মন ধোয়া যায় না – সমরেশ মজুমদার

KhoriBona

মন ধোয়া যায় না – সমরেশ মজুমদার
প্রকাশক : নির্মলকুমার সাহা
নির্মল বুক এজেন্সি
প্রচ্ছদ : রঞ্জন দত্ত
প্রথম প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৭
 .
দেবাশিস ভৌমিক
প্রীতিবরেষু

মন ধোয়া যায় না

মুখে পান গুঁজে চোখ বন্ধ করে বসে রইল কিছুক্ষণ। তার মুখের দিকে তাকিয়ে হাঁ করে বসে আছে দুই বালিকা। একজন ধৈর্য না রাখতে পেরে বলল, ‘তা হলে কী করব?’

পান চিবিয়ে রস গিলে কাননবালা বলল, ‘অ্যাই, তোর বয়স কত হল?’

‘দশ।’

দ্বিতীয়জন, যার নাম সরস্বতী, বলল, ‘আমি সাড়ে নয়।’

‘হুম। আর বেশি দিন নেই রে। তোদের জন্যে দুঃখ হচ্ছে রে!’

‘দুঃখ? কেন?’ প্রথমজন জিজ্ঞাসা করল।

‘তোরা কিছু করিসনি।’ আঙুল তুলে আকাশ দেখাল বুড়ি, ‘উনি করেছেন। এই পৃথিবীতে মেয়েমানুষ করে পাঠিয়েছেন, যাক গে। কী করবি বল।’

‘তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘পারবি, পারবি, সময় এলে ঠিক পারবি। শুধু আমার একটা কথা যদি মনে রাখবি বলে কথা দিস তা হলে বলি!’ কাননবালা পান চিবোতে চিবোতে বলল।

‘মনে রাখব, নিশ্চয়ই মনে রাখব।’ সরস্বতী জোর দিয়ে বলল।

‘তবে শোন।’ আশেপাশে তাকিয়ে নিল বুড়ি, ‘কখনও নিজের মনটাকে এঁটো হতে দিবি না। শরীর এঁটো করতে আসবে পুরুষমানুষরা। পারবে না। ধুয়ে ফেললে শরীর যে এঁটো হয়েছিল তা কারও বাপ বলতে পারবে না। তাই বলি, শরীর কখনও এঁটো হয় না। শরীর হল আকাশের মতো, জল ঝরায়, জলে ভিজে থাকে না। বুঝলি?’

প্রথমজন মাথা নেড়ে না বলল, ‘কী হলে মন হয় তা তো জানি না। অ্যাই সরস্বতী, তুই জানিস?’

মাথা নাড়ল সরস্বতী, ‘না তো। কী করে হয় দিদি?’

‘মনের স্পর্শ লাগলে মন এঁটো হয়। শরীর জল দিয়ে ধুলে এঁটো থাকে না। সাবান ঘষলে তো একদম সাফ! কিন্তু মন যে ধোয়া যায় না ভাই। এক বার এঁটো হয়ে গেলে বড় যন্ত্রণা।’ কাননবালার মুখে দুঃখ জমল।

সরস্বতী জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, মনকে ধোয়া যায় না? এমনি জলে না হোক সাবান দিয়ে যদি ধুয়ে ফেলি?’

‘দূর পাগলি! তুই চেষ্টা করে আকাশটাকে ধুতে পারবি? বর্ষায় তো অনর্গল জল ঝরে, তাতে কি আকাশ ভিজে চুপসে যায়? মন হল আকাশের মতো। তফাত একটাই, আকাশে সাত দিন ধরে মেঘ জমে থাকলেও তা ভেজাতে পারে না, কিন্তু তেমন তেমন মেঘ এলে মানুষের মন যে ভিজে যায়। তাই বলি, এক বার ভিজলেই মন এঁটো হয়ে যায়। তাই মনটাকে ভিজতে দিবি না। এক বার এঁটো হয়ে গেলে আর রক্ষে নেই।’ কাননবালা বলল।

প্রথম মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, ‘কী করলে মন এঁটো হবে না?’

কাননবালা বলল, ‘তোর যে মন আছে তা একদম ভাববি না। শুধু মনে রাখবি, তোর শরীর আছে। কারও অল্প সুন্দর, কারও বেশি সুন্দর শরীর। কারও আবার একটুও সুন্দর নয়। যার যেমন তার রোজগার তেমন।’

‘তা হলে মনের কথা ভাবব না?’ সরস্বতী জিজ্ঞাসা করল।

‘না। একদম না। সব সময় মনে রাখবি, মেয়েমানুষের মন নেই।’

অন্য মেয়েটি চিবুকে আঙুল দিল, ‘ও মা! এ কী কথা বলছ! একদম ভুল কথা! আমি তো মেয়েমানুষ হতে চলেছি, কিন্তু এর মধ্যেই আমার মন এসে গিয়েছে।’

কাননবালা মাথা ঝাঁকাল, ‘যত বোকা বোকা কথা!’

‘জানো!’ মেয়েটি প্রতিবাদ করল, ‘সে দিন রূপশ্রী সিনেমাহলে বীণামাসি সিনেমা দেখতে নিয়ে গিয়েছিল। দেবদাস। সিনেমাহলে বসে কী কান্না কেঁদেছি! বড় মেয়েরা কাঁদছে, বীণামাসি কাঁদছে, আর আমিও কেঁদেছি। আমার যদি একজন দেবদা থাকত তা হলে আমি তাকে ছেড়ে থাকতাম না। জানো, পুরো দু’দিন ধরে মন হু হু করছিল। আর তুমি বলছ, মেয়েমানুষের মন নেই! না, না, তুমি জানো না।’

কাননবালা হেসে যেন গড়িয়ে পড়ে। তারপর বলল, ‘তুই কী বোকা রে! একটা বুদ্বুদকে নদীর ঢেউ ভাবছিস? যাক গে, এ সব কথা কাউকে বলিস না।’

‘কেন?’

‘জানলেই তোকে পাউডার মাখিয়ে, সাজিয়েগুজিয়ে বারান্দায় দাঁড় করিয়ে দেবে। যা তোরা, আমাকে এখন একটু একা থাকতে দে।’ কাননবালা বলল।

সরস্বতীর যেতে ইচ্ছে করছিল না। বেঁকেচুরে বলল, ‘কেন? কী করবে এখন?’

‘একা চুপচাপ বসে থাকব। সারা জীবন তো শুধু বকবক করে গেলাম।’

 * * *

মাস পাঁচেকের মাথায় ওরা তাকে দেখতে এল। দুটো আধবুড়ি আর একটা আধবুড়ো। আধবুড়োটা বলল, ‘এখনও গায়ে গতরে জমেনি!’

দুই আধবুড়ির একজন বলল, ‘একদম কথা কোরো না। মেয়েমানুষের কিছু বোঝো তুমি? শুধু মাটি আর সারে হয়? সঙ্গে জল ঢালতে হয়। ঠিক আছে, যাও ভাই, আমরা তোমার মাসির সঙ্গে কথা বলি।’

ওরা যখন ফিরে যাচ্ছিল তখন আবার ডাক পড়ল। সরস্বতী কাছে যেতে দুই আধবুড়ির একজন বলল, ‘এই টাকাটা রাখো। সামনের পূর্ণিমায় ওই বুড়ো এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। খুব যত্নে থাকবে আমাদের ওখানে। আচ্ছা, চলি।’

মাসি ওদের বিদায় দিয়ে এসে বলল, ‘তোর কী ভাগ্যি সরো, রানির মতো থাকবি।’

‘আমি কি এখানে থাকব না?’

‘যাচ্চচলে! সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ার পর জিজ্ঞাসা করছে সীতা কার বোন? মেয়েমানুষ হল নদীর মতো, কখনও এক জায়গায় থাকে না, তুই জানিস না?’ মাসি হাসল।

‘তা হলে তুমি যে আছ, কাননবুড়ি যে আছে—?’

‘আমরা হলাম মজা নদী, স্রোত নেই। এ সব তুই পরে বুঝবি।’ মাসি বলেছিল। ছিল মফসসলে, চলে এল শহরের এক প্রান্তে। পাড়ার নাম মোহনতলা। সেই দুই আধবুড়ি যেমন তাকে ভালোমন্দ খেতে দেয় তেমনি জ্ঞান দেয় বিস্তর। কী করতে হবে, কী হবে না তা দু’বেলা কানে ঢোকায়। আশেপাশে যে সব লপেটা ছোকরা ঘরঘর করে, তাদের বাপ তুলে গালাগাল দেয়। চুল বেঁধে দিতে দিতে বলে, ‘শোন সরো, এই পৃথিবীতে কেউ কারও নয়। একটা কথা সব সময় মনে রাখবি, ফেলো কড়ি মাখো তেল, আমি কি তোমার পর? বুঝতে পারলি?’

মাথা নাড়ল সরস্বতী, ‘না তো!’

রেগে গেল আধবুড়ি। সরস্বতীর মাথাটা সামনে ঠেলে দিল বেশ জোরেই। বলল, ‘তুই একটা হাঁদি।’

 * * *

মোহনতলায় এখন সরস্বতীর বেশ নামডাক। দুই আধবুড়ি বলে বেড়ায়, এ রকম মেয়েমানুষ ভগবানের হাত দিয়ে বেশি বের হয়নি গো! আমরা বুড়ি হয়েছি, ও এখন ভর যুবতী, ইচ্ছে করলেই আমাদের কুচোখে দেখতে পারত। কিন্তু দেখেনি। বাড়িটা দোতলা করেছে। দোতলায় একটা ঘর দিয়েছে আমাদের, অন্যটায় নিজে থাকে। কিন্তু কোনো খদ্দেরকে একতলা থেকে দোতলায় তোলে না। বলে, দোতলাটা মন্দির, একতলাটা মোদোমাতালদের ফুর্তিখানা।

তবে হ্যাঁ, যত বয়স বাড়ছে তত মেজাজ কড়া হচ্ছে। সন্ধে থেকে অল্প পয়সার খদ্দের এলে দুজন, বেশি পয়সা দিলে একজন। তা যেই হও তুমি, রাত বারোটা বাজলেই বাড়ি ছেড়ে যেতে হবে। দুটো খদ্দের এলে দু’বার, একজন এলে এক বার, কলঘরে ঢুকবেই সরস্বতী। মাথা থেকে পা পর্যন্ত সাবান দিয়ে না রগড়ালে সে স্বস্তি পাবে না। তারপর ওপরে উঠে তার মনে হয়, কী আরাম! দুই বুড়ির এক বুড়ি বলে, ‘ও সরো, তোর এত মিষ্টি গলা, গান শেখ না। সকালবেলায় তো খদ্দের নিস না, তখন গান শেখ। কীর্তন, শ্যামাসংগীত আর রসের গান। দেখবি তোর রোজগার হু হু করে বেড়ে যাবে।’

ঠোঁট বেঁকায় সরস্বতী, ‘রোজগার বাড়লে খাবে কে? তোমাদের তো কিছুই হজম হয় না।’

তবু গুনগুন করে সরস্বতী। সকালবেলায় তখন মনে হয় কাননবালার কথা। কাননবালা বলেছিল, ‘শরীর কখনও এঁটো হয় না রে। জলে ধুলে শুদ্ধ হয়, সাবান ঘষলে তো কথাই নেই। কিন্তু খবরদার মন এঁটো করিস না। মন এঁটো হলে তোর সর্বনাশ হয়ে যাবে।’ কথাটা মনে রেখেছে সরস্বতী।

সেদিন থেকে মেঘ জমেছিল। সাধারণত এ রকম দিনে মোহনতলায় খদ্দের আসে না। বৃষ্টি বেশি হলে রাস্তায় জল জমে যায়, ফিরতে পারে না। খদ্দেররা। মুখ ভার হয়ে যায় দরজায় অপেক্ষায় থাকা মেয়েদের। বেশির ভাগ দরজা বন্ধ হয় না অনেক রাত পর্যন্ত। আশায় আশায়। কিন্তু জমা জল না কমলে সর্বনাশ।

ঈর্ষায় ওদের বুক টাটায় যখন দেখে এই ঝড়বৃষ্টির রাতেও খদ্দের ঢুকছে সরস্বতীর ঘরে। দোতলায় দুই বুড়ি ফোকলা দাঁতে হাসে, ‘একেবারে জহুরির চোখ, খুঁজেপেতে ঠিক মেয়ে এনেছিলাম রে।’

বৃষ্টি নেমেছিল, জল জমেছিল, সরস্বতী ভেবেছিল আজ খদ্দের আসবে না। তাই বিকেলে সাজগোজে মন দেয়নি। যে ঘরে এল, সে চোখ কপালে তুলল, ‘ও মা, এ কী!’

বিরক্ত হল সরস্বতী, ‘মনের কথা বলে ফেলো।’

‘লাল পাড়ার মেয়ের এমন সাদামাটা সাজ কেন?’

‘যেখানে রঙের সাজ দেখবে সেখানে গেলেই তো হয়।’

লোকটা মাথা নাড়ল, ‘বাঃ, কথায় দেখছি বাঁধন আছে। তা বৃষ্টি না ধরা পর্যন্ত থাকব, কত দিতে হবে?’

‘আশেপাশে জিজ্ঞাসা করে তবে ঢোকা উচিত ছিল।’ সরস্বতী বিরক্ত।

লোকটা ভাবল। লম্বা, পাঞ্জাবি—পাজামা পরা শরীর। মাথার চুল ঘাড় পর্যন্ত নেমেছে। একটু ভেবে বলল, ‘তুমি আমাকে খারাপ করে দিতে পারবে?’

‘এ কী রকম কথা!’ অবাক হল সরস্বতী। সে লোকটাকে ভালো করে দেখল। তার ঘরে যারা আসে তাদের সঙ্গে মিলছে না। লোকটা হাসল, ‘আমার কাছে যা আছে তা তোমায় দিয়ে যাব। তুমি চিন্তা কোরো না।’

‘ও সব শুকনো কথায় চিঁড়ে না ভিজিয়ে যা বলছি তা যদি দিতে পারো তাহলে থাকো, নইলে বিদায় নাও।’ খেঁকিয়ে উঠল সরস্বতী।

‘বেশ বলো, শুনব। তার আগে আমি একটা গান গাইছি, শুনে বলো, কেমন লাগল!’ লোকটি কথাগুলো বলে চোখ বন্ধ করল। সরস্বতী প্রমাদ গুনল। এই বর্ষার সন্ধ্যায় নির্ঘাত একটা পাগলের পাল্লায় পড়েছে সে। ইতিমধ্যে লোকটা গান শুরু করল, যা হওয়ার তা হবে।

যে আমারে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে রবে?

পথ হতে যে ভুলিয়ে আনে

পথ যে কোথায় সেই তা জানে,

ঘর যে ছাড়ায় হাত সে বাড়ায়—

সেই তো ঘরে লবে।

মেয়েলি গলা কিন্তু সুরেলা। কী রকম থতমত হয়ে গেল সরস্বতী। কী অদ্ভুত কথা। ঘর যে ছাড়ায়, সে আবার হাত বাড়ায় ঘরে নেওয়ার জন্যে। তার মুখ থেকে ‘বাঃ’ শব্দটা ছিটকে বের হল।

‘ভালো লাগল?’ ঘাড় বেঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করল লোকটা।

‘খুব।’ মাথা নাড়ল সরস্বতী, ‘এ রকম গান আর একটা শোনাবেন?’

‘এই হল মুশকিল। নিশ্চয়ই শোনাব। লোকটা গান ধরল, ‘তুমি শোন যদি গান আমার সমুখে থাকি,সুধা যদি করে দান তোমার উদার আঁখি—’

শুনতে শুনতে মুগ্ধতা বাড়ল। সরস্বতী জিজ্ঞাসা করল, ‘এ কার গান? আপনার?’

‘দূর! এ গান কি আমি বাঁধতে পারি? তোমার ভালো লাগছে?’

‘খুব। কোথায় থাকেন তিনি?’

‘কলকাতায়। কিন্তু শুনেছি তিনি খুব অসুস্থ,’ মাথা নাড়ল লোকটা, ‘শুনেছি তিনি আর গান বাঁধবেন না। শোনামাত্র বুকের ভেতরটা অসাড় হয়ে গেল। বেরিয়ে পড়লাম পথে। বৃষ্টি এল। তোমার ঘরে চলে এলাম। টাকাটা দিই?’

‘এই গান যিনি লিখেছেন, তিনি কোথায় থাকেন?’

‘অন্তরে।’ বলে আবার গান ধরল।

অন্তরে জাগিছ অন্তরযামী

তবু সদা দূরে ভ্রমিতেছি আমি।

সংসারে সুখ করেছি বরণ,

তবু তুমি মম জীবনস্বামী।

তারপর উঠে দাঁড়াল লোকটা, ‘বাইরে যখন অন্ধকার আজ অন্তরে তাকে দেখতে পাবে গো।’ একটা টাকা রেখে চলে গেল লোকটা।

পাথরের মতো বসে রইল সরস্বতী। পাড়ার সব বাড়ির আলো নিভে গেল। কিন্তু বুকের ভেতর কী যেন কিলবিল করছে। কিছুতেই শরীরে বল আসছে না। সরস্বতী স্থির করল, আলো ফুটলেই মানুষটাকে দেখতে যাবে।

আলো ফুটল। তৈরি হয়ে বাইরে বেরিয়ে এল সে। হঠাৎ সম্বিৎ এল, কোথায় যাচ্ছে সে? সেই অসুস্থ মানুষটা কোথায় থাকে তাই তো জানা নেই। আকাশের দিকে তাকাল সরস্বতী। কেউ একা হেঁটে যাচ্ছে সামনের পথ দিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে গান গাইছে নিজের মনে, ‘জীবনে যত পূজা হল না সারা জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।’

থমকে গেল সরস্বতী। তারপর দুই হাতে মুখ ঢাকল। দৌড়ে লোকটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এ কার গান গাইছেন আপনি?’

‘আমরা যাঁকে হারাব কিন্তু তিনি আমাদের কখনওই হারাবেন না, তাঁর গান।’

গান গাইতে গাইতে চলে যাওয়া লোকটির দিকে তাকিয়ে সরস্বতী অনুভব করল, তার মন এঁটো হয়ে গেল।

বড় শান্তি এল, বড় শক্তি এল মনে। চোখের জল আর হাসি একাকার হয়ে গেল। কিন্তু কাননবালা বলেছিল, মন এঁটো হলে যন্ত্রণা বাড়ে। কিন্তু কোথায় যন্ত্রণা! এই সুখ তো কখনও পায়নি। ভাগ্যিস মন ধোয়া যায় না!

আলোকিত অন্ধকার

তখন ‘দেশ’ পত্রিকায় গল্প লিখতাম। কেউ আমাকে উপন্যাস  লেখার প্রস্তাব তখনও দেয়নি, ৫০ হাজার শব্দের উপন্যাস লেখার চিন্তা মাথায় আসেনি। হঠাৎ একদিন কিংবদন্তি সম্পাদক সাগরময় ঘোষ ডেকে বললেন, ‘তুমি তো গ্রুপ থিয়েটার করতে, সিনেমা দ্যাখো?’

গল্প  লেখা ছাড়া আমার নেশা ছিল যাবতীয় গান শোনা আর সিনেমা দ্যাখা। ‘৫০ থেকে ‘৭৪ সাল পর্যন্ত যেসব বাংলা ছবি হলে এসেছে, তার অধিকাংশই আমার দ্যাখা। তারপর সিনে ক্লাবের সৌজন্যে বিদেশি ছবি দ্যাখাও অভ্যেস ছিল। তাই সাগরদা যখন দেশ পত্রিকার চলচ্চিত্র সমালোচকের দায়িত্ব দিলেন, তা আমার কাছে বড় পাওয়া। ঠিক হল যেহেতু গল্প লিখি, তাই সমালোচনা লিখব ছদ্মনামে। অমিত রায় নামটা সম্পাদকই পছন্দ করলেন।

তারপর ছবি দ্যাখা শুরু হল। তখন বছরে অন্তত ৩০টি বাংলা ছবি মুক্তি পেত। ১০টার বেশি ছবি কেন যে তৈরি হত ভেবে পেতাম না। তখন আমি বুঝেছিলাম, বাংলায় তিন শ্রেণির পরিচালক ছবি করেন। সত্যজিৎ রায় তো শুধু বিখ্যাত এবং প্রতিভার শেষকথা ছিলেন না, তিনি পরিচালকদের পরিচালক ছিলেন। তাঁর পরে তপন সিংহ, অসিত সেন, তরুণ মজুমদার, অজয় কর, আমাদের শ্রদ্ধা আদায় করেছিলেন। ঋত্বিক ঘটকের ছবি দেখেছি দর্শক হিসেবে। দেখে নাড়া খেয়েছি। কিন্তু সমালোচকের দায়িত্ব নেওয়ার পর ওঁর মাত্র একটি ছবি দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।

দ্বিতীয় শ্রেণির পরিচালকদের ধারাবাহিকতা ছিল না। হঠাৎ কোনো ছবিতে তাঁরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও পরের ছবিগুলোতে হারিয়ে যেত। তবু তাঁদের মধ্যে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, সলিল দত্ত সুস্থ ভাবনার ছবি করতেন যা দেখতে দর্শকরা উন্মুখ হয়ে থাকতেন।

তৃতীয় শ্রেণির পরিচালকদের ছবিগুলো তৈরি হত এমন সব কাহিনি নিয়ে যা তাঁরা মনে করতেন দর্শকরা খাবে। গদগদে গল্প যাতে থাকত প্রচুর কান্নার মিশেল। প্রথম সপ্তাহে ম্যাটিনি শো’র ইন্টারভ্যালে হকাররা রুমাল বিক্রি করার জন্যে দাঁড়িয়ে থাকত। যে—ছবি দেখার সময় রুমালের বিক্রি বেড়ে যেত সেই ছবির নির্মাতারা ভাবতেন হিট হয়ে গেছে। এছাড়া তাঁরা দর্শকদের শ্রেণিবিভাগ করতেন। গ্রামের দর্শকরা কান্না গেলে, মোটাদাগের রসিকতায় হেসে গড়িয়ে পড়ে। তাই শহরে ছবি না চললেও ক্ষতি নেই, গ্রামের দর্শকদের পেলেই ছবি তৈরির যা খরচ তার দ্বিগুণ ঘরে আসবে। এইসব ছবি দেখতে গিয়ে মনে হত কখন শেষ হবে! আজ স্বীকার করছি, অর্ধেক দেখার পর বসে না থেকে চলে এসেছি অনেকবার, সাগরদাকে বলেছি ছবিটি নিয়ে লিখব না। তিনি বলেছেন, ‘যা দেখেছ তাই লেখো।’ সেসময় বিভিন্ন কাগজে পরিচিত চিত্রসমালোচক চাকরি করতেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ সত্যি বিদগ্ধ। ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পাওয়ার পর যখন সবাই ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী নন, তখন দেশ পত্রিকার তখনকার চিত্রসমালোচক পঙ্কজ দত্ত উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লিখেছিলেন যেসব কথা, তা পরবর্তীকালে সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। শ্রীযুক্ত সেবাব্রত গুপ্ত এই রকম আর একজন সমালোচক যিনি চিত্রসমালোচক হিসেবে স্মরণীয়।

বেশিরভাগ ছবি যেদিন মুক্তি পেত সেই রাত্রে প্রযোজক নামী হোটেল বা ক্লাবে ককটেল এবং ডিনারের আয়োজন করতেন। চলচ্চিত্রজগতের বিখ্যাতদের সঙ্গে কাগজের সমালোচকদের ডেকে আপ্যায়ন করতেন। এই রেওয়াজটা এখনও হয়তো আছে কিন্তু আগের মতো জৌলুস নেই, কিছু সমালোচক সেইসব আসরে নিজেকে সংযত রাখতে পারতেন না। দামি মদ তাঁদের পায়ের জোর কেড়ে নিত। লক্ষ করতাম, তখনও চাকরি যায়নি কিন্তু সম্পাদক সমালোচনা লিখতে দেন না এমন একজন সমালোচক ওইসব পার্টিতে না গিয়ে থাকতে পারতেন না। একজন সমালোচক তো ওই পার্টিতে আমার ঘনিষ্ঠ হয়ে জিজ্ঞাসা করতেন, যে—ছবি দেখলাম তার কী কী ভালো বা খারাপ লাগল? প্রথমদিকে আমি সরল গলায় বলতাম। আর সেই কথাগুলোই ভদ্রলোকের কলম থেকে বেরিয়ে তাঁর কাগজে ছাপার অক্ষরে বেরিয়ে যেত।

সত্যজিৎ রায় বা তপন সিংহের ছবি মুক্তি পেলে সমালোচকরা তটস্থ থাকতেন। যেন ডার্বি ম্যাচ হচ্ছে। অসুস্থ হওয়ার পর সত্যজিৎ রায়ের পক্ষে আগের মতো শারীরিক ক্ষমতা না থাকায় ছবির বিষয় নির্বাচন করতেন সতর্কভাবে, যাতে তাঁর পরিশ্রম কম হয়। এই পর্যায়েও আমরা তাঁর কাছ থেকে কিছু ভালো ছবি পেয়েছি যা অন্যদের কাছ থেকে আশাই করা যেত না। একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। সাগরদা তখন অসুস্থ হয়ে বেলভিউ নার্সিংহোমে রয়েছেন। এই সময় সত্যজিৎ রায়ের একটি ছবি মুক্তি পেল। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি সেই ছবি দেখে আমার মনখারাপ হয়ে গেল। প্রথমত, ওই ছবিতে যিনি নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন, তাঁকে মেনে নিতে পারছিলাম না। শুধু আমি নই, রবীন্দ্র—উপন্যাসের প্রায় সব পাঠকই এব্যাপারে একমত ছিলেন। দ্বিতীয়ত, আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, ঘরের দেওয়াল যেন নড়ে উঠল। অর্থাৎ, যে—সেটে শুটিং হয়েছিল, তা কোনো কারণে কেঁপে গিয়েছিল যা পরিচালকের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া মনে হচ্ছিল, ছবি গল্পের গতি স্বস্তি দিচ্ছিল না। খুব বিনীত ভঙ্গিতে এইগুলো কেন হল তা সমালোচনায় জানতে চেয়েছিলাম। সম্পাদকীয় দফতরে  লেখা দিয়ে এলাম। তখন দেশ পত্রিকা সাপ্তাহিক। জ্যোতিষদা দেখাশোনা করতেন সমালোচনার পাতাগুলো। প্রুফ এলে আমার লেখা পড়ে জ্যোতিষদার চোখ বড় হয়ে গেল। তিনি সেই প্রুফ নিয়ে গেলেন সাগরদার কাছে, নার্সিংহোমে। সঙ্গে সঙ্গে আমার ডাক পড়ল সেখানে। সাগরদা বিছানায় শুয়েই বললেন, ‘তুমি কি মনে কর ঠিক লিখেছ?’

‘হ্যাঁ সাগরদা।’

‘আমার মনে হয় আর একবার ছবিটা দেখা দরকার। তোমার মত তাতে বদলে যেতে পারে। তুমি ছবিটা আবার দ্যাখো।’ সাগরদা বললেন।

বললাম, ‘আমি মন দিয়ে দেখেছি।’

‘আর একবার দ্যাখো। আসলে কী জানো। তোমার পিতা অথবা পিতামহ, যাঁরা অনেক পরিশ্রম করে তোমাদের সংসারকে দাঁড় করিয়েছেন, তোমাকে শিক্ষিত করেছেন, তাঁদের সামান্য ভুলভ্রান্তি নিয়ে সোচ্চচার হওয়া একধরনের অকৃতজ্ঞতা।’

সেদিনই ম্যাটিনি শো’তে আবার ছবিটা দেখলাম। প্রথমবারে যা চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল দ্বিতীয়বারে তাও চোখে পড়ল। বাড়ি ফিরে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসটা বের করে পড়তে বসলাম। পুরোটা পড়ার পর কিছুক্ষণ ভেবে সমালোচনাটা দ্বিতীয়বার লিখলাম। পরদিন জ্যোতিষদাকে লেখাটা দেওয়ার পর তিনি বললেন, ‘একটু বসো, পড়ে দেখি, সাবধানের মার নেই।’ পড়ার পর মাথা নাড়লেন তিনি, ‘না, ঠিকই আছে, খারাপ কিছু লেখোনি।’

সমালোচনা ছাপা হল। যে পড়েছে সে—ই বলেছে, এটা কি চলচ্চিত্র সমালোচনা, না বুক রিভিউ? রবীন্দ্র উপন্যাসের সমালোচনা  লেখার পর চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে কয়েকটি কথা, পরিচালকদের নাম, শিল্পীদের নাম লিখে কর্তব্য শেষ করেছি। শুনেছি, সত্যজিৎ রায় খুব বিরক্ত হয়েছিলেন, সাগরদার কাছে এই ধরনের লেখা, কেন লেখা বা ছাপা হয়েছিল তা জানতে চেয়েছিলেন। সাগরদা কী বলেছিলেন তা জানতে পারিনি কিন্তু এ ব্যাপারে সাগরদা আমাকে একটি কথাও বলেননি।

চিত্রসমালোচনা লেখার সুবাদে চলচ্চিত্রজগতের অনেক রথী—মহারথীর সঙ্গে পরিচয় এবং পরে ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। পিছন ফিরে তাকালে যাঁদের দেখতে পাই, তাঁদের মধ্যে উত্তমকুমার এবং অবশ্যই সূচিত্রা সেন ছিলেন না। অনিলদা, অনিল চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে তো দাদা—ভাইয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। অনেকেই জানেন না, অনিলদা অনবদ্য স্কেচ করতেন। কথা বলতেন চমৎকার। আমার যখন পরিচিতি একটু বাড়ল, তখন একদিন এন টি ওয়ান স্টুডিয়োতে গিয়েছিলাম। দূর থেকে দেখে অনিলদা চেঁচিয়ে বললেন, ‘এই যে সমরেশ, এতদিন ছিলে শিল্পী, এখন তো শিল্পিপতি। বাঃ!’ আর একজনের কথা এই প্রসঙ্গে বলব। তিনি নির্মলকুমার। আমার দেখা কয়েকজন ভদ্রলোকের মধ্যে নির্মলদা অন্যতম। পড়াশুনা করতেন প্রচুর। কোনো অপ্রীতিকর কথা বলতেন না। আমি যখন জানতে পারলাম নির্মলদা গল্প লিখতেন, দেশ বা অন্যান্য পত্রিকায় গল্প লিখেছেন একসময়। একসময় যে শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাংলা চলচ্চিচত্রের জগতে কম ছিলেন না তা প্রমাণিত। বিখ্যাত পরিচালক তরুণ মজুমদারের লেখার হাত নিয়ে কোনো সংশয় নেই। ওঁর লেখা গল্প দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। রাধামোহন ভট্টাচার্য, বিকাশ রায়ের সাহিত্যপ্রীতির কথা সবাই জানেন। আর সৌমিত্রদা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় যে শুধু প্রতিষ্ঠিত কবি নন, ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে আমাদের শ্রদ্ধেয় মানুষ হয়ে আছেন। এই ব্যাপারটা দ্রুত কমে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, অভিনয় করার জন্যে শিক্ষার কোনো দরকার নেই। একজন গ্রামে বসে কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না, তার চেহারা যদি সুদর্শন হয় এবং ক্ষমতাবান পরিচালকের চোখে পড়ে যায়। সে স্বচ্ছন্দে বাংলা ছবির নায়ক হয়ে যেতে পারে, এখন তা প্রমাণিত।

শেষপর্যন্ত একটা সময় এল যখন মনে হল, সমালোচকের কাজটা আর আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। এমন সব ছবি মুক্তি পেতে লাগল যা দেখার জন্যে ১০ মিনিটও বসা যায় না। মনে হচ্ছিল, অনর্থক সময় নষ্ট করছি। সাগরদার কাছে গিয়ে বললাম, আর নয়, আমি পারছি না। সমস্যার কথা শোনার পর তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, তোমাকে আর সিনেমার রিভিউ করতে হবে না। তুমি নতুন নাটক দেখে লেখো।’

নাটকের সমালোচনা আমি আগেও লিখছিলাম। বছরে ১০ কী ১২টা। সিনেমা দ্যাখার চেয়ে ভালো নাটক দেখতে অনেক বেশি ভালো লাগত। এই প্রসঙ্গে বলি, আমি শম্ভু মিত্রের অনুরাগী। ছাত্রাবস্থা থেকেই তাঁর নাটক দেখে আসছি। এখনও মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে ‘চার অধ্যায়’ নাটকের সেই দৃশ্যটির কথা, যেখানে শম্ভু মিত্র আমার প্রিয় কবিতার লাইন বলছেন তৃপ্তি মিত্রকে, ‘প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্রমাস, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ।’ ওঁর বাচনভঙ্গি, স্বর এবং অভিব্যক্তি আমার শরীরে অজস্র পুলকের জন্ম দিয়েছিল।

শম্ভু মিত্র যখন নিয়মিত অভিনয় করছেন না, তখন পশ্চিমবঙ্গের বেশ কয়েকটি দলের প্রথম সারির অভিনেতা—অভিনেত্রী তাঁকে রাজি করালেন অভিনয় করার জন্যে। সবাই মিলে করবেন গ্যালিলিওর জীবন। প্রধান চরিত্রে শম্ভু মিত্র। তার আগে গ্রুপ থিয়েটারের সংগীত পরিচালক হিসেবে দেবাশিস দাশগুপ্ত খুব নাম করেছে, তার সুরের গান, ‘কথা বলো না, কেউ শব্দ করো না’ তো সুপারহিট। ওর একটা  লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়ে সাগরদাকে বলেছিলাম। সেটা পড়ে সাগরদা দেবাশিসকে দেশ পত্রিকার সংগীত সমালোচকের দায়িত্ব দেন, সেই সঙ্গে ছোট নাটক দলগুলোর নাটকের সমালোচনাও সে লিখত। এই দেবাশিসের ছোট ছেলে যে তখন একেবারেই বালক, ‘গ্যালিলিওর জীবন’—এ একটি ছোট চরিত্রে গান গাইবার সুযোগ পেয়েছিল। ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে নাটক দেখতে গিয়ে শুনলাম, ছোট্ট ছেলেটা দারুণ গাইল। তারপর শম্ভু মিত্র। অপূর্ব অভিনয় তাঁর। কিন্তু একটা ব্যাপার আমার পছন্দ হল না। গ্যালিলেও কেন নিজের কথা বলতে গিয়ে বারংবার ঊরুতে থাপ্পড় মারবেন? নিজেকে অল্পবয়সি প্রমাণ করতে? সেটা সমালোচনায় লিখেছিলাম। এই লেখাটা শম্ভু মিত্রকে অপ্রসন্ন করেছিল। অভিনয় চলাকালীন দশর্কদের মধ্যে ছিলেন উৎপত্ত দত্ত। মাঝে মাঝেই অভিনয় দেখে উল্লসিত হয়ে ‘বাঃ বাঃ’ বলছিলেন। শম্ভু মিত্র অভিনয় করার সময় চাইতেন না দর্শকরা কোনো শব্দ করুক। উৎপল দত্তের প্রশংসাও তাঁকে প্রসন্ন করেনি, এখন ভাবি, বাংলা সংস্কৃতি জগতের দুই স্তম্ভ, সত্যজিৎ রায় এবং শম্ভু মিত্রের বিরক্ত—হওয়া কথাবার্তা সাগরদাকে শুনতে হয়েছিল আমার কারণে, কিন্তু তিনি আমাকে তার আঁচ পেতে দেননি।

ধারাবাহিক উপন্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় ক্রমশ আমি সরে এলাম সমালোচকের ভূমিকা থেকে। মনেও হচ্ছিল, এইসব লেখা লিখে আমি শত্রু তৈরি করছি। কিন্তু ‘সায়ক’—এর মেঘনাদ ভট্টাচার্য, যাদের নাটক ‘দায়বদ্ধ’ নিয়ে দীর্ঘ লেখা লিখেছিলাম; বলেছিল, ‘আপনার লেখা পড়ে আমাদের দর্শক বেড়ে গেছে।’ এরকম কথা বলেন, এমন মানুষ খুব কম। যখন শুধু নিজের লেখা লিখছি, তখন একসকালে ফোন এল সুপ্রিয় ব্যানার্জির কাছ থেকে।

সুপ্রিয় ব্যানার্জি। ফরসা, মোটাসোটা মানুষটি ইউনাইটেড স্টেটস ইনফরমেশন সার্ভিসের  কলকাতা অফিসের প্রাণপুরুষ বললে কম বলা হবে না। সাহেবদের সমীহ যিনি আদায় করেছেন স্বচ্ছন্দে, তিনি মনেপ্রাণে ঘোর বাঙালি ছিলেন। অতিশিক্ষিত, সুভদ্র যেসব বঙ্গসন্তানকে উনিশ শতক থেকে আমরা সমীহ করে এসেছি, সুপ্রিয়দাকে তাঁদের একজন বলে মনে হত।

রসরচনায় সিদ্ধহস্ত হলেও তেমন উৎসাহ নিয়ে লেখালেখি করেননি। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি স্যার উমেশচন্দ্র ব্যানার্জির উত্তরপুরুষ হলেও সুপ্রিয়দা কখনওই ওই প্রসঙ্গ তুলতেন না।

আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণ এই সুপ্রিয়দার সৌজন্যে। সেই সময় মার্কিন সরকার প্রতি বছর কোনো তরুণ লেখক বা শিল্পীকে দিন পনেরোর জন্যে তাঁদের দেশ ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে যেতেন। ওদেশ থেকেও তরুণ লেখক—শিল্পী ভারতে আসতেন। আমার আগে বেশ কিছু বাংলা ভাষার লেখককে ওঁরা আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে গেছেন। সুপ্রিয়দার সঙ্গে পরিচয় দূরের কথা, মানুষটি কেমন দেখতে তা—ই জানতাম না। হঠাৎ চিঠি পেলাম বিনীত ভাষায় লিখেছেন, কয়েকজন তরুণ লেখক—শিল্পী আমেরিকা থেকে এসেছেন। তাঁদের তিনি বাংলা খাবার খাওয়াতে চান। আমি যদি সেই মধ্যাহ্নভোজনে অংশ নিই তাহলে আনন্দিত হবেন। ইউএসআইএস—এর প্যাডের পাতায় যে—খাবারের দোকানের নাম লেখা রয়েছে, তা দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। বউবাজার এবং নির্মলচন্দ্র স্ট্রিটের মোড়ে বঙ্গলক্ষ্মী রেস্টুরেন্টকে যেতে—আসতে বহুবার দেখেছি। সাদামাটা বলেই মনে হত। কিন্তু সেসময় আজকের মতো নামী নামী বাংলা খাবারের রেস্টুরেন্ট ছিল না, তবু বিদেশিদের খাওয়ানোর জন্যে বঙ্গলক্ষ্মীতে যাওয়াটা একটু অস্বাভাবিক ছিল।

চিঠিতে—দেওয়া সময়ে সিঁড়ি ভেঙে বঙ্গলক্ষ্মীর দোতলায় উঠতেই দেখলাম ধুতি—পাঞ্জাবি পরা হাসিমুখের একটি মানুষ এগিয়ে এসে বললেন, ‘আসুন ভাই। আমি সুপ্রিয় ব্যানার্জি। আপনি যে সমরেশ তা দেখেই বুঝেছি। এঁরা আমাদের অতিথি। আলাপ করিয়ে দিই!’

তিনজন সাদা বিদেশিনী, একজন কালো বিদেশির সঙ্গে পরিচিত হলাম। সূর্য সেন স্ট্রিটের পাইস হোটেলের থেকে সামান্য উন্নত বঙ্গলক্ষ্মীর চেহারা। কিন্তু রান্না চমৎকার। খেতে খেতেই আমি সুপ্রিয়দার ভাই সমরেশ হয়ে তুমিতে পৌঁছে গেলাম।

এর কয়েক মাস পরে আমন্ত্রণপত্র পেলাম। দ্রুত পাসপোর্ট, ভিসা হয়ে গেল। প্যানঅ্যাম এয়ারলাইন্সের টিকিট যখন সুপ্রিয়দা আমায় দিলেন, তখন তাঁকে প্রশ্নটা করেছিলাম, ‘আচ্ছা, আমাকে কেন নির্বাচন করলেন?’

সুপ্রিয়দা হেসেছিলেন, ‘আমি তো করিনি। তাঁদের কর্ম তাঁরা করেছেন, আর তুমি বলছ আমি করেছি। তোমার ‘দৌড়’, ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ এই মুহূর্তে শুধু ওয়াশিংটনের লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসেই নেই, অনেক শহরের বড় লাইব্রেরিতেও গিয়ে পড়া যাচ্ছে। তোমার বয়সি অন্য কোনো লেখকের এই রকম বই না থাকায় ওরা তোমাকে বেছে নিয়েছে।’ আমার এখনও বিশ্বাস, সেদিন নিজেকে আড়াল করতেই সুপ্রিয়দা কথাগুলো বলেছিলেন। সজ্জনরাই নিজের প্রচার চান না।

আমেরিকা থেকে ফিরে এসেছি। ‘কালপুরুষ’  লেখা শেষ হয়েছে। কপালে ভারত সরকারের সাহিত্য অকাদেমির পুরস্কারটাও জুটে গিয়েছে। নিজেই অবাক হয়ে ভেবেছি। কী করে সম্ভব হল? তখনও সুনীলদা, শীর্ষেন্দুদা, যাঁদের অবশ্যই পুরস্কৃত করা কর্তব্য ছিল, তা না করে ‘কালবেলা’কে বেছে নেওয়া কেন হল? এ যেন আমারই লজ্জা! আমি এখনও ভাবি, অকাদেমির জুরিরা একটু তাড়াতাড়ি করে আমাকে বেছেছিলেন।

এদিকে তিনটে ধারাবাহিক, ‘উত্তরাধিকার’—’কালবেলা’— ‘কালপুরুষ’ লেখার পরেই ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ আমাকে চতুর্থ ধারাবাহিক উপন্যাসের জন্যে প্রস্তুত হতে বললেন। বিষয় যখন ভেবে পাচ্ছি না, তখনই সুপ্রিয়দার ফোন এল।

গেলাম ধর্মতলার ইউএসআইএস অফিসে। কোনো ভণিতা না করে তিনি বললেন, ‘শোনো সমরেশ। আমরা বাঙালিরা তো সব ব্যাপারে পিছিয়ে পড়ছি, তাই কেউ কিছু করার উদ্যোগ নিলে ভালো লাগে;তুমি নিশ্চয়ই দূরদর্শন দ্যাখো। সেখানে সরকারি কর্মচারীরা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সঙ্গে নাটক বানান। বেশিরভাগ নাটকের মান ভালো নয়। তা এখন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, বেসরকারি প্রযোজকরা যদি সময় কেনেন তাহলে তাঁদের নাটক করতে দেওয়া হবে। কিন্তু নাটকের খরচ তাঁদেরই তুলতে হবে বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞাপন দেখিয়ে। এই সুযোগটা নিতে এগিয়ে এসেছে একজন বাঙালি নাট্যকার, পরিচালক, অভিনতা। কিন্তু মাধ্যমটা যেহেতু নতুন তাই তিনি একজন ক্রিয়েটিভ মানুষকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চান। তুমি যদি রাজি হও তাহলে আমি খুশি হব।’

প্রস্তাবটা অভিনব। আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম সেই ভদ্রলোকের নাম।

সুপ্রিয়দা বললেন, ‘জোছন দস্তিদার। তুমি নিশ্চয়ই নাম শুনেছ!’

একটু হতাশ হলাম। কয়েক বছর আগে ‘দেশ’ পত্রিকায় আমি জোছন দস্তিদার পরিচালিত ‘প্রাগৈতিহাসিক’ নামের অল্পদৈর্ঘ্যের ছবির সমালোচনা লিখেছিলাম। ছবিটা যে ভালো লাগেনি তা ব্যাখ্যা করে লিখেছিলাম। সেই সমালোচনা পড়ে জোছনদা নিশ্চয়ই অখুশি হয়েছিলেন, তাই—সুপ্রিয়দাকে জিজ্ঞাসা করলাম, জোছনবাবুকে কি আমার কথা বলেছেন?

‘অবশ্যই। বলামাত্র জোছন রাজি হয়ে গেছে। দাঁড়াও, তোমাকে ওর সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’ সুপ্রিয়দা ল্যান্ডলাইনের রিসিভার টেনে নিলেন। তখনও মোবাইল ফোন কল্পনার মধ্যে ছিল না।

জোছনদার সঙ্গে সেদিন কথা হল। বললেন, ‘আগামী রবিবার সকাল দশটায় আমার বাড়িতে কয়েকজন এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে বসব। আপনার যদি খুব অসুবিধে না হয় তাহলে এলে খুশি হব।’

কোনো অভিমান বা খারাপ লাগার চিহ্ন তাঁর গলায় ছিল না।

রবিবারে ওঁর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, বাংলা গ্রুপ থিয়েটারের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি উপস্থিত হয়েছেন। আমরা আলোচনা করলাম। থিয়েটার না বলে দূরদর্শন ধারাবাহিক বলা ঠিক হবে। আর যদি এক বা দুই পর্বে শেষ হয় তাহলে তাকে টেলিফিল্ম বলাই সঙ্গত হবে। সেদিন জোছন দস্তিদার তাঁর সহকর্মী এবং ‘চার্বাক’ নাট্যদলের সদস্য শ্যামল সেনগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দেখলাম, ভদ্রলোক শান্ত ভঙ্গিতে বুঝেসুঝে কথা বলেন। আবেগে ভেসে যান না।

পর পর কয়েকটা দিন বসার পরে জোছনবাবু আমার দাদা হয়ে গেলেন। আমাদের সংস্থার নামকরণ করা হল ‘সোনেক্স’। লেক গার্ডেন্সের শ্যামল সেনগুপ্তের বাড়ির একতলায় ক্যামেরা এবং এডিটিংয়ের ব্যবস্থা হল। দোতলায় অফিস। প্রথম দিকে চেয়ার—টেবিল না থাকায় মেঝের ওপর কাগজ পেতে বসে কাজ করতাম।

এই সময় গৌতম ঘোষ  টিভির জন্যে বাংলা ‘গল্পবিচিত্রা’ নামে একটি টেলিফিল্ম বানাচ্ছিলেন। সম্ভবত ১৩টি পর্বের চুক্তি ছিল। আমার মাথায় তখন যে—চিন্তাটা পাক খাচ্ছিল তা হল, এমন একটা ধারাবাহিক নাটক তৈরি করতে হবে, যার কাহিনি কোনো প্রকাশিত গল্প—উপন্যাস থেকে নেওয়া হবে না। টিভির দর্শকদের কথা মনে রেখে তাঁদের জন্যে তৈরি করতে হবে। চিন্তাটা যখন ধীরে ধীরে একটা চেহারা নিচ্ছে, তখন ১০টি পর্বের টেলিফিল্ম শেষ করে গৌতম অন্য কোনো জরুরি প্রয়োজনে কাজটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন। ওই পর্বগুলোর স্পনসর ছিল দেজ মেডিক্যাল, ১৩টি পর্বের ভাড়া তারা দিয়ে রেখেছিল দূরদর্শনকে। ফলে, তিন পর্বের ভাড়া ফেরত পাওয়া যখন সম্ভব ছিল না, তখন  যোগাযোগ হওয়ায় সোনেক্স দায়িত্ব পেয়েছিল ওই তিনটি পর্বের জন্যে বাংলা গল্পবিচিত্রা তৈরি করতে। বাংলা ভাষায় টিভির টেলিফিল্মের ইতিহাসে একটি অভিনব ঘটনা ঘটল। তখন নতুন গল্প ভাবার সময় নেই বলে আমি আমার ‘উৎসবের রাত’ গল্পটির চিত্রনাট্য লিখে দেখলাম সেটি শেষ করতে দুটো পর্ব দরকার। তদ্দিনে রমাপ্রসাদ বণিক আমাদের সহকারী হিসেবে যোগ দিয়েছে। তাঁর অনুরোধে বিশিষ্ট নাট্যপরিচালক এবং অভিনেতা বিভাস চক্রবর্তী পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন। সে সময় টিভি সিরিয়াল ইন্ডাস্ট্রি তৈরি না হওয়ায় দূরদর্শনের কলাকুশলীরাই বেনামে কাজ করতেন। উৎসবের রাতের মূল দু’টি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন শ্রীযুক্তা তৃপ্তি মিত্র এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। নাটক না, চলচ্চিচত্রের আঙ্গিকে শুটিং হয়েছিল। আশ্চর্য স্বাভাবিক অভিনয় করেছিলেন ওঁরা। পরের একটি পর্বের নাটক ছিল ইন্দ্র মিত্রের হাসির গল্প ‘পরিণাম রমণীয়’ অবলম্বনে। অভিনয় করেছিলেন মমতা শংকর এবং এন বিশ্বনাথন।

‘উৎসবের রাত’ টেলিকাস্ট হওয়ামাত্র প্রশংসা পেলাম। আমরা খুশি হলাম। সেইসঙ্গে দেজ মেডিক্যালের কর্ণধার ভূপেন দে মশাই দেখা করতে চাইলেন। ওঁদের লিন্ডসে স্ট্রিটের অফিসে নয়, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে গিয়ে আমি আর জোছনদা দেখা করলাম। ছোটখাটো চেহারার মানুষটি দেজ মেডিক্যালের মতো প্রতিষ্ঠান শক্ত হাতে চালাচ্ছেন। বললেন, ‘আপনারা একটা ধারাবাহিক নাটক তৈরি করুন যাতে বাঙালি নিজেদের দেখতে পায়।’ জোছনদা তাঁকে আমার ভাবনা বলতেই তিনি খুব খুশি হয়ে বললেন, ‘এটা তৈরি করতে যা খরচ তা আমরাই বহন করব। আপনি কোনো নাম ভেবেছেন সমরেশবাবু?’ হেসে বলেছিলাম, মাথায় যে—নামটা ঘুরছে তা হল, ‘তেরো পার্বণ।’

‘বাঃ। চমৎকার। বাঙালির বারো মাসে তো তেরো পার্বণ লেগেই আছে। এই নামটাই রাখুন। বাকি সমস্যাগুলো আমাদের দিলীপ আপনাদের সঙ্গে বসে সমাধান করবে। ব্যস, এটাই ফাইনাল।’ ভূপেনবাবু হেসে হাত মেলালেন।

তারপর ক’দিন ধরে শুধু ‘তেরো পার্বণ’ ছাড়া আর কিছু মাথায় নেই। সবে আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের দেখে এসেছি। জেনেছি, তাঁদের কেউ কেউ এখনও দেশের কথা ভাবেন, কে কেমন আছেন জানতে চান। এইরকম এক যুবক প্রায় ১২ বছর পরে কলকাতায় ফিরেছে কয়েক সপ্তাহের জন্যে। ওই ১২ বছরে প্রচুর পরিবর্তন হয়ে গেছে কলকাতার। সামাজিক, আর্থিক, পারিবারিক জীবনের গড়নেও বদল এসেছে। ওই যুবকের চোখে সেই বদলে যাওয়া চেহারা ধরা পড়ছে একের পর এক। তার মা, দাদা, বউদি, দুই ভাইপো—ভাইঝির সংসারে থেকে সে আত্মীয়বন্ধুদের দেখছে। এই ছেলেটির নাম রাখলাম গৌরব। ডাক নাম গোরা।

জোছনদা ঝটপট ঠিক করলেন গোরার মায়ের চরিত্রটিতে অভিনয় করবেন চন্দ্রাদি, যিনি চার্বাক নাট্যদলের অন্যতম শিল্পী এবং ব্যক্তিজীবনে জোছনদার স্ত্রী। চন্দ্রাদির সঙ্গে ইতিমধ্যে পরিচিত হয়েছি। মনে হল, এই নির্বাচন যথাযথ। কিন্তু গোল বাধল গোরা চরিত্রটি নিয়ে। জোছনদার ইচ্ছে ওই চরিত্রে সিনেমার নায়ক তাপস পালকে নেবেন। প্রথম বাংলা ধারাবাহিকে তাপস পাল নায়ক হলে লোকে দেখবে। কিন্তু আমি বলেছিলাম, তাপস যত ভালো অভিনেতাই হোক না কেন, ওই চরিত্রে তাকে মানাবে না। কারণ, গৌরব ১২ বছর আমেরিকায় ছিল। তার বাচনভঙ্গি বিশেষ করে, ইংরেজি উচ্চচারণ, হাঁটাচলায় যে—ছাপ পড়েছে, তা  কলকাতায় থাকলে সম্ভব হবে না। সরল, মফসসলের যুবক তো নয়, তাপসকে দেখে মনেই হবে না সে ১২ বছর আমেরিকায় থেকেছে।

রোজ ঝগড়া হত আমাদের। অন্যান্য চরিত্রগুলোয় একের পর এক শিল্পী নেওয়া হয়ে গেছে। আমাদের প্রোডাকশন কন্ট্রোলার ছিল সঞ্জয় হালদার। সে তার দুই ছেলে—মেয়েকে নিয়ে আসতেই দেখলাম ওরা গৌরবের ভাইপো—ভাইঝির বয়সি। মেয়েটিকে খুব ভালো লাগল। ওদের দু’জনকেই নির্বাচন করা হল। ওই দু’জনের নাম ইন্দ্রনীল এবং ইন্দ্রাণী। সেই ইন্দ্রাণী হালদার তার যোগ্যতা প্রমাণ করে পরবর্তীকালে খ্যাতনামা অভিনেত্রী হয়েছে। এখনও দেখা হলে বুঝতে পারি, সে সেই দিনগুলো ভুলে যায়নি।

কিন্তু গৌরব পাওয়া যাচ্ছিল না। সোনেক্সের অন্যতম স্তম্ভ শ্যামল সেনগুপ্ত প্রথম থেকেই আমাকে সমর্থন করায় তাপস পালকে পাকা কথা দিতে পারছিলেন না জোছনদা। এদিকে শুটিংয়ের আর কয়েকদিন বাকি। রেগে গিয়ে জোছনদা বললেন, ‘শোন সমরেশ, কাল বিকেলের মধ্যে তুই যদি কোনো নাম না বলিস তাহলে আমি তাপসকেই ফাইনাল করব!’

খুব সমস্যায় পড়লাম। কিন্তু সেই বিকেলে দোতলায় জানলা থেকে দেখলাম নীচের লনে যারা ব্যাডমিন্টন খেলছে, তাদের মধ্যে লম্বা চেহারার যে—যুবক রয়েছে, যে আমাদের ক্যামেরা—এডিটিং; ইত্যাদির দেখাশোনা করে, তার সঙ্গে আমার কল্পনার গৌরবের প্রচুর মিল রয়েছে। আমি চিৎকার করে তাকে ডাকলাম। বললাম, ওপরে আসতে।

ছয় ফুটের চেহারাটা টান টান, মেদ নেই। ওপরে উঠে বিনীত ভঙ্গিতে যুবক আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, কিছু বলবেন?’

ওকে দেখলাম। ‘সোনেক্স’ চালু হওয়ার পর শ্যামলবাবুর এই বাড়িতে অফিস হয়েছে। বেশ কয়েকবার আসা হল। এই যুবক জোছনদার আত্মীয়, দেখা হলে সৌজন্য বিনিময় হয়েছে। ঘনিষ্ঠ হওয়ার কোনো কথাই নয়। তাই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি দিল্লিতে থাকতে, তাই তো?’

‘হ্যাঁ, স্যার।’

‘অভিনয় করবে? তেরো পার্বণে?’

‘সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই চেষ্টা করব।’

‘ঠিক আছে, পরে কথা বলছি।’ নেমে গেল দোতলা থেকে সে, যার নাম সব্যসাচী চক্রবর্তী।

জোছনদাকে প্রস্তাবটা দিতেই কয়েক সেকেন্ড অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোর চোখে কি ছানি পড়েছে? ভালো দেখতে পাচ্ছিস না?’

‘বুঝলাম না।’

‘ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিস?’

হ্যাঁ, সব্যসাচীর মুখের চামড়া মোলায়েম ছিল না।

বেশ কিছু ব্রণর দাগ, অমসৃণ মুখ হওয়া সত্ত্বেও একটা অন্য রকম স্মার্টনেস থাকায় সেটা দৃষ্টিকটু লাগত না।

জোছনদা বললেন, ‘ওই মুখ  টিভির পর্দায় দু’সেকেন্ড ক্লোজে ধরা যাবে না। ধরলেই পাবলিক টিভি বন্ধ করে দেবে। তুই পাগল হয়ে গিয়েছিস সমরেশ। তিন—চারটে এপিসোডের পর স্পনসর টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেবে। না, না, আমি তাপসের সঙ্গে কথা বলছি।’

শ্যামল সেনগুপ্ত আমাকে সমর্থন করলেন। বললেন, ‘কিন্তু ওই চরিত্রের সঙ্গে বেণুর হাঁটাচলা, কথা বলার ভঙ্গির খুব মিল রয়েছে। তাপসকে দেখে কি মনে হবে বিদেশে অনেকদিন থেকেছে?’

আমাদের দলভারী হল যখন জোছনদার স্ত্রী চন্দ্রাবউদি আমাকে সমর্থন করলেন। পরের দিন জোছনদা আমাকে বললেন, ‘তোর পছন্দ বেঠিক নয়। একদম নতুন নায়ককে পাবলিক যদি না নিতে পারে, তারপর ওই মুখ, ঠিক আছে কপালে যা আছে তা—ই হবে। তপনকে বলতে হবে বেশি ক্লোজ—আপে যেন না যায়। মেক—আপের পঞ্চুদাকে বলতে হবে যতটা সম্ভব মুখটাকে মেরামত করে দিতে।’

এখানে বলে রাখা ভালো, সব্যসাচীর ডাক নাম বেণু। ইউনিটের সবাই ওকে বেণু বলেই ডাকত। তপন দূরদর্শনের ক্যামেরাম্যান এবং পঞ্চুদা ওখানকার মেক—আপম্যান ছিলেন। তখনও পুণের ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে ছেলে—মেয়েরা বেরিয়ে আসেনি, তাই দূরদর্শনের কর্মচারীদের সাহায্য নিতে হত। সরকারি চাকরি বাঁচাতে তাঁরা নিজের নামে কাজ করতেন না।

তেরো পার্বণের শুটিংয়ের আগে ওয়র্কশপের জন্যে বেশি সময় পাওয়া যায়নি। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল শ্যামলের সূত্রে তেরো পার্বণের গৌরবের প্রেমিকার চরিত্রে অভিনয় করতে এসেছিলেন ইন্ডিয়ান এয়ার লাইন্সের এয়ার হোস্টেস খুশি মুখার্জি। খুশিকে চমৎকার মানিয়েছিল।

‘তেরো পার্বণ’ পরিচালনা করেছিলেন জোছন দস্তিদার, তাঁকে সাহায্য করেছে রমাপ্রসাদ বণিক। পরে রমাপ্রসাদকে পূর্ণ দায়িত্ব দিলেন জোছনদা। প্রতি বৃহস্পতিবারে রাত আটটায় আধঘণ্টার স্লটে ধারাবাহিকটি প্রচারিত হত। দুই সপ্তাহের মধ্যে তেরো পার্বণ জনপ্রিয়তার শীর্ষে চলে গেল। হিন্দিতে ‘বুনিয়াদ’ যে—জনপ্রিয়তা সমস্ত ভারতবর্ষ জুড়ে পেয়েছিল, তেরো পার্বণের গণ্ডি ছোট হলেও মুখে মুখে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

আমার সেই প্রথম ধারাবাহিকের জন্যে চিত্রনাট্য লেখা। স্বাভাবিকভাবেই বেশ রোমাঞ্চিত ছিলাম। মাঝে মাঝে দে’জ মেডিক্যালের বড়কর্তার সঙ্গে আলোচনা করতে আমাদের যেতে হত। জোছনদা প্রায়ই আমাকে সঙ্গে নিতেন। দে’জ মেডিক্যালের একজন অফিসার, দিলীপবাবু আমাদের সঙ্গে নিয়মিত  যোগাযোগ রাখতেন। এই হাসিখুশি ভদ্রলোকের সহযোগিতার কথা এখনও মনে আছে। সাধারণত আমরা ভূপেন দে মশাইয়ের বাড়িতে অথবা বালিগঞ্জ ফাঁড়ির অফিসে গিয়ে ওঁর সঙ্গে দেখা করতাম। একবার কোনো কারণে দিলীপবাবু আমাকে ওঁদের লিন্ডসে স্ট্রিটের অফিসে যেতে বললেন। সেখানে গিয়ে কাজ শেষ করে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় দিলীপবাবু একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমাদের আর এক কর্তা কথা বলতে চান, আসুন।’ জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এই কর্তার নাম শ্রীযুক্ত ধীরেন দে। নামটি জানেন না এমন ফুটবল অনুরাগী তখন কলকাতায় ছিলেন কিনা সন্দেহ। মোহনবাগান ক্লাবের সম্পাদক এই মানুষটির ক্লাবের প্রতি ভালোবাসার যে শেষ ছিলনা একথা আমরা মোহনবাগানি বন্ধুদের মুখে শুনেছিলাম।

ওঁর ঘরে নিয়ে গেলেন দিলীপবাবু। বললেন, ‘ইনি সমরেশ মজুমদার।’

টেবিলের উল্টো দিকে শীর্ণ চেহারার প্রৌঢ় মানুষটি একটু কেৎরে বসেছিলেন। মুখ দেখেই বুঝলাম, ওঁর মেজাজ একটুও ভালো নেই। আমাকে একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলেন, প্রায় মিনিটখানেক চুপ করে বসে থেকে বললেন, ‘বেশ তো লেখালেখি হচ্ছিল, এই লাইনে এলেন কেন? ছিঃ!’

আমি হতভম্ব। যে—কোম্পানি আমাদের তেরো পার্বণ স্পনসর করছে, তার একজন কর্তা এ কী কথা বলছেন! ধীরেনবাবু আবার বললেন, ‘এইসব নাচগান আর ফালতু নাটক করে সময় নষ্ট করছেন কেন?’

ওঁর বিরক্ত মুখ দেখে গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। তবু বললাম, ‘দর্শকরা তো খুব প্রশংসা করছে। সবাই ভালো বলছে।’

‘দর্শকদের চরিত্র জানেন না? টিম জিতলে মাথায় তুলে নাচে আর হেরে গেলে বাপ—মা তুলে গাল দেয়। কী করা যাবে! ভূপেনবাবুর ইচ্ছে হয়েছে তাই দে’জ মেডিক্যাল স্পনসর করছে। আমি কী বলব! কিন্তু আপনাকে বলছি, নিজের সর্বনাশ আর করবেন না। এসব ছেড়ে দিয়ে  লেখা নিয়ে থাকুন। আচ্ছা—’

বাইরে বেরিয়ে এলে দিলীপবাবু আমাকে সান্ত্বনা দিতে চেয়েছিলেন—’উনি একটু ওইরকম। মনে যা আসে তা বলে দেন। আসলে আপনাকে লেখক হিসেবে দেখতে উনি বেশি পছন্দ করেন, তাই।’

ঠিক তখনই ধীরেনবাবু তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে কোথাও যেতে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বললেন, ‘একটা প্লাস পয়েন্ট, ওই গোরা ছেলেটিকে কোথায় পেয়েছেন? খুব ভালো। রাইট চয়েজ।’ বলে চলে গেলেন।

সেই চুরাশি সালে যখন তেরো পার্বণে মজে আছি, তখন আমার বন্ধুরা, অভিভাবকরা প্রায় ধীরেনবাবুর মতোই কথা বলেছিলেন। টিভি এবং ফিল্ম গুলিয়ে ফেলে তাঁরা বলেছেন, ‘সিনেমা লাইনে গিয়ে নিজের সর্বনাশ করলে সমরেশ। এত অল্পবয়সে অকাদেমি পুরস্কার পেয়েও সিনেমা লাইনে গিয়েছ? এরপর কি আর লিখতে পারবে? একজন বুঝিয়েছিলেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র যদি সিনেমা না বানাতেন তাহলে বাংলা সাহিত্য তাঁর কাছ থেকে আরও ভালো লেখা পেত। শৈলজানন্দ সিনেমা করে নিজের সর্বনাশ করেছেন। এঁরা কেউ সত্যজিৎ বা ঋত্বিক হতে পারেননি, আবার তারাশঙ্কর বিভূতিভূষণকেও স্পর্শ করতে পারলেন না। অতএব ভেবে দ্যাখো সমরেশ, ভেবে দ্যাখো।’

ধীরেন দে মশাই বয়সে অনেক বড়। তাঁর মুখের ওপর কথা বলা ধৃষ্টতা হত। কিন্তু আমি একটা পথ খুঁজে নিলাম। সিরিয়ালের স্ক্রিপ্ট লেখা, শুটিংয়ের আয়োজন করার নেশা থেকে বেরিয়ে আসার কথা তখন ভাবছিলাম না। আবার লেখা ছেড়ে দেব তা স্বপ্নেও চিন্তা করিনি। হঠাৎ মনে হল, অনেক লেখক দশটা—পাঁচটা চাকরি করেন। সকাল—সন্ধে লেখেন। বিমল কর, রমাপদ চৌধুরী, শংকর যদি চাকরির সঙ্গে লেখা চালিয়ে যেতে পারেন তাহলে আমি পারব না কেন? সকালে খেয়েদেয়ে এগারোটার সময় সোনেক্সের অফিসে এসে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত যা কাজ করছি তা করে বাড়ি ফিরে যাব। লিখব সকাল এবং সন্ধ্যায়। লেখার সময় যেমন সিরিয়াল নিয়ে ভাবব না তেমনই সিরিয়ালের কাজ করার সময় লেখা নিয়ে ভাবব না। ক’দিনের মধ্যে বুঝতে পারলাম, এইরকমভাবে কম্পার্টমেন্ট ভাগ করতে আমার অসুবিধে হচ্ছে না। সিরিয়ালের পাশাপাশি লেখালেখি চালাতে সমস্যা হয়নি। এই সিরিয়াল করতে করতেই ‘গর্ভধারিণী’ অথবা ‘সাতকাহন’ লিখেছি, লিখতে পেরেছি।

তখন সোনেক্স ছিল জমজমাট। জোছনদা এবং শ্যামলবাবু তো ছিলেনই, আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল রমাপ্রসাদ বণিক। তারপর এল দেবাংশু সেনগুপ্ত। অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত ছেলে। এল যিশু দাশগুপ্ত। যিশু এসেছিল লাইটের অ্যারেঞ্জার হিসেবে। কিন্তু ওর বাসনা ছিল ক্যামেরাম্যান হওয়ার। বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান মহাজন সাহেবের ছায়ায় ছিল কিছুদিন। কিন্তু নতুন কারওর পক্ষে চট করে সুযোগ পাওয়া সহজ ছিল না। তাছাড়া আমাদের পূর্বঅভিজ্ঞতা না—থাকায় জোছনদা ক্যামেরা, সম্পাদনার দায়িত্ব দূরদর্শনের অভিজ্ঞদের হাতে দিয়ে নিশ্চিত ছিলেন। আমরা খুব ভাগ্যবান, বিখ্যাত সেতারশিল্পী দীপক চৌধুরীকে পেয়েছিলাম সংগীত পরিচালক হিসেবে।

প্রথমে ঠিক ছিল, তেরো পার্বণ শেষ হবে তেরো সপ্তাহে। নামকরণের সময় সেটাই ঠিক ছিল। প্রতি সপ্তাহের এপিসোড যেন একটা পার্বণ। দশ নম্বর যখন লিখছি, তখন জোছনদা বললেন, ‘দ্যাখ, সিরিয়াল এখন জমে ক্ষীর হয়ে গেছে। প্রতি বৃহস্পতিবার তেরো পার্বণ দেখা দর্শকদের অভ্যেসে এসে গেছে, তাই স্পনসররা চাইছে না তেরোটায় শেষ করে দিতে। তুই গল্প বাড়িয়ে যা।’

বললাম, ‘দুধে জল মেশালে স্বাদ নষ্ট হয়ে যায়।’

জোছনদা বললেন, ‘জল মেশাতে কে বলেছে? দুধে দুধ মেশা। তুই পারবি। আর তেরো পার্বণ হল নানান রকমের উৎসব। তেরো সপ্তাহে তা শেষ না—ও হতে পারে।’

যে—গল্প তেরো পর্বে ভেবেছিলাম, তা ছাব্বিশে নিয়ে গিয়ে বললাম, ‘আর নয়। ছাব্বিশে গোরা আমেরিকায় ফিরে যাবে।’

তখন তিন শিফটে এক পর্বের শুটিং করা হত। একটি এপিসোডের জন্যে পাওয়া যেত এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা। এখন নাকি একদিনে দেড় এপিসোডের শুটিং হয়। ফলে, নানান কৌশলের আশ্রয় নিতে হয় পরিচালকদের। কিন্তু সেই শুরুর সময় আমরা প্রচুর সময় অনেক যত্ন নিয়ে সিরিয়াল তৈরি করতে পেরেছিলাম।

কিন্তু ছাব্বিশেও থামতে চাইলেন না জোছনদা। অবশ্য এ ব্যাপারে স্পনসরের চাপ তাঁর ওপর ছিল। সোনেক্স তৈরি করতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হয়েছিল। একটা চালু সিরিয়াল থাকলে সেই আর্থিক সমস্যার সমাধান হয়। তাছাড়া সিরিয়ালের সঙ্গে জড়িত শিল্পী—কলাকুশলীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হতেন। কিন্তু আমার পক্ষে আর গল্প বাড়ানো সম্ভব ছিল না। আমি সরে যেতে রমাপ্রসাদ এবং জোছনদা যৌথ দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেই ওঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, রবার টেনে লম্বা করা হচ্ছে। তখন আমাকে অনুরোধ করলেন, ‘তুই শেষটা করে দে।’ শেষ এপিসোড  লেখা হল। তেরো পার্বণের বেশির ভাগ শুটিং হয়েছিল সল্ট লেকের একটি বাগানওয়ালা বাড়িতে। দারুণ অভিজ্ঞতা হল।

সোনেক্স পর পর কয়েকটা সিরিয়ালে হাত দিল। ‘উড়নচণ্ডী’, ‘আশ্চর্য দীপক’, ‘সেই সময়’। বাংলা সিরিয়ালে সোনেক্সের অবদান কখনওই ভোলা যাবে না।

কিছুদিন থেকেই আমার মনে হচ্ছিল, শুধু চিত্রনাট্যকার হিসেবে নয়, প্রযোজক হিসেবেও কাজ করা উচিত। তাতে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধে হয়। আর এই সময় আলাপ হল ‘বহুরূপী’ এবং ‘চেনামুখ’—এর অভিনেতা অরিজিৎ গুহের সঙ্গে। রমাপ্রসাদও আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। তিনজনে ঠিক করলাম, আমরা নতুন ধরনের সিরিয়াল করব। তখনও চ্যানেল বলতে ছিল একমাত্র দূরদর্শন। পূর্ণদাস রোডে আমাদের অফিস হল। সংস্থার নাম রাখা হল ‘টেলিফ্রেম’।

সাহিত্যিক সাংবাদিক সন্তাোষকুমার ঘোষ আমাকে শিক্ষিত করার চেষ্টা করেছিলেন। সাহিত্য ও জীবনবিষয়ক অনেক পরামর্শ তাঁর কাছে পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি।

পেছনে তাকিয়ে মনে হয়েছে যতটা যোগ্য হলে তার সদব্যবহার করা যেত তা আমি ছিলাম না। তখন সপ্তাহের অন্তত দিনতিনেক সন্তাোষদার সঙ্গে বিকেল—সন্ধে কাটত। রবীন্দ্রনাথের গান সম্পর্কে তাঁর পাণ্ডিত্য সমস্ত রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞরা তো বটেই, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় থেকে সুচিত্রা মিত্র স্বীকার করতেন। ফলে, প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ পেতাম।

সন্তাোষদার সঙ্গে আড্ডা জমত গণেশ অ্যাভেনিউয়ের এক পানশালায়। অভিনেত্রী সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের স্বামী মামাজি ওঁকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। আড্ডার দ্বিতীয় জায়গা ছিল পার্ক স্ট্রিটের লাগোয়া রাতদিন হোটেলের বাগানে। ওই রাতদিন হোটেলেই আলাপ হল এক ভদ্রলোকের সঙ্গে। ভারী শরীর, পায়ে প্রতিবন্ধকতা থাকায় ক্রাচের সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করেন অথচ মোটরসাইকেল চালান। অবশ্য সেই মোটরসাইকেলের ব্যালান্স রাখার জন্যেই সম্ভবত পাশে একটি ক্যারিয়ার লাগানো থাকত। ভদ্রলোক থাকতেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের হৃষীকেশ পার্কের কাছে। নাম আশুতোষ গুপ্ত। আলাপের সূত্র ছিল, আশুতোষবাবু ‘কালীয়’ নামে একটি পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশ করতেন। তাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে তিনি প্রতিবন্ধীদের সমস্যা নিয়েই লিখতেন। হাতের কাছে সন্তাোষদার মতো বড়মাপের লেখককে পেয়ে তিনি খুশি হয়েছিলেন। আমরা রাতদিনে গেলেই একবার দেখা করে যেতেন। যতদূর মনে পড়ছে, আশুতোষবাবু রাতদিন হোটেলের রিসেপশনের দায়িত্বে ছিলেন।

এই আশুতোষবাবু এবং তাঁর কালীয় পত্রিকার সঙ্গে একটু ঘনিষ্ঠ হতেই আমার মাথায় নতুন ধরনের  টিভি ধারাবাহিকের ভাবনা আসে। প্রতিবন্ধীদের জীবন, তাদের সমস্যার কথা বললে সেটা নিছক ডকুমেন্টারি টেলিফিল্ম হবে। দর্শকরা যেমন আকর্ষণ বোধ করবেননা, স্পনসর পাওয়াও শক্ত হবে। একজন প্রবীণ অবিবাহিত ডাক্তার, যিনি প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার জন্যে নার্সিং হোম চালান আর একটি কলগার্ল, যার প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে তাদের দু’জনকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে টিভি ধারাবাহিক তৈরি করার কথা ভাবলাম।

ভাবনাটা শক্ত হতে কয়েক বছর লেগে গেল। সন্তাোষদা গত হয়েছেন। আমার ‘তেরো পার্বণ’ পর্ব শেষ হয়েছে। অরিজিৎ গুহ এবং রমাপ্রসাদ বণিককে বিষয়টা বললাম। ওদের পছন্দ হল। স্থির হল, একদা যাত্রিক পরে ‘কাঁচের স্বর্গ’ ছবির নায়ক এবং তারও পরে বেশ কিছু ছবির পরিচালক—নায়ক দিলীপ মুখোপাধ্যায়কে ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করার প্রস্তাব দেব। তখনও দিলীপবাবুকে কোনো টিভি ধারাবাহিক তো দূরের কথা, টেলিফিল্মেও দেখা যায়নি। আমরা ওঁর লেক মার্কেটের কাছের বাড়িতে গিয়ে দেখা করলাম। প্রথমে কিন্তু কিন্তু করছিলেন। কারণ, টিভি—মিডিয়ার সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক তৈরি ছিল না। শেষপর্যন্ত রাজি হলেন। বললেন, ‘আপনার লেখা গল্প উপন্যাস এতদিন পড়েছি, অভিনয় করলে হয়তো খুব ভালো লাগবে।’

সব ঠিক হল কিন্তু টাকা পাব কোথায়? আমাদের তিনজনের সামর্থ্য ছিল না একটা টিভি ধারাবাহিক প্রযোজনা করার। শেষপর্যন্ত অরিজিৎ বন্ধুদের সাহায্য চাইল। চারজন দেড়লক্ষ করে টাকা আমাদের দিল এই শর্তে, টেলিকাস্ট হওয়ার পর টাকা পেলেই তাঁদের শতকরা দশ টাকা সুদসমেত ফেরত দিতে হবে।

এখন ব্যাপারটা স্বপ্ন বলে মনে হয়। ছয় লক্ষ টাকার পুঁজি নিয়ে কেউ যদি টিভি সিরিয়াল তৈরি করতে চায় তাহলে সেই স্বপ্নবিলাসীকে পাগল বলা হবেই। শুনেছি, এখন অন্তত একশোটি এপিসোড তৈরি করে অপেক্ষা করতে হয় কবে দেখানোর সুযোগ পাওয়া যাবে। স্পনসরদের টাকা পেতে পেতে একশো এপিসোড প্রায় ফুরিয়ে আসে। এই  লেখা লেখার সময় একজন প্রযোজক জানালেন, তিনি প্রথম দশটি এপিসোডের টাকা পেয়েছিলেন একশো তিরিশ এপিসোড টেলিকাস্ট হওয়ার পরে। অথচ আমরা মাত্র ছয় লক্ষ টাকা ধার করে টেলিফ্রেম শুরু করেছিলাম, ভাবা যায়?

ঠিক হল নতুন ধারাবাহিকের নাম হবে ‘মুক্তবন্ধ’, পরিচালনা করবে রমাপ্রসাদ বণিক। সোনেক্সে যাঁরা কাজ করতেন, তাঁদের অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। এই দলে ছিলেন হিমাংশু দাস। হিমাংশু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি দফতরের ইনস্পেক্টর হওয়া সত্ত্বেও সোনেক্সে গিয়েছিলেন শখ মেটাতে। শুটিং, সিরিয়ালের অন্য কাজকর্ম যা পর্দার পেছনে হয়, তা ওকে আকর্ষণ করত। কিন্তু কোনো টেকনিক্যাল ব্যাপারে ওর অভিজ্ঞতা না থাকায় জোছনদা হিমাংশুকে সহকারী প্রোডাকশন ম্যানেজার হিসেবে নিয়েছিলেন। যে—কোনো কাজের দায়িত্ব হিমাংশুকে দিলে তা ঠিকঠাক করে দিতে পারত সে। প্রোডাকশন ম্যানেজার ছিল সঞ্জয় হালদার। কিন্তু তাকেও নির্ভর করতে হত হিমাংশুর ওপর। একটা ঘটনার কথা বলছি। সদ্য শেষ হয়েছে তেরো পার্বণের চার নম্বর এপিসোড। হিমাংশু এসে জোছনদাকে একটা কাগজ দিল যাতে খরচের হিসেব রয়েছে। শুটিংয়ের জন্যে যে যা কিনেছে, যাদের টাকা দিতে হবে তার তালিকা বানিয়ে বলল, ‘সই করে দিন, ক্যাশিয়ারের কাছ থেকে টাকা নেব।’

জোছনদা হিসেবে আলতো চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘সাড়ে তিন হাজার টাকা!’ তারপর কলম বের করে কেটে আড়াই হাজার লিখে দিলেন। দেখামাত্র হিমাংশু চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপনি এককথায় হাজার টাকা কমিয়ে দিলেন? আমি কি পকেট থেকে টাকা খরচ করব? অসম্ভব। এভাবে কাজ করা আমার দ্বারা হবে না।’ বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার প্রতিবাদ শোনার পর জোছনদা কাগজটা টেনে নিয়ে আড়াই হাজার কেটে তিন হাজার লিখে দিলেন। বিড়বিড় করতে করতে হিমাংশু ক্যাশিয়ারের কাছে গেল টাকা নিতে। ব্যাপারটা লক্ষ করে জোছনদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এটা কী হল? আপনি তো স্ক্রুটিনি না করেই টাকা কমিয়ে দিলেন।’

‘যদি হিসেবটা ঠিকঠাক হত তাহলে শেষপর্যন্ত পাঁচশো টাকা কম পেলেও ও মেনে নিত? ফিল্মের হিসেবে জল থাকে। তা থেকে সিরিয়াল আলাদা হবে না।’ জোছনদা হেসে বলেছিলেন।

বললাম, ‘তাহলে জেনেশুনেও মেনে নিচ্ছেন কেন?’

জোছনদা তখন একটি মূল্যবান কথা বলেছিলেন, ‘দ্যাখ সমরেশ, একটা সৎ লোক যে কিনা অকর্মণ্য, আর একজন যে হয়তো অসৎ কিন্তু কাজে পটু, তুই দু’জনের কাকে পছন্দ করবি?’

একটু ভেবে বলেছিলাম, ‘দ্বিতীয়জনকে।’

‘কারেক্ট। কিন্তু আলগা করা চলবে না, তাহলেই কাজটা ভালোভাবে হবে। যে টাকা খরচ করছে তাকে একটু—আধটু স্বাধীনতা দিলে ক্ষতি নেই।’ জোছনদা বলেছিলেন।

আশুতোষবাবুর সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাঁর কালীয় পত্রিকা পড়ে আমি মুক্তবন্ধের চিত্রনাট্য লিখেছিলাম। যেহেতু প্রতিবন্ধী শিশুদের সমস্যা ধারাবাহিকে প্রাধান্য পেয়েছিল, তাই সতর্ক থাকতে হয়েছিল কোনো ভুল না থেকে যায়।

চিত্রনাট্য শেষ হল। ঠিক করেছিলাম মোট তেরোটি পর্বে ধারাবাহিক শেষ হবে। কিন্তু কলগার্লের চরিত্রে কোনো অভিনেত্রীকেই আমাদের পছন্দ হচ্ছিল না। আমরা স্থির করেছিলাম, দর্শকরা যাঁকে জানেন, চেনেন এমন কোনো অভিনেত্রীকে আমরা ওই চরিত্রে নির্বাচন করব না। নতুন অভিনেত্রীকে দেখলে দর্শক তাঁকে ধারাবাহিকের চরিত্র হিসেবেই ভাববে। মুশকিল হল সেরকম নবাগতা অভিনেত্রীকে আমরা পাচ্ছিলাম না। বিজ্ঞাপন দেওয়ার পর যেসব ছবি এল, তাদের কাউকে পছন্দ হল না। এই সময় রমাপ্রসাদ বণিক একটি মেয়েকে নিয়ে অফিসে এল। মেয়েটি নাকি  কলকাতায় তৈরি হিন্দি টেলিফিল্মে কাজ করেছে কিন্তু সেটা তাকে তেমন পরিচিতি দেয়নি। নতুন অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের অনেকেই ক্যামেরার সামনে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। এই মেয়েটিকে সেই অসুবিধায় পড়তে হবে না। কিন্তু রমাপ্রসাদ যাকে নিয়ে ঘরে এল, তাকে দেখে মনে মনে মুষড়ে পড়লাম। মেয়েটির চোখ দু’টি অত্যন্ত আকর্ষণীয়, সচরাচর দেখা যায় না। কিন্তু মুখে ঈষৎ ব্রণর দাগ এবং শরীর অত্যন্ত শীর্ণ ছিল। কথা বলার সময় বুঝলাম মেয়েলি মিষ্টি গলা ওর নয় যা চরিত্রের সঙ্গে মানানসই।

মেয়েটি চলে গেলে রমাপ্রসাদকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কোন চরিত্রে ওকে ভেবেছিস?’ সে সরল গলায় জবাব দিয়েছিল, ‘কেন? ওই কলগার্লের চরিত্রে।’

বয়সে অনেক ছোট, মান্য করে কথা বলে যে তাকে ব্যাপারটা বোঝাতে একটু বিপাকে পড়লাম। শেষপর্যন্ত জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুই কোনো কলগার্ল দেখেছিস। মানে বাস্তবে না—হোক সিনেমা—থিয়েটারে?’

‘প্রস্টিটিউট আর কলগার্লের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে?’

‘আছে।’

‘তা হলে দেখিনি।’

‘শোন, কথা বলা, হাঁটাচলায় চটক থাকবেই আর সেইসঙ্গে শরীরের গঠনও এমন যা অনেক পুরুষকে আকর্ষণ করে। আর এটাই ওদের ব্যবসার মূলধন। এই মেয়েটির শরীরের সঙ্গে কি তা মিলছে? এত রোগা মেয়েকে কি দর্শক কলগার্ল হিসেবে মেনে নেবে?’ জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

মাথা নিচু করে চলে গিয়েছিল রমাপ্রসাদ। দু’দিন পরে আমাদের মেক—আপম্যান পঞ্চুদা এসে বললেন, ‘ওই মেয়েটিকে আর একবার দেখুন।’

‘কোন মেয়েকে?’

‘যাকে রমাপ্রসাদ কলগার্লের চরিত্র করাতে এনেছিল।’ পঞ্চুদা বললেন।

তখন অরিজিৎ অফিসে ছিল। পঞ্চুদা মেয়েটিকে নিয়ে এলেন। ওর দিকে তাকিয়ে আমি হতভম্ব। দু’দিন আগে যাকে দেখে সাদামাটা রোগা মেয়ে বলে মনে হয়েছিল, তাকে এখন অনেক আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে। অরিজিৎ ওর সঙ্গে টুকটাক কথা বলার পর আমাকে বলল, ‘মনে হচ্ছে আমরা পেয়ে গেছি।’

বাংলা সিরিয়াল এবং পরবর্তীকালে হিন্দি সিরিয়ালের বিখ্যাত নায়িকাকে আবিষ্কার করার কৃতিত্ব রমাপ্রসাদ বণিকের, যাকে সাহায্য করেছিলেন পঞ্চুদা। অরিজিৎ আর আমি ওদের বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে এলাম। এই মেয়েটির নাম রূপা গঙ্গোপাধ্যায়।

অভিনয় শেখার ব্যাপারে রূপা রমাপ্রসাদের অনুগত ছাত্রী ছিল। যেমন থিয়েটারের রিহার্সালে, তেমনই শুটিংয়ের ফ্লোরে রমাপ্রসাদ কোনো আপস করত না। যতক্ষণ—না সে যা চাইছে তা কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রী দিতে না পারছেন, ততক্ষণ সে হাল ছাড়ত না। রূপাকে রমাপ্রসাদ অভিনয়ে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।

টেলিকাস্ট চলছিল। আমরা মুক্তবন্ধের শুটিং করতাম বেহালার একটি প্রতিবন্ধীদের হোমে। ওখানে কিশোর সাহু নামে একটি তরুণ আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। সে আগে গাড়ি চালাত। চলে এল প্রোডাকশনের কাজে। অনেক বছর পরে কিশোর সিরিয়ালের প্রযোজক হয়েছিল। একদিন শুটিংয়ে এসে রূপা সরাসরি চলে এল আমার সামনে। এসে প্রণাম করে বলল, ‘আচ্ছা, আপনি প্রভাত রায়ের নাম শুনেছেন?’ হেসে বললাম, ‘বিলক্ষণ। খুব ভালো পরিচালক।’

‘মুক্তবন্ধে আমার অভিনয় দেখে উনি আমাকে দেখা করতে বলেছেন। কী করব, যাব?’ রূপা জিজ্ঞাসা করেছিল।

বলেছিলাম, ‘অবশ্যই যাবে। কবে ডেকেছেন।’

‘আজ বিকেলে।’

সেদিন আমাদের শুটিং তাড়াতাড়ি শেষ হওয়ার কথাই ছিল। তাই রূপাকে ছেড়ে দিতে সমস্যা হয়নি। পরের দিন সে এসে জানাল, প্রভাতবাবু তাঁর পরের ছবির জন্যে ওকে নির্বাচিত করেছেন। সেদিন আমরা সবাই খুব খুশি হয়েছিলাম। তারপর মহাভারতের দ্রৌপদী করে সে খ্যাতির শীর্ষে উঠে গেল। এর মধ্যে একদিন ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োতে গিয়েছি একটা কাজে, হঠাৎ দেখি রূপা দৌড়ে আসছে। ওর পরনে যে—সিরিয়ালে কাজ করছিল তার পোশাক। এসে প্রণাম করে হাসল, ‘কেমন আছ?’

মুক্তবন্ধ শেষ হওয়ার বেশ কয়েক বছর পরে ঘটনাটা ঘটেছিল। ওপরে উঠে গেলে সাধারণত কেউ নীচের মাটির দিকে তাকায় না। হয়তো ভার্টিগো হয়, তাই? এটা অভিনেতা— অভিনেত্রীদের ক্ষেত্রে খুব প্রযোজ্য। রূপা কিন্তু ব্যতিক্রম।

টেলিফ্রেম তখন বেশ পরিচিতি পেয়েছে। আমাদের পরের ধারাবাহিক ‘কলকাতা’, কেন জানি না লোকে নাম দিয়েছিল ‘কলকাতা— কলকাতা’। এর অন্যতম কারণ সিরিয়ালের টাইটেল মিউজিক। মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই নাম। তার কথায় কলকাতা—কলকাতা থাকায় ওটাই নাম হয়ে গেল। যদিও সিরিয়ালের টাইটেলে শুধু কলকাতাই  লেখা হত। আর এই কলকাতার শিল্পী নির্বাচন করতে গিয়ে খুব অবাক হয়েছিলাম।

‘কলকাতা’ ধারাবাহিকের কাহিনি কোনো প্রকাশিত গল্প বা উপন্যাস থেকে নেওয়া হয়নি। টিভির দর্শকরা কয়েক হাত দূরে বসে দেখছেন।

কী দেখবেন তা তাঁরাই ঠিক করবেন। ততদিনে আরও কয়েকটি সংস্থা এগিয়ে এসেছে টিভির জন্যে ধারাবাহিক বানাতে। যে—ধারাবাহিক ভালো লাগে সেটা দেখতেই দর্শকরা সময় বেছে নেন। আমার মনে হয়েছিল, এই দর্শকদের আকৃষ্ট করতে নতুন ধরনের গল্প দরকার। প্রকাশিত এবং পঠিত গল্প—উপন্যাসের আগাগোড়া জানা থাকায় সামান্য পরিবর্তনও অনেক দর্শকের অপছন্দের কারণ হয়। সাধারণত একটি উপন্যাসের চলচ্চিত্ররূপ দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা হয়ে থাকে। অর্থাৎ, ধারাবাহিকের সাতটি পর্বেই মূল উপন্যাস শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। তাকে টেনে তেরো—ছাব্বিশ—ঊনচল্লিশ করতে গেলে কাহিনির উপকাহিনিগুলো বাড়াতেই হবে, নতুন কাহিনি জুড়ে দিতে হবে। এই কাজটা অনেক ক্ষেত্রেই দুধে জল মেশানোর বদলে জলে দুধ মেশানো হয়ে যায়। দর্শক সেটা বুঝতে পারেন।

তাই যে—গল্প দর্শক পড়েননি, জানেন না, তা—ই ধারাবাহিকের বিষয় হলে অনেক সুবিধে হয়। ‘কলকাতা’ সিরিয়ালের বিষয় হল একটি মাল্টিস্টোরিড বাড়ি, যেখানে নানান ভাষী মানুষ থাকেন, তাঁদের সমস্যা যা বাড়ির ম্যানেজার এবং কেয়ারটেকার সমাধান করার চেষ্টা করছে।

যেহেতু অরিজিতের চেহারা বেশ জাঁদরেল ছিল, কমেডি অভিনয়ও চমৎকার করতে পারত, তাই ম্যানজার হিসেবে ওকে দিব্যি মানিয়ে গেল। কিন্তু সমস্যায় পড়লাম কেয়ারটেকার চরিত্রটি নিয়ে। পরিচালক রমাপ্রসাদ বণিকের ইচ্ছে ছিল ওই চরিত্রটি রবি ঘোষমশাই করুন। ছোটখাটো চেহারা, অত্যন্ত সরল, অর্ধশিক্ষিত, মুখে বোকা বোকা হাসি, এমন ভূমিকায় রবি ঘোষকে দারুণ মানাবে। আমিও ওর সঙ্গে একমত ছিলাম। আমরা রবিদার বাড়িতে গেলাম, আগেই পরিচয় ছিল; রমাপ্রসাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক। চরিত্রটির বর্ণনা শুনে তিনি খুব উৎসাহিত হলেও দেখা গেল, আগামী নয় মাস তাঁর ব্যস্ততা থাকায় সময় বের করতে পারছেন না।

আমরা বিপাকে পড়লাম। নয় মাস অপেক্ষা করা প্রায় অসম্ভব। ‘টেলিফ্রেম’ তৈরি করার পর আমাদের খরচ বেড়েছে। অথচ ওই চেহারার কোনো ভালো অভিনেতার কথা মনে আসছিল না। তার ওপর অন্যান্য চরিত্রে যাঁরা অভিনয় করবেন বলে ঠিক করা হয়েছে, তাঁদের বেশিরভাগই অভিনয়জগতের মানুষ নন। একজন পারসি বৃদ্ধার চরিত্র কোনো বাঙালি অভিনেত্রী যত ভালো অভিনয় করুন, মানানসই হবে না। পার্ক স্ট্রিটের একটি পারসি পরিবারের সম্ভ্রান্ত বৃদ্ধাকে রাজি করিয়েছে অরিজিৎ। সুমিত্রা মুখোপাধ্যায় নামী অভিনেত্রী। কিন্তু আমরা ওঁর স্বামী কাপুর সাহেবকে, যাঁকে সবাই ‘মামাজি’ বলে চিনত, রাজি করিয়েছি অভিনয় করাতে। একটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতি ‘কলকাতা’ ধারাবাহিকের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে ছিল। বাঙালি অভিনেতা নেব না, কিন্তু কোথায় পাই তাঁদের। খবর এল, হিমাংশু খবর নিয়ে এল, শর্ট স্ট্রিটের একটি বাড়িতে অনেক ভাড়াটে থাকেন। তাঁদের মধ্যে দু’টি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারও আছেন। যোগাযোগ করা হল। ছেলেটিকে হিমাংশু অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ভেবেছিল কিন্তু আসলে সে নেপালি বাবা আর আমেরিকান মায়ের ছেলে। নাম বলল, ববি ইয়ং। যে—মেয়েটি ওই বাড়ির অন্য ফ্ল্যাটে থাকে, সে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, অস্ট্রেলিয়াতে চলে যাওয়ার কথা ভাবছে, তবে তার জন্যে মাস ছয়েক দেরি হবে। ওদের নির্বাচন করা হল। যতটা সম্ভব কম হিন্দি—ইংরেজি সংলাপ ওদের দিয়ে বলানো হবে বলে স্থির হল। ওই মেয়েটির আর অস্ট্রেলিয়াতে যাওয়া হয়নি। ওই বাড়িতে ভাড়াটে হয়ে আসা বিখ্যাত ফুটবলার চিমা ওকোরির প্রেমে পড়ে সে, পরে ওরা স্বামী—স্ত্রী হয়ে যায়।

বাঙালি দম্পতির জন্যে বেশি ভাবতে হয়নি। আমার কলেজজীবনের বন্ধু, যে পরে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করছিল, সেই সুব্রত নায়ককে চরিত্রটির সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে গেল। এর মধ্যে একদিন ‘দেশ’ পত্রিকার অফিসে গিয়েছি। করিডরে যে—মেয়েটির সঙ্গে দেখা সে ‘সানন্দা’ পত্রিকায় চাকরি পেয়েছে। কিন্তু কয়েক বছর আগে ক্যাথিড্রাল চার্চের মুক্তমঞ্চে ওকে নাটক করতে দেখেছি। জিজ্ঞাসা করলাম, ধারাবাহিকে অভিনয় করতে আগ্রহী কিনা? সে রাজি হতেই টেলিফ্রেম অফিসে আসতে বললাম। সেই মেয়ে আজকের সুদেষ্ণা রায়। এখন অভিনয় মাঝে মাঝে করে বটে কিন্তু চলচ্চিত্র পরিচালিকা হিসেবেই সে বেশি পরিচিত।

আমার বন্ধু মুকুন্দচন্দ্র দাস দীর্ঘদিন ‘বহুরূপী’তে ছিল, শম্ভু মিত্রের স্নেহধন্য সে। একদিন তার বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, সুনীলদা আড্ডা মারছেন। ওঁকে দেখামাত্র মন ভালো হয়ে গেল। সুনীলকান্ত বহুরূপীতে শম্ভু মিত্র—কুমার রায়ের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। ধুতি—পাঞ্জাবি পরা খাটো মানুষটির চোখ যেন কথা বলত। দৃষ্টিতে সহজেই কৌতুক আনতে পারতেন। তখন তো মোবাইল ছিল না যে, অরিজিৎ বা রমাপ্রসাদের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ আলোচনা করব। যেহেতু ওই দু’জনও বহুরূপীর প্রাক্তনী, তাই সুনীলদা ওদের খুব পরিচিত। একটু ঝুঁকি নিয়েই সুনীলদাকে প্রস্তাব দিলাম। উনি অবাক হলেন। ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় চাকরিসূত্রে। যে সরকারি অফিসে উনি চাকরি করতেন, সেখানে আমিও কিছুদিন ওঁর পাশে বসে কাজ করেছি। সুনীলদা বললেন, ‘ধ্যেৎ! কী যে বলিস!’

