kaktarua sayak aman online reading free

KhoriBona

কাকতাড়ুয়া – সায়ক আমান 

 প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ২০২৪ 
পত্রভারতী বুকস প্রাইভেট লিমিটেড 
 . 

 বাবাকে বাকিগুলোর মতো এটাও পড়বে না জানি। তাও এই বইটা তোমার জন্য রইল কমরেড…! .


 দেখুন, আমি যখন প্রথম প্রেম করেছিলাম তখন আমার বয়স পনেরো। আমার দেওয়া প্রেমপত্র সযত্নে ব্যাগে রেখে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে ঢুকেছিল মেয়েটি। তো একফাঁকে তার মা ব্যাগ থেকে সেই প্রেমপত্র উদ্ধার করে এবং পত্রপাঠ মেয়েকে উদোম ক্যালানি দিতে দিতে আমাকে অভিসম্পাত করে, ‘কম বয়সে পাকলে বাল, দুঃখ থাকে চিরকাল।’ 

 সেই মহিলার অভিশাপের জন্যই কিনা জানি না জীবনের যাবতীয় বালপাকনামি করতে আমি নিজের মধ্যে ভয়ঙ্কর তাড়াহুড়ো লক্ষ্য করেছি। তার ফ্ল্যাগশিপ প্রজেক্ট আপাতত আপনার হাতের তালুতে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এই বইটা। এ বই আমার এখন লেখার কথা নয়,  সত্যি বলতে কারোর কখনোই লেখার কথা নয়। 

 ধরুন আজ থেকে বছর পঞ্চাশ পরে সব শ্বাসই যখন নাভিশ্বাস, অ্যাডাল্ট সাইটের বদলে জীবনে যখন কেবল অ্যাডাল্ট ডাইপার, তখন পেছনে বেডপ্যান আর মাথায় ই-এম-আইয়ের বোঝা নিয়ে নাতিনাতনির পেচ্ছাপের গন্ধের মধ্যে দাঁত বের করে বসে একহাতে ক্যাথিটার অন্য হাতে কলম নিয়ে এরকম একটা কিছু লিখে ফেলা যায়। কিন্তু এই ভরা যৌবনে… 

 এ উপন্যাসে কোনও আশার আলো নেই। কারণ আমাদের জীবনে কোনও আশার আলো নেই। আমাদের রাজনীতি ঘৃণা শেখায়, আমাদের প্রেম হিংস্র কামড়াকামড়ি শেখায়, আমাদের শিক্ষা কুচুটে হতে শেখায়, ল্যাং মারতে শেখায়, আমাদের বাপ মা আমাদের নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক, সঁয়োসকিতি…অনেক কিছু শেখায়, আর তারপর শেখায় পেশার প্রয়োজনে কী করে সেসবের মুখে ছাই দিয়ে এমএনসি-র দাসত্ব করতে হয়। 

 তারপর এইসব যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে আমরা আশার আলো বলে খুঁজে নিই বিচ্ছিন্নতাকে। পরিচিত মানুষ, সমাজ, রাজনীতি সব কিছুর থেকে সরে এসে এক বিরক্তিময় অন্ধকারের আগলে মুখ লুকিয়ে ফেলি আমরা। শরীরটুকুনি আলোর মধ্যে জিইয়ে রাখি কেবল। 

 এই উপন্যাস একটা বিচ্ছিন্ন মানুষ, একটা বিষণ্ণ শহর আর একটা রূপকথার গল্প। এই সবকিছুর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যারা সরে দাঁড়িয়েছিল অনেকটা দূরে। আলোর বদলে রহস্য ঢেকেছিল তাদের। ঘন কুয়াশায় হেঁটে তারা কোথায় হারিয়ে গেছে আমি জানি না। 

 তবে একটাই আফসোস রয়ে গেল দাদা। অসময়ে এত বালপাকনামি করেও জীবনে তেমন দুঃখই বা পেলাম কোথায়? যে দুঃখে কোনও নির্জন স্টেশনে প্রায় যাত্রীহীন ট্রেনের কামরার দিকে চেয়ে হাত নাড়াতে পারতাম অনেকক্ষণ? কিংবা কোনও ব্যস্ত এয়ারপোর্টের সামনে, যেখানে শেষ দেখেছিলাম তাকে, সেখানে দাঁড়িয়ে বুড়ো হয়ে যেতে পারতাম হাসতে হাসতে? 

 নাঃ, জীবনে সুখ এল, দুঃখ এল, প্রেম যন্ত্রণা রোগ এল, শুধু কোনটাই চিরকাল থাকল না। কোনটার সঙ্গেই ঘর করা হল না। আপনার অভিসম্পাত কেন কাজ করল না কাকিমা? 

বরাবরই বলে এসেছি ‘এই নাও ১০ লাখ টাকা, আমার মেয়ের জীবন থেকে সরে যাও’ গোছের অর্থসমাগম না হলে আমার বই কেনার মানে হয় না। সেলফি কিংবা সই আমি ‘দাদা তোমার হাসিটা কী মিষ্টি’ বললে এমনিই গদগদ হয়ে করে দিই। 

 ভালো কথা, এই বই লিখতে গিয়ে আমি কোনও রিসার্চ করিনি (রিসার্চই যদি করতে হত তাহলে ‘ছাদে গাঁজা চাষ করে লাখপতি হওয়ার দশটি উপায়’ নিয়ে করতুম না?)। তবে হ্যাঁ? আমরা ছোটবেলায় যেসব খিস্তিখামারি করেছি সেসব এখনকার দিনে আর চলে না। এখনকার কচিকাঁচারা কী ধরনের খেউড় ব্যবহার করে সেটা জানার জন্য কিছু ছেলেপেলে জোগাড় করে তাদের প্রেমিকার বাপ-মা কিংবা প্রেমিকার বেস্ট ফ্রেন্ডের খবর নিতে হয়েছে। 

 এছাড়া এ বই লিখতে আমাকে তেমন কেউ সাহায্য-টাহায্য করেছে বলে মনে পড়ছে না। তবে আমার ভাইবোন আর কমরেডদের (তমাল, মোহনা, কৌশিক, আর্য্য, অভিব্রত, পৌলমি, টুনটুনি, দোলনকুমারী, পোলো, শালিনি) নামগুলো স্রেফ ‘না লিখলে কী মনে করবে’ ভেবে লিখে দিলাম। জায়গা কম পড়ছে দেখলে সম্পাদক মশাই নির্দ্বিধায় কেটে দেবেন। 

 পত্রভারতী থেকে এই নিয়ে আমার দুটো বই। বইয়ের দাম কম রাখার বায়না, ‘আজ দিচ্ছি, কাল দিচ্ছি’ করে ম্যানুস্ক্রিপ্ট ঝোলানো, ‘বইয়ের কভার ঠিক ততটা কালো নয়’ গোছের ট্যান্ট্রামস সহ্য করে এ বছরেও ‘ছলছল নয়নে, হাসিমাখা বদনে’ এই বইটা ছাপতে চেয়েছেন। একমাত্র বিবাহিত পুরুষ ছাড়া এত ধৈর্য আমি আর কারো মধ্যে দেখিনি। 

 এই একবছর আমার যাবতীয় প্রশ্নের মুখে, ‘এটা ঠিক এডিটোরিয়ালের দেখার বিষয় না’ ছুড়ে মারা অনিন্দিতাদিকে বিশেষ ধন্যবাদ। বইমেলায় কেউ তাকে, ‘আপনিই ওই বিচ্ছিরি বইটা এডিট করেছেন?’ বলে প্যাঁক দিলে সেটা ‘লেখকের দেখার বিষয় না’। 

 আর আমার ছোট ছোট ছানাপোনারা—এ বইটা কেনো বা না কেনো, ভালো লাগুক বা না লাগুক, আমার কিছুই যায় আসে না। একটা বা অনেকগুলো বই নয়, গল্প নয়, শিল্প-টিল্প সব বাজে কথা। আমি বছর বছর বই লিখি কারণ আমার তোমাদের মধ্যে থাকতে ভালো লাগে। তোমাদের গল্পগুলো শুনতে আর দু’একটা সস্তার খিল্লি টিল্লি করতে আমি গল্প ফাঁদার ছলনা করি। 

 চলুন, আপনাদের ঈশানীর গল্প বলি। আর তার স্কুটির পিছনে ঝুলে পড়া একটা গোবেচারা কাকতাড়ুয়ার গল্প… 

 দুটো পালিয়ে যেতে চাওয়া বিচ্ছিন্ন মানুষের গল্প। এতদিন আমি তাচ্ছিল্য ভরে চেপে রেখেছিলাম। আমি চলে যেতে দিলাম ওদের। আপনারা দেবেন না, কেমন? 

 সায়ক আমান
 ৬ই ডিসেম্বর, ২০২৩ 
 . 
 আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে 
স্বপ্ন নয়, কোন্‌ এক বোধ কাজ করে;
 স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
 হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়; 
আমি তারে পারি না এড়াতে, 
সে আমার হাত রাখে হাতে, 
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়, 
সব চিন্তা—প্রার্থনায় সকল সময় শূন্য মনে হয়, 
শূন্য মনে হয়। 
 —বোধ, জীবনানন্দ দাশ 

 Book Content

কাকতাড়ুয়া – প্রথম অধ্যায়

প্রথম অধ্যায়

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই নাদু নস্করের মেজাজটা তিরিক্ষি হয়ে গেল। বেড়ার ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসতেই চোখ কপালে উঠেছে তার। ঘরের উঠোন ছাড়িয়ে বাইরের খোলা বাগানটায় কাল রাতে যেন ছোট একটা যুদ্ধ হয়ে গেছে। কোথাও ছড়িয়ে আছে বিয়ার-হুইস্কির ফাঁকা বোতল, চিপসের প্যাকেট, কোথাও বা চাটের প্লেট গড়াগড়ি খাচ্ছে ঘাসের ফাঁকে। প্লাস্টিকের একটা চেয়ার মরা কুকুরের মতো আকাশের দিকে পা তুলে ছেতরে রয়েছে।

ভোররাতে মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছিল। এখন বাষ্পের একটা মিহি চাদর আকাশ বেয়ে নেমে আসছে এলোমেলো ঘাসের গালিচার উপরে। সেই জল বিন্দু বিন্দু হয়ে জমে আছে প্লাস্টিকের লাল টেবিল, সবজে মদের বোতল, ঝুলন্ত বাঁশপাতার গায়ে।

চাপা স্বরেই একটা খিস্তি করল নাদু নস্কর, ‘হারামির বাচ্চারা…’ তারপর লুঙ্গিটা হাঁটু অবধি তুলে বেঁধে উঠোনের বাইরে বেরিয়ে এল।

বিজলিমারি গ্রামে একটা সামারক্যাম্প চালায় নাদু নস্কর। প্রত্যন্ত গ্রাম্য এলাকায় জঙ্গলের মাঝে ছোট তিনটে কটেজ। শহর থেকে বন্ধুদের গ্রুপ কিংবা ফ্যামিলি নিয়ে এসে প্রকৃতির মাঝে দিন দুয়েকের ছুটি কাটিয়ে যাওয়ার একেবারে আদর্শ জায়গা। তাছাড়া এখানে কাছাকাছি কয়েকটা পুরোনো বাড়ির ধ্বংসাবশেষ আছে। বহুকাল হল পরিত্যক্ত হয়েছে বাড়িগুলো। বিকেল থাকতে থাকতে সেখান থেকেও ঘুরে আসা যায়। মাকড়সার জাল আর ভাঙা সিমেন্টের ফাঁকে জমা অন্ধকারে ভরে থাকে জায়গাটা। গা ছমছম করে।

তবে বিজলিমারি সামারক্যাম্পের ইউএসপি হল নৈঃশব্দ্য। দু’দিক বাঁশবনে ঘেরা। একদিকে ক্যাম্পের গেট ছাড়িয়ে কিছুদূর হেঁটে গেলেই একটা পুকুর গোছের পড়ে। পুকুরটা ছোট নয়। গঙ্গার একটা শাখা এদিকে ঢুকে আটকে গেছে। ফলে স্থির জলের নদীই বলা যায়। সেখানেই সারারাত জাল ফেলা থাকে। ভোরবেলা জাল আঁচিয়ে মাছ তুলে আনে নাদু।

এখন শীত আর বর্ষার মাঝামাঝি। পুকুর ভরাট হয়ে আছে। তবে তিনটে কটেজের মধ্যে একটা কটেজে কাল লোক ছিল না। বাকিদুটোর মধ্যে একটায় তিনটে মেয়ে ছিল। আর একটায় তিনজনের ফ্যামিলি। কাল রাত বাড়তে রুটি তরকারি খেয়ে ফ্যামিলি শুয়ে পড়েছিল, কিন্তু চ্যাংড়া মেয়ে তিনটে সারারাত মদ গিলেছে। তারপর মাতাল অবস্থায় যা করেছে তারই চিহ্ন পড়ে আছে বাইরের বাগান জুড়ে।

‘হরি, এই হরি…’ গলা তুলে ডাক দিল নাদু। পাশের বেড়ার ঘরটাতেই হরি শুয়েছিল। সকালে ঘুম ভাঙতে খানিক দেরি হয় তার। নাদু রোজই সকালে গম্ভীর ঘুমলাগা গলায় হাঁক দেয়। কিন্তু আজ সে ডাকে একটা রাক্ষুসে রাগ মিশেছিল। হরি তড়াক করে লাফিয়ে ছিটকে বাইরে বেরিয়ে এল।

কোনরকমে চোখ মুছতে মুছতে বলল, ‘আজ্ঞে…’

‘কাল কখন ঘুমিয়েছিলি?’ নাদু নস্করের গলায় চাপা রাগটা যেন দুপর্দা বেড়ে উঠেছে।

‘তা তো খেয়াল করিনি বাবু…’

‘সারারাত লণ্ডভণ্ড করেছে হারামির বাচ্চাগুলো…’ কথাটা বলেই উঠনের পাশে চিড়িক করে একদলা থুতু ফেলল নাদু নস্কর, ‘নেহাত ক’টা পয়সা দেয় বলে, নাহলে এ শালাদের…’

‘কী আর করবেন হুজুর…’ হরি কোনরকমে নাদুর রাগ প্রশমিত করার চেষ্টা করে।

‘ভবাকে নিয়ে পরিষ্কার করে দে। তারপর ছিপটা নিয়ে বেরো।’

‘ছিপ কী করব বাবু?’

‘আমার পাছায় ঢুকিয়ে দিবি শালা…’ রাগত গলায় ভর্ৎসনা করে নাদু, ‘মাছ ধরতে হবে। সকালে পুকুরের তাজা মাছ খাওয়ার বায়না আছে মহারানিদের…ধরে আনবি…’

কোমরটা সামনে এগিয়ে আড়মোড়া ভাঙে হরি, আয়েসি গলায় বলে, ‘সে তো দুপুরে, এখনও তো কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি…’

‘যা মদমুদ খেয়েছে তাতে দুপুরের আগে উঠবেও না…’

‘তাহলে একটু পরে যাই…’

নাদু আবার তিরস্কার করতে যাচ্ছিল। কী যেন ভেবে থেমে যায়। দাওয়ার উপরেই বসে পড়ে একটা বিড়ি ধরায়। তারপর একগাল ধোঁয়া ছেড়ে বলে, ‘কাল রাতে মরার মতো ঘুম হল হরি। এরা এত দক্ষযজ্ঞ করল, কিছুই বুঝতে পারলাম না…’

বিড়ির ধোঁয়াটা নাকের ডগা থেকে সরাতে সরাতে হরি বলল, ‘আমিও কখন ঘুমিয়েছি খেয়াল নেই কত্তা, তবে…’

‘তবে কী?’

‘কাল রাতে মনে হল আমার ঘরের পাশ দিয়ে কে যেন দৌড়াদৌড়ি করছে…’

নাদু মুখ বাঁকায়, ‘মদ খেয়ে লোকে কত কী করে। এরা আবার মেয়েছেলে। ছুটোছুটি করছিল হয়তো…’

‘না কত্তা, মেয়েছেলে নয়। একটা ব্যাটাছেলে। একবার ছুটে এদিক যাচ্ছে, একবার ওদিক…এত জোরে হাঁপাচ্ছে যে আমি ভিতর থেকে শুনতে পাচ্ছি…তারপর…’

‘তারপর কী?’ আবার ধোঁয়া ছাড়ে নাদু।

হরির মুখে হুট করেই ছায়া নামে, ‘ঘুম থেকে উঠে মনে ছিল না কত্তা, কিন্তু কাল রাতে কে যেন দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকছিল আমায়…খুব জোরে জোরে ধাক্কা। আমার যে কী হয়েছিল। ভয়ে আর দরজা খুলিনি…’

‘তোর দরজায়?’ নাদু ভুরু কুঁচকে জিগ্যেস করে।

হরি একটুক্ষণ কী যেন ভেবে বলে, ‘তাই তো মনে হল। তবে ঘুমের ঘোরে শুনেছি কত্তা…অন্য কারো ঘরেও হতে পারে। শুধু আমার খুব ভয় করছিল!

‘ভয়! এখানে তোর কীসের ভয়?’

হরির মুখের দিকে চেয়ে আশঙ্কা হয় নাদুর। কাল রাতে কেউ যদি সত্যি ডেকে থাকে, এবং ডাকা সত্ত্বেও হরি উত্তর না দিয়ে থাকে তবে ব্যাপারটা চিন্তার। মেয়েছেলেদের মাঝরাতে নানান রকম দরকার হতে পারে।

হাত বাড়িয়ে হরির কান টেনে ধরে নাদু, ‘তুই ব্যাটা কাল শুকনো টানিসনি তো? অ্যাঁ?’

হরি সজোরে দুদিকে মাথা নাড়ে, ‘না কত্তা, আমার পস্ট মনে আছে। রাতে খেয়ে থেকেই সরিলটা ভালো লাগছিল না। রাতের খাবার দাবার খেয়েই সোজা বিছনা নিয়েছিলুম…’

দুশ্চিন্তাটা মাথা থেকে সরানোর চেষ্টা করে নাদু, ‘তাহলে ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখেছিস। নে, কাজে লেগে পড়। মদের বোতল আলাদা রাখবি, আর বাকি যা প্যাকেট-ফ্যাকেট আছে সব ওই ডাস্টবিনের মধ্যে…তারপর ছিপটা নিয়ে…’

বাকি বিড়িটা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে উঠে পড়ে নাদু। উঠনের একধারে বেসিনের কাছে গিয়ে মুখে চোখে একটু জল দেয়। তামাটে মুখটা আয়নায় দেখে ভালো করে।

নাদুর বয়স পঁয়তাল্লিশের আশেপাশে। সংসার ধর্ম করেনি, ফলে বউ-বাচ্চার বালাই নেই। আগে কলকাতায় একটা ভাতের হোটেল চালাত সে। সেখান থেকে দু’পয়সা জমিয়ে গ্রামের দিকে এই জমিটা কিনেছিল দাম বাড়লে বেচে দেবে বলে। পুরোনো পরিত্যক্ত বাড়িগুলো নিয়ে তেমন মাথা ব্যথা ছিল না ওর। লোকে বলত ওখানে নাকি ভূত আছে। নাদু ভূতফুতে বিশ্বাস করে না। দু’পয়সা লাভের মুখ দেখবে, এই ছিল বাসনা। যতদিন না জমির দাম বাড়ছে ততদিন স্থানীয় লোকজন দিয়ে চাষবাস করাবে। বাঁধাকপি, টমেটো, সর্ষে আর আলুর চাষ শুরুও করেছিল। তবে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন খেয়াল চাপল মাথায়। চাষের জমি বাদ দিয়েও আরও পাঁচ ছটাক জমি খালি পড়েছিল নাদুর। ভাবে সেখানে একটা সামারক্যাম্প করলে কেমন হয়?

প্রথমে মাসদুয়েক তেমন লাভ হয়নি নাদুর। হতাশ হয়ে কটেজ বন্ধ করবে ঠিক করেছে এমন সময় শীত পড়তেই লোকজনের আনাগোনা শুরু হল। একে এমন রিমোট লোকেশন, তার উপরে নিস্তব্ধতার বাঁশপাতার হাহাকার শুনতে, খেতের টাটকা সবজি আর পুকুরের তাজা মাছ খেতে উৎসাহী লোকজনের বুকিংয়ে কলে ভরে যেতে লাগল হরির খাতা আর নাদুর পকেট। তবে এখানে ভূতের বাড়ি আর নিরিবিলিতে মদের লোভে চ্যানকা ছেলেমেয়েদের উৎপাতই বেশি। ভাতের হোটেল লিজে দিয়ে আপাতত এখানে এসেই ঘাঁটি গেড়েছে নাদু।

উঠোনের একদিকে একটা লম্বা দড়ি ঝুলছে। রাতে সেই দড়িতেই জামাপ্যান্ট মেলে দিয়ে লুঙ্গি পরে ঘুমাতে যায় নাদু। একবার পেট চুলকে নিয়ে দড়ি থেকে টেনে ফতুয়াটা গায়ে চাপায় নাদু। প্যান্টের জন্য হাত বাড়াতে গিয়েই থেমে যায়। আশ্চর্য! স্পষ্ট মনে আছে কাল রাতে দড়িতেই প্যান্টটা ঝুলিয়ে ঘুমাতে গেছিল, এখন উধাও!

চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়েও প্যান্টটাকে দেখতে পায় না নাদু। খানিক বিরক্ত হয়ে হাঁক দেয়, ‘এই হরি…’

বিড়িতে সুখটান দিতে ব্যস্ত ছিল হরি, সে পেছন না ফিরেই উত্তর দেয়, ‘আজ্ঞে বাবু…’

‘আমার প্যান্টটা দেখেছিস? কাল রাতে এইখানে ঝুলছিল…’

হরি দু’দিকে মাথা নাড়ায়, ‘দেখিনি তো বাবু…’

ভুরু কুঁচকে একবার বিড়বিড় করে নাদু নস্কর। তবে কি মদের নেশায় মেয়েছেলেগুলো সেটাও টেনে নিয়েছে? আবার চাপা স্বরে একটা খিস্তি করল নাদু।

ওর দিকে চেয়ে একবার হাসে হরি, হাতের বিড়িটা ছুড়ে ফেলতে ফেলতে বলে, ‘মেয়েছেলে আপনার প্যান্ট নিয়ে আর কী করবে বাবু? দেখুন কুকুর-টুকুরে টেনে নিয়ে গেল কিনা…’

কথাটা মন্দ বলেনি হরি। কিন্তু উঠোনের দড়িটা বেশ উঁচুতে। সাধারণ কুকুরের পক্ষে কি অতটা উঁচুতে নাগাল পাওয়া সম্ভব? অবশ্য কোনওভাবে যদি মাটিতে পড়ে গিয়ে থাকে তাহলে…

‘তুই বোতলগুলো তুলে নিয়ে বাগানটা পরিষ্কার কর, আমি খেতটা একবার দেখে আসি…’

ঘাড় নেড়ে সিঁড়ি থেকে উঠে পড়ে হরি। নাদু নস্কর কপালে ভ্রুকুটি নিয়েই খেতের দিকে এগিয়ে যায়।

চোখ খুলতেই শরীরটাকে অসম্ভব ভারী মনে হল ঈশানীর। মাথার দুপাশ থেকে যেন চেপে ধরে আছে কেউ। উপরে পাখাটা অদৃশ্য হয়ে ঘুরছে অথচ একটুও হাওয়া এসে লাগছে না গায়ে। সমস্ত শরীরে একটা ভিজে অনুভূতি।

দশ সেকেন্ড সেই ভাবেই পড়ে রইল ঈশানী। মাথাটা কাজ করতে সময় লাগবে। একটু জল খাওয়া দরকার। গলাটা শুকিয়ে এসেছে।

কোমরের উপর ভর দিয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতেই কাল রাতের ঘটনাটা আবছা ছবির মতো ফুটে উঠল মাথার ভিতর। কোনরকমে খাটের একটা দিক ধরে উঠে বসল।

যদ্দূর মনে পড়ছে কাল রাতে বেহেড হয়ে মদ খেয়েছিল ওরা তিনজন। তারপর কী হয়েছে, কোথায় হয়েছে, কে কী করেছে কিছুই মনে নেই। রয়ে গেছে কেবল মাথা ধরিয়ে দেওয়া অসম্ভব হ্যাংওভার, আর গলার ভিতর একটা বিশ্রী স্বাদ।

মুখের উপর একবার হাত বুলিয়ে নেয় ঈশানী। হুইস্কির গন্ধ ম-ম করছে ঘরের ভিতর। সম্ভবত কোথাও মদের বোতল উলটে রয়েছে। আশেপাশে তাকিয়ে বিছানায় কাউকে দেখতে পেল না ঈশানী। ব্যাপার কী? গার্গী আর অভিরূপার তো এখানেই থাকার কথা। কাল রাতে ওরা বাইরেই ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি? তাহলে তো ঠান্ডা লেগে আর রক্ষা থাকবে না।

মুখ বাড়িয়ে মেঝের দিকে তাকাল ঈশানী, এবং তাকাতেই একটা শরীর চোখে পড়ল। গার্গী উল্টে মেঝের উপর পড়ে রয়েছে। টি-শার্টটা পেট অবধি, মাথার পাশে একটা ফাঁকা বিয়ারের ক্যান গড়াগড়ি খাচ্ছে, এলোমেলো চুল দিয়ে মুখটা ঢাকা। একটা হাত পাশে আর একটা হাত উপরের দিকে করে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। অভিরূপার চিহ্ন নেই।

বালিশটা কোলের উপরে রেখে উঠে বসল ঈশানী। মেয়েটা সাতসকালে উঠে কি বেরিয়েছে কোথাও?

তাই বা কী করে হয়? কাল রাতে ও-ই সব থেকে বেশি মদ খেয়েছিল। এমনিতেই বেলা ন’টার আগে ঘুম থেকে ওঠে না। কাল অমন উদ্দাম একটা রাতের পর…

ঘুম চোখে দরজার দিকে একবার দেখল ঈশানী। নাঃ, কাল রাতে দরজা বন্ধ করেছিল কিনা মনে পড়ল না। সত্যি কথা বলতে কাল রাতের ঘটনা কেবল ক’টা ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যের মতো মাথার মধ্যে ভেসে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে। সেগুলোর দিকে মন দিতে ইচ্ছা করল না ওর।

কিছুক্ষণ কপালে হাত দিয়ে বসে রইল ঈশানী। ফোনটা চেক করল। নাঃ, বাড়ি থেকে কোনও কল আসেনি। ফেসবুকের কয়েকটা নোটিফিকেশন এসেছে বটে। কিন্তু সেগুলো এখন না দেখলেও চলে।

পা বাড়িয়ে খাট থেকে নেমে এল ঈশানী। ঘুমন্ত গার্গীর কাঁধে পা দিয়ে একটা ঠেলা দিল, ‘ওঠ ভাই, সকাল হয়েছে…’

গার্গী দুবার গোঁ গোঁ করল, তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘মনিশ আমাকে খেয়ে ছেড়ে দিল…’

‘মরে যা শুয়োরের বাচ্চা…’

পায়ের ঠেলায় ওকে মেঝের একদিকে করে দিয়ে দরজাটা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াল ঈশানী। চারপাশটা ভালো করে দেখল।

বেলা হতে নরম একটা রোদ উঠেছে। এই শীতকালে সেটা মন্দ লাগছে না। বাইরের বাগানের ধার দিয়ে ফুটে থাকা হলদে ফুলগুলো মাথা দোলাচ্ছে তাতে। বাসি মদের গন্ধটা কেটে যাওয়ায় বুক ভরে একটা নিঃশ্বাস নিল ঈশানী। মনের ওজন খানিক হালকা হল তাতে।

উঠোন জুড়ে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কেয়ারটেকার লোকটার ঘরের দরজাটা খোলা। সম্ভবত একটু আগে বেরিয়ে গেছে কোথাও। গাটা শিরশির করল ঈশানীর। সাতসকালে ওরা দুজন ছাড়া সবাই উধাও হল কোথায়?

‘অভি, এই অভি…’ গলা তুলে একবার ডাকল ঈশানী। কোনও উত্তর এল না। রিমঝিম হাওয়া বইছে জায়গাটা জুড়ে। সেই হাওয়ার সঙ্গে মিশে বাঁশপাতার আওয়াজ শোনা গেল কেবল। শির-শির-শির। কে যেন হাহাকার করে কাঁদছে জঙ্গলের মধ্যে থেকে।

ঘাড় চুলকাতে চুলকাতে আবার ঘরের ভিতর এসে বসে পড়ল ঈশানী। এতক্ষণে তন্দ্রাটা ভেঙেছে গার্গীর। সে হাত দিয়ে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বলল, ‘কাল রাতে কি একটু বেশিই বাওয়াল হয়ে গেছে ভাই?’

‘কী করে বুঝলি?’

ফাঁকা বিয়ারের ক্যানটা পরীক্ষা করে ছুড়ে ফেলে দেয় গার্গী, ‘শালা কিছুই মনে পড়ছে না…’

‘মনে যখন পড়ছে না তখন আর চিন্তা কী…’

গার্গী জিভ দিয়ে একটা আওয়াজ করে, ‘আগেই বলেছিলাম বালগুলো, রাম খা, রাম খা। তোর ওই এক জেদ—হুইস্কি ছাড়া খাবি না, আর সকালে হ্যাংওভারে মরবি। তোর দেখাদেখি অভিটাও…’ কথা শেষ না করে ঘরের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয় গার্গী, ‘মালটা সাতসকালে গেল কই?’

‘বাইরে তো নেই দেখলাম। ফোনটাও ফেলে গেছে।’

‘ফেলে যায়নি। কাল থেকে ওখানেই রাখা আছে।’

ঈশানীর ভুরু কুঁচকে যায়, ‘ফোন না নিয়ে মাল কোথাও যাবে বলে তো মনে হচ্ছে না। ব্রেক আপ হওয়ার পর থেকেই…’

ভাবনাটা মন থেকে সরানোর চেষ্টা করে ঈশানী, ‘মাথাটা ধরে আছে, চ, বাইরে থেকে ঘুরে আসি একটু…’

গার্গী মেঝে থেকে উঠে পড়ে। কাল রাতে যদ্দূর মনে পড়ছে বাইরের মেঝেতেই শুয়ে পড়েছিল ও। তারপরে ঈশানী না হলে অভিরূপা টানতে টানতে ওকে ঘরের ভেতর নিয়ে এসেছিল। রাতের স্মৃতিগুলো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আছে। ঠিক কী ঘটেছিল মনে নেই। একটা ছেলের গলা পেয়েছিল কি?

বড় করে নিঃশ্বাস ফেলল গার্গী। কাল সত্যি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে।

ঈশানী গার্গী আর অভিরূপা তিনজনেই একেবারে ছোটবেলার বন্ধু। এমনকী স্কুল আর কলেজও এক। তিনজনেরই বাড়ি উত্তর কলকাতার প্রায় একই জায়গায়। কলেজ থেকে বেরোনোর পর তিনজনের নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হয় না। তাই মাঝে মধ্যে সুযোগ পেলেই এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়ে ওরা।

তবে এবারের অভিযানের অন্য কারণ আছে। ওদের মধ্যে অভিরূপা সব থেকে বড়লোক। বাঁকুড়ার কাছে প্রায় জমিদারি গোছের একটা ব্যাপার আছে ওদের। অঢেল টাকা। আগে বাবা-মাও এখানে থাকত। বছরপাঁচেক আগে তারা বাঁকুড়া চলে যাওয়াতে ও ওর দাদা তন্ময়ের সঙ্গে কলকাতার ফ্ল্যাটে থাকে। ক’দিন আগে হুট করেই মাথায় কী ভূত চাপতে অভিরূপা ঠিক করেছে কলকাতা ছেড়ে বাঁকুড়া চলে যাবে বাবা-মায়ের কাছে। ফলে এরপর দেখা কবে হবে, তার ঠিক নেই। তাই এই ট্রিপটা অভিরূপাই স্পন্সর করেছে।

একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে ঈশানী। হাত দুটো মাথার উপরে তুলে একবার শরীর বাঁকিয়ে আড়মোড়া ভাঙে। যেটুকু মনে আছে তাতে কাল রাতে মদ খেয়ে আগুনের ধারে উদ্দাম নাচছিল ওরা। যত রাত বাড়ছিল তত বাড়ছিল ওদের নাচের ধুম। তারপর কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল…

একসময়ে খোলা মাঠের উপরে শুয়েছিল ঈশানী। শনশন করে হাওয়া বয়ে আসছিল কোথা দিয়ে যেন। তারপর অভিরূপাই বোধহয় হাত ধরে টেনে কোথায় একটা নিয়ে গেল ওকে।

মুখে রোদ লাগতে মনটা একটু হালকা হল গার্গীর। কাল রাতের কথা মনে করার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে একটা কথা মাথায় আসতেই অবাক হল ও। যে ছেঁড়া ছেঁড়া ছবিগুলো মাথায় জাগছে তার মধ্যে একটা ছবি ভারি অদ্ভুত। ওর মাথার উপরে খোলা আকাশ। অসংখ্য তারা জেগে আছে সেই আকাশে। দু’একটা বাদুড় উড়ে গেল কি? আকাশটা যেন হঠাৎই চলতে শুরু করল…

মনে মনে ভাবল গার্গী, সোজাসুজি আকাশ দেখতে পাচ্ছে মানে ও মাটির উপরেই শুয়ে আছে। কিন্তু আকাশ কি এভাবে সরে যেতে পারে? মদের ঘোরে এতটা ভুল দেখল ও?

এগিয়ে এসে বেতের ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ডাক দিল ঈশানী, ‘দাদা, শুনছেন?’

ভিতর থেকে কোনও আওয়াজ আসে না। গার্গী এসে দাঁড়ায় ওর পেছনে, ‘সকাল সকাল সব গেল কোথায়?’

ওর দিকে ফিরে তাকায় ঈশানী, ‘কাল রাতে তুই মেঝেতে পড়েছিলি, আমি কোথায় ছিলাম মনে আছে তোর?’

নিজের মাথার চুল খামচে ধরে গার্গী, ‘কী জানি। সব গুলিয়ে আছে মাথার ভিতর। এটুকু মনে আছে কেউ একটা আমাকে টেনে টেনে ঘরের ভিতর…’

হঠাৎ গার্গীর মাথার ভিতর একটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়ে যায়। কাল রাতে আকাশটা সরে যাচ্ছিল না, ও নিজেই আকাশের দিকে চিৎ হয়ে সরে যাচ্ছিল। অর্থাৎ কেউ ওকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।

কে হতে পারে? অভিরূপা বা ঈশানী এদের দুজনের কারোরই গায়ে এত জোর নেই যে ওকে পাঁজাকোলা করে সরাতে পারে। তাহলে?

‘আমার মনে হচ্ছে কাল রাতে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। আমাদের এতটা নেশা হওয়ার কথা নয় যে সব ভুলে যাব…’ ঈশানীকেও উদ্ভ্রান্ত দেখায়।

‘তোর কী মনে হচ্ছে?’ ঈশানীর দিকে আর একটু সরে আসে গার্গী।

ছিপের ডগায় চার লাগিয়ে পুকুর ধারে বসেছিল হরি। গুনগুন করে হিন্দি ফিল্মের সুর ভাজছে। এ পুকুরে মাছের অভাব নেই। তবে অন্যান্য মাছের সঙ্গে ছোটখাটো মাছও বিস্তর আছে। সেসব উঠে আসলে বঁড়শি খুলে আবার পুকুরে ফেলে দিতে হয়। পুকুরের ধারে ছিপ ফেলে বসে আছে তাও নয় নয় করে মিনিট কুড়ি হয়ে গেছে। এখনও ছোট কী বড় একটাও মাছ ওঠেনি। ব্যাপার কী? পুকুরের সব মাছ গেল কোথায়?

হরির এই খিদমতের কাজ করতে ভালো লাগে না। ওর বাবুর না হয় ঘর সংসার নেই। এই আদাড়েবাদাড়ে ঠাঁইনাড়া হয়ে পড়ে থাকতে অসুবিধা হয় না। কিন্তু ওর নিজের বউয়ের জন্য মাঝেমধ্যেই মন কেমন করে। সবে বছরখানেকও হয়নি বিয়ে করেছে। ফোনে ফোনে কথা বলে কি আর মনের খচখচানি কমে? হরি ঠিক করেছে আর মাসখানেক এই ঝামেলা সামলে পকেটে দুটো টাকা জমিয়ে শহরে পাড়ি দেবে। তারপর বাবু এক হাতে এই ভূতের বোঝা সামলাক।

গুনগুন করে সুরটা ভাজতে ভাজতে হঠাৎ একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ করে হরি। পুকুরের একেবারে ভিতরের দিকে এক জায়গায় যেন অনেকগুলো মাছ একসঙ্গে জড় হয়েছে। বড়বড় ঢেউ খেলছে সেখানে। বুদবুদ উঠছে। অনেক মাছ এক জায়গায় হলে এমনটা হয়ে থাকে।

হঠাৎ মাছগুলো পুকুরের ওখান থেকে জমা হচ্ছে কেন? আছে কী ওখানে? হরির মনের মধ্যে একটা চাপা কৌতূহল হয়। কাল রাত থেকেই কী যেন কারণে ওর মনের ভিতরে একটা আশঙ্কার মেঘ উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। কাল রাতটা যেন অন্য রাতের মতো ছিল না একেবারে।

কৌতূহলটা গলা চেপে ধরতেই জল থেকে ছিপটা তুলে পাশে সরিয়ে রাখে হরি। জামাটা খুলে পাশে রেখে ঘাটের সিঁড়ি ছাড়িয়ে জলের মধ্যে নেমে আসে।

পুকুরের জল খুব একটা গভীর নয়। সোজা হয়ে দাঁড়ালে বড়জোর গলা অবধি আসে। তার ওপর নিচের মাটি শক্ত গোছের। ফলে নির্ভয়ে জল কাটিয়ে ও কিছুদূর এগিয়ে আসে।

দাঁড়িয়ে থাকা জল বলে মাঝে মধ্যেই কচুরিপানা এসে জমা হয় জলের উপর। মাঝে মাঝে আগাছায় পা আটকে যায়। সেসব পাশ কাটিয়ে জল ঠেলে সেই তরঙ্গ লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় হরি। ওর ঠোঁটের কোণে গানের সুরটা থেমে গেছে এখন। একটা খাঁ-খাঁ নিস্তব্ধতা খেলা করছে পুকুরের উপরে। যেন এক্ষুনি কিছু একটা হবে।

কাছে আসতেই তরঙ্গগুলো কিছুদূর সরে যায়। অর্থাৎ ওর আসার সংকেত পেয়ে মাছগুলো যে যেদিকে পেরেছে ছুটে পালিয়েছে। কৌতূহলটা বেড়ে ওঠে হরির। সাতসকালে জলের মধ্যে কী থাকতে পারে যার জন্য মাছেদের মধ্যে এমন ছটাফটানি ঘটবে!

জল কাটিয়ে আরও কিছুটা এগোতেই একটা শীতল স্পর্শ লাগে হরির পায়ে। কোনও বড়সড় মাছ এসে ধাক্কা খেয়েছে ওর পায়ে। স্যাঁতস্যাঁতে স্পর্শটা। নিচের দিকে চেয়ে ঘোলাটে জলের ভিতরে কিছু দেখতে পায় না হরি। জলের ভিতর হাত বাড়িয়ে মাছটাকে উপরে তুলে আনবার চেষ্টা করে। কিন্তু মাছের আকৃতি তো এরকম…

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে হাতে যেটা উঠে আসে সেটা দেখে আতঙ্কে গলা দিয়ে একটা তীব্র চিৎকারের শব্দ বেরিয়ে যায়। হাতটা অবশ হয়ে আসে হরির।

একটা মানুষের পা! সারারাত জলে ভিজে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। সমস্ত চামড়া কুঁচকে ঠিক মাছের আঁশের মতোই দেখাচ্ছে।

হাতে সাড় ফিরতেই ছিটকে আসে হরি। মস্তিস্কের কুঠুরিতে হঠাৎ করেই আবার রক্ত সঞ্চালন শুরু হয়েছে ওর। মনে হচ্ছে পায়ের সঙ্গে সঙ্গে হাত দুটোও যেন আঁকড়ে ধরবে ওর পা।

‘লাশ…লাশ…’ চিৎকার করে ওঠে হরি। জল থেকে ওঠার শক্তিও লোপ পেয়েছে ওর।

একরকম জোর করেই বুকের ভিতর কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে হরি। আরও দুপা এগিয়ে যায় আসে। ধীরে ধীরে বাকি শরীরটা উঠে আসে জলের উপরে। সারারাত জল খেয়ে ভিতর থেকে ফুলে উঠেছে মানুষটা। তাও টি শার্টের রং আর মুখের অবয়ব দেখে মানুষটাকে চিনতে পারে হরি।

যে তিনটে মেয়ে ওদের ক্যাম্পে আছে তাদের মধ্যে একজন। কোনরকমে বুকে সাহস আনার চেষ্টা করে সে। কাল রাতে মদ খেয়ে কোনওভাবে জলে ডুবে মরেছে মেয়েটা। ওর বুকের ভিতরে শীতল আতঙ্কটা কিছুটা কমে আসে। মেয়েটা মরে গেল! কী হবে এবার? যদি পুলিশ ওকেই…

অবশ্য মেয়েটা তো মদ খেয়ে জলে ডুবে মরেছে। বড়জোর ক’দিনের একটা হুজ্জুতি হবে। বাকি ঝামেলা বাবু বুঝবে।

মেয়েটার শরীরটা ভেসে উঠতেই ওর মুখের দিকে একবার চোখ পড়ে হরির। দুটো চোখ খোলা। তীব্র আতঙ্কে যেন আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে মেয়েটা। নীলচে আকাশে কাউকে বুঝি খোঁজার চেষ্টা করছে। সেই বিস্ফারিত চোখের দিকে চোখ পড়লে ভয় লাগে। হরি চোখ নামিয়ে নেয়। গলার উপর দৃষ্টি নেমে আসে ওর। আর আসতেই ও থমকে যায়…

মেয়েটার গলায় কয়েকটা কালশিটের দাগ। ভালো করে তাকালে বোঝা যায় শক্ত হাতে গলা টিপে খুন করা হয়েছে মেয়েটাকে।

খেতের এদিক-ওদিক বেশ খানিকক্ষণ ধরে খোঁজাখুঁজি করেও প্যান্টের হদিশ পায় না নাদু নস্কর। মাথাটা আরও গরম হয়ে ওঠে ওর। একদিকে সর্ষেখেত হলদে সবুজ রঙে ঢেকে আছে। তার পাশেই বাঁধাকপির চাষ হয়েছে, সেটা পেরোলে টমেটো। সমস্ত জায়গাটা ভরে আছে সকালের ঝকঝকে রোদে। আল ধরে হেঁটে গোটা জমিটার উপরেই একবার টহল দিয়ে আসে নাদু নস্কর।

নাঃ, ও প্যান্ট উদ্ধারের আশা এবার ত্যাগ করা ছাড়া গতি নেই। হতাশ হয়ে একটা দীর্ঘশাস ফেলে এগোতে যাবে নাদু, এমন সময় পুকুরের দিক থেকে একটা চিৎকার ভেসে আসে। হরি চিৎকার করছে। ব্যাপার কী? বড়সড় কোনও মাছ উঠেছে নাকি!

নাদু হাসে। মেয়েগুলোর ভাগ্য ভালো। ভালো দিনেই মাছ খাওয়ার সাধ জেগেছে ওদের।

খুশি খুশি মনে সেদিকে এগোতে যেতেই একটা অদ্ভুত জিনিস খেয়াল হল নাদুর। কী যেন একটা নেই জায়গাটায়। কালও ছিল অথচ আজ ওর চাষের জমি থেকে কিছু একটা গায়েব হয়েছে।

একটু ভাবতেই জিনিসটার কথা মনে পড়ল নাদুর। ও এখানে চাষবাস শুরু করতেই কাকের উৎপাত হয়েছিল কিছুদিন। খেতের কাঁচা বাঁধাকপি টমেটো মাঝেমধ্যেই ফাঁকা করে দিয়ে যেত তারা। ফলে ক’দিন জোগাড়যন্ত্র করে একটা কাকতাড়ুয়া লাগিয়েছিল।

সেটা লাগাতেই ম্যাজিকের মতো কাজ হয়। কাক তো দূরের কথা একটা সাধারণ পোকামাকড় অবধি এ জমির ত্রিসীমানায় আসে না। ফলে সেটার দিকে এতদিন তেমন একটা নজর দেয়নি নাদু। অবহেলায় খেতের মাঝখানে তেমনই ঠায় দাঁড়িয়েছিল।

আজ অবাক হয়ে নাদু নস্কর লক্ষ করল—খেতের মাঝখান থেকে গোটা কাকতাড়ুয়াটা গায়েব হয়েছে। যেন নিজে পায়ে হেঁটেই কোথাও চলে গেছে সে…

কাকতাড়ুয়া – 2 অধ্যায়

দ্বিতীয় অধ্যায়

পানের দোকানটা ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে আসতেই একটা লাল স্কুটি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল তুহিরণ। রেলস্টেশন থেকে নেমে রিকশা করেই এতদূর এসেছে। এরপর থেকে নাকি আর রিকশা যাবে না। রাস্তায় কীসব কাটাকাটির কাজ হচ্ছে।

পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল ও। স্কুটির উপরে একটা মেয়ে বসে আছে। মাথা হেলমেটে ঢাকা থাকলেও দেখে বোঝা যায় ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

একটু ইতস্তত করে হাত তুলে ইশারা করল তুহিরণ। মেয়েটার শরীরে কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না। তার গায়ে একটা স্যন্ডো গেঞ্জি গোছের কালো জামা, তার সঙ্গে বারমুডা হাঁটুর একটু নিচ অবধি নেমেছে। তুহিরণকে হাত তুলতে দেখে স্কুটিটা চালিয়ে ওর কাছাকাছি এসে পড়ল মেয়েটা।

গুটিগুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেল তুহিরণ। মেয়েটা হেলমেট না খুলেই জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার নাম তুহিরণ সেন?’

‘ইয়ে…হ্যাঁ…’

‘মেয়ে দেখতে এসেছেন?’

একটু অপ্রস্তুতে পড়ল তুহিরণ। প্রশ্নটা শুনলেই কেমন জানি গা শিরশির করে। হালকা খোঁচা ছিল কি? ও কী বলবে ভেবে না পেয়ে একটা বোকাবোকা কায়দায় ঘাড় নেড়ে দিল।

স্কুটির ব্যাকসিটটা দেখিয়ে মেয়েটা বলল, ‘এত লজ্জা পাওয়ার কী হয়েছে? মেয়েই তো দেখতে এসেছেন, বাইজি নাচ তো দেখতে আসেননি…উঠে পড়ুন।’

তুহিরণের অপ্রস্তুত ভাবটা আরও বেড়ে গেল, ‘না, আমি মানে…অন্য কিছুতে যদি…’

‘পেছনে টোটোতেও যেতে পারেন। সাতজন না হলে ছাড়বে না। আধঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে।’

‘না, ঠিক আছে। আমার কোনও অসুবিধা নেই…’ না চাইতেও কথাটা বেরিয়ে গেল তুহিরণের মুখ দিয়ে।

মেয়েটা স্কুটি ঘুরিয়ে নিতে ওর পেছনের সিটটায় উঠে বসল সে। গুমগুম শব্দ করে স্কুটি স্টার্ট দিল।

মেয়েটা মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় এই প্রথম তাকে ভালো করে দেখার সাহস পেল তুহিরণ। রোগাটে ছিপছিপে চেহারা। ডান হাতের কবজির কাছে দুটো লাল তাগা জড়ানো। মাথার চুল হেলমেট ছাড়িয়ে পিঠের মাঝ বরাবর নেমেছে। গায়ের রং ফর্সার দিকে। বারমুডার দিকে ভালো করে তাকালে বোঝা যায় স্কেচ পেন দিয়ে কীসব আঁকা হয়েছে তার উপর। নড়বড়ে আঁকা নয়, পাকা হাতের কাজ।

এর আগে বাড়ির চাপে পড়ে কয়েক জায়গায় মেয়ে দেখতে গেছে তুহিরণ। তার মধ্যে কোথাও ওকে স্কুটিতে করে কেউ নিতে আসেনি। এখানে অবশ্য মা-বাবা আগেই দেখে গেছে। পছন্দ হওয়ায় ও নিজেই দেখতে এসেছে। বিশেষ করে মেয়েটার মুখশ্রীটা নাকি ভারি মিষ্টি। তবে ট্যাঁকট্যাঁক করে দু’কথা শুনিয়ে দিতেও ছাড়ে না। সব মিলিয়ে একটা টু-ইন-ওয়ান ফ্লেভার আছে। বাড়ির লোকও আসতে চেয়েছিল, কিন্তু মা-বাবার সামনে ওর একটু লজ্জা লজ্জাই লাগে। একা আসায় সেইসব বালাই নেই।

তাও অস্বস্তিটা রয়েই যায় তুহিরণের। সেটা কাটানোর জন্য সে আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করে, ‘আমি কিন্তু নিজেই চলে যেতে পারতাম, আপনার আবার…’

‘তাতে এক্সট্রা লাভ কিছু হত না। আপনি তো আর গাড়ি নিয়ে আসেননি, যে মেয়েপক্ষ দেখে হ্যাল খেয়ে যাবে…’

আবার বোধহয় খোঁচা দিচ্ছে মেয়েটা। একটু অসন্তুষ্ট হয় তুহিরণ, বলে, ‘হঠাৎ আপনাকে আনতে পাঠিয়েছে যে, বাড়িতে আর কেউ ছিল না?’

মেয়েটা আগের মতোই নিঃস্পৃহ গলায় বলে, ‘মেয়ের বাবার ক্যানসার। মা বাতের রোগী। আত্মীয়স্বজন, বুঝতেই পারছেন আসতে আসতে আপনার কানে ফুসমন্তর দেবে, ছেলেবন্ধু কিছু আছে, তারা এলে আপনার আবার মেল ইগোয় সুড়সুড়ি ধরবে, নিতে আসার মতো বাড়িতে কেউ নেই। অগত্যা…’

‘কেউই নেই বাড়িতে দেখছি, মেয়ে নিজে আছে তো?’ প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গের সুরেই বলে সে।

‘আজ্ঞে না।’

‘সে কী? আমি তো বলেই এলাম। কোথায় গেল?’ এবার সত্যিই রাগ হয় তুহিরণের।

‘আপনাকে নিতে।’

উত্তরটা বুঝতে একটু সময় নেয় সে। তারপর তুতলে বলে, ‘তা…তার মানে আপনি…’

স্কুটি চালাতে চালাতেই একহাতে হেলমেটটা খুলে ফেলে ঈশানী। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই সেটা পেছনে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা ধরুন তো। বেশিক্ষণ পরে থাকলে শালা মাথা কুটকুট করে…’

‘কিন্তু আপনি নিজেই আমাকে…’ তুহিরণ খাবি খায়।

‘আরে ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিতে বলছি না। হেলমেটটা ধরতে বলেছি শুধু।’

তুহিরণ আর কথা না বাড়িয়ে হেলমেটটা পায়ের উপর চেপে ধরে বসে। এতক্ষণ চুইংগাম গোছের কিছু চেবাচ্ছিল ঈশানী। সেটা ফুঁ করে কিছুটা দূরে ছুড়ে ফেলে দেয়। তুহিরণ লক্ষ করে কপালের আড়াআড়ি একটা ফেট্টি বাঁধা আছে তার। মুখটা ভারি নরম গোছের। রোগাটে চেহারায় গোল পাতার মতো মুখ আর পুরু ঠোঁট দিব্যি মানিয়েছে। চলন্ত স্কুটির দু’টো হ্যান্ডেল থেকে হাত তুলে নিয়ে হাওয়া আড়াল করে একটা সিগারেট ধরায় মেয়েটা। সেটাতে একটা টান দিয়ে বলে, ‘আপনি পার্টি করেন?’

‘পার্টি বলতে ওই বন্ধুরা ডাকাডাকি করলে মাঝেমধ্যে। বা ধরুন অফিসে…’

‘আরে ধুর মরা, সে পার্টির কথা বলছি না। সিপিএম তৃণমূল কিছু করেন না?’

‘আমি ঠিক রাজনীতির ব্যাপারটা…’

‘ব্যাস, হয়ে গেল, ফোর নাইন্টিএইট এ…’ মেয়েটা হতাশ গলায় বলে।

‘মানে?’

‘মানে আর কী, আগে লোকে আদর্শ ফাদর্সর জন্য পার্টি করত। এখন সন্ধেবেলা একটু গালাগাল দেওয়ার জন্য করে। মানে আপনি সিপিএম হলে তৃণমূলকে, তৃণমূল হলে সিপিএমকে সন্ধেবেলা একটু খিস্তিখামারি করে গা গরম করা আর কী। বা ধরুন সপ্তাহে একদিন পাড়ার মোড়ে একটু ক্যালাকেলি। যারা পার্টি করে না তারা খিস্তানোর লোকও পায় না। তারা বউ, প্রেমিকা কিংবা ধরুন ছেলেমেয়েকে ধরে ক্যালায়। মানে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স, মানে ফোর নাইন্টিএইট এ…’

তুহিরণের হাসি পায়। মেয়েটা মজাদার। এতক্ষণ ধরে কথা বলছে অথচ মুখটাই ভালো করে দেখা হয়নি। সে সামনের আয়নায় উঁকি মারার চেষ্টা করে ভালো করে মেয়েটার মুখ দেখবে বলে। পরক্ষণেই ভয়ে মুখ সরিয়ে নেয়। মেয়েটা দেখতে পেলেই চিত্তির।

‘বডি কাউন্ট?’

‘ইয়ে…কার বডি?’

মেয়েটা এবার আরও বিরক্ত হয়, ‘ধুর বালটা। বলছি সেক্স টেক্স করেছেন কিছু?’

এমন কিম্ভূত প্রশ্নের জন্যও তৈরি ছিল না তুহিরণ, ঢোঁক গিলে বলে, ‘ওটা…মানে…’

‘এত লজ্জার কী আছে বলুন তো? আমি করেছি। তবে কিসটা করিনি বুঝলেন, ওই এক সমস্যা আমার। করতে গেলেই মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাবে…কানাডার এক মহিলা ক্রিস্টিনা ডিফোরজেস কিস করতে গিয়ে দম আটকে মারা গেছিলেন, জানেন?’

‘তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ, মহিলার পি-নাট বাটারে এলার্জি ছিল। এদিকে বাঞ্চত বয়ফ্রেন্ডটা সেই খেয়ে এসেছে কিস করতে। ব্যাস, ওই গন্ধে এলার্জি, সেই এলার্জি থেকে শ্বাসকষ্ট তারপর খাল্লাস…সেই থেকে শালা হেব্বি ভয় ধরে গেছে আমার…’

কী বলবে বুঝে পায় না তুহিরণ, ‘আপনি এত কিছু জানলেন কেমন করে বলুন তো?’ সে সোজা হয়ে বসতে বসতে জিগ্যেস করে।

‘একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল…’ সিগারেটে একটা টান দেয় ঈশানী, ‘শালা টক্সিক মাকাল ছিল শুয়োরের বাচ্চাটা। তিন বছর ধরে জ্বালিয়ে খেয়েছে…’ কথাটা বলেই ধোঁয়া ছাড়ে সে, ‘বা শুধু জ্বালিয়েছে বলতে পারেন। খাওয়ার মতো দম ও মালের বান্টুতে নেই। কী জানেন, যারা মুখে বেশি বাঘ মারে তারা বিছানায় কিছুই মারতে পারে না…আপনি মারবেন?’

‘অ্যাঁ? মানে আমি…’ খাবি খায় তুহিরণ।

‘আহা কাউন্টার, নিন নিন…’

হেসে মাথা নাড়ে তুহিরণ, ‘না, না আমার কাছে আছে…’

মেয়েটা এগিয়ে দেওয়া সিগারেট ধরা হাতটা আবার গুটিয়ে নেয়, ‘আপনার এত নেকুপুসু মডেস্টি মারানোর কী আছে কে জানে, এমনিও তো বিয়ে হবে না। কী করবেন ফালতু এসব করে?’

‘বিয়ে হবে না জানলেন কী করে?’

‘সিম্পল, আমার আপনাকে পছন্দ হয়নি।’

‘তাহলে নিয়ে যাচ্ছেন কেন?’

‘আপনি যেতে চাইছেন তাই।’

‘বেশ, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি আমার ইচ্ছা নেই।’

মেয়েটা কাঁধ ঝাঁকায়, ‘তাতে লাভ নেই।’

‘লাভ নেই কেন?’

মেয়েটা এতক্ষণে স্কুটির গতি একটু কমিয়েছে, গলা তুলে বলে, ‘আপনার কী মনে হয় আপনাকে মেয়ে দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?’

‘হচ্ছে না?’

‘আজ্ঞে না, নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাকে ভয় দেখানোর জন্য।’

‘কীসের ভয়?’

ধোঁয়ার রিং ছাড়ে ঈশানী, ‘দেখুন আমি কলেজ পাশ করেছি নয় নয় করে বছরচারেক হতে চলল। বাবার ক্যানসার, মা পেনসনের অল্প কিছু টাকা পায়, তাও লোকাল বদ্দাদের কাটমানি দিয়ে। এখন আমার উচিত একটা চাকরি-বাকরি করে সংসারে দুটো পয়সা দেওয়া। বাবার একটা অপারেশন হওয়ার কথা আছে। পয়সার অভাবে সেটাও দিনের পর দিন পিছচ্ছে। মা কিছুটা আমার মুখ চেয়েই বসে আছে…’

‘আপনি চাকরি করছেন না?’

‘একটা পাড়ার স্কুলে আঁকা শেখাই। মাঝে মাঝে আর্ট এক্সিবিশান হয়। সেখানে প্রাইজ টাইজ পাই। ব্যাস ওই অবধি। আমার একটা জেদ বলতে পারেন, আঁকা নিয়েই থাকব…ওই সকাল থেকে কর্পোরেট বসের পেছনে তেল দেওয়া আমাকে দিয়ে হবে না বাল…’

 ‘কিন্তু ভয় দেখানোর ব্যাপারটা…’

‘আঃ আপনি এত গাড়ল কেন বলুন তো?’ ঈশানী বিকৃত গলায় খুলে বলতে থাকে ব্যাপারটা, ‘মায়ের আসল উদ্দেশ্য প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে একটা পাত্রপক্ষ এনে আমাকে এটা বোঝানো যে চাকরি-বাকরি না করে বসে থাকলে যে কোনওদিন আমার বিয়েটা হয়ে যেতে পারে…’

কথাটা বলে একটা পুরোনো তিনতলা বাড়ির সামনে স্কুটিটা দাঁড় করায় ঈশানী। তুহিরণ নেমে আসে। তারপর বাড়িটা ভালো করে দেখতে দেখতে বলে, ‘আপনাদের বাড়িটা বেশ পুরোনো, না?’

‘কেন আপনার পুরোনো বাড়ির জামাই হওয়ার শখ ছিল নাকি?’

তুহিরণ থতমত খায়। ঈশানী স্কুটিটা সিঁড়ির তলায় ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, ‘শরিকি বাড়ি, শালা কিছুই আমাদের না। সাত ভূতে খাচ্ছে। নাহলে কবে এ মাল বেচে ফ্ল্যাট উঠে যেত।’

‘আপনি তার মানে নিশ্চিত আমাদের বিয়েটা হচ্ছে না?’

মেয়েটা ওর দিকে দু’পা এগিয়ে আসে, কয়েক সেকেন্ড অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বলে, ‘দেখুন আপনাদের ছেলেদের না এই এক পা হড়কানো স্বভাব। মুখ দেখেই হ্যাল খেয়ে যান। আমাকে বিয়ে করলে দুদিনও সামলাতে পারবেন না। আমি ঠিক ম্যারেজ মেটিরিয়াল নই…আপনার প্রিয় রং কী?’

একটু ভাবে তুহিরণ, তারপর গাল চুলকে বলে, ‘নীল, কেন বলুন তো?’

‘তাহলে ওই রঙের শাড়ি পরব না, আরও পছন্দ হয়ে গেলে জোঁকের মতো পেছনে পড়ে যাবেন, যাগ্যে, আপনি উপরে যান, আমি আসছি…’

‘কিন্তু একসঙ্গে গেলেই তো…’ তুহিরণ বলতে গিয়ে থেমে যায়।

‘আহা-হা…’ মেয়েটা ভেংচি কাটে, ‘শখ কম নয়, না আপনার? এখন থেকেই পেছন পড়ে গেছেন! বাড়ির পেছনে সিঁড়ি আছে ওটা দিয়ে উঠব। সামনে দিয়ে উঠলে দোতলায় বাবার ঘর পড়ে, সিগারেটের গন্ধ পেয়ে যাবে ঠিক।’

মেয়েটা বাড়ির পেছন দিকে গায়েব হয়ে যেতে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে তুহিরণ। ভারি তাজ্জব ব্যাপার। মেয়েটা একই সঙ্গে নিজের মা-বাপ আর মেয়ের ভূমিকা পালন করছে। তবে একটু খ্যাপাটে হলেও মুখটা ভারি মিষ্টি। সে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসে।

ওদের বাড়ির একদম উপরের তলার একটা ঘরে থাকে ঈশানী। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলেই ছাদ। কমলিকা আর সঞ্জীবন থাকেন তার নীচের তলায়। একদম নীচতলার অন্যান্য ঘরগুলোতে বাড়ির অন্য শরিকরা থাকে।

নীচে নেমে বাবার ঘরে ঢোকার আগে একটু থমকায় ঈশানী। নিজের জামাটা টেনে কাছে নিয়ে এসে গন্ধ নেবার চেষ্টা করে। না, সিগারেটের গন্ধটা এই জামাটায় নেই। বাবার ঘর থেকে আগে কাশির আওয়াজ ভেসে আসত। ক’দিন হল সেটা কমেছে। শেষ কেমোটা নেওয়ার পর শরীরটা আগের থেকে কিছুটা ভালো হয়েছে।

দরজা খুলে ঘরে ঢুকে এসে বিছানার পাশে বসে ঈশানী। মানুষটার শরীর প্রায় বিছানার সঙ্গে মিশে গেছে। গাল ফুঁড়ে বেরিয়ে থাকা হাড়টার দিকে তাকালে ভারি মায়া লাগে ঈশানীর। ওই হাড়টাই যেন বারবার বলে দেয় বাবা বুড়ো হয়ে গেছে। ওকে দেখে সেই হাড়ের নিচে একটা হাসি ফোটে। ওই একটা হাসিরই কারণ হতে ভালো লাগে ঈশানীর। শীর্ণ হাতগুলো তুলে পাশের জায়াগটা দেখিয়ে সঞ্জীবন বলেন, ‘বস, বাবার কাছে তো আর আগের মতো আসিস না।’

ঈশানী জানে কথাটা মিথ্যে নয়। ও এখন বেশিরভাগ সময়টাই হয় সিগারেট নাহলে জয়েন্ট চড়িয়ে থাকে। বাবার নাক ভীষণ চলে। সব থেকে বড় কথা ছোট থেকে বাইরে যত অন্যায় করে আসুক, মা বুঝুক না বুঝুক, বাবা ঠিক বুঝে ফেলত। তবে এসব ছাড়া আরও কিছু কারণ আছে হয়তো। ঈশানী বুঝতে পারে না। মনে পড়ে পরশুদিন শেষ এসেছিল বাবার ঘরে। চুল আঁচড়ে দিয়ে গেছিল, সেই চুল এখন উসকোখুসকো হয়ে গেছে। চিরুনি নিয়ে অবিন্যস্ত চুল আঁচড়াতে থাকে ঈশানী, ‘এই বেগুনি জামাটায় কী সুন্দর দেখায় তোকে…’

ঈশানী নরম হাসি হাসে, ‘তোমার আমাকে কবে সুন্দর লাগেনি বলো তো?’

মানুষটা কী যেন ভাবে, তারপর বুকের উপরে হাত রেখে বলে, ‘যবে প্রথম তোকে দেখেছিলাম। সারা গায়ে রক্ত মাখামাখি, মাংসের ড্যালার মতো। চিৎকার, কান্নাকাটি, ম্যাটারনিটি ওয়ার্ডের গন্ধ। সব বাপেদের সন্তানকে প্রথম দেখে আনন্দ হয়। আমার ভয় লেগেছিল…’

‘কীসের ভয়?’

‘একটুখানি একটা রক্তের ডেলা, তার দায়িত্ব নিতে হবে। তাকে এত বড় একটা মেয়ে করে তুলতে হবে। ভয় লাগবে না? আমি কোনওদিন অত রেসপনসিবল ছিলাম না।’

ঈশানী হাসে, ‘তারপর ভয়টা কাটল কী করে?’

মেয়ের মাথায় একটা হাতে রাখেন ভদ্রলোক, ‘মেয়েকে নিয়ে বাপের ভয় কখনও কাটে না। মেয়ে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাপের থেকে ভয়টা মেয়ের মধ্যে চলে যায়। এই যেমন তুই এখন আমাকে নিয়ে ভয় পাস…’

চিরুনিটা একপাশে সরিয়ে রাখে ঈশানী, ‘সত্যি ভয় পেলে এইসব ফেরেব্বাজি ছেড়ে একটা চাকরি করতাম। তোমার জন্য তো কিছুই করতে পারি না।’

‘আমার জন্য যদি কিছু করতে চাস…’ হাত বাড়িয়ে মেয়ের কান মুলে দেন লোকটা, ‘তাহলে এই ফোঁকার অভ্যাসটা ছেড়ে দে এবার।’

ঈশানী একটু লজ্জা পায়, কান লাল হয়ে ওঠে ওর, সেটা সামাল দিতেই বলে, ‘কী হবে ছেড়ে? তুমি সারা জীবনে ক’টা সিগারেট খেয়েছিলে? কী লাভ হল বলো তো?’

করুণ হাসি হাসে মানুষটা, ‘ক্যানসার কোনও রোগ নয় রে মা, ক্যানসার হল জাস্ট ব্যাড লাক। কখন হবে, কার হবে, কীভাবে হবে কেউ জানে না। গ্রিভেন্স করার কোনও জায়গা নেই। বাদ দে ওসব, তোর সেই আর্ট গ্যালারির কী হল?’

‘ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম। আজ কল এলে যাওয়ার কথা ছিল। সে আর আসবে না। আমার আর ওসব হবে না বাবা, মা রোজ কথা শোনাচ্ছে, ভাবছি বিয়ে করে নেব…’ কথাটা বলে ঈশানী মুখ ফিরিয়ে নেয়।

মেয়ের হাতের উপর একটা হাত রাখে মানুষটা, ‘এই তুই মন খারাপ করছিস কেন বল তো? আরে তোর বাপ থাকতে মা কারো সঙ্গে বিয়ে দিতে পারবে না…’

মুখ ফেরায় ঈশানী। বাবার কপালে একটা হাত রাখে, ‘আমি সত্যি সত্যি কী চাই জানো বাবা?’

‘কী?’

‘আর্ট গ্যাল্যারির চাকরি না, বিয়ে না, টাকাপয়সা না, কিচ্ছু না। শুধু তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেও না বাবা…’ হুট করেই বাপের রুগ্ন বুকের উপরে আছড়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ওঠে ঈশানী, ‘বাকি সব কিছুর সঙ্গে আমি লড়াই করে নেব, মায়ের বকাঝকা, পাশের বাড়ির তানা, সব…শুধু তুমি চলে যেও না কোথাও…’

সঞ্জীবন বুঝতে পারেন মেয়ের মনটা ভালো নেই। ওর পিঠে দুটো চাপড় মারেন তিনি, ‘আরে সিপিএমের কাকারা অত সহজে ছেড়ে যায় না কমরেড…’ হাত বাড়িয়ে ঈশানীর চোখ থেকে জল মুছে দেন তিনি, ‘সত্তর সালে পার্টি নিষিদ্ধ ছিল। লাল ঝান্ডা দেখলেই গুলি করে মারত গুন্ডাগুলো। তখন পার্টিটাকে ছেড়ে গেলাম না, আর তোকে ছেড়ে চলে যাব?’

ঈশানী বাবার বুকে মুখ রেখে ফোঁপাতেই থাকে, সঞ্জীবন একরকম জোর করেই তার মুখটা তুলে ধরে, ‘আরে এই দেখো, আবার কান্নাকাটি করে ফেলে, আমার ডাকাবুকো মেয়েটা কান্নাকাটি করলে একদম ভালো লাগে না। তুই আমার চাম্পিয়ন মেয়ে না?’

ঠোঁট ফুলিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতেই কাতরাতে থাকে ঈশানী, ‘আমার ততক্ষণই সাহস থাকে যতক্ষণ তুমি আছ। তোমাকে ছাড়া আমি খুব ভিতু হয়ে যাব বাবা…’

ঈশানীর পিঠে হাত রাখে সঞ্জীবন, ‘একদিন আমিও আমার বাপকে জড়িয়ে এমন করে কেঁদেছিলাম, জানিস? তুই একদম আমার মতো হয়ে গেলি কবে বল তো?’

কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই পড়ে থাকে ঈশানী। তারপর মুখ তুলে চোখ থেকে জল মুছে নেয়। বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলে, ‘ছেলেটা দেখতে এসেছে। ভাগিয়ে দিয়ে আসি। রাতে আবার আসব, তুমি ঘুমিয়ে নাও…’

‘মন খারাপ করে দিলাম না তোর?’

দুপাশে মাথা নাড়ে ঈশানী। উঠে দাঁড়ায়।

সঞ্জীবনের চোখে মুখে একটা ক্লান্তির ছায়া নামে, পাশ ফিরে শুতে শুতে বলেন, ‘আচ্ছা, আজ রাতে একটা গল্প বলব তোকে। খুব মজার গল্প। মন খারাপ কেটে যাবে…আসিস কিন্তু…’

‘পছন্দ হয়নি?

‘না।’

‘পছন্দ না হওয়ার মতো কী আছে ওর মধ্যে?’

‘যা যা আছে সবকিছু আর দেখলাম কোথায়?’

কানের পাশ গরম হয়ে ওঠে কমলিকার। এতক্ষণ দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন মেয়ের সঙ্গে। এবার ধপ করে বিছানার উপরেই বসে পড়েন। দিনকতক হল বাতের ব্যথাটা বেড়েছে। একটানা দাঁড়িয়ে থাকলে পা ধরে যায়। তার উপরে এই মেয়ে এমনিতেই মাথা গরম করিয়ে দিয়েছে।

পাশের ঘরেই বুলির সঙ্গে বসে আছে ছেলেটা, সেটা মাথায় রেখেই গলাটা নিচে নামিয়ে ভর্ৎসনার সুরে বলেন কমলিকা, ‘মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে নোংরা কথা বলতে লজ্জা করে না?’

‘ঠিকাছে, আমি শুয়ে শুয়ে নোংরা কথা বলছি…’ বিছানার অন্য দিকে শুয়ে পড়ে ঈশানী। হাতটা আড় করে চোখের উপরে রাখে।

‘ইয়ার্কি মারছিস তুই? বুলিমাসি একটার পর একটা ভালো ছেলে খুঁজে নিয়ে আসে আর তুই একটার পর একটা রিজেক্ট করে যাস। তার কারণ জানি না ভেবেছিস?’

‘মহা মুশকিল তো! আমি রেন্ডি নাকি যে একটার পর একটা ছেলে নিয়ে আসবে আর আমি একটার পর একটা একসেপ্ট করে নেব?’

রাগে বিছানার চাদর খামচে ধরেন কমলিকা, ‘আস্তে কথা বল। পাশের ঘরেই আছে ওরা…’

‘লোকের পাশের ঘরে গিয়ে বসে থাকা ছাড়া বুলিমাসির কোনও কাজ আছে? যত্তসব গুড ফর নাথিং মিডল ক্লাস…’

‘তো কী করবে? তোর মতো এখানে ওখানে ছবি এঁকে নেচে বেড়াবে আর মায়ের পেনশন ধ্বংস করবে? মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে আগুন লাগিয়ে দিই ওসব ছবিতে। আর মিডল ক্লাসের উপর অতই যখন রাগ তখন একটু আপার ক্লাস হওয়ার চেষ্টাটা করো না। বাড়ির আরামে গিলে কুটে ওসব অনেক স্বপ্ন দেখা যায়…’

ঈশানীর শরীরে কোনও বিকার দেখা যায় না, অন্য হাতটাও চোখের উপরে রাখে, ‘হয়েছে তোমার খাওয়া নিয়ে তানা মারা? মাইরি বলছি শালা, বিয়ের জন্য ছেলে দেখার মতো যদি মা বাবা সিলেক্ট করার অপশন থাকত না, তুমি শালা জন্ম জন্মান্তর আঁটকুড়ে বাঁজা থেকে যেতে…’

‘তাও শান্তি থাকত জীবনে…’

‘জন্ম দিয়ে ভুল করেছ, তাই তো? আচ্ছা, নতুন কিছু শোনাতে পারো তো। রোজ রোজ ভাঙা রেকর্ড ভালো লাগে মানুষের?’ কথাটা বলে বিছানার উপরে উঠে বসে ঈশানী, ‘দেখো ছেলেটাকে তাড়াতাড়ি ভাগিয়ে ঝামেলা মেটাও। আমি একটু বেরব…’

‘কোথায় বেরবি?’

‘একটা থিয়েটার গ্রুপের স্টেজ ডিজাইন আছে…’

‘তুই নাটক করছিস কবে থেকে?’

‘করছি না, দেখছি, জন্ম থেকে, তোমার।’

কথাটা বলে কোমরে ভর দিয়ে উঠে পড়ে ঈশানী। তারপর গটগটিয়ে পাশের ঘরে এসে তুহিরণের পাশের সোফায় বসে পড়ে। ওদের ঠিক উল্টোদিকেই বসেছে বুলিমাসি। এতক্ষণ ওকে ফাঁকা পেয়ে এটা সেটা প্রশ্ন করছিলেন। ঈশানীকে ঢুকতে দেখে একটু তটস্থ হয়ে বসেন।

তেমন কিছু সাজগোজ করেনি ঈশানী। হালকা কাজল পরেছে, সঙ্গে বেগুনি জর্জেট শাড়ি, প্রায় অদৃশ্য কালো টিপ কপালে। চুলগুলো মাথার পেছনে খোঁপা করে বাঁধা। হাতের লাল তাগাটা তার মধ্যেও যেন মানিয়ে গেছে।

তুহিরণ হাঁ করে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। সে দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হাসে ঈশানী। বিড়বিড় করে বলে, ‘কী ব্যাপার, আপনি পিছলে গেলেন নাকি?’

তুহিরণ লাজুক গলায় বলে, ‘না, আপনাকে দেখতে ভালো সেটা অস্বীকার করি কী করে?’

‘তার থেকেও ভালো জয়েন্ট রোল করতে পারি সেটাই বা অস্বীকার করবেন কী করে?’

বুলিমাসি গোটা কথাটা শুনতে পাননি। কিছু একটা আন্দাজ করে নিয়ে বললেন, ‘জয়েন্টে, দারুণ রাঙ্ক হয়েছিল ওর। সরকারি কলেজে চান্স পেয়েছিল। পড়া শুরুও করেছিল, কিন্তু ওই, মাথার ক্যাড়াপোকাটা নড়ে গেল। তবে ওর কিন্তু গুণের শেষ নেই…’ বুলিমাসির মুখটা রসোগোল্লার মতো মনে হল ঈশানীর, তেমন রসালো গলাতেই বলে চললেন তিনি, ‘ওর বাবা তো অসুস্থ, মায়েরও শরীরটা ভালো নয়। এইটুকু মেয়ে একা হাতে গোটা সংসারের দায়িত্ব সামলায়…’

ঠোঁটের কোণে বিড়বিড় করে ঈশানী, ‘আমার মায়ের বাক্যবাণ সামলানোর কাছে সেটা কিছুই নয়…’

তুহিরণ আড়চোখে তাকায় ঈশানীর দিকে। টেবিলের উপরে একটা প্লেট আর দুটো চামচ পড়েছিল। তার মধ্যে কাঁটাচামচটা তুলে নিয়ে নড়াচড়া করে দেখতে শুরু করেছে মেয়েটা। কেমন যেন চিকচিক করছে চোখের মুণিদুটো।

‘ওর কথায় তুমি কিছু মনে করো না বাবা, ও একটু ওরকম। তোমার বাবা-মার তো ভালোই পছন্দ ছিল। ফোন করে বলেছে আমাকে। যদি তোমার আপত্তি না থাকে…’

তুহিরণ খাবি খায়, ঈশানী ঝুঁকে আসে ওর দিকে। বাঁ দিকের ভ্রুটা উপর দিকে তুলে বলে, ‘আছে? আপত্তি?’

আবার থতমত খায় তুহিরণ, গলকণ্ঠটা একবার ওঠানামা করে। কাঁটাচামচটা এবার টেবিলের উপর ধীরে সুস্থে ঘষছে ঈশানী। সেটার দিকে একবার তাকিয়ে দুবার খাবি খেয়ে ধরা গলায় তুহিরণ বলে, ‘ইয়ে…আসলে আমার একটু কথা ছিল আপনার সঙ্গে। যদি একটু…’

উঠে বারান্দার দিকে হেঁটে যায় ঈশানী। তুহিরণ পায়ে পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়ায় ওর সামনে। মাথাটা মেঝের দিকে নেমে আসে ওর। আধো স্বরে বলে, ‘ইয়ে…সিদ্ধান্ত তো আগেই হয়ে গেছে, আই মিন এটা একরকম গট আপ ম্যাচ বলা যায়। তাও যদি একটা ফেয়ার গেম…আমি কিন্তু পিনাট বাটার খাই না। বিশ্বাস করুন…’

ছেলেটার কথার দিকে মন নেই ঈশানীর। হাতের উপর ফোনটা রেখে তার স্ক্রিনে কী যেন দেখছে সে। যেন কথাগুলো কোনরকমে কাটিয়ে দিতে পারলেই বাঁচে। তুহিরণ এবার সত্যিই হতাশ হয়, আশ্চর্য কঠিন মেয়েটা। মনের ভিতরে কী চলছে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই।

সে আবার চেষ্টা করে, ‘মানে, আমি ওনাদের জানিয়ে দিচ্ছি যে আমাদের কারোরই তেমন পছন্দ নেই, কিন্তু আপনি শুধু জেনে রাখুন, আমার দিক থেকে পছন্দ আছে, আপনার যদি আমাকে পছন্দ…’

‘হয়ে গেছে…’ শব্দদুটো উচ্চারণ করেই লাফিয়ে ওঠে ঈশানী। এই হঠাৎ উত্তরের জন্যও প্রস্তুত ছিল না তুহিরণ। সে আঁতকে উঠে বলে, ‘অ্যাঁ! সেকী! আমাকে পছন্দ হয়ে গেছে আপনার?’

ঈশানী রাগত চোখে তাকায় ওর দিকে, ‘আরে অদ্ভুত ল্যাবা তো! সারাক্ষণ নিজের ধান্দায় থাকেন নাকি? আমার চাকরিটা হয়ে গেছে আর্ট গ্যালারিতে। এই দেখুন, এক্ষুনি যেতে বলেছে…’

এক্ষুনি আসা ই-মেলটা ওর সামনে তুলে ধরে ঈশানী, ‘উফ, ইচ্ছা করছে বাবাকে এক্ষুনি জানিয়ে আসি…’ ছুটে বাবার ঘরের দিকে যেতে গিয়েও থমকে যায় ও, ‘ঘুমাচ্ছে মনে হয়। থাক, একেবারে এসে জানাব…’

মুখে খুশির আলো খেলা করছে তার। সমস্ত শরীর থেকে এতক্ষণের ঝিমিয়ে পড়া ভাবটা অন্তর্হিত হয়েছে। শাড়ির আঁচলটা গুটিয়ে কোমরে বাঁধতে বাঁধতে বলে, ‘চলুন, আপনাকে স্টেশন অবধি ছেড়ে দিই। রাস্তায় ভালো মেয়ে পেলে ঝুলে পড়বেন। নাহলে আপনার এ জম্মে বিয়ে-টিয়ে হবে বলে মনে হচ্ছে না…’

তুহিরণকে স্টেশনে ড্রপ করে আর্ট গ্যালারির দিকে স্কুটিটা ছুটিয়ে দিল ঈশানী। মনের ভিতরে অদ্ভুত ফুর্তি হচ্ছে ওর। আর্ট গ্যালারির কিউরেটরের চাকরিটা যে হয়ে যাবে সেটা ও আগে ভাবতে পারেনি। ইন্টারভিউ মোটামুটি খারাপ যায়নি। কিন্তু মনে হয় একটু বেশিই বকে ফেলেছিল। তাও পছন্দ হয়ে গেছে মানে তেমন ভুলভাল কিছু…

দুপুরের রাস্তা প্রায় ফাঁকা। ওর গায়ে জড়ানো বেগুনি জর্জেট শাড়িটা এখন আলুথালু হয়ে আছে। হাওয়ায় মাঝে মাঝে উড়ে যাচ্ছে সেটা। উৎসাহের চোটে হেলমেটটাও নেওয়া হয়নি। এর মধ্যে যদি পুলিশে এসে পাকড়াও করে বিপদের আর শেষ থাকবে না। সতর্ক হয়ে স্কুটি চালাতে লাগল ঈশানী।

খানিক দূর যেতে ওর ফোনটা বেজে উঠল। পেছনটা একবার দেখে নিল সে। না, ওর ঠিক পেছনে কোনও গাড়ি নেই। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে কানে চেপে ধরল ঈশানী। ওপাশ থেকে বুলিমাসির গলা ভেসে এল, ‘রুনু, তাড়াতাড়ি বাড়ি আয়। তোর বাবা কেমন করছে…’

মিনিট পনেরো পর ঊর্ধ্বশ্বাসে স্কুটি চালিয়ে ঈশানী যখন বাড়ি ঢুকল তখন হুট করেই দুপুরের আলো কমে এসেছে। পাশের বাড়ি থেকে ঠং ঠং করে হাতুড়ি ঠোকার আওয়াজ আসছে। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় মনে হল যেন একটা নরম গন্ধ হাওয়ার মতো জড়িয়ে ধরছে ওকে।

অনেকগুলো সিঁড়ি একধাপে পেরিয়ে যখন দোতলায় উঠে এল ঈশানী তখন দরজার ভেতরটা ফিকে অন্ধকারে ভরে আছে।

ফ্রিজটা খোলা আছে কি? এত ঠান্ডা হয়ে আছে কেন ভিতরটা?

বাবার ঘরের দরজায় এসে থমকে দাঁড়ায় ঈশানী। খাটের পায়ের কাছে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে মা আর বুলিমাসি। বিছানার একপাশে এলিয়ে পড়ে আছে বাবার মৃতদেহটা। মুখে থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত মেঝেতে জলরঙের মতো মিশে গেছে।

সেই রক্তের ঠিক সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ঈশানী, বিড়বিড় করে বলে, ‘তুমি আমায় গল্পটা বললে না বাবা…’

কাকতাড়ুয়া – 3 অধ্যায়

তৃতীয় অধ্যায়

‘আপনাদের এখানে সিসিটিভি নেই, তাই না?’ ইনস্পেক্টর বিশ্বাস পুকুরপাড়টা খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করলেন।

‘সিসিটিভি বলতে…’ নাদু নস্কর গলা চুলকে বলল, ‘আগে একবার লাগানোর কথা হয়েছিল। কিন্তু গ্রাম সাইড তো, অত গুরুত্ব দিইনি। তারপর তো চোর ছ্যাঁচড়ের উৎপাত…কখন কী হয়ে যায়…’

‘হয়ে গেল তো?’ বাঁকা স্বরে কথাটা বলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হরির দিকে তাকালেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। সে অনেকক্ষণ থেকেই মুখ কাঁচুমাচু করে হাত কচলাচ্ছিল। চোখে চোখ পড়তেই যেন আরও কিছুটা জড়সড় হয়ে দাঁড়াল।

‘আশেপাশে সবটাই তো ফাঁকা মনে হচ্ছে। আপনারা বাজার দোকান করেন কোথা থেকে?’

‘আজ্ঞে বারো কিলোমিটারের মধ্যে আর কিছুই নেই। শুধু এই জঙ্গল। বাবুই বাইকে করে গিয়ে সকালবেলা বাজার করে আনেন। তাছাড়া ওই পেছনে খেত আছে। সবজিপাতি যা লাগে ওখান থেকেই হয়ে যায়।’

ঘণ্টাখানেক আগেই বডি পোস্টমর্টেমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের লোকজন এসে পুকুরপাড় থেকে বাঁশবন অবধি খুঁটিয়ে দেখেছে। কোথাও উল্লেখযোগ্য কিছুই প্রায় পাওয়া যায়নি। দুজন হাবিলদার গোছের লোক ক্যাম্পের একদিকে দুটো টুলের উপরে বসে ঢুলছিল। এতক্ষণ ইনস্পেক্টর বিশ্বাস তাদের সঙ্গে কিছু কথা বলছিলেন। আপাতত পুকুরপাড়টা সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন তিনি। তাকে অনুসরণ করছেন নাদু নস্কর আর হরি। আর একটা লোক খানিকটা দূরত্ব রেখে হাঁটছে ওদের ঠিক পেছনেই। এই লোকটার সঙ্গে একটু আগেই পরিচয় হয়েছে ইনস্পেক্টরের। অন্য তাঁবুর গেস্ট।

ক্যাম্পের দরজার পাশে রাখা নাদু নস্করের বাইকটার দিকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখে নিলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘রাতে ওই সদর দরজাটা আপনারা বন্ধ করেছিলেন, তাই তো? তারপর থেকে আর খোলা হয়নি?’

‘আজ্ঞে না। সকালে ঘুম থেকে উঠে আমিই খুলে পুকুর ধারে গেছিলাম। রাতে যেমন লাগিয়ে গেছিলাম সকালে তালা তেমনই ছিল। একটা আঁচও পড়েনি।’

পরের কথাটা ইনস্পেক্টর বিশ্বাস একটু চাপা স্বরেই বলেন, ‘মানে বাইরে থেকে দরজা খুলে কেউ ভিতরে আসেনি। অবশ্য বেড়া ডিঙিয়ে ভিতরে আসা কঠিন কিছু না। তাও…’

কথাটা শেষ না করেই আবার নাদু নস্করের দিকে ফেরেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘কাল রাতে আপনারা দুজন কোথায় ছিলেন?’

