো। আমি ওর ছবিওয়ালা গল্পের বইগুলো পড়বো…আমি…সব কিছু রেডি রাখবো, যদি…”
ও এখন কাঁদছে। লুইস ওর কান্না থামানোর কোন চেষ্টা না করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। ও যা বলছে একদিক দিয়ে ঠিকই বলছে। গেজের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে চাইছে ও। গেজকে ও অতীত হয়ে দিতে চাইছে না, গেজকে ও টপচার্টে জিন্দা রাখতে চাইছে… যতক্ষণ গেজের জন্যে সবার কষ্ট হবে, ততক্ষণই গেজ সবার মাঝে থাকবে। কষ্ট লাগা শেষ, গেজও হারিয়ে যাবে, চিরতরে।
“এলি, কেঁদো না মামনি,” সে বলে। “এরকম চিরকাল ধরে থাকবে না।”
এলি প্রায় চিরকাল ধরেই কান্না করলো, পাক্কা পনেরো মিনিট। ওর কান্না বন্ধ হবার আগেই ও ঘুমিয়ে পড়লো। নিচ তলার ঘড়িতে দশটা বাজার ঘন্টা বেজে উঠলো।
ওর স্মৃতি জিন্দা রাখো, এলি, সত্যই যদি তুমি চাও, ভেবে লুইস এলিকে চুমো খেলো। সাইকিয়াট্রিস্টরা বলবে এরকম করা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যে মোটেও ঠিক না-তা বলুক গে। কারণ আমি জানি তুমি কয়েকদিনের মধ্যেই হয়তো এই শুক্রবারেই ছবিটার কথা ভুলে যাবে। দেখা যাবে ছবিটা তোমার খাটের ওপর নিঃসঙ্গ অবস্থায় পরে থাকবে আর তুমি ড্রাইভ ওয়েতে সাইকেল চালাবে,বা বাসার পেছনের মাঠে খেলবে, হয়তো বা বান্ধবীর বাসায় গিয়ে পুতুলের জন্যে জামা বানাবে। গেজ তোমার সাথে আর থাকবে না; তোমার কোমল হৃদয়ের টপ চার্ট থেকে ও খসে পড়বে। ও হয়ে যাবে একটা
স্মৃতি যেটা ১৯৮৪ সালে ঘটেছিল। অতীতের কথা
লুইস রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির সামনে এসে দাঁড়ায়; সে একবার বিছানায় যাবার কথা চিন্তা করে, কিন্তু সে চিন্তা পালে হাওয়া পায় না।
ও জানে ওর কী লাগবে এবং সেটার জন্যে সে নিচতলায় নামে।
***
লুইস আলবার্ট ক্রিড ঠিক করেছে সে মাতাল হবে। নিচতলার সেলারে পাঁচ কেস বিয়ার আছে। লুইস বিয়ার খায়, জাড খায়, স্টিভ মাস্টারটন খায়, মিসি ডেন্ডিজও বাচ্চাদের দেখা-শোনা করার সময় দুই-একটা বিয়ার খায়, এমনকি চার্লটনও যে কয়েকবার ওদের বাসায় এসেছে সে বিয়ারই খেতে চেয়েছে। চাহিদার কথা চিন্তা করে একটা মদের দোকানের সেল চলাকালে সেখান থেকে গত শীতে দশ কেসের এক বিরাট চালান সে কিনে এনেছে।
লুইস এক কেস বিয়ার এনে একটা রেখে বাকিগুলো ফ্রিজে ঠেসে দেয়। বিয়ারের মুখ খোলার পরই সে চার্চকে দেখতে পায়। ফ্রিজ খোলার আওয়াজ পেয়ে সে খাবারের লোভে হেলতে দুলতে হাজির হয়ে লুইসের দিকে লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিড়ালটা ওর খুব কাছে ঘেঁষলো না। উপর্যুপরি লাথির কারণে হয়তো সে তার প্রতি লুইসের মনোভাব বুঝতে পেরেছে।
“তোর জন্যে কিছুই নেই,” লুইস বলে। “তোকে আজ তোর খাবারের ক্যান দেয়া হয়েছে। ক্ষুধা লাগলে পাখি মেরে খা গিয়ে।”
চার্চ বসে বসে লুইসকে দেখতে থাকে। লুইস অর্ধেক ক্যান বিয়ার গেলার সাথে সাথে বুঝতে পারে সেটা তার মাথায় চলে গেছে।
“তুই তো গুগুলো মেরে খাসনে, তাই না?” সে জিজ্ঞেস করে। “খুন করেই তোর মজা।”
চার্চ এখানে কোন খাবার পাবে না বুঝতে পেরে ড্রইং রুমের দিকে রওনা হয়। লুইস চার্চের পিছে পিছে যায়।
লুইস একটা চেয়ারে বসে চার্চের দিকে তাকায়। চার্চ কার্পেটের ওপর ভর দিয়ে সন্তর্পণে বসে আছে। যদি লুইস আবারো লাথি মারতে উদ্যত হয় তাহলেই দৌড়ে পালানোর জন্য প্রস্তুত সে।
তার পরিবর্তে লুইস চিয়ার্স করার ভঙ্গিতে তার বিয়ারের ক্যান উঁচু করে বলল, “গেজের জন্যে…আমার ছেলে…যে একদিন শিল্পী হতে পারতো, হতে পারতো অলিম্পিক সাতারু, অথবা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তুই কী বলিস, বজ্জাত বিড়াল?”
চার্চ তার অদ্ভুত ঘোলা চোখগুলো দিয়ে মিটমিট করে তাকায়।
লুইস বাকি বিয়ারটা লম্বা লম্বা ঢোকে পেটে চালান করে দেয়। গলায় জ্বালা হলেও সে উঠে ফ্রিজ থেকে আরেকটা বিয়ার নিয়ে আসে।
তিন নাম্বার বিয়ার পেটে চালান করার পর লুইসের মনে হলো সেদিনে প্রথমবারের মত সে নিজের মধ্যে ভারসাম্য টের পাচ্ছে। ছয়টা বিয়ার উধাও করে দেয়ার পর তার মনে হলো সে হয়তো আর ঘন্টাখানেক পর ঘুমোতে পারবে। অষ্টম বা নবম (সে এর মধ্যে বিয়ারের ক্যানের হিসেব হারিয়ে ফেলেছে) বিয়ার নিয়ে ফিরে আসার পর তার চোখ চার্চের ওপর পড়ে। বিড়ালটা কার্পেটের ওপর ঘুমোচ্ছে-বা ঘুমানোর ভান ধরেছে। ভাবনাটা ওর মাথায় এতো স্বাভাবিকভাবে এলো যেনো সেটা তার মনের এক কোণে আগে থেকেই ছিল, শুধু নিজেকে জানান দেয়ার অপেক্ষায় ছিলঃ
তুমি কাজটা কখন করবে? কখন তুমি গেজকে মিকমেকদের গোরস্থানে কবর দেবে?
এরপর, লেজারাস, উঠে এসো।
এলির ঘুমে ভেজা কন্ঠ,
স্যার বলেছেন যিশু যদি শুধু ‘উঠে এস’ বলতেন, তাহলে গোরস্থানের সব মরা উঠে আসতো।
লুইসের শরীর এতো তীব্রভাবে শিহরিত হয়ে উঠলো যে লুইস কুঁকড়ে যায়। তার হঠাৎ এলির স্কুলের প্রথম দিনের ঘটনা মনে পড়ে গেল। এলি স্কুল থেকে ফিরে এসে অনর্গল তার স্কুলের গল্প বলে যাচ্ছিল। ও আর রাচেল এলির গল্প শুনছিল আর ওই অবস্থাতেই গেজ লুইসের কোলে ঘুমিয়ে পড়ে। ও যখন গেজকে ওপরে নিয়ে গিয়েছিল ওর একটা ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল; কোন অশুভ কিছু যেন ওর পথ আগলে দাড়িয়েছিল। লুইস এখন বুঝতে পারছে; সেপ্টেম্বরের সেই দিনেই লুইসের মনের একটা অংশ বুঝতে পেরেছিল যে গেজ মারা যাবে। জিনিসটা অযৌক্তিক, জঘন্য, কুসংস্কার বাল ছাল… কিন্তু সত্য। সে জানতো। বিয়ারের ক্যান থেকে বিয়ার ছলকে উঠে ওর শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছে। চার্চ মাথা উঁচু করে ওর দিকে দুশ্চিন্তার সাথে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে যে আজকের বিড়াল খেদানো লাথি শুরু হলো বলে কি না।
জাডকে করা তার প্রশ্নটা লুইসের মনে পড়ে গেল; মনে পড়ে গেল প্রশ্নটা শুনে জাড কিভাবে চমকে উঠেছিল এবং হাতের ঝাঁকিতে কিভাবে দুইটা বিয়ারের বোতল উনি টেবিল থেকে ফেলে দিয়েছিলেন। একটা বোতল ভেঙে চৌচির হয়ে গিয়েছিল। ‘এসব কথা মুখেও আনবে না লুইস!”
কিন্তু সে কথাটা মুখে আনতে চাচ্ছে-বা অন্তত ভেবে দেখতে চাচ্ছে। পেট সেমিটারির ব্যাপারে; তার পেছনে যা আছে তার ব্যাপারে। বিষয়টার একটা মারাত্মক আকর্ষণ আছে। ব্যাপারটায় একটা অনস্বীকার্য ভারসাম্য আছে। চার্চ রাস্তায় মারা গিয়েছিল; গেজ রাস্তায় মারা গেছে। এই যে চার্চ-নিঃসন্দেহে অনেক বদলে গেছে-কিন্তু সে তাদের মাঝেই আছে। গেজ, এলি রাচেল সবাই তার সাথে মানিয়ে নিয়েছে। ও পাখি মারে, সত্য, ও কিছু ইঁদুর মেরে নাড়ি-ভুড়ি বের করে দিয়েছে, সত্য; কিন্তু এসব তো বিড়ালেরা করেই। চার্চ কোনভাবেই ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের বিড়ালে পরিণত হয়নি। ভেবে দেখলে ও অনেক দিক দিয়ে আগের মতই আছে।
তুমি খোঁড়া যুক্তি দিচ্ছ, একটা কন্ঠ ফিসফিস করে উঠে। ও আর আগের মত নেই। ও বদ হয়েছে। কাক, লুইস…কাকটার কথা মনে আছে?
“ওহ খোদা!” লুইস কাঁপা কাঁপা গলায় উচ্চস্বরে বলে উঠে। নিজের কন্ঠ সে নিজেই চিনতে পারে না।
খোদা? এতো কিছু থাকতে ঈশ্বরের নাম? ঈশ্বরের নিয়মে চার্চ মরেছিল। সেটা পছন্দ না হওয়ায় ওকে ফিরিয়ে এনে এখন ঈশ্বরের নাম নেয়া হচ্ছে?
সাবাস!
সে কি নিজেকে মিথ্যে বলছে? শুধু খোঁড়া যুক্তি না; সে নিজেকে মিথ্যেই বলছে।
তাহলে সত্যটা কী? তোমার সত্য জানতে এতো চুলকানি হচ্ছে, তাহলে সত্যটা কি?
সত্যটা হচ্ছে, প্রথমত চার্চ আসলে কোন বিড়াল না। ওকে বিড়ালের মত দেখা যায়, ও বিড়ালের মত অভিনয় করে, কিন্তু আসলে ও একটা নকল বিড়াল। হয়তো ভুয়া বিড়াল। চোখে দেখে বোঝা যায় না, কিন্তু অনুভব করা যায়। লুইসের একরাতের কথা মনে পড়ে; সেরাতে চার্লটন তাদের বাসায় এসেছিল প্রি-ক্রিসমাসের ডিনারে। খাওয়া দাওয়ার পর ওরা সবাই এখানে বসে গল্প করছিল এমন সময় হঠাৎ চার্চ চার্লটনের কোলে লাফিয়ে ওঠে। চার্লটন এক মুহূর্ত দেরি না করে ধাক্কা দিয়ে চার্চকে সরিয়ে দেন। তার চেহারায় একটা স্পষ্ট ঘৃণার ছাপ ফুটে উঠেছিল।
এটা হয়তো কোন বিশেষ ঘটনাই না। কেউ এটা নিয়ে কোন কথাও বলেনি। কিন্তু…চার্লটন বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি কিছু না জেনেও ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন যে বিড়ালটার সমস্যা আছে। লুইস বাকি বিয়ারটা গলায় ঢেলে দিয়ে আরেকটার জন্যে ফিরে গেল। গেজ যদি এরকমভাবে ফিরে আসে তাহলে ব্যাপারটা আসলেই জঘন্য হবে।
সে ক্যানের মুখ খুলে ঢকঢক করে বিয়ার গিলে। সে এখন মাতাল, নিরেট মাতাল এবং নিঃসন্দেহে কাল ওর জন্যে একটা ভালো রকমের মাথা ব্যথা অপেক্ষা করছে। ‘কিভাবে আমি মাতাল অবস্থায় আমার ছেলের ফিউনারেলে গিয়েছিলাম’, লেখক লুইস ক্রিড। তিনি আরো লিখেছেন ‘কিভাবে আমি ওকে এক মুহূর্ত পিছিয়ে পড়ার কারণে হারিয়েছি’ এবং আরো অনেক বই।
মাতাল। পাড় মাতাল। তার ধারণা সে মাতাল সেজন্যেই ওই আইডিয়াটা নিয়ে সে পরিস্কারভাবে চিন্তা করতে পারছে।
এতো কিছুর পরও আইডিয়াটার মারাত্নক রকম আকর্ষণ ক্ষমতা আছে, লোভ আছে, প্রাচুর্য আছে।
জাড তার মনের কানে কথা বলে ওঠেঃ
“এই কাজটা আমরা করেছি, কারণ এটা আমাদের পেয়ে বসেছিল। ওই গোরস্থানটা একটা গোপন জায়গা, আর এর গোপনীয়তা তুমি অন্যদের জানাতে চাইবে। আর তখন তুমি এটা কাউকে জানানোর জন্যে উপযুক্ত কারণ খুঁজে নিবে। এরপর তুমি সেটা করবেই। তুমি নিজেই সেটার পেছনে যুক্তি দাঁড় করাবে…এবং সেই যুক্তিগুলো তোমার কাছে খুব ঠিক মনে হবে…তবে আসল কথা তুমি সেটা করতে চাও। অথবা তুমি সেটা করতে বাধ্য।
জাডের আঞ্চলিক টান মাখা কন্ঠ ওর গায়ের রক্ত হিম করে দেয়, ওর গায়ে কাটা দেয়ায়, ওর ঘাড়ের লোমগুলো সব দাঁড় করিয়ে দেয়।
মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে…মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়…আর সেটা সে যত্ন করে রাখে।
জাড তাকে মিকমেকদের গোরস্থান সম্পর্কে আর কী কী বলেছে সেগুলো একটা একটা করে সে ভাবতে থাকে। সে তথ্যগুলো নিয়ে চিন্তা করতে থাকে, সেগুলো নেড়ে চেড়ে দেখে-ঠিক যেমনটা কোন পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার সময় লুইস করতো।
স্পট, জাডের কুকুর।
“যেখানটাতে ওর কাঁটাতার লেগে ঘা হয়েছিল সেটা আমি দেখতে পাচ্ছিলাম-জায়গাটায় কোন পশম ছিল না। কোন ঘা শুকিয়ে যাওয়ার পাঁচ বছর পর জায়গাটা যেমন দেখা যায়, স্পটের ঘায়ের জায়গাটাও তেমন দেখা যাচ্ছিল।
লেস্টার মরগানের পুরষ্কার জেতা ষাঁড়।
কালো ষাঁড়টার নাম ছিল হ্যানরাট্টি…শরীরের ভেতরের এক রকম ইনফেকশনে সেটা মারা যায় আর লেস্টার একটা স্লেজে করে সেই মরা ষাঁড়টাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিল। সে কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করেছিল তা আমি জানি না-কিভাবে সে ওই মরা গাছের স্তূপের ওপর ওটাকে তুলেছিল তাও জানি না-লোকজন বলে যে কেউ মন থেকে কিছু করতে চাইলে সে অবশ্যই সফল হয়। তবে যতক্ষণ আমরা ওই গোরস্থানটার ব্যাপারে বলছি, এই কথাটা একদম সত্য।
যাই হোক, হ্যানরাট্টি ফিরে আসে তবে লেস্টার তাকে দুই সপ্তাহের মাথায় গুলি করে মেরে ফেলে। ষাঁড়টা খুব বিগড়ে গেছিল-বিগড়ে গেছিল মানে চরমভাবেই বিগড়ে গেছিল। তবে এরকম আর কোন পশুর সাথে হতে আমি শুনিনি।
তুমি আবার কিসের দায় নিতে চাও, লুইস? চাঁদের আলোয় সেই জঙ্গলের ভেতরের পথে আবারো হাঁটতে চাও তুমি? আবার চড়তে চাও সেই সিঁড়িতে? হরর মুভির নায়ক বা নায়িকা ওই সিঁড়িগুলোতে চড়তে চাইলে দর্শকরা তাদের আহাম্মক বলবে। কিন্তু এই দর্শকেরাই সিগারেট খায়, সিটবেল্ট ছাড়া গাড়ি চালায়, এমন একটা ব্যস্ত এবং বিপজ্জনক রাস্তার পাশে পরিবার নিয়ে বসবাস করতে আসে যেখান দিয়ে বিরামহীনভাবে ভারি ভারি ট্রাক চলাচল করে। অতএব, লুইস, তোমার কী মত? চড়বে ওই সিঁড়িগুলোয়? তুমি কি তোমার ছেলেকে মৃতই রাখতে চাও না কি দেখতে চাও এক নাম্বার দরজার পিছনে কী আছে, দু নাম্বার দরজার পিছনে কী আছে বা তিন নাম্বার দরজার পিছনে কী আছে?
চলো, চলো!
ষাঁড়টা খুব বিগড়ে গেছিল…একবারই এরকম হয়েছে…ক্ষতটা…
লুইস বাকি বিয়ারটুকু সিঙ্কে ঢেলে দেয়। তার পৃথিবী দুলছে। মনে হচ্ছে তার বমি হবে।
দরজায় কেউ কড়া নাড়ে।
লম্বা সময় ধরে ওর মনে হলো এটা ওর শোনার ভুল, হ্যালুসিনেশন। কিন্তু দরজার আওয়াজ হতেই থাকে, হতেই থাকে। এবং হঠাৎ করেই লুইসের বানরের থাবার গল্পটা মনে পড়ে যায়। সেটা মনে হতেই ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সে ব্যাপারটা শারীরিকভাবে অনুভব করতে পারে; একটা হাত, মরা হাত-যেটা ফ্রিজের ভেতর রাখা হয়েছিল; সুযোগ বুঝে ওর শার্টের ভেতর ঢুকে গিয়েছে আর ওর হৃৎপিন্ডের ওপরে থাবা বসানোর জন্যে কিলবিল করছে। চিন্তাটা খুব ফালতু, কিন্তু লুইসের মনে সেটা মোটেই ফালতু মনে হচ্ছে না, একদমই না।
লুইস তার পা অনুভব করতে পারছে না কিন্তু কোনভাবে সেই পাগুলো দিয়েই হেঁটে দরজার কাছে গেল এবং হাতের অসাড় আঙুলগুলো দিয়ে কোনরকমে ছিটকিনি খুললো। সে টান দিয়ে দরজাটা খুলতে খুলতে ভাবেঃ নিশ্চয়ই পাস্কো এসেছে, মৃতের জগৎ থেকে, জগিং শর্টস পড়ে মুখে মাস খানেকে গজানো দাড়ি। মাথা থেতলানো পাস্কো; তার সেই সতর্কবাণী নিয়েঃ ওখানে যেও না। কী যেন একটা গান আছে না? যেও না সাথী…ও ও ও…যেও না সাথী…
দরজাটা খুলে গেলে দেখা গেল মাঝরাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারে দরজার সামনে জাড ক্র্যান্ডাল দাড়িয়ে আছেন। তার মাথার পাতলা সাদা চুল হাওয়ায় এলোমেলোভাবে উড়ছে।
লুইস হাসার চেষ্টা করে। তার মনে হলো সময় পিছিয়ে গিয়েছে। যেন আজ সেই থ্যাঙ্কসগিভিং’এর রাত আর কিছুক্ষণ পর তারা দুজনে এলির মরা বিড়ালটা পলিথিনের ব্যাগে ভরে সেই কবরস্থানে গোর দিতে যাবে। ‘ওহ, এখন কিছু জানতে চেয়ো না; শুধু আমার পিছে পিছে চলো।”
“আমি আসতে পারি লুইস?” জাড় জিজ্ঞেস করেন। তিনি তার শার্টের পকেট থেকে একটা সিগারেটের প্যাকেট বের করে ঠোঁটে গুঁজে দিলেন 1
“জানেন,” লুইস বলে। “অনেক রাত হয়েছে আর আমি বালতি বালতি বিয়ার গিলেছি।”
“হুম, গন্ধ পাচ্ছি,” জাড বলেন। তিনি একটা ম্যাচের কাঠি জ্বাললেন কিন্তু বাতাসে সেটা টিকতে পারলো না। এরপর তিনি হাত দিয়ে ঢেকে আরেকটা কাঠি জ্বালালেন কিন্তু সেটারও অকাল পরিণতি হলো। তার হাত কাঁপছে। তিনি আরেকটা কাঠি বের করে জ্বালাতে গিয়ে থেমে লুইসের দিকে তাকালেন। “আমি জ্বালাতে পারছি না,” জাড বলেন। “আমাকে কি ভেতরে ঢুকতে দেবে, লুইস?”
লুইস সরে দাঁড়ালে জাড ভেতরে ঢুকলেন।
অধ্যায় ৩৮
তারা দুজনে কিচেন টেবিলে বসে। জাড একটা বিয়ার নিলেন। হঠাৎ এলির কান্নার শব্দ আসলে ওরা দুজনেই জমে বরফ হয়ে যায়, বাচ্চাদের খেলায় বরফ হবার মত। কিন্তু এলির কান্না আর শোনা যায় না।
“আচ্ছা,” লুইস বলে। “আপনি আমার ছেলেকে কবর দেয়ার আগের রাতে বারোটার পর এখানে কি করছেন? আপনি একজন বন্ধু। কিন্তু এটা একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে।”
জাড বিয়ারে চুমুক দিয়ে হাতের উল্টো পাশে মুখ মুছে একদম লুইসের চোখ বরাবর তাকালেন। তার চোখে পরিস্কারভাবেই এমন কিছু ছিল যা দেখে লুইস চট করে নিজের চোখ নামিয়ে নেয়।
“লুইস, তুমি জানো আমি কেন এসেছি,” জাড বললেন। “তুমি এমন সব জিনিস ভাবছো যেটা ভাবা একদমই উচিত না। আর আমার ভয় তুমি শুধু ভাবছই না, তুমি সেটা বিবেচনাও করছো।”
“আমি বিছানায় গিয়ে ঘুমোনো ছাড়া আর কিছুই ভাবছি না, লুইস বলে। “কাল সকালে আমার ছেলেকে কবর দেয়া হবে।”
“তোমার আজ যেটুকু কষ্ট হবার ছিল তার চাইতে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে, আর এজন্যে একরকম আমিই দায়ি,” জাড নরম গলায় বললেন। “আর হয়তো তোমার ছেলের মৃত্যুর জন্যেও আমিই দায়ি।”
লুইস চমকে জাডের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে “কী সব আবোল তাবোল বলছেন!”
“তুমি গেজকে ওইখানে কবর দেয়ার কথা ভাবছো। প্লিজ, অস্বীকার করো না যে ওই চিন্তাটা তোমার মাথায় একবারো খেলেনি।”
লুইস কোন জবাব দেয় না।
“ওই জায়গাটার প্রভাব কতদূর তুমি জানো? না। আমি নিজেও জানি না, যদিও আমি আমার সারা জীবন এই জায়গাতেই কাটিয়ে দিয়েছি। আমি মিকমেকদের ব্যাপারে জানি, জানি যে ওরা ওই জায়গাটাকে মান্য করে…কিন্তু ভালো কিছু হিসেবে না। স্টানি আমাকে এই কথা বলেছিল। আমার বাবাও আমাকে পরে এই কথাই বলেছিলেন, যখন স্পট দ্বিতীয়বারের মত মারা গিয়েছিল। বর্তমানে মিকমেকরা, মেইন স্টেট আর আমেরিকান সরকার সবাই মিলে আইনী লড়াই লড়ছে জায়গাটার মালিকানার জন্যে। আসলে জায়গাটার মালিক কে সেটা কেউ বলতে পারে না। এক-এক সময় এক-এক জন নানান দাবি করেছে কিন্তু কোন দাবিই টেকেনি। যেমন ধরা যাক এই শহরের প্রতিষ্ঠাতার নাতির ছেলে এনসন লাডলোর কথা। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে তার দাবিই সবচাইতে জোড়ালো, কারণ শহরের প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ লাডলো এই পুরো এলাকাটা তখনকার রাজা জর্জের কাছ থেকে অনুদান পেয়েছিলেন। কিন্তু এনসন লাডলো ছাড়াও অন্য লাডলোরাও ওই জমির মালিকানার দাবি করে। পিটার ডিমার্ট বলে এক লোক আছে, যে দাবি করে সে কাগজে কলমে না হলেও একজন লাডলো এবং এই ব্যাপারে তার নাকি উপযুক্ত প্রমাণ আছে। তাছাড়া প্রতিষ্ঠাতা জোসেফ লাডলো শেষের দিকে টাকায় গরীব ছিলেন কিন্তু জমিতে বড়লোক ছিলেন। তিনি নাকি কাউকে পছন্দ হলেই শখানেক একর জমি দিয়ে দিতেন। তেমন দাবীদারও আছে।”
“এসবের কোন রেকর্ড নেই?” লুইস অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“ওহ, তা রেখেছিলেন উনারা,” আগের সিগারেটের পাছা থেকে একটা নতুন সিগারেট জ্বালিয়ে জাড বলেন। “দলিলে ঠিক এরকম লেখা,” জাড চোখ বন্ধ করে উদ্ধৃতি দিলেন, “কুইন্সবেরি রিজের বুড়ো মেপল গাছ থেকে অরিংটন খাল পর্যন্ত উত্তর থেকে দক্ষিণের সীমানা।” জাড নিরানন্দভাবে মুচকি হাসলেন। “কিন্তু ওই মেপল গাছ ১৮৮২ সালে উপড়ে পড়ে যায় আর ১৯০০ সাল হতে হতে পচে মাটির সাথে মিশে যায়। আর অরিংটন খালটা কয়েক শাখায় ভাগ হয়ে এখন একটা জলায় পরিণত হয়েছে, সেটাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ঘটনা। সব মিলিয়ে একটা লেজে-গোবরে অবস্থা। আর এক সময় বুড়ো এনসন লাডলোর ও এসবে আর কিছু যায় আসে না, কারণ বুড়ো ১৯২১ এ ওই কবরস্থানটার কাছে বজ্রপাতে পটল তুলেন।”
লুইস জাডের দিকে তাকায়। জাড তার বিয়ারে চুমুক দিলেন।
“যাই হোক। এরকম বহু জমি আছে যেটার মালিকানা নিয়ে কম কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি হয়নি। এসব কেসে লাভ শুধু আইনজীবীদের। আমার ধারনা ইন্ডিয়ানরা এক সময় এটা ফেরত পাবে আর এমনটাই হওয়া উচিত। যদিও ওসবে কিছু যায় আসে না, লুইস। আমি আজ তোমার কাছে এসেছি টিমি ব্যাটারম্যান আর তার বাবার কথা বলতে।”
“টিমি ব্যাটারম্যানটা আবার কে?”
“টিমি ব্যাটারম্যান ছিল সেই ২০ জন ছেলের একজন যাদের লাডলো থেকে হিটলারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে পাঠানো হয়। ও ১৯৪২ সালে এখান থেকে যায় আর ফেরত আসে ১৯৪৩ সালে, পতাকায় ঢাকা একটা কফিনে করে। ও ইতালিতে মারা যায়। তার বাবা, বিল ব্যাটারম্যান, আজীবন এখানে থেকেছেন। সে তার ছেলের খবরের টেলিগ্রাম পাওয়ার পর পাগলপ্রায় হয়ে যান…এবং এরপর তিনি একদম শান্ত হয়ে যান। তিনি মিকমেকদের গোরস্থানের ব্যাপারে জানতেন, বুঝলে? এবং তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন তিনি কি করবেন।”
লুইসের গা ঝিমঝিম করছে। সে জাডের দিকে লম্বা সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। সে বৃদ্ধের চোখে মিথ্যার চিহ্ন খোঁজার চেষ্টা করছে কিন্তু সেখানে এরকম কিছুই নেই। কিন্তু এই মুহূর্তে এরকম একটা কাহিনির উদয় হওয়া আসলেই সন্দেহজনক।
“আমাকে এটা আপনি আগে বলেননি কেন?” লুইস অবশেষে বলে। “যখন আমরা…বিড়ালটাকে…এরপর যখন আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ওইখানে কেউ কোন মানুষকে কবর দিয়েছে কি না। আপনি বলেছিলেন কেউ কখনো এরকম কিছু করেনি।”
“কারণ তখন তোমার জানার প্রয়োজন ছিল না,” জাড বললেন। “কিন্তু এখন প্রয়োজন।”
লুইস বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। “ও ছাড়া আর কাউকে কবর দেয়া হয়নি সেখানে?”
“আমি ব্যক্তিগতভাবে শুধু তার কথাই জানি,” জাড গম্ভীর গলায় বললেন। “কিন্তু আমি মনে করি না যে আর কেউ কখনো এরকম কিছু চেষ্টা করেনি। যেটা একবার হয়েছে, সেটা আগেও হয়েছে…এবং হয়তো তার আগেও।”
তিনি তার মেসতার দাগওয়ালা হাতের দিকে নিচু হয়ে তাকালেন। লিভিং রুমের ঘড়ি সাড়ে বারোটা বাজার জানান দেয় মৃদুভাবে।
“তুমি একজন ডাক্তার। তুমি লক্ষণ দেখে রোগ চেন…ফিউনারেল হোমের মর্টনসন আমাকে বলেছে তুমি কনক্রিটের ঢালাইয়ের ছাদের কবরের বদলে লাইনার কবরের জন্যে অর্ডার করেছো। এটা শুনেই আমি ঠিক করেছি তোমার সাথে সোজা-সাপ্টা কথা বলবো।”
লুইস লম্বা সময় ধরে জাডের দিকে তাকিয়ে থাকে। জাড চোখ মিটমিট করলেও চোখ সরালেন না।
অবশেষে লুইস বলে, “আপনি তো বেশ ভালোই গন্ধ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। আমি এর জন্যে দুঃখিত।”
“আমি তাকে জিজ্ঞেস করিনি তুমি কোন ধরনের কবরের অর্ডার করেছো।”
“তাই? হয়তো সোজাসুজি জিজ্ঞেস করেননি।”
জাড এই কথার কোন জবাব দেন না। তিনি এক দৃষ্টিতে লুইসের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
অবশেষে লুইস দীর্ঘঃশ্বাস ফেলে। তার প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে। “ ধুর বাল। আমার এতে কিছু যায় আসে না। হয়তো আপনি ঠিকই বলেছে। হয়তো এটা আমার মনে ছিল। আর যদি থেকেও থাকে তবে ছিল আমার অবচেতন মনে। আমি অর্ডার করার সময় এতো কিছু ভাবিনি। আমার মাথায় তখন ছিল গেজ, আর কিছু না।”
“আমি জানি তুমি গেজকে নিয়ে ভাবছিলে। কিন্তু এই দুই রকম কবরের তফাতটা তুমি জানো। তোমার আঙ্কেল একজন কবরের ঠিকাদার ছিলেন।”
হ্যাঁ, সে তফাতটা জানে। ঢালাইয়ের ভল্ট কবর হচ্ছে প্রচন্ড মজবুত একটা কাঠামো, যেটা বহু বছর ধরে টেকে। প্রথমে মাটির গর্তে একটা ছাদহীন রুমের মত তৈরি করা হয়, রড আর কনক্রিটের ঢালাই দিয়ে। এরপর এর ভেতরে কফিন রাখার পর একটা ক্রেন দিয়ে কিছুটা বৃত্তাকার একটা ভারি কনক্রিটের ছাদ বসিয়ে দেয়া হয়। আর সেটা জোড়া লাগানো হয় এমন মিক্সচার দিয়ে যেটা রাস্তার গর্ত ভরাট করতে ব্যবহার করা হয়। তার আঙ্কেল কার্ল তাকে বলেছে ওই মিক্সচার কিছু সময় পর খুব শক্তভাবে এটে যায়, যেটাকে ‘চিরস্থায়ী লক’ বলা হয়।
আঙ্কেল কার্ল অনেকের মতই গল্প করতে ভালোবাসতেন, তবে নিজের লোক পেলে তার গল্প করার প্রবণতা অনেকাংশে বেড়ে যেত। লুইস তার সাথে গ্রীষ্মের ছুটিতে বেশ কিছুদিন কাজ করেছিল, সহকারী আন্ডারটেকার হিসেবে। তিনি তার ভাতিজাকে তার করা একটি লাশ উত্তোলনের গল্প বলেছিলেন। ডিস্ট্রিক্ট এটর্নির অফিস থেকে তার কাছে অর্ডার এসেছিল একটা ঢালাই করা কবরের লাশ উত্তোলনের জন্যে, পুনরায় ময়নাতদন্তের প্রয়োজনে। তিনি গ্রোভল্যান্ডে গিয়েছিলেন কাজটা তদারকি করার জন্যে। ঢালাই কবর খুঁড়ে লাশ বের করা সহজ কাজ না। যারা হরর মুভি দেখে লাশ বের করা বুঝতে চাইবে তারা ভুল বুঝবে। দুইজন মানুষকে যদি শাবল কোদাল দিয়ে ওইরকম একটা কবর থেকে লাশ বের করতে বলা হয় তবে তারা দুই সপ্তাহেও তা করতে পারবে কি না সন্দেহ আছে। কাজ ভালোই আগাচ্ছিল; অন্তত শুরুতে। কবরের ওপর থেকে মাটি সরিয়ে ক্রেনের সাথে ছাদটা বাধা হয় শিকল দিয়ে। কিন্তু ক্রেন যখন ছাদটা উপরের দিকে টানতে থাকে, কথা মত উঠে না এসে সেটা খুব শক্ত হয়ে লেগে থাকে নিচের কাঠামোর সাথে। আঙ্কেল কার্ল চিৎকার করে ওই ক্রেনের অপারেটরকে থামতে বলছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন তার অফিসে ফেরত গিয়ে ওই জোড়া আলগা করার কিছু উপকরণ নিয়ে আসতে।
অপারেটর হয় শোনেনি অথবা তাকে গুরত্ব দেয়নি। হয়তো সে একেবারে শেষ দেখতে চাচ্ছিল। যাই হোক, ক্রেনের টানে ছাদের সাথে সাথে নিচের কনক্রিটের কাঠামোটাও উঠে আসতে শুরু করে। বলদটা আরেকটু হলে কাজটা করেও ফেলেছিল সফল ভাবে। আঙ্কেল কার্ল আর তার সহযোগী কবরটার ভেতর থেকে পানির শব্দ পাচ্ছিলেন, কয়েকদিন যাবৎ বেশ বৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু যখন কাঠামোটির প্রায় তিন চতুর্থাংশ বের হয়ে আসে, তখন ক্রেনটাই উল্টে গিয়ে সেই কাঠামোর ওপর ধপাস করে পড়ে। ক্রেনের ভালো ক্ষতি হলেও ড্রাইভার শুধু তার নাকটা ভাঙার পর বেঁচে যায়। ওইদিনের ওইসব ঝামেলার জন্যে সরকারের তিন হাজার ডলার খরচ হয়, যেখানে গড়ে খরচ পড়ে নয়শ ডলারের মত। আঙ্কেল কার্ল এই গল্পটা বলেছিলেন ওই ক্রেনের অপারেটরের খাতিরে। কারণ ওই বেকুব ড্রাইভার ছয় বছর পরে ওই এলাকার ট্রাক-চালক সমতির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিল।
আর লাইনার কবরগুলো খোলা এর চাইতে অনেক সহজ। এই কবরের বক্সের মত অংশটা বানানো হয় ঢালাই দিয়েই, কিন্তু খুব পাতলা কনক্রিট দিয়ে। আর ছাদ হিসেবেও হালকা একটা কনক্রিটের পাত দেয়া হয় আর সেটা শুধু বাক্সটার ওপর রেখে দেয়া হয়, কিছু দিয়ে আটকানো হয় না। যে কেউ একটু কায়দা করলেই সেটার ছাদ সরিয়ে লাশ বের করে নিতে পারবে। আর জাডও সেটাই ইঙ্গিত করছেন।
কায়দা করে যে কেউ তার ছেলের লাশ সেখান থেকে বের করে নিয়ে অন্য কোথাও কবর দিতে পারবে।
ছিহ্! আমরা এরকম কথা বলি না। এসব গোপন কথা।
হুম, আমি ভল্ট কবর আর লাইনার কবরের তফাতটা জানি বৈকি, লুইস বলে। “কিন্তু আপনি যা ভাবছেন সেরকম কোন চিন্তাই আমি করিনি।”
“লুইস-”
“অনেক রাত হয়েছে,” লুইস বলে। “অনেক রাত হয়েছে। আমার নেশা হয়ে গেছে আর বুকে ব্যথা করছে। আপনার যদি মনে হয় আমাকে গল্পটা শোনাবেন তাহলে আর আর দেরি করবেন না প্লিজ।” আমার উচিত ছিল বিয়ার না খেয়ে মার্টিনি খাওয়া। তাহলে দরজা খুলে বুড়োকে ঢুকতে দেয়ার আগেই বেহুশ হয়ে পড়তাম।
“আচ্ছা, লুইস। ধন্যবাদ।”
“বলুন।”
জাড কয়েক মুহূর্তের জন্যে চুপ করে থাকেন। এরপর তিনি বলতে শুরু করেন।
অধ্যায় ৩৯
“ওই সময়-মানে বিশ্বযুদ্ধের সময় আমাদের অরিংটনেও ট্রেন থামতো। বিল ব্যাটারম্যান তার ছেলে টিমির লাশ নেয়ার জন্যে স্টেশনে এসেছিলেন। চারজন ট্রেনের লোক তার ছেলের কফিনটা ধরাধরি করে নামায়। আমি তাদের মধ্যে একজন ছিলাম। লাশ নিয়ে এসেছিলেন একজন আর্মির লোক। তিনি একবারের জন্যেও ট্রেন থেকে নামেননি। তিনি তার বাকি বারোটা কফিনের সাথে ট্রেনের কামরার ভেতর নেশাগ্রস্থ হয়ে বসে ছিলেন।
“আমরা টিমিকে একটা ফিউনারেল হোমের ক্যাডিলাক গাড়িতে ওঠালাম। ওই সময় লাশ নেয়া লাগতো খুব দ্রুত, কারণ এখনকার মত লাশ পচা থামানোর মত ব্যবস্থা তখনো ছিল না। লাশ পচে যাওয়ার আগে কবর দেয়া অনেকটা রেসের মত ছিল। বিল ব্যাটারম্যান সবকিছু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন। তার চেহারা পাথরের মত শক্ত হয়ে ছিল…তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন একটা অনুভূতিহীন পাথরের মূর্তি। তিনি এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেননি। হুয়ে গার্বার সেদিন লাশবাহী ট্রেনটা চালাচ্ছিলেন। সে আমাকে বলেছিল লাশগুলো নিয়ে আসা আর্মির লোকটা নিজেও একটা বিচিত্র ভ্রমণ করেছে।
আর্মির লোকটা হুয়ের কাছে এসে নিজের শার্ট থেকে একটা হুইস্কির বোতল বের করে গলায় বেশ কিছুটা চালান করে দিয়ে বলেছিলেন, “ড্রাইভার সাহেব কি জানেন যে আপনি আজ এক রহস্যময় ট্রেন চালাচ্ছেন?”
“হুয়ে তার মাথা নাড়েন।
“চালাচ্ছেন। না জানলেও চালাচ্ছেন। অন্তত এলাবামা স্টেটে লোকে এসব ট্রেনকে রহস্যময় ট্রেনই বলে। এরপর লোকটা নিজে বুক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকিয়ে বলে ‘আমাদের হুল্টনে দুটা লাশ ডেলিভারি করে শুরু করতে হবে, এরপর একটা পাসাদুমকাগে, ব্যাঙ্গরে দুটো, একটা ডেরিতে আর একটা লাডলোতে…এবং আরো অনেকগুলো। আমার নিজেকে দুধওয়ালার মত মনে হচ্ছে। মাল খাবেন নাকি একটু?”
হুয়ে সেই প্রস্তাব নাকোচ করেন, কারণ তার তখনো অনেকটা পথ ট্রেনটা চালিয়ে নিতে হবে। আর তখন শহরের মাঝে দিয়ে ট্রেন চালানো এতো সহজও ছিল না। হুয়ে বলেছিলেন তারা যত জায়গায় লাশ ডেলিভারি দিয়েছেন সবখানেই লাশ নিতে আসা আত্মীয়-স্বজনদের কান্না-কাটি, শোকের মাতম দেখেছেন, শুধু লাডলো ছাড়া। ছেলের লাশ নিতে আসা বিলকে দেখে তার মনে হয়েছিল তিনি ভেতরে ভেতরে একদম মরে গিয়েছেন, এখন শুধু আত্মা পচে গন্ধ বের হওয়া বাকি। যখন হুয়ে গাড়ি থেকে নামলেন তিনি ওই আর্মির লোকটাকেও ডেকে নামালেন। এরপর তারা বেশ কয়টা ক্লাবে হানা দিলেন মাতাল হবার জন্যে। এমনকি তিনি না কি সেদিনই প্রথম কোন পতিতার সাথে বিছানায় গিয়েছিলেন। আর এরপর ঘুম থেকে উঠে হুয়ে মারাত্মক অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এরপর থেকে তিনি কানে ধরেছেন যে আর কোনদিন ওইরকম ‘রহস্যের’ ট্রেন তিনি চালাবেন না।
টিমির মরদেহ গ্রীনস্পেন ফিউনারেল হোমে নিয়ে যাওয়া হয় এবং দুই দিন পর তাকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় প্লেজেন্টভিউ গোরস্থানে কবর দেয়া হয়।
“টিমির মা মারা গিয়েছিলেন তারো প্রায় দশ বছর আগে, টিমিকে জন্ম দিতে গিয়ে। তো বুড়ো বিলের জীবনে আসলে টিমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। তার ওই নিঃস্ব হয়ে যাওয়াটাই অনেকাংশে দায়ি, যা ঘটেছিল তার জন্যে। তার আরেকটা বাচ্চা থাকলে হয়তো সে এরকম কিছু করতো না, সে জানতো আরো কেউ কষ্টে আছে এবং তাকে তার সাহায্য করতে হবে শোক কাটিয়ে ওঠার জন্যে। লুইস, শোনঃ তুমি এদিক দিয়ে ভাগ্যবান, কারণ তোমার আরেকটি সন্তান আছে। তোমার একটি সন্তান আছে এবং স্ত্রীও আছে।
বিল তার ছেলের প্লাটুনের লেফটেনেন্টের হাতের যে চিঠি পেয়েছিলেন তাতে টিমির মৃত্যুর বর্ণনা ছিল। সে ১৯৪৩’র জুলাইয়ের পনেরো তারিখ রোম যাবার পথে গুলিতে নিহত হয়। তার মরদেহ দুইদিন পরে দেশে ফেরত আনা হয় আর সেটা লাইমস্টোনে পৌঁছে উনিশ তারিখে। টিমির লাশ এর পর দিনই হুয়ে গারবের রহস্যের ট্রেনে তুলে দেয়া হয়। বিশ্বযুদ্ধের আমেরিকান সৈন্য যারা ইউরোপে মারা গিয়েছিল তাদের বেশিরভাগকেই ইউরোপেই কবর দেয়া হয়। কিন্তু ওই ট্রেনে সেদিন যাদের যাদের ফেরত পাঠানো হয়েছিল তারা সবাই স্পেশাল ছিল; টিমি মারা গিয়েছিল বীরের মত, একটা মেশিনগানের আস্তানা চার্জ করতে গিয়ে। সে মরনোত্তর সিলভার স্টার পদক পেয়েছিল।
“টিমিকে যেদিন কবর দেয়া হয়েছিল, তারিখটা আমার পরিস্কার মনে নেই, তবে খুব সম্ভবত বাইশে জুলাই। তার চার কী পাঁচদিন পরের ঘটনা। মার্জারি নামে এখানে এক মহিলা ডাকপিয়ন ছিলেন। তিনি সেদিন রাস্তায় টিমিকে হেঁটে যেতে দেখেন, ইয়র্কস লিভারি আস্তাবলের দিকে। তিনি তার গাড়ি নিয়ে রাস্তার পাশেই পড়ে যাচ্ছিলেন; বুঝতেই পারছো অবস্থাটা। তিনি সাথে সাথে পোস্ট অফিসে ফেরত গিয়ে জর্জ এন্ডারসনকে ডেস্কের ওপর তার পৌঁছে না দেয়া চিঠির ব্যাগ ছুঁড়ে মারেন এবং বলেন তিনি এক্ষুনি বাড়ির পথ ধরবেন।
“মার্জারি, তুমি কি অসুস্থ? তোমার মুখ বোয়াল মাছের পেটের মত ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।”
“আমি প্রচন্ড ভয় পেয়েছি, কিন্তু আমি সেটা নিয়ে তোমাকে কিছু বলতে চাই না,” মার্জারি বলে। “আমি এ ব্যাপারে ব্রায়ানের সাথেও কথা বলতে চাই না, আমার মায়ের সাথেও না, কারো সাথেই না। মরার পর যিশু যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে তাহলে হয়তো বলতে পারি কিন্তু আমি নিশ্চিত না।”
“শহরের সবাই জানতো টিমির মৃত্যুর কথা। তার মৃত্যুর খবর এখানকার স্থানীয় দৈনিকে তো ছাপা হয়েছিলই আবার কয়েকটা জাতীয় দৈনিকেও ছাপা হয়েছিল। তার ফিউনারেলে শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষ হাজির হয়। কিন্তু মার্জারি তাকে তার ফিউনারেলের পাঁচদিন পর দেখলেন, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে। তিনি অবশ্য এটা জর্জ এন্ডারসনকে বলেছিলেন অবশেষে, বিশ বছর পর, তিনি যখন তার মৃত্যুশয্যায়। জর্জ আমাকে বলেছিল তিনি তার মৃত্যুর আগে ওই ঘটনাটা কাউকে বলে যেতে চেয়েছিলেন। জর্জ বলেছিল ওই ঘটনাটা মহিলাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খাচ্ছিল।
“টিমিকে তিনি প্রচন্ড ফ্যাকাসে দেখেছিলেন। তার পরনে ছিল একটা পুরনো প্যান্ট আর একটা শিকারের জ্যাকেট, যদিও সেদিন চারদিক গরমে খা খা করছিল। তার চুলগুলো পেছনের দিকে টানা ছিল আর চোখগুলোকে লাগছিল কেকের ওপর লেগে থাকা কিসমিসের মত। তিনি জর্জকে বলেছিলেন, ‘আমি সেদিন ভূত দেখেছিলাম, জর্জি। তাই আমি সেদিন ওরকম ভয় পেয়েছিলাম। আমি কখনো চিন্তাও করিনি এরকম কিছু দেখবো।
যাই হোক, এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। খুব শীঘ্রই আরো কিছু লোক টিমিকে দেখতে পায়। মিসেস স্টার্টন; যাকে আমরা সবাই মিসেস ডাকতাম কিন্তু তার আসলেই বিয়ে হয়েছিল কি না কেউ জানতো না। তার গানের রেকর্ডের বেশ ভালো কালেকশান ছিল। তুমি তাকে ১০ ডলার দিলেই সে তোমার জন্যে পার্টির আয়োজন করে ফেলতো আর পার্টি শেষে বিছানায় যেতেও কোন আপত্তি করতো না। তিনি পেড্রেসন রোড যেখানে হেনকক রোডের সাথে মিলেছে সেখানে একটা দুই রুমের বাসায় একা থাকতেন। তার বাসার বারান্দা থেকে টিমিকে দেখছিলেন। তার ভাষ্যমতে টিমি তার বাসার সামনের রাস্তার মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছিল।
“ও শুধু সেখানে দাড়িয়ে ছিল। তার হাত দুটো দুপাশে ঝুলছিল, আর তার মাথাটা অস্বাভাবিকভাবে সামনের দিকে ঝুঁকে এসেছিল। মিসেস বলেছিলেন এই দেখে তিনি যেখানে ছিলেন সেখানেই পাথরের মত দাঁড়িয়ে ছিলেন। এরপর টিমি ঘুরতে শুরু করে। সে প্রথমে তার এক পা এগিয়ে দেয় এবং পরে আরেক পা এতো সামনে রাখে যে সে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল। এরপর টিমি একদম তার চোখ বরাবর তাকায়। তা দেখে তার হৃৎপিন্ড প্রায় বন্ধই হয়ে যায় আর কি। তিনি এতোটাই চমকে গিয়েছিলেন যে তার হাতের কাপড়ের ঝুঁড়িটা হাত থেকে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে থাকে।
“তিনিও টিমির চোখগুলোর কথা বলেছিলেন। তার মতে টিমির চোখগুলো ছিল একদম মৃত, মার্বেলের মত ঘোলাটে। কিন্তু তিনি বলেছিলেন যে টিমি তাকে ঠিকই দেখতে পেয়েছিল। তার দিকে তাকিয়ে সে মুচকি হাসে। শুধু হাসি না, সে তাকে উদ্দেশ্য করে কথাও বলে। টিমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিল তার সেই রেকর্ডের কালেকশান এখনো আছে কি না। থাকলে সে হয়তো এসে তার সাথে সঙ্গিত চর্চা করবে, আবার রাতও কাটাবে; হয়তো সেদিন রাতেই। এরপর মিসেস স্টার্টন দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেন এবং পরের পুরো এক সপ্তাহ তিনি আর ঘর থেকে বের হননি। ততদিনে অবশ্য ঝামেলাও শেষ হয়ে যায়।
“অনেকেই টিমিকে দেখেছে। তাদের বেশিরভাগই এখন কবরে। তবে কয়েকজন এখনো বেঁচে আছে, যেমন আমি। এদেরকে ঠিকভাবে জিজ্ঞেস করলে তুমি এই ঘটনা জানতে পারবে।
“আমরা ওকে দেখেছিলাম। ও তার বাবার বাসার সামনের পেড্রেসন রোড দিয়ে হেঁটে একবার এক মাইল পূর্বে যাচ্ছিল আবার এক মাইল পশ্চিমে যাচ্ছিল। এই আগু-পিছু সে সারাদিন করতে থাকে; কে জানে, হয়তো সারা রাতও করেছে। শার্ট অর্ধেক ইন থেকে বের হয়ে আছে, প্যান্টের চেন খোলা, ফ্যাকাশে মুখ…আর সেই চাহনি….”
জাড একটা সিগারেট ধরানোর জন্যে থামলেন। ম্যাচের কাঠির নীল ধোয়ার ভেতর দিয়ে তিনি লুইসের দিকে তাকালেন। গল্পটা যতই উদ্ভট হোক, তার চোখে একবিন্দু মিথ্যাও ছিল না।
“হরর মুভিতে এখন অনেক জম্বি দেখা যায়। তারা হেলতে দুলতে হাটে, ধীরে স্থিরে। তাদের চোখগুলোও থাকে তাদের মতই মৃত। টিমি ব্যাটারম্যানও সেরকমই ছিল; জম্বির মতই, কিন্তু জম্বি থেকে আরো বেশি কিছু। তার চোখগুলোর পেছনে কিছু একটা ছিল, লুইস। সেটাও আবার সব সময় বোঝা যায় না। সেটা কি ছিল আমি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। হয়তো বুদ্ধিমত্তা…না এই শব্দ এখানে ব্যবহার করা একদম ঠিক হবে না।
“জিনিসটা বেশ চতুর ছিল। সে যেভাবে মিসেস স্টার্টনের সাথে রাত কাটানোর কথা বলেছে তাতে অতটুকু অন্তত বোঝা যায়। তার ভেতরে কিছু চলছিল, কিন্তু সেটাকে ‘চিন্তা শক্তি’ আমি বলবো না। আর আমার এটাও মনে হয় না তার ভেতরের সেই জিনিসটা টিমির সত্তা…টিমির সাথে সেটার কোন মিল ছিল না। ওকে দেখলে মনে হবে ওকে নিয়ন্ত্রণ করছে কেউ দূর থেকে বসে, রেডিও সিগনালের মত কিছু দিয়ে। মনে হবে ও যদি তোমাকে স্পর্শ করে তাহলে তুমি চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে ফেলবে।
“পরদিন আমি কাজ থেকে বাসায় ফিরে দেখি জর্জ এন্ডারসন আমার বাসার পোর্চে বসে বরফ চা খাচ্ছে। তার সাথে আরো ছিল হানিবল বেনসন, যে তখন আমাদের এলাকার নির্বাচিত কর্তাদের মধ্যে দ্বিতীয় আর এলান পুরিন্টন, যে ছিল ফায়ার সার্ভিসের চিফ। নরমাও সেখানে বসেছিল, কিন্তু ও একটা কথাও বলেনি।
“জর্জ তার কাটা পায়ের ডগায় ম্যাসেজ করছিল। রেলে কাজ করার সময় অ্যাক্সিডেন্টে তার পা কাটা যায়। গরমের দিনে ওই কাটা জায়গায় ওর খুব ব্যথা হতো। ও সেই অবস্থাতেই আমার বাসায় এসেছিল, পরিস্থিতির কারণে।
“ঘটনা অনেক দূর এগিয়ে গেছে,’ জর্জ আমাকে বলে। ‘একদিকে আমার একজন মহিলা ডাক-পিওন আছে যে ওই পেড্রেসন রোডে চিঠি বিলি করতে যাবে না, তার গলা কেটে ফেললেও না। আবার অন্যদিকে এই সমস্যা সরকারের কাছেও একটা বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে।”
“সরকারের সাথে আবার কী হলো?’ আমি জিজ্ঞেস করি
“হানিবল বলছিল ওয়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে তার কাছে এক কিংসম্যান নামের লেফট্যানেন্ট ফোন করেছিল। তার কাজ হচ্ছে গুজব থেকে সত্য বের করা। ‘ওয়ার ডিপার্টমেন্টের কাছে চার-পাঁচটা চিঠি গিয়েছে এবং চিঠি পড়ে কিংসম্যান একটু চিন্তিতও বটে। যদি একজন একটা চিঠি লিখত তাহলে সেটা হেসে উড়িয়ে দেয়া যেত। আবার একই লোক যদি সবগুলো চিঠি লিখে পাঠাতো তাহলেও কিংসম্যান লোকাল পুলিশের কাছে ফোন করে বলতো যে তাদের এখানে একটা সাইকোপ্যাথ আছে যার হয়তো ব্যাটারম্যান পরিবারের সাথে কোন শত্রুতা ছিল। কিন্তু চিঠিগুলোর হাতের লেখা ছিল বিভিন্ন মানুষের, আর তারা সবাই একই ঘটনা বলছিল। তাদের কথা হচ্ছে টিমি ব্যাটারম্যান যদি মরে গিয়ে থাকে তাহলে তাদের রাস্তায় তার জীবন্ত লাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।
“এই কিংসম্যান কোন লোক পাঠাবে বা নিজেই চলে আসবে যদি ঝামেলাটা আরো দূরে গড়ায়,’ হানিবল বলে।
“তারা জানতে চায় টিমি আসলেই মারা গিয়েছে কি না; আর না হলে কফিনের ভেতর টিমির বদলে কে শুয়ে আছে।”
“লুইস, তুমি বুঝতেই পারছো কী রকম একটা লেজে গোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছিল। আমরা সেখানে ঘন্টাখানেক বসে আলাপ করি আর বরফ চা খাই। নরমা একবার জিজ্ঞেস করেছিল স্যান্ডউইচ বানিয়ে আনবে কি না। আমরা সবাই না করি
“আমরা নানান রকম ফন্দি ফিকির করলাম কিভাবে কি করা যায়। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা ব্যাটারম্যানদের বাড়িতে সশরীরে যাব। আমি সেই রাতের কথা কখনোই ভুলবো না, এমনকি যদি আরো একশ বছরও বেঁচে থাকি। সেদিন ছিল মারাত্মক গরম, মনে হচ্ছিল নরক তার প্রত্যেকটা দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে। আমাদের কারোরই ইচ্ছে ছিল না সেখানে যাওয়ার, কিন্তু আমাদের সেখানে যাওয়াটা ছিল খুবই প্রয়োজন। নরমাও সেটা বুঝতে পেরেছিল। তাও ও অন্য একটা দরকারের ছুঁতোয় আমাকে ভেতরে ডেকে বলেছিল, ‘ওদের পিছিয়ে আসতে দিয়ো না খবরদার। তোমরা যেটা করতে যাচ্ছো সেটা শেষ করে আসবে। এরকম বীভৎস ঘটনা কোন ভাবেই মেনে নেয়া যায় না।”
জাড লুইসের দিকে তাকিয়ে তাকে পরীক্ষা করলেন।
“নরমা এই শব্দটাই ব্যাবহার করেছিল। বীভৎস। এরপর ও প্রায় কানে কানে আমাকে বলে, ‘কিছু উল্টাপাল্টা ঘটলে কোন দিকে, কারো দিকে না তাকিয়ে খিচে দৌড়াতে শুরু করবে। প্রত্যেকের দায়িত্ব তার নিজের নিজের। তুমি আমার কথা চিন্তা করে পালিয়ে আসবে কিছু ঘটলে।”
“আমরা সবাই হানিবল বেনসনের গাড়িতে করে রওনা হলাম; ওই শালার তখন আঙুল ফুলে কলাগাছ অবস্থা। গাড়িতে আমরা সবাই চুপচাপ ছিলাম আর চিমনির মত সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছিলাম।
“যাই হোক আমরা সেখানে পৌঁছানোর পর এলেন বাড়ির মূল দরজায় নক করে, কিন্তু কেউ জবাব দেয় না। এরপর আমরা বাড়িটার পেছনে গিয়ে দেখলাম বিল ব্যাটারম্যান বাড়িটার পেছনের সিঁড়ির ওপর বসে আছে একটা বিয়ারের কেস নিয়ে। আর টিমি পেছনের উঠোনে দাঁড়িয়ে ডুবতে থাকা লাল সূর্যটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সূর্যের কমলা রোদে তার ফ্যাকাসে মুখটাও কমলা লাগছিল; মনে হচ্ছিল ওর মুখের চামড়া জীবন্ত অবস্থায় কেউ খুলে নিয়েছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল শয়তানের কাছ থেকে সাত দিনের দীক্ষা লাভ করার পর ও শয়তানের শিষ্য হয়েছে। ওর জামাগুলো থলথল করছিল; ওর কম করে হলেও পচিশ কেজি ওজন কমেছে। ওর চোখগুলো একদম ভেতরে বসে গিয়েছিল। চোখগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল দুটো গর্ত আর গর্তগুলোর ভেতর কোন পশু লুকিয়ে আছে। তার ঠোঁট দুটো লাফাচ্ছিল, বাম দিকে, ঘড়ির কাটার মতন।
জাড কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করে বলে, “ওকে একদম অভিশপ্তের মত লাগছিল।”
টিমি আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসে…এমন বীভৎস সেই হাসি, লুইস, দেখলে তোমার গলা ফাটিয়ে চিৎকার বেরিয়ে আসবে। এরপর টিমি আবার সূর্যাস্ত দেখায় মন দেয়। বিল বলেন, ‘আমি তোমাদের নক শুনতে পাইনি, ‘ যেটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা কারণ এলেন এমন ভয়ঙ্করভাবে দরজায় শব্দ করেছে যা শুনলে…শুনলে বধির লোকও লাফিয়ে উঠবে।
“পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল কেউ কিছু বলবে না। তাই আমি নিজেই বলি, ‘বিল, আমরা শুনেছিলাম আপনার ছেলে ইতালিতে মারা গিয়েছিল।”
“সেটা একটা ভুল কথা,’ তিনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেন। “তাই না কি?’ আমি বলি।
“তুমি ওকে ওখানে দেখতে পাচ্ছো না? না কী কানা হয়ে গেছ?”
“আচ্ছা, তাহলে প্লেজেন্টভিউ গোরস্থানে কবর দেয়া কফিনে কে ছিল?” এলেন এবার জিজ্ঞেস করে।
“তার আমি কী জানি?’ বিল বলেন, ‘আর তাতে আমার কিছু যায় আসে ও না।” এরপর তিনি একটা সিগারেটের প্যাক থেকে সিগারেট বের করতে গেলে হাত ফসকে সবগুলো সিগারেট মাটিতে পড়ে যায়। এরপর তিনি সেগুলো তুলতে গেলে দু/তিনটা ভেঙেও ফেলেন।
“‘হয়তো লাশ উত্তলন করে দেখা হবে,’ হানিবল বলে। ‘আমাকে ওয়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন দেয়া হয়েছিল, বিল। তারা জানতে চায় টিমির বদলে অন্য কোন মায়ের ছেলেকে কবর দেয়া হয়েছে কি না।”
“তাতে আমার কি? বিল উচ্চস্বরে বলেন। ‘আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি আমি তাতেই খুশি। টিমি সেদিন বাসায় এসে হাজির। ও হয়তো শেলের আঘাত থেকে শকে আছে অথবা ওরকম কিছু। একটু কেমন কেমন করছে, কিন্তু আমি জানি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“আসেন আমরা ফাজলামি বন্ধ করি,’ আমি বলি। আমার হঠাৎ করেই মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে যায়। “তারা যদি ওই কফিন খুঁড়ে তুলে তাহলে দেখবে সেটা একদম ফাঁকা। আমি জানি কী ঘটেছে, হানিবাল, জর্জ আর এলেনও জানে কি ঘটেছে এবং আপনিও খুব ভাল করেই জানেন কি ঘটেছে। আপনি জঙ্গলে গিয়ে খুব জঘন্য একটা কাজ করেছেন এবং আপনার নিজের ওপর আর এই শহরের ওপর গজব ডেকে এনেছেন।”
“তোমরা আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও,” তিনি বললেন। “তোমাদের কাছে আমার কোন কৈফিয়ত দিতে হবে না। আমি যখন ওই টেলিগ্রামটা পেয়েছিলাম আমার আত্মা আমার শরীর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, সেই অনুভূতি তোমরা বুঝবে না। যাই হোক, আমি আমার ছেলেকে ফিরে পেয়েছি এতেই আমি খুশি। ওদের কোন অধিকার ছিল না আমার ছেলেকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাওয়ার। ওর বয়স মাত্র সতেরো। আমার জীবনে আমার ছেলেই একমাত্র সম্বল আর ওদের কাজটা ছিল অবৈধ, একদম অবৈধ। আমি মারা খাক, ওয়ার ডিপার্টমেন্ট মারা খাক, ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকা মারা খাক আর তোমরাও মারা খাও। ও আমার কাছে ফিরে এসেছে। ও ঠিক হয়ে যাবে। আমার আর কিছুই বলার নেই। তোমরা এখন বিদেয় হও।”
“টিমির ঠোঁটগুলো বিকৃত হয়ে হয়ে কাঁপছিল। ওর কপাল বেয়ে বড় বড় ফোটায় ঘাম ঝরছিল। আর আমি তখনই খেয়াল করি যে ও একটা উন্মাদ। জিনিসটা হয়তো আমাকেও উন্মাদ বানিয়ে দিতো।”
লুইসের পেটে কেমন কেমন করছে। সে খুব দ্রুত অনেকগুলো বিয়ার খেয়ে ফেলেছে। বেশ বুঝতে পারছে কিছুক্ষনের মধ্যেই তার হড়হড় করে বমি হবে, সে। পেটের গুড়গুড়ানি তাকে জানান দিচ্ছে তার আর বেশি দেরি নেই।
“এরপর আমাদের আর কিছু করার ছিল না। আমরা ফেরার প্রস্তুতি নেই। হানিবল বলে, ‘বিল, খোদা তোমাকে রক্ষা করুক।”
“বিল বলেন, ‘খোদা আমাকে রক্ষা করেননি, আমি নিজেই নিজেকে রক্ষা করেছি।”
“তখনি টিমি আমাদের দিকে হেঁটে আসে। ও ঠিক মত হাঁটতেও পারছিল না। ওর হাঁটার ধরন ছিল অনেকটা বুড়োদের মত। সে তার এক পা অনেক উচুতে উঠিয়ে দেয়, এরপর সেটা সামনে এনে ধপাস করে ফেলে, এরপর একইভাবে আরেক পা… ওকে দেখলে কাঁকড়ার হাঁটাচলার কথা মনে পড়ে। ওর হাতগুলো প্রায় ওর হাঁটু পর্যন্ত ঝুলছিল। ও যখন বেশ কাছে চলে আসে তখন ওর মুখে লাল লাল দাগ দেখা যায়, দাগগুলো ব্রনের মত বা ছোট ছোট পোড়ার মত। আমার ধারণা ওগুলো ছিল মেশিন গানের বুলেটের ছিদ্র। ওর মাথা গুলির চোটে প্রায় উড়েই গিয়েছিল।
“আর ওর গায়ে কবরের গন্ধ ছিল। এক রকমের কালো গন্ধ, যেন ওর ভেতরের সবকিছু পচে গেছে। আমি দেখলাম এলেন হাত দিয়ে নিজের নাক চাপা দিচ্ছে। ভয়ঙ্কর বাজে গন্ধ। গন্ধের চোটে মনে হবে এখনি ওর সারা গায়ে পোকা কিলবিল করতে দেখবে।
“থামুন,” লুইস কর্কশ কণ্ঠে বলে। “অনেক শুনেছি।”
“না, শোননি,” জাড বলেন। তিনি খুব দৃঢ় কণ্ঠে বলেন। “পুরোপুরি না। সেখানে যা ঘটেছিল তা মুখে বলে বোঝানো সম্ভব না। ব্যাপারটা যে কতটা জঘন্য ছিল তা বোঝার জন্যে সেখানে উপস্থিত থাকতে হবে, লুইস। সে ছিল মৃত, আবার জীবিতও। আর সে…সে…সে কিছু কিছু জিনিস জানতো।”
“কিছু জানতো, মানে?” লুইস সামনে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে।
“হুম। সে এলেনের দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ দাঁত বের করে হাসে। এরপর সে নিচু গলায় কিছু বলে। তার কন্ঠ এতোই ক্ষীণ ছিল যে সেটা শুনতে তোমাকে ঝুঁকে পড়তে হবে। আর তার গলার শব্দ শুনে মনে হচ্ছিল তার কণ্ঠনালীর ভেতর নুঢ়ি পাথর ঢুকে আছে। ‘তোমার বৌ ড্রাগস্টোরে যেই ব্যাটার সাথে কাজ করে তার সাথে শুয়ে বেড়াচ্ছে, বুঝলে পুরিন্টন? তোমার বউয়ের হয়ে যাওয়ার সময় ও চিৎকার করে ওঠে। কী করবে তুমি পুরিন্টন?’