মুকুন্দ আমাকে সমর্থন করল। অনেক বোঝানোর পরে সুনীলদা আমাদের অফিসে আসতে রাজি হলেন। ষোলোটি এপিসোডের ওই ধারাবাহিকের অন্তত পঁচাত্তর ভাগ দৃশ্যে নিবারণ ঢোল অর্থাৎ, কেয়ারটেকার থাকবে। রমাপ্রসাদ ওঁকে চরিত্রটি বোঝাল। অরিজিৎ উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘জমিয়ে কাজ করা যাবে।’

সেদিন বিকেলে সুনীলদাকে নিয়ে বাইপাস দিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। সল্টলেক স্টেডিয়ামের কাছে বেলেঘাটা যাওয়ার রাস্তায় সুনীলদা গাড়ি থামাতে বললেন। ওখান থেকে তিনি রিকশায় বাড়ি ফিরে যাবেন। কিন্তু গাড়ি থেকে নামার আগে আমার দুটো হাত দু’হাতে ধরে তিনি ককিয়ে উঠলেন, ‘তুই আমাকে ছেড়ে দে সমরেশ। আমি পারব না। চিরকাল বহুরূপীতে ছোট চরিত্রে অভিনয় করে এসেছি, ক্যামেরার সামনে এত বড় চরিত্র আমি করতে পারব না।’ পঞ্চাশের কাছাকাছি একজন মানুষ কাকুতিমিনতি করছেন তাঁকে অব্যাহতি দিতে, আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সেই পূর্ণদাস রোড থেকে স্টেডিয়াম অবধি পৌঁছতে অন্তত আধঘণ্টা সময় লেগেছিল, আর এই সময়টা সুনীলদা চুপচাপ বসেছিলেন। শেষপর্যন্ত আমি বললাম, ‘তোমার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে? এইরকম চরিত্র অনেক বড় অভিনেতা সারাজীবনে পান না। আমরা প্রথমে রবিদার কথা ভেবেছিলাম। ওঁর সময় নেই—’ আমাকে শেষ করতে না দিয়ে সুনীলদা বললেন, ‘কার সঙ্গে কার তুলনা করছিস। আমি ওঁর নখের যোগ্য নই।’ বলেই হনহনিয়ে চলে গেলেন বেলেঘাটা যাওয়ার রিকশা ধরতে। দেখে মনে হচ্ছিল, ওঁর মাথা থেকে বিরাট বোঝা নেমে গেছে।

পরদিন সকালে ওঁর বাড়িতে গেলাম। অনেক বোঝানোর পরে সুনীলদা রাজি হলেন একটি শর্তে, ধারাবাহিকের পঁচাত্তর ভাগ নয়, চল্লিশ ভাগের বেশি তাঁর চরিত্র থাকবে না। আমি যখন তাঁকে ছাড়ছি না, তখন চোখ—কান বুজে ওইটুকু তিনি করে দেবেন।

শুটিং শুরু হল। প্রথম কয়েকদিন সেইসব দৃশ্য তোলা হচ্ছিল যেখানে সুনীলদার উপস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এটা রমাপ্রসাদ ইচ্ছে করেই করছিল। কিন্তু আমরা ক্রমশ দেখলাম, চরিত্রটির ভেতরে ঢুকে গিয়েছেন সুনীলদা। যখন টেলিকাস্ট শুরু হল, তখন সুনীলদা প্রায় স্টার হয়ে গেলেন। যেখানে যাচ্ছি সেখানেই নিবারণ ঢোলের প্রশংসা শুনছি। বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, বহুরূপীতে ওঁর অভিনয় দেখে সত্যজিৎ রায় তাঁর দু’টি ছবিতে সুনীলদাকে অভিনেতা হিসেবে নিয়েছিলেন। দু’টি চরিত্রই বেশ ছোট। তারপর দীর্ঘদিনের ব্যবধানে ‘কলকাতা’। রাতারাতি দর্শকদের মন জয় করে সুনীল সরকার, নিবারণ ঢোলের চরিত্র করে। দেখা হলেই বলতেন, বুঝলি, তোর জন্যেই এসব হল।’ আমাদের আপশোস, ধারাবাহিক শেষ হওয়ার পর যখন ছবি এবং ধারাবাহিকে অভিনয়ের প্রস্তাব একের পর এক আসছে, তখন চিকিৎসা বিভ্রাটের শিকার হয়ে চলে গেলেন সুনীলদা।

এই ‘কলকাতা’ ধারাবাহিকের শুটিং যখন চলছে, তখন এক বিকেলে পেটের সমস্যায় শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল রমাপ্রসাদ বণিক। অথচ পরের দিন আউটডোরে শুটিং। বাইপাসের পাশে চায়না টাউনে নিবারণ ঢোল যাচ্ছে একটি চিনা পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে। সেখানকার চামড়ার ফ্যাক্টরি, চিনা পত্রিকার অফিস ইত্যাদি বুক করা হয়ে গেছে। শুটিং না করতে পারলে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। অথচ পরিচালক অসুস্থ। কী করা যায় যখন ভেবে পাচ্ছি না, তখন অরিজিৎ বলল, ‘এই পর্বটা তুমিই পরিচালনা করো। গল্প তোমার, চরিত্রগুলো তোমার মাথায় আছে। এতদিন শুটিংয়ে থেকে অভিজ্ঞতাও তো হয়েছে।’

খুব নার্ভাস হয়ে গিয়েছিলাম এই প্রস্তাবে। তার ওপর খবর এল, আমাদের ক্যামেরাম্যানকে দূরদর্শন আচমকা গুয়াহাটিতে ট্রান্সফার করে দিয়েছে। অতএব শুটিং বন্ধ করতেই হবে বলে যখন সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছি, তখন যে—ছেলেটি ফ্লোরে আলোর তদারকি করে, সেই যিশু দাশগুপ্ত এগিয়ে এসে বলল, ‘সমরেশদা, ক্যানসেল করবেন না। আমাকে যদি সুযোগ দেন তাহলে ক্যামেরার কাজটা করতে পারি। প্লিজ সমরেশদা।’

অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। হাসিখুশি, পরিহাসে পটু ছেলেটির মুখে বেশ সিরিয়াস অভিব্যক্তি। হঠাৎ মনে হল, ওকে সুযোগ দিয়েই দেখা যাক।

সেদিনের কথা যিশু পরে বহুবার বলেছে। ক্যামেরাম্যান থেকে পরিচালক এবং শেষে প্রযোজক হয়ে সে একের পর এক ধারাবাহিক বানিয়েছে। বিপুল সম্পদ অর্জন করেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ক্যানসারের কাছে হার মানতে হয়েছে ওকে।

ঠিক হল, সকাল সাতটায় আমরা চায়না টাউনে পৌঁছে শুটিং শুরু করব। সুনীলদার মেক—আপ বলতে শুধু পাউডার লাগানো, চিনে চরিত্রদের তো সেই প্রয়োজনও ছিল না। সেই প্রথম ‘স্টার্ট ক্যামেরা’, ‘অ্যাকশন’ এবং ‘কাট’ বললাম চেঁচিয়ে। কিন্তু কিছুক্ষণ রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছিলাম, এ আমার কম্ম নয়। যিশুকে ক্যামেরা কোন অ্যাঙ্গেলে বসবে তা বলছি, অভিনেতা— অভিনেত্রীদের তাঁদের অভিনয় কেমন হওয়া উচিত তা বোঝাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি, যার কর্ম তারে সাজে…। এর মধ্যে একটা কাণ্ড হয়ে গেল। বড় বড় চামড়া, সম্ভবত গরু বা মোষের —শুকোতে দিয়েছিল ব্যবসায়ীরা। শুটিং চলাকালীন সুনীলদা তার দুর্গন্ধ সহ্য করতে না পেরে নাকে রুমাল গুঁজে হাঁটছিলেন। হঠাৎ হইহই চিৎকার এবং তারপর গালাগালি ভেসে এল। কিছু চিনে মহিলা তাঁদের কাজ ফেলে সুনীলদার চোদ্দোপুরুষ উদ্ধার করে যাচ্ছিলেন। সুনীলদা প্রথমে তাঁদের দিকে হাসি হাসি মুখ করে হাঁটছিলেন। শেষপর্যন্ত বেগতিক দেখে চেঁচিয়ে বললাম, ‘নাক থেকে রুমাল সরান।’

‘তাহলে বমি হয়ে যাবে।’ নাকে রুমাল চাপা দিয়েই চেঁচালেন সুনীলদা।

ফলে, ‘কাট’ বলা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

সেই সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ঘণ্টা দুয়েক চুপচাপ শুয়ে থাকার পর স্থির করলাম, কোনো প্রলোভনে পড়ে আর পরিচালনা করতে যাব না। সত্যি কথা বলতে কী, যাঁরা সারাজীবন ধরে পরিচালনা করে যাচ্ছেন, তা ভালো বা মন্দ হোক, তাঁরা আমার কাছে নমস্য, কারণ প্রচুর শারীরিক কষ্ট দিনের পর দিন তাঁরা সহ্য করতে পারেন।

‘কলকাতা’ ধারাবাহিক টেলিফ্রেমকে পরিচিতি দিয়েছিল। এই সময় রমাপ্রসাদ বলল, ‘সমরেশদা, আমার ইচ্ছে ‘উত্তরাধিকার’ করি।’

আমি প্রথমে এককথায় নাকচ করে দিয়েছিলাম। ছাপা উপন্যাস কখনওই  টিভির ধারাবাহিকে নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। কিন্তু রমাপ্রসাদ ক’দিন ধরে বলে গেল, ‘আমরা ষোলো এপিসোডের বেশি করব না। গল্প বিকৃত বা নষ্ট হবে না, কারণ চিত্রনাট্য আপনি লিখছেন। দেখুন, দর্শক এখনও চা বাগান বা সেখানকার ঘটনা দ্যাখেনি। তাছাড়া, ‘উত্তরাধিকার’ ধারাবাহিক হচ্ছে শুনলেই লোকে দেখতে আগ্রহী হবে।’

মাসখানেক পরে হার মানতে বাধ্য হলাম। এই সময় দু’টি ছেলে—মেয়ে আমার সঙ্গে চিত্রনাট্য লিখতে যোগ দিল।

শেখর সমাদ্দার এবং প্রীতিকণা পালরায়। অত্যন্ত ভদ্র, মার্জিত। শেখর পরবর্তীকালে নাট্যপরিচালক হিসেবে খ্যাত হয়েছে। চিত্রনাট্যকার হিসেবে প্রীতিকণা এখন সুপরিচিত।

‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাস লিখেছিলাম ‘দেশ’ পত্রিকায়, ঊনআশি সালে। ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত সেই উপন্যাস ছত্রিশ বছর পরেও বছরে দুটো সংস্করণ বিক্রি হয়।

সেই সময় আমাকে অনেকেই বললেন, ‘যাঁরা বইটি পড়েননি, তাঁদের যদি ধারাবাহিক দেখে খারাপ লাগে, তাহলে কেনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।’ অর্থাৎ, ধারাবাহিক খারাপভাবে তৈরি হলে বইটির ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাবে। বাংলা সিনেমার দৌলতে অনেক বিখ্যাত উপন্যাসের এই পরিণতি হয়েছে। তাছাড়া, প্রযোজকের একজন আমি, আমার উপন্যাস নিয়ে ধারাবাহিক তৈরি হচ্ছে বলে লেখক হিসেবে নিজেকে দক্ষিণা দিচ্ছি না। এটা ‘মুক্তবন্ধ’ থেকেই নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ফলে, ধারাবাহিক খারাপ হলে দু’দিক দিয়েই আমি ক্ষতিগ্রস্ত হব। তাই, আমরা সতর্ক থাকলাম কোনো ত্রুটি না রাখতে।

উত্তরাধিকারের কাহিনি একটি বালককে কেন্দ্র করে, যে উত্তরবঙ্গের একটি নির্জন চা বাগানে সাতচল্লিশ সালের পনেরো অগাস্টের সকালে জাতীয় পতাকা তুলেছিল। অতএব শুটিংয়ের সিংহভাগ হবে একটি চা বাগানে। লোকেশন দেখে বানারহাটের কাছে কাঁঠালগুঁড়ি চা বাগান আমাদের পছন্দ হল। অনিমেষের ঠাকুর্দার চরিত্রে অরিজিৎ গুহ, বাবা শংকর চক্রবর্তী এবং কাকা হিসেবে পীযূষ গাঙ্গুলিকে বেছে নিল রমাপ্রসাদ। ‘বহুরূপী’ থেকে বেরিয়ে ওরা ‘চেনামুখ’ নামে যে—গ্রুপ থিয়েটার করেছিল, সেখানে লাবণী সরকার নামে যে—মেয়েটি অভিনয় করত, তাকে অনিমেষের মা হিসেবে ভাবল রমাপ্রসাদ। মৌমিতা গুপ্তর প্রথম অভিনয়জগতে আসা বোধ হয় উত্তরাধিকার ধারাবাহিকের হাত ধরেই। রমাপ্রসাদের কৃতিত্বে ধারাবাহিক সফল হয়েছিল, আমার বইয়ের বিক্রিতেও ঘাটতি পড়েনি।

ট্রিলজির দ্বিতীয় বই ‘কালবেলা’। কিন্তু আমি জানতাম, কালবেলা প্রযোজনা করতে যে—টাকার প্রয়োজন, তা স্পনসরদের কাছে পাওয়া যাবে না। গল্পটাকে নষ্ট করতে চাইলাম না আমি। বহু বছর পরে গৌতম ঘোষ কালবেলা ছবি করেছিল। ওর মতো পরিচালকের পক্ষেই সেটা সম্ভব হয়েছিল।

রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল যা এখনও রয়েছে। আমার দেখা হাতেগোনা কয়েকজন ভদ্রলোকের একজন রঞ্জিত মল্লিক। উত্তমকুমারের পরে প্রথম হিট ছবি ‘শত্রু’র নায়কের সৌজন্যবোধ কখনও নষ্ট হয়নি। আমার ইচ্ছে হল, রঞ্জিতকে নিয়ে একটা বাংলা ধারাবাহিক করা উচিত। এর আগে তিনি জোছনদার পরিচালনায় ‘আশ্চর্য প্রদীপ’ নামে হিন্দি ধারাবাহিকে অভিনয় করেছিলেন। প্রস্তাব পেয়ে রঞ্জিত রাজি হলেন কিন্তু অন্যান্য ছবিকে ডেট দেওয়া থাকায় সপ্তাহের প্রতিদিন শুট করতে পারবেন না বলে জানালেন। আগে থেকে সময় ঠিক করা থাকলে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, আমরা এগোলাম। ধারাবাহিকের নাম ‘বালিকার প্রেম’। মা হারানো মেয়ে বাবাকেই ধ্যানজ্ঞানে পৃথিবী মনে করে। মেয়ে বড় হলেও বাবার কাছে সে বালিকামাত্র। সেই মেয়ে কলেজে পা দিতেই একটি তরুণ এল তার জীবনে। এই টানাপোড়েনেই নাটক এগিয়ে যাবে।

রঞ্জিতের মেয়ের চরিত্রটিতে ভালো অভিনেত্রীর প্রয়োজন। সমস্যা হল, তার বয়স বেশি হওয়া চলবে না। সেসময় ওই বয়সের অভিনেত্রী ইন্ডাস্ট্রিতে ছিল না। অথবা কেউ থাকলেও উল্লেখযোগ নয়। আমরা চারপাশে খোঁজ করতে লাগলাম। তখনও পনেরো—ষোলো বছরের মেয়ে পড়াশুনার ক্ষতি করে অভিনয় করবে, তা অভিভাবকরা চাইতেন না। তাই, যাকে পছন্দ হচ্ছিল তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না।

এই সময় একজন পরিচিত ভদ্রলোকের সূত্রে যে—মেয়েটি অফিসে এল, সে প্রায় ওই বয়সি। থাকে বিরাটিতে। জিজ্ঞাসা করে জানলাম, সে ইতিমধ্যেই বিএ পাশ করেছে। খাটো চেহারায় এবং মুখে—চোখে সারল্য থাকায় বয়স বোঝা যায়নি। সে এসেছিল শাড়ি পরে। অভিনয় করতে হবে স্কার্ট পরে। সেটা জানানোর সঙ্গেসঙ্গে মেয়েটি বেরিয়ে গেল। ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে এল স্কার্ট পরে। চমৎকার দেখাচ্ছিল তাকে। সংলাপ বলিয়ে ওকেই চরিত্রটিতে নেওয়া হল। আমাদের দুর্ভাগ্য, নানান কারণে ধারাবাহিকটি শেষ করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু মেয়েটির অভিনয়ের খ্যাতি স্টুডিয়ো থেকে ছড়িয়ে গিয়েছিল। পরে সে অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। মেয়েটির নাম শ্রীলেখা মিত্র।

‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তখনও  টিভির ব্যবসায় পুরোপুরি নামেনি। তারা আমাদের প্রস্তাব দিল ছয় পর্বের ধারাবাহিক তৈরি করে দিতে। কোনো প্রকাশিত গল্পের চিত্রনাট্য তারা চাইল।

ভাবলাম, সিনেমাজগৎ নিয়ে লিখলে কেমন হয়। তার কিছুদিন আগে একজন অভিনেত্রীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় যিনি বিয়ের পরে নিউ ইয়র্কে আছেন বহুকাল। গল্প চালু ছিল  কলকাতায় থাকার সময় অর্থাৎ, বিয়ের আগে এই অভিনেত্রী একজন অতিবিখ্যাত মন্ত্রীর ছেলের প্রেমে পড়েন। এতে মন্ত্রী শঙ্কিত হন, ছেলে যদি অভিনেত্রীকে বিয়ে করে তাহলে তাঁর মর্যাদা নষ্ট হবে ভেবে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী ওই অভিনেত্রীকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেন। সেখানে মন্ত্রীর স্ত্রীর ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।

এই কাহিনিকে অন্যভাবে সাজিয়ে চিত্রনাট্য লিখে নাম রাখলাম ‘সিনেমাওয়ালা’। কিন্তু অভিনেত্রীর চরিত্রে যাঁকেই ভাবা হচ্ছে, তাঁকে পছন্দ হচ্ছে না আনন্দবাজারের। তখন ‘আনন্দলোক’ পত্রিকার সম্পাদক ছিল দুলেন্দ্র ভৌমিক। দুলেন্দ্র আমাকে একটি মেয়ের ছবি পাঠাল। বেশ সুন্দরী মহিলা, ব্যতিক্রমী চেহারা। খবর দেওয়া হল। ভদ্রমহিলা এলেন। কথা বলে খুশি হলাম। শুটিংয়ের দিন ঠিক হল।

আমার টিভি সিরিয়াল জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনাটি এই সময় ঘটল। আজও আমি সেই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাইনি। ভদ্রমহিলার নাম নন্দিনী ঘোষাল। খুব ভালো নাচেন এবং সুন্দরী তো বটেই। ধারাবাহিকটির পরিচালক ছিল অভিনেতা দুলাল লাহিড়ি। প্রথম দু’দিনের অভিনয় দেখে দুলাল খুব খুশি। খুশি আমরাও। কিন্তু তৃতীয় দিনে স্টুডিয়োতে শুটিং দেখতে এল প্রযোজকদের একটি দল। শুটি চলাকালীন একজন নিচু গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই মহিলা কি বাড়ির কাজের লোক?’

‘আজ্ঞে না, উনিই নায়িকা!’ নিচু গলায় বললাম।

ভদ্রলোকের মুখ কালো হয়ে গেল। শুটিং দেখার আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন তিনি। তাঁকে উঠতে দেখে বাকিরাও চলে গেল। রাত্রে খবর এল, শুটিং বন্ধ রাখতে হবে। কারণ, আমরা যাঁকে নায়িকা হিসেবে নির্বাচিত করেছি, তাঁকে ওই চরিত্রে নাকি মানাচ্ছে না। আমি বোঝাতে চাইলাম, নায়িকা মানে সবসময় সেজেগুজে পটের বিবি হয়ে থাকা যায়, জীবনের লড়াইয়ের সময় সাজগোজ করলে খারাপ দেখাবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

এই অবস্থায় আমাদের উচিত ছিল ধারাবাহিক থেকে সরে দাঁড়ানো। শুটিং বন্ধ হয়েছে, কাল কোনো কাজ নেই, কথাটা নন্দিনীকে জানানো দরকার। কিন্তু সবাই কুণ্ঠিত হচ্ছিল খবরটা জানাতে। শেষপর্যন্ত অপরাধটা আমাকেই করতে হল। ফোনে নন্দিনীকে জানালাম, ‘বিশেষ কারণে আপাতত শুটিং বন্ধ রাখতে হচ্ছে।’ নন্দিনীর সঙ্গে কখনও আমার দেখা হয়নি। মুখোমুখি হইনি বলে প্রকাশ্যে লজ্জিত হইনি। নন্দিনী তার পরে বেশ কয়েকটি সিরিয়ালে কাজ করেছেন, বোধহয়, ছবিতেও তাঁকে দেখা গিয়েছে। কিন্তু ভাগ্য তাঁর ওপর সদয় হয়নি। আমি এখনও এই অপরাধবোধ থেকে বের হতে পারিনি।

‘সানন্দা’ পত্রিকা নায়িকা খোঁজার দায়িত্ব নিল। কিন্তু তারা যেসব ছবি পাঠাত, তাদের চেয়ে নন্দিনী হাজারগুণ যোগ্য ছিলেন। আমরা যখন হতাশার শেষ গণ্ডিতে পৌঁছে গিয়েছি, সেসময় একটি মেয়ে তার মায়ের সঙ্গে অফিসে এল। মেয়েটির ছিপছিপে লম্বা শরীর, চোখ এবং হাসি দেখে মনে হল যদি অভিনয় করতে পারে তাহলে একে নিয়ে সিনেমাওয়ালার কথা ভাবতে পারি, যদি তাতে প্রযোজকরা রাজি না হন তাহলে এই ধারাবাহিক থেকে আমরা সরে দাঁড়াব। দুলাল লাহিড়ি এসেছিল আড্ডা দিতে, তাকে বললাম মেয়েটিকে রিহার্সাল ঘরে নিয়ে গিয়ে বসতে। মনে আছে, মিনিট চল্লিশ পরে দুলাল এসে বলল, ‘একদম গলা নেই; এতক্ষণে যেভাবে বলতে বললাম, তার টেন পার্সেন্ট পেরেছে।’ বললাম, ‘একদিনে, আচমকা এসে যদি টেন পার্সেন্ট পারে তাহলে ওকে আর একটা সুযোগ দে। কাল আসতে বল।’

পরদিন দুপুরে মেয়েটি তার মাকে নিয়ে এলে দুলাল রিহার্সাল বসল। সে সময় আমাদের অফিসে এসেছিলেন ষাট—সত্তর দশকের একজন বিখ্যাত অভিনেত্রী যিনি পরবর্তীকালে পরিচালক হিসেবে খুব খ্যাত হয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে ওঁর অভিনয়, পরিচালনা এবং দীর্ঘমেয়াদি অপূর্ব সৌন্দর্যে মুগ্ধ। একটি নাটকের ব্যাপারে অরিজিতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি খোলা দরজা দিয়ে মেয়েটিকে দুলালের সঙ্গে যেতে দেখে বললেন, ‘আরে, ও এখানে কেন? আপনাদের সিরিয়ালে অভিনয় করবে?’

অরিজিৎ বলল, ‘দেখা হচ্ছে।’

‘বিপদে পড়বেন, অভিনয়ের ‘অ’ জানে না।’

সেদিন যদি আমরা ওই কথায় প্রভাবিত হতাম তাহলে বাংলা চলচ্চিত্র হয়তো বঞ্চিত হত। এই জীবনে বহুবার এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছি। বুঝেছি, কোনো একটি কাজ প্রথম দিকের আড়ষ্টতাকে যদি আক্রমণ করে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হবে। দেখা যাবে, সেই মানুষটি পরবর্তীকালে তার কাজের মাধ্যমে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছে।

দুলাল হাসিমুখে জানাল, ‘একদিনে খুব ইমপ্রুভ করেছে। মনে হচ্ছে পারবে।’

আমরা মেয়েটির কাছে তার ছবি চাইলাম। বললাম, ‘সব ঠিক থাকলে আগামী সপ্তাহেই শুটিং শুরু হবে।’

ছবি পাঠানো হল প্রযোজকদের কাছে। তাঁরা আপত্তি জানালেন না। এবার মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, সে কীরকম পারিশ্রমিক আশা করছে? সে লজ্জা পেল। বলল, ‘আপনারা যা ভালো মনে করবেন তা—ই হবে।’ এই মেয়েটির নাম ঋতুপূর্ণা সেনগুপ্ত। এখন ভাবতেই অবাক হয়ে যেতে হয়!

সিনেমাওয়ালার শুটিং শুরু হল। এই ধারাবাহিকের আগে ঋতুপূর্ণা মাত্র একটি ছবিতে অভিনয় করেছিল। ছবির নাম সম্ভবত ‘শ্বেতপাথরের থালা।’ ছোট্ট, নেগেটিভ চরিত্র। কিছুই করার ছিল না। তাই সিনেমাওয়ালার নায়িকার চরিত্রে সে যে অভিনয় করল, তা রাতারাতি দর্শকের মন জয় করে নিল। তারপর আর তাকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। মজার ব্যাপার হল, বহু বছর পরে সেই বিখ্যাত পরিচালিকার একটি সফল ছবিতে নায়িকার চরিত্রে ঋতুপর্ণা চমৎকার কাজ করেছে। পরিচালিকা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর ধারণা সঠিক ছিল না।

রাজা সেন তখন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। কিন্তু আমাদের অফিসের আড্ডায় নিয়মিত আসত। আসত রাজা দাশগুপ্ত। তখন ‘টেলিফ্রেম’ বেশ জমজমাট। কিশোর তো ছিলই, সহকারী পরিচালক হিসেবে সুশান্ত বসুও ভালো কাজ করছিল। এই সময় রাজা দাশগুপ্ত প্রস্তাব দিল, সে ‘কালপুরুষ’ উপন্যাসটি নিয়ে ধারাবাহিক করতে চায়। অনেক তর্ক—বিতর্কের পর আমি রাজি হলাম। কসবায় একটি বিশাল খালি গোডাউনে সেট ফেলা হল। একটি বস্তির সেট। সেটা বানালেন সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত শিল্পনির্দেশক অশোক বসু। তৈরি হওয়ার পর মনে হচ্ছিল, ওটা সত্যি বেলগাছিয়ার বস্তি।

কালপুরুষের অনিমেষ আর মাধবীলতার চরিত্রে প্রদীপ এবং অনসূয়া মজুমদারকে পরিচালক বেছে নিয়েছিলেন। সমস্যা হল অর্ক চরিত্র নিয়ে। পনেরো—ষোলো বছরের বেপরোয়া ছেলে অর্ক। শেষপর্যন্ত রাজা নিয়ে এল যাকে, তার বাবাকে চিনতাম। শ্যামল সেন এবং চিত্রা সেন গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেতা হিসেবে সুপরিচিত তাঁদের ছেলে কৌশিক, কৌশিক সেন। প্রথম সুযোগকেই ভালোভাবে ব্যবহার করেছিল কৌশিক, তাই এখন সে চুটিয়ে কাজ করে চলে।

কালপুরুষ রাজা দাশগুপ্তর একটি প্রথম শ্রেণির কাজ।

সেই সময় গ্রুপ থিয়েটারের যেসব দক্ষ অভিনেত্রী ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নাম ছিল অনসূয়া মজুমদারের। ‘বহুরূপী’ দলের বিখ্যাত প্রযোজনা ‘মৃচ্ছকটিক’—এ বসন্তসেনার চরিত্রে অভিনয় করে বেশ বিখ্যাত হয়েছিলেন।

নাটকটির পরিচালক ছিলেন কুমার রায়। পরে বহুরূপী থেকে বেরিয়ে এসে রমাপ্রসাদ বণিক, অরিজিৎ গুহ, শংকর ঘোষরা যখন ‘চেনামুখ’ দল তৈরি করল, তখন অনসূয়া সেই দলের অন্যতম অভিনেত্রী। আমার উপন্যাস ‘শরণাগত’র নাট্যরূপ দিয়েছিল রমাপ্রসাদ, অনসূয়া চমৎকার অভিনয় করেছিলেন। মাঝে মাঝে মনে হত, ভদ্রমহিলা অসাধ্যসাধন করছেন। একটি বহুজাতিক কোম্পানির উঁচু পদের দায়িত্ব নিয়ে চাকরি করতেন ভদ্রমহিলা, সেখানকার জীবনযাপন, কথাবার্তার ধরনের সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটারের আবহাওয়ার বিস্তর ফারাক সত্ত্বেও দুই জীবনের সঙ্গে সমান তাল মিলিয়ে চলেছিলেন। এই অনসূয়াকে যখন ‘কালপুরুষ’—এর মাধবীলতার চরিত্র করার জন্যে অনুরোধ করা হয়েছিল, তখন একটু সমস্যায় পড়েছিলেন তিনি। অফিস ছুটির পরে নাটকের রিহার্সাল দেওয়া যতটা সহজ, দিনের পর দিন অফিস কামাই করে ক্যামেরার সামনে অভিনয় করা তার বহুগুণ কঠিন ব্যাপার। যদি সরকারি চাকরি হত, বিশেষ করে যাঁরা সাধারণ চাকরি করতেন, তাঁদের অনেকেই অফিসকে ম্যানেজ করতে সক্ষম হতেন।

‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সময় থেকেই মাধবীলতা পাঠকদের অত্যন্ত প্রিয় চরিত্র হয়ে গিয়েছিল। পুরুষ পাঠকরা জানতে চাইতেন, ওরকম কোনো মেয়েকে আমি দেখেছি কি, না সবটাই আমার কল্পনা? বাংলাদেশে গিয়ে দেখেছি, একজন যুবতী যাঁর নাম ছিল তামান্না, তিনি আদালতে গিয়ে সেই নাম বাতিল করে মাধবীলতা রেখেছিলেন। এসব ব্যাপারের পর শিল্পী নির্বাচন করা বেশ কঠিন হয়ে গিয়েছিল। মাধবীলতার মধ্যে শিক্ষা, ব্যক্তিত্ব এবং সুন্দরী না হওয়া সত্ত্বেও চেহারায় যে—আকর্ষণের কথা আমি লিখেছিলাম, তা অনসূয়ার সঙ্গে খুব মিলে যাচ্ছিল। কিন্তু  টিভি সিরিয়াল তো সিনেমা নয় যে, পরিচালক আগেভাগেই অভিনেতাকে জানিয়ে দিতে পারেন অভিনয়ের জন্যে তাঁকে ক’দিন দরকার হবে! শুধু একজন অভিনেতা বা অভিনেত্রী যে—চরিত্রে অভিনয় করছেন এবং ধারাবাহিকের যেসব দৃশ্যে তিনি থাকবেন, সেগুলো টানা শুটিং করে ফেলাও সম্ভব নয়। শেষপর্যন্ত অনসূয়া লাঠি না ভেঙে সাপ মারতে চেয়েছিলেন।

অনিমেষ ‘উত্তরাধিকার’ উপন্যাসে ছিল বালক থেকে তরুণ বয়স পর্যন্ত। ‘কালবেলা’য় সে যুবক। কিন্তু কালপুরুষে সে জেল ফেরত এক প্রৌঢ়। তার যৌবন যেমন অস্তমিত, তেমনই মানসিকতায় আগের সেই দৃঢ়তা নেই। এই চরিত্রে প্রদীপ মুখোপাধ্যায়কে অভিনয় করার প্রস্তাব দিলাম। সত্যজিৎ রায়ের ‘জনঅরণ্য’ করে বেশ নাম করেছিল প্রদীপ। তারপর আমার প্রথম উপন্যাস নিয়ে শংকর ভট্টাচার্য যখন ‘দৌড়’ ছবি করে, তখন প্রদীপ তার নায়ক হয়। কিন্তু তারপর অভিনয়ের চেয়ে আয়কর বিভাগে ওকালতিতেই সে বেশি মন দিয়েছিল। কখনওসখনও ছোট চরিত্রে অভিনয় করে শখ মেটাত। এই সময়টায় প্রদীপের সঙ্গে আমার মোটামুটি  যোগাযোগ ছিল। অনিমেষ চরিত্রটি পেয়ে সে খুশি হয়েছিল।

কালপুরুষের সবচেয়ে আকর্ষণীয় চরিত্রের নাম অর্ক। উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল চুরাশি সালে। তার আগে অর্ক নামের বাঙালি খুব কম পাওয়া যেত। কালপুরুষ প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে প্রচুর শিশুর নাম রাখা হল অর্ক। এই সেদিনও একটি যুবকের সঙ্গে আলাপ হল। সে তার নাম বলল, অর্ক। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কি চুরাশি—পঁচাশিতে জন্মেছিলেন?’ যুবক অবাক হল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু কী করে বুঝলেন?’ উত্তরটা স্পষ্ট করিনি। তবে, শুধু ওই সময়ে নয়, তার অনেক পরে জন্মেছে এমন শিশুরও নাম রাখা হয়েছে অর্ক।

এই অর্ক চরিত্রে কোনো প্রতিষ্ঠিত অভিনেতাকে নেওয়া যাবে না। তাছাড়া, তার বয়স হতে হবে কুড়ির অনেক নীচে। আমরা তখন অ্যাকাডেমিতে নাটক দেখছি, যদি এমন ছেলের দেখা পাই। হঠাৎ রমাপ্রসাদ বলল, সমরেশদা, আপনি শ্যামল সেন—চিত্রাদিকে চেনেন?’

শ্যামলবাবুকে চিনতাম, ওঁর স্ত্রী চিত্রা সেনের অভিনয় দেখেছি। খুব ভালো অভিনেতা ছিলেন শ্যামলবাবু। যতদূর মনে পড়ছে, ‘আনন্দবাজার’—এর নাটক—যাত্রার পাতা সম্পাদনা করতেন যিনি, সেই লেখক প্রবোধবন্ধু অধিকারীর মাধ্যমেই ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। রমাপ্রসাদ বলল, ‘ওদের ছেলেকে একবার দেখতে পারেন। অর্ক হিসেবে মানাবে খুব, ওই বয়সেরই। তাছাড়া, বাবা—মায়ের রক্তের কল্যাণে অভিনয় নিশ্চয়ই খারাপ করবে না।’

খবর পেয়ে ছেলেটি এল। ছিপছিপে, মাথা ভর্তি চুল, চোখ দুটো কথা বলে। নাম বলল, ‘কৌশিক সেন’। মুখে জেদি ভাব থাকলেও বিনয়ের অভাব নেই। বলতে দ্বিধা নেই, তথাকথিত নায়কের চেহারা কৌশিকের ছিল না। অথচ প্রায় আড়াই দশক ধরে সে গ্রুপ থিয়েটারের সফল পরিচালক—অভিনেতা ছাড়াও ছবিতে নিয়মিত অভিনয় করে চলেছে। কিন্তু ওর শুরুর সময়ে দেখেছিলাম, সে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি।

কালপুরুষের সাফল্যের পর ‘টেলিফ্রেম’ যখন খানিকটা সচ্ছল, তখন আমরা আকাশে ছুঁতে গিয়ে মাটিতে আছড়ে পড়েছিলাম।

চুরাশি সালে যখন আমি আমেরিকায় গিয়েছিলাম ইউএসআইএস—এর আমন্ত্রণে, তখন নিউ ইয়র্কের কুইন্সে বন্ধু মনোজ ভৌমিকের বাড়িতে ছিলাম বেশ কিছুদিন। মনোজ ইঞ্জিনিয়ার। থিয়েটারকর্মী এবং একটি সাহিত্য পত্রিকা বের করত যার নাম ‘আন্তরিক’। মনোজ চমৎকার লিখত। ওর গল্প দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। যতদূর জানি, ওর একমাত্র উপন্যাসের নাম ‘এই দ্বীপ এই নির্বাসন’ ‘আনন্দ পাবলিশার্স’ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। আন্তরিক পত্রিকায় ওই উপন্যাস পড়ে আমি মুগ্ধ হয়েছিলম। মূলত, যেসব বঙ্গসন্তান বড় ডিগ্রি নিয়ে আমেরিকায় চাকরি করতে গিয়ে শেকড় গাড়ার চেষ্টা করেছেন, বাড়ি ফিরেছেন, গ্রিন কার্ড থেকে সিটিজেনশিপ নিয়েও যাঁদের দেশ সম্পর্কে মনকেমন করা অনুভূতি মরে যেতে যেতে থেকে গেছে, তাঁদের নিয়েই মনোজ উপন্যাসটি লিখেছিল। মনোজ হেসে বলেছিল, ‘ভাববেন না, আমরা আমেরিকায় এসে গ্রিন কার্ড পেয়ে একদম আমেরিকান সাহেব হয়ে যেতে পারিনি, চেষ্টা সত্ত্বেও পারিনি। আমাদের অনেকেই এখনও অজপাড়াগাঁর পুকুরপাড়ের বিধবা পিসিমা হয়ে আছেন।’

কোনো কোনো মানুষ একটু ঠোঁটকাটা হন। মনে হয়েছিল, মনোজ সেরকম হয়ে গিয়েছে।  কলকাতায় নাটক করা ছেলে নিউইয়র্কের সামারে পাজামা—পাঞ্জাবি আর চটি পরে ম্যানহাটনে যখন হাঁটে, তখন ওর মধ্যে একটা চাপা বিদ্রোহ ফুটে ওঠে। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘এদেশে এলেন কেন?’

মনোজ হেসে বলেছিল, ‘অদৃশ্য সোনার শেকল পরব বলে।’

পরের শনিবারে মনোজ তার গাড়িতে আমাকে নিয়ে গেল ওর পরিচিত একজনের বাড়িতে, যিনি নাকি আমার লেখা খুব পড়েছেন। দু’ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে একটি সুন্দর সাজানো কমপ্লেক্সে পৌঁছল মনোজ। দেখলাম, একটি বাড়ির সামনে অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। লক্ষ করলাম, ওই রাস্তার সব বাড়ির চেহারা একদম একইরকম। গৃহকর্তা দরজা খুলে হাতজোড় করে অভ্যর্থনা জানালেন। বাড়িতে অনেক অতিথি। সবার সঙ্গে ওপর ওপর আলাপ করিয়ে দেওয়ার পর গৃহকর্তা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী নেবেন? ভদকা উইদ টনিক, না স্কচ?’

আমার হয়ে মনোজ জবাব দিল—’স্কচ।’

ওদেশে যাঁরা গাড়ি চালান, তাঁরা কখনওই পান করেন না। মনোজ কিছু নিল না। দেখলাম, আমাকে আধপেগ হুইস্কি আর দু’টুকরো বরফ দেওয়া হল। আমি একটা চুমুক দিতেই গৃহকর্তা এসে বললেন, ‘আসুন মিস্টার মজুমদার, ডিনার সার্ভ করা হয়ে গেছে।’

আমি হতভম্ব। এখনই ডিনার খেলে হুইস্কি কেন দেওয়া হল? গ্লাস রেখে ডিনার খেতে যেতে বাধ্য হলাম। এই অবধি মনে হয়েছিল, এমন ঘটনা ঘটতেই পারে। অনেক মানুষ যখন খেয়ে বাড়ি ফিরবে, তখন একজনের জন্যে সেটা দেরি করানো ঠিক নয়। কিন্তু বিস্মিত হলাম, দু’ঘণ্টা পরে বাড়ি ফিরে। মনোজের স্ত্রী বাচ্চচাদের একজনের শরীর খারাপ বলে বাড়িতেই থেকে গিয়েছিলেন। দরজা খুলে তিনি আমার দিকে অদ্ভুত চোখে তাকালেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি সুস্থ আছেন তো?’

‘তার মানে?’

‘আপনি ওখানে গিয়ে প্রচুর পান করেছেন? ছি—ছি, এটা ঠিক হয়নি!’

‘আমি প্রচুর খেয়েছি?’ হতভম্ব হয়ে গেলাম।

‘একটু আগে লস এঞ্জেলেস থেকে আমার পরিচিত এক মহিলা ফোন করে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাঁরে, তোদের বাড়িতে যে—রাইটার সমরেশ মজুমদার এসেছে সে নাকি পাঁড় মাতাল? আজ লং আইল্যান্ডে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে গলা পর্যন্ত মদ গিলেছে। জানিস তুই?’

স্ত্রীর কথা শেষ হওয়া মাত্র মনোজ হো হো করে হেসে উঠেছিল। বলেছিল, ‘কী বলেছিলাম সমরেশ? বাংলার অজপাড়াগাঁর পুকুরপাড়ে বসে কুচুটে বুড়িরাও এদের প্রতিভার ধারে—কাছে আসবেন না।’

‘এই দ্বীপ নির্বাসনকে সিনেমায় রূপান্তরিত করলে কেমন হয়?’ মনোজের সঙ্গে কথা বলতেই সে খুব খুশি হয়ে বলল, ‘সমরেশ, আপনি ঠিক বলেছেন, এটা আমার স্বপ্ন। ঢাল নেই তলোয়ার নেই তবু যুদ্ধ করতে চাইছিলাম।

মনোজের উপন্যাসের কাহিনিতে ওখানকার বাঙালিদের কিছু সমস্যা জুড়ে চিত্রনাট্যের খসড়া তৈরি করার চেষ্টা করলাম।

কলকাতায় ফিরে আসার পরে এ নিয়ে মনোজ আমাকে বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছিল। তার একটাতে সে আমাকে দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছিল। মনোজের  কলকাতার বন্ধু কল্যাণ সর্বাধিকারী দেখা হতেই আমাকে তাগাদা দিত। আর তখনই আকস্মিক দুর্ঘটনায় মনোজকে পৃথিবী থেকে চলে যেতে হল।

জল পড়ল উৎসাহের আগুনে। কিন্তু একেবারে নিবে গেল না। মনোজ চলে যাওয়ার চার বছর বাদে আমরা স্থির করলাম, সিনেমা নয়, এই দ্বীপ এই নির্বাসন অবলম্বনে টিভি সিরিয়াল করব। সে কারণেই রেকি করতে অরিজিৎ, সুব্রত নায়েক এবং আমি আমেরিকায় গেলাম। পশ্চিম থেকে পূর্ব পর্যন্ত ঘুরে শুটিংয়ের জায়গা নির্বাচন করলাম।

ফিরে এসে চিত্রনাট্য লেখা হল। এবং তখন মনে হল, কলকাতা থেকে শিল্পী এবং কলাকুশলীদের নিয়ে আমেরিকায় গিয়ে এবং থেকে শুটিং করতে বিপুল খরচ হবে। সেই খরচ বাংলায় সিরিয়াল তৈরি করে তোলা সম্ভব নয়। একমাত্র হিন্দিতে যদি সিরিয়ালটি তৈরি হয়, তাহলে খরচের ধাক্কা সামলানো যেতে পারে।

কিন্তু আমি বা রমাপ্রসাদ হিন্দি ভাষায় চিত্রনাট্য—সংলাপ লিখতে অক্ষম। তাই, মদনসূদনজিকে অনুরোধ করলাম বাংলায় লেখা চিত্রনাট্যকে যতটা সম্ভব বজায় রেখে হিন্দিতে রূপান্তরিত করতে। মদনসূদনজি কলকাতার হিন্দি নাট্যজগতের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জড়িত ছিলেন। তিনি কাজ শুরু করলেন।

ঠিক হল, রমাপ্রসাদ বণিক পরিচালনা করবে। দীপংকর দে, শকুন্তলা বড়ুয়া, মনোজ মিত্র অভিনয় করবেন। অন্যান্য চরিত্রে আমরা নিউ ইয়র্কের বাঙালিদের মধ্যে থেকে অভিনেতা— অভিনেত্রী নির্বাচন করব বলে ঠিক করলাম। এঁদের অনেকের সঙ্গে মনোজ আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।

কলাকুশলীদের সবাই যাঁরা টেলিফ্রেমের অন্য প্রযোজনায় কাজ করেছেন, তাঁরাই থাকবেন। মুশকিল হল, এঁদের অনেকের পাসপোর্ট ছিল না। আবেদন করে সেটা পেতে সময় লাগল। এরপর ভিসা পাওয়া। আমেরিকান ভিসা সাধারণত সহজে পাওয়া যায় না। কিন্তু কপালে ছিল বলে আমরা পেয়ে গেলাম।

হিসেব করে দেখলাম, খুব কম করেও খরচ হবে বারো লক্ষ টাকা। ছাব্বিশ বছর আগে বারো লক্ষ প্রায় স্বপ্নের মতো মনে হত।

অরিজিতের বাল্যবন্ধু সিদ্ধার্থ দত্ত থাকত নিউ জার্সিতে। ওর স্ত্রী বনানী খুব ঘরোয়া মহিলা। আমেরিকায় রেকি করতে গিয়ে আমরা ওদের বাড়িতে কয়েকদিন ছিলাম।

সিদ্ধার্থর বেশ নাটকপ্রীতি ছিল। ওর কথা বলা, হাঁটাচলার মধ্যে একটা আলাদা ধরন ছিল যাকে বেশ কেতাদুরস্ত বলা যায়। দত্ত দম্পতি মনোজকে চিনত। সেটা নাটকের সূত্রেই। শোনামাত্র সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল ওরা। সিদ্ধার্থ, যার ডাক নাম অসি। বলল, ‘ভাই, আমাদের এই গরিবখানায় জনাচারেক থাকলে খুব খুশি হব। তাদের যাতে কোনো অসুবিধে না হয় সেটা আমরা লক্ষ রাখব। কিন্তু তার বেশি কোনো কিছু করার সামর্থ্য আমাদের নেই।’

বিদেশে, বিশেষ করে আমেরিকায় এটুকু সাহায্য পাওয়া কিন্তু কম কথা নয়। সিদ্ধার্থ আমাদের নিয়ে গেল নিউ জার্সির একটি হোটেলে। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে হাইওয়ের পাশে হোটেল। গেট পেরিয়ে যে—অফিসঘর, সেখানে দু’জন ভারতীয় কাজ করছেন, দু’জনের একজন প্যাটেল, অন্যজন জোশী। জানলাম, এই দোতলা হোটেলটির মালিক এক গুজরাতি ভদ্রলোক, যাঁর পদবি প্যাটেল। আমাদের যে—কয়েকটা ঘর লাগবে দেখে নেওয়ার পরে সিদ্ধার্থ এমনভাবে দরাদরি করতে লাগল যা লোকে শিলিগুড়ির হংকং মার্কেটে কিছু কেনার সময়ে করে থাকে। গোটা আষ্টেক ঘর মাত্র ৮০ ডলার দিতে হবে প্রতিদিনের জন্যে যা আমাদের বাজেটের কম বলাই ভালো।

এবার গাড়ি চাই। একটা মাইক্রো বাস যাতে সবাই একসঙ্গে শুটিং স্পটে যেতে এবং আসতে পারে। সিদ্ধার্থ আমাদের নিয়ে সেইরকম বাস ভাড়া করতে গেলে জানা গেল, ড্রাইভার—সমেত মাইক্রো নিলে প্রতি ১০ ঘণ্টায় ৩০০ ডলার, ড্রাইভার না লাগলে বাসের জন্যে ১০০ ডলার দিতে হবে। আমরা ঢোক গিললাম। আমেরিকায় প্রতিটি মানুষ সক্রিয়, কেউ বেকার বসে নেই। অন্তত যেসব ভারতীয় ওখানে গিয়েছে, তারা তো বটেই। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে যারা সারাদিন কাটায়, তারা কাজ করতে অনিচ্ছুক কালো মানুষ। তাই ৩০০ ডলার খরচ করা ছাড়া কোনো উপায় দেখলাম না।

এখানেই শেষ নয়। গাড়ির মালিক উপদেশ দিলেন— ‘আপনারা তো রাস্তাঘাটে শুটিং করবেন, তার জন্য অবশ্যই ইনসিয়োরেন্স করে রাখবেন।’

সর্বনাশ।  কলকাতার রাস্তায় শুট করতে হলে পুলিশের অনুমতি নিতে হত। কোনো ঝামেলার দিন না হলে আবেদন করলেই অনুমতি পাওয়া যেত। কিন্তু এখানে পুলিশ শুটিং করতে দেবে না যদি ইনসিয়োরেন্স করা না থাকে। ফুটপাতে যারা যাওয়া—আসা করবে, তাদের কেউ ক্যামেরার তারে জড়িয়ে আহত হলে মোটা ডলার ক্ষতিপূরণ চাইতে পারে। শুটিংয়ের সময় নানা কারণে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ইনসিয়োরেন্স না থাকলে তার ক্ষতিপূরণ করতে হলে চোখে সর্ষেফুল দেখতে হবে।

আমাদের ভরসা দিল সিদ্ধার্থ। সে ম্যানহাটনের একপাশে এক ইনসিয়োরেন্স কোম্পানিতে পাঠাল আমাদের। খুব খাতির করে তাঁরা অঙ্ক কষে বললেন, পনেরো দিনের জন্যে ৬০০০ ডলার প্রিমিয়াম দিতে হবে। তাহলে ওঁরা এক লক্ষ ডলারের কভারেজ দিতে পারবেন। দরাদরি করেও যখন কোনো লাভ হল না, তখন বেরিয়ে আসতে হল। কিন্তু আমাদের অবাক করে ভেতর থেকে একটি লোক চলে এসে বলল, ‘আপানরা এই কোম্পানিতে ট্রাই করতে পারেন। রাশিয়ান কোম্পানি কিন্তু রেট কম।’ লোকটা একটা কার্ড হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল।

রাশিয়ান ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির অফিসের সামনে পৌঁছে মনে হল চিৎপুরের মতো এলাকা। দোতলায় ওঠার সিঁড়িও ধোপদুরস্ত নয়। ওঁদের এক অফিসার খুব মন দিয়ে আমাদের সমস্যার কথা শুনলেন। তারপর বললেন, ‘আমরা আপনাদের জন্য একটা ভালো প্রিমিয়ামের ব্যবস্থা করছি। কিন্তু আপনাদের সতর্ক থাকতে হবে যাতে কোনো অ্যাকসিডেন্ট না হয়। আপনারা ৭৫০ ডলার প্রিমিয়াম দেবেন। কাগজপত্র সবসময় সঙ্গে রাখবেন। কিন্তু ডিডে  লেখা থাকবে কোনো অবস্থাতেই ৫০০০ ডলারের বেশি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। দয়া করে এই ডিডটা পুলিশকে দেখাবেন না।’

‘সে কী! মাত্র ৫০০০।’ আমরা হকচকিয়ে গেলাম।

‘ছয় হাজারের বদলে মাত্র ৭০০ ডলার দিলে এর চেয়ে বেশি কী আশা করবেন? আপনারা যদি সতর্ক হয়ে কাজ করেন তাহলে দেখবেন কোনো সমস্যা হবে না। পুলিশ দেখতে চাইলে আমরা যে—সার্টিফিকেট দেব সেটা দেখাবেন।’ ভদ্রলোক হাসিমুখে বললেন। আমরা খুশি হয়েছিলাম এই জেনে যে, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশও ভারতীয় মানসিকতা এড়াতে পারেনি। ঠিক হল, আমরা যখন শুটিংয়ের সময় আসব, তখন ইনসিয়োরেন্স করিয়ে নেব।

ওয়াশিংটনের ভয়েস অফ আমেরিকায় চাকরি করতেন রমেন পাইন। একশো ভাগ বাঙালি এই ভদ্রলোক একসময় কলকাতা দূরদর্শনে খবর পড়তেন। ‘৮৪ সালে যখন প্রথমবার ওয়াশিংটন যাই, তখন ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়। বাড়িতে যাই। ওঁর মেয়ে জয়ন্তী তখন কিশোরী। খুব মিষ্টি দেখতে এবং ওদেশের মেয়েদের ছাঁচে বড় হচ্ছে। নিউ ইয়র্কে ফিরে গিয়ে মনোজকে ওঁর কথা বলেছিলাম। তখন সিনেমার ভাবনা মাথায় ছিল। সেই সিনেমায় ওই বয়সের একটি মেয়ে মূল চরিত্রে ছিল। মনোজের খুব পছন্দ হয় ছবি দেখে। পরে সে কথা বলে ওকেই নির্বাচিত করে।

পাঁচ বছর পরে জয়ন্তীর বয়স বাড়লেও নিয়মিত ভরতনাট্যম নাচের কারণে চট করে বোঝা যায় না। আমরা রমেনবাবু বাড়িতে গেলাম। রমেনবাবু এবং জুলি বউদির আপত্তি ছিল না। জয়ন্তীও খুব উৎসাহিত। রমেনবাবু ততদিনে আমাদের রমেনদা হয়ে গিয়েছেন। তিনি সাহায্যের হাত বাড়ালেন। ঠিক হল, পাইনবাড়ি ছাড়া জয়ন্তীর পরিচিত একজনের খালি বাড়িতে আমাদের পুরো ইউনিট থাকবে। ওয়াশিংটনে শুটিংয়ের সময় আমাদের থাকার খরচ বেঁচে গেল। স্বস্তিকর সংবাদ।

বলতে দ্বিধা নেই, আমরা এই প্রজেক্ট নিয়ে এতটা উত্তেজিত ছিলাম যে আগুপিছু ভাবিনি। বিবেক ব্যানার্জি তখনই বেশ নামকরা ক্যামেরাম্যান। খুব সাহায্য করেছিল সে। প্রথমেই বলল, ‘আপনারা কেন আমেরিকায় গিয়ে ক্যামেরা ভাড়া করার কথা ভাবছেন? কলকাতা থেকে নিয়ে গেলে তেমন আধুনিক ক্যামেরা হয়তো হবে না কিন্তু খরচ বাঁচবে। তাছাড়া, যে—ক্যামেরায় এখানে কাজ করি তা ওখানে ব্যবহার করলে ক্ষতি কী?’

আমাদের ইউনিট তৈরি হল। তিনজন শিল্পী ছাড়া বাকিরা সবাই কলাকুশলী। এদের বেশিরভাগই কখনও বিদেশে যায়নি। হাতে প্রথমবার পাসপোর্ট পেয়ে ওরা বেজায় খুশি। প্রোডাকশন বয় ভানু আমেরিকায় যাচ্ছে, একথা স্টুডিয়োগুলোতে গর্বের সঙ্গে প্রচার করল। যাচ্ছে কিশোর, প্রোডাকশন ম্যানেজার হয়ে। ঠিক হল, অরিজিৎ থেকে যাবে কলকাতায়। ওর ভাষায়, ‘ফোর্ট আগলাব।’ অর্থাৎ, রমাপ্রসাদ বণিক শুটিং সামলাবে আর আমি পুরো ইউনিট যাতে ভালো থাকে তার দেখাশোনা করব।

রওনা হওয়ার দিন দশেক আগে হঠাৎ কামাল বাড়িতে এল। এই কামালকে আমরা জেনেছিলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সৌজন্যে। সুনীলদা ওকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছিলেন। যতদূর মনে পড়ছে, তার নাম ছিল ‘ভালোবাসা প্রেম নয়’। কামালের বাড়ি ছিল ঢাকার ধানমন্ডিতে। সেখানে তার মা—ভাইরা আছেন। কিন্তু সে ভাগ্যান্বেষণে গিয়েছিল কানাডায়, আমেরিকায়, কিন্তু তার একটা বদঅভ্যাস ছিল, সে কোথাও শেকড় গাড়তে পারত না। কামালকে নিয়ে লিখতে হলে একটা উপন্যাস লেখা হয়ে যাবে। এই লেখায় তার জায়গা নেই। আমরা আমেরিকায় শুটিং করতে যাচ্ছি শুনে কামাল বলল, ‘ঠিক আছে, ওই কয়েকদিন তোমাদের মাইক্রো বাস আমি চালিয়ে দেব। পার ডে ৫০ ডলার এবং থাকা—খাওয়ার খরচ দিলেই হবে।’

আমরা হাতে স্বর্গ পেলাম। পরের দিন কামাল ফিরে যাচ্ছিল আমেরিকায়। তাকে সিদ্ধার্থর নাম্বার দিয়ে বললাম,  যোগাযোগ করে যেদিন কেনেডি এয়ারপোর্টে পৌঁছাব, সেদিন বাস নিয়ে চলে আসতে।

১৮ জনের দল নিয়ে রওনা হলাম আমরা। দীপঙ্কর এলেন, মনোজদার সঙ্গে দীর্ঘকালের সুসম্পর্ক। শকুন্তলা বড়ুয়ার আন্তরিক কথাবার্তায় মনে হল বিদেশ সফর শান্তিতেই কাটবে। বোর্ডিং কার্ড নেওয়ার সময় দীপঙ্কর বলেছিলেন, ‘সবাই একসঙ্গে বসবে এমন সিট নিয়ো না, দুটো আলাদা গ্রুপ করে নাও।’

ফলে, বেশিরভাগ টেকনিশিয়ান অনেকটা পেছনে বসেছিল। এতে ওদের সুবিধেই হল। আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ওয়েলকাম ড্রিংক হিসেবে সফট ড্রিংক ছাড়াও হুইস্কি বা ভদকা পরিবেশন করা হয়। পাশাপাশি বসলে ওদের হাত বাড়িয়ে গ্লাস নিতে অস্বস্তি হত। সেটা হল না। আবার এয়ারহোস্টেসরা কখনওই দেড় বা দুইয়ের বেশি পেগ পরিবেশন করেন না। তাই কারওর মাতাল হওয়ার সুযোগ থাকছে না।

টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে কথা হয়েছিল, তাঁরা যা দক্ষিণা  কলকাতায় কাজ করলে পেয়ে থাকেন তা তো পাবেনই, তাছাড়া প্রত্যেককে ১০০ ডলার করে হাতখরচ বাবদ দেওয়া হবে। প্রস্তাবে কেউ অখুশি হননি।

ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমসের বাধা পার হওয়ার সময় বিবেক যেসব ক্যামেরা এবং সাউন্ডের যন্ত্রপাতি নিয়ে যাচ্ছে, তা ডিক্লেয়ার করে রসিদ সংগ্রহ করে নিল। এর ফলে ফিরে আসার সময় কাস্টমস কোনো আপত্তি করতে পারবে না। ওই লিস্ট আমি দেখিনি। শুনেছি, এটা খুব জরুরি। প্লেনে ওঠার সময় লক্ষ করলাম, প্রত্যেকের মুখে বেশ সপ্রতিভ ভাব। যে—ভানু আধমলিন জামাপ্যান্ট পরে কলকাতায় শুটিংয়ে সবাইকে চা—জল দিয়ে থাকে, তার পরনেও বেশ ঝকঝকে শার্টপ্যান্ট। সদ্য চুল কেটে বেশ স্মার্ট হয়ে হাঁটছে। দেখে ভালো লাগল।

জন কেনেডি এয়ারপোর্টে নেমে সমস্ত ফর্ম্যালিটি শেষ করে বাইরে বের হতেই দলের কেউ সবিস্ময়ে বলে উঠল, ‘এটা আমেরিকা? আমরা আমেরিকায় এসেছি? ভাবা যায়? কিন্তু এখানকার মাটি তো আমাদের দেশের মতোই।’

কামাল এগিয়ে এল—’ওয়েলকাম। ওয়েলকাম।’ হাত বাড়াল সে।

সত্যি বলতে হলে বলা উচিত, আমি একটু ভয়েই ছিলাম। সঙ্গী হিসেবে খুব মজার মানুষ কিন্তু কামাল যে স্বাভাবিক মানুষের মতো জীবনযাপন করে না, তার প্রমাণ সে অনেকবার দিয়েছে। তাই যদি বাস চালিয়ে আমাদের রিসিভ করতে সে এয়ারপোর্ট না আসে—এমন আশঙ্কা আমার মনে ছিল। ওকে দেখে এত খুশি হয়েছিলাম যে জড়িয়ে ধরেছিলাম।

প্রথমে হাডসন নদী পেরিয়ে নিউ জার্সির কোস্টার শহরে সিদ্ধার্থর বাড়িতে যাওয়া হল। সেখানে দীপঙ্কর, মনোজ মিত্র, শকুন্তলা বড়ুয়া নেমে গেলেন। ওঁদের সঙ্গে আমাদের তরফ থেকে থাকল শংকর ঘোষ।

বাকিদের নিয়ে চলে এলাম হোটেলে। দোতলার ঘরগুলোয় কে কোথায় থাকবে ঠিক করার পর কামালই রাতের খাবারের ব্যবস্থা করল। সবাই যে—যার ঘরের দরজা বন্ধ করার পর যখন শোয়ার তোড়জোড় করছি, তখন গাড়ির আওয়াজ কানে এল। আমার ঘরে আমি একাই ছিলাম। দরজা খুলে দোতলার বারান্দায় গিয়ে দেখলাম, একটা ট্যাক্সি এসে থামল সামনের খোলা জায়গায়। ট্যাক্সি থেকে যে নামল, তাকে এই রাতের হোটেলের আলোয় অপ্সরার মতো মনে হচ্ছিল। হাঁটু পর্যন্ত জুতো, তার ওপর অনেকটা খোলা, তারপর স্কার্টের প্রান্ত। কোমরের দুই ইঞ্চির চামড়া চকচক করছে। মেয়েটি বুক উঁচিয়ে হেঁটে আসতে আসতে ওপরের দিকে তাকাল। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে মাথা নাড়ল সে। তারপর অদ্ভুত হাসি হেসে হোটেলের নীচের ঘরে ঢুকে গেল।

মনে হচ্ছিল, সিনেমার একটি দৃশ্য দেখলাম।

মুখ ফিরিয়ে ডান দিকে তাকাতেই অবাক হলাম। দোতলার বারান্দাজুড়ে প্রায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমাদের ছেলেরা। মুখ দেখে মনে হল, মুগ্ধ হয়ে সিনেমা দেখল। আমি লক্ষ করেছি বুঝেই যে—যার ঘরে ঢুকে গেল।

বুঝলাম, এই হোটেলে অনেক নাটক অপেক্ষা করছে।

নিউ ইয়র্ক শহরে শুটিং করছি, মনোজ ভৌমিকের উপন্যাসকে ক্যামেরাবন্দি করছি। তাঁর ইচ্ছেকে বাস্তবে পরিণত করছি কিন্তু তিনি নেই! সামনে হেসে একমুখ দাড়ি নিয়ে এসে বলবেন না, ‘একদম ফাটাফাটি ব্যাপার, কী বলুন!’

প্রথম রাতে একা মোটেলের ঘরে শুয়ে ওঁকে খুব মিস করছিলাম; মনে পড়ল একটি দিনের কথা। নিউ ইয়র্কে প্রথমবার এসে যা দেখেছি তার সবই মনোজ দেখিয়েছিলেন। ছবি করবেন এমন কথা রোজ হত, চরিত্রগুলোর চেহারা নিয়ে আলোচনা করতেন। এক দুপুরে বললেন, ‘ছবিটা যদি বাংলায় হয় তাহলে একজনকে রাজি করাতে পারলে দারুণ হবে। ভদ্রমহিলা বাংলা বলতে পারেন, কাউকে দিয়ে ডাব করিয়ে নিতে হবে। হিন্দিতে হলে তার দরকার হবে না।’

কৌতূহলী হলাম, ‘কাকে দিয়ে করাতে চাইছেন?’

‘নিউ ইয়র্কেই থাকেন। দাঁড়ান, ওঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলে আসি।’

সেসময় মোবাইল ফোন কী তা আমরা জানতাম না। মনোজ পাশের ঘরে গিয়ে ফোনে কথা বলে এসে বললেন, ‘চলুন, বেরিয়ে পড়ি।’

আমি প্রশ্ন করতাম না, কোথায় যাচ্ছি। ওই শহরের কিছুই তো আমি জানতাম না। পাজামা—পাঞ্জাবি—চটি পরে মনোজ গাড়ি চালিয়ে মিনিট চল্লিশেক দূরত্বের এক বাড়ির সামনে আমাকে নিয়ে এলন। ফ্ল্যাট বাড়ি। ওপরের একটি ফ্ল্যাটের বেল টিপলে যিনি খুললেন, তাঁকে পরিচয় দিতে আমাদের বসতে বলে ভিতরে চলে গেলেন। ছিমছাম সাজানো ঘর, কোনো ছবি দেওয়ালে টাঙানো নেই। এই চরিত্রটি সুন্দরী ছিলেন একসময় যা এখনও তাঁকে দেখলে বোঝা যায়। অতএব যাঁর বাড়িতে এসেছি, তাঁকে দেখার জন্যে বেশ উৎসুক ছিলাম। একটু পরে ভদ্রমহিলা এলেন।

ইনি যে একদা অসামান্যা সুন্দরী ছিলেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বয়সের ছাপ পড়েছে এখন, ঈষৎ চর্বিও জমে গেছে শরীরে। কিন্তু মুখে বলিরেখা পড়েনি। গলায় আঁচল বা ওড়না জড়ালে চট করে বয়স ধরা মুশকিল হবে।

সোফায় বসে হেসে ইংরেজিতে বললেন, ‘কী ব্যাপার মনোজ? অনেকদিন দেখতে পাইনি, আজ ফোন করেই আসতে চাইলে!’

‘ইনি একজন বাঙালি লেখক। আমার বাড়িতে আছেন এখন। ওঁর সঙ্গে আমার সেই ছবির চিত্রনাট্যের লাইন—আপ সাজাচ্ছিলাম। আপনাকে একবার একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করতে অনুরোধ করেছিলাম। যদিও আপনি কথা দেননি, তবু সমরেশকে নিয়ে এলাম আপনাকে দেখানোর জন্যে।’ মনোজ বললেন।

‘কী আশ্চর্য! আমি যে অভিনয় করব তা তো তোমাকে বলিনি। হ্যাঁ, তোমার প্রজেক্টটা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। বলেছিলাম, ফিনান্সের ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করে বললেন, ‘নমস্কার। আমার দুর্ভাগ্য, আমি বাংলা পড়তে পারি না।’

‘তাতে কী হয়েছে! আমিও তো ওড়িয়া, তামিল, তেলুগু পড়তে পারি না। কিন্তু আপনি অভিনয় করলে চরিত্রটা প্রাণ পেত। খুব ভালো লাগত দর্শকদের।’ বিনীতভাবে বললাম।

‘মুশকিল! আমি তো বাংলায় কথা বলতেই পারব না!’

মনোজ বললেন, ‘ছবিটা যদি হিন্দিতে করি?’

‘হিন্দিতে? তার তো অনেক খরচ!’

‘চেষ্টা তো করা যেতে পারে!’

মহিলা হাসলেন, ‘আগে তোমার চেষ্টা সফল হোক, তারপর আমি কথা বলব! এখন কী খাবে বলো!’

‘কিছু না।’ মনোজ মাথা নেড়েছিলেন।

‘তা কি হয়। উনি প্রথমবার আমার কাছে এসেছেন!’

‘আপনি কথা না দিলে আমরা কিছুই খাব না।’ মনোজ বলেছিলেন।

ভদ্রমহিলা তিরিশ সেকেন্ড চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, ‘মনোজ, যখন কিছু হয় তখন আপনাআপনি হয়, তার জন্য জোর করতে হয় না। জোর করে কিছু আদায় করলে তার ফল ভালো হয় না।’

মনোজ হেসে বলেছিলেন, ‘ওকে! কফি খাব।’

‘থ্যাঙ্ক ইউ।’ ভদ্রমহিলা মাথা নেড়ে ভিতরে চলে গিয়েছিলেন।

বাইরে বেরিয়ে এসে মনোজ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কেমন দেখলেন?

‘খুবই ভালো, কিন্তু—’

‘চরিত্রটা যা তা থেকে বয়সে বড় বলছেন?’

‘না। তা বলছি না। বাংলায় হলে তো উনি রাজি হবেন না। হিন্দিতে করা কি সম্ভব হবে? সেটা সত্যি অনেক টাকার ব্যাপার!’

‘হুঁ!’ মনোজ গাড়িতে উঠলেন। খানিকটা চলার পর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আচ্ছা সমরেশ, ভদ্রমহিলাকে কি আপনার চেনা মনে হল?’

মাথা নেড়ে বললাম, ‘না। উনি নিউ ইয়র্কে থাকেন আর আমি  কলকাতায়, চেনার সুযোগ কোথায়?’

‘আচ্ছা, হিন্দি সিনেমার পদ্মিনীকে আপনার মনে আছে?’

‘অবশ্যই। ওঁর শেষ ছবি দেখেছি—’মেরা নাম জোকার’। ভদ্রমহিলা দারুণ ভরতনাট্যম নাচ জানতেন। তামিল, তেলুগু ছবিতেও অভিনয় করেছেন। কেন বলুন তো?’

মনোজ হাসলেন, ‘আপনি এতক্ষণ সেই পদ্মিনীর সঙ্গে কথা বলে এলেন। আমি আপনাকে সারপ্রাইজ দেব বলে আগে বলিনি।’

আমি তাজ্জব। হ্যাঁ, মীনাকুমারী, নার্গিস বা ওয়াহিদা রেহমানের মতো অভিনেত্রী ছিলেন না ঠিকই, কিন্তু তামিল এবং হিন্দি ফিল্মে পদ্মিনীর একটা বিশেষ জায়গা ছিল। ওই ‘মেরা নাম জোকার’—এ রাজ কাপুরের সঙ্গে তিনি চুটিয়ে অভিনয় করেছিলেন। বলতে দ্বিধা নেই, ওঁর শরীরের আকর্ষণ চমৎকার ছিল! অথচ সেই পদ্মিনীর সঙ্গে আধঘণ্টার বেশি সময় কাটিয়েও আমি তাঁকে চিনতে পারলাম না? নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চেহারা কী দ্রুত বদলে যায়!

একথা স্বীকার না করে উপায় নেই, আমাদের শিল্পী এবং কলাকুশলীরা যে—কষ্ট স্বীকার করে শুটিং করেছেন তা সচরাচর হয় না। মোটেলের ঘরে থাকাটা সমস্যার ছিল না, কিন্তু খাওয়া নিয়ে অভিযোগ করতেই পারতেন, করেননি। গাড়ি থামিয়ে ম্যাকডোনাল্ডের সামনে নেমে একটা হ্যামবার্গার আর চা খেয়ে ব্রেকফাস্ট করে কাজে নামতে ওঁরা আপত্তি করেননি। লাঞ্চে কিশোর ভানুকে সঙ্গে নিয়ে কিনে আনত বিগম্যাক, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। নামের জৌলুস ছিল, আসলে সেদ্ধ মাংসের দু’পাশে নরম পাউরুটি আর আলুভাজা। রাত্রে একটা গুজরাতি রেস্টুর্যান্টকে ম্যানেজ করে রুটি আর দু’রকমের সবজি নিয়ে আসত ওরা। এই খাবার দিঘা বা শান্তিনিকেতনে শুটিং করতে গিয়ে কোনো টেকনিশিয়ান খেতে চাইবেন না। আমাদের কলাকুশলীরা করেননি, কারণ তাঁরা জানতেন এর বেশি খেতে চাইলে আমাদের বাজেটে টান পড়বে।

শকুন্তলা, মনোজ মিত্র, দীপঙ্করদের খাওয়ার সমস্যা হয়নি। সিদ্ধার্থ আর বনানী যত্ন করে ব্রেকফাস্ট আর ডিনার খাওয়াতেন। দুপুরে আমাদের সঙ্গে লাঞ্চে খেতে তাই অসুবিধে হত না। মনে পড়ছে, একদিন লাঞ্চ খেতে খেতে যিশু দাশগুপ্ত জিজ্ঞাসা করেছিল মনোজদাকে—’কাল রাত্রে বনানীবউদি আপনাদের কী খাইয়েছিল?’

মনোজদা সরল মনে বলেছিলেন, ‘দীপঙ্কররা রুটি আর মুরগির মাংস খেয়েছিল। আমি খাইনি।’

‘সে কী! কিছুই খাননি?’ যিশুর চোখ বড় হয়েছিল।

‘না না। আমি একটু ভাত আর মাছের ঝোল খেয়েছিলাম।’

মনোজদার কথা শুনে যিশু এক মিনিট চুপ করে বসেছিল। তারপর বলেছিল, ‘সমরেশদা, আজ রাত্রে আমি মনোজদাদের সঙ্গে থাকব।’

‘সে কী! কেন?’ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

‘কতদিন মাছের ঝোল খাইনি! কীরকম স্বাদ তা ভুলেই গিয়েছি। আজ রাত্রে সেটা মনে রিনিউ করে যদি দরকার হয় মোটেলে হাঁটতে হাঁটতে ফিরে যাব। প্লিজ, না বলবেন না।’ যিশু বলেছিল।

পুরোটাই মজার কিন্তু কষ্টটা বোঝা যায়।

শুটিং চলছে। কখনও ওয়র্ল্ড ট্রেড সেন্টারের সামনে, কখনও সেন্ট্রাল পার্কে, ম্যানহাটনের রাস্তায়। সস্তায় বিমা করানো থাকায় পুলিশ আপত্তি করেনি। শুধু বলেছিল, আমাদের জন্যে যদি জ্যামজট হয় তাহলে ফাইন দিতে হবে। সেটা হয়নি। সে সময় নিউ ইয়র্কের বাঙালিরা মজে ছিলেন হেমন্ত—সন্ধ্যা—শ্যামলে, উত্তম—সুচিত্রা—সৌমিত্রতে। তারপর যে গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গেছে তার খবর তাঁরা রাখার দরকার মনে করতেন না। ফলে, নব্বই সালে যিনি বাংলা চলচ্চিচত্রের স্টার ছিলেন, তিনি ম্যানহাটনের ফুটপাথে হেঁটে গেলে কোনো বাঙালি ফিরেও তাঁর দিকে তাকাত না। দীপঙ্কর—শকুন্তলাকে দেখে ভিড় জমার তো কোনো কারণ ছিল না।

রোজ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুটিং চলত। যিশু এবং বিবেক গিয়ে ম্যানহাটনের দোকান যারা শুটিংয়ে আলো সাপ্লাই দেয়, তাদের কাছ থেকে কাজ চালাবার মতো আলো ভাড়া করে এনেছিল। কাজ শেষ হলে মোটেলে ফিরে খাওয়া—দাওয়ার পর আমি সবাইকে ঘুমাতে যেতে বলে নিজের ঘরে চলে আসতাম। কিন্তু ইউনিটের একজন এসে জানাল, রোজ রাত্রে কয়েকজন চুপচাপ বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে ঘণ্টা আড়াই পরে। যাদের নাম বলল, তাদের একজনকে বেশ স্নেহ করতাম। তাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করতেই স্বীকার করল, ‘বিশ্বাস করুন, কোনো খারাপ কাজ করি না। ওখানে গিয়ে একটা বিয়ার নিয়ে চুপচাপ বসে সব দেখি।  কলকাতায় এসব দেখার সুযোগ হয় না তো!’

‘কী দেখিস?’ জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

‘ওই আর কী! নাইট ক্লাব তো! ইংরেজি সিনেমায় দেখা যায়।’

‘কী দেখা যায়?’

‘উঃ, আপনি এত জিজ্ঞাসা করবেন না তো! মাইরি বলছি, আমরা কেউ কোনো খারাপ কাজ করিনি।’

‘কিন্তু নাইট ক্লাবে ঢুকতে তো ভালো ডলার লাগে!’

‘একটু বেশি। আমরা তো  কলকাতা থেকে এনেছিলাম।’

দেখলাম, বেশি জোরজারি করা ঠিক হবে না।

দু’দিন পরের রাত্রে দরজায় শব্দ। খুলে দেখলাম, বালিশ হাতে রমাপ্রসাদ দাঁড়িয়ে। করুণ মুখে জিজ্ঞাসা করল, ‘সমরেশদা, আপনার ওপাশের খাটে আজ রাত্রে শুতে পারি?’

‘কেন রে?’ অবাক হলাম—’তোর সমস্যা কী?’

‘কাল মাঝরাতে কেউ দরজায় নক করেছে। ঘুম হয়নি।’

‘বেশ, থাক।’

খানিক পরে মদনসূদনজি এসে হাজির—’দাদা, আপনার ঘরে কি আমি রাত্রে শুতে পারি?’

‘তোমার আবার কী হল? দরজায় কেউ নক করেছে?’

‘হ্যাঁ দাদা, নীচের ওই মেয়েটা।’

‘কোন মেয়েটা?’

‘ওই যে, একা থাকে। খুব চালু।’

‘কিন্তু আমার পাশের খাটে তো রমাপ্রসাদ শুয়ে আছে।’

‘তাতে অসুবিধে নেই। আমি ওর পাশে শুয়ে পড়ব।’

‘দ্যাখো।’

ঘণ্টাখানেক পরে, একটু ঘুমিয়ে পড়ার পর দরজায় শব্দ হল। খুলে দেখলাম বিবেক দাঁড়িয়ে আছে। মুখ—চোখে বেশ ভয়ের ছাপ। ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিয়ে সে বলল, ‘দাদা, আপনরা ঘরে আজ ঘুমোতে পারি?’

‘কেউ দরজায় নক করেছিল?’ জিজ্ঞাসা করলাম।

বিবেক অবাক হয়ে তাকাল, ‘আপনি কী করে জানলেন?’

‘জেনেছি। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না, কে না কে তোমাদের দরজায় নক করছে আর তোমরা ভয় পেয়ে কেন আমার ঘরে শোয়ার জন্যে চলে আসছ? দরজা খুলে দেখেছ কে কাজটা করছে?’ রেগে গেলাম আমি।

‘দেখেছি।’ বিবেক মাথা নাড়ল।

‘কে সে?’

‘ওই মেয়েটা যে নীচেরতলায় থাকে।’

আমি অবাক। মোটেলের নীচেরতলায় যে—মেয়েটিকে ঢুকতে দেখেছি তার সাজগোজ, চেহারা বলে দিচ্ছে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করে না। সে কেন দোতলার ঘরে মাঝরাতে নক করবে? বিবেককে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তাকে জিজ্ঞাসা করেছ কী চায়?’

‘হ্যাঁ। ও সোজা ঘরে ঢুকে এসে আমার হাত ধরে বলল যে, খুব বিপদে পড়েছে। আমি যদি পাঁচশো ডলার ধার দিই তাহলে ওর উপকার হবে।’ বেশ নার্ভাস গলায় বলল।

‘কীসের বিপদ?’

‘ওর মা নাকি অসুস্থ হয়েছে। তার চিকিৎসার জন্যে।’

‘প্রথম কথা, এদেশের নাগরিকদের চিকিৎসার জন্যে সরকারি ব্যবস্থা আছে। দ্বিতীয়ত, এত লোক থাকতে সে তোমার কাছে পাঁচশো ডলার চাইতে এল কেন? আগে আলাপ হয়েছিল?’

‘হ্যাঁ। মানে ওই আসা—যাওয়ার পথে হাই হ্যালো করেছিল। আমাকে বলে গেছে দু’ঘণ্টা পরে এসে ডলার নিয়ে যাবে। আমি তাই আমার ঘরে থাকব না।’ বিবেক বলল।

এটা খুবই অন্যায় কথা। ভাবছিলাম কী করা উচিত। বললাম, ‘তোমার কাছে ধার চেয়েছে। সেই ধার কখনওই শোধ করবে না।’

ওপাশের খাটে বসে মদনসূদনজি কথাবার্তা শুনছিলেন। এবার বললেন, ‘অন্যভাবে শোধ করবে। ওটাই ওর ব্যবসা।’

আমি টেবিলের কাছে গিয়ে মোটেলের অফিসের নাম্বার ইন্টারকমে টিপলাম, একটু পরে ওপাশ থেকে জানান দিল। নিজের পরিচয় দিয়ে ব্যাপারটা জানাতেই অফিস থেকে বলল, ‘কখনও মেয়েটাকে ডলার দেবেন না। শোধ তো করবেই না, তাছাড়া ওর যৌনরোগ আছে।’

‘সর্বনাশ। এইরকম মেয়েকে মোটেলে রেখেছ কেন?’

‘কী করব বলুন। কেউ ঠিক সময়ে ভাড়া যদি দেয়, যদি অন্য কাউকে বিরক্ত না করে, কোনো অপরাধে না জড়ায় তাহলে আমরা ওকে থাকতে দিতে বাধ্য। আমি ওকে ফোন করে বলছি যেন আপনাদের কাউকে আর বিরক্ত না করে। এর জন্য স্যার, আমরা খুব দুঃখিত।’ লোকটি বলল।

আমরা যখন কথা বলছি, তখন বাইরে গাড়ির শব্দ হল। আমি বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। পেছনে ওরাও এল। দেখলাম, নীচের খোলা জায়গায় দুটো পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। দু’জন অফিসার রিভলভার হাতে নিয়ে গাড়ি থেকে নামল। তারপর মোটেলের একতলার দিকে এগিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল ইংরেজি সিনেমা দেখছি। বিবেক চাপা গলায় বলল, ‘সর্বনাশ!’

তারপরেই নীচের ঘর থেকে মহিলার চিৎকার ভেসে এল। কান্না জড়ানো গলায় গালাগাল দিচ্ছে। তার পরেই দেখলাম, বিশাল চেহারার একটি কালো লোককে পেছন থেকে ধাক্কা দিতে দিতে একজন অফিসার গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। লোকটার হাতে হাতকড়ি লাগানো। তার পরেই মেয়েটাকে দেখতে পেলাম। সম্ভবত শুয়েছিল সে। শরীরে নামমাত্র পোশাক। তাকেও হাতকড়া পরিয়ে দ্বিতীয় অফিসার বের করে নিয়ে এল। সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে মেয়েটি। অশ্রাব্য গালাগাল করছে, ঠেলতে ঠেলতে দু’জনকে দুটো গাড়িতে তুলে অফিসাররা বেরিয়ে গেল।

ওরা চলে যাওয়ার পর আমার ঘর খালি হতে সময় লাগেনি। পরদিন শুটিংয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম, মেয়েটির ঘরে তালা দেওয়া। অফিসে কথা বলে জানলাম, কোর্ট যদি মেয়েটিকে শাস্তি না দেয় তাহলে সে ফিরে এলে তাকে ঘর খুলে না দিয়ে উপায় নেই। যে কালো, বিশাল চেহারার লোককে ওর ঘর থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে, সেই নাকি মেয়েটির নতুন বন্ধু। হয়তো তার প্রয়োজনেই বিবেকের কাছে মায়ের অসুখের গল্প বলে টাকা হাতাতে এসেছিল মেয়েটি। এরপর যতদিন ওই মোটেলে ছিলাম মেয়েটির দেখা পাইনি। কিন্তু শেষদিন, যখন মোটেল ছাড়ছি, তখন একটি রোগা, কালো ছেলের সঙ্গে সে ট্যাক্সি থেকে নামল। তারপর আমাদের চেনেই না এমন মুখ করে পাশ দিয়ে অফিসের দিকে চলে গেল। আমার ধারণা, আমাদের কেউ এজন্যে কষ্ট তো পায়নি, হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল।

নিউ জার্সির কয়েকটি বাড়িতে আমরা শুটিং করেছিলাম। ওঁরা সবাই মনোজের বন্ধু ছিলেন। আলোলিকা—ভবানীর সঙ্গে বেশ ভাব হয়ে গিয়েছিল। ওঁরা সবাই আমাদের সিরিয়ালে কোনো—না—কোনো ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। শমিতার বাড়িতে অনেক সময় ধরে শুটিং হওয়া সত্ত্বেও তিনি যে বিরক্ত হয়েছেন তা বোঝা যায়নি। সাধারণত, এদেশেও, কারওর বাড়িতে সিনেমার শিল্পীদের নিয়ে ছবির শুটিং করতে চাই প্রস্তাব দিলে প্রথমে খুশি মনে অনুমতি দিয়ে থাকেন। তারপর যখন দ্যাখেন, তাঁর সাজানো বাড়ি তছনছ করা হচ্ছে, কলাকুশলীরা শুটিংয়ের প্রয়োজনে যা করছে তা তাঁর মনঃপূত হচ্ছে না, তখন ভাবেন এরা কবে বিদায় হবে! ভদ্রতাবশত তাড়াতে পারেন না, চলে গেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। নিউ জার্সির বাঙালিরা এই অত্যাচার চুপচাপ সহ্য করেছেন।

সাধারণত শট নেওয়ার আগে শিল্পীরা সংলাপ রপ্ত করতেন। মদনসূদনজি লক্ষ রাখতেন যাতে উচ্চচারণ নিখুঁত হয়। এ ব্যাপারে শকুন্তলা বেশ চৌকস ছিলেন, দীপঙ্করও স্বচ্ছন্দ কিন্তু মনোজ মিত্রকে নিয়ে একটু সমস্যায় পড়তেন মদনসূদনজি। বাজারের বাঙালি—হিন্দিকে ঠিকঠাক করতে বেশ সময় দিতে হত। মনোজদাও ছাত্র হিসেবে বিনীত থাকতেন। বিবেক ছিল ক্যামেরায়, তাকে সাহায্য করত যিশু। এছাড়া আলো সাজত সে।

নিউ ইয়র্ক ছেড়ে ওয়াশিংটনে যাওয়ার আগে একটি ঘটনা ঘটল যার পরিণতি বেদনাদায়ক হতে পারত। প্রতিদিন সকাল—সন্ধ্যা কাজ করে যাচ্ছে সবাই, নিউ ইয়র্ক শহর ঘুরে দেখা দূরের কথা, বিশ্রামও হচ্ছে না! তাই যাওয়ার আগের দুপুরে শুটিং প্যাক—আপ হলে সবাইকে নিয়ে হাডসন পেরিয়ে ম্যানহাটনের পোর্ট অথরিটি টার্মিনালে চলে গেলাম শুটিংয়ের বাসে চেপে। তখন দুপুর তিনটে। সবাইকে বলে দিলাম সন্ধে ছ’টার মধ্যে যেন বাসের কাছে চলে আসে।

পোর্ট অথরিটি পার হতেই ফর্টি সেকেন্ড স্ট্রিটে তখন প্রচুর সেক্স শপ, লাইফ শো, পিপ হোল থেকে নানান ব্যবস্থা যা টুরিস্টদের আকর্ষণ করার জন্যে তৈরি। চুরাশি সালে ওখানে গিয়ে দেখেছিলাম বিশাল লাইন পড়েছে দোকানগুলোর সামনে। ঊননব্বুইতে গিয়ে সেই লাইন দেখিনি। কিছু বৃদ্ধা—বৃদ্ধ টুরিস্ট ঢুকছেন। শুনেছিলাম, ব্যবসা খারাপ হচ্ছে বলে ওগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। আমাদের শুটিংয়ের সময়ও তা চালু ছিল।

দলের ছেলেরা এক একটা ভাগে ভাগ হয়ে বেড়াতে গেল। সন্ধে ছ’টার আগেই সবাই ফিরেও এল। কিশোর মাথা গুনে বলল, ঠিক আছে। রমাপ্রসাদকে জিজ্ঞাসা করলে সে একই কথা বলল। কামাল বাস ছেড়ে যখন প্রায় হাডসনের কাছে চলে গেছে, তখন রমাপ্রসাদ চিৎকার করল, ‘মদনসূদনজি ওঠেনি।’

ওইসব রাস্তায় চট করে বাস থামানো মুশকিল। জিজ্ঞাসা করলাম, তুই যে তখন বললি সব ঠিক আছে?’

রমাপ্রসাদ বলল, ‘আমি ভেবেছিলাম ও আমার পেছনে বসে আছে।’

শেষপর্যন্ত কামাল বাস ঘুরিয়ে যেখানে এতক্ষণ ছিলাম, সেখানে চলে এল। কিন্তু মদনসূদনজি নেই। রাত নেমে গেলেও আলো এত জোরালো যে দিন বলেই মনে হচ্ছে। মদনসূদনজিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। লোকটা যে একা নিউ জার্সির মোটেলে ফিরে যেতে পারবেন এ বিশ্বাস আমাদের নেই। রুট চেনেন না, কোথায় নামবেন তাও জানেন না। এমনকী মোটেলের ফোন নাম্বারও ওঁর কাছে নেই। খুব অসহায় লাগছিল। মদনসূদনজি যদি পুলিশের কাছে যান তাহলে কি মোটেলের নাম বলতে পারবেন?

আধঘণ্টা অপেক্ষা করার পর কামালকে বললাম ম্যানহাটনের ওই এলাকার রাস্তাগুলোতে পাক মারতে। যদি ওঁকে দেখতে পাওয়া যায়। দু’বার ঘোরা হল কিন্তু কোথাও ভদ্রলোক নেই। ফিরে তো যেতেই হবে কিন্তু তার আগে পুলিশকে জানানো দরকার। একজন পুলিশ অফিসার গাড়িতে বসেছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে কাছাকাছি পুলিশ স্টেশনের হদিশ জেনে আমরা একটা গলি দিয়ে যখন এগোচ্ছি, তখন কামাল চিৎকার করে উঠল, ‘ওই যে, ওই যে!’

সামনের কাচের ভেতর দিয়ে দেখলাম, মদনসূদনজি রাস্তায় নেমে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে দু’হাত মাথার ওপর তুলে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন।

গাড়ি থেকে নামামাত্র মদনসূদনজি প্রায় ঝাঁপিয়ে এলেন। কিশোর দরজা খুলে দিয়েছিল। ওপরে উঠে একটা সিটে বসে পড়ে চোখ বন্ধ করে হাঁপাতে লাগলেন। ওঁর শ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কামাল গাড়ি চালু করল। আমি সবাইকে বললাম এখন ওঁকে কোনো প্রশ্ন না করতে! প্রায় রক্তশূন্য মুখে বসেছিলেন মদনসূদনজি। কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছিলেন। একজন বয়স্ক মানুষ অজানা জায়গায় সঙ্গীদের হারিয়ে এরকম নার্ভাস হবেন, ভাবিনি।

হাডসন পার হওয়ার পর একটু স্বাভাবিক হলেন ভদ্রলোক। ওঁকে আমার পাশে নিয়ে এলাম। হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন লাগছে এখন?’

‘অনেক ভালো।’

‘একটু জল খাবেন?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ!’

জল খেয়ে মদনসূদনজি বললেন, ‘আজ আমি মরেই যেতাম।’

যে—কাহিনি তিনি শোনালেন, তা রীতিমতো ভয়ংকর।

সবাই যে—যার ইচ্ছেমতন জায়গায় ঘুরছে দেখে মদনসূদনজি ফুটপাত ধরে একাই হেঁটে যাচ্ছিলেন। এ—দোকান সে—দোকানে উইন্ডো শপিং করে তিনি দেখতে পেলেন মেয়েরা দ্রুত টিউব স্টেশনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। তাদের জুতোর হিলের আওয়াজ যেন ঘোড়ার নালের শব্দের মতো মনে হচ্ছিল। ক্রমশ রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে গেলে উনি বুঝলেন এটা অফিসপাড়া। ছুটির পরে সবাই বাড়ি ফিরে গেছে। ডালহৌসিতে সন্ধের পর যা হয়। ছ’টা বাজতে দেরি নেই দেখে মদনসূদনজি যখন ফেরার জন্যে পা বাড়িয়েছেন, তখন তাঁর সামনে ফুটপাতজুড়ে দু’জন বড় চেহারার কালো মানুষ এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘হাই বেবি! কাম উইদ আজ।’

একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে বেবি বলায় মদনসূদনজির মনে হল এরা খারাপ লোক। তিনি পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে একজন তাঁকে টেনে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে চাইল। সর্বশক্তি এক করে নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়তে লাগলেন মদনসূদনজি। পেছন পেছন লোক দুটো খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে ছুটে আসছে। হাই বেবি, হাই বেবি চিৎকার কানে আসায় আরও জোরে পা চালালেন তিনি। মাঝে মাঝে খালি বিয়ারের ক্যান পেছন থেকে উড়ে আসছিল।

পেছনে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে মদনসূদনজি বাঁ দিকের দুটো বাড়ির মাঝখানের খাঁজের ভেতর ঢুকে পড়েছিলেন। নড়াচড়ার জায়গা ছিল না। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলেন, পাশের রাস্তা দিয়ে সেই লোক দুটো দৌড়ে যাচ্ছে সামনে, তাঁর খোঁজে। ওই অবস্থায় কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন তিনি জানেন না, যখন মনে হল লোক দুটো ধারে—কাছে নেই, তখন বেরিয়ে এসেছিলেন ফুটপাতে। আর তখনই দূরে আমাদের গাড়িকে আসতে দেখেন তিনি।

মদনসূদনজি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘এই দেশে এমন হয় জানতাম না। ওরা পশুর অধম। সরকার কিছু বলে না কেন?’

বলেছিলাম, ‘পৃথিবীর সব দেশেই ওরা আছে। কোথাও কম, কোথাও বেশি!’

নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন পৌঁছতে গাড়িতে ঘণ্টা চারেক—পাঁচেক লাগে। পথে পড়ে বাল্টিমোর, সেখানে, মানে শহরের মধ্যে ঢোকার কথা ছিল না। কিন্তু কয়েকজনের আগ্রহ দেখে ড্রাইভিং সিটে বসে কামাল বলল, ‘চলো, আজ যখন শুটিং নেই, তখন শহরটা দেখিয়ে দিই।’ আমি আপত্তি করিনি।

না করার যথেষ্ট কারণ ছিল। আমাদের ওই ইউনিটের বেশিরভাগ মানুষ সিনেমার সঙ্গে জড়িত। কেউ অভিনয় করেন, কেউ টেকনিশিয়ান, কেউ প্রোডাকশনের কাজ করেন। এঁরা যখন শুটিংয়ের জন্যে আউটডোরে যান, তখন বেশ যত্নে থাকেন। পান থেকে চুন খসে গেলে চট করে মেনে নিতে পারেন না। অভিনেতারা, যাঁরা নাম করেছেন, থাকেন রাজার হালে। নিজের পয়সায় পরিবার নিয়ে সচরাচর তাঁরা বেড়াতে যান না। কারণ, ওইরকম আরামে থাকতে হলে নিজেকেই খরচ করতে হবে। আর বাকিরা, বাড়িতে যা পান না, আউটডোরে গিয়ে সেই আরাম পেতে অভ্যস্ত। কিন্তু আমাদের এই প্রজেক্টে আমেরিকায় শুটিং করতে এসে ওঁরা সেই আরাম পাচ্ছেন না। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত পরিশ্রম করতে হচ্ছে কিন্তু গ্রুপ থিয়েটারের কর্মীদের মতো সব কিছু মানিয়ে তাঁদের থাকতে হচ্ছে। ভারতবর্ষের যে—কোনো জায়গায় আউটডোর শুটিংয়ে গেলে ওঁরা এরকম অবস্থায় বিদ্রোহ করতেন। কিন্তু দুটো কারণে সবাই হাসিমুখে থাকতেন। এক, ওঁরা আমেরিকায় এসেছেন। ওঁদের মধ্যে অনেকেরই আমেরিকায় আসার সামর্থ্য ছিল না। আর থাকলেও ভিসা পেতেন না। সেই খুশিটা কাজ করত। দ্বিতীয়ত, আমাদের সম্পর্ক এত নিবিড় ছিল, দাদা এবং ভাই ছাড়া কেউ কিছু ভাবত না, সমস্যা তৈরি হলে প্রোডাকশন বয় থেকে ক্যামেরাম্যান এবং আমি একসঙ্গে বসে সমাধান করার চেষ্টা করতাম, এটাও প্রত্যেকের মনের চেহারা বদলে দিয়েছিল। তাই কামাল কথাগুলো বললে আমারও মনে হয়েছিল, ওরা আমেরিকায় এসে একটু ঘুরে বেড়াবে না, তা হয় নাকি!