নাদু নস্কর আগের মতোই একবার গলা চুলকায়। তারপর টেবিলের উপর হাত ঘষে বলে, ‘আজ্ঞে আমাদের রোজই ঘুমাতে ঘুমাতে লেট হয়। সবার খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে বাসন ধুয়ে, আরও টুকটাক কিছু কাজ করে শুতে শুতে বারোটা বেজে যায়। কিন্তু কাল দুজনেই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ওই ধরুন এগারোটার মধ্যে…’

‘কেন? কাল একটু বেশি পরিশ্রম গিয়েছিল?’

দুদিকে মাথা নাড়ে নাদু, ‘আজ্ঞে না, সত্যি কথা বলতে অন্য দিন এর থেকে বেশি পরিশ্রম হয়।’

‘তাহলে কাল তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেন?’

নাদুকে একটু বিভ্রান্ত দেখায়। যেন প্রশ্নটার তেমন জোরাল উত্তর সে নিজেও হাতড়াচ্ছে, ‘কী জানি স্যার, মাথাটা বড্ড ব্যথা ব্যথা করছিল। মনে হল সারা শরীর জুড়িয়ে আসছে। চোখের পাতা ভারী হয়ে…কীরে হরি, বল না…’

ইনস্পেক্টর বিশ্বাস আর তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করেন না, পুকুরের অন্য প্রান্তটার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলেন, ‘বাদ দিন, কালকে রাতে আর অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি?’

‘অস্বাভাবিক কিছু…’ কথাটা বলতে গিয়ে একটু ইতস্তত করে নাদু নস্কর, ‘একটা ব্যাপার চোখে পড়েছে স্যার। কিন্তু তার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও যোগ আছে কিনা…’

‘কী চোখে পড়েছে?’

‘মাসছয়েক আগে আমাদের ওই পেছনের খেতে কাকতাড়ুয়া লাগিয়েছিলাম। কাল বিকেলে খেতে গিয়েও দেখিছি ওটা ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আজ গিয়ে দেখলাম নেই।’

‘নেই মানে? মাটিতে পড়ে আছে?’

‘আজ্ঞে না, কোথাও নেই।’

‘স্ট্রেঞ্জ!’ বিড়বিড় করেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘যদি কেউ খুন করেই থাকে, সে একটা কাকতাড়ুয়া সরিয়ে কী করবে, কত বড় ছিল কাকতাড়ুয়াটা?’

‘ফুট ছয়েকের বেশি হবে। একটা হাঁড়ি, দুটো বাঁশ, কিছু বিচালি আর একটা জামা চাপিয়ে আমিই বানিয়েছিলাম।’

‘বেশ, কাকতাড়ুয়া গায়েব হওয়া। আর কিছু?’

হরি অনেকক্ষণ ধরে কী একটা বলার জন্য উশখুশ করছিল। নাদু নস্কর ওর হাত ধরে টিপে দিতে থেমে যায়। ইনস্পেক্টর বিশ্বাস আবার নাদু নস্করের দিকে তাকালেন, ‘এখানে বাইরে থেকে টুরিস্টরা ছাড়া আর কে আসে?’

‘আসে বলতে গেস্ট বেশি থাকলে আমাদের দুজনের পক্ষে সামলানো একটু কঠিন হয়। তখন ভবা আসে।’

‘সেটা কে?’

‘ঝাঁটফাট দেয়, মাঝে মাঝে রান্নাও করে। তাছাড়া একজন বাউল আসে মাঝে মাঝে, চরণদাস…’

‘এই নির্জন প্রান্তরে বাউল কী করে?’

‘ক্যাম্পফায়ার হয় তো মাঝেমধ্যে। তো সেখানে কেউ কেউ বাউল গান শুনতে চায়। ফোন করলে আসে, আবার মাঝে মাঝে এমনি এমনিও আসে। বায়না না থাকলে নিজের মতো মাঠে বসে গান-বাজনা করে চলে যায়।’

‘কাল রাতে এদের দুজনের কেউ এসেছিল?’

দুপাশে মাথা নাড়ে নাদু নস্কর, ‘বাউলটা অনেকদিন হল আসে না। ডাকও পায় না তেমন। আজকাল তো লোকে ইস্পিকার টিকার নিয়েই আসে। মাথাতেও একটু গোলমাল আছে স্যার। মাঝে মাঝে উল্টোপালটা গল্প বলে, কেউ ওর কথা বিশ্বাস করে না। শিল্পী মানুষ তো, তাই একটু মাথা খারাপ। তবে ভবার আজ সকালে আসার কথা ছিল। যেরকম নোংরা করেছিল এরা…’

এই সময়ে পেছনে পায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকান ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। ওদের পেছনে থাকা লোকটা আপাতত জোরে পা চালিয়ে কাছাকাছি এসে পড়েছে। ইনস্পেক্টর বিশ্বাস তাকে দেখতে পেয়ে থামলেন, ‘আপনি সুব্রত ঘোষ?’

লোকটা উপরে নিচে মাথা নাড়ায়, ‘ফ্যামিলি নিয়ে ছুটি কাটাতে এসেছিলাম, দেখুন কী হয়ে গেল!’

‘আপনিও তো কাল রাতে এখানেই ছিলেন, কিছু দেখতে পাননি?’

ভদ্রলোক মনে হয় এ প্রশ্নটার উত্তর মনে মনে তৈরি করেই এসেছিলেন, সেটা একবার গুছিয়ে নিয়ে বললেন, ‘বারোটা বাজতেই আমরা ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়েছিলাম সবাই। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এসেছি। আমাদের তো আর মদটদের ব্যাপার নেই।’

‘বারোটা? মানে দশটার পর আরও দুঘণ্টা আপনারা বাইরে ছিলেন। তাও আবার মদ না খাওয়া অবস্থায়, কিছু দেখেননি?’

চারজন পুকুরের ধার দিয়ে আবার ক্যাম্পের দিকে হাঁটতে শুরু করে, ‘দেখেছি বলতে মেয়ে তিনটে প্রথমে একটা টেবিলে বসে মদ খাচ্ছিল। আর ওই গল্পগুজব, হাসাহাসি যা হয় আর কী। যে মেয়েটা মারা গেছে সেই চিৎকার চেঁচামেচি করছিল বেশি। তারপর একজন মনে হয় বাইরে, বেড়ার ওপারে কী একটা দেখতে পায়…’

‘মানে বাঁশবনের ভিতর! কী দেখতে পায়?’

‘তা বলতে পারব না। কিন্তু দেখেই চিৎকার করে ওঠে। বাকি দুজনও সেদিকে তাকায়। তারপর তিনজনে মনে হয় ঝগড়া করছিল। নোংরা খিস্তিখাস্তা, আমার এই বয়সে আর ওসব ভালো লাগে না…তারপর মনে হয় জঙ্গলেও গেছিল।’

‘অত রাতে তিনটে মেয়ে জঙ্গলে গেছিল? আপনি জানালেন কী করে?’ বিশ্বাস একটু সন্দেহের গলাতেই বলেন।

হাত বাড়িয়ে নিজের কটেজের জানলাটা দেখান সুব্রত ঘোষ, ‘আমার একটু সিগারেটের নেশা আছে। তো ওই জানলায় বসে সিগারেট খাচ্ছিলাম। তখনই দেখলাম জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে।’

‘সবাই?’

একটু মনে করার চেষ্টা করেন সুব্রত ঘোষ, তারপর বলেন, ‘অত মনে নেই। তবে দুজনকে দেখেছিলাম। আর একজন মনে হয়…’ দৃশ্যগুলো গুলিয়ে যায় তার মাথায়।

‘দুটো মেয়ে অত রাতে জঙ্গলে যাচ্ছে, আপনি বাধা দেননি?’

সুব্রত ঘোষ অপ্রস্তুতে পড়েন, ‘আমি কী বলব? এখানে সবাই ফুর্তিফার্তা করতে আসে। তার উপর আজকালকার শহুরে মেয়ে, মাতাল, কিছু বলতে গেলে যদি…’

‘বুঝতে পেরেছি, তারপর?’

‘তবে আমার কৌতূহল যে হচ্ছিল না বললে ভুল হবে। আমি জানলা ছেড়ে উঠে বাইরে তাকিয়েছিলাম। ওরা মনে হয় ফোনে টর্চ জ্বালিয়েছিল। ফলে জঙ্গলের মধ্যেই আছে বুঝতে পারছিলাম…’

‘আপনার সঙ্গে কে ছিল তখন?’

‘কেউ না। আমার স্ত্রী আর ছেলে আগেই ঘরে ঢুকে গেছিল।’

‘বেশ, তারপর কী হল?’

‘মেয়েগুলো হইচই করতে করতে জঙ্গলে ঢুকল। চারপাশটা এতটাই নিস্তব্ধ ছিল যে দূর থেকেই ওদের কথাবার্তা কানে আসছিল। ওরা তিনজনে কিছু একটা দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠেছিল।’

‘কী দেখেছিল সেটা দেখতে পাননি, তাই তো?’

‘আজ্ঞে না। বাঁশবনের বেশ কিছুটা ভেতরে চলে গিয়েছিল ওরা। আবছা আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। ছেলে হলে হয়তো পিছু নিতাম। কিন্তু মেয়ে তো, তার উপর আমার বউ আবার একটু…’

নাদু নস্কর এতক্ষণ মন দিয়ে সবটা শুনছিলেন। এবার খানিক জোর করেই হেসে বললেন, ‘মেয়েগুলো একেবারে গলা অবধি মদ গিলেছিল স্যার। অত নেশা করলে অন্ধকারে এটা-ওটা দেখতে পাওয়া আশ্চর্যের কিছু নয়। মনে হয় তাই থেকেই…’

কথাটায় তেমন গুরুত্ব দিলেন না ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘তারপর?’

‘তারপর বুঝলাম ভিতরে একটা হট্টগোল হচ্ছে। কীসব যেন আওয়াজ আসছিল ভিতর থেকে। মিনিট পনেরো সেভাবেই কাটল। ভয় করল আমার। গভীর রাতে বাঁশবনের ভিতর মেয়েগুলো কোনও বিপদে পড়ল না তো?’

‘তারপর?’

‘তারপর সব আওয়াজ থেমে গেল স্যার। ওরা মনে হয় ফিরেও এসেছিল। আমি আর অত গা করিনি। ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়েছিলাম।’

ইনস্পেক্টর বিশ্বাস পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছছিলেন। রুমালটা পকেটে ঢুকিয়ে চারপাশে তাকাতেই একটা বছর দশেকের বাচ্চাকে গাছের নিচে বাঁশের বেঞ্চে বসে পা দোলতে দেখলেন। সুব্রত ঘোষকে দেখিয়ে বললেন, ‘ওটা আপনার ছেলে?’

‘হ্যাঁ স্যার…’

হাতের লাঠিটা কোমরে গুঁজে সেদিকে এগিয়ে গেলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। ছেলেটার মুখটা ভারি মিষ্টি। একেবারে বাপের মতোই চেহারা তার। ইনস্পেক্টর বিশ্বাসকে পাশে বসতে দেখে সে একটু জড়সড় হয়ে বসল। তার পিঠে একটা হাত রেখে বিশ্বাস বললেন, ‘কাল রাতে তুমি ঘুম থেকে উঠেছিলে একবারও?’

ছেলেটা একবার বাবার মুখের দিকে তাকাল। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমার গরম লাগছিল বলে উঠেছিলাম।’

‘তো গরম কমানোর জন্য কী করলে?’

‘বাইরে এলাম।’

‘আচ্ছা? বাবা মা কী করছিল তখন?’

‘ঘুমাচ্ছিল।’

‘বাইরে এসে তুমি কী দেখলে?’

ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল, তারপর কী যেন ভেবে বলল, ‘দুটো দিদি ওইখানে চাতালে শুয়েছিল। একটা দিদি মরে গেছিল…’

শব্দটার মধ্যে একটা ধাক্কা ছিল। সোজা হয়ে বসলেন বিশ্বাস, ‘মরে গেছিল? কী করে বুঝলে?’

‘সারা গায়ে রক্ত ছিল। একদম মরার মতো পড়েছিল ওখানে। আর একটা দিদি ওর পাশেই শুয়েছিল। প্রথমে কাঁদছিল খুব। তারপর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু ও মরেনি…’

‘তারপর?’

‘তারপর আমার খুব ভয় পেল। আমি ঘরে চলে এলাম। তারপর আর কিছু মনে নেই আমার।’

‘আচ্ছা! অত রক্ত দেখে ভয় পেয়েছিলে, তাই তো?’

ছেলেটা দুদিকে মাথা নাড়ে, ‘রক্ত দেখে পাইনি।’

‘তাহলে?’

‘যে দিদিটা মরে গেছিল সে একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল…’

সুব্রত ঘোষ এগিয়ে এসে ছেলের পিঠে একবার চাপড় মারেন, ‘কী যা-তা বলছিস!’ বিশ্বাসের দিকে ঘুরে বলেন, ‘ও একটু বেশি কল্পনাপ্রবণ, বুঝতেই পারছেন…কাল রাতে ওরা কান্নাকাটি করছিল সেটা আমিও শুনেছি স্যার। কিন্তু আমার ছেলের এসব আজগুবি কথা…’

‘ভয়ে ভুল দেখেছে বুঝতে পারছি, কিন্তু…’ ছেলেটার মুখের উপরে আবার ঝুঁকে পড়েন বিশ্বাস, ‘কোন দিদিটার গায়ে রক্ত ছিল বলতে পারবে?’

‘ওই যে ফেট্টি আছে যার মাথায়…’

সুব্রত ঘোষ স্বগতোক্তির মতোই বললেন, ‘ও যে এসব দেখেছে সকাল থেকে আমাদের বলেনি স্যার…এই এখন…’

‘অনেক সময় বাচ্চারা পরিচিত লোকেদের বলতে চায় না। জানে বিশ্বাস করবে না, যাক গে…’ নাদু নস্করের দিকে ফিরে তাকালেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘আপনারা এখানে রক্তের দাগ টাগ কিছু পাননি?’

দুদিকে মাথা নাড়লেন নাদু নস্কর।

‘যে জায়গার কথা ও বলেছে সেখান থেকে আপনাদের ঘরের দূরত্ব মিটারকুড়ির বেশি না। আপনারা কেউ এত কান্নাকাটির কিছু শুনতে পেয়ে বাইরে এলেন না?’

‘মদ খেয়ে মেয়েরা কান্নাকাটি করবে এতে আশ্চর্যের কী আছে স্যার? তাই আমরা শুনেও গা করিনি।’

পেছন ফিরে একবার নাদু নস্কর আর হরির দিকে তাকিয়ে দেখে নিলেন সুব্রত ঘোষ। তারপর বিশ্বাসের কাছে সরে এসে চাপা গলায় বললেন, ‘উনি কিন্তু একটা কথা আপনার কাছে চেপে যাচ্ছেন।’

‘কী কথা?

‘ওই যে বাউলটার কথা উনি বলছিলেন, ও কাল রাতে এখানে এসেছিল। সারাদিন ছিল না, কিন্তু রাতে ছিল।’

‘তাই নাকি? আপনি দেখেছেন তাকে?’

‘দেখিনি, শুনেছি। আমি এমনি গান শুনতে শুনতে ঘুমাই। কালও ঘরে ঢুকে কানে ইয়ারফোন দিয়ে গান শুনছিলাম। এমন সময় মনে হল বাইরে থেকে দোতারার আওয়াজ আসছে। ভাবলাম কান বাজছে হয়তো। ইয়ারফোন খুলে ভালো করে শুনে বুঝলাম সত্যি একটু দূর থেকেই আসছে আওয়াজটা। এখানে আর কাউকে দোতারা বাজাতে শুনিনি। ফলে বুঝতে পারলাম বাউলটাই এসেছে।’

‘বাইরে বেরিয়ে আর দেখেননি, তাই তো? তারপর?’

নাদু নস্কর আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘আমাদের ক্যাম্পে একটা দোতারা আছে বটে স্যার…কিন্তু আমরা কেউ বাজাতে পারি না।’

‘হুম…’ ইনস্পেক্টর বিশ্বাসকে চিন্তিত দেখাল।

দুদিকে মাথা নাড়লেন সুব্রত ঘোষ, ‘তারপর আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালবেলা এদের চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙার আগে অবধি আর কিছুই জানি না।’

পাড়টা খুব একটা শক্তপোক্ত না। তার উপরে কদিন আগেই বৃষ্টি হয়ে গেছে। মদ্যপ অবস্থায় পাড়ে এসে পা হড়কে পড়ে যাওয়াটা বিচিত্র নয়। তবে জল তেমন একটা গভীর নয়। অন্তত সাঁতার জানে এমন কেউ সে জলে ডুবে মারা যাবে এটা একেবারেই অসম্ভব। কথার ফাঁকে যুক্তিগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস।

‘আপনার কী মনে হচ্ছে স্যার?’ সাব ইনস্পেক্টর মানিক এতক্ষণ চারপাশটা ঘুরে দেখছিল। সে বিশ্বাসের পাশে এসে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করে।

ঠোঁট দিয়ে চুকচুক করে একটা আওয়াজ করলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘খুন যে হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। তবে সবটা পোস্টমর্টেমের পরেই বোঝা যাবে। গলা টিপে না খুন হলে তাতে সাধারণত গলায় দাগ পড়ে না। এক যদি না খুনির হাতে ভীষণ জোর থাকে এবং খুব দ্রুত অতিরিক্ত প্রেশার দেওয়ার দরকার পড়ে। এখানে যেহেতু তাই হয়েছে, ফলে ধরে নেওয়া যায়…আপনি কী করেন?’

শেষ প্রশ্নটা আচমকাই ধেয়ে এসেছে সুব্রত ঘোষের দিকে। এক সেকেন্ডের জন্য থতমত খেয়ে আবার মুখে আগের হাসিটা ফিরিয়ে আনলেন তিনি, ‘আজ্ঞে সরকারি কলেজে ইতিহাস পড়াই। কলকাতায়। হালকা রিসার্চ টিসার্চও করতে ভালো লাগে। সেই জন্যেই এই জায়গাটা ঘুরতে আসা…’

‘এই জায়গায় আবার কোনও ইতিহাস আছে নাকি?’

সুব্রত ঘোষকে চিন্তিত দেখায়, ‘ঠিক ইতিহাস বলা যায় না। তবে বছর পঞ্চাশেক আগে, আই মিন নকশাল পিরিয়ডে এ এলাকা নকশালরাই আবিষ্কার করে। ওই অ্যাবানডানড বাড়িগুলোই জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকার আদর্শ জায়গা। তার আগে ধরুন নবাবী আমলের সময়ে…’

নাদু নস্কর দুম করেই কথা কেটে দেন, ‘নেটে খুঁজলে দেখতে পাবেন স্যার, এই জায়গাটা নিয়ে কতরকম কথা চালু আছে। মাঝে মধ্যেই লোকজন কীসব যেন দেখতে পায়। আমাদের হরির বউও একবার এসেছিল এখানে, থাকতে পারেনি বেশিদিন। থাকলেই নাকি গা’টা ভারভার লাগে। আমার কী মনে হয় স্যার…’

বাকি কথাগুলো শোনার খুব একটা প্রয়োজন আছে বলে মনে করলেন না ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। লোকটার কথার মধ্যে কেমন একটা গায়ে পড়ে গুজব রটানোর মতো ভাব আছে। বেশিক্ষণ শুনলে মনে হয় মিথ্যে কথা বলছে।

হাঁটতে হাঁটতে ক্যাম্পের কাছে চলে এসেছে ওরা। ক্যাম্পে ঢোকার দরজাটা একবার নিচু হয়ে পরীক্ষা করেন বিশ্বাস। কোনও রক্তের দাগ চোখে পড়ে না। কাল রাতে এখানে আদৌ কিছু হয়েছে বলে মনেই হয় না তার।

‘আপনি এখন ঘরে যান, আমাদের দরকার পড়লে আবার ডেকে নেব, কেমন?’

আর কথা না বাড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন সুব্রত ঘোষ। তার স্ত্রীর উৎসুক মুখটা জানলার কাছ থেকে একবার দেখা দিয়েই সরে গেল।

ওদের ঘরের ঠিক পাশেই ঈশানীদের কটেজ। একটু হেঁটে সেদিকে এগিয়ে এলেন তিনি। মেয়েদুটো আপাতত ঘরেই আছে। এখানে এসে সবার আগে ওদেরই বয়ান নেওয়া হয়েছে। তবে খুব বেশি কথা বলার মতো অবস্থায় নেই ওরা। গলায় একটা শব্দ করে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকে আসেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস।

ঈশানী আর গার্গী বিছানার উপরেই শুয়েছিল। চোখের পাতা খোলা। একদিকের জানলা ধুয়ে আসা আলো ছেঁড়া ছেঁড়া হয়ে ওদের গায়ের উপরে এসে পড়েছে। ইনস্পেক্টর বিশ্বাসকে ঘরে ঢুকতে দেখে উঠে বসে ঈশানী। মুখের উপরে একবার হাত চালিয়ে নেয়। মাথার ফেট্টিটা চোখের উপর নামিয়ে এনেছিল। সেটা আবার কপালে তুলে নিয়ে মাটির দিকে চেয়ে বসে থাকে।

‘আপনাদের আজ দুপুরের মধ্যেই কলকাতা পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ওর বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে দিয়েছে।’ বিছানার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস।

‘জানি, কথা হয়েছে আমাদের। ওর বডিটা…’

‘পোস্টমর্টেমে গেছে। সেখান থেকে একেবারে কলকাতা চলে যাবে। আপনারা গাড়ি নিয়ে এসেছিলেন তো?’

‘হ্যাঁ ওরই গাড়ি ছিল। আমি চালিয়ে এনেছিলাম।’

অন্য মেয়েটা এখনও আগের মতোই শুয়ে আছে বিছানায়, ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের গলার স্বর একটু নরম হল, ‘স্টেটমেন্ট আপনারা অলরেডি দিয়েছেন, ফলে এখন আর বিরক্ত করব না, শুধু কয়েকটা প্রশ্ন ছিল আপনাদের কাছে।’

‘হ্যাঁ, বলুন।’

‘কাল রাতে জঙ্গলে গেছিলেন আপনারা? আই মিন ধরুন ওই এগারোটার দিকে।’

ঈশানী একটু ভাবার চেষ্টা করে, তারপর কাঁধ ঝাঁকায়, ‘গিয়ে থাকতে পারি, আমার যেতে ইচ্ছা করছিল, এটুকু মনে আছে।’

‘ইচ্ছা করছিল কেন?’

ঈশানীর ক্লান্ত মুখে হাসি ফোটে, ‘ছোট থেকে বাঁশবনে ভূতের গল্প শুনে এসেছি, কলকাতায় থাকতে কি আর চাইলেই রাতে বাঁশবনে যাওয়া যায়?’

‘আপনাদের কোথাও কোনও আঘাত লেগেছিল কাল রাতে? মানে এমন কিছু যা থেকে রক্ত বের হয়?’

একটু অবাক হয়েই ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের দিকে তাকায় ঈশানী, ‘কই না তো, গার্গীও তো তেমন কিছু বলেনি আমাকে।’

দু’সেকেন্ড কী যেন ভাবলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। তারপর ঘরের দরজার দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললেন, ‘বেশ, আজ দুপুরে আপনারা ফিরুন। তবে দরকার পড়লে আবার ডেকে পাঠাব। তখন এতটা উজিয়ে আসতে হবে কিন্তু। হুট করে না জানিয়ে কোথাও যাবেন না, কেমন?’

বিশ্বাস বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। পেছন থেকে একটা প্রশ্ন শুনে থমকে দাঁড়ালেন, ‘ওকে কেন খুন করা হল বলতে পারবেন?’ পাশে শুয়ে থাকা মেয়েটা উঠে বসেছে এতক্ষণে।

‘সেটা এক্ষুনি বলা শক্ত। দাগগুলো দেখে যতদূর মনে হচ্ছে আগে গলা টিপে খুন করে তারপর জলে ফেলে দেওয়া হয়েছে। তবে প্রাইমারিলি দেখে যা বুঝলাম তাতে মেয়েটার সঙ্গে কোনও ফিজিক্যাল অ্যাসল্ট হয়নি। স্রেফ গলা টিপে খুন করা হয়েছে। মদ খাচ্ছিল যখন পয়সাকড়িও কাছে খুব একটা ছিল না আই গেস। গলায় চেন জাতীয় কিছু…’

‘ছিল না। মানিব্যাগ, মোবাইল ফোন সব এখানেই রাখা আছে।’

‘দেন পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট ছাড়া কিছুই বলা যাচ্ছে না। আমি আসছি এখন। আপনারা রেস্ট নিন।’

ইনস্পেক্টর বিশ্বাস ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বিছানার উপর উঠে বসে গার্গী। ঈশানী এবার মাথার রগদুটো টিপে ধরে, ধীরে ধীরে বলে, ‘আমার একটু একটু মনে পড়ছে, জানিস?’

‘কী?’

‘কাল রাতে আমি চিৎকার করছিলাম। তোদেরকে চিৎকার করে বলেছিলাম—তোরা কেউ আমাকে ছেড়ে যাস না…’ কথাটা বলে আবার নিজের চুল খামচে ধরে ঈশানী, ‘আমি? না তুই? নাকি…তিনজন একসঙ্গেই চিৎকার করছিলাম মনে হয়…’

পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা ধরায় গার্গী, মাথা নিচু করে বলে, ‘বাড়ি গিয়ে কী বলি বল তো? অভির বাড়িতে…’

‘তোকে কিছু বলতে হবে না। সোজা নিজের বাড়ি ঢুকে যাবি। যা বলার আমি সামলে নেব।’

করুণ হাসি হাসে গার্গী, ‘তুই চিরকাল এরকমই রয়ে গেলি।’

‘কীরকম?’

‘এই সব কিছু আমি সামলে নেব ব্যাপারটা। সব কিছুতে তোকে হিরো হতে হবে…একরকম নেশার মতো হয়ে গেছে।’

ঈশানীর মুখে একটা অপরিচিত হাসি খেলে, ‘জীবনে জাস্ট একবার যদি সত্যি সত্যি হিরো হয়ে যেতাম না, আর এই নেশাটা থাকত না। হতে পারিনি বলেই…’

‘আজ থেকে শালা ভিলেন হয়ে যাব। আজকের পর থেকে সব পাল্টে যাবে, লোকে সন্দেহের চোখে দেখবে, জ্যান্ত মেয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে পোস্টমর্টেমে কাটাছেঁড়া লাশ নিয়ে এলাম।’

‘ধুর, কিছু পাল্টাবে না…’ একহাতে মুখের সামনে থেকে ধোঁয়া সরায় ঈশানী, ‘ও শালা দু’দিন হইচই হবে। তারপর আবার যে কে সেই। সিনেমার সুপার হিরো আর সুপার ভিলেনদের সঙ্গে আমাদের একটাই তফাত। আমরা কেউ বেশি দিন হিরো আর ভিলেন হয়ে থাকতে পারি না…’

‘অভিকে ভুলে যাবে সবাই। আমরাও…’

বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে ঈশানী। টেবিলের উপর ছড়িয়ে থাকা জিনিসপাতি ব্যাগের ভিতর ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, ‘এই বেঁচে থাকাটা অনেকটা আকণ্ঠ মদ খাওয়ার মতো। যতদিন বেঁচে আছ সবাই মনে রাখবে। বুকের ধুকপুকুনিটা কমে গেলেই ভুলে যাওয়া শুরু। মাথা থেকে একবার নেশা নেমে গেলে ওই ছেঁড়া ছেঁড়া দৃশ্যের মতো মনে পড়ে কেবল…’

সিগারেটে লম্বা টান দেয় গার্গী, ‘তাও ওর একটা ঠিকঠাক ফ্যামিলি ছিল, পয়সা ছিল, কেরিয়ার ছিল, বাড়িতে ভালোবাসার লোকজন ছিল। আমরা শালা মরে গেলে আমাদের কথা কেউ মনেও রাখবে না। চাকরি নেই বাকরি নেই, বাপের পয়সায় খেয়ে দেয়ে খ্যাপা কুত্তার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা মরে গেলেই বা কী যায় আসে বল তো?’

ওর হাত থেকে কাউন্টার নিয়ে একটা টান দেয় ঈশানী, ‘এসব ভাবলে শালা আঁকতে ইচ্ছা করে আবার। কতকিছু করব ভেবেছিলাম, কিছুই করা হল না।’

‘তুই বাল বেফালতুই ছেড়ে দিলি। তোর আঁকা কার্টুনের মধ্যে কিছু একটা ছিল, অভিও বল…’

‘হ্যাঁ, অনেককিছু ছিল। আলবাল লোকজনের কথা শোনানো, সংসারে অভাব, ইঁদুরের মতো আলমারির কোণে লুকিয়ে থাকা। রাস্তাঘাটে পরিচিত কাকিমা দেখলে লুকিয়ে পড়া…’

‘রাগ হয় না তোর?’ গার্গী ওর চোখের দিকে চেয়ে জিগ্যেস করে।

ঈশানী মাথা নাড়ে। হ্যাঁ বা না তাতে কিছুই বোঝা যায় না। গার্গী আবার বলে, ‘বল, রাগ করে না তোর?’

‘করে…’ হুট করে ঈশানীর গলার স্বর পালটে গেছে। হাতের সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দেয় ঘরের এককোণে, ‘বিশাল রাগ হয় বাল আমার। কিন্তু তাতে কার কী ছেঁড়া গেছে ভাই? আমার বান্ধবিটাকে মাঝরাতে কেউ গলা টিপে মেরে দিল, আমি মাল খেয়ে উল্টে ছিলাম শালা, আমার বাপটা ঠিকঠাক চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেল…তারপর ছবি আঁকাটাও ছেড়ে দিয়ে বালের কর্পোরেট জব করছি সকাল বিকেল। কোন বালটা ছিড়তে পেরেছি আমি রাগ করে?’ গার্গীর মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে ঈশানী, ‘কী জানিস ভাই, যেসব বাঞ্চোত হেরে যায়, তাদের রাগটা আরও বেশি করে হেরে যায়।’

কথাগুলো বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ঈশানী। বাইরে থেকে একটা বাইকের আওয়াজ ভেসে আসে।

তন্দ্রা এসে গেছিল ঈশানীর। চোখ মেলে তাকাতেই গাড়ির সামনের সিটে তন্ময়ের মুখটা ফুটে উঠল। তন্ময় অভিরূপার দাদা। বছরখানেক হল ওর সঙ্গে রিলেশন গার্গীর। ভারি মিষ্টি সম্পর্ক ওদের।

খবরটা পেয়ে বাইকে করে দুপুরের আগেই এসে পৌঁছেছিল তন্ময়। সঙ্গে ছিল তার উকিল বন্ধু। সে সন্ধের দিকে কিছু কাজকর্ম মিটিয়ে বাইকটা নিয়ে ফিরবে।

বিকেল গড়াবার আগেই ওরা রওনা দিয়েছিল ওখান থেকে। সারাদিনের ক্লান্তিতে গাড়িতে ওঠার আধঘণ্টার মধ্যে ওরা দুজনেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।

গাড়ির কাচেই মাথা রেখে এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিল ঈশানী। পাশ ফিরে দেখল গার্গীর মাথাটা ওর কোলের উপরে পড়ে রয়েছে। ও সোজা হয়ে বসতে গার্গীও উঠে বসল।

‘কতদূর এসেছি জানো?’ তন্ময়ের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল সে।

‘ঘণ্টাখানেক লাগবে।’

একটা জংলি পিচরাস্তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে গাড়িটা। দুপাশে গাছপালার সার রাস্তার উপরে ঝুঁকে রয়েছে। অন্ধকার গাঢ় হয়ে জমাট বেঁধেছে তার ফাঁকে ফাঁকে। কোথাও জনবসতির কোনও চিহ্ন নেই। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিল ঈশানী।

‘ডিকিতে কী আছে রে?’ ধরা গলায় প্রশ্নটা করল গার্গী।

‘কী আবার থাকবে?’

‘একটা আওয়াজ হচ্ছে, খেয়াল করে দেখ।’

কান পেতে শোনার চেষ্টা করে ঈশানী। পিচের রাস্তার উপর গাড়ির চাকার আওয়াজে শব্দটা এতক্ষণ ওর কানে যায়নি। হঠাৎ করেই ওর মনে হল গাড়ির ডিকিতে ভারী কিছু যেন এক দিক থেকে আরেক দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে। চিন্তায় পড়ল ঈশানী। মদের বোতল রয়ে গেছে নাকি? কিন্তু আওয়াজটা ততটা গম্ভীর নয়। বরঞ্চ হালকা, ফাঁপা কিছু যেন গড়াচ্ছে গাড়ির ভেতরে।

‘গাড়িটা থামাও তো একবার…’ ঈশানী বলে।

‘কেন? কী হল আবার?’

‘বাথরুম যাব একটু। প্লিজ।’

গাড়ি থামতেই বাইরে বেরিয়ে এল ঈশানী। বাইরেটা থমথমে হয়ে আছে অন্ধকারে। অন্ধকারে দুপাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসা ঝিঁঝির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দের অস্তিত্ব নেই। হাওয়ায় একটা শীতশীত আমেজ খেলা করছে এখানে। ও এগিয়ে এসে ডিকিটা তুলে ধরে। তারপর ফোনের টর্চটা জ্বালিয়ে ভিতরে আলো ফেলে।

একটা কালো হাঁড়ি। তার উপরে চক দিয়ে কাঁচা হাতে মানুষের মুখ আঁকা। বাকি জায়গাটায় পড়ে আছে দুটো বাঁশ। একটা কালচে ছেঁড়া খোঁড়া জামা, আর কিছু খড় বিচালি গোছের জিনিস। ওর মুখ থেকে অজান্তেই একটা শব্দ বের হয়ে এল, ‘কাকতাড়ুয়া! কিন্তু এখানে কাকতাড়ুয়া কে রাখল…’

মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে ঈশানীর। মনে হয় এই কাকতাড়ুয়াটাকে ও আগেও দেখেছে। সেটা অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নয়। ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের পাশে একটা খেত ছিল। সেখানে কাকতাড়ুয়া থাকা বিচিত্র নয়। কিন্তু সেটা গাড়িতে তুলে দিল কে? আর কেনই বা দিল?

হুট করে মাথাটা গুলিয়ে ওঠে ওর। কিছু পুরোনো স্মৃতি যেন হঠাৎ করেই মনে পড়ে যায়। দু’হাতে মাথা চেপে ধরে ও। ডিকিটা এক ঝটকায় বন্ধ করে দিয়ে রাস্তার দিক থেকে দু’পা সরে আসে। সঙ্গে সঙ্গে একটা তীব্র আলো এসে পড়ে ওর গায়ে। এতক্ষণ ক্রমশ বেড়ে ওঠা আওয়াজটা ওর কানে যায়নি। রাস্তার ঠিক উল্টোদিক থেকে ছুটে আসছে একটা লরি। ওর থেকে মাত্র মিটার পনেরোর দূরত্ব আপাতত সেটার।

প্রবল আওয়াজে ঈশানী মুখ ফিরিয়ে তাকায়। কিন্তু ততক্ষণে ওর হাত পা কোনও অজানা অসুখে অবশ হয়ে গেছে। ও বোকার মতো তাকিয়ে থাকে সেই বেড়ে ওঠা হেডলাইটের আলোর দিকে। দূর থেকে কে যেন আর্তনাদ করে ওঠে।

খুট করে একটা আওয়াজ কানে আসে ওর। বুঝতে পারে ওর ঠিক পেছনে গাড়ির ডিকিটা খুলে গেছে। পরমুহূর্তেই একটা নরম হাত ওর কোমর চেপে ধরে ওকে দূরে সরিয়ে আনে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত লরিটার সামনে থেকে।

মাটির উপরে আছড়ে পড়ে ঈশানী। কোমর আর হাত ঠুকে যায় শক্ত পিচের রাস্তায়। সেই ধাক্কার প্রতিঘাতেই মাথার কোষে আবার রক্তসঞ্চালন শুরু হয় ওর। নোংরা একটা খিস্তি ভেসে আসে লরিটার দিক থেকে। ওদের গাড়িটা পেরিয়ে চলে যায় সেটা।

কোনরকমে উঠে দাঁড়ায় ঈশানী। কী হল এইমাত্র? ডিকির ভিতর কাকতাড়ুয়া ছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না। তাহলে লরিটার সামনে থেকে কে সরিয়ে ফেলল ওকে?

মাথা চেপে ধরে ঈশানী। কয়েক সেকেন্ড আগে শোনা একটা অপরিচিত গলার আওয়াজ ওর কানে বাজতে থাকে। পরিচিত, ভীষণ পরিচিত গলার আওয়াজটা! ওকে ছুটন্ত লরির সামনে থেকে সরিয়ে নিতে নিতে কেউ ওর কানের কাছে বলেছিল, ‘আপনি ভয় পাবেন না…আমি থাকতে কিচ্ছু হবে না আপনার…’

কাকতাড়ুয়া – 4 অধ্যায়

চতুর্থ অধ্যায়

মুখে বিড়ি গুঁজে দেওয়ালে রং চড়াচ্ছিল ঈশানী। রঙের বালতির মধ্যে ব্রাশ ডুবিয়ে রংটা মেশাচ্ছিল ভালো করে। সেই টকটকে লাল রং তুলে ব্রাশ বুলাচ্ছিল দেওয়ালে। ওর পাশেই দাঁড়িয়েছিল অভিরূপা। বাঁশের কঞ্চির ডগায় পতাকার ফিনফিনে কাপড় জড়াচ্ছিল সে। ঝান্ডাগুলো বানিয়ে নামিয়ে রাখছিল পাশে।

এমন সময় পেছনে একটা বাইক এসে থামতে ও মুখ তুলে তাকাল। তারপর বিড়িতে আর একটা টান দিয়ে আবার দেওয়ালে রং চড়াতে লাগল। লোকটাকে ও চেনে। কঞ্চিদা, ভালো নাম কৃষ্ণেন্দু। পাড়ার বখাটে ছেলে, ছেলেবেলায় ঈশানীকে কয়েকবার প্রোপোজ-টোপজ করেছিল। বাপের মোটামুটি পয়সা ছিল বলে পড়ালেখা তেমন করার দরকার হয়নি। তবে একবার কীসব সোনা লেনদেনের কেসে ফেঁসে গিয়ে গয়নার দোকানের মালিকের কাছে উত্তাল ক্যালানি খেয়েছিল। শুধু তাই নয়, কঞ্চিকে ভিতরের ঘরে নিয়ে গিয়ে নাকি নিজের পেছন চাটিয়েছিল। সেই থেকে পেছন চাটা একরকম নেশা হয়ে গেছে কঞ্চির।

সেই গয়নার কেসে ফেঁসেই পার্টি করা শুরু করেছিল কঞ্চি। তারপর থেকে সেই গরু দুইয়ে দুইয়েই মালামাল হয়ে গেছে। মেজাজ বদলে গেছে তখন থেকেই। কঞ্চি কম বয়সেই বুঝেছিল চারপাশের যা পরিস্থিতি তাতে মাথার বদলে জিভ চালানোই ভালো। আগের বছর ভোটে জিতে এলাকার কাউন্সিলর হয়েছে।

চোখ থেকে সোনালি ফ্রেমের চশমাটা খুলে বুকের কাছে গুঁজে নেয় কঞ্চি, তারপর একটু ভারিক্কি গলায় বলে, ‘তুই আজকাল সিগারেট ছেড়ে বিড়ি খাচ্ছিস কেন রে?’

‘পয়সা নেই, তাই।’ ঈশানী মুখ না ঘুরিয়েই বলে।

‘সারাদিন পড়াশোনা, কাজকর্ম ছেড়ে, ভোটের আগে দেওয়াল লিখলে কি আর পকেটে পয়সা আসে?’

ঈশানী মাথা নাড়ে, ‘না, না পয়সা আসে না। উটকো লোক আসে ফোকোটের জ্ঞান দিতে…’

কঞ্চিদা বাইক থেকে নেমে পড়ে। বাইকের সিটের উপরে হাত বুলিয়ে ধুলো ঝেড়ে বলে, ‘ফোকোটের জ্ঞান নয়, তবে একটা চাকরি দিতে পারি তোকে। করতে চাস তো বল…’

ঈশানীর মুখে একটা বাঁকা হাসি ফোটে, ‘তোমার বাপ ঠাকুরদার ব্যবসা চলছে লোকের চাকরি মেরে, আর তুমি এসেছ চাকরি দিতে? ফোটো তো এখান থেকে!’

‘সেই বাপ ঠাকুরদারই বাড়িতে চাকরির কথা বলছি…’ কঞ্চি বাইকের আয়নায় একবার মুখটা দেখে নেয়, ‘বাপিদার মেয়েটা আছে না? ক্লাস ফোরে পড়ে। ইংলিশ মিডিয়াম।’

‘তো আমি কী করব তাতে?’

‘আঁকা শেখাবি। উইকে চারদিন গিয়ে আঁকা শিখিয়ে আসবি। মাস গেলে দশহাজার টাকা। রাজি থাকলে বল…’

‘রাজি নেই।’ ঈশানী ব্রাশে ঘন করে রং লাগিয়ে কপাল থেকে চুল সরায়। একটু আগের কথাগুলো যেন শুনতেই পায়নি সে।

‘তা কেন থাকবি? ওই তো একটা সেক্টর ফাইভের চাকরি করিস। কত মাইনে পাস জানা আছে। আজ কিছু জমানো টাকা পয়সা থাকলে তো বাপটাকে বাঁচাতে পারতিস। কাল যদি মায়ের কিছু হয়, কী হবে?’

‘মরে যাবে…’ এতক্ষণে দেওয়ালের দিক থেকে ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকায় ঈশানী।

‘তাও তুই বাপিদার মেয়েকে আঁকা শেখাবি না?’ কঞ্চির মুখটা একবার কঠিন হয়ে ওঠে। বাপিদাকে মনে হয় কথা দিয়ে এসেছে সে। ঘ্যাসঘ্যাসে গলায় বলে, ‘এত অহঙ্কার কোত্থেকে আসে তোর…’ তারপর দেওয়ালে আঁকা চিহ্নটার দিকে চেয়ে একটা বাঁকা হাসি হাসে কাঞ্চি বলে, ‘যে পার্টি জিরো হয়ে গেচে তার দেওয়াল লিখে কী লাভ কে জানে…’

অভিরূপা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। এই কথাটা কানে যেতেই ঈশানীর একটা হাত চেপে ধরল ও, ‘ছেড়ে দে রুনু, মাথা গরম করিস না…’

কিন্তু ততক্ষণে আগুনে ঘি পড়ে গেছে, হাতের ব্রাশটা পাশে রেখে কঞ্চির দিকে এগিয়ে এল ঈশানী, ‘লাভ? তোমার মুখ দেখে তো মনে হয় না তোমাদের আদৌ দাঁড়ায়-টাড়ায় বলে। তাও বাচ্চামেয়েদের দিকে তাকিয়ে তোমাদের যা লাভ হয়, ঠিক তাই…’

‘মানে! কী বলতে চাইছিস কী তুই?’

‘মানে ওটা ভিতর থেকে আসে। ইন্সটিঙ্কট বলে। বাপ ঠাকুরদার থেকে পেয়েছ শুধু আলুর দোষ আর এই এত্ত বড় একটা জিভ। যেটা দিয়ে যখন তখন যার তার পোঁদ চেটে দেওয়া যায়…’

কঞ্চির মুখটা একবার শ্বাপদের মতো ফুঁসে ওঠে। চোখদুটো মুহূর্তে হলদে হয়ে যায়, ‘আরও খারাপ দিন আসবে তোর রুনু। সেদিন দেখব এত চোপা কোথায় যায় শালা…হ্যাট…’ হাতের এক ঘুষিতে ঈশানীর স্কুটির একটা আয়নার ডান্ডা বাঁকিয়ে দেয় কঞ্চি। যেন মনের আক্রোশ ঝেড়ে ফেলতে চায়।

মাটির উপর থুতু ফেলে বাইকে উঠে স্টার্ট দেয়। মালিকের মন বুঝেই হিংস্র ঘড়ঘড় শব্দ করে রাস্তা দিয়ে ছুটে চলে যায় সেটা।

অভিরূপা ওর চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে নিভে আসা গলায় বলে, ‘চাকরিটা করতে পারতিস। সকালের দিকটা তো ফাঁকাই থাকিস। উপরি কিছু আয় হত। টাকাটা এই মুহূর্তে কতটা দরকার তোর ভুলে যাচ্ছিস?’

উঠে গিয়ে আয়নাটা সোজা করে ঈশানী, তারপর সেটা পরিষ্কার করতে করতে বলে, ‘পারতাম। কিন্তু এই আয়নাগুলোই শালা যত নষ্টের গোড়া। আমি যদি কোনওদিন মুখ্যমন্ত্রী হতাম না, আগে নিয়ম করে সব আয়না ভেঙে ফেলতাম…’

অভিরূপা তাও তেমন মুখ ফুলিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে, ‘বাড়িতে দুটো মানুষ একা থাকিস। বিপদে পড়লে আজকাল লোকে পাশে এসে দাঁড়ায় না। তাও আবার মিডল ক্লাসের। রাস্তাঘাটেও গন্ডগোল করতে পারে। আমার চিন্তা হয় তোর জন্য…’

অভিরূপার গালে হাত রাখে ঈশানী, ‘মাঝে মাঝে ভাবি পয়সাকড়ি হলে ভালোই হত। বড় গাড়ি, বড় বাড়ি…তারপর মনে হয়…’

‘কী?’

ঈশানী কাঁধ ঝাঁকায়, ‘বেশি পয়সা হলে দেখতে খারাপ হয়ে যাব। ভালো ছেলে পটবে না। চ, বাড়ি যেতে হবে…’

অভিরূপা স্কুটিতে উঠতে উঠতে বলে, ‘তুই এদের অপমান করে ঠিক করিস না। রুলিং পার্টির লোক হাতে রাখা দরকার…’

বিড়িটা রাস্তার ধারে ফেলে দেয় ঈশানী, তারপর ওর হাত থেকে ঝান্ডাটা নিতে নিতে বলে, ‘বেশ তো, তুই হাতে রুলিং পার্টির লোক রাখ। আমি ঝান্ডা রাখছি…’

পতাকাটা স্কুটির সামনে গুঁজে নেয় ঈশানী। তারপর স্কুটিটা ছুটিয়ে দেয় রাস্তার উপর দিয়ে। এখান থেকে অভিরূপার বাড়ি যেতে গেলে ওর বাড়ি পেরিয়ে যেতে হয়। তার আগে একটা ছোট বাজার পড়ে। খুব ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে বাজারে আসত ঈশানী। মা যখন মাংস কিনত ও কিছুটা সরে দাঁড়াত। মুরগি কাটা দেখতে অস্বস্তি হত ওর। বিশেষ করে কাটার ঠিক আগে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার মুহূর্তে মুরগিগুলো যে চিৎকারটা করত সেটা খুব চেনা মনে হত। কে জানে কোথায় শুনেছে, মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়তো পৃথিবীর সব প্রাণীর মরতে না চাওয়ার চিৎকার একই রকম…

সেই দোকানটা পেরিয়ে গেলেই একটা মাছের বাজার। মাছের গন্ধ একদম সহ্য হয় না ঈশানীর। ও জায়গাটায় এসে অজান্তেই ওর চোখ বন্ধ হয়ে যায়।

স্কুটি চালাতে চালাতেই পেছন ঘোরে ঈশানী, ‘আমার পয়সা হলে শুধু এইটুকু শখপূরণের আছে, বুঝলি?’

‘কী শখ?’

‘একদিন স্কুটি করে বাড়ি ফিরব। আর এই মাছমাংসের গন্ধের মধ্যে দিয়ে ফিরতে হবে না। শুধু এইখানটায় এসে চোখ বন্ধ করলে ভেজা মাটির গন্ধ পাওয়া যাবে…’

‘এ বাড়িতে যতদিন আছিস ততদিন সেটা সম্ভব নয়।’

‘পালিয়ে যাব বলছিস?’

যে রাস্তাটার উপর দিয়ে চলেছে স্কুটিটা তার বেশিরভাগটা জুড়ে মাটির উপর আলপনা আঁকা আছে। রংবেরঙের নকশায় সেজে আছে রাস্তাটা। সরস্বতী পুজোর আগে গোটা রাস্তা জুড়ে এক দল ছেলেমেয়ে সারা রাত জেগে আলপনা দিত। গোটা ব্যাপারটার দায়িত্ব পড়ত ঈশানীর ঘাড়ে। কাজটা ভালোবেসেই করত ও। সরস্বতী পুজো হয়েছে তাও অনেকগুলো মাস হতে চলল। এতদিনে সে আলপনা কিছুটা ফিকে হয়ে গেলেও একেবারে উঠে যায়নি। তার উপর দিয়েই আপাতত ঈশানীর স্কুটির চাকা ছুটে চলেছে। সেদিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই অভিরূপা বলে, ‘তুই কবে প্রথম কার্টুন এঁকেছিলি মনে আছে?’

হেলমেটটা মাথার উপর ঠিক করে বসাতে বসাতে ঈশানী মনে করার চেষ্টা করে। তারপর ঠোঁট উল্টে বলে, ‘উঁহু…কী জানি, মনে পড়ছে না…’

‘মাঝে মাঝে আমার মনে একটা প্রশ্ন আসে, জানিস?’

‘কী প্রশ্ন?’

‘তুই তো সত্যিই ছোটবেলা থেকে এত রকমের আঁকা আঁকতে পারতিস। রিয়েলিস্টিক ড্রইং, পোট্রেট, ল্যান্ডস্কেপ। সেসব এঁকে পয়সাকড়িও ছিল। সব কিছু ছেড়ে কার্টুন কেন?’

ঈশানী হাসে, ‘ছোটবেলা থেকে ওই একটা জিনিসই অস্ত্র ছিল আমার, সারকাজম। জীবনে আর কিছু তো করতে পারিনি। তাই শেষ পর্যন্ত ব্যঙ্গটাকেই হাতিয়ার করে নিলাম…’

‘উঁহু এটা তুই বলে বেড়াস। আসল কারণ অন্য কিছু…’

‘তোকে কে বলল?’

ঈশানীর দু’কাঁধে হাত রাখল অভিরূপা, ‘তোর এই উপর উপর কঠিন হয়ে থাকা পারসোনাটা আর কেউ না জানুক আমরা ভালো করে জানি…একদিন কেউ এসে এটা ঠিক ভেঙে দেবে, দেখে নিস তুই…’

‘ভেঙে দেবে বলতে?’ ঈশানী অবাক চোখে আয়নার দিকে চায়। অভিরূপা ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়—

‘কেন জানি না মনে হয় সেই যে ছোটবেলায় যেরম ভাবতাম—আমাদের জীবনে একটা স্যাঠাভাঙা প্রেম আসবে। সর্ষে খেতের মধ্যে বসে ম্যান্ডোলিন বাজাবে কেউ, কারও জন্য খুব কাঁদতে ইচ্ছা করবে, কারও জন্য হাসতে ইচ্ছা করবে, এক ঝলক দেখার জন্যও কোচিনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছা করবে, কারোর বুকে মাথা দিয়ে ঘুমোতে ইচ্ছা করবে নিশ্চিন্তে…বড় হতে হতে আর মনে হয় ওসব কোনওদিন আর হবে না…ওসব ছোটবেলার খেয়াল হিসেবে ঠিক আছে…’

ঈশানী রাস্তার উপর চোখ রেখেই একটার পর একটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে যেতে থাকে, ‘তোর প্রেমটা তো ঠিকই ছিল। কেটে গেল কেন বল তো?’

‘গেল না, দিলাম। আমার আর ভালো লাগছিল না।’

‘কেন?’

‘আমাকে ধরে রাখা অত সহজ নয় রে রুনু। আমার মাথাটা খুব গোলমেলে। কখন কী যে করি…আমিও কাউকে ধরে রাখতে পারি না…’

‘আপাতত আমাকে ধরে রাখ, নাহলে উল্টে পড়বি।’ একটা ইউটার্ন নিতে নিতে ঈশানী বলে। অভিরূপা হেসে ওর কাঁধ খামছে ধরে।

এরপর থেকে রাস্তাটা ফাঁকা। স্কুটির বেগ বাড়িয়ে দেয় ও। উদাস হয়ে কী যেন ভাবতে ভাবতে বলে, ‘আমার এক মামা একবার ক’টা জ্যোতিষীর বই কিনেছিল, বুঝলি? বেয়াড়া শখ চড়েছিল মাথায়। কিছুদিন সেইসব বই চর্চাটচ্চা করে সে শালা বলেছিল, বাইশ বছরের পর থেকে আমার ভাগ্য নাকি সুপ্রসন্ন হবে। আমার জীবনে এমন একজন আসবে যে জীবনের সব কালো ছায়া দূর করে দেবে। জীবনের মানে খুঁজে দেবে। প্রাণ দিয়ে রক্ষা করবে আমাকে। তোর ওই সিনেমার হিরোদের মতো…’

‘তোর তো বাইশ পেরিয়ে গেছে। তেমন কেউ কখনও আসেনি?’

স্কুটির জোর বাড়ায় ঈশানী, ‘এসেছিল। তবে বাইশ বছরে নয়। জন্ম থেকে। আমার বাপ…’

‘গোস্বামী স্যার তোমাকে ডাকছেন ওনার ঘরে…’

ল্যাপটপের স্ক্রিনে মুখ গুঁজেছিল ঈশানী। গার্ডদাদার কথাটা শুনে মুখ তুলল সে, ‘আমাকে! কেন? আমি আবার কী করলাম?’

‘তা তো বলতে পারব না। তুমি নিজেই গিয়ে দেখো। তবে মনে হল স্যারের মেজাজটা আজ ভালো নেই…’

সামনে মেলে থাকা কাগজগুলো একদিকে সরিয়ে রাখল ঈশানী। তারপর এক গ্লাস জল খেয়ে কিউবিকল ছেড়ে উঠে আইল দিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেল কাচের ঘরটার দিকে।

হোসেন ওর পাশের চেয়ারে বসেছিল, সহানুভূতিমাখা গলায় বলল, ‘হাওয়া ভালো না। আজ গাঁড় ফাটল তোর।’

টিম লিডারের ঘরের দিকে হেঁটে যাওয়াটা মাঝেমধ্যে ওয়াক অফ সেম মনে হয় ওর। যেন ফাঁসির মঞ্চ অবধি ও হেঁটে যাচ্ছে আর বাকি কয়েদিরা ওর দিকে তাকিয়ে করুণার হাসি হাসছে। কিংবা থালা বাসন বাজিয়ে ফুর্তি করছে। তফাত কেবল একটাই, এখানে ফাঁসির পর আবার ফিরে আসতে হয়।

স্লাইডিং ডোরটা ঠেলে ঘরের মধ্যে মুখ বাড়াল ঈশানী। এই ঘরটার মধ্যে কেমন একটা টর্চার চেম্বারের গন্ধ আছে। এসিটা স্বাভাবিকের থেকে একটু বেশি কমানো। বেশিক্ষণ দাঁড়ালেই কেমন গা শিরশির করে।

‘আমি আসতে পারি স্যার?’ ঈশানী একটু গলা খাঁকারি দিয়ে জিগ্যেস করে।

উত্তর না পেয়ে আবার গলা তোলে, ‘মে আই কাম ইন স্যার?’

‘ইউ শুড…’

সামনের চেয়ারটা দেখিয়ে দিলেন গোস্বামী, ‘ইউ লুক এক্সজস্টেড। জল খাবে?’

প্রশ্নটার মধ্যে যে বক্রোক্তি মিশে ছিল সেটা বুঝতে পারল ঈশানী। টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে একটু হাসলেন গোস্বামী, ‘বা ধরো চা, কফি, বা বন্ধুবান্ধব মিলে যেগুলো খাও। এই ফেসবুকে ছবি দেখি আর কী…’

ঈশানী মুখ সরিয়ে নেয় সেদিক থেকে, ‘ওসব আগের ছবি। বাবা মারা যাওয়ার পর ছেড়ে দিয়েছি। আপনি আমার প্রোফাইল স্টক করছিলেন নাকি?’

প্রশ্নটায় পাত্তা দিলেন না গোস্বামী, ‘তা ছেড়ে দিয়ে কী করছ এখন? মানে অফিস ছাড়া?’

‘চেষ্টা করছি কিছু করার। বাড়ি ফিরে এত ক্লান্ত থাকি যে আর নতুন করে কিছু…’

‘এই অফিসে কাজ করার পরেও বাড়ি ফিরে যদি তোমার কিছু করতে ইচ্ছা করে বুঝবে অফিসটা ঠিকঠাক করছ না…’

ঈশানীর মাথাটা গরম হয়। কোনরকমে হাতের মুঠো শক্ত করে কাঁধ ঝাঁকায় সে, ‘আমি বুঝতে পারছি না আপনি কী বলছেন? আমার টার্গেট ফুলফিল করা…’

‘টু হেল উইথ ইয়োর টার্গেট। তোমার কি মনে হয় কর্পোরেট সেক্টরে টার্গেট ফুলফিল করতে পারলেই তোমার সাতখুন মাফ হয়ে যাবে?’

ঈশানী একটা বাঁকা হাসি হাসে, ‘আমি ইচ্ছামতো খুন করতে পারলে আর মাফ চাওয়ার দরকারই হত না…’

টেবিলে হালকা একটা চাপড় মারেন গোস্বামী, ‘এই, তোমাদের জেনারেশনের এই মুখটার জন্যেই যত সমস্যা। যাদবপুর কি জেএনইউতে বসে দু চারটে ব্রা প্যান্টি আন্দোলন আর বড় বড় ভাষণ ছাড়া কোনও অউকাত নেই তোমাদের…’

‘ঠিক যেমন অউকাত শব্দটা নেই, বাংলায়…’ ঈশানী মুখ ফিরিয়ে একবার নাক চুলকে নেয়, ‘হঠাৎ আমার উপর এত রেগে গেলেন কেন? হয়েছেটা কী?’

‘উই হ্যাভ রিপোর্টস, তোমার আচার-আচরণ ঠিক নেই…’

‘ঠিকই বলেছেন। আমার কাছের কেউ না হলে এত ভালো করে চিনত না। দাবিটা কী?’

‘মিস্টার সোনাল ফ্রম গুজরাট তোমার সঙ্গে আলাদা করে কন্টাক্ট করেছিল প্রজেক্টের ব্যাপারে। তুমি তাকে ডিনাই করেছ কেন?’

‘প্রজেক্ট!’ ঈশানী ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘কীসের প্রজেক্ট? কফি খাওয়ার? হেই ওয়ানা হ্যাভ সাম কোল্ড কফি উইথ ক্রিম? বাঞ্চত শালা…’

‘তুমি খাও না কফি?’

একটু পিছিয়ে বসে ঈশানী, ‘খাই। ওনার চেহারাটা দেখেছেন? আরে শুয়োরের বাচ্চা ওই চেহারায় ক্রিম খেলে ডায়াবেটিসে মরবি…’

‘শাট ইয়োর ফাকিং মাউথ আপ…’ টেবিলের উপর আক্রোশে পেনটা ছুড়ে ফেলেন মিস্টার গোস্বামী, ‘আর একটা কথা বললে কুত্তার মতো লাথি মেরে বের করে দেব অফিস থেকে। আমার অফিসে থাকতে গেলে তোমার উপর তলার কথা তোমায় শুনতে হবে। আর এই এটিটিউডটা বাইরের পাপোষে রেখে আসবে। মাসের শেষে স্যালারিটা এমনি এমনি ঢোকে না…’

ঈশানী কিছু বলে না। একটানা চেয়ে থাকে নিচের দিকে। ঘরের কনকনে এসিটার হাওয়া গরম হয়ে ওর গায়ে লাগে।

‘আর নিচে তাকিয়ে কী দেখছিস বাঁড়া? তাকা…’ গোস্বামীর কথাগুলো থুতুর মতো আছড়ে পড়ে ওর মুখে।

মুখ তুলে তাকায় ঈশানী।

‘ভালো করে মনে রাখ। তোকে কিনে রেখেছি আমরা। সেভেন হান্ড্রেড ফিফটি রুপি আ ডে। আমাদের কথায় তুই স্ক্রিনের দিকে তাকাবি, মেইল করবি, ঘাড় নিচু করে কাজ করবি। ইউ উইল ওয়াক দ্যা ওয়ে উই ওয়ান্ট, স্পিক দ্যা ওয়ে উই ওয়ান্ট, এন্ড ফাক দ্য ওয়ে উই ওয়ান্ট…’

ঈশানীর হাতে মুঠো খুলে যায়, বাবার কথা মনে পড়ে যায় ওর। একাত্তরের দশকে লাল ঝান্ডা নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়া বাবা। চাষির গান, বারুদের গন্ধ, ধানের খেতে লুকিয়ে থাকা রক্তের দাগ, পুলিশের এনকাউন্টার, ব্যারিকেড…

উঠে এসে ওর একটা হাত চেপে ধরেন গোস্বামী, ‘বুঝিস না কেন বল তো, তুই তো আমার মেয়ের মতো…খারাপের জন্য বলি?’

ঈশানীর মুখে কোনও কথা ফোটে না। এসির ঠান্ডা হাওয়ায় কয়েক সেকেন্ড পর সেই লাল রঙ নিজে থেকেই হালকা হয়ে আসে।

‘আমাকে ক্ষমা করো বাবা…’ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে সে।

‘কী বললে?’ গোস্বামী ফিরে তাকান ওর দিকে।

‘ওই যে আপনি মেয়ের মতো ভাবেন বললেন। তাই ক্ষমা চাইলাম। আর হবে না এরকম…’

গোস্বামীর ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ঈশানী দেখল গার্ডদাদা দাঁড়িয়ে আছে ঘরের ঠিক বাইরেটায়। ওকে দেখে তার চোখ মুখ কেমন যেন নিভে এল।

‘তুমি একবার ওয়াশরুমে যাও দিদি। মুখটা কেমন যেন দেখাচ্ছে…’

‘লাগবে না। প্রেশার আছে কাজের…’ কথাটা বলে একরকম তাকে পাশ কাটিয়েই নিজের কিউবিকলের দিকে এগিয়ে গেল ঈশানী।

‘কী বলল রে তোকে?’ পাশ থেকে কে যেন জিগ্যেস করল। মানুষটাকে দেখতে পেল না ঈশানী।

নিজের কিউবিকলে এসে আবার ল্যাপটপ গুছিয়ে বসল সে। সামনের ছড়িয়ে থাকা কাগজগুলোর উপর কী যেন খুঁজতে থাকল মন দিয়ে। কালকের লগবুকের আপডেটটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছে না। ওটাকেই অ্যাটাচ করে একটা মেইল করতে হবে…

একটা সাদা পাতা খসে পড়ল ঈশানীর পায়ের কাছে। সেটা তুলে নিল। নাঃ, নিতান্ত অদরকারি কাগজ। ওয়েস্ট পেপার বাস্কেটে ফেলে দিতে যাচ্ছিল, থেমে গেল। ফেলেই তো দেবে কাগজটা।

ফাঁকা সাদা দিকটা উল্টে তার ওপরে বড় করে একটা বাক্য লিখল ঈশানী, ‘ক্ষমা করো বাবা…’

তারপর কী মনে হতে আবার লিখল। আবার, আবার…

ছোটবেলায় হাতের লেখা প্রাকটিস করার মতো লিখেই চলল ঈশানী…

‘আশেপাশে যা দেখতে পাচ্ছ তাই আঁকো।’ মুকুন্দ স্যার এই কথাটা রোজই বলেন। আর ক্লাস ভর্তি ছেলেমেয়েরা হাঁ করে স্যারের মুখের দিকেই চেয়ে থাকে। স্যার ওদের আপেল, আম আর কুঁড়েঘর আঁকতে শিখিয়েছেন। দুটো লাইন টেনে আকাশে উড়ন্ত পাখি আঁকতে শিখিয়েছেন। কিন্তু ওদের চারপাশে সেসব কিছুই নেই। যা আছে সেগুলো আঁকা ভারি শক্ত। সেগুলো মোটেই শুধু লাইন দিয়ে তৈরি নয়।

আজও কথাটা শুনে ক্লাসের বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে তেমন কোনও হেলদোল দেখা গেল না। কেউ কেউ সাদা পাতার ওপরে আঁক কাটল। কেউ কুঁড়েঘরের চালা বানাতে বসল।

রুনু যেখানে বসে আছে তার পাশেই একটা খোলা জানলা। আঁকার ক্লাসে এটাই ওর জায়গা। যখন এখানে ভর্তি হয়েছিল তখন গরমকাল ছিল। জানলা দিয়ে রোদ আসত বলে এ সিটে কেউ বসতে চাইত না। রুনুই ওখানে গিয়ে বসে। আপাতত শীতকাল আসবে আসবে করছে। রোদের আমেজটা মন্দ লাগে না রুনুর। সকাল সকাল স্নান করে চুল আঁচড়ে মা ওকে স্কুলে পাঠিয়ে দেন। হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে রোদের তাপ গায়ে মাখতে ভালোই লাগে।

কিন্তু ইদানীং এই জানলাটা ওকে টানে অন্য একটা কারণে। এই আঁকার স্কুলটা একতলা। জানলার ঠিক লাগোয়া একটা গাছপালার ঝোপ। রোজই জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সেই ঝোপে একটা সাপকে দেখতে পায় রুনু। বেশ বড়সড়ো চেহারা। ঝোপের মধ্যে থেকে সরসর করে সরে একদিক থেকে অন্যদিকে চলে যায়। মাঝে ওদের আঁকার স্কুলের জানালাটার কাছে এসে একবার থমকে দাঁড়ায়। আচ্ছা সাপটা ছেলে না মেয়ে? কে জানে, মনে মনে ওর একটা নাম দিয়েছে ঈশানী—চারু। ছেলেদেরও হতে পারে, মেয়েদেরও হতে পারে।

রুনু খেয়াল করে দেখেছে চারু রোজ ঠিক ওই জায়গায় এসে একইভাবে মাথা তুলে জানলা দিয়ে কী যেন দেখে। মনে হয় ওকেই দেখে। খয়েরি ডোরাকাটা গায়ের রং। খুদে খুদে চোখ দুটো যেন সারাক্ষণ জলে ভরে থাকে। ভারি মায়া লাগে ওই চোখের দিকে চেয়ে থাকলে।

সাপেদের এরকম অদ্ভুত স্বভাব আছে বলে রুনু আগে শোনেনি। প্রথমদিন অমন করে ঘাসের ভিতর থেকে মাথা তুলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভয়ই লেগেছিল। কিন্তু রোজ একই ঘটনা ঘটতে ঘটতে ওর ভয়টা কেটে গেছে। বরঞ্চ এখন মনে হয় চারুর সঙ্গে যেন বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওর।

সাপেদের তো হাত-পা নেই, তাই মাথা তুলেই ওর সঙ্গে গল্প করতে চায় সাপটা। মাঝে মাঝে জিভ বার করে। ভাবখানা এমন যেন একটু কথা বলতে পারলেই কত কী বলে ফেলত!

রুনু ভেবেছে একদিন চারুকে খেতে দেবে। সাপেরা কী খায়? ব্যাঙ খায় নিশ্চয়ই। কিন্তু ব্যাঙ পাবে কোথায়? আচ্ছা চারুর কি বিষ আছে? নিশ্চয়ই নেই। বাবা বলেছে, ফনাওয়ালা সাপেদের কেবল বিষ থাকে। আমাদের আশেপাশে যেসব সাপ ঘুরে বেড়ায় তাদের বিষ থাকার কথা নয়।

‘কী হল, তুমি আঁকছ না কেন? জানলার বাইরে তাকাও আর যা দেখছ তাই আঁকো।’

স্যারের ধমক খেয়ে আবার বাইরে তাকায় রুনু। চারু এখন ওর দিকে চেয়ে আছে। যেন চোখে চোখে কত কথা বলতে চাইছে ওর সঙ্গে। ভারি মিষ্টি একটা অনুভূতি হয় রুনু। ওর মনে হয় সাপটা চাইছে রুনু ওর একটা ছবি এঁকে দিক। বড় বড় আঁকিয়েদের যেমন মডেল হয়, সাপটা ওর মডেল হতে চাইছে।

জানালার দিকে এগিয়ে বসে রুনু। কী মনে হতে একবার সেদিকে তাকিয়ে হাত নাড়ে। ও স্পষ্ট বুঝতে পারে সাপটা যেন খুশি হয়। অপলক চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। আরও কয়েকবার জিভ বের করে কী যেন বলতে চায়…

ঠিক সেই সময় একটা থান ইট সজোরে এসে পড়ে সাপটার শরীরের ঠিক মাঝবরাবর।

বাইরে গার্জিয়ানরা এসেছিল বাচ্চাদের নিতে। তাদের মধ্যেই কয়েকজন দেখতে পেয়েছে সাপটাকে। তারপরে ছুড়ে মেরেছে ইটটা।

‘ওকে মারছ কেন?’ রুনু চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু বাইরে ততক্ষণে হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে।

‘কোনও আক্কেল নেই এদের! এত বাচ্চা আসে তার দরজার বাইরেই এত বড় সাপ!’

‘আর একটু হলেই কামড়ে দিত…মেরে দিন অজয়দা…’

ইটের ঘা খেয়ে সাপটা ঝোপের মধ্যেই পড়ে গেছে। খুব কি আঘাত লেগেছে ওর? রুনু জানলা ধরে দাঁড়িয়ে আবার চিৎকার করে ওঠে, ‘ওকে মেরো না, ওর বিষ নেই, ওর বিষ নেই…’

অভিভাবকদের মধ্যে কয়েকজন হট্টগোল করে এগিয়ে আসে। পাশের ঝোপ থেকে কয়েকটা লাঠি কুড়িয়ে নিয়েছে ওরা। আঘাত পেয়ে আর নড়তে পারেনি সাপটা। তেমন করেই আলগা হয়ে পড়ে আছে ঝোপের মধ্যে। হাত নেই, পা নেই, পলক নেই বলে যন্ত্রণাও বোঝা যায় না তার…

ঘাসের উপর একটু চলার চেষ্টা করে আবার ঘাসের উপরেই নেতিয়ে পড়ে সে। অভিভাবকের দল ততক্ষণে লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করেছে সাপটাকে। বারবার আঘাত হানছে ওর মাথা বরাবর। সাপটা মরে যাবে এবার।

রুনুর চোখ ছাপিয়ে জল আসে, ‘ও আর আসবে না, ও আমার বন্ধু, মেরে ফেলো না ওকে, মেরো না, মেরো না…’

সাপটা কি চাইল ওর দিকে? একবার শেষ দেখা দেখে নিল বাচ্চা মেয়েটাকে? চোখে পলক নেই বলে বোঝা যায় না।

দেহটা ক্রমশ ঝিমিয়ে আসছে ওর। লোকগুলো বীরবিক্রমে পা দিয়ে থেঁতলে দিয়েছে ওকে। তাদের মধ্যেই একজন আরও সাহস দেখিয়ে এগিয়ে আসে। দড়ির মতো তুলে ধরে মৃতপ্রায় সাপের দেহটা। তারপর অবলীলায় মাঝখান থেকে চিরে ফেলে সাপটাকে।

‘যা দেখতে পাচ্ছ তাই আঁকো, অত ভাবতে হবে না…’ মুকুন্দ স্যার আবার হাঁক দিয়ে ওঠে।

লোকগুলো ততক্ষণে সাপের শরীরটাকে লাঠির ডগায় তুলে কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছে। এখনও কি বেঁচে আছে ও? চোখে কি একই রকম জল টলটল করছে?

চোখের জল মুছে দ্রুত সাদা পাতার উপরে কয়েকটা আঁক কাটে রুনু। তারপর খাতার পাতাটা জানলার ঠিক সামনে তুলে ধরে। যেন ওই মৃত চোখদুটোকেই শেষ বারের মতো দেখাতে চায় তার ছবি। সাপটা সে ছবি দেখে কিনা আর বোঝা যায় না।

‘এ কী! এর মধ্যেই তোমার আঁকা হয়ে গেল?’

ওর হাত থেকে কাগজটা ছিনিয়ে নেন মুকুন্দ স্যার। রুনু ফিরেও তাকায় না সেদিকে। মাটির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে আর একবার চোখের জল মোছে সে। তারপর স্তব্ধ হয়ে যায়।

কাগজটা ভালো করে দেখেন মুকুন্দ, মুখে চোখে বিরক্তির রেখা ফোটে তার, ‘সাপই যখন আঁকবে তখন ঠিক করে আঁকো! সাপ এরকম থ্যাঁতলানো আর মাঝখান থেকে চেরা হয় নাকি?’

কাগজটা ছুড়ে মেয়েটার সামনে ফেলে দেন মুকুন্দ স্যার, ‘ছবি আঁকতে বলেছিলাম তোমায়। কার্টুন এঁকেছ কেন?’

কাকতাড়ুয়া – 5 অধ্যায়

পঞ্চম অধ্যায়

বাইরে দরজায় বৃষ্টির করাঘাত শোনা যেতেই চমকে ওঠে ঈশানী। দুপুরবেলা একগাদা জামাকাপড় ছাদে মেলে দিয়ে এসেছিল। বিকেলের আগেই সেগুলো তুলে ফেলার কথা। কিন্তু কথাটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে। এমনিতেই রবিবার একটা ছুটির দিন পায়, সেদিন আর বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছা করে না। এগারোটার সময় ঘুম থেকে উঠে বাড়ির কিছু কাজকর্ম করে তারপর দুপুর গড়ানোর আগেই খেয়ে দেয়ে কিছু একটা সিনেমা বা সিরিজ নিয়ে বিছানা নেয়।

আজও তেমনি প্ল্যান ছিল। সকাল সকাল মায়ের ঠেলা খেয়ে পুরোনো জামাগুলো কেচে শুকোতে দিয়েছিল, হুট করে কখন আকাশ মেঘে ভরে এসেছে খেয়াল করেনি। এক্ষুনি জামাকাপড় ভিজে সপসপে হল বলে।

তড়িঘড়ি দরজা খুলে ছাদের দিকে দৌড় দিল সে। আকাশে গড়গড় করে মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে আকাশ চিরে বাজ পড়ছে। এই ঝামেলার মধ্যেও মনটা ভালো হয়ে গেল ঈশানীর। বাজপড়ার গড়গড় আওয়াজ ওর চিরকাল খুব ভালো লাগে।

একসঙ্গে তিন চারটে সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে যখন ছাদে উঠে এল তখন বৃষ্টির তোড় খানিকটা বেড়েছে। একদিকের আকাশ ডিমের কুসুমের মতো লালচে হয়ে আছে। অন্যদিকে গাছপালার সার জোলো বাতাসে মাথা দোলাচ্ছে।

দ্রুত জামাকাপড়গুলো টেনে আড় করা হাতের উপরে জড় করতে লাগল ও। একটা ফিনফিনে সাদা বাটিকের পাঞ্জাবিতে এসে আটকে গেল। এটা বাবার প্রিয় পাঞ্জাবি ছিল। বাড়িতে থাকলে কিংবা সামনে বাজারে দোকানে যেতে হলে এটাই পরে যেতেন। বাবা চলে যাওয়ার পরেও এটা হাতের কাছে রাখে ঈশানী। পাঞ্জাবিটা এতটাই পাতলা যে কাচতে বা শুকোতে কিছুতেই বেশি সময় লাগে না।

পাঞ্জাবির কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে একবার গন্ধ নিল ঈশানী। হ্যাঁ, বাবার গন্ধটা এখনও রয়ে গেছে বুকের কাছে। এতবার কাচলেও গন্ধটা কিছুতেই হারাতে চায় না। মুখ সরিয়ে একটানে পাঞ্জাবিটা দড়ি থেকে টেনে নিতেই সামনের দৃশ্যটা ওর চোখের সামনে খুলে গেল; ঈশানী থমকে দাঁড়াল।

কাকতাড়ুয়াটা ছাদের একপাশে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

ক্যাম্প থেকে ফেরার পর প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে গার্গীর সঙ্গেও আর সেভাবে কথাবার্তা হয়নি ঈশানীর। ওকে বাড়ি থেকে খুব একটা বেরোতে দিচ্ছে না ওর বাড়ির লোকজন। ঈশানী নিজে থেকে দু’একবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।

সেদিন বাড়িতে ঢোকার আগে ওদের বাড়ির সামনে গাড়িটা পার্ক করিয়েছিল তন্ময়। তখনই কালো হাঁড়ি, বাঁশ দুটো আর হাবিজাবি খড়কুটোগুলো একরকম মনের খেয়ালেই বাড়িতে এনে তুলেছিল ঈশানী। গোটা কাকতাড়ুয়ার ব্যাপারটা খানিক রহস্যজনক লেগেছিল বলেই বোধহয়। তবে ঘরের ভেতর তো আর কাকতাড়ুয়া রাখা যায় না, তাই ছাদে বসিয়ে দিয়েছে।

মা পায়ের ব্যথায় খুব একটা ছাদে আসতে পারে না। তবে ওদের বাড়ির অন্যদিকেই গুপ্ত’দারা থাকে। তাদের মধ্যে একজনই মাকে গিয়ে ফেচকেছিল, ‘হ্যাঁগো, তোমাদের মেয়েটার কি মাথা খারাপ হয়েছে? খামোখা ছাদে একটা কাকতাড়ুয়া এনে রেখেছে কেন?’

ঈশানী তেমন কিছু উত্তর দেয়নি। দেওয়ার দরকারও পড়েনি। এ বাড়ির লোক তেমন একটা ছাদে আসে না।

তাও মা একবার আপত্তি জানিয়েছিল, ‘ছাদে কাকতাড়ুয়া এনে তুলেছিস কেন?’

‘ছাদে গাঁজা চাষ করেছি। সেই গাছ পাহারা দিচ্ছে। খুশি?’

ঈশানী সত্যি সত্যিই আর সেরকম কোনও উত্তর খুঁজে পায়নি।

এখন ও ভালো করে তাকাল সেটার দিকে। কেমন যেন সরল সাদাসিধে একটা ভাব আছে কাকতাড়ুয়াটার মধ্যে। খানিকক্ষণ চেয়ে থাকলে মনটা নরম হয়ে আসে। সেদিন রাতে কি গাড়ির ডিকি থেকে বেরিয়ে এসে এই কাকতাড়ুয়াটাই ওর জীবন বাঁচিয়েছিল? কিন্তু তা কী করে সম্ভব!

ভালো করে কালো হাঁড়িটার দিকে তাকায় ঈশানী। গোল গোল চোখ দুটোর মাঝে ছোট্ট চোখের মণি। মুখটা অনেকটাই ঝাপসা হয়ে এসছে। তাও মনে হয় ওর দিকেই যেন ঠায় তাকিয়ে আছে কাকতাড়ুয়াটা।

আগ্রহটা বেড়ে উঠতে কাকতাড়ুয়াটার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে ও। কোনওরকম দায়সারা করে মুখ এঁকে একটা চেহারা ফোটানোর চেষ্টা হয়েছে। সে কারণেই খানিক অসহায় দেখাচ্ছে মুখটা। হাঁড়ির পেছন দিকটা একবার দেখল ও। তারপর বাঁশের মাথা থেকে খুলে নিয়ে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল। ছাদে আলো কমে এসেছে। তাও খুদে খুদে দুটো নকশা চোখে পড়ল ওর। হাঁড়ির একবারে ভিতর দিকে খোদাই করে একটা ঘুড়ি আর একটা ডানা মেলা ঈগল আঁকা আছে। ভারি মজা লাগল ঈশানীর। রান্নার হাঁড়িতে এমন অদ্ভুত ছবি খোদাই করা একটু বিচিত্র বটে।

টুপটুপ করে জল পড়ছে হাঁড়ির উপর। চকের দাগ আরও আবছা হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন মায়া লাগে ঈশানীর। হাড়িটা খুঁটির উপর বসিয়ে ও গোটাটা শক্ত করে ধরে সাবধানে ছাদের এক দিকের শেডের তলায় নিয়ে আসে। ছোটবেলায় এখানে পাখিদের একটা ঘর ছিল। এখন সেসব পাখি উড়ে যাওয়ায় ফাঁকা পড়ে আছে শেডটা।

একটা শুকনো জায়গা খুঁজে নিয়ে হাতের জামাকাপড়গুলো নামিয়ে রাখে ঈশানী।

কাকতাড়ুয়াটাকে সেখানেই দাঁড় করিয়ে দেয় ও। একটু হেসে হাঁড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘নিজে নিজে কবে হাঁটতে চলতে শিখবি বল তো?’

কথাটা বলেই নিজের মনেই হাসে ঈশানী, ‘কীরে? তুই শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা? হুম?’

টুকটুক করে কালো হাড়ির গায়ে দুবার নিজের মনেই টোকা মারে সে। তারপর ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে কোথাও কোনও আস্বাভাবিক কিছু আছে কিনা। নাঃ, নেই।

‘সেদিন আমাকে বাঁচালি কী করে বলত?’

একইরকম ঘোলাটে মুখে দাঁড়িয়ে থাকে কাকতাড়ুয়াটা। ঈশানী ওর মাথায় হাত রেখে বলে, ‘আবার বিপদে পড়লে আবার বাঁচাবি আমাকে?’

একটু সরে এসে হাঁড়িটা দেখে ঈশানী। মুখটা ঝাপসা হয়ে এসেছে। ও কি নিজেই এঁকে দেবে কিছু একটা? ভাবতে ভাবতে একটা আইডিয়া খেলে যায় ওর মাথায়।

কী মনে হতে এক দৌড়ে নিচে গিয়ে চকের বাক্সটা নিয়ে আসে সে। তারপর হাতের ঘষায় পুরোনো দাগটা তুলে দেয় হাঁড়ি থেকে। অন্য একটা মুখ আঁকতে হবে এখানে। কী আঁকা যায়?

আঙুল কামড়ে কিছুক্ষণ ভাবল ঈশানী। একটা ভাবনা মাথায় আসতেই মনটা খুশি হয়ে উঠল। ও শেষ কার্টুন এঁকেছিল আজ থেকে প্রায় মাসছয়েক আগে। তারপর থেকে রং পেন্সিল তুলি সব থেকে দূরেই থাকে।

এগিয়ে এসে কালো হাঁড়ির মুখে খসখস করে চক চালাল ঈশানী। কয়েক সেকেন্ড পরেই সে হাঁড়ির গায়ে একটা মানুষের মুখ ফুটে উঠল। নিজেকেই এঁকেছে ঈশানী। চোখের চশমাটা থেকে শুরু করে মাথার ব্যান্ডটা অবধি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। অনেকদিন পর নিজেকে ছেলেমানুষ মনে হল ওর। হাসি পেয়ে গেল।

পাখির শেডটার পেছনেই ছাদের পাঁচিল। হাতের উপরে ভর দিয়ে সেটার উপরে উঠে বসল। কয়েক সেকেন্ড অপলকে তাকিয়ে রইল নিজের কাকতাড়ুয়াটার দিকে। তারপর একটা হাত বাড়িয়ে দিল তার দিকে, ‘হেল্লো মিস প্রামাণিক। নাইস টু মিট ইউ…’

বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। জলের ধারার মধ্যে থেকে একটা অপরিচিত ঘষটানো আওয়াজ কানে আসছে। ঈশানীদের বাড়ির আশেপাশে বেশ কয়েকটা নারকেলগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোও যেন উৎসুক হয়ে তাকিয়ে জীব আর জড়ের এই বিচিত্র কথোপকথন মন দিয়ে লক্ষ করছে।

‘আমিও আপনার মতো, কার্টুন…’ ঈশানী বাড়ানো হাতটা নামিয়ে নিয়ে বলে, ‘জোক…’

বৃষ্টির ফোঁটা এসে পড়ে ঈশানীর শরীরে। ও যেখানে বসেছে সেটা শেডের বাইরে। মুখের উপর হাত বুলিয়ে একবার সেই জল মোছার চেষ্টা করে ও, তারপর হাল ছেড়ে দেয়।

কাকতাড়ুয়ার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ছাদের বাইরে তাকায় ঈশানী, ‘জীবনের গাঁড় মেরে আছে ভাই তোর। খাদ্য আন্দোলন করা বাপের মেয়ে হয়ে কর্পোরেটের খিস্তি আর লাথি ঝাঁটা খাচ্ছিস…’

কাকতাড়ুয়াটা কিছু শুনতে পায় না মনে হয়। কানদুটো আঁকা হয়নি। হাত বাড়িয়ে দুপাশে দুটো কান এঁকে দেয় ঈশানী।

বৃষ্টির আওয়াজ এখন ধুয়ে দিচ্ছে আশেপাশের সমস্ত শব্দ। তাও ও যেন নিজেকেই বলে চলে, ‘বিশাল বড় বড় স্বপ্ন ছিল, বুঝলি? বিশাল বড় একটা চোপা ছিল, কিন্তু কিছু ছিঁড়তে পারিসনি। হ্যাঁ, চাইলে হয়তো বাবাকে বাঁচাতে পারতিস, দুটো পয়সা রোজগার করতে পারতিস…’ কথাগুলো বলতে বলতেই আবার সেদিকে ঘুরে তাকায় ঈশানী, ‘দেখ, তোর ব্যাপারে এত কিছু জানি আমি। আমার ব্যাপারে কিছু বল…জানিস না?’

মুখ নামিয়ে নিয়ে হাসে ঈশানী, একটু দম নিয়ে বলে, ‘আমি একটা ন্যাকা মেয়েছেলে, জানিস। জানি, দেখে মনে হয় না, কেউ জানে না, কিন্তু বিশাল ন্যাকা…এক একটা ঝামেলায় পড়ি আর মনে হয় কেউ এসে উদ্ধার করবে আমাকে। কেউ এসে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে…শালা সব ঝামেলায়…’

পাঁচিল থেকে নেমে আসতে যাচ্ছিল ঈশানী। এমন সময় ওর পকেটের মধ্যে ফোনটা বেজে ওঠে। আননোন নাম্বার। ফোনটা রিসিভ করে কানে চেপে ধরে ও। ওপাশ থেকে একটা আধা পরিচিত গলা ভেসে আসে, ‘কী রে, আছিস কেমন?’