“এলেন একদম চমকে যায়, তুমি ওকে দেখলেই বুঝতে কথাটা ওর গায়ে লেগেছে। এলেন এখন একটা নার্সিং হোমের বাসিন্দা, শেষবার যা শুনেছি। ওর বয়স এখন নব্বই এর মত। ওই সময় ওর বয়স ছিল চল্লিশ আর সেসময় ওর দ্বিতীয় বউ নিয়ে লোকমুখে নানান রসালো কথা ঘুরে বেড়াতো। তার ওই বউ ওর দূরসম্পর্কের কাজিন। সে এলেন আর তার প্রথম বউ লুসির সাথে কিছুদিনের জন্যে থাকতে এসেছিল। লুসি যুদ্ধের আগে দিয়ে মারা যায় আর তার এক বছর পর এলেন ওই মেয়েটাকে বিয়ে করে বসে। মেয়েটার নাম ছিল লরিন, বয়স তখন চব্বিশ এর মত হবে। তখন থেকেই তার নামে নানান কথা বলতো লোকে, যে ওকে সহজেই পটিয়ে বিছানায় নেয়া যায় এরকম বিভিন্ন কথা বার্তা। কিন্তু ওই মেয়ে ভাবতো কেউ কিছুই বুঝে না। এলেনও হয়তো এসব নিয়ে দু-একবার ভেবেছে কারণ সে চিৎকার করে বলে উঠেছিল, ‘চুপ শালা! পাছায় লাথি মারবো শুয়োরের বাচ্চা!”
“চুপ করো টিমি,’ বিল বলেন। বিলকেও অসুস্থ দেখাচ্ছিল, যেন তিনি তখনি ফিট হয়ে যাবেন বা বমি করে চারদিক ভাসিয়ে দিবেন। ‘একদম চুপ, টিমি।”
“কিন্তু টিমি তার বাবার কথা গ্রাহ্যই করলো না। এরপর সে জর্জ এন্ডারসনের দিকে তাকিয়ে বলে, “তোমার নাতি, যার জন্যে তুমি একটা দোকান করে দিয়েছো, সে তোমার মরার জন্যে দিন গুনছে। সে শুধু তোমার টাকার আশায় তোমার দেখাশোনা করে। ইস্টার্ন ব্যাংকে জমানো তোমার টাকার লোভে। এজন্যেই সে তোমার এতো খাতির করে। কিন্তু পিছে সে তোমার নামে টিটকারি মেরে ল্যাংড়া বুড়ো বলে; ও আর ওর বোন দুজনই।” লুইস, বিশ্বাস করবে না, টিমির গলা এর মধ্যেই অন্যরকম হয়ে গেছে। ওকে আরো নিষ্ঠুর শোনাচ্ছিল। ও এমনভাবে বলছিল যেন সাক্ষাত এন্ডারসনের নাতিই কথাগুলো বলছিল।
“কী আশা নিয়েই না তোমার নাতি তোমার মরনের জন্যে প্রতিক্ষা করছে! কিন্তু যখন তোমার মরার পর ও জানবে যে তোমার ফুটো কড়িটাও নেই, তখন কি হবে জর্জ?”
“কথাটা শুনে বিল হকচকিয়ে পিছিয়ে যায় আর বাড়ির বারান্দার সিঁড়িতে পা হড়কে ও মাটিতে পড়ে যায়।
“বিল কোনরকমে জর্জকে আবার দাঁড় করায় আর টিমিকে ধমকে ধমকে চুপ করতে বলেন। এরপর টিমি হানিবলের সম্পর্কে কিছু বলে, এরপর আমার সম্পর্কে। ততক্ষণে ও বদ্ধ উন্মাদের মত ক্ষিপ্রভাবে কথা বলছে, চিৎকার করছে। আমরাও ততক্ষণে পেছাতে থাকি, আর এরপর দৌড়ে পালাতে শুরু করি। জর্জ পড়ে যাওয়ায় ওর নকল পা টা নড়ে যায়। তার পা এখন উল্টোদিকে দেখাচ্ছে। আমরা ওকে আমাদের কাঁধে ভর দিয়ে কোন রকমে সেখান থেকে পালাই।
“আমি টিমিকে তখনই শেষ দেখি। বিকেলের শেষ রোদে তাকে একদম লাল দেখাচ্ছিল, তার মুখের দাগগুলো, উস্কোখুস্কো চুল… সে আমাদের লক্ষ্য করে চিৎকার করছিল আর গলা ফাটিয়ে হাসছিল। ‘বোকাচোদা! ল্যাংড়া বুড়ো! ভদ্দরলোক! মাগীবাজ!’ এগুলো সে বার বার বলতে থাকে আর এরপর সে হাসতে শুরু করে। আসলে সে চিৎকার করছিল…তার ভেতর থেকে কিছু একটা সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করছিল।”
জাড থামলেন। তিনি বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছেন।
“জাড,” লুইস বলে। “টিমি যেসব বলেছিল…সেগুলো কি সত্যি?”
“সত্য,” জাড বিড়বিড় করে বলে। “ওহ খোদা! সেসব একদম সত্য ছিল। আমি ব্যাঙ্গরের একটা বেশ্যা পাড়ায় যেতাম মাঝে মাঝে। যেটায় এখানকার অনেকই যেতো। আমার মাঝে মাঝে একঘেয়েমি চলে আসলে নতুনত্বের খোঁজে সেখানে যেতাম। অথবা যেসব জিনিস আমার স্ত্রী করতে চাইতো না সেসব কোন মহিলাকে দিয়ে টাকার বিনিময়ে করিয়ে নিতাম। কিন্তু সেসব আমি তখন থেকে আরো সাত/আট বছর আগেই ছেড়ে দিয়েছি। এসব নরমা জানতে পারলে আমাকে যে ছেড়ে চলে যেতো তা না, তবে ওর মনের ভেতরে কিছু একটা মরে যেত, চিরতরে; খুব প্রিয় আর মধুর কিছু।”
জাড়ের চোখ লাল হয়ে ফুলে গেছে। বুড়ো মানুষের চোখের জল খুব কুৎসিত, লুইস ভাবে। কিন্তু জাড যখন তার হাত ধরার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। লুইস তার হাত খুব শক্ত করে ধরলো।
“সে আমাদের খারাপ দিকটাই শুধু বলেছিল,” তিনি কয়েক মুহূর্ত পরে বলেন। “শুধুই খারাপগুলো। আর খোদা জানে যে প্রত্যেক মানুষের জীবনেই যথেষ্ট খারাপ জিনিস আছে, তাই না? তার দুই/তিন দিন পর এলেনের দ্বিতীয় বউ লরিন চিরতরে লাডলো ছেড়ে চলে যায়। আর এই ব্যাপারে এলেন আমাদের সাথে কখনোই কোন কথা বলেনি। জর্জ মারা গিয়েছিল ১৯৫০ সালে। তার মৃত্যুর পর সে তার নাতি নাতনীদের জন্যে কিছু রেখে গিয়েছিলেন বলে শুনিনি। হানিবলকে ওর অফিস থেকে বের করে দেয়া হয়, টিমি তাকে যেই দোষ দিয়েছিল ঠিক সেরকম একটা দোষে। সেটা কী ছিল আমি তোমাকে বলবো না, তবে এটুকু বলতে পারি সেটা ছিল শহরের ফান্ড থেকে তার নিজের সুবিধার জন্যে খরচ করা। এরকম কথাও শোনা যাচ্ছিল তাকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করা হবে, কিন্তু সেটা আর করা হয়নি। তাকে চাকরি থেকে বের করে দেয়াই যথেষ্ঠ কঠিন শাস্তি ছিল তার জন্যে। সে আকাশ থেকে এক লাথিতে মাটিতে এসে পড়ে।
“কিন্তু এসব মানুষের মধ্যে অনেক ভালো জিনিসও ছিল। কিন্তু মানুষ সেটা ভুলে যায়। হানিবলই কিন্তু ইস্টার্ন জেনারেল হাসপাতালের ফান্ড জোগাড় করে দিয়েছিল, ঠিক যুদ্ধের আগে দিয়ে। এলেন ছিল আমার চেনা সবচাইতে দরাজ দিলের লোক, সে বহু মানুষের উপকার করেছে। আর জর্জ এন্ডারসন শুধু চেয়েছিল পোস্ট অফিসের দায়িত্বটা খুব ভালোভাবে চালিয়ে নিতে, তার সাধ্য মত।
“কিন্তু সেই জিনিসটা শুধু আমাদের খারাপ দিকগুলোই বলেছিল। সে চেয়েছিল আমরা আমাদের খারাপ দিকগুলোই মনে রাখি কারণ সেটা নিজেই খারাপ ছিল…আর সে জানতো যে আমরা ওর জন্যে বিপজ্জনক। যুদ্ধে যাবার আগে যেই টিমি ব্যাটারম্যানকে আমরা চিনতাম সে ছিল খুবই ভদ্র একটা ছেলে। হয়তো একটু বোকা, কিন্তু খুব ভালো মনের। কিন্তু সেদিন আমরা যাকে দেখেছিলাম, যে লাল সূর্যের দিকে তাকিয়ে ছিল…সেটা ছিল একটা শয়তান। অথবা একটা জম্বি অথবা একটা ভূত। হয়তো সেটা কি ছিল সেই নামটাও আমি জানি না, তবে আমার ধারনা মিকমেকরা হয়তো ঠিকই বলতে পারবে।
“কী?” লুইস অসাড়ভাবে জিজ্ঞেস করে।
“যে জিনিসকে উয়িন্ডিগো ছুয়ে দিয়েছে,” জাড বললেন। তিনি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরে সেটা ছাড়লেন। এরপর তিনি নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকালেন।
“ওহ! অনেক রাত হয়ে গেছে, লুইস। আমি যতটুক বলবো ভেবেছিলাম তার দশ গুন বলে ফেলেছি।”
“আমার মনে হয় না,” লুইস বলে। “খুব দ্রুতই বলেছেন। এখন বলুন ঘটনার শেষটা কিভাবে হলো।”
“দুদিন পরে ব্যাটারম্যানদের বাড়ি আগুনে পুড়ে যায়,” জাড বলেন। “বাড়িটা একদম পুড়ে গিয়েছিল। এলেন বলেছিল যে কোন সন্দেহ নেই বাড়িটাতে ইচ্ছে করেই আগুন লাগানো হয়েছে। বাড়ির একমাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত কেরোসিন ছিটিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই তেলের গন্ধ তিনদিন পরেও পাওয়া যাচ্ছিল।”
“তারা দুজনেই পুড়ে যায়?”
“হুম, তারা পুড়ে যায় ঠিকই। কিন্তু তারা আগে থেকেই মৃত ছিল। টিমির বুকে দুইবার গুলি করা হয় একটা পুরনো কোল্ট পিস্তল দিয়ে, যেটা বিলের হাতে পাওয়া গিয়েছিল। সবকিছু দেখে যা মনে হয় তা হলো, বিল প্রথমে তার ছেলেকে গুলি করে খুন করে। এরপর তাকে বিছানায় শুইয়ে সে পুরো বাড়িতে কেরোসিন ছিটিয়ে দেয়। এরপর সে নিজের ইজি চেয়ারে বসে কোল্ট পিস্তলের নলটা নিজের মুখে পুরে নেয়।”
“ওহ খোদা!” লুইস বলে।
“তাদের লাশ ভীষনভাবে পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু কাউন্টি মেডিকেল অফিসার লাশ পরীক্ষা করে বলেছিলেন টিমি প্রায় দুই/তিন সপ্তাহ আগেই মারা গিয়েছে।”
নীরবতা।
জাড উঠে দাঁড়ান। “আমি যখন বলেছিলাম হয়তো আমিই তোমার ছেলেকে মেরে ফেলেছি তখন আমি একটুও বাড়িয়ে বলিনি। মিকমেকদের গোরস্থানটা খুব শক্তিশালী একটা জায়গা। মিকমেকরা এটার সম্পর্কে জানতো কিন্তু তার মানে এই না যে জায়গাটার জন্যে তারাই দায়ি। জায়গাটা খুবই বাজে একটা জায়গা। আমার কখনোই উচিত হয়নি তোমাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া, সেটা আমি এখন বুঝতে পারছি। জায়গাটার ক্ষমতা আছে ঠিক, কিন্তু তুমি যদি তোমার আর তোমার পরিবারের ভালো চাও তাহলে সেই ক্ষমতা থেকে সাবধান থাকবে। আমি ওই ক্ষমতার কাছে তখন খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। তুমি নরমার জীবন বাঁচিয়েছিলে আর তাই আমি তোমার উপকার করতে চেয়েছিলাম। আর এই সুযোগ নিয়ে ওই বদ জায়গাটা আমার ভালো নিয়তকে খারাপ কাজে ব্যাবহার করেছে। জায়গাটার ক্ষমতা আছে… আমার ধারনা সেই ক্ষমতা আসে ধাপে ধাপে, অনেকটা চাঁদের মত। সেটা আগেও ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছিল, আর আমার ভয় হচ্ছে সেটা সামনেও আবার ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসবে। আমার ধারনা জায়গাটা আমার মাধ্যমে তোমার কাছে পৌঁছাতে চাইছে তোমার ছেলের উসিলায়। তুমি বুঝতে পারছো আমি কী বলতে চাইছি?” তিনি কাতর চোখে লুইসের দিকে তাকান।
“আমার মনে হয় আপনি বলতে চাইছেন যে জায়গাটা জানতো যে গেজ মারা যাবে,” লুইস বলে।
“না, আমি বলতে চাইছি ওই জায়গাটাই হয়তো গেজকে খুন করেছে কারণ আমি তোমাকে সেখানকার ক্ষমতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। আমি বলতে চাইছি আমি হয়তো ভালো নিয়তে তোমার ছেলেকে খুন করেছি, লুইস।”
“আমি এসব বিশ্বাস করি না,” লুইস কাঁপা কাঁপা গলায় বলে। “আমরা কালকে গেজকে ব্যাঙ্গরে কবর দিচ্ছি। ও ব্যাঙ্গরেই থাকবে। আমার ওকে পেট সেমেটারি বা তার পিছনে নিয়ে কবর দেয়ার কোন ইচ্ছে নেই।”
“প্রমিজ করো! জাড শক্ত গলায় বলেন। “আমাকে প্রমিজ করো।”
“প্রমিজ,” লুইস বলে।
কিন্তু তার মনের পেছনে একটা ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, একটা ক্ষীণ আশার ভাবনা। সেটা কোনভাবেই তার মন থেকে যাচ্ছে না।
অধ্যায় ৪০
কিন্তু এসব কিছুই ঘটেনি। এই সব কিছু-গমগম করতে থাকা ট্রাক, গেজের জাম্পারে ছুঁয়ে যাওয়া আঙুল, রাচেলের গেজের ফিউনারেলে যাওয়ার জন্য পরা ঘরের কোট, এলির গেজের ছবি নিয়ে ঘোরাঘুরি আর গেজের চেয়ার বিছানার পাশে নিয়ে ঘুমানো, স্টিভ মাস্টারটনের চোখের পানি, আরউইন গোল্ডম্যানের সাথে মারামারি, জাড ক্র্যান্ডালের বলা টিমি ব্যাটারম্যানের বিভৎস কাহিনি-এই সব কিছুর অস্তিত্ব ছিল লুইসের মনে, যখন সে ছুটতে থাকা গেজের পিছনে দৌড়াচ্ছিল, সেই কয়েক সেকেন্ডে। ওর পেছন থেকে রাচেল আবার চিৎকার করে উঠে, “গেজ! থামো! প্লিজ আর দৌড়ায় না, বাবা! কিন্তু লুইস একটুও ভ্রুক্ষেপ করে না, সে প্রাণপণে দৌড়াতে থাকে। হ্যাঁ, ওইসব ঘটনার একটা ঘটলো। সে দূর থেকে একটা ট্রাকের ইঞ্জিনের গমগম আওয়াজ শুনতে পেল আর হঠাৎ করেই তার জাড ক্র্যান্ডালের প্রথম দিন বলা একটা কথা মনে পড়ে গেল, তুমি শুধু বাচ্চারা রাস্তার আশেপাশে যায় কি না খুব খেয়াল রাখবে, মিসেস ক্রিড। এই রাস্তাটায় বড় বড় ট্রাক দিনরাত চলে।
গেজ এখন উঠোনের হালকা ঢাল দিয়ে দৌড়াচ্ছে, রুট-১৫’র দিকে। তার ছোট্ট ছোট্ট পাগুলো এলোমেলোভাবে তাকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আনাড়িভাবে দৌড়ানোর কারণে খুব স্বাভাবিকভাবেই তার হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সে পড়ছে না; সে ছুটেই চলছে। ট্রাকের ইঞ্জিনের গমগম শব্দ এখন গর্জনের মত শোনাচ্ছে, ট্রাকটা এখন খুব কাছেই। ঘুমের ঘোরে সে এই শব্দ প্রায়ই শোনে, তখন এই শব্দটা তার বেশ আরামদায়ক মনে হয়; কিন্তু আজ সেই একই শব্দ তার খুব ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে।
ওহ খোদা! প্লিজ ওকে যেন আমি ধরতে পারি। প্লিজ ওকে রাস্তায় যেতে দিও না!
লুইস চূড়ান্তভাবে তার গতি বাড়ায় এবং লম্বা লাফ দেয়, আমেরিকান ফুটবল খেলোয়ারদের ট্যাকেল করার মত করে। যে মুহূর্তে গেজের গতি তাকে রোডের ওপর নিয়ে যাচ্ছিল, লুইসের আঙুলগুলো গেজের জ্যাকেটের পেছনে স্পর্শ করে….এবং সে তাকে ধরে ফেলে।
সে চোখের পলকে গেজকে হ্যাচকা টানে খসখসে নুড়ি পাথর বিছানো মিটিতে ফেলে দেয়। পড়ে গিয়ে লুইসের নাক ফেটে রক্ত বেরিয়ে যায়। সে তার অন্ডকোষেও প্রচন্ড ব্যথা পায়। ওহ! আমি ফুটবল খেলব জানলে অন্ডকোষের গার্ড পড়েই নামতাম, লুইস ভাবে। কিন্তু তার নাকের ব্যথা আর অন্ডকোষের ব্যথা ছাপিয়ে তার মন থেকে একটা পাথর নেমে যাওয়ার অনুভূতি হয়, যখন সে গেজের ব্যথায় কাতর হওয়া কান্নার আওয়াজ শুনতে পায়। একটু পরেই ট্রাকের গর্জনে তার কান্নার আওয়াজ চাপা পড়ে যাবে।
লুইস তার তলপেটে মারাত্নক ব্যথা থাকার পরেও সে কোন মতে উঠে বসে গেজকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে। এর একটু পরেই রাচেলও তাদের সাথে যোগদান করে। “কক্ষনো রাস্তায় দৌড়াবে না, গেজ! কক্ষনো না! এই রাস্তাটা খুব পচা! পচা!” আর গেজ এতো অবাক হয় যে সে তার কান্না বাদ দিয়ে তার মায়ের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে।
“লুইস, তোমার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে,” এরপর সে লুইসকে হঠাৎ করে এতো জোরে জড়িয়ে ধরে যে লুইসের প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসে।
“শুধু তাই?” সে বলে। “আমি মনে হয় খোজা হয়ে গেছি…আহ… ব্যথা!”
এটা শুনে রাচেল হিস্টিরিয়াগ্রস্থের মত হাসতে শুরু করে। তা দেখে লুইসের মনে হয়, গেজ যদি আসলেই মারা যায়, তাহলে হয়তো রাচেল সত্যই পাগল হয়ে যাবে।
কিন্তু গেজ মারা যায়নি; ওই সব কিছুই তার কল্পনায় ঘটেছে, যখন সে গেজের মৃত্যুর সাথে পাল্লা দিয়ে উঠোনের ওপর ছুটছিল। মারাত্মক পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিনাটি বিষয়ের বিবরণসহ ছিল সেই কল্পনা।
গেজ গ্রামার স্কুলে পড়াশোনা শুরু করে, আর সাত বছর বয়সে সে ক্যাম্পে যাওয়া শুরু করে, যেখানে সে সাঁতারে বেশ ভালই দক্ষতা দেখাতে শুরু করে। আর সে এটাও প্রমাণ করে সে তার বাবা-মাকে ছাড়া একমাস থাকার পরেও তেমন কোন উল্লেখযোগ্য মানসিক রোগে ভোগেনি। ওর বয়স যখন দশ, তখন সে তার পুরো গ্রীষ্ম আগাওয়াম ক্যাম্পে কাটাতে থাকে। সে এগারো বছর বয়সে চারটা ক্যাম্পের সব বাচ্চাদের নিয়ে আয়োজিত সাতার প্রতিযোগিতায় দুটি নীল মেডেল আর একটি লাল মেডেল জেতে। সে লম্বা হয়, বড় হয়, কিন্তু সে সেই আগের মিষ্টি গেজই থেকে যায়।
সে হাইস্কুলে প্রথম সারির ছাত্র হয় আর স্কুলের সাঁতারু দলের সদস্য হয়। এই স্কুলটা লুইস সাজেস্ট করেছিল কারণ সেখানে সাঁতারের ভালো সুবিধা আছে। রাচেল খুবই মন খারাপ করে যখন সতেরো বছর বয়সে গেজ ক্যাথলিক খ্রিস্টান হতে চায়। রাচেলের ধারণা এসবই গেজ করছে তার গার্লফ্রেন্ড মেয়েটাকে খুশি করার জন্যে। রাচেল বলেছিল, “যদি ওই বেশ্যা মেয়েটা ওর মাথায় এসব ঢুকিয়ে না থাকে, তাহলে আমি কাচা গু খাবো।” রাচেল ধারণা করেছিল গেজ অলিম্পিকের স্বপ্ন কবর দিয়ে খুব শীঘ্রই মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলবে, তার পড়াশোনারও ইতি হবে। কয়েক বছরের মধ্যেই দেখা যাবে সে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বেঢপ ভুড়ি নিয়ে ট্রাকের ড্রাইভারি করছে আর দুনিয়াতে আরো দশটা ক্যাথলিক বাচ্চার জন্ম দিয়েছে।
লুইস অবশ্য ভেবেছিল গেজ এসব নিজের ইচ্ছেতেই করছে। যেদিন গেজ চার্চে গিয়ে দীক্ষা নেয় সেদিন লুইস সেটার ফটো তুলে তার শ্বশুড়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়, ক্ষেপানোর উদ্দেশ্যে। রাচেলের ধারণা ভুল হয়, ও সেই মেয়েটিকে বিয়ে করে না। আর মেয়েটিও যে কোন বেশ্যা না সেটার প্রমানও তারা ভালোভাবেই পায়।
সে জন হপকিন্সে যায় এবং অলিম্পিক সাঁতারু দলে জায়গা করে নেয়। এরপর একদিন, ট্রাকের হাত থেকে গেজকে বাঁচানোর প্রায় ষোল বছর পর, গেজ নিজের দেশের হয়ে অলিম্পিকে সাঁতারে সোনার মেডেল জেতে। যখন তাকে মেডেল পরিয়ে দেয়া হয় এবং তার দেশের জাতীয় সঙ্গিত বাজিয়ে শোনানো হয়, গেজ তার জাতীয় পতাকার দিকে তাকিয়ে থাকে। এই দৃশ্যটা লুইস আর রাচেল তাদের বাসার টিভির সামনে বসে দেখে, তাদের চুল ততদিনে পেকে গিয়েছে, আর তাদের দুজনের
দুজনের চোখেই পানি। “যাক…অবশেষে।” সে কাঁপা গলায় বলে রাচেলকে জড়িয়ে ধরার জন্যে সেদিকে ফিরে। রাচেলের দিকে তাকিয়ে সে দেখলো রাচেল তার দিকে বিষ্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে। লুইসের চোখের সামনেই রাচেলের বয়স আরো বেড়ে যেতে লাগলো, প্রথমে মাস, পরে বছরকে বছর। টিভিতে জাতীয় সঙ্গিতের আওয়াজ ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। যখন লুইস টিভির দিকে ফিরে তাকালো সেখানে সে গেজের জায়গায় আরেকটা কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেকে দেখতে পেল, যার মাথার কোকড়া চুলে লেগে থাকা ঘাম চিকচিক করছে।
অবশেষে।
শেষ।
ওহ খোদা! সব শেষ!
লুইস বৃষ্টি ভেঁজা সকালে জেগে উঠলো, একটা বালিশ জাপটে ধরা অবস্থায়। তার মাথায় তীব্র ব্যথা, যেটা হার্ট বিটের সাথে তাল মিলিয়ে ওর মাথায় হাতুড়ির মত পেটাচ্ছে; ব্যথাটা বাড়ে, এরপর কমে, বাড়ে এরপর কমে। সে একটা পুরনো বিয়ারের গন্ধ মিশ্রিত ঢেকুর তুলে। ওর পেট ফুলে উঠেছে। সে ঘুমের মধ্যেই কাঁদছিল, চোখের জলে তার বালিশটা ভিজে গেছে। ঘুমের মধ্যেও তার একটা অংশ সত্যটা জানতো আর সেজন্যেই সে কেঁদেছে।
সে উঠে কোনরকমে পা হড়কাতে হড়কাতে বাথরুমে যায়। একদম অন্তিম মুহূর্তে টয়লেটের কমোডের কাছে পৌঁছায় এবং গতরাতের খাওয়া একগাদা বিয়ার উগড়ে দেয়।
হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসে পড়ে সে, এরপর চোখ বন্ধ রেখেই হাতড়ে হাতড়ে টয়লেটের ফ্লাশটা টেনে দেয়। সে আয়নার সামনে যায়, নিজের চোখ কতটুকু লাল হয়েছে বোঝার জন্যে। কিন্তু গ্লাসটা ঢাকা ছিল। ওর মনে পড়ে গেল রাচেল ওদের বাসার সবগুলো আয়নার গায়ে কভার লাগিয়ে দিয়েছে।
কিসের অলিম্পিক সাঁতারু দল, আর কিসের কি, লুইস আনমনে ভাবতে ভাবতে তার বিছানায় ফিরে যায়। তার মুখে আর গলায় বিয়ারের টক বিস্বাদের আস্তর লেগে আছে। সে শপথ করলো যে সে আর জীবনেও এই বিষ ছোবে না। অলিম্পিক মেডেল না হয় না হবে। কিন্তু এই শপথ এই বারই সে প্রথম করছে না, বা এটা তার শেষ বারও না।
লুইস তার বিছানায় বসে থাকে। জানালা দিয়ে অলস ভঙ্গিতে বৃষ্টির পানি পড়ছে। তার মাথা গতরাতের নেশার দরুন ব্যথায় দপদপ করছে। আর এরই মধ্যে পুত্রশোক তাকে জেঁকে ধরে। শোক এসে তার ভেতরের সবগুলো বাধ ভেঙে দেয়। সে তার দুহাতে মুখ গুজে দুলে দুলে কাঁদতে শুরু করে আর ভাবতে থাকে যে সে একটা দ্বিতীয় সুযোগ পাওয়ার জন্যে সব কিছু করতে পারে, সব কিছু।
অধ্যায় ৪১
গেজকে সেদিন দুপুর দুটোয় কবর দেয়া হয়। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেলেও আকাশে মেঘের আনাগোনা ছিল। গেজের ফিউনারেলে আসা বেশিরভাগ লোকজনই আন্ডারটেকারের দেয়া কালো ছাতা বহন করছে।
রাচেলের অনুরোধে ফিউনারেল পরিচালক গেজের জন্যে খোঁড়া কবরের পাশে দাড়িয়ে বাইবেল থেকে কিছু বাণী পড়লেন। বাণীটা ছিল ছোট বাচ্চাদের নিয়ে। লুইস কবরের অন্যপাশে দাড়িয়ে থাকা তার শ্বশুড়ের দিকে তাকায়। গোল্ডম্যান এক পলকের জন্যে তার দিকে চেয়ে চট করে চোখ নামিয়ে নিলেন। তার ভেতরে আর ঝগড়া করার মত কোন শক্তি অবশিষ্ট নেই। তার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে, তার সিল্কের ছোট টুপির পাশ দিয়ে তার সাদা চুল বাতাসে এলোমেলোভাবে উড়ছে। মুখের কাঁচা-পাকা দাড়িতে তাকে আগের চাইতেও বেশি খিটখিটে স্বভাবের মনে হচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি ঠিক মত জানেনই যে তিনি কোথায় আছেন। কিন্তু লুইস চেষ্টা করেও উনার জন্যে তার মনে কোন সহানুভূতির উদ্রেক করতে পারলো না।
গ্রেভ লাইনারটার ওপর একটা চকচকে ফ্রেমের ওপর গেজের ছোট্ট সাদা কফিনটা রাখা হয়েছে। খুব সম্ভবত কফিনের ছিটকিনি ঠিক করা হয়েছে। কবরের চারপাশ নকল ঘাস দিয়ে কার্পেটিং করা হয়েছে, সেসব ঘাস এতো সবুজ যে তা দেখে লুইসের চোখে জ্বালা হচ্ছে। সেই সব ঘাসের ওপর কয়েক ঝুড়ি ফুল রাখা হয়েছে। লুইস ফিউনারেল পরিচালকের কাঁধের ওপর দিয়ে সামনের দিকে তাকায়। সামনে একটা ছোট টিলার মত, সেখানে বেশ কিছু কবর আর একটা বিশাল মনুমেন্ট। মনুমেন্টের গায়ে খোঁদাই করে লেখা : ফিস। সেই মনুমেন্টের ওপর দিয়ে হলুদ একটা কিছু দেখতে পায় সে। সেটা ভালো করে দেখার জন্যে নড়ে চড়ে তাকায়। যখন ফিউনারেল পরিচালক সবাইকে বললেন, চলুন আমরা সবাই মৃতের জন্যে মাথা নিচু করে প্রার্থনা করি কিছুক্ষণ,’ তখনো লুইস মাথা উঁচু করে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ ভালোভাবে তাকানোর পর সে বুঝতে পারে সেটা কী। সেটা একটা বড় পে-লোডার ট্রাক। ট্রাকটা লোকজনের দৃষ্টি সীমার বাইরে রাখা হয়েছে; সঙ্গত কারণেই। ফিউনারেলের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই সেটার ড্রাইভার লাফিয়ে ট্রাকে উঠবে, তার জ্বলন্ত সিগারেটটা পিষে কোথাও লুকিয়ে ফেলে, কারণ ফিউনারেল হোমের কর্মচারীরা সিগারেটের ফিল্টার এখানে সেখানে ফেলে রাখলে খুব শীঘ্রই তাদের চাকরি খেয়ে দেয়া হয়। কারণ এখানকার অনেক কাস্টমারই ফুসফুসের ক্যান্সারে ভুগে মারা গিয়ে থাকে। ট্রাকে উঠে সে ট্রাকের লোডে যা আছে তা গেজের কবরের ওপর ফেলবে এবং গেজকে দিনের আলো থেকে বঞ্চিত করবে, চিরতরে…অথবা অন্তত পুণরুত্থান দিবস পর্যন্ত।
পুণরুত্থান… আহ, একটা শব্দ বটে।
(যেটার চিন্তা থেকে নিজেকে তোমার হাজার মাইল দূরে রাখতে হবে এবং তুমি সেটা খুব ভাল করেই জানো)।
ফিউনারেল পরিচালক যখন “আমেন” বললেন, তখনই লুইস রাচেলের হাত ধরে সেখান থেকে চলে আসতে চায়। রাচেল বিড়বিড় করে সামান্য প্রতিবাদ করে, ‘আরেকটু থাকি, প্লিজ লুইস।” কিন্তু লুইস সেটা গ্রাহ্য করে না। তারা তাদের গাড়ির দিকে এগুতে থাকে। লুইস দেখে ফিউনারেল ডিরেক্টরের সহকারী সবার হাত থেকে তাদের ফিউনারেল হোমের ছাপ মারা ছাতাগুলো নিয়ে স্ট্যান্ডে সাজিয়ে রাখছে। লুইস ডান হাতে রাচেলের হাত ধরে আছে আর বাম হাতে এলির সাদা গ্লাভস পড়া হাত। এলি নরমা ক্র্যান্ডালের ফিউনারেলে যে ড্রেস পরেছিল, সেই একই ড্রেস পরেছে আজকে।
লুইস যখন ওদের গাড়িতে বসিয়ে দিলো তখন জাড আসেন। জাডকে দেখেও মনে হচ্ছে তার রাতটা খুব একটা ভালো যায়নি।
“তুমি ঠিক আছো, লুইস?”
লুইস মাথা ঝাঁকায়। জাড একটু নিচু হয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে রাচেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি ঠিক আছো, রাচেল?”
“আমি ঠিক আছি,” রাচেল প্রায় ফিসফিস করে জবাব দেয়। এরপর তিনি এলির দিকে তাকিয়ে বলেন, “তোমার কি খবর, সোনামনি?”
“আমি ভালো আছি,” বলে এলি বিশ্রীভাবে হাসে, জাডকে বোঝানোর জন্যে যে সে কতটা ভালো আছে।
“তোমার ওই ছবিটা কিসের?”
লুইসের একবার মনে হচ্ছিল যে এলি জাডকে ছবিটা দেখাবে না, কিন্তু পরমুহূর্তেই এলি ছবিটা খুব বিব্রতভাবে জাডের হাতে তুলে দেয়। জাড ছবিটা নিয়ে তার লম্বা, শুকনো আঙুলগুলো দিয়ে ধরে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলেন। তার আঙুলগুলো দেখলে মনে হয় সেটা কল-কারখানা বা কন্সস্ট্রাকশনের কাজের জন্যে উপযোগী-কিন্তু এই আঙুল দিয়েই তিনি কতোটা স্বাচ্ছন্দ্যের সাথেই না গেজের গা থেকে মৌমাছির হুল তুলে নিয়েছিলেন, অনেকটা জাদুকরের মত…বা সার্জনের মত।
“খুব সুন্দর তো ছবিটা,” জাড বলেন। “তুমি ওকে স্লেজে চড়িয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছো। ও নিশ্চয়ই খুব মজা পাচ্ছিল, তাই না?”
কাঁদতে শুরু করা এলি মাথা ঝাঁকায়।
রাচেল কিছু বলতে চাইলে লুইস তার হাত চেপে নিষেধ করে-একটু শান্ত থাকো।
“আমি ওর সাথে এভাবে অনেক খেলতাম,” এলি ফোপাতে ফোপাতে বলে, “আর ও শুধু হাসতো আর হাসতো। আর খেলার পর আম্মু আমাদের কোকা বানিয়ে দিতো আর বলতো, ‘তোমাদের বুট জুতোগুলো জায়গামত রাখো,’ আর গেজ তখন ওর বুটগুলো ধরে উঁচু করে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলতো ‘বুট! বুট!’ এতো জোরে বলতো যে আমার কান ফেটে যেত। তোমার মনে আছে, আম্মু?”
রাচেল মাথা ঝাকায়।
“আমি নিশ্চিত খুব ভালো সময় ছিল সেটা,” ছবিটা ফিরিয়ে দিয়ে জাড বলেন। “ও মরে গিয়ে থাকতে পারে, এলি, কিন্তু তুমি চাইলে ওর স্মৃতিগুলো তোমার কাছে রাখতে পারো।”
“আমি তাই করবো,” এলি নিজের মুখ মুছতে মুছতে বলল। “আমি ওকে খুব ভালোবাসতাম, মিস্টার ক্র্যান্ডাল।”
“আমি জানি, সোনামনি।” তিনি নিচু হয়ে ওর গালে চুমু খেলেন। এরপর তিনি রাচেল আর লুইসের দিকে তাকালেন, তার চাহনিতে একটা প্রশ্ন। রাচেল জাডের দিকে তাকিয়েই তার চোখ নামিয়ে নিল, সে ঠিক বুঝতে পারছে না জাডের চাহনির মানে। কিন্তু লুইস ঠিকই বুঝতে পারে। তোমরা তোমাদের মেয়ের জন্যে কি করছো? জাডের চোখগুলো জিজ্ঞেস করছে। তোমাদের ছেলে মরে গেছে, কিন্তু তোমাদের মেয়ে এখনো বেঁচে আছে। ওর জন্যে তোমরা কী করছো?
লুইস তার চোখ সরিয়ে নেয়। সে এলির জন্যে কিছুই করতে পারবে না, অন্তত এখনো না। ওকে ওর কষ্টের সমুদ্র নিজে নিজেই পাড়ি দিতে হবে। লুইসের মাথা এখন তার ছেলের চিন্তায় ঠাসা।
অধ্যায় ৪২
বিকেল হতে হতে আকাশে আরেক পাল নতুন মেঘ এসে হাজির হয় এবং খুব বাতাস বইতে থাকে। লুইস একটা জ্যাকেট গায়ে চাপিয়ে দেয়ালের হুক থেকে তার গাড়ির চাবিটা নেয়।
“কোথায় যাচ্ছ, লু?” রাচেল জিজ্ঞেস করে। ওর প্রশ্নে তেমন কোন আগ্রহ নেই। দুপুরের খাবারের পর থেকে ও আবার কাঁদতে শুরু করেছে। এর পর থেকে ও অনবরত কেঁদেই যাচ্ছিল, একটুও না থেমে। লুইস ওকে শান্ত করার জন্যে জোর করে একটা ভ্যালিয়াম ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছে। এখন ও একটা পত্রিকার ক্রসওয়ার্ডের পাতা খুলে বসে আছে, যেটার তেমন কিছুই সলভ করা হয়নি। পাশের রুমে এলি চুপচাপ বসে টিভিতে একটা ছায়াছবি দেখছে।অনলাইন ফিল্ম স্ট্রিমিং পরিষেবা
“আমি ভাবছিলাম একটা পিজ্জা নিয়ে আসবো।”
“তখন খেতে পারোনি?”
“তখন ক্ষুধা ছিল না,” সে সত্য বলে, এরপর মিথ্যেটা বলে, “এখন ক্ষুধা পাচ্ছে।”
আজ বেলা তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত লাডলোর ফিউনারেল হোমে গেজের ফিউনারেলের সর্বশেষ আনুষ্ঠানিকতা হয়ে গিয়েছে, খাওয়া-দাওয়ার আনুষ্ঠানিকতা। স্টিভ মাস্টারটন এবং তার স্ত্রী এসেছিল হ্যামবার্গার আর নুডুলস নিয়ে। চার্লটন এসেছিলেন কুইচে নিয়ে। “এটা তোমরা যতদিন ইচ্ছে ফ্রিজে রেখে খেতে পারবে, যদি আজ বেঁচে যায়,” তিনি রাচেলকে বলেন।
“কুইচে খুব সহজেই গরম করে নিতে পারবে।” প্রতিবেশি ডেনিকাররা বেকড হ্যাম নিয়ে এসেছেন। গোল্ডম্যানরা নানান রকমের খাবার আর চিজ নিয়ে এসেছেন। তারা এসে একবারও লুইসের সামনে পড়েননি; এতে লুইস বেশ খুশিই হয়েছে। জাড়ও চিজ নিয়ে এসেছেন, তার প্রিয় মিস্টার র্যাট চিজ। সুরেন্দ্র হারদু নিয়ে এসেছে আপেল। দেখা গেল ফিউনারেলের খাবারের আনুষ্ঠানিকতায় ধর্ম একটা বিবেচ্য বিষয়।
ফিউনারেল পার্টিটা নীরব হলেও একদম স্তব্ধ ছিল না। সাধারণ পার্টির মত দেদারসে মদ গেলা না হলেও কিছু ঠিকই গেলা হয়েছে। লুইস গতকালই প্রতিজ্ঞা করেছিল সে আর এই বিষ ছোঁবে না, কিন্তু গতকালের ঘটনা আজ তার কাছে অনেক অতীতের কিছু বলে মনে হচ্ছে। সে কয়েকটা বিয়ার গেলার পর ভাবছিল তার চাচা কার্লের কাছ থেকে শোনা ফিউনারেলের নানান গল্প লোকজনকে বলে শোনাবে। যেমন, সিসিলির কুমারী মেয়েরা নাকি মৃতের গায়ের কাপড় থেকে কিছু কাপড় কেটে নিয়ে যায়, কারণ তাদের বিশ্বাস সেই কাপড় তাদের বালিশের নিচে নিয়ে ঘুমালে তারা দ্রুত প্রেমিক খুঁজে পাবে। আবার আইরিশ ফিউনারেলে নকল বিয়ের আয়োজন করা হয় মাঝে মাঝে, আর তাদের পায়ের বুড়ো আঙুলগুলো এক সাথে বেঁধে দেয়া হয় কারণ তাদের বিশ্বাস এতে করে মৃতের ভূত পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়াতে পারে না।
রাচেল একবার কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু তার মা তাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসেন। রাচেল তার মায়ের গলা জড়িয়ে আঝোরে কাঁদছে, যেটা সে লুইসের সাথে করতে পারেনি; এর কারণ হয়তো সে নিজেকে এবং লুইসকে গেজের মৃত্যুর জন্যে কিছুটা হলেও দায়ি করে। তাই হয়তো সে তার মায়ের কাছে সান্ত্বনার জন্যে গিয়েছে এবং তার মা তাকে সেটা দিচ্ছে। তাদের দুজনের কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আরউইন গোল্ডম্যান তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন, তার এক হাত রাচেলের কাঁধের ওপর রাখা এবং তিনি চোখে মুখে বিজয়ীর অসুস্থ ভঙ্গিমা নিয়ে রুমের অপর পাশে লুইসের দিকে তাকিয়ে আছেন।
এলি একটা সিলভার ট্রেতে খাবার নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। ট্রেতে টুথপিক দিয়ে গাঁথা কেনাপি পরিবেশন করা। গেজের ছবিটা সে তার বগলের নিচে শক্ত করে গুঁজে রেখেছে।
লুইসকে যারা সমবেদনা জানাচ্ছে সে তাদেরকে ধন্যবাদ দিলো। তার আচরণ একটু শীতল, লোকদের সাথে থেকেও যেন সে নেই। সে কোথায় যেন তাকিয়ে কী ভাবছে। বাকিরা হয়তো ভাবছে সে তার অতীত নিয়ে চিন্তা করছে, চিন্তা করছে তার গেজবিহীন সামনের জীবনের কথা। কিন্তু কেউ এটা ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি সে আসলে একটা কবর ডাকাতির কথা চিন্তা করছে; হয়তো জাড়ও না। সে শুধুই ভাবছে। ভাবলেই যে সেটা করতে হবে এমন তো কোথাও লেখা নেই।
লুইস অরিংটন কর্নার স্টোর থেকে এক ডজন বিয়ারের ক্যান আর দুটো পেপারনি-এন্ড-মাশরুম পিজ্জার অর্ডারের জন্য পিজ্জার দোকানে ফোন দেয়।
“কি নাম লিখবো পিজ্জার অর্ডারে, স্যার?”
ওজ দ্য গেয়েট অ্যান্ড টেয়িল, লুইস ভাবে।
“লু ক্রিড।”
“আচ্ছা, লু, আমরা আজ খুব ব্যস্ত আছি। তাই হয়তো পয়তাল্লিশ মিনিট লাগবে আপনার অর্ডারের জন্যে। তাতে আপনার চলবে?”
“শিওর,” লুইস বলে ফোন রেখে দিল। সে তার গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালু করলে তাকে এই ভাবনাটা খোঁচায় যে ব্যাঙ্গরে কমপক্ষে বিশটা পিজ্জার দোকান আছে। কিন্তু সে সেই দোকানেই অর্ডার করেছে যেই দোকানটা গেজের গোরস্থান প্লেজেন্টভিউর কাছাকাছি। তাতে কী? লুইস অস্বস্তি নিয়ে ভাবে। তারা আসলেই ভালো পিজ্জা বানায়। ফ্রিজের ময়দার কাই তারা ব্যবহার করে না। তারা পিজ্জার রুটি বানানোর সময় সেটা ওপরে ছুঁড়ে মারে আবার ক্যাচ ধরে, কাস্টমারদের চোখের সামনেই। এটা দেখে কী হাসিটাই না গেজ-
সে তার চিন্তাটা বাদ দেয়।
পিজ্জার দোকানটাকে পাশ কাটিয়ে গেজের গোরস্থান প্লেজেন্টভিউর দিকে গাড়ি চালিয়ে যায় সে। হয়তো ধারণা করেছিল, সে এই কাজটাই করবে। কিন্তু তাতে কি কোন ক্ষতি আছে? নেই। গাড়িটা পার্ক করে রাস্তা পেরিয়ে গোরস্থানের গেটের কাছে আসে। গোরস্থানের লোহার গেটটা গোধুলীর শেষ আলোয় হালকা ঝকমক করছে। গেটের ওপরের বোর্ডে বড় বড় অক্ষরে লেখা : ‘অপরূপ দৃশ্য।” গোরস্থানের নামের কি বাহার…মনোরম দৃশ্য। কিন্তু দৃশ্যটা লুইসের কাছে মনোরমও লাগলো না আবার অপ্রীতিকরও মনে হলো না। গোরস্থানটা বেশ কয়েকটা টিলা নিয়ে গড়া। গোরস্থানের ভেতর সারি সারি গাছ আর বিক্ষিপ্তভাবে লাগানো কিছু কাদুনে গাছ। গাছগুলোকে শেষ বিকেলের মৃদু আলোতে কুচকুচে কালো দেখাচ্ছে। গোরস্থানটা একদমই নীরব না, পাশের মহাসড়ক থেকে বিরামহীনভাবে ভারি যানবাহনের আওয়াজ আসছে। আর অন্ধকার হতে থাকা আকাশে একটা আলোর আভা দেখা যাচ্ছে: ব্যাঙ্গর এয়ারপোর্টের আলো।
গেটটা সম্ভবত লক করা, ভেবে সে গেটের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু গেটটাতে কোন লক ছিল না। হয়তো এতো আগে গেটের লক লাগানো হয় না। আর যদি গেট লক করেও তাহলে কেন করে? মাতাল, বদ ছেলেপেলে আর স্টান্টবাজদের দূরে রাখতে? এদেশে তো গরিব দেশের মত লাশ চুরি হয় না। গেটের ডানের পাল্লাটা মৃদু প্রতিবাদ করে খুলে যায়। তাকে কেউ দেখছে কি না সেটা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে লুইস গেটের ভেতরে ঢুকে যায়। সে গেটটা পেছনের দিকে ধাক্কা দিয়ে লাগিয়ে দিলে গেটটা লাগার ক্লিক শব্দ শুনতে পায়।
সে মৃতের শহরে দাঁড়িয়ে চারপাশ ভালো করে দেখতে থাকে।
চমৎকার নির্জন একটা জায়গা। মানুষের মন কী বিচিত্র। তাদের বাসস্থানহীন জীবিতেরা রাস্তায় ঘুমালেও মৃতরা ঠিকই মনোরম জায়গায় ঘুমায়। তার মনের ভেতর জাড কথা বলে উঠেন। তার কণ্ঠে দুশ্চিন্তা আর-আতঙ্ক? হ্যা। আতঙ্ক।
লুইস, তুমি এখানে কী করছ? তুমি এমন এক রাস্তার দিকে তাকাচ্ছো যেই রাস্তায় তোমার যাওয়া একদমই ঠিক হবে না।
সে কন্ঠটা ঠেলে সরিয়ে দেয়। সে শুধু নিজের ওপরই অত্যাচার করছে, অন্য কারো ওপর না। আর কারোর জানার প্রয়োজন নেই যে সে সন্ধ্যার আলোতে এই গোরস্থানে এসেছিল।
সে গেজের কবর লক্ষ করে এগোয়। গাছের সারির নিচ দিয়ে হাঁটতে থাকে। গাছের কচি পাতা তার মাথার ওপর বাতাসের দুলুনিতে কানাকানি করতে থাকে। তার হৃৎপিন্ডে হাতুড়ি পেটাচ্ছে। কবর আর স্মৃতিস্তম্ভগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো। কিছুক্ষণ পর পর কবরস্থানের বড় বড় ম্যাপ লাগানো। ম্যাপে পুরো কবরস্থানে দেখা যাচ্ছে কোন কবরগুলো ভরাট আর কোনগুলো এখনো খালি আছে। বিক্রির জন্যে প্লট। এক রুমের এপার্টমেন্ট ঘুমোনোর কামরা।
পেট সেমেটারির মত না জায়গাটা, ভেবে সে ক্ষণিকের জন্যে থমকে দাঁড়ায়। না, একদমই না। পেট সেমেটারির কবরগুলো এলোমেলো হলেও একটা শৃঙ্খলা আছে, যেন বিশৃঙ্খলার ভেতর থেকেই শৃঙ্খলার আবির্ভাব হয়েছে। গোলাকার কবরের সারিগুলো খুব শৃঙ্খলার সাথেই একদম মাঝখানে গিয়ে মিলিত হয়েছে। যেন বাচ্চা কাচ্চারা কিছু না বুঝেই একটা প্যাটার্ন তৈরি করে ফেলেছে তাদের সমষ্টিগত চেতনা থেকে, যেন…
হঠাৎ লুইসের মনে হলো পেট সেমেটারিটা একরকমের… বিজ্ঞাপন। মেলাতে সার্কাসের বিজ্ঞাপন করা হয় সার্কাসের প্রধান তাঁবুর বাইরে। তাঁবুর বাইরে ফ্রিতে আগুনের খেলা দেখে লোকজন আগ্রহী হয়ে পয়সা দিয়ে টিকেট কিনে সার্কাসের শো দেখতে যায়। সার্কাসের মালিকরাও জানে লোকজনকে কাবাব পোড়া ধোঁয়া না দেখালে তারা কাবাব কিনতে আসবে না।
পেট সেমেটারির কবরগুলোর বৃত্তাকার শেপটা পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন ধর্মীয় চিহ্নের সাথে মিলে যায়। একটা বৃত্তের ভেতরে আরেকটা বৃত্ত, তার ভেতরে এভাবে আরো অনেক বৃত্ত। ভেতরের বৃত্ত ছোট হতে হতে বিন্দুতে পরিণত হয়। অনেকের মতে সেই বিন্দুটা অসীম বা ইনফিনিটি।
বিশৃঙ্খলা থেকে শৃঙ্খলা, অথবা শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলা, যে যেভাবে নিতে চায়। এই চিহ্নটা মিসরীয়রা তাদের ফারাওদের সমাধিতে খোদাই করে দিত, ফিনিশিয়ানরা তাদের রাজাদের কবরে এঁকে দিত; গিল্ডকিংরা বৃটেনের বিখ্যাত স্টোনহেঞ্জ বানিয়েছে পৃথিবীর ঘড়ি হিসেবে, সেখানেও এরকম প্যাটার্ন পাওয়া যায়; জুডিও ক্রিশ্চিয়ান বাইবেলেও এরকম চিহ্নের কথা আছে, ঈশ্বর যখন জবের সাথে কথা বলেন তখন এরকম আকৃতির একটা ঘূর্ণি তৈরি হয় বাতাসে।
ওই চিহ্নটা পৃথিবীর সবচাইতে প্রাচীন ক্ষমতার চিহ্ন। এই চিহ্নটাই হয়তো সবচাইতে পুরনো সূত্র, যেটা উপসাগরীয় অঞ্চল বা গালফের সাথে সারা পৃথিবীর সম্ভাব্য সম্পর্কের প্রমাণ।
অবশেষে সে গেজের কবরের কাছে পৌঁছায়। পে-লোডার ট্রাকটা আশে- পাশে নেই। নকল ঘাসের কার্পেটটা সরিয়ে নেয়া হয়েছে। গেজ যেখানে শুয়ে আছে সেখানটার ওপরে আয়তক্ষেত্রের মত একটা জায়গায় ঝুরঝুরে মাটি দেখা যাচ্ছে, এই ঝুরঝুরে মাটির গভীরতা খুব সম্ভবত পাঁচ ফুট হবে। ওর কবরের ফলকটি এখনো লাগানো হয়নি।
লুইস কবরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে। দমকা বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলোভাবে উড়ছে। এতক্ষণে চারদিক অন্ধকার হয়ে এসেছে, আকাশে মেঘের দল ছুটে বেড়াচ্ছে।
কেউ আমার মুখে টর্চের আলো ফেলে জিজ্ঞেস করতে আসেনি আমি এখানে কী করছি। কোন পাহারারত কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে আসেনি। গেটটাও লক করা নেই। আমি যদি একটা কোদাল আর বেলচা নিয়ে আসতাম-
সে ঝাঁকি দিয়ে নিজের মাঝে ফিরে আসে। ধরা যাক গোরস্থানের কেয়ারটেকার বা পাহারাদার এসে তাকে তার ছেলের নতুন কবরে খোঁড়া গর্তের মধ্যে আবিষ্কার করলো, তখন কী হবে? হয়তো এটা পত্রিকায় যাবে না, কিন্তু আবার যেতেও তো পারে। তাকে হয়তো পুলিশে দেয়া হবে। কোন অপরাধে? লাশ চুরি? মনে হয় না। ভ্যান্ডালিজমের দোষে অভিযুক্ত করার সম্ভাবনাই বেশি। আর এই খবর চাপা থাকবে না। লোকজন ঠিকই জেনে যাবে; এরকম একটা খবর না ছড়িয়ে পারে না। স্থানীয় এক ডাক্তারকে তার রোড অ্যাক্সিডেন্টে নিহত দুই বছরের ছেলের নতুন কবর খুঁড়তে থাকা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে; কি রসালো খবর! সে তার চাকরি হারাবে। আর তা না হলেও, এসব গল্প শুনে রাচেলের কি অবস্থা হবে সে তা চিন্তাও করতে পারছে না। আর এলিকে তার ক্লাসের বাচ্চারা যে কি বলে ক্ষেপাবে সেটাও সে কল্পনা করতে পারছে। লাশচোরের বাচ্চা। ওকে হয়তো মানসিক ডাক্তারের কাছে মাথা ঠিক আছে কি না পরীক্ষা করতে পাঠানো হবে।
কিন্তু আমি গেজকে আবার জীবন ফিরিয়ে দিতে পারি! আমি ওকে আবার আমার কোলে ফিরিয়ে আনতে পারি!
কিন্তু সে কি আসলেই এই কথা বিশ্বাস করে?
সত্য হচ্ছে, সে বিশ্বাস করে। গেজের মৃত্যুর আগে এবং পরে, সে বার বার নিজেকে বুঝিয়েছে যে চার্চ আসলে সেবার মরেনি, শুধু জ্ঞান হারিয়েছিল। চার্চকে কবর দেয়ার পর সে সেখান থেকে মাটি সরিয়ে বের হয়ে ফিরে এসেছে। মনিব ভুলে তার পোষা প্রাণীকে কবর দিয়ে দেয়, আর বিশ্বস্ত প্রাণীটা কবর থেকে নিজেকে বের করে বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু সেটা একদমই সত্য না। চার্চ আসলেই মরে গিয়েছিল আর মিকমেকদের গোরস্থান ওকে আবার ফিরিয়ে এনেছে।
সে গেজের কবরের পাশে বসে তার জানা সবগুলো তথ্য গুছিয়ে ভাবতে থাকে, যতটুকু গুছিয়ে ভাবনা এই কালো যাদু তাকে করতে দেয়।
টিমি ব্যাটারম্যান। প্রথমত, সে কি গল্পটা বিশ্বাস করেছে? দ্বিতীয়ত, তাতে কি কিছু যায় আসে?
জাড যেই পরিস্থিতিতে গল্পটা তার থলে থেকে বের করেছেন সেটা বেশ সন্দেহজনক। কিন্তু তারপরও লুইস সেটার বেশিরভাগটাই বিশ্বাস করেছে। যদি লোকজন মিকমেক কবরস্থানের ওই ক্ষমতার কথা জানে তাহলে কেউ না কেউ সেই ক্ষমতা নিয়ে একটু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখবে সেটাই স্বাভাবিক। আর সেটা শুধু কুকুর-বিড়ালেই সীমাবদ্ধ থাকবে সেটাও বিশ্বাস করা কঠিন।
আচ্ছা, ঠিক আছে। তাহলে কি সে এটাও বিশ্বাস করে টিমি ব্যাটারম্যান একটা শয়তান বা জম্বিতে পরিণত হয়েছিল?
এটা অধিকতর কঠিন প্রশ্ন। আর সে এটা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তা করছে কারণ সে জানে সে এটা বিশ্বাস করতে চায় না। আর এরকম একপেশে মানসিকতা নিয়ে চিন্তা করলে ফলাফল কি হয় সে আগেও দেখেছে।
না, সে এটা বিশ্বাস করতে চায়না টিমি ব্যাটারম্যান কোন অশুভ কিছুতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে সে এই কারণে নিজের চিন্তা-ভাবনা ঘোলাটে হয়ে যেতে দিতে পারে না।
লুইস হ্যানরাট্টির কথা ভাবে; মিকমেকদের গোরস্থানে কবর দেয়া সেই ষাঁড়টার কথা। জাড বলেছিলেন ষাঁড়টা খুব বিগড়ে গিয়েছিল, অনেকটা টিমি ব্যাটারম্যানের মতই। পরবর্তীতে যে লোক অমানসিক পরিশ্রম করে মিকমেকদের গোরস্থানে ষাঁড়টাকে স্লেজে করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল, সেই লোকই সেটাকে গুলি করে সরিয়ে দেয় তার বদ স্বভাবের কারণে। টিমি ব্যাটারম্যানকেও প্রায় একইভাবে তার বাবা দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেন।
কিন্তু সেই ষাঁড়টা বদ হয়ে গিয়েছিল মানে কি বাকি সব পশুরাও বদ হয়ে গিয়েছিল? না। তাহলে দেখা যাচ্ছে ষাঁড়ের ঘটনাটা স্বাভাবিক কেস না, বরং অস্বাভাবিক কেস। অন্য কেসগুলো দেখি—জাডের কুকুর স্পট, বুড়ো মহিলার টিয়া, চার্চ নিজে। তারা সবাই পরিবর্তিত হয়ে ফিরে এসেছে, তাদের পরিবর্তনগুলোও চোখে পড়ার মতই; কিন্তু অন্তত স্পটের ক্ষেত্রে পরিবর্তনগুলো এতো জঘন্য ছিল না সেটা নিশ্চিত হয়ে বোঝা যায়, কারণ তাহলে জাড নিশ্চয়ই লুইসকে সেখানে নিয়ে যেতেন না। পরে অবশ্য সেই কাজের জন্যে তিনি অনুতপ্ত হয়েছেন, অনেক হাবি-জাবি কথা বলেছেন যেগুলোর আসলেই কোন আগা-মাথা নেই।
সে কিভাবে শুধু এক টিমি ব্যাটারম্যানের গল্প শুনে এই সুযোগটা হাতছাড়া করবে? একটা উদাহরণ দিয়ে তো সবটা বোঝা যায় না।
তুমি নিজে যেই ফলাফল চাও, সেটা প্রমাণ করার জন্যে সব যুক্তি সেইদিকেই ব্যবহার করছো, তার মন বিরোধীতা করে ওঠে। অন্তত নিজেকে চার্চের ব্যাপারের সত্যটা তো বলো। তুমি যদি ওর নির্মমভাবে খুন করা ইঁদুর আর পাখিগুলোর কথা বাদও দাও,-ও যেরকম হয়ে গেছে সেটা নিয়ে তুমি কী বলতে চাও? ওকে এখন যেটা বলা যায় তা হচ্ছে বেকুব; এর চাইতে ভালো কিছু ওর সম্পর্কে বলা যায় না। গেজকে নিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর দিনটার কথা মনে আছে তোমার? কতটা প্রাণবন্ত ছিল গেজ? তুমি গেজের সেই স্মৃতিটা নিয়ে বেঁচে থাকতে চাও? নাকি ওকে ফালতু হরর মুভির জম্বিদের মত কবর থেকে উঠিয়ে আনতে চাও? আর জম্বি না হলেও খুব বেশি হলে একটা বেকুব বাচ্চা ছেলে হিসেবেই নাহয় তাকে ফেরত পাবে, যে রোবটের মত সারাদিন টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে, আর খাওয়ার সময় চারদিকে খাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়, কারণ তার জন্যে নিজে নিজে খাওয়াটাও একটা বিরাট জটিল কাজ; আর যে কখনো নিজের নামটাও লিখতে পারবে না। এই ব্যাপারে তুমি কি বলবে? মনে আছে জাড তার কুকুরকে নিয়ে কি বলেছিল? আমার মনে হচ্ছিল আমি একটা মাংসপিন্ডকে গোসল করাচ্ছি।” এটাই কি তুমি চাও? শ্বাস নিতে পারা একটা মাংসপিন্ড? আর তা নিয়েও যদি তোমার কোন সমস্যা না থাকে তাহলেও তুমি তোমার ফিরে আসা মৃত ছেলের ব্যাপারে তোমার স্ত্রীর কাছে কি জবাব দিবে? এলিকে কি বলবে? স্টিভ মাস্টারটনকে কি বলবে? পুরো দুনিয়াকে কি বলবে? মিসি ডেন্ডিজ যখন তোমাদের বাসায় এসে ড্রাইভওয়েতে গেজকে তার তিন চাকার সাইকেল চালাতে দেখবে তখন কি হবে? তুমি কি তার আর্তচিৎকার শুনতে পারছো? তুমি কি তার আতঙ্কিত চেহারাটা দেখতে পাচ্ছো? তুমি সাংবাদিকদের কি বলবে? রিয়ালিটি টিভির লোকজন যখন তোমার আর তোমার পুণরুত্থান ঘটা ছেলেকে নিয়ে প্রোগ্রাম করার জন্যে বাসায় ক্যামেরা নিয়ে হাজির হবে তখন তুমি তাদের কি বলবে?
কিন্তু আসলেই কিছু যায় আসে না কি এটা তার ভেতরের কাপুরুষত্বের কন্ঠ? সে কি বিশ্বাস করে যে এসব কিছু সামাল দেয়া যাবে না? রাচেল কি তার মৃত ছেলেকে ফিরে পেয়ে আনন্দের অশ্রু ঝরানো ছাড়া অন্য কিছু করবে?
হ্যাঁ, সে বুঝতে পারছে খুব ভাল সম্ভাবনা আছে যে গেজ ফিরতে পারে…ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে। কিন্তু তাই বলে কি ওর প্রতি তার ভালোবাসা কমে যাবে? যাদের বাচ্চা বোবা-কালা বা অন্ধ, পেট বাইরে ঝোলা হয়ে জন্মায় তারা কি তাদের সন্তানকে ভালোবাসে না? যাদের সন্তান ধর্ষণ, খুন বা নিরপরাধীর উপর জুলুমের মত অপরাধ করে, তারা কি তাদের সেইসব সন্তানদের জন্যে বিচারকের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে না?
সে কি মনে করে গেজ যদি একটা অথর্ব হয়ে ফিরে আসে তাহলে সে তাকে ভালোবাসতে পারবে না? যদি সে আট বছর পর্যন্ত ডায়াপার পরে, যদি সে দশ বছরে প্রথম শ্রেণী পাশ করে? বা যদি জীবনেও না করে? সে কি তার ছেলেকে একেবারে ত্যাগ করবে, যখন একটা শেষ চেষ্টা করার উপায় আছে?
