শিউলি – সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ............................................................................................
প্রথম সংস্করণ: জুন ১৯৯৪
প্রকাশক: আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড
প্রচ্ছদ: কৃষ্ণেন্দু চাকী আমার বাঙলাদেশের বোন স্নেহের শিরিনকে
Book Content
শিউলি – 1-9
শিউলি – 1-9
॥ ১ ॥
শরৎ এসে গেছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের হাতি ভেসে যাচ্ছে শুঁড় তুলে। দক্ষিণের জমিতে ঝাঁকড়া একটা শিউলি গাছ। সবে ভোর হচ্ছে। আকাশ থেকে অন্ধকারের পাতলা সর সরে যাচ্ছে। দিন যে চোখ রগড়াচ্ছে। সেই পাতলা আলোয় শিউলিগাছের তলায় একটি ছেলে আর একটি মেয়ে ফুল কুড়োচ্ছে। দূরে ঝিরিঝিরি নিমগাছের ডালে একজোড়া দোয়েল খুব শিস দিচ্ছে। সবার আগে দোয়েল উঠে পড়ে। আকাশে দিনের আলোর একটা আঙুল পড়লেই হল। দোয়েল আর বিছানায় থাকতে পারে না। কাক তখনও ঘুমজড়ানো গলায় একজন আর একজনকে জিজ্ঞেস করতে থাকে, ক’টা বাজল রে! ভোর কি হল! শালিকটালিক অনেক বেলায় ওঠে। কিছু মানুষের মতো। বেড-টি না পেলে বিছানা ছাড়তে পারে না। টিয়ারা অবশ্য বেশ ভোরেই ওঠে। উঠেই আকাশে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে জগিং করার জন্য। ভোরবেলাটা সব পাখিরই গান সাধার সময়। গুরুর নির্দেশ, ভোরবেলা খালি পেটে একঘন্টা গলা সাধবে। সূর্যের আলোর রং বেশ মিহিদানার মতো না হলে দিনের প্রথম ফলে ঠোকর মারা চলবে না। একমাত্র ব্যক্তিক্রম চড়াইপাখি। তারা উঠেই পাঠশালায় চলে যায় নামতা পড়তে। চড়াই গান সাধে না। অঙ্কে ভাল, তাই কেবল নামতা পড়ে।
জয় এইসব খবর খুব জানে। ছেলেটির নাম জয়, মেয়েটির নাম জয়া। জয়া জয়ের চেয়ে দু’ বছরের বড়। একজোড়া ভাই, বোন। ফুলের মতো সুন্দর। জয়ের একমাথা কোঁকড়া-কোঁকড়া চুল। বাঁশির মতো নাক। জয়ার গায়ের রং পদ্মফুলের মতো। চোখ দুটো নীল সরোবরের মতো। তাদের বাবা হলেন জেলার সদর হাসপাতালের বড় ডাক্তার। মা স্কুলের প্রধানশিক্ষিকা। তারা যে-বাড়িটায় থাকে, সেটা একটা সুন্দর বাংলো। চারপাশে অনেকটা জায়গা। ইংরেজ আমলের তৈরি। ইংরেজ-ডাক্তাররা থাকতেন। সেইভাবেই তৈরি। উঁচু-উঁচু, বড়-বড় ঘর। খাওয়ার ঘর। বিশাল একটা রান্নাঘর একপাশে। ঢাকা বারান্দা দিয়ে জোড়া। দু’পাশে বড়-বড় দুটো বাথরুম। বসার ঘরে একটা ফায়ার প্লেস। সেকালে মনে হয় খুব শীত পড়ত। দক্ষিণের বারান্দায় দাঁড়ালে অনেক দূরের আকাশে একটা পাহাড় দেখা যায়। ভোরবেলা পাহাড়টার রং হয় গাঢ় নীল। দুপুরে জমাট কালো। সন্ধের আগে সোনালি হয়ে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
রোজ ভোরবেলা জয়া এসে জয়কে ডাকে, “ভাই, ওঠ। দ্যাখ, ভোর হচ্ছে।”
জয়া দিদিমার কাছে শোয়। জয় শোয় দাদুর কাছে। দাদু সারা বছর জানলা খুলে শোন। ঘরে যত আলো-বাতাস খেলবে তত শরীর ভাল থাকবে। সব জানলা খুলে শুলে ঠাণ্ডা লাগার ভয় থাকে না। একটা খুলে শুলে ঘর গরম-ঠাণ্ডা হয়ে সর্দি-কাশি হওয়ার ভয় আছে। দাদু বলেন, এর নাম ‘চিল’। দাদু বলেছেন, যারা খুব ভোরবেলা বিছানা ছাড়তে পারে, তারা মালিক হয়। কিসের মালিক? বিশাল বড় একটা দিনের মালিক। তাদের সূর্য দেরিতে অস্ত যায়। তার মানে? তারা অনেকদিন বাঁচে। যারা রোদ-চড়ার আগে স্নান করে নিতে পারে, তাদের কোনওদিন জ্বর হয় না। যারা ভোরবেলা শিশিরভেজা সবুজ ঘাসে পা রাখতে পারে, তারা প্রাণ পায়। প্রাণ মানে আনন্দ। আর যারা পাখির গান শোনে তারা ভগবানের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।
জয়া যেই ডাকে, “ভাই ওঠ, দ্যাখ, ভোর হচ্ছে।”
অমনই জয় চোখ মেলে তাকায়। ওই সময়টা ঘুম পাতলাই হয়ে আসে। ইচ্ছে করলে নিজেই উঠতে পারে। দিদির মিষ্টি গলায় ‘জয়’ ডাকটার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। মাথার কাছে বড় জানলায় দক্ষিণের আকাশ। ফলসার মতো রং। সরু সুতোর মতো আলোর চুল-ফাট। ধ্যানমগ্ন সেই পাহাড়। পিপারমেন্টের মতো সিরসিরে বাতাস। দাদু বলেছেন, “ঘুম থেকে ওঠার সময় নিজেকে ভাববে, তুমি একজন চিনা ছাত্র। তারা কী করে! বিছানা থেকে উঠেই, বিছানায় ক্যাঁত করে একটা ব্যাক-কিক ঝাড়ে। সারাদিন বিছানার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্ক নেই। বিছানায় লাথি মারে কেন? বিছানা হল মানুষের শত্রু। মানুষ যতক্ষণ ঘুমোয়, ততক্ষণ সে মৃত। ঘুম হল, সাময়িক মৃত্যু। রোজ যদি কেউ আট ঘন্টা ঘুমোয়, তা হলে বছরে ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে দু’ হাজার ন’শো কুড়ি ঘন্টা। বছরের চারটে মাস ঘুমিয়েই কাটছে। তা হলে কেউ যদি সত্তর বছর বাঁচে, তার ঘুমেই চলে গেল তেইশটা বছর। গোটা একটা যৌবন। সেই কারণেই চিনারা বিছানায় লাথি মারে। জীবনে যাঁরা বড় হন, তাঁরা সকলেই নিদ্রাকে জয় করেন। নেপোলিয়ান ঘোড়ার পিঠেই সামান্য সময় ঘুমিয়ে নিতেন।” জয় বিছানাটাকে লাথি মারে না। দাদুর বিছানা। বিছানাটাকে সে প্রণাম করে। মনে-মনে বলে, “বিছানা, তুমি আমার জীবনের তেইশটা বছর কেড়ে নিয়ো না। আর আমার ঘুম তুমি ভাল-ভাল, মজার-মজার স্বপ্নে ভরে দাও।”
জয়ের দাদুর নাম শিবশঙ্কর। মহাদেবের মতোই চেহারা। প্রায় ছ’ ফুট লম্বা। অনেকটা গ্রিক দেবতার মতো দেখতে। বড় এঞ্জিনিয়ার ছিলেন। দেশ-বিদেশ অনেক ঘুরেছেন। অনেক বড়-বড় কাজ করেছেন। বড়-বড় সেতু তৈরি করেছেন। অনেক খেতাব, অনেক পুরস্কার পেয়েছেন কাজের জন্য। বনে-জঙ্গলে-পাহাড়ে গিয়ে কাজ করেছেন। বাঘ এসে তাঁবুর চারপাশ শুঁকে গেছে। পাগলা হাতি এসে খোঁটা উপড়ে দিয়েছে। গাছের গুঁড়ি ভেবে পাইথনের পিঠে বসেছেন। কুমির এসে তীরে বেঁধে রাখা ছাগল টেনে নিয়ে গেছে। পাহাড় থেকে নেমে এসেছে মহুয়া-মাতাল ভালুক। ক্যাম্প চেয়ারে ঘুমিয়ে থেকেছে। শেয়াল এসে স্যাণ্ডউইচ খেয়ে গেছে। মাথার বালিশের তলায় সাপ কুণ্ডলি পাকিয়ে সারা রাত শুয়ে গেছে। ব্রিজের উঁচু গার্ডার থেকে পাগলা নদীতে পড়ে গেছেন। বন্যায় বাঁধ ভেঙেছে। সারারাত জলের তোড়ে দাঁড়িয়ে বাঁধ মেরামত করেছেন। ভাই-বোনের চোখে দাদু একজন হিরো। প্রথম রাতে ঘন্টা-দুই বিছানায় বিশ্রাম করেন। তারপরেই নিজের টেবিলে গিয়ে বসেন। ব্যাঙের ছাতার মতো ছোট্ট একটা বিলিতি টেবিল ল্যাম্প আছে। ভেতর দিকে আয়না লাগানো। ছোট্ট বাল্বেও জোর আলো। সেই আলোটা জ্বেলে দাদু অঙ্ক কষতে বসেন। যত কঠিন, জটিল অঙ্ক। নিজের একটা জীবনকাহিনী লিখছেন, বন-জঙ্গল-নদী-পাহাড়। মাঝে-মাঝে জয় আর জয়াকে সেটা পড়ে শোনান। লেখাটা অসাধারণ হচ্ছে। কত কী জানা যায়! কী ভীষণ উত্তেজনা। একজন শিক্ষিত, সাহসী, চরিত্রবান মানুষের জীবনকথা। কখনও মাঝরাতে ছাঁত করে জয়ের ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছে, দাদু পিঠখাড়া চেয়ারে বসে আছেন তার দিকে পিছন ফিরে, পাথরের মূর্তির মতো। একমাথা পাকা চুল। কত রাতে জয় দাদুকে স্বপ্নে দেখেছে। পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন দু’ হাত তুলে। জয়কে ডাকছেন, “কমরেড, উঠে এসো। এখানে আকাশ অনেক নীল। বাতাস অনেক হালকা। এখানে দাঁড়ালে পৃথিবীর শেষ দেখা যায়। ” জয় যতবার চেষ্টা করে কিছুতেই উঠতে পারে না। চিৎকার করে বলে, “দাদু, আমি পারছি না।” তখন পাহাড়ের মাথা থেকে ভেসে আসে কণ্ঠস্বর, “নিজের মনের হাত ধরো, ঠিক উঠতে পারবে। মনের চেয়ে বড় মই কিছু নেই।”
জয়ার ডাকে জয় যখন বিছানা ছেড়ে ওঠে, তখন শিবশঙ্কর বাংলোর পুব দিকের বাগানে একটা বেদির ওপর বসে থাকেন। ওদিকেই পাথর ছড়ানো রাস্তা। ময়াল সাপের মতো এঁকেবেঁকে স্টেশনের দিকে চলে গেছে। দু’পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ইউক্যালিপটাস, সেগুন আর দেবদারু। ঝলমলে রোদ উঠলে পথটা ছায়ায় ঢেকে যায়। পথের ঝাঁকে সাদা রঙের ছোট্ট একটা চার্চ। চূড়ার ওপর ঘন্টা দুলছে। আর কিছু দূরে একটা আশ্রম আছে। ভেতরে ছোটমতো একটা মন্দির। সেই মন্দিরে আছে জীবন্ত রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ। চার্চের দরজা। দরজাটা ঠেললেই টিংলিং করে ঘন্টা বাজে। ভেতরটা সুন্দর সাজানো। চমৎকার গন্ধ। বাহারি মোমবাতি, বাহারি কাগজ, যিশু খ্রিস্টের বই, পেনসিল, খাতা, কলম, ছবি আঁকার রং, তুলি, শিশুদের জামা, লজেন্স, চকোলেট সব পাওয়া যায়। শীতকালে ফুল বিক্রি হয়। বড়দিনের আগে ক্রিসমাস ট্রি। প্লাস্টার অব প্যারিসের নানারকম মূর্তি। ব্রোঞ্জের আইকন। দোকানে সব সময় সুন্দর চেহারার একজন নান থাকেন। জয় আর জয়া গেলেই তিনি বলেন, “ হ্যাল্লো গড্! হোয়াট ইউ ওয়ান্ট?” তাঁর শরীর থেকে আইভি লতার গন্ধ বেরোয়। চোখে ঝকঝকে সোনালি ফ্রেমের গোল চশমা। ফরসা মুখের সঙ্গে একেবারে মিশে থাকে। দোকানটা তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। চারপাশে তাকায়, মনে করে স্বপ্ন দেখছে। রাস্তাটা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে, সেখানে একটা নদী আছে। নদীর নাম, সরলা।
জয়ের ঘরে স্বামী বিবেকানন্দের বড় একটা ছবি আছে। স্বামীজির মাথায় পাগড়ি। হাত দুটো বুকের ওপর ভাঁজ করে রাখা। মাথায় পাগড়ি। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। মুখে লেগে আছে মৃদু হাসি। চোখ খুললেই জয় ছবিটা দেখতে পায়। শুনতে পায় স্বামীজি যেন বলছেন, “উত্তিষ্ঠিত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত। ওঠো, জাগো, জ্ঞানলাভ করো।” দাদু শিবশঙ্কর জয়কে ভাল-ভাল শ্লোক মুখস্থ করিয়েছেন। যেগুলো মনে-মনে আওড়ালেই বেশ বল পাওয়া যায়। শিবশঙ্কর বলেছেন, “জল যেমন ফোটাতে হয়, ফিল্টার করতে হয়, সেইরকম মনকেও ফোটাতে হয়, ফিল্টার করতে হয়। ভাল-ভাল চিন্তার মধ্যে দিয়ে মনকে নিয়ে যেতে হয়। চোখকে দেখাতে হয় সুন্দর দৃশ্য। কানকে শোনাতে হয় সুন্দর গান, সুন্দর কথা, সুন্দর শ্লোক। হাত দিয়ে স্পর্শ করতে হয় সুন্দর ফুল।”
জয় বিছানা থেকে নেমেই একটু হাত-পা ছুড়ে নেয়। দাদু কয়েকটা ফিগার শিখিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “লক্ষ করে দেখবে, জীবজন্তু অনেকক্ষণ শুয়ে থাকার পর, যেমন ধরো, বেড়াল. কি কুকুর, যখন ওঠে তখন শরীরটাকে স্ট্রেচ করে। আড়মোড়া ভাঙে। দোয়েল পাখি ভোরবেলা লেজের ব্যায়াম করে। পিড়িক-পিড়িক করে লেজ নাচায়। মৌটুসি ফুলের মধু খাওয়ার নাম করে একই জায়গায় ভেসে থেকে খুব খানিক ডানার ব্যায়াম করে নেয়। ব্যাঙ হাইজাম্প প্র্যাকটিস করে। ফড়িং বাতাস সেলাই করে। যেন সুচ মুখে নিয়ে একবার এদিক যাচ্ছে, একবার ওদিক যাচ্ছে। প্রজাপতি হয়ে যাচ্ছে হালকা কাগজ। কাঠঠোকরা গাছের গুঁড়িতে ঠোঁটের হাতুড়ি ঠুকে ঘাড়ের ব্যায়াম করে নিচ্ছে। কাঠবেড়ালি দৌড় কম্পিটিশন করছে। সবাই সব কিছু করছে, মানুষ পড়ে আছে বিছানায়। অতি কষ্টে যাও-বা উঠল, ছেতরে পড়ল চেয়ারে। চা ছাড়া চলার শক্তি নেই। তারপরেই মুখের সামনে মেলে ধরবে খবরের কাগজ।”
জয় বেক বেণ্ড, ফ্রন্ট বেণ্ড, স্ট্রেচিং এইসব করে, চটপট মুখ ধুয়ে নেবে ; তারপরেই বাসী জামাকাপড় ছেড়ে দিদির সঙ্গে চলে যাবে বাগানের ঘাসে। এখন শরৎকাল। শিশিরে ঘাস ভিজে-ভিজে। ঘাসের ডগায় নীল-নীল নাকছবি ফুল। দিদির কচি কলাপাতা রঙের ফ্রকটা জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। দিদির গায়ের রঙের সঙ্গে বেশ মিশে যায়। তারা দু’জনে শিউলি গাছের তলায় এসে দাঁড়ায়। দিদি ঠোঁটে আঙুল রেখে কোনওরকম শব্দ করতে বারণ করে। শিউলি ফুল ঝরে পড়ার নাকি একটা শব্দ আছে। দিদি শুনতে পায়। খুব ফিসফিসে শব্দ। বাতাসের মতো। ঝরে পড়ার সময় প্রতিটি ফুল বলে, “মা-আ, তোমার কোল থেকে আমি মাটির কোলে গেলুম।”
“দিদি, গাছ তখন কী বলে? হায়!”
“হায় বলবে কেন? গাছ বলে, আয় মা।”
“ফুলেরা কি সব মেয়ে?”
“ফুল, ফল, গাছ, এরা সব মেয়ে।”
“তুই শুনতে পাস, আমি কেন পাই না?”
“তুই তোর কানটাকে খাড়া কর। ঠিক শুনতে পাবি। গাছের সঙ্গে ফুলের কথা।”
জয় খুব চেষ্টা করে। দিদি কত কী শুনতে পায়, দেখতে পায়। দিদির গায়ে নাকি তারার আলো এসে পড়ে। সে নাকি আলপিন ফোটার মতো। চাঁদের আলোয় দিদির চুল ভিজে-ভিজে হয়ে যায়। জয় দেখেছে। মিথ্যে নয়। সত্যিই হয়। দিদি কচুপাতার ওপর শিশিরের ফোঁটাটাকে মুক্তোর মতো জমিয়ে দিতে পারে। দিদির মাথায় কোথা থেকে উড়ে এসে সাদা পায়রা বসে। কাঁধে এসে বসে ছিট-ছিট ঘুঘু। কাঠবেড়ালি হাত থেকে বাদাম খেয়ে যায়। একটুও ভয় পায় না। দিদি যখন শালিক পাখির ঝাঁকে গিয়ে দাঁড়ায় একটা পাখিও উড়ে যায় না। ক্যাঁচর-ম্যাচর করে দিদির সঙ্গে সমানে গল্প করে। জয়ের বেলায় এইসব হয় না। কেন হয় না! দিদি বলেছে, ভেতরে একটুও হিংসে থাকলে হবে না। একেবারে মাটির মানুষ হতে হবে।
শিউলি গাছের তলায় দিদি উবু হয়ে বসেছে। সবুজ ঘাসের সঙ্গে সবুজ ফ্রক মিশে গেছে। একমাথা কালো চুল। ফিসফিস করে শিউলি ঝরছে। ঝরে পড়ছে দিদির মাথায়, ঘাড়ে, পিঠে। এই সময় দিদিকে মনে হয় দেবী।
শিউলি গাছের তলাটা ফুলে-ফুলে সাদা। সবুজ ঘাস। সাদা ফুল। হলুদ বোঁটা। ফিনফিনে শিশির। সব মিলিয়ে সে এক কাণ্ড! হঠাৎ জয়া বলবে, “জয়, অনুমতি নিয়ে গাছটাকে খুব করে ঝাঁকা।”
“কার অনুমতি, দিদি?”
“গাছের অনুমতি। গাছ হল দেবতা। গাছকে বল, বৃক্ষদেবতা, তোমাকে একটু ঝাঁকাচ্ছি। আজকের সব ফুল ঝরিয়ে দাও। আমাদের পুজো হবে।”
বেশ গায়েগতরে, হুড়ম-দুড়ুম কাজ হলে জয়ের ভীষণ মজা লাগে। মনে হয় বেশ একটা কিছু হচ্ছে। মাঝে মধ্যে বাগানে ছাগল ঢুকে পড়ে। রাম খেলোয়ানদের রামছাগল। জয়ের ওপর ভার পড়ে ছাগলটাকে তাড়াবার। সে এক দক্ষযজ্ঞ ব্যাপার। ছাগল ছুটছে এদিক থেকে ওদিকে, পেছনে ছুটছে জয়। ছাগল ঝুল কাটছে। তেড়ে আসছে গুঁতোবার জন্য। একবার-দু’বার জয়কে হয়তো ল্যাং মেরে ফেলে দিচ্ছে। শেষে ছাগলও হাঁপাচ্ছে, জয়ও হাঁপাচ্ছে। ছাগলটা আবার মাঝে-মাঝে হুঁহুঁ করে হেসে ওঠে। কিন্তু রাম খেলোয়ানের মেয়ে এসে যেই ডাকলে, ‘চাচা, আ যাও।’ অমনি ছাগলটা বাধ্য ছেলের মতো গুটি-গুটি চলে যাবে। ছাগলটার নাম, চাচা। রাম খেলোয়ানের মেয়ের নাম গৌরী। মেয়েটা একটু দুষ্টুমতো আছে। জয়কে জিভ দেখায়। ভেংচি কাটে। ছোট-ছোট পাথরের টুকরো ছুড়ে মারে। জয় বুঝতে পারে না, মেয়েটা কেন অমন করে। সে তো কিছুই করেনি, তা হলে গায়ে পড়ে ঝগড়া কেন? একদিন ভুট্টা ছুড়ে মেরেছিল। এবার আখের খাদি দিয়ে খোঁচা মেরেছিল। জয় কিছু বলে না। অবাক হয়ে মেয়েটাকে দেখে। ধারালো মুখ, ঝকঝকে দুটো চোখ। এক মাথা এলোমেলো চুল। সামান্য লালচে রং। সব সময় একটা ঘাগরা পরে থাকে। হাতে নানা রঙের গালার চুড়ি। জয় কোনও-কোনও সময় তাড়া করলে মেয়েটা হাসতে-হাসতে ছুটে পালায়। হরিণের মতো ছুটতে পারে।
জয় যখন গাছটাকে বলে, “তোমাকে একটু ঝাঁকাচ্ছি,” তখন গাছকে মনে হয় বড়সড় একজন মানুষ। বাবার মতো, দাদুর মতো। মায়ের মতো। জয় শুনতে পায়, গাছ যেন বলছে, “ঠিক আছে জয়, তুমি যত পারো আমাকে দোলাও।”
জয় গাছটাকে ঝাঁকায়। পাতায়-পাতায় খসখস শব্দ হয়। শিশিরের ফোঁটা ঝরে। অজস্র সাদা ফুল ঝরে পড়ে দিদির গায়ে, মাথায়। একেবারে চাপা পড়ে যায়, এত ফুল। তারপর তারা ঘাসের ওপর সাদা একটা চাদর বিছিয়ে মুঠো-মুঠো ফুল তোলে। ফুলের একটা পুঁটলি তৈরি হয়। হঠাৎ জয়া দৌড়তে শুরু করে। “জয়, রান।” জয় ছুটতে থাকে দিদির পেছনে-পেছনে। তারা বাগানের এ-মাথা থেকে ও-মাথা চলে যায়। ওদিকে গোলাপ বাগান। ধর্মা মালী এসে রোজ খুব যত্ন করে। অনেকদিনের পুরনো মানুষ। অনেকের অনেক বাগান করেছে। নিজের কিন্তু এক ছটাকও জমি নেই। মানুষটার কবির মতো চেহারা। চোখ দুটো যেন স্বপ্ন দেখছে। রোদে পুড়ে, জলে ভিজে শরীরটা ফাটা-ফাটা হয়ে গেছে। জীবনে কখনও অসুখ করেনি। পেট খারাপ, মাথাধরা, জ্বর এসব কখনও হয়নি। পোড়া মাটির পুতুলের মতো শরীর। মানুষটা গাছের সব কিছু জানে। গাছের কখন খিদে পায়, কখন দুঃখ হয়, কখন আনন্দ।
সেই গোলাপ বাগানে এসে তাদের দৌড় থেমে যায় ভাই আর বোন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সারারাত ধরে গোলাপ ফুটেছে। লাল, কালো, হলুদ, সাদা। টাটকা, তাজা গোলাপ। দূরের পাহাড়টা তখন আরও কাছে এগিয়ে আসে। আরও স্পষ্ট। পাথরের খাঁজ দেখা যায়। পাহাড়ের মাথায় একটা সমাধি আছে। একটা ক্রস পোঁতা আছে। পরিষ্কার দেখা যায়। জয় ভাবে, পাহাড় এত পাথর কোথা থেকে পায়!
দিদি গোলাপদের সাবধানে আদর করে। লাল, হলুদ, কাগজের টুকরোর মতো বড় বড় প্রজাপতি নেচে বেড়ায়। আর ঠিক সেই সময় চার্চের ঘন্টা বাজে। জয় আর জয়া জানে, এইবার তাদের স্কুলে যাওয়ার সময় হয়েছে। সকালের স্কুল। তাদের সকালের খাওয়াটা দাদুর তদারকিতে হয়। বিলিতি ব্রেকফাস্ট নয়, দিশি নাস্তা। কল বেরনো ছোলা, আখের গুড়, বাদাম, পাকা পেঁপে, দুধ-রুটি। বাড়িতে পাউরুটির প্রবেশ নিষেধ।
॥ ২ ॥
জয়, আ!
দাদুর এইটাই কায়দা। অঙ্কের মানুষ। জয় আর জয়ার কমন ফ্যাকটার জয়টা বের করে নিয়ে একটা আ যোগ করলেই ভাই আর বোন দুজনকেই ডাকা হল।
“জয়-আ।”
বাগানের পুব দিকের বেদীতে বসে শিবশঙ্কর ডাকছেন। বড়-বড় চুল কাঁচাপাকা, গ্রিকদের মতো খাড়া নাক। ঋষির মতো দেখায়। সুর্যের লাল গোল থালা পুব দিগন্তে মাথা তুলেছে। যেন জল থেকে মাথা ঠেলে উঠছেন শক্তিশালী এক দেবতা। সোনার মতো তাঁর রং। যত বেলা বাড়বে ততই তাঁর তেজ প্রখর থেকে প্রখরতর হবে। শিবশঙ্করের পাশেই চারটে জবা গাছ, ঝাঁকড়া হয়ে আছে। একটা লাল টুকটুকে জবা মা কালীর মতো লাল লকলকে জিভ বের করে বাতাসে দোল খাচ্ছে। সূর্যের প্রথম কিরণ বড় মিষ্টি। সোনালি মায়ায় চারপাশ ভরে দিতে চায়। জীবনপাত্র যেন কানায়-কানায় ভরে উঠছে। চারপাশ ঝকঝক করছে। আকাশ এই মুহুর্তে ঘন নীল। দুলারিদের একঝাঁক সাদা পায়রা আকাশে ডিগবাজি খাচ্ছে। আনন্দে মাতোয়ারা। একটু পরেই তো এই মুহুর্তটা আর থাকবে না। আগুন ধরে যাবে প্রকৃতিতে। তখন আর পাথরে পা রাখা যাবে না। জল থেকে ধোঁয়া উঠবে। প্রজাপতিরা পাতার আড়ালে ছায়া খুঁজবে। কাক ক্লান্ত হয়ে ডাকবে কি ডাকবে না!
দাদুর ডাক শুনে জয় আর জয় প্লাস আ, জয়া দু’জনেই তীরবেগে দৌড়ল। এই ডাকটার জন্যে তারা অপেক্ষা করে থাকে। বাগানের গাছে-গাছে জল যাওয়ার জন্যে মালী ধর্মা নালি কেটে রেখেছে। তার পাশে-পাশে ছোট-ছোট ঘাস, ছোট-ছোট চারা গাছ। নুড়িপাথর নানা রঙের। কম উচ্চতার ছোট-ছোট বেড়া এখানে ওখানে। জয় এই সব বাধা মানতে চায় না। জয়া বেড়াগুলো পাশ কাটিয়ে যায়। জয়ের কাছে সেগুলো হার্ডলের মতো। টপাটপ টপকে যায়। দৌড়বীরের মতো।
তারা জানে কী করতে হবে! দৌড়ে গিয়ে দাদুর দু’পাশে বসে পড়তে হবে। হাঁপালে চলবে না। দাদু বলবেন, “ছুটবে, কিন্তু হাঁপাবে না।” সেটা কী করে সম্ভব হবে! ছোটার তালে-তালে শাস নেবে। রিদ্মিক ব্রিদিং। ছন্দোবদ্ধ শ্বাস-প্রশ্বাস।
শিবশঙ্কর বললেন, “এসে গেছ, আমার দুই খরগোশ। আজ কতক্ষণ সময় লাগল দেখি।” বুকপকেট থেকে স্টপওয়াচ বের করে দেখলেন, “চল্লিশ সেকেন্ড। কালকের চেয়ে দু’সেকেন্ড কম। গুড।” শিবশঙ্কর জয় আ, বলে ডেকেই স্টপওয়াচ চালু করে দেন। এটাও তাঁর একটা হিসেব। ফিট্নেস পরীক্ষা। যেদিন সময় বেশি লেগে যায়, সেদিন বুঝতে হবে শরীর ঠিক যাচ্ছে না। কমজোর হয়ে আছে। সঙ্গে-সঙ্গে খোঁজ নেবেন, ঠিকমতো খাচ্ছে কি না ! কী খাচ্ছে! খাদ্যে কোনও কিছু অভাব ঘটছে কি না! মিনারল, সল্ট, ভিটামিন, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট। জল ঠিকমতো খাওয়া হচ্ছে কি না। যাবতীয় তথ্য তিনি সংগ্রহ করে ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা নেবেন।
শিবশঙ্কর বললেন, “এই মাসের বেস্ট টাইম। সেদিন তোমরা পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড নিয়েছিলে। ওয়াস্ট রেকর্ড অব দিস মান্থ। ইউ হ্যাভ ইমপ্রুভড। আরও দশ সেকেন্ড কমাতে হবে। লেটুস আরও বেশি খেতে হবে। গাজর আর ছোলার মাত্রা বাড়াও। দুটোই হর্সপাওয়ার।”
দিগন্ত ছুঁয়ে থালার মতো সূর্য সম্পূর্ণ প্রকাশিত। শিবশঙ্কর বললেন, “হাত জোড় করো। এসো, দিনকে আমরা আবাহন করি। লেট আস স্টার্ট দি ডে।”
সমবেত প্রার্থনার সময় এটা। চাইবার সময়। ধন নয়, জন নয়, এমন এক চাওয়া, যা কেউ চায় না—
তেজোহসি তেজো ময়ি বৈহি।
বীর্যমসি বীর্যং ময়ি বৈহি।
বলমসি বলং ময়ি বৈহি।
ওজোহস্যোজো ময়ি বৈহি।
মনুরসি মনুং ময়ি বৈহি।
সহোহসি সহো ময়ি বৈহি।
শিবশঙ্কর গম্ভীর গলায় বলতে লাগলেন, “তুমি তেজ, আমাতে তেজ স্থাপন করো। তুমি বীর, আমাতে বীরত্ব স্থাপন করো। তুমি বল, আমাতে বল স্থাপন করো। তুমি শক্তি, আমাতে শক্তি স্থাপিত করো। তুমি মানসিক তেজ, আমাতে মানসিক তেজ স্থাপন করো। তুমি প্রভাব, আমাতে প্রভাব স্থাপিত করো।”
দু’পাশে দু’জনের মাথায় দুটো হাত রেখে শিবশঙ্কর অনেকক্ষণ বসে রইলেন স্থির হয়ে। এই ছেলে আর মেয়ে বড় হবে। পৃথিবীর মুখোমুখি হবে। শক্তি, তেজ, বীরত্ব নিয়ে। জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। জগৎকারণ সূর্য তুমি এদের তেজ দাও, দীপ্তি দাও, সৎ গুণ দাও। আমাদের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমাদের ছাইয়ের ওপর অমিত তেজে এদের সভ্যতা যেন জেগে ওঠে। এক প্রদীপ থেকে আর-এক প্রদীপে শিখা এইভাবেই ছড়ায়। শিবশঙ্করের চোখে জল। শেষ নাহি যার শেষ কথা কে বলবে। গির্জায় প্রেয়ারের ঘন্টা। সোনার পাতের আকাশের গায়ে গাঢ় নীল পাহাড়।
দেখার সকাল শেষ হল। বাতাস গরম হয়ে উঠছে। রোদের তেজ বাড়ছে। দূরে বহুদূরে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মেন লাইনের ট্রেন যাচ্ছে ময়াল সাপের মতো এক পেট লোক নিয়ে। দূরে জৈন মন্দিরের চূড়ায় সাদা একটা পতাকা উড়ছে পতপত করে।
বাইরের বাগানে যখন এই সব হচ্ছে, ভেতরের বাড়িও জেগে উঠেছে। দিদিমার গায়ের রং কাশীর পাকা পেয়ারার মতো। চোখে সোনালি চশমা। পরে আছেন চওড়া লাল পাড় সাদা শাড়ি। তিনি তদারকি করছেন একটা জিনিস। দাদু যার নাম রেখেছেন, স্বাস্থ্য-নির্যাস। রান্নাঘরের বাইরে লাগাদাঁই একটা শিলে দুলারি দুলে-দুলে কালমেঘ পাতা বাটছে। সকালে সকলের প্রথম খাওয়া হচ্ছে কালমেঘের রস। সে যত তেতোই হোক হাসি মুখে খেতে হবে। ওইসময় ছেলে আর মেয়ের মুখ দেখে, মা সুর করে গাইবেন, কালো সে যতই কালো হোক, মেঘ তো নয়, সে যে সবুজ পাতা।
দিদিমা খুব রাশভারী মানুষ। তাঁর মুখের ওপর কথা বলার সাহস কারও নেই। কলকাতার খুব নামকরা কবিরাজের মেয়ে। নিজেও কবিরাজি করেন। এ-তল্লাটের যত মানুষ তাঁর ওষুধ খেয়ে বেঁচে আছে। সপ্তাহে তিনদিন চার্চে বসে রুগি দেখেন। বিনাপয়সায়। সেই-সেই দিনে ভিড় লেগে যায়। দিদার চিকিৎসার খুব নামডাক। জয় আর জয়ার গায়ে মাঝে-মাঝে হাত রেখে উত্তাপ দেখেন। শরীর হবে পাথরের মতো শীতল। হাতের তালু ছ্যাঁক-ছ্যাঁক করলে বুঝতে হবে লিভার ঠিক চলছে না। পিত্ত বাড়ছে। কবিরাজি মতে শরীরের তিনটি উপাদান, বায়ু, পিত্ত, কফ। তিনের সমতাই হল সুস্বাস্থ্য! দিদার অনেক বই আর পুঁথি আছে। দিদার সহকারী হল দুলারি। কুড়ি-বাইশ বছরের দেহাতি একটি মেয়ে। মিশনারিদের স্কুলে ছেলেবেলায় পড়েছে। মিশনারিদের প্রভাবে সবসময় ঘাগরার মতো একটা পোশাক পরে থাকে। ঘাড় পর্যন্ত কাটা চুল ঝুমুর ঝুমুর করে। শ্যামলা কিন্তু সুন্দরী। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ভাল ইংরেজি বলতে পারে। চোখে মুখে বুদ্ধির ছাপ। দিদাকে বলে, মাদার মেডিসিন। দিদা ফর্মুলা বলে দেন, দুলারি গাছগাছড়া কিনে এনে ওষুধ তৈরি করে। মেয়েটি খুব খাটতে পারে। যত পরিশ্রম করে তত হাসে। মুখের হাসি যেন ফুরোয় না। কোনও বিরক্তি নেই। যা বলবে তাই রবে হাসিমুখে। জয় আর জয়ার দিদা প্রায়ই বলেন, “দুলারি, আমার এই বিদ্যা সব তোকে দিয়ে যাব। দেখবি, জীবনে তোর কোনও অভাব থাকবে না। তবে একটা কথা, অন্যকে ভাল করতে গেলে নিজেকে ভাল হতে হবে। সৎ, সুন্দর। অন্যের অনিষ্ট চিন্তা করলে হবে না। রোজ সকালে উঠে বলতে হবে, পৃথিবীর সকলের মঙ্গল হোক।”
সেই কালমেঘের রস সকলকেই খেতে হয়। কারও মুক্তি নেই। জয়ের বাবা মজা করে বলেন, “জানো মা, তোমার কল্যাণে গুড ডে আর বলার উপায় রইল না, বলতে হবে বিটার ডে। ”
দাদু শিবশঙ্কর ছোট একটা কারখানা করেছেন। তিনি বলেন, “কোনও মানুষেরই অলস বসে থাকা উচিত নয়। কিছু-না-কিছু একটা করা উচিত। বাইবেলে আছে, আর্ন ইয়োর ব্রেড বাই দি সোয়েট অব ইয়োর ব্রাউ। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার করবে। শিবশঙ্কর মডেল তৈরি করেন। ব্রিজের মডেল, কালভার্টের মডেল, কারখানার মডেল, বহুতল বাড়ির মডেল। আর-একটা জিনিস করেন, মেকানিক্যাল টয়, কলের পুতুল। যে খেলনা দম দিলেই চলবে। সে-সব অসাধারণ জিনিস। বিলিতি ছাঁচে, বিলিতি ধাঁচে তৈরি। খুব ভাল বাজার। পাটনা, দিল্লি, কলকাতা সব জায়গায় চালান যায়। শিবশঙ্করের ছোটমতো একটা কারখানা আছে। সব কাজ নিজেই করেন। সারাদিন সেইখানেই থাকেন। দিনের বেলা ভাত খান না। আলস্য আসার ভয়ে। বিলিতি ধরনের জীবনে বিশ্বাসী। সকালে হেভি ব্রেকফাস্ট, মডারেট একটা লাঞ্চ, হেভি সাপার। তারপর তেড়ে মাইলখানেক বেড়ানো। সেই বেড়ানোর দু’জন সঙ্গী, জয় আর জয়া।
যে-রাস্তাটা ময়াল সাপের মতো এঁকে বেঁকে পাহাড়ের দিকে চলে গেছে নদী পেরিয়ে, সেই সরলা নদীর তীরে এসে তাদের চলা থেমে যায়। সারাটা পথ শিরশিরে বাতাস। পথের নুড়িতে জুতোর মশমশ শব্দ। কখনওসখনও ছিটকে যায় ছররার শব্দে। দেবদারু আর ইউক্যালিপটাসের পাতায় বাতাসের শনশন শব্দ। পাতার ফাঁকে রাতের গাঢ় নীল আকাশ কাঁপে। তারা ছড়িয়ে থাকে হিরের কুচির মতো। সরলা যত এগিয়ে আসে বাতাস তত হিম হয়। সরলার তীরে কোনও বিশাল গাছ নেই। শীর্ণ নদী। বর্ষায় তার দু’কূল ছাপিয়ে যায়। অন্যসময় সামান্যই জল। পায়ের পাতা ডোবে কি ডোবে না। অস্ফুট কুলুকুলু শব্দ। নদী যেন হৃদয়ের কথা বলতে বলতে এগিয়ে চলেছে রাতের দুই পথিকের মতো। দিনের বেচাকেনা শেষ করে হাট থেকে ফিরছে।
নদীর ধারে মসৃণ পাথর আছে। শিবশঙ্কর নাতি আর নাতনিকে নিয়ে বড় একটা পাথরে পাশাপাশি বসেন। মাথার ওপর নীল-কালো আকাশ। নক্ষত্রপুঞ্জ। গ্যালাক্সি, মিল্কিওয়ে। অদূরে নদী। জলে ভেজা বালিতে সিনসিন শব্দ। জয় আর জয়ার প্রথম-প্রথম গা ছম ছম গ্রত। যেতে-যেতে সাহস বেড়ে গেল। এখন আর করে না। এখন ভালই লাগে। একদিন যেতে না পারলে মন ছটফট করে।
শিবশঙ্কর ছেলে আর মেয়ে দুটোকে কনস্টিলেশান চেনান। তারা চেনার একটা ছড়া শিখিয়েছেন, 0 Be A Fine Girl, Kiss Me Right Now। এই ছড়ায় লুকিয়ে আছে তারাদের রং আর উত্তাপ। সাদাটে সবুজ রঙের তারা হল সবচেয়ে উত্তপ্ত। গ্রিন হোয়াইট স্টার। এরা হল ও গ্রুপের তারা। বি হল ব্লু নীল। উত্তাপ অনেক কম। এ হল ব্লু হোয়াইট। হিরের মতো। আরও শীতল। ফাইনের এফ হল হলদে তারা, সাদাটে-হলদে। গার্লের জি হল একেবারেই হলদে। কিসের কে হল কমলা রঙের তারা। হলুদ-কমলা। মি-র এম হল নির্ভেজাল কমলা। রাইটের আর হল লাল-কমলা। নাও-এর এন হল টকটকে লাল। একেবারেই শীতল। মাথার ওপর অন্ধকার আকাশ। তারাদের দ্যাখো। চেষ্টা করো রং চিনতে। তাকিয়ে দ্যাখো কালপুরুষকে। ওই দ্যাখো কালপুরুষের কুকুর। সপ্তর্ষি কেমন শুয়ে আছে। ধ্রুবতারা খুঁজে পাওয়ার সহজ নিয়মটা শিখে নাও। আকাশ থেকে চোখ ফিরিয়ো না। এখনই উল্কাপাত হতে পারে। গ্রহ-নক্ষত্রের সাম্রাজ্য ছেড়ে জ্বলন্ত রকেটের মতো নেমে আসছে উল্কাপিণ্ড। পৃথিবীতে পৌঁছবার আগেই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। সেই পাথরের ওপর বসে শিবশঙ্কর রবীন্দ্রনাথ আবৃত্তি করেন। এপাশে জয়, ওপাশে জয়া। দু’জনের কাঁধে দু’হাত—
ফুরাইলে দিবসের পালা
আকাশ সূর্যেরে জপে
লয়ে তারকার জপমালা।
কোনও-কোনও দিন সত্যিই উল্কাপাত দেখা যায়। আকাশ আলোকিত করে নেমে আসছে জ্বলন্ত উল্কাপিণ্ড। নীল পাহাড়ের মাথায়। জয় আর জয়া কান খাড়া করে থাকে, যদি ঠকাস করে, পাথরে পাথর পড়ার শব্দ শুনতে পায়। পায় না। তার আগেই সব ছাই।
শিবশঙ্করের অদ্ভুত একটা হিসেব আছে, কতক্ষণ বসবেন, কখন উঠে বাড়িমুখো হবেন। হিসেবটা করেন বাতাস বুঝে। জলে-জঙ্গলে-পাহাড়ে থাকতে-থাকতে বাতাসের উত্তাপ অনুভব করে রাত বোঝার ক্ষমতা হয়েছে। আকাশের নক্ষত্রমণ্ডলও সেই নির্দেশ দেয়। প্রকৃতির নিজস্ব একটা ঘড়ি আছে। প্রকৃতির মধ্যে থাকলে সেই ঘড়ির সময় বোঝা যায়। শিবশঙ্কর ঠিক সময়ে বলবেন, “চলো, এইবার ফেরা যাক।” সরলা নদী তখন স্বপ্নের মধ্যে বিড় বিড় করে বলছে যেন, “কল্লোলমুখর দিন / ধায় রাত্রি-পানে/ উচ্ছল নির্ঝর চলে সিন্ধুর সন্ধানে।”
॥ ৩ ॥
বাড়িতে একটা গাড়ি আছে। দুধসাদা রং। সেই গাড়িটা কেউ চাপে না। খুব প্রয়োজন হলে ডাক্তারবাবু গ্যারাজ থেকে গাড়িটা বের করেন। যারা গাড়ি চাপে তারা সাধারণ মানুষ থেকে অনেকটা দূরে সরে যায়। বাবু হয়ে যায়, সুখী হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ তাদের আর ভালবাসে না। বড়লোকদের মানুষ ঘৃণা করে, অবিশ্বাস করে। যখন তোমার খুব বিপদ, একমাত্র তখনই গাড়ি চাপতে পারো।
ডাক্তারবাবু সাইকেল চাপেন। কোনও অহঙ্কার নেই। বিলেত ফেরত ডাক্তার। ইচ্ছে করলেই সাদা গাড়িতে চেপে হুস্ করে হাসপাতালে যেতে পারেন। জয়, জয়াকে স্কুলে দিয়ে আসতে পারেন। না, সে নিয়ম নেই। শিবশঙ্করের কড়া হুকুম—হেঁটে যাবে, হেঁটে আসবে। এক মাইল পথ কিছুই নয়। হাঁটলে মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। হাঁটলে ভাল চিন্তা আসে মনে। হাঁটলে শরীর সুস্থ থাকে। বিদ্যাপ্রতিষ্ঠানে বিনীতভাবে যেতে হয়। স্কুল বড়লোকি দেখাবার জায়গা নয়। অধ্যয়ন এক তপস্যা। যত কষ্ট করবে তত ভাল ফল পাবে। রোদে হাঁটতে হবে, তাতে কী হয়েছে! গরমের দেশে গরম সহ্য করতে হবে। শীতের দেশে শীত। পৃথিবীটা সুখের জায়গা নয়। কষ্ট সহ্য করতে পারলেই সুখ। কষ্ট যখন আর কষ্ট থাকবে না, তখন দুঃখও আর থাকবে না। পৃথিবীটা বীরের জায়গা। স্বাস্থ্যই শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মানুষ ছাড়া পৃথিবীর আর কোন প্রাণী পরনির্ভর! পাখি কি পালকি চাপে? নিজের ডানায় ভর করে ওড়ে। ঘোড়া কি গাড়ি চাপে? ঘোড়া গাড়ি টানে। শিবশঙ্করের কাছে পনেরো মাইল টানা হেঁটে যাওয়াটা কিছুই নয়। বৈশাখের চড়া রোদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাগান কোপাতে পারেন। একটা কথা তিনি প্রায়ই বলেন। শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়।
সকাল হল কাজের সময়। ছ’টা থেকে ন’টা টানা পড়তে হবে। ন’টা থেকে দশটা স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি। ঠিক দশটায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাড়ে দশটায় স্কুল। সরলা নদীর তৃতীয় বাঁকে জোড়া বটের মাঠে তাদের মিশনারি স্কুল। এক ফরাসি পাদরি এই শতাব্দীর প্রথম দিকে এই স্কুল স্থাপন করেছিলেন। ছেলে মেয়ে একসঙ্গে পড়ে। শুধু লেখাপড়া নয়, নানারকম হাতের কাজ শেখানো হয়। উঁচু ক্লাসের ছেলেমেয়েদের সমাজসেবা করতে হয়। স্কুলটা যখন হয় তখন এই অঞ্চলের লোকসংখ্যা খুব কম ছিল। এখন সংখ্যা অনেক বেড়েছে। শহর এগিয়ে এসেছে। বড়-বড় কলকারখানা হয়েছে। গালার চাষ হয়, মাইকা তো আছেই। এই অঞ্চলের মাইকা খুব উঁচুদরের। মাটির তলায় পরতে-পরতে সঞ্চিত আছে ঝকঝকে এই অভ্র। অবাক হয়ে দেখার মতো। মাটির তলায় কে এমন করে সাজিয়ে রেখেছে! সরলা নদীর জলে এই অভ্রের কণা চিক চিক করে। মাটির তলায় উৎকৃষ্ট চুনাপাথর আছে। অনেকের ধারণা। সরলা নদীর আশপাশে কোথাও সোনা আছে। প্রায়ই কিছু-কিছু মানুষ আসেন অনুসন্ধানে। দল বেঁধে। চুপিচুপি খোঁজপাত চালান। তাঁদের হাবভাব অপরাধীর মতো। যেন কোনও অন্যায় করতে এসেছেন। সরলা নদীতে সোনার নুড়ির সন্ধান করেন। বৃদ্ধ আদিবাসীদের সাহায্য নেন। যাঁরা খুব বৃদ্ধ তাঁরা অনেক খবর রাখেন। তাঁরা এক-একজন এক একটা ইতিহাসের মতো। অতীত ঐশ্বর্যের খবর রাখেন তাঁরা। শিবশঙ্কর জানেন, ওঁরা কী জন্য আসেন। যতই লুকোবার চেষ্টা করুন, শিবশঙ্করকে ফাঁকি দেওয়া শক্ত। তিনি জানেন কোন অঞ্চলে কী থাকতে পারে! সরলা নদী আর ওই নীল পাহাড়। এর মাঝের জায়গাটা খুবই রহস্যময়। ওখানে অনেক কিছু থাকা সম্ভব। কে আর সেভাবে অনুসন্ধান করে দেখছে।
জয় আর জয়ার বাবার নাম উদয়ন। টুকটুকে ফরসা। হাসিখুশি একজন মানুষ। তাঁর অনেক গুণ। শুধু একজন নামকরা ডাক্তার নন। ভীষণ ভাল সরোদ বাজান। রোজই রেওয়াজে বসেন, একটু বেশি রাতে। শিবশঙ্কর বলেন, “যারা কাজের লোক তাদের কখনও সময়ের অভাব হয় না। ইচ্ছে করলে তারা সব কাজের জন্যে সময় বের করতে পারে। যারা অলস তারাই বলবে, সময় পাই না।” মায়ের নাম উমা। মা খুব ভাল ছবি আঁকেন। আর্ট কলেজের পাশ করা। বাবা আর মাকে পাশাপাশি দেখলে, ঠাকুমা বলেন, হর-পার্বতী। ঠাকুমাই পছন্দ করে মাকে এনেছিলেন। তাই মায়ের কথা বলতে ঠাকুমার ভীষণ গর্ব। জয়ের প্রায়ই মনে হয়, সে স্বপ্নের মধ্যে আছে। বাবা গভীর রাতে সরোদে দরবারী আলাপ করছেন। দাদু টেবিলল্যাম্পের সামনে বসে তাঁর জীবন কাহিনী লিখছেন, হলুদ রঙের মোটা পার্কার কলম দিয়ে। সকালবেলা দিদা ও দুলারি হামানদিস্তায় কবিরাজি ওষুধ কুটছেন। বেলা শেষের পড়ন্ত আলোয় মা বাগানের বেদীতে বসে জলরঙে ছবি আঁকছেন। নীল রঙের মোটা ভাঙ্গেরি সুট পরে শিবশঙ্কর তাঁর ওয়ার্কশপে নতুন কোনও খেলনার মডেল তৈরিতে ব্যস্ত। কোথাও কোনও দুঃখ নেই, অভাব নেই, খ্যাচাখেচি নেই। তাই কি বাংলোটার নাম, ‘আনন্দ ধাম’।
ডাক্তার উদয়ন চট্টোপাধ্যায় সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই হাসপাতালে বেরিয়ে যান। জয় আর জয়া পড়া ছেড়ে সেই সময়টায় গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। পাশে মা, দিদা, দুলারি, শিবশঙ্কর, ধর্মা, রামখেলোয়ান, এমনকী তাদের কুকুরটাও। কুকুরের নাম ‘মোহর’। মোহরকে কুকুর বললে জয়া ভীষণ রেগে যায়। বলে, ও কুকুর নয়, মানুষ। কথাটাই যা বলতে পারে না, আর দু’পায়ে দাঁড়াতে পারে না, এইটুকুই যা তফাত। পুরো পরিবার গেটের সামনে হাসিমুখে। উদয়ন হাসতে-হাসতে হাত নেড়ে তাঁর সবুজ সাইকেলে উঠবেন। সবাই একসঙ্গে বলতে থাকবেন, “দুর্গা, দুর্গা।” শিবশঙ্কর রোজই যেমন সাবধান করেন সেইরকম সাবধান করবেন, স্নেক বেন্ডের কাছে ধীরে চালিয়ো। আধমাইল দূরে রাস্তাটা সাপের মতো আঁকাবাঁকা হয়ে আছে, জায়গাটা একটু বিপজ্জনকও। গাছপালাও বেশি। এপাশ থেকে ওপাশে কী আসছে দেখা যায় না। ওই জায়গায় সাঁওতালদের বোঙ্গা মন্দির। কলকাতার লাহিড়িদের বিশাল বাগানবাড়ি। ভেতরে তিন-চারটে বিশাল অ্যালসেশিয়ান ঘাঁউ-ঘাউ করে। বাতাসে ইউক্যালিপটাসের ঝস-ঝস শব্দ। রাস্তাটা ওই জায়গায় একটু গড়ানে মতো। নুড়ি পাথরে সাইকেলের চাকা হড়কে যেতে পারে। উদয়ন যতক্ষণ না রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছেন ততক্ষণ সবাই গেটের সামনে। সে এক সুন্দর চিত্র। উদয়ন চলে যাওয়ার পর বাড়িটা যেন ফাকা-ফাঁকা হয়ে যায়। সকলেরই মনে একটা দুঃখ-দুঃখ ভাব। উদয়ন যতক্ষণ থাকেন, বাড়ি একেবারে জমজমাট। কখনও রবীন্দ্রসঙ্গীতের লাইন গাইছেন, কখনও চলতি হিন্দি গান। কখনও সাধারণ কথা কবিতার মতো করে বলছেন। কখনও জয়াকে রাগিয়ে দিচ্ছেন। জয়ের সঙ্গে ককফাইট করছেন। আবার শিবশঙ্করের সঙ্গে যখন গভীর কোনও আলোচনা করেন তখন আবার অন্য মানুষ। যখন ধর্মার সঙ্গে গাছের আলোচনা করেন তখন এক অভিজ্ঞ মালী। যখন উমার সঙ্গে রান্নার আলোচনা করেন তখন পাকা রাঁধুনি। যখন নিজের মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকেন তখন একেবারে শিশু। আকাশের মতো উদার এক মানুষ ডাক্তার উদয়ন চট্টোপাধ্যায়। আর শিবশঙ্কর হলেন সমুদ্রের মতো গভীর।
জয় আর জয়াদের স্কুলের পোশাক ধবধবে সাদা। রাজহাঁসের মতো। জয়া যখন ফ্রিল দেওয়া সাদা ফ্রকটা পরে জয় তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, দিদিটা কী সুন্দর ! লাহিড়িদের বাগানের শ্বেতপাথরের পরীটার মতো। আবার জয় যখন সাদা প্যান্ট, শার্ট, মোজা, জুতো পরে সামনে এসে দাঁড়ায়, জয়া ভাবে, ভাইটা তার কী সুন্দর! চার্চের দেবদূতের মূর্তিটার মতো।
ভাই বোন একা-একাই স্কুলে যায়। এখন তারা বড় হয়েছে। যাওয়ার পথে একে-একে আরও অনেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। একটা দল তৈরি হয়। প্রথমেই পড়ে শিরিনদের বাড়ি। মেয়েটা জয়ার ক্লাসে পড়ে। ভীষণ ভাল নাচতে পারে। শিরিনের এক বুড়ি দিদা ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা কাজ করতেন কয়লার খনিতে। বিশাল এক খনি দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান ; তখন শিরিন খুবই ছোট। আজ পাঁচ বছর হল শিরিনের মা মারা গেছেন। খুব কষ্টে সংসার চালাচ্ছেন শিরিনের দিদা। তিনি কারুকাজ করা মোমবাতি তৈরি করেন। চার্চের সুন্দর দোকানে সেই সুন্দর বাতি বিক্রি হয়। এক-একটার এক-এক রকম ডিজাইন। কোনওটা পরী, কোনওটা বৃদ্ধ, কোনওটা লতাপাতাজড়ানো স্তম্ভ! নানারকমের রং। দেখলে চোখ ফেরানো যায় না। শিরিনের দিদা এইসব কাজ মিশনারি মেমসায়েবের কাছ থেকে শিখেছেন। এত খেটেও রোজগার তেমন হয় না। তাই বাড়ির জমিতে বাগান করেছেন। সবজি তো ফলেই, সেই সঙ্গে ফুল। সেরা গোলাপ ফোটে শিরিনদের বাগানে। বেতের ছোট-ছোট বাস্কেটে রাঁচিতে চালান যায়। ঠাণ্ডা গাড়ি এসে রোজ সকালে নিয়ে যায়। অবশ্যই ফুল ফোটার সিজ্নে।
শিরিনদের একটা কুকুর আছে। অনেক বয়েস তার। নাম আসমান। বাড়ির বাইরে উঠোনের একপাশে ছায়ায় শুয়ে থাকে সারাদিন। চোখ দিয়ে জল পড়ে। শুয়ে-শুয়ে অতীতের কথা ভেবে কাঁদে, যখন শিরিনের বাবা আর মা বেঁচে ছিলেন। যখন এই বাড়িতে আনন্দ ছিল। হাসি ছিল, গান ছিল। সেই সব দিনের কথা ভেবে কাঁদে। জয়া রোজই এই আসমানের জন্যে স্যান্ডউইচ করে আনে। জয়া এলেই আসমান বুঝতে পারে, এমন একজন কেউ এসেছে যে তাকে ভালবাসে।
আসমান টলমলে পায়ে উঠে দাড়িয়ে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দীর্ঘ ডাকটা ডেকে উঠল আকাশের দিকে মুখ তুলে। যার ভাষা হল, “দেবি, তুমি এসেছ! ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।” আসমান জয়ার গায়ে গা ঘষছে আর তার চামরের মতো লেজটা এপাশে-ওপাশে আনন্দে দোলাচ্ছে। জয়া খাবার এনেছে সেইটাই একমাত্র কারণ নয়। জয়া ভালবাসা এনেছে। বৃদ্ধ অ্যালসেশিয়ানের চোখে জল। এ জল দূঃখের নয়, আনন্দের। শিবশঙ্কর শিখিয়ে দিয়েছেন, নাকের পাশ দিয়ে জল বেরোলে বুঝবে কাঁদছে, আর কানের দিক দিয়ে জল বেরোলে বুঝবে আনন্দের। সে মানুষই হোক আর পশুই হোক।
আসমানের এই ডাক শুনলেই শিরিন বুঝতে পারে জয় আর জয়া এসেছে। আকাশছোঁয়া এই ডাক আসমানের গলা দিয়ে অন্য সময় বেরোয় না। শিরিন বইয়ের ব্যাগ নিয়ে দালানে বেরিয়ে এল। ছোট্ট ছিমছাম একটা বাংলো। সামনে দুটো বড় ঘর। পেছনে ঢাকা বারান্দা। টালির গড়ানে ছাদ। পেছনের বারান্দায় শিরিনের দিদার মোমের কারখানা।
সাদা ফ্রকপরা শিরিনকে দেখলে জয় চমকে ওঠে। ধারালো ছুরির মতো চেহারা। মুখটা যেন মোম দিয়ে ছাঁচে ঢালাই করে দিয়েছেন শিরিনের দিদা। হরিণের মতো টলটলে চোখ। দিঘির মতো ছলছলে। হাত দুটো লম্বা-লম্বা। প্রায় হাঁটুর কাছ পর্যন্ত চলে গেছে। লম্বা-লম্বা চাঁপার কলির মতো আঙুল। ঘাড়ের কাছ পর্যন্ত ঝুমকো চুল। জয় অবাক হয়ে শিরিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। দিদি একরকমের সুন্দরী, শিরিন আর একরকমের। দিদি জলের মতো, শিরিন আগুনের মতো। প্রদীপের শিখার মতো।
জয়ার ব্যাগ থেকে একটা আই ড্রপসের ছোট শিশি বেরোল। নরম একটা ন্যাকড়া। আসমানের মুখটা ওপর দিকে তুলে ধরে জয়া দু’ চোখে ড্রপস দিয়ে দিল। তারপর নরম ন্যাকড়া দিয়ে চোখ দুটো মুছিয়ে বললে, “আমার লক্ষী ছেলে।” আসমান বললে, “ভৌ ঔ ঔ।” এ ভাষা জয়া বোঝে। জয়া বললে, “হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি তো আমার লক্ষী ছেলে।” জয়া আসমানকে ফিশ-স্যান্ডউইচ খাওয়াতে লাগল। শিরিনের দিদা পা টেনে-টেনে ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন। ধবধবে সাদা একটা শাড়ি পরে আছেন। গোলাপি রঙের পাড়। বৃদ্ধার শরীর ক্রমশই অচল হয়ে আসছে, কিন্তু মুখে উজ্জ্বল হাসি! এ-হাসি তাদেরই মুখে লেগে থাকে, জীবনের কাছে যারা পরাজিত হয় না।
জয়া জিজ্ঞেস করল, “দিদা, আজকের রান্না হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ মা।”
“কে রাঁধল?”
“শিরিনই সব করে আজকাল, আমার শরীরে আর তেমন জোর পাই না। আমি এইবার আমার বাতির কাজ নিয়ে বসব। দেখছ না, আকাশ কেমন নীল হয়েছে। পুজো এসে গেল।”
“কে সাহায্য করবে?”
“নিজেকেই নিজে সাহায্য করব। গড হেল্প দোজ, হু হেল্প দেমসেল্ভস, আমার গুরু বলতেন।”
জয়া আসমানকে বললে, “যাও, খাওয়া হয়ে গেছে, এইবার লক্ষী ছেলে হয়ে আবার শুয়ে পড়ো। দিদাকে দেখবে, কেমন?”
তিনজনে পথে নেমে এল। ঝাঁঝালো রোদ। পথের নুড়িগুলো ব্রাশকরা দাঁতের মতো ঝকঝকে হাসছে। পিচফলের মতো আকাশ। চার্চের চুড়াটা ছবির মতো। তিনজনে স্নেক বেন্ডের কাছে এসে দেখল, দূর থেকে বিশাল এক মোটর সাইকেল চেপে একজন সায়েব আসছেন। লাল রঙের মোটর সাইকেল। এত বড় গাড়ি তারা আগে কখনও দেখেনি। এই সায়েবই বা কে? চার্চের কেউ নন তো!
॥ ৪ ॥
সেই লাল, প্রায় একতলা উঁচু মোটর সাইকেল বাঘের মতো এগিয়ে আসছে। লাল টকটকে, দৈত্যের মতো একজন মানুষ তার আরোহী। সোনালি চুল বাতাসে ফরফর করে উড়ছে। জয়, জয়া আর শিরিনদের সামনে এসে গাড়িটা ঝপ করে থেমে গেল।
সায়েব বললেন, “গুড মরনিং মাই বয়েজ। ”
কেউ ইংরেজি বললে জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। সে নিজেও দু-চারটে ইংরেজি বলতে পারে। শিবশঙ্কর ইংরেজিতে কথা বলা শেখান। ভুল হোক ক্ষতি নেই, ঝরঝর বলে যাবে। ইংরেজি না জানলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে।
জয় বলল, “গুড মরনিং। হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ?”
সায়েব হেসে বললেন, “ভেরি গুড। আমি অল্প-অল্প বাংলা বলতে পারে। শিবশঙ্করবাবুর বাংলোয় যেতে চায়। সে আর কোতো দূর?”
জয় বলল, “তিনি আমার দাদু, গ্র্যাণ্ড ফাদার। এই রাস্তার শেষে সেই বাংলো, আর এক কিলোমিটার গেলে পেয়ে যাবেন।”
“তোমরা স্কুলে যাচ্ছে?”
“ইয়েস আঙ্কল।”
জয় আঙ্কল বলায় সায়েব ভীষণ খুশি। সামনের দিকে একটা বাক্স। সেই বাক্সে হাত ঢুকিয়ে বড় একটা প্যাকেট বের করে জয়ের হাতে দিয়ে বললেন, “লজেন্স। এনজয় ইট ইন ইয়োর ক্লাস।” সায়েব হাত নেড়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেলেন। জয় দেখল লজেন্সের প্যাকেটের গায়ে লেখা, ‘জার্মানি’। সায়েব তা হলে জার্মান। দাদুর কোনও এক সময়ের বন্ধু হয়তো। স্কুল থেকে বাড়ি না ফিরলে রহস্য পরিষ্কার হবে না। যেমন সায়েব, তেমনই তার গাড়ি।
জয় শিরিনের হাতে প্যাকেটটা দিয়ে বলল, “তুই ভাগ করে দিস।”
শিরিন আর জয় সমবয়সী। একই ক্লাসে পড়ে। পাশাপাশি বসে।
শিরিন অবাক হয়ে বলল, “আমাকে দিচ্ছিস কেন? জয়াদি ভাগ করে দেবে।”
জয়া প্রশংসার চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাল, যার অর্থ, ঠিক করেছিস ভাই। তোর শিক্ষাটা ঠিক-ঠিক হয়েছে। এইভাবেই পরকে আপন করে নিতে হয়। দাদু শিবশঙ্কর যেমন বলেন, গোটা পৃথিবীটাই তোমার সংসার। সবাই তোমার আত্মীয়। সকলকেই ভালবাসতে শেখো, আপন করে নিতে শেখো। দাদু শিবশঙ্কর প্রায়ই একটা সংস্কৃত বলেন, বসুধৈব কুটুম্বকম্। কোনও কোনও জিনিস আছে, যতই করিবে দান তত যাবে বেড়ে। সেই জিনিস হল, শিক্ষা আর ভালবাসা।
তিনজন পথ হাঁটছে। জয় আগে-আগে। সে আস্তে হাঁটতে পারে না। লাফিয়ে চলে। পথের দু’ পাশে অনেক আকর্ষণ। রোজই দেখে তবু পুরনো হয় না । রসকষহীন বাবলাগাছ। মজার গাছ। শাখা-প্রশাখা আছে। পাতা আছে, কাঁটা আছে, কিন্তু ঘন ছায়া নেই। তরল ছায়া। ছোট-ছোট বেতগাছ। সেই গাছে আবার ছোট-ছোট থোকা-থোকা ফল। নানারকমের ফার্ন। হরেক রঙের নুড়ি। বহুরকমের পোকা। কচ্ছপের মতো এক ধরনের ছোট-ছোট পোকা আছে। পিঠটা তেলা, নানারকমের রঙের বাহার। সোনার রঙের মাছি। গেরুয়া রঙের ফড়িং। জয় বিভোর হয়ে যায়।
সরলা নদীর ধার দিয়ে পথ চলে গেছে। চড়া রোদে জল ঝলমল করছে। বালির কণা আগুনের মতো জ্বলছে। চোখে ধাঁধা লেগে যায়। মাথা ঝিমঝিম। ওই পথ ধরে কিছু দূর এগোলেই স্কুলবাড়িটা চোখে পড়ে। বিশাল একটা গম্বুজ। তার মাথায় হাওয়া-মোরগ। বড়-বড় অক্ষর বসানো গোল একটা ঘড়ি। স্কুলবাড়িকে ছায়া দিয়ে ঘিরে রেখেছে বড়-বড় গাছ। শিশু, অর্জুন, দেবদারু। বাতাসের সাঁই-সাঁই শব্দ। স্কুলের পাশে সরলা নদী ধাপ ভেঙে ঝরনার মতো হয়েছে। ঝিরঝির শব্দ সারাদিন। পাথরের খাঁজে-খাঁজে মাছের ঘুরপাক। এই দিকের সব মানুষই জৈন ধর্মাবলম্বী। কেউ মাছ-মাংস খায় না। তাই মাছেরা নির্ভয়ে সাঁতার কাটে।
পাঁচিল-ঘেরা স্কুলবাড়ি। লোহার গেট কারুকার্য-করা। সাদা নুড়ি বিছানো পথ সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা জমিতে গিয়ে শেষ হয়েছে। ছেলেমেয়েরা ক্লাসে যাওয়ার আগে এইখানে সমবেত হয় প্রার্থনা করার জন্য। পরিচালনা করেন স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল, স্টিফেন্স সায়েব। বড় মিষ্টি মানুষ। কখনও কড়া কথা বলেন না। বেত ব্যবহার করেন না। কেউ কোনও অন্যায় করলে নিজেকে শাস্তি দেন। এতে ছেলেমেয়ে, এমনকী শিক্ষকরাও লজ্জা পেয়ে যান। পরের বার অন্যায় করার সময় ভাবতে হয়, গম্ভীর এক মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঠায় রোদে দাঁড়িয়ে থাকবেন।
দু’শোর মতো ছেলেমেয়ে সবুজ মাঠে। তাদের সাদা পোশাক। সবাই সার বেঁধে দাঁড়িয়ে। পামগাছের পাতার ছায়া জমির ওপর কাঁপছে ঝিরিঝিরি করে। চারপাশে ফুলের বেড। পিটার দাঁড়িয়ে আছেন অ্যাকর্ডিয়ান নিয়ে। পিটার বড় মজার মানুষ। দক্ষিণ ভারতের বড় একটা সাকার্স দলে ছিলেন তিনি। সব ছেড়ে চলে এসেছেন। ছেলেমেয়েদের অ্যাথলেটিক্স শেখান। মাঝে-মাঝে আউটিং-এ নিয়ে যান। স্কাউটিং শেখান। নীল পাহাড়ের জঙ্গলে তখন তাঁবু পড়ে। রাতে ক্যাম্প-ফায়ার। অ্যাকর্ডিয়ান বাজিয়ে গান। আগুনে মেটে আলু পুড়িয়ে নুন দিয়ে খাওয়া। আসছে সেই সব দিন। শরতের পরেই আসবে হেমন্ত। রোদ আরও নরম হবে। শীতের হাওয়ায় লাগবে নাচন আমলকীর ওই ডালে ডালে।
পিটারের অ্যাকর্ডিয়ান বেজে উঠল অর্গানের সুরে। গানের প্রথম লাইন জয়াই ধরে। তারপর আর সকলে :
আলোয় আলোকময় করে হে এলে আলোর আলো।
আমার নয়ন হতে আধার মিলালো মিলালো ॥
সকল আকাশ সকল ধরা আনন্দে হাসিতে ভরা,
যে দিক-পানে নয়ন মেলি ভালো সবই ভালো! ॥
এই গানটা জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। গাইতে গাইতে সে বিভোর হয়ে যায়। আলো শুধু আলো, চারপাশে আলোর আঁচল উড়ছে। অ্যাকর্ডিয়ানের একটানা গম্ভীর সুর। পামগাছের পাতার খসখস শব্দ। পাখির ডাক। সমবেত কণ্ঠ :
তোমার আলো গাছের পাতায় নাচিয়ে তোলে প্রাণ।
তোমার আলো পাখির বাসায় জাগিয়ে তোলে গান ॥
তোমার আলো ভালোবেসে পড়েছে মোর গায়ে এসে
হৃদয়ে মোর নির্মল হাত বুলালো বুলালো ॥
প্রার্থনা শেষ হয়ে গেল। প্রিন্সিপ্যাল সায়েব এইবার একে-একে সকলের পোশাক পরীক্ষা করছেন। সামান্য ময়লা থাকলে তাকে আর ক্লাস করতে দেবেন না। দাঁত আর নখও পরীক্ষা করবেন। ময়লা পোশাক, বড় নখ, নোংরা দাঁত নিয়ে কেউ তাই আসে না। ভয় পায় ভীষণ। স্টিফেন্স সায়েব বলেন, “ক্লিনলিনেস ইজ নেক্স্ট টু গডলিনেস।’
ক্লাসরুমের দরজা ঝকঝকে পালিশ করা। প্রতিটি বেঞ্চ, হাইবেঞ্চ ঝকঝক করছে। কেউ ছুরি দিয়ে নাম লেখার চেষ্টা করে না। মেঝে মুখ দেখার মতো পরিষ্কার। এই স্কুল প্রত্যেকের গর্ব। মাস্টারমশাইয়ের টেবিলে ফুলদানিতে ফুল। সমস্ত জানলা খোলা। আকাশের নীল যেন আবিরের মতো ঘরে উড়ে-উড়ে আসছে।
শিরিন আর জয় একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসে। জয় শিরিনকে ভীষণ ভালবাসে। তার অল্প লালচে চুল। খাড়া নাক, ধারালো চোখ। লম্বা-লম্বা হাতের আঙুল। পাকা পেয়ারার মতো গায়ের রং। তার বসার ধরন, কথা বলার ভঙ্গি, জয় যত লক্ষ করে ততই অবাক হয়ে যায়। শিরিন যেদিন ক্লাসে আসে না, সেদিন জয় মনমরা হয়ে থাকে।
তাদের স্কুলের সব ক্লাসেই অদ্ভুত একটা ব্যাপার হয়। মাঝে-মাঝেই শিক্ষক এসে বলেন, আজ আর আমি পড়াব না, আজ তোমাদের পড়াবে—যে-কোনও একজন ছেলে বা মেয়ের নাম বলবেন, তাঁর ইচ্ছামতো। ভয় পেলে চলবে না। তরতর করে ডায়াসে গিয়ে উঠতে হবে। অভিজ্ঞ একজন শিক্ষকের মতো পড়াতে হবে। মাস্টারমশাই একপাশে চুপ করে বসে শুনবেন।
আজ প্রথমেই ইতিহাসের পিরিয়ড। ক্লাসে এলেন সরলবাবু। লম্বা, ফিনফিনে মানুষ। চোখে ভারী চশমা। নিখুঁত সাজপোশাক। ওলটানো চুল। ফরসা রং। ভীষণ শান্ত মেজাজ। চেয়ারে বসলেন। ক্লাসের সবাই দাঁড়িয়ে উঠেছিল, তারাও বসে পড়ল। সরলবাবু সকলের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। হাসিটা ভারী মিষ্টি। জিজ্ঞেস করলেন, “তোমরা সবাই ভাল আছ?”
সকলে একসঙ্গে বলে উঠল, “হ্যাঁ সার। আপনি কেমন আছেন?”
“তোমরা ভাল থাকলে আমিও ভাল থাকতে বাধ্য।”
ক্লাসের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “আজ জয় তোমাদের ক্লাস নেবে। জয়, কাম হিয়ার, টেক দি ক্লাস। আজ তোমার বিষয় হল, কেন আমরা ইতিহাস পড়ব!”
জয় প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গেল। ইতিহাস পড়ে। কিন্তু কেন পড়ে! হঠাৎ মনে হল, দাদু, শিবশঙ্কর বলেছিলেন, “কোনও অবস্থাতেই ঘাবড়াবে না। ভয়কে জয় করতে পারলেই সব কাজ সহজ। নিজেকে প্রশ্ন করলেই জবাব আপনি পাবে। তোমার মনই উত্তর দেবে।”
শিরিন হেসে ইশারা করল, “যাও।”
জয় এমনিতে ভীষণ স্মার্ট। টকটক করে ডায়াসে গিয়ে উঠল। মাথা নিচু করে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ সার!” এইসব আদব-কায়দা এই স্কুলের সবাই জানে। জয় ক্লাসের দিকে তাকিয়ে বলল, “গুড মরনিং ফ্রেণ্ডস—আজ আমাদের প্রশ্ন হল, কেন ইতিহাস পড়ব! অতীতকে জানার জন্যে ইতিহাস পড়ব। ইতিহাস পড়তে আমার কেমন লাগে? ভীষণ ভাল লাগে। আমি আমার দাদুকে জিজ্ঞেস করি, দাদুর বাবার কী নাম ছিল, তাঁর বাবার নাম। আমি ক্রমশই পেছোতে থাকি। একসময় আমার দাদু হেরে যান। আর বলতে পারেন না। আমি জিজ্ঞেস করি, এখানে আসার আগে আমরা কোথায় ছিলুম। আমার দাদু দু’শো বছর পর্যন্ত পেছোতে পারেন, যখন আমরা হুগলিতে ছিলাম, তারপর আর পারেন না। এই যে আমার জানতে ইচ্ছে করে, অনেক, অনেক বছর আগে কী হয়েছিল, কী হত, এই জানতে ইচ্ছে করে বলেই ইতিহাস পড়ি। ইংরেজ আসার আগে ভারতে কারা ছিলেন, শক, হুন দুল, মোগল, পাঠান, আমি জানতে চাই, তাই ইতিহাস পড়ি। পলাশিতে সিরাজের সঙ্গে ক্লাইভের কী হয়েছিল আমার জানা দরকার, কীভাবে আমরা পরাধীন হলুম। সব কিছুরই ইতিহাস আছে, মোটরগাড়ির, প্লেনের, কামানের, বন্দুকের, এমনকী দাঁত মাজার ব্রাশের। ইতিহাস আমাদের পিতা।”
সরলবাবু উঠে এসে জয়কে জড়িয়ে ধরে বললেন, “স্পেল্নডিড। সুন্দর বলেছ। শনিবার আমাদের গেট টুগেদারে আই প্রমিস ইউ এ প্রাইজ।”
এই স্কুলে সকলকে ফ্রি লাঞ্চ দেওয়া হয়। সেও বেশ মজার ব্যাপার। ঝকঝকে একটা ট্রলি। তার ওপর বিশাল এক পাত্রে গরম স্যুপ। পাউরুটির ভাজা টুকরো। কাঠের একটা হাতা। গাড়িটা ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে আসছেন পিটার। তাঁর মাথায় সাদা চোঙা টুপি। স্যুপটা তিনিই তৈরি করেন। স্যুপের একটা গানও আছে, “সুইম ইন মাই স্যুপ বাট নেভার গেট ড্রাউন্ন্ড।”
॥ ৫ ॥
সেই লাল মোটর সাইকেল বাগানের একপাশে বিশ্রাম করছে। জয় আর জয়া গেট খুলে বাগানে ঢুকতে- ঢুকতে দেখতে পেল। সেই সায়েব তা হলে এসেছেন। বিরাট মোটর সাইকেলটার সামনে ভাইবোন দাঁড়িয়ে পড়ল। বিস্ময়কর জিনিস! লেখা আছে, হোন্ডা। বহু দেশের পতাকার স্টিকার লাগানো। সামনে-পেছনে, পাশে বড়-বড় বাক্স ফিট করা। হাতলটা এত চওড়া যে, দৈত্যের মতো মানুষ না হলে দু’ হাত ফাঁক করে ধরতে পারবে না। মোটর সাইকেল নয় তো, যেন নিরেট শক্তি। জয় পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার মেপে নিল। আরও অনেক বড় হতে হবে।
বসার ঘর থেকে হাহা হাসির শব্দ ভেসে আসছে। বাড়ি একেবারে জমজমাট। সায়েবের বুট জুতো বারান্দায় খোলা রয়েছে। সেটাও দেখার মতো। উঁচু হিল। একগাদা বকলস লাগানো বিচিত্র এক জিনিস !
