শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান – জর্জ বার্নাড শ
শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান – জর্জ বার্নাড শ
গ্রন্থনা বুক ফার্ম
জানুয়ারি ২০১৮
মূল প্রচ্ছদ : জন ফারলেই
প্রচ্ছদ রূপায়ণ ও লে আউট : সৌম্যেন পাল
সহায়তা : শিলাদিত্য সিনহা রায়
বর্ণসংস্থাপন : প্রদীপ গরাই
প্রূফ সংশোধন : অনমিত্র রায়
বুক ফার্ম-এর পক্ষে শান্তনু ঘোষ ও কৌশিক দত্ত কর্তৃক
৭ এল, কালীচরণ শেঠ লেন, কলকাতা ৭০০০৩০ থেকে প্রকাশিত
মুদ্রক : এস পি কমিউনিকেশন প্রা লি, কলকাতা ৭০০০০৯
.
কৈফিয়ত – প্রণব মুখোপাধ্যায়
কালো মেয়ের উপাখ্যানে যে উপাদানটি আমায় সর্বাগ্রে আকর্ষণ করেছিল তা তার ননসেন্স গুণপনা। বার্নার্ড শ-র সব লেখাই, বলার অপেক্ষা রাখে না, হিউমার আস্বাদনে ভরপুর। আর এই কাহিনির মজাটাও পূর্ণমাত্রায় বিরাজ করছে ‘ননসেন্স’ ঘরানায়। ‘অ্যালিস’-এ আমরা পাই ‘Mock Turtle’ কাকে বলে। না, যা দিয়ে ‘Mock Turtle’-এর ঝোল তৈরি হয়! এই গোত্রের মজা আর কি! ‘দেখতে পেলাম তিনটে শুয়োর মাথায় তাদের নেইকো টুপি’, এ সেই গোত্রের। গল্পটির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে anti-logic-এর মজা, যার সংজ্ঞা হয় না। (শুয়োরের মাথায় টুপি থাকাই নাকি স্বাভাবিক ছিল!) কেন হাসি পায় বোঝানো যায় না। যেমন T S Eliot-এর এর ‘Old Possum’s Book of Practical Cats’-কবিতাগুচ্ছের খুঁটিনাটি অর্থ খুঁজতে গেলেই মজা নষ্ট হয়। শ-এর কাহিনির দৌড়ে শুধু কল্পনা নয়, কল্পনার ‘লজিক’টিও বাস্তববোধের ঊর্ধ্বে।
গল্পের দ্বিতীয় বিশেষত্বটি হল, এর নায়িকা কালো মেয়েটি নগ্নিকা। গল্পে সেকথার উল্লেখ কোথাও নেই, নগ্ন-ভূমিকা খুঁজে পাওয়া যায় না না-নাটক, না-উপন্যাস আখ্যানটিতে। অথচ চিত্রকর যে স্বাধীনতা নিয়েছেন (শ-এর মতামত অনুযায়ী) তা পাঠকমহলে বিতর্কমূলক। ছবিতেই দেখা যাচ্ছে সে শ্রীহীন, অথচ সরল, অকপট একটি স্ত্রীমূর্তি। (অকপট কথাবার্তাগুলির মধ্যে ধরা আছে শ-এর মুখের চাপান-উতোর।) বীর প্রমীলা সে। তথাকথিত অসভ্য শ্রেণিভুক্ত হয়েও ‘অ-সভ্যতা’কে সে শাসাতে পারে। কিন্তু তার বিতর্কেও আছে ননসেন্স আস্তরণ, যা কোনো নীতিশাস্ত্রকেই মাথা তুলতে দেয়নি। সভ্যজগতের চলনবলন হোঁচট খায় মেয়েটির কাছে। এর অঙ্গে কী আবরণ উঠবে? যা-ই উঠুক না কেন, সে চিহ্নিত হয়ে যাবে বিশেষ কোনো প্রজাতিরূপে, তার জাত ধর্ম বর্ণ, এইসব পরিচয়ে। সে নামগোত্রহীন নিরপেক্ষ এক প্রতিভূ, যে ঈশ্বর সন্ধানে ব্যস্ত। এই বিবস্ত্র চেহারার কোনো পরিচয় নেই, শুধু তার চামড়ার চাকচিক্যের বর্ণনা ছাড়া। তার নগ্নরূপ দিয়েই তার যা কিছু অজ্ঞতা ও সরলতা। তার বহিরঙ্গ বর্ণনার কোনো প্রয়োজনই হয়নি গল্পের পরিকল্পনায়। সে নির্বোধ, সে আবরণকে আভরণ করতে শেখেনি। অথচ তার সরলতার মধ্যেই প্রকট হচ্ছে নির্বুদ্ধিতার এক নূতন সংজ্ঞা। তার নগ্ন চেহারা ঢুঁড়ে আর কোনো কিছুই পাওয়া যাবে না, শুধু পাওয়া যাবে তার মাতৃত্বে অভিষেকের উল্লেখ। তার সঙ্গে ছবির নগ্নতার কোনো যোগাযোগ নেই। তার নগ্নতা ও মাতৃত্বে অভিষেকের যে সংক্ষিপ্ত উল্লেখ আছে গল্পের উপসংহারে, তা নানা পাঠক নানাভাবে বিশ্লেষণের অধিকারী। অম্লান বৈশিষ্ট্যে ভাস্বর শ-এর এই মহিলাটি আলোচিত হোক নানাভাবে।
Book Content👉
শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান – ১
এক
এ কাহিনীর পটভূমি আফ্রিকার গভীর অরণ্য। মিশনারী মেমদিদিটির কাছে অরণ্যের কালো মেয়েটির দীক্ষাগ্রহণ সম্পন্ন হল।
খর্বুটে চেহারার মেমদিদিটির বয়েস তিরিশের নিচেই হবে। নিবাস, সুদূর ইংল্যাণ্ড। ছোট্ট দেহটায় বিশাল একটা হৃদয় বয়ে বেড়াচ্ছেন। সংসারে শান্তি-টান্তি জুটল না অমন একটা হৃদয় নিয়ে। তাই জঙ্গলে চলে এলেন অসভ্য বুনোগুলোর মাঝে পরিত্রাতা যীশুর ভালোবাসা বিলিয়ে দিতে। ছোটবেলায় ইস্কুলের ক্লাশে দিদিমণিদের দিকে তিনি এমন উদাস হয়ে শ্রদ্ধাভরে তাকিয়ে থাকতেন যে তাঁকে সবাই করুণা করতেন, কেউ বকাঝকা করতে পারতেন না। অথচ অন্য মেয়েদের সঙ্গে তিনি মিশতেনই না। আর আঠারো বছর না পুরতেই টপাটপ প্রেমে পড়তে লাগলেন চার্চের পাদ্রীগুলোর সঙ্গে। একসঙ্গে ছ জনের সঙ্গে জমে উঠল ভাবসাব। যেই বিয়ের প্রস্তাব এল অমনি টুক টুক করে কেটে পড়লেন। পাদ্রীগুলোও হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। তবে একজন হতাশায় সেঁকো বিষ খেল। এতে অবশ্য মেমদিদিটি তূরীয় আনন্দরই স্বাদ পেলেন। অপার্থিব মহিমার এক মাখো মাখো আস্বাদ আর কি!
তবে এ ঘটনার পর তাঁর বিয়ের পাট চুকে গেল চিরতরে। যাই হোক, আফ্রিকার কালো মেয়েটি, যাকে খ্রীশ্চান করা হল, বেশ বড়িয়া চীজ মানতেই হবে। চকচকে গা হাত পা, মসৃণ সাটিনের মতো। তার শ্যামবর্ণের পাশে মেমদিদিটি যেন ফ্যাকফ্যাকে সাদা ছাই মাখা ভূত। আর চাল চলন? সে বেশ অস্বস্তিতেই ফেলেছে মেমদিদিকে। দীক্ষা শেষ হতে না হতেই বলে, ‘বলুন, ঈশ্বর কোথায়।’
মেমদিদি উদাস কণ্ঠে বললেন, ‘তিনি তো বলেইছেন, আমায় খোঁজো!’ খ্রীশ্চান হলি, শিষ্ট মনে সব কিছু মেনে নে না বাবা, তা নয় ধম্মো নিয়ে এটা সেটা কূট প্রশ্ন। প্রভু যীশুকে নিয়ে কত কী যে বানাতে হল তার প্রশ্নের জবাবে! শেষমেষ তাকে ইংরিজি শিখিয়ে, হাতে একটা ছেঁড়া বাইবেল গুঁজে দিয়ে তবে মেমদিদির ছুটি। আর কালো মেয়েটাতো তার মুগুরের মত ডাণ্ডাটা ঘোরাতে ঘোরাতে জঙ্গলে ঢুকল। ঈশ্বরকে ঢুঁড়ে বার করবেই সে!
প্রথমেই চোখে পড়ল একটা মাম্বা সাপ। ক্ষেপে গেলেই কামড়ায়। কালো মেয়েটি শিক্ষা পেয়েছে জীবজন্তুর প্রতি সদয় হতে। (জীবজন্তুরা কূট প্রশ্ন তোলে না বলে মেমদিদিটির একটু দুর্বলতা ছিল ওদের ওপর।) আর শিক্ষা পেয়েছে নির্ভয় চিত্ত হতে। তাই কালো মেয়েটি ডাণ্ডাটা একটু আড়াল করে বাগিয়ে ধরে সাপটিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘ওহে শোনো, তোমাকে কে গড়েছে বল দেখি? কে জাগিয়েছে তোমার মধ্যে খুনের প্রবৃত্তি, আর সে জন্য দিয়েছে বিষ?’
সাপটা এই শুনে থমকে দাঁড়াল। ইশারায় ডাকল মেয়েটিকে। বলল, ‘আমার সঙ্গে এস, তাঁকে দেখতে পাবে।’
এঁকে বেঁকে সাপ চলল গাছপালা ছেড়ে পাথুরে জমি বেয়ে ওপর দিকে। মেয়েটিকে নিয়ে এল একটা চোখা নাক-মুখওলা মানুষের সামনে। বেশ খানদানী চেহারা, একমাথা ঘন দোলানো চুল। একমুখ দাড়ি গোঁফ। যেমনি সাদা দেহ, তেমনি সাদা চুল দাড়ি। হাতে একটা রাজদণ্ডের মত ঠ্যাঙা লাঠি।
বলা নেই কওয়া নেই, সেই লাঠিটা দিয়ে হঠাৎ লোকটা সাপটাকে গদাম করে এক ঘা কসিয়ে সাবাড় করে দিলে।
এই কাণ্ড দেখে মেয়েটা বেশ রেগেই গেল। বিরক্ত মুখে বলল, ‘ঈশ্বরকে খুঁজতে বেরিয়েছি, পারেন সন্ধান দিতে?’
‘তাকে তো পেয়েই গেছিস রে!’ লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, ‘বোস দেখি হাঁটু গেড়ে আমার সামনে, পুজো কর আমায়। আমিই গড়েছি স্বর্গ, আমিই গড়েছি ধরিত্রী। যা কিছু দেখছিস সব, সব আমার গড়া। আমিই সাপের মুখে ঢেলেছি বিষ, মায়ের বুকে দিয়েছি দুধ। আমার হাতেই মৃত্যু আর জরা, আমার হাতেই বজ্র এবং বিদ্যুৎ, ঝড়, ঝঞ্ঝা আর মহামারী। এসবই আমার মাহাত্ম্যের চিহ্ন। . . .কই, হাঁটু গেড়ে বোস! . . .আমার কাছে খালি হাতে এসেছিস যে! পরের বার তোর বাচ্চাকে নিয়ে আসবি, বলি দেব। কচি ছানার রক্তের ঘ্রাণ বড় প্রিয় আমার।’
—আমার বাচ্চা কোথায়, আমি যে কুমারী!
—তবে তোর বাপকে ধরে নিয়ে আয়, সে তোকে আমার পায়ে বলি দিক। আর শোন, তোর বাপের যে সাঙ্গোপাঙ্গ আসবে তাদের বলিস কিছু পুরুষ্টু পাঁঠা আনতে। বহুদিন পাঁঠার ঝোল খাইনি। না আনলে সব কটাকে ব্যারাম ধরিয়ে টপাটপ মেরে ফেলব, এই বলে দিলুম।’
মেয়েটির মাথায় আগুন চড়ে গেল। কঠিন গলায় বলল, ‘আমায় কি কচি খুকী পেয়েছ, না বাহাত্তুরে বুড়ি, যে তোমার এসব শয়তানী চালবাজিতে ভয় পাব? সত্যিই যদি ঈশ্বর থাকেন তো তাঁর নামে শপথ করে বলছি, ওই সাপটাকে যেমন মারলে তেমনি তোমায় আমি থেঁতলে—’ বলেই ডাণ্ডাটা মাথার ওপর তুলে পাহাড় বেয়ে তেড়ে এল। আশ্চর্য!চূড়োয় উঠে দেখে কোথা দিয়ে কখন কীভাবে কে জানে, লোকটা চম্পট দিয়েছে।
মহা ধাঁধায় পড়ল মেয়েটি। এই সংকটে সে তার বাইবেলের প্রথম কয়েকটা পাতা খুলে পড়তে গেল, কিন্তু পাতাগুলো এতই উইয়ে খাওয়া যে ঝুর ঝুর করে বাতাসে আর ধূলোয় মিশে গেল। গভীর হতাশায় দীর্ঘশ্বাস পড়ল মেয়েটির। ফের শুরু হল তার পথ চলা। এবার পথে পড়ল একটা ঝমঝমা সাপ। চললেই তার গায়ের আঁশে শব্দ ওঠে ঝমর-ঝমর করে। মেয়েটি তাকে বলল, ‘তুমি দেখছি বেশ জানান দিয়ে আস। চুপিসাড়ে আস না। ভালো ভালো। তোমার দেবতাটি তাই নিশ্চয়ই ভালো হবেন। কোথায় তিনি বলতে পার?’
ঝমঝমা সাপ বলল, ‘এস আমার সঙ্গে।’
সাপের সঙ্গে মেয়েটি হাজির হল এক মনোরম উপত্যকায়। সেখানে রূপোলী চুলদাড়িওলা এক আধবুড়ো লোক একটা ঝকঝকে টেবিল পেতে বসে রয়েছে। টেবিলে ছড়ানো রয়েছে গুচ্ছের লেখাজোকা কাগজ আর কলম। স্বর্গের পরীদের হাতে অমন সুন্দর সুন্দর কলম দেখা যায়। লোকটার বেশ দয়ালু চোখ মুখ, কিন্তু হলে হবে কী, গোঁফ জোড়া মোষের শিঙের মত ওপরদিকে পাকানো। আর ভুরু দুটিতে কীরকম একটা দুষ্টুমির ছায়া।
বুড়োটা সাপকে দেখেই বলল, ‘বাঃ, এই তো এনেছিস! সাপটাও মহা খুশি হয়ে জঙ্গলে সেঁধোল ঝমর ঝমর করতে করতে। এবার বুড়োটা বলল, ‘ওহে শ্যামাঙ্গী, আমায় ভয় পেয়ো না। আমি নির্দয় ঈশ্বর নই। শুধু একটু তক্কো করি, এই যা। আমাকে পূজো আচ্চা করার কোন প্রয়োজন নেই। দোষে গুণে তৈরি আমি, বুঝলে হে! . . .কই, চুপ করে রইলে যে, কিছু একটা বলো, তক্কো জমাই।’
কালো মেয়ে : আপনিই গড়েছেন এই পৃথিবী?
বুড়ো : নিশ্চয়!
কালো মেয়ে: কেন গড়তে গেলেন এই বিচ্ছিরি জায়গাটা?