‘কে বলছেন?’

‘শুনলাম নাকি ছেলে দেখা হচ্ছে?’ ওপাশের গলাটার মধ্যে কী যেন আছে। ঈশানী একটু অবাক হয়। মা সাধারণত ওর নম্বর পাত্র-পাত্রী বিজ্ঞাপনে দেয় না। তাহলে এই নাম্বার লোকটা পেল কী করে?

‘আপনি ভুল নম্বরে কল করেছেন। আমি একটু…’

‘তা আপনি পার ঘণ্টা কীরকম চার্জ করেন?’ ওপাশের গলার মধ্যে এবার একটু ব্যঙ্গ এসে মেশে। ঈশানীর মাথাটা দপ করে জ্বলে ওঠে, দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘হোয়াট দা ফাক ডু ইউ মিন বাই দ্যাট? কে বলছেন আপনি?’

‘কেন রে রেন্ডি, যার সঙ্গে এতদিন শুয়েছিস তার গলা চিনতে পারছিস না?’

এতক্ষণে গলাটা চিনতে পারে ঈশানী। এই খিস্তিটা দেওয়ার একটা বিশেষ ধরন আছে। জীবনে এতবার শুনেছে খিস্তিটা কিন্তু এরকম বুকে এসে ছুলে দিতে পারেনি কেউ। চার বছর এই মানুষটার সঙ্গে প্রেম করেছিল ও। ফোনের উপর ওর হাতের চাপ আরও শক্ত হয়।

‘আমি তোর সঙ্গে কোনও কথা বলতে চাই না। ফোনটা রাখি ব্লাডি মাদারফাকার…’

‘চোপ! তোর মতো রেন্ডির সঙ্গে কথা বলার এমনিতেও কোনও শখ নেই আমার। তোর বেশ্যাবৃত্তির জন্য আমি কেস খাচ্ছি সেটা জানাতেই কল করেছিলাম…’

‘বলে যা, তারপর রেখে দে…’

ওপাশের মানুষটা একবার গলা খাঁকারি দিয়ে বলতে শুরু করে, ‘শোন। আমার ফোনটা খারাপ হয়েছিল বলে সার্ভিসিংয়ে দিয়েছিলাম। তো ফেরত নিতে গিয়ে দেখি ছেলেটা বলছে ফোনটা সারাতে দেড় লাখ টাকা লাগবে…’

টাকার অঙ্কটা অবিশ্বাস্য লাগে ঈশানীর কানে। কিন্তু কিছু বলতে পারে না।

‘আমি বললাম, বাঁড়া ফোনের দামই হাজারকুড়ির বেশি হবে না সেটা সারাতে দেড় লাখ লাগবে কেন? শুয়োরের বাচ্চা বলে ফোনের মেমোরিতে নাকি কীসব লোচা রয়েছে। আমি বললাম কীসের লোচা। তো সে দাঁত কেলিয়ে আমাকে কিছু ছবি খুলে দেখালো…’

হুট করেই থেমে যায় ওপাশের ছেলেটা। ঈশানী এবার অধৈর্য হয়, ‘ছবি? কীসের ছবি?’

‘তোর, আমার। আর আমাদের ন্যাংটো বডির…ছবিগুলো শালা ফোনে রয়ে গেছে আমার খেয়ালই ছিল না ল্যাওড়া। তো আমাকে বলল সে ছবিগুলো নাকি ও শালা কপি করে নিয়েছে। এখন টাকাক’টা পেলে ছবিগুলো ডিলিট করে দেবে। আর না পেলে তো বুঝতেই পারছিস মাইরি…’

ঈশানী কোনও কথা বলে না। বাইরে বৃষ্টির আওয়াজ ওর কানে প্রবেশ করে না। ফোনটা ভীষণ রকম গরম হয়ে ঠেকছে ওর কানে।

‘বিশ্বাস কর ভাই, আমি অনেক তেন্ডাইমেন্ডাই করলাম। মাল কিছুতেই শুনতে রাজি নয়। শেষে একলাখ তিরিশে রফা হয়েছে। এবার তুই তো বুঝতেই পারছিস পাপ তো একা আমার নয়…’

‘আমি কী করব?’ ঈশানীর গলার স্বর শান্ত শোনায়।

‘পর্নস্টার হতে চাইলে কিছুই করবি না। যদি না চাস তাহলে টাকাটা তোকেই দিতে হবে। অত কিছু যায় আসে না। এবার তুই ভেবে দেখ…’

কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোনটা রেখে দেয় ঈশানী। একবার ঠোঁট কামড়ে বাইরের দিকে তাকায়। ওর মুখে ঠিক কী অনুভূতি খেলা করছে তা বোঝা যায় না। কিছুক্ষণ স্থির হয়ে সেদিকে চেয়ে থেকে সরে আসে ও।

মাথাটা ঘোরাতে গিয়ে কাকতাড়ুয়াটার দিকে চোখ পড়ে যায়। ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলে, ‘কী দেখছিস বল তো?’

উত্তর আসে না। তেমন হাসিমুখেই কাকতাড়ুয়াটা চেয়ে আছে ওর দিকে। ঈশানী কাঁধ ঝাঁকায়, ‘আমারও এসবে কিছু যায় আসে না। বাড়ির সামনে গিয়ে দুটো খিস্তি দিলেই…’

থেমে যায় সে। গলকণ্ঠটা একটু ওঠানামা করে। ছাদের পাঁচিলটাই একবার শক্ত করে ধরে, ‘আসলে মোটামুটি সালটেই নিতাম যদি আমার বাপটা…’

কাকতাড়ুয়ার দিকে আবার তাকায় ঈশানী, ‘কিছু বলতে পারতাম না হয়তো…কিন্তু জীবনে শালা যতই কষ্টে থাকি, যতই প্রবলেমে থাকি, বাপের কাছে গিয়ে বসলে সব ঠিক হয়ে যেত। বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন…কেমন…’ পরের শব্দগুলো অনেকক্ষণ পর উচ্চারণ করে, ‘অসহায় লাগে…’

কয়েক সেকেন্ড ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঈশানী। বৃষ্টি এখন মুষলধারে পড়তে শুরু করেছে। ওর বলা কথাগুলো বৃষ্টির আওয়াজের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে। আর ছাদের পাঁচিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ওর শরীরটাও সেই বৃষ্টির ছাটে গায়েব হয়ে যাচ্ছে। এই কাকতাড়ুয়াটা ছাড়া পৃথিবীর অন্য সমস্ত প্রাণীর কাছে ওর সব অস্তিত্ব মুছে গেছে এই মুহূর্তে। ওর মাথাটা নিচের দিকে নেমে আসে, শরীরটা কেঁপে ওঠে একবার।

‘আমি আর পারছি না…আমি সত্যি পারছি না আর…’ ফুঁপিয়ে ওঠে ঈশানী। অনেক দিন পর শক্ত মেয়েটার চোখ ফেটে জল আসে। পিঠটা দুমড়ে বেঁকে যায়। দুটো হাত দিয়ে কাকতাড়ুয়ার একটা খুঁটি খামচে ধরে ও, ‘আমি আর কত কিছু সহ্য করব, আর কত…আমিও তো মানুষ একটা…’ অবোধ শিশুর মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে ঈশানী। বহু বছর পর।

রাতে একটা খটখট আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল ঈশানীর। ছাদের দিক থেকে আসছে আওয়াজটা। আড়চোখে একবার ঘড়ি দেখে নিল সে। আড়াইটে বাজে। ছাদের দরজা ও নিজে বন্ধ করে এসেছে। কে আছে ছাদে? এক যদি বাইরে থেকে কেউ…

হাত বাড়িয়ে ফোনটা একবার দেখে নেয় ঈশানী। একটা মিসড কল ফুটে আছে সেখানে। গার্গী ফোন করেছিল মিনিট খানেক আগে। ও রিং করতে ওপাশ থেকে তার উদ্বিগ্ন গলা শোনা যায়, ‘ভাই তুই ঠিক আছিস তো?’

‘আছি মোটামুটি, তোর বাড়ির কী অবস্থা?’

‘আগের থেকে বেটার। দু-একদিনের মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে মনে হয়। তবে আমি তোকে…’

একটু ইতস্তত করে গার্গী। কী যেন বলতে চেয়েও নিজেকে আটকাচ্ছে সে। ঈশানী তাড়া দেয় তাকে, ‘রাতবিরেতে কী ছেনালি করছিস শালা। বল না কী বলবি?’

‘তোর সেদিন রাতের কথা আর কিছু মনে পড়েনি?’

‘উঁহু…’

‘আমার অল্প অল্প মনে পড়েছে।’

‘কী মনে পড়েছে?’

আবার ওপাশ থেকে গার্গীর কাটাকাটা গলার আওয়াজ পাওয়া যায়, ‘তুই শিওর তোর শরীরে কোনও মেজর ক্ষত নেই? মানে কোনও শুকনো রক্তের দাগ…’

‘না তো, কেন?’

‘আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে তোকে সে রাতে ছুরি মেরেছিল কেউ। ঠিক ছুরি কিনা মনে পড়ছে না, কিন্তু কোনও ধারালো অস্ত্র দিয়ে…’

‘কী বলছিস শালা! মাথা খারাপ নাকি? ছুরি খেলাম আমি আর গলা টিপে খুন হল অভি?’

‘অভির কথা কিছু মনে পড়ছে না। কিন্তু তুই মাটির উপর পড়েছিলি। তোকে কে ছুরি মেরেছে জিগ্যেস করেছিলাম আমি। তুই কথা বলতে পারছিলিস না। কোনরকমে আঙুল তুলে মাঠের একটা জায়গা দেখিয়েছিলি…’

‘কী ছিল সেখানে?’

‘কিছু ছিল না।’ গার্গীর গলা এবার ফিসফিসে শোনায়, ‘মানে তখন কিছু ছিল না। কিন্তু একটু আগেই ছিল। একটা কাক…কাক…’

‘কাকতাড়ুয়া?’ ঈশানীর মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে আসে শব্দটা।

‘তোর মনে আছে ওটার কথা? সেদিন রাতে ওই কাকতাড়ুয়াটা নিয়েই কিছু ঘটেছিল…’

ঈশানী অস্থির হয়ে ওঠে। দু’হাত দিয়ে মাথার চুল খামচে ধরে সে। প্রথম থেকে ধীর গলাতে বলে, ‘তারপর কী হল?’

‘তারপর…তারপর…তুই…মরে গিয়েছিলি…’

হেসে ওঠে ঈশানী। এতক্ষণ গার্গীর কথায় একটা হালকা আগ্রহ জাগছিল ওর মনে। কিন্তু এই শেষ কথাটায় মেজাজটাই কেমন ফুরফুরে হয়ে গেল ওর, ‘আচ্ছা কাল দেখা কর অফিসের আগে। ফুলমালা আনিস মনে করে…’

ফোনটা রাখতে রাখতে একবার থমকাল ঈশানী। ছাদের দিক থেকে একটু আগের আওয়াজটা আবার এসেছে। চোরছ্যাঁচড় এল নাকি?

কিন্তু ওদের বাড়ির যে অবস্থা ভালো নয় তা বাইরে থেকে বাড়িটা একবার দেখলেই পরিষ্কার বোঝা যায়। সেখানে কে চুরি করতে আসবে?

নাহ্, ছাদে কী হচ্ছে সেটা নাহয় একবার দেখেই আসা যাক।

মোবাইলে আলোটা জেলে ও বাইরে বেরিয়ে আসে। এত রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে নিশ্চয়ই। মায়ের ঘরে একবার উঁকি দিয়ে দেখে মশারির মধ্যে মা পাশ ফিরে শুয়ে আছে। বাইরে থেকে ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়েছে তার গায়ে।

একবার আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসে ছাদে। মনটা একটু হালকা হয়ে আসে। দূরের আকাশে চাঁদ ঝুলে আছে। কয়েকটা বাদুড় মাঝে মধ্যে ওড়াউড়ি করছে তার পাশ দিয়ে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল ঈশানী। এবং নিতেই বুঝতে পারল কাল রাতে যে ক’টা রজনীগন্ধা ফুটেছিল তার থেকে আজ কয়েকটা কম ফুটেছে।

ফাঁকা ফুলের টবগুলো পড়েছিল একপাশে। সেদিকেই এগিয়ে যায় ঈশানী। কাল অফিস থেকে ফেরার সময় অন্য কোনও গাছ কিনে আনবে।

বৃষ্টির জলে ভরে আছে টবটা। নিচের দিকটা এবড়ো খেবড়ো থাকায় সেটা হালকা টোকাতেই নড়াচড়া করে। সম্ভবত এতক্ষণ কোনও পাখি এসে বসেছিল তার উপর। ফলে নড়ছিল টবটা। ভারী টব নড়ার ফলে যে আওয়াজটা হচ্ছিল সেটাই নিচ থেকে শুনতে পাচ্ছিল ও!

একটু নিশ্চিন্ত হয়ে আলোটা নিভিয়ে দেয় ঈশানী। এবং সঙ্গে সঙ্গে খেয়াল করে ছাদে আরও একটা আলো জ্বলছে। গত মাসেই গুপ্তদার বউ সন্ধেবেলা ছাদে জামাকাপড় মেলতে এসে পা ঠুকে পড়েছিলেন। তারপর থেকে ওরাই দায়িত্ব নিয়ে পাখির শেডের তলায় লাগিয়ে দিয়েছিল আলোটা। সেই আলোতেই ছাদটা অর্ধেক আলোকিত হয়ে থাকে।

হঠাৎ একটু বিরক্ত লাগে ঈশানীর। চরাচর ডুবে আছে অন্ধকারে। কোথাও কেউ নেই। কেবল মাঝে একটা ক্যাটক্যাটে এল.ই.ডি লাইট জ্বলছে।

কী মনে হতে ও এগিয়ে এসে আলোটা নিভিয়ে দেয়। শেডের নিচে এখন ঘন অন্ধকার। চাঁদের আলো পড়ছে না সেখানে। কাকতাড়ুয়ার মুখ অন্ধকারে তলিয়ে যায়। সেদিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে আবার ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াচ্ছিল ঈশানী। পেছন থেকে হঠাৎ একটা খসখসে আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।

খুব নরম অথচ স্পষ্ট আওয়াজ। যেন অন্ধকারের মধ্যে আওয়াজ না করে সাবধানে চলতে গিয়ে কিছু মাড়িয়ে ফেলেছে কেউ।

‘কে?’

ঈশানী জানে ছাদে এই মুহূর্তে ও ছাড়া আর কেউ নেই। তাও প্রতিবর্তক্রিয়ার মতোই বেরিয়ে আসে প্রশ্নটা।

আবার একটা আওয়াজ আসে শেডের তলার অন্ধকার থেকে। এবার যেন ইচ্ছা করেই করা হয়েছে আওয়াজটা। ঈশানী সাহসে ভর করে এক পা এগিয়ে যায় সেদিকে, ‘কে দাঁড়িয়ে আছে?’ তার গলার স্বরে আত্মবিশ্বাস মেশে এবার।

‘আপনি চলে যাবেন না প্লিজ…’

অন্ধকার থেকে ভেসে আসা গলাটা একটা শিরশির অনুভূতি খেলিয়ে দেয় ঈশানীর বুকে। হাতটা অবশ হয়ে আসে ওর। স্পষ্ট দেখেছে শেডের নিচে কাকতাড়ুয়াটা ছাড়া আর কিচ্ছু ছিল না। তাছাড়া এই গলাটাও ওর চেনা…

‘কে আপনি? ছাদে কী করছেন?’ ঈশানী বোঝে ওর গলা কাঁপছে। উত্তেজনাটা কিছুতেই লুকাতে পারছে না ও।

‘আপনি আলো জ্বালাতে পারেন। আমি ভূত-প্রেত নই…শুধু ভয় পেয়ে চলে যাবেন না…’

কাঁপাকাঁপা হাতেই মোবাইলের আলোটা জ্বালায় ঈশানী। তারপর ফোনটা তুলে ধরে সামনের দিকে। সে আলো গিয়ে পড়ে শেডের তলায় একটা অবয়বের উপরে। আধো অন্ধকারে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে সেখানে।

একটু আগে কাকতাড়ুয়াটা যেখানে দাঁড়িয়েছিল এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটা সম্পূর্ণ মানুষ। এবং সে মানুষ ঈশানীর চেনা—সে মানুষ ঈশানী নিজে।

ঈশানীর মনে হয় ওর সামনে যেন কেউ একটা আয়না এনে রেখেছে। ওর হাতের আলোটা কেঁপে যায়। বাঁ হাত দিয়ে চোখ কচলে নেয় একবার। বিড়বিড় করে বলে, ‘আজ রাতে কি তাহলে গাঁজাটা…’ একপা পিছিয়ে গিয়ে বলে, ‘আপনি…আপনি আমার মতো…’

ওর উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার মুখে বিড়ালের মতো সতর্কতা। সেই সঙ্গে খানিকটা ভয়, ‘আমি আপনি নই। কেবল ওই মুখটা আপনি নিজের মতো করে এঁকেছিলেন বলে…’

‘কে…কে আপনি?’ এতক্ষণে শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে চিৎকার করে ওঠে ঈশানী।

‘আমি কাকতাড়ুয়া…’

রাতের হাওয়া যেন আচমকাই বেগ বাড়িয়ে ঝাপটা মারে ঈশানীর মুখে। ওর চুল উড়ে এসে পড়ে মুখের সামনে। আকাশে উড়ন্ত বাদুড়গুলো মুহূর্তে কোথায় যেন গায়েব হয়ে যায়। চরাচর গ্রাস করে নেমে আসে নিস্তব্ধতা।

‘মানে আপনি সেদিন…কী চান আপনি?’ ঈশানী আবার সাহস জড়ো করার চেষ্টা করে।

‘উত্তর। আপনার মতোই। আমি কে, কোথা থেকে এলাম, কেন এলাম…কেন সবকিছু আমার চোখের সামনে…আর তারপর…’

‘তারপর কী?’ ঈশানী থমথমে গলায় জিগ্যেস করে।

‘আপনি একটা কাজ করে দিতে পারবেন আমার?’

‘কী?’

‘আমাকে মেরে ফেলতে পারবেন?’

কথাগুলো ঈশানীর মাথায় ঢোকে না। সত্যি নেশার ঘোরে দেখছে না তো এসব? অবিকল ও নিজে দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। গায়ে সেই কাকতাড়ুয়ার ছেঁড়া জামা আর একটা ছিটের প্যান্ট। ও কিছুই উত্তর দিতে পারে না।

কাকতাড়ুয়াকেও বিভ্রান্ত দেখায়। দুহাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে ছাদের একদিকে সরে আসে সে। বাইরের অন্ধকারে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িগুলোর দিকে চেয়ে কী যেন খুঁজতে থাকে ক্রমাগত।

‘কিন্তু আপনি কাকতাড়ুয়া থেকে মানুষ হলেন কী করে?’ ঈশানী এগিয়ে যায় মানুষটার দিকে।

‘অন্ধকারে। আমার শরীরের উপর শুধুমাত্র অন্ধকার থাকলেই আমি বদলে যেতে পারি। কাকতাড়ুয়া থেকে মানুষ আর মানুষ থেকে কাকতাড়ুয়ায়…’

সেদিন গাড়ির ডিকির কথা মনে পড়ে যায় ঈশানীর। ডিকি বন্ধ করতেই অন্ধকারে ঢেকে যায় ভিতরটা।

অবিকল নিজের মতো দেখতে মানুষটার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় ঈশানী। রাতের শান্ত হাওয়া এতক্ষণে ওদের ঘিরে বইতে শুরু করেছে। কয়েক সেকেন্ড স্থির চোখে সেই মুখটার দিকে চেয়ে থাকে সে। আয়নায় কিংবা ছবিতে নিজেকে এমনটাই দেখেছে এতদিন। ভারি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয় ওর। ধীরে সুস্থে বলে, ‘জানি না স্বপ্ন দেখছি কিনা। কিন্তু যদি সত্যি হয় তাহলে নিশ্চয়ই সাহায্য করব আপনাকে…’

কাকতাড়ুয়া এবার মিষ্টি করে হাসে। ওর দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলে, ‘আমার আগে তোমার নিজের সাহায্য দরকার।’

ঈশানী প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে যায়, ‘ওঃ, তুমি শুনেছ সব…’

‘আমার তো শোনা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই। তাছাড়া আমাদের দুজনের পরিস্থিতি একই, তাই না?’

‘মানে?’

‘জীবনে কোথায় যাব, কী করব কিছুই জানি না। শুধু পাগলের মতো উত্তর খুঁজে চলেছি…’ কথাটা বলে মেয়েটা পাঁচিলের উপরে উঠে বসে। পা দুটো ঝুলিয়ে দেয় বাইরের দিকে। ঈশানী ওর পেছনে এসে দাঁড়ায়।

দূরে কলকাতা শহর ঝিমিয়ে আছে। ভালো করে কান পাতলে শোনা যায় কোথা থেকে যেন একটা বিড়ালের কান্না ভেসে আসছে…নাকি গাড়ির আওয়াজ! রাস্তা দিয়ে কেউ কি হেঁটে চলে গেল? কটা বাজে আন্দাজ করা যাচ্ছে না।

একসময় ঈশানী ওর আরও কাছে সরে এসে বলে, ‘আমার অনেক কিছু জিগ্যেস করার আছে তোকে…সেদিন রাতে…’

‘হবে সব…’ মেয়েটা স্থির চোখে চায় ওর দিকে, ‘সময় আছে অনেক। তার আগে শুধু বল…’

‘কী?’

‘ভয় পেয়ে চলে যাবি না কোথাও…’

‘যাব না…’

রাতের হাওয়া ওদের ছুঁয়ে বইতে থাকে। কখন যেন চাঁদের বুক থেকে মেঘ সরে গেছে…

কাকতাড়ুয়া – 6 অধ্যায়

ষষ্ঠ অধ্যায়

রুনু যখন চোখের জল মুছতে মুছতে স্কুলের বাইরে বেরিয়ে এল ততক্ষণে স্কুল চত্বর ফাঁকা হয়ে গেছে। কেবল উঁচু ক্লাসের কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রী গেটের কাছে বসে গল্প করছে। ঝাপসা চোখে সেদিকে একবার তাকিয়ে নেয় রুনু। তারপর যেদিকে দু’চোখ যায় হেঁটে কিছুদূর এগিয়ে আসে। ওর হাঁটু অবধি নীল স্কার্টের কোমর ছাড়িয়ে শার্ট বেরিয়ে আছে বাইরে। মাথার চুল আধখাওয়া কটন ক্যান্ডির মতো এলোমেলো হয়ে আছে। চোখের কোণে চিকচিক করছে জল।

দুলে দুলে হাঁটছে বলে ব্যাগের ভিতর ফাঁকা জলের বোতল আর টিফিন বক্সে ঘষা লেগে খটখট করে আওয়াজ হচ্ছে। জুতোর ভেতর দুপুরবেলা খেলতে গিয়ে জল ঢুকে গেছে। মোজা ভিজে স্যাঁতস্যাঁত করছে। তাতে ওর ভিতরের অস্বস্তিটা বেড়ে উঠছে ক্রমাগত।

পাঁচিলের দিকে তাকাতেই চেনা মুখটা দেখতে পেল রুনু। ওকে দেখতে পেয়েই বাবা সাইকেল নিয়ে এগিয়ে আসছে। মেয়ের বেরোতে এত দেরি হচ্ছে দেখে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কপালে।

‘কী রে কাঁদছিস কেন ব্যাটা?’ ওর সামনে এসে জিগ্যেস করেন সঞ্জীবন। মেয়ের চোখের কোণে শুকনো জলের দাগটা নজর এড়ায়নি। রুনু প্রশ্নটার উত্তর দেয় না। ব্যাগটা সাইকেলের কেরিয়ারে রেখে সামনের রডে উঠে বসে।

‘বকা খেয়েছিস, না গার্জেন কল?’

রুনু আবারও কোনও উত্তর দেয় না। খালি একবার নাক টানে। সঞ্জীবন বোঝেন মেয়ে কথা বলতে চাইছে না। এখন ওর পেট থেকে কিছুই বের করা যাবে না।

সাইকেলে উঠে প্যাডেল করতে গিয়েই ওর হাঁটুর দিকে চোখ পড়ে যায় সঞ্জীবনের। দুটো হাঁটু লাল হয়ে আছে। সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলেন, ‘নিল ডাউন করিয়েছিল কেন?’

‘তলপেটে লাথি মেরেছিলাম বলে।’ এতক্ষণ পরে রুনুর গম্ভীর গলা শোনা যায়।

‘কাকে মেরেছিলি?’

‘চিন্ময়ীকে…’

‘মেরেছিলি কেন?’

‘ও বলেছিল আমরা গরিব। সবার বাবা গাড়ি করে নিতে আসে, শুধু আমার বাবা সাইকেলে করে নিতে আসে…’

সঞ্জীবন হাসেন। সাইকেলটা চালিয়ে মাঠের ধার দিয়ে স্কুল চত্বরের বাইরে বের করে আনেন। একটা বাম্পার পড়ে এখানে। ধীরে সুস্থে পার হয়ে যান সেটা, ‘তো মারলি কেন?’

‘মারব না? আমাকে গরিব বলবে কেন?’

‘গাড়ি থাকলে কি এমন বাবার কোলের কাছে বসে যেতে পারতিস? আলাদা আলাদা সিটে বসতে হত। তাছাড়া শুধু গাড়ি করে ঘুরলে এই শহরটাকে চিনবি কী করে?’

এইবার মনটা খুশি হয় ঈশানীর। ওর কাছে ওর বাবা হিরো হওয়ার সবথেকে বড় কারণ ছিল এইটাই। গোটা কলকাতা শহরটা যেন বাবার হাতের তলায়। কী সব ভারী ভারী নাম! রাসবিহারী, ওয়েলিংটন, লেলিন সরনি, কালীঘাট! ভয় লাগত ঈশানীর। জায়গাগুলো কোথায় কে জানে। ওখানে ছেড়ে দিলে বাবা না থাকলে কী করে বাড়ি ফিরতে হবে কিছুই জানে না ও।

অথচ বাবা সব জানে। বাড়ির কেউ কোথাও যাওয়ার আগে বাবার কাছেই জিগ্যেস করতে আসে, ‘মেসো, অমুক জায়গার বাস কী করে ধরব? তমুক জায়গায় যেতে গেলে কোথায় নামতে হবে?’

বাবা পটাপট বলে দেয়। তখনই বুকটা চওড়া হয়ে যায় ঈশানীর। ওর মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে একদিন ও কলকাতাটাকে এভাবে চিনবে। একদিন ও নিজেও কাউকে চেনাবে এই শহরটা। সেদিন ও নিজেও হিরো হবে।

বিকেলের রোদ মরে আসছে শহরের বুক থেকে। সাইকেলের ঘণ্টির টুংটুং আওয়াজ আসছে মাঝে মাঝে। বাবা ওকে বেল কখন বাজাতে হয় শিখিয়ে দিয়েছে। বাবা সাইকেল চালালে, সামনে কোনও গাড়ি এলেই ও বেল বাজিয়ে দেয়।

‘আমরা কি সত্যি গরিব বাবা?’ রুনু রাস্তার উপর নজর রাখতে রাখতেই বলে, ‘ম্যাম বলে যারা ভালো করে পড়াশোনা করে না তারা সারাজীবন গরিব থেকে যায়। তাদের বাড়ি গাড়ি কিছুই হয় না…’

শোভাবাজারের রাস্তার পাশে বস্তি ঘরগুলোর দিকে চোখ যায় রুনুর। নীল রঙের নোংরা দেওয়াল, ঘরের দরজার বাইরেই ড্রেন। বাইরের রেলিঙয়ে ঝুলন্ত ন্যাকড়ার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে ছেঁড়া তোশক, মশারি, আর বাসনকোসন। একগাদা বাচ্চা ছেলেমেয়ে গিজগিজ করছে ঘরের ভিতর।

ওদের দিকে দেখায় রুনু, ‘ওরাও তাহলে পড়াশোনা করেনি বাবা?’

কী ভেবে রাস্তা থেকে একটু সরে আসেন সঞ্জীবন। দাঁড় করান সাইকেলটাকে। তারপর খানিক দূরে হাতিবাগানের মোড়ের দিকটা দেখিয়ে বলে, ‘দেখ তো এই রাস্তায় যত লোক দেখতে পাচ্ছিস, তারা কী করছে?’

রুনু একবার চারদিকটা ভালো করে তাকিয়ে দেখে নেয়। তারপর বলে, ‘ওই তো একটা লোক ঠেলাগাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। একটা লোক আইসক্রিম বিক্রি করছে, আর ওই লোকটা কাঁধে করে গামছা বেচছে, ওই টাকমাথা লোকটা অফিস যাচ্ছে…আর ওই খালি গায়ের লোকটা শুয়ে আছে…’

‘মানে এরা সবাই হয় কাজ করছে, না হয় কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। কাউকে ফাঁকি মারতে দেখছিস?’

ভালো করে সরেজমিন করে নেয় রুনু, ‘কই, না তো। সবাই খুব ব্যস্ত। কেউ একটু দাঁড়াতেই চাইছে না।’

‘এদিকে স্কুলে কিন্তু ফাঁকি মারতে দেখেছিস, তাই না?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু তাতে কী হল?’

‘বুঝলি রুনু,’ ওর পিঠে হাত রাখে বাবা। ‘পড়াশোনা করতে কারও ভালো লাগতেও পারে, নাও লাগতে পারে। অঙ্ক কষতে ইচ্ছা হয়, আবার হয় না। কিন্তু খিদে সবার পায়। পাবেই…তাই যারা খেতে পায় না, জামাকাপড় পরতে পায় না, থাকার মতো জায়গা নেই, তারা পয়সা রোজগারে ফাঁকি দেয় না। যে যতটা পারে, যার বুদ্ধিতে যতটা সম্ভব, ততটা পয়সা রোজগার করতে চায়। গাড়ি বাড়ি হোক না হোক পরের কথা, কিন্তু কেউ যদি খেতে না পায়, চাকরি না পায়, দিনের শেষে ঘুমানোর মতো ছাদ না পায়, শরীর খারাপ হলে ওষুধ না পায়, তাহলে ধরতে হবে…’

‘কী ধরতে হবে বাবা?’

‘তোকে তো ফেলুদা পড়ে শুনিয়েছি, নিজেই বল। তুই আইসক্রিম খেতে চাইলি না অথচ তুই আইসক্রিম খাচ্ছিস, এর মানে কী হতে পারে?’

‘মানে আমাকে কেউ জোর করে খাওয়াচ্ছে।’

সঞ্জীবন খুশি হয়ে মাথা নাড়ান, ‘ঠিক বলেছিস। ওদের কেউ জোর করে গরিব বানিয়ে রেখেছে…’

‘কে বানিয়ে রেখেছে?’

সঞ্জীবন বোঝেন এইবার মেয়ের প্রশ্নগুলো আরও দূরূহ হয়ে উঠছে, তিনি তাও বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘দুনিয়ায় কারও দুঃখ হয় বলে কারও আনন্দ হয়, পৃথিবীর একদিকে অন্ধকার হয় বলে অন্যদিকে দিন আসে। আর কেউ বড়লোক হবে বলে কাউকে জোর করে গরিব করে রাখা হয়…’

‘আমাদের গরিব করে যে বড়লোক হয়েছে তাকে তুমি চেনো?’ বাবার মুখের দিকে চেয়ে জিগ্যেস করে ঈশানী।

সঞ্জীবন হাসেন, মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি, তিনি উত্তর দেন, ‘চিনি, বড় হলে তুইও চিনবি।’

‘তারপর কী করব?’

‘করার অনেক কিছু আছে। বড় হলেই বুঝতে পারবি…’

‘আর কিছুতেই যদি কাজ না হয়?’

সঞ্জীবনের মুখে একটা আদুরে হাসি খেলে যায়, ‘কিছুতেই কাজ না হলে আজ চিন্ময়ীকে যা করেছিস তাই করবি, কেমন?’

হাতিবাগানের মোড়ের কাছে একটা আইসক্রিমের গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। সেটার সামনে সাইকেল দাঁড় করান সঞ্জীবন। তারপর দুটো অরেঞ্জ কাঠি আইসক্রিম কিনে একটা মেয়েকে দেন, একটা নিজে নেন। রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট সিঁড়ি খুঁজে নিয়ে তার উপরেই বসে পড়েন দুজন।

সেটা কয়েকবার মুখে দিয়েই হো-হো করে হেসে বাবার দিকে তাকায় রুনু, ‘বাবা, তোমার মুখ কমলা হয়ে গেছে…’

জিভ বের করে নিজেরও মুখ দেখায় রুনু। সামনে হাতিবাগানের সচল রাস্তাটা পড়ে আছে। গাড়িঘোড়ার শব্দে কান পাতা দায়। তাও বাবার পাশে বসে ভারি নিশ্চিন্ত লাগে ওর। মুখের সঙ্গে সঙ্গে মনের ভিতরের রাগটাও কমে আসে ধীরে ধীরে।

‘একটা কথা মনে এসেছে আমার বাবা।’ রুনু আইসক্রিম খেতে খেতে হুট করেই বলে বসে।

‘কী কথা…’

‘এই রাস্তায় সবাই কাজ করছে শুধু আমরা ফাঁকি মারছি। বাড়ি না গিয়ে আইসক্রিম খাচ্ছি…আমরা কি পয়সা রোজগারে ফাঁকি দিচ্ছি বাবা?’

গম্ভীর মুখে মাথা নাড়েন বাবা, ‘উঁহু, আমরা মজা করায় মন দিচ্ছি। আর যারা মজা করায় মন দেয় তারা সত্যিকারের বড়লোক…বুঝলি?’

সেদিন চেনা পথে বাড়ি ফেরে না ওরা। হাতিবাগানের মোড় থেকে অন্য গলিঘুঁজি ধরে সাইকেল চালাতে থাকেন বাবা। রুনুর মজা লাগে। একই রাস্তায় রোজরোজ যেতে ভালো লাগে না। অকারণেই দুবার সাইকেলের ঘণ্টি বাজিয়ে ও বলে, ‘আচ্ছা বাবা, এই যে তুমি রাস্তাঘাট কত কিছু চেনো, আমি বড় হয়ে গেলে আমাকে এত রাস্তা চেনাবে কে?’

‘কেন, বড় হলে আমিই শিখিয়ে দেব। নাহলে নিজেই শিখে নিতে পারবি…’

‘আমি সত্যি পারব?’

‘নিশ্চয়ই। তুই তো টাফ গার্ল। একদম অমিতাভ বচ্চনের মতো।’

আরও কিছুদূর সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে যান সঞ্জীবন। রুনু আবার পেছন থেকে প্রশ্ন করে, ‘বাবা, আর একটা প্রশ্ন এসেছে মনে, করব?’

‘কর না…’

‘যে লোকগুলো আমাদের গরিব করে বড়লোক হয়েছে তুমি বড় হয়ে তাদেরকে কিছু করলে না কেন?’

সঞ্জীবনের সাইকেল থেমে যায়। কিছুক্ষণ ফাঁকা রাস্তার উপরেই সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে রাখেন তিনি। তারপর নিচে নেমে মেয়েকে কোলে তুলে নেন, ‘আমি বড় হওয়ার পর একদিন তুই এলি। তারপর আর আমার যুদ্ধ করতে ইচ্ছা করল না। বুঝতে পারলাম, আমার যা যুদ্ধ করার ছিল করা হয়ে গেছে। এবার অস্ত্র তৈরি করতে হবে…’

কথাটা বলে মেয়েকে আবার সাইকেলে বসিয়ে সিটে উঠতে যাচ্ছিলেন সঞ্জীবন। হঠাৎ করে বুক চেপে ধরে কাশতে শুরু করে সে। হাত দিয়ে মুখ ঢাকতে গিয়ে লাল হয়ে যায় হাতটা। সেটা মেয়ের থেকে লুকাতে দ্রুত পকেটে ঢুকিয়ে দেন তিনি…

‘বাবা, কী হয়েছে বাবা?’ রুনু অসহায় হয়ে প্রশ্ন করে।

‘ভাই সামনে পুলিশ আছে, তোরা নেমে হেঁটে আয়। আমি এগিয়ে যাচ্ছি।’ কথাটা বলে কোনও উত্তর পেল না ঈশানী। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল ওর দুই বান্ধবি একে অপরের পিঠের উপর মাথা দিয়ে পড়ে আছে।

বিরক্ত হয়ে আবার মুখ ঝামটা দেয় ও, ‘দু’হাজার টাকা খসে যাবে আমার…নাম আবালগুলো…’

মাথা নাড়ে অভিরূপা, ‘তুই আমাকে বাড়ি দিয়ে আয় ভাই। আমি মায়ের কাছে যাব।’

গার্গীর মুখটা লাল হয়ে আছে। তার তরল গলা শোনা যায়, ‘তোর কথা শুনে শালা মাল খেতে এসেছিলাম। বাড়ি নিয়ে যাবি না মানে?’

‘নিয়ে যাব না বলিনি। এইটুকুনি রাস্তা হেঁটে আয়। একে ট্রিপল ক্যারি করছি, তার উপর মাথায় হেলমেট নেই, তারপর মাল খেয়ে আছি। কত টাকার ফাইন হবে আইডিয়া আছে?’

গার্গী অভিরূপাকে আরও ভালো করে আঁকড়ে ধরে, ‘তোর শালা যদি আইডিয়া থাকত তাহলে বানচোদটার সাথে প্রেম করতে যেতিস? বড় এসেছে আইডিয়ামারানি…’

‘দেখ, এসব ফালতু কথা বলার সময় নেই। নাম তোরা।’

‘নামব না। কর তুই কী করে নিবি…’ অভিরূপা তরল গলায় বলে।

‘তাহলে গাঁড় মারা।’ বাইক থেকে নেমে ওদের দুজনকে একটা ধাক্কা দেয় ঈশানী। দুজনেই ব্যালেন্স হারিয়ে খসে পড়ে রাস্তার উপরে। মাথায় আর কোমরে চোট লাগে ওদের।

নেশার আলস্য কেটে গিয়ে রাগ আরও চড়ে যায় ওদের মাথায়, ‘শুয়োরের বাচ্চা, নেশা হয়নি বলে গরম দেখাচ্ছিস, না?’

গার্গী এগিয়ে এসে ঈশানীর চুল খামচে ধরে, ‘তোর এক কথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। রাত দশটায় পেট ভর্তি করে মাল খাওয়ালাম। আর তারপরে রাস্তার উপর ফেলে চলে যাচ্ছিস, বেইমানের বাচ্চা?’

ধাক্কা দিয়ে ওকে সরানোর চেষ্টা করে ঈশানী, ‘আমি বেইমানি করেছি?’

‘করিসনি? আমরা মরি-বাঁচি খোঁজ নিয়েছিস এতদিন? ক’বার ফোন করলে রিসিভ করেছিস? আজ এখানেই মেরে দেব শালা তোকে…’ অভিরূপা আবার ধাক্কা দেয় ওকে। ঈশানী বোঝে ওর নেশাটা বেশি চড়েছে আজকে। বড়লোকের মেয়ে, ছোট থেকে একা একা মানুষ হয়েছে। ফলে একবার কিছু মাথায় ঢুকলে করতে পারে না এমন কাজ নেই। তার উপরে এখন আবার পেটে মদ পড়েছে।

ঈশানী বাইকের উপর চড়ে বসে, ‘জেনে বুঝে নাটক করিস না। তোরা খুব ভালো করে জানতিস ও কারও সঙ্গে আমায় কথা বলতে দিত না।’

‘দিত না মানে? দাসী হয়েছিলি বাঁড়া ওর? মজা পেলি না? খুব মজা পেলি আমাদের মুখে মুতে দিয়ে?’

অভিরূপা এগিয়ে এসে চেপে ধরে ঈশানীর হাতটা। কবজি থেকে কনুই অবধি অনেকগুলো সিগারেটের ছ্যাঁকার দাগ। কিছু পুরোনো কিছু নতুন। অনেকগুলো দাগ দাঁতের। বুক, পিঠ, থাই থেকে শুরু করে কোমর অবধি ঈশানীর সারা শরীর ভরে আছে আগুনের দাগে।

আজ সন্ধেবেলায় নতুন দাগগুলো দিয়েছে অভিষেক। ঘাড়ের কাছে দাঁতের ক্ষতগুলো এখনও ব্যথা হয়ে আছে। চুলের মুঠি ধরে এত জোরে টেনেছে যে মাথাটা ঝিমঝিম করছে এখনও।

সম্পর্কটা দীর্ঘদিন ধরেই নোংরা হয়ে গেছে। আজ ঈশানী শেষবারের মতো বলতে গিয়েছিল যে ও আর এই সম্পর্কে থাকবে না। এর আগেও বহুবার বলেছে এই একই কথা। এগুলো শুনলেই অভিষেক ঝাঁপিয়ে পড়ে ওর উপর। আছড়ে কামড়ে ওর শরীরটাকে শেষ করে দিতে চায়। আজ সঙ্গে আরও দুটো বন্ধু নিয়ে এসেছিল, ওদের সামনেই দেওয়ালে চেপে ধরে হাতে সিগারেটের ছ্যাঁকা দিয়ে গেছে। বন্ধুদুটো ঘিরে দাঁড়িয়ে হাসিহাসি করছিল তখন। ঈশানী কিছুই বলতে পারেনি। চোখ থেকে জল বেরিয়েছিল শুধু।

বাড়ি আসার সময় ফোন করেছিল গার্গীকে, ‘তোরা বেরোতে পারবি আজ একটু? মাল খাব।’

ঈশানীর গলা শুনে গার্গী বুঝেছিল কিছু একটা হয়েছে। বাড়িতে কোনরকমে ম্যানেজ করে বেরিয়েও এসেছিল অভিরূপাকে নিয়ে। তবে বেশি মদ খায়নি ঈশানী। হাতের জ্বালাটা যন্ত্রণা দিচ্ছে ক্রমাগত। সেটা শুধুমাত্র রামে কমবে না।

ওরা দুজন মদ খেতে খেতে কখনও ওকে গালাগাল করেছে, কখনো হাত বুলিয়েছে মাথায়, কখনো ফোন করে খিস্তি মারতে চেয়েছে অভিষেককে। ঈশানী কেবল চুপ করে বসেছিল। ওর ভিতরে অনুভূতিগুলো আজ সন্ধ্যা থেকেই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তার উপরে অতিরিক্ত মদ খেয়ে দুটোই হ্যাল হয়ে গেছে। এখন কোনরকমে ওদের বাড়ি দিয়ে আসতে পারলে শান্তি।

মনে মনে নিজেকেই গাল দেয় ঈশানী। ও নিজেও বাড়ি ফিরলে আজ কপালে দুঃখ আছে। আজকাল দেরি করে বাড়ি ফিরলে মায়ের বাক্যবাণ শতছিন্ন করে দেয় ওকে।

ও দুজনকে শান্ত করার চেষ্টা করে, ‘দেখ, আমাকে নিয়ে তোদের যা অভিযোগ সব বাড়ি গিয়ে করবি। রাস্তাটা এসব করার জায়গা নয়…’

‘কেন? কেন করব না? এই যে…’ নাটকীয় ভঙ্গিতে ঈশানীর দিকে হাত মেলে দেয় গার্গী, ‘ইনি হচ্ছেন দি গ্রেট বিল্পবী ঈশানী প্রামাণিক, ছোটবেলা থেকে যাকে স্কুলে-কলেজে সবাই ভয় পেত, ছেলেরা চোখ তুলে দেখতে সাহস পেত না, স্যারেরা বকাঝকা দেওয়ার আগে দুবার ভাবত, সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা বস্তির জানোয়ার ছেলের সিগারেটের ছ্যাঁকা খেল আর একটাও শব্দ উচ্চারণ করতে পারল না…’ ঈশানীর দিকে ফিরে তাকায় গার্গী, ‘তোর লজ্জা করল না রুনু?’

‘করেছে লজ্জা…’

গার্গী শুনতে পায় না কথাটা, ‘কী বললি?’

‘করেছে লজ্জা!’ চিৎকার করে ওঠে ঈশানী, ‘বেঁচে থাকতে লজ্জা করে আমার। যদি পারতাম আগুনে পুড়ে মরতাম। কিন্তু পারি না…তাই ছ্যাঁকা খাই, দিনের পর দিন খাই। কী করব বল? আজ তোদের এই মাতাল অবস্থায় বাড়ি পৌঁছানোর সময় তোদের বাপ-মা-দাদা যে দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইবে তাতেও লজ্জা লাগবে, কী করব আমি?’

গার্গী আর অভিরূপা আর কিছু বলে না। বাধ্য পুতুলের মতো ফাঁকা রাস্তার উপর দিয়ে হাঁটতে থাকে। হেলমেটটা মাথায় গলিয়ে স্কুটিতে স্টার্ট দেয় ঈশানী।

ওদের দুজনকে বাড়ি পৌঁছে ঈশানী যখন বাড়ি ঢুকল তখন রাত বারোটার কাছাকাছি। ওর সারা শরীরে মদের গন্ধ। সেই সঙ্গে কাটা ছেঁড়া দাগ। জামাকাপড় দু-এক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। সেগুলো ঢাকা দেওয়া মুশকিল।

স্কুটিটা বাইরে পার্ক করে পেছনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে মায়ের ঘরে উঁকি দিল ঈশানী। টেবিলের উপর খাবার রাখা নেই। তার অবশ্য দরকার হবে না। তেমন খিদে পাচ্ছে না ওর। কিন্তু মা আজ এত চুপচাপ? ওর সাড়া পায়নি নাকি?

বাবার ঘরের বাইরে ঝুলন্ত আয়নার সামনে এক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়ায় ঈশানী। উশকোখুশকো চুলগুলো ঠিক করে নেয়। বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকে আসে।

দরজা খুলে দেখে কমলিকা শুয়ে আছেন বিছানায়। গলা অবধি চাদর মুড়ি দেওয়া। একটু অবাকই লাগে ঈশানীর। এখন তো চাদর মুড়ি দেওয়ার মতো ঠান্ডা পড়েনি।

ও এগিয়ে এসে হাত রাখল মায়ের কপালে। ছেঁকা লাগল হাতে। সঙ্গে সঙ্গে এক চটকায় হাতটা সরিয়ে দিলেন কমলিকা।

‘এ কী! তোমার তো জ্বর, ওষুধ খেয়েছ?’ গায়ে হাত রেখে বলল ঈশানী।

‘তোকে জানতে হবে না। গিয়ে শুয়ে পড়।’

‘ফোন করে তো বলবে একবার আমাকে! আমি চলে আসতাম।’

‘বললাম তো, ভাবতে হবে না।’ কথাটা বলে চাদরটা আবার গায়ে টেনে নেন কমলিকা।

ঈশানী টেবিলের ড্রয়ার থেকে থার্মোমিটার নিয়ে এসে ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, ‘বলে রেখেছি ওষুধপত্র সব আমার ড্রয়ারে থাকে। জ্বর এলে অন্তত একটা খেয়ে নেবে।’

‘ভয় লাগে হাত দিতে। জীবনে যা ফুর্তি করছিস তাতে কন্ট্রাসেপ্টিভ ছাড়া অন্য কিছু রাখিস বলে তো মনে হয় না।’

একটা হাত দিয়ে মায়ের শরীরটা তুলে খাটের একদিকে সোজা করে বসায় ঈশানী। আবার একটা ধাক্কায় এক হাত ছিটকে আসে ওর, ‘জামাটা বদলে আয়। মদের গন্ধ বেরোচ্ছে।’

‘ওষুধটা খাও, আমি চেঞ্জ করে আসছি।’

ওষুধটা হাতে নিয়ে মুখে পুরে দেন কমলিকা, গলায় জল ঢেলে সেটা গিলে নিয়ে বলেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয় তোর বাবা ভাগ্যিস আগে চলে গেছে, না হলে তাকেও এসব দেখতে হত…’

মায়ের মুখে থার্মোমিটার গুঁজে দেয় ঈশানী। খানিকটা যেন তাকে চুপ করানোর জন্যেই। ঘড়ির দিকে নজর রাখে সে।

‘মদ খাওয়া ছেড়েই দিয়েছি। ভালো লাগে না আর। আজ একটু দরকার পড়ে গেল বলে…তোমার যদি কাল শরীর খারাপ লাগে বোলো, অফিসটা যাব না তাহলে…’

মুখ থেকে থার্মোমিটার সরিয়ে ফেলেন কমলিকা, ‘কী করবি বাড়িতে বসে? আমার সেবা?’

‘না, দেখব।’

‘কী দেখবি?’

‘তোমাকে আফসোস করতে। আমাকে জন্ম দিয়েছিলে বলে।’

‘তো হবে না আফসোস?’ কমলিকার মুখ দিয়ে আগুন ঝরে পড়ে, ‘যার তার বিছানায় ল্যাংটো হওয়া মেয়ের জন্ম দিয়েছি।’

ঈশানী কয়েক পলক নিঃস্পৃহ চোখে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে, ঠোঁটদুটো কেঁপে ওঠে কয়েকবার, ‘তোমার সামনে কি ল্যাংটো হয়েছি মা?’ মাটির উপর দুটো হাঁটু রেখে মায়ের পায়ের কাছে বসে ঈশানী, ‘তুমি জানো আমার গায়ে কতগুলো ক্ষত আছে? পেটে আর বুকে আমি কতবার ব্লেড চালিয়েছি? যাতে যন্ত্রণাটা পাই। ওগুলো তুমি দেখতে পাও না।’

কমলিকা চুপ করে থাকেন। ওর শরীরের উত্তাপ ঘরের ভিতরেও ছড়িয়ে পড়তে থাকে ধীরে ধীরে। মাথার ফেট্টিটা খুলে পাশে নামিয়ে রাখে ঈশানী, ‘তুমি ভুলেই গেছ আমায় মা। তাও এসবের জন্য আমি তোমায় দোষ দিই না। আমি কী করব বলো? আমি তোমার পছন্দের বার্বি ডল হতে পারিনি। আমি তোমার সেই মেয়েটা হতে পারিনি যাকে তুমি ভালোবাসতে পারতে…’ মাটিতে বসেই একটু এগিয়ে মায়ের পায়ের পাতা চেপে ধরে ঈশানী, ‘কিন্তু প্লিজ এটুকুনি বোঝ, আমি ছাড়া তোমার কেউ নেই। ভালো হই, খারাপ হই, নোংরা হই, আমাকে নিয়ে চালাতে হবে তোমাকে। আই অ্যাম সরি মা, কিন্তু আমাকে নিয়েই চালাতে হবে তোমাকে…’

উল্টোদিকে ফিরে শুয়ে পড়েন কমলিকা। ঈশানী উঠে পড়ে মেঝে থেকে। কিছুক্ষণ সেভাবেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। সারা গা থেকে উগ্র মদের গন্ধ বেরোচ্ছে। আসার সময় অভিরূপা একবার বমি করেছিল ওর গায়ে, সেটাও মিশে আছে সেই মদের সঙ্গে। এক্ষুনি স্নান করা দরকার।

ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা বাথরুমে চলে যায় ঈশানী। জামাকাপড় খুলে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ে। ঝিমঝিমিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে ওর মাথা থেকে বুকে, পেটে…সিগারেটের দাগ ছাইয়ের মতো ধুয়ে গিয়ে শুধু ক্ষতগুলো জেগে থাকে। বাথরুমের আয়নায় নিজের মুখ দেখে ঈশানী।

একটা গান ভেসে আসছে কোথা থেকে যেন। হরিপদ একজন সাদামাটা ছোটখাটো লোক। অঞ্জন দত্তর গান। বাবা খুব শুনত এই গানটা। ছোট ক্যাসেটে গান চালিয়ে বাপ-মেয়েতে শুয়ে পড়ত বিছানায়। তারপর সারাদুপুর বাবার বুকের কাছে শুয়ে অঞ্জন দত্তর গান শুনত ঈশানী। কবে যেন হারিয়ে গেছে সেই পুরোনো ক্যাসেটগুলো। এখন লোকে আর সেই ক্যাসেটে গান শোনে না। অঞ্জন দত্তকেও দেখতে কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে।

তেল আর সাবান যেখানে রাখা থাকে সেখান থেকে একটা ব্লেড হাতে তুলে নেয় ঈশানী। জল ধুয়ে দিচ্ছে ওর হাতটা। মোটামুটি আন্দাজে শিরাটা খুঁজে নিয়ে তার কাছাকাছি ব্লেডটা নিয়ে যায় ও। কিছুক্ষণ সেখানেই ধরে থাকে…

এখনও গান আসছে। হরিপদকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে অন্য গ্রহ থেকে আসা কিছু বিচিত্র জীব। হরিপদ স্পেসশিপে ওঠার আগে ঠায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে ঈশানীর জন্য। কার্নিশ বেয়ে নেমে আসা এলিয়েনরা অপেক্ষা করছে, বিরক্ত হচ্ছে, ঠিক শাওয়ারের শোঁশোঁ শব্দের মতোই আওয়াজ করছে ওদের স্পেসশিপ, দেরি হয়ে যাচ্ছে…

কেউ কোনও দিন তার খোঁজ করেনিকো আর

ছিল নাকো কেউ তার কোনও খোঁজ করবার

কেউ করেনিকো কোনও শোক

গানটা শেষ হওয়ার আগেই জানলা দিয়ে ব্লেডটা বাইরে ফেলে দেয় ঈশানী। তারপর স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে আয়নায়। হরিপদ ওকে ফেলেই চলে যায়…

কাকতাড়ুয়া – 7 অধ্যায়

সপ্তম অধ্যায়

হালকা তন্দ্রা এসে গেছিল ঈশানীর। রাত দুটো বাজতে সেটা নিজে থেকেই কেটে গেল। সিঁড়ি দিয়ে এক ছুটে ছাদে চলে এল সে।

আজ সারাদিন ভাবনাটা তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেয়েছে। কাল রাতে যা ঘটল সব কি সত্যি? সকালে ঘুম ভাঙতে দেখে ছাদেরই একটা পাঁচিলে মাথা দিয়ে শুয়েছিল সে। কাকতাড়ুয়াটা ঠিক শেডের নিচে আগের মতোই দাঁড়িয়েছিল। সেটার সামনে গিয়ে একবার ঘুরেফিরে দেখেছিল ঈশানী। নাঃ, বিশ্বাস হয়নি। রাতের স্বপ্ন ভেবে নেমে গেছিল সিঁড়ি দিয়ে।

কিন্তু সারাদিন কথাটা বেরোতে চায়নি মাথা থেকে। এত জীবন্ত স্বপ্ন! মেয়েটার হাতের স্পর্শ এখনও যেন ওর হাতে লেগে। সন্ধে হতেই ঠিক করেছিল, রাতে এসে আর একবার পরীক্ষা করবে ব্যাপারটা। সেই তক্কে তক্কে ছিল সারাদিন।

ছোট আলোটা আজও জ্বলছে ছাদে। কালকের মতোই একটা মৃদু হাওয়া বইছে ধীরে। চাঁদের আলোয় কাকতাড়ুয়াটার দিকে এগিয়ে এল ঈশানী। বুকের ভিতরটা কোনও অজানা আশঙ্কায় ছমছম করে উঠল ওর।

সাদা আলোটা নিভিয়ে দিল ঈশানী। ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল শেডের তলাটা। আর ঈশানীর বুকের মধ্যে ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন বলে গেল—শেডের তলাটা জীবন্ত। দুটো অসহায় চোখে কেউ চেয়ে আছে ওর দিকে।

‘কেউ আছেন? কেউ…’

‘আপনি কাকে চাইছেন?’ অন্ধকার থেকে ভেসে আসা গলার স্বর আগের মতোই শিরশিরানি ধরিয়ে দেয় ওর বুকে। মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটটা সেদিকে ফেলতেই কাল রাতের মুখটা আবার দেখতে পায়।

মাথায় হাত দিয়ে ছাদেরই এক কোণে বসে পড়ে ঈশানী। মাথার ভেতরটা ভোঁভোঁ করছে ওর। নিজের চোখে যা দেখছে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না। মেয়েটা শুধু ওর গলার স্বরেই কথা বলছে তাই নয়, শব্দগুলোও যেন ওরই ভোকাবুলারি থেকে বেরিয়ে আসছে।

মেয়েটা সেটা বুঝতে পেরেই একটু হাসে, তারপর এগিয়ে আসে ওর দিকে, ‘কী করলেন সারাদিন?’

ঈশানী নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়, ‘সকালে গার্গীর সঙ্গে দেখা করলাম। তারপর অফিস। তুই?’

পরিচিত মুখ বলে সম্বোধন পালটে গেছে। মেয়েটা সেটা খেয়াল করেও করে না। দূর আকাশের দিকে তাকাল সে, ‘দাঁড়িয়ে থাকলাম এখানে। আমার আর কী কাজ? অপেক্ষা করলাম কখন দুপুর থেকে বিকেল হবে, বিকেল থেকে সন্ধে, তারপর রাত…’

‘আগে দেখিসনি? বিকেল, সন্ধে, রাত?’

ওর পাশে ঠিক ওর মতো করেই বসে পড়ে মেয়েটা, ‘মাঠে যখন দাঁড়িয়ে থাকতাম তখন দেখতাম। রোজ…’ ওর গলা হারিয়ে যায় দূরে, ‘দিনের পর দিন একই দৃশ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখবি এই দুনিয়ায় কেউই নিয়মিত নয়। মাঠের আল ধরে হেঁটে যাওয়া বউটা একদিন তার স্বামীকে নিয়ে পার হবে, বকরি ইদের পর গরু আর ছাগলগুলো পার হবে না, আকাশে ঝাঁক বেঁধে যে পাখিগুলো উড়ে যায় তারাও এক থাকে না…শুধু…’

‘শুধু?’

‘শুধু সূর্যটা একই থাকে। ও রোজ একাই ওঠে, একই রাস্তায় হেঁটে আবার একাই ডুবে যায়। সঙ্গী নেই, ছুটি নেই, বদল নেই। সারাদিনের এই অনিয়মিতের ঝাঁকে একমাত্র নিয়মিত। তাকে রোজ রোজ দেখেও কি মন ভরে, বল?’

ঈশানী অবাক হয়ে চেয়েছিল মেয়েটার দিকে। ঝাপসা অন্ধকারে কেবল তার শরীরের আউটলাইনটা দেখা যাচ্ছে। হুট করেই কাল রাতে গার্গীর বলা কথাগুলো মনে পড়ে যায়। অভিরূপার মৃত্যুর সঙ্গে কি কিছু যোগ আছে কাকতাড়ুয়াটার? কথাটা মনে হতেই ওর দিক থেকে একটু সরে আসে ঈশানী। একটু দম নিয়ে জিগ্যেস করে, ‘তাহলে আগের রবিবার মাঠে তুইও ছিলিস, তাই না?’

উপরে নিচে মাথা নাড়ায় মেয়েটা, ‘তুইও ছিলিস। অবশ্য মনে থাকার কথা নয়…’

‘তুই তো কাকতাড়ুয়া অবস্থায় থাকলেও দেখতে পাস, অভিকে যে খুন করেছে তাকে দেখিসনি?’

মেয়েটা হুট করেই স্থির চোখে ওর দিকে তাকায়, ‘কাল দুপুরে যখন আমাকে ধরে কাঁদছিলি তখন এইসব প্রশ্নগুলো তো করিসনি! হঠাৎ প্রশ্নগুলো বদলে গেল কেন বল তো?’

ঈশানী হাঁটুর উপর হাত রেখে বসে, ‘তখন বলার মতো কেউ ছিল না। অগত্যা…’

‘আজ্ঞে না। তুই বলার মতো কেউ থাকলেই বলতে পারিস না। না থাকলে পারিস, তাই না?’ কথাটা বলে আবার আগের মতো হাসে মেয়েটা, ‘তুই প্রশ্নের উত্তর চাস, না নিজের…কী যেন বলেছিলি…গাঁড় মেরে যাওয়া জীবনটার কিছু ব্যবস্থা করতে চাস?’

ঈশানী অবাক চোখে ওর দিকে তাকায়, তারপর তাচ্ছিল্য ভরে মাথা নাড়ায়, ‘আমাকে হেল্প করা অসম্ভব…’

মুখ থেকে চুল সরিয়ে উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা, ‘দুটো বাঁশের খুঁটি আর একটা কালো হাঁড়ির সঙ্গে মাঝরাতে কথা বলা সম্ভব ছিল?’

ঈশানী বসে বসেই সামনে পা মেলে দেয়, ‘বেশ, ধরে নিলাম তুই আমাকে হেল্প করলি। কিন্তু তার বদলে? আমি কী দিতে পারি তোকে?’

‘বলেছিলাম তো কাল। আমাকে মেরে ফেলতে হবে…’

‘কেন?’

মেয়েটা দূরে অন্ধকারে মুখ ডোবানো বাড়িগুলোর দিকে দেখিয়ে বলে, ‘আমার এখানে থাকার কথা নয় তাই। যার যেখানে থাকার কথা নয়, তার সেখানে থাকতে অসুবিধা হবে না?’

‘কিন্তু আমি মানুষ খুন করতে পারি না।’ ঈশানী কঠিন গলায় বলে।

‘করতে হবে না। শুধু ওই হাঁড়িটা ভেঙে ফেললেই হবে।’

‘ব্যাস?’ ঈশানী অবাক চোখে তাকায়, ‘এটুকু করলেই তুই সব ঠিক করে দিবি? আর কিচ্ছু চাইবি না?’

ঠোঁট কামড়ায় মেয়েটা, ‘চাইতে পারি অনেককিছু। তবে আপাতত একটা ইচ্ছা হচ্ছে খুব।’

‘কী?’

‘তুই তো স্কুটি চালাস। আমাকে একটু ঘুরতে নিয়ে যাবি?’

প্রস্তাবটায় একটু ঘাবড়ে যায় ঈশানী, ‘ঘুরতে বলতে? কোথায়?’

‘ধর, এই শহরটা। আমি কোনওদিন শহর দেখিনি। তুই স্কুটি করে আমাকে শহর দেখাবি। কেমন?’

‘কিন্তু তাতে কী লাভ? সেই একই ঘরবাড়ি, একই ফাঁকা রাস্তা। একই হারামি লোকজন…’

‘উঁহু, আমার কাছে তো সবই নতুন। আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেছি বছরের পর বছর। একটু না হয় ঘুরতে বেরোলাম।’

‘বেশ, সকালে অফিসে যাওয়ার আগে নাহয়…’

‘এখন…’ মেয়েটার গলার স্বর কঠিন শোনায়।

‘খেপেছিস নাকি? এত রাতে স্কুটি নিয়ে শহর দেখতে বেরোয় কেউ?’

‘তোর কাছে দুটো হেলমেট আছে?’

‘না…’

‘তাহলে কাল সকালে দুটো একই দেখতে মেয়েকে একই সঙ্গে রাস্তায় ঘুরতে দেখলে ব্যাপারটা ভালো হবে? তার থেকে এই রাতটাই ভালো…তাই না?’

ঈশানী আবার আপত্তি জানাতে যাচ্ছিল। কিন্তু থেমে গেল। বাইরে নরম একটা হাওয়া দিচ্ছে। সেটা গায়ে মাখতে মন্দ লাগবে না। এত রাতে মা-ও ঘুমিয়ে পড়েছে। বাইরের চাবিটাও ওর কাছে। স্কুটিটা বের করতে খুব একটা আওয়াজ হবে না। ওদের বাড়ির পেছন দিক দিয়ে যে সিঁড়িটা আছে সেটা দিয়ে নেমে গেলে কেউ টেরও পাবে না।

‘কিন্তু যাবি কোথায়?’

‘তোর যেখানে যেতে ইচ্ছা করে। বা ধর, যে জায়গাটা এড়িয়ে চলিস…’

‘আচ্ছা বেশ, চল…’

ঈশানী স্কুটিটা যখন বাইরে আনল ততক্ষণে রাত আড়াইটে ছাড়িয়েছে। মেয়েটা ওর ঠিক পেছনেই বসল। মৃদু আওয়াজ করে ফাঁকা রাস্তা দিয়ে চলতে শুরু করল স্কুটিটা। দুপাশে ঘুমন্ত বাড়িগুলো সরে যাচ্ছে পেছন দিকে। ওদের ছুটন্ত শরীরদুটো ছাড়া বাকি শহরটাকে যেন কার্ডবোর্ড দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে কেউ।

বাজারের কাছে এসে নিজে থেকেই চোখ বন্ধ হয়ে যায় ঈশানীর। সামনের আয়নায় সেটা লক্ষ করে মেয়েটা, বলে, ‘হাসছিস কেন বল তো?’

‘আমার চিরকাল একটা শখটা ছিল, জানিস? এই রাস্তাটা দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে নিতাম। কসাইগুলো মুরগি কাটত। সহ্য হত না গন্ধটা। ভেবেছিলাম টাকা হলে এমন একটা জায়গায় থাকব যেখানে বাড়ি ফেরার সময় চোখ বন্ধ করতে হবে না…’

‘তারপর?’

‘এখন ভাবছি কী বোকা ছিলাম! রাতে বেরোলেই তো আর কিছু দেখতে হত না…’

স্কুটির গতি বাড়িয়ে দেয় ঈশানী। রাস্তা যতটুকু দেখা যাচ্ছে কোথাও কিছু নেই। সবটুকু জুড়ে নিস্তব্ধতা। হাতে আঁকা ছবির মতো স্থির হয়ে আছে সবকিছু। এমনকী রাস্তায় একটা কুকুরও নেই। সকালে যেখানে ভিখারি বসে থাকে সেখানেও কেউ নেই।

আবার পেছন থেকে মেয়েটার গলা ভেসে আসে, ‘রাতে বেরোসনি কেন?’

‘এ শহরে রাত্তিরবেলা মেয়েদের বেরোনো অতটা সেফ নয়। একা একা বেরোতে ভয় লাগে…’

‘আজকে ভয় লাগছে না?’

‘না, আজকে তুই আছিস…’

‘আমিও তো মেয়ে…’

হুট করেই স্কুটিটা থামিয়ে দেয় ঈশানী। কী যেন ভেবে নিয়ে বলে, ‘ভালো কথা, জিগ্যেসই করা হয়নি। তুই সত্যি মেয়ে? মানে আমি নিজেকে এঁকেছিলাম বলে না হয় আমার মতো দেখতে হয়েছে কিন্তু…’

‘আমি কাকতাড়ুয়া, তুই আমার খোলস যেভাবে আঁকবি, আমি ঠিক তাই…নিজের ব্যাপারে কিছুই মনে নেই আমার।’

‘বেশ, কাল তাহলে তোকে গং ইউ বানিয়ে দেব।’

‘সেটা কে?’

‘কোরিয়ান হিরো। আমার ক্রাশ ছিল একসময়।’

মেয়েটা হেসে ফেলে। ঈশানী বাগবাজারের সরু রাস্তার ভিতর দিয়ে স্কুটিটাকে ছুটিয়ে দেয়। এখানে বাড়িগুলো আরও ঘন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবুজ কাঠের জানলাগুলো আঁটসাঁটো করে বন্ধ, শুকনো কলতলা পড়ে আছে। ভাঙা ছাদের একদিকে নুয়ে পড়া বাসায় পাখিগুলোও স্কুটির আওয়াজে পাশ ফিরে শোয়। মাঝে মাঝে বাড়ির ফাঁক দিয়ে আকাশে ছুটন্ত চাঁদটাকে দেখা যায়। চাঁদটা অবিরত ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার লোভ দেখাচ্ছে বুঝি।

‘আচ্ছা তোকে দেখতে না হয় আমার মতো, কথাও আমার মতো বলতে পারিস। কিন্তু…’

‘তুই সাজতে যা যা দরকার তার সব জানি আমি। তার বেশি কিছুই জানি না। স্মৃতি না, দুঃখ না, অনুভূতি না…আমি একটা ছদ্মবেশ। আর কিছু না…’

 ‘তাহলে ভুল সময়ে এলি। আর ক’দিন আগে এলে আমার বাবার সঙ্গে দেখা করিয়ে দিতাম। আর দুর্গাপুজো দেখাতাম তোকে। তখন এইসব গলিতে ঘোরার মজাই আলাদা…’ একটা বাঁক নিতে নিতে বলে ঈশানী।

‘দুর্গাপুজো কী?’

‘ওই তোর মতোই বলতে পারিস। মাটির মূর্তি বানিয়ে পুজো করে লোকে। ভাবে সে মূর্তিতে কোথাও প্রাণ আছে। তার কাছে এটা সেটা চায়…’

‘আর বদলে কী দেয়?’

ঈশানী কয়েক সেকেন্ড ভেবে উত্তর দেয়, ‘বদলে কিছুই দেয় না। মানে সম্পর্কটা মা মেয়ের মতো অনেকটা। আমরা ভক্তি শ্রদ্ধা করি, আর তার বদলে ইচ্ছাপূরণ চাই…’

‘তুই মাকে ভক্তি করিস?’

ঈশানী হাসে, ওর মুখের উপরে অচেনা কিছু রেখা খেলে যায়, ‘কী জানিস, জন্মের পর বাচ্চা যত বড় হয় তত সে একা হতে থাকে, তত তার মধ্যে খিটখিটে ভাব বাড়তে থাকে। বাবা-মা এদিকে ততটা একা হয় না। বাবার মা থাকে, মায়ের বাবা থাকে। তারপর একদিন মা-বাবার মধ্যে একজন মরে যায় আর ছেলে-মেয়ে কাউকে না কাউকে খুঁজে পেয়ে যায়। টেবিলটা জাস্ট ঘুরে যায়। আমরা বড়বেলায় ওদের একাকীত্বটা বুঝি না, ওরা কম বয়সে আমাদেরটা বোঝে না…’

কথাটা বলে মুখ ফেরায় ঈশানী, ‘তুই তো এত বছর একা একা দাঁড়িয়েছিলি। খিটখিটে হলি না কী করে?’

‘কারণ আমার শুধু ওই দাঁড়িয়ে থাকটুকুনিই ছিল। আমি কিছু চাইতাম না। না চাইলে হতাশও হতে হয় না। এই দেখ, এখন চাইছি—এখন আবার হতাশ হতে হবে…’

‘কী চাইছিস এখন?’

‘তুই কার্টুন আঁকাটা আবার শুরু কর। ওটা ছেড়ে দিলি কেন বল তো?’

ঈশানী কাঁধ ঝাঁকায়, ‘কী লাভ করে? টাকাপয়সা নেই ওতে। দুটো লোকে পিঠ চাপড়াবে। দুটো নিব্বা-নিব্বি কটা টাকা দিয়ে তাদের বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের কার্টুন আঁকিয়ে নেবে, বড়জোর অমুক স্মৃতি পুরস্কার, তমুক সিলভার জুবিলিতে একটা অ্যাওয়ার্ড দেবে। ওসব করে লাভ নেই…’

‘তাহলে তুই কী হলে খুশি হবি?’

‘আমি বড় স্কেলে কিছু একটা করতে চাই। মানে যেটার সত্যিকারের কিছু মূল্য আছে…’

কথাটা বলতে বলতে একটা মাঠের সামনে এসে স্কুটিটা দাঁড় করালো ঈশানী। তারপর চাবিটা লক করে নেমে এল মাঠের উপর।

‘এটা তো মাঠ। কী আছে এখানে?’

ঈশানী চাবিটা কোমরে গুঁজে হাঁটতে লাগল সামনের দিকে, ‘আমার স্কুল…’ আঙুল তুলে মাঠের একপাশে একটা বিল্ডিং দেখাল সে, ‘টুয়েলভ অবধি এখানেই পড়েছিলাম। ইদানীং জানি না কেন আর আসতে ইচ্ছা করে না।’

‘করে না কেন?’

মাঠের মোটামুটি মাঝামাঝি হেঁটে আসে দুজনে। ঈশানী ঘাসের উপরেই বসতে বসতে বলে, ‘কী জানি, এখানে এলে খুব বাবার কথা মনে পড়ে যায়। পুরোনো বন্ধুদের কথা, স্যারেদের কথা, ওসব আর মনে করতে চাই না…’ মেয়েটার কাঁধে একটা চাপড় মারে ঈশানী, ‘এই জানিস স্কুলে পড়ার সময়ে একটা নিব্বি টাইপের শখ হয়েছিল আমার…’

‘কীরকম?’

‘সরস্বতী পুজোর দিন ছিল। সবে ইলেভেনে উঠেছি। চারিদিকে সবাই প্রেম করছে। সবাই প্রিন্সেপ ঘাট ছুটছে। বাড়িতে পুজো-টুজো দিয়ে ভাবলাম আমিও একটু ঘুরে আসি। দেখি কী হয়। ওমা! সেখানে গিয়ে দেখি বন্ধুরা সবাই আছে, কিন্তু কেউই একা নেই। সব শালা শাড়ি কিংবা পাঞ্জাবি পরে মাল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমিই শুধু একা এসেছি। কী লজ্জার কথা ভাব…’

‘তারপর কী হল?’

পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরায় ঈশানী, ধোঁয়া ছেড়ে বলে, ‘তারপর আর কী, প্রেস্টিজের পুরো গ্যামাক্সিন হয়ে গেল। ঘাটের থামের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম। মনে মনে ভাবছিলাম একদিন না একদিন আমিও শালা শাড়ি পরে পাঞ্জাবি পরা মাল নিয়ে আসব এখানে…’

‘এসেছিলি?’

‘ধুর…’ তাচ্ছিল্য ভরে হাত নাড়ায় ঈশানী, ‘সেসব আর হল কই।’

‘বেশ, আমাকে যা খুশি সাজাতে পারিস। মিটে গেল ঝামেলা।’

‘আর একটা শখ ছিল, সেটা অবশ্য চাইলেও হবে না।’

‘কী?’

ঈশানীর গলা উদাস শোনায়, ‘মায়ের কাছে শুনেছি কলকাতায় একসময় দোতলা বাস চলত। মা আর বাবা বাসের দোতলার সামনের সিটে বসে বাড়ি ফিরত। আমার খুব রোম্যান্টিক লাগে ব্যাপারটা…কানে গান চলবে, আর গোটা কলকাতা ঘুরে দেখব উঁচু থেকে…দোতলা বাস কলকাতা থেকে তুলে নেওয়া উচিত হয়নি…ধুর…’

ঈশানী করুণ হাসি হাসে। পাঁচিলের দিকে চেয়ে থাকে একটানা। গলাটা উদাস শোনায় তার, ‘ছোটবেলায় বাবা সাইকেলে করে স্কুল থেকে নিতে আসত আমাকে। আর ঠিক ওইখানটায় দাঁড়িয়ে থাকত, জানিস? আমি একা একা স্কুলের গেট থেকে বেরিয়ে এলেই সাইকেল নিয়ে এগিয়ে আসত আমার কাছে…’

সিগারেটের ধোঁয়া অপ্সরার আঁচলের মতো হাওয়া বেয়ে উঠতে থাকে উপরের দিকে। বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে তারা। মাঠের ঘাসের ভিতর থেকে লুকিয়ে ডেকে চলেছে ঝিঁঝি। তাছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই কোথাও।

‘চল, দেখে আসি দেওয়ালটা…’ ঈশানীর হাত ধরে টান দেয় মেয়েটা।

‘কেন? দেওয়ালে কী আছে?’

মেয়েটা উত্তর দেয় না। গায়ের জোরে ঈশানীর হাত ধরে টানতে থাকে সে। তেমন করে টেনেই স্কুলের পাঁচিলের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা দুজনে।

পাঁচিলটা পুরোনো হলেও উপরে সিমেন্ট করা আছে বলে মসৃণ দেখাচ্ছে। চাঁদের আলো ফুটে আছে আকাশে। তাতে চোখে পড়ে পাঁচিলের গায়ে বড় করে রং দিয়ে লেখা—এখানে বিজ্ঞাপন মারিবেন না।

মেয়েটা নিচু হয়ে মাটি থেকে একটা ইটের ঢ্যালা কুড়িয়ে নেয়, তারপর সেটা ঈশানীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘নে, শুরু কর।’

‘কী শুরু করব?’

‘ওমা! এই যে বলছিলি বড় স্কেল চাই। আপাতত এর থেকে বড় স্কেল তো আর দেখতে পাচ্ছি না…’

ঈশানী অবাক হয়ে একটু পিছিয়ে আসে, ‘তুই বলছিস, আমি এখানে ছবি আঁকব?’

‘কার্টুন। কাল সকালে যারা এই মাঠে খেলতে আসবে তারা সবাই দেখবে। স্কুলের স্যারেরা দেখবে। ভেবে দেখ, এত বড় স্কেল, দর্শক, আর কী চাই?’

দেওয়ালটা দেখায় ঈশানী, ‘এখানে আঁকাজোকা করা নিষিদ্ধ।’

‘এত রাতে কে দেখতে আসছে?’ কথাটা বলে মেয়েটা একটু পিছিয়ে যায়, ‘তাছাড়া আমি আছি তোকে গার্ড দেওয়ার জন্য। কাউকে আসতে দেখলেই এলার্ট করে দেব।’

হাতে ইটের টুকরোটা নিয়ে হতভম্ব হয়ে ঈশানী দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মেয়েটার নির্ঘাত মাথা খারাপ। এই রাতবিরেতে একটা আস্ত স্কুল বিল্ডিংয়ের দেওয়ালে কার্টুন আঁকা…

ইটটা হাত থেকে ফেলে দিতে যাচ্ছিল ঈশানী, কিন্তু তার আগেই গোস্বামীর মুখটা মনে পড়ে যায়। সেই কিউবিকল, এপ্রেজাল, চিল্ড এসি, পরিপাটি করে পরা জামাকাপড়…ইউ উইল ওয়াক দ্যা ওয়ে উই ওয়ান্ট, লিভ দ্যা ওয়ে…মাথাটা গুলিয়ে ওঠে ওর। হাতের মুঠোতে ইটটা শক্ত করে ধরে এগিয়ে যায় ঈশানী।

দেওয়ালের উপর খসখস করে কয়েকটা দাগ টানতে থাকে সে। রাতের হাওয়ায় সমুদ্রের গন্ধ এসে মেশে। ঝিমঝিমে অনুভূতি গ্রাস করে ওর মাথার ভিতরটা। মেয়েটা একটু পিছিয়ে গিয়ে একমনে লক্ষ রাখছিল চারপাশটা। আঁকতে আঁকতে একবারও তার দিকে ফিরে তাকায় না ঈশানী।

খানিকক্ষণ পর সেখানে ফুটে ওঠে একটা ভাঙাচোরা চেহারার স্কুটি এবং উপরে ততোধিক ভাঙাচোরা চেহারার একটি অল্প বয়সি মেয়ে। চোখদুটো গোলগোল করে মন দিয়ে স্কুটি চালাচ্ছে সে, আর মেয়েটির ঠিক পেছনেই বসে আকাশের দিকে হাত-পা তুলে গান গাইছে হাঁড়িমাথা আর লাঠির শরীরওয়ালা একটা বেখাপ্পা চেহারার কাকতাড়ুয়া।

ভারি মজার ছবিটা। দেখলে এক নিমেষে হাসি পেয়ে যায়।

ছবি আঁকা শেষ হতে ইটটা রাস্তার উপর ছুড়ে ফেলে মেয়েটার দিকে এগিয়ে আসে ঈশানী, একটু হেসে ভুরু তুলে বলে, ‘ঠিকঠাক লাগছে?’

মেয়েটা আগের মতোই মিষ্টি করে হাসে, তারপর বলে, ‘সে আমি কেন বলব? কাল সকালে যারা এখানে আসবে তারা বলবে…’

মাথার চুলগুলো বেঁধে নেয় ঈশানী, বলে, ‘ধুর, রাস্তাঘাটের দেওয়ালে এসব ছবি কত আঁকা থাকে…ওসব দেখতে লোক আসে না।’

মেয়েটাও মাথা নাড়ায়, ‘ঠিকই। এমন কোনও জায়গা দরকার যেখানে লোকের চোখে পড়বে। আচ্ছা এখানে লোকজন জড়ো হয় কোথায়?’

‘কলকাতায়? তা সেরকম জায়গা বিস্তর আছে। ময়দান, ভিক্টোরিয়া, নন্দন, তারপর ধর এতগুলো মেট্রো স্টেশন, জোড়াসাঁকো…’

‘বেশ, পরদিন তাহলে যে কোনও একটা জায়গায় নিয়ে যাবি।’

‘মানে? আমি ওই জায়গাগুলোতেও ইট দিয়ে ছবি আঁকব নাকি?’

মেয়েটার মুখে ভাবান্তর দেখা যায় না, ‘ইট দিয়ে ঠিক ফুটছে না ব্যাপারটা। তোর কাছে অন্য কিছু নেই?’

ঈশানীর নিজের চুলই খামচে ধরতে ইচ্ছা করে, ‘থাকবে না কেন? একসময় দেওয়াল লিখতাম প্রচুর। তাছাড়া আলপনা দিয়েছি রাতের পর রাত। কিন্তু তুই নিজে জানিস কি বলছিস? একবার পুলিশে ধরতে পারলে…’

‘পারবে না, আমি পাহারা দেব বলছি তো…’

‘ধুর বাল। অত যখন কলকাতা রাঙানোর ইচ্ছা হয়েছে তখন শিখিয়ে দেব তোকে, নিজে গিয়ে এঁকে আসবি।’

ঈশানীর দিকে এক পা এগিয়ে আসে মেয়েটা, ‘শিখছি তো, তুই যখন আঁকছিলি তখনই শিখেছি। কিন্তু আঁকা না…’

‘তাহলে?’

মেয়েটার মুখে চাঁদের আলো এসে পড়ে, ঠিক যেমন করে এসে পড়ে জ্যৈষ্ঠের মাঠে দুলন্ত পাকা ধানের শিষে, ‘আমার মতো তুইও বদলে যেতে পারিস…’

‘কখন?’

‘যখন ছবি আঁকিস, তখন। তখন আর তোর সঙ্গে কিচ্ছু থাকে না। পুরোনো প্রেম, কষ্ট, বাবা, দুপুরবেলা যে এত কান্নাকাটি করছিলি…সবটুকু পাল্টে যায়…তখন আর তোর কোনও কষ্ট নেই, স্মৃতি নেই, দুর্বলতা নেই। সারাক্ষণ যে মুখোশটা পরে থাকিস তখন সেই মুখোশটাই হয়ে যাস তুই। আর তুই যদি পাল্টাতে পারিস, তাহলে এই শহরটাও পাল্টাবে…’

আঁকাটার দুপাশে ওরা দুজন বসে পড়ে। স্তব্ধ হয়ে যাওয়া শহর বিছিয়ে থাকে ওদের সামনে। ঝিঁঝির আওয়াজটা এখন আর একটু বেড়ে উঠেছে। কোনও নির্দিষ্ট সুরে বাজছে কি? অস্বস্তি শুরু হয় ঈশানীর। সেটা কাটাতেই বলে, ‘একটা ব্যাপার আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না, জানিস?’

‘কী ব্যাপার?’

‘এর আগেও তো এতদিন ওই মাঠে ছিলি তুই। এত মানুষ স্পর্শ করেছে, হঠাৎ সেদিনই জাগলি কী করে?’

‘স্পর্শে জাগে না কিছু।’

‘তাহলে কীসে জাগে?’

‘অসহায়তায়। সেদিন রাতে পাগলের মতো কাঁদছিলিস। মনে হচ্ছিল সবকিছু হারিয়ে ফেলেছিস। অমন করে মনে হয় জীবনে কোনওদিন কাঁদিসনি। কাঁদতে কাঁদতে একটাই কথা বলছিলি বারবার…’

‘আমার কিছু মনে নেই। শুধু মন বলে সে রাতে অলৌকিক কিছু একটা ঘটেছিল।’

মেয়েটার গলা ফিসফিসে শোনায়, ‘মাঝে মাঝে এমন এক একটা রাত আসে আমাদের জীবনে, যখন আমরা বুঝতে পারি চারপাশে ইট কাঠ পাথরের মতো যা কিছু পড়ে আছে তা দিয়ে আর চোখের জল থামবে না। তখন আমরা অলৌকিকের খোঁজ করি…এমন কিছু যা কেবল পৃথিবীর নিয়মে চলে না…’

‘কিন্তু আমি তো অলৌকিকের খোঁজ করিনি…’

‘করেছিলি, সেদিন রাত্রিবেলা বারবার চিৎকার করে বলছিলি—তোমরা কেউ আমাকে ছেড়ে যেও না, কেউ একটা আমার কাছে থেকে যাও…’ ঈশানীর দিকে মুখ ফেরায় মেয়েটা, ‘এ পৃথিবীতে কারো থেকে যাওয়ার থেকে বেশি অলৌকিক আর কিছু হয় না…’

‘মানে তুই বলতে চাইছিস আমার এত বন্ধু-বান্ধব প্রেম করে, একে অপরকে ভালোবাসে। আমার বাবা মাকে ভালোবাসত, মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত…সেসব কিছুই সত্যি নয়?’