বসার ঘরে ঢুকতেই সায়েব হইহই করে উঠলেন, “এসো, এসো, আমার নাতি এসো, আমার নাতনি এসো।” শিবশঙ্করের কাছ থেকে শব্দ দুটো সকালেই শিখেছেন জয় হ্যান্ডশেক করার জন্য ডান হাতটা বাড়িয়ে দিল। সায়েবের বিশাল পাঞ্জার মধ্যে টুনটুনি পাখির মতো ঢুকে গেল। লোহার মতো শক্ত হাত। চাপ দিয়ে নারকোল ফাটাতে পারেন।
শিবশঙ্কর বললেন, “আমার বন্ধু ম্যানফ্রেড। আমরা একসঙ্গে কাজ করেছি। আমার চেয়ে অনেক বড় এঞ্জিনিয়ার। জার্মানি থেকে ওই মোটর সাইকেলে চেপে চলে এসেছে। সাহসটা একবার ভাবো! তোমাদেরও ওইরকম সাহসী হতে হবে ।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “আরে তুমি কী বলছ! তোমার মতো এঞ্জিনিয়ার ভারতে ক’জন আছে! আমি তো তোমার কাছে লোড ডিস্ট্রিবিউশান, সেন্টার অব গ্র্যাভিটি শিখেছি। ইউ আর মাই গুরু। আর সাহস! তোমার চেয়ে বেশি সাহস আমার নেই। তুমি বর্ষার নদীতে যেভাবে পিলার তৈরি করেছ, আমাদের সাহসে কুলোত না। অসমের জঙ্গলে তুমি পাগলা হাতিকে ভয় পাওনি। কোনও কিছুর সাহায্য না নিয়ে তুমি যেভাবে পাহাড়ে চড়তে, আমরা ইউরোপিয়ানরা তা ভাবতেও পারব না কোনওদিন। আমার মতো সাহসী হতে না বলে, বলো তোমার মতো সাহসী হতে। ”
শিবশঙ্কর বললেন, “যাও, তোমরা ড্রেস চেঞ্জ করে জলখাবার খেয়ে এসো। আমরা ততক্ষণ দুই বন্ধুতে গল্প করি।”
ছড়ছড় শব্দ করে সামনের পাথুরে পথ ধরে গোরুর পাল ঘরে ফিরছে। সন্ধে নামছে। ধর্ম ইঁদারা থেকে জল তুলে বাগানে ঢালছে। নালিতে-নালিতে জল বইছে কুলকুল শব্দে। ধর্মার মেয়ে গৌরী গান গাইছে আপন মনে। সন্ধেবেলায় মেয়েটার ভাব আসে, তখন গান গায় সুরেলা গলায়। যা মনে আসে তাই গায়। শুনতে ভালই লাগে। সাঁঝের পাখিদের কিচিরমিচির জলসা, গোরুর হাম্বা, জলের কুলকুল শব্দ, গৌরীর গান। একটা মায়াবী পরিবেশ।
বসার ঘরে মাউথ অর্গান বেজে উঠল। ম্যানফ্রেড বাজাচ্ছেন বিলিতি সুর। বাড়ি একেবারে জমজমাট। উদয়ন হাসপাতাল থেকে ফিরছেন সাইকেল করে। দূর থেকে বাড়িটা দেখতে পাচ্ছেন। জানলায়-জানলায় আলো। গেট খুলে ঢুকতে-ঢুকতে মাউথ অগানের শব্দ পেলেন। চোখে পড়ল বিশাল মোটর সাইকেলটা। গেট খোলার শব্দ পেলেই জয় আর জয়া ছুটে আসে। একদিনও ভুল হয় না। জয়া কেরিয়ারের পেছন থেকে বাবার অ্যাটাচিটা খুলে নেয়। বাবা ফেরা মানেই ভীষণ আনন্দ।
উদয়ন মোটর সাইকেলটা দেখিয়ে বললেন, “কে এসেছেন?”
জয় বললে, “দাদির অনেকদিনের বন্ধু ম্যানফ্রেড সায়েব। জার্মানি থেকে এসেছেন এই মোটর সাইকেলে চেপে। এখন মাউথ অর্গান বাজাচ্ছেন।”
“ম্যানফ্রেড এসেছেন? বলিস কী! গ্রেট ম্যান।”
“তুমি চেনো?”
“চিনব না? ভারতবর্ষে থাকার সময় আমাদের এখানে প্রায়ই আসতেন। ”
উদয়ন বসার ঘরে ঢোকামাত্রই সায়েব হইহই করে উঠলেন, “হ্যালো ডক্টর। আফটার সো মেনি ইয়ার্স। হাউ আর ইউ মাই সান?”
“আমি ভীষণ ভাল আছি। আপনি?”
“আমিও ভাল। আমি এখন একজন গ্লোবট্রটার। সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়াই, আর আমাদের দেশের কাগজে ফিচার লিখি। আই ডোন্ট কেয়ার মাই এজ। আমি বীর।”
‘বীর’ বলে সায়েব অদ্ভুত একটা ভঙ্গি করলেন। সবাই হোহো করে হেসে উঠলেন। দমকা বাতাস ঘরে ঢুকল শিউলির গন্ধ নিয়ে। ফুল ফুটতে শুরু করেছে। ফুল কখনও ভুল করে না।
জয় আর জয়ার মা উমা অদ্ভুত নিয়মে চলেন। তিনি বলেন, সকলের সব কাজ শেখা উচিত। করা উচিত। শুধু লেখাপড়া নিয়ে থাকলেই হবে না, সংসারের কাজও শিখতে হবে। মানুষ গাছতলায় থাকে না, পাঁচতারা হোটেলে থাকবে না। তাকে সংসারেই থাকতে হবে। তাই জয়াকে সন্ধেবেলায় ঘন্টাখানেকের জন্য রান্নাঘরে ঢুকতে হয়। মা তাকে রান্না শেখান। উমা নিজে গ্র্যাজুয়েট। লেখাপড়ায় সেরা ছাত্রী ছিলেন, আবার ভীষণ ভাল ছবি আঁকেন। রবীন্দ্র, নজরুল, অতুলপ্রসাদের গানে ওস্তাদ। রান্নায় যে-কোনও সেরা হোটেলের বাবুর্চিকে হার মানিয়ে দেন।
রান্না শিখতে জয়ার বেশ ভালই লাগে। বিরক্ত হয় না। সায়েবকে মাছের কচুরি খাইয়ে অবাক করা হবে। তারই আয়োজন চলেছে। উমা জয়াকে শেখাচ্ছেন কী করে চামচে দিয়ে মাছ থেকে কাঁটা আলাদা করে ফেলতে হয়। উমার নির্দেশে গৌরীর মা একপাশে বসে মসলা তৈরি করছে। আর একদিকে কাপড় জড়ানো ময়দার তাল একটু-একটু করে ফুলছে।
জয়কে সন্ধের পরেই পড়তে বসতে হয় ঠাকুমার ঘরে। ঘরটা বেশ বড়। একপাশে খাট। বিছানায় একটা কালো কম্বল পাতা। ঠাকুমা তার ওপর বসে মালা জপ করেন। দক্ষিণ দিকে জানলার কাছে টেবিল। পরী ধরে আছে টেবিল আলো। জানলার বাইরে বাগান। ঘরে একটা ধূপের গন্ধ ঘুরপাক খাচ্ছে। বড় শান্ত এই ঘর। পুব দিকের জানলার কাছে আর-একটা টেবিল। সেটা দিদির। সেই টেবিলে পাথরের তৈরি মা-সরস্বতীর ছোট্ট সুন্দর একটা প্রতিমা আছে। দিদি রোজ ফুল দিয়ে সাজায়। এই টেবিলে মাঝারি মাপের হাঁস-টেবিল ল্যাম্প। টেবিল সাজানো নিয়ে ভাইবোনে জোর প্রতিযোগিতা। কে কত ভালভাবে সাজিয়ে রাখতে পারে। জয়ের টেবিলে একটা পাখির বাসা আছে। তার মধ্যে ডিমের মতো দেখতে সাদা-সাদা পাথর। এক ঝড়ের বিকেলে জয় বাসাটা কুড়িয়ে পেয়েছিল শিশুগাছের তলায়। সেই থেকে বিস্ময়কর বাসাটা খুব যত্নে আছে জয়ের টেবিলে। টেবিল সাজানোর প্রতিযোগিতায় জয় দিদির সঙ্গে কিছুতেই পেরে ওঠে না। জয়া ভালসা কাঠ দিয়ে সুন্দর তিনতলা একটা বাড়ি তৈরি করেছে। সেই বাড়ির বারান্দা আছে। বাইরে থেকে ওপরতলায় ওঠার সিঁড়ি আছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ছোট একটা মেয়েপুতুল। মাঝে-মাঝে সেই বাড়ির ভেতর আলো জ্বলে ওঠে। আলোর কায়দাটা দাদি করে দিয়েছেন।
সারাদিন হুটোপাটি হয় খুব, তাই বই খুলে বসার পর জয়ের চোখে ঘুম ঢুলে আসে। তখন সে ছোট্ট একটা ডিবে খোলে। ডিবেটা দিয়েছে শিরিন। ডিবের মধ্যে নস্যি আছে। আঙুলের ডগায় সামান্য একটু নিয়ে চোখে ঘষে দেয়। হুহু করে জল বেরোতে থাকে, ঘুম ছুটে যায়। শিরিন জয়কে এই কায়দাটা শিখিয়েছে। শিবশঙ্কর অবশ্য জয়কে বলেছেন, ঘুম পেলে একটু দৌড়োদৌড়ি করে আসবে, ঘুম ছেড়ে যাবে। জয় করে কোনও ফল পায়নি। বাবা বলেছেন চোখে ঝাপটা মারবি। তাতেও কিছু হয় না। শিরিনের দাওয়াইটাই অব্যর্থ। ঘুম বেশ কিছুক্ষণের জন্যে ছিটকে পালায়।
জয় ইংরিজি দিয়ে শুরু করেছে। মন ছটফট করছে। বসার ঘরে কত কী কাণ্ড হচ্ছে। কত গল্প। কত দূর থেকে একজন মানুষ এসেছেন কত গল্প নিয়ে। আজ পড়ায় মন বসছে না। ঠাকুমা জয়কে লক্ষ করছিলেন। বললেন, “মন চঞ্চল হয়েছে দাদাভাই?”
“একটু, একটু। বসার ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে।”
“ম্যানফ্রেডদাদু কয়েকদিন থাকবেন। আগে কালকের পড়া। মনটাকে যে বাঁধতে হবে দাদাভাই। সেইটাই যে আসল সাধনা। খেতে বসে গল্প হবে। খাওয়ার পর গল্প হবে। এখন মন দিয়ে পড়ো।”
মন স্থির করার একটা কায়দা ঠাকুমা শিখিয়ে দিয়েছেন জয়কে। জয় টেবিলের ড্রয়ার থেকে সেইটা বের করল। জিনিসটা আর কিছুই নয়, সাদা একটা কার্ড, তার মাঝখানে সবুজ একটা টিপ। তিন হাত দূরে চোখের সামনে রেখে এক দৃষ্টিতে সেই সবুজ ডটটার দিকে তাকিয়ে থাকা। জলে চোখ ভরে আসবে, তখন চোখ বুজিয়ে ফেলে দুই ভুরুর মাঝখানে নাকের ওপর কপালের কাছে সেই বিন্দুটাকে দর্শন। দেখতে-দেখতে ধীরে-ধীরে নিজের মধ্যে নিজে তলিয়ে যাওয়া। এই কায়দাটা জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। ভেতরটা তখন সমুদ্রের মতো শান্ত, গভীর হয়ে যায়। মনে হয় রুপোর মতো সাদা চাঁদের আলোয় বসে আছে। ঠাকুমার হাতে জপের মালা নিঃশব্দে ঘুরে চলেছে। রান্নাঘর থেকে উত্তম রান্নার গন্ধ ভেসে আসছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জয়া এসে তার টেবিলে হাঁস-আলো জ্বেলে বসে পড়ল। নীল ফ্ৰকপরা দিদির ঘাম-ঘাম মুখের দিকে জয় একবার তাকাল। এইবার জয়ের পড়াটা খুব জমে যাবে। দিদির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পড়বে। জয়া খাতা খুলে খসখস করে লিখতে-লিখতে ঠাকুমাকে বললে, “তোমার ওষুধ খেয়েছ?”
ঠাকুমা অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, “আজও ভুলেছি।”
“তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না ঠাম্মা। একদিন খাও, তো একদিন খাও না।”
“ওষুধ দেওয়ার দায়িত্ব তো তোর!”
“দেখছ তো আজ রান্নাঘরে এলাহি ব্যাপার। নিজে নিয়ে একদিন একটু খেতে পারলে না! ওষুধ খেলে কার অসুখ ভাল হবে?”
“আমার। কিন্তু দিদিভাই ওষুধটা তুমি হাতে করে না দিলে আমার যে তেমন কাজ হয় না। তুমিও ভুলেছ, আমিও ভুলেছি। ”
ছ’ ফুট লম্বা বিশাল ম্যানফ্রেড ঘরে ঢুকে বললেন, “হ্যাল্লো, গ্র্যান্ড ওল্ড লেডি! স্বর্গসুখ উপভোগ করছ?”
ঠাকুমা বললেন, “এই স্বর্গ মানুষের তৈরি। আপনি বসুন।”
সায়েব একটা চেয়ারে বসলেন। জয়া ততক্ষণে ঠাকুমার বিস্ময়কর ওষুধের আলমারিটা খুলে ফেলেছে। ভেতরে ওষুধের জার, বয়াম, কৌটো। অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ ঘরে ছড়িয়ে পড়ল।
সায়েব বললেন, “ওয়ান্ডারফুল! এটা কিসের ট্রেজার হাউস?”
“আয়ুর্বেদিক মেডিসিন্স।”
জয়া সুন্দর একটা কড়ির পাত্র থেকে ছোট্ট একটা গুলি বের করে খলে ফেলে মধু দিয়ে মাড়তে শুরু করল। খল আর নুড়ি একসঙ্গে ঠাকুমার সামনে ধরল। তিনি চেটে-চেটে খেয়ে ফেললেন।
সায়েব প্রশ্ন করলেন, “এফেক্ট?”
“বুকে সর্দি বসতে পারে না। ফুসফুস পরিষ্কার থাকে।”
ম্যানফ্রেড জয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, “জাস্ট লাইক অ্যান এঞ্জেল?”
॥ ৬ ॥
বসে আছেন সায়েব। সামনের দেওয়ালে আদ্যিকালের দেওয়ালঘড়ি। পেন্ডুলামটা বিশাল। ধীরে দোলে। এত ধীর, যেন সেকেন্ড, মিনিটের তোয়াক্কাই নেই। সায়েব ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে বললেন, “টাইম ইউ ওল্ড জিপসি ম্যান। কবে জীবন শুরু করেছি খেয়ালই নেই। আজও চলেছি, আরও কতদিন চলব। পৃথিবীটা এখনও আমার কাছে পুরনো হল না। সব সময় নতুন। আই লাইক ইট। আই লাইক ইট ভেরি মাচ।”
ঠাকুমা বললেন, “আমিও তো বুড়ি হয়েছি, আমারও খুব ভাল লাগে। আরও অনেক, অনেকদিন বাঁচতে ইচ্ছে করে। জয়, জয়া বড় হবে। মানুষ হবে। সেইসব দেখে যেতে ইচ্ছে। ওরাই আমার স্বপ্ন।”
“আমি যে-ক’দিন আছি তার মধ্যেই ওদের আমি কিছু ভাল জিনিস শিখিয়ে যাব যা ওদের জীবনে খুব কাজে লাগবে। না আমি যাই, ওরা পড়ছে। পরে কথা হবে।” ম্যানফ্রেড বেরিয়ে গেলেন।
জয় প্রশ্ন করল, “দিদা বলতে পারো কী করে অমন লম্বা হওয়া যায়!”
উত্তর দিল জয়া, “পারি, গাছের ডাল ধরে রোজ ঘন্টাখানেক ঝুলে থাকলে তুই দশ বছরে ওইরকম লম্বা হয়ে যাবি। ”
ঠাকুমা বললেন, “শুনেছি রিং করলে অমন লম্বা হওয়া যায়। আমার বাবাকে করতে দেখেছি। তিনি বেশ লম্বা ছিলেন।”
জয়া বলল, “লম্বা হয়ে তোর কী লাভ হবে?”
“বেশ অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাব। কেমন মজা হবে!”
জয়া বলল, “বকবক না করে কালকের পড়াটা করে নাও খোকা।”
“আমার পড়া হয়ে গেছে দিদি।”
“ওরে আমার বিদ্যাসাগর! বসতে না বসতেই পড়া হয়ে গেল। ”
“তুই আমাকে একটা অঙ্ক দেখিয়ে দিবি দিদি!”
“এই তো পথে এসো। এখনও তোর অঙ্ক হয়নি। চলে আয় টেবিলে। ”
জয় খাতা নিয়ে দিদির টেবিলে গেল। মাঝে-মাঝে জয়ের অঙ্ক আটকে যায়। দিদির পাশে চেয়ার টেনে বসতে-বসতে জয় প্রশ্ন করল, “দিদি, লম্বা হলে মাথা খোলে রে!”
“খুলতে পারে, আবার নাও খুলতে পারে। মাথা একটা আলাদা জিনিস।”
“মাথার জন্যে কী করা উচিত?”
“মাথাকে খাটাতে হয়। যেমন ধর তোর এই অঙ্কটা, কুড়িটা গুলি সাতজনের মধ্যে সমান ভাগ করে দিতে হবে, কীভাবে করবি?”
“অনেকক্ষণ মাথা খাটিয়ে দুটো রাস্তা পেয়েছি।”
“পেয়েছিস? কী কী রাস্তা!”
“কুড়িটা গুলি সাতজনের মধ্যে সমান ভাগ করা যায় না, একুশটা হলে যেত।”
“তা হলে কী করবি।”
“এক নম্বর সমাধান, ভাগ না করা। বুঝিয়ে বলা, ভাই! কিছুদিন অপেক্ষা করো, আর-একটা গুলি জোগাড় করতে পারলেই তোমাদের সমান ভাগে ভাগ করে দেব। তোমরা আজ শুধু দেখে রাখো। দু’ নম্বর সমাধান, সাতজনের দু’জনকে বুঝিয়ে-বাঝিয়ে সরিয়ে দেওয়া, গুলি বাজে জিনিস, গুলি খেললে লেখাপড়ার ক্ষতি। তোমরা ভাল ছেলে হবে, বড় হবে, মানুষ হবে। তোমাদের কি গুলি-গুলি করা উচিত? দু’জনকে কাটাতে পারলেই, রইল পাঁচজন। হাতে কুড়িটা গুলি। তখন প্রত্যেককেই চারটে করে দেওয়া যাবে।”
জয়া ভাইকে জড়িয়ে ধরে গালে একটা চুমু খেল। ফোলাফোলা ঠাণ্ডা গাল, দৃষ্টদুষ্টু দুটো চোখ। জয় দিদির বুকে মাথা গুঁজে বলল, “দিদি হল রে! হল না।”
“খুব হল। অঙ্ক না হয়ে ম্যানেজমেন্ট হল। যদি তোকে বলা হয় সমান ভাগে ভাগ নয়, শুধু ভাগ করে দাও, তা হলে কতরকমে ভাগ করবি!”।
জয় সোজা হয়ে বসল, এ আর-এক সমস্যা। সাতজনকে দুটো করে দিলে হাতে থাকে ছ’টা। তারপর! আচ্ছা! দু’জনকে তিনটে করে দিলে। হাতে থাকে দুটো, সেই দুটো দিয়ে শেষেরজনকে সন্তুষ্ট করতে হবে। এ ছাড়া এলোমেলো অনেক কিছু হতে পারে। হাতে থাকে ছ’টা। তারপর! আচ্ছা! ছ’জনকে তিনটে করে দিলে। হাতে থাকে দুটো, সেই দুটো দিয়ে শেষেরজনকে সন্তুষ্ট করতে হবে। এ ছাড়া এলোমেলো অনেক কিছু হতে পারে।
জয় আর জয়া। দু’জনই অঙ্কে মশগুল। ধীরে-ধীরে রাত বাড়ছে। ঠাকুমা চোখে গোল চশমা লাগিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘শান্তিনিকেতন’ পড়ছিলেন। বই মুড়ে উঠে পড়লেন। এইবার সংসারের কাজে একটু সাহায্য করতে হবে। কেউ চায় না তিনি কিছু করেন। বয়েস হয়েছে। এখন তাঁর বিশ্রামের সময়। তিনি মনে করেন, শ্রমই বিশ্রাম। এ কথা সবাই জানে, তাঁর কাজের ধরনটাই আলাদা। পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি, অনেকটা শিল্পকর্মের মতো। প্লেটে খাবার সাজাবার ধরনটাই আলাদা। গেলাসে জল দেবেন, গেলাসের বাইরে এক ফোঁটাও লেগে থাকবে না এমনভাবে স্যালাড সাজাবেন, যেন ফুল ফুটে আছে। ধীর, স্থির, গম্ভীর। একটাও বাজে কথা বলেন না, অকারণে হাসেন না। ঠাকুরমার মধ্যে একটা সাধিকার ভাব আছে। বাইরে তিনি মাতাজি নামে পরিচিত। মাতাজি সামনে গিয়ে দাঁড়ালে সব সমস্যার সমাধান। অসুখ সেরে যায় তাঁর দেওয়া কবিরাজি ওযুধে, পারিবারিক সমস্যা মিটে যায় তাঁর উপদেশে।
ঠাকুমা একবার উঁকি মারলেন বসার ঘরে। পাজামা-পাঞ্জাবি পরে ম্যানফ্রেড বসে আছেন সোফায়, আরাম করে। শিবশঙ্কর তাঁকে নিজের লেখা ভ্রমণকাহিনী পড়ে শোনাচ্ছেন। সায়েব তন্ময় হয়ে শুনছেন। একপাশে ছোট একটা টেবিল। টেবিলের ওপর একটা ব্রিজের মডেল। মধ্যপ্রদেশে ভয়ঙ্কর একটা নদীর ওপর এই রেল-ব্রিজটা শিবশঙ্কর তৈরি করেছিলেন। দুরূহ কাজ। এইটা করার পর এঞ্জিনিয়ার হিসেবে তাঁর খ্যাতি দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেইসব দিনের কথা মনে পড়ছে ঠাকুমার। বাড়িতে মাঝেমধ্যে একটা-দুটো চিঠি আসত। সেই চিঠি থেকে জানা যেত শিবশঙ্কর ভাল আছেন। একটা কিছু বিপদ ঘটলেও ঘটতে পারত। শিবশঙ্কর একটা কথাই বলতেন, সাবধানের মার নেই, আবার মারেরও সাবধান নেই। ব্রিজটা তৈরি করতে গিয়ে অনেকেই দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন। শিবশঙ্কর বলতেন, প্রোফেশনাল হ্যাজার্ড। সেই অসীমসাহসী জীবনের কথা শিবশঙ্কর ইংরেজিতে লিখছেন। যতটা লিখেছেন সবটাই ঠাকুমা শুনেছেন। অনবদ্য হচ্ছে। ভীষণ টান। ছোট-ছোট রসিকতা। মজার-মজার ঘটনা। শিবশঙ্কর এখন যেটা পড়ছেন, সেখানে একটা মজার ঘটনা আছে। তখন শিবশঙ্কর উত্তর ভারতে। ক্যাম্প করে আছেন। জঙ্গল সাফ করে নতুন রেল লাইন পাতার কাজ চলছে। রাতে ক্যাম্পে এসে দেখলেন, বিছানায় আরাম করে শুয়ে আছে পেল্লায় মাপের একটা ভালুক। এত আরামে শুয়ে আছে যে, শিবশঙ্করের ডাকতে ইচ্ছে করল না। শিবশঙ্কর ক্যাম্প-চেয়ারে বসে রইলেন। ভালুকের ঘুম ভাঙার অপেক্ষায়। ক্লান্ত শিবশঙ্কর বসে থাকতে-থাকতেই এক সময় ঘুমিয়ে পড়েছেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মৃদু আলোয় দেখলেন, ভালুক তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে, শিবশঙ্কর এতটুকু ভয় না পেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যালো মিস্টার, ঘুম ভাল হয়েছে?” ভালুকের ভাষা থাকলে বলত, “ইয়েস, থ্যাঙ্কস।” ভাষা নেই, তাই শব্দ করে হাসল। ক্যাম্পের পরদা তুলে চলে গেল বাইরে। সেই ভালুকটা শিবশঙ্করের বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। প্রায় রোজই আসত। পাউরুটি, কলা, এইসব খেত। ভালুক যথেষ্ট ভদ্রলোক।
জয় হঠাৎ দালানে বেরিয়ে এসে ছোটাছুটি শুরু করে দিল। ঘুম তাড়াচ্ছে। শিবশঙ্কর পড়া থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যালো ব্রাদার! আক্রমণ করেছে?”
জয় বলল, “অ্যাটাক্ড বাই স্লিপ।”
“তোমার চক্ষুচূর্ণে কাজ হচ্ছে না?”
“নো সার, ফুরিয়ে গেছে।”
“আর কতটা বাকি?”
“এখনও একটা সাবজেক্ট।”
জয় দালানের এ-মাথা থেকে ও-মাথায় ছোটাছুটি করছে। দেওয়ালে মানুষ-মাপের লম্বা একটা আয়না। মাঝে-মাঝে তার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিচ্ছে। চোখ দুটো করমচার মতো লাল। ঘুম কোথায় আসে? মাথায়, না চোখে!
ম্যানফ্রেড পরামর্শ দিলেন, “সিঙ এ সঙ। গান গাইলে ঘুম ছেড়ে যায়।”
জয় চার-পাঁচটা ডন মেরে ঘরে ঢুকে গেল। জয়া একমনে পড়ছে। নড়াচড়া নেই, স্থির। পিঠের ওপর ঝুলছে মোটা একটা বিনুনি। টেব্ল-ল্যাম্পের আলো এসে পড়েছে সুন্দর মুখে। খাড়া একটা নাক।
“তোর কেন ঘুম পায় না দিদি!”
“আমি অ্যালাউ করি না। আমি আমার কাজে ঢুকে যাই।”
“কী করে ঢুকিস?”
‘আমার মনটাকে ঢুকিয়ে দি।”
“আমি পারি না কেন?”
“তুই ভীষণ ছটফটে। একসঙ্গে অনেক কথা ভাবিস। যখন পড়বি তখন কেবল পড়বি। যখন খেলবি তখন কেবল খেলবি।”
“তোর হাতটা আমার মাথায় ঠেকিয়ে একটু আশীর্বাদ করে দে না দিদি!”
“ঠাট্টা করছিস!”
“বিশ্বাস কর, তোকে দেখলে মনে হয়, মা সরস্বতী!”
“আর আমার মনে হয়, তুই একটা আস্ত পাগল।”
“দিদি, পাগলদের নাকি সর্দিকাশি হয় না!”
“এইবার শুরু হল তোর গবেষণা। ভীষণ বকব জয়। কাল তোর ক্লাস এগ্জাম।”
“আমি জোরে-জোরে পড়ব কিন্তু।”
“তোর যা খুশি তাই কর। আমাকে বকাবি না।”
জয় বিজ্ঞান খুলে বসল। ফুল। দু-চার লাইন পড়ামাত্রই মন ঢুকে গেল বিষয়ে। ফুল কাকে বলে! রোদই কি ফুল হয়ে ফোটে? মাটি, জল, জৈব পদার্থ, বাতাস, রোদ। সব মিলিয়ে একটা ম্যাজিক। একটা ফুলের কত অংশ, ক্যালিক্স, সেপাল্স, করোলা, পেটাল্স, স্ট্যামেন্স, স্টিগ্মা, স্টাইল, ফুলের সুগন্ধ, নেক্টাব। শর্ট ডে প্ল্যান্ট, অল্প সময় আলো পেলেই ফুল এসে যায়। লং ডে প্ল্যান্ট, বহুক্ষণ আলো না পেলে ফুল ফোটে না। সূর্যমুখী রোদের দিকে মুখ ঘোরায়, কেন ঘোরায়! মাধ্যাকর্ষণে শিকড় কীভাবে মাটির তলায় নামতে থাকে। অন্ধকারে একটা গাছের চারাকে মাটিতে শুইয়ে রাখলে দেখা যাবে শিকড় ঘুরে গেছে মাটির দিকে, আর ডগা বেড়ে উঠছে ওপর দিকে। শিকড়ের অনুসন্ধান জল।
জয়ের চোখে আর ঘুম নেই। পৃথিবীর বিস্ময়ে মন ঢুকে গেছে, যেভাবে শিকড় ঢোকে মাটিতে। জয়ের কানের কাছে এখন বোমা ফাটালেও শুনতে পাবে না।
॥ ৭ ॥
খড়ক সিং বড় মজার মানুষ। তিনি এসেছেন। মাঝে-মাঝেই মানুষটা অদৃশ্য হয়ে যান। ফিরে আসেন একঝোলা গল্প নিয়ে। কঞ্চির মতো পাকানো চেহারা। ফুটছয়েক লম্বা তো হবেনই। ঠাকুর্দা সাত ফুট লম্বা ছিলেন। বাবা সাড়ে-ছয়। ক্রমশই কমছে। খড়ক সিং বলেন, “খড়করা ছোট হয়ে যাচ্ছে ক্রমশই, সেইটাই আমার ভয়। লম্বা হলে মানুষ অনেক দূর দেখতে পায়। আর যারা দূর দেখতে পায়, তাদের জ্ঞান খুব বেড়ে যায়।” খড়ক সিংয়ের বিশাল একজোড়া গোঁফ। দুটো ডগা মোম দিয়ে সরু করা। পায়ে খটখটে নাগরা। চুস্ত পাজামা, কুর্তা গায়ে। বড় বড় দুটো কান। কানের পাশে চুল। আতরের তুলো গোঁজা। ভীষণ মেজাজি মানুষ বড়দের সঙ্গে একেবারে মেশেন না, ছোটদের সঙ্গে ভীষণ খাতির। বলেন, “বড়রা সব ফুরিয়ে এসেছে, তাদের সঙ্গে মেলামেশা করলে নিজেও ফুরিয়ে যাব।”
খড়ক সিংয়ের ছোট একটা বাড়ি আছে। এত ছোট, যেন খেলাঘর। একটা ঘর, চারপাশে বারান্দা, একটা বাথরুম। ছোট একটা সাজঘর, ছোট্ট একটা বসার ঘর। বাড়িটা একটা বাগানের মধ্যে বসানো। বড় বড় গাছ। পাতায়-পাতায় বাতাসের সিমসিম শব্দ। নানারকম পাখির ডাক। কাঠবেড়ালির খেলা। বছরের বেশিরভাগ সময় বাড়িটা বন্ধ থাকে। খড়ক সিং এলে আলোয় আলোকময়। কেউ নেই খড়ক সিংয়ের। খড়ক সিং বলেন, “খড়ক সিংয়ের খড়ক সিং আছে।” বলে, হা-হা করে হাসেন। কেউ না থাকাটা যেন ভীষণ আনন্দের।
খড়ক সিং এসেছেন জেনে জয়, জয়া আর শিরিন ছুটল স্কুল ছুটির পরেই। তাদের কাছে এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু নেই। তাদের বন্ধু এসে গেছেন। শেষ বিকেলের আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে। নীল কাগজের আকাশ পশ্চিমে সূর্যের লাল রং শুষেছে। কালো বিন্দুর মতো ঝাঁক-ঝাঁক পাখি উড়ছে। খড়ক সিং সামনের খোলা জায়গায় পায়চারি করছেন। পায়ে জরির কাজ-করা খটখটে নাগরার জুতো, মাথায় একটা পাগড়ি। খড়ক সিং অনেক সময় অনেককে দেখতে পান। যে নেই, যারা নেই। তাদের সঙ্গে কথা বলেন। সেইরকমই একজন অদৃশ্য কেউ খড়ক সিংয়ের পাশাপাশি ঘুরছেন। সিং হাত-পা নেড়ে কথা বলছেন। কিছু একটা বোঝাচ্ছেন তাকে। এমনই তন্ময়, তিনজনকে দেখতেই পাচ্ছেন না। সিং এ-পাশ থেকে ও-পাশে যাচ্ছেন, পেছন-পেছন তিনজন। আবার, ও-পাশ থেকে এ-পাশ। কাকে বোঝাচ্ছে, মাথা জিনিসটা খুব খারাপ জিনিস। কোনও কিছু ঢুকলে সহজে বেরোতে চায় না। বেরোতে চায় না কি, বেরোবেই না। একেবারে গেড়ে বসবে। যেন গাড়ি চেপেছে। আবার হুকুম করবে, হিঁয়া চলো, হুঁয়া চলো। যেই বলব, “অ্যায় উতারো, আভি উতারো।” সঙ্গে-সঙ্গে বলবে, “চোপরাও। কী মজা।”
খড়ক সিং হা-হা করে হেসে বললেন, “এ কেয়া চক্কর, কেয়া তামাশা! ড্রাইভার, চৌক মে চলো।”
“কাহে জি?”
“হাম লাড়ডু খায়েগা।”
জয়, জয়া, শিরিন, তিনজনে একসঙ্গে চিৎকার করল, “লাড্ড লায়া হুঁ।”
সিংজি চমকে পেছন ফিরে তাকালেন, “আরে মেরা দোস্ত, তোমরা খবর পেয়ে গেছ!”
“তোমাকে আর চৌকে যেতে হবে না। আমরা লাডডু এনেছি, ছাতু এনেছি।”
“তোমাদের জন্যে আমিও এনেছি। জবরদস্ত সব জিনিস।”
খড়ক সিংয়ের ঘরে একটা যোধপুরী সিন্দুক আছে। তার গায়ে অসম্ভব সব কারুকার্য। হাঁ হয়ে যেতে হয়। এমন সিন্দুকেই রাজারা মণিমুক্তো রাখতেন। হিরে, জহরত, চুনি, পান্না। সিংজি একটা বেতের মোড়ায় বসলেন। ওরা তিনজন কার্পেটে। ঘরের চারপাশে নানা মাপের ঘন্টা ঝুলছে। কোনওটার শব্দ খুব মিঠে, কোনওটার খুব ভারী। কোনওটা সা, কোনওটা রে, কোনওটা গা। সব মিলিয়ে পরিপূর্ণ স্বরগ্রাম। বাতাসে দোল খায়, সা রে গা মা পা ধা নি। দরজায় একটা ভারী সিল্কের পরদা। ঘরের কোণে একটা আলবোলা। ঘরে যেন স্বপ্ন খেলা করছে। দেওয়ালে একটা তরোয়াল বাঁকা করে রাখা। দোনলা একটা বন্দুক। একপাশে একজনের শোওয়ার মতো একটা চারপায়া। বিছানায় ভেলভেটের চাদর। টেবিলের ওপর ফুলসমেত ফুলদানি।
খড়ক সিং মোড়ায় বসে-বসেই সিন্দুকের ডালা খুললেন। ঘরটা সুগন্ধে ভরে গেল।
জয় বলল, “আঃ, কিসের গন্ধ রে দিদি?”
সিংজি বললেন, “মৃগনাভি। আসলি জিনিস। এবার আমি নিয়ে এসেছি। এই গন্ধে হরিণ পাগল হয়ে যায়। সহজে পাওয়া যায় না। অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি।”
সিংজি সিন্দুক থেকে প্রথমে বের করলেন সিল্কের কাপড়। তুলতুলে নরম। সোনার মতো রং। একটা টুকরো তুলে দিলেন জয়ার হাতে, “এইতে তোমার একটা ফ্রক হবে। তোমাকে মানাবে! আর এই টুকরোটা শিরিনের। দুটো মেয়ের দুটো ফ্রক। এইবার দেখি ছেলেটার জন্যে কী আছে!”
সার্জের একটা পিস বেরোল। সুন্দর রং। রংটা যে কী, জয় তা বুঝতে পারল না। কাপড়টা হাতে নিয়ে খড়ক সিং বললেন, “এইটাতে আমার জয়ের একটা স্যুট হয়ে যাবে। এইসব আমি যোধপুর থেকে কিনেছি। গোটা কতক বড়-বড় আসরে আমি গান গাইলুম, রোজগারটা বেশ ভালই হল, বুঝলে। মোটা টাকা। রাজা। মহারাজার দেশ।”
“আমাদের খুব আনন্দ হচ্ছে ; কিন্তু তুমি গান শিখলে কবে?” জয়া প্রশ্ন করল।
“গান? তোমরা আমার গান শোনোনি?”
“তুমি তো রেওয়াজই করো না!”
“আমার যখন যা মনে আসে, আমি তাই করি। আমার ভেতরে সব আছে। এক-এক সময় এক-একটা বেরিয়ে পড়ে। কী করে কী হয়, সে আমি বলতে পারব না।”
“কী গান গাইলে?”
“কেন, খেয়াল, ঠুংরি। বিশ্বাস হচ্ছে না। বেশ, তা হলে একটু শোনো।”
খড়ক সিং খেয়ালের একটা মুখ গেয়ে শোনালেন। শুনিয়ে বললেন, “বাপ্রে বাপ, কী সুর! নিজের গানে নিজেই অবাক। কে গাইছে রে বাবা! ভেতরে কে বসে আছে!”
ওরাও অবাক হয়ে গেছে। যেমন সুর তেমনই কাজ, একেবারে পাকা ওস্তাদ।
শিরিন বলল, “ঠিক একেবারে বড়ে গোলাম আলির মতো। তার মানে তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে গান গাও। আমরা শুনতে পাই না।”
সিংজি বললেন, “সে আমি বলব না। আমি কী করি, আমি নিজেই জানি না। আচ্ছা, অত কথার দরকার কী! আমি যা করি, আমিই করি, তাতে কার কী! আরও জিনিস আছে, সেসব বের করি। আজ রাত্তিরে আমার আবার নেমন্তন্ন আছে। বড়িয়া ভোজ।”
জয়া বলল, “কে করেছে?”
“খড়ক সিং।”
তিনজনেই হাঁ হয়ে গেল। এ আবার কেমন কথা!
জয়া বলল, “সে আবার কোন খড়ক সিং?”
“কেন? এই খড়ক সিং। খড়ক সিং আবার ক’জন আছে!”
“নিজেকেই নিজে নেমন্তন্ন করলে?”
“তা হলে কে করবে। আমার কে আছে! আর কারই বা কে থাকে! আমার আমিই থাকে। একে শূন্য দশ, দশে শূন্য একশো। সেই এক। একশোয় শূন্য হাজার। সেই এক। সবাই বলে, হাজার হাজার, লাখ, কোটি। অনেক, অনেক। সবই শূন্যের খেলা। আসল হল এক। তা এসব কথা কেন? পাকা-পাকা কথা। বুড়োদের মতো পাকা-পাকা কথা আমি একদম লাইক করি না।”
জয়া বলল, “কে রাঁধবে?”
“রোজ যে রাঁধে। খড়ক সিং। আমি রাঁধব, আমিই আমাকে খাওয়াব। সোজা কথা।”
“কী রাঁধবে?”
“এখনও ঠিক করিনি। ওস্তাদ যা খেতে চাইবে, তাই করে দেব।”
“তোমার কথা কিছু বুঝি না বাপু।”
“পারবে, পারবে। ভাল করে অঙ্ক শিখলেই পারবে। অঙ্কে স্ট্রং না হলে এসব বোঝা যায় না। আমাকে আর বকিয়ো না। আমি এখন সিন্দুক খুলেছি।”
সিন্দুক থেকে নানা জিনিস বেরোতে লাগল। হার, চুড়ি, সোনার জলের কাজ-করা বাঁধানো নোটবুক। নানারকমের টিপ, চামড়ার ব্যাগ, বেল্ট, আতরের শিশি। সব ভাগাভাগি হয়ে গেল তিনজনের মধ্যে। খড়ক সিং উঠে পাশের ছোট ঘরে গেলেন। সেখান থেকে নিয়ে এলেন এক ঝুড়ি প্যাঁড়া। বেশ পেস্তাটেস্তা দেওয়া।
টেবিলের ওপর রেখে বললেন, “যে যটা পারো খাও, তারপর বাড়ি নিয়ে যাও। এ যা খেতে! তবে আমাদের চৌকের লাড্ড়ুর কাছে লাগে না।”
জয়া বলল, “তুমি ভারী একগুঁয়ে। তবু তোমাকে বলি, আমাদের বাড়িতে এক জার্মান সায়েব এসেছেন। দাদির বন্ধু। তুমি আমাদের বাড়িতে চলো না। আজ আমাদের বাড়িতে তুমি রাত্তিরে খাবে।”
“ধুত! আমার কারও বাড়ি যেতে ভাল লাগে না। বোকা-বোকা লাগে। চুপ করে বসে থাকো, মাঝে-মাঝে এক-আধটা কথা বলো। হাসতে ইচ্ছে করছে না, তবু জোর হাসো। ওসব আমি পারি না। বড়-বড় লোকদের এড়িয়ে চলতে হয়। সমানে-সমানে মিশবে, সামনে-সামনে লড়বে। এইসব আমি শিখেছি। আমাকে তোমরা মুখ্য ভেবো না। আমি বলি কী, তোমরা আজ এখানে খেয়ে যাও। সে একটা হবে। নতুন একটা রান্না বের করেছি।”
শিরিন বলল, “কী সেটা?”
“কাবাব।”
“কাবাব অনেককালের পুরনো।”
“এ হল আলুর কাবাব। খেলে বুঝবে, কী জিনিস! মাথা খাটিয়ে বের করেছি। আরে, মানুষ তো জীবজন্তু খেয়ে-খেয়ে দুনিয়াটা ফাঁক করে দিলে। ছাগল খাচ্ছে, ভেড়া খাচ্ছে, মুরগি খাচ্ছে। খেয়েই যাচ্ছে, খেয়েই যাচ্ছে। ওদের বন্দুক নেই, ভাষা নেই, নেতা নেই, সব রাজ্যেই আছে নিজেদের কোনও রাজত্ব নেই, দুর্বল। ধূর্ত মানুষ মেরেকেটে খেয়ে সব শেষ করে দিলে।”
খড়ক সিংয়ের খড়খড়ে মুখ করুণ হয়ে এল। চোখ দুটো খুব বড় বড়। সেই চোখে জল।
জয় বলল, “তুমি কাঁদবে না কি?”
“কান্না পেলে কী করব? আমার যখন যা পায়, আমি তখন তাই করি। আমার ভেতর আছে। সেই ভেতরে আর-একটা লোক আছে। সেই কলসিটার কথা মনে আছে? আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের সেই কলসিটা। যার মধ্যে দৈত্য ছিল ধোঁয়া হয়ে। যাক, সেসব কথা থাক। তোমরা আবার ভয় পেয়ে যাবে। ব্যাপারটা তো মোটেই সোজা নয়। একের মধ্যে দুই। সেই দু নম্বরটাই আমাকে চালায়। তা বলো, আজ আমাদের ফিস্ট হবে কি না! কাল তো রবিবার। আজ না পড়লেও চলবে। আজ আবার চাঁদের রাত। বলো তো, তোমাদের বাড়িতে একটা চিঠি লিখে দি, অনুমতি চেয়ে।”
খড়ক সিং উঠে গেল জানলার ধারের টেবিলে। কারুকার্য করা ছোট্ট একটা আবলুস কাঠের টেবিল।
॥ ৮ ॥
তা মন্দ হল না। খড়ক সিংয়ের চিঠি কেউ ‘না’ করতে পারে কি। কাল রবিবার, তবে আর ভয় কী! শনিবারের একটা বেলা একটু ফুর্তি করে নাও। ম্যানফ্রেড বললেন, “মানুষটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ভেরি ইন্টারেস্টিং। আমি যদি যাই, কিছু মনে করবেন?”
শিবশঙ্কর বললেন, “কিছু মনে করার লোকই নয় সে। খড়ক সিংয়ের ঠাকুর্দা ছিলেন রাজপুতনার এক নেটিভ স্টেটের রাজা। তারপর একটু-একটু করে রাজ্যপাট সবই গেল। গেলে কী হবে, মেজাজটা রাজা-মহারাজার মতোই আছে। চলো, আমিও যাব।”
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই খড়ক সিংয়ের বাড়িতে জোর জমায়েত। সিং সেজেছে কী। সাদা পাজামা, কুর্তা, গেরুয়া পাগড়ি। বুকের কাছে ঝকঝকে একটা লকেট দুলছে। পায়ে জরির নাগরা। ম্যানফ্রেড ফটাস-ফটাস করে গোটাকতক ছবিই তুলে ফেললেন।
শিবশঙ্কর বললেন, “কিছু লিখবে না কি?”
“ভাবছি একটা স্টোরি করব। এইরকম চরিত্র কোথায় পাব। আমাদের দেশে নেই।”
“ঘন্টাখানেক মিশলেই বুঝতে পারবে, এমন মানুষ কল্পনাও করা যায় না।”
সিং বললেন, “আমার একটাই গুণ, আমি পাগল।”
শিবশঙ্কর বললেন, “কেমন করে বুঝলে?”
“খুব সহজ। পাগলের দুটো অসুখ কখনও হয় না, সর্দি-কাশি,
জ্বর-পেটখারাপ। আমারও হয় না, আমি পাগল। পাগলদের গায়ে ভীষণ জোর হয়। আমারও খুব জোর।”
“তোমার মতো পাগল আমিও হতে চাই।” শিবশঙ্কর বললেন।
“পাগল তো হওয়া যায় না, পাগল হয়ে যায়। অনেক বছর আগে একদিন সকালে উঠে আমি দেখি কী, আমি পাগল হয়ে গেছি। সে খুব মজা।”
“সেটা কীরকম?”
“ঘুম থেকে উঠেই ধেই-ধেই করে নাচতে লাগলুম। যত নাচি, তত আনন্দ। ছুটে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলুম। সকলকে ডেকে বললুম, আমার ভাল-ভাল জিনিস যা আছে, সব তোমরা নিয়ে যাও। আধ ঘন্টার মধ্যে আমার ঘর ফাঁকা। আমি, শুধু আমিই দাঁড়িয়ে আছি। সে কী মজা! একেবারে হালকা।”
“তারপর এইসব এল কোথা থেকে? এই ফার্নিচার টার্নিচার।”
“সেও এক মজা। যেই সব দিয়ে দিলুম, অমনই সব এসে গেল। দেখলুম, দিলেই তবে আসে। খালি না করলে ভর্তি হয় না। ধরুন, এক কলসি জল আছে। সেই জলটা না ফেললে নতুন জল ভরা যাবে না। আগে খালি করতে হবে। বুঝলেন, এসব হল ওপরওয়ালার কথা। আমরা তো বিশ্বাস করি না। বিশ্বাস করলে হাতে-হাতে ফল। আপনার সেই ওয়াটসন সাহেবকে মনে আছে? গালার চাষ করতেন। জঙ্গলে গিয়ে বাঘ মারতেন।”
“খুব মনে আছে। শেষের দিকটায় সাধুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন।”
“সেই ওয়াটসন সাহেব বিলেত চলে যাওয়ার আগে আমাকে ডাকলেন। ডেকে বললেন, ‘খড়ক সিং, সব লে যাও। আমি বললুম, সাহেব, আমি তো নিতে পারি না, দিতে পারি।’ সাহেব বললেন, ‘তা হলে তুমি উপার্জন করো। আমি শুনেছি তোমার অনেক জুড়িবুটি জানা আছে।’ সাহেবের হাঁপানির টান উঠত। সারারাত জেগে থাকতেন। একটা ওষুধ তৈরি করে দিলুম, সাহেবের কিছুটা ইলাইজ হল। সাহেব বললেন, ‘এইটটি পারসেন্ট সেরেছে, এইবার তোমার ফি হিসেবে সব নিয়ে যাও।’ আমি বললুম, ‘সাহেব তুমি পাঠিয়ে দাও। যা তুমি দিতে চাইছ, সব পাঠিয়ে দাও।’ আবার আমার ঘর ভরে গেল।”
শিবশঙ্কর বললেন, “আমরা এই যে এলুম, এতে তোমার কোনও আপত্তি আছে?”
“আমার আপত্তি! এ তো আমার সৌভাগ্য। তবে একটাই কথা, বুড়ো হয়ে বসে থাকলে হবে না, ছোট হয়ে যেতে হবে।”
“সেটা এই বয়সে কী করে সম্ভব হবে খড়ক সিং?”
“খুব হবে। বাইরে চলুন, আমি কায়দাটা দেখিয়ে দিচ্ছি।”
বাইরেটা চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। কৃষ্ণচূড়ার পাতা ঘুমিয়ে পড়েছে। পড়লেও ঝলমলে আকাশের গায়ে তুলির আঁচড়ের মতো বেশ দেখাচ্ছে। ছোট-ছোট ঝোপ চাঁদের আলোয় রুপার পাতের মতো দেখাচ্ছে। মিষ্টি একটা বাতাস বইছে। ইউক্যালিপটাস গাছ সোজা আকাশের দিকে উঠে গেছে। কিছু দূরেই ঝাঁকড়া দেবদারু। গোটা বাগানটায় আলোছায়ার খেলা। থই থই আলো, ভারী-ভারী ছায়া। জমজমাট রহস্য।
খড়ক সিং বললেন, “কেমন লাগছে?”
ম্যানফ্রেড বললেন, “ওয়াণ্ডারফুল! রোমান্টিক ইন্ডিয়ান নাইট।”
সিং বললেন, “আমরা এইবার কিছুক্ষণ চোর-চোর খেলব।”
শিবশঙ্কর বললেন, “এই বয়েসে? সবাই যে পাগল বলবে খড়ক সিং।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “সেটা কী খেলা?”
“হাইড অ্যান্ড সিক গেম। একজন চোর হবে, বাকি সবাই লুকিয়ে থাকবে। যে চোর, সে খুঁজবে। একটা বুড়ি থাকবে। লুকনো জায়গা থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে যে বুড়ি ছুঁয়ে ফেলবে, সে আর চোর হবে না।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “ইন্টারেস্টিং! হয়ে যাক এক রাউণ্ড।”
গোনা শুরু হল, দশ, কুড়ি, তিরিশ, চল্লিশ। গুনছে জয়া। চোর হলেন খড়ক সিং। সিং বললেন, “জানা আছে নিয়মটা? পাঁচ মিনিটের মধ্যে সব লুকিয়ে পড়ুন। আমি রেডি বলেই খুঁজতে বেরোব। এই বেদিটা হল বুড়ি।”
শিবশঙ্কর আর জয়া উত্তর দিকে গেলেন। জয় আর শিরিন দক্ষিণে। ম্যানফ্রেড পুবে। লুকোবার মতো একটা জবরদস্ত জায়গা খুঁজতে গিয়ে শিবশঙ্করের মনে হল, সত্যিই তিনি ছোট হয়ে যাচ্ছেন। জয়ার সমবয়সী হয়ে গেছেন। বেশ উৎসাহ পাচ্ছেন। এমনভাবে লুকোতে হবে, কেউ যেন খুঁজে না পায়। খুঁজে-খুজে একেবারে হয়রান হয়ে যাবে। হাতে মাত্র পাঁচ মিনিট সময়।
জয়া বলল, “এই রঙ্গনের ঝোপের পাশে হামাগুড়ি দিয়ে থাকলে কেমন হয়!”
“এটা খুব সহজ জায়গা। আর-একটু এগিয়ে চলল। ওই দ্যাখো, ওদিকটা সবচেয়ে অন্ধকার।”
অন্ধকার জায়গাটায় পাথরের স্তৃপ। বড় একটা ব্যারেল পড়ে আছে। কোনও কাজে কোনওকালে কেউ এনেছিল। শিবশঙ্কর বললেন, “জয়া, ফ্যান্টাস্টিক! ভগবান আছেন। আয়, এইটার ভেতর ঢুকে বসে থাকি।”
“ওটার ভেতর ঢোকার চেষ্টা কোরো না। পরে আর বেরোতে পারবে না। বরং এর আড়ালে বোসো। সাপ বা বিছে কামড়ালে জানি না। “
“সাপ, বিছে এই সিজনে থাকে না।”
দু’জনে ব্যারেলের আড়ালে ঘাপটি মেরে বসলেন। শিবশঙ্করের বেশ মজা লাগছে। ফিসফিস করে জয়াকে বললেন, “কথা বলবি না। হঠাৎ হাঁচি পেলে, চেপে যাবি।”
ম্যানফ্রেড পুব দিকে যেতে-যেতে ভাবলেন, “বাঃ, বেশ মজা! সেই ছেলেবেলাটা ফিরে এসেছে। যখন কোনও ভাবনাচিন্তা ছিল না। পড়া আর খেলা। নদীতে নৌকো বাওয়া। হে হিটলার, কোথায় যুদ্ধ, আণবিক বোমা, কে মাথা ঘামায়! ওসব বড়দের ব্যাপার! সবুজ মাঠ, সাদা গোরু, ভেড়ার পাল। এক বন্ধু। খেলার, মাঠে সন্ধ্যা নেমে আসত। চিমনির ধোঁয়া। অর্কেস্ট্রার সুর। বিছানায় নীল ঘুম। মিকি মাউসের ছবি। ম্যানফ্রেডের সঙ্গে কিশোর ম্যানফ্রেডের যেন দেখা হয়ে গেল, “হালো ফ্রেড! তুমি এতদিন ছিলে কোথায়! আমাকে ছেড়ে কোথায় গিয়েছিলে ফ্রেন্ড!” সামনেই একটা ঝুপড়ি আমগাছ। ম্যানফ্রেড তার ডালে চেপে বসলেন। ইন্টারেস্টিং! গাছে চড়ার অভ্যেসটা বজায় আছে। নাকের ডগায় পাখির বাসা। এক থোপা চাঁদের আলো পড়েছে। মা তার বাচ্চাকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। ম্যানফ্রেড মনে-মনে বললেন, “ডোন্ট স্টার!”
জয় আর শিরিন যে-দিকটায়, সেদিকে বড়-বড় গাছ। মোটা গুঁড়ি। সিমেন্ট-বাঁধানো শুকনো একটা চৌবাচ্চা। জয় বলল, “এই চৌবাচ্চাটা!”
শিরিন বলল, “মাথামোটা! আগেই তো এই জায়গাটা খুঁজবে! এমন জায়গায় লুকোতে হবে, যাতে চোখে না পড়ে।”
“সেটা তা হলে কোন জায়গা!”
“আর-একটু এগিয়ে চলো।”
কিছুদূরেই একটা বাহারি পাতার ঝোপ। নরম সবুজ ঘাস। গাছের পাতার ভেতর দিয়ে নেমেছে ছাপকা-ছাপকা চাঁদের আলো। শিরিন বলল, “এই ঝোপের আড়ালে আমরা চুপটি করে শুয়ে থাকব। কেউ খুঁজে পাবে না। জায়গাটা খুব সুন্দর!”
“ঘাসে যে ঠাণ্ডা। যদি জ্বর হয়?”
“তোর যাতে জ্বর না হয়, সে আমার দায়। তোকে আমার এই ওড়না দিয়ে ঢেকে রাখব।”
শিরিন গোলাপি রঙের শালোয়ার-কামিজ পরে আছে। তার ওপর পেঁয়াজ রঙের ওড়না। ওড়নায় ছোট-ছোট চুমকি বসানো। যেখানে-যেখানে একটু-একটু চাঁদের আলো পড়েছে, সেই জায়গাটা ঝলমল করছে। শিরিনের গায়ে গোলাপের গন্ধ। আতর মেখেছে।।
“আর তোর যদি জ্বর হয়?”
“মেয়েদের সহজে অসুখ করে না। বকবক না করে লুকিয়ে পড় বোকা।”
অনেক দূর থেকে খড়ক সিং চিৎকার করলেন, “রেডি?”
জয় আর শিরিন জড়াজড়ি করে ঝোপের আড়ালে নরম ঘাসে বসে পড়ল। শিরিন ওড়না দিয়ে ঢেকে দিল জয়কে। জয় শিরিনের সঙ্গে একেবারে মিশে আছে। শীত-শীত, ভয়-ভয়। শিরিনের শরীরের উষ্ণতা তাকে ঘিরে রেখেছে। নরম ওড়না। চারিদিক একেবারে নিস্তব্ধ। শিরিনের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ জয় শুনতে পাচ্ছে। কোথায় কে যেন খসখস করে কেসে উঠল। জয় দু হাত শক্ত করে শিরিনকে জড়িয়ে ধরল। শিরিন ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “ভয় করছে?”
“কে কাসছে?”
“চুপ করো।”
খড়ক সিং। লম্বা শরীর। মাথায় পাগড়ি। বিশাল বিশাল গাছ। পাতাবাহারের ঝোপ। রঙ্গনা, টগর, জবা, গোলাপ, মুসান্ডা। খড়ক সিং ছায়ার জালিকাটা চাঁদের আলো-ধোয়া মাঠে একা দাঁড়িয়ে। ম্যানফ্রেড গাছের ডালে বসে দেখতে পাচ্ছেন। সিং ছেলেমানুষের মতো এক রাউন্ড নেচে নিলেন। তারপর আরামসে এগিয়ে গেলেন পশ্চিম দিকে।
জয়া দাদুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আমাদের যদি কোনওদিন খুঁজে না পায়!”
“ভালই তো, তা হলে আমরা চিরকালের মতো হারিয়ে যাব।”
॥ ৯ ॥
আবার সেই কাশির শব্দ। একটা বিশ্রী খসখসে আওয়াজ। সাধারণত সন্দেহজনক চরিত্রের লোকেরাই এইভাবে কাশে। জয়ের সেইরকমই ধারণা। চাঁদের আলো আরও জোর হয়েছে। চারপাশ ফুটফট করছে। কোথাও কোনও ঝোপে হাসনুহানা ফুটেছে। গন্ধে মাতোয়ারা। দূরে কোথাও একটা পাখি ডাকছে টিটির-টিটির করে।
ভয় করছে। শীত শীত লাগছে। জয় শিরিনের বুকের কাছে ঢুকে গেছে। স্বচ্ছ ওড়নার ভেতর দিয়ে চন্দ্রালোকিত প্রকৃতি দেখছে। যেন স্বপ্ন দেখছে। শিরিনের রেশমি চুড়িদার আর জামা পিছলে রুপোর মতো চাঁদের আলো নামছে। ছোট্ট কপালে সোনালি টিপ। আবার সেই করাত-কাটা কাশি।
জয় ফিসফিস করে বলল, “ভয় করছে।”
দু হাতে জয়কে জড়িয়ে ধরে শিরিন বলল, “কিসের ভয়! আমি তো রয়েছি। কোনও ভয় নেই।”
গাছের ডালে বসে ম্যানফ্রেড সব দেখতে পাচ্ছেন। খড়ক সিং যেন সেকালের এক মহারাজা। সেইরকম পোশাক। বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছেন। মাথায় পাগড়ি। পরে আছেন শেরওয়ানি। নাকতোলা জরির নাগরা। খড়ক সিং খুঁজছেন। কে কোথায় লুকিয়ে আছে। চোর-চোর খেলার সময় সবই কেমন রহস্যময় হয়ে ওঠে। সবাই আছে। হাতের কাছেই আছে, তবু সব যেন কেমন ফাঁকা-ফাঁকা। সন্দেহ, কেউ আছে তো! যদি না থাকে। চারপাশে অনেক ঝোপঝাড়। সবক’টাই সন্দেহজনক। আড়ালে যদি কেউ থাকে! সেও এক ভয়ঙ্কর চমক। বুকটা ধড়াস করে উঠবে। খড়ক সিং ভয়ে-ভয়ে এগোচ্ছে। ম্যানফ্রেডের খুব মজা লাগছে। অসহায় লোকটিকে দেখে মনেই হচ্ছে না, সে খুব সাহসী। ম্যানফ্রেডের পকেটে আখরোট ছিল। তাক করে ছুড়লেন। খড়ক সিংয়ের পায়ের কাছে পড়ল। সিংজি চমকে উঠলেন। এপাশ-ওপাশ তাকালেন। আকাশের দিকে তাকালেন যেন জিনিসটা আকাশ থেকে পড়েছে! সাবধানে নিচু হয়ে ঘাসের ওপর পড়ে থাকা আখরোটটা দেখে বোঝার চেষ্টা করলেন জিনিসটা কী। হাত বাড়িয়েও তুললেন না জিনিসটা। ভয় পেয়েছেন।
জয়া দাদুকে বলল, “আমরা কিন্তু এখন বুড়ি ছুঁতে পারি। সিংজি সামনে এগিয়ে গেছেন।”
“তা হলে আর কষ্ট করে লাভ কী! জায়গাটা তো খুব সুখের নয়। চলো বেরিয়ে পড়ি।”
দু’জনে নিঃশব্দে বেরিয়ে, গাছের আড়ালে আড়ালে বেদির ওপর। আর কিছু করার নেই। শিবশঙ্কর বললেন, “বড় তাড়াতাড়ি আমরা বুড়ি ছুঁয়ে ফেললুম। আরও কিছুক্ষণ সাসপেন্সে থাকলে হত!”
জয়া বলল, “একটা ব্যাঙ আমাকে খালি গোত্তা মারছিল। তা না হলে তো বেশ মজাই লাগছিল।”
“ব্যাঙ তো বর্ষাকালে!”
“সে হল ভিজে ব্যাঙ, এটা শুকনো ব্যাঙ। শীতের মুখে বেরোয়।”
“ব্যাঙের আবার শুকনো ভিজে আছে নাকি?”
“ফলের মধ্যে যেমন তরমুজ আর গোলাপজাম। একটা ভিজে আর একটা শুকনো। যেমন হাঁস আর মুরগি।”
“বুঝে গেছি। অ্যাজ ক্লিয়ার অ্যাজ এবিসি।”
খড়ক সিং সোজা-বাগানের শেষ মাথায়। সেখানে নিচু পাঁচিল। পাঁচিলের ওপাশের জমি অনেকটা ঢালু হয়ে নেমে গিয়ে এক দৌড়ে চলে গেছে সরলা নদীর দিকে। নদীর দিকটা ধোঁয়া-ধোঁয়া। কুয়াশা উঠছে। রাতের দিকে নদী যেন নিশ্বাস ফেলে। চাঁদের আলো যেন রুপোর আঁচল দুলিয়ে দিয়েছে। খড়ক সিং চোর-চোর খেলা ভুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। পৃথিবীটা কী ভয়ঙ্কর সুন্দর! মানুষ কেন তাকিয়ে দ্যাখে না! কেবল কাজ কাজ করে দৌড়ে মরে। সব কেবল পেটের ধান্দা। সুন্দর যা-কিছু সবই পেটের জগতের বাইরে।।
শিরিন বলল, “সিংজি বাগানের শেষ মাথায়, চল জয়, আমরা বুড়ি ছুঁয়ে ফেলি।”
“পারব তো! সেই বেদিটা অনেক দূরে।”
“খুব পারব। আমরা দুজনে পাঁই পাঁই করে ছুটব।”
শিরিন আর জয় জড়াজড়ি করে বসেছিল। সেইভাবেই উঠে দাঁড়াল। শিরিন জয়ের মাথা থেকে ওড়নাটা টেনে খুলে নিল। জয়ের চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। সেইদিকে তাকিয়ে শিরিন বলল, “পাগল, পাগল দেখাচ্ছে।” তারপর জয়কে আদর করে বলল, “সোনা ছেলে।” আর তখনই সেই কাশির শব্দটা আবার। কে যেন দেশলাই ঘষছে। মার ছুট।
ম্যানফ্রেড গাছের ডালে বসে দেখছেন। চাঁদের হাঁসির বাঁধ ভেঙেছে, উছলে পড়া আলো। সবুজ ঘাস। অন্ধকার ঝোপ গেরিলা সৈন্যদের মতো ওত পেতে আছে। একটা ছেলে, একটা মেয়ে ছুটছে। ছুটছে। ছুটছে পাতলা ছায়া। ম্যানফ্রেডের মনে হচ্ছে তিনি যেন কোনও শেকস্পিয়রের নাটক দেখছেন।
বেদিতে বসেই তারা হাঁপাতে লাগল। খুব ছুটছে।
শিবশঙ্কর বললেন, “তোরা কোথায় ছিলিস?”
“ওই ওপাশে অনেকটা দূরে, সেখানে একটা বদমাইশ লোক লুকিয়ে আছে। কেবল খসখস করে কাশছে।”
জয়ের কথা শুনে শিবশঙ্কর হেসে বললেন, “বদমাইশ লোক লুকিয়ে থাকলে কাশবে কেন? কাশলে তো ধরা পড়ে যাবে! বরং বলো, একটা লোক বসে-বসে কাশছে, তার কাশি হয়েছে। সে তো আর চোর-চোর খেলছে না?”
শিরিন বলল, “লোকটা কে?”
শিবশঙ্কর বললেন, “কোনও দেহাতি হবে। খড়ক সিংয়ের বন্ধুও হতে পারে।”
দূরে দেখা গেল, খড়ক সিং আসছেন। যেন সম্রাট শাজাহান। মাথায় পাগড়ি। চাঁদের আলোয় জরি ঝলমল করছে। সিংজির চলনটা অদ্ভুত। একেবারে সোজা, খাড়া। লাঠির মতো।
সিংজি এসে শিবশঙ্করকে বললেন, ‘আপনারা সবাই এসে গেছেন, কিন্তু সেই সায়েব কোথায়?
“নিশ্চয় কোনও জব্বর জায়গায় লুকিয়ে আছেন।”
“আমি তো সব খুঁজে এলাম।”
“তোমার খোঁজা তেমন সুবিধের নয়। আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেল। দেখতে পেলে না।”
“কে বলেছে দেখতে পাইনি। আপনারা দু’জনে ছিলেন ব্যারেলের ভেতর। আর ওরা দু’জন ছিল রামছাগলের ঝোপে।”
শিরিন বলল, “রামছাগল মানে?”
“তা হলে আপনারা যে চোর হয়ে যেতেন।”
হঠাৎ মাউথ অগান বেজে উঠল। বিদেশি মার্চিং সুর। যুদ্ধের বাজনা। সুরটা আকাশে ভাসছে।
সিংজি বললেন, “কে বাজাচ্ছে! যুদ্ধের বাজনা।”
শিবশঙ্কর বললেন, “আমার বন্ধু ম্যানফ্রেড।”
সেই সুর লক্ষ্য করে সবাই এগিয়ে চলল। বাজনাটা আকাশ থেকে নামছে। কোনও ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে নয়। সবাই তখন ওপর দিকে তাকাচ্ছে আর এগোচ্ছে। দেখা গেল আমগাছের ডালে দুটো পা ঝুলছে। সেই গাছের নীচে সবাই গিয়ে দাঁড়াল। পাতার ফাঁকে-ফাঁকে চাঁদের আলো। সেই আলো ছাপকা-ছাপকা হয়ে ম্যানফ্রেডের গায়ে পড়েছে। গাছের ডালে বেশ কায়দা করে বসে ম্যানফ্রেড বিভোর হয়ে মাউথ অর্গান বাজাচ্ছেন।
শিবশঙ্কর বললেন, “তোমার সাহস তো কম নয়! রাত্তিরবেলায় গাছে উঠে বসে আছ!”
ম্যানফ্রেড বাজনা থামিয়ে বললেন, “ফ্যান্টাসটিক জায়গা। সাহস থাকে তো উঠে এসো। ওপর থেকে নীচেটা ফাইন দেখাচ্ছে। স্বপ্নের মতো। চাঁদের আলোয় চরাচর ভেসে যাচ্ছে। জমিটাকে মনে হচ্ছে রুপোর কার্পেট। জয়, তুমি ক্লাইম্ব করতে পারবে?”
শিবশঙ্কর হইহই করে উঠলেন, “না, না, পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙবে।”
ম্যানফ্রেড গাছের ডাল থেকে বললেন, “শঙ্কর, তোমাদের অ্যাপ্রোচটা ঠিক নয়। তোমরা হলে ভয়ের উপাসক। সাহস দাও, সাহস। পৃথিবীটা সাহসীদের। তারাই পৃথিবীটাকে ভোগ করতে পারে। আগেই নেগেটিভ চিন্তা কেন? থিঙ্ক পজেটিভ। পড়ে যাবে কেন? আমি তো সহজেই উঠে এলুম, আমার এই বয়সে, এত বড় একটা শরীর নিয়ে। কাম আপ জয়। এখানে এলে তুমি এই চাঁদের আলোর রাত আরও বেশি এনজয় করতে পারবে।”
জয় ভয় পেয়েছে। জীবনে সে গাছে চড়েনি। গাছটার মোটা গুঁড়ি। তলার দিকে কিছু সরু-সরু ডালপালা। অনেকটা উঁচুতে দুটো মোটা ডাল দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে চলে গেছে। সেই ডালের আরও শাখা-প্রশাখা।।
ম্যানফ্রেড বললেন, “গাছের গুঁড়িটাকে, মায়ের মতো দু হাতে জড়িয়ে ধরে, দুটো পায়ের চাপে তরতর করে উঠে এসো। মনকে বলো, মন, আমি ওপরে যাব। দেহ হল মনের দাস।”
শিরিন বলল, “যা না। ঠিক পারবি। আমি বলছি, তুই পারবি। আমি পারি আর তুই পারবি না। নিজেকে একটা হনুমান ভাব। “
জয়ের ইতস্তত ভাবটা কেটে গেল। সে এগিয়ে গিয়ে গাছের গুঁড়িটা জড়িয়ে ধরল। ঠাণ্ডা খড়খড়ে। ম্যানফ্রেড ওপর থেকে বললেন, “পারবে, তুমি নিশ্চয় পারবে। না পারার কোনও কারণ নেই। ইট ইজ সো ইজি।”
জয় দু’ পা দিয়ে গুঁড়িটা জড়িয়ে ধরল, যেন মায়ের কোলে উঠতে চাইছে। হঠাৎ মনে হল, সে পারবে। গাছটাকে বড় আপন মনে হল। মনে হল, একটু আগে, সে যেমন ভয়ে শিরিনকে জড়িয়ে ধরেছিল, সেইরকম গাছটাকে জড়িয়ে ধরেছে। শরীরটাকে ওপর দিকে একটু হ্যাঁচকা মারতেই সে হাতখানেক উঠে গেল। তখন তার খুব আনন্দ। এই তো পারছে। সে পেরেছে। শিরিন আর জয়া দু’জনেই উৎসাহ দিচ্ছে, “ওঠ, ওঠ। উঠে যা ওপরে, আরও ওপরে।” ম্যানফ্রেড বলছেন, “আপ, আপ, ক্লাইম্ব আপ।”
দুটো বড় ডাল যেখানে বিভক্ত হয়েছে, জয় সেই জায়গাটায় পৌঁছে গেল। আর কোনও ভয় নেই তার। ইট ইজ সো ইজি। দুটো হাত আর দুটো পা অসাধ্য সাধন করতে পারে। জয় যে ডালে বসেছে, তার ওপরের ডালে ম্যানফ্রেড।।
ম্যানফ্রেড বললেন, “হ্যালো, মাই ব্রেভ ম্যান! এইবার বলো নীচের দিকটা কেমন লাগছে!”
জয় বলল, “ওয়াণ্ডারফুল। স্বপ্নের মতো।”
“ইয়েস! জীবন হল স্বপ্ন। যে সেই স্বপ্ন দেখতে পারে, সেই আনন্দে থাকে।”
জয় চিৎকার করে বলল, “গ্র্যান্ডফাদার, আমি পেরেছি।”
খড়ক সিং বললেন, “নামবে কী করে?”
ম্যানফ্রেড বললেন, “মাটির টানে।”
“ধপাস করে পড়ে যাবেন?”
“সে যখন আমরা নামব তখনই দেখবেন। চিতাবাঘের মতো।”
ম্যানফ্রেডের মাউথ অর্গান বেজে উঠল। বিজয় উল্লাসের সুর। চাঁদের আলোর ওড়না দুলছে।
শিউলি – 10-19
শিউলি – 10-19
॥ ১০ ॥
রাত মনে হয় অনেক হল। কারও ঘড়ি দেখার কোনও তাড়া নেই। ঘড়ি হল দাসত্ব। সময়ের দাস হয়ে সব সময় বাঁচতে ইচ্ছে করে না। মানুষ কেন সময়ের হিসেব রাখবে! সময়ই মানুষের হিসেব রাখুক। ম্যানফ্রেড বলছেন, “সবই তো হল, আগুন জ্বলল কই! কখন হবে আলু কি কাবাব!”
খড়ক সিং ভাবে আছেন। মানুষটার মাঝে-মাঝেই এমন হয়। দেহ একখানে, মন আর-একখানে। আজকের পৃথিবীটা যেন ঝলমলে রুপোর পৃথিবী। গাছপালা যেন জড়োয়ার গয়না পরে বসে আছে। মাঝে-মাঝে পাখিদেরও আচমকা ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। টিক, টিক, টিটির টিক করে ডেকেই, মায়ের ধমক খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ছে, “শুয়ে পড়। রাত এখনও অনেক বাকি।”
খড়ক সিং উদাস গলায় বললেন, “আমার তো অনেক পরিকল্পনা ছিল সায়েব, আসল কথা হল আমার ঘরে আজ কিছুই নেই। আর সবচেয়ে বড় কথা হল, আমার জেব আজ একেবারে খালি।”
ম্যানফ্রেড হা-হা করে হেসে বললেন, “বহুত আচ্ছা! এমন নিমন্ত্রণ আমি জীবনে দেখিনি। তা হলে আজ আমাদের কাল্পনিক ভোজ হোক। কাগজ কলম দাও, একটা মেনু করে ফেলি। সেইটা পড়লেই আমাদের খাওয়া হয়ে যাবে।”
শিবশঙ্কর বললেন, “খড়ক সিংকে আমি চিনি, আজকের পরিচয়! আচ্ছা খড়ক, তোমার স্টকে চা আছে?”
“চা আজ সকালে শেষ হয়ে গেছে। দু চামচের মতো ছিল।”
“আচ্ছা, জল আছে?”
“জল ছিল, অনেক জল। খেতে গিয়ে দেখি, একটা ব্যাং সেই জলে চান করতে নেমেছে।”
“দুধ আছে খড়ক সিং?”
“দুধ ছিল, খাঁটি মোষের দুধ। মোটা একটা বেড়াল এসে খেয়ে গেছে।”
“তা হলে তোমার আছেটা কী?”
“মহারাজ! আমি আছি। আমার সেবা আছে। আমার মন আছে।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “একেবারে সাচ্চা মানুষ। কোনও ঝামেলা নেই। আজ রাতটা আমরা চাঁদের আলোয় বসে গল্প করে কাটাই। প্রত্যেকে একটা করে গল্প বলবে। জীবনের অভিজ্ঞতা।” একটা মোটর গাড়ি আসার শব্দ হল। ঝকঝকে একটা গাড়ি এসে ঢুকল বাগানে। দরজা খুলে নেমে এলেন উদয়ন, উমা, জয়ের ঠাকুমা আর ধর্মা।
এগিয়ে আসতে-আসতে উদয়ন বললেন, “খাওয়াদাওয়া সব হয়ে গেছে?”
শিবশঙ্কর হাসতে-হাসতে বললেন, “কিচ্ছু না। ওসবের কোনও পাট নেই। কল্পনার গার্ডেন পার্টি। কল্পনায় খাও। তোমার যা-খুশি খেয়ে যাও। ভাবো আর খাও। কোনও সমস্যা নেই। সহজ ব্যাপার। কাবাব খাও, বিরিয়ানি খাও, ফ্রাই খাও, কাটলেট খাও।”
উদয়ন বললেন, “আমরা সেইটাই অনুমান করেছিলুম।” ধর্মার দিকে ফিরে বললেন, “সব নামা।” গাড়ির বুট খুলে ধমা সব নামাতে লাগল, ঝকঝকে পোর্সিলিনের ডিনার প্লেট, কোয়াটার ডিশ, স্যুপ বোল। বেতের বাস্কেটে নানারকম খাবারদাবার, বিশাল একটা হাঁড়ি, ডেকচি। রাতের বাতাসে যাবতীয় সুখাদ্যের গন্ধ।।
খড়ক সিং ফোঁসফোঁস করে বললেন, “পোলাওয়ের গন্ধ পাচ্ছি, শাস্ত্রীয় কায়দায় রান্না!”
উদয়ন বললেন, “আমার মায়ের তৈরি।”
“পেস্তা, বাদাম, কিশমিশ যথেষ্ট পরিমাণে পডেছে তো? চপচপে খাঁটি ঘি?”
“অবশ্যই।”
“আমার অন্তরাত্মা ঠিক এই জিনিসটাই খেতে চাইছিল। তা হলে আমি ঝাড়লণ্ঠনটা জ্বালি।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “বাইরে খাওয়া হবে না? চাঁদের আলোয়?”
খড়ক বললেন, “রাজকীয় খাওয়া রাজকীয়ভাবেই খাওয়া উচিত।”
খড়কের এক পূর্বপুরুষ খড়ককে একটা ঝাড়লণ্ঠন উপহার দিয়েছিলেন। খড়কের ঘরে সেটা ঝুলছে। খড়কের একটা দামি কাশ্মীরি কার্পেট আছে। সেইটা ঘরের মাঝখানে বিছানো হল। মাথার ওপর ঝাড়লণ্ঠন জ্বলছে। মনে হচ্ছে ছোটখাটো একটা রাজবাড়ি। একটু নাচগান হলেই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ হয়।
খড়ক বললেন, “একটু নাচগান হোক। আচ্ছা, আমরা এতজন রয়েছি, আজ কি কারও জন্মদিন নেই!”
ম্যানফ্রেড বললেন, “সেই কাজটা আমি করেছি সিংজি। আমি আজ জন্মেছিলুম।”
খড়ক হইহই করে বললেন, “তা হলে, আজ সায়েবের জন্মদিন। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। একটা উপহার তো দেওয়া উচিত!”