কিন্তু লুইস তুমি তো মহাশূন্যে বাস করো না! লোকে কী বলবে-
সে এই চিন্তাটা খুব ক্ষিপ্রভাবে মন থেকে সরিয়ে দেয়। এখন যেসব বিষয় পাত্তা দেয়া যাবে না সেসবের মধ্যে ‘মানুষ কী ভাববে’ লিস্টের সবচাইতে ওপরে।
লুইস মাথা নিচু করে গেজের কবরের দিকে তাকালে তার শরীর দিয়ে আতঙ্কের একটা শিহরণ বয়ে যায়। নিজের অজান্তেই তার আঙুলগুলো গেজের কবরের মাটির ওপর একটা প্যাঁচানো বৃত্তাকার চিহ্ন এঁকেছে।
সে সাথে সাথে তার দুহাতের আঙুলগুলো দিয়ে চিহ্নটা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। এরপর সে গোরস্থান থেকে বেরিয়ে যায়, দ্রুতপদে, প্রতিনিয়ত ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করতে করতে। তার মনে হচ্ছে এখনি কেউ তার পথ আগলে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে এখানে এই সময়ে সে কী করতে এসেছে।
পিজ্জা নিতে অনেক দেরি হয়ে যায় তার। যদিও এটাকে একটা ওভেনের ওপর অল্প তাপে রেখে দেয়া হয়েছিল, সেটাকে এখন দেখতে তেলতেলে ঠান্ডা রুটির মত দেখাচ্ছে। সেটাকে মুখে দিয়ে লুইসের মনে হলো সে রান্না করা মাটি খাচ্ছে। একটা পিস কোন রকমে গিলে বাকিটা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়, বক্স সহ। সে চায় না রাচেল তাদের বাসার ময়লার ঝুড়িতে একটা প্রায় না খাওয়া পিজ্জা দেখুক। কারণ তাহলে রাচেল হয়তো বুঝে যাবে তার ব্যাঙ্গর আসার প্রধান কারণ পিজ্জা খাওয়া ছিল না।
লুইস এখন সময় আর পরিস্থিতি নিয়ে ভাবছে।
সময়। সময় হয়তো খুবই গুরুত্বপূর্ন একটা বিষয়। টিমির মৃত্যুর পর অনেকটা সময় পেরিয়ে গিয়েছিল যতক্ষণে তার বাবা তাকে মিকমেকদের কবরস্থানে কবর দেয়। টিমি গুলি খেয়েছিল উনিশ তারিখে। তাকে প্রথমবার কবর দেয়া হয়েছিল খুব সম্ভবত বাইশ তারিখে; জাডের মতে। এর চার থেকে পাঁচ দিন পর মার্জারি তাকে রাস্তার ওপর হাঁটতে দেখেন।
আচ্ছা, ধরা যাক বিল ব্যাটারম্যান তার ছেলের প্রথম কবরের চার দিন পর…না, হিসেবে ত্রুটি থাকলে সেটা রক্ষণশীল দিকেই ধরা যাক। ধরা যাক তিন দিন পর। আর তর্কের খাতিরে ধরা যাক টিমির পুনরুত্থান ঘটে পচিশ তারিখে। তাহলে এক রকম বলা যায় যে তার মৃত্যু আর কবর থেকে উঠে আসার মধ্যে তফাত ছিল ছয় দিনের। আর সেটা হয়তো দশ দিনও হতে পারে। গেজের ক্ষেত্রে চারদিন এর মধ্যেই চলে গেছে। বিলি ব্যাটারম্যান যদি ছয় দিনের মধ্যেও কাজটা করে থাকে যার কমে আসলে সেটা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না-তাহলেও লুইসের এখনো তার চাইতে কম সময়ে কার্যসিদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। যদি…
যদি সে চার্চের সময় যে পরিস্থিতি ছিল সেই একই পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। চার্চ খুব ভালো সময়ে মরেছিল, তাই না? তার পরিবারের কেউই বাড়িতে ছিল না, যখন চার্চ রাস্তায় গাড়ির ধাক্কা খেয়ে মারা যায়।
তার পরিবারের সবাই তখন শিকাগোতে বেড়াচ্ছে।
লুইসের কাছে ধাঁধাঁর শেষ অংশটাও পরিস্কার হয়ে যায়।
***
“আমাদের তুমি কী করতে বলছো?” রাচেল লুইসের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
রাত প্রায় দশটা। এলি ঘুমিয়ে পড়েছে। রাচেল আরেকটা ভ্যালিয়াম খেয়েছে এর মধ্যে। সেও অনেকটা ঘোরের মধ্যে ছিল, কিন্তু লুইসের কথাটা ঠিকই তাকে ধাক্কা দিয়েছে।
“আমি চাচ্ছি তোমরা তোমার বাবা-মার সাথে শিকাগোতে ফিরে যাও,” লুইস ধৈর্য সহকারে আবারো বলে। তুমি যদি এখনি তাদের এয়ারলাইন্সে ফোন করো, তাহলে তোমরা একই প্লেনে যেতে পারবে।”
“তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? বাবার সাথে তোমার ওই মারামারির পর-”
লুইস মিথ্যা বলার ক্ষেত্রে আনাড়ি। কিন্ত কোন অদ্ভুত এক কারণে সে নিজের মধ্যে মিথ্যা বলার জন্যে একরকম অনুপ্রেরণা পাচ্ছে।
“ওই মারামারিই একটা বড় কারণ। আমার মনে হয় আমাদের মীমাংসা হয়ে যাওয়া উচিত। পুরনো ঘা আরো খুঁচিয়ে লাভ নেই, তা আমি বুঝতে পারছি রাচেল…মারামারির ঠিক আগে আমি ওইরকমই কিছু করার চিন্তা করছিলাম। মারামারি শুরুর আগে সত্যই আমি সব ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে চাচ্ছিলাম।”
“কিন্তু এই সময়ে তোমাকে ফেলে তাদের কাছে যাওয়া আমার একদমই ভালো লাগছে না। তোমাকে এখন আমাদের প্রয়োজন। আর তোমারও আমাদেরকে প্রয়োজন।” রাচেলের চোখগুলো লুইসকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে। “অন্তত আমি আশা করি যে তোমার আমাদেরকে প্রয়োজন। আর আমাদের কারোই এমন অবস্থা নেই যে-”
“এখানে থাকার মত কোন অবস্থা তোমাদের নেই,” লুইস জোর দিয়ে বলে। তার মনে হচ্ছে তার জ্বর আসছে। “আমি খুশি যে তোমার আমাকে প্রয়োজন আর আমারো তোমাদেরকে প্রয়োজন। কিন্তু এই বাসাটা এখন তোমার থাকার জন্যে দুনিয়ার সবচাইতে নিকৃষ্ট জায়গা। গেজ এই বাসার সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাছাড়া আমার মনে হয় এটা এলির জন্যেও খুব খারাপ।”
সে রাচেলের চোখে স্পষ্ট বেদনার ছাপ দেখতে পায়। তার এই নিচুদরের যুক্তি শুনে সে নিজের কাছেই লজ্জিত। সে যত পড়াশোনার বই পড়েছে, সবগুলো তাকে বলেছে কারো প্রিয়জন মারা গেলে তাদের প্রথমেই খুব ইচ্ছে হয় ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যেতে। আর এই কাজটা তার জন্যে খুবই ক্ষতিকর, কারণ সে তার নতুন বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাচ্ছে, বাস্তবতা না মেনে নিয়ে। বইয়ে লেখা আছে কারো প্রিয়জনের মৃত্যু হলে তাদের উচিত তারা যেখানে ছিল সেখানেই থাকা এবং শোকের মাঝেই শোক কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা। কিন্তু লুইস এখন এসব কিছুই পরোয়া করে না। সে শুধু চায় তার পরিবারকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দিতে, অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও।
“আমি জানি,” রাচেল বলে। “তুমি ব্যাঙ্গর যাওয়ার পর আমি ঘরটা ভ্যাকিউম ক্লিনার দিয়ে পরিস্কার করছিলাম; কিছু করে নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যে। তখন আমি সোফাটা একটু সরালে সেটার নিচে গেজের ছোট ছোট গাড়িগুলো দেখি…মনে হচ্ছিল…গাড়িগুলো অপেক্ষা করছে গেজের জন্যে…তাদের নিয়ে খেলার জন্যে…” রাচেলের কাঁপতে থাকা কন্ঠ এবার একদম ভেঙে যায়, তার চোখ বেয়ে পানি ঝরতে শুরু করে। “এরপর আমি আরেকটা ভ্যালিয়াম খাই কারণ আমি আমার কান্না থামাতে পারছিলাম না…আমি এখনো এজন্যেই কাঁদছি…কী এক নরক শুরু হলো আমাদের জীবনে লুইস?…লুইস আমাকে একটু ধরবে?”
লুইস তাকে জড়িয়ে ধরে, খুব ভালোভাবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার নিজেকে একটা ভন্ড বলে মনে হচ্ছে। তার মনের ভেতর নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে, কিভাবে এই চোখের পানিকে তার নিজের স্বার্থে কাজে লাগানো যায়।
“এরকম আর কয়দিন চলবে লুইস? আমি কসম খেয়ে বলতে পারি আমি যদি ওকে ফিরে পেতাম তাহলে ওর আরো বেশি বেশি খেয়াল রাখতাম, ওরকম কিছুই ওর সাথে হতে দিতাম না। লুইস, ওই ড্রাইভার খুব দ্রুত গাড়ি চালাচ্ছিল, কিন্তু তাই বলে আমাদের দোষও মাফ হয়ে যায় না। আমি কখনো কল্পনাও করিনি এতো কষ্ট থাকতে পারে জীবনে। লুইস, এই যন্ত্রণা থেকে আমার কোন রেহাই নেই; যখন আমি ঘুমোতে যাই তখনো আমি স্বপ্নে ওই দৃশ্যটাই দেখি, বার বার…আমি দেখি ও রাস্তাটার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে… আর আমি চিৎকার করে ওকে ডাকছি…
“শ্শ্শ্…রাচেল, শ্শ্শ।”
রাচেল তার ফোলা মুখ তুলে তার দিকে তাকায়। “লুইস, গেজতো কোন দুষ্টুমিও করছিল না…ওর কাছে দৌড়ে পালানো ছিল একটা নিছক খেলা…ট্রাকটা খারাপ সময় এসে পড়েছিল…মিসি ডেন্ড্রিজ ফোন করেছিল যখন আমি কাঁদছিলাম… উনি বললেন খবরের কাগজে বেরিয়েছে ওই ট্রাকের ড্রাইভারটা না কি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।”
“কী?”
“সে না কি তার গ্যারাজে গলায় দড়ি দিয়ে মরার চেষ্টা করেছে। সে খুবই ডিপ্রেশনে আছে, খবরের কাগজে এ রকমই নাকি লিখেছে…”
“ও মরলেই ভালো,” লুইস ঘৃণা ভরা কন্ঠে বলে, কিন্তু তার নিজের কন্ঠস্বর তার কাছে অনেক দূরের কিছু বলে মনে হয়। তার সমগ্র শরীরে হঠাৎই কাঁটা দিয়ে ওঠে।…সেটা আগেও ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করছিল, আর আমার ভয় হচ্ছে সেটা সামনেও আবার ক্ষমতার শীর্ষে চলে আসবে…”আমার ছেলে মরে কবরের নিচে শুয়ে পচছে। আর সে হাজার ডলারে জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে আরো বেশি ডিপ্রেসড হোক। আর কিইবা শাস্তি হবে ওর আমাদের ছেলেকে খুন করার জন্যে? বেশি হলে ওর লাইসেন্স কিছুদিনের জন্যে বাতিল করা হবে আর কিছু টাকা জরিমানা হবে…”
“মিসি বলছিলেন তার স্ত্রী আর বাচ্চারাও নাকি তাকে ছেড়ে চলে গেছে, “ রাচেল মৃদু গলায় বলে। “এই খবর অবশ্য তিনি খবরের কাগজ থেকে পাননি। ওখানকার একজনকে না কি মিসি চিনেন। ড্রাইভার লোকটা সেই সময় নেশাগ্রস্থ ছিল না, কোন ড্রাগসও সে নেয়নি। তার আগেও বেশি গতিতে গাড়ি চালানোর কোন পুলিশ রেকর্ড নেই। সে বলেছে সে যখন লাডলো পৌঁছায় তার না কি হঠাৎ একটা ঝোঁক চাপে স্পিডের প্যাডেলে চাপ দেয়ার। সে বলেছে এরকম সে কেন করেছে সে নিজেও জানে না।”
ঝোঁক চাপে…স্পিডের প্যাডেলে চাপ দেয়ার।
জায়গাটার ক্ষমতা আছে…
লুইস চিন্তাগুলো ঠেলে সরিয়ে দেয়। সে আস্তে করে তার স্ত্রীর হাত চেপে ধরে। “তোমার বাবা-মাকে ফোন কর, এক্ষুনি। তোমার আর এলির এই বাসায় আর একদিনও থাকা উচিত না। এক দিনও না।”
“তোমাকে ছাড়া না,” রাচেল বলে। “লুইস, আমি চাই আমরা সবাই একসাথে থাকি। এটাই সবচাইতে বেশি দরকার।”
“আমি তিন দিন পরেই চলে আসবো তোমাদের কাছে-আর খুব বেশি হলে চার দিন।” সবকিছু ঠিকঠাক মত চললে রাচেল আর এলি আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যেই এখানে ফিরে আসতে পারবে। “অফিসে আমার বদলে আরেকজনকে দায়িত্ব দিয়ে যেতে হবে। অন্ততপক্ষে কোন পার্টটাইম ডাক্তার হলেও লাগবে। নাহলে সুরেন্দ্র খুব বিপদে পড়ে যাবে। জাডকে বললে তিনি নিশ্চয়ই আমাদের বাসাটা দেখে রাখবেন। আর আমাদের বিদ্যুত বন্ধ করে ফ্রিজে যা আছে তা মিসি ডেন্ডিজদের ডিপ ফ্রিজে রেখে যেতে হবে।”
“এলির স্কুল…”
“ম্যানেজ করা যাবে। খুব বেশি হলে তিন সপ্তাহের ক্লাস বাকি আছে। আমি ওদের বলে নিশ্চয়ই ম্যানেজ করতে-”
“লুইস?”
লুইস থামে। “কী?”
“তুমি আমার কাছে কিছু লুকোচ্ছো।”
“লুকোচ্ছি?” সে রাচেলের দিকে স্বাভাবিকভাবে তাকায়। “কী বলছো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
“কিছু লুকোচ্ছো না?”
“না। একদমই না।”
“আচ্ছা, আমি এখনি তাদের ফোন করছি…তুমি যদি আসলেই আমাদের সেখানে পাঠাতে চাও।”
“আমি চাই,” সে বলে, আর তার কথাগুলো তার মাথার ভেতর প্রতিধ্বনি করতে থাকে। “এলির জন্যেই এটা বেশি প্রয়োজন।”
রাচেল তার লাল চোখগুলো দিয়ে লুইসের দিকে তাকায়। ভ্যালিয়ামের প্রভাবে তার চোখ চকচক করছে। “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার জ্বর এসেছে, লুইস।”
রাচেল লুইসের জবাব দেয়ার আগেই ফোন তুলে তার বাবা-মায়ের হোটেলে ফোন দেয়।
***
গোল্ডম্যানরা রাচেলের শিকাগো যাওয়ার প্রস্তাবে যারপরনাই খুশি হন। তিন- চার দিন পর লুইসের আবির্ভাবের ব্যাপারটা তারা এতো উৎসাহের সাথে নিলেন না, কিন্তু চিন্তা কী? লুইসের শিকাগো যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। সে ভেবেছিল কোন ঝামেলা হলে প্লেনের টিকিট নিয়ে ঝামেলা হতে পারে। কিন্তু সেখানেও তার ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়ে দেখা দিল। রাচেল তার বাবা-মায়ের প্লেনেই টিকিট পেয়ে গেল; তবে পুরো পথের না। মাঝখানে সিনসিনাটিতে একটা যাত্রা বিরতি আছে। সেখানে রাচেল আর এলি নেমে যাবে অন্য প্লেনে ওঠার জন্যে। খুব বেশি হলে তাদের এক ঘণ্টা বেশি লাগবে শিকাগো পৌঁছাতে।
অনেকটা জাদুর মত, লুইস এয়ারলাইন্সের সাথে কথা বলার পর ফোন রাখতে রাখতে ভাবে। তার মাথায় জাডের কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। জায়গাটার ক্ষমতা আছে…সেই ক্ষমতা আসে ধাপে ধাপে…আর আমার ভয় হচ্ছে সেটা সামনেও আবার…
দূর হ!, সে জাডের কণ্ঠকে কর্কষভাবে বলে। আমি গত দশ মাসে অনেক অদ্ভুত জিনিস দেখেছি আবার বিশ্বাসও করেছি। কিন্তু তাই বলে আমি এটা বিশ্বাস করবো না যে এক টুকরো জমির প্লেনের টিকেট বিক্রির ওপর প্রভাব খাটানোর মত ক্ষমতা আছে।
“আমার ব্যাগ গুছাতে হবে,” রাচেল প্যাডে লেখা ফ্লাইটের সময় দেখে বলে।
“একটা বড় সুটকেস নাও শুধু।” লুইস বলে।
“আমাদের দুজনের জিনিসের জন্যে? লুইস, তুমি কি ফাজলামো করছো আমার সাথে?”
“আচ্ছা, ঠিক আছে আরো দুই-একটা ছোট ব্যাগ নাও লাগলে। কিন্তু আগামী তিন সপ্তাহের প্রত্যেক দিনের জন্যে আলাদা ড্রেস নিতে গিয়ে কাহিল হবার দরকার নেই,” সে বলে, কিন্তু সে ভাবছে, যেহেতু তোমরা খুব শীঘ্রই এখানে ফিরে আসছো। “বেশি হলে এক সপ্তাহ বা দশ দিনের জন্যে প্যাক কর। আর তোমার কাছে তো চেকবই আর ক্রেডিট কার্ড আছেই। প্রয়োজন পরলে কিনে নিও সেখান থেকে।”
“কিন্তু আমাদের সেই সামর্থ্য-” রাচেল বলতে গিয়ে থেমে যায়। তার কাছে এখন সব কিছুই ঘোলাটে মনে হয়।
“আছে, আমাদের সেই সামর্থ্য আছে।” লুইস বলে। “ গেজের কলেজের জন্যে আমরা যেই টাকাটা জমিয়েছিলাম সেটা তুলে খরচ করা যাবে। হয়তো ব্যাংকের ফর্মালিটিসের জন্যে দুই-এক দিন দেরি হবে–”
রাচেলের মুখটা আবারো কুঁচকে যেতে আরম্ভ করে। লুইস তাকে জড়িয়ে ধরে। ও ঠিকই বলেছিল…যন্ত্রণাটা বারে বারে আঘাত করে…করতেই থাকে… ‘রাচেল, প্লিজ,” সে বলে। “প্লিজ, কেঁদো না।” থাকে…‘রাচেল,
কিন্তু রাচেল কাঁদে-না কেঁদে উপায় কী?
রাচেল যখন ওপরতলায় ব্যাগ গুছাচ্ছে, ফোনটা বেজে ওঠে। লুইস ছোঁ মেরে ফোনটা লুফে নেয়। তার ধারণা এয়ার টিকেটের অফিস থেকে ফোন দেয়া হয়েছে এবং এখনি তাকে বলা হবে যে একটা ভুল হয়ে গেছে, আসলে কোন ফ্লাইট পাওয়া যাচ্ছে না আপনাদের সুবিধা মত। আমি জানতাম সব কিছু যেন একটু বেশি বেশি সহজেই হয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু আসলে ফোন করেছেন আরউইন গোল্ডম্যান।
“আমি রাচেলকে ডেকে দিচ্ছি,” লুইস বলে।
“না।” এরপর বেশ কিছুক্ষণ ফোনের কোন পাশেই কেউ কথা বলে না, অস্বস্তিকর নীরবতা। বুড়ো হয়তো ভাবছে আমাকে কোন গালিটা আগে দিবে।
গোল্ডম্যান যখন নীরবতা ভেঙে কথা বললেন, তার কন্ঠ শুনে মনে হলো তিনি খুব কষ্ট করে কথাগুলো মুখ দিয়ে বের করছেন। “আমি তোমার সাথেই কথা বলতে চাই। ডোরি চায় আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাই…আমার ব্যবহারের জন্যে। আমার মনে হয়…লুইস, আমার মনে হয় আমি নিজেও তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে চাই।”
বাহ! মহৎ লোক! আপনার জন্যে সম্মানে আমার পেশাব পেয়ে যাচ্ছে।
“আপনাকে ক্ষমা চাইতে হবে না,” লুইস যান্ত্রিক গলায় বলে।
“আমি যা করেছি তা ক্ষমার অযোগ্য,” তিনি বলেন। এখন মনে হচ্ছে তিনি ঠেলে ঠেলে এক একটা শব্দ নিজের গলা দিয়ে বের করছেন। “রাচেল আর এলিকে শিকাগো আসতে বলায় আমি বুঝতে পেরেছি তোমার মনটাই বড়, আর আমি যা করেছি তা ছোট মনের কাজ।”
এরকম কথা যেন সে আগেও শুনেছে, খুব পরিচিত মনে হচ্ছে কথাটা।
হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল। মনে পড়ায় তার অনুভূতি হলো মারাত্নক টক লেবু চুষে খাবার মত। সেরকম কথা রাচেল বলে। রাচেলও বলে, আমি খুব দুঃখিত তোমার সাথে এরকম করেছি; কিন্তু তা বলে নিজের ইচ্ছেটাই ফাইনাল হবার পর। ঠিক তার বাবার মতন। বাপকা বেটি, সিপাইকা ঘোড়া; কুছ নেহি তো থোড়া থোড়া।
বুড়ো তার মেয়েকে আর নাতনীকে ফিরে পেয়েই যারপরনাই খুশি। তারা ঠিক সেখানেই যাচ্ছে যেখানে তিনি তাদের চান। ইচ্ছে যখন পূরণ হয়েই গিয়েছে, এখন তিনি নিজের উদারতা দেখাতেই পারেন। আরউইন যদ্দুর জানেন, তার হিসেবে তিনি জিতেছেন। অতএব চলো যা ঘটেছে সব ভুলে যাই আমরা। চলো ভুলে যাই আমি তোমাকে তোমার ছেলের ফিউনারেলের দিন তার লাশের সামনে ঘুষি মেরেছি, চলো ভুলে যাই তুমি যখন পড়ে গেছিলে তখন আমি তোমার পাছায় লাথি মেরেছি, চলো ভুলে যাই যে আমার ধাক্কা লেগে তোমার ছেলের কফিন মাটিতে পড়ে গিয়েছিল-যাতে সেটার ছিটকিনি ভাঙায় তুমি কফিনের খুলে আসা ডালার ফাক দিয়ে শেষ বারের মত তোমার ছেলের গোলাপি হাতটা দেখতে পাও। চলো সব ভুলে যাই। যা হয়েছে তা মনে রেখে লাভ কি?
কিন্তু আরউইন, জানিস? আমি চাই তুই এই মুহূর্তে জাহান্নামের রাস্তা ধর। কিন্তু শুধু আমার পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে বলে…
“সমস্যা নেই, মি. আরউইন,” সে বলে। “দিনটা…আসলে দিনটা আমাদের সবার জন্যেই খারাপ একটা দিন ছিল।”
“না, সমস্যা আছে,” তিনি বাধা দিয়ে বলেন। তার কন্ঠ শুনে তার মনে হচ্ছে তিনি আন্তরিকভাবেই দুঃখিত। লুইসের বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হচ্ছে না, কিন্তু আসলেই বুড়োকে আন্তরিকই মনে হচ্ছে। বুড়ো এখন প্রায় ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তার গলার স্বর ধীর এবং কাঁপা কাঁপা। “দিনটাকে সবার জন্যে খারাপ বানিয়েছি আমিই। আমার আহাম্মকির জন্যেই এসব ঘটেছে। যখন আমাকে আমার মেয়ের সবচাইতে বেশি দরকার ছিল, ঠিক তখনই আমি ওকে আঘাত করেছি…তোমারো হয়তো আমাকে দরকার ছিল…কিন্তু আমি তোমাকেও কষ্ট দিয়েছি। আমি তোমার সাথে জঘন্য আচরণ করার পরও যখন তুমি আমার সাথে ভালো ব্যাবহার করছো, আমার নিজেকে এখন আসলেই একটা দুর্গন্ধযুক্ত ময়লার বস্তা মনে হচ্ছে। এবং আমার এরকমই মনে হওয়া উচিত।”
এই ব্যাটা চুপ কর। নইলে কিন্তু চিৎকার চেঁচামেচি করে সব ভন্ডুল করব, লুইস মনে মনে বলে।
“রাচেল সম্ভবত তোমাকে বলেছে লুইস…আমাদের আরেকটা মেয়ে ছিল।”
“জেন্ডা,” লুইস বলে। “হ্যাঁ, রাচেল আমাকে বলেছে ওর কথা।”
“ওই ঘটনাটা আমাদের সবার জন্যে খুব কঠিন ছিল। রাচেলের জন্যে হয়তো সবচাইতে কঠিন ছিল-জেন্ডার মৃত্যুর সময় সেখানে রাচেল একাই ছিল। কিন্তু সেটা আমার আর ডোরির জন্যেও কম কষ্টের ছিল না। ডোরি প্রায় ভেঙেই পড়েছিল-”
আপনার কি মনে হয় রাচেল ভেঙে পড়েনি? আপনার কি মনে হয় না বাচ্চারাও ভেঙে পড়তে পারে? বিশ বছর পর এখনো সে মৃত্যুর সাথে সম্পর্কিত যেকোন কিছু থেকে কয়েকশো হাত দূরে থাকে। কিন্তু এখন তার সাথেই এই ঘটনা ঘটলো। এটা একটা বিস্ময় যে ওকে এখনো হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নাকে নল দিয়ে খাওয়ানো লাগছে না। তাই, আমাকে এসব বালের কথা বলতে আসবেন না, যে সেটা আপনাদের জন্যে কেমন কষ্টের ছিল। টাকলার বাচ্চা টাকলা।
“জেন্ডার মৃত্যুর পর থেকে রাচেলই আমাদের একমাত্র অবলম্বন… আমরা ওর ব্যাপারে সবসময় দরকারের চাইতে একটু বেশিই হুশিয়ার থাকতাম…ওর পিঠের ব্যথার কষ্টগুলো পুষিয়ে দিতে চাইতাম…আমরা ওই সময় সেখানে ছিলাম না এই অপরাধটাও পুষিয়ে দিতে চাইতাম।”
হ্যাঁ, বুড়ো এখন সত্যই কান্না করছে। তার কান্না করার কি দরকার? এটা দেখে লুইসের তার প্রতি নিজের অকৃত্রিম ঘৃণাটা বজায় রাখতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। কষ্ট হলেও সে এখনো বজায় রাখতে পারছে। সে ইচ্ছে করেই গোল্ডম্যানের সেই চেকবই বের করে লুইসকে কিনতে চাওয়ার দৃশ্যটা মনে করে; কিন্তু ওই দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ডে সে জেল্ডাকে দেখতে পায়। ব্যথায় কাতর হয়ে চিৎকার করতে থাকা জেল্ডা, যার মুখ ফ্যাকাসে কুঁচকানো আর হাতের আঙুলগুলো পাখির থাবার মত। একটি গোল্ডম্যান বংশের ভূত।
“প্লিজ,” সে বলে। “প্লিজ, মিস্টার গোল্ডম্যান। ব্যাপারটা যতটুকু খারাপ তার চাইতে আর খারাপ না করি, ওকে?”
“আমি এখন বিশ্বাস করি তুমি একজন ভালো মানুষ এবং আমি আগে তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম। আমি জানি তুমি কী ভাবছো। তুমি ভাবছো যে আমি যা চাই তা পেয়ে গেছি তাই আমি এখন এসব বলছি…তুমি হয়তো ভাবছো আমি একদিন চেক দিয়ে তোমাকে কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু লুইস, ঈশ্বরের কসম…”
“আর না,” লুইস ভদ্রভাবে বলে। “প্লিজ, থামুন…..আমি সত্যই আর পারছি না।” এখন তার গলাও কাঁপছে।
“আচ্ছা, ঠিক আছে,” গোল্ডম্যান বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। “আমি আর শুধু এটুকুই বলতে চাই যে আমি আসলেই দুঃখিত। আমি তোমার কাছে আমার অপরাধের জন্যে ক্ষমা চাই। তোমার আমাকে মাফ করতে হবে না। কিন্তু আমি এটা বলার জন্যেই ফোন দিয়েছিলাম। আমি ক্ষমা চাই।”
“আচ্ছা,” লুইস বলে। তার মাথা দপদপ করছে, সে নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলে। “ধন্যবাদ, আপনাকে মাফ করে দেয়া হয়েছে।”
“তোমাকে ধন্যবাদ লুইস,” তিনি বলেন। “আর এজন্যেও ধন্যবাদ যে ওদেরকে তুমি যেতে দিচ্ছ। হয়তো এটাই ওদের জন্যে সবচাইতে ভালো। আমরা ওদের জন্যে এয়ারপোর্টে অপেক্ষা করবো।”
“আচ্ছা, ঠিক আছে,” লুইস বলে। হঠাৎ ওর মাথায় একটা আইডিয়া আসে এবং সেটার স্বাভাবিকতার কারণে সেটাকে খুবই লোভনীয় মনে হচ্ছে। সে সব ভুলে যাবে…এবং সে গেজকে তার ‘প্লেজেন্টভিউ’ গোরস্থানের কবরেই শুয়ে থাকতে দিবে। যে দরজা তার মুখের ওপর অকস্মাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছে, সেই দরজা নিয়ে সে আর টানাটানি করবে না; বরং দরজায় তালা লাগিয়ে চাবি ছুঁড়ে ফেলে দেবে। তার স্ত্রীকে যা বলেছে সে আসলে তাই করবে। কয়েক দিনের মধ্যে এদিকটা একটু গুছিয়ে নেবে এবং এরপর সাথে সাথে প্লেনে চড়ে তাদের কাছে পৌঁছে যাবে। তারা হয়তো পুরো গ্রীষ্মটাই সেখানে কাটিয়ে আসবে, তার স্ত্রী এবং কোমল হৃদয়ের মেয়ের সাথে। তারা চিড়িয়াখানায় যাবে, লেকে নৌকায় চড়তে যাবে, জাদুঘরে যাবে। সে এলিকে সিয়ার্স টাওয়ারের সবচাইতে ওপরের তলায় নিয়ে গিয়ে শহরটা সেখান থেকে কেমন চমৎকার দেখায় তা দেখাবে। এরপর যখন আগস্টের মাঝামাঝি তারা ফিরে আসবে, তারা ফিরে আসবে একটা মৃতপ্রায় বাড়িতে। হয়তো তাদের নতুন করে সব শুরু করতে হবে, নতুন সুতো দিয়ে বুনন শুরু করতে হবে; এখন এখানে যে সুতো আছে সেই সুতো নোংরা, সুতোয় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ।
কিন্তু একি তার ছেলেকে আরেকবার খুন করার সামিল না?
তার ভেতর থেকে আরেকটা কন্ঠ তার সাথে এই ব্যাপারে তর্ক করতে চায়, কিন্তু লুইস সেটার গলা টিপে ধরে।
“আরউইন, আমার এখন যেতে হবে। রাচেল সব ঠিকভাবে নিয়েছে কি না চেক করে ওকে বিছানায় নিয়ে যেতে হবে।”
“আচ্ছা। গুড বাই, লুইস। আর আরেক বার–”
সে যদি আরেকবার বলে সে দুঃখিত, আমি চিৎকার করবো। “গুড বাই, আরউইন,” সে বলেই ফোনটা রেখে দিল।
***
রাচেল তাদের রুমে কাপড়ের মাঝে ডুবে আছে। খাটের ওপর ব্লাউস, চেয়ারের ওপর ব্রা, দরজার হাতলে পাজামার হ্যাঙ্গার ঝুলছে। জানালার নিচে সারিবদ্ধ সৈন্যদলের মত অনেকগুলো জুতো লাইন করে রাখা। দেখা যাচ্ছে ও ধীরে ধীরে গোছগাছ করলেও বেশ ভালোভাবেই গোছাচ্ছে। লুইস মনে মনে হিসেব করে দেখলো এসব নেয়ার জন্যে অন্তত তিনটা সুটকেস লাগবে, হয়তো চারটা। কিন্তু এটা নিয়ে ওর সাথে তর্ক করার মত কিছু সে খুঁজে পেল না। তার চাইতে সে বরং রাচেলকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়।
“লুইস,” শেষ সুটকেসটা বন্ধ করে রাচেল বলে। সুটকেসটি মৈনাক পর্বতের মত লাগছে। এটার চেন লাগানোর জন্যে লুইস সেটার ওপর উঠে বসে আর রাচেল নানান কায়দা করে চেন লাগায়। “তোমার সত্যি আর কিছু বলার নেই?”
“ওহ খোদা…কী সেটা বউ?”
“আমি জানি না,” সে জবাব দেয়। “আমি তো জানতেই চাচ্ছি।”
“তোমার কী মনে হচ্ছে? আমি মাগীপাড়ায় শুতে যাবো? সার্কাসে যোগ দিব? না কি?”
“জানি না। কিন্তু ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তুমি আমাদের এখান থেকে তাড়াতে চাইছো।”
“রাচেল, ফালতু কথা বলো না!” সে অনেকটা নকল রাগ নিয়ে বলে। তার এই অবস্থাতেও আফসোস হতে থাকে যে সে এতো সহজে ধরা পড়ে যাচ্ছে।
রাচেল তিক্তভাবে হাসে। “লু, তুমি কখনোই ঠিক করে মিথ্যা বলতে পারো না।”
লুইস প্রতিবাদ করতে চাইছিল কিন্তু রাচেল তাকে সেই সুযোগ না দিয়েই বলে ওঠে, “এলি গত রাতে স্বপ্নে দেখেছে তুমি মারা গেছ। গত রাতে ও হঠাৎ কান্না করতে করতে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। আমি ওর সাথে দু-তিন ঘন্টা ঘুমোনোর পর আবার তোমার কাছে এসে শুয়েছি। স্বপ্নে ও দেখেছে তুমি কিচেনের টেবিলে বসে আছো, তোমার চোখগুলো খোলা কিন্তু ও জানে যে তুমি মরে গেছো। ও না কি স্টিভ মাস্টারটনকেও কাঁদতে শুনেছে।”
লুইস তার দিকে হতাশা ভরা চোখে তাকায়। “রাচেল, ওর ভাই মাত্র মারা গেছে। এখন এটা স্বাভাবিক যে ও স্বপ্নে ওর পরিবারের অন্য কাউকে মৃত-”
“সেটা আমিও জানি। কিন্তু ও যেভাবে বলছিল…সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল স্বপ্নটার মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণীর মত কিছু একটা ছিল।” রাচেল শুকনোভাবে হাসে। “তুমি সেখানে থাকলে হয়তো বুঝতে।”
“হয়তো,” লুইস বলে।
স্বপ্নটার মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণীর মত কিছু একটা ছিল।
“আমার সাথে শুবে চলো,” রাচেল বলে। “ভ্যালিয়ামের প্রভাব কেটে গেছে আর আমি নতুন করে খেতেও চাই না। কিন্তু আমার ভয় লাগছে। আমি নিজেও স্বপ্ন দেখছি…”
“কিসের স্বপ্ন?”
জেল্ডাকে দেখি,” রাচেল সরলভাবে বলে। “গেজ মারা যাবার পর থেকে যখনি আমি ঘুমোতে যাই, জেল্ডা আমার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে। ও বলে এবার সে আমাকে ঠিকই উচিত শিক্ষা দিবে। বলে যে ও আর গেজ দুজন মিলেই আমাকে উচিত শিক্ষা দিবে। কারণ আমি ওদের মরতে দিয়েছি।”
“রাচেল, এটা—”
“আমি জানি। স্বপ্ন স্বপ্নই। স্বাভাবিক জিনিস। কিন্তু তবুও আমার সাথে বিছানায় এসো আর পারলে স্বপ্নগুলোকে দূরে রাখো।”
তারা অন্ধকারে শুয়ে আছে।
“রাচেল, জেগে আছো?”
“হুম।”
“একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি?”
“কর।”
লুইস ইতস্তত করে। সে চায় না রাচেলের কাতরতা আরো বাড়িয়ে দিতে।
“তোমার মনে আছে, গেজের যখন নয় মাস, আমরা ওকে নিয়ে খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম?”
“হ্যা, অবশ্যই মনে আছে। কেন?”
গেজের যখন নয় মাস বয়স, লুইস তার ছেলের মাথার আকার দেখে দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। বার্টেরিয়ার চার্টের হিসেবে গেজের বয়সের তুলনায় ওর মাথা স্বাভাবিকের চাইতে বড় দেখাচ্ছিল। গেজ অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই তার মাথা উঁচু করতে পারতো, কিন্তু লুইস তারপরও গেজকে জর্জ টার্ডিফের কাছে নিয়ে যায়, যিনি হয়তো সমগ্র দেশের না হলেও শিকাগোর সবচাইতে ভালো নিউরোলজিস্ট। রাচেল জানতে চেয়েছিল গেজের কী সমস্যা আর লুইস ওকে সত্য কথাটাই বলেছিল। ওর ধারণা তাদের ছেলের হয়তো হাইড্রোসেফালিক রোগ হয়েছে, যে রোগে মাথা অস্বাভাবিকভাবে বড় হয়ে যায়। শুনে রাচেলের মুখ একদম সাদা হয়ে যায়।
“ওকে তো আমার কাছে স্বাভাবিকই মনে হয়.” রাচেল বলে।
লুইস মাথা ঝাঁকায়। “আমার কাছেও, কিন্তু তার পরও আমি কোন ঝুঁকি নিতে চাই না।”
“অবশ্যই, আমিও চাই না।”
ডাঃ টার্ডিফ গেজের মাথার মাপ নেন। এরপর তিনি দুটো আঙুল দিয়ে গেজের মুখে গুতো দেন, থ্রি স্টুজেস স্টাইলে। গেজ চমকে ওঠে। টার্ডিফ হাসেন। লুইসের হার্ট কিছুক্ষণের জন্যে গলে তরল হয়ে যায়। ডাক্তার গেজের হাতে একটা বল দেন। গেজ সেটা কিছুক্ষণ ধরে থাকার পর ফেলে দেয়।
এরপর ডাক্তার সাহেব বলটা নিয়ে বাউন্স করাতে থাকেন, গেজের চোখের দিকে নজর রাখতে রাখতে। গেজের চোখগুলো বলটিকে অনুসরণ করছিল।
“আমার ধারণা ফিফটি-ফিফটি চান্স আছে যে গেজের রোগটা আছে,” তিনি পরে অফিসে বসে লুইসকে বলেন। “না-হয়তো চান্স আরেকটু বেশি। কিন্তু রোগটা যদি থাকেও, যেটা খুব প্রকট না। ওকে চারপাশের ব্যাপারে খুব সচেতন মনে হচ্ছে। আর যদি সমস্যা থাকেও, এখন এর জন্যে ভালো শান্ট অপারেশন আছে।”
“শান্ট অপারেশন…মানে ব্রেইন সার্জারি,” লুইস বলে।
“ছোট ব্রেইন সার্জারি।”
সে গেজের ব্যাপারে দুশ্চিন্তা শুরু করার পরে ওই অপারেশনটা সম্পর্কে জেনেছে। অপারেশনে মাথা থেকে অতিরিক্ত তরল পদার্থ বের করে আনা হয়। ওই অপারেশনটা তার কাছে একদমই ছোট মনে হয়নি। কিন্তু সে মুখে কিছু বলে না। তাও ভাগ্য ভাল যে অপারেশনটা আছে।
“আর, খুব ভাল সম্ভাবনা আছে যে আপনার ছেলের মাথা এমনিতেই স্বাভাবিকের চাইতে একটু বড়। সিএটি স্ক্যান থেকে শুরু করি আমরা, কি বলেন?”
লুইস রাজি হয়েছিল। গেজ এক রাত হাসপাতালে কাটায়। গেজকে জেনারেল এনেসথেসিয়া দেয়া হয় এবং নানান কিসিমের যন্ত্র তার মাথায় লাগানো হয়। রাচেল আর লুইস হাসপাতালের নিচ তলাতেই অপেক্ষা করে আর এলি তার নানার বাসায় গিয়ে তাদের কেনা নতুন ভিডিও রেকর্ডারে টানা সিসেমি স্ট্রিট দেখতে থাকে। লুইস বসে বসে হিসেব কষছিল। জেনারেল এনেসথেসিয়ায় মৃত্যুর শতকরা সম্ভাবনা, শান্ট অপারেশানে মৃত্যুর শতকরা সম্ভাবনা, হাইড্রোসেফালাসে বুদ্ধি প্রতিবন্ধি হওয়ার শতকরা সম্ভাবনা, মৃগী রোগি হওয়া বা অন্ধ হয়ে যাওয়ার শতকরা সম্ভাবনা…ওহ! অসংখ্য রকমের সম্ভাবনা।
টার্ডিফ লম্বা সময় পর ওয়েটিং রুমে আসেন, যেখানে রাচেল আর লুইস বসেছিল। তার সাথে তিনটি সিগার। তিনি লুইসের মুখে একটা গুজে দিলেন, একটা রাচেলের মুখে, আরেকটা নিজের মুখে। রাচেল এতো অবাক হয় যে সে মানা করার সুযোগটিও হারায়।
“গেজ একদম ঠিক আছে।”
“এটা জ্বালিয়ে দিন,” রাচেল হাসি আর কান্না মেশানো কন্ঠে বলে। “আজ বমি করে সব ভাসিয়ে দিলেও আমি এটা টেনেই ছাড়বো।”
মুচকি হাসতে হাসতে ডাক্তার তার সিগারটা জ্বেলে দেন।
খোদা ওকে রুট-১৫ তে মরার জন্যে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, লুইস এখন ভাবে।
“রাচেল, যদি গেজের আসলেই হাইড্রোসেফালিক রোগ থাকতো, আর যদি ওকে আমরা সুস্থ করতে না পারতাম…তাহলেও কি তুমি ওকে ভালবাসতে?”
“এই অদ্ভুত প্রশ্ন কেন লুইস!”
“পারতে? ওকে ভালোবাসতে?”
“অবশ্যই। যা কিছুই ঘটতো, আমি ওকে ভালোবাসতাম।”
“যদি ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধি হয়ে যেত, তাহলেও?”
“হুম, অবশ্যই।”
“তুমি কি ওকে কোন নার্সিং হোমে রাখতে?”
“না, আমার মনে হয় না,” রাচেল ধীরে ধীরে বলে। “তুমি এখন যেরকম উপার্জন করছো তাতে হয়তো সেটা আমরা করতে পারতাম, কিন্তু আমি ওকে আমার কাছেই রাখতাম যদি সেটা সম্ভব হত। কিন্তু লুইস, এসব আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেন?”
“আমি তোমার বোন জেল্ডার কথা ভাবছিলাম,” সে বলে। সে নিজের মিথ্যে বলার স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায়। “ভাবছিলাম ওই যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে তুমি আবার যেতে পারতে কি না।”
“দুটো এক না,” রাচেল বলে। “গেজ হচ্ছে…মানে, গেজ হচ্ছে গেজ, আমাদের ছেলে। এটাই যথেষ্ট। হয়তো খুব কঠিন হত, কিন্তু…তুমি নিজে কি ওকে নার্সিং হোমে রাখতে চাইতে? পাইনল্যান্ডের মত একটা জায়গায়?”
“চল ঘুমোই।”
“ভালো আইডিয়া। আমার মনে হচ্ছে আমি এখন ঘুমোতে পারবো,” ও বলে। “আজকের দিনটাকে ভুলতে চাই।”
“আমেন,” লুইস বলে।
বেশ কিছুক্ষণ পর রাচেল ঘুম জড়ানো গলায় বিড়বিড় করে কিছু বলে।
“হুম…হুম…,” লুইস রাচেলের কানের পাতায় চুমু খায়। “এখন ঘুমোও।”
স্বপ্নটার মধ্যে ভবিষ্যদ্বাণীর মত কিছু একটা ছিল।
অনেকটা সময় লুইস নির্ঘুম শুয়ে থাকে। অবশেষে সে যখন ঘুমোয় ততক্ষনে চাঁদের বাকানো শিং জানালা দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
অধ্যায় ৪৩
পরদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও প্রচন্ড গরম পড়ে। লুইস যখন রাচেল আর এলির লাগেজগুলো চেক-ইন করে কম্পিউটার থেকে তাদের টিকিট দুটো নেয়, ততক্ষনে ও দরদর করে ঘামছে। তার ব্যস্ত থাকতে ভালই লাগছে। গতবার যখন ওরা থ্যাঙ্কসগিভিংয়ে গিয়েছিল, সেবারের সাথে কিছু কিছু জিনিস মিলিয়ে বুকে একটা চিনচিন ব্যথা অনুভব করে সে।
এলি মনমরা হয়ে আছে আর কিছুটা অদ্ভুত আচরণ করছে। আজকে সকালে এলির মুখ দেখে লুইসের কয়েকবার মনে হয়েছে এলি কিছু সন্দেহ করছে।
চোরের মন পুলিশ পুলিশ, সে নিজেকে বলে।
সকালে যখন এলিকে বলা হলো ও আর ওর আম্মু ওর বাবাকে ফেলে শিকাগো যাচ্ছে, হয়তো পুরো গ্রীষ্মের জন্যে, এলি কিছু না বলেই তার ব্রেকফাস্ট খেতে থাকে (গেজের পছন্দের ব্রেকফাস্ট কোকা বেয়ারস)। ব্রেকফাস্ট সেরে ও নিজের রুমে গিয়ে সেখানে রাচেলের রাখা পোশাক আর জুতো চাপিয়ে নেয়। সে এয়ারপোর্টে তার আর গেজের সেই ছবিটা নিয়ে এসেছে। লুইস যখন টিকেটের জন্যে লাইনে দাঁড়িয়ে, এলি তখন শান্ত মেয়ের মত লবিতে ট্রাভেলারদের জন্যে রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে ছিল।
মিস্টার এবং মিসেস গোল্ডম্যান ফ্লাইটের চল্লিশ মিনিটের মত আগে এসে উপস্থিত হন। প্রচন্ড গরমের মধ্যেও আরউইন গোল্ডম্যান আঁটসাট কোট-টাই চাপিয়ে এসেছেন। এসেই তিনি মিসেস গোল্ডম্যানকে এলি আর রাচেলের সাথে বসিয়ে তার ভাড়া করা গাড়িটি জমা দিতে গেলেন।
লুইস আর গোল্ডম্যান একই সময়ে বাকিদের সাথে এসে মিলিত হয়। লুইস প্রথমে একটু ভয়ে ভয়ে ছিল, সে ভেবেছিল এখানেও হয়তো তিনি আবার তার নাটক শুরু করবেন। কিন্তু তা থেকে লুইস বেঁচে যায়। তিনি লুইসের সাথে খুব জোরে হ্যান্ডশেক করেন এবং বিড়বিড় করে ‘হ্যালো’ বলেন। তার দিকে তার শ্বশুড়ের এক মুহূর্তের লজ্জা মেশা চাহনি দেখেই লুইস বুঝে নেয় যে তার শ্বশুড় গতদিন ফোনে কথা বলার সময় মাতাল অবস্থায় ছিলেন।
তারা সবাই এস্কেলেটর দিয়ে ওপর তলার বোর্ডিং লাউঞ্জে গিয়ে বসে। ডোরি গোল্ডম্যান তার সাথে করে একটি এরিকা জংয়ের উপন্যাস নিয়ে এসেছেন কিন্তু তিনি সেটা খুলেও দেখছেন না; তিনি তাকিয়ে আছেন এলির হাতে থাকা ছবিটার দিকে।
লুইস তার মেয়েকে জিজ্ঞেস করে ও প্লেনে পড়ার জন্যে বইয়ের দোকান থেকে কোন বই কিনতে চায় কি না।
এলি আবার তার দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। এই ব্যাপারটা লুইসকে নার্ভাস করে দিচ্ছে।
“তুমি নানা বাড়িতে গিয়ে দুষ্টুমি করবে না তো?” লুইস বইয়ের দোকানের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এলিকে জিজ্ঞেস করে।
“না বাবা। বাঙ্ক অফিসার কি আমাকে ধরবে? এন্ডি বলেছে যারা স্কুল ফাঁকি দেয় তাদেরকে বাঙ্ক অফিসার ধরে শাস্তি দেয়ার জন্যে।”
“তোমার বাঙ্ক অফিসারকে নিয়ে চিন্তা করা লাগবে না। আমি সব ম্যানেজ করে নেব। তুমি আগামী সেমিস্টারে ফিরে এসে আবার ক্লাশ শুরু করতে পারবে।”
“আমার পরের সেমিস্টার যে কেমন হবে…” এলি বলে। “আমি তো কখনো কোন গ্রেডে পড়িনি। শুধু কিন্ডারগার্টেনে পড়েছি। গ্রেডের ছাত্ররা কি করে আমি জানি না। মনে হয় হোমওয়ার্ক করে।”
“ভালোই হবে, মামনি।”
“বাবা, তুমি কি এখনো নানার ওপর রেগে আছ?”
“তুমি এরকম কেন ভাবলে যে আমি তোমার নানাকে পছন্দ করি না?” এলি এমনভাবে তার কাঁধ দুটো উচু করে যেন এই বিষয়টাতে তার তেমন আগ্রহ নেই। “তুমি যখন নানার কথা বলো, তুমি সব সময় রেগে থাকো।”
“ছি! বাজে কথা বলে না।”
“সরি।”
এলি আবারো তার দিকে সেই অদ্ভুত চাহনিটা দিয়ে বাচ্চাদের বুক কর্নারের বইগুলো দেখতে গেল। বাচ্চারা এতো কিছু কিভাবে বোঝে? ও আরো কতকিছু বোঝে কে জানে! এটা কি ওর ওপর কোন খারাপ প্রভাব ফেলছে? ওর নানাকে নাকি আমি পছন্দ করি না! অবশ্যই করি না, হাজারবার করি না।
“বাবা, এই বইগুলো কিনে দেবে?” এলি কয়েকটা বাচ্চাদের বই হাতে নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করে। বইগুলো দেখে লুইস কয়েক মুহূর্তের জন্যে নস্টালজিক হয়ে পড়ে, সেগুলোর মধ্যে একটা তার ছোটবেলার সবচাইতে প্রিয় গল্পের বই যেটা সে এতোদিন পর দেখলো।
“হ্যা, মামনি, কিনে দিচ্ছি।” বলে ওরা ক্যাশ কাউন্টারের লাইনে দাঁড়ায়।
“আমি আর তোমার নানা একজনকে আরেকজন অপছন্দ করি না,” লুইস বলে। তার মনে পড়ে গেল বাবা-মায়েরা কিভাবে তাদের বাচ্চাদের মিথ্যা বলে, কিভাবে তারা তাদের বাচ্চাদের শেখায় কেউ যদি মন থেকে বাচ্চা চায়, তাহলে সেটা তারা খুঁজে পায়, বা ডাকপিয়ন এসে বাচ্চা দিয়ে যায়। সে ঠিক করেছিল সে কখনো তার বাচ্চাদের সাথে এরকম মিথ্যা বলবে না। কিন্তু সে গত কয়েকদিন যাবত বেশ পাকা মিথ্যুক হয়ে উঠেছে, এখন আর থেমে ফায়দা কি?
“ওহ,” এলি বলেই চুপ হয়ে যায়।
নীরবতাটা লুইসের খুব অস্বস্তিকর লাগতে থাকে। তাই সে বলে “শিকাগোতে খুব মজা করবে, তাই না?”
“মনে হয় না.”
“না কেন?”
ও লুইসের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, “আমার ভয় লাগছে।” লুইস ওর হাত ধরে বলে, “কিসের ভয় মামনি? তুমি কি প্লেনে চড়তে ভয় পাচ্ছ?”
“না,” এলি বলে। “আমি জানি না আমি কিসের ভয় পাচ্ছি। বাবা, আমি স্বপ্ন দেখেছি একটা। আমরা সবাই গেজের ফিউনারেলে আর ফিউনারেলের লোকটা গেজের কফিন খোলে কিন্তু কফিনের ভেতর গেজ নেই। এরপর আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি বাসায়। বাসায় আমি গেজের বিছানায় গিয়ে দেখি বিছানাও খালি, গেজ নেই, কিন্তু সেখানে কাদা লেগে আছে।”
লেজারাস, উঠে এসো।
কয়েক মাসের মধ্যে প্রথমবারের মত লুইসের পাস্কোর মৃত্যুর পরে দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে; সেই স্বপ্নটা, যেটা দেখার পর সে পায়ে কাদা মাটি আর পাইনের সুচারু পাতা নিয়ে জেগে উঠেছিল।
লুইসের ঘাড়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে যায়।
“স্বপ্ন কিছু না মামনি,” সে এলিকে বলে এবং অন্তত তার নিজের কাছে তার গলাটা বেশ স্বাভাবিক মনে হয়। “এগুলো এমনিই চলে যাবে।”
“আমি চাইছিলাম তুমি আমাদের সাথে আসো,” এলি বলে। “আর না হলে আমরাও থেকে যাই। আমরা থাকতে পারি, বাবা? আমি নানা-নানীর সাথে যেতে চাই না…আমি শুধু স্কুলে ফিরে যেতে চাই। ঠিক আছে?”
“কয়েকটা দিনের ব্যাপার মাত্র, এলি” সে বলে। “এখানে আমার কিছু”–সে ঢোক গিলে-”কাজ আছে, এরপর আমি তোমাদের কাছে চলে যাব। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিবো কী করা যায়।”
লুইস ভেবেছিল এলি তর্ক শুরু করবে বা ওর দুর্বার ক্রোধের বহিপ্রকাশ ঘটবে। হয়তো লুইস তাতে কিছুটা খুশিও হতো, কারণ এলির এই ব্যাপারটা সে চেনে, কিন্তু এলির সেই অদ্ভুত চাহনিটা সে একদমই চেনে না। কিন্তু এলি কিছুই বলে না, সে তার চেহারাটা গম্ভীর করে রাখে আর ওর নীরবতায় লুইসের ভেতরে তোলপাড় চলতে থাকে। লুইস ওকে আরো কিছু জিনিস জিজ্ঞেস করতে পারতো, কিন্তু তার সেই সাহস হলো না; সে যতটুকু জানতে চায় ইতিমধ্যে তার চাইতে বেশি জেনে গেছে।
এলি আর লুইস বাকিদের কাছে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই ফ্লাইটের ব্যাপারে ঘোষনা দেয়া হয় এবং ওরা চারজন লাইনে দাঁড়ায়। লুইস তার স্ত্রীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়।
এরপর সে এলিকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খায়। এলি তার দিকে তার ভবিষ্যৎদ্রষ্টা চোখগুলো দিয়ে তাকায়। “আমি যেতে চাই না,” এলি এতো আস্তে আস্তে বলে যে চারদিকের কোলাহলের কারণে লুইস ছাড়া সেটা আর কেউ শুনতে পায় না। “আম্মুও থেকে যাক।”
“এলি, এমন করে না মামনি,” লুইস বলে। “তুমি ভালই থাকবে।”
“আমি ভালই থাকব,” ও বলে। “কিন্তু তুমি কেমন থাকবে? বাবা, তুমি কেমন থাকেবে?”
প্যাসেঞ্জারদের লাইন এগোতে শুরু করেছে। রাচেল এলির হাত ধরে টানলে এলি বাঁধা দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বাবার দিকে তাকিয়। এতে পেছনের লাইন কিছুক্ষণের জন্যে থেমে যায়। গতবার শিকাগো যাওয়ার সময় এলি দ্রুত যাওয়ার জন্যে কেমন ছটফট করছিল তা লুইসের চোখের সামনে ভাসে-চল, চল, চল!
“বাবা?”
“যাও মামনি, প্লিজ।”
রাচেল এলির দিকে তাকালে প্রথমবারের মত তার অদ্ভুত চাহনিটা দেখে কিছুটা চমকে ওঠে। “এলি,” রাচেল হতবাক হয়ে এলির দিকে তাকিয়ে বলে। লুইসের মনে হচ্ছে রাচেল একটু ভয়ও পেয়েছে। “তুমি লাইন আটকে রেখেছো, মামনি।”
এলির ঠোট কেঁপে উঠে ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এরপর রাচেল ওকে সামনের দিকে টানলে ও আর বাঁধা দেয় না। এলি লুইসের দিকে ফিরে তাকালে সে তার মেয়ের চোখে মুখে পরিস্কার আতঙ্কের ছাপ দেখতে পায়। সে মুখে নকল হাসি ফুটিয়ে এলির দিকে হাত নাড়ে।
জবাবে এলি তার হাত নাড়ে না।
অধ্যায় ৪৪
লুইস এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার সাথে সাথে একটা শীতল চাদর তার মনকে ঘিরে ধরে। সে বুঝতে পারে সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। তার যে ব্রেনের সাহায্যে সে মেডিকেলে পড়া শেষ করে এসেছে বৃত্তি আর রাচেলের ওয়েট্রেসিংয়ের আয় থেকে, সেই একই ব্রেন পুরো পরিকল্পনাটাকে অনেকগুলো ছোট ছোট ভাগে ভাগ করে নিয়েছে; তার পরীক্ষার সময় পড়াগুলো যেভাবে ভাগ করে নিত। যেন এটা তার জন্যে আরেকটা পরীক্ষা, কিন্তু সে এই পরীক্ষায় একশো মার্ক পেতে চায়।
সে একটা হার্ডওয়ারের দোকানের সামনে গাড়ি পার্ক করে ভেতরে ঢুকে। “কী সাহায্য করতে পারি?” দোকানের ক্লার্ক জিজ্ঞেস করে।
“আমার একটা ফ্লাশ লাইট লাগবে-আর সেটার মাথার হুড। বা ওরকম কিছু।”
দোকানের ক্লার্ক একজন ছোট খাট মানুষ। সে মুচকি হাসে, কিন্তু হাসিটা মজা পাবার হাসি না। “শিকারে যাচ্ছেন নাকি?”
“মানে?”
“মানে হরিণ শিকারে যাচ্ছেন নাকি?”
“একদমই না। আমার শিকারের লাইসেন্স নেই।”
ক্লার্ক লুইসকে চোখ টিপে দেয় এবং হাসে। “আমার নাক গলানোর কিছু নেই, বুঝতে পেরেছি। হুম, ওইরকম বড় লাইটের হুড পাওয়া যায় না। তবে একটা মোটা কাপড়ের মাঝখানে ফুটো করে ব্যবহার করে দেখতে পারেন। তাতে আলোর রশ্মি কমে একটা পেন লাইটের আলোর মত হবে।”
“হুম, তাতেও চলবে,” লুইস বলে। “ধন্যবাদ।”
“শিওর। আর কিছু?”
“হ্যা,” লুইস বলে। “আমার একটা কুঠার, একটা বেলচা আর একটা কোদাল লাগবে। ছোট-হাতলওয়ালা বেলচা আর বড়-হাতলওয়ালা কোদাল। মোটা দড়ি, আট ফিট লম্বা। এক জোড়া কাজ করার গ্লাভস। আট ফিট বাই আট ফিট ত্রিপল।”
“সবই আছে।”
“একটা সেপটিক ট্যাঙ্ক খুঁড়তে হবে,” লুইস বলে। “দেখা যাচ্ছে আমি আমার এলাকার কিছু নিয়ম ভঙ্গ করছি, আর আমার খুব নাক গলানো কিছু প্রতিবেশি আছে। আমি জানি না আমার লাইটটায় হুড লাগিয়ে কোন লাভ হবে কি না কিন্তু চেষ্টা করে দেখতে চাই।”
ওহ! তাহলে নাক বন্ধ করে রাখার জন্যে একটা কাপড়ের ক্লিপও কিনে নিন।”
লুইস হাসে, যেন এটা খুব হাসির একটা কৌতুক হয়েছে এবং হাসাটা তার কর্তব্য। তার সব মিলিয়ে বিল আসে প্রায় ঊনষাট ডলার। সেটা সে কার্ডে পরিশোধ না করে নগদে পরিশোধ করে। সে কারো জন্যে কোন সূত্র রাখতে চায় না।
***
লুইস জিনিসপত্রগুলো নিয়ে একটু বিপদে পড়ে যায়। গাড়ির পেছনে করে এসব নিয়ে বাসায় ফিরলে সেটা যে জাডের নজরকে ফাঁকি দিতে পারবে না সেটা লুইস জানে। আর এসব দেখলে জাডের সবকিছু বুঝতে এক সেকেন্ড লাগবে। আজ সে এই ঝুঁকি একদমই নিতে চায় না।
এরপর হঠাৎ তার মনে হলো তার আসলে বাসায় ফেরার কোন প্রয়োজন নেই। সে গেজের কবরস্থানটার সামান্য দূরে হাওয়ার্ড জনসনস মোটর লজ নামের একটা মোটেলে যায়। সে সেখানে চেক ইন করে ডি.ডি. রামোর নামে আর রুমের ভাড়া পরিশোধ করে নগদ টাকায়।
সে একটু ঘুমিয়ে নিতে চায়, কারণ আগামীকাল সকালে বিশ্রামটা তার কাজে লাগবে। তার সামনে অনেক অনেক উদ্ভট কাজ বাকি।
কিন্তু তার ব্রেন ঘুমুতে রাজি হয় না।
সে অচেনা এক মোটেলের রুমে মাথার নিচে হাত পেতে শুয়ে থাকে। সে তার জামা কাপড় ছাড়েনি, শুধু জুতো খুলেছে আর ওয়ালেট এবং চাবির গোছাটা খাটের পাশের নাইট টেবিলে রেখেছে। তার নিজেকে পরিচিত পৃথিবী থেকে একদম বিচ্ছিন্ন মনে হচ্ছে-তার পরিবার, তার অফিস, সবকিছু থেকে। হঠাৎ তার ব্রেনে একটা চিন্তা উঁকি মারে, তার পরিচিত কোন মানুষের সাথে দেখা হবার আগে তার ছেলের সাথে দেখা হচ্ছে।
পরিকল্পনাটা মাথার ভেতর ঘুরপাক খেতে থাকে। সে প্রত্যেক কোণ থেকে চিন্তা করে দেখে সেটার কোন ত্রুটি আছে কি না। চিন্তা করতে করতে সে বুঝতে পারে সে উন্মাদ হওয়ার খুব কাছাকাছি আছে। উন্মাদ হবার জন্যে প্রয়োজনীয় সব উপকরণই তার চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এবং নিজেকে ঠিক রাখতে হলে তাকে পা টিপে টিপে এগুতে হবে। কিন্তু সে এটাও বুঝতে পারছে যে সে উন্মাদ হবার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।
টম রাসের কন্ঠ তার মাথার ভেতর স্বপ্নের মত ভেসে বেড়াতে থাকে :
‘ও মৃত্যু, তোমার হাত খুব শীতল! আমি তোমার হাত আমার হাঁটুতে টের পাচ্ছি…তুমি আমার মাকে নিয়েছ, আবারো কি ফিরে আসবে না তুমি?’
উন্মত্ততা। চারদিকে উন্মত্ততা। উন্মত্ততা তাকে খেদিয়ে বেড়াচ্ছে।
সে মানসিক সুস্থতা এবং বিকারের মাঝামাঝি সূক্ষ্ম রেখার ওপর হাঁটছে। সে তার পরিকল্পনাটা আরেকটু ঝালিয়ে নেয়।
আজ রাত এগারোটার সময় কবর খুঁড়ে কফিন থেকে সে তার ছেলের লাশ বের করে আনবে। লাশটাকে সে ত্রিপলে পেচিয়ে গাড়ির ট্রাঙ্কে রাখবে। এর আগে সে কফিনটা আগের জায়গায় রেখে কবরটা আবারো আগের মত করে ভরে ফেলবে। এরপর সে লাডলোতে ফিরে যাবে এবং গেজের লাশ ট্রাঙ্ক থেকে বের করবে…আর এক জায়গায় বেড়াতে যাবে। হ্যাঁ, সে এক জায়গায় বেড়াতে যাবে।
গেজ ফিরে আসলে সেটার ফলাফল দুরকম হতে পারে। হয়তো গেজ ফিরে আসবে গেজ হিসেবেই। হয়তো তার বুদ্ধি-সুদ্ধি অনেকটাই লোপ পাবে বা সে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে ফিরে আসবে। তবে লুইসের মনের এক কোণে এই আশাটাও লুকিয়ে আছে, গেজ একদম ভালো হয়েই ফিরে আসবে। কিন্তু যাই হোক, গেজ তো গেজই, তার ছেলে, রাচেলের ছেলে এবং এলির ভাই।
আর হতে পারে গেজের বদলে অশুভ কিছু বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসবে। লুইস মেনে নিয়েছে যে এমন কিছু ঘটতে পারে। হতে পারে গেজের মৃতদেহে খুব খারাপ কিছু ভর করে ফিরে আসবে। সেক্ষেত্রে গেজের প্রকৃত সত্তাকে চিরতরেই হারাতে হবে।
তবে ফলাফল যাই হোক, সে আর তার ছেলে ছাড়া আর কেউ বাসায় থাকবে না তখন। আর সে…
আমি ওকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব।
হ্যা। সে তাই করবে।
আমি ওকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখব, শুধু ওর দেহের না, ওর সত্তারও। অ্যাক্সিডেন্টের ট্রমার জন্যে আমি ওকে কিছু ছাড় দেব, যেটার কথা তার মনে থাকতেও পারে আবার নাও পারে। চার্চের উদাহরণ থেকে আমি অনুমান করছি যে গেজের মানসিক সমস্যা থাকবে, হয় কম বা খুব বেশি। আমি ওর অবস্থা দেখে ভেবে দেখব যে গেজ কি আসলেই আবারো আমাদের পরিবারের অংশ হতে পারবে কি না। এজন্যে আমি চব্বিশ ঘন্টা থেকে বাহাত্তর ঘন্টা পর্যন্ত সময় নেব। এরপর যদি মনে হয় যে ক্ষতির পরিমাণ খুব বেশি, যেমন গেজ ফিরে আসে আরেক টিমি ব্যাটারম্যানের মত অশুভ কিছু হিসেবে আমি ওকে মেরে ফেলব।
একজন ডাক্তার হিসেবে সে অনুভব করে যে, গেজ যদি গেজ না হয়ে অন্য কোনকিছুর জন্যে একটা বাহন মাত্র হয়, তাহলে লুইস জিনিসটাকে সহজেই মেরে ফেলতে পারবে। জিনিসটার কান্না বা আকুতি-মিনতিতে সে সেটাকে মেরে ফেলা থেকে পিছু পা হবে না। একটা প্লেগের জীবাণুবাহী ইঁদুরকে সে যেমন অনায়াসে মেরে ফেলতে পারবে, ওই অশুভ জিনিসটাকেও সে সেভাবেই মেরে ফেলতে পারবে। হয়তো কোন পানীয়ের সাথে পিল মিশিয়ে ওকে খাইয়ে দেবে, বা ইঞ্জেকশনের শট। ওর ব্যাগে যথেষ্ট পরিমাণে মরফিন আছে। আর সেই রাত্রে সে তার ছেলের মৃতদেহ প্লেজেন্টভিউ কবরস্থানে আগের জায়গাতে রেখে আসবে। ধরা না পড়ে কাজটা করার জন্যে তার নিজের ভাগ্যের ওপর দ্বিতীয়বারের মত ভরসা করা ছাড়া ওর কিছুই করার নেই। যদিও সে এখনো জানে না তার ভাগ্য প্রথমবারেও তার প্রতি সুপ্রসন্ন হবে কি না। মিশন বিফলে গেলে পেট সেমিটারিতেই তার ছেলেকে আবার কবর দেয়ার কথা সে প্রথমে ভেবেছিল, কিন্তু তা নাকচ করে দেয়। সে চায় না তার ছেলের অন্তিম ঠিকানা সেখানে হোক। এর অনেকগুলো কারণ আছে। কোন বাচ্চা পাঁচ বা দশ বছর পর তার প্রিয় কুকুরকে সেখানে কবর দিতে গিয়ে হয়তো গেজের হাড়-গোড় খুঁজে পাবে-সেটা একটা কারণ, কিন্তু সবচাইতে বড় কারণ হচ্ছে-পেট সেমিটারি তার বাড়ির খুব কাছে।
আর এরপর সে প্লেন ধরে শিকাগো গিয়ে তার পরিবারের সাথে মিলিত হবে। রাচেল বা এলি কেউ তার এই ছোট্ট এক্সপেরিমেন্টের কথা জানতেও পারবে না।
আর ফলাফল যদি অন্য রকম হয়, যেটা সে তার মন প্রান দিয়ে চায়ঃ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সময় পেরিয়ে গেলে বাপ-বেটা বাসা থেকে বেরিয়ে পড়বে, রাতের আঁধারে। সে কিছু জরুরি কাগজ-পত্র নিজের সাথে নিয়ে নিবে এবং এখান থেকে সে চিরতরেই চলে যাবে। তারা দুজন একটা মোটেলে উঠবে, হতে পারে এখন সে যে মোটেলে আছে সেটাতেই।
পরদিন সকালে সে তাদের সবগুলো ব্যাংক একাউন্টের টাকা নগদে আর ট্রাভেলার্স চেক হিসেবে পরিবর্তন করে নেবে। এরপর তারা একটা প্লেনে চেপে বসবে-খুব সম্ভবত ফ্লোরিডার উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে সে রাচেলকে ফোন করে বলবে এলিকে নিয়ে তার কাছে চলে আসতে, ও কোথায় যাচ্ছে সেটা ওর বাবা-মাকে না জানিয়ে। লুইস বিশ্বাস করে সে এই ব্যাপারে রাচেলকে রাজি করাতে পারবে। কোন প্রশ্ন করো না, রাচেল। শুধু একটা প্লেনে চেপে চলে এসো, এক্ষুনি।
সে রাচেলকে তার (তাদের) ঠিকানা দিবে। এলি আর রাচেল একটা গাড়ি ভাড়া করে এয়ারপোর্ট থেকে চলে আসবে সেই ঠিকানায়। তারা দরজায় নক করলে দরজা খোলার জন্যে গেজকে সাথে নিয়ে যাবে। গেজের গায়ে হয়তো তখন থাকবে গোসলের পোশাক।
এবং এরপর-
এর পরের কথা চিন্তা করার মত সাহস তার হলো না; সে বরং পরিকল্পনার শুরুর দিকটা নিয়ে চিন্তা করতে শুরু করে আবারো। সে ভেবে দেখলো তাদের একদম নতুন করে, নতুন পরিচয়ে জীবন শুরু করতে হবে, যাতে আরউইন গোল্ডম্যান তার পেটমোটা চেকবইয়ের জোরে তাদের খুঁজে বের করতে না পারেন।
তার এবং তার পরিবারের লাডলোর বাড়িতে প্রথম আসার দিনের একটা স্মৃতির কথা লুইসের মনে পড়ে গেল। সে ক্লান্ত, ত্যক্ত আর বিরক্ত হয়ে ভেবেছিল সবকিছু ছেঁড়ে ছুড়ে দিয়ে অরলান্ডোতে পালিয়ে গিয়ে ডিজনি ওয়ার্ল্ডে মেডিকের কাজ জুটিয়ে নিবে। হয়তো সেটা খুব খারাপ একটা আইডিয়া ছিল না।
সে ঘুমিয়ে পড়ে। সে তখনো ঘুমোচ্ছিল যখন তার মেয়ে এলি নায়াগ্রা জলপ্রপাতের আশে পাশে একটা প্লেনে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে; সে ঘুমোচ্ছিল যখন প্লেনের একজন স্টুয়ার্ডেস ছুটে দেখতে আসে কি হয়েছে; সে ঘুমোচ্ছিল যখন রাচেল তার মেয়েকে শান্ত করার চেষ্টা করে; সে ঘুমোচ্ছিল যখন এলি বার বার চিৎকার করে বলতে থাকেঃ ‘আম্মু! গেজ! আম্মু গেজ বেঁচে আছে! গেজ আব্বুর ব্যাগ থেকে ছুরি বের করে আমাকে মারতে এসেছে! আমাকে ওর কাছ থেকে বাঁচাও! বাবাকে ওর হাত থেকে বাঁচাও!’