বুড়ো: চমৎকার! বেশ বলেছ হে, এই তক্কোটাই চাইছিলাম। খুব বুদ্ধি তোমার। . . .শোনো, জোব বলে আমার একটা চাকর ছিল। এত ম্যাদামারা যে তাকে অভিশাপ-টভিশাপ দিয়ে একটু চাঙ্গা করতে চাইলাম। তবু ব্যাটা মুখে খোলেনা। তার বৌ তাকে কত শেখাল আমায় গাল পাড়তে। দোষ নেই মেয়েটার। তাকে খুব জ্বালিয়েছি, কষ্ট দিয়ে একেবারে রোগা করে দিয়েছি। তা জোব ব্যাটা একটু-আধটু তক্কো করতে শিখল। তবে আমার প্রকোপে ব্যাটা জর্জরিত হয়ে শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করল।
কালো মেয়ে: আমি তর্ক করতে আসিনি। জানতে এসেছি, পৃথিবী যখন গড়লেনই, এটাকে এত বদ মুল্লুক করলেন কেন?
বুড়োটা এই শুনে ক্ষেপে উঠল— ‘বদ মুল্লুক, তারজন্য জবাবদিহি করব তোমার কাছে? আমার খুঁত ধরতে এসেছ? গড়ো না দেখি একটা রূপময় বসুন্ধরা, পারবে? যাও, একটা তিমি মাছ গড়ে নিয়ে এস দেখি! আরে বাবা, তিমি গড়তে গেলে একটা আস্ত সাগর আর আকাশও গড়তে জানা চাই হে। একটা ইঁদুর গড়ার ক্ষমতা নেই আবার জবাবদিহি চায়! মাটি খুঁড়ে এক ফোঁটা জল বের করতে পারে না, আর যে আমি সসাগরা ধরিত্রী খুলে বসে আছি তার কাছে এসেছে স্পর্ধা দেখাতে! আগে এই তক্কের জবাব দাও— তুমি কি নিজেকে আমার চেয়ে বড় বলে মনে কর?’
কালো মেয়ে বলল, ‘এ তো তর্ক নয়, অহমিকার বুলি। তর্ক কাকে বলে সে সম্পর্কে আপনার কোন ধারণাই নেই।’
‘কী!’— গর্জন করে উঠল বুড়োটা। ‘আমি কী জানি আর কী জানি না তার বিচার করবে তুমি? . . .ওরে খুকী, তোর আস্পর্ধা দেখে হাসি পায়।’
কালো মেয়ে : হাসুন, ক্ষতি নেই, আমি জবাব চাই কেন পৃথিবীটা এমন করে গড়লেন। আমি হলে মানুষগুলোকে এত পাপী করতাম না। কেন আপনি সাপের মুখে বিষের থলি গুঁজেছেন? পাখির মত সুন্দর জীব গড়তে পারেন অথচ কেন গড়লেন বাঁদরের মত কুৎসিত জানোয়ার?
বুড়ো: বুদ্ধি থাকে তো জবাব দে না কেন গড়েছি এসব।
কালো মেয়ে: বলব? আপনার মধ্যে লুকিয়ে আছে কুটিল মন।
বুড়ো: হেঁয়ালি কোরো না, আমি তক্কো চাই!
কালো মেয়ে : যে ঈশ্বর আমার কথার জবাব দিতে পারেন না তাঁকে আমার কোন প্রয়োজন নেই। এসব সৃষ্টি সত্যিই আপনার কিনা সন্দেহ আছে। তিমি মাছের কথা বলছিলেন না? সেও তো বিশ্রী, বেঢপ, কুচ্ছিৎ জন্তু। ছবি দেখেছি আমি।
বুড়ো: ওরে বোকা, সবই আমার ইচ্ছে। কুচ্ছিৎ তিমি গড়ে যদি আমি মজা পাই তো তোর কী রে?
কালো মেয়ে : নাঃ, আপনার সঙ্গে আর বকতে পারছি না। আপনি মেজাজ ঠিক রাখতে পারেন না, ব্যবহারও যথেষ্ট খারাপ। . . .বেচারা জোব! আপনাকে মিছিমিছি শুধু শ্রদ্ধাই করে গেল। এই জঙ্গলে দেখছি অনেক বুড়োই ঈশ্বর সেজে বসে আছে। দেখাচ্ছি মজা।
এই বলে মেয়েটা ডাণ্ডা তুলল। আধবুড়ো ঈশ্বর অমনি ক্ষিপ্র গতিতে টেবিলের তলা দিয়ে মাটির গর্ভে সুড়ুৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
মেয়েটি ফের বাইবেলে মনোনিবেশ করতে যাবে এমন সময় একটা দমকা হাওয়ায় গোটা বিশেক পাতা খুলে গিয়ে এদিক ওদিক উড়ে পালাল।
মেয়েটি গভীর মনোবেদনা নিয়ে বসে রইল। ঈশ্বরের খোঁজ মিলল না, বাইবেলেরও দফা গয়া। আর বুড়ো দুটোর সঙ্গে বকে বকে মেজাজটাও খিঁচড়ে গেছে। সাত-পাঁচ ভাবছে এমন সময় গ্রীক পোষাকে ফিটফাট, দাড়ি গোঁফ কামানো এক ছোকরা কোত্থেকে এসে হাজির। মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে গভীর শ্রদ্ধায় নত হয়ে বলল, ‘মশাইয়ের চোখ দুটি দেখছি জ্ঞানীর মত। বলতে পারেন, ঈশ্বর থাকেন কোথায়?’
ছোকরাটি বলল, ‘ওসব ভেবে কষ্ট পেয়ো না। যেমন যা দেখছ, মেনে নাও। এসবের ঊর্ধ্বে আর কিছু নেই, থাকতে পারে না। সব পথ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে কবরের ধূলোয়। নৈরাজ্যের অন্ধকারে কী কাজে লাগবে জ্ঞানগম্মির অহঙ্কার? শোনো, নাকের ডগায় যা যা দেখছ, তাই নিয়েই সন্তুষ্ট থাকো।’
কালো মেয়ে : কিন্তু আমার মন যে আরো দূরে যেতে চায়! ঈশ্বরই যে আমার সব আশা ভরসা। তাঁকে পাচ্ছি কই?
ছোকরা: যদি বলি ঈশ্বর-টিশ্বর কেউ নেই?
কালো মেয়ে : সেকী! এ তো অজ্ঞতার কথা! এসব ভাবলে যে আমি খারাপ মেয়ে হয়ে যাব!
ছোকরা: কে বলেছে এ সব? আর যদি খারাপ মেয়েই হয়ে যাও, ক্ষতিটা কী?
কালো মেয়ে: না না, খারাপ হতে আছে নাকি?
ছোকরা: তাহলে আগে ঠিক করে জানো, তুমি ভালো না খারাপ।
মেয়েটি চিন্তায় পড়ে গেল। ভেবে-টেবে বলল, ‘এই শুধু জানি যে আমায় ভালো হতে হবে। ভালো হতে হবে। ভালো হওয়া কি খারাপ?’
ছোকরা: হেসে বলল, ‘এ সব চিন্তার কোন মানেই নেই।’
মেয়েটি বলল, ‘আপনার কাছে মানে নেই, কিন্তু ঈশ্বরের কাছে আছে। আমার সর্বদা কী মনে হয় জানেন? মনে হয় যেদিন সত্যিকারের ভালো মেয়ে হব সেদিনই পাব ঈশ্বরের দেখা।’
‘কী খুঁজতে কী পাও দেখ। আমার উপদেশ হচ্ছে, কাজকাম করে যাও, যে কটা দিন বাঁচবে জীবনের কাজে লাগাও। মরলে তো কাজও নেই কম্মোও নেই, এসব ফালতু জিজ্ঞাসাও অবশ্য নেই।’
‘মরার পরেও তো কিছু আছে!’ মেয়েটি বলল, ‘এখানে না বাঁচলেও মরার পরের ভবিষ্যৎটাতো মানতে হবে!’
ছোকরা: তুমি কি তোমার জন্মের আগের কথা জানো? অতীত, যা এক সময় সত্যি ঘটেছে তা যদি না জানো তো ভবিষ্যৎ, যা ঘটেইনি সেটা নিয়ে মাথাব্যথায় কী লাভ?
কালো মেয়ে: কিন্তু তাতো ঘটবেই, সূর্য তো রোজ উঠবেই!
ছোকরা: কে বলেছে? সূর্যও একদিন জ্বলে জ্বলে ফুরিয়ে যাবে।
কালো মেয়ে: জীবনও তো সূর্যের মতো, একটা শিখা। দিন দিন পুড়ে চলেছে। কিন্তু প্রতিটি শিশুর জন্মলগ্নে সে আগুন নতুন করে জ্বলে উঠছে। মৃত্যুর চেয়ে তাই জীবন বড়। হতাশার চেয়ে আশা। আমি আমার কাজ করব যখন জানব আমার কাজটা ভালো। সেটা জানতে হলে ভূত-ভবিষ্যৎ জ্ঞানের বড় প্রয়োজন।
ছোকরা: এবার কট মট করে তাকিয়ে বলল, ‘অর্থাৎ তুমি নিজেই একটা আস্ত ঈশ্বর বনতে চাও!’
কালো মেয়ে: মুখ নামিয়ে বলল, ‘সে চেষ্টা কি অন্যায়?’
এ সবের পর মেয়েটি জানতে চাইল ছেলেটির পরিচয়। ছেলেটি বলল, ‘আমার নাম কোহেলেথ। ধর্মের জ্ঞান বিলোই। আমিও ঈশ্বরকে পেলাম না। যদি তুমি পাও, প্রার্থনা করি তিনি তোমার সহায় হোন, আর শোন, গ্রীক ভাষাটা রপ্ত কর, এটা তাবৎ জ্ঞানের ভাণ্ডার!’
হাত নেড়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল ছেলেটি। কালো মেয়ে সোজা দিকে না গিয়ে অন্য আর একদিকে হাঁটা দিল। গভীর চিন্তার ছায়া পড়েছে তার মনে। চলতে চলতে, ভাবতে ভাবতে সে ঘুমিয়ে পড়ল, ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই চলতে লাগল।
হঠাৎ নাকে এল হিংস্র জন্তুর ঘ্রাণ। চমকে চোখ খুলে দেখে পথ জুড়ে একটা ধেড়ে সিংহ বসে বসে রোদে গা গরম করছে, যেন উনুনের ধারে ছাপোষা বিড়ালটি। পশুরাজের কেশরটি সত্যিই মনোরম, অন্যপ্রদেশের সিংহের ভেজা ন্যাতার মত চুপসানো নয়, বেশ ফোলা ফোলা।
কালো মেয়েটি এগিয়ে এল। যেন কোন পাহাড়ী ফুল তুলছে। এই ভাবে আদুরে হাতে সিংহের থুতনি ধরে একটু নেড়ে দিল সে। পশুরাজ (রাজা রিচার্ড তাঁর পোষাকী নাম) হাস্যময়তায় উদ্ভাসিত হলেন। বিগলিত হয়ে চলতে লাগলেন মেয়েটির সঙ্গে। সাবধানে চলল ওরা। সিংহের চেয়েও বলবান জন্তুর অভাব নেই জঙ্গলে। ওরা দেখতে পেল ঢেউ খেলানো চুল দোলানো এক মানুষকে। একটা বেঢপ ছয় নম্বরী নাক তার। পরনে তার কিচ্ছুটি নেই, এক জোড়া চটি ছাড়া। কুঞ্চিত চোখ মুখ, পেল্লায় নাসিকায় দুটো ইয়া ইয়া ফুটো। গলা দিয়ে তার ঘড়ঘড়ে আর্তনাদের মত একটা আজব শব্দ হচ্ছিল। যেন কোন বিপাকে পড়েছে। মেয়েটিকে দেখে কিন্তু গর্জন থামিয়ে বেশ নিবিষ্টচিত্তে চেয়ে রইল।
কালো মেয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘হে মহোদয়, আপনি কি সেই ভবিষ্যৎদ্রষ্টা যোগী পুরুষ যিনি নগ্ন দেহে বিকট সুরে বিলাপ করেন?’
‘তা একটু বিলাপ-টিলাপ করি বইকী।’ বিনয়ী সুরে লোকটি বলল। ‘আমার নাম মাইকা। কী করতে পারি তোমার জন্যে?’ লোকটি শুধালো।
‘আমি ঈশ্বরকে খুঁজছি,’ মেয়েটি জানাল, ‘এক বুড়োর দেখা পেয়েছিলাম যিনি পাঁঠার ঝোল খেতে চাইলেন আর আমার বাচ্চাকে হাঁড়ি কাঠে ফেলে—’
এই না শুনে লোকটা এমন বিশ্রী, উৎকট বিলাপ শুরু করল যে রাজা রিচার্ড ভয়ের চোটে ঝটপট একটা ঝোপের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে চুপচাপ বসে ল্যাজ আছড়াতে লাগলেন এদিক ওদিক। পরিস্থিতি খুব ভালো ঠেকল না তাঁর।
লোকটা চেল্লাতে লাগল, ‘সে বুড়ো একটা জোচ্চোর। একটা রাক্ষস। সত্যিকারের ঈশ্বরকে পাওনি তুমি। তিনি তোমার কাছে প্রেম ছাড়া আর কী চাইতে পারেন? তিনি তোমার কাছে চাইবেন ক্ষমা আর ন্যায় বিচারের গুণ। চাইবেন তোমার সঙ্গে দীনজনের মতো পথ চলতে। আর কী চাইবেন তিনি! আর কী!. . .’
মেয়েটি বুঝল এই বুড়োটা তিন নম্বর ঈশ্বর। একে অন্যগুলোর থেকে ভালোই ঠেকছে। তবে ক্ষমা, ন্যায় বিচার এ সব তো জজ সাহেবদের সম্পত্তি। আর কোথায় চলেছি না জানলে ঈশ্বরের পায়ে পায়ে হেঁটে কী লাভ তাও বুঝতে পারল না মেয়েটি।
বুড়োটা বলল, ‘দরিদ্রের মত চলতে শেখ, পথ দেখাবেন তিনি। কোথায় চলেছ সে জেনে তুমি কী করবে?’
কথাটা মেয়েটির মনঃপূত হল না। বলল, ‘আমার কি চোখ নেই? আমি নিজেই চলতে পারি। তিনি আমায় চোখ, মন সব দিয়েছেন। তবে কেন আর তাঁকে আমার হয়ে দেখতে কিংবা ভাবতে বলি?’
এই শুনেই বুড়ো লোকটা ফের বীভৎস বিলাপ জুড়ল। রাজা রিচার্ড তো চমকে ল্যাজ তুলে দে দৌড়। মাইল দুয়েক টানা ছুটে তবে হাঁফ ছাড়ে। আর মেয়েটি তার উল্টো দিকে দৌড়ল প্রায় মাইল খানেক। অবশেষে তার হুঁস ফিরল। ভাবল, ‘বেআক্কেলে বুড়োটার ভয়ে এমন দৌড়চ্ছি কেন? দূর দূর!’ তারপর ডাণ্ডাটা পাকাতে লাগল সে।
কে যেন কোত্থেকে বলে উঠল, ‘তোমার ভয়, তোমার আশা আকাঙ্ক্ষা সবই তোমার মনগড়া।’ এ বক্তাটিও প্রৌঢ়, দৃষ্টি অতি ক্ষীণ। চোখে মোটা কাচের চশমা। একটা এবড়ো-খেবড়ো গাছের গুঁড়ির ওপর বসে আছেন।
‘তোমার অভ্যাসের অজানিত প্রতিক্রিয়ার তাড়নায় তুমি অমন দৌড়াচ্ছিলে।’— লোকটি বললেন। ‘সিংহের বনে বাস কর, তাই গর্জন শুনলেই পালানোর অভ্যাস অর্জিত হয়েছে। ঐ যে বললাম, অভ্যাসজনিত অজানিত তাড়না। পঁচিশ বছর গবেষণাগারে কাটিয়ে আমি এইসব আবিষ্কার করেছি। অসংখ্য কুকুরের খুলি ঘেঁটেছি। ওদের গাল ফুটো করে লালা ঝরিয়েছি। মানুষেরা আমায় নতমস্তকে প্রণাম করেছে প্রাণীর আচার ব্যবহার সংক্রান্ত এইসব আবিষ্কারের জন্যে।’
মেয়েটি ব্যঙ্গ করল, ‘এর জন্যে পঁচিশ বছর লাগল! পঁচিশ সেকেণ্ডে আমি এসব বলে দিতে পারতাম। আর অতগুলো কুকুরের প্রাণ যেতনা।’
‘তোমার অজ্ঞতা সীমাহীন’, ক্ষীণ দৃষ্টির মানুষটি বললেন। ‘ব্যাপারটা একটা কচি বাচ্ছাও বোঝে, এই যেমন তুমি বুঝে গেলে। কিন্তু গবেষণাগারে প্রমাণিত তো হয়নি কোনদিন! আর তাই এটাকে বৈজ্ঞানিক সত্য কোনদিনই বলা যেত না যদি না আমি এ বিষয়ে গবেষণা করতাম। আচ্ছা, তুমি কি কোনদিন কোন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছ?’