খড়ক তাঁর সিন্দুকের দিকে এগিয়ে গেলেন। ডালাটা খুলে ফেললেন। খুঁজে-খুঁজে বের করলেন জরির কাজ করা একটা যোধপুরি আচকান। মাপে বেশ বড়ই। আচকানটা ম্যানফ্রেডকে পরিয়ে দিয়ে বললেন, “কেয়া বাত! সবাই হাততালি দিন।”
ফটাফট হাততালি। প্রশ্ন হল, কে নাচতে পারে, কে গাইতে পারে। শিরিন নাচতে পারে, জয়া গাইতে পারে। আসর জমে গেল। ম্যানফ্রেডের মাউথ অর্গান, জয়ার গান, শিরিনের নাচ। তবলার অভাবে শিবশঙ্কর একটা খালি টিনের কৌটোয় বোল তুলতে লাগলেন।
উদয়ন এক সময় বললেন, “আর না, খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। ঠাণ্ডা হলে আর খেতে ভাল লাগবে না।”
রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। খাওয়াদাওয়া শেষ হয়ে গেল। ম্যানফ্রেড বললেন, “জীবনে আমার এমন জন্মদিন হয়নি। বহুকাল মনে থাকবে। ভারতবর্ষ এক অদ্ভুত দেশ। এত ভালবাসা কোনও দেশে নেই। তাই তো আমি বারেবারে আসি। আমি তো একেবারেই একা। আমার কেউ নেই। আমি, আমার মোটর সাইকেল, আর আমার পথ। এখানে এসে দেখছি, আমার কত আপনজন!”
শিবশঙ্কর বললেন, “বাকি জীবনটা তুমি এখানেই কাটাও না, আমাদের সঙ্গে। অনেক তো ঘুরলে, অনেক তো দেখলে, অনেক রোজগারও করলে, আর কী হবে! একটা সময় সব কিছু ছাড়ার অভ্যাস করতে হয়। প্রথমে ধরবে তারপর ছাড়বে, এইটাই তো হল সুখে থাকার মন্ত্র। আমাদের ভারত তো সেই শিক্ষাই দিয়েছে। শেষটায় বাণপ্রস্ত।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “আমার মাথাতেও সেইরকম একটা চিন্তা আসছে শঙ্কর! এই ছেলেমেয়ে তিনটেকে যদি ভালভাবে মানুষ করে দিতে পারি। জয় এঞ্জিনিয়ার, জয়া ডাক্তার, শিরিন বোটানিস্ট! ওদের সাফল্য দেখতে-দেখতে একসময় আমি ঘুমিয়ে পড়ব! ওই সরলা নদীর ধারে আমার সমাধি হবে। সেখানে একটা শিউলিগাছ? আমি শুরতেই যেতে চাই। আকাশে তখন পালতোলা মেঘের নৌকো। ফুসফুস করে শিউলি ঝরবে আমার সমাধিতে। হুইসপারিং ফ্লাওয়ার। আমার বুকে পড়বে, ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করবে, “ম্যানফ্রেড! আর ইউ স্লিপিং!”
খড়ক বললেন, “জন্মদিনে মৃত্যুর কথা আসছে কেন?”
শিবশঙ্কর বললেন, “সেইটাই তো স্বাভাবিক! অঙ্ক কি বলে জানো? জন্মদিন মানে মৃত্যুর দিকে একটা বছর এগিয়ে যাওয়া। মনে করো তোমার ব্যাগে অনেক টাকা আছে, রোজ তুমি একটা করে খরচ করছ। একদিন দেখলে, তোমার ব্যাগ খালি! দিন হল সেই টাকা! মানুষ হল দিনের ঝোলা। জগমে দো দিনকা মেলা।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “চিনদেশে ওইজন্যেই বলে, জন্ম মানেই মৃত্যু। একটা শিশু জন্মাল, তারপর এক ঘণ্টা, দু ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা, মানে সে মৃত্যুর দিকে এক ঘণ্টা, দু ঘণ্টা, তিন ঘণ্টা এগোল, মানে মৃত্যুর ঘড়ি চালু হয়ে গেল।”
শিবশঙ্কর বললেন, “ঘড়ি বলে টিক টিক, ঠিক ঠিক, ঠিক ঠিক। সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়। কতদিন আগে পড়েছি! মনে নেই।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “আঃ বাইবেলে একটা জবরদস্ত কাপলেট আছে, ইন্টারন্যাল প্যাসেজ:
Time, like an ever-rolling stream
Bears all its sons away
They fly forgotten, as a dream
Dies at the opening day
একটা নদী অনন্তকাল হু-হু করে বয়ে চলেছে, খড়কুটোর মতো জীবন ভেসে চলেছে, যে গেল সে গেল, কেউ মনে রাখবে না। সব স্বপ্ন। তারপর ইংরেজিটা কী সুন্দর, Dies at the opening day, দিনের হিসেব খোলার দিনেই দিনের মৃত্যু। ক্রেডিট না ডেবিট।”
শিবশঙ্কর জয়, জয়া, শিরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই শোনো, ইংরেজির এই ইউজটা মনে রাখো, dies at the opening day. পরে কাজে লাগবে। ভাল ইংরেজি লিখতে হলে বাইবেলটা পড়া দরকার। মহাত্মা গান্ধীর ইংরেজিকে বলা হয় বাইবেলের মতো সুন্দর। নেহরুর ইংরেজিও সুন্দর ছিল।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “কাল থেকে তোমাদের তিনজনকে আমি বাইবেল পড়াব। As for man, his days are as grass, as a flower of the field, so he flourisheth. মানুষের দিনগুলো সব ঘাসের মতো, ফুলের মতো ফুটতেই থাকে। লেখাপড়ার মতো সুন্দর জিনিস আর কিছু নেই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মশগুল হয়ে থাকা যায়। আচ্ছা জয়, আজ আমরা কে কী ভাল কাজ করেছি, তার একটা হিসেব নেওয়া যাক। তুমি কী করেছ?”
জয় একটু ভেবে বলল, “শাস্তি পাওয়ার ভয় থাকলেও আজ আমি একটা সত্যি কথা বলেছি। আমাদের স্কুলের একটা দামি ফুলদানি আমি অসাবধানে ভেঙে ফেলেছিলুম। সোজা প্রিন্সিপ্যালকে গিয়ে বলেছি। তিনি দুঃখ পেলেও আমাকে কিছু বলেননি।”
“জয়া তুমি?”
“আমি আমার টিফিন আজ একজনকে দিয়ে দিয়েছি। সে দু’দিন না খেয়ে ছিল। সে জলভরা চোখে আমাকে বলেছিল, ‘মা।’ এমন মা বলা আমি কোনওদিন শুনিনি।”
“শিরিন তুমি?”
“সকালে টাঙ্গা চাপা পড়ে একটা কুকুরের সামনের ডান পা ভেঙে গিয়েছিল, আমি কাঠের টুকরো আর ব্যান্ডেজ দিয়ে সেই পা প্লাস্টার করে দিয়েছি। সে আমাকে কামড়ায়নি। সে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিল। মুখ তুলে সে যে-ডাকে ডেকেছিল, তার মানে আমি জানি—”শিরিন তোমাকে ধন্যবাদ।তুমি আমার বোন!”
“খড়ক সিং?”
“সায়েব! জীবনের সবসেরা কাম আজ হামনে কিয়া। এই দীনের আস্তাবলে আপনাদের মতো মেহমানদের সমবেত করার উপলক্ষ হাতে পেয়েছি। দুঃখের জীবন থেকে একফালি আনন্দের সময় বের করে আনতে পেরেছি।” খড়ক সিং হাত জোড় করলেন।
সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন, “কেয়া বাত, কেয়া বাত।”
॥ ১১ ॥
জয় অবাক হয়ে দেখছে, চার্চের দোকানে ভাল-ভাল পোস্টার এসেছে। কাচের শো-কেসে আটকে রেখেছে। একটা পোস্টার ভীষণ ভাল লাগছে। কিছুই না, নীল জমি, বড় একটা মোমবাতি জ্বলছে। মোম গলে গড়িয়ে নেমেছে কয়েক ফোঁটা। ইংরেজিতে লেখা দুটো লাইন, যার মানে, বাতির ধর্মই হল জ্বলতে-জ্বলতে, আলো দিতে-দিতে ক্ষয়ে যাওয়া।
কাচের দরজা ঠেলে জয় দোকানে ঢুকল। দরজায় ছোট-ছোট ঘন্টা লাগানো আছে। শব্দ হল, টিং লিং। এই শব্দটা জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। সে ভাবে, দিদির সঙ্গে বিলেত যাবে। সুন্দর একটা দেশ। ভীষণ শীত। সকালে ভীষণ কুয়াশা। সেই ধোঁয়ার মধ্যে দিয়ে ফগলাইট জ্বেলে দোতলা বাস আসছে, আসছে সুন্দর-সুন্দর মোটর। সুন্দর পোশাক-পরা ছেলেমেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে অফিসে, কলেজে, স্কুলে। কারও দাঁড়াবার সময় নেই। সে-দেশে শুধু কাজ আর কাজ। লেখা, পড়া, সকলের এক চেষ্টা, জীবনে বড় হতে হবে। দাদুর মুখে এইসব দেশের গল্প শুনতে-শুনতে, জয়ের মনে হয়, সেই দেশে যেন সে চলেই গেছে। একা গেলে হবে না, দিদিকেও যেতে হবে। দিদিকে ছেড়ে সে থাকতে পারবে না। দিদি যাবে ডাক্তারি পড়তে, জয় যাবে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। ভাবতে ভাবতে জয় একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়।
দোকানের যে নানকে জয় সবচেয়ে ভালবাসে, মোমের মতো মিষ্টি মুখ, তিনি বললেন, “তোমার কী চাই জয়?” মিষ্টি হাসি, ঝকঝকে দাঁত। জয় বলল, “ওই পোস্টারটা আমার ভীষণ ভাল লেগেছে, কত দাম মাদার?”.
“ওনলি ফাইভ রুপিজ, মাই সান।”
জয় থমকে গেল। তার পকেটে মাত্র দু টাকা আছে। দু টাকায় তো হবে
না। জয় বিষন্ন মুখে চলে যাচ্ছিল, নান জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল জয়?”
“মাদার, আমার কাছে অত টাকা নেই। দু টাকা আছে।”
“তুমি নিয়ে যাও, পরে টাকা পাঠিয়ে দিয়ো।”
“না মাদার, মা রাগ করবেন। আমি টাকা এনে নিয়ে যাব।”
নান বললেন, “দ্যাটস ভেরি গুড। তোমার বিচার-বুদ্ধির প্রশংসা করি। এর জন্যে তোমাকে একটা পুরস্কার দিতে চাই। হিয়ার ইজ এ ডট পেন ফর ইউ। সি হাউ নাইস। ডিপ ব্লু।”।
জয় জিনিসটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখল। গভীর নীল রং। ছোট্ট-ছোট্ট সাদা অক্ষরে লেখা, গড়্স ডিসাইপ্ল। খুব লোভ হল জয়ের। পকেটে রাখতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কী মনে হল, ঝকঝকে মেহগিনি কাঠের কাউন্টারে কলমটা নামিয়ে রাখল।
নান জিজ্ঞেস করলেন, “হোয়াট ইজ দ্যাট জয়? হোয়াট ইজ ইয়োর থট!”
“মাদার, এক্সকিউজ মি, একটাতে আমার হবে না, তাই নেব না। আমার যে তিনটে চাই। একটা আমার জন্যে, একটা আমার দিদির জন্যে, আর-একটা আমার শিরিনের জন্যে। মাদার, তিনটে কোথায় পাবেন?”
সন্ন্যাসিনী তিনটে পেন জয়ের হাতে দিয়ে বললেন, “গড ব্লেস ইউ মাই সান। এই মনটাকে ধরে রাখার চেষ্টা কোরো। পৃথিবী খুব ভাল, আবার খুব খারাপও। মানুষ যত বড় হয়, সে ততই স্বার্থপর হয়। লিভ উইথ গড!”
দোকানের ভেতরে অনেক আলমারি। কাচের ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে কত কী সাজানো। প্লাস্টার অব প্যারিসের তৈরি যিশুর মূর্তি, মেরিমাতা, মালায় গাঁথা ছোট-ছোট ক্রস, সোনালি, রুপোলি। কত সুন্দর-সুন্দর গ্রিটিংস কার্ড। অন্যসব মূর্তি। ফুলের সাজি হাতে দিদির মতো একটা মেয়ে। টুপি মাথায় এক বৃদ্ধ।
জয় অবাক হয়ে দেখছে। ইয়োরোপ, আমেরিকা, ম্যানফ্রেড দাদুর দেশ জার্মানিতে তাকে যেতেই হবে। জয় এক ছুটে দোকান থেকে বেরিয়ে এল। অকারণে অনেকটা পথ ছুটে সে সেই সাঁকোটার ওপর এসে দাঁড়াল, যার তলা দিয়ে অল্প একটু জলের ধারা নিজের মনেই কথা-বলতে বলতে কোথা থেকে কোথায় চলে যায়। যেন একটা ছেলে আর মেয়ে গল্প করতে করতে কোথাও যাচ্ছে। সাঁকোর তলায় টিয়াপাখির ঝাঁক আসে। কেন আসে কে জানে! বোধ হয় চোর-চোর খেলতে। দু’ ধারে অনেক বড় মাঠ। সেই মাঠ বেয়ে ভেসে আসে দূর দেশের বাতাস।
সাঁকোর ওপর থেকে একটা নুড়ি তুলে জয় জলে ফেলল। টিপুং করে শব্দ হল। কে একজন ছিপ আর জাল নিয়ে সরলা নদীতে মাছ ধরতে যাচ্ছেন। যেতে-যেতে জয়কে বললেন, “ডাক্তারবাবুর ছেলে না?”
জয় বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”
“বাঃ, বেশ ভদ্র তো তুমি! কেমন আজ্ঞে, হ্যাঁ, বললে। আর তা হবেই বা না কেন? কোন পরিবারের ছেলে, দেখতে হবে তো! তা তুমি এখানে একা-একা কী করছ?”
“আজ আমাদের স্কুল ছুটি তো, তাই এমনই বেড়াচ্ছি। এই জায়গাটা আমার খুব ভাল লাগে।”
“তোমার সঙ্গে দেখছি আমারও খুব মিল। আমি যখন তোমার মতো ছোট ছিলুম, তখন একা-একা এখানে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতুম।”
“এই সাঁকোটা তখনও ছিল!”
“ছিল বইকী! মানুষ ছাড়া পৃথিবীতে অনেক কিছু অনেকদিন থাকে। ওই চার্চটা যখন তৈরি হয়েছিল, তখনই সাঁকোটা তৈরি হয়। সায়েবরা তৈরি করেছিল। সেই সায়েবের নাম ছিল ফুলার।”
“তখনও টিয়া আসত?”
“আসবে না! ঝাঁক ঝাঁক টিয়া। এই যেমন ধরো, তুমি এলে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, আমার ছেলেবেলাটা দাঁড়িয়ে আছে। ধরো, আজ হোক কাল হোক আমি চলে যাব, তখন তুমি কিন্তু থাকবে এই সাঁকোর ওপর দাঁড়িয়ে। তারপর ধরো, অনেক বছর চলে গেল, তখন তুমি আর নেই ; কিন্তু কেউ না কেউ তো থাকবেই। এইটাই হল মজা। ভীষণ মজা।”
“আপনি মাছ ধরেন কেন?”
“আমি তো মাছ ধরি না।”
“তা হলে ছিপ নিয়ে যাচ্ছেন কোথায়?”
“হ্যাঁ, এই প্রশ্নটা করতে পারো! তা হলে শোনো, আমার অনেক বয়েস। আশি তো হবেই, তার বেশিও হতে পারে। আমি অনেক বছর চাকরি করেছি। কি চাকরি জানো? আমি রেলের এঞ্জিন চালাতুন। উঃ, সে একটা চাকরির মতো চাকরি। মাঠ, পাহাড়, নদী, জঙ্গল পেরিয়ে আমার লোহার এঞ্জিন ছুটছে। নিশুত রাত। কখনও ঘোর অন্ধকার কখনও চাঁদের আলো, ঝড়, বৃষ্টি, তুফান, চলেছে এঞ্জিন। লোকটাকে আমার ভীষণ ভাল লাগত।”
“কোন লোকটা?”
“আরে, ওই ক্যানাডিয়ান এঞ্জিন। কী একখানা চরিত্র বলো তো! কী সাহস, কী তেজ। সেই তো আমার গুরু। কোনও বাধা মানে না, এতটুকু ভয় নেই। মাঝরাতে উঠে পড়ল একটা ব্রিজে, সে কী শব্দ। গুমগুম। অনেক নীচে ঠাণ্ডা একটা নদী। পাহাড়ের পেটকাটা টানেল, ঢুকে গেল তার ভেতর। আমার খুব এঞ্জিন হতে ইচ্ছে করে। তোমার?”
“আমার ইচ্ছে করে ঘোড়া হতে।
“সেটাও মন্দ নয়, বেশ বাদামি রঙের তেজী একটা ঘোড়া। অবশ্য ঘোড়ার পিঠে একজন বীরকে চেপে বসতে হবে, যেমন ধরো বীর হামির, কি রানা প্রতাপ ! বেশ, তুমি তা হলে ঘোড়াই হও, আমি কিন্তু এঞ্জিন হব, ক্যানাডিয়ান এঞ্জিন। দাউদাউ আগুন জ্বলবে, আর আমি ছুটব বাঁশি বাজিয়ে, চারপাশ কাঁপিয়ে।”
“না, তারপর কী হল বলুন?”
“কিসের কী হল?”
“ওই যে অনেক বছর চাকরি করলেন।”
“ও হ্যাঁ, তারপর আমি বুড়ো হয়ে গেলুম। রেল কোম্পানি বলল, ভগবান দাস, গুডবাই। আমার ছুটি হয়ে গেল। তখন আমার খুব দুঃখ হল। আমার পাহাড়, আমার নদী, ওভারব্রিজ, অন্ধকার, চাঁদনি রাত, এইসব ছেড়ে আমি বাঁচব কী করে ! তখনই আমি একটা ফন্দি করে ফেললুম, এই ছিপ। মজাটা দেখেছ, সুতো আছে, ফাতনা আছে, বঁড়শি নেই, একটা লোহা বাঁধা। টোপও নেই।”
জয় অবাক হয়ে বলল, “সে আবার কী?”
“তোমাকে একটা জিনিস শিখিয়ে দিই, তোমার এই বয়েস থেকে যদি করতে পারো, তা হলে দেখবে, বড় হয়ে কী হয়ে গেছ! কেউ তোমার কিছু করতে পারবে না। যখনই সময় পাবে, চুপ করে জলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকবে। আমি মাছ ধরার নাম করে জলে ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে বসে থাকি,ঘন্টার পর ঘন্টা। স্রোত বয়ে যাচ্ছে, আমি তাকিয়ে আছি। চোখ দুটো ঠাণ্ডা হয়ে আসছে, ভেতরে যা কিছু শক্ত-শক্ত ছিল, যেমন ধরো রাগ, হিংসে, লোভ, সব গলে যাচ্ছে, ভেতরটা টলটল করছে। কী সুখ, কী শান্তি, আমার ছটফটানি কমে যাচ্ছে, নদী আমাকে বলছে, চলো চলো, তরতর করে চলো, কিছুই থাকবে না, থাকতে পারে না, এইটাই জগতের নিয়ম। কী, শক্ত লাগছে ?”
জয় বলল, “কই, না তো। আমার খুব ভাল লাগছে আপনাকে।”
“এই দ্যাখো, তোমার দেখছি হবে।”
“আমার দিদিরও হবে।”
“তোমার দিদি আছে, হ্যাঁ তাই তো, দেখেছি তাকে।”
“দিদি আমার চেয়েও ভাল। ফাদার নাম রেখেছেন দয়া।”
“তার তো হবেই। তোমাদের বংশটা যে ভাল। তোমার দাদু, দিদিমা, বাবা, মা। আর একটা কথা বলে যাই, মাঝে-মাঝে রাতের দিকে ফাঁকা জায়গায় কাঠকুটো জড়ো করে আগুন জ্বালাবে। লকলকে শিখার দিকে তাকিয়ে থাকবে। ভাববে, সব পুড়ে যাচ্ছে, ভেতরের সব জঞ্জাল। তিরিশটা বছর আমি এঞ্জিনের গনগনে আগুনের দিকে তাকিয়ে থেকেছি।”
জয় সাহস করে জিজ্ঞেস করল, “তাতে আপনার কী হয়েছে?”
“আমার সব ভয় চলে গেছে। সমস্ত দুশ্চিন্তা চলে গেছে, ঝড়, বৃষ্টি, রোদ, নদী, পাহাড়, জঙ্গল আমাকে কাছে টেনে নিয়েছে। আমি ভীষণ ভাল আছি। লোকে আমাকে বলে পাগল। তা বলুক, আমি তো আনন্দে আছি।”
কাঁধে ছিপ নিয়ে তিনি হনহন করে চলে গেলেন। মনেই হয় না, অত বয়স হয়েছে। জয় ভাবল, শিরিনকে ডট পেনটা দিয়ে তারপর সে বাড়ি যাবে। না, আগে শিরিনকে কেন? আগে তার দিদি। অনেকক্ষণ দিদিকে দেখেনি সে।
জয় ছুটল বাড়ির দিকে। কিছুদূর যেতেই সে দেখতে পেল ম্যানফ্রেডদাদু সেই বিশাল মোটর সাইকেল চেপে আসছেন।
“হ্যালো জয়।” তিনি গাড়িটা থামালেন। ভুটুভুট আওয়াজটা থামল না।
“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
“ওই সরলা নদীর ওপারে, যেখানে সবাই সারাদিন ধরে গোল্ড নাগেট খোঁজে।
তুমি যাবে?”
“আমাকে যে দাদুর অনুমতি নিতে হবে!”
“আ, দ্যাট্স ফাইন। তা চলো, অনুমতিটা নিয়ে আসি, তুমি আমার পেছনে উঠে বসতে পারবে? ক্লাইম্ব।”
জয় কোনওমতে উঠে বসল। মোটর সাইকেল ছুটল বাড়ির দিকে।
॥ ১২ ॥
শিবশঙ্কর তখন বাগানে কাজ করছিলেন। হাতে একটা খুরপি। খালি পা। সবুজ ঘাসের ওপর ধবধবে সাদা দুটো পা। গোলাপ গাছের অদ্ভুত স্বভাব। তার আবার গোড়ার মাটি আলগা করে দিয়ে শিকড়ে শিশির খাওয়াতে হয়। যত শিশির খাবে গাছ তত তাজা হবে। শিবশঙ্করকে সাহায্য করছে জয়া। তার হাতে একটা কোটো। সেই কৌটোয় বোনমিল, সুপার ফসফেট সব মিশিয়ে একটা সার তৈরি হয়েছে। গাছের খাদ্য! কৌটোর মধ্যে একটা চামচে আছে। জয়া মেপে-মেপে গাছদের খাবার দিচ্ছে। মা যেভাবে ছোট ছেলেদের খাওয়ায়। মাঝে-মাঝে জয়ার কপালে চুল ঝুলে পড়ছে। ওপর হাত দিয়ে চুল সরিয়ে দিচ্ছে অদ্ভুত কায়দায়। আবার সেই নিচু হচ্ছে, ঝুলে পড়ছে চোখের ওপর। শেষে বিরক্ত হয়ে দাদুকে বলছে, “কেউ যদি অবাধ্য হয় তাকে কি করা উচিত?”
শিবশঙ্কর মাটি আলগা করতে করতে বললেন, “তাকে প্রথমে ভাল কথায় বুঝিয়ে বলতে হবে, অবাধ্যতার ভবিষ্যৎ যে ভাল নয়, এ-কথা তাকে জানাতে হবে।’
“আর সে যদি মানুষ না হয়!”
“মানুষ ছাড়া আর কে অবাধ্য হবে দিদি! ওই গুণটা একমাত্র মানুষেরই আছে। বাধ্য মানুষ, অবাধ্য মানুষ—এই নিয়েই পৃথিবী।”
“অবাধ্যতা করছে আমার চুল। খালি কপালের ওপর ঝুলে পড়ছে।”
“ওটা চুলের অবাধ্যতা নয় দিদি, তোমার ম্যানেজমেন্টের অভাব। বেশ করে বাঁধতে পারোনি। আমার কাছে এসো, ঠিক করে বেঁধে দি।”
বাগানের যত গাছ, যত পাখি সেই অপূর্ব দৃশ্য দেখল, খুরপি ফেলে, হাতের মাটি ঝেড়ে শিবশঙ্কর উঠে দাঁড়ালেন। ফুটফুটে সুন্দর একটি মেয়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে।
শিবশঙ্কর বললেন, “চুলের আর দোষ কী! এই বয়সেই এত চুল, পিঠ ছাপিয়ে নেমে গেছে! তায় আবার এমন সুন্দর কপাল! আমি চুল হলে, আমিও ঝাঁপিয়ে-ঝাঁপিয়ে কপালে পড়তুম। দাঁড়া, আমি একটা সাঁওতালী খোঁপা বেঁধে দি’ তোর।”
“তুমি পারবে?”
“কেন পারব না?”
কয়ফার ইজ অ্যান আর্ট। কয়ফার মানে কি?”
“খোঁপা।”
“দ্যাটস রাইট। আমাদের দেশের আদিবাসীরা খোঁপার কায়দায় বিদেশীশাস্ত্রকেও হার মানিয়ে দেবে। অজন্তার গুহাচিত্র দেখেছিস?”
“দেখেছি।”
“সুন্দরীদের খোঁপা দেখেছিস, কতরকম! এইভাবে চুল বাঁধার জন্য দেহাতী গ্রাম থেকে তোকে একটা হাড়ের কাঁটা এনে দেব।”
জয়া চুপ করে দাদুর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। একমাথা কালো কুচকুচে চুল। রোদ পড়ে চিকচিক করছে। শিবশঙ্কর মাথার ওপর তুলে একটা খোঁপা বাঁধছেন। শবরীরা যেভাবে বাঁধে।
বেঁধে দেওয়ার পর জয়া বলল, “তুমি এসব শিখলে কোথায়?”
“দেখে আর সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে। আমাদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক দু’জন, আমাদের চোখ, আমাদের কমন সেনস। এইবার ঠিক আছে?”
“একেবারে টাইট। নো প্রব্লেম। এবার যখন আমাদের স্কুলে নাটক হবে, তোমাকে নিয়ে যাব, আমাদের সাজিয়ে দেবে।”
“আমাকেও একবার অভিনয় করতে দে না। সেই কবে কোনকালে কলেজে অভিনয় করেছি। সেই সময় আমার খুব নাম হয়েছিল রে!”
“তুমি করবে? সেলফিশ জায়েন্টের জায়েন্ট হবে?”
“হ্যাঁ, হব। কেন হব না!”
“মেকআপ নিলে তোমাকে খুব মানাবে। দাঁড়াও, আমাদের প্রিন্সিপ্যালের সঙ্গে কথা বলব।”
“তা হলে আমি দাড়িটা রাখতে শুরু করি।”
মোটর সাইকেলের বিপুল গর্জনে দু’জনের কথা চাপা পড়ে গেল। ম্যানফ্রেড আর জয় এসে দেখল, দাদু আর নাতনীতে অন্তরঙ্গ কথা হচ্ছে। জয়ের খুব মনখারাপ হল, এতক্ষণ সে কেন ছিল না! দিদি আর দাদি দু’জনে মিলে তাকে ছাড়াই কেমন কত কী করে ফেলল! সে বাদ পড়ে গেল! একটু অভিমান হল। সে যখন নেই, তখন দু’জনে কেন এইসব কাজে লেগে গেলেন! টিমে যখন একজন নেই তখন কি ফিল্ডে নামা উচিত হয়েছে?
জয়ের চোখ ছলছল করছে। জয়া বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা। ভাইটাকে তো চেনে। ভীষণ নরম। ভীষণ ভালবাসে সকলকে। ভোরের মিষ্টি ফুলের মতো। শিউলির মতো।
জয়া বলল, “এখন ঠেটি ফোলালে হবে কী! তুই-ই তো তেজ করে বেরিয়ে গেলি।”
“তোকে বললুম, “চল দিদি একটু ঘুরে আসি, তুই তখন কাজ দেখালি।”
“বা রে ছেলে, মা আমাকে বললেন, ঠাকুর ঘরের জোগাড় করে দিতে, দিদা পুজোয় বসবেন, সেটা কে করবে শুনি! তুই আমাকে ফেলে অমনই হনহন করে চলে গেলি। যেমন গিয়েছ, এখন বোঝো ঠেলা। আমরা কত কী করে ফেললুম।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “দেখি, একা-একা সাঁকোর দিক থেকে আসছে, বললুম, চলে। সরলার ওপার থেকে একটা রাউন্ড মেরে আসি। বলল, দাদু আর দিদির অনুমতি ছাড়া যাবে না। গুড ট্রেনিং। “।
জয় দিদির কাছে এগিয়ে এসে বলল, “তোর জন্য সুন্দর একটা উপহার এনেছি।”
সেই নীল রঙের সুন্দর ডটপেনটা দিদির হাতে দিল। গায়ে সাদা অক্ষরে লেখা, গডস ডিসাইপল।
শিবশঙ্কর বললেন, “আমাকে দাও। আপাতত এইটাই হাড়ের কাঁটার কাজ করবে।”
ডটপেনটা জয়ার খোঁপায় গুঁজে দিলেন।
ম্যানফ্রেড বললেন, “চুলটা বেশ কায়দায় বাঁধা হয়েছে, একেবারে অন্যরকম দেখাচ্ছে।”
জয়া বলল, “দাদু করে দিয়েছেন।”
“তোমার দাদু একটা জিনিয়াস। কী না জানেন? জয়, তুমি কি যাবে? আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“দিদি না গেলে যাব না।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “দিদি, তুমি কি যাবে?”
“আপনারা কোথায় যাচ্ছেন?”
“সরলা নদীর ওপারে একবার যাব। দেখে আসি নদী সত্যিই কোনও অজানা জায়গা থেকে সোনা বয়ে আনছে কি না!”
জয়া বলল, “দাদি, যাবে?”
“তিনজনে একটা মোটর সাইকেলে?”
ম্যানফ্রেড বললেন, “দ্যাট্স, নো প্রবলেম। আমার গাড়িতে ইজিলি চারজন চাপতে পারে।”
জয় বলল, “আমরা তো ঠিক-ঠিক চারজনই আঙ্ক্ল।”
“আর-একজন কে?”
“কেন, শিরিন! তাকে ফেলে আমরা যাই কী করে?”
“দ্যাট্স ট্রু, সেও তো একটা কথা।”
শিবশঙ্কর বললেন, “তোমরা তো খুব স্বার্থপর! আমাকে ফেলে রেখে এমন একটা এক্সপিডিশনে চললে! জানো কি, সরলা ইজ মাই রিভার, আমার নদী। সরলা আমাকে বড় করেছে। সরলার ধারে বসে আমি আমার জীবনের কত সমস্যার সমাধান খুঁজে পেয়েছি। সেখানে তোমরা যাচ্ছ আমাকে ফেলে রেখে! আমিও যাব !”
ম্যানফ্রেড বললেন, “তা হলে আমাদের অন্যভাবে যেতে হবে।”
“তাই যাব। আমরা মোটরে যাব। ফেরার সময় সরলায় চান করে আসব। চান করার সব সাজসরঞ্জাম নিয়ে যাব সঙ্গে করে।”
“সে তো খুব ভাল হবে। নদীতে কতকাল স্নান করিনি।”
খুশির হাওয়া খেলে গেল। ছুটিটা তা হলে খুবই জমে যাবে। বেশ বড়সড় রকমের একটা অভিযান।
জয়া বলল, ‘খাওয়াটাও যদি আমরা বাইরে করে নিই, তা হলে কেমন হয়!”
শিবশঙ্কর বললেন, “সে তো খুবই ভাল হয় , কিন্তু খাব কোথায়!”
জয়া বলল, “কাছাকাছি একটা জায়গা আছে, আমাদের একটা কাজ করতে হবে, যাওয়ার সময় বলে যেতে হবে, আমরা ক’জন খাব, কী খাব।”
“পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন তো?”
“সে দেখলেই তুমি বুঝতে পারবে।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল গাড়ি। চালাচ্ছেন ম্যানফ্রেড, পাশে বসে আছেন শিবশঙ্কর। পেছনে বসেছে জয় আর জয়া। পথেই পড়বে শিরিনের বাড়ি। তাকে তুলে নেওয়া হবে। কিছুদূর যাওয়ার পরই দেখা গেল, চার্চের ফাদার ব্রাউন, সাদা পোশাক, কাঁধে একটা কুড়ল। গাড়িটাকে রাস্তা দেওয়ার জন্য ফাদার পাশে সরে দাঁড়ালেন। শিবশঙ্কর ম্যানফ্রেডকে বললেন, “স্টপ।” ফাদারের সামনে গাড়ি দাঁড়াল।
শিবশঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, “ফাদার, হোয়্যার টু?”
প্রবীণ মানুষ। ধবধবে ফরসা মুখ, চামড়ায় অল্প-অল্প ভাঁজ, চোখে সোনার ফ্রেমের গোল চশমা। রোদ পড়ে ঝলমল করছে। হাসি-হাসি মুখে বললেন, ‘টু ফরেস্ট, অন দি আদার সাইড অফ দি সরলা।”
“কাম ইন। আমরাও ওদিকে যাচ্ছি।”
ফাদার কুড়ল নিয়ে সাবধানে পেছনে বসলেন, জয়ার পাশে। সুন্দর একটা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ল। ফুল-ফলের গন্ধ। যেমন বেরোয় ঠাকুরঘরে।
শিবশঙ্কর বললেন, “ফাদার, জঙ্গলে যাচ্ছেন কেন?”
“গাছের ডাল কাটতে। আমার ওই একটা হবি, ডালপালার স্বাভাবিক ভাস্কর্যকে ফুটিয়ে তোলা। নেচার, দি গ্রেট আর্টিস্ট। আমি তার উদ্যানে এক অনুসন্ধানকারী। যখনই সময় পাই ঘুরে বেড়াই জঙ্গলে-সঙ্গলে। এ এক ভয়ঙ্কর নেশা।”
শিরিনের বাড়িতে গাড়ি থামল। শিরিন তার পোষা খরগোশের জন্য ঘাস কাটছিল। কোনওরকমে খরগোশের খাঁচায় ঘাস ঢুকিয়ে লাফাতে-লাফাতে গাড়িতে এসে উঠল। এইবার গাড়ি ছুটল সরলার দিকে।
সরলার দিকে বাঁক নিচ্ছে পথ, জয়া বলল, “সামনের বাঁ দিকের রাস্তায় আমাদের একটু ঢুকতে হবে।”
ম্যানফ্রেড গাড়ি ঢোকালেন। কাঁকুরে পথ। দু’পাশে ঘাস। সার-সার ইউক্যালিপ্টাস গাছ। মিষ্টি একটা বাতাস বয়ে আসছে উত্তর থেকে। পথ ক্রমশ খাড়া হতে-হতে একটা উঁচু মাঠে গিয়ে উঠল। সেখানে একটা বহুকালের বাড়ি। লোহার গেট। বড় নির্জন। মানুষ আছে বলে মনেই হয় না। অজস্র পাখি হরেক সুরে গান গায়।
॥ ১৩ ॥
সরলার তীরে এসে গাড়ি দাঁড়াল। রোদ ঝলমলে অপূর্ব একটা দিন। সোনার মোহরের মতো। শিশুগাছের ছায়ায় গাড়িটাকে রেখে সবাই নেমে এল। বড়, ছোট, মাঝারি অজস্র পাথরের ঢল নেমে গেছে। অনেকটা নীচে নদী। কুলকুল করে বহে চলেছে। নদীর ওপারে যেতে হবে। সেখানে বন। প্রথমে পাতলা, ক্রমে গভীর হতে হতে নীল পাহাড়ে গিয়ে ঠেকেছে। সে যে কত গভীর আর কত দূর, বলা সহজ নয়।
জলের কাছে দাঁড়িয়ে ছোটখাটো একটা গবেষণা চলেছে, নদীর ওপারে কীভাবে যাওয়া যায়! কত জল! মাঝখানের গভীরতা কত! জয় দেখছে পাথরের আড়ালে আড়ালে জলের আবর্তে মাছ খেলা করছে। রুপোর মতো চকচকে ছোট ছোট মাছ। শিরিন দেখছে, বড় বড় ঘাসের ডগায় ফড়িং নাচছে। জয়া দেখছে, এক ঝাঁক টিয়া শিশুগাছের মাথায় মহা গুলতানি করছে। কী একটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ভীষণ করমচর। দাদু বলেছেন, ওদেরও নিজস্ব ভাষা আছে। বোঝার চেষ্টা করলে বোঝা যায়। দিনের পর দিন শুনতে হবে, লক্ষ করতে হবে, মনে রাখতে হবে।
জয় সেই মজার মানুষটাকে দেখতে পেল। ছিপ নিয়ে যিনি আসছিলেন সাঁকোর ওপর দিয়ে। অনেকটা ওপাশে একটা বড় পাথরের ওপর বসে আছেন জলে ছিপ ফেলে। পরিষ্কার, কাচের মতো নীলচে জল। বালির কণা সোনার মতো চিকচিক করছে।
ফাদার ব্রাউন বললেন, “আই ক্যান সল্ভ দ্য প্রবলেম। দেয়ার ইজ এ পয়েন্ট ফ্রম হোয়ার উই ক্যান ওয়াক আক্রশ দ্য রিভার। উত্তরে এক ফারলং হাঁটতে হবে। সেখানে নদীর ওপর অনেক বোল্ডার পড়ে আছে, তার ওপর দিয়ে ব্যালান্স করে যেতে পারলে পা ছাড়া আর কিছু ভিজবে না।”
শিবশঙ্কর বললেন, “আই নো দ্য প্লেস। তবে জায়গাটা খুব ডেঞ্জারাস। ব্যালান্সের একটু এদিক-ওদিক হলেই পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙার চান্স।”
ফাদার বললেন, “আমার অভ্যাস আছে। আমি পাথরগুলোকে ভালবাসি, পাথরগুলোও আমাকে ভালবাসে। দিস ইজ রেসিপ্রোক্যাল। আই লাভ ইউ অ্যান্ড ইউ লাভ মি।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “পৃথিবীতে এমন কোনও কাজ নেই যা মানুষ পারে না। শঙ্কর, ইউ রিমেম্বার, মধ্যপ্রদেশের র্যাভাইনে আমাদের সেই অভিযান! আমরা মরেও যেতে পারতুম। মরিনি, কারণ আমরা মরতে চাই না। এই না-টাই আমাদের শক্তি। আমরা হারতে চাই না, পালাতে চাই না, দুঃখ চাই না, মৃত্যু চাই না অসুস্থ হতে চাই না।”
ফাদার ব্রাউন বললেন, “তা হলে আমাদের যাত্রা শুরু হোক। স্পটে গিয়ে পরীক্ষা হবে, কোন থিয়োরিটা ঠিক।”
নদীর তীর ধরে হাঁটা শুরু হল। পাথর আর পাথর। জায়গায় জায়গায় সামান্য সামান্য ঘাস। হরেক রকমের আগাছা। পথ কখনও ওপরে উঠছে, কখনও গড়িয়ে নেমে যাচ্ছে নীচে। জয়, জয়া, শিরিন তিনজনেই খুব মজা পাচ্ছে। ঝলমলে রোদ, ফুসফুস হাওয়া, জল বয়ে যাওয়ার কুলকুল শব্দ। জুতোর তলায় পাথরের আওয়াজ। সঙ্গে তিনজন মনের মতো মানুষ। ফাদার ব্রাউন আসায় ব্যাপারটা আরও জমে গেছে। এই অঞ্চলের সবাই ফাদারকে ভীষণ ভালবাসে তাঁর অপূর্ব ব্যবহারের জন্যে। দেবতার মতো মানুষ। মুখে সব সময় একটা হাসি লেগে থাকে। অমলিন হাসি। ফাদার চলেছেন আগে আগে, পেছনে শিবশঙ্কর, মাঝে ছোটরা, সব শেষে ম্যানফ্রেড। ম্যানফ্রেডের’ হাতে একটা হান্টিং নাইফ। ম্যানফ্রেড গান গাইছেন। কয়েকটা বিশাল বিশাল গাছ আকাশের নীলে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। দ্যাখো, আরও কত বড় হতে পারি।
সবাই এসে হাজির হলেন সেই বোল্ডার পয়েন্টে। এই জায়গাটার একটা ইতিহাস আছে। বিশাল বিশাল এই পাথর এল কোথা থেকে! সিপাহি বিদ্রোহের সময় পলাতক ইংরেজ সৈন্যরা এখানে একটা ঘাঁটি গেড়েছিল, তারাই না কি নদী পারাপারের জন্যে এই পাথর সাজিয়েছিল। সেই থেকে এইভাবেই পড়ে আছে। সবাই বিশ্বাস করে এই কথা। এ ছাড়া আর কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু পাথরগুলো আনা হয়েছিল কোথা থেকে? এই প্রশ্নের উত্তর আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি।
দেখলে মনে হয় সার সার বাচ্চা হাতি এপার থেকে ওপারে চলে গেছে। জল লেগে লেগে শ্যাওলা হয়েছে। ম্যানফ্রেড দেখে শুনে বললেন, “ব্যাপারটা খুব সহজ হবে না। স্লিপ করার চান্স আছে। ফাদার বললেন, “জুতো পায়ে হবে না। খালি পায়ে যেতে হবে।”
শিবশঙ্কর বললেন, “পা হড়কালে কী হতে পারে।”
ফাদার বললেন, “কিছুই না, জলে পড়ে যেতে হবে। সামান্য চোট লাগবে, এই আর কী!”
“তা হলে পড়ে গেছি ভেবে জল ভেঙে যাওয়াই ভাল।”
ফাদার বললেন, “তা হলে দেখুন, আমি কীভাবে পার হচ্ছি! আমি কোনও কিছু ভাবব না। কেবল ভাবব, আমার আগে আগে চলেছেন প্রভু যিশু। আমি তাঁর পেছন-পেছন চলেছি। আমি বিশ্বাসে পার হব।”
ফাদার জুতো খুললেন না। ছোট্ট একটা লাফ মেরে প্রথম পাথরের ওপর উঠে পড়লেন। কাঁধে কুড়ল। তারপর যেন কিছুই নয়, টকটক করে ওপারে চলে গেলেন।
ম্যানফ্রেড বললেন, “আমার তেমন বিশ্বাস নেই, আমি আমার অহঙ্কারের হাত ধরে পার হব।” এই কথা বলে ম্যানফ্রেড পাথর থেকে পাথরে লাফাতে লাফাতে সোজা ওপারে চলে গেলেন।
জয়া জিজ্ঞেস করল, “দাদু তুমি কী করবে?”
“আমি তোমাদের সামনে একটা উদাহরণ হওয়ার জন্যে তোমাদের সামনে রেখে পার হব। আমাদের দাদু পেরেছে, এই ভাবনা ভাবতে ভাবতে আমি পেরিয়ে যাব।”
শিবশঙ্কর হাসতে হাসতে অতি সহজেই পেরিয়ে গেলেন।
জয় বলল, “দিদি, আমরা?”
“আমরা পরপর তিনজন। দাদু পেরেছেন আমাদেরও পারতে হবে।”
“যদি পড়ে যাই!”
“কখনই পড়ব না। কেন পড়ব! পড়া যায় না। সে তো লজ্জার। আমি আগে তারপর তুই, তারপর শিরিন।”
জয়া একটা হালকা প্রজাপতির মতো প্রথম পাথরের চাঁইটায় উঠে পড়ল। মসৃণ, হড়হড়ে, পিছল। কোথায় কীভাবে দাঁড়িয়ে আছে চিন্তা করলেই পড়ে যেতে হবে। জয় শিরিনের মুখের দিকে তাকাল। শিরিন বলল, “মনে নেই, খড়ক সিংয়ের বাগানের গাছে তুই কীভাবে উঠেছিলিস। আমি ভয় করব না ভাই করব, না দুবেলা মরার আগে মরব না। ওঠ, আমি ধরছি, উঠে পড়।”
জয়া হাত ধরে জয়কে তুলে নিল। শিরিন নিজেই উঠে পড়ল। তিনজনে পরপর এগোচ্ছে। পাথরের মাঝে মাঝে ফাঁক। সেই ফাঁকের ভেতর দিয়ে জল চলেছে, কবিতার মতো কথা বলতে বলতে। জলচর প্রাণী পাথরের গা বেয়ে কিছুটা উঠেই আবার জলে ঝাঁপ মারছে। আগে জয়া, মাঝে জয়, পেছনে শিরিন। শিরিন জয়কে বলছে, “একেবারে নীচের দিকে তাকাবি না, ওপারের দিকে তাকা।” জয় তাই করছে। দূরে নীল বন, ধূসর পাহাড়। দাদু আর সায়েব দু’জন। সবাই মিলে যেন ডাকছে—আয়, আয় চলে আয়, অজানাকে জানবি আয়।
নদীর মাঝখানে জল বেশ গভীর। স্রোতও বেশি, জোর বাতাস। রোদ যেন হলুদ কণায় পাউডারের মতো উড়ে যাচ্ছে। জয় আর ভয় পাচ্ছে না একটুও। তার বেশ মজা লাগছে। চারপাশ দিয়ে জল ছুটে চলেছে তরতর করে। এপার ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে, ওপার এগিয়ে আসছে ক্রমশ। মনে হচ্ছে এপারের চেয়ে ওপারটা অনেক ভাল। মাঝে মাঝে পা স্লিপ করতে চাইলেও জয় মনে দিয়ে পা দুটোকে নিয়ন্ত্রণ করছে। নদীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে নদীর দু’পাশের বাঁক যেন আরও ভাল করে দেখা যাচ্ছে। সেও এক বিস্ময়!
তারা তিনজনেই একটুও টাল না খেয়ে নদী পেরিয়ে এল। এপারটা একটু অন্ধকার অন্ধকার। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। অদূরেই ঘন জঙ্গল। লাখখানেক ঝিঁঝিঁ অবিরাম ঘুঙুর বাজিয়ে চলেছে। প্রকৃতির আসরে যেন হাজার নর্তকী মহারানিকে নাচ দেখাচ্ছে। একটা তিতিরের কর্কশ ডাক। শরীর হিম করে দেয় এমন অপ্রাকৃত ডাক।
ফাদার ব্রাউন বললেন, “এই ডাকের একটাই মানে, দেখতে পেয়েছে।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “কী দেখতে পেয়েছে?”
“বাঘ। বাঘ বেরোলে সারা জঙ্গলের আবহাওয়া পালটে যায়। বাতাস পর্যন্ত থমকে যায়। কী হয় এই আশঙ্কায় সব স্তব্ধ। সাক্ষাৎ মৃত্যু। একটা প্রাণ যাবেই যাবে।”
শিবশঙ্কর বললেন, “আমাদের সঙ্গে তো কোনও অস্ত্রই নেই।”
ফাদার বললেন, “প্রয়োজনও নেই। এ বাঘ মানুষ খায় না। খুবই ভদ্র। ভয় একটাই, সাপের ভয়। সাবধানে চলাফেরা করবেন। সাপ অনেক সময় গাছের ডালে দোল খায়। মাথায় বা ঘাড়ে ছোবল মারতে পারে। অজগরও আছে।”
সব শুনে জয় ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল। জঙ্গলের মুখে দাঁড়িয়ে আছে তারা ভেতরে মাইলের পর মাইল ঘন জঙ্গল। মাথার ওপর সূর্য। টর্চ লাইটের ফোকাসের মতো সূর্য-কিরণ পাতার ফাঁকে ফাঁকে নেমেছে। জঙ্গলের ভেতরটাকে মনে হচ্ছে থিয়েটারের স্টেজ। নাটকের পরের অঙ্ক এখনই শুরু হবে।
ম্যানফ্রেড বললেন, “জঙ্গলের ভেতরে আমাদের যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। আমাদের অনুসন্ধানের বিষয় এই নদী।”
ফাদার বললেন, “বুঝেছি। সোনা। কীভাবে যে গুজবটা ছড়িয়েছে। আমি তো প্রায়ই আসি, আমার চোখে কিছু পড়েনি।”
“ওভাবে তো পড়বে না চোখে। নদীর তলা থেকে বালি তুলে ছেঁকে ছেঁকে দেখতে হবে।”
“সে তো খুব পরিশ্রমের ব্যাপার। তা ধরুন এক-আধ কণা সোনা পেলেন, তাতে কার কী লাভ!”
“লাভ একটাই, সত্যিই যদি পাওয়া যায়, তাহলে আমাদের দেখতে হবে উৎসটা কোথায়। আসছে কোথা থেকে!”
“নদী আসছে ওপর থেকে! তা হলে নদী ধরে আপনাকে আরও উত্তরে এগোতে হবে। সে পথ তো সহজ নয়। অনেকেই চেষ্টা করে পারেনি।”
“সেইটাই তো চ্যালেঞ্জ।”
ফাদার তখন বললেন, “আমি জঙ্গলে ঢুকছি। এখন আলো সবচেয়ে ভাল। এর পর ছায়া নেমে আসবে।” ফাদার হাসতে হাসতে জঙ্গলে ঢুকে গেলেন। শিবশঙ্কর বললেন, “আমরা অপেক্ষা করে থাকব। খুব দেরি করবেন না।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “এইবার আমরা জলে নামব। ছোটরা এই কাপড়টা টান করে ধরবে, আর আমি বালি তুলে তুলে এর ওপর ফেলব। জল ঝরে যাবে, থাকবে বালি। এইবার সেই বালি ধুয়ে চেলে দেখতে হবে সোনার দানা আছে কি না! আজ যদি না-ও পাই, একদিন না একদিন পাবই।”
শিবশঙ্কর বললেন, “যদি থাকে, যদি না থাকে?”
“আমি জানি আছে। ওল্ড ডক্যুমেণ্ট্ বলছে, এখানে আছে। যে পাথরগুলো পেরিয়ে আমরা এলুম সেগুলো এখানে অকারণে ফেলা হয়নি। ফেলা হয়েছে বালি আটকাবার জন্যে।” ম্যানফ্রেড নেমে গেলেন হাঁটু জলে।
॥ ১৪ ॥
তরতর করে জল বয়ে যাচ্ছে। পায়ের তলার বালি, নুড়ি পাথর সরে-সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি! চলন্ত জমির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা। ম্যানফ্রেড আর শিবশঙ্কর জল আর বালি তুলে-তুলে কাপড়ে ফেলছেন। কাপড়টা যেন চালুনি। জল পড়ে যাচ্ছে তলা দিয়ে, বালিটা থেকে যাচ্ছে। চিকচিকে বালি, ছোট-ছোট নুড়ি। জয় কেবলই ভাবছে, এই বুঝি সোনার ঢেলা উঠবে। কোথায় কী! বালি আর বালি।
জয় জিজ্ঞেস করল, “সোনা কখন উঠবে দিদি!”
শিরিন বলল, “দাঁড়া, অত সহজে সোনা উঠলে তো হয়েই গেল। ছাঁকতে-ছাঁকতে এক সময় উঠবে।”
শিবশঙ্কর বললেন, “সোনার আশা আমি করি না। আমার এই ব্যায়ামটাই বেশ লাগছে। একবার নিচু হচ্ছি, একবার সোজা হচ্ছি। কোমরের ব্যায়াম হচ্ছে। আর ভাল লাগছে এই প্রকৃতি। নদী, পাহাড়, জঙ্গল। কত ভাগ্য করলে মানুষ এমন একটা জায়গায় আসতে পারে!”
ম্যানফ্রেড বললেন, “তোমাদের দেশটা খুব সুন্দর। তোমাদের কবি লিখেছিলেন, এমন দেশটি কোথাও তুমি পাবে নাকো খুঁজে।”
হঠাৎ একটা কী উঠল। বেশ ভারী! পাথরের সঙ্গে ঠোকা লেগে ঠং করে শব্দ হল।
জয় চিৎকার করে উঠল, “সোনা, সোনা।”
সবাই ঝুঁকে পড়লেন কাপড়ের ওপর। দেখা গেল সোনা নয়, বেশ বড় একটা চাবি। চকচক করছে। বালি ছাঁকা বন্ধ হয়ে গেল। সবাই চাবিটা নিয়ে তীরে উঠে পড়লেন। চাবি এমন একটা জিনিস। চাবির সঙ্গে অনেক রহস্য জড়িয়ে থাকে। তা ছাড়া এত বড় চাবি সচরাচর দেখা যায় না। কার চাবি, কিসের চাবি!
শিরিন বলল, “চাবি যখন পাওয়া গেছে, তখন গুপ্তধনও পাওয়া যাবে।”
জয়া বলল, “আমার মনে হয়, ওই নীল পাহাড়ে গুহা আছে, সেই গুহায় বিশাল বড় একটা সিন্দুক আছে, সেই সিন্দুকের এই চাবি। সিন্দুকটা খুলতে পারলেই…।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “কিং সলোমন মাইন। হিরে, চুনি, পান্না।”
চাবিটা পরীক্ষা করতে করতে ম্যানফ্রেড বললেন, “চাবিটা ইংল্যান্ডের তৈরি, পরিষ্কার লেখা আছে, চাবস, ইংল্যান্ড, এইট টু নাইন জিরো।”
শিবশঙ্কর চাবিটা হাতে নিলেন। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললেন, “ইংল্যান্ডের এই কোম্পানি সিন্দুক তৈরির জন্যে বিখ্যাত। একটা কাজ করলে হয়, এই নম্বরটা জানিয়ে ওদের একটা চিঠি লিখলে, ওরা আমাদের জানিয়ে দিতে পারে, সিন্দুকটা কত সালে তৈরি হয়েছিল, কে কিনেছিল?”
ম্যানফ্রেড বললেন, “এত পুরনো রেকর্ড কি ওরা রাখবে?”
“নিশ্চয় রাখবে। চাবিটার আকার আকৃতি দেখে মনে হচ্ছে, কাস্টমস বিল্ট। কেউ না কেউ অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়েছিল।”
“ওরা যদি সত্যিই জানায় তা হলে কী হবে!”
“নিশ্চয় কোনও রাজা-মহারাজার নাম জানাবে। আমরা তখন এই চাবিটা নিয়ে সেই রাজদরবারে যাব।”
জয়, জয়া, শিরিন তিনজনেই একসঙ্গে বলে উঠল, “আমরাও যাব। আমরা
রাজদরবার দেখিনি।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “ধরো, এটা যদি দুশো-আড়াইশো বছর আগের হয়! সেসব রাজা তো আর নেই। “
“তাঁদের বংশধরেরা আছেন। তাও যদি না থাকেন, ইতিহাস আছে। ইতিহাস তো লোপাট করা যাবে না।”
একটা চাবি কত কল্পনার দরজা খুলে দিতে পারে! নদী কথা বলতে-বলতে হেঁটে চলেছে, পাথরবিছানো পথ। কোন সুদূর থেকে ঠেলতে-ঠেলতে নিয়ে এসেছে বিশাল এক চাবি। চাবিটা হয়তো কোনও সিন্দুকের, এখন এটা সময়ের চাবি, এই চাবি দিয়ে খোলা যাবে শতাব্দীর দরজা। ফাদার ব্রাউন কুঠার কাঁধে বেরিয়ে এলেন গভীর জঙ্গল থেকে। হাতে কিছু বিচিত্র গঠনের ডালপালা। তিনি কাছে এসে দেখলেন, বিরাট একটা চাবি নিয়ে চলেছে গবেষণা। তিনিও যোগ দিলেন।
“ফাদার, এই চাবি সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন?” প্রশ্ন করলেন শিবশঙ্কর।
“একটা গল্প জানি।”
“চাবির গল্প?”
“একটা সিন্দুকের গল্প। এখানে পুরনো লোক যারা আছে, তারা সবাই জানে। সিপাইদের তাড়া খেয়ে ইংরেজরা যখন পালাচ্ছে, তখন কর্নেল ওয়াটসনের ঘোড়ার পিঠে একটা সিন্দুক চাপানো ছিল। সিন্দুক মানেই ভ্যালুয়েবক্স। লুটপাট করা যত গয়না, হিরে, জহরত। সরলা নদীর মাঝামাঝি এসে, সিপাইদের গুলি খেয়ে কর্নেলের ঘোড়া নদীতে পড়ে গেল। কর্নেল প্রাণ বাঁচাতে কোনওরকমে পালিয়ে গেলেন। জলে তলিয়ে গেল সিন্দুক।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “সিন্দুক তলাক, চাবিটা তো কর্নেলের সঙ্গেই চলে যাওয়ার কথা। এ তো দেখছি চাবি আছে, সিন্দুকটাই নেই।”
ফাদার বললেন, “স্টোরিটা আমার শেষ হয়নি। ভারী সিন্দুক জলে পড়ে বালিতে গেঁথে রইল। কর্নেল জানতেন, জলের স্রোত যতই হোক, সিন্দুকটাকে বেশিদূর ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। আফটার থ্রি ডেজ, তিনদিন পরে, গভীর রাতে সিন্দুকের লোভে কর্নেল কেম ব্যাক। একেবারে একলা। পরিকল্পনাটা ছিল, সিন্দুকটা উদ্ধার করে, সব মালপত্র নিয়ে ইংল্যান্ডে পালাবেন। জানতেন না সিপাইরা এই সুযোগটার অপেক্ষায় থাকবে। হি ওয়াজ বুচার্ড। হ্যান্ড টু ডেথ। তারপর সেই সিন্দুকটা হয়ে গেল গল্প। কেউ বলে, সেটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কেউ বলে, সিন্দুকটা সিপাইদের হাতে পড়েছিল। সে যাই হোক, আজ আপনারা সেই চাবিটাই মনে হয় পেলেন। সেই সিন্দুকের তল্লাশ আজও শেষ হয়নি। মানুষ অমর না হলেও, মানুষের লোভ অমর।”।
শিবশঙ্কর বললেন, “চাবিটা আমরা কী করব? ফেলে দেব জলে?”
ফাদার বললেন, “সেটা ঠিক হবে না। ওর গায়ে প্রায় তিনশো বছরের ইতিহাস লেগে আছে। প্রিজার্ভ ইট। এমনও তো হতে পারে, এই বোল্ডারের তলায় কি ওই জঙ্গলে বা নীল পাহাড়ের কোনও গুহায় সেই সিন্দুকটা যখের ধনের মতো পড়ে আছে। আমাদের খড়ক সিং কিন্তু এখনও আশা ছাড়েনি। আপনারা চাবিটা সিংকে প্রেজেন্ট করতে পারেন। সে খুব উৎসাহ পাবে। মানুষটা জেগে স্বপ্ন দেখে।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “খুব ভাল বলেছেন, এটা তার স্বপ্নের চাবি। সিন্দুক পাওয়া যাক না যাক এই চাবি দিয়ে সে কত স্বপ্নের সিন্দুক খুলে ফেলবে।”
চাবি-পর্ব শেষ হয়ে গেল। বেলা বেশ প্রখর হয়েছে। আর কি বালি ছাঁকা হবে? দুপুরের পাখিরা সব ডাকতে শুরু করেছে। এইসব নিয়ম প্রকৃতির। সকালে ডাকে এক জাতের পাখি, তারা গান শেষ করে চলে যাওয়ার পর বসে দুপুরের আসর। সবশেষে বসে বিকেলের আসর। তারপর রাত এসে ঘুম পাড়িয়ে দেয়। তখন জঙ্গলে শুরু হয় হিংস্র পশুদের দাপাদাপি। সে আসরে গানবাজনা নেই, কেবল গর্জন আর আর্তনাদ। ধকধক করে চোখ জ্বলছে শিকারী পশুর। নিঃশব্দে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে শিকারের দিকে। প্রকৃতিতে জীবে জীবে সম্পর্ক খাদ্য-খাদকের।
শিবশঙ্কর বললেন, “আমাদের তো আবার নিমন্ত্রণ আছে। সেই সুন্দর বাড়িতে।”
“হ্যাঁ, তাই তো!” জয়ার মনে পড়ল।
সেই যে আসার পথে তারা যে বাড়িটায় গিয়েছিল। উঁচু একটা টিলার ওপর। বড়বড় গাছ চারপাশে। বিশাল একটা গেট। গেটের বাইরে মার্বেল পাথরের ফলকে আজও পড়া যায় বাড়িটার অস্পষ্ট নাম, লিলি ফোর্ট। বাড়িটা ছিল এক দয়ালু সাহেবের। সেই সাহেবের কেউ ছিল না। তিনি এক ভারতীয় মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছিলেন। মৃত্যুর সময় বাড়ি, বিষয়-সম্পত্তি সব তাঁকেই দান করে যান। শর্ত ছিল একটাই, তুমি কোনওদিন বিয়ে করতে পারবে না। সেই মহিলার যখন বয়স হল, তখন তিনি সব দান করে গেলেন তাঁর পালিতা কন্যাকে। সেই মেয়েটি সন্ন্যাসিনীর জীবন যাপন করেন। অনাথ মেয়েদের মানুষ করেন। তারা নানারকম হাতের কাজ করে। সেইসব জিনিস বিক্রি হয়, বিদেশেও যায়। সেই মহিলার একটা কিচেন আর বেকারি আছে। খাবারদাবার উৎসবে-অনুষ্ঠানে যায়, স্কুলে লাঞ্চ-প্যাকেট, হাসপাতালে রোগীদের খাবার। এইভাবেই নারীপ্রতিষ্ঠানটি ক্রমশ বড় হচ্ছে। জয়ার সঙ্গে মহিলার খুব ভাব। সেই মহিলাকে এই তল্লাটের সবাই নিবেদিতা বলে। সেই সাহেবের ঘরসংসারের খবর জানা নেই। তিনি ছিলেন স্কটল্যান্ডের মানুষ। ভাগ্যের সন্ধানে ভারতে এসেছিলেন। তাঁর মেয়েরই হয়তো নাম ছিল লিলি। কত কী যে হয় এই পৃথিবীতে! ভগবানও বোধ হয় খবর রাখেন না।
ম্যানফ্রেড বললেন, “তা হলে তো লাঞ্চটাইম হয়ে গেছে, আমরা চান টান করে নিই।”
জয় বলল, “সোনা?”
“সোনা তো আমাদের শোনা কথা। আছে বলে মনে হয় না।”
ফাদার বললেন, “হতাশ হবেন না। থাকতেও পারে, তবে এই জায়গায় নয়, আরও ডাউন স্ট্রিমে।”
“সে তা হলে আর-একদিন হবে।”
সবাই তখন স্নানের জন্য নেমে গেলেন কোমর-জলে। পরিষ্কার টলটলে জল। নীচে শীতল স্রোত, ওপরে উষ্ণ। সে বেশ মজার অনুভূতি! তিরতির করে জল বইছে। ছোট-ছোট মাছ ঘুরপাক খাচ্ছে। মাথার ওপর ভীষণ নীল একটা আকাশ। সেই আকাশে পায়রার ঝাঁক। গাছের ফাঁকে-ফাঁকে নীল পাহাড়। বনের ভেতরে বনমোরগের কড়কড়ে ডাক।
ম্যানফ্রেড সাঁতার কাটার চেষ্টা করছেন। জল তেমন গভীর নয় বলে সুবিধে হচ্ছে না। জয় দু হাতে একটা পাথর ধরে খলবল করে পা ছুড়ছে। শিরিন আর জয়া একটা পাথরে বসে জলে পা দোলাচ্ছে। ফাদার স্নান করবেন না। তিনি ভোরে সেকাজ সেরে নিয়েছেন।
ম্যানফ্রেড জয়কে বললেন, “তোমাকে আমি সাঁতার শিখিয়ে দিয়ে যাব। একজন মানুষের সব কিছু শেখা উচিত, সাইক্লিং, ড্রাইভিং, ক্লাইম্বিং, ট্রেকিং, লাইফ সেভিং, ফাইটিং, বক্সিং। তোমাকে আমি সব শেখাব।”
এক সময় সবাই স্কুল থেকে উঠে পড়লেন। গাছের আড়ালে গিয়ে যে-যার জামাকাপড় পালটে নিলেন। এইবার ওই বোল্ডারের ওপর দিয়ে ওপারে যেতে হবে। আবার সেই ব্যালান্স। প্রথমে জয়। এবার জয়ের আর একটুও ভয় করল সে বেশ তরতর করে এগোতে লাগল। ম্যানফ্রেড তো লাফাতে-লাফাতে চলেছেন। সবার পেছনে ফাদার, কাঁধে কুঠার, হাতে ডালপালা, শিকড়বাকড়। ফাদারের আজকের শিকার।
সবাই এসে গাড়িতে উঠছেন। জয় তাকিয়ে দেখল, নদীর বাঁকে সেই লোকটি ছিপ ফেলে সেই একইভাবে বসে আছে, নদী, পাখি, বাতাস তাকে গান শোনাচ্ছে।
গাড়ি স্টার্ট নিল।
॥ ১৫ ॥
রুটি যখন বেক করা হয় তখন চারপাশের আকাশ বাতাস আমোদিত হয়ে ওঠে। এত সুন্দর একটা স্বাস্থ্যকর খিদে-খিদে গন্ধ। লিলি ফোর্টে ঢোকার মুখে সেই গন্ধটাই পাওয়া গেল। পাউরুটি তৈরি হচ্ছে। গম আর ইস্ট মিলেমিশে আগুনের উত্তাপে এই সুগন্ধ তৈরি করেছে।
বাগানের মধ্যে দিয়ে পথ চলে গেছে। দু’পাশে নানারকম মরসুমি ফুল ঝলমলে বাতাসে রঙের প্রজাপতি হয়ে আছে। ছোট-ছোট নুড়ি পাথর আলোর তীর ছুড়ছে। সিঁড়ির উঁচু ধাপে দাঁড়িয়ে আছেন নিবেদিতা। সারা মুখে মোমের মতো হাসি। তিনি বললেন, “এ লিটল লেট।”
ফাদার বললেন, “আমরা নদীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলুম। এমন একটা দিনে নদী যেন আলোর টোপর পরে নেচে চলেছে। কত তার কথা, কত তার গান! আমরা আর আসতে পারছিলাম না। “
সাদা-ধবধবে শাড়ি-পরা নিবেদিতা বললেন, “প্লিজ কাম ইন। লাঞ্চ ইজ রেডি।”
সেগুন কাঠের দরজা, ঝকঝকে পালিশ ত্রা। এত উচু যে, একটা হাতি চলে যেতে পারে। সেকালের মানুষরা মনে হয় খুব লম্বা লম্বা হতেন। অথবা তাঁদের মন ছিল খুব উচু। লম্বা একটা করিডর এপাশ থেকে ওপাশে চলে গেছে। শেষ মাথায় আলোর ইশারা। সবাই সেইদিকেই চলেছেন। শেষ মাথায় একটা চাতাল। চারপাশে রেলিং দিয়ে ঘেরা। সেইটা পেরোতেই আর-একটা ব্লক। প্রথমেই একটা হলঘর। সেই ঘরে নানা শিল্পকর্মের প্রদর্শনী। বিক্রির কাউন্টার। ম্যানফ্রেড থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন। শিবশঙ্কর বললেন, “চলো, আগে লাঞ্চটা সেরে আসি। তারপর সব দেখা যাবে।”
ম্যানফ্রেড ছেলেমানুষের মতো বললেন, “কী আনন্দ হচ্ছে! ছেলেবেলার মনটা ফিরে আসছে। সেই পুতুল, পরীর গল্প, সেই আমার স্কুল, খেলার মাঠ, আমার সহপাঠীরা আমার সেইসব স্বপ্নের দিন।”
শিবশঙ্কর বললেন, “কিছুই হারায় না, সব স্মৃতিতে জমা থাকে। ব্যাঙ্কে যেমন জমা থাকে আমাদের সঞ্চয়।”
জয়া বলল, “মাদার, আমার আঁকা সেই ছবিটা?”
“সেটা বিক্রি হয়ে গেছে মা। ফরেস্ট অফিসারের স্ত্রী কিনে নিয়ে গেছেন। ছবিটা তাঁর ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”
হল পেরিয়ে এমনই একটা বড় ঘর। সেই ঘরে একটা পিয়ানো। একসার চেয়ার। একটা দেওয়ালে একটিমাত্র ছবি, ম্যাডোনার হাসিমুখ। ম্যানফ্রেড বললেন, “একেই বলে টেস্ট। একটিমাত্র ছবি। সমস্ত ঘরটা যেন হাসছে। অন্য কেউ হলে দশ-বিশটা ছবি ঝুলিয়ে একটা ক্রাউড তৈরি করে ফেলত।”
এই ঘরটার পরেই খাবার ঘর। বেশিরভাগটাই কাচ দিয়ে ঘেরা। আলোর বন্যা বইছে। সাদা কাপড়-ঢাকা লম্বা টেবিল। চারপাশে দশ বারোটা কালো কুচকুচে চেয়ার। মেঝেটাও কালো কুচকুচে। সাদাকালোর খেলায় সকলে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। ঘরের চারকোণে চারটে ফার্ন গাছের সুদশ্য টব। একটা অ্যাকোয়ারিয়াম। হরেক রকমের মাছ ঘুরপাক খাচ্ছে। সবচেয়ে রাজকীয় গোল্ড ফিশ। রাজার মতো বেড়িয়ে বেড়াচ্ছে জলাধারে। জয়ের দিদির এসব দেখা আছে। জয় আর শিরিন হাঁ হয়ে গেছে। কিছুই নয়, অথচ কত কিছু।
সবাই যার-যার চেয়ারে বসে পড়লেন। একটা কার্ডে লেখা আছে দিনের মেনু। স্যপ, ব্র্যাকেটে লেখা ডাল। ডাল স্যুপ। তারপর গরম ওভেন ফ্রেশ ব্রেড উইথ হোমমেড বাটার। স্যালাড়। বেড পিজ। ভেজিটেল আ-লা-কার্তা। স্মোকড় ফিশ। ফ্রায়েড পোট্যাটো। পুনস ইন হানি। হোমমেড আইসক্রিম।
ম্যানফ্রেড বললেন, “একেবারে ইউরোপিয়ান মেনু!”
নিবেদিতা বললেন, “আপনারা রয়েছেন, সেই কারণে এই ব্যবস্থাই করা হল। সামান্য অনুরোধ খাওয়া শুরুর আগে, জয়েন মি ইন প্রেয়ার।”
স্যুপ এসে গেল। যাঁরা পরিবেশন করছেন, তাঁদেরও পোশাক ধবধবে সাদা। চুল স্কার্ফে ঢাকা। ঠোঁটে সাদা পটি বাঁধা। চুলে স্কার্ফ বাঁধার কারণ খাবারে যাতে চুল না পড়ে। ঠোঁটে পটি বাঁধার কারণ, হঠাৎ যাতে খাবারে না থুতু পড়ে। হঠাৎ তো কেউ কথা বলে ফেলতেও পারে। স্বাস্থ্যের কারণে পটি বাঁধা। কত সাবধানতা।
নিবেদিতা হাতজোড় করে বললেন, “আজ আমরা যা খাচ্ছি, তা কিন্তু বাসী খাবার।”
শিবশঙ্কর বললেন, “সে আবার কী! গরম স্যুপ, ধোঁয়া উঠছে। বলছেন বাস
“ব্যাপারটা এইরকম, এইটা আমাদের কালকের অর্জন। কালকের ফল আমরা আজ ভোগ করছি। বর্তমানে বসে আমরা অতীতের ফল ভোগ করি। Cast thy bread upon the waters: for thou shalt find it after many days. আজ ভাসাও জলে তোমার রুটি, কারণ সেই রুটিই পরে তোমার কাছে ফিরে আসবে। প্রভু! আজ আমি যা ভোগ করছি তা আমার অতীতের কৃতকর্মের পুরস্কার।
Give us grace that we may cast away
the works of darkness, and put
upon us the armour of light.
নিন শুরু করুন।”
স্বচ্ছ নীল পাত্রে গরম সুপ, ছোট-ছোট ভাজা রুটির টুকরো ভেসে বেড়াচ্ছে। অসাধারণ তার স্বাদ। কচি কাঁচালঙ্কার গন্ধ, সামান্য লেবুর ছোঁয়া। শিরিন জয়ের কানে কানে বলল, “এইরকম একটা সুপ রোজ পেলে তিনদিনে চেহারা ফিরে যাবে। কী সুন্দর খেতে!”
এসে গেল গরম তাজা পাউরুটি। এক-একটা ফুলের মতো দেখতে। সেই সুন্দর গন্ধ। একটা দিকের রং পালিশ করা বাদামি। রুমাল দিয়ে ঝকঝকে করতে ইচ্ছে করে। এমন জিনিস কি খেতে ইচ্ছে করে! ছোট-ছোট পাত্রে নরম মাখন। মাখন মাখাবার জন্য ঝকঝকে ছোট-ছোট ছুরি।
শিবশঙ্কর বললেন, “ম্যানফ্রেড, খাওয়াটাকেও শিল্পের স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়।”
“অবশ্যই যায়। সেইজন্যেই বলে, জীবন শিল্প। শুধু জন্মালেই হয় না, বাঁচাটাও শিখতে হয় শিবশঙ্কর। শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, রসবোধ। ফুলের গন্ধ, চাঁদের আলো, পাখির সুর, সুন্দর গল্প, সুন্দর গান, সুন্দর সাহিত্য, সুন্দর বাড়ি, সুন্দর পরিবার, সুন্দর মানুষ, সুন্দর কথা, সুন্দর ব্যবহার, ফুলের পাপড়ির মতো জীবনের বাহার।”
ফাদার বললেন, “এর অনেকটাই আমাদের জীবনে নেই। সাধনাই জীবন। এই কথাটা আমরা সবাই ভুলে গেছি। “
সবাই মনের আনন্দে খেয়ে চলেছেন। কাচের জানালার বাইরে সবুজ, ঝাঁঝালো মধুর মতো রোদ, একঝাঁক প্রজাপতি রঙিন কাগজের মতো উড়ছে। ফিনফিনে ডানা মেলে। জয়ের মনে হচ্ছিল এই অপূর্ব জায়গায় সে যেন চিরদিন থাকতে পারে। সব কেমন সাজানো-গোছানো, সুন্দর একটা নিয়মে বাঁধা। কেমন করে মানুষ এমন সুন্দর হয়ে ওঠে! স্বপ্নকেও সত্য করে তোলে!
ম্যানফ্রেড নিবেদিতাকে বললেন, “আমার একটা প্রস্তাব আছে।”
নিবেদিতা হাসতে-হাসতে বললেন, “বলুন, কী প্রস্তাব আপনার?”
“আপনার সাধনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। একা একজন এত সব করতে পারেন, আমি ভাবতেও পারি না। আমার ইচ্ছে করছে আপনার কাজের সঙ্গী হতে। আমার জীবনের সব সঞ্চয় আপনার সেবায় লাগাতে চাই। এটাকে আরও, আরও বড়, বিশাল বড় করতে চাই। আরও, আরও সব বিভাগ যোগ করতে চাই। হচ্ছে যখন, বেশ ভাল করেই হোক না। আপনার আপত্তি আছে? এমন প্রস্তাব নিয়ে ক’জন আসেন বলুন?”
“ আপত্তি থাকবে কেন?”
“আমি তো আপনাকে বিদেশি মুদ্রা দিয়ে সাহায্য করব, সেইরকম একটা পরিকল্পনা ভাবুন।”
“আমার ভাবাই আছে। একটা সর্বাধুনিক হাসপাতাল। মানুষ বিনা চিকিৎসায় মরছে।”
“আমিও ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলুম।”
“আমার আর-একটা ভাবনাও আছে। সেটা আপনাকে পরে জানাব।”
“আমারও একটা পরিকল্পনা আছে।”
শিবশঙ্কর বললেন, “আমারও একটা প্ল্যান আছে। আমার ওই খেলনার কারখানাটাকে যদি আরও বড় করা যায়, তা হলে অনেকের রোজগারের ব্যবস্থা হতে পারে। এই অঞ্চলের মানুষের খুব অভাব। ম্যানফ্রেড তুমি যদি সত্যিই কিছু করো, তা হলে আমিও লেগে যেতে পারি। জীবন ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে ভাই। সারাজীবন তো নিজেদের জন্যই করা হল, এইবার অন্যের কথা ভাবার সময় এসেছে। শুনলে অবাক হবে, আমার বাবা অন্যের জন্যে ভিক্ষে করতেন। সেই টাকায় কারও চিকিৎসা হত, কারও পড়ার খরচ চলত। কারও মেয়ের বিয়ে! দু’হাতে তিনি পরের সেবা করে গেছেন। সারা জীবন ধরে তিনি আমাদের একটা কথাই বলতেন, লিভ ফর আদার্স। একানে ঢুকে ওকান দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমরা শুনেও শুনিনি।”
শিবশঙ্কর দুঃখ-দুঃখ মুখ করে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। নিবেদিতা বললেন, “ আপনার সব কথা আমরা জানি। আপনার আর আপনার ছেলের মতো মানুষ এই তল্লাটে আর ক’জন আছেন? আপনার স্ত্রী তো দেবীর মতো। আপনার নাতি-নাতনিও সেইভাবেই বড় হচ্ছে। জয়া তো এই বয়সেই আমার ডান হাত। জয়া কী বলেছে জানেন, ও বিয়ে করবে না, আমার সঙ্গে কাজ করবে, বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে এখানে চলে আসবে।”
সবাই বাগানে বেরিয়ে এলেন। ফাদার বললেন, “তোমার এই বাগানে আমার একটা হাতের কাজ রেখে যাই। কিছুই না, আমার এই ডালপালার শিল্প।”
নিবেদিতা বললেন, “সে তো আমার মহা-সৌভাগ্য। ফাদার, আপনার জীবন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে। ফাদার ইউ আর গ্রেট। ক্রাইস্টের জীবন আপনিই ঠিক-ঠিক নিতে পেরেছেন। আমরা পারিনি। আমাদের অহঙ্কার আছে। আমরা এখানেও অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াচ্ছি। গ্ৰোপিং ইন দি ডার্ক। আমরা এখনও সকলের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পাইনি।”
“তুমি একটু বেশি বলছ মেয়ে। আমি জানি, আমি কী! আমাকে সবাই পাগল বলে।”
“আপনার মতো পাগল আমরাও হতে চাই। পারি না। চেষ্টা করে কি আর পাগল হওয়া যায়?”