ছিমছাম শহর বাল্টিমোর। সমুদ্রের একটা অংশ ঢুকে গেছে শহরের ভিতরে। তার দু’পাশে অনেক সাজানো বেড়াবার জায়গা, রেস্টুর্যান্ট। বাস থেকে নেমে সবাই দেখতে বেরিয়ে গেল। মনোজদা, মনোজমিত্র আমার পাশে দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখতে দেখতে বললেন, ‘ইস, আমাদের দিঘাকে যদি এরকম সাজানো যেত!’ বিদেশের ভালো কিছু দেখে যিনি দেশের কথা ভাবতে পারেন, তাঁকে শ্রদ্ধা করতেই হয়। বহু বছর দিঘায় যাইনি, জানি না জায়গাটা কতটা সুন্দর হয়েছে!

বাল্টিমোরের সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে সেদিন ভাবতেও পারিনি আর সাত বছর বাদে এই শহরে ঘুরে ফিরে দিন দশেক থাকতে হবে। সেটা সাতানব্বুই সাল। নাটক করতে গিয়েছিলাম আমেরিকার বিভিন্ন শহরে। আমারই  লেখা নাটক ‘তিন নম্বর চোখ’। অভিনয় করেছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জিত মল্লিক, দুলাল লাহিড়ি, শংকর ঘোষ, শকুন্তলা বড়ুয়া এবং লাবণী সরকার। সেটা অন্য কাহিনি। ভবিষ্যৎ যদি বুঝতে পারা যেত তাহলে আমাদের আয়োজক ঘোষমশাইয়ের সঙ্গে সাত বছর আগেই দেখা করে আসতাম।

ওয়াশিংটনে রমেন পাইনের বাড়ির সামনে আমাদের মাইক্রো বাস যখন থামল, তখন ঘড়িতে সন্ধে সাড়ে ছ’টা কিন্তু চারপাশে ঝকঝকে আলো। রমেনদার মেয়ে জয়ন্তী যে কিনা আমাদের সিরিয়ালের নায়িকা, কথা দিয়েছিল, থাকার ব্যবস্থা সে করে দেবে। রমেনদার একটি বেডরুমে এত লোক থাকতে পারবে না। শকুন্তলা, লাবণী ছাড়া দীপঙ্কর এবং মনোজদা, আমি আর দুলাল থেকে গেলাম রমেনদার বাড়িতে, জুলিবউদির তদারকিতে। বাকিদের নিয়ে জয়ন্তী চলে গেল। তখন জানতে পারলাম, ওইটুকু মেয়ে একটা বাড়ি কিনেছে কিছুদিন আগে। সেখানে বাকিরা আরামে থাকতে পারবে। ওদের রাতের খাবার জুলিবউদি করে দেবেন, সকাল—দুপুর ম্যাকডোনাল্ড থেকে যেমন খাই, তেমন খেয়ে নেব। কৃতজ্ঞতার সীমা—পরিসীমা নেই। রমেনদা— জুলিবউদি এবং জয়ন্তী না থাকলে আমাদের পক্ষে শুটিং করা সম্ভব হত না।

রমেনদাদের বাড়িটি ছবির চেয়েও সুন্দর। বাড়ির সামনে নির্জন রাস্তাটি বাঁক নিয়ে নীচে নেমে গিয়েছে। এই জায়গাটির নাম ভার্জিনিয়া। ভার্জিনিয়া থেকে বেরিয়ে পটম্যাক নদীর ব্রিজ দিয়ে ওয়াশিংটনে পৌঁছতে বেশি সময় লাগে না। সারাদিন আমরা ওয়াশিংটন শহরে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনমতো শুটিং করতাম। আমেরিকা রাষ্ট্রপতির বাসভবনের পাশের মাঠে অনুমতিপত্র দেখিয়ে শুটিং করেছি। সেখানে একটি কালো ছেলে, যার বয়স বড়জোর একুশ, এসে বলল, ‘তোমাদের ছবিতে আমাকে অভিনয় করার সুযোগ দাও। দেখবে, তোমাদের একদিন পৃথিবীর সবাই কুর্নিশ করবে।’

ছেলেটি কথা বলছিল আর শরীর দোলাচ্ছিল, রোগা ছেলেটির দাঁতের তলায় চিউইংগাম। যিশু জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তুমি কে হে?’

‘আমি কে?’ ছেলেটা যেন হেসে গড়িয়ে পড়ল—’ঈশ্বর তোমাকে চোখ দিয়েছেন কিন্তু দেখার শক্তি দেননি। ভবিষ্যতে আমি হলিউডের সিডনি হতে পারি, মাইকেল জ্যাকসন হওয়াও অসম্ভব নয়। অন্তত ওই বাড়িটায় পাঁচ কী দশ বছর আরামে থাকতে পারি। তখন তোমাদের ছবির দাম কীরকম বেড়ে যাবে ভেবে দ্যাখো। অতএব, আমাকে একটা চরিত্র দাও ও বিখ্যাত হও।’

রমাপ্রসাদ তাকে বোঝাতে চাইল, এটা ছবি নয়,  টিভি ধারাবাহিক। অনেক কষ্টে ছেলেটার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, অনেকেই অভিনয়ের সুযোগ চাইতে এসেছে কিন্তু এইরকম প্রস্তাব আজ পর্যন্ত কারওর মুখে শুনিনি।

আমাদের সিরিয়ালের নাম ছিল ‘নির্বাসিত’। মনোজ লিখেছিল ‘এই দ্বীপ এই নির্বাসন’। সেখানে আমেরিকায় গিয়ে শিকড় গেড়েছিলেন এক বাঙালি দম্পতি, যাঁদের একমাত্র মেয়ে ওদেশীয় আবহাওয়ায় বড় হয়ে উঠলেও মেয়েটির বাবা দেশের ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তিনি চাইতেন, মেয়ে যতই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত হোক, যেন মনেপ্রাণে বাঙালি হয়ে থাকে। এই ব্যাপারে মেয়েটির মা ছিলেন একেবারেই চুপচাপ। স্বামীর সঙ্গে তিনি একমত না হলেও বিরোধিতা করতেন না। সারাজীবন স্বামীর ছায়া হয়ে সংসার সামলে সেই সাহস অর্জন করেননি। ফলে যে—কষ্ট পেতেন তা চুপচাপ সহ্য করতেন।

সেই মেয়ে একটি কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের প্রেমে পড়ল। খবরটা কানে আসতেই বাবা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। বাবা ও মেয়ের মধ্যে যে—উত্তেজিত কথাবার্তা, তাতে মেয়ে যতটা যুক্তি দেখাচ্ছিল বাবা তার বিন্দুমাত্র নয়।

এই কালো ছেলেটির সন্ধান আগেরবার যখন নিউইয়র্কে এসেছিলাম, তখনই করেছিলাম। ছেলেটির অভিনয়টা জানতে হবে। নিউ ইয়র্কে ব্রডওয়ে থিয়েটার মানে থিয়েটারের ফাইভ স্টার ব্যাপার। তার নীচের শ্রেণিতে আছে অফ—ব্রডওয়ে থিয়েটার, অফ—অফ—ব্রডওয়ে থিয়েটার। প্রচুর ছেলেমেয়ে সেসব নাটকে নিয়মিত অভিনয় করে। একজন খোঁজখবর নিয়ে জানালেন, একেবারে সাধারণ নাটকের দলে অভিনয় করে এমন ছেলে ভারতীয় সিরিয়ালে অভিনয় করার জন্যে দিনে অন্তত এক হাজার ডলার চাইছে। এই পারিশ্রমিক দেওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। আবার ওই চরিত্রে কালো অভিনেতাকে না নিলে সমস্যাগুলো বিশ্বাসযোগ্য করা যাবে না।

আমরা যখন ওয়াশিংটন থেকে নিউ ইয়র্কে ফিরে আসছি, তখন সুদীপ্তর ফোন এল রমেনদার বাড়িতে। এই সুদীপ্ত অদ্ভুত লড়াকু মানুষ। যখন  কলকাতায় ছিল, তখন ‘চেনামুখ’—এ অভিনয় করত। রমাপ্রসাদ বণিক তখন চেনামুখের পরিচালক। ওর কাছে অভিনয় শিখে পরবর্তীকালে খ্যাতি পেয়েছে খরাজ মুখার্জি, শান্তিলাল মুখার্জি, চন্দন সেনরা। সুদীপ্তও কিছুদিন রমাপ্রসাদের সঙ্গে ছিল। তারপর আমেরিকায় চলে যায় নাটক বিষয়ে পড়াশুনা করতে। পরে এই নিয়ে সে—দেশে শিক্ষকতাও করেছে। রমাপ্রসাদ আমেরিকায় ধারাবাহিকের শুটিং করতে এসেছে বলে যখন খবর পেয়েছিল, তখনই যোগাযোগ করেছিল। রমাপ্রসাদ তাকে কালো যুবক অভিনেতার কথা বলেছিল। ফোনে সুদীপ্ত জানাল, তাদের সঙ্গে অভিনয় নিয়ে পড়ছে এমন একটি ছেলের সঙ্গে, তার কথা হয়েছে যে কাজটা করতে রাজি হয়েছে। টাকাপয়সা নিয়ে সমস্যা হবে না।

নিউ জার্সির মোটেলে ছেলেটিকে নিয়ে সুদীপ্ত এল। ছিপছিপে লম্বা ছেলে। কালো হলেও মুখের গড়ন ভারতীয়দের পছন্দ হবে। রমাপ্রসাদের মুখে চরিত্রটা শুনে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘গুড, গুড!’

রমাপ্রসাদ ওকে দিয়ে কয়েকটা সংলাপ বলালেন। শোনার পর বলল, ‘আমরা তোমাকে কীরকম পারিশ্রমিক দিলে তুমি কাজটা করবে?’

ছেলেটি একটু ভেবে বলল, ‘আমি হার্লেমে থাকি। ওখান থেকে আমাকে পোর্ট অথরিটিতে এসে বাস ধরতে হবে এখানে আসার জন্যে। তোমরা আমাকে আসা—যাওয়ার বাস ভাড়াটা দিয়ে দিও।’

আমরা অবাক। বলে কী ছেলেটা?

পাঁচদিন শুটিং করেছিল ছেলেটা। ইউনিটে সবার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। যিশু ওর ভালো বন্ধু হয়ে গেল, যদিও যিশু বয়সে বেশ বড়। যিশু ওকে অনুরোধ করেছিল হার্লেমে নিয়ে যেতে। আমি আপত্তি করেছিলাম। নিউ ইয়র্কের একপাশে কালোমানুষরা যে—এলাকায় নিজেদের মতো থাকে, সেখানে সাদা পুলিশরা সবসময় ঢুকতে সাহস পায় না। গোলমাল সেখানে লেগেই থাকে। ঝুঁকি নেওয়ার কোনো মানে নেই।

ওই ধারাবাহিকে দীপঙ্কর দে বাবার ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করেছিল। মনোজদাও মামুর চরিত্রে অসাধারণ। শকুন্তলা বড়ুয়া রমাপ্রসাদকে খুশি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু এঁরা তো পেশাদার অভিনেতা। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়েছিল জয়ন্তী পাইন। ভার্জিনিয়াতে সে নাচের স্কুল করবে প্ল্যান করেছিল। ভরতনাট্যম শেখাবে। রমেন পাইনের মেয়ে জয়ন্তীর অভিনয় দেখে রমাপ্রসাদ বলেছিল, ‘এই সিরিয়াল টেলিকাস্ট হওয়ার পর তোমাকে আমেরিকা ছাড়তে হবে।’

জয়ন্তী চমকে গিয়েছিল—’সে কী! কেন?’

‘হিন্দি আর বাংলা ছবির প্রযোজকরা তোমাকে নায়িকা করে ছবি বানাতে চাইবে। আমি যেটুকু বুঝি তাতে বলছি, তোমার অভিনয় হিট করবেই।’

আমি জানি না, জয়ন্তী স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল কি না!

তারপর এল সেই ভয়ংকর দিন।

শুটিংয়ের শেষদিন দুপুরে  কলকাতা থেকে সিদ্ধার্থর বাড়িতে ফোনটা এল। এই শুটিং বন্ধ করার জন্যে কলকাতার আদালতে আবেদন করা হয়েছে এবং আদালত ইনজাংশন জারি করেছে যাতে শুটিং আর না করা হয়। মাথা ঘুরে গেল। যে ফোন করেছিল সে এর বেশি কিছু বলতে পারল না। কলকাতা—নিউ ইয়র্কের সময়ের পার্থক্য প্রায় সাড়ে নয় ঘণ্টা। তখন আমরা নিউ জার্সিতে সিদ্ধার্থর বাড়ির সামনে শুট করছিলাম। তৎক্ষণাৎ ওর বাড়িতে গিয়ে অরিজিৎকে ফোন করলাম।

অরিজিৎ বলল, ‘হ্যাঁ, খবরটা সত্যি।’

‘সে কী! তুমি জানাওনি কেন?’

‘জানাতাম। শুটিং তো আজই শেষ হওয়ার কথা।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু ব্যাপারটা কী?’

‘মনোজ ভৌমিকের স্ত্রী আদালতে আবেদন করেছেন, আমরা তাঁর পরলোকগত স্বামী অথবা তাঁর অনুমতি না নিয়ে আমেরিকায় যে—ধারাবাহিকের শুটিং করতে গিয়েছি, তার কাহিনি মনোজ ভৌমিকের লেখা। তিনি মনোজ ভৌমিকের একমাত্র স্বত্বাধিকারী। তাঁর অনুমতি না নেওয়া মানে তাঁকে প্রতারণা করা। এই কারণে ধারাবাহিকের শুটিং যাতে আদালত বন্ধ করে দেয় তার জন্যে আবেদন করেছেন।’ অরিজিৎ জানাল।

‘কিন্তু—’

আমাকে থামিয়ে দিয়ে অরিজিৎ বলল, ‘টেলিফোনে এ নিয়ে আলোচনা করে কোন লাভ নেই। তোমরা ভালোভাবে ফিরে এসো, তারপর ভাবা যাবে।’

রিসিভার রেখে দেখলাম, ইউনিটের সবাই আমার পেছনে উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। যিশু জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে সমরেশদা?’

বললাম, ‘তেমন কিছু নয়। একটু ভুল বোঝাবুঝি, সব ঠিক হয়ে যাবে?

রমাপ্রসাদ চেঁচিয়ে বলল, ‘প্যাক—আপ। শুটিং শেষ।’

সিদ্ধার্থর স্ত্রী বনানী এক গ্লাস জল এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘জলটা খেয়ে নিন। আপনি একটু বসুন সমরেশ।’

বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় বলে শুনেছিলাম, সেদিন প্রত্যক্ষ করলাম। এই এত পরিশ্রম, এতগুলো মানুষকে দেশ থেকে নিয়ে এসে এতদিন ধরে যে—শুটিং করা হল, তা বিফলে যাবে?

‘টেলিফ্রেম’ শুরু করেছিলাম ‘মুক্তবন্ধ’ নামে একটি বাংলা ধারাবাহিক দিয়ে। তারপর অনেকগুলো সিরিয়াল করেছি, কাউকে ঠকাইনি, যা জমিয়েছিলাম তার পুরোটা খরচ করে আমেরিকায় এসেছিলাম হিন্দি ধারাবাহিক ‘নির্বাসিত’ করতে। দিল্লির মান্ডি হাউসের কর্তারা আগ্রহী ছিলেন। ভেবেছিলাম, টেলিকাস্ট হলে পুরো টাকা দিয়ে একটা  টিভি সিরিয়ালের শুটিং করার মতো বাড়ি কিনব। নাম দেব ‘টেলিফ্রেম’। কিন্তু এটা কী হল?

আজ এত বছর পরে কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চাইছি না। সেই মানসিকতাও নেই। যে—দুঃখ এবং কিছুটা ক্রোধ তৈরি হয়েছিল, তা এই পঁচিশ—ছাব্বিশ বছরে ধীরে ধীরে হারিয়ে গিয়েছে।

কিন্তু মনোজের লেখা চিঠিগুলোর দিকে যখনই তাকাই, তখনই ভাবি মনোজ যদি ভবিষ্যৎ দেখতে পেত তাহলে খুব কষ্ট পেত।

”সমরেশ, ‘এই দ্বীপ এই নির্বাসন’ আন্তরিক পত্রিকার পাতায় পড়ে থাকত যদি না আপনি উদ্যোগী হয়ে আনন্দ পাবলিশার্সকে বই করতে অনুরোধ না করতেন। আমার মনে এই গল্প নিয়ে ছবি করার ইচ্ছে ছিল। আপনি এসে ইচ্ছেটা উসকে দিলেন। কলকাতায় গিয়ে আপনার সঙ্গে চিত্রনাট্য নিয়ে অনেক কথা বলতে গিয়ে দেখেছি আপনি গল্পে ঢুকে গেছেন।”

আর একটি চিঠিতে, ”অভিনেতাদের ভিসা করে ফেলুন। কাগজ পাঠাচ্ছি। জয়ন্তী ফাইন্যাল। আচ্ছা, আমি যদি কোনো কারণে ছবিটা না করতে পারি তাহলে আপনি কি করতে পারবেন? আমি জানি ছবিটা ঠিকঠাক হবে।”

এর কয়েকদিন পরে দুর্ঘটনায় মনোজ পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

আর আমার মাথায় ভাবনাকে সে চাপিয়ে দিয়ে গেল। তখন ওর স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি, তারও আগ্রহ ছিল।

দীর্ঘ কয়েক বছর পরেও আদালতে যখন ফয়সালা হল না, তখন অর্থদণ্ড দিয়ে ওর স্ত্রীর কাছ থেকে ছাড়পত্র পেলাম। ইনজাংশন উঠল। কিন্তু শুটিংয়ের ক্যাসেট চালিয়ে দেখা গেল এই কয়েকবছর ক্ষত সর্বাঙ্গে বসে গেছে। ওদের আর ব্যবহার করা যাবে না। তাছাড়া লো ব্যান্ডে শুট করা ক্যাসেট তখন একেবারেই অচল।

হজম করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

আজ পেছন ফিরে তাকালে বুক ভারী হয়। রমাপ্রসাদ বণিক চলে গিয়েছে পৃথিবী থেকে। যিশু দাশগুপ্ত নেই, নেই মদনসূদনজিও। এই তিনজনই ছিল ‘নির্বাসিত’র তিন স্তম্ভ।

অর্জুন এবং চাইনিজ সিগারেট


কাল রাত্রে পর পর কয়েকটা বোমা বিকট শব্দে ফেটেছিল। শহরের এদিকটায় যাঁরা বাস করেন, যেমন সেনপাড়া, হাকিমপাড়া বা আদালত এলাকার মানুষ ওই শব্দের সঙ্গে জন্ম ইস্তক পরিচিত। শুকনো খটখটে তিস্তায় যখন বালি ওড়ে, কাশের জঙ্গল যখন মাথাচাড়া দেয়, নদীর ধারা যখন শীর্ণ থেকে শীর্ণতর হয়ে আসে, তখন পাহাড়ে বৃষ্টি নামলেও সমতলের আকাশে এক ফোঁটা মেঘ দেখা যায় না। এইরকম সময়ে আগাম জানান না দিয়ে আচমকা মধ্যরাতে তিস্তার শুকনো পাঁজরা ফাটিয়ে বোমার বিকট আওয়াজ উঠে আসে। শহরের তিন পাড়ার মানুষ জানে, কাল ভোর ভোর অন্ধকারে যাঁরা তিস্তার ধার ঘেঁষে বেড়াতে যাবেন, তাঁরা দেখতে পাবেন তিস্তার ওপরের বালির স্তর ভিজে গেছে, বাতাসের দাপটও তাকে ওড়াতে পারছে না। তারপর যত বেলা বাড়বে, বালির নীচ দিয়ে চুঁইয়ে আসা জল ওপরে উঠে আসবে। গত রাতে বালির নীচে জমে থাকা বাতাস যা গ্যাসের মতো চেপেছিল, তা চুঁইয়ে আসা জলের চাপে ঊর্ধ্বমুখী হতেই বালির স্তর ফেটে বোমার বিকট শব্দ তৈরি করেছিল।

কিন্তু প্রতি বছরের এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে এবছর প্রাতঃভ্রমণকারীরা কোনো মিল দেখতে পেলেন না। তিস্তার বুকে এই ভোরেও শুকনো বালি উড়ছে, কাশগাছগুলো নির্বিকার দুলছে। কোথাও বালি ভিজে যায়নি। শুধু তিস্তার গায়ে সরকারি বাড়িটা যা বাতিল হয়ে পড়েছিল, যার জানলা দরজা প্রয়োজন পড়ায় মানুষ গোপনে খুলে নিয়ে গিয়েছিল, যার একপাশে মাঠ আর অন্যপাশে তিস্তা, তা ধ্বংসস্তূপ হয়ে পড়ে আছে। এতদিন দোতলা করার পরিকল্পনায় তৈরি পরিত্যক্ত বাড়িটিতে কেউ কেউ ভূতের আস্তানা ভেবে এড়িয়ে যেত। উঠতি বয়সের ছোকরারা যার আড়ালে গিয়ে সিগারেট খাওয়া রপ্ত করত, সেটা শুধু ইটবালির স্তূপ হয়েই থাকেনি, তার ভেতর থেকে মানুষের শরীরের অংশবিশেষ বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

আতঙ্ক ছড়াল। বাতাসের আগে পৌঁছে গেল সরকারের কানে। পুলিশের গাড়ি ছুটে এল, জেলাশাসক, এসপি—ও। কর্ডন করে বাড়িটিকে জনতার আওতা থেকে আলাদা করে দেওয়া হল। সকালটা আচমকাই ছুটির সকাল হয়ে গেল শহরবাসীর কাছে। সবাই দু’চোখ মেলে দেখতে চায়, ওরা কারা, যারা ইটের তলায় চাপা পড়ে আছে?

একটা দুটো নয়, চার—চারটে শরীর যা এখন লাশ হয়ে গেছে। পুলিশ ধ্বংসস্তূপ ঘেঁটে বের করল। কারওর হাত উড়ে গেছে, কারওর মাথা। কিন্তু পরনের পোশাক বলছে সেগুলো কমদামি নয়।কাপড়ের সেরা দোকান

গাড়িতে চাপিয়ে তাদের নিয়ে পুলিশ চলে যাওয়ার পর ভিড় পাতলা হতে লাগল। তারপর নানান ভাবনা ছড়িয়ে পড়ল শহরের মানুষগুলোর মনে। ওরা কারা? কী করছিল ওই পরিত্যক্ত বাড়ির ভিতরে? মধ্যরাত্রে যে—বোমা ফাটার বিকট শব্দ হয়েছিল, সেটা নিশ্চয়ই ওই বাড়ি থেকে বের হয়েছিল। তাহলে কি তারা সন্ত্রাসবাদী! ওই বাড়িতে বসে এই শহরটাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল অথবা তার প্রস্তুতি নিচ্ছিল?

পুলিশের বোম স্কোয়াড এল একটু বেলা করে। ঘিরে রাখা বাড়িটার ভেতরে খুঁজতে গিয়ে আবার একটা বোমা ফাটল, যার শব্দে আতঙ্কিত তখনও দাঁড়িয়ে থাকা কিছু দর্শক দে দৌড় দিল। বোমায় অতি ক্ষুদ্র অংশের আঘাতে বোম স্কোয়াডের একজন কর্মী আঘাত পেলেন ; উপযুক্ত রক্ষাব্যবস্থা থাকায় তা গুরুতর হয়নি। কিন্তু তাঁকে হাসপাতালে পাঠাতে হল।

বিকেল নাগাদ পুলিশ ধ্বংসস্তূপ যাচাই করে একটা বড় টিনের ট্রাঙ্কে যে—অস্ত্র সম্ভারের দর্শন পেল, তা দেখে তাদের চোখ বিস্ফারিত। এত আধুনিক অস্ত্র পুলিশের অনেকেই এর আগে দ্যাখেনি, ব্যবহার করার কৌশল তাই জানার কথা নয়।

দেশ—বিদেশের টিভি চ্যানেল, কাগজের সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। টিভিতে বাড়িটির ছবি বারংবার দেখানো হল। বলা হচ্ছিল, যেসব মৃতদের মর্গে নিয়ে রাখা হয়েছে, তাদের পরিচয় এখনও জানা যায়নি। এদের কারওর পকেটে এমন কিছু পাওয়া যায়নি যা থেকে এদের সম্পর্কে কোনো ক্লু পাওয়া যায়। পুলিশ সূত্রে বেসরকারিভাবে জানা গিয়েছে, ওই চারজনের একজনের পকেটে এক প্যাকেট চাইনিজ সিগারেট ছিল।

সিগারেট খাওয়ার চল এই অঞ্চলে আগের থেকে অনেক কমে গিয়েছে। দাম লাগামছাড়া বলে নিম্নবিত্ত ও বিত্তহীনরা বিড়ি খেয়ে নেশা মেটায়। দামি বিদেশি সিগারেট কিনতে হলে বড় দোকানে ঢুঁ মারতে হয়। এককালে কিছু চিনে সিগারেট নেপালের ধূলাবাড়ি সীমান্ত দিয়ে ভারতে আসত। হংকং মার্কেটে পাওয়া যেত। বোধ হয় চাহিদা নেই বলেই চিনে সিগারেট এই অঞ্চলের বাজার গুটিয়ে নিয়েছে।

সেই সিগারেটের প্যাকেট মৃত লোকটির পকেটে পাওয়া গেল কী করে? স্কচ হুইস্কি যে খায়, সে স্কটল্যান্ডে গিয়ে খাওয়া শিখেছে এমন ধারণা অতি মূর্খও করবে না, তাই চিনে সিগারেট পকেটে পাওয়া গিয়েছে বলে লোকটা চিনে গিয়েছিল তা পুলিশ ভাবছিল না।

কিন্তু স্থানীয় পুলিশের ওপর নির্ভর করতে চাইল না জাতীয় সরকার। তারা তাদের প্রশিক্ষিত দল পাঠাল জলপাইগুড়িতে। তারা দেখল, উদ্ধার করা অস্ত্রের গা থেকে সযত্নে লেখাগুলো মুছে ফেলা হয়েছে যাতে ওগুলো কোথায় তৈরি হয়েছে বোঝা না যায়। কিন্তু ওদের অভিজ্ঞতা থেকে ওরা বুঝল, অস্ত্রগুলো বিদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। যে—বোমাগুলো ফেটেছিল, তা ব্যবহার করার উপযুক্ত শিক্ষা না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। ওই দুর্ঘটনা না ঘটলে যা অস্ত্র ছিল, তা দিয়ে জলপাইগুড়ি শহরের অর্ধেকটা গুঁড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হত।

ঘটনার পর তৃতীয় রাত্রে আবার বোমা ফাটার বিকট শব্দ শুনতে পেয়ে শহরের লোক ভয়ে ঘরের বাইরে এল না। সশস্ত্র পুলিশ, জাতীয় বাহিনীর লোকজন রাত্রেই ছুটে গেল তিস্তার পাড়ে। শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে তারা তিস্তার বুকে আলো ফেলে অবাক হয়ে দেখল, ওপরের বালি ভিজে চপ চপ করছে। সকাল হতেই তিরতিরিয়ে জল উঠে এল ওপরে। শুকনো বালির মরা খাত জলে টলমল করতে লাগল। কোথাও কোনো ধ্বংসস্তূপ নেই। স্থানীয় মানুষ জানাল, ওই শব্দ তিস্তার বুক থেকে উঠে এসেছিল, প্রতি বছর যা হয়।

ভারতে জয়গাঁ আর ভুটানের ফুন্টশোলিং বর্ডার পোস্ট থেকে অনুমতিপত্র নিয়ে সারাদিন ধরে বাসে চেপে রাজধানী থিম্পু বা পারোতে যাওয়া যায়। বিদেশি টুরিস্টরা যাঁরা বিমানে যান না, তাঁরা এই পথেই যাতায়াত করেন। কিন্তু থিম্পু বা পারো নয়, ফুন্টশোলিং ছাড়িয়ে পাহাড়ে ওঠার সময় এমনসব জায়গা দিয়ে যেতে হয় যার প্রচার তেমনভাবে হয়নি। এইরকম একটা জায়গার নাম চাপসা।

নামটা অর্জুন জেনেছিল অমল সোমের চিঠি পড়ে। দীর্ঘদিন অমল সোম বাইরে বাইরে ঘুরছেন। পাহাড় তাঁর প্রিয় জায়গা। মাঝে দু’তিন সপ্তাহের জন্যে জলপাইগুড়ির হাকিমপাড়ার বাড়িতে আসেন। তখন অর্জুনের সঙ্গে দু’বেলা দেখা হয়। অমলদা এখন ভুটানে। হাইওয়ে থেকে এক মাইল ভেতরে যে—বাংলোয় তিনি থাকেন, তার মালিক ভুটানের রাজার পিসি। বৃদ্ধা মহিলা অমলদাকে খুব পছন্দ করেন। তাঁর অনুরোধেই অমলদা এই বছর ওই বাংলোতে আছেন। অমলদা লিখেছিলেন, ‘চলে এসো অর্জুন, জায়গাটা তোমার ভালো লাগবে। রাজার পিসির বাংলো, ঘরের অভাব নেই। কাজের লোক দূরত্ব রেখে সেবার জন্যে তৎপর। এসো, দিনকয়েক থেকে যাও। তবে একটাই শর্ত, সকালে ব্রেকফাস্টের সময় এক ঘণ্টা আর বিকেলে চা পানের সময় ছাড়া আমাকে কথা বলতে বাধ্য করবে না।’

মাকে বলতেই অনুমতি পাওয়া গিয়েছিল। জলপাইগুড়ির কদমতলা থেকে বাসে উঠে বীরপাড়া—হাসিমারা হয়ে সোজা জয়গাঁতে গিয়ে নেমেছিল। জয়গাঁ অবাঙালি ব্যবসায়ীদের জায়গা। বেশ নোংরা। কিন্তু সীমান্তের গেট পেরিয়ে ভেতরে পা দিলেই ফুন্টশোলিং দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। ওখান থেকে নিজের আইডেন্টিটি কার্ড দেখিয়ে ফোটোকপি জমা দিয়ে আবেদন করলে ভুটানে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া যায়। অর্জুন থিম্পু বা ভুটানে বেড়াতে যাচ্ছে না। ভুটানের রাজার পিসির বাংলোয় যাচ্ছে শুনে অফিসাররা সানন্দে অনুমতি দিয়ে দিলেন।

ওখান থেকেই বাসে উঠল অর্জুন। সীমান্তের কাছাকাছি ভারতীয় অঞ্চলের বাজারে ভুটানের টাকা স্বচ্ছন্দে চলে। বেআইনি ব্যাপার হলেও কোনো ব্যবস্থা সরকার নেয় না। বাসের ভাড়া ভারতীয় টাকায় দেওয়া সত্ত্বেও কিছু টাকা অর্জুন ভাঙিয়ে ভুটানি টাকা করে নিয়েছিল।

বাস ছাড়ার আগে অর্জুন জেনে নিয়েছিল, ফুন্টশোলিং থেকে চাপসার দূরত্ব প্রায় আটানব্বই কিলোমিটার। পাহাড়ি পথ। পৌঁছতে অন্তত চার ঘণ্টার একটু বেশি সময় লাগবে। চাপসার আগে পড়বে তিনটে ছোট শহর। গেদু, চুখা, ব্যান্ডেল। এতটা সময় চুপচাপ বসে না থেকে ঘুমিয়ে নেওয়াই ভালো। অর্জুন বাসের যাত্রীদের দিকে তাকাল। বেশিরভাগই ভুটানের মানুষ। তারা বসে আছে চুপচাপ। যত বকবকানি কয়েকজন বাঙালি টুরিস্টের মুখে। থিম্পুতে কী কী বিদেশি জিনিস কিনতে পাওয়া যায়, তাই নিয়ে তিনজন জোরে জোরে আলোচনা করছিল। একজন জল ঢালতে চাইল—’দূর, আমেরিকান বা জাপানি মাল ওখানে পাবি না। যা পাবি তা আসে চিন থেকে। চিনা হুইস্কির চেয়ে ইন্ডিয়ান হুইস্কি অনেক ভালো। চিনের সিগারেট খুব কড়া।’

সঙ্গীদের একজন বলল, ‘তুই তো কখনও ভুটানে আসিসনি—’

‘তাতে কী হয়েছে? যারা গেছে তাদের কাছে শুনেছি।’

অর্জুন চোখ বন্ধ করল।

ব্যান্ডেল পার হতেই শীত শীত অনুভূতি হতেই চোখ খুলল সে। ব্যাগ থেকে জ্যাকেট বের করে পরার পরে আরাম হল। একটু পরে দূরে বরফে ঢাকা পাহাড়ের চুড়োগুলো দেখতে পেল। চাপসায় নেমে পড়ল সে বাস থেকে। বেশ খিদে পেয়েছিল। অমল সোমের কাছে পৌঁছতে এক মাইল হাঁটতে হবে। অর্জুন চারপাশে তাকিয়ে খাবারের দোকানটা দেখতে পেল। ভেতরে ঢুকে জানতে চাইল চিকেন মোমো পাওয়া যাবে কিনা! ভুটানি মহিলা একগাল হেসে বললেন, ‘অবশ্যই যাবে। আর আপনাকে জানিয়ে রাখি, আজ আমার ফার্মের চিকেনই মোমোতে খেতে পারবেন।’

কাঠের চেয়ার টেবিলে আরও কয়েকজন বসে ভাত আর মাংসের ঝোল খাচ্ছিল। একটু দূরত্বে বসে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, রাজার পিসির বাংলোতে কোন রাস্তা দিয়ে যাব?’

মহিলার কপালে ভাঁজ পড়ল। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি সাধু সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন?’

‘সাধু সাহেব? না—না। ওখানে অমলদা আছেন, অমল সোম, উনি আমার গুরু বলতে পারেন।’ অর্জুন বলল।

মহিলা বললেন, ‘ওখানে যিনি আছেন, তিনি তো সাধুর মতো জীবনযাপন করেন। আবার বিকেলে কোট টাই পরে বাংলোর সামনে হাঁটেন। যারা ওই বাংলোতে চাকরি করে তারা বলে, উনি কারওর সঙ্গে কথা বলেন না। খুব জরুরি হলে সকালে আর বিকেলে দেখা করতে পারেন। তাই আমরা ওঁর নাম দিয়েছি সাধু সাহেব।’

অর্জুন বুঝতে পারল, মহিলা অমলদার কথাই বলছেন।

মোমোটা মোটেই সুস্বাদু ছিল না। কিন্তু দাম বেশি নয়। খাওয়ার পর মহিলা যে—পথ দেখিয়ে দিলেন, সেই পথে হাঁটতে শুরু করল অর্জুন।

খানিক বাদে ঘরবাড়ি ছাড়িয়ে জঙ্গুলে পাহাড়ি পথ ধরতে হল। তবে কাঁচা নয়। রাস্তাটা যত্নে পিচ দিয়ে বাঁধানো, যদিও বেশি চওড়া নয়। এখন প্রায় বিকেল। গাছে গাছে প্রচুর পাখি ডাকছে। বাঁ দিকটায় খাদ থাকায় দূরের বরফমাখা পাহাড়গুলো চমৎকার দেখাচ্ছে। শেষসূর্যের রোদে তাদের রূপ যেন আরও খুলে গিয়েছে। অমলদা এরকম জায়গা ছেড়ে জলপাইগুড়িতে কেন থাকতে চাইবেন! বড় বড় পাইন আর দেবদারু গাছের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অর্জুনের মনে হল, ওইসব গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে কেউ তাকে লক্ষ করছে। একটা পাথর তুলে জঙ্গলে ছুড়তেই যে—প্রাণীটিকে এক পলকের জন্যে সে দেখতে পেল, তাকে বাইসন বলেই মনে হল। খুব উঁচুতে নয়, তবু পাহাড় বটেই, এই উচ্চচতায় বাইসন থাকে কিনা তা জানে না অর্জুন।

শেষপর্যন্ত পিচের পথ যেখানে শেষ হয়ে গেল, সেখানে বড় লোহার গেট। গেটের দু’পাশ দিয়ে পাঁচিল চলে গিয়েছে দু’দিকে। ভেতরের দোতলা বাংলোর ছাদ গেটের বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। অর্জুন গেটের গায়ে পৌঁছে দেখল, ভেতর থেকে তালা দেওয়া রয়েছে।

সে শব্দ করার আগেই একজন ভুটানি কর্মচারী ছুটে এল। গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপকা নাম?’

‘অর্জুন’

সঙ্গে সঙ্গে লোকটা কপালে আঙুল ছুঁইয়ে হেসে তালা খুলতে খুলতে বলল, ‘আইয়ে সাব।’

ভেতরে ঢুকল অর্জুন। সুন্দর ফুলের বাগান, সাজানো লন। লোকটা তাকে নিয়ে গেল দোতলার একটি ঘরে। অর্জুন দেখল যে—কোনো দামি হোটেলের ঘরের থেকে কোনো অংশে কম আরামদায়ক নয়। লোকটা বলল, ‘স্যার, ইয়ে আপকো কামরা।’

ব্যাগটা রেখে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘অমল সোম কাঁহা হ্যায়?’

‘আউর দশ মিনিট, দশ মিনিট বাদ সাবকো টি টাইম হোগা। আপ ফ্রেশ হোকে নীচে আ যাইয়ে।’ লোকটা চলে গেল।

বাথরুমের আয়তন শোয়ার ঘরের মতনই। গিজার থাকা সত্ত্বেও এই অবেলায় স্নানের ঝুঁকি নিল না অর্জুন। একটু তাজা হয়ে নীচে নামল সে। একটা বিশাল কুকুরকে চেনে বেঁধে আর একটি লোক হাঁটছিল লনে। অর্জুনকে দেখে কুকুরটা এত দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল যে মনে হল, বাঁধা না থাকলে ওটা ঠিক ঝাঁপিয়ে পড়ত। ওর পালক ওকে বেশ জোরে ধমক দিল। তারপর ভুটানি ভাষায় বেশ কিছু কথা বলল। কুকুরটার দাঁত দেখা গিয়েছিল। শোনার পর মুখ বন্ধ হল। এবার লোকটি কুকুর নিয়ে অর্জুনের দিকে এগিয়ে গেল। অর্জুন প্রতিবাদ করল, ‘আরে, কী করছ তুমি। এনো না ওকে।’

পিছন থেকে অমল সোমের গলা ভেসে এল— ‘আরে, তোমার ঘ্রাণ ওকে নিতে দাও। ওটা নেওয়ার পর তোমাকে আর শত্রু ভাববে না।’

শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অর্জুন। চেনে বাঁধা বিশাল কুকুরটা তার চারপাশে ঘুরে শরীরে নাক ঠেকিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে লোকটার কাছে লনের দিকে চলে গেলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল অর্জুন। সে অমল সোমের দিকে তাকাল।

পরনের পোশাক পরিপাটি। কোটের তলায় হাফ স্লিভ সোয়েটার, হাতে ছড়ি। বললেন, ‘তুমি নিশ্চয়ই একটু পরিশ্রান্ত?’

‘না। তেমন নয়। এতক্ষণ তো বাসে বসে ঘুমাচ্ছিলাম।’ অর্জুন বলল।

‘সে কী? তুমি বাসে বসে ঘুমাও নাকি? তাহলে দু’পাশের জায়গাগুলো, গাছপালাকে তো দেখতে পাবে না। বাসের ভেতরের অন্য যাত্রীরা কে কেমন বিহেভ করছে, তাও অজানা থেকে যাবে। তাই না?’

‘হ্যাঁ, অমলদা, আপনি ঠিকই বলেছেন।’ অর্জুন স্বীকার করল।

‘তোমার ঘর পছন্দ হয়েছে?’ অমল সোম এগিয়ে এলেন।

‘হ্যাঁ। খুব ভালো ব্যবস্থা।’

‘মিসেস দোরজির বয়স এখন পঁচাশি। বিয়ে করেননি। রাজার পিসিমা বলে প্রচুর সম্পত্তির মালিক। কিন্তু নরম মনের মানুষ। ওঁর অনেকগুলো বাংলোর মধ্যে এটি একটি। এখানে আমি আছি বলে উনি খুব খুশি কিন্তু আমাকে একেবারেই বিরক্ত করেন না। সমস্যা সেখানেই।’

‘কীরকম?’

‘এতবড় বাংলোর ভাড়া কত হবে জানি না কিন্তু আমি আমার সাধ্যমতো যদি দিতে চাই, তাহলে তিনি অপমানিত বোধ করবেন। এই বাংলোর কর্মচারীদের মাইনে, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ —সব স্টেট থেকে আসে। আমি জোর করে আমার খাওয়ার খরচ দিই। আমাকে ভদ্রমহিলা খুব পছন্দ করেন। মুসৌরিতে প্রথম আলাপ হয়েছিল। কিন্তু এখানে আছি বলে মাঝে মাঝে এমন কিছু অনুরোধ করেন যে না বলতে পারি না। ওঁকে কী করে বোঝাই, পুরনো জীবন থেকে আমি সরে এসেছি!’ অমল সোম বললেন।

কৌতূহল হল, অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘কীরকম অনুরোধ?’

ঘড়ি দেখলেন অমল সোম। বললেন, ‘ভদ্রলোক যদি সময়ের দাম বোঝেন তাহলে কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁর দর্শন আমরা পাব। ইনি প্রবীণা রাজকুমারীর সূত্রে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছেন।’ অমল সোম কথা শেষ করতেই গেটের বাইরে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা গেল। যে—লোকটি অর্জুনের বেলায় দরজা খুলেছিল, সে দৌড়ে গিয়ে প্রশ্ন করে তালা খুলল। অর্জুন বুঝতে পারল, কে কখন দেখা করতে আসবে তার লিস্ট লোকটির কাছে আছে।

গাড়ি বাইরে রেখেই যে—ভদ্রলোক ভেতরে ঢুকলেন, তাঁর পরনে ভুটানি পোশাক। মাথায় ভুটানি টুপি। যে দরজা খুলেছিল, তাকে জিজ্ঞাসা করে ভদ্রলোক অর্জুনদের দিকে এগিয়ে এসে পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, ‘গুড আফটার নুন। আমি থিম্পু থেকে আসছি। আমার নাম লেনডুপ।’

‘গুড আফটার নুন। আমি অমল সোম আর ইনি আমার তরুণ বন্ধু অর্জুন।’ হাত বাড়িয়ে দিলেন অমল সোম। করমর্দন শেষ করে অর্জুনের সঙ্গে হাত মেলালেন ভদ্রলোক।

‘ঠিক সময়ে এসেছেন বলে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আসুন, আমরা চায়ের টেবিলে বসে কথা বলি।’ অমল সোম বাংলোর ভেতরে পা বাড়ালে ওঁরা তাঁকে অনুসরণ করলেন। বাংলোর নীচতলার একদিকে সুন্দর বসার ব্যবস্থা, অন্যদিকে বিরাট ডাইনিং টেবিল, চেয়ার। সেখানে ইতিমধ্যে খাদ্যবস্তু সাজিয়ে অপেক্ষা করছে দু’জন বেয়ারা। তাদের সাদা পোশাকে এক ফোঁটা ময়লা নেই।

চিকেন স্যান্ডউইচ চিবোতে চিবোতে লেনডুপ বললেন, ‘আমি খুব সমস্যায় রয়েছি। রাজার পিসি। মানে, প্রিন্সেসের সঙ্গে আমার মায়ের যোগাযোগ ছিল। ওঁরা দু’জন একসময় ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করেছিলেন। মায়ের কাছে শোনার পর প্রিন্সেস পরামর্শ দেন আপনার সঙ্গে দেখা করতে। আমাদের সৌভাগ্য যে আপনি এই সময় ভুটানে আছেন। আমি অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি।

অর্জুন লক্ষ করছিল, ভদ্রলোকের ইংরেজি উচ্চচারণ প্রায় বিদেশিদের মতো। অমল সোম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ‘প্রিন্সেস বোধ হয় জানেন না যে, আমি ওই প্রফেশন থেকে অবসর নিয়েছি। তাছাড়া আপনি ভুটানের মানুষ, আমি এখানে বিদেশি। আপনার সমস্যার গভীরতা আমার পক্ষে কি জানা সম্ভব?’

লেনডুপ বললেন, ‘মিস্টার সোম, আমি কি সমস্যার কথা বলতে পারি?’

অমল সোম মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেন।

‘আমি ব্যবসা করি। ছাত্রাবস্থা কেটেছে বস্টন শহরে। এখন ব্যবসার জায়গা থিম্পু আর নিউ ইয়র্ক। গত সাত—আট বছর ধরেই আমাকে এই কারণে ঘন ঘন বিদেশে যেতে হয়। আমার স্ত্রী অত্যন্ত বিদুষী কিন্তু একটু বেশি পুত্রস্নেহে কাতর। আমি চেয়েছিলাম, ছেলেকে ইংল্যান্ড বা আমেরিকায় পড়াতে। কিন্তু দেরাদুনে স্কুল শেষ করার পর ওর মা ওকে অতদূরে পাঠাতে চাইল না। ছেলে তখন আবদার করল, সে বেজিংয়ে গিয়ে পড়াশুনা করবে। হয়তো দূরত্ব কম বলে ওর মা রাজি হল। ছেলে বেজিং থেকে মাস্টার্স করলে আমি ওকে ব্যবসায় আসতে বললাম। কিন্তু সে রাজি হল না।’ আপশোসে মাথা নাড়লেন লেনডুপ।

‘ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক। পড়াশুনা করার পর ছেলে— মেয়েরা বাবার ব্যবসায় যেতে চায় না।’ অমল সোম বললেন, ‘তারপর?’

‘ইদানীং আমাকে একটু বেশি বাইরে থাকতে হচ্ছিল। থিম্পুতে এলে ছেলেকে দেখতে না পেয়ে যখন স্ত্রীকে ওর কথা জিজ্ঞাসা করতাম, তখন শুনতাম হয় পারোতে বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছে, নয় তো দিল্লিতে চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছে। মোটকথা, গত ছয় মাস আমি ছেলেকে দেখতে পাইনি।’

‘এখন তো সবাই মোবাইল  ফোন ব্যবহার করে। আপনার ছেলের কাছে নিশ্চয়ই দামি মোবাইল ফোন রয়েছে।  ফোনে কথা বলেছেন?’

‘করেছি। কিন্তু তার ফোন সবসময় সুইচ অফ করা থাকে।’

‘আপনার ছেলেই কি সমস্যার কারণ?’ অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হ্যাঁ।’ লেনডুপ দু’বার মাথা ওপর—নীচ করলেন— ‘আমি জানতাম না সে গত ছয় মাস ধরে বাড়িতে নেই।’ আমাকে খবরটা বলাই হয়নি।’

‘আপনার স্ত্রী তো জানতেন।’

‘হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু বললে আমাকে ডিসটার্ব করা হবে, আমি রেগে যেতে পারি, এই ভয়ে ওর মা ব্যাপারটা একদম লুকিয়ে রেখেছিল।’ লেনডুপ বললেন।

‘ছেলের খোঁজ পেয়েছেন?’

‘না।’

‘কেউ বা কোনো দল কি ওকে কিডন্যাপ করতে পারে?’

‘জানি না। তবে ছয় মাস ধরে সে নিখোঁজ, তাকে যদি কিডন্যাপ করা হয়, তাহলে কি কিডন্যাপাররা এতটা সময় মুখ বন্ধ করে থাকবে? তারা অবশ্যই আমার কাছে টাকা চাইবে। খামোকা ছেলের থাকা—খাওয়ার জন্যে খরচ করবে কেন? ছয় মাস লুকিয়ে রাখার তো কোনো যুক্তি নেই।’ লেনডুপ অমল সোমের দিকে তাকালেন।

‘পুলিশকে জানিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ। কিছুদিন আগে ওর মা যখন আর লুকোতে না পেরে আমাকে সত্যি কথা বলল, তখন প্রথমেই পুলিশকে জানিয়েছি।’

‘পুলিশ কিছু জানিয়েছে?’

‘না। ওর ছবি প্রতিটি থানায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওর মতো বয়সের কোনো মৃতদেহ গত ছয়মাসে কোথাও পাওয়া যায়নি। তাই পুলিশ এটাকে মার্ডার কেস হিসেবে না দেখে মিসিং কেস বলে ভেবে নিয়েছে। আপনি যদি এই ছেলের সন্ধান নিতে রাজি থাকেন!’

হাত তুলে লেনডুপকে থামালেন অমল সোম—’আপনাকে আমি প্রথমেই বলেছি, আমার সম্পর্কে আপনি কী শুনেছেন জানি না। কিন্তু আমি একদম অবসর নিয়েছি। আমাকে মার্জনা করবেন। প্রিন্সেসকে আমি আমার অক্ষমতার কথা জানিয়ে দেব। তবে—’ একটু থামলেন অমল সোম—’তবে আমার এই তরুণ বন্ধু অর্জুন এখন সত্যান্বেষণে খুব দক্ষ হয়েছে। শুধু দেশ নয়, বিদেশে গিয়েও ও এই কাজে সফল হয়েছে। ওর যদি আগ্রহ থাকে আর আপনি যদি ওকে দায়িত্ব দেন, তাহলে কাজটা হতে পারে।’

অর্জুনের দিকে তাকালেন লেনডুপ— ‘আপনি কোথায় থাকেন?’

‘জলপাইগুড়ি শহরে।’ অরুন বলল,

‘জলপাইগুড়ি? কলকাতায় নয়?’ অবাক হলেন ভদ্রলোক।

‘না। জলপাইগুড়ি শহরেই আমার জন্ম, পড়াশুনা। ওখানেই অমলদার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। যা কিছু শিখেছি তা ওঁর কাছেই শেখা।’ অর্জুন বলল।

‘আচ্ছা!’ একটু ভাবলেন লেনডুপ— ‘ঠিক আছে। মিস্টার সোম যখন বলছেন, তখন আমার আপত্তি নেই। ছেলেকে খুঁজে বের করতে যা যা সাহায্য করার তা আমি করব। আপনি কাজ শুরু করুন।’

এতক্ষণ অর্জুন চুপচাপ দু’জনের কথা শুনছিল। অমল সোম যে তার কথা মিস্টার লেনডুপকে বলবেন সে অনুমান করতে পারেনি। থিম্পু বিদেশি একটি রাষ্ট্রের রাজধানী। কখনও যায়নি সে থিম্পুতে। সেই শহরের একটি যুবক গত ছয় মাস ধরে বাড়িতে নেই, তাকে খুঁজে বের করতে হবে। কী করে সেটা সম্ভব, এটা তো প্রায় খড়ের গাদা থেকে সুচ খুঁজে বের করা।

অর্জুন বলল, ‘দেখুন, আমি ওখানে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। ভুটান আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র। কিন্তু খুব অল্প তথ্য আমার জানা আছে। আপনার ছেলে সম্পর্কেও আমি কিছুই জানি না। তাই আমার মনে হয়, আপনাদের এখন পুলিশের ওপর নির্ভর করলেই ভালো হবে।’

কাঁধ নাচালেন লেনডুপ। তারপর ম্লান হাসলেন— ‘মিস্টার সোম, আমি আপনার কথা অনেক শুনেছিলাম। ভুটানে পুলিশের বাইরে কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা নেই, যাঁরা সত্য খুঁজে বের করতে সাহায্য করে থাকেন। আপনি এসেছেন জেনে আমার মা প্রিন্সেসের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, আমি খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম।’ ভদ্রলোক মাথা নিচু করলেন।

‘এত হতাশ হবেন না মিস্টার লেনডুপ। অর্জুন ওর অজ্ঞতার কথা বলল, এটা মিথ্যে নয়। তবে অর্জুন, তুমি একবার থিম্পু শহরে যেতে পার। ছেলেটির বাড়ি, ওর বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পার।’ অমল সোম বললেন।

অর্জুন তাকাল— ‘ঠিক আছে।’

অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার ছেলে বেজিংয়ে পড়াশুনা করতে গিয়েছিল। সে কি তার পরেও চিনে গিয়েছে?’

‘হ্যাঁ, একবার গিয়েছিল। বলেছিল, পুরনো সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। তবে ওর পাসপোর্টে যে—ভিসার স্ট্যাম্প ছিল, তার মেয়াদ শেষ হতে আরও চার বছর দেরি আছে।’ লেনডুপ বললেন।

‘তাহলে তো সে ছয় মাস আগে, আপনি যখন বিদেশে ছিলেন, তখন চিনে চলে যেতে পারে। সেখানে ওর যেসব বন্ধু রয়েছে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন?’ অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হ্যাঁ, তাদের একজনের  ফোন নাম্বার ওর ঘরে রাখা একটা ডায়েরিতে পেয়েছিলাম। কিন্তু যতবার ফোন করেছি, কথা বলতে পারিনি। ফোন বন্ধ নয় কিন্তু কোনো শব্দই হয়নি।’ লেনডুপ বললেন।

সন্ধে এখানে ঝুপঝাপ নেমে পড়ে। বেয়ারারা এসে ঘরে আলো জ্বেলে দিয়ে গেল। লেনডুপ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মিস্টার অর্জুন কি এখন আমার সঙ্গে থিম্পু যেতে পারবেন?’

অমল সোম বললেন, ‘একী! আপনি এখন যাবেন নাকি! অন্ধকারে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালানো নিরাপদ নয় বলে জানতাম!’

‘আমরা অভ্যস্ত মিস্টার সোম। তাহলে কাল সকাল ন’টায় এখানে গাড়ি চলে আসবে। আপনি যদি তৈরি থাকেন তাহলে ভালো হয়।’ উঠে দাঁড়ালেন মিস্টার লেনডুপ— ‘আমি জানি না, আপনি কীরকম পারিশ্রমিক নেন। ও ব্যাপারে কোনো অসুবিধে হবে না। আচ্ছা, এখন আমি চলি।’

ঘড়ি দেখলেন অমল সোম। তারপর উঠে হাতে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘অর্জুন, ওঁকে এগিয়ে দিয়ে এসো আর হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে কাল সকালে আবার কথা হবে। তুমি টিভি দেখতে পার, বই পড়তে চাইলে তাও পাবে। খেয়ে—দেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়। আমি চললাম।’

‘কোথায় যাচ্ছেন?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

‘ধ্যানে বসব।’

মিস্টার লেনডুপকে গেটের বাইরে রাখা গাড়িতে তুলে দিল অর্জুন। গাড়ি বেরিয়ে গেলে সে অন্ধকারে চারপাশে তাকাচ্ছিল। এই সময় পেছন থেকে দরজা—খোলা লোকটা এগিয়ে এসে বলল, এখানে এখন দাঁড়িয়ে থাকবেন না সাহেব। ভেতরে আসুন, গেট বন্ধ করে দিতে হবে।’

অর্জুন বলল, ‘কেন এখানে দাঁড়াতে নিষেধ করছ?’

‘সাহেব, এই জঙ্গলের ভয়ংকর জানোয়াররা অন্ধকারে বেরিয়ে আসে। আসুন আসুন সাহেব।’ লোকটা এমন ব্যস্ত হল যে, অর্জুন ভেতরে চলে এল। সে যখন দরজা বন্ধ করছিল, তখন অর্জুনের মনে পড়ল, সে যখন এই বাংলোয় আসার জন্যে জঙ্গলের পথে হাঁটছিল, তখন একটা প্রাণীকে গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল।

রাতটা ভালোই কাটল। মাঝে একবার ঘুম ভেঙেছিল। তখন আশপাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসা অদ্ভুত শব্দগুলো কানে এসেছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, এই জঙ্গলের প্রাণীরা রাত্রে সক্রিয় হয়।

অর্জুন সকালে যখন অমল সোমের সঙ্গে চায়ের টেবিলে, তখনই অমল সোমের মোবাইল বেজে উঠল। ‘হ্যালো’ বলে তিনি মোবাইল কানে চেপে কিছুক্ষণ শোনার পর বললেন, ‘মাই গড! চারজন মারা গিয়েছে?’ ওদিক থেকে আরও খবর জানানোর পর অমল সোম বললেন, ‘অর্জুন, খুব খারাপ খবর শুনলাম।’

‘কী খবর?’

‘কাল রাত্রে তিস্তার চরের পাশে বাতিল বাড়িতে ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয়েছে। চার—চারটে তাজা ছেলে মারা গিয়েছে।’

‘তিস্তার কোন চরে?’

‘হাকিমপাড়া থেকে সেনপাড়ায় যাওয়ার পথে কি কোনো ইমকমপ্লিট বাড়ি ছিল?’ অমল সোম জিজ্ঞাসা করলেন।

অর্জুনের মনে পড়ল। ঠিক সেনপাড়ার শেষে তিস্তা ব্রিজের কাছাকাছি ওইরকম বাড়ি তো ছিলই। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘বিস্ফোরণ কেন হয়েছিল?’ উগ্রপন্থীদের কাজ নাকি?’

অমল সোম বললেন, ‘জলপাইগুড়ির মতো নিরীহ শহরে উগ্রপন্থীরা কোন কারণে বোমা ফাটাবে তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। এটা একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু যে—চারজন মারা গিয়েছে তারা ওখানে কেন ছিল, তা নিশ্চয়ই পুলিশ খুঁজে বের করবে।’

‘এই চারজনের পরিচয় জানা গিয়েছে?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

‘শুনলাম, আইডেন্টিফাই করা যায়নি।’ অমল সোম বললেন, ‘এখান থেকে থিম্পু বেশি দূর নয়। রাস্তাটা দুটো ভাগ হয়ে যাবে। একটা থিম্পুর দিকে, অন্যটা পারো শহরে শেষ হবে। রাজার পিসিমার রেফারেন্সে এসেছেন মিস্টার লেনডুপ। তাই যাও। যদি মনে হয় কেসটা ইন্টারেস্টিং, তাহলে কাজ শুরু করো। নাহলে আজ বিকেলে ফিরে এসো। যা হোক, যা করবে তা আমাকে জানিও। কিছু বলবে?

অর্জুন হাসল— ‘না। একটা নতুন জায়গা দেখা হবে, সেটা আবার দেশের রাজধানী, এটাও তো কম কথা নয়।’

ঘরে ফিরে তৈরি হল সে। ব্যাগটা সঙ্গে নিতে হবে, কারণ যদি থেকে যেতে হয় ওখানে, তাহলে দরকার হবে। কিন্তু মাথার ভেতর থেকে কিছুতেই অমল সোমের কাছে আসা খবরটা মুছে যাচ্ছিল না। আজ অবধি জলপাইগুড়ি শহরে বিস্ফোরণে চারজন মারা গিয়েছে বলে সে শোনেনি। এসব ব্যাপার বীরভূম বা মালদায় প্রায়ই হয়ে থাকে। কাগজে তার খবর বের হয়। সীমান্ত পেরিয়ে প্রচুর উগ্রপন্থী ভারতবর্ষে ঢুকে পড়েছে। তাদের কেউ কেউ বোমা তৈরি করতে গিয়ে ভয়ংকর দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে। অবশ্য রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও পরস্পরকে আক্রমণ করার জন্যে গোপনে বোমা তৈরি করতে গিয়ে আহত বা নিহত হয়েছে। এই খবর কাগজেই বেরিয়েছে। কিন্তু জলপাইগুড়ি শহরে এরকম কাণ্ড কী করে হল?

হ্যাঁ, জলপাইগুড়ি শহর থেকে দেশের সীমান্ত বেশি দূরে নয়। উগ্রপন্থীরা চাইলেই ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে লুকিয়ে চলে আসতে পারে। কিন্তু আজ অবধি সেরকম ঘটনা ঘটেনি। অর্জুনের খেয়াল হল, কাল এখানে আসার পরে মাকে  ফোন করা হয়নি। মায়ের সঙ্গে কথা বললে নিশ্চয়ই অনেক খবর জানা যাবে। ইদানীং মা সব খবর খুঁটিয়ে জেনে নিচ্ছেন। কিন্তু মোবাইল বের করে অর্জুন বুঝতে পারল, তার সিম কার্ড এখানে কাজ করবে না। হাজার হোক এটা বিদেশ। অমল সোম নিশ্চয়ই তাঁর ফোন রোমিং করে রেখেছেন, তাই অসুবিধে হয়নি।

কাঁটায় কাঁটায় ন’টার সময় মিস্টার লেনডুপের পাঠানো গাড়ি চলে এল। এই সময় অমল সোমকে বিরক্ত করা চলবে না। স্থানীয় মানুষরা ওঁর যে—নামকরণ করেছে তা একদম সঠিক।

গাড়ি চালাচ্ছিল যে তার বয়স পঁচিশের বেশি নয়। হিন্দি এবং ভাঙা ইংরেজি বলতে পারে। নাম বলল, ‘জিগমে’। বলে শব্দ করে হাসল। মাথা নেড়ে গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, ‘এই নাম যার সে হয় রাজা নয় মন্ত্রী হয়, ড্রাইভারি করে না। আমি করি।’

বেশ হাসিখুশি ছেলে, মুখটাও মিষ্টি। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি ইন্ডিয়ার কোন শহরে গিয়েছ?’

‘জয়গাঁ বহুৎ খারাপ জায়গা।’

‘কেন?’

‘আমার পকেট থেকে মোবাইল চুরি করেছিল?’

‘এরকম তো সব শহরেই হয়।’

‘তা হয়—’ স্টিয়ারিংয়ে আঙুল ঠুকল জিগমে— ‘আপনি থিম্পুতে যতদিন থাকবেন, ততদিন আমার গাড়িতে ঘুরবেন। সাহেব বলেছেন।’

‘বাঃ, খুব ভালো। তুমি লেনডুপ সাহেবকে কতদিন চেনো?’

‘পাঁচ বছর। আমি পড়াশুনা করলে সাহেব আমাকে বড় চাকরি দিতেন। আমেরিকাতে যেতে পারতাম।’ জিগমে বলে যাচ্ছিল।

‘সাহেবের ছেলেকে তুমি নিশ্চয়ই চেনো!’

‘হ্যাঁ। কিন্তু ওর কথা বলবেন না।’ গম্ভীর হল জিগমে।

‘কেন?’

‘ওর বাবা কত ভালোমানুষ, আমার মতো সামান্য ড্রাইভারকেও সম্মান করে কথা বলেন আর ছেলে আমাদের মানুষ বলেই মনে করে না। বলে, আমরা নাকি ক্রীতদাস। মেরুদণ্ড নেই।’ মুখ বেঁকাল জিগমে।

সোজা হয়ে বসল অর্জুন— ‘একথা বলার কারণ কী?’

‘আমাদের দেশের প্রধান হলেন রাজা। যুগ যুগ ধরে আমরা তাঁর প্রজা হয়ে আছি। এই রাজাকে মেনে তো আমরা খুব কষ্টে নেই। যেসব দেশে রাজা নেই, পাবলিক প্রধানমন্ত্রীকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে, সেই দেশগুলোতে হাঙ্গামা লেগেই আছে। ঠিক কিনা বলুন সাহেব! রাজাকে সম্মান করলে আমরা কেন ক্রীতদাস হয়ে যাব?’ কথাগুলো বলার সময় জিগমের মুখ—চোখ বেশ সিরিয়াস হয়ে উঠল।

‘তুমি ঠিক কথা বলছ।’ অর্জুন বলল।

‘থ্যাংক ইউ সাহেব।’

‘তোমার সাহেবের এই ছেলের বন্ধুদের চেনো?’

‘না। চিনব কী করে? মনে হয় থিম্পুতে ওর কোনো বন্ধু নেই। ওর সব বন্ধু চিনে থাকে।’

‘চিনে?’

‘হ্যাঁ, বেজিং শহরে।’

‘তুমি কী করে জানলে?’

‘ও ওই শহরে কয়েক বছর পড়াশুনার জন্যে ছিল। আট—নয় মাস আগে ওর তিনজন বন্ধু বেজিং থেকে ভুটানে বেড়াতে এসেছিল। তিনজনেই চিনা।’

‘বন্ধুরা তো আসতেই পারে। তখন মিস্টার লেনডুপ থিম্পুতে ছিলেন?’

‘না। সাহেব তখন আমেরিকায় ব্যবসার জন্যে গিয়েছিলেন।’

‘মিস্টার লেনডুপের ছেলে কি বন্ধুদের বাড়িতে রেখেছিল?’

‘না স্যার। ওরা হোটেল হিমালয়ে উঠেছিল।’

‘তুমি ওদের নিয়ে গাড়িতে ঘুরেছ?’

‘নাঃ। এলভিস নিজেই গাড়ি চালাত।’

‘এলভিস কে?’

হাসল জিগমে— ‘সাহেবের ছেলের ভুটানি নাম থাকলেও সে নিজের নাম এলভিস বলতেই পছন্দ করে।’ মাথা দুলিয়ে স্টিয়ারিংয়ে তবলা বাজাল সে, ‘এলভিস প্রিসলি।’

রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে গেল। একটা পথ গিয়েছে পারো শহরে। ওরা থিম্পুর পথ ধরল। বরফে মোড়া পাহাড়ের চুড়োগুলো এখন বেশ কাছে। ঠান্ডাও বাড়ছে একটু একটু করে।

থিম্পু শহরে ঢুকল গাড়ি। সুন্দর সাজানো শহর। অর্জুন একটু অবাক হল। একটা রাস্তার মোড়ে গাড়ি থামলে সে দেখতে পেল কোনো ট্রাফিক লাইট নেই। পুলিশ হাত দেখিয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল করছে। কোনো দেশের রাজধানীতে এই ব্যবস্থা মানে ট্রাফিকের চাপ কম।

গাড়ি থামল হোটেল হিমালয়ের সামনে। জিগমে বলল, ‘সাহেব আপনার থাকার ব্যবস্থা এখানেই করেছেন।’ বলল, ‘সুটকেসটা দিন।’

তিনতারা হোটেল হলেও বেশ কেতাদুরস্ত। রিসেপশনিস্ট বলল, ‘আপনি নিশ্চয়ই স্মোক করেন না?’

‘না।’

‘ভালো হল। আমাদের দুটো স্মোকিং রুম আছে কিন্তু সে দুটো অলরেডি অকুপায়েড। আপনার জন্যে মিস্টার লেনডূপের অনুরাধে হোটেলের সবচেয়ে ভালো ঘরের একটা রাখা হয়েছে।’

লোকটা উর্দি পরা বেয়ারাকে ইশারা করলে সে এগিয়ে এসে জিগমের হাত থেকে স্যুটকেস নিয়ে ইশারা করল অনুসরণ করতে। জিগমে বলল, ‘স্যার, আমি সাহেবের বাড়িতে যাচ্ছি। তা—ই অর্ডার আছে।’

তিনতারা হোটেলের ঘর যেমন হয় তার চেয়ে বোধ হয় একটু ভালো। বাথরুম তো বেশ বড়। ঠান্ডা যা তাতে এসি মেশিন চালু করার দরকার নেই। একটা ব্যালকনি আছে। সেখানে দাঁড়িয়ে অর্জুন শহরের অনেকটা দেখতে পেল।

বেয়ারা জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কি ঘরে লাঞ্চ করবেন স্যার?

‘রেস্টুর্যান্ট আছে তো, সেখানেই যাব। লাঞ্চ টাইম কখন?

‘শুরু হয়ে গিয়েছে। আড়াইটের মধ্যে যাবেন স্যার।’

‘ঠিক আছে। আপনি এই হোটেলে কতদিন কাজ করছেন?’

‘তিন বছর। আমি আগে দিল্লির হোটেলে কাজ করেছি।’

‘ঠিক আছে।’ অর্জুন বলামাত্র ঘরের  টেলিফোন বেজে উঠল।

সে এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলে সাড়া দিতেই মিস্টার লেনডুপের গলা শুনতে পেল— ‘গুড আফটারনুন মিস্টার অর্জুন। থিম্পুতে আসার জন্যে ধন্যবাদ। আশা করি কোনো অসুবিধে হয়নি।’

‘একটুও না।’

‘আপনি কতক্ষণ সময় নেবেন তৈরি হতে?’

‘আমি চাপসা থেকে তৈরি হয়েই বেরিয়েছি।’

‘ও গুড!’ মিস্টার লেনডুপ বললেন, ‘আজ যদি আমাদের বাড়িতে আপনি লাঞ্চ করেন তাহলে খুব খুশি হব। আমার স্ত্রীও চাইছেন!’

‘নিশ্চয়ই।’

‘তাহলে আমি জিমেকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। শুনলাম, ওর সঙ্গে আপনার অনেক কথা হয়েছে। বেশি বলে কিন্তু ছেলেটা ভালো।’

জিগমে মিনিট কুড়ির মধ্যে অর্জুনকে মিস্টার লেনডুপের বাড়িতে পৌঁছে দিল। গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির দিকে তাকিয়ে অর্জুন বুঝতে পারল, মিস্টার লেনডুপ শুধু ধনী মানুষ নন, তাঁর রুচিরও প্রশংসা করতে হয়।

মিস্টার লেনডুপ অপেক্ষা করছিলেন। অর্জুনকে অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, ‘আমরা একেবারে খাওয়ার টেবিলে চলে যাই। ঠিক সময়ে না খেলে আমার স্ত্রীর অ্যাসিডিটি হয়ে যায়।’

মাথা নাড়াল অর্জুন। ভদ্রলোক যে প্রচুর বড়লোক তা চারপাশের আসবাব দেখলেই বোঝা যায়। খাওয়ার ঘরের মাঝখানে তিনটে টেবিল। জোড়া দিলে তিরিশজন মানুষ আরামসে খেতে পারে।

একদম শেষের টেবিলে অর্জুনকে নিয়ে যেতেই মিসেস লেনডুপ ঘরে ঢুকলেন। মধ্যবয়সিনী মহিলা অত্যন্ত সুন্দরী কিন্তু অর্জুন অবাক হয়ে দেখল, ওঁর মুখে মঙ্গোলিয়ান ছাপ নেই। হাত জোড় করে বললেন, ‘নমস্কার, আপনি এসেছেন তাই আমি খুশি হয়েছি।’

পরিষ্কার বাংলায় কথাগুলো বললেন ভদ্রমহিলা।

মিস্টার লেনডুপ বললেন, ‘আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে, আপনি অবাক হচ্ছেন। হ্যাঁ, আমার স্ত্রী বাঙালি।’

মিসেস লেনডুপ বললেন, ‘বসুন।’

তিনজনে বসার পরে মিস্টার লেনডুপ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘লাঞ্চের আগে আপনি কি কোনো হার্ড ড্রিংক নেবেন?’

‘না।’ মাথা নাড়ল অর্জুন।

মিসেস লেনডুপ বললেন, ‘উনি জেমস বন্ড নন, ওঁর লাইটার রহস্য সমাধানের গল্প আমি পড়েছি। আমেরিকাতে গিয়েও ড্রিংক করেননি।’

খাওয়া আরম্ভ হল। মিস্টার লেনডুপ স্ত্রীকে বললেন, ‘তুমিই বলো।’

ছোট টুকরো করে খাবার মুখে তুলছিলেন মিসেস লেনডুপ। বললেন, ‘আমার ছেলের ব্যাপারটা তো আপনি শুনেছেন। আমি যদি স্নেহে অত কাতর না হয়ে যেতাম, তাহলে ও এত বেপরোয়া হতে পারত না। দোষ আমারই।’

বলতে বলতে গলা ধরে এল মিসেস লেনডুপের। মিস্টার লেনডুপ একটা পেপার ন্যাপকিন এগিয়ে দিলেন।

তিরিশ সেকেন্ড পরে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘এলভিস কোথায় যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন? কোনো ধারণা আছে?’

‘না। বিন্দুমাত্র না। সে এখানকার কোনো ছেলের সঙ্গে মিশত না। তবে কিছু না বলে বাড়ি থেকে চলে গিয়ে যখন ফিরে আসত, তখন জিজ্ঞাসা করলে বলত, ইন্ডিয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলাম।’ মিসেস লেনডুপ শ্বাস ফেললেন।

‘ওর চেহারায় কি আপনার আদল বেশি?’

মিস্টার লেনডুপ জবাব দিলেন, ‘চোখ আমার মতো, পাহাড়ের মানুষদের যেমন হয় কিন্তু মুখ বিশেষ করে, নাক ওর মায়ের মতো। আমি ওর ছবি আপনাকে দেব।’

অর্জুন বলল, ‘ওর পাসপোর্ট কি বাড়িতেই আছে?’

‘না।’ মিসেস লেনডুপ মাথা নাড়লেন—’পাসপোর্ট নিয়ে গেছে।’

‘ইন্ডিয়ায় যেতে পাসপোর্ট—ভিসার দরকার হয় না। ও তো বেজিংয়ে পড়াশুনা করেছে। সেখানে চলে যায়নি তো?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

মিস্টার লেনডুপ বললেন, ‘যতদূর জানি, ওর স্টুডেন্ট ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর এখন চিনা সরকার টুরিস্টদের নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ভিসা ইস্যু করে। মায়ের সঙ্গে ব্যাঙ্কে একটা জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েছিলাম। সেই অ্যাকাউন্টের প্রায় সব টাকা সে তুলে নিয়ে গেছে।’

‘কত টাকা?’

‘আঠাশ লক্ষ টাকা।’

হকচকিয়ে গেল অর্জুন। এত টাকা নিয়ে ওই অল্পবয়সি ছেলে কোথায় যেতে পারে? সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কি জানেন, ওর কোনো বান্ধবী আছে কিনা? থিম্পুতে না থাক, চিন বা ভারতে?’

মাথা নাড়লেন মিসেস লেনডুপ— ‘না। আমি ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে পছন্দ করে না এলভিস। আমি জানি।’

খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। হাত—মুখ ধোয়ার পর অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘এলভিস নিশ্চয়ই এই বাড়িতেই থাকত?’

মিসেস লেনডুপ একটু প্রতিবাদের স্বরে বললেন, ‘থাকত বলছেন কেন? যে—কোনো মুহূর্তে ফিরে এলে সে এই বাড়িতেই থাকবে। এটা তো ওর নিজের বাড়ি।’

‘আই অ্যাম সরি!’ অর্জুন বিব্রত হল— ‘আমি কিছু না ভেবে বলেছি। এলভিসের ঘরে আমরা যেতে পারি?’

‘মুশকিলে ফেললেন।’ মিস্টার লেনডুপ বললেন।

‘কী রকম?’

‘সে চলে যাওয়ার সময় তার ঘরের দরজা লক করে গেছে। চাবি ওর কাছেই আছে। এই কয়মাস ঘর বন্ধ হয়েছে।’

‘সে কী! আপনারাও ওটা বন্ধ রেখেছেন?’

মিসেস লেনডুপ বললেন, ‘ওর ঘর খুললে রেগে যেতে পারে ভেবে খুলিনি। ছেলেবেলায় ওকে শিখিয়েছিলাম, অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপারে কৌতূহল দেখাবে না।’

‘ঠিক আছে। এমন তো হতে পারে, ওই ঘরে খোঁজ করলে জানতে পারতেন সে কোথায় গেছে! তাহলে এত দুশ্চিন্তা করতে হত না।’ অর্জুন বলল।

‘আমি সেটা ভেবেছিলাম।’ মিস্টার লেনডুপ বললেন।

‘আপনি যখন আমাকে দায়িত্ব দিয়েছেন, তখন এলভিসের বেডরুমটা আমি দেখতে চাই। হয়তো এমন কোনো ক্লু পাওয়া যাবে যা আমাকে সাহায্য করবে।’ অর্জুন বেশ জোরের সঙ্গে বলল কথাগুলো।

মিস্টার লেনডুপ তাঁর স্ত্রীর দিকে তাকালেন— ‘আমি মনে করি, উনি ঠিক কথা বলছেন। বেশ কয়েক মাস তো অপেক্ষা করলে, এখন দরজার তালা ভাঙাই যেতে পারে।’

ভদ্রমহিলা কোনো কথা বললেন না।

বাড়ির কাজের লোককে দায়িত্ব দেওয়া হল। বাইরে ঝোলানো তালা নয়, ল্যাচ কি! খুলতে অনেক কসরত করতে হচ্ছিল। শেষপর্যন্ত ভেঙে ফেলা ছাড়া উপায় থাকল না। ঘরের সবক’টা জানলা বন্ধ। দীর্ঘমাস হাওয়া না ঢোকায় গুমোট গন্ধ পাক খাচ্ছিল। জানলা খুলে পাখা চালিয়ে দেওয়ার পর ওঁরা ঘরে ঢুকলেন। অর্জুন দেখল, তিন দেওয়ালে তিনজন বিখ্যাত মানুষের বিশাল ছবি সাঁটা রয়েছে। মাও সে তুং, হো চি মিন এবং চে গুয়াভেরা। তিনজনের শরীরে সৈনিকের পোশাক।

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার ছেলে কি রাজনীতি করত?’

মিস্টার লেনডুপ মাথা নাড়লেন— ‘জানি না। এদের ছবি যে সে এত পছন্দ করে, তাও তো জানা ছিল না।’

টেবিল এবং শেলফে অনেক বই। বেশিরভাগ ইংরেজি। কিছু চিনা বই রয়েছে। বোঝা যাচ্ছে, ছেলেটা চিনা ভাষা জানে। পোশাক ঝুলছে অনেকগুলো। ড্রয়ারে বেশ কয়েকটা দামি কলম এবং সিগারেটের প্যাকেট।

‘আপনার ছেলে দেখছি বিদেশি সিগারেট খেত।’ প্যাকেটটা তুলে দেখল অর্জুন। অর্ধেক খালি।

‘থিম্পুতে থাকতে খেত বলে মনে হয় না।’

‘তাহলে বেজিংয়ে গিয়ে শুরু করেছিল।’

মিস্টার লেনডুপ কথা বললেন না। প্যাকেটটা টেবিলের ওপর রেখে বইয়ের আলমারিটা ভালো করে দেখল অর্জুন। সেই আলমারির মাঝখানের তাকে পেয়ে গেল লাল ডায়েরিটা। কয়েকটা পাতায় চোখ বুলিয়ে অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা আমি একদিনের জন্যে হোটেলে নিয়ে যেতে চাই। আপত্তি আছে?’

এবার হাসলেন মিস্টার লেনডুপ— ‘একদম না। আমি চাই আপনি এলভিসকে খুঁজে বের করুন। ও আমার একমাত্র ছেলে।’

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার ছেলের ঘরে কোনো মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট দেখতে পাচ্ছি না। বাড়িতে কি গানের জন্যে আলাদা ঘর আছে?’

‘না। এই বাড়িতে কেউ গান—বাজনা করে না। তবে এলভিস খুব গান শুনত। পড়াশুনা করার সময় ছাড়া ওর কানে তার গোঁজা থাকত।’ মিস্টার লেনডুপ বললেন, ‘এই কথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?’

‘যার নাম এলভিস সে গান—বাজনার সঙ্গে যুক্ত থাকবে না তা ভাবতে অসুবিধে হয়, তাই। হ্যাঁ, ও যেসব গান শুনত তার সিডিগুলো কোথায়?’

মিসেস লেনডুপ এতক্ষণ ছেলের বিছানার ওপর পাথরের মতো বসেছিলেন। এবার কথা বললেন, ‘ও কোথায় কী রেখে গেছে আমাকে বলে যায়নি।’

হোটেল হিমালয়ে ফিরে আসতে না আসতেই বৃষ্টি নামল। পাহাড়ে যখন ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে, তখন মনে হয় প্রলয় শুরু হয়ে গিয়েছে। ঘরের আলো জ্বেলে এই অপরাহ্নে ডায়েরিটা নিয়ে বসতেই অর্জুনের মনে এল জলপাইগুড়ির কথা তিস্তার চরের পাশে আচমকা যে বোমা বিস্ফোরণ হল, তার পুরো খবর জানা হয়নি। অমলদাকে যিনি জানিয়েছিলেন, তিনি কতটা নির্ভরযোগ্য তা কে জানে! অমলদাকেও এ ব্যাপারে কৌতূহলী মনে হল না।

নিজের মোবাইল অন করে হতাশ হল অর্জুন। কোনো নেটওয়ার্ক নেই। কিন্তু জলপাইগুড়ির কদমতলার জগুদার সঙ্গে একটু কথা বললে অনেক খবর জানা যাবে যা মায়ের পক্ষে বলা সম্ভব হবে না।

সে ঘর থেকেই হোটেলের অপারেটরকে  ফোনে ধরে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমাকে ইন্ডিয়ার লাইন দেওয়া কি সম্ভব হবে?’

অপারেটর নাম্বার জিজ্ঞাসা করলে অর্জুন জলপাইগুড়ির কোড এবং  টেলিফোন নাম্বার জানিয়ে দেওয়ার দশ সেকেন্ডের মধ্যেই রিং শুরু হল। আবার রিসিভার তুলতেই ওপাশে জগুদার গলা শোনা গেল— ‘হ্যালো! কে?’

‘জগুদা, আমি অর্জুন।’

‘আরে, তুমি কোথা থেকে, লং ডিসটেন্স মনে হচ্ছে!’

‘হ্যাঁ, আমি এখন থিম্পুতে। শুনলাম, জলপাইগুড়ির তিস্তার পাশে বোমা ফেটেছে। ওটা কেউ ইচ্ছে করে ফাটিয়েছে, না ফেটে গেছে?’

‘এটাও নিশ্চয়ই শুনেছ, চারজন মারা গিয়েছে। যারা ফাটিয়েছে, তারা যদি ইচ্ছে করে ফাটিয়ে থাকে, তাহলে নিজেরাই মারা যেত না। তাছাড়া অত শক্তিশালী বোমা আর্মি ছাড়া কারওর কাছে নেই।’

‘কিন্তু কেন, কী উদ্দেশ্যে ওরা এসেছিল?’

‘বোঝা যাচ্ছে না। উচ্চচপর্যায়ের তদন্ত চলছে।’

‘যে—চারজন মারা গিয়েছে, তারা কি শহরের ছেলে?’

‘না। অন্তত এখনও পর্যন্ত কেউ ক্লেম করেনি। দু’জনের মুখ উড়ে যাওয়ায় আইডেন্টিফাই করা সহজ হবে না। তবে, পোশাক এবং জুতো দেখে পুলিশের মনে হয়েছে, ওরা বেশ ধনী পরিবারের ছেলে। আমি জলপাইগুড়ির ওসির কাছে জানতে পারলাম।’ জগুদা বললেন।

‘এরা চারজনেই বাঙালি’?

‘তাই—বা বলি কী করে! ওসি বুঝতে পারছেন না এদের পরিচয়। যে—বাড়িতে বোমা বিস্ফোরণ হয়, সেখানে ওরা যে ছিল তা কেউ টের পায়নি। মনে হয়, আগের দিন ওরা ওখানে আশ্রয় নিয়েছিল।’

‘আর কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি?’

‘এখনও পর্যন্ত নয়। তবে, একজনের পকেটে চাইনিজ সিগারেট ছিল।’

‘সে কী! কী সিগারেট, প্যাকেটে কী নাম লেখা ছিল খোঁজ নেবেন?’

‘ওসি নামটা বলেছেন। বেশ মজা লেগেছে শুনে? সিগারেটের প্যাকেটের নাম যে চাইনিজ ওয়াল হতে পারে ভাবিনি, কবে ফিরছ?’

‘এখনও ঠিক নেই। গিয়ে দেখা করব। রাখছি।’

রিসিভার নামিয়ে রেখে টেবিলে রাখা সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিল অর্জুন। না, এই প্যাকেটের কোথাও কোনো ইংরেজি শব্দ ছাপা নেই। যা লেখা তা চিনা ভাষায় লিখেছে। অতএব এটা যে ‘চাইনিজ ওয়াল’ সিগারেট তা বলা যাচ্ছে না। অর্জুনের মনে হল, এটা আলাদা কোম্পানির তৈরি সিগারেট যা সম্ভবত চিন ভূখণ্ডেই বিক্রি হয়! প্যাকেটের ওপর তাই ইংরেজিতে লেখার প্রয়োজন হয়নি। ইংরেজিতে লেখা ‘চাইনিজ ওয়াল’ সিগারেট সম্ভবত বিদেশে বিক্রি হয়। সিঙ্গাপুর, তাইল্যান্ড ইত্যাদি জায়গার সঙ্গে ভারতের পূর্বাঞ্চলেও চলে আসে প্যাকেটগুলো। এলভিসের ঘরে পাওয়া চিনে সিগারেটের প্যাকেটের সঙ্গে বোমা বিস্ফোরণে নিহত যুবকের পকেটে পাওয়া সিগারেট মিলে গেল না। মিলে গেলে সমস্যাটা অনেক সহজ হয়ে যেত।

ডায়েরিটা নিয়ে বসল অর্জুন। বেশিরভাগই ইংরেজিতে লেখা। কিছু পাতা চিনে ভাষায়। বোঝাই যায়, এলভিস ভাষাটায় তেমন স্বচ্ছন্দ ছিল না। ইংরেজি লেখাটা যত চোস্ত হাতে লেখা, চিনা শব্দগুলো লিখেছিল আড়ষ্ট হাতে। কিন্তু ইংরেজি লিখতে লিখতে আচমকা চিনা ভাষা লিখল কেন? অচেনা ভাষা পড়া যখন যাবে না, তখন ইংরেজিতে চোখ রাখল অর্জুন। মাও সে তুঙের লংমার্চের কথা লিখেছে সে। কীভাবে চিনের মানুষ সেই দীর্ঘ যাত্রাপথে এক হয়ে গিয়েছিল, অনেক প্রতিবন্ধকতা সামনে এলেও তারা হার মানেনি, তা লিখতে লিখতে মন্তব্য করে গিয়েছে এলভিস।

আর একটি পাতায় সে প্রশ্ন তুলেছে। বুদ্ধদেব যখন বৌদ্ধ ধর্ম বা যিশু যখন খ্রিস্ট ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন, তখন পৃথিবীর অবস্থা কীরকম ছিল তার বর্ণনা লিখেছে সে। সেই সময়ের মানুষ তাদের জীবনযাত্রার ধরন, তাদের অস্তিত্বের আমূল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। তাহলে সেই সময়ের মানুষের জন্যে তৈরি ধর্মভাবনা এখানকার মানুষের ক্ষেত্রে কী করে প্রযোজ্য হবে? সে লিখেছে, ওইসব মেকি ধর্ম এখনই বাতিল করে দেওয়া উচিত। কিছু লোক গোটা পৃথিবীর মানুষকে বোকা বানিয়ে ওইসব ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজেরা মহাআরামে আছে। এদের মুখোশ খুলে দেওয়া উচিত।

অর্জুনের মনে হল, এই যুবক নানান কারণে নিশ্চয়ই খুব ক্ষুব্ধ ছিল। ছেলের মনের এই অবস্থা তার বাবা—মা নিশ্চয়ই জানতেন না।

আর একটি পাতায় চোখ রাখতেই সোজা হয়ে বসল অর্জুন। এলভিস লিখেছে— ‘নিজের জন্মের ওপর মানুষের কোনো হাত থাকে না। জ্ঞান হওয়ার পর সে বুঝতে পারে কোন পরিবারে সে জন্মেছে! যেমন আমি। মিস্টার লেনডুপ আমার জন্মদাতা। এব্যাপারে আমার তো কিছু করার ছিল না। কিন্তু জ্ঞান হওয়ার পর আমি দেখলাম, ওই ভদ্রলোক টাকা ছাড়া কিছু চেনেন না। আরও টাকার জন্যে তিনি দেশ ছেড়ে আমেরিকায় গিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। কোন দেশ? না আমেরিকা। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী বুর্জোয়া দেশ যারা গরিব দেশগুলোকে মানুষ বলে মনে করে না। সেই দেশের মানুষের চাটুকারিতা করে মিস্টার লেনডুপ কোটি কোটি টাকা রোজগার করছেন। প্রশ্ন হল, সেই টাকা নিয়ে তিনি কী করছেন? ভুটানের হাজার হাজার শিশু দু’বেলা খাবার পায় না। কত মানুষ চিকিৎসা করাতে পারে না পয়সার অভাবে। মিস্টার লেনডুপ টাকার পাহাড়ের স্বপ্ন পূর্ণ করতে আমেরিকায় বছরের বেশিরভাগ সময় পড়ে থাকেন, অথচ তার দশ শতাংশ গরিব মানুষদের বাঁচার জন্যে সাহায্য করেন না। এই লোকের টাকায় আমি বড় হয়েছি, আমার পড়াশুনার খরচ এই লোকটা দিয়েছে তা ভাবলেই!’

এই অবধি লেখার পর বাকি পাতা সাদা রেখে দিয়েছিল এলভিস। অর্জুনের মনে হচ্ছিল, এই ছেলেটার মনে যে—জ্বালা ছিল, তা ওর বাবা—মা টের পাননি। বাংলায় প্রবাদ আছে, দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ। কিন্তু মাস্টার লেনডুপকে দৈত্য বলে মনে হয়নি তার।

বাইরে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। অর্জুনের ইচ্ছে হল এক কাপ চা খেতে। রিসিভার তুলে রুমসার্ভিসকে চায়ের অর্ডার দিল সে।

যে—বেয়ারা তাকে এই ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল সে—ই চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল। জিজ্ঞাসা করল চা তৈরি করে দিতে হবে কিনা? অর্জুন মাথা নাড়লে লোকটা যত্ন করে চা বানাতে লাগল।

অর্জুন কথা বলল, ‘আমি যাঁর গেস্ট হয়ে এখানে আছি সেই মিস্টার লেনডুপের ছেলে এলভিসকে কি তুমি দেখেছ?’

মাথা নেড়ে লোকটা বলল, ‘হ্যাঁ স্যার। মিস্টার এলভিস এই হোটেলকে খুব পছন্দ করতেন।’

‘কীরকম?’

‘যখন থিম্পুতে থাকতেন, তখন মাঝে মাঝে এই হোটেলে দু’দিন থেকে যেতেন।’ চায়ের কাপ এগিয়ে দিল লোকটা।

‘তাই? হোটেলে থাকতেন কেন? ওঁর বাড়ি তো এখানেই।’

‘বড়লোকের ছেলের তো অনেক রকমের খেয়াল হয়। হোটেলে থাকার সময় তিনি বই পড়তেন আর ঘুমাতেন।’

‘বাঃ, বেশ শখ তো! কয়েক মাস আগে ওঁর কয়েকজন বিদেশি বন্ধু থিম্পুতে এসেছিল। তারা কি এই হোটেলেই উঠেছিল?’

‘হ্যাঁ।’ হাসি ফুটল লোকটার ঠোঁটে— ‘হ্যাঁ। মিস্টার এলভিসের তিনজন চিনা বন্ধু এসেছিল। ওরা হিন্দি দূরের কথা, ইংরেজিও জানত না। মিস্টার এলভিস দোভাষীর কাজ না করলে আমরা খুব অসুবিধায় পড়তাম।’

‘মিস্টার এলভিস কি তখন বাড়ি থেকে আসা—যাওয়া করতেন?’

‘না—না। তিনি তখন এই হোটেলেই থেকে গিয়েছিলেন।’

‘ওঁর বন্ধুরা কেমন ব্যবহার করেছিল?’

‘ভালোই। ওদের সঙ্গে একটা গ্রুপ ফোটো তুলেছিলাম।’

‘বাঃ। ছবিটা আছে?’ অর্জুন চায়ে চুমুক দিল।

‘নিশ্চয়ই। আমার একজন বন্ধু হোটেলে দেখা করতে এসেছিল। তার মোবাইলে তুলে দিয়েছিল। পরে প্রিন্ট করে কপি দিয়েছে আমাকে।’

‘সেই ছবি আপনার কাছে আছে?’

‘নিশ্চয়ই। মিস্টার এলভিস ছবির একটা কপি চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি যখন কপি হাতে পেলাম, তখন থেকে তিনি থিম্পুর বাইরে চলে গিয়েছেন। আর আসেননি।’ বেয়ারা বলল।

‘আপনি কি ছবিটা আমাকে দেখাতে পারবেন।’

‘আপনি দেখতে চাইছেন। বেশ। দেখাব।’

চায়ের ট্রে নিয়ে লোকটা চলে গেল।

হোটেলের ঘর থেকে বেরুবার প্রশ্ন নেই, অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। এর মধ্যে মিস্টার লেনডুপের  ফোন এল—’কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?’

‘বৃষ্টিতে বেরুতে পারছি না, এইটুকুই।’

‘ওটা আমার হাতে নেই।’

‘আচ্ছা, আপনার ছেলের তিন বন্ধু এই হোটেলে ক’দিন থেকেছিল। তাদের হোটেলের বিল কি আপনি দিয়েছিলেন?’

‘আমি তখন বিদেশে ছিলাম। ফিরে এসে শুনেছি। হ্যাঁ, বিল আমাব স্ত্রী পে করেছিলেন। ভেবেছিলেন, ছেলে তার বিদেশি বন্ধুদের তো বাড়িতেও তুলতে পারত। তা না করে হোটেলে রেখে বাস্তববুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে। তাই বিল পে করে দিয়েছিলেন। কেন বলুন তো?’

‘সেসময় এলভিস বন্ধুদের সঙ্গে এই হোটেলেই ছিল।’

‘তাই নাকি? আমি তো জানি না।’

‘শুধু তা—ই নয়, মাঝে মাঝে, আপনার অনুপস্থিতির সময় সে এই হোটেলে দু’তিনদিন থেকে যেত।’ অর্জুন জানাল।

একটু চুপ করে থেকে মিস্টার লেনডুপ বললেন, ‘এই ব্যাপারগুলো আমার কাছে কখনওই বলেননি আমার স্ত্রী। যাক গে, আজ রাত্রে আপনি কি বাইরে ডিনার করতে আগ্রহী?’

‘না—না বৃষ্টি পড়ছে। এখানেই যা হোক কিছু খেয়ে শুয়ে পড়ব।’

‘যদি দরকার হয় তাহলে আমাকে জানাবেন। গুডনাইট।’

অর্জুন গুডনাইট বলার আগেই লাইন কেটে দিলেন মিস্টার লেনডুপ।

রাত ন’টা নাগাদ পোশাক বদলে হোটেলের ডাইনিং রুমে এল অর্জুন। বেশ বড় হলঘর। চারটে চেয়ার এক টেবিলে যার অধিকাংশই এখন খালি। সম্ভবত বৃষ্টির কারণেই বাইরে থেকে কেউ খেতে আসতে পারেনি। অর্জুন দেখল যাঁরা আছেন, তাঁদের সবাই বিদেশি, ভারতীয়রাই সংখ্যায় বেশি।

কোণের দিকের টেবিলের চেয়ার টেনে বসল সে। বেয়ারা মেনু কার্ড দিয়ে গেলে সে দেখল ভারতীয় খাবারই বেশি। বিশেষ করে, পাঞ্জাবি খাবার। চিকেন আর তন্দুরি রুটির অর্ডার দিয়ে সে চারপাশে তাকাল কিন্তু পরিচিত বেয়ারার দেখা পেল না। সম্ভবত লোকটার কাজের সময় শেষ হয়ে গিয়েছে অথবা তার ডিউটি এখন এই ডাইনিং রুমে নয়।

যে—ভুটানি ছেলেটি খাবার নিয়ে এল সে বেশ হাসিখুশি। অর্জুন তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ভাই, আমি একজন বেয়ারাকে খুঁজছি যে আমাকে হোটেলের ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল। তার নাম জিজ্ঞাসা করা হয়নি। শুধু সে বলেছে আগে দিল্লির হোটেলে চাকরি করেছে। এরকম কাউকে কি বুঝতে পারছ?’