মেয়েটা হাসে, ও গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে এসেছে, ‘আমি তো বলিনি এ পৃথিবীতে অলৌকিক বলে কিছু হয় না…চল, ওঠা যাক এবার…’

ওরা দুজনেই উঠে পড়ে। স্কুটির চাবি ঘোরাতে ঘোরাতে ঈশানী বলে, ‘মানে আমার বিশ্বাস জাগিয়েছিল তোকে…’

‘না, তোর চোখের জল জাগিয়েছিল আমাকে…’

ফাঁকা রাস্তার উপর দিয়ে আবার ছুটতে শুরু করে স্কুটিটা। মেয়েটা দুটো হাত রেখেছে ওর পিঠে। নরম, পুরোনো আঁচলের মতো স্পর্শ। যেন কেবল স্পর্শ দিয়েই ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে ওকে। মোড় ঘোরার সময়ে একবার সে হাত যেন ঈশানীর গলা ছুঁয়ে যায়। হাতঘড়িতে সময় দেখে ও—প্রায় চারটে বাজতে যায়। ও জানে দেরি হলে অসুবিধা নেই। কেউ অপেক্ষা করছে না ওর জন্য। কখনই করছে না।

ফেরার সময় অন্য একটা রাস্তা ধরে ঈশানী। হরি ঘোষ স্ট্রিট ছাড়িয়ে গ্রে স্ট্রিট ধরে। এ রাস্তাটা একটু ঘুরপথে ওদের বাড়ি পৌঁছায়। ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফোটে ওর।

মোটামুটি হাতিবাগানের মোড়ে এসে থেমে যায় ঈশানী। স্কুটিটা রাস্তার একপাশে দাঁড় করিয়ে দেয়। ওর পেছনে বসা মেয়েটা একটু অবাক হয়, ‘একী এখানে থামলি যে…’

‘যেখানে যেতে ইচ্ছা করে না সেখানে নিয়ে গেলাম, আর যেখানে ইচ্ছা করে সেটা বাদ দেব?’

চারপাশটা ভালো করে দেখে মেয়েটা। জমজমাট জায়গাটা আপাতত শুনশান ফাঁকা হয়ে গেছে। জুতো, জুয়েলারি আর জামাকাপড়ের দোকানগুলোর শাটার নামানো। ট্রাফিক পুলিশের দলও বাতি স্বয়ংক্রিয় করে দিয়ে চলে গেছে। নিজে থেকেই বদলে যাচ্ছে আলোগুলো। যেন গোটা হাতিবাগান এলাকাটা খালি করে দিয়ে এখানকার সব বাসিন্দারা কোথায় চলে গেছে।

‘এটা তো একটা বাজার মনে হচ্ছে, ছবি আঁকবি এখানে?’

‘উঁহু,’ ঈশানী ঘাড় নাড়ে। তারপর একেবারে রাস্তার মোড়ে গিয়ে দাঁড়ায়। চারদিকের পথঘাট একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বলে, ‘শুধু একটু খেয়াল রাখবি, লরি এলে পাশ দিয়ে দিতে হবে, কেমন?’

‘কিন্তু করবিটা কী?’

‘স্কুল থেকে ফিরতে খুব জ্যাম হত এখানে। পরে পুজোর আগে এখানে জামা বানাতে আসতাম। তখন একটা ইচ্ছা হত…’

‘কী ইচ্ছা?’

ওর দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দেয় ঈশানী, ‘আপাতত তুই মেয়ে, আমার হাত ধরতে গা শিরশির করবে না। চলে আয়।’

মেয়েটা একরকম বোকা বোকা মুখ করেই এগিয়ে আসে ওর দিকে। ওর বাড়িয়ে রাখা হাতটা ভ্যাবলার মতো ধরে। দুজনেই কয়েক সেকেন্ড থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে।

কী যেন একটা গান গুনগুন করছে ঈশানী। পুরোনো কিশোর কুমারের গান। পল পল দিল কে পাস…

গানটা গাইতে গাইতে আচমকাই মেয়েটার হাত ধরে একটা টান দেয় ঈশানী। এক ঝটকায় ওর এক হাত থেকে অন্য হাতের দিকে চলে আসে মেয়েটা। হাতটা মাথার উপরে তুলে ওকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয় ঈশানী। মুখে একটা হাসি লেগে থাকে ওর। মেয়েটা পড়ে যাওয়ার ঠিক আগে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে। তারপর সেও হেসে ওঠে খিলখিলিয়ে।

কাল তুঝকো দেখা থা ম্যায় আপনি আঙ্গন মে

জ্যাসে কেহ রাহি থি তুম ‘মুঝে বাঁন্ধ লো বাঁন্ধন মে’

ব্যস্ত একটা শহরের ব্যস্ততম মোড় আপাতত ফাঁকা হয়ে পড়ে আছে। শোভাবাজার, শ্যামবাজার, কলেজস্ট্রিট, স্টার থিয়েটার, ভূতুড়ে, বিপজ্জনক ছাপপড়া বাড়িগুলো হাঁ করে দর্শকের চেয়ারে বসে থাকে। ওরা সব ভুলে বাতাসে ছন্দ তুলে কেবল নাচতে থাকে…

ইয়ে ক্যায়সা রিস্তা হ্যায়, ইয়ে ক্যায়সা সপনে হ্যায়

বেগানে হো কার ভি কিঁউ লাগতে আপনে হ্যায়

মধ্যে মধ্যে একটা দুটো লরি পাশ কাটিয়ে চলে যায় ওদের। তাদের ড্রাইভাররা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। দুটো জমজ বোন রাত তিনটের সময়ে হাতিবাগানের মোড়ে নাচছে কেন বুঝে পারে না ওরা।

দুহাতে শক্ত করে মেয়েটার কোমর চেপে ধরে ঈশানী। কাছে নিয়ে আসে ওকে। দুজনেরই চুল এলোমেলো। আচমকাই মেয়েটার চোখের মাঝে সেই হারিয়ে ফেলা ঈশানীকে দেখতে পায় ও। যাকে ও ভালোবাসতে চেয়েছিল। আয়নায় তাকিয়ে বারবার যাকে দেখতে চেয়েছিল। যাকে অন্যরা কেউ পছন্দ করেনি বলে নিজেই কবে যেন ভাসিয়ে দিয়েছিল ভাসানের ঘাটে। আজ অনেক বছর পর তাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে বুকে টেনে নেয় ও…

উল্টোডাঙ্গার দিক থেকে ছুটে আসা লরির আলো এসে পড়ে ওদের গায়ে। দুটো নাচতে থাকা মানুষের দৈত্যাকৃতি ছায়া গিয়ে পড়ে ঘুমন্ত কলকাতা শহরের বুকে…

ম্যায় সোচ মে রেহতা হু, ডর ডর কে কেহতা হু

পল পল দিল কে পাস, তুম রেহতি হো…

কাকতাড়ুয়া – 8 অধ্যায়

অষ্টম অধ্যায়

চরণদাস ক্যাম্পসাইটে পৌঁছে দেখল সেখানে ছোটখাটো একটা মেলা লেগে গেছে। সমস্ত জায়গাটা জুড়ে কিছু উর্দিধারি পুলিশের ভিড়। এদিক ওদিক ঘুরে হম্বিতম্বি করছে তারা। পুকুরের ধার জুড়ে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদল মানুষ। তাদের কয়েকজন মাঝে মাঝে পুকুরের তলা থেকে তুলে আনা কাদা আর কচুরিপানার মধ্যে উঁকি দিয়ে কী যেন দেখার চেষ্টা করছে। নিজেদের মধ্যে কীসব যেন গুজগুজ করছে তারা।

পুকুর চাঁছা হচ্ছে। ডুবুরি নামিয়ে পুকুরের তলায় তল্লাশি চালাচ্ছে পুলিশ। আসতে আসতে চরণদাসের সঙ্গে নাদু নস্করের একবার চোখাচোখি হয়েছিল। সে ব্যাজার মুখ করে বলল, ‘দেখো দেখি কী বিপদ। মানুষ মরেছে শ্বাসবন্ধ হয়ে আর বড়বাবু খুঁজছেন খুনের অস্তর…কী যে সাহেবের খেয়াল…’

চরণদাস উত্তর করেনি। ওর চোখে মুখে ভয়। এসব ঘটনার আগাপাস্তলা কিছুই জানত না ও। আজ সকালে পুলিশের ফোন পেয়ে জানতে পেরেছে এখানে একটা খুন হয়ে গেছে।

পুকুরেরই একধারে বড়বাবুকে খুঁজে পেতে খুব একটা বেগ পেতে হল না চরণদাসকে। ইনস্পেক্টর বিশ্বাসও তাকে দেখেই চিনতে পারলেন। যদিও এখন হাতে দোতারা নেই, তাও চেহারা দেখেই তাকে বাউল বলে চিনে নেওয়া যায়। গায়ে একটা পুরোনো খদ্দরের জামা, সেই সঙ্গে নোংরা নীল লুঙ্গি। পাকিয়ে যাওয়া দড়ির মতো চেহারায় অবিন্যস্ত জটার মতো চুল। বোঝা যায় শরীরের সমস্ত জোর একমাত্র কণ্ঠনালী আর তারের উপর আঙুলের ছটফটানিতে গিয়ে জমা হয়েছে।

ওকে দেখেই বড়বাবু চোখ তুলে তাকালেন। পুকুরে নামা লোকগুলোকে আঙুল তুলে কী নির্দেশ দিলেন, তারপর ওর দিকে ফিরে বললেন, ‘তুমিই তার মানে এখানে গানবাজনা করো?’

‘আজ্ঞে, হ্যাঁ বাবু।’

‘তা কেমন চলছে গানবাজনা?’

চরণদাস মাথা নাড়ে। যার মানে হ্যাঁ বা না দুটোই হতে পারে।

ইনস্পেক্টর বিশ্বাস দ্রুত প্রসঙ্গে চলে আসেন, ‘গত রবিবার তুমি ক্যাম্পে এসেছিলে?’

‘আজ্ঞে, না স্যার। একসপ্তা হয়েছে এমুখো হইনি আমি। ডাকই হয়নি।’

‘ডাক না পেলেও তো আসো শুনেছি।’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ। রোজদিন তো কাজ পাই না। আবার গানবাজনা না করলেও চলে না। আমার তো দল-টল নেই। ভাবি যাই একটু মাঠে বসে গানবাজনা করি।’

‘তোমার বাড়ির কাছে মাঠ নেই?’

একটু থতমত খেয়েই ঘাড় নাড়ায় চরণদাস, ‘আজ্ঞে, তা আছে।’

‘ক্যাম্পের আশেপাশে তো কিছুই নেই। তোমার বাড়ি এখান থেকে দশ কিলোমিটার দূরে। এতদূর এসে গান গাও কেন? তাও আবার ডাক না পেয়ে?’

এইবার চরণদাসের মুখে একটা লালচে ভাব ফুটে ওঠে। পরের কথাগুলো যত্ন করে মেপে বলে সে, ‘মাঠঘাট সবই আছে বাবু। কিন্তু তাও আমি ওখানেই যাই।’

‘কেন?’

‘ওই মাঠে বসে গান গাইতে ভালো লাগে। বাউলরা চাইলেই সব জায়গায় মন খুলে গান গাইতে পারে না। ও মাঠে গান গাইলে মনে হয় কে যেন ভিতর থেকে গাইয়ে নিচ্ছে, আমি গাইছি না।’

‘মাঠে তো কেউ থাকে না। তুমি গান শোনাও কাকে?’

‘আজ্ঞে, একটা কাকতাড়ুয়া আছে বাবু। তার সামনে বসেই গান গাইতাম…’ কথাটা বলতে বলতেই বিশ্বাসের কাছে সরে আসে চরণদাস, ফিসফিসে কিন্তু গাঢ় গলায় বলে, ‘আপনাকে কী বলব বাবু, মাঝে মাঝে স্পষ্ট মনে হয় কাকতাড়ুয়াটা যেন মন দিয়ে আমার গান শুনছে। একদম কান খাড়া করে। আমি যখন ওর দিকে দেখছি না, তখন আমার দিকে চেয়ে আওয়াজ করে হাসছে। তাকালেই আবার সেই গম্ভীর মুখ…মাঝে মাঝে সে যেন আমার বাজানোর সঙ্গে সঙ্গে খড়ের আঙুল নাড়ায়…’

পুকুরের দিক থেকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। শার্টের উপরের বোতামটা খুলে দেন। পকেট থেকে ফোন বের করে তার অন্ধকার স্ক্রিনে একবার চুল ঠিক করে নিয়ে বলেন, ‘তুমি নেশা টেশা করে গান গাও নাকি?’

‘না স্যার। আমি সত্যি বলছি…’

‘মানে তুমি বলছ সেদিন রাতে তুমি ওখানে ছিলে না।’

‘আজ্ঞে না। সেদিন সারাদিন গুপি পোদ্দারের পুকুরের মাছ ধরা হচ্ছিল। সেখানেই ছিলাম। রাতে সেই মাছ ভেজে মদের আসর বসিয়েছিল গুপি। সেখানেই ছিলাম…’

‘সবাই সে রাতে মদ খাচ্ছিল নাকি?’ বিড়বিড় করে বলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। তারপর মুখ তুলে বলেন, ‘খুনের দিন এই ক্যাম্পে যে দোতারাটা আছে সেটা কেউ বাজাচ্ছিল। এ এলাকায় আর কে দোতারা বাজাতে পারে জানো?’

চরণদাসের মুখে হাসি ফোটে, ‘এই কথা! আগে বলবেন তো কত্তা। সেদিন রাতে আমি এখানে দোতারা বাজাইনি তা ওর আওয়াজ শুনলেই বুঝবেন।’

‘সে কী! কী করে?’

‘দোতারার রকমফের হয় কত্তা। আমি বাজাই বাংলা দোতারা। আর এখানে যেটা রাখা আছে সেটা ভাওয়াইয়া দোতারা। দুয়ের আওয়াজ আলাদা হয়…যে কেউ শুনলেই বুঝবে…’

ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের নির্দেশে ক্যাম্পের দোতারাটা হাজির করতে বেশি সময় লাগল না। হরি ছাউনি থেকে সেটা নিয়ে এসে তুলে দিল চরণদাসের হাতে। সুব্রত ঘোষ একটু দূরে দাঁড়িয়েছিলেন। দোতারা আসতে দেখে তিনিও ওদের কাছে এগিয়ে এলেন।

দু-একবার কান মুলে দোতারাটা বাজাতে শুরু করল চরণদাস। ইনস্পেক্টর বিশ্বাস সুব্রত ঘোষের দিকে চোখ তুলে বললেন, ‘কী বুঝছেন মিস্টার ঘোষ, সে রাতে এরকম কিছুই বেজেছিল?’

‘আজ্ঞে, হ্যাঁ স্যার…’ ভুরু কুঁচকে তিনি বললেন, ‘অবিকল এই আওয়াজ। সাধারণ দোতারার যেমন আওয়াজ হয় তার থেকে একটু ভোঁতা। আমি ভেবেছিলাম দূর থেকে আসছে বলে হয়তো। এখন বুঝতে পারছি…’

মানিক ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের দিকে সরে আসে, ‘মানে সেদিন চরণদাস সত্যি এখানে ছিল না?’

‘সেটা বলা সম্ভব নয়। এও হতে পারে ও বাইরে থেকে এসে বাজিয়েছিল দোতারাটা। তবে সেটা হওয়া একটু অ্যাবসার্ড…’ চরণদাসের দিকে চেয়ে আবার প্রশ্ন করলেন বিশ্বাস, ‘এ জিনিস এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ বাজাতে পারে না?’

‘দোতারা আর কেউ বাজায় বলে তো জানি না।’

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। কিছুরই থই পাচ্ছেন না তিনি। আপাতত মনে হচ্ছে সেদিন রাতে বাইরে থেকে বেড়া ডিঙিয়ে কেউ ভিতরে আসেনি। এদিকে এখানে যারা সেদিন ছিল তাদের মধ্যে কেউ দোতারা বাজাতে জানে না। তাহলে হলটা কী?

‘বেশ তুমি এসো এখন। পরে দরকার পড়লে ডাকব।’

ঘাড় নেড়ে সরে পড়ল চরণদাস। বিশ্বাস দেখলেন জল থেকে ডুবুরি উঠে আসছে। তার মুখের দিকে চেয়ে কোনও আশার আলো দেখতে পেলেন না তিনি। বড় কিছু থাকলে এতক্ষণে চোখে পড়ে যেত। হতাশ হলেন তিনি।

মানিক তার পাশে পাশেই হাঁটছিল, সেও পুকুরের দিক থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল, ‘মিস্টার ঘোষের স্ত্রী ছেলেকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছি স্যার। কিছুই বের করতে পারলাম না। সেদিন রাতে ঘুমিয়ে একেবারে সকালে উঠেছে। মাঝে কিছুই দেখেনি, কিছুই শোনেনি। তবে যেমন খাণ্ডার মেজাজ—শালা চাইলে স্বামীকে যেকোনওদিন কেটে ফেলতে পারে…’

‘তবে এখানে কেউ কেটে ফেলেনি। খুন হয়েছে গলা টিপে, ঠান্ডা মাথায়। তাও আবার বাজনা বাজাতে বাজাতে। নাহে, এ জিনিস ও মহিলার কম্মো নয়…’

‘ঠান্ডা মাথায় বলছেন কেন?’

‘খুনের ধরনটা দেখো। কোনও তাড়াহুড়ো নেই। মারামারি নেই। একদম মোক্ষম আঙুলে গলা টিপে ধরে শ্বাস বন্ধ করে পুকুরে ফেলে দিয়েছে। কেউ কোনও আওয়াজ পায়নি, চিৎকার হয়নি, সকালবেলা যে যার মতো শান্তিতে ঘুম থেকে উঠেছে…’

মানিক একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘এইটাই মুশকিল। শালা সবাই হয় ঘুমাচ্ছিল নাহয় মাল খেয়েছিল। কাকে যে বিশ্বাস করব…’

পুকুরের দিকে এতক্ষণ উঁকি দিচ্ছিলেন সুব্রত ঘোষ। এবার সেদিকে এগিয়ে যান ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। নাদু নস্করও আসেন ওদের পেছন পেছনে। সুব্রত ঘোষের দিকে চেয়ে একটা নরম হাসি হাসেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘আপনারা তো আজকেই চলে যাচ্ছেন, নাকি?’

‘হ্যাঁ, আর কী করব? বউ-বাচ্চাও আর থাকতে চাইছে না।’

বিশ্বাসের মুখে হাসি খেলে যায়। নিজের মাথাতেই একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বলেন, ‘আপনার থেকে আর সেরকম কিছু জিগ্যেস করার নেই। শুধু একটা ব্যাপার জানতে ইচ্ছা করছে। অবশ্য তদন্তের কিছু নয়…’

‘বেশ তো, বলুন না…’

দাড়িতে হাত ঘষেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘আমি ওদের লগবুকটা চেক করছিলাম। তাতে দেখছি গত তিনমাসে এখানে যারা এসেছে তারা সবাই হয় বন্ধু-বান্ধব না হয় প্রেমিক-প্রেমিকা। ভেবে দেখলাম সেটাই স্বাভাবিক। এসব রিমোট ক্যাম্পে লোকে মদ খেয়ে হইহুল্লোড় করতে আসে। আর আপনি এসেছেন রিসার্চ করতে, তাও আবার ফ্যামিলি নিয়ে। কারণটা কী বলুন তো?’

চারপাশটা একবার দেখে নেন সুব্রত। তারপর একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন, ‘আমার বউ একটু স্ট্রিক্ট স্যার। আমাকে একা একা প্রায় কোথাও যেতে দেয় না। ও একটু রিলিজিয়াস ফ্যানাটিক। মন্দির টন্দির না থাকলে খুব একটা বেরোতে চায় না…’ নরম হাসি হাসলেন সুব্রত, ‘গবেষণা করতে করতেই এই জায়গাটার কথা জানতে পেরেছিলাম। এখানে তো হোটেল-টোটেল বলে কিছু নেই, অগত্যা ওই ক্যাম্পেই…’

‘তা গবেষণায় কী পেলেন?’ কথাটা বলেই জিভ কাটেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘মানে, যদি আপনার বলতে অসুবিধা না থাকে…’

একটু উশখুশ করেন সুব্রত ঘোষ। বোঝা যায় ওর মনের মধ্যে যে কথাগুলো আছে তা এমন হুট করে বলা সম্ভব নয়। তাও মোটামুটি একটা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি, ‘এখানকার লোকেরা ওই বাড়িগুলোকে হানাবাড়ি বলে চালিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে। কেউ বলে এগুলো নাকি জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ। তো কেউ বলে ওখানে নাকি কারা আত্মহত্যা করেছিল। তবে একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই আপনি বুঝতে পারবেন এসব একদম বোগাস। আসলে ওই বাড়িগুলো তৈরির পেছনে অন্য একটা কারণ আছে। সেটা অতটা মারকাটারি বা ভূতুড়ে না হলেও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ!’

‘কীরকম?’

‘ওগুলো সবই তৈরি হয়েছিল আজ থেকে প্রায় তিনশো বছর আগে। মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে তখন আলিবর্দী খান। মানে ধরুন ওই সতেরোশো চল্লিশের গোড়ার দিকে। আপনি বর্গীদের কথা তো জানেন?’

‘মানে মারাঠা আক্রমণ? সেই যে খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এল দেশে?’

‘এক্স্যাক্টলি। এই বর্গীরা মোট ছ’বার বাংলা আক্রমণ করে লুটপাট চালায়। লুটপাট বলতে ভয়ঙ্কর লুটপাট। ঘোড়া নিয়ে অতর্কিতে আক্রমণ করে গ্রামের পর গ্রাম লুট করত। ছোট ছোট ঘোড়ায় চড়ে পঞ্চকোট পাহাড় পেরিয়ে বাংলার গ্রামে গঞ্জে আছড়ে পড়ে তারা হাঁক পাড়ত—রুপি লে আও। তারপর সেই রুপি আদায় হলে চলত অত্যাচার। বাচ্চা মেয়ে থেকে বয়স্ক মহিলাদের অবাধে গণধর্ষণ, জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেওয়া, বাড়িতে আগুন লাগানো, পরিবারের সামনেই এক এক করে সকলের শিরচ্ছেদ…এও শোনা যায় কোনও যুবতী মেয়ে সম্মান রক্ষা করতে পুকুরে ডুব মেরে লুকিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করলে তাকেও বর্শায় গেঁথে জল থেকে তুলে এনে ধর্ষণ করত বর্গীরা।’

‘অত্যাচার করেছে বলে জানতাম। কিন্তু এতটা ডিটেলে জানতাম না আগে। তারপর?’

‘যেহেতু বর্গীদের মূল লক্ষ্য ছিল টাকাপয়সা তাই কলকাতা বা তার আশেপাশের এলাকার ধনী ব্যবসায়ীরা একটা পন্থা অবলম্বন করলেন। তারা নিজেদের এলাকা ছেড়ে পূর্ববাংলার দিকে সরে আসতে লাগলেন। সেখানে বর্গীদের উৎপাত কম ছিল। আপনি এখনও বাংলাদেশে গেলে এরকম কয়েকশো বছরের পুরোনো পরিত্যক্ত পাড়া দেখতে পাবেন। যার বেশিরভাগই কলকাতার বণিকরা গিয়ে তৈরি করেছিল। পরে মুসলমান আক্রমণের সময় আবার তাড়া খেয়ে ঘর ছাড়তে হয় তাদের। বাড়িগুলো সেই থেকে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে আছে…

‘এখানে আসার আগে এই ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর কিছু ছবি দেখেছিলাম আমি। সাধারণত সে সময়ে এই ধরনের বাড়ির বাইরে সাদা শ্বেতপাথরের উপর কালো দিয়ে সন তারিখ আর পরিবারের উপাস্য দেবতার নাম লেখা থাকত। তারিখটা দেখে আমার সন্দেহ হয়। সবই সতেরোশো চল্লিশের আশেপাশে। গঠনগুলো দেখেও বোঝা যায় বাড়িগুলো বিত্তবান বণিকদের তৈরি। কিন্তু একটা খটকা লাগল…’

‘কী খটকা?’

‘এখানে আশেপাশে বনজঙ্গল ছাড়া তেমন কিছু নেই। বর্গীদের হাত থেকে লুকিয়ে থাকার জন্য আদর্শ জায়গা বটে। সত্যি কথা বলতে তখনকার দিনে বর্গীরা পাহাড় থেকে নেমে এসে এরকম ছোটখাটো আস্তানা গড়েই আক্রমণের প্রস্তুতি নিত। কিন্তু সে তো বর্গীরা। বণিকদের নিজেদের রাজ্যে এমন লুকিয়ে পড়ার দরকার পড়ল কেন? পালাতে হলে তার জন্য তো পূর্ববঙ্গ ছিল। এখানে এসেই বাড়ি বানাল কেন? এক হতে পারে তারা ইচ্ছা করেই সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চেয়েছিল। কিন্তু তারই বা কারণ কী?’

ডুবুরিদের মধ্যে একটা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে এতক্ষণে। কিন্তু ইনস্পেক্টর বিশ্বাস গল্পে ডুবে গেছেন। সেদিকে আর কান গেল না তার, ‘মানে আপনি বলছেন তিনশো বছর আগে বণিকরা তৈরি করেছিল এই বাড়িগুলো?’

‘দুর্গা বা কালীর কোথাও কোথাও উল্লেখ থাকলেও বেশিরভাগ ফলকেই সিদ্ধিদাতা গনেশের নাম…’

‘কিন্তু তারা গেল কোথায়?’

সুব্রত একটু হাসলেন। ইনস্পেক্টর বিশ্বাস যে ব্যাপারটায় মনোযোগী হয়ে পড়েছেন সেটা তার মুখ দেখে বোঝা যায়। সামনে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বললেন, ‘সেটা আমি বলতে পারব না। তবে একটা ওয়াইল্ড গেস করতে পারি। ইতিহাসের ক্ষেত্রে সাধারণত ওয়াইল্ড গেস জিনিসটা চলে না। আরও রিসার্চ করা দরকার। আপাতত…’

‘আপাতত যা মনে হচ্ছে সেটাই বলুন…’

একটা সিগারেট ধরান সুব্রত, তারপর একটা হাত পকেটে গুঁজে বলেন, ‘এই বর্গীদের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা ছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত। নাগপুরের রাজা রঘুজি ভোঁসলের দেওয়ান আর আর্মি কমান্ডার। বেশিরভাগ আক্রমণ তার তত্ত্বাবধানে করত বর্গীরা। ইতিহাসের পাতা জুড়ে বাংলার বুকে তার নৃশংসতার নানারকম উপাখ্যান পাওয়া যায়। তার কিছু সত্যি আর কিছু মিথ্যে।

‘তো সতেরোশো তেতাল্লিশের দিকে এই ভাস্কর পণ্ডিত একবার শ’পাঁচেক বর্গী নিয়ে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করেন। কিন্তু ঠিক আক্রমণের আগেই পিছু হটে আবার নাগপুর ফিরে যান। পথে কোনও অতর্কিত আক্রমণে বেশ কিছু সৈন্য মারা পড়েছিল। তাই এই অপ্রত্যাশিত পশ্চাদপসরণ। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন আসে। আক্রমণটা করল কে?

‘পঞ্চকোট পাহাড় ডিঙিয়ে যে পথে মুর্শিদাবাদে প্রবেশ করতে হয় তার মধ্যে এমন কোনও আক্রমণ হওয়া সম্ভব নয়। আলিবর্দী নিজেই যদি করে থাকে তাহলে তার ক্রেডিটে সেটা প্রচার হওয়ার কথা। সেটাও হয়নি। তাহলে?

‘তাহলে ভাস্কর পণ্ডিত কি মিথ্যে বলেছিলেন? কোনও আক্রমণ হয়নি? তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে প্রশ্ন হল এতগুলো লোক মারা গেল কেমন করে?’

ইনস্পেক্টর বিশ্বাস হাঁ করে চেয়েছিলেন সুব্রতর মুখের দিকে। তিনি পকেট থেকে ফোন বের করে একটা ম্যাপের ছবি বের করে দেখালেন তাকে, তারপর একটা বিশেষ জায়গায় আঙুল রেখে বললেন, ‘এবার মন দিয়ে দেখুন, আমরা আপাতত যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেটা নাগপুর থেকে পাহাড় টপকে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার রাস্তার মধ্যে পড়ে…’

‘মানে আপনি বলতে চাইছেন ভাস্কর পণ্ডিত নিজে আক্রমণ করেছিলেন এখানে। এবং তিনিই এখানকার বণিকদের খুন করেন কোনওভাবে…’

মাথা নাড়েন সুব্রত, ‘ওই যে বললাম ওয়াইল্ড গেস। এরকম গোঁজামিলের অঙ্ক কষতে থাকলে নাইটস টেম্পলাররা এদেশে এসে প্রথম দুর্গাপুজো চালু করেছিল বলেও হিসেব মিলিয়ে দেওয়া যায়…’

দূর থেকে ভেসে আসা একটা ডাক শুনে ফিরে তাকান সুব্রত, ‘ইয়ে, আমার বউ ডাকছে। আমি না হয় একটু পরে…’

সুব্রত দ্রুত পায়ে সরে পড়তে মানিককে সঙ্গে নিয়ে আবার পুকুরের দিকে হাঁটা দেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। তার মুখেও এখন দুশ্চিন্তার ভাঁজ খেলা করছে। এতক্ষণের গল্পটা মেলানোর চেষ্টা করেও কূল পাচ্ছেন না তিনি।

‘আপনি একটা খুনের মামলায় ইতিহাস নিয়ে ভাবছেন কেন বলুন তো?’ মানিক জিগ্যেস করে।

প্রশ্নটা শুনেই যেন ইতিহাস থেকে আবার পুকুরের দিকে দৃষ্টি ফেরে তার। মানিকের দিকে না তাকিয়েই বলেন, ‘উঁহু, ভাবছিলাম বাইরে থেকে এসেই যদি কেউ খুন করে থাকে তাহলে সেটা কে হতে পারে? মেয়েটার কোনও প্রেমিক…’

‘সে একটা ছিল। মাসছয়েক হল যোগাযোগ নেই। ছেলেটি অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেছে। হালকা কথা কাটাকাটিও হয়েছে। তবে ঘটনার দিন সে কলকাতাতেই ছিল। আমি স্যার ভাবছিলাম…’

‘কী ভাবছিলে?’

‘আচ্ছা ধরুন যে কেয়ারটেকার দুটো ছিল তারাও তো কেউও হতে পারে। গলা টিপে খুন করা এমন আহামরি কিছু কাজ নয়। তারপর জলে ফেলে…’

‘কিন্তু কারণটা কী? সেটাই তো বুঝতে পারছি না। যদি সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট হত তাহলে না হয় বলা যেত যে মদ খেয়ে ঝোঁকের মাথায়…’ প্রবল মাথা নাড়েন বিশ্বাস, ‘কোনও দিকেই কোনও আলো পাচ্ছি না হে…সবই গুলিয়ে যাচ্ছে…’

মানিক কী যেন ভাবছিল, তেমন উদাস গলাতেই সে বলে, ‘ভারী অদ্ভুত একটা রাত, তাই না স্যার? ছোটাছুটি হল, দাপাদাপি হল, একটা মানুষ খুন হল, একটা মানুষ রক্তাক্ত হল, কান্নাকাটি হল আবার সেই একই রাতে কে যেন দোতারা বাজিয়ে গান গাইল। আর সব কিছুর মাঝখান থেকে উধাও হল একটা কাকতাড়ুয়া। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে স্যার কাকতাড়ুয়াটাই খুনি…’

ইনস্পেক্টর বিশ্বাস কিছু বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় পুকুরের দিক থেকে একটা তুমুল হইচই ভেসে আসে। ভাবসাব দেখে মনে হয় জল থেকে কিছু একটা জিনিস তুলে এনেছে ওরা। মানিক আর ইনস্পেক্টর বিশ্বাস দ্রুত ছুট দেন সেদিক লক্ষ্য করে।

ডুবুরিদের মধ্যে একটা বাচ্চা ছেলে ছিল। সেই কাদামাখা একটা চকচকে কিছু এনে ফেলেছে ডাঙায়। ইনস্পেক্টর বিশ্বাস নিচু হয়ে কাদার মধ্যে থাকা ধাতব জিনিসটা বের করে আনলেন ঘাসের জমির উপরে। হাত দিয়ে জমাট কাদা সরাতেই সকালের রোদে ঝকমক করে উঠল ব্লেডটা। একটা ছ’ইঞ্চি লম্বা ছুরি।

ছুরিটা নাদু নস্করের দিকে তুলে ধরলেন ইনস্পেক্টর, ‘এটা তোমাদের ছুরি?’

নাদু আর হরি দুজনেই দুপাশে মাথা নাড়াল।

‘আগে দেখেছ কেউ এটা?’

‘না স্যার।’

ছুরিটা ভালো করে পরীক্ষা করলেন ইনস্পেক্টর। ‘খুব একটা পুরোনো নয় এটা। দিনতিনেকের বেশি জলের তলায় থাকার কোনও লক্ষণ নেই। ফলাটা যথেষ্ট ধারালো। এমন একটা ছুরি দিয়ে খুন করা আশ্চর্যের কিছু নয়। কিন্তু খুনটা…’

বিশ্বাসের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিল মানিক, ‘কিন্তু ছুরি দিয়ে তো আদৌ খুনটা হয়নি স্যার।’

‘তাও ছুরিটা কেউ এনেছিল…’

‘যদি গলা টিপেই খুন করবে তাহলে ছুরি দিয়ে হলটা কী?’

‘আর যদি কিছু নাই হয়ে থাকে তাহলে সেটা অকারণে জলের তলায় ফেলার দরকার পড়ল কেন?’

ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের মুখে ছায়া নামল। প্লাস্টিকের প্যাকেটে ভরে সেটা মানিকের হাতে দিয়ে বললেন, ‘এটা ভালো করে পরীক্ষা করে দেখো ছুরিটার ব্যাপারে আর কিছু জানা যায় কিনা…ভালো কথা, পোস্টমর্টেম রিপোর্ট কী বলছে?’

মানিক কাঁধ ঝাঁকায়, ‘তেমন কিছুই না স্যার। স্টমাকে রাতের খাবার আর মদ ছিল। সেই কারণেই খুনের সময়ে খুব একটা বাধা দিতে পারেনি। খুনি পেছন থেকে গলা টিপে ধরে খুন করে তাকে। গভীর রাতের দিকে, আইমিন দুটো থেকে তিনটের মধ্যে হয় খুনটা…’

‘শরীরে মদ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায়নি?’

মনে করার চেষ্টা করে মানিক, ‘অ্যালকোহল ছাড়া ওষুধ পাওয়া গেছে স্যার। অ্যানালজেস্টিক আর ঘুমের ওষুধ। তবে আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি মেন্টাল ডিপ্রেশনের জন্য ভিক্টিম অনেকদিন ধরেই ঘুমের ওষুধ খেত। ওটা পাওয়া যাওয়াটা খুব একটা অড নয় স্যার…’

বিশ্বাসের ভুরু কুঁচকে যায়, থেমে থেমে বলেন, ‘অড নয়। কিন্তু সিচুয়েশনটা ভাবলে একটা খটকা লাগছে। যে মেয়ে সেদিন রাতে বান্ধবিদের সঙ্গে অত মদ খাবে, সে হঠাৎ ঘুমের ওষুধ খেতে যাবে কেন? মদ খেয়ে, তারপর ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ার জন্য তো এই বয়সের ছেলেমেয়েরা ঘুরতে আসে না। সারারাত পার্টি করার প্ল্যান ছিল…’

‘আপনি কী বলতে চাইছেন স্যার? কেউ ঘুমের ওষুধ খাইয়েছিল ওকে? কিন্তু খুন করার ইন্টেনশন থাকলে ঘুমের ওষুধ খাওয়াবে কেন? ঘরে ঢুকে ঘুমিয়ে পড়লে পুকুরে ডুবিয়ে মারতে তো সুবিধা হওয়ার কথা নয়…’

‘ঠিকই বলেছ, এক যদি না…’

‘কী?’

‘সেদিন কেয়ারটেকার দুজনও ঢের আগে ঘুমিয়ে পড়েছিল।’ বিশ্বাস দাড়ি চুলকে বলেন, ‘আচ্ছা মানিক, এমনও তো হতে পারে সেদিন ঘুমের ওষুধের টার্গেট ভিক্টিম ছিল না। ছিল অন্য কেউ…’

‘অন্য কেউ বলতে? কে?’

‘সবাই। আসল খুনের প্ল্যানটা এমন কিছু ছিল যাতে সবার মধ্যে একটা ঘুমঘুম ভাবের দরকার ছিল খুনির…’

মানিকের মুখে মুহূর্তে উত্তর শোনা যায়, ‘তা কী করে হবে স্যার? সবার খাবারেই যদি ঘুমের ওষুধ মেশানো হয়ে থাকে তাহলে মিস্টার ঘোষ আর ওর ফ্যামিলিও তো…’

কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল মানিক। কথার মাঝেই দ্রুত পা চালিয়ে সুব্রত ঘোষের ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। সুব্রতও ঘর থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। বিশ্বাসকে এগিয়ে আসতে দেখে একটু থমকে যান। বিশ্বাস কঠিন গলায় জিগ্যেস করেন, ‘আচ্ছা মিস্টার ঘোষ, আপনি বলছিলেন আপনার স্ত্রী নাকি ভীষণ ধার্মিক। তো তিনি নিশ্চয়ই মাঝে মধ্যে নিরামিষ খান?’

‘হ্যাঁ তা খায়…’ আমতা আমতা করেন সুব্রত ঘোষ।

‘এবং আপনাকেও ওর সঙ্গে তাই খেতে হয়—কী, তাই তো?’

‘ইয়ে…সেটা তো…’

‘তো গত রবিবারও আপনারা নিরামিষ খেয়েছিলেন?’

‘হ্যাঁ, অন্যদের জন্য মাংস হয়েছিল। আমরা তিনজন শুধু…’

ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের মাথায় বিদ্যুৎ খেলতে থাকে। মানিকের দিকে ফেরেন তিনি, ‘সেদিন রাতে সবার খাবারেই ঘুমের ওষুধ মেশানো হয়েছিল। তবে রুটিতে নয়, মাংসে। কেবল যে মিশিয়েছিল সে জানত না যে মিস্টার ঘোষ এবং তার ফ্যামিলি সেদিন নিরামিষ খাবেন…’

‘কিন্তু কে মেশাবে?’

‘যার সে রাতে ম্যাজিক দেখানোর ছিল…’

নাদু নস্কর এতক্ষণ বিড়ালের মতো অনুসরণ করছিল ওদের। এবার হুট করেই তার দিকে ফেরেন বিশ্বাস, ‘ভাত আর তরকারি সব এক জায়গাতেই রান্না হয় আপনাদের? নাকি আলাদা আলাদা জায়গায়?’

‘আজ্ঞে, স্যার ভাত, তরকারি সবই ভিতরে হয়। কেবল মাংসটা ক্যাম্পফায়ারে পুড়িয়ে রান্না হয় বলে বাইরে…’

‘সেটা সেদিন সবারই খাওয়ার কথা ছিল, তাই না?’

‘হ্যাঁ…’ সুব্রত ঘোষের দিকে আঙুল দেখায় নাদু নস্কর, ‘ওনারা যে নিরামিশ খাবেন সেটা সন্ধের আগে বলেনি আমাদের।’

‘সেদিন রান্নাটা কে করেছিল?’

নাদু নস্কর একটু থতমত খায়, ‘ইয়ে আমিই করেছিলাম। কিন্তু আমি তো খাবারে কিছু…’

‘সারাক্ষণ আপনারা মাংসটার ধারেই বসেছিলেন?’ শক্ত গলায় প্রশ্ন করেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘মাঝে উঠে যাননি কোথাও?’

নাদু নস্কর ঝটপট জবাব দেয়, ‘পোড়ার মধ্যে কোথাও যাইনি। কিন্তু বাঁশ থেকে বের করার পর ওতে লেবু মাখাতে হয়। তখন…’

‘তখন কেউ গিয়েছিল, তাই তো?’

কী যেন ভাবার চেষ্টা করে নাদু নস্কর, তারপর বলে, ‘ঠিক মনে পড়ছে না। তবে মনে হয় গিয়েছিল…’

‘কে গিয়েছিল?’

‘ওই যে তিনটে মেয়ের মধ্যে একজন। বলল ও নাকি ভালো রান্না করতে পারে। তখনও পেটে মদ পড়েনি। ওইটুকু মেয়ে আবদার করল মাংসে লেবু মাখাবে। আমি আর না করতে পারিনি স্যার। ও যখন লেবু মাখাচ্ছিল আমি কয়েকবার উঠে গেছিলাম। তখন যদি কিছু…’

নাদু নস্করের চোখের সামনে তিনটে ছবি তুলে ধরেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘এর মধ্যে কোন মেয়েটা বলতে পারেন?’

আঙুল দিয়ে একজনকে দেখিয়ে দেয় নাদু নস্কর, ‘এই যে…এই মেয়েটি…’

ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের মুখটা বুকের উপরে নেমে আসে, চোখে হাসির ঝিলিক খেলে যায় তার। মানিক উঁকি মারে ছবিটার উপরে। তিনটে মেয়ের মধ্যে একজন ভিকটিম। মাঝে ঈশানী প্রামাণিকের ছবির উপরে আটকে আছে নাদু নস্করের আঙুল।

কাকতাড়ুয়া – 9 অধ্যায়

নবম অধ্যায়

ঘাসের জমি থেকে এগিয়ে এসে সিংহদরজার কাছে যখন ভূপেন এসে দাঁড়াল তখন কলকাতার পথঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের চারদিকটা অবশ্য এখনও আলোকিত। সাদা আলো দিয়ে আদ্যপান্ত মুড়ে ফেলা হয়েছে সমস্ত বিল্ডিংটা। চারদিকের জমি ফাঁকা পড়ে আছে, মধ্যে মধ্যে ঝোপঝাড়। তার ফাঁকে ফাঁকে আপাতত অন্ধকার জমেছে।

সমস্ত দিকটায় একবার সতর্ক চোখ বুলিয়ে নেয় ভূপেন। সাধারণত এ সময়টায় এদিকে কেউ আসে না। ওদের জনা পনেরো নাইট গার্ডের হাতে দায়িত্ব দেওয়া থাকে। তাছাড়া এখানে বেশ কয়েক জায়গায় সিসিটিভি লাগানো আছে। সেগুলো সর্বক্ষণ দৃষ্টি রেখে চলেছে।

ভূপেনের বয়স চল্লিশের আশেপাশে। তবে ছিপছিপে সুঠাম চেহারা বলে তাকে দেখে চল্লিশের একটু কম মনে হয়। বছর তিনেক হল এখানকার রাতের সিকিওরিটির দায়িত্ব ও নিজেই সামলাচ্ছে। আপাতত সমস্ত জায়গাটা টহল দিয়ে দেখছে ও। হাতের মোটা লাঠি দিয়ে মাঠের উপর পড়ে থাকা আবর্জনা সরিয়ে দিচ্ছে ইতিউতি। কখনও মাঠ ছেড়ে ঢুকে আসছে ভিতরের অফিস ঘরে। এখান থেকে সবক’টা সিসিটিভি কন্ট্রোল করা হয়। সেই স্ক্রিনের উপরে নজর রাখছে মাঝে মাঝে।

এত কিছুর দরকার নেই অবশ্য। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে সিকিওরিটি নিয়ে তেমন বড় কিছু ঝামেলা হয়নি আজ অবধি। তাছাড়া মেমোরিয়ালের ভিতরের দরজা অনেকক্ষণ আগে বন্ধ হয়ে গেছে। বাইরে চুরি হওয়ার মতো ছোট আর দামি জিনিস প্রায় কিছুই নেই।

বিল্ডিংয়ের সামনের দিকের মাঠের কাছে আসতেই ভূপেন একবার থমকে দাঁড়ায়। ওর ঠিক ডানদিকে ছোটখাটো ঝোপঝাড় হয়ে আছে। সেটা একবার নড়ে উঠল না? অদ্ভুত শব্দ আসছে কি ওদিক থেকে? অবশ্য এখানকার বাগানে কিছু রাজহাঁস ঘুরে বেড়ায়। তারাও হতে পারে। কিন্তু সেগুলোকে তো অনেক আগেই ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ঝোপটা লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় ভূপেন। এত রাতে এখানে কে আসতে পারে? বিকেলে এখানে এসে কি কেউ বেরোয়নি?

ইচ্ছা করেই ঘাসের উপর পায়ের শব্দ তুলে সেদিকে এগিয়ে যায় ও। মুখ বাড়িয়ে একবার দেখে নিয়ে লাঠি দিয়ে ঝোপটা সরানোর আগেই পেছন থেকে একটা আওয়াজ আসে।

‘কিছু খুঁজছেন স্যার?’

পিছন ঘুরে অবিনাশকে দেখতে পায় ভূপেন। অবিনাশ সিকিউরিটিতে যোগ দিয়েছে। চৌকস ছেলে। সারারাত ছটফটে পায়ে গোটা চত্বরটা ঘুরে বেড়ায়। একটু এদিক থেকে ওদিক হলেই সোজা হেড অফিসে ফোন করে জানিয়ে দেয়।

‘ঝোপটা মনে হল দুলছিল।’ ভূপেন আবার মুখ ফিরিয়ে নিয়ে জবাব দেয়, ‘রাতে কেউ ঝোপের মধ্যে থাকলে মশার কামড় খেয়ে মরে যাবে।’

অবিনাশ নিজেই সেদিকে এগিয়ে যায়। তারপর হাত দিয়ে ঝোপটা একদিকে টেনে ধরে মুখ বাড়িয়ে দেয়, ‘কই কিছু নেই তো স্যার…’

ভূপেনের দিকে চোখ তুলে তাকায় অবিনাশ, থমথমে গলায় বলে ‘পিনাকিদা বলছিল, এই বিল্ডিংয়ে নাকি ভূত আছে স্যার। তাদের কেউ নয় তো?’

‘তুই তো দেখছি ভারি ভিতু ছেলে, এই জন্যেই রাতে ঘুম হয় না নাকি?’

অবিনাশ ভালো করে একবার চোখ রগড়ে নেয়। তারপর মুখে হাত ঘষতে ঘষতে বলে, ‘ঘুম হয় তো স্যার। দুপুরে ফার্স্ট ক্লাস ঘুম দিই রোজ।’

‘তাহলে তোর চোখ মুখ এরকম ঢুলু ঢুলু লাগছে কেন? নাহ, এরকম করে তুমি কাজ করবে কী করে?’

অবিনাশ বুঝতে পারে না। নিজের মুখেই বারবার হাত বুলিয়ে দেখতে থাকে। ভূপেনের মুখে একটা হাসি খেলে, হাতের ফ্লাস্ক থেকে একটা কাপে কফি ঢালতে ঢালতে বলে, ‘কফিটা খেয়ে নে। আপাতত আর ঘুম আসবে না…’

কথা না বাড়িয়ে কফিটা খেয়ে নেয় অবিনাশ। সিকিওরিটি হেড নিজের কফি থেকে ওকে ভাগ দিয়েছে, সে জিনিস চাইলেও রিফিউজ করা যায় না।

কফি খেয়ে আবার বিল্ডিংয়ের অন্যদিকে পা বাড়ায় অবিনাশ। যতক্ষণ সে সামনের দিকে হাঁটতে থাকে ভূপেন ঠায় তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। তারপর ওর দেহটা দূরের দিকে মিলিয়ে আসতেই ঝোপের দিকে একটু সরে আসে। নরম গলায় হাঁক দেয়, ‘ডেঞ্জার ক্লিয়ার, তুই চলে আয়…’

পেছনের একটা ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে ঈশানী। ওর কাঁধে একটা ব্যাগ। সে ব্যাগের মধ্যেই আছে রঙের সরঞ্জাম, ব্রাশ আর স্প্রে পেন্ট।

ঈশানী বিদ্যুতের শিখার মতো দৌড়ে এসে দাঁড়ায় একটা গাছের আড়ালে। চারু এসে দাঁড়ায় ওর পাশে। বুকের ভিতরে এখনও টিপটিপ করে রক্তের ফোঁটা পড়ছে। ঈশানী হাঁপাতে হাঁপাতেই বলে, ‘বাকিগুলোর কী অবস্থা?’

‘সব কটাকেই কফি খাইয়েছি। কয়েকটা খেতে চায়নি, সেগুলোকে অন্য ভাবে সাইজ করতে হবে। আমি খোঁজ নিয়েছি এইখানে সিসিটিভি নেই। এখানেই ছবি আঁক…’

‘ধুর…’ ঈশানী বিরক্ত হয়, ‘এখানে তো ক’টা থাম। লোকে দেখে আমল দেবে না। অন্য কোথাও চ…’

‘সিসিটিভি দেখে নিলে?’

‘তুই ওগুলো বন্ধ করিসনি?’

ভূপেন হাতের উপর ঘুষি মারে, ‘চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু শালা বন্ধ করতে গেলে কীসব কোড চাইছে, বিস্তর হ্যাপা।’

কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে ঈশানী, তারপর কী যেন ভেবে বলে, ‘এক কাজ কর, ঝোপের ভিতর দিয়ে আয়। সামনে গিয়ে দেখি কিছু আছে কিনা…’

‘ওখানে সিসিটিভি দেখে নিলে?’

‘আঃ…’ বিরক্ত হয় ঈশানী, ‘ঝোপের ভিতর ছেলেমেয়ে বসে চুম্মাচাটি, গুচুপুচু করে। যদি সত্যি সিসিটিভি থাকত তাহলে এতদিনে দু’একটা ভাইরাল হত। সেটা হয়নি যখন ও জায়গাটা সেফ…চলে আয়…’

ঝোপের ভিতর দিয়ে সতর্ক বিড়ালের মতো এগোল দুজনে। কখনও ঝোপ খুব নিচু হয়ে গেলে মাথা নিচু করে হাঁটু মুড়ে গেল। কখনও নিজের শরীর দিয়ে ঈশানীকে ঢেকে দিল চারু। মিনিট দশেক সেভাবে চলার পর ভিক্টোরিয়ার বিশাল সিংহাসনে বসা মূর্তিটার সামনে এসে দাঁড়াল ওরা।

এতক্ষণ ঝোপের মধ্যে গুড়ি মেরে চলে হাঁপিয়ে গেছিল ঈশানী। ঝোপের মধ্যেই বসে বিশ্রাম নিতে লাগল সে। সামনে বসে থাকা রানির মূর্তির দিকে চেয়ে বলল, ‘দেখ মাগিকে, এমন রেলা নিয়ে বসে আছে, যেন কত বড় বাল ছিঁড়েছে…’

‘তাও রানি বলে কথা…’

‘ওর জায়গায় আমি জন্মালে আমিও হতাম। রাজা-রানি হতে কোনও ক্ষমতা লাগে না। তাদের সিংহাসন থেকে হটিয়ে গলাটি কুচ করে কেটে দিতে পারলে তবে বুঝব, হ্যাঁ বাপের ব্যাটা।’

‘তাও এত বড় একটা মেমোরিয়াল তো আছে…’

‘বালের মেমোরিয়াল। বাঙালি এসব মেমোরিয়াল ফিয়ালকে পাত্তা দেয় না। ব্রিটেনের রানি রেলা নিয়ে সিংহাসনে বসে থাকে আর হাওড়ার হাবু শ্যাওড়াফুলির সীমাকে তার সামনেই রডে বসায়…’

চারদিকে একবার ভালো করে দেখে নেয় চারু। মুখে প্রশস্ত হাসি ফোটে তার, ‘এই এখানে মনে হচ্ছে কোনও ক্যামেরা ফ্যামেরা নেই। ওখানে তাও গাছ ছিল। এখানে ক্যামেরা লাগানোর জায়গাও নেই।’

‘আছে তো…’ ঈশানী উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে, ‘ওই যে মাগি বসে আছে রেলা নিয়ে। সমস্ত বিধবা পিসিমারাই সিসিটিভি ক্যামেরা, জানিস না?’

‘বিধবা পিসিমা! ইংল্যান্ডের রানি?’

‘নয়?’ ঈশানী ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, ‘বড় বংশের মেয়ে বলে ছোট থেকে প্রেম ভালোবাসা হয়নি। রানির বিয়াল্লিশ বছর বয়সে স্বামী এলবার্ট মারা যায়। বছরদশেকের বিবাহিত জীবন। মেনোপজটা কোয়ি না সাথ, আপনা হাত হয়েই কাটাতে হয়েছে। আর একটু হলেই “আর কত রাত একা থাকব” গানটা ইংল্যান্ডের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে যেত…’

‘বিধবা তো বুঝলাম, কিন্তু পিসিমা কেন?’

‘আরে, এদের স্বভাবই হল নিজের ছেলে উচ্ছন্নে গেলেও পরের মেয়ে কোথায় কার সঙ্গে ওঠা বসা করে তার খবর রাখা। এই মহিলারও সে স্বভাব ছিল।’

‘তোকে কে বলল?’

স্ট্যাচুটার দিকে ধীরে পায়ে এগোতে এগোতে বলে ঈশানী, ‘আঠেরোশো নব্বইয়ের দিকে রানির শাসনকালে, একটা বছর পনেরোর ছেলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। পেশায় সে ডাক পিয়ন। চোদ্দটা শিলিং পাওয়া যায় তার কাছ থেকে। পুলিশ সন্দেহ করে ছেলেটা নাকি চুরি করেছে পয়সাগুলো। তো তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে জেরা করা শুরু হলে তার কাছে থেকে যা জানা যায় তাতে শোরগোল পড়ে যায়। ছেলেটি বলে সে নাকি ক্লিভল্যান্ড স্ট্রিটের একটা পুরুষ পতিতালয়ে বেশ্যার কাজ করে। সে সময়ে ব্রিটেনে হোমোসেক্সুয়ালিটি ভয়ঙ্কররকম নিষিদ্ধ। রানির ওড়নায় আগুন লাগে যখন জানা যায় রানির ছেলের বিশেষ চাকর আর্থার সামারসেট নাকি সেই পতিতালয়ের ডেলি কাস্টমার। তার থেকে খোঁজ নিয়ে আরও বড় বড় কাস্টমারদের নাম উঠে আসে। সবাই রানির ঘরের লোক। যে রানি গে, লেসবিয়ানদের বিরুদ্ধে দিনের পর দিন একটার পর একটা আইন জারি করে আসছেন, দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে লোক গরম করছেন, তারই খাস লোকেরা পুরুষ বেশ্যাদের বিছানা গরম করছে। মজার না? এরপর কী হল গেস কর দেখি…’

‘কী?’

‘ওই পনেরো বছরের ছেলেটা দুম করেই একদিন ভীষণ স্বাভাবিক কোনও রোগে ভুগে মরে গেল…’

সিঁড়ি দিয়ে উঠে মূর্তির কাছে পৌঁছে ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র বের করে ঈশানী। কয়েকটা রঙের কৌটো, একটা স্প্রে পেন্ট, একটা ব্রাশ আর একটা ছোট টুল। এই টুলটাকে অ্যাডজাস্ট করে উঁচু করে নেওয়া যায়। আগে দেওয়াল লেখার সময় উঁচু দেওয়ালে লিখতে হত মাঝে মাঝে। তখন পার্টি থেকেই দিয়েছিল এই টুলটা। তারপর থেকে ঈশানীর কাছেই পড়ে আছে।

সেটার পায়াগুলো খুলে টুলটাকে উঁচু করে চারু। ঈশানী সেটার উপর উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে। টুলটা তেমন পোক্ত নয়। ভালো করে ধরে না থাকলে নড়বড় করে।

শ্বেতপাথরের উপরে রং বসানো সহজ নয়। রঙ সহজে দাঁড়ায় না। চক পেন্ট ছাড়া অন্য কোনও রং বসে না তাতে। সেটা জোগাড় করতে আবার বেশ বেগ পেতে হয়। কাল সন্ধ্যায় নিজেই গিয়ে কিনে এনেছে ও।

কয়েক পোঁচ সাদা রং দিয়ে একটা মোটামুটি ছবি আঁকার মতো এক মিটারের সাদা সারফেস তৈরি করে ঈশানী। এই শীত শীত রাতেও পরিশ্রম আর উত্তেজনায় ওর কপালে ঘাম দেয়। চারু এখনও শক্ত করে ধরে আছে টুলটা। ঈশানীর নিজের থেকে যেন ওরই বেশি আগ্রহ গোটা ব্যাপারটায়।

ব্রাশটা হাতে নিয়ে রং বোলাতে বোলাতে ঈশানী বলে, ‘তুই আমার কাছে রয়ে তো গেলি, কিন্তু রাখব কী করে সেটাই ভাবছি…’

‘কেন? ছাদে যেমন আছি তেমন থাকব।’

‘সে তো আমি যতক্ষণ অফিসে আছি ততক্ষণ। ছাদের চাবি আমার কাছেই থাকে। ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমার তো অফিস থেকে ফিরে তোর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করবে। তখন কী হবে?’

‘কী আবার হবে? তখন ছাদে চলে আসবি।’

‘আচ্ছা? ও পাশের বাড়ির লোকজন তাদের ছাদ থেকে দেখে ফেললে? ছাদে একটা উটকো ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছি—ব্যাপারটা মায়ের কানে আসতে বেশিক্ষণ লাগবে না। সিসিটিভির অভাব এখানে থাকলেও আমার বাড়িতে নেই।’

‘তাহলে?’

রং করতে করতেই একটুক্ষণ ভাবে ঈশানী, ‘তাহলে আমি অফিস থেকে ফিরে তোকে ঘরে নিয়ে চলে আসব। বাড়িতে থাকলে তুই ঈশানী হয়ে থাকাই ভালো। হুট করে কেউ দেখে ফেললে সন্দেহ করবে না।’

‘কিন্তু একসঙ্গে দেখে ফেললে?’

‘তখন প্রমাণ হবে বাড়িতে আমি একাই গাঁজা খাই না…’ অন্য একটা রং হাতে তুলে নেয় ঈশানী, ‘ভালো করে একটা সিডিউল তৈরি করতে হবে বুঝলি। ভালো কথা, তোর খাওয়াদাওয়া করতে হয়?’

চারু টুল থেকে হাত সরিয়ে নেয়, ‘লোভ লাগে, কিন্তু না খেলে মরে যাব না…’

প্রাথমিক রংটা বসে যেতে সেটা শুকানোর জন্যও অপেক্ষা করে ঈশানী। তারপর সাদা রঙের অন্য দিকটায় হাত চালায়।

চারু চারিদিকটা আরেকবার দেখে নেয়। আশেপাশে কোনও গার্ডকে এখনও দেখা যাচ্ছে না। একটু নিশ্চিন্ত হয় সে।

‘আচ্ছা, মাঠে দাঁড়িয়ে থাকার কথা তো মনে আছে তোর। তার আগের কিছু মনে নেই? মানে তার আগে তুই কোথায় ছিলি, কীভাবে ছিলি, কোন কোন মানুষদেরকে দেখেছিস?’

চারু কাঁধ ঝাঁকায়, ‘সবকিছু মনে থাকে না। কিছু ছোট ছোট ছবি মনে পড়ে…তার কোনও মানে বুঝতে পারি না…’

‘যেমন?’

‘যেমন ধর, একদল লোক। এখনকার মতো জামা পরে নেই। লম্বা ঝুলওয়ালা জামা, বেশ শক্তপোক্ত…তাদের হাতে তলোয়ার। একটা দরজা দিয়ে ঢুকে আসছে তারা। তলোয়ার চালাচ্ছে…ঠুংঠাং আওয়াজ, রক্ত…অনেক রক্ত…’

বলতে বলতে নিজের মাথা টিপে ধরে চারু, ‘ভাবলে খুব মাথা ব্যথা করে, আর মন খারাপ হয়ে যায়।’

ঈশানী বিড়বিড় করে, ‘তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধ হচ্ছে, গলা কাটছে, এসব তো মধ্যযুগে হত। তুই কি তখন থেকেই দুনিয়ায় আছিস?’

‘হতে পারে, আমি কী করে বলব?’

‘তোর মাথার পিছনে দুটো চিহ্ন আছে। একটা ঘুড়ি আর একটা পাখি। ওগুলোর মানে কী জানিস?’

‘উঁহু…’

হঠাৎ ঈশানীর চোখে ঝিলিক দিয়ে ওঠে, ‘আমার বাবার এক প্রফেসর বন্ধু আছেন। কলেজে ইতিহাস পড়ান। এইসব দিকে হেব্বি ইন্টারেস্ট। তার সঙ্গে যদি তোর একবার দেখা করানো যেত…ওই দৃশ্যগুলো ডিটেলে বলতে পারলে কিছু সাহায্য করতে পারত মনে হয়…’

দুজনের কেউই আর কোনও কথা বলল না। শুধু মাঝে মাঝে রঙের কৌটোয় ব্রাশ ডোবানোর ছপছপ আওয়াজ। আর সেই সঙ্গে দূরে ঘুমন্ত শহরের বুক দিয়ে ছুটে যাওয়া একটা দুটো যানবাহনের আওয়াজ। ঈশানীর ব্রাশ বুলানোর সঙ্গে সঙ্গে কয়েক ফোঁটা রং মাটিতে ছিটকে পড়ছে। কিছু কিছু এসে লেগেছে চারুর মুখে। ও হাত দিয়ে মুছে নিচ্ছে সেটা।

মাঝে মাঝে তাকিয়ে দেখছে আঁকাটার দিকে। একটা ফাঁকা রাস্তার উপরে মনের খেয়ালে নাচছে সেই মেয়েটা আর সেই বিচিত্র চেহারার কাকতাড়ুয়াটা। তাদের দুজনের মুখেই হাসি। দুজনেরই অন্য কোনও দিকে খেয়াল নেই। দেখতে দেখতে চারুর মুখে ঠিক একইরকম হাসি ফোটে।

ঈশানীর আঁকা প্রায় শেষ। টুলটা তুলে নেবার জন্য ও মাটিতে নামতে যাবে, এমন সময় দূর থেকে একটা চিৎকার শোনা গেল, ‘হেই কন হে উধার…কী করছ তোমরা?’ সঙ্গে তীব্র হুইশলের শব্দে ভরে উঠল চত্বরটা।

‘গাঁড় মেরেছে!’ লাফিয়ে টুল থেকে নামতে গিয়ে চারুর গায়ের উপর হুড়মুড়িয়ে পরল ঈশানী। ধুলোতে মাখামাখি হল দুজন।

দূর থেকে একটা গার্ড দেখতে পেয়েছে ওদেরকে। চিৎকার করে লাঠি নিয়ে তেড়ে আসছে এদিকে। তার হাতে একটা মোটা লাঠি। হুইশলে ফুঁ দিয়েই চলেছে লোকটা। কিন্তু এদিকের বেশিরভাগ গার্ড আধোঘুমে তলিয়ে আছে। তাদের কানে গেল না সেই হুইশল।

চারু একটু ঠেলে দূরে সরিয়ে দিল ঈশানীকে, ‘তুই লুকিয়ে পড়, বাকি আমি বুঝে নিচ্ছি।’

ঈশানী ওর হাত ধরে তাড়া দেয়, ‘লুকিয়ে কী হবে? চল পালাই, দৌড়ালে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারব।’

মুখ ঝামটা দেয় চারু, ‘হ্যাঁ, আমরা বেরোই আর ওরা দেখতে পেয়ে সব মুছে দিক। সকালে লোকজন না দেখতে পেলে কোনও লাভ নেই।’

‘তাহলে কী হবে?’

উত্তেজনার মুহূর্তে আর কিছু মাথায় আসে না ওদের। লোকটা আপাতত মিটার কুড়ির মধ্যে এসে পড়েছে। দুজনে দৌড়ে সামনেরই একটা অন্ধকার ঝোপের আড়ালে ঢুকে পড়ে। একটা বেরিয়ে থাকা লতায় পা আটকে চারুর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঈশানী। দুজনের একটু ধস্তাধস্তিও হয়। জামাকাপড় ছিঁড়ে যায় কয়েক জায়গায়।

এতক্ষণে লোকটা দৌড়ে এসে পৌঁছেছে ঝোপটার কাছে। আক্রোশে ঝোপের উপর একটা লাঠি চালায় সে, ‘বেরিয়ে আয় শুয়োরের বাচ্চারা। আজ তোদের গাঁড়টি কেমন করে মারি দেখ।’

‘আমরা নিজেরাই ওটা করে নিতাম স্যার, আপনার আবার আসার কী দরকার ছিল?’ ঈশানী অন্ধকার থেকেই গলা তুলে উত্তর দেয়।

মেয়ের গলার আওয়াজ পেয়ে লোকটা আরও রেগে যায়। চিৎকার করে বলে, ‘ছিঃ ছিঃ, এরকম একটা জায়গায় এসে নোংরামি করতে লজ্জা করে না? বাড়িতে বাপ-মা নেই তোদের?’

‘কী করব স্যার? একটা কাকতাড়ুয়াও আছে…’

লোকটা মানে বুঝতে পারে না। আবার ঝোপের উপরে লাঠি চালিয়ে বলে, ‘বেরিয়ে আয়, আজ মজা দেখাচ্ছি তোদের।’

আর উপায় নেই। চারু ঈশানীকে অন্ধকারে রেখে নিজে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে আসে। ওকে দেখে লোকটা অবাক হয়ে যায়, ‘স্যার আপনি! ঝোপের মধ্যে মেয়ে নিয়ে…’

পিছন থেকে উত্তর আসে, ‘ছেলে নিয়ে বসলে তো আপনার রানি রেগে যেত…’

‘চুপ কর তুই মাগি…’ কথাটা বলে ভূপেনের দিকে তাকায় লোকটা, ‘আমি এটা আপনার থেকে এক্সপেক্ট করিনি স্যার। এটা আপনি করতে পারেন না…’

‘কেন? ওনার দাঁড়ায় না আপনি জানলেন কী করে? আপনিও ওনার সঙ্গে ঝোপে…’

লোকটা রাগত ভঙিতে এবার ভূপেনের কলার খামচে ধরতে যায়। কিন্তু তার আগেই থেমে গিয়ে তেমনি গড়গড়ে স্বরে বলে, ‘আমি এটা উপরমহলে রিপোর্ট করছি এক্ষুনি…’

‘তার আগে ওর নিচমহলটা একটু বাজিয়ে দে তো চারু…’

পেছন থেকে নির্দেশটা আসার সঙ্গে সঙ্গে একটা পা উঠে আসে চারুর। লোকটার দুই পায়ের মাঝে আছড়ে পড়ে সেটা। প্রবল যন্ত্রণায় মুখ ধরে মাটিতেই বসে পড়ে সে। পায়ের মাঝখানটা চেপে ধরে মাটিতে শুয়েই কাতরাতে থাকে।

চারু ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে, ‘রিপোর্ট পরে করবেন নাহয়। আপাতত মাথা ঠান্ডা করে একটু কফি খান, কেমন?’ জোর করে ওর মুখে গরম কফি ঢেলে মুখটা চেপে বন্ধ করে দেয় চারু। তারপর দুটো পা ধরে টেনে ঢুকিয়ে নেয় অন্ধকার ঝোপের ভিতর। লোকটা তাও ছটফট করতে থাকে।

ঈশানী ওর গালে আলতো করে দুটো থাপ্পড় মারে। নরম স্বরে বলে, ‘দেখুন, বেশি ছটফট করবেন না। ঘণ্টাখানেকের মামলা, সালটে দিয়ে চলে যাব…’

হাঁপাতে হাঁপাতেই আবার প্রতিবাদ করে লোকটা, ‘আপনারা…আপনারা এইভাবে জায়গাটাকে নোংরা…’

মুখ দিয়ে চুকচুক করে আওয়াজ করে ঈশানী, ‘এই যে আপনি ব্রিটেনের রানির রক্ষী হয়ে বসে আছেন। এটা পয়লা নম্বরের বোকাচোদামি। আসলে কী জানেন, ইংরেজ আমলের নিয়ম এখন আর চলে না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে এসেছিল পয়সা কামাবে বলে, তারপর রাজনীতি শুরু করে। এখনকার দিনে ব্যাপারটা উল্টে গেছে। আগে লোকেরা রাজনীতি করে তারপর পয়সা কামায়। এই ঢেমনি মাগির গার্ড না হয়ে যদি কোনও কেষ্টবিষ্টুর বডিগার্ড হতেন তাহলে কোটি কোটি টাকা কামাতেন…আপাতত শুয়ে থাকুন, কাজ আছে আমাদের…’

চারুর হাতটা ধরে বেরিয়ে আসে ঈশানী। চারু মেইন গেটের দিকে টানতে থাকে ওকে, ‘চল, কাজ তো শেষ…’

ঈশানী অবাক হয়, ‘শেষ কীসের? সবে একটা ছবি এঁকেছি।’

‘তো তুই কি কমিকস্ট্রিপ বানাবি নাকি?’

চারুর পিঠে একটা হাত রাখে ঈশানী, ‘দেখ চারু, সেক্স হোক বা আর্ট—ঈশানী প্রামাণিকের একবার চড়ে গেলে আর সহজে নামে না।’

দুজনে যখন মেইন গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে তখন আকাশ নীল হতে শুরু করেছে। স্কুটিটাকে ইচ্ছা করেই একটা সরু গলির ভেতর দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছিল ওরা। সেখানে হেঁটে যেতেও অন্তত মিনিট দশেক লাগবে।

ওদের দুজনের শরীরই ধুলো মাখা। ঈশানীর গায়ে কয়েক জায়গায় ধাবড়া হয়ে রং লেগে আছে। ছিঁটে ছিঁটে সাদা রং লেগেছে চারুর গায়েও। মাথার চুলগুলো এলোমেল হয়ে আছে দুজনের। ক্লান্ত লাগছে বলে হাতটা ধরে হাঁটছে ঈশানী।

কিছুদূর হেঁটে এসে পিঠে ব্যাগটা ভালো করে চাপিয়ে নেয় সে। দু’পাশে বড়বড় রাস্তাগুলো নিঝুম হয়ে পড়ে আছে। নন্দন, রবীন্দ্রসদন পেরিয়ে এসে আরও কিছুদূর হাঁটতে থাকে ওরা। ওদের জুতোর মসমস শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই আশেপাশে। কলকাতার ঘুম ভাঙতে আরও ঘণ্টাখানেক দেরি।

চারু ঈশানীর পিঠে একটা হাত রেখে বলে, ‘এই, ক্লান্ত লাগছে না তোর, না?’

অবসন্ন মুখেই মাথা নাড়ায় ঈশানী, ‘ক্লান্ত না, ভালো লাগছে। আমার জীবনে এরকম দিন খুব একটা আসেনি।’

চারু হাসে, চোখ উল্টে বলে, ‘দেখে যাও গুরু, সবে তো শুরু।’

ঈশানীর ঠোঁটের ফাঁকে হাসির ঝিলিক দেখা যায়। আনমনে চলতে চলতে সে হঠাৎ করেই জিগ্যেস করে, ‘আচ্ছা, তুই ওই কথাটা কেন বলেছিলি?’

‘কোন কথাটা?’

‘এই জগতটা তোর নয়। এখানে তো সব ঠিকঠাকই চলছে। আমার সঙ্গে আছিস, মজা করছিস, রাত জেগে অনাসৃষ্টি করছিস, এমন করে চলে গেলে হয় না?’

একটু সময় নিয়ে দুদিকে মাথা নাড়ায় চারু, ‘তোকে ঠিক ব্যাপারটা বোঝাতে পারব না। চারপাশে যত তাকাই মনে হয় এর কোনটাই আমার জগৎ নয়। আমার এখানে থাকার কথাই নয়। এই অনুভূতিটা ঠিক বোঝানো যায় না। কিন্তু একবার বুঝে ফেললে আর নিস্তার নেই এর হাত থেকে। আর কোনভাবেই তাকে ধরে রাখা যায় না…ও তুই বুঝবি না…’

ঈশানী উপর নিচে মাথা নাড়ায়, ‘কিছু বুঝতে না পারলেই আমার আগে জীবনানন্দ দাশের কথা মনে পড়ত জানিস। ছোটবেলায় সিলেবাসে কবিতাগুলো ছিল যখন, শালা কিছু বুঝতে পারতাম না…তারপর বড় হতে বুঝলাম কবি ক্রমাগত তোকে এটা বুঝিয়ে যাবে যে এই লাইনগুলো আদৌ তোর জন্য লেখা নয়। তুই এখানে আউটসাইডার…স্ট্রেঞ্জার! এটা ওর আর ওর নিজের জগতের একটা কনভারসেশন। তুই যদি এখান থেকে আড়ি পেতে কিছু বুঝে নিতে পারিস তাহলে নে। কিন্তু আমি দরজা খুলে তোকে এখানে স্বাগত জানাচ্ছি না…’ ঈশানীর গলা কোথায় যেন হারিয়ে যায়, ‘সারাজীবন তাকে একটা অচেনা শহরে, অচেনা মানুষের মধ্যে, অচেনা হাতের ছোঁয়ায় বেঁচে থাকতে হয়…তবে…’

‘তবে কী? বল…’

‘তোর দিকে তাকালে মনে হয় না। তুই রোজ পাল্টে যাস, তোকে চাইলে আমি যা খুশি করে ফেলতে পারি, কিন্তু তাও তোকে ভীষণ চেনা লাগে…’

চারু ওর কাঁধে হাত রেখে হাঁটে। ভোরের আগে বাড়ি ফিরতে হবে ওদের। তারপর ঈশানী ঘরে ঢুকে যাবে, আর ও দাঁড়িয়ে থাকবে ছাদে। ভাববে সূর্যের ওই আকশময় গতিপথের ঠিক কোনখানে ঈশানী অফিসে ঢুকেছে, ঠিক কখন কী বোর্ডের উপর ফড়ফড়িয়ে চলছে ওর আঙুলগুলো, কখন বসের ধাতানি খেয়ে মনটা খারাপ হয়েছে ওর। তারপর সূর্য ডুবে গেলে অপেক্ষা করবে ওর বাড়ি ফেরার। এতদিন চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে এক জায়গায়, কিন্তু কোনওদিন এমন করে অপেক্ষা করেনি কারও জন্য…

আরও খানিকটা আলো ফোটে। কলকাতার ফাঁকা রাস্তা দিয়ে দূরের দিকে হেঁটে যায় দুটো মানুষ। ক্লান্ত শরীরে একে অপরের আশ্রয়ে ঘন হয়ে আসে। বিড়বিড় করে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে থাকে ঈশানী—

আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্‌ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনায় সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।

কাকতাড়ুয়া – 10 অধ্যায়

দশম অধ্যায়

‘হিস্ট্রি অফ বিজলিমারি রুইন্স’—নামটা দিয়ে গুগল সার্চ করতেই একগোছা রেজাল্ট ভেসে উঠল স্ক্রিনের উপর। তাদের উপর একবার চোখ বুলিয়ে ঈশানী বুঝতে পারলে কোনও লিঙ্কই কাজের নয়। কোনও গণ্ডগ্রামের জঙ্গলের মাঝে কিছু ভাঙাচোরা বাড়িঘর নিয়ে খুব বেশি লোকের আগ্রহ আছে বলে মনে হয় না। কয়েকটা লিংকে ঢুকে ঘোরাঘুরি করল ঈশানী। তারপর কী বোর্ডের ফন্টটা বদলে বাংলা করে নিল।

ছোটখাটো দু-একটা ইনফরমেশন নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। একটা লিংকে আগ্রহ হতে ক্লিক করল। সেটা খুলে যেতে কোনরকমে চোখ বুলিয়ে পড়তে লাগল। গোটাটা পড়ে অবশ্য খুব একটা ভক্তি হল না। স্থানীয় সংবাদপত্র বলছে ও অঞ্চলে নাকি ভূতের উপদ্রব আছে। সাদা শাড়ি পরা কিম্ভূত মহিলা দেখা গেছে। মাঝরাতে উল্টোপাল্টা চিৎকার শোনা গেছে এই জাতীয় আরও কিছু হাবিজাবি। খোঁজাখুঁজি করে স্থানীয় এক বাউলের নম্বরও পাওয়া গেল। সে নাকি মাঝেমধ্যেই ওই ক্যাম্পে আসে। নাম—চরণদাস।

একদল লোক বলছে একসময় ওই বাড়িগুলোতে কোথা থেকে নাকি কিছু কাপালিক গোছের লোকজন এসে বসবাস করতে শুরু করে। অতটা রাস্তা উজিয়ে এসে লোকের ঘরবাড়ি থেকে হাঁসমুরগি চুরি করে নিয়ে যেত তারা। স্থানীয় লোকজন মিলে একদিন আক্রমণ করতে তারা নাকি কোথায় পালিয়ে যায়। দাঙ্গার সময়ে বহুলোককে গুমখুন করে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ওখানে।

‘হ্যালো মিস প্রামাণিক…’

নিজের কিউবিকলের উল্টোদিক থেকে গোস্বামীর গলা পেয়ে মুখ তুলে তাকায় ঈশানী। ওর শিরদাঁড়াটা সোজা হয়ে যায়। গোস্বামী ওর দিকে এগিয়ে আসেন। চোখের দিক থেকে একবার দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলেন, ‘ব্যাপার কী? রাতে ঘুম হচ্ছে না?’

ঈশানী মুখে লজ্জার ভাব আনে, ‘আসলে কাজের প্রেশার এত বেড়েছে…ভাবলাম কিছু কাজ না হয় বাড়ি থেকেই করে দিই। তাই রাত জেগে…’

‘ওয়েল, চোখের তলায় কালি না পড়লে এপ্রেজাল, ইনক্রিমেন্ট কোনওটাই হয় না মাই ডিয়ার…’

‘পয়সা দিয়ে কী করব স্যার ঘুম না এলে?’

‘পয়সা ক্যান পে ফর ইয়োর ইএমআই। অ্যান্ড ট্রাস্ট মি, ইএমআই-এর থেকে বেশি ঘুম আর কিছুই নষ্ট করতে পারে না।’

‘সেই জন্যেই আপনারা এমন ঝাঁ চকচকে অফিস সাজিয়ে রাখেন, না স্যার? যাতে এরকম বড়লোকের অফিস থেকে বেরিয়ে বারো টাকার বাসের টিকিট কাটতে গায়ে লাগে, চিল্ড এসি থেকে বেরিয়ে বর্ষায় ফ্যানের হাওয়া অসহ্য লাগে, আমার ধর্মতলার ফুট থেকে কেনা আড়াইশো টাকার শার্ট পরে আসতে পারি না…আপনারা জানেন ইএমআই-এর খাঁড়াটা ঘাড়ে না পড়লে আমরা বোকা পাঁঠার মতো এখানে ছুটে আসব না। তাই আপনারা সেক্স আর কন্ডোম দুটো একসঙ্গে বিক্রি করেন…’

‘তুমি কি আমাদের বেশ্যা বলতে চাইছ?’ গোস্বামীর মেজাজটা আজ ভালো আছে। মজার ছলেই জিগ্যেস করলেন তিনি।

‘বেশ্যা!’ ঈশানী আঁতকে ওঠে, ‘যার প্রতি অনুভূতি নেই, ক’টা পয়সার জন্য তার সঙ্গে সেক্স করে তাকে খুশি করা অনেক বড় জাতের অভিনয় স্যার। একটা আর্ট। ও আপনারা পারবেন না। আপনারা পয়সার জন্য শুধু চাটতে পারেন। ওইটুকুতে বেশ্যা হওয়া যায় না…’

এগিয়ে এসে ওর পিঠে হাত রাখেন গোস্বামী, ‘লাঞ্চ হতে চলল। ক্যাফেটেরিয়ায় এসো, কেমন?’

মাথার ফেট্টিটা আয়নায় দেখে ভালো করে এঁটে নেয় ঈশানী। তারপর ফোনের স্ক্রিন খোলা রেখেই ফ্লোর ছাড়িয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় চলে আসে।

মিনিটপাঁচেক আগেই লাঞ্চ হয়েছে। এখন সমস্ত জায়গাটা জুড়ে ওর অফিস কলিগরা কেউ বসে কেউ বা দাঁড়িয়ে আবার কেউ কেউ জটলা করে গল্প করছে। এদের কারো সঙ্গেই ঈশানীর তেমন একটা জমে না। তাও একটা পরিচিত টেবিলের ধার খুঁজে নিয়ে বসে পড়ল ও।

একটু দূরেই বসেছেন গোস্বামী। এই টেবিলে বসে আছে অরুনাভ, হোসেন আর আলিশা। মুখদেখা একটা বন্ধুত্ব আছে ওদের সঙ্গে। তিনজনেই ওকে দেখে একবার হাসল, তারপর আবার ঝুঁকে পড়ল ফোনের স্ক্রিনের উপরে। ঈশানীর খুব একটা ইচ্ছা ছিল না। তাও ভদ্রতার খাতিরে একটা মেকি আগ্রহ দেখানোর চেষ্টা করল, ‘কী দেখছিস তোরা?’

অরুনাভ ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে আড়মোড়া ভাঙল, ‘কলকাতার লোকজনেরও খেয়েদেয়ে কাজ নেই।’

‘কেন? কী হয়েছে?’

‘খবরটা দেখোনি তুমি?’ হোসেন নিজের ফোনটা এগিয়ে দিল ওর দিকে। এতক্ষণ তিনজনে মিলে একটা খবর পড়ছিল ওরা। সেটাই আপাতত এগিয়ে দিয়েছে ঈশানীর দিকে। স্ক্রিনটা চোখের সামনে এনে হেডলাইনে চোখ রাখতেই ঈশানীর বুকের মধ্যে দিয়ে একটা গরম স্রোত নেমে গেল। হেডলাইনের সঙ্গে একটা ছবিও আঁকা আছে। ছবিটা ওর চেনা। ভীষণ চেনা।

ছবি থেকে ওর চোখ খবরের দিকে সরে আসে। ধীরে ধীরে পড়তে থাকে—শহর জুড়ে অদ্ভুত পাগলের উপদ্রব। গত দিন দশেক ধরে একদিন পরপর কলকাতার গুরুত্বপূর্ণ কিছু জায়গায় মাঝরাতে ওয়ালকালার বা স্প্রে পেন্ট দিয়ে কারা যেন কার্টুন এঁকে দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় মিটারখানেক বর্গের জায়গা জুড়ে রঙিন কার্টুন। ছবিগুলো যে একজনেরই আঁকা সেটা বোঝা যাচ্ছে ছবির চরিত্রদের দেখে। বিষয়বস্তু আলাদা আলাদা হলেও চরিত্র মাত্র দুটি। একটা অল্পবয়সি মেয়ে, আর একটা অদ্ভুত দেখতে কাকতাড়ুয়া। তারা কোথাও একে অপরের সঙ্গে নাচছে, কোথাও ফাঁকা রাস্তার উপরে শুয়ে রাতের তারা দেখছে, আবার কোথাও একজন অন্যজনের ঘাড়ের উপর উঠে উঁকি দিচ্ছে ঘুমন্ত লোকের বাড়িতে। সব থেকে বেশি হইচই পড়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দেওয়ালে ভোরবেলা এরকম ছবি আঁকা থাকতে দেখে। রাতে যথেষ্ট প্রহরা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে আঁকা হল ছবিটা তাই নিয়ে চাঞ্চল্য পড়ে গেছে। এছাড়াও এখনও অবধি তারা কার্টুন এঁকেছে হাওড়া ব্রিজের থামে, ন্যাশনাল মিউজিয়ামের দরজায়, ও জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে। সব থেকে বড় কথা যে বা যারা এ ছবি আঁকছে তাদের উদ্দেশ্যটা কী?

এই সমস্ত হেরিটেজ জায়গায় রং দিয়ে কার্টুন আঁকা উচিত কিনা সেই নিয়ে সেলেবদের মতামত ছেপেছে ফলাও করে।

অরুনাভ একটু ভেবে বলল, ‘ভিক্টোরিয়ায় ছবি আঁকল আর কেউ দেখতে পেল না?’

হোসেন খবরটা আগেই পড়েছিল, সে বলল, ‘মেন যে গার্ড সে বলছে তাকে নাকি তারই মতো দেখতে একটা লোক দুই থাপ্পড়ে অজ্ঞান করে দিয়েছিল। তারপর থেকে আর কিছু মনে নেই। আর একজন গার্ড বলেছে সে ওই মেইন গার্ডকে নাকি একটা ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে মেয়ে নিয়ে ফস্টিনস্টি করতে দেখেছে…’

খবরটা পড়ে ফোনটা নামিয়ে রাখল ঈশানী। নিজের ফোনের স্ক্রিনে আবার মন দিল।

আলিশা বলে মেয়েটা কফিতে চুমুক দিচ্ছিল এতক্ষণ, সে ফোনটা হোসেনের হাতে ফেরত দিতে দিতে বলল, ‘এতে ক্ষতি কী আছে? ছবিই তো এঁকেছে।’

‘সেটা বড় কথা নয়। ধরতে পারলে পুলিশে বাখান দেবে। তাও এতটা রিস্ক নিয়ে আঁকছে যখন কিছু তো উদ্দেশ্য আছে শালাদের।’ অরুনাভ বলে।

‘সমস্ত জায়গার একটা নিজস্ব সৌন্দর্য আছে, সেখানে যা হোক একটা কিছু আর্ট গুঁজে দিলেই সেটা সুন্দর হয়ে যায় না। সেটা মোড়ের মাথায় রবীন্দ্রসঙ্গীত হোক আর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কাকতাড়ুয়াই হোক…’ হোসেন ফোনটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে।

‘আরে রাখ তোর সৌন্দর্য। আমার মনে হয় এরা অ্যানার্কিস্ট। আই মিন ডার্ক নাইটের জোকারের মতো। এইভাবে সবকিছু উল্টোপাল্টা করে দেওয়াটাই এদের অ্যাজেন্ডা…’

আলিশা কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে শান্ত গলাতেই বলে, ‘আমার কিন্তু মনে হয় এটা এক রকমের আন্দোলন!’

‘কীসের আন্দোলন?’

‘আচ্ছা তুই ছেলেবেলায় কী হতে চাইতিস? আইটি প্রফেশনাল?’

‘উঁহু ট্রাক ড্রাইভার। একটা গেম এনে দিয়েছিল দাদা, তাতে ট্রাক চালাতে হত। সিমুলেশন গেম। সেইটা শালা একেবারে নেশার মতো হয়ে গেছিল। সেই থেকে শখ ছিল বড় হয়ে ট্রাক ড্রাইভার হব…’

‘তারপর হলি না কেন? স্কিল ছিল না?’