সবাই লনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসলেন। ফাদার বসলেন গাছের ডাল নিয়ে। একটা রূপ চেষ্টা করলেই খুঁজে পাওয়া যায়। ফাদার সেই রূপটাকেই ফুটিয়ে তুলছেন ধীরে-ধীরে। সকলের চোখ সেই দিকে। কায়দাটা হল কোনটা রাখবেন, কোনটা ছাঁটবেন! একটা করে ডাল কাটছেন, আর বসে থাকছেন কিছুক্ষণ, ধ্যানে বসে থাকার মতো। কারও কোনও কথা বলার সাহসই হচ্ছে না। যেন একটা ধ্যানের ক্লাস চলেছে। ফাদারের সাধনা ও নিমগ্নতা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে। বিকেল প্রায় হয়ে এল বলে! সূর্য পশ্চিমে অনেকটা ঢলে পড়েছে। নীল পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের মাথায় আলোর খেলা চলেছে। ছোট-ছোট গাছগুলোও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। একজোড়া কাঠঠোকরা বাগানের গাছে ঠোটের তাল ঠুকছে । জয় জয়া শিরিন, তিনজনে বসেছে পাশাপাশি। জয়া মাঝখানে আর দু’জন দু’পাশে।জয়ার একটা হাত জয়ের কাঁধে, আর-একটা হাত শিরিনের মুঠোয়। অল্প-অল্প গরম জলে স্নান করার মতো নরম রোদে বসে জয়ের শরীর আরামে যেন এলিয়ে আসছে। একপাশে দিদি, আর-একপাশে শিরিন। ম্যানফ্রেড আর শিবশঙ্কর পাশাপাশি। ফাদারের পাশে নিবেদিতা। ম্যানফ্রেডের নীল চোখে সমুদ্র।
ফাদার কুটকুট করে ডাল কাটছেন, আবার চুপচাপ বসে থাকছেন বেশ কিছুক্ষণ। আবার যেই খুঁজে পাচ্ছেন পথ, হাত চলছে দ্রুত। কোনওদিকে খেয়াল নেই। পিঠ বেয়ে কাঠপিঁপড়ে উঠছে ঘাড়ের দিকে। নিবেদিতা সাবধানে সরিয়ে দিচ্ছেন, আলতো আঙুলে। কী একটা হতে চলেছে, কেউই বুঝতে পারছেন না। ম্যানফ্রেড আধশোয়া হয়ে আছেন।
ফাদার শেষ একটা ডাল কুট করে কাটামাত্রই পরিপূর্ণ রূপ। তিনজন পাশাপাশি বসে আছে। তিনটি কিশোর। ফাদার শরীরের টানটান ভাব আলগা করে বললেন, “যা চেয়েছিলাম তাই হল—জয়, জয়া, শিরিন। বসে রইল এই বাগানে।”
পাঁচিলের ওপারে জেগে উঠল বিশাল এক জরির পাগড়ি, একটা লাঠির অংশ, ডগায় ঝুলছে পুঁটলি। তিনটেই এগোচ্ছে।
॥ ১৬ ॥
খড়ক সিং। শিরিন বলল, “নাচতে নাচতে কোথায় আবার চললেন আমাদের সিংজি?” শিবশঙ্কর ছুটে গেলেন পাঁচিলের দিকে, “খড়ক সিং, খড়ক সিং।”
পাগড়ি, লাঠির ডগা, পুটলি প্রথমে স্থির হল। কিছু পরেই পাঁচিলের মাথার ওপর জেগে উঠল পরিচিত সেই মুখ। বহু দেশ ঘুরেছে এই মুখ। রোদ মেখেছে, বরফে শীতল হয়েছে, বৃষ্টিতে ধুয়ে গেছে। মুখের ভাঁজে-ভাঁজে, খাঁজে-খাঁজে যেন সেইসব অভিজ্ঞতার কথা লেখা রয়েছে। চোখ দুটো হয়ে গেছে আকাশের মতো।
জয়কে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তুমি বড় হয়ে কী হবে! যেমন সবাই জিজ্ঞেস করে, হোয়াট ইজ ইয়োর অ্যাম্বিশান! জয় একটুও চিন্তা না করেই বলবে, আমি খড়ক সিং হতে চাই। ফুটছয়েক লম্বা ছিপছিপে একজন মানুষ। লোহার মতো শরীর। ছুরির মতো ধারালো মুখ। দেশে-দেশে যে নেচে বেড়ায়। সবাই যার বন্ধু।।
খড়ক সিং গেট ঠেলে বাগানে এসে ঢুকলেন। সব্বাইকে এক জায়গায় দেখে তাঁর কী আনন্দ!
জয়া বলল, “তুমি আমাদের ফেলে রেখে আবার কোথায় চললে?”
খড়ক সিং লাঠি, পুঁটলি নামিয়ে ঘাসের ওপর প্রার্থনার ভঙ্গিতে বসে বললেন, “আমার দানাপানি ফুরিয়ে গেছে দিদি। আমার ফুসফুসে আর বাতাস নেই। আমার লণ্ঠনে আর তেল নেই। বলার মতো আমার আর কোনও গল্প নেই। এখন আমি আমার তালুকে খাজনা তুলতে যাচ্ছি।”
এইসব কথার অন্য মানে। জয়া তা জানে। হেঁয়ালি। দানাপানি মানে চোখ অনেক দিন একই দৃশ্য দেখছে। মনের খোরাক শেষ হয়ে গেছে। নতুন-নতুন দেশ, নতুন-নতুন দৃশ্য না দেখলে খড়ক সিংয়ের প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। মন মরুভূমি হয়ে যায়। লণ্ঠনে আর তেল নেই মানে, সেইসব মানুষের সঙ্গে অনেক দিন দেখা হয়নি যাঁরা আশা জাগাতে পারেন, বাঁচার উৎসাহ দিতে পারেন, এমন কথা বলতে পারেন যা শুনলে ভেতরের আলো জ্বলে উঠে চারপাশ আলোকিত করে। তালুক আবার কী! খড়ক সিং কি জমিদার নাকি! গোটা পৃথিবীটাই তাঁর জমিদারি। খড়ক সিং যখন যেখানেই যান সেইটাই তাঁর নিজের হয়ে যায়। সবাই আত্মীয়, সবাই আপনার লোক।।
শিবশঙ্কর বললেন, “কোনও ননাটিস না দিয়ে আমাদের এইভাবে ফেলে রেখে চলে যাচ্ছ যে বড়!”
খড়ক বিষন্ন মুখে বললেন, “কত দিন দেখিনি যে!”
“কাকে দেখনি?”
“সে এক দুষ্টু মেয়ে, নেচে-নেচে চলে যায় এক জায়গা থেকে আর-এক জায়গায় গান গাইতে গাইতে।”
শিরিন বলল, “জানি। সে এক নদী। তুমি প্রায়ই সেই নদীটার কথা বলতে। নদীটার নাম লিডার। ঠিক কি না?”
“ঠিক, ঠিক। সে এক মজার নদী। এই জল আছে, আবার এই জল নেই। চারপাশে পাহাড়। পাহাড়ের মাথায় মেঘ জমবে। কালো মেঘ। তখনই সাবধান। যেই একপশলা বৃষ্টি হল, তখনই অপেক্ষা করো। কান পেত শোনা। জলের আওয়াজ। আসছে আসছে। হঠাৎ নদী ফুলে ফেঁপে উঠল। নাচতে-নাচতে নেমে এল জল। সে কী তোড়! পাথরটাথর সব ছিটকে দিয়ে জল চলল আর-এক দেশে। সমুদ্র থেকে মেঘ, মেঘ থেকে বৃষ্টি, বৃষ্টি থেকে নদী। কেমন মজা!”
জয়া বলল, “ওই নদীতে তোমার একবার কী সাংঘাতিক কাণ্ড হয়েছিল!”
“ও হো, সেই তো আমার প্রথম পরিচয়। আমি কি ছাই জানতুম খটখটে শুকনো নদী হঠাৎ ফুলেফেঁপে উঠবে অমন! শুধু নুড়ি। মাঝে-মাঝে, খাঁজে-খাঁজে চিকচিক জল।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “একে বলে গর্জ। চারপাশে খাড়া পাহাড়, মাঝখান দিয়ে চলে গেছে নদীপথ।”
আবার গল্প জমে উঠল। এইবার খড়ক সিং পা মুড়ে বসেছেন। আর বোধহয় মনে নেই কোথায় যাওয়ার জন্যে লাঠি, পোঁটলা নিয়ে বেরিয়েছিলেন। ফাদার একপাশে কাত হয়ে আছেন। শিবশঙ্কর যেন ধ্যানে বসেছেন! নিবেদিতা কোলে হাত জড়ো করে বসে আছেন বালিকার মতো। খড়ক সিং গল্প বলছেন।
লিডার নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। সে এক সুন্দর দুপুর। চারপাশে বড়-বড় চির, চিনার গাছ। পাহাড়ের দেওয়াল। হিমঠাণ্ডা হাওয়া। অজস্র নুড়ি ফেলে-ফেলে নদী গেছে ডান দিক থেকে বাঁ দিকে। কোন খাঁজে একটু জল কুলুক কুলুক শব্দ করছে। ডান দিকের পাহাড়ের মাথায় ঝুলছে ঝুলকালো একটুকরো মেঘ। সেই মেঘের কোলে বকসাদা টুকরো টুকরো মেঘ। মানুষ বড় অদ্ভুত জীব। সব মানুষেরই ধারণা, এপারের চেয়ে ওপার ভাল। স্বদেশের চেয়ে বিদেশ ভাল। আমার চেয়ে তুমি ভাল। খড়কের দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হল, লিডারের ওপারটা আরও সুন্দর। আরও অনেক গাছ, ফুল, ফল, ছায়া, পাখি। তা গেলে কেমন হয়! যাওয়া তো তেমন কঠিন নয়। আমার এত বড়-বড় পা, আর ওই তো গোল-গোল নানা মাপের পাথর! একটা থেকে আর-একটায় পা ফেলে-ফেলে চলে যাব। নদীতে তো জলই নেই। যাঁহাতক ভাবা তাঁহাতক খড়ক সচল। পাথর থেকে পাথরে পা ফেলে-ফেলে ব্যালেন্স করে-করে যেই নদীর মাঝামাঝি গেছেন, ডান দিকের পাহাড়ের মাথায় গড়াম করে একটা ভয়ঙ্কর শব্দ হল। খড়ক বুঝতেই পারলেন না ব্যাপারটা কী হল। যা হল তাকে বলে মেঘ ভেঙে পড়া, ক্লাউডবার্স্ট। খড়ক এত সব জানেন নাকি! তিনি মনের আনন্দে মাঝনদীতে দাঁড়িয়ে। এপার যত দূরে ওপারও তত দূরে। হঠাৎ খড়ক দেখেন ডান দিক থেকে জল ছুটে আসছে। জলের পাঁচিল। খড়ক জানেন এর পর কী হবে! জলের তোড়ে উলটে পড়ে ভেসে চলে যাবেন। পাথরের ঠোকাঠুকিতে শরীর চুরমার। মৃত্যুভয় মানুষকে বিকল করে দেয়। খড়কের তাই হল। বাঁচার উৎসাহটাই চলে গেল। যা হয় হবে। নিজেই পাথরের মতো ভারী। দেখছেন প্রচণ্ড বেগে ফুলে-ফুলে ছুটে আসছে দুগ্ধধারার মতো জল। হঠাৎ কোনও এক শক্তির টানে খড়ক ছিটকে গিয়ে পড়লেন নদীর ওপারে, আর ঠিক সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড গর্জনে এসে গেল জলের ধারা। সব তোলপাড় করে বইতে লাগল নদী। খড়ক চোখ বুজে ছিলেন। চোখ চেয়ে দেখলেন তিনি কার পায়ের কাছে পড়ে আছেন। ওপর দিকে তাকালেন, দীর্ঘদেহী এক সাধু। মিষ্টি হেসে বললেন, “এখনও তোমার যাওয়ার সময় হয়নি। তোমার এখনও অনেক অকাজ বাকি।”
খড়ক সেই সাধুর পেছন-পেছন এক গুহায় এসে ঢুকলেন। সাধু এক ধমক দিয়ে বললেন, “পেছন-পেছন আসছিস কেন, কী মতলব!”
খড়ক সাধাসিধে সরল মানুষ। তেমন ভয়ডরও নেই। বললেন, “সে তো আপনিই জানেন। আমাকে বাঁচালেন কেন? ধারেকাছে কোথাও তো আপনি ছিলেন না। আমি নদীর মাঝখানে, আপনি নদীর তীরে। হাত ধরে নিশ্চয় টানেননি। কায়দাটা কী করেছিলেন, সে আপনিই জানেন। তা যখন বাঁচালেন তখন শুধু হাতে ফিরব নাকি!”
সাধু বললেন, “বোস। তোর ভেতরটা একটু খুলে দিই।”
ম্যানফ্রেড জিজ্ঞেস করলেন, “খুলে দিই মানে?”
খড়ক বললেন, “জামা খোলা। আমরা সবাই একটা জামা পরে থাকি। অহঙ্কারের জামা। আমার এই নাম। আমি অমুকের ছেলে, আমার এত টাকা, ক্ষমতা, মান-সম্মান, ডাঁটের ঠেলায় অন্ধকার। সাধুজি আমার সেই জামাটা একটানে খুলে দিলেন।”
শিবশঙ্কর বললেন, “সেটা কীভাবে খুললেন?”
‘মাত্র দুটো কথায়। তুমি আছ, তুমি নেই। নেই মানে একেবারেই নেই। আর কোনওদিন ফিরবে না। তোমার ঘরবাড়ি, ঘটিবাটি সব পড়ে থাকবে। কিছুই তোমার সঙ্গে যাবে না।”
“এই কথাতেই হয়ে গেল! অমন কথা আমি লক্ষবার শুনেছি, আমার কিছুই হয়নি।”
“শুধু শুনলে তো হবে না, ধ্যান করতে হবে। আমি আছি, আমি নেই। সাধু সাতদিন আমাকে এই ধ্যান করালেন। মাঝে-মাঝে সুন্দর সব গল্প বলতেন। একটা গল্প আমার এখনও মনে আছে। আমাদের জীবনটা কেমন।”
নিবেদিতা বললেন, “গল্পটা শুনি।”
খড়ক সিং সকলের মুখের দিকে এক একবার তাকালেন, তারপর জয়াকে প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, আমার কি এখন খিদে পেয়েছে? পেটে চোঁচাঁ শব্দ হচ্ছে।”
“কখন খেয়েছ তুমি?”
“কাল সকালে।”
“সে কী! তারপর আর খাওনি কিছু?”
“একটু গাফিলতি হয়ে গেছে দিদি, খাওয়ার কথা মনে ছিল না। এই সময়টায় কি খাওয়া যায়!”
নিবেদিতা বললেন, “ভাবনা নেই, চা এসে গেছে। আমি কেক আনতে বলছি।”
চা আর কেক এসে গেল। প্লাম কেক। খড়ক খাচ্ছেন। খাওয়ার ধরনটা ছোট ছেলের মতো। কোনও মন নেই। কোলের ওপর গুঁড়ো পড়ছে। টুকরো পড়ছে। কোনও খেয়াল নেই। চায়ের কাপে কেক ডুবিয়ে ফেলছেন। একেবারে অমনোযোগী খাইয়ে।
জয়া বলল, “একটু মন দিয়ে খাও না গো! অমন ফেলে ছড়িয়ে খাচ্ছ কেন?”
“আমি ফেলব কেন! কেকের যেমন স্বভাব। ভেঙে-ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। ও তুমি ভেবো না, আমি যখন শেষ করব, তখন সব তুলে তুলে খেয়ে নেব। এখন আমি মানুষ, তখন আমি মুরগি। খুঁটে-খুঁটে খেতে ভীষণ ভাল লাগে। কোনওদিন খেয়ে দেখো।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “এইবার সেই গল্পটা হোক না।”
খড়ক সিং গল্প শুরু করলেন। এক পথিক একদিন একটা মাঠের পথ ধরে হেঁটে চলেছে। বেশ যাচ্ছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। হঠাৎ সামনে একটা বাঘ। পথিক অমনি উল্টো দিকে দে ছুট। চোঁ-দৌড়। বাঘ কি সহজে ছাড়ে! বাঘও ছুটছে পেছন-পেছন। পথিক একটা খাড়াই বেয়ে পাহাড় চূড়ায় উঠে পড়ল। বাঘ তখনও পেছনে। এইবার কী হবে! আর তো পালাবার জায়গা নেই। সামনে বিশাল খাদ। তখন একটা মোটা আঙুরলতা ধরে সে খাদে ঝুলে পড়ল। বাঘটা শিকারের দিকে ঝুঁকে পড়ে ফোঁস-ফোঁস করছে। লোকটি ভয়ে কাঁপছে। নীচের দিকে তাকাল। বিশাল খাদ। অনেক নীচে ওটা কী! আর-একটা বাঘ। অপেক্ষা করে আছে। হাত ফসকে কি লতা ছিঁড়ে একবার পড়লে হয়, ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলবে। লোকটার শরীর ভয়ে হিম হয়ে এল। এইবার ভয়ের ওপর আর-এক ভয়। কোথা থেকে দুটো ইঁদুর বেরিয়ে এল, একটা সাদা আর একটা কালো। ইঁদুর দুটো লোকটির ঝুলে থাকার একমাত্র অবলম্বন সেই লতা চিবোতে শুরু করল। একটু পরেই ছিঁড়ে যাবে, আর লোকটি পড়ে যাবে কয়েক হাজার ফুট নীচে। সেখানে অপেক্ষা করে আছে আর-একটা বাঘ। হঠাৎ লোকটির নজর চলে গেল পাশে, সেখানে এক থোলো পাকা আঙুর ঝুলছে। ডান হাত বাড়িয়ে একটা আঙুর ছিঁড়ে লোকটি মুখে পুরল, আঃ, কী অপূর্ব স্বাদ!
খড়ক সিংয়ের গল্প শেষ হয়ে গেল।
“এই গল্পের অর্থ?” ম্যানফ্রেড জিজ্ঞেস করলেন।
ফাদার বললেন, “খুব গভীর অর্থ। এই হল মানুষের জীবন। আঙুরলতা হল আয়ু। সাদা ইঁদুর আর কালো ইঁদুর হল দিন আর রাত্রি। একটা করে দিন যাচ্ছে আর মানুষ একদিন করে এগিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে। সামনে মরণ, পেছনে মরণ।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “এ আর নতুন কথা কী! অতসব ভাবতে গেলে কাজকর্ম মাথায় উঠবে। আসল কথা হল জীবনটাকে ফেলে না রেখে কাজ করে যাও। মোমবাতি জ্বলবে, আলো দেবে, গলবে। তরোয়াল খাপে থাকবে না, যুদ্ধে যাবে। কলমে কালি শুকোবে না, লিখবে। নদী স্থির থাকবে না, বয়ে যাবে! এই তো ধর্ম! জীবন নিয়ে নাকেকাঁদার তো কোনও কারণ নেই।”
“নেইই তো!” ফাদার বললেন, “তাই তো ওপরে বাঘ, নীচে বাঘ, ইঁদুর কাটছে লতা, তবু হাত বাড়িয়ে একটি আঙুর ছিঁড়ে মুখে পোরো।”
শিবশঙ্কর সেই বিশাল চাবিটা খড়কের হাতে দিলেন। খড়ক লাফিয়ে উঠলেন, “এ কী!”
॥ ১৭ ॥
চাবি! একটা চাবি দেখে খড়ক সিং এমন আশ্চর্য হয়ে গেলেন কেন?
“ব্যাপারটা কী?” জিজ্ঞেস করলেন শিবশঙ্কর।
“এই চাবিটা আমারই। আমিই নদীর জলে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলুম তিন মাস আগে।”
“আর সিন্দুকটা!”
“সেটা আছে যোধপুরে।”
“তা সিন্দুক আছে যখন, চাবিটা ফেলে দিলে কেন?”
“সিন্দুকটা কোনওদিন আমি খুলে দেখিনি, দেখতেও চাই না।”
“সে আবার কী কথা! দেখতে চাও না কেন?”
“বড়লোক হয়ে যাওয়ার ভয়ে। যদি অনেক কিছু বেরিয়ে পড়ে, তা হলে আমার বুকে একটা ধাক্কা লাগবে। আমি সঙ্গে-সঙ্গে মরে যাব।”
“বড়লোক হতে তোমার ইচ্ছে করে না?”
“একদম না। বড়লোক হলে আমি আর হাঁটতে পারব না। আমার এই পুঁটলি, লাঠি, সব চলে যাবে। আমার এই পাগড়ির রং পালটে যাবে। আমার নাগরা ছুটি পেয়ে যাবে। আমি আর হাসতে পারব না। নাচতে, গাইতে পারব না। আমাকে সবাই খাতির করবে। পেছনে অনেক লোক লেগে যাবে। আমার জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে।”
“তোমার মতো অদ্ভুত মনের মানুষ পৃথিবীতে আর ক’জন আছে?”
“অনেক আছে, অনেক। আমার মতো বেরিয়ে পড়ুন পথে, দেখতে পাবেন তাদের। পৃথিবীটা যে কী মজার, আপনাদের ধারণা নেই বড়বাবু। আপনারা বড় হিসেব করে চলেন। চামচে দিয়ে জীবন মাপেন।”
ম্যানফ্রেড বললেন, “তা হলেও সিন্দুকটা একবার খুলে দেখা উচিত। ট্রেজার চেস্ট! তা ছাড়া চাবিটা যখন আবার ফিরে এল! চাবিটা সিন্দুকের কাছে আবার ফিরে যেতে চাইছে, তাই না!”
“আপনাদের খুব লোভ হচ্ছে, তাই না?”
“লোভ নয়, কৌতূহল। সেই রাজা-মহারাজাদের জিনিস। সোনার মুকুট, হিরে বসানো। মুক্তোর মালা, লাল রুবি, সবুজ পান্না।”
খড়ক বললেন, “আর যদি দেখা যায় কিছুই নেই, তা হলে কী হবে! সেই দুঃখ তখন সামলাব কেমন করে! তার চেয়ে আমার কিছু আছে কি নেই, না জেনেই আমি বড়লোক।”
ম্যানফ্রেড হতাশ হয়ে বললেন, “এ-লোকটা বড় গোলমেলে। একেবারেই অন্য ধরনের, আমাদের সঙ্গে মেলে না।”
শিবশঙ্কর বললেন, “সেই কারণেই তো ওকে সবাই ভালবাসে। সব সময় আনন্দে নেচে বেড়াচ্ছে। ঘরদোর, ঘটিবাটি, সুখদুঃখ, কোনও কিছুই ওকে ধরে রাখতে পারে না। আচ্ছা খড়ক! আচ্ছা, আমরা যদি সবাই মিলে, ধরো এই সামনের শীতে তোমার যোধপুরে গিয়ে সকলের সামনে সিন্দুকটা খুলি, তা হলে কেমন হয়।”
“সে হয়। তা হলে চাবিটা আপনাদের কাছেই রাখুন, আমি যাই, আমাকে সেই লিভার নদীর সাধু খুব ডাকছেন। আমি শুনে আসি। আসি আর না আসি, আপনারা যাবেন। যোধপুর প্যালেসে।”
“প্যালেসে?” শিবশঙ্কর হাঁ হয়ে গেলেন, “প্যালেসে কী করতে যাব?”
“বড়বাবু, সেইখানেই যে আমার পূর্বপুরুষ থাকতেন!”
খড়ক এমনভাবে কথাটা বললেন, যেন কিছুই নয়। পূর্বপুরুষ প্যালেসে থাকতেন, তার মানে রাজার ছেলে।
সে ফকিরের মতো পথে-পথে ঘুরছে। তাইতেই তার আনন্দ! আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ। জয়া ঠিক সেই কথাটাই গেয়ে উঠল রবীন্দ্রনাথের গানে :
আমার এই পথ-চাওয়াতেই আনন্দ।
খেলে যায় রৌদ্রছায়া, বর্ষা আসে বসন্ত ॥
ফাদার আর থাকতে পারলেন না, জয়ার সঙ্গে তিনিও গলা মেলালেন। বাংলা উচ্চারণে সামান্য গোলমাল থাকলেও, বেশ ভরাট গলা, সুরও আছে। দু’জনে গাইছেন :
কারা এই সমুখ দিয়ে আসে যায় খবর নিয়ে
খুশি রই আপন মনে—বাতাস বহে সুমন্দ ॥
সন্ধে নেমে গেছে, পাতলা পেঁয়াজের খোসার মতো। গোলাপি আকাশ।
বিন্দু বিন্দু পাখির ঝাঁক দূর আকাশে। গান ভেসে যায়। এ-পৃথিবীতে যেন দুঃখ নেই, পরীক্ষা নেই, পাশ-ফেল নেই। বাতাস সত্যিই সুমন্দ বইছে। নিবেদিতাও চেষ্টা করছেন গলা মেলাবার :
সারাদিন আঁখি মেলে দুয়ারে রব একা,
শুভখন হঠাৎ এলে তখনি পাব দেখা।
ততখন ক্ষণে ক্ষণে হাসি গাই আপন-মনে,
ততখন রহি রহি ভেসে আসে সুগন্ধ ॥
সন্ধ্যার আধো-অন্ধকারে সবুজ ঘাসের ওপর সাদা-সাদা চায়ের কাপ আরও সাদা দেখাচ্ছে। দিন এইবার রাতের বিছানায় একেবারেই ঘুমিয়ে পড়বে। একটা দিনের কর্মকান্ড সব শেষ হয়ে এল। এইবার সবাই ঘাসের কার্পেট ছেড়ে উঠে পড়বেন।
শিবশঙ্করের শেষ প্রশ্ন খড়ককে, ‘‘তা হলে তুমি রাজার ছেলে! এ-কথা তো আগে বলোনি!”
“আমরা তো সবাই রাজার ছেলে বড়বাবু। এ আর আলাদা করে বলার কী আছে! এই মুলুকের যিনি রাজা, যাঁর চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা, আমরা সবাই তো তাঁর সন্তান!”
“তবু তোমার ইতিহাসটা জানতে ইচ্ছে করে। তোমার পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহের কথা। একজন রাজপুত বীর তুমি। তোমার সিংহাসন ছিল, বর্ম, শিরস্ত্রাণ ছিল, তুমি যোদ্ধা, তোমার মধ্যে এত প্রেম কোথা থেকে এল! এত ত্যাগ, বৈরাগ্য!”
“সে আসে বড়বাবু! হঠাৎ এসে যায়। যেমন হঠাৎ মেঘ আসে, আসে বৃষ্টি। সেইরকম! যেমন হঠাৎ জ্বর আসে।”
ফাদার উঠে দাঁড়িয়েছেন। সাদা পোশাকে তাঁকে মনে হচ্ছে পাথরের মূর্তি।
তিনি বললেন, “গ্রেস! গড়স গ্রেস। হঠাৎ নেমে আসে। রবীন্দ্রনাথের সেই গান! তোমরা কেউ গাও না। বড় সুন্দর। আমি যে রোজ শুনি, সেই গান :
বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি
শুষ্ক হৃদয়লয়ে আছে দাঁড়াইয়ে
ঊর্ধ্বমুখে নরনারী ॥
না থাকে অন্ধকার, না থাকে মোহপাপ
না থাকে শোকপরিতাপ।
খড়ক সিং তাঁর লাঠি-পুঁটলি নিয়ে উঠে দাঁড়াতে-দাঁড়াতে বললেন, “সে-গল্প আর-একদিন বলব। আমার একটা ঘোড়া ছিল। সেই গল্পটা এইভাবেই শুরু হবে। আজ আমি যাই।”
পড়ে রইল শূন্য বাগান। মন কেমন-করা রাতের বাতাস। পাতার শব্দ। মোটর স্টার্ট নিচ্ছে। পেছনে লাল আলো। চার্চের ঘন্টা বাজছে রাতের অন্ধকারে।
॥ ১৮ ॥
জয়কে জয়ের মাস্টারমশাই বনমালীবাবু বলেছিলেন, “বেশ টাইট করে বাঁধানো ছোট্ট একটা খাতা নিজের কাছে রাখবে, আর রোজ রাতে পড়াটড়া সব শেষ করে নিজের অভিজ্ঞতার কথা যেমন পারো সব লিখে রাখার চেষ্টা করবে। সেইসব ঘটনা, যা তোমাকে ভাবায়, চিন্তা করায়, আনন্দ দেয়।”
জয় লিখছে, সেই খাতাটায় লিখছে : আজ দিদি শিউলিতলায় বসে কাঁদছিল। আমি আড়াল থেকে দেখেছি। দিদি কেন কাঁদছিল আমাকে খুঁজে বের করতে হবে। কে দুঃখ দিয়েছে দিদিকে! দিদির চোখে জল দেখলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। দিদি সব সময় হাসবে তাই তো আমি চাই। আমাদের বাড়ির সবাই যেন আনন্দে থাকে। গান, গল্প, বেড়ানো, বনভোজন। লেখাপড়া তো আমরা ঠিকই করছি। কেউ তো বলতে পারবে না আমরা ফাঁকিবাজ। দিদি বলছিল, কেউ এসে চলে গেলে আমার ভীষণ কষ্ট হয়। ম্যানফ্রেড জেঠু গ্যাংটক চলে গেছেন কাল, তাই কি দিদি কাঁদছিল। তিনি তো পনেরো দিন পরে ফিরে আসবেন, তা হলে বোকা মেয়ের মতো কাঁদছিল কেন! মাকে আমি বলতে পারি, কিন্তু বলব না। আরও কয়েকদিন দেখব। এটা আমার আর দিদির ব্যাপার। শিরিন আমার জন্যে নীল একটা সোয়েটার বুনছে, আজ আমার মাপ নিয়েছে কাঁধের। শীত তো আসছে! শিরিনকে আমি কী দেব! আমি তো বুনতে জানি না। শিরিনকে আমার অনেক কিছু দিতে ইচ্ছে করে। আমি যখন বড় হব, চাকরি করব, তখন শিরিনকে একটা ফুলের বাগান দেব। সবুজ ঘাসে ঢাকা। শিরিন বাগান ভীষণ ভালবাসে। পাখি ভালবাসে। আমি মরিসাস থেকে পাখি এনে দেব। ফিজি থেকে এনে দেব ম্যাকাও। শিরিন আর আমার দিদিকে নিয়ে বেড়াতে যাব গ্রিসে। কবে যে আমি বড় হব! মানুষ কেন তাড়াতাড়ি বড় হয় না! এক বছরে মাত্র একবছর বয়েস বাড়ে! সার দিলে গাছ তাড়াতাড়ি বাড়ে, কী দিলে মানুষ তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠবে। দাদুকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলুম, তিনি বলেছিলেন, শিক্ষা আর অভিজ্ঞতায় মানুষ তাড়াতাড়ি বড় হয়।
এর পর জয় আর-এক পাতায় লিখল, খড়ক সিংয়ের চাবিটা নিয়ে আমার যোধপুর যেতে ইচ্ছে করছে। আমার বন্ধু বিমলকে কথাটা বলেছি। সে বলেছে পরীক্ষার পর শীতের সময় আমরা যাব গভীর রাতে প্যালেসের রক্ষীদের চোখে ধুলো দিয়ে আমরা ভেতরে ঢুকব। ও বলছে বটে, কাজটা তেমন সহজ হবে না। প্রাসাদ মানে বিশাল বড় একটা বাড়ি। সেই বাড়িতে কত ঘর! কোন ঘরে সেই সিন্দুক আছে আমরা জানব কেমন করে! অতই সোজা নাকি! চোরেরাই পারবে ম্যানফ্রেড জেঠু গ্যাংটক থেকে ফিরলে কথা হবে। সায়েব জেঠ আমাকে বীর হতে বলেছেন। বীর হতে গেলে তিনটে জিনিস চাই। শরীর, শিক্ষা, সাহস। আমাকে বলেছেন, ভাজাভুজি বেশি খাবে না। তেলেভাজা, আলুর চপ, ডালফুলুরির দিকে একদম তাকাবে না। ফুচকা ছোঁবে না। শীতকালে আইসক্রিম খেতে পারো, গ্রীষ্মকালে একেবারেই নয়। সব কিছু সেদ্ধ-সেদ্ধ খাবে, স্ট্রুর মতো করে। প্রচুর সবজি খাবে। দুধ না খেলেও চলবে, টক দই খাবে। ফল খাবে। আমাদের পেটে নাকি একটা বাগান আছে! ফ্লোরা, ফনা। আমাদের হজমে সাহায্য করে, রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে। টক দই খেলে সেই বাগান খুব ভাল থাকে। প্রচুর জল খেতে বলেছেন। জলই স্বাস্থ্য। বলেছেন, সূর্য ওঠার আগে বিছানা ছাড়বে। সেই বিছানার দিকে সারাদিনে আর ফিরেও তাকাবে না। আবার সেই রাতে, যখন শুতে যাবে। কী শীত, কী গ্রীষ্মে, ভোরবেলা ঠাণ্ডা জলে স্নান করবে। সাবান খুব কম মাখবে। নিজের কাজ নিজেই করে নেবে, যেমন জামাকাপড় কাচা, ইস্ত্রি করা, বিছানা করা, ঘর পরিষ্কার, বাথরুম পরিষ্কার, ঝুল ঝাড়া। রোজ এক ঘণ্টা বাগান করবে। সন্ধেবেলা সূর্যাস্তের ঠিক পরেই নির্জনে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকবে। তখন ভাববে, একটা দিন তো চলে গেল, কাজ কী হল! দিনটাকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পেরেছি তো! আকাশের দিকে তাকাবে। দেখবে, উড়ে যাচ্ছে পাখির ঝাঁক। দূর থেকে দূরে। ভাববে, পৃথিবীর সীমা আছে, আকাশ কিন্তু অসীম। আকাশে কারও অধিকার নেই। মাটি কেনা যায়, বাঁধা যায়, আকাশ কেনা যায় না, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা যায় না। আকাশের কাছে প্রার্থনা করবে, শক্তি দাও, স্বাধীনতা দাও। পবিত্রতা দাও। মন্দিরের চুড়ো, চার্চের চুড়োর দিকে তাকিয়ে থাকবে যতক্ষণ পারবে। দেখবে আস্তে-আস্তে তোমার মন বড় হচ্ছে। মন হয়ে উঠছে দেহের চেয়ে বড়। বিশাল, বিরাট। রোজ কিছু-না-কিছু ভাল কবিতা পড়বে। সকলের সঙ্গে সবসময় হেসে কথা বলবে। কখনও রাগ করবে না। রাগ খুব খারাপ জিনিস। শরীর আর মনের ক্ষতি করে। বন্ধু করবে তবে জানবে, তোমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু তুমি নিজে। জীবজন্তুর কাছ থেকেও অনেক কিছু শেখার আছে। কুকুরের কাছ থেকে নেবে বিশ্বস্ততা। গোরুর কাছ থেকে নেবে সরলতা, পাখির কাছ থেকে নেবে আনন্দ, ঘোড়ার কাছ থেকে নেবে সহিষ্ণুতা, সিংহের কাছ থেকে নেবে শৌর্য, বাঘের কাছ থেকে নেবে গতি, হরিণের কাছ থেকে চঞ্চলতা, প্রজাপতির কাছ থেকে নেবে ভারহীনতা, উইপোকার কাছ থেকে নেবে লেগে থাকার ক্ষমতা, হাতির কাছ থেকে নেবে বিশালতা।
যেসব বস্তু প্রাণহীন তারাও তোমাকে অনেক কিছু দিতে পারে। ধরো, একটা চেয়ার। যখন ঘরে কেউ নেই, চেয়ারটার দিকে তাকিয়ে থাকবে। সামান্য একটা চেয়ার। তাকিয়ে থাকতে-থাকতে তোমার মনে হবে, চেয়ার হল সাধনা। তোমাকে বসে থাকা শেখায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকা। টেবিল তোমাকে দেয় জ্ঞান। বন্ধ দরজা বলে, খোলো, খুলে এগিয়ে যাও। চৌকাঠ বলে, টপকে যাও। জানলা হল, আলো, বাতাস, শব্দ। এইভাবে তুমি শেখো। নিজেকে প্রস্তুত করো। দেহে নয়, মনে লম্বা হও। নির্জনতার সঙ্গে বন্ধুত্ব করো। পথে যখন চলবে, কোনওদিকে তাকাবে না। দেখারও একটা নিয়ম আছে। যেটা দেখবে সেইটাই দেখবে, অন্যটা নয়। মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবে। যা বলবে, তা গুছিয়ে বলবে। সব সময় সত্য কথা বলবে।
জয় ডায়েরি বন্ধ করে ঘরের বাইরে এল। দুধের মতো চাঁদের আলো থইথই করছে চারপাশে। শিবশঙ্করের পড়ার ঘরে আলো জ্বলছে। দিদি দিদাকে গল্প শোনাচ্ছে। জয়া মুখে-মুখে গল্প তৈরি করতে পারে। গল্পের মুখটা ধরিয়ে দেন দিদা। এক গ্রামে এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ ছিল। দিদা আর কিছু বলবেন না, এইবার দিদি সেইটাকে টেনে-টেনে বাড়াবে। মজার খেলা দিদি এইটা খুব পারে। গল্পটাকে কোথা থেকে কোথায় যে টেনে নিয়ে যাবে, কেউ জানে না।
জয় দিদার ঘরে গিয়ে ঢুকল। বিশাল খাটে খদ্দরের রঙিন চাদর। মৃদু একটা আলো জ্বলছে। টেবিলে খোলা রয়েছে দিদার পুরু কাঁচের চশমা। ঝিনুকের মতো দেখাচ্ছে। কবিরাজি গাছগাছড়ার সুন্দর গন্ধ। দেওয়ালে সেই বড় ছবিটা, রাম, লক্ষ্মণ, সীতা। বনবাসে চলেছেন। এই ছবিটা দেখলেই জয়ের খুব মন খারাপ হয়ে যায়। রাজার ছেলে কেন বনে যাছে! সীতাকে তার দিদি বলতে ইচ্ছে করে। রাম জামাইবাবু। খাটে বেশ জমিয়ে বসে আছে দু’জনে। দিদা আর দিদি। জয় গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঠেলেঠুলে শুয়ে পড়ল দিদার পাশে। একপাশে জয়, অন্যপাশে জয়া, মাঝখানে দিদা। দিদার এক হাতে ধরা জয়ার হাত। অন্য হাতে ধরলেন জয়ের হাত। চারটে হাতই আলতো পড়ে আছে তাঁর বুকের ওপর। বালিশে মাথা। পাকা চুল ঘেরা প্রসন্ন মুখ। আধবোজা চোখ। সুন্দর একটা সুখের ছবি।
জয় জিজ্ঞেস করল, “আজ কী গল্প ধরিয়েছ দিদা?”
“এখনও ধরাইনি। তুমি ধরাও আজ।”
শুয়ে-শুয়ে জয়ের মনে হচ্ছিল, একটা সমুদ্র। সমুদ্রটা শান্ত খাটটা যেন একটা জাহাজ। তিন জনে সেই জাহাজের ডেকে ভাসছে। জয়ের মনে হল, গল্পটাকে এইভাবে ধরালে দিদি আর বেশিদূর এগোতে পারবে না। বিপদে পড়ে যাবে।
জয় বলল, “বেশ, আমিই বলছি। ভারত সাগরে একদিন রাতে দেখা গেল একটা জাহাজ এলোমেলো ভেসে চলেছে, তার ওপরের ডেকে চিত হয়ে পড়ে আছে তিনজন মানুষ।”
॥ ১৯ ॥
জয় ভেবেছিল, দিদি গল্পটা সুবিধে করতে পারবে না। দিদি সমুদ্রের কী জানে, কতটুকু জানে! একটা জাহাজ, বিশাল সমুদ্র। ওপরের ডেকে তিনটে লোক। সহজ নাকি এমন গল্প! জয়া প্রথমটায় একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। গল্পটাকে কোথা থেকে ধরে কোন দিকে নিয়ে যাবে! রূপকথার গল্প করে ফেললে চলবে না। অরুণ-বরুণ-কিরণমালা। ওরা তিনজন বড় হয়ে বাণিজ্যে যাচ্ছিল, এমন সময় মাঝসমুদ্রে সর্বনাশা ঝড়। মাস্তুল ভেঙে গেল, পাল উড়ে গেল। জয়া জানে জয় এই গল্প বিশ্বাস করবে না। বলবে, ‘দিদি, আমি কী এখনও অতটাই ছোট আছি যে, আমাকে রূপকথার গল্প শোনাচ্ছিস!’
জয়কে সত্যি গল্প বলতে হবে, যে-গল্পে ইতিহাস আছে। জয়া শুরু করল, “স্পেনের মানুষ সমুদ্র ভালবাসে। তাদের কেউ ভীষণ ভাল নাবিক। কেউ আবার দুর্দান্ত জলদস্যু। ছেলেরা যেই বড় হয়। সাবালক হয়, স্বাস্থ্যে যখন তাদের শরীর ফেটে পড়ে। তারা আর ঘরে থাকতে পারে না! সমুদ্র তাদের ডাকে, নতুন দেশ হাতছানি দেয়। তারা ভূগোল-টুগোলের ধার ধারে না। প্রাকৃতিক দৃশ্য, মানুষজন তাদের সেইভাবে টানে না, যেমন আমাদের টানে। তারা চায় দেশজয় করতে, ধনসম্পদ লুঠ করে নিজের দেশে এনে ফেলতে। নিজের দেশকে তারা বড়লোক করবে। ভীষণ নিষ্ঠুর, তেমন দয়ামায়া নেই। রক্ত দেখলে তাদের আনন্দ হয়। এইভাবেই তারা একদিন দক্ষিণ আমেরিকা, মেক্সিকো এইসব দেশ জয় করেছিল, দখল করেছিল। সেখানে তখন প্রচুর ঐশ্বর্য। সোনা, রুপো, দামি পাথর। সে হল গিয়ে সপ্তদশ শতাব্দীর কথা। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের কিছু পরেই। সব হইহই করে আসতে লাগল নতুন দেশে। যে-দেশের নাম হল নিউ ওয়ার্ল্ড।”
জয় বলল, “দিদি, কলম্বাসের কথা আগে একটু বল।”
“কলম্বাসের পুরো নাম, ক্রিস্টোফার কলম্বাস, জাতিতে ইতালীয় ; কিন্তু স্পেনের রাজার চাকরি করতেন। ১৪৯২ সালে আবিষ্কার করেন সান সালভাদর, এখন যার নাম হয়েছে ওয়াটলিং আইল্যান্ড। ওই সময়ই আবিষ্কার করেন বাহামাস, কিউবা আর হাইতি। ১৪৯৩ থেকে ‘৯৬-এর মধ্যে আবিষ্কার করেন। গুয়াদেলপা, মন্টসেরাট, অ্যান্টিগুয়া, পুয়েরটোরিকো আর জামাইকা। ১৪৯৮ সালে কলম্বাস হাজির হলেন দক্ষিণ আমেরিকায়। এই হল কলম্বাসের কথা।”
“তুই এত সব জানলি কী করে? আমি কেন জানি না!” জয়ের অভিমান হল।
জয়া বলল, “আমি যে তোর চেয়ে বড়। ফাদার আমাকে একটা বই দিয়েছেন, সেই বইয়ে সব আছে। এতে চোখ ছলছল করার কী আছে! আমি জানলে তুইও জানবি পাগলা।”
“ফাদার যে তোকে একটা বই দিয়েছেন, সে-কথা বলিসনি কেন?”
“কী আশ্চর্য! বইটা তো আমাদের পড়ার টেবিলেই রয়েছে।”
“তুই আর আমাকে আগের মতো ভালবাসিস না দিদি! তুই আর আমাকে কিছু বলিস না। তুই একা-একা সব জায়গায় যাস। আমাকে সঙ্গে নিস না। তুই কেমন নিবেদিতাদির লিলি কোর্টে একা-একা গিয়ে ভাব জমিয়ে নিয়েছিস। ওখানে বসে তুই ছবি আঁকিস, ওদের কত কাজে সাহায্য করিস! আমাকে বলিসনি।”
এইবার জয় সত্যিই কেঁদে ফেলবে। দিদির ওপর ভয়ঙ্কর অভিমান হয়েছে। দিদি তাকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, দিদি তার চেয়ে বেশি সব জেনে ফেলছে, শিখে ফেলছে। কেন, কেন? এমন কেন হবে! এই দিদিই তো একদিন বলেছিল, দেখ জয়, আমি আর তুই একই গাছের দুটো ডাল। একই পাখির দুটো ডানা।
জয়া জয়কে জড়িয়ে ধরে বললে, “বোকা ছেলে, লিলি ফোর্টে যে ছেলেদের যেতে দেয় না। যেতে দিলে তোকে আমি নিশ্চয় নিয়ে যেতুম।”
“যেখানে আমি যেতে পারব না সেখানে তুই যাস কেন?”
“আমাকে যে অনেক কিছু শিখতে হয় ভাই, যা তোকে কোনওদিন শিখতে হবে না, যেমন সেলাই, বোনা, রান্না, ফুল সাজানো, রোগীর সেবা, ইনজেকশান দেওয়া, ফ্লুইড চালানো, ঘর সাজানো।”
“এমন কোনও ওষুধ নেই দিদি, যা খেলে মেয়ে হওয়া যায়! আমরা বেশ দুই বোন হয়ে যেতুম?”
দিদা বললেন, “সে উপায় নেই রে গাধা। ছেলে হওয়াই তো ভাল। তোর দাদা, তোর বাবার মতো লম্বা-চওড়া হবি। লেখাপড়া শিখে একা-একা দেশ-বিদেশ ঘুরবি। কত মানুষ দেখবি, কত অভিজ্ঞতা হবে। দিদির বিয়ে হলে দিদি তো তোকে ছেড়ে চলে যাবে, তখন তুই কী করবি?”
জয়ের আর গল্প শুনতে ভাল লাগল না। সমুদ্র, জাহাজ, নিউ ওয়ার্ল্ড, স্পেনের নাবিক, যাক, সব ভেসে চলে যাক। জয় বিছানা থেকে ছিটকে নেমে পড়ল। ছুটে চলে গেল বাগানে। আকাশে একটা ভাঙা চাঁদ। নরম আলোয় প্রকৃতিতে যেন সেতার বাজছে রিমঝিম করে। অনেক অনেক দূরে কেউ কাঠ কাটছে। কোথায় একটা পাম্প চলছে ঘিনঘিন শব্দে। জয় রক থেকে বাগানে লাফিয়ে পড়ে শিউলি গাছের তলায় চলে গেল। এই গাছের তলায় তাদের জীবনের অনেক সুন্দর মুহূর্ত ফুলের মতো ঝরে আছে। জয় গাছ তলায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকাল। পাতার ফাঁকে-ফাঁকে আলোর আকাশ। ঘাসের ওপর পাতার ছায়া। সেই দিকে তাকিয়ে জয় ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। দিদি তার পাশে নেই, এ তো সে ভাবতেই পারে না। বিয়ে হয়ে গেলেই হল। দিদি বিয়ে করবে না। বিয়ে খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার। দিদিদের নিয়ে চলে যায়। দিদি যদি বিয়ে করেও জামাইবাবু এই বাড়িতে থাকবে।
উদয়ন ঠিক এই সময়েই সরোদে ধরেছেন বাগেশ্রী। এই সুরটা শুনলেই জয় হয়ে যায় পথিক। পথ চলে গেছে দূরে, বহু দূরে নীলপাহাড়ের কোল দিয়ে। অনেক রাতের পথিক সে। খড়ক সিংয়ের মতো লাঠি-পোঁটলা নিয়ে চলেছে। পায়ে কড়া নাগরা। পাথর চুরচুর হয়ে যাওয়ার শব্দ। তারা মিটমিট করানো বাতাস। বিশাল-বিশাল দৈত্যের মতো গাছ। ডালে-ডালে বানরছানার কিচিমিচি।
ভাইয়ের খোঁজে জয়া ছুটে এসেছে। জয়া আজ শাড়ি পরেছে, ফিকে হলুদ রং। জয়া বলল, “এখানে অন্ধকারে কী করছিস? কিছু কামড়ালে কী হবে?”
“কামড়ালে কামড়াবে, তাতে তোর কী? তোর তো বিয়ে হয়ে যাবে, তুই তো জামাইবাবুর!”
“তোর মতো এমন নরম ভাইটাকে নিয়ে আমি কী করি! আমার যখন বিয়ে হবে তখন তুইও তো বড় হয়ে যাবি। বড় হয়ে গেলে তোর নিজের কত বন্ধুবান্ধব হবে, তখন আমাকে কি তোর মনে থাকবে! তুই তখন বিলেত চলে যাবি। সেই সব দিন একেবারে অন্যরকম হয়ে যাবে।”
“দেখিস, আমি তোর শ্বশুরবাড়িতে কোনওদিন যাব না। তোর বরটা অসুর। রাবণের মতো। দশটা মাথা, ডাবের মতো চোখ। বিটকেল একটা লোক। সারা শরীরে ভালুকের মতো লোম।”
“তুই দেখেছিস বুঝি?”
“এখনও দেখিনি, দেখতে চাইও না।”
“তোর তো শিরিন আছে, প্রাণের বন্ধু। আমাকে তোর আর দরকার কী?”
জয় একটু লজ্জা পেল। চাপা গলায় বললে, “ধ্যাত।”
“আজকাল আমাকে আর বলাও হয় না। কোথায় জয়, কোথায় জয়! জয় শিরিনদের বাড়িতে।”
“শিরিনের সঙ্গে আমি লেখাপড়া করি। শিরিন আমাকে পড়ায়, আমি পড়াই শিরিনকে।”
“সে তো ভালই, তা হলে আর দিদি-দিদি করছিস কেন?”
জয় ঘাসের উপর বসে পড়ল। একটু স্যাঁতসেতে। ফুলের গন্ধ। পিটিং পিটিং করে লাফিয়ে পালাল কয়েকটা পোকা। জয় জানে ওগুলো কী? ঘোড়া ফড়িং। রাতে বেরোয়। ছোট-ছোট দেখতে। কী করে সারারাত কে জানে! এই গাছতলাতেই বিশাল একটা ব্যাঙ থাকে। জয় আর জয়া তার নাম রেখেছে, কোলাভোলা। ভীষণ ভাল। বন্ধুর মতো। চুপচাপ পড়ে থাকে একপাশে। মুড়ি-লজেন্স খেতে ভালবাসে। মহাকৌতূহলী একটা ইঁদুরও আছে। সারারাত ঘুরে-ঘুরে বেড়ায় চৌকিদারের মতো।
দূর থেকে একটা সাদা মূর্তি এগিয়ে আসছেন। দিদা।
কাছে এসে বললেন, “কী, অভিমান ভেঙেছে! কাপ ভাঙে, ডিশ ভাঙে, অভিমান কি অত সহজে ভাঙে! কোথাকার জল কোথায় গড়াল, তাই না! খুব হয়েছে, এইবার সব চল। রাত প্রায় বারোটা হল। কালপুরুষ কতটা নীচে নেমে পড়েছে, দেখেছ?”
জয়ার হঠাৎ খড়ক সিংয়ের একটা কথা মনে পড়ল, “রাত না জাগলে পথিবীটাকে জানা যায় না। একটা অন্য পৃথিবী ওইসময় জেগে ওঠে। অন্যধরনের সব প্রাণী ঝোপঝাড় গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। কতরকমের বাদুড় আর প্যাঁচা। গাছেরা এইসময় অন্যরকমের শ্বাস ছাড়ে। আকাশের যত তারা সব এইসময় বেরিয়ে পড়ে মিছিল করে। চাঁদ একা-একা ভেসে পড়ে, যে-সব শব্দ দিনের পৃথিবীতে শোনা যায় না, সেই সব শব্দ শোনা যায় রাতে। খড়ক বলেছিলেন, ‘রাতে চুপ করে বসবে একপাশে। শরীরের শক্ত ভাবটা আলগা করে দেবে। ধীরে-ধীরে তলিয়ে যাবে, যে-ভাবে একটা ঢিল তলিয়ে যেতে থাকে সরোবরের জলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুনতে পাবে, কে যেন কথা বলছে তোমার ভেতরে। এই ভেতরের মানুষটাই তো বাইরের মানুষটাকে চালায়।’ খড়ক সিং নিজের মতো করে নিজের উচ্চারণে রবীন্দ্রনাথের গান গায় :
যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক, তারা তো পারে না জানিতে—
তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছ আমার হৃদয়খানিতে।
যারা কথা বলে তাহারা বলুক, আমি করিব না কারেও বিমুখ
তারা নাহি জানে ভরা আছে প্রাণ তব অকথিত বাণীতে।
নীরবে নিয়ত রয়েছ আমার নীরব হৃদয়খানিতে ॥
জয় তাকিয়েছিল জয়ার মুখের দিকে। আলোছায়ায় মুখটা যেন জ্বলজ্বল করছে। ফিকে-হলুদ শাড়ির আঁচল বাতাসে দুলছে। জয়ের সব অভিমান গলে গেল। দু’ হাতে দিদির কোমর জড়িয়ে ধরে বলল, “আজ আমি তোর কাছে শোব দিদি।”
দিদা বললেন, “তা হলে তোমার মনের সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে?”
শিবশঙ্কর পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, “এ বাড়ির কোনও মানুষের চোখেই দেখি ঘুম নেই! এত রাতে কিসের সভা হচ্ছে এখানে?”
দিদা বললেন, “মান-অভিমানের পালা।”
“কার আবার অভিমান হল?”
“জয় সুন্দরের। বিষয়টা হল, দিদি কেন তার চেয়ে বেশি শিখে ফেলছে!”
“তাই তো! এ অতি সাঙ্ঘাতিক কথা। তুমি যাচ্ছ এগিয়ে আমি পড়ছি পিছিয়ে। তা তুমিও সমান তালে এগোও। আমার কাছে আছে খনি। আছে সোনা-হিরে-জহরত। ওরে তোরা কে নিবি আয়!”
শিবশঙ্কর দু’জনের হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলেন। কিশোরের হাত কিশোরীর হাত। বাইরে ছিল তাই ঠাণ্ডা। দু’জনেই পবিত্র, তাই ফুলের গন্ধ। বারান্দা পেরিয়ে চলেছেন তিনজন। উদয়নের ঘর। কার্পেটে বসে তন্ময় হয়ে সরোদ বাজাচ্ছেন, এইবার ধরেছেন কেদারা। মুখের চেহারাটাই অন্যরকম হয়ে গেছে। মা উমা কুকুরের গায়ে বুরুশ দিচ্ছেন। দিনের শেষ কাজ। দিদার ঘরে ধূপ জ্বলছে। সারা বাড়িতে সেই গন্ধ।
শিবশঙ্কর এসে দাঁড়ালেন সিঁড়ির মুখে। ঘুরে-ঘুরে উঠে গেছে ওপর দিকে। এই সিঁড়িটা সাধারণত ব্যবহার করা হয় না। কেউ তেমন আসে না এদিকটায়।
শিউলি – 20-29
॥ শিউলি – 20-29 ॥
॥ ২০ ॥
সিঁড়িটা প্যাঁচ মেরে-মেরে উঠে গেছে দোতলায়। বাড়ির প্রধান অংশের সঙ্গে এদিকটার কোনও সম্পর্ক নেই। শিবশঙ্করেরই বেশি যাওয়া-আসা। জয় আর জয়া ছুটির দিনে কখনও-সখনও এসেছে। গা-ছমছম ভয়ে বেশিক্ষণ থাকতে পারেনি। পালিয়ে গেছে। কিসের ভয়, কেন ভয় তা বোঝার চেষ্টা করেনি। “দিদি ভয়,” বলে, জয় আগে ছোটে, তারপর জয়া। দু’জনেই হাঁপাতে থাকে। শেষে একসময় সব ভুলে যায়। জায়গাটা গোয়েন্দা গল্পের মতো। একটা লম্বা টানা বারান্দা। কাচ দিয়ে ঘেরা। দুপুরে অদ্ভুত একটা আলো আসে। বাইরের গাছপালা পাতার ছায়া ফেলে রাখে। ডান দিকে বেশ বড় একটা ঘর। সেই ঘরের দুটো দরজা। সব সময় তালা বন্ধ। নির্জন দুপুরে কোথা থেকে ভেসে আসে ঘড়ির শব্দ। টিক টিক ঠিক ঠিক। বারান্দাটা শেষ হয়েছে আর-একটা ছোট ঘরে। দরজাটা কাচের। সেই ঘরে আছে ছোট একটা টেবিল আর একটা চেয়ার। দরজার মাথায় দেওয়ালে একটা হরিণের শিং। ফ্যাঁকড়া বের করে ভয় দেখাচ্ছে, যেন। মৃত্যু যেন জীবন্ত হয়ে আছে। মানুষের নিষ্ঠুরতা। বন্দুকের শব্দ। এই দিকটায় সবসময় কেমন যেন একটা ওষুধ-ওষুধ গন্ধ বেরোয়।
ঠিক বারোটা বাজল। রাত বারোটা। ঘড়িটা আছে ঘরের মধ্যে। শব্দের সঙ্ঘাতিক ঝঙ্কার। চড়া সুরে বাঁধা। জয়ের কী হয় জানি না, রাতের ঘড়ি জয়ার কাছে ভীষণ ভয়ের বস্তু। সবাই যখন ঘুমোয় ঘড়ি তখন একা-একা চলছে তো চলছেই। সময়টাকে টেনে-টেনে নিয়ে চলেছে। রাতের রেলগাড়ির এঞ্জিনের মতো। জয়ার তখনই মনে পড়ে যায় সেই গল্পটা—ডাইনি ও ঘড়ি। সেই ডাইনি করত কী, রোজ গভীর রাতে নিঃশব্দে তার মায়াবলে এক-একটা বাড়িতে ঢুকে পড়ত আর সেই বাড়ির ঘড়িটাকে জোরে চালিয়ে দিত, এত জোরে যে, সকালে সবাই ঘুম থেকে উঠে দেখত, বুড়ো হয়ে গেছে। সব চুল পাকা, গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে, চোখের দৃষ্টি মরে গেছে। দাঁত পড়ে গেছে। কোমর ভেঙে গেছে। কুকুরটা কবে মরে গিয়ে কঙ্কাল হয়ে পড়ে আছে বিছানার তলায়। সারা বাড়ি ঝুল আর ধুলোয় ভরে গেছে। বাইরের জগৎও পালটে গেছে কত। সময় চুরি করত সেই ডাইনি। মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস। বাদুড় যেভাবে ফল চোষে সেইভাবে চুষে নিত মানুষের সময়। তখন কী হল, সেই শহরের মেয়র মতলব বাতলালেন, রাতে কেউ আর যেন না ঘুমোয়। সারাদিন-রাত জেগে থাকো। তা এমনি তো জেগে থাকা যায় না। সবাই কাজ করো। সারাদিন-রাত শুধু কাজ। দেখতে দেখতে সেই ছোট্ট, শান্ত, নির্জন শহর বড় হতে লাগল। ধনে-জনে-সম্পদে-আলোয়। বিশাল থেকে বিশালতর। চারপাশে তার সমুদ্র। দূর থেকে জাহাজের নাবিকরা দেখতে পেত আলোর মালায় সাজানো সেই দেশ। বাতাসে ভেসে আসছে কনসার্টের সুর। মাথার আকাশে বাজি থেকে-থেকে রং-বেরঙের ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছে। সমুদ্রের ধারে সুন্দর-সুন্দর পোশাক পরে ছেলেমেয়েরা ঘুরছে। ঘুরছে নাগরদোলা। অমনি তারা বলত, ওই সেই হোলিল্যাণ্ড। হোলিল্যাণ্ড থেকে হয়ে গেল হল্যাণ্ড।
শিবশঙ্কর তালা খুললেন। সেই ওষুধ-ওষুধ গন্ধটা আরও বাড়ল। শিবশঙ্কর সবার আগে ঢুকে আলো জ্বালালেন। একটা হলঘর। মেঝেটা কালো কষ্টিপাথরের। চকচকে লম্বা একটা টেবিল মাঝখানে। চারপাশে ছ’টা চেয়ার। সমস্ত দেওয়াল জুড়ে শুধু বই আর বই। এপাশে-ওপাশে নানা মাপের শো-কেস। সেই সব কেসে দেশ-বিদেশের পুতুল। দেশের নাম লেখা রয়েছে, ডেনমার্ক, জার্মানি, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, চিন, রাশিয়া, আইসল্যান্ড, আফ্রিকা, সুইজারল্যাণ্ড, ভারত। ঠিক যেমন দেশ, তেমন পুতুল। সেইরকম সাজপোশাক। রঙিন ছাতা ধরা জাপানি গেইসা। স্পেনের বুলফাইটার। রাশিয়ার ব্যালেরিনা। চিনের ভুড়িঅলা। জার্মানির গায়ক। ইংল্যাণ্ডের রয়্যালগার্ড। আমেরিকার কাউবয়। হাঁ হয়ে যাওয়ার মতো দৃশ্য। প্রতিটি দেশের চরিত্র তাকে-তাকে সাজানো। ডেনমার্কের ফুলওয়ালি। কল্পনার জোর থাকলে ওই পুতুলগুলোর দিকে তাকিয়ে সেই দেশে চলে যাওয়া যায়। ডেনমার্কের ফুলের বাগানে, ইংল্যাণ্ডের বাকিংহাম প্যালেসে। জার্মানির কনসার্টে, আমেরিকার টেক্সাসে। জয় ভাবছে, দাদা এত দিন কেন ঢুকতে দেননি এই ঘরে, কারণটা কী! ঘরের শেষ মাথায় বড়-বড় দুটো কাচের আলমারি। তার তাকে-তাকে নানা মাপের কাচের জার। প্রতিটি জারে তরল পদার্থ। আর তাতে ভাসতে সরীসৃপের দেহ। বহুরকমের সাপ, লিজার্ড, বিছে, মাকড়সা, অদ্ভুত-অদ্ভুত চেহারার কীটপতঙ্গ সব। প্রত্যেকটার গায়ে নামের লেবেল, লাতিন ভাষায়। তারপর বই। এনসাইক্লোপিডিয়া, জেনারেল নলেজ, বিজ্ঞানের বই, অ্যাস্ট্রনমি, ফিজিকস, কেমিস্ট্রি, সাইকোলজি, এসপিডিশান, শিকার, জীবনী, দর্শন। কী নেই! সব আছে। কত বই এক জায়গায়। জয় আর জয়া চোখ ফেরাতে পারছে না।
শিবশঙ্কর ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বললেন, “এইসব তোমাদের। অনন্ত জ্ঞানভান্ডার। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। জানব, আমি আরও জানব। কলম্বাসের সমুদ্র-অভিযানের চেয়েও রোমাঞ্চকর। জ্ঞানসমুদ্রে ভেসে যাও। কত দেশ, কত জাতি, তাদের রীতি-নীতি, ভাষা, উৎসব, কত প্রাণী, গিরি-অরণ্য, সমুদ্র-আকাশ। সব এই ঘরে তোমাদের জন্য মজুত। শুধু ভেসে পড়ো। তোমাদের এই বয়সে বোঝার মতো সহজ বইও আছে।”
“দাদা আপনি এই ঘরটা সব সময় বন্ধ করে রাখেন কেন?” জয় প্রশ্ন করল।
শিবশঙ্কর হেসে বললেন, “তার একটা কারণ আছে দাদু। আমার বাবা ছিলেন মস্ত বড় শিকারি, আবার সে-যুগের সেরা একজন জীববিজ্ঞানী। ওই যে দেখছ কোণের বড় বাক্সটা, ওর মধ্যে অনেক ফায়ার আর্মস আছে, আর ওই আলমারিটায় আছে অনেক বিষ, যার এক কণা ছড়িয়ে গেলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ব, মারাও যেতে পারি, সেই কারণেই এই সাবধানতা।”
“তা হলে আমরা এই ঘরে আসব কী করে?”
“আমার সঙ্গে আসবে, বই নিয়ে চলে যাবে। থাকবে না বেশিক্ষণ।”
“কী কী অস্ত্র আছে দাদা?”
“প্রায় সবরকম। এখানে বাবার সময় খুব ডাকাতি হত, আর হত রায়ট। আত্মরক্ষার জন্য বাবাকে সবই রাখতে হয়েছিল। এটা কিন্তু খুব গোপনীয়, তোমরা কাউকে বলবে না। অস্ত্র রাখা এখন বেআইনি। কিন্তু কী করব! বাবার স্মৃতি। ওইসব প্রাচীন অস্ত্র এখন আর পাবে না, জাদুঘরে রাখার মতো। লোভ ছাড়া যায় না। ভবিষ্যতে তোমরা বড় হয়ে জাদুঘরে দান করে দিয়ো। নাও চলো, রাত অনেক হল।”
জয় বলল, “বাবা কেন আসেন না এই ঘরে?”
“তোমার বাবার কথা আর বোলো না। মহা ভিতু। তার নাকি ওই সাপগুলোকে দেখলে শরীর কেমন করে, রাতে ঘুম আসে না। ওর আবার ভয়ঙ্কর ভূতের ভয়। এই বয়সেও ভূত দেখতে পায় যেখানে-সেখানে। কী বলবে বলো। আমার সারা জীবনটাই তো ভূতের সন্ধানে কেটে গেল, একটিবারের জন্যও দেখা মিলল না। ভূত আর ভগবান, দুইই সমান। কৃপা না করলে দর্শন মেলে না।”
জয়া বলল, “এদিকটায় এলেই কিন্তু গা-ছমছম করে। কেমন যেন মনে হয়।’’
“সে তোমার ওই পুরনো জিনিসপত্তরের জন্য। দেখবে, একটা পুরনো আমলের আলমারি, কি খাট, কি টেবিল দেখলেও গা-ছমছম করবে। সেইজন্য আমার ব্যাখ্যা হল, অতীতই ভূত। বর্তমানের সঙ্গে যা বেমানান, সেইটাই ভূত।”
জয় বলল, “আর ওই কাচের দরজাঅলা ঘরটা! ওটা কী দাদা! ওখানে কী হত?”
“ওই ঘরটার খুব একটা স্টোরি আছে। তোমরা এখানে শুনলে ভয় পাবে। নীচে চলো, বলব।”
॥ ২১ ॥
খড়ক সিং সেই যে বেরিয়েছিলেন, তারপর হাঁটতে-হাঁটতে গান গাইতে-গাইতে সোজা স্টেশনে। সে কম দূর নয়, অনেকটা পথ। মাঝারি গতিতে হাঁটলে পাক্কা এক ঘণ্টা। এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট লাগল। সিংজির পকেটে একটা পকেট-ঘড়ি সব সময় থাকে। পুরনো আমলের জিনিস। ঘড়িটা নিয়ে সিংজির ভীষণ অস্বস্তি। ঘড়িটা সোনার। ডায়ালের রংটা সমুদ্রের জলের মতো সবুজ। সোনার কাঁটা। এত দামি ঘড়ি পকেটে রাখতে ইচ্ছে করে না। যে-জিনিস অন্যের লোভ জাগায়, সে-জিনিস রাখা কেন বাপু! চোর কেন চুরি করে? তোমার অনেক আছে, তার কিছু নেই বলে। তোমার নেই, তার নেই, আমার নেই, কোনও ঝামেলাই নেই। খড়ক সিং যখনই ঘড়ি দেখেন, লুকিয়ে দেখেন, যেন মহা অপরাধ করছেন।
কুড়ি মিনিট বেশি লাগার কারণ, সিংজির হঠাৎ চা খেতে ইচ্ছে করেছিল। পথের পাশে দেহাতি দোকান। একজন লরি ড্রাইভার বসে-বসে চা খাচ্ছিলেন, তিনি সিংজির চেহারা আর পোশাক দেখে ভেবে নিলেন, ইনি একজন মস্ত গুনিন। এ-কথা, সে-কথা হতে-হতে পেড়ে ফেললেন নিজের অসুখের কথা। পেটের কাছে মাঝে-মাঝেই কী একটা ঠেলে ওঠে বলের মতো। তখন আর খাড়া থাকা যায় না, শুয়ে পড়তে হয়। সিংজি এতই ভদ্র যে, পাছে লোকটি ভুল ভাবার জন্য বিব্রত হয় তাই অস্বীকার করতে পারলেন না। না বললে লোকটির আশাভঙ্গ হবে তাই সিংজিকে গুনিন সাজতে হল।
সিংজি বললেন, “তা হলে চা খাচ্ছ কেন?”
“চায়ের জোরেই যে আমার গাড়ি চলে। চা হল ইস্টিম।”
কথাটা একেবারেই বেঠিক নয়। বড়লোকরা দিনে দু’বার খায়, সকালে আর বিকেলে। গরিব লোকেরা বারেবারে খায়। সিংজি নিজেই তো তিরিশবার খায়। পরীক্ষার জন্য শিরা থেকে রক্ত টানলে রক্তের বদলে চা আসবে। যেভাবেই হোক পেটের ব্যাপারটা সিংজি ভালই বোঝেন। সেটা ওই নিজের পেট বুঝতে-বুঝতে হয়েছে। হাকিমের কাছে গেছেন, তাঁদের কথা শুনেছেন, অসুখ না সারুক নিজের জ্ঞান বেড়েছে। ওইজন্য বলে, ভাল ডাক্তার হতে হলে ভাল রোগী হও আগে।
“তা তোমার পেট খালি থাকলে হয়, না যখন ভর্তি থাকে?”
“খালি থাকলে হয়।”
সিংজি বললেন, “শুয়ে পড়ো।”
লোকটি বেঞ্চের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। সিংজি পেটটা খানিক টেপাটিপি করলেন আচ্ছাসে। সেটা না করলে লোকটির বিশ্বাস আসবে না। পরীক্ষার শেষে বললেন, “এক চামচে কাঠকয়লার গুঁড়ো মধু দিয়ে মেড়ে রোজ সকালে খাও। তোমার পেট আচ্ছা হয়ে যাবে।”
লোকটি উঠে বসে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সিংজির মুখের দিকে। এমন ওষুধ সে জীবনে শোনেনি। সিংজি বললেন, “সারতে ঠিক সাতদিন লাগবে।”
লোকটি কিছুটা বিশ্বাস, কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে তার গাড়িতে উঠে চলে গেল। চলে যাওয়ার পর দেখা গেল হয় সে ইচ্ছে করে চায়ের দাম দেয়নি, নয়তো কাঠকয়লা খাওয়ার আতঙ্কে ভুলে গেছে। খড়ক সিং দোকানের মালিককে বললেন, “কোঈ বাত নহি, আমি দিয়ে দিচ্ছি।”
দোকানের মালিক সসম্রমে জিজ্ঞেস করলেন, “জি, আপনি হাকিম আছেন?”
সিংজি মুচকি হাসলেন। মিথ্যে কথা বলাটা ঠিক হবে না। আবার এটাও ঠিক, হাকিম যে নই তাই বা কী করে বলা যায়! অনেকরকম ওষুধ তো সত্যিই জানা আছে। সেসব ওষুধ অবশ্য খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। কোথায় কোন জঙ্গলে, কোন পাহাড়ে হয়ে আছে কে জানে!
দোকানদার বললেন, “হাকিমজি! আমার একটা অসুখ ভাল করে দিতে পারেন!”
“কী অসুখ?”
“আমার রাতে ঘুম হয় না। সারারাত জেগে থাকি।”
এইসব ওষুধ সিংজির একেবারে মুখস্থ, একটুও ভাবতে হয় না। বললেন, ‘‘চন্দন বাটা খাও, রোজ সকালে। আর সূর্য ওঠার আগে সরলা নদীতে চান করো, আর যত পারো লাউ, ঢ়্যাঁড়স খাও। রোজ কমসে কম তিন মাইল জোরে-জোরে হাঁটো। আমি ফিরে এসে খবর নেব, তুমি কেমন আছ!”
সিংজি পয়সা বের করলেন, লোকটি কিছুতেই নিল না। সিংজির মহা বিপদ। তিনি কারও কাছ থেকে কিছু নেন না। এইটা তাঁর একটা ধর্ম। এখন জোর করে দিলে লোকটি দুঃখ পাবে। সিংজি দু’ কাপ চায়ের দাম উনুনের ধারে চুপিচুপি চোরের মতো রেখে পালিয়ে এলেন।
বেশ লাগছিল শেষ বেলায় হাঁটতে। সারাদিনের গরমের একটা গন্ধ বেরোচ্ছে। উত্তপ্ত পাথর, পাতা, ফল-ফুলের গন্ধ। পৃথিবীটা ভয়ঙ্কর রকমের সুন্দর বলে খড়ক সিং গান ধরেছেন। গাইতে-গাইতে চলেছেন। রাস্তাটা উঁচু। দু’পাশ ঢালু হয়ে দিগন্তবিস্তৃত মাঠে গিয়ে মিশেছে। সেখানে ছাই রঙের আলো। জায়গায়-জায়গায় কালো পাথরের স্তর। পাহাড় হতে-হতে থেমে গেছে। এই কচি পাহাড় বা পাহাড়ের সম্ভাবনা দেখতে সিংজির খুব ভাল লাগে। কখনও যদি জোর ভূমিকম্প হয়, তা হলে হয়তো আবার ঠেলে উঠতে থাকবে। এইরকমই নাকি হয়। একজন পণ্ডিত মানুষ একবার ট্রেনে যেতে-যেতে পৃথিবীর অনেক গোপন খবর দিয়েছিলেন। আকাশের অনেক রহস্যের কথা বলেছিলেন। পৃথিবী সব সময় ভেতরে-ভেতরে থরথর করে কাঁপছে। সেই কাঁপনে সমুদ্রের তল উঁচু হয়, নিচু হয়। সমভূমি হঠাৎ ওপর দিকে ঠেলে উঠতে থাকে। মানুষ এর কিছুই তেমন জানতে পারে না। কত তারা হঠাৎ মরে যায়। আকাশেও তৈরি হয় গভীর গর্ত।
খড়ক সিং এইসব ভাবতে-ভাবতে, নিজের সঙ্গে কথা কইতে-কইতে, গান গাইতে-গাইতে স্টেশনে পৌঁছে গেল। ছোট্ট স্টেশন, কিন্তু খুব সুন্দর। নদীর নামেই স্টেশনের নাম—সরলা। বড়-বড় ইউক্যালিপ্টাস গাছ। দেখলেই মনে হয়, কেউ যেন ঠাকুদা, কেউ যেন বাবা, জ্যাঠামশাই, কাকা। কোনওকালে বেড়াতে এসে, এইখানে সব স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কৃষ্ণচূড়া বাতাস করছে। অর্জুন পাহারা দিচ্ছে। এই স্টেশন থেকে ছোট একজোড়া লাইন দূর এক জঙ্গলে চলে গেছে। এককালে সেখানে বড়-বড় কাঠের ব্যবসা ছিল। এখন কাঠকাটা বন্ধ হয়ে গেছে সরকারি আইনে। ছোট রেলে চেপে লকড়ি আর আসে না। মাঝে-মাঝে পাথর আসে। কালো, সাদাটে। আর আসে গোরু, ভেড়া, ছাগল। শীতের সময় সবজি আসে।
একপাশে মাস্টারমশাইয়ের ঘর, তারবাবুর ঘর। চারপাশটা বেশ সবুজ ঘাসে ঢাকা। ছোট-ছোট ফুল গাছ, পাতাবাহার গাছ। একটা তিতকুটে গন্ধ। গন্ধটা বেশ ভালই লাগে সিংজির। কোনও একটা গাছের গন্ধ। কী গাছ, তা জানা নেই। বনতুলসী হতে পারে। ভাঁটফুল হতে পারে। গন্ধটার একটা বেশ মাদকতা আছে। মাস্টারমশাই খাতাপত্তর দেখছেন, তারবাবু টরেটক্কা। এই যন্ত্রটা খড়ক সিং ভীষণ ভালবাসে। কত দূরে কে একজন বসে আছে, কোন শহরে কোন জেলায় টরেটক্কার ভাষায় তার সঙ্গে কথা হচ্ছে।
মাস্টারমশাই মুখ তুলে বললেন, “আরে সিংজি যে, আবার কোথায়! বইঠিয়ে। ট্রেন তো চলে গেছে অনেকক্ষণ, আজ তো আর এদিকে ট্রেন নেই বাবুজি!”