‘বহুবার!’ বলল মেয়েটি। ‘এই তো, এক্ষুনি করতে পারি। . . .জানেন কি আপনি কীসের ওপর বসে আছেন?’
‘জানি। আমি বসে আছি এক অতি প্রাচীন মৃত মহীরুহের শরীরে, যে শরীর সময়ের বিধ্বংসী প্রভাবে সতত ক্ষয়িষ্ণু—’
‘ভুল কথা!’ কালো মেয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আপনি জানেনও না, দিব্যি বসে আছেন একটা ঘুমন্ত কুমীরের পিঠে!’
আঁক করে উঠে চশমা সামলে লোকটা উদভ্রান্তের মত দৌড় দিল। তারপর কাছাকাছি যে গাছটা পেল সেটায় হাঁচড় পাঁচড় করে বেয়ে তরতর করে উঠে গেল। কাজটা এ বয়েসে বেশ অস্বাভাবিকই বটে।
মেয়েটি হেসে বলল, ‘আরে মশাই, নেমে আসুন। আপনার জানা উচিৎ ছিল কুমীর নদীতে থাকে। আমি শুধু মাত্র একটা বৈজ্ঞানিক গবেষণা করলাম আপনার ওপর।’
লোকটা পিট পিট করে চারিদিক দেখে কাতর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘নামি কী করে? পড়ে যে হাত পা ভাঙব!’
‘তাহলে উঠলেন কী করে?’ মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল।
‘তাই তো ভাবছি!’ লোকটি প্রায় কেঁদে ফেলে আর কি!
‘হায় হায়, আমার বোধ হয় আর মাটিতে নামা এ জীবনে আর হল না!’ চশমা খুলে চোখ মুছতে লাগল লোকটি।
কালো মেয়েটি শুধু বলল, ‘আমার গবেষণাটি বেশ চমকপ্রদ বলুন?’
‘নির্দয় গবেষণা, কুটিল গবেষণা। বদমাশ মেয়ে কোথাকার—’ গাছ থেকে চিৎকার ভেসে এল— ‘আমার মত এমন ক্ষীণজীবী মানুষকে মানসিক আঘাত হেনে তার হৃদযন্ত্রকে এমন দুর্বল করা কি উচিৎ কাজ? সারাজীবন আমি দ্বিতীয়বার কোন গাছের গুঁড়িতে বসতে পারব না। . . . আমার নাড়ী দ্রুত ছুটছে! হাত যদি ছেড়ে যায় তবে মাধ্যাকর্ষণে টুপ করে একটা আধলা ইঁটের মত খসে পড়ব আমি। আমার এ কী হাল করলে!’
‘জন্তু-টন্তু নিয়ে এত গবেষণা করেছেন, আর এটুকুতেই এত ভয়? আমাদের জঙ্গলে আদিম জাদুর জোর আপনার গবেষণার চেয়ে দেখছি শতগুণ বেশি। একটা কথা বলে কেমন আপনার মত দুর্বল মানুষকে গাছে চড়িয়ে দিয়েছি!’
‘দোহাই, আরো একটা কথা বল যাতে আমি আবার মাটিতে নেমে পড়তে পারি!’ লোকটা কাকুতি মিনতি করল।
‘আচ্ছা তাই বলব’, এই বলেই মেয়েটি হঠাৎ বিকট চেঁচাল, ‘আরে আরে, সাবধান! একটা কালকেউটে আপনার ঘাড় চাটছে!’
এই না শুনেই লোকটা এক মুহূর্তে গাছ থেকে কী কায়দায় যেন সটান পৌঁছে গেল মাটিতে। যদিও শেষটায় পিঠের দিক করে পড়ল, তবে সামলে নিয়ে খাড়া হল। তারপর ব্যাজার মুখে গা হাত পা ঝেড়েঝুড়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা, সাপটাপ কিছু নেই।’
‘তা তো নেইই। মিথ্যে অমন ভয় পেয়ে গেলেন!’
‘মোটেই ভয় পাইনি, বিন্দুমাত্র না’— চিৎকার জুড়ল লোকটি। মেয়েটি নরম গলায় জানাল, ‘কিন্তু যে ভাবে নেমে এলেন মনে হল ভয় পেয়েছেন।’
যেন কিছুই হয়নি এইভাবে লোকটি বলল, ‘ঐ যে বলছিলাম না অভ্যাসজনিত অজানিত প্রতিক্রিয়ার তাড়না। . . .ভাবছি কুকুরকে এমনভাবে গাছে চড়ানো যায় কিনা।
কালো মেয়ে : কেন, কুকুরকে গাছে চড়িয়ে কী হবে?
বৈজ্ঞানিক: মানে বিষয়টি বেশ একটা বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে স্থাপন করা আর কি!
কালো মেয়ে: যত বাজে কথা। কুকুর আবার গাছে চড়ে?
বৈজ্ঞানিক: আরে, আমিও কি চড়তে পারতাম কল্পিত কুমীরের তাড়া না খেলে? কী করে কুকুরকে কুমীরের কল্পনা করানো যায় বলোতো?
কালো মেয়ে: সত্যিকারের কুমীর ছেড়ে দিলে কেমন হয়?
বৈজ্ঞানিক: ওতে খরচ পড়বে বেশি। কুকুরের পিছনে তেমন খরচাই নেই। কুকুরের ট্যাক্সোওলা আসে মাঝে মাঝে, তখন কুকুরটাকে খড়ের গাদায় লুকিয়ে ফেললেই হল। আর চোরাই কুকুর আজকাল পাওয়াও যাচ্ছে বেশ সস্তায়। সেক্ষেত্রে কুমীর বড় মাগগী। এ নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তার প্রয়োজন।
কালো মেয়ে: চলে যাবার আগে দয়া করে বলে যাবেন ঈশ্বরে আপনার বিশ্বাস আছে কিনা।
বৈজ্ঞানিক: ঈশ্বর নামক বস্তুটি এক বস্তাপচা আদিম প্রকল্পনা। এই সৌরজগৎ এক বিশাল প্রকল্পধাক্কা আর কম্পনজনিত তাড়নায় এর সৃষ্টি। . . .ধর একটা চিমটে দিয়ে তোমার হাঁটুটা খুবলে নিলাম, তাহলে—
কালো মেয়ে: তাহলে আমার এই ডাণ্ডাটা দিয়ে তোমার ঠ্যাঙেও আমি দেব একটি ঘা।
বৈজ্ঞানিক: একটু চমকে উঠে সামলে নিলেন। তারপর বকেই চললেন, ‘বৈজ্ঞানিক সূত্রের খাতিরে এইসব অপ্রয়োজনীয় আঘাতের তাড়না বারণ হওয়া উচিৎ। তবুও চিন্তার পারম্পর্যজনিত তাড়নায় নানা উদাহরণের পরিপ্রেক্ষিতে এইসব আঘাতেরও মূল্য আছে বইকী! এই প্রতিক্রিয়ার ওপর আমার দীর্ঘ পঁচিশ বছরের গবেষণা আছে।’
কালো মেয়ে: কীসের প্রতিক্রিয়া?
বৈজ্ঞানিক: সারমেয়র থুতুর।
কালো মেয়ে: আপনি একজন জ্ঞানবৃদ্ধ, তাই না?
বৈজ্ঞানিক: না, জ্ঞানী হবার আগ্রহ আমার নেই। নানা অজানা তথ্য আমি পৃথিবীকে সরবরাহ করে থাকি, আর এইভাবে প্রতিষ্ঠা করি বৈজ্ঞানিক সত্যকে।
কালো মেয়ে দয়া, প্রেম এসব যদি নিঃশেষ হয়ে যায়, শুধু জেনে আর জেনে পৃথিবীর কী ভালোটা হবে শুনি? কী যে জানতে চান তাই আপনারা জানতে শেখেননি। সে বুদ্ধিই নেই।
বৈজ্ঞানিক: বুদ্ধি নেই! সত্যিই বড় অজ্ঞ তুমি হে কিশোরী! জান কি, বৈজ্ঞানিকদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত কেবল বুদ্ধি আর বুদ্ধি।
কালো মেয়ে: আপনার কুকুরদের ওসব বোঝান গিয়ে। আপনার প্রতিক্রিয়া পদ্ধতি কি কোন মানুষের মন আর চরিত্রে কোনদিন প্রয়োগ করে দেখেছেন? শুধুই কুকুর নিয়ে তাদের মুখ ভেঙেছেন আর লালা বের করেছেন।
বৈজ্ঞানিক: অর্থহীন কথাবার্তা। গবেষণা চলবেই, যতদিন না মানুষের হৃদয় নামক বস্তুটিকে টেবিলে এনে ফেলতে পারছি! মুস্কিল হল, সেটা করতে গেলেই লোকটা মরছে।
কালো মেয়ে: আমি কিন্তু এই ডাণ্ডার একঘায়ে হৃদয়-টিদয় শুদ্ধু একটা জ্যান্ত মানুষকে পঞ্চত্ব পাইয়ে দিতে পারি।
বৈজ্ঞানিক: ভাবনায় পড়লেন কথাটা শুনে। বললেন, ‘হৃদয় শুদ্ধু! বল কী! . . .একবার একটা লোককে মরতে দেখেছিলাম। তবে কারোর হৃদয়ের অপমৃত্যু তো চোখে পড়েনি!’
কালো মেয়েটি বলল, ‘আপনি জাহান্নমে গেছেন, তাই চোখে পড়েনি। আচ্ছা চলি।’
এই শুনে বৈজ্ঞানিকটি মহাখাপ্পা হয়ে চলে গেলেন। বলে গেলেন, ‘এসব ব্যক্তিগত আক্রমণ আমার মোটে পছন্দ হয় না। চলি।’
তিনি গেলেন একদিকে, কালো মেয়েটি অন্যদিকে হাঁটতে হাঁটতে একটা মস্ত পাহাড়ের ধারে এল। সেটা বেয়ে বেয়ে একেবারে চূড়োয় এসে পৌঁছাল সে। সেখানে যীশুখ্রীষ্টের এক বিশাল ক্রুশ আগলে এক রোমান সৈনিক গম্ভীর মুখে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। এই ক্রুশ জিনিসটাকে সহ্য করতে পারে না কালো মেয়েটি। মনে পড়ে যায় এতে গেঁথেই মারা হয়েছিল বেচারা যীশুকে। মনে পড়ে যায় যীশুর যন্ত্রণার কথা। কী কষ্টই না পেয়েছিলেন তিনি! অথচ সেই মিশনারী মেমদিদিটি ক্রুশের কথা উঠলেই কীরকম যেন গদগদ হয়ে উঠতেন; আবেগে উদ্ভাসিত হত তাঁর মুখখানি। গা জ্বলে যেত কালো মেয়ের। তাই সে বিরক্ত হয়ে চেয়ে রইল ক্রুশটার দিকে। অমনি খ্যাঁক করে উঠল সৈনিকটা। বর্শা বাগিয়ে চিৎকার করল, ‘অ্যাই কেলে জানোয়ার, অমন ঘেন্না-ঘেন্না মুখে কী দেখছিস রে? শীগগির মুণ্ডু নামা! জানিস, এই পবিত্র ক্রুশ হচ্ছে আইন আর ন্যায় বিচারের প্রতীক! এই পবিত্র ক্রুশ হচ্ছে পরম শান্তির আধার!’ মেয়েটির ভাবের কোন পরিবর্তন ঘটল না দেখে বর্শা উঁচিয়ে মারতে এল সৈনিকটি। মেয়েটি ঝট করে সরে গিয়ে সৈনিকটির ঠ্যাঙেই বসিয়ে দিল তার ডাণ্ডার বেদম এক ঘা। গোড়ালি ভেঙে পড়ে গেল সৈনিকটি। কাৎরাতে লাগল। মেয়েটি বলল, ‘কী, কেমন লাগল! এই ডাণ্ডাটা হচ্ছে আমাদের শান্তিশৃঙ্খলা, আইন সবকিছুর, কী বলে যেন, ইয়ে, ঐ প্রতীক।’
মেয়েটাকে খতম করবে বলে সৈনিকটি উঠে দাঁড়াতে গেল, কিন্তু পারল না। ফের পড়ল ধপাস করে। আর পড়েই ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল। মেয়েটা ছুটতে ছুটতে পালিয়ে গেল অনেক দূরে। একটা পাহাড়ের বাঁকে অদৃশ্য হবার আগে সে একবার দম নেবার জন্য দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে চাইল। দেখল সৈনিকটি মাটিতে বসেই প্রবল আক্রোশে ঘুসি দেখাচ্ছে তাকে।
শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান – ২
দুই
তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পড়ল মেয়েটি। খুঁজে খুঁজে একটা পাতকুয়োর ধারে এসে দাঁড়াল। এক আঁজলা জল তুলে মুখে দিতে যাবে, কোত্থেকে একটা লোক এসে হাজির! শূন্য থেকে একটা পেয়ালা এনে এগিয়ে ধরল তার দিকে। আশ্চর্য! লোকটিকে আগে দেখতেই পায়নি সে।
‘আমার স্মৃতিতে এই পেয়ালায় চুমুক দিয়ে কণ্ঠ সিক্ত করো, হে রমণী!’ লোকটি ঘোষণা করল বেশ কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে।
মাথা নামিয়ে মেয়েটিও অভিবাদন জানাল তাকে। তারপর জল খেল ঢকঢক করে। পেয়ালাটা ফেরৎ দিতেই লোকটি সেটা ফের শূন্যে অদৃশ্য করে ফেলল। মেয়েটি হেসে বলল, ‘বাঃ দারুণ ভেল্কি তো! মস্ত জাদুকর আপনি! যাক, আপনিই তবে বলতে পারবেন ঈশ্বর কোথায়।’
জাদুকর: তোমার মধ্যেই। আমার মধ্যেও বটে।
কালো মেয়ে: কিন্তু তিনি স্বয়ং আমি, না আমার কেউ?
জাদুকর: বলতে পার তোমার পিতা।
মেয়েটি মোটেই খুশি হল না এ কথায়। বলল, ‘মাতা নয় কেন?’