‘ছিল কিনা বুঝব কী করে? আমাদের দেশে, আমাদের মতো মিডল ক্লাস বাঙালি ফ্যামিলিতে চাইলেই ওসব হওয়া যায় না।’

আলিশা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে কাঁধ ঝাঁকায়, ‘আমি ডান্সার হতে চেয়েছিলাম। এখন কর্পোরেট বসের আঙুলের ইশারায় ল্যাজ নাচাচ্ছি। আমাদের এই সিস্টেমটা না, আমাদের একটা নির্দিষ্ট দিকে বয়ে নিয়ে যায়। তোমাকে ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, তোমাকে ডাক্তার হতে হবে, তোমাকে ব্যবসা করতে হবে, নয় তোমাকে সরকারি চাকরি করতে হবে। তার বাইরে তোমার জীবনে কোনও অ্যাজেন্ডা থাকতে পারে না। তুমি ভালো ছবি আঁকবে কেন? না বায়োলজিতে মাছের পিত্তথলি আঁকতে সুবিধা হবে।

তুমি ভালো গান গাইবে কেন? না পাশের বাড়ির ব্যানার্জিবাবুর মেয়ে কি সুন্দর গান গেয়েছে…এই ঝাঁটের এডুকেশন সিস্টেম তৈরি করেছি আমরা, যার কাজই হচ্ছে একটা মানুষের ভেতরের শিল্পীসত্তাকে গুড়োগুড়ো করে ফেলা। আমরা যতদিন পারি নিজেদের ভেন্টিলেশনে চলে যাওয়া প্রিয়জনদের মতো নিজেদের স্বপ্নগুলো লুকিয়ে লুকিয়ে বাঁচিয়ে রাখি। তারপর একদিন এইসবের চক্করে আমাদের সত্যিকারের ইচ্ছাগুলো, আমাদের আর্টগুলো মরে যায়। মরে যায়, আর বিচার পায় না…বাড়ির লোক মরার পর বিচার না পেলে লোকে আন্দোলন করে…’

‘কিন্তু এ কেমন আন্দোলন? কী লাভ হবে এসব করে?’

‘আন্দোলন লাভের জন্য হয় না। লাভ একটা মাড়োয়াড়ি কনসেপ্ট। আন্দোলন হয় লোকের অসুবিধা করার জন্য। আগে একটাকা বাসের ভাড়া বাড়লে মেট্রো ভাঙচুর হত। জোর করে জমি অধিগ্রহণ হলে রাস্তা অবরোধ হত, ধর্মঘট হত। জোর করে মানুষের শিল্পীসত্তাকে নষ্ট করে দেওয়ার বিরুদ্ধে এরকম একটা প্রতিবাদ হলে তাতে খারাপ কিছু অন্তত আমি দেখি না…’ কথাটা বলে ঈশানীর দিকে তাকায় আলিশা, ‘তোর কী মনে হয় ঈশানী? তুইও তো কার্টুন আঁকতিস?’

নিজের ফোনেই মন দিয়ে কী যেন দেখছিল ঈশানী। সেদিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলে, ‘চোখগুলো ঠিকঠাক হয়নি। নাকটা আরও লম্বা হত…’

হোসেন ফোন দেখতে দেখতে বলে, ‘সাত রাতে এগারোটা ছবি এঁকেছে। এত পারফেকশন নিয়ে কাজ করবে কী করে?’

‘ক’টা?’ আচমকাই মুখ তুলে প্রশ্ন করে ঈশানী।

‘এগারোটা। এই তো লিস্ট ধরে দিয়েছে। ভিক্টোরিয়া, পার্ক স্ট্রিট, রবীন্দ্রসরোবর মেট্রো…’

মনে মনে কী যেন হিসেব করে ঈশানী। ওর ভুরু দুটো কুঁচকে যায়। মনটা সেদিক থেকে সরিয়ে আবার নিজের ফোনের দিকে নজর দেয় ও। বিজলিমারির ক্যাম্পসাইট সম্পর্কে বেশ কয়েকটা ছোটখাটো খবরের লিঙ্ক খুঁজে পেয়েছে ও। সেগুলো ঘেঁটে দেখতে গিয়েই একটা আর্টিকালের ছবিতে ওর চোখ আটকে যায়।

এক সাংবাদিক বাড়িগুলোর ব্যাপারে খোঁজখবর করতে এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। এলাকার লোক দাবি করে ওর ভিতরে কিছু পুরোনো কাঠের ভাঙা আসবাব আর রান্নার জিনিসপত্র ছাড়া কিছুই পড়ে ছিল না। তবে সেগুলোও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার লোকজনই কোথাও সরিয়ে ফেলে।

কয়েকটা বাচ্চা ছেলের কাছ থেকে ধ্বংসস্তূপ থেকে নিয়ে আসা কিছু মাটির জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। সেগুলোরও ছবি আছে একটা। সেই ছবিতেই চোখ আটকেছে ঈশানীর।

একটা বাচ্চা ছেলের সামনে রাখা টেবিলে উল্টে রাখা আছে একটা কালচে হাঁড়ি। এই হাঁড়িটা ঈশানী চেনে।

ভিডিওর ডেসক্রিপশন বক্স থেকে সাংবাদিকের নাম্বারটা পাওয়া গেল। টেবিল থেকে উঠে ব্যালকনিতে এসে দ্রুত সেই নম্বরে কল করল ঈশানী। ওপাশ থেকে একটা কণ্ঠ ভেসে এল, ‘হ্যালো…’

‘ইউটিউব থেকে পেলাম আপনার নম্বরটা।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু…’

‘বিজলিমারি ক্যাম্পসাইটের খবরটা আপনি কভার করেছিলেন। গ্রামের লোক ওই বাড়িগুলো থেকে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে আসে। সেগুলো কী ছিল মনে পড়ছে আপনার?’

আর্টিকালটা অন্তত বছর দুয়েক আগের। মনে করতে একটু সময়ে লাগে মানুষটার, ‘তেমন দরকারি কিছু না। কিছু মাটির বাসনকোসন, আর…’

‘কালো হাঁড়ি?’

ভদ্রলোকের গলায় উচ্ছ্বাস খেলে যায়, ‘হ্যাঁ, কালো হাঁড়ি। প্রচুর কালো হাঁড়ি ছিল বাড়িগুলোতে। হাঁড়িগুলো দেখতে একটু অড। মানে সচরাচর ওরকমটা দেখা যায় না। তাছাড়া অতগুলো হাঁড়ি নিয়ে ওই ক’টা লোক ঠিক কী করছিল…’

‘কাকতাড়ুয়া বানাচ্ছিল।’ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে ঈশানী।

দুপুরবেলা নিজের অফিসে বসে পা দোলাচ্ছিল কৃষ্ণেন্দু। বাইরে একদল লোক বসে আছে। গলা তুলে একজন একজন করে ডেকে নিচ্ছে ও। মন দিয়ে তাদের সমস্যা শুনছে। তারপর এটা সেটা বুঝিয়ে দিয়ে কোনরকমে বাইরে বের করে দিচ্ছে। এই এলাকার কাউন্সিলর হওয়ার পর থেকে প্রতি মঙ্গলবার এই ব্যাপারটা চালু করেছে ও। এতে জনসংযোগ বাড়ে। কৃষ্ণেন্দু জানে মানুষের জন্য কী করছি সেটা বড় কথা নয়, কিছু করছি করছি বলে মনে হলেই ওষুধে কাজ দেয়।

‘পরের জন আসুন…’

পর্দা সরিয়ে বুড়োটাকে ঢুকতে দেখেই পিত্তি জ্বলে উঠল ওর। আজ প্রায় দশদিন হল রোজ আসছে লোকটা। রোজ একই দাবি। ওর ছেলের নাকি কি একটা প্রকল্পে টাকা পাওয়ার ছিল, সেটা কিছুতেই অ্যাকাউন্টে ঢুকছে না। কৃষ্ণেন্দু অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে ওর হিসসাটুকু বুঝিয়ে না দিলে ওর পক্ষেও সে টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। টাকা তো ও একা খায় না, স্যাংশন করার ক্ষমতাও ওর একার নেই।

মুখটা ব্যাজার করে বোতাম খোলা জামার ফাঁক দিয়ে বুক চুলকে নিল কৃষ্ণেন্দু। তারপর তেমনি তেঁতো গলায় বলল, ‘আপনি আবার চলে এসেছেন দাদু? এভাবে দরজায় দরজায় ঘুরে কি কাজ হবে…’

ভদ্রলোক কাচুমাচু মুখে বললেন, ‘তোমরা ভোটের আগে দরজায় দরজায় ঘুরলে, কাজ হল তো…’

কৃষ্ণেন্দু ধমক দিতে যাচ্ছিল। এমন সময় আর একটা লোক ঘরে ঢুকে আসে। তাকে দেখে একটু ঘাবড়ে যায় কৃষ্ণেন্দু। লোকটা উচ্চতায় অন্তত সাড়ে ছ’ফুট। শরীর তো নয়, যেন পেশির প্রদর্শনী। চোখে কালো সানগ্লাস, গলার কাছে একটা ফেট্টি বাঁধা। গায়ের রং সাহেবদের মতো ফর্সা। মাথাজোড়া টাক। দেখলেই ভয় আর ভক্তি দুটোই একসঙ্গে জাগে।

কৃষ্ণেন্দু মুখ থেকে অবাক ভাবটা দ্রুত সরিয়ে ফেলল, ‘এই আপনি কে? ওনার হয়ে গেলে তারপর আপনি আসবেন…’

বৃদ্ধ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই লম্বা লোকটার পাতলা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল, ‘না না আমি ওনার সঙ্গেই এসেছি। মেসোমশাই, আপনি বসুন না…’

মেসোমশাই? এরকম দুবলা ভগ্নপ্রায় বৃদ্ধের বোনপোর এমন হলিউডি হিরোর মতো চেহারা! ব্যাপারটা কেমন যেন বিশ্বাস হয় না কৃষ্ণেন্দুর। বুড়োটা কি ভাড়া করে গুন্ডাটুন্ডা নিয়ে এসেছে? অবশ্য তাতেও ক্ষতি নেই। এই অফিসে ওকে চমকানোর ধক কোনও বাছাধনের নেই। সে যতই গাঁট্টাগোট্টা লোক হোক।

লোকটার দিকে তাকিয়েই কৃষ্ণেন্দু বলে, ‘দেখুন, ওনাকে তো বলেইছি, ওনার টাকাটা যদি নিতে হয়, আমাদের কথা একটু ভাবতে হবে। আগের আমলে তো কিছুই পেতেন না। আমরা তবু…’

ঠাস করে একটা চড় এসে পড়ে কৃষ্ণেন্দুর গালে। দামড়া হাতের থাপ্পড় খেয়ে মুখটা প্রায় উল্টোদিকে ঘুরে যায় তার। মুখ দিয়ে গোঁৎ করে একটা শব্দ বেরিয়ে আসে। ঘাড়টা একটু হলে ভেঙে যাচ্ছিল। মুখ থেকে খানিকটা থুতু ছিটকে বেরিয়ে আছে তার। মুহূর্তে চেয়ার থেকে তেড়ে ফুঁড়ে উঠতে যায় কৃষ্ণেন্দু, ‘চুদির ভাই! তুই আমাকে চড়…’

আবার একটা চড় এসে পড়ে ওর গালে। আবার ঘাড় ঘুরে যায় পেছনে। বিষম ব্যথায় পাকস্থলী অবধি গুলিয়ে ওঠে। লাফিয়ে উঠে লোকটার গলা ধরতে চায় কৃষ্ণেন্দু কিন্তু হাত পৌঁছায় না। তার আগেই লোকটা ওর গলা টিপে ধরে।

কোঁকাতে কোঁকাতে বুড়োর দিকে তাকায় কৃষ্ণেন্দু, ‘গুন্ডা নিয়ে এসেছেন না? গুন্ডা নিয়ে এসেছেন? যা করার করে নে শুয়োরের বাচ্চা। ওইদিকে সিসিটিভিতে রেকর্ড হচ্ছে সব…যদি বেঁচে থাকি…’

আবার চড়।

অবশ হয়ে আসে কৃষ্ণেন্দুর গাল। হাঁপাতে হাঁপাতেই সে বলে, ‘তুই জানিস না পার্টিতে আমার কোথায় কোথায় হাত আছে…’

‘তার আগে তোর কোথায় কোথায় হাত দিয়ে চটকে দিই একবার দেখ…’ বলেই কৃষ্ণেন্দুর দুপায়ের ফাঁকটা সজোরে চেপে ধরে লোকটা। চিৎকার করে ওঠে কৃষ্ণেন্দু। ওর সমস্ত শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে কান মাথা দিয়ে ফুটো হয়ে রক্ত বেরোবে এক্ষুনি। যন্ত্রণায় এবার কেঁদে ফেলে সে, ‘ও মেসো, ক্ষমা করে দিন মেসো। আপনার সই আমি করে দিচ্ছি…’

বুড়ো কিছু বলার আগেই লোকটা আবার চড় মারে ওর গালে। কৃষ্ণেন্দু আবার চেঁচিয়ে ওঠে, ‘আরে আবার মারছেন কেন, বললাম তো সই করে দিচ্ছি…’

‘সে তো মেসোমশাইয়ের কাজটা। আমার কাজটা?’

‘আ…আপনার আবার কী কাজ?’

ওকে মাটিতে নামিয়ে রেখে ওর ঘরের চারদিকটা ভালো করে নজর ঘুরিয়ে দেখে নেয় লোকটা। তারপর বলে, ‘এখানে তুই যে কাজটা করিস সেটা আদৌ তোর কাজ না। আই মিন ভগবান তোকে সে কাজের জন্য তৈরি করেনি…’ কথাটা বলে চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে লোকটা। নীলচে স্বপ্নালু চোখে তাকায় ওর দিকে, ‘তুই বরঞ্চ যেটা ভালো পারিস সেটাই কর…’

‘কী? আমি…’

কৃষ্ণেন্দুর মুখের কথা মুখেই রয়ে যায়। লোকটার পাথরের মতো মুখে একটা হাসি খেলে গেছে ততক্ষণে। বুড়োর দিকে চেয়ে সে নরম গলায় নির্দেশ দেয়, ‘আপনি চোখ বন্ধ করে নিন মেসোমশাই…’ বলেই কৃষ্ণেন্দুর দিকে পেছন ফিরে একটু ঝুঁকে নিজের প্যান্টের বোতাম খুলে সেটা মাটিতে নামিয়ে ফেলে লোকটা। চড়া এসিতেও কৃষ্ণেন্দু অদ্ভুতরকম ঘামতে থাকে।

দশমিনিট পর আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায় লোকটা। ঠাসিয়ে আর একটা চড় মারে কৃষ্ণেন্দুর গালে। ঘরের সিসিটিভি ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে নিজের মুখটা একবার দেখে। চোখ মারে। তারপর এক দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

লোকটা বেরিয়ে যেতে দু’সেকেন্ড সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে কৃষ্ণেন্দু। তারপর চাপা চিৎকার করে ফোনে একটা নম্বর ডায়াল করে। ওপাশ থেকে রিসিভ হতেই গর্জন শোনা যায়, ‘চুদির ভাইটাকে বেরতে দিবি না, ফরসা করে, টাকমাথা…’

অভিজিৎ কৃষ্ণেন্দুর অফিসের দরজা সামলায়, ফোনের ওপাশে তারও চিৎকার শোনা যায়, ‘আমাকে ধাক্কা মেরে এক্ষুনি বেরিয়ে গেল স্যার। গায়ে কী জোর!’

কৃষ্ণেন্দুর লাল মুখ হিংস্র নেকড়ের মতো দেখায়, ‘কোয়ি বাত নাহি। সিসিটিভি আছে। যেখানেই থাক হিঁচড়ে টেনে আনব। মাদারচোদকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে…’ কথাটা বলতে বলতেই এগিয়ে গিয়ে বুড়োর কলার খামচে ধরে কৃষ্ণেন্দু, ‘শুয়োরের বাচ্চা, বল কোত্থেকে ভাড়া করে এনেছিলি…’

বুড়ো খাবি খায়, ‘আমি আনিনি স্যার। ও বাইরে বসেছিল। নিজে বলল আমার সঙ্গে আসবে। তারপর থেকে আমি কিছুই…’

ধাক্কা মেরে বুড়োর মাথাটা দেওয়ালে ঠুকে দেয় কৃষ্ণেন্দু, ‘ধরে আনি ওকে, তারপর তোর বিচিও ফাটাব আমি…’

টেবিলে ফিরে যায় ও। পার্টিরই দুটো ছেলে আর অভিজিৎ এতক্ষণে ঘরে ঢুকে ঝুঁকে পড়েছে সিসিটিভি ফিডের উপর। রিওয়াইন্ড করে একটু আগের দৃশ্য চালানো হয়েছে সেখানে।

কৃষ্ণেন্দু আবার চাপা গর্জন করে, ‘শেষে যা, শেষে। একবার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে ছিল শুয়োরের বাচ্চাটা, মুখটা দেখ…’

একটু এগিয়ে ঠিক সেই টাইমস্ট্যাম্পেই স্ক্রিন ফ্রিজ করে অভিজিৎ। লোকটা ক্যামেরার দিকে এগিয়ে আসছে। নিজের মুখটা ভালো করে দেখছে। তারপর ক্যামেরার দিকে তাকিয়েই একবার চোখ মেরে দৌড় লাগাচ্ছে। মুখটা দেখতে পেয়েই সে স্তব্ধ হয়ে যায়। স্ক্রিন জুড়ে ফুটে আছে লোকটার মুখ।

‘এই…এই চুদির ভাইটা…রাস্তাঘাটে যেখানে দেখতে পাবি জ্যান্ত জ্বালিয়ে দিবি…’ কৃষ্ণেন্দুর গলা হুঙ্কারের মতো শোনায়।

‘এই লোকটা এসেছিল আপনার ঘরে?’ অভিজিৎ মিনমিনে গলায় জিগ্যেস করে।

‘কেন? চিনিস একে?’

‘একটা প্রশ্ন করব স্যার?’

‘কী প্রশ্ন?’

অভিজিৎ ওর দিকে হতবাক মুখ তুলে তাকায়, ‘আপনি কি শুধু দেশি পানু দেখেন?’

‘মানে? কী বলতে চাইছিস কী?’

‘বিদেশি দেখলে আপনিও লোকটাকে চিনতে পারতেন। লম্বা, টাকমাথা, জমকালো ফিগার, নীল চোখ, চওড়া হাসি…’

নিজের ফোনে কী একটা নাম লিখে সার্চ করে দেখায় অভিজিৎ। কয়েক সেকেন্ড সেদিকে স্থির চোখে চেয়ে থাকে কৃষ্ণেন্দু। শিরদাঁড়া দিয়ে কোথায় যেন ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় তার।

অভিজিৎ জিজ্ঞেস করে, ‘ক্লিপটা কি পুলিশে দেব স্যার?’

‘না…’ থমথমে গলায় বলে কৃষ্ণেন্দু, ‘ডিলিট করে দে…’

সাড়ে দশটার কাছাকাছি বেজেছে। লালবাজারের বেশিরভাগ দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল কয়েকটা খোলা। দোকানগুলোর দিকে দেখতে দেখতেই চারু বলে, ‘আজ এত তাড়াতাড়ি বেরোলি যে, কিছু প্ল্যান আছে নাকি?’

‘আছে তো…’ একটা মিউজিকাল ইন্সট্রুমেন্টের দোকানের সামনে হুট করেই স্কুটিটা দাঁড় করাতে করাতে বলে ঈশানী।

চারু হেলমেট খুলে অবাক হয়ে তাকায় ওর দিকে, ‘এখানে, এখানে কী হবে?’

‘তুই দাঁড়া এখানে। আমি আসছি…’ কথাটা বলে দোকানের ভিতরে ঢুকে যায় ঈশানী। মিনিটখানেক পরেই একটা মাঝারি সাইজের বাক্স হাতে বেরিয়ে আসে বাইরে।

‘এতে কী আছে?’ চারু অবাক হয়ে জিগ্যেস করে।

‘খুলে দেখ…’

সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতেই বাক্সটা খুলতে থাকে চারু। এত রাতে চারদিকের রাস্তা ফাঁকা হয়ে গেছে। মাথার উপর দিয়ে যাওয়া জট পাকানো ইলেক্ট্রিকের তার আর লাইটপোস্টের ছায়া চাঁদের আলো ফুঁড়ে জেগে আছে রাস্তার উপরে। তার সঙ্গে মিশেছে কলকাতার হলদে সোডিয়াম ভেপারের আলো।

বাক্সটা খুলে ফুটপাথেরই একদিকে সরে আসে চারু। একটা দোতারা বের করে এনেছে তার ভিতর থেকে। অবাক হয়ে একবার ঈশানীর দিকে আর একবার দোতারাটার দিকে তাকিয়ে দেখল সে, ‘আ…আমি এটা বাজাই তুই জানলি কেমন করে?’

‘চরণদাস বাউল বলল মাঠের কাকতাড়ুয়াটা নাকি হাঁ করে ওর গান শুনত। তাই থেকেই বুঝলাম…পরশু ফোন করে ওদের বলে রেখেছিলাম। আজ আনিয়ে রেখেছে…’

দোতারার তারগুলোর উপর আদর করে আঙুল বোলাতে থাকে চারু। উজ্জ্বল হাসিতে ভরে ওঠে ওর মুখ, ‘তোকে যে আমি কী বলব মাঝে মাঝে বুঝতে পারি না…’

‘বলতে হবে না। গেয়ে শোনালেই হবে…’

স্কুটিটা পেছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করে ওরা। রাস্তার একদিকে বন্ধ চশমার দোকান। বাইরে বিশাল আকারের ফাঁকা ফ্রেমের কাটআউট। সেগুলোর ভিতর দিয়ে কারা যেন চেয়ে থাকে ওদের দিকে। পুরোনো বাড়িঘরের ভিতর বহুদিন আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া চিল ছাদের ঘর থেকে কে বুঝি ছাদের পাঁচিলে এসে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে রাস্তার দিকে।

ঈশানী চারুর দিকে চেয়ে বলে, ‘তুই শুধু দেখে দেখে দোতারা বাজাতে শিখে নিয়েছিলি?’

‘সারাদিন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে সব কিছুই ইন্টারেস্টিং লাগে। দিনের পর দিন ও বাজাত আর আমি শুনে যেতাম। শেষে শিখে গেলাম…’

একটা গলির মধ্যে আলোছায়া জায়গা বুঝে সরে আসে ওরা। রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া একটা বেঞ্চ আছে এখানে। পুরোনো চাতালের ভাঙা অংশ সেই বেঞ্চের সঙ্গে জুড়ে আছে। দেখে বোঝা যায় এককালে এখানে পুরোনো কলকাতার রোয়াক ছিল। পাড়ার বয়স্করা সন্ধেবেলা বসে বসে আড্ডা দিত। এখন প্রগতির অত্যাচারে সে রোয়াকের একটা অংশ তাদের নিয়ে কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

বেঞ্চের উপরে বসেই দোতারাটা বাগিয়ে ধরে চারু। ঈশানী পা ছড়িয়ে নিচে চাতালের উপর বসল। যেন এক্ষুনি গানের মজলিশ শুরু হবে। আরাম করে সেটাই দেখতে বসেছে। মুখে টলটলে হাসি খেলা করছে তার। গান শুরু করতে যাচ্ছিল চারু, কিন্তু তার আগেই থেমে যায়।

‘আবার কী হল? শুরু কর…’ ঈশানী ভুরু কুঁচকে বলে।

‘উঁহু, একটা জিনিস মিসিং…’

‘কী জিনিস?’

‘চরণদাস যখন গান গাইত ওর পায়ে একটা ঘুঙুর বাঁধা থাকত। ওটা দিয়ে গানের তাল রাখত। সেটা এখানে নেই…’

‘তাহলে কী হবে?’ ঈশানীকে অস্থির দেখায়।

‘একটা ব্যাবস্থা আছে…’ বেঞ্চ থেকে উঠে ঈশানীর সামনে গিয়ে বসে পড়ে চারু। তারপর পকেটে হাত ঢুকিয়ে কী যেন বের করে আনে। ঈশানী তাকিয়ে দেখে জিনিসটা নূপুর।

ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গোড়ালির কাছ থেকে লং স্কার্টটা একটু উপরে তুলে পায়ে সেটা পরিয়ে দেয় চারু। ঈশানী অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে। চাঁদের আলোয় ছেলেটার অদ্ভুত মায়াবি মুখটা আশ্চর্য নরম দেখায়। ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দাঁতের রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায় তার, ‘আমি গান গাইলে তোকে নাচতে হবে…’

‘তাই? তাহলে দেখবে কে?’

‘আমরা। শুধু এখন নয়, যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন।’ ঈশানীর কপালে আঙুল রাখে ছেলেটা, ‘এখান দিয়ে। আয়…’

চারুর হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ায় ঈশানী। দোতারাটা বাজতে শুরু করেছে। তার তালে তালে নাচতে থাকে ঈশানী। রুনরুন করে ওর পাতলা নূপুরটাও তাল মিলিয়ে বাজতে শুরু করে দোতারার শব্দের সঙ্গে।

নিজের মধ্যে বিলীন হয়ে গিয়ে একমনে বাজিয়ে চলেছে ছেলেটা। দোতারাটা ওর হাতের সঙ্গে মিশে গেছে যেন। ঈশানী ওর পেছনে এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকে মাথা রাখে ওর কাঁধে।

ছেলেটা এখনও গেয়ে চলেছে। দু’হাতে ছেলেটার কোমর জড়িয়ে ধরে ঈশানী। এতদিন অভ্যাস নেই বলে এইটুকু নেচেই হাঁপিয়ে গেছে ও। দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে থাকে।

বহুদিনের জমা যন্ত্রণা ছেলেটার কাঁধের উপর যেন নেমে যায় সেই নিঃশ্বাস বেয়ে…

কাকতাড়ুয়া – 11 অধ্যায়

একাদশ অধ্যায়

ঘরের দরজাটা খুলতেই একরাশ মন খারাপ চেপে ধরল গার্গীকে। এই ঘরটায় আগে বহুবার এসেছে ওরা। নতুন কিছু নয়। আজ শুধু ওর সঙ্গে ওর দুই বান্ধবি নেই। তার বদলে তন্ময় দাঁড়িয়ে আছে ওর পেছনে। সেই চাবি দিয়ে খুলেছে দরজাটা।

ঘরের একদিকে জানলা লাগোয়া অভিরূপার একটা ফুট দুয়েকের পোর্ট্রেট। তার এক পাশে একটা গিটার। অন্যদিকে ছোট বেড সাইড টেবিলের উপর কয়েকটা ম্যাগাজিন রাখা। সেগুলো চাপা দেওয়া আছে কলিন হুভারের বই দিয়ে। বইটা শেষ করে যেতে পারেনি অভিরূপা। সে চলে যাওয়ার পর একটা সপ্তা কেটে গেছে প্রায়। প্রাথমিক শোকটা কাটিয়ে উঠলেও গার্গী আর তন্ময়ের মধ্যে কী যেন একটা হারিয়ে গেছে।

ঘরের ভেতর ঢুকে জানলার দিকে এগিয়ে আসে গার্গী। অন্যবার ঘরে ঢুকলে ওই বিছানাতেই হয় শুয়ে থাকত অভি, নইলে স্নান করার পর খাটের একপাশে চুল বিছিয়ে শুয়ে গল্পের বই পড়ত। এই বিছানায় বসে কতবার প্র্যাকটিক্যালের লেখা কমপ্লিট করেছে তিনজনে, কতবার ব্রেকআপের পর মদ খেয়ে বমি করেছে মেঝেতে, এখনো যেন মেয়েটার গলার স্বর ঘরের ভেতর শুনতে পাওয়া যায়।

তন্ময় ওর পাশের চেয়ারটাতেই বসে পড়ে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘বাড়ির অবস্থা তো একেবারেই ভালো নেই বুঝতেই পারছিস। আমারও আর এখানে থাকতে ভালো লাগে না। বোনটাকে নিজের হাতে করে মানুষ করেছিলাম…’

‘তো? চলে যাবে? আমার কী হবে ভাবলে না?’ গার্গী জানলার দিক থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলে। সকালের রোদ এসে পড়ে ওর মুখে। চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে।

‘আমি থাকতেই বা কী লাভ হচ্ছে তোর?’

‘রাতারাতি কিছু ঠিক হবে না তন্ময়। একটা মানুষ চলে গেছে। এই সময়টা…’ এগিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখে গার্গী, ‘এই সময়টা আমার পাশে আর কাউকে পাচ্ছি না…’

‘ঈশানী?’ তন্ময় হাত দিয়ে ওর চোখের কোণ থেকে জলটা মুছে দেয়, ‘ঈশানী এল না?’

‘ওর তো অফিস আছে। তাছাড়া আগের মতো আমার সঙ্গে মেশে না আর…’

‘সে কি, তোর সঙ্গে মেশে না কেন?’

একটু দূরে সরে গিয়ে আবার জানলায় হেলান দিয়ে দাঁড়ায় গার্গী, ‘জানি না। কিছু একটা হয়েছে ওর। নিজের খেয়ালে থাকে, সবকিছু থেকে একটু আলাদা হয়ে গেছে…’

‘ক’দিন যেতে দে, ঠিক হয়ে যাবে…’

গার্গী একটা নরম হাসি হেসে দুদিকে মাথা নাড়ায়, ‘নাগো, আর কিছু ঠিক হবে না। আমাদের তিনজনের মধ্যে অভিই একটু আঠার মতো কাজ করত। আমার আর রুনুর মধ্যে মাঝেমধ্যেই ঝামেলা হত। ওই দায়িত্ব নিয়ে মাঝখান থেকে সবকিছু ঠিকঠাক করত। মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো?’

‘কী?’

‘আমরা তলে তলে ওকে হিংসা করতাম। বড়লোকের মেয়ে, জীবনে যা চেয়েছে হাতের সামনে পেয়েছে। এমনকী স্বাধীনতাও। আমাদের দুজনেরই একটা কমন এনিমি ছিল ও। ফলে আমি আর ঈশানী ঝামেলা করলে সেই আগুনে একটু ঘি দিয়ে মিটমাট করে নিতাম নিজেদের মধ্যে…’

দেওয়ালে ঝুলন্ত অভিরূপার ছবিটার দিকে তাকায় তন্ময়, ‘কী জানি, আমার তো মনে হয় একইরকম দুঃখ মানুষকে মিলিয়ে দেয়। একই কারণে যারা কাঁদছে তারা একে অপরের সঙ্গে থাকলে বুক হালকা হয়…’

গার্গী মাথা নাড়ে, ‘সে অন্য কষ্টের বেলা। মানুষের মরে যাওয়ার কষ্টের সঙ্গে অন্য কষ্টের তফাত আছে। অন্যগুলোতে আমরা মলম লাগাই—এ বছর ফেল করেছি তো পরের বছর পড়াশোনা করে পাশ করে যাব, এ বছর প্রেমে ল্যাং খেয়েছি, আবার একটা স্যাঠাভাঙা প্রেম হবে। কিন্তু মৃত্যু জিনিসটা…’ গার্গীর গলার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে আসে, ‘একমাত্র ভুলে যাওয়া, ইগনোর করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। সে অন্যের হোক বা নিজের…’

তন্ময় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘আমার বাবা মা-ও মানিয়ে নেবে, বল? একদিন না একদিন?’

গার্গী হাসে, ‘তোমার নিলাদ্রির কথা মনে আছে? সেই কলেজে প্রেম করতাম যার সঙ্গে?’

‘হ্যাঁ, তারও কেউ মারা গেছিল নাকি?’

‘উঁহু, লং ডিস্ট্যান্স ছিল। খুব একটা কথাবার্তা কিছু হত না। রাতে আমি কলেজ থেকে আর ও অফিস থেকে ফিরে একটু গল্পগুজব করতাম। তারপর ঘুমিয়ে পড়তাম। লোককে দেখে মাথা গরম হয়ে যেত। শালাদের কাজ নেই নাকি? সারাদিন ফোন করে গুজগুজ, ভিডিও কল, সেলফি তুলে পাঠানো, কোথায় যাচ্ছি না যাচ্ছি সময় করে জানানো। ন্যাকাচোদা মনে হত। একটা মানুষের সঙ্গে কত কথা থাকতে পারে? আরে দু’বছর ধরে প্রেম করছি, সারাদিন কথা বলে যেতে হবে কেন? তখন ঈশানী একটা কথা বলেছিল, জানো?’

‘কী?’

‘বলেছিল এই সারাদিনের কথা বলাটা আসলে ইনভেস্টমেন্ট…’

‘ইনভেস্টমেন্ট বলতে?’

‘মানে ধরো, তুমি রোজ যার সঙ্গে রাতে এক ঘণ্টা কথা বলো সে তোমাকে ছেড়ে যেতে চাইলে শুধু ওই এক ঘণ্টাটাকেই ভুলতে হবে। তুমি রোজ যার সঙ্গে জুড়ে থাকো, যার গামছা, সাবান তেলে তোমার আঙুলের গন্ধ লেগে থাকে, তাকে ছেড়ে যাওয়াটা আরও কঠিন…সম্পর্কের বাঁধন শক্ত করতে গেলে কোথাও না কোথাও জুড়ে থাকতে হয়…’

‘মনের বাঁধনটা কিছু নয়?’

সামনে ঝুঁকে একগাল হেসে তন্ময়ের দিকে তাকায় গার্গী, ‘শুধু মনের বাঁধন নিয়ে কি জীবন চলে আমাদের? আমি অভিকে দু’সপ্তাহ আগে যতটা ভালোবাসতাম এখনও ততটা বাসি। বেঁচে থাকলে ও বাসত আমি জানি। তাতে খুশি থাকছি কি?’

বড় করে একটা শ্বাস নেয় গার্গী, ‘বাদ দাও এসব। দেবু যোগাযোগ করেছিল তোমাদের সঙ্গে?’

‘ওর সঙ্গে তো ব্রেক আপ হয়ে গেছিল ছ’মাস আগে। তবে যোগাযোগ রেখেছিল মনে হয়। মাঝখানে একদিন এসেছিল। আমি বললাম ঘরে ঢুকে দেখো যদি কোনও জিনিসপাতি নিয়ে যাওয়ার হয়, নিয়ে যাও…’ দু’দিকে মাথা দোলায় তন্ময়, ‘ছেলেটা খারাপ ছিল না, জানিস?’

উপর নিচে মাথা নাড়ায় গার্গী, ‘আমাদের তিনজনের মধ্যে ওরই বয়ফ্রেন্ডটা পাগলের মতো ভালোবাসত। কিন্তু মাঝে কী যে হল, কীসের ভূত চাপল মাথায়। অকারণেই ব্রেক আপ করল ছেলেটার সঙ্গে। আসলে ও চিরকালই ওইরকম। একবার কিছু মাথায় ঢুকল তো করতে পারে না এমন কাজ নেই। ভালোবাসাটাও, না ভালোবাসাটাও…’ কথাটা বলতে বলতেই অন্য একটা ভাবনা এসে ঘিরে ধরল গার্গীকে, প্রসঙ্গটা পাল্টে নিল সে, ‘ওর কললিস্টটা পাওনি তোমরা?’

‘পেয়েছি। আমি একবার চোখ বুলিয়ে দেখেছি, চোখে পড়ার মতো তেমন কিছু তো পাইনি তার মধ্যে…’

‘আমাকে একবার দাও তো…’

ভিতরের ঘর থেকে প্রিন্ট করা কললিস্টটা এনে গার্গীর হাতে দিল তন্ময়, ‘সেরকম অচেনা নাম্বার কিছু নেই। ওই একবার দু’বার কল এসেছে ব্যাস। তুই দেখ কিছু পাস কিনা…’

কললিস্টের পাতা উল্টাতে থাকে গার্গী। বেশ কয়েকটা নাম্বার থেকে বারবার ফোন এসেছে। তার মধ্যে ওর নিজেরটাই এসেছে ঘুরেফিরে। ঈশানীরও থাকার কথা ছিল অথচ নেই। শেষ ক’মাসে কি ভালোমতো কথা হয়নি ওদের দুজনের?

অন্য নাম্বারগুলো চেনা নয়। হয়তো নামগুলো দেখলে চিনতে পারত। ফোন নম্বরগুলোর পাশে ডিউরেশন লেখা আছে। তার মধ্যে একটু বড়সড়গুলো খতিয়ে দেখতে থাকল গার্গী।

হঠাৎ একটা নম্বার দেখে গার্গীর চোখ আটকে গেল। পাতাটা সামনে তুলে ধরে বলল, ‘এই ব্যাপারটা খেয়াল করেছ তুমি?’

‘কী?’

‘এই নম্বারটা থেকে বেশ কয়েকটা কল এসেছে। কিন্তু কলটা এসেছে অদ্ভুত সময়ে…’

‘অদ্ভুত সময়ে বলতে?’

ডিটেইলগুলো মেলাতে মেলাতে গার্গী বলল, ‘সব ক’টা কলই এসেছে রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ। মিনিটকুড়ি কথা হয়ে ফোন রেখে দিয়েছে।’

‘তাতে অদ্ভুতের কী আছে?’

নিজের মনেই বিড়বিড় করে গার্গী, ‘সেরকম কিছু না। কিন্তু ওই সময়ে আমি টিউশনি পড়িয়ে ফিরতাম। তোমাদের ফ্ল্যাটের সামনে দিয়েই যেতাম বলে মাঝে একবার দুবার ফোন করেছিলাম নিচে নেমে দেখা করার জন্য। কিন্তু ও কিছুতেই দেখা করত না। এমনকী ফোনটাও যেন রাখতে পারলে বেঁচে যেত…’

‘কেন? কী এমন করত তখন?’

‘বলত ওর নাকি কীসব অনলাইন ক্লাস আছে। কিছুতেই মিস করা যাবে না…’

তন্ময় একটু ভেবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, ‘কল করে অনলাইন ক্লাস, তাও আবার কুড়ি মিনিটের! অদ্ভুত তো! নম্বরটা কার দেখ তো…’

এক সেকেন্ড ঠোঁটে আঙুল রেখে ভাবে গার্গী। তারপর নিজের পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে ট্রু-কলারে নাম্বারটা সার্চ করে। সঙ্গে সঙ্গে নাম্বারের মালিকের নাম ফুটে ওঠে—অভিষেক চৌধুরী।

তন্ময় ঝুঁকে পড়ে স্ক্রিনের উপর, ‘এই ছেলেটা আবার কে?’

‘ঈশানীর বয়ফ্রেন্ড।’ থমথমে গলায় কথা বলে গার্গী। পরক্ষনেই মুখ তুলে বলে, ‘অভির ফোনটা আছে না তোমার কাছে?’

‘হ্যাঁ, ওতে কিছু পায়নি পুলিশ তাই ফেরত দিয়ে দিয়েছে…’ দ্রুত ভিতরের ঘর থেকে অভিরূপার ফোনটা এনে গার্গীর হাতে দেয় ও, ‘লকটা খোলাই আছে। দেখ কিছু পাওয়া যায় কিনা…’

কন্ট্যাক্টে গিয়ে নম্বরটা সার্চ করে গার্গী। কিছুই পাওয়া যায় না সেখানে। নম্বরটা ওর ফোনে সেভ করা নেই। হোয়াটস্যাপে গিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না নম্বরটা।

নিজের চুল খামচে ধরে গার্গী। বিড়বিড় করে বলে, ‘অভি আমাদের লুকিয়ে অভিষেকের সঙ্গে কথা বলল, কিন্তু একবারও হোয়াটস্যাপে পিং করল না?’

তন্ময় অনেকক্ষণ ধরেই সমস্ত ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল। সে একটু সন্দেহের গলাতেই বলল, ‘আচ্ছা, এই যে ঈশানীর এক্স বয়ফ্রেন্ড, অভি তাকে চিনত?’

‘চিনত বলতে এক দুবার দেখা হয়েছিল। ফোন নাম্বার নিয়েছিল কিনা মনে নেই। কিন্তু দুদিন অন্তর তাকে ফোন করে এতক্ষণ কথা বলবে, তার উপর আবার আমাদেরকে মিথ্যে বলবে…এর কী কারণ থাকতে পারে?’

‘আমি একবার ফোন করব ছেলেটাকে?’

গার্গী ঠোঁট কামড়ায়, ‘না, তোমাকে করতে হবে না। আমিই করছি…’

নিজের ফোন থেকে নম্বরটা ডায়াল করে গার্গী। কয়েকবার রিং হতে ওপাশ থেকে ফ্যাসফ্যাসে গলা শোনা যায়, ‘বল। তুই এতদিন পরে?’

‘অভিরূপার খবরটা পেয়েছিস তুই?’

‘হ্যাঁ। এমন সময়ে জানতে পেরেছি যে একটু সমবেদনা ফেদনা জানানোর উপায় ছিল না। কী কেলো কেস মাইরি। এই জন্য বলি বেশি মাল ফাল খেয়ে…যাক গে, আমাকে ফোন করছিস কেন?’

গার্গী দ্রুত প্রসঙ্গে আসে, ‘তোর অভিরূপার সঙ্গে কথা হত?’

ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো গলা শোনা যায়, ‘সেসব আমি তোকে বলতে যাব কেন? তুই ওর ভাতার নাকি?’

গার্গীর দাঁতে দাঁত ঘষে যায়, ‘মেয়েটা মারা গেছে অভিষেক! কললিস্টে দেখা যাচ্ছে তোকে প্রায়ই রাত্রিবেলা ও অন্তত মিনিট কুড়ির জন্য ফোন করত। কী চলছিল তোদের মধ্যে?’

‘দেওয়া নেওয়া চলছিল। হয়েছে? তোর তাতে এত ছেঁড়াটা যাচ্ছে কেন?’

গার্গীর হাত থেকে ফোনটা প্রায় ছিনিয়ে নেয় তন্ময়। কঠিন গলায় বলে, ‘দেখ, তুই যেই হোস ভাই। এই কললিস্ট পুলিশই আমাদের দিয়েছে। যদি আমাদের কাছে সত্যি কথা বলিস আমরা থানা-পুলিশ করব না। কিন্তু যদি…’

এইবার বোধহয় ছেলেটা একটু ঘাবড়ে যায়। পুলিশের নামটা বলতেই গলার স্বর নরম হয়ে আসে। মিনমিন করে বলে, ‘আরে, তোমরা এত রাগ করছ কেন বলো তো? ও ফোন করত আমাকে। মাঝে মাঝে খবর নিত। আর তাছাড়া…’

‘তাছাড়া কী?’

‘কিছুদিন হল ওর মনটা ভালো যাচ্ছিল না।’

‘কী নিয়ে ভালো যাচ্ছিল না? আর সব থেকে বড় কথা ভালো না গেলে সেটা বলার মতো লোকজন ছিল। খামোখা তোকে কল করতে যাবে কেন?’

দেওয়ালে রংটা করে পেছনদিকে সরে আসে ঈশানী। একবার ভালো করে চেয়ে দেখে উপরে। শিয়ালদা চত্বর গভীর রাতে খানিকটা ফাঁকা হয়ে গেছে। ফলে জগদীশ চন্দ্র বোস রোডের ব্রিজের উপরে বসে থাকা দুটো ছেলে মেয়েকে খেয়াল করেনি কেউ। ব্রিজের উপরে বসেই আজ বিশাল কাটআউটে ছবি এঁকেছে ঈশানী। তারপর সেটা শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়েছে ব্রিজ থেকে। আপাতত রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা যেকোনও বাস বা গাড়ি থেকে ব্রিজের মাঝ বরাবর ঝুলন্ত অবস্থায় দেখা যাবে সেটাকে। সমস্ত কাজটা শেষ করে নিচের রাস্তায় দাঁড় করানো স্কুটিটার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। ঈশানী অবাক চোখে চেয়ে থাকে ঝুলন্ত ছবিটার দিকে।

সেই মেয়েটা আর কাকতাড়ুয়া আজ একে অপরের দিকে বিভোর হয়ে তাকিয়ে আছে মুখোমুখি। ভাবখানা যেন এই বুঝি চুমু খেতে যাবে ওরা। কিন্তু কাকতাড়ুয়া বেচারার ঠোঁট বলে কিছু নেই বলে মুখটা ব্যাজার হয়ে রয়েছে তার। পেছনের আকাশে জ্বলজ্বল করছে চাঁদ। সেই চাঁদের দুটো চোখ আর একটা মুখ। সঙ্গে খুদে খুদে দুটো হাতও আছে। সে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছে যেন দুজনে এই মুহূর্তে যে চুমুটা খেতে চলেছে সেটা চোখে দেখতে চাইছে না সে…

চারুর দিকে হাত দুটো এগিয়ে দেয় ঈশানী। ওর দুটো হাতেই রং লেগে আছে। তাই একটা দিয়ে আরেকটা ধুতে গেলে চারিদিকে রং লেগে যাবে।

বোতল থেকে রিমুভার মেশানো জলটা বের করে কচলে কচলে ওর হাতটা ধুইয়ে দিতে থাকে চারু। সেটা হয়ে গেলে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে দেয় ভালো করে।

ঈশানী একবার গাল টিপে দেয় ওর, আজ ছবিটা অন্যদিনের থেকে বেশ বড় হয়েছে। শরীরের পরিশ্রমটা কম যায়নি। হাঁপাতে হাঁপাতেই বলে, ‘কেমন হয়েছে বল?’

চারুর মুখে একটা করুণ ভাব ফুটে ওঠে, ‘ধুর, ভালো না। কাকতাড়ুয়ার একটা ঠোঁট থাকা উচিত ছিল।’

‘তাতে কী লাভ?’ ঈশানী হাসে, ‘আমার ঠোঁট আছে, তাও চুমু খেতে পারি না। দম বন্ধ হয়ে যায়…’

‘তাহলে কাকতাড়ুয়া ভালোবাসলে সেটা প্রকাশ করবে কী করে?’

‘কাকতাড়ুয়া ভালোবাসা লুকিয়েই রাখতে পারে না। যাই করে, তাতেই প্রকাশ হয়ে যায়…’ কথাটা বলে পকেট থেকে রুমাল বের করে চারুর মুখ মুছিয়ে দেয় ঈশানী, ‘তুই এত ঘামছিস কেন বল তো?’

‘আমার শরীরটা কলকাতার উপযুক্ত নয়। হুট করে এসে পড়েছি। অস্বস্তি হওয়াই স্বাভাবিক…’

‘আচ্ছা, কাল থেকে তোকে ভারতীয় করে দেব। আর কষ্ট হবে না। ঠিকাছে?’

চারু হালকা হেসে মাথা দোলায়, ‘দরকার নেই। আমায় যেভাবে দেখতে চাইবি আমি তাই। আসলে তো আমি কালো হাঁড়ি বই কিছু নই…’

দুজনে একসঙ্গে রাস্তার উপরে হাঁটতে শুরু করে। যতক্ষণ না আঁকাটা শেষ হচ্ছে ততক্ষণ একটা চাপা টেনশন চলে ঈশানীর মনে। কেউ ধরে ফেললেই সব শেষ। চারু অবশ্য স্কুটি নিয়ে রেডি হয়েই থাকে। এই ক’দিনে স্কুটি চালানোর বিদ্যেটা ভালোই রপ্ত করে ফেলেছে সে। ঈশানী লক্ষ করেছে চারু যেকোনও কিছু খুব তাড়াতাড়ি শিখে ফেলতে পারে।

শরীরটা আরও ক্লান্ত লাগে ঈশানীর। চারুর হাতটা চেপে ধরে রাস্তার উপর ভীষণ ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করে ও, মাথাটা রাখে ওর বাহুর উপর।

‘বল না বাবা, ঠিক হয়েছে আঁকাটা?’

পেছন ফিরে আর একবার ব্রিজ থেকে ঝুলন্ত ছবিটা দেখে নেয় চারু, তারপর ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে, ‘উম, কিউট হয়েছে ভীষণ!’

খুশি হয়ে হাত থেকে মুখ তুলে চারুর চোখের দিকে তাকায় ঈশানী, ‘তোকেও ভীষণ কিউট লাগছে আজ…’

চারু মুখ বাঁকায়, ‘ধুর, আমার রূপের কমপ্লিমেন্ট দিলে আমার ভালো বা খারাপ কোনটাই লাগে না…’

‘সেভাবে দেখতে গেলে এই পৃথিবীর কোনও মানুষকেই তার রূপের কমপ্লিমেন্ট দেওয়া যায় না। রূপের পেছনে আমাদের নিজেদের অবদান সামান্যই…’

‘তাহলে আমাকে কীসের কমপ্লিমেন্ট দেওয়া যায়?’

একটুক্ষণ কী ভেবে নেয় ঈশানী, তারপর তেমনই উদাস গলায় বলে, ‘আমি যতক্ষণ আঁকি ততক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তোর এই পাহারা দেওয়াটার…’

‘তখন আমার করারও কিছু থাকে না। দাঁড়িয়ে না থেকে যাব কোথায়?’

ঈশানী দাঁড়িয়ে পড়ে ওর গালে একটা হাত রাখে, ‘জানিস, এই পৃথিবীতে যেসব মানুষ গান গায়, ছবি আঁকে, নাচে, কবিতা লেখে, তাদের উপর একটা অভিশাপ কাজ করে। তারা ওই সময়টুকুনির জন্য নিজের সব কিছু ভুলে যায়। এটাও ভুলে যায় যে কেউ তাদের জন্যও অপেক্ষা করছে, তাদের পথ চেয়ে বসে আছে। তারপর যখন গান, আঁকা কিংবা নাচটা শেষ হয়ে যায় তখন আচমকাই তাদের ভিতর একটা ছটফটানি শুরু হয়। ভয় হয় তাদের। এই যে এতক্ষণ ভুলে ছিল, তাই অভিমান করে সবাই চলে যায়নি তো? ফিরে তাকালে হাসি মুখে কাউকে দেখতে পাবে তো?’

‘তারপর?’

‘আমি রোজ আঁকা শেষ করার পর ভীষণ ভয় নিয়ে পেছন ফিরে তোর দিকে তাকাই। আমার খুব ভয় করে। আমি যখন আঁকছিলাম তখন তুই কি ডেকেছিলি আমাকে? তোর কোনও বিপদ হয়েছিল তখন? আমি সাড়া দিইনি বলে না জানিয়েই কোথাও চলে গেছিস…ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে পেছন ফিরে আমি দেখতে পাই…’

‘কী দেখতে পাস?’

‘যে তুই রোজ একইরকমভাবে মুখে হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস…’ হাত বাড়িয়ে ওর দুটো গাল টিপে দেয় ঈশানী, ‘এটা আমার খুব কিউট লাগে। তোর এই অকারণে থেকে যাওয়াটা…’

চারুর মুখে হুট করেই একটা বদল আসে, ‘তোর কেন মনে হয় আমি অকারণে পাশে আছি? হয়তো আমার কোনও উদ্দেশ্য আছে?’

‘জানি…’ শান্ত গলাতেই বলতে থাকে ঈশানী, ‘তোর উদ্দেশ্য কোথাও না থাকতে চাওয়া। শুধু এটা ভাবিস না যে…’

‘কী?’

কথাটা বলার আগে হাসে ঈশানী, মুখ নামিয়ে নেয়, ‘আমাকে দিয়ে এর আগে এ কথাটা কেউ বলাতে পারেনি। কিন্তু…’ ওকে দুহাত দিয়ে কাছে টেনে নেয় সে, ‘এটা বুঝিস না যে তোকে ছাড়া আমার চলবে না?’

চারু একটু সরে আসে, ‘কেন? না চলার কী আছে? আমি যেতে যেতে তুই নিজেই সব শিখে যাবি।’

‘আমার বাবাও এরকম একটা কথা বলেছিল। তারপর দুম করে একদিন চলে গেছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম গাঁড় ফেটে যাবে। তারপর দেখলাম নাহ…আমি জানি আমি পারব।’ কথাটা বলে আর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না ঈশানী, ‘চল, আর একটু হাঁটি। আজ বেশ হাওয়া দিচ্ছে…’

ওর হাতটা ধরে ফেলে চারু, তারপর বলে, ‘তোর ভয় করে না?’

‘কীসের ভয়?’

চারু একটু অবাক গলায় বলে, ‘আমরা তেমন কিছু পাপ না করে থাকলেও শহরের কয়েকটা পুলিশ অন্তত আমাদের খুঁজছে। কাগজে লেখালিখি হচ্ছে। স্কুটিটা যদি কেউ দেখতে পেয়ে যায়, তারপর সন্দেহ করে গাড়ির নাম্বার দেখে আমাদের বের করে, বাড়িতে একবার ঢুকলেই কিন্তু বুঝতে পারবে…’

ঈশানী নরম হাসি হাসে, ‘তুই ভুলে যাচ্ছিস তুই কাকতাড়ুয়া। ভয় দেখানো তোর কাজ, ভয় পাওয়া না। আচ্ছা একটা গান শোনা আমাকে, ভয় কেটে যাবে…’

এতক্ষণে সত্যিকারের খুশি হয় চারু। একগাল হেসে বলে, ‘এই তোকে বলা হয়নি। আমি নিজে নিজে একটা গান শিখেছি। চরণদাসের শুধু দেহতত্ত্ব আর দেহতত্ত্ব। আমি একটা অন্য গান শিখেছি…’

‘আমাকে শোনানোর জন্য গান শিখেছিস তুই?’

ভেংচি কাটে চারু, ‘নাহ, রাতে অন্য মেয়ের স্কুটি চেপে ঘুরি তো, তাকে শোনাব বলেই শিখেছি…’

পিঠ থেকে দোতারাটা সামনে এনে তার তারের উপরে হাত রাখতে যাচ্ছিল চারু। ঈশানী হাত বাড়িয়ে ওকে বাঁধা দেয়, ‘না, দোতারাটা বাজাতে হবে না। ওটা তুই পাশে রাখ। খালি গলায় গা…’

একটু রুষ্ট হয় চারু, ‘কেন? দোতারা বাজালে কী সমস্যা? তোর ভালো লাগে না শুনতে?’

‘লাগে, ভীষণ ভালো লাগে। কিন্তু বাজাতে হবে না…’

‘কেন?’

‘আঃ, বড্ড প্রশ্ন তোর! দেব এক্ষুনি হাঁড়ি ফাটিয়ে। যা বলছি সেটা কর না…’

ভাবাচ্যাকা খেয়ে দোতারাটা সরিয়ে রাখে চারু। রাস্তার একদিকের দেওয়ালে পিঠ রেখে অন্ধকারে মিশেই গলা খাঁকারি দেয় একবার। তারপর খালি গলাতেই গাইতে থাকে। ফাঁকা রাস্তার উপরে ভেসে যায় ওর গানের সুর। মৃদু ঝোড়ো হাওয়া কলকাতার পুরোনো গলির ফাঁকে ফাঁকে বয়ে নিয়ে যায় সেই গান। সেখান থেকে বুঝি আরও দূরে।

আচমকাই এগিয়ে এসে ওর বুকের উপর মাথা রাখে ঈশানী। দুহাতে ওর কোমর জড়িয়ে ধরে, ফিসফিসে স্বরে বলে, ‘বোকা, দোতারা বাজালে বুকে মাথা রাখা যায় না…’

গান গাইতে গাইতেই চারুর মুখে হাসি ফোটে। ঈশানীর মাথার উপরে একটা হাত রাখে ও। গলার স্বর আরও নরম হয়ে আসে। ঘুমপাড়ানি গানের সুরের মতো শোনায়।

কতক্ষণ কেটেছে কেউ জানে না। সময়ের হিসেব ভুলে গেছে ওরা। এর মধ্যে চারু একটা গান শেষ করে অন্য গান শুরু করেছে। দূর থেকে একটা পুলিশের গাড়ির আলো রাস্তার উপরে পড়তে ঈশানীকে নিয়েই আরও একটু অন্ধকারে সরে আসে চারু। ঈশানী আচমকা ভয় পেয়ে ধড়মড়িয়ে জেগে ওঠে। তারপর আবার শান্ত হয়ে যায়।

‘এই তুই গান শুনছিস না?’ ঈশানীর ঘুম জড়ানো মুখের একটা গালে হাত রেখে জিগ্যেস করে চারু।

লজ্জিত হয় ঈশানী, ‘আসলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম…’

মাথাটা আবার নিজের বুকে টেনে নেয় চারু, ‘একদিন দুদিন একটু বিশ্রাম দে। রোজ রোজ রাত জেগে এসব না করলেও হবে। ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসছে তোর…’

সজোরে দুপাশে মাথা নাড়ে ঈশানী, ‘না, ক্লান্ত নয়…’

‘তাহলে?’

‘ক্লান্ত তো আমি অনেক মাস ধরে চারু। আজ আসলে একটুও ভয় করছিল না তাই। নিশ্চিন্ত লাগছিল ভীষণ। চল, বাড়ি ফিরতে হবে…’

অন্ধকার থেকে সরে দুজনে হেঁটে কিছু দূর এগিয়ে আসে। স্কুটিটা এখনও রাস্তার একপাশেই দাঁড় করানো আছে। রঙের ক্যান আর ব্রাশগুলো যত্ন করে স্কুটির ভিতরে ঢুকিয়ে নেয় ঈশানী। দুজন মিলে বোতল থেকে জল খায়।

আজ রাতে শেষবারের মতো দেখে নেয় একটু আগের আঁকাটাকে। কে জানে হয়তো কাল সকাল হওয়া মাত্র পুরসভার লোক এসে গাড়িচাপা কুকুরের বডির মতো সরিয়ে ফেলবে আঁকাটা।

এতক্ষণে রংটা শুকিয়েছে। চাঁদের আলোয় আর একটু বেশি ঝলমল করছে সেটা। দুজনে কিছুক্ষণ তৃপ্তির দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সেটার দিকে। ঈশানী চারুর হাতটা ধরে বলে, ‘আমার সব স্বপ্নগুলো তোর কবে হয়ে গেল বল তো?’

‘তোর দুঃখগুলো আমাকে বলতে ইচ্ছা করেছিল যবে। যবে আমি ছাড়া আর কাউকে বলতে পারিসনি…’

‘আমি দুঃখ দিয়ে কত কিছু কিনে নিলাম বল? স্বপ্ন, বেঁচে থাকা, আর সব ভয় হারিয়ে গেল আমার…’

হঠাৎ করে ওর দিকে সরে আসে ঈশানী, ‘একদম ভয় করছে না কেন বল তো?’

‘আমারও করছে না। আমি…’

ঘাড় ধরে ওর মুখটা নিজের মুখের কাছে আনে ঈশানী। তারপর জিজ্ঞেস করে, ‘এখন?’

‘এবারে একটু করছে। কিন্তু ঠিক ততটা নয়।’

আরেকটু কাছে নিয়ে আসে, ‘বেশ, এবার বল, এখন করছে?’

বিড়বিড় করে চারু, ‘আমি না কোনওদিন কাউকে চুমু খাইনি।’

‘আমিও। ঠোঁটে চুমু আমার আজ অবধি নিজে থেকে কাউকে খাওয়া হয়নি…’

‘কেন?’

‘আমার খালি মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাবে। বেশিক্ষণ ওভাবে থাকলে আমি দম আটকে মরে যাব…’

চারু হতাশ হয় কিনা বোঝা যায় না, ‘ওঃ, তাহলে তো…’

মুখটা সরিয়ে নিতে যাচ্ছিল চারু। হঠাৎ করেই ঈশানী দুহাতে ওর মাথাটা টেনে নেয়। সজোরে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় ওর ঠোঁটে। চারু থতমত খেয়ে কোনরকমে বলে, ‘এই যে বললি দম আটকে মরার ভয় করে…’

‘এই যে বললাম আমার আর কিছুর ভয় করছে না। দম আটকে মরারও না…’

ওদের নিজেদের আঁকা শরীরদুটো নিজেদের শরীরের ছায়াতে ঢেকে যায়। কেবল দুটো কপালের মাঝখান দিয়ে ঈশানীর আঁকা চোখ, হাত আর লজ্জিত মুখওয়ালা চাঁদটাকে দেখা যায়।

সে চাঁদের আলো এতক্ষণ এসে পড়েছিল ফাঁকা রাস্তায়। দুহাত দিয়ে চোখ ঢেকে আছে ছবির চাঁদটা। আর আকাশের চাঁদটাকে ঢেকে দেয় ছেঁড়া মেঘের দল…

কাকতাড়ুয়া – 12 অধ্যায়

দ্বাদশ অধ্যায়

খবরের কাগজের অফিসে একগাদা কাগজপত্র নিয়ে ওলটপালট করছিলেন রানা সরকার। আর একটু হলেই মাথাটা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড় হয়েছে তার। পরশু রবিবার, কাগজের স্পেশাল সেকশনে একটা ফিচার যাওয়ার কথা। যে সাংবাদিককে সেটা লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তিনি দস্তুরমতো ছড়িয়েছেন। এখন হয় তাকে নিজেকেই কিছু লিখতে হবে নাহলে এমন কোনও লোক জোগাড় করতে হবে যে একদিনের মধ্যে ব্যাপারটা নামিয়ে দিতে পারবে।

ভাবনাটা মাথায় আসতেই থমকালেন রানা সরকার। এই ধরনের রবিবাসরীয় ফিচার লেখার আদর্শ লোক একজন ছিল বটে, কিন্তু সপ্তাখানেক ধরে লোকটা ওর ফোন রিসিভ করছে না। উপায়ন্তর না দেখে একদিন তার বাড়িতেই ফোন করেছিলেন সরকার। তার স্ত্রী জানিয়েছেন তার হাসব্যান্ড নাকি কী একটা ব্যাপার নিয়ে গবেষণা শুরু করেছেন। সেটা থেকে যতদিন না কনক্লুসিভ কিছু পাচ্ছেন ততদিন কারও সঙ্গে তিনি কথা বলবেন না।

‘ধুর শালা! আমার হয়েছে যত জ্বালা…’ কথাটা বলে টেবিলে একটা চাপড় মারলেন সরকার। টেবিলটাকেই দু’ঘা দিয়ে মাথা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলেন। নিজে কিছু লিখতে গেলে আগে নার্ভকে আয়ত্তে নিয়ে আসতে হবে।

টেবিল চাপড়ানোর আওয়াজের জন্যই যেন অন্য একটা শব্দ অপেক্ষা করছিল। দরজায় নক হতেই মুখ তুলে তাকালেন সরকার। খবরের কাগজের অফিসে সকালের দিকটায় চিৎকার চেঁচামেচি লেগেই থাকে। প্রতি মিনিটে কারও না কারও ফোন বাজছে, কেউ না কেউ কফির জন্যও চিৎকার করছে, তার মধ্যে হালকা টোকার শব্দ সহজে শোনা যায় না। কিন্তু এই নকটা আলাদা করে চেনেন সরকার। গলা তুলে হাঁক পাড়লেন, ‘শালা কী ভাগ্য আমার…ভিতরে এসো।’

ঘরের দরজা খুলে যে মুখটা উঁকি দিল সেটা আজ দিনসাতেক ধরে দেখার জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন তিনি। এতদিনে গবেষণার গভীর তমসাজাল থেকে মুখ তুলে চেয়েছেন তিনি।

সাংবাদিক মহলে অনির্বাণ ঘোষালের নাম এবং দুর্নাম দুটোই পাশাপাশি হাঁটে। একবার লোকটার মাথায় কিছু ঢুকলে তার গভীরে ঢুকে ফর্দাফাই না করে ফেললে তার শান্তি হয় না। সে খুনের মামলা হোক, টলিউডে কালো টাকার খেলা হোক, কিংবা ঠাকুরপুকুরে সেলিব্রিটি জ্যোতিষীর বাটপাড়িই হোক। এসব করতে গিয়ে কম বিপদে পড়েননি। কিন্তু তাতে ভয় পাওয়ার বান্দা অনির্বাণ ঘোষাল নন। একসময় অ্যাক্টিভ রাজনীতি করতেন। পরে ব্যক্তিগত কারণে সরে দাঁড়ান। তবে এখনও রাজনৈতিক মহলে ভয়ঙ্কর প্রভাব আছে বলে শোনা যায়।

‘শালা, এক সপ্তাহ যেভাবে তোমার বউয়ের থেকে তোমার খোঁজ নিচ্ছি তাতে মহিলা নির্ঘাত আমাকে গে-টে কিছু একটা ভেবে বসে আছেন।’ রানা সরকার বিরক্ত গলায় বলেন।

অনির্বাণ সামনের চেয়ারে বসতে বসতে বলেন, ‘গে কিনা জানি না, কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে আমার বউ সন্দেহ করছে আমি আর একটা প্রেম করছি।’

‘সে কী! কেন?’

‘সারাদিন মুখে ফোন গুঁজে বসে আছি বলে।’

ঠোঁট উল্টান রানা সরকার, ‘তা একটা আধবুড়ো দামড়া সাংবাদিক সারাদিন মোবাইল নিয়ে খুটখুট করলে সন্দেহ হবার কথা বইকি…কিন্তু তোমার বউ যে বলল তুমি নাকি কাজ করছ?’

টেবিলের উপর রাখা বাটি থেকে একটা ক্যান্ডি তুলে মুখে দিল অনির্বাণ, সেটা চুষতে চুষতে বললেন, ‘আপনি কোন পাথরের তলায় ঘর বানিয়ে থাকেন জানি না, কিন্তু আজকাল আমাদের বেশিরভাগ কাজ ফোনেই হয়ে যায়। তাতে সুবিধাও বেশি, সময়ও বেঁচে যায়…’

‘তা, কী এমন কাজ করছিলে তুমি?’

‘সিম্পল। ইন্সটাগ্রামে রিলস দেখছিলাম…’

সরকারের চোখ কপালে উঠে যায়, আবার টেবিলের থাবড়া মারবার উপক্রম করে বলেন, ‘তুমি এক সপ্তা বাড়ি বসে রিলস দেখছিলে?’

‘উঁহু…’ মাথা নাড়ায় অনির্বাণ, ‘শুধু ইন্সটা কেন? ফেসবুকেও দেখেছি। বেশ ভালো কন্টেন্ট। তারপর ধরুন ইউটিউব শর্টস…’

একটা পায়ের উপর অন্য পা তুলে বসেন অনির্বাণ, ‘দেখুন, সত্যিকারের পেজ থ্রি সাংবাদিকের কাজ না, অনেকটা অন্যের হেগো পোঁদ ছুঁচিয়ে দেওয়ার মতো। মানে মূল ঘটনা যা ঘটার ঘটে গেছে, আপনাকে শুধু সব ঘটে যাওয়ার পর বাকিটুকু আঁচিয়ে নিয়ে ব্যাপারটা বুঝে ফেলতে হবে। আগে মানুষ খবরের কাগজে হাগত, গল্পের বইতে হাগত, সিনেমা থিয়েটারে হাগত, এখন এই ইন্সটা, আর ফেসবুকে হাগে…’

‘সকাল সকাল যা সব শোনাচ্ছ লাঞ্চটা পেটে ঢুকলে হয়। তা ওসবে খুঁজে পেলেটা কী?’

‘স্কেয়ারক্রো চ্যালেঞ্জ।’ হাতের ফাইলটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে ফিতেটা খুলে দিলেন অনির্বাণ। তারপর ক্যান্ডিটা চুষতে চুষতে আচমকাই চিবিয়ে ফেলে বললেন, ‘এই মালটাই এখন ট্রেন্ডিং-এ যাচ্ছে…’

‘সেটা আবার কী?’

অনির্বাণ বিরক্ত হয়ে মুখ তোলেন, ‘আপনারও তো ইন্সটা আছে। সেখানে কি শুধু নাইটি পরা বউদিদের নাচ দেখেন?’

একঢোঁক জল খেয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নেন অনির্বাণ, একবার গলা চুলকে নিয়ে বলেন, ‘দিনকতক হল কলকাতার ছেলেমেয়েরা এক বিচিত্র খেয়ালে মেতেছে। রাস্তাঘাটে, লোকের বাড়ির দেওয়ালে, নর্থ কলকাতার সরু গলির মধ্যে হাতের সামনে চক, ইট কিংবা বাড়ি থেকে আনা রংতুলি যা পাচ্ছে তাই দিয়ে একটা বেখাপ্পা কাকতাড়ুয়া আঁকছে।’

‘যাহ্ শালা! কাকতাড়ুয়া কেন?’

‘অসুবিধাটা কোথায়? আর কতদিন লোকে শহরের দেওয়ালে কাস্তে হাতুড়ি, ঘাস আর পদ্ম দেখবে বলুন তো? চোখের আরাম বলেও তো একটা ব্যাপার আছে?’

‘বেশ, তারপর?’

‘তারপর সেই কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে একটা সেলফি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে হ্যাসট্যাগ দিচ্ছে—স্কেয়ারক্রো চ্যালেঞ্জ। একজন অন্যজনকে চ্যালেঞ্জ ট্যাগ করে দিচ্ছে। ব্যাস চেইন রিঅ্যাকশনের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা…’

‘কিন্তু এতে লাভ কী হচ্ছে এদের?’

হাত ওলটান অনির্বাণ, ‘আপাতভাবে খুব ইনোসেন্ট একটা মজা, বা হুজুগও বলতে পারেন। কিন্তু এদের একটা নেতা গোছের আছে। আমার যতদূর মনে হয় তার কিছু অ্যাজেন্ডা আছে…’ কেটে কেটে সময়ে নিয়ে বলতে থাকেন অনির্বাণ, ‘ব্যাপারটা শুরু হয় সপ্তাখানেক আগে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের দেওয়ালে কারা যেন ঘটা করে বিশাল কয়েকটা কার্টুন এঁকে রেখে যায়। তারপর কলকাতার আরও কয়েকটা নাম করা জায়গায়। সেই ছবিগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। আমার মনে হয় বাজনার নেপথ্যের এই মূল গায়েন বাকিদের মতো এতটা ইনোসেন্ট নয়…তার খোঁজেই…’

এতক্ষণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন সরকার। মাথা চুলকে বললেন, ‘তুমি কি এই নিয়ে ফিচারটা লিখবে ভাবছ?’

‘আমি লিখব ভাবছি না, লিখছি। আপনি ছাপবেন কিনা সেটা ভেবে দেখুন…’

‘তুমি খেপেছ নাকি?’ ধমকে ওঠেন সরকার, ‘এটা রবিবার লোকে লুচি কষা মাংস খেতে খেতে পড়বে?’

জিভ দিয়ে চুকচুক করে একটা আওয়াজ করেন অনির্বাণ, ‘বাঙালি লুচির সঙ্গে মাংস নয়, আলুর দমটা প্রেফার করে। কষা মাংসটা গরম ভাতের সঙ্গে, তাও আবার কলাপাতার থালায়। এই জন্যেই বলি আপনারা বাঙালির পালস বোঝেন না…যার সঙ্গে ক্রিকেট, রাজনীতি আর সেলেবদের কেচ্ছা জড়িয়ে নেই তার কোনও কিছুতেই পাত্তা দেবেন না…’

‘তা বলে রাস্তাঘাটে লোকে কাকতাড়ুয়া আঁকছে, তারপর সেলফি তুলে পোস্ট করছে, এটা খবর? এটা ছাপিয়ে আমরা আরও এনকারেজ করব? এরপর লোকে রেল স্টেশনে বিকিনি পরে ভোজপুরি গানে নাচলেও সেটাও এনকারেজ করতে হবে…’

হাত তুলে টেবিলের উপরে আবার চাপড় মারতে যাচ্ছিলেন সরকার। তার আগেই অনির্বাণের বাজখাঁই গলায় টেবিল কেঁপে ওঠে, ‘আপনার লজ্জা করে না স্যার এই কথাটা বলতে?’ টেবিল থেকে উঠে পড়ে অনির্বাণ, ‘লজ্জা করে না? আচ্ছা রেলস্টেশনে নাচবে না। কোথায় নাচবে? আপনার বাড়ির ছাদে? কোথায় নেচে দুটো পয়সা রোজগারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন আপনারা? যে পয়সা দিয়ে আজকের ভাতটা খেয়ে সে কাল আবার নাচতে যাবে?

 ‘ধরুন আমি শুধু ছবি আঁকতে পারি। আমি কোথায় ছবি আঁকলে ফ্ল্যাটভাড়াটুকু জোগাড় করতে পারব? কোথায় অভিনয় করলে মায়ের রোজের ওষুধটুকু কিনতে পারব?…নেই। কোথাও নেই। আমি আমার প্যাশন ফলো করলে শাস্তি হিসেবে আমার না খেয়ে মরার সব বন্দোবস্ত করে রেখেছেন আপনারা। আর কারা দেয় সেই শাস্তিটা জানেন? কোনও মন্ত্রী নয়, আমলা নয়, ভারতমাতা নয়, সংবিধান নয়—যারা এই দেশটা চালায়—কর্পোরেট পুঁজিপতিরা। তারা গান গাওয়া, ছবি আঁকা, অভিনয় জানা লোক নিয়ে কী করবে? তাদের ইয়েসম্যান দরকার, আঙুলের তলায় ট্যালট্যালে হতে পারা গাধার বাচ্চা দরকার…’

অনির্বাণের মুখ লাল হয়ে এসেছে, শব্দগুলো গনগনে আগুনের মতো বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে, ‘শুধু ভিক্টরিয়াটা সম্পদ? হাওড়া ব্রিজটা সম্পদ? আর এই যে এতগুলো শিল্পীকে, তাদের সম্ভবনাকে রোজ জেনে বুঝে খুন করছেন আপনারা, তারা সম্পদ নয়? মিস্টার সরকার, যে সমাজ ঘুমিয়ে থাকে তাকে ঠেলা দিয়ে জাগানো যায়। কিন্তু যে সমাজ টাকার গন্ধ আর কর্পোরেটের খুড়োর কল দেখে ঘুমানোর ভান করছে, তাকে জাগাতে গেলে তার মোক্ষম জায়গাটা টিপে ধরতে হয়…’

আবার এগিয়ে এসে চেয়ারে বসে পড়ে অনির্বাণ, ‘আপনার কী মনে হয়? লোকে বিকিনি দেখার জন্য ট্রেনে নাচ দেখে? আরে নেটে সার্চ করলে কয়েক লাখ বিকিনি আর কয়েক হাজার পানু সাইট আসে। যে মিউজিশিয়ান হতে চাওয়া ছেলেটা আটঘণ্টা অফিস করে ক্লান্ত শরীরে বাড়ি ফেরে, সে একজন আর্টিস্টকে এই নরখাদক সিস্টেমটার মুখে ছরছর করে মুতে দিতে দেখতে চায়…’

ঘরের উত্তাপ বেড়ে উঠেছে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে বসে থাকেন সরকার। নখ খোঁটেন। অকারণেই একবার জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কী যেন খোঁজেন, তারপর ঠান্ডা গলায় বলেন, ‘আহা, তুমি এত চটছ কেন? বসো, জল খাও…’

আর একটা ক্যান্ডি তুলে মুখে পোরেন অনির্বাণ, শান্ত গলায় বলেন, ‘আমার কাছে জনবার্তার কন্ট্র্যাক্ট আছে, আপনি না চাইলে…’

‘আমি চাই না কখন বললাম?’ হাত নাড়ান সরকার, ‘কিন্তু এগুলো সবই তো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। তুমি আলাদা করে কী লিখতে পারবে? আই মিন, এইসব সোশ্যাল ইস্যু নিয়ে মরাল পুলিশিং করা তো নিউজ পেপারের কাজ নয়।’

‘আমি একটা ইন্টারভিউ করতে চাই।’

‘কার?’

‘এই মেইন আর্টগুলো যে বা যারা করছে তার। যেভাবেই হোক তাকে খুঁজে বের করতে হবে।’

পরের কথাটা বলতে একটু সময় লাগল সরকারের, ‘আচ্ছা, ধরেও নিলাম তুমি তাদের খুঁজে বের করলে। তারা ইন্টারভিউ দিতে চাইবে কেন? মানে ধরো, ওরা যে কাজটা করছে সেটা তো লিগ্যাল নয়। পুলিশ ধরলে…’

মুখ তোলেন অনির্বাণ, ‘দেশের যেখানেই যান বেশিরভাগ স্থাপত্যের গায়ে আপনি ঝুনু আই লাভ ইউ বা রাহুল লাভস প্রিয়া দেখতে পাবেন। আইপিসির চারশো পঁচিশ বলছে সরকারি সম্পত্তি কিংবা হিস্টরিকাল হেরিটেজের কোনরকম ক্ষতি করলে তার বদলে পাঁচমাস জেল হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে আদৌও সম্পত্তির কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। দেওয়ালে করা রং সামান্য ধুলেই উঠে যাবে। পুলিশ বড়জোর একটু চমক ধমক দিতে পারবে, ফারদার আঁকাটা বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু যেহেতু ওরা কোনও ক্রাইম করেনি, তাই ওরা চাইলে ওদের আইডেন্টিটি রিভিল করতে আমি বাধ্য থাকব না…’

‘বেশ, তাহলে তো অসুবিধার কিছু নেই। কিন্তু এদের খুঁজে বের করবে কী করে?’

এইবার ফাইল খুলে কয়েকটা ছবি বের করে সামনে রাখেন অনির্বাণ। কী যেন খুঁজতে খুঁজতে বলেন, ‘খুঁজে বের করতে একটু সময় লাগবে, তবে তাদের সম্ভব্য ঠিকানাটা কী সেটা মনে হয় আন্দাজ করতে পেরেছি।’

‘কী করে?’

কয়েকটা ফটোগ্রাফ রানা সরকারের সামনে ফেলে দেয় অনির্বাণ, তারপর বলে, ‘আপনি খেয়াল করলে দেখবেন স্যার মূল কার্টুনগুলো যারা এঁকেছে তাদের আঁকাগুলো প্রায় গোটা কলকাতা জুড়ে ছড়ানো, এবং বলাই বাহুল্য কোনও পার্টিকুলার অর্ডারে নয়। খাপছাড়াভাবে। মঙ্গলবার ঢাকুরিয়া হলে বুধবার বরানগর। সেটা অবশ্য ইচ্ছা করেই করা। যাতে এইসবের উৎসস্থল খুঁজে বের করা না যায়। কিন্তু আর্টিস্টের ট্রেডমার্ক তার আর্টে থেকে যায়। সেটা চাইলেও মুছে ফেলা যায় না। ছবিগুলোর দিকে ভালো করে তাকালেই শিল্পীকে পড়ে ফেলা যায়…’

‘মানে?’

‘ভালো করে দেখুন। এখানে যে মেল ফিগারটা, আই মিন কাকতাড়ুয়া আঁকা হয়েছে সেগুলো ক্লিয়ার লাইন ড্রয়িং। সব ছবিতে তার চোখ, মুখ, নাক, গলার একটা সিঙ্ক্রোনিসিটি আছে। কিন্তু মহিলা চরিত্রটার এক একটা ছবিতে এক একরকম প্রোপরশন। মানুষ যাকে চোখের সামনে দেখে তাকে নিয়ে কনফিউজড থাকে না। কিন্তু যাকে কেবল আয়নায় বা ছবিতে দেখতে পায় তার আকার আকৃতি নিয়ে সঠিক ধারণা করতে পারে না। ফলে সেটা ছবিতে ছবিতে বদলে যায়। এবার দেখুন, প্রায় সব ছবিতে কাকতাড়ুয়া আর মেয়েটার মধ্যে মেয়েটা দর্শকদের থেকে একটু হলেও কাছে আছে। অর্থাৎ শিল্পীর চোখে সে পারস্পেক্টিভ ক্যারেক্টার…’

‘মানে বলতে চাইছ, যে ছবিটা আঁকছে সে মেয়ে? কিন্তু এমনও তো হতে পারে আসল ছবিটা অন্য কেউ ছোট করে কাগজে এঁকে দিচ্ছে। সেটা দেখে দেখে এ আঁকছে…’

‘উঁহু, সেটা আমার মনে হয় না।’

‘কী করে?’

‘দেখুন, শিল্পী দু’ধরনের হয়, এক কপি শিল্পী আর দুই ওরিজিনাল শিল্পী। আমাদের এখানে যারা কার্টুন এঁকেছে তাদের সবার ধরন খুব কাছাকাছি। এর কারণ আমরা ছোট থেকে মোট তিনটে কার্টুন পড়ে বড় হয়েছি। টিনটিন, এস্টেরিক্স আর নারায়ণ দেবনাথের বাচ্চাদের জন্য তৈরি করা কয়েকটা চরিত্র। এরা সবাই পরিষ্কার লাইন টেনে চরিত্র আঁকতেন। ভিসুয়ালি খুব কমপ্লেক্স ছিল না। ফলে আমরা কার্টুন বানাতে গেলে এদের প্রভাব ছাড়িয়ে বাইরে বেরোনো মুশকিল। কিন্তু এই আর্টিস্টের আঁকার ধরন খেয়াল করলে বুঝবেন এর নিজস্ব ঘরানা আছে। এ সহজ কার্টুনই আঁকছে, কিন্তু লাইনগুলো ততটা ক্লিয়ার নয়। যেন বাস্তব থেকেই নেওয়া, সহজ ঢঙেই মুড়ে দেওয়া, কিন্তু সহজ কথা বলার তাগিদ নেই…এই শিল্পীর যা মুড তাতে এর পক্ষে কপি করা সম্ভব নয়…’

‘বেশ, কিন্তু আমরা কলকাতা জুড়ে কার্টুনিস্ট মেয়ে খুঁজে বের করব নাকি? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে তো।’

হেসে দুদিকে মাথা নাড়েন অনির্বাণ, ‘মনে হয় না তার দরকার হবে স্যার…’ কথাটা বলে একটা বিশেষ ছবি টেবিলের উপরে ফেলে দেন অনির্বাণ, ‘ঠিক এতদূর এসেই আমি আটকে ছিলাম। কিছুতেই নিজেদের খুঁজে বের করার কোনও উপায় রাখছে না এরা। স্কেয়ারক্রো চ্যালেঞ্জের হ্যাশট্যাগে ক্লিক করলে শুধু হাজার হাজার রিলস আসছিল। বিরক্ত হয়ে সেগুলোই একটার পর একটা চালিয়ে রেখেছিলাম। তার মধ্যে একটা বিশেষ রিলসে আমার চোখ আটকে গেল এবং সেখান থেকেই সূত্রটা খুঁজে পেলাম। সেখান থেকে নেওয়া এই ছবিটা…’

টেবিলের উপরে রাখা ছবিটা তুলে একবার দেখলেন সরকার। একটা বছর কুড়ির মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা ইট দিয়ে আঁকা ছবির পাশে। সম্ভবত একটা পাঁচিলের গায়ে আঁকা ছবিটা। স্কুটি চালাচ্ছে একটা মেয়ে আর তার পেছনে হাত পা তুলে বসে আছে একটা কাকতাড়ুয়া। ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা ভিয়ের মতো আঙুল তুলে হেসে সেলফি তুলছে সেটার সঙ্গে।

‘সাধারণ ভাঙা ইট দিয়ে আঁকা এরকম আরও অনেক ছবি আছে। কিন্তু এই ছবিটা তার মধ্যে আলাদা। মূল ছবিগুলো যে বা যারা এঁকেছে তাদের ঘরানার সঙ্গে এই ছবিটার অদ্ভুত মিল…আপনি দেখলেই বুঝতে পারবেন…’

ছবিটা খতিয়ে দেখলেন সরকার, অনির্বাণ বলতে থাকেন, ‘এই রিলসটার ক্ষেত্রে ছবিটা যে তুলেছে সে কার্টুনটা আঁকেনি। আমার যতদূর মনে হচ্ছে স্যার এই ছবিটাও ওরিজিনাল আর্টিস্টরাই এঁকেছে। তবে একটু অখ্যাত জায়গায় আর সাধারণ ইটের টুকরো দিয়ে আঁকা বলে সবাই চিনতে পারেনি…’

‘বেশ, ধরে নিলাম এটাও ওদেরই আঁকা। তা হলেও তো আমাদের লাভ কিছু হচ্ছে না।’

অনির্বাণ কথাটায় পাত্তা দেন না, বলে যেতে থাকেন, ‘যে প্রোফাইল থেকে ছবিটা আপলোড হয়েছে তাকে যোগাযোগ করলাম আমি। জিগ্যেস করলাম এই ছবিটা সে নিজেই এঁকেছে কিনা। মেয়েটা জানালো ওটা ওর নিজের আঁকা নয়। উত্তর কলকাতার একটা স্কুলের পাঁচিলে নাকি এই ছবিটা আঁকা ছিল। ছবিটা দেখে ওদের চ্যালেঞ্জের কথা মাথায় আসে, তখনই রিলস বানিয়ে ফেলে। ওর সঙ্গে সঙ্গে আরও অনেকেই বানিয়েছে…’

‘এখান থেকে কী লাভ হল তোমার?’

দুটো হাত মাথার উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙেন অনির্বাণ, ‘টিনটিনের মোট তেইশটা বই রঙিন। শুধু প্রথম বইটা সাদা-কালো। তাছাড়া সেখানে টিনটিনের চরিত্রটা তেমন একটা প্রতিষ্ঠিত নয়। তার কারণ জানেন?’

‘কারণ ওটা প্রথম আঁকা হয়েছিল। তখনও আরজে টিনটিনকে নিয়ে অতটা শিওর ছিলেন না…’

‘বিঙ্গো!’ হেসে ওঠেন অনির্বাণ, ‘আমার মনে হয় এই ছবিটা ওদের প্ল্যানের অংশ ছিল না। বরঞ্চ হুট করে একদিন খেয়ালের বশে এই ছবিটা আঁকার পর থেকেই ওরা পরপর আঁকা শুরু করে।’

একটু ভাবলেন সরকার, ‘বৃত্তটা ছোট হল বটে। কিন্তু উত্তর কলকাতাও তো ছোট জায়গা নয়। খোঁজ শুরু করতে গেলে…’

ছবিটা আবার তুলে ধরেন অনির্বাণ, ‘যে দেওয়ালটা দেখছেন সেটা একটা মেয়েদের স্কুল। আমরা জানি আর্টিস্ট মেয়ে, এবং সম্ভবত সে খুব ভালো কার্টুন আঁকতে পারে বলে পরিচিত…’

ক্যাফের দরজা দিয়ে ঢুকতেই অভিষেককে দেখতে পায় গার্গী। এগিয়ে এসে ওর সামনের চেয়ারটা টেনে বসে পড়ে সে। পিঠের ব্যাগটা খুলে নিচে নামিয়ে রাখে।

সামনে রাখা সোনালি মদের গ্লাসে চুমুক দেয় অভিষেক। মুখ তুলে ঠোঁট চেটে বলে, ‘আছিস কেমন তুই?’

‘তোর সঙ্গে ফালতু গেঁজানোর ইচ্ছা সময় কিচ্ছু নেই আমার। কী বলবি বল…’

‘তুই যে রেকর্ড করছিস না কী করে বুঝব?’