ছেলেটা চট করে চারপাশে তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘খুব খারাপ খবর স্যার। ওর চাকরি চলে গিয়েছে।’

‘সে কী? কেন?’ অবাক হয়ে গেল অর্জুন।

‘আমি বলতে পারব না।’ ছেলেটি খাবার টেবিলে সাজিয়ে চলে গেল।

অর্জুনের মাথায় ব্যাপারটা ঢুকছিল না। লোকটাকে বেশ দক্ষ কাজের মানুষ, বলেই মনে হয়েছে তার। এরকম একজনকে হোটেল কর্তৃপক্ষ কেন আচমকা সরিয়ে দেবে? বেয়ারারা যেসব অপরাধের জন্যে চাকরি খোয়ায় সেসব অপরাধ ওই অভিজ্ঞ লোকটি কেন করবে? আর তার প্রশ্নের জবাবে এই হাসিখুশি বেয়ারার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল এবং কিছু বলতে পারবে না বলে চলে গেল, এটাও তো স্বাভাবিক নয়।

খাওয়া শেষ হলে সেই বেয়ারা এল সই করাতে। অর্জুন সই করতে করতে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার ডিউটি শেষ হবে কখন?’

‘সকাল ছ’টায়।’

‘আমি হোটেলের সামনে তোমার জন্যে দাঁড়াব।’

বেয়ারা কোনো কথা না বলে তার কাজ শুরু করলে অর্জুন চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল।

ঘরে এসে ভাল করে তাকাল অর্জুন। না, কোনো ক্যামেরা চোখে পড়ল না। হোটেলের ঘরে গোপনে ক্যামেরা রাখা সৌজন্যের বিরোধী। টেবিল ল্যাম্প, খাটের নীচে, দরজায় পর্দার পাশে নজর দিয়ে অর্জুন হাসল। ছবি তোলা সৌজন্যবিরোধী হতে পারে কিন্তু এই ঘরে যা শব্দ হবে তা বাইরে রেকর্ড করার ব্যবস্থা করলে তাকে কী বলা যেতে পারে?

অর্জুন মনে করার চেষ্টা করল। এই ঘরে আসার পর সে দু’জনের সঙ্গে কথা বলেছে। এক, ওই বেয়ারাটির সঙ্গে, দুই, টেলিফোনে জগুদার সঙ্গে। নিশ্চয়ই সেইসব কথা রেকর্ডেড হয়েছে। কেন? হোটেলের কর্তৃপক্ষের কি ইন্টারেস্ট হবে তার কথাবার্তা সংরক্ষণ করায়? বেয়ারার সঙ্গে কথা বলার সময় সে মিস্টার লেনডুপ এবং এলভিসের প্রসঙ্গ এনেছিল। এলভিস ও তার চিনে বন্ধুদের কথায় বেয়ারা তাকে এমন কোনো তথ্য দেয়নি যা তৃতীয় ব্যক্তিকে রুষ্ট করতে পারে!

জলপাইগুড়ির জগুদার সঙ্গে কথা বলার সময় সে বোমা বিস্ফোরণের ব্যাপারটা জানতে চেয়েছিল। জগুদা যেটুকু জেনেছিলেন সেটুকুই বলেছিলেন। কিন্তু সেই কারণে বেয়ারার চাকরি চলে যাবে কেন?

 ফোন বাজল। রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই মিস্টার লেনডুপের গলা কানে এল, ‘ডিনার হয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ। খুব ভালো খাবার। এই হোটেলে ব্যবস্থা করার জন্যে ধন্যবাদ।’

‘শুনে খুশি হলাম। বাই দ্য বাই, ছেলের ডায়েরি থেকে কিছু জানতে পারলেন? ওর মা খুব অধৈর্য হয়ে পড়েছেন।’

‘না না। ওঁকে বলুন সব ঠিক হয়ে যাবে। ভিনসেন্ট খুব ভালো ছাত্র ছিল। ডায়েরি পড়লে বোঝা যায় একথা।’

‘কিন্তু কোথায় যেতে পারে সে?’

‘দেখুন, ওর বয়সের ছেলেরা অ্যাডভেঞ্চার করতে ভালোবাসে। অজানাকে জানতে চায়। তার জন্যে জীবনের ঝুঁকি নিতে পিছুপা হয় না। কিন্তু একা একা তো অ্যাডভেঞ্চার করা যায় না। সমস্যা এখানেই। আপনারা বলেছেন থিম্পুতে এলভিসের কোনো বন্ধু ছিল না। তাহলে কাদের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারে যাবে।’

‘আপনি ভুল করছেন মিস্টার অর্জুন। আমার ছেলে খুব নরম প্রকৃতির। ছেলেবেলায় প্রজাপতি দেখে ভয় পেত। একবার একটা নিরীহ পিঁপড়ে ওর হাতে ওঠায় ঘণ্টাখানেক ধরে কেঁদেছিল। ওর পক্ষে অ্যাডভেঞ্চারের কষ্ট সহ্য করা সম্ভব নয়।’ মিস্টার লেনডুপ একটু থেমে জিজ্ঞাসা করলেন। ‘আচ্ছা, আপনার কী মনে হয়, কতদিন লাগবে ওকে খুঁজে বের করতে?’

‘এর উত্তর এই মুহূর্তে দেওয়া সম্ভব নয়। আপনি আপনাদের পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন তো?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই। ঠিক আছে, গুড নাইট।’ মিস্টার লেনডুপ যেন হতাশ হয়েই লাইন কেটে দিলেন। ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকল অর্জুনের কাছে। সে আজই প্রথম থিম্পু শহরে এসেছে। আট ঘণ্টাও কাটেনি। অথচ এর মধ্যেই মিস্টার লেনডুপ এত অধৈর্য হয়ে পড়লেন কেন? সে বিছানায় চলে এল। এতক্ষণ যেসব কথা হল তা নিশ্চয়ই হোটেল কর্তৃপক্ষের কানে পৌঁছে যাবে। কোনো বিরূপ কথা বলেনি সে। তাই রাতটা নির্বিঘ্নে ঘুমাতে পারবে।

ভোর পাঁচটায় ঘুম ভেঙে গেল অর্জুনের। জানলার পর্দা ফাঁক করে দেখল বাইরে বৃষ্টি পড়ছে না কিন্তু আকাশ মেঘলা। ধীরে—সুস্থে তৈরি হয়ে নিল সে। নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল। ছায়ায় মোড়া চওড়া রাস্তা, একটাও মানুষ চোখে পড়ল না। সে অপেক্ষা করল।

আলোর তেজ বাড়ল না কিন্তু একটু একটু করে পথে মানুষ, গাড়ি দেখা গেল। হোটেলের সামনে এসে দাঁড়াল একটা বেকারির ভ্যান। তা থেকে নানা সাইজের প্যাকেট নামিয়ে ঢোকাচ্ছিল ভ্যানের লোকেরা। অর্জুন বুঝতে পারল, হোটেলের দরজা খুলে গিয়েছে। সে ঘরে ঢুকে জুতো পরে নিয়ে দরজা বন্ধ করে প্যাসেজ দিয়ে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামতে নামতে চোখ বোলাল চারদিকে। ভিজিটর দূরের কথা, কোনো বেয়ারাকেও দেখা যাচ্ছে না। না গেলেও অর্জুন জানে ক্লোজ সার্কিট টিভি ক্যামেরা সর্বত্র চোখ রাখছে।

রিসেপশনিস্ট তাকে দেখে হাসল, ‘মর্নিং ওয়াক?’

মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলল অর্জুন।

রিসেপশনিস্ট বলল, ‘আপনি সোজা ক্লক টাওয়ারের দিকে চলে যান। রাস্তাটা ভালো। এখন তো একদম ফাঁকা পাবেন।’

‘ধন্যবাদ।’ বলে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল অর্জুন।

কিন্তু কয়েক পা হেঁটে একটা বড় বাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে সে হোটেলের সামনেটা নজরে রাখল। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, রেস্টুরেন্টের সেই হাসিমুখের ছেলেটাকে সধারণ শার্ট—প্যান্টে বেরিয়ে আসতে দেখল সে। যেখানে অর্জুন দাঁড়িয়ে সে পথ ধরে হেঁটে আসছে ছেলেটা। ছেলেটা তাকে লক্ষ করেনি দেখে অর্জুন ডাকল না। খানিকটা এগিয়ে যেতে দিয়ে সে ছেলেটাকে অনুসরণ করল। আপনমনে হেঁটে যাচ্ছিল ছেলেটা। হঠাৎ রাস্তার একপাশ দিয়ে নেমে যাওয়া সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতে লাগল। অনেকটা নীচের পথে নেমে ছেলেটা যখন হাঁটছে, তখন দ্রুত পা চালিয়ে অর্জুন ওর পাশে চলে এল।

যেন ভূত দেখল ছেলেটা— ‘আপ?’

‘মর্নিং ওয়াক।’ অর্জুন হাসল।

ছেলেটা সতর্ক চোখে পেছনে তাকিয়ে নিল। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘কোনো অন্যায় কাজ না করে কিছু রোজগার করতে চাইলে আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি।’

‘কীরকম?’

‘আমি তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, তুমি যা সত্যি তা—ই বলবে!’

ছেলেটা মাথা নাড়ল— ‘আমার মা বলত, সবসময় সৎপথে রোজগার করতে।’

‘গুড। যে—বেয়ারার চাকরি কাল চলে গেছে, তা কেন গেল তুমি বলতে পারবে না বলেছিলে। কেন ভয় পেয়েছিলে?’

‘ঝামেলার ভয়ে।’

‘কীসের ঝামেলা?’

‘আমাদের এব্যাপারে কাউকে কিছু বলতে নিষেধ করা হয়েছে।’

‘ওই বেয়ারার নাম কী?’

‘পদম।’

‘নিশ্চয়ই পদম চুরিচামারি করেছিল!’

‘একদম না। ও খুব সৎমানুষ।’

‘বিশ্বাস করি না। সৎমানুষ হলে চাকরি যাবে কেন?’

‘আমি জানি না।’

‘পদম থাকে কোথায়?’

‘চ্যাঙলানের ওপাশে।’

‘জায়গাটা এখান থেকে কতদূরে?’

‘আধঘণ্টা হাঁটতে হবে।’

‘আমি তোমাকে পাঁচশো টাকা দিতে পারি যদি ওর বাড়ি দেখিয়ে দাও।’

‘ওর বাড়িতে আপনি কেন যাবেন?’

‘পদমের কাছে একটা ছবি আছে। তিনজন চিনা যুবকের সঙ্গে এখানকার একজন ভুটানি যুবকের ছবি। ওটা দেখতে চাই।’

‘হায়!’ অদ্ভুত গলায় আওয়াজ করল ছেলেটি।

‘কী হল?’

‘ওই ভুটানি ছেলের নাম কি এলভিস?’

‘হ্যাঁ। কেন?’

‘সাহেব, আমাকে আপনি যেতে দিন। আমি টাকা চাই না।’

‘তুমি ভয় পাচ্ছ কেন?’

‘হোটেলের কেউ যদি আপনার সঙ্গে আমাকে দেখতে পায় তাহলে চাকরি চলে যাবে। বোধ হয় পদম আপনাকে ছবি দিতে চেয়েছিল, তাই ওর চাকরি গেল।’

‘এলভিসের ছবি যদি পদম আমাকে দেয় তাহলে অপরাধ কোথায়?’

‘আমি জানি না সাহেব।’

‘তুমি জানো কিন্তু বলতে চাইছ না।’

‘ঠিক আছে! চলুন। আমি দূর থেকে দেখিয়ে দেব পদম কোথায় থাকে কিন্তু কাছে যাব না।’ হাঁটতে শুরু করল ছেলেটি।

প্রায় চল্লিশ মিনিট হাঁটল ওরা। চ্যাঙলান ব্যবসাকেন্দ্র। সেটা ছাড়িয়ে বস্তি মতন জায়গায় এসে ছেলেটি বলল, ‘সাহেব, ওই বস্তিতে পদম থাকে। নাম বললেই দেখিয়ে দেবে সবাই।’

অর্জুন পকেট থেকে পার্স বের করে পাঁচশো টাকার নোট এগিয়ে ধরতেই ছেলেটি মাথা নাড়ল— ‘না সাহেব, আমি অসৎ পথে টাকা নেব না।’

‘তার মানে?’

‘আমি তো আপনাকে সত্যি কথা বলিনি।’ বলেই ছেলেটা হনহনিয়ে পেছনে হেঁটে গেল। এরকম ছেলে বোধ হয় ভুটান ছাড়া অন্য কোথাও বেশি নেই, অর্জুনের মনে হল।

বস্তির সামনে এক বৃদ্ধ কুকুর নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। পরনে ভুটানি পোশাক। অর্জুন তাকে নমস্কার করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, পদম কোথায় থাকে?’

‘এখানেই থাকত; আজ এখানে নেই।’ নিরাসক্ত গলায় বৃদ্ধ বললেন।

‘কোথায় গেলে ওকে পাওয়া যাবে?’

‘হাসপাতালে।’ বৃদ্ধ কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে বস্তির ভেতর ঢুকে গেলেন।

কাল যে—লোকটা স্বাভাবিকভাবে তার সঙ্গে কথা বলল তার চাকরি চলে গেল এবং এখন তার ঠিকানা হাসপাতাল। ঘটনার আকস্মিকতায় অর্জুন হতভম্ব হয়ে গেল। কিন্তু লোকটা নিশ্চয়ই একা থাকত না। তার সংসারে যারা আছে তাদের সঙ্গে তো সে কথা বলতে পারে। কিন্তু কী পরিচয় দিয়ে কথা বলবে?

অর্জুন দেখল, একটা বাচ্চচা মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতে একটি যুবক বস্তি থেকে বেরিয়ে আসছে। অর্জুন তাকে হাতজোড় করে নমস্কার জানাতেই সেও ফিরিয়ে দিল।

‘আপনার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে পারি?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘আমি দিল্লিতে থাকি।’ অর্জুন কথা বানাল— ‘ওখানে একজন ভুটানি ভদ্রলোক, যিনি হোটেলে কাজ করতেন, তাঁর সঙ্গে ভালো পরিচয় হয়েছিল, উনি বলেছিলেন থিম্পুতে এলে দেখা করতে। এখানকার ঠিকানা দিয়েছিলেন, ওঁর নাম পদম। আপনি ওঁকে চেনেন?’

‘হ্যাঁ। কাল ওর খুব জোর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। হাসপাতালে ভর্তি আছেন। ভাগ্য ভালো ছিল তাই বেঁচে গেছে।’

‘কী অ্যাক্সিডেন্ট?’

‘গাড়ি ধাক্কা মেরেছিল।’

‘কোন হাসপাতালে আছেন?’

যুবক তাকে হাসপাতালের হদিশ দিয়ে মেয়েটিকে নিয়ে চলে গেল।

এখন সকাল সাড়ে সাতটা। তবু খোঁজ নিতে হাসপাতালে পৌঁছে গেল অর্জুন। এই সময় যেমন হয়, বাইরের লোকেদের ভেতরে ঢোকা যেমন নিষেধ, তেমনই ভেতরের খবর বাইরের লোকদের জানানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। অর্জুন প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর দেখতে পেল, একজন বাঙালি ভদ্রমহিলা হাসপাতালে ঢুকছেন। ভঙ্গিতে মনে হল, হয় ইনি হাসপাতালের নার্স অথবা ডাক্তার। সে এগিয়ে গিয়ে নমস্কার করল, ‘আপনার সঙ্গে এক মিনিট কথা বলতে পারি?’

‘হ্যাঁ, বলুন।’ পরিষ্কার বাংলায় বললেন ভদ্রমহিলা।

‘আমি উত্তরবাংলার জলপাইগুড়ি শহরে থাকি। গতকাল আমার একজন পরিচিত মানুষ দুর্ঘটনায় পড়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ভিজিটিং আওয়ার্স শুরু হতে অনেক দেরি আছে। তিনি কেমন আছেন তা যদি দয়া করে আমাকে জানান তাহলে—’ অর্জুন কথা শেষ করল না।

‘কী নাম?’

‘পদম। ও বাঙালি নয়।’

‘আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন।’ ভদ্রমহিলা ভেতরে পা বাড়ালে দারোয়ান তাঁকে সেলাম জানাল। অর্জুনের মনে হল, এই মহিলা কোনো সাধারণ কর্মচারী নন। নাহলে দারোয়ান ওভাবে সোজা হয়ে সেলাম করত না।

মিনিট কুড়ি পরে একটি লোক ভেতর থেকে বেরিয়ে চারপাশে দেখতে দেখতে অর্জুনের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কোত্থেকে এসেছেন?’

‘জলপাইগুড়ি।’

‘আমার সঙ্গে আসুন। ম্যাডাম ডেকেছেন।’

অর্জুন লোকটিকে অনুসরণ করে ভেতরে ঢুকে হাসপাতালের দোতলায় উঠে যে—ঘরের সামনে পৌঁছল, তার দরজার পাশের বোর্ডে লেখা রয়েছে— ডক্টর আই রায়? পর্দা সরিয়ে লোকটা তাকে ভেতরে যাওয়ার জন্যে ইশারা করল।

ভদ্রমহিলা, যাঁর নাম ডক্টর রায় তখন  ফোনে কথা বলছিলেন, ইশারায় উলটো দিকের চেয়ারে বসতে বললেন। কথা শেষ করে ভদ্রমহিলা অর্জুনের দিকে তাকালেন— ‘আপনার নামটা জানতে পারি?’

‘আমি অর্জুন।’

ভদ্রমহিলার কপালে ভাঁজ পড়ল— ‘আপনি নিশ্চয়ই সেই অর্জুন নন, যিনি জলপাইগুড়ির মতন মফসসল শহরে থেকেও রহস্যসন্ধান করে যাচ্ছেন, একের পর এক। ওঁর অনেক অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি আমি পড়েছি। যাক গে, এই পদম লোকটি আপনার খুব পরিচিত?’

‘না। গতকালই এখানকার হোটেল হিমালয়ে পরিচয় হয়েছিল। ওর কাছে একটা ছবি আছে যা আমাকে দেবে বলে কথা দিয়েছিল।’

‘কিছু মনে করবেন না, ও কি ওখানে চাকরি করে?’

‘করত। বেয়ারার চাকরি। কালই চাকরিটা চলে গিয়েছে।’

‘অর্জুন, আমি খুব দুঃখের সঙ্গে বলছি, লোকটা আজ ভোরবেলায় মারা গিয়েছে। হেড ইনজুরি। এবং সেটা ইচ্ছাকৃত। পুলিশ একবার এসে ঘুরে গেছে। এখনই এখানকার অফিসার ইনচার্জ হাসপাতালে আসবেন।’

‘মারা গিয়েছে?’ হতাশ গলায় বলল অর্জুন— ‘বেচারা।’

‘হ্যাঁ। ওর ইনজুরি দেখে মনে হয়েছে এটা একটা খুনের কেস।’

‘অনেক ধন্যবাদ আমাকে খবরটা দেওয়ার জন্যে, আচ্ছা—’

অর্জুন উঠে দাঁড়াতেই ডক্টর রায় বললেন, ‘প্লিজ, একটু বসুন। আপনি বলেছিলেন পদম আপনাকে কোনো ছবি দিতে চেয়েছিল!’

‘হ্যাঁ।’

‘কিছু মনে করবেন না। আপনি কি হোটেল হিমালয়ে উঠেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘আর কালই যে—বেয়ারার সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছিল সে কেন আপনাকে ছবি দিতে যাবে? ছবি মানে ফোটোগ্রাফ না পেন্টিং?

‘ফোটোগ্রাফ!’ অর্জুন হাসল।

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ডক্টর রায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, আপনি জলপাইগুড়ির কোন পাড়ায় থাকেন?’

‘কদমতলায়।’

‘তার মানে আপনি কি সেই অর্জুন যার কাহিনি আমি পড়েছি?’

‘বোধহয়।’ অর্জুন হাসল।

‘আরে সর্বনাশ।’ করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিলেন ডক্টর রায়। তারপর হাসিমুখে বললেন, ‘জরুরি কোনো কাজ না থাকলে বসুন না।’

অর্জুন আবার বসল। কিন্তু তখনই বাইরে থেকে গলা ভেসে এল— ‘আসতে পারি?’

‘আসুন, আসুন। ডক্টর রায় অর্জুনকে বললেন, ‘অফিসার এসে গেছেন।’

যে—ভদ্রলোক ঘরে এলেন, তাঁকে আপ্যায়ন করে বসতে বললেন ডক্টর রায়। তারপর বললেন, ‘ইনি পুলিশের বড়কর্তা, মিস্টার ওয়াংচু। আর এঁর নাম অর্জুন। বিখ্যাত ডিটেকটিভ।’

অর্জুন হাত মিলিয়ে বলল, ‘একটু ভুল হল, আমি ডিটেকটিভ নই, সত্যসন্ধান করি।’

‘আই সি।’ ওয়াংচু বললেন, ‘থিম্পুতে কি বেড়াতে এসেছেন?’

‘না। ঠিক বেড়াতে নয়। মিস্টার লেনডুপ আমাকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর ছেলের খোঁজ করার জন্যে। তাকে চার—পাঁচ মাস ধরে পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘আই সি। ব্যাপারটা আমরা জানি। ছেলেটা চিনে যাতায়াত করত, সেখানেই পড়াশুনা করেছিল। আমার ধারণা সে সেখানেই চলে গিয়েছে। আপনি থিম্পুতে কতদিন হল এসেছেন?’

‘গতকাল দুপুরে এসেছি।’

‘নিশ্চয়ই হোটেল হিমালয়ে উঠেছেন?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি বললেন কী করে?’

‘বাঃ। ওই হোটেলের অন্যতম শেয়ার হোল্ডার হলেন মিস্টার লেনডুপ। তাই আপনাকে উনি নিজের হোটেলেই তো রাখবেন।’ মিস্টার ওয়াংচু ডক্টর রায়ের দিকে তাকালেন— ‘ডক্টর, পদমের পোস্টমর্টেম কবে হবে? এটা যখন মার্ডার কেস, তখন এ নিয়ে হইচই হবেই।’

ডক্টর রায় বললেন, ‘আশা করি, দুপুরের মধ্যে রিপোর্ট পেয়ে যাব।’

অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘অ্যাক্সিডেন্ট কীভাবে হয়েছিল?’

‘লোকটা হেঁটে আসছিল। পেছন থেকে গাড়ি ওকে ধাক্কা দেয়। লোকটা ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। গাড়ির যেখানে ওঠার কথা নয়।’

‘গাড়িটাকে ধরা সম্ভব হয়েছে?’

‘না। তখন বৃষ্টি পড়ছিল। রাস্তার লোক ছিল না। পদম ছাতার তলায় হাঁটছিল। ইচ্ছাকৃত খুন।’

‘কেন?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

‘প্রশ্নটা সহজ কিন্তু উত্তরটা বেশিরভাগ সময় খুঁজে পাওয়া যায় না।’

মিস্টার ওয়াংচু কথা শেষ করতেই ডক্টর রায় বললেন, ‘অর্জুন কালই পদমের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন।’

‘আই সি! হ্যাঁ, পদম তো হোটেল হিমালয়ে কাজ করত। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে জিজ্ঞাসা করব, কীরকম কথা হয়েছিল?’

‘স্বাভাবিক কথা। পদম ঘরে চা সার্ভ করতে এসেছিল। কথা প্রসঙ্গে মিস্টার লেনডুপের ছেলে এলভিসের কথা বলি। তখন পদম বলে, এলভিস তার তিনজন চিনা বন্ধুদের সঙ্গে হোটেল হিমালয়ে একসময় থেকে গিয়েছে। পদম ওদের সঙ্গে ছবি তুলেছিল। আমি সেই ছবি দেখতে চেয়েছিলাম। সে দেখাবে বলে কথা দিয়েছিল। রাত্রে শুনতে পেলাম, পদমের চাকরি গিয়েছে। আজ সকালে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে জানতে পারলাম, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। পদম মারা গিয়েছে শুনে খুব খারাপ লাগছে।’

মাথা নাড়লেন মিস্টার ওয়াংচু। তারপর ডক্টর রায়কে বললেন, ‘ডক্টর, আমি একবার পদমের ডেডবডি দেখতে চাই!’

‘সিয়োর।’ বলে ডক্টর রায় ফোনের রিসিভার তুলে কাউকে নির্দেশ দিয়ে বেল বাজালেন। যে—লোকটি অর্জুনকে ওই ঘরে নিয়ে গিয়েছিল সে চলে এল সঙ্গে সঙ্গে। ডক্টর রায় বললেন, ‘আমাকে একটা জরুরি মিটিংয়ে যেতে হবে। আমি যদি সঙ্গে না যাই—’

‘ইটস ওকে। এই লোকটি নিয়ে যাবে তো? ঠিক আছে। তাহলে চলি ডক্টর রায়।’ বলে মিস্টার ওয়াংচু অর্জুনের দিকে তাকালেন— ‘আপনি যদি ইচ্ছে করেন তাহলে আসতে পারেন। অবশ্য মৃত মানুষকে দেখতে ইচ্ছে না হওয়া স্বাভাবিক।’

‘না। আমি তা মনে করি না। চলুন। নমস্কার ডক্টর রায়।’ অর্জুন বলল।

যে—ঘরে পদমের শরীর রাখা হয়েছে সেখানে আর কোনো মৃতদেহ ছিল না। লোকটি সেখানে ওদের নিয়ে এলে ঘরের দায়িত্বে যে ছিল সে এগিয়ে এসে মিস্টার ওয়াংচুকে সেলাম জানিয়ে পদমের ঊর্ধ্বাঙ্গের সাদা কাপড় সরিয়ে দিল। মাথার অনেকটাই ব্যান্ডেজে মোড়া। ডান দিকের হাত থেঁতলে গেছে, খানিকক্ষণ খুঁটিয়ে দেখে মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘রাস্তার বাঁ দিক ধরে হাঁটছিল লোকটা। গাড়ি ফুটপাতে উঠে এসে ওর ডান দিকটা স্ম্যাশ করেছে। মিস্টার অর্জুন, আপনার আর কিছু দেখার আছে?’

‘না।’

‘চলুন।’

হাসপাতালের বাইরে এসে অর্জুন মিস্টার ওয়াংচুকে বলল, ‘আমি একবার পদমের বাড়িতে যেতে চাই। ওর বাড়ির লোক বলতে পারলেও পারে কোনো শত্রু ছিল কিনা?’

‘পদমের বাড়িতে কেউ নেই। বস্তির একটা ঘরে একাই থাকত। কিন্তু লোকটা বিবাহিত, বউ থাকে দিল্লিতে। সেখানেই চাকরি করে। এই খবর আমরা পেয়ে গেছি।’ বলে হাসলেন মিস্টার ওয়াংচু— ‘তাছাড়া পদমের মার্ডার কেস নিয়ে আপনার তো আগ্রহ থাকার কথা নয়। আপনার ক্লায়েন্ট মিস্টার লেনডুপ, যিনি আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছেন তাঁর ছেলে এলভিস লেনডুপকে খুঁজে বের করতে। তাই না?’

‘ঠিক কথা? কিন্তু আমার মনে হচ্ছে পদমের মৃত্যুর সঙ্গে এলভিসের কোনো—না—কোনো যোগাযোগ আছে।’ অর্জুন বলল।

‘সেটা তো জানার উপায় নেই। মৃত মানুষ কথা বলে না।’

‘কিন্তু আমরা যাকে জড়পদার্থ বলি তা অনেকসময় কথা বলে।’

‘আপনি কি সেরকম কিছুর সন্ধানে ওর বাড়িতে যেতে চাইছেন?’

‘হ্যাঁ, অবশ্য আপনি যদি সাহায্য করেন!’

একটু ভাবলেন মিস্টার ওয়াংচু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি কি এখানে হোটেলের গাড়িতে এসেছেন?’

‘না। আমি হেঁটে এসেছি।’

পদম যে—বস্তিতে থাকত তারা বোধ হয় পুলিশের গাড়ি চেনে। তাই মিস্টার ওয়াংচুর গাড়ি দেখে নির্লিপ্তভঙ্গিতে সরে দাঁড়াল। অর্জুন বুঝতে পারল, বস্তির মানুষ পুলিশকে এড়িয়ে চলে। মিস্টার ওয়াংচুকে দেখে একজন সেপাই এগিয়ে এসে সেলাম করল। তাকে ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ক’জন ডিউটিতে আছ?’

‘দু’জন স্যার।’

‘হুঁ। কেউ ঘরে ঢুকতে চেয়েছিল?’

‘একজন এসেছিল। ওর ভাইপো, আমরা ঢুকতে দিইনি।’

‘সে যে ভাইপো তা জানলে কী করে?’

‘ছেলেটা নিজেই বলল।’

‘বস্তির লোকজন ওকে ভাইপো হিসেবে জানে?’

লোকটা মুখ নিচু করল— ‘জিজ্ঞাসা করা হয়নি স্যার।’

পদমের ঘরের সামনে দাঁড়ানো দ্বিতীয় সেপাই সোজা হয়ে সেলাম জানাল। অর্জুন দেখল, শুধু পদমের ঘর নয়, আশপাশের ঘরের দরজাও বন্ধ। জলপাইগুড়ির কোনো পাড়ায় খুন হয়ে যাওয়া মানুষের বাড়িতে পুলিশ এলে কৌতূহলীদের সামলানো মুশকিল হয়। এখানে ঠিক তার উলটো। পুলিশ দরজার তালা আগেই খুলেছিল। ওয়াংচুর পেছনে অর্জুন ভেতরে ঢুকল। আট বাই বারো ঘরে একটা তক্তাপোশ, বাঁ দিকে রান্নার সরঞ্জাম, দুটো ছোট আলমারি আর একটা মিটকেস। এই ছিল পদমের সংসার। ছোট আলমারির একটার মাথায় ফ্রেমে বাঁধানো মহিলার ছবি। অনুমানে বোঝা গেল, ইনিই পদমের স্ত্রী।

মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘কী দেখতে চাইছেন, দেখুন!’

অর্জুন কাচের আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে দেখার চেষ্টা করল। ভেতরে বেশ কিছু জামা—প্যান্ট ভাঁজ করে রাখা। আলমারির গায়ে তালা নেই। ওটা খুলে দেখতে গিয়ে বড় খামটার ওপর চোখ পড়ল। খামের ভেতর পদমের ব্যক্তিগত কাগজপত্র, চাকরির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার থেকে জীবনবিমার কাগজ। শেষপর্যন্ত একটা ছোট অ্যালবামের সন্ধান পেল। কিন্তু তার ভেতরে পদমের বাল্যকালের ছবিগুলো রয়েছে। অ্যালবাম রাখতে যেতেই কার্ডটা চোখে পড়ল— ফোটো ওয়র্ল্ড, থিম্পু। কী মনে হতে কার্ডটা তুলে নিল অর্জুন। মিস্টার ওয়াংচু তখন তার দিকে তাকিয়ে।

‘ওটা কার কার্ড?’ মিস্টার ওয়াংচু জিজ্ঞাসা করলেন।

‘ফোটো ওয়র্ল্ড নামের একটি দোকানের।’

‘ছোট ফোটোর দোকান। চ্যাঙলানে। ওটা কী দরকার?’

অর্জুন বলল, ‘বাংলায় একটা ছড়া আছে, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দ্যাখো তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্যরতন।’

‘পেলে খুশি হব। এবার যেতে হবে।’ বাইরে বেরিয়ে মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘আমি আমার রিপোর্টে আপনার কথা লিখব না। আপনি যে সঙ্গে এসেছিলেন তা জানাবার দরকার মনে করছি না। দয়া করে আপনিও কাউকে একথা বলবেন না!’

‘কাউকে বলতে আপনি কি মিস্টার লেনডুপের কথা বলছেন?’

মিস্টার ওয়াংচু জবাব না দিয়ে কাঁধ নাচালেন। তারপর পুলিশের গাড়িতে উঠে বেরিয়ে গেলেন।

একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে ঢুকে টোস্ট—ওমলেট আর চা খেয়ে নিল অর্জুন। কয়েকটা কথা তার মাথায় জট পাকাচ্ছিল। হোটেল হিমালয়ের অন্যতম অংশীদার যে মিস্টার লেনডুপ, তা তাকে জানানো হয়নি। হয়তো এটা বড়লোকের বিনয়। কিন্তু সেই হোটেলেই এলভিস তার চিনে বন্ধুদের নিয়ে কয়েকদিন থেকেছে, এটা কী করে সম্ভব? এলভিস তার বাবার বিরুদ্ধে যাবতীয় ঘৃণা তার ডায়েরির পাতায় উগরে দিয়েছে। যে—বাবাকে সে বুর্জোয়া বলে মনে করে, তার হোটেলে সে কেন চিনে বন্ধুদের নিয়ে থাকল? ওই হোটেলের দুটো ঘরের দৈনিক ভাড়া কম নয়। সেটা কে দিয়েছিল? এলভিসের মা জানেন, হোটেলটার মালিকানায় তাঁর স্বামীর ভাগ আছে। তিনি কেন টাকা দিতে যাবেন? চিনে ছেলেরা কি দিয়েছিল? যদি না দিয়ে থাকে, যদি আদৌ কোনো পেমেন্ট না দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে এলভিসের সততা সম্পর্কে প্রশ্ন উঠবেই। সে কি মায়ের প্রশ্রয় পেয়ে বাবাকে ব্যবহার করেছিল?

দ্বিতীয় ভাবনাটা স্রেফ অনুমানের ওপর নির্ভর করে মাথায় এল। মিস্টার ওয়াংচু যেন তাকে সতর্ক করার চেষ্টা করেছিলেন, তাকে মিস্টার লেনডুপ দায়িত্ব দিয়েছেন এলভিসকে খুঁজে বের করতে, পদমের মৃত্যুরহস্য সমাধান করতে নয়। মিস্টার ওয়াংচুর কথার ভঙ্গিতে মনে হয়েছিল তিনি মিস্টার লেনডুপকে চটাতে চাইছেন না। কেন? মিস্টার লেনডুপ একজন ধনী ব্যবসায়ী, থিম্পুর রাজনৈতিক মহলে ভদ্রলোক ক্ষমতাবান, তা অর্জুনের অবশ্য জানা নেই। কিন্তু পুলিশের একজন বড়কর্তা তাঁকে এত সমীহ করবেন কেন?

এখন সকাল দশটা বেজে গিয়েছে। চ্যাঙলান একটি কমার্শিয়াল এলাকা। দোকানপাট, অফিস খুলে গিয়েছে, ফোটো ওয়র্ল্ড খুঁজে বের করতে বেশি পরিশ্রম করতে হল না। সাধারণ ফোটোর দোকান; এক বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন— ‘টুরিস্ট? ছবি তুলবেন?’

মাথা নাড়ল অর্জুন— ‘না। আপনি কি দোকানের মালিক?’

বৃদ্ধ হাসলেন— ‘মালিক থেকে চাকর, আমিই সব কিছু।’

‘আপনি হোটেল হিমালয়ে চাকরি করত একজন যার নাম পদম, তাকে মনে করতে পারছেন?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ হ্যাঁ। ওর বউয়ের ছবি তো আমি এনলার্জ করে বাঁধিয়ে দিয়েছি। আপনি পদমের কাছ থেকে আসছেন?’

‘হ্যাঁ, পদম কি আপনাকে ওর মোবাইলে তোলা কোনো ছবি প্রিন্ট করতে দিয়েছিল?’

বৃদ্ধ মনে করার চেষ্টা করলেন— ‘হতে পারে? অনেকেই তো দেয়।’

‘সেই ছবিতে তিনজন চিনে ছেলে ছিল।’

হঠাৎ বৃদ্ধের মুখের চেহারা বদলে গেল— ‘আপনি জানলেন কী করে?’

‘পদমই বলেছে।’

‘ও। তাহলে তো এটাও বলেছে, সেই ছবি একটা লোক এসে পদমের নাম করে নিয়ে গেছে, যাকে পদম পাঠায়নি আমার কাছে।’ বৃদ্ধ বললেন।

‘সে কী?’ অবাক হল অর্জুন।

‘সামান্য একটা ছবি যে কেউ মিথ্যে বলে নিয়ে যেতে পারে, তার অভিজ্ঞতা আমার ছিল না। পরে পদম যখন এসে শুনল, তখন সে—ও অবাক হয়ে গেল। যদিও মোবাইলটা আমার কাছেই ছিল বলে আমি আবার পদমকে প্রিন্ট বের করে দিয়েছিলাম—’ বৃদ্ধ বললেন।

‘যে—লোকটি মিথ্যে বলে নিয়ে গিয়েছিল সে কি এখানকার মানুষ?’

‘বোধ হয়, তার মুখ মনে নেই। তবে ভুটানিতেই কথা বলছিল। কিন্তু আপনি আমাকে এসব জিজ্ঞাসা করছেন কেন?’

‘কারণ সেই ছবি পদমের কাছে নেই। আপনার কাছে কি এক্সট্রা কপি আছে?’

‘না, নেই।’ বৃদ্ধ মাথা নাড়লেন।

‘কোনোভাবে কি অন্তত দেখানো যায় না। আমি কপি চাই না, কিন্তু শুধু দেখার জন্যে দু’শো টাকা দিতে রাজি আছি।’ অর্জুন বলল।

‘কী আশ্চর্য! ছবিটা তো আপনি পদমের কাছে গেলেও দেখতে পাবেন।’

মৃত্যুর খবরটা দিতে গিয়েও সামলে নিল অর্জুন। বলল, ‘পদম থাকলে সমস্যা হত না, ও এখন থিম্পুতে নেই।’

‘ও। একটু অপেক্ষা করুন, খুঁজে দেখতে হবে। বউনির সময়ে দু’শো টাকা দিতে চাইছেন, না বলা ঠিক নয়। একটু অপেক্ষা করুন।’ বৃদ্ধ ভেতরে চলে গেলেন। অর্জুন রাস্তার দিকে তাকাল। বেশ শান্ত পরিবেশ। তাহলে পদম জানত, ওই ছবি তার নাম করে কেউ বা কারা নিয়ে গিয়েছে কিন্তু একথা তাকে বলেনি সে। অবশ্য বলার কোনো কারণ ছিল না। ছবিটা কার দরকার হতে পারে? যে নিয়েছে সে মোবাইলের চিপস রেখে যাবে কেন? নাকি শুধু দেখতে চেয়েছিল ছবিটায় কী আছে!’

বৃদ্ধ ফিরে এল— ‘দুটো ছবি তোলা হয়েছিল। যেটা ভালো সেটাই পদম নিয়ে গিয়েছে। একটু আউট অফ ফোকাস প্রিন্টটা আমার পুরনো ছবির প্যাকেটে পড়েছিল। দেখুন, এতে যদি আপনার কাজ হয়!’

একটা না—ছাঁটা ছবি এগিয়ে দিল বৃদ্ধ। সামান্য নড়লেও ছবিটা বোঝা যাচ্ছে। তিনটে চিনা ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এলভিস। ওর বাবা যে ভুটানের মানুষ তার ছাপ ছেলেটির মুখে বিন্দুমাত্র নেই।

পার্স খুলে দুটো একশো টাকার নোট এগিয়ে দিল অর্জুন। টাকা নিয়ে বৃদ্ধ বলল, ‘ছবিটা ইচ্ছে করলে রাখতে পারেন। প্যাকেট ভর্তি হয়ে গেলে তো ফেলেই দিতাম।’

ধন্যবাদ জানিয়ে ছবি নিয়ে রাস্তায় নামল অর্জুন।

হোটেলে পৌঁছে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকল অর্জুন। তারপর ছবিটা সামনে ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। এলভিসের বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপরে ওটা কী? অনেকক্ষণ লক্ষ করে অর্জুনের মনে হল, ওটা বেশ বড়সড় জড়ুল। ছবিতে বেশ কালচে দেখাচ্ছে। চিনে ছেলেগুলোর কোনো বিশেষ বৈশিষ্ট্য নেই, চিনেরা যেমন হয়, তেমনই।

অর্জুন উঠে বসে রিসিভার তুলে অপারেটরকে বলল মিস্টার লেনডুপকে  ফোনে ধরতে। আধ মিনিট পরে মিস্টার লেনডুপের গলা কানে এল— ‘ইয়েস, মিস্টার অর্জুন, গুড মর্নিং, বলুন কী করতে পারি?’

‘আপনাকে জানানো হয়নি, এলভিসের একটা ছবি আমার দরকার!’

‘কেন?’

‘যাকে খোঁজার দায়িত্ব দিয়েছেন, তার চেহারা না জানলে খুঁজব কী করে?’

‘তা অবশ্য। কিন্তু ওর এখনকার চেহারার কোনো ছবি আছে কিনা আমি জানি না। বাড়িতে এলভিসের শৈশব এবং বাল্যকালের অনেক ছবি আছে।’

‘পাসপোর্ট ভিসার জন্যে ছবি তুলতে নিশ্চয়ই হয়েছিল। আপনার স্ত্রী নিশ্চয়ই খবর রাখেন।’ অর্জুন বলল।

‘ঠিক আছে। আমি দেখছি। পেলে পাঠিয়ে দেব। আর হ্যাঁ, আমাকে এখনই পারো শহরে যেতে হচ্ছে, সারাদিন দেখা হবে না।’

‘ঠিক আছে। আমিও একবার মিস্টার অমল সোমের কাছে যেতে পারি।’

‘বেশ তো। আমি জিগমেকে বলে দিচ্ছি। হোটেলের অপারেটরকে বললে সে জিগমেকে ডেকে দেবে, আর কিছু?’

‘না। ধন্যবাদ।’

‘বাই দ্য ওয়ে, আপনি কতটা এগিয়েছেন?’

প্রশ্ন শুনে অর্জুন ইচ্ছে করেই সশব্দে হাসল— ‘ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? সময় এলে আমিই আপনাকে জানাব।’

ঘণ্টাখানেক পরে দরজায় শব্দ হল। অর্জুন দরজা খুলতেই একজন বেয়ারা সেলাম করে খামটা দিয়ে চলে গেল। খাম থেকে ছবি বের হল। এলভিসের ছবি। বছর পনেরো—ষোলো বছরের এলভিস। সরল চোখে সামনে তাকিয়ে আছে। বাঁ হাতের কনুইটা যেন ইচ্ছে করেই পেছনে রেখে ছবি তোলা হয়েছে। ফলে বাঁ হাতের কনুই ক্যামেরায় ধরা পড়েনি আর সেইজন্যে জুড়ুলটাকে দেখা যাচ্ছে না।

অর্জুন হোটেল থেকে বেরিয়ে একটু এলোমেলো হাঁটল। সে যখন বুঝতে পারল, তাকে কেউ অনুসরণ করছে না, তখন একটা  টেলিফোন বুথে ঢুকে ভারতে ফোন করতে চাইল। ছোট দুটো খোপ। তার একটায় ঢুকে জিরো নাইন ওয়ান ঘুরিয়ে জলপাইগুড়ির কোড নাম্বার এল, ফোন নাম্বার ডায়াল করতেই জগুদার ফোন জানান দিল।

জগুদা সাড়া দিলেন—’হ্যালো।’

‘আমি অর্জুন বলছি।’

‘হ্যাঁ, বল।’

‘বোমা বিস্ফোরণের কিনারা হল?’

‘নাঃ। যে—ছেলে চারটে মারা গিয়েছে, তাদের পুলিশ এখনও আইডেন্টিফাই করতে পারেনি। অবশ্য এখন লোকাল পুলিশ নয়, তদন্ত হাতে নিয়েছে আইএনআই।’

‘যে—ছেলেটার পকেটে চাইনিজ সিগারেট পাওয়া গিয়েছে তাকে কীরকম দেখতে বলতে পারবেন?’

প্রশ্ন করামাত্র লাইন কেটে গেল। কয়েকবার হ্যালো বলার পর রিসিভার নামিয়ে রাখল অর্জুন। বুথের লোকটা বলল, ‘একশো আশি টাকা হয়ে গেছে। আবার ফোন করবেন?’

‘হ্যাঁ।’ অর্জুন রিসিভার তুলল। কিন্তু কয়েকবার চেষ্টা করেও জগুদার গলা শুনতে পেল না। অদ্ভুত সব আওয়াজ ভেসে এল।

বুথের লোকটা বলল, ‘পাচ্ছেন না? ইন্ডিয়ার ফোন সবসময় গোলমাল করে। আপনি চিন কিংবা আমেরিকায় ফোন করুন, সঙ্গে সঙ্গে লাইন পেয়ে যাবেন।’

একশো আশি টাকা খরচ হল কিন্তু কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। অর্জুন হোটেলে ফিরতে ফিরতে ভাবল একবার অমল সোমের সঙ্গে দেখা করা দরকার। যে—সন্দেহটা মনে পাক খাচ্ছে সেটা তো ভুল হতে পারে। আর সঠিক হলে তার এক মুহূর্ত ভুটানে থাকা নিরাপদ নয়। এ বিষয়ে অমল সোমের মতামত জানা তার কাছে খুব জরুরি।

রিসেপশনিস্ট হাসল। হেসে বলল, ‘পুলিশ আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্যে এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল।’

‘আমার জন্যে?’ অর্জুন অবাক হল— ‘কেন? কিছু বলেছে?’

‘না না, এটা রুটিন ডিউটি। আসলে আমরা আমাদের ক্লায়েন্টদের নিরাপত্তার ব্যাপারটায় খুব গুরুত্ব দিই। কারওর কোনো অসুবিধে বা গোলমাল হলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়।’

‘আমার তো কোনো অসুবিধে বা গোলমাল হয়নি।’ অর্জুন বলল।

‘না হলে খুব ভালো। কিন্তু হতে পারে আশঙ্কা করে, আমরা পুলিশকে খবর দিয়েছি। একজন বেয়ারা হঠাৎ দেখতে পায় আপনার ঘরের দরজা খোলা রয়েছে। কেউ তো দরজা খুলে রেখে বাইরে যায় না। আপনি ঘরের চাবি সঙ্গে নিয়ে বাইরে গিয়েছিলেন; তাহলে দরজা খোলা কেন? পুলিশ এসে চেক করেছে কিন্তু ঘর লন্ডভন্ড করে যায়নি কেউ। কিন্তু কোনো কিছু চুরি গেলে একমাত্র আপনি জানতে পারবেন। তাই ওরা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিল। যদি আপনার মনে হয় কিছু চুরি গিয়েছে তাহলে ওদের জানালে ব্যবস্থা নেবে।’ কথাগুলো বলে রিসেপশনিস্ট হাসল— ‘হোটেল হিমালয়ে আজ পর্যন্ত চুরি হয়নি। আশা করি, আপনার সব জিনিস ঠিকঠাক আছে।’

দ্রুত ঘরে চলে এল অর্জুন। ঘরের দরজা বন্ধ। সম্ভবত হোটেল থেকেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলল সে। চারদিকে কোনো গোলমাল চোখে পড়ল না। তার সুটকেসও যেমন ছিল তেমনই রয়ে গিয়েছে। ওটা খুলে বুঝল, কেউ ভিতরে হাত দেয়নি। তাহলে দরজা খোলা ছিল কেন? কী করেই—বা খুলল। সে দরজাটা যে বন্ধ করেই বেরিয়েছিল তা স্পষ্ট মনে আছে।

বিছানা—বালিশ ঠিকঠাক রয়েছে, হঠাৎ মনে আসতেই সে খুঁজতে আরম্ভ করল। ডায়েরিটা, এলভিসের ডায়েরিটাকে দেখতে পাচ্ছে না সে। ওটা বালিশের পাশেই রাখা ছিল। আর সেই ডায়েরির মধ্যে ‘ফোটো ওয়র্ল্ড’ থেকে নিয়ে আসা এলভিসদের গ্রুপ ফোটোর কপি রাখা ছিল। সেটাও নেই। কিন্তু রয়ে গিয়েছে মিস্টার লেনডুপের পাঠানো ছবিসুদ্ধ খামটা।

আরও একটু খুঁজে দেখল অর্জুন। আর কোনো সন্দেহ নেই যে এই ঘরের দরজা কেন খোলা হয়েছিল।

ঘরের  ফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলতেই সে শুনল, ‘রিসেপশন থেকে বলছি স্যার। সব ঠিক আছে তো?’

হাসল অর্জুন— ‘সব ঠিক আছে। আমার কিছুই খোয়া যায়নি।’ রিসিভার নামিয়ে রাখল সে।

ক্রমশ সরল হয়ে যাচ্ছে সমস্যা। তার কাছে এলভিসের ডায়েরি রয়েছে এটা মিস্টার লেনডুপ জানেন, বাইরের কারওর এটা জানার কথা নয়। ডায়েরিটা তার কাছে থাকুক এটা যে চায় না, সে কী করে খবরটা পেল? যাকে পাঠানো হয়েছিল সে কি শুধু ডায়েরির জন্যে এসেছিল না, ফোটো ওয়র্ল্ড—এর গ্রুপ ছবিটাও লক্ষ্যে ছিল? সে ছবিটা যে সংগ্রহ করেছিল, তা ওই দোকানের বৃদ্ধ মালিক কি কাউকে জানিয়েছিলেন? নাকি সেই দোকান থেকে তাকে অনুসরণ করে এই হোটেলে কেউ এসেছিল? কেন আসবে? সবশেষে হোটেলের ঘরের দরজার চাবি একটা ক্লায়েন্টের কাছে অন্যটা রিসেপশনে থাকে। তাহলে যে দরজা খুলেছিল সে চাবি কোথায় পেল? তা না হলে দরজা খুলল কী করে?

অর্জুন রিসিভার তুলল। অপারেটরকে বলল, ‘মিস্টার লেনডুপের ড্রাইভার জিগমেকে দয়া করে ফোন করে হোটেলে আসতে বলবেন?’

‘সিয়োর স্যার!’

‘আর একটা কথা, আপনাদের হোটেলের প্রতিটি ঘরে কি সাউন্ড রেকর্ড করার ব্যবস্থা আছে?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

একটু সময় নিয়ে অপারেটর বলল, ‘উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়, স্যার।’

আধঘণ্টা পরে রিসেপশন থেকে জানানো হল, গাড়ি এসে গিয়েছে। তৈরি ছিল অর্জুন। স্যুটকেস নিয়ে নীচে নেমে চাবি ফেরত দিয়ে বলল, ‘মিস্টার লেনডুপের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গিয়েছে।’

‘ওকে স্যার।’

হোটেলের বাইরে গাড়ির সামনে জিগমে অপেক্ষা করছিল। তাকে দেখে হাত নেড়ে হাসল সে। ঠিক তখনই পুলিশের গাড়ি এসে দাঁড়াল সামনে। গাড়ি থেকে নামলেন মিস্টার ওয়াংচু। সুটকেস জিগমের হাতে দিয়ে অর্জুন এগিয়ে গেল, ‘কী ব্যাপার? আপনি!’

‘শুনলাম, হোটেলে আপনার ঘর থেকে কিছুই চুরি যায়নি।’

অর্জুন হাসল, ‘এর মধ্যে খবর পেয়ে গেছেন?’

মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘আপনার সম্পর্কে আমরা সব খবর পেয়েছি। আপনি পুলিশের সঙ্গে সবসময় সহযোগিতা করেছেন। আমাদের বড়কর্তার ইন্ডিয়ান কাউন্টার পার্ট আপনার খুব প্রশংসা করেছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, আপনার সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর হোটেলের বেয়ারা পদম খুন হয়েছিল। আবার আজ সকালে পদমের ঘর থেকে কার্ড নিয়ে ফোটোর দোকানে গিয়েছিলেন আপনি। কিন্তু সেখান থেকে আপনি চলে আসার পর ওই বৃদ্ধ খুন হয়েছেন।’

কয়েক সেকেন্ড কথা বলতে পারল না অর্জুন। তার মুখের দিকে তাকিয়ে মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘আমরা খবর নিয়ে জেনেছি, আপনি দোকান থেকে বেরিয়ে আসার পরেও বৃদ্ধ দোকানদার সুস্থ ছিলেন। দু’জন কাস্টমারের সঙ্গে কথাও বলেছেন। একটা ফোন করেছেন অর্থাৎ, ওঁর সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক দেখতে পাচ্ছি না।’

‘কীভাবে মারা গিয়েছেন উনি?’

‘কেউ খুব কাছ থেকে গুলি করেছিল। সম্ভবত সাইলেন্সার লাগানো ছিল বলে কেউ শব্দ শুনতে পায়নি।’ মিস্টার ওয়াংচু বললেন, ‘হয়তো ব্যাপারটা একদম কাকতালীয় কিন্তু কয়েকঘণ্টার মধ্যে থিম্পুতে দুটো মানুষ খুন হয়ে গেল এবং সেই দুটো লোক খুন হল আপনার সঙ্গে কথা বলার পরে। এব্যাপারের পেছনে কি কোনো কারণ থাকতে পারে মিস্টার অর্জুন?’ মিস্টার ওয়াংচু জিজ্ঞাসা করলেন।

অর্জুন মানুষটির দিকে তাকাল। খুশি না হলে বা রেগে না গেলে পাহাড়ি মানুষের মনের কথা সহজে বোঝা যায় না। সে বলল, ‘পদমের কাছে এলভিস এবং তার তিনজন চিনে বন্ধুর ছবি ছিল। এলভিসের এখনকার চেহারা কেন, কোনো কালের চেহারাই আমি জানতাম না। অনুরোধ করায় আজ মিস্টার লেনডুপ ছেলের অল্প বয়সের ছবি পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি পদমকে অনুরোধ করেছিলাম তার কাছে

যে—ছবিটা আছে সেটা দেখাতে। সে রাজি হয়েছিল। হয়তো সে কারণেই—’

‘আপনার সঙ্গে পদমের কথা বলার সময় আর কেউ ছিল?’

‘না। তবে এই হোটেলের ঘরে আপনি সামান্য শব্দ করলেই সেটা কোনো ঘরে রেকর্ডেড হয়ে যায়।’

‘আচ্ছা! সিসিটিভির কথা জানি, এটা তো শুনিনি। তাহলে সেই ছবির কপি বৃদ্ধের দোকান থেকে আনতে গিয়েছিলেন। কিন্তু পেয়েছিলেন কি? বৃদ্ধ কি দিয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ। তবে রাফ কপি, আনকাট। সেটাই হয়তো ওঁর অপরাধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই ছবিও হোটেলের ঘর থেকে চুরি হয়েছে।’

‘আচ্ছা! শুধু এই ছবিটাই চুরি হয়ে গেল?’

‘না। এলভিসের লেখা একটা ডায়েরি আমি মিস্টার লেনডুপের বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিলাম। ছবির সঙ্গে সেটাও চুরি হয়ে গিয়েছে।’

মাথা নাড়লেন মিস্টার ওয়াংচু, ‘আপনি যে—কাজের দায়িত্ব নিয়ে থিম্পুতে এসেছিলেন, সেটা মনে হচ্ছে কিছুটা গুলিয়ে যাচ্ছে!’

‘হ্যাঁ। তা তো বটেই। আমাকে কেউ, খুব প্রভাবশালী কেউ, একদম পছন্দ করছেন না। তাই যাঁরা আমাকে সাহায্য করছেন, তাঁদের সরিয়ে দিচ্ছেন। বিনাদোষে কেন এঁদের খুন করা হল বুঝতে পারছি না।’ অর্জুন বলল।

‘খুনগুলো করা হয়েছে আপনাকে সতর্ক করার জন্যে। তাতে যদি আপনি সতর্ক না হন তাহলে শেষ আঘাতটা আপনার ওপর আসাই স্বাভাবিক। মিস্টার অর্জুন, আমার মনে হচ্ছে, আপনি অন্তত কয়েকদিনের জন্যে থিম্পুর বাইরে চলে যান। আপনার নিজের নিরাপত্তার জন্যেই যাওয়া উচিত।’ কথাগুলো বলে মিস্টার ওয়াংচু তাঁর গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ি চলে গেলে অর্জুন জিগমের গাড়িতে উঠল। জিগমে জিজ্ঞাসা করল, ‘পুলিশ সাহেব কি আপনাকে ভয় দেখাচ্ছিল?’

অর্জুন হাসল, ‘উনি ভয় দেখাবেন কেন?’

জিগমে গাড়ি চালু করে বলল, ‘পুলিশের কাজ তো ওটাই।’

মিস্টার ওয়াংচুকে কতটা বিশ্বাস করা যায়? তাঁর শহরে দু’দুটো খুন হয়ে গেল অথচ তিনি যেন খুনিকে ধরতে খুব উৎসাহিত নন। বরং নির্লিপ্ত মনে হচ্ছে। অর্জুন থিম্পুর বাইরে চলে গেলে যেন স্বস্তি পাবেন ভদ্রলোক।

হোটেল হিমালয়ের ঘরে ঘরে শব্দ রেকর্ড করার ব্যবস্থা আছে জেনেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না ভদ্রলোক। সিসিটিভির প্রসঙ্গ তুলে ব্যাপারটাকে হালকা করলেন। যদি রেকর্ড করার প্রক্রিয়া কয়েক মাস ধরে চালু থাকে তাহলে এলভিস এবং তার চিনে বন্ধুরা যে—ঘরে থেকে কথা বলেছে, তাও রেকর্ডেড হয়ে আছে। অর্জুন চাইলে হোটেল ম্যানেজার অবশ্যই সহযোগিতা করত না কিন্তু মিস্টার ওয়াংচু তাঁর পদাধিকার বলে চাইলে সেটা অবশ্যই পেতেন। সেই কথাবার্তার রেকর্ড থেকে হয়তো এমন তথ্য পাওয়া যেত যা এলভিসের ব্যাপারে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যেত। মিস্টার ওয়াংচুকে ওই অনুরোধ করতে গিয়েও করেনি সে। লোকটা যদি সৎমানুষ হয় তাহলে প্রভাবশালীরা বিরক্ত হবে, বিপদে পড়বেন তিনি। আর যদি সৎ না হয় তাহলে অর্জুনের বিপদ বাড়বে।

জিগমে গাড়ি চালাচ্ছিল চুপচাপ। অর্জুন জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি মিস্টার ওয়াংচুকে পছন্দ করো না, না?’

‘আমার পছন্দ—অপছন্দে কার কী যায় আসে!’ জিগমে উদাস।

‘মনে হচ্ছে আজ তোমার মুড ভালো নেই!’ অর্জুন বলল।

‘কী করে ভালো থাকবে? আমার দাদার শ্বশুরকে আজ খুন করা হয়েছে। লোকটার কোনো দোষ ছিল না। কারওর মনে হল ওকে খুন করা দরকার, তাই খুন হয়ে গেল? আজব দুনিয়া।’ চে�চিয়ে কথাগুলো বলল জিগমে।

‘তোমার দাদার শ্বশুরের কি ফোটোর দোকান ছিল?’

গাড়ি চালাতে চালাতে চট করে ঘাড় ঘুরিয়ে অর্জুনকে দেখে নিয়ে জিগমে বলল, ‘আপনি কী করে জানলেন!’

অর্জুন কথা বলল না। জিগমে আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, আপনি কি পুলিশে কাজ করেন?’

‘না। একদম না। একটু আগে মিস্টার ওয়াংচুর কাছে শুনছিলাম।’

‘ও, তাই বলুন।’

‘আচ্ছা জিগমে, থিম্পুতে চাইনিজ সিগারেট পাওয়া যায়?’

‘যায় স্যার।’

‘মিস্টার লেনডুপের ছেলে এলভিস কি সিগারেট খেত?’

‘ওই বয়সের বেশিরভাগ ছেলেই সিগারেট খায়। এখন একটু কমে এসেছে। তবে এলভিসকে কয়েকবার সিগারেট খেতে দেখেছি।’

‘ভুটানের রাজার পিসির বাংলোর গেটের সামনে একটা বাইসন দাঁড়িয়েছিল। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে বিদুৎগতিতে চলে গেল, পাশের জঙ্গলে। জিগমে বলল, ‘স্যার, আমাদের কপাল ভালো, না হলে ভরদুপুরে বাইসনের দেখা পেতাম না।’

‘বাইসনের সঙ্গে কপালের কী সম্পর্ক?’ অর্জুন জিজ্ঞাসা করল।

‘হাজার বছর আগে একজন গরিব মানুষ অভাব সহ্য করতে না পেরে পাহাড়ি ঝরনার পাশে গিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। ঠিক সেই সময় ওই ঝরনার অন্য পারে একটা বাইসন এসে দাঁড়ায়। বাইসন তাকে বলে, বোকারাই আত্মহত্যা করে। তোমার প্রাণ তুমি তৈরি করোনি, তাই তাকে মারার অধিকার তোমার নেই। তুমি বাড়ি ফিরে যাও। আমাকে দেখার পর তোমার আর কোনো কষ্ট থাকবে না। গরিব লোকটা বাড়ি ফিরে গেল। কিছুদিনের মধ্যেই সে বিশাল ধনী হয়ে গিয়েছিল।’

জিগমের কথা শুনে হেসে গাড়ি থেকে নামতেই অর্জুন শুনল মোবাইলে রিং হচ্ছে। ওটা জিগমের মোবাইল। জিগমে যন্ত্রটা বের করে কানে চেপে ‘হ্যালো’ বলেই সোজা হয়ে বসল। তার গলা দিয়ে চিৎকার ছিটকে বের হল! ভুটানি শব্দ উত্তেজিত হয়ে বলতে বলতে সে অর্জুনের দিকে তাকাল। তারপর যন্ত্রটা বন্ধ করে গাড়ি চালু করে জিগমে উত্তেজিত হয়ে বলতে বলতে সে অর্জুনের দিকে তাকাল। তারপর যন্ত্রটা বন্ধ করে গাড়ি চালু করে জিগমে উত্তেজিত গলায় বলল, ‘পারো থেকে  ফোন এসেছিল। ওখানে বোমা বিস্ফোরণ হয়েছে। বড় সাহেবের ড্রাইভার মারা গিয়েছে। সাহেব খুব উন্ডেড। সেন্সলেস। হাসপাতালের ডাক্তাররা বাঁচাবার চেষ্টা করছে, আমি পারো যাচ্ছি স্যার।’ গাড়ি ঘুরিয়ে দ্রুত চলে গেল জিগমে।

মুহূর্তে ছবি বদলে গেল। হোটেল হিমালয়ের অন্যতম অংশীদার মিস্টার লেনডুপকে খুন করতে কে চেয়েছে? ছেলের সন্ধান করতে যে—ভদ্রলোক তাকে অনুরোধ করেছেন কিন্তু প্রতিটি পদক্ষেপ তার ওপর নজর রেখেছেন বলে অর্জুনের ধারণা কিন্তু কেন সেটা করেছেন তা বুঝতে পারছিল না বলেই অমল সোমের সঙ্গে আলোচনা করতে এসেছিল সে। ভদ্রলোক যে হোটেল হিমালয়ের অন্যতম অংশীদার তা কখনও অর্জুনকে জানাননি। অংশীদার বলেই হোটেলের সব খবর তিনি সহজে পেয়ে যেতেন। এরকম লোককে কে হত্যা করবে? তার কী উদ্দেশ্য?

শব্দ করতেই গেট খুলে দিল সেই কর্মচারী। অর্জুন এগোতেই দেখল অমল সোম ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন। ওঁর রুটিন অনুযায়ী এখন কারওর সঙ্গে কথা বলার সময় নয়। কথা বলবেন বিকেলের চায়ের সময়। অর্জুন অবাক হল।

অমল সোম বললেন, ‘তোমার কথাই ভাবছিলাম।’

‘কেন?’ অর্জুন তাকাল।

‘তুমি বোধহয় জানো না মিস্টার লেনডুপ এই মুহূর্তে হাসপাতালে। বোমা বিস্ফোরণে ভয়ংকরভাবে ইনজিওরড। ওঁর ড্রাইভার মারা গিয়েছে। গাড়িতে ওঠার সময় বিস্ফোরণ ঘটে।’ অমল সোম বললেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল কিন্তু কোনো কথা বলল না।

‘একটু আগে পারো থেকে ফোন পেয়েছি। তখনই মনে হল তোমার কথা।’

‘কারা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে তা জানতে পেরেছেন?’

‘না। শরীরে বোমা বেঁধে যে—ছেলেটি এসেছিল তাকে পুলিশ এখনও শনাক্ত করতে পারেনি, কারণ তার মুখ উড়ে গিয়েছে বিস্ফোরণের সময়ে। কিন্তু ছেলেটার পকেটে একটা চিনে সিগারেটের প্যাকেট পাওয়া গিয়েছে।’ অমল সোম হাসলেন ‘জলপাইগুড়ির তিস্তার পাশে যে—বিস্ফোরণ হয়েছিল সেখানেও একটি মৃত ছেলের প্যান্টের পকেটে চিনে সিগারেট পাওয়া গিয়েছে। দুটো বিস্ফোরণের মধ্যে কোনো যোগসূত্র থাকা অসম্ভব নয়।’ অমল সোম বললেন।

‘এখন আমারও একই কথা মনে হচ্ছে।’ অর্জুন বলল।

‘তোমাকে মিস্টার লেনডুপ ওঁর ছেলেকে খুঁজে বার করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। উনি এখন যে—অবস্থায় আছেন তাতে ব্যাপারটা আর গুরুত্বপূর্ণ রইল না। কিন্তু যারা ওকে মারতে চেয়েছে তারা তোমাকেও টার্গেট করতে পারে। আমার মনে হয়, তোমার এখনই জলপাইগুড়িতে ফিরে যাওয়া উচিত। ওরা যদি তোমার কাছে পৌঁছয় তাহলে তুমি জলপাইগুড়িতে থাকলেই ভালোভাবে মোকাবিলা করার সুযোগ পাবে।’ অমল সোম বললেন।

বাসে ফুন্টশোলিং পৌঁছতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল। সেখান থেকে জলপাইগুড়ির বাস না পাওয়া গেলেও হাসিমারা পর্যন্ত ট্যাক্সি পেয়ে গেল। হাসিমারা থেকে ট্রেন ধরে শিলিগুড়িতে পৌঁছে জলপাইগুড়ির বাস পেতে অসুবিধে হল না।

বাসে বসেই জগুদাকে ফোন করল সে। ভারতে আসার পর থেকে অর্জুনের মোবাইল দিব্যি কাজ করছে। জগুদা বললেন, ‘এত রাত্রে, তুমি কোথায়?’

‘অনেক রাত হয়ে গেছে না? সরি জগুদা। ভুটান থেকে আসছি। আধঘণ্টার মধ্যে জলপাইগুড়িতে পৌঁছে যাব। নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেল?’

‘আছে। আমি তো এখন থানায় আড্ডা মারছি বন্ধুর সঙ্গে।’

‘বাঃ। তাহলে ওখানেই কিছুক্ষণ থাকুন। আমি আসছি।’ অর্জুন বলল।

রিকশা নিয়ে যখন সে থানায় পৌঁছল, তখন এগারোটা বেজে গিয়েছে। তাকে দেখে জগুদা বললেন, ‘ঝড়োকাকের মতো দেখাচ্ছে যে!’

‘সেরকমই তো অবস্থা।’

‘এঁকে তো চেনো।’ বন্ধু পুলিশ অফিসারকে দেখালেন জগুদা।

‘নিশ্চয়ই। আচ্ছা, বোমা বিস্ফোরণে যারা মারা গিয়েছে, তাদের ডেডবডি কি দেখা যেতে পারে?’

‘অনুমতি নিতে হবে। ওরা এখন এনআইএ—র আওতায়। তবে ওদের ছবি দেখাতে পারি।’ ড্রয়ার খুলে খাম থেকে ছবিগুলো বের করে সামনে রাখলেন অফিসার। চারটে মৃতদেহ, দুটোর ঊর্ধ্বাঙ্গ নেই। বাকিরা ক্ষতবিক্ষত। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে সোজা হয়ে দাঁড়াল অর্জুন। একটি শরীরের বাঁ হাতের কনুইয়ের পাশে যে—জড়ুল ছিল তা ছবিতেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওই ছেলেটির পকেটে কি চিনে সিগারেটের প্যাকেট ছিল?’

অফিসার মাথা নাড়লেন— ‘হ্যাঁ। আপনি কী করে জানলেন?’

‘এই ছেলেটির পরিচয় আপনাকে দিচ্ছি। সম্ভবত, এর নাম এলভিস লেনডুপ। থিম্পুর মিস্টার লেনডুপের ছেলে।’

কথাগুলো বলে অর্জুন ঘর থেকে বেরিয়ে এল। তারপর মধ্যরাতের শহরের রাস্তায় রিকশায় উঠে বাড়ির দিকে এগোতে লাগল।

আদুরি

ভোর হতে না হতেই চলে আসে আদুরি। সেসময় একমাত্র কুন্দনন্দিনী বিছানা ছেড়ে উঠোনের দরজা খোলেন। এই সময় প্রতিদিনই প্রায় একই সংলাপ বিনিময় হয়। কুন্দনন্দিনী বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘একটু  আলো ফুটলে এলে কি অসুবিধে হয়? অ্যাঁ। অন্ধকারে যে বের হন, দিনকাল তো ভালো নয়।’

আদুরি ঠোঁট বেঁকায়, ‘যাকে যমেও ছোঁবে না তার আবার কীসে ভয়! নিজের ঘুম সহজে ভাঙে না, সেকথাই বলো।’

‘আমার ঘুম? ঘুম নিয়ে খোঁটা দিলি হারামজাদি? বিধবা হওয়ার পর চোখ থেকে ঘুম যে চলে গিয়েছে তা তুই বুঝবি কী করে? যা, উনুন ধরা। এখনই সবাই খাট থেকে নেমে চা—চা করবে।’

কাজ শুরু হয়ে যায় আদুরির। চা—বাগানের লাগোয়া এই বাড়িতে সে কাজ করছে দশ বছর। কুড়ি বছর বয়সে কাজে এসেছিল। নিয়ে এসেছিল ওর বাবা শনিচর। কুন্দনন্দিনী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘ও যদি ভালো কাজ করে তো কথাই নেই। কিন্তু দুদিন বাদে যে বিয়ে হয়ে চলে যাবে। তখন আবার লোক খোঁজো, কাজ বোঝাও!’

শনিচর মাথা নেড়েছিল, ‘না মা। ওসব চিন্তা করতে হবে না। আদুরির বিয়ে অনেকদিন আগেই হয়ে গিয়েছে।’

বারান্দায় কুন্দনন্দিনীর পাশে দাঁড়িয়েছিল পুত্রবধূ আরতি। চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘এই বললে ওর বয়স কুড়ি, বিয়ে অনেকদিন আগে হলে তা কত বছর বয়সে হয়েছিল?’

শনিচর হেসেছিল, ‘আমার বাপ তার বন্ধুর নাতির সঙ্গে বিয়েটা দিয়েছে। আমাদের কারও কথা শোনেনি। আদুরির বয়স তখন পাঁচ, ওর বরের বয়েস বারো।’

‘সর্বনাশ!’ আরতির মুখ থেকে শব্দটা বেরিয়ে এল।

কুন্দনন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিয়ের পর মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে না গিয়ে তোমার কাছে পড়ে আছে কেন? শ্বশুরবাড়ি কোথায়?’

‘তিলাগুড়ি চা—বাগানে ওর শ্বশুর কাজ করে। তার বাপ বিয়েটা দিয়েছিল বলে সে মেনে নিতে পারেনি। ভেবেছিল ছেলের বিয়ে দিয়ে অনেক টাকা পাবে, বাপের জন্যে তা পায়নি। তারপর বড় হয়ে ছেলে মিলিটারিতে নাম লিখিয়ে চলে গেল। ওরা কেউ যোগাযোগ রাখেনি। তাই বললাম, কোনো চিন্তা করবেন না, আদুরিকে একটু ভালোবাসলে দেখবেন ও সব কাজ করে দেবে।’ শনিচর মেয়ের মাইনে ঠিক করে চলে গিয়েছিল।

সেই থেকে আদুরি আসে ভোর না হতেই, বাড়ি ফিরে যায় সন্ধের আগেই। ওর কাজে তো বটেই, ব্যবহারেও সবাই খুশি।

এই আদুরি আজ ভোর না হতেই এই বাড়ির উঠোনে পা রাখল না, কুন্দনন্দিনী অবাক হলেন। ধীরে ধীরে বাইরের বারান্দায় গিয়ে তিনি সামনে তাকালেন। মাঠ, মাঠের পরে পিচের রাস্তা। ওই দিক দিয়েই আদুরি আসে। কিন্তু রোদ উঠে গেল, আদুরির দেখা পাওয়া গেল না।

বেলা বাড়ছে, রোদ চড়ছে কিন্তু আদুরির দেখা নেই। এতগুলো বছর ধরে সে কাজ করছে, কখনও না বলে কামাই করেনি। ছেলে প্রদীপ্ত বেরিয়ে গেল চায়ের ফ্যাক্টরিতে। ওর ডিউটির সময় হয়ে গিয়েছে। আরতি বলল, ‘মা, কাউকে পাঠিয়ে খোঁজ নিলে হত না? পাশের গাড়ির খোকনকে বলব?’

‘আমার মনে হচ্ছে শনিচরের শরীর খারাপ হয়েছে বলে আদুরি আসতে পারছে না। কী করা যাবে, নিজেদেরই হাত লাগাতে হবে!’ কুন্দনন্দিনী বললেন।

ওঁরা যখন গতরাতের এঁটো বাসন নিয়ে কলতলায় বসেছেন তখনই হইহই করে এসে পড়ল আদুরি। হাতে বড় চটের ব্যাগ। সেটা একপাশে রেখে আরতি আর কুন্দনন্দিনীকে সরিয়ে বাসন মাজতে বসে গেল।

ছাড়া পেয়ে স্বস্তি হল কুন্দনন্দিনীর। তবু বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত দেরিতে এলি কেন? দেরি হবে এই খবরটা দিতে কি অসুবিধে হয়েছিল?’

কথা বলল না আদুরি। কিন্তু ফিক করে হাসল।

আরতি বললেন, ‘ওমা! ওভাবে হাসছিস কেন?’

জবাব না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বাসন মেজে চলল আদুরি। এক ঘণ্টার মধ্যে হাতের কাজ শেষ করে ব্যাগটা নিয়ে বাথরুমে ঢুকে গেল আদুরি। পাঁচ মিনিট পরে যখন বেরিয়ে এল তখন শাশুড়ি—বউমার চোখ ছানাবড়। সাদা থান আর সাদা ব্লাউজ পরে বাইরে এসে আদুরি বলল, ‘আজ তোমরা রান্না করে নাও, আমাকে এখন যেতে হবে।’

কুন্দনন্দিনী হতভম্ব, ‘যেতে হবে মানে? কোথায় যাবি?’

‘আর বোলো না। আমার বাবা বুড়ো হয়ে গেছে।’

আরতি জিজ্ঞাসা করল, ‘তার বুড়ো হওয়ার সঙ্গে তোর কোথাও যাওয়ার কী সম্পর্ক? আর হঠাৎ এই পোশাক পরলি কেন?’

‘আমি বলেছি একদিনই পরব। কাল থেকে ছুঁয়েও দেখব না।’

আরতি কুন্দনন্দিনীর দিকে তাকাল ‘ওর কথা কিছু বুঝতে পারছেন মা? আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না—!’

কুন্দনন্দিনী গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঠিক করে বল, কোথায় যাচ্ছিস?’

‘শ্বশুরবাড়িতে—!’ চিবুক নামাল আদুরি।

‘অ্যাঁ!’ শাশুড়ি—বউমার গলা থেকে শব্দটা একসঙ্গে ছিটকে এল।

‘তাই তো বললাম। বুড়ো হয়ে বাবার জেদ বেড়ে গিয়েছে। বলল, এতদিন যাওনি, ঠিক আছে, আজ যেতেই হবে তিলাগুড়িতে।’

‘কেন? আজ কী আছে সেখানে?’

‘ওমা, আমাকে যে বিয়ে করেছিল তার লাশ আসবে সেখানে। সেই লাশ বাপ—মা—বউকে দেবে মিলিটারি। তাই আমাকে যেতে হবে।’

‘কী বলছিস তুই? তোর স্বামীর লাশ আসবে মানে? সে কি মরে গিয়েছে?’ কুন্দনন্দিনী চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

‘এতক্ষণ ধরে বলছি কী? কাশ্মীরে ছিল। সেখানে কারা বোমা ছুড়েছিল। সেটা গায়ে লেগেছিল, তাতেই মরে গিয়েছে লোকটা।’ আদুরি ব্যস্ত হল। ‘আমাকে দুপুর বারোটার মধ্যে ওখানে পৌঁছোতে হবে।’

‘তুই একা যাবি?’

‘না, না। আমার দেওর আসবে নিতে।’

‘বিয়ের পর তো কখনও যাসনি?’

‘কে বলল? পাঁচ বছর বয়সে পাঁচ দিনের জন্যে গিয়েছিলাম তো।’

আরতি জিজ্ঞাসা করল, ‘তাহলে এবার দ্বিরাগমনে যাচ্ছিস?’

‘তা বলতে পার।’ মাথা নাড়ল আদুরি।

‘তোর দেওরকে চিনতে পারবি?’

‘নাঃ! কী করে চিনব? তার তো তখন সাত বছর বয়স ছিল। আমার থেকে দু—বছরের বড়। আজ বাবা ওর সঙ্গে কথা বলার পর চিনিয়ে দেবে!’ মাথা নাড়ল আদুরি, ‘উঃ, আজ কত কাজ!’

‘দাঁড়া। শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছিস, কিছু টাকা নিয়ে যা!’ কুন্দনন্দিনী আরতিকে ইশারা করলেন।

‘না—না—না।’ হাত নেড়ে আরতিকে থামাল আদুরি, ‘টাকা লাগবে না। আমার যাওয়া—আসার সব খরচ ওরা দেবে।’

‘তা দিলেও হাতে কিছু রাখা উচিত আদুরি।’ আরতি বলল।

‘লাগলে ওদের কাছ থেকে চেয়ে নেব।’ আদুরি হাসল।

‘যদি না দেয়? কোনোদিন ঘর করিসনি, তুই তো ঘরের বউ নস।!’ কুন্দনন্দিনী বোঝাবার চেষ্টা করলেন।

‘আমাকে খুশি না করলে ওদের তো বিপদ হবে।’

‘মানে?’ আরতি বুঝতে পারল না।

‘ওদের ছেলে তো যুদ্ধক্ষেত্রে মারা গিয়েছে। তাই মিলিটারি অনেক টাকা দেবে। স্বামী মারা গেলে তার বউকে দেয়। তার মানে আমাকে দেবে। সেই টাকার জন্যে আমাকে ওরা খুশিতে রাখবে না?’ আদুরি বলল, ‘এবার আমাকে ছাড়ো, যেতে হবে।’

কুন্দনন্দিনী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তার মানে তুই আর কাজ করবি না?’

অবাক হল আদুরি, ‘একথা জিজ্ঞাসা করছ কেন?’

‘অত টাকা পাওয়ার পর তুই তো পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকবি।’

‘পাগল!’

‘মানে?’

‘ঝাঁটা মারি ওই টাকার মুখে।’

‘সেকী?’ একই সঙ্গে—শাশুড়ি—বউমা শব্দটা বলে ফেলল।

‘আচ্ছা বলো তো, যার চেহারা মনে নেই, এই এতগুলো বছরে যে আমার খবরও নিল না তার মরার পর আমি হাত পেতে টাকা নিতে যাব কেন? ওর বাপ—মা ভাইরা নিয়ে ফুর্তি করুক।’ আদুরি ব্যাগ তুলে নিয়ে পা বাড়াল।’

কুন্দনন্দিনী পেছন থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তাই যখন ভাবছিস তখন থান পরে যাচ্ছিস কেন?’

ঘুরে দাঁড়াল আদুরি, ‘কী করব বলো! বাবা বলল অ্যাদ্দিন তুই যা ছিলি তা ছিলি, কিন্তু আজ থেকে তুই বিধবা হয়ে গেছিস। মরা স্বামীর মুখ দেখে বিধবার দায়টা শেষ করে আয়। বুঝলে?’

কুন্দনন্দিনী এবং আরতি কথা বলতে পারলেন না।

আদুরি হাসল, ‘তোমাদের মুখ দেখে মনে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারোনি।’ আজ থেকে আমি মুক্ত। বুঝলে? পাঁচ বছর বয়সে যে লোকটা আমাকে বেঁচে থাকতেও মেরে দিয়ে গিয়েছিল আজ তার মরা শরীর আমাকে বাঁচিয়ে দিতে আসছে। চললাম।’

ওঁরা দেখলেন, পাখির মতো উড়ে উড়ে চলে গেল আদুরি।

আপনি হলে কী করতেন?


অন্ধকার মঞ্চ। কলিং বেলের শব্দ। প্রথম দু—বার ধীরে, তৃতীয়বার একটু বেশিক্ষণ। মঞ্চে আলো জ্বললে দেখলাম, পাশের ঘর থেকে এক মধ্যবয়সিনি বেরিয়ে  দরজার পাশের সুইচ থেকে হাত সরালেন। তাঁর পরনে ব্লাউজ এবং শায়া। সেই অবস্থায় বাইরের দরজার কী—হোলে চোখ রেখে দেখতে চাইলে চতুর্থবার বেল বেজে উঠল। এবার আরও জোরে। মধ্যবয়সিনি চমকে ছিটকে সরে এলেন।

মধ্যবয়সিনি : কে? কে?

দরজার বাইরে থেকে : আমি,  দরজা খোল। মধ্যবয়সিনি ঠোঁট কামড়ে দু—পাশে মাথা রাখল। না, এত রাতে দরজা খুলব না।

 দরজার বাইরে থেকে: প্লিজ, প্লিজ, মালিনী, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না, ভিতরে ঢোকার পর তুমি যা চাও বলতে পার…!

মধ্যবয়সিনি, যার নাম মালিনী, ভিতরের ঘরে চলে গিয়েই ফিরে এল একটা নাইটি পরতে পরতে। সেটা পরা হলে দু—হাতে মাথার চুল ঠিক করে দরজা খুলতেই বছর চল্লিশের এক স্বাস্থ্যবান পুরুষ ভিতরে ঢুকে সামনের চেয়ারে সশব্দে বসে পড়ল। চুপচাপ দরজা বন্ধ করে সেখানে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে—

 মালিনী : এত রাত্রে আমাকে না জ্বালালে তোমার সুখ হয় না, না?

 সুব্রত : আমার সুখ—!

 মালিনী : যেখানে ছিলে সেখানেই সকাল পর্যন্ত থেকে গেলে না কেন? নাকি থাকতে দিল না? অবশ্য তোমার ওই বিকট নাকের গর্জন কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব নয়।

 সুব্রত : কী যা তা বলছ?

 মালিনী : যা তা বলছি? সন্ধে সাড়ে সাতটায় তোমার অফিসে ফোন করেছিলাম। সেখান থেকেই তো জানতে পারলাম।

 সুব্রত : কী জানতে পারলে?

 মালিনী : অফিস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটা বেয়ারা গোছের লোক বলল, ‘চার বাজে মিসেস মুখার্জি আর সাহাব সাইট মে ভিজিট করনে গিয়া।’ তখনই বুঝেছি। সাইট না ছাই। ওই মিসেস মুখার্জি মানে ডিভোর্সি পুরুষখেকো মহিলা? ইদানীং তুমিও ছোঁক ছোঁক করছ।

 সুব্রত : মালিনী একটু ভদ্রভাষায় কথা বললে ভালো হয় না?

 মালিনী : আশ্চর্য! তোমার কাছে আমি কোনটা ভালো কোনটা মন্দ শিখব? তোমার কাছে? প্লিজ আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। এখন যেটুকু রাত আছে আমাকে ঘুমোতে দিলে ধন্য হয়ে যাব।

(মালিনী ভিতরের দরজার দিকে এগোতেই ল্যান্ড ফোন বেজে উঠল। শব্দটা সুশ্রাব্য নয়। মালিনী দাঁড়িয়ে পড়ল। সুব্রত উদবিগ্ন মুখে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু সে পা বাড়াবার আগেই মালিনী পৌঁছে গিয়ে রিসিভার তুলে একটু অপেক্ষা করে বলল, ‘হ্যালো!’)

 (ওপারের কথা শুনে)

 মালিনী : হ্যাঁ। এত রাত্রে কে ফোন করছেন? (চোখ বন্ধ করে শুনল)

 মালিনী : আপনি আমার প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করছেন। আপনার পরিচয় না পেলে কথা বলব কী করে? (আবার শুনল মালিনী)

 মালিনী : ও তাই বলুন। (হেসে ফেলল)। সুব্রত বাড়ি ফিরে এসেছে কি না তা জানতে ওর মোবাইলে ফোন করলেই তো পারতেন।

(উত্তরটা শোনার পর সুব্রতর দিকে তাকাল মালিনী। দাঁড়িয়ে থাকা সুব্রত ধীরে ধীরে বসে পড়ল।)

 মালিনী : সেকি! মোবাইল অফ করে রেখেছে! কী খারাপ কথা। আপনি ওকে শেষ কখন দেখেছেন? মানে, কখন শেষবার কথা হয়েছে?’

 (উত্তরটা শুনল মালিনী)

 মালিনী : না, না, আপনি যথেষ্ট চিন্তা করছেন, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। একটা প্রবাদ আছে, জানেন নিশ্চয়ই, মাতালরা কখনও গাড়ি চাপা পড়ে না। আর সব পাখি যেমন ঘরে ফেরে তেমনি সব স্বামী ঠিকঠাক ঘরে ফিরে আসবে। আচ্ছা, গুড নাইট।

 (রিসিভার নামিয়ে রেখে খুব শান্ত গলায়)

 মালিনী : মিসেস অঞ্জনা মুখার্জি। তোমাকে তিনি শেষবার দেখেছিলেন রাত দশটায়। দেখা হওয়ার পক্ষে সময়টা শোভনসীমার শেষ দিকে পড়লেও শালীনতা ছাড়ায় না। কিন্তু তুমি বাড়ি ফিরে এসেছ কি না তা জানতে পাঁচ ঘণ্টা পরে ফোন করেছেন। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন হয়তো। ঘুম ভাঙতেই দুশ্চিন্তা হতেই আর ঘড়ি দেখেননি। মোবাইল বন্ধ দেখে ল্যান্ডলাইনে ফোন করলেন। কিছু বলবে তুমি।

 (সুব্রত জোরে শ্বাস নিল। কথা বলল না।)

  মালিনী : আচ্ছা সুব্রত, তুমি বাড়িতে ঢোকার পর তুমি চারবার কথা বলেছ। আর আমি একাই বকবক করে চলেছি। এই ব্যাপারটার যদি কোনো দর্শক থাকত তাহলে সে নিশ্চয়ই আমাকে মেয়েভিলেন বলে ভেবে নিত। মেয়েভিলেনের বাংলা কী হবে জানি না। আচ্ছা, তোমাকে কি অসহায় নায়ক হিসেবে কল্পনা করত?

 সুব্রত : মালিনী, এত রাত্রে তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। তুমি ঘুমোতে যাও। এখনও রাত শেষ হতে দেরি আছে।

 মালিনী : আমি যে তোমার মতো অঙ্ক করে সব কিছু করতে পারি না তা তুমি জানো। আমাকে ঘুমোতেও হবে অঙ্ক করে?

 সুব্রত : বেশ। তাহলে শোনো, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, সন্দেহ করা তোমার এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।

 মালিনী : চমৎকার। একজন মহিলা রাত তিনটের সময়  ফোন করে জিজ্ঞাসা করছেন তুমি বাড়ি ফিরেছ কি না। এটাকে আমি স্বাভাবিক মনে করব? অথচ তুমি অফিস থেকে ফোন করে বলেছিলে তোমাকে সাইটে যেতে হচ্ছে! এই তোমার সাইটে যাওয়ার নমুনা?

 সুব্রত : কী বলব বল। তুমি তো আমার কথা বিশ্বাসই করবে না।

 মালিনী : বিশ্বাস করার জন্য যে জায়গার দরকার হয় সেটা তুমি রাখনি।

 সুব্রত : আমি অফিস থেকে বেরিয়েছি তিনটের সময়। ইনস্পেকশন শেষ করে সন্ধে সাড়ে ছটায়, যখন বেরোতে যাচ্ছি তখন চারতলায় যে নতুন কনস্ট্রাকশন হচ্ছিল সেখানে একজন লেবার গলায় দড়ি দিয়েছে। ব্যস, হয়ে গেল। সেই ঝামেলা শেষ হতে হতে রাত দুটো বেজে গেল। পুলিশের প্রশ্ন তো শেষ হয় না।

 মালিনী  : (হেসে ওঠে) গল্পটা কাঁচা হয়ে গেল! সাইটে তুমি একা যাওনি। সঙ্গে মিসেস মুখার্জিও ছিল। একজন ডিভোর্সি এবং পুরুষখেকো মহিলা সন্ধের পর সঙ্গে থাকলে যে গল্পটা বাস্তব হয়ে যায় তা চেপে যাচ্ছ কেন?

 সুব্রত : মিসেস মুখার্জি আমার সহকর্মী। এছাড়া তাঁর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁকে অফিস থেকেই পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সুইসাইডের খবর পেয়ে এত নার্ভাস হয়ে পড়েন যে সবাই ওকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে। তিনি চলেও গিয়েছেন।

 মালিনী : তাহলে এত উদবেগে এই সময়ে ফোন করলেন কেন?

 সুব্রত : জানি না। বোধহয় সুইসাইডের ব্যাপারটা ওঁর মাথায় থাকায় সময় গুলিয়ে ফেলেছিলেন।

 মালিনী : ঠিক আছে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি না কিন্তু বিশ্বাস করার ভান করছি। মেয়েটা পাস না করা পর্যন্ত এই ভানটা করে যেতে হবে। আমি শুতে চললাম।

 (মালিনী বেরিয়ে গেল। এই প্রথমবার সুব্রতকে একটু হালকা দেখাল।)

দ্বিতীয় দৃশ্য

(একই ঘর। মালিনী যে দরজা দিয়ে বেরিয়েছিল, তার উলটো দিকের দরজা দিয়ে ঢুকল সুব্রত। বাড়িতে থাকার পোশাক। এখন সকাল। চেযারে বসে চারপাশে তাকিয়ে বিরক্ত হল। তারপর গলা চড়িয়ে ডাকল)

 সুব্রত : মানুর মা, মানুর মা। সকাল সাড়ে সাতটা অথচ এখনও চা পেলাম না। খবরের কাগজই বা কোথায়। মানুর মা, শুনতে পাচ্ছ?

 মালিনী : (ওপাশের দরজা দিয়ে ঢুকল)। মানুর মা শুনতে পাবে না।

 সুব্রত : মানে?

 মালিনী : তোমার কণ্ঠস্বর গ্রামে পৌঁছোচ্ছে না।

 সুব্রত : সে কি! ও দেশে গিয়েছে নাকি?

 মালিনী : হ্যাঁ। ওর ছেলের অসুখের খবর পেয়ে কাল সন্ধের ট্রেনে ক্যানিং রওনা হয়েছে। রাতটা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে আজ ভোরে নৌকায় উঠবে। অতএব চ্যাঁচামেচি করে কোনো লাভ নেই।

 সুব্রত : সর্বনাশ! ব্যাপারটা ভেরিফাই না করেই ওকে ছেড়ে দিলে?

 মালিনী : ওর দেশের এক মাস্টারমশাই ফোন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়নি তিনি মিথ্যে বলছেন। ছেলে অসুস্থ শুনে আমি কোনো মাকে, আগে ভেরিফাই করি তারপর ছাড়ব, বলব? আশ্চর্য!

 (কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ)

 সুব্রত : কবে আসবে বলেছে?

  মালিনী : তিন চারদিন লাগবে বলেছে। আমি ওটা এক সপ্তাহ ধরে নিচ্ছি। এবার শোন। আমার পক্ষে রান্নাবান্না করে সংসারের সব কাজ শেষ করে অফিস যাওয়া অসম্ভব নয় কিন্তু পরিশ্রম আমি করতে চাই না। আমি সাতদিন ছুটি নিচ্ছি।

 সুব্রত : ও।

 মালিনী : তুমি সকালে উঠে চা চা করে চ্যাঁচাবে না। যখন হবে তখন পাবে। প্রথমে বাজারে যাবে। ফ্রিজে মাছ রাখতে দাও না, ফ্রেশ মাছ না খেলে টেস্ট পাও না বলে এসেছ এতদিন। দয়া করে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে বাজার করে আনবে। নিজের জামাকাপড় নিজে কাচবে। মনে রেখো, আমাকে যেমন রান্না করতে হবে তেমনি ঘর ঝাঁট দেওয়া, মোছা, বাসন ধোয়ার কাজটাও করতে হবে। তুমি দয়া করে নিজের বিছানা ঠিকঠাক করে নেবে। (উঠে দাঁড়ায়) চা দিচ্ছি, খেয়ে বাজারে যাও। আর হ্যাঁ, তোমার অফিস পাঁচটায় ছুটি হয়, ছটার মধ্যে বাড়ি ফিরবে।

 সুব্রত : (অবাক হয়ে)। কেন?

 মালিনী : (যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ায়) । কেন? প্রশ্নটা তুমি করতে পারলে সুব্রত? আমি সারাদিন ঝি—গিরি করব আর তুমি অফিসের পর ক্লবে গিয়ে ফুর্তি করবে?

 (সুব্রত মাথা নীচু করল। মালিনী বেরিয়ে গেল)

তৃতীয় দৃশ্য

(সন্ধেবেলা। একই ঘর। বেল বাজাল। মালিনী ঘরে ঢুকে  দরজা খুলল। সুব্রত অপরাধীর ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল)

 সুব্রত : একটু দেরি হয়ে গেল। বেশি না (মোবাইল দেখল) ঘণ্টা দেড়েক। বিশ্বাস কর, ক্লাবে যাইনি। অফিসেই…

 (মালিনী চেয়ারে বসল)

 মালিনী : আজ দুপুরে মানুর মায়ের ফোন এসেছিল।

 সুব্রত (উজ্জ্বল মুখে) : আচ্ছা, পাঁচদিন তো হয়ে গেল। কাল আসবে?

 মালিনী : এখন আসতে পারবে না। কবে পারবে তাও জানে না। আমাকে লোক দেখে নিতে বলল। ভালো কাজের লোক যেন হাতের মোয়া।

 সুব্রত : (বসে পড়ে চেয়ারে)। সর্বনাশ!

 মালিনী : শোন, আমার পক্ষে এত পরিশ্রম করা সম্ভব নয়। তাছাড়া সাতদিন ছুটি নিয়েছি। অফিস থেকেও ফোন এসেছিল, জয়েন করতে বলছে।

 সুব্রত : তাহলে…।

 মালিনী : আমি কাল সকাল সকাল মায়ের কাছে চলে যাব। ওখান থেকেই অফিস করব যদ্দিন তুমি একজন হোলটাইমার না পাও।

 সুব্রত : আমি হোলটাইমার কোথায় পাব?

 মালিনী : বন্ধুদের বল, পাড়ায় খোঁজ নাও।

 সুব্রত : ইমপসিবল। এ পাড়ায় জীবনদা নামে একজন আছে তার নামটাই এখন পালটে গেছে।

 মালিনী : তার মানে?

 সুব্রত : ভদ্রলোকের স্ত্রীর জন্য কোনো কাজের লোক চারদিনের বেশি টেঁকে না। রবিবার সকালে ওকে বেরোতে হয় নতুন কাজের লোকের খোঁজে। তার ফলে পাড়ায় ওঁর নাম হয়ে গিয়েছে ঝি খোঁজা বাবু, সরি।

(এই সময় বাইরে থেকে কেউ বেল বাজাল। মালিনী উঠল। দরজা খুলল। একটি বছর কুড়ির আটপৌরে মেয়ে হাতে কাপড়ের ব্যাগ, ঢিপ করে প্রণাম করল মালিনীকে)

 মালিনী : (একটু পিছিয়ে গিয়ে) আরে! তুমি কে? প্রণাম করছ কেন?