জাদুকরও কেমন যেন একটু দমে গেল এ কথায়। বলল, ‘আমার কথাই বলি। মাকে ধরে বসে থাকলে ঈশ্বর সন্ধান হতোই না। তবে হ্যাঁ তাঁর আঁচলে আঁচলে থাকলে কিছু টাকা-কড়ি হাতে নিয়ে জমিয়ে বসতে পারতাম। এমন দলছুট ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়াতে হত না।’
কালো মেয়েটি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আর আমার কথা বলি। বাপটা সবসময় পেটাতো আমায়। তারপর বড় হতে এই ডাণ্ডাটা হাতে পেলাম। একদিন বাপটাকেই এক বাড়ি মেরে মাটিতে পেড়ে ফেললাম একেবারে। জানেন, একটা সাদা মানুষের কাছে আমায় বিক্কিরি করে দিচ্ছিল আর একটু হলেই। না না, ঈশ্বর আমার বাপ একথা বলবেন না দয়া করে।’
জাদুকর হেসে বলল, ‘বাপ বলে না মানো, এটা মানো তো যে ঈশ্বরের করুণায় আমরা একে অপরকে ভালোবাসি নিজেরই ভাই বোনের মতো?’
কালো মেয়েটি জবাব দিল, ‘উঁহু। মেয়েদের ভালোবাসা ভাইয়ের থেকে এক সময় ঘুরে যায় অপরিচিত মানুষের দিকে। এই যেমন আমার যাচ্ছে, আপনার দিকে।’
জাদুকর: আচ্ছা আচ্ছা, ভাইবোন বা মা এসব পারিবারিক উপমা ছেড়ে দাও। আমরা হচ্ছি মানবগোষ্ঠী। এক পরিবারভুক্ত। সকলে সকলকে ভালোবাসি— এই ভাবে বললে কেমন হয়? যে তোমায় ঘৃণা করে, তাকে ভালোবাসো। যে তোমায় অভিশাপে ভস্ম করে তাকে তুমি আশীর্বাদে ভরিয়ে দাও।’
মেয়েটি তবু খুশি হয় না। বলে, ‘না না, সক্কলকে ভালোবাসা বিলানো যায় না। এই ধরুন আমার এই ডাণ্ডাটা দিয়ে সকলকে পেটানো উচিৎ কি? অথচ ঈশ্বর কিছু লোক তৈরি করেছেন যাদের আমি পছন্দ করি না, আর তারাও আমায় করে না। তাই পেটাতেই হয়। আর এমন কিছু লোক আছে যাদের এক্ষুনি সাপের মত মেরে ফেলা উচিৎ। কারণ তারা মানুষকে শুষে খায়।’
জাদুকর: ঐ সব খারাপ লোকেদের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমায় কষ্ট দিও না, দোহাই।
কালো মেয়ে: যা খারাপ তা ভুলে থাকলে বেশ ভালোই লাগে, কিন্তু তাতে সুফল কিছুই মেলে না। আচ্ছা, আপনি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন?
জাদুকর: একটু কুঁকড়ে গেল এই প্রশ্নে। কিন্তু পরমুহূর্তে হেসে বলল, ‘এসব বিষয়গুলো ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে যেও না।’
কালো মেয়ে: কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজের ব্যাপারে আর উৎসাহ না থাকলে কোন কিছুরই তো মানে হয় না। এই তো বললেন আমার উচিৎ সব্বাইকে ভালোবাসা। তাহলে আমি আপনাকে ভালোবাসি একথা বলতে পারি তো? এটা কি ছোট মুখে বড় কথা হল মনে করেন?
জাদুকর: ছি ছি, তা কেন? ওসব ভেবো না। তুমি কালো হতে পার, আর আমি সাদা। কিন্তু দুজনেই ঈশ্বরের সৃষ্টি, দুজনেই সমান।
কালো মেয়ে: এ আবার কী ভেবে বসলেন! কালো-সাদার কথাটা তো চিন্তাই করিনি আমি। ধরুন আমি এক সাদা চামড়ার রানী আর আপনি আমার রাজা। —ওকী, চমকে উঠছেন কেন?
জাদুকর: না না, ও কিছু না। মানে, কী জানো, আমি হচ্ছি দীনের অধিক দীন। তাও নিজেকে মাঝে মাঝে রাজা বলে ভেবে বসি। কেন জানো? কপটতা পেয়ে বসে।
কালো মেয়ে: আ হা হা, রাজা যেন কী একটা মহান বস্তু! মহাপাজী হয় কিছু রাজা। যাকগে, ধরুন আপনি হলেন রাজা সলোমন আর আমি হলাম রানী শিবা। বাইবেলে যেমন আছে আর কি। আপনার কাছে এসে বললাম, ওগো, তোমাকে ভালবাসি। তার মানে আমি তোমাকে চাই, অর্থাৎ অধিকার করতে চাই। এইভাবে প্রেমের নামে এক মত্ত সিংহীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আমি আপনাকে দখল করে নিলাম। আপনাকে এরপর থেকে চলতে হচ্ছে আমার পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী। আপনার ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম আর নেই। আপনি আর ঈশ্বর-এর মাঝে আমি এসে হাজির হচ্ছি। এটা কি অত্যাচার নয়? ভালোবাসা প্রেম এসব না মানুষকে আসলে গিলে খেতে আসে। আপনি কি চাইবেন স্বর্গেও এই প্রেম বিরাজ করুক?
জাদুকর: প্রেম ছাড়া আবার স্বর্গ হয় নাকি?
কালো মেয়ে: হয় না, তবে সে প্রেম আলাদা। সে প্রেম মহান। ‘আমি তোমার, তুমি আমার’ বলে জাপটা জাপটি প্রেম নয়। এ ওর গলা ধরে ঝুলে পড়া নয়। জানেন, সাদা মানুষগুলো আমার সঙ্গে বড় একটা মেশে না পাছে কালো চামড়ার মেয়ের প্রেমে পড়তে হয়! ভাই বোন সেজে ভগবানের সেবা করতে বেরোয় তো ওরা। সমস্ত প্রেম নিবেদন করে ঈশ্বরকে আর নিজেরা উপোসী থাকে।
জাদুকর: দুঃখের কথা।
কালো মেয়ে: দুঃখের কথা তো বটেই! বোকা কোথাকার। শরীর যেমন প্রেম চায়, তেমনি মন চায় একাকীত্ব। সেখানে অপরের প্রেমের দৌরাত্ম্য অচল। একটা শরীর, একটা মন নিয়ে চলা যায় না। প্রত্যেকের প্রয়োজন আর একটা শরীর, আর একটা মন। কিন্তু হৃদয়, আত্মা? সে চায় একাকীত্ব। —ঈশ্বরের সঙ্গে প্রেম। তাই আপনার মতো মানুষের কাছে যখন কোন নারী এসে বলে দেহ দাও, মন দাও, আত্মা দাও, হৃদয় দাও, সব দাও, তখন আপনি আর্তনাদ করে ওঠেন। ঈশ্বরের খোঁজে বেরিয়ে একা চলতে হয়, সবাইকে প্রেম বিলোও এ সব কথা ছলনা ছাড়া কী বলুন তো? যে শিকারী তার ক্ষুধার্ত শিশুর জন্য প্রাণী হত্যায় বেরিয়েছে, তাকে ‘রক্তপাত ঘটিও না’ বলে উপদেশ দেওয়া যায় কি? ঈশ্বরের প্রেমের মাঝে আবার জীবে প্রেম বলে মানুষকে টানা কেন?
জাদুকর: তবে কি বলতে চাও এই বাণী বিলোব যে তোমরা একে অপরকে হত্যা করো?
কালো মেয়ে: দেখুন আপনাদের বাণী-টানীগুলো, সব না সস্তার দাওয়াই। বেশ চলে বাজারে। আমি ওসব বাণীর সন্ধানী নই। আমি ঈশ্বর সন্ধানী।
জাদুকর: তবে চালিয়ে যাও তোমার সন্ধান। ঈশ্বর তোমার সহায় হোন এই কাজে।
বলে অদৃশ্য হয়ে গেল জাদুকর।
আরো মাইলখানেক হেঁটে মেয়েটি দেখা পেল এক জেলের। সেই কবেকার মান্ধাতার আমলের লোক। কাঁধে একটা প্রকাণ্ড গীর্জা বয়ে নিয়ে চলেছে। মেয়েটি তাই দেখে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে আরে নড়বড়ে ঘাড়টা ভাঙল বুঝি!’ এই বলে সে সামলাতে গেল জেলেকে। জেলে বলল, ‘উঁহু, কিচ্ছুটি হবে না আমার। আমি পাথর আর আমার কাঁধে এই দেবতার আধার।’ বেশ উৎফুল্লই দেখাচ্ছিল তাকে। কালো মেয়ে তবু চেঁচাল, ‘কে বলেছে তুমি পাথর? চেপ্টে মরবে যে!’ জেলে বলল, ‘মিছিমিছি ভয় পাচ্ছ।’ তারপর কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আসলে এটা কাগজের তৈরি। এই দেখ এটা নিয়ে কেমন নাচতে পারি।’ এই বলে গীর্জা কাঁধে নাচতে নাচতে বুড়ো জেলে চলে গেল। গীর্জার ঘণ্টাগুলো তালে তালে বাজতে লাগল দুলুনিতে, রিনটিন রিনটিন করে। এর পরই ঢুকল কোত্থেকে সব দলে দলে লোক। সব্বার ঘাড়ে একটা করে কাগজের গীর্জা। আর সবার মুখেই এক কথা— ওগো মেয়ে, জেলেকে বিশ্বাস কোরো না। আমার গীর্জাটা একদম খাঁটি, সত্যিকারের। মেয়েটার এসব অসহ্য লাগল। পথ ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল সে। ঢুকতেই হল, কারণ লোকগুলো এরই মধ্যে বচসা বাধিয়েছে, এ ওকে ঢিল, পাথর ছুঁড়ে মারতে লেগেছে। নাঃ এখানে ঈশ্বরের খোঁজ মিলবে না মোটেই।
ওরা চলে যেতে মেয়েটি কী মনে করে রাস্তাতেই এসে দাঁড়াল। দেখা পেল এক ইহুদির। ইহুদিটি ব্যস্ত সমস্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘তিনি এসেছেন কি?’
কালো মেয়ে: ‘তিনি’টি কে?
ইহুদি ঐ যে যিনি বলেছিলেন আসবেন! তাঁর এক্ষুনি আসা দরকার। মানুষ মানুষকে ধরছে আর মারছে।
কালো মেয়ে: কেউ এলেই এই মারামারি থেমে যাবে ভাবছেন?
ইহুদি তিনি আসবেনই আসবেন। সব কিছু ঠিকঠাক করে দেবেন তিনি।
কালো মেয়ে: সব কিছু ঠিকঠাক হবার জন্যে বসে থাকলেই হয়েছে আর কী! তাহলে চিরকালই বসে থাকুন।
এই না শুনে ইহুদিটি হায় হায় করে একরাশ থুতু ছিটিয়ে দিল মেয়েটির গায়ে। তারপর গটমট করে চলে গেল।
এই ইহুদিটাও বেশ বুড়ো। এই বুড়োগুলোর পাল্লায় পড়েই মেয়েটা নাজেহাল। ইহুদিটি চলে যেতে তাই সে খুশিই হল। হাঁটতে হাঁটতে এল একটা গাছের ছায়ায় ঘেরা সরোবরের ধারে। দেখল সেখানে জনা পঞ্চাশেক ওরই জাতের কালো মানুষ কতগুলো সাদা সাহেবের চাকর হয়ে এসেছে। চাকরেরা নিজেদের মধ্যে খাওয়া-দাওয়া সারছিল। একটু দূরে বসেছিল ওদের সাদা প্রভুরা আর তাদের সাদা সাদা বউরা। টুপি আর আঁটোসাঁটো প্যাণ্টালুন পরা প্রভুদের দেখে বোঝাই যাচ্ছিল এরা পর্যটক।
চাকরদের সর্দারটিকে ইশারায় ডেকে কালো মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, ‘এরা কীসের পর্যটনে বেরিয়েছে?’
সর্দার চাকরটি বলল, ‘এঁরা ”কৌতূহল” সংস্থার মানুষজন।’
মেয়েটি আরো জানতে চাইল, ‘এরা ভালো না খারাপ?’
‘ভালো খারাপের বোঝেটা কী এরা? শুধুই নিজেদের মধ্যে কিচির মিচির করে ঝগড়া করে। উদ্ভট সব বিষয় নিয়ে তর্ক করে।’ চাকরটি জানাল। একটা মেমসাহেব হঠাৎ কালো মেয়েটিকে দেখতে পেল। দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই মেয়ে, চলে যাও! হটো হটো। চাকরগুলোর সব মাথা খাবে দেখছি।’
কালো মেয়েটিও চেঁচিয়ে বলল, ‘মাথাতো খেয়েই নিয়েছেন আগে।’
মেমসাহেবটি গর্জে উঠল, ‘কী! আমার পঞ্চাশ বছর বয়েস হয়ে গেল, আমি খাব ওদের মাথা? যাও যাও নিজের কাজে যাও।’
কালো মেয়ে কিন্তু নড়ল না। বলল, ‘ওরা আপনাদের মত মেমসাহেব নয়, ওদের মাথা সাফ থাকবে। আচ্ছা, আপনারা ”কৌতূহল” সংঘের লোকজন, তা কীসের কৌতূহল জানতে পারি কি?’ তারপর একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, ‘ঈশ্বর সম্বন্ধীয় ব্যাপারস্যাপার কিছু?’
‘ঈশ্বর সম্বন্ধীয়’ শুনেই তারা এমন হেসে গড়িয়ে পড়ল, যে সাহেবগুলো, যারা এতক্ষণ ঢুলছিল, চমকে-টমকে একাকার। ‘কী হয়েছে, হয়েছেটা কী’ বলে তারাও বেশ আগ্রহ দেখাতে লাগল। হাসির কারণটা তখন তাদের বেশ করে বুঝিয়ে-টুঝিয়ে দিতে হল। শুনে সাহেবদের মধ্যে একজন বলল, ‘সভ্যদেশে বহুদিন হল ঈশ্বর-চর্চা বন্ধ হয়ে গেছে।’ একজন বলল, ‘সেই কোন কালের শেক্সপীয়র কী পীর নাকি? আঠারশো শতাব্দীর জাতীয় সঙ্গীতে ঈশ্বর নেই? তাঁর সঙ্গে নোংরা রাজনীতি জড়িয়ে গান লেখা হয়নি?’ সেই দ্বিতীয় ভদ্রলোক বললেন, ‘না-না, সে ঈশ্বর এ ঈশ্বর নন! . . . মধ্যযুগের ঈশ্বর আমাদের নাকে ঝামা ঘষেছেন! বুর্জোয়ারা এসে ঈশ্বরের নাকেই ঝামা ঘষল।’ প্রথম ভদ্রলোকটি বলল, ‘আর তারপর পেটি বুর্জোয়ারা? তারা দেবদূতের পরিষ্কার স্লেটে দুনম্বরী রোজগারের হিসেব কষতে লাগল।’ তৃতীয় ভদ্রলোক বলল, ‘এই দুই ঈশ্বরই এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন, কী বল?’ কালো মেয়ে মনে মনে কী সব হিসেব কষে বলল, ‘তাহলে ঈশ্বর সংখ্যা দাঁড়াল ছয়। কিন্তু যে-ঈশ্বরকে আমি খুঁজছি তিনি এরা কেউ নন।’
প্রথম ভদ্রলোক: তুমি ঈশ্বরকে খুঁজছ? তোমার গোষ্ঠীতে কী সব ভূত প্রেত আছে শুনি, তাদের নিয়েই তো থাকলে পারো। ভাবছ আমাদের ঈশ্বর তাদের চেয়ে বড় কিছু হবেন?’