সে তখনো ঘুমোচ্ছে, যখন এলি কিছুটা শান্ত হয়ে মায়ের বুকে মাথা দিয়ে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে, আর ডোরি ভাবছেন রাচেলেরও এরকম হয়েছিল যখন জেল্ডা মারা যায়।
সে যখন ঘুম থেকে ওঠে ঘড়িতে তখন সোয়া পাঁচটা, বাইরে বিকেলের রোদ কমে আসছে।
বর্বর কাজ, ভেবে সে উঠে পড়ে।
অধ্যায় ৪৫
তিনটা দশ মিনিটে যখন প্লেন থেকে সব যাত্রীরা নেমে পড়ে, এলি ক্রিড তখন প্রায় হিস্টিরিয়াগ্রস্ত। এলির অবস্থা দেখে রাচেল খুব ভয় পেয়ে গেছে।
কেউ স্বাভাবিকভাবে ওর কাঁধে হাত রাখলেও ও লাফিয়ে উঠছে এবং তার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকছে। আর ওর পুরো শরীর কাঁপছে। প্লেনের দুঃস্বপ্ন দেখাটা খারাপ ছিল কিন্তু এটা…রাচেলের বুঝতেও পারছে না সে কি করবে।
টার্মিনালে গিয়ে নিজের পায়ের সাথে হড়কে গিয়ে এলি মেঝেতে পড়ে যায়। ও পড়ে গিয়ে ওঠার কোন চেষ্টাও করলো না। লোকজন করুণা ভরা চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ব্যস্তভাবে হেঁটে যাচ্ছে। রাচেল ওকে টেনে তোলে।
“এলি, কী হয়েছে মামনি?” রাচেল জিজ্ঞেস করে।
কিন্তু এলি কোন উত্তর দেয় না। তারা লাগেজের জন্যে গেলে রাচেল তার বাবা-মাকে তাদের দিকে হাত নাড়তে দেখে। সেও তাদের দিকে হাত নাড়ে এবং তারা রাচেলদের কাছে চলে আসে।
“রাচেল, এলির কী অবস্থা?”
“ভালো না, মা।”
“আম্মু এদিকে বাথরুম আছে? আমি বমি করবো।”
“ওহ, ঈশ্বর,” রাচেল হতাশা ভরা কন্ঠে বলে ওঠে আর এলির হাত ধরে সামান্য দূরের লেডিস রুমটার দিকে দ্রুতপায়ে হাঁটতে শুরু করে।
“রাচেল, আমি আসবো?” রাচেলের মা বলেন।
“না, বরং আমার লাগেজগুলো নিন, আপনি তো চেনেন।”
সৌভাগ্যক্রমে লেডিস রুমটা ফাঁকাই ছিল। টয়লেটের দরজার লক খোলার জন্যে কয়েন দরকার। রাচেল তার ব্যাগের ভেতর কয়েনের জন্যে হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে সে খেয়াল করে সেখানকার মোট তিনটি টয়লেটের লক নষ্ট; খোদাকে ধন্যবাদ জানায় সে। টয়লেটের একটা দরজার ওপর কেউ পেন্সিল দিয়ে লিখে রেখেছেঃ ডোনাল্ড জন একটা সেক্সিস্ট শুয়োর!
রাচেল টান দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলে। এলি তার পেট চেপে গোঙাচ্ছে। ও ওয়াক ওয়াক করলো বেশ কয়েকবার, কিন্তু বমি করলো না; গলা দিয়ে শুধু বাতাস বেরিয়ে এলো শব্দ করে।
এলি যখন বলল ওর একটু ভালো লাগছে, রাচেল ওকে বেসিনের কাছে নিয়ে ওর মুখ ধুয়ে দিল। এলি ভয়ঙ্কর ফ্যাকাসে হয়ে গেছে, আর ওর চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।
“এলি, কী হয়েছে? আমাকে বলবে?”
“আমি জানি না, আম্মু,” ও বলে। “কিন্তু আমি জানতাম কোন একটা ঝামেলা আছে যখন আব্বু আমাকে আমাদের শিকাগো যাওয়ার কথা বলেছে। আব্বুর কিছু একটা হয়েছিল।”
লুইস তুমি কী লুকাচ্ছো? তুমি কিছু যে লুকাচ্ছো তা জলের মত পরিস্কার। এমনকি এলিও সেটা বুঝতে পারছে।
রাচেলের নিজেরও খুব অস্থির লাগছে। মাসিক শুরু হবার দু-তিন দিন আগে মেজাজ যেমন খিটমিটে হয়ে থাকে, তেমন লাগছে ওর।
“কী?” রাচেল সামনের আয়নায় এলির প্রতিবিম্বকে লক্ষ করে বলে। “মামনি, বাবার কি হয়েছে বলে তোমার মনে হয়?”
“জানি না,” এলি বলে। “আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। সেটা গেজ বা চার্চের ব্যাপারে। আমার মনে নেই।”
“এলি, তোমার স্বপ্নটা বলো আম্মুকে।”
“আমি দেখেছি আমি পেট সেমিটারিতে,” এলি বলে। “প্যাক্সকাও আমাকে নিয়ে গিয়েছে আর বলেছে বাবাও সেখানে যাবে আর খুব খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে।”
প্যাক্সকাও?” রাচেল একটা অজানা আতঙ্কে চমকে ওঠে। নামটা ওর কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে, সে আগে শুনেছে নামটা কোথাও কিন্তু মনে করতে পারছে না। “তুমি দেখেছো যে প্যাক্সকাও তোমাকে পেট সেমিটারিতে নিয়ে গেছে?”
“হ্যা, ও নিজের এই নামই বলেছিল। আর-” হঠাৎ এলির চোখগুলো প্রশস্ত হয়ে যায়।
“তোমার আর কিছু মনে আছে?”
“ও বলেছিল ওকে পাঠানো হয়েছে সতর্ক করার জন্যে কিন্তু ও সতর্ক করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবে না। সে আরো বলেছে…কি যেনো…বাবা নাকি তার খুব কাছে ছিল যখন তার আত্মাকে ক-কব-কি যেন মনে নেই।” ও চড়া গলায় বলে।
“মামনি,” রাচেল বলে। “আমার মনে হয় তুমি গেজকে নিয়ে খুব বেশি ভাবছো তো, তাই এরকম স্বপ্ন দেখেছো। আর আমি নিশ্চিত তোমার বাবা ভালই আছে। এখন ভালো লাগছে?”
“না,” এলি ফিসফিস করে বলে। “আম্মু, আমার ভয় করছে। তোমার করছে না?”
“উ-হু,” রাচেল হাসার চেষ্টা করে মাথা নাড়ে-কিন্তু ও সত্যিই ভয় পাচ্ছে; প্যাক্সকাও নামটা ওর ভেতরে ছোটখাটো তোলপাড় শুরু করিয়ে দিয়েছে। ওর মনে হচ্ছে ও নামটা কোন এক খারাপ সময়ে শুনেছে, সেটা হতে পারে কয়েক মাস বা কয়েক বছর আগে, কিন্তু শুনেছে।
“সবকিছুই ঠিক আছে,” রাচেল এলিকে বলে। “নানা-নানুর কাছে ফিরে যাই চলো।”
“আচ্ছা,”
একজন মহিলা তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে বকতে বকতে লেডিস রুমে ঢুকলেন। ছেলেটা হিসু করে তার শর্টস ভিজিয়ে ফেলেছে। বাচ্চাটাকে দেখে রাচেলের গেজের কথা মনে পড়ে গেল। ওর ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকা আগুনে যেন কেউ হাপড় দিয়ে হাওয়া দিয়েছে।
“চলো,” সে বলে। “আমরা তোমার নানাবাড়ি গিয়েই আব্বুকে ফোন দিব।”
“ও শর্টস পড়ে ছিল,” এলি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে। “কে শর্টস পড়া ছিল আম্মু?”
“প্যাক্সকাও,” এলি বলে। “আমার স্বপ্নে ও লাল শর্টস পড়ে ছিল।
নামটা আবারো শুনে রাচেলের পেটে একটা পাক দিয়ে ওঠে… নিজের উপস্থিতি জানান দিয়েই আবার অনুভূতিটা চলে যায়।
গোল্ডম্যানদের কাছে ফিরে গেলে ডোরি জিজ্ঞেস করেন, “এখন একটু ভালো লাগছে, সোনামনি?”
“একটু,” এলি বলে। “আম্মু”
এলি তার মায়ের দিকে তাকিয়ে থেমে যায়। রাচেল মুখে হাত দিয়ে হতভম্ব ভঙ্গিতে বসে আছে, তার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। ওর মনে পড়েছে। নামটা যেন ওকে হাতুড়ির বাড়ির মত আঘাত করেছে। ওর আরো আগেই নামটা মনে পড়া উচিত ছিল। ও ওই ঘটনাটা ভুলে যেতে চেয়েছিল বলেই হয়তো এতক্ষণ মনে পড়ছিল না।
“আম্মু?”
রাচেল ধীরে ধীরে তার মেয়ের দিকে তাকায়। এলি তার মায়ের ঘাড়ের হলকা মটমট শব্দ শুনতে পায়। রাচেল তার মুখের ওপর থেকে হাত সরায়।
“তোমার স্বপ্নের লোকটা কি তার পুরো নাম বলেছে?”
“আম্মু, তোমার কি হ-”
“তোমার স্বপ্নের লোকটা কি তার পুরো নাম বলেছে?”
ডোরি তার কন্যা এবং নাতনীর দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যেন ওরা দুজনেই পাগল হয়ে গেছে।
“হ্যা, কিন্তু আমার মনে নেই…আম্মু ব্যথা পাচ্ছি তো—”
রাচেল নিচে তাকিয়ে দেখলো সে নিজের অজান্তেই এলির হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে।
“ওর নামের শুরুতে কি ভিক্টর?”
এলি চমকে একটা দ্রুত শ্বাস টেনে নেয়। “হ্যা, ভিক্টর! ও বলেছিল ওর নাম ভিক্টর। আম্মু, তুমিও কি ওকে স্বপ্নে দেখেছো?”
“প্যাক্সকাও না পাস্কো,” রাচেল বলে। “পাস্কো।”
“আমি তো সেটাই বলেছি, প্যাক্সকাও।”
“রাচেল, কি হয়েছে?” ডোরি জিজ্ঞেস করেন। তিনি রাচেলের হত ধরে সেটার শীতলতা টের পেয়ে ভুরু কুঁচকে ফেলেন। “আর এলির কি হয়েছে?”
“ওর কিছু হয়নি,” রাচেল বলে। “তবে আমার ধারণা লুইসের কিছু হয়েছে। অথবা কিছু হতে যাচ্ছে। এলির সাথে একটু বসো, মা। আমি বাসায় ফোন করবো।”
রাচেল উঠে টেলিফোন বুথের কাছে যেতে যেতে ব্যাগ থেকে একটা পয়সা খুঁজে বের করে। সে কল করলে বেশ কিছুক্ষণ ফোন রিং হয়, কিন্তু ওদিক থেকে কেউ ফোন ধরে না।
ও হতাশ হয়ে কিছুক্ষণ ফোনটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ও বলেছিল ওকে পাঠানো হয়েছে সতর্ক করার জন্যে কিন্তু ও সতর্ক করা ছাড়া কিছুই করতে পারবে না…বাবা না কি তার খুব কাছে ছিল যখন তার আত্মাকে…
রাচেল ঠান্ডা মাথায় ভাবার চেষ্টা করে। আসলে কী হচ্ছে তাদের সাথে? কেন লুইস তাদের এরকম অদ্ভুতভাবে শিকাগো পাঠিয়ে দিচ্ছে? গেজের মৃত্যু ছাড়াও কি আরো কিছু আছে এর পেছনে? আর ভিক্টর পাস্কো, যে লুইসের প্রথম অফিসের দিনে মৃত্যু বরণ করে, এলি তার ব্যাপারে কতটা জানে?
কিছুই জানে না, তার মন নিশ্চিতভাবে জবাব দেয়। তুমি এই ব্যাপারটা এলির কাছ থেকে দূরে রেখেছিলে, যেমনটা যেকোন মৃত্যুর ব্যাপারে তুমি করে থাকো। তোমার মনে আছে এলির বিড়ালের সম্ভাব্য মৃত্যুর ইস্যু নিয়ে সেদিন লুইসের সাথে কিরকম বেকুবের মত ঝগড়া করেছিলে তুমি? কারণ তুমি মৃত্যুকে ভয় পেতে, এবং এখনো পাও। তার নাম ছিল ভিক্টর পাস্কো, এবং এলিকে এই নাম তুমি কখনোই বলোনি। রাচেল, এসব কী হচ্ছে?
রাচেলের হাত এমনভাবে কাঁপছে যে তার কয়েনটা আবার টেলিফোনে ঢুকাতে বেশ কয়েকবার চেষ্টা করতে হয়। ও এবার লুইসের অফিসে ফোন করে এবং চার্লটন ফোন ধরেন। তিনি একটু অবাক হয়েই বলেন যে তিনি লুইসকে দেখেননি এবং আজ লুইসকে অফিসে দেখলেই বরং অবাক হতেন। এই বলে চার্লটন আবারো রাচেলের কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন। এরপর রাচেল তাকে বলে, যদি লুইস অফিসে যায় তাহলে যেন তিনি লুইসকে রাচেলের বাবার বাসায় ফোন দিতে বলেন। হ্যা, লুইসের কাছে আমার বাবার বাসার ফোন নাম্বার আছে, সে চার্লটনের প্রশ্নের জবাবে বলে। রাচেল আসলে তার বাবার বাসার ফোন নাম্বার আর এরিয়া কোড দিয়ে চার্লটনকে বুঝতে দিতে চাইছিল না তার বাবার বাড়ি মহাদেশের আরেক মাথায়।
রাচেল ফোন রেখে দেয়। তার শরীর হালকা হালকা কাঁপছে।
এলি পাস্কোর নাম হয়তো অন্য কোথাও শুনেছে। তুমি নিশ্চয়ই ওকে খাঁচার ভেতর বন্দি করে লালন-পালন করো না। হয়তো ও টিভি বা রেডিওতে শুনেছে, অথবা ওর ক্লাসে কেউ ওকে বলেছে। হতেও তো পারে, তাই না?
রাচেলের তার কলেজে বক্তৃতা দেয়া এক মনোবিজ্ঞানীর কথা মনে পড়ে গেল। তিনি বলেছিলেন সঠিক পরিস্থিতি তৈরি করা গেলে একজন মানুষ তার জীবনের সব পরিচিত (হোক যত সামান্য পরিচয়) মানুষের নাম মনে করতে পারবে। এমনকি কোন দিন সে কী খেয়েছে, তার দীর্ঘ জীবনের কোন দিনের আবহাওয়া কেমন ছিল সবকিছু মনে করতে পারবে। তিনি বলেছিলেন মানুষের ব্রেনের স্মৃতি শক্তি যদি কম্পিউটারের মেমোরির সাথে তুলনা করা হয় তাহলে মানুষের ব্রেনের অসংখ্য মেমোরি চিপের প্রতিটির ধারন ক্ষমতা হবে ১৬ K, 32K বা 64K না, বরং শত কোটি K। আর সেসব চিপের প্রতিটিতে কতটুকু স্মৃতি ধারণ করা যায় তার কোন ধারণা মানুষের এখনো নেই। অতএব মানুষের ব্রেনে এতো জায়গা যে সেখানে কখনো নতুন তথ্য স্টোর করার জন্যে আগের তথ্য মুছে ফেলার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সব তথ্য আমাদের আসলেই প্রয়োজন নেই। তাই আমাদের ব্রেন যেটা করে সেটা হচ্ছে মেমোরির কিছু অংশ সে সুইচ অফ করে রাখে। না হলে অপ্রয়োজনীয় তথ্যের স্রোতে আমরা পাগল হয়ে যেতাম, যেটাকে বলে ইনফর্মেশনাল ইনস্যানিটি। তিনি বলেছিলেন, “যদি তোমাদের মাথায় পুরো এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তাহলে সেই তথ্যের পাহাড়ে তুমি তোমার পায়ের মোজা খুলে কোথায় রেখেছো তা খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে।”
এটা শুনে ক্লাসের ছেলে-মেয়েরা হাসাটা কর্তব্য মনে করে হেসে উঠেছিল।
কিন্তু এটা কোন মনোবিজ্ঞান ক্লাস না, যেখানে বোর্ডে কিছু বিষয়ভিত্তিক শব্দ লেখা থাকে আর কোন আঁতেল প্রফেসর পিরিয়ডের শেষ পনেরো মিনিটে কথার ঝড় তুলে প্রচুর জ্ঞান ভিক্ষা দেন তার ছাত্রদের। এখানে কিছু একটা সাংঘাতিক ঘাপলা আছে-তুমি সেটা অনুভব করতে পারছো। আমি জানি না সেটার সাথে পাস্কো, চার্চ বা গেজের কোন সম্পর্ক আছে কি না, কিন্তু সেটার সাথে লুইসের কিছু না কিছু সম্পর্ক আছে। কী সেটা? এটা কী—
হঠাৎ একটা আশঙ্কা ওর হৃদয় কাঁপিয়ে দেয়। ও আবারো টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে নেয়, আর তার খুচরা কয়েনের জন্যে টেলিফোনের নিচে হাত পেতে রাখে। লুইস কি আত্মহত্যার কথা চিন্তা করছে? এজন্যেই কি ও সবাইকে বাড়ি থেকে সরিয়ে দিয়েছে? আর এলি কি আসলেই কোন টেলিপ্যাথি বা ওইরকম কিছু দেখেছে?
কয়েনের অভাবে সে এবারের কলটা কালেক্ট কল করে, মানে যে ফোন রিসিভ করবে সে খরচ দিবে। ফোনটা পাচ… ছয়…সাত বার রিং হয়। ফোনটা রেখে দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে একটা কণ্ঠ বলে ওঠে, “হ্যালো?”
“জাড! জাড আমি-”
“এক মিনিট ম্যাডাম,” টেলিফোন অপারেটর বলে। “আপনি কি মিসেস ক্রিডের কাছ থেকে একটা কালেক্ট ফোন কল রিসিভ করবেন?”
“হুম,” জাড বলেন।
“দুঃখিত স্যার, এটা কি হ্যা ছিল নাকি না?”
“আমি রিসিভ করবো,” জাড বলেন।
“আচ্ছা। ধন্যবাদ। আপনারা কথা বলুন,” অপারেটর বলে।
“জাড, আপনি লুইসকে দেখেছেন আজকে?”
“আজ তো দেখিনি, রাচেল। কিন্তু আমি সকালে বাজার করতে গ্রোসারির দোকানে গিয়েছিলাম। আর দুপুরে বাড়ির পেছনের বাগানে কাজ করেছি। কেন বল তো?”
“ওহ, তেমন কিছু না। এলি আজ প্লেনের মধ্যে একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছে। তাই আমি ওর মনের ভার কমাতে চাচ্ছিলাম আর কী।”
“প্লেন?” জাডের কন্ঠ হঠাৎ একটু তীক্ষ্ণ হয়ে যায়। “তুমি এখন কোথায়, রাচেল?”
“শিকাগো,” সে বলে। “এলি আর আমি আমার বাবা-মার সাথে কিছুদিন থাকার জন্যে এসেছি।”
“লুইস তোমাদের সাথে যায়নি?”
“ও কয়েক দিন পরে আসবে,” রাচেল বলে। জাডের কন্ঠে এমন কিছু আছে যাতে ওর নিজের কন্ঠ স্বাভাবিক রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। ব্যাপারটা ওর একদম ভালো লাগছে না।
“লুইসের ইচ্ছেতেই কি তোমরা শিকাগো গিয়েছ?”
“উম্ম্, হ্যাঁ। জাড, কি হয়েছে? কিছু একটা হয়েছে, ঠিক?”
“তুমি এলির স্বপ্নের ব্যাপারটা আমাকে বলবে?” জাড কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পরে বললেন।
অধ্যায় ৪৬
রাচেলের কথা বলার পরে জাড একটা পাতলা কোট গায়ে দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন। বাইরে মেঘ জমেছে আর বেশ বাতাস বইছে। লুইসের বাসায় যাওয়ার জন্যে রাস্তা পার হবার আগে তিনি খুব ভালো করে রাস্তায় কোন ট্রাক আছে কি না দেখে নেন। সব নষ্টের মূলে হচ্ছে এই ট্রাকের গুষ্টি। বজ্জাত ট্রাকের গুষ্টি।
তিনি অনুভব করতে পারছেন পেট সেমিটারি তাকে টানছে। আগে টানটা ছিল খুব লোভাতুর, তাকে নানান লোভ দেখিয়ে প্রভাব বিস্তার করতো সেটা। কিন্তু এবারে একদম উল্টোটা। এবার অশুভ জিনিসটা তাকে যেন হুমকি দিচ্ছে। নাক গলাবে না, বুড়ো।
কিন্তু তিনি নাক গলাবেন। কারণ এর অনেকটা দায় তারই।
তিনি দেখতে পান লুইসের হোন্ডা সিভিক গাড়িটা গ্যারেজে নেই। আরেকটা ধুলো পড়া ফোর্ড ওয়াগন গাড়ি গ্যারেজে পড়ে আছে। তিনি বাড়ির পেছনের দরজাটা চেক করে দেখেন সেখানে তালা দেয়া নেই।
“লুইস,” তিনি কোন উত্তর পাবেন না জেনেও ডাকলেন, নীরবতা কাটান দেয়ার জন্যে। বুড়িয়ে যাওয়াটা তাকে খুব যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে। তার হাত-পা এখন আগের চাইতে কয়েক গুণ ভারি মনে হয়। বাগানে মাত্র দু ঘন্টা কাজ করে তার কোমরে আজ প্রচন্ড ব্যথা হয়েছে। তখন মনে হচ্ছিল তার বাম কোমরের হাড়ে কেউ পেরেক ঠুকে দিয়েছে।
তিনি বাড়িটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। মনে হচ্ছে তিনি লুইসের বাসায় চুরি করে ঢুকেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে বুড়ো চোর, ভেবে তিনি কাজে লেগে পড়লেন। তিনি এমন কিছু দেখতে পেলেন না যা দেখলে তিনি আসলেই খুব ভয় পেয়ে যেতেন, যেমনঃ দাতব্য সংস্থায় গেজের কাপড় আর খেলনাগুলো না দিয়ে (রাচেল বলেছিল গেজের জিনিসপত্রগুলো দাতব্য সংস্থায় দান করে দিবে) ঘরেই বক্স করে রাখা…বা গেজের রুমে তার ছোট খাটটা আবারো পেতে রাখা। কিন্তু বাড়ির ভেতর এসবের কোন চিহ্ন তিনি খুঁজে পেলেন না। কিন্তু বাড়িটায় একটা শূন্য অনুভূতি হচ্ছে, যেন শূন্য বাড়িটা পূৰ্ণ করার জন্যে কিছু একটা অপেক্ষা করছে।
হয়তো আমার প্লেজেন্টভিউ গোরস্থানে যাওয়া উচিত, সেখানে কী হচ্ছে দেখার জন্যে। হয়তো লুইসের সাথেও আমার দেখা হয়ে যাবে। তাহলে ওকে নিয়ে আমি ডিনারে গেলাম বা ওরকম কিছু।
কিন্তু বিপদ প্লেজেন্টভিউ সেমিটারিতে না, আসল বিপদ এখানে, এই বাড়িতে আর এর পেছনে।
জাড লুইসদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা পেরিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে গেলেন। তিনি কিচেনের ফ্রিজ থেকে একটা বিয়ারের সিক্স প্যাক বের করে সামনের লিভিং রুমের জানালার সামনে বসলেন। এই জানালা দিয়ে লুইসের বাড়িটা বেশ ভালোভাবে দেখা যায়। তিনি একটা বিয়ারের ক্যান খুললেন আর একটা সিগারেট জ্বালালেন। বিকেল প্রায় শেষ হয়ে আসছে। নানান চিন্তা জাডের মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। রাচেলের মনোবিজ্ঞানী শিক্ষকের কথাগুলো যদি জাড জানতেন তাহলে বলতেন এক দিক দিয়ে সেই মনোবিজ্ঞানী ঠিকই বলেছে। কিন্তু বুড়োদের স্মৃতির প্রদীপ দিন দিন নিষ্প্রভ থেকে নিষ্প্রভতর হতে থাকে। সাথে সাথে তার শরীরের অন্য অঙ্গ- প্রত্যঙ্গগুলোও। পুরনো ঘটনাগুলো একটু একটু করে মনে করতে হয়। স্মৃতি থেকে ঝাপসা সেপিয়া টোনের ছবিগুলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হতে থাকে, রঙ্গিন হতে থাকে, কণ্ঠগুলো দূর থেকে ভেসে আসা প্রতিধ্বনির মত শোনা যায় আর এরপর ধীরে ধীরে সেগুলো বোধগম্য হয়। এটাকে ইনফরমেশন খোঁজা বলে না, জাড ওই মনোবিজ্ঞানীকে বলতেন। এটাকে বলে ভীমরতি জাড তার মনের পর্দায় লেস্টার মরগানের ষাঁড় হ্যানরাট্টিকে দেখতে পেলেন, যেটা চোখ আগুনের মত লাল করে নড়তে থাকা যে কোন জিনিসকে শিং দিয়ে গুতিয়ে জন্মের শিক্ষা দিতে চাচ্ছে। এমন কি বাতাসে কোন গাছের পাতা নড়লে ঘাড়টা সেই গাছকেও রেহাই দিচ্ছে না। লেস্টার ষাঁড়টাকে মেরে ফেলার আগে ষাঁড়টা নিজের মস্তিষ্কবিহীন মাথার শিং দিয়ে গুতিয়ে সীমানার ভেতরের সব গাছের গুড়ি ছ্যাড়াব্যাড়া করে ফেলে। ষাঁড়টাকে মেরে ফেলার পর লেস্টারের যেমন বিশ্রী অনুভূতি হচ্ছিল, জাডেরও এখন তাই হচ্ছে।
তিনি বিয়ার গিলতে থাকলেন আর সিগারেট ফুঁকতে থাকলেন। দিনের আলো মিলিয়ে গেলেও তিনি ঘরের বাতি জ্বালালেন না। ধীরে ধীরে তার জ্বলন্ত সিগারেট অন্ধকারে একটা লাল বিন্দুতে পরিণত হয়। তিনি লুইস ক্রিডের ড্রাইভ ওয়ের দিকে নজর রাখছেন। তার বিশ্বাস লুইস যখন ফিরে আসবে, যেখান থেকেই সে ফিরে আসুক-তিনি ওকে অল্প কিছু কথা বলবেন। লুইস যেন উল্টো পাল্টা কিছু করতে না পারে সেই জিনিসটা তিনি দেখবেন।
কিন্তু তিনি এখনো সেই শয়তানের জায়গাটার অশুভ শক্তির হালকা টান অনুভব করতে পারছেন। শক্তিটা সেখানকার পাথরের স্মৃতিস্তম্ভগুলোর নিচের অপবিত্র মাটি থেকে বেরিয়ে আসছে।
নাক গলাবে না, বুড়ো। নাক গলালে আফসোস করবে, খুব আফসোস। জিনিসটাকে পাত্তা না দেয়ার চেষ্টা করে তিনি সিগারেট আর বিয়ার শেষ করছেন এবং অপেক্ষা করতে লাগলেন।
অধ্যায় ৪৭
জাড যখন রকিং চেয়ারে বসে তার বাড়ির দিকে নজর রাখছে, লুইস তখন হাওয়ার্ড জনসনস ডাইনিং রুমে বসে বেশ কিছু বিস্বাদ খাবার দিয়ে তার ডিনার সারছে।
তার সামনে প্রচুর খাবার এবং সবগুলো খাবারই কুখাদ্য-একদম তার দেহ যা চায়। বাইরে গোধূলীর আলো মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে। সে খাবারগুলো তার গলা দিয়ে ঠেলে দেয়। একটা স্টেক। একটা বেকড পটেটো। একটা বিনসের সাইড ডিশ, যেটাতে সবুজের নাম মাত্র নেই। একটা আপেল পাই ওয়েজ, তার ওপরে দেয়া আইস্ক্রিম, যেটা গলে গলে পড়ছে। সে রেস্টুরেন্টের এক কোণের একটা রুমে বসেছে। লোকজনের আসা যাওয়া দেখছে আর ভাবছে পরিচিত কারো সাথে না দেখা হয়ে যায়। সে আবার ক্ষীণ আশাও করছে যেন কোন পরিচিত মানুষের সাথে তার দেখা হয়ে যায়। তাহলে নানান রকম প্রশ্ন হবে-রাচেল কোথায়? তুমি এখানে কী করছ? কী হচ্ছে?-এবং এসব প্রশ্নের কারণে হয়তো জটিলতা সৃষ্টি হবে, এবং সে হয়তো তাই চাচ্ছে। ইস্তফা দেয়ার একটা ছুঁতো।
এবং আসলেই দেখা গেল তার পরিচিত এক দম্পতি ডাইনারে এসে ঢুকেছে। সে তখন তার আপেল পাই শেষ করে তার দ্বিতীয় কাপ কফি পান করছে। রব গ্রিনেল, ব্যাঙ্গরের একজন ডাক্তার এবং তার সুন্দরি বউ বারবারা। লুইস তাকে দেখে চেনার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু ওয়েট্রেস দুজনকে দূরের একটা বুখে নিয়ে যায়। লুইস তাদের আর দেখতে না পেলেও মাঝে মাঝে গ্রিনেলের অল্প বয়সের পাকা চুলের উঁকিঝুঁকি দেখতে পাচ্ছে।
ওয়েট্রেস চেক নিয়ে আসে। সে চেকে সাইন করে এবং সাইনের নিচে তার রুম নাম্বার লিখে দেয়। এরপর সে বেরিয়ে পড়ে।
বাইরে বেশ বাতাস বইতে শুরু করেছে। আকাশে কোন তারা নেই কিন্তু প্রচুর মেঘ দ্রুত বেগে ভেসে বেড়াচ্ছে। লুইস ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণের জন্যে, হাতগুলো পকেটে ঢুকিয়ে, বাতাসের দিকে মাথা উচু করে। এরপর সে তার রুমে ফিরে গিয়ে টিভি চালিয়ে দেয়। মারাত্নক কিছু করার জন্যে হাতে অনেক সময় আছে আর বাইরের বাতাসটা তাকে নার্ভাস করে দিচ্ছে।
সে টানা চার ঘন্টা টিভি দেখে। একটি কমেডি প্রোগ্রামের আধা ঘন্টার আটটি পর্ব এক বসায় দেখে ফেলে সে। তার মনে পড়ে সে অনেক দিন পর এতো লম্বা সময় ধরে টিভি দেখলো। অনুষ্ঠানের মহিলাদের দেখে তার মনে হচ্ছে এদেরকেই সে আর তার হাই স্কুলের বন্ধুরা ‘মাল’ বলতো।
ঠিক এই সময়েই শিকাগোতে ডোরি গোল্ডম্যান চিৎকার করে উঠেন, “ফিরে যাবে? এখনি ফিরে যেতে চাচ্ছো তুমি? তুমি মাত্র এসে পৌঁছেছ এখানে!”
লাডলোতে নিজের বাসার জানালার কাছে বসে জাড ক্র্যান্ডাল সিগারেট ফুঁকছেন, বিয়ার গিলছেন এবং নিজের স্মৃতির ডাইরি নেড়েচেড়ে দেখছেন। আগে হোক, পরে হোক, লুইস ঠিকই তার বাড়িতে ফিরে আসবে। পেট সেমিটারিতে যাওয়ার অন্য রাস্তা আছে ঠিক, কিন্তু লুইস সেসব চেনে না। যেতে হলে তাকে তার নিজের বাড়ির কাছ থেকেই শুরু করতে হবে।
এসব ঘটনার ব্যাপারে কিছু না জেনেই লুইস তার সামনে থাকা রঙ্গিন টেলিভিশন সেটের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে এসব টিভি প্রোগ্রামের ব্যাপারে যা শুনেছিল- একটা শ্বেতাঙ্গ পরিবার, একটি ব্লাক পরিবার, একটা বড় লোকের স্টুপিড পরিবারের সাথে একটি খুব বুদ্ধিমান ছেলের বসবাস, একজন সিঙ্গেল মহিলা, একজন বিবাহিত মহিলা এবং একজন ডিভোর্সি মহিলা। সে টিভির সামনে বসে জানালা দিয়ে বাইরের রাত দেখার ফাঁকে ফাঁকে এই সবকিছুই দেখে ফেলেছে এর মধ্যে।
টিভিতে ১১টার সংবাদ শুরু হওয়া মাত্র লুইস টিভি অফ করে বেরিয়ে পড়ে। বেরিয়ে পঢ়লো সেই কাজটি করতে, যেই কাজটি করার সিদ্ধান্ত হয়তো সে রাস্তার ওপর গেজের রক্ত মাখা বেসবল ক্যাপটা পড়ে থাকতে দেখেই নিয়ে নিয়েছিল। তাকে সেই শীতলতার চাদর আবারো জাপটে ধরছে, কিন্তু তার ভেতর থেকেও একটা উষ্ণতার বিকিরন হচ্ছে। এই উষ্ণতা হচ্ছে তার ব্যগ্রতা, আবেগ অথবা লোভ। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। এই উষ্ণতা তাকে সেই শীতলতা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি যোগাচ্ছে। সে যখন নিজের হোন্ডা সিভিক গাড়িটার ইঞ্জিন ইগনিশন করলো, তখন সে ভাবল জাডের কথাই হয়তো ঠিক; জায়গাটার ক্ষমতা বাড়তে থাকে। সে এখন সেই ক্ষমতা তার চারপাশে টের পাচ্ছে, যেটা তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে এবং সে ভাবে, আমি কি থামতে পারবো? আমি যদি থামতে চাই তাহলেও কি আমি থামতে পারবো?
অধ্যায় ৪৮
“তুমি কী চাচ্ছো? ডোরি আবারো জিজ্ঞেস করেন। “রাচেল…তুমি খুব ক্লান্ত…রাতটা ভালো করে ঘুমিয়ে তারপর…”
রাচেল শুধু তার মাথা নাড়ে। সে তার মাকে বোঝাতে পারবে না যে কেন তার ফিরে যাওয়া খুব দরকার। অনুভূতিটা তার ভেতরে প্রথমে কেবল মাঠের ঘাসের ডগাগুলোতে ঢেউ খেলানো বাতাসের মত আবির্ভাব হয়। এরপর সেটা বাড়তে বাড়তে চারদিকের সব গাছপালা দোলাতে থাকে; এরপর সেটা বাড়িঘর কাঁপানো ঝড়ো হাওয়ার মত বইছিল; আর অবশেষে সেই হাওয়া হারিকেনের রূপ নিয়েছে এবং যে কোন মুহূর্তে তা চারদিকের সব কিছু ভেঙেচূড়ে উড়িয়ে নিয়ে যাবে।
শিকাগোতে তখন ছয়টা বাজে। ব্যাঙ্গরের ডাইনারে লুইস তার বিস্বাদ খাবারের সামনে বসে ছিল। রাচেল আর এলি খাবার টেবিলে বসে তাদের খাবার নাড়াচাড়া করছে, কিন্তু তেমন কিছুই খাচ্ছে না। রাচেল বারবার খাবারের প্লেট থেকে মুখ তুলে এলির দিকে তাকাচ্ছে। এলি তার আবেদন ভরা চাহনি দিয়ে রাচেলের দিকে তাকিয়ে বলছে যে আম্মু তুমি বাবাকে বিপদ থেকে বাঁচানোর জন্যে কী করছো?
রাচেল জাডের টেলিফোনের জন্যে অধীরভাবে অপেক্ষা করছে। ফোনটা যখন অবশেষে বেজে উঠলো রাচেল প্রায় লাফিয়ে উঠে ছো মেরে রিসিভারটা তুলে নিল। কিন্তু জাড ফোন করেননি, করেছেন ডোরির ব্রিজ ক্লাবের একজন বান্ধবি, ডোরি ঠিকভাবে ফিরেছেন কি না জানার জন্যে।
বড়রা সবাই কফি খাওয়া শুরু করলে রাচেল হঠাৎ তার ন্যাপকিনটা ছুঁড়ে ফেলে বলে উঠলো, “বাবা…মা… আমি সরি, কিন্তু আমার বাসায় যেতে হবে। আমি যদি আজ একটা প্লেন ধরতে পারি তাহলে আজ রাতেই যাব।”
ওর বাবা মা হতভম্ব হয়ে পড়েন কিন্তু এলি স্বস্তিতে তার চোখ বন্ধ করে ফেলে।
তারা রাচেলকে বুঝতে পারে না এবং রাচেলও তাদের ব্যাপারটা বোঝাতে পারে না। সে বিশ্বাস করে না এলি ভিক্টর পাস্কোর নাম কোন টিভির খবরে শুনেছে আর তার বাবার সাথে পাস্কোর সংযোগটা ও বুঝে নিয়েছে অবচেতন মনে।
“রাচেল, মা আমার।” তার বাবা খুব নরম ঠান্ডা গলায় বলে, যেভাবে কেউ কোন হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগির সাথে কথা বলে। “এগুলো সবই তোমার ছেলের মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া। তুমি আর এলি দুজনেই ব্যাপারটায় খুব কঠিনভাবে রিয়েক্ট করছো, কিন্তু সেটা তোমাদের দোষ না। কিন্তু তুমি একদম ভেঙে পড়বে যদি তুমি—”
রাচেল তার কথার জবাব দেয় না। সে ফোনের কাছে গিয়ে টেলিফোন ডিরেক্টরি থেকে ডেল্টা এয়ারলাইন্সের নাম্বার বের করে ডায়াল করতে থাকে। ডোরি ওর পাশে দাঁড়িয়ে ওকে বলছেন যে ওর অন্তত আরেকবার চিন্তা করে দেখা উচিত, লাভ ক্ষতিগুলো লিস্ট করে দেখা উচিত…এবং তার পেছনে এলি দাঁড়িয়ে আছে মুখ কালো করে কিন্তু এখন ওর মুখে একটা হালকা আশার আভা দেখা যাচ্ছে, যা দেখে রাচেল কিছুটা ভরসা পাচ্ছে।
“ডেল্টা এয়ারলাইন্স,” ফোনের ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠ বলে। “কিম বলছি। কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
“আমার আজ রাতেই শিকাগো থেকে ব্যাঙ্গর যাওয়া প্রয়োজন, খুবই ইমারজেন্সি। আপনি একটু চেক করে দেখবেন ভেঙে ভেঙে যাওয়ার টিকিট পাওয়া যাবে কিনা?”
“ম্যাম, এটা খুব শর্ট নোটিস,” কিম সন্দেহের গলায় বলে।
“তাও, প্লিজ চেক করে দেখুন,” রাচেল বলে, সামান্য ভাঙা গলায়।
“আমি স্ট্যান্ডবাই বা যে কোন কিছু নিতে রাজি আছি।”
“আচ্ছা, ম্যাম। একটু ধরুন তাহলে।” টেলিফোনটা নীরব হয়ে যায়।
রাচেল তার চোখ বন্ধ করে ফেলে এবং কয়েক মুহূর্ত পরে সে তার বাহুতে একটা ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব করে। সে তার চোখ খুলে দেখে এলি তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আরউইন এবং ডোরি নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন তাদের দিকে তাকিয়ে। যেভাবে মানুষ বদ্ধ পাগলের দিকে তাকায়, রাচেল ভাবে। ও এলির দিকে তাকিয়ে মনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে হাসে।
“মা, উনাদের কথা শুনবে না, প্লিজ,” এলি নিচু গলায় বলে। “প্লিজ।”
“ঠিক আছে, বিগ সিস্টার,” রাচেল বলেই চেহারা কুচকে ফেলে। গেজের জন্মের পর থেকে তারা এলিকে বিগ সিস্টার বলে ডাকতো। কিন্তু এখন সে আর কারো বড় বোন না।
“থ্যাঙ্কস,” এলি বলে।
“এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই না?”
এলি ওপর নিচে মাথা ঝাঁকায়।
“মামনি, আমারও মনে হচ্ছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তুমি আমাকে আরো কিছু বলতে পারলে আমার বুঝতে সুবিধে হতো। এটা কি শুধু ওই স্বপ্নটা?”
“না,” এলি বলে। ‘এটা… এটা সব কিছুই। মনে হচ্ছে এটা আমার শরীরের ভেতর দিয়ে বইছে। তুমি কি এটা টের পাচ্ছো, মামনি? অনেকটা ইয়ের মত—”
“অনেকটা বাতাসের মত।”
এলি চমকে উঠে।
“কিন্তু তুমি কি জানো এটা কী? আর ওই স্বপ্নের ব্যাপারে আর কিছু মনে আছে তোমার?”
এলি খুব জটিলভাবে চিন্তা করে কিন্তু এরপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও দুপাশে মাথা নাড়ে। “আব্বু। চার্চ। আর গেজ। আমার শুধু এই মনে আছে। কিন্তু এই তিনে মিলে কী হয়েছিল আমার মনে নেই!”
রাচেল খুব শক্ত করে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। “সব ঠিক হয়ে যাবে মামনি,” রাচেল বলে কিন্তু তার মনের ভার একটুও কমে না।
“হ্যালো, ম্যাম,” রিজার্ভেশন ক্লার্ক বলে।
“হ্যালো?” রাচেল টেলিফোনের রিসিভার আর এলির হাত দুটোই খুব শক্ত করে ধরে।
“আমার মনে হয় আমি আপনাকে ব্যাঙ্গর পর্যন্ত ভাংতি টিকিট জোগাড় করে দিতে পারবো। কিন্তু আমার মনে হয় আপনার অনেক রাত হয়ে যাবে।”
“সেটা কোন ব্যাপার না.” রাচেল বলে।
“আপনার কাছে কলম আছে? ব্যবস্থাটা খুব জটিল।”
“হ্যা, এক সেকেন্ড,” রাচেল ড্রয়ার থেকে একটা পেন্সিল বের করতে করতে বলে। ও একটা চিঠির খাম নেয় সেটার পেছনে লিখার জন্যে। “এবার বলুন।”
রাচেল খুব মন দিয়ে শুনে সব লিখে রাখে। এয়ারলাইন ক্লার্কের বলা শেষ হলে সে মৃদু হেসে হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনি দিয়ে • বানিয়ে এলিকে দেখিয়ে বোঝায় সব ঠিক হয়ে যাবে। হয়তো, সব ঠিক হয়ে যাবে, সে মনে মনে বলে। শিকাগো থেকে ব্যাঙ্গর যাওয়ার যে রুট সে পেয়েছে তার জন্যে তাকে কয়েকবার প্লেন চেঞ্জ করতে হবে এবং তার মধ্যে অল্প সময়ের মধ্যে বস্টনে একটা প্লেন থেকে নেমে আরেকটা প্লেন ধরা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। “প্লিজ, সবগুলো বুক করে ফেলুন,” রাচেল বলে। “এবং আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।”
কিম রাচেলের নাম এবং ক্রেডিট কার্ডের ইনফর্মেশন নেয়ার পর ফোন রাখে। রাচেল ফোন রেখে বাবার দিকে তাকায়। “বাবা, তুমি আমাকে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে আসবে গাড়িতে করে?’
“আমার তোমাকে নিষেধ করা উচিত,” গোল্ডম্যান বলেন। “আমার উচিত এই পাগলামো এখানেই বন্ধ করা।”
“খবরদার!” এলি চিৎকার করে ওঠে। “এটা কোন পাগলামি না! একদম না!” গোল্ডম্যান চোখ পিটপিট করে পিছিয়ে যান। তিনি এলির ফেটে পড়া দেখে বেশ হকচকিয়ে গেলেন।
ওকে পৌঁছে দিয়ে এসো, আরউইন,” ডোরি কিছুক্ষণ নীরবতার পরে বললেন।”আমার নিজেরও নার্ভাস লাগছে। লুইসের খবর নেয়াটা আমারও জরুরি মনে হচ্ছে।”
গোল্ডম্যান কিছুক্ষণ তার স্ত্রীর দিকে তাকানোর পর তার মেয়ের দিকে ফিরলেন। “আচ্ছা, আমি তোমাকে পৌঁছে দেব, সেটাই যদি তোমার ইচ্ছে হয়,” তিনি বলেন। “আর…তুমি চাইলে আমিও তোমার সাথে যেতে চাই।”
রাচেল দুপাশে তার মাথা নাড়ে। “ধন্যবাদ বাবা। কিন্তু আমার সিটগুলোই প্লেনের শেষ সিট। খোদা যেন আমার জন্যেই সেগুলো বাঁচিয়ে রেখেছেন।”
আরউইন গোল্ডম্যান দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। হঠাৎ তাকে খুব বুড়ো মনে হতে থাকে। রাচেলের হঠাৎ মনে হলো তার বাবাকে জাড ক্র্যান্ডালের মত লাগছে।
তোমার এখনো ব্যাগ গুছানোর সময় আছে,” তিনি বলেন। “আমাদের এখান থেকে এয়ারপোর্ট যেতে চল্লিশ মিনিট লাগবে, যদি আমি আগের মত গাড়ি চালাই, যখন তোমার মা আর আমার বিয়ে হয়েছিল। ওকে তোমার একটা ব্যাগ খুঁজে দাও, ডোরি।”
“আম্মু,” এলি বলে। রাচেল তার মেয়ের দিকে ফেরে। এলির চেহারায় এখন হালকা ঘাম চিকচিক করছে।
“কী, মামনি?”
“সাবধান থেকো, মা,” এলি বলে।
অধ্যায় ৪৯
গাড়ি থেকে সন্ধ্যার আলোতে রাস্তার পাশের গাছগুলোকে মনে হচ্ছিল সেগুলো দ্রুত বেগে পেছনে চলে যাচ্ছে। লুইস তার হোন্ডাটা মেসন স্ট্রিটে পার্ক করে। রাস্তাটা প্লেজেন্টভিউর দক্ষিণ সীমানা ঘেষে। এখানে বাতাস এতো জোরে বইছে যে সে গাড়ির দরজা খোলার সাথে সাথে তার হাত থেকে দরজাটা ছুটে যায়। দরজাটা তাকে বেশ শক্তি খরচ করে বন্ধ করা লাগে। তার জ্যাকেট বাতাসে উড়ছে। গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে ত্রিপলে পেঁচানো মাটি খোঁড়ার জিনিসগুলো বের করে সে।
ত্রিপলে মোড়া জিনিসগুলো দুহাতে পাজঁকোলা করে দুটো স্ট্রিট লাইটের মাঝখানের অপেক্ষাকৃত অন্ধকার জায়গায় এসে দাঁড়ায়। সাবধানে চারদিক চেক করে রাস্তা পেরিয়ে গোরস্তানের লোহার বেড়ার সামনে যায়। সে চায় না কেউ তাকে দেখুক। এমনকি যে পথচারী তাকে এক মুহূর্তে দেখে পরের মুহূর্তে ভুলে যাবে, সেরকম কেউ তাকে দেখুক সেটাও সে চায় না। পাশে একটা দেবদারু গাছের ডালপালা বাতাসে গর্জন করছে। তার প্রচন্ড ভয় হচ্ছে। এই কাজটা শুধু বর্বর না, এটা পাগলামি।
রাস্তায় কোন গাড়ি নেই। মেসন স্ট্রিটের স্ট্রিট ল্যাম্পগুলোকে মনে হচ্ছে অনেকগুলো ছোট হতে থাকা আলোর গোলা, যেগুলো রাস্তার পাশের ফুটপাত আলোকিত করে রেখেছে। দিনের বেলা পাশের ফেয়ারমাউন্ট গ্রামার স্কুল ছুটি হলে ছেলেরা এখানেই বাইক চালায় আর মেয়েরা দড়িলাফ খেলে, পাশের গোরস্তানের দিকে খেয়াল না করেই। কিন্তু হ্যালোয়িনের সময় জায়গাটার কদর বেড়ে যায়। তখন হয়তো তারা রাস্তাটা পেরিয়ে গোরস্তানের লোহার বেড়ার গায়ে কাগজের কঙ্কাল ঝুলিয়ে দেয় তাদের জানা কিছু কৌতুক নিয়ে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করতে করতে। এই গোরস্থানটা শহরের সব চাইতে জনপ্রিয় জায়গা; এখানে আসার জন্যে মানুষেরা মরেই যাচ্ছে। আর কেউ একবার এসে ঢুকতে পারলে আর বেরোতেও চায় না।
“গেজ,” সে বিড়বিড় করে বলে। গেজ ওখানেই আছে, লোহার বেড়ার ওপাশে; তাকে অযাচিতভাবে মাটির জেলে আটকে রাখা হয়েছে। তোমাকে আমি বের করে আনবো গেজ, সে ভাবে। তোমাকে বের করে আনবো, বা চেষ্টা করতে করতে মারা যাব।
সে আবারো চারদিকে ভালো করে দেখে নিয়ে হাতের জিনিসগুলো বেড়ার ওপাশে ছুঁড়ে দেয়। বান্ডেলটা মাটিতে পড়ে যাবার সময় একটা ধাতব শব্দ হয়। হাত ঝেড়ে নিয়ে লুইস সেখান থেকে সরে যায়। জায়গাটা সে নিজের মনে চিহ্ন দিয়ে রাখে। যে যদি ভুলেও যায় তাহলেও খুব একটা সমস্যা নেই। ভেতরে গিয়ে লোহার বেড়া বরাবর হেঁটে ওর হোন্ডা সিভিক বরাবর এসে দাঁড়ালেই হবে।
কিন্তু গেট কি খোলা থাকবে এতো রাতে?
সে মেসন স্ট্রিটের স্টপ সাইনের দিকে হেঁটে যায়। বাতাসের কারণে রাস্তার ওপর গাছের ছায়া নৃত্য করছে।
মোড় নিয়ে প্লেজেন্ট রোডে ওঠে সে, লোহার বেড়াটা অনুসরণ করতে করতে। একটা গাড়ির হেড লাইটের আলো দেখতে পেয়ে লুইস পাশের দেবদারু গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে যায়। গাড়িটা কোন পুলিশের গাড়ি না; সাধারণ একটা ভ্যান। সেটা বেশ খানিকটা দূরে যাওয়ার পর সে আবারো হাঁটতে শুরু করে।
অবশ্যই গেট খোলা থাকবে। থাকতেই হবে।
সে গেটের কাছে পৌঁছে যায়। সে গেটে ধাক্কা দেয়।
গেট লক করা।
আরে বেকুব, এটা তো লক থাকারই কথা। তুমি কি সত্যি ভেবেছিলে যে পৌরসভার এলাকার মধ্যে একটা গোরস্তানের দরজা কেউ রাত এগারোটা পর্যন্ত খোলা রাখবে? এখন আর কেউ লোকজনকে এতোটা বিশ্বাস করে না, বন্ধু। সুতরাং, এখন তুমি কী করবে?
এখন তাকে বেড়াটা টপকাতে হবে। বানরের মত লোহার বেড়াটার ওপরে উঠতে হবে। সে শুধু আশা করতে পারে যে সেসময় কেউ টিভি থেকে তাদের চোখ সরাবে না।
হ্যালো, পুলিশ স্টেশন? আমি মাত্র দেখলাম দুনিয়ার সবচাইতে ধীর আর বুড়ো খোকাকে, প্লেজেন্টভিউ গোরস্থানের দেয়াল টপকাতে। দেখে মনে হচ্ছিল সে ভেতরে ঢোকার জন্যে মরে যাচ্ছে। আমার মনে হয় ব্যাপারটা আপনাদের একটু দেখা উচিত। কে জানে, হয়তো কেঁচো খুঁড়তে …
লুইস প্লেজেন্ট স্ট্রিট ধরে হাঁটতে থাকে এবং কিছুক্ষণ পর ডানে মোড় নেয়। তার পাশপাশি লোহার বেড়াটাও এগিয়ে চলছে, বিরামহীনভাবে। বাতাসের তোড়ে তার কপালের ঘাম বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। তার ছায়া কখনো স্ট্রিট লাইটের আলোয় গাঢ় হয়ে উঠছে আবার কখনো আলোর অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে। সে চলতে চলতে মাঝে মাঝে বেড়াটার দিকে চট করে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এরপর সে দাঁড়ায় এবং বেড়াটার দিকে ভালো করে তাকায়।
তুমি এটার ওপরে চড়বে, খোকা? হাসিও না।
লুইস ক্রিড যথেষ্ট লম্বা একজন পুরুষ, সে লম্বায় প্রায় ছয় ফুট দুই ইঞ্চি, কিন্তু লোহার বেড়াটার উচ্চতা হবে কমপক্ষে নয় ফুট। আর লোহার প্রত্যেকটা শিক ওপরের দিকে তীরের ফলার মত সুচারু। দেখতে বেশ সুন্দর, কিন্তু যদি বেড়া টপকানোর সময় পা পিছলে যায় এবং তার ভারি শরীরের ওজন সেই ফলাগুলোর ওপর পড়ে তাহলে কোন একটা ফলা তার অন্ডকোষ ফাটিয়ে দিলে অবাক হবার মত কিছু নেই। আর তখন শিকে গাথা বারবিকিউড শুয়োরের মত লটকে থাকতে হবে, যতক্ষণ না তার চিৎকার শুনে কেউ পুলিশে খবর দেয়।
তার জামা ঘামে ভিজে পিঠের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। চারদিক বেশ সুনশান, শুধু হ্যামন্ড রোড থেকে কিছু গাড়ি চলাচলের শব্দ আসছে।
ভেতরে ঢোকার একটা উপায় অবশ্যই পাওয়া যাবে।
পেতেই হবে।
লুইস, ভেবে দেখো। তুমি পাগল হতে পারো কিন্তু এতোটা পাগল তুমি না। হয়তো তুমি কোনভাবে বেড়ার ওপরে উঠতে পারবে। কিন্তু ওই সুচারু ফলাগুলোতে নিজের বিচি না গেথে টপকে যেতে একজন ট্রেইনড জিমন্যাস্ট লাগবে, যেটা তুমি নও। আর ধরলাম তুমি কোনভাবে ঢুকতে পারলে, কিন্তু সেখান থেকে গেজকে নিয়ে তুমি কিভাবে বেরিয়ে আসবে?
সে হাঁটতে থাকে। সে বুঝতে পারে চক্রাকারে গোরস্থানটাকে প্রদক্ষিণ করা ছাড়া কাজের কাজ কিছুই সে করছে না।
ঠিক আছে, উত্তর পাওয়া গেছে। আজ রাতে আমি বাসায় ফিরে কাল আবার এখানে আসবো, বিকেলের দিকে। চারটার দিকেই আমি ভেতরে ঢুকে লুকিয়ে থাকবো মাঝরাত পর্যন্ত। এভাবে চিন্তা করলে কাজটা আজও করতে পারতাম।
খুব ভালো বুদ্ধি, ওহ গ্রেট স্বামী লুইসানন্দ! আর তুমি যে কবর চুরি করার যন্ত্রপাতিগুলো ভেতরে ছুঁড়ে ফেলেছ, সেগুলো দেখলে গোরস্থানের লোকেরা কি আঙুল চুষবে?
জিনিসগুলো ঝোপের ভেতর পড়েছে। কে দেখতে যাবে ওসব?
ভাবনাটা বেশ যৌক্তিক, কিন্তু সে এখানে কোন যৌক্তিক কাজ করতে আসেনি। তার মন বলছে আজ যদি সে ফিরে যায়, তাহলে সে কাল এখানে ফিরে আসতে পারবে না। হয় কাজটা সে আজ করবে, নাহলে কখনোই করতে পারবে না। এই সেই মুহূর্ত।
এই রাস্তায় বাড়ির সংখ্যা তুলনামূলক কম। বেড়ার ভেতর দিয়ে সে দেখতে পায় এখানকার কবরগুলো বেশ পুরনো; ফলকগুলো বেশি গোলাকার আর তাদের অনেকগুলোই সামনে বা পেছনের দিকে হেলে পড়েছে। একটু সামনেই আরেকটা স্টপ সাইন। আরেকবার মোড় নিলে সে যেই রাস্তা থেকে শুরু করেছিল কবরস্থানের বিপরীত দিকে, সেই রাস্তার প্রায় সমান্তরাল আরেকটা রাস্তায় গিয়ে হাজির হবে। আর যখন সে তার শুরুর জায়গায় ফিরে যাবে তখন সে কি করবে? আরেকটা টিকেট কেটে আবারো কবরস্থানের চারপাশে বেড়াতে আসবে? না কি পরাজয় মেনে নেবে?
সামনের মোড়ে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা গেল। লুইস চট করে আরেকটা গাছের পেছনে দাঁড়িয়ে যায়। গাড়িটা খুব ধীরে ধীরে চলছে এবং একটু পরেই গাড়ির প্যাসেঞ্জার সাইড থেকে একঠা স্পট লাইট গোরস্থানের লোহার বেড়ার ওপর এসে পড়ে। লুইসের হৃৎপিন্ড লাফিয়ে তার গলার কাছে চলে আসে। এটা একটা পুলিশের গাড়ি, সেমেটারিটা চেক করছে।
সে নিজেকে গাছটার সাথে একদম মিশিয়ে ফেলার চেষ্টা করে, মুখটা গাছের খসখসে বাকলের ওপর চেপে ধরে। সে প্রার্থনা করতে থাকে যেন গাছটা তাকে ঢেকে রাখার জন্যে যথেষ্ট মোটা হয়। স্পটলাইটের আলো তার দিকে ছুটে আসে। সে তার মুখ নিচু করে ফেলে যাতে ঝাপসা আলোয় তার চেহারা না বোঝা যায়। লাইটটা গাছের কাছে পৌঁছে এক মুহূর্তের জন্যে হারিয়ে যায় এবং পরমুহূর্তেই গাছের ডান দিক থেকে আবারো আত্মপ্রকাশ করে। সে সামান্য একটু বায়ে সরে যায়। সে অপেক্ষা করতে থাকে কখন গাড়ির ব্রেক লাইট জ্বলে উঠবে, এরপর গাড়ির দরজা খুলে যাবে। কে! কে ওখানে? গাছের পেছনে কে! ওখান থেকে বেরিয়ে আসুন বলছি! দুহাত যেন খালি থাকে! এখুনি বেরিয়ে আসুন বলছি!
পুলিশের গাড়িটা চলতেই থাকে। এরপর মোড়ের কাছে গিয়ে বাঁয়ে চলে যায়। লুইস গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ে। সে দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে এবং তার গলা শুকিয়ে গেছে। সে ভাবে পুলিশের গাড়িটা হয়তো তার হোল্ডা সিভিকটা দেখবে, কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। কারণ মেসন রোডে সন্ধ্যার পর থেকে সকাল ছয়টা পর্যন্ত পার্কিং করার অনুমতি আছে। আর সেখানে আরো বেশ কিছু গাড়ি পার্ক করা আছে। সেগুলোর মালিক আশেপাশের বাড়ির মালিকেরাই হবেন।
লুইস খেয়াল করলো সে তার রক্ষক গাছটার ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে।
তার মাথার ওপর থেকেই গাছের একটা ডাল বেরিয়ে গেছে। সে ভাবলো হয়তো-
আর কিছু চিন্তা না করেই সেই ডালে পা রেখে গাছে উঠতে থাকে। তার টেনিস জুতোর ঘষায় গাছের মরা বাকল ঝুর ঝুর করে ঝড়ে পড়তে থাকে নিচের ফুটপাতে। সে আরেকটু কসরত করে গাছের উরুসন্ধিতে নিজেকে টেনে তোলে। পুলিশের গাড়িটা যদি আবারো এই রাস্তায় ফিরে আসে তাহলে তাদের স্পটলাইট হয়তো এই গাছের ডালে একটা অদ্ভুত জন্তু আবিষ্কার করবে। তাকে খুব দ্রুত এগুতে হবে।
সে আরেকটু উঁচু একটা ডালে চড়লো, যে ডালটা লোহার বেড়ার ওপর দিয়ে গোরস্তানের ভেতরে চলে গেছে। তার নিজেকে বারো বছরের কিশোর বলে মনে হতে থাকে, যেটা এক সময় হয়তো সে ছিল। গাছটা একদম স্থির না, বিরামহীন বাতাসে সেটা সহজেই দুলছে। গাছের পাতাগুলো বাতাসে মর্মর আওয়াজ করছে। লুইস তার বর্তমান অবস্থা বিবেচনা করে এবং আর বেশি কিছু না ভেবেই ডালটা ধরে ঝুলে পড়ে। ডালটা একজন মানুষের বাহুর চাইতে একটু বেশি মোটা। তার পা মাটি থেকে প্রায় আট ফিট উপরে ঝুলছে। সে একটু একটু করে বেড়াটার দিকে এগুতে থাকে। ডালটা কিছুটা নিচে নেমে এলেও ভাঙার কোন চিহ্ন দেখালো না। নিচের ফুটপাতে তার ছায়াটাকে দেখা যাচ্ছে গাছে ঝুলতে থাকা একটা বানরের মত। বাতাসে তার উষ্ণ বগল শীতল হয়ে যাচ্ছে। তার মুখ আর ঘাড় বেয়ে নামতে থাকা ঘামের মধ্যেই সে শীতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার নড়াচড়ার সাথে সাথে গাছের ডালটিও দুলতে থাকে। সে যত সামনে এগোয়, দুলুনিও তত বাড়তে থাকে। তার হাত ক্লান্ত হয়ে আসছে আর তার ভয় হচ্ছে তার ঘামে ভেজা হাত হয়তো পিছলে যাবে।
সে বেড়ার কাছে পৌঁছে গেছে। তার টেনিস জুতোগুলো বেড়ার চোখা ফলা থেকে প্রায় এক ফুট নিচে ঝুলছে। এই কোণ থেকে ফলাগুলোকে একদমই ভোঁতা মনে হচ্ছে না। ভোঁতা হোক আর ধারালো হোক, সে এখন বুঝতে পারছে এখানে শুধু তার অন্ডকোষই বিপদে নেই। সে যদি বেকায়দায় ফলাগুলোর ওপর গিয়ে পড়ে তাহলে তার ওজন তীক্ষ্ণ ফলাগুলোকে তার ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারে। ফিরে আসা পুলিশেরা হয়তো তাহলে হ্যালোয়িনের জন্যে খুব জীবন্ত একটা আগাম ডেকোরেশন পাবে প্লেজেন্টভিউর বেড়ার ওপর।
হাঁপিয়ে না উঠলেও সে খুব দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। তার পাগুলো দিয়ে বেড়ার ফলাগুলো খুঁজতে থাকে, একটু বিশ্রাম নেয়ার জন্যে। তার পাগুলো শূন্যে নেচে বেড়াচ্ছে কিন্তু যা খুঁজছে তা পাচ্ছে না।
সে একটা আলো দেখতে পায় যেটা ক্রমশ বাড়তে থাকে।
ওহ খোদা! গাড়ি আসছে!