খড়ক সিং একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। ছোট স্টেশন। সব ট্রেন সবদিক থেকে আসে না এখানে, এখান থেকে প্রথমে যেতে হবে পটনায়। সেখান থেকে যেখানে যাবে যাও।
তারবাবু বলেন, “খড়কজি, একটা রেক আসছে, রাত ন’টার সময় এখান দিয়ে পাস করবে। ছোট লাইন ধরে ডুমডুমায় যাবে, আপনি একবার বলেছিলেন, ওইদিকটা দেখতে ইচ্ছে করে। বলেন তো তুলে দিই। একেবারে খালি। বকরি আর শালপাতা আনতে যাচ্ছে।”
খড়ক সিং লাফিয়ে উঠলেন। ডুমডুমা! সেই লাইন! জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। গভীর ঘন জঙ্গল। কোনও লোকালয় নেই। শুধু গাছ আর গাছ। দিনের বেলাতেও অন্ধকার। একটা দুটো আদিবাসী গ্রাম। মাঝেমধ্যে বাঘ বেরোয়। বুনো শূকর। ডুমডুমা পৌঁছতে তা প্রায় ঘণ্টা পনেরো লাগবে।
খড়ক সিং তবু বললেন, “আমি যে কাশ্মীর যাব বলে বেরিয়েছি।”
তারবাবু বললেন, “সে তো সবাই যায়, যে-কোনও সময় যাওয়া যায়, ডুমডুমায় ক’জন যেতে পারে।”
একেবারে খাঁটি কথা। লাখ কথার এক কথা। খড়ক সিং খুব যে সাহসী, তা বলা যায় না। ভূতের ভয় তো আছেই, সেটা কিছু নয়। অনেক বড়-বড়, নামকরা মানুষের ভূতের ভয় আছে। বাঘ-ভাল্লুককে সে ভয় পায় না, ভয় পায় ছোট-ছোট কিম্ভুতকিমাকার পোকাকে। এইসব পোকা জঙ্গলে প্রচুর। রাত্তিরবেলা তিষ্ঠোতে দেয় না। তবে একটা কথা আছে। খড়ক সিং ভয় পেতে ভীষণ ভালবাসেন। সেই কারণেই ভয়ের জায়গায় ছুটে-ছুটে যান। ভয়ে শরীর হিম হয়ে যায়, সেটাই আনন্দের।
খড়ক সিং বললেন, “হ্যাঁ আমি যাব। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে।”
“তা হলে ঠিক ন’টার সময় এখানে হাজির থাকবেন।”
“বহত আচ্ছা।”
মাস্টারজি বললেন, “রাতের খাওয়াটা তা হলে কোথায় হবে!”
সিংজি বললেন, “সে যা হয় হবে।”
“আপনি আমার কোয়ার্টারে চলুন। আমি এখনই যাব।”
মাস্টারজি একা মানুষ। ত্রিভুবনে কেউ নেই। ঘরে একটা খাটিয়া, একটা কুঁজো, মুখে গেলাস চাপা। মোটা একটা শতরঞ্জি। একটা চুলা। এক সেট থালা-বাসন। চুলা ধরাতে-ধরাতে মাস্টারজি বললেন, “কাল দুপুরে পৌছবেন, সঙ্গে দশখানা রুটি অন্তত থাকা চাই, আর গুড়। জল তো নিতেই হবে। তা হলে হিসেবটা হয়ে যাক। এখন আপনার দশ, আমার দশ, কাল সকালে আমার পাঁচ, আপনার দশ, মোট পঁয়ত্রিশ, তার মানে চল্লিশ, চল্লিশখানা রুটির মতো আটা বের করে আপনি মেখে ফেলুন, আমি ততক্ষণে ডালটা তৈরি করে ফেলি। দুধ চাই নাকি, দুধ?”
সিংজি বললেন, “দুধ এখন পাবেন কোথায়?”
“ব্যবস্থা আছে, আছে। ওই ওপাশে আমার ছাগল আছে, দুয়ে নিয়ে এলেই হবে। ডালটা চাপিয়েই যাব। তবে একটা কথা, ছাগলের মেজাজ যদি খারাপ থাকে, দুধ হবে না। সে-কথা আগেই বলে রাখছি।”
সিংজি আটা মাখতে বসলেন। এই কাজটা সিংজি ভালই পারেন। তাঁর কুস্তির গুরু শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, খড়ক, কুস্তি শেখার আগে আটা ঠাসা শেখ। কনুই দিয়ে আটার তালে রদ্দা মারবি। সেই রদ্দাই পরে লড়াইয়ের সময় লাগাবি। ময়দার মতো ঠাসবি প্রতিপক্ষকে।
ডালে একহাতা খাঁটি ঘি ঢেলে দিলেন মাস্টারজি। গন্ধে মাত হয়ে গেল চারপাশ। দরজার বাইরে শুয়ে আছে একটা কুকুর। সিগারেটের যেমন দুটো মাপ হয়, নর্মাল সাইজ আর কিং সাইজ, কুকুরটারও তেমনই কিং সাইজ। ডাল, রুটি খেয়ে-খেয়ে এইরকম হয়েছে। পাঁচখানা রুটি তার বরাদ্দ, এক বাটি ডাল, এক কাপ দুধ। তারপর একটা কবিরাজি গুলি খেয়ে, সামনের কম্পাউন্ডের বকুলতলায় দুর্গা বলে শুয়ে পড়ে। কারও সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদ নেই। ভগবানের নাম নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। গলায় আবার একটা মাদুলি।
মাস্টারজি দুধ দুইতে গেছেন। সিংজি হাতে চাপড় মেরে-মেরে, দু’পাশে দুলিয়ে-দুলিয়ে রুটি গোল করছেন। চুলায় গনগনে আগুন। হঠাৎ একটা হুড়মুড় করে আওয়াজ। মাস্টারজির গলা, “মর গিয়া, মর গিয়া।” কুকুরটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে আওয়াজের দিকে ছুটল ঘেউ-ঘেউ করতে করতে। সিংজি গান গাইছিলেন। গান থেমে গেল। অন্ধকারে ঝটাপটির শব্দ।
॥ ২২ ॥
ঘোর অন্ধকার। কেরোসিন তেলের গন্ধ। খড়ক সিং বুঝতে পারছেন না, ব্যাপারটা কী হল। কুকুরটা সমানে চিৎকার করছে। খড়ক সিং এইবার একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “আরে বেটা চিল্লাতা কিঁউ।” তারপর চিৎকার করে ডাকলেন, “মাস্টারজি।” অন্ধকারে একটা চ্যাটাই পড়ে ছিল, তার তলা থেকে ভেসে এল ক্ষীণ কণ্ঠস্বর, “হাঁ জি। আমাকে মেরে ফেলেছে।”
মেরে ফেললে কেউ কথা বলতে পারে না। মাস্টাজির ছাগল খুব খারাপ মেজাজে ছিল। মেরেছে শিঙের গুঁতো। তাতেও শান্তি হয়নি। মেরেছে জোড়াপায়ে লাথি। লণ্ঠনটা একপাশে ছিটকে চলে গেছে। ছাগল তার ঘরের দরমাটরমা ভেঙে বেরিয়ে চলে গেছে। সে যাক। রাগ পড়লে আবার ফিরে আসবে। আপাতত মাস্টারজি আহত। বুকে চোট লেগেছে। কেটেকুটে গেছে।
সিংজি ধরে-ধরে ঘরে নিয়ে এলেন। কপালের একটা পাশ আলুর মতো ফুলেছে।
“এই বদমেজাজি ছাগলটা রেখেছেন কেন?”
“রাখব কেন? ছাগলটা নিজের থেকেই রয়েছে। আমি তো বলেই দিয়েছি, তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। তবু কি শোনে! ঠিক ফিরে আসে। ফিরে এলে কী করব! অতিথিকে না খাইয়ে রাখব! এমন নয় যে, দুধ দিতে পারে না! ইচ্ছে করলেই পারে, আসলে সেই ইচ্ছেটাই নেই।”
“ওষুধ-বিসুধ কোথায় আছে বলুন, লাগিয়ে দিই।”
“ওষুধ কিছু নেই, উনুন নিবে গেলে ছাই লাগিয়ে দোব। সবচেয়ে ভাল ওষুধ। রুটিগুলো আগে করে ফেলি, ট্রেন আসার সময় হয়ে গেল।”
মাস্টারজি উনুনে চাটু বসালেন। সিংজি বললেন, “কেন তকলিক নিচ্ছেন, আমি তো বানাচ্ছি। এসব কাজ আমার খুব ভাল আসে। প্রতাপ সিং আমার গুরু ছিলেন। কুস্তি শেখাতেন। তাঁর আখড়ায় রোজ রাতে আমাকে দুশো রুটি তৈরি করতে হত। পহেলবানদের খানা তো আপনি জানেন। ডেলি চল্লিশ সের, পঞ্চাশ সের। যতবড় পহেলবান তত ভারী খানা। শেষকালে হাতির সঙ্গে কমপিটিশন।”
এইরকম সব কথা হতে-হতে দশখানা রুটি নেমে গেল। অড়হরকা ডাল, গরমাগরম রোটি আর আচার। মাস্টারজি একটা ঢেকুর তুললেন, ঠিক যেন বাছুরের ডাক। এই ঢেকুর যতক্ষণ না উঠছে ততক্ষণ খাওয়াই হল না। খডক সিং মাপমতো খেলেন, তারপর বজ্রাসনে বসে কাঠের চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়ালেন। এইসব ছোটখাটো টোটকা গুরুর কাছ থেকে পাওয়া। বজ্রাসনে বসলে হজম হয়, চুল আঁচড়ালে টাক পড়ে না কোনওদিন, চুলে পাক ধরে না সহজে। মাস্টারজির এসব জানা ছিল না। হজমের কোনও গোলমাল এখনও পর্যন্ত নেই। এই অঞ্চলের জলে লোহা পর্যন্ত হজম হয়ে যায়, তবে চুল ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে। সামনের দিকটায় টাক পড়ার ভাব হচ্ছে। মাস্টারজিও কিছুক্ষণ বজ্রাসনে বসে রইলেন।
ট্রেন আসার সময় হয়ে গেল। ঘরের জানলা দিয়ে স্টেশন দেখা যাচ্ছে। নির্জন, নিরালা। একটি মাত্র বাতি জ্বলছে। কেমন একটা মায়া। এই রেকটা পাশ করিয়ে দিতে পারলেই মাস্টারজির ছুটি। তখন তিনি খাটিয়া ফেলে শুয়ে পড়বেন। শুয়ে শুয়ে ছেলেবেলার কথা ভাববেন। সাহেবগঞ্জের সেই বাড়ি, বাগান, গঙ্গার ধার, পাহাড়, পাহাড়ের মাথায় রাতের বেলা আগুনের রেখা। ঘাসে আগুন ধরিয়ে দিত দেহাতিরা। বাবার কথা মনে পড়বে। ফরসা, টকটকে চেহারা। কালো কোট পরে ওকালতিতে যেতেন। মায়ের কথা মনে পড়বে। সন্ধেবেলা রামচরিতমানস পড়তেন সুর করে। মনে পড়বে দিদির কথা। এইসব ভাবতে-ভাবতে মাস্টারজি ঘুমিয়ে পড়বেন। তখন দূরে বহুদূরে, নদী, পাহাড়, জলজঙ্গল টপকে ছুটছে মেলট্রেন ডিহরি-অন-সোন, দেরাদুন, দিলসাদগঞ্জ। কত কত দেশ, কত লোক, কত ভাষা!
থালাবাসন, ঘটি, গেলাস সব একপাশে পড়ে রইল। খড়ক সিংয়ের রুটি আর গুড়ের প্যাকেট তৈরি। এইবার খাওয়ার পালা। মাস্টারজি পাঁচখানা রুটি আলাদা করে রেখেছিলেন। সেই রুটি পাঁচখানা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।
খডক সিং জিজ্ঞেস করলেন, “কাকে দেবেন? স্টেশনে কেউ আছে?”
মাস্টারজি ধরা-ধরা গলায় বললেন, “সে যদি ফিরে আসে তা হলে খাবে কী?”
“কার কথা বলছেন? এত রাতে আর কে আসবে?”
“আমার ছাগল। ফিরে সে আসবেই। আমাকে ছেড়ে যাবে কোথায়! রাগ করে গেছে। রাগ কমে গেলেই ফিরে এসে আমাকে খুঁজবে। মাস্টারজি, মাস্টারজি বলে ডাকবে। আমাকে ভীষণ ভালবাসে যে।”
মাস্টারজি সেই ভাঙা ঘরে একটা পাত্রে ছাগলটার জন্যে রুটি আর গুড় রাখলেন, তারপর স্টেশনের দিকে যেতে-যেতে বললেন, “সিংজি, পৃথিবীতে সকলের কথাই ভাবতে হয়, সকলকে নিয়েই থাকতে হয়। এ হল মেলামেশা, ভাব-ভালবাসা, বন্ধুত্বের জায়গা।”
সিংজি বললেন, “সে আর আপনি আমাকে কী বলবেন! আমি তো সেই ছেলেবেলা থেকেই এই কথা বিশ্বাস করে আসছি, আর সব ছেড়ে পথে-পথে ঘুরছি। লোকে ধন, অর্থ কত কী পায়, আমি পেয়েছি মানুষ আর মানুষের ভালবাসা।”
লোহার বেড়া টপকে দু’জনে প্ল্যাটফর্মে এসে গেলেন। মাস্টারজির ঘরে একটা ব্যস্ততা। রেকটা আসছে। তারবাবু আগের স্টেশনের সঙ্গে বার্তাবিনিময় করছেন। লাইনম্যান চলে গেছেন তাঁর গুমটি ঘরে। সিগন্যাল-রুমে সিগন্যাল ম্যান। একটা ট্রেন আসা কি সহজ কথা। খড়ক সিংয়ের এইসব দেখতে ভীষণ ভাল লাগে। সিগন্যালের পাখা পড়ে গেছে। জ্বলে উঠেছে সবুজ আলো। লাইনের পাশ দিয়ে যে দু’সার তার চলে গেছে, সেই তারে ঝাঁঝ একটা শব্দ। মাস্টারজির এখন অন্য চেহারা। রেলকোম্পানির সেই অদ্ভুত কোটটা গায়ে চাপিয়েছেন। কাগজপত্র রেডি করছেন। সেই একটু আগের ছেলেমানুষি ভাবটা আর নেই। এখন তিনি পুরোপুরি ইস্টিশন মাস্টার।
খড়ক সিং প্ল্যাটফর্মে খাড়া। কাঁধে সেই লাঠি-পুঁটলি। ট্রেন আসছে পিলপিল করে। পুরনো আমলের এঞ্জিন। ট্রেন ঢোকার পথে ছোট একটা পাহাড়মতো ছিল। সেটাকে ডিনামাইট দিয়ে ফাটিয়ে লাইন পাতা হয়েছে। দু’পাশে খাড়া পাথরের দেওয়াল। ট্রেন আসছে। এঞ্জিনের গুমগুম ঝঙ্কার। প্ল্যাটফর্মে ট্রেনটা ঢুকে জোরে একটা শ্বাস ফেলে হাঁফাতে লাগল। কত পথ পার হয়ে এল, ক্লান্ত তো হবেই। এঞ্জিন থেকে ফায়ারম্যান আর ড্রাইভার নেমে এলেন। অনেক পেছনের বারান্দাওলা ছোট্ট কামরা থেকে নামলেন কালো কোট, সাদা প্যান্ট পরা গার্ডসাহেব। তিনি এগিয়ে আসছেন। ফায়ারম্যান আর ড্রাইভারের মাথায় নীল টুপি। সিংজি একপাশে দাড়িয়ে ছোটাছুটি দেখছেন। সবচেয়ে শান্ত ফায়ারম্যান আর ড্রাইভার। ফায়ারম্যান হাতের তালুতে খইনি ডলছিলেন, কিছুটা ড্রাইভারকে দিয়ে বাকিটা নিজের ঠোঁটের নীচে টিপে দিলেন। বয়লারে আগুন ভলভল করছে। লাল আভা গনগন করছে।
স্টেশনমাস্টার গার্ডসাহেবের সঙ্গে কথা বলতে-বলতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। সোজা সিংজির কাছে।
গার্ডসাহেব বললেন, “আপনি তা হলে আমার ভ্যানে চলুন। দু’জনে গল্প করতে-করতে যাওয়া যাবে।”
সিংজি বললেন, “আমি খোলা রেকে শুয়ে-শুয়ে যাব, আকাশ দেখতে-দেখতে, তারা দেখতে-দেখতে।”
“বাবুজি, সেটা ঠিক হবে না। মাস্টারজির আত্মীয় মানে আমারও আত্মীয়। ঘন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ট্রেন যাবে। গাছের ডালে-ডালে সাপ ঝুলে থাকে। বিষাক্ত-বিষাক্ত পোকা, জন্তু জানোয়ার, আপনার বিপদ হতে পারে সিংজি!”
সিংজিকে কিছুতেই ভয় পাওয়ানো গেল না। তখন ঠিক হল, এঞ্জিনের ঠিক পরের রেকটাতে সিংজি থাকবেন। বড় মাপের বিপদ হলে চিৎকার করবেন। সিংজির শরীর একেবারে ফিট। কোনও সাহায্য ছাড়াই রেকে উঠে পড়লেন। তিনবার বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল। মাস্টারজি হাত নাড়াচ্ছেন। চিৎকার করে বললেন, “সাবধানে যাবেন।”
সিংজির পুঁটলিতে একটা কম্বল তো থাকেই। মোটা পাহাড়ি কম্বল। রেকের মেঝেতে সেটা বিছিয়ে ফেললেন। তারপর পুঁটলিটা মাথায় দিয়ে শয়ন। পাশে পাহারাদার লাঠি। ট্রেনের গতি বাড়ছে। ছোট-ছোট টিলা, পাথুরে প্রান্তর ছেড়ে ট্রেন এইবার জঙ্গলে ঢুকবে। সরলা নদীর ওপর রেলব্রিজে উঠছে। সিংজি শুয়ে-শুয়ে আশপাশের বিশেষ কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না। রেকের ইস্পাত দেওয়ালে দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। সিংজি দেখছেন, আকাশ, ছড়ানো ছেটানো তারা। ট্রেন যত জোরেই ছুটুক আকাশের শেষ নেই। একটা পাহাড় পাশ দিয়ে ছুটে পালাতে পারে, তারা তা পারে না। কালপুরুষ সেই একই জায়গায় একইভাবে থেকে সিংজিকে দেখছে। একটুও স্থান পরিবর্তন হয়নি।
ট্রেন জঙ্গলে ঢোকার মুখে একবার থামল। এখানে একটা হল্ট আছে। সিংজি উঠে দাঁড়ালেন। ছোট্ট তিনটে কাঠের বাড়ি। তিনটি পরিবার থাকে। এঁরা রেলের কর্মচারী। একটা গোরু শুয়ে আছে। বেশ শক্তসমর্থ ইউনিফর্ম-পরা একজন মানুষ ছুটতে-ছুটতে গিয়ে গার্ডের ভ্যানে উঠে পড়লেন। তাঁর কাঁধে একটা বন্দুক। বন্দুকটা দেখে সিংজির বিশ্বাস হল, জঙ্গলটা তা হলে সত্যিই বিপজ্জনক। কপালে থাকলে বড়মামার সঙ্গে মোলাকাত হয়ে যেতে পারে। সবচেয়ে ভাল লাগছে এই তিনটে কাঠের বাড়ি। জঙ্গলের মুখে। সবুজ ঘাসে ঢাকা জমি। টিংটিং আলো। দু-চারটে বড় বড় অতি প্রাচীন গাছ। শান্ত, নিরালা। জানা রইল, কাশ্মীর, কান্দাহারে না গিয়ে এই জায়গাটায় বারেবারে আসা যায়। চুপচাপ বসে থাকো। বসে বসে দ্যাখো, প্রকৃতির খেলা। ফেরার সময় এই জায়গাটায় নামতে হবে। বাড়ির সব বাসিন্দারা রেল দেখার জন্য এত রাতেও বাইরে বেরিয়ে এসেছে। যেন কোনও উৎসব হচ্ছে। একটা তাগড়া কুকুর এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে খেলছে। ট্রেন দেখে খুব আনন্দ হয়েছে।
ট্রেন ছোট্ট একটা সিটি দিয়ে যাত্রা শুরু করল। সিংজি আবার কম্বলে বসে পড়লেন। এইবার সেই ভয়ের এলাকা। যদি এমন হয়, একটা কেঁদো বাঘ লাফিয়ে এই রেকের ওপর এসে পড়ে! আবার যদি এমন হয়, ছটাং করে একটা সাপ ছিটকে এল গাছের ডাল থেকে। ভয় পেতে যে কী মজা লাগে। সিংজির মনে হল, একটু গান গাইলে কেমন হয়! না, সেটা ঠিক হবে না। জঙ্গল এখন ঘুমোচ্ছে। বিরক্ত হবে। সিংজি পুঁটলি মাথায় দিয়ে আবার শুয়ে পড়লেন। বেশ একটা ঠাণ্ডার ভাব। গাছপাতার গন্ধ। আকাশ এইবার ছোট হয়ে আসছে। ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। বড় বড় গাছের শাখাপ্রশাখায় ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। ট্রেন এইবার বেশ জোরেই ছুটছে। ট্রেনও ভয় পায়!
সিংজি স্থির হয়ে শুয়ে আছেন ছ’ ফুট লম্বা একটা শরীর। পাশে শুয়ে থাকা লাঠিটাও ওইরকম লম্বা। সিংজি মাঝে-মাঝে গান গান, আমরা দুটি ভাই, শিবের গাজন গাই। তুমি আর আমি। তোমার আমি, আমার তুমি। হাত দিয়ে দেখে নিলেন লাঠিটা ঠিক আছে কি না! ঝুমঝুম শব্দে গাছের শাখাপ্রশাখা মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। ডেলা-ডেলা অন্ধকার ঘুরপাক খেতে-খেতে এসে দূরে ছিটকে চলে যাচ্ছে। খ্যাখ্যা করে ডাকছে হয় কোনও পশু, না হয় কোনও পাখি। একেবারে অচেনা একটা জগতের মধ্যে দিয়ে ছুটছে লৌহদানব। টেনিসবলের মতো ভাসমান আলো। সিংজি জানেন ওই আলোর বলগুলো হল জোনাকি। অনেকদূরে একসঙ্গে অনেক শেয়াল ডেকে উঠল। হয়তো বাঘ দেখেছে। জঙ্গলের একটা জায়গায় বাতাস মনে হল ভীষণ গরম। খড়ক সিং ব্যাপারটা বোঝার আগেই ট্রেন সেই জায়গাটাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল। তারাদের অবস্থান দেখে মনে হল রাত অনেকটা এগিয়ে গেছে ভোরের দিকে। দুটো কি তিনটে হবে মনে হয়।
সিংজির তন্দ্রামতে এসেছিল। কিছুটা সময় বোধ হয় ঘুমিয়েও ছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মনে হল বুকের ওপর ভারীমতো কী একটা রয়েছে। বেশ নরম-নরম। অন্ধকারে ঠাহর হচ্ছে না। হাত দিয়ে দেখতে গিয়ে হাত সরিয়ে নিলেন।
॥ ২৩ ॥
একটা ভয়। প্রথমেই খড়ক সিং যেটা ভাবলেন, সেটা হল, বিষাক্ত একটা সাপ কুণ্ডলি পাকিয়ে বুকের ওপর শুয়ে আছে। একটু নড়াচড়া করলেই শপাং করে ছোবল মারবে। এদিকে এঞ্জিন বেশ জোরেই ছুটেছে। রেকগুলোয় ঘটঘটাং শব্দ হচ্ছে। কোথাও একটা চেন ঝুলছে, সেই চেনের শব্দ। জঙ্গল আরও গভীর হয়েছে। যাকে বলে ডেন্স ফরেস্ট। আকাশটাকাশ আর দেখা যাচ্ছে না। শুধু ডালপালার ছাউনি। রাত কত হল আন্দাজ করা মুশকিল। গাছের ফাঁকে-ফাঁকে অন্ধকারের খেলা, সেই অন্ধকারে প্রেতিনীর নিশ্বাসের মতো ফিকে ধোঁয়ার সুতো। সারাদিন মাটি যে জল ছেড়েছে, শেষরাতের ঠাণ্ডায় তা বাষ্প হতে শুরু করেছে। ভোরের দিকে বনভূমি কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। কোথায় একটা ‘ওঁয়া, ওঁয়া’ শব্দ হয়ে মিলিয়ে গেল। সিংজির এই ভয়টা ভীষণ ভাল লাগে। ভয়ে দম আটকে আসে, শরীর থ্যাসথ্যাসে, গলা দিয়ে শব্দ বেরোয় না ; কিন্তু উপভোগ্য।
বুকের ওপর নরম প্রাণীটা সিংজির কুর্তা খামচে ধরে আছে। মনে হচ্ছে চারটে ছোট-ছোট পা। তা হলে সাপ নয়, অন্য কিছু। সেটা কী! এলই বা কোথা থেকে! সিংজি পুঁটলি মাথায় দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আছেন। ট্রেন দুলছে। জীবটাও বুকে বসে দুলছে। সিংজির হাত দুটো স্পর্শ নেওয়ার জন্য এগোচ্ছে, আবার পিছিয়ে আসছে ভয়ে। কোথাও মেঘ ডাকার মতো ভয়ঙ্কর একটা শব্দ হল। মেঘ না বাঘ! না অন্য কোনও প্রাণী! মেঘ হলেও মেঘ নয়। মেঘ ভেবে নিলে তো সব রহস্যেরই শেষ। অজানা কোনও ভয়ঙ্কর প্রাণী ভেবে নিতে পারলে আরও ভাল হয়। দৈত্য, রাক্ষস! এই জঙ্গলে কি রামচন্দ্র আসেননি! পঞ্চপাণ্ডবও তো আসতে পারেন। সেইসব ইতিহাস কি আর লেখা আছে!
প্রাণীটা গুটিগুটি শরীরের নীচের দিকে নামছে। এইবার যা থাকে বরাতে, সিংজির একটা হাত এগিয়ে এসে আলতোভাবে স্পর্শ করল। বাঃ, ভারী সুন্দর তো, নরম নরম, কচি-কচি, ভেলভেটের মতো লোম। সিংজি শুয়ে-শুয়েই ঘাড়টা একটু তুললেন। দুটো মণি যেন ধকধক করে জ্বলছে। সিংজি বুঝতে পারলেন, মণি নয়, দুটো চোখ। অন্ধকারে জ্বলছে। কোন প্রাণীর চোখ জ্বলে! বাঘের! বেড়ালের! বেড়াল এই এত রাতে আসবে কোথা থেকে! বাঘের বাচ্চাই হবে। মায়ের কোল ছেড়ে পালিয়ে এসেছে। বাঘ হয়ে কামড়াতে এখনও বহু বছর দেরি। বাঘের বাচ্চা আর বেড়ালবাচ্চায় খুব একটা পার্থক্য হবে না।
সিংজি উঠে বসলেন। বাচ্চাটা গড়িয়ে কোলের ওপর পড়ে গেল। সিংজির সাহস বেড়েছে। দু হাতে তুলে দেখলেন। কী সুন্দর! একটা হনুমানের বাচ্চা! এই কচি বয়সেই ল্যাজের কী বাহার! যে বড় হবে, ছেলেবেলা থেকেই তার মধ্যে সেইসব লক্ষণ দেখা দেয়। মহাবীরের শরীরের সবচেয়ে বড় গৌরবই তো ল্যাজ! তিন ফুট শরীরে সাত ফুট ল্যাজ। এই বয়সেই তার শোভা দ্যাখো।
হনুমানের বাচ্চাটা মনে হয় গাছ থেকে পড়ে গেছে। ঘুমোতে-ঘুমোতে পাশ ফিরেছিল। মানুষের বাচ্চা যেভাবে খাট থেকে পড়ে যায়, সেইভাবেই ধপাস। সে না হয় হল, কিন্তু সেটা কোন গাছ। মায়ের শিশুকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় তো আর রইল না। ট্রেন তো থামতে জানে না! চলছে তো চলছেই। যখন সকাল হবে, জঙ্গলের ফেলে আসা অঞ্চলের বহু দূরে, কোনও একটা গাছে মা হনুমান জেগে উঠে দেখবে, কোলের শিশুটি নেই। তখন কী হবে! সেই হনুমানের বেদনা সিংজির মনে ছড়িয়ে পড়ল। কান্না আসছে। না, কেঁদে লাভ নেই। কোনও সমস্যারই সমাধান হবে না। যতদিন না সাবালক হচ্ছে, ততদিন সিংজিকেই মা হয়ে মানুষ করতে হবে।
শেষ রাত। বেশ একটা শীত-শীত ভাব। বাচ্চাটা কোলের গরম খুঁজছে। গায়ে একটা হনুমান-হনুমান গন্ধ। সিংজি পুঁটলি থেকে একটা চাদরমতো বের করে বাচ্চাটাকে চাপা দিলেন। বেশ গুটলিমুটলি হয়ে শুতে-শুতে বাচ্চাটা একটা ‘উ’করে আরামের শব্দ করল। সেই আরামটা যেন সিংজির সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল।
ট্রেন যত জোরেই ছুটুক, ডুমডুমা পৌঁছবে সেই দুপুরে। এর মধ্যে বাচ্চাটার ব্রেকফাস্ট আছে, লাঞ্চ আছে। ডিনার ডুমডুমাতেই হবে। ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চের ব্যবস্থা চলন্ত ট্রেনেই করতে হবে।
“আচ্ছা, হনুমান কী খায়?” অদৃশ্য কাউকে প্রশ্ন করলেন খড়ক সিং। এইটাই তাঁর অভ্যেস। তিনি মনে করেন কেউ না কেউ সদাসর্বদা তাঁর পাশে আছেন। কখনও তিনি একা নন।
সেই অদৃশ্য বন্ধু তাঁর মনে বসে থেকে উত্তর দিলেন, “কলা খায়। কারণ আমি শুনেছি বাঙালি লেড়কারা হনুমান দেখলেই চিৎকার করে, এই হনুমান কলা খাবি, বড় বউয়ের বাবা হবি। তবে একটা প্রশ্ন আছে, বড় হনুমান কলা খায়, লেড়কা হনুমান কি খেতে পারবে! ওর কি দাঁত বেরিয়েছে? একেবারে দুধের বাচ্চা তো!”
দাঁত বেরিয়েছে কি না দেখার জন্য সিংজি বাচ্চাটার মুখে একটা আঙুল ঢোকালেন। দাঁতের চিহ্ন নেই। নরম-নরম মাড়ি। হনুমানটা চকচক করে চুষতে লাগল। খুব মজা পেয়েছে মনে হল। কলা চটকে দিলে খেতে পারবে। কিন্তু ডুমডুমায় কলা কি পাওয়া যাবে!
“হনুমান আর কী খায় ভাই!” খড়ক সিং আবার প্রশ্ন করলেন।
“হনুমান পাকা পেঁপে খায়।”
“পাকা পেঁপে ডুমডুমায় অবশ্যই পাওয়া যাবে। কিন্তু সে তো দুপুরের আগে হবে না। তার আগে কী খাওয়ানো যায়! সঙ্গে রুটি আছে দশখানা। আর আছে গুড়। ছাতুও আছে। ছাতু নরম করে মেখে খাওয়ানো যায়। একটাই ভয়, যদি পেট খারাপ হয়!”
সিংজি খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। যখনই চিন্তা আসবে, শুয়ে পড়বে। বেশি চিন্তা শরীরের পক্ষে খারাপ। তিনি পুঁটলি মাথায় দিয়ে শুয়ে পড়লেন। নরম পেটের ওপর চাদরের তলায় বাচ্চা হনুমান। লেজটা কোমরের পাশ দিয়ে বেল্টের মতো ঝুলছে। যেন নাইলনের দড়ি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সিংজি ঘুমিয়ে পড়লেন আবার। পুটপাট করে নানারকম পোকা এসে গায়ে পড়ছে। সিংজির পোকার ভয় নেই। জঙ্গলের এই এক দোষ, ভয়ঙ্কর পোকামাকড়ের উপদ্রব।
চড়া রোদ চোখে পড়তেই সিংজির ঘুম ভেঙে গেল। ট্রেন থেমে পড়েছে। জায়গাটা জঙ্গল নয়। কিছুটা ফাঁকা। হল্ট স্টেশন। স্টেশন মানে কী! প্ল্যাটফর্ম নেই। সবুজ একটা জমি। রেল কোম্পানির ছোট্ট একটা গুমটি। নীল জামা পরা একজন কর্মচারী। গার্ডসাহেব, ড্রাইভার, ফায়ারম্যান সবাই নেমে পড়েছেন। সিংজি দেখলেন, সকলের হাতেই চায়ের গেলাস। খুব অভিমান হল, কেউ তাঁকে ডাকেননি। সবাই স্বার্থপরের মতো চা-পান করছেন। সে যাই হোক, মানুষের কাজ মানুষ করেছে। কিন্তু হনুমান! কোথায় গেল! এদিকে-ওদিকে তাকালেন। রেকের এক কোণে কিছু খড় পড়ে ছিল। বাচ্চাটা তার ওপর শুয়ে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।
সিংজি এক লাফে রেক থেকে নেমে এলেন। ফায়ারম্যান বললেন, “আরে ভাই, আপনি! আপনার কথা আমরা ভুলেই গিয়েছিলুম। ঘুম কেমন হল?”
সিংজি বললেন, “তোফা! আপনার ঘুম কেমন হল?”
বলেই খেয়াল হল, ফায়ারম্যান, ড্রাইভার, গার্ডসাহেব, এঁরা ঘুমোবেন কী করে! তা হলে তো ট্রেন থেমে যাবে। সঙ্গে-সঙ্গে বললেন, “না, না, আপনারা ঘুমোবেন কী করে !”
ফায়ারম্যান বললেন, “আমরা পালা করে ঘুমোই। এই লাইনে তো ভয় নেই। সিঙ্গল লাইন। এঞ্জিন একবার চালিয়ে দিলেই গড়গড় করে চলবে।”
হল্ট স্টেশনের সিগন্যালম্যানের নাম, দুবে। তিনি বললেন, “আপনার চা আনি। আপনি মুখ ধুয়ে নিন।”
সঙ্গে-সঙ্গে সিংজির অভিমান কেটে গেল। তিনি দুবেজির হাত দুটো ধরে বললেন, “ভাইসাব, কাল রাতে ভগবানজি আমাকে একটা জিনিস দিয়েছেন। তার জন্যে একটু দুধ চাই। আপনি ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন! যা পয়সা লাগে আমি দেব।”
“জিনিসটা কী?” সকলেরই খুব কৌতূহল।
সিংজি বললেন, “দাঁড়ান, আমি নিয়ে আসি।”
সিংজির ফিট শরীর। একেবারে চাবুকের মতো। তড়াক করে লাফিয়ে রেকে উঠে পড়লেন। নেমে এলেন বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে। সকালের আলোয় সুন্দর দেখাচ্ছে। সারা গায়ে কচি-কচি ধূসর লোম। বাচ্চা হলে কী হয়, মুখটা সেই পোড়া কালো। মহাবীর সেই যে রামচন্দ্রের সময় রাগের মাথায় লঙ্কাদাহন করতে গিয়ে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড করলেন, অমন মুখটা পুড়িয়ে ফেললেন, সেই থেকে মহাবীরের ফ্যামিলিতে সব মুখ পোড়া। পৃথিবীতে এমন কোনও ক্লিনজিং মিল্ক নেই যা দিয়ে এটার কিছু করা যায়!
সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন, “আরে ভাই, এ তো বড়িয়া চিজ।”
গার্ডসাহেব বললেন, “ইউ আর ভেরি লাকি। আপনার ভাগ্য ফিরে যাবে ভাই!”
দুবেজি চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন, “লছমি, লছমি!”
দূরের কুঠিয়া থেকে একটা মেয়ে ছুটতে ছুটতে এল। দুবেজির এই একটিমাত্র মেয়ে। আর-একটু বড় হলেই হাতরাসে মামার বাড়িতে চলে যাবে লেখাপড়া করতে। এদিকে স্কুল, কলেজ কিছুই নেই। তেমন লোকজনও নেই। দুবেজি মেয়েকে বললেন, “দেখেছিস, বাবুর কোলে কী?”
সিংজির কোলে হনুমান-বাচ্চা। লেজটা ঝুলছে। লছমির কী আনন্দ!
সিংজিকে বলল, “আমাকে দেবে তুমি? আমি খাওয়াব, মানুষ করব!”
ড্রাইভারসাহেব হাসতে-হাসতে বললেন, “মায়ি, তুমি যত চেষ্টাই করো, একে মানুষ করতে পারবে না, বলো, হনুমান করব।”
মেয়েটির মুখ ভোরের শিউলির মতো সুন্দর, পবিত্র। সিংজি কেমন যেন মায়ায় পড়ে গেলেন। গলার স্বর মধুর মতো মিষ্টি। সিংজি মনে-মনে ভাবলেন, আমি একটা ভবঘুরে মানুষ, শেষে এই হনুমান-বাচ্চাটার মায়ায় মজে থাকব। তার চেয়ে দিয়ে দেওয়াই ভাল। একটু বড় হলেই তো গাছের জীব গাছে ফিরে যাবে।
সিংজি বললেন, “মুন্নি, তুমি নেবে! তোমার মা রাগ করবেন না!”
লছমির মুখ করুণ হয়ে গেল। চোখ দুটো হয়ে উঠল জল-টলটলে। লছমি বলল, “আমার মা নেই।”
মা নেই! এইটুকু মেয়ের মাকে ভগবান কেড়ে নিয়েছেন। এইবার সিংজির চোখে জল। দু’ হাতে ধরে আছেন হনুমান বাচ্চা। চোখ মুছতে পারছেন না। দু’ গাল বেয়ে জল ঝরছে। পবিত্র আলোর সকাল। চারজন রেলের পোশাক-পরা কর্মচারী, তার মাঝে সাদা কুর্তার সিংজি আর পরীর মতো একটি মেয়ে। লোহার দানবের মতো একটা মালগাড়ি। চারপাশে বিশাল-বিশাল প্রাচীন গাছ। সব সবুজ। সে যেন এক নাটকের দৃশ্য। এরই মাঝে তিলকশোভিত, হৃষ্টপুষ্ট এক মানুষ এলেন। তিনি পণ্ডিতজি। দুবেজি তাঁকে প্রণাম করলেন। তিনি অবাক হয়ে হনুমান বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছেন।
সিংজি লছমিকে বললেন, “তা হলে এটা তুমিই নাও। কী খাওয়াবে! এখনও দাঁত হয়নি।”
লছমি বলল, “দুধ খাওয়াব, কচিপাতা খাওয়াব, পেঁপে খাওয়াব, আমার একটা দোলা আছে, সেই দোলায় শোওয়াব।”
হনুমান-বাচ্চাটা যেন মায়ের কোলে যাচ্ছে, সেইভাবে লছমির কোলে গিয়ে তার বুকে মুখ গুঁজে দিল। লেজটা এখনই এত বড় যে, মাটিতে গিয়ে ঠেকছে। সিংজির কাছে ল্যাজটাই এক বিস্ময়!
দুবেজিকে পণ্ডিতজি বললেন, “কী, বলিনি তোমাকে! তোমার খুব সৌভাগ্য আসছে। মহাবীরের বাচ্চা এসে গেল। তুমি এইবার বড় স্টেশানে বদলি হয়ে যাবে। তোমার মাইনে বেড়ে যাবে।”
সিংজি বললেন, “বড় স্টেশানে গিয়ে কী হবে, এই জায়গাটাই তো অনেক ভাল।”
পণ্ডিতজি বললেন, “সংসারী মানুষের পক্ষে এই জায়গা ভাল নয়, তা ছাড়া দুবেজি এই অঘ্রানে আমার মেয়েকে বিয়ে করবে।”
খড়ক সিং লছমির দিকে তাকালেন। নিপাপ, সুন্দর একটা মুখ, বুকের কাছে চেপে ধরে আছে বাচ্চা হনুমান। সৎমা এসে মেয়েটার সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবে কে জানে! দুবের ওপর ভীষণ রাগ হল। লোকটা ব্যাডম্যান। লোকটা শুধু নিজের কথাই ভাবছে। মায়ের কোলছাড়া হনুমান মা-হারা একটা মেয়ের কোলে। দু’জনেই দু’জনকে চিনেছে খুব। পৃথিবীটা খুব ভাল, কিছু মানুষ ব্যাড, ভেরি-ভেরি ব্যাড।
॥ ২৪ ॥
“চা। চা খাবেন না? গরম চা, খাঁটি দুধের চা?”
সিংজি অসম্ভব রেগে গেছেন। লোকটা এই বয়েসে আবার নতুন করে সংসার করছে। আর সেই সংসারে এই ফুলের মতো মেয়ে সৎ মায়ের খিদমত খাটবে! গাছের ডাল ভাঙা ছপটি দিয়ে পটাপট পিটবে। কেউ তখন দেখার থাকবে না। পণ্ডিতজিটাও কেমন মানুষ! ধার্মিক! লোকটাকে কোথায় সংসার থেকে প্রকৃতিতে বেরিয়ে আসার পথ দেখাবে, তা না, ঠেলে সংসারে ঢোকাচ্ছে। বদস্য বদ!
সিংজি বললেন, “চা আমি খাব না।”
“কেন খাবেন না! চা খান না!”
মিথ্যে বলতে শেখেননি সিংজি। তিনি বললেন, “খাই, কিন্তু খাব না এখন। ট্রেন কখন ছাড়বে?”
গার্ডসায়েব বললেন, “চা না খেলে এখুনি সিটি মেরে দেব।”
“তা হলে তাই মারুন।”
সিংজি এক লাফে গাড়িতে উঠে পড়লেন। গার্ডসায়েব বললেন, “কী ফিট শরীর!”
এঞ্জিন ভুস করে খানিক স্টিম ছাড়ল। জায়গাটা একেবারে ধোঁয়া হয়ে গেল। সিংজির এই দৃশ্যটা দেখতে ভীষণ ভাল লাগে। দৈত্যের নিশ্বাস। সকালের রোদ ওই ধোঁয়ায় যেই সুযোগ পেয়েছে রামধনু রচনা করে ফেলেছে। সিংজি জানেন, ঈশ্বর আসলে একজন শিল্পী। বিরাট শিল্পী। সব সময় কাজ করে চলেছেন। সেই বাষ্পের ভেতর দিয়ে লছমির মুখ কখনও স্পষ্ট হচ্ছে, কখনও ঝাপসা। হনুমানের বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে আছে লছমি। সিংজি বলেন, আমি একটা শুকনো মানুষ, আমার চোখে কখনও জল আসে না। কথাটা একেবারেই বেঠিক। সিংজি পূর্ণিমার চাঁদ দেখলে কেঁদে ফেলেন, গাছে বসন্তের সবুজ পাতা দেখলে চোখ জলে ভরে আসে। অপরের দুঃখ দেখলে বুক ফেটে যায়। লছমির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হল, দু’গাল বেয়ে জল গড়াচ্ছে। ট্রেনের গতি বেড়ে গেছে। সব পেছনে ফেলে, সেই ছোট্ট জনপদ আর কয়েকটা মানুষকে ছেড়ে ট্রেন আবার ঢুকে পড়ল জঙ্গলে। অকারণে দু’বার সিটি মেরে জঙ্গলের স্তব্ধতাকে চমকে দিল।
সিংজি তাঁর কম্বলের ওপর বেশ গুছিয়ে বসেছেন। পাশে পোঁটলা, লাঠি আর পাগড়ি। রাতের জঙ্গল আর দিনের জঙ্গলে অনেক তফাত। কতরকমের আলোর খেলা! কতরকমের সবুজ! পাতার ফাঁকে-ফাঁকে সূর্যকিরণ ঢুকে কতরকম কাণ্ডই যে করেছে। মনে হচ্ছে, যজ্ঞ চলেছে। যেন বিশাল বড় এক মঞ্চ সাজানো হয়েছে, এখুনি রাজা-রানি, পাত্র-মিত্র সবাই এসে অভিনয় শুরু করে দেবেন। জীবজগৎও জেগে উঠেছে। কয়েক হাজার পাখির বিচিত্র কলরব। অসংখ্য বানর ডালে-ডালে কিচিরমিচির করছে। বীর হনুমানের হুপহাপ ডাক। এই সময় একটা বাঘের খুব প্রয়োজন ছিল। ট্রেনের এই খোলা বগিতে হালুম করে লাফিয়ে পড়লে বেশ মজা হত। অমন সুন্দর একটা জন্তু, কিন্তু ভাব করার উপায় নেই। সিংজির পূর্বপুরুষরা বাঘ পুষতেন। রাজা-মহারাজাদের ব্যাপারই ছিল অন্যরকম। সেইসব কথা বেশ মনে পড়ে। প্যালেসের বাগানে একসার খাঁচা। মহারাজার নিজের চিড়িয়াখানা। বেলা তিনটের সময় বাঘকে মাংস খাওয়ানো হত। সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য! তর্জনগর্জন, ছেঁড়াছিঁড়ি, রক্তারক্তি। বিশাল এক অজগর ছিল। গোটা একটা জ্যান্ত ছাগল স্রেফ গিলে নিত। ম্যাকাও পাখি ছিল। তারা খেত কাগজি বাদাম, কিশমিশ। নির্জন সেই বাগানে, ভরদুপুরে, সিংজি একা-একা বাঘের খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেন। সামনের দুটো থাবার ওর মুখ রেখে শুয়ে আছে দুপুরবেলার বাঘ। লাল-লাল চোখে তাকাচ্ছে। সিংজি যত বলেন, “মেরা দোস্ত” ততই বাঘটার চোখ আরও লাল হতে থাকে। শেষে একটা হুঙ্কার। সিংজির এক লাফ। সেই বঝেছিলেন, বাঘ কখনও আপনার হয় না। আচ্ছা, মানুষই কি হয়! দুবেজি কি লছমির আপনার লোক। ঘুরেফিরে সেই লছমির চিন্তাটা আবার এসে গেল। কিছুতেই তাড়ানো যাচ্ছে না।
বাতাসে একটা শিসের শব্দ। সিংজি চমকে উঠলেন। শব্দটা কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল বিদ্যুতের মতো। কানটা যেন গরম হয়ে উঠল। পরক্ষণেই ক্ল্যাং করে একটা শব্দ হল। বগির স্টিলের দেওয়ালে লেগে কী একটা পড়ে গেল। সিংজি অবাক হয়ে দেখলেন, একটা তীর। সাচ্চা তীর, যে-তীরে মানুষ, জীবজন্তু, পশু সব মারা যায়। সিংজি উঠে গিয়ে তীরটা নিয়ে এলেন। তীক্ষ্ণ লোহার ফলা। লম্বা একটা বেতের ডাণ্ডায় বাঁধা। পেছনের খাঁজে-খাঁজে তেজপাতার মতো পাত আটকানো। দেখার মতো সৌন্দর্য! সিংজি এতদিন তীর দেখে এসেছেন ছবিতে। রাজারা যুদ্ধ করেন। কিরাতরা শিকার করে। সত্যিকারের একটা তীর। একচুল এদিক-ওদিক হলে খড়ক সিংয়ের মৃত্যু হত। কানের পাশে গেঁথে যেত। মৃত্যু যখন হয়নি, তখন মৃত্যুদূতের সৌন্দর্যের তারিফ করতে ক্ষতি কী! জঙ্গল তাকে উপহার দিয়েছে এই তীর। অনেক পেছনে পড়ে আছে জঙ্গলের সেই অঞ্চল। ট্রেন তো থেমে নেই। ঘিচিঘিচি করে এগিয়েই চলেছে। কোনও ব্যাধ পাখি শিকারের জন্যে তীরটা ছুড়েছিল। কোনওভাবে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে চলে এসেছে। কে বলে, জীবনে কোনও উত্তেজনা নেই! ট্রেনের মতো একঘেয়ে শুধু চলেই যায়। এই তো সেই উত্তেজনা। আর একটু হলেই তো মরে যেত। যুদ্ধে যেভাবে রাজা-মহারাজারা মরে। রাজার ছেলে রাজার মতো বাঁচতে না পারুক, আর-একটু হলেই রাজার মতো মরে যাচ্ছিল।
তীরটাকে সযত্নে একপাশে রাখলেন খড়ক সিং। যতদিন বাঁচবেন ততদিন এটা তাঁর কাছে থাকবে। এটা যুদ্ধের, মৃত্যুর তীর নয়, শান্তির, জীবনের তীর। যেই মনে হল, খুব বাঁচা বেঁচে গিয়েছি, অমনই ভীষণ খিদে পেয়ে গেল খড়ক সিংয়ের। পুঁটলিটা খুললেন। দশখানা রুটির মালিক আমি। গুড়ও আছে। ছাতু আছে। মেঠাইও আছে। তা হলে এইবার নাস্তাটা করে ফেলা যাক।
সিংজির পোঁটলা থেকে রুটি বেরোল। রাতের ভিজে বাতাসে গুড় একটু রসে গেছে। জঙ্গলের সবচেয়ে প্রাচীন গাছকে উদ্দেশ্য করে খড়ক সিং একটা রুটি ও একটু গুড় নিবেদন করলেন, “হে বৃক্ষদেবতা! গ্রহণ করো।” গোল করে মুড়ে ছুড়ে দিলেন জঙ্গলের দিকে। এই জঙ্গলের প্রাণীরা জীবনে রুটি দেখেছিল কি! আস্ত একটা রুটি দেখে কী আনন্দই না হবে। তা হলে আরও একটা দেওয়া যাক। সিংজি আর-একটা রুটি ছুড়ে দিলেন। ছোড়ার নেশায় ছুড়তে যাচ্ছেন। চাকার মতো ঘুরতে-ঘুরতে গিয়ে যে-কোনও একটা গাছের গুঁড়িতে লেগে পড়ে যাচ্ছে ডানাভাঙা পাখির মতো। যখন খেয়াল হল, তখন আর একটামাত্র রুটি পড়ে আছে। কী করবেন! সবই যখন দেওয়া হয়ে গেল, তখন এই একটা কেন আর বাকি থাকে! এই জঙ্গলের কোথাও-না-কোথাও সেই নন্দলালা আছেন, যিনি বুকে বসে বাঁশি বাজান, তাঁকেই নিবেদন করে দেওয়া যাক। মেরা নন্দলালা! শেষ রুটিটা সিংজি ছুড়ে দিলেন। ট্রেন তখন অরণ্যের সবচেয়ে গভীরতম অংশ দিয়ে যাচ্ছে। দিনের বেলাতেই রাতের অন্ধকার। লক্ষ-লক্ষ ঝিঁঝিঁ একসঙ্গে ঝুনঝুনি বাজাচ্ছে। এত অন্ধকার যে, রাতের প্রাণীরাও বেরিয়ে পড়েছে। শেয়াল ডাকছে—হুক্কা হুয়া, কেয়া হুয়া। শেয়াল সিংজির ভীষণ প্রিয় প্রাণী। একবার খুব ইচ্ছে হয়েছিল, কুকুরের বদলে একটা শেয়াল পুষবেন। সবাই বলল, শেয়াল কোনওদিন পোষ মানে না। সিংজি দেখলেন, গাছের ডালে বেশ একটা মোটা সাপ প্যাঁচ মারছে। কী সাপ কে জানে। ভারী বাহার। হঠাৎ জঙ্গলের ভেতর মেঘ ডাকল যেন। সিংজির কী আনন্দ! এই তো তিনি ডাকছেন। বাঘ ভাইয়া।
ট্রেনের গতি ক্রমশই কমছে। সামনেই একটা ব্রিজ। তলায় সরলা নদী খেলা করতে-করতে ছুটছে। এই ব্রিজটা শিবশঙ্কর তৈরি করেছিলেন। কাজটা অবশ্যই খুব কঠিন ছিল। খুব ধীর গতিতে ট্রেন ব্রিজে উঠল। অনেক নীচে শীর্ণ নদী। সিংজি ঝুঁকে পড়লেন নদী দেখার জন্য। সরলা এই জায়গায় ভীষণ সুন্দর। এইখানেই নাকি সোনা পাওয়া যায়। সিংজির সোনার লোভ নেই। যাদের আছে তারা আসে আর বাঘের পেটে যায়, সাপের ছোবল খায়। বেলা দুটো নাগাদ ট্রেন ডুমডুমা পৌঁছল। ঝলমলে রোদ, নীল আকাশ। ঝাঁক-ঝাঁক সাদা পায়রা উড়ছে আকাশে। স্টেশনটা ছবির মতো। একসময় খুব ব্যস্ত এলাকা ছিল। আজ আর ব্যস্ততা নেই। কিন্তু স্টেশনটা সেইরকম আছে। সবুজ ঘাসে ঢাকা প্ল্যাটফর্ম। ঘর বাড়ি সব কাঠের। সায়েবদের তৈরি সায়েবী কায়দায়।
লাঠি, পোঁটলা নিয়ে সিংজি নেমে এলেন। হাতে নতুন আর একটা জিনিস, তীর। প্ল্যাটফর্মের এপাশ থেকে ওপাশ, ওপাশ থেকে এপাশ, লম্বা-লম্বা পা ফেলে সিংজি কয়েকবার পায়চারি করে নিলেন। স্টেশনমাস্টার বেরিয়ে এলেন কাঠের ঘর থেকে। বেশ ঋষি-ঋষি চেহারা। সিংজিকে বললেন, “আপনি আসছেন খবর পেয়েছি। থাকার ব্যবস্থাও করে ফেলেছি। ওই যে দেখছেন দূরে একটা বাংলো, ওই বাংলোটার নাম ব্রাউন বাংলো। টিম্বার মার্চেন্ট ক্রিস্টোফার ব্রাউন থাকতেন। এখন তো এই জায়গাটার আর সে ইজ্জত নেই। আইন হয়ে গেছে জঙ্গল কাটা চলবে না। বাংলোটা আমিই দেখাশোনা করি। আপনি সোজা চলে যান। ওখানে আবদুল আছে। রান্নাও হয়ে গেছে। আমার নাম সীতারাম সাকসেনা।”
সিংজি বাংলোর দিকে এগোলেন। স্বপ্নের মতো জায়গাটা। এপাশে-ওপাশে আরও অনেক পরিত্যক্ত কাঠের বাংলো। একতলা, দোতলা। কেউ থাকে না। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়ছে। আগাছা, পরগাছায় ঢাকা পড়ে আসছে। অনেকটা দূরে কচ্ছপের পিঠের মতো একটা বড় মাঠ। সেই মাঠে একটা মেলা বসেছে। রঙিন কাপড়ের পতাকা উড়ছে। মাদলের শব্দ। সাঁওতাল মেয়েরা নাচছে। এখন রিহার্সাল দিচ্ছে। রাতে হবে বড় নাচ। এই মেলা চলবে তিনদিন। ওদিক থেকে অনেকে এই মেলায় আসে। ওইদিকেই সেই নীল পাহাড়। যে- পাহাড়টার কাছে যাওয়ার জন্য জয় আর জয়া ছটফট করে। একদল বাচ্চার চিৎকার কানে আসছে। সিংজির মন চাইছিল এখনই মেলায় চলে যান। অনেক লোক, নানারকম ছোট-ছোট জিনিস, দেখতে ভাল লাগে। হাড়ের চিরুনি, হাড়ের মালা, কাঠের হাতা। মানুষের আনন্দ দেখলে সিংজির খুব আনন্দ হয়।
আবদুল বাইরেই বসে ছিল। সিংজিকে দেখেই বলল, “মহারাজ, আপনি এসে গেছেন!”
সিংজি বললেন, “আবদুলভাই, আমার পূর্বপুরুষ মহারাজ ছিলেন, আমি তো ভাই ফকির।”
“বড় ফকিরই তো মহারাজ, সিংজি।”
কাঠের মেঝে। চলতে গেলে শব্দ হচ্ছে। খুব একটা সাজানো না হলেও বেশ পরিষ্কার।
“মাস্টারজি এলে নাস্তা করবেন, না আগেই করে নেবেন?”
“আমি আগে চান করব।”
বাংলোর পেছন দিকে মাঠ। মাঠ পেরোলেই জঙ্গল। সবুজ হয়ে আছে। জঙ্গল যেখানে শুরু হয়েছে, তার মুখেই দোতলা একটা কাঠের বাড়ি। সেই বাড়ির দোতলার বারান্দায় একজন লোক বন্দুক হাতে পায়চারি করছে। ওই হল ফরেস্ট রেঞ্জারের বাংলো। বন্দুক হাতে বাগান পাহারা দিচ্ছে। এত বিশাল জঙ্গল পাহারা দেওয়া যায়!
সিংজি ভাবলেন, কতক্ষণ আর লাগবে, পায়ে-পায়ে মাঠটা পেরিয়ে জঙ্গলটায় একবার উকি দিয়ে আসি। ফরেস্ট অফিসারের বাংলো। তলায় অফিস। অফিসের সামনে অনেক নোটিস ঝুলছে। কাঠ কুড়োতে চাইলে কী করতে হবে, পাতা কুড়োতে চাইলে কী করতে হবে, কার কাছে অনুমতি নিতে হবে। সিংজি একটা-দুটো পড়ে আর পড়লেন না। জঙ্গলের মুখে, রোদ আর অন্ধকারের সীমানায় দাঁড়ালেন। গাছ আর গাছ। তরল অন্ধকারে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যুগের পর যুগ। এদিকটায় চচ্চড়ে রোদ, ওদিকে অন্ধকার। ও যেন আর-এক রাজার রাজত্ব। অদৃশ্য প্রহরীরা যেন হইহই করে ডাকছে, “আইয়ে জনাব, আইয়ে জনাব।”
সেই সীমাহীন অতল আকর্ষণে আর-একটু হলেই ধরা দিতে চলেছিলেন সিংজি, পেছন দিক থেকে আবদুল হাত চেপে ধরল। “মাত যাইয়ে মহারাজ। খাতরা হায়।”
জঙ্গলে চোখ দিয়ে? পথ খুঁজলে পাবে না। জঙ্গলে পথ চেনার জন্য চাই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। তেমন একজন মানুষ এখানে একজনই আছে, তার নাম আবদুল। “মহারাজ! আপ জানতে হি নেহি। গাছ ছাড়াও এই জঙ্গলে আরও অনেক কিছু আছে।”
॥ ২৫ ॥
ব্রাউন সায়েবের একটা ছবি ঝুলছে হলঘরে। খুব ধারালো চেহারা। চোখ দুটো হাসি-হাসি। খড়ক সিং একটা আরাম কেদারায় বসে আছেন। রাতের খাওয়া হয়ে গেছে। আবদুল প্রথমে মেঝেতেই বসে ছিল। সিংজি তাকে তুলে আর-একটা আরামকেদারায় বসিয়েছেন। মেঝেতে বসবে কেন আবদুল! প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক সে ইংরেজ আমলে ছিল। দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে, এখন সবাই সমান।
বলে বটে সবাই সমান, সে কথার কথা। প্রভুও আছে ভৃত্যও আছে। আবদুল একটু আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। এতখানি বয়েস হল, সে কখনও এমন চেয়ারে বসেনি। আবদুল ঘুম-ঘুম চোখে ব্রাউন সায়েবের গল্প বলছে। এখানকার লোক এখনও তাঁকে মনে রেখেছে। একটু পাগলাটে ধরনের ছিলেন। মানুষের উপকার করাই ছিল তাঁর কাজ। যা রোজগার করতেন তার অর্ধেকটাই দান করে দিতেন। বাংলোর পেছনে তাঁর একটা ডিসপেনসারি ছিল। রোজ সকালে সেখানে বসে রুগি দেখতেন। দাঁত তুলতে পারতেন। চোখ পরীক্ষা করতে পারতেন। মাঝে-মাঝে আবার জজসাহেব হয়ে যেতেন। মারামারি, জমিজমা নিয়ে গোলমাল, চুরির কেস, দু’ পক্ষকে দু’ পাশে বসিয়ে, বিচার করে মিটমাট করে দিতেন। সে রায় সবাই হাসিমুখে মানত। সদর আদালতে যাওয়ার দরকার হত না। সায়েবের তিনটে কুকুর ছিল।
সিংজি জিজ্ঞেস করলেন, “সায়েবের আর কেউ ছিল না?”
“হয়তো বিলেতে ছিল, এখানে কেউ ছিল না। তিনি একা। একা হলে কী হবে, এখানকার সবাই তো তাঁর আপনার লোক। আমি ছিলাম তাঁর বাবুর্চি। আমাকে ভীষণ ভালবাসতেন। দশ কাঠা জমি আমাকে দান করে গেছেন।”
“সেই জমিতে আপনি কী করেছেন? বাড়ি?”
“সেই জমি আমি বিক্রি করে দিয়েছি। না করে উপায় ছিল না। আমার খুব টাকার দরকার ছিল। কাজটা আমি ভাল করিনি। সায়েব বেঁচে থাকলে আমাকে অমন কাজ করতে হত না।”
“সায়েব মারা গেছেন?”
“সায়েবকে মেরে ফেলেছে। অমাবস্যার রাতে এই বাংলোতে ডাকাতি হয়েছিল। আপনি যে-চেয়ারে বসে আছেন, সকালে ওই চেয়ারে সায়েবকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। বুকে তিনটে গুলি।”
সিংজি একটু নড়েচড়ে বসলেন। চেয়ারটা তা হলে ভাল নয়। অভিশপ্ত চেয়ার। সিংজি ভয় ভালবাসেন। রক্ত হিম করা ভয়। সেই ভয়ই তো এই বাংলোয়। রাতটা ভালই কাটবে। আবদুল এখনই চলে যাবে। সে এখানে থাকে না। সিংজি একা থাকবেন।
আবদুল বলল, “একটা কথা বলে যাই মহারাজ, সব দরজা-জানলা বন্ধ করে শোবেন। দরজার কড়া নাড়লে কি টোকা দিলে, কি ধাক্কা দিলে দরজা খুলবেন না। খুললেই বিপদ।”
“কে ধাক্কা দেবে?”
“ সে আছে। অত জেনে কী দরকার!”
আবদুল বলছে আর নিজেই ভয়ে জড়সড় হয়ে যাচ্ছে। সিংজির সেইটাই খুব মজার মনে হচ্ছে। লোকটার কী ভাগ্য! একসঙ্গে কতরকম ভয় পাচ্ছে! ভূতের ভয়, চোর-ডাকাতের ভয়। জন্তু-জানোয়ারের ভয় পাচ্ছে কি না কে জানে!
সিংজি জিজ্ঞেস করলেন, “জঙ্গল থেকে রাতের দিকে জন্তু-জানোয়ার আসে না!”
“কেন আসবে না! ইচ্ছে হলেই চলে আসবে। তবে গভীর রাতে জঙ্গলের মায়া ছেড়ে বোকা না হলে কে আর আসবে! তবে কখনও-কখনও কেউ অসুস্থ হলে চলে আসে। সায়েব যখন বেঁচে ছিলেন তখন অসুস্থ একটা ময়াল সাপ চলে এসেছিল। পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা এই ঘরে। সাপটার পিঠে বড়-বড় তিনটে কাঁটা ফুটে ছিল। শজারুর কাঁটা। ঘা হয়ে গিয়েছিল। উপকারী, ভাল মানুষকে বনের জীবজন্তুও চেনে। মনে হয় চিকিৎসার জন্যেই এসেছিল সাপটা। সায়েবের কোনও ভয়ডর ছিল না। আমাকে বললেন, ‘আবদুল গরম পানি লে আও।’ আমি গরম জল করে আনলুম। সায়েব বললেন, ‘তুমি মুখটা চেপে ধরো’। ‘পারব না সায়েব, আমার ভয় করছে।’ সায়েব তখন ওই তিন-পায়া-অলা টেব্ল ল্যাম্পের স্ট্যান্ডটা এনে সাপের গলায় রেখে বললেন, ‘তুমি চেয়ারে দাঁড়িয়ে চেপে ধরে থাকো, কোনও ভয় নেই। তোমার কিচ্ছু হবে না।’ আল্লার নাম নিয়ে আমি তাই করলুম। সায়েব সাঁড়াশি দিয়ে পটাপট কাঁটা তিনটে টেনে তুলে ফেললেন। গরম জলে বোরিক পাউডার দিয়ে ওয়াশ করলেন, তারপর কী সব ওষুধ লাগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যাও, সব ঠিক হো যায়েগা।’ সাপটা কিছুই করল না। নড়ল না, চড়ল না, মাথা তুলল না। সারারাত আরামসে এখানে শুয়ে রইল। ভোরবেলা উঠে চলে গেল। সায়েব আর সাপ সারারাত এই ঘরেই শুয়ে রইলেন। সাপটা মাঝে-মাঝেই সায়েবকে দেখতে আসত। ওই রাত্তিরবেলা। সারারাত থেকে চলে যেত।”
সিংজি জিজ্ঞেস করলেন, “কিছু খেত না!”
“হ্যাঁ, সায়েব তাকে দুধ খেতে দিতেন।”
আবদুল আর কিছুক্ষণ থেকে চলে গেল। বাংলোতে ইলেকট্রিক আছে। স্টেশনের সঙ্গে কানেকশান। সিংজি এইবার বাংলোটা পুরো ঘুরে দেখলেন। এই বড় হলঘরটার সঙ্গে আরও দুটো ছোট ঘর আছে। শোবার ঘর। খাট আছে, পরিপাটি বিছানা। বাথরুমের সঙ্গে লাগোয়া সাজপোশাকের ঘর। সায়েবের স্টাডিটা দোতলায়। প্রচুর বই, একটা কার্পেট পাতা। লেখার টেব্ল ছাড়াও আর-একটা টেল কোণের দিকে। সেই টেব্লের ওপর ট্রেতে পর-পর পঞ্চাশটা স্মোকিং পাইপ সাজানো। সায়েবের স্মৃতি সর্বত্র। এরা সব যত্ন করে রেখেছে। একজন মানুষ ভাল হলে, সবাই তাঁকে মনে রাখার চেষ্টা করে—যত দিন পারা যায়। একটা পয়সা ফেলার বাক্স। সেই বাক্সের গায়ে লেখা, ‘পুট টেন কয়েন্স এভরি ডে। ফর আদার্স।’ পরের সেবার জন্য রোজ দশটা করে টাকা ফ্যালো। একটা দেওয়ালে একটা পোস্টার। লেখা আছে, ‘লিভ ফর আদার্স।’ অন্যের জন্য বাঁচো। সায়েবের বাস্ট ফোটোর সামনে দাঁড়িয়ে সিংজি নমস্কার করে বললেন, “আমাকে তোমার মতো করো।”
সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে। সিংজির মনে হচ্ছে, এইবার একটু শুই। আবার মনে হচ্ছে, মেলায় মাদল বাজছে, গেলে কেমন হয়! কত আনন্দ। বাঁশের ডগা চিরে ফট-ফটাফট বাজাচ্ছে। বাচ্চাদের প্রবল কলরব। মনকে আর বশে রাখা যাচ্ছে না। অনেক কষ্টে সিংজি নিজেকে আরামকেদারায় বসিয়ে রাখলেন। কোনওমতেই আর বাইরে যাবেন না। একটা দিনের পক্ষে যথেষ্টই হয়েছে। রাত হল ভাবার সময়। এক-একটা দিন হল এক-একটা সাদা কাগজ। গভীর রাতে সেই কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরে দেখতে হয়, লেখায়-লেখায় ভরাতে পেরেছ কি না! সেই অদৃশ্য লেখা হল, সৎকর্ম। সিংজি ভেবে পেলেন না কোনও সৎকর্ম। আজ কিছুই করা হয়নি। একটা দিন বেকার চলে যাচ্ছে।
আধো অন্ধকারে তিনি কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠলেন। সায়েবের স্টাডির দিকে যাচ্ছেন। হঠাৎ মনে হল, একটা কুকুর যেন শুয়ে ছিল, উঠে চলে গেল। ফোঁস করে শব্দও করল। মনের ভুল, ওই যে সায়েবের তিনটে কুকুরের গল্প শুনেছেন। স্টাডির আলোটা জ্বাললেন। নাকে টোব্যাকোর গন্ধ লাগল। মনের ভুল। ওই যে সায়েব পাইপ খেতেন শুনেছিলেন। ভয় পেলে মানুষ কত কী সষ্টি করতে পারে! সিংজি জোব্বার পকেট হাতড়ে দশটা কয়েন বের করে সেই বাক্সটায় এক, দুই, তিন করে ফেলতে লাগলেন। খালি বাক্স। খট-খট আওয়াজে একটা করে টাকা পড়ছে। যেই দশ হল, অমনই কানের কাছে কে যেন স্পষ্ট বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ।”
॥ ২৬ ॥
জয় পড়তে বসেছে। জয়া জানলার কাছে বসে গাছপালা, আকাশ, বাতাসের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করে গান গাইছে।
জয় বলল, “দিদি, তোর আজ লেখাপড়া নেই? গান গাইছিস খুশ মেজাজে?
“কেন গাইব না! আমার সব হোমটাস্ক, আমি কাল রাতেই সেরে ফেলেছি, সেই সময় তুমি যে ভাই বসে বসে ঢুলছিলে! তখন তো তুমি আমার কথা শোনোননি বাছা।”
“তোর গানে আমার পড়ার ডিস্টার্ব্যানস হচ্ছে।”
“আমি তো গুনগুন করছি। তোমার ডিস্টার্ব্যানসের কারণ, তোমার মন আকাশে উড়ছে। ছোটুলাল ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, সেই ঘুড়ির দিকে তোমার মন। মনটাকে আকাশ থেকে নামিয়ে এনে তোমার বইতে রাখো, তাহলে আর আমার গান শুনতে পাবে না।”
“তুই দিদি খুব স্বার্থপর। তোর এখন কী করা উচিত বল তো?”
“বলো?”
“আমার মনোবল বাড়াবার জন্যে তোরও পড়তে বসা উচিত।”
“আর আমার মনোবল বাড়াবার জন্যে তুমি কী করেছিল ভাই, বসে বসে ঘুমিয়েছিলে! তখন তো তোমার মনোবল শব্দটা একবারও মনে আসেনি!”
“আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, জেগে থাকতে পারলে ঠিকই আসত। আমি কী করব রে দিদি, যতবার চোখ বড়-বড় করে তাকাই, ততবারই চোখ ছোট হয়ে আসতে-আসতে একেবারেই বুজে যাচ্ছিল। জানিস তো দিদি, ছোট ছোট স্বপ্নও দেখছিলুম।”
হঠাৎ জয় ফোঁসফোঁস করে কান্না শুরু করল। জয়া জানলার কাছ থেকে প্রথমে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল ভাইয়ের দিকে। ফোঁপানি ক্রমশই বাড়ছে। বড়-বড় চোখে টলটলে জল। জয়া উঠে এসে জয়ের মাথার পেছনে হাত রাখল। রেশমের মতো একমাথা চুল। বেশ একটা ফুল-ফুল গন্ধ। জয়াকে ফাদার বলেছিলেন, মানুষ যত পবিত্র চিন্তা করবে ততই তার গা দিয়ে সুগন্ধ বেরোবে। চেহারা সুন্দর হবে। মুখটা হয়ে যাবে ভগবানের মতো।
জয়া বলল, “তোর কান্নার কারণটা কী বলবি?”
জয় দিদির বুকে মুখ গুঁজে দু’ হাতে কোমর জড়িয়ে ধরে আরও কাঁদতে লাগল। ফুলে-ফুলে কান্না। কাঁদছে তো কাঁদছেই।
জয়া বলল, “পাগলের মতো কাঁদছিস কেন বলবি!”
অনেক চেষ্টা করে, অনেকবার ঢোঁক গিলে, কান্নার দমকা আবেগ সামলে জয় বলল, “আমি কেন ঘুমিয়ে পড়লুম দিদি!”
“পড়েছিস-পড়েছিস, বেশ করেছিস।”
“তাই তো তুই আমার থেকে আলাদা হয়ে গেলি।”
“আলাদা হয়ে গেলুম কোথায়!”
“দিদি, তুই আমাছে ছেড়ে কখনও কোথাও যাস না দিদি।”
জয়ের আবার কান্না। আচ্ছা এক পাগল! শুয়ে আছে হয়তো দু’জনে পাশাপাশি। পাশ ফিরতে হলেও জয় জয়াকে জিজ্ঞেস করবে, “দিদি! আমি একটু ওপাশ ফিরব?”
এইবার জয়ার চোখে জল। কেন সে অমন কথা বলল ভাইকে! মজা করে বললেও মনে লেগেছে। ব্যাপারটা আরও অনেকদূর হয়তো গড়াত। হঠাৎ জানলার বাইরে বাগানে একটা মাথা দেখা গেল। জানলার বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন, সরলা স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। ভাইবোন দু’জনেই তাঁকে চেনে।
মাস্টারবাবুকে দু’জনেই খুব ভালবাসে। ভীষণ সরলমানুষ। মজার মজার গল্প বলেন। হঠাৎ কখনও ছুটির দিনে এসে বলেন, “আজ আমি তোমাদের রান্না করে খাওয়াব।” ভাল রাঁধতে পারেন। রান্না করতে ভালবাসেন। ভালই রাঁধতে পারেন কত রকমভাবে, কত কায়দায়।
মাস্টারবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “দুজনে জড়াজড়ি করে কাঁদছ মনে হচ্ছে, কী হয়েছে?”
জয়া চোখ মুখতে-মুছতে বলল, “আমাদের খুব দুঃখ হয়েছে।”
“সে তো বুঝতেই পারছি। দুঃখের কারণ নেই, এমনই দুঃখ।”
“আঃ, সে বেশ ভাল। আকাশে যেমন মেঘ করে, সেইরকম আর কী! আমারও মাঝে-মাঝে এইরকম হয়। তখন আমি যে-কোনও লাইনের একটা ট্রেনে উঠে পড়ে, দু-চারটে স্টেশন পেরিয়ে যাই। ভাঁড়ে চা খাই, ঝালমুড়ি খাই। আবার আর একটা ট্রেনে চড়ে ফিরে আসি। মন ঠিক হয়ে যায়। কখনও একটা গাছের তলায় গিয়ে বসি। গাছকে যদি মনের দুঃখের কথা বলা যায়, গাছ খুব তাড়াতাড়ি মন ভাল করে দিতে পারে। খবরদার নদীর কাছে ভুলেও যেয়ো না, মন আরও খারাপ করে দেবে। কেন জানো! নদী কেবল চলেই যায়। সবচেয়ে ভাল ঘুমিয়ে পড়া। একটা ঘুম যদি দিতে পারো, দুঃখও ঘুমিয়ে পড়বে। তবে একটা জিনিস কিছুতেই মাথায় আসছে না আমার, এই বয়েসে তোমাদের মনে দুঃখ আসছে কেন? ভাল কথা নয়।”
মাস্টারজি শিবশঙ্করের কাছে চলে গেলেন। ভীষণ দরকার। কোনওরকমে আধঘণ্টার জন্যে স্টেশন ছেড়ে এসেছেন। শিবশঙ্কর তখন তাঁর ওয়ার্কশপে হেলিকপ্টার তৈরি করছিলেন। খেলনা-হেলিকপ্টার। মাস্টারবাবুকে দেখে তিনি অবাক। এই সময়ে তো তাঁর আসার কথা নয়। শিবশঙ্কর হাতের কাজ ফেলে রেখে বললেন, “মাস্টারজি, এনি বিপদ?”
“নো বিপদ সার! একটা মেসেজ ফ্রম খড়ক সিং।”
“খড়ক সিং? সে তো কাশ্মীরে?”
“না সার, সিংজিকে আমি একটা রেকে চাপিয়ে ডুমডুমা ফরেস্টে পাঠিয়ে দিয়েছি।”
“ডুমডুমা! কী সর্বনাশ! সে তো ভূতের জায়গা!”
“সিংজি ভূত দেখতে ভালবাসেন। সিংজির মেসেজ হল, আপনাকে আর ডাক্তারবাবুকে এখুনি একবার ডুমডুমা হল্টে যেতে হবে, ভীষণ বিপদ।”
“সে কী! খড়ক সিংয়ের বিপদ! কী বিপদ!”
“মেসেজে আর কিছু নেই, এইটুকুই আছে।”
“যাব কীভাবে?”
“সে ব্যবস্থা আমি করেছি। লাইন ইনস্পেকশন ট্রলিতে চেপে আপনারা যাবেন।”
“কোনও বিপদ হবে না তো?”
“একেবারেই হবে না, তা কেমন করে বলি, তবে আপনারা তো সাহসী, বিপদের ঝুঁকি নিতে চান, নিতে পারেন। রেডি হয়ে একঘণ্টার মধ্যে চলে আসুন স্টেশনে।”
“ফরেস্টের রিপোর্ট কী? শেরটের ঘুমোচ্ছে, না জেগে আছে? সঙ্গে বন্দুক নিতে হবে?”
“একটা নিয়ে নিন। দিন কয়েক আগে পাগমার্ক দেখা গেছে। সিপলার দিক থেকে এই সময়ে আসে।”
“তা হলে তো, জমবে ভাল, কতদিন দেখা হয়নি মামার সঙ্গে। শেষ দেখা হয়েছিল কুমায়ুনের জঙ্গলে। মামা তখন লাঞ্চ করছিলেন।”
মাস্টারজি বললেন, “আমার আর দাঁড়াবার সময় নেই সায়েব, আমি চলছি, ট্রেন পাস করাতে হবে। আপনারা রেডি হয়ে চলে আসুন।”
শিবশঙ্কর উদয়নকে ডেকে বললেন, “একটা এস. ও. এস. এসেছে খড়ক সিংয়ের কাছ থেকে। আমাদের তো একবার যেতে হবে এখুনি।”
উদয়ন জামা ইস্ত্রি করছিলেন, “খড়ক সিং কোথায়! তিনি তো কাশ্মীরে!”
“তিনি কাশ্মীরে যেতে গিয়ে চলে গেছেন ডুমডুমায়।”
“ডুমডুমায়! সে তো ভয়ঙ্কর জায়গা।”
“খড়ক এখন পড়ে আছে ডুমডুমা হল্টে। মনে হয় খুব অসুস্থ।”
“তাই হবে। ওখানকার জল আর মশা! ভাইরাস ম্যালেরিয়াও হতে পারে। ওইসব জায়গায় কেউ যায়!”
“উদয়ন তুমি তা হলে রেডি হয়ে নাও। এক ঘণ্টার মধ্যে আমাদের স্টেশনে যেতে হবে। মাস্টারজি একটা ট্রলি রেখেছেন। সেই ট্রলিতে আমরা যাব।”
“ওই হনুমান দুটো যাবে কি?”
“জয় আর জয়া। কষ্ট হবে না!”
“কষ্ট আবার কী! এই বয়সে কষ্ট না করলে আর কবে করবে। আমরা চারজনে বেশ হইহই করে যাব, ওদের ওই ভয়ঙ্কর জঙ্গলটাও দেখা হয়ে যাবে। কত ভ্যারাইটিজ অব বার্ডস। অন্য প্রাণীও তো আছে!”