তৃতীয় ভদ্রলোক: আমাদের তো নানারকম পাঁচমিশেলি ঈশ্বর। তাদের একটাকেও তোমাদের হাতে তুলে দেওয়া যায় না।
কালো মেয়ে আপনাদের যাজকেরা আমাদের ঈশ্বর বিশ্বাস দিয়েছেন, আর আপনারাই যদি এভাবে ঈশ্বর বিরোধী হন তাহলে আমাদের হাতে কোনদিন খুন হয়ে যাবেন! আমরা সংখ্যায় অগুন্তি। আমাদের অস্ত্রশস্ত্রও আছে।
দ্বিতীয় ভদ্রলোক: এ কথাটা ভাববার মত বটে। আমরা যা মানি না তা এদের শেখাতে আসি কেন? এ অন্যায়। কেন সত্যি কথাটা এদের শেখাই না যে পৃথিবীর সৃষ্টি নিছক প্রাকৃতিক কারণে, আর ঈশ্বর হচ্ছেন গল্পকথার নায়ক?
প্রথম ভদ্রলোক: এসব বললে ওরা কী শিখবে জানেন? ধর্ম নেই, পাপ বলে কিছু হয় না, তাই জোর যার মুল্লুক তার। আর সেটা শিখলেই আমাদের ওরা গুঁড়িয়ে দেবে। মনে রাখবেন ওদের জোর কিছু কম নয়। আমরা ওদের ধরে ধরে চাকর বানিয়েছি কেন সে তো ভালোই জানি— ওরা আমাদের চেয়ে বেশি চটপটে, বেশি পরিচ্ছন্ন। আর বুদ্ধিতেও ওরা পিছিয়ে নেই।’
‘ওদের আচার ব্যবহারও অতীব প্রশংসনীয়’— এক ভদ্রমহিলার স্বীকারোক্তি শোনা গেল।
‘ঠিক,’ জানালেন প্রথম ভদ্রলোক। ‘একটা ঈশ্বর-টিশ্বরে ওদের মতি করান দরকার। সেই ঈশ্বরই ওদের হাত থেকে আমাদের বাঁচাবে যেদিন আমাদের ঈশ্বর-অবিশ্বাসের বিরুদ্ধে ওরা জেহাদ ঘোষণা করবে।’
এক চশমা পরা মহিলা বেশ গম্ভীর গলায় এবার বলে উঠলেন, ‘কোন কিছুকে ঋণাত্মক কোন সংখ্যার বর্গমূল দিয়ে ভাগ করতে বললে ওরা পারবে? পারবে না। তাই বলছি ঈশ্বর-টিশ্বর বোঝান, কিন্তু সৌরজগৎ নিয়ে যেন কিছু বলতে যাবেন না। ঐ বর্গমূলের মধ্যেই সৌর রহস্যের আসল চাবিকাঠি।’
দ্বিতীয় ভদ্রলোক: বাজে কথা। ঋণাত্মক সংখ্যার বর্গমূলটা স্রেফ ধাপ্পা। আসলে প্রাকৃতিক পছন্দ অপছন্দের ব্যাপার।
এক ভদ্রলোক হতাশ জর্জর গলায় হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘এসব কথার কী প্রয়োজন? আসল কথা, দিনে দিনে সূর্যের হল্কা কেমন যেন কমে আসছে। আমরা কোনদিন না ঠাণ্ডায় জমে মরি! এই নির্মম সত্যের নিরিখে এসব আলোচনার কোন মানে নেই, থাকতে পারে না।’
‘সাধু সাধু!’ কে একজন ছোকরা বেশ উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল। তারপর দাঁড়িয়ে উঠে গলা ঝেড়ে বক্তৃতা শুরু করল— ‘আমাদের এই ভ্রাম্যমাণ সঙ্ঘের প্রধান চিকিৎসক রূপে আপনাদের অবগতির জন্য জানাই যে যতক্ষণ না সৌর বিকিরণের ঘটনাবলি ত্যাগ করছেন ততক্ষণ বিশ্বাস রাখতেই হবে যে সূর্য দিন-দিন উত্তপ্ত হচ্ছে এবং এর ফলে আমরা না ঝলসে মরি কোনদিন!’
হতাশ ভদ্রলোক বললেন, ‘এসব কথায় কীসের সান্ত্বনা? একদিন না একদিন তো আমাদের বিলীন হয়ে যেতেই হবে!’
প্রথম ভদ্রলোক: উঁহু, তা মোটেই জোর দিয়ে বলা যায় না।
‘না, বেশ জোর দিয়েই তা বলা যায়!’ হতাশ ভদ্রলোক রূঢ়স্বরে জানালেন। ‘তাপের অন্তঃস্থলে জীবনের অনুভূতি বিদ্যমান, এটা প্রমাণিত সত্য এবং এ সত্য নিয়ে প্রশ্ন তোলাই অবান্তর। ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া বাতাসে যেমন বাঁচতে পারি না ঠিক তেমনি শবদাহের চুল্লিতেও না। পৃথিবী এই দুইয়ের যে কোন একটি অবস্থায় পৌঁছলেই তো আমরা খতম!’
প্রথম ভদ্রলোক: দূর! তাও আবার হয় নাকি? এই দেহ, যা কিনা আমাদের একান্ত অংশ, যা কিনা তাপমাত্রার একান্ত অসহায় শিকার, তা একদিন বিলীন হবেই এবং তা হবে ঘরে দোরেই, স্বাভাবিক আলো হাওয়ার মাঝেই। কিন্তু মরা আর জ্যান্তে তো তফাৎ আছেই! কোন না কোন উপায়ে তা তাপমাত্রার অধীন কিনা সেটার প্রমাণ পাওয়ার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। না হাড়, না মাস, না রক্ত— কোনটা দিয়েই এ তফাৎ করা যাবে না যদিও এই হাড় মাস রক্তই বিচিত্র এক নিয়মে গড়ে তোলে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। তফাৎটা অশরীরী। এটা বুঝতে হলে তড়িৎ চুম্বকীয় স্রোতকেই অবলম্বন করতে হবে তার কম্পনের হার অনুযায়ী, ইথার তরঙ্গের ঘূর্ণীতে, অবশ্য ইথার বলে যদি কিছু থাকে। অর্থাৎ কিনা ইথারের যদি কোন অস্তিত্ব থাকে এবং থাকলেও তা ঠাণ্ডায় জমে যাওয়া কোন গ্রহেই আছে কিংবা আছে গনগনে সূর্যের জ্বালামুখে।’
এই দীর্ঘ বক্তৃতা শুনে এক ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, ‘জানছেন কেমন করে যে সূর্য অতি গরম বস্তু?’
সেই হতাশ ভদ্রলোকটি ওপর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘অ্যাঁ, আফ্রিকার রোদে বসে এই কথা বলছেন!’
‘ফোড়নও কড়ায় পড়লে মনে হয় গরম, কিন্তু সেই গরমে কি দেশলাই কাঠি জ্বালানো যায়?’ ভদ্রমহিলাটি তর্ক জমালেন।
‘মনে অমনি হলেই হল? মনে হতে পারে পিয়ানোর ডান ধারের স্বরলিপি বুঝি বাঁ ধারের চেয়ে উচ্চগ্রামের। আসলে তো তারা সমান সমান!’ বেশ উৎসাহ ভরে আর এক মহিলা কাটান দিলেন। অন্য এক মহিলা চিৎকার জুড়লেন, ‘মনে হতে পারে বুনো কাকাতুয়ার রঙ বুঝি খুব চড়া, কিন্তু তা আসলে ঘরোয়া চড়ুইয়ের রঙের চেয়েও ফিকে। মনে অমনি হলেই হল?’
এক ব্যক্তিত্বপূর্ণ ভদ্রলোক সমঝোতা করতে চাইলেন, ‘এসব হেঁয়ালির জবাব দেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। এসব প্রাচীন কূট তর্ক। আমি মশাই ছুরি কাঁচি ধরা বদ্যি। আমি বলছি, শুনুন সকলে, মেয়েছেলেদের ঘিলুতে যে বাটির মত জিনিসটা থেকে রক্ত চালান যায় সেটা ব্যাটাছেলেদের বাটির চেয়ে কিঞ্চিৎ বৃহৎ। ফলত ক্ষরিত রক্তের আধিক্য ওঁদের, অর্থাৎ মেয়েছেলেদের ভাবনা চিন্তাকে কিঞ্চিৎ জট পাকিয়ে দেয়। ফলত ফোড়নের ঝাঁঝকে গরম মনে হয়, পিয়ানোর স্বরলিপিকে মনে হয় হেঁড়ে গলায় হাঁকডাক, বুড়ো কাকাতুয়ার রঙকে ওরা চড়া স্বরের হৈচৈ ভেবে বসে।’
সেই প্রথম ভদ্রলোকটি এই শুনে বললেন, ‘বাঃ, ডাক্তারবাবুর সাহিত্যবোধ খুব প্রশংসনীয়। কিন্তু এটাই আমার প্রতিপাদ্য বিষয় নয়। কথা ছিল সেটি কী বস্তু, যা কিনা সূর্যের তাপ হয়েও গরম ফোড়ন? সেটি কি চাঁদের নাকি বরফের হিম, নাকি নিছক গোবেচারি লোকের প্রতি নিক্ষিপ্ত ব্যঙ্গের ঝাল? এই সমস্ত অঘটনেরই তো অকুস্থল এই পৃথিবী।’ সেই হতাশ ভদ্রলোক বললেন, ‘উঁহু, পৃথিবীর শীতলতম অঞ্চল অকুস্থল হতে পারে না। কারণ তা বাসযোগ্য নয়।’
প্রথম ভদ্রলোক বললেন, ‘কিন্তু উষ্ণতম অঞ্চল যোগ্য তো বটে! এবং এও বলে দিচ্ছি, শীতল অঞ্চলেও মানুষকে বাস করতে হবে একদিন যেদিন জনসংখ্যা অত্যধিক বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া মেরু অঞ্চলে তো পেঙ্গুইনরা দিব্যি রয়েছে। আর সূর্যের মধ্যিখানেও তো বাস করার ক্ষমতা রাখে সালামাণ্ডার সরীসৃপ। আমাদের ঠাকুমাদিদিমারাও তো নরকের কুণ্ডে দিব্যি রয়েছেন!’ হতাশ ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে অমনি বলে উঠলেন, ‘নরকে যাদের বিশ্বাস আছে, হাবিজাবি সব জিনিসেই তাদের বিশ্বাস। এমনকী তারা বংশপরম্পরায় অর্জিত অভ্যাসেও বিশ্বাসী।’
এই শুনে দলের প্রকৃতিবিদ ভদ্রলোকটি বললেন, ‘আপনি বিবর্তনবাদে বিশ্বাস রাখেন নিশ্চয়ই?’
হতাশ ভদ্রলোক জানালেন, ‘নিশ্চয়ই। আমাকে কি আপনি মৌলবাদী ঠাওরালেন নাকি যে এ প্রশ্ন করছেন?’ ‘যদি তাই হয় তবে যাবতীয় অভ্যাস এবং বংশপরম্পরায় অর্জিত অভ্যাসে আপনার তো বিশ্বাস থাকা উচিত। কিন্তু হায়, সেই স্বর্গীয় উদ্যানের বিশ্বাসই যে রক্তে বইছে সবার! নতুন বিশ্বাস গ্রহণ করুন, সেই সঙ্গে পুরনোগুলোকে দূর করে দিন। তা না, বিজ্ঞান-বিজ্ঞান করছেন আর অন্তরে মৌলবাদী হয়ে বসে রয়েছেন। তাই বলি, আপনারা নির্বোধ; প্রতিক্রিয়াশীল বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণার পয়লা নম্বরের শত্রু। নড়ে বসতে হলেই আপনারা চেল্লাতে থাকেন— থামাও থামাও, ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।’
সেই প্রথম ভদ্রমহিলা বললেন, ‘হ্যাঁ, এসব ভাঙাটাঙার ব্যাপারে সবাই একমত। যদিও অন্য কোন ব্যাপারে মতৈক্য হওয়াটা বড়ই কঠিন।’
একজন মহিলা একটু ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললেন, ‘অন্তত এই মুহূর্তে ওঁরা কিন্তু একটি বিষয়ে একমত।’ প্রথম মহিলাটি উৎসুক হলেন, ‘কী, কী বিষয়ে?’
‘ঐ যে, ঐ বিষয়ে—’ বলে সেই মহিলা আঙুল তুলে কালো মেয়েটিকে দেখালেন।
প্রথম মহিলা একবার ভালো করে কালো মেয়েটিকে দেখে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন, ‘আরে, তুমি এখনও দাঁড়িয়ে রয়েছ? কখন চলে যেতে বলেছি!’ কালো মেয়ে নিরুত্তর। মন দিয়ে মহিলাটিকে সে দেখতে লাগল; তার হাতের মধ্যে ডাণ্ডাটি মৃদু মৃদু পাক খেতে লাগল। চলে তো সে গেলই না, উল্টে অঙ্কবিদ মহিলাটির দিকে চেয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী সব মূল-টুল বলছিলেন না? কোথায় হয় ওসব, জানতে পারি কি?’
‘কোথায় আবার কী হবে?’ ঝাঁঝিয়ে উঠলেন অঙ্কবিদ মহিলা।
‘ঐ যে মূল না মূলো কী বলছিলেন?’
মহিলাটি এবার নরম হয়ে বললেন, ‘আসলে ওটা বর্গমূল, অর্থাৎ একটা সংখ্যা। . . .আচ্ছা, তুমি এক দুই করে গুনতে পার?’ কালো মেয়েটি কর গুনে গুনে বলল, ‘এক দুই তিন চার পাঁচ— এইভাবে বলছেন?’
‘ঠিক!’ অঙ্কবিদ মহিলা বললেন, ‘এবার একের থেকে উল্টো দিকে গুনে যাও দেখি!’
‘এক, একের চেয়ে কম এক, একের চেয়ে কম দুই, একের চেয়ে কম তিন. . .’ মেয়েটি হিসাব করে চলে।
অমনি হাততালি পড়ে যায়। একজন বলে ওঠে, ‘চমৎকার!’ কেউ বলে, ‘স্বয়ং নিউটন!’ কেউ আহ্লাদিত হয়ে বলল, ‘লিবনিজ!’ কেউ চেঁচাল ‘আইনস্টাইন!’ একজন জাতিতত্ত্ববিদ ছিলেন সেই দলে। আনন্দে লাফিয়ে উঠে বললেন, ‘বন্ধুগণ, বলেছিলাম না, পরবর্তী সভ্যতার ধারক এবং বাহক হবে এই কালা আদমিগুলো! হে সাদা মনিষ্যির দল, তোমাদের মেয়াদ শেষ। দলে দলে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলে পড়।’
কালো মেয়েটি না বলে পারল না, ‘তোমরাও আমাদের মত হও না। বোকার মত অত অবাক হবার কী আছে? ঐ যে তোমাদের বন্দুক, এও তো বেশ একটা আশ্চর্যেরই বস্তু। আমরা হয়ত একদিন ঈশ্বরকে পেয়ে যাব তবু কস্মিনকালেও বন্দুক তৈরি করতে পারব না। ঐ বন্দুক উঁচিয়ে তোমরা আমাদের দাস বানিয়েছ। এতই কুঁড়ে, ওগুলো আমাদেরই হাতে তুলে দিয়ে ছুঁড়তে বলছ তোমাদের কাজে। তাই একদিন হয়ত বলবে, আর পারি না বাপু, বন্দুকটা তৈরি করে নিয়ে এস তো! এই বলে বন্দুক তৈরির মন্ত্রটাও আমাদের শিখিয়ে দেবে। এমন রঙিন জল তৈরি করেছ যা খেলে লোকে ঈশ্বর-টিশ্বর ভুলে গিয়ে অকপটে খুনখারাপি করে বেড়াতে পারে। সে সব জল আমাদেরই বিক্রি করেছ, তৈরি করতেও শেখাচ্ছ। আর সব সময় আমাদের জমি চুরি করে অনাহারে রেখে তোমাদের ওপর শুধু ঘৃণাই সৃষ্টি করাচ্ছ। আমরা তোমাদের কুটিল সাপের চেয়েও ঘৃণা করি। কিন্তু এর পরিণতি কি জানো? একদিন তোমাদের ঐ রঙিন জল-টল খেয়ে তোমাদের মারতে বের হব আমরা তোমাদেরই বন্দুকগুলো দিয়ে। তোমরা যেমন তোমাদের মধ্যে মারামারি করে মরছ, আমরাও তারপর আমাদের মধ্যে মারামারি বাধাব। যতক্ষণ না ঈশ্বর হাজির হন, ততদিন চলবে এ মারণযজ্ঞ। তিনি যে কোথায় তা যদি জানতাম! আপনারা কেউ দয়া করে বলে দেবেন তিনি কোথায়?’