সে দ্রুত হাত চালাতে চেষ্টা করে কিন্তু তার হাতের তালু কিছুটা ফসকে যায়। তার এক হাতের আঙুলের সাথে আরেক হাতের আঙুলের বজ্র আটুনি খুলে আসছে।
পা দিয়ে বেড়া খুঁজতে খুঁজতেই সে তার ব্যথা হয়ে যাওয়া বাম বাহুর নিচ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকায়। এটা একটা গাড়িই, তবে সেটা থামার কোন রকম চিহ্ন না দেখিয়ে মোড়ের দিকে চলে যায়। খুব লাকি। যদি সেটা-
তার হাত আবারো পিছলে যায়। ডালের খসে পড়া বাকল তার মাথার ওপর ঝরে পড়ে। তার এক পা বেড়া খুঁজে পেয়েছে, আর আরেক পায়ের প্যান্ট বেড়ার ফলার সাথে আঁটকে গেছে। কিন্তু তার আর বেশিক্ষণ ঝুলে থাকার মত শক্তি নেই। লুইস প্রাণপণে তার পা ঝাড়া দেয়। ডালটা নিচু হয়ে আসে এবং তার হাত আরেকটু পিছলে যায়। সে কাপড় ছেঁড়ার আওয়াজ শুনতে পায় এবং পর মুহূর্তেই খেয়াল করে সে বেড়ার দুটো ফলার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ফলাগুলো তার টেনিস জুতোর সোলে বিপদজনকভাবে খোঁচা দিচ্ছে এবং তার যন্ত্রণাও হচ্ছে কিন্তু সে তারপরও সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে। কারণ তার হাতের সামান্য আরাম তার পায়ের ব্যথার চাইতে অনেক বেশি দামি বলে মনে হচ্ছে।
সে বাঁ-হাতে ডালটা ধরে থেকে ডান হাতের তালু জ্যাকেটে মুছে নেয়। এর পর একইভাবে সে বাম হাতও মুছে নেয়।
ফলাগুলোর ওপর আরেকটু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পর সে আবার সামনে এগোয়। ডালটা এখানে আরো চিকন হয়ে যাওয়ায় সে এখন বেশ ভালোভাবেই ডালটা ধরতে পারছে। টারজানের মত ঝুলে ঝুলে এগিয়ে যায় বেড়ার ফলা পেছনে ফেলে। হঠাৎই ডালটা খুব বিপদজনকভাবে নিচে নেমে আসে। সে একটা ‘মট’ শব্দ শুনতে পায় এবং ডাল থেকে হাত ছেড়ে দেয় নিজেকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে।
খুব বাজেভাবে মাটিতে পড়ে সে। তার এক হাঁটু একটা কবরের পাথুরে ফলকের সাথে ঠুকে যায়, তীব্র যন্ত্রণা টের পায় পায়ে। হাঁটু চেপে ধরে ঠোট কামড়ে ঘাসের ওপর গড়াগড়ি খেতে থাকে সে। প্রার্থনা করতে থাকে তার হাঁটুর বাটি যেন না ফেটে যায়। অবশেষে ব্যথা কমে আসে এবং তার মনে হয় সে হয়তো তার কাজ চালিয়ে যেতে পারবে যদি সে ব্যথাটাকে তাকে পেয়ে বসতে না দেয়। হয়তো।
সে উঠে দাঁড়িয়ে মেসন স্ট্রিটের বেড়ার দিকে হাঁটতে থাকে, যেখানে তার জিনিসগুলো রয়েছে। তার ব্যথা প্রথমে অনেক বেশি ছিল এবং সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল; কিন্তু হাটার সাথে সাথে সেটা একটা ভোতা ব্যথায় পরিণত হয়। তার গাড়ির ফার্স্ট এইড কিটে অ্যাসপিরিন আছে। সেটা মনে করে নিয়ে আসা উচিত ছিল। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। রাস্তায় গাড়ির জন্যে সে চোখ খোলা রাখে। কোন গাড়িকে আসতে দেখলেই সে একটু ভেতরের গাঢ় অন্ধকারে সেধিয়ে যায়।
মেসন স্ট্রিটে লোকজনের আনাগোনা তুলনামূলক বেশি তাই সে বেড়ার একটু ভেতর দিয়ে হাঁটে, তার গাড়ি বরাবর পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত। সে যখন দ্রুত পায়ে তার ত্রিপলের বান্ডেলটা নিয়ে আসার জন্যে প্রস্তুত হয় তখন সে পায়ের শব্দ আর একজন মহিলার আওয়াজ শুনতে পায়। সে একটা কবরের ফলকের পেছনে বসে পড়ে-হাঁটুতে ব্যথা না থাকলে সে হয়তো হাঁটু গেড়ে বসতো। সে রাস্তার ওপাশের ফুটপাত দিয়ে একটি প্রেমিক জুটিকে হেঁটে আসতে দেখে। তারা একে অপরের হাত জড়াজড়ি করে আসছে, আর হালকা আলোয় তাদের হাঁটতে দেখে লুইসের একটা টিভি প্রোগ্রামের কথা মনে পড়ে। পরের মুহূর্তে তার প্রোগ্রামটার নামটিও মনে পড়ে : ‘দ্য জিমি ড্যুরনেইট আওয়ার।” লুইস যদি এখন কবরের ফলকের পেছন থেকে লাফিয়ে বের হয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে, “শুভরাত্রি, মিসেস কালাবাস!”
তারা লুইসের গাড়ির পেছনের স্ট্রিট লাইটের আলোর নিচে এসে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে। তাদের দেখে লুইসের নিজের প্রতি একরকমের ঘৃণা বোধ হয়। তার নিজেকে কোন সস্তা কমিক বইয়ের চরিত্র মনে হতে থাকে, যে মতের শহরে ঘাপটি মেরে লোকজনের প্রেম-পিরিতি গিলে গিলে খায়। মাথা ঠিক আর নষ্টের মাঝের বিভাজন রেখাটা কি আসলেই এতো সূক্ষ্ম? সে ভাবে। এতোই সূক্ষ্ম যে কেউ চাইলেই এক পাশ থেকে আরেক আশে পা ফেলতে পারে? গাছে চড়া, গাছের ডালে ঝোলা, কবরস্থানে লাফিয়ে পড়া…গর্ত খোঁড়া? এতোই কি সোজা? এসবই কি পাগল হবার জন্যে যথেষ্ট না? আমার ডাক্তার হতে লেগেছে আট বছর, আর আমি আজ এতো সহজেই একজন লাশ চোর হয়ে গেলাম?
সে তার হাত মুঠো করে মুখে পুরে দেয়, তার ভেতর থেকে বের হতে চাওয়া কিছু শব্দকে রুখে দিতে।
লুইস অধৈর্য হয়ে প্রেমিক জুটির প্রস্থানের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর তারা হেঁটে একটা বাড়ির সামনে গিয়ে শেকড় বেয়ে উঠে দরজার সামনে দাঁড়ায়। লোকটা কিছুক্ষণ চাবির জন্যে পকেট হাতড়ায় এবং তার কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা বাড়িতে ঢুকে পড়ে। রাস্তাটা আবারো নির্জন হয়ে পড়ে। চারদিকে বাতাসে গাছের নড়াচড়ার শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। তার ঘামে ভেজা কপালের ওপরের চুলগুলো এলোমেলোভাবে উড়ছে।
লুইস ছুটে বেড়াটার কাছে গিয়ে নিচু হয়ে তার ত্রিপলে মোড়া বান্ডেলটার জন্যে ঝোঁপের নিচে হাতড়ায়। জিনিসটা এখানেই ছিল, সে তার আঙুলের নিচে সেটার অস্তিত্ব টের পায়। জিনিসটা তুলে নিলে সেটা একটা চাপা ধাতব শব্দ করে। সে বান্ডেলটা নিয়ে নুড়ি বিছানো পথে উঠে আসে।
রাস্তাটার একদম ধার ঘেষে হাঁটতে থাকে সে, কারণ কাউকে দেখতে পেলে সে যেন সহজেই পাশের দেবদারু গাছের আঁধারে সেঁধিয়ে যেতে পারে। হতেই পারে কবরস্থানের কোন ফুল টাইম কেয়ারটেকার আছেন এবং হয়তো তিনি মাঝে মাঝে কবর পাহারা দিতে ঘুরে বেড়ান।
কিছুদূর গিয়ে রাস্তাটা দুভাগ হয়ে গেলে সে বামের রাস্তাটা বেছে নেয়। এই রাস্তাটি তাকে গেজের কবরে পৌঁছে দিবে। গেজের কবরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ তার মনে হয় সে গেজের চেহারা মনে করতে পারছে না। চিন্তাটা তাকে আতঙ্কিত করে তোলে। সে থমকে দাঁড়িয়ে সামনের কবরের সারি আর ফলকগুলোর দিকে চেয়ে থেকে গেজের চেহারা মনে করার চেষ্টা করে। গেজের মুখাবয়বের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য তার আলাদা আলাদা করে মনে পড়তে থাকে—ওর সোনালী চুল, ওর তির্যক চোখ, ওর ছোট ছোট সাদা দাঁত, শিকাগোর বাসার সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ওর চিবুক কেটে গিয়েছিল, সেই দাগটা। সে সবগুলো জিনিস আলাদাভাবে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু সব কিছু মিলিয়ে কোন পূর্ণাঙ্গ ছবি সে দাঁড় করাতে পারছে না। সে দেখতে পায় গেজ রাস্তাটার দিকে দৌড়ে যাচ্ছে, দৌড়ে যাচ্ছে অরিংকো ট্রাকটার সাথে তার সাক্ষাতের দিকে, কিন্তু গেজের মুখ উল্টো দিকে হওয়ায় সে তা দেখতে পাচ্ছে না। সে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন রাতের বেলা গেজকে তার খাটে কল্পনা করে, কিন্তু গেজের মুখের জায়গায় সে অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পায় না।
গেজ, তুমি কোথায়?
লুইস তুমি কি একবারও ভেবে দেখেছো যে তুমি হয়তো তোমার ছেলের কোন উপকারই করছো না? হয়তো ও যেখানে আছে আনন্দেই আছে…হয়তো পরকালের ব্যাপারে তোমার ফালতু ধারনা ঠিক না। হয়তো ও ফেরেশতাদের সাথে খেলছে অথবা ঘুমোচ্ছে। আর ও যদি আসলেই ঘুমিয়ে থাকে তাহলে তুমি কি জানো ওর বদলে কাকে তুমি জাগিয়ে তুলবে?
ওহ গেজ, তুমি কোথায়? আমাদের বাড়িটা তোমাকে ছাড়া খাঁ খাঁ করছে।
কিন্তু ও কি আসলেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করছে? কেন সে গেজের চেহারা মনে করতে পারছে না আর কেনই বা সে জাড, ভিক্টর পাস্কো আর তার নিজের আক্কেলের বিরুদ্ধে গিয়ে এসব পাগলামো করছে?
লুইস পেট সেমেটারির স্মৃতি চিহ্নগুলোকে মনে করে। মনে করে কিভাবে কবরের সারিগুলো বৃত্তের মত গোল হতে হতে কেন্দ্রে গিয়ে মিলিত হয়েছে এবং সে আবারো সেই শীতলতা অনুভব করে নিজের চারপাশে। সে এখানে কেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গেজের চেহারা মনে করার চেষ্টা করছে?
সে খুব শীঘ্র তার ছেলের চেহারা বাস্তবেই দেখতে পাবে।
গেজ উইলিয়াম ক্রিড গেজের এপিটাফে লেখা, সাথে তার জন্ম তারিখ এবং মৃত্যু তারিখ। আজ কেউ ওর কবরে এসেছিল। সে কবরের ওপর তাজা ফুল দেখতে পায়। কে এসেছিল? মিসি ডেনড্রিজ?
তার হার্টবিট খুব জোরালো হলেও বেশ লম্বা তফাতে হচ্ছে। ধুকপুক…ধুকপুক। সে যদি কাজটা আসলেই করতে চায়, তাহলে তার এখনই শুরু করা উচিত। রাত অফুরন্ত নয় এবং রাতের পরই ভোরের আলো ফুটবে।
সে নিজেকে শেষবারের মত প্রশ্ন করে উত্তর পায়, হ্যাঁ, সে আসলেই কাজটা করতে চায়। তার মাথা উপর নিচে ঝাঁকায় এবং পকেটে হাত দিয়ে একটা ছোট পকেট নাইফ বের করে আনে। সে ত্রিপলের বান্ডেলটা স্কচটেপ দিয়ে পেচিয়ে নিয়েছিল। টেপটা সে তার পকেট নাইফ দিয়ে কেটে নেয়। সে বান্ডেলটা খুলে যন্ত্রপাতিগুলো সাজিয়ে রাখে, ঠিক যেভাবে সে অপারেশনের আগে তার সার্জারির যন্ত্রপাতিগুলো সাজিয়ে নেয়।
যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে আছে ফ্লাশ লাইটটা, যেটার মুখ সে হার্ডওয়্যারের দোকানের ক্লার্কের পরামর্শ অনুযায়ী মোটা কাপড় দিয়ে পেচিয়ে নিয়েছে। কাপড়টার ওপর একটা পয়সা রেখে স্কালপেল দিয়ে একটা গোল ফুটোও করে নিয়েছে সে। আছে ছোট হাতলের কুঠারটা, যেটা এখানে তার ব্যবহার করার কোনই পরিকল্পনা নেই। কবরের মুখটা ঢালাই করে লাগানো থাকলে বা মাটি যদি পাথুরে হতো তাহলে জিনিসটা কাজে দিত। আর আছে বেলচা, কোদাল, দড়ি আর গ্লাভস। সে দুহাতে গ্লাভস পড়ে কোদাল তুলে নিয়ে কাজ শুরু করে।
কবরের মাটি এখনো বেশ নরম, তাই খোঁড়া খুব সহজ। কবরের সীমানা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে এবং কবরের মাটি কবরের সীমানার বাইরের মাটি থেকে তুলনামূলক নরম। তার মন একটা তুলনা করেঃ এখানে খোঁড়াখুঁড়ি করা আর যেখানে সে গেজকে কবর দেয়ার পরিকল্পনা করছে সেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করার মধ্যে। সেখানে তার কুঠারটা দরকার হবে। এরপর সে চিন্তা করা একদম বন্ধ করার চেষ্টা করে। চিন্তা তার কাজে বাধা দিচ্ছে।
সে মাটি খুঁড়ছে এবং বায়ে ফেলছে; একটা ছন্দের মত করে, যে ছন্দটা গর্ত গভীর হবার সাথে সাথে মেনে চলা কঠিন হতে থাকে। সে কবরের খোঁড়া গর্তে পা রাখে এবং নতুন মাটির একটা সোদা গন্ধ তার নাকে লাগে। গন্ধটা সে আঙ্কেল কার্লের সাথে কাজ করার সময় থেকে চেনে।
ডিগার, সে থেমে তার কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ভাবে। তার আঙ্কেল কার্ল বলেছিলেন যারা কবর খোঁড়ে পুরো আমেরিকায় তাদের ডিগার বলা হয়।
সে আবারো খুঁড়তে শুরু করে।
সে শুধু আরেকবার থামে, তার হাত ঘড়ির সময় দেখার জন্যে। বারোটা বেজে বিশ মিনিট। মনে হচ্ছে সময় তার হাত থেকে বান মাছের মত পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছে।
চল্লিশ মিনিট পর তার কোদাল শক্ত কিছুকে আঘাত করে এবং তার হৃৎপিন্ড একটা পালস মিস করে। সে ফ্লাশ লাইটটা নিচের দিকে মুখ করে সুইচ টিপে দেয়। মাটির ফাঁক দিয়ে একটা ধূসর-রুপালী কিছু দেখা যাচ্ছে। এটা গ্রেভ লাইনারের ছাদ। লুইস আর কোদাল ব্যবহার করতে চাইলো না কারণ এতে গ্রেভ লাইনারের ছাদের সাথে কোদাল লেগে বিকট শব্দ হবে, যা এতো রাতে মোটেই কাম্য না।
সে কবরের গর্ত থেকে বের হয়ে দড়িটা নিয়ে আসে। গ্রেভ লাইনারের পার্ট পার্ট ছাদের প্রতিটি অংশের সাথে একটা করে লোহার রিং লাগানো আছে। সে ছাদের অর্ধেক অংশের প্রতিটি রিংয়ের ভেতর দিয়ে দড়িটা ঢুকিয়ে দেয়। এরপর কবর থেকে বেরিয়ে ত্রিপলটি বিছিয়ে সেটার ওপর হাঁটু গেড়ে বসে দড়ির দুই মাথা দু হাতে নেয়।
লুইস, এটাই তোমার শেষ সুযোগ।
ঠিক। এটাই আমার শেষ সুযোগ আর আমি সুযোগটা কাজে লাগাচ্ছি।
সে দড়ির দুই মাথা ধরে টান দেয়। কনক্রিটের স্ল্যাবগুলো উঠে আসে এবং কবরের পাশে লম্বালম্বিভাবে দাড়িয়ে থাকে।
লুইস দড়িটা রিংগুলো থেকে বের করে পাশে ছুড়ে মারে। পরের অংশের জন্যে তার দড়িটা আর কাজে লাগবে না।
সে আবারো কবরে নেমে পড়ে, খুব সাবধানে, যাতে খাড়া করে রাখা কনক্রিটের স্ল্যাবগুলো পড়ে না যায়। কিছু পাথর গড়িয়ে গেজের কফিনের ওপর পড়ে ফাপা থাপ থাপ শব্দ করে।
নিচু হয়ে বাকি গ্রেভলাইনারের ছাদটা ধরে সে ওপরের দিকে টেনে তোলে। টেনে তোলার সময় তার মনে হয় তার হাতের ভেতর ঠান্ডা কিছু গলে যায়। যখন গ্রেভলাইনারের বাকি অংশ টেনে দাঁড় করায় এবং এরপর নিজের হাতের দিকে তাকায়, সে দেখতে পায় একটা কেচো সেখানে মৃত্যুযন্ত্রণায় কিলবিল করছে। সে ঘৃণায় নিঃশব্দ চিৎকার করে তার হাতটা কবরের পাশের মাটিতে ঘষে ঘষে মুছে নেয়।
এরপর সে ফ্লাশ লাইটের আলো আবারো নিচে ফেলে।
ফিউনারেল সার্ভিসে শেষ দেখা কফিনটা লুইস আরেকবার দেখতে পায়। এই সেফটি-ডিপোজিট বক্সেই তার ছেলেকে নিয়ে তার সব স্বপ্ন কবর দেয়ার কথা। পূর্বের শীতলতার বিপরীতে এবার তার মধ্যে ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে। না, সে তা হতে দেবে না।
লুইস হাতড়ে হাতড়ে কোদালটা খুঁজে নেয়। সে কোদালটা তার কাঁধের ওপর তুলে কফিনের ছিটকিনির ওপর আঘাত করে। একবার, দুবার, তিনবার, চারবার। সে চোখ মুখ খিচিয়ে রেখেছে।
গেজ, কফিন ভেঙে তোমাকে বের করে আনব আমি। দেখে নিও।
ছিটকিনিটা প্রথমবারের আঘাতেই প্রায় খুলে আসে। কিন্তু লুইস তারপরও উপর্যুপুরি আঘাত করতে থাকে, শুধু সেটাকে খোলার জন্যে না; বরং সেটাকে আঘাত করার জন্যে। তার হুশ ফিরে এলে সে থামে, কোদালটা উঁচু করা অবস্থায়।
কোদালের ব্লেডটা বাকা হয়ে গেছে। সেটা পাশে ছুড়ে ফেলে দুর্বল পায়ে কবরের বাইরে এসে দাঁড়ায় সে। তার পেট গুলিয়ে আসছে। তার রাগ যেমন হঠাৎ করে এসেছিল, তেমনি হঠাৎ করেই চলে গেছে। এর বদলে তার ভেতর আবারো সেই শীতলতা প্রবেশ করে। তার জীবনে কখনো এতো একা লাগেনি। তার নিজেকে একজন এস্ট্রনট মনে হচ্ছে, যে তার শিপ থেকে মহাশূন্যে ছিটকে পড়েছে এবং ট্যাঙ্কের অক্সিজেন ফুরিয়ে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করছে। বিল ব্যাটারম্যানেরও কি এমন লাগছিল? সে ভাবে।
সে মাটিতে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। তার পায়ের আড়ষ্ট ভাব কমে আসলে উঠে বসে কবরে নামে। সে ফ্লাশলাইটের আলো ছিটকিনির ওপর ফেলে দেখে যে সেটা শুধু ভাঙেনি, সেটা এক কথায় ধ্বংস হয়ে গেছে। সে রাগে অন্ধ হয়ে কোদালের আঘাতগুলো করেছিল, কিন্তু দৈবক্রমে আঘাতের প্রত্যেকটিই একদম জায়গা মত পড়েছে। ছিটকিনির আশেপাশের কাঠও চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গেছে।
লুইস ফ্লাশ লাইটটা বগলে চেপে ধরে। সে একটু নিচু হয়ে বসে। হাতড়ে হাতড়ে কফিনের ঢাকনার খাঁজ খুঁজে বের করে সেখানে নিজের আঙুলগুলো প্রবেশ করিয়ে দেয়। সে এক মুহূর্তের জন্যে থামে, কিন্তু সেটা থামার জন্যে নয়। এরপর সে কফিনের দরজাটা খোলে।
অধ্যায় ৫০
রাচেল ক্রিড আরেকটু হলেই বস্টন থেকে পোর্টল্যান্ডের প্লেনটা ধরতে পারতো। আরেকটু হলেই। শিকাগোর প্লেনটা ঠিক সময়েই ছাড়ে (একটি আশ্চর্য হবার মত ঘটনা), লা গার্ডিয়াতেও সময় মত পৌঁছে (আরেকটি) আর নিউ ইয়র্ক ত্যাগ করে শিডিউলের পাঁচ মিনিট পর। প্লেনটা বস্টন পৌঁছে পনেরো মিনিট লেটে-এগারোটা বারোতে। তার হাতে সময় ছিল তের মিনিট।
তাও সে হয়তো প্লেনটা ধরতে পারতো, কিন্তু যে শাটল বাসটা লোগান টার্মিনালে চক্রাকারে চলে, সেটা আসতে দেরি করে। রাচেল অধীর ব্যগ্রতা নিয়ে বাসটার জন্যে অপেক্ষা করে, শরীরের ওজন এক পা থেকে আরেক পায়ে বদলে, যেন ওর বাথরুম চেপেছে, আর তার মায়ের দেয়া ট্রাভেল ব্যাগটা বার বার হাত বদল করে।
এগারোটা পঁচিশেও যখন বাসটা না আসে, রাচেল দৌড়াতে শুরু করে। ওর জুতোর হিল লো হলেও সেটা তার দৌড়ে সমস্যা করছিল। ও এক পা হড়কে গিয়ে ব্যথা পায় এবং জুতোগুলো খুলে হাতে নেবার জন্যে থামে। এখন সে শুধু প্যান্টিহোস পায়ে দৌড়াচ্ছে। সে এলিগেনি এবং ইস্টার্ন এয়ারলাইন্স পেরিয়ে যায়। ও জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে এবং ওর শরীরের এক পাশে ব্যথা করতে শুরু করেছে।
ও হাঁপাতে শুরু করে, ব্যথাটাও বাড়তে থাকে। এখন ও ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনাল পেরোচ্ছে, আর একটু সামনেই ডেল্টা এয়ারলাইনের টার্মিনাল। সে ছুটতে ছুটতে দরজা দিয়ে ঢোকে। ঘড়িতে সময় এগারোটা সাইত্রিশ।
ডিউটিতে থাকা ক্লার্কের একজন রাচেলের দিকে তাকায়।
“১০৪ নাম্বার ফ্লাইট,” রাচেল হাঁপাতে হাঁপাতে বলে। “পোর্টল্যান্ডের ফ্লাইট। সেটা কি চলে গেছে?”
ক্লার্ক লোকটি মনিটরের দিকে তাকিয়ে বলল, “এখানে বলছে এখনো যায়নি, কিন্তু ফাইনাল বোর্ডিংয়ের জন্যে আরো পাঁচ মিনিট আগে ঘোষণা দেয়া হয়েছে। আমি ফোন করছি। কোন ব্যাগ আছে চেক-ইনের জন্যে?”
“না,” রাচেল হাঁপাতে হাঁপাতে বলে। সে তার ঘামে ভেঁজা চুলগুলো চোখের ওপর থেকে সরায়। ওর হার্ট বুকের ভেতরে পাগলের মত লাফাচ্ছে।
“তাহলে আমার ফোনের জন্যে অপেক্ষা না করে যত জোরে পারেন দৌড়ান।
রাচেল খুব দ্রুত দৌড়াচ্ছে না-তার সেই সামর্থ্য আর নেই। সে যতটুকু পারলো ততটুকু জোরেই দৌড়ায়। রাতের জন্যে এস্কেলেটর বন্ধ আছে, রাচেল তাই সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে। সিকিউরিটি চেক পয়েন্টে পৌঁছানোর পর সেখানকার হতভম্ব মহিলা সিকিউরিটি গার্ডের দিকে তার ব্যাগটা প্রায় ছুঁড়ে মারে। ব্যাগটা এক্স-রে চেম্বারের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় সে তার হাতের মুষ্টি বার বার খুলতে আর বন্ধ করতে থাকে। এক্স-রে চেম্বার থেকে ভালোভাবে বের হবার আগেই সে ব্যাগের ফিতা ধরে ছো মেরে ব্যাগটা নিয়ে আবারো ছুটতে শুরু করে। ব্যাগটা উড়তে উড়তে তার কোমরে গিয়ে ধাক্কা খায়।
দৌড়াতে দৌড়াতে সে ওপরের মনিটরের দিকে চোখ বুলায় : ফ্লাইট ১০৪ পোর্টল্যান্ড শিড ১১: ২৫, গেট নং- ৩১ বোর্ডিং।
৩১ নাম্বার গেট আরো বেশ খানিকটা দূরে। মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে নিতে নিতে ও খেয়াল করলো যে বোর্ডিং শব্দটা পরিবর্তন হয়ে ডিপার্টিং শব্দটি ব্লিঙ্ক করতে শুরু করেছে। ছেড়ে যাচ্ছে প্লেনটা।
একটা হতাশার চিৎকার ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। ও গেটের কাছে গিয়ে দেখতে পেল গেটের এটেনডেন্ট ফিতা সরাচ্ছে, যেটাতে লেখা : ফ্লাইট ১০৪ বোস্টন-পোর্টল্যান্ড ১১:২৫।
“চলে গেছে?” ও অবিশ্বাসের কণ্ঠে বলে। “আসলেই চলে গেছে?”
এটেন্ডেন্ট ওর দিকে সমবেদনার চোখে তাকায়। “প্লেনটা এগারোটা চল্লিশে ছেড়ে গেছে, আমি সরি ম্যাম। একটুর জন্যে মিস করেছেন।” সে লম্বা জানালা দিয়ে একটা প্লেন দেখায়। সেটা হরেক রকম বাতি ব্লিঙ্ক করতে করতে টেক অফের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে।
“কেউ আপনাকে বলেনি আমি আসছি?” চিৎকার করে বলল রাচেল।
“ওরা যখন ফোন করে, ততক্ষণে প্লেনটা অ্যাক্টিভ ট্যাক্সিওয়েতে চলে গেছে। সেটাকে ওই অবস্থায় ডেকে ফেরত পাঠালে পাইলট, প্যাসেঞ্জার সবাই মিলে আমার মুন্ডু চিবিয়ে খেত। আমি সরি। আপনি যদি আর চার মিনিট আগেও আসতে পারতেন—”
রাচেল বাকি কথা শোনার জন্যে অপেক্ষা না করেই উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করে। সিকিউরিটি চেক পয়েন্টের মাঝামাঝি রাস্তায় এসে ওর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে। ও ফ্লোরেই বসে থাকে, যতক্ষণ না সুস্থ বোধ করে। এরপর সে জুতোগুলো পড়ে নেয়। এর আগে ওর এক পায়ের ছিড়ে ফালাফালা হয়ে যাওয়া স্টকিং থেকে একটা সিগারেটের ফিল্টার সে তুলে ফেলে দেয়। আমার পা নোংরা এবং আমার বালও সেটা কেয়ার করে না, সে ভাবে।
টার্মিনালের দিকে হেঁটে যায় সে।
ওই মহিলা সিকিউরিটি তাকে দেখে বললে, “মিস করেছেন?”
“হুম।”
“আপনি যাবেন কোথায়?”
“পোর্টল্যান্ডের ফ্লাইট ছিল। সেখান থেকে ব্যাঙ্গর।”
“তাহলে আপনি একটা গাড়ি ভাড়া করে নেন না কেন? সাধারণ কেস হলে আপনাকে আমি এয়ারপোর্টের কাছের কোন হোটেলে উঠতে পরামর্শ দিতাম। কিন্তু আমার যদি কখনো কোন মহিলাকে দেখে মনে হয়ে থাকে তাদের গন্তব্যে যাওয়া খুব জরুরি, আপনিই সেই মহিলা।”
“আমিই সেই মহিলা, তাতে কোন সন্দেহ নেই।” সে ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবে। “আপনার আইডিয়াটা কাজ করতে পারে, তাই না? যদি এজেন্সিগুলোয় গাড়ি পাওয়া যায় আর কি।”
সিকিউরিটি গার্ড মহিলা হাসে। “গাড়ি পাবেন। যদিও আবহাওয়া খারাপ থাকলে গাড়ি পাওয়া যায় না, আর এখানে আবহাওয়া প্রায়ই ঝামেলা করে।”
রাচেল মহিলার কথা শুনেও শুনলো না। তার ব্রেন ইতিমধ্যে হিসেব কষতে শুরু করে দিয়েছে।
পোর্টল্যান্ডে ড্রাইভ করে গিয়ে ব্যাঙ্গরের ফ্লাইট ধরা অসম্ভব, এমনকি যদি ও সুইসাইডাল স্পিডে গাড়ি চালায় তবুও। তার চাইতে একেবারে সোজা ব্যাঙ্গর যাওয়াই ভালো। কতক্ষণ লাগবে? সেটা নির্ভর করে দূরত্বের ওপর। আড়াইশো মাইল সংখ্যাটা তার মনে আসে, সম্ভবত জাডের কাছে এরকম কিছুই সে শুনেছিল। ওর রওনা দিতে অন্তত রাত সাড়ে বারোটা বাজবে। পুরো রাস্তা পঁয়ষট্টি মাইল বেগে গেলে পুলিশের গতিসীমা লঙ্ঘনের জন্যে থামানোর সম্ভাবনাও কম। সে মনে মনে আড়াইশো কে পঁয়ষট্টি দিয়ে ভাগ করে। চার ঘন্টার কিছু কম…চার ঘন্টাই ধরা যাক। ওর অন্তত একবার বাথরুমে যাওয়ার জন্যে থামা লাগবে। যদিও ওর মনে হয় না এই পরিস্থিতিতে ঘুম আসার কোন সম্ভাবনা আছে, তারপরও ও নিজেকে যদ্দূর চেনে ওর অন্তত একবার ব্ল্যাক কফির জন্যে থামতে হবে। এসব কিছুর পরেও ও ভোরের আগেই লাডলো পৌঁছতে পারবে। মনে মনে হিসেব শেষ করে ও সিঁড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করে-গাড়ি ভাড়ার ডেস্ক নিচ তলায়।
“গুড লাক, ম্যাম,” সিকিউরিটি গার্ড মহিলা বললেন। “ভালো থাকবেন।”
“ধন্যবাদ,” রাচেল বলে। রাচেলেরও মনে হয় কিছুটা গুড লাক তার প্ৰাপ্য।
অধ্যায় ৫১
গন্ধটা ওর নাকে মোক্ষম আঘাত করে এবং সে কাশতে কাশতে কুকড়ে যায়। সে কবরের পাড় জাপটে ধরে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে থাকে। যখন তার মনে হয় যে তার একটু ভালো লাগছে ঠিক তখনই তার পেট থেকে রাতের খাবারগুলো বেরিয়ে আসে। সে কবরের বাইরে বমি করে ভাসিয়ে দেয়। এরপর সে কবরের পাড়ের মাটিতে মাথা রেখে হাঁপাতে থাকে। এক সময় বমি ভাবটা চলে যায়। সে দাঁতে দাঁত চেপে বগল থেকে ফ্লাস লাইটটা নিয়ে খোলা কফিন বরাবর ধরে।
একটা প্রচন্ড আতঙ্ক ওকে প্রায় অবশ করে দেয়, ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখলে যেমনটা হয়; যে স্বপ্নগুলো দেখে জাগার পর আর মনে করা যায় না।
গেজের লাশের মাথাটা নেই।
লুইসের হাতগুলো এমনভাবে কাঁপতে থাকে যে সে দুহাত দিয়ে ফ্লাশ লাইটটা চেপে ধরে; শিক্ষানবিস পুলিশদের ট্রেনিংয়ে দুহাত দিয়ে যেভাবে পিস্তল ধরতে শেখানো হয়, সেভাবে। কিন্তু তার পরেও আলোর রশ্মি কাঁপতেই থাকে। আলোর রশ্মিটাকে কবরে ফিরিয়ে আনতে তার বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে।
এটা অসম্ভব, সে নিজেকে বলে। তুমি যা দেখেছো, সেটা অসম্ভব।
লুইস ধীরে ধীরে আলোর চিকন রশ্মিটা গেজের পা থেকে মাথার দিকে ওঠাতে থাকে। প্রথমে ওর পায়ের জুতো, এরপর স্যুটের প্যান্ট, এরপর ওর ছোট্ট কোট (ওহ খোদা, কোন দু বছরের বাচ্চার স্যুট পড়ার প্রয়োজন হওয়াটা উচিত না), এরপর স্যুটের কলার, এরপর-
গেজের মৃত্যুকে ঘিরে সব ক্রোধ তার মধ্যে এসে ভর করে। তার মনে হচ্ছে সে পাগল হয়ে যাবে।
লুইস তার প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে হাতড়ে তার রুমালটা বের করে আনে। এক হাতে লাইটটা ধরে সে বেশ খানিকটা নিচু হয়। এই অবস্থায় যদি খাড়া করে রাখা গ্রেভ লাইনারের কোন স্ল্যাব তার ওপর এসে পড়ে তাহলে নিশ্চিতভাবেই তার ঘাড় ভাঙবে। সে খুব আলতোভাবে তার রুমালটা দিয়ে গেজের মুখের ওপর জন্মানো শ্যাওলাগুলো মুছে দেয়-শ্যাওলাগুলো এতো গাঢ় সবুজ রঙের যে তা দেখে লুইস ভেবেছিল গেজের মাথাই হয়তো গায়েব হয়ে গিয়েছে।
শ্যাওলাগুলো পাতলা হয়ে জন্মেছে। এরকমটা হতে পারে তার বোঝা উচিত ছিল; এর মধ্যে বৃষ্টি হয়েছে এবং গ্রেভ লাইনার ওয়াটার প্রুফ না। ফ্লাশ লাইটের আলো দুদিকে ফেলে লুইস দেখতে পায়, গেজের কফিনটার চারদিকে বেশ কাদা। মর্টিশিয়ান যদিও জানতেন যে সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্টের কারণে গেজের কফিন খোলার সম্ভাবনা নেই, তার পরও তিনি তার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন-যেটা মর্টিশিয়ানরা প্রায় সব সময়ই করে থাকে। তার ছেলেকে দেখে মনে হচ্ছে একটা বাজেভাবে বানানো পুতুল। তার মাথার কয়েক দিকে অসমভাবে ফুলে আছে। তার চোখগুলো চোখের পাতার অনেকটা ভেতরে ঢুকে গেছে। ওর মুখ থেকে সাদা কিছু বেরিয়ে আছে, যেটাকে একটা সাদা জিবের মত দেখাচ্ছে। লুইস ভাবে মর্টিশিয়ান হয়তো অতিরিক্ত ক্যামিকেল ব্যবহার করে ফেলেছেন, আর একটা ছোট শিশুর ক্ষেত্রে কতটুকু যে যথেষ্ট তা বোঝাটাও নিশ্চয়ই কঠিন
এরপর সে বুঝতে পারে জিনিসটা আসলে তুলো। লুইস নিচু হয়ে তুলোটা গেজের মুখ থেকে তুলে নেয়। গেজের ঠোটগুলো একটা ‘প্লিপ’ শব্দ করে বন্ধ হয়ে যায়। ওর ঠোঁটগুলোকে অস্বাভাবিক কালো আর দীর্ঘ মনে হচ্ছে। লুইস তুলোটা কবরের কাদার মধ্যে ফেলে দিলে সেটাকে কালোর মধ্যে এক টুকরো ঘৃণিত শুভ্রের মত দেখায়। তুলোটা সরানোতে গেজের এক গাল একদম ভেতরে ডেবে গেছে।
“গেজ,” সে ফিসফিস করে বলে, “তোমাকে বের করে নিয়ে যাচ্ছি, ঠিক আছে?”
সে প্রার্থনা করে যাতে কেউ এদিকে না চলে আসে, যেমন কেয়ারটেকারের রাত সাড়ে বারোটার টহল বা ওরকম কিছু। এখন ব্যাপারটা শুধু এমন না যে লুইস শুধু ধরা পরতে চায় না, এখন যদি কেউ এসে ওর মুখে টর্চের আলো ফেলে তাহলে ও কোদালটা তুলে তার মাথায় বসিয়ে দেবে।
তার হাত গেজের লাশের নিচে ঢুকিয়ে দেয়। গেজের দেহ হাড্ডিবিহীন লাশের মত থলথল করে ওঠে। তার নিশ্চিতভাবে মনে হচ্ছে সে গেজের লাশটা তুললে সেটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়বে এবং তার হাতে কয়েকটা টুকরো ছাড়া আর কিছুই থাকবে না। ও এরপর কবরের ভেতর দাঁড়িয়ে টুকরোগুলো বুকে নিয়ে চিৎকার করে উঠবে। আর এভাবেই লোকেরা উন্মাদ লুইসকে খুঁজে পাবে।
থামিস না, ভীতুর ডিম। থামিস না!
গেজের গায়ের বোটকা স্যাতস্যাতে অবস্থা সত্ত্বেও লুইস গেজকে তার দুহাতে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়, যেভাবে সে ওকে ওর খাট থেকে বহুবার তুলেছে। গেজের মাথা নিচের দিকে ঝুলে যায়। গেজ সেই সেলাইগুলো দেখতে পায় যেটা গেজের মাথাটাকে তার কাঁধের সাথে লাগিয়ে রেখেছে।
দুর্গন্ধে লুইসের নাড়িভুড়ি উল্টে আসছে। ওই অবস্থাতেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে গেজকে কোন রকমে কফিন থেকে বের করে আনে।
অবশেষে সে গেজকে কোলে শুইয়ে বসে পড়ে কবরের পাশে। লুইসের পাগুলো কবরের গর্তে ঝুলছে, মুখটা ভয়ঙ্কর ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে, চোখগুলোকে গর্তের মত লাগছে এবং ওর মুখটা দুঃখে নিচের দিকে বাঁকা হয়ে আছে।
“গেজ,” লুইস বলে গেজকে তার কোলে দোল দিতে থাকে। গেজের চুলগুলো লুইসের কব্জির সাথে লেগে আছে, যেগুলো একদম তামার তারের মতই মৃত। “গেজ, বাবা সব ঠিক হয়ে যাবে। আরেকটু ধৈর্য ধরো। আজ রাতটা শুধু অপেক্ষা করো, প্লিজ গেজ। আমি তোমাকে ভালবাসি গেজ, বাবা তোমাকে ভালোবাসে।”
লুইস তার ছেলেকে কোলে করে দোল দিতে থাকে।
রাত পৌনে দুটোর মধ্যে লুইস কবরস্থান ছেড়ে যাবার জন্যে প্রস্তুত হয়। গেজের লাশটার ব্যবস্থা করাই সবচাইতে কঠিন ছিল-ওই সময় তার মন; মহাশূন্যে ভাসতে থাকা মহাকাশচারী সবচাইতে দূরে ভেসে গিয়েছিল। তার পিঠ আর কোমরের পেশিগুলো ব্যথায় দপ দপ করছে। তার মনে হচ্ছে পেশিগুলো লাফাচ্ছে। কিন্তু এই অবস্থায় বিশ্রাম নিতে নিতে সে ভাবে সে হয়তো গেজকে ফিরিয়ে আনতে পারবে। হয়তো পুরোটাই ফিরিয়ে আনতে পারবে।
সে গেজের লাশ ত্রিপলের ওপর রেখে ভালোভাবে পেঁচিয়ে নেয়। এরপর টেপ দিয়ে ভালোমত পেচিয়ে দুই মাথা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে ফেলে। সে কফিনের দরজাটা বন্ধ করে; এরপর একটা চিন্তা করে দরজাটা খুলে সেটার ভেতর ভচকে যাওয়া কোদালটা রেখে দেয়। জিনিসটা প্লেজেন্টভিউতেই থাক; প্লেজেন্টভিউ তার ছেলেকে হারাচ্ছে, কিন্তু কোদালটা সে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিক। সে কফিনের দরজাটা বন্ধ করে গ্রেভলাইনারের অর্ধেক স্ল্যাব জায়গামত নামিয়ে আনে। সে ভেবেছিল বাকি অর্ধেক সে ধাক্কা দিয়ে জায়গামত ফেলে দিবে, কিন্তু তাতে সেগুলো ভেঙে যেতে পরে বলে ও থামে। একটু চিন্তা করে সে তার বেল্টটা লোহার রিংগুলোর ভেতর ঢুকিয়ে সেগুলো শুইয়ে দেয়। এরপর সে বেলচাটা ব্যবহার করে গর্তটা ভরাট করতে থাকে। এবারও দেখা গেল কবর পুরোপুরি ভর্তি করার জন্যে যথেষ্ট মাটি নেই। কবরটিকে সামান্য নিচু দেখাচ্ছে যেটা কারো চোখে পড়তে পারে। আবার নাও পারে। আবার চোখে পড়লেও হয়তো এটাকে কেউ আমলে নিবে না। সে নিজেকে এটা নিয়ে বেশি চিন্তা করতে দেয় না-কারণ তার সামনে আরো অনেক জটিল এবং বর্বর কাজ পড়ে আছে। এবং সে প্রচন্ড ক্লান্ত।
চলো, চলো!
“ঠিক” লুইস বিড়বিড় করে।
বাড়ন্ত বাতাসে আশেপাশের গাছপালা নেচে উঠলে লুইস ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকায়। সে তার যন্ত্রপাতিগুলো ত্রিপলের বান্ডেলটার পাশে রাখে। তার লাইট ব্যবহার করতে ইচ্ছে হলেও সে ইচ্ছেটা দমন করে। লাশ আর জিনিসগুলো রেখে লুইস যে পথে এসেছিল সেই পথে হেঁটে হেঁটে ওই লোহার শিকের বেড়াটার কাছে যায়, পাঁচ মিনিট পর। তার গাড়িটা রাস্তার ওপাশে পার্ক করা আছে। এতো কাছে, কিন্তু বহু দূরে।
সে ওদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঘুরে আরেক দিকে হাঁটতে থাকে। এবার সে গেটের উল্টো দিকে যায়, বেড়াটার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে, যতক্ষণ না বেড়াটা মেসন স্ট্রিট থেকে প্রায় নব্বই ডিগ্রী কোণে মোড় নিয়েছে। সেখানে সে একটা ছোট ডোবা দেখতে পায়, যাতে নর্দমার ময়লা এসে পড়ে। সেখানে যা দেখলো তাতে সে কেঁপে ওঠে। ডোবাটা নষ্ট ফুলে ভরা। এক স্তরের ওপর আরেক স্তর ফুল। বৃষ্টি আর বরফগলা পানিতে এগুলো এখানে ভেসে এসেছে।
ওহ খোদা।
না, এই জিনিসগুলো ঈশ্বরের জন্যে না। এসব হচ্ছে সেই অপদেবতার জন্যে যা খ্রিস্টধর্মের চাইতেও অনেক বেশি পুরনো। রাচেলের বোন সেটাকে বলতো : ওজ দ্য গেয়িট অ্যান্ড টেয়িল, মৃত জিনিসের দেবতা, নর্দমার পচা ফুলের দেবতা, রহস্যের দেবতা।
লুইস ডোবাটার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তাকে হিপনোটাইজ করা হয়েছে। এবং অবশেষে সে একটা লম্বা শ্বাস গিলে এমনভাবে সেদিক থেকে চোখ সরায় যেন কেউ এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনে তাকে হিপনোটাইজড অবস্থা থেকে ফিরিয়ে এনেছে।
সে এগোয়। একটু সামনে গিয়েই যা খুঁজছিল তা পেয়ে যায় সে। তার মনে হচ্ছে গেজের কবরের দিনই তার মন অবচেতনভাবে এই জিনিসটা মনে রেখেছে।
অন্ধকারে লুইস দাঁড়িয়ে আছে গোরস্তানের লাশঘরের সামনে। ফেব্রুয়ারির শীতে যখন মাটি শক্ত হয়ে যায় এবং বুলডোজার দিয়েও মাটি খোঁড়া সম্ভব হয় না তখন লাশগুলো এই ঘরে সংরক্ষণ করা হয়। তাছাড়া অন্য সময়েও ব্যবসার চাপ বেড়ে গেলেও এই ঘরটা কাজে লাগে।
লুইস জানে যে গোরস্থানে ব্যবসা মাঝে মাঝে বেড়ে যায়। কোন এলাকায় হঠাৎ হঠাৎ কোন বোধগম্য কারণ ছাড়াই অনেক মানুষ মারা যায়।
“সব মিলিয়ে ব্যালেন্স হয়ে যায়,’ আঙ্কেল কার্ল বলেছিলন। ‘যদি দেখা যায় মে মাসের দুই সপ্তাহে কেউ মরেনি, তাহলে আমি বলে দিতে পারি যে নভেম্বরের দুই সপ্তাহেই আমার দশটা ফিউনারেল করা লাগবে। তবে নভেম্বরে এরকম খুব কমই হয় আর ক্রিসমাসের সময় কখনোই হয় না, যদি অনেকেই মনে করে ক্রিসমাসের সময় অনেক মানুষ মারা যায়। ক্রিসমাস ডিপ্রেসন; যতসব ফালতু কথা। এই ব্যবসার যে কাউকে জিজ্ঞেস করলে তোমাকে তাই বলবে। বেশিরভাগ মানুষই ক্রিসমাসের সময় খুশি থাকে আর তাই তারা আরো বাঁচতে চায়। তাই তারা আসলেই বেঁচে থাকে। সাধারণত ফেব্রুয়ারির সময় মৃত্যুর ঢল নামে। অনেকে ফ্লুতে মরে, কারো নিউমোনিয়া হয়-কিন্তু এসবই আসল কারণ না। অনেকে দেখা যায় এক/দেড় বছর ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করেছে পালোয়ানের মত। কিন্তু ফেব্রুয়ারি আসলে তাদের মনে হয় তারা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে এবং এই সুযোগে তাদের ঘরের ফুটো দিয়ে মৃত্যুও প্রবেশ করে সাপের মত। জানুয়ারির একত্রিশে এ দেখা গেল তাদের ক্যান্সার ভালোর দিকে, আর ফেব্রুয়ারির চব্বিশে তাকে পাওয়া যাবে কবরের গর্তে। ফেব্রুয়ারিতে মানুষের হার্ট অ্যাটাক হয়, ফেব্রুয়ারিতে মানুষের স্ট্রোক হয়, ফেব্রুয়ারিতে মানুষের ব্রেইন হেমারেজ হয়। ফেব্রুয়ারি একটা খারাপ মাস। আর আমরা যারা এই ব্যবসায় আছি, তারা এই ব্যাপারে অভ্যস্ত। আবার কোন কারণ ছাড়াই এই একই ঘটনা জুনে বা অক্টোবরেও হয়। কিন্তু আগস্টে কখনো হয় না। আগস্ট খুব স্লো সময় আমাদের ব্যবসায়। যদি না কোন গ্যাস বিস্ফোরণ হয় বা কোন বাস ব্রিজের ওপর থেকে পড়ে যায়; তাছাড়া আগস্টে কখনোই লাশ ঘর ভরে না। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে দেখা যায় আমরা কফিনের ওপর কফিন রেখেও জায়গা করতে পারছি না। এরপর আমাদের একটু গরমের জন্যে দোয়া করা লাগে যাতে করে লাশ রাখার জন্যে আমাদের কোন এ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া করা না লাগে।
আঙ্কেল কার্ল হেসেছিলেন। লুইসও হেসেছিল।
লাশ ঘরটা দেখলে মনে হবে ছোট একটা টিলার ভেতর মাটি কেটে দরজা বসিয়ে দেয়া হয়েছে। টিলাটা স্বভাবতই প্রাকৃতিক না। সুন্দর একটা লাশ ঘর বানানোর জন্যেই এটা তৈরি করা হয়েছে। টিলাটার দুটো উঁচু অংশ আছে, অনেকটা মানবীর স্তনযুগলের মত। এই টিলাটা লম্বায় লোহার বেড়াটা থেকে ফুট দুই-এক কম। আর টিলার ওপরের দিকটা সমতল।
লুইস চারদিক দেখে ঢালু বেয়ে ওপরে উঠে যায়। বেড়ার ওপাশে প্রায় দুই একরের মত খালি জায়গা…না একদম খালি না, একটা ছোট ছাউনি দেয়া ঘর দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত গোরস্তানের যন্ত্রপাতি রাখার ঘর, লুইস ভাবে।
চারদিক একদম সুনশান, জন মানবের কোন চিহ্ন নেই। বাতাসে গাছ পালার নড়াচড়া ছাড়া সে আর কোন নড়াচড়া দেখতে পায় না।
সে পাছায় ভর দিয়ে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে নিচে নামে, তার ভয় হচ্ছিল সে পড়ে গিয়ে আবারো হাঁটুতে ব্যথা পাবে। এরপর সে তার ছেলের কবরের কাছে ফিরে যায়। আরেকটু হলেই ত্রিপলে মোড়া নিজের ছেলের লাশের সাথে পা হড়কে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। সে খেয়াল করে দেখলো টানা দুবার পা হড়কাতো, প্রথমবার লাশে, পরের বার তার পাশে রাখা তার যন্ত্রপাতিতে। সে কোমরের ব্যথায় চোখ মুখ কুঁচকে নিচু হয়ে ত্রিপলের রোলটা তুলে নেয়। বান্ডেলের ভেতরে গেজের লাশের এপাশ ওপাশ সরে যাওয়া টের পায় এবং সে অনবরত শুনতে থাকা একটা কণ্ঠ ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে যেটা বলেই যাচ্ছে যে তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
সে লাশ মোড়ানো ত্রিপলের বান্ডেলটা লাশ ঘরটার কাছে নিয়ে যায়। সে ভেবে দেখে তার হাতের চল্লিশ পাউন্ডের জিনিসটা টিলার ওপর ওঠাতে তার কী করা লাগবে, যেহেতু তার দড়িটা আর নেই। সে একটু পিছিয়ে যায়, এরপর প্রাণপণে টিলার ঢাল বরাবর দৌড়াতে থাকে। বেশ খানিকটা ওঠার পর ঘাসে ওর পা পিছলে যায় আর ও শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে বান্ডেলটা সামনের দিকে ছুঁড়ে মারে। বান্ডেলটা একদম টিলার চূড়ার কাছে গিয়েই পড়ে। বাকি অংশটা সে ক্রল করে করে ওঠে। চারদিকে তাকিয়ে বান্ডেলটি বেড়ার গায়ে হেলান দিয়ে সে বাকি জিনিস আনতে ফিরে যায়।
সে আবারো টিলার চূড়ায় ওঠে এবং হাতে গ্লাভস পড়ে নিয়ে জিনিসগুলো বান্ডেলের পাশে সাজিয়ে রাখে। এরপর সে বেড়ায় হেলান দিয়ে বসে, হাঁটুর ওপর হাতগুলো রেখে একটু জিরিয়ে নেয়। ক্রিসমাসে রাচেলের উপহার দেয়া ডিজিটাল ঘড়িটা বলছে সময় এখন দুইটা এক।
সে নিজেকে সামলে নেয়ার জন্যে পাঁচ মিনিট সময় নেয়। এরপর সে বেলচাটা বেড়ার ওপাশে ফেলে দেয়। সে ঘাসের ওপর সেটা পড়ার ‘ধাপ’ শব্দ শুনতে পায়। সে ফ্লাশ লাইটটা তার পকেটে আটাতে চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। বেড়ার শিকের ফাঁক দিয়ে সেটাকে ঢুকিয়ে দিয়ে ছেড়ে দেয়। সেটা যেন কোন পাথরে বাড়ি খেয়ে না ভেঙে যায় যায় সেই আশা করতে করতে সে টিলার গা বেয়ে সেটার গড়িয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে থাকে। তার এখন মনে হচ্ছে তার প্যাকস্যাক পড়া দরকার ছিল।
সে তার পকেট থেকে টেপটা বের করে সেটা দিয়ে কুঠারের হাতলটা খুব ভালোভাবে ত্রিপলের বান্ডেলটার সাথে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লাগায়। শেষ না হওয়া পর্যন্ত টেপ প্যাঁচাতেই থাকে এবং সেটা শেষ হয়ে গেলে সেটার খালি রিংটা পকেটে পুরে রাখে। সে বান্ডেলটা উঁচু করে বেড়ার ওপর ধরে; তার কোমড় ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠে এবং সে বুঝতে পারে আগামী সপ্তাহের পুরোটা তাকে আজ রাতের মাশুল গুনতে হবে। এরপর সে বান্ডেলটা ছেড়ে দেয় এবং সেটার মাটিতে পড়ার শব্দে সে চোখ-মুখ কুচকে ফেলে।
এবার সে তার এক পা বেড়ার ওপাশে দিয়ে দুটো শিকের মাথা হাত দিয়ে ভালোভাবে ধরে আরেকটি পাও ওপাশে নিয়ে যায়। এরপর বেড়ার গায়ের খাঁজে পা বাজিয়ে সে মাটিতে নেমে আসে।
ও টিলাটার নিচের দিকে নেমে এসে সাথে সাথেই বেলচাটা পেয়ে যায়। গাছের ফাক দিয়ে স্ট্রিট লাইটের আলো পড়ে সেটার ফলাটা মৃদু জ্যোতি ছড়াচ্ছে। ফ্লাশ লাইটটা খুঁজে পেতে তার বেশ ঝামেলায় পড়তে হয়। সেটা যেখানে থাকবে বলে লুইস ভেবেছিল সেখানে সেটা নেই। সে তাই হামাগুড়ি দিয়ে হাতড়ে হাতড়ে সেটা খুঁজতে থাকে ঘন ঘাসের মধ্যে। সে তার নিশ্বাস এবং হৃৎপিন্ডের পালস নিজ কানে শুনতে পাচ্ছে।
অবশেষে সেটা খুঁজে পায়, তার অনুমান থেকে পাঁচ ফিট দূরে। সে তার হাত দিয়ে ফ্লাশ লাইটের মাথাটা চেপে ধরে সুইচ টিপে দেয়। তার হাত জ্বলে উঠলে সে বুঝতে পারে জিনিসটা ঠিকই আছে।
সে তার পকেট নাইফ দিয়ে টেপ কেটে কুঠারটা বান্ডেল থেকে আলাদা করে এবং যন্ত্রপাতিগুলো ঘাসের ওপর থেকে গাছগুলোর দিকে নিয়ে যায়। সে সবচাইতে বড় গাছটার পেছনে দাঁড়িয়ে মেসন স্ট্রিটের দুই দিকে তাকায়। জন মানব শূন্য। পুরো রাস্তা জুড়ে একটা বাড়ির দোতলাতে আলো জ্বলছে-হয়তো কোন ইনসমনিয়া রোগি।
সে দৌড়ায় না, কিন্তু বেশ জোরে হেঁটে হেঁটে ফুটপাতে উঠে আসে। গোরস্তানের অন্ধকার থেকে স্ট্রিট লাইটের আলোতে বেরিয়ে তার খুব অনিরাপদ বোধ হতে শুরু করে। সে একটা কুঠার, একটা বেলচা আর একটা ফ্লাশ লাইট নিয়ে ব্যাঙ্গরের দ্বিতীয় বৃহত্তম হাড্ডিখানার সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে; কেউ তাকে দেখে ফেললে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নিতে এক এক সেকেন্ডের বেশি লাগার কথা না।
দ্রুত রাস্তা পেরোয় সে। তার গাড়িটা আর পঞ্চাশ গজের মত দূরে কিন্তু তার মনে হচ্ছে পাঁচ মাইল। সে ঘামতে ঘামতে এগোয়, আর কোন গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ, বা কোন পায়ের আওয়াজ যেটা তার নিজের না, বা জানালা খোলার শব্দের জন্যে কান খাড়া করে।
সে তার গাড়ির গায়ে কুঠার আর বেলচাটা ঠেস দিয়ে পকেটে চাবির জন্যে হাতড়াতে থাকে। চাবিটা নেই, দুই পকেটের একটিতেও। সে আবারো ঘামতে শুরু করে। তার হৃৎপিন্ড আবারো প্রচন্ডভাবে লাফাতে থাকে আর দাঁতের সাথে দাঁত লেগে যায়। তীব্র আতংক তাকে জাপটে ধরে।
সে চাবি হারিয়ে ফেলেছে, খুব সম্ভবত যখন সে গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়ে হাঁটুতে ব্যথা পেয়ে গড়াগড়ি খেয়েছিল তখন। চাবিটা হয়তো ঘাসের ভেতর পড়ে আছে। ঘাসের ভেতর থেকে ফ্লাশলাইটটা খুঁজে পেতেই তাকে গলদঘর্ম হতে হয়েছিল, আর চাবি খুঁজতে গেলে সেটা পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু সে তা ভালো করেই জানে। শেষ, সব শেষ। একটা ছোট ভুলের কারণে সব শেষ।
এক মিনিট, পকেটটা আবারো চেক করো লুইস। পকেটের পয়সাগুলো যেহেতু পড়ে যায়নি, চাবিটাও পড়ে যাওয়ার কথা না।
লুইস এবার খুব ধীরে ধীরে পকেট দুটো চেক করে, পয়সাগুলো বের করে, এমনকি পকেটগুলো উল্টো করে বের করে।
কোন চাবি নেই।
গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে সে ভাবে কী করবে। তাকে আবারো বেড়া পেরিয়ে কবরস্থানের ভেতর ঢোকা লাগবে, গেজের লাশ যেখানে আছে সেখানে রেখেই। ভেতরে ঢুকে ফ্লাশ লাইট দিয়ে চাবি খুঁজতে গিয়ে হয়তো সারা রাত পেরিয়ে যাবে কিন্তু চাবি খুঁজে পাওয়া-
হঠাৎ একটা ভাবনা ওর ক্লান্ত মনে উঁকি দেয়।
সে একটু বাঁকা হয়ে গাড়ির ভেতরে তাকায়। তার চাবির গোছাটা গাড়ির ইগনিশন সুইচ থেকে ঝুলছে।
ঘোৎ করে শব্দ করে দৌড়ে গাড়ির ওপাশে গিয়ে দরজা খুলে চাবির গোছাটা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়। তার মাথার মধ্যে একটা প্রোগ্রামে কার্ল মালডেনের কণ্ঠ ভেসে আসেঃ গাড়ি লক কর। চাবিটা নিয়ে নাও। একটা ভালো ছেলেকে খারাপ হতে সাহায্য করো না।
সে গাড়িটার পেছনে গিয়ে ট্রাঙ্ক খুলে সেখানে বেলচা, কুঠার আর ফ্লাশ লাইটটা রেখে ট্রাঙ্কের দরজাটা ধাম করে লাগায়। এরপর গাড়ি থেকে বিশ বা ত্রিশ ফিট সামনে যাওয়ার পর তার মনে পড়ে সে আবারো চাবিটা ফেলে যাচ্ছে, এবার ট্রাঙ্কের তালায় ঝুলন্ত অবস্থায়।
স্টুপিড! সে মনে মনে নিজেকে গালি দেয়। এরকম ছাগলামি করলে সব কিছু ভুলে যাও, তোমাকে দিয়ে কিসসু হবে না!
সে ফিরে গিয়ে চাবি নিয়ে আসে।
গেজকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে মেসন স্ট্রিটের প্রায় অর্ধেক চলে আসার পর কোথাও একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। না-শুধু ঘেউ ঘেউ না, সেটা রীতিমত রাগে গজরাচ্ছে। গর্র্র্-ঘেউ! ঘেউ! রাস্তাটা কুকুরের গর্জনে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
লুইস একটা গাছের ছায়ায় আশ্রয় নিয়ে ভাবতে থাকে কী হতে যাচ্ছে আর সে কী করবে। সে সেখানে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে যে রাস্তার পাড়ের সবগুলো বাড়ির বাতি হয়তো এক এক করে জ্বলে ওঠবে।
কিন্তু দেখা গেল মাত্র একটা বাতি জ্বলে উঠেছে, লুইস যে ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে তার বিপরীতে। একটু পরে একজন ধমকের সুরে বলে উঠে, “চুপ কর, ফ্রেড!”
গর্র্র্-ঘেউ! ফ্রেড জবাব দেয়।
“কুত্তাটাকে চুপ করাও, স্ক্যানলন, নাহলে আমি পুলিশে ফোন করছি!,” লুইস রাস্তার যে পাশে সেখান থেকে একজন চিৎকার করে বলে ওঠে আর লুইস চমকে প্রায় লাফিয়ে ওঠে এবং বুঝতে পারে এখানকার নির্জনতা আসলে কতটা ক্ষণস্থায়ী। তার চারদিকে অসংখ্য চোখ, আর কুকুরটা মানুষের ঘুমে ব্যঘাত ঘটাচ্ছে, যে জিনিসটা এখানে তার একমাত্র বন্ধু। বদমাইস কুত্তা! তোর গুষ্টি কিলাই!
ফ্রেড আবারো তার গলা সাধা শুরু করে; কিন্তু সে যেই গর্র্র্ করার পর ঘেউ করে উঠবে এমন সময় ফ্রেড কারো আঘাতে কেউউউ করে কঁকিয়ে ওঠে এবং সেখান থেকে সামান্য হুটোপুটির আওয়াজ আসতে থাকে।
ফ্রেডের বাসার দরজা বন্ধ হবার শব্দের পর থেকে আবারো চারদিকে অমূল্য নীরবতা নেমে আসে। সেই বাসার লাইটটা আরো কয়েক মুহূর্ত পরে নিভে যায়।
লুইসের মনে হচ্ছিল তার আরো কিছুক্ষণ ছায়ায় ঘাপটি মেরে থাকা উচিত, কিন্তু সময় হাত ফসকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
সে গেজের লাশের বান্ডেলটা হাতে নিয়ে রাস্তা পেরিয়ে গাড়ির পেছনে যায় এবং কাউকেই দেখতে পায় না। ফ্রেড তার শান্তি বজায় রাখছে। সে বান্ডেলটা এক হাতে নিয়ে চাবি দিয়ে ট্রাঙ্কের ডালাটা খোলে।
গেজের জায়গা হবে না।
লুইস লম্বা-লম্বি ভাবে, সটানভাবে এবং আড়া-আড়িভাবে বান্ডেলটা ট্রাঙ্কে ঢোকানোর চেষ্টা করে, কিন্তু কোনভাবেই জায়গা করতে পারে না। ট্রাঙ্কটা খুব ছোট। লুইস বান্ডেলটা ঠেসে ঠুসে, মুচড়িয়ে ঢুকিয়ে দিলেও হয়তো গেজ রাগ করবে না, কিন্তু তার দ্বারা সেটা সম্ভব না।
সে তার ছেলের লাশ হাতে নিয়ে ট্রাঙ্কের কাছে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে কি করা যায় এবং সে তখনই একটা গাড়ির শব্দ শুনতে পায়। গাড়িটা এদিকেই আসছে। সে আর কিছু চিন্তা না করে দ্রুত গাড়ির প্যাসেঞ্জার সাইডে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে বান্ডেলটা সিটে রেখে দেয়।
সে সামনের দরজাটা বন্ধ করে দৌড়ে গাড়ির পেছনে গিয়ে ট্রাঙ্কের ডালাটা বন্ধ করে। ঠিক এই মুহূর্তেই গাড়িটা তাকে প্রদক্ষিণ করে এবং সে ওই গাড়ি থেকে কিছু মাতালের শোরগোল শুনতে পায়। সে ড্রাইভিং সিটে বসে যেই হেডলাইট জ্বালাতে যাবে তখনি একটা আতঙ্কের চিন্তা তাকে নাড়া দেয়। গেজ নিচের দিকে মুখ করে নেই তো? ওর হাঁটু এমন হয়ে ভাঁজ হয়ে আছে যা দেখে মনে হচ্ছে গেজ ওপরের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে, কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে ওর পা মুচড়ে উল্টো দিকে ভাঁজ হয়ে আছে?
তাতে কী আসে যায়? তার ক্লান্ত বিরক্ত মন বলে। এসব মাথা থেকে কি ঝেড়ে ফেলতে পারবে তুমি? এসবে কিচ্ছু আসে যায় না!
আসে যায়। অনেক কিছু আসে যায়। কারণ এটা কোন কাপড়ের বান্ডেল না, এটা গেজ!
ও গেজের দিকে ঝুঁকে পড়ে বান্ডেলটার গা হাতড়ে হাতড়ে ভেতরের জ্যামিতি বোঝার চেষ্টা করে। তাকে একজন অন্ধের মত মনে হচ্ছে, যে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে জিনিসটা কি তা বোঝার চেষ্টা করছে। অবশেষে সে একটা উঁচু জিনিস হাত দিয়ে অনুভব করতে পারে যেটা গেজের নাক ছাড়া আর কিছু হতে পারে না-গেজ ঠিকভাবেই আছে।
এরপরই সে গাড়িটা চালু করে লাডলোর পঁচিশ মিনিটের যাত্রা শুরু করতে পারে।
অধ্যায় ৫২
রাত একটায় জাড ক্র্যান্ডালের ফাঁকা বাড়িতে তার টেলিফোনটা বেজে উঠলে তিনি চমকে জেগে উঠেন। স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি। স্বপ্নে তার বয়স ছিল তেইশ বছর আর তিনি জর্জ চ্যাপলিন এবং রেনে মিকাউড, তার দুই বন্ধুর সাথে একটা ট্রেনের কাপলিং শেডে বসে হুইস্কি গিলছিলেন। তাদের সামনে ট্রেনের ইঞ্জিনের জ্বলতে থাকা কয়লার লাল আভা ঝাপসা কাচের ওপাশ থেকে বিকিরণ করছে। তারা এক এক করে রসালো গল্প বলে যাচ্ছেন আর বাকিরা হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তার বয়স তেইশ এবং নরমাও নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। রেনে মিকাউড এক ইহুদিকে নিয়ে আরেকটা রসালো গল্প ফাঁদতে যাচ্ছে-
এমন সময় ফোনটা বেজে ওঠে এবং তিনি ঝাঁকি দিয়ে ঘুম থেকে জেগে ওঠেন। তিনি নিজের কাঁধের ব্যথায় ককিয়ে ওঠেন, যেন কোন ভারি পাথর তার ওপর এসে পড়েছে-ভারি জিনসটা হচ্ছে তেইশ থেকে তিরাশি, মোট ষাটটি বছর একবারে তার ওপরে এসে আছড়ে পড়ার ফল। তিনি আরো ভাবেন, তুমি ঘুমাচ্ছিলে খোকা। এভাবে রেলপথ চালালে কাজ হবে না…অন্তত আজ রাতে না।
তিনি তার কাঁধ এবং কোমরের ব্যথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে উঠে দাঁড়িয়ে ফোনের কাছে যান।
রাচেলের ফোন।
“জাড, ও কি বাসায় ফিরেছে?”