 মেয়েটি : বারে! আপনি আমার চেয়ে কত বড়—! আমার নাম কুন্তী।

 মালিনী : কুন্তী? এখানে কী দরকারে এসেছ? কে পাঠাল তোমাকে?

 কুন্তী : যমুনা মাসি। আমি ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। যমুনা মাসি কাজে যাচ্ছিল, সব শুনে আপনাদের বাড়িতে আসতে বলল।

 মালিনী : ও হ্যাঁ, যমুনাকে আজ বিকেলে বলেছিলাম। ভিতরে এসো।

(মালিনী তার চেয়ারে গিয়ে বসল। কুন্তী মেঝেতে উপুড় হয়ে বসতে গিয়েও বসল না।)

 কুন্তী : মাসি, ইনি নিশ্চয়ই দাদাবাবু?

 মালিনী : দাদাবাবু!

 সুব্রত : ওঁকে মাসি বললে আমাকে মেসো বলতে হবে।

 কুন্তী : ও। বাড়ির কর্তাকে তো দাদাবাবু বলে সবাই…।

 মালিনী : ঠিক আছে। তোমাকে আত্মীয়তা তৈরি করতে হবে না। তোমাকে কি যমুনা এ বাড়িতে কাজের জন্য পাঠিয়েছে?

 কুন্তী : হ্যাঁ, মাসি, আমাকে আপনি আশ্রয় দিন।

  মালিনী : তুমি কি এই পাড়ার কোনো বাড়িতে কাজ করতে?

 কুন্তী : হ্যাঁ। ওই যে বটগাছ আছে যে বাড়ির সামনে, ওই মল্লিকদের বাড়িতে। দু—বছর কাজ করেছি। সকাল ছ—টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ করতাম।

 মালিনী : বললে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলে? কেন?

 কুন্তী  : (ঠোঁট কামড়ায়, আঁচলে চোখ মোছে) আমাকে তাড়িয়ে দিল গো।

 মালিনী : দু—বছরের কাজের লোককে কেউ এমনি তাড়ায় না। কী করেছিলে?

 কুন্তী : একটা চিনে মাটির কাপ হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গিয়েছিল বলে বড় গিন্নি গায়ে হাত তুলল। ঘাড় ধরে বের করে দিল। বলল, মাইনেটাও দেবে না। (ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।)

 সুব্রত : বুর্জোয়া মেন্টালিটি। কী করে পাবে!

 মালিনী : তোমার দেশ কোথায়?

 কুন্তী : কাকদ্বীপের কাছে।

 মালিনী : বাড়িতে কে কে আছে?

 কুন্তী : মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ নেই। আয়লা সবাইকে খেয়ে নিয়েছে। থাকার মধ্যে আছে মামা আর মামি। মামি চায় না আমি ওদের বাড়িতে থাকি।

 মালিনী : এই যে বললে কাকদ্বীপের কাছে বাড়ি?

 কুন্তী : ওখানেই তো মামা—মামি থাকে।

 মালিনী : হুম। তুমি কী কী কাজ ভালো জানো।

 কুন্তী : নিজের মুখে কী বলব মাসি, কাজ করিয়ে দেখ।

 মালিনী : শোন, সকাল নটার মধ্যে ভাত ডাল তরকারি আর মাছের ঝোল করে দিতে হবে। তার আগে চা, দু—বার। আমার টিফিনটাও করে দিতে হবে। রাত্রে এক একবার এক একরকম, পারবে?

 কুন্তী : আপনারা যদি চাইনিজ খেতে ভালোবাসেন, তাহলে রাত্রে তাই করে দেব।

 (মালিনী সুব্রতর দিকে তাকাল।)

 সুব্রত : তুমি মোগলাই রান্না জানো?

 কুন্তী : ওই বাড়ির ছোটবাবু আমার হাতের মোগলাই রান্না খুব পছন্দ করত।

 মালিনী : তুমি যা বলছ তাতে…। থাক গে। এখানে কাজ করলে কত মাইনে চাও? দেখ, আমরা দু—জনই থাকি। আমাদের মেয়ে বেঙ্গালুরুতে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। অতএব কাজের চাপ একদমই নেই। তাই বল, কত চাও?

 কুন্তী : আমি কী বলব মাসি। আমি তো একটু আশ্রয়ের জন্য আপনাদের বাড়িতে এসেছি। এখানে আমি নিরাপদে থাকতে পারব। যা দেবেন তা আপনারাই ঠিক করবেন।

 সুব্রত : না না। এটা হতে পারে না। আচ্ছা মল্লিকবাড়িতে তুমি কত পেতে?

 কুন্তী : ওখানে অনেক মানুষের কাজ করতে হত। আচ্ছা, আমি কেমন কাম করি তা একমাস দেখুন, দেখে যা দেবেন তাই আমি খুশি হয়ে নেব।

 মালিনী : তোমার জিনিসপত্র কোথায়? ওই ব্যাগে কী আছে?

 কুন্তী : এতেই সব। দু—তিনটে শাড়ি, জামাটামা…। আমার আবার জিনিস!

 মালিনী : (উঠে দাঁড়ায়)। তুমি ব্যাগটাকে রেখে বাইরে যাও। যমুনাকে ডেকে নিয়ে এসো। তোমাকে রাখার আগে আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।

 কুন্তী : আমি এখনই যাচ্ছি। ব্যাগটাকে এখানে রাখি?

 (কুন্তি ব্যাগ রেখে বেরিয়ে যায়)

 সুব্রত : একেই বলে মেঘ না চাইতেই জল। একে কী বলা যায়। কাকতালীয় ব্যাপার? যাই হোক, সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। তোমাকে কাল থেকে সাত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হবে না। রান্না করতে হবে না।

 মালিনী : বাঃ, বেশ। এই মেয়েটাকে রাখলাম। ওর রান্না খেয়ে কাল দু—জনে অফিসে বেরিয়ে গেলাম। গোটা ফ্ল্যাটে ও একাই থাকল। তারপর সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে দেখলাম সব ভোঁ ভাঁ। আলমারি ভেঙে সব নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। পুলিশ কী বলবে? একজন অজানা অচেনা মেয়ের হাতে ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে কী করে গেলেন? কী জবাব দেবে?

 সুব্রত : আরে! এটা তো মাথায় আসেনি। মানুর মা দশ বছর ধরে ছিল। ওর নাড়ি নক্ষত্র তুমি জানো। এ তো একেবারে উটকো। তাহলে কী করবে? রাখবে না? কিন্তু মুশকিল হল, নতুন যে আসবে তারই তো একই অবস্থা হবে। ইস, আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন। মানে, আগেকার একান্নবর্তী পরিবারে এই সমস্যা তো হত না।ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ

 (একটু ভেবে) আচ্ছা মালিনী। ওই যমুনা যদি সার্টিফিকেট দেয়, যদি বলে, কুন্তী চোর ডাকাত নয়, তাহলে কি আমরা ওকে রাখতে পারি?

 (এই সময়  ফোন বেজে উঠল।  মালিনী এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলল)

 মালিনী : হ্যালো! কে বলছেন? (উত্তর শুনল) ও যমুনা, তুমি কোথায়? (উত্তর শুনল) অ। শোন, ওই মেয়েটা, যার নাম কুন্তী, তাকে তুমি তো পাঠিয়েছ। কিন্তু মেয়েটা কেমন? (উত্তর শুনল) যা দিনকাল, কাউকে বাড়িতে রাখতে ভয় হয়। আবার আমরা যারা চাকরি করি, তাদের তো না রেখেও উপায় নেই। ওকে তুমি কীরকম চেনো? (উত্তর শুনল) ভাবো। চিনে মাটির পেয়ালা, তার দাম যাইহোক, ভাঙার জন্য মেরে তাড়াবে? তা তুমি ওকে দু—বছর ধরে চেনো? (উত্তম শুনল) দ্যাখো যমুনা, তোমাকে তো দুবেলা দেখছি, ঠিকেকাজ ছাড়া করবে না তুমি, নইলে তোমাকেই বলতাম আমার বাড়িতে রাত—দিনের কাজ করতে। তা তোমার উপর ভরসা করে ওকে না হয় রাখছি। (উত্তর শুনল) তা বলতে। শোয়ার ঘরের দরজাটাও তালা দিয়ে রাখব।

 (রিসিভার নামিয়ে রাখল)

 মালিনী : (স্বগতোক্তি)। দেখা যাক, কপালে কী আছে।

 সুব্রত : না না। ভালোই হবে, চিন্তা করো না।

 মালিনী : আমার কপাল কী রকম তা তো জানি।

 (আড় চোখে স্বামীকে দেখে ভিতরে চলে যায় মালিনী)

 (ঠিক তখনই বেল বাজে। সুব্রত এগিয়ে যায় দরজা খুলতে)

চতুর্থ দৃশ্য

(রাত। খাওয়ার টেবিল। সুব্রত অপেক্ষা করছিল। মালিনীও। কুন্তী খাবার পরিবেশন করছিল। খাবার দেখে চোখ বড় হয়ে গেল সুব্রতর।

 সুব্রত : মাই গাড। এটা কী?

 কুন্তী : (শাড়ি পালটেছে)। মিশ্র ভাজা ভাত। সঙ্গে ঝাল হাড়ছাড়া মাখা মাখা মুরগির টুকরো।

 সুব্রত : (হাঁ হয়ে গেল)। মিশ্র—

 মালিনী : মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর বোনলেস চিলি চিকেন।

 সুব্রত : ও। শুনলে কীরকম অচেনা বাংলা খাবার বলে মনে হয়। শুরু করা যাক। (চামচে ভাত তুলে মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে) আঃ ফার্স্টক্লাস। মনে হচ্ছে চিনে হোটেলে বসে খাচ্ছি।

 মালিনী : সুব্রত।

 সুব্রত : হ্যাঁ।

 মালিনী : ধীরে ধীরে। হ্যাঁ। ভালোই রান্না হয়েছে। কুন্তী। (খেতে খেতে) কিন্তু কোথায় শিখলে এসব রান্না?

 কুন্তী : মল্লিক বাড়ির ছোট মেয়ে বিয়ের আগে যখন এসব রান্না শিখছিল তখন ওর সঙ্গে থেকে শিখে নিয়েছি। আমি বিরিয়ানিও পারি।

 সুব্রত : অ্যাঁ? বিরিয়ানি? কী কপাল? সামনের রবিবার দুপুরে তাহলে বিরিয়ানি হয়ে যাক। কী বল মালিনী?

 কুন্তী : জাফরান না পড়লে বিরিয়ানির স্বাদ খোলে না। কিন্তু খাঁটি জাফরানের দাম তো অনেক। বড় হোটেলও তা দিতে পারে না।

 সুব্রত : কুছ পরোয়া নেই। যত দাম হোক, আমি নিয়ে আসব।

 মালিনী : আমার মনে হয় আপাতত তোমার সামনে এখন যা রয়েছে তাই তোমার খাওয়া উচিত।

 (এই সময় ফোন বেজে উঠল। পাশের ঘরে)

 কুন্তী : আপনারা খাচ্ছেন, আমি ফোন ধরব?

 মালিনী : ধরো। দরকারি ফোন হলে বোলো আধঘণ্টা পরে করতে।

 (দ্রুত চলে গেল কুন্তী। রিং বন্ধ হল)

 মালিনী : সুব্রত, শুরুতেই এত প্রশংসা করলে ওর মাথা কি ঠিক থাকবে?

 সুব্রত : না। আমি একটু অ্যাপ্রিসিয়েট করছিলাম।

 মালিনী : ওর সামনে না করলেই কি নয়। কুন্তী ভালো কাজ করলে তো আমাদের ভালো লাগবেই। কিন্তু এত ভালো কাজ যে করে তাকে একটা পেয়ালা ভাঙার জন্য ওরা ছাড়িয়ে দিল?

 সুব্রত : তাহলে কি মল্লিকবাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেব?

 মালিনী : না। না। তেমন কিছু হলে যমুনা ওকে দিত না।

 (কুন্তী ফিরে এল। মুখে একগাল হাসি)

 মালিনী : কী হয়েছে?

 কুন্তী : উনি আপনাকে চাইছিলেন। বললাম এখন খাচ্ছেন, পরে ফোন করবেন। তখন বললেন, তুমি কে?

 আমি আমার নাম বললে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি দাদাবাবুর মেয়ে? (খিলখিলিয়ে হাসে)

 সুব্রত : কে? কে ফোন করেছিল?

 কুন্তী : এই যাঃ নামটা তো জিজ্ঞাসা করিনি।

  মালিনী : পুরুষ না মহিলা?

 কুন্তী : না না পুরুষ না। গলার স্বর খুব মিষ্টি। দাদাবাবু আর একটু মিশ্র ফ্রায়েড ভাত দেব?

 সুব্রত : আচ্ছা, দাও—! (কুন্তী রান্নাঘরে চলে গেল)

 মালিনী : ইনি কে?

 সুব্রত : ইনি? কার কথা বলছ?

 মালিনী : রাত দশটায় যিনি  ফোন করেছেন।

 সুব্রত : আশ্চর্য! আমি কী করে বলব। ফোন করে তো তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, আমার সঙ্গে নয়।

 মালিনী : কিন্তু ওকে জিজ্ঞাসা করেছেন তোমার মেয়ে কি না। আমার মেয়ে কি না জিজ্ঞাসা করেননি। অর্থাৎ পরিচয় তোমার সঙ্গেই। কিন্তু আমার সঙ্গে কেন কথা বলতে চাইছেন?

 (মালিনী তাকাল সুব্রতর দিকে) এই সময় কুন্তী খাবার নিয়ে এল।

 সুব্রত : কুন্তী, তুমি যার সঙ্গে ফোনে কথা বললে, তিনি তোমাকে কী জিজ্ঞাসা করেছেন, মনে করে বল?

 কুন্তী : ওই যে বললাম, তুমি কি দাদাবাবুর মেয়ে? এই তো বললেন।

 সুব্রত : দাদাবাবুর মেয়ে। দাদাবাবুর নাম বলেছেন?

 কুন্তী : না তো। কোনো নাম বলেননি।

 সুব্রত : (মালিনীকে)। শুনলে? ফোনটা তো রং নাম্বারও হতে পারে। এই কলকাতায় লক্ষ লক্ষ দাদাবাবু আছেন। তাই না। আমি উঠছি।

 কুন্তী : ও মা! আপনি আর একটু নেবেন বললেন যে!

 সুব্রত : না। পেট ভরে গেছে।

 (সুব্রত বেরিয়ে যায়)

 মালিনী : আমাকে দাও। নিয়ে যখন এসেছ তখন দাও।

 (মালিনীর প্লেটে খাবার দিতে লাগল কুন্তী)

পঞ্চম দৃশ্য

(বাইরের ঘর। আরাম করে বসে বই পড়ছিল সুব্রত। একা। ঘড়িতে এখন রাত সাড়ে দশটা। হঠাৎ পিছনের দরজায় শব্দ হল। বই বন্ধ করে সুব্রত পিছনে তাকাতেই কুন্তীকে দেখতে পেল, অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে)

 সুব্রত : কী ব্যাপার?

 কিছু বলবে?

 কুন্তী : ভাবলাম, জিজ্ঞাসা করি।

 সুব্রত : করো।

 কুন্তী : আপনি কি এখন একটু কফি খাবেন?

 সুব্রত : কফি?

 কুন্তী : হ্যাঁ। কেউ কেউ রাতের খাবারের পর কফি খায়। ওই বাড়ির ছোটবাবু নিয়ম করে খেত।

 সুব্রত : (হেসে ফেলে)। বাঃ বেশ তো। দাও।

 (কুন্তী হেসে চলে যায়। সুব্রত খুশিতে মাথা নাড়ে)

ষষ্ঠ দৃশ্য

(অফিসের পোশাকে সুব্রত। এখন সন্ধ্যা। মালিনী দরজা খুলল বেল বাজলে)

 মালিনী : বাবাঃ, আজ কি শরীর খারাপ?

 সুব্রত : কেন? দেখে কি মনে হচ্ছে?

 মালিনী : যখন কাজের লোক ছিল না তখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার সময় মুখ হাঁড়ি হয়ে যেত। কুন্তী আসার পর তো আবার আগের রুটিন। আজ হঠাৎ তাড়াতাড়ি এলে?

 সুব্রত : তাহলে ঘণ্টা দুয়েক পার্কে বসে আসি।

 মালিনী : না না। বসো।

 সুব্রত : তুমি কখন ফিরলে?

 মালিনী : আধঘণ্টা হল। জানো, কুন্তী আজ পাটিসাপটা তৈরি করছে।

 সুব্রত : গ্রেট। ওটা জানে?

 মালিনী : আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। শোন—।

 সুব্রত : থামলে কেন?

 মালিনী : তুমি আমার উপর খুব অসন্তুষ্ট তাই না?

 সুব্রত : হঠাৎ এই উপলব্ধি?

 মালিনী : সেই রাত্রে এক অজানা মহিলা ফোন করল আর কুন্তী যেই দাদাবাবু বলল অমনি আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল।

 সুব্রত : ঠান্ডা হল কী করে?

 মালিনী : সেই মহিলা আর কেউ নয়, আমার মাসতুতো বোন ইতি। ও তো তোমাকেও দাদাবাবু বলে কয়েকবার ডেকেছে। সেই রাত্রে ফোন করার পর আজ আবার করেছিল। খুব বকেছি ওকে, বলেছি, আর কখনও দাদাবাবু বলবি না। প্লিজ রাগ কোরো না—!

 (এই সময় ল্যান্ডফোন বেজে উঠল)

 সুব্রত : দাঁড়াও, আমি ধরছি। (এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তোলে) হ্যালো! (ওপারে কথা শুনে) হ্যাঁ, ঠিক নম্বরেই ফোন করেছেন। কাকে চাই। (উত্তর শুনে) কুন্তী? আপনি কুন্তীর সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন…

 (সুব্রত মালিনীর দিকে তাকায়। মালিনীর চোখ বড় হয়ে যায়)

 (উত্তর শুনে) কে আপনি? ওর ভাই! কীরকম ভাই? কী নাম আপনার? (ঠোঁট কামড়াল সুব্রত) রিসিভার রেখে দিতে দিতে বলল) ব্যাটা লাইন কেটে দিল।

  মালিনী : ওর ভাই?

 সুব্রত : (কাছে এসে)। ভাই না ফালতু। ভাই হলে নাম বলত না?  ফোন কেটে দিত? গলার স্বর শুনেই—

 মালিনী : কিন্তু কুন্তী তো বলেছে, ওর বাবা, মা, ভাইরা, আয়লায় ডুবে মরে গেছে। এই পৃথিবীতে মামা—মামি ছাড়া আর কেউ নেই।

 সুব্রত : ওকেই জিজ্ঞাসা করা দরকার।

 মালিনী : আচ্ছা, এমন তো হতে পারে এই ফোনটা ওর মামাতো ভাই করেছিল। কুন্তীই হয়তো তাকে নাম্বারটা দিয়েছে।

 সুব্রত : তার মানে এই ফোনটা কুন্তী ব্যবহার করছে। মানুর মা যখন ছিল তখন তালা দিয়ে রাখতে। এখন রাখো না?

 মালিনী : মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। (গলা তুলে) কুন্তী, অ্যাই কুন্তী?

 (কুন্তী প্রায় দৌড়ে ঘরে এল)

 কুন্তী : আমাকে ডাকছেন মাসি?

 মালিনী : তোমার কোনো মামাতো ভাই আছে?

 কুন্তী : না। মামার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তাই আমাকে কোকিল বলত। ডানায় জোর এলেই উড়ে যখন যাব তখন থাকার দরকার নাই।

 (মালিনী সুব্রতর দিকে তাকায়)

 কুন্তী : কিছু হয়েছে নাকি মাসি?

 সুব্রত : একটি ছেলে এইমাত্র ফোন করেছিল। বলল যে তোমার ভাই। নাম জিজ্ঞাসা করাতে লাইন কেটে দিল।

 মালিনী : তুমি কি এই বাড়ির নাম্বার কাউকে দিয়েছ?

 কুন্তী : মাইরি বলছি (জিভ বের করে) সরি, মাইরি বলতে নেই। না, না, আমি কাউকেই নাম্বার দিইনি।

 সুব্রত : তাহলে এই ছেলেটা কে? আন্দাজ করতে পার?

 (মাথা নীচু করে একটু ভাবল কুন্তী)

 মালিনী : কী হল?

 কুন্তী : একটা কথা বলব বলব করেও আপনাদের বলতে পারিনি। কী জানি যদি ভুল বোঝেন। জানেন, তোমাদের এই পাড়াটা ভালো না।

 মালিনী : খুলে বল। বুঝতে পারছি না।

 কুন্তী : আপনাদের বাড়িতে আগে যে কাজ করত সে কিছু বলেনি?

 মালিনী : কী ব্যাপার?

 কুন্তী : এই পাড়া নিয়ে? ওহো, সে বলবে কী করে! আমার মতো বয়সি তো ছিল না। বয়স কম হলে ঠিক বলত।

 মালিনী : আঃ কী বলতে চাও খুলে বলো তো।

 কুন্তী : এই পাড়ার ছেলেগুলো আমাকে দেখলেই ফুট কাটে। গান গায়। কে তুমি নন্দিনী, আগে তো দেখিনি…। এত লজ্জা লাগে তখন!

 সুব্রত : (রেগে গিয়ে)। কারা? নাম জানো?

 কুন্তী : আমি কী করে নাম জানব! আজ সকালে যখন বাজারে যাচ্ছি, তখন একজন তো সাইকেল চালিয়ে আমার গায়ের কাছে এসে শাহরুখ খানের মতো বলল, ‘ম্যাটিনি শো দেখে আসি চল, যাবে? আমি মাটির দিকে তাকিয়ে হেঁটে গেছি, মুখ তুলিনি। হয়তো সেই ফোন করেছিল?

 সুব্রত : ফোন নাম্বার পাবে কোথায়?

 কুন্তী : বারে! আমি কী করে বলব? তবে আপনাদের ওই ফোনের নম্বর তো অনেকেই জানে। এই যেমন বাজারের মুদির দোকান, যেখান থেকে মাসকাবারি আসে, মাছওয়ালা শিবু, মানে মাসি ফোন করে ওদের জিনিসপত্র মুটের মাথায় পাঠাতে বলতেন। এসব আমার জানার কথা নয়, বাজারে গিয়ে, ওদের মুখে জেনেছি।

 সুব্রত : বুঝেছি। এই ছেলেটাকে দেখিয়ে দিতে পারবে? অন্তত ওর নামটা বললেই হবে।

 কুন্তী : না দাদাবাবু, আপনি ওদের জব্দ করলে আমার বাইরে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তখন দোকান যাবে কে? বাজার করবে কে? মাসি, আমি কি ঠিক বলছি না? আমাকে যদি বাইরে যেতে না হয়, তাহলে আমি কালই ওর নাম জেনে আপনাকে বলে দেব।

 সুব্রত : আমরা থাকতে তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন কুন্তী?

 কুন্তী : ভয় পাবো না। এখন ওরা পিছনে একটু ফুট কাটছে, আপনি কিছু করলে ওরা ঠিক অ্যাসিড বালব ছুড়ে আমার মুখ পুড়িয়ে দেবে। পোড়া মুখের কথা ভাবলেই আমি শিউরে উঠি।

 মালিনী : ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি যাও। তোমাকে কারও নাম জানাতে হবে না। বাইরে যখন যাবে তখন সাবধানে যাওয়াআসা করবে।

 (কুন্তী মাথা নেড়ে ভিতরে চলে যায়)

  মালিনী : ছেলেগুলোর কী রুচি! ঘেন্না লাগে! খোঁজ নিলে দেখবে এই ছেলেরা সব ভদ্রলোকের সন্তান।

 সুব্রত : কুন্তীর চেহারা সুন্দর বলেই হয়তো—! দেখি, এই পাড়ার পার্টির নেতা আমাকে খুব দাদা দাদা করে, তাকে বলব। অনেক কপাল করে কুন্তীর মতো কাজের লোক পেয়েছি, ওকে হারাতে চাই না।

 (এই সময়  টেলিফোন বেজে উঠল)

 (সুব্রত উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল)

 সুব্রত : হ্যাঁ বলছি। (শুনল) ঠিক নাম্বারেই ফোন করেছেন। কে বলছেন? (শুনল) হ্যাঁ। আচ্ছা সে, কোথায়? দিন।

 (রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে মালিনীকে)

 সুব্রত : মানুর মা কথা বলতে চাইছে। বলবে?

 (মালিনী ইশারায় সুব্রতকেই কথা বলতে বলল)

 সুব্রত : হ্যাঁ, মানুর মা। কেমন আছে তোমার ছেলে? (শুনল) বাঃ, খুব ভালো। তুমি ভালো আছ তো? (শুনল) আমরা সবাই ভালো আছি। (শুনল) না না, এত তাড়তাড়ি তোমাকে এখানে আসতে হবে না। অনেকদিন পরে দেশে গিয়েছ। ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হোক, তুমিও বিশ্রাম নাও। (শুনল) না না, আমাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। যদি হয় তাহলে এই নাম্বারে ফোন করে দেব। (শুনল) কত টাকা? (শুনল) ঠিক আছে, তোমার বউদিকে বলছি। তোমার ঠিকানা তো ওর ডায়ারিতে লেখা আছে। পেয়ে যাবে। রাখছি।

 (রিসিভার রেখে স্ত্রীর কাছে এল)

 সুব্রত : অনেক কষ্টে কাটাতে পেরেছি। চাইলে কালই চলে আসত। খারাপ লাগছিল কিন্তু কুন্তী যা রান্না করে, যেভাবে ঘর পরিষ্কার রাখে তার সিকিভাগও মানুর মা পারে না। টাকা দেব যখন তখন ভালো সার্ভিসই চাইব।

 মালিনী : কত টাকা চাইল?

 সুব্রত : দু—হাজার।

 মালিনী : যাওয়ার সময় হাজার নিয়ে গিয়েছে। অবশ্য ওর পাওনা ছিল হাজার তিনেক। হিসেব করেই চেয়েছে।

 সুব্রত : মানি অর্ডার করে দিও, নইলে টাকার জন্য চলে আসতে পারে। এসে যদি কুন্তীকে দেখে তাহলে—।

 মালিনী : কুরুক্ষেত্র বাধাবে। আমাদের অসুবিধে হচ্ছিল কি না জিজ্ঞাসা করল?

 সুব্রত : হ্যাঁ। আসলে বহু বছর ধরে আছে, একটা অ্যাটাচমেন্ট হয়ে গিয়েছে। জিজ্ঞাসা তো করবেই।

 মালিনী : হাতে ধরে রান্না শিখিয়েও ওকে আটপৌরে রান্না ছাড়া করাতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, মানুর মায়ের সবচেয়ে বড় গুণ হল ও খুব সৎ। একটা টাকাও কখনও এদিকওদিক করেনি। স্নানের সময় বাথরুমে কতবার হার খুলে রেখে এসেছি, ও ঠিক এনে দিয়েছে।

 সুব্রত : কুন্তীকেও অসৎ বলে মনে হয় না।

 মালিনী : এই তোমার মুশকিল। যাকে ভালো লাগে তাকে রাতারাতি আকাশে তোল। সবে তো এল, একটু সবুর কর, তারপর বলবে।

 (মালিনী উঠল)

সপ্তম দৃশ্য

(মধ্যরাত। সেই বসার ঘরের সোফায় সুব্রত পাশ ফিরে আধশোয়া। বোঝা যাচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরের এক কোণের মিউজিক সিস্টেমে রবীন্দ্রনাথের গান বাজছে, ‘সহেনা যাতনা। ভিতরের দরজার ফ্রেমে এসে দাঁড়াল মালিনী, রাতপোশাক। মুখে বিরক্তি)

 মালিনী : এখন রাত বারোটা বাজে। তুমি কী চাইছ?

 সুব্রত : আমি? কী চাইছি! (উঠে বসে)

 মালিনী : আঃ, গান কেউ এত রাত্রে ওই ভল্যুমে শোনে না। দয়া করে কমিয়ে দেবে—

 সুব্রত : (রিমোট টেপে, শব্দ থেমে যায়)। তুমি অনুরোধ করলে আমি কি উপেক্ষা করতে পারি?

 মালিনী : তুমি কী পারো আর না পারো তার ফিরিস্তি এই মাঝরাতে আমাকে দিতে হবে না। এই রাতদুপুরে অত জেরে গান বাজিয়ে আমার ঘুম নষ্ট করে তুমি কী চাইছ?

 সুব্রত : দ্যাখো, এখন আমি আর কিছুই চাই না। কারণ জানি, চাইলেও পাব না।

 মালিনী : ন্যাকামি! তুমি কি চাইছ আমি এখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই?

 সুব্রত : এত রাত্রে কোথাও যাওয়া কি খুব জরুরি?

 (মালিনী রাগে বিরক্তিতে কাঁধ নাচাল এবং এই সময় সশব্দে বাজ পড়ল। তারপর বৃষ্টির আওয়াজ।  মালিনী কানে হাত চাপল)

 সুব্রত : ওই শব্দের উপর আমার কোনো কনট্রোল নেই।

 মালিনী : উঃ ভগবান!

 সুব্রত : এককালে ওঁর ছিল। এখন ভগবানের ক্ষমতা প্রায় নিল। এই যে লে—তে মেঘ ভেঙে মাটিতে আছড়ে পড়ল, নেপালে ভূমিকম্পে কত মানুষ মারা গেল, ভদ্রলোক কিছুই করতে পারলেন না।

 (মালিনী দ্রুত ভিতরে চলে গেলে আবার বাজ পড়ল সশব্দে। বৃষ্টি জোরালো হয়েছে। সুব্রত সোফায় আধশোয়া হয়ে রিমোট হাতে নিয়েও রেখে দিল। তারপর চোখ বন্ধ করল)

অষ্টম দৃশ্য

 (সকাল। সুব্রত পাশ ফিরে শুয়ে আছে। কুন্তী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল)

 কুন্তী : দাদাবাবু, ও দাদাবাবু, উঠুন, আটটা বেজে গেছে।

 সুব্রত : (ঘুম জড়ানো গলায়)। কটা বাজে?

 কুন্তী : আটটা বেজে দু—মিনিট।

 (শোনামাত্র লাফিয়ে উঠে বসল—)

 সুব্রত : ‘আরে! আমাকে ডাকোনি কেন?’

 কুন্তী : ডেকেছি। এই নিয়ে তিন তিনবার। প্রথমবার, মাসি যখন চা খেলেন, দ্বিতীয়বার, উনি যখন বাথরুমে গেলেন, তৃতীয়বার—

 সুব্রত : থাক। ওটা তাহলে এক গজের চা। ফেলে দিয়ে নতুন চা নিয়ে এসো।

 কুন্তী : এক গজের চা মানে?

 সুব্রত : তিনবার ফুটিয়েছ গরম রাখার জন্য।

 কুন্তী : এম্মা! আপনার জন্য প্রতিবারই নতুন করে চা বানাই—

 সুব্রত : তাই! থ্যাংক ইউ, দাও। (হাত বাড়িয়ে পেয়ালা নেয়) এই সময় ভিতর থেকে মালিনীর গলা ভেসে আসে —কুন্তী, ব্রেকফাস্ট দে।’ কুন্তী দৌড়ে ভিতরে চলে যায়। সুব্রত তৃপ্তির সঙ্গে চা খায়। মালিনী ঘরে ঢোকে)

 মালিনী : শোন, আজ থেকে তুমি আমার ঘুমের ডিসটার্ব করবে না। কাল রাত্রে আমাকে ঘুমের ওষুধ খেতে হয়েছে। এখন এই সাতসকালে ছুটতে হবে। শরীরটা এত ম্যাজম্যাজ করছে।

 সুব্রত : সরি, ম্যাডাম, আর তোমাকে রাতবিরেতে বিরক্ত করব না। কিন্তু এই ভোরবেলায় ব্রেকফাস্ট খেয়ে ছুটছ কোথায়?

 মালিনী : ভোরবেলায়। এখন কটা বাজে তা জানো? আটটা বেজে গিয়েছে আর তুমি নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছ। আছ বেশ।

 সুব্রত : এই তো বললে সাতসকালে ছুটতে হবে। যাচ্ছ কোথায়?

 মালিনী : অফিসের পিকনিকে। (কুন্তীর গলা ভেসে আসে— মাসি!)

 (মালিনী ভিতরে চলে যায়,  টেলিফোন বেজে ওঠে। সুব্রত চায়ের কাপ রেখে উঠে গিয়ে রিসিভার তোলে।)

 সুব্রত : হ্যালো! (উত্তর শোনে) হ্যাঁ, কে বলছেন? (উত্তর শোনে) আপনি মালিনীর সহকর্মী? বলুন কী চাই? (উত্তর শোনে) না, মালিনী সাজগোজ করছে, এখনও বাড়ির বাইরে পা দেয়নি। কিছু বলতে হবে? (উত্তর শোনে) আপনি বাড়ির নীচের রাস্তায় গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন? খুব ভালো। (উত্তর শোনে) ওর মোবাইল বোধহয় খারাপ হয়েছে। সরি। রাখছি ভাই। (রিসিভার নামিয়ে রাখে। তারপর একটু খুশি খুশি গলায় ডাকে, মালিনী—’। মালিনী জুসের গ্লাস নিয়ে ঢোকে)

 মালিনী : এমন চিনি মেশানো গলায় ডাকছ, কী ব্যাপার?

 সুব্রত : অমিতাভবাবু তোমার জন্য বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়িতে বসে আছেন। পিকনিকের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

 মালিনী : এ কথা তোমাকে কে বলল!

 সুব্রত : ফোন করেছিলেন। তোমাকে মোবাইলে পাচ্ছেন না। কেন যে মানুষকে অপেক্ষা করাও।

 মালিনী : তুমি কী বলতে চাইছ?

 সুব্রত : আমি তো কিছুই বলতে চাইনি।

 মালিনী : তুমি আমাকে আবার ছোট করলে। তোমার কথায় নোংরা ইঙ্গিত ছিল। আমি অমিতাভবাবুকে আমার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে বলিনি। উনি নিজেই এসেছেন। নীচে গিয়ে দ্যাখো, ওঁর গাড়িতে আমাদের অন্য সহকর্মী মহিলাও আছেন। ছিঃ। তোমার সঙ্গে কথা বলতে— (ফোন বেজে উঠল। সুব্রত এগিয়ে যাচ্ছিল। মালিনী গলা তুলল—)

 মালিনী : তুমি ধরবে না।

 সুব্রত : হয়তো অমিতাভবাবু আবার ফোন করেছেন!

 মালিনী : আমি দেখছি। (মালিনী এগিয়ে যায়, রিসিভার তোলে)

 মালিনী : হ্যালো! (উত্তর শোনে) ও, তুমি। বল, যমুনা। খুব কি জরুরি? আমি এখন ব্যস্ত, বেরোতে হবে—! (শোনে) কী কথা? ঠিক আছে, তুমি সন্ধের পরে এসো, শুনব। (উত্তর শোনে) কী করেছে কুন্তী? (উত্তর শোনে) ওকে ছাড়িয়ে দেব? সেকি? কেন? তুমিই তো দেখেশুনে দিয়েছ (উত্তর শোনে) তারপর নার্ভাস হয়ে রিসিভার রেখে দেয়। ঠোঁট কামড়ায়)

 সুব্রত : (এগিয়ে যায়)। কী হয়েছে?

 ( মালিনী খুব ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসে পড়ে। ঠিক তখনই আবার ফোন বেজে ওঠে। সুব্রত এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তোলে।)

 সুব্রত : হ্যালো (উত্তর শুনে রিসিভারে হাত চেপে মালিনী বলে) অমিতাভবাবু—।

 মালিনী : না না অসম্ভব। ওঁকে বলে দাও হঠাৎ শরীর খুব খারাপ হয়েছে, আমি যেতে পারব না, খুব দুঃখিত।

 সুব্রত : (টেলিফোনে) কিছু মনে করবেন না, মালিনীর শরীর খুব খারাপ হয়েছে, বোধহয় প্রেসার বেড়ে গেছে। তাই আপনাদের চলে যেতে বলল, ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

 (রিসিভার নামিয়ে রাখে সুব্রত। মালিনীর পাশে গিয়ে বসে।)

 সুব্রত : কুন্তীকে ছাড়িয়ে দিতে বলেছে যমুনা?

 (দু—হাতে মুখ ঢেকে থাকা মালিনী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে)

 সুব্রত : কেন? ওর কী অপরাধ? তুমি এত আপসেট হচ্ছ কেন? দেখো, নিশ্চয়ই যমুনা তার কোনো ভাইঝি, ভাগ্নীকে কুন্তীর জায়গায় ঢোকাতে চাইছে না।

 (মালিনী মাথা নাড়ল—’না’।)

 সুব্রত : তাহলে?

 মালিনী : কুন্তী প্রেগন্যান্ট।

নবম দৃশ্য

 (একই ঘর। একটু সময় এগিয়েছে। স্বামী—স্ত্রী এখন কাছাকাছি)

 সুব্রত : আমরা বোধহয় একটু বেশি রি—অ্যাক্ট করছি মালিনী। কুন্তী আমাদের কাজের মেয়ে। সে কীরকম কাজ করছে সেটাই আমরা দেখব। তাই না? ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আমরা ভাবছি কেন?

 মালিনী : ভাবতে হবে সুব্রত। কারণ আমরা একা একা থাকলেও সমাজকে নস্যাৎ করতে পারি না। আমাদের বাড়িতে একটি অবিবাহিতা মেয়ে কাজ করছে এবং সে প্রেগন্যান্ট যা কয়েক মাসের মধ্যেই সবাই বুঝতে পারবে, কেউ প্রশ্ন করলে তার জবাব দেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব আমাদের নিতে হবেই।

 সুব্রত : একটা কথা, কুন্তী যে অবিবাহিতা এই সিদ্ধান্তে আসছ কী করে?

 মালিনী : কী আশ্চর্য! ও প্রথম দিনেই বলেছিল মামা এবং মামি ছাড়া ওর কোনো আত্মীয় বেঁচে নেই। স্বামী থাকলে বলত না? তাছাড়া ওর সিঁথিতে সিঁদুর দেখেছ?

 সুব্রত : ওটা অনেকেই পরে না, চুল উঠে যাবে বলে তুমিও পরো না। মালিনী (উঠে দাঁড়ায়) কার সঙ্গে আমি কথা বলছি।

 সুব্রত : প্লিজ এত অধৈর্য হয়ো না। কাজের পিছনে না ছুটে আগে কানে হাত দিয়ে দেখো ওটা যথাস্থানে আছে কি না।

 মালিনী : মানে?

 সুব্রত : প্রথমে কুন্তীর সঙ্গে কথা বল। যাও।

 মালিনী : যাও মানে? আমি তোমার সামনেই ওর সঙ্গে কথা বলব।

 (চেঁচিয়ে ডাকে) কুন্তী, কুন্তী এই ঘরে এসো।

 সুব্রত : তুমি তো ওকে তুই করে বলতে।

 মালিনী : আঃ।

 (কুন্তী হাসি মুখে ঢোকে)

 কুন্তী : একি মাসি, তুমি এখনও এখানে? কখন পিকনিকে যাবে?

 মালিনী : (খুব গম্ভীর গলায়) ওখানে চুপ করে দাঁড়াও। তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, ঠিকঠাক উত্তর দেবে।

 কুন্তী : আমি তো কখনও তোমাকে বেঠিক উত্তর দিইনি মাসি।

 মালিনী : বড্ড বেশি কথা বলছ কুন্তী। প্রথমে জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কি বিবাহিত? বিয়ে হয়েছিল? হলে আমাদের বলনি কেন?

 সুব্রত : বিয়ে হয়ে থাকলে তোমার স্বামীর নাম বল।

 কুন্তী : (খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে) ওমা, এসব কী বলছ তোমরা। আমার বিয়ে হল কবে? হ্যাঁ, একবার মামা কোন দোজবরের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু টাকা পায়নি বলে শেষপর্যন্ত বিয়ে দেয়নি। বিয়েই যখন হয়নি তখন স্বামীর নাম কী করে বলব?

 (সুব্রত এবং মালিনী পরস্পরের দিকে একবার তাকাল)

 মালিনী : শোন, একটু আগে যমুনা  ফোন করেছিল।

 কুন্তী : ওমা! ফোন করার কী আছে। দু—বেলা বাড়ির সামনে দিয়ে এই বাড়ি ওই বাড়ি কাজে যায়।

 সুব্রত : সরাসরি জিজ্ঞাসা কর।

 মালিনী : যমুনা তোমার সম্পর্কে যা বলেছে তা শোনার পর তো আর এই বাড়িতে রাখতে পারি না।

 সুব্রত : কিন্তু যমুনার কথায় বিশ্বাস করছি না বলে তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছি, কথাটা সত্যি না মিথ্যে?

 কুন্তী : আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বললাম তো আমার এখনও বিয়ে হয়নি। এটা মিথ্যে নয়, একদম সত্যি।

 সুব্রত : তাহলে তুমি মা হচ্ছে কী করে?

 কুন্তী : মা?

  মালিনী : তোর পেটে বাচ্চচা আসেনি? সত্যি কথা বল?

 (কুন্তী ঠোঁট কামড়াল, মাথা বুকের কাছে ঝুঁকল)

 মালিনী : কী কথা নেই কেন মুখে? ছি ছি ছি। আইবুড়ো মেয়ে হয়ে এমন কাণ্ড করেছিস বলে তোকে মল্লিকবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, ঠিক কি না বল?

 (কুন্তী ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ে দু—হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।)

 মালিনী : এখানে বসে কেঁদে কোনো লাভ হবে না। আমি আর তোমাকে রাখতে পারব না। যে কয়েকদিন কাজ করেছ তার জন্য টাকা দিয়ে দিচ্ছি নিয়ে বিদায় হও।

 (কুন্তী পাথরের মতো বসে কেঁদে চলল)

 মালিনী (রেগে গিয়ে)। কথাগুলো কানে গিয়েছে।

 কুন্তী : (মুখ না তুলে) কেন? আমার দোষ কী?

 মালিনী : অদ্ভুত! এর পরেও জিজ্ঞাসা করছে আমার দোষ কী?

 কুন্তী : আপনারাই তো বলেন আমি খুব ভালো রান্না করি, ঘরের সব কাজ মানুর মায়ের থেকে অনেক ভালো করি, তাহলে আমাকে চলে যেতে বলছেন কেন? আমার দোষ কী?

 মালিনী : আমাদের দেশের মেয়েরা বিয়ের আগে মা হয় না, তুমি হয়েছ। দোষটা কী জানো না।

 কুন্তী : আমাকে ছোটবাবু অন্য কথা বলেছিল।

 সুব্রত : ছোটবাবু, সে কে?

 কুন্তী : যে বাড়িতে কাজ করতাম, সেই মল্লিকবাড়ির ছোটবাবু।

 সুব্রত : কী বলেছিল?

 কুন্তী : অনেক আগে এদেশের কুমারী মেয়েরা মা হত। আমার নামে একজনের নাম ছিল অনেক আগে। সে নাকি কুমারী অবস্থায় বাচ্চচার মা হয়েছিল। ছোটবাবু বলেছিল, তাকে সবাই সতী বলে। তাহলে?

 সুব্রত : (মালিনীকে) কথাগুলো মিথ্যে বলেনি।

 মালিনী : (চাপা গলায়)। সুব্রত। শোন কুন্তী, আমি আর কথা বাড়াতে চাই না।

 কুন্তী : কিন্তু মাসি, আমি কোথায় যাব?

 মালিনী : ওসব ঘটনা যখন ঘটিয়েছিলে তখন মনে ছিল না?

 কুন্তী : (মাথা নাড়ে)। না। বিশ্বাস করুন।

 মালিনী : যে চুলোয় যাও, আমার তাতে কিছু যায় আসে না।

 কুন্তী : এমন করে বলবেন না মাসি। আমার কেউ নেই। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না।

 মালিনী : এসব কথা মল্লিকবাড়ির গিন্নিকে বলনি কেন? ওরা তাড়িয়ে দিল আর তুমি এ বাড়িতে এসে কাপ ভাঙার চমৎকার গল্প বানালে। এখন অন্য কোথাও গিয়ে নতুন গল্প শোনাও।

 (কুন্তী কাঁদতে থাকে আবার। দু—হাতে মুখ ঢেকে)

 সুব্রত : ঠিক আছে, যে তোমার এই অবস্থার জন্য দায়ী তাকেই সব দায়িত্ব নিতে হবে। আমি তাকে বাধ্য করব। কী নাম তার?

 (কুন্তী কেঁদেই চলল)

 সুব্রত : কেঁদে তো কোনো লাভ হবে না। আমি তোমার উপকার করতে চাইছি। তোমার এই অবস্থার জন্য আর একজন দায়ী। নামটা বল। আমি পার্টির লোকদের বলে তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।

 মালিনী : সমাজসেবা করছ?

 সুব্রত : এটুকু না করলে—! হ্যাঁ বল।

 কুন্তী : কী বলব!

 সুব্রত : নাম। মল্লিকবাড়ির কেউ?

 (কুন্তী মাথা নাড়ে, হ্যাঁ বলে)

 সুব্রত : কে? কী নাম? মল্লিকবাড়ির বড়বাবু?

 কুন্তী : এম্মা। ছিঃ। তিনি বুড়ো মানুষ।

 সুব্রত : তাহলে মেজবাবু?

 কুন্তী : না—না উনি মেজ বউদিকে খুব ভয় পান।

 সুব্রত : তাহলে নিশ্চয়ই সেজবাবু?

 কুন্তী : সেজবাবু তো বিদেশে থাকেন।

 মালিনী : এত ন্যাকামি করছ কেন? ছোটবাবুর নামটা বলে ফ্যালো।

 কুন্তী : কী করে বলব? ঠিক বুঝতে পারছি না।

 মালিনী : মানে? বুঝতে পারছিস না মানে? ছোটবাবু তোকে—।

 কুন্তী : হ্যাঁ। কিন্তু ওর এক বন্ধু মাঝে মাঝে বাড়িতে আসত। ঠিক দুপুরবেলায় সেও আমাকে ছাড়েনি।

 মালিনী : সর্বনাশ। এ তো ভয়ংকর মেয়েছেলে! একসঙ্গে দু—দুটো পুরুষকে—। উঃ। ওর পেটে যে আছে তার বাবা কে তা কী করে বুঝবে?

 সুব্রত : বাচ্চচাটা হওয়ার পর ডিএনএ টেস্ট করা ছাড়া উপায় নেই।

  মালিনী : এই, তুই দূর হ। এসব শোনার পর উঃ আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে।

 কুন্তী : আমি কোথায় যাব মাসি?

 মালিনী : খবরদার আমাকে মাসি বলবি না।

 কুন্তী : বেশ, আপনি যখন চাইছেন না, কিন্তু—!

 মালিনী : আবার কিন্তু কেন?

 কুন্তী : আজ তো বৃহস্পতিবার। আজকের দিনে কাউকে তাড়ালে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। আমাকে অন্তত কাল সকাল পর্যন্ত থাকতে দিন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি—।

 মালিনী : আমি এসব কথা শুনতে চাই না, তুমি বিদায় হও।

 কুন্তী : এমন করে বলছেন কেন? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি?

 মালিনী : হায় ভগবান!

 কুন্তী : আচ্ছা দাদাবাবু, আমি এখানে থাকলে আপনাদের কি খুব ক্ষতি হবে? আমি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালে সবাই আমাকে ছিঁড়ে খাবে। উঃ। আমার পেটে যেটা আছে তার জন্য ভয় পাচ্ছেন? আচ্ছা, যখন ওর আসার সময় হবে তখন আমাকে কোনো হাসপাতালে দিয়ে দেবেন। আপনাদের একটুও কষ্ট দেব না।

 (সুব্রত কিছু বলতে যাচ্ছিল, মালিনী তাকে হাত তুলে থামাল)

 মালিনী : এসব কিছুই করতে হবে না তোমাকে। একটু আগে বলেছিলে আজকের রাতটা থাকতে চাও, কাল ভোরে চলে যাবে। বেশ তাই হোক। আজ তুমি তোমার ঘর থেকে বের হবে না। কোনো কাজ করতে হবে না। এখন চলে যাও সামনে থেকে—।

 (প্রায় দৌড়ে ভিতরে চলে গেল কুন্তী। মালিনী সোফায় এসে শরীরটাকে তার উপর ছেড়ে দিল। তিরিশ সেকেন্ড চুপচাপ।

 সুব্রত : মেয়েটার কী হবে বল তো?

 (মালিনীর চোখ বন্ধ। জবাব দিল না।)

 সুব্রত : হয় ওকে রেডলাইট এরিয়ায় গিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে নয়তো আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। যদি ওকে, ধরো, মাদার টেরেজার মতো কোনো হোমে নিয়ে যাওয়া যেত। বড় ভালো মেয়েটা।

 মালিনী : (চোখ খুলল)। এখনও ওকে দেখলে বোঝা যাচ্ছে না। ওসব করতে গেলে যে সময় যাবে, তখন যদি বলে এই বাড়ির দাদাবাবু ওর এই অবস্থার জন্য দায়ী তখন কী জবাব দেবে? জবাব দিতে পারবে তো? (মালিনী উঠে ভিতরে যেতে গিয়ে দাঁড়ায়)

 মালিনী : বাইরের দরজায় লক করে রাখো। কিছুই অসম্ভব নয়।

 (মালিনী চলে যায়)

দশম দৃশ্য

 (বাইরের ঘর) রাত অনেক। বই পড়ছিল সুব্রত। হঠাৎ পিছনের  দরজার শব্দ হল। চমকে উঠল সুব্রত। বই বন্ধ করল। তারপর পিছনে তাকাতেই দরজায় কুন্তীকে দেখতে পেল। অর্ধেকটা আড়ালে।

 কুন্তী : দাদাবাবু—!

 (সুব্রত মুখ নীচু করল। উত্তর দিল না)

 কুন্তী : আপনার জন্য একটু কফি করে আনি?

 (সুব্রত ঠোঁট কামড়াল)

 কুন্তী : আপনি তো রোজ খেতেন, আজ খাবেন না?

 (মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। যখন আলো ফিরে আসে তখন কুন্তী দরজায় নেই। সুব্রত মাঝখানে দাঁড়িয়ে)

 সুব্রত : (দর্শকদের দিকে তাকিয়ে)। কী উত্তর দেব আমি? মন চাইছে, বলি, হ্যাঁ, দাও, নিশ্চয়ই কফি খাব। কিন্তু আমি এমন খোলা গলায় বলতে পারছি না কেন? আপনি, আপনারা হলে কী উত্তর দিতেন?

পয়মন্ত

ওঃ, সেই ঘোড়া! লাগাম কেনার ক্ষমতা নেই, ঘোড়া কিনে বসলে! তিন—তিন বছর হয়ে গেল, ফার্স্ট—সেকেন্ড হওয়া দূরের কথা, ঘোড়াটা থার্ড—ও হয়নি। ওই ঘোড়াই তোমার কাল হয়ে গেছে। বিক্রি করে দাও ওটাকে!’

দেড় মাস হাসপাতালে থাকার পরে বাড়ি আসার সময় ইন্দিরা সুগতকে বলল, ‘তোমার—আমার অ্যাকাউন্টে মাত্র তিরিশ হাজার পড়ে আছে। অথচ হাসপাতাল বলছে, যা দিয়েছি তারপরেও নব্বুই হাজার দিতে হবে। টাকাটা কোত্থেকে দেবে?’

সুগত এই দেড় মাসে খুব দুর্বল হয়ে পড়েছিল। ক’দিন থেকে তার মনে হচ্ছিল হাসপাতালে বেশি দিন থাকলে সে আর বাঁচবে না! কথাটা শুনে সে ফাঁপরেই পড়ল। ওই নব্বুই হাজার না—দিলে হাসপাতাল তাকে ছাড়বে না। সে স্ত্রী’র দিকে তাকাল। ইন্দিরা বলল, ‘আমার দিকে তাকিয়ে কোনো লাভ হবে না। যখন তোমার জ্ঞান ছিল না তখন বাধ্য হয়ে আমি হাসপাতালে টাকা জমা দিয়েছি। আমার পক্ষে আর দেওয়া সম্ভব নয় তা জানাতেই আজ এসেছি।’

‘আমার আর টাকা নেই ইন্দিরা।’ কাঁপা গলায় বলল সুগত।

‘ব্যাঙ্কে নেই, নিশ্চয়ই অন্য কোথাও লুকিয়ে রেখেছ।’

‘বিশ্বাস করো, কোথাও নেই। থাকার মধ্যে শুধু ওই ঘোড়াটা আছে।’ কাতর গলায় বলল সুগত।

‘ওঃ, সেই ঘোড়া! লাগাম কেনার ক্ষমতা নেই, ঘোড়া কিনে বসলে! তিন—তিন বছর হয়ে গেল, ফার্স্ট—সেকেন্ড হওয়া দূরের কথা, ঘোড়াটা থার্ড—ও হয়নি। ওই ঘোড়াই তোমার কাল হয়ে গেছে। বিক্রি করে দাও ওটাকে!’ ইন্দিরা বেশ চেঁচিয়ে কথাগুলো বলল।

‘কেউ কিনবে না।’ মাথা নাড়ল সুগত হাসপাতালের বেডে শুয়ে। ট্রেনার বলেছে, এই বছরটা দেখবে তারপর ছেড়ে দেবে। ইন্দিরা, আমাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে নিয়ে যাও। এই নব্বুই হাজার আমি ঠিক শোধ করে দেব।’

‘অসম্ভব! তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না। তুমি একটা ভয়ংকর মিথ্যেবাদী, মিথ্যে ছাড়া তোমার মুখ থেকে কোনোও শব্দ বের হয় না। ভাগ্যিস বিয়ের পর তোমার কথায় ভুলে আমি চাকরিটা ছাড়িনি, নইলে আজ না—খেয়ে মরতে হত। চাকরি করি বলে তুমি কখনও আমার দায়িত্ব নাওনি। আমি অনেক করেছি, আর তোমাকে দয়া দেখাতে চাই না।’ ইন্দিরা বলল।

‘শেষবার, শেষবার, প্লিজ—!’

‘তোমার হয়ে কেউ টাকা না—মেটালে হাসপাতাল কী করবে? মারতে তো পারে না। পুলিশকে জানাবে। পুলিশ তোমাকে অ্যারেস্ট করবে। কিন্তু ওরা তো দু’বেলা খেতে দেবে তোমাকে।’ ইন্দিরা হাসল।

‘উঃ, ভগবান! একথাও, আমাকে শুনতে হল!’

‘বিয়ের সময় ভাত—কাপড়ের দায়িত্ব কি আমি নিয়েছিলাম?’

চোখ বন্ধ করল সুগত। জবাব দিল না।

‘ঠিক আছে। এবার আর দয়া করব না। নব্বুই হাজার টাকা তুমি একবছরের মধ্যে শোধ করবে দশ হাজার টাকা ইন্টারেস্ট যোগ করে।’

‘ঠিক তাই। আর বাড়িতে তোমার থাকার ব্যবস্থা আমি আলাদা করে দিয়েছি। আমার রান্নাঘর এবং বেডরুমে তোমার অ্যাকসেস নেই।’

‘তাহলে আমি খাব কোথায়?’

‘ওটা তোমার সমস্যা।’ ইন্দিরা উঠে গিয়েছিল।

সেই দিন বিকেলে নবনী তাকে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে বাড়িতে নিয়ে এল। পুরনো বন্ধুরা সবাই হাওয়া হয়ে গেলেও নবনীটা আসা—যাওয়া করে। তবে ইদানীং সুগতর মনে হয়, সেটা তার বন্ধু হিসেবে যতটা, তারচেয়ে অনেক বেশি ইন্দিরার জন্য। নবনী বলল, ‘এই রইল পাঁউরুটি—মাখন। খিদে পেলে খেয়ে নিয়ো। আর এসব ওষুধ—যা হাসপাতাল থেকে দিয়েছে, তা কখন খেতে হবে নিশ্চয়ই জানো? আমি চললাম।’

এই বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরজা দুটো। একটা, পাশের দিকটা, এতকাল বন্ধ থাকত। নবনী তাকে ওই দরজা খুলে ঢুকিয়েছে। একটা ঘর, বাথরুম, চিলতে জায়গা —যেখানে স্টোভ, হাঁড়ি, থালা—গ্লাস রাখা আছে। ওদিকে যাওয়ার দরজা ওধার থেকে বন্ধ। ওদিকে গোটাতিনেক বড় ঘর, ভালো টয়লেট; দারুণ কিচেন—যা ইন্দিরা ভোগ করছে। করুক।

বাথরুম থেকে বিছানায় ফিরে আসতে মাথা সামান্য টলল। এটা অত দিন অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকার জন্য, দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে আশ্বস্ত করল সুগত। তারপর বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়ে ভাবল, সে আর টেনশন নেবে না। আজ পর্যন্ত সাতজন লোক তার কাছে টাকা পায়। তিন লক্ষ বাহাত্তর হাজার টাকা। এই টাকা সে ধার করেছিল। ব্যবসাটা ডুবে যায় আড়াই বছর আগে। সেই ক্ষতি সামলাতে ধার করতে হয়। ইন্দিরা বলে ওই ঘোড়াটাই নাকি অপয়া! অথচ ওর নাম ‘পয়মন্ত’। ট্রেনার হাবিব খানকে সে প্রতি মাসে দশ হাজার দিত ঘোড়ার খাওয়া আর ট্রেনিংয়ের জন্য। গত একবছর দিতে পারেনি। হাবিব খান সহানুভূতি দেখিয়েছিল, ‘আপনার প্রবলেম বুঝতে পারছি স্যর। ঠিক আছে, আপনাকে প্রত্যেক মাসে টাকা দিতে হবে না। ওটা আমিই দিয়ে দেব। আমরা স্টেবলে কোনো ঘোড়া তো না—খেয়ে থাকতে পারে না। অবশ্য আপনি যদি চান তা হলে ওকে অকশনে তুলতে পারি। কেউ যদি কিনে নেয়, যা টাকা পাবেন তাই আপনার লাভ।’

মন চাইছিল না, তবু বাধ্য হয়ে সম্মতি দিল সুগত। রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব আরও ওইরকম পাঁচটা ঘোড়াকে অকশনে তুললে চারটে বিক্রি হয়ে গেল। পড়ে রইল পয়মন্ত আর অন্য একটা ঘোড়া। যে—ঘোড়া কুড়িটা রেস করেও প্রথম দিকে আসতে পারেনি, তাকে কেউ কিনতে চাইল না। আর তখন থেকে বুকে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে গেল সুগতর। হাবিব খান তাকে বলেছে এই বছরটা দেখবে। যদি পয়মন্ত প্রথম তিন ঘোড়ার মধ্যে দৌড় শেষ করে, তা হলে যে—টাকা প্রাইজ মানি হিসেবে পাবে, তা হাবিব খান ওর ‘খরচ’ হিসেবে নিয়ে নেবে। না—হলে পয়মন্তকে কেউ ‘রেসের ঘোড়া’ হিসেবে কিনবে না। ময়দানের ঘোড়ার গাড়ির মালিকরা নিশ্চয়ই কিনে নেবে।

চোখ খুলল সুগত। আর কিছু দিন পরে মরশুম শেষ হয়ে যাবে। তার মধ্যে যদি পয়মন্ত কিছু না—করতে পারে তা হলে হাবিব খান ওকে স্টেবল থেকে বের করে দেবে। চিরকাল তো কেউ ভস্মে ঘি ঢালতে পারে না!

অথচ এরকম তো হওয়ার কথা ছিল না। তখন ব্যবসা রমরমিয়ে চলছিল। ‘সাদা’ টাকার সঙ্গে ‘কালো’ টাকা। হাবিব খানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন অসিত মিত্তির। বিশাল বড়লোক। বারোটা রেসের ঘোড়া মুম্বই—বেঙ্গালুরুতে দৌড়য়। হাবিব খান বলেছিল, ‘মিত্তির সাহেব তো কলকাতার রেসকোর্সে ইন্টারেস্টেড নন, কিন্তু দারুণ একটা বাচ্চচা আছে। ইচ্ছে করলে কিনতে পারেন।

সেই মাথায় ঢুকেছিল। ঘোড়া কিনলে কী—কী লাভ হয় তার ছবি সুন্দর এঁকেছিল হাবিব খান। ‘কালো’ টাকা কীভাবে ‘সাদা’ করা যায় তা বুঝিয়েছিল। কিন্তু ‘কালো’ দূরের কথা, সব ‘সাদা’ টাকা যে ব্যবসা ডুবে যাওয়ায় জল হয়ে যাবে—তা তো সে—সময় জানা ছিল না!’ ঘোড়ার মালিক’ হিসেবে রেসকোর্সে যাওয়ার সেসব সুদিনের কথা খুব মনে পড়ে। তারপর যখন ব্যবসা গেল, রেসকোর্সে গেলেই পাওনাদাররা তাগাদা দিতে লাগল, তখন ভয়ে—লজ্জায় যাওয়া বন্ধ করল সুগত। যেদিন পয়মন্ত দৌড়ত, সেদিন সকালে হাবিব খানের ফোন আসত, ‘আজ দৌড়চ্ছে, প্রে করুন, প্রে করলে যদি আপনার ভগবান দয়া করেন।’

‘প্রে’ করত সুগত, কিন্তু পরদিন কাগজের কোথাও পয়মন্তের নাম না—দেখে যা বোঝার বুঝে যেত। হাবিব খানকে জিগ্যেস করেছিল, কেন সে মিথ্যে কথা বলে পয়মন্তকে কিনিয়েছিল? হাবিব খান বলেছিল, বাচ্চচা যখন ছিল তখন পয়মন্ত দারুণই ছিল, কিন্তু ট্রেনিংয়ের সময় একটু সেট ব্যাক হয়ে গিয়েছে। সুগত বুঝে গিয়েছিল, তার সঙ্গে পয়মন্তের কোনো পার্থক্য নেই।

তিন লক্ষ বাহাত্তরের সঙ্গে ইন্দিরার এক লক্ষ যোগ করলে যা দাঁড়ায় তা এই জীবনে জোগাড় করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। হাসপাতালে যাওয়ার আগে এই ঘরের আলমারিতে রাখা বইয়ের ভাঁজে দশটা একশো টাকার নোট রেখে গিয়েছিল সে। ওই এক হাজার টাকাই তার ভরসা। দু’বেলা রুটি—তরকারি কিনে খেলেও পঞ্চাশ দিনে শেষ হয়ে যাবে। হোক! ওই টাকার শেষ দশটা যতদিন পকেটে থাকবে ততদিন সে মৃত্যুর কথা ভাববে না।

পরের দিন ওদিকের দরজায় পা দেওয়ার আগে নবনী এই ঘরে এল, ‘এই তো অনেক ভালো দেখাচ্ছে। দোকানের খাবার বেশি দিন না—খেয়ে নিজে হাত পুড়িয়ে যা পারো রেঁধে খাও।’

‘অনেক ধন্যবাদ। তোমার মোবাইলটা একটু দাও তো, আমারটায় ব্যালেন্স আর নেই।’ হাত বাড়াল সুগত।

নবনী মোবাইলটা দিলে হাবিব খানের নাম্বার ডায়াল করল সুগত। নাম বলতেই হাবিব চিৎকার করে বলল, ‘আরে! আপনি কোথায় ছিলেন এত দিন? গতকালও ফোন করে শুনেছি সুইচড অফ। শুনুন, কাল পয়মন্ত জীবনের শেষ দৌড় দৌড়চ্ছে। আপনাকে জানিয়ে দিলাম।’

‘শেষ দৌড় মানে?’ হতভম্ব সুগত।

‘আর ওর পিছনে পয়সা খরচ করব না। কাল একটা কাপের বাজি আছে। দুই মাইল ছুটতে হবে। এই দূরত্ব ও কোনোদিন দৌড়য়নি। যদি থার্ড হয়, তা হলে আমাদের তিন লাখ আসবে। সেক্ষেত্রে আর একবছর রাখতে পারি ওকে। নইলে ময়দানের ঘোড়ারগাড়ির মালিক মনসুর আলি চল্লিশ হাজার দিয়ে ওকে নিয়ে যাবে। ওই টাকার অনেক বেশি আমি খরচ করেছি ওর পিছনে, তাই আপনাকে শেয়ার দিতে পারব না।’

‘কাল কখন রেসটা হবে?’ সুগত জিগ্যেস করল।

‘বিকেল সাড়ে তিনটেতে।’

‘হাবিব ভাই, আজ সন্ধেবেলায় আপনার স্টেবল যেতে পারি? পয়মন্তকে শেষবার দেখে আসতে ইচ্ছে করছে।’

‘ঠিক আছে, আসুন।’

আজ দুপুরে ভাত, আলু সেদ্ধ, ডিম সেদ্ধ, মাখন দিয়ে মেখে খেয়ে ঘণ্টাদুয়েক ঘুমিয়ে নিল সুগত। অল্প টাকার মধ্যেই খরচটা থাকল। মাখন তো নবনী দিয়ে গিয়েছিল। পেটে ভাত এবং শরীরে দুপুরের ঘুম পাওয়ায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাসস্ট্যান্ড অবধি পৌঁছেছিল সুগত। কিন্তু বুঝতে পারছিল, বাসে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। হাজার টাকা দ্রুত কমে যাচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেই তার। ট্যাক্সি নিল সে।

হাবিব খানের স্টেবল পৌঁছতে সন্ধে নেমে গেল। হাবিব নেই। কিন্তু হেড সহিস তাকে চিনতে পারল। ‘আইয়ে সাব। আপনার লাক খুব খারাপ। একটা ঘোড়া তিন বছরে একবারও ফ্রেমে আসবে না এমন হয় না। আমিই বড় সাহেবকে বললাম, পয়মন্তকে লম্বা দৌড়ে দিন বলা যায় না কিছু। কোনো দরকার আছে?’

‘একবার পয়মন্তকে দেখতে চাই।’ সুগত বলল।

হেড সহিস একটি জুনিয়র সহিসকে সঙ্গে দিল।

পরপর ঘরগুলোতে হাবিব খানের কাছে ট্রেনিং—পাওয়া ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে আছে। পয়মন্তের কাছে পৌঁছে দিয়ে ছেলেটি চলে গেলে সুগত ঘোড়াটার দিকে তাকাল। পয়মন্ত তার দিকে তাকাচ্ছে। তারপর মাথা নীচু করল। সুগতর মনে হল পয়মন্ত লজ্জা পাচ্ছে। ও কিছুই করতে পারেনি বলে অপরাধবোধে আক্রান্ত হচ্ছে। হঠাৎ মাথা, ঘুরতে লাগল সুগতর। সে ধীরে—ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। স্টেবলের আবছা অন্ধকারে যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন তার মাথায়, গালে, গলায় ভিজে—ভিজে অনুভূতি। পয়মন্তের মুখ নেমে এসেছে তার মুখের ওপর। জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে পয়মন্ত। উঠে বসল সুগত। তারপর দুই হাতে পয়মন্তের মুখ ধরে ফুঁপিয়ে উঠল, ‘পয়মন্ত, তুই আমাকে বাঁচা। একমাত্র তুই পারিস আমাকে বাঁচাতে।’

হাবিব খান তার স্টেবল থেকে সুগতকে আবার হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিল। ডাক্তার বলেছেন, ‘ভয়ের কিছু নেই। টেনশনে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল সুগত। কালই ছেড়ে দেওয়া হবে।’ সুগত চাইছে দুপুরেই ছাড়া পেতে। কারণ সাড়ে তিনটের যে—রেসটায় দু’মাইল পয়মন্ত দৌড়বে, এমন দৌড় কখনও দৌড়য়নি সে। মনে—মনে দৌড় শুরু করল সুগত। পয়মন্তর হয়ে।

সুহাসিনীর কপাল

কেউ কেউ কপাল করে আসে, যেমন সুহাসিনী। দশ—বারো বছরে বান্ধবীরা যখন মায়েদের ধমকে রান্নাঘরে উঁকি দিতে বাধ্য হয়েছিল তখন মা বলেছিল, ‘না না, তোকে উনুন তাতে যেতে হবে না। বিয়ের পর থকে তো রান্নাঘরই মেয়েদের শরীর খেয়ে নেয়, এখন থেকেই সেটা প্র্যাকটিস করতে হবে না।’ বাবা শুনে বলেছিলেন, ‘ঠিক কথা বলেছ সুপ্রভা, তবে কিনা একটু— আধটু রান্না না শিখলে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে সমস্যায় পড়বে বেচারা।’

মা চোখ পাকিয়েছিলেন, মেয়ের বিয়ে এমন বাড়িতে দেব যেন সেখানে গিয়ে রাঁধুনির চাকরি করতে হবে না। পাঁচটা কাজের লোক যাদের রাখার ক্ষমতা নেই তাদের বাড়িতে মেয়ে দেব না।’

শহরের একমাত্র কলেজটিতে ছেলেমেয়েরা একসঙ্গে পড়াশুনা করে। বাবার ইচ্ছে ছিল না সেখানে মেয়ে পড়ুক তাই কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে পড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু মা বলেছিল, ‘ক’বছর পরে মেয়ে তো শ্বশুরবাড়িতে যাবেই, এখন থেকে কাছছাড়া কেন করব? নিজেকে ঠিক রাখলে ছেলেদের সঙ্গে পড়লেও ওর কোনো ক্ষতি হবে না।’ বি এ পাশ করার পর মায়ের মনের মতো পাত্রের সংসারে চলে এসেছিলেন সুহাসিনী।

কেউ কেউ কপাল করে আসে। নইলে এরকম শাশুড়ি কেউ পায় যিনি বলেন, তোর শ্বশুর কিংবা বর কিছু খেতে চাইলেই তুই রান্নাঘরে ঢুকবি না। হোক গ্যাসের আগুন, অত সুন্দর রং ঠিক নষ্ট করে দেবে। সবসময় সেজেগুজে থাকবি আর বই পড়বি। এই পৃথিবীটাকে জানতে হলে বই ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। আমি যে লাইব্রেরির মেম্বার, তোকেও তার মেম্বার করে দেব।’

আরম্ভ হল গল্পের বই পড়া। বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ— শরৎচন্দ্র—হয়ে আশাপূর্ণা দেবী। স্বামী মানুষটা ভারী ভালো ছিল। শুধু বলেছিল, ‘সুহাসিনী, তুমি বই পড়ো যখন আমি বাড়িতে থাকব না।’

‘যখন বাড়িতে থাকবে?’

‘আমার দিকে চেয়ে থেকো।’ স্বামী হেসে বলেছিল।

স্বামীর সঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেলে, এমনকী সিনেমায় গেলেও ভালোভাবে সেজে যেতে হবে। সাজ শেষ হলে শাশুড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে তিনি খুঁটিয়ে দেখবেন। কোনো কিছু পছন্দ না হলে কী করতে হবে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতেন। শাড়িওয়ালা থেকে কাশ্মীরি শালওয়ালা বাড়িতে আসত। শাশুড়ি আগে বউমাকে যা মানাবে তা কিনতেন, তারপর নিজের এবং অন্যদের। খোকা হওয়ার সময় নার্সিংহোম থেকে সুহাসিনীকে সাহস জুগিয়ে গিয়েছিলেন দু’দিন দুইরাত। শ্বশুরমশাই হেসে বলেছিলেন, ‘শাশুড়িদের বদনাম একাই ঘুচিয়ে দিলে তুমি। খুব ভালো, খুব ভালো।’

মা—বাবা নেই, শ্বশুর—শাশুড়ি নেই, স্বামীও চলে গেছেন। এখন ছেলে আর বউমার সঙ্গে তিনি থাকেন। কিন্তু বউমা বলে, ‘কথাটা ঠিক নয়। আমরা তোমার সঙ্গেই থাকি।’

বড় অদ্ভুত মেয়ে এই বউমা। নামটিও অদ্ভুত, উপলা। ছেলে পছন্দ করেছিল, উপলাও ছেলেকে। স্বামী বিয়েটা দিয়ে গিয়েছিলেন। এবাড়িতে এসে নিজেই এগিয়ে সংসারের হাল ধরেছিল উপলা। ব্যাপারটা শোভন নয় বলে সুহাসিনী আপত্তি জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘এখন তোমার আনন্দ করার সময়। সংসার নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।’

উপলা হেসে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কাউকে তো মাথা ঘামাতে হবে।’

‘হ্যাঁ, ওটা না হয় আমিই ঘামাই।’ সুহাসিনী হেসে বলেছিলেন।

‘না না। তুমি কী করে ভাবলে তোমার মা কিংবা শাশুড়ি যা করতে দেননি তা আমি তোমাকে করতে দেব?’ উপলা হেসেছিল।

মেয়েটিকে ভারী পছন্দ সুহাসিনীর। ইদানীং ওর পাল্লায় পড়ে বেরোতে হচ্ছে। দুপুরের খাওয়ার পর একঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে উপলা তাঁকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। টেলিফোনে ওলা অথবা উবের ট্যাক্সি ডেকে নেয়। তারপর সোজা কোনো শপিং মলে। সাউথ সিটি মলে যেতে খুব ভালো লাগে সুহাসিনীর। ভরদুপুরেই কত মানুষ মলের ভেতর ঘুরছে। কেনাকাটা না করেও উইন্ডো শপিং—এই দিন ফুরিয়ে যায়। তাছাড়া সপ্তাহে অন্তত তিনদিন মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখা তো আছেই। বেশিরভাগই হিন্দি কিন্তু দেখতে বেশ ভালো। বাংলা ছবি ‘প্রাক্তন’ দেখতে দেখতে সুহাসিনীর মনে হয়েছিল, স্কুলে পড়ার সময় পাড়ার সিনেমা হলে মায়ের সঙ্গে দু’তিনবার সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন। মা উত্তমকুমারের ভক্ত হলেও ‘একটা সিনেমায় সৌমিত্র চ্যাটার্জি ছিলেন। ছিপছিপে সুন্দর চেহারা। কত বছর আগের কথা। সৌমিত্র চ্যাটার্জি এখনও সুন্দর আছেন। তার মানে অনেকসময় বয়স সৌন্দর্য কেড়ে নেয় না।

ছেলে এনে দিল স্মার্টফোন। একটু রাগ করে বললেন, ‘ওমা! এত দামি ফোন কেন কিনলি? আমি কাকে ফোন করব?’

‘যাকে ইচ্ছে তাকে করবে। তোমাকে তো কিছুই দিতে পারি না।’ ছেলে দেখিয়ে দিয়েছিল কী করে মোবাইল ফোনটা ব্যবহার করতে হয়। আঙুল ছোঁয়ালেই গোটা পৃথিবী যেন সামনে চলে আসছে। ক্রমশ মজা লাগল সুহাসিনীর। মজাটা বাড়াতে সাহায্য করল উপলা। হোয়াটস আপ, ফেসবুক চালু করে দিল সে। সুহাসিনীকে শিখিয়ে দিল কী করে সেগুলো ব্যবহার করতে হয়।

এতকাল সুহাসিনী ফোন করতেন মাসতুতো বোন বা সেইসব আত্মীয়দের যাঁরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পছন্দ করতেন। কিন্তু এখন আর কথা বলার দরকার হয় না। হোয়াটস আপে বিনা পয়সায় এর—ওর খবর নিতে পারছেন।

হোয়াটস আপ চালু করার পর বেশ মজা হল। একজন লিখল, সুহাসিনী, তুমি কোন সুহাসিনী?

থমকে গেলেন সুহাসিনী। আমি কোন সুহাসিনী? সবাই আমাকে আনন্দে রাখতে চেয়েছিল। সারা জীবন আমি আনন্দে আছি। আমাকে যাঁরা আনন্দে রাখতে চেয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই চলে গিয়েছেন। যাওয়ার আগে দায়িত্বটা আর একজনকে দিয়ে গিয়েছেন। তাহলে আমি কোন সুহাসিনী যাকে কেউ দুঃখে থাকতে দিতে চায়নি! মা যখন চলে গিয়েছিলেন তখন শাশুড়ি তাঁর পাশে ছিলেন। তিনিই বুঝিয়েছিলেন, ‘সবাইকে সময় হলে চলে যেতে হয়। তোমার মাকে চলে যেতে হল কিন্তু আমি তো আছি। তুমি দুঃখ পেলে অন্যকেও তো দুঃখ দেবে।’ কথাটা মনে ধরেছিল। শাপমোচনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন একই কথা। তালভঙ্গের অপরাধে উর্বশীকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল স্বর্গ থেকে চলে যেতে হবে মর্ত্যধামে। সেখানে গিয়ে দুঃখ পাবে, দুঃখ দেবে।

অর্থাৎ দুঃখ যে পায় সে—ই দুঃখ দেয়। এই অভিশাপ অনন্তকাল ধরে মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু সুহাসিনী কাউকে দুঃখ দিতে চান না তাই নিজে দুঃখ পেতে চাননি। শাশুড়ি বা স্বামীর চলে যাওয়ায় বিষণ্ণ হয়েছিলেন নিশ্চয়ই কিন্তু তা থেকে তাঁকে মুক্ত করার মানুষের অভাব হয়নি।

আমি এই সুহাসিনী। নিজের মনেই বললেন তিনি।

ফেসবুকে হারিয়ে যাওয়া মানুষের সন্ধান পেলেও পাওয়া যেতে পারে। সুহাসিনী স্মৃতি হাতড়ে তেমন কারও নাম পেলেন না যার সন্ধান তিনি করতে পারেন। শেষ পর্যন্ত সবিতার কথা মনে এল। স্কুলের শেষ তিনটে বছরে খুব বন্ধু ছিল ওরা। সবিতা কলকাতার কলেজে পড়তে যাওয়ার পর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। সেটা আর জোড়া লাগেনি। উপলাকে সবিতার কথা বললেন তিনি। সবিতার বাবার নাম, বাড়ির ঠিকানাও। কিন্তু সেই সবিতা নিশ্চয়ই বিয়ের পর অন্য ঠিকানায় চলে গিয়েছে। উপলা হাল ছাড়ার মেয়ে নয়। অনেক চেষ্টা করে সে সবিতার মোবাইল নাম্বার জোগাড় করে এনে বলল, ‘নাও, ফোন করে আগে বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলে নাও।’

‘এটা অন্য কোনো সবিতার নাম্বার নয় তো?’

‘না গো, না। সেই সবিতাই। ভদ্রমহিলা বিয়ে করেননি, বড় চাকরি করেন। আমার সঙ্গে কথা হয়েছে।’ উপলা বলল।

‘ওমা, তাই!’

যেহেতু উনি এখনও বাপের বাড়িতে আছেন তাই খোঁজ পেতে অসুবিধে হয়নি। তুমি শাশুড়ি হয়েছ শুনে বললেন, মাই গড!’

সুহাসিনী ফোন করার আগেই সবিতার ফোন এল, ‘বাই এনি চান্স, তুমি কি সেই সুহাসিনী যার গালে একসময় টোল পড়ত?’

সুহাসিনী হেসে ফেললেন, ‘এখনও পড়ে।’

‘মাই গড। অ্যাদ্দিন কোথায় ছিলে খুকি? আমি সবিতা। মনে আছে?’

‘বিলক্ষণ!’

‘যে মেয়েটা ফোন করেছিল সে কে? বলল, তোর বন্ধু। গলা শুনে তো মনে হল না। বলল, শাশুড়ি হয়ে গিয়েছিস! তাই?’

‘হ্যাঁ। তুই?’ পাল্টা প্রশ্ন করলেন সুহাসিনী।

‘বয়ে গিয়েছে। পুরুষ মানুষ তো বটেই, শ্বশুর—শাশুড়ির গোলামি করার জন্যে আমি জন্মাইনি। বাবা চেয়েছিলেন আমি বিয়ে করি। একজনকে পছন্দও হয়েছিল। সে বিয়ের কথা বললে বাবার কথা ভেবে তাকে বলেছিলাম, বিয়ে করতে পারি কিন্তু মা হতে পারব না। রাজি থাকলে বল।’

সুহাসিনী বুঝলেন তিনি ঠিক সবিতার সঙ্গে কথা বলছেন। তাই খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বললেন তিনি?’

‘টুক করে কেটে পড়ল।’

‘এখন তুই কেমন আছিস সবিতা?’

‘ফাটাফাটি। চাকরি করি। টাকা জমিয়েছি। কেউ পাশে শুয়ে নাক ডাকলেও টলারেট করতে হবে না। তোর স্বামীর নাক ডাকে?’

‘আগে তো ডাকত না।’

‘বুড়ো হওয়ার পর ডাকছে তাই তো?’

‘সেটা জানার সুযোগ পাইনি। তার আগেই সেরিব্র্যাল হল, তিনদিনের মধ্যে চলে গেল।’

‘ওহো!’ সবিতার গলায় একটু সহানুভূতির সুর!

‘তুই ওহো বললি কেন? তখন আমার খারাপ লেগেছিল কিন্তু খারাপ লাগাটা মনে নেই।’ সুহাসিনী বললেন।

‘মাই গড! তুই তো একদম বদলে গিয়েছিস সুহাসিনী। এক কজ কর। সামনের শনিবারে ইন্ডিয়া ক্লাবে চলে আয়। এই সাড়ে বারোটা নাগাদ। একসঙ্গে লাঞ্চ করব।’ সবিতা বলল।

‘নারে! শনি—রবি ছেলের ছুটি থাকে। দুপুরে একসঙ্গে না খেলে ভালো লাগে না। তাছাড়া বউমাকে না নিয়ে আমি কোথাও যাই না।’

‘যাচ্চচলে। তোর আমার মধ্যে বউমাটি কোত্থেকে আসছে? মুখ খুলে কথাই বলতে পারবি না তুই। ঠিক আছে, তুই ভেবে দ্যাখ। দেখা করতে ইচ্ছে হলে ফোন করিস। বাই।’

কথাগুলো উপলাকে বললেন না সুহাসিনী। সবিতা ওকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইছে না শুনলে ওর খারাপ লাগতে পারে। স্কুলে পড়ার সময় সবিতা একটু ক্যাট ক্যাট করেই কথা বলত। কিন্তু মা হবে না বলে বিয়ে করবে না এটা তখন ভাবা যেত না। বড় চাকরি করে, ইন্ডিয়া ক্লাবে লাঞ্চ করে যখন তখন নিশ্চয়ই ওই অভিজাত ক্লাবের মেম্বার। গলার স্বরে কর্তৃত্ব। এমন মহিলা পুরুষসঙ্গ ছাড়া দিব্যি কাটিয়ে দিল জীবনটা। গল্প উপন্যাসে এরকম চরিত্র পেয়েছেন সুহাসিনী, জীবনে দেখেননি। অবশ্য তাঁর সীমাবদ্ধ জীবনে দেখার মতো বেশি কিছু ছিল না।

সেই রাত্রে নতুন করে বুদ্ধদেব গুহর লেখা ‘কোয়েলের কাছে’ খুলে বসেছিলেন। কী মনে হতে টাচফোন খুলে দেখলেন ফেসবুকে কেউ তাঁকে ইনভাইট করেছে বন্ধু হওয়ার জন্যে। বেশ মজা লাগল। এই প্রথম কেউ এই আগ্রহ দেখাল। উপলা যেভাবে শিখিয়ে দিয়েছিল সেইভাবে পাস ওয়ার্ড ব্যবহার করে তিনি জানতে পারলেন, মানুষটির নাম শোভন বসু। বয়স সাতান্ন। ইংরেজির অধ্যাপক। সুহাসিনী যে কলেজে ছেলেদের সঙ্গে পড়েছেন সেই কলেজের ছাত্র। বছরটা দেখে মনে হচ্ছিল হয় সহপাঠী নয় এক বছরের সিনিয়ার।

শোভন বসু নামের কাউকে মনে করার চেষ্টা করলেন সুহাসিনী। যে দুজন সহপাঠী তাঁর সঙ্গে ভাব করার চেষ্টা করত এবং তিনি যাদের নির্লিপ্ত থেকে সরিয়ে দিতেন তাদের কারও নাম তো শোভন ছিল না।

পরের দিন সবিতা ফোন করল, ‘অ্যাই তোকে শোভন ফেসবুক করেছে?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু উনি কে? আমার নাম্বার কী করে পেল?’

‘তোর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে শুনে নাম্বার চেয়ে নিয়েছিল। তারপরে মনে হল দিয়ে ঠিক করিনি। ফোন করলে ধরিস না।’

‘সেকি! কেন?’

‘তুই এখনও হাঁদা থেকে গেলি। আরে আমাদের বয়সি একটা লোক বিয়ে না করে আছে। এরা কি ডেঞ্জারাস হয়, জানিস না?’

‘না তো!’

‘ওঃ। মাই গড। এরা সারাজীবন ধরে মেয়েদের ভোগ করেও টায়ার্ড হয় না। দে নো দ্য আর্ট। তোর সঙ্গে আলাপ করে কখন কীভাবে তোকে গিলে খাবে তুই বুঝতেই পারবি না। যখন হজম হয়ে যাবি তখন কেঁদে কূল পাবি না। আমি এদের হাড়ে হাড়ে চিনি।’ সবিতা ফোন রাখল।

ধন্দে পড়লেন সুহাসিনী। তাঁর এক মামা ছিলেন, আশি বছরে গত হয়েছেন, বিয়ে করেননি। সারাজীবন যতটা সম্ভব অন্যের উপকার করেছেন। কখনই কোনো মেয়ের ক্ষতি করেছেন বলে শোনা যায়নি। বাবা খুব প্রশংসা করতেন ডক্টর বিধানচন্দ্র রায়ের। তিনিও অবিবাহিত ছিলেন। তাহলে? আর শোভন বসু লোকটা যদি খারাপ হবে তাহলে সবিতা তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক রেখেছে কেন? সুহাসিনীর মোবাইল নাম্বারও কেন দিতে গেল? জীবনে প্রথমবার সুহাসিনীর মনে কুচিন্তা এল। উল্টোটাও তো হতে পারে। সারাজীবন ধরে যেসব অবিবাহিতা মহিলা ছেলেদের ভোগ করেও টায়ার্ড হয় না, সবিতা এখন তাদের একজন নয় তো? মোবাইল অফ করলেন সুহাসিনী।

শরীর কেমন ঘিনিয়ে উঠল। এই রাত্রে সুহাসিনীর মনে হল স্নান করা দরকার, না হলে রাত্রে ঘুমাতে পারবেন না। এও তাঁর কপালে ছিল?

পরবাসে

কেনাকাটা শেষ হয়ে গিয়েছিল গতকালই। সাতদিনের ইন্ডিয়া ভ্রমণের উদ্দেশ্য ছিল নার্গিসকে ডাক্তার দেখানো। তিন মাস আগে ঢাকা থেকে মেল, ফোন করে বিখ্যাত ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া গিয়েছিল।

নার্গিসের সঙ্গে সিরাজের বিয়ে হয়েছিল আট বছর আগে। সুন্দরী স্ত্রী ঘরে আসার পর সিরাজের গার্মেন্ট ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠেছিল। বনানীতে বড় ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে সার্কুলার রোড ছেড়ে। সবই ঠিকঠাক শুধু ওদের সংসারে সন্তান আসছিল না। প্রথম দুই বছর এ নিয়ে মাথা ঘামায়নি ওরা, তারপর যখন দুই পক্ষের আত্মীয়রা জানতে চাইল কবে সুখবর পাবে তখনই টনক নড়ল। প্রথম দিকে নার্গিসের মনে হয়েছিল এত তাড়াহুড়ার কী আছে? শরীরে সন্তান এলে হবু মায়েদের কী কী সমস্যা হয় তা তার জানা আছে। আর সেই সন্তান পৃথিবীতে আসার পর অন্তত বছর তিনেক তার সেবায় নিজেকে তৈরি রাখতে হয়। নার্গিসের এক ভাবিকে বলতে শুনেছে সে, দিনে জ্বালায়, রাতে ঘুমাচ্ছি না। এই বাচ্চচার জ্বালায়, কেন যে মেয়ে মানুষ হয়ে জন্মালাম! বাচ্চচার বাপের তো এসব সামলাতে হয় না।

অতএব নার্গিস চেয়েছিল হাত—পায়ে শিকল না জড়িয়ে যতদিন থাকা যায় ততদিনই সুখের। কিন্তু চার বছর পরে সিরাজ বলল, ‘না’, এবার কেউ আসুক। ওকে মানুষ করতেও তো সময় লাগবে। মানতে বাধ্য হল নার্গিস।

কিন্তু কোথায় কী! বন্ধুদের উপদেশে সিরাজ প্রথম একজন মহিলা গাইনি ডাক্তারের কাছে নার্গিসকে নিয়ে গেল। তিনি পরীক্ষা করে বললেন, নার্গিসের শরীরে কোনো অস্বাভাবিকত্ব নেই। মা হওয়ার সব রকম যোগ্যতা তার রয়েছে। চাপ পড়ল সিরাজের মনে। তাহলে কি তার শারীরিক ত্রুটির কারণে নার্গিস মা হতে পারছে না? কিন্তু পরীক্ষায় জানা গেল, সিরাজও স্বাভাবিক। আর তাতেই সমস্যা বাড়ল।

বন্ধুরা বলল, আরও মহিলা গাইনি ডাক্তারের কাছে যেতে। ডাক্তার আগের রিপোর্টগুলো দেখে বললেন, যদি ধরে নিই এ রিপোর্টগুলোয় ভুল নেই তাহলে বলব শুধু সময়ের অপেক্ষা করুন। সন্তান আসবেই। ডাক্তার ভিটামিন জাতীয় ওষুধ দিয়েছিলেন।

কিন্তু সাড়ে সাত বছর যখন চলে গেল তখন নার্গিসের মানসিক পরিবর্তনগুলো লক্ষ করল সিরাজ। এখন সে মা হতে চাইছে, কোনো ত্রুটি না থাকা সত্ত্বেও সেটা সম্ভব হচ্ছে না বলে ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছে। এই সময় এক বন্ধু ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায়ের খবরটা দিল। কলকাতার এই বৃদ্ধ ডাক্তার এই ধরনের সমস্যার সমাধান করে আসছেন বেশ কয়েক বছর ধরে। কিন্তু তার অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়া খুব মুশকিল। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যার রোগী তিনি দেখে থাকেন কিন্তু অপেক্ষার তালিকা দীর্ঘ। সিরাজ গুগলে ডক্টর মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে যেসব তথ্য পেল তাতে উৎসাহিত হল। সে মেল পাঠাল একটা অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য, উত্তর এল না। শেষে ডক্টর মুখোপাধ্যায়ের অফিসের কর্মচারীর সঙ্গে কথা হল তিনবার চেষ্টার পর। সে বাংলাদেশ থেকে ফোন করছে শুনে ভদ্রলোক একটু নরম হলেন। বললেন, বাবার কাছে শুনেছি আমাদের বাড়ি ছিল বিক্রমপুরে, ঠিক আছে আপনারা আমি যে তারিখটা বলছি সেই তারিখে বিকেল সাড়ে পাঁচটার মধ্যে স্যারের চেম্বারে পৌঁছে যাবেন। ভদ্রলোক তারিখ এবং ঠিকানা জানিয়ে দিলেন। খবরটা নার্গিসের মুখে হাসি ফোটাল।

কিছুদিন আগেও ইন্ডিয়ায় যাওয়ার জন্য ভিসা নিতে ইন্ডিয়ার হাইকমিশনারের অফিসের সামনে লাইন দিতে হত। সেই লম্বা লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোর ইন্ডিয়ায় যাওয়ার প্রয়োজন যে চিকিৎসা করাতে, আজমিরের তীর্থ দর্শন করতে, ব্যবসা সংক্রান্ত কারণে অথবা বেড়াতে। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়াতে হত। কিন্তু নিয়মটা বদলে দেওয়া হয়েছে। এখন অনলাইনে অ্যাপ্লিকেশন করতে হয়। কম্পিউটারই জানিয়ে দেয় কোন তারিখে ভিসার জন্য ইন্ডিয়ার হাইকমিশনারের অফিসে যেতে হবে।

সিরাজ সমস্যায় পড়ল এখানেই। যতবার সে চেষ্টা করছে অনলাইনে অ্যাপ্লাই করতে ততবারই বিফল হচ্ছে। কিছুতেই তার আবেদন পৌঁছোচ্ছে না। এক বন্ধু ব্যাপারটা শুনে খুব হাসলেন, আপনি ব্যবসা করেন আর এই সাধারণ ব্যাপারটা মাথায় ঢুকল না কেন?

কী ব্যাপার?

আপনি অনলাইনে আবেদন করে নাম্বার পেয়ে গেলেন। হাইকমিশনে গিয়ে কারণ বুঝিয়ে পাশাপাশি ভিসার ছাপ মারিয়ে বিনা পয়সায় ইন্ডিয়ায় চলে যাবেন! মামার বাড়ি!

বুঝলাম না। বিনা পয়সায় মানে? ভিসার জন্য তো ফি দিতে হয় না।

তাই তো বিনা পয়সায় বললাম। বন্ধু বললেন।

তাহলে কী করে এত লোক ইন্ডিয়ায় যাচ্ছে? সিরাজ প্রশ্ন করল। ভিসার জন্য ট্রাভেল এজেন্টের কাছে যান। এক সপ্তাহের মধ্যে পাসপোর্ট নিয়ে হাইকমিশনে পৌঁছোতে পারবেন। তবে তার জন্য ভিসাপিছু তিন থেকে চার হাজার টাকা সেলামি দিতে হবে। বন্ধু বললেন।

আমি এত চেষ্টা করেও পাচ্ছি না, ওরা কী করে পাবে?

আপনার তো ভিসা পাওয়া নিয়ে কথা, এত প্রশ্ন করে কী লাভ! ও হ্যাঁ, সব ট্রাভেল এজেন্ট কিন্তু এই কাজ করে না, আমি আপনাকে একটা সন্ধান দিচ্ছি, এতে ফোন করুন কাজ হয়ে যাবে আশা করি। বন্ধু নম্বর দিলেন।

আট হাজার টাকার বিনিময়ে ইন্ডিয়ায় যাওয়ার ভিসা পেল সিরাজ এবং তার স্ত্রী। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল সিরাজের। এই আট হাজার টাকার একটা টাকাও বাংলাদেশ সরকার অথবা ইন্ডিয়ার সরকার পাবে না। প্রতিদিন বহু লক্ষ টাকা এভাবে কিছু মানুষ, হাতিয়ে নিচ্ছে। মুশকিল হল, প্রতিবাদ করে যেমন ইন্ডিয়ায় যাওয়া বন্ধ করা উচিত হবে না তেমনি এজেন্টদের বিপদে ফেলাও সম্ভব হবে না।

সকালের বাসে উঠে পদ্মা পেরিয়ে বর্ডার ডিঙিয়ে কলকাতার মার্কুইস স্ট্রিটে ওরা পৌঁছেছিল সন্ধে নাগাদ। হোটেলের খবর ঢাকা থেকেই নিয়ে এসেছিল সিরাজ। সেখানে পৌঁছে নার্গিস খুশি হল।

স্নান সেরে নার্গিস জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা, এখান থেকে নিউমার্কেট কতদূরে? বহু বছর আগে একবার কলকাতায় এসেছিল সিরাজ। তার স্মৃতি আবছা। তবে নিউমার্কেটের কথা মনে আছে। পরের দিন সকালে ওরা পায়ে হেঁটে নিউমার্কেট ঘুরে এল। সিরাজ বলল, আজ কোনো কেনাকাটা নয়, তার জন্য অনেক সময় পাবে। আগে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করি, তারপর—

নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই সল্টলেকের ডাক্তারের চেম্বারে পৌঁছে গেল ওরা। ট্যাক্সি ড্রাইভার লোকটি সওয়ারিরা নতুন বুঝতে পেরে বেশি ঘুরিয়ে ভাড়া আদায় করেনি।

স্লিপে নিজেদের নামধাম লিখে বেয়ারাকে দেওয়ার পর ওরা দেখল অন্তত আটটি দম্পতি প্রতীক্ষাঘরে বসে আছেন। ওরা বসতে না বসতেই একজন প্রৌঢ় ভিতর থেকে বেরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সিরাজ ভাই কে?’