এক ভদ্রলোক রেগেমেগে বলে উঠলেন, ‘ওরে মেয়ে, আমাদের তৈরি বন্দুক হাতে তোরা যে বাঘ সিংহের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছিস, তার বেলা?’
‘হ্যাঁ, ওদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে আমরা পড়ছি তোমাদের খপ্পরে। বাঘ সিংহের সঙ্গেই থাকি আমরা, ওরা আমাদের শরীরটা থেঁতো করে দিয়ে যায় মাঝে মাঝে, হৃদয়টা তো আর থেঁতো করতে পারে না! আর ওদের যখন পেট ভরা থাকে, ওরা আমাদের ছোঁয় না। কিন্তু তোমাদের তো লোভের শেষ নেই, প্রভু! তোমরা আমাদের বংশকে বংশ গতর খাটিয়ে মেরে শেষ করছ। খেতে দাও না, পরতে দাও না, শুধু নিংড়ে নিতে জানো। তোমরা জানো না আমাদের চাহিদার ন্যূনতম মাত্রাটাও। তোমাদের ঈশ্বর নকল, ঝুটো! তোমরা পাষণ্ড, বর্বর। নিজেরাও ঠিকভাবে বাঁচতে শিখলে না, অন্যদেরও বাঁচতে দিতে শিখলে না। ঈশ্বরকে যদি কোন দিন খুঁজে পাই, বলব, হে করুণাময়, ঐ সাদা প্রভুগুলোকে মারবার শক্তি দাও, আর শিক্ষা দাও যাতে আমরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে না মরি।’
প্রথম মহিলা এবার অতি ব্যগ্র হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘দেখেছ! কী বলেছিলাম! আমাদের চাকরগুলোর মাথা খাবে মেয়েটা। ওরা কী রকম মন দিয়ে মেয়েটার কথা গিলছে! ওদের চোখগুলো দেখো, কী বীভৎস চাউনি! বন্দুকটা কোথায়! আমি গুলি করে শেষ করব ঐ মেয়েটাকে।’ এই বলে ফস করে একটা রিভলবার বার করে ফেললেন মহিলাটি। কিন্তু অস্ত্রটা খাপ থেকে বার করে বাগিয়ে ধরবার আগেই কালো মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর, ডাণ্ডাটা ঘুরিয়ে এক ঘা কষিয়ে দিয়ে দে ছুট। কালো মানুষের দল ফেটে পড়ল উল্লাসে।
মেয়েটি বহুক্ষণ ছুটে পিছন ফিরে দেখল কেউ ওকে ধাওয়া করে আসছে কিনা। হাঁটতে হাঁটতে পুরনো পথের দিকেই ফিরল সে। সেই ‘কৌতূহলী’ সংঘ তখন অন্য দিকে চলে গেছে। মেয়েটি চলতে চলতে এক সময় দেখল সে সেই কুয়োটার ধারেই ফের এসে দাঁড়িয়েছে। তখন সবে সন্ধ্যা নেমেছে। সেখানে কারা একটা ছাউনির ঘেরাটোপ খাটিয়ে ঘর মতন বানিয়েছে। সেই ঘরে ছড়িয়ে রয়েছে কাঠ আর মাটির নানারকম মূর্তি। এ ধরণের মূর্তি বাজারে বিক্রি হয়। হঠাৎ দেখে একটা ক্রুশে হাত-পা পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছে সেই জাদুকর। আর ঘরের মালিকটি সেই জাদুকরকে দেখে কাঠ কুঁদে একটা মূর্তি গড়ছে। ঠিক তাদের সামনে পাতকুয়ার পাড়ে চড়ে বসে আছে এক পাগড়ি পরা আরবী। কোমরে গোঁজা আছে ছোরা। সে একমনে মূর্তি গড়া দেখছে আর দাড়ি আঁচড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে গজ গজ করছে— ‘এসব মূর্তি টুর্তি আবার কেন? দেবতার সুসমাচারে এ সব তো লেখা নেই। নেহাৎ পাপাচারে দুর্বল হয়ে আছে, নইলে এই ছুরি বসিয়ে শেষ করতাম।’
জাদুকর বলল, ‘মূর্তি সেজে বেরিয়েই তো রুটির জোগাড় করি। শিল্পীদের কাছ থেকে খাবার পয়সা জুটে যায়। এই জন্যেই ক্রুশের ওপর পড়ে আছি এত কষ্ট করে; খানকতক মূর্তি গড়া হলে তবে ছুটি পাই। ছুটি পেয়েই চলে যাই মানুষের কাছে সত্যের সন্ধান দিতে। কিন্তু কেউ কান দেয় না আমার কথায়। আর তখনই ভেল্কিবাজি দেখাই। ওরা বোকা বনে যায়। অবাক হয়ে পয়সা ছোঁড়ে। ভেল্কির ফাঁকি ধরতে পারে না। ওদের স্বভাবও বদলালো না কোনদিন। যে নিষ্ঠুর সেই নিষ্ঠুরই রয়ে গেল ওরা। নাঃ, ঈশ্বর আমার সহায় নন।’
আরবীটি দাড়ি চুলকে বলল, ‘ঈশ্বরের এমন ব্যাভার মোটেই ভালো নয়। আমিও বেরিয়েছি সত্যের সন্ধান দিতে। আমি বলেছি সব মূর্তিকেই পুজো কর, মূর্তি না জুটলে পাথর এনে মাথায় ঠেকাও। সবের মধ্যেই সর্বশক্তিমান আল্লাহ বিরাজমান। তাঁর মূর্তি আজও কেউ গড়তে পারেনি, পারবেও না। যদি সে মূর্তি কেউ গড়ে ফেলে তবে বলব স্বয়ং ঈশ্বর নির্দয়। নিজের হাতে টুঁটি টিপে মারব ঈশ্বরকে।’ একটু ভেবে বলল, ‘কিন্তু মারতে গেলে তো তাঁকে সশরীরে পাওয়া চাই!’
জাদুকরটি হাঁ হাঁ করে উঠল— ‘না, না, আমার বাণী হচ্ছে রক্তপাত ঘটিও না।’
আরবী যাদের বাঁচার অধিকার নেই তাদের তো মরতেই হবে। বাগানে ফুল ফোটাতে গেলে আগাছা তো সাফ করা চাই।
জাদুকর: তা, কাকে বাঁচাতে হবে আর কাকে মারতে হবে সে বিচার করবেটা কে? আমার দেশের পাদ্রী মহোদয়েরা জটলা করে কী রায় দিয়েছেন শুনবে? আমার নাকি বাঁচারই অধিকার নেই। হয়ত তাঁরাই ঠিক!
দীর্ঘশ্বাস পড়ল জাদুকরের।
আরবী: আরে, ঐ জন্যে তো আমিও পালিয়ে বেড়াচ্ছি। আমার পিছনেও হুলিয়া, আমাকে নাকি খুন হতে হবে।
জাদুকর: তোমার বুকের পাটা আছে দেখছি। আমি তো ভয়েই মরছি।
আরবী: না না, প্রশংসার কিছু নেই। মনের জোর পেয়েছি ভগবৎভক্তিতে। সবই তাঁর ইচ্ছা। . . .আচ্ছা, তুমি কখনও কোন বই-টই লিখেছ?
জাদুকর: বই লিখলে কি আর এই ক্রুশে শুয়ে থাকতে হয় আমায়? ছাপার অক্ষরেই তাহলে ছড়িয়ে দিতে পারতাম আমার বার্তা সারা দুনিয়ায়। পয়সাও হত যথেষ্ট। লেখক নই, তবে উপাসনার গান একটা লিখেছিলাম বটে একবার। বুঝলাম, ঈশ্বর চান না আমি লিখি। তিনি কণ্ঠ দিয়েছেন যে! কথা বলাই আমার কাজ।
আরবী: আমিও আল্লার দয়ায় বেশ কয়েক পাতা লিখে ফেলেছি। কিন্তু কিছু শয়তান বাগড়া দিচ্ছে। আর আল্লাও ওদের চটাতে চান না। তাই করলাম কী, ঐ শয়তানগুলোর পড়ার জন্যে বই লেখা শুরু করলাম। নরকে গিয়ে ওদের কী হাল হবে সেইসব রক্ত জল করা বর্ণনা সাজালাম। পাশাপাশি সাজালাম স্বর্গের পরম শান্তিময় ছবি।
জাদুকর: তুমি তো বেশ প্রতিভাবান লোক হে! নামযশ জুটবেই তোমার কপালে একদিন।
শেষের কথাটা উচ্চারিত হল কিছুটা হতাশায়!
আরবী: যৌবনে শাদী করেছিলাম এক বিধবাকে। ওর দাস হয়ে ছিলাম বলতে পার। ওকে উটে চড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে হত। আর আজ এই অধম আল্লাহ ছাড়া আর কারও দাস নয়। তাঁর আশ্রয়েই বেঁচে আছি শয়তানের কলুষ স্পর্শ বাঁচিয়ে।
খোদাই করতে করতে এবার শিল্পী মুখ খুললেন— ‘যা সুন্দর তাই সত্য। সেই সুন্দরের পুজো কর। যে ঈশ্বর নিজের মূর্তি গড়তে নিষেধ করেন, সে ঈশ্বরে বাপু আমার মতি নেই।’
শুনে আরবীটি একেবারে খিঁচিয়ে উঠল, ‘পাষণ্ড, অবিশ্বাসী! ঈশ্বরের নামে যে সব জন্তুর মূর্তি তৈরি হয়েছে সেখানেও মানুষ মাথা নত করবে বলতে চাও?’
জাদুকর শিল্পীকে দেখিয়ে বলল, ‘এই ছুতোরটার গড়া মূর্তিও নাকি ঈশ্বর!’ শুনে আরবী ভক্তটি বকে চলল একটানা, ‘হ্যাঁ, খ্রীস্টানগুলো তো ভেড়ার মূর্তিকেও ঈশ্বর বলে পুজো করতে শুরু করেছে। তাঁর কোন মূর্তিই হয় না, তো গড়বে কী? তা না পেরে তাঁর তৈরি ভেড়াকে নকল করে তৈরি করছিস আর পুজো করছিস! পাপী কোথাকার! আর তুমিও বলিহারি! ক্রুশে পড়ে আছ সেই নকলের কাজে ইন্ধন জোগাতে! তুমিও কি কম পাপী? তাঁর তৈরি আকাশ মাটিকে নকল করতে বসেছো! খোদার ওপর খোদকারি! বন্ধ কর এসব।’
শিল্পী হাসলেন। তাচ্ছিল্যের হাসি। বললেন, ‘থামো। ঘরের কোণে ঐ পর্দাটা তুলে দেখে এস; এমন সব রূপবান গ্রীক দেবতার মূর্তি গড়েছি যে তোমার আল্লাহও হিংসেয় জ্বলে মরবে। আরে, শিল্পী আরও বড় ঈশ্বর। তোমার আল্লাহ তো মেয়েমানুষ গড়েছেন, পারবেন তিনি প্রেমের দেবী গড়তে?’ এই বলে পর্দা সরিয়ে ভেনাসের মূর্তিটি এনে শিল্পী গর্বভরে বসিয়ে দিলেন।
কালো মেয়েটি হঠাৎ বলে উঠল, ‘ও মেয়ের দেহ তো ঠাণ্ডা, কোথায় ওর প্রাণের স্পন্দন?’
মেয়েটিকে এতক্ষণ কেউ লক্ষ্য করেনি। আরবীটি সেই শুনে চমকে উঠে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, ‘ঠিক, ঠিক কথা বলেছে ও! জ্যান্ত মূর্তি খুঁতো হওয়াও ভালো— মরা মূর্তি? দুয়ো দুয়ো! কথা দিয়ে নয়, ছুরি বিঁধিয়ে এইসব উদ্ধত শিল্পীদের শেষ করে দেওয়া উচিত।’
এই ভয়ঙ্কর কথাতেও কোন বিকার ঘটল না শিল্পীর। বললেন, ‘আমি তবুও বেঁচে থাকব। আমার ভেনাসকে দু’টুকরো করলে সে পাথরই থাকবে— ঠাণ্ডা, নিষ্পাপ পাথর। আর ঐ মেয়েটিকে তোমার ছুরি দিয়ে দু’ ফালা কর— কী থাকে ওর দেখ।’
আরবী মহা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ঘৃণা হয়।’ তারপর সে মেয়েটির দিকে ফিরে যেন বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, ‘হে বালিকা, আমার আর একটি ভার্যার অতীব প্রয়োজন। তুমি সে আশা পূর্ণ করো।’
‘তা, কটা বৌ আছে তোমার?’ কালো মেয়ে জিজ্ঞাসা করল। আমতা আমতা করে আরবী বলল, ‘এই মানে, একটু হিসেব করে বলতে হবে তো; তবে এটুকু জেনে রেখো, আমি অত্যন্ত দায়িত্বশীল স্বামী। তোমাকে সুখী করতে আমি সদা সচেষ্ট—’
‘আমি তো সুখ চাই না, আমি চাই ঈশ্বর।’
‘সেকী! এখনও তাকে পাওনি?’ —ক্রুশে শুয়েই ধড়ফড় করে উঠল জাদুকর।
‘পাব না আবার! অনেক ঈশ্বর পেয়েছি। যার সঙ্গেই দেখা, সেই বলেছে সে ঈশ্বর। আর শিল্পীর কাছে তো ঘরভর্তি ঈশ্বর। তার সবকটাই আধমরা। তবে মানুষ না পাঁঠা যেটা বাঁশি বাজাচ্ছে, ওটাকে তবু একটু ঈশ্বর ঈশ্বর লাগে। সত্যিকার বলে মনে হয়। আমি তো নিজেই না মেয়ে না একটা রামছাগল। আমিও কি চাই না কোন দেবী বনে যেতে? . . .আচ্ছা, ঈশ্বর মানেই পুংলিঙ্গ কেন?’
শিল্পী: ব্যস্ত হয়ে কাজ থামিয়ে ভেনাসকে দেখিয়ে বললেন, ‘কেন, ইনি তো মহিলা!’
‘তা ওঁর নিচের দিকটা অমন মোটা কাপড়ে ঢাকাঢুকি কেন? এই বাকি অর্ধেক শরীরটুকু নিয়ে ওঁর এত লজ্জা! সাদা মানুষদের ঘরে ঘরে শোভা পান উনি; খুব তো সমাদর শুনি ওঁর। অথচ আমার কাছে ওঁর কানাকড়িও দাম নেই।’
জাদুকর বলল, ‘একটু মানুষ-মানুষ গন্ধ ওঁদের দেহে না থাকলে তোমার সঙ্গে ওঁদের যোগাযোগটা হবে কী করে বলো তো?’
‘মানুষ নয়, মানুষী বলুন!’ —কালো মেয়েটির দাবি।
‘মেয়ে: ঈশ্বর মানেই মহান।’ এই শুনে আরবী ভক্তটি প্রায় কেঁদে ফেলল— ‘হে আল্লা, এইসব কাণ্ডজ্ঞানহীন মেয়েছেলের হাত থেকে আমায় রক্ষা করো! এই মেয়েছেলেরা তোমার এত অপরূপ সৃষ্টি, অথচ কী ঝঞ্ঝাটটাই না বাধাতে পারে এরা! যা খুশি তাই করে।’ তারপর কালো মেয়েকে বলল, ‘শোনো মেয়ে, মহান আল্লার করুণার কথা তো তুমি কানেই তোলো না। কোন ঈশ্বর তোমায় খুশি করবেন?’