“না,” জাড বলেন। “রাচেল, তুমি কোথায়? তোমাকে আগের চাইতে কাছে মনে হচ্ছে?”
“আমি আগের চাইতে কাছেই আছি,” রাচেল বলে। যেভাবেই হোক বোঝা যাচ্ছে যে রাচেল আগের চাইতে বেশ কাছে আছে এবং ফোনের তারে দূর থেকে ভেসে আসা এক রকম গুন গুন শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দটা বাতাসের। এই শব্দটা সবসময় তাকে মৃতদের কন্ঠের কথা মনে করিয়ে দেয়, যেন অনেক মৃতের কন্ঠ এক সাথে সমবেত সঙ্গিত গাইছে। “আমি মেইনের বিডেফোর্ডে একটা দোকান থেকে বলছি।”
“বিডেফোর্ড!”
“আমার পক্ষে আর শিকাগোতে বসে থাকা সম্ভব হয়নি। এলির সাথে যাই হচ্ছিল না কেন, তা আমার সাথেও হচ্ছিল। আর আপনিও সেটা অনুভব করতে পারছেন, আমি আপনার গলা শুনেই বুঝতে পারছি।”
“হুম।” তিনি প্যাক থেকে একটা বিড়ি তার ঠোঁটের কোণে চালান করে দেন। এরপর তিনি একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে সেটাকে তার নিজের হাতের কাঁপুনির সাথে কাঁপতে দেখেন। তার হাত কাঁপতো না, অন্তত এই দুঃস্বপ্ন শুরু হবার আগে। তিনি বাইরের বাতাসের কালো গর্জন শুনতে পান। মনে হচ্ছে সেটা বাড়িটাকে হাতের মুঠোয় নিয়ে ঝাকাচ্ছে।
অশুভ ক্ষমতা বাড়ছে। আমি অনুভব করতে পারছি।
তার বুড়িয়ে যাওয়া হাড়ে আতঙ্ক ঢুকে পড়ে।
“জাড, প্লিজ বলুন এসব কি হচ্ছে!”
তার মনে হয় রাচেলের সব কিছু জানার অধিকার আছে; এবং সেটার প্রয়োজনও আছে। এবং তিনি তাকে সব খুলে বলবেন। পুরো গল্পটা। তিনি ওকে বলবেন ঘটনাগুলো কিভাবে একটার সাথে আরেকটা লেগে একটা চেইন তৈরি করেছে-নরমার হার্ট অ্যাটাক, এলির বিড়ালের মৃত্যু, ওখানে কোন মানুষকে কবর দেয়া হয়েছে কি না সে ব্যাপারে লুইসের প্রশ্ন, গেজের মৃত্যু। আর খোদাই জানে লুইস সেই চেইন আরো কতদূর টেনে নিয়ে গেছে। তিনি ওকে সবই খুলে বলবেন। কিন্তু ফোনে না।
“রাচেল, তুমি প্লেনের বদলে মহাসড়কে কেমন করে?”
রাচেল সব খুলে বলে কিভাবে ও বস্টনে ফ্লাইট মিস করেছে। “আমি একটা এভিস গাড়ি ভাড়া করেছি। তবে আমি যে সময়ের হিসেব করেছিলাম তা থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছি। লোগানে একবার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম, আর এখন আমি মাত্র মেইনে এসে পৌঁছেছি। আমি হয়তো ভোরের আগে এসে পৌঁছাতে পারবো না। কিন্তু…জাড…প্লিজ। প্লিজ আমাকে বলুন এসব কি হচ্ছে। আমার খুবই ভয় হচ্ছে আর আমি এও বুঝছি না কেন আমার ভয় হচ্ছে।”
“রাচেল। আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোন,” জাড বললেন, “তুমি পোর্টল্যান্ড পর্যন্ত ড্রাইভ করে এসে একটা হোটেলে রুম নিয়ে থেকে যাও। একটু ঘুমিয়ে-”
“জাড, এ রকম করা আমার পক্ষে সম্ভব?”
“একটু ঘুমিয়ে নাও। ভয়ের কিছু নেই রাচেল। এখানে হয়তো কছু একটা ঘটতে চলেছে, আবার সেটা নাও হতে পারে। আর যদি আমি যা ভাবছি তাই ঘটে তাহলে তোমার এখানে থাকা একদমই উচিত হবে না। আমি ব্যাপারটা দেখবো। এটা আমি দেখবো কারণ এর দায় আমারই। আর কিছু না হলে তুমি দুপুরের আগে দিয়ে চলে এসো তাতেও কোন সমস্যা নেই। আমার ধারনা লুইস তোমাকে দেখে খুব খুশিই হবে।”
“আমি আজ রাতে ঘুমোতে পারবো না, জাড।”
“পারবে,” জাড আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেন-হয়তো যে রাতে যিশুকে জেলে নেয়া হয়েছিল, পিটারও সেদিন একই রকম ভেবেছিল। পাহারারত অবস্থায় ঘুম। “হ্যা, তুমি পারবে। রাচেল, তুমি যদি গাড়ি চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়ে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাও তাহলে একবারও ভেবে দেখেছো এলি আর লুইসের কী হবে?”
“তাহলে আমাকে বলুন কী হচ্ছে এসব। যদি আমাকে সব খুলে বলেন তাহলে আমি হয়তো আপনার কথা শুনবো। কিন্তু আমার জানতে হবে!”
“লাডলোতে আসার পর তুমি তোমার বাসায় না গিয়ে সোজা আমার বাসায় চলে আসবে। আমি যা জানি তার সব তোমাকে খুলে বলবো রাচেল। আর আমি লুইসকে দেখে রাখবো।”
“না, এখুনি বলুন, প্লিজ,” রাচেল বলে।
“নো, ম্যাম। এই কথা ফোনে বলার কথা না। রাচেল, এটা সম্ভব না। তুমি আসো তারপর বলবো। তুমি এখন পোর্টল্যান্ডে এসে ঘুমিয়ে নাও।”
এরপর বেশ লম্বা একটা নীরবতা।
“আচ্ছা,” রাচেল বলে। “হয়তো আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু একটা কথা বলুন, ব্যাপারটা কতটুকু খারাপ?”
“ব্যাপারটা আমি সামলাতে পারবো,” জাড ঠান্ডা গলায় বলেন। “তবে কোন ব্যাপার ঠিক যত খারাপ হতে পারে, ব্যাপারটা ঠিক ততই খারাপ।”
বাইরে একটি গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখা যায়, ধীর গতিতে চলছে সেটি। জাড চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে সেটাকে ভালো করে দেখেন। এরপর সেটা লুইসের বাসার সামনে এসে গতি বাড়িয়ে চলে গেলে তিনি আবারো বসে পড়েন।
“আচ্ছা, ঠিক আছে,” রাচেল বলে। “বাকি রাস্তা ড্রাইভ করাও মাথার ওপর একটা মস্ত পাথর বলে মনে হচ্ছে।”
“পাথরটাকে গড়িয়ে যেতে দাও,” জাড বলেন। “প্লিজ, নিজেকে আগামীকালের জন্যে ঠিক রাখো। এখানে সব ঠিকঠাক থাকবে।”
“আপনি প্রমিজ করছেন আমি এলে সব বলবেন?”
“হ্যাঁ। বিয়ার খেতে খেতে তোমাকে সব কিছু পরিস্কার করে খুলে বলবো।”
“গুড বাই, তাহলে,” রাচেল বলে। “এখনকার জন্যে।”
“এখনকার জন্যে,” জাড সম্মতি জানান। “তোমার সাথে কাল দেখা হবে, রাচেল।”
রাচেলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি ফোনটা রেখে দিলেন।
.
তিনি ভেবেছিলেন কেবিনেটে ক্যাফেইন পিল আছে, কিন্তু তিনি খুঁজে পেলেন না। তিনি নিজেকে গাল দিতে দিতে বাকি বিয়ারগুলো ফ্রিজে তুলে রেখে এক মগ ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নিলেন। তিনি কফির মগ নিয়ে আবারো জানালার পাশে এসে আগের জায়গায় বসে পাহারা দিতে লাগলেন।
কফি এবং রাচেলের সাথে কথাবার্তা তাকে আরো পয়তাল্লিশ মিনিটের মত জাগিয়ে রাখে, কিন্তু এর পর তিনি আবারও ঢুলতে শুরু করেন।
পাহারায় বসে কিসের ঘুম, বুড়ো? যা হচ্ছে তার জন্যে তুমি দায়ি এবং এর মাশুলও তোমাকেই দিতে হবে। সুতরাং পাহারায় বসে কোন ঘুম নেই।
তিনি ফ্রেশ সিগারেট জ্বালিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে কাশতে শুরু করলেন। তিনি তার সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে রেখে দুহাত দিয়ে দুচোখ কচলাতে লাগেন। বাইরে একটা দশ চাকার ট্রাক রাস্তা আলোকিত করে রাতের বাতাস ফুরে দ্রুতবেগে এগিয়ে যায়।
তিনি আরেকবার ঘুমে ঢলে পড়ছেন টের পেয়ে নিজের দুই গালে হাতের এপিঠ ওপিঠ দিয়ে দুটো চড় মারলেন ঘুম তাড়াতে। চড় খেয়ে তার কান ভো ভো করছে। তার হৃদয়ে আতঙ্ক ঢুকে পড়েছে, গুপ্ত আততায়ীর মত।
জিনিসটা আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে…হিপনোটাইজ করছে… জিনিসটা চায় না আমি জেগে থাকি। কারণ ও কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে। হ্যা, আমি সেটা টের পাচ্ছি। এবং জিনিসটা চায় যাতে আমি তার পথে কোন বাধা সৃষ্টি করতে না পারি।
“না,” তিনি গম্ভীর হয়ে বলেন। “একদম না। শুনতে পাচ্ছিস? আমি এটা থামাবই। এমনিতেই বহুদূর জল গড়িয়েছে।”
চারদিকে বাতাস গর্জন করে ওঠে আর রাস্তার ওপাশের গাছগুলো যেন হিপনোটাইজ করার দোলকের ন্যায় দুলছে। তার মন আবারো ট্রেন ইঞ্জিনের সামনের সেই দিনে ফিরে যায়। তারা সারাটি রাত কথা বলে কাবার করে দিচ্ছিলেন; তিনি, জর্জ আর রেনে মিকাউড। তিন জনের মধ্যে এখন শুধু তিনি একাই টিকে আছেন। রেনে ১৯৩৯ এর মার্চে এক ঝড়ের রাতে দুটো গাড়ির মাঝখানে পিষ্ট হয়ে মারা যায় আর জর্জ গত বছর হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে। তার চেনাজানা অনেকের মধ্যেই সে একাই বেঁচে আছেন এবং এক বুড়ো বেকুবে পরিণত হয়েছেন। বেকুবের কাছে বেকুব মার্কা কাজগুলোকে প্রায়ই পরোপকার বলে মনে হয়, কখনো গৌরব বলে মনে হয়-প্রাচীন রহস্য বলে বাহবা নেয়া, সেটাকে আরো কারো কাছে পৌঁছে দেয়া, পুরনো গ্লাস থেকে জল নতুন গ্লাসে ঢেলে দেয়া…
ওই ইহুদি কী বলে শোন। “আমার কাছে এমন একটা জিনিস আছে যেটা তোমার বাপের জন্মেও দেখোনি। এই পোস্ট কার্ডগুলো, দেখে মনে হচ্ছে মেয়েগুলো সাঁতারের ছোট-খাটো পোশাক পড়ে আছে তাই না? কিন্তু এটাকে যদি ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুছে দাও, তাহলে গায়ের কাপড় সব উধাও হয়ে ওরা জন্মদিনের পোশাক পড়ে ফেলবে, চোখের-”
জাডের মাথা তার বুকের দিকে ঝুঁকে যায়।
“-চোখের নিমিষে। কিন্তু আবার কার্ডগুলো শুকিয়ে নিলেই ওদের গায়ের কাপড় ফিরে আসবে। শুধু তাই না। আমার কাছে আরো আছে—”
রেনে সামনের দিকে ঝুঁকে হেসে হেসে গল্প বলছে আর জাড বিয়ারের বোতল ধরে আছেন-তার মনে হলো বোতলটা তার হাতেই আছে এবং সেটা ধরার জন্যে তিনি বাতাসে হাত মুঠো করলেন।
অ্যাশট্রেতে সিগারেটটা জ্বলে জ্বলে শেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তাকে টানার কেউ নেই। জাড ঘুমিয়ে পড়েছেন।
আর চল্লিশ মিনিট পর যখন লুইসের গাড়ির পেছনের বাতি জ্বলে উঠলো এবং লুইস তার গাড়িটা নিয়ে ড্রাইভওয়ে দিয়ে গ্যারেজে ঢোকে, জাড কিছুই শুনলেন না, নড়লেন না বা জেগেও উঠলেন না; যেমনটা পিটারও টের পাননি, যখন রোমান সৈন্যরা যিশুকে ধরে নিয়ে যায়।
অধ্যায় ৫৩
লুইস কিচেনের ড্রয়ার থেকে আরেকটা নতুন টেপ নিয়ে সেটা দিয়ে কুঠার আর বেলচা ভালো করে একসাথে পেচিয়ে নেয়। এরপর গ্যারেজ থেকে একটা রশি নিয়ে যন্ত্রপাতিগুলো বেঁধে কাঁধে ঝুলিয়ে নেয়ার জন্য বেঁধে নেয়।
রশিতে ঝুলছে যন্ত্রপাতি। হাতে গেজ।
জিনিসগুলো সে তার পিঠে ঝুলিয়ে নেয়। এরপর গাড়ির কাছে গিয়ে দরজা খুলে ত্রিপলের বান্ডেলটা বের করে আনে। গেজ চার্চের চাইতে অনেক ভারি। ওকে নিয়ে মিকমেক গোরস্তানে যেতে গেলে হয়তো শেষের দিকে তাকে বুকে ভর দিয়ে দিয়ে যেতে হবে। আর এরপর তাকে সেই পাথুরে জায়গায় কবর খুঁড়তে হবে, কুঠার দিয়ে পাথরের গা থেকে ফুল্কি ছোটাতে ছোটাতে।
কিন্তু সে সব করবে। যেভাবেই হোক।
লুইস ক্রিড তার গ্যারাজ থেকে বেরিয়ে বাতি নেভানোর জন্যে থামে। সে সামান্য দূরে অন্ধকারের মধ্যেও পেট সেমেটারিতে যাওয়ার পথটা দেখতে পাচ্ছে। ছোট ছোট ঘাসে ঢাকা রাস্তাটা এক অদ্ভুত নরম উজ্জ্বলতায় অন্ধকারের মাঝেও বেশ বোঝা যাচ্ছে।
দমকা হাওয়া ওর চুলগুলোতে বিলি কেটে দিচ্ছে। হঠাৎ ছোটবেলার অন্ধকারের ভয় তাকে পেয়ে বসে। সে নিজেকে খুব অসহায়, দূর্বল ভাবার সাথে সাথে প্রচন্ড আতঙ্কিতও হয়ে পড়ে। সে কি আসলেই এই অন্ধকার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হাতে একটি লাশ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে? এই গভীর রাতে, একাকী?
এতো কিছু ভেবো না। এগিয়ে যাও।
লুইস হাঁটতে শুরু করে।
বিশ মিনিট পর সে যখন পেট সেমেটারিতে পৌঁছে, ওর হাত পা অবসাদে কাঁপছে। সে তার কোলে বান্ডেলটা নিয়ে মাটির ওপর বসে পড়ে। বিশ মিনিটের জন্যে বিশ্রাম নেয় সে, ঝিমুতে ঝিমুতে। তার ভয় ভয় ভাবটা কেটে গেছে। অবসাদ তার ভীতিকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে দুশ্চিন্তা করে যে সে আসলেই মরা গাছের ধ্বংসস্তুপটার ওপর উঠতে পারবে কি না। কিন্তু সে জানে যে তাকে চেষ্টা করতে হবে। তার হাতের চল্লিশ পাউন্ডের বান্ডেলটা এখন দুইশো পাউন্ড বলে মনে হচ্ছে।
কিন্তু আগে যেমনটা হয়েছিল, আবারো সেটাই ঘটলো। ব্যাপারটা অনেকটা পুরনো স্বপ্ন মনে করার মত…না, ঠিক মনে করার মত না, অনেকটা বাস্তবের মত অনুভব করার মত। তার মনে হয় কেউ তাকে ঠেলে ওপরে উঠিয়ে দিচ্ছে; ঠিক যেমন প্রথমবার মরা গাছের স্তুপে পা রাখার সময় অদ্ভুত অনুভূতিটা হয়েছিল। তার শরীর এখনো ক্লান্ত কিন্তু সেটা এখন খুব নগন্য বিষয় বলে মনে হচ্ছে।
শুধু আমাকে অনুসরণ করো। আমাকে অনুসরণ করো আর নিচের দিকে একদম তাকাবে না, লুইস। আগুপিছু করবে না আর নিচে তাকাবে না। আমি রাস্তা চিনি। তবে আমাদের খুব দ্রুত যেতে হবে।
দ্রুত এবং কোন কিছু না ভেবে, হ্যা- যেভাবে জাড গেজের গা থেকে মৌমাছির হুলটা টেনে তুলেছিলেন।
আমি রাস্তা চিনি।
কিন্তু যাওয়ার পথ একটাই। হয় সেটা তোমাকে যেতে দিবে, নয়তো দিবে না। আগে সে একবার নিজে নিজে এটার ওপর ওঠার চেষ্টা করে পারেনি কিন্তু এবার সে দ্রুত এবং কোন কিছু না ভেবে পা তুলে দিয়েছে, যেমনটা জাড তাকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
সে ওপরে উঠছে, নিচের দিকে একদমই না তাকিয়ে, হাতে নিজের ছেলের ত্রিপলের কাফনে মোড়া লাশ নিয়ে। একদম ওপরে উঠে গেলে আবারো বাতাস তার চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে শুরু করে।
একদম ওপরে এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়ায় সে এবং এরপরই নামতে শুরু করে, সিঁড়ি বেয়ে নামার মত করে। কুঠার আর বেলচাটা তার পিঠের সাথে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ধাতব শব্দ করছে। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যেই সে পাইনের সুচারু পাতা ভরা মাটিতে নেমে আসে। তার পেছনে গোরস্তানের সেই লোহার বেড়ার চাইতেও উঁচু ধ্বংসস্তূপটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
সে তার ছেলেকে নিয়ে পথ চলতে শুরু করে, গাছের ডাল-পালায় বাতাসের কান্না শুনতে শুনতে। শব্দটাকে তার আর একদমই ভয় লাগছে না। এই রাতের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
অধ্যায় ৫৪
রাচেল ক্রিড “বামে পোর্টল্যান্ড” লেখা একটা সাইনবোর্ড দেখে; কিছুটা সামনে গিয়ে বামে মোড় নিতে হবে পোর্টল্যান্ড যেতে চাইলে। সে রাস্তার পাশে আরেকটি সবুজ সাইন বোর্ড দেখে, হলিডে ইন মোটেলের। একটি বিছানা, ঘুম। এই অজানা, অসহনীয় টেনশন থেকে সাময়িক মুক্তি। এবং সাময়িক হলেও তার ছেলের তীব্র শোক থেকে রেহাই, যে ছেলে আর পৃথিবীতে নেই। তার মনে হচ্ছে এই শোকের যন্ত্রণা অনেকটা আক্কেল দাঁত তোলার মত। প্রথমে অবশ করার ইনজেকশনের প্রভাবে ব্যথা তেমন সুবিধে করতে পারে না, কিন্তু সেটা ধূর্ত বেড়ালের মত ঘাপটি মেরে থাকে হামলে পড়ার জন্যে। আর যখন ইনজেকশনের প্রভাব চলে যায়, ওব্বাবা, তুমি একদমই হতাশ হবে না।
লোকটা এলিকে বলেছে তাকে পাঠানো হয়েছে সতর্ক করার জন্যে… কিন্তু সে নিজে থেকে কিছু করতে পারবে না। লোকটা এলিকে বলেছে সে আর তার বাবা পাশাপাশি ছিল যখন তার আত্মা বের করে নেয়া হয়।
জাড জানেন, কিন্তু বলতে চাচ্ছেন না। কিছু একটা হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কি?
আত্মহত্যা? এটা কি আত্মহত্যা? লুইস এরকম করবে আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু ও মিথ্যা বলছিল তা দিনের আলোর মত পরিস্কার। সেটা ওর চোখ বলছিল… ধুর, শুধু চোখ না, পুরো চেহারাই এক কথা বলছিল…যেন ও চাইছিল আমি মিথ্যাটা ধরে ফেলি…এবং বাধা দেই…কারণ ওর একটা অংশ খুব ভয় পাচ্ছিল।
ভয়? লুইস তো কখনোই ভয় পায় না!
হঠাৎ সে গাড়ির স্টিয়ারিং কষে টেনে বামে ঘুরিয়ে দেয়। ছোট গাড়িটার টায়ার তীব্র আওয়াজ করে প্রতিবাদ জানায়। এক মুহূর্তের জন্যে ওর মনে হয়েছিল গাড়িটা বুঝি উল্টেই যাবে। কিন্তু সেরকম কিছু হয় না এবং ও হলিডে ইন পেছনে ফেলে পোর্টল্যান্ডের পথে চলতে থাকে। সামনে আরেকটা সাইনবোর্ড চোখে পড়ে তার, যেটায় চকচকে রঙে লেখা : জেরুজালেম লট। অদ্ভুত নাম, সে ভাবে। নামটা কেমন যেন…এসো, জেরুজালেমে ঘুমোতে এসো।
কিন্তু আজ রাতে ওর চোখে ঘুম নেই। জাডের কথায় সে আশ্বস্ত হতে পারছে না। সে একেবারে বাসায় চলে যেতে চাচ্ছে। জাড জানেন কী হচ্ছে এবং তিনি প্রতিজ্ঞাও করেছেন তিনি খারাপ কিছু ঘটতে দিবেন না। কিন্তু তিনি একজন আশি বছরের বৃদ্ধ এবং মাত্র তিন মাস আগে তিনি তার স্ত্রীকে হারিয়েছেন। ভরসা করার মত অবস্থা তার নেই। লুইস যে তাকে এভাবে এক প্রকার বাসা থেকে খেদিয়ে দিলো, সেটা মেনে নেয়া তার কোনভাবেই উচিত হয়নি। কিন্তু গেজের মৃত্যু তাকে দুর্বল করে দিয়েছে। এলির সেই ছবিটি সর্বদা সাথে নিয়ে ঘোরা, ছবিতে গেজ আর এলির নিষ্পাপ মুখ…রাতের অন্ধকারে ওর বারবার ইচ্ছে হয়েছে লুইসকে ঘৃণা করতে, তার ভেতরে এই বেদনার জন্ম দেয়ার জন্যে আর ওকে সান্ত্বনা না দেয়ার জন্যে (অথবা তার থেকে সান্ত্বনা না নেয়ার জন্যে, যেটা দেয়া রাচেলের খুব প্রয়োজন ছিল), কিন্তু ও পারেনি। সে এখনো লুইসকে প্রচন্ড ভালোবাসে, আর ওর মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল…কেমন নির্লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল…
গাড়ির স্পিড মিটারের কাটা ষাট মাইলের এর ঘর থেকে একটু ডানে সরে আছে। মিনিটে এক মাইল করে। আড়াই ঘন্টায় হয়তো লাডলো পৌঁছানো যাবে। হয়তো ও সূর্যাস্তের আগেই সেখানে পৌঁছে যাবে।
সে হাতড়ে হাতড়ে গাড়ির রেডিওটা চালু করলে একটা পোর্টল্যান্ডের রক এন্ড রোল স্টেশান খুঁজে পেল। ও ভলিউম বাড়িয়ে সাথে সাথে গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করে, ঘুম তাড়াবার জন্যে। পোর্টল্যান্ড থেকে দূরে চলে আসায় আধা ঘন্টা পর স্টেশনটা হারিয়ে যেতে শুরু করলে সে একটা অগাস্টা স্টেশনে ফিরে যায়। সে জানালার কাচ নামিয়ে দিয়ে বিরামহীন রাতের বাতাস তার গায়ে বইতে দেয়।
সে ভাবে, এই রাত কি কখনো শেষ হবে?
অধ্যায় ৫৫
লুইসের মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে। সে মাঝে মাঝেই নিচে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছে তার হাতে ত্রিপলের বান্ডেল নাকি সবুজ পলিথিনের ব্যাগ। তার মনে পড়ে যে, জাডের যেদিন চার্চকে কবর দেয়ার জন্যে তাকে এই পথে নিয়ে গিয়েছিলেন তার পরদিন ঘুম থেকে উঠে তার আগের রাতের ঘটনা তার কাছে কেমন ঘোলাটে হয়ে গিয়েছিল-কিন্তু তার এটাও মনে পড়ে যে সে রাতের অনুভূতিগুলো কতটা জীবন্ত ছিল, তার ইন্দ্রিয়গুলো কেমন তীক্ষ্ণ হয়ে গিয়েছিল, কিভাবে তার মনে হচ্ছিল যে তার ইন্দ্রিয়গুলো তার দেহ থেকে বেরিয়ে তাকে ঘিরে রেখেছিল আর আশেপাশের গাছ-পালাগুলোকে ছুঁয়ে দিয়ে যেন তাদের সাথে টেলিপেথিকভাবে যোগাযোগও করছিল।
সে পথ ধরে কখনো নিচে নামছে কখনো উপরে উঠছে। কোথাও পথটা রুট ১৫’র মত প্রশস্থ আবার কোথাও এতো সরু যে তাকে বান্ডেলটা লম্বালম্বি ভাবে নিতে হচ্ছে যাতে সেটা দুপাশের ঝোঁপঝাঁড়ের সাথে না বেজে যায়। সে পাইনের কষের গন্ধ পাচ্ছে এবং তার পায়ের নিচে পাইনের সুচারু পাতার মচমচ টের পাচ্ছে-যে অনুভূতিটা কানে শোনার চাইতে পায়ে বেশি অনুভব হচ্ছে।
অবশেষে বেশ কিছুক্ষণ যাবত পথটা আরো বেশি ঢালু হয়ে নিচের দিকে নামতে থাকে। এর কিছুক্ষণ পর তার এক পা অল্প পানির নিচের থকথকে কাদায় ফ্যাচ করে ডেবে যায়…চোরাবালি, যদি জাড ঠিক বলে থাকেন। লুইস নিচে তাকিয়ে চারদিকের অবস্থাটা দেখে নেয়। মাঝে মাঝে কিছু বিশ্রী রকম ঝোঁপঝাড়। ঝোঁপঝাড়ের পাতাগুলো এতো বড় বড় যে সেগুলো দেখে গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের উদ্ভিদ মনে হচ্ছে। তার মনে পড়ে সেদিন রাতেও কেমন একটা উজ্জ্বল আভা ছিল চারদিকে। কেমন যেন বৈদ্যুতিক।
সামনের জায়গাটাও ওই স্তুপটার মত-স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে হবে। আমাকে ফলো করো আর নিচে তাকাবে না।
আচ্ছা ঠিক আছে…আর হ্যা, এরকম গাছ এই এলাকায় আর কখনো দেখেছো? এই এলাকায় বা অন্য কোথাও? কি আজগুবি গাছ এগুলো?
বাদ দাও, লুইস…সামনে চলো।
সে শুধু প্রথম পা একটা ঘাসের স্তূপে ফেলার সময় নিচে তাকিয়ে দৃষ্টি ওপরে তুলে সামনের দিকে তাকায় এবং সাবলীল ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়। তার পা অভ্যস্থভাবেই একটার পর একটা ঘাসের আঁটির ওপর পড়ছে। বিশ্বাস হচ্ছে অভিকর্ষ বলকে সত্য বলে মেনে নেয়া, সে ভাবে; এই কথাটা সে কোন দর্শন বা ধর্ম লেকচারে শোনেনি, বরং তার হাই স্কুলের পদার্থ শিক্ষকের কাছ থেকে শুনেছিল একদিন ক্লাসের একদম শেষ মুহূর্তে…যেটা লুইস কখনো ভোলেনি 1
সে মেনে নিয়েছে মিকমেকদের গোরস্থানের মৃতকে পুণরুখান করার ক্ষমতা আছে এবং সেজন্যেই সে ঈশ্বরের জলা দিয়ে ছেলের লাশ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, নিচের দিকে বা পেছনে না তাকিয়ে। শরৎকালের শেষ সময় হওয়াতে এবার জায়গাটিতে শোরগোল তুলনামূলক বেশি। ঝোঁপের ভেতর থেকে অনবরত ঝিঁঝিঁর দল সমবেত সঙ্গিত গেয়ে যাচ্ছে, যেটা শুনে লুইসের মনে হচ্ছে তারা এখানে লুইসকে চায় না। একটা ব্যাঙ মাঝে মাঝে তার গলা সেধে যাচ্ছে। জলাতে বিশ কদম এগোনোর পর তার খুব কাছে দিয়ে কিছু একটা ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে চলে যায়…হয়তো কোন বাদুড় হবে।
মাটির ওপরে ভাসতে থাকা কুয়াশা তার চারদিকে ঘুরতে শুরু করে। ঘন কুয়াশায় প্রথমে তার জুতো অদৃশ্য হয়ে যায়, এরপর তার হাঁটু এবং অবশেষে কুয়াশা তাকে চারদিক থেকে ক্যাপসুলের মত ঘিরে ফেলে। তার মনে হচ্ছে আজকের আলোর আভাটা বেশি উজ্জ্বল, যেটা কোন অদ্ভুত হৃৎপিন্ডের পালসের মত দপদপ করছে। সে প্রকৃতির শক্তিগুলোকে কখনোই এরকম সমবেত রূপে দেখেনি, যেন এটা কোন সত্তা… সচেতন কোন সত্তা। জলাটা জীবিত। কিন্তু তাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় সেটা কি রকম তাহলে সে তা বর্ণনা করতে পারবে না। কিন্তু সে জানে জায়গাটা সম্ভাবনা এবং শক্তিতে ভরপুর। এর মাঝে লুইসের নিজেকে খুব অসহায় এবং ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে।
এরপর সে একটা শব্দ শুনতে পায়, যেটা সে আগেও শুনেছেঃ একটা অট্টহাসি, যেটা শেষে কান্নায় পরিণত হয়। কিছুক্ষণ নীরবতার পর হাসিটা আবারো শোনা গেল, এবার সেটা বাড়তে বাড়তে উন্মত্ত চিৎকারের মত শোনা যায় এবং আতঙ্কে লুইসের রক্ত জমাট বেঁধে যায়। কুয়াশা তার চারদিকে স্বপ্নের মত ঘুরছে। হাসিটা ফিকে হয়ে আসে, বাতাসে সেটার মৃদু গুঞ্জন শোনা গেলেও ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না। না, এটা অবশ্যই প্রকৃতির কোন খেলা। বাতাস বইলে তার চারপাশের কুয়াশার চাদর ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দিত…তবে লুইস নিশ্চিত না কুয়াশার ওপাশে যা আছে সে তা দেখতে চায় কি না।
তুমি হয়তো কিছু শব্দ শুনতে পাবে, মানুষের গলার মত। কিন্তু ওসব কিছু না। ওগুলো লুন হাঁসের ডাক, শুনতে মানুষের হাসির মত। হাসগুলো থাকে দক্ষিণে। কিন্তু এখানে শব্দ অনেক দূর ভেসে আসে। খুব মজার ব্যাপার।
“লুন হাঁস,” লুইস বলে এবং তার ভাঙা গলা দিয়ে বের হওয়া কর্কশ কন্ঠটা সে নিজেই ঠিক মত চিনতে পারে না। কিন্তু নিজেকে শুনে তার মনে হয়েছে সে কৌতুকের গলায় শব্দটা বলেছে। ওহ খোদা… তার গলাটা আসলেই কৌতুকপূর্ণ মনে হয়েছে।
সে একটু ইতস্তত করে আবারো সামনে এগোয়। তার এই সামান্য থেমে যাওয়ার শাস্তি হিসেবেই যেন তার এক পা ঘাসের গুচ্ছের ওপর না পড়ে কাদায় গিয়ে পড়ে এবং দেবে যায়। থকথকে কাদা থেকে পা টেনে বের করতে গিয়ে সে আরেকটু হলেই জুতোটা হারাতে বসেছিল।
কণ্ঠটা যদি সেটা তাই হয়ে থাকে আবারো ফিরে এলো, এবার তার বাম পাশ থেকে। মুহূর্ত পরে তার পেছন থেকে…একদম পেছন থেকে, তার মনে হচ্ছিল সে ঘাড় ঘুরালেই তার এক ফুট দূরে জ্বলজ্বলে চোখ আর চকচকে দাঁত সম্বলিত কোন রক্তে মাখা জিনিস দেখতে পাবে…কিন্তু লুইস এবার একটুও গতি কমায় না। সে একদম সোজা সামনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগলো।
হঠাৎ করেই তার চারদিকের কুয়াশার আভাটা কমে যায় এবং সে বুঝতে পারে যে সামনে বাতাসে একটি মুখমন্ডল ভাসছে, যেটির চোখে কটাক্ষের দৃষ্টি এবং মুখ দিয়ে আবোল তাবোল কিছু বলছে। মুখমন্ডলটির চোখগুলো চাইনিজ পেইন্টিংয়ের মানুষের চোখগুলো যেমন ওপরের দিকে তীর্যকভাবে টেনে দেয়া হয় সেরকম। কালচে-হলুদ চোখগুলো যেন জ্বলজ্বল করছে। মুখে একটা বাঁকা হাসি আর নিচের ঠোঁটটা বাইরের দিকে বেরিয়ে এসেছে এবং এতে করে মুখের কালচে-বাদামি দাঁতগুলো বেরিয়ে পরেছে যেগুলো ক্ষয় হতে হতে একদম বেদানার দানার মত হয়ে এসেছে। কিন্তু লুইসের সবচাইতে অবাক লাগে জিনিসটার কান দুটো, যেগুলো আসলে কান না বরং পেঁচানো শিং…শিংগুলো শয়তানের শিংয়ের মত নয়। শয়তানের শিং হয় ছাগলের শিং এর মত। এই শিংগুলো ভেড়ার শিংয়ের মত ভেতরের দিকে পেঁচানো।
ভেসে থাকা ভয়ঙ্কর মাথাটা যেন কথা বলছে-হাসছে। এর ঠোঁটগুলো নড়ছে কিন্তু বাইরে ঝুলে থাকা নিচের ঠোঁটটি কখনোই স্বাভাবিক অবস্থায় গেল না। জিনিসটির নাক দিয়ে শ্বাস- প্রশ্বাসের সাথে সাথে বাষ্প বেরুচ্ছে।
লুইস সামনে এগুতে থাকে এবং এক পর্যায়ে জিনিসটা জিভ বের করে দেয়। জিভটা লম্বা এবং সুচারু, নোংরা হলুদ রংয়ের। জিভের গায়ে মাছের মত আঁশ এবং হঠাৎ একটি আঁশ ম্যানহোলের ঢাকনার মত উঠে আসে এবং সেখান থেকে একটি কৃমি কিলবিল করে বেরিয়ে আসে। জিনিসটার কন্ঠমনি যেখানে থাকার কথা, জিভটা ওই পর্যন্ত ঝুলে লিক লিক করছে… জিনিসটা হাসছে।
লুইস গেজকে তার বুকের সাথে চেপে ধরে, ওকে রক্ষা করার ভঙ্গিতে। ওর পা কেঁপে যায় এবং তার পা পাতলা ঘাসে পিছলে যেতে শুরু করে।
তোমার সেইন্ট এলমোর আগুন চোখে পড়তে পারে, যেটাকে নাবিকরা ফু-লাইট বলতো। এটা অদ্ভুত অদ্ভুত আকার আকৃতি তৈরি করে, কিন্তু এটা আসলে ইলেক্ট্রিকাল চার্জের খেলা ছাড়া কিছুই না। যদি এরকম কোন অদ্ভুত কিছু তোমার চোখে পড়লে ভয় লাগে, তাহলে অন্যদিকে তাকাবে।
জাডের কন্ঠ তাকে এই বিপদ থেকে উত্তরণের পথ বাতলে দেয়। সে আবারো সোজা সামনের দিকে হটতে শুরু করে, প্রথমে একটু ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে এবং একটু পরই সে নিজের ভারসাম্য খুঁজে পায়। সে অন্যদিকে তাকায়নি কিন্তু এটা বুঝতে পারে যে মুখটা যদি জিনিসটা আসলেই কুয়াশা এবং তার মনের কারসাজি না হয়ে থাকে সবসময় তার থেকে সমান দূরত্ব রেখে চলছে। এবং কয়েক সেকেন্ড বা মিনিট পরে মুখটা স্রেফ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
এই জিনিস সেইন্ট এলমোর আগুন না।
না, অবশ্যই না। জায়গাটা নানান রকম প্রেতাত্মা দিয়ে ভরপুর; এক কথায় গিজগিজ করছে। এখানে কেউ তার মাথা ঘুরালেই হয়তো এমন জিনিস দেখতে পাবে যাতে তার মাথার তার ছিঁড়ে কয়েক হাজার টুকরো হয়ে যাবে। সে এসব নিয়ে ভাববে না। এসব নিয়ে ভাবার কোন প্রয়োজন নেই। কোন প্রয়োজন নেই-
কিছু একটা আসছে।
লুইস একদম ঠায় দাঁড়িয়ে যায় আর কান পেতে শব্দটা শুনতে থাকে…অপ্রতিরোধ্য কিছুর এগিয়ে আসার শব্দ। তার মুখ একদম মরা মাছের মুখের মত হা হয়ে যায়, যেন তার মুখ বন্ধ রাখার পেশিগুলো স্রেফ অকেজো হয়ে গেছে।
এরকম শব্দ সে আগে কখনোই শোনেনি—জীবন্ত এবং দানবাকৃতির কিছু। শব্দটা আরো কাছিয়ে আসছে, সাথে সাথে ডালপালা ভাঙার নিকট থেকে নিকটতর শব্দও দ্রুত এগিয়ে আসছে। সেই বিশাল আকৃতির পায়ের তলায় একটা ঝোঁপের দুমড়ে মুচড়ে যাওয়ার শব্দ হলো। লুইসের পায়ের নিচের জেলির মত মাটি একই সুরে কেঁপে কেঁপে উঠছে। সে বুঝতে পারে যে সে গোঙাচ্ছে (ওহ খোদা! ও আমার খোদা! কুয়াশার মধ্যে দিয়ে এটা কি আসছে) এবং আবারো গেজকে নিজের বুকে চেপে ধরেছে; সে টের পায় যে আশেপাশের ঝিঁঝিঁ পোকাগুলো একদম চুপ করে গেছে; সে আরো টের পায় চারদিকের বাতাসে একটা জঘন্য, অপবিত্র, কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে যার গন্ধ পচা শুয়োরের মাংসের মত।
জিনিসটা যাই হোক, জিনিসটা দানবীয় কিছু।
লুইসের আতঙ্কিত চেহারা একটু একটু ওপরের দিকে উঠতে থাকে, যেন সে কোন সদ্য উড্ডয়ন হওয়া রকেটকে অনুসরণ করছে। জিনিসটা চারদিক কাঁপিয়ে তার দিকেই ধেয়ে আসছে, এবং কাছেই একটা গাছ উপড়ে পড়ার বিকট মটমট শব্দ হয়-একটা আস্ত গাছ, শুধু একটা ডাল নয়।
লুইস কিছু একটা দেখতে পায়।
চারদিকের কুয়াশা সামান্য এক পলকের জন্যে কিছুটা ধূসর হয়ে আসে এবং সে দেখতে পায় জিনিসটির কোন নির্দিষ্ট আকার বা আকৃতি নেই, কিন্তু জিনিসটি কমসে কম ষাট ফিট উঁচু হবে। জিনিসটা কোন স্রেফ চোখের ভেল্কি বা অশরীরী কিছু না; দানবীয় জিনিসটা চলাচল করার সাথে যে বাতাসের ঝাপটার সৃষ্টি হয়েছে সেটা সে খুব ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছে।
এক মুহূর্তের জন্যে তার মনে হয় সে তার ওপরে দুটো কমলা-হলুদ রংয়ের আলোর গোলা দেখতে পেয়েছে, যেগুলো দেখতে চোখের মত।
এরপর শব্দটা ফিকে হয়ে যেতে আরম্ভ করে। শব্দটা চলে যেতে থাকলে একটা ঝিঁঝিঁ বিব্রত ভঙ্গিতে ডেকে ওঠে। এরপর তাকে জবাব দেয় দ্বিতীয় একটি ঝিঁঝিঁ। তাদের আলাপে যোগ দেয় তৃতীয় আরেকটি ঝিঁঝিঁ; এরপর চার নাম্বার ঝিঁঝিঁ তাদের সাথে আড্ডা জুড়ে দেয়; এরপর পঞ্চম এবং ষষ্ঠ ঝিঁঝিঁ মিলে ঝিঁঝিঁদের সমবেত সঙ্গিত আরম্ভ করে। জিনিসটার চলাচলের শব্দ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসতে থাকে…আরো কমে…এবং এক সময় আর শোনা যায় না।
অবশেষে লুইস আবারো চলতে শুরু করে। তার পিঠ এবং কাঁধ ব্যথায় টনটন করছে। সে এতো ঘেমেছে যে তার মনে হচ্ছে সে গলা থেকে হাঁটু পর্যন্ত ঘামের আন্ডারওয়্যার পড়ে আছে। এই মৌসুমে জন্ম নেয়া ক্ষুধার্ত মশাগুলো তাকে নাস্তা বানিয়ে খাচ্ছে।
ওহ খোদা! এটাই সেই উইন্ডিগো—যেটা দেশের উত্তরাঞ্চলে দাপিয়ে বেড়ায়, যেটা স্পর্শ করলে মানুষ মানুষখেকো হয়ে যায়। এটাই সেই জিনিস। জিনিসটা আমার ষাট গজের মধ্যে চলে এসেছিল।
সে নিজেকে বোকার মত চিন্তা করতে নিষেধ করে। তাকে হতে হবে জাডের মত আর পেট সেমেটারির পরের জঙ্গলে যা দেখবে সেগুলো নিয়ে বেশি ভাববে না—এগুলো হচ্ছে লুন হাঁস, সেইন্ট এলমোর আগুন আর নিউ ইয়র্ক বুলপেনের সদস্য। এগুলো আর যাই হোক জঙ্গলে ছোঁকছোঁক করতে থাকা কোন প্রেত না। পৃথিবীতে আছে ঈশ্বর, ঈশ্বরের প্রার্থনার জন্যে রবিবার দিন, আছে তার প্রার্থনাকারী শুভ্র পোশাকধারী যাজকেরা…আর রাতের আঁধারে বিচরণ করতে থাকা প্রেত বা পিশাচ বলে কিছু নেই।
লুইস তার ছেলেকে নিয়ে হাঁটতে থাকে এবং এক সময় তার পায়ের নিচের মাটি শক্ত হতে আরম্ভ করে। আরেকটু সামনে এগিয়ে সে একটা উপড়ে পড়া গাছ দেখতে পায়, যেটি দেখে মনে হচ্ছে গাছটা আসলে কোন দৈত্যের ফেলে দেয়া সবুজ পালকের ঝাড়ু।
গাছের গোড়াটা ভেঙে একদম চৌচির হয়ে গেছে। আর ভাঙা অংশটি এতো টাটকা যে সেটির ভাঙা জায়গাগুলো দিয়ে এখনো কষ বেরুচ্ছে। গাছটা তার পথের ওপর পড়েছে। লুইস পড়ে থাকা গাছটার ওপরে উঠলে তার হাতে সেই কষ লাগে, যেটা এখনো উষ্ণ। আর গাছের ওপাশে ছিল একটা গর্তের মত যেটা থেকে বের হওয়ার জন্যে তার দু-হাতের সাহায্য লাগে। যদিও গর্তের তলায় ঝোঁপঝাড়গুলো একদম চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। সে এটাকে কোন পায়ের ছাপ বলে মেনে নিতে নিজেকে সুযোগ দিবে না। সে হয়তো চারদিকে তাকিয়ে দেখতে পারতো এরকম গর্ত আরো আছে কি না, কিন্তু সে নিজেকে সেই অনুমতি দেয় না। সে শুধু হেঁটে গেল, তার গায়ের চামড়া ঠান্ডা হয়ে এসেছে, মুখটা এখনো গরম আর হৃদয়টা উড়ে বেড়াচ্ছে।
তার পায়ের নিচের মাটির ফ্যাচফ্যাচ কমে এসেছে। কিছুক্ষণের জন্যে সে নিজের পায়ের নিচে পাইনের সুচারু পাতার মচমচ শুনতে পায় এবং তার পরেই মাটি পাথুরে হতে আরম্ভ করে। সে তার গন্তব্যের খুব কাছে চলে এসেছে।
ভূমি দ্রুত ওপরের দিকে খাড়া হয়ে উঠে যাচ্ছে। একটা মাথা বের করে থাকা পাথরে তার হাঁটুর নিচের হাড় যন্ত্রণাদায়কভাবে ধাক্কা খায়। কিন্তু সেটা সাধারন কোন পাথর না। লুইস তার এক হাত নিচে নামিয়ে সেটা স্পর্শ করে এবং এতে তার অসাড় হয়ে যাওয়া কনুই যন্ত্রনায় চিৎকার করে ওঠে।
এখান থেকে পাথরে কাটা সিঁড়ি। শ্রেফ আমাকে অনুসরণ করো। এটার ওপরে উঠলেই আমরা গন্তব্যে পৌঁছে যাব।
সে ধাপগুলো দিয়ে উঠতে আরম্ভ করে এবং তার মাঝে আবারও ক্লান্তিকে পরাজিত করে উত্তেজনা ফিরে আসে…কিছুটা হলেও। সে ওপরে ওঠার সাথে সাথে বিরামহীন বাতাসের রাজ্যে প্রবেশ করতে থাকে। সে মনে মনে ধাপের সংখ্যার হিসেব রাখছে। শক্তিশালী বাতাস তার গা থেকে তার জামা খুলে নিতে চাচ্ছে, গেজের লাশ মোড়ানো ত্রিপলটা বাতাসের তোড়ে ফটফট করে শব্দ করেই চলছে, অনেকটা নৌকার পালের মত।
মাথা পেছনে নিয়ে আকাশে তারকারাজির বিস্তৃত বিন্যাসের দিকে তাকায়। সে তারাদের মাঝে চেনা কোন বিন্যাস দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে নিচের দিকে তাকায়। এর পাশেই পাথরের দেয়ালটা। দেয়ালটা একদমই মসৃণ নয় বরং খুবই এবড়ো থেবড়ো, ঝুরঝুরে এবং সেটার সর্বাঙ্গ দিয়ে ছোট ছোট পাথর বেরিয়ে আসছে। কোথাও সেটাকে নৌকার মত লাগে, কোথাও লাগে চোখ মুখ সহ মানুষের মাথার মত। শুধু ধাপগুলো পাথর কেটে বানানো হওয়ায় সেগুলো বেশ মসৃণ।
লুইস একদম ওপরে পৌঁছে মাথা নিচু করে দাঁড়ায়। সে দুলে দুলে কাঁদছে এবং ফোঁপাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে তার বুকে কেউ শেল বিধিয়ে দিয়েছে।
বাতাস তার চুল নাচাচ্ছে আর কানের সামনে ড্রাগনের মত গর্জন করছে। আজ জায়গাটিকে বেশি আলোকিত মনে হচ্ছে। আগের দিন কি আকাশ মেঘলা ছিল? নাকি সে ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি? যাই হোক, তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু সে দেখতে পাচ্ছে এবং তাতেই তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শিহরণ মাথা থেকে নিচে নেমে যায়।
একদম পেট সেমেটারির মত।
তুমি এটা ঠিকই জানতে, সে চারদিকের পাথরের ছোট ছোট স্তুপগুলো পর্যবেক্ষণ করতে থাকলে তার মন তাকে ফিসফিস করে বলে। স্তুপগুলো এক সময় পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ ছিল। তুমি জানতে, অথবা তোমার জানা উচিত ছিল যে-এগুলো একই বিন্দুতে মিলিত বৃত্ত নয়, এগুলো স্পাইরাল…
হ্যাঁ। এই পাথুরে ছাদের ওপরে একটা বিশাল স্পাইরাল, যেটার সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন মানুষের হাতে। কিন্তু এখন কোন পাথরের স্তম্ভ অবশিষ্ট নেই। লুইস দেখে কবর দেয়া লাশগুলো প্রাণ ফিরে পেয়ে মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসার ফলে প্রতিটি স্তম্ভই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। কিন্তু তার পরেও পাথরের স্তূপগুলো এমনভাবে পড়ে আছে সেগুলোর সমন্বয়ে তৈরি স্পাইরাল শেপটা বেশ বোঝা যাচ্ছে।
কেউ কি এটা আকাশ থেকে দেখেনি? লুইস অবাক হয়ে ভাবে। তার মনে পড়ে যায় সেসব ড্রয়িংয়ের কথা, যেগুলো কোন এক ইন্ডিয়ান গোত্র দক্ষিণ আমেরিকার মরুভূমির বুকে তৈরি করেছিল। কেউ কি আকাশ থেকে এসব দেখেনি? আমার প্রশ্ন হচ্ছে দেখে থাকলে ওরা এটাকে ভেবেছেটা কি?
সে হাঁটু গেড়ে বসে গেজের লাশটা মাটিতে রেখে ঘোঁৎ করে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ে।
অবশেষে তার ভেতর সম্বিত ফিরে আসতে শুরু করেছে। সে তার পকেট নাইফ দিয়ে পিঠে ঝুলিয়ে রাখা কুঠার আর বেলচার টেপটা কেটে দেয়। সেগুলো ধাতব শব্দ করে মাটিতে পড়ে। লুইস দুহাত ঈগল পাখির মত দুদিকে ছড়িয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। সে শূন্য দৃষ্টিতে আকাশের তারার দিকে চেয়ে থাকে।
জঙ্গলে জিনিসটা কী ছিল? লুইস, লুইস, যে নাটকের চরিত্রগুলোর মধ্যে ওই জিনিসটা আছে, সেই নাটকের সমাপ্তি কি ভালো কিছুতে হতে পারে?
কিন্তু এখন ফিরে যাওয়ার জন্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে এবং সে নিজেও সেটা জানে।
তাছাড়া, সে নিজেকে বোঝায়, ভালো কিছু হলেও তো হতে পারে; ঝুঁকি নেয়া ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না; আবার হয়তো ভালোবাসা ছাড়াও ঝুঁকি নেয়া যায় না। আর আমার সেই ব্যাগটা তো আছেই, নিচতলারটা না, বাথরুমের শেলফের ব্যাগটা, যেটা আনার জন্যে আমি জাডকে পাঠিয়েছিলাম নরমার হার্ট অ্যাটাক করার রাতে। সেখানে সিরিঞ্জ আছে, আর যদি কিছু হয়…খারাপ কিছু…তাহলে আমি ছাড়া অন্য কারো সেটা জানার প্রয়োজনও পড়বে না।
তার হাত যখন কুঠারের হাতল হাতড়াচ্ছে, তার চিন্তাগুলো প্রার্থনার গুনগুনের মত তার মাথায় বাজতে থাকে। সে হাঁটু গেড়ে বসে থাকা অবস্থায়ই কুঠার দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে শুরু করে। প্রত্যেকবার কোপ দেয়ার পরই সে ক্লান্তিতে কুঠারের হাতলের ওপর পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ধীরে ধীরে গর্তটা বড় হতে থাকে এবং তার কাঙ্ক্ষিত আকার ধারণ করতে থাকে। সে হাতড়ে হাতড়ে গর্তের পাথরগুলো একপাশে স্তূপের মত করে সরিয়ে রাখছে। কিন্তু কিছু পাথর সে আলাদা করে রাখে।
পাথরের স্তম্ভ বানানোর জন্যে।
অধ্যায় ৫৬
রাচেল নিজের গালগুলো চড় মেরে মেরে জ্বালিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তার পরও সে ঝিমুচ্ছে। সে এখন পিটসফিল্ডে এবং মহাসড়কে তার গাড়ি ছাড়া আর কোন গাড়ি নেই। হঠাৎ তার মনে হয় ডজনখানেক রুপালি চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে এবং ক্ষুধার্ত আগুনের মত লক লক করছে।
সেগুলো আস্তে আস্তে নিজেদের রাস্তার সীমানার ছোট ছোট থামের গায়ে আলোর প্রতিফলন হিসেবে নিজেদের জানান দেয়। গাড়িটা থামগুলোর একদম গা ঘেষে চলছে, সামান্য বাঁয়ে দিয়ে।
রাচেল সম্বিত ফিরে পেয়ে ঝটকা দিয়ে স্টিয়ারিংটা বামে ঘুরিয়ে দেয়। টায়ারের তীক্ষ্ণ কান্নার সাথে সাথে ও একটা চাপা ধাতব শব্দও শুনতে পায়! খুব সম্ভবত গাড়িটার সামনের বাম্পারের ডান দিকটা রাস্তার সীমানার কোন এক থামে আলতো চুমু খেয়েছে। তার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে গলার কাছে চলে যায় এবং তার বুকে এমনভাবে হাতুড়ি পেটাতে থাকে যে সে চোখে কিছু আজব আকৃতি দেখতে থাকে এবং সেই আকৃতিগুলোও বিটের তালে তালে ছোট হচ্ছে, আবার বড় হচ্ছে। এই আতঙ্ক এবং একটুর জন্যে বেঁচে যাওয়ার অনুভূতি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। এতো কিছুর পরও কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই ও আবারো ঝিমুতে শুরু করে, যদিও রেডিওতে রবার্ট গর্ডন চিৎকার করে “Red Hot” গানটা গেয়ে যাচ্ছে।
একটা ভীতিকর চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খায়। “ভীতিকর, তা ঠিক, সে রক এন্ড রোলের মাঝে বিড়বিড় করে বলে। ও হাসার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। কারণ চিন্তাটা এখনো যায়নি এবং এই অন্ধকার ভূতুরে রাতে চিন্তাটাকে কিছুটা বাস্তব বলে মনে হচ্ছে। তার নিজেকে একটা কার্টুনের চরিত্র বলে মনে হচ্ছে, যে একটা মস্ত গুলতির রাবার ঠেলে দৌড়াতে চেষ্টা করছে। দৌড়াতে দৌড়াতে রাবারটা লম্বা হতে থাকে এবং একসময় তার শক্তি আর রাবারে জমা হওয়া বিভব শক্তি সমান হয়ে যায়… বস্তুর জড়তার ফলে…কি?…সাধারণ পদার্থবিদ্যা…কিছু ওকেও পেছনে টেনে ধরে রাখতে চেষ্টা করছে…নাক গলাবে না, তোমাকেই বলছি…স্থির বস্তু তার স্থিতি বজায় রাখতে চেষ্টা করে…উদাহরণস্বরুপ, গেজের লাশ…একবার তাতে গতির সঞ্চার করে দিলে…..
এবারের গাড়ির টায়ারের চিৎকার আগেরবারের চাইতেও বিকট হয়ে শোনা যায়; কয়েক মুহূর্তের জন্যে গাড়িটা রাস্তার সীমানার থামের বেড়াতে ঘষতে ঘষতে তীব্র ধাতব ক্যাচক্যাচ শব্দ করতে করতে এগিয়ে যায়। কিছুক্ষণের জন্যে গাড়িটা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। গাড়িটা থমকে দাঁড়ালে রাচেল ব্রেকে পা দিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। এবার সে ঝিমুচ্ছিল না, একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছিল, গাড়ি ষাট মাইল বেগে চলতে থাকা অবস্থায়। তার ভাগ্য খুব ভালো যে সে এখনো অক্ষত আছে। যদি রাস্তার সীমানার বেড়া না থাকতো বা যদি…
সে গাড়িটা রাস্তার পাশে পার্ক করে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করে। সে হতভম্ব এবং আতঙ্কিত।
কিছু একটা আমকে ওর থেকে দূরে রাখতে চাইছে।
যখন ওর মনে হয় ও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে, ও আবারো গাড়ি চালাতে শুরু করে।
গাড়ির নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কোন ক্ষতি হয়নি। তবে কাল গাড়িটা ফেরত দিতে গেলে যে অনেকগুলো কড়া প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে ও তা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে।
বাদ দাও। সেটা পরে দেখা যাবে। আগে আমার ভেতরে কিছু কফি ঢালা লাগবে-এটাই আপাতত প্ৰথম কাজ।
মাইল খানেক ড্রাইভ করার পর ও একটা লম্বা সোডিয়াম লাইটের সাইন দেখতে পায় এবং ডিজেল ইঞ্জিনের বিরতিহীন গুঞ্জন শুনতে পায়। সে রেস্টুরেন্টের সাথে লাগোয়া ফিলিং স্টেশান থেকে গাড়িটায় তেল ভরে নেয়। “গাড়িটার এই পাশটাকে তো একদম ধর্ষণ করে দিয়েছে কেউ,” তেল দিতে দিতে ফিলিং স্টেশনের লোকটা বলে। এরপর ও গাড়িটা পার্ক করে ডাইনারে ঢুকলে ওর নাকে বেশ কয়েক রকম ঘ্রাণ আসে চর্বি ওয়ালা মাংস রাইয়ের, ডিমের ওমলেট…এবং ফ্রেশ পবিত্র কফির সুঘ্রাণ।
রাচেল এক এক করে তিন কাপ কফি গলায় ঢেলে দেয়, অনেকটা ওষুধের মত-কালো এবং কড়া মিষ্টি। ডাইনারের এক কোণে কিছু ট্রাক ড্রাইভার মিলে ওয়েট্রেসদের সাথে ঠাট্টা মশকরা করছে। ফ্লুরোসেন্ট বাতির আলোয় ওয়েট্রেসদেরকে ক্লান্ত নার্সদের মত লাগছে, যারা অনেক অনেক দুঃসংবাদ বয়ে বেড়াচ্ছে।
রাচেল তার বিল পরিশোধ করে গাড়ির কাছে ফিরে যায়। কিন্তু গাড়িটা চালু হতে চায় না। চাবি ঘোরালে গাড়িটা শুধু হালকা করে কাশছে।
রাচেল স্টিয়ারিং হুইলে দুর্বলভাবে ঘুসি মারতে থাকে। কিছু একটা তাকে থামাতে চাইছে। এই গাড়িটা প্রায় নতুন। সব মিলিয়ে গাড়ির অডোমিটারে পাঁচ হাজার মাইল হবে। এটার এভাবে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু তার পরেও সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। আর সে তার বাড়ি থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে পিটসফিল্ডে আটকা পড়েছে।
সে ট্রাকগুলোর বিরতিহীন গুঞ্জন শুনতে থাকে। তার হঠাৎ করে মনে হয়, যেই ট্রাকটা গেজকে হত্যা করেছে সেটা এই ট্রাকগুলোর মধ্যেই আছে।
রাচেল তার মাথা নুইয়ে কাঁদতে শুরু করে।
অধ্যায় ৫৭
লুইস কিছুতে পা হড়কে একেবারে ভূপাতিত হয়। তার মনে হচ্ছে সে আর উঠতে পারবে না—ওঠে দাঁড়ানো তার সাধ্যের বাইরে। তাকে এখানেই শুয়ে শুয়ে পেছনের ঈশ্বরের জলার ঝিঁঝিঁদের সমবেত সঙ্গিত শুনতে হবে এবং তার শরীরের অসংখ্য স্থানের সমবেত ব্যথা সইতে হবে। সে এখানেই শুয়ে থাকবে যতক্ষণ না সে ঘুমিয়ে পড়ে। বা মরে যায়। সম্ভবত সে মরেই যাবে।
তার মনে আছে সে তার খোঁড়া গর্তে ত্রিপলের বান্ডেলটা রেখে গর্তটা খুঁড়ে তোলা পাথুরে মাটি দিয়ে নিজ হাতে ঢেকে দিয়েছে। এরপর ভরে ফেলা গর্তটার গায়ে একটার ওপর একটা পাথর রেখে রেখে স্তম্ভ তৈরি করেছে, যেটার গোড়ার দিকে মোটা আর ওপরের দিকে চিকন। এটুকু তার মনে আছে…
এরপর কী হয়েছে সে তেমন মনে করতে পারছে না। তাকে অবশ্যই সিঁড়ির ধাপগুলো ভেঙে নামতে হয়েছে, সেটা নাহলে তার এখানে থাকা সম্ভব হতো না…সে এখন আছেটা কই? সে আশেপাশে তাকিয়ে পাইন গাছের জঙ্গল দেখে যদ্দূর বুঝলো সে পেট সেমেটারির মরা গাছের ধ্বংসস্তূপটার কাছে চলে এসেছে। সে কি এমনি এমনি হাঁটতে হাঁটতেই ঈশ্বরের জলা পেরিয়ে এসেছে? হয়তো তাও সম্ভব। হয়তো।
এই জায়গাটা ভালোই দূরে আছে। এখানেই ঘুম দেই।
কিন্তু নিজেকে দেয়া মিথ্যা আশ্বাসটাই যেন তাকে নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দেয় এবং সামনে চলার শক্তি যুগিয়ে দেয়। কারণ সে যদি এখানে থাকে তাহলে হয়তো ওই জিনিসটা ওকে ধরে ফেলবে… হয়তো জিনিসটা এখনো জঙ্গলেই আছে আর তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
দু হাতের তালু দিয়ে নিজের মুখটা ঘষতে থাকে সে এবং এক হাতে রক্ত দেখে অবাক হয়। কোন এক সময় সে তার নাক ফাটিয়ে ফেলেছে। “তাতে কী বাল হয়েছে?” সে কর্কশ গলায় বিড়বিড় করে এবং চারদিকে হাতড়াতে থাকে যতক্ষণ না কুঠার আর বেলচাটা পায়।
মিনিট দশেক পরে সে সামনে মরা গাছের ধ্বংসস্তূপটা দেখতে পায়। লুইস সেটায় চড়ে বসে এবং বেশ কয়েকবার একদম ভূপাতিত হতে হতে শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নেয়। সে প্রায় নিচে নেমে আসে। সে তার পায়ের দিকে তাকায় এবং সাথে সাথেই একটা ডাল ভেঙে যায় (নিচে তাকিও না, জাড বলেছিলেন)। এরপর আরেকটা ডাল নিচ থেকে সরে যায় এবং সে ধপাস করে মাটির ওপরে গিয়ে পড়ে।
আজ রাতে এই নিয়ে দুটা গোরস্তানে আমি পড়ে গেছি। আর দুবারই যথেষ্ট!
সে আবারো হাতড়ে হাতড়ে তার বেলচা আর কুঠারটা খুঁজে বের করে। এরপর একটু থেমে সে চারদিকে ভালো করে দেখে। তার পাশেই স্মাকি র কবর। খুবই অনুগত ছিল সে, লুইসের ক্লান্ত মন ভাবে। এর একটু পরেই ট্রিক্সি, কিল্ট অন দ্য হাইওয়ে। বাতাস এখনো বেশ জোরেই বইছে এবং সে একটা চাপা ধাতব টিং-টিং শব্দ শুনতে পায়। হয়তো কোন মৃত পোষা প্রাণীর শোকাতুর মালিক তার বাবার যন্ত্রপাতি দিয়ে টিনের কৌটো কেটে সেটিকে পিটিয়ে সোজা করে একটা লাঠির সাথে পেরেক মেরে লাগিয়ে দিয়েছে। শব্দটা তার মধ্যে আবারো ভয় ঢুকিয়ে দেয়। সে অত্যধিক ক্লান্ত। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে একটা অসুস্থ পালস বিটের মত মনে হচ্ছিল। সে কাজটা করে ফেলেছে। আর সেই টিং টিং শব্দটা যেন তাকে সেটা জানান দিতেই ঘন্টার মত অনবরত বেজে চলছে।
সে পেট সেমেটারির ভেতর দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। সে ‘মার্তা আমাদের প্রিয় খোরসগোশ’-এর কবরটা পেরিয়ে যায়, যে ১৯৬৫’র পহেলা মার্চ মারা গেছে। পলিনেশিয়া’র শেষ বিশ্রামস্থলটা ডিঙিয়ে যায়। ধাতব টিং টিং শব্দটা এখন আরো জোরালোভাবে শোনা যাচ্ছে। থেমে নিচে তাকায় সে। তারার আলোয় ঢলে পড়া খুঁটির সাথে লাগানো আয়তাকার টিনের গায়ের লেখাটা পড়ে। রিঙ্গো আমাদের প্রিয় ইঁদুর, ১৯৬৪-১৯৬৫। এই টিনটাই বার বার পেট সেমেটারির প্রথম বৃত্তের আরেকটা বোর্ডের সাথে বাড়ি খাচ্ছে আর টিং- টিং আওয়াজ করছে। সে টিনটা বাঁকা করে দেয়ার জন্যে নিচু হয়…এবং এরপর আতঙ্কে জমে যায়।
কিছু একটা নড়ছে। ধ্বংসস্তূপের ওপাশে কিছু একটা নড়ছে।
সে যেই শব্দটা শুনেছে সেটা কারো গোপনীয়তার সাথে চলাচলের শব্দ-পাইনের সুচের মচমচ, ঝোঁপঝাঁড়ের নড়াচড়া। বাতাসে আশে পাশের পাইন গাছের কোলাহলের মাঝে সেই শব্দটা প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিল।
“গেজ?” লুইস চিৎকার করে ডাকে।
রাতের অন্ধকারে পেট সেমেটারিতে দাঁড়িয়ে সে তার মৃত ছেলের নাম ধরে ডাকছে, ব্যাপারটা বোধগম্য হওয়ার সাথে সাথেই তার মাথার তালুর সবগুলো চুল খাড়া হয়ে যায়। সে মারাত্নক জ্বরে আক্রান্ত রোগির মত কাঁপতে শুরু করে।
“গেজ?”