সিরাজ উঠে দাঁড়াল, ‘আমি।’

‘আপনার মিসেস—?’

‘ইনি।’

আসেন, ভিতরে আসেন। একটা ছোট্ট ঘরে তাদের বসিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘টেলিফোনে আমার সঙ্গেই আপনার কথা হয়েছিল।’ মাথা নাড়লেন তিনি। ‘খুব আপশোস হয়, জানেন, ছেলেবেলায় বাবা—মায়ের সঙ্গে আমি বিক্রমপুরের ভাষায় চমৎকার কথা বলতে পারতাম। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়েছি। মাও চলে গেলেন কিছুদিন পরে। তারপর কলকাতার মানুষদের সঙ্গে এখানকার ভাষায় কথা বলতে বলতে জিভ থেকে দেশের ভাষা কখন মুছে গেছে বুঝতে পারিনি। এখন চেষ্টা করলেও সব শব্দ ঠিকভাবে উচ্চচারণ করতে পারব না। আচ্ছা একটা ফর্ম ভরতি করতে হবে।’

ভদ্রলোক ছাপানো একটা ফর্ম বের করে, সিরাজের কাছ থেকে জেনে নিয়ে তথ্য লিখে নিতে লাগলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বিয়ে কত বছর আগে হয়েছে?’ উত্তর শুনে বললেন, ‘সময়টা সন্তান হওয়ার পক্ষে বেশি। কখনও জন্মনিরোধক পদ্ধতির সাহায্য নিয়েছেন?’ প্রশ্ন কানে যেতেই নার্গিস মুখ নীচু করল। সিরাজ একটু সংকোচের সঙ্গে জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, প্রথম দুই বছর।’

‘কখনও কনসিভ করেছেন?’

‘না।’

‘আপনাদের দুইজনের ব্লাড গ্রুপ কি আলাদা?’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনারা ওখানে যেসব টেস্ট করিয়েছেন তার রিপোর্ট কি এনেছেন?’

‘হ্যাঁ।’ ব্যাগ থেকে একটা ফাইল বের করে এগিয়ে দিল সিরাজ। ‘সিরাজ ভাই, আপনারা এখানেই একটু অপেক্ষা করুন।’ ভদ্রলোক সমস্ত রিপোর্ট নিয়ে ভিতরে চলে গেলেন।

মিনিট দশেক পরে তিনি এসে ওদের নিয়ে গেলেন ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায়ের কাছে। কাশফুলের মতো চুল, ফরসা মানুষটি বললেন, ‘আসুন মা, আসুন, বসুন।’ সিরাজ লক্ষ করল ডাক্তার নার্গিসকে মা বলে সম্বোধন করলেও তাকে কিছু বললেন না। ওঁর সামনে নার্গিসের ফাইল খোলা।

‘ঢাকা শহরের ট্রাফিক জ্যাম কি এখনও আগের মতো আছে?’ ডক্টর মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘বিকেলবেলায় এয়ারপোর্ট থেকে ধানমান্ডি যেতে দুঘণ্টা লেগে যেত। এখন শুনেছি ফ্লাইওভার হয়ে যাওয়ায় সমস্যা কিছুটা কমে গেছে।

সিরাজ বলল, ‘শুক্রবার যে পথ পনেরো মিনিটে যাওয়া যায়, তা অন্য দিন দেড় ঘণ্টা এখনও লাগে। আরও কয়েকটা ফ্লাইওভার হয়ে গেলে—’

এবার নার্গিসের দিকে তাকালেন ডাক্তার। ‘মা, বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের শরীরের সত্তর শতাংশ রহস্য জেনে গিয়েছেন, বাকি আছে ত্রিশ শতাংশ। আমার তো মনে হয় অজানা রয়েছে পঞ্চাশ শতাংশ। শরীরের সব কিছু আপাতচোখে ঠিক আছে তবু কেন সন্তান হচ্ছে না তার যুক্তি খুঁজতে গিয়ে অনেক পরীক্ষা—নিরীক্ষা হচ্ছে। অথচ দেখুন, গরিব ঘরের মায়েদের যখন সন্তানের প্রয়োজন নেই তখনও তারা বছরের পর বছর মা হয়ে যাচ্ছেন। প্রকৃতির এক অদ্ভুত খেয়াল এটা। ঢাকায় যেসব পরীক্ষা হয়েছে তা আমি এই ফাইল থেকে জেনেছি। কিন্তু যে পরীক্ষাগুলো করানো হয়নি তা অবিলম্বে করানো দরকার। কাল সকালেই করে নিন। ওই রিপোর্ট পাওয়ার পর চিকিৎসা শুরু করব।’

সিরাজ বলল, ‘আমাদের কি এখানে অনেক দিন থাকতে হবে?’

‘কী করে থাকবেন? ভিসা দেওয়া হয় নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। থাকার দরকার নেই। কিন্তু যোগাযোগ রাখতে হবে।’

হঠাৎ নার্গিস জিজ্ঞাসা করল, ‘আমি মা হতে পারব তো?’

‘ভরসা রাখুন, না না, আমার উপর নয়’ একটা আঙুল উপরের দিকে তুলে হাসলেন ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায়।

সিরাজ অবাক হল, ‘আপনি এসব মানেন?’

‘সেই পুরোনো কথা। আপনি নিজের চোখে বাতাসকে দেখেছেন? না, দেখেননি। কিন্তু অনুভব করেছেন, যে অনুভব করতে পারে সে পায়।’ ডক্টর মুখোপাধ্যায় প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন।

ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায়ের সহকারী ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করে, এক হাজার টাকা ফি জমা দিয়ে রসিদ নিল সিরাজ। তিনি পার্ক স্ট্রিট এলাকায় একটি প্যাথলজির কার্ড দিয়ে বললেন, ‘সকাল ৮টার মধ্যে এখানে পৌঁছে যাবেন স্যারের প্রেসক্রিপশন নিয়ে। আপনারা কোথায় উঠবেন?’

সিরাজ বলল, ‘মার্কুইস স্ট্রিট—ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের মোড়ে, এক হোটেলে।’

‘বাঃ ওখান থেকে হেঁটে যেতে কয়েক মিনিট লাগবে। আমি আপনাদের নাম ওদের ফোনে বলে দিচ্ছি যাতে বেশি অপেক্ষা না করতে হয়।’

নার্গিস চুপচাপ শুনছিল। এই ভদ্রলোককে দেখতে তার এক মামার মতো, যিনি বিয়ের এক বছরের মধ্যে স্ত্রী মারা যাওয়ার পরে আর বিয়ে করেননি। তার মনে হল এর সঙ্গে কথা বলা যায়। সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা, উনি কি নতুন টেস্ট করতে দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ, মা।’

‘সেগুলো কি খুব কঠিন?’

‘একদম নয়। এমজিএমএম আদৌ কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। সন্তান না হওয়ার পিছনে অনেক কারণ থাকে। যেমন অ্যান্টিবডি যদি বেশি হয়ে যায় তাহলে এই সমস্যা হয়। দেখবেন, যেসব মেয়ের শরীরে অতিরিক্ত চর্বি থাকে তাদের পক্ষে মা হওয়া অনেক সময় সম্ভব হয় না। ভয় পাবেন না মা’ ভদ্রলোক বললেন।

বাইরে বেরিয়ে এসে সিরাজ বলল, ‘তোমার অন্তত ওই সমস্যা নেই।’

‘কী সমস্যা?’

‘তোমার ফিগার দারুণ, কোনো বাড়তি চর্বি নেই।’ সিরাজ হাসল।

‘ধ্যাৎ, অসভ্য!’ লজ্জা পেল নার্গিস।

সেদিন দুপুরে হোটেলের উলটো দিকের রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে ওরা অবাক হয়ে গেল। একেবারে বাসার রান্না, মেনুকার্ডে ভর্তাই দেখল পাঁচ রকমের। সিরাজ বলেই ফেলল, ‘জানো, কলকাতায় এসে মনেই হচ্ছে না বিদেশে এসেছি। বাংলায় কথা বলছি, বাংলা খাবার খাচ্ছি, কোনো সমস্যা নেই।’

নার্গিস বলল, ‘মানুষগুলোও কী রকম ভালো। ডাক্তারবাবুর কথা বাদ দাও, ওঁর অ্যাসিস্টান্টের ব্যবহার ঠিক আত্মীয়ের মতো।’

‘একটু ভুল করলে’, সিরাজ বলল, ‘আত্মীয়রাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শত্রু হয়।’

গোটা দুপুর—বিকেল ওরা নিউমার্কেট ঘুরল। সিরাজ বলল, ‘আজ বেশি কিছু কিনো না, শুধু পছন্দ করে যাও। পরে এসে কিনবে।’

‘আমি তো যা দেখছি তাই কিনতে ইচ্ছে করছে’, নার্গিস বলল।

‘সর্বনাশ! আরে এসব তো ঢাকায়ও পাওয়া যায়।’

‘একদম না। তুমি কি ঢাকায় শাড়ির দোকানে যাও যে জানবে কী পাওয়া যায় কী যায় না? ভয় নেই, তোমার পকেট খালি করব না।’

সিরাজ বলল, ‘দ্যাখো আমাদের মনে রাখতে হবে এখানে কী জন্য এসেছি। তার পিছনে কত খরচ হবে তা জানি না। সব মিটে গেলে ফিরে যাওয়ার আগে যা থাকবে তাই দিয়ে যত পার কিনে নিয়ে যেও।’

তিনটে দিন ধরে নানান পরীক্ষার পরে রিপোর্ট দেখে ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘আমি যে ওষুধ লিখে দিচ্ছি তা নিয়ম করে খেতে হবে। ঢাকায় ওষুধ কেনার ঝুঁকি না নিয়ে কলকাতা থেকেই কিনে নিয়ে যান।’

সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘এতে কাজ হবে ডাক্তারবাবু?’

‘যে ত্রুটির কথা রিপোর্ট বলছে সেটা যদি ওষুধে সেরে যায় তাহলে কাজ না হওয়ার তো কথা নয়। আমার বিশ্বাস আপনারা হতাশ হবেন না।’

‘আমাদের আবার কবে আসতে হবে? সিরাজ জানতে চাইল।

‘যোগাযোগ রাখবেন, তাহলেই হবে। কিন্তু তিনমাস পরে অবশ্যই ফোন করে জানাবেন অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে কিনা।’ ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায় পেইসক্রিপশন এগিয়ে দিলেন, বললেন, ‘কবে ফিরে যাচ্ছেন?’

‘আগামী পরশু।’ সিরাজ জবাব দিয়েছিল।

‘এক মাসের ওষুধ খাওয়ার কথা বলা হয়েছিল প্রেসক্রিপশনে। দেখা গেল ওষুধ বেশি দামি। কেনার পরে সিরাজ বলল, ‘এবার তুমি কেনাকাটা করতে পার। হোটেলের ভাড়া আর রাস্তায় লাগতে পারে এমন টাকা বাদ দিয়ে বাকিটা তোমার কেনাকাটায় খরচ করতে পার। কী কিনবে তার লিস্ট বানিয়েছ?’

‘হুঁ।’ মাথা নাড়ল নার্গিস।

‘কখন বানালে দেখতেই পেলাম না!’

‘সব তোমাকে দেখিয়ে করতে হবে নাকি?’ নার্গিস হেসেছিল। সারাদিন ধরে কেনাকাটা করে ওরা হোটেলে ফিরে এসেছিল। রাতে ওষুধ খাওয়ার পরে নার্গিস বলল, ‘আমার জন্য অনেক খরচ হয়ে গেল।’

‘তবে তোমার জন্য নয়, কেনাকাটার জন্য।’ সিরাজ স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল।

‘দূর আমি চিকিৎসার কথা বলছি।’

‘ও, খরচটা তোমার জন্য কী করে বলছ?’

‘আমার জন্য নয়? সব মেয়ের তো বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই স্বচ্ছন্দে বাচ্চচা হয়ে যায়। আমার বেলায় আট বছরেও হল না।’

‘তার জন্য তুমি একা দায়ী নও, তোমার স্বামীও দায়ী। তাই সে খরচ হয়েছে তা তোমার একার জন্য হয়নি, আমাদের দু—জনের জন্যই হয়েছে।’ সিরাজ বেড সুইচ টেনে নিয়ে আলো নিভিয়ে দিল।

কাল সকালে বাস ছাড়বে। বিকেলে পার্ক স্ট্রিট ঘুরে নিউমার্কেটে গিয়েছিল ওরা বেশ ভিড়। হাঁটতে অসুবিধে হচ্ছিল নিশ্চল স্ট্রিট দিয়ে। হঠাৎ ধাক্কা খেল সিরাজ। দুটো লোক দু—দিক দিয়ে তাকে ধাক্কা মারায় সে ভারসাম্য হারাল। সিরাজের অবস্থা দেখে নার্গিস চিৎকার করে উঠল। আর তখনই একটা লোক সিরাজের কাঁধের ঝোলানো ব্যাগ ছিনতাই করে দু—জনের একজন দৌড়োল। দ্বিতীয়জন দৌড়োল বিপরীত দিকে। চিৎকার—চ্যাঁচামেচির মধ্যে নিজেকে সামলে সিরাজ সামনে দৌড়োতে গিয়েও থমকে গেল। ব্যাগ ছিনতাইকারীকে আর ভিড়ের জন্য দেখা যাচ্ছে না।

নার্গিস দৌড়ে এল ‘ব্যাগটা নিয়ে গেল যে।’

ভিড় ঠেলে যতটা সম্ভব দ্রুত এগিয়েও ছিনতাইকারীকে দেখতে পেল না সিরাজ। নার্গিস ছুটছিল ওর পিছু পিছু। তখনই খেয়াল হতেই চিৎকার করল সিরাজ, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে, আমার সব নিয়ে গেল লোকটা।’ সেই চিৎকার শুনে ওদের চারপাশে ভিড় হয়ে গেল। উত্তেজনায় কথা বলতে পারছিল না সিরাজ। থরথর করে কাঁপছিল সে। একজন নার্গিসকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে দিদি?’

নার্গিস বলল, ‘ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।’

লোকটা মাথা নাড়ল, ‘শালারা এই কারবারই করে।’ বলে পাশের দোকানের দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। ‘কালু খেয়াল রাখিস, সামনে ভিড় জমছে।’

এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যাগে দামি কিছু ছিল?’

‘আমার সব ছিল, সব—।’ এতক্ষণে কথা বলতে পারল সিরাজ।

‘সব মানে?’

‘পাসপোর্ট, ডলার, টাকা—উঃ।’ দুহাতে মাথা চেপে ধরল সিরাজ।

‘পাসপোর্ট? আপনারা কি বিদেশি?’

একটা ভারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘কী ব্যাপার? এখানে এত ভিড় কেন?’

খুব রোগাটে একজন পুলিশের পোশাক পরা লোক ভিড় সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়াতেই অনেকেই সরে যেতে লাগল। অফিসার সিরাজের দিকে তাকালেন। ‘কী ব্যাপার?’

‘ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়েছে।’ কাতর গলায় বলল সিরাজ।

‘অদ্ভুত। নিজের ব্যাগ নিজে সামলে রাখতে পারেন না?’ অফিসার ধমক দিলেন।

‘থাকেন কোথায়?’

‘বনানী, ঢাকায়।’

‘আই বাপ!’ অফিসারের চোখ বড় হল, ‘কী ছিল ব্যাগে?’

‘সব।’

‘সব মানে?’

‘পাসপোর্ট, ডলার, টাকা—।’

‘বুঝেছি। এক্ষুনি থানায় গিয়ে ডায়ারি করুন। যান।’

‘থানা কোথায়?’ নার্গিস জিজ্ঞাসা করল।

‘আপনি কে?’

সিরাজ বলল, ‘আমার ওয়াইফ।’

অফিসার একটু ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘আসুন আমার সঙ্গে।’

নার্গিস দেখল যারা ভিড় জমিয়েছিল তাদের কয়েকজন ওদের পিছন পিছন আসছে। সে দ্রুত পা চালিয়ে সিরাজের পাশে চলে এল। স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার খুব কষ্ট হচ্ছিল। এত ভেঙে পড়েছে কেন সিরাজ? হাঁটতে হাঁটতে সে একসময় দেখল পিছনে কোনো কৌতূহলী মানুষ নেই।

থানায় ঢোকার পর পনেরো মিনিট তাদের অপেক্ষা করতে হল। একজন সেপাই এসে বলল, ‘যান, যা বলবার ভিতরে গিয়ে বলুন।’

ভিতরে ঢুকতেই একটা হলঘর দেখতে পেল ওরা। সেখানে গোটা চারেক টেবিলের পিছনে একটা করে পুলিশ বসে লোকের সমস্যা শুনছে।

‘কী দরকার ভাই?’ সামনের খালি টেবিলের পিছনে বসা অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমার ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গিয়েছে স্যার, সিরাজ বলল।

‘কোথায়?’

‘নিউমার্কেটের সামনে।’

‘কী ছিল ব্যাগে?’

‘আমার পাসপোর্ট, ডলার আর ইন্ডিয়ার টাকা।’

অফিসার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি বাংলাদেশি?’

‘আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি।’

‘ইনি?’

‘আমার ওয়াইফ।’

‘কী জন্য এসেছেন?’

‘আমার স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে।’

উত্তর শুনে অফিসার নার্গিসের দিকে তাকালেন। একটু অবাক হলেন।

বললেন, ‘ওঁকে দেখে তো অসুস্থ বলে মনে হচ্ছে না।’

‘ডক্টর শতদল মুখোপাধ্যায়ের চিকিৎসায় ও আছে।’

ডক্টর শতদল মানে বিখ্যাত গাইনোকোলজিস্ট?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’

‘বসুন আপনারা।’ অফিসার ইশারা করলে ওরা খালি চেয়ারে বসল। অফিসার একটা খাতায় লিখতে লিখতে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনাদের নাম, ঠিকানা বলুন।’ সিরাজ জবাব দিল।

‘কলকাতায় কবে এসেছেন? কোন হোটেলে উঠেছেন?’ সিরাজ জানাল।

অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘পাসপোর্ট নম্বর বলুন?’

সিরাজ মনে করার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুতেই সবকটা নম্বর মনে করতে পারল না। সে হতাশ গলায় বলল, ‘ঠিক মনে আসছে না।’

‘কোথাও লিখে রাখেননি?’

‘না স্যার।’

নার্গিস নীচু গলায় মনে করিয়ে দিল, হোটেলে লিখেছিল। সঙ্গে সঙ্গে সিরাজ বলে উঠল, ‘হোটেলে ঢোকার সময় ওরা পাসপোর্টের জেরক্স নিয়েছিল, নম্বর ওদের কাছে পাওয়া যাবে।’

পকেট হাতড়ে একটা কার্ড বের করে এগিয়ে দিল, ‘এইটে হোটেলের কার্ড।’

‘ঠিক আছে। দু—জনের পাসপোর্টই গেছে?’

‘না। শুধু আমারটা ওই ব্যাগে ছিল।’ সিরাজ বলল।

‘ম্যাডাম, আপনার পাসপোর্ট কি সঙ্গে আছে?’ অফিসার হাত বাড়ালেন।

নার্গিস তার হাতব্যাগ খুলল। ভিতরের চেন টেনে পাসপোর্ট বের করে এগিয়ে দিল সামনে। সেটা খুলে ছবির সঙ্গে নার্গিসকে মিলিয়ে নিয়ে পাসপোর্টের নম্বরটা ডায়ারিতে লিখে নিলেন। তারপর হোটেলের কার্ড তুলে টেলিফোনের বোতাম টিপলেন।

‘হ্যালো। নিউমার্কেট থানার এসআই দত্ত বলছি। শুনুন, আপনাদের হোটেলে বাংলাদেশ থেকে একটি কাপল এসেছেন চিকিৎসার জন্য। দাঁড়ান, অফিসার একটু আগে লেখা নাম পড়লেন।

‘সিরাজুর রহমান, নার্গিস রহমান, চিনতে পেরেছেন? গুড। এই সিরাজুর রহমানের পাসপোর্ট নম্বরটা আমার এখনই দরকার। হ্যাঁ, ধরে আছি।’ রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে অফিসার সিরাজের দিকে তাকালেন, ‘বিদেশে এসে পাসপোর্ট হারালে কী বিপদে পড়তে হয় তা আন্দাজ করতে পারছেন?’

‘আমি তো হারাইনি, ছিনতাই করে নিয়ে গেছে।’ সিরাজ বলল।

‘দোষ কার? আপনার। আপনি কেয়ারলেস ছিলেন বলেই ছিনতাই করতে পেরেছে। আপনার স্ত্রী সতর্ক ছিলেন তাই ওঁর ব্যাগ ছিনতাই হয়নি।’ আবার রিসিভার কানে চাপলেন অফিসার। ‘হ্যাঁ, বলুন।’ নম্বর তারিখ কোথা থেকে ইস্যু হয়েছিল। ভিসার নম্বর তারিখ কবে থেকে এবং কতদিনের জন্য ভিসা দেওয়া হয়েছিল সব লিখে নিয়ে অফিসার বললেন, ‘আপনাদের কাছে তো জেরক্স আছে। এই জেরক্সের জেরক্স দু কপি করে এখনই কাউকে দিয়ে থানায় পাঠিয়ে দিন। কী? যা বলছি তাই করুন।’

রিসিভার রেখে চোখ বন্ধ করলেন অফিসার। সিরাজ কাতর গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘স্যার, আমার ব্যাগটা ফেরত পাব তো?’

চোখ খুললেন অফিসার, ‘ঢাকা শহরে কারও ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গেলে সেই ব্যাগ কি ফেরত পাওয়া যায়?’

সিরাজ উত্তর দিল না। কারা কোন এলাকায় ছিনতাই করে তা নিশ্চয়ই পুলিশ জানে। যদি পুলিশ চেষ্টা করে তাহলে নিশ্চয়ই ছিনতাইকারীদের ধরতে পারে। কিন্তু এই কথাগুলো বললে অফিসার কী প্রতিক্রিয়া দেখাবেন তা বুঝতে না পেরে সে মুখ খুলল না। অফিসার বললেন, ‘কলকাতায় কয়েক কোটি মানুষ আসে—যায় থাকে। সমুদ্রের গভীরে যদি একটা নৌকা ডুবে যায় তাহলে সেটাকে ভাগ্য ছাড়া খুঁজে পাওয়া যায় না।’

‘আর কী ছিল আপনার ব্যাগে?’

‘ডলার, ইন্ডিয়ার টাকা।’

‘ডলার। কত ডলার?’

‘একশো দুই ডলার।’ মনে করে বলতে পারল সিরাজ।

‘ইন্ডিয়ার টাকা?’

‘পাঁচ হাজারের মতো।’

‘দেশে ফেরার টিকিট?’

‘হোটেলের ঘরে রাখা আছে।’

সব লেখার পর সই করে টিপসই মেরে সিরাজের হাতে একটা কপি দিয়ে অফিসার বললেন, ‘আপনার ভিসার মেয়াদ শেষ হচ্ছে কবে?’

‘আরও দিন সাতেক আছে।’

‘না নেই। কারণ, ইন্ডিয়ায় আপনি এই মুহূর্তে বেআইনিভাবে আছেন। আপনার কাছে পাসপোর্ট নেই তাই ভিসাও দেখাতে পারবেন না। এখন যদি আপনাকে ভারতীয় পুলিশ অ্যারেস্ট করে তাহলে গভীর জলে পড়বেন। তাই অবিলম্বে আপনাদের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে গিয়ে সাহায্য চান। ওঁরা যদি আপনাকে ডুপ্লিকেট না হোক টেম্পোরারি পাসপোর্ট বের করে দেন, ওঁরাই আপনাকে অ্যাডভাইস করবেন ঠিক কী কী করতে হবে। এছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।’

‘ছিনতাইকারীকে ধরার কোনো চান্স নেই?’ এবার নার্গিস জিজ্ঞাসা করল।

‘ম্যাডাম, ব্যাগটা যদি খুব দামি না হয় তাহলে রাস্তার পাশে কোনো ডাস্টবিনে ওটা পেতে পারেন। কিন্তু ডলার, টাকা কি কেউ ফেরত দেয়?’

‘পাসপোর্ট? ওটা তো কারও কাজে লাগবে না।’ সিরাজ বলল।

‘কী করে জানলেন? আপনার কাছাকাছি দেখতে এমন লোক পৃথিবীতে আছে যে বিশ পঞ্চাশ হাজার টাকায় ওটা কিনে নেবে। ধরুন কোনো জঙ্গি যার বাংলাদেশে গিয়ে থাকা দরকার সে আপনার পাসপোর্ট ভিসা ব্যবহার করে আজই চলে যাবে সীমান্ত পেরিয়ে।’ অফিসার হাসলেন।

‘সর্বনাশ!’ সিরাজের মুখ থেকে শব্দটা বের হল।

‘চিন্তা করবেন না। নম্বরটা পেয়ে গেছি বলে আপনার ক্ষেত্রে ওই বিপদ হবে না। আমি হেড অপিসে রিপোর্ট করছি, ওরা ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশনকে জানিয়ে দেবে। আপনার পাসপোর্ট যে ব্যবহার করবে তাকে গ্রেফতার করা হবে। আর হ্যাঁ, আপনার যে পাসপোর্ট খোয়া গিয়েছে এ কথা কাউকে বলবেন না। মানে সাধারণ লোক বা হোটেলের কাউকে বলার দরকার নেই।’

এর মধ্যেই একটি লোক এসে কপালে হাত ঠেকাল। ‘কী চাই?’

‘হোটেল থেকে এটা পাঠিয়েছে স্যার।’ লোকটা খামখানা দিল।

খামখানার ভিতর থেকে কাগজগুলো বের করে অফিসার লোকটিকে বললেন, ‘ঠিক আছে। যেতে পার।’

লোকটার চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে অফিসার দুটো কাগজ সিরাজের দিকে এগিয়ে বললেন, ‘আপাতত দুধের বদলে ঘোল নিয়ে যান। আপনি যে অবৈধভাবে ভারতবর্ষে আসেননি অন্তত এটা বলতে পারবেন। আর হ্যাঁ, আমাদের না জানিয়ে হোটেল ছেড়ে শহরের বাইরে যাবেন না। এখন দ্রুত বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনার অফিসে চলে যান।’

কাগজ দুটোয় নিজের পাসপোর্টের জেরক্স দেখতে পেল সিরাজ। ঘরের বাইরে এসে নার্গিস জিজ্ঞাসা করল, ‘দেশে ফেরার টিকিট তো আছে। হোটেলের টাকাও তো ঘরে রেখেছিলে। এখন ওই কাগজ দেখিয়ে বর্ডার পেরিয়ে দেশে ফেরা যাবে না?’

‘বোধহয় না।’ মাথা নাড়ল সিরাজ।

‘তাহলে কী হবে?’ নার্গিসের মুখে মেঘ জমল। এই সময় অফিসার বাইরে বেরিয়ে এসে ওদের দেখে বললেন, ‘একি, এখনও এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?’

সিরাজ বলল, ‘খুব অসহায় লাগছে, কী করব বুঝতে পারছি না।

আইনে যা আছে তা অনুসরণ করা ছাড়া আপনার আর কিছুই করার নেই।’ অফিসার নার্গিসের দিকে তাকালেন, ‘আপনার কাছে কিছু টাকা কি আছে?’

কথা না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল নার্গিস।

‘তাহলে এখনই একটা ট্যাক্সি নিয়ে বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে চলে যান। ওঁদের সমস্যাটা বলুন। ওঁরা বলে দেবেন আপনাদের কী করতে হবে। আর দেরি করলে গিয়ে দেখবেন অফিস বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’

অফিসার ট্যাক্সি ডেকে না দিলে ওই সময় নিউমার্কেটে ট্যাক্সি পাওয়া প্রায় অসম্ভব হত। পুলিশ অফিসার হুকুম করেছে বলে ট্যাক্সি ড্রাইভার একটুও না ঘুরিয়ে পার্ক সার্কাসের হাইকমিশনারের অফিসের সামনে পৌঁছে দিল। নার্গিসের টাকায় ভাড়া মিটিয়ে ওরা দেখল হাইকমিশনারের অফিসের সব দরজা বন্ধ। সবচেয়ে বড় দরজার গায়ের বেলের বোতাম টিপল সিরাজ। তিনবার টেপার পরে গলা ভেসে এল, ‘কে? কী চাই?’

সিরাজ উপরের দিকে তাকিয়ে বুঝল স্পিকারের মাধ্যমে শব্দ বাইরে আসছে। সিরাজ মুখ তুলে জবাব দিল, ‘আমরা বাংলাদেশের সিটিজেন। খুব সমস্যায় পড়েছি। একটু দরজাটা খোলেন।’

কথাগুলো বলার সময় অজান্তেই ঢাকার ভাবভঙ্গি এসে গেল সিরাজের। শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ভিতরে ঢুকল ওরা। সামনের রিসেপশন ডেস্কের পিছনে একজন বয়স্ক মানুষ বসে আছেন। পিছনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

‘সমস্যা কী?’

সিরাজ বলল, ‘ভাই, একটু আগে আমার পাসপোর্ট, ডলার, টাকা ছিনতাই হয়ে গিয়েছে। নিউমার্কেটের সামনে।’

‘সর্বনাশ!’

‘আমাকে এই বিপদ থেকে রক্ষা করুন ভাই।’

‘ইনি?’

‘আমার ওয়াইফ।’

‘আপনার পাসপোর্টও ছিনতাই হয়ে গেছে?’

‘না, না।’ দ্রুত মাথা নাড়ল নার্গিস।

‘যাক বাঁচলেন।’ রিসেপশনিস্ট বললেন, ‘শুনুন, যেখানে আপনার ছিনতাই হয়েছে সেখানকার থানায় গিয়ে ডায়ারি করুন। তারপর সেই ডায়ারির কপি নিয়ে এখানে আসুন। অবশ্য এসব করে এখানে আসার আগেই অফিস বন্ধ হয়ে যাবে। কোথায় উঠেছেন?’

‘হোটেলে।’

‘থানা থেকে ডায়ারির কপি নিয়ে সোজা হোটেলে চলে যাবেন। ঘর থেকে কালকের আগে বের হবেন না। কাল সকাল দশটায় এখানে চলে আসবেন। তাড়াতাড়ি যান।’

‘ভাই, থানায় গিয়ে ডায়ারি করা হয়ে গেছে। এই যে কপি।’ পকেট থেকে কাগজ বের করতে যাচ্ছিল সিরাজ, ভদ্রলোক ধমকালেন, ‘আরে, এতক্ষণ চুপচাপ ছিলেন কেন? ফালতু সময় নষ্ট। ওটা প্রথমে বলতে পারতেন না?’ বেশ রাগত ভঙ্গিতে বেল বাজালেন তিনি, কিন্তু কেউ এল না। একটু অপেক্ষা করে ইনটারকমের বোতাম টিপে বললেন, ‘স্বামী—স্ত্রী এসেছে, স্বামীর পাসপোর্ট চুরি হয়ে গিয়েছে। হ্যাঁ, বাংলাদেশের নাগরিক।’ ওপাশের কথা শোনার পর বললেন, ‘তাহলে কি আগামীকাল আসতে বলব?’ আবার একটু চুপ করে থেকে রিসিভার নামিয়ে রাখতেই একজন কর্মচারী ভিতরের দরজা ঠেলে ঘরে এল। ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘কোথায় ছিলে হাসি। এদের নিয়ে এখনই আকবর ভাইয়ের কাছে যাও। একটু পরই উনি বেরিয়ে যাবেন।’

মাথা নেড়ে হাসি সিরাজদের ভিতরে নিয়ে এল। হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন জিলা?’

‘ঢাকা।’

‘আমার বাসা গেন্ডারিয়াতে।’

সিরাজ বুঝতে পারল এই লোকটা কথা বলার জন্য কথা বলতে চাইছে। সে চুপচাপ হাঁটতে লাগল। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে একটা ঘরের সামনে তাদের দাঁড়াতে বলে ভিতরে ঢুকে গেল হাসি।

বেরিয়ে এল কয়েক সেকেন্ড পরে। ‘যান ভিতরে যান।’

টেবিলের ওপাশে একজন সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে ছিলেন। ওরা ঘরে ঢুকতেই বললেন, ‘বসুন। কী করে চুরি হল?’

চেয়ারে বসল ওরা। সিরাজ ব্যাপারটা কীভাবে হয়েছিল তা জানাল।

আকবর বললেন, ‘বিদেশে এসেছেন, একটু সতর্ক থাকবেন না? ভাবি বোধহয় বেশি সতর্ক ছিলেন, ওঁর ব্যাগ ছিনতাই হয়নি। কী কী ছিল?’

‘পাসপোর্ট, ডলার, টাকা।’ সিরাজ জবাব দিল।

আকবর একটা ফর্ম এগিয়ে দিলেন, ‘এটা ধরুন। ডায়ারি কপিটা দিন।’

কাগজটা দিয়ে ফর্ম হাতে নিল সিরাজ। ডায়ারির কপিতে চোখ বুলিয়ে আকবর বললেন, ‘আমি আজ বেশিক্ষণ সময় দিতে পারব না ভাই। জরুরি মিটিংয়ে যেতে হবে। খুব তাড়াতাড়ি ফর্ম ভরতি করে দিন তো।’

হোটেল থেকে পৌঁছে দেওয়া জেরক্স কপির পাসপোর্ট নম্বর লিখতে পারায় সুবিধে হল। ফর্ম ভরতি করে এগিয়ে দিল সিরাজ। আকবর বললেন, ‘আজ তো ছুটির সময় হয়ে গিয়েছে। আমি এই অ্যাপ্লিকেশনের উপর সই করে জেরক্স দিচ্ছি। যত্ন করে রাখবেন। কাল সকালে আসুন। আমরা এর ভিত্তিতে যে কাগজ দেব তা নিয়ে এখানকার লর্ড সিনহা রোডে আইবি অফিসে দেখা করবেন। ওরা আইনমাফিক যা করার করবেন। ভাবিকে সঙ্গে আনবেন কারণ, ওঁর কাছে বৈধ পাসপোর্ট আছে।’

ফেরার সময় ট্যাক্সি পাওয়া গেল না। দূরত্ব বেশি না, পথটা ওরা হেঁটেই চলে এল। হোটেলে ফিরে নার্গিস বলল, ‘উঃ কী ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে এখানকার মানুষজন খুব ভালো।’

চেয়ারে বসে জুতোর ফিতে খুলছিল সিরাজ, খুলতে খুলতেই বলল, ‘তাহলে যে লোকটা ছিনতাই করেছিল সেও ভালো লোক?’

‘তা কেন? খারাপ লোক তো সব জায়গায় থাকে। কিন্তু থানায় যে পুলিশ অফিসার আমাদের সাহায্য করলেন, বাংলাদেশ হাইকমিশনের আকবর ভাই কী ভালো ব্যবহার করলেন, ইচ্ছে করলে তা নাও করতে পারতেন।’ নার্গিস বেশ জোরের সঙ্গে বলল।

‘এই ব্যবহার করাটা ওদের ডিউটির মধ্যে পড়ে।’

‘সবাই যে যার ডিউটি ঠিকঠাক করে?’

নার্গিসের যে রাগ হচ্ছে বুঝতে পেরে হেসে ফেলল সিরাজ। কথা ঘোরাবার জন্য বলল, ‘চা খাবে?’

‘না। আগে আমি চেঞ্জ করব।’

‘কর।’

‘কর মানে? তুমি পাঁচ মিনিটের জন্য বাইরে যাও, প্লিজ!’

হেসে ফেলল সিরাজ, ‘আশ্চর্য ব্যাপার। হঠাৎ আমাকে লজ্জা পাচ্ছ?’

নার্গিস কথা না বলে ঘরে পরার পোশাক বের করতে লাগল। সিরাজ বলল, ‘বাথরুমে গিয়ে চেঞ্জ কর।’

‘বাথরুমের মেঝেতে জল পড়ে থাকে, খারাপ লাগে।’

‘আহা গিয়ে দেখ জল নাও থাকতে পারে।’ সিরাজ কথাগুলো বলতেই বন্ধ দরজায় শব্দ হল।

নার্গিস বলল, ‘কেউ এসেছে, তুমি বাইরে যাও।’ বাইরে বেরিয়ে আসতেই ভদ্রলোককে দেখতে পেল সিরাজ। যাওয়া—আসার সময় রিসেপশনের পিছনে এঁকে কয়েকবার দেখেছে। ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে এল। সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপার।’

‘আপনার সঙ্গে আলাপ হয়নি। আমি মিস্টার গুপ্তা, এই হোটেলের ম্যানেজার। আচ্ছা, আজ পুলিশ আপনার পাসপোর্টের জেরক্স পাঠাতে বলেছিল কেন বলুন তো? এরকম ঘটনা তো কখনও ঘটে না।’

‘বোধহয় ওদের দরকার হয়েছিল।’ বলতে বলতে সিরাজ সতর্ক হল। নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা তৈরি করবে এই লোকটা।

‘কেন দরকার হয়েছিল তা কি আপনি জানেন?’

সত্যি কথাটা বেরিয়ে এল সিরাজের মুখ থেকে। ম্যানেজার চোখ বড় করলেন, ‘সর্বনাশ! আপনার পাসপোর্ট নেই?’

‘আমার কাছে জেরক্স আছে।’

‘জেরক্সে কি কাজ হয়? ধরুন আপনার কাছে একশো টাকার নোটের একটা জেরক্স আছে, সেটা দিয়ে দোকান থেকে জিনিস কিনতে পারবেন?’

‘না।’

‘দেখুন ভাই, বৈধ পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া আমার হোটেলে কাউকে থাকতে দিতে পারি না। এটা সম্পূর্ণ আইনবিরুদ্ধ। আজ রাতে যেতে হবে না, কাল সকালে হোটেল ছেড়ে দিতে হবে।’ ম্যানেজার বেশ শক্ত গলায় বললেন কথাগুলো।

সিরাজ বলল, ‘আপনি ভুল করছেন। আমি থানায় ডায়ারি করেছি, তার কপি সঙ্গে আছে। থানার অফিসার আপনাদের পাঠানো পাসপোর্টের জেরক্স কপির উপর সই করে দিয়েছেন, সেটাও সঙ্গে আছে। তার উপর আমি যে দেশের নাগরিক সেই দেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস থেকেও এ ব্যাপারে কাগজ পেয়েছি। আগামীকাল আপনাদের লর্ড সিনহা রোডের এসবি অফিসে গেলে পাকা কাগজ পেয়ে যাব। আমার সঙ্গে কাগজগুলো যদি আপনার কাছে বৈধ বলে মনে না হয়, তাহলে কাল এসবি অফিসের কাগজকে নিশ্চয়ই বৈধ বলে মনে করবেন?’

ম্যানেজারকে একটু চিন্তিত দেখাল। সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘আর কিছু বলবেন?’

‘আপনি ওইসব কাগজ নিয়ে রিসেপশনে আসুন।’

‘কেন?’

‘সাবধানের মার নেই ভাই। ওগুলো জেরক্স করিয়ে রেখে দেব।’ ফিরে আসার পরে জামাকাপড় পালটানো হয়নি বলে ওইসব কাগজ সিরাজের পকেটেই ছিল। ম্যানেজার নীচে নেমে ওগুলো জেরক্স করিয়ে নিজের জন্য কপি করাল। ম্যানেজার জিজ্ঞাসা করল, ‘কপি, নিয়ে কী করবেন?’

‘যদি আবার ছিনতাই হয়ে যায়।’ সযত্নে পকেটে রেখে বলল সিরাজ।

‘শুনুন। আপনি কাল বিকেলের মধ্যে এসবি অফিস যদি কোনো কাগজ দেয় তা দেখাবেন। না হলে প্লিজ—!’ ম্যানেজার কথা শেষ করলেন না।

রাতে হোটেলের যে বেয়ারা খাবার দিতে এল সে বলল, ‘স্যার, আপনার সমস্যা শুনেছি। ভাবির তো পাসপোর্ট আছে, আপনারা দেশে চলে যান।’

‘কীভাবে যাব? পাসপোর্ট কোথায়?’ সিরাজ জিজ্ঞাসা করল।

‘কোনো সমস্যা নেই।’

‘তার মানে?’

‘যে বাসে এসেছেন তার ফেরার টিকিট তো আছে?’

‘হ্যাঁ, আছে।’

‘বাসে ওঠার সময় টিকিট দেখবে, পাসপোর্ট দেখতে চাইবে না। তাই সোজা বাসে উঠে পড়বেন হোটেলের সামনে থেকে।’

‘তারপর? বর্ডারে গিয়ে কী করব? ওরা তো পাসপোর্ট, ভিসা দেখতে চাইবে? জেরক্স দেখালে পুলিশ ডাকবে।’ সিরাজ বলল।

‘পুলিশের বাবার কাগজ তো আপনার সঙ্গে থাকবে।’

‘তার মানে?’

‘লর্ড সিনহা রোডের এসবি অফিসের কাগজ দেখালে ওরা আর কিছু বলবে না। আপনারা বর্ডার পেরিয়ে যাবেন।’

নার্গিস চুপচাপ শুনছিল, এবার বলল, ‘যদি বলে পাসপোর্ট না দেখলে যেতে দেবে না। ভিসাটা দেখতে চাইলে দেখাতে পারবে না তুমি?’

সমর্থনে মাথা নাড়ল সিরাজ।

বেয়ারা হাসল, ‘তার ব্যবস্থা আছে।’

‘কীরকম?’ জিজ্ঞাসা করল সিরাজ।

‘ব্যাপারটা যদি গোপন রাখেন তাহলে বলতে পারি।’ লোকটার মুখে রহস্যের হাসি। সিরাজ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

‘কিছু খরচ করতে হবে। অচেনা লোক দেখলে বেশি টাকা চায়। আমার চেনাজানা লোক হলে ছয় হাজারে রাজি হয়ে যাবে।’ বেয়ারা বলল।

‘কীরকম?’

‘আমি ফোন করে দেব। বর্ডারে বাস গিয়ে থামতেই আপনারা যখন নামবেন তখন বন্ধু চলে আসবে আপনাদের কাছে।’

‘আরে আমাদের চিনবে কী করে?’

‘হোয়াটসঅ্যাপে ছবি পাঠিয়ে দেব। আজকাল তো সমস্যা হয় না। হ্যাঁ, বর্ডারে পৌঁছে গেলে আপনাকে আর চিন্তা করতে হবে না। জামাই আদরে পার করে দেবে। আপনার ছিনতাই হয়ে গেছে, ছয় হাজার টাকা আছে তো?’

নার্গিস মাথা নাড়ল, ‘আছে।’

‘আপনার এই বন্ধুর নাম কী? কী করেন?’ সিরাজ জিজ্ঞাসা করল।

‘কবীর ভাই। এসব কাজই করে থাকেন।’

‘আপনি আমার এত উপকার করবেন, আপনাকে কত দিতে হবে?’

‘এ নিয়ে আপনাকে একটা কথাও বলব না। আপনাদের দেখেই মনে হয়েছে বড় মনের মানুষ, তাই মুখ ফুটে কিছু চাইব না।’ লোকটি দরজার দিকে এগোল।

‘কিন্তু টাকা দেব অথচ কাজ হল না তখন—?’

‘আমার নামে কুত্তা পুষবেন। পাঁচ বছর ধরে লোক পাঠাচ্ছি। একটা কেসও ফেল করেনি। তাছাড়া পুরো টাকা দেবেন কেন? বর্ডার পার হওয়ার আগে তিন হাজার দেবেন। ওপারে গিয়ে আবার বাসে ওঠার সময় বাকি টাকা দিলেই হবে। বাসে। সিট বুক করেছেন?’

‘আসার সময় তো ডেট দিয়েছিলাম।’

‘আরে না না। এখানে আসার পর কনফার্ম করতে হবে। কাল তো পারবেন না, পরশু সকালের বাসে সিট বুক করে দেন।’

‘খুব ভালো হয়। অনেক ধন্যবাদ।’ কথাটা বলল নার্গিস।

লোকটা দরজা ভেজিয়ে চলে গেলে সিরাজ স্ত্রীর দিকে তাকাল। ‘তুমি ওকে ধন্যবাদ দিলে। যদি আমাকে জেলে যেতে হয় কী করবে?’

‘বলল তো, কোনো ভয় নেই। আমি শুনেছি ইন্ডিয়া থেকে অনেকেই পাসপোর্ট, ভিসা ছাড়া বাংলাদেশে যায়। তারা যায় কী করে বল?’

‘কারা কীভাবে যায় তা তারাই জানে, আমি আমার নিজের দেশে ঘুস দিয়ে ঢুকব তা ভাবতেই পারছি না।’ মাথা নেড়েছিল সিরাজ, ‘জানি না কপালে কী আছে।’

পরদিন সকাল দশটায় বাংলাদেশ ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে আকবর ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শুনল তিনি মিটিংয়ে আছেন। বাইরে ভিসার জন্য লাইন পড়েছে। নার্গিস সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘কত লোক বাংলাদেশে যাচ্ছে, না?’

একটু বিরক্ত হল সিরাজ। ‘আচ্ছা, তুমি এখন এসব ভাবছ? আমার সমস্যার যদি সমাধান না হয় তাহলে তোমার খারাপ লাগবে না?’

‘এ কথা কী করে বললে?’

‘আমি তো তোমাকে এ নিয়ে চিন্তা করতে দেখছি না।’

‘কেউ চিন্তা করছে কিনা তা দেখা যায় না।’

‘ও। ধর আমাকে ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট থাকার অনুমতিপত্র দিল না। আবার ফিরে যাওয়ার বৈধ কাগজ নেই। ওরা তো আমাকে জেলে পাঠাবে। তোমার ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই তোমাকে ঢাকায় ফিরে যেতে হবেই। আমি এখানকার জেলে থাকব আর তুমি ঢাকায়—, ভাবতে পারছ?’ সিরাজ স্ত্রীর দিকে তাকাল।

‘না।’

‘কী করবে তুমি?’

‘আমি ফিরে যাব না।’

‘ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর এ দেশে থাকা অপরাধ।’

‘তোমার শাস্তি হবে।’

‘হোক, শুধু বলব, আমাকে যেন তোমার সঙ্গে জেলের এক জায়গায় রাখে। তাহলে সব মেনে নেব।’ নার্গিস হাসল। তার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা খুঁজে পাচ্ছিল না সিরাজ।

ঘণ্টাখানেক পরে আকবর ভাইয়ের ঘরে ঢুকতে পারল ওরা। আকবর বললেন, ‘সরি, আপনাদের অপেক্ষা করতে হল। কালকের কাগজটা দিন। আর হ্যাঁ, ম্যাডাম, আপনার পাসপোর্ট এনেছেন?’

সেগুলো হস্তগত করে বেল বাজিয়ে পিয়োনকে ডেকে বললেন, ‘এগুলো নিয়ে অফিসে যাও। যা করতে হবে তা ওদের বলা আছে।’

লোকটা কাগজ নিয়ে চলে যাওয়ার পরে আকবর বললেন, ‘সাধারণত স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিস আমাদের সুপারিশ মেনে নেয়। আপনাদের যে কাগজ দেব তা নিয়ে এখান থেকে সোজা ওদের অফিসে চলে যান।’

মাথা নাড়ল সিরাজ। নার্গিস জিজ্ঞাসা করল, ‘যদি ওরা না মানে?’

‘খারাপ চিন্তা কেন ডেকে আনছেন?’ আকবর হাসল।

নার্গিস বলল, ‘আমরা যে হোটেলে আছি তার বেয়ারা বলেছে যে, ছয় হাজার টাকা দিলে তার লোক বর্ডার পার করে দেবে। ঢাকায় ফিরে যেতে ওর অসুবিধে হবে না কিন্তু উনি ভয় পাচ্ছেন যদি ধরা পড়ে যান। আচ্ছা ধরা পড়ার কোনো চান্স কি আছে?’

আকবরের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বললেন, ‘তাহলে আমার কাছে আসার কী প্রয়োজন ছিল? দালাল ধরে চলে গেলেই পারতেন।’

সিরাজ প্রতিক্রিয়া বুঝে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করল, ‘না না, আমি বেআইনিভাবে ফিরতে চাই না। আসলে লোকটা এমনভাবে ওকে বুঝিয়েছে যে, বুঝতেই পারছেন, মেয়েদের সহজেই ভয় পাওয়ানো যায়।’

‘অত্যন্ত ভুল কথা বললেন।’ আকবরের মুখ এখনও থমথমে।

‘মানে?’

‘আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন মহিলা। বিরোধী নেত্রীও তাই। আপনার কি মনে হয় এঁদের সহজে ভয় পাওয়ানো সম্ভব?’

মাথা নাড়ল সিরাজ, ‘না না, ওঁদের কথা আলাদা। ওঁদের ব্যক্তিত্ব, ভাবনাচিন্তা একেবারেই আলাদা।’

‘পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মহিলা। ইন্ডিয়ার অনেক রাজ্যেই মহিলা মুখ্যমন্ত্রী আছেন। ইন্ডিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মিসেস ইন্দিরা গান্ধী। মুখে যা আসে তা বলে ফেলা মোটেই ভালো নয়।’ আকবর যেন নিজেকে ক্ষত ক্ষত করলেন, ‘আপনাকে যে বেয়ারা এই প্রস্তাব দিয়েছে তার নাম কী?’

সিরাজ নার্গিসের দিকে তাকাল। নার্গিসের মুখ অন্য পাশে ঘোরানো। সে বলল, ‘প্রয়োজন হয়নি বলে নাম জিজ্ঞাসা করিনি।’

‘কিন্তু এখন তো প্রয়োজন হবেই। এ ধরনের লোককে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া উচিত। এরা কত নিরীহ মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে হাজার হাজার টাকা বেআইনিভাবে রোজগার করছে। আপনাদের বলেছে ছয় হাজার টাকা দিলে ওরা বর্ডার পার করে দেবে?’ আকবর জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়ল সিরাজ।

আকবর হেসে ফেললেন, ‘ওটা ক্রমশ বাড়বে। আপনার পকেট শূন্য হওয়ার পর যখন থামবে তখন আপনি চোখে সরষে ফুল দেখবেন। এই বেআইনি পারাপার করার চেনে কত লোক থাকে তার আন্দাজ আছে?’

‘না।’

‘বর্ডারে যাওয়ার আগেই ছয় হাজার কর্পূরের মতো উড়ে যাবে।’

আকবর একটু ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘দুটো পথ আছে। একটা হল, আপনারা যে হোটেলে আছেন তার পুলিশ স্টেশনে গিয়ে ব্যাপারটা জানান। দুই, আপনার পাসপোর্ট ছিনতাই হয়ে গেছে, সেটা আমাদের জানিয়েছেন। সেইসঙ্গে একটা চিঠি ডেপুটি হাইকমিশনারকে আজই লিখুন। সেই চিঠিতে হোটেলের একটি বেয়ারা যে টাকার বিনিময়ে সীমান্ত পার করিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে তা জানাবেন। সেই চিঠি পেয়ে আমরা পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলব। আমার মনে হয় দ্বিতীয়টা করাই আপনার পক্ষে সহজ হবে।’

আকবর নার্গিসের দিকে তাকালেন, ‘আপনার ভিসা কবে শেষ হবে?’

নার্গিস পাসপোর্ট বের করে এগিয়ে দিল। পাতা উলটে আকবর ভিসার ছাপ এবং লেখা পড়লেন। ‘আর তো বেশি দেরি নেই। আপনাদের ডাক্তারের সঙ্গে যা কাজ ছিল তা কি শেষ হয়ে গিয়েছে?’

‘হ্যাঁ।’ সিরাজ বলল।

‘বেশ। এখান থেকে লর্ড সিনহা রোডের স্পেশাল ব্রাঞ্চ হয়ে পুলিশের অফিসে যান। ওঁরা যদি বেশি সময় না নেন তাহলে ভালো। না হলে আপনি ওঁকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিন। আপনার সমস্যা মিটে গেলে ফিরে যাবেন।’ আকবর বললেন।

‘আমি একা ফিরে যাব?’ প্রায় আঁতকে উঠল নার্গিস।

‘কেন? কোনো অসুবিধে তো নেই। আপনারা কীসে এসেছেন?’

‘বাসে’ সিরাজ বলল।

‘গুড। মার্কুইস স্ট্রিট থেকে সকালে বাস ছাড়ে। আপনি ওঁকে সেই বাসে উঠিয়ে দেবেন। বর্ডার পার হওয়ার সময় নামতে হবে। তখন বেলা এগারোটা—সাড়ে এগারোটা। অন্য যাত্রীদের সঙ্গে ইমিগ্রেশন কাস্টমস করিয়ে আবার ওদিকের বাসে উঠে বসলে ঢাকায় পৌঁছোবার আগে একমাত্র লঞ্চে নামতে পারেন। কোনো সমস্যা নেই।’ আকবরের কথার মধ্যে পিয়োন একটা ফাইল নিয়ে এল। সেটা খুলে পড়ার পর নীচে সই করলেন আকবর। ফাইলের মধ্যে ঠিকানা লেখা যে খামটা ছিল তার ভিতরে সই করা কাগজের একটা কপি ভাঁজ করে ঢুকিয়ে এগিয়ে দিলেন। সিরাজের দিকে, ‘আশাকরি এতেই আপনার কাজ হয়ে যাবে।’

পিয়োন বলল, ‘স্যার কপিতে সই করিয়ে নিতে বলেছে।’

আকবর মাথা নাড়লেন, ফাইলটা সামনে রেখে বললেন, ‘সই করুন। পুরো নাম, ঢাকার ঠিকানা, পাশে কলকাতার হোটেলের নাম ঠিকানা।’

সব চুকে গেলে উঠে দাঁড়ালেন আকবর, ‘লর্ড সিনহা রোড এখান থেকে বেশি দেরি নয়। হেঁটেও যাওয়া যায় কিন্তু আপনাদের হয়তো অসুবিধে হবে। আপনারা নীচের রিসেপশনে জিজ্ঞাসা করুন। কীভাবে যেতে হবে। ট্যাক্সি পেলে তো কথাই নেই। আর হ্যাঁ, যদি থানায় গিয়ে ডায়ারি না করেন, তাহলে অবশ্যই আজ বিকেলের মধ্যে চিঠিটা দিয়ে যাবেন।’

ওরা নীচে নেমে এল। নেমেই নার্গিস শক্ত করে সিরাজের কনুই ধরল।

‘আমি যাব না, কিছুতেই তোমাকে ছেড়ে যাব না।’

‘আরে কী করছ? হাত ছাড়।’

‘তুমি যদি ভেবে থাক—’

‘আমি কিছুই ভাবছি না। এখন লর্ড সিনহা রোডে যাওয়া ছাড়া আর কোনো চিন্তা মাথায় নেই।’ সিরাজ নার্গিসের হাত ছাড়িয়ে নিল। রিসেপশনে লোকদের সঙ্গে কথা বলে সিরাজ বুঝতে পারল হেঁটে যাওয়ায় অসুবিধে আছে। পথ গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা বেশি। অফিস থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ধরতে গিয়ে কিছুটা সময় নষ্ট হল। কোনো ড্রাইভারই যেতে চাচ্ছিল না। শেষতক একজন বলল, ‘মিটারে যা উঠবে তার উপর পঞ্চাশ টাকা বেশি দিতে হবে।’

নার্গিস বলল, ‘রাজি হয়ে যাও। নইলে যাওয়াই হবে না।’

লোকটাকে অতিরিক্ত টাকা দিতে খারাপ লাগছিল সিরাজের। এটা অন্যায়। বিদেশে এসে সে যদি অন্যায় সহ্য করতে না চেয়ে পুলিশের সাহায্য চায় তাহলে ফল কী হবে তা জানা নেই, হয়তো আজ সারাদিন এই সমস্যায় আটকে থাকতে হতে পারে। এসবি অফিসে যাওয়া হয়ে উঠবে না। হেসে ফেলল সিরাজ।

পাশে বসে নার্গিস জিজ্ঞাসা করছিল, ‘একি! হাসছ কেন?’

‘হঠাৎ মনে হল, রবীন্দ্রনাথ এই সমস্যায় পড়লে কী করতেন?’

‘যত বাজে বাজে চিন্তা।’ মুখ ফেরাল নার্গিস।

প্রায় দেড় ঘণ্টা পরে ওরা যখন স্পেশাল ব্রাঞ্চের অফিসারের কাছে পৌঁছোতে পারল তখন লাঞ্চ—আওয়ার শুরু হয়ে গিয়েছে। ভদ্রলোক স্বাভাবিকভাবেই চেয়ারে নেই। পিয়োন গোছের একজন বলল, ‘বাইরে অপেক্ষা করুন, উনি দুটোর সময় আসবেন।’ অতএব অপেক্ষা করতে হল।

সিরাজ বলল, ‘চল, এখানে না বসে থেকে কোথাও গিয়ে খেয়ে আসি।’

‘আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। তোমার খিদে পেলে বল।’ নার্গিস বলল।

সিরাজের উৎসাহ চলে গেল। এই সময় এক ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ালেন।

‘আপনারা কী প্রয়োজনে এসেছেন?’

সিরাজ উঠে দাঁড়াল, ‘অফিসার লাঞ্চে গিয়েছেন তাই অপেক্ষা করছি।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু প্রয়োজনটা কী?’

‘আমরা বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিস থেকে আসছি। একটা সমস্যা হয়েছে। শুনলাম যিনি লাঞ্চে গিয়েছেন তিনি আমাদের সমস্যার কথা শুনবেন।’ খুব বিনীত গলায় বলল সিরাজ।

‘আসুন।’ অফিসার ভিতরে গেলেন।

ওরা ঘরে ঢুকে দেখল, যে চেয়ারটি ওরা খালি দেখে গিয়েছিল সেই চেয়ারে গিয়ে বসলেন ভদ্রলোক। ইশারা করলেন টেবিলের এপাশে বসতে। ওরা বসার পর অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন ‘বলুন, কী হয়েছে?’

সিরাজ নিউমার্কেটের ঘটনাটা সংক্ষেপে বর্ণনা করল।

অফিসার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘থানায় ডায়ারি করেছেন?’

‘হ্যাঁ।’ ডায়ারির জেরক্স কপি বের করে এগিয়ে দিল সিরাজ।

মন দিয়ে সেটা পড়লেন অফিসার। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই কোনো হোটেলে উঠেছেন, কোন হোটেলে?’

সিরাজ হোটেলের নাম বলে জানাল, ‘চেক ইন করার সময় ওরা আমাদের পাসপোর্ট এবং ভিসার জেরক্স রেখেছিল। থানা থেকে সেগুলোর কপি আনিয়ে তার জেরক্স দিয়েছে।’

অফিসার সেগুলো দেখলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখানে কে আসতে বলেছে?’

‘ডেপুটি হাইকমিশনারের অফিসে গিয়েছিলাম—, ওহঃ ওঁরা এই চিঠি দিয়েছেন আপনাদের।’ খামটা বের করে দিল সিরাজ।

হাসলেন অফিসার, ‘এটাই তো প্রথমে দেওয়া কর্তব্য ছিল, তাই না?’ সিরাজ জবাব দিল না। ভুলটা স্বীকার করে নিল মুখ না খুলে। চিঠিটা পড়লেন অফিসার। তারপর বললেন, ‘প্রতিদিন শয়ে—শয়ে মানুষ বাংলাদেশ থেকে বেআইনিভাবে ভারতে ঢুকে পড়ে। তাদের পাসপোর্টের বালাই নেই। স্বাভাবিকভাবে ভিসাও থাকে না। এদের বেশিরভাগই পশ্চিমবাংলার সীমান্তের কাছাকাছি জেলায় থেকে যেতে চায়। ঠিক লোককে ধরে ভোটার কার্ড, ন্যাম—কার্ড, আধার কার্ডও ওরা পেয়ে যায়। ব্যাংকে গিয়ে অ্যাকাউন্ট খোলে, তারপর পাসপোর্টের জন্য দরখাস্ত করে। সবকিছু ঠিকঠাক দেখালে পাসপোর্ট পাওয়া কঠিন নয়। তারপর ট্রাভেল এজেন্টকে দিয়ে পাসপোর্টে ভিসার ছাপ যদি দেওয়াতে পারে তাহলে বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে কাজকর্ম করে আবার ফিরে আসতে অসুবিধে হয় না। আমাদের পশ্চিমবাংলার মালদা, মুর্শিদাবাদ, উত্তর চব্বিশ পরগনায় এদের সন্ধানে সরকার তল্লাশি করছে। কিন্তু আর একদল আছে যাদের উদ্দেশ্য থেকে যাওয়া নয়। কোনো অবৈধ কাজ করে ফিরে যেতে চায় তারা। সন্ত্রাসবাদীরা এই দলের। কিন্তু ফেরার সময় বেআইনিভাবে ফিরে যাওয়ার ঝুঁকি এরা নিতে চায় না। তারা চোরাই পাসপোর্টের সন্ধান করে। আপনি বলছেন যে, আপনার পাসপোর্ট ছিনতাই হয়ে গিয়েছে। সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে সেই পাসপোর্ট এর মধ্যে বিক্রি হয়ে গিয়েছে। দশ—বিশ—পঞ্চাশ হাজার দিয়ে কিনে কোনো সন্ত্রাসবাদী বাংলাদেশে ফিরে গিয়েছে সিরাজ সেজে।’

‘কী করে সেটা সম্ভব? পাসপোর্টের ফোটোগ্রাফের সঙ্গে সেই লোকটার চেহারা তো মিলবে না।’ অবিশ্বাসী গলায় জিজ্ঞাসা করল সিরাজ।

‘আপনার পাসপোর্টের ছবির সঙ্গে এখনকার আপনার কি খুব মিল আছে? আপনার মুখে দাড়ি থাকায় তো আরও সুবিধে। দাড়িওলা লোকদের মুখের পার্থক্য চট করে করা যায় না।’ অফিসার বললেন।

‘সর্বনাশ!’ সিরাজের মুখ থেকে শব্দটা বেরিয়ে এল।

পাশ থেকে নার্গিস বলে উঠল, ‘কতবার বলেছি দড়িটা রেখ না, তোমাকে মানায় না, কথা শুনলে তো—’

অফিসার বললেন, ‘এমন তো হতে পারে আপনি আপনার নিজের পাসপোর্ট বিক্রি করে দিয়েছেন!’

‘সে কী? কী বলছেন আপনি?’ প্রায় চিৎকার করে উঠল সিরাজ।

‘আমি বলছি না কাজটা আপনি করেছেন। কিন্তু কেউ কেউ করেন। করে আমাদের কাছে আসেন সাহায্যের জন্য। ঠিক আছে, ডেপুটি হাইকমিশনারের এই চিঠিকে আমরা নিশ্চয়ই সম্মান দেব। আপনি কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কলকাতায় থাকতে পারেন। কিন্তু কখনই কলকাতার বাইরে যাবেন না। আর প্রতিদিন একবার এই অফিসে হাজিরা দিয়ে যাবেন। আপনারা এখন বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন। অর্ডার তৈরি করতে একটু সময় লাগবে।’

সিরাজের মুখ প্রায় রক্তশূন্য হয়ে গেল। ফ্যাসফেসে গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘এই তদন্ত শেষ হতে কতদিন লাগবে?’

‘বেশিদিন না। আপনি যেসব তথ্য হাইকমিশনকে দিয়েছেন তা ভেরিফাই করতে যেটুকু সময় লাগবে তার বেশি আপনাকে এদেশে আটকে রাখব না।’

এবার নার্গিস কথা বলল, ‘কিন্তু আমার ভিসার সময় তো পেরিয়ে যাবে।’

‘ওটা কখনই যেন না হয়।’ গম্ভীর গলায় বললেন অফিসার।

‘তার মানে, ওকে এখানে একা রেখে আমি ঢাকায় চলে যাব?’ প্রায় ডুকরে উঠল নার্গিস, ‘এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।’

অফিসার তাকালেন, ‘ম্যাডাম, ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিদেশে থাকাকে অপরাধ বলে গণ্য করা হয়। তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া অন্যদিকটার কথা ভাবুন। ওর পাসপোর্টের সঙ্গে টাকা—পয়সাও চুরি হয়ে গেছে। আপনার কাছে যা আছে তা দিয়ে দু—জনের খরচ চালানোর বদলে একজনের খরচ ভালোভাবে চলাটা ঠিক কিনা? আপনারা প্লিজ বাইরে গিয়ে বসুন।’ বাইরের বেঞ্চিতে বসেই কেঁদে ফেলল নার্গিস। সিরাজ চাপা গলায় বলল, ‘কী করছ? সবাই তোমাকে কাঁদতে দেখছে!’

‘আমি ভাবতেই পারছি না—’ কথা শেষ করতে পারল না নার্গিস। ‘পরিস্থিতি অনুযায়ী তো চলতে হবে।’ সিরাজ বলল, ‘আমি তো এখানে চিরদিন থাকছি না। তুমি যাওয়ার কদিনের মধ্যেই তো ফিরে যাব। তাছাড়া রোজ তোমার সঙ্গে ফোনে কথা হবেই।’ শব্দ করে শ্বাস ফেলল নার্গিস।

এসবি অফিসের অনুমতিপত্র হাতে পেয়ে স্বস্তি হল সিরাজের। এখন কেউ বলতে পারবে না সে বেআইনিভাবে এদেশে আছে। বাইরে বেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে চিকেন বিরিয়ানি আর কাবাবের অর্ডার দিল সিরাজ। এই দুটোই নার্গিসের খুব প্রিয় খাবার। কিন্তু সিরাজ লক্ষ করল আজ খাবারের নাম নার্গিসকে খুশি করল না।

‘তোমার কাছে এখন যা আছে তাতে হোটেলের ভাড়া মিটিয়েও কয়েকদিন চলে যাবে। তবে তুমি যাওয়ার পরে আমি হোটেল পাল্টাব।’

‘কেন?’ চোখ ছোট হল নার্গিসের।

‘আমার একার জন্য অত বড় ঘরের তো দরকার নেই। কম ভাড়ায় কোনো হোটেলে থাকলে পয়সা বাঁচবে।’

একটু ভাবল নার্গিস। তারপর বাঁ—হাতের মোটা সোনার বালা টেনে খুলে সিরাজের সামনে রাখল, ‘এখানে সোনার ভরি কত করে জানি না। এতে আড়াই ভরি সোনা আছে। তোমাকে পয়সা বাঁচানোর জন্য সস্তার হোটেলে যেতে হবে না।’

অবাক হয়ে গেল সিরাজ, ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?’

নার্গিস উত্তর দিল না।

সিরাজ বলল, ‘বালাটা হাতে পরে নাও। যে টাকা আছে দিব্যি হয়ে যাবে।’

‘যদি না হয় তখন কী করবে? এই কলকাতায় তোমার পরিচিত কেউ কি আছে যার কাছে গিয়ে ধার চাইতে পার? আছে?’ নার্গিস জিজ্ঞাসা করল।

‘না, নেই।’

‘তুমি তো সঙ্গে কার্ড নিয়ে আসনি!’

‘ওইটাই ভুল হয়ে গেছে। এতগুলো ডলার, টাকা যে ছিনতাই হবে তা ভাবিনি। অবশ্য, কার্ড থাকলে তা পার্সে থাকত। পার্সটা তো ব্যাগেই থাকার কথা। ওটাও ছিনতাইকারী নিয়ে যেত। অবশ্য ব্যবহার করতে পারত না।’ সিরাজ হাসল।

‘তুমি কী মানুষ বলো তো!’ নার্গিস অবাক হয়ে তাকাল।

‘মানে?’

‘এই ভয়ংকর পরিস্থিতিতেও হাসতে পারছ?’

‘তুমি বেশি টেনশন করছ!’

‘জানি না। বালাটা রেখে দাও। দরকার হলে বিক্রি করে দেবে। যদি দরকার না হয় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।’

খাবার এল। সিরাজ লক্ষ করল, আজ নার্গিসের বিরিয়ানিতে একটুও উৎসাহ নেই। সে কথা না বাড়িয়ে বালাটা পকেটে রেখে দিল।

এসবি অফিসের অনুমতিপত্রটি কয়েক কপি জেরক্স করিয়ে ওরা হোটেলে ফিরে এল। রিসেপশনিস্টকে একটা কপি দিয়ে সিরাজ বলল, ‘এটা ম্যানেজারকে দিয়ে দেবেন। উনি খুব চিন্তায় ছিলেন।’ লিফটের দিকে পা বাড়াতেই সেই বেয়ারাকে দেখতে পেল ওরা। নার্গিস নীচু গলায় বলল, ‘ওই যে, ওর নাম জিজ্ঞাসা কর।’

কিন্তু লোকটা নিজেই এগিয়ে এল, ‘স্যার, কাল ফিরে যাবেন তো?’

‘কেন?’

বাসের সিট পাওয়া খুব মুশকিল, তাই জিজ্ঞাসা করলাম।

‘আমরা তো ঢাকা থেকেই ফেরার জন্য সিট রিজার্ভ করেছি।’

‘ও, কিন্তু এখানে এসে রিকনফার্ম করেছেন কি?’

‘না, সেটা করা হয়নি।’

‘তাহলে সিট না থাকার চান্সই বেশি। আমি আপনাদের দেখা না পেয়ে নিজ থেকেই সাড়ে ছ—টার বাসে দুটো সিট রিজার্ভ করেছি। আসলে শুধু বাসের সিট নয়, বর্ডারের অ্যারেঞ্জমেন্টও তো আগে থেকে করে রাখতে হয়। নইলে সমস্যা হলে আপনিই বলবেন, আমি ফোরটুয়েন্টি কারবার করেছি।’

বেয়ারা বলল, ‘আপনি একবার বাসের অফিসে গিয়ে টিকিটটা নোট করিয়ে আসুন স্যার। মুখের কথা তো তাই ওরা পেনসিলে লিখে রেখেছে।’

‘তোমার নাম কী ভাই?’ সিরাজ তাকাল।

‘আজ্ঞে রামচন্দ্র মণ্ডল। সবাই রামু বলে ডাকে।’ বেয়ারা হেসে চলে গেল। বাইরে বের হতেই নার্গিস জিজ্ঞাসা করল, ‘সত্যি আমাকে চলে যেতে হবে?’

মাথা নাড়ল সিরাজ, ‘তুমি খুব অবুঝ হয়ে যাচ্ছ।’

‘তা তো বলবেই!’ ঠোঁট ফোলাল নার্গিস।

সিরাজ হাত নেড়ে বোঝাতে চাইল, ‘ধরো, তুমি আমার সঙ্গে ইন্ডিয়াতেই রয়ে গেলে। তোমার ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেল। তখন পুলিশ তোমাকে ধরে এ দেশে অবৈধভাবে থাকার অপরাধে জেলে ঢুকিয়ে দিল, তুমি জেলের ভিতরে আর আমি বাইরে। ব্যাপারটা চিন্তা করে দেখো, কীরকম লাগবে?’ সিরাজ মাথা নাড়ল, ‘তুমি চিন্তা করো না, আমি খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যাব।’

রামচন্দ্র অন্তত বাসের ব্যাপারে মিথ্যে বলেনি। পেনসিলে লেখা রয়েছে, রিজার্ভেশনের খাতায়, মিস্টার সিরাজ, মিসেস সিরাজ।

সিরাজ ঢাকা থেকে কেনা বাসের রিটার্ন টিকিট দেখিয়ে কাউন্টারের লোকটিকে বলল, ‘আমরা ঢাকা থেকেই সিট রিজার্ভ করে এসেছিলাম। কিন্তু কাল সকালে আমার ওয়াইফ ফিরে যাবেন, আমার যেতে দেরি হবে।’

‘কিন্তু একটু আগে দুটো সিট রিজার্ভ করার কথা হয়েছে।’

‘যে এসেছিল সে জানত না।’

লোকটি খাতায় নার্গিসের পুরো নাম লিখে নিয়ে বলল, ‘কিন্তু আপনি তো সমস্যায় পড়বেন ভাই।’

‘কীরকম?’

‘উনি তো এই টিকিট নিয়ে বাংলাদেশে চলে যাবেন। আপনি কী করবেন?’

‘এই টিকিটের জেরক্স করে রাখছি।’

‘না ভাই, জেরক্স টিকিট অ্যালাউ করা হয় না।’

‘তাহলে কী হবে?’

‘আপনাকে নতুন টিকিট কাটতে হবে। কিন্তু যেহেতু আপনি বাংলাদেশের নাগরিক তাই হয় ডলারে নয় বাংলাদেশের টাকায় টিকিট কাটবেন।’

হঠাৎ নার্গিস বলে উঠল, ‘উঃ, কেন যে ইন্ডিয়াতে এলাম।’

‘এসেছি ডাক্তার দেখাতে।’ তারপর লোকটাকে বলল, ‘আপনি যখন বলছেন এটাই নিয়ম তখন আর কী করা যাবে। টিকিট কেটে নেব।’

ওরা যখন বাইরে বেরিয়ে এল তখন কাউন্টারের পাশে দাঁড়ানো একটা লোক পিছন পিছন এসে ডাকল, ‘স্যার।’

সিরাজ দাঁড়াল। লোকটা বেশ অবাক গলায় জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি কাল দেশে ফিরে যাবেন না?’

‘না।’

‘সর্বনাশ!’ লোকটা বিড়বিড় করল।

‘কেন কী হয়েছে?’

‘আপনি যাবেন বলে সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে।’

‘কী ব্যবস্থা?’ কপালে ভাঁজ পড়ল সিরাজের।

‘কেন রসিকতা করছেন স্যার? রামুর সঙ্গে তো ডিল ফাইনাল হয়ে গেছে।’

লোকটার ঠোঁটে রহস্যের হাসি।

‘না, কোনো ডিল ফাইনাল হয়নি। তাছাড়া কাল যাওয়া সম্ভব নয়।’

‘পাসপোর্ট ভিসা ছাড়া এদেশে থাকবেন না স্যার। বিপদে পড়বেন।’

সিরাজ কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে শুরু করল। নার্গিস বলল, ‘আশ্চর্য, এর মধ্যে ওরা তোমার যাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলল? মনে হচ্ছে এরা খুব অর্গানাইজড।’

নার্গিসের কথায় কীসের ইঙ্গিত তা বুঝতে পেরেও চুপ করে থাকল সিরাজ।

হোটেলের ঘরে ফিরে আসার পরে সিরাজ বলল, ‘আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়। ভোর ভোর উঠতে হবে। সাড়ে ছ—টার আগেই বাস টার্মিনালে পৌঁছোতে হবে।’

গম্ভীর মুখে নার্গিস বলল, ‘একটু আগে খেয়েছি, আমি আর রাতে খাব না।’

‘ও।’ সিরাজ মেনে নিল, ‘তাহলে তুমি সঙ্গে যা যা নিয়ে যাবে তা গুছিয়ে নাও। ঘুম থেকে ওঠার পর সময় পাবে না। আমার জামা—প্যান্ট ওই ছোট সুটকেসেই রেখে যেও।’

এই সময় দরজায় শব্দ হল। সিরাজ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই রামচন্দ্রকে দেখতে পেল, ‘নমস্কার স্যার। ভিতরে আসতে পারি?’ হ্যাঁ কী ব্যাপার? সিরাজ বিরক্ত হল।

‘এই মাত্র শুনলাম আপনি কাল ফিরে যাচ্ছেন না। এটা কি সত্যি?’

‘হ্যাঁ। আমার ওয়াইফ ফিরে যাচ্ছেন, আমি তো যেতে পারছি না।’

‘যেতে পারছেন না কেন? সব ব্যবস্থা তো হয়ে গেছে।’

‘ভাই, স্পেশাল ব্রাঞ্চ আমাকে এখানে থাকার অনুমতি দিয়েছে। রোজ একবার করে ওদের অফিসে হাজিরা দিতে হবে। এই অবস্থায় যদি আমি গোপনে দেশে ফিরে যাই তাহলে বিপদে পড়বই।’ সিরাজ বলল।

‘আপনি না ফিরে গেলে তো আমি বিপদে পড়ব।’

‘কেন? আপনার বিপদ হবে কেন?’

‘কবীর ভাই আমাকে খতম করে দেবে।’ কাঁদো কাঁদো গলায় রামচন্দ্র বলল, ‘লোকটার ক্ষমতা আপনি জানেন না!’

‘এর মধ্যে ওই লোকটি কী করে আসছেন?’

‘স্যার, আপনি ফিরে যেতে চান, আপনার পাসপোর্ট নেই, তাই ভিসাও নেই। এই অবস্থায় আইনসম্মতভাবে আপনি পার হতে পারবেন না। একমাত্র কবীর ভাই সাহায্য করলে সেটা সম্ভব হবে।’

‘কিন্তু আমি তো বেআইনিভাবে ফিরে যাচ্ছি না।’

‘এখন সেটা সম্ভব নয় স্যার।’ দু—পাশে মাথা নাড়ল রামচন্দ্র।

‘কেন?’

‘সব ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার পর আপনি যদি না যান তাহলে কবীর ভাই ক্ষতিপূরণ চাইবে। টাকাটা ওকে দিতেই হবে।’

রেগে গেল সিরাজ, একি অন্যায় কথা কিন্তু নিজেকে সামলে নিল সে। সে বলল, ‘আমি ওর কী ক্ষতি করেছি যে, ক্ষতিপূরণ দিতে হবে?’

‘আপনার যাতে কোনো অসুবিধে না হয় তাই কবীর ভাই যাকে যা দেওয়ার তা অ্যাডভান্স পেমেন্ট করে দিয়েছেন। উনি কোনো কাজ পেন্ডিং রাখেন না।’ রামচন্দ্র হাতজোড় করল, ‘আপনি একটু ভাবুন। আপনি যদি টাকাটা না দেন তাহলে উনি আমার কাছ থেকে আদায় করবেন। আমি গরিব মানুষ, একেবারে মরে যাব স্যার।’

নার্গিস চুপচাপ ওদের কথা শুনছিল। এবার বলল, ‘এত সব ঝামেলা যখন হচ্ছে, টাকা যখন দেওয়া হয়ে গেছে তখন তুমি ফিরেই চল।’

সঙ্গে সঙ্গে মাথা বাড়াল রামচন্দ্র, ‘আপনি ঠিক বলেছেন। কথায় বলে, এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন? টাকাটা যখন দিতে হবেই তখন চলে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’

‘ভাই রামচন্দ্র, সেটা এখন আর সম্ভব নয়। আমার স্ত্রী কাল যাবে, আমি পরে আইনসম্মতভাবে যাব।’ ঠিক আছে? কথা শেষ করতে চাইল সিরাজ।

‘ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না স্যার। কবীর ভাই ওর যাওয়াতে সমস্যা তৈরি করতে পারেন। এমনিতে খারাপ নয় কিন্তু রেগে গেলে ওকে হিসেবে রাখা যায় না।’

‘আমার ওয়াইফের যাওয়াতে কী সমস্যা করবে সে? ওর বৈধ পাসপোর্ট আছে, ভিসার তারিখ এখনও শেষ হয়নি, বাংলাদেশের নাগরিক নিজের দেশে ফিরে যাবে, কে তাকে আটকাতে পারে?’ উত্তেজিত হল সিরাজ।

নার্গিসও রেগে গেল, ‘আমি তো সাহায্যের কথা বলিনি তাহলে সেই লোক আমাকে সমস্যায় ফেলবে কেন? আমার নাম জানবে কী করে?’

‘আপনারা যে স্বামী—স্ত্রী যাচ্ছেন এটা কবীর ভাই জানেন। কান টানলে তো মাথা আসবেই। তবে কবীর ভাইকে আমি একটা অনুরোধ করতে পারি।’ রামচন্দ্র যেন একটা পথ দেখতে পেল, ‘উনি যেমন যাচ্ছেন চলে যান। ওকে যেন কোনো সমস্যায় কবীর ভাই না ফেলেন। কিন্তু আপনি যাওয়ার সময় টাকাটা দিয়ে যাবেন। অবশ্য বুঝতেই পারছেন, সময়ে দিচ্ছেন না বলে একটু বেশি দিতে হবে।’

‘আশ্চর্য ব্যাপার। আমি বৈধ কাগজ নিয়ে যখন যাব তখন ফালতু টাকা দিতে যাব কেন? আর একটু বেশি দিতে হবে মানে?’

‘বেশি না। ধরুন দশ হাজার। কাল গেলে ছয় হাজারে হয়ে যেত।’

‘যদি টাকা না দিই?’

‘আটকে যাবেন। কাস্টমস ডিপার্টমেন্ট আপনার ব্যাগে এমন জিনিস পেয়ে যাবে যা নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। তারপর কী হবে ভেবে দেখুন।’

‘তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?’

‘না স্যার, যা সত্যি তাই বলছি।’

সিরাজ একটু চিন্তা করল, ‘ঠিক আছে, তোমার কথা আমি মেনে নিলাম। তুমি কবীর ভাইকে জানিয়ে দাও যাতে আমার ওয়াইফকে একটুও বিরক্ত না করে।’

‘আমি বুঝিয়ে বলছি স্যার। আচ্ছা আসছি। ওহো, ডিনার করবেন না?’ মাথা নেড়ে নিঃশব্দে সিরাজ না বলতেই রামচন্দ্র ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

টিভি খুলল সিরাজ। খবর শুনছে। প্রায় প্রতিটি খবর খুন, জখম এবং ধর্ষণের। পৃথিবীর সব দেশের কিছু মানুষ এখন উন্মত্ত হয়ে গেছে। মেয়ের সম্মান রক্ষা করার জন্য বাবা প্রতিবাদ করায় তাকে সমাজবিরোধীরা খুন করেছে, এরকম দুটো খবর শোনার পর টিভি বন্ধ করে দিল সে।

নার্গিস ততক্ষণে সুটকেস গুছিয়ে ফেলেছে। তারপর নিজের মনে বলল, ‘আমার কিছুই ভালো লাগছে না। বুকের উপর কিছু চাপ হয়ে বসে আছে।’

‘ওষুধগুলো নিয়েছ?’ সিরাজ জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ’ না তাকিয়ে জবাব দিল নার্গিস।

‘আজ সারাদিন যা গেল, নিশ্চয়ই ওষুধ খেতে ভুলে গেছ?’

‘তোমার যদি তাই মনে হয় তবে তাই!’

‘তুমি বড্ড বেশি অভিমান করছ সোনু।’

বহুকাল বাদে স্বামীর মুখে সোনু শব্দটি শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না নার্গিস। বিছানার উপর বসে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। ওর ভেঙে পড়া বেচারা এখন এতটাই করুণ যে সিরাজ দ্রুত পাশে এসে বলল, ‘প্লিজ কেঁদো না।’ সঙ্গে সঙ্গে দু—হাতে সিরাজকে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা রাখল নার্গিস। তার গলায় কান্না জড়ানো শব্দ তৈরি হল, ‘তোমাকে ছেড়ে আমি থাকব কী করে?’

‘কটা দিন তো! এই তো গত বছর ব্যবসার কাজে তাইওয়ান গিয়েছিলাম, তখন তো এমন করনি! তুমি শক্ত হও, আমি খুব শিগগির চলে আসব।’ নার্গিসের মুখ দু—হাতে ধরে উপরের দিকে তুলল সিরাজ। জল উপচে পড়ছে দু—চোখ থেকে। পরম যত্নে নিজের ঠোঁট দিয়ে সেই জল মুছিয়ে দিতে চাইল সিরাজ। চোখে ঠোঁটের স্পর্শ পেতেই মুখ তুলে সিরাজের ঠোঁটে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল নার্গিস। আর সেই মুহূর্তে পৃথিবীটাকে ভুলে গেল ওরা। এ শুধু শরীরের সঙ্গে শরীরের মিলন নয়, এ যেন দুটো মনের জড়িয়ে মিশিয়ে একাকার হয়ে যাওয়া। তারপর দু—জন দু—জনকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকা। নীরবে।

সকাল ছ—টা দশে নার্গিসের সুটকেস বয়ে নিয়ে হোটেল থেকে কয়েক পা হেঁটে বাস টার্মিনালে চলে এল সিরাজ। পিছনে সালোয়ার কামিজ এবং ওড়নায় জড়ানো নার্গিস।

বেশিরভাগ যাত্রী ততক্ষণে এসে গেছে। সুটকেস জমা দিয়ে নার্গিসকে নিয়ে বাসে উঠে জানলার পাশের আসনে বসিয়ে দিতেই নীচ থেকে গলা ভেসে এল, ‘প্যাসেঞ্জার ছাড়া কেউ বাসে উঠবেন না।’

সিরাজ বলল, ‘সাবধানে যেও, চিন্তা করো না।’

শোনামাত্র নার্গিস মাথার ওড়নার প্রান্ত মুখের উপর টেনে নিল।

নীচে নেমে এল সিরাজ। একটু পরে বাস ভরতি হয়ে গেলে সে দেখল নার্গিসের পাশের আসনে একটি বাচ্চচা মেয়ে বসেছে। ওড়নার ফাঁক দিয়ে নার্গিস তাকে দেখল। দেখেই এর মধ্যে হাতে ধরে রাখা রঙিন চশমা চোখে পরে নিল।

বাস ছেড়ে দিল সীমান্তের উদ্দেশে।

ভোরের কলকাতা কখন পিছনে চলে গেছে তা নার্গিস জানে না। সে বাসের জানলায় মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসেছিল। অদ্ভুত সব ভাবনা ভেবে যাচ্ছিল সে। আজ রাতে ঢাকায় ফিরে গিয়ে আগামীকাল যদি সেই ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে দেখা করে বলে, তার ইন্ডিয়ায় ফিরে যাওয়া খুব জরুরি, তিনি যেন মাসখানেকের জন্য ভিসার ব্যবস্থা করে দেন তাহলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। প্রথমত, সে আবার কলকাতায় এসে সিরাজের সঙ্গে থাকতে পারে। দ্বিতীয়ত, সে এলে টাকার ব্যবস্থা করেই আসবে।

কিন্তু একবার ইন্ডিয়া থেকে ঘুরে গেলে সঙ্গে সঙ্গে কি ইন্ডিয়া হাইকমিশন আবার ভিসা ইস্যু করবে? এ ব্যাপারে কী নিয়ম আছে তা নার্গিসের জানা নেই। যদি নিয়ম না থাকে তাহলে কি ট্রাভেল এজেন্ট কোনো পথ বের করতে পারবে না? এই যে তারা ইন্ডিয়াতে আসবে বলে অনেক চেষ্টা করেও নেটে লিঙ্ক পায়নি, জানাশোনা কেউই ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইন্ডিয়া হাইকমিশনের নেটের কাছে পৌঁছোতে পারে না, অথচ বিশেষ বিশেষ ট্রাভেল এজেন্টকে টাকা দিলেই তারা ঝটপট যোগাযোগ করিয়ে দেয়। এটা যদি সম্ভব হয় তাহলে ইন্ডিয়া ঘুরে ফিরে যাওয়ার দু—দিনের মধ্যে ভিসা পাওয়ার ব্যবস্থা ট্রাভেল এজেন্ট নিশ্চয়ই করে দিতে পারবে।

একটু হালকা লাগল এই ভাবনা ভাবার পর। জোরে শ্বাস ফেলল নার্গিস। আর তারপরেই মনে পড়ল মতিন ভাইয়ের কথা। মতিন ভাই একজন প্রবীণ সাংবাদিক। সবসময় ওর মনে হাসি লেগে আছে। ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে। তারপর থেকে সিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ থেকে গেছে। মতিন ভাই তাকে বোনের মতো স্নেহ করেন। মন্ত্রীমহলে মতিন ভাইয়ের বেশ খাতির আছে। সংসদ ভবনে সহজেই যাতায়াত করেন তিনি। সিরাজের সমস্যার কথা মতিন ভাইকে বললে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলে এখনই ব্যবস্থা নিতে পারেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যদি পাসপোর্ট ছাড়াই সিরাজকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে দিতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করেন তাহলে সেই অনুরোধ নিশ্চয়ই উপেক্ষিত হবে না। এখন খুব আপশোস হচ্ছিল। মতিন ভাইয়ের নামটা কেন কলকাতায় থাকার সময় মনে এল না। তাহলে কলকাতা থেকেই তাকে ফোন করে সব কথা বলে সাহায্য চাওয়া যেত।

তৃতীয় যে ভাবনাটা মনে এল সেটা কেন এত দেরিতে এল? ওরা তো স্বচ্ছন্দে পুলিশকে বলতে পারত, সিরাজের যে ব্যাগ ছিনতাই হয়েছে সেই ব্যাগের মধ্যে তার পাসপোর্টের সঙ্গে ওরও পাসপোর্ট ছিল। নার্গিস যদি তার পাসপোর্ট ছিনতাই হয়ে গেছে বলে একটু অভিনয় করত তাহলে আজ কী হত? এসবি অফিসার তাকেও কলকাতায় থাকার অনুমতি দিতেন যা তিনি সিরাজকে দিয়েছেন। তাহলে সিরাজকে ছেড়ে আজ তাকে চলে আসতে হত না। নিজের পাসপোর্ট টয়লেটে গিয়ে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ টেনে দিলে এই জীবনে সেটাকে খুঁজে পাওয়া যেত না। তাহলে সে দিব্যি সিরাজের সঙ্গে কলকাতাতেই থাকতে পারত! কেন যে বুদ্ধিটা মাথায় আসেনি। কিন্তু সিরাজ রাজি হত না, এ ব্যাপারে নার্গিসের কোনো সন্দেহ নেই। অসৎ কাজ করার ব্যাপারে লোকটার খুব আপত্তি। তাই ওর কাছেও তাকে মিথ্যে বলতে হত। হোটেল থেকে বের হওয়ার আগে নিরাপদে থাকবে বলে সে নিজের পাসপোর্ট সিরাজের ব্যাগে রেখেছিল। এই কথা সিরাজ অবিশ্বাস করত না, ব্যস, তাহলেই কলকাতায় থাকার সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। পরে, হোটেলে ফিরে সিরাজকে লুকিয়ে নিজের পাসপোর্ট নষ্ট করে দিলেই হত।

‘আন্টি!’

পাশ থেকে গলা ভেসে আসতেই চোখ খুলল নার্গিস, বাস দাঁড়িয়ে আছে একটা হাইওয়ের পাশে। যাত্রীদের বাস থেকে নেমে যাওয়া শুরু হয়েছে। একটি বছর দশেকের মেয়ে যে তার পাশে বসেছিল সেই তাকে আন্টি বলে ডেকেছিল। নার্গিস তাকাতেই মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি ব্রেকফাস্ট করবেন না?’

‘ব্রেকফাস্ট?’ শব্দটা চট করে মাথায় নিল না।

‘হ্যাঁ, সবাই নেমে যাচ্ছে ব্রেকফাস্ট করতে।’ বলে উঠে পড়ল মেয়েটি। দরজার সামনে একজন মহিলা হাসি মুখে দাঁড়িয়ে এদিকে তাকিয়েছিলেন। মেয়েটি এগিয়ে যেতে তিনি নীচে নামলেন।

নার্গিস জানলা দিয়ে দেখতে পেল একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়েছে বাস। সেখানে যাত্রীদের প্যাকেট দেওয়া হচ্ছে। সকালে হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় সিরাজ জোর করে তাকে চা আর বিস্কুট খাইয়ে দিয়েছিল। এখন মনে হল খেতেই ইচ্ছে করছে না। সে চুপচাপ বসে রইল।

মিনিট পনেরো পরে সে আবার আন্টি ডাকটা শুনতে পেল। চোখ খুলে নীচে তাকাতেই পাশে বসা মেয়েটিকে দেখতে পেল। মেয়েটি বলল, ‘এখানকার টয়লেটটা বেশ ভালো, আপনার দরকার হলে যেতে পারেন।’

এবার হেসে ফেলল নার্গিস। মেয়েটা তো বেশ ভালো। ব্রেকফাস্ট খেতে যাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো উৎসাহ হয়নি কিন্তু এখন মনে হল ওঠা উচিত। ঢাকা থেকে আসার সময় দু—বার ভয়ংকর টয়লেটের অভিজ্ঞতা তার হয়েছিল। এখানকার টয়লেট বেশ ভালো হলে সেটা ব্যবহার করাই উচিত।

নার্গিস নীচে নামতেই মেয়েটি হাত তুলে দেখিয়ে দিল কোন দিক দিয়ে টয়লেটে যেতে হবে। গিয়ে দেখল মেয়েটি ঠিক কথাই বলেছে। ফিরে এসে সে মেয়েটিকে মহিলার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলল, ‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’

‘এম্মা, এটুকু বলেছি বলে ধন্যবাদ দিচ্ছেন কেন?’ মেয়েটি বলল।

মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি ব্রেকফাস্ট খেলেন না।’

‘না খিদে নেই।’

‘আপনিকি ঢাকায় থাকেন?’ মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল।

‘হ্যাঁ, তোমরা?’

‘আমরা ব্যারাকপুরে থাকি। বাংলাদেশে বেড়াতে যাচ্ছি।’ মেয়েটি হাসল, মহিলা বললেন, ‘ওর বাবা এখন অন ডেপুটেশন ঢাকায় চাকরি করছেন। এই সুযোগে বেড়াতে যাচ্ছি আমরা। উনি ঢাকার বাস টার্মিনালে এসে আমাকে নিয়ে যাবেন। ঢাকা থেকে আমরা চট্টগ্রামেও যাব।’

‘সাবধান থাকবেন।’ নার্গিস বলল।

মহিলার মুখে ছায়া জমল, ‘কেন? ভয়ের কিছু আছে?’

দ্রুত মাথা নাড়ল নার্গিস, ‘না না। শুধু প্রত্যেকে নিজের পাসপোর্ট সাবধানে রাখবেন। ওটা হারিয়ে গেলে ভয়ংকর বিপদ হবে।’

‘হারাবে কেন?’ মহিলা যেন একটু স্বস্তি পেলেন।

‘ধরুন, আপনি কোনো ভিড়ের রাস্তায় হাঁটছেন, আপনি আপনার পাসপোর্ট ব্যাগে রেখেছেন। হঠাৎ দেখলেন ব্যাগ ছিনতাই হয়ে গেল। ছিনতাইকারীকে কিছুতেই ধরা গেল না। এ কথা ভেবেই বললাম। পাসপোর্ট না থাকলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আপনি দেশে ফিরতে পারবেন না সহজে।’ নার্গিস বলল।

‘সে কি! মহিলা আতঙ্কিত হলেন, ‘অনেক উপকার করলেন ভাই। আমি এই ব্যাপারে সবসময় সতর্ক থাকব। প্রথমবার বিদেশ যাচ্ছি তো!’

বিদেশ শব্দটি কানে যেতে হেসে ফেলল নার্গিস।

‘হাসলেন কেন?’ মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হাসলাম আপনি বিদেশ বললেন বলে। হ্যাঁ, আইন অনুযায়ী দুটো দেশ আলাদা, স্বাধীন। এক দেশ থেকে অন্য দেশে যেতে হলে পাসপোর্ট ভিসার দরকার হয়। অথচ আপনি যখন সীমান্ত পার হয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাবেন তখন বুঝতেই পারবেন না অন্য দেশে গেছেন। এক ভাষা, এক গান, এক গল্পকবিতা, দুই দেশের সংস্কৃতির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। তাহলে বিদেশ হল কী করে? কিন্তু আইন যখন বলছে বিদেশ তখন না মেনে উপায় নেই। তাই হাসি এল, এল নিজের অজান্তেই।’ নার্গিস বলল।

সীমান্তের এপাশে এসে বাস থামল। যাত্রীদের জিনিসপত্র বের করে দেওয়া হল। প্রথমে ভারতীয় হাইকমিশনে, ভারতীয় কাস্টমসে হাজিরা দিয়ে একটু হেঁটে বাংলাদেশ ইমিগ্রেশনে লাইন দিতে হবে। সুটকেস বেশ ভারী কিন্তু তুলতে পারল নার্গিস। ঠিক সেই সময় একটি কিশোর এসে দাঁড়াল সামনে, ‘দ্যান, আমাকে দ্যান।’

‘কেন?’