‘কোনো ঈশ্বরই খুশি করতে পারেন না কাউকে। অমন ঈশ্বর আবার হয় নাকি?’ শিল্পী বললেন।
কালো মেয়ে: জগতের রহস্য নাকি লুকিয়ে আছে কী সব বর্গমূলোয়। তিনিই নাকি দেবতা। হ্যাঁ গো, সাদা মেমদিদিরা তাই তো বলছিলেন। কী সব সংখ্যাটংখ্যা নাকি বসে আছেন ঈশ্বর হয়ে। তাঁরা বিয়ে করেন না, অথচ গুণ করলেই বেড়ে চলেন। হঠাৎ কেমন যেন মনে হয় তাঁদের শুরুও নেই, শেষও নেই। এক এক কম করে গুণে যাও, তবু শুরুতে কোনদিনই পৌঁছতে পারবে না। আচ্ছা, তিনি কি অনন্ত?
আরবী অনন্তটনন্তর মূল্য কানাকড়িও নেই আমার কাছে। অনন্ত যদি সত্যি হয়ে ধরাই না দিল, তো তাকে নিয়ে আমার দরকারটা কী?
মেয়ে সংখ্যা নিয়ে একটাই সত্যি কথা, তা হল, সে অনন্ত। অন্য সব সত্যিই ভুল সত্যি। আমার তাই মনে হয় সংখ্যাই ঈশ্বর।
শিল্পী: সংখ্যাকে খাওয়াও যায় না, বিয়ে করাও যায় না।
মেয়ে: ঈশ্বর তো খাওয়া আর বিয়ে করার জন্য অন্য জিনিস সৃষ্টি করেছেন। আমরা আমাদের মধ্যেই তো বিয়ে-থা করতে পারি।
শিল্পী: সংখ্যাকে কি আঁকা যায়? তবে সংখ্যা নিয়ে আমার কী হবে?
আরবী: কেন, আমরা তো সংখ্যা আঁকতে পারি। জানো, সংখ্যার চিহ্ন এঁকে দুনিয়া জয় করতে পারি আমরা। এই দেখ— বলে আরবীটি বসে পড়ে মাটিতে কী সব কাটাকুটি খেলতে লাগল।
কালো মেয়ে: যিনি আমায় দীক্ষা দিয়েছেন, তিনি বলেছিলেন, ঈশ্বর হচ্ছেন এক যাদু সংখ্যা। তিনি নাকি তিনের মধ্যে এক, একের মধ্যে তিন।
আরবী: হ্যাঁ, সেটা তো সোজা ব্যাপার। শোনো তবে। এই যেমন আমি হচ্ছি ছেলের বাপ, বাপেরও ছেলে বটে। মনুষ্য চরিত্রের নানা রূপ। আল্লাহই একক এবং অদ্বিতীয়। নিজেই নিজের সঙ্গে গুণ করেন, যোগ করেন। পেঁয়াজের খোসা আর কি। ছাড়াতে ছাড়াতে সবই ফক্কা। অসংখ্য তারার সংখ্যাটি তিনিই। বাতাসের ভরের পরিমাপ যদি থাকে তবে তা তিনিই।
শুনে শিল্পী বলে উঠলেন, ‘তুমি দেখছি পুরোদস্তুর কবি!’ আর যায় কোথা, এই শুনে আরবীটি রেগে লাল। কোমর থেকে ছোরাটা বের করে বলল, ‘কী! আমি কবি? অশ্লীল ছড়াকার? এর জবাব দেব আমি রক্তপাতে।’ শিল্পী অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, ‘আরে শোনো শোনো, আমি ঠিক সেভাবে বলিনি। ছড়াকার ভেবে লজ্জা পাচ্ছ? মানুষ মরে হেজে যায়, ছড়া বেঁচে থাকে চিরকাল। তোমার দেখছি কথায় কথায় খুন চড়ে— আরে মানুষ মেরে মড়া বানানো কি সৃষ্টিশীল কাজ? মড়াকে সাজিয়ে রাখা যায় ঘরে? পুঁতে ফেলতে হয়, নইলে পচে বদ গন্ধ ছাড়ে যে।’ আরবীটি এই শুনে শান্ত হয়ে ছোরাটি খাপে পুরে বসে পড়ল পাতকুয়োর পাড়ে। বলল, ‘ঠিক! শয়তানের নোংরা কণ্ঠস্বর আল্লার স্বর্গীয় সুষমায় স্নাত হয়ে ধন্য হয়। বিশ্বাস কর, আমি ধূ ধূ মরুর বুকে উট ছুটিয়ে যেসব গান শোনাতাম, তার জন্যে এক পয়সাও কখনো চাইনি সওয়ারীদের কাছে।’
জাদুকর বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও এসব বিষয়ে সাচ্চা মনিষ্যি। ঈশ্বর আমার পিতা, আমার পরিবার, আমার পরিজন— আমি আর কাউকে মানি না। বাবা মাকেও না।’
আরবী: তবে মন মেজাজ চাঙ্গা রাখতে দু’চারটে বউ-টউ চাই। একটা মাত্র মেয়েমানুষ দিয়ে মেয়ে জাতটার বিচার করা যায় না। প্রথম বউটাকে সত্যিকারের চিনলাম যখন শেষ বিয়েটা করলাম। শেষ ছুঁড়িটা একেবারে পাক্কা শয়তান। তাকে পেয়েই তো বুঝলাম যে প্রথম বউটা ছিল সত্যিকার দেবী।
কালো মেয়ে: আর বউগুলোর কি আরো বিয়ের দরকার নেই তোমাদের মত পুরুষগুলোকে চিনতে?
এই শুনে আরবীটি একমনে আল্লাকে ডাকতে ডাকতে বিড়বিড় করে বলল, ‘এই কালো মেয়েমানুষটার ছোঁয়াটাও কী ভয়ানক!’ তারপর মেয়েটাকে বলল, ‘শোনো, পুরুষের কথার ওপর কথা বলো না। যখন জ্ঞানবিদ্যার কথা হচ্ছে তখন এসব আচরণ কি শোভা পায়? পুরুষ হচ্ছে আল্লার প্রথম সৃষ্টি। মেয়েমানুষ তার পরে।’
কালো মেয়ে মানি, একা পুরুষে সৃষ্টি থাকে অসম্পূর্ণ। ঈশ্বর তাই মহিলা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এক পুরুষের পঞ্চাশটি মেয়েমানুষ দরকার আর পঞ্চাশটি মেয়েমানুষকে খুশি থাকতে হবে একটি পুরুষকে নিয়ে? এ কীরকম বিচার গো?
শুনে আরবীটি কানে আঙুল দিল। বিড়বিড় করতে লাগল, ‘হে আল্লাহ, পরজন্মে যেন আইবুড়ো হয়ে জন্মাই। এই উদ্ধত মেয়েগুলোকে আর তো সহ্য হয় না। . . .শোন তবে, আমি এক বউ চাইলেই তো হল না, অন্য অনেক মেয়েমানুষ যে আমাকে চাইবেই! বিদ্যেধরী কোন মেয়েছেলে নিশ্চয়ই একটা নিরেট গোমুখ্যু ব্যাটাছেলেকে চাইবে না। ভালো বংশধর তৈরি করতে সে আমার কাছেই আসবে, হ্যাঁ, পঞ্চাশ নম্বর বউ হয়েও আসবে।’
কালো মেয়েও ছোড়নেওয়ালী নয়। বলল, সে বিদ্যেধরীটি পঞ্চাশ ব্যাটাছেলে না ঘাঁটলে জানবে কী করে আপনার মূল্য?
‘হা আল্লাহ, এসব কী বিশ্রী কথা শুনতে হচ্ছে! তার চেয়ে তোমার চরণে আশ্রয় দাও।’ ককিয়ে উঠল আরবীটি। তারপর বলল, ‘ওরে নির্বোধ, যে মেয়েছেলের পঞ্চাশটি স্বামী তার সন্তানের পঞ্চাশটি বাপ! হায় হায় হায়! সে সন্তানকে পিতৃহীন বলাই তো ভালো।’
কালো মেয়ে কিছুই বোঝ না দেখছি। সে সন্তানের মা থাকলেই তো হল। তাছাড়া পঞ্চাশটি নয়, ঐ পঞ্চাশের মধ্যে কোন একজনই তার বাপ।
‘তাহলে জেনে রাখ’— আরবীটি চেঁচাল, ‘পৃথিবীতে এমন নির্লজ্জ পাপী মেয়েছেলেও আছে যে অসংখ্য পুরুষকে পটিয়েছে, কিন্তু কোনদিনও মা হতে পারেনি। আর আমি যে মেয়েমানুষকে মনে ধরেছে, বিয়ে করেছি একের পর এক। তারা সবাই মা হয়েছে।’ এই বলে খুব গর্বের সঙ্গে সে জানাল— ‘আমি এই ধরাধামে রেখে যাব অসংখ্য বংশধর।’ বলেই চলল সে— ‘মেয়েদের গর্ভযন্ত্রণা বড় যন্ত্রণা। পুরুষরা বাবা সেদিক দিয়ে বেঁচে গেছে। কী আর করবে বল, মেয়েছেলেদের প্রতি আল্লাহর এই রকমই বিচার। এটাই মেনে নাও, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আল্লাহ এর অন্যথা করেন কী করে?’
কালো মেয়ে ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘জানি জানি, তোমার আর সাধ্য কী যে সন্তান ধারণ কর। প্রকৃতির নিয়ম মানি। কিন্তু জেনে রাখো, একটি মেয়েমানুষের অনেক পুরুষ থাকতেই পারে, আর প্রতি পুরুষের কাছ থেকেই সে সন্তান পেতে পারে।’
‘হে আল্লাহ, মেয়েমানুষেই নাকি শেষ কথা বলে? এই উদ্ধত মেয়েমানুষটিকে দেখে তোমার এই বাণী আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি বাক্যহীন। আমায় ক্ষমা করো।’ এই বলে আরবীটি ঈশ্বরের উদ্দেশে নত হয়ে রইল।
শিল্পী তার কাজ করতে করতে বলল, ‘পঞ্চাশটি মেয়েছেলে যখন একটি পুরুষকে ঘিরে ধরে তাদের শেষ কথা শোনায় তখন হট্টগোলটা কেমন হয় একবার ভাবো!’
আরবী বিড়বিড় করে বলেই চলে, ‘মনে পড়ে যায় সেই নরকের কথা যেখানে এদের মতো পাপীরা পাপ মুক্ত হয়ে পরম করুণাময়ের আশ্রয় লাভ করে ধন্য হয়।’
কালো মেয়েটি চলে যেতে যেতে শুনিয়ে দিয়ে গেল, ‘যে পুরুষ মানুষেরা শুধু মেয়েমানুষের গপ্পো করে, তাদের কাছে ঈশ্বর খুঁজতে চাই না আমি।’ শিল্পীটি চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, ‘আর যে মেয়েমানুষেরা পুরুষ নিয়ে গালগপ্পো করে সেখানেও যেন ভিড়ো না!’
শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান – ৩
তিন
দূর থেকে হাত নেড়ে এ কথায় সম্মতি জানিয়ে হেসে বিদায় নিল মেয়েটি। চলতে চলতে বনের প্রান্তে একটা সুন্দর ছবির মত গ্রামের ধারে এসে পৌঁছল। সেখানে একটা শুকনো, চিমড়ে মত লোক বসে বসে মাটি কোপাচ্ছে। তবে তার চোখ দুটো উজ্জ্বল— মুখের মধ্যে খাড়া নাকটাই যেন সর্বস্ব। দুষ্টুমিতে ভরা। কেমন যেন মিচকে পারা। কিন্তু মোটের ওপর বেশ বুদ্ধিমান চোখ মুখ বুড়োটার।
‘এই যে শুনছেন!’ মেয়েটি ডাকল।
বুড়োটা মুখ তুলে বলল, ‘কী চাই?’
‘ঈশ্বর কোথায় জানতে চাই। মনে হচ্ছে আপনিই বলতে পারবেন।’
‘ভেতরে এস, এই বাগানেই পাবে তাঁকে! মাটি খুঁড়লেই বেরোবেন তিনি। চলে এস।’
‘দূর! ওভাবে তাঁকে পাওয়া যায় নাকি? যাক গে, অনেক ধন্যবাদ। চলি।’ মেয়েটি নিরাশ হয়ে বলল।
‘ওহে শোনো শোনো, কীভাবে তাকে পাবে বলে মনে কর?’
‘যে ভাবেই পাই, আপনার ঐ উপায়ে নয়।’
বুড়োটা বলে, ‘যারাই ঈশ্বরকে পেয়েছে তারাই শেষ পর্যন্ত তিতিবিরক্ত হয়েছে। তাঁকে পেলেই যে মন খুশ হয়ে যাবে তা যেন ভেবো না।’
‘জানি না। তবে সেই সাদা পাদ্রী দিদিমণি দু’লাইন পদ্য শিখিয়েছেন—
সবার উপরে বিরাজ করেন যিনি
ভালবাসার ধনটি শুধুই তিনি।
‘যে লিখেছে সে হদ্দ বোকা।’ বুড়োটা সাফ জানিয়ে দিল।— ‘সেটাকে ধরে ক্রুশে চড়ানো উচিত। বিষ খাইয়ে মারা উচিত। হাতে পায়ে দড়ি বেঁধে হাঁড়িকাঠে মুণ্ডু এঁটে আগুন ধরিয়ে দেওয়া উচিত। চিরটা কাল চাইলাম ঈশ্বরের কাজ করতে। আর আজ যদি শুনি ঈশ্বর আসছেন এই রাস্তা ধরে তবে আমি নেংটি ইঁদুরের মতো ছুট মেরে কোনো গর্তে ঢুকে পড়ে থাকব যতক্ষণ না তিনি পার হয়ে যান। আমায় দেখতে পেলেই তিনি একেবারে পায়ের তলায় থেঁতলে মারবেন। ”হা ঈশ্বর যো ঈশ্বর” যারা করে তারা ভাবে ঈশ্বরের সামনে বুঝি দাঁড়াতে পারবে। মোটেই না। তুমি জুপিটার আর সিমেল-এর গল্প শুনেছ?’
‘না তো, বলুন না, শুনি।’
‘জুপিটার হচ্ছেন এক ঈশ্বর। জানো তো ঈশ্বরের বহু নাম। এই যেমন এইদিকেই কিছুদিন আগে একজন বলল আল্লাহ।’
মেয়েটি বলে উঠল, ‘জানি জানি, আমিও ওটা শুনেছি।’
‘যাই হোক,’ বুড়ো বলে চলল, ‘ঈশ্বর জুপিটার তো সিমেল বলে মেয়েটির প্রেমে পড়ে গেলেন। তিনি চাইলেন মেয়েটির কাছে ঈশ্বর সেজে না থেকে বেশ মানুষ মানুষ আচরণ করবেন। কিন্তু মেয়েটা চায় জুপিটারকে ঈশ্বর রূপেই পেতে। তবেই না পাওয়া! ঐতেই কাল হল মেয়েটির।’
‘কী হল?’ কালো মেয়ে শুধায় উদগ্রীব হয়ে।
‘মহান ঈশ্বরের মহত্ত্বের ছটায় মেয়েটি ঝলসে মরে গেল। একটা মাছি আগুনে পড়ে গেলে যেমন হয় আর কি! তাই তো বলি, সাবধান। ঈশ্বরের মহত্ত্বের ধারেকাছে ভিড়োনা। এই আমার মত একটা ছোট্টখাট্টো বাগান করে ফুল ফোটাও, আগাছা ছেঁটে ফেলো, তাহলেই তাঁর আশীর্বাদ পাবে। আর বেশি কিছু চেও না।’
মেয়েটি জিজ্ঞাসা করে, ‘কোনদিনই কি তাঁর মহত্ত্ব সহ্য করতে পারব না?’