‘বুঝবি না, চাইলে তোকে এক্ষুনি পুলিশে দিতে পারি। শুধু আমরা চাই না অকারণে তোর হ্যারাসমেন্ট হোক…’

অভিষেক চারদিকটা একবার দেখে নেয়, ‘দেখ, সত্যি বলছি এই কেসে আমি কোনও হারামিপনা করিনি। কিন্তু বুঝিসই তো আমার কারবার অত সিধা না। একবার পেছনে পুলিশ লাগলে কোথায় না কোথায় ফেঁসে যাব…’

‘ইউ হ্যাভ মাই ওয়ার্ড, এবার বল, অভিরূপার সঙ্গে প্রেম চলছিল তোর?’

আবার ধীরে সুস্থে সোনালি তরলে একটা বড় চুমুক মারে অভিষেক, ‘ঠিক প্রেম নয়। কাইন্ড অফ একটা ফিজিক্যাল ইন্টিমেসি। ওই মাঝে মধ্যে ওর বাড়ি গিয়ে…’

‘কবে থেকে?’

‘ঈশানীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে থাকতেই অভিরূপার প্রতি আমার একটা ইন্টারেস্ট ছিল। ঈশানীর একটা আলগা রূপ আর বিশাল দেমাগ ছাড়া আর কিছুই নেই শালা। অভিরূপার পয়সাকড়ি আছে। মেয়েটার মাথাটা খেতে পারলে ওকে টিপে ভালোই রস আসবে। অনেকদিন আগেই একবার ঠারেঠুরে বলেছিলাম ওকে। তখন ওর বয়ফ্রেন্ড ছিল। হেব্বি খেপে গিয়েছিল। শুধু জুতোতে বাকি রেখেছিল আমাকে…’

‘আশ্চর্য! তুই ওকে এসব বলেছিলি আমাদের কোনওদিন জানায়নি…তারপর?’

‘তো আমাদের সম্পর্কটা কেটে যাওয়ার মাসখানেক পরে হঠাৎ করে একদিন আমাকে ফোন করে ছোটখাটো কিছু দরকারে। কিন্তু আমি শালা বুঝতে পেরেছিলাম, ওসব দরকার ফরকার বাজে কথা। সদ্য ব্রেক আপ হয়েছে, এক্সকে ভোলার জন্য ও একটু নোংরা হতে চাইছে। আর আমার শালা নোংরা করাই কাজ।

‘তারপর?’

‘তখন থেকেই ওর সঙ্গে নিয়মিত কথাবার্তা হত। তো করতে করতেই প্রথমে সেক্স চ্যাট। তারপর একদিন দেখা করে…তারপর থেকে ওটাই কন্টিনিউ হতে থাকে। দুসপ্তাহে একবার না হলেও দেখা করতাম আমরা। আমার শালা একটা ফিলিংস গোছের আসছিল, সেটা ওকে বলেওছিলাম। কিন্তু ও শালা কিছুতেই ভালোবাসবে না আমাকে। খাওয়াখায়িই হবে, ব্যাস। মাঝে মাঝে অবশ্য নানারকম দরকারের কথা বলত…’

‘কীরকম দরকার?’

অভিষেক একটু সময় নিয়ে বলে, ‘নানারকম। সেগুলো সবই একটু ঘাপলা টাইপের। যেমন ধর অমুক লোকটা কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে, অমুক ড্রাগটা কোন ডিলারের কাছে পাওয়া যায়, মাঝে মাঝে আবার অনেকের ফেসবুক হ্যাক করে দিতেও বলত। দু-একজনকে ফোন করে চমকেওছি ওর কথায়…’

‘তুই করতিস সব?’

অভিষেকের মুখটা বিরক্ত দেখায়, ‘শালা, নিজের ইচ্ছায় কে করে এইসব? আমি তো একটা বড় মালফাল কামিয়ে এসব থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টাই করছিলাম। ও প্রথমে এইসব কাজের জন্যও টাকা অফার করেছিল। আমি রাজি হচ্ছিলাম না, এসব কাজে শালা পুলিশের ঝামেলা আছে। তখন ও শালা সিডিউস করা শুরু করল। আমিও রক্ত মাংসের মানুষ…’

‘মানে তুই বলছিস তোর সঙ্গে একটা ফিজিকাল ইন্টিমেসি করে তোকে দিয়ে ও এমন কিছু কাজ করিয়ে নিত যেটা ওর পক্ষে ততটা সম্ভব ছিল না…’

গার্গীর নিজেরও বিশ্বাস হয় না কথাগুলো। এসব নোংরামো করার মতো মেয়ে অভি ছিল না। এতটা ডেস্প্যারেট ও হল কীসে?

অবশ্য চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার মতো মানুষ অভিষেকও না। কিন্তু ওর মুখ দেখে এখন মিথ্যে বলছে বলেও মনে হচ্ছে না।

গার্গী অন্য প্রসঙ্গে আসে, ‘তুই বললি অভি মারা যাওয়ার তিনদিন পরে তুই জানতে পেরেছিলি। এতই যখন ভালোবাসা জন্মেছিল তখন এই তিনদিন একটাও মেসেজ করলি না কেন?’

অভিষেক গ্লাসে একটা চুমুক দিতে যাচ্ছিল, অবাক হয়ে মুখ তোলে, ‘তোকে কে বলল করিনি?’

‘করেছিলি?’

‘যেদিন মারা যায় তার পরদিন সকালেও করেছি…’

গার্গী খেঁকিয়ে ওঠে, ‘মিথ্যেবাদী! ওর ফোন আছে আমাদের কাছে। তোর একটাও মেসেজ নেই সেখানে। মরার আগে নাহয় ও তোর মেসেজ ডিলিট করে গেছে। পরে কি ওর ভূত এসে করেছে?’

গার্গীর কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষা না করেই পকেট থেকে নিজের মোবাইল ফোনটা বের করে অভিষেক। তারপর একটা চ্যাট বক্স বের করে ওর সামনে ফেলে দিয়ে বলে, ‘এই দেখ…’

চ্যাট থ্রেডটা ভালো করে দেখে গার্গী। এবং দেখতেই একটা খটকা লাগে। অভি বলে সেভ করা নম্বরটার হোয়াটসঅ্যাপ প্রোফাইলে ডিসপ্লে পিকচারটা ফুটে আছে। সেটার দিকে ভালো করে তাকায় গার্গী। বিড়বিড় করে বলে, ‘এটা অভিরূপার হোয়াটসঅ্যাপ ডিপি নয়…’

‘এখানেই তো কথা হত…’

দ্রুত প্রোফাইলটা চেক করে গার্গী। এটা অন্য নাম্বার। ও মুখ তুলে বলে, ‘এটা অভিরূপার নাম্বার কবে থেকে?’

‘তা বলতে পারব না। প্রোফাইলটা ক্রিয়েট করেছে মাস পাঁচেক আগে। মানে ওর ব্রেকআপ হওয়ার মাসখানেক পর থেকে। আগে এখানেই ফোন করতাম বেশিরভাগ, অন্য নম্বরটায় বেশি কল করতে ও বারণ করেছিল। এখন এটায় কল করলে সুইচড অফ বলে…’

গার্গীর মাথার ভিতরটা গুলিয়ে যেতে শুরু করেছে, সে বলে, ‘কিন্তু ওর ফোনে দুটো সিম ছিল বলে তো মনে পড়ছে না। তাছাড়া ও যদি তোর সঙ্গে প্রেম করার জন্য অন্য নম্বর নিয়েও থাকে তাহলে সেটা আমাদের থেকে লুকানোর কী আছে? আমরা তো ওর ফোন খুলে চ্যাট দেখতে চাইতাম না।’

‘আমি কিছু জানি না ভাই। তোদের এই ভুলভাল চক্করের মাঝে আমার গাঁড়টি এবার মারা যাবে…’

‘আচ্ছা ও তোকে দিয়ে যে কাজগুলো করাত সেগুলো তোর চ্যাটবক্স ঘাঁটলেই পাওয়া যাবে?’

‘যাওয়ার তো কথা, ও আমাকে সব ডিলিট করতে বলত। কিন্তু আমি করিনি।’

‘গোটা চ্যাটটা ফরওয়ার্ড কর আমাকে উইথ মিডিয়া…’

আরও কিছুক্ষণ মদ খেয়ে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে যায় অভিষেক। গার্গী মন দিয়ে দেখতে থাকে চ্যাটটা। দেখতে দেখতে ভুরু কুঁচকে যায় ওর। বেশ কিছু মানুষের ব্যাপারে খোঁজখবর করেছে অভিরূপা। সহজে সুইসাইডের উপায় জানতে চেয়েছে কখনও, দু-একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট হ্যাকও করতে চেয়েছে। আশ্চর্য! এসব করে লাভ কী হত ওর?

ভালো করে চ্যাটটা পড়তে থাকে গার্গী। হঠাৎই কয়েকটা মেসেজ আর ছবিতে ওর চোখ আটকে যায়। কী আশ্চর্য! অভি হঠাৎ এর ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছে কেন?

গার্গীর মন বলে উত্তরের ভীষণ কাছে এসে পড়েছে ও…

কাকতাড়ুয়া – 13 অধ্যায়

ত্রয়োদশ অধ্যায়

ক’দিন ধরেই মেয়ের আচরণে একটা অদ্ভুত খাপছাড়া ভাব লক্ষ করেছেন কমলিকা। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরেই আগে বিছানায় পড়ে যেত। শরীর এত ক্লান্ত থাকত যে মায়ের সামনে এসে দু’মিনিট বসার সময় থাকত না।

কমলিকা আগে শখ করে মেয়ের জন্য এটা সেটা রান্নাবান্না করতেন। ক্লান্ত শরীরে ও কোনরকমে দুটো মুখে দিয়েই উপরে চলে যেত। কথা বিশেষ বলত না। ধীরে ধীরে কমলিকা নতুন কিছু রান্না করা ছেড়েই দিয়েছিলেন। ওর নিজের খাওয়ার তেমন বাছবিচার নেই। দু’একটা সবজি ফুটিয়ে নিলেই হল।

ইদানীং মেয়েটা অফিস থেকে ফিরে উপর থেকে হাত মুখ ধুয়ে নিচের ঘরে চলে আসে। কমলিকার সঙ্গে বসে এটা সেটা নানান গল্প করে। কতরকম অদ্ভুত প্রশ্ন করে। মায়ের সারাদিনের কাজকর্মে যেন নতুন করে আগ্রহ জেগেছে ওর।

ছোট থেকে ঈশানীকে এরকম কখনো দেখেনি কমলিকা। সে বরাবরই একটু চাপা স্বভাবের। একা একা থাকতেই ভালোবাসে। হঠাৎ করে হল কী মেয়েটার?

আজও সন্ধেবেলা রান্না চাপিয়েছিলেন কমলিকা। দরজার কাছে আওয়াজ হতে ঘুরে দেখলেন ঈশানী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। মুখ ঘুরিয়ে বিরক্ত গলাতেই বললেন, ‘খিদে পেলে কিছু করার নেই। রান্না হতে একটু দেরি আছে…’

ঈশানী এগিয়ে আসে গ্যাসের কাছে, ‘ধুর, কীসব রান্না করো আজকাল। পরোটা খাব।’

শেষ কথাটার মধ্যে একটা আদুরে আবদার মিশে ছিল। কমলিকা অবাকই হন।

‘পরোটা খাবি! এখন?’

‘তাহলে পাঁজিটা নিয়ে এসে সময় দেখি একটা?’

কমলিকা কড়া থেকে মুখ না সরিয়েই বলেন, ‘এখন আবার পরোটা কে করবে? তাছাড়া ডাল ভাত পড়ে আছে…’

‘কাল সকালে খেয়ে নেব।’

কমলিকা এবার সত্যি বিরক্ত হয়। গ্যাসটা কমিয়ে দিয়ে বলে, ‘আমি এখন আর অত খাটতে পারব না। মায়ের বয়স হয়েছে বুঝতে শেখ। খেলে খা, নাহলে খাস না।’

‘তোমাকে করতে বলেছে কে?’ মুখ বাঁকায় ঈশানী, ‘আমিই করে নেব। তোমাকে না দিয়ে খাব।’

দ্বিতীয়বার অবাক হন কমলিকা। ঈশানী আজ অবধি কোনওদিন যেচে পড়ে রান্না করতে চায়নি। হুট করে হল কী মেয়েটার?

‘তুই সত্যি রান্না করবি?’

‘তুমি শিখিয়ে দিলে।’

বিস্মিত হয়ে কৌটো থেকে ময়দা বের করেন কমলিকা। সেটা গামলায় ঢেলে তেল আর জল দিতে সেটা মাখতে শুরু করে ঈশানী। কমলিকা মেয়ের পিঠে একটা হাত রাখেন, ‘তোর কী হয়েছে বল তো? প্রেমে পড়েছিস নাকি?’

উপরে নিচে মাথা নাড়ায় ঈশানী, ‘একটা মেয়ের…’

‘মেয়ের!’ ওর মুখের দিকে তাকান কমলিকা, ‘সে ভালোই করেছিস। এমনিতেও কোনও ছেলে বেশিদিন থাকতে পারবে না তোর সঙ্গে। তোর মনে আছে ছোটবেলায়…’ কথাটা বলেই হেসে থেমে যান কমলিকা, ‘ছোটবেলার কথা বলতে শুরু করলে আর তোকে রান্না শেখানো হবে না।’

‘তুমি বলো না, আমার ভালো লাগে শুনতে।’

কমলিকা আদুরে গলায় বলতে শুরু করেন, ‘ছোটবেলায় তুই মোটাসোটা ছিলি বলে বন্ধুরা রাগাত। তাদের মধ্যে কেউ তোকে বলেছিল মা মোটা হলেই নাকি মেয়ে মোটা হয়। তারপর তোর আমার উপর সে কী রাগ! আমি তখন একটু মোটাসোটাই ছিলাম। শেষে তোকে আমার বিয়ের আগের ছবি বের করে দেখালাম, যে আগে আমি রোগাই ছিলাম। তুই হবার পরে মোটা হয়ে গেছি। সেই প্রথম তুই বলেছিলি যে জীবনেও কোনওদিন বিয়ে করবি না…’

ঈশানী হাসে, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কী? সব খাওয়া ছেড়ে দিলি। এমনকি যে পরোটা খেতে এত ভালোবাসতিস সেটা দেখলেও লালা গিলে নিতিস। আমি ইচ্ছা করে তোকে দেখিয়ে দেখিয়ে পরোটা বানাতাম।

‘শেষে একদিন আর লোভ সামলাতে পারলি না। আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একসঙ্গে ছ’টা পরোটা খেয়ে নিলি ওই বয়সে। খুব তৃপ্তি করে খেয়েছিলি সেদিন…’

কী যেন ভেবে একটু থমকে যান কমলিকা, মেয়ের দিক থেকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলেন, ‘তুই কবে বড় হয়ে গেলি জানিস রুনু?’

‘কবে?’

‘ছোটবেলায় নিজেকে খুব ভালোবাসতিস। কবে থেকে যেন আর বাসলি না। মানুষ যতদিন নিজেকে ভালোবাসতে পারে ততদিনই সে ছোট থাকে…’

ঈশানী কাঁধ ঝাঁকায়, ‘শুধু নিজের কথা ভাবলে তোমাদের খেয়াল রাখতাম কী করে? তোমরা জন্ম দিয়েছিলে, তোমরাই বড় করে দিয়েছ।’

মোক্ষম উত্তরটা কমলিকার ঠোঁটের কাছেই ঘুরঘুর করছিল, ‘বেশ, তাহলে এবার একটা মেয়েকেই না হয় বিয়ে কর। তার ঘাড়ে আমার দায়িত্ব দিয়ে আবার ছোট হয়ে যাবি।’

ঈশানীর হাত থেকে ময়দা ছাড়তে শুরু করেছে, সে ময়দার তালটাকে উলটে দিয়ে বলে, ‘দায়িত্ব অদ্ভুত জিনিস মা। কাউকে দেওয়া যায় না, শুধু নেওয়া যায়।’

মেয়ের মাথায় অনেকদিন পর হাত রাখেন কমলিকা, ‘তাহলে আগে নিজের দায়িত্ব নে।’

হুট করেই চোখ তোলে ঈশানী। চোখের মণিটা ভারি উজ্জ্বল দেখায় ওর। ঠোঁটের পাশে এক চিলতে হাসি খেলে যায়, ‘নিয়েছি, বিশ্বাস করো। তুমি শুধু আমাকে নিয়ে চিন্তা কোরো না।’

কমলিকার আবারও অদ্ভুত লাগে। ঈশানী এমন কথা আগে কোনওদিন বলেনি। নিজের যত্ন নেওয়ার মেয়ে সে কোনওদিন না। চিরকালের অগোছালো, ভবঘুরে, খামখেয়ালি। বাপের মতো খেয়াল স্রোতে ভেসে যাওয়া উড়ন্ত পালকের মতো। হঠাৎ করে হলটা কী মেয়েটার?

ঈশানীর যখন ঘুম ভাঙে তখন রাত দশটা। আজ অফিস থেকে ফিরে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়েছিল। বুঝতে পারে খিদেয় পেট চোঁচোঁ করছে। মুখের উপর হাত চালিয়ে একবার মাকে হাঁক পাড়তে যাচ্ছিল, এমন সময় দরজায় একটা আওয়াজ শুনতে পেয়ে মুখ তুলে তাকায়।

মুখ তুলে দেখে চারু ঢুকছে ঘরে। হাতের প্লেটটা সে নামিয়ে রাখে ঈশানীর সামনে।

খাবারটা হাতে তুলে ঢাকনা খুলেই সে অবাক হয়ে যায়, উৎসাহী গলায় বলে, ‘মা পরোটা বানিয়েছে? আমার দুদিন ধরে খেতে ইচ্ছা করছিল…উফফফ…’

এক টুকরো পরোটা ছিঁড়ে মুখে দেয় ঈশানী। ওর চোখদুটো নিজে থেকেই বন্ধ হয়ে আসে, ‘এই জিনিসটা আমার মা যা বানায় না, কেউ করতে পারে না…’

‘তাই নাকি!’ চারু মুচকি হাসে।

‘তাই না? খেয়ে দেখ…’ জোর করে এক টুকরো পরোটা চারুর মুখে ঢুকিয়ে দেয় ঈশানী। সেটা চিবাতে চিবাতে চারু বলে, ‘ঠিকই আছে। কিন্তু ঠিক মায়ের মতো হয়নি।’

চোখদুটো গোল গোল করে হাত থেকে প্লেটটা নামিয়ে রাখে ঈশানী, ‘এই, এটা তুই বানিয়েছিস? তুই আমার জন্য রান্না শিখলি চারু?’

দুটো হাত দিয়ে ওর গাল টিপে দেয় ঈশানী, ‘তুই পুরো হাসব্যান্ড মেটিরিয়াল, দাঁড়া একটা ভালো মেয়ে দেখে তোর বিয়ের ব্যবস্থা করছি।’

‘তারপর তোকে পরোটা করে দেবে কে?’

ঈশানী হাঁটুর উপর মুখ রেখে ভাবুক গলায় বলে, ‘তোর বউ শালা আমাকে পরোটা খেতে দেবে না দেখছি। আমি তো ওকে তোর কলা খেতে দেব, ও পরোটা খেতে দেবে না কেন?’

মুখটা নিচের দিকে নেমে আসে চারুর। গাল চুলকে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলে, ‘বলবি ছেলের কলা নয়, বাঁশ আছে…’

পরোটা মুখে আটকে বিষম খায় ঈশানী। খ্যাঁকখ্যাঁক করে কেশে ওঠে সজোরে। টেবিলের উপর থেকে জল তুলে ওর সামনে ধরে ওর পিঠে চাপড় মারে চারু।

ঈশানী কোনওরকমে দমক সামলে নিয়ে বলে, ‘দেখ শালা, খাবার সময় এইসব উল্টোপাল্টা হাসাবি না। দম আটকে মরব। আবার যদি হাসিয়েছিস…’

‘কী করবি হাসালে?’

দুহাতে ওর মুখ জড়িয়ে ধরে গালে চুমু খায় ঈশানী। চারু এক ঝটকায় সরে আসে, ‘এই, আমার গালে তেল লাগাচ্ছিস কেন?’

‘তোর চিন্তার কী? পাল্টে দেবো…’ কথাটা বলেই মুখ তোলে ঈশানী, ‘আচ্ছা আমাকে কেমন লাগে তোর?’

চারু একটু ভাবে, কী যেন অনুভব করতে করতে বলে, ‘মদ খেয়ে মনে হয় লিভারটা গেছে। কিছু খেলেই হালকা ব্যথা হয়। কয়েকটা জায়গার লোম কিছুদিন কাটা হয়নি বলে খচখচ করছে, সেক্সুয়াল ডিজায়ারটা একটু বেশি, মাঝে মাঝেই কুটকুটানি বাড়ে, আর…’

হাঁই হাঁই করে ওকে বাধা দেয় ঈশানী, ‘এই চুপ কর শালা। এইসব কে বলতে বলেছে? জিগ্যেস করলাম আমি মানুষ হিসেবে কেমন?’

চারু ওর দিকে স্থির চোখ তুলে তাকায়, ‘তোকে ছাড়া আর কোনও মানুষকে চিনি না আমি।’

‘তো?’

‘চিনতে চাইও না…’ কথাটা বলে চারু হাসে। তারপর হাঁ করে চেয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। ক্লান্ত মুখ থেকে ঘুম মুছে গিয়ে একটা আদুরে স্ফিত ভাব ফুটে উঠেছে সেখানে। সামনে এসে পড়া চুলগুলো নরম স্পর্শে ঘিরে আছে ওকে। ভারি মজা লাগে ওর।

হঠাৎই মুখ তুলে ওর দিকে তাকায় ঈশানী। করুণ মুখে বলে, ‘সত্যি চলে যাবি চারু? থেকে যেতে পারবি না?’

চারু মুখে কিছু বলে না। ওর পায়ের উপর মাথা রেখে শিশুর মতো কুঁকড়ে শুয়ে পড়ে।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মুখে আবার পরোটা ছিঁড়ে ঢুকিয়ে নেয় ঈশানী, ‘রেখে দেব, দেখিস…ঠিক রেখে দেব…’

অন্ধকার রাস্তাটা দিয়ে হেঁটে আসছিল ঈশানী। ওর আশেপাশে কেউ নেই। রাত ক’টা বাজে তা ও জানে না। দূর থেকে একটা হসপিটালের গেট দেখা যাচ্ছে। সমস্ত জায়গাটা ওষুধের গন্ধে ভরে আছে। হাঁটতে হাঁটতে কি তবে হসপিটালের সামনে এসে পড়ল? তাও এত রাতে? মাথার ভিতরে চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে ওর। মাথাটা খামচে ধরে একবার।

হসপিটালের গেটে একটা দারোয়ান বসে স্থির ছবির মতো ঘুমাচ্ছে। একটা মাছি ভনভন করে উড়ে এসে বসছে তার দাড়িতে। এখান থেকে কী করে বাড়ি ফিরবে বুঝতে পারে না ও। কলকাতার রাস্তা তেমন একটা চেনে না।

সাত পাঁচ না ভেবেই ও এগিয়ে যেতে থাকে। মিটার পঞ্চাশেক হেঁটে গিয়ে শেষ হচ্ছে রাস্তাটা। যেখানে শেষ হচ্ছে তার ঠিক আগে একটা আবর্জনার স্তূপ। কারা যেন পুরোনো জিনিস ফেলে দিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে কিছু নোংরা পুঁটলি। হসপিটালের আবর্জনার কাছে গেলেই গা গুলিয়ে ওঠে। তাও পায়ে পায়ে হেঁটে সেদিকে এগিয়ে গেল ঈশানী।

খানিকটা এগোতেই মনে হল স্তূপের ভেতর থেকে একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওই নোংরা পুঁটলিগুলোর আড়ালে বসে কে যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মনের আগ্রহটা বেড়ে ওঠে ঈশানীর। হাঁটার গতি বেড়ে যায় ওর।

কান্নার শব্দ লক্ষ্য করে এগিয়ে যায় ঈশানী। একটু আগের ওষুধের গন্ধটা ভারি অসহ্য লাগে ওর। তাও নাকে চাপা দেয় না।

আর একটু এগোতেই একটা পুঁটুলির আড়ালে একটা বছর পাঁচেকের বাচ্চা মেয়ের মুখ চোখে পড়ে ঈশানীর। অবাক চোখ তুলে তাকায় সে ঈশানীর দিকে।

গন্ধটা হুট করেই কমে যায়। ঈশানী অবাক হয়ে চেয়ে দেখে মেয়েটার হাতে একটা সাদা কাগজ। একটা ভাঙা পেন্সিল দিয়ে তার উপরে কিছু একটা আঁকার চেষ্টা করছে সে। আর আঁকতে আঁকতে অকারণেই ফুঁপিয়ে কাঁদছে। এমন ফুটফুটে মিষ্টি একটা বাচ্চাকে রেখে দিয়ে গেল এখানে?

ঈশানী ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়, ‘নাম কী রে তোর?’

‘রুনু…’ মেয়েটা ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নাক মুছে বলে।

‘তোকে কে রেখে গেছে এখানে?’

মেয়েটা ঠোঁট উল্টায়। তারপর কান্না থামিয়ে ওর দিকে দুটো হাত বাড়িয়ে দেয়, ‘তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? তোমার সঙ্গে?’

মেয়েটার চারপাশে তাকাতেই ঈশানীর চোখের মণি থমকে যায়। যে জিনিসগুলো পাশে পড়ে আছে সেগুলো ও চেনে। একটা উলের টুপি, একটা ভাঙা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট টিভি, একটা ফাঁকা পাখির খাঁচা…এগুলো সব ওর নিজের…

বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা আবার নামিয়ে নেয় ঈশানী, অদ্ভুত নরম হাসি খেলে যায় ওর ঠোঁটে, বাচ্চাটার মাথায় হাত রাখে ও, ‘তোকে কোথায় নিয়ে যাই বল তো? তুই কাকে সব থেকে বেশি ভালোবাসিস?’

‘মাকে…’

ঈশানী পরিচিত হাসিটা হাসে, ‘আমিও। কিন্তু তোকে পেয়ে মা ভালো থাকবে না…কেউ ভালো থাকবে না। তুই যত বড় হবি, তত কষ্ট পাবে সবাই…’

‘তাহলে তোমার কাছে…’

ঈশানী হাসে, ‘আমারও যে থাকার জায়গা নেই রে…’

পাশে পড়ে থাকা একটা কাগজ তুলে নিয়ে ভারি আদুরে গলায় রুনু বলে, ‘আমাকে নিয়ে যাও, আমি ভাল্লুক আঁকতে পারি। তোমাকে এঁকে দেব।’

এগিয়ে ধরা ছবিটা হাতে নিয়ে পরম মমতায় তার উপরে হাত বোলায় ঈশানী। চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে ওর।

‘আমাকে তুমি নিয়ে যাবে না?’

দুপাশে মাথা নাড়ায় ঈশানী।

‘আমি এখানে থাকলে তো মরে যাব একটু একটু করে…’

ঈশানী আর তাকায় না ওর দিকে। মেয়েটা তেমনই গোল গোল চোখ তুলে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। ঈশানী বুঝতে পারে পেছন থেকে মুছে যাচ্ছে ওর আঁকার খাতা, ওর পরিচিত মানুষ, ওর বাড়িতে পরা জামা, ওর জ্যামিতি বক্স, বিস্কুটের কৌটো, সেফটিপিন দিয়ে আঁটা স্কুলের ব্যাচ…

‘দিদি…’ পেছন থেকে শেষবারের মতো ডাকে মেয়েটা। ঈশানী থমকে দাঁড়ায়। কিন্তু পেছন ফিরে তাকায় না। পেছন থেকে মিলিয়ে আসা গলা শোনা যায়, ‘তোমার আমাকে এখানে ফেলে যেতে কষ্ট হচ্ছে না দিদি? আমি কিন্তু আর তোমাকে ভাল্লুক এঁকে দেব না…’

শব্দগুলো প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ওর কানে। ঈশানী চোখ বন্ধ করে নেয়।

বিকেল থেকেই ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। অফিসে থাকলে বৃষ্টি পড়ছে কিনা বোঝা যায় না। বিকেলে বাইরে বেরোতেই বুকটা ধক করে ওঠে ঈশানীর। আজ কাকতাড়ুয়াটাকে শেডের তলায় ঢাকা দিয়ে রাখা হয়নি। একটা দুশ্চিন্তা দলা পাকিয়ে ওঠে ঈশানীর বুকের মাঝে। ছটফট করেই কেটে যায় বাকি সময়টা। বাড়ি ফিরে সবার আগে ছুটেছিল ছাদে। একটা চাদর দিয়ে কাকতাড়ুয়ার আগাপাস্তলা ঢেকে তবে শান্তি।

তারপর অনেকক্ষণ বসে চুপচাপ গল্প করেছে ওর সঙ্গে। মনের খেয়ালে কত রকম ছবি এঁকেছে ওর মুখে। সাজিয়েছে ইচ্ছামতো। ওর ভালো লাগে এই চারুকে সাজাতে। ও যখন কথা বলতে পারে না, ওর সঙ্গে কথা বলে যেতে ভালো লাগে। সব কথা মন খুলে বলা যায় ওকে।

আকাশের দিকে চেয়ে ঈশানী বুঝতে পারে আজ রাতে আর কোথাও বেরোনো হবে না। তাছাড়া মাঝেমধ্যে পাশের বাড়ির ছাদে লোকজন ওঠে। তারা কারোর সঙ্গে ওকে কথা বলতে দেখলে সন্দেহ করতে পারে।

ছাদে বসে কাকতাড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল ঈশানী। ঘুমের মধ্যে মনে হয় স্বপ্নও দেখছিল একটা। সেটা দেখতে দেখতেই ভেঙে গেছে ঘুমটা। ঈশানী উঠে এসে কাকতাড়ুয়ার পাশে দাঁড়ায়। বৃষ্টির সঙ্গে বয়ে আসা হাওয়াতে ওর গায়ের চাদর সরে গেছে। সেটা আবার ভালো করে জড়িয়ে দেয় গায়ে। কালচে মাটির শরীরে আদর করে হাত বুলিয়ে দেয়।

‘সারাদিন কষ্ট হয় না আমাকে ছাড়া?’ নিজের মনেই বিড়বিড় করে জিগ্যেস করে, ‘কী করব বল, চাকরিটা ছেড়ে দিতে ইচ্ছা করে, কিন্তু…’

ছাদের সিঁড়ির কাছ থেকে একটা পায়ের আওয়াজ পেয়ে ও মুখ ফিরিয়ে তাকায়। সরে এসে ভালো করে উঁকি মারতে দেখে মা উঠে এসেছে ছাদে। একটু অবাক হয় ঈশানী।

সময় তখন এগারোটার কাছাকাছি। এ সময় মায়ের ছাদে আসাটা মোটেই স্বাভাবিক নয়। বাতের ব্যথায় শেষ কয়েক মাসে মা হাতে গুনে দু-দিনবার ছাদে এসেছে।

সেদিকে এগিয়ে গিয়ে ঈশানী বিরক্ত গলায় বলে, ‘একী! তুমি ঘুমাওনি এখনও? আমাকে যে বললে এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বে?’

‘ঘুম আসছে না।’ সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরিয়ে আসতে আসতে কমলিকা বলেন।

‘তাহলে অন্তত চিৎকার করে ডাকতে তো পারো!’

কমলিকা বড় করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের হাঁটু চেপে ধরে বলেন, ‘তোকে ডাকতে আসিনি। নিজেই এসেছি ছাদে…’

আর একটু বেশি অবাক হয় ঈশানী, ‘তুমি হঠাৎ ছাদে…’

‘আজকাল বেশির ভাগ সময় তুই ছাদেই কাটাস। দেখতে এলাম কী করিস একা একা…আমাকে নিয়ে চিরকাল অভিযোগ ছিল তোর, মা সবকিছুতে ফোঁপরদালালি করে…’

কমলিকার ঠান্ডা লাগার ধাত আছে। টিপটিপে বৃষ্টিতে ভিজলে আর দেখতে হবে না। ঈশানী ধরে ধরে মাকে এনে শেডের তলার বেঞ্চে বসায়। হাত দিয়ে পরিষ্কার করে দেয় বেঞ্চটা। নিজে দাঁড়ায় পাশে। ওর আর কাকতাড়ুয়ার মাঝে বসেছেন।

কাকতাড়ুয়ার দিকে একবার তাকান কমলিকা, ‘হঠাৎ এই অনামুখোটার গায়ে চাদর চাপিয়েছিস কেন?’

ঈশানী একটা বাঁকা হাসি হাসে, ‘সারাজীবন তো কারো যত্ন নিতে পারলাম না, অগত্যা কাকতাড়ুয়াটাকে দিয়েই একটু টেস্ট করে দেখি পারি কিনা…’

‘ঠিক বয়সে বিয়ে না হলে মেয়েদের মাথায় এমন অনেক খেয়াল চাপে…’ কালো হাঁড়িটার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন কমলিকা। হাঁটুর ব্যথাটা বেড়েছে। ছাদে এসে তো পড়েছেন, নামবেন কীকরে নিজেও জানেন না। তার উপরে এই টিপটিপে শীতের বৃষ্টি।

ঈশানী বুঝতে পারে আবার ছলেবলে বিয়ের প্রসঙ্গ আনতে চাইছে মা। বুলিমাসি মনে হয় আবার নতুন সম্বন্ধ এনেছে। সে বিরক্তিকর প্রসঙ্গটা বদলে ফেলতেই বলে, ‘কাল আমি রাতে বাড়ি থাকব না…’

‘কোথায় যাবি?’

‘অভির কেসটার ব্যাপারে মুর্শিদাবাদে যেতে হবে, থানা থেকে ডেকেছে। গেলে ফেরাটা চাপ হয়ে যাবে।’

‘একা যাবি?’

‘না, সঙ্গে অফিসের একটা বান্ধবি যাবে।’

‘বেশ, যাস…’ নিঃস্পৃহ গলায় কথাটা বলে দূরের দিকে চেয়ে তেমনই ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে থাকেন কমলিকা।

‘ছোটবেলায় তিনজনেই ছাদে আসতাম, মনে আছে তোমার মা?’ ঈশানী বৃষ্টির ধারার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বলে।

‘তুমি, আমি আর বাবা। আমি বাবার কোল থেকে নামতেই চাইতাম না…’

কমলিকা ছাদের পাঁচিলে হেলান দেন, পায়ে হাত ঘষতে ঘষতে বলেন, ‘ছোটবেলায় তুই ওইরকম ছিলিস। কারো কোলে উঠতে পারলে আর নামতে চাইতিস না।’

ঈশানী হাসে, ‘তাই আর কেউ কোলে নিতেই চায়নি কোনওদিন। তাই না মা?’

‘না না, তা কেন? তোর বাবা অনেক বড় বয়স অবধি কোলে নিয়েছে তোকে। তারপর তুই বড় হয়ে গেলি। তখনও জেদ করতিস। কিন্তু বাবার গায়ে আর জোর ছিল না। যতদিন পেরেছে কোলে করে ছাদে নিয়ে এসেছে…’ কমলিকার গলা শান্ত হয়ে আসে, ‘ওর জীবনের ওই একটাই শখ ছিল। সন্ধ্যা হলেই মেয়েকে ছাদে নিয়ে বসে থাকা আর হাবিজাবি গল্প শোনানো…’

‘তোমার কি হিংসা হয়? তোমাকে নিয়ে আসত না বলে?’

‘নাহ, আফসোস হয়। পয়সাকড়ি রোজগার করার শখটা যদি থাকত আজ আমাদের এই অবস্থা হত না।’

কয়েক সেকেন্ড থম হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঈশানী, তারপর জিগ্যেস করে, ‘তোমার আফসোস হয় না, বাবার মতো একটা লোককে বিয়ে করার জন্য?’

ঘাড় নাড়ায় কমলিকা, ‘হবে না কেন? রোজ হয়। কলকাতা শহরের বড়বাড়ির মেয়ে ছিলাম। এখন এই সাতভূতের বাড়িতে একা একা পড়ে আছি…’

ঈশানীর মুখে বাঁকা হাসিটা খেলে যায়। উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে সে বলে, ‘বাবাকে শেষবার যখন নিয়ে যাচ্ছিলাম তখন তুমি বাবার মুখ দেখতে চাওনি। শুধু একবার গলা তুলে বলেছিলে—আমাকেও তাড়াতাড়ি নিয়ে যেও। তখন খুব কষ্ট হয়েছিল, এখন ভাবলে মাঝে মাঝে খুব হিংসা হয় জানো…’

‘কীসের হিংসা?’

‘মনে হয়, আমি কাউকে এমন করে ভালোবাসতে পারব না কোনওদিন।’

‘হিংসা তো আমারও হয় তোকে…’

‘আমাকে! কীসের জন্য?’

‘তোর বাবার মরা মুখটা দেখতে পেরেছিলি। চুল্লিতে ঢোকানোর আগে একবার পা’টা ছুঁয়ে দেখতে পেরেছিলি।’

‘কী লাভ হয়েছে তাতে? পা হাত সব ঠান্ডা হয়ে ছিল…’

‘লাভ লোকসান জানি না…তিরিশ বছর আগে কথা দিয়েছিলাম জীবনে সব অবস্থায় থাকব। পার্টি হেরে গিয়ে আবার নিষিদ্ধ হয়ে গেলেও থাকব, যা দুপয়সার চাকরি করে সংসার চলত সেটা চলে গেলেও থাকব, অসুস্থ হয়ে হেগেমুতে রেখে দিলেও থাকব। সবেতেই থাকলাম, শুধু যে শরীরটাকে ছেড়ে রেখে গেল সেটাকে পুড়িয়ে শেষ করে দেওয়ার সময় থাকতে পারলাম না…’

ঈশানী চুপ করে থাকে। টপটপ বৃষ্টির জলের আওয়াজ আসছে শেডের উপর থেকে। ঠান্ডা হওয়ার ঝাপটা এসে ওদের ঘিরে বইছে মাঝে মাঝে, তারপর আবার হারিয়ে যাচ্ছে দূরে।

‘তবে এখন আর এটা ভেবে আফসোস হয় না…’

‘কেন?’

‘ওই যে, তুই ছিলিস বাবার মুখাগ্নির সময়। এমন একটা মেয়ে তৈরি করে দিয়েছি তোর বাবাকে। ওইটাই আমার থাকা…’

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে ঈশানী। তারপর হুট করে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসে, ‘তোমার আমার উপর ভীষণ রাগ, তাই না মা?’

উপরে নিচে মাথা নাড়ান কমলিকা, ‘আজকের নয়। অনেক পুরোনো রাগ। ছোট থেকে তুই একদম তোর বাবার মতো। যেদিন হসপিটালে বেডে প্রথম জানতে পেরেছিলাম যে আমার মেয়ে হয়েছে, খুব খুশি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোকে একদম আমার মতো করে বড় করব। আমি যা যা পারিনি তুই পারবি, আমি যা যা বুঝিনি তুই বুঝবি। কিন্তু তুই হলি বাবার মতো। কবে যেন আমার থেকে তোকে কেড়ে নিল…তুই আমার থেকে বাবাকে বেশি ভালোবাসলি…’

ঈশানী মুখের সামনে এসে পড়া চুলগুলো কানের পেছনে ঠেলে দেয়, ‘তোমরা কোনওদিন আমাকে বুঝতে দাওনি তোমরা দুটো আলাদা টিমে খেলছ। তাই আমাকে কোনওদিন দল বেছে নিতে হয়নি।’

কমলিকা নিজের মনেই হাসে, ‘তোর বাবা দেড়হাজার টাকা মাইনে পেত। আমাদের আলাদা টিমে খেলার উপায় ছিল না রুনু…’

বৃষ্টির বেগ বেড়েছে এতক্ষণে। দূরের দৃশ্য ঝাপসা হয়ে যায় তাতে। পাশের বাড়ির ছাদ, টেলিফোনের টাওয়ার, অন্ধকারে কোথায় হারিয়ে গিয়ে শুধু জলের চাদর জেগে থাকে ওদের চোখের সামনে।

হুট করেই ঈশানীর হাতটা চেপে ধরেন কমলিকা, ‘তুই আমাকে ক্ষমা করে দে রুনু…’

ঈশানী অস্বস্তিতে পড়ে। হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চায় সে, ‘আমি! ক্ষমা! কী বলছ, কিছুই বুঝছি না…’

‘তুই এত তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেলি, এত শক্ত হয়ে গেলি, আমি কোনওদিন চেষ্টাও করে দেখলাম না—তোকে এখনও কোলে নেওয়া যায় কিনা…এমন করে চোখের জল লুকাতে শিখে গেলি যে ভেবেই দেখলাম না এখনও মুছিয়ে দিতে হয় কিনা…আমি তোর ভালো মা হতে পারিনি রুনু…তুই আমাকে ক্ষমা করে দে…’

মায়ের মাথাটা নিজের বুকে টেনে নেয় ঈশানী। ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। ওর গলাতেও বাষ্প এসে জমা হয়। বৃষ্টির শব্দে মিশে কয়েকটা ছেঁড়া ছেঁড়া শব্দ ছড়িয়ে পড়ে শেডের তলার জমাট হাওয়ায়, ‘আমি তো শুধু এটুকু বোঝাতে চেয়েছিলাম মা, যে আমি আর তুমি দুটো ভুল মানুষ হতে পারি, কিন্তু আমাদের আর কেউ নেই…তুমি শুধু ভুলটাই দেখে গেলে, কখনও তোমার কখনও আমার…’

দুহাতে মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেয় ঈশানী, তারপর আবার শক্ত করে বুকের মধ্যে চেপে ধরে। কমলিকার কান্না ভেজা গলা শোনা যায়, ‘বুলি আবার একটা ছেলের কথা বলছিল। আমি দূর দূর করে ভাগিয়ে দিয়েছি।’

ঈশানী হেসে ফেলে। এক ফাঁকে নিজের চোখের জলটা মুছে নেয়। মনটা হালকা হয়ে যায় ওর।

‘তোর কাউকে ভালো লেগেছে, নারে রুনু?’ হুট করে মুখ না তুলেই প্রশ্ন করেন কমলিকা।

আচমকা প্রশ্নে একটু থতমত খেয়ে যায় ঈশানী, ‘তোমাকে কে বলেছে এসব?’

‘তোর অনেক কথাই জানি আমি…’

বুকের ভিতরটা ঠান্ডা হয়ে যায় ঈশানীর। থমথমে গলায় সে বলে, ‘যেমন?’

‘যেমন মাঝে মাঝেই গভীর রাতে তুই আমার পাশে শুয়ে পড়িস। মাথায় হাত দিয়ে দেখিস জ্বর এসেছে কিনা, শরীর খারাপ হয়েছে কিনা। তারপর বিড়বিড় করে কত কথা বলিস, কত গল্প করিস, ভাবিস মা ঘুমিয়ে পড়েছে…’

‘আমি?’ ঈশানী অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকায়। কয়েক সেকেন্ড সেভাবে তাকিয়ে থেকেই ওর দৃষ্টি ঘুরে যায় কাকতাড়ুয়াটার দিকে।

‘তুই পাশে এসে শুলে আমার ভারি নিশ্চিন্ত লাগে…তোর বকবক শুনতে শুনতেই কখন যেন ঘুম এসে যায়…’

ছাদের মেঝেতে জল জমেছে। বৃষ্টির ফোঁটা তার উপর পড়ে ছিটকে এসে লাগছে হাঁড়ির মুখে। কয়েক সেকেন্ড সেদিকে তাকিয়ে থেকে আবার চোখ ফিরিয়ে নেয় ঈশানী, নরম গলাতেই বলে, ‘আচ্ছা মা, যদি কোনওদিন জানতে পারো আমি এর কিছুই ছিলাম না। তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, যত্ন নেওয়া, সঙ্গ দেওয়া, এসবের কিছুই আমি করিনি, আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাহলে আমাকে কম ভালোবাসবে?’

কমলিকা মেয়ের কোলে মাথা রেখে প্রায় শুয়ে পড়েন, ‘তোদের বয়সের ছেলেমেয়েরা এইটাই ভুল করিস। তোরা জানিস না, বাবা-মা ছেলেমেয়েদের একবারই ভালোবাসে। যখন তাদের প্রথম দেখে, তখন। তারপর বড় হতে হতে কেউ ভালো হয়, কেউ খারাপ, কেউ মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করে, কেউ বখে যায়, তার সঙ্গে ভালোবাসার কোনও সম্পর্ক নেই। পৃথিবীর অন্য সব সম্পর্কে মানুষকে পরীক্ষা দিতে হয়। বারবার পাশ করতে হয়। তার নম্বর বাড়ে কমে। শুধু মা-বাবার কাছে ছেলেমেয়েরা শত চেয়েও অন্য কিছু হতে পারে না…’

ঈশানীর মাথাটা কমলিকার গালের উপর নেমে আসে। চোখের জলটা ঢেকে ফেলে ও।

‘আমার খুব আফসোস হয়, জানো মা? আমি বাবার জন্য কিছু করতে পারিনি। জানি না জীবনে কত টাকা-পয়সা রোজগার করব, কী হবে না হবে। কিন্তু আর যাই করি না কেন আমি আর আমার বাবাকে বাটিকের পাঞ্জাবি কিনে দিতে পারব না, আরও কয়েকটা কেমো ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থা করতে পারব না, বাবার পার্টিকে আবার ক্ষমতায় এনে দেখিয়ে দিতে পারব না। তুমি আমাকে আর একটু আগে থেকে কেন ভয় দেখালে না মা?’

কমলিকার শরীর জুড়ে ক্লান্তি নামে। চোখ বুজে আসতে থাকে তার, তার মধ্যেই বলেন, ‘আমি ওই লোকটার সঙ্গে তিরিশ বছর ঘর করেছি। তোর থেকে ঢের ভালো চিনি ওকে। রোজ সকালে উঠে আর ঘুমাতে যাওয়ার সময় তোর হাসি মুখটা দেখতে পেলে ওসব আদর্শ ফাদর্স জলের দরে বিকিয়ে দিত…’

ঈশানী আর কিছু বলে না। ওদের ঠিক পাশে দুটো হাত দুদিকে ছড়িয়ে নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কাকতাড়ুয়াটা। যেন রক্ষা করে দুটো ভাঙাচোরা মানুষকে। বৃষ্টির শব্দ বেড়ে ওঠে…

কাকতাড়ুয়া – 14 অধ্যায়

চতুর্দশ অধ্যায়

উত্তর কলকাতার স্কুল থেকে কার্টুনিস্ট খুঁজে বের করার ব্যাপারটা যতটা সহজ মনে হয়েছিল ততটা হয়নি। কে কবে কোন প্রাক্তনী ভালো ছবি আঁকতে পারত সেটা স্কুল অথরিটি বলতে পারেনি। কয়েকজনের নাম তারা বলেছিল বটে, কিন্তু তারা কেউই উত্তর কলকাতার আশেপাশে থাকে না।

অগত্যা দিনকতক হল রাতবিরেতে বাইক নিয়ে এলাকাটায় টহল দিচ্ছেন অনির্বাণ। রাত মোটামুটি এগারোটার পরে সন্দেহজনক লোকজনকে স্কুটি নিয়ে যেতে দেখলেই ফলো করছেন কিছুদূর। এই ক’দিন সেটা করে কিছু লাভ হয়নি। আজ একটু হতাশ হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। এত সুন্দর একটা লিড পেয়েও ধরতে পারবেন না!

বাগবাজারের মোড় পার করে একটা কচুরির দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালেন অনির্বাণ। কাল রাতে একেবারে টিপু সুলতান মসজিদের গায়ে কার্টুন এঁকে গেছে কেউ। দু-একজন লোক নাকি দুটো ছেলেমেয়েকে ছবি আঁকতে দেখেওছে। কিন্তু তাদের মুখ ঢাকা ছিল বলে চিনতে পারেনি। তারা হইহই করে তেড়ে আসতেই একটা দাঁড় করিয়ে রাখা স্কুটিতে উঠে চম্পট দিয়েছে দুজনে।

এতদিন তেমন আমল না দিলেও এখন নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। দেশের যা পরিস্থিতি, কোথাকার জল কোথায় গড়ায় ঠিক নেই। দুম করে কাদা ছোড়াছুঁড়ি করে একটা দাঙ্গা শুরু হয়ে যেতে পারে। ছেলেমেয়ে দুটোকে গোরুখোঁজা খুঁজতে শুরু করেছে পুলিশ।

অনির্বাণ আজ কলেজ স্ট্রিটে এসেছিলেন একটা বইয়ের রয়াল্টির চেক নিতে। প্রকাশনের অফিসে বসে গল্প করতে করতে বেলা হয়ে গেছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে সোজা চলে এসেছেন বাগবাজার। এখানে এলেই পটলার কচুরির গন্ধে গন্ধে এদিকে চলে আসেন।

কচুরির ভিতর আলুর তরকারি পুরে মুখে সবে চালান করতে যাবেন এমন সময় একটা অল্পবয়সি ছেলে হুড়মুড়িয়ে প্রায় ওর গায়ের উপরে এসে পড়ল। আর একটু হলে গরম তরকারি ছলকে পড়ছিল ওর গায়ে, কোনরকমে সামলে নিলেন অনির্বাণ।

‘ইয়ে স্যার! আপনি!’ ছেলেটা হাঁ করে তাকাল ওর মুখের দিকে।

অনির্বাণ একটু থতমত খেলেন, ‘কে তুমি?’

‘স্যার আমি আপনার অনেক বই পড়েছি। সেই যে প্রাচীন ভারতের যৌনজীবন নিয়ে যেটা লিখেছিলেন, তারপর রবীন্দ্রনাথের জীবনের নারী নিয়ে যেটা…’

চারপাশটা একবার দেখে নিলেন অনির্বাণ, একটু ধমকের সুরে বললেন, ‘আঃ, হয়েছে সেসব। তোমার চাইটা কী?’

‘অনেকদিন কচুরি খাইনি, আপনি যদি খাওয়ান আপনাকে একটা দরকারি ইনফরমেশন দেব আমি।’

অনির্বাণের হাতটা নিজে থেকেই আবার শালপাতার উপরে নেমে আসে। হাঁক পেড়ে আর এক প্লেট কচুরির অর্ডার দেন তিনি। তারপর জিগ্যেস করেন, ‘কী ইনফরমেশন?’

ছেলেটা একটু কাছে সরে এসে ফিসফিসে স্বরে বলে, ‘আজ রাতে ওরা কোথায় ছবি আঁকবে আমি জানি।’

‘তাই নাকি? তা তুমি কী করে জানলে?’

‘কারণ আমি ওদের একজন স্যার…’

ছেলেটার মুখের দিকে ভালো করে তাকালেন অনির্বাণ। ভরদুপুরে ইয়ার্কি করতে এসেছে নাকি। অবিশ্বাসের গলায় বলেন, ‘এতটা বোকা তোমরা নও মনে হয়। এই যে আমি তোমাকে চিনে গেলাম এবার যদি পুলিশে ধরিয়ে দিই? বিশেষ করে কাল রাতে যা করেছ তোমরা তারপর পুলিশ তোমাদের চুঙ্কুমুনু করে ছেড়ে দেবে বলে তো মনে হয় না।’

‘কী এমন করলাম?’ তেমন হাসি মুখেই জিগ্যেস করে ছেলেটা।

‘মসজিদের গায়ে ছবি এঁকে কী প্রমাণ করতে চাও? এবার যদি ওই ছবির জন্য হুট করে একটা দাঙ্গা লেগে যায় তার সমাধান আছে তোমাদের কাছে?’

‘এরোসল পেন্ট রিমুভার…’ বলে ছেলেটা কচুরিতে কামড় বসায়। চাকুম চুকুম করে চিবানোর আওয়াজ শোনা যায়।

‘মানে?’

‘মানে আমাদের আঁকা কার্টুন পেন্ট রিমুভার দিলেই উঠে যাবে। কিন্তু মানুষের বিরুদ্ধে মানুষকে খেপিয়ে তোলা এই ধর্মগুলোকে কী করে তুলে ফেলবেন স্যার?’

অনির্বাণ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন ছেলেটা হুট করে একটা প্রশ্ন করে বসে, ‘ইয়ে, ধর্মের কথায় মনে পড়ল স্যার। আপনি নেফথিসের ব্যাপারে কিছু জানাতে পারবেন?’

আচমকা প্রশ্নটার জন্য তৈরি ছিলেন না অনির্বাণ। কচুরির প্লেটটা শেষ করে সে ডাস্টবিনের মধ্যে ফেলে দেন। তারপর বলেন, ‘সে তো ইজিপ্টের একজন দেবী।’

ছেলেটা আগ্রহে ঘাড় নাড়ে, ‘হ্যাঁ, আপনি দু’বছর আগে একটা বই লিখেছিলেন। ইজিপ্টের দেবতা ও তাদের মিথ। ভালোমতো পড়াশোনা করে লিখেছিলেন বোঝা যায়, কিন্তু তেমন একটা চলেনি। তো সেখানেই আপনি নেফথিসের কথা লিখেছিলেন। তবে বড্ড অল্পের উপর লিখে বেরিয়ে গেছেন। গোটাটা যদি আমাকে বলতেন…’

পাশেই একটা সিমেন্টের বেঞ্চের উপর এসে বসে পড়ে ওরা দুজন। ছেলেটা এর মধ্যে আরও গোটাচারেক কচুরি সাঁটিয়ে দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে ভীষণ খিদে পেয়েছিল তার।

ওর খাবার দিকে কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকেন অনির্বাণ। ছেলেটা সেটা লক্ষ করেই মিষ্টি করে একগাল হেসে বলে, ‘এত খাচ্ছি দেখে অবাক হচ্ছেন, না? আসলে খেলেও গায়ে লাগে না তো, তাই ইচ্ছামতো খেয়ে যাই। শরীরটা তো বেশিক্ষণের নয়…’

‘মানে?’

‘আপনি নেফথিসের কথা বলুন। কে ছিলেন ভদ্রমহিলা?’

অনির্বাণ একটা সিগারেট ধরান। সামনে ব্যস্ত রাস্তা। চতুর্দিকে কলকাতা শহরের কোলাহল। তার মধ্যে এ কথাগুলো বলতেও কেমন জিভ আটকে যায়।

‘ইজিপ্টের ছদ্মবেশের দেবী ছিলেন নেফথিস। মানুষ মরে গেলে তার শরীরের মধ্যে যে বদলগুলো আসে সেগুলো নাকি তিনিই পরিচালনা করেন। ইজিপ্টের অন্য দেবতাদের নিয়ে লেখালিখি হয়, কেবল নেফথিস একটু অবহেলিত থেকে যান। সে কারণেই আমি একটু ভালোরকম পড়াশোনা করেছিলাম। সেটা করতে গিয়েই জানতে পারি নেফথিসকে নিয়ে একটা মিথ চালু আছে। সে মিথ একাধিক পিরামিডের গায়ে ছবি দিয়ে লিখে রেখেছিল ইজিপশিয়ানরা। খুব একটা জনপ্রিয় নয়, তবে আমার খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল গল্পখানা…’

‘কী রকম গল্প?’

‘স্বর্গের বড় দেবতা আমুন-রা একদিন মানুষের উপরে খুশি হয়ে ভারি বিচিত্র এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেললেন। তিনি স্বর্গের দরজা উন্মুক্ত করে দিলেন। কাতারে কাতারে মর্ত্যের মানুষ স্বর্গে ঢুকে পড়তে লাগল। এটা ভাঙল, ওটা ছুড়ল, সাজানো বাগান তছনছ করে দিল। সমস্ত কিছু নষ্ট করার পর তাদের চোখ গিয়ে পড়ল স্বর্গের নিচুতলায় থাকা বারোজন দুর্বল অন্ধকারের দেবতাদের উপর। তাদের ক্ষমতা় খুব একটা আহামরি কিছু ছিল না। কিন্তু তাও দেবতা তো। মানুষ গিয়ে সেই দেবতাদের আক্রমণ করল। আচড়ে কামড়ে শাবল দিয়ে গেঁথে রক্তাক্ত করে দিল তাদের। সেই দুর্বল দেবতাদের তখন প্রাণ যায় যায়।

‘তাই দেখে মানুষ হইহই করে এটা বিশ্বাস করতে শুরু করল যে দেবতারাও একেবারে অজর অমর অক্ষয় নয়। তাঁদের মৃত্যু আছে, আক্রমণ করলে তাঁরাও ধ্বংসও হবে।

‘দেবতারা পড়লেন বিপদে। মানুষের মনে যদি এই ধারণা জন্মায় যে ঈশ্বরও তাদের মতো নশ্বর তাহলে কোনওদিন হয়তো স্বর্গ জয় করে ফেলবে তারা। এ অবস্থায় দেবতারা শরণাপন্ন হল নেফথিসের। নেফথিস আর উপায় না দেখে তাঁর উপাস্য দেবতার মূর্তি ভেঙে বারো ভাগ করে সেই বারো খণ্ড মাটি দিয়ে বারোটা হাঁড়ি তৈরি করলেন।’

‘হাঁড়ি?’

‘হ্যাঁ। তার জাদু বলে সেই হাঁড়ির উপর যারই মুখ ভাবতে ভাবতে আঁকা হবে সে-ই স’শরীরে হাজির হবে। দেবতারা সেই বারোটা হাঁড়িতে বারোজন দেবতার মুখ এঁকে দিলেন। মানুষও দেখল এত মারধোর করে যে দেবতাদের তারা আধমরা করে দিল তারা একেবারে বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন…

‘সে যাত্রা কোনওরকমে বাঁচলেও পরে ওই দেবতারা সেরে উঠলে তাদের বডি ডাবলের আর দরকার রইল না। ফলে হাঁড়িগুলোকে আবার নেফথিসের কাছে ফেরত দিয়ে দেওয়া হল। নেফথিস বুঝলেন এ হাঁড়ির যা ক্ষমতা তাতে ওগুলো হাতে পেলে যে কেউ আমুন-রা সেজে স্বর্গ শাসন করতে পারবে। ফলে তিনি হাঁড়িগুলো ধ্বংস করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু শোনা যায় সব হাঁড়িগুলো নাকি ধ্বংস হয়নি। স্বর্গ থেকে ফেরত আসার সময় মানুষের মধ্যে কেউ কেউ নাকি সেই হাঁড়ির খোঁজ পেয়ে সেগুলো চুরি করে এনেছিল…’

একটু থেমে জল খেয়ে আবার বলেন অনির্বাণ, ‘এমনকী নেফথিসের ছবিতেও দেখতে পাবে তাঁর মাথার উপর একটা বিশেষ লম্বাটে আকৃতির হাঁড়ি আঁকা হয়। কথিত আছে যেহেতু নেফথিস তাঁর নিজের উপাস্য দেবতার শরীরের মাটি দিয়ে এই হাঁড়িগুলো বানিয়েছিলেন তাই এদের মধ্যেও ঈশ্বরের অংশ আছে। এগুলোও এক একটা দেবমূর্তি। এদের সামনে অসহায় হয়ে মন থেকে কিছু চাইলে ইচ্ছাপূরণ হয়…তাছাড়া…’ স্মৃতি হাতড়ান অনির্বাণ, ‘আরও কিছু লেখা ছিল। কিন্তু আমার এখন মনে পড়ছে না…’

বাগবাজার মোড়ের বেঞ্চে বসে কিছুক্ষণ পাথরের মূর্তির মতো থম হয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে ছেলেটা, তারপর বলে, ‘বাপ রে! এ তো ভয়ঙ্কর গল্প!’

মুচকি হেসে ছেলেটার দিকে তাকান অনির্বাণ, ‘এই যে তুমি এতক্ষণ কার্টুনের কথা বলছিলে, আধুনিক কার্টুন বলতে আমরা যা বুঝি তার সব কিছুই শুরু হয়েছে প্রাচীন ইজিপ্টে। মানুষের শরীরে শেয়ালের মাথা, অর্ধেক সিংহ অর্ধেক মানুষ, সুকুমার রায়ের ঢের আগে এসব ইজিপশিয়ানরাই তৈরি করে গেছিল। কিন্তু তোমাদের সঙ্গে এসবের সম্পর্ক কী?’

কচুরির প্লেটটা ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ছেলেটা। তারপর জলের জগটা নিয়ে এসে হাত ধুতে ধুতে বলে, ‘সব এখন শুনে নিলে কী করে হবে? আজ রাতে কাউকে নিয়ে প্রিন্সেপ ঘাটে আসুন। দেখা হবে…’

‘ছোটবেলায় আমাদের ইতিহাসের স্যার একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন—রাজাদের শুধু মৃত্যুদিন মনে রাখতে হয়। জন্মদিন মনে না রাখলেও চলে। পরে বড় হতে হতে খেয়াল করেছি ব্যাপারটা। কোন রাজা কবে জন্মেছেন বইতে লেখা থাকত না। কিন্তু মৃত্যুর সালটা পরীক্ষায় আসত…’

আজ সকাল হতেই বেরিয়ে পড়েছিল ঈশানী। প্রোফেসর বলেছিলেন, ওনাকে কাজের ব্যাপারে পাকড়াও করতে হলে সব থেকে ভালো জায়গা ওর কলেজ। দুটো ক্লাসের মাঝে কলেজের বাগানে কিছুক্ষণ পায়চারি করেন ভদ্রলোক। তার মধ্যেই ভাবনার অবকাশ থাকে।

‘কারণ রাজাদের জন্ম সিগনিফিকেন্ট নয়, কিন্তু রাজার মৃত্যুতে ইতিহাসের গতিপথ বদলে যায়…’ ঈশানীর মুখে উত্তর খেলে যায়।

‘এক্স্যাক্টলি।’ অপরেশ মহাপাত্রের ফর্সা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ইউনিভার্সিটির করিডোর ছেড়ে বেশ কিছুদূর বেরিয়ে এসেছে ওরা। প্রোফেসর মহাপাত্রের এই এক সমস্যা। স্থির হয়ে বসতে তিনি কিছুতেই পারেন না। তার উপরে ইতিহাস নিয়ে প্রশ্ন করলে আরওই অস্থিরতা ভর করে তার শরীরে।

এখনও খোলা ঘাসের বাগিচার উপরে হেঁটে চলেছেন তিনি। মাঝে মাঝে দু-একজন ছাত্র পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তার দিকে চেয়ে হালকা হাসি ছুড়ে দিচ্ছে। কিন্তু সেদিকে বেশি মন নেই বৃদ্ধ প্রোফেসরের। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে ইতিহাসের গল্প বলে চলেছেন তিনি।

‘এবং ইতিহাসের গতিপথ পালটে যাওয়া মানে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন রাতারাতি বদলে যাওয়া। ধরো আজ হুট করে আবার ভারতে ইংরেজ আক্রমণ হল। আবার কোম্পানি ক্ষমতায় এসে কর্তৃত্ব শুরু করল, তাতে তো দেশের সোয়া’শো কোটি মানুষের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে যাবে, তাই না?’

‘তা তো বটেই।’

‘কিন্তু আসল সর্বনাশটা হবে কাদের?’

‘যারা এতদিন আগের রাজার ছায়ায় বসে করে খাচ্ছিল। মানে মন্ত্রী, আমলা, সেনাপতিদের…নতুন রাজা ভালোও হতে পারে, নাও পারে। সে আগের মন্ত্রীসভাকে রাতারাতি বরখাস্ত করে দিতে পারে, এমন কোনও আইন আনতে পারে যাতে মন্ত্রী সান্ত্রীদের ক্ষমতা হ্রাস পায়…’

‘শুধু তাই নয়, এক এক জন রাজার এক এক রকম চরিত্র থাকত। কারও প্রবল পরাক্রমশালী বলে রেপুটেশন ছিল, তার আমলে কোনও বহিঃশত্রু আক্রমণ করার সাহস পায়নি। আবার কেউ কামিনি কাঞ্চন নিয়েই ব্যস্ত থেকেছে। কয়েক বছর পরেই পাশের রাজ্য আক্রমণ করে জয় করে নিয়েছে তার সাম্রাজ্য…ইতিহাস বই খুললে দেখবে একজন রাজা মারা গেছে মানে তার সাম্রাজ্যের ধরন পাল্টে গেছে। কারও উপর দেশের মানুষের রাগ ছিল, কাউকে দেশের মানুষ ভালোবাসত। এবং এই সমস্ত রাগ পছন্দ অপছন্দ ভালোবাসা—রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। ফলে কোনও একটা দেশের রাজার আচমকা মরে যাওয়া দেশের রাজনীতিতে অভাবনীয় বদল আনত…’

ঈশানী চুপ করে থাকে। কথা শুনে বোঝা যায় প্রোফেসর মহাপাত্রের কথা এখনও শেষ হয়নি।

‘তো রাজার মৃত্যু, অসুস্থ হয়ে মরণাপন্ন হওয়া, বা সন্ন্যাসগ্রহণ—এই সব কিছু আটকানোর জন্য একটা উপায় ছিল…সেটা কী গেস করতে পারবে?’

ঠোঁট কামড়ে একটু ভাবে ঈশানী। মাথা নাড়ে, ‘উঁহু…’

‘বডি ডাবল। ঝিন্দের বন্দী সিনেমাটা তো দেখেছ। সেকালের এই হিস্টোরিকাল ফিকশনগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও সত্যিকারের ঘটনাকে চড়িয়ে বাড়িয়ে লেখা হত। এন্থনি হোপ অবশ্য প্রিজনার অফ জেন্দা ঠিক কোথা থেকে লিখেছিলেন সে নিয়ে কিছু বলে যাননি, তবে ইতিহাসের চরিত্রদের বডি ডাবল ব্যবহার করা নতুন কিছু নয়। স্বয়ং জোসেফ স্টালিন মোট তিনটে বডি ডাবল ব্যবহার করতেন, যার মধ্যে সব থেকে বিখ্যাত ছিল ফেলিক্স দাদায়েভ। এমনকী স্টালিনের কমরেডরাও নাকি দাদায়েভকে দেখে স্টালিন বলে ভুল করত। হিটলারের নাকি একাধিক বডি ডাবল ছিল। বার্লিনে তার আত্মহত্যার পর রাশিয়ানরা দাবি করে হিটলারের বাসস্থান ও তার আশেপাশে প্রচুর লোকের মৃতদেহ পাওয়া গেছে যাদের চেহারা ও সাজগোজ অবিকল হিটলারের মতো। এমনকী স্টালিনও প্রথমে দাবি করেন হিটলার মোটেই সুইসাইড করেননি। তার বদলে স্পেনে পালিয়ে গেছেন…

‘এলা স্ল্যাক নামক এক মহিলা ব্রিটেনের রানির ঘোষিত বডি ডাবল। তিরিশ বছর ধরে নাকি রানিকে অবিকল মিমিক করার ট্রেনিং নিয়েছেন তিনি। এসব উদাহরণ দিতে গেলে শেষ হবে না। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে আজকের ইন্টারনেট আর মিডিয়ার জুগে এ জিনিসটা সহজ হলেও আজ থেকে কয়েক শো বছর আগে ব্যাপারটা ভাবাই যেত না…’

‘কেন?’

‘কারণ লোকে তখন রাজার কেবল নামটাই জানত। ছবি দেখার উপায় ছিল না। একমাত্র সম্বল হাতে আঁকা ছবি। তাও রাজার আসল চেহারাকে বাড়িয়ে চড়িয়ে আঁকার ফলে সত্যিকারের চেহারাটা চেনা যেত না। ফলে কার সঙ্গে রাজার মুখের অবিকল মিল আছে সেটা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। আবার মন্ত্রী সান্ত্রীদের পক্ষেও সারা দেশ খুঁজে রাজার লুক এলাইক বের করে আনা সম্ভব নয়…’

‘আচ্ছা, বাংলায় এরকম বডি ডাবলের কোনও গল্প চালু নেই?’

প্রোফেসর মহাপাত্র ওর মুখের দিকে চেয়ে হাসেন। মাথায় একটা হাত রেখে বলেন, ‘তোমার মাথাটা কিছু নিয়ে খারাপ হয়েছে বুঝতে পারছি। কিন্তু তুমি ভুল লোকের কাছে এসেছ মনে হচ্ছে। আমি কেবল ইতিহাস নিয়ে একটু পড়াশোনা করি…তবে…’ কী যেন মনে পড়তে কথা বলতে বলতেও থমকে যান মহাপাত্র, ‘তুমি ভাস্কর পণ্ডিতের নাম শুনেছ?’

‘হ্যাঁ, কেন শুনব না?’

‘তাহলে মূল ঘটনায় চলে আসি। মন দিয়ে শুনবে আর মনে মনে কল্পনা করবে…’

মাঠের একপাশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন প্রোফেসর মহাপাত্র। দুটো হাত সামনে তুলে যেন ছবি আঁকার চেষ্টা করেন তিনি। ওদের সামনের কলেজ গ্রাউন্ড মুহূর্তে পরিণত হয়ে যায় কয়েকশো বছর আগের মুর্শিদাবাদের গ্রামে। যে গ্রামের মানুষ আতঙ্কে জড়সড় হয়ে আছে। যে-কোনও সময় হতে পারে বর্গী আক্রমণ।

‘সতেরোশো বিয়াল্লিশ সালের পনেরোই এপ্রিল। বাংলার বুকে ভয়ঙ্কর দিন। নাগপুর থেকে চল্লিশ হাজার বর্গী নিয়ে বাংলা আক্রমণ করলেন ভাস্কর পণ্ডিত। নবাব আলিবর্দী খাঁ তখন কটকের যুদ্ধ সেরে ফেরার পথে বর্ধমানের রাণীনগরের কাছে তাঁবু ফেলে বিশ্রাম নিচ্ছেন। এই সময় গোপনে ভাস্কর পণ্ডিত তাঁর তাঁবু আক্রমণ করলেন। নবাব কোনরকম বেঁচে কাটোয়ায় চলে আসেন। নবাব পালিয়ে যাওয়ার আক্রোশে ভাস্কর পণ্ডিত মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে লুটপাট চালান। নবাব আবার সেনাবাহিনী নিয়ে মুর্শিদাবাদ রওনা দিলে ভাস্কর পণ্ডিত আবার ঘুরপথে কাটোয়ায় চলে আসেন। এখানেই নৃশংস লুটপাট চালিয়ে বর্ধমান রাজার বাড়িটা আয়ত্তে এনে ঘাঁটি গেড়ে বসেন তিনি। একশো বছর পরে সে বাড়িটা একেবারে ভেঙেচুরে গেলেও এখনও কয়েকটা দেওয়াল রয়ে গেছে সে বাড়ির…এবং রয়ে গেছে একটা কামানের গোলার দাগ…’

‘কিন্তু আমার প্রশ্নটা…’

হাত তুলে ওকে বাধা দেন প্রোফেসর, ‘এই বাড়িতেই নাকি একটা সোনার দুর্গা বানিয়ে পুজো শুরু করেন ভাস্কর পণ্ডিত। কিন্তু সে পুজো সম্পূর্ণ হতে পারে না। ওই বছরই সাতাশে সেপ্টেম্বর পুজোর মধ্যেই আলিবর্দী ভাস্কর পণ্ডিতের ঘাঁটি আক্রমণ করেন। যেভাবে তাঁবুতে বিশ্রাম নেওয়ার সময় আলিবর্দীকে আক্রমণ করেছিলেন, সেভাবেই নবমীর রাতে নাচে গানে ক্লান্ত থাকা বর্গীসেনার উপর মুহুর্মুহু কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকেন নবাব। বর্গীবাহিনি ছারখার হয়ে যায় সে গোলার আঘাতে। পুজো অসমাপ্ত রেখেই পালানোর চেষ্টা করে তারা। এই সময় সোনার মূর্তি বুকে চেপে ধরে গঙ্গায় ঝাঁপ দেন ভাস্কর পণ্ডিত। এরপর থেকে তার আর কোনও খবর পাওয়া যায় না…’

‘মারা গেছিলেন?’

প্রোফেসর হাসেন, ‘তোমার সেটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না? ধার্মিক মানুষ। মুসলমান নবাবের গোলায় দুর্গামূর্তি ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে মূর্তি নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দেন। কিন্তু বর্ধমানের উত্তাল গঙ্গায় অত ভারী একটা জিনিস নিয়ে ঝাঁপ দিলে বেঁচে থাকার আদৌ কোনও সম্ভবনা থাকে?’

‘তাহলে এর পরের বর্গী আক্রমণগুলো…’

‘এর ঠিক দেড়বছর পর আবার বর্গীরা মেদিনীপুর আক্রমণ করে। তাদের নেতৃত্ব কে দিয়েছিল গেস করো…’

‘ভাস্কর পণ্ডিত!’

উপরে নিচে মাথা নাড়েন প্রোফেসর, গলা ধরে এসেছে তাঁর, ‘বলিউডি নায়কদের মতো ইতিহাসে মরে গিয়ে ফিরে আসা চরিত্রের প্রচুর উদাহরণ আছে। এখন সবগুলো বলতে গেলে আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাবে…’

‘আপনি বলতে চাইছেন এগুলো সব বডি ডাবল?’

‘তুমি গল্প শুনতে চেয়েছিলে আমি বলে দিলাম। এরপর যা বোঝার তুমি নিজের মতো হিসেব করে নাও…’

ঈশানী বুঝতে পারে প্রোফেসর তাড়াহুড়ো করছেন। ক্লাস শুরু হতে চলেছে তার। উল্টোদিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিলেন তিনি, থেমে জিগ্যেস করেন, ‘তা তোমার অফিস নেই আজকে?’

ঈশানী একটু থতমত খায়, ‘না, না সকালে শরীরটা আসলে…’

প্রোফেসর হাসেন, ‘বুঝতেই পারছি। আগে তুমি বলতে এখন আপনি বলছ। সব ভুলে মেরে দিয়েছ দেখছি…’

ঈশানী একটু খাবি খায়। সেও উল্টোদিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল। হঠাৎ কী যেন মনে করে একটু থেমে যায়।

‘প্রোফেসর…’ পেছন থেকে ডাকে সে।

‘হ্যাঁ বলো…’

‘আর একটা ছোট দরকার ছিল। জানি না আপনি হেল্প করতে পারবেন কিনা, কিন্তু তাও…’ সে পকেট থেকে একটা সাদা কাগজ বের করে ওর সামনে তুলে ধরে। তার উপরে কয়েকটা মামুলি চিহ্ন পেনসিলে আঁকা আছে। সেগুলো দেখিয়ে জিগ্যেস করে, ‘এই চিহ্নগুলো দেখে কিছু মনে পড়ছে আপনার?’

‘একটা ঘুড়ি, একটা ডানা ছড়ানো ঈগল…’ গালে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ ভাবেন প্রোফেসর। বিড়বিড় করে বলেন, ‘ডানা ছড়ানো ঈগল অনেক কিছুরই সিম্বল হতে পারে। কিন্তু ঘুড়ি ব্যাপারটার মধ্যে একটা বাঙালি-বাঙালি ব্যাপার…মাই গড!’ শেষ কথাটা বলে থমকে একটুক্ষণ চেয়ে থাকেন সেদিকে।

ঈশানী কৌতূহলী হয়ে জিগ্যেস করে, ‘কিছু বুঝলেন স্যার?’

‘এটা একটা দেবতার চিহ্ন। তবে বাঙালি নয়, এমনকী ভারতীয়ও না। উড়ন্ত ঘুড়ি আর ডানা ছড়ানো ঈগল নেফথিসকে সিম্বলাইজ করে…’

‘নেফথিস?’ ঈশানী কৌতূহলী গলায় জিগ্যেস করে।

‘ইজিপ্সিয়ান গড অফ ম্যাজিক এন্ড কেমোফ্লাজ!’

বাবুঘাট ফেরির কাছে এসে বাইকটা দাঁড় করালেন অনির্বাণ। হেলমেট মাথা থেকে খুলে একবার চারপাশটা দেখে নিলেন। তারপর মাথাটা পেছন ঘুরিয়ে পেছনে বসে থাকা রাজেনের উদ্দেশে বললেন, ‘সামনের স্কুটিটাই মনে হচ্ছে…’

রাজেনও সামনের ফাঁকা রাস্তাটার উপর দাঁড় করিয়ে রাখা স্কুটিটাকেই দেখছিল, সে চাপা গলায় বলল, ‘শালা, এত দূরে রেখে চালাচ্ছে যে নম্বরটাও দেখতে পাচ্ছি না।’

বাবুঘাটের কাছাকাছি এসেই স্কুটিটা দেখতে পেয়েছিল অনির্বাণ। একটা অল্পবয়সি ছেলে। তার পিঠে একটা অস্বাভাবিক বড় ব্যাগ। এত রাতে স্কুল কলেজ, টিউশনির বালাই নেই। তাহলে এত বড় ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে কোথায়? এখান থেকেই সন্দেহ জমাট বাঁধে ওর মনে।

আজ একা বেরোননি অনির্বাণ। সঙ্গে রাজেনকে নিয়েছেন। রাজেন আগে পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করত, মাসকয়েক আগে কী একটা কারণে সেসব ছেড়ে এখন একটা প্রাইভেট এঞ্জেন্সি চালাচ্ছে। রাত বিরেতে এইসব অ্যাডভেঞ্চারে যেতে হলে ওকে সঙ্গে নেন অনির্বাণ।

হুট করেই একেবারে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়েছে ছেলেটা। হাত তুলে ওদের ইশারা করছে। হাতটা গ্লাভসে ঢাকা। মুখ পেছনে না ঘুরিয়েই হাতছানি দিয়ে ডাকে সে। অনির্বাণ বাইক থেকে নেমে সেদিকে এগিয়ে যান।

ওর পেছনে গিয়ে দাঁড়াতে হেলমেট খোলে ছেলেটা। অনির্বাণ সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর মুখের দিকে তাকায়। সকালের ছেলেটা নয়। কেমন যেন চাকমা চাকমা দেখতে। টানাটানা চোখ, ফর্সা গায়ের রং, মুখটা ভারি মিষ্টি। ওর মনে হয় এই মুখ ও আগেও দেখেছে। কোনও বিদেশি সিনেমায় সম্ভবত।

‘আমাকে খুঁজছেন আপনারা?’ ছেলেটা পরিষ্কার বাংলায় জিগ্যেস করে।

‘তোমাদের একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই আমরা।’

‘বেশ তো নিন। প্রশ্ন করুন, উত্তর দিচ্ছি।’

অনির্বাণ একবার রাজেনের দিকে তাকান, তারপর ওর চোখ নেমে আসে ছেলেটার মুখের দিকে, ‘ঠিক এভাবে নয়। যদি তোমাদের মুখ দেখাতে অসুবিধা না থাকে…’

‘আমরা কখন বললাম মুখ দেখাতে অসুবিধা, আপনারা দেখতে চাননি তাই আমরা দেখাইনি…অবশ্য মুখ জিনিসটা থেকে থেকে বদলে যায়। যেটা বলতে চাইছি সেটাই আসল…’

‘মাঝরাতে শহরের নামি দামি জায়গায় কার্টুন আঁকছ কেন তোমরা?’

‘আপনারা কার্টুনকে বছর শেষে গিয়ে ভোট দিয়ে আসবেন আর আমরা দেওয়ালে একটু আঁকতে পারব না?’

‘শাট আপ…’ ধমক দেন অনির্বাণ, ‘খুব বড় বড় কথা? থাবড়ে বাঁদরনাচ দেখিয়ে দেব তোমাকে…’

‘বাঁদরনাচের কথায় মনে পড়ল…’ কী মনে করে নিজের মোবাইল ফোনটা বের করতে থাকে ছেলেটা, ‘আপনি কিন্তু স্যার ইন্সটাগ্রামে ভাইরাল হওয়া থেকে জাস্ট এক পা দূরে…’

ফোনে একটা ভিডিও চালিয়ে দেয় ছেলেটা। সেটা দেখেই বুকের ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে যায় অনির্বাণের। একটা সবুজ পর্দা ঝুলছে ব্যাকগ্রাউন্ডে, আর তার সামনে তিনি নিজে প্রায় অর্ধনগ্ন হয়ে নাচছেন।

ছেলেটা একটা অহঙ্কারি হাসি হাসে, ‘আমি বানিয়েছি, ভালো হয়নি না স্যার? আসলে নাচটা আমার এখনও ঠিক…’

‘এ সবের মানে কী?’ গর্জে ওঠেন অনির্বাণ, ‘করতে কী চাইছ তোমরা?’

‘সিম্পল। আপনাকে আমার একটা কাজ করে দিতে হবে স্যার।’ নির্লিপ্ত স্বরে বলে ছেলেটা।

‘তোমার লজ্জা করে না আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছ?’

অবাক হয় ছেলেটা, ‘আরে ব্ল্যাকমেইল কোথায় দেখছেন? এসব জিনিস ইনস্টাগ্রামে ছেড়ে দিলে কী লেভেলের ভাইরাল হবেন ভাবতে পারছেন? পেছনটা যা দুলিয়েছেন। উফ…’

‘কী করতে হবে আমাকে?’ বরফের মতো শীতল স্বরে বলেন অনির্বাণ।

‘খুব সিম্পল। আগামী রবিবার আপনাকে এখানে একটা ভ্যালেন্টাইনস ডে অ্যারেঞ্জ করতে হবে। সঙ্গে আরও দু-একটা টুকটাক ব্যবস্থা…কিছুই অসম্ভব নয়…’ কথাটা বলে অনির্বাণের হাতে একটা বাক্স তুলে দেয় সে, ‘এতে টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনার শুধু ঝক্কির দায়িত্ব…’

‘মানে? এসব আমার কাজ নাকি?’

‘সে আপনি জানেন। আপনার তো পলিটিকাল লেভেলে ভালো যোগাযোগ আছে। রাজনীতি করার সময় ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কাজও করেছেন বলে শুনেছি। কিছু একটা মোচ্ছব লাগিয়ে দিন। ছেলেমেয়েরা মিষ্টি করে সেজে এখানে আসবে। হাতে গোলাপ নিয়ে প্রেম টেম করবে, একটু নাচ গান হবে…ব্যাস…’

‘তাতে তোমাদের লাভ কী?’ অনির্বাণ অবাক হয়ে জিগ্যেস করেন।

‘সবসময় লাভ-লাভ করেন কেন বলুন তো? আপনি সাংবাদিক না ব্যবসায়ী?’

অনির্বাণ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। এমন সময় প্রিন্সেপ ঘাটের বাগানের দিকে কী যেন একটা নড়ে ওঠে। রাজেন হঠাৎ সেদিকে দেখিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘স্যার, ওই দিকে একজন ছবি আঁকছে বলে মনে হচ্ছে…’

কথাটা বলেই সে ছুটে যায় সেদিক লক্ষ্য করে। একটা মেয়েলি শরীর বাগানের দিক থেকে বেরিয়ে এসে অন্ধকারের মধ্যে লুকিয়ে পড়ে ওকে দেখে। মেয়েটার পিঠে একটা ঢাউস ব্যাগ।

রাজেন সেখানে পৌঁছানোর আগেই একটু আগের ছেলেটা স্কুটি নিয়ে অন্ধকারটার সামনে ব্রেক কষে। মেয়েটা দ্রুত উঠে পড়ে স্কুটিতে। গড়গড় শব্দে আওয়াজ তুলে স্কুটিটা ছুটে বেরিয়ে যায় ওদের ছাড়িয়ে।

পেছন না ফিরেই হাত তুলে টাটা করে মেয়েটা। অনির্বাণ আর রাজেন হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। ওদের দৃষ্টি সরে আসে প্রিন্সেপ ঘাটের ভিতরের দেওয়ালের দিকে। সেখানে নতুন একটা ছবি আঁকা হয়েছে…একঝাঁক রং চঙে মানুষের মাঝে হাতে একটা গোলাপ নিয়ে হাঁটছে একটা মেয়ে আর তার হাত ধরে ওদের দিকে পেছনে ঘুরে হাঁটছে একটা কাকতাড়ুয়া…

হাসতে হাসতে গলির পথ ধরে দৌড়ে আরও কিছু দূর এগিয়ে আসে ওরা। ঈশানীর নূপুর ফাঁকা গলির ভিতর রুমঝুম বাজতে থাকে। উত্তর কলকাতার সরু গলির এই সুবিধা। কোনওটার ভিতরে দুটো মানুষ ঢুকে অন্ধকারে লুকিয়ে দাঁড়ালে আর কোনও ভাবেই খুঁজে পাওয়ার কোনও সম্ভবনা নেই।

স্কুটিটা দাঁড় করানো আছে একটু দূরে। গলির ভিতর দিয়ে একসঙ্গে হাসতে হাসতে আর হাঁপাতে হাঁপাতে সেদিকে এগোতে থাকে ওরা দুজনে।

‘এত কী কথা বলছিলি ওদের সঙ্গে?’ ঈশানী জিগ্যেস করে।

‘দরকার ছিল।’

‘কীসের?’

ছেলেটা ভুরু তোলে, ‘আমি ভগবান। আমার কাজকর্ম নিয়ে অত প্রশ্ন করা চলে না।’

‘আর আমি শুনেছিলাম, মানুষের মধ্যেই ভগবান থাকেন।’

চারুর হাতটা দুহাতে জড়িয়ে হাঁটতে থাকে ঈশানী। মাথাটা রাখে ওর বাহুতে। এভাবে হাঁটতে ভারি নিশ্চিন্ত লাগে ওর। কয়েক পা নিঃশব্দে হেঁটে আসে ওরা। রাতের কলকাতা থমথম করছে ওদের দুপাশে।

‘আমি কোনওদিনও ভাবিনি, জানিস কারও সঙ্গে এইভাবে হাঁটব…’

‘এইভাবে বলতে?’

‘এইভাবে গায়ের উপর লেগে। আমি ছোটবেলা থেকে একটু রুক্ষশুষ্ক গোছের। লোকজনকে প্রেম করতে দেখলে কেমন ন্যাকান্যাকা লাগত। আর দেখ, তোর সাথে মিশে আমি নিজেই কেমন ন্যাকা হয়ে গেলাম…’

‘কী করে হলি?’