‘আমি আপনাকে হেল্প করলে অসুবিধা নাই তো?’

‘তুমি কি কুলি? কত নেবে?’

‘যা দেবেন।’ কিশোর সুটকেস তুলে নিল। ‘ম্যাডাম, আপনি তো ঢাকায় যাবেন স্যার আসেন নাই?’

‘না।’

‘ম্যাডাম, আপনার নাম কি নার্গিস আপা?’

‘হ্যাঁ।’

‘আসেন।’ কিশোর একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল সুটকেস হাতে নিয়ে। ততক্ষণে নার্গিসের মনে খটকা লেগে গেছে। ওর নাম তো এর জানার কথা নয়। জানল কী করে? চারপাশে তাকাল। বাসের যাত্রীরা লাইন দিয়ে ভিতরে যাচ্ছে। হঠাৎ একটি রোগা মানুষ সামনে এসে দাঁড়াল। ‘নমস্কার ভাবি। রাস্তায় কোনো অসুবিধা হয়নি তো?’

উত্তর না দিয়ে সন্দেহের চোখে তাকাল নার্গিস।

‘আপনি আমাকে চিনবেন না। চিনবেনই বা কী করে? কখনও তো দেখা হয়নি। কিন্তু কলকাতায় রামচন্দ্রের মুখে আমার নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন।’ লোকটা হাসল।

‘কবীর ভাই।’ মুখে থেকে অসাড়ে শব্দটা বেরিয়ে এল নার্গিসের।

‘হ্যাঁ, ভাবি। ঠিক নাম বলেছেন, আমি রামচন্দ্রকে খুব শাসন করেছি। সিরাজ ভাই যখন বলেছেন যাওয়ার সময় জরিমানা সমেত টাকা দিয়ে যাবেন, তখন আপনাকে ভয় দেখানোর কী দরকার ছিল! যাক গে, এই বর্ডারে আমি থাকতে আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। নতুন শাড়ি এক ডজন নিয়েছেন?’ কবীর ভাই হাসল।

‘না—না।’

‘নিলে পারতেন। কোনো দেশের কাস্টমস অফিসার সুটকেস খুলে দেখবে না যদি আমার কথা শোনে। এই বাদল, ভাবিকে নিয়ে যা। আমার বলা আছে তবু তুই স্যারকে মনে করিয়ে দিবি। তারপর ভিতরের বাসে ওঠার আগে ‘আহার’ হোটেলে নিয়ে যাবি।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে কবীর ভাই বলল, ‘ভাবি, আপনি আজ আমার অতিথি। সব কাজ শেষ হওয়ার পরে বাসে ওঠার আগে একটু ডাল—ভাত—মাংস খেয়ে নিলে আমি খুব খুশি হব। আহারের রান্না খুব ভালো হয়। যান, যান।’

নার্গিস অবাক হয়ে দেখল স্বাভাবিক দু—তিনটি প্রশ্ন ছাড়া তাকে কিছুই জিজ্ঞাসা করা হল না। সুটকেস খোলা দূরের কথা হাত দিয়ে দেখলও না। দু—দেশের স্ট্যাম্প পাসপোর্ট নেওয়ার পরে খেয়াল হল। বাদল নামের কিশোর এখন দায়িত্ব দিয়ে গেছে করিম নামের একটি কিশোরকে। সেই সুটকেস তুলে দিয়েছিল রিকশায়। দিয়ে বলেছিল আহারের সামনে গিয়ে থামতে। সেখানে পৌঁছোনোর কয়েক মিনিট পরেই করিম এসে হাজির হল, ‘আসেন আপা।’

‘কোথায়?’

‘রেস্টুরেন্টে। খাবেন তো। কবীর ভাই অর্ডার দিছে।’

‘না, আমার খিদে নেই। ওখানে ঢাকার বাস দাঁড়িয়ে আছে, না?’

‘হ্যাঁ আপা। কিন্তু আপনি না খেয়ে গেলে কবীর ভাই খুব দুঃখ পাবেন। যশোরের কইতেল খুব ভালো রান্না করে এরা।’ করিম বলল।

কথা না বাড়িয়ে নিজেই সুটকেসকে টেনে বাসের পাশে চলে এল নার্গিস। এসে দেখল অন্য যাত্রীরা তখনও পৌঁছোয়নি। বাস ভরতি হওয়ার পরে নার্গিসের মনে হল তার চেয়ে এই বাচ্চচা মেয়েটি যদি জানলার পাশে বসে তাহলে ও চোখ ভরে বাংলাদেশকে দেখতে পাবে। নার্গিস মেয়েটিকে বলল, ‘তুমি আমার জায়গায় এসে বসো।’

চকচক করে উঠল মেয়েটির চোখ, ‘আপনার অসুবিধে হবে না তো?’

‘একটু না।’ মাথা নেড়ে জায়গা বদল করল নার্গিস।

বাস চলতে শুরু করেছিল। মেয়েটি জানলার বাইরে তাকাল। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস, তাই জানলা খোলা না হলেও দেখা যাচ্ছিল বাইরের পৃথিবী।

দুপুরের খাবার রাঁধুনি রেস্টুরেন্টে খাচ্ছিল সিরাজ। এই রেস্টুরেন্টের রান্নার ধরন অবিকল ঢাকার রান্নার মতো। সিরাজ ওয়েটারকে ডেকে বলল, ‘ভাই, এক প্লেট শিম ভর্তা দেবেন?’

‘সরি স্যার। শিম ভর্তা শেষ হয়ে গিয়েছে।’ ওয়েটার বলল। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে এক ভদ্রলোক চেঁচিয়ে বললেন, ‘আমি বেগুন ভর্তা বললাম, তুমি বললে আজ হয় নাই। উনি শিম ভর্তা বললেন, তুমি শেষ হয়ে গিয়েছে বলছ। তাহলে এই কথাগুলো তোমাদের মেনুকার্ডে রেখেছ কেন? যত্তসব।’

ভদ্রলোকের উলটো দিকে বসে যিনি খাচ্ছিলেন তিনি চাপা গলায় বললেন, ‘তুমি চুপ করবে? না হলে আমি উঠে যাব।’

যিনি উত্তেজিত হয়েছিলেন তিনি কাঁধ সরিয়ে থেমে গেলেন। সিরাজ এবার ওদের দিকে তাকাল। অবশ্যই বাংলাদেশ থেকে ওঁরা এসেছেন কিন্তু তার চেনার কথা নয় যদিও ভদ্রলোককে যিনি শাসন করলেন তাকে চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। মহিলা যথেষ্ট সুন্দরী, তিরিশের আশপাশে বয়স। সে দেখল ভদ্রমহিলা একটু ঝুঁকে ভদ্রলোককে কিছু বললেন। ভদ্রলোক তার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। হাসলেন তিনি, তারপর ওয়েটারকে ইশারায় কাছ থেকে একটা প্লেট এগিয়ে দিলেন। ওয়েটার সঙ্গে সঙ্গে চলে এল সিরাজের কাছে, ‘শিম ভর্তার শেষ প্লেটটা ওই স্যারদের দিয়েছিলাম। উনি বললেন, যদি আপনি খান তাহলে অর্ধেক নিতে পারেন।’

হেসে ফেলল সিরাজ। এরকম প্রস্তাব সে কখনও পায়নি। বাঁ হাতটা উপরে তুলে সে ভদ্রলোককে নিষেধ করল। এবার ভদ্রমহিলা ঘুরে বসলেন, ‘এতটা আমাদের বেশি হয়ে যাবে। আপনি সংকোচ না করলে আমাদের ভালো লাগবে।’

‘আপনি এ কথা বললেন এটাই যথেষ্ট। অনেক ধন্যবাদ।’ সিরাজ বলল। খাওয়া শেষ করে দাম মিটিয়ে যখন সে বের হচ্ছে তখন ওরাও বের হচ্ছিল। ভদ্রলোক বললেন, ‘আপনি কোথা থেকে এসেছেন? নিশ্চয়ই ফরিদপুর?’

‘না। একদম খাস ঢাকা থেকে।’ সিরাজ বলল।

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘দেখলে’ তোমাকে কতবার বলেছি আন্দাজ করবে না। ওটা কিছুতেই মেলাতে পার না তুমি।’

এক একজনের ভাগ্য এরকম হয়ে থাকে।’ ভদ্রলোক বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনার নামটা?’

ভদ্রমহিলা বললেন, ‘জেনে তুমি কী করবে?’

‘তাহলে তো মানুষের সঙ্গে কথা বলাই যায় না।’

‘তার আগে তোমার তো জানা উচিত উনি কথা বলতে চান কিনা।’

এদের কথা শুনে হেসে ফেলল সিরাজ, ‘এভাবে বলবেন না ম্যাডাম।’

‘আমি তামান্না—!’ ভদ্রমহিলা হাসলেন। ‘আর ইনি হলেন আমার বড় ভাই, মইনুল রহমান। আমরা কাল ইন্ডিয়াতে এসেছি। থাকি গুলশান।’

‘আচ্ছা! আমি সিরাজ। আমার ফ্ল্যাট গুলশান থেকে বেশি দূরে নয়। আগে থাকতাম সার্কুলার রোডে, এখন বনানীতে।’

মইনুল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনি উঠেছেন কোথায়?’

‘এই কাছেই।’ হোটেলের নাম বলল সিরাজ।

তামান্না বললেন, ‘খুব ভালো লাগল আলাপ করে। আপনি নিশ্চয়ই দলবলের সঙ্গে আছেন?’

‘না না। একদম একাই আছি।’ সিরাজের কথাটা বলতেই একটা চিনচিনে অনুভূতি হল বুকের ভিতরে। নার্গিস না চলে গেলে এ কথা বলতে হত না। মইনুল জিজ্ঞাসা করল, কী কাজে এসেছেন এখানে?

বলতে গেলে অনেক কথা বলতে হয়। নার্গিসকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনেই তাকে ইন্ডিয়ায় আসতে হয়েছে বললে হয়তো অনেক প্রশ্ন শুনতে হবে।

সে বলল, ‘ব্যবসা সংক্রান্ত কথা বলতে এসেছিলাম।’

‘কী ব্যবসা আপনার। মইনুল যেন নাছোড়বান্দা।’

‘গার্মেন্টের’।

‘ফ্যাক্টরি আছে?’

মুখে কিছু না বলে মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল সিরাজ। তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কোথায় উঠেছেন?’

‘বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে একটা গেস্টহাউসে। প্রতিবার এখানেই উঠি।’

‘তার মানে মাঝে মাঝেই আসেন?’

‘হ্যাঁ।’ তামান্না বললেন, ‘আমরা টিভির টেলিফিলম ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।’

এবার পরিষ্কার হল সিরাজের কাছে, ‘ও, তাই বলুন।’

‘মানে?’ তামান্নার চোখ ছোট হল।

‘আপনাকে দেখে মনে হচ্ছিল কোথায় যেন দেখেছি। আপনি একসময় বাংলাদেশের টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন, তাই না?’ সিরাজ জিজ্ঞাসা করল।

‘করেছেন কী বলছেন? ভালো চরিত্র হলে ও এখনও অভিনয় করে।’

‘আপনি বোধহয় নিয়মিত টিভি দেখেন না!’

‘তা ঠিক। কিন্তু এখানে কীভাবে টেলিফিলমের ব্যবসা হয়?’

‘একদিনে সবকিছু জেনে ফেলা ঠিক নয়’। মইনুল হাসলেন, ‘আজ বিকেলে, যাক সন্ধের পর কী করছেন?’

‘তেমন কিছু না।’

পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে মইনুল সিরাজের হাতে দিল, ‘এটা যে গেস্টহাউসে আছি তাদের কার্ড। কোয়ালিটি নামে একটা রেস্টুরেন্টের পাশের গলি। সন্ধে সাড়ে ছয়টায় চলে আসুন। গল্প করা যাবে।’

‘দেখি।’ ঘড়িটা দেখতে দেখতে বলল সিরাজ।

‘দেখি নয়’ তামান্না হাসলেন, ‘আমি কিন্তু খুব এক্সপেক্ট করব।’

‘তাহলে চলি। আপনি কোথায় যাবেন? মইনুল জিজ্ঞাসা করলেন।

‘আমি? ও, লর্ড সিনহা রোডে।’

লর্ড সিনহা রোডের এসবি অফিসে গিয়ে প্রথমে তল পাচ্ছিল না সিরাজ। গতকালের সেই অফিসারটি এখন অফিসে নেই। অন্য যাঁরা আছেন তাঁরা যেহেতু তার কেস জানেন না তাই পাত্তা দিচ্ছিলেন না। শেষপর্যন্ত মরিয়া হল সিরাজ। একজন অফিসারকে দেখে মনে হল ইনি বেশ উঁচু পদের। তাঁকে সে বলল, ‘স্যার, আমি একজন বাংলাদেশের নাগরিক। এখানে পাসপোর্ট ছিনতাই হয়ে যাওয়ায় যা যা ব্যবস্থা নেওয়ার তা নিয়েছিলাম। এখানকার একজন অফিসার সে সব জানেন। তিনি হুকুম দিয়েছিলেন, রোজ একবার এসে দেখা করে যেতে। কিন্তু তিনি আজ অফিসে না থাকায় কার কাছে হাজিরা দেব বুঝতে পারছি না।’

‘থাকার পারমিট পেয়েছেন?’

‘হ্যাঁ স্যার।’

‘নামটা বলুন।’

‘সিরাজ।’

‘ঠিক আছে। কাল আসবেন। আচ্ছা, আপনি কি সরকারের কাছে দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে কোনো আবেদন করেছেন?’

‘না। সেরকম আবেদন করা হয়নি।’

‘কাল যখন আসবেন একটা আবেদনপত্র নিয়ে আসবেন।’ অফিসার তাঁর ঘরের দিকে চলে গেলেন।

এসবি অফিস থেকে বেরিয়ে সিরাজের মনে হল খুব শিগগির সে দেশে ফিরে যেতেও পারে। অফিসারের কথা শুনে তার সেরকমই মনে হচ্ছিল। এই সময় যদি নার্গিস সঙ্গে থাকত তাহলে কী খুশি হত! নার্গিস এখন কোথায়? লঞ্চে চেপে সেকি পদ্মা পেরিয়ে গিয়েছে?

এটা সিনেমা হলে ঢুকে ম্যাটিনি শো দেখে সিরাজ। ছবি শেষ হলে হোটেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে মনে হল মইনুল এবং তামান্না তাকে সন্ধ্যাবেলায় যেতে বলেছিল। কোথায় বালিগঞ্জ ফাঁড়ি সে জানে না। সেখানে গিয়ে তাদের সঙ্গে কী কথা বলবে সে? তার চেয়ে হোটেলের পাড়ায় ফিরে অপেক্ষাকৃত কম দামের হোটেল খুঁজে সন্ধেটা কাটিয়ে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তার পরেই মনে হল যদি দু—তিন দিনের মধ্যে যাওয়ার সরকারি অনুমতি পাওয়া যায় তাহলে হোটেল পালটে কী লাভ। যাওয়ার আগে নার্গিস যে হোটেলে সে আছে তার ফোন নম্বর, ই—মেল নম্বর নিয়ে গিয়েছে। নার্গিস নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবে। হোটেল বদলালে সেটা সম্ভব হবে না। অবশ্য সিরাজ কাল সকালে কার্ড দিয়ে নার্গিসকে টেলিফোন বুথ থেকে ফোন করার কথা ভেবেই রেখেছে। তাহলে সন্ধেটা ওদের সঙ্গে কথা বলে কাটানো খারাপ নয়।

কলকাতায় সব ট্যাক্সিচালক যে বদ নয়, তা বুঝতে পারল সিরাজ। বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কোয়ালিটি রেস্টুরেন্টের পাশের গলিতে সিরাজকে নামিয়ে দিল ঠিক ভাড়া নিয়ে। কয়েক পা হাঁটতেই গেস্ট হাউসের বোর্ড চোখে পড়ল। এখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে।। গেটের উপর আলো জ্বলছে। দারোয়ান গোছের যে লোকটা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তাকে মইনুলের নাম বললে প্রথমে চিনতে পারল না।

সিরাজ বোঝাতে চেষ্টা করল, ‘ওঁরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। যখনই আসেন এই গেস্টহাউসে ওঠেন।’

‘মেমসাহেবের সঙ্গে এসেছেন?’ লোকটা প্রশ্ন করল।

‘মেমসাহেবের সঙ্গে? হ্যাঁ হ্যাঁ।’

‘আসুন।’

ভিতরে আর একটি বেয়ারা দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে দায়িত্ব দিয়ে লোকটা ফিরে গেল। দোতলায় উঠে বেয়ারা বলল, ‘এখানে দাঁড়ান। আপনার নামটা বলুন। কার সঙ্গে দেখা করবেন?’

‘আমার নাম সিরাজ। ওঁরা আমাকে অনুরোধ করেছিলেন আসার জন্য। এই কার্ডটা ওঁরাই দিয়েছিলেন। নিয়ে গিয়ে দেখান।’ সিরাজ বলল।

‘বেয়ারা তাকে দাঁড় করিয়ে প্রথম ঘরটির বেল বাজাল। তারপর দ্বিতীয় ঘরের বেলের বোতাম চাপল। কয়েক সেকেন্ড পরে দুটো দরজা প্রায় একসঙ্গে খুলে গেল। দুই দরজায় দু—জন দাঁড়িয়ে। তাকে দেখতে পেয়ে প্রথমে তামান্না হেসে বলল, ‘আরে! আপনি? আসুন, আসুন, কী সৌভাগ্য।’

মইনুল বললেন, ‘আসুন, আমার ঘরে বসি?’ প্রশ্নটা তামান্নাকে।

‘না না। এই ঘরেই বসি। এখানে একটা ব্যালকনি আছে।’ তামান্না বললেন।

তামান্নার ঘরে ঢুকে মইনুল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চা না কফি?’

সিরাজ মাথা নাড়ল, ‘আমি চা খেয়ে ট্যাক্সিতে উঠেছি। তাছাড়া আমি চায়ের খুব ভক্ত নই।’

মইনুল বললেন, ‘সেই জন্য আপনার গায়ের রং ফরসা।’

তামান্না ধমক দিলেন, ‘যত্তসব বাজে কথা। বসুন।’

সোফায় বসার পরে তামান্না জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সারাদিন কাজ করতে হল?’

‘না, কাজ যা ছিল তা হয়ে গেছে।’ সিরাজ বলল।

‘তার মানে এখন ছুটির মেজাজ। আপনি কখনও দার্জিলিং গিয়েছেন?’

‘না।’

‘আমি একবারই গিয়েছিলাম। খুব ইচ্ছে ছিল এবার ঘুরে আসার। কিন্তু কলকাতার লোকেরা তো তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতেই পারে না তাই আটকে আছি।’ তামান্নার যেন মনে পড়ল, ‘এক্স চ্যানেল থেকে ফোন করেছিল?’

মইনুল মাথা নাড়লেন, ‘না তো।’

‘আমাদের তো উচিত ছিল তাগাদা দেওয়ার।’ তামান্না গম্ভীর।

‘আমি এখনই উঠছি।’ পকেট থেকে মোবাইল বের করে কাউকে ফোন করলেন মইনুল। তারপর কথা বলতে বলতে ব্যালকনিতে চলে গেলেন। কথা শেষ করে ফিরে এসে বললেন, ‘সমস্যা হয়ে গিয়েছে।’

‘কী সমস্যা?’

‘এখনই ওদের অফিসে যেতে বলছেন।’

‘কেন?’ তামান্নার কপালে ভাঁজ।

‘উনি কাল সকালে ফ্লাইটে মুম্বই চলে যাবেন। আমাদের কাগজপত্র তৈরি হয়ে আছে। গিয়ে নিয়ে আসতে বললেন।’ মইনুল বললেন।

‘চেক?’

‘হ্যাঁ, চেকও।’

খুশির চিৎকার ছিটকে বের হল তামান্নার গলা থেকে। সেই খুশি নিয়ে তিনি বললেন, ‘আর দেরি নয়, যাও, নিয়ে এসো।’

‘আমি একা যাব?’

‘এটা তো একটা বেয়ারার কাজ, তাও পারবে না!’

‘লোকটা—, তিনজনেই যাই। ওখান থেকে কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া যাবে।’

‘আমার আর বেরুতে ইচ্ছে করছে না। ট্যাক্সি নিয়ে যাবে আসবে। বেশি সময় লাগবে না। এত অলস কেন?’ তামান্না মুখ ফেরাল।

‘ঠিক আছে। সিরাজ ভাই, বুঝতেই পারছেন, না গেলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আমি যাব আর আসব। আপনি ততক্ষণ গল্প করুন।’ মইনুল ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

সিরাজ কথা বলল, ‘ভালো খবর শুনতে ভালো লাগে।’

‘ক—দিন ধরে খুব ঘোরাচ্ছিল লোকটা। সুন্দরী মহিলা দেখলেই কিছু লোকের চোঁক চোঁক করার স্বভাব থাকে। এই লোকটারও তাই আছে। এত সহজে কাজটা হয়ে যাবে তা আশা করিনি। আপনি আমার গুডলাক নিয়ে এলেন।’ হাত বাড়ান তামান্না। কাঁপা হাতে তামান্নার হাত স্পর্শ করেই ছেড়ে দিল সিরাজ। তারপর বলল, ‘দুপুরে বলছিলেন, টেলিফিলমের ব্যবসা, এটাই সেটা?’

হ্যাঁ। আমরা ঢাকায় টেলিফিলম বানাই। ভূতের গল্প, রহস্য গল্পের খুব চাহিদা আছে ইন্ডিয়াতে। পঁচিশ মিনিট থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের টেলিফিলম। তাতে না হয় পশ্চিমবাংলার অ্যাক্টর বা অ্যাক্টেÉসকে রাখি যাতে এখানকার পাবলিক চেনে। সেই টেলিফিলম এরা কিনে নেয়। এরা মানে এখানকার চ্যানেল। আমরা ইন্ডিয়ান রাইট বিক্রি করি। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়াতে যেসব পে—চ্যানেলে বাংলা প্রোগ্রাম দেখানো হয়, সেখানেও বিক্রি করি।’ তামান্না হাসলেন।

‘বাংলাদেশে দেখান না?’

‘এখনও দেখাইনি। দেখালে আইনে আটকাবে না কিন্তু এখানকার বাজার নষ্ট হয়ে যেতে পারে।’

‘ইন্ডিয়ান অভিনেতা—অভিনেত্রীরা ঢাকায় যান?’

‘উত্তরটা আমি দেব না। এটা সিক্রেট।’ হাসলেন তামান্না।

সিরাজ লক্ষ করছিল খবরটা আসার পর থেকে তামান্না খুব ভালো মেজাজে আছেন।

সে বলল, ‘আপনাদের এখানে কি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে?’

‘আমার এক দুলাভাইয়ের আছে। তিনি ইন্ডিয়ান সিটিজেন। ওঁকে আমাদের বিজনেসের পার্টনার করে নিয়েছি।’ উঠে দাঁড়ালেন তামান্না, ‘লেটস সেলিব্রেট। চলুন একটু হেঁটে আসি।’

‘হাঁটবেন?’ হকচকিয়ে গেল সিরাজ, ‘এই সময়? বেশ চলুন।’

তামান্না তৈরি হয়ে দরজার দিকে এগোল। তারপর কী ভেবে দাঁড়িয়ে গেল, ‘না, থাক। কোথায় আর হাঁটব। রাস্তায় যা ভিড়। ট্যাক্সি নিয়ে লেকের ধারে গেলে ভালো হাঁটা যেত। তার চেয়ে চলুন, গল্প করি।’ আবার ফিরে এল তামান্না। সোফায় বসে জিজ্ঞাসা করল, ‘দুপুরে বললেন, আমাকে চেনা চেনা লাগছে। আমার কোনো নাটক দেখেছেন?’

মাথা নাড়ল সিরাজ, ‘আমার নাম মনে থাকে না। তবে আপনি খুব আধুনিক মহিলার চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।’

‘ও, পেয়িং গেস্ট। পরিচালক ছোট প্যান্ট পরাতে চেয়েছিলেন, চ্যানেল আপত্তি করেছিল। তা সেই চরিত্রে নিশ্চয়ই ভালো লেগেছিল আমাকে, নইলে এতদিন মনে রেখেছেন কেন, তাই না?’ প্রশ্নটা করেই তামান্না মুখে একটু দুষ্টু ভাব ফুটিয়ে তুলল।

‘তা ঠিকই। নইলে মনে থাকত না।’ ঘড়ি দেখল সিরাজ।

‘ওমা, আপনি ঘড়ি দেখছেন কেন?’

‘অনেকটা সময় বিরক্ত করলাম তো?’

‘দূর! আপনি না এলে পাথরের মতো মুখ করে টিভি দেখতাম। আপনি এলেন বলে ভালো খবরটা চলে এল। লেটস সেলিব্রেট!’ হাসল তামান্না।

‘বেশ তো!’

তামান্না এগিয়ে গিয়ে ফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল করে বলল, ‘রুম নম্বর টুয়েলভ থেকে বলছি। একটা চিকেন কাবাব আর বিলি ফিশ পাঠিয়ে দেবেন ভাই? হ্যাঁ, হ্যাঁ। একটু তাড়াতাড়ি। আপনারা সার্ভ করতে বেশ দেরি করেন।’ রিসিভার নামিয়ে তামান্না বললেন, ‘এই দুটো এরা খুব ভালো করে।’ বলে চলে গেলেন ঘরের অন্য প্রান্তে। ঘড়ি দেখল সে। নার্গিসের বাস কি ঢাকায় পৌঁছে গেছে?

তামান্না এগিয়ে এল হাতে ট্রে নিয়ে। সামনের টেবিলে সেটা রাখতেই দেখা গেল দুটো গ্লাসের নীচের দিকে রঙিন তরল পদার্থ, এক বোতল ঠান্ডা জল আর কন্টেনারে বরফের টুকরো রয়েছে। উলটো দিকের সোফায় বসে তামান্না বললেন, ‘গ্লেন ফেভিক। আমি তো কালে ভদ্রে পান করি, করলে গ্লেন ফেভিক ছাড়া কিন্তু খাই না। আপনার অসুবিধা হবে না তো?’

‘এসবের স্বাদ আমার জানা নেই। কোনটা ভালো, খারাপ কোনটা আমি বলতে পারব না। তবে আমার মনে হয় দামি হলে খুব একটা পার্থক্য বোধহয় থাকে না।’ সিরাজ বলল।

‘একি বললেন আপনি? তামান্নার চোখে বিস্ময়।’

‘কেন?’

‘আচ্ছা ধরুন, দু—জন ওয়েল বিহেভড, শিক্ষিত, সুদর্শন, পুরুষের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য থাকবে না? দু—জন একই বয়সের সুন্দরীর সবকিছু এক থাকবে?’

অস্বস্তিতে পড়ল সিরাজ, ‘না। ঠিক বলেছেন। আমি কথাটা ফিরিয়ে নিচ্ছি।’

হাসল তামান্না, ‘আপনি যখন প্রথমবার কলকাতায় এসেছিলেন তখন কি মনে হয়েছিল, কখনও খাইনি যখন এখন কেন খাব?’

হাসল সিরাজ, ‘তা মনে হবে কেন?’

‘আপনি বিবাহিত?’

‘হ্যাঁ।’ পরিষ্কার গলায় বলল সিরাজ।

‘বিয়ের আগে মনে হয়েছিল কি কখনও বিয়ে করিনি, কেন করব?’

‘তা মনে হয়নি।’

‘তাহলে এখন মনে হচ্ছে কেন? এটা তো বিষ নয়। আপনি কীরকম পুরুষ মানুষ, নিজের উপর কনফিডেন্স নেই?’

‘বিদেশে আছি। হোটেলে ফিরতে হবে। যদি নেশা হয়ে যায়।’

‘হবে না। আমার যদি না হয় আপনার হবে না। আর যদি হয় তাহলে নিশ্চিত থাকুন, আপনাকে হোটেলে পৌঁছে দেওয়া হবে।’ তামান্না গ্লাস তুলে বলল, ‘লেটস সেলিব্রেট। উল্লাস!’ গ্লাস তুলে মাথা নাড়ল সিরাজ। এ অবস্থায় বেশি রূঢ় হওয়া অভদ্রতা করা হবে। সে ঠিক করল যতটা সম্ভব কম চুমুক দেবে যাতে গ্লাসের মদ শেষ হতে অনেক সময় লাগে। তামান্না যেরকম চুমুক দিল তাতে গ্লাসের তরল পদার্থ অনেকটাই কমে গেল। ঠোঁট ভিজোল সিরাজ। না, কোনো কটু স্বাদ নেই, গন্ধও মন্দ নয়। আচ্ছা, দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার পর তামান্না জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার মিসেসকে নিয়ে এলেন না কেন? এ ভারী অন্যায়। বাঙালি পুরুষরা একাই ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে।’

‘তাহলে ঠিক কোনটা?’ তামান্না জিজ্ঞাসা করল।

‘উনি কলকাতায় আসতে চাইলেন না।’

‘সে কী! কেন? কলকাতায় এসে শপিং করার লোভ নেই?’

‘না! খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ তো।’

‘তাই বলুন।’ তামান্না মাথা নাড়ল, ‘আপনার মিসেস যদি জানতে পারেন আমি আপনাকে এই ড্রিংক অফার করেছি তাহলে নির্ঘাত ছেড়ে চলে যাবেন। ভয় নেই, কেউ জানবে না। কিন্তু এক পথের পথিক না হলে একসঙ্গে হাঁটা মুশকিল।’

‘তা ঠিক।’

‘কিন্তু আমি মনে করি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ঝগড়া করার চেয়ে ঢের ভালো। যে যার নিজের মতো থাকুক। ব্যস।’ তামান্না বলল, ‘একি। আপনি তো চুমুকই দিচ্ছেন না। গ্লাসে যা ছিল তাই রয়েছে।’

শোনামাত্র সামান্য বড় চুমুক দিল সিরাজ।

তামান্না বলল, ‘জানেন, অনেক দিনের ইচ্ছে একটা বাংলা ছবি করার। ভারত—বাংলাদেশের যৌথ প্রযোজনায় ছবিটি করব। দু—দেশের অভিনেতা— অভিনেত্রীরা অভিনয় করবে। শুটিং হবে দু—দেশেই।’

‘বাঃ, খুব ভালো কথা। পরিচালনা কে করবেন?’

‘ঠিক করিনি। মুশকিল হল আমার একার পক্ষে প্রযোজনা করা সম্ভব নয়। অত টাকা আমার নেই। অনেকেই এগিয়ে আসছেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। সহ—প্রযোজক হতে চান তাঁরা, কিন্তু আমি নির্ভর করতে পারছি না।’

‘কেন?’

‘সব মানুষকে তো বিশ্বাস করা যায় না। অথবা খুব টাইট বাজেটে ছবিটা করব। ধরুন দু—কোটি টাকার ছবি। আমি অর্ধেক দিতে পারি।’ একটু খেয়ে গ্লাস শেষ করল তামান্না, ‘আচ্ছা, এ ব্যাপারে আপনার কি ইচ্ছে আছে?’

‘আমার?’ হকচকিয়ে গেল সিরাজ।

‘না না। এখনই কোনো কমিটমেন্টে যেতে বলছি না। পরে, ভেবে বলবেন। টাকা—পয়সা তো সারাজীবন ধরেই রোজগার করা যায়, কত লোক হাজার হাজার কোটি টাকা রোজগার করে মরে যায়। তাদের কথা মানুষ জানে না, মরে যাওয়ার পর কেউ তাদের মনেও রাখে না। কিন্তু বেঁচে থাকার সময় একটা কিছু করে যাওয়া যা নিয়ে মানুষ কথা বলবে তার দাম আলাদা। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালির কথা কেউ কখনও ভুলতে পারবে? জীবন থেকে নেওয়ার কথা? একজন ভালো বন্ধু পেলে একসঙ্গে সেরকম একটা কিছু করার চেষ্টা করতাম। না, না, এখনই আপনাকে কিছু বলতে হবে না।’

শুনতে শুনতে সিরাজের মনে হচ্ছিল তামান্না খুব সত্যি কথা বলছে। কিন্তু প্রায় এক কোটি টাকা সে হয়তো জোগাড় করতে পারে, জলে ফেলতে পারে না। এতকাল সে শুনেছে সিনেমা তৈরি করা মানে জুয়া খেলা। কোন সিনেমা চলবে, কোন সিনেমা থেকে লাভ না হোক লগ্নির টাকা ফেরত পাওয়া যাবে তা কেউ বলতে পারে না। কত মানুষ এই লাইনে টাকা ঢেলে ডুবে গিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। যাদের প্রচুর কালো টাকা আছে, রাখার জায়গা নেই, যাদের মনে লোভের সাপ ছোবল মারে তারাই ছবি তৈরিতে টাকা ঢালে বলে গল্প শুনেছে সে।

কিন্তু আজ তামান্নার কথা শুনে মনে হচ্ছিল ঢাকায় ফিরে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা উচিত। সবাই মিলে চাঁদা তুলে টাকাটা যদি দেওয়া যায়—

‘আপনার মুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ ভাবছেন?’

‘না না। ফিরে গিয়ে নিশ্চয়ই ভাবব।’ সিরাজ বলল। তারপর তার মুখ থেকে অজান্তেই প্রশ্নটা বেরিয়ে এল, ‘আপনি এই ব্যবসায় ভাইকে সঙ্গে পেয়েছেন, বাড়ির সবাই কি আপনাকে সাপোর্ট করেন?’

‘বাড়ির সবাই মানে?’ অদ্ভুত চোখে তাকাল তামান্না।

‘আপনার হাজব্যান্ড, বাবা, মা—।’

‘সরি। বাবা, মা চায় আমি যা ভালো বুঝি তাই যেন করি। আর হাজব্যান্ড? বিয়ের তিন মাস পরে উনি সিঙ্গাপুর থেকে যে ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরছিলেন সেটার হদিশ এখনও মেলেনি, মোট বিরানব্বইজন যাত্রী, পাইলট আর এয়ার হোস্টেসদের নিয়ে পুরো প্লেনটা আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।’

‘সরি। কিছুদিন আগে এরকমভাবেই একটা প্লেন হারিয়ে গিয়েছে। আগে শুনেছি বারমুডা ট্রাঙ্গেলে এরকম ঘটনা ঘটত। কদিন আগের ঘটনা এটা?’

‘আট বছর হয়ে গেল। প্রাথমিক শোক যখন কাটিয়ে উঠলাম তখন আর একটা সমস্যা তৈরি হল। আমি বিধবা কি বিধবা নই? এমনও তো হতে পারে সমুদ্রে প্লেন ডুবে যাওয়ার সময় কিছু যাত্রী প্রাণ বাঁচাতে পেরেছেন। তাঁদের মধ্যে আমার হাজব্যান্ডও ছিলেন। হয়তো এমন কোনো দ্বীপে ওঁরা আশ্রয় নিয়েছেন যার খবর সভ্যজগৎ রাখে না। অপেক্ষা করে করে এই দু—বছর আগে এয়ারলাইনসের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে ওদের কেউ বেঁচে নেই। হ্যাঁ, ক্ষতিপূরণ পেয়েছি। এই হল আমার কথা।’ বলতে বলতে সিরাজের গ্লাসে দ্বিতীয়বার হুইস্কি ঢেলে দিল তামান্না। সিরাজ বলল, ‘আমার আর খাওয়া ঠিক হবে না।’

‘কেন? শরীর কি খারাপ লাগছে?’ তামান্না উদবিগ্ন হল।

সিরাজ মাথা নাড়ল, ‘না না, সেসব কিছু নয়।’

‘আপনি এনজয় করছেন তো?’

‘তা করছি।’

‘দূর। আর আপনি বলতে ভালো লাগছে না, আমাকে তুমি বলুন।’

‘বলল। আজই তো আমাদের পরিচয় হল।’

সিরাজের কথা শোনামাত্র প্রচণ্ড জোরে হেসে উঠল তামান্না। তার হাসি যেন থামতেই চাইছিল না। অপ্রস্তুত হয়ে সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘আরে, হাসছেন কেন?’ হাসি থামিয়ে তামান্না জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রথম আলাপের দিনে বুঝি তুমি বলা যায় না?’

‘একটু কীরকম লাগে না?’

‘আচ্ছা মশাই, আমাদের এই উপমহাদেশে এতদিন প্রায় সব বিয়ে সম্বন্ধ করে হত। তাই তো? অভিভাবকরা আলোচনা করে একমত হলে বিয়ের দিন ঠিক হত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে লোক দেখানো আয়োজন করে পাত্র পাত্রীকে দেখত। কথাবার্তা তেমন হত না। অনেক পাত্র বা পাত্রী তো সেই সুযোগ পেত না, তারা ছবিতে ভবিষ্যতের সঙ্গীকে দেখে নিত। ঠিক বলছি তো?’ তামান্না জিজ্ঞাসা করল। ‘একদম ঠিক।’ অজান্তেই গ্লাসে চুমুক দিল সিরাজ।

‘বিয়ে হল। সেই রাতে বরকনে একসঙ্গে বিছানায় ঘুমোতে গেল। আমার বান্ধবীদের কাছে শুনেছি, প্রথম রাতেই তারা স্বামীকে সেক্সের আনন্দ দিতে বাধ্য হয়েছে। আলাপ—পরিচয় নেই, একটা নতুন মানুষের সঙ্গে যদি পুরুষরা সেদিন করতে পারে তাহলে আমাকে তুমি বলতে আপনার দ্বিধা হচ্ছে কেন?’ সরাসরি সিরাজের মুখের দিকে তাকাল তামান্না। ঠিক সে সময় দরজার বাইরে শব্দ হল। একটু পরে ঘরে ঢুকলেন মইনুল। তাকে দেখে তামান্না উঠে দাঁড়াল। ‘পেয়েছ? পুরোটা দিয়েছে তো?’

‘টিডিএস কেটেছে। কিছু করার নেই। একটা খাম এগিয়ে দিলেন মইনুল। তামান্না খাম খুলে একটা কাগজ আর চেকটা ভালো করে পড়ে ঘরের পিছনে রাখা টেবিলের ড্রয়ারে ঢুকিয়ে দিল।’

‘বাঃ, তোমরা শুরু করে দিয়েছ?’ মইনুল হাসল।

‘আমরা সেলিব্রেট করছি।’ তামান্না ফিরে এল।

‘কর। বুঝলেন ভাই, আমার এসব চলে না। পেটে আলসার আছে। মাঝে মাঝে ভাবি টাকা রোজগার করে কী হবে, খেতে পারি না যখন।’

‘আবার শুরু করলে? শোনো, সিরাজকে আমি প্রোপোজাল দিয়েছি। ওই আমার ফিলম প্রোজেক্ট সিনেমা তৈরির ব্যাপারটা ওঁকে বলেছি। সিরাজ একটু সময় নিয়েছেন ভেবে দেখবেন বলে।’ তামান্না বলল।

মইনুল বললেন, ‘বেশিরভাগ প্রোজেক্ট শুরু হয় না ওই বেশি ভাবাভাবি করা হয় বলে। জলে না নামলে কি সাঁতার কাটা যায়?

তোমরা ডিনার করবে কখন? ঘড়ি দেখলেন মইনুল।

‘আমার আজ দেরি হবে। রোজ তো করি না, আজ আমাকে ড্রিংকে পেয়েছে।’

হোটেলের দারোয়ান যখন সিরাজকে ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছিল তখন কলকাতার রাস্তায় কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই, ফুটপাতে মানুষের সংখ্যা হাতে গোনা। রাতে মার্কুইস স্ট্রিটের হোটেলে পৌঁছে কয়েক পা এগোতেই একটা কথা ভেসে এল, ‘মিস্টার সিরাজ? প্লিজ—’

সিরাজ তাকাল। রিসেপশনিস্ট তাকে ডাকছে। সে ডেস্কের সামনে যেতেই লোকটা একটা কাগজ এগিয়ে দিল, ‘ঢাকা থেকে দু—বার ফোন করেছিলেন এক মহিলা। নাম বলেছেন নার্গিস। বলেছেন ঠিকঠাক পৌঁছে গিয়েছেন।’

কাগজটা সামনে ধরল সিরাজ। তাতে লেখা আছে, নার্গিস, জিরো ওয়ান ফাইভ ফাইভ টু থ্রি এইট ফাইভ থ্রি…। বাকিটা ঝাপসা দেখাচ্ছে। মাথা নাড়ল সিরাজ, থ্যাংকু। কাগজটা পকেটে পুরে ঘরের দিকে পা বাড়াল সে।

সকালে যখন ঘুম ভাঙল তখন সকাল দশটা। তাড়া করে বিছানা থেকে উঠতেই মনে পড়ল গত রাতের কথা। নার্গিস তাকে দু—দুবার ফোন করেছিল। না, নিশ্চই খুব চিন্তায় আছে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে হোটেলের কাছাকাছি টেলিফোন বুথে চলে এসে ঢাকায় ফোন করল সিরাজ। একটু পরেই নার্গিসের গলা শুনতে পেল, ‘কাল কোথায় ছিলে?’

‘একটু বেরিয়েছিলাম। তুমি ভালোভাবে পৌঁছে গেছ তো?’

‘একদিন পরে জিজ্ঞাসা করছ? রাত দশটাতেও হোটেলে ফেরনি। ঠিক করে বল কোথায় গিয়েছিলে?’ নার্গিসের গলায় সন্দেহ।

‘আশ্চর্য! এখানে আমি কোথায় যেতে পারি?’ আমতা আমরা করল সিরাজ।

‘যাওয়ার জায়গার অভাব আছে নাকি? পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস নেই।’

‘কী যা তা বলছ।’

‘ঠিক বলছি। পনেরো মিনিট আগে আবার ফোন করেছিলাম, তুমি জানো?’

‘না তো!’

‘কী করে জানবে? ঢাকায় সকাল ছটায় উঠে পড়ি, ওনারা দশটা পর্যন্ত ঘুমোচ্ছেন। দ্যাখো, তুমি এমন কিছু করো না যা—’

‘আহা। তুমি তিলকে তাল করছ। শোনো, একটা আশার খবর আছে। আবেদন করলে এসবি আমাকে বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দিতে পারে।’

‘তার আগে আমি কলকাতা পৌঁছে যাব’। নার্গিসের গলায় প্রত্যয়।

‘মানে? তুমি আবার ভিসা পাবে কী করে।’

‘চেষ্টা করলে সব হয়। শোনো, আমি সঙ্গে নেই বলে যা ইচ্ছে হবে তাই কোরো না।’

‘ঠিক আছে। রাখছি।’ রিসিভার নামিয়ে রাখল সিরাজ।

নার্গিসের কথা শুনে তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সবে কাল নার্গিস তাকে ছেড়ে ঢাকায় গেল, এর মধ্যেই ওর মনে সন্দেহ ঢুকে গেল? অথচ কলকাতা থাকার সময় কখনওই এই মানসিকতা দেখায়নি। এতগুলো বছরের বিবাহিত জীবনে কয়েকবার অভিমান করেছে নার্গিস, সে কথা রাখতে পারেনি বলে, কিন্তু সন্দেহ করেনি কখনও। আজ দু—জন দু—দেশে আছি বলে মনে সন্দেহ এল।

এখনও এপাড়ায় রেস্টুরেন্ট চালু হয়নি। কিন্তু কলকাতার রাস্তায় ফুটপাথ ঘেঁষে ছোট ছোট চায়ের স্টল বোধহয় ভোররাত থেকেই চালু হয়ে যায়। তার একটা থেকে ভাঁড়ে চা আর নোনতা বিস্কুট খেল সিরাজ। এই চায়ের মান অনেক বড় রেস্টুরেন্টের চেয়ে মন্দ নয়, দাম মাত্র চার টাকা।

হোটেলের সামনে পৌঁছে যে ট্যাক্সিটাকে দেখতে পেল, একজন মহিলা এই সকালে চোখে রোদচশমা পরে পিছনের আসনে বসে আছেন। কৌতূহলী না হয়ে সে হোটেলে ঢুকতেই গলা কানে এল, ‘এই যে কোথায় গিয়েছিলেন?’

মইনুলকে দেখে অবাক হল সিরাজ, ‘একি, আপনি?’

‘আর বলবেন না। আপনার বান্ধবী এমন জেদ ধরল যে আসতে হল।’

‘আমার বান্ধবী?’

‘মাই গড! আপনি তামান্নাকে বান্ধবী বলে মনে করেন না?’

‘ও, না না! কিন্তু ব্যাপার কী?’

‘বাইরে চলুন। সে ট্যাক্সিতে বসে আছে।’

মইনুলকে অনুসরণ করে বাইরে আসতেই ট্যাক্সির দরজা খুলে তামান্না নীচে নেমে দাঁড়াল। তারপর ঈষৎ ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ‘পাশ দিয়ে গেলেন কিন্তু ফিরে তাকালেন না। কী, খুব অবাক হয়ে গেছেন তো?’

‘মানে, আমি ঠিক, এই হোটেলে আপনারা এলেন কী করে?’

সিরাজ কিছুই বুঝতে পারছিল না।

‘একি!’ তামান্না বেশ জোরে শব্দটা বলল, ‘কাল রাত্রে কী কী বলেছেন তা আপনার মনে নেই নাকি?’

মনে করার চেষ্টা করেও সফল হল না সিরাজ।

‘কী বলেছিলেন তা মনে নেই? কী করেছিলেন তাও কি ভুলে গেছেন?’

‘বিশ্বাস করুন, ট্যাক্সিতে ওঠার আগের সময়টার কথা মনে পড়ছে না।’

‘আচ্ছা, এই যে আমাকে আপনি আপনি বলছেন, কী কথা বলেছিল।’

‘হ্যাঁ, এটা মনে আছে।’

‘তাহলে এখনও আপনি বলছেন কেন?’

মইনুল চুপচাপ শুনছিলেন, বললেন, ‘আর ওকে লজ্জা দেওয়ার দরকার নেই।’

‘ঠিক আছে। ওকে!’ মাথা নাড়ল তামান্না, ‘ট্যাক্সিতে ওঠো তো।’

আচমকা আপনি থেকে তুমিতে চলে গেল তামান্না।

সিরাজ বুঝতে পারল তর্ক করে লাভ নেই। সে যখন ট্যাক্সি ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠতে যাচ্ছে তখন তামান্না বলল, ‘ওখানে বসলে কথা বলতে অসুবিধে হবে। তুমি পিছনে এসে বস।’ সে ট্যাক্সিতে উঠে দরজা খুলে রাখল।

মইনুল সামনের সিটে উঠে বসল। সিরাজ যখন পিছনের সিটে উঠতে যাচ্ছে তখন হোটেলের দরজায় এসে রামচন্দ্র চেঁচিয়ে বলল, ‘আপনার কল এসেছিল ঢাকা থেকে।’

লোকটা নার্গিসের ফোনের কথা বলছে বুঝে সিরাজ হাত নেড়ে জানাল, ‘ঠিক আছে।’ ট্যাক্সি চলতে শুরু করলে সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘সল্টলেকে। গিয়েছ ওখানে?’ তামান্না জিজ্ঞাসা করল।

নার্গিসকে ডাক্তার দেখাতে সল্টলেকে নিয়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু সেসব গল্প এড়াতে সিরাজ মাথা নেড়ে না বলল।

মইনূল বললেন, ‘কাল রাত্রে তামান্নাকে যা যা বলেছিলেন তা মনে করার চেষ্টা করুন ভাই। আমরা ধরে নিয়েছি আপনি মিথ্যে বলেননি।’

‘বাধ্য না হলে আমি মিথ্যে বলি না।’ সিরাজ বললেন।

‘গুড। কাল রাত্রে তোমাকে কেউ বাধ্য করেনি। তুমি যা বলেছ তা মনের আবেগে বলে গেছ। নিশ্চয়ই মিথ্যে বলনি।’

সিরাজ চুপ করে থাকল। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছিল তার। কী বলেছে সে? হঠাৎ তার হাতের উপর তামান্নার হাতের চাপ অনুভব করল সিরাজ। সে তাকাতেই ফিসফিসে গলায় তামান্না বলল, ‘তুমি খুব ভালো!’

চকিতে সামনের দিকে তাকাল সিরাজ। ড্রাইভারের পাশের সিটে মইনুল চোখ বন্ধ করে বসে আছে। গাড়ির আওয়াজ ছাপিয়ে তামান্নার গলার স্বর তার কানে যায়নি।

‘আমাকে একটু হেল্প করবেন?’ সিরাজ তামান্নার দিকে তাকাল।

‘আবার করবেন?’ চোখ পাকাল তামান্না।

‘বেশ, করবে?’

সঙ্গে সঙ্গে তামান্নার পাঁচ আঙুল সিরাজের পাঁচটা আঙুলকে জড়িয়ে ধরল, ‘বল’।

‘আমি তো আগে কখনও ড্রিংক করিনি। তাই আজ সব কথা মনে করতে পারছি না, ঠিক কী বলেছিলাম।’

‘অনেক অনেক কথা। কোন হোটেলে উঠেছ, সারা দিন কী কী কাজ করেছ, এসবি অফিসে গিয়েছিলে, এইসব।’ তামান্না হাসল।

‘এসবি অফিসের কথা বলেছি?’ অবাক হয়ে গেল সিরাজ।

‘হুঁ। খুব টেনশনে ছিলে। কাল ওখানে যাওয়ার পর তোমার সেই টেনশন কিছুটা কমেছে। আরও বলেছ…

‘কী বলেছি?’

‘কবীর ভাইয়ের কথা—।’

‘কবীর ভাই?’ চমকে উঠল সিরাজ।

‘একি! তোমার কি একটুও মনে নেই?’ তামান্না হাসল।

‘না, মনে নেই।’ তামান্না হাসল।

‘না, মনে নেই।’ কিন্তু কথাটা বললে স্বীকার করে নিতে হবে যে, সে মাতাল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মাতালরা, যা বলে তা পরে মনে থাকে না। তাহলে লোকে কেন বলে, ‘জাতে মাতাল, তালে ঠিক!’

সিরাজ হাসার চেষ্টা করল, ‘হ্যাঁ, মনে পড়ছে।’

সামনের সিট থেকে মইনুলের গলা ভেসে এল, ‘সরাসরি কথা বলে নিলে হয় না?’

‘হ্যাঁ, বলছি।’ কথাটা তামান্না বলল বটে কিন্তু সে সিরাজের আঙুল আঁকড়ে বসে রইল। সরাসরি দূরের কথা, কোনো কথাই বলল না। প্রায় আধঘণ্টা চলার পর মইনুল জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সিটি সেন্টারের কাছে এসেছি?’ ড্রাইভার হিন্দিতে বলল, ‘সামনের আইল্যান্ড পার হলেই সিটি সেন্টার।’

‘তাহলে আইল্যান্ড পার করে থামুন। আমরা ওখানেই নামব।’ মইনুল বললেন।

ট্যাক্সি ছেড়ে দিয়ে মইনুল বললেন, ‘আমি এগিয়ে দেখি, তোমরা ধীরে এসো।’ মইনুলকে অনেকটা এগিয়ে যেতে দেওয়ার পর তামান্না বলল, ‘সিরাজ, তোমাকে আমি বন্ধু বলে ভেবেছি। কাল দুপুরে হয়তো পরিচয় হয়েছিল কিন্তু তুমি চলে আসার পর মনে হয়েছে আমার আর কোনো অভাব নেই। তুমি বন্ধু থাকবে তো?’

‘নিশ্চয়ই।’

‘আমি আমার স্বপ্নের সিনেমা করতে চাই। যার কাছে টাকা চাইছি সে কিছুটা অ্যাডভ্যান্টেজ নিতে চাইছে। আমি তাতে রাজি নই।’

‘ঠিকই তো।’

‘কিন্তু তুমি যদি হেল্প কর তাহলে কারও কাছে কোনো অবলিগেশনে না গিয়ে আমরা টাকাটার ব্যবস্থা করে ফেলতে পারি।’ তামান্না সিরাজের হাতের আঙুলে চাপ দিল।

‘বল, কী করতে হবে?’ সিরাজ কৌতূহলী হল।

‘বলব। চল, আগে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলি।’ ততক্ষণে মইনুল একটি দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গেছেন। বাড়ির দরজা—জানলা বন্ধ। সামনে ফেন্সিংয়ের ওপাশে এক চিলতে বাগান রয়েছে। মইনুল গেট খুলে ভিতরে গিয়ে দরজার পাশে বেলের বোতামে চাপ দিলেন। তিনবারের পর পাশের জানালা খুলে গেল। একজন বৃদ্ধ উঁকি দিলেন, ‘কাকে চাই?’

‘বলুন মইনুল আর তামান্না এসেছে।’ মইনুল বললেন।

‘নাম বললেন দু—জনের অথচ লোক দেখছি তিনজন।’ বৃদ্ধ বললেন।

‘ও। ওর নাম সিরাজ ভাই। ঢাকার লোক।’

মইনুল বলা মাত্র জানলা বন্ধ হয়ে গেল। মিনিট আড়াই পরে বৃদ্ধ দরজা খুললেন। লুঙ্গি এবং ফতুয়া পরনে। বললেন, ‘সোজা উপরে চলে যান।’

সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে আসতেই ওপাশের ঘর থেকে হুইলচেয়ারে বসে এক সম্ভ্রান্ত চেহারার প্রৌঢ় বেরিয়ে এলেন, ‘আসুন আসুন। আসতে নিশ্চয়ই কোনো সমস্যা হয়নি? এই ঘরে এসে বসুন।’ প্রৌঢ় হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে গেলেন। সুন্দর সাজানো ঘর। সোফায় বসার পর ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চা না কফি’? তামান্না হাসল, ‘একটুও ব্যস্ত হবেন না। আমরা একটু আগেই কফি খেয়েছি। ওহ হো, আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই, ইনি সিরাজ ভাই, ঢাকায় থাকেন, বস্ত্র ব্যবসায়ী।’

‘এককালে খুব ভালো বাজার ছিল, এখন কীরকম?’ ভদ্রলোক সিরাজকে প্রশ্ন করলেন।

‘মোটামুটি।’ সিরাজ সতর্ক হয়ে জবাব দিল।

‘আমি সুধাংশু মণ্ডল। একটা অ্যাকসিডেন্টের পর এই হুইলচেয়ার আমার ভরসা। হ্যাঁ, মইনুল ভাই, আমি কথা বলেছি, আপনার ছবির জন্য এক কোটি টাকা চাইছেন। অথচ যে পার্টি দেবে সে কোনো ইনটারফেয়ার করুক এটা আপনারা চান না!’

মইনুল মাথা নাড়লেন, ‘তামান্নার সেটাই ইচ্ছে।’

তামান্না বলল, ‘ইনটারফেয়ার করলে ভালোভাবে কাজ করা যায় না।’

‘ঠিক কথা।’ সুধাংশু মণ্ডল মাথা নাড়লেন। ‘কিন্তু অত টাকা দিয়ে কেউ মুখ বন্ধ করে বসে থাকবে এটা আশা করা একটু—। আবার এর উলটোটাও হতে পারে।’

‘কীরকম?’ তামান্না জিজ্ঞাসা করল।

‘যে টাকা দিতে পারে তার মুখ প্রথমেই বন্ধ করে দিন।’

সেটা সম্ভব হবে? তামান্না বিস্মিত।

‘অসম্ভব বলে কোনো শব্দে আমি বিশ্বাস করি না।’

‘একটু পরিষ্কার করে বলুন—!’ তামান্না অনুরোধ করল।

‘আপনাকে তো কয়েকদিন আগে ইঙ্গিত দিয়েছিলাম—!’ হাসলেন সুধাংশু মণ্ডল।

‘হ্যাঁ, আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করেছি। কাজটা কি খুব কঠিন?’

‘কঠিন না হলে কেউ পয়সা খরচ করে?’

‘ঠিক কতজন লোক—’

‘কুড়িজন। কিন্তু কারও কোনো কাগজপত্র নেই।’

‘কেউ ইন্ডিয়ার নাগরিক নয়?’

‘না। ওরা কেউ বাংলাদেশেরও নাগরিক নয়।’

‘তাহলে কোথাকার—?’

‘এটা আপনার না জানলেও চলবে। বলেছি, ব্যাপারটা সোজা—বাসে করে বর্ডারের কাছে গিয়ে দালালকে পাঁচশো হাজার দিয়ে বাংলাদেশে যাওয়া এদের পক্ষে সম্ভব নয়।’ সুধাংশু মণ্ডল বললেন।

‘কেন?’ মইনুল প্রশ্ন করলেন।

‘কারণ অনেক। তার একটা হল এরা কেউ বাংলায় কথা বলতে পারে না। বাংলা ভাষা ওদের জানা নেই। এবার নিশ্চয়ই সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন। কুড়িজন লোককে বাংলাদেশের সীমান্তের পঞ্চাশ কিলোমিটার ভিতরে পৌঁছে দিলেই দায়িত্ব শেষ। আপনারা মাথাপিছু পাঁচ লাখ পেয়ে যাবেন। সুধাংশু মণ্ডল হাসলেন।

‘আমরা যাব কিন্তু আপনার ব্যাপারটা…’

‘ওটা আপনাদের চিন্তার বিষয় নয়। আপনারা এক কোটি পাবেন এবং কাজ করতে যে খরচ হবে তা করে বাকিটা সিনেমার জন্য রেখে দেবেন। কেউ আপনাদের সিনেমা তৈরির কাজে ইনটারফেয়ার করবে না!’

তামান্না বলল, ‘তাতেও তো অনেক টাকা খরচ হয়ে যাবে!’

‘তা তো হবেই। খরচ করার পরে যে টাকা থাকবে তা তো কম নয়। তাই না? আজ সকালে আপনি ফোনে যার কথা বলেছেন তিনিই তো এই মানুষ! সিরাজ ভাই। সিরাজ ভাই যদি সাহায্য করেন তাহলে নিশ্চয়ই উনিও খালি হাতে সাহায্য করবেন না। অবশ্য এসব আপনাদের ব্যাপার। সুধাংশু মণ্ডল বললেন।

মোড অফ পেমেন্ট হল ইন্ডিয়া থেকে ওঁরা যেদিন রওনা হবেন সেদিন পঁচিশ লাখ পাবেন, সীমান্ত পার হলেই পঞ্চাশ লাখ, সীমান্তের ওপারে পঞ্চাশ কিলোমিটার গেলে বাকি পঁচিশ। বুঝতে পেরেছেন?

তামান্না জিজ্ঞাসা করল, ‘প্রথম কিস্তি পাওয়ার পর বাকিটা যদি না পাই—’

মাথা নাড়লেন সুধাংশু মণ্ডল, ‘একটা কথা মনে রাখবেন, এরা কখনওই বেইমানি করে না। করতে দেয় না। যা কথা হবে তা থেকে একটুও সরে যাবে না ওরা। আবার বিশ্বাস করে প্রথম পঁচিশ লাখ টাকা দিয়ে যদি ওরা দ্যাখে আপনারা বেইমানি করেছেন তাহলে ওদের মনে কোনো মায়াদয়া থাকবে না। তাছাড়া এত ভাবছেন কেন? আমি তো আছি।’

সিরাজ চুপচাপ শুনছিল। তার মনে হচ্ছিল কোনো ভয়ংকর অপরাধমূলক সিনেমার সেটে পৌঁছে গিয়েছে সে। আচমকা তার মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে এল ‘আচ্ছা, আপনি যাদের ওঁরা বলছেন, তারা কে?’

সুধাংশু মণ্ডল তামান্নার দিকে বিরক্ত চোখে তাকালেন? তামান্না তড়িঘড়ি বলল, ‘ওঁরা কারা তা জেনে আমাদের কোনো লাভ নেই। ওরা আমাদের টাকা দেবে এজন্য কাজটা করব। সিরাজ, কাল রাতে আপনি বলছিলেন সীমান্ত পারাপারের ব্যাপারে সাহায্য করতে পারে এমন একজন ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোক আপনার জানা আছে। তাই নয়?’

সঙ্গে সঙ্গে সুধাংশু সিরাজের দিকে তাকালেন, ‘কে? কোন জায়গায়?’

‘বনগাঁ বর্ডারে, তাই তো কাল বললেন?’

‘আপনি কি কবীর ভাইয়ের কথা ভাবছেন? সুধাংশু মণ্ডল প্রশ্ন করলেন।

কাল রাতে মদপান করে কতটা বলেছে তা একটুও মনে না পড়ায় সিরাজ মাথা নেড়ে বলল, ‘হ্যাঁ’।

‘না, না। ওকে বিশ্বাস করা যাবে না। এসব ব্যবসাতেও মিনিমাম একটা সততা রাখতেই হয়। এই লোকটা আদ্যোপান্ত অসৎ। তাছাড়া ওর কারবার চুনোপুঁটিদের নিয়ে। রুই—কাতলাকে হ্যান্ডেল করার ক্ষমতা ওর নেই।’ যেন কিছু মুছে দিচ্ছেন এমন ভঙ্গিতে হুইলচেয়ারে বসে হাত নাড়লেন সুধাংশু মণ্ডল।

‘কবীর ভাই পার করে দিতে পারবে না?’

‘বোধহয় না। আর যদি পারে তাহলে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাবে। বর্ডারের ওপারে ঢুকিয়েই আরও বেশি টাকা চাইবে। শুধু আপনাদের কাছে নয়, ওদের কাছেও। না না, আপনারা যদি টাকা চান আরও বড় কাউকে ধরুন। এসবি অফিসের কোনো বড় কর্তাকে যদি টোপ দিতে পারেন, তাহলে কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু এজন্য আপনারা মাত্র বাহাত্তর ঘণ্টা সময় পাবেন। তারপর ওরা ত্রিপুরা বর্ডার দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করবে। তাহলে কখন আমাকে জানাবেন?’

‘কালকের মধ্যেই’। তামান্না বলল.

‘কোনো সোর্স আছে?’ সুধাংশু মণ্ডল অবাক হলেন।

‘আরে সিরাজ ভাই ওদের ভালো চেনেন।’

‘তাহলে তো কথাই নেই। কিন্তু ফোনে বেশি কথা বলবেন না। যদি পজিটিভ হয় তাহলে জিজ্ঞাসা করবেন, বাংলাদেশে যাচ্ছি, কিছু বলতে হবে নাকি?’

‘ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ। আশা করি দেখা হবে।’ মইনুল উঠে দাঁড়ালে তামান্না এবং সিরাজ উঠে পড়ল। সিরাজের মাথার ভিতরে একটা দপদপানি শুরু হয়ে গেল। কাল রাতে সে তামান্নাকে এসবি—র কথাও বলেছে? সর্বনাশ! তার মানে, সে যে পাসপোর্ট হারিয়ে ইন্ডিয়াতে আছে তাও তামান্নাকে বলেছে? তামান্না তখন বলেছিল কাল রাতে সে যা বলেছে এবং করেছে তার কিছুই এখন মনে নেই। কথাটা যে সত্যি তা একটু একটু করে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু বলার পাশাপাশি কী করেছিল সে? সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ঠোঁট কামড়াল সিরাজ।

সিটি সেন্টারের দিকে কয়েক পা যেতেই ট্যাক্সি পেয়ে গেল ওরা। মইনুল বলেন, ‘ব্যাপারটা যে খুব গোপনীয় তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?’

‘হ্যাঁ. পারছি।’ সিরাজ বলল।

‘আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। উনি বললেন বটে বাহাত্তর ঘণ্টা কিন্তু আমাদের টার্গেট করতে হবে ছত্রিশ ঘণ্টা।’ মইনুল বললেন।

তামান্না জিজ্ঞাসা করল, ‘এসবি অফিসটা কোথায়?’

‘লর্ড সিনহা রোডে।’ সিরাজ উত্তর দিল।

‘ওটা কি তোমার হোটেলের কাছে?’

‘বেশি দূরে নয়।’

গুড। তোমাকে ওই অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে আমরা গেস্টহাউসে চলে যাচ্ছি। তুমি চেষ্টা কর কাজটা এগিয়ে নিয়ে যেতে।’

‘কীভাবে?’

‘আচ্ছা, আজ গেস্টহাউসে ডিনারে ওকে ডাকো। ভদ্রলোক আসার পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তামান্না বলল।

মইনুল ট্যাক্সির সামনের সিটে বসে বলল, ‘গুড আইডিয়া। হাতে সময় পাওয়া যাচ্ছে। ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি হবে না।’

তামান্না বলল, ‘এসবি অফিস থেকে বেরিয়ে তুমি সোজা গেস্টহাউসে চলে এসো। খবরটা পাওয়া যাবে। তখন লাঞ্চ করব। ওকে?’

এসবি অফিসের সামনে ট্যাক্সি থেকে নেমে পড়ল সিরাজ। ট্যাক্সি চলে গেলে সে খুব ফাঁপরে পড়ল। এসবি—র অফিসারকে সে কী করে বলবে আজ রাতে ডিনারে চলুন। তাকেই এরা ভালো করে চেনেন ন। তামান্নাদের তো চেনার কথা নয় তাহলে তাদের ওখানে ডিনারে যাবেন কেন? উলটে এরকম প্রস্তাব দেওয়ার জন্য তাকে হয়তো বিপদে ফেলে দেবেন।

আজ হাজিরা দেওয়ার পর একজন পিয়োনের কাছ থেকে সাদা কাগজ চেয়ে নিয়ে দেশে ফেরার অনুমতি চেয়ে একটা করুণ আবেদনপত্র লিখল সে। তারপর আবেদনপত্রের জেরক্স বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনারের চিঠির কপির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে সেই অফিসারের ঘরের দরজায় পৌঁছে ভিতরে ঢোকার অনুমতি চাইল।

অফিসার বললেন, ‘ও আপনি, আসুন।’

সিরাজ আবেদনপত্র সামনে রাখলে ভদ্রলোক সেটা পড়লেন। তারপর বললেন, ‘আপনার সম্পর্কে আমরা খোঁজ নিয়েছিলাম। ঢাকায় তো আপনার প্রশংসা করার জন্য প্রচুর মানুষ আছে। কিন্তু!’ থামলেন অফিসার।

‘কিন্তু স্যার?’

‘সব কিছু তো নিয়ম মেনে করতে হয়।’ অফিসার বললেন, ‘আপনার কেসটা নিয়ে অনেক জল ঘোলা হত। আদালতে মামলা যাচ্ছিল। সেখানে ফয়সালা হতে কত মাস বা বছর যেত তা কেউ জানে না। কিন্তু আপনার ভাগ্য খুব ভালো।’

‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ সিরাজ হতভম্ব।

‘যে লোকটি ছিনতাই করে আপনার ব্যাগ নিয়ে পালিয়েছিল সে ধরা পড়ে গেছে। না, ডলার বা টাকা লোকটার কাছে পাওয়া যায়নি কিন্তু আপনার পাসপোর্ট পাওয়া গিয়েছে। সেই পাসপোর্টে যে ভিসার ছাপ আছে তার মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি। আপনি এখনই সেই থানায় চলে যান যেখানে ডায়ারি করেছিলেন। আমি ফোন করে দিচ্ছি, ওখানে গেলেই পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে যাবেন।’ অফিসার বললেন।

ঠিক দুটোর সময় থানা থেকে নিজের পাসপোর্ট পেয়ে গেল। এখন সে স্বাধীন। ইচ্ছে করলে আগামীকাল সকালে ঢাকার বাসে উঠে বসতে পারে। এত আনন্দ কখনও হয়নি তার। ইচ্ছে হচ্ছিল এখনই নার্গিসকে ফোন করে খবরটা জানিয়ে দেয়। কিন্তু না, ওকে চমকে দিতে হবে সোজা বাড়িতে পৌঁছে।

হোটেলে চলে এল সে। প্রথমে তামান্নাকে ফোন করল, ‘আমি লাঞ্চে যেতে পারছি না। কিছু মনে করো না।’

‘কেন?’

‘পর পর কয়েকটা জরুরি কাজ এসে গেছে।’

‘আশ্চর্য! এত তাড়াতাড়ি কাজ এসে গেল। থাক গে, কথা হয়েছে?’

‘পুরো রাজি হননি।’

‘রাজি করাও সিরাজ। তোমাকে আমরা সিনেমা—প্রোজেক্টের টেন পার্সেন্ট প্রফিট দেব। বুঝতেই পারছ টাকার অ্যাকাউন্ট কত হবে! যেমন করেই হোক ওঁকে নিয়ে এসো। ওঁর নামটা কী?’

‘মিস্টার গুপ্তা, ওঁর ঘরের দরজার গায়ে লেখা দেখেছি।’

‘আমরা খোঁজ নিচ্ছি। তুমি বিকেল পাঁচটার মধ্যে কনফার্ম কর, প্লিজ।’

রিসেপশনের ফোন নামিয়ে রেখে সিরাজ জিজ্ঞাসা করল, ‘আমার বিল রেডি করবেন? কত হয়েছে জানা দরকার।’

লোকটি বলল, ‘ একটু দাঁড়ান।’ তারপর কম্পিউটারের বোতাম টিপে একটা কাগজে টাকার অঙ্ক লিখে এগিয়ে দিল। সেটা দেখে খুশি হল সিরাজ। নার্গিস যে টাকা রেখে গিয়েছে তাতে বিল মেটানো যাবে। কিন্তু ফেরার টিকিট, কবীর ভাইয়ের ট্যাক্স মেটানোর টাকা তার কাছে থাকবে না। এখন একমাত্র উপায় নার্গিসের গয়না বিক্রি হবে এসব খরচ মেটানো।

হঠাৎ রিসেপশনিস্ট বলল, ‘ভাই আপনি কি রামচন্দ্রের নামে পুলিশের কাছে কমপ্লেন করেছিলেন?’

‘আমি? না তো!’ সিরাজ অবাক হল, কেন?

‘একটু আগে পুলিশ ওকে অ্যারেস্ট করেছে।’

‘সে কী! কেন?’

‘জানি না। কবীর ভাই বলে একজন হোটেলে এসে আপনার খোঁজ করছিল। লোকটা রামচন্দ্রের পরিচিত। ওরা যখন কথা বলছিলেন তখনই পুলিশ আসে। দুজনকেই ধরে নিয়ে গিয়েছে, খুব সিরিয়াস কেস নাকি।’ লোকটি বলল।

‘আপনার কেন মনে হল আমি কমপ্লেন করতে পারি?’

‘ওই কবীর ভাই আপনার খোঁজ করছিল। তারপরই পুলিশ এসেছিল। ম্যানেজারবাবু আপনাকে রামচন্দ্রের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছেন। তাই—’

খুব স্বস্তি পেল সিরাজ। তার মনে হল পাসপোর্ট ফেরত পেয়ে গেছে বলে এসবি—র অফিসারকে ধন্যবাদ দেওয়া তার কর্তব্য ছিল। সে হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে চলে এল এসবি অফিসে। ভদ্রলোক তখন বাইরে যাচ্ছিলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সমস্যার সমাধান হয়েছে?’

‘হ্যাঁ স্যার। আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকলাম।’

‘যত তাড়াতাড়ি পারেন দেশে ফিরে যান।’

‘হ্যাঁ স্যার, এখানে এই দু—দিন খুব ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’

‘যেমন?’

‘যে হোটেলে আছি তার বেয়ারা বেআইনিভাবে বর্ডার পার করে দেবে বলেছিল, টাকা চেয়েছিল ছয় হাজার। আমি রাজি হইনি, সেই বেয়ারাকে আজ পুলিশ অ্যারেস্ট করেছে।’ সিরাজ বলল।

‘হ্যাঁ। তার দলের মূল চাঁইকেও অ্যারেস্ট করা হয়েছে।’

‘ও আপনি জানেন?’

‘জানি। একটা কথা বলি, দয়া করে কোনো গেস্টহাউসে গিয়ে নতুন করে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। বুদ্ধিমান মানুষও পরিস্থিতি খারাপ হলে নির্বোধ হয়ে যান। দয়া করে সেটা হবেন না। আপনার ভিসায় কি শুধু রোড এবং ট্রেন আছে, না এয়ারও মেনশন করা হয়েছে?’

পাসপোর্ট বের করে ভিসার পাতা খুলল সিরাজ। তাতে লেখা আছে, এয়ার রোড।

অফিসার সেটা দেখে বললেন, ‘গুড। আজ রাত সাড়ে ন—টায় যে ফ্লাইট আছে তার টিকিট কাটুন।’

‘প্লেনের টিকিট?’

‘হ্যাঁ। আচ্ছা, গুডলাক।’ অফিসার বেরিয়ে গেলেন। হোটেলে ফিরে এসে সব বিল মিটিয়ে দেওয়ার পর সিরাজ দেখল যা হাতে রইল তাতে বাসের টিকিট হতে পারে, প্লেনের নয়। প্লেনে যেতে হলে নার্গিসের গয়না বিক্রি করতেই হবে। সেটা করতে একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না।

জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতেই রিসেপশন থেকে ফোন এল, এক বৃদ্ধা দেখা করতে চান। নীচে নেমে এল সে। দেখল বেশ বয়স্ক মানুষ তার জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি বললেন, ‘আপনি সিরাজ ভাই?’

‘হ্যাঁ। আপনি?’

‘আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি। আপনার ব্যাগ যে চুরি করেছিল সে আমার নাতি। পুলিশ তাকে ধরেছে।’

‘ও। আমি কী করতে পারি?’

‘আপনার ব্যাগে পাসপোর্ট ছাড়া যা ও পেয়ে সরিয়ে রেখেছিল তা আমি এই প্যাকেটে এনেছি। আপনি ওকে ক্ষমা করে দিন। ওর বিরুদ্ধে কেসে সাক্ষ্য দেবেন না। আপনি না সাক্ষ্য দিলে নাতি ছাড়া পেয়ে যাবে।’ একটা প্যাকেট এগিয়ে ধরলেন বৃদ্ধ।

‘প্যাকেটে কী আছে?’ গলার স্বর যেন বদলে গেল সিরাজের।

‘আপনার যা যা ছিল।’ ডলার, টাকা। বৃদ্ধ বললেন।

‘বাঃ, আমি শুনেছিলাম, চুরির পরে পাসপোর্ট বিক্রি করে দেওয়া হয়। আপনার নাতি বিক্রি করেনি কেন?’ সিরাজ জিজ্ঞাসা করল।

‘কী বলব স্যার, আপনার ছবি দেখে ও বিক্রি করতে পারেনি। ওর বাবা, মানে আমার ছেলে দু—বছর আগে মারা গিয়েছে। আপনার মুখের সঙ্গে তার মুখের খুব মিল।’

‘কত বয়স আপনার নাতির?’

‘পনেরো।’

‘এই বয়সে চুরি, ছিনতাই করছে, আপনারা তাকে আটকাচ্ছেন না?’

‘খারাপ ছেলেদের পাল্লায় পড়লে বাড়ির কথা কানে তোলে না। স্যার, ওর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবেন না। এই বুড়োর ও ছাড়া কেউ নেই।

‘আপনাকে কথা দিতে হবে ওই খারাপ ছেলেদের কাছ থেকে ওকে সরাতে হবে।’

‘আমি এবার খুব চেষ্টা করব স্যার।’

‘ঠিক আছে, আমি সাক্ষ্য দেব না। আপনি যান।’

ঘরে গিয়ে প্যাকেট খুলে সিরাজ দেখল তার সমস্ত টাকা—ডলার যেমন ছিল তেমনই রয়ে গেছে। সে গুনে দেখল যা টাকা রয়েছে তাতে প্লেনের টিকিট কিনতে সমস্যা হবে না। তার মনে হল, একের পর এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে চলেছে। এসবই সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ। মাইকেল মধুসূদনের লেখা একটা লাইন মনে পড়ে গেল, প্রবাসে দৈবের বশে…।

মার্কুইস স্ট্রিটে যে ট্রাভেল এজেন্ট রমরমিয়ে ব্যবসা করে তারা সিরাজকে উপদেশ দিল, ‘সোজা এয়ারপোর্টে চলে যান। ওখানে টিকিট কাউন্টারে নিশ্চয়ই টিকিট পেয়ে যাবেন। রাতের ওই ফ্লাইট এখনই ভরতি হয় না।’

অতএব সুটকেস নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠল সিরাজ। পিছনের সিটে শরীর এলিয়ে দিয়ে মনে হল, আহ, কী শান্তি। আজ গভীর রাতে ফ্ল্যাটের দরজায় বেলের বোতাম টিপে জীবনের সবচেয়ে বড় সারপ্রাইজের স্বাদ নার্গিসকে দেবে সে। পকেট থেকে ওর গয়না বের করে পরিয়ে দেবে। বলবে, তোমার যা ছিল তা সব ঠিকঠাক আছে। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে জ্যামে। সে ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করতে লোকটা বলল, ‘সামনে কিছু একটা হয়েছে, সব গাড়ি তো দাঁড়িয়ে আছে। ছেড়ে দেবে এখনই।’

আবার সিটের পিছনে মাথা হেলিয়ে বসল সিরাজ। তামান্নারা ভাবতেও পারছে না সে আজ রাতের ফ্লাইটে ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে। তামান্না মেয়েটির ব্যবহার খুব ভালো কিন্তু একটা কিছু রহস্য আছে ওর কথাবার্তা—ব্যবহারে। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল এসবি অফিসের মিস্টার গুপ্তার কথা। দয়া করে কোনো গেস্টহাউসে গিয়ে নতুন করে নিজের বিপদ ডেকে আনবেন না। সোজা হয়ে বসল সে। তখন মাথায় ভালো করে ঢোকেনি। এখন মনে হল হঠাৎ এই কথা কেন বলেছেন মিস্টার গুপ্তা? তার কাছে নিশ্চয়ই খবর আছে, সে তামান্নাদের গেস্টহাউসে গিয়েছিল। অর্থাৎ তামান্নারাও এসবি—র নজরে আছে।

আচমকা শীত শীত বোধ ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত শরীরে, মনে। সিরাজ কাতর গলায় ট্যাক্সি ড্রাইভারকে বলল, ‘ভাই, যে করেই হোক আমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে চলুন। গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা ধরুন। যা ভাড়া মিটারে উঠবে তার ডাবল দেব আমি, প্লিজ।’

ট্যাক্সি ড্রাইভার হর্ন বাজাতে লাগল।

সামনের গাড়িগুলো একটু নড়ছে, এগোচ্ছে—!

বিবাহ বিবরণ

পাত্র দেখতে পাত্রীপক্ষ আসছে, তাও আবার ছয়জনের দল, যার অর্ধেক ছেলে, অর্ধেক মেয়ে, বেশ অবাক হলেন মুকুন্দচন্দ্র। খবরটা এনেছিল তার শালা শ্যামাপদ। বাউন্ডুলে স্বভাবের লোক, বউ মরে যাওয়ার পর যেন সব ব্যাপারে উৎসাহ বেড়ে গেছে। টেবিল চাপড়ে বলল, ‘বুঝলেন জামাইবাবু, মেয়েটিকে দেখে আমি যাকে বলে মুগ্ধ, তাই হয়ে গিয়েছি।’

মুকুন্দচন্দ্র শালাকে বোঝার চেষ্টা করলেন, ‘মুগ্ধ হওয়ার কারণ?’

‘একেবারে কল্পনার মতো। দেখলে মনে হবে যমজ।’ শ্যামাপদ বলেছিল।

কল্পনা মারা গিয়েছে বছর দশেক আগে। বেশ মিষ্টি দেখতে ছিল মেয়েটা। মুকুন্দদাস ওকে খুব পছন্দ করতেন। দিঘার সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছিল। সাঁতার না জানা সত্ত্বেও শ্যামাপদ নাকি জলে ঝাঁপিয়েছিল বউকে বাঁচাতে যা মুকুন্দদাস পুরোপুরি বিশ্বাস করেননি।

জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এত লোকের আসার কী দরকার, দুজন এসে কথা পাকা করে গেলেই তো হত।’

‘বুঝছেন না,’ শ্যামাপদ মাথা নেড়ে বলল, ‘তিনজন পাত্রীর মায়ের তরফের তিনজন বাপের দিকের। আমি অনেক অনুরোধ করেছিলাম দুপুরে এসে খাওয়া—দাওয়া করে পাত্রকে দেখতে কিন্তু ওরা আসবে সকাল আটটায়। নটা—দশটায় ফিরে যাবে জলখাবার খেয়ে!’

মুকুন্দচন্দ্র সোজা হলেন, ‘সেকি! অত সকালে কেন?’ বশিষ্ঠ, ভৃগু ও নারদ—ইত্যাদি ঋষিদের উদ্দেশে জলদান করা হয়। এরপর পিতামহ ভীষ্মের উদ্দেশে তর্পণ করা হয়, তারপরই পিতৃলোকের উদ্দেশে চলে জলদান। সমস্ত অনুষ্ঠানটির মধ্যে আমাদের ভারতবর্ষের সংস্কৃতির মূল ভাবনাটি, বা ভিত্তিভূমিটি পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। মহালয়ার পরেই চন্দ্রের গতি অনুযায়ী শুরু হয় শুক্লপক্ষের বা দেবী পক্ষের। এই অমাবস্যা থেকে পরের পূর্ণিমা পর্যন্ত আমাদের আরাধনার কাল। সেই আরাধনার সূচনা হয় মহালয়ার পিতৃঅর্চনার মধ্য দিয়ে। এরপরেই দেবীপূজার মূল অংশে ধীরে ধীরে প্রবেশ করি আমরা।

শরৎকালে দেবীর আরাধনা হয় বলে এই পূজা শারদীয়া। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে ও কাঠক সংহিতায় দেবী অম্বিকাকে ‘শত’ রূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে ‘শরদ্বৈ অম্বিকা’। শরৎ রূপিণী অম্বিকার পূজা বলেই তা শারদীয়া। পণ্ডিতগণ বলেন, এ হল অকালবোধন। সূর্যের গতিপথে এ সময় দক্ষিণায়ন। শ্রাবণ থেকে পৌষমাসে দক্ষিণায়নের সময়। এ সময় দেবতারা নিদ্রিত থাকেন। ত্রেতাযুগে রামচন্দ্র রাবণবধের উদ্দেশে নিদ্রিত দেবীকে উদবোধিত করে পূজা করেছিলেন। তাই এই পূজা অকালবোধন নামে খ্যাত। যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি তাঁর ‘পূজা—পার্বণ’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ঋগবেদের ঋষিগণ রবির উত্তরায়ণ হইতে বৎসর আরম্ভ করিতেন। হিম অর্থাৎ শীত ঋতুতে আরম্ভ এই কারণে তাঁহারা ‘হিম’ শব্দে বৎসর বুঝিতেন। শত হিম বললে শত বৎসর বুঝাইত। কতকাল পরে কে জানে, তাঁহারা শরৎ ঋতু হইতেও আর এক বৎসর গণিতে আরম্ভ করেন। এই বৎসরের নাম ছিল শরৎ। শতং শরদঃ জীবতু—শত শরৎ বাঁচিয়া থাক—এইরূপ আশীর্ব্বচন ছিল। ইহা অদ্যপি শুনিতে পাই।’ এই শরৎকালকে কেন্দ্র করেই পরিস্ফুট হয়েছে দেবীর শস্যদায়িনী রূপ।

শস্যের সঙ্গে দেবীর নিগূঢ় সম্পর্ক! মহেন—জো—দারোর প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মধ্যে আমরা এমন এক নারীর দেখা পাই, যাঁর গর্ভ একগুচ্ছ শস্যে শোভিত। দেবীর আর—এক রূপ হল তাঁর শস্যবধূ রূপ। এই শস্যবধূকে আমরা বলি নবপত্রিকা। নয়টি গাছের সমাহার নবপত্রিকায় কলাগাছের সঙ্গে থাকে কচু, হরিদ্রা, জয়ন্তী, বেল, ডালিম, মানকচু, অশোক এবং ধান। আবার প্রত্যেকটি শস্যের জন্য পৃথক পৃথক দেবী নির্দিষ্ট আছেন। কলা গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন ব্রাহ্মণী, কচুর কালিকা, হরিদ্রার দুর্গা, জয়ন্তীর কার্তিকী, বেল গাছের জন্য দেবী শিবা, ডালিম গাছের দেবী রক্তদন্তিকা, অশোকের শোকরহিতা, মানকচুর চামুণ্ডা এবং ধান্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী হলেন লক্ষ্মী। নবপত্রিকার নয়টি শস্যতে দেবীর অধিষ্ঠান কেন? এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে দেবীর গাত্রবর্ণ হলুদরঙের তাই নবপত্রিকায় হলুদের স্থান দেবী জয়রূপিণী বলে জয়ন্তী দেবী রূপে পূজিতা। তিনি মানদায়িনী তাই মানকচুর সঙ্গে তাঁর যোগ। বেল শঙ্করের প্রিয়, তাই দেবীর বিল্ববৃক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক নিবিড়। তিনি মানবের শোকহরণ করেন তাই অশোক গাছ তাঁর অধিষ্ঠান। জীবের প্রাণস্বরূপিণী দেবী জীবের প্রাণ প্রদানকারী মূল অন্ন ধান্যে বিরাজিতা। তাই ধান নবপত্রিকায় স্থানলাভ করে। অসুরবিনাশকালে দেবীর দন্ত ডালিমফুলের মতো রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল। দেবী এর ফলে রক্তদন্তিকা নামে খ্যাত হন। দেবীর রক্তদন্তিকা রূপের জন্য ডালিম স্থান পান নবপত্রিকাতে। এইভাবে বিভিন্ন শস্যের সঙ্গে দেবীকে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেবীর শাকম্ভরী রূপটিও সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। শস্যদায়িনী রূপে দেবীর দশটি অস্ত্রের সঙ্গে দশরকমের শাককেও যুক্ত করা হয়েছে। এরা হল, পত্র অর্থাৎ পাতা, অগ্র, মূল, করীর, ফল, কাণ্ড, অস্থিরূঢ়ক, ত্বক, ফুল, কবক। এখানে দশরকমের শাকের কথা বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলি হল বৃক্ষেরই এক একটি অংশ। আমাদের জীবনের নানা অংশ, পিতৃপুরুষ বন্দনা থেকে শাকান্ন পর্যন্ত দেবীপূজার সঙ্গে জড়িত।

বর্তমানে দেবী পূজা কয়েকটি পদ্ধতি মতে সম্পন্ন করতে হয়। সাধারণত বৃহন্নন্দিকেশ্বর পুরাণোক্ত পদ্ধতি, দেবী পুরাণ ও কালিকা পুরাণোক্ত পদ্ধতিকে ব্যবহার করা হয়। কালিকাপুরাণে দেবীর মূর্তি তিন রকম—একবার ইনি উগ্রচণ্ডা অষ্টাদশ ভুজা, একবার ভদ্রকালী ষোড়শভুজা, একবার দুর্গা, কাত্যায়নী দশভুজা। এই তিনমূর্তিতেই দেবী মহিষমর্দিনী। এই পুরাণে ষাট অধ্যায়ে দেখা যায়—প্রথম সৃষ্টিতে মহিষাসুরকে উগ্রচণ্ডা রূপে, দ্বিতীয় সৃষ্টিতে ভদ্রকালীরূপে, এখন দুর্গারূপে তাঁকে বধ করছেন দেবী। দেবীপুরাণে শুক্লপক্ষের প্রতিপদ থেকে নয় রাত্রি দেবীর পূজার কথা বলা হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে  রামায়ণের অকাল বোধনের কাহিনি। সীতা উদ্ধারের জন্য রাবণকে বধ অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু দেবীকৃপায় পুষ্ট লঙ্কারাজকে বধের জন্য দেবীর আরাধনা করা প্রয়োজন। তাই দেবকুলের নিদ্রার সময়, দেবীকে জাগরিত করে পূজার আয়োজন করেছিলেন দশরথ পুত্র রাম। শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে তাই বিল্ববৃক্ষে দেবীর বোধনের আয়োজন এবং তারই মাধ্যমে দেবী পূজার সূচনা। ঘুমন্ত দেবীকে প্রথমে জাগ্রত করতে হবে, তারপর তাঁর পূজার আয়োজন! তাই অকালবোধনের কাহিনি, দেবী পূজায় একটি নতুন মাত্রা সংযোজিত করেছে। সব নিয়েই আমাদের বর্তমান দুর্গোৎসব।

‘পাত্রীর মামা বললেন, সকালে মন ভালো থাকে, সত্যিকারের চেহারাটা ভালো বোঝা যায়। মানে, সকালে তো কেউ চট করে মেকআপ নেয় না, তাই।’

‘মেকআপ! কী আশ্চর্য! ওরা কি মেয়েছেলে পাত্র দেখতে আসছে?’

‘এই আপনার মুশকিল জামাইবাবু। চিরকাল ব্যাকডেটেড থেকে গেলেন। আজকাল কেউ ছেলে বা মেয়ে নয়। সবাই ইউনিসেক্স। যাই, দিদিকে সব ভালো করে বুঝিয়ে বলে যাই।’ শ্যামাপদ ভেতরে চলে যেতেই বাইরে থেকে শান্তিময় মুখ নিচু করে ঘরে ঢুকল। মুকুন্দচন্দ্রের সামনে দিয়ে সে ভেতরে চলে যাচ্ছিল, কাশি শুনে দাঁড়াল।

মুকুন্দচন্দ্র বললেন, ‘তোমার মামা খবর এনেছেন, আগামী রবিবার সকাল আটটায় পাত্রীপক্ষ তোমাকে দেখতে আসছেন। তুমি ভোর ছটার আগেই ঘুম থেকে উঠে দাঁত মেজে, দাড়ি কামিয়ে স্নান সেরে নেবে। তারপর পরিষ্কার পাজামা—পাঞ্জাবি পরে ওদের জন্যে অপেক্ষা করবে।’

শান্তিময় মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।

‘তোমাকে ওরা যা যা প্রশ্ন করবে তার ঠিকঠাক জবাব দেবে।’

শান্তিময় এবার মুখ তুলল, ‘কী কী প্রশ্ন?’

‘সেটা আমি কী করে বলব?’ মুকুন্দচন্দ্র বিরক্ত হলেন।

‘আঁচ পেলে ভালো হত, তৈরি থাকতাম।’

‘তোমার মামাকে জিজ্ঞাসা করো, তিনি বলতে পারবেন। যাও।’

প্রশ্ন শুনে শ্যামাপদ ভাগ্নের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলেন, ‘তোর নাম জিজ্ঞাসা করবে, কত মাইনে পাস জানতে চাইবে। অসুখবিসুখ আছে কিনা, ঘুমালে নাক ডাকে কিনা জেনে নিয়ে হয়তো হাঁটতে বলবে।’

‘হাঁটতে বলবে কেন?’ শান্তিময় অবাক হল।

‘পুরুষোচিত হাঁটা কিনা দেখতে চাইবে। হয়তো গান গাইতে বলবে।’

‘গান? ওরে বাবা, আমি তো…।’

‘জানি, তোদের বংশে কারও গলায় সুর নেই তা জানি। মায়ের কোনো গুণ যদি এক ফোঁটা পেতিস তাহলে বর্তে যেতিস।’

পাশে বসা মা আপত্তি করল, ‘আঃ, কী যা তা বলছিস?’

‘থামো তো? সত্যি কথা শুনতে খারাপই লাগে। আর হ্যাঁ, বিয়ের পর বউমাকে তুই, তুমি, আপনি, কী বলে সম্বোধন করবি জানতে চাইতে পারে।’

‘এ আবার একটা প্রশ্ন হল? আপনি বলব।’

‘হয়ে গেল! যেমন বাপ তেমন ছেলে! ওসব ব্যাকডেটেড ব্যাপার। আজকালকার ছেলেমেয়েরা বিয়ের পর তুই তোকারি করে শুনিসনি!’

মা বলল, ‘ইস। শুনলে সাঁওতাল মনে হয়।’

‘কালচার, লোকসংস্কৃতি। লেটেস্ট ফ্যাশান।’

পাত্রীপক্ষ এল, জমিয়ে গল্প করল, চা—জলখাবার খেয়ে চলে গেল, পাত্রকে একটাও প্রশ্ন করল না। যাবার সময় সম্মতি জানিয়ে গেল।

এবার মুকুন্দচন্দ্র শ্যালক শ্যামাপদকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গিয়ে একইরকম সৌজন্য দেখানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু শ্যামাপদকে সামলাতে পারলেন না। জামাইবাবু কেন প্রশ্ন করছেন না দেখে শ্যামাপদ মুখ খুলল, ‘আচ্ছা মা, বিয়ের পর তুমি তোমার স্বামীকে কী বলে সম্বোধন করবে? তুমি, তুমি বা আপনি?’

‘আমার ঠাকুমা ঠাকুরদাকে আপনি বলতেন। আমার মা বাবাকে তুমিই বলে।’ পাত্রী, যার নাম দীপাঞ্জনা থামল।

শ্যামাপদ উৎসাহিত হল, ‘তাহলে তোমার তো তুই বলা উচিত।’

‘কেন? আমি কোনো সম্বোধন না করেও কথা বলতে পারি।’

‘যেমন?’ হকচকিয়ে গেল শ্যামাপদ।

‘কাগজটা পড়া হয়েছে? কতক্ষণ পরে বেরুনো হবে?’ দীপাঞ্জনা হেসে বলল, ‘এইরকম আর কী!’

আর প্রশ্ন করেনি শ্যামাপদ। মুকুন্দদাস দিন পাকা করলেন।

শান্তিময়ের বন্ধু সংখ্যা তিনজনের বেশি নয়। তারা দীপাঞ্জনার ছবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বলল, ‘বাঃ বেশ দেখতে।’

বন্ধুদের কারও বিয়ে হয়নি কিন্তু বিস্তর পড়াশুনা। চারজনের একটা মিল আছে, কেউ সিনেমা দূরের কথা, টিভিও দ্যাখে না। বই ওদের জগৎ।

একজন বলল, ‘বিয়ের পর তুই বদলে যাবি শান্তি।’

‘কেন? বদলে যাব কেন?’ শান্তিময় প্রশ্ন করল।

‘সবাই নাকি যায় আমার ঠাকুমা এখনও বলে, বাবা নাকি বিয়ের পর বদলে গিয়েছে।’ প্রথমজন গম্ভীর মুখে বলল।

দ্বিতীয়জন বলল, ‘সবাই বদলে যায় না। কেউ কেউ ঠিক থাকে। যারা বউকে স্বভাবিত করতে পারে তারা ঠিক থাকে। ব্যাপারটা অনেকটা আগুনের মতো। তুই সরাসরি আগুনে হাত দিলে হাত পুড়ে যাবে। কিন্তু একটা কাচের পাত্রে আগুন রেখে সেই পাত্রকে ধরলে কিছুই হবে না, উলটে ঘর আলোয় ভাসবে।

তৃতীয়জন বলল, ‘তাই বোধহয় প্রথম রাতে যারা বেড়াল মারতে যায় তারা সারাজীবন বউ—এর বেড়াল হয়ে থাকে।’

শান্তিময় এসব শুনে হকচকিয়ে গেল। বলল, ‘তাহলে আমি কী করব?’

বন্ধুরা পরামর্শ দিল, ‘প্রথম রাতেই বেড়াল মারতে যাস না।’

‘বেড়াল? সে কি বাপের বাড়ি থেকে বউ বেড়াল সঙ্গে নিয়ে আসবে?