শিবশঙ্কর কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, “এ-যাত্রায় থাক উদয়ন। সিংজি যদি সিরিয়াসলি অসুস্থ হয়। তা হলে তাকে ওই ট্রলিতেই আনতে হবে। তখন আর জায়গা হবে না।”
উদয়ন বললেন, “জানেন বাবা, একটা রিস্ক নিয়ে দেখা যাক। মাস্টারজি আছেন, ফেরার যা হয় একটা ব্যবস্থা তিনি করবেন। দেখুন, লুক বিফোর ইউ লিপ—বলে বটে, তবে লিপ বিফোর ইউ লুক-এর আলাদা একটা মজা আছে। অ্যাডভেঞ্চারের ওইটাই তো মজা! আপনার সঙ্গে যাওয়ার সুযোগ আবার কবে আসবে, কে বলতে পারে।”
শিবশঙ্কর বললেন, “অলরাইট! চলুক তা হলে!”
জয় আর জয়া, একটু আগে খুব দুঃখে ছিল। ‘গেট রেডি’-এই আদেশটা আসামাত্রই ভাই আর বোনের দুজনেই হনুমানের মতো লাফাতে লাগল। কী মজা! ভীষণ মজা।
জয় বলল, “দিদি! আমাকে শিকারির ড্রেস পরিয়ে দে।”
জয়া বলল, “আমি, কী পরব!”
“তোরও শিকারির ড্রেস। কত বড় একটা জঙ্গলে যাবি।”
সবচেয়ে ভাল স্কাউটের পোশাক। একঘণ্টা পরেই দেখা গেল, টিম বেরিয়ে পড়েছে স্টেশনের দিকে। শিবশঙ্করের কাঁধে বন্দুক।
॥ ২৭ ॥
পথে নেমে পড়লেন সবাই। রাজার পোশাকের মতো ঝলমলে দিন। শিবশঙ্কর হাসতে-হাসতে বললেন, “এইসব ভড়ং আমার একেবারে ভাল লাগে না ।”
উদয়ন বললেন, “কোন ভড়ং?”
“এই কলোনিয়াল সাহেবদের মতো কাঁধে বন্দুক। কোথায় বাঘ? আর বাঘ যদি সামনে এসে দাঁড়ায়ও, মারতে পারব! মারার মুহূর্তেই মনে পড়বে, মানুষের চেয়ে বাঘ দামি। মানুষের সংখ্যা পোকার মতো বাড়ছে, বাঘের সংখ্যা কমছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ করা উচিত।”
“আমরা যে-জঙ্গলে যাচ্ছি, সেই জঙ্গলে বাঘফাগ নেই। থাকলে খটাস আছে। বনবেড়াল।”
“তা হলে এই ভারী বন্দুকটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছি কী কারণে! লোককে দেখাবার জন্যে! তোমরা এগোও, আমি বরং রেখে আসি।”
উদয়ন বললেন, “আমাকে দিন। জিনিসটা অনেকদিন জঙ্গলের হাওয়া খায়নি, বাইরের আলো-বাতাস পায়নি। ওরও তো ইচ্ছে করে! তারপর ধরুন যদি কিছু হয়! বাঘ না থাকুক বদমাশ লোকের তো অভাব নেই। দলমা পাহাড়ের দিক থেকে ডাকাত আসে। সেরকম হলে একটু ভয়টয় দেখানো যাবে।”
মাস্টারজি তাঁর ঘরের বাইরে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে একটা পেটি খোলাচ্ছিলেন। শিবশঙ্করদের দেখে বললেন, “আ গিয়া! বহত আচ্ছা!” একটা হাঁক ছাড়লেন, “গিরধারী!”
মোটাসোটা একজন মানুষ যেন মাটি ফুঁড়ে উঠলেন, “হাঁ জি।”
জয় দেখছিল, পেটিটা কিসের! চায়ের। ডুয়ার্স থেকে এসেছে। মাস্টারজির আবার চায়ের ব্যবসা আছে। এ কথা সে জানে। আবার মজা এই, চায়ের ব্যবসা থেকে যে-টাকা রোজগার করেন তার সবটাই দান করে দেন চার্চকে। সেই টাকায় চার্চ গরিবদের সেবা করে। সবাই বলেন, “মাস্টারজি ইজ রিয়েলি গ্রেট। মাথায় সামান্য ছিট আছে হয়তো!” তা তো আছেই, তা না হলে কেউ ছাগলের জন্য পাগল হয়। স্টেশন চত্বরে টিয়ার ঝাঁক এলে কাজ ফেলে ছুটে আসেন! যেন ভারতবর্ষের প্রেসিডেন্ট এসেছেন। কোনও মানুষ কোলাব্যাঙ পোষেন! ঘরের মধ্যে থপথপ করে ঘুরছে। কেউ এলে গর্ব করে দেখান, “বঙ্গালকা ব্যাঙ।”
“মাস্টারজি, এই বাচ্চা দুটোকে নিয়ে যাব?” প্রশ্ন করলেন উদয়ন।
“হোয়াই নট? ওদের স্টিফেন্স গর্জটা দেখিয়ে আনবেন? সিক্স মাইল্স ফ্রম ডুমডুমা।”
“সেটা কী? কখনও শুনিনি তো!”
“সরলা নদী একটা গুহায় ঢুকে আবার বেরিয়ে আসছে। নদী খেলা করছে। দুষ্টু মেয়ে সরলা। আর দেখাবেন ভৈরব মন্দির। রেলিক্স। শিবলিঙ্গ পাতালে ঢুকে গেছেন। বিশাল এক গর্ত। গর্তের মুখের কাছে দাঁড়ালে শুনতে পাবেন, ‘শিব শিব’। একটা ঠাণ্ডা গরম ভাপ ওপরে উঠে আসছে। ভাগ্য ভাল থাকলে শুনতে পাবেন পাতালে জলের শব্দ। অনেকটা হরিদ্বারের গঙ্গার শব্দের মতো, ‘হর হর’। আর-একটা জিনিস দেখে আসবেন, সেটা আছে ডিসকিম বলে একটা জায়গায়, থ্রি মাইল্স ইস্ট অব ডুমডুমা হল্ট। একটা গাছ, যার সব পাতা হলদে, আর কোনও দুটো পাতা একরকমের নয়। এক-একটা এক-একরকম। ক্রেজি ইয়েলো ট্রি।”
শিবশঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, “মাস্টারজি বন্দুক কি নিয়ে যাব?”
“নিশ্চয়। কখন দরকার হবে কেউ বলতে পারে? জঙ্গল, নদী, আগুন আর মানুষকে বিশ্বাস নেই।”
“শাঁ করে শব্দ। ট্রলি এসে গেল। ঠেলতে হয় না। পাওয়ারে চলে। একটু সাবধানে বসতে হয়। পড়েটড়ে গেলে সেরকম কিছু নয়, লাইনের খোয়ায় কেটেকুটে যাওয়ার ভয় আছে। মাস্টারজি হাত নেড়ে যাত্রা করিয়ে দিলেন। গিরধারীর হাতে কন্ট্রোল। জয়া জয়কে জড়িয়ে ধরে আছে। শিবশঙ্করের কোলের ওপর বন্দুক। উদয়ন আড়ষ্ট। একেবারে খোলা চারপাশ। একটু ভয়-ভয় করতেই পারে।
গিরধারী জিজ্ঞেস করল, “আমি যদি গান গাই আপনাদের অসুবিধে হবে?”
শিবশঙ্কর প্রশ্ন করলেন, “খুব জোরে?”
“না না, আস্তে-আস্তে।”
“কী গান গাইবে, হিন্দি সিনেমার!”
“না সরকার, আমি ভজন গাইব।”
“বেশ, ধরো।”
গিরধারী গলা দিয়ে সামান্য একটু সুর বের করেছে, সবাই একেবারে মোহিত।
“আরে ভাই, তুমি তো একেবারে পাকা গাইয়ে। সুর লাগাচ্ছ কী! প্রাণটা একেবারে ছটফট করে উঠছে।”
“কী যে বলেন সরকার! লজ্জা দেবেন না। বিশ বছর তালিম নিয়েছি। কিছু হয়নি। আমার গুরুজি বলতেন, গিরধর! একটা গাধাকে তালিম দিলে সে এতদিনে শিখে যেত।”
গিরধারী ধরেছে, “রাম নাম সুখদারি, সাচ্চা মনসে ভজো রাঘব তো, ইকদিন মুক্তি পায়ি।” আর গাইছে কী? মালপোর মতো গলায় ঠাসা সুর। তেমনই সব সুষম-সুষম কাজ। ভৈরবীর বাহার। উদয়ন শিবশঙ্করকে বললেন, “বাবা! এঁকে কলকাতার কনফারেন্সে নিয়ে গেলে কেমন হয়!”
“খুব খারাপ হয় বাবা। সেখানে কেউ কল্কে দেবে না। কনফারেন্সে গান বড় কথা নয়, কে গাইছে সেইটাই বড় কথা! নাম চাই, নাম।”
জয় আর জয়া দু’জনে বসে আছে জড়াজড়ি করে। বেশ ভালই লাগছে। স্লিক-স্লিক করে বেশ বড় মাপের একটা পিঁড়ে যেন সাঁই-সাঁই করে চলেছে। জমি খুব কাছে। একটু ঝুঁকে হাত বাড়ালেই ঘষড়ে যাবে। এমন অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। জয় বলল, “দিদি! হঠাৎ ব্রেক কষলে আমরা তো ছিটকে পড়ে যাব।”
“সেই জন্যেই তো তোকে ধরে আছি। ব্রেক কেন কষবে! ধীরে-ধীরে স্পিড কমাতে-কমাতে থেমে যাবে। দূরে একটা টানেল। এগিয়ে আসছে হুহু করে। চুপচাপ অন্ধকার। এইরকম টানেল ট্রেনে পেরোবার সময় তেমন কিছু মনে হয় না। কামরায় বসে আছি। মাথার ওপর ছাত। হঠাৎ ঝলমলে আলো থেকে থকথকে অন্ধকার। অন্ধকার, অন্ধকার, আবার আলো। এই অভিজ্ঞতাটা একেবারে অন্যরকম। অন্ধকারের সিংহদুয়ার এগিয়ে আসতে-আসতে ট্রলি ঝাঁ করে ঢুকে পড়ল। হিম-হিম স্যাঁতসেঁতে অন্ধকার। বিশাল এক গুহা। তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হয়তো শ্যাওলা জমেছে পাথরের দেওয়ালে। ওপাশে অনেক দূরে আলোর দরজা। বেরোবার পথ। প্রথমে ছিল প্রদীপের শিখার মতো। ক্রমে বড় হতে-হতে বৃত্তাকার। ট্রলির শব্দে ভেতরটা গমগম করে উঠল। কানে তালা ধরে যাওয়ার জোগাড়। গিরধারী বলল, “রাম রাম বলে চিৎকার করো, দেখবে এক রাম কত রাম হয়ে যাবে।”
শিবশঙ্কর ছেলেমানুষের মতো হুপ করে একটা শব্দ করলেন। ধ্বনি, প্রতিধ্বনি, ট্রলির শব্দ সব একাকার হয়ে, ভয়ঙ্কর শব্দঝঙ্কার।
ট্রলি হুস করে বেরিয়ে এল আলোয়। জঙ্গলের সীমানায় এসে গেছে ট্রলি। ছবির মতো সামনে পড়ে আছে একজোড়া রেল লাইন। ঝলমলে আলোর ধূসর পাথর। একপাল হনুমান দূরে লাইনের ওপর সভা করছে। ট্রলিটার আবার হর্ন আছে। প্যাঁক-প্যাঁক। পেছনে একটা পতাকা পতপত করে উড়ছে।
উদয়ন বললেন, “গ্রেট মিস্টেক। সঙ্গে এক ফ্লাস্ক চা থাকা উচিত ছিল।”
গিরধারী বলল, “সে আর ভাবতে হবে না, মাস্টারজি চা, বিস্কুট, পাউরুটি সব দিয়ে দিয়েছেন। তাড়াতাড়িতে আর কিছু পারেননি। তবে আটা, ঘি, ডাল, আলু দিয়েছেন।”
উদয়ন বললেন, “কেন?”
“দিল!”
“দিল মানে?”
“সরকার! মানুষটার দিল হল দিল্লি, রাজধানী। রাজার মতো। আমাকে বলেছেন, দুপুরে একটা ভাল জায়গায় ট্রলি দাঁড় করিয়ে, কাঠকুটো জ্বেলে গরম চাপাটি, ডাল আর আলুর তরকারি রেঁধে আপনাদের খাওয়াতে।”
শিবশঙ্কর শুনে বললেন, “দেখেছ! দিল্লিতে দিল নেই, দিল আছে কোনও-কোনও মানুষের মনে। এই যে জায়গাটায় আমরা আছি, এই সরলা নদীর তীর, এখানে যে কত মানুষ আছে, যাদের মনটা হল খাঁটি সোনা। এই খড়ক সিং, গিরধারী, মাস্টারজি, ফাদার।”
গিরধারী বলল, “সরকার! আপনাদের কেন বাদ দিচ্ছেন। আর আমার এই দাদা, দিদি। জয়, জয়া!”
জয়া বলল, “আপনি আমাদের চেনেন?”
“হাই দিদি, চিনব না! মনে নেই, চার্চের অনুষ্ঠানে আমরা সবাই মিলে গান করেছিলুম। আমাকে চিনতে পারোনি। আমি প্রত্যেক বছর তোমাদের সান্টাক্লজ সাজি।”
“ওমা, তাই নাকি! ইউ আর গ্রেট। ইউ আর নাইস, ইউ আর সুইট।” ট্রলির স্পিড বেড়েছে, কারণ, ঢালুতে নামছে। রোদ চড়লেও কষ্ট হচ্ছে না। ছায়া রোদ, রোদ ছায়া এইভাবেই চলছে!
গিরধারী তার ঝোলা থেকে একটা ফ্লাস্ক বের করে উদয়নের হাতে দিতে-দিতে বলল, “চায় গড়ম।”
॥ ২৮ ॥
এই জায়গাটারও একটা নাম আছে, ‘লিটল হাট’।
সেই সময় সায়েবদের খুব যাওয়া-আসা ছিল এই তল্লাটে। ডুমডুমায়, ডুমডুমা হল্টে। ফরেস্টে তাঁরা আসতেন ঘোড়ায় চড়ে। এই জায়গায় জঙ্গল হঠাৎ কোনও কারণে বেশ কিছুটা জায়গা ছেড়ে রেখেছে। একেবারে ফাঁকা। এক কণা ঘাসও নেই। কালো কঠিন মাটি। মসৃণ।
ট্রলি থেকে সবাই নেমে এসেছেন গিরধারী মালপত্র নামাচ্ছে। এইখানে দুপুরের রান্না হবে। এর পর আরও অনেকটা পথ। সে-পথ খুবই দুর্গম। জঙ্গল গভীর। বন্যপ্রাণীর উৎপাত আছে।
জয় জিজ্ঞেস করল, “দাদা, এখানে কী ভূত থাকে?”
“ভূত বলে কিছু আছে নাকি রে দাদা? হঠাৎ এমন প্রশ্ন!”
“জঙ্গল এই জায়গাটাকে ছেড়ে রেখেছে কেন?”
“কেন বলো তো! অনুমান করো। মাটিটা পা দিয়ে দ্যাখো।”
জয়া বলল, “এটা মাটি নয়, পাথর দাদা। একটা পাহাড় হতে-হতে আর হয়নি, থেমে গেছে।”
শিবশঙ্কর বললেন, “দ্যাট্স রাহট। ঠিক বলেছিস দিদি। একটা পাহাড় ফর্ম করছিল। আপাতত থেমে আছে। ভবিষ্যতে হতেও পারে। মাটির নীচে আছে। যেহেতু শিলা, সেই হেতু এই জায়গাটায় গাছপালা হয়নি। একগাছা ঘাসও জন্মায়নি। যেন মৃত্যুর শানবাঁধানো বেদি। সেইজন্যই জয়ের মনে হয়েছে ভৌতিক। সায়েবরা নাম রেখে গেছেন, লিটল হাট। হাত-পা ছড়িয়ে বেশ বিশ্রাম করা যায়। জঙ্গলের ছায়া, ঠাণ্ডা। একটা ঘুমও দেওয়া যায় পাখির গান শুনতে-শুনতে। তবে ভাই সমস্যা একটাই, সাপ আছে, নানারকম সাপ। কিলবিল করে চলে যেতে পারে পাশ দিয়ে। সাপ ভয় না পেলে মানুষকে শুধু-শুধু কামড়ায় না।”
জয় বলল, “দাদা, পাহাড় কেমন করে হয় আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।”
“দাদাভাই, সে যে সৃষ্টির আদিকালের ব্যাপার। জিওগ্রাফির ভাষায় যাকে বলে সাইল অব ইর্শান। গঠন ও ক্ষয়। পাহাড় কীভাবে হয় জানো? আপলিফ্ট ফোল্ডিং, ফণ্টিং আর ভলক্যানিক অ্যাকটিভিটি। বড় হয়ে যখন হায়ার জিওগ্রাফি পড়বে, তখন পাবে জিওমরফোলজি। সেইখানে আছে প্লেট টেকনিক্স। খুব আকর্ষক বিষয়। পৃথিবীটাকে কার না জানতে ইচ্ছে করে!”
উদয়ন জঙ্গলে গেছেন গাছের শুকনো ডাল সংগ্রহ করতে। গিরধারী পাথরের চাঁই জোগাড় করে এনেছে। জলের ব্যবস্থা সঙ্গেই আছে। তা ছাড়া জঙ্গলের ভেতর দিয়ে কিছুটা গেলেই সরলা নদীর বাঁক। সরলার জলও খারাপ নয়। তবে সেখানে যাওয়ার দরকার হবে না। যথেষ্ট জল আছে।
জয়া গিরধারীকে বলল, “আমি আপনাকে সাহায্য করি।”
“নিশ্চয় করবে। সকলকেই সাহায্য করতে হবে।”
শিবশঙ্কর বসলেন আলু কাটতে। গিরধারী তিন-চারটে বড়বড় ছুরি এনেছে। জয়া বসেছে ডাল বাছতে। ডালে বড়-বড় পাথর থাকে। উদয়ন এসে গেলেন শুকনো ডালপালার বোঝা নিয়ে। গিরধারীর সঙ্গে আছে কড়া আর চাটু। আছে একটিন ভাল ঘি। অড়হর ডাল চেপে গেছে। লকলকে আগুন। জয়ের কাজ হল, আগুনে শুকনো গাছের ডাল ঠেলা। গিরধারী ময়ান দিয়ে আটা ঠাসছে। যত ঠাসবে রুটি তত নরম হবে।
উদয়ন বললেন, “জঙ্গলে অদ্ভুত একটা জিনিস দেখে এলুম।”
শিবশঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, “কোনও জন্তু?”
“না, এক ধরনের ফল। লতানে গাছ। কলার মতো দেখতে থোলো থোলো ফল ঝুলছে।”
গিরধারী বলল, “বড়িয়া চিজ। ভেরি টেস্টফুল। ও জিনিসটা তরুকলা। পারেন তো দু-চার থোলো তুলে আনুন। খাঁটি ঘি আছে। শুকনো কাবাব বানিয়ে দোব মিরচা দিয়ে।”
উদয়ন ঝেড়েঝুড়ে উঠলেন। জয় বলল, “আমি যাব তোমার সঙ্গে।”
জয়া বলল, “বাঃ, বেশ স্বার্থপর তো তুই। একা-একা কেমন জঙ্গল দেখে নিবি?”
গিরধারী বলল, “তোম ভি যাও ম্যাডাম।”
“আপনাকে কে সাহায্য করবে?”
“আরে বহেনজি হিঁয়াপর দো আদমি তো হ্যায় নাকি?”
জয়া বলল, “দাদা আমি যাব?”
“যাও দিদি, তবে সাবধানে যেয়ো। তিনটে জিনিস সজাগ রেখো, চোখ, কান আর নাক।”
ওরা তিনজনে গভীর জঙ্গলের দিকে রওনা দিল। বড়-বড় গাছ। কতরকমের গাছ। ঝোপঝাড়। হঠাৎ আলো কমে গেল। একটানা ঝিঁঝি ডাকছে। তিতকুটে গন্ধ। জঙ্গলের ছোটখাটো প্রাণীরা ভীষণ ব্যস্ত। গাছের গুঁড়িতে লাল পিঁপড়ের দল অঙ্কের মতো আপ অ্যান্ড ডাউন ছে। শুঁয়োপোকার স্বাস্থ্য দেখে দু’জনেই আঁতকে উঠল।
উদয়ন বললেন, “প্রচুর ভিটামিন পায় তো, তাই সব ওইরকম চেহারা।”
গাছের শুকনো ডাল কঙ্কালের হাতের মতো ঝুলে রয়েছে। মাকড়সার জালই কত রকমের। কোথায় একটা পাখি ডাকছে অদ্ভুত শব্দে টিটির টিটির করে। উদয়ন আর সেই তরুলতা, যাতে তরুকলা ফলে খুঁজে পাচ্ছেন।।
“আশ্চর্য ব্যাপার। কোথায় গেল বল তো। এই হল জঙ্গলের খেলা! দিক ভুল হতে একটুও দেরি হয় না।”
জয় বলল, “চলো না, আর-একটু ভেতরে যাই।”
উদয়ন বললেন, “খেপেছিস! হারিয়ে যেতে পাঁচ মিনিটও লাগবে না। জঙ্গল বড় ভয়ঙ্কর জায়গা।”
জয়া কী একটা কুড়িয়ে পেল। শক্তমতো। ছুঁচলো। “এটা কী বাবা?”
উদয়ন দেখে বললেন, “বুলেট। কেউ শিকারটিকার করতে এসেছিল।”
“এখানে কী শিকার পাবে? আমরা তো কিছুই দেখছি না!”
“কিচ্ছু বলা যায় না রে জয়ী, কখন কী বেরিয়ে আসবে।”
হঠাৎ জয়ার নাকে একটা বোটকা গন্ধ লাগল। উদয়নও পেয়েছেন গন্ধটা।”
জয়া বলল, “বাবা।”
উদয়ন বললেন, “পেয়েছি মা। চল, সরে পড়ি।”
জয় জিজ্ঞেস করল, “গন্ধটা কিসের?”
উদয়ন বললেন, “হতে পারে বাঘ।”
তিনজনে পা চালিয়ে বেরিয়ে এলেন জঙ্গল থেকে। শুধু হাতে ফিরতে দেখে শিবশঙ্কর বললেন, “কী হল তোমাদের তরুকলা?”
উদয়ন বললেন, “জায়গাটা হারিয়ে ফেলেছি। ভেতরে বেশিক্ষণ থাকার সাহস হল না। মনে হল বাঘের গন্ধ। বাঘ কি আছে?”
গিরধারী বলল, “বাঘ নেই আবার। খুব আছে।”
ডাল, রুটি, তরকারি ভালই খাওয়া হল। গিরধারীর রান্না খুব ভাল। মসলাপাতি কিছুই তেমন নেই, স্রেফ হাতের কেরামতি। শিবশঙ্কর চিতপাত হয়ে শুয়ে পড়লেন পাথরের ওপর। সোনালি রঙের এক ধরনের পোকা উড়ছে ছোট-ছোট। উদয়ন উদাস চোখে তাকিয়ে আছেন বিশাল জঙ্গলের দিকে। জয় আর জয়া ছোটাছুটি করছে। গিরধারী মালপত্র সব প্যাক করে ট্রলিতে তুলছে, এমন সময় সারা জঙ্গল কেঁপে উঠল বাঘের গর্জনে।
গিরধারীর কোন ভয় নেই। হাসতে হাসতে বলল, “মামার খিদে পেয়েছে। রুটি, ডাল খাবে মামা? এখানে রেখে যাচ্ছি। আমরা চলে যাওয়ার পর এসে খেয়ে যেয়ো।”
শিবশঙ্কর বললেন, “উদয়, বন্দুকটা হাতের কাছে রাখো।”
উদয়ন বললেন, “এ-বাঘ ম্যানইটার নয়। এখানে ম্যানইটার নেই।”
জয় আর জয়া জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে।
জয় বলল, “দিদি, যদি একবারের জন্য দেখা যেত। জ্যান্ত বাঘ কখনও দেখিনি।”
জয়া বলল, “আমাদের বরাতে কি আর বাঘ দেখা আছে! ডাকটা তো ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে।”
গিরধারী বলল, “এইবার সব চলে আসুন। রাত ন’টার মধ্যে পৌঁছতেই হবে।”
ট্রলি স্টার্ট নিল। ক্রমশ স্পিড বাড়ছে। বাঘের ডাক থামেনি। মাঝে-মাঝেই ডাকছে। কোনও কারণে অসন্তুষ্ট হয়েছে। বেলা পড়ে আসছে। জঙ্গলে তাড়াতাড়ি রাত নামে। পথে তেমন কিছু আর হল না। দিদির কোলে মাথা রেখে জয় ঘুমিয়ে পড়েছিল। ন’টা পাঁচে তারা ডুমডুমা হল্টে পৌঁছে গেল। ট্রলি থেকে নামতেই দূবেজি এগিয়ে এল।
গিরধারী বলল, “সিংজি কোথায়?”
“আমার বাড়িতে।”
শিবশঙ্কর বললেন, “খুব বাড়াবাড়ি? কথাটথা বলতে পারছে?”
দুবে বলল, “সিংজির কিছু হয়নি। হয়েছে আমার লেড়কির। ডাক্তারবাবু সে আর বাঁচবে না।”
দুবে ফোঁস ফোঁস করে কাঁদতে লাগল।
শিবশঙ্কর বললেন, “আমি ডাক্তার নই, ডাক্তার আমার ছেলে।”
দুবে উদয়নের হাত ধরে বলল, “মেয়েটাকে বাঁচান ডাক্তারবাবু!”
দুবের কাঠের বাড়ি। লণ্ঠন জ্বলছে। চারপাশে জঙ্গুলে পোকা উড়ছে। এক-একটা আবার বুলেটের মতো ফটাস-ফটাস করে গায়ে এসে পড়ছে। জয় বাঘের ডাকে ভয় পায়নি, এই পোকার ভয়ে সিঁটিয়ে আছে। এক-একটা পোকার আবার বিরাট-বিরাট শুঁড়। জামার বুকের কাছে ঠ্যাং আটকে গিয়ে উড়তে পারছে না, তির তির করে ডানা নাড়ছে। পোকার জ্বালায় অস্থির অস্থির।
গলা পেয়ে সিংজি এক লাফে বেরিয়ে এলেন। দু’ হাত দিয়ে শিবশঙ্করকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “মেরা দোস্ত!”
“ব্যাপারটা কী?”
দুবের সেই মেয়েটি বিছানায় শুয়ে আছে। কোনও হুঁশ নেই।
সিংজি ডুমডুমা যাওয়ার সময় এই মেয়েটিকেই সেই হনুমানের বাচ্চাটা দিয়ে গিয়েছিলেন। এর বাবা আবার বিয়ে করছে শুনে সিংজি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। দুবে খামখেয়ালি লোক। মেজাজ কখন কেমন থাকে বলা মুশকিল। মেয়েটাকে যখন-তখন মারে। কোনওদিন খেতে পায়, কোনওদিন পায় না। ডুমডুমা থেকে ফিরছিলেন সিংজি। দেখতে এসেছিলেন। দেখেন, মেয়েটা জ্বরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে তিনদিন। কোনও চিকৎসা হয়নি। বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। গায়ে এক ফোঁটা রক্ত নেই। বদমাশ দুবে মনে মনে চাইছে, মেয়েটা মরে যাক। মরে গেলে সে সুখে নতুন সংসার পাতবে। ওর শ্বশুর পণ্ডিতজিটাও মহা শয়তান। ওর পুজো-অর্চনা সব বৃথা। লোকটা মহা ধান্দাবাজ।
উদয়ন বিছানার পাশে বসে পরীক্ষা করছেন রোগীকে। ময়লা চাদর। অপরিচ্ছন্ন ঘর। ভ্যাপসা গন্ধ। জ্বরে মেয়েটার গা পুড়ে যাচ্ছে। উদয়ন বললেন, “কেস খুব সিরিয়াস। এই জঙ্গলে এর কোনও ইলাইজ সম্ভব নয়। একে নিয়ে যেতে হবে আমার হাসপাতালে। সিভিয়ার ইনফেক্শান। ব্লাড দিতে হবে। মেয়েটা অ্যানিমিয়ায় প্রায় শেষ হতে চলেছে।”
সিংজি দুবেকে বললেন, “মেয়েটার কী অবস্থা করেছ বুঝতে পারছ?
“সবই রামজির হাত।”
আর যায় কোথায়! সিংজি সপাটে এক চড় হাঁকালেন দুবের গালে। “শয়তান! ইসমে রামজিকা ক্যা করনা হায়। ইয়ে তুমহারা শয়তানি। দুবে! এই মেয়ে যদি মারা যায় তা হলে তোমাকে আর তোমার ওই শ্বশুরকে শ্বশুরাল পাঠাব!”
দুবে থতমত হয়ে গেল। জয় আর জয়া মেয়েটির মাথার কাছে দাঁড়িয়ে আছে! যেন দুটো দেবশিশু।
॥ ২৯ ॥
সায়েব আমলের রেল কোম্পানির বাড়ি যেমন হয়, সেইরকম একটা বাড়ি। দুটো ঘর, একটা উঠোন। রক, রান্নাঘর। রান্নাঘরের ছাতে ধোঁয়া বেরোবার জন্যে বাচ্চা হাতির পিঠের মতো পোড়া মাটির পাইপ। জয় আর জয়া দু’জনেরই এইগুলো দেখতে বেশ মজা লাগে। আলাদা একটা শোভা। মনে হয় এখনই বুঝি জ্যান্ত হয়ে চলতে বেরোবে। বাড়ির বাইরের দেওয়াল প্লাস্টার করা নয়। রেল কোম্পানির বাড়ি যেমন হয় আর কি। সিমেন্ট পয়েন্টিং করে লাল রং লাগানো। উঠোনে একটা কদমগাছ। ডালপালা দু’পাশে লম্বা-লম্বা হাত ছড়িয়ে নাচছে যেন।
রাত্তিরবেলা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, বাদুড় যখন গাছের ডাল থেকে ছাতার মতো খসে পড়ে আকাশে উড়ে যায় মাঝরাতের চাঁদের গায়ে মেঘ যায় খেলা করতে, তখন পৃথিবীতে কি অনেক কাণ্ডকারখানা হয়! গাছ মাঠের ওপর দিয়ে হনহন করে হাঁটছে। অন্য গাঁয়ে তার আত্মীয়কে দেখতে যাচ্ছে। কালো হাঁস রুপোর ডিম পাড়ছে। আকাশের তারা পুকুরে চান করতে নামছে। বাঁকা রাস্তা সোজা হয়ে যাচ্ছে। কে জানে কী হয়! কেইবা সারা রাত জেগে থেকে দেখছে। জয়া একদিন জয়কে বলেছিল, “চল, আমরা সারারাত জেগে থেকে দেখি। শ্রাবণী পূর্ণিমার গভীর রাতে লম্বা লম্বা এক ধরনের ফড়িং উত্তরদিক থেকে উড়ে আসে, যাদের মুখ নাকি ঠিক মানুষের মতো।” এই সব কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না, তবু করতে হয়। পৃথিবীতে রহস্যের কি শেষ আছে!
জঙ্গল ঘেরা নতুন জায়গায় এলে এইসব অদ্ভুত-অদ্ভুত ভাবনা আসবেই আসবে। চেনাকে অচেনা মনে হবে। জয়ের একটু ভয়ভয় করছে। লণ্ঠনের আলোয় মানুষের ছায়া বড়-বড় দেখাচ্ছে। একটা কুকুর শুয়ে আছে বাঘের মতো বড় দেখাচ্ছে। গাছের পাতায় পাতায় উনোনের ধোঁয়া সরু সুতোর মতো পাক খাচ্ছে। কদমের ডালে ছোট ছোট ঘণ্টা দুলছে। তারই টিং টাং শব্দ।
জয়া দুবের মেয়ে লছমির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ফুলের মতো ফুটে আছে যেন। কত অসহায়! জয়া কপালে হাত রাখল। আলতো হাত। খুব জ্বর। জয়া বলল, “বাবা, কপালে জলপটি দেব?”
শিবশঙ্কর বললেন, “ঠাণ্ডা জলে মাথাটা বেশ করে ধুইয়ে দেওয়াই ভাল। তিনের ওপর উঠলে তাই করা হত আমাদের ছেলেবেলায়।”
উদয়ন বললেন, “ভাবছি, এত বড় বড় চুল, যদি জল বসে যায়!”
“জল বসবে না মনে হয়, হিটে টেনে নেবে। অনেকটা আরাম পাবে উদয়ন।”
“তা হলে সাহস করে দেখা যাক।”
জয়ের মনে পড়ল, তার এবার এইরকম প্রবল জ্বর হয়েছিল। তিন, চার। চোখ বুজিয়ে পড়ে থাকত সারা দিন। মাথার কাছে মা, পায়ের কাছে দিদি। বাবা মাঝে-মাঝে এসে দেখে যাচ্ছেন। জানালার কাছে চেয়ারে বসে আছেন দাদি। সকলেরই কী দুশ্চিন্তা! চার্চের ফাদার সাইকেলে আসছেন, দিনে অন্তত দুবার, “হাউ ইজ মাই সান! প্রে প্রে, প্রে টু দি লর্ড!”
জয়ের সেই কথাটা মনে পড়ল, “প্রে, প্রে, প্রে টু দি লর্ড!”
দিদি লছমির মাথা ঘোয়াচ্ছে। সিংজি গুম মেরে দাঁড়িয়ে আছেন একপাশে। দুবের চড় খেয়েও লজ্জা নেই। বলছে, “ছোটদের এইরকম জ্বর হতেই পারে। আগেও কতবার হয়েছে।”
জয় অন্ধকারে কদমগাছের তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। মাথার ওপর নীল-কালো আকাশ। মা-কালীর গায়ের মতো রং। মা-কালীকে খুব আপন মনে হয় জয়ের। আগে অনেকবার প্রার্থনা করে দেখেছে, বেশ ফল হয়। এই বিশ্বাসের কথা সে কাউকে বলে না। শিরিন বারণ করে দিয়েছে, বলেছে, “বিশ্বাসটা নিজের মধ্যে রাখবি। তা না হলে আর কোনও কাজ হবে না। স্বপ্নে যদি কিছু দেখিস কাউকে বলবি না, তা হলে স্বপ্নের ফল ফলবে না!”
জয় আকাশের দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলতে লাগল মনে মনে, “মা, আমার কথা শোনো মা, মেয়েটাকে ভাল করে দাও মা!” জয় বেশ বুঝতে পারল, প্রার্থনাটা বেশ জমে গেছে। মনটা খুব স্থির হয়েছে।
ফাদার একবার কথায়-কথায় আর-এক ফাদারকে বলেছিলেন, জয় পাশে দাঁড়িয়ে শুনেছিল, যার জন্যে প্রার্থনা করছ, তার চেহারাটা চোখ বুজিয়ে ভাববে। ভাবতে ভাবতে বলবে, “ও লর্ড! কিওর হিম, কিওর হিম।”
জয় চোখ বুজিয়ে লছমীর মুখটা ভাবছিল, আর প্রার্থনা করছিল। বেশ তন্ময় হয়ে গিয়েছিল, এমন সময় কদমগাছের ডালে একটা প্যাঁচা এসে বসায় ডালটা দুলে উঠল। বেশ বড় একটা প্যাঁচা। ধবধবে সাদা রং। জয়ের মনে হল, এটা খুব ভাল লক্ষণ। সাদা প্যাঁচা মঙ্গল আনে। ঠোঁটে ঠোঁট ঘষে, খটাস-খটাস শব্দ করছে। মাঝে-মাঝে দমকা বাতাসে গাছের পাতা দুলে উঠছে।
জয় ঘরে ঢুকে দেখল, লছমি চোখ মেলেছে। জয়া কপালে হাত রেখে জিজ্ঞেস করছে, “কেমন লাগছে তোমার বোন? একটু ভাল?”
ঘরে এত অপরিচিত লোেক দেখে লছমি অবাক হয়ে গেছে। প্রত্যেকের দিকে এক-একবার করে তাকাচ্ছে আর চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। উদয়নের ফরসা ধারালো মুখ। চোখে চশমা। শিবশঙ্করের সাধুর মতো মুখ। গিরধারীর থলথলে হাসি-হাসি মুখ। জয়ার মুখ, জয়ের মুখ। লছমি যেন সব দেখছে। ঘরে একটা আলো জ্বলছে টিমটিম করে। সেই আলোয় বড় বড় ছায়া পড়েছে দেওয়ালে’।
লছমি খুব ক্ষীণ গলায় বলল, “বহিন, পানি পিয়ুঙ্গি।”
জয়া চারপাশে তাকিয়ে দেখল, ঘরে কোথাও কোনও জলের কুঁজো নেই। আসলে এই দুবে লোকটা মহা অলস। সব সময় পড়ে পড়ে ঘুমোয়। সংসারের কাজ কিছুই করে না। সব ওই বাচ্চা মেয়েটিকে দিয়ে করায়। লছমি জ্বরে পড়েছে, কে জল আনবে! পাশের ঘরে একটা মাটির কলসি রয়েছে, জল নেই একফোঁটা। কিছু দূরে রাস্তার ধারে একটা টিউবওয়েল আছে। জয়া দেখেছিল ঢোকার সময়! গেলাস কোথায়?
সিংজি ভীষণ রেগে চিৎকার করে উঠলেন, “অ্যায় দুবে!”
দুবে বোধ হয় সত্যিই ঘুমোচ্ছিল। একেবারে দায়-দায়িত্বহীন আকাট একটা মানুষ। আজকের দিনটা যাক তারপর না হয় ভাবা যাবে কালকের কথা। গিরধারী এক লাফে ঘরের বাইরে চলে গেল। তার এইসব ধানাই-পানাই ভাল লাগে না একেবারে। যা করতে হবে তা দুমদাম করে ফেলাই ভাল। করার পর একটু বোসো, গল্প করো, সময় নষ্ট করো। তখন কত সুখ! বাবা বলতেন, “কাজ সেরে বোসো, শত্রু মেরে হাসো।” গ্রিধারী অন্ধকারে ছুটতে-ছুটতে চলে গেল লাইনের ধারে। সেখানে ট্রলি, ট্রলিতে আছে,জলের পট।
জয়া লছমিকে জল খাওয়াল, কী ভীষণ তৃষ্ণা! কতক্ষণ জল খায়নি কে জানে!
উদয়ন একপাশে সরে গিয়ে শিবশঙ্করকে ফিসফিস করে বললেন, “এখানে রাখলে মেয়েটাকে কোনওভাবেই বাঁচানো যাবে না। লাংসে হেভি কনজেশন। মরুক বাঁচুক একে নিয়ে যেতে হবেই।”
সারাটা রাত সবাই বসে রইল লছমিকে ঘিরে। শেষ রাতে হঠাৎ টেম্পারেচার নামতে শুরু করল। হাত পা বরফের মতো ঠাণ্ডা। গরম জল! হটব্যাগ! কোথায় পাওয়া যাবে! বৃথাই ছোটাছুটি। গিরধারী ঢুলছিল। তার চটকা ভেঙে গেল। হটব্যাগ না পাওয়া যাক, গরমজল তো পাওয়া যাবে!
গিরধারী রকের একপাশে সরে গিয়ে ঝপাঝপ্ কয়েকবার ডন-বৈঠক মেরে নিল। তারপর হাঁটুতে রেখে একটা গাছের ডাল ভাঙল মটাস শব্দে। আগুন আছে, গাছের শুকনো ডাল আছে, জল আছে, “গিরধারী ভি হ্যায়। তব তো গরম পানিভি হ্যায়।” গিরধারী এইসব বলতে-বলতে আগুন জ্বেলে ফেলল। হে ভগবান! লছমি যেন বাঁচে।
শিউলি – 30-39
॥ শিউলি – 30-39 ॥
॥ ৩০ ॥
একটা বড় বোতল পাওয়া গেল। গিরধারী বোতলটাকে চিনতে পেরেছে। গরমজল ভরছে আর মনে মনে বলছে, “দুবে, তোমার সব গুণই আছে। মেয়ে বিনাচিকিৎসায় মরো-মরো আর তুমি ব্যাটা নেশাভাঙ করছ। তোমাদের মতো মানুষদের কী করা উচিত জানেনা, মাটিতে পুঁতে ডালকুত্তা দিয়ে খাওয়ানো।”
জয়া বোতল দিয়ে লছমির পায়ে সেঁক দিচ্ছে। জয় কপালে জলপট্টি লাগাচ্ছে। শিবশঙ্কর, উদয়ন, দুবে, খড়ক সিং, গিরধারী বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে পরামর্শ করছেন, কী করা যায়! এখানে কিছুই পাওয়া যায় না। এক কবিরাজ আছেন, আর আছেন এক ওঝা। সাপে কামড়ালে কি ভূতে ধরলে চিকিৎসা করেন। সেসব ভয়ঙ্কর চিকিৎসা।
বাইরে গাছের পাতায় বাতাসের হুটোপাটি। এতক্ষণে চিনে-লণ্ঠনের মতো আকাশে একটা চাঁদ উঠেছে। পূর্ণিমার পর যেমন ওঠে। অনেক রাতে। ভৌতিক সঁদ। কোথায় কী ফুল ফুটেছে। তীব্র গন্ধ ভেসে আসছে। একটা পাখি আচমকা চ্যাঁ চ্যাঁ করে ডাকছে।
গিরধারী কোথায় ছিল কে জানে। এস বললে, “আর দেরি নয়, রাত দুটো বাজল। রান্না হয়ে গেছে। খাবেন চলুন।”
সামনের রকে যে যেমন পারলেন বসে পড়লেন। একটাই লণ্ঠন। আলোর তেমন মেজাজ নেই। শালপাতার থালায় মোটা-মোটা রুটি, জল আর আলুর তরকারি। তাই যেন অমৃত। দূরে কাঠের আগুনে ধিকিধিকি জ্বলছে। জঙ্গলের দিক থেকে নানারকম পোকা উড়ে এসে লণ্ঠনের ঘাড়ে পড়ছে। জয় ভয়ে দিদির গায়ে সিঁটিয়ে আছে।
জয়া বলছে, “ভাই! তুই এইসব পোকা আগেও কত দেখেছিস, আজ এত ভয় পাচ্ছিস কেন? এরা বেশিরভাগই হল জাতে ফড়িং, না হয় মথ, আর ওই বড়গুলো হল গুবরে। একবার চিৎ হয়ে গেলে আর উড়তে পারে না, পড়ে পড়ে সাঁতার কাটে ওই দেখ তিনটে এরই মধ্যে চিত হয়ে গেছে।”
জয় বলল, “আমার ভয় করছে ওই ঘুরঘুরেগুলোকে। এক-একটার সাইজ দেখেছিস দিদি! ঘুরঘুরে যদি কামড়ায়, মেঘ না ডাকলে ছাড়ে না।”
“কে তোকে এইসব আজগুবি কথা বলছে! আমাকে কতবার কামড়েছে! কিচ্ছু না, যেখানে কামড়াবে সেইখান থেকে অল্প একটু মাংস তুলে নেবে। একটু জ্বালা করবে, জায়গাটা লাল হয়ে ফুলে উঠবে। তাতে কী হয়েছে! পৃথিবীতে বাঁচতে গেলে মানুষকে কত কীই তো কামড়াতে পারে! আমাকে একবার কাঁকড়া বিছে কামড়েছিল। তুই তখন খুব ছোট। ট্যাঁট্যাঁ করে খালি কঁদতিস। তোয়ালের ওপর শুয়ে থাকতিস। আর মা বলত, এই আমার এক কাঁদুনে ছেলে হয়েছে। জয়ীটা আমার এইরকম ছিল না।”
“তুই তখন কী করতিস দিদি!”
“বাবু হয়ে বসে তোকে কোলে শুইয়ে হাঁটু নাচাতুম, আর আঁ-আঁ করে গান গাইতুম। খোকা ঘুমলো পাড়া জুড়লো বর্গি এল দেশে। বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দোব কিসে।”
“তখন আমি ঘুমিয়ে পড়তুম!”
“অতই সোজা! তোকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেই ঘুমিয়ে পড়তুম। তবে একটা ছড়ায় খুব কাজ হত, স্টোভের শব্দের সঙ্গে বললেই তোর ঘুম এসে যেত।” “মনে আছে?”
“মনে থাকবে না? ছড়া কেউ ভোলে? সেই ছড়াটা হল:
সৈদাবাদের ময়দা আর কাশিমবাজারের ঘি।
একটু সবুর করো খোকা, লুচি ভেজে দি।”
“লুচি! দিদি! এই সময় ফুলকো ফুলকো লুচি আর ঝালঝাল, লাললাল আলুর দম কেমন লাগত।” কথাটা বলেই কথাটা আবার ফিরিয়ে নিল জয়। “না রে দিদি, সত্যি বলছি, আমার খেতে ভাল লাগছে না। লছমি তো আমাদেরই বোন! সে মনে হয় সারাদিন কিছুই খায়নি। খেয়েছে রে দিদি!”
জয়া একটু ভেবে বলল, “মনে হয় খায়নি। কে খাওয়াবে! ওর বাবাটা যেন কেমন!”
“সকলের বাবা কেন আমাদের বাবার মতো হয় না!”
“হাতের পাঁচটা আঙুল কি সমান! হয়নি যখন হয়নি। কী আর করা যাবে বল?”
“দিদি, লছমি বাঁচবে তো!”
জয়ের গলা ধরে আসছে। জয়া জানে জয় এইবার কাঁদবে। এত নরম ওর মনটা! একবার তার খুব ধুম জ্বর হয়েছিল। জয়কে তার মাথার কাছ থেকে সরানো যায়নি। কানের কাছে মুখ এনে কখনও ফিসফিস করে বলে “দিদি, ডাঁসা পেয়ারা খাবি!” কখনও বলে, “নিমকি বিস্কুট খাবি! খুব ভাল লাগবে জ্বরের মুখে। মা সজনে ডাটা রেঁধেছে চেয়ে আনব? চিবোবি?” সারাদিনেও যখন জ্বর ছাড়ল না, তখন জয় বাবাকে কাঁদতে-কাঁদতে বলছে, “তুমি কী ডাক্তার সাতদিনেও দিদি ভাল হল না। দিদি, আমার মরে যাবে বাবা, আমার একটা মাত্র দিদি।” এমন পাগল ছেলে! শিউলি ফুলের মতোই নরম। একমাথা পশমের মতো চুল। খরগোশের মতো দুটো কুচকুচে কালো চোখ। তাকালেই মনে হয় কতকালের এক সাধু যেন বসে আছে চোখের ভেতর। বুদ্ধদেবের মতো বড়-বড় দুটো কান। হাত দুটো শরীরের তুলনায় অনেক লম্বা। দাদি বলেন, এসব নাকি ভীষণ ভাল লক্ষ্মণ। ওকে ঠিকমতো তোমরা মানুষ কোরো। শুধু লেখাপড়া করে বড়-বড় ডিগ্রি ডিপ্লোমা পেলেই, মানুষ মানুষ হয় না। সৎশিক্ষা দিতে হয়, জীবনের শিক্ষা। সব চেয়ে বড় শিক্ষা হল, মানুষকে ভালাবাসার শিক্ষা, প্রকৃতিকে ভালবাসার শিক্ষা, জীবজন্তুকে ভালবাসার শিক্ষা। সদাচার, সৎভাবনা, সৎসঙ্গ।
জয় আবার প্রশ্ন করল, “কী রে দিদি, বল না, লছমি বাঁচবে তো! তুই যা বলিস তা-ই হয়।”
“চল, ওঠ, সকলের খাওয়া হয়ে গেছে।”
বিশাল একটা গুবরে-পোকা ভো করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে ঠকাস শব্দে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে গেল মেঝেতে। যেন উড়ন্ত গণ্ডার। ইস্পাতের মতো শক্ত শরীর। মেঝেতে পড়েই সেই চিতসাঁতার কাটার ভঙ্গি। সারা রাত ওইভাবে থাকবে। ভোরবেলায় নিস্তেজ। পোকাদের যত দাপট রাতে। দিন হল পাখির, প্রজাপতির, ডানাকাঁপানো ফড়িংয়ের। ফড়িং যেন ছোট্ট ছোট্ট হেলিকপ্টার।
হাত ধুতে ধুতে জয় বলল, “কই দিদি,বললি না!”
“দাড়া, পরে বলব। ভেবে বলব।”
“তার মানে বাঁচবে না।”
“ছিঃ অমন কথা বলতে নেই। সব সময় প্লাস ভাববি। মাইনাস নয়।”
জয়ের হাই উঠল। গিরধারী পাশেই ছিল, বলল, “আমি বলি কী, তোমরা দু’জনে ট্রলিতে গিয়ে শুয়ে পড়ো। ব্যাগে কম্বল আছে, চাদর আছে। দু’ঘণ্টা ঘুমিয়ে নাও।”
শিবশঙ্কর দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। তিনি বললেন, “ফাকায় না শোয়াই ভাল। কত কী আছে। তা ছাড়া হিম পড়ছে, ঠাণ্ডা লেগে যাবে।”
“হাঁ, সো বাত তো ঠিকই হায়।”
“শের না থাক, জঙ্গলে কটাস আছে, জংলি কুকুর আছে, শেয়াল আছে।”
গিরধারী মাথা নেড়ে বলল, “শোচা নেহি।”
জয়া বলল, “দাদি, আমাদের ঘুমপায়নি। আমরা লছমির কাছে রাত জাগব।”
“সেই ভাল। আমি এই বাইরেটায় পায়চারি করব। রাতের আর কতটুকুই বা বাকি আছে!’
গিরধারী বলল, “থোড়ি হায় বাকি। সব রাত বুধ্গয়ি।”
শিবশঙ্কর বললেন, “থোড়ি কে লিয়ে, তাল নহি ছোড়ি! আহা! কী কথা! নর্তকী নাচছে। নেচেই চলেছে রাতভোর। শেষটায় আর যেন পারছে না। পা আর চলছে না। তখন একজন বলছে, এইবার না হয় বন্ধ করো। বিশ্রাম করো। নর্তকী বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখছে, রাতের আকাশে আলো ফুটছে। সারা রাতের মুজরো। সবাই দেখছে। সে হেরে যাবে! তখন বলছে, সব রাত বুধগয়ি, থোড়ি হায় বাকি, থোড়ি কে লিয়ে তাল নহি ছোড়ি। আমরাও তাল ছাড়ছি না। বুঝলে গিরধারী! দিনের প্রথম পাখিটা যেই ডেকে উঠবে, সঙ্গে-সঙ্গে আমাদের ট্রলি স্টার্ট করবে। গিরধারী, একমাত্র তুমিই আমাদের মধ্যে বেশ মোটা আর থলথলে আছ।”
“মহারাজ, সে আমার যৌবনকালের কথা। আমার বাবা ছিলেন মহাজন। অঢেল পয়সা। তোফা খানা, সেই সঙ্গে কুস্তি। শরীর চড়চড় করে বেড়ে উঠল হাতির মতো।”
“তারপর!”
“তারপর সেই একই কহানিয়া। সরাবী আদমির কিছু থাকে না। সব ফৌত হয়ে গেল। পিতাজি পপার। সব বেচে, খেয়ে বেহস্তে চলে গেল। আমি আর আমার মা ভিখিরি বনে গেলুম। রামজি কা কেয়া কৃপা! তা বাবুজি, আমাকে কি করতে হবে, বাতাইয়ে!”
“তুমি কম্বলটম্বল জড়িয়ে মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বসবে, আর আমি ট্রলি চালাব।”
“পারবেন?”
“অনেক চালিয়েছি আমি। গিরধারী! আমি রেলের এঞ্জিনিয়ার ছিলুম। এইসব লাইনটাইন আমারই পাতা।”
“ঠিক হায় বাবুজি! আমি একটু লেটে নিই।”
“উঠতে পারবে?”
“জরুর!”
গিরধারী রকের একপাশে চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। সঙ্গে-সঙ্গে নাসিকাগর্জন।
॥ ৩১ ॥
একসঙ্গে এত পাখি তো শহরে ডাকে না। বউ কথা কও, দোয়েল, শ্যামা, ময়না, টিয়া, খঞ্জনা, দাঁড়কাক, শালিক, ছাতারে, হাঁড়িচাচা, টুনটুনি, মউটুসি, ফুলটুসি, তিতির, বক। সে এক মহাশোরগোল। গাছের পাঁচতলায় বসে হনুমানের হুপহাপ। সকলেই যেন বলতে চাইছে, ভাই উঠে পড়ো, উঠে পড়ো সব, সকাল এসে গেছে। আমাদের দিনের মেয়াদ ওই তো মাত্র বারো ঘণ্টা। এর মধ্যে খেতে হবে, খেলতে হবে, আকাশে উড়তে হবে, পাখনা ঝটপটিয়ে চান করতে হবে কখনও ধুলোয়, কখনও জলে, কত গান গাইতে হবে! আমাদের কাজের কি শেষ আছে! কেউ খাবে পোকা, কেউ শুধু ফল, কেউ ধরবে মাছ। কেউ আবার নিজেই খাদ্য হয়ে যাবে। সন্ধেবেলা হিসেব মেলাতে বসে দেখা যাবে, পাশের বাসার চঞ্চল ফেরেনি। সেই দুপুর থেকেই মালার কোনও খোঁজ নেই। যাও, দ্যাখোগে যাও, জঙ্গলের কোনও গাছের তলায় পড়ে আছে সাদা পালক, হলুদ পালক, কি নীল পালক। কি যাও কোনও হাটে। মানুষ ধরে নিয়ে গিয়ে খাঁচায় বন্দি করেছে। আকাশ কেড়ে নিয়েছে। মাটির জীব আকাশের স্বাধীনতার মর্ম কী বুঝবে!
গিরধারী থম মেরে একপাশে বসে এইসব ভাবছিল। ঘাড়ের কাছের একটা জায়গা লাল হয়ে ফুলে আছে। কাল রাতে কোনও এক সময় বিছেটিছে কিছু কামড়ে দিয়েছে। এইসব হলে সে এই ভাবে: আমি মানুষ, এত বড় একটা দেহ, ছোটখাটো পোকামাকড় আমার কী করবে! একটু জ্বালা করবে, জায়গাটা কিছুদিন ফুলে থাকবে। বড়জোর সামান্য জ্বর হবে। এই সময়টায় তার ভীষণ মায়ের কথা মনে পড়ে। সুখের জীবন থেকে দুঃখের জীবন। শেষে মারাই গেলেন অকালে। বড়লোক গরিব হয়ে গেলে বিশ্রী লাগে। গিরধারী ভাবল, পরের বার সে পাখি হয়ে জন্মাবে। কাঠঠোকরা হতে তার বেশি ভাল লাগে। প্রথম প্রথম ভাবত বক হবে। সাদা ধবধবে। অনেক বকের আবার লেজের দিকে সামান্য একটু হলুদের ছোঁয়া থাকে। যেন রাঁধতে-বাঁধতে তুলে হলুদের হাত মুছে ফেলেছে। বক হবে না গিরধারী। যতই সাদা হোক। সারাদিন জলে দুটো পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে তার নির্ঘাত নিমোনিয়া হয়ে যাবে।
গিরধারী এইসব ভাবছিল রেল লাইনের ওপর বসে। স্লিপারের মাঝখানের সব পাথর রাতের শিশিরে ভিজে গেছে। আর-একটু পরেই রোদ উঠবে। পুবের আকাশ সিঁদুরে হয়েছে। গিরধারী উঠে দাঁড়াল। এইবার ওঁরা আসছেন। সবার আগে খড়ক সিং। দু’ হাতের ওপর শুইয়ে নিয়ে আসছেন লছমিকে। চাদর দিয়ে মোড়া। সিংজির মাথায় জরির কাজ-করা তাজ। আলোয় চকচক করছে। পেছনেই উদয়ন। তাঁর পেছনে শিবশঙ্কর। তাঁর একপাশে জয় আর একপাশে জয়া। সবার শেষে লছমির বাবা দুবে।
গিরধারীর কাছে এসে শিবশঙ্কর বললেন, “দেখলে তো, সেই দেরি হয়ে গেল। তুমি অবশ্য ঠিকই উঠলে, আমরাই দেরি করে ফেললুম। গিরধারী, তুমি কি সাধক? সত্যি বলবে!”
“কেন মহারাজ, এ-সন্দেহ কেন হল আপনার?”
“তুমি সারাদিন একটুও না বলে পরিশ্রম করতে পারো। তোমার মুখে সবসময় একটা হাসি। বাইরের লোকদেখানো নকল হাসি নয়। ভেতরের সাচ্চা হাসি। আর পনেরো মিনিটের ঘুমেই তোমার চলে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, তোমার কাছে এলে মনে বেশ একটা আনন্দ আসে। এ ক্যায়সে হো সেকতা। তোমার চোখ দুটো আকাশের মতো নীল। তোমার দাঁত ঝকঝকে সাদা। তোমার চুল কুচকুচে কালো। তোমার মুখে একটা আলো।”
গিরধারী শিবশঙ্করের হাত দুটো চেপে ধরে বলল, “অ্যায়সি না বোলো মহারাজ। মেরা কুছ নেহি হ্যায়। এক ইনসান। বাস্, অওর কুছ নেহি। পরে একটু কথা হবে মহারাজ! আমরা এখন স্টার্ট করি। রোদ আর একটু চড়লে আমব্রেলা ফিট করব। এখন খোলাই চলি। স্পিড় পাওয়া যাবে।”
যেমন প্ল্যান হয়েছিল, গিরধারী বসল লছমিকে কোলে নিয়ে। পাশে জয়া। তার কাছে জলের বোতল, ভাঁজকরা একটা গামছা। দিদির পাশে জয়। উদয়ন এমনভাবে বসেছেন, যাতে ছেলে মেয়ে দুটো কোনওসময় ছিটকে না পড়ে যায়। সিংজি বসেছেন খাপখোলা তরোয়ালের মতো। মাথায় ঝকঝকে জরির তাজ। শিবশঙ্কর এইবার স্টার্ট করবেন। লছমির বাবা দুবে লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে শুকনো মুখে। উদয়নকে বলছে “ডাক্তারবাবু, আমার মেয়ের জীবন আপনি ফিরিয়ে দেবেন। দেবেন তো ডাক্তারবাবু!” দুবের চোখে জল। সিংজি এমন চোখে তাকাচ্ছেন, যেন ভাল করে দেবেন। জয়ার সেই দেখে খুব কষ্ট হল। সাধারণত সে বড়দের ব্যাপারে কথা বলতে চায় না। এখনও সে বড় হয়নি। সবে একটু-একটু বড় হয়েছে। তবু সে না বলে পারল না, “আমরা সবাই খুব চেষ্টা করব। আপনি ভাববেন না। ওখানে ভাল মিশনারি হাসপাতাল আছে।”
দুবে বলল, “দিদিমণি, আমাকে ছুটি না দিলে আমি তো যেতে পারব না।”
খড়ক সিং হুঙ্কার দিলেন, “যেতে তোমাকে হবে না। মেয়ে আমাদের, আমরা বুঝব। তোমার পরশু বিয়ে, তুমি সেই বিয়েটাই ভাল করে করো, মেয়ের ভাবনা আমরাই ভাবব।”
“রেডি, ওয়ান, টু থ্রি,” শিবশঙ্কর ট্রলি ছেড়ে দিলেন। বাতাস আর বাতাস। চারদিকে জমজমাট পাখির ডাক। সবাই সুস্থ, একমাত্র গিরধারীর কোলে মেয়েটাই অসুস্থ। চোখ বুজিয়ে পড়ে আছে ন্যাতার মতো। মেয়েটার মুখে একটা কিছু আছে, দেখলেই ভীষণ মায়া হয়। সিংজির দোষ নেই। মেয়েটাই টানছে সকলকে। গিরধারী সেইটাই দেখছিল। গা বেশ গরম। জ্বরের তাড়সে মুখটা থমথমে লাল। আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘ। সারাটা দিন একটু মেঘলা-মেঘলা থাকলে বেশ হয়। জয়া গামছার ভাঁজ খুলে রেডি হচ্ছে। প্রয়োজন হলেই বাতাস করবে। এইরকম একটা ভয়ঙ্কর সময়েও জয়ার ভাল লাগছে এই কারণে, একসঙ্গে সবাই পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি কেমন বসে আছে। সবাই কত ভাল, কত উপকারী। ভাল লাগছে আরও একটা কারণে, কত বড় একটা কাজ পাওয়া গেছে, একটা মেয়েকে যেমন করেই হোক বাঁচাতে হবে। গিরধারী কেমন যত্ন করে লছমিকে ধরে আছে। একটা ভীষণ নরম বিছানাতেও এত আরামে শোওয়া যেত না।
শিবশঙ্কর বললেন, “আমার খুব ইচ্ছে করে, ছোট-ছোট ছেলেমেয়ে, যাদের কেউ দেখার নেই, যত্ন করার নেই, তাদের জন্য হোম তৈরি করি একটা। ওইসব বিলিতি মিশনারি কায়দার নয়। ভারতীয় ধরনের। একটা বড় বাড়ি। সেখানে আমরা সবাই একসঙ্গে থাকব, একটা বড় পরিবারের মতো। যেমন ছেলেবেলায় আমাদের বিশাল বড় এক যৌথ পরিবার ছিল ভাগলপুরে, বাবা, জ্যাঠা, কাকা, দাদা, মেজদা, পিসি, খুড়ি। ভালবাসায়, শিক্ষায় সবাই বড় হবে। কেউ ভাববে না আমি পর। আমি আশ্রমে আছি, আমাকে সবাই দয়া করছে। একটা মানুষ যদি অন্যের দয়া আর উপেক্ষা নিয়ে বড় হয়, সে কোনওদিন সুস্থ সুন্দর মানুষ হতে পারে না। কুঁকড়ে যায়। কত-কত জীবন এইভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আর আমরা কেবল আমাদের কথাটাই ভাবছি। আমার ছেলে, আমার মেয়ে, আমার নাতি, আমার নাতনি! আমরা সব অপরাধী, স্বার্থপর। যতদিন আমরা থাকব, ততদিন এ-দেশের কিছু হবে না।”
গিরধারী বলল, “আপনি যা বললেন, তা যদি করতে পারেন, আমি সব ছেড়ে আপনার কাছে চলে আসব। আপনার সেই হোমের সব কাজ আমি করব। বাজার করা, রান্না করা, ছেলেমেয়েদের সেবা করা। আর আমি ষাট হাজার টাকা জমিয়েছি, সেই টাকাটা আপনাকে আমি দিয়ে দেব।”
খড়ক সিং বললেন, “আমি আমার বাড়িটা আর জায়গাজমি সব দিয়ে দেব। যখন যা হুকুম করবেন, সব করে দেব। আমার শরীরে এখনও খুব শক্তি আছে।”
জয়া বলল, “আমি আর মা হাতের কাজ শেখাব।”
উদয়ন বললেন, “আমি ডাক্তার হব।”
জয় বলল, “আমি তা হলে কী করব!”
জয়া বলল, “তুই একেবার ছোট যারা তাদের পড়াবি।”
জয় খুব খুশি হল। কিছু একটা করতে না পারলে ভাল লাগে নাকি!
খড়ক সিং বললেন, “আপনারাই বলুন, মেয়েটাকে এনে আমি কোনও অন্যায় করেছি?”
শিবশঙ্কর বললেন, “খুব ভাল করেছ। এর চেয়ে ভাল কাজ আর হয় না।”
“যদি খারাপ কিছু হয়ে যায়!”
“হবে না। আমরা আছি। উদয়ন আমার ছেলে, প্রশংসা করা উচিত নয়, ও খুব ভাল ডাক্তার।”
উদয়ন এই ফাঁকে লছমির নাড়িটা একবার দেখে নিলেন। বেশ ভার হয়ে আছে। তেমন কিছু ওষুধ পড়েনি। চিকিৎসা শুরু হলে মনে হয় সেরে উঠবে। ট্রলি সাঁই-সাঁই দৌড়চ্ছে। রোদের তেমন তেজ নেই। লছমি এক-একবার চোখ খুলছে। চোখে একটা ভয়, কেমন যেন একটা আতঙ্কের ভাব। জয়া কপাল টিপে দিচ্ছে, ছোট্ট, চুলঘেরা কপাল।
তখন ক’টা হবে! রাত প্রায় দশটা। সকলে নিরাপদে সরলা স্টেশনে এসে পোঁছল। গিরধারী সেই একভাবে ষোলো-সতেরো ঘণ্টা লছমিকে কোলে নিয়ে বসে থাকার ফলে পা সোজা করতে পারছে না। অবশ হয়ে গেছে। উদয়ন লছমিকে কোলে তুলে নিলেন। খড়ক সিংয়ের কাঁধে ভর রেখে গিরধারী পায়ের রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে।
শিবশঙ্কর জিজ্ঞেস করলেন, “সোজা হাসপাতালে, না বাড়িতে।”
উদয়ন বললেন, “সোজা হসপিটাল যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। নার্সিং আর মেডিসিন—দুটোরই ভীষণ প্রয়োজন।”
“তা হলে তুমি স্টেশন মাস্টারের ঘরে বোসো, আমি চট করে গাড়িটা নিয়ে আসি।”
“আপনাকে আর কষ্ট দেব না। গিরধারী এই ট্রলিতেই কিছুক্ষণ বসুক। লছমিকে কোলে নিয়ে। আমরা সবাই বাড়ি যাই। আপনার এইবার একটু বিশ্রাম দরকার। আমি গাড়ি বের করে যা করার সব করছি।”
“আর ইউ নট টায়ার্ড!”।
“নট দি লিস্ট। আপনি যা শিখিয়েছিলেন, এতক্ষণ বসে-বসে তাই করছিলুম। প্রাণায়াম। এক, দুই, তিন, চার; এক, দুই, তিন, চার। শ্বাসের ড্রিল।”
“দেখেছ! তোমার বিশ্বাস হয়েছে তো?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, খাসকে কন্ট্রোল করতে পারলে মানুষ অসীম শক্তির অধিকারী হতে পারে।”
“জেনে রাখো, কচ্ছপ আর হাতি প্রাণায়াম-সিদ্ধ যোগী।”
গিরধারী, খড়ক সিং, লছমি বসে রইল। এরা সবাই লাইন পেরিয়ে, তার টপকে হাঁটতে লাগল বাড়ির দিকে। গিরধারী তখন একটু ইতস্তত করে খড়ক সিংকে বলছে, “মালেক!”
“কে তোমার মালেক! মালিক এই দুনিয়ায় একজনই আছেন, ভগবান।”
“দেখতে তো পাই না, তবে হ্যাঁ, শুনতে পাই তাঁর কথা।”
“আমেরিকার কথা শুনেছ?”
“শুনেছি মালিক।”
“দেখেছ?”
“না মালিক, জিন্দেগিতে দেখাও হবে না।”
“তার মানে আছে, তুমি না দেখলেও আছে, দেখলেও আছে।”
“মালেক, আপনি খইনির নাম শুনেছেন?”
“শুনেছি।”
“দেখেছেন?”
“না, সেভাবে দেখিনি, তবে হাতের তালুতে ফেলে রগড়াতে আর পেটাতে দেখেছি।”
“তা হলে মালিক, থোড়া মেহেরবানি করে আমার বাঁ পকেটে হাত ঢোকান।”
গিরধারী গত চব্বিশ ঘণ্টা খইনি খায়নি। তার মাথা ঝাঁঝাঁ করছে। বুদ্ধি নিভে আসছে। সিংজিকে তাই কাতর অনুরোধ। মেয়েটা কোলে আছে, দুটো হাতই জোড়া। সিংজি নির্দেশমতো চুন আর দোক্তাপাতা একসঙ্গে মিলিয়ে দলতে লাগলেন। মনে হল, কাজটা নেহাত মন্দ নয়। কিছুক্ষণ বেশ সময় কেটে যায়, কত কী ভাবনা আসে মনে।
এই বেখেয়ালে তিনি এক কাণ্ড করে বসলেন। পুরো মশলাটাই নিজের মুখে ফেলে গিলে নিলেন। গিরধারী হাঁ-হাঁ করে ওঠার আগেই কাজ শেষ। হেডলাইট জ্বেলে উদয়নের গাড়ি আসছে। এদিকে সিংজি লাইনের ধারে ফ্ল্যাট। কখনও মনে হচ্ছে ওপরদিকে উঠে যাচ্ছেন ঘুরতে-ঘুরতে। কখনও মনে হচ্ছে, শুয়ে আছেন ঘুরন্ত এক চাকিতে। সব ঘুরছে চাকার মতো।
॥ ৩২ ॥
এখন যদি কেউ প্রশ্ন করে, খড়ক সিং, তোমার হলটা কী! তোমার সেই পুঁটলি, লাঠি, তোমার সেই দেশে-দেশে ঘুরে বেড়ানো। লিডার নদীর সাধু, রাজস্থানের ফকির, বিন্ধ্যপর্বতের যোগী! খড়ক সিং বলবেন, দিনদুনিয়ার মালিক আমাকে একটা মানুষ উপহার দিয়েছেন। তার নাম লছমি। দশ-এগারো বছরের সুন্দর একটা মেয়ে। এখন সেইটাই আমার সাধনা। সেই মেয়েটাকে বড় করব, মানুষ করব। উদয়নজির মতো একজন নামজাদা ডাক্তার করব।
পাঁচ মাস পরে দেখা যাচ্ছে, লছমি উদয়নের চিকিৎসায় সেরে উঠেছে। একটা মাস যমে-মানুষে টানাটানি। এক-এক সময় মনে হয়েছে আর বুঝি ধরে রাখা গেল না। উদয়ন, আরও সব ডাক্তারবাবু যাঁরা ছিলেন, বিশেষ করে ডাক্তার আব্রাহাম, তাঁরা লড়াই করে যমের হাত থেকে ছিনিয়ে এনেছেন মেয়েটাকে। লছমির বাবা আর আসেনি, কোনও খবরও নেয়নি। এতে খড়ক সিং খুব খুশি। মনে করো, ভগবান তোমাকে একটা দামি হিরে উপহার দিলেন, তুমি তার মূল্য বুঝলে না, কাচ ভেবে ফেলে দিলে। দিলে, বেশ করলে। এইবার আমি সেইটাকে ঝেড়েঝুড়ে, ভাল করে মুছে, আমার কাছে রেখে দিলাম। জিনিসটা তখন আমার। লছমির বাবা যদি কোনওদিন এসে খুব হম্বিতম্বি করে, তা হলে ওই যে লাঠি, যে-লাঠি দেশে-দেশে ঘুরে বেড়িয়েছে, সেই লাঠি দিয়ে শয়তানটাকে পেটানো হবে।
“লছমি! মায়ি! তোর মন তো খারাপ হবে না?”
কেন খারাপ হবে! এত ভালবাসা, এত স্নেহ-যত্ন সে আর কোথায় পেয়েছে! কোথায় পাবে! খড়ক সিং শেষে সংসারী হয়ে গেলেন! তিন মাথার মোড়ে যেখানে এই তল্লাটের বিশাল বড় একটা শিরীষ গাছ একেবারে আকাশের ছাদে গিয়ে ঠেকেছে, সেই গাছের তলায় মিষ্টি ছায়ায় সিংজি একটা দোকান দিয়েছেন। সবাই অবাক! যতই হোক রাজার ছেলে তো! অনেক-অনেক অতীতে ফিরে গেলে দেখা যেত, পেল্লায় এক রাজপ্রাসাদে চাবুকের মতো এক যুবক ঘোড়ায় চাপা শিখছেন। নিশানা লক্ষ্য করে বন্দুক ছুড়ছেন। সায়েব শিক্ষক ইংরেজি শেখাচ্ছেন।
দোকানটা কিসের! চা, বিস্কুট, পান, বিড়ি, সিগারেট, পানমসলা আর খইনির। দোকানের সামনে তিনটে বেঞ্চ পাতা। লজ্জা-টজ্জা নেই। পরিশ্রম করে, সৎ পথে টাকা রোজগার করব। আমি গরিব মানুষ, দেশের শতকরা আশি ভাগ মানুষ গরিব। লছমি, তুই আর আমি সেই দলের। কষ্টে না থাকলে মানুষ বড় হতে পারে না। বড় লোক, পয়সাঅলা লোকের ঘরে জন্মালে মানুষ বদমাশ হয়। পেল্লায় তার অহঙ্কার, হনুমানের লেজের মতো। মানুষকে মানুষ বলে মনে করতে চায় না। দুটো চোখ থাকে ঠিকই, তবে অন্ধ। আকাশ, গাছ, পথ, নুড়ি, পথের ধুলো, ফুল, পাখি কিছুই দেখে না। একেবারে বাজে, একপেশে একটা জীব।
লছমি, তুই আমাকে দোকানের কাজে সাহায্য করবি, বাড়ি সামলাবি, আবার লেখাপড়াও করবি। চব্বিশ ঘণ্টায় দিন, সেটা কিছু কম সময় নয়। পড়ে-পড়ে না ঘুমোলে অনেক কিছু করা যায়। সিংজি বেশ খুশ মেজাজেই আছেন। দোকানটা ধরে গেছে। এই অঞ্চলের সবাই মানুষটাকে ভীষণ ভালবাসে যে! একরোখা, আত্মভোলা মানুষ। কারও পরোয়া করেন না। ভাই, তুমিও মানুষ, আমিও মানুষ। তোমার মান-সম্মান তোমার কাছে, আমার মান-সম্মান আমার কাছে। বন্ধু বলে যদি নিতে পারো, তোমার জন্য জান দিয়ে দেব। আর যদি মেজাজ দেখাও, তম্বি করো, তা হলে আমিও ছেড়ে কথা বলব না, সে তুমি যেই হও।
কাকভোরে যত লোক নানা কাজে বেরিয়ে পড়ে। কেউ যাচ্ছে মাইকার কারখানায় কাজ করতে, কেউ চলেছে দূরপাল্লার ট্রাক নিয়ে, রিকশা নিয়ে, টাঙ্গা নিয়ে। দেহাতি মেয়েরা চলেছে সব্জি নিয়ে, ঘি নিয়ে, মধু নিয়ে। বাইরে থেকে যাঁরা স্বাস্থ্য ফেরাতে এসেছেন, তাঁরা চলেছেন বেড়াতে। সকলেই সিংজির খদ্দের। খানদান চেহারা। পরিষ্কার জামা-কাপড়। সুন্দর ব্যবহার। সবাই দু দণ্ড বসে শান্তি পায়। লছমিরানি কাপ-গেলাস ধোয়, খদ্দেরকে চা-বিস্কুট এগিয়ে দেয়। সবসময় মুখে একটা মিষ্টি হাসি।
শিবশঙ্কর খড়ক সিংকে অনেক বুঝিয়েছিলেন, “তোমার এই কষ্ট করার কী মানে হয়, আমাকে বোঝাবে! লছমি তো আমাদেরও মেয়ে, আমরা কি তার দায়দায়িত্ব নিতে পারি না!”
“খুব পারেন, তবে কী জানেন, আমি আমার চরিত্রটা কিছু বদলাতে চাইছি। লোকে আমাকে পাগল বলে। দেশে-দেশে ঘুরে বেড়াই, যা খুশি তাই করি। আমার কোথাও কোনও দায়িত্ব নেই। এটা ঠিক নয়। আমি একটা মেয়েকে জোর করে তার বাবার কাছ থেকে নিয়ে এসেছি। দায়িত্বটা আমার। দেখতে চাই, সেই দায়িত্ব আমি পালন করতে পারি কি না।”
“মেয়েটাকে এত খাটালে সে লেখাপড়া করবে কখন?”
“বেশি তো খাটাই না; সকালে কয়েক ঘণ্টা, বিকেলে কয়েক ঘণ্টা। কাজ করবে, লেখাপড়াও করবে। পৃথিবীটা আয়েস করার জায়গা নয়।”
“যা ভাল বোঝো করো, তবে আমাদের একেবারে ভাল লাগছে না। তুমি আমাদের দূরে সরিয়ে দিচ্ছ।”
জয় বাগানের দিকের রকে বসে-বসে খুব ভাবছে! মুখ গম্ভীর। জয়া কলম পরিষ্কার করতে-করতে দেখছিল। জয় বেশ কিছুদিন হল এইরকম হয়ে গেছে। কারণটা জানা দরকার। জয়া ভাইয়ের কাছে এসে বসে পড়ল। পিঠে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “তোর কী হয়েছে রে? শরীর খারাপ?”
জয় সে-কথার উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করল, “দিদি! আমার ক’টা প্যান্ট, জামা, জুতো আছে রে!”
জয়া একটু ভেবে, মনে-মনে হিসেব করে বললে, “কুড়ি-পঁচিশটা হবে। জামা আর প্যান্ট। জুতো চার জোড়া। কেন? কাউকে কিছু দেওয়ার কথা ভাবছিস?”
জয় এ-প্রশ্নের কোনও উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন করল, “আমরা সারাদিন ক’বার খাই?”
জয়া বলল, “চারবার। সকালে ব্রেকফাস্ট, ডিম, টোস্ট, কলা, ফল, দুধ। তারপর ভাত, ডাল, মাছ, তরকারি। বিকেলে টিফিন। রাতে রুটি, কি লুচি, তরকারি, আবার দুধ। কেন, তোর কি মনে হচ্ছে খাওয়া কম? আরও কিছু হলে ভাল হত! মাঝে-মাঝে তো আমরা বাদাম, ছোলা, চকোলেট, বিস্কুটও খাই। শিঙাড়া খাই, কচুরি খাই।”
জয় হঠাৎ অন্যরকমের একটা প্রশ্ন করল, “আমরা বড়লোক, তাই না?”