‘কী জানি, হয়তো সবার ভেতরেই সব কিছু থাকে। এক একটা মানুষের ছোঁয়ায় এক একটা মুখ বেরিয়ে আসে। ভিতরের জিনিসটা একই থেকে যায়…’

‘ভিতরের জিনিস? কোন জিনিস?’

‘কারও সঙ্গে থাকতে চাওয়া। ছোট ছোট গল্প, একটুখানি হাসি, একটু কান্না। চারু…’ ওর দিকে ফিরে চায় মেয়েটা, ‘আমি সব সুখ ছেড়ে দিতে রাজি, শুধু সব দুঃখগুলো তোর সঙ্গে কাটাতে দে…’

‘কিন্তু আমি তো চলে যাব…’

ঈশানী নরম করে হাসে, ‘দুর্গাপুজোয় তোর সঙ্গে হাঁটতে পারব না। সরস্বতী পুজোয় প্রিন্সেপ ঘাটে প্রেম করতে পারব না। যে রাস্তাগুলো আমরা সাজিয়েছি, সেই সব রাস্তাগুলোয় অন্য লোকে হাঁটবে। শুধু তুই আর আমি থাকব না…’

‘তুই তো থাকবি, তুই একা একা আঁকতে পারবি না?’

ঈশানী ওর হাতটা আর একটু শক্ত করে ধরে, ‘জানি না। ওরা আমাদের সব আঁকা তুলে দেবে। হয়তো রয়েও যাবে কোথাও কোথাও। তার উপরে হাত বুলিয়ে যাব মাঝে মাঝে।’

চারু ওর কাঁধে একটা হাত রাখে, ‘আমি চলে গেলেও তোর কাছে থেকে যাব রুনু?’

‘তুই চলে গেলেও তুই যাবি না…’

অর্থহীন শব্দ খেলা করে ওদের মাঝে। আর কেউ নেই কোথাও। কলকাতার ফাঁকা গলি পুরোনো হিসেবের খাতা খুলে ভুল হয়ে যাওয়া কোনও অঙ্ক মেলায়…

কাকতাড়ুয়া – 15 অধ্যায়

পঞ্চদশ অধ্যায়

‘আপনি মোটামুটি কত বছর বয়স থেকে মদ খাচ্ছেন মিস প্রামাণিক?’ চেয়ারের উপরে জমিয়ে বসতে বসতে প্রশ্ন করলেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস। টেবিলের একদিকে বসে আছে মানিক। সে একটা কাগজে কীসব যেন লিখে রাখছে। বিশ্বাসের ঘরের একদিকের দেওয়াল ঘেঁষে বসে আছে একটা বছর পঁচিশের ছেলে। মিস প্রামাণিকের সঙ্গেই এসেছে সে। তার পরনে কালো শার্ট প্যান্ট। একটা বই হাতে নিয়ে পড়ছে সে। কিন্তু কান সজাগ রয়েছে ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের দিকে।

‘সাত আট বছর আগে থেকে শুরু করি। কলেজে পড়ার সময় থেকে…আগে বেশি খেতাম, ইদানীং ছেড়ে দিয়েছি প্রায়।’

‘মানে নিয়মিত খেতেন বলা যায়। দোকানের বিল দেখে বুঝতে পারছি সেদিন ক্যাম্পে মোট তিনটে সাড়ে সাতশোর বোতল নিয়ে গেছিলেন আপনারা। সঙ্গে কয়েকটা বিয়ারের ক্যান। গার্গী বসু নিজে বলেছেন তিনি একটা গোটা বোতলের খানিকটা বেশি খেয়েছিলেন। অভিরূপা দত্ত তার কাছাকাছিই। সকালে আমি যখন আপনাদের ঘরে যাই সেখানে হুইস্কির বোতল উল্টেছিল। অর্থাৎ সেখানেও নষ্ট হয় কিছুটা। আপনি স্বাভাবিকের থেকে কিছু বেশি খেলেও স্মৃতিভ্রংশ হওয়ার মতো মদ খেয়েছিলেন বলা যায় না, তাই না?’

বিশ্বাসের চোখের দিক থেকে চোখ সরানোর অছিলায় ঘরের চারপাশটা একবার দেখে নেয় ঈশানী, ‘র’ খেয়েছিলাম, ইদানীং আর অতটা খেতাম না তাই একটু চড়ে গিয়ে…’

‘সাধারণত র’ খেতেন? নাকি সেদিন…’

‘সেদিন খেয়েছিলাম, ইচ্ছা করছিল তাই…’

‘কেন? হঠাৎ এরকম ইচ্ছা?’

উত্তর দিতে একটু সময় নেয় ঈশানী, ‘জানতাম আর হয়তো সবাই মিলে খাওয়া হবে না। তাই বাড়াবাড়ি কিছু…’

‘কী করে জানলেন আর হবে না?’

‘আমাদের তিনজনের সম্পর্কটা আর আগের মতো ছিল না। মাসে একবার কথা হত কী হত না। বুঝতে পারছিলাম দূরত্ব বাড়ছে। খানিকটা সেই কারণেই এই ট্রিপটা…’

‘দূরত্ব বাড়ার কারণ কী বলুন তো?’ বিশ্বাস ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকান।

‘আমার বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে আমার আর কিছু ভালো লাগত না। ফোন রিসিভ করতাম না দিনের পর দিন। কোথাও যেতে বললে যেতাম না। সারাদিন অফিস করে মনমেজাজও খারাপ থাকত। ওরা অনেকবার চেষ্টা করেছিল। আমারই…’

‘সেই জন্যেই ঘুমের ওষুধ খেতে হত?’

মুখ তোলে ঈশানী, চোখে ঝিলিক খেলে যায় তার, ‘আপনাকে কে বলল আমি ঘুমের ওষুধ খেতাম?’

বিশ্বাস একটা বাঁকা হাসি হাসেন, ‘আপনার ব্যাঙ্ক ট্রানজাকশন। কী জানেন, কাঁচা অপরাধীরা ফোনের কললিস্ট আর চ্যাট ডিলিট করতে যতটা তৎপর হয় ব্যাঙ্ক ট্রানজাকশন নিয়ে ততটা মাথা ঘামায় না। আপনার সে সময়ের পাসবুক বলছে আপনি আলাদা আলাদা ওষুধের দোকান থেকে ইউপিআই দিয়ে আনন্যাচারাল নাম্বার অফ ঘুমের ওষুধ কিনেছেন। সেই সঙ্গে অ্যান্টি-ডিপ্রেসেন্ট। ঠিক কী হয়েছিল বলুন তো আপনার?’

ঈশানী অস্বস্তিতে পড়ে, মুখের সামনে থেকে চুল সরাতে সরাতে বলে, ‘বললাম তো, বাবা চলে যাওয়ার পর থেকেই…’

‘আপনার বাবা মারা গেছেন ছ’মাস আগে, ট্রিপে যাওয়ার আগে হুট করে অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট খাওয়ার মতো কী হয়েছিল আপনার?’ বিশ্বাসের গলা কঠিন শোনায়। প্রশ্নটা প্রতিধ্বনিত হয় ঘর জুড়ে। ঘরের বাতাস আচমকাই ভারী হয়ে ওঠে। আড়চোখে একবার বেঞ্চের দিকে তাকায় ঈশানী। ছেলেটা এখনও আগের মতোই বসে আছে ওর দিকে চেয়ে।

‘আচ্ছা বাদ দিন, ওসব আপনার পারসোনাল ব্যাপার। না বলতে চাইলে নাই বলবেন। আমি বরঞ্চ অন্য একটা পারসোনাল প্রশ্ন করি, কেমন?’

টেবিলের উপর দুকাপ চা রাখা আছে। এখনও অবধি কেউ চুমুক দেয়নি তাতে। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

‘সেদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পে যারা ছিল তাদের মধ্যে একাধিক লোক বলেছে যে সেদিন আপনার আর মিস দত্তের মধ্যে মদ খাওয়ার সময় একটা হিটেড ডিবেট হয়। দুজনের কথা-কাটাকাটি হাতাহাতির জায়গায় পৌঁছায়। ঠিক কী নিয়ে ঝগড়া করছিলেন আপনারা বলতে পারবেন?’

‘ওর সম্পর্ক নিয়ে, দেবজ্যোতি বলে একটা বয়ফ্রেন্ড ছিল ওর। তার সঙ্গে একরকম জোর করে ব্রেক আপ করেছিল। ছেলেটা ভালো ছিল। আমাকে ফোন করে মাঝে মধ্যে কান্নাকাটি করত, ওকে বোঝাতে বলত।’

‘আপনি বোঝাতেন?’

‘চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু লাভ হয়নি। ও বুঝতে চাইত না। ওর কথা শুনতেই চাইত না। দেবুও বারবার ফোন করে যেত আমাকে। আমি মাঝে পড়ে গেছিলাম।’

‘আপনারও তো ওরকমই একটা অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, তাই না?’ বিশ্বাসের গলা অতিরিক্ত নরম শোনায়, ‘মানে আপনার ব্রেক আপ তো অ্যারাউন্ড ওই টাইমেই হয়।’

উপরে নিচে মাথা নাড়ায় ঈশানী।

‘তো সেদিন সন্ধ্যায় সেই নিয়েই কথা কাটাকাটি হয়। আপনি ওকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, ও বুঝতে চায় না। মদের ঘোরে হালকা মারপিট হয়। তারপর?’

‘তারপর আমার মনে নেই।’ মুখ তুলে তাকায় ঈশানী, ‘আমি মনে হয় উঠে চলে এসেছিলাম ওখান থেকে।’

‘তারপর তক্কে তক্কে ছিলেন কখন ও পুকুরপারে যাবে, তাই না?’

ঈশানী হাসে, ‘ওকে খুন করব বলে? অভিকে খুন করে আমার লাভ কী?’

হাত দুটো দুদিকে ছড়িয়ে দেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘সে তো আপনি বলবেন আমাকে। আমি বড়জোর অপশন দিতে পারি। যেমন ধরুন, আপনার এবং মিস দত্তর ব্রেক আপ হয় এই দেবু বলে ছেলেটিকে নিয়েই। ছেলেটি আপনাকে ভালোবেসে ফেলে এবং আপনার সঙ্গে একটা অ্যাফেয়ার হয় ওর। সেটা জানতে পেরে মেয়েটি আপনাকে কনফ্রন্ট করে এবং তখন থেকেই আপনাদের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। ছেলেটি কিন্তু মিস দত্তকে ছাড়তে চায় না। উল্টে সে আপনার সঙ্গেই দূরত্ব বাড়াতে শুরু করে। যৌন ঈর্ষা থেকে সেদিন রাতে মিস দত্তকে খুন করে জলে ফেলে দেন আপনি।’

কিছুক্ষণ কেউ কোনও কথা বলে না। ইনস্পেক্টর বিশ্বাস আড় চোখে লক্ষ করেন চেয়ারে বসা ছেলেটা এখন বই থেকে মুখ তুলে সটান তাকিয়ে আছে এদিকে।

‘মদের হিসেব বলছে সেদিন যতটা প্রিটেন্ড করছেন ততটা নেশা আপনার হয়নি, আপনার সঙ্গে মিস দত্তের সম্পর্ক খারাপ ছিল সেটা সহজেই বোঝা যায়, আপনার বান্ধবি গার্গী বসুর জবানবন্দী অনুযায়ী সেদিন সন্ধে থেকে আপনার বিহেভিয়ারের মধ্যে কিছু চেঞ্জ আসে। আপনার মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়। এতদিনের নেশাড়ু হয়েও মদ ঢালতে গিয়ে পেগ উল্টোপাল্টা করে ফেলেন বারবার। জয়েন্ট রোল করতে গিয়ে হাত কাঁপছিল আপনার। আমার যতদূর মনে হচ্ছে দুশ্চিন্তায় ছিলেন আপনি, তাই না? কিছু হারিয়ে ফেলেছিলেন?’

অবাক চোখে মুখ তুলে তাকায় ঈশানী, ‘হারিয়ে ফেলেছিলাম! কই না তো।’

‘আপনি শিওর?’ বিশ্বাসের গলায় ব্যঙ্গ ঝড়ে পড়ে। একবার গলা ঝাড়া দিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা, এই ধরনের ট্রিপে বেড়াতে এলে লোকে কী কী জিনিস আনছে তার একটু লিস্ট করে আনে। আপনি এনেছিলেন?’

উপরে নিচে মাথা নাড়ায় ঈশানী, ‘করেছিলাম। গুগল ডকে লিখে সেভ করে রেখেছিলাম।’

‘এতদিনে সেটা নিশ্চয়ই ডিলিট করে ফেলেননি?’

‘না…’

‘দেখি একটু।’

পকেট থেকে ফোনটা বের করে গুগল ডকটা খুলে ওর দিকে এগিয়ে দেয় ঈশানী। ইনস্পেক্টর বিশ্বাস ভালো করে চোখ বোলান তাতে। তারপর মুখ তুলে বলেন, ‘এখান থেকে কিছু ডিলিট করেননি আপনি, তাই তো?’

‘না।’

টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে মোড়া ছুরি বের করে ওর সামনে রাখেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘দেখুন তো এটা চিনতে পারেন কিনা…’

ঈশানী এক নজর সেদিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয়।

বিশ্বাসের গলায় ব্যঙ্গটা আরও ধারালো হয়, ‘ছুরিটা যে আপনার সেটা প্রমাণ করতে আমাদের দু’মিনিটও লাগবে না। ক্যাম্পের অন্তত তিনজন লোক আপনাকে এটা দিয়ে হুইস্কির বোতল খুলতে দেখেছে। তো এনেছিলেন যখন লিস্টে লিখলেন না কেন বলুন তো?’

আমতা আমতা করে ঈশানী, ‘ভুলে গেছিলাম…’

‘হতে পারে, আবার এও হতে পারে, ছুরি দিয়ে মেয়েটাকে খুন করাই উদ্দেশ্য ছিল আপনার। কোনও কারণে ছুরি দিয়ে খুনটা করতে পারেননি আপনি। এও হতে পারে খুন করার আগে কোনওভাবে হারিয়ে যায় ওটা। মদ্যপ অবস্থায় মিস দত্তকে খুন করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি আপনাকে। খুনটা করে বডি জলে ফেলে আপনি ঘরে চলে আসেন।’

এতক্ষণে গলার স্বরে একটা কাঠিন্য এসে মেশে ঈশানীর, ‘আপনি কি এরেস্ট করতে চাইছেন আমাকে?’

‘উঁহু, তাতে লাভ নেই। ওরকম দুম করে কাউকে অ্যারেস্ট করা যায় না। তার উপর আপনি আবার মহিলা, দু’মিনিটে বেল পেয়ে যাবেন। আমি শুধু বলছি…’ টেবিলের উপর ভর দিয়ে এগিয়ে আসেন ইনস্পেক্টর বিশ্বাস, ‘একটা ভালো উকিলের খোঁজ করে রাখুন। খারাপ দিন আসছে…’

মিনিট পাঁচেক পর থানা থেকে বেরিয়ে যায় ছেলেমেয়ে দুটো। ওরা চলে যেতে বিশ্বাসের দিকে সরে আসে মানিক, ‘আপনার কী মনে হচ্ছে স্যার? খুনটা এ-ই করেছে?’

ওর পিঠে একটা হাত রাখেন বিশ্বাস, ‘ভুল করছ মানিক, খুনি খুঁজে বের করা ফেলু মিত্তিরের কাজ। পুলিশের কাজ এভিডেন্স জোগাড় করা। এক্ষেত্রে সেটা নেই। ভিক্টিম ছাড়া সাতজন সেদিন ওই ক্যাম্পে ছিল। দুজন কেয়ারটেকার কিছুই জানে না, দুজন মদের ঘোরে চুর হয়ে ছিল, একজন ঘর থেকে বেরোয়নি, একজন বেরিয়েই কিছু দেখার আগেই ঢুকে গেছে, আর একজন বলছে ভূতের গল্প। একমাত্র আকাশে চাঁদ ছাড়া আর সাক্ষী দেওয়ার মতো কেউ নেই…তবে আমার কী মনে হচ্ছে, জানো?’

‘কী?’

‘খুন না করে থাকলেও এই মেয়েটা এমন কিছু জানে যা ও বলতে চাইছে না।’

সিঁড়ি দিয়ে জরাজীর্ণ বাড়িটার দোতলায় উঠে আসে ওরা। একটা কালো শার্ট আর কালো রঙের জিন্স পরেছে চারু। ঈশানী শখ করেই কিনে দিয়েছে এটা। গায়ে একটু টাইট হয়েছে তাও মোটামুটি মানিয়ে গেছে।

অন্ধকারে ঢেকে আছে বাড়িটা। চারপাশে কোথাও তাকালে কিছু দেখা যায় না। শুধু মাইলের পর মাইল ঘন জঙ্গল। আর তার মাঝে মোট চারটে ভাঙাচোরা বাড়ি, একটা ছোট নাটমন্দির, একটা কুয়ো, আর বাড়িগুলোর মাঝে যাতায়াত করার মতো সিমেন্টের রাস্তা। এখান থেকে ক্যাম্পে যেতে মিনিটদশেকের বেশি সময় লাগে না।

যে বাড়িটায় ওরা উঠেছে সেটা অন্যগুলোর থেকে অপেক্ষাকৃত কম ভাঙাচোরা। নিচে একটা ছোট্ট চাতাল করা। তার উপর সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো চারটে চেয়ার। সেই চেয়ারের মাঝে একটা ছোট্ট টেবিল। তিনশো বছর আগে এখানে বসে দাবা খেলা হত। দাবার বোর্ডের পাশেই রাখা থাকত সুরাপাত্র। এখন সেই দাবার বোর্ড দাবাড়ুদের নিয়ে কোথায় উধাও হয়েছে যেন। হার জিত শেষ হয়েছে, জং ধরেছে চেয়ার টেবিলে।

এর ঠিক উপরেই একটা ঝুলবারান্দা। আপাতত সিঁড়ি দিয়ে উঠে সেই বারান্দাতেই এসে বসে ওরা দুজন। আকাশের চাঁদটা বেড়ে উঠেছে। চারদিকে কোথাও আলো নেই বলে জ্যোৎস্না খেলা করছে নিশ্চিন্তে।

চারু একদিকের ভাঙা দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে, ‘এরকম ফাঁকা জায়গায় না এলে চাঁদটা দেখাই হয় না। একসময় কী অদ্ভুত ভালো লাগত দেখতে!’

‘ওসব বাজে কথা, জীবনে একটা এত মিষ্টি চাঁদ আছে তাই ওদিকে নজর পড়ে না সেটা বল…’

হেসে ওর দিকে তাকায় চারু, ‘তুই এই ক’দিনে না একটু বদলে গেছিস রুনু।’

‘কেমন বদল?’

‘আগে একটু হার্ডকোর রাফ-এন্ড-টাফ টাইপের ছিলি। এখন একটু নিব্বি গোছের লাগে মাঝে মাঝে…’

‘রোদে ঘোরার পর ছায়ায় এসে বসে আর কেউ ছাতা মাথায় দিয়ে থাকে না।’ বাইরের দিকে তাকায় ঈশানী, ‘অন দ্যা কন্ট্রারি সামনের শুক্রবার আমার জন্মদিন। বুড়ি হয়ে গেলাম শালা…’

‘তাতে দুঃখের কী আছে? বয়সের সঙ্গে সঙ্গে গ্ল্যামারটাও তো বাড়ছে…’

সত্যি ওর মুখের দিক থেকে চোখ ফেরানো যায় না সহজে। চারু মাঝে মাঝে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ওর দিকে। যখন ও অফিস থেকে ফেরে, কিংবা সারারাত এখানে ওখানে ঘুরে ছুটে বেড়ানোর পর যখন চারুর কাঁধে মাথা রেখে চোখ বোজে, কী ভীষণ প্রাচীন গুহার দেওয়ালে আঁকা কারুকার্যের মতো দেখায় ওর মুখটা। এখনও ও সেদিকে চেয়ে থাকে।

‘আমার চিরকাল মনে হয়েছে জানিস, আমার এরকম তিনশো বছর আগেই জন্মানো উচিত ছিল। এত লোকজন, হইচই, চিৎকার চেঁচামেচি থাকবে না। জঙ্গলের মাঝখানে ছোট একটা বাড়ি। একটা কুয়োতলা, ঠাকুরতলা, লালপাড় সাদা শাড়ি আর আলতা পরে দৌড়ে যাব…’

‘তারপর দুম করে বর্গীরা আক্রমণ করবে, আর গলাটি কেটে দিয়ে চলে যাবে…’

ঈশানী বিরক্ত হয়, মেজাজটা খিঁচে যায় তার, ‘তুই কীসের দেবতা ছিলিস বল তো? মুড খেঁচিয়ে দেওয়ার?’

‘হতে পারে, বেশি মুড উঠে গেলে তোর আবার চুমু খেতে ইচ্ছা করবে।’

‘না না, আমি আর তোকে চুমু খাব না।’

‘কেন?’

‘রোজ নতুন নতুন চেহারার লোককে চুমু খেতে ভালো লাগে? বারোভাতারি মনে হয় নিজেকে।’

‘বেশ চোখ বন্ধ করেই খাস।’

হঠাৎ ওর দিকে চোখ তুলে তাকায় ঈশানী, কিছুক্ষণ স্থির চোখে চেয়ে থেকে বলে, ‘আমার চোখ বন্ধ করতে ভয় লাগে। যদি তুই না জানিয়ে চলে যাস, আমার সবকিছু ভেস্তে যাবে।’

হাতটা ধরে ওকে নিজের দিকে টেনে নেয় চারু। ওর বুকে পিঠ রেখে বসে ঈশানী। হাত রাখে ওর গালে। তারপর দুজনে চেয়ে থাকে দূর প্রান্তের দিকে। চাঁদটা আগের থেকে একটু সরে এসেছে, যেন আকাশের ভিতর এদিক-ওদিক করে ওদের খোঁজার চেষ্টা করছে এই পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তূপের খাঁজে।

‘চারু…’

‘বল।’

‘আমাদের তো একসঙ্গে থাকা হবে না। হলে একটা এরকম বাড়িতে থাকতাম আমরা, বুঝলি?’

জঙ্গলের ভেতর থেকে কিচকিচ করে কীসের যেন শব্দ আসছে। আকাশের বুকে অচেনা পাখি ডানা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে। চোখ বন্ধ করে চারুর বুকে মাথা রেখে ঈশানী ভাবে, এখন এখানে যদি ও ঘুমিয়ে পড়ে আস্তে আস্তে ভোর হলে শুনতে পাবে একতলার কাঠের দরজা ক্যাচ করে খুলে যাওয়ার আওয়াজ। রেকাবি হাতে ফুল কুড়াতে যাবে কেউ নিজের ঘর থেকে। স্নানের শব্দ আসবে, রান্নার জোগাড়যন্ত্র করতে বসবে কেউ। আর ওদেরকে দেখে হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকবে। ওর চোখদুটো বন্ধ হয়ে যায়…

‘ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? স্বপ্ন দেখছিস?’ চারু ঠেলা দেয় ওকে।

‘হুম, স্বপ্ন দেখছিলাম। এই পৃথিবীর সব থেকে ভয়ঙ্কর স্বপ্ন—ঘর বাঁধার স্বপ্ন।’

কোথা থেকে যেন আওয়াজ আসে একটা, একতলার ঘরে উপর থেকে কিছু খসে পড়ে বুঝি। চারু কান পেতে শোনে, ‘কীসের শব্দ বল তো?’

কাঁধ ঝাঁকায় ঈশানী, ‘কী জানি, বাড়িটা হয়তো কিছু বলতে চাইছে আমাদের।’

‘আচ্ছা? কী বলছে?’

‘বলছে কয়েকশো বছর ধরে ওরা শান্ত হয়ে পড়ে আছে। তার মধ্যে একদিন আমরা এসেছি। ওরা আমাদের বলতে চায় এটা আমাদের জায়গা নয়। এখানে আমাদের থাকার কথা নয়। যার থাকার কথা তার অপেক্ষা করছে। সে ছেড়ে চলে গেছে বলে অভিমানে ভেঙেচুরে পড়েছে বাড়িটা। এমন করে কালের গর্ভে তলিয়ে যাবে তাও কাউকে থাকতে দেবে না তার ভিতরে।’

‘ধুর, বাড়ি অত কিছু ভাবে না। কেউ এসে যত্ন নিলে সেভাবে থাকতে শুরু করলে, কে জানে এখানেও হয়তো মানুষ থাকতে পারবে। বাচ্চার হাসি শোনা যাবে, বুড়োদের রাগারাগি শোনা যাবে, শুধু একটু যত্ন নিতে হয়…’

চারুর বুক থেকে উঠে পড়ে ঈশানী, ‘চল, বাইরেটা দেখে আসি। পুরোনো বাড়ির কুয়োতলা দেখতে ভারি ভালো লাগে আমার।’

দুজনে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করে। এখানে আলো কম। তাও ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বালায় না ওরা। কেবল শক্ত করে চারুর হাত ধরে পথ খুঁজে নেয় ঈশানী। একসময় হুট করেই ওর হাতের উপর চাপটা বেড়ে ওঠে, ‘এই, এখানে কিন্তু অনেকগুলো অপমৃত্যু হয়েছে চারু, একদল মানুষ কচুকাটা হয়েছে। ভূত-টুত নিশ্চয়ই আছে এখানে।’

‘তো? আমি কী করে জানব?’

‘না জানার কী আছে? তুইতো হাঁড়ি হয়ে পড়েছিলি এখানে। কিছু দেখিসনি? অবশ্য ভগবানের নামে ভূত পালায়…’ খিলখিল করে হেসে ফেলে ঈশানী, ‘ছোটবেলায় ভয় পেলে মা একটা মন্ত্র বলতে শিখিয়েছিল—ভূত আমার পুত/ পেত্নী আমার ঝি/ রাম লক্ষণ বুকে আছে/ ভয়টি আমার কী? এখন কী বলব? কালো হাঁড়ি বুকে আছে ভয়টি আমার কী?’

‘কালো হাঁড়ি বুকে আছে শুনতে কেমন অশ্লীল লাগছে না?’

ওরা দুজনে হেসে ওঠে। হাসতে হাসতেই ঈশানী বলে, ‘সত্যি রে, অনেক বছর আগে যদি জন্ম হত…।’

‘কেন?’

‘এই যে ধর এই বাড়িগুলোতে কারা থাকত, তাদের দেখতে কেমন ছিল, স্বভাব চরিত্র কেমন ছিল, কাকে ভালোবাসত, কীসে দুঃখ পেত, কোনও কিছুই আর জানতে পারব না আমরা। আর আমাদের দেখ, আজ থেকে তিনশো বছর পর সবাই সবকিছু জানবে। জাস্ট ইন্টারনেটে একবার সার্চ করলেই আমাদের ইনফরমেশন বেরিয়ে যাবে…’

‘তাতে ক্ষতি কী তোর?’

‘ক্ষতি নেই? লোকে জানবে ঈশানী প্রামাণিক তার বান্ধবি অভিরূপা দত্তকে মদ খেয়ে যৌন হিংসার চোটে গলা টিপে খুন করেছে।’

‘সত্যি করেছিস নাকি?’

‘আমি কী করে বলব? আমি তো মাল খেয়ে ছিলাম। তুই বল।’

চারু একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, ‘তুই খুন-টুন করতে পারিস বলে আমার বিশ্বাস হয় না। তবে যৌন হিংসা মারাত্মক জিনিস, মাথায় উঠলে কাকে কী করে দেয়…’

ঈশানী বাঁকা চোখে ওর দিকে চায়, ‘যাহ্ শালা! তুই কী করে জানলি? তোর কবে যৌন হিংসা হল?’

‘যখন তুই আমার কপালে হাত বুলিয়ে দিস।’

‘সে তো তোরই শরীর…’

‘কোনও শরীরই তো আমার নয়…’

ঈশানী হাওয়ায় হাত তোলে, ‘তো কী করব?’

‘আমার হাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দিবি।’

ঈশানী খিকখিক করে হেসে ফেলে। কপাল চাপড়ায় একবার। কোনরকমে হাসির দমক থামিয়ে বলে, ‘আমি অভিকে খুন করিনি চারু। তবে আমার আফসোস হয়।’

‘কী নিয়ে?’

‘ওকে তেমন করে ভালোবাসতে পারিনি। বাসলে হয়তো এতটা ডেস্পারেট হয়ে যেত না। আর আফসোস হয়…’

‘কীসে?’

‘বাবা এতদিন অসুস্থ ছিল, কষ্ট পেয়েছে, ছটফট করেছে। এমনকী আমি জানি আসন্ন মৃত্যুর ভয়ও পেয়েছে। বারবার বলেছি দেখো, সেরে যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাবাকে কোনওদিন বলা হয়নি—দেখো, আমি থাকতে তোমার কিছু হতে দেব না। তুমি শুধু ভয় পেয়ো না বাবা। তোমার মেয়ে আছে…কারণ আমি ভেতরে ভেতরে জানতাম আমার কিছু করার ক্ষমতা নেই।’

ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে আরও কিছুদূর এগিয়ে আসে ওরা। চারটে পুরোনো বাড়ি চারটে ক্ষুধার্ত দানবের মতো ঝুঁকে এসেছে মাঝখানটায়। চারটে নরখাদক মিলে দুটো মানুষের দিকে লোলুপ দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে যেন।

চত্বরটা পেরিয়ে গেলে এক ধারে একটা ছোট জলাশয়। খানিকটা স্থির জলও আছে তাতে। তার শ্যাওলা ধরা সিঁড়ির উপর কিছুক্ষণ বসে ওরা গল্প করে। জলের উপরে দুলন্ত গাছের ছায়া ধীরে ধীরে ওদের মুখের উপর এসে দুলতে থাকে। কিছুক্ষণ সেই ভাবে গল্প করে ওরা উঠে আসে।

চারদিক ঘুরতে ঘুরতে পুরোনো কুয়োটার কাছে এসে উপস্থিত হয় একসময়। কুয়োটা বড়। উপর দিকে একটা তারের জাল দিয়ে ঢাকা। সেটাও মধ্যে মধ্যে ছিঁড়ে গেছে। উঁচু পাঁচিলের একদিক খসে পড়েছে নিচে।

চারুর হাত ধরে সেদিকে এগিয়ে যায় ঈশানী। একবার ভেতরে উঁকি মেরে উঠে বসে পড়ে পাঁচিলের উপর। চারু বাধা দেয়, ‘এই নেমে দাঁড়া। নিচে পড়ে যাবি তো…’

ঈশানী মুখ ঘুরিয়ে নেয়, ‘অতই যখন চিন্তা তখন বেঁধে দে।’

‘বাঁধব কী করে? এখানে দড়ি কোথায়?’

সামনে ঝুঁকে চারুর দুটো হাত ধরে কোমরে টেনে নেয় ঈশানী, ‘বোকা কোথাকার, দড়ি দিয়ে নয়, হাত দিয়ে।’

ওর শরীরের ঠেলায় কুয়োর ভিতর প্রায় ঝুঁকে পড়ে চারু। ওর মাথাটা ঢুকে আসে ভেতরে। আর একটু হলেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভিতরে গিয়ে পড়ত দুজনে। বুকের ভিতরটা গরম হয়ে ওঠে ঈশানীর। কোনরকমে হাত দিয়ে একটা প্রান্ত খামচে ধরে নিজেদের আটকে নেয় সে।

কিন্তু ততক্ষণে চারুর চোখ পড়েছে কুয়োর নিচের দিকে। তার মুখটা হঠাৎ করেই লাল হয়ে ওঠে। চিৎকার করে সরে আসতে চাই ও। চিৎকারটা ছড়িয়ে পড়ে ফাঁকা চত্বর জুড়ে।

‘কী হল চারু?’ দু’গালে হাত রেখে ওকে শান্ত করতে চায় ঈশানী। ছেলেটার সমস্ত শরীরটা কাঁপছে। যেন এইমাত্র একটা বিদ্যুতের শিখা স্পর্শ করে গেছে ওকে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতেই বসে পড়ে ও। ভয়ার্ত চোখে চেয়ে থাকে কুয়োর দিকে, মুখ থেকে বেরিয়ে আসে আতঙ্ক জড়ানো কথাগুলো, ‘ওই লোকগুলো…লোকগুলো…’

‘কোন লোক? কাদের কথা বলছিস?’

‘এখানে…এখানে ওদের জড় করেছিল লোকগুলো।’ আঙুল তুলে দেখাল চারু, ‘লোকগুলোর মাথা পাঁচিলে আর উল্টোদিকে ওদের বাড়ির মেয়েদের মাথা। জ্যান্ত! তারপর চোখের সামনেই মেয়েগুলোকে পেছন থেকে তলোয়ার দিয়ে…আর মাথাগুলো ওই পাঁচিলের উপরে রেখে…আঃ…’ আবার ছিটকে পড়ে চারু। নিজের বুক খামচে ধরছে ও বারবার। ঈশানী দৌড়ে যায় ওর দিকে। ও বিড়বিড় করে বলেই চলে, ‘একজন একজন করে…সমস্তটা ভেসে যাচ্ছিল রক্তে…’

চারপাশে তাকায় সে, ‘এত চিৎকার করছে কে? এত আওয়াজ কেন? চুপ…সবাই চুপ…ওই যে ওই ঝুলছে ওদের গলাকাটা শরীর…ওই বাড়ির বারান্দা থেকে…ওই যে পড়ে আছে দেহ…আর রক্ত…’ স্প্রিং-এর মত ছিটকে বারবার সরে যায় চারু।

আবার ছুটে গিয়ে ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে ঈশানী। ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে মাথায়। চারুর চোখ হারিয়ে গেছে আকাশে, ‘আমার…আমার কষ্ট হচ্ছে খুব রুনু…’

ও চেয়ে দেখে ছেলেটার নাক কান আর মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে আসছে। সেটা মুছতে মুছতে ওকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে ঈশানী, ‘এই জায়গাটা ভালো নয়। চল, আমরা এখান থেকে চলে যাই…’

ওর হাতটা ধরে প্রাণপণে দৌড় দেয় ঈশানী। আশপাশের প্রত্যেকটা বাড়ির ভেতর থেকে যেন চিৎকার শুনতে পাচ্ছে ওরা। হাহাকার করছে সবাই, সেই সঙ্গে তলোয়ারের আওয়াজ, মেয়েদের বুকভাঙা কান্না, রক্তের গন্ধ, লাশের গন্ধ, সেইসঙ্গে কারা যেন আকাশ ফাটিয়ে হাসছে…

‘আমাকে ছেড়ে দে রুনু…’ প্রবল যন্ত্রণায় সিমেন্টের চাতালের উপরে বসে পড়ে চারু। জোরে জোরে শ্বাস পড়ছে ওর।

ওর সামনে গিয়ে বসে পড়ে ঈশানী। তারপর দুহাতে ঢেকে দেয় ওর চোখ, ‘ছাড়ব না।’

‘আমাকে চলে যেতে হবে, আমি আর এখানে থাকতে পারব না রুনু, এই জগৎটা আমার নয়…আমাকে চলে যেতে হবে…’ হাঁপাতে হাঁপাতেই ক্লান্ত গলায় বলে ছেলেটা।

এতক্ষণে ওর শারীরিক যন্ত্রণাটা কমে এসেছে। বুকটা ওঠানামা করছে দ্রুত। চোখের মণিদুটো এখনও ঝাপসা হয়ে আছে।

ঈশানী ওর গালে নরম করে হাত রাখে একবার। তারপর কপালে ঠোঁট ঠেকায়, ‘বেশ, চলে যাস…’

কাকতাড়ুয়া – 16 অধ্যায়

ষোড়শ অধ্যায়

সোমবারে কাজের প্রেশার এমনিতেই বেশি থাকে। নিজের চেম্বারে বসে ল্যাপটপের স্ক্রিনে দ্রুত কাজ সারছিলেন গোস্বামী। এমন সময় বাইরে থেকে মেয়েলি গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, ‘স্যার, আসব?’

গোস্বামী উত্তর দিলেন না। একবার মুখ তুলে আবার মাথা নামিয়ে নিলেন। প্রশ্নটা আবার আসবে ভেবেছিলেন, কিন্তু এল না। উল্টে কাচের দরজাটা একটা লাথিতে খুলে গেল।

জিন্সের সঙ্গে জ্যাকেট গোছের একটা জামা পরে ঢুকে এল মেয়েটা। গোস্বামী অবাক হয়ে তাকালেন তার দিকে, ‘একী! তুমি নক না করে ঢুকে পড়লে কেন?’

‘আপনি এখানে বসে হস্তমৈথুন করেন নাকি যে নক করে ঢুকতে হবে?’ ঈশানী এগোতে এগোতে বলল।

‘স্কাউন্ড্রেল! তোমার লজ্জা করছে না, বসের সঙ্গে এই ভাষায় কথা বলতে?’

চুকচুক করে মেয়েটা একটা শব্দ করে মুখ দিয়ে, ‘ওই দেখুন, আপনারা এই ইংরেজি গালি দেন, ফ্রাস্ট্রেশন ক্লিয়ার হয় না। উপরের বদলে নিচে দিয়ে বের করতে হয়…’

কথাটা বলে পকেট থেকে একটা বিড়ি বের করে দেশলাই দিয়ে ধরায় ঈশানী। তার ধোঁয়াটা উড়ে যায় উপর দিকে। দেশলাইটা নিভিয়ে ফেলে দেয় দূরে।

বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান গোস্বামী। কী ভয়ঙ্কর স্পর্ধা মেয়েটার! চিৎকার করে ওঠেন তিনি, ‘হাউ ডেয়ার ইউ! তুমি অফিসের মধ্যে বিড়ি ধরাচ্ছ! এক্ষুনি ফায়ার অ্যালার্ম বাজবে।’

‘বাজুক, ভালোই তো। কারণ এক্ষুনি এখানে আগুন লাগতে চলেছে।’ কথাটা বলে পা দিয়ে একটা চেয়ার টেনে এনে তার উপর বসে পড়ে ঈশানী।

ওর দিকে তাকিয়ে হিংস্র গলায় বলেন গোস্বামী, ‘তুমি জানো? তোমাকে আমি চাকরি থেকে বের করে দিতে পারি…’

‘আজ্ঞে না স্যার। ওটা আমি নিজেই ম্যানেজ করে নিতে পারব। সব থেকে বড় কথা আমাকে চাকরি থেকে বের করার অবস্থায় আপনি নেই। কারণ এই মুহূর্তে আপনার ব্যাংকের যা কন্ডিশন তাতে এই কোম্পানি আর কতদিন চালাতে পারবেন জানি না।’

‘মানে! কী বলতে চাইছ তুমি?’

ঈশানী বিড়িতে বড় করে টান দেয় একটা, ‘ওই যে বললাম, এখানে আগুন লাগতে চলেছে। তবে ঘরে নয়, আপনার গাঁড়ে।’ কথাটা বলে গোস্বামীর ফোনের দিকে বিড়ি ধরা হাতেই ইশারা করে ঈশানী। রোবটের মতো ফোনটা তুলে সদ্য আসা মেসেজটা চেক করেন গোস্বামী। এবং করতেই তার বুকের রক্ত জল হয়ে যায়।

‘এ…কী এসব! আমার সব টাকা…’

খিকখিক করে হাসে ঈশানী।

ফোনটা কাঁপা হাঁতে টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখেন গোস্বামী, ‘কী? কী করেছ তোমরা? কে আছে এর পেছনে?’

‘আপনার পেছনে? বাঁশ পড়ে গেছে স্যার। ও আর বার করা যাবে না।’ বিড়িতে টান দেয় ঈশানী, একটা পায়ের উপর অন্য পা’টা তুলে দিয়ে বলে, ‘আপনার হাতের ছাপ, পায়ের ছাপ, চোখের মণির ছাপ, আরও কিছু বাজে বাজে জায়গার ছাপ জাল করে কেউ বা কারা আপনার অ্যাকাউন্টের সমস্ত টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে কোনও অফসোর একাউন্টে। অফসোর বোঝেন তো স্যার? সুইস ব্যাঙ্ক? যেখানে আপনার বাবুরা কালো ধোন রাখে। আর আপনারা মাঝে মাঝে মুখে নেন…’

গোস্বামীর সমস্ত মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কিছু বলতে পারেন না তিনি। হতবাক চোখে নিজের ফোনের দিকে চেয়ে থাকেন। ঈশানী বলে চলে, ‘তারপর ধরুন আপনার যত শেয়ার, সব ডীম্যাট অ্যাকাউন্ট ভেঙে কোথায় ভোগে গেছে কে জানে…চাইলে আপনার বাড়িতে পরা ছেঁড়া হাফপ্যান্টটাও টেনে নিয়ে যেত শালারা। আপনার ভালো গামছা আছে তো স্যার? বাঙালির আবার ওইটা নিয়েই একটা ফ্যাসিনেশন ছিল এককালে…’

‘আমি…আমি তোমাকে পুলিশে…’

টেবিলের উপর একটা চাপড় মারে ঈশানী, ‘আমি তো আপনাকে শুধু খবর দিতে এসেছি। আমার উপর রাগ দেখাচ্ছেন কেন বলুন তো? অ্যাঁ?’ কথাটা বলে বিড়িতে টান দিয়ে বড় করে একটা নিঃশ্বাস নেয় সে, ‘এবার দেখুন, আপনি আর যেহেতু আমাকে পয়সা দেবার মতো অবস্থায় নেই, তাই এই চাকরি ছাড়তে বাধ্য হচ্ছি…’

রেজিগনেশন লেটারটা গোস্বামীর সামনে ছুড়ে ফেলে দিল ঈশানী। গোস্বামী দেখেন তাতে বড় করে লেখা, ‘আমি চললাম, আপনি বাল ছিঁড়ুন।’

চেয়ার থেকে উঠে এসে ওর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে মেয়েটা বলল, ‘আপনাকে আমরা কিনে নিয়েছি স্যার। ইউ উইল লিভ দ্যা ওয়ে উই ওয়ান্ট, স্পিক দ্যা ওয়ে উই ওয়ান্ট, ফাক দ্যা ওয়ে…’ কথাটা বলতে গিয়ে থেমে যায় ঈশানী, ‘থাক, আজকের পর থেকে ও আর এমনিতেই হবে না আপনার।’

এতক্ষণে সত্যি বাজতে শুরু করেছে ফায়ার অ্যালার্মটা। কথাগুলো বলে লাথি মেরে চেয়ার উল্টে দিয়ে দরজার দিকে হাঁটা লাগায় ঈশানী। কিছুদূর এসে আবার থেমে যায় সে। পেছন ঘুরে বলে, ‘আপনি আমার বাপ হতে চেয়েছিলেন না? আমার বাপ খুব ছোটবেলায় একটা সাজেসশন দিয়ে গেছিল আমাকে। পিতৃআজ্ঞা পালন না করে যাই কোথায় বলুন…’

এগিয়ে এসে গোস্বামীর তলপেটে একটা লাথি মারে ঈশানী। নিজের চেয়ারের উপরেই উল্টে পড়েন গোস্বামী। পানের পিক ফেলার একটা বালতি রাখা ছিল চেয়ারের পাশে, সেটা উল্টে যায়। নিজের পানের পিকে নিজেই মাখামাখি হন। বিড়িটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় ঈশানী।

স্কুটি করে বাড়ি আসতে আধঘণ্টা লাগে ওর। বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছিল তখন চারু ঘরেই ছিল। কিন্তু ওকে আর দেখতে পায় না ঈশানী। ঘরের দরজা খুলে ও অবাক হয়ে দেখে বিছানার উপর একটা নীল শাড়ি রাখা আছে কেবল। আর তার ঠিক পাশেই কলকাতার ম্যাপে একটা বিশেষ জায়গায় পিন গাঁথা। এটা চারুই করেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন? ওকে কি ওখানে যেতে বলছে? হঠাৎ হলটা কি ছেলেটার?

সাতপাঁচ ভেবে শাড়িটা পরে চোখে হালকা কাজল দিয়ে বেরিয়ে পড়ে ঈশানী।

স্কুটি করে বাবুঘাটের কাছে পৌঁছতেই সমস্ত জায়গাটায় একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করল ও। অন্যদিন এখানটা গাড়িঘোড়ার জ্যামে ভর্তি থাকে। আজ সেসবের চিহ্নমাত্র নেই। তার বদলে কাতারে কাতারে ছেলেমেয়ে শাড়ি আর পাঞ্জাবি পরে প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে হেঁটে চলেছে। বাসগুলোতেও অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের ভিড়। বাইকে করেও যাচ্ছে কেউ কেউ।

অবাক লাগল ঈশানীর। এরকম দৃশ্য সাধারণত ভ্যালেন্টাইনস ডে আর সরস্বতী পুজোয় দেখা যায়। আজ তো সেসব কিছুই নয়, তাহলে রাস্তায় এমন যুগলের ঢল নেমেছে কেন? এত প্রেম করার হিড়িক পড়েছে কেন?

অবাক হয়ে সমস্তটা দেখতে লাগল ঈশানী। কেউ হাসছে, কেউ গান গাইছে, কেউ হাসতে হাসতে একে অপরের গায়ে ঢলে পড়ছে। সবারই মুখে হাসি। সবার গায়ে রঙিন জামাকাপড়। তাদের মধ্যে একজনকে হঠাৎ থামাল ঈশানী, ‘এ ভাই, এখানে হঠাৎ হচ্ছেটা কী?’

‘কার্নিভাল হচ্ছে দিদি। জানেন না?’

‘কার্নিভাল! কীসের?’

‘রোজ কার্নিভাল। লোকে গোলাপ নিয়ে আসবে আর গিফট করবে, ব্যাস। এই কেস…আপনি ফেসবুক করেন না? এতদিন ধরে অ্যাড দিল…’

‘আমার আসলে ফেসবুক টেসবুক…’ কথাটা শেষ না করেই আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে প্রিন্সেপ ঘাটের গেটের কাছে এসে পড়ল ও।

স্কুটিটা বাইরে পার্ক করে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে ঈশানী হাঁ হয়ে গেল। চারিদিকে গিরগিজ করছে ছেলেমেয়ের দল। হাসছে, গান গাইছে। ঠিক যেন শহরের বুকে একখণ্ড সরস্বতী পুজো ভুল করে ঢুকে পড়েছে কোনও ফাঁক দিয়ে। অল্পবয়সি ছেলে মেয়েদের কলকাকলিতে ভরে আছে জায়গাটা।

মনে মনে ভাবল ঈশানী, এখানে এতকিছু আয়োজন হয়েছে! চারু জানত, অথচ ও জানত না!

লোকজনের কাউকেই ও চেনে না। কী করবে ভেবে না পেয়ে গোল করে একবার চারদিকটা ঘুরে ফেলল ও। মনটা খারাপই হয়ে গেল। এত কিছুর মাঝে, এত প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে ও একা দাঁড়িয়ে। সেই ছেলেবেলায় যেমন…

‘ম্যাডাম, আপনি কি আমাকে খুঁজছেন?’

পিছন থেকে ডাকটা শুনে ঘুরে তাকাল ঈশানী। তাকাতেই মুখটা হাঁ হয়ে গেল ওর। চারুর গায়ে আপাতত একটা কালো পাঞ্জাবি। এটা তো বাড়িতে ছিল না! নিশ্চয়ই আজ বেরিয়ে কোথাও থেকে কিনেছে।

ওকে দেখে মনে শান্তি পায় ঈশানী, ‘এসব কী হচ্ছে বল তো? এখানে আসবি আমাকে আগে থেকে তো জানাবি…’ কথাগুলো বলতে গিয়েও থেমে যায় সে। কয়েক সেকেন্ড পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে, ‘চারু, এসব তুই করিসনি তো?’

চারু হাসে। তারপর হাতের একটানে কাছে টেনে নেয় ওকে। হাতের সাদা ফুলটা গুঁজে দেয় ওর কানের পাশে। বড় মাঠটার মাঝখানে দাঁড়িয়ে, কয়েকশো ছেলেমেয়ের মাঝে একে অপরের দিকে চেয়ে থাকে নিঃশব্দে। ওদের ঘিরে যেন মেলা বসেছে একটা। দেওয়ালে ঝলমল করছে ওদেরই এঁকে যাওয়া কার্টুন। লাল গোলাপে ভরে আছে জায়গাটা। কেবল ঈশানীর নীল শাড়ি, চারুর কালো পাঞ্জাবি আর মাথায় গোঁজা সাদা ফুলটা যেন তার মধ্যে থেকে অদৃশ্য রেখা দিয়ে আলাদা করে দিয়েছে কেউ।

অল্প অল্প দুলতে থাকে ঈশানী, চারু ওর মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে, ‘চুপ করে আছেন যে, কিছু জিগ্যেস করবেন ম্যাডাম?’

ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকায় ঈশানী, ‘কী খবর তোর?’

‘তুই জানিস না? যার সঙ্গে চব্বিশ ঘণ্টা থাকিস তার খবর জানিস না?’

‘জানি তো, তাও হাঁড়ির খবর নিচ্ছিলাম…’

চারু হাসে না, মুখে ছদ্ম বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে বলে, ‘বলি হাঁড়ি যাই তোর কথার মার প্যাঁচ। হাঁড়ি স্বীকার করলাম…’

খিলখিল করে দুজনে হেসে ওঠে। কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই নাচতে থাকে সবাই। মুহূর্তগুলো ডুবে যায় চরাচরে। কিছুক্ষণের জন্যও ঈশানীর মনে হয় ওদের আশপাশ ফাঁকা হয়ে হয়ে গেছে। কোথাও কেউ নেই। কেবল চারুর নরম আদুরে দুটো চোখ আর বাতাসে হালকা জুঁই ফুলের গন্ধ জড়িয়ে দিয়েছে কেউ।

কিছুক্ষণ পর বাইরের রাস্তা থেকে একটা অপরিচিত যান্ত্রিক শব্দ আসতেই একটা হইহই পড়ে যায় ছেলেমেয়েগুলোর মধ্যে। কী যেন একটা এসেছে বাইরে!

আওয়াজটা শুনতে পেয়েই ঈশানীর হাত ধরে দৌড় দেয় চারু। ঈশানী ওকে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে, ‘কী ব্যাপার? আবার কী হল? দৌড়াচ্ছিস কেন?’

কোনও উত্তর দেয় না ছেলেটা। ওর হাত ধরে প্রাণপণে টানতে থাকে মেইন গেটের দিকে।

প্রিন্সেপ ঘাট থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেই ঈশানী অবাক হয়ে দেখে একটা দোতলা বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে বাইরের রাস্তায়। একটা আস্ত দোতলা বাস! কিন্তু কলকাতায় কি এখনও দোতলা বাস চলে?

অবাক হয়ে ও একবার বাসটার দিকে, একবার চারুর মুখের দিকে তাকাতে থাকে। সে তাড়া দেয়, ‘হাঁ করে দেখছিস কী? তাড়াতাড়ি না গেলে সিট দখল হয়ে যাবে…’

ওর হাত ধরেই চারু আবার টান দেয়। দুজনে মিলে একরকম লাফাতে লাফাতে উঠে পড়ে বাসের দোতলায়। ছুটে গিয়ে একদম সামনের সিটে বসে পড়ে চারু। হাত দিয়ে রিজার্ভ করে রাখে পাশের সিটটা। ঈশানী সেখানে বসে পড়তেই ধীরে ধীরে গতি নেয় বাসটা।

‘তুই আমার জন্য কেন এত কিছু…’ থমথমে গলায় হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে ও।

চারু ওর চুলে হাত রাখে, ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে ওর, ‘কারণ তুই আমার শহর জোড়া লাল গোলাপের মাঝে, বাঁচিয়ে রাখা ভোরের শিউলি…’

ওর ফোনটা হাতে নিয়ে ইউটিউবে গিয়ে একটা বিশেষ গান চালিয়ে দেয় ছেলেটা। তারপর ইয়ারফোনটার দুটো দিক দুজনের কাণে গুঁজে দেয়।

Georgia, wrap me up in all your

I want you in my arms

Oh, let me hold you

I’ll never let you go again like I did

Oh, I used to say

সামনে বিশাল কাচের জানলার দিকে চোখে মেলে দেয় ওরা। দেখে মনে হয় ড্রাইভার নেই, তাও চলছে বাসটা। শহরটা সিনেমার পর্দার মতো ফুটে ওঠে চোখের সামনে।

ওদের কানে বাজতে থাকে গানটা।

Love her, once again

You fell, I caught you

I’ll never let you go again

বাস ভর্তি হয়ে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। প্রথমে বাবুঘাটের দিকে, তারপর সেটা ছাড়িয়ে কলকাতার অলিতে গলিতে রাজপথে ঘুরে বেড়াতে থাকে বাসটা।

বাসের দোতলার জানালা থেকে হাঁ করে সেই শহরের দিকে তাকিয়ে থাকে দু’জন। কখন যেন ঈশানীর হাতটা এসে জড়িয়ে যায় চারুর হাতে। চোখ বেয়ে জল নামে তার…

I was lost within the darkness, but then I found her

I found you…

অভিষেকের যখন ঘুম ভাঙল তখন ওর সারা শরীরে একটা ঝিমঝিম ভাব। মাথাটা চেপে ধরে ও মনে করার চেষ্টা করল কাল রাতে কোথায় ছিল। হ্যাঁ, ফেসবুকে ক’দিন ধরে কথা হচ্ছিল একটা মেয়ের সঙ্গে। কাল তার সঙ্গেই ডেট ছিল। দেখাও করেছিল। তারপর সিগন্যাল পেতে দুজনে মদ খেতে গেছিল কোথায় যেন…খাওয়া সবে শুরু করেছে…

আর কিছু মনে নেই ওর। তারপর চোখ খুলেছে এই বন্ধ ঘরের ভিতরে।

চারিদিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল অভিষেক। ঘরটা দেখে মনে হয় একটা হসপিটালের মধ্যে শুয়ে আছে ও। মাথার উপরে এসি মেশিন থেকে হাওয়া বেরোনোর শোঁশোঁ শব্দ। দূরে একটা টেলিফোন বেজে উঠল ক্যানক্যান করে। অজানা কোনও মেশিন বিঁপবিঁপ শব্দ করে চলেছে। কাল রাতে কি তাহলে মদ খেয়ে কোনও অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল? গায়ে হাতে পায়ে অবশ্য কোনও ব্যথা অনুভব করতে পারল না।

‘কেউ আছেন? কেউ…’ দুবার ডাকার চেষ্টা করলে অভিষেক। জামা থাবড়ে দেখল ফোনটা পর্যন্ত ওর কাছে নেই। তারপরই মনে পড়ল কাল সকালেই পকেটমারি হয়েছে। তারপর থেকে তাড়াহুড়োয় সিমটাও ব্লক করা হয়নি।

কয়েকবার চিৎকার চেঁচামেচির পর হুট করেই খুলে গেল দরজাটা। দরজা খুলে একটা মেয়ে ঢুকে এল ঘরে। তাকে দেখে মনে কিছুটা স্বস্তি পেল অভিষেক। এই মেয়েটার সঙ্গেই তো কালকে ছিল। এখন তার গায়ে সেই একই জামা। সেই একই রকম নরম দৃষ্টি চোখে। চোখ থেকে সহানুভূতি ঝরে পড়ছে।

এগিয়ে এসে অভিষেকের পাশের চেয়ারে বসে পড়ল মেয়েটা। তারপর ওর কপালে একবার হাত বুলিয়ে বলল, ‘কেমন আছ এখন?’

অভিষেক উঠে বসার চেষ্টা করল, ‘আমার কী হয়েছে?’

মেয়েটা ওকে আশ্বস্ত করে মাথা নাড়ে, ‘আরে নানা, নতুন করে কিছু হয়নি। সমস্যাটা অনেকদিনের…’

‘কীসের সমস্যা?’

‘আলুর।’ হালকা হেসে বলে মেয়েটা।

‘তুমি কী বলতে চাইছ?’ অভিষেকের গলার স্বর কঠিন হতে থাকে।

‘আলুর চাষ খুব কঠিন জিনিস। যেমন লাভ, তেমন ক্ষতি। একবার রোগ লাগলে পুরো মাঠ কে মাঠ শেষ। চাষিকে গলায় দড়িও দিতে হয়। তাই রোগ লাগা আলু তুলে ফেলাই ভালো।’

‘দেখ ভাই…’ অভিষেক হাত তুলে বাধা দেয় ওকে, ‘আমার এসব ভালো লাগছে না। আমি এখান থেকে কাটব।’

‘হ্যাঁ, কাটাকাটির জন্যই আনা হয়েছে তোমাকে এখানে।’

অভিষেক ছটফটিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। মেয়েটা বুকের উপর একটা ধাক্কা মেরে ওকে আবার বিছানাতেই ফেলে দেয়, ‘আপনি চাইলে অপারেশন নাই করাতে পারেন। আপনার বডি, আপনার চয়েজ। কিন্তু সেক্ষেত্রে কী হবে সেটা একবার ভালো করে বুঝে নিন, কেমন?’

হাতের ফোনটা তুলে ধরে স্ক্রিনটা ওকে দেখায় মেয়েটা। অভিষেক চমকে ওঠে। এটা তো ওর নিজের ফোন! এমনকী ওর ফেসবুক প্রোফাইলটাও খোলা আছে সেখানে। কিছু ছবি আপলোড হয়েছে প্রোফাইল থেকে।

‘আপনি তার মানে চুরি করেছিলেন ফোনটা। কিন্তু আমার লকটা…’

‘আঃ, যা বোঝাচ্ছি চুপ করে বুঝুন।’ স্ক্রল করতে থাকে মেয়েটা। অভিষেক অবাক হয়ে দেখে ছবির সঙ্গে সঙ্গে কিছু ভিডিও পোস্ট হয়েছে ওর নিজের প্রোফাইল থেকে। ভিডিওতে ও নিজেই ক্যামেরার সামনে বসে চোখে জল নিয়ে কীসব যেন বলে চলছে। এই ভিডিওগুলো কবে শুট করল মনে পড়ছে না তো? বলছেটাই বা কী?

‘এই ভিডিওগুলোতে আপনার এতদিনের কৃতকর্মের সমস্ত কনফেশন আছে। আপনি নিজে মুখে স্বীকার করছেন আজ অবধি কী কী পাপ করেছেন। সঙ্গে প্রমাণও দিয়েছেন। ফলে অবিশ্বাস করার কোনও জায়গা নেই।’

অভিষেক এক ঝটকায় ফোনটা নিতে যায়, মেয়েটা আবার ধাক্কা মেরে শুইয়ে দেয় ওকে, ‘এখন এগুলো সব “ওনলি মি” করে পোস্ট করা আছে। আপনি যদি চান পুলিশের এখানে হাজির হতে কুড়ি মিনিটের বেশি সময় লাগবে না। তারপর ধরুন পাবলিকের হাসাহাসি, জেল, পুলিশের ক্যালানি, সোশ্যাল লিঞ্চিং-এর চক্করে আপনার মায়ের আত্মহত্যা…কেসটা কি খুব ভালো হবে? তার উপর জেলে আবার আপনাকে সেক্স অফেন্ডারদের সেলে রাখা হবে। তারা এমনিতেই আপনার আলু চটকে দেবে…তার থেকে কী দরকার? এখনই ওসব মোহমায়া ত্যাগ করে ফেলুন না হয়…’

অভিষেক হতবাক মুখে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। মুখে কথা ফোটে না তার। শরীরটা দুবার কেঁপে ওঠে থরথর করে। বিড়বিড় করে বলে, ‘আপনি…আপনি কেন আমাকে…’

পকেট থেকে বের করে একটা সিগারেট ধরায় মেয়েটা, অভিষেকের বিস্মিত মুখের দিকে চেয়ে অল্প হেসে বলে, ‘আরে নানা। এটা আমার খাবার জন্য নয়। আমি সিগারেট খাই না। এটা আপনার জন্য…’ কথাটা বলেই যেন কী মনে পড়ে তার, ‘আহঃ! এখানে তো সিগারেট খাওয়া বারণ! কোথায় ফেলি বলুন তো? একটা এসট্রে…’

চারপাশে তাকিয়ে সিগারেটের জ্বলন্ত দিকটা চকিতে অভিষেকের হাঁ করা মুখের ভিতর ঢুকিয়ে মুখটা চেপে ধরে মেয়েটা। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠতে গিয়েও পারে না অভিষেক। ওর গোটা শরীর ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে যায়।

কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই ধরে রেখে উঠে পড়ে মেয়েটা। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই যাচ্ছিল, হঠাৎ থমকে যায়, ঘুরে তাকিয়ে বলে, ‘ভালো কথা, আপনার অপরেশনের বিলটা আপনার অ্যাকাউন্ট থেকেই পে করে দিয়েছি আমি। দেড় লাখ চাইছিল, এক লাখ কুড়িতে রফা হয়ে গেছে…’

কথাটা বলে আর একবার মুচকি হেসে সটান ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মেয়েটা…

সন্ধ্যাবেলা বিজলিমারি ক্যাম্প সাইটে এসে পৌঁছালো মানিক। যতদিন এখানে পোস্টিংয়ে আছে, দিনের বেলা ছাড়া আসা হয়নি। তাও পুলিশের কাজে।

আজ সকাল থেকেই মাথাটা ভার হয়েছিল ওর। এই খুনের কেসটার আদতে কোনও লিড পাওয়া যাচ্ছে না। খুনি একটা ছোট এভিডেন্স অবধি ফেলে যায়নি, যাতে তাকে খুঁজে বার করা যাবে। ইনস্পেক্টর বিশ্বাসকে দেখেও মনে হচ্ছে না খুব একটা আশার আলো দেখছেন বলে।

অগত্যা বিকেলে মাথাটা একটু পরিষ্কার করতে বাইক নিয়ে বেরিয়েছিল মানিক। বিশ্বাসের সঙ্গে একটু আগেই কথা হয়েছে। তিনি নাকি কী একটা অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন।

বাইকটা একটু দূরে দাঁড় করিয়ে ক্যাম্পের কাছাকাছি আসতেই নাদু নস্করের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। হন্তদন্ত হয়ে কী যেন কাজে বেরোচ্ছিলেন তিনি। মানিকের সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যেতে হেসে জিগ্যেস করল, ‘কী ব্যাপার? ক্যাম্প ফাঁকা নাকি?’

বিমর্ষ দেখাল নাদু নস্করের মুখটা, ‘ওই ঘটনার পর থেকে আর লোক আসছে না স্যার। এখানকার কাজকর্ম বোধহয় তুলতে হবে।’

মানিক ওকে আশ্বস্ত করে, ‘লোকে খুন হতে চায় না বটে, কিন্তু খুনের গল্প ভালোবাসে। ক’দিন অপেক্ষা করুন। কাস্টমারদের খুনের গল্পই শোনাতে হবে।’

দাঁত বের করে হাসে নাদু নস্কর, ‘আজ্ঞে গল্পের শেষে যদি খুনি ধরা পড়ে তাহলে শুনিয়ে আরও শান্তি।’

মানিক বোঝে কথাটার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন খোঁচা আছে। আগের হাসিটা আবার মুখে ফিরিয়ে এনে ক্যাম্পের ভেতরের দিকে হাঁটতে থাকে সে। কয়েক পা ভেতরে আসতেই একটা দোতারার শব্দ কানে আসে।

ক্যাম্পের পেছনের খেত থেকে আসছে আওয়াজটা। সেই বাউলটা কি আবার এসেছে আজকে? আওয়াজটা লক্ষ্য করে ক্যাম্প ছেড়ে এগিয়ে আসে মানিক। এখানে আলো বিশেষ নেই। ক্যাম্পের ফ্যাটফ্যাটে সাদা আলোই তেরচা হয়ে এসে পৌঁছায় এখানে।

দোতারার আওয়াজটা লক্ষ্য করে চরণদাসকে খুঁজে পায় মানিক। মাঠের উপরেই বসে টুংটাং করে দোতারা বাজিয়ে গুনগুন করে গান গাইছে লোকটা। কোথাও কেউ নেই। এই ফাঁকা মাঠের মাঝে কাকে গান শোনাচ্ছে কে জানে!

মানিক ওর দিকে হেঁটে আসতে দেখে দোতারা থামিয়ে লোকটা একটু হাসে। মানিক বসতে বসতে বলে, ‘থামলে কেন? ভালোই তো লাগছিল।’

একটা দেঁতো হাসে হাসি চরণদাস, ‘পুলিশ দেখলে ভয় লাগে স্যার। আর ভয় লাগলে গান গাওয়া যায় না।’

কথাটায় মজা পায় মানিক, ‘এখন তো পুলিশের উর্দি পরে নেই, তাও ভয় লাগছে?’

‘আমি তো বাউলের আলখাল্লা পরে নেই স্যার। তাহলে কি আমি গান গাইতে পারি না?’

মানিক বোঝে চরণদাস খ্যাপাটে হলেও কথার মারপ্যাঁচ বোঝে। সে ঘাসের উপরে হাত রেখে মাঠের প্রান্তের দিকে চায়। এই ক’দিনে যতগুলো জবানবন্দী শুনেছে তার মধ্যে কোথাও অসংগতি আছে, কোথাও সন্দেহের অবকাশ আছে। একমাত্র চরণদাসের কথার মধ্যে হালকা অবাস্তবতার ছোঁয়া আছে।

তার নাকি বারবার মনে হয়েছে যে কাকতাড়ুয়াটার সামনে বসে সে গান গায় সেটা জীবন্ত। আবার সেটাই খুনের পর মাঠ থেকে উধাও হয়ে যায়। এই দুইয়ের মধ্যে কি কোনও যোগসূত্র আছে?

একটা ব্যাপার মনে হয়েছিল মানিকের, তবে ইনস্পেক্টর বিশ্বাস হাসাহাসি করবেন বলে সেটা বলতে পারেনি মুখ খুলে। এই মুহূর্তে মাঠে আর কেউ নেই, এই বাউলটাও খ্যাপাটে গোছের, একে কথাটা বলা যেতেই পারে।

একহাতে ভর দিয়ে বসে আলাপ জমায় সে, ‘আচ্ছা ধরো কাকতাড়ুয়াটাই খুন করে পালিয়ে গেছে…’

চারণদাসের মুখে হাসি ফোটে, ‘আপনি সে জিনিস দেখেননি বলে বলছেন। ও কাকতাড়ুয়ার মুখ দেখলেই বুঝবেন খুন টুন করা তার কম্মো নয়।’

‘দেখব আর কী করে…’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মানিক, ‘তার ছবি আর কে তুলে রেখেছে?’

‘আমার কাছে আছে স্যার…’ কথাটা বলেই নিজের স্মার্ট ফোন বের করে চরণদাস, ‘আমি একবার তুলে রেখেছিলাম। এই যে সেই ছবি…’

কাকতাড়ুয়ার ছবিটা মানিকের সামনে মেলে ধরে চরণদাস। সত্যিই একটা কালচে হাঁড়ি আর তার নিচে একটা বাঁশের খুঁটির উপর জামা পরানো।

পাশে আরও ছবি আছে কিনা দেখতে স্লাইড করে মানিক। অন্য একটা ছবি চলে আসে ওর সামনে। ছবিটা চরণদাসের সামনে তুলে ধরে মানিক, ‘এই যে মেয়েটা…একে আপনি চিনতেন?’

জায়গাটা একটা স্টেজের ধার। সেখানে একটা অল্পবয়সি মেয়ের সঙ্গে ছবি তুলেছে চরণদাস। মেয়েটাই হাসি মুখে তুলেছে সেলফিটা।

‘চিনি বলতে…’ মনে করার চেষ্টা করে চরণদাস, ‘কলকাতায় দেখা হয়েছিল একবার। তারপর থেকে ফোনও করেছিল ক’বার…’

‘মানে, তুমি ছ’মাস ধরে এই মেয়েটিকে চেনো?’ মানিকের মাথার ভিতরে একটা সমুদ্র স্রোত আছড়ে পড়ে। পকেট থেকে ফোন বের করে ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের নম্বরটা ডায়াল করে সে।

ফোনটা বেজেই চলেছে। আজ ইনস্পেক্টর বিশ্বাসের ছেলেকে স্কুল থেকে আনতে যাওয়ার কেউ ছিল না। এদিকে চারটের সময় স্কুল ছুটি। তারপর কেউ না গেলে একা একা ফিরতে পারবে না ছেলেটা। ফলে বিশ্বাসকে নিজেকেই আসতে হয়েছে।

ভেবেছিলেন ছেলেকে তুলে বাড়িতে দিয়ে আবার কাজে ফিরবেন। কিন্তু পথে আসতে আসতে বমি করল ছেলেটা। স্কুলে মনে হয় আজে বাজে কিছু খেয়েছিল। তাকে সেখান থেকেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে যেতে সন্ধে হয়ে গেছিল। হালকা জ্বরও এসেছিল বোধহয়।

ডাক্তারের চেম্বার থেকে ছেলেকে নিয়ে সবে বাইকে উঠে একটু এসেছেন। এমন সময় বাজতে শুরু করল ফোনটা। বিশ্বাস ভেবেছিলেন ধরবেন না। শেষে বার তিনেক রিং হওয়ার পর ধরতেই হল। আননোন নম্বর।

‘হ্যালো ইনস্পেক্টর সুজিত বিশ্বাস বলছি।’

‘আমি গার্গী বসু বলছি। অভিরূপা দত্ত খুনের…’

‘হ্যাঁ। বলুন। আমি একটু রাস্তায় আছি আসলে। পরে…’

আর কথা না বাড়িয়ে সরাসরি প্রসঙ্গে চলে আসে গার্গী, ‘মিস্টার বিশ্বাস, আমি জানি খুনটা কে করেছে…’

কাকতাড়ুয়া – 17 অধ্যায়

সপ্তদশ অধ্যায়

‘আজ আর আমার চালাতে ইচ্ছা করছে না। তুই চালা, আমি বসে থাকি…’ কথাটা বলে ঈশানী সাইকেলের সামনে উঠে বসে পড়ে। চারু বসে ওর পেছনে। তারপর প্যাডেল করতে থাকে একমনে। ওর মুখে আজ বিশেষ কথা ফুটছে না। কী যেন ভাবনায় ডুবে রয়েছে সকাল থেকে।

আজ স্কুটিটা বের করেনি ওরা। তার বদলে ওর বাবার পুরোনো সাইকেলটা বের করেছে ঈশানীই। আগে অনেকবার ভেবেছিল বিক্রি করে দেবে। তাও অবহেলায় রয়ে গিয়েছিল সিঁড়ির এক পাশে। আজ অনেকদিন পর সেটা চড়তে ইচ্ছা করেছে।

খোলা রাস্তা দিয়ে প্যাডেল করতে থাকে চারু। ঈশানীর মাথাটা বারবার ওর বুকে ধাক্কা খাচ্ছে। ওর ঠোঁট গিয়ে লাগছে ঈশানীর মাথায়। রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়ে ঘিরে ধরছে ওদের বারবার।

আজ একটা লাল পাড় সাদা শাড়ি পরেছে ঈশানী। চারু আলতা লাগিয়ে দিয়েছে ওর পায়ে। মাঝে মাঝে সাইকেল জোরে চললে হালকা হাওয়ায় উড়ছে শাড়িটা। তেলের গন্ধ আসছে ওর চুল থেকে। এতকিছুর মধ্যেও কপালের ফেট্টিটা মানিয়ে গেছে ওকে। চুলের ঢল অভিমানি চোখের জলের মতো কোনরকমে সামলে রেখেছে। মাঝে মাঝে অকারণেই সাইকেলের ঘণ্টি বাজাচ্ছে সে। টুংটাং আওয়াজটা মন ভালো করে দেয়। যেন অজান্তেই বলে যায় আজ খারাপ কিছু ঘটবে না। আজ ভালো কিছু ঘটার দিন।

‘তোর আমাকে মনে থাকবে চারু?’ হঠাৎ করে জিগ্যেস করে ঈশানী। ওর মুখটা দেখা যাচ্ছে না।

‘আমার মন বলে কিছু থাকবে কিনা তা-ই জানি না। তোর কষ্ট হবে না?’

‘আমার কষ্ট বলে কিছু আছে কিনা তা-ই জানি না…’ হাতে ধরা জয়েন্টে টান দেয় ঈশানী, ‘তবে এই ক’দিন মজা হল বল? কত কী করলাম, দু’একটা লোকের পেছনে লাগলাম, দু’একজনকে ছুট করালাম, একটা ছোটখাটো আন্দোলন টাইপের শুরু করে দিলাম…নিজের জীবনটা কোথায় গিয়ে যেন ঠিক হয়ে গেল…একটা পারফেক্ট জীবন, সবকিছু ঠিকঠাক। মায়ের সঙ্গেও ক্যাচাল নেই। হারামির বাচ্চার অফিসটা ছেড়ে দিলাম, সাংবাদিকটা ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য গরুখোঁজা খুঁজছে, মনে হয় একটা ভালো চাকরিও পেয়ে যাব। কী বল?’

চারু ঘাড় নাড়ে, ‘আমি আগেই বলেছিলাম, তুই যা চাইবি ঠিক তাই হবে…’

ঈশানীর মুখে চওড়া করে একটা হাসি ফোটে, ‘তুই তো এক রকমের ভগবান। যে যা চাইবে তাকে তাই দিয়ে দিতে পারিস…’

‘ধুর, আমার বিশ্বাস হয় না। আমি অত বড় কিছু নই।’

‘তুই আমার কাছে তার থেকে বড় কিছু ছিলিস। বন্ধু ছিলিস। আচ্ছা…’ কী যেন ভেবে ঈশানী প্রশ্ন করে, ‘তোর কাছে কিছু চাইলে আমাকে দিবি?’

‘কী?’

‘আমাকে বিয়ে করবি?’

থতমত খায় চারু, ‘বিয়ে…মানে…’

হেসে ফেলে ঈশানী। তারপর জয়েন্টে আরেকটা লম্বা টান দেয়, ‘ইয়ার্কি মারছিলাম, তোকে তো বলা হবে না আর। আমি জীবনে কাউকে এরকম নিব্বি টাইপের কথাবার্তা বলিনি।’

‘বিয়ে করতে চাওয়ার সঙ্গে নিব্বির কী সম্পর্ক? বিয়ে একটা সিরিয়াস ব্যাপার, ঠিকঠাক হলে জীবন বর্তে যায়।’

‘তোকে যে ক’দিন পেয়েছিলাম তাতেই বর্তে গেছি, আরও রেখে দিলে কী হত কে জানে…এই একটা গান শোনা আমাকে…’

‘এখানে? সাইকেলে যেতে যেতে?’

‘হ্যাঁ, সেই যে গানটার কথা বলেছিলাম তোকে? বাবা শোনাত আমায় গুনগুন করে? ফাইভ হান্ড্রেড মাইলস…’

চারু মিহি স্বরে গাইতে থাকে গানটা। কিছুক্ষণ মন দিয়ে শোনে ঈশানী। দুপাশের বাড়িগুলোর দিকে মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে তাকায়। তারপর আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় আকাশের দিকে। এক সময় মুখ না ফিরিয়েই জিগ্যেস করে, ‘এই, মানে কী বলত গানটার? গানটা শুনলে কোন দৃশ্য মাথায় আসে?’

একটুক্ষণ ভেবে উত্তর দেয় চারু, ‘মনে হচ্ছে একটা লোক যে বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছে না। কিন্তু তাও তাকে যেতে হচ্ছে। সে জানে অনেক অনেক বছর পর অবধি শুধু তার ট্রেনের হুইসল শোনা যাবে…’

‘ট্রেনের হুইসল জিনিসটা কী অদ্ভুত! তাই না? শুনলেই মনে হয় কাকে যেন ডাকছে। যেন কাছে আসতে বলছে। শুধু যে স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকে, সে সেই ডাক শুনে ছুটে যেতে পারে না। অন্য সবাই পারে, শুধু সে নয়…সে শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। হুইসলটা ওকে বলে—আমি তোমার জীবনে কষ্ট হব না, দুঃখ হব না, আমার কাছে কখনও আসতে ইচ্ছা করবে না, পাশে বসে গল্প করতে ইচ্ছা করবে না, শুধু শুনতে পাবে আমি ডাকছি। পাঁচশ মাইল দূর থেকেও ডাকছি…’

সাইকেল চালিয়ে শোভাবাজার ঘাটের ধারে এসে পড়ে ওরা। এত রাতে সমস্ত ঘাট শুনশান হয়ে গেছে। কোথাও একটা জনপ্রাণীর দেখা নেই। এর আগে যতগুলো জায়গায় ওরা গিয়েছিল তার কোথাও কেউ না কেউ ছিল। অন্ধকারের আড়ালে ওদের লুকানোর দরকার পড়েছে। আজ লুকানোর কোনও কারণ নেই।

ঘাটের একধারে সাইকেলটাকে দাঁড় করিয়ে দেয় চারু। ঈশানী চোখ তুলে তাকায় ওর দিকে, ‘আমি কখনও রাতের গঙ্গা দেখিনি। চল, একটা জায়গা দেখাই তোকে। ওখানেই ছবি আঁকব আজ। কেউ দেখতে পাবে না হয়তো, শুধু আমাদের জন্য…’

‘কিন্তু কী আছে ওখানে?’

‘কিচ্ছু নেই, শুধু আমার যখন খুব মন খারাপ হত ওখানে এসে বসে থাকতাম। গঙ্গার ধারে অনেকের সঙ্গে ঘুরতে এসেছি। আমার এক্স, আমার বন্ধুবান্ধব, আমার ক্রাশ, কলেজে পড়তাম যখন বন্ধুরা মিলে এখানে এসে গান বাজনা করতাম, গাঁজা খেতাম। কিন্তু এই জায়গাটায় আমি কখনও কারও সঙ্গে আসিনি। আমার মন খারাপের ঠিকানাটা তুই ছাড়া আর কাউকে জানাব না আমি…’

গঙ্গার ধার দিয়ে হেঁটে কিছু দূর চলে আসে ওরা। শ্মশান পেরিয়ে, পুতুলবাড়ি পেরিয়ে হাঁটতে থাকে। একটু সন্ধের দিকে এলে জমজমাট হয়ে থাকে জায়গাটা। লোকচলাচল করে। অল্পবয়সি ছেলেমেয়েরা সেলফি তোলে জড়ো হয়ে। আইসক্রিম আর মোমোর দোকানে হট্টগোল, অটোর হাঁকডাক। রেলগেট পড়ে যাওয়ার পর লোকের ভিড়ভাট্টা। এখন সব শান্ত হয়ে গেছে। জীবন্ত প্রাণী বলতে কয়েকটা কুকুর আর রাস্তার ধারে ব্যোম হয়ে পড়ে থাকা কয়েকটা ছোকরা গাঁজাখোর।

সেসব ছাড়িয়ে একটা বাঁধানো ঘাটের কাছে চলে আসে ওরা। দু-চারটে মানুষের বসার মতো জায়গা করা আছে সেখানে। এখানে বসলে গঙ্গাটাকে দেখা যায় পুরোপুরি। অথচ গঙ্গার বুকে ভেসে যাওয়া লঞ্চ থেকে কেউ চাইলেও দেখতে পাবে না ওদের।

এ জায়গাটায় এমনিতেই কিছু গ্রাফিতি করা আছে। পুরোনো কলকাতার বাবুদের ছবি। তার মধ্যে ওদের ছবি আলাদা করে চিনে নেওয়ার উপায় প্রায় নেই বললেই চলে।

তবু তার মধ্যে একটা ফাঁকা দেওয়াল খুঁজে নেয় ঈশানী। আলতো করে হাত বুলায় সেই দেওয়ালে। তারপর হাতের ব্যাগ খুলে রংয়ের কৌটোগুলো বার করতে থাকে। আজ বড় করে ছবি আঁকবে বলে দুটো রঙের বালতি এনেছে ঈশানী। সেগুলো চারুই ব্যাগ থেকে বের করে দেয়।

‘আজ এতগুলো রঙ এনেছিস কেন? ক’টা ছবি আঁকবি?’

‘একটাই, তবে বড় করে। আজ চলে যাবি তো, তাই ইচ্ছা হল…’

ঝমঝম শব্দ করে সাইকেলটা নিয়ে একটু পেছনে সরে এসে দাঁড়াল চারু। ফেট্টিটা মাথার উপরে তুলে চুলগুলো বেঁধে নিল ঈশানী। তারপর রং চড়ালো দেওয়ালে।

‘কথা বলছিস না কেন বল তো? আমার উপর রাগ হচ্ছে, না তোর?’

‘কেন?’ আঁকতে আঁকতেই জিগ্যেস করে ঈশানী।

‘এই যে আমি আজ চলে যাচ্ছি।’

‘ধর, যেতে দিলাম না তোকে…ধরে রাখলাম।’

চারুর মুখে করুণ হাসি ফোটে, ‘আমার কষ্ট হবে জেনেও আমাকে আটকে রাখবি না তুই। আমি চিনি তোকে…’

যেটুকু রং চড়েছে সেটা ভালো করে দেখে ঈশানী, ‘আমাদের কন্টেন্ট ভাইরাল হয়েছে কিন্তু। ইন্সটাগ্রাম খুললেই চারিদিকে হ্যাশ ট্যাগ দেখতে পাচ্ছি।’

‘ওটাকে বন্ধ হতে দিস না। আমি জানি তুই একাই পারবি।’

আবার তুলি টানতে থাকে ঈশানী, ‘আমি কোনওদিন কিছু একা পারিনি। আমি, আর একটা মানুষের অনুপস্থিতি, কখনও বাবার, কখনও বান্ধবির, কখনও তোর। তুই চলে যাওয়ার পর যে ছবিটা আঁকব সেটাও আমার মাথায় ঘুরছে, বুঝলি?’

‘কী ছবি?’

‘একটা ফাঁকা ঘাট, শুধু মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। কাকতাড়ুয়া নেই। চাঁদ আছে, জল আছে, মেয়েটা হয়তো নাচছে, কিন্তু সব কিছুর মাঝখান থেকে কাকতাড়ুয়া গায়েব।’

ছবিটা ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে শুরু করেছে দেওয়ালে। একে একে চড়েছে নীল, হলদে আর হালকা খয়েরি। ক্রমশ একটা ছবি ফুটে উঠছে তাতে। ফ্রেমের একদিকে অন্ধকার, অন্যদিকে মেয়েটা এগিয়ে যাচ্ছে আলোর দিকে। উল্টোদিকের অন্ধকারে কাকতাড়ুয়া মিশে যাচ্ছে…

ছবিটা দেখতে দেখতে একটা হাসি ফুটল চারুর মুখে, ‘তোকে কে বলল আমি অন্ধকারে যাচ্ছি? আমি যেখানে যাব সেখানে অন্ধকার তো নাও থাকতে পারে।’

‘তাতে কী? কোথায় যাচ্ছিস আমিও জানি না। ছবিটা আমি এঁকেছি, আমার কাছে তো থাকছিস না। আমার কাছে তুই এরপর থেকে অন্ধকার…’

‘তুই ভুলে যাবি আমাকে?’ চারুর গলা ধরে আসে।

ঈশানী মুখ বাঁকায়, ‘এইজন্যই বলেছিলাম বিয়ে করে নিতে। সুখে শান্তিতে ঘর করব একসঙ্গে। সেক্স করব, “ও মাই গড” বলে চিৎকার করলে তোর গায়ে লাগবে না। ইচ্ছা হলে তোর জন্য ভাত রান্না করব, ভাত পুড়ে গেলে তোকেই খাব। দুটো তিনটে আন্ডা বাচ্চা হবে, তাতা থই থই নাচবে…এই আমাদের বাচ্চা হলে কী নাম দেব বল তো?’

‘কী?’

‘নরহাঁড়ি পাতিল…’

দুজনেই হেসে ওঠে। চারু ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নদীর দিকে চায়, ‘বিয়ে কর আর যাই কর, কোনকিছুই চিরকাল থাকবে না। তুইও কি চিরকাল থেকে গেছিস কারও কাছে?’

‘আরে আজব তো! অন্য কাউকে দু’ঘা কিল মারার পর আমার পিঠে কিল পড়লে কি কষ্ট কম হয়? জীবনটা যদি ডেবিট ক্রেডিটের খেলা হয় তাহলে সব হিসাব মিলে যায়। কিন্তু আমি হিসাব মেলার কথা বলছি না। কষ্টের কথা বলছি। বেঁচে থাকতে খুব কষ্ট হয়। জাস্ট আত্মহত্যা করতে পারি না বলে বেঁচে আছি আমি…’

‘তোর মুখে এসব কথা শুনলে তোর বাবা খুব কষ্ট পেত।’

ঈশানী হাসে, ‘বাবা শুনতে পেলে কথাগুলোই থাকত না। বাবা শুনতে পায় না বলেই কথাগুলো জন্মেছে…’

চুলগুলো আবার খুলে দিয়ে ঘাটের দিকে এগিয়ে যায় ঈশানী। একটা সিঁড়ির পাঁচিলের উপর হাত রেখে বলে, ‘বাবা যখন মরে গেল, একটা অদ্ভুত অনুভূতি হয়েছিল। মনে হচ্ছিল সত্তর বছর আগে বাবা যখন জন্মেছিল তখন যে মানুষগুলো বিছানার পাশে দাঁড়িয়েছিল তাদের কথা। তাদের কেউ হয়তো এসে দাদুকে ডেকে বলেছিল, শুনছ তোমার ছেলে হয়েছে, কেউ হয়তো শাঁখ বাজিয়েছিল। কেউ মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। কেউ বাচ্চার নাড়িটা কেটেছিল তখন। সেই মানুষগুলোর কাছে আজকের দিনটা কী ভীষণ অবাস্তব ছিল, তাই না? আমি চাই আমার কাছেও ঠিক ততটাই অবাস্তব হোক বাবার চলে যাওয়াটা। ওই মানুষগুলোর মধ্যে মিশে যাওয়া যায় না চারু?’

‘জানি না…’ চারু এগিয়ে এসে ওর চোখের কোল থেকে জল মুছে দেয়। মাথাটা ধীরে ধীরে টেনে নেয় বুকে, ‘ভয় লাগছে তোর, তাই না?’