প্রথমদা বলল, ‘প্রকাশ্যে বেড়াল নিয়ে কেউ যায়! অযাত্রা। এমনি বেড়াল নয়, প্যানিশ ছোট গল্পে পড়েছিলাম, বিয়ের ঘরের ভিতরে একটা পুষি বেড়াল থাকে। খুব আদুরে, তাকে চোখে দেখা যায় না। বুঝলি?’

শান্তিময় অনুমান করতে চেষ্টা করেও সক্ষম হল না।

বিয়ে হয়ে গেল। ছাঁদনাতলাতেই কয়েকবার আড়চোখে দেখার চেষ্টা করেছিল। শান্তিময় কিন্তু দীপাঞ্জনার চিবুক যেহেতু বুকের কাছে নামানো ছিল তাই হতাশ হয়েছিল। বিয়ের লগ্ন ছিল শেষরাতে, তাই বাসরের প্রশ্ন উঠল না। রাত জেগে মেয়ে নাকি ঘুমিয়ে কাদা। পরের দিন ফিরে আসা এবং কালরাত্রি। দেখাদেখি নেই।

তারপর ফুলশয্যার রাত, বন্ধুদের বিদায় দিয়ে ঘরের দিকে এগোনো মাত্র শ্যামাপদ তাকে ডেকে বলল, ‘আজ থেকে তোমার সত্যিকারের সংসারজীবন শুরু হচ্ছে। তুমি এমন কিছু করো না যা বউমাকে দুঃখ দেবে।’

ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলল শান্তিময়।

শ্যামাপদ বলল, ‘যাও।’

ঘরের দরজা ভেজানো, বাইরে থেকে শব্দ করল শান্তিময়। দ্বিতীয়বারে দীপাঞ্জনার গলা ভেসে এল ভেতর থেকে, ‘দরজা খোলাই আছে।’

সামান্য চাপ দিতেই দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকে আবার সেটা বন্ধ করে তাকাল শান্তিময়।

ফুল দিয়ে চমৎকার সাজানো বিছানায় একপাশে বসে আছে দীপাঞ্জনা। তার হাতে বই। দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল শান্তিময়ের, খাটের পাশে গিয়ে বলল, ‘বসতে পারি?’

‘অবশ্যই।’ হাসল দীপাঞ্জনা।

‘কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো?’ কথা খুঁজছিল শান্তিময়।

‘বিন্দুমাত্র নয়।’

কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ চলে গেল। আবার মুখ খুলতে গিয়ে মামার উপদেশ মনে পড়ল, সোজা হয়ে বসল শান্তিময়। তারপর বলল, ‘তো—তো—তো—।’

‘শুনছি।’ দীপাঞ্জনা শব্দটা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই বলল।

‘ঘুম পাচ্ছে নাকি?’ শান্তিময় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

‘একটু একটু।’

‘তাহলে শুয়ে প—প—।’ কিছুতেই ‘শুয়ে পড়’ মুখ থেকে বের হল না দীপাঞ্জনা হাসল, ‘শুয়ে পড়া যাক।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ—।’—শুয়ে পড়ল শান্তিময় বিছানার একপাশে।

মাঝখানে পাশবালিশ, দীপাঞ্জনাও বালিশে মাথা রাখল। কয়েক সেকেন্ড পরে শান্তিময় বলল, ‘ইয়ে, আমার না কোনো অভিজ্ঞতা নেই। মানে এক্সপেরিয়েন্স আর কী!’

‘ও।’

‘ভাবিনি তো।’

‘ও। স্কোপও ছিল না বোধহয়।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক তাই।’ তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে মুখ ফেরাল, ‘আছে নাকি?’

দীপাঞ্জনা গম্ভীর হল, ‘কী?’

‘ওই যে, এক্সপেরিয়েন্স!’

‘থাকলে কী হবে?’ বাঁকা গলায় জিজ্ঞাসা করল দীপাঞ্জনা।

‘তার মানে আমারই মতন, তাই না?’

‘হুঁ।’ দীপাঞ্জনা চোখ বন্ধ করল।

‘তাহলে আজ ঘুমিয়ে পড়া যাক।’

‘হ্যাঁ। গুডনাইট।’ হাসি চাপল দীপাঞ্জনা।

‘গুডনাইট।’ শান্তিময় বড় শ্বাস ফেলল।

বালিশে মাথা দিয়ে শান্তিময়ের মুখে একটা হতাশ্বাস বেরিয়ে এল।

—এ—দিনটা এ—রাতটা নিয়ে মানুষের কত স্বপ্ন থাকে, আমাদের ঝগড়া দিয়ে শুরু হল।

—বিয়ের আগে এক্সপেরিয়েন্সের কথাটা বলাই অন্যায় হয়েছিল। দীপা বলল।

শান্তিময় বলল—ঠিকই। আসলে আমার মুখে না—কথা আসছিল না।

এইবার দীপা বললে—তবে আমার ঠাকুমা বলেন, ফুলশয্যায় ঝগড়া হলে, পরে বাকি জীবন সুখে কাটে। আর যারা ফুলশয্যায় মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে, পরে বাকি জীবন ঝগড়া করে। তোর ঠাকুরদার মতন।

শান্তি এবার উৎসাহে উঠে বসে। পাশবালিশটা সরিয়ে বলে — তাহলে তো জমিয়ে ঝগড়া করা যাক। তবে কী জানো— একটা শ্লোক আছে—অজা—যুদ্ধে ঋষিশ্রাদ্ধে প্রভাতে মেঘডম্বর। দাম্পত্যকলহে চৈব বহবারম্ভে লঘু ক্রিয়া। এর মানে হল— ছাগলে ছাগলে লড়াইয়ে মনে হয় কত না কী হবে, শেষে একটা ঢুঁ, ঋষিমশাই সকাল থেকে তোড়জোড় করছেন শ্রাদ্ধের, দান করলেন কি না একটা হরতকী, ভোরবেলায় মেঘ ডাকলে কদাচিৎ বৃষ্টি হয়। আর দাম্পত্যকলহ—ফাটাফাটি ঝগড়া—এই বুঝি দুজনে দুদিকে চলে গেল—আবার পরদিন দেখ—নিশ্চিন্তে ঘর—সংসার করছে।

প্রথম আড়ষ্টতা ভাঙতে শান্তি অনেকক্ষণ বকে গেল।

সব শুনে দীপা বলল—সর্বনাশ!

শান্তিময় অবাক হল। বলল—এতে সর্বনাশের কী হল?

দীপা জিজ্ঞেস করল—তুমি কি সংস্কৃতের পণ্ডিত নাকি! আমার দিদি, মাসতুতো দিদি রমাদি, বলেছিল—দীপু, খবরদার মাস্টার স্বামীর পাল্লায় পড়বি না। নয়তো আমার মতো, হেডমাস্টার স্বামীর পাল্লায় পড়ে জীবন ছারখার হয়ে যাবে! এটা উচিত নয়, ওটা উচিত নয়।

শান্তি হেসে বলল—মাস্টারও নই, সংস্কৃতপণ্ডিতও নই। আমি তো ব্যাংকে কাজ করি। শ্লোকটা জানা ছিল, তাই তোমার কাছে একটু বিদ্যে জাহির করলাম। এই মাত্র।

দীপাও এতক্ষণে সহজ হয়েছে। ঘরের আলো অনেকক্ষণ নিভেছে। দীপা বলল—ভাগ্যিস তোমাদের বাড়িতে ফুলশয্যায় আড়ি পাতার সেরকম কেউ নেই। না হলে আমাদের কথাবার্তা শুনে হইচই পড়ে যেত।

শান্তি বলল—ফুলশয্যা নিয়ে সব থেকে মিষ্টি মজার গল্প আছে শরদিন্দুর।

দীপা বলল—আমি পড়েছি। বর সবাইকে তাড়িয়ে যখন দরজা বন্ধ করতে যাবে, তখন ঘরের মধ্যেই কে বললে—এই কী হচ্ছে! বর আবার বাইরে যাবে, বউ তার জামা ধরে টেনে দেখালে, কড়িকাঠে একটা ময়না না কাকাতুয়া বসে।

শান্তি বলল—পাখিটা শেষকালে কী বলেছিল জানো?

দীপা বলল—জানি। জ্বালালে!

শান্তি মৃদু হেসে বলল—কেন বল তো?

দীপা এইবার লজ্জা পেল। বালিশে মুখ গুঁজে বলল—তুমি একটা অসভ্য। ধ্যেৎ।

শান্তি সাহস পেয়ে দীপার মুখটা তুলে নববধূকে প্রথম চুম্বন করল।

স্নেহের খেলা

সমুদ্রের গায়ে একতলা দুই কামরার বাড়ি, বাড়িওয়ালা এগারো মাসের বেশি ভাড়া দেবেন না। বললেন, ‘আমার বাড়িতে আপনি অনন্তকাল থাকবেন আর আমি কয়েকটা টাকার বিনিময়ে প্যাট প্যাট করে তা দেখব, নো, তা হতে পারে না। বেশি ভাড়া চাইছি না, ঠিক এগারোটি মাস থাকুন, তারপর কেটে পড়ুন।’

সমীরপতি তাতেই রাজি হলেন। অনেকদিন থেকেই মনে হচ্ছিল কোনো নির্জন জায়গায় কয়েক মাস থাকলে কেমন হয়! যেখানে কলকাতার হইচই, মিছিল, রাস্তার ট্রাফিকজ্যাম থাকবে না। স্ত্রীকে বললেন কথাটা। শোনামাত্র তিনি তীব্র প্রতিবাদ করলেন, ‘অসম্ভব! সব ছেড়ে ছুড়ে আমি ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে গিয়ে থাকতে পারব না। তোমার ইচ্ছে হয়েছে, তুমি যাও।’

সমীরপতি স্বস্তি পেলেন না, বললেন, ‘তোমাকে ফেলে গেলে দুশ্চিন্তায় ভুগব।’

‘রোজ দুপুরে একটা ফোন করলেই চিন্তা দূর হবে। সবাই তো তাদের বাড়িতে যেতে বলে, তুমি আছ বলে যেতে পারি না। এই সময়টা আমি এর বাড়ি ওর বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন থেকে আসতে পারি। আহা, কী খুশি হবে সবাই।’ স্ত্রী বললেন।

বাড়িওয়ালা থাকেন শহরে। বাড়ি দেখা—শোনার দায়িত্ব দিয়েছেন যার ওপর তার স্ত্রী এসে দুবেলা রান্না—পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে। সকালের গাড়িতে স্টেশনে নেমে একটা অটোরিকশা ভাড়া করে সমুদ্রের ধারের বাড়িতে চলে এলেন সমীরপতি। কথা হয়ে ছিল, কেয়ারটেকার দরজা খুলে দিল। ঘরদোর দেখিয়ে বলল, ‘আমার বউ কাল থেকে রান্না করে দিতে পারে। আজ আপনাকে দোকানের খাবার খেতে হবে।’

‘কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু খাবারের দোকান কত দূরে?’

‘আপনি কি নিরামিষ খান?’

‘দুটোই চলে।’

‘তাহলে চিন্তা করবেন না। আমি বলে দেব। ওরা দুপুরের খাবার একটার মধ্যে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। ভাত ডাল ভাজা তরকারি আর মাছের ঝোল। মাছ না খেলে দু—রকমের তরকারি আর চাটনি।’ কেয়ারটেকার জানাল।

‘তাহলে আজ মাছটা থাক। নিরামিষ দিতে বলো।’

‘এখানে চুরিচামারির কোনো ভয় নেই। তবে রাত্রে দরজা বন্ধ করে শোবেন।’

‘চুরি যখন হয় না, তখন—।’

‘সামনেই তো ঢেউ দেখছেন। রাত্রে ভয়ংকর হয়। তখন সমুদ্র থেকে কোনো প্রাণী তো উঠে আসতেই পারে। তাই সতর্ক থাকা ভালো। আর একটা কথা—।’ বলে লোকটা সমুদ্রের দিকে তাকাল, ‘বাবু, সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে গত দু—বছরে তিন— তিনজন মার গিয়েছে। চোরা ঢেউ টেনে নিয়ে গিয়েছে। তাই সমুদ্রে না নামাই ভালো।’

‘কোনখানে হয়েছে ঘটনাগুলো?’

‘এই, এ—বাড়ির সামনে। এখানেই ভাড়া থাকত তারা। আচ্ছা, চলি।’

লোকটা চলে যাওয়ার পর সমীরপতি বাড়িটাকে ভালো করে বুঝে নিলেন। সাজানো ফ্ল্যাট, যেখানে যা দরকার সেখানে তা রাখা আছে। কিচেনে গ্যাস থেকে রান্নার সব সরঞ্জাম সাজানো। টেবিলে ফ্লাস্ক দেখে সেটা খুলে খুশি হলেন তিনি। গরম চা। লোকটা করেছে কিন্তু তাকে বলতে ভুলে গিয়েছে। সমুদ্র নিয়ে কথা বলতে এত মগ্ন ছিল যে চায়ের কথা বেমালুম ভুলেছে। কাপে চা ঢেলে নিয়ে সমীরপতি বারান্দার বেতের চেয়ারে বসলেন। এখানকার সমুদ্রের ঢেউ—এর কাছে দিঘার সমুদ্র লজ্জা পাবে। বিশাল ঢেউগুলো যেন ফুঁসতে ফুঁসতে এগিয়ে এসে তীরের কাছে ভেঙে পড়ছে। কানে তালা লাগানো আওয়াজ। সেইসঙ্গে বইছে দুরন্ত বাতাস। কিছুক্ষণ তাকাবার পরে মনে হয় সমুদ্রের এই রাগী চেহারার কাছে মানুষ কত অসহায়।

ঢেউগুলোতে ছায়া পড়ল। কোথায় ছিল কে জানে, খানিকটা মেঘ ধীরে ধীরে এসে সূর্য আর সমুদ্রের মাঝখানে দেওয়াল তুলতেই  জলের রং বদলে গেল। আর এই রং বদলে যাওয়া ঢেউগুলোকে যেন বেশি হিংস্র বলে মনে হচ্ছিল। পৃথিবীটা যদি মাত্র আধ ইঞ্চি এদিকে ঢলে আসে তাহলে এই বাড়িঘর, সামুদ্রিক শহর এক নিমেষে জলের তলায় চলে যাবে। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম ঘটনা বেশি ঘটলে কেউ সমুদ্রের ধারে বাসা বানাত না।

দুপুরের খাবারটা নেহাত মন্দ ছিল না। কলেজ জীবনটা হোস্টেলে কাটাতে হয়েছিল সমীরপতিকে। এতদিন পরে সেই হোস্টেলের ঠাকুরের রান্নার স্বাদ ফিরে পেলেন তিনি। ওড়িশ্যাবাসীদের রান্নার ধরনে বোধহয় তেমন পার্থক্য থাকে না।

বিকেলে হাঁটতে বের হলেন সমীরপতি। সমুদ্রের এদিকটা একেবারেই ফাঁকা। জলের ধারের বালিতে, সব সমুদ্রের ধারের মতো এখানেও কুচি কুচি লালচে কাঁকড়া ভিড় করে ছিল, তাঁর পায়ের আওয়াজ টের পাওয়ামাত্র এক ছুটে গর্তে গেল। এত দ্রুত ওরা ছুটতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করা যাবে না। আর গর্তের সংখ্যা অগুনতি। যত তিনি এগোচ্ছেন তত এই খেলা চলছে। খানিকটা এগিয়ে পেছনে তাকালে দেখতে পাচ্ছেন তাঁর পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যাওয়া মাত্রই কাঁকড়াগুলো আবার ওপরে উঠে এসেছে।

প্রায় সিকি মাইল হাঁটার পরে দোকানটাকে দেখতে পেলেন তিনি। একটা বড় ঢিবির ওপর দোকান, আশেপাশে কোনো বাড়িঘর নেই। দোকানদার মধ্যবয়সি, সাধারণ মানুষ। তার সামনের বেঞ্চিতে তিনজন বসে আছেন, যাঁর একজন বেশ বৃদ্ধ। সমীরপতি কাছাকাছি হতেই দোকানদার হাত মাথায় ঠেকিয়ে বলল, ‘আসুন বাবু, নমস্কার। কেমন লাগছে।’

‘খুব ভালো। কিন্তু আমাকে—।’ কথা শেষ করলেন না সমীরপতি।

‘এখানে কথা ঢেউ—এর আগে ছোটে। অনন্তবাবুর বাড়িতে নতুন ভাড়াটে এসেছে, আজ হোটেল থেকে খাবার গিয়েছে, এসব তো আমরা জেনে গিয়েছি।’ দোকানদার বলল।

বৃদ্ধ মাথা দুলিয়ে হাসলেন, ‘আমিও আপনার মতন।’

‘মানে বুঝলাম না!’ সমীরপতি বৃদ্ধের দিকে তাকালেন।

‘আমিও আপনার মতো নিরামিষ খাই। মাছ—মাংস—ডিম বাদ দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু পেঁয়াজ রসুন ছাড়তে পাচ্ছি না।’ বৃদ্ধ বললেন।

‘কাকা, দয়া করে ছেড়ো না। তাহলে আমার দোকান তুলে দিতে হবে।’

খুব অবাক হলেন সমীরপতি। এসব খবর নিশ্চয়ই ওই কেয়ারটেকার চারপাশে ছড়িয়েছে। অবশ্য হোটেল থেকেও এরা জানতে পারে। তিনি দেখলেন এটা সেই অল—ইন—ওয়ান ধরনের দোকান। প্রয়োজনীয় সব জিনিস এই দোকানে পাওয়া যায়। কিন্তু কাছাকাছি কোনো বাড়ি নেই, দোকান চলে কী করে!

প্রশ্নের উত্তর পেতে দেরি হল না। দোকানের ভেতর থেকে টেলিফোনের রিং—এর আওয়াজ ভেসে এল। দোকানদার হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে কথা বলতে বলতে কাগজে কীসব লিখে নিয়ে রিসিভার রাখল। তারপর হেসে বলল, ‘হারানদা, তোমার কাজ এসে গিয়েছে।’

‘কোন হোটেল?’

‘সাগরবিলাস। প্রায় বাইশশো টাকার মাল। তুমি দুশো রাখলে সাড়ে চব্বিশ শো নিয়ে এসো। ওরে হরিপদ, ভালো করে কাগজে যা লেখা আছে তা প্যাক করে হারানদাকে দে।’

দোকানের ভেতর থেকে একটা বেঁটে কিন্তু শক্তসমর্থ লোক এসে কাগজটাকে নিয়ে আবার চলে গেল। দোকানদার বলল, ‘শুনলাম, কাল থেকে আপনার বাড়িতে রান্না শুরু হবে। যা নেওয়ার নিঃসংকোচে নিয়ে যেতে বলবেন। একটা বাড়তি পয়সা নেব না। ইচ্ছে করলে বাবু মাস গেলে দাম দিতে পারেন। কোনো চিন্তা নেই।’

‘না, না, আমি ধারবাকিতে বিশ্বাস করি না। নগদ টাকা দিয়ে যা নেওয়ার নিয়ে যাব।’ সমীরপতি বললেন, ‘আচ্ছা, এই সমুদ্রে স্নান করা কি খুব বিপজ্জনক?’

সামনের বেঞ্চিতে বসা বৃদ্ধ বললেন, ‘জল যেমন মানুষের বন্ধু তেমনি শত্রুও। ওপরে ঢেউ দেখছেন, ভয়ংকর ঢেউ, কিন্তু তার নীচে আছে চোরা স্রোত। অজগরের মতো পাক দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওসব সামলে কেউ কেউ সাঁতার কাটে বটে, হিম্মত আছে তাই কাটে।’

দোকানদার মাথা নাড়ল, ‘না বাবু,  জলে না নামাই ভালো।’

সমীরপতি বললেন, ‘এদিকের সমুদ্রে তো হিংস্র জন্তু থাকার কথা নয়, তাই না?’

দোকানদার মাথা নাড়ল আবার, ‘না, কুমির বা জলহস্তীকে কেউ দ্যাখেনি।’

বৃদ্ধ বলল, ‘তবে রাতবিরেতে বাইরে না বের হওয়াই ভালো। রাতের অন্ধকার তখন সমুদ্রের তলার অন্ধকারে মিশে যায়। কী দরকার তখন সেসব দেখার!’

মাথা নেড়ে আর একটু হেঁটে বাড়ি ফিরে এলেন সমীরপতি। হাওয়া দিচ্ছে সোঁ সোঁ করে। বাড়ির কাছাকাছি এসে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। অজস্র কুচিকুচি কাঁকড়া একটা বড়, বেশ বড় কাঁকড়াকে যেন গার্ড করে তলায় নিয়ে যাচ্ছে। মৌমাছির চাকে যেমন রানি মৌমাছি থাকে, তেমনি বোধহয় এই খুদে কাঁকড়াদেরও রানি কাঁকড়া আছে। নির্জন সমুদ্রের ধার দিয়ে রানি কাঁকড়া হয়তো ভ্রমণে বেরিয়েছে। কিন্তু কাঁকড়াদের বালির নীচে পালিয়ে যাওয়ার যে গর্ত তা খুব সরু। ওই বড় কাঁকড়ার শরীর তো সেখান দিয়ে নীচে যেতে পারবে না। সমীরপতির মনে হল পায়ের আওয়াজ টের পেতেই রানি কাঁকড়া নিশ্চয়ই সমুদ্রের জলে নেমে যাবে।

তিনি এগোনোমাত্র ক্ষুদেগুলো প্রাণের ভয়ে দৌড়ে যে যার গর্তে ঢুকে পড়ল। রানি কাঁকড়া রয়ে গেল যেখানে ছিল। সমীরপতি কাছে গিয়ে হেসে ফেললেন। হাত বাড়িয়ে যেটাকে চোখের সামনে আনলেন সেটা একটা মৃত কাঁকড়ার খোল। তার শরীরের সব মাংস উধাও হয়ে গিয়েছে। এবং এই ঘটনাটা যে বেশ কিছুদিন আগে ঘটেছে তা খোলটার শুকনো চেহারা দেখলেই বোঝা যায়। কথা হল, ওই ক্ষুদেগুলো ওই শুকনো খোলটাকে নিয়ে যাচ্ছিল কোথায়!

শোপিসের মতো বারান্দার একপাশে খোলটাকে রেখে ভেতরে ঢুকলেন সমীরপতি।

রাতের খাওয়া তাড়াতাড়ি হয়েছিল। হোটেলের ছেলেটা দিয়েছিল সন্ধের পরে। হাওয়ার ধাক্কায় বারান্দায় বসা যাচ্ছিল না। ঘরের ভেতর জানলার পাশে চেয়ার টেনে বসে সমুদ্র দেখছিলেন সমীরপতি। কী শান্তি!

বাথরুম যাওয়ার প্রয়োজন হতে বুঝলেন, তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখলেন রাত গভীর হয়েছে। ঘড়ির কাঁটা একটা বাইশে। এরকম সময়ে ঘুম ভাঙলে চট করে আবার ঘুম আসতে সময় লাগে। বিছানায় না গিয়ে চেয়ারেই বসলেন তনি। আকাশে এখন চাঁদ উঠেছে। ফিনফিনে জ্যোৎস্নায় ভাসছে বালির চর, সমুদ্র। ঢেউ—এর উদ্দাম ভাব খানিকটা কম। এইসময় তার চোখ  জলের কিনারায় যেতেই তিনি সোজা হয়ে বসলেন। ওগুলো কী? পরপর কয়েকটা উঠে আসছে জল থেকে। ভালো করে দেখে বুঝতে পারলেন ওগুলো কচ্ছপ। কিন্তু এত বড় শরীর তাদের যে চট করে বিশ্বাস করতে পারেননি। এক দুই করে আটটা কচ্ছপ গুনলেন সমীরপতি। ওরা এগিয়ে আসছে এই বাড়ির দিকে। জলে ভেজা শরীরগুলোর ওপরে জ্যোৎস্না পড়ায় চকচক করছে। যেতে যেতে হঠাৎ সামনের কচ্ছপটা থেমে গেল। সমীরপতি লক্ষ করলেন ওরা জল থেকে ওঠা মাত্র খুদে কাঁকড়াগুলো যারা বালির ওপর ছুটে বেড়াচ্ছিল তারা উধাও হয়ে গিয়েছে। সামনের কচ্ছপটা তার ভারী শরীর নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে কোনোমতে ওপরে উঠে এল। অবাক হয়ে সমীরপতি দেখলেন বিকেলে রেখে দেওয়া সেই কাঁকড়ার খোলটাকে গপ করে মুখে পুরে চিবিয়ে গিয়ে ফেলল কচ্ছপটা। তারপর নীচে নেমে দলের সঙ্গে বাড়ির পাশে বালির ঢিপির দিকে চলে গেল। জানলা দিয়ে ওপাশটা দেখা যাচ্ছিল না। সমীরপতি নিঃশব্দে এপাশের ঘরের জানলায় চলে এলেন। কচ্ছপগুলো এখন বালির ওপর স্থির হয়ে থাকার চেষ্টা করলেও মাঝে মাঝে তাদের শরীর নড়ছে। শেষ পর্যন্ত তারা একটু সরে গিয়ে দুই পায়ে বালি ছিটোতে লাগল। সেই সময় সমীরপতির চোখে পড়ল ডিমগুলো। ডিমের ওপর বালিচাপা দিয়ে কচ্ছপগুলো আবার জলে নেমে গেল। ডিমগুলো বালির তলায় থাকায় এখন দেখা যাচ্ছে না। কচ্ছপরা ডিম পাড়তে বালিতে উঠে আসে। তারপর কি আর মাথা ঘামায় না? এইসময় দুটো বড় চেহারার রাতপাখি তীব্র চিৎকার করতে করতে বালির ঢিপির ওপর পাক খেতে লাগল। সমীরপতি দ্রুত বাড়ি থেকে নেমে চিৎকার করলে পাখি দুটো উড়ে গেল। ওরা নিশ্চয়ই ডিমের অস্তিত্ব টের পেয়েছে। বালির নীচে পড়ে থাকা অসহায় ডিমগুলোর আত্মরক্ষা করার ক্ষমতা নেই। সমীরপতি ডিমগুলোর ওপরে আরও বালি চাপা দিতে লাগলেন যাতে ওরা অক্ষত থাকে।

পরের দিন কয়েকটা কুকুরকে বালির ঢিপির ওপর দেখে বুঝতে পারলেন সমীরপতি ওরা ডিমের গন্ধ পেয়ে গেছে। লোক লাগিয়ে বালির ঢিপির যেখানে ডিমগুলো আছে সেখানে শক্ত করে বেড়া লাগালেন তিনি। মাথার ওপর চ্যাটাই—এর বেড়া দিয়ে দিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল ওদের মায়েরা নিশ্চয়ই রাতের বেলায় আসবে, ডিমের প্রতি টান তো থাকবেই। কিন্তু শেষরাত পর্যন্ত জেগেও তাদের দেখা না পেয়ে খুব হতাশ হলেন তিনি।

সময় কাটাবার এক খেলা পেয়ে গেলেন তিনি। ডিমগুলো বাঁচাতেই হবে। পাখি, কুকুরদের কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না, কিন্তু খুদে কাঁকড়াগুলোকে আর দেখা যাচ্ছে না কেন? শেষ পর্যন্ত কৌতূহলী হয়ে বালি খুঁড়ে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ডিমগুলোর খোলা পড়ে আছে আর তাদের ঘিরে খুদে কাঁকড়াদের শরীর চাক বেঁধেছে। খুঁড়তে খুঁড়তে শেষপর্যন্ত একটা ডিম পেয়ে গেলেন যা অক্ষত। সেটাকে তুলে বাড়ির ভেতর নিয়ে এলেন তিনি।

সমীরপতি অপেক্ষা করে আছেন, কবে তার অতিথিকে তার মায়ের কাছে পৌঁছে দিতে পারবেন।

আঁতাত

মেয়েটা আগে কথা বলত কম, এখন তো মুখ খোলেই না। যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ হয় ল্যাপটপের সামনে, নয় বিছানায়। ওর ঘরে গিয়ে কোনো জিনিসপত্রে কেউ হাত না দেয়, বলে দিয়েছিল যেদিন, সেদিন থেকে মনীষা আর ওই ঘরে ঢোকেন না। ঘরে না ঢুকলেও মেয়েটার কথা ভাবলেই শ্বাস ভারী হয়। সকাল আটটায় মেয়ে বেরিয়ে যায় অফিসে। সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে ওর অফিস। বাসেই যায়। চার্টার্ড বাস পেয়ে গেছে। ফেরে অফিসের গাড়িতে, কখনও সন্ধ্যায়, কখনও একটু রাতে। পঞ্চাশ হাজার টাকার মাইনের অর্ধেকটা দিতে এসেছিল মেয়ে। মনীষা খুশি হলেন, যখন দেখলেন মেয়ের বাবা সেটা নিতে রাজি না হয়ে বললেন, ‘আমার তো কোনো অসুবিধে হচ্ছে না, ওই টাকাটা ব্যাঙ্কে রাখো।’

মেয়ের বাবার নাম নিখিলেশ। সামনের বছর কলেজের চাকরি শেষ হবে। আজ অবধি মনীষাকে গলা তুলে কথা বলেননি। দু’বছর আগে যেদিন মেয়ের বিয়েটা আদালত ভেঙে দিতে অনুমতি দিল, সেদিন মনীষা নিখিলেশের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। নিখিলেশ নিচু গলায় বলেছিলেন, ‘এখন কেঁদে কী হবে!’

‘আমার জন্যে, শুধু আমার জন্যে মেয়েটার ডিভোর্স হয়ে গেল।’ মনীষা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন।

শোনার পরেও কথা বলেননি নিখিলেশ। কিন্তু মেয়েকে ডেকে বলেছিলেন, ‘যা হওয়ার ছিল তা হয়ে গিয়েছে। এখন থেকে কীসে তোমার ভালো হবে, সেটা নিজে ভেবে ঠিক করবে। তোমার জীবনটা একান্ত তোমারই। এটা মনে রেখো।’

মনীষার মাসতুতো দাদা সম্বন্ধটা এনেছিলেন। ছেলে হাওড়ার বেশ বনেদি পরিবারের। নিজেও ভালো চাকরি করে, সুপুরুষও। দেখেই মুগ্ধ হয়েছিলেন মনীষা। জামাই হিসেবে ছেলেটিকে পেলে মেয়ে সুখী হবে ভেবেছিলেন। দু’পক্ষের দেখাশুনা এবং কথা বলাবলির পরে ছেলে মেয়েকে নিয়ে একদিন দামি রেস্টুরেন্টে গিয়ে লাঞ্চ খেয়ে এসেছিল। বিয়ে হল।

মনীষা প্রায়ই মেয়ে—জামাইকে বাড়িতে আসতে বলতেন, ‘শনিবার এসে রবিবারের বিকেলে হাওড়ায় যেয়ো।’ প্রথম কয়েক সপ্তাহ জামাই মেয়েকে নিয়ে এসেছিল। তারপর মেয়ে একাই আসতে লাগল। ব্যাপারটা নিখিলেশ পছন্দ করলেন না। কিন্তু মনীষা বলতেন, ‘আমাদের একটাই সন্তান, ও এলে তোমার আপত্তি হচ্ছে কেন? এটা ওর নিজের বাড়ি, আসবেই তো।’

তারপর এক শনিবারে বাপের বাড়িতে এসে রবিবারের বিকেলে মেয়ে আর শ্বশুরবাড়িতে ফিরে গেল না। বলল, ‘আমি এখানেই থাকব।’

‘থাক না। কিন্তু ওই বাড়িতে কি কিছু হয়েছে?’ মনীষা জিজ্ঞাসা করেছিলেন।

‘না।’ মেয়ে গম্ভীর মুখে বলেছিল।

‘তাহলে?’

‘এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার মা।’ মেয়ে বলেছিল।

রাত্রে স্বামীর কাছে প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন মনীষা। নিখিলেশ বললেন, ‘কিছু হয়ে থাকলে ও যদি মনে করে বলা উচিত, নিজেই বলবে। চাপ দিয়ো না।’

বছর আড়াই পরে এক শুক্রবারে মাঝদুপুরে বাড়ি ফিরে এল মেয়ে। সেদিন কলেজ ছুটি থাকায় বাড়িতেই ছিলেন নিখিলেশ। মেয়ে ঘরে এসে বলল, ‘আজ আদালত থেকে নিষ্কৃতি পেলাম। বিয়েটা আর বোঝা হয়ে থাকল না।’

নিখিলেশ মেয়ের দিকে তাকালেন, ‘এসব কাজ তুমি একাই করলে?’

‘না। আমার সঙ্গে পড়ত সর্বাণী, ও এখন ওকালতি করে। ও—ই করে দিল।’

ঘরে ঢুকছিলেন মনীষা, আঁতকে উঠলেন—’সেকি! তুই ডিভোর্স করলি, আর আমাকে একবারও জানাবার প্রয়োজনবোধ করলি না।’

‘তুমি একটু ভুল বললে মা, আমি একা ডিভোর্স করিনি। দু’জনে একমত হয়েই করেছি। আর জানালে টেনশন করতে, তাই হয়ে যাওয়ার পরে জানালাম।’ মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।

তারপর থেকে মনীষার একটাই চিন্তা, কত কুমারী মেয়ের ভালো বর পাওয়া যাচ্ছে না, ডিভোর্সি মেয়েকে কে বিয়ে করবে। মনীষা স্বামীকে বারংবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘আচ্ছা, ধরো, ওর আবার বিয়ের সম্বন্ধ এল। তারা তো জানতে চাইবে কেন ডিভোর্স হয়েছিল? তার জবাবে কী বলব?’

‘কিছুই বলবে না।’ নিখিলেশ বলেছিলেন।

‘তার মানে?’

‘ওর বিয়ের ব্যাপারে মাথা না ঘামালে প্রশ্নটার উত্তর তোমাকে দিতে হবে না।’

কিন্তু হাল ছাড়েননি মনীষা। বোনের ছেলে শৈবাল তাঁর খুব প্রিয়। তাকে দিয়ে শাদি ডট কম, বিয়ে ডট কমে বিজ্ঞাপন দিলেন। একটু অসত্যির আশ্রয় নিলেন। লিখলেন, বিবাহমাত্র বিচ্ছিন্না। কিন্তু যেসব পাত্রের সন্ধান পাওয়া গেল, তাদের কাউকে পছন্দ হল না তাঁর। কেউ সন্তানকে নিয়ে ডিভোর্সি, কেউ অবিবাহিত কিন্তু বয়স পঞ্চাশের আশপাশে।

এক রবিবারের সকালে চা খাওয়ার সময় মেয়ে বলল, ‘তোমরা সামনের শনিবারের বিকেলে কি কোথাও যাচ্ছ?’

মাথা নেড়ে ‘না’ বললেন নিখিলেশ। মনীষা জানতে চাইলেন, ‘কেন রে?’

‘তোমাদের সঙ্গে আলাপ করতে একজন আসতে চায়। সঙ্গে অবশ্য ওর বাবা—মা থাকবে।’ মেয়ে বলল।

‘সেকি!’ মনীষা উল্লসিত—’কখনও তো বলিসনি। কোথায় থাকে ওরা?’

‘সল্টলেকে থাকেন বাবা—মা। ছেলে থাকে সিডনিতে।’ মেয়ে বলল।

‘তোর সঙ্গে কী করে আলাপ হল?’

‘ফেসবুকে।’

‘সিডনিতেই চাকরি করে?’

‘হ্যাঁ।’

‘তোর সঙ্গে কথা হয়?’

‘বা রে! কেন হবে না? রোজই কথা হয়।’

মনীষার উৎসাহ বেড়ে গেল। স্বামীকে বললেন, ‘তুমি অমন গোমড়া মুখ করে বসে থেকো না। আমার ঠিকুজিতে বিদেশ ভ্রমণ ছিল। ভাবতাম, কথার কথা। ভগবান এতদিনে সেটাকে সত্যি করে দিচ্ছেন।’ নিখিলেশ তাকালেন, কিছু বললেন না।

মনীষা মেয়েকে বললেন ছেলেটি কী কী খেতে ভালোবাসে তা জেনে নিতে। একদিন পরে মেয়ে জানাল, ‘ও সব খায়। তুমি যা দেবে তাতে না বলবে না।’

বিকেলে চায়ের আসর কিন্তু মনীষা পদ করলেন জবর। ছেলে এল, সঙ্গে মা—বাবা। চেহারা দেখেই বোঝা যায় অত্যন্ত অভিজাত পরিবারের মানুষ ওরা। ছেলেটি তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলে মনীষার বুক জুড়িয়ে গেল। গল্পে গল্পে সময় কেটে গেল ভালো। যাওয়ার সময় ছেলের মা বললেন, ‘একবার ঝড় গিয়েছে, আর যেন সেটা না হয়।’ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ

‘মানে?’ মনীষা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘ওর আগের বিয়েটা ঠিকঠাক হয়নি। অবশ্য ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে তিন বছর আগে।’ ছেলের মা বললেন, ‘আপনার মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছে আর ভুল হবে না।’

ওঁরা চলে যাওয়ার পরে মনীষা মেয়ের দিকে তাকালেন—’ও যে ডিভোর্সি তুই জানতিস?’

‘হ্যাঁ, কেন জানব না!’ মেয়ে বলল।

‘ডিভোর্সটা হয়েছিল কেন?’

‘জানি না।’

‘আশ্চর্য! যাকে পছন্দ করছিস তার কেন ডিভোর্স হল জানতে চাইবি না?’ মনীষা অবাক হয়ে গেলেন—’হয়তো খুব মদ খায়। মারধর করে। বাইরে ধর্মাশোক, ভেতরে চণ্ডাশোক তো অনেক পুরুষ হয়ে থাকে।’

‘হতে পারে!’

‘ওর বউ কি অস্ট্রেলিয়ার মেয়ে?’

‘ওর এক্স বউ বল। মা, এখানকারই। ইনকাম ট্যাক্স অফিসার।’

মেয়ের পেট থেকে আর কোনো খবর বের করতে পারলেন না মনীষা।

নিখিলেশকে বললেন, কোনো লাভ হবে না। কিন্তু মেয়ের জীবনে আর একটা ধাক্কা যেন না আসে, সেজন্যে ওদের ডিভোর্সের কারণটা জানতেই হবে বলে ঠিক করলেন মনীষা। ছেলেটির এক্স স্ত্রী ইনকাম ট্যাক্সের অফিসার। শুধু এই তথ্য নিয়ে কীভাবে তাকে খুঁজে বার করা যায়! সেই মেয়েই বলতে পারবে ছেলেটি কতখানি বদ। তাই বোনের ছেলে শৈবালের শরণাপন্ন হলেন মনীষা। শৈবাল বলল, ‘আমার এক বন্ধু ইনকাম ট্যাক্সে চাকরি করে। দাঁড়াও, খবর নিতে বলছি।’

‘কী করে বুঝবে কোন মেয়ে?’

‘নিশ্চয়ই দেখতে খারাপ নয়। বয়সও বেশি হতে পারে না। এরকম একজন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার মহিলা, যাঁর ডিভোর্স হয়েছে এই খবর নিশ্চয়ই চাপা থাকবে না।’ শৈবাল তার মাসিকে আশ্বস্ত করল।

সাতদিনের মাথায় ফেলুদার মতো তৎপর শৈবাল মহিলার খবর শুধু নিয়ে এল না, তাঁর মোবাইলের নাম্বারও এনে দিল। সরকারি অফিসে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা বিয়ে করলে বা ডিভোর্স হলে অফিসকে জানাতে বাধ্য থাকেন। শৈবালের বন্ধু তার সূত্র ব্যবহার করে মহিলার প্রাক্তন স্বামীর যে নাম পেয়েছে, তা জেনে খুশি হলেন মনীষা। সন্দেহ থাকল না, এই ছেলেটি তাঁদের বাড়িতে এসেছিল।

মনীষার তর সইছিল না, তবু রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। অফিসের দিনে নিশ্চয়ই মেয়েটি ব্যস্ত থাকবে, এই সময় বিরক্ত করা উচিত নয়। রবিবারে ফোন করলেন তিনি। মেয়েটির গলা পেলেন—’হ্যালো!’

‘আমি কি রচনার সঙ্গে কথা বলছি?’ মনীষা জিজ্ঞাসা করলেন।

‘হ্যাঁ। আপনি কে বলছেন?’

‘আমাকে আপনি চিনবেন না।’

‘কিন্তু কে ফোন করছেন সেটা তো বলবেন!’

‘নিশ্চয়ই। আমি তোমাকে তুমি বলছি ভাই।

তোমার মায়ের বয়সি আমি।’

‘আপনি কিন্তু এখনও পরিচয় দিচ্ছেন না!’

‘বলছি। আমার মেয়ে একটি ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে, তাকে বিয়ে করতে চাইছে। আমরা জানতে পারলাম, ছেলেটি ডিভোর্সি। হ্যালো—।’

‘বলুন!’

‘হ্যাঁ, তারপর জানলাম, সেই ছেলের সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছিল। নিশ্চয়ই এমন কোনো মারাত্মক ঘটনা ঘটেছিল যে, তুমি ডিভোর্স করতে বাধ্য হয়েছিলে। বাঙালি মেয়েরা তো চট করে সংসার ভাঙতে চায় না। এখন ওই ছেলের সঙ্গে আমার মেয়ে সংসার করতে চাইছে, ওর জীবনেও যদি ওরকম ঘটনা ঘটে, বুঝতেই পারছ, মা হিসেবে আমার ভয় হবেই। তাই তোমাকে ফোন করছি, তোমাদের ডিভোর্স কেন হয়েছিল যদি বল তাহলে খুব উপকার হয়।’

‘আশ্চর্য!’ মেয়েটি বলল, ‘আপনার মেয়ে যার সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছে তাকেই জিজ্ঞাসা করুন, আমাকে কেন বিরক্ত করছেন!’

‘ওই তো মুশকিল, ওকে এসব প্রশ্ন করলে মেয়ে অসন্তুষ্ট হচ্ছে। আমি তোমার মায়ের মতো, আমাকে বলো। তাছাড়া, ছেলেটা তো মিথ্যে বলতেও পারে।’

‘দেখুন, এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এ নিয়ে আমি কথা বলতে রাজি নই।’ ফোন বন্ধ করে দিল মেয়েটি।

হতাশ হলেন মনীষা। ডিভোর্স হওয়ার পর এত চাপাচাপি কেন? তাহলে কি এই মেয়েটিরই দোষ ছিল? কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্রী তিনি নন। আবার কয়েকদিন পরে ফোন করলেন মনীষা। মেয়েটি একটু রুষ্ট হয়ে এড়িয়ে গেল। তাতেও দমে গেলেন না মনীষা। দিন পনেরো পরে আবার ফোন করলেন, ‘মা, আমি ঘুমোতে পারছি না, তুমি আমাকে এড়িয়ে যেয়ো না, প্লিজ!’

মেয়েটি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল।

মনীষা বললেন, ‘বলো মা, আমাকে সাহায্য করো।’

মেয়েটি বলল, ‘ঠিক আছে, শুনুন। সে অক্ষম, পুরুষত্বহীন।’ বলেই লাইনটা কেটে শুধু দিল না, মনীষা দেখলেন মেয়েটি ফোনের সুইচ অফ করে দিল। হতভম্ব হয়ে বসে থাকলেন তিনি। তারপর কেঁদে উঠলেন সশব্দে। কান্না শুনে নিখিলেশ ঘরে এলেন—’কী হল?’

কাঁদতে কাঁদতে মনীষা বললেন, ‘আবার খুকির ডিভোর্স হবে গো।’

‘বিয়ের আগেই ডিভোর্স হয়ে যাবে?’ নিখিলেশ অবাক।

এবার গড়গড় করে মনীষা যা শুনেছেন তা—ই বলে গেলেন।

নিখিলেশ বললেন, ‘তোমার যদি মনে হয় খুকিকে সতর্ক করা দরকার। কর।’

‘নিশ্চয়ই দরকার, একশোবার দরকার। আসুক সে।’

রাত্রে বাড়ি ফিরতেই মেয়েকে তাঁদের ঘরে আসতে বললেন মনীষা। মেয়ে অবাক হল—’কী ব্যাপার? খুব জরুরি মনে হচ্ছে?’

‘হ্যাঁ শোন, এই ছেলেকে তুই ভুলে যা।’ মনীষা কঠোর গলায় বললেন।

‘ওমা, কেন?’

‘ও তোর উপযুক্ত নয়।’

‘কী করে বুঝলে?’

‘আহা, যা বলছি, তাই শোন।’

‘তোমার কথার পেছনে যে—যুক্তি আছে সেটা বলো।’

মনীষা স্বামীর দিকে তাকালেন—’তুমি বলো।’

নিখিলেশ শান্ত গলায় বললেন, ‘তোমার মা খবর নিয়ে জেনেছেন, এই ছেলেটি অত্যন্ত শীতল, যৌনশক্তিহীন। তাই—’

হঠাৎ খিলখিল করে হেসে মেয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা কী করে জানলে?’

‘তার মানে? যে করেই হোক জেনেছি। তুই হাসছিস কেন?’ মনীষা বললেন।

‘কারণ, আমি অনেকদিন আগেই জেনেছি।’ মেয়ে বলল।

‘অ্যাঁঃ সেকি!’ মনীষার চোখ কপালে উঠল—’জেনেও বিয়ে করতে চাইছিস?’

‘আমি তো এরকম একজনকে খুঁজছিলাম।’

‘শুনছ!’ আঁতকে উঠলেন মনীষা।

‘এমন একজন যাকে ভালোবাসতে পারব, এ সেই ছেলে। বিয়ের পর ভিসা পেলেই আমি সিডনিতে গিয়ে থাকব।’

‘আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’ মনীষা দু’হাতে মুখ ঢাকলেন।

‘তোমরা জানতে চেয়েছিলে কেন আমি ডিভোর্স চেয়েছিলাম, বলিনি। নিজেই সব ব্যবস্থা করেছিলাম। এখন বলছি। ওই বিয়ের পর বুঝতে পারলাম, আমি সেক্স সহ্য করতে পারছি না। তোমাদের সেই জামাই আমাকে ফ্রিজিড ওম্যান বলেছিল। সে নিস্তার চেয়েছিল বলে ডিভোর্স পাওয়া সহজ হয়েছিল। ভেবেছিলাম, বাকি জীবন একাই থাকব। কিন্তু হঠাৎ ফেসবুকে এই ছেলেটির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর বুঝলাম, ও আমারই মতো। ওর সঙ্গে সারাজীবন থাকা যায়। তোমরা এ নিয়ে ভেব না, আশীর্বাদ করো, এবার যেন ভালো থাকি।’ মেয়ে চলে গেল নিজের ঘরে।

নিখিলেশ হাসলেন, ‘ভালো, এরকম আঁতাত কদাচিৎ হয়।’

ফ্যামিলি পাবের সুন্দরী

লাস ভেগাস থেকে নিউইয়র্ক শহরে যাচ্ছিলাম। গ্রে—হাউন্ড বাসে চেপে। শুনেছিলাম ওই দূরত্ব একটানা গেলে শরীর তো খারাপই হয়, অনেকের নার্ভের সমস্যাও হয়। প্রায় সারাদিন বাসে বসে না থেকে ঠিক করেছিলাম যে জায়গা ভালো লাগবে সেখানেই নেমে যাব। দশ দিন যে কোনো গ্রে—হাউন্ড বাসে যাওয়া যাবে এমন টিকিট কাটায় নামা ওঠার সমস্যা ছিল না। রুক্ষ প্রকৃতি দুধারে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসে বসে দেখতে মন্দ লাগছিল না। হঠাৎ প্রকৃতির চেহারা পালটে যেতে লাগল। ক্রমশ বরফে ঢাকা যে শহরে গিয়ে বাস জিরোবার জন্য থেমেছিল তার নাম ডেটন, নেমে পড়েছিলাম। গ্রে—হাউন্ড বাস টার্মিনাসের ভিতর ঠান্ডা নেই যন্ত্রের কারণে। বাইরে শূন্য ডিগ্রির নীচে। এরকম পরিবেশে কখনও থাকিনি বলে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম। জিজ্ঞাসা করে জানলাম বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটলেই অনেক মোটেল পেয়ে যাব।

চাকাওয়ালা স্যুটকেস নিয়ে বাইরের রাস্তায় পা দিতেই জুতো বরফের নীচে। স্যুটকেসের চাকা অকেজো। শুধু বরফ বলেই টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছিল। মোটেলগুলো চোখে পড়ল। তখন প্রায় বিকেল। আকাশে মেঘ থাকায় রোদ নেই। সবকিছু ছায়া ছায়া। কিন্তু মোটেলগুলোর গায়ে নিওন আলোয় লেখা ‘নো রুম। ফুল।’

শেষপর্যন্ত যে মোটেলে ঘর পেলাম তার ভাড়া দৈনিক পঁয়ত্রিশ ডলার। পরিচ্ছন্ন ঘর, টয়লেট, বিছানার চাদর ধবধবে। জামাপ্যান্ট পরেই শুয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর খিদেটাকে টের পেয়ে উঠে বসলাম। এই মোটেলে ঢোকার সময় কোনো রেস্টুরেন্ট নজরে পড়েনি। আপাদমস্তক গরম পোশাকে মুড়ে বাইরে বেরুতেই দেখলাম প্যাসেজেও বরফ জমছে। পা ফেলতেই অনেকটা পিছলে কোনোমতে সোজা হলাম। বুঝলাম, অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটা বোকামি হবে এখানে।

রিসেপশনিস্ট লোকটি দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করানো কফি তৈরির মেশিন দেখিয়ে বলল, যত ইচ্ছে কফি খান, দাম দিতে হবে না। খাবার খেতে হলে আপনাকে ফ্যামিলি পাবে যেতে হবে।’

ইংরেজি গল্প উপন্যাসে ফ্যামিলি পাবের কথা পড়েছি। খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করে জানলাম দশ মিনিটের পথ। শুকনো রাস্তায় যা দশ মিনিট বরফ ভেঙে গেলে তা পঁচিশ মিনিট লাগতে বাধ্য। সন্ধের সময় যায়নি, রাত নামে বোধহয় দেরিতে। রাস্তায় একটা মানুষ দূরের কথা, প্রাইভেট গাড়িও নেই। মাঝে মাঝে পরপর দুটো বড় বাস বরফ গুঁড়িয়ে চলে গেল। আধঘণ্টা পরে ফ্যামিলি পাবের আলো দেখতে পেলাম। সব জানলা—দরজা বন্ধ। একটা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই ব্যাঞ্জোর আওয়াজ কানে এল। অল্প আলোয় টেবিলে টেবিলে কিছু মানুষ বসে সেই বাজনা শুনছেন। উলটোদিকের বার কাউন্টারে সামনের লম্বা টুলে কয়েকজন বসে। আমি সেদিকে এগিয়ে যতেই কাউন্টারের ওপাশে দাঁড়ানো বারম্যান হাসল, ‘গুড ইভনিং, স্যার। আমাদের এই পাবে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি। আপনার যেখানে ইচ্ছে সেখানে বসতে পারেন।’

‘ধন্যবাদ’ বলে সামনের লম্বা টুল টেনে তার ওপর বসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখন কিছু খেতে চাই। কী পাওয়া যাবে?’

লোকটি উত্তর দেওয়ার আগে পাশে বসা এক বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘খিদে কীরকম?’ মোটামুটি।

বৃদ্ধ বারম্যানকে যে খাবার আনতে বললেন তার নাম আমি কখনও শুনিনি। তাছাড়া ওর কথার টান অন্যরকম হওয়ায় ইংরেজি বুঝতে অসুবিধে হল। কিন্তু আমার সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি সেই টানটা ব্যবহার করলেন না। ‘আপনি কোন দেশের মানুষ?’

‘ইন্ডিয়া।’

‘মাই গড! ইউ আর ফ্রম দি কান্ট্রি অফ ইন্দিরা?’ বৃদ্ধ চেঁচিয়ে বললেন।

সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের সবাই হাত তুলে আমাকে ‘হ্যালো’ ‘হ্যালো’, বলতে লাগল। বুঝলাম সেই কবে খুন হওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখনও এঁদের কাছে প্রিয় মানুষ। ওই মুহূর্তে আমি ভুলে গেলাম জরুরি অবস্থার কথা, বরুণ সেনগুপ্ত— গৌরকিশোর ঘোষের কারাবাসের কথা। ইন্দিরাই যেন ইন্ডিয়া হয়ে গিয়েছে এঁদের কাছে।

খাবার এল। আমার কোনো জানা খাবার নয়, কিন্তু খুব সুস্বাদু। পাশে বসা বৃদ্ধ বললেন, ‘এর সঙ্গে এখানে তৈরি এক গ্লাস বিয়ার খাও। ভালো লাগবে।’

আপত্তি করলাম না। দিশি বিয়ারের স্বাদ মন্দ নয়।

‘আপনি এই শীত শীত সন্ধ্যায় বিয়ার খাচ্ছেন?’ প্রশ্নটা কানে আসতেই বাঁ দিকে তাকালাম। বেশ সুন্দরী, তারওপর যত্ন করে সাজগোজ করা এক মধ্যবয়সিনি কখন এসে আমার বাঁ দিকে দাঁড়িয়েছেন টের পাইনি। মহিলার সঙ্গে আর কেউ আছেন বলে মনে হল না।

বললাম, ‘উনি বললেন, খেতেও খারাপ নয়।’

‘আপনি বরং এই পাবে তৈরি স্কচ ট্রাই করতে পারেন। বিয়ার তো বৃদ্ধরা পান করে। নিজেকে নিশ্চয়ই বৃদ্ধ মনে করেন না।’ মহিলা হাসলেন।

এতদিন আমেরিকায় ঘুরে জেনে গেছি এখানে হুইস্কিকে স্কচ বলা হয়। তার সঙ্গে স্কটল্যান্ডের কোনো সম্পর্ক নেই। বিয়ার শেষ করে আমি এক পেগ হুইস্কি চাইলাম। বারম্যান জিজ্ঞাসা করল, ‘লার্জ অর স্মল?’

ডানপাশে বসা বৃদ্ধ হো হো করে হেসে বলল, ‘মাইক’ ইনি আমার মতো বৃদ্ধ নন। ওঁকে লার্জ দাও। স্কচ অন রক।’

সঙ্গে সঙ্গে বরফের টুকরোর মধ্যে সোনালি তরল পদার্থ গ্লাসে করে চলে এল সামনে। মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কিছু নেবেন না?’

মহিলা হাসলেন। আঙুল নেড়ে বললেন, ‘আই অ্যাম ফুল। আপনি ট্যুরিস্ট?’

‘হ্যাঁ।’

‘কোথায় উঠেছেন?’

‘মোটেলে। মোটেল ভাস্কো।’

‘বাঃ। আমি ওর পাশেই থাকি।’

পান করতে করতে দেখছিলাম পাশে বসে যাঁরা আড্ডা দিচ্ছেন তাঁদের কারও সঙ্গে মহিলা কথা বলছেন না। পর পর দু—গ্লাস হুইস্কি পান করতে করতে আমি মহিলার অনেক খবর জেনে ফেললাম। দু’বছর আগের সামারে ভয়ানক রোড অ্যাক্সিডেন্টে ওঁর স্বামী এবং ছেলে মারা গিয়েছে। পেছনের সিটে বসেছিলেন বলে সাতদিন হাসপাতালে থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন। ইনস্যুরেন্স থেকে যে ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন তার সুদে বেঁচে থাকা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে অনেকেই তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি।

জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেন?’

মহিলা বললেন, ‘প্রথমত, স্বামীর স্মৃতি ভুলিয়ে দেবে এমন কেউ আসেনি। দ্বিতীয়ত, কাউকে দেখে মনে ভালোবাসা তৈরি হয়নি। কী করব বলুন!’

এরকম অকপট কথা শুনে ভালো লাগল। টেবিলে টেবিলে মানুষ গল্প করছে, পান করছে। কিন্তু চিৎকার নেই, শব্দ বলতে ওই ব্যাঞ্জোর সুর। পাশে বসা বৃদ্ধ বললেন, ‘ওহে, তুমি তো এখানে নতুন। যত রাত বাড়বে তত ঠান্ডাও। আমি এখন বাড়ি ফিরব, তোমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে যেতে পারি।’

বৃদ্ধকে অনেক ধন্যবাদ দিলাম। বললাম না, আমার পাশের সুন্দরী যখন বাড়িতে ফিরবেন তখন তাঁর সঙ্গেই যাব। তিনি তো আমার মোটেল ভাস্কোর পাশেই থাকেন। বৃদ্ধ উঠলেন। দাম মিটিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যে কোনো নতুন জায়গায় নবাগতদের সতর্ক থাকা উচিত। তারপর এমন ঠান্ডার রাত। তোমার সঙ্গে কথা বলে ভারী ভালো লাগল। আমি জানি, আর কখনও আমাদের দেখা হবে না। কিন্তু ঈশ্বর তোমাকে ভালো রাখুন, শুভরাত্রি।’

ঘড়িতে যখন রাত দশটা তখন মহিলা বললেন, ‘আমি একটু টয়লেটে যাচ্ছি।’ তাঁকে চলে যেতে দেখে বারম্যানকে জিজ্ঞাসা করতে জানলাম যে বৃদ্ধ চলে গিয়েছেন তিনি আমার খাবার এবং বিয়ারের দাম মিটিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু হুইস্কির দাম দেননি। বারম্যান হেসে বলল, ‘উনি স্কচ পছন্দ করেন না!’

আমি হুইস্কির দাম দিতেই বারম্যান বলল, ‘গুড নাইট। আপনার মোটেলে ফিরে যেতে অসুবিধে হবে না তো? ওখানে মিস্টার মরিশন বসে আছেন, ঠিক এগারোটার সময় বাড়ি ফেরেন, আপনি ওঁর সঙ্গে ফিরতে পারেন।’

বললাম, ‘অনেক ধন্যবাদ। মোটেলে ফিরতে আমার অসুবিধে হবে না।’ একটু অপেক্ষা করে ফ্যামিলি পাবের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই মনে হল ভয়ংকর ঠান্ডা আমাকে কাঁপিয়ে দিল। চারধারে বরফ আর সেই সঙ্গে কনকনে বাতাসের চাবুক। ধাতস্থ হতে সময় লাগল। মহিলা এতক্ষণ টয়লেটে কী করছেন কে জানে? কিন্তু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকাও যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করলাম। সাদা বরফের ওপর ফিনফিনে চাঁদের আলো পড়ায় চারপাশ রূপকথার মতো মনে হচ্ছে। তবে ঠান্ডা যদি একটু কম হত—!

হঠাৎ পেছন থেকে মহিলার গলা ভেসে এল, ‘খুব দুঃখিত। একটু দেরি হয়ে গেল।’ আমি দাঁড়ালাম। মহিলাদের ঠান্ডাবোধ কম বলে শুনেছি। এঁর বোধহয় বেশ কম। পাবের ভেতর স্বাভাবিক উত্তাপে যে পোশাকে ছিলেন তাই পরে বেরিয়ে এসেছেন। পাশে হাঁটতে শুরু করে মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন লাগছে?’

‘খুব সুন্দর শুধু ঠান্ডাটা যদি না থাকত।’ বললাম।

‘এই তো জীবন। শুধুই ভালো, শুধুই আনন্দ কখনওই পাওয়া যায় না। ওদের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ, দুঃখ এসে পড়বেই। অবশ্য জীবনটা যদি আনন্দে ভরা হত তাহলে হয়তো ভালো লাগত না। একঘেয়ে মনে হত।’

‘বাঃ, সুন্দর কথা বলেন আপনি।’

‘আপনার ব্যবহারও সুন্দর। আচ্ছা, আমরা কেউ কারও নাম জানি না তাই না?’

নিজের নাম বললাম। শুনলাম তাঁর নাম অ্যানিটা।

অ্যানিটা বললেন, ‘এই যে আপনি যদি এই জায়গায় চিরটাকাল থেকে যেতেন তাহলে আমি একজন ভালো সঙ্গী পেয়ে যেতাম।’ সত্যি কথাই বললাম, ‘থাকতে পারলে ভালো হত।’

আমাকে মোটেলের দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে অ্যানিটা ‘গুড নাইট’ বলে চলে গেলেন। মদ্যপানের কারণেই ঘুম এল তাড়াতাড়ি।

সকালে মোটেল থেকে চেক আউট করার সময় মনে হল অ্যানিটার সঙ্গে যদি আর একবার দেখা করে যেতাম তাহলে ভালো লাগত। তাছাড়া ওকে আমরা টেলিফোন বা ই—মেল নাম্বারটা দিলে যোগাযোগ হতে পারত। রিসেপশনিস্টকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি এখানে কতদিন আছেন?’

‘আট বছর।’ লোকটা গম্ভীর গলায় বলল।

‘আপনাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?’

‘বলুন!’

‘আমি আমার টেলিফোন আর ই—মেল একটা কাগজে লিখে দিচ্ছি। অনুগ্রহ করে যদি আপনাদের এক প্রতিবেশিনী মহিলার কাছে পৌঁছে দেন! ওঁর সঙ্গে গত রাতে এখানকার ফ্যামিলি পাবে আলাপ হয়েছিল।’

লোকটার কপালে ভাঁজ পড়ল, ‘ঠিকানা কী?’

‘জিজ্ঞাসা করা হয়নি। বললেন এই মোটেলের কাছেই থাকেন। ভদ্রমহিলার নাম অ্যানিটা। পদবি জানি না।’

চোখ বন্ধ করে বোধহয় মনে করার চেষ্টা করছিল লোকটা। ওকে সাহায্য করার জন্য বললাম, ‘দু’বছর আগে ওঁর স্বামী আর ছেলে মোটর দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছেন। উনি ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন।’

এবার লোকটি চোখ খুলল, ‘তাই বলুন। দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল ওই ফ্যামিলি পাবের সামনে। একটা লরির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে ওঁরা মারা গিয়েছিলেন।’

‘কিন্তু ভদ্রমহিলা—!’

আমাকে থামিয়ে রিসেপশনিস্ট বলল!’ ‘হ্যাঁ, তিনিও। তাঁর নাম অ্যানিটা। মাঝে মাঝে এই মোটেলে ঢুকে কফি খেতেন। অবশ্য অনুমতি নিয়েই খেতেন। ওদের বাড়িটা ভদ্রলোকের ভাই বিক্রি করে দিয়েছেন। কিন্তু আপনি অ্যানিটাকে মিট করলেন কী করে?’

আমি আর দাঁড়ালাম না। বরফের ওপর দিয়ে স্যুটকেসটাকে প্রাণপণ টানতে লাগলাম গ্রে—হাউন্ড বাস স্টেশনে পৌঁছবার জন্য। প্রতি মুহূর্তে ভয় হচ্ছিল পেছন থেকে গলা ভেসে আসবে, ‘খুব দুঃখিত। একটু দেরি হয়ে গেল!’

হে বৃক্ষনাথ

‘জয় বৃক্ষনাথ, তোমার দয়ায় এই পৃথিবী এখনও সন্তান প্রসব করে যেতে পারছে। তোমাকে শত কোটি প্রণাম।’ ভোররাতে ঘুম ভাঙার পর, সেই ঘর— যা পঁচিশ বছর আগে কোনোরকমে মাথা গোঁজার জন্য বানিয়েছিলেন শ্রীপতি, বেরিয়ে এসে সমস্ত শরীর মাটিতে বিছিয়ে প্রণাম করার সময়, মন্ত্র উচ্চচারণের মন নিয়ে শব্দগুলো চারপাশে ছড়িয়ে দিলেন। তখন কয়েকশো পাখি দিন ফোটার আনন্দে লক্ষ লক্ষ গাছের ডাল থেকে ডালে লাফিয়ে লাফিয়ে আনন্দের চিৎকার করে চলেছে। শ্রীপতি খুশি হলেন। ওই পাখিরাও তাঁকে নকল করে বলে চলেছে, ‘জয় বৃক্ষনাথ, জয় বৃক্ষনাথ!’

বৃক্ষের কোনো লিঙ্গ নেই। তাঁর ইচ্ছেমতো তিনি পিতা হতে পারেন, ইচ্ছে বদলে গেলে, মাতা। তিনি ভগবান! তিনি ফুল দেন, ফল দেন। পাতা, ডাল থেকে শেকড় —সবই তাঁর দান, যা পাখি থেকে মানুষকে সমৃদ্ধ করে। তাঁর শরীর থেকে নির্যাস বের করে মানুষ নিজের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে মজবুত করে। এখন শ্রীপতির সামনে—পিছনে তিন লক্ষ বৃক্ষ আর তরু। আহা, সব তরু যদি বৃক্ষ হয়ে উঠতে পারত!

পঁচিশ বছর আগে এই ভূখণ্ড ছিল পাথুরে। মাটি খুঁজতে পাথর সরাতে হত। টাটা থেকে বান্দোয়ান হয়ে গালুডি যাওয়ার পথে এক দুপুরে মনে হয়েছিল, এখানকার পৃথিবী বড় খাঁ—খাঁ। মানুষ নেই কোথাও। তাদের গ্রাম অনেক দূরে। এই সরু পিচের রাস্তার দু’পাশে আদিম কাল যেন অভুক্ত হয়ে নেতিয়ে রয়েছে। কীরকম মায়া লেগে গেল মনে। ঘোরও লাগল। জমির দাম কত?  জলের চেয়ে সস্তা। বছরে মাস দেড়েক ছিঁটেফোঁটা ছাড়া বাকি সময় এখানকার আকাশ বাঁজা হয়ে থাকে যে!  জল চাও তো হাঁটো তিন ক্রোশ পথ। সেখানে সরকার বাহাদুর দু’—দুটো চাপাকল বসিয়েছে। লাইনে দাঁড়ালে ঘণ্টা দেড়েক পরে জল তো পাবেই। তাই জল বড় মূল্যবান। অন্তত জমির যিনি মালিক তিনি তাঁকে পাগল ভাবছেন। পঁয়তাল্লিশ বছরের আইবুড়ো বোন, যার বিয়ে হয়নি চোখে দেখে না বলে, সংসারের কোনো কাজে না—লাগলেও যাকে অন্তত ভাত আর আলুসেদ্ধ দিতে হয়, তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব নিয়ে যদি কেউ আসে তা হলে লোকটাকে পাগল ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায়? দশ বিঘে জমির মালিক হতে কুড়ি হাজার টাকা দিতে হল। টাটা কোম্পানির চাকরির সুবাদে কিছু টাকা জমানো ছিল, সেটাই কাজে লেগে গেল। তারপরেই একটা টালির ঘর, ইট সাজিয়ে তার ওপর সিমেন্ট ঢেলে সেই ঘরের মেঝের সঙ্গে টাটা থেকে লোক নিয়ে গিয়ে, পাথর সরিয়ে একশো পঁচিশ ফুট নিচে নামতেই পাইপ দিয়ে গলগলিয়ে জল বেরিয়ে এল ওপরে। সেই জলের উচ্ছ্বাস যখন পাথরের ওপর দিয়ে চারপাশে ছড়িয়ে যাচ্ছিল তখন অদ্ভুত দৃশ্যটা দেখতে পেলেন শ্রীপতি। পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে পোকাগুলো। জলের স্রোতে নাকানিচোবানি খাচ্ছে। জীবনে কোনোদিন এমন জলের স্রোত শুধু ওরা কেন, ওদের চোদ্দোশো পুরুষও দেখেনি! এটা মনে আসতেই শ্রীপতি থমকেছিলেন। তাঁর মনে পুরুষ শব্দটি কেন এল? চোদ্দোশো নারী না—থাকলে ওরা এখন কী করে সাঁতার শিখত?

বিপদ বাড়ল। ভোর হতে না—হতেই জায়গাটা যেন বাজার। কাছাকাছি গ্রাম থেকে মানুষের ঢল নামল তাঁর টালির ঘরের সামনে—জল চাই, জল দাও। তুমি একা মানুষ তোমার এত আছে, আমরা অনেক, আমাদের এক ফোঁটাও নেই। শ্রীপতিরও তাই মনে হল। যেখানে গাছ আছে, শ’য়ে শ’য়ে গাছ, তারা মাটির নিচের জল শেকড় দিয়ে শরীরে টানে। ওই জলের মালিকানা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

শ্রীপতি রাজি হলেন। কিন্তু বললেন, ‘জল যেখান থেকে উঠে আসছে তার ওপর পাথরের চাপ পড়ছে। আপনারা রোজ একটু একটু করে পাথর সরিয়ে দিন। আমি এখানে গাছ লাগাব!’

এক কথায় সবাই রাজি। কিন্তু গাছ? এখানে গাছ! ওরা এতকাল পাহাড়ের কোলে যে—সব গুল্ম দেখে এসেছে তাকেই গাছ ভেবে নিয়েছে। এখানে গাছ হবে?

শ্রীপতি স্বপ্ন দেখলেন এবং দেখালেন, ‘হবে, হবে। বড় বড় বৃক্ষ হবে। তার পাতার ছায়া মাটিতে পড়বে। দূরদূরান্ত থেকে পাখিরা উড়ে এসে আর ফিরে যাবে না। তারপর সেই গাছগুলোর আকর্ষণে শুকনো আকাশ একটু একটু করে ভিজে হয়ে উঠবে। সেই ভেজা আকাশ থেকে জল ঝরবে মাটিতে।’

দু’বেলা জল ভরে নিয়ে অকৃতজ্ঞ হয়নি মানুষরা। শ্রীপতি দেখলেন, তাঁর দশ বিঘে জমির ওপর থেকে ওরা সমস্ত পাথর তুলে সামনের রাস্তায় সুন্দর করে বিছিয়ে দিয়েছে। তারপর সময় পেলেই চাপাকলের হাতল টেপা আর জলের ধারা জমির সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ চলল। কয়েকদিন পর ভোর ভোর নাকে গন্ধটা লাগল। সোঁদা গন্ধ। শ্রীপতি হাসলেন। বুঝলেন, তাঁর জমির মাটি ঋতুমতী হয়েছে!

টাটা থেকে এল, ঘাটশিলা থেকেও। প্রভিডেন্ট ফান্ডের অনেকটা লেগে গেল সেসব করতে। দশ ভাগ চারা নেতিয়ে গেলেও নব্বই ভাগ তরতর করে মাথা তুলতে লাগল। আর সেই সময় লোকটা এল একটি বালককে নিয়ে। এই জমি একদা যার ছিল তার ভাই ওই লোকটা। বলল, ‘বাবু, আমি সংসার ছেড়ে চলে যাচ্ছি। হিমালয় আমাকে ডাকছে।’

শ্রীপতি অবাক হলেন, ‘সে কী! কী করে বুঝলে?’

‘শয়নে, স্বপনে, জাগরণে ভগবান যেন বলেন, আয় হরিদ্বারে আয়। আমার জমিজমা, ঘরবাড়ি নেই। বউ ছিল, সে—ও মরেছে গলায় দড়ি দিয়ে। দাদার আশ্রয়ে লাথিঝেঁটা খেয়ে ছিলাম। আর নয়, এবার হরিদ্বারে চলে যেতে চাই।’ লোকটা বলল।

‘তা আমার কাছে এলে কেন, কী করব আমি?’

‘বাবু, এটা আমার ছেলে। ওর মা নাম রেখেছিল দুখী। দুখীরাম। ওর জেঠি ওকে সহ্য করতে পারে না। ওর দোষ হল, কথা বলতে পারে না। আপনি যদি ওকে আশ্রয় দেন, আপনার সব কাজ ও হাতে হাতে করে দেবে, বড় নরম মন ওর। ওকে আপনি আশ্রয় দিলে আমি নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারি।’ লোকটা বলল।

শ্রীপতি তাকালেন ছেলেটির দিকে। বছর ছয়েক বয়স। ছেঁড়া খাকি হাফপ্যান্ট, পাঁজর বের করা খালি গা। তার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে। সব স্থির হয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বললেন, ‘এই ছেলে, ওই পলাশ গাছের পাশে গিয়ে দাঁড়া দেখি। কে বেশি লম্বা, তুই না ওটা?’

ছেলেটা ঘাবড়ে গেল। এরকম আদেশ কেউ তাকে কখনও করেনি। তার বাবা বলল, ‘যা, ওঁর কথামতো কাজ কর।’

ছেলেটা হেঁটে গেল পলাশ গাছের চারার পাশে।

শ্রীপতি হাসলেন, ‘বাঃ, একদম মাথায় মাথায়।  গাছ যেমন লম্বা হবে তোকেও তার সঙ্গে তাল রেখে লম্বা হতে হবে বুঝলি!’

লোকটা বলল, ‘হে হে, মানুষ কি গাছের সঙ্গে পারে!’

মাথা নাড়লেন শ্রীপতি, ‘বেশ, থাক। যতদিন কথা শুনবে ততদিন থাকতে পারবে। তবে হ্যাঁ, ওই নাম এখানে চলবে না। দুখী নয়, এখানে থাকতে হলে ওর নাম হবে সুখী, সুখরাম…’ বলে তাকালেন ছেলেটির দিকে। সুখী তখন পলাশ চারার কচি পাতায় আঙুল বোলাচ্ছে আলতো করে। শ্রীপতির মনে হল, এ থাকবে।

এক বছরের মধ্যে জমির চারপাশের গাছগুলো যেন বৃক্ষ হওয়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল। এক বিকেলে কোথা থেকে দুটো ঘুঘু এসে বসল আমগাছের ডালে। বসে অদ্ভুত গলায় ডাকতে লাগল। সুখী ছুটে এল শ্রীপতির কাছে। হাত ধরে টেনে নিয়ে আঙুল তুলে গাছের ডালে প্রায় গায়ে গা মিশিয়ে থাকা পাখিদুটোকে দেখাল। খুশি হলেন শ্রীপতি। বললেন, ‘তোমরা কোন কানন থেকে এলে গো!’ তারপরেই শব্দ করে হেসে উঠলেন। সুখী অবাক হয়ে তাকাল। হাসির কারণ কী? শ্রীপতি যেন নিজের সঙ্গে কথা বললেন, ‘লোকে বলে, সর্বস্বান্ত হলে ভিটেয় ঘুঘু চরে। এত পাখি থাকতে তোরাই নন্দ ঘোষ হয়ে গেলি!’

সুখী শব্দ করল। ও যখন প্রবলভাবে কিছু বলতে চায় তখন গলা থেকে ওই রকম শব্দ বের হয়। সেটা শোনার পর শ্রীপতি ছেলেটার সামনে হাঁটু মুড়ে বসলেন, ‘ঠিক আছে, এভাবেই বল, অ।’

সুখী তাকাল। তৃতীয়বার বলার পর সে শব্দ বের করল কিন্তু সেটা অ—এর ধারে কাছে গেল না। তবে শ্রীপতি ছাড়ার পাত্র নন। দশ মিনিট ধরে চেষ্টা করে করে গলার শিরা ফুলে উঠছে দেখে, ছেলেটাকে ছেড়ে দিলেন। বেচারা কোনোদিন অ—আ—ই—ঈ বলতে পারবে না? কোনোদিন অক্ষর চিনবে না? আর তখনই শব্দটা ছিটকে বের হল সুখীর মুখ থেকে, ‘অ! অ!’

সুখী তাকিয়ে রয়েছে তাঁর পিছন দিকে। ওর চোখ বিস্ফারিত। দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকালেন শ্রীপতি। তিন ফুট লম্বা হয়ে ফণা তুলেছে কেউটে সাপ। আর—একটু এগোলেই সে শ্রীপতির শরীরে বিষ ঢেলে দিতে পারবে। চকিতে সরে আসতে আসতে দেখলেন সুখী জোরে জোরে হাততালি দিতে দিতে লাফাচ্ছে আর তার মুখে শব্দ ছিটকে আসছে, ‘অ, অ, অ!’

সেদিনই মাথায় এসেছিল ভাবনাটা। এখানে স্কুল বলতে সেই বান্দোয়ান আর গালুডিতে। দশ থেকে বিশ মাইল হেঁটে বাচ্চচাদের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই অনন্তকাল থেকে একে পর এক জন্মে যাওয়া এখানকার শিশুরা হিন্দি, বাংলা অক্ষর চেনে না, ইংরেজি তো স্বপ্নের বাইরে। এরা বড় হয় প্রাকৃতিক নিয়মে। শরীরে শক্তি যতদিন থাকে ততদিন তার বিনিময়ে খাদ্য সংগ্রহ করে। কেউ দু’মাসের চাষবাস থেকে ফসল তুলে সারাবছর আধপেটা খেয়ে থাকে, দলে দলে চলে যায় বাইরে, কাজের সন্ধানে। গিয়ে ভাবে, শহরের বাবুরা কী আরামে আছে। সেই আরামের কণামাত্র তাদের গ্রামে পৌঁছায়নি। আগের প্রজন্ম এটাকে স্বাভাবিক ভেবে নিয়েছিল, এখন গুমরে উঠলেও এরাও একই পথে হাঁটছে। শ্রীপতির মনে হল, এত গাছ তিনি পুঁতেছেন, গাছগুলো একটু একটু করে বৃক্ষ হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সুখীরামের মতো বাচ্চচাগুলোকে যদি অক্ষর চেনাতে পারতেন, অক্ষর থেকে বাক্য। সেই বাক্য উপুড় হয়ে স্লেটে লিখত আর মুছত। তাই করতে করতে ওদের কেউ সাইকেল চালিয়ে বান্দোয়ানের স্কুলে, সেখান থেকে কলেজে গিয়ে এক—একজন এক—একটা বৃক্ষ হয়ে নতুন পথ দেখাতে পারত। এই পারাটাকে ভাবনায় না—রেখে বাস্তবে নিয়ে এলে কেমন হয়!

জমির একপাশে বড় একচালা ঘর তৈরি হবে। একা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয় তাই টাটানগরের কর্মক্ষেত্রে ফিরে গিয়ে আইনসম্মতভাবে অবসর নিয়ে কিছু ভাতা হাতে পেলেন। তারপর বন্ধু বা পরিচিতদের কাছে হাত পাতলেন। কেউ দিলেন, দিলেন না অনেকেই। কিন্তু খবর ছড়িয়ে গেল। টাটানগরের ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়ে শ্রীপতি জঙ্গলমহলের শিশুদের অক্ষর চেনাতে স্কুল খুলতে চান।

চালাঘর তৈরি হওয়ার পর টাটানগর থেকে একটা গাড়ি এল। নামী বহুজাতিক কোম্পানির অফিসাররা গাড়ি থেকে নেমে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। শ্রীপতির সঙ্গে কথা বললেন। তাঁরা ফিরে যাওয়ার তিনদিন পরে চিঠি এল। সেই কোম্পানি এই সংস্থার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট জানতে চেয়েছে। সংস্থা নেই। তাই টাটানগরের প্রিয় বন্ধুদের নিয়ে একটা সংস্থা তৈরি করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলা হল। তারপর সেই কোম্পানির চেক এল। এক লক্ষ এক টাকা অনুদান দিলেন তাঁরা। শ্রীপতি তাঁর গাছেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জয় বৃক্ষনাথ! সবই তোমার কৃপা।’

প্রথমে অনেক অনুরোধের পর, আটটা শিশু এল যাদের পায়ে একটা আধছেঁড়া চটিও নেই। পেট—পিঠ এক হয়ে গেছে!

আটজনকে নিয়ে এসেছিল তাদের বুড়োবুড়ি অভিভাবকরা। তাদের বিদায় করতে চাইলেও তারা বেশি দূরে গেল না। শিশুগুলোকে প্যান্ট খুলিয়ে দাঁড় করালেন শ্রীপতি। তারপর চাপাকলের মুখে প্লাস্টিকের পাইপ ঢুকিয়ে তাদের স্নান করালেন। স্নানের এমন আনন্দ ওরা বোধ হয় কখনও পায়নি। আবার প্যান্ট পরিয়ে লাইন দিয়ে বসিয়ে সুখীকে ইশারা করলেন। ভোর ভোর ফেনাভাত আর আলুসেদ্ধ করা ছিল, সুখী শিশুদের সামনে প্লাস্টিকের থালায় তা ধরে দিতে ওরা তখন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। সম্বিৎ ফিরতেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল থালার ওপর। শ্রীপতি চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেলার শব্দ শুনলেন। খাওয়ার পর হাতমুখ ধুইয়ে সুখীকে বললেন ওদের একচালার নিচে নিয়ে যেতে। স্নান সেরে খাওয়া হয়েছে, এখন পড়াশোনা আরম্ভ হবে। নিজের টালির ঘর থেকে বড় স্লেট আর চক নিয়ে চালাঘরের কাছে পৌঁছে শ্রীপতি দৃশ্যটা দেখলেন। আটটি শিশু চালাঘরের নিচে পাটির ওপর পড়ে আছে। প্রত্যেকের চোখ বন্ধ, এর মধ্যেই ঘুমে কাদা হয়ে গেছে সবাই। হয়তো জীবনে এই প্রথমবার পেটভর্তি ভাতের আরাম ওদের শরীর শিথিল করে দিয়েছে। শ্রীপতি দেখলেন, খানিকটা দূরে বসে সুখী ঘুমন্ত শিশুদের দিকে তাকিয়ে আছে। শ্রীপতি ঠিক করলেন, ওরা আজ ঘুমোক। কাল থেকে পড়াশোনার পথ বের করতে হবে।

জয় বৃক্ষনাথ! মানুষ নিজের পায়ে নিজেই কুড়ুল মারছে কারণ তাদের কৃতজ্ঞতাবোধ নেই। বৃক্ষনাথ, তুমি না—থাকলে মানুষ পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে যেত। মুখ তুলে তাকালেন তিনি। এই পঁচিশ বছরে লক্ষ  গাছ আরও লক্ষ গাছের জন্ম দিয়েছে এখানে। তাদের জায়গা দিতে জমি কিনতে হয়েছে শ্রীপতিকে। সন্তানের সংখ্যা বেড়ে গেলে বাড়িতে তো ঘর বানাতেই হয়। সেইসব চারাগাছগুলো এখন বিশাল বৃক্ষ। সেই দুটো পাখি কোথায় হারিয়ে গেছে, এখন নানা জাতের পাখির ভিড় এখানে, কাঠবিড়ালিরা সাহসী হয়ে দৌড়ে বেড়ায় চারধারে। চালাঘরটা নেই। তার জায়গায় দোতলা স্কুলবাড়ি হয়ে গেছে। টাটা থেকে কয়েকজন সব ছেড়ে চলে এসেছেন বাচ্চচাদের পড়াশোনা শেখাবেন বলে। তাঁদের থাকার জন্যে ঘর বানাতে হয়েছে। বিশাল উনুন দিনরাত জ্বলে খাবার তৈরি করার জন্যে। ব্যাঙ্ক বাস দিয়েছে। সেই বাস ভোরের অন্ধকার থাকতে বেরিয়ে যায় পাহাড়ি গ্রাম থেকে বাচ্চচাদের নিয়ে আসতে। তাদের অঙ্গে এখন স্কুলের ইউনিফর্ম। বাস থেকে নেমে গেট দিয়ে লাইন করে ঢোকার সময় তারা কচি গলায় বলে, ‘গুড মর্নিং স্যার।’

কী করে কোথা থেকে কী হয়ে গেল! পঁচিশ বছর আগে যা ভাবতে পারেননি, তা সম্ভব হল মানুষের ভালোবাসায়। এই যে কালো শিশুরা এসে অ—আ শিখছে, নামতা পড়ছে, বাক্য লিখতে পারছে, কলকাতার এক রিপোর্টার এই এলাকার মাওবাদীদের ইন্টারভিউ করতে এসে জেনে ফেললেন সেকথা। জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনারা সব ভাঙছেন, জ্বালিয়ে দিচ্ছেন, মানুষ মারছেন কিন্তু ওই বৃক্ষনাথের স্কুলকে কিছু বলছেন না কেন? সঙ্গে সঙ্গে কপালে আঙুল ছুঁইয়ে মাওবাদী নেতা বলেছিলেন, ‘আমরা জন্ম দিয়েছি। আমাদের যেমন জন্ম দেওয়া হয়েছিল। আমাদের কেউ মানুষ করার চেষ্টা করেনি। আমাদের বাচ্চচাদের উনি মানুষ করার চেষ্টা করছেন। ওঁর ক্ষতি মানে তো আমাদের বাচ্চচাদের ক্ষতি!’ ব্যস। পরের দিনের কলকাতার নামী কাগজ ছেপে দিল খবরটা। বারুদের বিপরীতে গোলাপ।

যখন বন্দুকের যুদ্ধে সরকার জিতে গেল, বুকে জ্বলুনি মেটার সুযোগ না—পেয়ে জঙ্গলমহল শান্ত হতে বাধ্য হল, তখন শহরের মানুষ আসতে লাগল নিজের চোখে দেখতে। কেউ কেউ আবেগে আক্রান্ত হয়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে দিল খবরটা। নিঃসম্বল হয়েও মানুষ গড়ে চলেছেন শ্রীপতি। একটু একটু করে সাহায্য আসতে লাগল। শুধু দেশ থেকে নয়, বিদেশ থেকেও বাঙালি টাকা পাঠাচ্ছে এই ভেবে, একটু ভালো কাজ করা যাক।

শ্রীপতির পক্ষে এখন এসব ঝক্কি সামলানো সম্ভব নয়। তার জন্যে কয়েকজন আছেন। কিন্তু এসব নিয়ে যখনই ভাবেন তখন শ্রীপতির মনে হয়, কিছুই তো করা হল না। সেই যে আট শিশু, যাদের তিনি প্রথম দিনে স্নান করিয়েছিলেন তারা এখন কোথায়? ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে দু’জন গিয়েছিল বান্দোয়ানে নাইনে ভর্তি হতে। বাকিরা হয় অটো চালায় নয়তো পানবিড়ি অথবা মুদির দোকান করেছে। এখনও অবধি কোনো ছেলে বা মেয়ে এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করেনি, ‘আপনি কেন আমাকে অক্ষর চিনিয়েছেন? কেন প্রতিদিন আমাকে গুড মর্নিং বলতে শিখিয়েছিলেন? এমন শিখে আমার কী উপকার হল? যে শেখেনি সে যেমন অটো চালাচ্ছে, আমিও তো তাই চালাচ্ছি! উত্তর দিন!’

না। কেউ প্রশ্নটা করেনি। একজন সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই যে বাচ্চচারা এখানে পড়তে এলে আপনি ফেনাভাত, সেদ্ধ বা তরকারি খাওয়ান, এটা এক ধরনের ঘুষ দেওয়া নয় কি?’

‘মানে!’ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন শ্রীপতি।

‘ওরা খাওয়ার লোভে আসে। পড়াশোনার টানে নয়। বাড়িতে হয়তো সকালে কিছুই খেতে পায় না তাই এখানে কামাই করে না। দু’দিন খাবার বন্ধ করে দেখুন তো হাজিরার সংখ্যা ঠিক থাকে কিনা!’ সাংবাদিক বলেছিলেন।

মাথা নেড়েছিলেন শ্রীপতি, ‘আমি এভাবে ভাবি না। একটা গাছের চারাকে বড় করতে হলে রোজ  জল দিতে হয়। সেই জল ওরা বাড়িতে ঠিকঠাক পায় না, তাই আমি চেয়েচিন্তে ভিক্ষে করে আনি ওদের জন্যে। এর বেশি কিছু নয়।’

জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে সুখীর শরীরটা এগিয়ে এল তাঁর সামনে। বছর বত্রিশের যৌবন ওর শরীরে। যে—পলাশ গাছের পাশে দাঁড় করিয়ে ওর দৈর্ঘ্য তিনি জরিপ করেছিলেন, সেই পলাশ এখন আকাশছোঁয়া। হাসলেন শ্রীপতি, সেই সুখী—ই বা কম কীসে! অন্তত ছ’ফুট হয়ে গেছে ওর শরীর।

‘কিছু বলবি?’ শ্রীপতি জিজ্ঞেস করলেন।

মাথা নাড়ল সুখী, তারপর ইশারা করল অনুসরণ করতে। ওপাশের স্কুলবাড়ি আজ চুপচাপ। রবিবারে এদিকে পাখিরা চলে আসে। উলটোদিকের দোতলার ওপরের ঘরদুটো গেস্টরুম। খাওয়া—থাকা সমেত দিনে ছ’শো টাকা। দোতলার পিছনে প্রচুর গাছগাছালি। সেখানে পৌঁছে সুখী ঘাসের বুকে পড়ে থাকা বোতলটাকে দেখাল। মদের বোতল। মুখ তুললেন শ্রীপতি। কোন ঘরের জানালা দিয়ে এটা ছোঁড়া হয়েছে বুঝতে না পেরে বললেন, ‘ওপরে চল।’

আজকাল সিঁড়ি ভাঙার সময় হাঁটু জানান দেয়। দুটো ঘরের দরজাই ভেতর থেকে বন্ধ। কড়া নাড়লেন তিনি প্রথম দরজার। কোনো সাড়া নেই। তৃতীয়বারে যে দরজা খুলল, তার একমুখ দাড়ি, রুক্ষ চেহারা। খেঁকিয়ে বলল, ‘কেন বিরক্ত করছেন?’

‘বাধ্য হয়ে করছি। আপনারা কি মদ্যপান করে জানালা দিয়ে বাইরে বোতল ছুড়ে ফেলেছেন?’ শ্রীপতি জিজ্ঞেস করলেন।

‘আমরা এখানে মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করতে আসিনি। যারা করছে তাদের বলুন। আর হ্যাঁ, এভাবে হুটহাট বিরক্ত করতে আসবেন না।’ ছেলেটা মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল। তারই ফাঁকে শ্রীপতি দেখলেন, ঘরে যে—দ্বিতীয় ছেলেটি খাটের ওপর বসে আছে, সে যেন ভয়ংকর ভয় পেয়েছে। এরা কারা? গতকাল যখন এসেছিল তখন বলেছিল, আদিবাসীদের সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণার কাজ করতে এসেছে। ততক্ষণে দ্বিতীয় দরজার কড়া নেড়েছে সুখী। কোনো সাড়া নেই। তৃতীয়বারেও যখন দরজা খুলল না তখন শ্রীপতি বললেন, ‘দরজা ভেঙে ফেল।’

দু’মিনিটে কাজটা করে ফেলল সুখী। ঘরে ঢুকে নাকে আঙুল চাপলেন শ্রীপতি। মদ এবং গাঁজার কটু গন্ধ যেন চাপ হয়ে রয়েছে। সামনে বিছানার ওপর দুটো শরীর পড়ে আছে। দু’জনের পরনে হাফপ্যান্ট, ছেলেটির ঊর্ধ্বাঙ্গে কিছু নেই, মেয়েটির আঁটোসাঁটো গেঞ্জি। দু’জনের চোখ খোলা, হাতে হাত, পায়ের ওপর পা। শ্রীপতি এগিয়ে গিয়ে কয়েকবার ডাকলেন। কোনো হুঁশ নেই। তারপর নাকের নিচে আঙুল রাখলেন দু’জনের। না, মারা যায়নি।

এখানে মোবাইলের লাইন পাওয়ার চেয়ে লটারির পুরস্কার পাওয়া সহজ। একটা কাগজে কয়েকটা লাইন লিখে সুখীকে পাঠিয়েছিলেন বিএসএফের ক্যাম্পে। আধমাইল দূরের সেই ক্যাম্পের ইনচার্জ শ্রীপতির গুণমুগ্ধ। সাইকেলে তাঁকে চিঠি পৌঁছে দেওয়ামাত্র তিনি লোকজন নিয়ে হাজির হলেন দুটো গাড়ি নিয়ে। জ্ঞানহীন শরীরদুটো নিয়ে একটা গাড়ি ছুটল বান্দোয়ানের হেলথ সেন্টারে। ওরা সম্পর্ক লিখিয়েছিল স্বামী—স্ত্রীর, পকেটে যে—আইডেন্টি কার্ড পাওয়া গেল তার সঙ্গে ছেলেটি যে—নাম এখানে ঢোকার সময় বলেছিল তা মিলছে না।

দ্বিতীয় ঘরের দরজা খুলছিল না। যখন ভাঙার চেষ্টা হল তখন বিকট শব্দে বোমা ফাটল। ভেতর থেকে গুলি ছোড়া শুরু হতেই, বিএসএফের জোয়ানরা পালটা আক্রমণ করলেন। দশমিনিট পরে সব শান্ত হলে ওঁরা মৃতদেহ দুটোর সঙ্গে এক বাক্স অস্ত্র নিচে নামিয়ে আনলেন। শ্রীপতি দেখলেন, সেই দাড়িওয়ালা ছেলেটিকে। মুখের সেই রুক্ষতা এখন এক ফোঁটাও নেই। বান্দোয়ান থানা থেকে পুলিশ এল। সব শোনার পর মৃতদেহ দুটো নিয়ে চলে গেল ওরা।

সবাই চলে যাওয়ার পর শ্রীপতি তাঁর সহকর্মীদের ডাকলেন। বললেন, ‘অচেনা অজানা কাউকে আর ঘর ভাড়া দেওয়া হবে না। তাতে যদি অভাব বাড়ে তাও সহ্য করতে হবে।’

সবাই একমত হল। যিনি টাকাপয়সার দায়িত্বে আছেন তিনি বেশ কুণ্ঠার সঙ্গে জানালেন, ‘এই মাসে অনুদানের পরিমাণ খুব কম। কীভাবে সব খরচ চালানো যাবে তা বুঝছি না। খরচ অনেক কমিয়েও সামলানো সম্ভব হয়তো হবে না।’

দ্বিতীয়জন বলল, ‘আচ্ছা, আমাদের তো অনেক গাছ। তাদের একটা কেটে বিক্রি করলে তো মাসের খরচ উঠে যাবে। আমরা একটা গাছের বদলে দুটো  গাছ লাগিয়ে দেব।’

কথাটা সবার মনে ধরলেও শ্রীমতির মুখ দেখে তাঁর মনের কথা কেউ বুঝতে পারল না। ওরা চলে গেলে সুখী এগিয়ে এসে শ্রীপতির সামনে বসে দু’পাশে মাথা নাড়ল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শ্রীপতির হাত ধরে হাঁটতে লাগল। গাছের পর গাছ, শ্রীপতি যাদের পঁচিশ বছর আগে লাগিয়েছেন, বড় করেছেন, তাদের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে সুখী সেই গাছটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গত ঝড়ে যে খুব নড়বড়ে হয়ে গিয়েছিল। শেকড় উপড়ে গিয়েছিল অনেকটা। একটু কাত হয়ে রয়েছে বিশাল গাছটা। সুখী আঙুল তুলে সেই গাছটাকে দেখাল।

মাথা নাড়লেন শ্রীপতি। তারপর এগিয়ে গিয়ে গাছটার শরীরে হাত বোলালেন। ছেলেমেয়েদের বাপ—মা অনেক কষ্ট করে বড় করে, শিক্ষিত করে। বাপ—মা বৃদ্ধ হলে সেই ছেলেমেয়েরা যদি পাশে দাঁড়ায় তো ভালো, না দাঁড়ালে এখন অনেকেই আপশোস করেন না। স্বাভাবিক ভেবে নেন। এইসব গাছ তাঁর সন্তানের মতো। এদের কেউ কেউ যদি আত্মদান করতে প্রাকৃতিক কারণে বাধ্য হয় তা হলে বৃদ্ধ পিতার মতো তিনি উপকৃত হবেন।

চোখ বন্ধ করলেন শ্রীপতি। নিঃশব্দে বলতে লাগলেন, ‘হে বৃক্ষনাথ, তুমি আমার সহায় হও। এখনও তো ওই বৃক্ষের পাতা সবুজ, এখনও পাখিরা ওর ডালে এসে বসছে। আমি কী করব? যেহেতু আমি মানুষ, প্রয়োজনের সময় আমি যদি চোখ বন্ধ করে থাকি তা হলে আমার বিবেক ঘুমিয়ে থাকবে। হে বৃক্ষনাথ, আমায় তুমি ক্ষমা করো।’

___

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(60)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!
Do you have any doubts? chat with us on WhatsApp
Hello, How can I help you? ...
Click me to start the chat...