“বড়লোক নই, তবে অবস্থা খারাপ নয়।”
“তার মানে, আমরা কোনওদিন বড় হতে পারব না!”
“চেষ্টা করলেই বড়লোক হতে পারবে, তবে চাকরি করে তো বড়লোক হওয়া যায় না, ব্যবসা করতে হবে।”
“আমি বড়লোক হওয়ার কথা বলছি না, বড় মানুষ হওয়ার কথা বলছি।”
“সে তুমি ভাল করে লেখাপড়া করে, বিজ্ঞানী, লেখক, দার্শনিক, অধ্যাপক হলেই হতে পারবে।”
“বড়লোকরা বড় মানুষ হতে পারে না।”
“এইসব বাজে কথা তোকে কে বলেছে?”
“শিরিনকে বলেছে খড়ক সিং। শিরিন আমাকে বলেছে।”
“কী বলেছে খড়ক সিং?”
“বলেছে, ছেলেবেলায় যারা না চাইতেই সব কিছু পেয়ে যায়, তাদের চরিত্র নষ্ট হয়ে যায়। বুদ্ধি ভোঁতা হয়ে যায়, ভিতু হয়ে যায়, জীবনের সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা চলে যায়। তারা আর মানুষ হতে পারে না। তারা মানুষের সঙ্গে মিশতে পারে না। তাদের খুব অহষ্কার হয়। বড়-বড় কথা বলে। তাদের সবাই তখন ঘেন্না করে। আমরাও ঠিক ওইরকম হয়ে যাব রে দিদি! আমার পঁচিশটা প্যান্ট, পঁচিশটা জামা, চার জোড়া জুতো, সারাদিন খালি খাচ্ছি আর খাচ্ছি। আমাদের কত জিনিস! মায়ের কত গয়না! বাবার কত স্যুট। কালার টিভি, টেপরেকর্ডার, ফ্রিজ। আমরা কোনওদিন মানুষ হতে পারব না দিদি।”
“তা হলে, এখন কী করবি?”
“ভাবছি সব দিয়ে দেব। আজই সব দিয়ে আসব চার্চের অর্ফানেজ-এ। চারটে প্যান্ট, চারটে জামা আর এক জোড়া জুতো থাকবে, বাকি সব দিয়ে দেব। আর চারবার খাব না, খাব দু’বার, সকালে ভাত, ডাল, তরকারি। রাতে ভাত, ডাল, তরকারি। মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, আইসক্রিম, কাস্টার্ড, কচুরি, কাটলেট, ফিশচপ, এইসব খাবই না। জানিস তো ডিম খেলে বুদ্ধি কমে যায়।”
“কে তোকে বলেছে, ডিম খেলে বুদ্ধি কমে যায়?”
“আমি শুনেছি, ছোটরা ডিম খেলে তাদের বুদ্ধি কমে যায়।”
জয় বিজ্ঞের মতো কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, “মাকে কিছু জানাবি না, আজ দুপুরে আলমারি থেকে সব বার করে দিয়ে আসব।”
“তারপর মা যখন জানতে পারবেন!”
“তখন মাকে সব বলব।”
“কিছু করার আগে বাবা আর মায়ের অনুমতি নিতে হয়। আমি অন্তত এইটুকু জানি। তাঁদের অনুমতি ছাড়া যে-কোনও কাজ করাটাই অন্যায়, পাকামো।”
“আমি তো ভাল কাজই করছি রে দিদি!”
“ভাল কাজও মাকে না জানিয়ে করাটা অপরাধ। আমি পড়েছি, সন্ন্যাসী হওয়ার আগে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য তাঁর মায়ের অনুমতি নিয়েই সংসার ত্যাগ করেছিলেন।”
“আমিও একটা গল্প পড়েছি, একটা ব্যাঙের একটা টাকা ছিল। সেই টাকাটা ছিল তার গর্তে। একদিন একটা হাতি সেই গর্তটা ডিঙিয়ে গিয়েছিল। তখন ব্যাঙটা বেরিয়ে এসে খুব রাগ করে হাতিটাকে লাথি দেখাতে লাগল, আর বলল, তোর এত বড় সাধ্য যে, আমায় ডিঙিয়ে যাস। গল্পটার কী মর্যাল বল তত দিদি! টাকার এত অহঙ্কার! খড়ক সিং ওই গাছতলায় বসে আমাদের সেই অহঙ্কারটাকেই ভাঙছেন। চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছেন, তোমাদের জাত আলাদা, আমার জাত আলাদা।”
“তুই বড়দের মতো কথা বলছিস, ছোটরা এইসব বড়-বড় জ্ঞানের কথা বলে না। বাবা, মা আমাদের যেমন রাখবেন, যেভাবে রাখবেন, আমরা সেইভাবেই বড় হব। খড়ক সিংয়ের মাথায় পাগলামি ঢুকলে আমরা কী করতে পারি! তোকে এত সব কে ভাবতে বলেছে!”
“শিরিন এখন কেন কেবল লছমির কাছেই থাকে? আমাদের বাড়িতে আসে না। বলে, ‘তোরা বড়লোক। তোদের পয়সার অহঙ্কার। তোর বাবা পাইপ খান। তোর মা সিল্কের শাড়ি পরেন। তোরা সবাই বাড়িতে চটি পায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াস’।”
জয়া বলল, “বেশ করি। যাদের বাড়ির যেমন নিয়ম। আর পাইপ খেলেই লোক বড়লোক হয় না। খড়ক সিংয়ের বাড়িতে তো রুপোর আলবোলা আছে। দাঁড়া, আমি দাদিকে গিয়ে সব কথা বলছি। দাদি যা বলবেন, সেইটাই ঠিক।”
শিবশঙ্কর তাঁর ছোট্ট কারখানায় বসে একটা বিদেশি খেলনার মডেল দেখছিলেন। দেখছিলেন, কীভাবে সেটা তৈরি করা যায় এখানে। একটা মোটরগাড়ি, যেটা চলতে-চলতে সামনে বাধা দেখলেই পাশ কাটিয়ে যায়। নিজের ইচ্ছে মতো হেডলাইট, টেল লাইট জ্বালাতে পারে। হর্ন বাজাতে পারে। ব্যাক করে দিক পরিবর্তন করতে পারে। খেলনাটা তৈরি হয়েছে জাপানে। শিবশঙ্কর খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলেন। এমন সময় জয় আর জয়া সেই ঘরে ঢুকল।
॥ ৩৩ ॥
ফুল গাছে জল যাওয়ার জন্য বাগানে অনেক নালা কাটা আছে বেশ হিসেব করে, কায়দা করে। এক জায়গায় জল ঢাললে বেশ কুলকুল করে বহে যায় অনেকটা দূর। যেন সব ছোট-ছোট নদী। নালার ধারে-ধারে জল পেয়ে বেশ বড়-বড় ঘাস জন্মেছে। জয়ের মনে এতটুকু সুখ নেই। খড়ক সিং কেমন পর হয়ে গেলেন। লছমিকে তাদের সঙ্গে মিশতে দেন না। শিরিন এখন খড়ক সিংয়ের খুব প্রিয়। শিরিনদের বাড়িতে লছমিকে যেতে দেন। জয় একটা নালার ধারে উবু হয়ে বসে দেখছিল, একটা ছোট্ট ব্যাঙ লাফিয়ে লাফিয়ে পোকামাকড় ধরছে। সবে খেতে শিখেছে নতুন, তাই খুব খিদে। বড় ডানাওলা একটা পোকা জলে ডুবে মারা গেছে। আটকে আছে নরম মাটিতে। মনে হয় কাল সন্ধের দিকে এই মৃত্যুটা ঘটেছে। তখন নালাটা জলে পূর্ণ ছিল। কোনওভাবে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারেনি। ডানা ভিজে গেলে ওড়া যায় না। ওড়ার জন্য শুকনো ডানা চাই।
গাছের একটা শুকনো ডাল দিয়ে জয় পোকাটাকে খুঁটে-খুঁটে তুলল। ডানার কী বাহার! দেহের চেয়ে ডানা বড়। এইটুকু একটা শরীরকে ওড়াবার জন্য এত বড় দুটো পাখনার কী দরকার ছিল! জয় চমকে উঠেছে, পিঠের ওপর কে হাত রাখল, সে খেয়াল করেনি। পেছন ফিরে তাকিয়ে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। স্বপ্ন নয় তো! হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন আর কেউ নন, খড়ক সিং। জয় তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে টাল রাখতে না পেরে উলটে গেল ঘটের মতো। তাকে আর উঠতে হল না। সিংজিই পাশে বসে পড়ে তাকে কোলের কাছে টেনে নিলেন।’
“তুমি আমার ওপর রাগ করেছ জয়?”
জয়, “হ্যাঁ করেছি?” বলেই কেঁদে ফেলল। তার চোখে জল। কুলকুল করছে।
সিংজি বললেন, “আর রাগ করতে হবে না, আমি নিজেই ভাব করতে এসেছি। আমার খুব ভুল হয়েছিল। আমার মাথায় ভূত চেপেছিল। আমি তো একটু গোঁয়ার আছি। যা-তা উলটোপালটা ভাবি। নিজের খেয়ালে চলি, কারও কথা শুনি না, তাই না আমার জীবনটা এইরকম হয়ে গেছে। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। দেখবে চলো, তোমার দাদা কী করছেন।”
সিংজি জয়কে বুকে চেপে ধরে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। জয়া এই সময়টায় মাকে সংসারের কাজে সাহায়, করে। মাঝে-মাঝে ছুটে যায় ঠাকুমার কাছে। এই সকালেই ঠাকুমা বসেন তাঁর লতাপাতা, জড়িবুটি নিয়ে। এই সংসারের কেউই কিন্তু অলস নয়। সকলেই খুব পরিশ্রমী। হুকুম করে কাজ করাবার অভ্যাস কারও নেই। শিবশঙ্কর, উদয়ন দু’জনেই বলেন, “সেল্ফ হেল্প ইজ বেস্ট হেল্প।”
সিংজি জয়কে নিয়ে সেই গাছতলার দোকানে এলেন। শিবশঙ্কর পাকা দোকানদারের মতো জাঁকিয়ে বসেছেন। চা তৈরি করছেন। সামনে চারজন খদ্দের। একজন হলেন চার্চের ফাদার। তিনি সাইকেলে হেলান দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। শিবশঙ্করকে নির্দেশ দিচ্ছেন, “স্ট্রং লিকার, এ ফিউ ড্রপ্স অব মিল্ক জাস্ট ফর কালারিং অ্যাণ্ড এ পিঞ্চ অব শুগার।” লছমি খলরবর করে কাপ-ডিশ ধুচ্ছে।
শিবশঙ্কর জয়কে দেখে মজা করে বললেন, “বলুন, আপনি কেমন চা চান? জাস্ট প্লেন লিকার? অর উইথ মিল্ক?”
জয় বলল, “আপনি দোকান চালাচ্ছেন?”
“জাস্ট টু শশা ইউ, সকলেই সব কাজ পারে। কোনও কাজই ছোট নয়। ডিগনিটি অব লেবার।”
ফাদার চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঠোঁট সরিয়ে বললেন, “দ্যাট্স রাইট। রোজ সকালে আমি চার্চের সামনের রাস্তাটায় ঝাড়ু দি। আই লাইক ইট। এই তো একটু পরেই আমি আমাদের ডেয়ারিতে গিয়ে গোরুর কাজে লেগে যাব। খুব পরিশ্রম। বাট আই লাইক ইট। মাথা আর শরীর দুটোকেই খাটানো চাই।”
শিবশঙ্কর বললেন, “জয়, যাও লছমিকে সাহায্য করো। তুমি কয়লা ভাঙো। ওই যে গাছতলায় পড়ে আছে। হাতুড়িটা দ্যাখো কোথায় আছে।”
সিংজি বললেন, “আমি তা হলে জলের ড্রামটা ভরে ফেলি।”
এই কাজটা খুব সহজ নয়। জলের কল বেশ দূরে। সিংজি দু’ হাতে দুটো বড় বালতি তুলে নিলেন। সিংজির ক্ষমতা আছে। দু’ বালতি জল দু’ হাতে ঝুলিয়ে অতটা পথ আসতে তাঁর কোনও কষ্টই হবে না। জয় কয়লার চাঁই ভাঙতে-ভাঙতে ভাবছে, কাজটা সহজ মনে হলেও সহজ নয়। তার হাত খুব নরম। মনে হচ্ছে ফোস্কা পড়ে যাবে। তা পড়ক। সে তো মনে-মনে এইরকম পরিশ্রমই করতে চেয়েছিল। ‘দাদা, পারছি না, কষ্ট হচ্ছে’, এ-কথা তো এখন বলা চলবে না। দুটো হাত কয়লার গুঁড়োয় কালো হয়ে গেছে। কপালে ঘাম জমেছে। নাকের কাছটা চুলকোচ্ছে। চুলকোবার উপায় নেই। কালি লেগে যাবে।
শিবশঙ্কর একবার তাগাদা লাগালেন, “কী হল, কয়লা দাও। আগুন যে নেমে যাচ্ছে মাস্টার।”
লছমি জয়ের কাছে এসে বলল, “হাতুড়িটা আমাকে দাও। তাড়াতাড়ি ভেঙে দিই। আরও ছোট করে ভাঙতে হবে।”
জয় প্রথমে ভাবছিল রেগে যাবে। তারপর ভাবল, সত্যিই তো সে ঠিকমতো পারছে না। এদিক-ওদিকে দূরে-দূরে ছিটকে যাচ্ছে। হাতুড়িটা ঠিকমতো চালাতেও পারছে না, এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। জয় ঠাণ্ডা গলায় বলল, “আমি নতুন তো, তাই ঠিক মতো পারছি না। তুমি দেখিয়ে দাও, দেখবে, ঠিক পারব।”
লছমি হাতুড়ি নিয়ে বসল। জয় দেখছে খুব একটা জোরে মারছে না। টুকটুক করে মারছে। এক-একটা ঢেলা চার টুকরো হয়ে খুলে যাচ্ছে। বাঁ হাতের তালুটাকে এমনভাবে আড়াল দিয়ে রেখেছে যে, একটা টুকরোও দূরে ছিটকে যাচ্ছে না।
জয় অবাক হয়ে ভাবছে, যেমন অঙ্ক কষা শিখতে হয়, ছবি আঁকা শিখতে হয়, সেইরকম কয়লা ভাঙা, কাঠ কাটা সবই শিখতে হয়। মন দিতে হয়, শুধু শ্রম দিলেই হয় না। লছমি জানে কোথায় ছোট্ট একটু আঘাত দিলে ঢেলাটা সহজেই খুলে যাবে।
রাতের বেলা, খাবার টেবিলে সভা বসল, পারিবারিক সভা। সবাই আছেন। শিবশঙ্কর জয়কে জিজ্ঞেস করলেন, “ঠিক ঠিক বলো তো তোমার কেমন লাগল আজ?”
জয় বলল, “ভাল লাগল না।”
“কেন লাগল না! তুমি তো লছমির মতোই হতে চাইছিলে!”
“আমার মনে হল, সব কাজ সকলের জন্যে নয়।”
“দ্যাট্স রাইট। আমিও ঠিক ওই কথাটাই বলতে চেয়েছি, যার কাজ তার সাজে, অন্যের মাথায় লাঠি বাজে। প্রত্যেকের পরিবারের ধারা এক-একরকম। যে যে-পরিবারে জন্মেছে, তাকে সেই পরিবারের ধারায় বড় হতে হবে। সে ভালই হোক আর খারাপই হোক। গীতায় শ্রীভগবান বলছেন, স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ। এই শ্লোক তোমরা বহুবার শুনেছ। আমাদের পরিবারের ধারা লেখাপড়া, জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা। আমরা অলস, ভোগী নই। আমাদের যেমন রোজগার আমরা সেইভাবেই থাকি। আমাদের জোর করে আরও নীচে নেমে যাওয়ার অর্থ হয় না। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ জয়?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, চা তৈরি করতে আপনার কেমন লাগছিল?”
“মনে হচ্ছিল সময় নষ্ট করছি। ওই সময়টায় আমি ইলেকট্রনিক্স সম্পর্কে আরও লেখাপড়া করে আধুনিক পৃথিবীটাকে আরও বেশি জানার চেষ্টা করতে পারতুম। সেইটাই হত আমার কাজ। পৃথিবীতে তিন ধরনের কাজ আছে জয়। একধরনের কাজ শুধু শরীর দিয়েই করা যায়। আর-একধরনের কাজ মাথা দিয়ে। ব্রেনওয়ার্ক। তৃতীয় কাজে শরীর আর মাথা দুটোই লাগে। থার্ড ওয়ান ইজ দ্য বেস্ট। বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং-এর কথা তোমরা শুনেছ। যাঁকে বলা হচ্ছে দ্বিতীয় আইনস্টাইন। তাঁর তীব্র তীক্ষ্ণ ব্রেন ছাড়া আর কিছুই নেই। মোটর নিউরন ডিজিজে শরীর সম্পূর্ণ বিকল। কিন্তু মাথা! সেই মাথা দিয়ে তিনি এই বিশ্বের সৃষ্টি রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছেন। তাঁর লেখা বই ‘এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’ বিজ্ঞানী মহলে সাড়া ফেলে দিয়েছে। হকিংকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘আপনি কি বিশ্বাস করেন ঈশ্বর এই বিশ্ব সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনিই একে নিয়ন্ত্রণ করছেন?’ হকিং একটি কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন, ‘না।’ তা হলে কী? কী সেই রহস্য!”
জয় আর জয়ার চোখ উত্তেজনায় চকচক করছে, “আমরা সেই রহস্য জানতে চাই।”
“তা হলে চলো বসার ঘরে।”
॥ ৩৪ ॥
শিবশঙ্কর বেশ জমিয়ে বসলেন কার্পেটের ওপর। চেয়ার বা সোফায় বসে গল্প ঠিক জুতসই হয় না। জয়া দাদির সেই প্রিয় তাকিয়াটা এনে দিল। জয় নিয়ে এল জলের বোতল। খাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরে শিবশঙ্কর জল খান। সেইটাই হল স্বাস্থ্যকর নিয়ম। ঘরে একটা মৃদু আলো জ্বলছে। পরিবেশটা গল্পের। কাচের দরজার বাইরে গাছপালা। রাতের অন্ধকার আকাশ।
শিবশঙ্কর শুরু করলেন, “ব্ল্যাক হোল’-এর নাম শুনেছ তোমরা?”
“শুনেছি দাদি, কিন্তু ঠিক বুঝিনি।”
“তা হলে একটু পেছন থেকে শুরু করি। আলো জিনিসটা কী?”
জয় খুব বুদ্ধিমানের মতো বলল, “অন্ধকারের উলটোটাই হল আলো।”
শিবশঙ্কর বললেন, “ভালই বলেছ দাদু, তবে ব্যাখ্যাটা অত সহজ নয়। দুটো মত আছে। প্রায় দুশো বছরের পুরনো। নিউটনের মত হল, আলো হল কণার সমষ্টি, পার্টিক্ল। কণা দিয়ে তৈরি। কণার প্রবাহ। ওই সময়ের আর-একটা মত, আলো হল তরঙ্গ, ঢেউ। তখন এই নিয়ে সংশয় ছিল। আধুনিক বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুটোই ঠিক। আলো ঢেউ, আলো কণা। এখন বিজ্ঞানীমহলে তর্ক শুরু হল, আলো যদি শুধু ঢেউ বা তরঙ্গ হয়, তা হলে মাধ্যাকর্ষণ কেমন করে কাজ করবে! বস্তুকে আকর্ষণ করা যায়, বস্তুহীন তরঙ্গ কেমন করে আকৃষ্ট হবে! কিন্তু আলো যদি বস্তুকণা হয় তা হলে গ্র্যাভিটি কাজ করবে। যেমন কামানের গোলা, রকেট, প্ল্যানেট। একদল বললেন, আলোর কণা এত জোরে ছোটে যে, গ্র্যাভিটি সেই গতিকে মন্থর করতে পারে না। তখন রোয়েমারের আবিষ্কার প্রমাণ করল, আলোক তরঙ্গের গতি অসীম নয়, তারও একটা সীমা আছে। তার মানে আলো মাধ্যাকর্ষণকে এড়াতে পারে না। গ্র্যাভিটি আলোর ওপর কাজ করে। বিজ্ঞানীরা ভাবতে বসলেন। জয় তোমাকে বলছিলুম, এই পৃথিবীতে মানুষের কাজের শেষ নেই। খডক সিং চায়ের দোকান করেছে বলে, চা করাটাই একমাত্র কাজ, তা নয়। যার মাথা আছে সে মাথার কাজ করবে। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন মিচেল সেই ১৭৮৩ সালে এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেন লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির পত্রিকায়। লিখলেন, যেসব তারা আকারে বিশাল এবং নিরেট ঘন, সেইসব তারার অভিকর্ষ-ক্ষেত্র বা গ্র্যাভিটেশনাল ফিল্ড ভীষণ শক্তিশালী। এমন আকর্ষক ক্ষমতা যে, সেইসব তারা আলো ছিটকে বাইরে আসতে পারে না। আলোর রশ্মি বাইরে আসতে চাইলেই টেনে ধরে রাখে। মিচেল বললেন, এইরকম অনেক অন্ধকার তারা আকাশে আছে যার আলো দেখা যায় না; কিন্তু আকর্ষণ অনুভব করা যায়। অনেকটা এইরকম, অন্ধকারে বাবু বসে আছেন সোফায়। হাত ধরে টানছেন; কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। এই রকমের তারাকেই বিজ্ঞানীরা এখন বলছেন ব্ল্যাক হোল। সত্যিই তাই, মহাকাশে অন্ধকার শূন্যতা। বস্তু অদৃশ্য অথচ আকর্ষণ বিশাল। কয়েক বছর পরে এক ফরাসি বিজ্ঞানী মার্কুইস দ্য লাপ্লেস ঠিক এই একই সিদ্ধান্তে এলেন নিজের চিন্তা ও ভাবনায়। মিচেলের গবেষণা তিনি জানতেন না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এইসব থিয়োরি একেবারে বাতিল হয়ে গেল। ফিরে এল ওয়েভ থিয়োরি। আলো বস্তুকণা নয়, তরঙ্গ। ১৯১৫ সালে আইনস্টাইন নিয়ে এলেন জেনারেল রিলেটিভিটি। বড় হলে তোমরা পড়বে। এর পর আরও কিছুকাল গেল, শেষে জানা গেল বিশাল ওজনদার তারার রহস্য। সেই জটিল বিজ্ঞান তোমরা এখনই বুঝতে পারবে না। তবে এইটুকু জেনে রাখো, এক-একটা তারা যেন হাইড্রোজেন বোমা। তারার জন্ম হল গ্যাস থেকে, যার বেশির ভাগটাই হল হাইড্রোজেন। হাইড্রোজেন অ্যাটম একটা আর-একটার ঘাড়ে এসে চাপছে। সেও তোমার অভিকর্ষের খেলা। আমি তোমাকে টানছি, তুমি আমাকে টানছ। গ্যাস যত সঙ্কুচিত হতে থাকে ততই এই ধাক্কাধাক্কি, সঙ্ঘর্ষের গতি বেড়ে যায়। অণুতে-অণুতে ঠোকাঠুকি। মত্ত মাতামাতি। এই ঠোকাঠুকিতে উত্তাপ বাড়বে, ক্রমশই বাড়বে। শেষে ওই গ্যাসের বলয় এতটাই উত্তপ্ত হবে যে, হাইড্রোজেন অণু ধাক্কাধাক্কিতে আর ছিটকে যাবে না, একটার সঙ্গে আর-একটা জড়িয়ে তৈরি করবে হিলিয়াম। হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম হওয়ার সময় যে উত্তাপ তৈরি হবে, তা ওই হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরণের উত্তাপ। আর এই কারণেই তারা আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলে। এইসঙ্গে আরও এক মজার ব্যাপার হয়। গ্যাসের একটা বেলুন তৈরি হয়। প্রচণ্ড উত্তাপে গ্যাসের ভেতরের চাপ বাড়তে থাকে, এক সময় আকর্ষণ আর বিকর্ষণের শক্তি এক হয়ে তৈরি হয় উত্তপ্ত, জ্যোতির্ময় গ্যাস বলয়। রবারের বেলুনের মতো একটা ব্যাপার। ভেতরের বাতাস চাইছে আরও ফুলতে, আর রবারের শক্তি সেই ফোলাটাকে আটকে রাখছে। এইভাবে এক-একটা তারা হাজার-হাজার, কোটি-কোটি বছর ধরে তার জ্বালানির সঞ্চয় নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে। প্রত্যেকটাই এক-একটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার হাউস।
“সে তো হল; কিন্তু এইসব হল কখন, কী করে হল, কেন হল, কেই-বা হওয়ালেন। এর কর্তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমার কারখানায় সে আমি যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করছি। জয়া রান্নাঘরে বসে রাঁধছে। জয় বাগানে গাছের গোড়ায় মাটি খুঁড়ছে, পৃথিবীটাকে আমরা যখন থেকে দেখছি, তখন থেকেই এই একই দৃশ্য। কাজের পেছনে কেউ-না-কেউ একজন আছে। কেউ না থাকলে আমরা বলি ভূতের কাণ্ড। আকাশের দিকে তাকালে দেখি গ্রহ, সূর্য, চন্দ্র, তারা, ছায়াপথে তারার মেঘ। দেখছি, হাজার-হাজার বছর ধরে মানুষ এই দেখছে। দেখতে-দেখতে, বিজ্ঞানীদের আগে দার্শনিকের মাথায় প্রথম এই প্রশ্ন এল, এই জমি কার, এই আকাশ কার, গ্রহ, নক্ষত্র দিয়ে এই আকাশকে কে এমন করে সাজাল! বিশাল-এর স্রষ্টা কে? কে তা জানা যাচ্ছে না! তখন একটা সম্ভ্রম জাগছে মনে। কে তুমি, আর বলতে পারছি না। সম্মান জানাতে ইচ্ছে করছে। কে আপনি? বিশালের চেয়ে বিশালতর আপনি। বিশালতম। আপনি মানুষ নন, ভগবান, ঈশ্বর! ‘ভগ’ শব্দের অর্থ, ঐশ্বর্য। কী-কী সেই গুণ! যার জন্যে তিনি ভগবান, বীর্য, যশঃ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য। এই সৃষ্টি তাঁর। বিজ্ঞানীর এলাকা তাঁর গবেষণাগার। তিনি কার্যের পেছনে কারণের অনুসন্ধান করতে চান। তাঁর কাছে জল শুধু জল নয়, দুই অণু হাইড্রোজেন, এক অণু অক্সিজেন। এর পেছনে আর যাওয়ার দরকার নেই। হাইড্রোজেন, অক্সিজেন এল কোথা থেকে? এ-প্রশ্ন বিজ্ঞানীদের মনে এসেছে অনেক অনেক পরে। আর সেই অনুসন্ধানেরই উত্তর: বিগ ব্যাং। ‘সেকেন্ডকে একশো ভাগ করে তার একভাগ নাও। সৃষ্টি ধরো শুরু হচ্ছে। কিছু নেই, কেউ নেই। শূন্য মহাশূন্য। হঠাৎ এক বিস্ফোরণ। সময়ের শুরু। একের একশো সেকেন্ড। একটা বিস্ফোরণ নয়, একসঙ্গে অজস্র বিস্ফোরণ। ধরো গোলাকার এক মহাশূন্যের ওপরে, নীচে, এপাশে-ওপাশে একসঙ্গে অজস্র বিস্ফোরণ, বিগ ব্যাং। কালীপুজোর সময় একসঙ্গে অনেক পটকায় আগুন দিলে যা হয়। বস্তুকণা ভীমবেগে একটা থেকে আর-একটা ছিটকে-ছিটকে চলে যাচ্ছে। সেই একশো সেকেন্ড সময়ে বিশ্বের উত্তাপ একশো কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সবচেয়ে উত্তপ্ত তারার কেন্দ্রের উত্তাপের চেয়েও উত্তপ্ত সেই প্রাথমিক উত্তাপ। তোমার, আমার কল্পনার বাইরে। সেই ভয়ঙ্কর উত্তাপে বস্তু যা দিয়ে তৈরি, অণু, পরমাণু, এমনকী তার চেয়েও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ভেঙে চুরমার। কোনওটাই কোনওটার সঙ্গে সংলগ্ন নেই। বস্তুর এই অবস্থাকে আধুনিক হাই এনার্জি নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের পরিভাষায় বলা হচ্ছে, এলিমেন্টারি পার্টিকল্স। এই প্রাথমিক বস্তুকণার একটা জাত হল ইলেকট্রন, এর চার্জ হল নেগেটিভ। মাইনাস। বৈদ্যুতিক তারে এই ইলেকট্রনই প্রবাহিত হয়। বর্তমান বিশ্বের সমস্ত অণু-পরমাণুর বাইরের দিকে এই ইলেকট্রনই সাজানো আছে। এর পরেই আসছে সমান আয়তনের আর-এক ধরনের পার্টিক্ল পজিট্রন। যার চার্জ হল পজেটিভ। সৃষ্টির আদিতে পজিট্রন আর ইলেকট্রন সমান সংখ্যায় ছিল। এখন আর তা নেই। এখন হাই-এনার্জি গবেষণাগারে পজিট্রন তৈরি করা হয়, কোনও-কোনও রেডিয়ো অ্যাক্টিভ পদার্থ থেকে পজিট্রন বেরিয়ে আসে। কস্মিক-রে ও সুপারনোভায় পজিট্রন পাওয়া যাবে। সৃষ্টির সেই আদি তাণ্ডবে আরও এক ধরনের পার্টিক্ল ছিল, যার নাম নিউট্রিনো। ভৌতিক বস্তুকণা, যার না আছে আয়তন, না আছে কোনও চার্জ। সেকেন্ড অথাৎ সময় যত এগোলো, প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণের পর বিচ্ছুরিত হল আলো। প্রচণ্ড আলো, ভয়ঙ্কর আলো। একালের কোয়ান্টাম থিয়োরি কী বলছে জানো, আলো আর বস্তুকণা আলাদা নয়, এক। আলো হল ফোটন। যার কোনও আয়তন নেই, বৈদ্যুতিক শক্তিও নেই। আমাদের এই ইলেকট্রিন বাল্বের দিকে তাকাও। একটা ফিলামেন্ট। বিদ্যুত্তরঙ্গ আসছে। ফিলামেন্টের এক-একটা অণু যে-মুহূর্তে উচ্চশক্তি হায়ার এনার্জি থেকে লোয়ার এনার্জিতে আসছে, সঙ্গে-সঙ্গে বেরিয়ে আসছে একটা ফোটন। এই ব্যাপারটা একের-পর-এক এত দ্রুত ঘটছে, যে সবসময় আমরা একটা স্থির আলো দেখতে পাচ্ছি। নিরবচ্ছিন্ন আলো। একমাত্র একটা ফোটো ইলেকট্রিক সেল একটা একটা করে এই ফোটন গুনে দিতে পারে।
“এদিকে সময় এগোচ্ছে, সেকেন্ডের একশো ভাগের এক ভাগ, দু ভাগ, তিন ভাগ। প্রথম বিস্ফোরণের উত্তাপ কমছে। একের দশ সেকেন্ডে তিরিশ হাজার মিলিয়ন ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এক সেকেন্ড পরে দাঁড়াল দশ হাজার মিলিয়ন ডিগ্রি, চোদ্দ সেকেন্ড পরে দাঁড়াল, তিন হাজার মিলিয়ন ডিগ্রি। মনে করো বিশাল এক পাত্র, তার মধ্যে ভীষণ, ভীষণ গরম একটা স্যুপ। সেই অদ্ভুত স্যুপের নাম, বিজ্ঞানীদের ভাষায়, ‘কসমিক স্যুপ’। এই স্যুপ থেকে বেরিয়ে আসবে আর কিছুক্ষণ পরেই— সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্র। বেরিয়ে আসবে পৃথিবী, জয়, জয়া, উদয়ন, খড়ক, শিবশঙ্কর। চলো, আজকের মতো আমরা নিদ্রা যাই।”
॥ ৩৫ ॥
সকালবেলা খড়ক সিং এসে হাজির। শিবশঙ্কর তখন সবে দাড়ি কামানো শেষ করে আর এক কাপ চায়ের জন্য চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। দাড়ি কামানো একটা পরিশ্রমের কাজ। সেই কাজের পর শিবশঙ্কর এইভাবে বলেন, ‘চা ইজ এ মাস্ট।’ খড়ক সিংকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার চা চলবে! চায়ের দোকানের মালিক কি চা খায়?”
খড়ক সিং চেয়ারে বসতে-বসতে বললেন, “খায়। আপনাদের বাড়ির চা হল অমৃত। রাস্তা থেকে গন্ধ পাওয়া যায়।”
শিবশঙ্কর অন্দরমহলের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করলেন আবার, “এক কাপ নয় দু’ কাপ চা।”
খড়ক সিংকে এইবার শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন। “সাত সকালে দোকান ছেড়ে! ব্যাপারটা কী?”
“মালুম হোতা হায় কী…।”
“বাংলা তো ভালই জানো, বাংলাতেই বলো না! হালুমমালুম করছ কেন?”
“মনে হচ্ছে কী, আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি।”
“কোথায় যেতে গিয়ে হারালে? একটা রোড ম্যাপ সঙ্গে রাখলেই পারতে!”
“আমি ছিলুম নদী, হয়ে গেলুম ডোবা।”
“কেন হলে? কেউ কি তোমায় হতে বলেছিল?’
“আমার দোকানটা খুব জমেছে।”
“সে তো ভাল কথা।”
“আমি দোকান তুলে দিয়ে চলে যাচ্ছি। মেয়েটাকে আপনাদের কাছে রেখে যাব।”
“কোথায় যাবে তুমি?”
“যেমন যাই। আমার তো যাওয়ার তেমন জায়গা নেই। আমি এক জায়গায় বেশিদিন থাকতে পারি না। আমার কষ্ট হয়। মাথার ওপর হিমালয়, নদী, ঝরনা, তুষার, হিমবাহ, কত তীর্থ। আমাকে কেবলই ডাকছে, চলে আয়, চলে আয়। রাতে বিছানায় শুতে যাই, বিছানা আমাকে ছুড়ে ফেলে দেয়।”
“সবই বুঝলুম, মেয়েটাকে তা হলে আনলে কেন?
“ওরা খাটিয়ে-খাটিয়ে, না খেতে দিয়ে মেরে ফেলত। মায়া পড়ে গেল, তাই নিয়ে এলুম। বড় ভাল মেয়ে। একবার ভাবছি সঙ্গে নিয়ে যাই, তারপর ভাবছি পারবে না। আমি মাইলের পর মাইল হাঁটব, পাহাড়ে চড়ব, ওর কষ্ট হবে।”
“তুমি কোথাও যাবে না, তোমাকে আমরা যেতে দেব না। তুমি এইখানে তোমার দোকান নিয়ে থাকবে। অনেক ঘুরেছ। সারা ভারতবর্ষ তোমার অন্তত একশোবার দেখা হয়েছে। এইবার এক জায়গায় বসতে শেখো।”
“সে আমি পারব না মালিক। আমি শুকিয়ে মরে যাব। আমি সেই ছেলেবেলা থেকেই ঘুরছি। কত জায়গায় আমার কত বন্ধু আছে। কত গাছ আছে! দু-তিন বছর অন্তর-অন্তর এক-একটা জায়গায় যাই খোঁজ নিতে। কে-কে বেঁচে আছে, কে-কে মারা গেছে।”
শিবশঙ্কর ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ কয়েকবার পায়চারি করে নিলেন। চা এসে গেছে। চেয়ারে আর বসলেন না। কাপটা হাতে তুলে নিয়ে একটা চুমুক দিয়ে টেবিলে নামিয়ে রাখলেন। ভয়ঙ্কর কোনও চিন্তার সময় শিবশঙ্কর বসতে পারেন না। এটা সেই ছেলেবেলার অভ্যাস। যখন কোনও অঙ্কের সমাধান আটকে যেত, শিবশঙ্কর রাস্তায় নেমে পড়তেন। হাঁটছেন আর ভাবছেন। ঠিক এক মাইলের মাথায় মাথার মধ্যে একটা চাকা ঘুরে গেল, অঙ্ক মিলে গেল খাঁজে-খাঁজে।
শিবশঙ্কর চায়ে আর-একটা চুমুক মেরে বললেন, “সারা জীবন ঘুরে-ঘুরে তুমি কী পেলে! এখন তোমার বয়েস হয়েছে, এইটা ভেবে দেখার সময় এসেছে। পেলেটা কী।”
“আনন্দ পেয়েছি। এক জায়গায় অনেকদিন আটকে থাকাটাই দুঃখের। শোনেননি বন্ধনই দুঃখের কারণ।”
“কিছু বন্ধন আছে বড় সুখের। এই যে আমি ছেলে, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি। আমিও তোমার মতো আমার যৌবনে বনে জঙ্গলে, পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরেছি। রেলের লাইন পাতার কাজে। এখন আমার এই জীবনই ভাল লাগে। এরা বড় হবে, মানুষ হবে, আমি দেখব। আমি বেঁচে থাকব এদের মধ্যে।”
“আপনার সংসার আছে, আমার কিছুই নেই। আমি আমার ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। বিশাল বড় একটা গাছের তলায় বসে আছি। এপাশে আমার পুঁটলি, ওপাশে আমার লাঠি। দূরে একটা জমাট পাহাড়। মাথায় তার মেঘের ডানা। সূর্য নামছে পশ্চিমে। গাছের ডালে পাখিরা সব ফিরে আসছে, আর আমি চলে যাচ্ছি। আমার ভেতর থেকে আমার আত্মা বেরিয়ে এল। ডিম থেকে ছানা বেরিয়ে এসে ডানা ঝাড়ে, সেইরকম আমার আত্মা ডানা ঝেড়ে দেহের খাঁচাটাকে একটা লাথি মেরে এগিয়ে যাবে পথিকের মতো। ছোট হতে, হতে, হতে ক্রমশ অদৃশ্য হয়ে যাবে।”
“তোমার মাথা আর আমার মুণ্ড। এতই যদি সহজ হত মৃত্যু! তোমাকে বাঘে খাবে। ডাটার মতো হাড় চিবোবে। তোমার যদি বাত থাকে তা হলে অবশ্য আরাম পাবে। শোনো, ওসব রোমান্টিক কথা শুনতে ভাল, কাজের কথা ।হল,—ময়েটাকে মা-বাবার কাছে রেখে এসো। পরের দায়িত্ব কেন ঘাড়ে নিচ্ছ? পরে ওরা এসে হামলা করবে। তখন কী হবে!”
খড়ক সিং খোঁচা খেয়ে লাফিয়ে উঠল, “হামলা! হামলা করবে কে? খড়ক সিংয়ের তরোয়ালের ধার কি কমে গেছে!”
“অ্যায়, এইটাই আমি চাই। জাগো, জাগো, খডক সিং। সব যোগের সেরা যোগ, কর্মযোগ। তোমার ওই গাছতলার চায়ের দোকানটা আমার ভীষণ ভাল লেগেছে। গাছের ডালে পাখির জটলা, নীচে কতরকমের মানুষের ভিড়। উনুনে গনগনে আগুন। ছাই উড়ছে। চায়ের গন্ধ। ওরই একটা পাশে যদি থাকার ব্যবস্থা করা যায় দরমাটরমা ঘিরে, তা হলে যা হবে না?” শিবশঙ্করকে খুব খুশিখুশি দেখাচ্ছে। একটা যেন স্বপ্ন দেখছেন!
সিংজি বললেন, “আপনার আর আমার দু’জনেরই এক অভাব। সংসারে আমাদের থাকা উচিত নয়। যাক, একটা কথা বলব! এক মাসের জন্যে আমাকে ছুটি দিন, আমি ঝাঁ করে একটু ঘুরে আসি। কিছু না, চির, চিনার, গাছ আর পাহাড়গুলোকে একবার দেখে আসি। এই বিষয়ী মানুষদের সঙ্গে বেশিদিন থাকলে আমার ভেতরটা কেমন করে?”
“তোমার মেয়েকে আমরা দেখব। জয় আর জয়া যখন আছে তখন আমার আর কোনও ভাবনা নেই। মেয়ে তোমার মনের আনন্দে থাকবে। কিন্তু, তোমার দোকানটার কী হবে?”
“এক মাস বন্ধ থাকবে।”
“কত লোক ফিরে যাবে! ভোরবেলা যারা কাজে যায় তোমার দোকানে, চ খেয়ে, তাদের কী হবে! এই শীত আসছে।”
“তা হলে এক মাস দোকানটা আপনিই চালান। আপনার তো অহঙ্কার নেই। মান-সম্মানের ভয় নেই। ছেলে বড় ডাক্তার, আপনি বড় এঞ্জিনিয়ার; কিন্তু চালচলনে বোঝাই যায় না!”
“সিংজি, অহঙ্কার আমাদের নেই। তোমারও নেই, আমারও নেই। তুমি নিজেকে অতটা ছোট করছ কেন? তুমিও তো রাজার ছেলে। তবে কী জানো, চায়ের দোকান আমি চালাতে পারব না! ওটা কী হবে বলো তো, লোকদেখানো পাগলামি। নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই। আমার দিন ছোট হয়ে আসছে। এখনও অনেক কাজ বাকি। সেইসব কাজ আমাকে তুলতে হবে। তুমি অন্য কাউকে বলো। শিরিনের মাকে বলে দ্যাখো না!”
“হবে না। তার নিজের কারবার ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।”
“তা হলে দোকানটা বন্ধই থাক। মাসখানেক পরে এসে খুলবে।”
“সেই ভাল। মেয়েটাকে আমি আজ রাতে রেখে যাব।”
রাত সাড়ে আটটার সময় খড়ক সিং লছমিকে নিয়ে এলেন। মনের মতো করে মেয়েটাকে সাজিয়েছেন! চুমকি-বসানো লাল একটা ফ্রক পরিয়েছেন। একেবারে নতুন। কপালে লাল টিপ। দু’ হাতে পরিয়েছেন গালার চুড়ি। সুন্দর একটা সুটকেসে লছমির জিনিসপত্র। দু’ বাক্স মিঠাই এনেছেন। সবাই মিষ্টিমুখ করবেন। লছমি সিংজির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। নতুন জায়গা, তাই লজ্জা করছে!
জয়া এসে মেয়েটার হাত ধরল, “লছমি! তোমার ভয় কিসের! তুমি তো আমাদের বোন।”
জয়ার মা মাথায় হাত রেখে বললেন, “এটা তো তোমার নিজের বাড়ি। আমি তো তোমার মা!”
লছমি অবাক হয়ে উমাকে দেখছে। বড়-বড় চোখ দুটো ছলছল করছে। বিশ্বাস গ্রতে পারছে না—মানুষ এত ভাল হয় কী করে! যবে তার জ্ঞান হয়েছে তবে থেকেই সে যাদের দেখে আসছে, তাদের শরীরে দয়ামায়া, স্নেহ-মমতা কিছুই নেই। তাদের কথা ছিল—হয় খাটো, না হয় মার খাও।
লছমি দৌড়ে এসে জয়ের মায়ের কোমরটা জড়িয়ে ধরল। সিংজি বললেন,
“আমি তা হলে আসি।”
তাঁর মুখটা কেমন বিষণ্ণ দেখাল। ঘর থেকে চলে যাচ্ছেন এমন ভাবে, যেন। মন চাইছে না, জোর করে যাচ্ছেন।
॥ ৩৬ ॥
জয় আর জয়া এখন দু’জনে একসঙ্গে শোয়। এই ব্যবস্থাটা নিজেরাই করে নিয়েছে। কারণ একটাই, যতক্ষণ না ঘুম আসে ততক্ষণ দু’জনে গল্প করা যায়। সারাদিন শুধু কাজ আর কাজ, পড়া আর পড়া। এদিকে কথা তো কম নেই। কত কথাই তো বলার আছে। কত গল্প! আকাশে কী আছে। আকাশের সীমা কত দূর! পৃথিবী ছাড়া আর কোথায় প্রাণী আছে! হ্যালির ধুমকেতুর তারা কবে দেখতে পাবে? ভারতবর্ষের মানুষ কি কোনওদিন চাঁদে যাবে না! পেনসিল রকেট কি তৈরি করা যায় না! হ্যাম রেডিয়ো অপারেটর হতে গেলে কী করতে হবে! সমুদ্রের তলায় কী আছে! দ্বারকা কেমন করে তলিয়ে গেল। আটলান্টিস দ্বীপ কীভাবে তলিয়ে গেল স্ট্রেটস অব জিব্রালটারে। আইসবার্জ শেষ পর্যন্ত কোথায় যায়। টাইটানিক কীভাবে তলিয়ে গেল! ডেথ ভ্যালি কোথায়। বকর-বকর করতে করতে এক সময় দু’জনেরই কথা জড়িয়ে আসে। শ্বাসপ্রশ্বাস ভারী হতে থাকে। এক সময় ঘর নিস্তব্ধ। মশারির ভেতর জয় আর জয়া গভীর ঘুমে।
আজ তারা অন্য কথা বলছে। আজকের বিষয় খড়ক সিং।
জয় বলল, “দিদি, খড়ক সিংজি ওইভাবে চলে গেল কেন? ইচ্ছে করছে না, তবু চলে গেল।”
জয় বলল, “তুই ধরেছিস ঠিক। মনে হল, সেই শক্তি নেই, সেই আনন্দ নেই। কী যেন একটা হয়েছে।”
“দিদি, সিংজি আবার ফিরে আসবে তো?”
জয়া কোনও উত্তর দিল না। বিছানায় চুপ করে বসে রইল অনেকক্ষণ। এত বড় একটা দেশ! নদী, প্রান্তর, অরণ্য, শহর! এই নির্জন রাতে অমন সুন্দর একটা মানুষ কোথা থেকে কোথায় চলেছে একা-একা কে জানে! জয়া নিজের মনেই বলে উঠল, “কোনও কথা শোনে না মানুষটা। তোমার বয়েস হচ্ছে, সেই কথাটা বোঝো না কেন? তুমি আমাদের কাছে থাকো। খাওদাও, গল্প করো, তা না, সারা ভারত ঘুরছ। তোমার ঘোরার আর শেষ নেই। কিছু একটা হয়ে গেলে, কে তোমাকে দেখবে! এমন অবাধ্য ছেলে আমি জীবনে দেখিনি।”
উত্তেজনায় জয়া মশারি তুলে খাট থেকে নেমে এল। সারা ঘরে পায়চারি করছে। জয়ার এইটাই অভ্যাস। দুশ্চিন্তা এলে সে এই রকমই করে। জয়া এই মুহূর্তে খড়ক সিংয়ের মা। পায়চারি করতে করতে বলছে, “এইবার তুমি ফিরে এসো, তোমার পায়ে আমি শেকল পরাব।”
জয় বলল, “জানিস দিদি, বেশ হত, যদি পুলিশ অ্যারেস্ট করে কিছু দিন জেলে রেখে দিত।”
“সে তো করবে না। খাঁটি একজন সাধুকে পুলিশ অ্যারেস্ট করবে কেন!”
“দিদি, তুই এইবার বিছানায় ঢুকে পড়। কাল সকালে আমরা খবর নিতে বেরোব।”
“কোথায় যাবি খবর নিতে? কোন জায়গায় যাবি? কার কাছে যাবি?”
“স্টেশনে মাস্টারবাবুর কাছে যাব। সিংজির বাড়িতে একবার যাব। শিরিনের কাছে যাব। তুই এইবার শুয়ে পড় দিদি।” আলো নিবিয়ে দু’জনে শুয়ে পড়ল। জয় জয়ার বুকে আলতোভাবে একটা হাত ফেলে রেখেছে। জয়া দু’হাতের মুঠোয় সেই হাত ধরে আছে। দু’জনে একই সঙ্গে ঘুমের সাগরে ভেসে যেতে চায়। পাশাপাশি দুটো নৌকোর মতো যেন ছাড়াছাড়ি না হয়ে যায়। একটা খাতা করেছে, ‘স্বপ্নের খাতা’। রোজ যা স্বপ্ন দেখে দু’জনে লিখে রাখে। স্বপ্নের দেশের ভূগোল আলাদা। ঘরবাড়ির রং অন্যরকম! মানুষগুলো উজ্জ্বল। সবচেয়ে আশ্চর্যের হল, স্বপ্নের দেশে রাত নেই। সেখানে যেন চির সকাল। জয় আর জয়া আর একটা খাতা করেছে, সেই খাতাটার নাম ‘দর্শন’। রোজ কিছু-না-কিছু এমন দৃশ্য বা ঘটনা চোখে পড়ে যা লিখে রাখার মতো। একটা ঘটনা বললেই বোঝা যাবে: দুটো ছেলে দোকান থেকে একটা সামোসা কিনে গাছতলায় দাঁড়িয়েছে। ভেঙে ভাগ করে দু’জনে খাবে। ভাঙতে পারছে না। ফু দিচ্ছে। এমন সময় কোথা থেকে একটা মেয়ে এল। চুলে তেল নেই। শতচ্ছিন্ন ফ্রক। কিছু বলছে না। একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে শিঙাড়াটার দিকে। ছেলে দুটো একবার করে শিঙাড়াটা দেখছে, একবার করে মেয়েটাকে। শেষে যার হাতে শিঙাড়াটা ছিল সে এগিয়ে গিয়ে, ঠাকুরকে যেভাবে ভোগ নিবেদন করে সেইভাবে শিঙাড়াটা মেয়েটির হাতে দিল। মেয়েটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে কেঁদে ফেলল। ছেলেটা মেয়েটার পিঠে হাত বোলাচ্ছে। মেয়েটা শিঙাড়াটা মুখে তুলতে পারছে না। হাত কাঁপছে। ছেলেটা বলছে, “বহিন, খা লো, খা লো!” মেয়েটা কাঁদছে আর খাচ্ছে। এই ঘটনার শেষে জয় লিখছে, আমার খেতে বসতে লজ্জা করে। কতরকমের খাবার! অর্ধেক খাই, অর্ধেক ফেলে দি। আমরা ক্রিমিনাল। জয় এখন বড় হচ্ছে। তার মাথায় নিজের চিন্তা আসছে। বিচার, বিশ্লেষণ আসছে। জয় লিখছে, আমরা সবাই ভণ্ড, শয়তান আমরা। স্বামীজি লিখছেন: আমি এত তপস্যা করে এই সার বুঝেছি যে, জীবে জীবে তিনি অধিষ্ঠান হয়ে আছেন; তা ছাড়া ঈশ্বর-ফিশ্বর কিছুই আর নেই। জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু সর্ব ভূতে সেই প্রেমময়
মন প্রাণ শরীর অর্পণ কর সখে—এ সবার পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
যদি একজনের মনে—এ সংসার-নরককুণ্ডের মধ্যে একদিনও একটু আনন্দ ও শান্তি দেওয়া যায়, সেইটুকুই সত্য, এই তো আজন্ম ভুগে দেখছি—বাকি সব ঘোড়ার ডিম।
একটু ক্ষণের মধ্যেই জয় ঘুমিয়ে পড়ল। জয়ার আর কিছুতেই ঘুম আসছে না। একটু যেই আসছে, কে যেন ডেকে চমকে দিচ্ছে। বহু দূর থেকে ভেসে আসা সেই ডাক। জয়া, জয়া। জয়া আর শুয়ে থাকতে পারল না। উঠে পড়ল। নেমে এল খাট থেকে। অন্ধকার চেয়ারে বসে বোঝার চেষ্টা করল, ব্যাপারটা কী হতে পারে। মনের ভুল কী! কেবলই মনে হচ্ছে, কেউ ডাকছে।
জয়া বেরিয়ে এল ঘর থেকে। বাড়ি অন্ধকার। সবাই গভীর ঘুমে। বাইরে বাগানের দিকের আলোটা যেমন রোজ জ্বলে সেই রকম জ্বলছে। সেই আলোয় কিছু-কিছু গাছের পাতা ঝিলমিল করছে। বারান্দার শেষ মাথার কাচের জানলায় আলোর আভা। জয়া দাদির ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দরজার ছিটকিনি ভেতর থেকে কোনওদিন বন্ধ করেন না শিবশঙ্কর। বলেই রেখেছেন যার যখন দরকার হবে আমাকে এসে ডাকবে। একটুও ইতস্তত করবে না। আমি প্রায় জেগেই থাকি। পাশের ঘরে দিদা। সেই ঘরে আজ লছমি শুয়েছে। আর একটু পরেই শেষ রাত থেকে ভোর পর্যন্ত দিদার মালা-জপ শুরু হবে। কান পাতলে শোনা যাবে তুলসীর মালা জপ করার খুটুস খুটস শব্দ।
জয়া সাবধানে, নিঃশব্দে দরজা খুলে শিবশঙ্করের ঘরে ঢুকল। দুধসাদা বিছানায় শিবশঙ্কর চিত হয়ে শুয়ে আছেন। বাগানের আলোর আভায় ঘরের অন্ধকার তেমন ঘন হতে পারেনি। স্বচ্ছ জলের মতো টলটল করছে। জয়া ঢুকতেই শিবশঙ্কর বললেন, “ঘুম আসছে না তো! মনে হচ্ছে, কে যেন দূর থেকে ডাকছে, তাই তো।”
জয়া খুব অবাক হয়ে বলল, “আপনি কী করে জানলেন দাদা?”
“আমি যে শুনতে পাচ্ছি।”
জয়া বিছানায় বসে পড়ল শিবঙ্করের পাশে। শিবশঙ্করের বুকে একটা হাত রাখল। শিবশঙ্কর দু’ হাতে সেই হাতটা ধরলেন। জয়া বলল, “এমন কেন হচ্ছে দাদি! আমারও হচ্ছে, আপনারও হচ্ছে। কে ডাকছিল দাদি?”
“অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে সেইটাই তো ধরার চেষ্টা করছি।”
“আমার কেবলই মনে হচ্ছে, খড়ক সিং ডাকছে। খড়ক সিংয়ের কোনও বিপদ হয়েছে।
“আমারও সেইরকমই মনে হচ্ছে।”
শিবশঙ্কর উঠে বসে বললেন, “এই সিগন্যালটা কি উপেক্ষা করা উচিত! মনের ভুল, কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেওয়া উচিত।”
“চলুন, আমরা দুজনে সিংজির বাড়ির দিকে একবার যাই। দেখে আসতে ক্ষতি কী!”।
শিবশঙ্কর উঠে দাঁড়াতেই জয় এল ঘরে, “ঘুমোতে পারছি না, কে ডাকছে।”
জয়া বলল, “তুইও শুনতে পেয়েছিস?”
“পাব না? খড়ক সিংয়ের গলার মতো গলা।”
তিনজনে মাঝরাতের প্রায়-অন্ধকার রাস্তায় বেরিয়ে এলেন। হিম-হিম বাতাস। এই বাতাস গায়ে লাগলেই জয়ের মনে হয়, প্রেতের নিশ্বাস কফিনের ঢাকনা খুলে বেরিয়ে আসছে।
॥ ৩৭ ॥
এত রাতে কখনও তারা রাস্তায় বেরোয়নি। দু’পাশে দু’হাত মেলে পড়ে আছে নির্জন অন্ধকারে। ঝুপুর ঝাপুর গাছে তাল তাল অন্ধকার। দু’পাশের অন্ধকার ঝোপে জোনাকির নৃত্য। বেশ লাগতে পারত; কিন্তু লাগছে না, কারণ খড়ক সিংয়ের চিন্তা। রাস্তাটা ডান দিকে বেঁকে চলে গেছে স্টেশনের দিকে, বাঁ দিকে ডাক বাংলোর মাঠ ছুঁয়ে সোজা সরলা নদীতে। চৌরাস্তার প্রশস্ত পরিসরে দুটো কুকুর ভীষণ খেলা করছে। তিরতির করে ছুটছে, লাফিয়ে-লাফিয়ে উঠছে, দু’জনে দু’জনকে জাপটে ধরে উলটে পড়ছে। লুটোপুটি খাচ্ছে। সবাই একটু থমকে দাঁড়াল সেই দৃশ্য দেখে।
শিবশঙ্কর বললেন, “বুঝলে, এইটাই হল মজা। কুকুরদের ঘড়ি নেই তো, তাই সময়ের দাসত্ব করতে হয় না। সোম নেই, শুক্র নেই, মাস নেই, বছর নেই। গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমোচ্ছে, এরা দ্যাখো কেমন মহানন্দে কুস্তি লড়ছে। দিন গেল রাত গেল, বলে কোনও দুশ্চিন্তা নেই। আমরাই কেবল, ‘সময় চলিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়’ বলে হায় হায় করি।”
হঠাৎ বহু দূর থেকে হুউ-হুউ করে একটা শব্দ ভেসে এল। একটা কুকুর কাঁদছে। এই কুকুর দুটোর খেলা বন্ধ হয়ে গেল। এরা এতক্ষণ মুখে হ্যা-হ্যা করে শব্দ করছিল। সেই শব্দ বন্ধ। একপাশে চুপ করে বসে আছে। ভয় পেয়েছে ভীষণ।
জয়া বলল, “দাদি, খুব অশুভ লক্ষণ। কুকুর কাঁদছে। দূরে, ডাকবাংলোর মাঠে।”
শিবশঙ্কর প্রথমে কোনও উত্তর দিলেন না। পরে বললেন, “এসব আমাদের কুসংস্কার। কুকুর হল নেকড়ে বাঘের বংশধর। নেকড়ে হল, ‘প্যাক অ্যানিম্যাল’। দল বেঁধে ঘোরায় অভ্যস্ত। আর ভয় পেলে সমস্বরে এইভাবে চিৎকার করে অন্য দলকে জানিয়ে দেয়, বিপদের গন্ধ পেয়েছি। শিকারিরা সেই অনাদিকাল থেকে নেকড়ে শিকার করে আসছে। গুলির শব্দ বা গুলির মতো শব্দে এরা ভয় পেয়ে যায় আজও। এরই নাম ‘অ্যানিম্যাল ইনস্টিংক্ট’। কুকুরের ঘ্রাণ, কুকুরের কান খুব তীক্ষ্ম।”
শিবশঙ্করের কথার মাঝেই এই কুকুর দুটোও আকাশের দিকে মুখ তুলে একই ভাবে ডাকতে লাগল। সে ডাক সহ্য করা যায় না। গা-ছমছম করে। অজানা আশঙ্কায় বুক ভরে যায়। কুকুর দুটো ওইভাবে ডাকতে-ডাকতে ধীরে-ধীরে এগোতে লাগল ডাকবাংলোর মাঠের দিকে। মাথার ওপর তারায় ভরা কালো আকাশ। ঝুপসি গাছপালা, হিলহিলে বাতাস, কুকুরের সমবেত কান্না, জয়ের ভয় করছিল। সে দিদির হাতটা চেপে ধরল।
জয়া বলল, “কী রে, ভয় করছে!”
“কেমন গা ছমছম করছে। তোর কিছু মনে হচ্ছে না দিদি?”
‘আমারও কেমন যেন লাগছে। বাইরে বেরিয়ে এত রাত তো কখনও দেখিনি।”
শিবশঙ্কর বললেন, “কুকুর দুটো আমাদের ডিরেকশান দিচ্ছে। চলো ডাকবাংলোর দিকে যাই।”
তিনজনে বাঁ দিকের রাস্তা ধরে এগোতে লাগলেন। হঠাৎ গায়ে দু-তিন ফোঁটা জল পড়ল।
জয় বলল, “কী হল? আকাশে মেঘ নেই, বৃষ্টি পড়ছে কেন?”
জয়া বলল, “মনে হয় স্বাতী নক্ষত্রের জল। এই জল ঝিনুকের পেটে পড়লে মুক্তো হয়। তাই না দাদি?”
“হোক, না হোক, ভাবতে ভীষণ ভাল লাগে। যেমন কুকুর কেন কাঁদে! অশরীরী আত্মা দেখে কাঁদে। আমরা দেখতে পাচ্ছি না। কুকুর দেখতে পাচ্ছে। পৃথিবীটাকে রহস্য দিয়ে ঘিরতে পারলে বেশ লাগে। বেঁচে থাকার একঘেয়েমিটা কেটে যায়।”
জলের রহস্যটা পরিষ্কার হল না। পৃথিবীতে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যার কোনও বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে না। এই যে তারা মাঝরাতে বিছানা ছেড়ে পথে নেমে এসেছে, এর ব্যাখ্যাটা কী! কে যেন ডাকছে! তাই তো! সে ডাক কে শুনেছে? ডাকবাংলোর মাঠ এসে গেল। বিশাল সেই গুলমোহর গাছ। মাঠের মাঝখানে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। যে-কুকুরটা কাঁদছিল, সেটা ওই গাছটার তলাতেই দাঁড়িয়ে আছে। আর যে দুটো খেলছিল, সে দুটোও থমকে দাঁড়াল কিছু দূরে। একটা কিছু ঘটেছে ওই গাছতলায়। অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে না। শিবশঙ্কর, জয় আর জয়া ধীর পায়ে এগোচ্ছেন। কিছু ঘাস, কিছু কাঁকর। জুতোর তলায় পাথরের কড়কড় শব্দ।
আরও কিছুটা এগোতেই মনে হল গাছের গুঁড়িতে হেলে আছে একটা মূর্তি। শিবশঙ্কর টর্চ ফেললেন। একপাশে পুঁটলি, আর একপাশে লাঠি, হেলে আছে খড়ক সিং। জয় আর জয়া ছুটে গিয়ে দু’পাশে বসে পড়ল। জয়া বুকে কান রাখল। খুব ক্ষীণ একটা শব্দ আছে এখনও। শিবশঙ্কর এসে নাড়িটা ধরলেন। মাথাটা নিচু করে আছেন। বোঝার চেষ্টা করছেন, মানুষটা কতদূর এগিয়েছে ওই জগতের দিকে। ঘড়ি সেকেন্ডের মাত্রায় টিকটিক করছে কি না। হাতটা সাবধানে সিংজির কোলের ওপর রেখে শিবশঙ্কর বললেন, “এই সময় উদয়নকে ভীষণ প্রয়োজন। তোমরা দু’জনে পাহারা দিতে পারবে?”
জয়া বলল, “কেন পারব না দাদি!”
“তা হলে আমি গিয়ে ডেকে আনি। তোমরা টর্চটা রাখো।”
“টর্চটা আপনি নিয়ে যান।”
“টর্চ তোমাদের কাছে রাখো। যে-কোনও সময় প্রয়োজন হতে পারে। অন্ধকারে এই পথটুকু যেতে আমার কোনও অসুবিধে হবে না।”
শিবশঙ্কর গাছকে বললেন, “বৃক্ষদেবতা। এই তিনজনকে তোমার আশ্রয়ে রেখে যাচ্ছি। দেখো কিন্তু। কোনও বিপদ যেন না হয়!”
শিবশঙ্কর বড়-বড় পা ফেলে বাড়ির দিকে চললেন। সিংজির দু’পাশে জয় আর জয়া বসে আছে। এ কী হল! খড়ক সিংয়ের তো এইরকম ইচ্ছেই ছিল। গাছের তলায় মৃত্যু আসবে রাজার পোশাকে। রাজপুত রাজাদের মতো পোশাক পরে। বর্ম, শিরস্ত্রাণ। এসে বলবেন, ‘বীর! তোমার পৃথিবীর কাজ শেষ। চলো, এইবার স্বর্গের বাগানে। সেখানে দুঃখ নেই, লড়াই নেই, শুধু আনন্দ।’
জয় আর জয়া দেখছে, মাঝরাতের তারা যেন গাছের ডাল থেকে পাতার আড়ালে ঝুলে আছে। বিরাট মাঠ ছড়িয়ে আছে চারপাশে। অন্ধকারে জমাট হয়ে আছে ডাকবাংলোটা। তিনটে কুকুর বসে আছে তিন দিকে। দূর থেকে ভেসে আসছে ট্রেনের শব্দ। কোথায় কে যেন তিনবার শাঁখ বাজাল। ভয় যে একেবারেই করছে না, তা নয়, তবে মনে হচ্ছে, কিসের ভয়! তেমন হলে, আমাদের তো সিংজি আছেন। তিনি লাফিয়ে উঠবেন। সিংজির সঙ্গে তো কারও চালাকি চলবে না!
জয়া কায়দা করে সিংজির পেছন দিকে চলে গেছে, যাতে তাঁর মাথাটা জয়ার নরম বুকে থাকতে পারে! শ্বাস-প্রশ্বাস পড়ছে বলে মনেই হচ্ছে না। শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা।
“তুমি আমাদের ছেড়ে চলে যাবে সিংজি! তুমি এত নিষ্ঠুর! আমরা থাকব, তুমি থাকবে না! আমরা কার সঙ্গে গল্প করব! বেড়াতে যাব! খেলা করব! তুমি কেন যাবে! কে তোমাকে ডেকেছে! তুমি যে বলতে, আমার জয় আর জয়াকে বড় করে দিয়ে তারপর আমি যাব। সেই কথা তো তুমি রাখলে না সিংজি! শুনেছি, ভগবান আছেন। ভীষণ-ভীষণভাবে ডাকলে তিনি সাড়া দেন। এই গাছ, এই আকাশ, গভীর রাত, এ তো বাড়ি নয়, তা হলে ভগবান কেন আসবেন না! আমরা আরও বড় হয়ে যাই তারপর না হয় সিংজি যাবেন!”
জয়া সেই ভগবানকে ডাকছে। তিনি ইচ্ছে করলে সবই তো করতে পারেন।
জয়া জয়কে, বলল, “পুঁটলিটা একবার খুলে দেখ তো, একটা চাদর পাস কি না। গা-টা বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।”
জয়া সিংজিকে দু’-হাতে জড়িয়ে ধরে আছে। তার শরীরের গরম যতটা দেওয়া যায়! জয় পুঁটলিটা খুলতেই একটা লোটা গড়িয়ে এল বাইরে। দু-একটা জামাকাপড়। তিন-চারখানা বই। একটা কম্বল। এর বেশি কিছু নেই। জয় কম্বলটা নিয়ে সিংজির গায়ে চাপা দিয়ে দিল। কুকুর তিনটে সজাগ প্রহরীর মতো সব দেখছে। গাছের ডালে একটা পাখির নড়েচড়ে বসার শব্দ।
জয়া বলল, “পা দুটো দেখ তো জয়।”
“খুব ঠাণ্ডা রে দিদি।”
“দু’ হাত দিয়ে বেশ করে ঘষ।”
জয় পায়ের পাতা ঘষছে। আর তো কিছু করার নেই। জয়া বেশ করে জড়িয়ে ধরে আছে। একনাগাড়ে ভগবানকে ডাকছে। ‘তোমার মৃত্যুকে বারণ করো ভগবান। যার যাওয়ার সময় হয়নি, তাকে কেন নিয়ে যাচ্ছ?’ সিংজি একসময় একটু যেন নড়ে উঠলেন। জয়া ভাবল, ভগবান তার কথা বুঝি শুনছেন। দূরে একটা গাড়ির হেডলাইট দেখা যাচ্ছে। ওই তো দাদি আসছেন বাবাকে নিয়ে। এখন একটা ইনজেকশান। জয়া ডাক্তারের মেয়ে। সে জানে, কী হলে কী করতে হয়। গাড়িটা হু-হু করে আসছে। ভগবান আসছেন। সবাই তো তাই বলেন, “ডাক্তারবাবু আমাদের ভগবান!”
॥ ৩৮ ॥
জয়ার আলিঙ্গনে খড়ক সিংয়ের দেহটা একবার কেঁপে উঠেই স্থির হয়ে গেল, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই গাড়িটা এসে থামল। উদয়ন আর শিবশঙ্কর ঝটপট নেমে এলেন।
জয়া চিৎকার করে বলল, “যাঃ ফুরিয়ে গেল।”
জয়া কেঁদে ফেলেছে। জয় দাড়িয়ে আছে হতভম্ব হয়ে। জয়া কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। জানা বাংলাও মনে আসছে না। ফুলে-ফুলে কাঁদছে। তাদের বাড়িতে কান্না জিনিসটা সবাই অপছন্দ করেন। মানুষ আজ হোক কাল হোক মারা যাবেই। জীবনে হরেকরকম দুঃখ আসতেই পারে। তোমাকে সহ্য করতে হবে। সেটাও একটা শিক্ষা। মন খারাপ হবেই। সেটাকে চেপে রাখতে হবে ভেতরে। হাঁউমাউ করলে মৃত মানুষ ফিরে আসবে না। জয়া সেই কারণে ফুলছে। খড়ক সিংয়ের মাথাটা এলিয়ে আছে তার বুকে।
উদয়ন নাড়ি দেখলেন। শিবশঙ্করকে বললেন, “কিছু করা গেল না। আর পাঁচটা মিনিট আগে আসতে পারলে হয়তো টেনে রাখা যেত।”
“যে যাবে সে যাবেই। তা না হলে তোমার নতুন গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হবে কেন! ওইখানেই আমাদের দশটা মিনিট সময় চলে গেল।”
“তেলে ময়লা এসে গেল।”
“খড়ক এইভাবে এত তাড়াতাড়ি চলে যাবে ভাবতেও পারিনি। আমাদের আনন্দের হাট ভেঙে দিয়ে গেল।”
উদয়ন বললেন, “মনে হচ্ছে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। যাই হোক, জয়া খুব বেকায়দায় পড়েছে। আসুন আমরা ধরাধরি করে ঘাসের ওপর শোওয়াই। তারপর অ্যাম্বুলেন্স আনতে হবে।”
শিবশঙ্কর বললেন, “দাড়াও, আগে একটা কম্বল বিছিয়ে দিই। জায়গাটায় কাঁকর বালি আছে। এমনই শোওয়ালে লাগবে। উদয়ন আর জয় খড়ক সিংয়ের পোঁটলা থেকে তার সেই বিখ্যাত গেরুয়া রঙের কম্বলটা বের করে মাঠে বিছিয়ে দিল। তারপর ধরাধরি করে খড়ক সিংকে তার ওপর শোওয়ানো হল। জয় কাদোকঁদো গলায় বলল, “বাবা, একবার চেষ্টা করে দ্যাখো না, তুমি ইচ্ছে করলে সবই পারো। তুমি তো কতজনকে বাঁচিয়েছ বাবা।”
উদয়ন জয়কে বুকের কাছে টেনে নিলেন। বুঝতেই পারছেন, ছেলেটার ভেতরে কী হচ্ছে। মানুষের ক্ষমতা কতটুকু, দেহ থেকে প্রাণ একবার বেরিয়ে গেলে কিছুই আর করার থাকে না। টিউব থেকে টুথপেস্ট একবার বেরিয়ে গেলে আর ঢোকানো যায় না।
জয়া বসে আছে খড়ক সিংয়ের মাথার কাছে। শিবশঙ্কর দাঁড়িয়ে আছেন বুকে হাত রেখে। মাথার ওপর বিশাল গাছ। শাখা-প্রশাখা হাত মেলে আছে ঊর্ধ্ব আকাশে। যেন ভয়ঙ্কর এক নৃত্য থেমে গেছে কারও আদেশে। তারারা তাকিয়ে আছে নীচের পৃথিবীর দিকে। এই দৃশ্যটাও নিশ্চয় তাদের চোখে পড়ছে। তারার মতোই ঝকঝকে একজন মানুষ খসে পড়েছে। এক রাজপুত বীর। যাঁর জীবনের ইতিহাস আভাসে কিছুটা জানা গেছে। অতীতটাকে যিনি সবসময় অতীতেই রাখতে চাইতেন। অতীত ছাড়াই যিনি একটা নতুন বর্তমান তৈরি করতে চেয়েছিলেন।
শিবশঙ্কর সেই নিস্তব্ধতায় হঠাৎ বলে উঠলেন, “এ হল ইচ্ছামৃত্যু। খড়ক এইরকম একটা মৃত্যুর কথা প্রায়ই আমাকে বলত। আর ঠিক তাই হল। সেইভাবেই চলে গেল। অসুখটসুখ নয়, বাঁচার ইচ্ছেটা চলে গেল তো মানুষের হয়ে গেল!”
সবাই প্রথমটায় একটু থমকে গিয়েছিলেন। বক্সিং-এর রিং-এ যেমন হয়। ঘুসি খেয়ে পড়ে গেল। চোখে অন্ধকার। তারপর প্রতিযোগী আস্তে-আস্তে দড়ি ধরে উঠে দাড়াল। উদয়ন বললেন, “আমি অ্যাম্বুলেন্স আনি।”
“অ্যাম্বুলেন্স এনে কী হবে! অ্যাম্বুলেন্স ডেডবডি নেবে না। আনতে হবে একটা ভ্যান। খড়ক সিংকে প্রথমে আমরা নিয়ে যাব তার বাড়িতে। তারপর সকলের সঙ্গে, ব্যবস্থা কী করা যায়, পরামর্শ নিতে হবে।”
“সৎকারই তো একমাত্র ব্যবস্থা।”
“আত্মীয়স্বজন কি কেউ নেই! অতখানি একটা বাগানবাড়ির কে ওয়ারিশান হবে! পুলিশের পারমিশন ছাড়া আমরা সৎকারেরও অধিকারী নই। অনেক ঝামেলা পরে আসতে পারে।”
“আপনারা তা হলে অপেক্ষা করুন। আমি থানা থেকেই ভ্যান আনছি।”
“দাড়াও, সেখানেও কিছু চিন্তার আছে।”
শিবশঙ্কর আর উদয়ন গাছের তলায় শিকড়ের ওপর পাশাপাশি বসলেন। পুলিশের হাতে তুলে দিলে, আইন খুব কড়া। পোস্টমর্টেম তো করবেই। অকারণ কাটা-ছেঁড়া। এখনও রাত অনেক বাকি। পৃথিবী নিদ্রিত। কিছু না, নিঃশব্দে সিংজিকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাঁর ঘরের বিছানায় শুইয়ে দাও। সব সমস্যার সমাধান। তারপরে একটা ডেথ সার্টিফিকেট ও সৎকার।
জয় গাড়ির পেছনের দরজাটা খুলে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। শিবশঙ্কর, উদয়ন আর জয়া ধরাধরি করে সিংজিকে পেছনের আসনে আধশোয়া করে রাখল। সমস্যাটা হচ্ছিল পা নিয়ে। শরীর ক্রমশই শক্ত হয়ে আসছে। একেই বলে ‘রাইগার-মর্টিস’। জয়ার হয়তো কিছুই হচ্ছে না; কিন্তু জয়ের একটু অস্বস্তি লাগছিল। প্রাণহীন দেহ। যে মানুষটাকে সে খড়ক সিং বলে জানত, সে মানুষটা চলে গেছে। খোলটা পড়ে আছে। ক্রমশ শক্ত হয়ে যাচ্ছে শরীরটা। পা দুটোকে আরও একটু ভাজ করতে গেলে মট করে ভেঙে যাবে। এই দেহটাকে জয় চেনে না। এই দেহটা তার কাছে আতঙ্কের মতো। ভয় দেখাচ্ছে। একে নিয়ে পেছনের আসনে সে বসতে পারবে না। শরীরটা বরফের মতো ঠাণ্ডা।
শিবশঙ্কর ভাবছেন, তাঁরা কি খুনি! কীরকম ভয়ে-ভয়ে দেহটা তুলছেন। কেউ যেন দেখে না ফেলে! দেখে ফেললেই বিপদ। দিনকাল আর আগের মতো নেই। মানুষ এখন মানুষকে সন্দেহের চোখে দেখে। শিবশঙ্কর জয় আর জয়াকে বললেন, “তোমরা চট করে পেছনে ঢুকে বসে পড়ো।”
জয় যা ভেবেছিল তাই হল। মৃতদেহের পাশে বসতে তার ভয় করছে।
জয়া বলল, “দু’জনে বসা যাবে না দাদি। আমি বসছি। জয়কে আপনি সামনে নিয়ে নিন।”
উদয়ন চালকের আসনে বসতে বসতে বললেন, “কুইক, কুইক, ভোর হয়ে আসছে।”
শিবশঙ্কর পেছনের ডিকিতে খড়ক সিংয়ের পোঁটলাটা তুলে দিলেন। গাড়ি চলতে শুরু করল। সিংজির বাড়িতে পৌঁছতে দশ মিনিটের মতো সময় লাগল! বিশাল বাগান ঝিম মেরে আছে। অজস্র ঝিঁঝিঁ পোকা ঝনঝন করে ডাকছে। এইসব গাছপালা, ফুল, ফল, সিংজি আর কোনওদিনই দেখতে পাবেন না। একসময় কত কী করে রেখে গেছেন এই উদ্যানে! এইখানেই তো তাঁর বেশি সময় কাটত।
ঘরে তো ঢোকা হবে; কিন্তু দরজায় তালা। সেই তালার চাবি কোথায়! খড়ক সিং যে জামাটা পরে আছেন সেটা একটা জোব্বার মতো। অনেক তার পকেট। জয়া খুঁজছে। এক-এক পকেটে এক-একরকম জিনিস। একটা পকেটে হাঁসের ডিমের মত দেখতে ধবধবে সাদা একটা পাথর রয়েছে। আর-এক পকেটে ছোট্ট একটা ডায়েরি। বুকপকেটের ভেতর দিকের পকেটে কিছু টাকা রয়েছে। সবই আছে, কেবল চাবিটাই নেই।
পোঁটলাটা খোলা হল। সবই আছে সেখানে, এমনকী হোমিওপ্যাথিক ওষুধের একটা ব্যাগ। পাউচের মতো। কিন্তু চাবিটা নেই। এইবার কী হবে! এদিকে যে ভোর হয়ে আসছে। আকাশের কালো ক্রমে তৃরল হয়ে যাচ্ছে।
বেশ একটু দুশ্চিন্তারই কারণ হল। চাবি কোথায়! তালা ভাঙা কি সহজ কাজ। অত বড় লাগাই তালা! সেই সময় জয়ের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল। অবশ্য বুদ্ধিটা সে পেয়েছে ইংরেজি সিনেমা থেকে। চাবিটা পকেটে বা পোটলায় নেই, আছে অন্য কোনও লুক্কায়িত জায়গায়। দরজার আশেপাশে কোনও ফুলগাছের টবের তলায়, অথবা কোনও গাছের গোড়ায় পাথরের তলায়।
সবাই যখন ভাবছে, জয় তখন চুপিচুপি খুঁজতে বেরিয়েছে। দরজার দু’ধারে, এপাশে-ওপাশে দুটো করে এরিকা পামগাছের টব। দরজার সামনে একটা পাপোশ বেশ বড় মাপের। জয় পাপোশটা টানতে-টানতে একপাশে নিয়ে গেল। শানবাঁধানো মেঝে। চাবির কোনও সন্ধানই নেই। খুব ভালভাবে দেখে মনে হল, একটা কিছু রহস্য এইখানেই আছে।
জয় দাদির কাছ থেকে টর্চটা চেয়ে আনতে গেল। শিবশঙ্করও এলেন রহস্য অনুসন্ধানে। পরিষ্কার মেঝে, তার মাঝখানে একটা টালি একেবারে খাপে-খাপে বসানো। কারণটা কী! জয়ের মতো শিবশঙ্করও কারণটা বুঝতে চাইলেন। ওইখানে একটা কন্দর আছে। একটা পকেট। টালিটাকে তুলতে হবে। কিন্তু কীভাবে!