দুহাতে চারুকে জড়িয়ে ধরে ঈশানী। ওর জামা ভিজে যায় অবাধ চোখের জলে। ভেজা চুল ওড়ে বুকের কাছে। কাঁদতে কাঁদতে কেঁপে ওঠে মেয়েটার শরীরটা। ও হাঁটছে না, তাও নূপুরের শব্দ শোনা যায়। তেলের গন্ধটা আরও ঘন হয়ে আসে। চারুর মনে হয় একটা নরম আবেশে ও ডুবে যাচ্ছে। ঝড়ে বাসাহারা উদ্ভ্রান্ত পাখির মতো মেয়েটা মিশে যেতে চাইছে ওর বুকে।

‘ধুর…’ ওর বুক থেকে মুখ তোলে ঈশানী, ‘আমি না, তুই ভিতু।’

ওর গাল টিপে দেয় চারু, ‘আমার তো আর কেউ নেই রুনু। ভয় পেলে শুধু তোকেই জড়িয়ে ধরার থাকে…’

‘আচ্ছা! তাই সেদিন রাতে ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিলি আমাকে?’

উত্তর দিতে যাচ্ছিল চারু। থেমে যায়। মাথার মধ্যে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন ফুটে উঠছে ওর। ও অবাক হয়ে ঈশানীর দিকে তাকায়, ‘তোর যদি সে রাতের কথা কিছু মনেই না থাকে, তাহলে তুই জানলি কী করে আমি তোকে ভয় পেয়ে জড়িয়ে ধরেছিলাম?’

ঈশানীর চোখের কোণে কাজল এখন আগের চেয়ে আরও গাঢ় হয়েছে। ঠোঁটের কোণে একটা মিহি হাসি ফুটে ওঠে…

‘বাবা, ও বাবা, বলো না গল্পটা…ঘুমিয়ে পড়ছ কেন? বাবা…’ বাবাকে ঠেলা দিয়ে জাগানোর চেষ্টা করে রুনু। সঞ্জীবনের ঘুম পেয়েছিল। তার উপর শরীরটা খুব একটা ভালো লাগছে না। তাও মেয়ের আবদারের সামনে কোনও ওজর চলে না।

‘আচ্ছা কীসের গল্প শুনবি বল।’ মেয়ের দিকে ফিরে শোন তিনি।

‘ভূতের গল্প।’ চোখ গোলগোল করে বলে রুনু।

‘কিন্তু ভূতে তো আমি বিশ্বাস করি না।’ মেয়ের হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে স্মৃতি হাতড়ান সঞ্জীবন, ‘তবে হ্যাঁ, একটা লোক আমাকে একটা ভূতের গল্প বলেছিল। সেইটার কথা আমার এখনও মনে আছে।’

‘কী রকম?’

কপালে হাত রেখে ঘটনাটা মনে করার চেষ্টা করেন সঞ্জীবন। এতকাল আগের ঘটনা ভালো করে মনে পড়ার কথা না। তাও ব্যাপারটা এতটাই চমকপ্রদ যে মনের ভিতরের পাতকুয়োর তলানিতে এখনও রয়ে গেছে। সেই কুয়োতেই বালতি ডোবান।

‘অনেক বছর আগের কথা, বুঝলি? আমি একবার পুলিশের তাড়া খেয়ে লুকিয়েছিলাম মুর্শিদাবাদের একটা গ্রামে।’

‘কোন গ্রাম?’

সঞ্জীবন আবার স্মৃতি হাতড়ান, ‘যদ্দূর মনে পড়ছে গ্রামের নাম ছিল বিজলিমারি…’

নামটা পছন্দ হয়ে রুনুর। ঠোঁটের কোণে কয়েকবার সেটা উচ্চারণ করে নেয়।

‘তো সেই গ্রামে ছিল এক বিশাল জঙ্গল। সেই জঙ্গলের মধ্যে ছিল কয়েকটা পুরোনো বাড়ি।’

‘জঙ্গলের মধ্যে? কে থাকত সেখানে?’

‘বাড়িগুলো কারা তৈরি করেছিল কেউ জানে না।’

‘ভূতুড়ে বাড়ি?’

সঞ্জীবন আপত্তি করেন, দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বলেন, ‘ভূতুড়ে বাড়ি বলে কিছু হয় না রুনু। যে বাড়িতে মানুষ থাকে না, আর যে মানুষের কাছে অন্য মানুষ থাকে না তাদের লোকে ভূতুড়ে বলে ভুল করে। যাক গে, তো সেই বাড়িটায় আমরা মাসখানেক লুকিয়েছিলাম। তখন সেই বাড়িগুলোতে একটা অদ্ভুত লোক থাকত। কী করে থাকত কে জানে। জঙ্গলের মধ্যে ভাঙাচোরা বাড়ি। কোথাও কিছু নেই, ধুধু ফাঁকা। বাজার দোকান করতে গেলেই সাইকেল নিয়ে ঠেঙিয়ে অনেক দূর যেতে হয়। তো সেই লোকটা একবার একটা গল্প বলেছিল আমাদের…’

‘কীসের গল্প?’

‘একটা দেবতার। তার শরীরের মাটি থেকে তৈরি হয়েছিল একটা হাঁড়ি। লোকটা বলেছিল বিদেশ থেকে একবার কে যেন নিয়ে এসেছিল হাঁড়িটা। তারপর লুকিয়ে ফেলেছিল এদেশের এক রাজার কাছে। তারপর সেই রাজার মন্ত্রী সেই হাঁড়ি চুরি করে অন্য কাউকে দেয়। তারপর নানান হাত ঘুরতে ঘুরতে সেটা এসে পৌঁছায় বঙ্গদেশে। তো তখনকার বুদ্ধিমান কিছু লোক দেখল হাঁড়িটা যে-সে লোকের হাতে পড়লে তো মহা মুশকিল। তারা হাঁড়িটা লুকিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করল। আবার মাটির তলায় কি অন্য কোথাও লুকাতে দরকারে সেটা খুঁজে বের করে আনাও মুশকিল। তখন তারা এই জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি বানিয়ে কিছু লোককে দায়িত্ব দিল সেটার রক্ষণাবেক্ষণ করতে…’

‘হাঁড়িতে কী ছিল বাবা?’

সঞ্জীবন চোখদুটো নাটকীয় কায়দায় গোলগোল করে বলেন, ‘সেই হাঁড়িটা পুতুলের মতো করে সাজিয়ে যাকে খুশি তৈরি করা যায়। একদম আসলের মতো। শরীরটা এক, অবিকল হাত নাক মুখ চোখ পেট সব এক…শুধু আত্মাটা আলাদা।’

‘যাকে খুশি বানিয়ে ফেলতে পারব? যেমন খুশি মানুষ বানিয়ে ফেলতে পারব? কী করে?’

‘নিয়ম হল…’ সঞ্জীবন কিছুটা স্মৃতি হাতড়ে আর কিছুটা আন্দাজে বলতে থাকেন, ‘আমরা যার শরীর বানাতে চাইছি তার কথা মনে মনে ভাবতে ভাবতে তার মতো করে একটা মুখ এঁকে দিতে হবে ওই হাড়ির গায়ে।’

‘তাহলেই তৈরি হয়ে যাবে?’

‘উঁহু, শুধু আঁকলেই হবে না। তারপর সেই গোটা জিনিসটাকে নিয়ে গিয়ে ফেলতে হবে অন্ধকারের মধ্যে। যেই সব কিছু অন্ধকার হয়ে যাবে, পুতুলের গায়ে আর কোনও আলো থাকবে না, অমনি নিজে থেকেই পুতুলটা বদলে মানুষ হয়ে যাবে।’

‘যে-কেউ পুতুলটা ব্যবহার করতে পারবে?’ রুনু গালে হাত দিয়ে প্রশ্ন করে। তার আগ্রহ আপাতত তুঙ্গে উঠেছে, ‘উঁহু, সে যেহেতু দেবতা, তাই তার সামনে কোনও ফাঁকি চলবে না। তাকে তুলে এনে পুজো করা যায় না। যেখানে সে থাকবে সেখানেই তার সামনে গিয়ে মনের সব কথা খুলে বলতে হবে। তাহলে সে সব ঠিক করে দেবে…’

‘কেন?’

‘কেন আবার কী রে? ওটাই তো দেবতার কাজ।’

রুনু অভিযোগ করে, ‘তুমি যে বলো ভগবান বলে কিছু নেই…’

হাত দিয়ে মেয়ের মাথার চুল ঘেঁটে দেন সঞ্জীবন, ‘যে মানুষ অন্য মানুষের কষ্টে পাশে থাকে, তাকে ভালোবেসে তার বেঁচে থাকাটা একটু সহজ করে দেয়, তাকে অনেকে অনেক নামে ডাকে। কেউ বন্ধু নামে ডাকে, কেউ ভগবান বলে ডাকে…’

‘হাঁড়িটা চিনব কী করে?’

এইবার একগাল হাসেন সঞ্জীবন, ‘এখনকার হাঁড়ি সাধারণত মিশমিশে কালো হয় না। কিন্তু ওই হাঁড়িটা ছিল কালো। তার পেছনে দুটো চিহ্ন ছিল।’

‘কীসের চিহ্ন?’

‘সেইটাই মনে পড়ছে না। ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম। দেখে বলে দেব নাহয়। এখন ঘুমা…’

চুপ করে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে মেয়েটা। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে টুকটুক করে। ওর মনের ভেতর অদ্ভুত ভাবনাটা গেঁথে যায়। সত্যিই কি এরকম হয়?

বাবা আজ অবধি ওকে মিথ্যে কথা বলেনি কখনও। বাবা কি তবে জেনে বুঝে ওকে মিথ্যে বলল? অদ্ভুত বাড়ির সেই অদ্ভুত লোকটা কি বাবা মন থেকে বানিয়েছে? রুনু ঠোঁটে হাত রেখে গভীর ভাবনায় ডুবে যায়…

নাটক প্রায় শেষের দিকে। গরম গরম মনোলগ ডেলিভার করছে একটা ছেলে। এরপর নাটক শেষ হবে বাউল গান দিয়ে। কলাকুশলীরা সবাই গ্রিনরুমের ভিতর সেঁধিয়ে গিয়েছে। কেবল বাউল চরণদাস বসে আছে স্টেজের একপাশে। তার মুখ কাঁচুমাচু। বিপদে পড়েছে সে।

আজ পেমেন্ট নিয়েই বাড়ি যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু প্রোডিউসার একটু আগে এসে জানিয়েছে আজ টিকিট তেমন বিক্রি না হওয়ায় সবার পেমেন্ট দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে আজ খালি হাতেই বাড়ি যেতে হবে তাকে। পরের শো’তে ডাবল পেমেন্ট হবে।

কিন্তু খালি হাতে বাড়ি ফেরার উপায় নেই চরণদাসের। সেই গ্রাম থেকে কলকাতা আসার পথে পকেটে যেটুকু টাকা ছিল সব বাস আর ট্রেন ভাড়ায় ফুরিয়ে গেছে। ওইটুকু টাকা অবশ্য চাইলে এরা দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু চরণদাসের ওই এক রোগ। সে মুখ ফুটে দরকারের কথা বলতে পারে না।

আপাতত না জুটেছে পেমেন্ট, না পেয়েছে খাবার দাবার। খালি পেটে কী আর মন থেকে গান আসে? অগত্যা দোতারাটা হাতে নিয়ে তারটা সুরে বাঁধছিল সে। এমন সময়ে একটা অল্পবয়সি মেয়ে এসে বসে পড়ল ওর পাশে, ‘টাকা লাগবে নাকি কাকা?’

মেয়েটার হাতে একটা বিস্কুটের প্যাকেট। সেটা চরণদাসের দিকে বাড়িয়ে ধরেছে সে, ‘আপনি এটা খেয়ে নিন। টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে…’

খুশি হয়ে মেয়েটার দিকে তাকাল চরণদাস। ভারি মিষ্টি মুখ মেয়েটার। ততটাই নরম গলার আওয়াজ। সে একটু ইতস্তত করে বলল, ‘তোমাকে কে বলল টাকার দরকার?’

‘আপনি অনেকক্ষণ থেকে পকেট থেকে কয়েকটা নোট বের করে গুনছিলেন আর মুখ চুন করে আবার ঢুকিয়ে রাখছিলেন, তাই ভাবলাম…তবে এমনি এমনি পয়সা আমি দিই না…’ মেয়েটা জোর করেই কঠিন করল গলার স্বর, ‘আমাকে একটা গান শোনাতে হবে…’

মেয়েটাকে মনে ধরল চরণদাসের। ও গ্রামের বাউল। গান গেয়ে যে ক’টা টাকা পায় তাতেই ওর সংসার চলে যায়। তার বাইরে অতিরিক্ত আদর আপ্যায়ন কেউ করে না বললেই চলে। উল্টে গ্রামের দিকে ও নিজেই যেচে পড়ে গান শুনিয়ে বেড়ায়।

‘কেন শোনাব না? কী গান শুনবে বলো?’

‘এমন গান যেটা আমি আগে কখনও শুনিনি।’

চরণদাস হেসে ফেলে, ‘তোমরা শহরের ছেলেমেয়েরা আর তেমন বাউল গান শুনেছ কবে?’

দোতারা কোলে নিয়ে টুংটাং করে সে, ‘বাউল গান শুনতে গেলে আমাদের গ্রামে যেতে হবে।’

‘তুমি ওখানেই গাও?’

চরণদাস হাত ঘোরায়, ‘রাস্তাঘাটে গাই, হাটের লোক শোনে। কেউ ডাকলে গাই…আর সন্ধেবেলা মাঠে বসে গাই। তখন শুধু একটা কাকতাড়ুয়া শোনে…’

‘কাকতাড়ুয়া গান শোনে?’ ঈশানী হেসে ফেলে।

‘সত্যি গো!’ চোখ বড় বড় করে বলে চরণদাস, ‘আমাদের গ্রামের খেতে একটা কাকতাড়ুয়া আছে বুঝলে? আমি তারই সামনে বসে গান গাই। গাইতে গাইতে কেবল মনে হয় কালো হাঁড়ির মাথাটা আমার দিকে ঠায় চেয়ে গান শুনছে। যেন জীবন্ত…আগে আগে ভয় করত, এখন ভালো লাগে…’

‘কালো হাঁড়ি? কোন গ্রামে থাকো বললে তুমি?’

‘বিজলিমারি, নাম শুনেছ?’

মাথা চুলকায় ঈশানী, ‘চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু কোথায় শুনেছি মনে পড়ছে না…’

‘এই তো, দেখো না। আমার কাছে ছবিও আছে।’ চরণদাস নিজের স্মার্ট ফোন বের করে তার গ্যালারিতে মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা কাকতাড়ুয়ার একটা ছবি দেখায়। বোঝা যায় সেটা নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ আছে তার। আবার একই চর্বিতচর্বন করতে থাকে সে, ‘খালি মনে হয় যেন সে আমার দিকে চেয়ে চেয়ে গান শোনে। ক’দিন পরে গেলে মন খারাপ করে। দুঃখের গান গাইলে চোখ দিয়ে জল পড়ে। আনন্দের গান গাইলে যেন দু’হাত তুলে নাচতে চায়। এত জায়গায় এত লোককে গান শুনিয়েছি…ওকে শুনিয়ে যা আনন্দ, তা আর কোথাও পাই না…’

একটা পুরোনো গল্প এতক্ষণে মনে পড়ে যায় ঈশানীর। এ গল্পটা বাবার কাছে অনেকবার শুনেছে। বাবা নিজেও অবশ্য বিশ্বাস করত না গল্পটা। ওর কী খেয়াল হয়, হুট করে চরণদাসের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নেয় ও, ‘তুমি আমার একটা কাজ করে দেবে কাকা?’

‘কী কাজ?’

‘এরপর যেদিন যাবে আমার জন্য একটা জিনিস দেখে দেবে? কাকতাড়ুয়াটার পিছনে কোনও চিহ্ন আছে কিনা?’

একটুও সময় নেয় না চরণদাস, ‘আছে তো…’

‘মানে?’

‘একদিন ওর মাথাটা খুলে আমি দেখেছি। ওর পেছনে একটা ঘুড়ি আর একটা পাখির ছবি আছে। কে খেয়াল বসে করে রেখেছে কে জানে…’

বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ায় ঈশানী। ওর মাথার ভিতরটা ভোঁভোঁ করছে। বুকের ভিতর বহুদিন আগে বন্দী হওয়া একটা পাখি ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে যেতে চাইছে বুঝি কোথাও।

ঝুমঝুম শব্দে বেল পড়ে গেল নাটকের। চরণদাস উঠে দাঁড়াল, ‘আসতে হবে দিদিভাই। গান গাওয়ার সময় হল…আমি চললাম। এরপর আবার শো থাকলে এসো…তখন কথা হবে…’

তটস্থ হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে ঈশানী। চরণদাস স্টেজে উঠেছে। নাটকের শেষে তার গলায় খেলছে লালনের গান। মাঠে ঘাটে ঘুরে, মন্দিরে, মসজিদে, দরগায়, বাড়ির নিকোনো উঠোনে, পুকুরঘাটে কাকে যেন খুঁজে চলেছে ফকির লালন।

কিন্তু সেদিকে মন বসে না ঈশানীর। বাবা কি তাহলে মিথ্যে বলেনি? সেই লোকটাও কি মিথ্যে বলেনি তবে?

কাকতাড়ুয়া – 18 অধ্যায়

অষ্টাদশ অধ্যায়

‘এই, এই, ওখান থেকে কী একটা মুখ বাড়াচ্ছে! জঙ্গলের ভিতরে…’ গার্গী টেবিল থেকে কোনরকমে মাথা তুলে বলে। তারপর আবার নেতিয়ে পড়ে গোল টেবিলটার উপরে।

‘ওখানে তোর শ্বশুর আছে বে। দেখতে এসেছে মাল খেয়ে কোনও পরপুরুষের গায়ে পড়ছিস কিনা…’ অভিরূপা হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলে।

‘চুপ কর মাগি…’ টেবিলে মাথা রেখেই ধমকে ওঠে গার্গী, ‘আমার শ্বশুর তোর বাপ হয়…’

গার্গীর নেশাটাই এদের মধ্যে সবথেকে বেশি চড়েছে। আর একটা গ্লাস মুখে তুলতে যাচ্ছিল সে, তার আগেই ঈশানী থামিয়ে দিল তাকে, ‘আর খাস না, এবার বমি করবি।’

‘তুই কে বে আমাকে বারণ করার?’ গার্গী গর্জে ওঠে, তারপর হুইস্কির গ্লাসে আবার মদ ঢালতে ঢালতে বলে, ‘শালা মদ খাব, বমি করব তারপর দেখতে যাব জঙ্গলে কী আছে…’

‘আমিও যাব…’ অভিরূপা ওর কাঁধে আলগা হাত রেখে বলে।

‘তোদের কি মাথা খারাপ?’ ঈশানী মদের গ্লাস নামিয়ে রাখে টেবিলের উপরে, ‘এত রাতে আর কিছু না থাক সাপখোপ কামড়ে দিলে কী হবে?’

এতক্ষণে আবার মাথা তোলে গার্গী, ওর চোখদুটো ঢুলুঢুলু লাগছে, ঠোঁটের কষ বেয়ে তরল গড়িয়ে পড়ছে, ‘দেখ, বেশি জ্ঞান মারাবি না। অত যখন উচিত অনুচিত বোধ তখন নিজের লাইফটার এমন পোঙ্গা মেরে রেখে দিয়েছ কেন?’

অভিরূপা সায় দেয় ওকে, ‘ঠিকই তো, সারাক্ষণ শুধু বিধবা পিসিমাদের মতো ঘ্যানঘ্যান…’

একটা হাত বাড়িয়ে ওর টি-শার্টের কলার খামচে ধরে ঈশানী, ‘বেহায়া কোথাকার? লজ্জা করে না বলতে? আমি যা করেছি সেটা অন্তত বলতে পেরেছি তোদের। তোর মতো লুকিয়ে রাখতে হয়নি…’

অভিরূপার মুখ নেমে আসে বুকের উপরে, ‘লোককে বলে বেড়ানোর মতো কাজ করিনি তাই বলতে পারিনি…’

‘যে বন্ধুত্বের মধ্যে শুধু বলে বেড়ানোর মতো কথাই বলা যায়, সেটা বন্ধুত্ব নয়।’

অভিরূপা বিরক্ত হয়, ‘দেখ, মাল খেয়ে তোর এই জীবনদর্শন মারানো আমার সহ্য হচ্ছে না…’

শেষ কথাগুলো মাথায় ঢোকে না গার্গীর। সে নেশাতুর চোখে মুখ তুলে বলে, ‘তোরা শালা কী নিয়ে বাওয়াল করছিস আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।’

‘তোর নেশা চড়ে গেছে। বলে লাভ নেই, খিস্তিখামারি করবি। কাল সকালে বলব।’ ঈশানী অন্যমনস্কভাবে বলে।

‘হ্যাঁ, আমাকে তো এখন মাতাল বলবিই। শালারা নিজেরা সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মেছিস। একজনের বাপের কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর একজনের রূপের বাহার। আমাকে বানানোর সময়ই শালা ভগবান চসমখোর হয়ে গেছিল…’

অভিরূপা হুইস্কির গ্লাসে আরেকটা চুমুক মারে, ‘তোর একটা স্টেবল সম্পর্ক আছে। রোজ রাতে কান্নাকাটি করে ঘুমোতে হয় না তোকে…’

‘চুপ কর। সম্পর্ক না, রাখতে জানতে হয়। সবকিছু তোদের মতো ফোকটে পাওয়া যায় না। আমি চাইলে আমার প্রেমটা দুদিনে কেটে যেত…’ কথাটা বলে আবার ঈশানীর দিকে দৃষ্টি পড়ে তার, ‘আর এই আবালটাকে দেখ। একটা কুকুরের জন্য নিজের চারটে বছর বরবাদ করল…’

বিরক্ত লাগে ঈশানীর। মদের বোতলটা টেবিলের উপরেই রেখে সে উঠে পড়ে, ‘তোরা এখানে কামড়াকামড়ি কর। আমি একটু আসছি…’

‘আসছিস মানে? কোথায় যাবি তুই?’

‘তোদের এই ফালতু ক্যাচাল আমার ভালো লাগছে না। একটা দিন একটু শান্তিতে কাটাতে এসেছি। নিজের জীবনের রিগ্রেট নিয়ে বিটি খেতে নয়…’

গার্গী আর কিছু বলে না। নেশার ঘোরে আপাতত সবকিছুই ঝাপসা দেখতে শুরু করেছে। ঈশানী উঠে পড়ে। অভিরূপাও ওর পেছন পেছন আসে।

‘তুই আবার চললি কোথায়?’ ঈশানী জিগ্যেস করে।

‘জানি না, ফ্রাস্ট্রেটেড মাতালের খিস্তি খেতে ইচ্ছা করছে না।’

দুজনে মিলে পুকুরের দিকে পা বাড়ায়। একটু খোলা হাওয়া না খেলে নেশাটা ভালো চাগাবে না। উপরের আকাশে চাঁদ ঝুলে আছে। এ জায়গাটায় আলো কম, তাও কড়া অভিভাবকের মতো জ্যোৎস্নাকে এখানে আসতে দিতে চাইছে না সে।

‘গার্গী ভুল বলেনি, বুঝলি?’ ঈশানী হাঁটতে হাঁটতেই বলে।

‘কী?’

‘ওই যে, সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হয়। রেড ফ্ল্যাগকে জীবনে জায়গা দিয়ে, ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে বাচ্চামি করে “আমারটা কেন টিকলো না” বলে বেফালতু কাঁদুনি করে কোনও লাভ নেই।’

‘দেবুটা আমায় খুব ভালোবাসত রে, একটা হারামির বাচ্চার জন্য ছেলেটাকে কষ্ট দিলাম…’ সজল চোখে ঈশানীর দিকে তাকায় অভিরূপা, ‘আচ্ছা রুনু, তুই আমার জায়গায় থাকলে কি এখন ফোন করতিস ওকে?’

‘করতাম। কিন্তু তার আগে অন্য একটা কাজ থেকে যায়…’

পুকুরের পথ ছেড়ে আবার দুজনে এগিয়ে যায় ক্যাম্পের দিকে। ওদের কটেজটা ফেলে অন্য কটেজটার দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। জানলাটা এই মাত্র বন্ধ করে দিয়েছে কেউ। দরজাটাও আঁটসাঁটো করে বন্ধ। সে দরজায় একবার সজোরে টোকা মারে অভিরূপা, ‘এই ছোটলোকের বাচ্চা…’

ভিতর থেকে কোনও আওয়াজ আসে না। অভিরূপা ক্ষিপ্র হাতের আবার ধাক্কা মারে, ‘তোর সঙ্গে আমার কথা আছে। বাইরে আয়…’

 ভিতর থেকে আবারও কোনও আওয়াজ আসে না।

‘বউয়ের কোলে বসে আছিস নাকি রে শালা…বেরো, না হলে আমি তোর…’

খিস্তিটা দিতে গিয়েও অভিরূপার গলার স্বর হঠাৎ করে কমে আসে। মাটিতে পড়তে পড়তেও নিজেকে সামলে নেয় ও। ঈশানী বসে পড়ে ওর পাশে। ওর বুকে মুখ গুঁজে আচমকাই ককিয়ে ওঠে অভিরূপা, ‘নিজের লাইফটা নিজেই শেষ করে ফেললাম আমি রুনু। আমার নিজের লাইফটা…’ বন্ধ দরজাটার দিকে দেখায় সে, ‘আমি তো এরকম নই, বল?’

ঈশানী ধীরে ধীরে ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকে, ‘দুঃখ পাওয়া মানুষ এরকম-ওরকম হয় না পাগলি। আগে দুঃখটা সামলে নে তারপর বিচারসভা বসাবি…’

‘সবাই আমাকে ঘেন্না করবে বল? আমার মতো একটা মেয়ে মরে গেলেই সবাই খুশি হবে…’ অভিরূপার গলা দিয়ে কান্নার স্রোত নামে।

‘আমি সবাই নই, আমি রুনু…’

‘তুইও করবি। তুই সব জানিস না।’ অভিরূপা ওর দিকে তাকিয়েই ফোঁপাতে থাকে। তারপর কোনরকমে কান্নার বেগ আটকে ছেঁড়াছেঁড়া শব্দে উচ্চারণ করে, ‘আমি তোর এক্সের সঙ্গে শুয়েছি। অনেকবার…’

ঈশানী চুপ করে থাকে। কেবল অভিরূপার মাথায় ওর হাতটা থেমে যায়। মুখ তোলে অভিরূপা, ‘তুই আমাকে খারাপ মেয়ে ভাবছিস, না?’

‘না, তুই না। তবে তোর রুচিটা আমার থেকেও খারাপ…’ কথাটা বলে আবার সচল হয় ওর হাতটা, ‘আমরা সবাই জীবনে এমন কাজ করেছি, যা করা উচিত ছিল না। অত ঘেন্না করতে গেলে বাকি অনুভূতিগুলো জায়গাই পাবে না।’

‘শালা সব কিছুর ম্যানুয়াল থাকে, জীবনের কোনও ম্যানুয়াল থাকে না…’ অভিরূপা রাগত গলায় বলে।

‘কারণ জীবনটা অনলাইনে অর্ডার দেওয়া প্রডাক্ট নয়। জীবনটা কলেজ প্রোজেক্টের মতো। সেটাকে ধীরে ধীরে তৈরি করতে হয়। ম্যানুয়াল থাকে না, বন্ধু থাকে…’

থেমে যাওয়া কান্নাটা আবার ধাক্কা দিয়ে যায় অভিরূপার বুকে, ‘সবাই কেন তোর মতো হয় না রুনু?’

ঈশানীর মুখে একটা হাসি খেলে যায়, ‘যখন দুঃখ হয় তখন সবার এটা মনে হয়। তারপর আবার আগের মতো…ওঠ এখন। একটা ওষুধ দিচ্ছি, ঘুমিয়ে পড়…’

‘তুই আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিবি না?’ অসহায় শিশুর মতো বলে অভিরূপা।

‘দেব, কবে দিইনি? শুধু…’ একটু থেমে বলে ঈশানী, ‘আজ আমার একটু কাজ আছে রে।’ কথাটা বলে ভিতরের দিকটা একবার দেখে নেয় ও। কেয়ারটেকার দুটো নিজেদের ঘরে ঢুকে দরজা দিয়েছে। ওরা আজ রাতে আর বাইরে বেরোবে না।

‘আমার খুব ভয় করছে রুনু। ওর বউটা যদি জেনে গিয়ে থাকে…’

পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে ওর হাতে দিয়ে দেয় ঈশানী। তারপর হাত ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলে, ‘এসব বড়বড় কাকিমাদের অনেক দেখা আছে আমার। এটা দেখালেই সায়া ভিজিয়ে ফেলবে। ভয় পাস না…’

ওকে নিয়ে নিজেদের কটেজের দিকে এগিয়ে আসে ঈশানী। আর একবার ভালো করে কেয়ারটেকারদের ঘরের দিকটা দেখে আসে। নাহ্, কেউ জেগে নেই। আজ রাতে এখানে যাই হোক না কেন তাতে ঝামেলা পাকানোর উপায় নেই তাদের।

অভিরূপাকে কটেজের বিছানায় শুইয়ে দেয় ঈশানী। গার্গী পড়েছিল টেবিলের উপরেই। আরেকটু হলেই মাথাটা খসে মাটিতে পড়ত। ওকে টানাটানি করে কোনও লাভ হয় না। মুখ দিয়ে গোঁগোঁ আওয়াজ করে আবার ঘুমে ঢলে পড়ে সে।

অগত্যা কটেজের দরজার দিকে সরে আসে ঈশানী। চাবিটা খুঁজে পায় না সে। এতক্ষণ উত্তেজনার মধ্যে সেটা কোথায় রেখেছে মনে পড়ে না। অভিরূপার কাছে গিয়ে ওর মাথায় একটা হাত রাখে ঈশানী। ঘুমের মধ্যেও ও ঈশানীর হাত টেনে ধরার চেষ্টা করে, ‘কোথায় যাচ্ছিস রুনু? যাস না, আমার ভয় করছে…’

ঈশানী হাসে, ‘ভয়ের কিচ্ছু নেই। চলে আসব এক্ষুনি।’

ওকে ওষুধটা খাইয়ে শান্ত করে দরজাটা টেনে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে রুনু। রান্নাঘরের এককোণে দোতারাটা আগেই দেখেছিল। দরজাটা আলতো ফাঁক করে ঢুকে সেটা হাতে তুলে নেয়।

চারপাশটা আরেকবার ভালো করে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে হাঁটতে থাকে খেতের দিকে।

অন্ধকারে কুপকুপ করছে জায়গাটা। ফাঁকা মাঠ জুড়ে অসংখ্য জোনাকি জ্বলছে টিমটিম করে। যেন পথ দেখিয়ে একটা বিশেষ দিকে নিয়ে যেতে চাইছে ওকে। সেই পথ ধরেই মিনিটখানেক হেঁটে একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ায় সে।

মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইটের আলো যেখানে গিয়ে পড়েছে সেখানে জমির একটা ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একটা ফুট ছয়েক লম্বা কাকতাড়ুয়া। কালো মাটির হাঁড়ি দিয়ে মাথাটা বানানো হয়েছে। মুখে চকের দাগ প্রায় উঠে গেছে, তার মাঝেও একটা কান অবধি মুচকি হাসি চিনে নেওয়া যায়। দুটো খড়ের হাত দুদিকে মেলে দিয়েছে সে। আঙুলের মতো খড়গুলো মাতাল হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। যেন সেই হাত নেড়েই ঈশানীকে কাছে ডাকতে চাইছে সে।

হাতের দোতারাটা নিয়ে কিছুক্ষণ তারের উপর টুংটাং করে আওয়াজ করে ঈশানী। তারপর বিরক্ত হয়ে সেটা পাশে রেখে দেয়। মেঠো জমির উপরেই পিঠ দিয়ে শুয়ে পড়ে সে। বিড়বিড় করে যেন নিজের মনেই বলে, ‘আমার কথা বলার মতো কেউ নেই জানেন…আপনার আবার শোনার অঢেল সময়, তাই না?’

হুট করেই উঠে দাঁড়ায় ঈশানী, ‘আসলে পেটে মদ পড়েছে তো। সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে…আপনি শুনবেন আমার সব কথা? শুনতে শুনতে কোথাও চলে যাবেন না তো?’ কথাটা বলে নিজেই হেসে ফেলে ঈশানী, ‘অবশ্য আপনি যাবেনই বা কোথায়? কিন্তু…’ ঠোঁট কামড়ে কী যেন ভাবে ঈশানী, ‘আমি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে কিছু বলিনি কোনওদিন। ঠিক আমার বাপের মতো…উঁহু…’

ঈশানী একবার হাসিমুখে চায় কাকতাড়ুয়াটার দিকে। তারপর এগিয়ে এসে রুমাল দিয়ে মুখের দাগগুলো পরিষ্কার করে মুছে দেয়। জমি থেকেই একটা ইটের ঢ্যালা কুড়িয়ে নিয়ে নিজের মুখের মতো একটা মুখ এঁকে দেয় হাঁড়ির উপরে। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বসে পড়ে তার পাশে।

রাতের হাওয়া ঝাপটা মেরে যায় ওদের শরীরে। দূরদূরান্ত অবধি কেবল মিটমিটে জোনাকির আলো ছাড়া আর কোনও স্পন্দন নেই। ওদের ঘিরে পাক খেতে শুরু করেছে মেঠো হাওয়াটা। সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেটা।

‘হ্যাল্লো মিস প্রামাণিক…’ সিগারেটে একটা বড় টান দিয়ে কাকতাড়ুয়ার দিকে তাকায় ঈশানী, ‘নিশ্চয়ই এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোর লেগে গেছে আপনার? আপনি শুনবেন আমার কথা? আমার দুঃখের কথা, ছোটবেলার কথা, বাবার কথা, আমার শরীরের সব দাগের কথা?’

হাসিমুখেই দাঁড়িয়ে থাকে কাকতাড়ুয়াটা। ঈশানী তার পায়ের কাছেই বসে পড়ে। তারপর দু’হাতে তার শরীর জড়িয়ে ধরে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে শুরু করে…

আধঘণ্টা পরে একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যায় অভিরূপার। ওদের ঘরের দরজাটা কেউ খুলছে। ও আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পায় না। ধীরে ধীরে ও উঠে বসে। ঘরে ঢুকে আসা লোকটাকেও চিনতে পারে। শরীরটা ককিয়ে ওঠে ওর।

‘তুমি! তুমি এখানে এসেছ কেন? ঈশানী কই? ঈশানী?’ চাপা গলায় চিৎকার করে অভিরূপা।

‘চুপ কর। কেউ নেই এখানে। আমার তোর সঙ্গে কথা আছে…’

‘আমার কোনও কথা নেই। তুমি যা ইচ্ছা করো। আমার আর তোমার কিছুতে কিচ্ছু এসে যায় না…’

‘তুই কেন এরকম সর্বনাশ করছিস আমার?’ লোকটা এগিয়ে এসে ওর ঘাড়ের উপর হামলে পড়ে, ‘আমার ঘরের দরজায় গিয়ে ওভাবে চিৎকার করে…’

অভিরূপার মুখ বুকের উপর নেমে আসে, ‘ভুল হয়ে গেছে। নেশায় আছি, অতটা…’

‘আমার বউ যদি জানতে পারলে কী হবে ভাবতে পারছিস?’ ওর কলার খামচে ধরে গালে একটা চড় মারে লোকটা।

দু’হাতে ধাক্কা মেরে ওকে সরানোর চেষ্টা করে অভিরূপা, ‘তো যাও না শালা, আমার পেছনে লাগতে এসেছ কেন?’

একহাতে ওর মুখ চেপে ধরে লোকটা, ‘এটা চিৎকার করার জায়গা নয়। আয় আমার সঙ্গে…’ কথাটা বলে হাত ধরে টান দেয়। মদ আর ওষুধের ঘোরে বাধা দিতে পারে না মেয়েটা। সুব্রত ওকে বাইরের ফাঁকা জায়গাটায় বের করে আনেন। তারপর টেনে আনে পুকুর পাড়ে। হাতে ব্যথা লাগে ওর। কবজির কাছে অসহ্য যন্ত্রণায় ও ককিয়ে ওঠে, ‘ঈশানী, কোথায় তুই?’

পুকুরপাড়টা ফাঁকা। স্থির শান্ত জলের উপরে চাঁদ পড়ে আছে। তারই একধারে ওকে নিয়ে আসেন সুব্রত, ‘তুই কী চাস? আমি সুইসাইড করি?’

‘তুই যা খুশি কর। ঈশানী কোথায় গেল…ঈশানী…’ ডাকতে যায় অভিরূপা। ওর মুখ চেপে ধরেন সুব্রত।

‘মদের ঘোরে আছিস তুই, তোকে বিশ্বাস করি না আমি।’ ওর মুখটা চেপে ধরেই গড়গড়ে গলায় বলেন সুব্রত।

‘আমাকে কেউ বিশ্বাস করে না। আমার কেউ নেই…’ অগোছালো গলায় কথাগুলো বলে একটু সরে আসার চেষ্টা করে মেয়েটা। নিজের মাথার চুলগুলো খামচে ধরে ও, ‘ছেড়ে দাও আমাকে, আমি আর তোমাকে জ্বালাব না…’

মেয়েটার মুখের দিকে ভালো করে তাকান সুব্রত। চাঁদের নরম আলোয় একটা শিশুর মতো দেখাচ্ছে ওকে। ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদবে বুঝি এক্ষুনি। এদিক-ওদিক চেয়ে ওর মাকে খোঁজার চেষ্টা করে চলেছে।

ওর হাতটা ছেড়ে দেন সুব্রত। মেয়েটা আর না দাঁড়িয়ে ছুটে যেতে চায় কটেজের দিকে। হঠাৎ করেই পেছন থেকে কে যেন ওর গলা চেপে ধরে। নড়াচড়ার শব্দ করেও পারে না অভিরূপা। ওর পা টলছে। মাথার ভিতরের অনুভূতিগুলো নিভে আসছে একটু একটু করে।

‘খানকি মাগি, আমার জীবনটা শেষ করে বেঁচে ফিরবি ভেবেছিস?’ পেছন থেকে হিসহিসে গলার আওয়াজটা ভেসে আসে।

জামার হাতায় মুখটা মুছে নিয়ে যখন মুখ তোলে ঈশানী ততক্ষণে ওর চারপাশটা বদলে গেছে। একটু আগের হাওয়াটা এখন আরও জোরে দিচ্ছে। অন্ধকারটা মনে হয় আরও ঘন হয়ে এসেছে ওর চারপাশে।

মুখ তুলে সামনের দিকে তাকায় ও। চোখের কোল থেকে জলটা মুছে নেয়। বুঝতে পারে ওর সামনের অন্ধকারটা জীবিত। একজোড়া চোখ সেই অন্ধকার থেকে চেয়ে আছে ওর দিকে। তাও না বোঝার ভান করে।

ঘাসের উপরে পায়ের আওয়াজ হয়। ও উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় হাঁক দেয়, ‘কে?’

‘আমি।’ মেয়েলি গলা ভেসে আসে।

‘কাকতাড়ুয়া কথা বলছে?’ নেশাতুর গলায় বলে ঈশানী, ‘মনে হয় একটু বেশি চড়ে গেছে…’

দোতারাটা মাটি থেকে তুলে নেয় কেউ। তারপর অন্ধকার গায়ে মেখে মাঠেরই একধারে বসে পড়ে। কিছু একটা সুর ধরে সে। পরিচিত সুর। ফিনফিনে গলায় কোনও গান গাইতে থাকে মেয়েটা। ঈশানী একমনে শুনে যায়।

অদ্ভুত একটা গান গাইছে মেয়েটা। ফাঁকা মাঠের উপর দিয়ে নতুন ফলা ফসলের গন্ধ মেখে ভেসে যায় ওর গান। দূর প্রান্তে একটু পরেই ভোর নামবে। যেন দিগন্তের কাছ দিয়ে গিয়ে সেই ভোরের অপেক্ষাতেই বাজতে থাকে গানটা। মদের থেকেও গভীর কোনও নেশায় ডুবে যায় ঈশানী। বিস্তীর্ণ ফসলের খেত উধাও হয়ে যায় কোথায়।

গানটা শেষই হয়ে এসেছিল এমন সময় দূর থেকে একটা চিৎকার ভেসে আসে। চাপা একটা যন্ত্রণামাখা চিৎকার। গান গাইতে গাইতে মেয়েটা সতর্ক হয়ে ওঠে। খানিকটা যেন ভয় পায় সে। ঈশানীরও ভুরু কুঁচকে যায়।

পুকুরের দিক থেকে এসেছে আওয়াজটা। কিছু একটা মিশে ছিল সেই আওয়াজে। মেয়েটার কী যেন খেয়াল হয়। ভয় পেয়ে সে ছুটে যায় অন্ধকারে। কোনদিকে যাবে বুঝতে পারে না। কোণঠাসা বেড়ালের মতো পালাতে থাকে। একবার কটেজের কাছে এসে পড়ে। একটা ওরই বয়সি মেয়ে টেবিলের উপরে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। উঠোনের তারে ঝুলছে একটা প্যান্ট। সেটা টেনে নিয়ে পরে ফেলে সে। ঈশানী পেছন থেকে একবার ডাকে তাকে, কথাটা কানেও যায় না তার।

কটেজ ফেলে ঝোপঝাড় পার করে এগিয়ে চলে মেয়েটা। এখনও কাকতাড়ুয়ার লম্বা ছেঁড়া জামাটা ওর গায়ে। জামাটা শরীরের তুলনায় বড় হওয়ায় হাঁটু অবধি ঢেকে আছে সেটা। তার নিচে প্যান্টটা দেখা যায় না।

দ্রুত পা চালিয়ে মেয়েটা পুকুরের দিকে় চলে আসে। এবং আসতেই দুটো মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা। নিজেদের মধ্যে চাপা স্বরে কী যেন বলছিল তারা। ঝোপের মধ্যে পায়ের আওয়াজ হতেই সতর্ক হয়ে এদিকে তাকায়। মেয়েটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করে ওদের।

লোকটা আচমকাই হিংস্র ভঙিতে এগিয়ে আসে ওর দিকে। মুখে চাঁদের আলো পড়ে খুদার্ত নেকড়ের মতো দেখায় তাকে। মেয়েটা ছুটে পালিয়ে আসতে যায়, কিন্তু তার আগেই লোকটা ধরে ফেলে ওকে। গড়গড়ে গলা শোনা যায়, ‘তুই খুন করেছিস ওকে, তুই খুন করেছিস…কাল পুলিশ এসে তোকেই…’

ছটফটিয়ে ওঠে মেয়েটা। লোকটার হাতে একটা কিছু চকচক করছে। ওর হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এক দৌড়ে পালাতে যায় মেয়েটা। উপায়ান্তর না দেখে লোকটা ওর পিঠে সজোরে বসিয়ে দেয় ছুরিটা।

যন্ত্রণামাখা শব্দ করে ঘাসের উপরে পড়ে যায় মেয়েটা। লোকটা আবার ছুরি চালায় ওর পেটে। বারবার ছুরির আঘাতে কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকে ওর শরীর। একসময় ঝিমিয়ে আসে শরীরটা। দেহটা ওইভাবেই ফেলে রেখে উঠে দাঁড়ায় লোকটা।

সঙ্গের সেই মহিলা পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ছুরিটা ছুড়ে পুকুরে ফেলে দিয়ে দুজনেই দৌড় দেয় কটেজের দিকে।

মিনিটখানেক পর আধমরা অবস্থাতেই উঠে দাঁড়ায় মেয়েটা। বড় করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নেয়। সমস্ত শরীরময় যন্ত্রণা। দুহাতে নিজের মাথাটা চেপে ধরে যেন যন্ত্রণাটাই কমিয়ে আনতে চায়। সারা শরীর থেকে টপটপিয়ে রক্ত পড়ছে ওর।

ও ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় কটেজের দিকে। এই যন্ত্রণার স্রোত আপাতত একজনই উপশম করতে পারে…

চাপা চিৎকারের শব্দটায় তন্দ্রা ভাঙে গার্গীর। উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশটা ভালো করে দেখে নেয়। পুকুরের দিক থেকে একটা আওয়াজ এল না?

নেশার ঘোরের মধ্যেও ও বুঝতে পারে চিৎকারটা অভিরূপার। টলতে টলতে কোনরকম এগিয়ে যায় সেদিকে। এবং যেতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। একটা ছায়া মূর্তি টলমল পায়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে।

মূর্তিটাকে দেখেই আঁতকে ওঠে ও। মেয়েটার গোটা শরীর ভেসে যাচ্ছে রক্তে। ছুরির আঘাত সমস্ত শরীরে।

‘এ…এ কী করে হয়েছে তোর রুনু?’

মাটির উপরেই পড়ে যায় মেয়েটা। শরীরটা ধীরে ধীরে ঝিমিয়ে আসছে ওর। এই মুহূর্তে ওকে একজনই বাঁচাতে পারে। পারে ওর শরীরটাকে পাল্টে দিয়ে। ও কাতর চোখে কিছু বলার চেষ্টা করে, কিন্তু পারে না। আঙুল তুলে মাঠের দিকে দেখায়…

কী করবে বুঝতে পারে না ঈশানী। মেয়েটা ভয় পেয়ে হুট করে কোথায় পালিয়ে গেল? এখন কেউ ওকে দেখতে পেলেই মুশকিল। অবশ্য এখন কারো জেগে থাকার কথা নয়…

সাতপাঁচ ভেবে পুকুরের দিকে পা বাড়ায় ঈশানী। পাড়ে পৌঁছে দেখে পুকুরপাড় ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। চারপাশটা একটু আগের মতই খাঁ খাঁ করছে।

ও দ্রুত দৌড়ে আসে কটেজের দিকে। মেয়েটা কি তবে এখানেই এসেছে? মনের ভিতরে একটা মেঘ জমা হয় ওর। চিৎকারটা শুনে আগেই এগিয়ে যাওয়া উচিত ছিল ওর। ভেবেছিল কেউ মদের ঘোরে চিৎকার করছে। কিন্তু…

ছুটে ক্যাম্পের সামনে এসেই থমকে দাঁড়ায় ঈশানী। ক্যাম্পের উঠোনের এক পাশে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে গার্গী। অন্য দিকে রক্তাক্ত অবস্থায় শুয়ে আছে ওর মতোই দেখতে মেয়েটা। গোটা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে তার।

ঈশানীর মাথায় বোধ আসতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। ছুটে এসে পাঁজাকোলা করে কোনরকমে তুলে নিয়ে যায় গার্গীকে। ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে টেনে দেয় দরজাটা। তারপর আবার ছুটে আসে মেয়েটার কাছে…এতক্ষণে মেয়েটা মাটির উপরেই হাতড়ে হাতড়ে একটা ফাঁকা কটেজের উঠোনে গিয়ে উঠেছে। এখানে চাঁদের আলো এসে পড়ছে না।

ক্যাম্পের ভিতরে একটা অজানা বাতাস খেলছে। দূর থেকে কীসের যেন আওয়াজ ভেসে আসছে ক্রমাগত। মেয়েটার মুখের উপরে ঝুঁকে পড়ে ও, ‘বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও…অন্ধকার…আলোগুলো নিভিয়ে…’

হাতের ইশারায় ঈশানী বুঝতে পারে মেয়েটা ওকে ক্যাম্পের আলোগুলো নিভিয়ে দিতে বলছে। ও এক ছুটে গিয়ে সবক’টা আলো নিভিয়ে দেয়। কুপকুপে অন্ধকারে ঢেকে যায় সমস্ত চত্বরটা। একটা জোনাকিও আসেনি এখানে।

আবার ফোনের ফ্ল্যাশলাইটটা জ্বালায় ঈশানী। তার আলো গিয়ে পড়ে উঠোনের উপর। একটু আগে যেখানে রক্তাক্ত অবস্থায় শুয়েছিল মেয়েটা সেখানটা এখন ফাঁকা। কেবল একটা কালো মাটির হাঁড়ি, দুটো ফুট ছয়েকের বাঁশ আর কিছু ছেঁড়া ছেঁড়া খড় পড়ে আছে সেখানে।

ধীরে ধীরে সেটার দিকে এগিয়ে যায় ঈশানী। নরম একটা হাসি খেলে ওর মুখে। কিছুক্ষণ থম মেরে সেই হাঁড়িটার দিকে চেয়ে থেকে বলে, ‘তোমার মুখে যা আঁকব তুমি তাই হয়ে যাবে, তাই না?’

কথাটা বলে হাঁড়িটা কোলের উপরে তুলে নেয় ঈশানী। তারপর আরেকটা ইটের টুকরো জোগার করে হাঁড়ির উপরে কী যেন আঁকতে থাকে।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেখানে একটা মানুষের মুখ ফুটে ওঠে। ফোনের আলোটা নিভিয়ে দেয় ঈশানী।

নিস্তব্দ কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যায়। কিছুক্ষণ পর ফ্ল্যাশলাইটটা আবার জেলে দেয় ঈশানী। সেটা গিয়ে পড়ে একটা বছর ষাটেকের মানুষের শরীরে। রোগাটে রুগ্ন চেহারা। দুগালে হাড় উঠে এসেছে বাইরে। সতর্ক বিড়াল চোখে ঈশানীর দিকে তাকায় লোকটা। বোঝা যায় ভয় পেয়েছে সে। একটু আগে তার উপর আক্রমণটা ঠিক কেন হয়েছে সে এখনও বুঝতে পারেনি। অন্ধকারে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করে সে…

ঈশানীর নরম স্বর শোনা যায়, ‘তুমি আমাকে গল্পটা বললে না বাবা…যেটা শুনলে আমার সব ঠিক হয়ে যাবে?’

লোকটা ভিতু চোখ তুলে ওর দিকে তাকায়। মেয়েটা কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছে না ও। কয়েক সেকেন্ড নেয় ওকে বিশ্বাস করতে। চোখের মণিটা আগের তুলনায় শান্ত হয়ে আসে। মনের ভিতর কেউ বুঝি বলে দেয় মেয়েটা ওর কোনও ক্ষতি করবে না। মেয়েটা হাত বাড়িয়ে ওর হাতটা ধরে ফেলে শক্ত করে।

‘এসো আমার সঙ্গে…’ হাত ধরে টান দেয় ঈশানী। লোকটা কিন্তু নড়তে চায় না। এখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারেনি সে।

ঈশানী ফিরে তাকায়, একটা বিচিত্র হাসি খেলে যায় ওর মুখে, ‘ভয় পেয়ো না। আমি থাকতে তোমার কিচ্ছু হবে না…’

একটু দূরে ওদের গাড়িটা পার্ক করে রাখা ছিল। দুজনে দৌড়ে সেটার কাছে চলে আসে।

চাবি দিয়ে গাড়ির ডিকিটা খুলে তুলে ধরে ঈশানী। তারপর ইশারা করে ভিতরে।

‘আপনি ঢুকে পড়ুন এর মধ্যে। কেউ কিছু বুঝতে পারবে না।’ লোকটা ভিতরে ঢুকে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়তে গাড়ির ডিকিটা এক টানে বন্ধ করে দেয় ঈশানী।

নরম একটা হাসি খেলে যায় ওর মুখে। কিছুক্ষণ গাড়িতে হেলান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। চারদিকের সমস্ত আওয়াজ নিভে গেছে। দৃশ্য হারিয়ে গেছে অন্ধকারের গভীরে। শুধু দূরে টিমটিমে আগুন জ্বালিয়েছে কয়েকটা জোনাকি। ইতস্তত উড়ে যাচ্ছে এদিক-ওদিক। কে জানে কাকে অক্ষম আলো দেখিয়ে কাছে টানতে চাইছে ওরা। সেদিকে কিছুক্ষণ স্থির চোখে চেয়ে থাকে ঈশানী। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে ভেঙে পড়ে কান্নায়…

কাকতাড়ুয়া – 19 অধ্যায়

উনবিংশ অধ্যায়

‘তুই সব জানতিস? তাহলে এতদিন আমাকে বলিসনি কেন? কী করতে চেয়েছিলি তুই?’ চারু ওর দিকে ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে আসে। শরীরে অদ্ভুত অস্থিরতা ভিড় করেছে তার।

‘তুইও তো জানতিস। তাও বলিসনি আমায়…সেদিন রাতে কে তোকে ছুরি মেরেছিল…’

হাতটা নিজের শরীরেই আছড়ায় চারু, ‘লোকটা বারবার বলছিল তুই করেছিস খুনটা। তোকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে…তাই আমি ভেবেছিলাম সত্যিই তুই…’ চারু চিৎকার করে ওঠে।

‘যে আমি খুন করেছি অভিকে, তাই তো?’

চারু উত্তর দেয় না। ওর বুকের ভিতর অজানা রক্তক্ষরণে ফোঁটা পড়তে থাকে। চারপাশে কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারে না। ঈশানীর মুখে আজ সন্ধে থেকে যে অদ্ভুত হাসিটা লেগে আছে সেটা এতদিনে একবারও দেখেনি ও। হুট করেই ভীষণ অচেনা লাগতে শুরু করেছে ওকে। উত্তর দেয় না মেয়েটা। কেবল রঙের কৌটোগুলোর উপর আনমনে হাত বুলাতে থাকে। গুনগুন করে কী যেন একটা গান গাইতে থাকে। খোলা চুলের ঝালর হাওয়া এসে অল্প অল্প উড়িয়ে দিচ্ছে মাঝে মাঝে।

হাত দিয়ে মাথার উড়ন্ত চুল ঠিক করে ঈশানী, নরম গলায় বলে, ‘ধুর, এত খুনখারাপির গল্প ভালো লাগছে না। এমনিতেই আমাকে একা একা ফিরতে হবে বলে মন খারাপ করছে…’ কী যেন ভেবে চারুর হাতে নিজের ফোনটা দেয় ঈশানী, ‘ফেরার সময় আমি একা বাড়ি যাব না। গার্গীকে ফোন করে লোকেশন দিয়ে বলে দে—ও যেন মাকে নিয়ে এখানে চলে আসে…’

চারু কথা বাড়ায় না। তাই করে। ফোনটা রেখে ওর দিকে এক পা এগিয়ে এসে আবার প্রশ্ন করে, ‘কী চাইছিস তুই?’

‘স্নান করতে।’ রঙের কৌটোগুলোকে আদর করতে করতেই উত্তর দেয় ঈশানী, ‘আজ আমার জন্মদিন, একবার মাঝরাতে স্নান না করলে হয়?’

কথাটা বলে ছড়িয়ে থাকা রঙের কৌটগুলোর মধ্যে একটা তুলে নেয় ঈশানী। মুখে বলে, ‘সব বলব, আগে স্নান করে নিই। তুই ততক্ষণ একটা সিগারেট জ্বালিয়ে রাখ।’

কথাটা বলে ওর কাছে এসে মাথা থেকে ফেট্টিটা খুলে ফেলে ঈশানী। তারপর পরিয়ে দেয় চারুর মাথায়। ঘন চুলের বোঝা এসে পড়ে ওর মুখের উপর। দুটো ভুরুর মাঝে কালো টিপটা আরও বেশি ফুটে ওঠে। ভরাট কালো দুটো চোখ তুলে ওর দিকে চেয়ে থাকে ঈশানী। চোখের পলক ফেলতে চায় না যেন। কী অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে! চারু মোহিত হয়ে চেয়ে থাকে। এত প্রশ্ন মনে ভিড় করে আসছিল, এই কাজল কালো চোখদুটো কোন মায়ায় বুঝি সব প্রশ্ন ভুলিয়ে দেয় ওকে।

চোখ নামিয়ে নিয়ে রঙের বালতি হাতে ঈশানী এগিয়ে যায় ঘাটের দিকে। চারু অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ওর ছিপছিপে শরীরটার দিকে। মেয়েটা কী করছে কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

এতদিন ধরে সব জানত ও? নিজেই ইচ্ছা করে জাগিয়েছিল কাকাতাড়ুয়াটাকে? এতদিন অভিনয় করছিল ওর সঙ্গে? কিন্তু উদ্দেশ্যটা কী?

কিছুটা গঙ্গার জল আঁজলা করে তুলে মাথায় ঢালে ঈশানী। ভিজে শাড়িটা লেপ্টে যায় ওর গায়ে। ওর নরম মুখে একটা অচেনা হাসি ফোটে। কয়েক সেকেন্ড নিজের শরীরেই পরম মমতায় হাত বোলায়।

তারপর ওর হাতে ধরা রঙের কৌটোয় ভরা জলটাও ঢেলে দেয় নিজের মাথায়। মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভিজে স্নান হয়ে যায় মেয়েটা। চাঁদের আলো এসে পড়ে ওর মুখের ওপর। দেখে মনে হয় জল থেকে উঠে আসা রূপকথার মেয়ে চাঁদের রুপোলি আলো মেখে স্নান করেছে। জল ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর কপাল, বুক, পিঠ। চুল চুইয়ে ঝিরঝির করে ঝরে পড়ছে দু-এক ফোঁটা। ঘন চোখদুটো তুলে তাকালে ভয় লাগে, যেন একবার সে চোখের নজর পড়লেই বুক অবধি চিরে ফালাফালা করে ফেলবে।

চারু চোখ সরাতে পারে না, মনে হয় অনন্ত জীবন থাকলে চিরকাল এই জ্যোৎস্নামাখা মেয়ের মুখের দিকে চেয়েই ও কাটিয়ে দিতে পারে।

কোনরকমে মুখ চোখের উপর থেকে জলটা মুছে নিয়ে ঈশানী সরে আসে চারুর দিকে। গা দিয়ে জল ঝরতে থাকে ওর।

ঈশানী ঝুঁকে পড়ে ওর ব্যাগ থেকে বের করে একটা সিগারেট মুখে দেয়। পকেট থেকে বার করে একটা দেশলাই জ্বালায় চারু। চারু এগিয়ে যেতে যাচ্ছিল ওর দিকে। হঠাৎ করে একটা চেনা গন্ধ আসে ওর নাকে। এখানে তো গন্ধটা আসার কথা নয়।

‘এখানে কেরোসিন কোথা থেকে…’ চারু কথাটা শেষ করতে পারে না। হঠাৎই ঈশানী প্রায় দৌড়ে আসে ওর দিকে। হাতের একটা ধাক্কায় জ্বলন্ত দেশলাইটা গিয়ে পড়ে ওর শরীরে। চারু দেশলাইটা সরিয়ে দিতে চায়, কিন্তু ততক্ষণে ঈশানীর সমস্ত শরীর হলদে আলোয় ভরে উঠেছে। ঝলসে যায় চারুর চোখ। আলো বের হচ্ছে যেন ঈশানীর শরীর থেকে। এভাবেই কি কল্পনা করেছিল ওকে?

উত্তেজনার মুহূর্তে এতক্ষণ গন্ধটা ও খেয়াল করেনি। একটু আগেই ঈশানী নিজের মাথায় যেটা ঢেলেছে, সেটা জল নয়…

দু-পা পিছিয়ে দাঁড়ায় ঈশানী। ওর শরীর জুড়ে জ্বলে উঠেছে আগুন। সাদা শাড়িতে ছড়িয়ে পড়েছে নীলচে শিখা। আলতা পরা পা বেয়ে সাপের মতো পেঁচিয়ে উঠছে। পুড়িয়ে দিচ্ছে চুল, পিঠ…লেলিহান শিখার উত্তাপে ভরে ওঠে ঘাটটা।

‘চারু…’ অসহায় দুটো হাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে দেয় ঈশানীর জ্বলন্ত শরীর, ‘আমার খুব যন্ত্রণা হচ্ছে চারু…খুব…যন্ত্রণা…চারু…’

আগুনে পুড়তে থাকা মানুষটার মুখ থেকে কি কান্নার আওয়াজ আসছে? নাকি হাসছে? চারু বুঝতে পারে না।

‘কেন করলি তুই এটা?’ চারু দৌড়ে ওকে ধরতে যায়। কিন্তু পারে না। তার আগেই ঈশানী গায়ের আগুন নিয়ে সজোরে দৌড়াতে শুরু করেছে ঘাটের ধার দিয়ে। ঊর্ধ্বশ্বাসে, উদ্ভ্রান্ত জোনাকির মতো জ্বলতে থাকে সে।

জলের উপর দিয়ে ভেসে আসা জোলো হাওয়ার স্পর্শে ওর শরীরে আগুন আরও জ্বলতে শুরু করে। বুকে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রাস করে ওকে। যন্ত্রণায় উন্মাদের মতো চিৎকার করে মেয়েটা।

‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে চারু…আমি শেষ হয়ে গেলাম…’ হাওয়ায় ভাসা শব্দগুলো জলের মতো ভেসে আসে ওর কানে।

একটা আলোয় ঘেরা জোনাকি-মানুষ হাওয়ায় আঁচল ছড়িয়ে বাতাসের উপরে দিয়ে উড়ে চলেছে।

‘কেন করলি তুই এটা?’ হাঁপাতে হাঁপাতেই প্রাণপণে ওর পেছনে দৌড়তে শুরু করে চারু।

গভীর রাতের উত্তর কলকাতার রাস্তা ধরে ছুটে চলে গাড়িটা। পেছনের সিটে কমলিকাকে নিয়ে বসে আছে গার্গী। গাড়িটা চালাচ্ছে তন্ময়। ওদের দুজনেরই চোখ রাস্তার দিকে। বুকের ভিতরে অসহ্য টেনশন খেলা করে যাচ্ছে ওদের।

‘মেয়েটার ক’দিন ধরে যে কী হয়েছে…’ কমলিকা জানলা দিয়ে বাইরে তাকান, ‘অবাধ্য ছিল, বদরাগী ছিল। এখন কেমন যেন হয়ে গেল।’

‘অভির চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারেনি একদম। তাছাড়া এই ইনভেস্টিগেশনটা এই ক’দিনে…’

‘লোকটা তো বউ সমেত ধরা পড়েছে শুনলাম। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না…’

জানলা থেকে মুখ সরিয়ে নেয় গার্গী। মোবাইলের স্ক্রিনে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়, তারপর বলে, ‘এক বছর আগে অনলাইন ক্লাস করতে করতেই হুট করে ইউনিভার্সিটির এক বছর কুড়ির বড় প্রফেসরের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে অভি। অনেক চেষ্টা করে সরে আসার, কিন্তু কিছুতেই অবশেসন থেকে সরে আসতে পারে না। বরঞ্চ যত চেষ্টা করে তত লোকটার প্রতি টান বাড়তে থাকে।

‘অভি ছোট থেকেই প্রচণ্ড জেদি। একবার কোনও কিছু মাথায় ঢুকলে সহজে সেখান থেকে ওকে সরানো যেত না। প্রফেসরের কাছে ও কমপ্লিটলি সারেন্ডার করে। প্রফেসর বুঝতে পারেন বড়লোকের বোকা-সোকা জেদি মেয়েটাকে তিনি শারীরিক বা মানসিক যে কোনরকমভাবে ব্যবহার করতে পারবেন। সেটাই করতে শুরু করেন। তবে নিজের সেফটির ব্যাপারটা মাথায় ছিল তার। প্রোফেসরের শর্ত ছিল সম্পর্ক রাখতে গেলে অভিকে তার টার্মেই চলতে হবে। নিজের ফোন থেকে যোগাযোগ করা যাবে না। একটা আলাদা নম্বর ব্যবহার করতে হবে। দেখা হবে গোপনে, এবং নিকটতম বন্ধুকেও জানানো যাবে না। অভি ব্যপারটা মেনে নেয়।

‘কিন্তু কিছুদিন পরেই অভি বুঝতে পারে এভাবে চলবে না। ওকেই সম্পর্কটাকে কোনও একটা পরিণতির জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। প্রথমে একটু গাঁইগুঁই, সেখান থেকে সাড়া না পেয়ে ওর জেদ আরও আরও বেড়ে ওঠে। প্রোফেসরের কিছু আচরণে ওর সন্দেহও হয়। ও বোঝে গোপনে লোকটার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতে হবে ওকে।

‘কিন্তু খোঁজ নেওয়ার উপায় কী? এসব কাজের জন্য ওর কাছে একমাত্র পরিচিত লোক হল অভিষেক। কিন্তু সে টাকাপয়সার বিনিময়ে এ কাজ করতে চায় না। ততদিনে অভির মাথাটা খারাপ হয়েছে। জেদের চরম পর্যায় পৌঁছে গেছে। অভিষেককে ঠিক কী দিয়ে টোপ দেওয়া যায় সে আগে থেকেই জানত। সেই টোপটাই গিলে ফেলে অভিষেক।

‘তো এইভাবে খবর নিতে গিয়েই ও জানতে পারে ও ছাড়াও আরও বেশ কিছু মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে প্রফেসরের। ওর বিশ্বাসভঙ্গ হয়। সেই এক জেদের বশেই ও বিদ্রোহ করে।

‘দিনের পর দিন ঝগড়াঝাঁটির পর প্রফেসর শেষবার ওর সঙ্গে দেখা করতে রাজি হন। কিন্তু প্রফেসর জানতেন না এই অ্যাফেয়ারের খবর ওর স্ত্রীয়ের কাছে কোনভাবে পৌঁছেছিল। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি বিজলিমারি সামারক্যাম্পে আসেন।

‘সে রাতে পুকুরের ধারে যখন অভিরূপা প্রফেসরের সঙ্গে কথা বলছিল, তখন হঠাৎ করেই পেছন থেকে প্রফেসরের স্ত্রী অভিরূপার গলা টিপে ধরেন। খুনের প্ল্যান তার আগে থেকে ছিল কিনা জানি না। কিন্তু হঠাৎ করেই তার রাগ সপ্তমে ওঠে এবং প্রফেসরের সামনেই অভিরূপাকে খুন করেন তিনি।

‘ছুরিটা পকেটে থাকলেও সেটা বার করতে যাওয়ার আগেই প্রফেসর সম্ভবত ওর হাতটা ধরে নেন। যেহেতু ছুরিটা ওদের নয় এবং অভির শরীরে ততক্ষণে প্রাণ নেই তাই পুকুরে ছুড়ে ফেলে দেন সেটা। তারপর বডিটাও একইভাবে…’

সমস্ত ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে একটু সময় লাগে কমলিকার, কয়েক সেকেন্ড সেভাবেই চুপ করে থেকে একটা প্রশ্ন করেন তিনি, ‘কিন্তু রুনু যখন সবকিছু জানত তাহলে ও আমাদের সেটা বলল না কেন?’

‘বলেছে…’ গার্গী জানলা দিয়ে বাইরে তাকায়, ‘আপনাকে যা বললাম, তার কিছুটা আমার নিজের আন্দাজ করা। আর বাকিটা ও নিজেই আজ সন্ধ্যায় বলেছে আমাকে।’

‘কিন্তু এতদিন পর বলল কেন?’ কমলিকা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন।

‘জানি না, ও কী করছে আমি বুঝতে পারছি না।’

‘পাগল মেয়ে…কী জানি কী করছে…’ কমলিকার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ গাঢ় হয়।

‘কেন করলি তুই এটা?’ ফাঁকা গঙ্গার ঘাট জুড়ে চারুর গলার আওয়াজ ভেসে যায় দূরে। গনগনে আগুন আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরছে ঈশানীকে। আরও জোরে, আরও হরিণপায়ে ও দৌড়াতে শুরু করে। ওর পা, কোমর, বুক, পিঠ, মুখ, সব ঝলসে দিতে থাকে লেলিহান শিখা। কানের পাশ দিয়ে সেই গরম হাওয়াই দৌড়াতে থাকে চারুর। একটু আগের আঁকা ছবির মতো, শরীরে আলো মেখে দৌড়ায় একটা শাড়ি পরা মেয়ে আর অন্ধকারে ওর পিছু ধাওয়া করে চলে একটা কাকতাড়ুয়া।

কিছুক্ষণ পর ঝলসে যাওয়া শরীরেই রাস্তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় ঈশানী। উন্মাদ চিৎকার এতক্ষণে গোঙানিতে পরিণত হয়েছে। পোড়া শরীরে কাতরাতে থাকে মাটির উপর শুয়ে। এখন আর চেনা যায় না ওকে।

চারু দৌড়ে গিয়ে ওর সামনেই বসে পড়ে। মাথার চুলগুলো আর একটাও অবশিষ্ট নেই। পেট আর বুকের কাছে মাংস বেরিয়ে পড়েছে। সমস্ত শরীরময় পোড়া রক্তের গন্ধ। দুহাতে ওকে ধরতে যায় চারু, কিন্তু স্পর্শ করতেই আগুনের উত্তাপে নিজে থেকেই হাত সরে আসে ওর।

‘কেন করলি তুই এরকম?’ হাহাকার বেরিয়ে আসে চারুর গলা দিয়ে। দুহাতে ঈশানীর মাথাটা নিজের কোলের উপরে তুলে নেয় সে, ‘এখানে কাছাকাছি কোথায় হসপিটাল…’

ঈশানীর বুকটা শব্দ করে ওঠানামা করছে। মাংস পুড়ে ভিতরের লাল পাঁজরা দেখা যাচ্ছে। চারুর কোলের উপর হাত রাখে ঈশানী, ছেঁড়া ছেঁড়া যন্ত্রণামাখা শব্দ বেরিয়ে আসে মুখ থেকে, ‘আর কষ্ট দিস না আমাকে। একটু…একটু থাক…’

কী বীভৎস দেখাচ্ছে মুখটা! নরম দুটো গাল পুড়ে গিয়ে গালের হাড় বেরিয়ে এসেছে বাইরে। যেন পরিচিত মুখটায় কেউ আলকাতরা মাখিয়ে দিয়েছে ইচ্ছামতো।

‘তুই কেন করলি এরকম রুনু?’ চারু আছড়ে পড়ে ওর বুকের উপরে।

তেমনই হাঁপাতে থাকে ঈশানী, পোড়া মুখে হাসি ফোটে তার, ‘কারণ…কারণ…আমার এখানে থাকার কথা নয় চারু…’

চারু ওর কথা বুঝতে পারে না, ওর ক্ষয়ে আসা শরীরটাকে ধাক্কা দিয়ে সচল করার চেষ্টা করে, ‘সব তো ঠিক হয়ে গেছিল। আমরা দুজনে মিলে…তোর মা, কেরিয়ার, তোর স্বপ্ন…’

বিড়বিড় করে কী যেন বলে চলেছে মেয়েটা, এত যন্ত্রণার মধ্যেও ওর মুখে হাসি ফুটে আছে, বিকৃত হয়ে গেছে পরিচিত মুখ অথচ এই হাসিটা যেন জন্মজন্মান্তর ধরে হেসে আসছে ও, ‘রুনু বড় হতে হতে শুধু বুঝেছিল এই জগৎটা ওর জন্য নয়। এই মৃত্যু, এই লোভ, নিঃসঙ্গতা…’ রুনুর দেহটা আর স্পর্শ করা যায় না। সে ক্ষয়ে আসা হৃৎপিণ্ডের কাছে কয়েকটা মুহূর্ত ভিক্ষা করে নেয়, ‘আমি যতদিন বেঁচেছি চারু, শুধু বুঝেছি এ জগৎ আমার জন্য নয়…তাই…আমি এখানে কারোর কেউ নই…’

দুটো কালচে হয়ে যাওয়া হাত উঠে আসে উপরে। চারুর দুগাল চেপে ধরে সেগুলো, ‘তাই আমি নিজেকে তোকে দিয়ে গেলাম। শুধু আমার স্মৃতি ছাড়া, অনুভূতি ছাড়া, এই বোধ ছাড়া যে আমি এই সংসারের কেউ নই…তুই পারবি না আমার হয়ে থাকতে?’

‘চুপ কর…’ চিৎকার করে ওঠে চারু, ‘তুই কোথাও যেতে পারবি না। এক্ষুনি হসপিটালে নিয়ে গেলে…’

হাসতে হাসতেই মাথা নাড়ে ঈশানী, ‘চুপ…চুপ কর বোকা কোথাকার, অনেকটা পুড়ে গেছি। আমার এতদিনের প্ল্যান ভেস্তে দিবি তুই?’

শক্ত করে ওর হাত চেপে ধরে চারু, ‘সব প্ল্যান ছিল না তোর? প্রথম দিন থেকে। আমাকে জাগানো থেকে, কান্না থেকে, বাড়ি নিয়ে যাওয়া থেকে…সব…সব…’

একটা যন্ত্রণার ঢেউয়ে শরীর কুঁকড়ে যায় ঈশানীর, সেটা সামলে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ও আবার মুখ তুলে তাকায়, ‘তুই…তুই…রাগ করিস না আমার উপর। আমার কাছে আর কী উপায় ছিল বল?’

দুহাতে ওর শরীরটাকে সজোরে বুকে চেপে ধরে চারু। বুক ঠেলে কান্নার দমক বেরিয়ে আসে ওর। গঙ্গার শান্ত জল বয়ে চলে ওদের পাশ দিয়ে। তাতে ভেসে যায় দূর থেকে বয়ে আসা লতার চাদর। সে চাদরে কখনও উড়ে এসে বসে একটা ফিঙে। কিছুদূর ভেসে আবার উড়ে কোথায় চলে যায় তারা।

‘কাঁদিস না, একটা কাজ আছে তোর…’ দুটো অক্ষম হাতে চারুকে ঠেলা দেয় ঈশানী, ‘রঙের বালতিগুলো নিয়ে আয়, আর দড়িটা…যা…’

‘কী হবে ওগুলো?’ চারু চোখের জল না মুছেই জিগ্যেস করে।

ঈশানী কথা বলতে পারে না। চারু ওকে ঘাটেই রেখে দ্রুত পায়ে দৌড়ে গিয়ে রঙের বালতিগুলো দুহাতে বয়ে নিয়ে আসে। এতক্ষণ ঈশানীর শরীরটা আরও ঝিমিয়ে এসেছে। ওকে দড়ি নিয়ে আসতে দেখে খুশি হয় সে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। ফুসফুসটা ঝিমিয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে, ‘এবার ওগুলো আমার পায়ের সঙ্গে বেঁধে দে…’

‘পায়ের সঙ্গে…’ কথাগুলো বলতে গিয়েও থেমে যায় চারু। এরপর কী হবে সেটা এতক্ষণে বুঝতে পারে ও। হাঁটু গেড়ে মাটিতেই বসে পড়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে চারু। ঈশানী সেদিকে চেয়ে বিরক্ত হয়, ‘আঃ, শুধু কাঁদে। এত কাঁদলে রুনু হতে পারবি না…’

মাটি থেকে উঠে দাঁড়ায় চারু। ঈশানীর কাঁপতে থাকা দুটো পায়ে শক্ত করে বাঁধে দুটো দড়ি। অন্য প্রান্তটা বাঁধে দুটো রঙের বালতিতে। তারপর আবার গিয়ে বসে ওর মাথার কাছে। ওর মাথাটা আবার তুলে নেয় কোলে।

‘মায়ের যত্ন নিস…আমি ছাড়া আর কেউ নেই মায়ের…’

‘নেব…’ চারুর গলা কেঁপে যায়। কোনরকমে উচ্চারণ করে শব্দটা।

‘ওদের কখনও বুঝতে দিস না।’

‘দেব না।’

ঈশানী কাঁদছে কিনা ওর মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই, বিকৃত স্বর বেরিয়ে আসে গলা দিয়ে, ‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে চারু…’

চারু আচমকাই ওর তপ্ত শরীরটাকে সজোরে চেপে ধরে, আবার হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে ও, ‘তুই কেন এমন করলি রুনু, কেন এমন করলি…’

একটা তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে ঈশানীর বীভৎস মুখ জুড়ে, ‘আমার সব দায়িত্ব আমি তোকে দিয়ে গেলাম চারু। যা কিছু আমার ছিল, আমার স্কুল, আমার ছেঁড়া জামা, আমার ঘর, আমার একলা কাঁদার জায়গা, আমার লাল পতাকাগুলো, আমার অভাব, আমার মা…ভালো থাকবি তো?’

উপরে নিচে মাথা নাড়ে চারু। দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া যায়। ঘাটের উপরের রাস্তাটাও হালকা আলোকিত হয়ে ওঠে। ঈশানী তাড়া দেয়, ‘এবার আমাকে জলে ফেলে দে। তাড়াতাড়ি কর, ওরা এসে গেলে…’

ঈশানীর গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে এসেছে। যন্ত্রণায় শরীরটা ছোট হয়ে গেছে তার। জোলো হাওয়ার স্পর্শে ক্ষতগুলো আরও লালচে হয়ে উঠছে।

ওর শরীরটা জলের ধারে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেয় চারু। কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে একবার। ওর চোখের দিকে একবার অবাক চোখে তাকায় ঈশানী। শেষবারের মতো হাসি ফোটে মেয়েটার মুখে, ‘বিশ্বাস কর, আমি জীবনে কাউকে আটকে রাখিনি। শুধু তোকে আমি যেতে দিলাম না কোথাও…তোর কষ্ট হবে জেনেও যেতে দিলাম না তোকে…’ ঈশানীর মুখটা চারুর কানের কাছে আসে, চওড়া হাসি হাসছে সে। শেষ শব্দগুলো বেরিয়ে আসে ধীরে ধীরে, ‘আমাকে ছেড়ে যাস না কোথাও…’

হাতের আলতো ঠেলায় ঈশানীর দগ্ধ শরীরটাকে জলের ভিতর ঠেলে দেয় চারু। মুহূর্তে দেহের ভারে জলের ভিতরে ডুবে যায়। কালচে চামড়ায় নরম জলের স্পর্শ লাগে। দেহ পোড়া ছাই মিশে যায় জলে। ওর পায়ে বাঁধা দড়িগুলোও দেহের টানে গিয়ে পড়ে জলের ভিতর।

মুহূর্তে গঙ্গার গভীরে তলিয়ে যায় সমস্ত কিছু। বাতাসে পোড়া গন্ধ ভাসে। ঘাটের চাতালে কালচে পোড়া দাগ দেখা যায়। জলের স্রোত বেড়ে উঠে আবার কমে আসে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড পর…একটা মানুষের চলে যাওয়ার আর কোনও চিহ্ন পড়ে থাকে না কোথাও…

ঘাটের ঠিক উপরেই একটা গাড়ি এসে থামে। নিস্তব্ধতার মাঝে জলের ছপছপ আওয়াজ ঢেকে দেয় ইঞ্জিনের হিংস্র শব্দ। কমলিকাকে নিয়ে নিচে নেমে আসে গার্গী। চারু সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে আসে দ্রুত।

গাড়ি থেকেই দেখতে পেয়েছে ওরা। গার্গীই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে ওকে। ওর মুখের দিকে চেয়ে অবাক হয়ে জিগ্যেস করে, ‘কী হয়েছে বল তো তোর? কাঁদছিস কেন?’ কথাটা বলতে বলতেই এক হাত দিয়ে ওর চোখের জল মুছে দেয় সে।

কমলিকাও নেমে এসেছে। কোনরকমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মেয়ের কাছে এগিয়ে আসেন তিনি। দুটো হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরেন রুনুকে, ‘এভাবে হুট করে বেরিয়ে যায় কেউ বাড়ি থেকে? মা বুড়ো হয়েছে, চিন্তা হয় না? চল, বাড়ি চল, তোর হচ্ছে আজ…’

দুটো মানুষ দু’দিক থেকে জড়িয়ে ধরে আছে রুনুকে। গঙ্গার উপর দিয়ে ভেসে আসা হাওয়া এখনও আগের মতোই বইছে। ভোর হবে কি একটু পরে? কে জানে?

‘মায়ের উপরে অভিমান করে বোকা মেয়ে? কে আছে আমার তুই ছাড়া?’ কমলিকা নিজের চোখের জল মোছে।

‘আচ্ছা, আমার বাড়ি চল দুজনে, একসঙ্গে অনেক গল্প করব, কেমন? আর ওই কী যেন সাংবাদিকটা, ও তোর ইন্টারভিউ নেবে বলেছে…খবরের কাগজে…’ হাসি মুখে ঈশানীর দিকে চেয়ে কথাগুলো বলছিল গার্গী। হঠাৎ ঘাটের ভিতরের দিকে দৃষ্টি গিয়ে পড়ে তার। ভালো করে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করে সে, ‘এই, তুই কী পুড়িয়েছিলি এখানে?’

‘তুই কী পুড়িয়েছিলি এখানে?’ ফাঁকা ঘাটে যেন প্রতিধ্বনিত হয় শব্দগুলো।

দুটো মানুষের মাঝে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে চারু। ওদের কোনও কথা কানে ঢুকছে না ওর। চোখদুটো গঙ্গার জলের উপর স্থির হয়ে গেছে। যে জলের উপর আর কোনও আলোড়ন নেই। একই ভাবে ভেসে যাচ্ছে একগুচ্ছ লতা। তার উপরে এসে বসছে ঘাটের পাখি। কী যেন খুঁজে নিয়ে আবার উড়ে যাচ্ছে দূরে।

চোখ বন্ধ করেও চারু দেখতে পায় ভাসতে ভাসতে জলের অতল গভীরে তলিয়ে গেছে ঈশানীর শরীরটা। যেখান থেকে আর কখনও ফিরে আসবে না সে, আর কখনও ভেসে উঠবে না জলের উপরে। পুড়ে যাওয়া শরীর আর কোনও প্রমাণ রাখেনি তার অস্তিত্বের।

কেবল জলের ভিতর ওর পায়ে বাঁধা রঙের বালতিগুলোর ঢাকনা খুলে গেছে। আর সেই বালতি থেকে বেরিয়ে আসছে অসংখ্য রং। সিগারেটের ধোঁয়ার মতো সে রামধনু বেরিয়ে এসে গঙ্গার ঘোলাটে জলকে রঙিন করে উঠে আসছে উপরের দিকে।

চারু দেখতে পায়, ওইটুকু বালতির রঙে একটু একটু করে রঙিন হয়ে যাচ্ছে ঘোলাটে জলের নদীটা…

কাকতাড়ুয়া – 20 অধ্যায়

শেষ

ভর দুপুরের কলকাতা। হাতিবাগানের মোড়ে বিরাট একটা মিছিল নেমেছে। বাচ্চা ছেলেমেয়ের দল স্লোগান দিতে দিতে হেঁটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। লাল পতাকা ধরা তাদের হাতে। কারো মুখে হাসি, কারো মুখে ক্রোধ, কারোর মুখে দুপুরের রোদ আর দরদরিয়ে ঘামের ক্লান্তি। বন্ধুর মুখ আচলে মুছিয়ে দিচ্ছে কেউ কেউ। সামনে যারা আছে তাদের হাতে একটা প্ল্যাকার্ড তাতে লেখা ছিল—

‘আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বন্টন
আমাদের তীর্থ হবে শস্যপূর্ণ ফসলের মাঠ।’

মিছিলের পাশ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। যানবাহনের গতি কমে যাচ্ছে বলে বিরক্ত হয়ে গালাগাল দিচ্ছে কেউ। জ্যামে আটকে আছে ঝাঁ চকচকে বিদেশি গাড়ি, মাল নিয়ে যাওয়া লরি আর রিক্সাওয়ালার দল। রাস্তার ধারে বসা একটা হাতকাটা ভিখারি অদৃশ্য কাকে যেন ঢিল ছুড়ে মারার চেষ্টা করছে।

জ্যামে অনেকক্ষণ ধরে আটকে ছিল অনির্বাণ। উপায়ন্তর না দেখে বাইকটা এক পাশে দাঁড় করিয়ে সেটা থেকে নেমে আসে। তারপর গাড়িঘোড়ার ফাঁক গলে মিছিলের ভিতর ঢুকে পড়ে এক ফাঁকে।

সবাই অল্পবয়সি ছেলেমেয়ে। কুড়ি থেকে তিরিশের মধ্যে বয়স। তাদের যে কেউই হতে পারে মেয়েটা। এর মধ্যে থেকে খুঁজে নেওয়া সহজ কথা নয়। তাও অনির্বাণ মিছিলে হাঁটার অছিলায় একজন একজন করে দেখে নেয়। হাতের ছবির সঙ্গে মিলিয়ে দেখে মাঝে মাঝে।

হঠাৎ করে একটা মুখ পরিচিত মনে হয় ওর। হাতে লাল ঝান্ডা নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। এগিয়ে গিয়ে তাকে থামায় ও, ‘এক্সকিউজ মি, আপনি ঈশানী প্রামাণিক?’

‘কেন বলুন তো?’ মেয়েটা স্লোগান দিতে দিতেই মুখ তুলে জিগ্যেস করে।

‘আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল আমার।’

মেয়েটা হাঁটতে হাঁটতেই বলে, ‘বেশ তো। যেতে যেতেই কথা হোক…আসুন…’

মেয়েটার পাশাপাশি হাঁটতে থাকে অনির্বাণ। হাতিবাগান থেকে মিছিল এগিয়ে যায় কলেজ স্ট্রিটের দিকে। যে পথ দিয়ে মিছিল এগোয় তার উপরেই গোটা রাস্তা জুড়ে কাল রাতে আলপনা দিয়ে বিশাল একটা ছবি এঁকে গেছে কেউ। সেই ছবির উপর দিয়েই হেঁটে যাচ্ছে মিছিলে হাঁটা ছেলেমেয়েগুলো…

কে কবে কোথায় হারিয়ে যায় কলকাতা শহর তার হিসেব রাখে না। তার সামনে এগিয়ে যাওয়ার তাড়া থাকে। তার বয়েই গেছে দিনের শেষে লাভ-ক্ষতির হিসেবে বসতে। এ শহর বেনিয়াদের শহর নয়।

উসকোখুসকো চুলের, এক বেলা রুটি অন্যবেলা জল খাওয়া, বোতাম ছেঁড়া জামায় পিচ রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া শিল্পীর শহর। এখানে কেউ কারও হারিয়ে যাওয়ার হিসেব রাখে না।

শুধু শহরের ব্যস্ততম রাস্তার উপর দুপুরবেলা রোদ, ঘাম, চিৎকার, উন্মাদ ভিখারি আর রাজনৈতিক মিছিলের মাঝে, এসফাল্টে আঁকা আলপনায় চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে, সাদা ফুল হাতে একা কাকতাড়ুয়া…

***

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(60)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!
Do you have any doubts? chat with us on WhatsApp
Hello, How can I help you? ...
Click me to start the chat...