শব্দটা আর নেই।
সময় হয়নি; আরো সময় লাগবে। জানি না আমি কিভাবে জানি, তবে আমি জানি। ওটা গেজ না। ওটা…অন্য কিছু।
লুইসের হঠাৎ তাকে বলা এলির কথাটা মনে পড়ে যায়, যিশু বলেছিলেন, ‘লেজারাস, উঠে এসো’…কারণ যিশু যদি শুধু ‘উঠে এসো’ বলতেন তাহলে ওই কবরস্থানের সব মরা উঠে আসতো।
ধ্বংসস্তূপের ওপাশের শব্দটা আবারো শুরু হয়েছে। বাঁধের ওপাশে। বাতাসের কারণে শব্দটা প্রায় শোনাই যাচ্ছে না। যেন কোন অন্ধ কিছু তার ওপর নজর রাখছে। তার মারাত্নক উত্তেজিত মস্তিষ্ক নানান বীভৎস, অসুস্থ জিনিস কল্পনা করতে থাকে, কোন দানবীয় চিকা অথবা কোন মস্ত বাদুড় ওড়ার পরিবর্তে ঝোঁপঝাঁড়ের ভেতর দিয়ে দাপাদাপি করতে করতে এগোচ্ছে।
লুইস ধ্বংসস্তুপটার দিকে নজর রেখে এক পা এক পা পেছাতে থাকে, যতক্ষণ না সে বেশ খানিকটা পথ পাড়ি দেয়। এরপর সে সামনের দিকে ফিরে পা চালায়। আর তার বাড়ির পেছনের মাঠ যখন সিকি মাইল দূরে, সে দৌড়াতে শুরু করে।
লুইস গ্যারেজের ভেতর লক্ষ্যহীনভাবে কুঠার আর বেলচাটা ছুঁড়ে ফেলে। এরপর সে তার বাড়ির ড্রাইভওয়ের মাথায় দাঁড়িয়ে সে যে রাস্তায় এসেছে সেদিকে তাকায়। এরপর সে আকাশের দিকে তাকায়। রাত পৌনে চারটা। রাত আর বেশি বাকি নেই। আটলান্টিকের পাড়ে হয়তো ভোরের আলো ফুটে গেছে ইতিমধ্যে। কিন্তু লাডলোতে এখনো নিকষ রাত। বাতাস এখনো বিরামহীন স্রোতে বয়ে চলছে।
সে গ্যারেজের দেয়াল ধরে হেঁটে হেঁটে পেছনের দরজা খুলে বাসায় ঢোকে। কোন বাতি না জ্বেলেই কিচেনের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কিচেন আর ডাইনিং রুমের মাঝখানের ছোট বাথরুমে ঢুকে পড়ে। বাথরুমে ঢুকে সে সুইচটা টিপে দেয় এবং প্রথমেই সে যা দেখতে পায় তা হচ্ছে টয়লেটের ট্যাঙ্কের ওপরে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে থাকা চার্চ। চার্চ তার হলদে-সবুজ চোখ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“চার্চ,” সে বলে। “আমার মনে আছে তোকে কেউ বাসার বাইরে বের করে দিয়েছিল।”
চার্চ জবাব না দিয়ে ট্যাঙ্কের ওপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। হ্যা, কেউ আসলেই চার্চকে বাড়ির বাইরে বের করে দিয়েছিল; সে নিজে। সেটা তার খুব পরিস্কারভাবে মনে আছে। যেমনটা তার মনে আছে বাড়ির সেলারের জানালাটা বদলে সে ভেবেছিল সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু সে এখন ভালো করেই জানে, যখন চার্চ ঘরে ঢুকতে চায়, সে যেভাবেই হোক ঢুকে পড়ে। কারণ সে এখন আর আগের মত নেই।
তাতে কিছু আসে যায় না। যেসব ঘটছে তাতে তার মনে হচ্ছে কিছুতেই কিছু এসে যায় না। তার নিজেকে আর মানুষ মনে হচ্ছে না, মনে হচ্ছে সে জর্জ রোমারিওর সিনেমার কোন বেকুব জম্বি, অথবা এলিয়টের হলোম্যান কবিতার কোন চরিত্র। আমি থাবাওয়ালা কোন জন্তু হলে কিন্তু বেশ হত, তাহলে চার হাত পায়ে ভর দিয়ে লাফাতে লাফাতে ঈশ্বরের জলা পেরিয়ে মিকমেক গোরস্থানে পৌঁছে যেতাম, সে ভাবতে ভাবতে ফিক করে হাসে।
“আমার মাথার ভেতরে শুধু শুকনো খড়, চার্চ” সে ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলে। সে এখন তার শার্টের বোতাম খুলছে। “এটা বিশ্বাস না করলে তোর খবর আছে রে।”
তার বাঁ পাশের পিঠে পাজরের নিচ থেকে কোমর পর্যন্ত কালশিটে পড়ে গেছে। আর প্যান্ট খুলে সে দেখতে পায় হাঁটুর যেখানে সে ব্যথা পেয়েছিল সেই জায়গাটা ফুলে একদম আলুর মত হয়ে গেছে। জায়গাটা এখনই পচে যাওয়া মাংসের মত কালচে বেগুনি রং ধারণ করেছে। তার ধারণা এখন হাঁটু নড়াচড়া করা বন্ধ করে দিলেই সেটা একদম শক্ত হয়ে যাবে, একেবারে সিমেন্টের মত। আঘাতটা দেখে মনে হচ্ছে সেটা হয়তো বৃষ্টির দিনে হঠাৎ হঠাৎ নিজের সুপ্ত অস্তিত্বের জানান দিতে চাবে, যতদিন সে বেঁচে থাকবে ততদিন।
লুইস হাত বাড়িয়ে চার্চের গায়ে এক ঘা বসিয়ে দিতে চায়, কিছুটা আরামবোধ হবে ভেবে। কিন্তু চার্চ চট করে ট্যাঙ্কের ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে তার অদ্ভুত চলনে হেঁটে হেঁটে চলে যায়, অন্য কোন বিশ্রামের জায়গার খোঁজে। যাওয়ার আগে চার্চ একবারের জন্যে লুইসকে দেখে নেয়।
মেডিসিন কেবিনেটে বেনর-গাজ ছিল। লুইস টয়লেটের সিট নামিয়ে সেটার ওপর বসে। তারপর এক দলা মলম সে তার আহত হাঁটুতে মেখে দেয়। এরপর সে আরো কিছু মাখে তার কালশিটে পরা পিঠে-হাতুড়ে অপারেশন।
টয়লেট থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে যায়। সে হলের লাইটটা জ্বেলে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে থাকে। কি অদ্ভুত লাগছে! এখানে দাঁড়িয়েই সে ক্রিসমাস ইভে রাচেলকে নীলকান্তমণিটা উপহার দিয়েছিল। জিনিসটা ছিল তার রোবের পকেটে। ওইতো তার চেয়ারটা, যেখানে বসে সে নরমা ক্র্যান্ডালের হার্ট অ্যাটাকের পর এলিকে মৃত্যুর ব্যাপারে বুঝিয়েছিল—যে ব্যাপারগুলো সে এখন নিজেও বিশ্বাস করে না। ক্রিসমাস ট্রি-টা ছিল ওই কোণে, এলির আঁকা টার্কিটা—যেটাকে লুইসের কাছে ভবিষ্যতের কোন কাক বলে মনে হয়েছিল- স্কচ টেপ দিয়ে জানালার সাথে ঝোলানো, আর তারো আগে এখানে কিছু ইউনাইটেড ভ্যান লাইন্সের বক্স ছাড়া কিছুই ছিল না, যেগুলো দেশের মিড-ওয়েস্ট থেকে ট্রাকে করে এখানে নিয়ে আসা হয়েছিল আর সেগুলোর ভেতরে ছিল তার পরিবারের যত জিনিসপত্র। ওর মনে পড়ে যায় বক্সের ভেতরে তাদের জিনিসপত্রগুলোকে তার কাছে কেমন গুরুত্বহীন মনে হচ্ছিল-যেন তার পরিবার আর বিশ্বের মাঝের একটা সুরক্ষিত দেয়াল, যেটা তার পরিবারকে দূরে রাখে সেই পৃথিবী থেকে যেখানে তাদের নাম অথবা পারিবারিক রীতিগুলো কেউ জানে না।
সবকিছু কী যে অদ্ভুত লাগছে তার কাছে…কতই না ভালো হতো যদি সে ইউনিভার্সিটি অফ মেইনের নাম কখনোই না শুনতো, অথবা লাডলো নাম, অথবা জাড ক্র্যান্ডাল বা নরমা ক্র্যান্ডালের নাম, অথবা এখানকার কোন কিছুর ব্যাপারেই।
সে ওপরতলার বাথরুমে গিয়ে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে মেডিসিন কেবিনেটের ওপর থেকে তার ছোট কালো ব্যাগটা নামিয়ে আনে। সে ব্যাগটা নিয়ে মাস্টার বেডরুমে গিয়ে সেটার ভেতরের জিনিসগুলো উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে। হ্যা, কয়েকটা সিরিঞ্জ আছে, যদি প্রয়োজন পড়ে। আর সার্জিকাল টেপের রোল এবং সার্জিকাল গাটের মাঝে কয়েকটা সাঙ্ঘাতিক তরলের এম্পুল রয়েছে।
যদি প্রয়োজন পড়ে।
লুইস ব্যাগের ডালাটা লাগিয়ে সেটা বিছানার পাশে রেখে দেয়। সে রুমের বাতি নিভিয়ে মাথার নিচে হাত দিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। বিছানার আরামে তার শরীর গলে যায়। তার চিন্তা আবারো ডিজনি ওয়ার্ল্ডের দিকে মোড় নেয়। দেখতে পায় ডিজনি ওয়ার্ল্ডে সে সাদা পোশাক পড়ে একটা সাদা মাইক্রো গাড়ি চালাচ্ছে যেটার গায়ে মিকি মাউসের কানের লোগো আঁকা-যাতে বাইরে থেকে দেখে বোঝা না যায় এটা একটা রেস্কিউ ইউনিট। পয়সা দিয়ে ঘুরতে আসা কাস্টমারদের ভয় পাইয়ে ফায়দা কি?
গেজ তার পাশে বসে আছে। ওর গায়ের চামড়া রোদে পুড়ে আকর্ষনীয় রকম তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। তাদের বাঁয়েই গুফি দাঁড়িয়ে আছে, সে একটা ছোট ছেলের সাথে হ্যান্ডশেক করছে; ছেলেটা নিজের সৌভাগ্য যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। একটু সামনেই ‘উইনি দা পুহ্,’ দুজন বুড়ি দাদীর সাথে দাঁড়িয়ে ছবির পোজ দিচ্ছে আর তৃতীয় দাদী হাসতে হাসতে তাদের ছবি তুলছে; আর একটা খুব সুন্দর পোশাক পড়া ছোট্ট মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছে, “আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি, টিগার! আমি অনেক পছন্দ করি তোমাকে, টিগার!”
তারা দুজন মিলে পাহারা দিচ্ছে। তারা দুজন এই জাদুর দুনিয়ার রক্ষক এবং তারা সব সময় তাদের সাদা গাড়িতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ইমার্জেন্সির জন্যে রাখা তাদের গাড়ির লাল ফ্লেশার বাতিটা ড্যাশবোর্ডে যত্ন সহকারে ঢেকে রাখা হয়েছে, লোক চক্ষুর আড়ালে। তারা বিপদ খুঁজে বেড়াচ্ছে না তবে বিপদ যদি তার চেহারা দেখায় তাহলে তাকে মোকাবেলার জন্যে ওরা একদম প্রস্তুত। মৃত্যু এখানেও ঘুরে বেড়াচ্ছে, যদিও জায়গাটার উদ্দেশ্য শুধুমাত্র নির্মল বিনোদন। মৃত্যুকে হিসেবের বাইরে রাখার কোন উপায় নেই। হয়তো দেখা যাবে মেইন স্ট্রিট থেকে ফিল্ম কিনতে থাকা হাসি মুখের মানুষটা হঠাৎ মুখ বাঁকা করে নিজের বুক চেপে ধরছেন, অথবা স্কাই চেরিয়টের সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে কোন গর্ভবতী মহিলার হয়তো প্রসব বেদনা উঠবে, নরমান রকওয়েলের মত কোন পরমা সুন্দরি তরুণী হয়তো হঠাৎ মৃগি রোগে আক্রান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে যাবে এবং খিঁচুনির কারণে তার ব্রেইন সিগনালগুলো জ্যাম হয়ে সে হয়তো কাটা মুরগির মত তড়পাতে থাকবে। লোকজনের সান-স্ট্রোক, হিট-স্ট্রোক, ব্রেইন-স্ট্রোক হয়, অনেকের আবার বিভিন্ন রাইডে চড়েও স্ট্রোক হয়ে যায়। এমনকি এখানে স্বয়ং ওজ দ্য গেয়েট অ্যান্ড টেয়িল নিজেও আছে। তাকে পার্কের বিভিন্ন জায়গায় মাঝে মাঝেই দেখা যায়। লুইস এবং গেজের কাছে সে পার্কের অন্যান্য কার্টুনের চরিত্র, যেমন মিকি, গুফি বা টিগারের মতই পরিচিত। কিন্তু সে এমনই একটা চরিত্র যার সাথে কেউ ছবি তুলতে চায় না, বা কেউ তাদের ছেলে-মেয়েদের তার সাথে পরিচিত করিয়ে দিতে যায় না। লুইস আর গেজ তাকে খুব ভালো করে চেনে। তারা কিছু দিন আগে নিউ-ইংল্যান্ডে তার মোকাবেলা করছে। সে কাউকে বালিশ চাপা দেয়ার জন্যে, গলায় মার্বেল আটকে দম বন্ধ করে মারার জন্যে বা বিদ্যুতের সাথে লাগিয়ে ঝলসে দেয়ার জন্যে ঘাপটি মেরে আছে। তাকে পাওয়া যাবে পাশের বৈদ্যুতিক বোর্ডে বা বাতির খালি সকেটে, এক্ষুনি। মৃত্যু আছে অর্ধেক ঠোঙ্গা বাদামে, এক পিস চর্বিওয়ালা গরুর মাংসে, বা পরবর্তী সিগারেটের প্যাকে। সে আছে সব সময়। সে মরণ আর অসীম জীবনের সবগুলো চেকপয়েন্টে ওৎ পেতে আছে। আছে নোংরা সুঁচ, বিষাক্ত পোকা, পানিতে ডুবে থাকা বিদ্যুতের তার, বনের দাবানলে। কেউ তার গোসলের চৌবাচ্চায় ঢুকলে সেখানেও তার বন্ধু ওজ সর্বদা হাজির। কেউ যখন প্লেনে চড়ে, ওজ-ও তাতে চড়ে বসে। সে আছে খাবার পানিতে, খাবারে। কেউ যখন একলা অন্ধকারে ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করে, “কে? কে ওখানে?” তখন তার উত্তরটাই ফিরে আসেঃ ভয়ের কিছু নেই বন্ধু। আমি। হাই! আছো কেমন? তোমার পাছায় ক্যান্সার হয়েছে বন্ধু, খুব সরি আমি। সেপ্টিসেমিয়া! লিউকেমিয়া! খেলাসেমিয়া! করনারি থ্রম্বসিস! এন্সেফালাইটিস! অস্টেওমায়েলিটিস! হে হে! চলো চলো! দরজার ওপাশে ছুড়ি দিয়ে ঠেক দেয়া হিরোইঞ্চি। মাঝ রাতের ফোনকল। হাত ভর্তি ট্যাবলেট, চিবিয়ে খাও। এ্যাস্কাইজিয়েশর পরে নখের নীলচে হয়ে যাওয়া-ব্রেন তখন বাঁচার জন্যে সব অক্সিজেন টেনে নেয় এমনকি নখের নিচের জীবন্ত কোষগুলো থেকেও। হ্যালো, ভাই ও বোনেরা, আমার নাম ওজ দ্য গেয়েট অ্যান্ড টেয়িল, তবে চাইলে শুধু ওজ বললেও হবে আমার সাথে তো এতোদিনে সবার এক রকম দোস্তিই হয়ে গেছে। আপনাদের সবাইকে একটু হার্ট ফেল বা মস্তিষ্কের জমাট রক্ত বা অন্য কিছু উপহার দিতে এসেছি। সময় নেই একদম, এর পরই আমাকে আবার ছুটতে হবে এক প্রসূতি মহিলার কাছে, গিয়ে বাচ্চার মাথা আগে না বেরিয়ে যেন পাছা আগে বেরিয়ে একটা গিরিঙ্গি লাগে সেটাও তো দেখতে হবে। তারপর আবার ছুটতে হবে নিউ ইয়র্কে, গ্যাসের লাইনের লিক থেকে পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে মারতে।
আর চিকন কণ্ঠটা কাঁদতে থাকে, “আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি, টিগার! আমি অনেক পছন্দ করি তোমাকে, টিগার! আমি সব সময় তোমাকে পছন্দ করবো আর আমি সব সময় ছোট থাকবো। আর আমার মনে শুধু নেবরাস্কার ওই ভদ্র নকল ওজ’ই বেঁচে থাকবে! আমি তোমাকে অনেক…
আমরা ঘুরে বেড়াই…আমি আর আমার ছেলে…আমরা এটা সেক্স বা যুদ্ধের খাতিরে করি না, করি ওজ দ্য গেয়িট অ্যান্ড টেয়িল-এর বিরুদ্ধে এক মহান এবং হতাশাজনক লড়াইয়ে লড়ে যেতে। আমি আর আমার ছেলে, আমাদের সাদা গাড়িতে করে ফ্লোরিডার আকাশের নিচে ঘুরে বেড়াই। আর সাইরেনের লাল বাতিটা ঢেকে রাখা আছে, কিন্তু প্রয়োজন হলেই সেটা বের করা হবে…আর এটা আমাদের ছাড়া আর কারো জানারও প্রয়োজন নেই কারণ মানুষের হৃদয়ের মাটি পাথুরে। মানুষ তার হৃদয়ে যা পারে জন্মায়…আর সেটা সে যত্ন করে রাখে।
এসব উদ্ভট আধো-স্বপ্নের চিন্তা করতে করতে লুইস ক্রিড ঘুমে তলিয়ে যেতে শুরু করে, বাস্তবতার সাথে তার সব সংযোগ একটা একটা করে খুলে পড়তে শুরু করে যতক্ষণ না তার শ্রান্তি তাকে এক গভীর স্বপ্নহীন কালো দুনিয়ায় টেনে নেয়।
পূবের আকাশে ভোরের রেখা দেখা দেয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শোনা যায়। খুব ধীরে এবং ঢেপসাভাবে পা পড়ছে। হলের ছায়ার ভেতর ছায়ামূর্তিটা চলাচল করে। এর সাথে একটা গন্ধও আসে- খুব বাজে দুর্গন্ধ। এমনকি লুইস তার গাঢ় ঘুমের মাঝেও বিড়বিড় করে গন্ধের দিক থেকে অন্যদিকে মুখ সরিয়ে নেয়।
ছায়ামূর্তিটা মাস্টার বেডরুমের দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ, অনড় হয়ে। এরপর সেটা ভেতরে ঢোকে। লুইসের মুখ বালিশে ডুবে আছে। একটা সাদা হাত এগিয়ে আসে এবং বিছানার পাশের ডাক্তারি ব্যাগ খোলার ‘ক্লিক’ শব্দ হয়।
এরপর ভেতরের জিনিস নড়াচড়ার আরো কিছু চাপা শব্দ।
হাতটা ব্যাগের ঔষধ, এম্পুল আর সিরিঞ্জ অনাগ্রহের সাথে ঠেলে সরিয়ে দেয়। এরপর সে একটা জিনিস পায় এবং সেটা বের করে আনে। প্রভাতের প্রথম আভায় সামান্য একটু রূপালি ঝলক দেখা গেল।
ছায়ামূর্তি রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
পর্ব-৩
তৃতীয় পৰ্ব
ওজ দ্য গেয়েট
অ্যান্ড টেয়িব্ল
“ব্যাপারটা মাত্র আমার মাথায় এসেছে,” মিসেস হোয়াইট হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে বলেন। “ব্যাপারটা আগে কেন আমার মাথায় আসেনি? তোমার মাথায়ই বা কেন আসেনি?”
“মাথায় কী আসেনি?” মিস্টার হোয়াইট জিজ্ঞেস করেন।
“আমাদের বাকি দুটো ইচ্ছে,” তিনি দ্রুত জবাব দেন। “আমরা মাত্র একটা ইচ্ছে ব্যবহার করেছি।”
সেটাই কি যথেষ্ট না?” তিনি অনেকটা রেগে জানতে চান স্ত্রীর কাছে।
“না!” তিনি চিৎকার করে বলেন। “আমরা আরেকটা ইচ্ছে ব্যবহার করবো। শিগগির নিচে গিয়ে জিনিসটা নিয়ে এসে সেটার কাছে আমাদের ছেলেকে আবারো বাচিয়ে তোলার ইচ্ছেটা করো।”
—ডব্লিউ. ডব্লউ, জেকবস্ (দি মাঙ্কিস্ প)
অধ্যায় ৫৮
জাড ক্র্যান্ডাল ঝাঁকি দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। তিনি আরেকটু হলে ঝাঁকির চোটে চেয়ার থেকেই পড়ে যাচ্ছিলেন। তিনি মনে করতে পারছেন না তিনি কতক্ষণ ঘুমিয়েছেন; পনের মিনিট হতে পারে আবার তিন ঘন্টাও হতে পারে। তিনি হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন পাঁচটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি। তার মনে হচ্ছে ঘরের সবকিছুই যেন অতিসূক্ষ্মভাবে তাদের স্থান পরিবর্তন করেছে। বসে ঘুমানোয় তার পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে।
আরে, ভীমরতি হওয়া বুড়ো, দেখো তুমি কী করেছ!
কিন্তু তিনি জানেন। তিনি খুব ভালো করেই জানেন যে দোষ তার একার না। কিছু তাকে পাহারারত অবস্থায় জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল।
ব্যাপারটা বেশ ভীতিজনক। কিন্তু কিসে তার ঘুম ভাঙল? এটা আরো বেশি ভীতিজনক। তিনি কিছু একটা শুনতে পেয়েছেন। তিনি নিশ্বাস চেপে রেখে কান পেতে রাখলেন; তিনি নিজের হার্টবিটের দপদপানি শুনতে পারছেন।
আবার শব্দ হলো। যে শব্দে তিনি জেগে উঠেছেন এরকম কিছু না। দরজার কবজার চাপা ক্যাচক্যাচ শব্দ।
জাড তার বাড়ির সব রকম শব্দ চেনেন-মেঝের কোন কাঠটা ক্যাচক্যাচ করে, সিঁড়ির কোন ধাপটা কিচকিচ শব্দ করে, ছাদের থেকে পানি পড়ার টিনের নালা কোথায় কোথায় মাতাল হাওয়ার তোড়ে শব্দ করে, যেমনটা গতরাতে করেছে। এই শব্দটাও তিনি খুব ভালো করেই চেনেন। এটা তার বারান্দা দিয়ে ঘরে ঢোকার ভারি দরজাটার শব্দ, সেটাকে মাত্রই কেউ খুলেছে। এবার তিনি বুঝতে পারলেন তার ঘুম ভেঙেছে কিসের শব্দে। শব্দটা তার বারান্দা থেকে বাইরে যাওয়ার স্বচ্ছ দরজার স্প্রিংয়ের শব্দ।
“লুইস?” তিনি দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন। কিন্তু তিনি জানেন এটা লুইস হবার আশা নেই বললেই চলে। যে এসেছে, এসেছে তাকে শাস্তি দেয়ার জন্যে।
পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে লিভিং রুমের দিকে এগোতে থাকে।
“লুইস?” তিনি আবারো ডাকার চেষ্টা করেন, কিন্তু ডাকটা তার গলাতেই মরে যায়, কারণ তিনি শেষ রাতের আগন্তুকের সাথে আসা গন্ধটাও টের পাচ্ছেন। গন্ধটা খুব নোংরা। পচে যাওয়া বিষাক্ত কাদার দুর্গন্ধ।
তিনি ঘরের কোথায় কী আছে তা দেখতে পাচ্ছেন-নরমার আলমারি, ড্রেসার, ওয়ারড্রব কিন্তু আবছা আবছাভাবে। তিনি তার পানি জমে যাওয়া পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করলেন। তার মন চিৎকার করে বলছে যে তার আরো সময় দরকার। আচমকা এই জিনিসটার মোকাবেলা করার অবস্থা তার বুড়ো দেহে নেই। টিমি ব্যাটারম্যানের সময় তিনি যুবক ছিলেন, কিন্তু এখন তিনি ভীমরতিগ্রস্ত এক বুড়ো।
তার সামনের দরজাটা খুলে যায় এবং মাঝেতে বেশ কয়েকটা নতুন ছায়ার আবির্ভাব হয়। তাদের মধ্যে একটি ছায়া বেশ বড়।
ওহ খোদা! কি দুৰ্গন্ধ!
অন্ধকারে আবারো পায়ের শব্দ।
“গেজ?” জাড অবশেষে নিজ পায়ে দাঁড়ান। তিনি তার চোখের এক কোণ দিয়ে অ্যাশট্রেতে তার না খাওয়া সিগারেটটির ছাইয়ের রোলটা দেখলেন। “গেজ, তুমি?”
এরপর জিনিসটা চিৎকার করে ওঠে এবং মুহূর্তের মধ্যে জাডের হাড়গুলো সাদা বরফে পরিণত হয়। জিনিসটা লুইসের ছেলে না। গোরস্তান থেকে অন্য কোন প্রেত উঠে এসেছে।
না। এর কোনটিই না।
শব্দটা করেছে লুইসের হুলো বেড়াল চার্চ। বিড়ালটার চোখগুলো ময়লা লাইটের মত জ্বলজ্বল করছে। এরপর সে চোখগুলো অন্য এক দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার সাথে আসা সঙ্গির দিকে।
জাড পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি নিদারুণ দুর্গন্ধের মাঝে নিজের চিন্তা ভাবনা ঠিক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ঘরটা প্রচন্ড ঠান্ডা হয়ে গেছে। জিনিসটা সাথে করে শীতলতা বয়ে নিয়ে এসেছে।
জাডের পা দুটো টলমল করে ওঠে- বিড়ালটা তার পা ঘেষে ঘেষে আদুরে ভঙ্গিতে পুর্র্ পুর্র্ করছে। তিনি ভয়ানক চমকে গিয়েছিলেন। জাড লাথি মেরে বিড়ালটাকে পায়ের কাছ থেকে খেদান। লাথি খেয়ে চার্চ দাঁত মুখ খিচিয়ে হিসিয়ে ওঠে।
ভাবো। বেকুব বুড়ো। হয়তো এখনো দেরি হয়ে যায়নি। হয়তো এখনো সামান্য সময় আছে তোমার বুড়ো হাতে… জিনিসটা ফিরে এসেছে, কিন্তু এটাকে আবারো মেরে ফেলা যাবে…যদি তুমি ভালোভাবে চিন্তা করতে পারো…
তিনি কিচেনের দিকে পিছিয়ে যান এবং তার হঠাৎ মনে পড়ে যায় যে কিচেনের তৈজসপত্র রাখার ড্রয়ারে একটা মাংস কাটার ছুঁড়ি আছে।
তিনি পিছিয়ে যেতে থাকলে তার পায়ে কিচেনের দরজাটা বাড়ি খায়। তিনি সেটা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলেন। তার বাসায় কী এসে ঢুকেছে সেটা এখনো অস্পষ্ট, কিন্তু তিনি সেটার শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। তিনি সেটার এক হাতের সামনে পিছে আগু-পিছু করা দেখতে পাচ্ছেন। জিনিসটার হাতে কিছু একটা আছে, কিন্তু কি তা তিনি বুঝতে পারছেন না। তিনি কিচেনে ঢুকে পড়লে দুই পাল্লার দরজাটা নিজে থেকেই বুজে যায় এবং উল্টো দিকে ঘুরে দৌড়াতে শুরু করেন তৈজসপত্র রাখার ড্রয়ার লক্ষ্য করে। ঝাঁকি দিয়ে ড্রয়ারটা খুলে ছুঁড়িটা পেয়ে গেলেন। ছুঁড়ির হাতলটা শক্ত করে চেপে ধরে তিনি আবার দরজার দিকে ফিরলেন। কিছুটা সাহস ফিরে পেয়েছেন তিনি।
মনে রেখ, এটা কোন মানুষের বাচ্চা না। ওকে তুমি কব্জা করে ফেললে হয়তো তোমার মন গলাতে কান্না শুরু করবে বা চিৎকার চ্যাঁচামেচি করবে, কিন্তু ভুলেও তা পাত্তা দেয়া যাবে না। তুমি বহুবার ধরা খেয়েছ, বুড়ো। এটা তোমার শেষ সুযোগ।
দরজার কপাট দুটো আবারও খুলে যায়। প্রথমে বিড়ালটা ঢুকলো। জাড়ের চোখ সেটাকে অনুসরণ করে কিছুক্ষণের জন্যে। এরপর তিনি আবার দরজার দিকে তাকান।
কিচেনটা পূর্বমূখী এবং জানালা দিয়ে ভোরের মৃদু দুধ-সাদা আলো ঘরে প্রবেশ করছে। অল্প আলো, কিন্তু যথেষ্ট।
গেজ ক্রিড ঘরে ঢোকে। তার গায়ে তার ফিউনারেলের স্যুট। স্যুটের কাঁধের কাছে এবং গলার দুদিকের ভাজ করা অংশে শ্যাওলা জন্মেছে। তার সাদা শার্টও শ্যাওলায় নোংরা হয়ে আছে। তার মাথার সুন্দর সোনালী চুলগুলো কাদায় লেপ্টে আছে। একটি চোখ একদম উল্টে গেছে, সেটা শূন্য দৃষ্টিতে অনির্দিষ্ট দিকে তাকিয়ে আছে। আরেকটা চোখ জাডের দিকে তাক করা।
গেজ তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
“হ্যালো জাড,” গেজ তার শিশুসুলভ কিন্তু স্পষ্ট গলায় বলে। “আমি তোর পচা গলা আত্মাটাকে নরকে পাঠাতে এসেছি। তুই একবার আমার চরম ক্ষতি করেছিলি। তুই কি ভেবেছিস আমি সব ভুলে যাবো আর কখনো প্রতিশোধ নেব না?”
জাড ছুঁড়িটা শাসানোর ভঙ্গিতে উঁচু করে ধরেন। “আয় তাহলে, দেখি কে কার ক্ষতি করে।”
“নরমা মরে গেছে। তোর মৃত্যুর পর কাঁদার জন্যে আর কেউ নেই, “ গেজ বলে। “কী এক সস্তা মাগী যে ছিল তোর বউ। সে তোর সব দোস্তের সাথে বিছানায় গেছে, জাড। সে তাদেরকে তার পাছায় ঢোকাতে দিত। এভাবেই ও সবচাইতে বেশি মজা পেত। মাগী এখন নরকে জ্বলছে। আমি ওকে সেখানে দেখেছি, জাড। আমি ওকে সেখানে নিজের চোখে দেখেছি।”
জিনিসটা আরো দু পা এগোয়। মেঝেতে ছোট ছোট কাদা মাখা জুতোর ছাপ পড়ে। জিনিসটা তার এক হাত সামনে বাড়িয়ে দেয়, হাত মেলানোর ভঙ্গিতে; আরেক হাত পেছনে মোড়া।
“শোন, জাড,” সেটা ফিসফিসিয়ে বলে-জিনিসটার মুখ হা হয়ে খুলে যায় আর মুখের দুধ দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ে। যদিও সেটার ঠোঁটগুলো নড়ে না কিন্তু সেটার গলা দিয়ে নরমার কন্ঠ বেরিয়ে আসে।
“তোমাকে নিয়ে আমি কত ঠাট্টা করেছি! আমরা সবাই তোমাকে নিয়ে ঠাট্টা করতাম। আমরা হাসতে হাসতে—”
“থাম!,” জাড তার হাতের ছুঁড়িটা দিয়ে শাসান।
“আমি তোমার বন্ধুদের সাথে তোমার-আমার খাটে সেক্স করেছি। হের্কের সাথে করেছি, জর্জের সাথে করেছি, আমি তোমার সব বেশ্যাদের কথা জানতাম, কিন্তু তুমি জানতে না যে তুমি একটা বেশ্যাকেই বিয়ে করে এনেছো। আর আমরা যে তোমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতাম, জাড! আমরা সেক্স করতাম আর তোমাকে নিয়ে হাসসসসতে হাসসসসতে-”
“চুপ কর!” জাড চিৎকার করে ওঠেন। তিনি জিনিসটার ওপর আঘাত করার জন্যে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে যান এবং তখনই পাশের টেবিলের নিচে ঘাপটি মেরে বসে থাকা চার্চ বেরিয়ে এসে তার পায়ের ওপর হামলে পড়ে। চার্চ দুই কান পেছনের দিকে নিয়ে হিংস্রভাবে হিসিয়ে যাচ্ছে। তিনি ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে পড়ে যান। তার হাত থেকে ছুঁড়িটা ছিটকে পড়ে যায়। ছুঁড়িটা মেঝেতে শব্দ করে গড়াতে গড়াতে রেফ্রিজারেটরের নিচের ফাঁকে ঢুকে যায়।
জাড বুঝতে পারেন তাকে আবারো বোকা বানানো হয়েছে এবং সান্ত্বনা হচ্ছে এবারই হয়তো শেষবার। বিড়ালটা তার পায়ের ওপর চড়ে বসে দাঁত-মুখ খিচিয়ে চায়ের কেটলির মত হিসিয়ে যাচ্ছে। চার্চের চোখ জ্বলজ্বল করছে। এরপর গেজ তার ওপর উঠে আসে। গেজ তার পেছনে লুকিয়ে রাখা হাতটা সামনে নিয়ে আসে এবং জাড দেখতে পান গেজ তার হাতে কি ধরে আছে। জিনিসটা লুইসের কালো ব্যাগে থাকা একটা স্কালপেল। পেন্সিলের সাইজের জিনিসটা দিয়ে ডাক্তারেরা কাটাকুটি করেন। সেটার মাথায় থাকে মারাত্নক ধারালো একটি ব্লেড।
“ওহ খোদা!” জাড আতঙ্কিত কণ্ঠে বলেন এবং ডান হাত বাড়িয়ে আঘাত থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। তার চোখে ভেল্কি লেগে গেল; নিশ্চয়ই তার মাথা খারাপ হয়ে গেছে কারণ তিনি স্কালপেলটা একই সাথে তার হাতের তালুর দুপাশেই দেখতে পাচ্ছেন। এরপর উষ্ণ কিছু তার মুখের ওপর গড়িয়ে পরতে থাকে, এবং তিনি বুঝতে পারেন।
“আমি তোর বারোটা বাজাব, বুড়ো ভাম!” গেজের ভেতরের জিনিসটা খিল খিল করে হাসতে হাসতে বলে। হাসির সাথে সাথে জিনিসটার বিষাক্ত নিশ্বাস জাডের মুখে এসে লাগছে। “তোকে ভালোমত শায়েস্তা করবো আমি! একেবারে রামচোদা চুদবো তোকে…যত…খুশি!”
জাড খপ করে গেজের কব্জি ধরতে গেলেন। তার হাতের মুঠোয় গেজের হাতের রাবারের মত চামড়ার খাবলা উঠে আসে।
গেজ স্কালপেলটা জাডের হাত থেকে টেনে বের করে ফেলে। স্কালপেলটা হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় একটা লম্বা ক্ষত রেখে যায়।
“আমার…যত…ইচ্ছে!”
স্কালপেলটা আরেকবার নেমে আসে।
এরপর আরেকবার।
এরপর আরেকবার।
অধ্যায় ৫৯
“এখন স্টার্ট দিন তো ম্যাম,” ট্রাক ড্রাইভার বলে। সে রাচেলের ভাড়া গাড়ির ইঞ্জিন চেক করছে।
রাচেল চাবিটা মোচড় দেয়ার সাথে সাথে ইঞ্জিনটা গর্জন করে ওঠে। ট্রাক ড্রাইভার লোকটা ইঞ্জিনের ডালা বন্ধ করে রুমালে হাত মুছতে মুছতে গাড়ির জানালার সামনে এসে দাঁড়ায়। তার মুখটা হাসি হাসি, মাথায় একটা টমস ট্রাক কোম্পানির ক্যাপ।
“আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ,” রাচেল বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে। “আমি কী করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।”
“ওহ, এটা একটা বাচ্চা ছেলেও ঠিক করতে পারবে। তবে এতো নতুন গাড়ির এরকম সমস্যা আগে কখনো দেখিনি।”
“কেন? কি হয়েছিল?”
গাড়ির ব্যাটারির তার খুলে এসেছিল। কেউ ওটা নিয়ে টানাটানি করেনি তো?”
“না,” রাচেল বলে। সে গুলতির রাবার ব্যান্ডের ইলাস্টিসিটির বিরুদ্ধে চলতে থাকার অনুভূতির কথা ভাবে।
“তাহলে হয়তো চলতে চলতেই এমন হয়ে গেছে। কিন্তু আমি জিনিসটা খুব টাইট করে লাগিয়ে দিয়েছি। আর কোন সমস্যা হবার কথা না।”
“আমি আপনাকে কিছু টাকা দিতে পারি?” রাচেল দ্বিধাজড়িত কণ্ঠে বলে। লোকটা গলা ফাটিয়ে হাসতে থাকে। “নাহ, ম্যাম,” সে বলে। “আমরা হচ্ছি এই রোডের রক্ষক, জানেন না?”
রাচেল মুচকি হাসে। “আচ্ছা… ধন্যবাদ।”
“ওয়েলকাম,” সে হাসিমুখে বলে। সকালের রোদে তার চেহারা উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।
জবাবে রাচেলও তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এরপর সে রাস্তার দুপাশ দেখে নিয়ে গাড়িটা পার্কিং লট থেকে রাস্তায় উঠিয়ে দেয়। রাচেল যতটুকু আশা করেছিল, কফিটা তার চাইতে অনেক বেশি কাজে দিয়েছে। তার ঘুম একেবারে পালিয়েছে, এক ফোটা ঝিমুনিও আসছে না আর। কিন্তু ওই অস্বস্তিকর চিন্তাটা তাকে আবারো পাখির পালকের মত আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। ওকে কেউ আটকে রাখতে চাইছিল। ব্যাটারির তার এরকম অদ্ভুতভাবে খুলে আসা…যাতে ওকে একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে আটকে রাখা যায়….
রাচেল নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসে। নির্দিষ্ট সময়টা কিসের জন্যে?
অপরিবর্তনীয় কিছু ঘটার জন্যে।
বাজে চিন্তা। ফালতু। কিন্তু রাচেল তবুও গাড়ির গতিটা একটু বাড়িয়ে দেয়।
পাঁচটা বাজে, জাড ক্র্যান্ডাল যখন তার হাত দিয়ে বন্ধু ডাঃ লুইস ক্রিডের ব্যাগ থেকে চুরি হওয়া একটি স্কালপেল থেকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করছিলেন, এলি তখন একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে ওঠে, আর রাচেল মহাসড়ক থেকে লোকাল রাস্তায় প্রবেশ করে। সে হ্যামন্ড স্ট্রিট দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যায়, যে রাস্তাটা তার ছেলের গোরস্তানের পাশেই, যেখানে তার ছেলের কফিনে একটি কোদাল ছাড়া আর কিছুই নেই। এরপর সে ব্যাঙ্গর-ব্রিউয়ার ব্রিজ পেরোয়। পৌনে পাঁচটার দিকে ও রুট ১৫ তে উঠে আসে এবং লাডলো বরাবর গাড়ি ছোটাতে থাকে।
রাচেল ঠিক করে সে আগে জাডের সাথেই দেখা করবে। তার করা প্রমিজের এটুকু অন্তত সে রাখার চেষ্টা করবে। তাছাড়া তাদের হোন্ডা সিভিক গাড়িটা তাদের ড্রাইভওয়েতে নেই, সম্ভবত লুইস সেটা নিয়ে কোথাও গিয়েছে। তবে গাড়িটা তাদের গ্যারেজে থাকার সম্ভাবনাও আছে, কিন্তু তাদের বাসাটাকে দেখে মনে হচ্ছে বাসাটা শূন্য, সেখানে কেউ নেই। তার একবারের জন্যেও মনে হয় না লুইস বাসায় আছে।
রাচেল তার গাড়িটা জাডের পিকাপের পেছনে পার্ক করে। সতর্কভাবে চারদিক দেখে নিয়ে সে তার গাড়ি থেকে নামে। সকালের নতুন আলোতে ঘাসের শিশির ঝকমক করছে। কোথাও একটা পাখি ডেকে আবারো চুপ হয়ে গেল। সে বড় হবার পর থেকে হাতে গোনা কয়েকবার এতো সকালে জেগে ছিল, তাও কোন না কোন দরকারে। তবে একাকিত্বের অনুভূতি থাকলেও এরকম নতুন সকাল ওর কাছে সবসময়ই ভালো লাগে, নতুন এবং শুভ কিছুর সূচনা বলে মনে হতো। কিন্তু আজকের সকালের কিছুই তার কাছে ভালো বলে মনে হচ্ছে না। তার ভেতরে একটা চাপা অস্বস্তি কাজ করছে যেটার জন্যে শুধু গত চব্বিশ ঘন্টা এবং তার মৃত ছেলের শোকই দায়ি না।
সে বারান্দার স্বচ্ছ দরজাটা খুলে বারান্দায় প্রবেশ করে পুরনো ধাঁচের বেলটা বাজানোর জন্য। ও আর লুইস যেবার জাডদের বাসায় প্রথম এসেছিল তখন এই বেলটা ওর বিশেষ পছন্দ হয়েছিল। বেলের প্রজাপতির মতো সুইচটা ক্লকওয়াইজ ঘোরালে একটা জোরালো মিউজিকাল সাউন্ড বেজে ওঠে। পুরনো দিনের মিউজিকটা ওর বেশ লাগে।
বেলটা চাপতে গেলে মেঝের দিকে তাকিয়ে ও ভ্রু কুচকে ফেলে। সেখানে কাদামাখা পায়ের ছাপ, কেউ কাদা মাখা পায়ে পোর্চের দরজা থেকে এখানে হেঁটে এসেছে। পায়ের ছাপের আকার বলে দিচ্ছে সেটা কোন বাচ্চার পায়ের ছাপ। কিন্তু সে সারারাত জেগে ড্রাইভ করলেও কোন বৃষ্টির দেখা পায়নি। বাতাস ছিল, কিন্তু কোন বৃষ্টি হয়নি।
সে পায়ের ছাপগুলোর দিকে লম্বা সময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। এবং সে টের পায় বেল চাপার জন্যে তাকে তার হাতটা ঠেলে সামনের দিকে নিতে হচ্ছে। সে বেলটা ধরে…কিন্তু ওর হাত আবারো নিচে নেমে আসে।
আমার অবচেতন মন হয়তো এই নিস্তব্ধতা ভেঙে বেল বাজাতে চাচ্ছে না। হয়তো জাড গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, আর এই জোরালো বেল শুনে তিনি লাফিয়ে…
কিন্তু তার ভয়টা এই জায়গায় না। ওর যখন থেকে মনে হচ্ছিল যে ও চাইলেও জেগে থাকতে পারছিল না, তখন থেকেও ওর বেশ নার্ভাস লাগছিল, এক রকম ভয়ও লাগছিল। কিন্তু এই ভয়টা একদম নতুন। এই ভয়ের উৎস এই ছোট ছোট পায়ের ছাপগুলো। তার মন চিন্তাটাকে থামাতে চেয়েছিল, কিন্তু তার মন অত্যন্ত ক্লান্ত।
—গেজের পায়ের ছাপ।
থামো তো। থামো।
ও বেলের সুইচটা ঘুরিয়ে দেয়।
সে যা ভেবেছিল তার চাইতেও বিকট আওয়াজ করে ওঠে বেলটা, এবং চারদিকের নীরবতায় সেটাকে মিউজিকাল বলেও মনে হয় না। রাচেল চমকে লাফিয়ে পিছিয়ে যায়। সে মৃদু হাসে কিন্তু সেই হাসিতে কোন কৌতুক নেই। সে জাডের পায়ের শব্দের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে কিন্তু তেমন কিছুই শুনতে পায় না। নিস্তব্ধতার পর আরো নিস্তব্ধতা। সে বুঝতে পারছে না সে আবারো ওই প্রজাপতির মত বেলের সুইচটা ঘোরাতে পারবে কি না। তবে যখন দরজার ওপাশ থেকে শব্দটা আসে, সেটার জন্যে রাচেল একদমই প্রস্তুত ছিল না।
ওয়ায়াও!…ওয়ায়াও!… আওওও!
“চার্চ?” সচকিত হয়ে রাচেল ডাকে। সে দরজার কাঁচ দিয়ে ওপাশটা দেখার জন্যে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়ায় কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। দরজার গ্লাসের অংশটা পর্দা দিয়ে ঢাকা; খুব সম্ভবত নরমার কাজ। “চার্চ, তুমি?”
ওয়ায়াও!
রাচেল দরজা ধাক্কা দেয়। দরজার লক খোলা। চার্চ হলওয়েতে লেজ দুপায়ের চারদিকে প্রায় গোল করে গুটিয়ে বসে আছে। বিড়ালটার গায়ের পশমে গাঢ় কিছু লেগে আছে। রাচেল প্রথমে ভাবে সেটা কাদা, কিন্তু পরক্ষণেই দেখতে পায় চার্চের গোফে ফোটা ফোটা তরল লেগে আছে, যেগুলোর রং লাল।
চার্চ রাচেলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই নিজের থাবাটা উঠিয়ে চাটতে শুরু করে। চার্চের চোখ রাচেলের দিক থেকে এক মুহূর্তের জন্যেও সরে না।
“জাড!” রাচেল উচ্চস্বরে ডাকে। তাকে এখন আতঙ্কিত শোনাচ্ছে। সে বাড়ির ভেতর পা রাখে।
বাড়িটা তাকে কোন জবাব দেয় না; শুধুই নিস্তব্ধতা।
রাচেল ভাবতে চেষ্টা করে কিন্তু কোত্থেকে যেন জেল্ডার চিন্তা তার মাথার ভেতর ঢুকে তাকে ভাবতে বাধা দিতে থাকে। কিভাবে জেন্ডার হাতগুলো মুচড়ে বাকা হয়ে গিয়েছিল, কিভাবে জেল্ডা রেগে গেলে দেয়ালে মাথা ঠুকতো আর তাতে কিভাবে সেই কাঠের দেয়ালের কাগজের প্রলেপ উঠে এসেছিল। এখন জেল্ডাকে নিয়ে ভাবার সময় না, যেখানে জাড হয়তো বিপদে পড়েছে। তিনি কি বেহুশ হয়ে পড়ে গেছেন? তার মত বুড়ো লোকের ক্ষেত্রে সেটা অস্বাভাবিক কিছু না।
ব্যাপারটা ভেবে দেখো। সেই স্বপ্নগুলোর কথা ভাবো তুমি ক্লজেটের দরজা খুললে ভেতর থেকে জেল্ডা তোমার ওপরে লাফিয়ে পড়তো, তার কালচে হয়ে যাওয়া চেহারাটা থাকতো হাসি হাসি; বাথটাবে গোসল করতে থাকার স্বপ্ন, যেটাতে তুমি দেখতে পেতে বাথটাবের পানি যাওয়ার ডেনের ফুটো দিয়ে জেল্ডা তোমার দিকে তাকিয়ে আছে; বেসমেন্টের স্বপ্ন যেখানে তুমি তাকে বেসমেন্টের ফার্নেসের পেছনে কিলবিল করতে দেখতে, ওই স্বপ্নটা যেখানে-
চার্চ আবারো তার ধারালো দাঁত বের করে চিৎকার করে ওঠে, ওয়ায়াও!
লুইসের কথাই ঠিক ছিল। চার্চকে খোজা করানো ঠিক হয়নি। কিন্তু লুইস বলেছিল খোজা করলে ওর ভেতরের জংলীভাব চলে যাবে। লুইসের কথা ভুল ছিল; চার্চ এখনো শিকার করে। সে-
ওয়ায়াও! চার্চ আবারো চেঁচিয়ে ওঠে এবং ছুটে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে থাকে।
“জাড?” রাচেল আবারো ডাকে। “আপনি ওপরে আছেন?”
ওয়ায়াও! যেন রাচেলের প্রশ্নের হ্যাঁ সূচক জবাব দিতেই চার্চ আবারো চিৎকার করে ওঠে। এরপর সে হলে অদৃশ্য হয়ে যায়।
ও এখানে ঢুকলো কী৭ করে? জাড কি ওকে দরজা খুলে ঢুকতে দিয়েছে? দিলে কেন দিলেন?
রাচেল অস্বস্তিতে পা বদল করে দাঁড়ায়। সবচাইতে ভয়ঙ্কর ব্যাপারটা হচ্ছে…মনে হচ্ছে কেউ এই সবকিছু পরিকল্পনা করে করছে, যেন কেউ চাইছিল সে এখানে আসুক, আর-
এরপর ওপর থেকে একটা ব্যথায় কাতর, চাপা আর্তনাদ ভেসে আসে-জাডের গলা, কোন সন্দেহ নেই। উনি হয়তো বাথরুমে পড়ে গেছেন অথবা হোঁচট খেয়ে পা ভেঙে ফেলেছেন, বা মাজার হাড় মচকে ফেলেছেন; বুড়োদের হাড় খুব নরম। আর তুমি কি হাবিজাবি ভাবছো এখানে দাঁড়িয়ে? চার্চের গায়ের লোম রক্তে মাখা ছিল, রক্ত। জাড আঘাত পেয়েছেন আর তুমি এখানে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে আছো? সমস্যাটা কি তোমার?
“জাড!” তার গলায় আবারো আওয়াজ ফিরে আসে এবং সে দৌড়ে সিঁড়ির ওপর উঠতে থাকে।
সে আগে কখনো জাডের বাসার ওপরতলায় আসেনি। হলের জানলাটা নদীর দিকে মুখ করা, পশ্চিমমুখী; তাই জায়গাটা এখনো খুব অন্ধকার। সিঁড়ির রেলিঙের পাশ দিয়ে হলটা বাড়ির পেছনের দিকে চলে গেছে। দেয়ালে একটা প্রাচীন গ্রীসের দালানের ছবি টাঙ্গানো।
(জেল্ডা অনেক বছর ধরে তোমার অপেক্ষায় আছে আর এবার শুর অপেক্ষা শেষ হতে চলছে। ঠিক দরজাটা খোল, তোমাকে ধরার জন্যে জেল্ডা সেখানেই থাকবে, ওর বাঁকানো পিঠ নিয়ে, পেশাব আর মৃত্যুর গন্ধ নিয়ে। আজ জেন্ডার পালা এসেছে)
কাতর, চাপা আর্তনাদটা আবারো ভেসে আসে, ডানের দ্বিতীয় দরজার ওপাশ থেকে।
রাচেল দরজাটার দিকে হাঁটতে থাকে। তার জুতোর হিল মেঝের বোর্ডে খট-খট শব্দ করছে। তার মনে হচ্ছে সে কোন ওয়ার্পের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে-টাইম ওয়ার্প বা স্পেস ওয়ার্ল্ড না, বরং সাইজ ওয়ার্স। এগোনোর সাথে সাথে সে ছোট হতে শুরু করেছে। প্রাচীন গ্রীসের দালানের ছবিটা মনে হচ্ছে ক্রমশ উঁচু হয়ে যাচ্ছে। দরজার কাচের গোলাকার হাতলটা মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওর চোখের উচ্চতায় চলে আসবে। সে হাতলটা ধরার জন্যে হাত বাড়ায়…এবং সেটা স্পর্শ করার আগেই সেটা ঝটকা মেরে খুলে যায়।
সেখানে জেল্ডা দাড়িয়ে আছে।
সে কুঁজো হয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে আছে এবং ওর পিঠ মুচড়ে বাঁকা হয়ে গেছে। ওর শরীর এতোটাই বিকৃত হয়েছে যে ওকে দু ফিটের মত লম্বা একটা বামনের মত দেখাচ্ছে। এবং কোন এক অদ্ভুত কারণে জেন্ডা গেজের কবরের পোশাক পরে আছে। কিন্তু এটা জেল্ডাই, ওর চোখগুলো এক উন্মাদ আনন্দে জ্বলজ্বল করছে, মুখটা একদম বেগুনী। জেল্ডা চিৎকার করে বলে, “আজ তোকে আমি বাগে পেয়েছি, রাচেল। আমি তোর পিঠ আমার পিঠের মত মুচড়ে দেব আর তোকে সারাজীবন বিছানায় পচে গলে মরতে হবে। বিছানা থেকে তুই আর জীবনেও উঠতে পারবি না, জীবনেও না-”
চার্চ জেন্ডার এক কাঁধের ওপর বসে আছে। জেল্ডার চেহারা হঠাৎ মোচড়াতে মোচড়াতে পরিবর্তন হয়ে যায়। রাচেল বিষম আতঙ্ক নিয়ে দেখলো যে এটা আসলে জেল্ডা না-ও কিভাবে এই ভুলটা করতে পারলো? এটা তো গেজ। ওর মুখটা কালো হয়ে যায়নি, বরং মুখটা রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। আর ওর মুখটা ফুলে গেছে, যেন ও প্রচন্ডভাবে আঘাত পেয়েছিল এবং এরপর কেউ আনাড়ি হাতে ওকে ঠিক করে দিয়েছে।
রাচেল চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকে, দুহাত সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে। গেজ ছুটে গিয়ে তার মায়ের দুহাতে নিজেকে সপে দেয়। পুরো সময়টা সে তার এক হাত পিছমোড়া করে রাখে, যেন সেই হাতে সে কোন বনো ফুলের তোড়া ধরে আছে।
“আমি তোমার জন্যে একটা গিফট এনেছি, মা!” গেজ চিৎকার করে বলে। “আমি তোমার জন্যে একটা গিফট এনেছি, মা! আমি তোমার জন্যে একটা গিফট এনেছি, আমি তোমার জন্যে একটা গিফট এনেছি!”
অধ্যায় ৬০
লুইসের চোখে গনগনে সূর্যের আলো পড়লে সে জেগে ওঠে। সে বিছানা থেকে ওঠার চেষ্টা করলে পিঠে ব্যথার ঘাইয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। আবারো বালিশের ওপর ধপাস করে শুয়ে পড়ে। নিজের শরীরের দিকে নজর বুলিয়ে দেখে সে। বাইরের পোশাক পড়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।
বেশ কিছুক্ষণ সেভাবেই শুয়ে থাকে লুইস। তার শরীরের প্রত্যেকটি পেশি আড়ষ্ট হয়ে আছে। নিজেকে ধীরে ধীরে ওই অবস্থা থেকে বের করার চেষ্টা করে। এর পর সে উঠে বসে।
“ওহ শিট,” সে বিড়বিড় করে। তার স্পষ্ট মনে হচ্ছে রুমটা মৃদুভাবে দুলছে। তার পিঠটা নষ্ট দাঁতের মত ব্যথায় টনটন করছে। মাথা নাড়লে তার মনে হয় তার ঘাড়ের রগের জায়গায় কতগুলো মরিচা পড়া হ্যাচকো ব্লেড লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। তবে সবচাইতে মারাত্মক অবস্থা ওর হাঁটুর। সেখানে Ben- Gaz. মাখিয়ে দুই পয়সার লাভও হয়নি। তার উচিত ছিল একটা কটিশনের ইঞ্জেকশন নেয়া। হাঁটুর কাছে তার প্যান্টটা এমনভাবে টাইট হয়ে লেগে আছে যেন ভেতরে কোন বেলুন ফুলিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
“খুব ভালো,” সে বিড়বিড় করে। “ফার্স্ট ক্লাস ডাক্তারি।
সে বিছানার পাশে পা নামিয়ে বসার জন্যে খুব ধীরে ধীরে আহত পা টা বাঁকা করতে চেষ্টা করে। ব্যথা সহ্য করার জন্যে তার এক ঠোঁট আরেক ঠোঁটের সাথে এতো জোরে চেপে ধরে যে সেগুলো পুরো সাদা হয়ে যায়। যখন পাটা একটু একটু করে বাঁকা হতে শুরু করে, সে মনোযোগ দিয়ে ব্যথার কথাবার্তা শোনার চেষ্টা করে, এবং বোঝার চেষ্টা করে, অবস্থা কতটা নাজুক।
গেজ! গেজ কি এসেছে?
ভাবনাটা তাকে ব্যথা সত্ত্বেও নিজের দু পায়ে দাঁড় করিয়ে দেয়। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। তাদের রুম থেকে প্রথমে গেজের রুমে যায়। সে গেজকে পাগলের মত খুঁজতে থাকে, গেজের নাম বিড়বিড় করতে করতে। কিন্তু রুমে গেজ নেই। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এলির রুমে যায়। সেটাও খালি। এরপর সে তাদের বাড়তি রুমটাতে যায়, যেটা রাস্তার দিকে মুখ করা। সেটাও খালি। তবে-
রাস্তার ওই পাড়ে একটা অচেনা গাড়ি পার্ক করা, জাডের গাড়ির পেছনে।
তাতে কী হয়েছে?
ওই পাশে একটা অচেনা গাড়ি ঝামেলার সংকেত হতে পারে। সেটাই সমস্যা।
লুইস জানালার পর্দা এক পাশে সরিয়ে গাড়িটা ভালো করে দেখে। ছোট একটা নীল গাড়ি। আর সেটার ওপরে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে চার্চ, হয়তো ঘুমোচ্ছে।
সে পর্দাটা ছেড়ে দেয়ার আগে বেশ লম্বা সময় নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। জাডের সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে। তাতে কী? আর গেজের কী হয়েছে সেটা বোঝার জন্যে আরো অপেক্ষা করতে হবে। চার্চ ফিরে এসেছিল দুপুর একটার দিকে, আর এখন বাজে মাত্র সকাল নয়টা। মে মাসের এক সুন্দর দিনের সকাল নয়টা। সে ভাবে সে নিচে গিয়ে কফি বানাবে নিজের জন্যে, এরপর হিটিং প্যাডটা বের করে সেটা তার হাঁটুতে পেঁচিয়ে-
—আর চার্চ ওই গাড়ির ওপরে কী করছে?
“আরে ধুর,” সে উঁচু গলায় স্বগতোক্তি করে নিচতলায় যাবার জন্যে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে পা ফেলতে থাকে। বিড়াল হচ্ছে অলসের গুষ্টি,” কোন জায়গায় আরাম পেলেই সেটা সে নিজের বিছানা বানিয়ে ফেলে।
কিন্তু চাৰ্চতো এখন আর রাস্তা পেরোয় না, মনে নেই?
“ধুর, ফালতু চিন্তা,” সে বিড়বিড় করে বলে এবং সিঁড়ির মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে যায়। সে নিজের সাথে কথা বলছে, ব্যাপারটা ভালো লক্ষণ না। ব্যাপারটা-
জঙ্গলে কাল রাতে জিনিসটা কি ছিল?
ব্যাপারটা অনাহূতের মত তার মাথায় আসে এবং সেটা ভেবে সে আবারো তার ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরে, যেমনটা বিছানা থেকে ওঠার সময় করেছিল। সে কাল রাতের ওই জিনিসটাকে নিয়ে একটা স্বপ্ন দেখেছে। সে স্বপ্নে দেখেছে জিনিসটা তাকে ছুঁয়ে দিয়েছে, তার ভেতরের যা কিছু পবিত্র ছিল তা সব আজীবনের জন্যে নষ্ট করে দিয়েছে। আর সেটা তাকে শুধু মানুষখেকো বানায়নি বরং মানুষখেকোদের সর্দার বানিয়ে দিয়েছে। সে দেখে সে পেট সেমেটারিতে আছে, কিন্তু একা নয়। বিল এবং টিমি ব্যাটারম্যানও সেখানে ছিল। জাডও সেখানে ছিলেন, তাকে লাগছিল মরা লাশের মত। তার কুকুর স্পট তার পাশে বসে ছিল এবং সেটার কলারে বাধা দড়িটা ছিল তার হাতে। লেস্টার মরগানও তার লম্বা লোহার শিকলে বাধা ষাঁড় হ্যানরাট্টিকে নিয়ে সেখানে উপস্থিত ছিল। হ্যানরাট্টি মাটিতে বসে চারদিকে হিংস্র চোখে তাকাচ্ছিল। এবং কোন এক কারণে রাচেলও সেখানে ছিল। তার হয়তো খাবার টেবিলে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটেছিল হয়তো কেচাপের বোতল থেকে ক্যাচাপ ছিটকেছে অথবা ক্রেনবেরি জেলির ডিস উল্টে গেছে। কারণ তার জামায় ছিল লাল ছোপ ছোপ দাগ।আমার আশেপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট
আর ধ্বংসস্তূপের পেছনে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের মত লম্বা, গিরগিটির মত চামড়া, জ্বলন্ত হারিকেনের মত হলুদ চোখ আর কানের বদলে পেঁচানো শিং ওয়ালা জিনিসটা। উইন্ডিগোটাকে দেখে মনে হচ্ছিল সেটা কোন গিরগিটি আর মানবীর মিলনের ফলে জন্ম নিয়েছে। জিনিসটা তার তীক্ষ্ণ নখওয়ালা আঙুল সবার দিকে তাক করলে সবাই মাথা উঁচু করে সেটার দিকে তাকায়।
“থাম,” লুইস ফিসফিস করে বলে এবং নিজের গলা শুনে নিজেই ভয় পেয়ে যায়। সে ঠিক করে কিচেনে গিয়ে নিজের জন্যে ব্রেকফাস্ট বানাবে, যেকোন সাধারণ দিনের মত। ব্যাচেলরদের ব্রেকফাস্ট, মজাদার কোলেস্টেরলে ভরপুর। ফ্রাইড-এগ স্যান্ডউইচ, সাথে অনেক অনেক মেয়নেজ এবং বারমুডা অনিয়নের স্লাইস। তার নোংরা গা থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে, কিন্তু গোসল সে পরেই করবে। জামাকাপড় ছাড়াটাকে তার অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ বলে মনে হচ্ছে। আর ওর ভয় হচ্ছে ওর ফুলে যাওয়া হাঁটু প্যান্ট থেকে বের করতে হলে ওকে হয়তো ওর ব্যাগে রাখা স্কালপেলটা দিয়ে প্যান্টের পাটা কাটতে হবে। স্কালপেলের মত সূক্ষ্ম যন্ত্র এসব কাজের জন্যে না। কিন্তু বাসায় থাকা কোন ছুরি দিয়েই তার জিন্সের প্যান্টটা কাটা যাবে না, রাচেলের সেলাইয়ের কেচি দিয়েও এই কাজ হবে না।
তবে প্রথমে ব্রেকফাস্ট।
সে কিচেনে যাওয়ার সময় সামনের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে জাডের ড্রাইভওয়েতে পার্ক করা নীল গাড়িটার দিকে তাকায়। গাড়িটির গায়ে শিশির জমে আছে, তার মানে গাড়িটি এখানে বেশ কিছু সময় ধরেই আছে। চার্চ এখনো গাড়ির ছাদেই আছে তবে এখন সে ঘুমোচ্ছে না। চার্চের দিকে চোখ গেলে লুইস দেখে চার্চ তার নোংরা হলদে-সবুজ চোখগুলো দিয়ে তার দিকেই চেয়ে আছে।
লুইস চমকে পিছিয়ে আসে, যেন সে উঁকি দিতে গিয়ে ধরা খেয়ে গেছে। সে কিচেনে গিয়ে ঝনঝন শব্দ করে একটা ফ্রাইং পেন বের করে চুলোয় বসিয়ে দেয়। ফ্রিজ থেকে ডিম নিয়ে আসে সে। কিচেনটা ঝকঝকে, তকতকে। সে শিস্ বাজানোর চেষ্টা করে, এরকম একটা সকালে শিস্ বাজিয়ে সকালটাকে আরো সুন্দর করার জন্যে, কিন্তু সক্ষম হয় না। সবকিছু ঠিকঠাক দেখালেও আসলে সবকিছু ঠিকঠাক নেই। বাসাটাকে মারাত্মক শূন্য লাগছে আর গতরাতের অভিজ্ঞতা এখনো তার ওপর পাথরের মত চেপে আছে। কিছুই ঠিক নেই। তার মনে হয় একটা ছায়া নড়ছে এবং তার ভয় হতে লাগে।
সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাথরুমে গিয়ে দুটো অ্যাসপিরিন নিয়ে অরেঞ্জ জুস দিয়ে গিলে নেয়। চুলার কাছে ফিরে যাবার পথে টেলিফোনটা বেজে ওঠে।
সে সাথে সাথে ফোনটা রিসিভ না করে বোকার মত সেটার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন তার সামনে জটিল কোন ধাঁধাঁ পরিবেশন করা হয়েছে।
ফোনটা রিসিভ করো না লুইস। ফোনটা তোমার জন্যে স্রেফ খাঁটি দুঃসংবাদ বয়ে আনবে। লুইস তুমি এমন এক দড়ি নিয়ে টানাটানি করছো যেটার আরেক মাথা আছে একদম গভীর অন্ধকারে। তুমি সত্যই জানতে চাও না দড়ির ওপাশে কি হচ্ছে। তোমার এখন যেটা করা উচিত সেটা হচ্ছে গ্যারেজ থেকে গাড়িটা নিয়ে হাওয়া হয়ে যাওয়া। খবরদার ফোনটা-
সে ফোনের রিসিভারটা তুলে নেয়। আরউইন গোল্ডম্যান ফোন করেছেন। আর তিনি যখন হ্যালো বললেন ঠিক তখনই লুইস কিচেনের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত পায়ের ছাপ দেখতে পায়-ছোট্ট ছোট্ট কাদা মাখা পায়ের ছাপ— তার মনে হলো তার হার্ট জমে গেছে এবং তার চোখের বলগুলো বড় হয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। তার বিশ্বাস তাকে দেখাচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীর পাগলা গারদের কোন পাগলের মত। এগুলো গেজের পায়ের ছাপ। গেজ রাতে এখানে এসেছিল। অতএব এখন ও কোথায় আছে?
“আরউইন বলছি, লুইস…লুইস? আছো? হ্যালো?”
“হ্যালো, হ্যা, বলুন,” সে বলে এবং তার মনে হচ্ছে সে জানে তিনি কি বলতে যাচ্ছেন। সে নীল রংয়ের গাড়িটার রহস্য বুঝতে পারছে। সে সবই বুঝতে পারছে…বুঝতে পারছে দড়ির ওপাশে কি আছে…সে যদি আগেই বুঝতে পারতো…কিন্তু তা আর সম্ভব না। এখন দড়িটা এবং দড়ির সাথে যা এসেছে সবই তার দায়।
“ওহ, ভেবেছিলাম কেটে গেছে,” তিনি বললেন।
“নাহ, রিসিভার আমার হাত থেকে পিছলে গিয়েছিল,” লুইস জবাব দেয়, শান্ত কন্ঠে।
“রাচেল কি গতরাতে বাসায় ফিরেছে?”