এইবার আবার জয়ের সন্ধানী আবিষ্কার। একটা পামগাছের টবের মাটিতে একটা খুরপির মতো কী গোঁজা রয়েছে। জয় মাটি থেকে সেটাকে টেনে তুলল। ফলাটা বেশ শক্ত ব্লেডের মতো। জয় সেই যন্ত্রটা এনে শিবশঙ্করের হাতে দিল। এঞ্জিনিয়ার মানুষ। বুঝতেই পারলেন, এটার কোনও বিশেষ ব্যবহার আছে। এইটাই হয়তো খাজে ঢুকিয়ে টালিটাকে তোলা যাবে।
গাড়ির পেছনের আসনে খড়ক সিংয়ের মাথা জয়ার বুকে হেলে আছে। একটা মানুষ, যার কোনও শ্বাসপ্রশ্বাস পড়ছে না। হিমশীতল দেহ। জয়ার ভয় করছে না।; কিন্তু ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কে আর চাঁদের আলোয় বাগানে বসে দেশ-বিদেশের সাধুসন্তের গল্প শোনাবেন! ইতিহাসের পুরনো কথা বলবেন! ডিমের মতো সাদা পাথরটা কি শিব! ছোট্ট ডায়েরিটায় কী লেখা আছে!
উদয়ন জিজ্ঞেস করলেন, “চাবির সন্ধান পাওয়া গেল?”
শিবশঙ্কর বললেন, “হয়তো!”
“ভোর যে হয়ে এল!”
জয়ার হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই ছেলেবেলার কবিতা:
ভোর হল দোর খোলো
খুকুমণি ওঠো রে!
ওই দেখ জুঁইশাখে
ফুলখুকি ছোটো রে!
রবিমামা দেয় হামা
গায়ে রাঙা জামা ওই!
কী সুন্দর! রবি মামা দেয় হামা! জয়া বলল, “সিংজি ওঠো! ভোর তো হয়ে গেল!”
॥ ৩৯ ॥
চাবিটা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল। দরজার তালায় চাবিটা কিন্তু লাগল না। এ তো মহা সমস্যা! সমস্যার সমাধান এল জয়ের মাথা থেকে। জয় বলল, “দাদি, পেছন দিকে একটা দরজা আছে। এটা মনে হয় সেই দরজার চাবি।”
শিবশঙ্কর জয়কে নিয়ে বাগানের পেছন ঘুরে বাড়ির বিপরীত দিকে চলে গেলেন। এদিকে খিড়কির দরজা। সেই দরজাতেও একটা তালা ঝুলছে। চাবিটা সেই তালাতে লাগল। দরজা খুলে তাঁরা ভেতরে ঢুকলেন। সেটা একটা ঢাকা বারান্দা। কয়েকটা চেয়ার আর টেবিল সাজানো। একপাশে সিন্দুকের মতো দেখতে বড় একটা কাঠের বাক্স। আকার-আকৃতি দেখলে মনে হবে, ভেতরে অনেক জিনিস ঠাসা আছে। শিবশঙ্করের এখন অন্য ভাবনা, সামনের দরজার চাবিটা কোথায়! এই চাবি দিয়ে বারান্দা পর্যন্ত আসা গেছে। ভেতরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সিংজি কায়দাটা বেশ ভালই করে গেছেন। একটা চাবি পেলেও ভেতরে যেতে হলে বেশ মাথা খাটাতে হবে।
জয় বলল, “দাদি, সামনের দরজার চাবিটা এইখানেই আছে কোথাও।”
“ঠিকই বলেছ, আমারও সেইরকমই মনে হচ্ছে। এসে দেখি মাথা খাটাই।”
শিবশঙ্কর একটা চেয়ারে চোখ বুজে ধ্যানে বসলেন। বারান্দার দেওয়ালে কয়েকটা ছবি ঝুলছে। ছবির পেছনে অবশ্যই রাখবে না। ওটা খুবই সহজ জায়গা। এমন একটা জায়গা যেটা খুবই সহজ, কিন্তু সহসা মাথায় আসবে না। হঠাৎ শিবশঙ্করের মনে হল, সিন্দুত্রে পায়। কোনও একটা পায়ায় ছোট্ট একটা পকেট আছে। চাবিটা আছে তার মধ্যে।
শিবশঙ্কর জয়কে বললেন, “সিন্দুকের পায়া চারটে চেক করো। একটা পায়া ফাঁপা আছে।”
জয় হাঁটু গেড়ে বসে পায়াগুলো দেখছে। সত্যিই তাই, পেছন দিকের ডান দিকের পায়াটা ফাঁপা। একটা পকেট রয়েছে। সেই পকেটে শুয়ে আছে লম্বা একটা চাবি। একটু টানতেই বেরিয়ে এল। ফাঁকটা চাবিটার মাপেই তৈরি। মানুষটার বুদ্ধির প্রশংসা না করে পারা যায় না। খড়ক সিং রহস্য ভালবাসতেন। তা তো বাসবেনই। রহস্য যে তাঁর রক্তেই ছিল। আলোয়ার, যোধপুর, বুন্দেলখণ্ড, চিতোর। প্রাসাদ, দুর্গ, সুড়ঙ্গপথ, গুপ্তঘর, এইসবের মধ্যেই তো তাঁর ছেলেবেলা কেটেছিল। বয়েস যেই বাড়ল, হঠাৎ একদিন মনে হল, পৃথিবীটা অনেক বড়। রাজপ্রাসাদের চেয়ে রাজপথের আকর্ষণ অনেক বেশি। এইরকমই মনে হয় কিছু হয়েছিল। কোথাও হয়তো বড়রকমের একটা দুঃখ জমেছিল। হয়তো দেখেছিলেন, বিষয়ের জন্য ভাই ভাইকে খুন করছে। বাবা ছেলেকে আততায়ীর হাতে তুলে দিচ্ছেন। দুঃখটা যে কী, তা আর জানা হল না।
সামনের দরজাটা খোলা হল। বিশাল সেই হলঘরটা। যে-ঘরে কত জমায়েত হয়ে গেছে। গান, বাজনা, খাওয়াদাওয়া, মজলিশ। কত রাত এই ঘরে কেটে গেছে হইহই করে। অদ্ভুত সুন্দর একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে সারা ঘরে। আতরের? ধূপের? ধুনোর! কোনও মসলা হয়তো জ্বলছিল। নিভে গেছে জ্বলতে-জ্বলতে। গন্ধটা ভেসে বেড়াচ্ছে। যদি এমন ভাবা যায়, এ হল খড়ক সিংয়ের পূত আত্মার গন্ধ। দেহ ছেড়ে অনেক, অনেক, কোটি, কোটি আলোকবর্ষ দূরে চলে যাওয়ার আগে দেখতে এসেছেন নিজের ফেলে যাওয়া আয়োজন। পারস্যের গালিচা, ফৈজাবাদের ঝাড়লণ্ঠন, মোরাদাবাদের বিদুরির কাজ। জয়পুরের মার্বেল স্ট্যাচু। পথে-পথে ঘুরলে কী হবে, রাজকীয় শৌখিনতা ভেতর থেকে বেরিয়ে আসত।
খড়ক সিংকে শুইয়ে দেওয়া হল তাঁর পালঙ্কে। ঘরের আলমারিতে দামি-দামি সব পোশাক, আলোয়ান, জাজিম, কাশ্মিরি শাল। খুব দামি একটা আলোয়ান বের করে খড়ক সিংয়ের দেহ ঢেকে দেওয়া হল। মুখটা শুধু জেগে রইল। চিরনিদ্রায় নিদ্রিত এক বীর। আর ঠিক তখনই আলো ফুটল। যত পাখি ছিল সব একসঙ্গে ডেকে উঠল। একদল কচি শিশুর কলরবের মতো। একটা দাঁড়কাক কোথায় বসে ডাকছে। অদ্ভুত ডাক, খং খং। জয়া খুঁজতে-খুঁজতে ছোট একটা দেরাজের মধ্যে, যা খুঁজছিল তা পেয়ে গেল। ভাল-ভাল ধূপের প্যাকেট, চন্দন তেল, গোলাপ আর খসের আতর। জয়া খড়ক সিংয়ের শিয়রে একগোছা ধূপ জ্বেলে দিল। ভাইকে নিয়ে বাগানে গেল। ফুলের সন্ধানে। সেই তো শিউলি। ফিসফিস কথার মতো ঝরে আছে কত ফুল। অন্যদিকে ফুটে আছে রাশি রাশি গোলাপ। এইসব ছেড়ে চলে গেলে তুমি। এই এত সুন্দর পৃথিবী। তুমি খুব নিষ্ঠুর খড়ক সিং। জয়া আর জয় শিউলি কুড়োচ্ছে। সাদা পাখির হলুদ ঠোঁট। শিশির তো পড়েছেই, দু-একটা বড় দানা, জয়ার চোখের ফোঁটা-ফোঁটা জল। খুব প্রাণের মানুষ যখন চলে যায় তখনই জানা যায় আমাদের ভেতরে একটা নদী আছে, একটা আকাশ আছে, মেঘ জমে সেখানে, একটা সানাই আছে। আপনি বাজে। চোখ দুটো কাচের শার্সি, ফোঁটা-ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে আপনি।
একটু বেলা বাড়তেই খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে। খড়ক সিংকা অন্ত হোগিয়া। এত লোকও ভালবাসত মানুষটাকে। চার্চের ফাদার, মসজিদের মৌলবী, মন্দিরের পুরোহিত, স্টেশনের মাস্টারমশাই, ডাকঘরের বড়বাবু, কেউই আর বাকি রইলেন না। বিশাল জনসমাগম। সবাই নীরব। সকলেরই চোখ ছলছলে। ফুল, শুধু ফুল। সিংজি চাপা পড়ে গেছেন। এই একটা ব্যাপারে মানুষের কার কিছু নেই। মেনে নিতে হবে। জয়ের খুব রাগ হচ্ছে। ভগবান ভাল নন। মানুষকে কষ্ট দেওয়াই তাঁর কাজ। জয়ের পাশে লছমি দাঁড়িয়ে আছে হতভম্ব হয়ে। একসময় খুব কেঁদেছিল। এখন আর কাঁদছে না। চোখের জল গালে শুকিয়ে আছে।
বেলা একটার সময় শবযাত্রা শুরু হল। একটা ম্যাটাডর ভ্যানে শুয়ে আছেন। খড়ক সিং। কয়েক মন ফুল তাঁর ওপর সাজানো। বেশিরভাগই গোলাপ। সবাই চলেছেন সরলার তীরে। নদী যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেইখানে নির্জন, ঘাসে ঢাকা শ্মশান। বিরাট বিরাট গাছ জায়গাটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মাটি ফুঁড়ে কোনও এক সময় একটা পাথর ঠেলে উঠছিল একপাশে। অনেকটা শিবলিঙ্গের মতো দেখতে। হিন্দুদের কাছে তিনিই এখন শিব। বড়লোক ভক্ত মাথার ওপর একটা ছাদ চড়িয়ে দিয়েছেন। জমিয়ে দিয়েছেন পাথরবাঁধানো বেদি। চারপাশ খোলা। জায়গাটার বেশ একটা গাম্ভীর্য আছে। সন্ধের দিকে ভয়-ভয় করে।
সরলার কূল ছুঁয়ে সাজানো হল চিতা। উদয়নই সব করছেন। শ্মশানে যে কাঠ দেয় সেই বৃদ্ধ রামরিক সিংজির মৃত্যুতে এত ভেঙে পড়েছেন যে, কাঠ টানতে গিয়ে মাঝে-মাঝে বসে পড়ছেন। সিংজির সঙ্গে দুপুরে ওই শিবের চাতালের পাশে দু’জনে দাবা খেলতেন। মন ভাল থাকলে সিংজি ভজন গান শোনাতেন। শিবরাত্রির রাতে সিংজি ওই ঘাসে ঢাকা জমিতে প্রাণ খুলে নাচতেন। নাচতে-নাচতে ভোর। রামরিকের সেইসব কথা মনে পড়ছে আর জল এসে যাচ্ছে চোখে।
চিতায় শয়ন করিয়ে উদয়ন জয়কে ডাকলেন, “এসো, মুখাগ্নি তোমাকেই করতে হবে। মৃত্যুর সঙ্গে এই তোমার প্রথম পরিচয় জয়। পৃথিবীর দুটি সত্য, জন্ম এবং মৃত্যু। আর কোনও সত্য আছে কি না আমরা জানি না। যন্ত্রণা আছে, বঞ্চনা আছে, শত্রুতা আছে, হত্যা আছে, দারিদ্র্য আছে, ব্যাধি আছে, তবে তার কোনওটার মধ্যেই সত্য নেই। সবই আপেক্ষিক। মৃত্যু হল অগ্নি, পবিত্র। সকলকেই গ্রাস করে। রাজা অথবা ভিখারি। বলো, ওঁ অগ্নিং প্রজ্বলিতং বলে..।” জয়ের হাতে একটা জ্বলন্ত মশাল। হাত কাঁপছে। চিতায় চিত হয়ে শুয়ে আছেন খড়ক সিং। ঠোঁটে আগুন ছোঁয়াতে হবে। “বাবা, আমি পারছি না। আমি যে ভীষণ ভালবাসতুম। আমরা একসঙ্গে চাঁদের আলোয় সরলা নদীর তীরে জারুল গাছের তলায় বসে কত গল্প করেছি। শীতের রোদে বনভোজন। নদী পেরিয়ে আমরা নীলপাহাড়ে গেছি শীতের পাখি দেখতে। আমরা রেলে চেপে গেছি চুনারে। আমরা গড়ের অন্ধকারে লুকোচুরি খেলেছি। আমরা বাগানের গাছের ডালে দোলনা বেঁধে আচার চাখতে-চাখতে দোল খেয়েছি। আমি পারব না।”
বলো জয়, “জাতবেদং হুতাশনম সুবর্ণবর্ণমমলং… পারতে তোমাকে হবেই। পৃথিবীতে যখন এসেছ, দুঃখ, সুখ সমানভাবেই ভাগ করে নিতে হবে। হাট যেমন বসবে, হাট তেমনই ভাঙবে। ফুল যেমন ফুটবে, ফুল তেমনই ঝরবে। সবকিছুর যেমন শুরু আছে, সবকিছুর তেমনই শেষ আছে।” মশালের আগুনের লকলকে জিভ। সত্যই তার বর্ণ সুবর্ণের মতো। ফরফর করে শব্দ হচ্ছে। আগ্রাসী তার খিদে। উদয়ন মন্ত্র পড়ছেন, “ব্রহ্মৈব তেন গন্তব্যং ব্ৰহ্মকর্মসমবিনা। যে-কাজের জন্য তুমি এসেছিলে, সে কাজ শেষ হল। যাও, এইবার ফিরে যাও অনন্তে।”
জয় একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেল। সে আর কিছু ভাবতে পারছে না। ঘটনা তাকে ঠেলে নিয়ে চলেছে। যা হবে তা হবেই। চিতার আগুন লাফিয়ে উঠল আকাশের দিকে, যেন নাম-সঙ্কীর্তনের দল দু’হাত আকাশে তুলে নাচছে। সবাই এখন গোল হয়ে বসে খুব চাপা গম্ভীর গলায় একটানা বলে চলেছেন, “রাম নাম সত্য হায়।” ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে আকাশের দিকে। নীল আকাশ। পাখি আর ডাকছে না। বাতাসও বইছে না। পড়ন্ত রোদে সরলার জল লাল। পৃথিবীতে খড়ক সিংয়ের কে রইল। পরকে করেছ নিকট বন্ধু। সবাই তোমার আপন।
জয়া লছমিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে ভূঁইফোঁড় শিবের চাতালে। মেয়েটা দুদিনের জন্য মানুষের মতো মানুষ একজনকে পেয়েছিল। ভাগ্য খারাপ, সে চলে গেল। জয় দেখছে আর ভাবছে, সিংজি গেছেন, সে আর কী করা যাবে! কিন্তু আমরা তো আছি। আমাদের আর-এক বোন হল। জয় ভাবছে, যদি আমি কোনওদিন লেখক হতে পারি, তা হলে খডক সিংয়ের জীবনী লিখব। খুঁজতে খুঁজতে চলে যাব বিকানির, যোধপুর, আলোয়ার। অনুসন্ধান করে বের করব জন্মস্থান, পিতা-মাতা। কোন শহর, কোন প্রাসাদ। একটু-একটু করে মানুষটাকে ফিরিয়ে আনব। অস্পষ্টকে স্পষ্ট করব।
শিবশঙ্কর একটা পাথরের ওপর বসেছেন। বসে- বসে ভাবছেন, আই উইল মিস হিম ভেরি মাচ। লাঠিটা কাঁধে, তাতে একটা পুঁটলি বাঁধা, মাথায় একটা বৃহৎ পাগড়ি, পায়ে জরির কাজ করা নাগরা। কে যায়, খড়ক সিং। ওই তো সূর্য ডুবছে। চিতা নিভে এসেছে। ছাই। আগুনের রেখা কোন হরফে কী লিখে যাচ্ছে বোঝার উপায় নেই। হয়তো সেই কথাই লিখছে, যে-কথাটা তিনি নাতিকে প্রায়ই বলেন:
তুলসী যব জগমে আয়ো জগ হাসে তোম রোয়।
আয়সে কর্ণি করলো কি, তোম হাসো জগ রোয় ॥
শিউলি – 40-43
॥ শিউলি – 40-43 ॥
॥ ৪০ ॥
কিশোর মনে একটা আঘাত লাগল। সবচেয়ে কাছের মানুষটা কেমন ঝপ করে চলে গেল! বলা নেই কওয়া নেই। জয়ের মনটা কেমন যেন আকাশের মতো হয়ে গেল। অন্যমনস্ক সবসময়। একটা ভয় ঢুকেছে মনে। দাদি, ঠাকুমা, এঁদের তো বয়েস হয়েছে। তবে! তবে এঁরাও তো একে-একে চলে যাবেন। জয় বাগানের শিউলিগাছের তলায় দাঁড়িয়ে ছিল। সারা রাত ধরে যে-ফুল ফোটে, সারা সকাল সেই ফুল ঝরে যায়। গাছ! তোমার দুঃখ হয় না কোনও?
গাছ বলবে, কিসের দুঃখ। এই তো নিয়ম! পৃথিবীর যেমন নিয়ম, সেইরকমই তো হবে। জয় গাছের তলায় ঘাসের ওপর বসে পড়ল। সবে সকাল হচ্ছে। পরিষ্কার নীল আকাশ। চার্চের চুড়াটা ঝকঝক করছে। সেইদিকে তাকিয়ে জয় বসে আছে। জয়া দূর থেকে ভাইকে দেখছিল। তারও খুব দুঃখ হয়েছে। প্রকাশ করে না। তার এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা, ভাইটাকে কেমন করে সামলানো যায়! ছেলেটা বড় নরম প্রকৃতির। কথায়-কথায় জল এসে যায় চোখে। সকলকে নিয়ে থাকতে ভালবাসে। সকলের জন্য বড় বেশি ভাবে।
জয়া এগিয়ে এসে বলল, “এই ওঠ। চল আমার সঙ্গে। অনেক কাজ আছে। আমি একা পারব না।”
“কী কাজ রে দিদি! এই সকালে এত কাজ তুই কোথায় পেলি?”
“দেখবি চল।”
এই বাড়ির একটা ঘরে শুধু বই থাকে। তিনপুরুষের যত বই সব সাজানো আছে পর-পর, খোলা র্যাকে। দেওয়াল চাপা পড়ে গেছে। সব বই। মাসখানেক হল, একটা কি একজোড়া জ্ঞানপাগল ইঁদুর এই ঘরে ঢুকেছে। ইঁদুর তো চোখ দিয়ে পড়ে না, দাঁত দিয়ে পড়ে। কেটে-কেটে পড়ে। কেটে পড়ে কেটে-পড়ে। কিছুতেই আর খুঁজে পাওয়া যায় না তাদের। এখানে-ওখানে জমে থাকা গ্রন্থচূর্ণ দেখে শিবশঙ্কর হায়-হায় করে ওঠেন। জ্ঞানের চানাচুর। সব গেল, বেদ, বেদান্ত, অ্যাস্ট্রোনমি, ফিলজফি, শেলি, বায়রন, কিট্স। উই আর ইঁদুরের দেখ ব্যবহার/ কাঠ কাটে, বস্ত্র কাটে, করে ছারখার॥
ইঁদুর বইয়ের কোন ধরে জ্ঞানের গভীরে কেটে-কেটে ঢুকতে চায়। বিশ্লেষণাত্মক লেখাপড়া। শিবশঙ্কর মাথা খাটিয়ে একটা লোশন বের করেছেন। বইয়ের চারপাশে মাখিয়ে দিলে ইঁদুরের কাছে জ্ঞান আর তেমন সুস্বাদু নাও লাগতে পারে। বইয়ের সংখ্যা তো কম নয়, আবার সব বইয়ে লাগাতে না পারলে বোঝা যাচ্ছে না, ফর্মুলাটা কার্যকর হল কি না। মূর্খ ইঁদুর বড় একটা দেখা যায় না। সকলেরই জ্ঞানের ক্ষুধা অসীম। শিবশঙ্কর বলেন, ভোরেসাস।
সিংজি চলে যাওয়ার পর লছমি এখন এই বাড়িরই এক মেয়ে। জয়ার সঙ্গে তার আর কোনও তফাত নেই। পরিষ্কার বাংলা বলে। মেয়েটা খুব ভাল। সবসময় নিজের ভাবে থাকে। শান্ত, ধীর। এই বয়েসেই অনেক হাতের কাজ জানে। একধরনের প্রতিভা। কেউ শেখায়নি। নিজে নিজেই সব বের করে মাথা খাটিয়ে। জয়াও অনেক কিছু জানে। তাই দু’জনে খুব মিলেছে। লছমি ভীষণ পরিচ্ছন্ন, আর খুব খাটতে পারে। এ সেই জালা থেকে বেরিয়ে আসা দৈত্যটার মতো। কাজ ছাড়া থাকতেই পারে না।
এই বইয়ে মেকআপ লাগাবার কাজে লছমিও লেগে গেছে। বেশিরভাগ বইই র্যাক থেকে নেমে এসেছে মেঝেতে। ঘরে আর পা রাখার জায়গা নেই। জনসভা নয়, বইসভা। অভিধান, বিশ্বকোষ, বেদান্ত ভাষ্য, এঁরা যেন সব প্রধান অতিথি, সভাপতি, বিশেষ অতিথি। ঘরে পা রেখেই মনে হল, সারারাত অনেক বক্তৃতার পর যেন কারও শোকে পাঁচ মিনিটের নীরবতা চলছে। বইয়ের আড়ালে কে যেন খুসখুস করছে। সামান্য নড়াচড়া। লছমি আগেই এসে বইয়ের আড়ালে কাজে বসে গেছে। শিবশঙ্কর যে ফর্মুলাটা তৈরি করেছেন তার একটা বিশেষ গন্ধ আছে। শিকার ধরার সময় বেড়ালের শরীর থেকে নাকি এইরকম একটা গন্ধ বের হয়। সেই গন্ধে ইদুর চম্পট দেয়। সেই গন্ধটাই ঘরে ছড়িয়ে আছে।
লছমির একটা সুন্দর নতুন নাম হয়েছে, ‘সাহারা’।
জয়া বলল, “সাহারা, তুই এসে গেছিস, আমাকে ডাকিসনি কেন?”
“দিদি, আমি তো সেই শেষ রাত থেকে এখানেই আছি।”
“কেন রে? তুই ঘুমোসনি?”
“ঘুমিয়ে তো ছিলুম দিদি, কে আমাকে ডেকে দিলে। সেই সাধু, যে রোজ আমার স্বপ্নে আসে। তার হাতে সাজিভরা ফুল। এক মাথা পাকা চুল। সাদা, লম্বা, দাড়ি গোঁফ। চোখে চকচকে হাসি। আর আমার ঘুম এল না।”
“আমাকেও ডাকবি তো!”
“তুমি কাল কত রাতে শুয়েছ বলো? ঠিকমতো না ঘুমোলে তোমার তো শরীর খারাপ হবে!”
“তোকে বলেছে।”
বইয়ের বাধা টপকে জয় আর জয়া সাহারার পাশে চলে গেল। সেই জায়গার মেঝেতে একটু ফাঁক আছে। নিয়মটা এই হয়েছে, যেসব বইয়ের কাজ হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো চলে যাচ্ছে পেছন দিকে। আর তিনপাশে ছড়িয়ে আছে না-হওয়া বই। তার সংখ্যা কম নয়। যে-গতিতে কাজ হচ্ছে, দেখেশুনে মনে হচ্ছে, কমসে কম আরও পনেরো দিন লেগে যাবে শেষ করতে।
সাহারার পাশে বসে পড়ে জয়া বলল, “এইসব বই একা একজন পড়ে শেষ করতে পারবে!”।
জয় বলল, “স্বামীজি হলে পারতেন। শুধু পারতেন না, পাতার পর পাতা গড়গড় করে মুখস্থ বলতেন। কী করে এমন হয় রে দিদি! আমার কেন হয় না!”
“স্বামীজি এক-এক পাতা একনজরে পড়তেন। একটা অক্ষর, একটা লাইন নয়। তুই চেষ্টা কর, তোর সবটা না হলেও, কিছুটা তো হবে! সবাই কী আর স্বামীজি হতে পারেন? তুই চেষ্টা কর।”
সাহারা হাসতে-হাসতে বলল, “কোসিস করো ভাইয়া।”
এইসব কথা শুনলে জয়ের ভীষণ ভাল লাগে। এমন একজন হতে হবে, যার কথা সবাই মনে রাখবে। হ্যাঁ, একজন এসেছিল বটে, মানুষের মতো মানুষ! দাদি বলেন, ইচ্ছেটাই সব। মানুষ ইচ্ছে করেছিল বলেই চাঁদে যেতে পেরেছিল। ইচ্ছে করেছে বলেই আরও দূর কোনও গ্রহে চলে যাবে একদিন। ইচ্ছাই হল বিজ্ঞান। জয় যত না কাজ করে, তার চেয়ে বেশি পড়ে। জয়া এইটাই চায়। বই হল মনের দরজা আর জানলা। ওই পথ ধরে যদি বেরিয়ে যেতে পারে, মন মশগুল। জয়ের হাতের কাছে স্বামীজির একখণ্ড রচনাবলী। পাতা ওলটাতেই একটা জায়গা বেরিয়ে পড়ল, কে আন্ডারলাইন করে রেখেছেন, “পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়নই পাপ। শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম, দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই পাপ। স্বাধীনতাই ধর্ম, পরাধীনতাই পাপ। অপরকে ভালবাসাই ধর্ম, অপরকে ঘৃণা করাই পাপ। ঈশ্বরে ও নিজ আত্মাতে বিশ্বাসই ধর্ম, সন্দেহই পাপ।
॥ ৪১ ॥
দেখতে-দেখতে পরীক্ষা এসে গেল। অ্যানুয়াল এগজামিনেশান। এ-বছর আবার শীতও পড়েছে সেই রকম জবরদস্ত। লেপের তলা থেকে হাত বের করতে ইচ্ছে করে না। দুপুরে রোদের তেমন তেজই নেই। রকে রোদ এসে পড়েছে। শিবশঙ্কর একটা ডেকচেয়ারে বসে আছেন। বহুকাল পরে আবার পড়ছেন, করবেটের সেই বিখ্যাত বই, ‘ম্যান ইটার্স অব কুমায়ুন’। মনটা যখন ‘দুঃখু দুঃখু’ হয়ে ওঠে তখন এই বইটা পড়েন। এই বইটাতে শিবশঙ্করের যৌবন আছে। তখন তরুণ এঞ্জিনিয়ার। দেরাদুনের জঙ্গলে ক্যাম্প করে আছেন। রেললাইন পাতা হচ্ছে। সঙ্গে আর-এক সাহেব, স্যামুয়েল। দু’জনেই সমবয়সী। স্কটল্যান্ডের ছেলে। খুব আমুদে ছিল। সে কেবল বলত, “শঙ্কর, ফাইন্ড অ্যান ইন্ডিয়ান যোগী, আই ওয়ান্ট টু মাস্টার ইন্ডিয়ান রোপ ট্রিক।”
রাতের বেলা দূর জঙ্গলে বাঘ ডাকত। স্যামুয়েল সঙ্গে-সঙ্গে রাইফেল তুলে নিত হাতে। বাঘ-ভাল্লুকের ভয় তার ছিল না। ভয় পেত গুবরে পোকা, বিটলসকে। ভোঁ করে উড়ে এলেই আপাদ মস্তক চাদর চাপা দিয়ে শুয়ে পড়ত, “শঙ্কর সেভ মি ফ্রম দ্যাট আগলি পেস্ট।” স্যামুয়েলের কথা খুব মনে পড়ে। ছেলেটা খুব সরল ছিল। বাড়ি থেকে চিঠি এলে পড়াত। কার সঙ্গে কী সম্পর্ক বুঝিয়ে দিত। মাকে খুব ভালবাসত। দিদির জন্যে মন কেমন করত। স্যামুয়েলের স্বভাবটা ছিল বাঙালি ছেলেদের মতো। যত বয়েস বাড়ছে ততই অতীত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আর একবার যদি কোনও অলৌকিক উপায়ে যৌবনটাকে ফিরে পাওয়া যেত! সন্ধ্যা নেমে আসছে কুমায়ুনের জঙ্গলে। গাছের মাথা থেকে অন্ধকার নেমে আসছে থরে-থরে। সূর্যাস্তের আলোয় নদীর জল লাল। তাঁবুর বাইরে আগুন জ্বালতে হবে। কাঠকুটো সংগ্রহ করে আনছে কর্মীরা। বাবুর্চি রান্নার আয়োজন করছে। লোহার লাইন, স্লিপার, গাডার ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। দেহাতে ফিরে যাচ্ছে মোষের দল। কোম্পানির ডাক্তার ডিসপেনসারি খুলে বসেছেন। সেখানে কিছু দেহাতি নারী-পুরুষও এসেছে চিকিৎসার জন্যে। এরই মাঝে স্যামুয়েল মাউথ অগান বাজাচ্ছে।
বইটা ভোলাই আছে। দু-এক পাতা হয়তো পড়েছেন। তাই যথেষ্ট। অতীতে ফিরে যাওয়ার পক্ষে সেইটাই যথেষ্ট। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধবে। শিবশঙ্কর চলে যাবেন মিশরে। পিরামিডের দেশ। সেখানে বিশ্ববিখ্যাত ফিল্ড মার্শাল রোমেলের যুদ্ধ দেখেছিলেন। প্রকৃতই ‘ডেজার্ট ফক্স’। যেমন সেই মানুষটির সাহস তেমনই তাঁর রণকৌশল। ইংরেজরাও তাঁকে শ্রদ্ধা করত। শিবশঙ্কর ছিলেন ব্যাকলাইনে, এঞ্জিনিয়ারিং কোরে। ফ্রন্টলাইন থেকে প্রতিদিনই খবর আসত রোমেলের বীরত্বের। ভাঙা ট্যাঙ্ক, হাল্কা ট্যাঙ্ক, কম ডিভিশান নিয়ে একের-পর-এক যুদ্ধ জয় করে চলেছেন। দুর্ধর্ষ তাঁর গতি। ক্ষুরধার তাঁর বুদ্ধি। প্রাইম মিনিস্টার চার্চিল তখন ইংল্যান্ডের হাল ধরেছেন। সার আর্চিবল্ড ওয়াভেল তখন মধ্যপ্রাচ্যের কমান্ডার জেনারেল। ইজিপ্টের পশ্চিমের ইতালীয় সৈন্যরা ইংরেজদের মার খেয়ে ছাতু। তাসের ঘরের মতো প্রতিরোধ ভেঙে চুরমার। ব্রিটিশ লেফটন্যান্ট জেনারেল সার রিচার্ড ও কোনার তখন দুর্বার। ঠিক দুটো মাস, ইতালিয়ানদের মারতে মারতে ও কোনার ইজিপ্টের ওপর দিয়ে ঝড়ের মতো বয়ে গেলেন। ঢুকে পড়লেন লিবিয়ায়, সিরেনাইকার ঘাড়ের ওপর দিয়ে বারদিয়ায়। বারদিয়া, টোবরুক, ডেরনা, বেনগাজি দখল করে নিলেন। ইতালির দশ ডিভিশান সৈন্য ছারখার। মুসোলিনির একলাখ তিরিশ হাজার কামান, চারশো ট্যাঙ্ক, দেড়শো এয়ারক্র্যাফ্ট খতম। পরাজিত, নীতিভ্রষ্ট কিছু ইতালীয় সৈন্যের শেষ আশ্রয়স্থল তখন ট্রিপোলি। মুসোলিনির তখন খুব অহঙ্কার হয়েছিল। হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গোটা দুনিয়ার জমিদারি ভাগাভাগি করবে। নাজিম আর ফ্যাসিজম এক হয়েছে। মুসোলিনি তখন হাউ-হাউ করে কাঁদতে শুরু করেছেন। উত্তর আফ্রিকার সাম্রাজ্য শেষ হয়ে গেল। মুসোলিনি চিৎকার করছেন, হিটলার, বাঁচাও বাঁচাও। শিবশঙ্কর তখন ইংলিশ গ্যারিসনের পেছনে এঞ্জিনিয়ারিং কোরে। সঙ্গে আর একজন বাঙালি ছিল সুশোভন মুখার্জি। শিবপুরের ছেলে। ছেলেটি একটু ভিতু ধরনের ছিল। গোলাগুলির শব্দে ভয় পেত। তার ওপর মরুভূমির উত্তাপ। একশো কুড়ি, তিরিশ কিছুই নয়। চোখ ঝলসানো রোদ। এতটুকু বাতাস নেই। মাইলের পর মাইল বালি। তার ওপর মাথায় হেলমেট। পরনে মোটা টিউনিক। গায়ের চামড়ায় ফোস্কা। কালচে-কালচে দাগ। পেটের গোলমাল। দুটো ফুসফুসেই বালি। মানুষ যে কত কষ্ট সহ্য করতে পারে!
ঠিক ওই সময় হিটলার রোমেলকে পাঠালেন। রোমেল এসেই ভেল্কি দেখালেন। সৈন্যবল, অস্ত্রবল, ট্যাঙ্কবল কিছুই নেই। যা ঝড়তিপড়তি ছিল তাই দিয়েই বেনগাজি দখল করে নিলেন। ব্রিটিশ সেকেন্ড আর্মার্ড ডিভিশান ছত্রখান। টোবরুকে অস্ট্রেলিয়ান নাইনথ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশান সম্পূর্ণ কোণঠাসা। সেকেণ্ড আর্মার্ড ডিভিশানের পেছনেই ছিলেন শিবশঙ্কর। রিট্রিট। তাঁর গ্যারিসন পালাচ্ছে। নাজিদের হাতে পড়ার ভয়ে সুশোভন মুকুজ্যে আত্মহত্যা করেছে। রাতে ডেজার্টের টেম্পারেচার নেমে যাচ্ছে শূন্যের নীচে। সঙ্গে কম্পাস নেই, অ্যামুনিশান নেই, র্যাশান নেই। এইভাবে পালাতে পালাতে শিবশঙ্কর একটা উট পেয়ে গেলেন। কীভাবে এল, কোথা থেকে এল জানেন না। পেটের নীচে হ্যাভারস্যাকে খাবার, একটা বাইনোকুলার। সেই উটের সাহায্যে তিনি ইন্ডিয়ান ফোর্থ আর্মার্ড ডিভিশানকে পেয়ে গেলেন অলৌকিকভাবে। এই উটটার কথা শিবশঙ্কর আজও ভুলতে পারেননি। দুটো চোখে করুণার দৃষ্টি। যেন তাকে উদ্ধার করার জন্যেই দিগন্ত থেকে ছুটে আসছে বেঁচে থাকার মতো রশদ নিয়ে।
জিম করবেট থেকে আফ্রিকার মরুভূমিতে। মন কত স্বাধীন! সময়, ভূগোল কিছুই মানে না। শিবশঙ্কর নিজের ঊরুতে একবার হাত বুলোলেন। গভীর একটা ক্ষত চিহ্ন। শার্পনেলের টুকরো ঢুকে গিয়েছিল। আর্মি হসপিটালে তিন মাস শুয়ে থাকতে হয়েছিল। তখন পেনিসিলিন আসেনি। ভরসা সালফার ড্রাগস। পা’টা হয়তো কাটাই যেত। এক ইতালিয়ান সার্জেন বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ইংল্যান্ডে শিক্ষাপ্রাপ্ত। এনিমি নন। শিবশঙ্করের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল খুব।
অদূরেই জয় আর জয়া মাদুর পেতে একমনে অঙ্ক কষছে। শিবশঙ্করও লছমিকে ‘সাহারা’ বলে ডাকতে শুরু করেছেন। সাহারা মুহুয়াগাছের ছায়ায় বসে কবিরাজি ওষুধের গুলি পাকাচ্ছে। শিবশঙ্করের একটু তন্দ্রামতো আসছে। সেই তন্দ্রার ঘোরে দেখছেন। একটা বড় বইয়ের শেষ পাতাটা তিনি যেন পড়ছেন। বিহারে বাঙালির ইতিহাস। শেষ পাতায় দেখতে পাচ্ছেন কিছু ছবি। পাহাড় পাহাড়ের জায়গায়, নদী নদীর জায়গায়, কেবল বাঙালিদের বাড়িগুলিই ভেঙে পড়েছে। ধ্বংসস্তূপ। গোলাপবাগান শুকিয়ে ছার। ফোয়ারা জল ছুড়ছে না। দরজা, জানলা লোপাট। লোহার গেট অদৃশ্য। থাম, পিলার, আর্চ হেলে গেছে। হলঘরের কার্পেটে সাত পুরু ধুলো। গ্যারাজে মোটর গাড়ির কঙ্কাল। আস্তাবলে সাপ। দেওয়ালে পূর্বপুরুষের অয়েল পেন্টিং হেলে আছে। একটা ওয়াল ক্লকের খাঁচা। ডায়াল নেই। শুধু পেন্ডুলামটা ঝড়ের বেগে দুলছে।
শিবশঙ্কর নিদ্রিত অবস্থাতেই ফুঁপিয়ে উঠলেন চাপা কান্নায়। সাহারা ছুটে আসছে, “কী হল দাদি!”
॥ ৪২ ॥
প্রথমে শিবশঙ্কর বুঝতে পারছিলেন না তিনি কোথায় আছেন। একটা মেয়ের মুখ কুঁকে আছে তাঁর মুখের ওপর। ছোট্ট নাকে দুলছে ছোট্ট একটা নোলক। প্রথমেই দেখতে পেয়েছেন সাহারাকে। এপাশে জয়, ওপাশে জয়া। তিনজনেই একসঙ্গে প্রশ্ন করছে, “তোমার কী হয়েছে দাদি! তুমি অমন করছ কেন?”
শিবশঙ্কর পরিবেশে ফিরে এসেছেন। মুখে ফুটে উঠেছে হাসি। তিনজনকেই একসঙ্গে জড়িয়ে ধরে বললেন, “বয়েস! বয়েস হয়েছে আমার। তাই যৌবনের জন্যে কাঁদছি গো। অনেককাল আগে আমাদের আস্তাবলে একটা বৃদ্ধ ঘোড়া ছিল। সে দুপুরবেলা কাঁদত। দু’চোখ বেয়ে জল ঝরছে। বুঝতে পারতুম, কেন কাঁদছে! শক্ত মাটিতে টগবগ করে দৌড়তে পারে না বলে তার এই কান্না। শক্তি হারালে জীব জড় হয়ে যায়। এই দ্যাখ না, এই চেয়ারটার সঙ্গে আমার কোনও পার্থক্য আছে? আমিও পড়ে আছি, এও পড়ে আছে। দুটোই সমান। বই হাতে নিয়ে আমার যৌবনের কথা ভাবতে-ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি। স্বপ্ন দেখছি, আমার সেই কুমায়ুনের জঙ্গল, আমার সেই ব্যায়াম করা ফৌজি শরীর। আমার ছেলে তখন তোমাদের মতোই কিশোর। আমার একটা মেয়ে ছিল। সে-কথা তো আমি ভুলেই গেছি। সে বেঁচে থাকলে তোমাদের বাবার একজন দিদি থাকত। সাত বছর যখন বয়েস, হিল-ডায়েরিয়ায় মারা গেল। কোনওভাবেই বাঁচানো গেল না। সেই দুঃখটাকে আমি কাজ দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছি। মনে পড়ে গেলেই কষ্ট হয়। কেন আমার কাছে এল, কেনই বা চলে গেল, কোথায়ই বা গেল! যখন ভাবি, তখন কোনও কূলকিনারা খুঁজে পাই না।”
শিবশঙ্করের একটা হাত সাহারা ধরেছে, আর একটা হাত জয়া।
“চলো, ওঠো। তোমাকে আর বসতে হবে না। আমাদের সঙ্গে বেড়াতে চলো। বিকেল হয়েছে। রোদ পড়ে এসেছে। আমরা সাঁকো পেরিয়ে সরলা নদীর দিকে চলে যাব। যাওয়ার পথে সিংজির বাড়িটা একবার দেখে যাব। তোমার তো আগে মন খারাপ হত না এমন।”
শিবশঙ্কর ডেকচেয়ার থেকে নিজেকে তুলতে তুলতে বললেন, “মন বড় ছটফটে মা, বর্তমানের সঙ্গে বেঁধে না রাখলেই অতীতে পালাতে চায়। অতীত যেন মধু।”
জয়া বলল, “কই আগে তো তোমার এমন মন খারাপ হত না, এখন হচ্ছে কেন?”
“তোদের হারাবার ভয়ে।”
“আমরা কোথায় হারিয়ে যাব দাদি! আমরা হারাব কেন?”
“উদয়ন বদলি হয়ে যাচ্ছে। তোরা মনে হয় লখনউ চলে যাবি দিদি। খুব শিগগির।”
“কে বলেছে তোমাকে? কই আমরা তো কিছু শুনিনি।”
উদয়ন এর আগে আমাকে একবার বলেছিল। কাল আবার বলল। অর্ডার নাকি এসে গেছে।’
“না, বাবাকে আমরা বলব, এই জায়গা ছেড়ে কোথাও যাওয়া হবে না। এখানে আমরা বড় হয়েছি। এই জায়গাকে আমরা ভালবাসি। এই নদী, পাহাড়, জঙ্গল, মাটি। আমরা যাব না।”
“এখানে শুধু তোরা বড় হয়েছিস? এখানে আমিও বড় হয়েছি। আমার বাবা এখানে প্রথম এসেছিলেন ডাক্তার হয়ে। এই জায়গায়, এই বাংলোতে। এটা ছিল একজন চিনা ম্যাজিশিয়ানের। তাঁর কাছ থেকে বাবা কিনেছিলেন। পরে এটাকে অদলবদল করেছিলেন। তারপর আমি এঞ্জিনিয়ার হয়ে ফিনিশিং টাচ দিয়েছি। এই বাড়িতে তোর বাবা বড় হয়েছে। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে।”
“আমরা কিছুতেই যাব না দাদি।”
“তা বললে কী হয় দিদি! তোদের বাবা ইণ্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসের ডাক্তার। আমার বাবার খুব ইচ্ছে ছিল, নাতিকে বড় ডাক্তার করবেন। তাঁর ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে। তার সামনে পড়ে আছে বিরাট ভবিষ্যৎ। শুনছি ভিয়েনা যাবে হার্টের ওপর আরও জানতে, শিখতে। যদি অস্ট্রিয়ায় সেট্ল করে, তা হলে তোমাদেরও যেতে হবে। সে এক অসাধারণ দেশ। শিক্ষিতের দেশ। সুন্দরের দেশ। না ঘুরলে জীবনকে কি জানা যায় দিদি! আমিও কত ঘুরেছি। আমার বাবা তখন এখানেই একা একা কাটিয়েছেন। তাঁর মনটা ছিল ইংরেজদের মতো। বলতেন, এক জায়গায় পড়ে থাকলে মানুষ কূপমণ্ডুক হয়ে যায়। পৃথিবীকে দ্যাখো, জীবনকে গতিশীল করো। অভিজ্ঞতা অর্জন করো। সাহসী হও। যোদ্ধা হও। আমার ছেলেকেও তাই হতে হবে। তোমাদেরও সেই পথ। তখন ছিল ইংরেজ আমল। দেশটা ছিল এক শাসনে বাঁধা। এখন তো সব টুকরো টুকরো। মানুষও আর আগের মতো নেই। মানুষে মানুষে আর আগের ভালবাসা নেই। এই জায়গার অর্থনীতি দিন দিন মরে আসছে। সবাই খুব লাফিয়েছিল, সরলা নদীর ওপারে সোনা পাওয়া যাবে। সব মিথ্যে। ম্যানফ্রেড ছুটে এল। সেই যে গেল, আর পাত্তা নেই। এই জায়গায় বাঙালির আর ফিউচার নেই। দিন দিন ঘৃণা বাড়ছে। আমাদের সকলকেই একদিন যেতে হবে। উদয়নের সঙ্গে কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমার ওইসব কথাই হচ্ছিল। যতদিন পারা যায় আমরা বুড়ো-বুড়ি এই বসবাস আগলে রাখি। তোমরা নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন ভবিষ্যৎ তৈরি করো। আজ সকালে আর একটা খবর শুনে মন খারাপ হয়ে গেল, চার্চের বিদেশি ফাদার আর নানরা সব দেশে ফিরে যাচ্ছেন। রাজনৈতিক চাপে তাঁরা এখানে আর আগের মতো কাজ করতে পারছেন না।”
একটু পরে সবাই দল বেঁধে রাস্তায় নেমে পড়লেন। পথ সেই আগের মতোই আছে। পথের কোনও পরিবর্তন হয় না। চারপাশে শাল আর মহুয়া। পলাশে ফটাস-ফটাস ফুল ফুটেছে। কৃষ্ণচূড়া লাল। পশ্চিমে সূর্য ঢলেছে। রাস্তার ওপর দিয়ে পিছলে যাচ্ছে আলো। চার্চে নতুন রং পড়েছে, চূড়াটা ঝলমল করছে শেষ বেলার আলোয়। ঝকঝকে নতুন সাইকেলে চেপে চলেছেন নীল পোশাকপরা ডাকপিয়ন। কোথাও কোনও পরিবর্তন নেই। যা কিছু সব মনে। একজন নেই। যে নেই, সে না থাকায় মনে হচ্ছে জায়গাটাই নেই। সে হল খড়ক সিং। জায়গাটার আত্মাটাই যেন বেরিয়ে চলে গেছে। খোলসটা পড়ে আছে।
পথেই পড়ল শিরিনদের বাড়ি।
শিবশঙ্করই প্রথমে বললেন, “শিরিনের অনেকদিন কোনও খবর নেই, কেন বল তো?”
জয়া বলল, “স্কুলেও আসছে না অনেকদিন। অথচ সামনেই পরীক্ষা।”
“খবর নাওনি কেন?”
“পড়ার চাপে সময় পাইনি দাদি।”
“চলো একবার ঘুরে যাই।”
কাঠের গেট। গেট পেরোলেই ছোট্ট বাগান। নিজের খেয়ালেই ফুল আছে ফুটে। মাটি শুকনো খটখটে। ঝরা পাতা। কোথাও কোনও সাড়া শব্দ নেই। পাথর বাঁধানো পথ। সামনেই সাদা রক। তিন ধাপ সিঁড়ি দরজায় বিশাল এক তালা। জনপ্রাণীর চিহ্ন নেই। খরগোশের খাঁচা শূন্য। বাড়িটা গোল হয়ে ঘুরে এলেন সবাই মিলে। পেছনে ইদারা। লম্বা লম্বা পেঁপে গাছ। ফলের ভারে নড়তে চড়তে পারছে না।
শিবশঙ্কর সব দেখেশুনে বললেন, “মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিন ওরা এখানে নেই। রকের ওপর বাতাসের তৈরি বালির রেখা। গেল কোথায়! না বলে তো যায় না! কী জানি, কী আবার হল!”
হঠাৎ নিচু হয়ে কী একটা তুললেন, কাগজের মতো। দোমড়ানো মোচড়ানো। “দেখেছ! ভাঁজ করা একটা দু’টাকার নোট। মনে হচ্ছে, সবাই খুব তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে চলে গেছে।”
শিবশঙ্করকে খুব চিন্তিত দেখাল। কী হল শিরিনদের! দিনকাল মোটেই ভাল নয়! কে যে কখন কী করে ফেলে। গেট-খোলা। বাগানে যে কেউ ঢুকে পড়তে পারে। অবশ্য এদিকের মানুষ এখনও তেমন অসৎ হয়ে যায়নি। সবাই মনমরা হয়ে সরলা নদীর দিকে এগিয়ে চললেন। কিছু দূর গিয়ে শিবশঙ্কর বললেন, “আমরা খবর নিইনি বলে শিরিনের অভিমান হয়েছিল, সেই কারণে বিপদে পড়েও আমাদের কোনও খবর দেয়নি। যেভাবেই হোক খবরটা নিতে হবে। কাল সকালে পোস্টাপিসে গিয়ে মাস্টারবাবুকে জিজ্ঞেস করতে হবে। মনটা বড় উতলা হয়ে রইল। খুব অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে।”
কথায় কথায় তাঁরা খড়ক সিংয়ের বাগানের সামনে এসে পড়লেন। গেট ঠেলে ঢুকলেন সবাই। অনেক পাখি এসে নেমেছে। খোলা জায়গাটা তাদের কলরবে মুখর। বড় বড় গাছ বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে। সিংজি অনেক খেটে বাগানটাকে তৈরি করেছিলেন। নানা দেশের গাছ লাগিয়েছিলেন। এপাশে-ওপাশে বেদি তৈরি করিয়েছিলেন বসার জন্য। এপাশে-ওপাশে সুন্দর সুন্দর সাদা ফেনসিং। মানুষটার যেমন উঁচু নজর ছিল, সেইরকম রুচি।
শিবশঙ্কর সকলকে নিয়ে বাগানের মাঝখানে একটা বেদিতে বসলেন। খুব হাওয়ার বিকেল। গাছের মাথায় ঝপঝপ শব্দ হচ্ছে। শিবশঙ্কর নাতি-নাতনিদের নিয়ে বেশ আরামে বসেছেন। সকলেই তাঁকে ঘিরে আছে। সাহারা তার মাথাটা শিবশঙ্করের পিঠে ঠেকিয়ে রেখেছে। জয় বাগানটায় একবার চক্কর মেরে এসে বলল, “দাদি, এই বাগানবাড়ির কী ব্যবস্থা হবে?”
“সেটাও তো চিন্তার। কেউই তো এল না দখল নিতে। জানো তো, এরই মধ্যে সত্যি মিথ্যে জানি না, একটা খবর পেলুম, খড়ক সিং সত্যিই নাকি রাজস্থানের একটা স্টেটের রাজা হতে পারত। সিংহাসনের উত্তরাধিকার তারই ওপর বর্তাত। রাজা হওয়ার ভয়ে সে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। সে এক হইচই ব্যাপার। ইংরেজের পুলিশ। তারা তো ছেড়ে কথা কইবে না। তারা এসে খড়ক সিংয়ের পরের ভাইকে খুনের দায়ে গ্রেফতার করল। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে মামলা টিকল না। রহস্য রহস্যই রয়ে গেল। সেই সময়কার কাগজপত্রে এই নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হয়েছিল। খড়ক সিং আসলে কে, এই তথ্য একজন মাত্র জানতেন, তিনি বেনারসের এক সাধু। তিনি মৃত্যুর আগে রাজস্থানের সেই এস্টেটের ইংরেজ রেসিডেন্টকে জানিয়ে গিয়েছিলেন। তখন স্বাধীনতার আগে সেই এস্টেটের প্রাপ্য ভাগ সিংজিকে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। সিংজি নেননি। তবু সিংজির ভাই দাদার জন্য ধনদৌলতের একটা অংশ আলাদা করে রেখেছিলেন। সিংজির ভাই তো সিংজির মতোই সৎ হবেন। আমার ধারণা, এটা গল্পকথা নয়, সত্য ঘটনাই। এখন তো আর সেই রাজা নেই, থাকলে সব জানা যেত।”
সবাই অবাক হয়ে গল্প শুনছে।
শিবশঙ্কর সাহারাকে বললেন, “তোর এমন বরাত, তুই একটা রাজাকে পেয়েও হারালি। এখানে সিংজির নামে যতদিন না একটা কিছু করতে পারছি, ততদিন আমার শান্তি নেই।”
জয়া বলল, “বাবা চলে গেলে, তুমি একা-একা করবে কী করে!”
“এই কাজটার জন্য তোমার বাবাকে তো আটকে রাখা যাবে না। একাই তো অনেক কিছু করেছি, এটাও না হয় একাই করব। সঙ্গে চাবিটা এনেছ নাকি, তাহলে বাড়ির ভেতরটা একবার দেখে যাই।”
“চাবি যে আনিনি দাদি।”
“তা হলে চলো, সরলাতেই যাই। সন্ধের মুখে জায়গাটা বেশ ভালই লাগবে।”
সবাই হাঁটতে-হাঁটতে গল্প করতে করতে নদীর দিকে চললেন। শেষ দিনের আকাশটা কাচের মতো হয়ে উঠেছে।
॥ ৪৩ ॥
সবাই খেতে বসেছেন। টেবিলটা বিরাট। প্রাচীন আমলের। শিবশঙ্করের পিতা এক সাহেবের কাছ থেকে উপহার হিসেবে পেয়েছিলেন। অনেক কারুকার্য। খুব যত্নে থাকে এ বাড়ির সব কিছু। শিবশঙ্করের দু’পাশে জয় আর জয়া। বিপরীত দিকে উদয়ন, পাশে সাহারা। রাত ন’টা। বাড়িটা খালি-খালি লাগছে। সব বাঁধছাঁদা হয়ে গেছে। উদয়ন সঙ্গে বিশেষ কিছু নিচ্ছেন না। কিছু জামাকাপড়, চাদর, প্রয়োজনীয় বই। সবই কিনে নেবেন নতুন জায়গায় গিয়ে।
নানারকমের রান্না হয়েছে আজ। বিদায় ভোজ। কেউই তেমন প্রফুল্ল মনে খেতে পারছে না। চেষ্টা করছে। মজার-মজার কথা হচ্ছে। জোর করে সবাই হাসছে। মাঝে-মাঝে মিইয়ে যাচ্ছে। সব চুপচাপ। হঠাৎ যেই মনে পড়ছে বিষণ্ণ হলে তো চলবে না, সঙ্গে-সঙ্গে কথা। আবার হাসি। ভীষণ এক টানাপোড়েনে পড়েছে মন। তারই মধ্যে চলেছে খাওয়ার অভিনয়। শিবশঙ্কর একবার বললেন, “মাছের কালিয়াটা বড় জবরদস্ত বেঁধেছে আজ বউমা। তোমার কাছে কাঁচালঙ্কার আর্টটা আমাকে শিখতে হবে। তুমি একটা রান্নার বই লেখো, নাম দাও ‘সপ্তপদী’। ভূমিকাটা আমাকে লিখতে দিয়ো।”
ইংরেজিতে একটা কথা আছে, ‘ফ্ল্যাট। শিবশঙ্করের কথাটা সেই রকম ফ্ল্যাট হয়ে হারিয়ে গেল, কারও মন স্পর্শ করল না। জয় বেড়ালটাকে দেখছে। ছেলেবেলা থেকে সে আর দিদি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিল। একপাশে চোখ মুদে নিশ্চিন্ত আরামে বসে আছে। ভেতরে আরাম যখন খুব জমে যাচ্ছে, আর রাখা যাচ্ছে না, তখন হাই তুলে বাইরে একটু ছেড়ে দিচ্ছে, প্রেশার কুকারের স্টিমের মতো। টেবিলে যারা বসেছে, তাদের কথা হল—ভাঙব তবু মচকাব না।
প্রথমে যে ভাঙল, সে সাহারা। খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। গিলতে পারছিল না। কান্নার দলা আটকাচ্ছিল গলার কাছে। হঠাৎ চেয়ার ঠেলে দুদ্দাড় করে ছুটে চলে গেল বাইরে। একেবারে বাগানে। সেখানে চাঁদের আলোর ফিনিক ফুটছে। একটা বেশ বড় আকারের ব্যাঙ বেড়ার ধারে থপাক-থপাক করে লাফিয়ে উঠছে মাঝে-মাঝে। শান্তিতে বসতে দিচ্ছে না সুস্বাদু কিছু পোকা। তা না হলে ধ্যানটা এতক্ষণে বেশ জমে যেত।
সাহারাকে ওইভাবে ছুটে যেতে দেখে জয় অনেকক্ষণ ধরেই ভাঙব-ভাঙব করছিল। সাহারাই পথ দেখাল। জয় শিবশঙ্করের পাশ থেকে কোনও কথা না বলে উঠে চলে গেল। শিবশঙ্কর বললেন, “এইবার একে-একে সব আপসেট হচ্ছে। আমার কিন্তু কিছু হচ্ছে না; কারণ আমার স্বভাবটা হল প্যাটন ট্যাঙ্কের মতো। উদয়ন, তোমার কিছু হচ্ছে!”
উদয়ন কোনও উত্তর দিতে পারলেন না। নীরবে উঠে চলে গেলেন। সঙ্গে-সঙ্গে জয়া। বিশাল টেবিলে একা শিবশঙ্কর। ঝলমল করছে আলো। সাদা পোর্সিলেনের নানা আকারের প্লেট। ফিনফিনে কাচের গেলাসে টলটলে জল। রান্নাঘর থেকে খাওয়ার ঘরে আসার দরজায় থমকে দাঁড়িয়ে জয়ের মা আর দিদা। দু’জনেরই হাতে খাবার প্লেট। একটা কিছু পরিবেশন করতে আসছিলেন তাঁরা। এতক্ষণে বেড়ালটা উঠে আড়মোড়া ভাঙছে। সে কিছু বুঝতে না পেরে মিউ করে একবার ডাকল। তারপরে টুক করে লাফিয়ে উঠল শিবশঙ্করের কোলে। তিন পাক ঘুরে লেজ গুটিয়ে বেশ জুতসই করে শুয়ে পড়ল। শোওয়ামাত্রই আদরের ঘড়ঘড় শব্দ। সাদা ধবধবে, ভীষণ লোমলা একটা কাবুলি বেড়াল।
শিবশঙ্কর নিজের মনেই বললেন, “যাদের মন নেই, পৃথিবীতে তারাই সুখী।”
সারা বাড়িতে একটা থমথমে পরিবেশ। কখনও একটা বাসন রাখার শব্দ। কখনও কল খোলার। কখনও সংক্ষিপ্ত আদেশ। বেড়ালটাকে খেতে দে। কুকুরটাকে বাগানে ঘুরিয়ে আন। শিবশঙ্কর ডেকচেয়ারে আধশোয়া হয়ে ভাবছেন, কাল থেকে নতুন আর একরকমের জীবন শুরু হবে। অকারণে কথা বলতেও ইচ্ছে করছে না। এক-একটা পরিস্থিতিতে যে-কোনও কথাই খুব অবান্তর মনে হয়। সরলা স্টেশন ছুঁয়ে রাতের শেষ ট্রেন চলে যাচ্ছে। সেই হুহু করা শব্দটা শিবশঙ্কর শুনছেন। বয়েসের সঙ্গে-সঙ্গে মনের আঁটসাঁট ভাবটা নষ্ট হয়ে যায়। আজেবাজে চিন্তা আসে। যেখানে বসে আছেন সেইখান থেকে সরলা ডাকঘরের বাড়ির একটা অংশ দেখা যায়। বাইরের দেওয়ালে একটিমাত্র আলো জ্বলছে। সারা রাত জ্বলে থাকবে একা আলো। জ্বলে থাকাটাই তার কর্তব্য, যেমন শিবশঙ্করের বেঁচে থাকাটাই অবশিষ্ট কয়েক বছরের কর্তব্য।
ভেতরের ঘরে কেউ একজন ফুপিয়ে কাঁদছে। বোঝার চেষ্টা করলেন, কে? মনে হচ্ছে, জয়ার মা। মেয়েটা বড় ভাল। এক নম্বর মেয়ে। বড় স্নেহের পাত্রী। এত বছর সংসারে আছে। রাগতে তো জানেই না, সবসময় মুখে একটা হাসি। এই প্রথম শিবশঙ্কর তাকে কাঁদতে দেখছেন।
জয়, জয়া আর সাহারা রাতের অন্ধকারে অদ্ভুত একটা কাজে ব্যস্ত। পরিকল্পনাটা জয়ের। একটা কাগজে তারা লিখেছে:
প্রিয় শিউলি,
তোমাকে এনেছিল জয়া খড়ক সিংয়ের বাগান থেকে। সঙ্গে ছিল শিরিন। তুমি বড় হলে আমাদের চোখের সামনে। তুমি আমাদের আর-এক বোন। তুমি প্রতি শরতে সন্দর ফুল ফোটাবে। এখন যেমন ফোটাচ্ছ। রোজ সকালে, একটা, দুটো, অনেক অনেক, ফুল তুমি বিছিয়ে রাখবে তলায়, ঘাসের ওপর। আমরা থাকছি না। কালই চলে যাচ্ছি অনেক দূরে। তোমার কাছে আমাদের আর এক বোন সাহারা থাকছে। তুমি আমাদের দাদি আর দিদাকে দেখো। আমাদের আরও এক বোন শিরিন না বলে কোথায় চলে গেছে, যদি ফিরে আসে তার হাত ভরে দিয়ো ফুলে। চার্চের ফাদার আর সিস্টারদের দেখো। আর আঙ্কল ম্যানফ্রেড যদি ফিরে আসেন, তাঁকে বোলো, মোটর সাইকেল তো আছেই আমাদের ওখানে একবার যেতে। মানফ্রেড মারা গেছেন এ-কথা আমরা বিশ্বাস করি না।
তুমি ভাল থেকো। অনেক, অনেক বছর বেঁচো। তুমি হলে শিশিরের ফুল। আমরা যদি না আসি, তুমি আমাদের অপেক্ষায় থেকো। তোমাকে আমরা ভুলব না কোনওদিন।
ইতি তোমার
জয় ও জয়া।
এইবার কী হবে! জয়া একটা শিশির মধ্যে চিঠিটাকে গোল করে পাকিয়ে ঢুকিয়েছে। মুখটাকে ভাল করে বন্ধ করেছে ছিপি আর গালা দিয়ে। দুপুরবেলা তিনজনে মিলে বেশ গভীর একটা গর্ত খুঁড়ে রেখেছিল শিউলিতলায়। গর্ত থেকে যা মাটি উঠেছিল সারাদিনের রোদে শুকিয়ে বেশ ঝুরঝুরে হয়েছে। জয়া খুব সাবধানে বোতলটাকে সেই গর্তে শোওয়াল। বোতলের গলায় নিজের হাত থেকে খুলে একজোড়া চুড়ি পরিয়েছে। সাবধানে ঝুরো ব্যুরো মাটি ফেলছে তিনজনে। ঝুপঝাপ শব্দ। গর্তটা ভরে গেল। হাত দিয়ে চেপে-চেপে মাটি বসিয়ে জায়গাটা সমান করে তার ওপর ঘাস বিছিয়ে দিল।
জয়া সাহারাকে বলল, “কারওকে বলবি না এখানে কী আছে। তুই তো থাকবি, জায়গাটা পাহারা দিবি। বর্ষায় যদি দেবে যায়, আর একটু মাটি দিয়ে দিবি। লক্ষ্মী বোন আমার!”
রাতের অন্ধকার, তবু তারা টর্চ জ্বেলে বাগানটা একবার চক্কর মেরে এল। গন্ধরাজ গাছগুলো ফুলে-ফুলে সাদা হয়ে গেছে। গন্ধে চারপাশ আমোদিত। কাল রাতে তারা তো আর এখানে থাকবে না। তখন অনেক-অনেক দূরে। রাতের বাগানের রহস্যটা তাই শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে।
তারা রকে উঠতে-উঠতে শুনল, দাদি বলছেন, “তোমরা এইবার শুয়ে পড়ো, কাল ভোর-ভোর উঠতে হবে। সকালেই ট্রেন। মনে আছে তো!”
উদয়নের ঘরের মেঝেতে সার-সার ব্যাগ আর সুটকেস। সব গোছগাছ করে সাজানো। প্রত্যেকটায় ক্যালেন্ডার থেকে সংখ্যা কেটে লাগানো হয়েছে, এক, দুই, তিন। নাম, ঠিকানা লেখা হয়েছে। উদয়ন নিজের খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন, পায়ের ওপর পা, কপালের ওপর ভাঁজ করা দুটো হাত। ওপরের ঠোঁট দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে আছেন। নিজের সঙ্গে যখন বোঝাপড়া চলে তখন এইটাই তাঁর চিরপরিচিত ভঙ্গি। এই সময় কেউ তাঁকে বিরক্ত করে না। উদয়ন মিতবাক স্বভাবের মানুষ। সবসময় নিজের ভাবেই মগ্ন থাকেন।
জয়, জয়া আর সাহারা দিদার খাটে। দিদাকে ঘিরে বসেছে। বেড়ালটাও আছে। নিশ্চিন্ত মনে গা চাটছে নানাভাবে, নানা কায়দায়। যেন একটু পরেই কোনও দূর দেশে বেড়াতে যাবে। জয়া তার নরম তুলতুলে গায়ে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, “তুই কোথাও বেড়াতে যাবি নাকি রে পুসি!”
পুসি তার ব্যস্ততা থামিয়ে জয়ার দিকে মুখ তুলে আধবোজা চোখে বললে, “মিউউ।” জয় দিদার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। উলটো হাতে গলাটা জড়িয়ে ধরে বলল, “একটা গল্প বলো না দিদা, সেই ছেলেবেলার গল্প, এক যে ছিল রাজা, আর এক যে ছিল রানি।”
দিদা বলছেন, “সে রাজ্য নেই, রাজা নেই, রানিও আর নেই। রাজপুত্র আর রাজকন্যা গেছে দূর বিদেশে লেখাপড়া করতে। তারা বলেছে, জ্ঞানের রাজ্য জয় করে, সেই রাজত্বের রাজসিংহাসনে বসবে। তারাও যুদ্ধ করবে। জ্ঞানের তরোয়াল দিয়ে অন্ধকার, অজ্ঞান, কুসংস্কার, অভাব, অত্যাচারের সঙ্গে লড়াই করবে। তাদের মহারাজাধিরাজ, মহাজ্ঞানেশ্বর, স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি সেই রাজকুমারকে দুটো তরোয়াল ঘোরাতে শিখিয়েছেন, ত্যাগ আর বৈরাগ্য। দুটা ধবধবে সাদা ঘোড়া কিনে দিয়েছেন, একটার নাম কর্ম, আর একটার নাম ধর্ম। একটা ঝকঝকে রথ দিয়েছেন, সেই রথের নাম সংযম। সেই রথের সারথি এক উজ্জ্বল পুরুষ, তাঁর নাম বিবেক। আর মহাশিক্ষক হলেন, সময়। এই হল চিরকালের গল্প। এইবার আমার এক প্রিয় কবিতার শেষটা শোননা:
“যতদূর যতদূর যাও, বুদ্ধিরথে করি আরোহণ,
এই সেই সংসার-জলধি, দুঃখ সুখ করে আবর্তন।
পক্ষহীন শোন বিহঙ্গম, এ যে নহে পথ পালাবার,
বারংবার পাইছ আঘাত, কেন কর বৃথায় উদ্যম?
ছাড় বিদ্যা জপ যজ্ঞ বল, স্বার্থহীন প্রেম যে সম্বল;
দেখ, শিক্ষা দেয় পতঙ্গম— অগ্নিশিখা করি আলিঙ্গন।
রূপমুগ্ধ অন্ধ কীটাধম, প্রেমমত্ত তোমার হৃদয়;
হে প্রেমিক, স্বার্থ-মলিনতা অগ্নিকুণ্ডে কর বিসর্জন।
ভিক্ষুকের কবে বল সুখ? কৃপাপাত্র হয়ে কিবা ফল?
দাও আর ফিরে নাহি চাও, থাকে যদি হৃদয়ে সম্বল।
অনন্তের ভুমি অধিকারী, প্রেমসিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,
‘দাও, দাও’—যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।
ব্রহ্ম হতে কীট-পরমাণু, সর্বভূতে সেই প্রেমময়,
মন প্রাণ শরীর অপর্ণ কর, সখে, এ সবার পায়।
বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।
চোখ বুজে আবৃত্তি করছিলেন। চোখ খুলে দেখলেন, সামনে পরিপূর্ণ সংসার। সুরেলা, দৃপ্তকণ্ঠের আবৃত্তি শুনে সবাই ঘরে চলে এসেছেন। স্বামী, পুত্র, পুত্রবধ, কাজের মেয়েরা, বাগানের মালী। শিবশঙ্কর বললেন, “অনেকদিন পরে তুমি বেরিয়ে এলে। তা হলে একটা গানও হয়ে যাক।”
বৃদ্ধা এককথায় ধরলেন, রবীন্দ্রনাথের গান, “মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে/আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে।”
এক সময় গান শেষ হল। একে-একে সব আলো নিভে গেল। শুধুমাত্র একটি দেওয়ালঘড়িতে সময়ের টিকটিক চলার শব্দ।
সকাল ছ’টার সময় বাড়ি একেবারে খালি। সবাই সরলা স্টেশনে। ট্রেন আসবে ছ’টা কুড়িতে। ছেড়ে যাবে ছটা তিরিশে। মাস্টারমশাই বেরিয়ে এসেছেন প্ল্যাটফর্মে, “ডাক্তারবাবু আমারে ছেড়ে সত্যিই তা হলে চললেন!”
উদয়ন বললেন, “আমার একেবারেই যেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু কী করব আমার চাকরি।”
“আমাদের শহরটা এইবার সত্যিই খালি হয়ে গেল। আমার চাকরি আর মাত্র এক বছর আছে। তারপর আমিও চলে যাব মুঙ্গেরে। আপনি যাচ্ছেন প্রবাসে, আর আমি যাব আবাসে, তাও আমার দুঃখ লাগছে। এই জায়গাটার একটা মায়া আছে।”
চার্চের ফাদার বললেন, “সামনের মাসে আমরাও ফিরে যাচ্ছি স্কটল্যান্ডে।”
মাস্টারমশাই বললেন, “শ্মশান হয়ে গেল! শিবশঙ্করবাবু, আপনি কী করবেন?”
“নতুন যাঁরা আসবেন আমি তাঁদের নিয়েই নতুনভাবে বাঁচতে শিখব। মানুষ চলে গেলেও জায়গাটা তো পালাচ্ছে না। আমার কোনও দুঃখ নেই। আই নো হাউ টু লিভ!”
ট্রেন আসছে। সেই নিষ্ঠুর যন্ত্র, যে মানুষের কাছ থেকে মানুষকে নিয়ে চলে যায়। শিবশঙ্কর জয় আর জয়াকে দেখছেন। কী সুন্দর বেড়ে উঠছে ছেলেমেয়ে দুটো। অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। অসম্ভব হবে এদের ছেড়ে বেঁচে থাকা। সে-কথাটা তো বলা যায় না। বড়জোর একটা গান গাওয়া যায় মনে-মনে:
তোমার হল শুরু আমার হল সারা—
তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা॥
তোমার জ্বলে বাতি তোমার ঘরে সাথী
আমার তরে রাতি, আমার তরে তারা॥
শিবশঙ্কর আবেগ অপছন্দ করেন, তাই মনে-মনে বললেন, যেখানেই থাক তোমরা বড় হও, মানুষ হও। তোমাদের মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব। শিবশঙ্কর লক্ষ করছেন, সকলের চোখই ভরা নদী।
ট্রেন থামতে-থামতে একেবারেই থেমে গেল। এঞ্জিনের একটা আলাদা ধরনের ব্যক্তিত্ব আছে। বেপরোয়া কঠিন। প্রথম শ্রেণীর কামরা থেকে একজন মাত্র যাত্রী নামলেন। চোখে পড়ার মতো চেহারা। ছ’ ফুট লম্বা ছিপছিপে ধারালো চেহারা। পরনে শেরোয়ানি। দেখলেই মনে হয় যোধপুর থেকে আসছেন, ধনী মানুষ।
ভদ্রলোক এগিয়ে এসে পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, “আমি খড়ক সিংজির ভাই। আপনারা!”
শিবশঙ্কর বললেন, “আমি, আমরা সবাই সিংজির বন্ধু। অনেক আগেই আপনাকে আশা করেছিলুম।”
“দুঃখিত, আমি ইংল্যান্ডে ছিলুম। আসামাত্রই আমার ম্যানেজার কাগজের বিজ্ঞাপনটা দেখালেন। সঙ্গে-সঙ্গে চলে এসেছি।”
“এই আমার ছেলে ডাক্তার উদয়ন। এই ট্রেনেই ওরা যাবে। একটু অপেক্ষা করুন, ওদের আগে তুলে দিই।”
“ও ইয়েস।”
ভদ্রলোক নিজেই মালপত্র তোলার জন্য ব্যস্ত হলেন। একেবারে নিরহঙ্কারী মানুষ, “ডক্টর ইওর ডেসটিনেশান?”
“লখনউ।”
“লখনউ! দ্যাট ইজ মাই ডেসটিনেশান। দ্যাট ইজ মাই সেকেন্ড হোম। এখান থেকে আমি ওখানেই যাব। তখন আপনার সঙ্গে দেখা হবে। ইউ উইল বি ইন দ্য জেনারেল হসপিটাল। আপনাকে আমি আমার গার্ডেন হাউসে রাখব। দ্যাটস দ্য বেস্ট লোকেশান ইন দ্য সিটি। আমাদের ক্লাবে আপনাকে মেম্বার করে নেব। ইউ উইল লাভ দ্য প্লেস।”
শিবশঙ্কর বললেন, “দেখলে, কী অভাবনীয় যোগাযোগ! সব যেন আগে থেকে ঠিক করা ছিল।”
হুইস্ল বাজল। ঠ্যাং-ঠ্যাং ঘণ্টা। ট্রেন এইবার ছাড়বে। কামরায় সবাই বেশ গোছগাছ করে বসেছে। প্রণামের পালা সাঙ্গ। কেউই কথা বলতে পারছে না। বলতে গেলেই কান্না বেরিয়ে আসবে।
ট্রেন গতি নিয়েছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে সরে যাচ্ছে একসার মুখ। পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি, নাতনি। দূরে, আরও দূরে। বাঁশির শব্দ। লোহার একটা সরীসৃপ সংসারের আধখানা ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেল। শেষ, গার্ডের কামরাটা যেন ভাসতে-ভাসতে দৃষ্টিপথের বাইরে চলে গেল। পড়ে রইল প্ল্যাটফর্ম। একজোড়া নিষ্ঠুর রেল লাইন। আর কয়েকজন মানুষ। শিবশঙ্কর ফিরে তাকালেন নবাগতের দিকে, “চলুন। লেট্স গো।”
যেমন সময় বলে মানুষকে, চলো হে। চলতে তোমাকে হবেই। হয় এদিকে, না হয় ওদিকে। তুমি যদি নাও চলো, আমি তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাব আমার স্রোতে। আজ থেকে কালে, কাল থেকে আরও দূর কালে। অদৃশ্য এক মহাতরঙ্গ। বহুকাল পরে, কে কোথায় থাকবে! কেউ থাকবে না, কেউ থাকবে। এই নিবাস পরিত্যক্ত হবে। একটি সুখের সংসারের স্মৃতি। ভেঙে পড়া পাঁচিল। গেট নেই। পিলার দুটো আছে। আগাছায় ঢেকে গেছে বাগান। জীর্ণ বাড়ি, রোদে-পোড়া দরজায় বিশাল এক মরচে-ধরা তালা। উদয়ন কোথায়! হয়তে কলকাতায়। অবসর জীবন কাটাচ্ছেন। জয় কোথায়? আমেরিকায়। জয়া? জয়া তো ইংল্যান্ডে। আর সাহারা! সে তো সরলাতেই সংসার করেছে। শিবশঙ্কর তাকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছেন।
শরতের ভোরে পরিত্যক্ত নির্জন বাগানে শিউলি তখনও আকাশের শিশির ধরে ফুল করে ঝরিয়ে চলেছে। তার তো চলা নেই। সময়েরও হিসেব সে রাখে না। সে শুধু জানে, সময়কে কেমন করে ফুলে ফোটাতে হয়, আর নিঃসীম আনন্দে নিঃশেষে ঝরাতে হয়।
____