“ওহ, হ্যা, ফিরেছে,” সে নীল গাড়িটার কথা ভাবতে ভাবতে বলে। সেটার ওপর শুয়ে থাকা চার্চের কথা ভাবে আর ভাবে কী নিঃসঙ্গই না লাগছিল গাড়িটিকে। তার চোখ মেঝেতে পায়ের ছাপগুলো অনুসরণ করছে।
“আমার ওর সাথে কথা আছে কিছু,” তিনি বলেন। “এক্ষুনি দরকার। এলির ব্যাপারে।”
“এলি? এলির কী হয়েছে?”
“আমার মনে হয় রাচেলকে-”
“রাচেল এখন এখানে নেই। দোকানে রুটি আর দুধ কিনতে গেছে। এলির কি হয়েছে? বলুন, প্লিজ!”
“আমাদের ওকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। ও কিছু দুঃস্বপ্ন দেখে একদম হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অবস্থা ভালো না হওয়ায়—”
“তারা ওকে সিডেটেড করেছে?”
“মানে?”
“মানে স্নায়ু ঠান্ডা করার জন্যে কিছু দিয়েছে?”
“ও, হ্যাঁ। ওকে একটা পিল দিয়েছিল। এরপর ও ঘুমিয়ে পড়ে।”
ও কিছু বলেছে? কি দেখে এতো ভয় পেয়েছে?” লুইস এখন ফোনের রিসিভারটা প্রচন্ড শক্তি দিয়ে খামচে ধরে আছে।
ফোনের ওপাশে নীরবতা-বেশ লম্বা নীরবতা। তবে এবার লুইস কিছু বলে না।
“ওই জিনিসটাই ডোরি সব চাইতে বেশি ভয় পেয়েছে,” অবশেষে তিনি বললেন। “ও প্রথম দিকে অনেক আবোল তাবোল বলে…এরপর কান্নার জন্যে কিছু বোঝা যায়নি। ডোরি নিজেও…মানে…”
“এলি কি বলেছিল?”
“ও বলে ওজ দ্য গ্রেট অ্যান্ড টেরিব্ল ওর মাকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু ও জিনিসটা উচ্চারণ করে ‘ওজ দ্য গেয়িট অ্যান্ড টেয়িল।” যেভাবে আমাদের আরেক মেয়ে জেল্ডা উচ্চারণ করতো। বিশ্বাস করো লুইস, আমি চাইছিলাম এই প্রশ্নটা রাচেলকে করি। তোমরা এলিকে জেল্ডা আর জেন্ডার মৃত্যুর ব্যাপারে কতটুকু বলেছো?”
লুইস তার চোখ বন্ধ করে ফেলে; ওর মনে হচ্ছে ওর পায়ের নিচের মাটি মৃদু কাঁপছে। মিস্টার গোল্ডম্যানের কণ্ঠটা মনে হচ্ছে খুব ঘন কুয়াশা ভেদ করে আসছে।
তুমি হয়তো কিছু শব্দ শুনতে পাবে, মানুষের গলার মত। কিন্তু ওসব কিছু না। গুগুলো লুন হাঁসের ডাক, শুনতে মানুষের হাসির মত। হাঁসগুলো থাকে দক্ষিণে। কিন্তু এখানে শব্দ অনেক দূর ভেসে আসে। খুব মজার ব্যাপার।
“লুইস, আছো?”
“ওর অবস্থা কি ভালোর দিকে?” লুইস জিজ্ঞেস করে। তার নিজের কন্ঠও যেন দূর থেকে ভেসে আসছে। “আর কেন এরকম হলো ডাক্তার কিছু বলেছে?”
“ওর ভাইয়ের ফিউনারেলের শক থেকে,” গোল্ডম্যান বলেন। “আমার নিজের ডাক্তার এসেছিলেন। লেনথর্প। ভালো ডাক্তার। উনি বলেছেন এলির গায়ে জ্বর আছে তবে ও ঘুম থেকে উঠার পর হয়তো এসব ঘটনা মনেও করতে পারবে না। কিন্তু তারপরও আমার মনে হয় রাচেলের চলে আসা উচিত। লুইস, আমি ভয় পেয়ে গেছি। আমার মনে হয় তোমারও চলে আসা উচিত।”
লুইস কোন জবাব দেয় না।
“লুইস, গেজ মারা গেছে, “ গোল্ডম্যান বলেন। “আমি জানি এটা তোমাদের জন্যে মেনে নেয়া অনেক কঠিন। কিন্তু তোমাদের মেয়ে তো বেঁচে আছে। এবং এখন ওর তোমাদের দুজনকেই খুব প্রয়োজন।”
ঠিকই বলেছেন। আপনি একটা বুড়ো ভাম হতে পারেন, কিন্তু ১৯৬৫র এপ্রিলের সেই দিনে আপনার দুই মেয়েকে নিয়ে ঘটা সেই দুঃসহ ঘটনা হয়তো আপনার মাথায় কিছু আক্কেলের উদয় ঘটিয়েছে। আমি জানি ওর আমাকে প্রয়োজন, কিন্তু আমি আসতে পারবো না, কারণ আমার ভয় হচ্ছে-খুব ভয় হচ্ছে- যে আমার হাতে হয়তো ওর মায়ের তাজা রক্ত লেগে আছে।
লুইস তার হাতগুলোর দিকে তাকায়। হাতের নখের নিচে জমে থাকা মাটির দিকে তাকায়, যেসব কিচেনের মেঝের পায়ের ছাপের মাটির মতই।
“আচ্ছা,” সে বলে। “আমি বুঝতে পেরেছি। আমরা যত শীঘ্র পারি চলে আসবো, আরউইন। পারলে আজ রাতেই চলে আসবো। ধন্যবাদ।”
“আমরা যতটুকু সম্ভব করছি,” তিনি বলেন। “হয়তো আমরা অনেক বুড়িয়ে গেছি। লুইস, সেটা হয়তো আমরা সব সময়ই ছিলাম।”
“ও কি আর কিছু বলেছে?” লুইস জিজ্ঞেস করে।
গোল্ডম্যানের জবাবটা তার কাছে মনে হলো ফিউনারেলের ঘন্টার মত।
“অনেক কিছুই বলেছে, তবে আমি শুধু এটুকুই বুঝেছি, ‘প্যাক্সকাও বলেছে অনেক দেরি হয়ে গেছে।”
সে টেলিফোনটা রেখে হতবুদ্ধি অবস্থায় চুলার দিকে এগোতে থাকে; হয়তো ব্রেকফাস্ট তৈরি করে আপাতত সব কিছু ভুলে থাকতে। কিচেনের মাঝামাঝি গিয়ে ওর মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে, চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করে। ও মেঝেতে পড়ে যাচ্ছে… যাচ্ছে তো যাচ্ছেই…মনে হচ্ছে ও ঘোলাটে গভীরতায় ডুবে আছে। ওর মনে হয় ও পড়ে গিয়ে বেশ কয়েকটা পাক খায়। এক সময় তার আহত হাঁটুতে আঘাত লাগে এবং একটা তীব্র ব্যথার ঝলকানি তার পা থেকে সারা শরীরে পৌঁছে যায়। সে কিছুক্ষণ হামাগুড়ি দিয়ে এগোয় এবং তার চোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে যায়।
অবশেষে সে উঠে দাঁড়ায়। সে দুলছে। কিন্তু তার মাথা এখন পরিস্কার লাগছে।
পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এবং সে সত্যি সত্যি প্যান্টের পকেটের ওপর হাত রেখে গাড়ির চাবিটার আরামদায়ক অস্তিত্ব অনুভব করে। সে এক্ষুনি পারে তার গাড়িটায় উঠে শিকাগো চলে যেতে। সেখান থেকে সে এলিকে নিয়ে গা ঢাকা দিবে। গোল্ডম্যান হয়তো ততক্ষনে বুঝতে পারবে কোন একটা ঝামেলা আছে, সেটা একটা সমস্যা। কিন্তু তার পরও সে এলিকে সাথে করে নিয়ে যাবে, দরকার হলে ওকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে।
সে তার হাত চাবির ফুলে থাকা অংশ থেকে সরিয়ে নেয়। পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেটা মরে গেছে। সেটা তার অনুশোচনা, ক্লান্তি বা হতাশার কারণে নয়। এর কারণ মেঝের পায়ের ছাপগুলো। মনে মনে সে স্পষ্ট দেখতে পায় সে দেশের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছে, প্রথমে ইলিনয়েস, তারপর ফ্লোরিডা; প্রয়োজন পড়লে বিশ্বের আরেক মাথায় পালিয়ে যেতেও তার আপত্তি নেই। কিন্তু এমন একদিন ঠিকই আসবে যেদিন সে তার দরজা খুলে দেখবে সেখানে গেজ দাড়িয়ে আছে; ওকে দেখাবে ওর পূর্বের অবয়বের একটা হাস্যকর রেপ্লিকার মত, ওর নীল চোখগুলো হবে নোংরা হলুদ আর ও মিটমিট করে হাসবে লুইসকে দেখে। অথবা এলি হয়তো গোসলের জন্যে বাথরুমের দরজা খুলে দেখবে বাথটাবে গেজ দাড়িয়ে আছে, তার সারা গায়ে সেই অ্যাক্সিডেন্টের অসংখ্য ক্ষত; তার শরীরে কবরের গন্ধ।
সেই দিন আসবেই-তার মনে এক ফোঁটা সন্দেহও নেই।
“আমি এতো বড় বোকামি কিভাবে করলাম?” সে শূন্য রুমে স্বগতোক্তি করে। “কিভাবে?”
বোকামি না লুইস, শোক। এর মধ্যে পার্থক্য আছে…খুব সূক্ষ্ম, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। এটাই ওই জায়গাটার শক্তির উৎস। সেটার শক্তি বাড়ছে, জাড বলেছিলেন এবং তিনি সঠিক ছিলেন-এবং এখন তুমি নিজেও সেই শক্তির একটা অংশ। সে তোমার শোক থেকে নিজের খাবার নিংড়ে বের করে নিয়েছে, এবং সে তোমার শোকের মাত্রাও বাড়িয়ে দিয়েছে…দ্বিগুন করেছে, বর্গ করেছে, বাড়াতে বাড়াতে nতম পাওয়ারে নিয়ে গেছে। এটা শুধু শোক থেকেই নিজের খাবার নিংড়ে নেয় না, এটা তোমার মানসিক সুস্থতাকেও নিজের খাবার বানিয়েছে। এটা খেয়েছে তোমার স্ত্রীকে, এবং প্রায় নিশ্চিতভাবে তোমার সবচাইতে কাছের বন্ধুটিকেও এবং তোমার ছেলেকেও। এমনই হয়, যখন রাতের আঁধারে তোমার দরজায় অশুভ কিছু এসে কড়া নাড়লে তুমি তাকে তাড়িয়ে দিতে দেরি কর।
আমি এখন আত্মহত্যা করবো, খুব সম্ভবত। এ সুযোগ এখনো আমার হাতে আছে। আমার ব্যাগে তার জন্যে বেশ কার্যকরী জিনিসও আছে। জিনিসটা সবকিছু খুব নিখুঁতভাবে সাজিয়েছে, একেবারে শুরু থেকে। ওই গোরস্তান অথবা উইন্ডিগো, যেই হোক জিনিসটা। সেটাই আমাদের বিড়ালকে রাস্তায় ঠেলে দিয়েছে মরার জন্যে, এবং খুব সম্ভবত গেজকেও। সেটা রাচেলকেও ডেকে এনেছে, তবে তার সুবিধামত সময়ে। আমার এখন আত্মহত্যাই করা উচিত…এবং আমি করতেও চাই।
কিন্তু এর আগে কিছু জিনিস ঠিক করা দরকার, তাই না?
হ্যা। দরকার।
গেজের ব্যাপারটা দেখা দরকার। গেজ এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সে পায়ের ছাপ অনুসরণ করে, সেগুলো ডাইনিং রুম থেকে লিভিং রুম হয়ে ওপরের সিঁড়িতে উঠে গেছে। এখানে ছাপগুলো অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে, কারণ সে ওপর থেকে নামার সময় না দেখে সেগুলো মাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর পায়ের ছাপটা তার বেডরুমে যায়। সে এখানে এসেছিল, লুইস অবাক হয়ে ভাবে, সে একদম এখানেই এসেছিল, এরপর সে দেখতে পায় যে তার মেডিকেল ব্যাগের ডালাটা খোলা।
ভেতরের জিনিসগুলো, যেগুলো সে সব সময় খুব গুছিয়ে রাখে, এলোমেলো অবস্থায় আছে। ব্যাগে যে স্কালপেলটা নেই সেটা বুঝতে তার খুব বেশি দেরি হয় না এবং সেটা বুঝতে পেরে সে দু হাতে মুখ ঢেকে কিছুক্ষণ বসে থাকে, তার গলা দিয়ে মৃদু গোঙানীর শব্দ বেরুচ্ছে।
অবশেষে সে ব্যাগটা খুলে আবারো ভেতরের জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে থাকে।
আবারো নিচতলায় থামে।
ভাঁড়ার ঘরের দরজা খোলার শব্দ হলো। একটা কাপবোর্ড খোলার এবং এরপর বন্ধ করার শব্দ হলো। এরপর ক্যান ওপেনারের কর্কশ গোঙানি। সবশেষে গ্যারেজের দরজা খোলার এবং বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো। এরপর বাড়িটা মে মাসের রোদে শূন্যভাবে দাঁড়িয়ে থাকে, যেমনটা দাঁড়িয়ে ছিল গত বছরের আগস্ট মাসের এক দিনে, এক নতুন পরিবারের আগমনের অপেক্ষায়…যেমন হয়তো আরেকটা নতুন পরিবারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবে ভবিষ্যতের কোন এক সময়। হয়তো কোন সদ্য বিবাহিত যুবক-যুবতী আসবে-ছেলেটি কোন ব্যাংকের ক্রেডিট ডিপার্টমেন্টে কাজ করবে, আর মেয়েটি হয়তো কোন ডেন্টাল সার্জন বা চোখের ডাক্তারের এ্যাসিসটেন্ট হবে। ছেলেটা হয়তো ফায়ারপ্লেসের জন্যে কাঠ চিরবে আর মেয়েটা হয়তো চুল পনিটেল করে মিসেস ভিন্টনের মাঠে ঘাসফুল কুড়োতে যাবে, তার সোনালী চুল রোদে ঝকঝক করবে কিন্তু সে কখনই জানবে না যে এই আকাশে একটা অদৃশ্য শকুন উড়ে বেড়াচ্ছে। তারা নিজেরা নিজেদের অভিনন্দন জানাবে, তাদের কোন ফালতু কুসংস্কারে বিশ্বাস না করার জন্যে, এই বাড়িটা কেনার মত প্রয়োজনীয় দৃঢ় মনোবল থাকার জন্যে। তারা হয়তো তাদের বন্ধুদের দাওয়াত দিয়ে বলবে বাড়িটার ইতিহাসের জন্যে তারা বাড়িটা প্রায় পানির দরে পেয়েছে। তারা তাদের এটিতে থাকা ভূতের ব্যাপারেও কৌতুক করবে এবং ক্যাসেট প্লেয়ারে ব্যাকগেমন বা মাইল বর্নের গান শুনবে।
এবং হয়তো তাদের একটি পোষা কুকুর থাকবে।
অধ্যায় ৬১
একটা রাসায়নিক সার ভরা অরিংকো ট্রাক দ্রুতগতিতে লুইসের গায়ে দমকা হাওয়া লাগিয়ে চলে গেল। এরপর লুইস রাস্তা পার হয়, তার পিছু পিছু তার ছায়াও আসছে। তার এক হাতে একটি মুখ খোলা বিড়ালের খাবারের ক্যান।
চার্চ তাকে আসতে দেখে উঠে বসে এবং সাবধানী চোখে নিরীক্ষণ করতে থাকে।
“হাই, চার্চ, “ লুইস বাড়িটা পরীক্ষা করে দেখতে দেখতে বলে। “ক্ষুধা লেগেছে?”
সে খাবারের ক্যানটা নীল গাড়িটার ট্রাঙ্কের ওপর রাখে এবং সাবধানে চার্চকে দেখতে থাকে। চার্চ খাবারের লোভে গাড়ির ছাদ থেকে ট্রাঙ্কে নেমে আসে এবং খেতে শুরু করে। লুইস তার এক হাত জ্যাকেটের পকেটে ঢোকায়। চার্চ তার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকায়, যেন সে লুইসের মতলব আঁচ করতে পারছে। লুইস মুচকি হেসে গাড়ি থেকে এক পা সরে দাঁড়ায়। চার্চ আবারো খেতে শুরু করে এবং লুইস তার জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা সিরিঞ্জ বের করে আনে। সে সিরিঞ্জের কাগজের মোড়ক খুলে ফেলে এবং সেটায় পচাত্তর মিলিগ্রাম মরফিন ঢুকিয়ে নেয়। সে মাল্টিডোজের ভায়ালটা তার পকেটে রেখে চার্চের দিকে হেঁটে যায়, যে আবারো চারদিকে সন্দিগ্ধভাবে তাকাচ্ছে। লুইস চার্চের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে, “খেয়ে নাও, চার্চ। চল চল চল, তাইনা?” সে চার্চের ঘাড়ের লোমে হাত বুলিয়ে দেয় এবং চার্চ কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে আবার খেতে শুরু করে। লুইস এবার চার্চের পেটের কাছে চেপে ধরে পাছার মধ্যে সিরিঞ্জের সুইটা ঢুকিয়ে দেয়।
চার্চ তার হাত থেকে ছোটার জন্যে পড়িমরি করে তড়পাতে থাকে আর খামচি মারতে থাকে, কিন্তু লুইস তাকে চেপে ধরে রাখে, সিরিঞ্জটা একদম খালি করা পর্যন্ত। চার্চ গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে লাফিয়ে পড়ে। সে হিংসাত্মক ভঙ্গিতে লুইসের দিকে তার হলদে-সবুজ চোখে তাকায় এবং চায়ের কেটলির মত হিসিয়ে উঠতে থাকে। চার্চ লাফিয়ে পড়ায় তার পাছায় বিদ্ধ সিরিঞ্জটা নিচে বাড়ি খেয়ে ভেঙে গেছে। তাতে লুইসের কোন ভাবান্তর হলো না। ওই জিনিস তার কাছে আরো আছে।
চার্চ প্রথমে রাস্তার দিকে যেতে শুরু করলেও পরে আবার বাসার দিকে ফিরে যেতে থাকে, যেন সে ভুলে কিছু ফেলে গেছে। অর্ধেক পথে সে মাতালের মত দুলতে শুরু করে। পোর্চে ওঠার সিঁড়ির প্রথম ধাপটাতে ওঠে এবং ঢলে পড়ে যায়। সেখানে এক পাশ হয়ে শুয়ে ধীরে ধীরে শ্বাস টানতে থাকে সে।
লুইস নীল চেভেট গাড়িটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে। সে যে ব্যাপারে আগে থেকেই প্রায় নিশ্চিত হয়ে আছে, এখন তার প্রমান পায়। গাড়ির সিটে রাচেলের পার্স, স্কার্ফ এবং একটা ডেল্টা এয়ারলাইনের ফোল্ডার থেকে বেরিয়ে থাকা প্লেনের টিকিট।
যখন সে জাডের বাসার পোর্চের দিকে এগুতে আরম্ভ করে, চার্চের বুকের ওঠা নামা একদম বন্ধ হয়ে গেছে। চার্চ মারা গেছে। আবারো।
লুইস সেটাকে ডিঙ্গিয়ে পোর্চের সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল।
“গেজ?”
জাডের বাড়ির সামনের হল ঘরটায় বেশ ঠান্ডা লাগছে। ঠান্ডা এবং অন্ধকার। তার কথাটা নীরবতার ওপর এমনভাবে আছড়ে পড়ে যেমনটা কোন পাথর আছড়ে পড়ে গভীর কূপের জলে।
“গেজ?”
কিছুই না। এমনকি পার্লারের ঘড়ির টিকটিকও বন্ধ হয়ে গেছে। আজ সকালে ঘড়িতে চাবি দেয়ার কেউ ছিল না।
কিন্তু ফ্লোরে পায়ের ছাপ দেখা যাচ্ছে।
লুইস লিভিং রুমে যায়। সেখানে সিগারেটের গন্ধ, তবে বেশ পুরনো। সে জানালার পাশে জাডের চেয়ারটা দেখতে পায়। সেটা এক পাশে ঠেলে সরানো আছে, যেন কেউ সেখান থেকে তড়িঘড়ি করে উঠে গেছে। জানালার দেয়ালে একটা অ্যাশট্রে এবং সেটার ওপর একটা জ্বলে শেষ হওয়া সিগারেটের ছাইয়ের রোল।
জাড এখানে বসে কিছুর দিকে নজর রাখছিলেন। কিন্তু কিসের দিকে? অবশ্যই আমার জন্যে, আমার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়। তবে উনি আমাকে দেখেননি। যেভাবেই হোক এড়িয়ে গেছেন।
লুইস লাইন করে রাখা চারটা বিয়ারের ক্যানের দিকে তাকায়। এই কটা বিয়ার তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট না। হয়তো তিনি সেই সময় উঠে বাথরুমে গিয়েছিলেন। তবে যাই হোক, সেটাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে মেনে নেয়া যায় না, তাই না?
কাদামাখা পায়ের ছাপ জানালার চেয়ারের দিকে এগিয়ে গেছে। মানুষের ছাপের সাথে কিছু বিড়ালের পায়ের হালকা ছাপও আছে। চার্চ গেজের ছোট্ট জুতোর ছাপের ওপর দিয়ে হেঁটে গেছে এবং তখন চার্চের পায়ে কাদা লেগে হালকা ছাপগুলো পড়েছে। এপর ছাপগুলো কিচেনের দরজার দিকে গেছে।
লুইস ছাপগুলো অনুসরণ করে। তার বুকে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে।
ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ফেলে সে এবং মেঝেতে জাডের সবুজ প্যান্ট পড়া ছড়িয়ে থাকা পা আর গায়ের চেক শার্ট দেখতে পায়। বৃদ্ধ রক্তে ভেসে যাওয়া মেঝেতে পড়ে আছেন, সেই রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে যাচ্ছে।
লুইস হাত দিয়ে নিজের গালে থাপ্পর মারে, যেন সে অন্ধ হয়ে যেতে চাইছে। কিন্তু সেটা সম্ভব না; সে চোখ জোড়া দেখতে পাচ্ছে, জাডের খোলা চোখ জোড়া। তিনি যেন লুইসকে দোষারোপ করছেন; হয়তো নিজেকেও করছেন এই সব কিছুর সূচনা করে দেয়ার জন্যে।
কিন্তু তিনি কি দায়ি? লুইস ভাবে। তিনি কি আসলেই দায়ি?
জাডকে জায়গাটার কথা বলেছে স্টানি বি., আর স্টানি বি.কে সেটার কথা বলেছে তার বাবা, এবং স্টানি বি.র বাবাকে বলেছে তার বাবা, যিনি ইন্ডিয়ানদের সাথে ব্যবসা করা শেষ ব্যবসায়িদের একজন, যিনি একজন ফ্রেঞ্চ, এবং সে সময় ফ্রাঙ্কলিন পিয়ার্স জীবিত ছিলেন এবং ছিলেন দেশের প্রেসিডেন্ট।
“ওহ জাড়,আমাকে ক্ষমা করে দিন,” সে বিড়বিড় করে বলে।
জাড তার শূন্য দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে।
“প্লিজ, মাফ করে দিন,” লুইস আবারো বলে।
তার পা নিজে থেকেই নড়তে আরম্ভ করে এবং তার মন গত থ্যাঙ্কসগিভিংয়ের কথা কল্পনা করতে থাকে। সেদিনের রাতের কথা না, যখন সে আর জাড মিলে চার্চকে পেট সেমেটারিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। বরং সেদিন দিনের বেলাতে নরমা টেবিলে যে টার্কি ডিনার পরিবেশন করেছিলেন তার কথা। সেদিন নরমা তাদের কিচেনের লোয়ার ড্রয়ার থেকে একটা লন কাপড়ের টেবিল ক্লথ বের করে টেবিলের ওপর বিছিয়ে দিয়েছিলেন। লুইস টেবিল থেকে কাপড়টা নিয়ে সেটা জাডের নিথর দেহের ওপর বিছিয়ে দেয়। জিনিসটা মাটিতে নামতে থাকা প্যারাশুটের মত জাডের দেহের ওপর বিছিয়ে যায়, সাথে সাথেই সেটির গায়ে কতগুলো লাল লাল গোলাপের পাপড়ির মত দাগ দেখা দেয়।
“আমাকে মাফ করে দিন,” সে তৃতীয় বারের মত বলে। “মাফ করে—”
ওপর তলায় কিছু নড়ে ওঠে, কিছু ঘষা খাওয়ার শব্দ হয়। লুইসের কথা তার ঠোঁটেই মরে যায়। শব্দটা মৃদু এবং খুব নরম, তবে সেটা যে ইচ্ছাকৃতভাবে করা, তাতে তার মনে কোন সন্দেহ নেই। শব্দটা তাকে শোনানোর জন্যেই করা হয়েছে।
তার হাত কেঁপে উঠতে চায় কিন্তু সে তা হতে দেয় না। হেঁটে সে দাবার ঘরের ডিজাইনের রেক্সিনে ঢাকা টেবিলটার কাছে যায়। তার পকেট থেকে আরো তিনটা বেকটন-ডিকসন সিরিঞ্জ বের করে সেগুলো কাগজের মোড়ক থেকে বের করে টেবিলের ওপর সুন্দরভাবে লাইন করে রাখে। সে আরো তিনটি মাল্টিডোজ ভাইল বের করে সিরিঞ্জগুলো ভরে নেয়। সিরিঞ্জের প্রত্যেকটিতে যে পরিমাণ তরল আছে তা দিয়ে একটি করে বড়সড় ঘোড়া মেরে ফেলা যাবে-অথবা হ্যানরাট্টি নামের ষাঁড়টাকে; যদি প্রয়োজন পড়ে। সে সিরিঞ্জগুলো আবারো নিজের পকেটে ঢুকিয়ে রাখে।
কিচেন থেকে বেরিয়ে লিভিং রুম পেরিয়ে সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়ায়।
“গেজ?”
ওপরের অন্ধকার থেকে একটা শিশুসুলভ খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসে—সেই হাসির শীতলতায় লুইসের পিঠের চামড়া কাটা দিয়ে ওঠে।
সে ওপরে উঠতে শুরু করে। ওপরে উঠার সময়টা তার কাছে বেশ লম্বা মনে হয়। সে বুঝতে পারে কোন অভিযুক্ত আসামীকে যখন পিছমোড়া করে হাত বাঁধা অবস্থায় মঞ্চে ওঠানো হয় তখনও হয়তো তার সময়টা এরকম লম্বা (এবং ভয়ঙ্কর রকম স্বল্প) মনে হয়।
অবশেষে ওপরে ওঠে সে, এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে, দেয়ালের দিকে তাকিয়ে। সে এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে? জানে না। সে বুঝতে পারছে তার মাথা আস্তে আস্তে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সে ব্যাপারটা স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারছে, যেন সেটা এক রকমের অনুভূতি। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। সে ভাবে কোন তুষারের ভারে বোঝাই হওয়া গাছ যখন ঝড়ের বাতাসে উপড়ে যায়, তার ঠিক আগ মুহূর্তে গাছটার যে রকম অনুভূতি হয়-আদৌ যদি গাছেরা কিছু অনুভব করতে পারে-, তারও সেরকমই লাগছে। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং…মজাদার।
“গেজ, আমার সাথে ফ্লোরিডা যাবে?”
আবারো সেই শিশুসুলভ খিলখিল হাসি।
পাশে তাকালে তার স্ত্রীর মৃতদেহের দৃশ্য তাকে আমন্ত্রণ জানায়, যাকে সে একবার দাঁতে কামড়ে ধরে গোলাপ উপহার দিয়েছিল। ওর মৃতদেহ হলের মাঝ বরাবর পড়ে আছে। তার পা দুটোও জাডের পায়ের মত ছড়িয়ে আছে। তার পিঠ আর মাথা একটু বাঁকা হয়ে দেয়ালে ঠেস দেয়া। কেউ বিছানায় বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে গেলে যেমন দেখা যায়, ওকে ঠিক তেমন লাগছে।
লুইস তার মৃত স্ত্রীর দিকে এগিয়ে যায় এবং পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে।
হ্যালো, ডার্লিং, সে ভাবে, তুমি ফিরে এসেছো।
রক্ত ছিটে দেয়ালের ওয়ালপেপারে লেগেছে, নানা আকৃতিতে। রাচেলকে স্কালপেল দিয়ে আঘাত করা হয়েছে বহুবার। এক ডজন বার, দুই ডজন বারও হতে পারে, কে জানে? তার স্কালপেলটা নিজের যোগ্যতার ভালো প্রমান দেখিয়েছে।
হঠাৎ করে লুইস তার স্ত্রীকে দেখতে পায়; প্রকৃত অর্থেই দেখতে পায় এবং সে চিৎকার করতে আরম্ভ করে।
তার তীক্ষ্ণ চিৎকার বাড়ির ভেতর প্রতিধ্বনি আর বিকট নাদ সৃষ্টি করে, যেখানে বর্তমানে শুধুমাত্র মৃত্যুরই বসবাস। তার চেহারা পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে, পেছনের চুল খাড়া হয়ে আছে, চোখগুলো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সে চিৎকার করতে থাকে। তার শুকনো গলার চিৎকারের ধ্বনি নরকের ঘন্টার মত বাজছে। একে একে সব বিভৎস চিত্রগুলো লাগামহীন হয়ে আছড়ে পরে তার মনের দেয়ালে। ইনফার্মারির কার্পেটে ভিক্টর পাস্কোর মৃত্যু, গোঁফে সবুজ পলিথিনের টুকরো নিয়ে চার্চের ফিরে আসা, রাস্তায় পড়ে থাকা গেজের রক্তভেজা বেসবল ক্যাপ … কিন্তু সবচাইতে বেশি দেখলো ঈশ্বরের জলার কাছের সেই জিনিসটা, যেই জিনিসটা একটা আস্ত গাছ উপড়ে দিয়েছিল, সেই হলুদ চোখের জিনিসটা; উইন্ডিগো নামের মৃত জিনিসটা যার স্পর্শ অকথ্য রকমের প্রবৃত্তির জন্ম দেয়।
রাচেলকে শুধু হত্যা করা হয়নি।
কেউ তার ওপর…কেউ তার ওপর নিজের মনের ঝাল মিটিয়ে নিয়েছে।
(ক্লিক!)
দরজা খোলার শব্দ হয়।
লুইস চিৎকাররত অবস্থাতেই মুখ তুলে তাকায়। অবশেষে সে দেখা পায়। এইতো গেজ। ওর মুখ রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে, চিবুক দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত পড়ছে, আর মুখে একটা নারকীয় মুচকি হাসি। তার এক হাতে লুইসের স্কালপেল।
স্কালপেল ধরা হাতটা যখন লুইসের দিকে নেমে আসে, কিছু চিন্তা না করেই একটু পিছিয়ে যায় সে। স্কালপেলটা ঝট করে তার মুখের কাছ দিয়ে চলে যায়, আর গেজ কিছুটা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। সে চার্চের মতই নড়বড়ে। লুইস গেজের পা বরাবর লাথি মারে এবং গেজ উদ্ভট ভঙ্গিতে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। আর সে উঠে পড়ার আগেই লুইস তার দুপাশে দু হাঁটু রেখে চেপে বসে। তার এক হাঁটুর নিচে গেজের স্কালপেল ধরা হাতটা।
“না,” তার নিচে চাপ খাওয়া জিনিসটা বলে উঠে। জিনিসটার মুখ কুচকে গেছে এবং ঘৃণা প্রকাশ পাচ্ছে। “না, না, না – “
লুইস তার পকেটের ভেতর থেকে একটা সিরিঞ্জ খামচে ধরে। তাকে খুব দ্রুত কাজ করতে হবে। নিচের জিনিসটাকে একটা পিচ্ছিল মাছের মত মনে হচ্ছে এবং জিনিসটার কব্জিতে যত জোরে চাপই দেয়া হোক না কেন, সেটা স্কালপেলটা হাত থেকে ছাড়ছে না। এরপর লুইসের মনে হলো যে তার তাকিয়ে থাকা অবস্থাতেই জিনিসটার চেহারা মুচড়ে মুচড়ে পাল্টে যাচ্ছে। প্রথমে চেহারাটা জাডের চেহারার মত পাল্টে গেল; মৃত জাডের শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকা চেহারা। এরপর সেটা বদলে ভিক্টর পাস্কোর বিপর্যস্ত চেহারার মত হয়ে যায় এবং চোখগুলো এলোমেলোভাবে ঘুরতে আরম্ভ করে। ভিক্টরের চেহারাটা অনেকটা আয়নার মত মনে হচ্ছে, কারণ লুইসকেও তার মতই দেখাচ্ছে, ফ্যাকাসে এবং উন্মত্ত। এরপর সেটা আবারো বদলে গেল। এবার সেটা জঙ্গলের সেই জিনিসটার চেহারা ধারণ করলো -নিচু কপাল, মৃত হলুদ চোখ, লম্বা জিভ; দ্বিখন্ডিত এবং চোখা। জিনিসটা মৃদু হাসছে এবং হিস হিস করছে।
“না, না, না-না-না—”
জিনিসটা নিচ থেকে প্রচন্ড ঝটকা দিয়ে লুইসকে সরিয়ে দিতে চায়। লুইসের হাত থেকে সিরিঞ্জটা ছিটকে পড়ে গড়িয়ে হলের মাঝামাঝি চলে যায়। সে তার পকেট থেকে হাতড়ে আরেকটা সিরিঞ্জ বের করে আনে এবং সোজা গেজের পিঠে সেটা বসিয়ে দেয়।
জিনিসটা তার নিচে প্রচন্ডভাবে তড়পাতে শুরু করে এবং তাকে প্রায় ছুঁড়েই ফেলছিল আরেকটু হলে। তিন নাম্বার সিরিঞ্জটা বের করে লুইস ঘোৎ করে একটা শব্দ করে সেটা গেজের বাহুতে বসিয়ে দেয় এবং সিরিঞ্জটা চেপে পুরোটা তরল গেজের দেহে প্রবেশ করিয়ে দেয়। এরপর সে উঠে হলওয়ের দিকে ধীরে ধীরে এগুতে থাকে। গেজ উঠে খুব দ্রুত পায়ে তার দিকে এগুতে শুরু করে। কিন্তু পাঁচ কদম পরেই জিনিসটার হাত থেকে স্কালপেলটা খসে পড়ে। স্কালপেলের ব্লেডটা প্রথমে মেঝে স্পর্শ করে এবং তারপর পুরো স্কালপেলটা। সেটা কাঠের মেঝেতে আঘাত করে কাঁপতে থাকে। দশ কদম পরে জিনিসটার চোখের অদ্ভুত হলদে আলোটা ফিকে হয়ে আসতে থাকে। আর দুই কদম এগিয়ে সেটা হাঁটুতে ভর দিয়ে পড়ে যায়।
এবার গেজ মাথা তুলে লুইসের চোখের দিকে তাকায়-তার ছেলে ওর চেহারা দুঃখী-দুঃখী, যন্ত্রণায় কাতর।
“বাবা!,” ও চিৎকার করে ওঠে, এবং পরমুহূর্তেই মেঝের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।
লুইস নিজের জায়গায় আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর সে সাবধানে গেজের দিকে এগোয়; সে কোন রকম ছলচাতুরীর জন্যে নিজেকে সতর্ক রাখছে। কিন্তু কোন ছলচাতুরী ঘটে না, গেজের হাত খপ করে তাকে খাবলে ধরারও চেষ্টা করে না। সে গেজের গলার নিচে একটা আঙুল দিয়ে ওর পাল্স খুঁজে সেটা চেপে ধরে থাকে। সে তার জীবনে শেষবারের মত ডাক্তারি করছে, পালস চেক করছে যতক্ষণ না সেটা একদম হারিয়ে যায়।
যখন পালস একদমই বন্ধ হয়ে যায় তখন লুইস উঠে দাঁড়িয়ে অলস ভঙ্গীতে হলের অপর প্রান্তে হেঁটে যায়। সে হলের এক কোণে বসে পড়ে এবং নিজেকে দেয়ালের কোণায় চেপে একটা ছোট বলের মত করে গুটিয়ে নেয়। তার মনে হয় সে যদি নিজের আঙুল চুষতে শুরু করে তাহলে সে হয়তো নিজেকে আরো ছোট করে ফেলতে পারবে। তাই সে মুখে তার বুড়ো আঙুলটা ঢুকিয়ে চুষতে শুরু করে।
এভাবে প্রায় দু ঘন্টার মত থাকে…এবং ধীরে ধীরে অন্ধকার এবং খুব- সম্ভব একটা আইডিয়া তার মাথায় আসে। সে তার মুখ থেকে আঙুলটা বের করে। তাতে একটা পপ করে শব্দ হয়। লুইস আবারো চলতে শুরু করে (হেই-হেই! চলো, চলো)।
যে রুমে গেজ লুকিয়ে ছিল, সে রুমে ঢুকে বিছানার চাদরটি নিয়ে আসে লুইস। সে চাদরে তার স্ত্রীর দেহটা মুড়িয়ে নেয়, খুব যত্নসহকারে, ভালবাসার সাথে। সে টেরও পায় না যে সে গুনগুন করছে।
***
জাডের গ্যারেজ থেকে গ্যাসোলিন খুঁজে বের করে লুইস। ঘাস কাটার যন্ত্রটার পাশে পাঁচ গ্যালনের একটা লাল ক্যান। যথেষ্টর চাইতে বেশি। সে শুরু করে কিচেন থেকে, যেখানে জাডের লাশ টেবিল ক্লথের নিচে পড়ে আছে। লুইস সেটা গ্যাসোলিনে ভিজিয়ে দেয় এবং সেখান থেকে লিভিং রুমে যায় গ্যাসোলিন ঢালতে ঢলতে। কার্পেট, সোফা, ম্যাগাজিনের র্যাক, চেয়ার সবকিছুতে গ্যাসোলিন ঢেলে সে নিচতলার হল পর্যন্ত যায়। বাতাসে গ্যাসোলিনের তীব্র গন্ধ।
জাড়ের থেমে থাকা ঘড়িটা যে চেয়ারে ছিল সেখানেই সে জাডের ম্যাচের বক্স খুঁজে পায়; সিগারেট প্যাকের ওপর। লুইস সেটা নিয়ে নেয়। বাড়ির সামনের দরজার কাছে গিয়ে সে একটা ম্যাচের জ্বলন্ত কাঠি তার কাঁধের ওপর দিয়ে পিছনে ছুঁড়ে মারে এবং দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। আগুনের ব্লাস্টের তাপ তার ঘাড়ের চামড়ায় এসে আছড়ে পড়ে। সে দরজাটা ভালো করে লাগিয়ে দেয় এবং পোর্চে কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়ায়, দরজার পর্দার ওপাশে কমলা শিখার নাচানাচি দেখতে। এরপর সে হেঁটে বারান্দা পেরোয়, তার মনে পড়ে সে আর জাড মিলে এখানে লক্ষ বছর আগে বিয়ার গিলত। বাড়ির ভেতর থেকে লেলিহান আগুনের চাপা গর্জন ভেসে আসছে। এরপর সে বেরিয়ে পড়ে।
অধ্যায় ৬২
লুইসের বাড়ির আগের মোড়ে এসে স্টিভ মাস্টারটন ধোঁয়া দেখতে পায়-লুইসের বাসা থেকে না, তার বিপরীত দিকের বুড়োর বাড়িটা থেকে।
লোকটা লুইসকে নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিল তাই সকাল সকাল এখানে চলে এসেছে। চার্লটন তাকে আগের দিনে রাচেলের ফোনকলের ব্যাপারে বলেছেন, যা স্টিভের মনে নানান প্রশ্নের উদ্রেক করে।
সে আসলে ঠিক জানে না কী নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে, কিন্তু তার মনে ব্যাপারটা বারবার খোঁচাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল তার একবার লুইসের বাড়ি গিয়ে দেখে আসা উচিত সব ঠিক আছে কিনা মানে বর্তমান পরিস্থিতিতে যতটুকু ঠিক থাকা সম্ভব আর কি।
বসন্তের চমৎকার আবহাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল ইনফার্মারি প্রায় রোগি শূন্য এবং সুরেন্দ্র তাকে বলেছে ও একাই সবকিছু সামাল দিতে পারবে, চাইলে যেতে পারে সে। শুনে স্টিভ লাফিয়ে তার বাইকে উঠে লাডলোর দিকে ড্রাইভ করে চলে আসে। হয়তো তার দরকার ছিল না, কিন্তু তার খুবই দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। তার এটাও মনে হচ্ছিল যা হবার তা ইতিমধ্যেই হয়ে গেছে, সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। চিন্তাটা খুব অর্থহীন, কিন্তু তার পেটের মধ্যে কেমন কেমন একটা অনুভূতি হচ্ছে-ঠিক যেমনটা হয়েছিল ভিক্টর পাস্কোর ওই ঘটনার সময়। কোন বিচারেই সে ধার্মিক না (যখন কলেজে ছিল তখন সে সেখানকার নাস্তিক ক্লাবের মেম্বার ছিল। তার এডভাইজার তাকে ডেকে আন- অফিসিয়ালি বলেছিলেন যে এতে করে তার মেডিকেল স্কুলে স্কলারশিপ পেতে সমস্যা হতে পারে। সেই কথা শুনে অবশ্য সে নাস্তিক ক্লাব থেকে বেরিয়ে আসে), কিন্তু যে কোন জীবের মতই তার ভেতর আশঙ্কার জন্ম হচ্ছে। আর ভিক্টর পাস্কোর মৃত্যুটাও যেন তার পরের এক বছরের টোন সেট করে দিয়েছিল, যেভাবেই হোক। বছরটা কোনভাবেই ভালো বলা যায় না। এর মধ্যে সুরেন্দ্রর দুইজন আত্মীয় ইন্ডিয়ার জেলে আটক হয়েছেন, রাজনৈতিক কারণে। আর সুরেন্দ্র তাকে পরে বলেছে যে তাদের মধ্যে একজন তার খুব প্রিয় চাচা, যাকে এখন একরকম মৃতই বলে দেয়া যায়। সুরেন্দ্র খুব কেঁদেছিল বলতে বলতে, আর তার মত একজন ঠান্ডা ভারতীয় লোকের অমন কান্না দেখে স্টিভ একরকম ভয়ই পেয়ে যায়। চার্লটনের মায়ের ব্রেস্ট কেটে ফেলে দিতে হয়েছে এবং ডাক্তার তারপরও কোন রকম ভরসা দেননি। ভিক্টর পাস্কোর মৃত্যুর পর স্টিভ নিজে চারটা ফিউনারেলে অংশগ্রহণ করেছে-তার শ্যালিকা, যে গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে, একজন কাজিন, যে মারা গেছে একদম একটা তুচ্ছ বাজি লেগে, (বৈদ্যুতিক পোলে চড়া তার জন্যে কোন ব্যাপারই না, সেটা প্রমাণ করতে গিয়ে); তার বৃদ্ধ দাদা; আর লুইসের ছোট্ট ছেলে।
সে লুইসকে খুবই পছন্দ করে এবং সে নিশ্চিত হতে চায় যে লুইস ঠিক আছে। লুইসের জীবন বর্তমানে নরকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।
যখন সে ধোঁয়াটা প্রথমে দেখতে পেয়েছিল তখন সে ভেবেছিল ভিক্টর পাস্কোর একাউন্টে হয়তো আরেকটা স্কোর যোগ হতে যাচ্ছে। মরে গিয়ে ভিক্টর পাস্কো হয়তো অশুভ কোন বাঁধ ভেঙে দিয়েছে। কিন্তু ভাবনাটা বোকার মত, এবং লুইসের বাড়িটি তার প্রমাণ। সকালের রোদে নিউ ইংল্যান্ড আর্কিটেকচারের সাদা বিল্ডিংটা সহি সালামতেই দাঁড়িয়ে আছে।
লোকজন বুড়োর বাড়ির দিকে দৌড়ে যাচ্ছে। স্টিভ যখন তার বাইকটা লুইসদের বাড়ির ড্রাইভওয়েতে পার্ক করছে তখন সে দেখতে পেল একজন লোক পুড়তে থাকা বাড়িটার পোর্চে উঠে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে গিয়ে পরক্ষণেই ফিরে আসে। লোকটার ভাগ্য ভালো, কারণ মুহূর্ত পরেই দরজাটার কাঁচ বার্স্ট হয় এবং সেখান থেকে লকলকে আগুন দাউদাউ করে বেরিয়ে আসে। সে যদি দরজাটা খুলতো তাহলে সে হয়তো এতক্ষণে কাবাব হয়ে যেত।
আগুনের আদিম রহস্যে স্টিভ কিছুক্ষণের জন্যে লুইসকে ভুলে যায়। সব মিলিয়ে হাফ ডজনের মত লোক জড়ো হয়েছে। ‘হতে পারতো হিরো’ লোকটা বাদে সবাই নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখছে। ‘হতে পারতো হিরো’ দাঁড়িয়ে আছে ক্র্যান্ডালদের উঠোনে। এবার পোর্চ আর বাড়ির দেয়ালের জানালাগুলো ভয়ঙ্করভাবে বিস্ফোরিত হয় আর ‘হতে পারতো হিরো’ মাথা নিচু করে পড়ি মড়ি করে ছুটতে থাকে। বাড়ির ভেতর থেকে আগুনের কমলা হাতের ছোঁয়ায় পোর্চের দেয়ালের সাদা রং ফোসকার মত উঠে যেতে শুরু করে। স্টিভ দেখলো পোর্চে রাখা একটা ইজি চেয়ার কিছুক্ষণ ধোঁয়া ছাড়ার পর দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে।
বাড়ি পুড়তে থাকার মট মট শব্দের মধ্যে ‘হতে পারতো হিরো’ চিৎকার করে বলে, “বাড়িটার আর কোন আশা নাই। ভেতরে যদি জাড থাকে তাহলে উনিও এতক্ষণে আর নেই।”
স্টিভ যেই চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল যে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেয়া হয়েছে কি না, তখনি সে দূর থেকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির ক্ষীণ সাইরেন শুনতে পায়। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে অনেকগুলো গাড়িই আসছে। তারা আসছে, কিন্তু ‘হতে পারতো হিরো’র কথাই ঠিক। বাড়িটার আর কোন আশা নেই। হাফ-ডজন ভাঙা জানালা দিয়ে আগুনের শিখা বেরিয়ে এসেছে আর বাড়ির সামনের দিকের দেয়ালেও আগুন ধরে গেছে।
এরপর তার লুইসের কথা মনে পড়ে। লুইস যদি বাসায় থাকতো তাহলে কি তার এতক্ষণে পুড়তে থাকা বাড়ির সামনে চলে আসার কথা না?
স্টিভ তার চোখের কোন দিয়ে কিছু একটা দেখতে পায়।
লুইসের ড্রাইভওয়ের পেছনে একটা মাঠ পেছন দিকের একটা পাহাড়ে ধীরে ধীরে উঠে গেছে। মে মাসেই মাঠের ঘাস বেশ লম্বা হয়ে গেছে। কিন্তু মাঠে খুব যত্ন করে ঘাস কেটে একটা রাস্তা বানানো হয়েছে, অনেকটা গলফ কোর্টের ছাটা ঘাসের মত করে। পথটা মাঠের অপর প্রান্তে গিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এঁকে বেঁকে ওপরের দিকে উঠে গেছে। মাঠটা যেখানে জঙ্গলের সবুজের সাথে মিলিত হয়েছে ঠিক সেখানে সে একটা উজ্জ্বল সাদা জিনিস দেখতে পায়। জিনিসটা দেখার পর বুঝে উঠার আগেই সেটা আবার অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু যতটুকু দেখেছে তাতে ওর মনে হয়েছে একজন লোক একটা সাদা বান্ডিল বয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
লোকটা লুইসই ছিল, তার মন অযৌক্তিক হলেও খুব জোরালোভাবে তাকে বলে। লোকটা লুইসই, আর তুমি দ্রুত ওর কাছে যাও। কারণ খুব খারাপ কিছু ঘটেছে এবং তার চাইতে আরো খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে, যদি তুমি ওকে না থামাও।
সে লুইসের ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকে আর বার বার পা বদল করতে থাকে।
স্টিভ বাবু, ভয়ে তোমার পেট পাতলা হয়ে গেছে, তাই না?
হ্যাঁ, একদম। সে কোন কারণ ছাড়াই ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে। কিন্তু আবার এক রকমের একটা…..
আকর্ষণ।
হ্যাঁ, একটা আকর্ষণও কাজ করছে ওই পথটার দিকে, যেটা মাঠ পেরিয়ে বনের দিকে চলে গেছে। ওই পথটা নিশ্চয়ই কোন নির্দিষ্ট জায়গায় যাবার পথ, তাই না? সব পথেরই একটা গন্তব্য থাকে।
লুইস। লুইসের কথা ভুলে বসো না বেকুবের মত! তুমি এখানে লুইসের জন্যে এসেছো, বনে পিকনিক করতে আসেনি।
“ওখানে কী পেলে রেন্ডি?” ‘হতে পারতো হিরো’ চিৎকার করে উঠে। তার বিকট চিৎকারটা কেমন যেন আশাবাদী রকম শোনায়
রেন্ডির উত্তর অবশ্য সাইরেনের আওয়াজে অনেকটাই চাপা পড়ে যায়। “মরা বিড়াল।”
“পোড়া?”
“পোড়া মনে হয় না,” রেন্ডি জবাব দেয়। “এমনিই মরা।”
রেন্ডি আর ‘হতে পারতো হিরো’র কথোপকথন শুনে স্টিভের কোন এক অদ্ভুত কারণে মনে হয় যে সে যা ভেবেছিল তাই ঠিক। লোকটা লুইসই ছিল।
সে আগুনে পুড়তে থাকা বাড়িটা পেছনে ফেলে মাঠের পথটা ধরে হাঁটতে শুরু করে। সে যখন বনের কাছে পৌঁছে ততক্ষণে সে ঘেমে উঠেছে। বনে পৌঁছালে গাছের ছায়া তার বেশ আরামদায়ক লাগে। বনে নানান গাছপালা আর বুনো ফুলের একটা মিষ্টি গন্ধ।
বনের ভেতরে ঢুকে সে ছুটতে শুরু করে। সে নিজেও জানে না সে কেন ছুটছে বা কেন তার হার্টবিট বেড়ে দ্বিগুন হয়ে গেছে। পাহাড় থেকে নামার রাস্তায় সে আরো জোরে দৌড়ায়। রাস্তাটা খুবই পরিস্কার। অবশ্য সে যখন পেট সেমেটারির গেট দিয়ে ঢুকে তখন সে শুধু দ্রুত হাঁটছে। তার ডান পাশে বগলের নিচে জ্বালা করছে, হয়তো খোঁচা লেগেছে কিছুর সাথে।
সে পেট সেমেটারির কবরগুলোর বৃত্তাকার আকৃতি, কবরগুলোতে টাঙ্গানো পিটিয়ে সোজা করা টিন বা বোর্ডের লেখা-কিছুই মনোযোগ দিয়ে দেখলো না। তার দৃষ্টি আরো সামনে, লুইসের দিকে। লুইস একটা মরা গাছ-পালার ধ্বংসস্তূপের ওপর চড়ছে, অভিকর্ষ বলকে একরকম কাচকলা দেখিয়ে। সে একটার পর একটা পা ফেলে ধ্বংসস্তুপটার ওপর উঠে যাচ্ছে, নিচে না তাকিয়ে, শুধুমাত্র সামনের দিকে তাকিয়ে; যেন সে সম্মোহিত অবস্থায় আছে, অথবা যেন সে স্লিপ ওয়াকিং করছে। লুইস তার দুই হাতে পাজাকোলা করে সাদা জিনিসটা বহন করছে যেটা স্টিভ তার চোখের কোণ দিয়ে দেখতে পেয়েছিল। কাছ থেকে দেখে আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই-জিনিসটা একটা লাশ। জিনিসটার এক মাথা দিকে একটা লো হিলের জুতো পড়া পা বেরিয়ে আছে। আর স্টিভ সাথে সাথেই খুব নিশ্চিত আশঙ্কার সাথে বুঝতে পারে সেটা রাচেলের দেহ।
লুইসের চুল সাদা হয়ে গেছে।
“লুইস!” স্টিভ চিৎকার করে ওঠে।
লুইস ফিরে তাকায় না, থামেও না। সে স্তুপটার একদম মাথায় উঠে আবার ওইদিকে নামতে শুরু করে।
ও পড়ে যাবে। সে খুব লাকি, অসম্ভব লাকি, কিন্তু এখনি ও পড়ে যাবে। আর কমসে কম ওর পা তো ভাঙবেই-
কিন্তু লুইস পড়ে যায় না। সে কিছুক্ষণের জন্যে স্টিভের দৃষ্টির বাইরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর স্তূপের ওপাশে বনের রাস্তায় সে আবার লুইসকে দেখতে পায়।
“লুইস!” স্টিভ আবারো চিৎকার করে ওঠে।
এবার লুইস থেমে পেছন ফিরে তাকায়।
স্টিভ যা দেখতে পায় তাতে সে একদম হতভম্ব হয়ে পড়ে। পাকা চুলের পাশাপাশি লুইসের চেহারাও একদম বুড়িয়ে গেছে।
প্রথমে তাকে লুইস বলে চেনাই যাচ্ছিল না। কিন্তু স্টিভ ধীরে ধীরে ওকে চিনতে পারে। লুইসের ঠোঁটগুলো নড়ছিল। কিছুক্ষণ পর স্টিভ বুঝতে পারে যে লুইস হাসার চেষ্টা করছে।
“স্টিভ,” সে ভাঙা গলায় বলে, অনিশ্চিতভাবে। “হ্যালো, স্টিভ। আমি ওকে কবর দিতে নিয়ে যাচ্ছি। খালি হাতেই কাজটা করা লাগবে মনে হচ্ছে। কাজ শেষ হতে হতে মনে হয় অন্ধকার হয়ে যাবে। ওখানকার মাটি খুব পাথুরে। মনে হয় না তুমি আমাকে সাহায্য করতে চাও, তাই না?”
স্টিভ তার মুখ খুলে, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বের হয় না। সে হকচকিয়ে গেছে এবং আতঙ্কিত বোধ করছে। কিন্তু তার পরও সে লুইসকে সাহায্য করতে চায়। যেভাবেই হোক, এই জঙ্গলের পরিবেশে সেটাই খুব…খুব স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।
“লুইস,” সে অবশেষে কর্কশ স্বরে বলতে সক্ষম হয়। “কী হয়েছে, লুইস? ঈশ্বরের দোহাই লাগে লুইস…কি হয়েছে? ও কি…ও কি আগুনে পুড়ে গেছে?
***
“আমি গেজের বেলা অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম,” লুইস বলে। “আমার দেরির কারণে গেজের ভেতরে একটা কিছু ঢুকে পড়েছিল। কিন্তু রাচেলের বেলা সেরকম হবে না, স্টিভ। আমি জানি রাচেলের বেলা অন্যরকম হবে।”
লুইস তার দিকে একটু এগিয়ে আসে। স্টিভ বুঝতে পারছে লুইস পাগল হয়ে গেছে—সেটা সে খুব পরিস্কারভাবে বুঝতে পারছে। লুইসের মাথা খারাপ হয়ে গেছে আর ওকে দেখাচ্ছে ভয়ঙ্কর ক্লান্ত। তবে লুইসের ক্লান্তির ব্যাপারটাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় স্টিভের মনে অধিক নাড়া দেয়।
“তুমি সাহায্য করলে খুব উপকার হতো,” লুইস বলে।
“লুইস, আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাইলেও তো তা সম্ভব না। এই মরা ডালপালার স্তূপ আমি কোনভাবেই পেরুতে পারবো না।”
“আরে পারবে,” লুইস বলে। “অবশ্যই পারবে। তোমার যেটা করা লাগবে তা হচ্ছে নিচের দিকে না তাকিয়ে একদম স্বাভাবিকভাবে হেঁটে উঠে যেতে হবে। এটাই সিক্রেট, স্টিভ।”
লুইস ঘুরে দাঁড়ালো এবং স্টিভ তাকে আরো ডাকলেও সে তা না শুনে পথ ধরে বনের ভেতর ঢুকে যায়। কিছুক্ষণের জন্যে স্টিভ গাছপালার ফাঁক দিয়ে সেই সাদা চাদরের ফরফরানি দেখতে পায়। এর পর আর কিছুই দেখা যায় না।
সে দৌড়ে ডালপালার স্তুপটার কাছে যায় এবং কোন রকম চিন্তা করা ছাড়াই সেটা বেয়ে উঠার চেষ্টা করে। সে হাতড়ে হাতড়ে শক্ত কিছু ধরে সরীসৃপের মত স্তূপটার গা বেয়ে উঠতে চেষ্টা করে, পা দিয়ে ডাল ঠেলে ঠেলে। তার শরীরে একটা পাগলা উত্তেজনা ভর করেছে-যেন সে একদম বিশুদ্ধ অক্সিজেন টেনে নিয়েছে শরীরে। তার বিশ্বাস ছিল সে উঠতে পারবে-এবং সে উঠেও যায়। সে সাবলীলভাবেই কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই স্তূপটার ওপরে উঠে যায়। স্তূপটার ওপর কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়ায় সে। ভারসম্য রাখার জন্যে সে হালকা হালকা দুলছে ডালের ওপর। সে আবারো লুইসকে দেখতে পায় জংলী পথটাতে।
লুইস পিছে ফিরে স্টিভের দিকে তাকায়। তার স্ত্রীর লাশ পেঁচানো চাদরের রোলটা সে পাঁজাকোলা করে ধরে রেখেছে।
“তুমি হয়তো কিছু শব্দ শুনতে পাবে,” লুইস বলে। “মানুষের গলার মত। কিন্তু ওসব কিছু না। ওগুলো লুন হাঁসের ডাক, শুনতে মানুষের হাসির মত। হাসগুলো থাকে দক্ষিণে। কিন্তু এখানে শব্দ অনেক দূর ভেসে আসে। খুব মজার ব্যাপার।”
“লুইস-”
কিন্তু লুইস আবারো ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
স্টিভ আরেকটু হলেই লুইসকে ফলো করতে শুরু করেছিল আর একটু হলেই।
আমি হয়তো ওকে সাহায্য করতে পারবো…আর আমি ওকে আসলেই সাহায্য করতে চাই। কারণ চোখে যা দেখা যাচ্ছে তার বাইরেও হয়তো আরো কিছু আছে, যেটা আমার জানা দরকার। ব্যাপারটাকে খুব…খুব গুরত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে ব্যাপারটা একটা সিক্রেট। একটা রহস্য।
তক্ষুনি ওর পায়ের নিচে একটা ডাল খুব জোরে মট শব্দ করে ভেঙে যায়। ডাল ভাঙার শব্দটাকে শোনায় রেস শুরু হবার আগের গুলির আওয়াজের মত। ও হঠাৎ করেই নিজের মধ্যে ফিরে আসে। হঠাৎ করেই বুঝতে পারে সে ঠিক কি করছে এবং ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। কেউ স্লিপ ওয়াকিং করে কোন বড় দালানের ছাদের শেষ মাথায় এসে জেগে উঠলে তার যে অবস্থা হবে, স্টিভের অবস্থাও হয়েছে ঠিক সেই রকম। তার চেহারায় ভীষন আতঙ্ক
রাচেল মরে গেছে আর আমার ধারণা লুইসই ওকে খুন করেছে। লুইস উন্মাদ হয়ে গেছে, বদ্ধ উন্মাদ, কিন্তু-
এখানে শুধু পাগলামি না-আরো অনেক অনেক খারাপ কিছু একটা আছে। তার মনে হচ্ছে জঙ্গলের ভেতর কিছু একটা তার ব্রেনকে চুম্বকের মত আকর্ষণ করছে। লুইস যেখানে রাচেলের লাশ নিয়ে যাচ্ছে আকর্ষণটা তাকে সেখানেই নিয়ে যেতে চাচ্ছে।
আহা, এসোই না…এসে দেখো পথটা কোথায় গেছে। ওখানে তোমার দেখার মত কিছু জিনিস আছে, স্টিভানো, এমন সব জিনিস যেগুলো তুমি তোমার নাস্তিক ক্লাব থেকে জানতে পারবে না।
এরপর, হয়তো জিনিসটা একদিনের জন্যে যথেষ্ট শিকার পেয়ে যাওয়ায় স্টিভের ওপর থেকে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, এবং স্টিভের পথটা ধরে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছে যেন হঠাৎ করেই উবে যায়। স্টিভ পেছনের দিকে টলমলভাবে দু পা পিছিয়ে যায়। এবার ওর পায়ের নিচ থেকে আরো অনেকগুলো ডাল সরে যায় এবং ওর বা পা-টা ফসকে ভেতরের দিকে ঢুকে যায়। পা ঝাটকা দিয়ে টেনে বের করতে গেলে ভাঙা ডালের চোখা অংশে লেগে ওর পায়ের স্নিকার খুলে আসে এবং ডালটি পায়ের মাংসের ভেতর ঢুকে যায়। সে পেট সেমেটারির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। আরেকটু এদিক সেদিক হলেই একটা কমলা রঙের কবরের ফলকের চোখা কাঠ ওর পেটে ঢুকে যেত।
উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে বিভ্রান্তের মত তাকাতে থাকে সে আর ভাবতে থাকে তার সাথে কি হয়েছে…বা আদৌ কিছু হয়েছে কি না। এর মধ্যেই ব্যাপারটাকে ওর স্বপ্নের মত লাগছে।
এরপর গভীর বনের ভেতর থেকে, যেখানে ফকফকা রোদের আলোতেও মনে হয় সেখানকার আলোর রং সবুজ, সেখান থেকে একটা চাপা কিন্তু বিকট খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে আসে। স্টিভ চিন্তাও করতে পারে না কি সেই জিনিস, যার হাসির শব্দ এতো বীভৎস।
জুতো ছাড়া এক পা নিয়েই সে ছুটতে আরম্ভ করে এবং চিৎকার করার চেষ্টা করে, কিন্তু তার গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয় না। সে যখন লুইসের বাড়ির কাছে আসে, তখনো সে দৌড়াচ্ছে। সে যখন তার বাইকে বসে ইঞ্জিন চালু করে তখনো সে চিৎকার করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সে বিপরীত দিক থেকে আসতে থাকা একটা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির একদম গা ঘেষে যায়। হেলমেটের ভেতরে তার মাথার পেছন দিকের চুলগুলো দাঁড়িয়ে গেছে।
যখন অরনোতে তার নিজের ফ্লাটে পৌঁছে, তার মন থেকে একদম মুছে যায় যে সে লাডলোতে গিয়েছিল। সে অফিসে ফোন করে অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়ে নেয় আর একটা পিল খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে।
স্টিভ মাস্টারটন সেদিনটার কথা আর কখনই মনে করতে পারেনি…শুধু সেসব স্বপ্নে ছাড়া যেগুলো একদম ভোরের দিকে দেখে। সেসব স্বপ্নে সে দেখতে পায় খুব দানবাকৃতির কিছু একটা তাকে ছুঁয়ে দিতে চাচ্ছে… কিন্তু একদম শেষ মুহূর্তে এসে জিনিসটা আর ওকে ছোঁয় না।
জিনিসটার হলুদ চোখগুলো মস্ত আকারের…অনেকটা ফগ ল্যাম্পের মত।
স্টিভ এসব স্বপ্ন থেকে মাঝে মাঝে চিৎকার করতে করতে বিষ্ফোরিত চোখে জেগে ওঠে এবং সে ভাবেঃ তোমার মনে হচ্ছে তুমি চিৎকার করছো। কিন্তু ওসব কিছু না। কিন্তু ওসব কিছু না। গুগুলো লুন হাঁসের ডাক, শুনতে মানুষের হাসির মত। হাঁসগুলো থাকে দক্ষিণে। কিন্তু এখানে শব্দ অনেক দূর ভেসে আসে। খুব মজার ব্যাপার।
কিন্তু সে জানতো না, মনে করতে পারতো না এই ভাবনার মানে কী। পরের বছর সে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দেশের আরেক মাথায় একটি চাকরি জুটিয়ে নেয়, সেন্ট লুইসে।
লুইসের সাথে তার শেষ সাক্ষাত এবং তার নতুন চাকরির জন্যে চলে যাওয়ার মধ্যকার সময়ে সে একবারের জন্যেও লাডলো যায়নি।
পরিশিষ্ট
সেদিন বিকেলের আগে পুলিশ আসে। তারা নানা রকম প্রশ্ন করলেও তাদের মনে কোন সন্দেহের উদ্রেক হয় না। জাডের পোড়া বাড়ির ছাই এখনো গরম, সেগুলো নেড়েচেড়ে এখনো ভেতরে দেখা হয়নি। লুইস তাদের প্রশ্নের জবাব দেয়। তাদের দেখে মনে হলো তারা সন্তুষ্ট। তারা লুইসের সাথে কথা বলে বাড়ির বাহিরে। পুরোটা সময় লুইস মাথায় হ্যাট পড়ে ছিল। তাতে ভালোই হয়েছে, নাহলে ওর পাকা চুল দেখে হয়তো তারা নানান প্রশ্ন করতো। সেটা খুব খারাপ হতো তার জন্যে। সে তার বাগান করার গ্লাভসও পড়ে ছিল এবং তাতেও খুব ভালো হয়েছে। কারণ ওর হাতগুলো ছিল রক্তাক্ত এবং ক্ষত- বিক্ষত।
সেই রাতটা সে সলিটায়ার খেলে পার করে দেয়, প্রায় শেষ রাত পর্যন্ত।
তাসের একটা নতুন হাত বাটতে বাটতে বাড়ির পেছনের দরজাটা খোলার শব্দ পায়।
তুমি যা করবে সেটা তোমারই বাকির খাতায় লেখা থাকবে এবং আগে হোক পরে হোক তা ঠিকই তোমার কাছে ফিরে আসবে, লুইস ক্রিড় ভাবে।
সে সেদিকে ফিরে না তাকিয়ে তার কার্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তার পেছন থেকে ধীরে ধীরে ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে আসতে থাকা পায়ের শব্দ আসতে থাকে। তাসের রাণীটা দেখতে পায় সে। তার হাত সেটার ওপর রাখে।
পায়ের শব্দ একদম তার পেছনে এসে থেমে যায়।
নিস্তব্ধতা।
লুইসের কাঁধে কেউ একটা ঠান্ডা হাত রাখে। এরপর রাচেলের খরখরে, মাটি ভরা কন্ঠ শোনা যায়।
“ডারলিং,” জিনিসটা বলে।
.
ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ – ডিসেম্বর ১৯৮২
***