‘উঁহু।’ বুড়োটা ঘাড় নাড়ে। ‘পারবে, যেদিন তুমি তাঁর সব উদ্দেশ্য সাধন করে নিজেই ঈশ্বর বনে যাবে। তাঁর উদ্দেশ্য অনন্ত। সে সব সাধন করতে করতেই একটা মানুষ নিঃশেষ হয়ে যায়। উদ্দেশ্য সমাপনের পর বেঁচে থাকার মতো অবস্থা তোমার আর থাকবে ভাবছ? আধমরা হয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে তাঁকে দেখার আনন্দই মাটি হবে। তার চেয়ে চলে এস, তাঁর নাম স্মরণ করে বাগানে হাত লাগাও।’
মেয়েটি ধীরে ধীরে তার ডাণ্ডাটা মাটিতে নামিয়ে রাখল, তারপর বাগানে ঢুকল। কাজে নেমে পড়ল সে।
মাঝে মাঝে আরো কত লোক আসে এই বাগানে। হাত লাগায়। ওদের দেখে প্রথম প্রথম মেয়েটির হিংসে হত। পরে সবাইকেই সে মেনে নিতে শিখল।
একদিন কোত্থেকে একটা লালচুলো আইরিশ গাঁইয়া এসে জুটল। বাগানের পিছন দিকে মূলোর ক্ষেত সাফ করতে বসে গেল সে।
মেয়েটি তাকে দেখে তিরিক্ষি হয়ে বলল, ‘কে তোমাকে এখানে ঢুকতে বলেছে?’
গাঁইয়াটি থতমত খেয়ে বলল, ‘মানে, এই নিজের থেকেই ঢুকে পড়েছি আর কি!’
মেয়ে: বাগানটা ঐ বৃদ্ধের, ওঁর অনুমতির প্রয়োজন আছে।
গাঁইয়াটি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘দেখো, আমি সমাজবাদী সংঘের লোক। বাগান কারো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন হতে পারে বলে আমি মনে করি না। তাছাড়া ঐ বুড়ো হাবড়া লোকটার গতরে তেমন আর তাগদ নেই। ওর হয়ে আলুটা মূলোটা আমি ফলাতে পারি।’
মেয়ে: ও, তাহলে তুমি এখানে ঈশ্বরের খোঁজে আসনি?
‘দূর দূর! আমি ঈশ্বর খুঁজতে যাব কেন, পারলে ঈশ্বরই আমাকে খুঁজে মরুক না! তাছাড়া ঈশ্বরকে এখনও ঠিকমত গড়াই হয়নি। অনেক ভুল ত্রুটি রয়ে গেছে। এসো না, তুমি আর আমি তাঁকে গড়ে তুলি! লোকে তাঁর চিন্তা তো ছেড়েই দিয়েছে। শুধু নিজের কথাই ভাবছে সবাই।’ এই বলে থকাস করে এক গাল থুতু ফেলে জামায় মুখটা মুছে লোকটা মাটি কোপাতে থাকে।
বুড়ো লোকটা ধারে কাছেই ছিল। রকমসকম দেখে বুঝল লোকটি এক্কেবারে চাষাড়ে। কিন্তু এমন লোককেই তো এ বাগানে দরকার। তার মনে হল লোকটা বেশ বিশ্বস্ত। বাগান ছেড়ে নড়বে না সহজে। তাই তারা দুজনে মিলে আইরিশটিকে সংযত আচরণ আর ভদ্র ভাষা শিক্ষা দিতে লাগল। কিন্তু তাকে কিছুতেই বোঝানো গেল না যে ঈশ্বর শাশ্বত, অপার তাঁর মহিমা। বোঝানো গেল না যে তাঁর উদ্দেশ্য সাধনের কাজ অপরিসীম যা সমাজবাদীর একার পক্ষে করে ওঠা সম্ভব নয়। তবু লোকটাকে শিক্ষাদান করতে করতে তার সঙ্গে এরা বেশ ঘনিষ্ঠই হয়ে উঠল। অভ্যস্ত হয়ে উঠল ঠাট্টা তামাশায়।
একদিন সেই বুড়ো লোকটি কালো মেয়েটিকে বলল, ‘তোমার মতো এমন একটি মেয়ে আর কতদিন আইবুড়ো থাকবে? এবার একটা বরটর জোটাও, চাট্টি ছেলেপিলে হোক। আমি বড্ড বুড়ো, নইলে লড়ে যেতুম পাত্র হিসেবে। এক কাজ করো, ঐ আইরিশটাকেই ধরো।’
শুনে মেয়েটি তো মহা খাপ্পা হয়ে বাগান ছেড়ে চলে গেল। রাত জেগে ভাবতে লাগল, কীভাবে, কখন ঐ ডাণ্ডা পিটিয়ে আইরিশ ভূতটাকে বাগানের বাইরে বার করে দেবে। বুড়োটাকে ছাড়া মেয়েটি আর কাউকেই চিনতে চায় না। সে কিছুতেই মানতে পারছিল না বুড়ো লোকটি তার থেকে ষাট বছরের বড়। ভাবতেই পারছিল না যে শীগগির একদিন বুড়োটা মরে যাবে আর সে পড়ে থাকবে একা।
বুড়ো লোকটা মেয়েটাকে এই রূঢ় সত্য কথাটা বোঝাতে লাগল দিনের পর দিন। মেয়েটা শেষে একদিন রাজি হল বিয়ে করতে।
বুড়োর সঙ্গে পিছনের বাগানে গিয়ে হাজির হল সে। আইরিশটিকে বলল যে তাকে বিয়ে করবে।
এই না শুনে কোদাল কাঁধে তুলে ‘বাপরে’ বলে লোকটা দৌড় দিল। কিন্তু বাগানের ফটকটা ভেবেচিন্তে আগেই তালাচাবি মেরে রেখেছিল বুড়ো। লোকটা প্রাণপণে ফটক ডিঙোবার চেষ্টা করতে লাগল। ততক্ষণে ওরা ছুটে গিয়ে ওর ঠ্যাং ধরে নামিয়ে আনল।
ধরা পড়ে কাঁদো-কাঁদো গলায় লোকটা বলল, ‘ঐ কেলে মাগীটাকে বিয়ে করতে হবে?’ এতদিনের শেখানো পরিশীলিত ভাষা সেই মুহূর্তে সব ভুলে গেল সে। ‘আমায় ছেড়ে দিন দয়া করে, আমি কোন মেয়েছেলেকেই বিয়ে করতে চাই না!’
কিন্তু তা বললে কী চলে! লোকটা ততক্ষণে কালো মেয়েটির লোহার মতো বন্য হাতের মুঠোয় বন্দী। বুড়োটা লোকটাকে বোঝাতে লাগল, ‘আরে ঝুলে পড়ো, খোকা, ঝুলে পড়ো। সাদা ছাই মেমের চেয়ে এই কালো রঙের মেয়ে: অনেক ভালো। দেখ দেখ, কেমন মসৃণ এর গা। আর তাছাড়া কোনো সাদা মেম তো আর ঈশ্বরের খোঁজ রাখবে না।’
তর্ক বিতর্ক চলল বহুক্ষণ। ধমকেধামকে, তুতিয়েপাতিয়ে, গেলাসখানেক দামী মদ গিলিয়ে শেষমেষ লোকটাকে রাজি করানো গেল। লোকটি বলল, ‘ঠিক আছে, না হয় ওটাকেই বউ বলে মেনে নিলাম।’
তারপর তো শ্যামাঙ্গীর সঙ্গে আইরিশ সাহেবের বিয়ে হয়ে গেল। মেয়েটি সংসার সামলাল, সন্তান ধারণ এবং পালন করল (বাচ্চাগুলো পুরোপুরি কালো কিংবা পুরোপুরি সাদা নয় কিন্তু, কফি রঙের), বাগানের কাজের ফাঁকে স্বামীর ছেঁড়া জামা সেলাই করল (আইরিশটা গা থেকে দিনের পর দিন জামা খুলতেই চাইত না), এত ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে ঈশ্বর-সন্ধানে আর মনই রইল না। তবু মাঝে মাঝে কচি বাচ্চাকে নাইয়ে ধুইয়ে গা মুছিয়ে দিতে দিতে তার মনে পড়ত মুক্তির কথা, নির্বাণের বাণী। মাঝে মাঝে বাচ্চাগুলোর কানে কানে বলত, ‘এই! যদি ঈশ্বরকে পেয়ে যাই, তাঁর সঙ্গে জীবন কাটাই, তোদের বাপ রেগে যাবে না তো রে!’ বাচ্চাগুলো কিছু না বুঝে হাঁ করে চেয়ে থাকত মায়ের মুখের দিকে।
তো, তারপর বাচ্চাগুলো বড় হল। সংসারের কাজে অবসর পেয়ে কীরকম যেন একা হয়ে পড়ল মেয়েটি। তখন বড্ড মনে পড়ত ঈশ্বরকে। কিন্তু তখন আর শক্তি নেই তার দেহে। ডাণ্ডাটা সে আর তুলতেই পারে না।
১৯৩২ সালে ইংল্যান্ডে এবং আফ্রিকার গ্রীষ্মে যখন ফিনসনায় পাঁচ সপ্তাহের জন্য রয়ে গেছি তখনই এই গল্পটি লেখার প্রেরণা জাগে। নাট্যকার হিসাবে এই গ্রন্থটিকে আমার স্বভাবমতো নাটক আকারেই লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু দেখি আমি কালো মেয়েকে নিয়ে গল্প লিখে চলেছি। এবং গল্পটি যখন লেখা হল আমি ভাবতে লাগলাম বস্তুটির অর্থ কী দাঁড়াল। আমি বার বার পাঠককে মনে করিয়ে দিয়েছি যে আমার বিশ্লেষণ সদা সর্বদা সঠিক নয়। জাত লেখকরা সব কলম্বাসের মতো। এক ‘জাত’ লেখক তাই অন্য ‘জাত’ লেখকদের মতোই আসল লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারেন না। এইজন্যই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছে বই শেষ করে তাঁদের মধ্যে পালিয়ে বাঁচার একটি প্রবণতা থাকে। তবে এই ভীতিটি একটি পবিত্র ধর্ম। কারণ এই ভীতিটিই ধরিয়ে দিতে পারে তাদের ভুল ত্রুটি, কিংবা বিদ্যাচর্চার দৌড় কতটুকু। সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাসের মতো আমি দৃঢ় চিত্তে বিশ্বাস করি যে আমার যাবতীয় লেখার প্রাণশক্তি আহরিত হয় ঘটনার প্রতি লক্ষ্যে এবং কল্পনার মিশ্রণে। এবং এই দুটি অস্ত্রের প্রয়োগে ত্রুটি থাকতেই পারে এবং বিষয়বস্তু বানিয়েনের ‘হোলি ওয়ার’-এর হাস্যকর এক উলটপুরাণের মতো চিরসমাপ্তিতে পরিণত হতেও পারে।
যাই হোক, গল্পটির কোথায় প্রাণশক্তি সে-সম্বন্ধে আমি-ই না হয় নিজেই একটি বিবৃতি পেশ করি।
কিছু অবুঝ মানুষের মাঝে প্রায়ই শোনা যায় আমরা নাকি প্রাচীন গোষ্ঠীর মানুষ, নূতন চিন্তার আলোক নাকি আমাদের সয় না।
আমি মোটেই তা মানি না।
বরঞ্চ নূতনভাবে ধ্যানধারণা যে বিশ্বাসযোগ্যতার সঙ্গে মানুষ গ্রহণ করে, তা মাঝে মাঝে ভীতির উদ্রেক করে। লোকে লেখার আমোদ উপকরণের উপর বিশ্বাসী। তা তাদের সন্তুষ্ট করে। খরচ করে বই কিনে সেইটাই তাদের লাভ। আমি নিজেকে জন স্টুয়ার্ট মিল-এর মতোই বলি যে, গৃহীত ধারণাগুলির মধ্যে যেগুলি আমার, সেগুলির আকর্ষণ একদিন-না-একদিন হারিয়ে যাবেই। শপথবাক্য যখন ভঙ্গুর হয়ে যায় লোকে তাদের ভুলে যায়। এই ধর্ম বাছাই পদ্ধতি, তার মধ্যে যা সত্য, যা অবিনাশী তা সাময়িকভাবে চাপা থাকলেও লোকে ভুলে গেলেও নূতনভাবে আবিষ্কৃত হয়, সেগুলি প্রাথমিক প্রমাণিত সত্য, যাকে আমরা বিজ্ঞান বলি। এইভাবেই আমরা প্রমাণিত সত্যকে গ্রহণ করি ও আমাদের মনকে উর্বর করে তুলি। সেগুলি সত্যকার শিক্ষার রূপ বলে পরিগণিত হতে থাকে। সেগুলি স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মেকি শিক্ষার থেকে আলাদা।
দুঃখের বিষয়, এই অতি সাধারণ বিষয়টিতে আমরা মনে রাখি না প্রাচীন সেই মন্তব্যটি— তোমরা নোংরা জলটা ফেলে দিয়ো না, যতক্ষণ না ওটাকে কাজে লাগিয়ে তুমি সম্পূর্ণ পরিষ্কার হচ্ছ। এই আগে থেকেই ফেলে দেওয়ার অভ্যাসটি ভুল, তোমার সঠিক পরিণতি ঘটছে সেই আপ্তবাক্যটিতে,’যখন তুমি তোমার স্বচ্ছ, পরিষ্কার জলের ধারাটি পাচ্ছ, তখনই তোমার উচিত নোংরা জলটি ফেলে দেওয়া। মনে রেখো, স্বচ্ছ আর নোংরার মিশ্রণ যেন কস্মিনকালেও না ঘটে।’
এবং ঠিক এই জিনিসটিই আমরা শিখিনি। আমাদের অভ্যাস হচ্ছে স্বচ্ছ জলটিকে নোংরা জলটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া। আর তার ফলে আমাদের মনটাতেও ছিটে লেগে যায় এই কুকর্মের। এই অপবিত্র মন যেন গলা, পচা প্রাচীন বস্তুর গুদামঘরের মতো। অকেজো ভাঙা কাচের টুকরো আর ন্যাকড়ার ফালি। এই সংগ্রহশালায় পড়ে থাকে— উইলিয়াম দ্য কংকারার, লিং বা হেনরি দ্য সেভেন্থ, মোজেস এবং জেশাস, সেন্ট অগাস্টিন ও আইজাক নিউটন, কেলভিন এবং ওয়েলেসলি, রানি ভিক্টোরিয়া ও মি এইচ জি ওয়েলস। আর আছেন কিছু সম্পদ যেমন, কার্ল মার্কস ও আইনস্টাইন কিন্তু তাঁরা তো ‘ক্রোক’ হয়ে গেছেন, আর ‘ক্রোক’ হয়েছেন আমায় নিয়ে ডজনখানক মানুষ এবং স্টুয়ার্ট মিল। একেবারে উপরের সারি নিয়ে যাদের কারবার কুকর্মেই তাদের মগজ ভরপুর। আর আমাদের স্কুল-কলেজের বিদ্যা হল সেই শুদ্ধ আর নোংরা জলের মিশ্রণ। তাদের নিয়েই প্রতিটি নতুন প্রজন্মের সৃষ্টি। এইসব বিদঘুটে বুদ্ধি যাদের মগজে জন্মে তাদের বিপ্লবচিন্তা ভুল। তাদের রাজনৈতিক ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়াই উচিত। বোকাহাবারাই বরং নেতৃত্ব দিক।
এই উলটপুরাণের ধারণা বাইবেলকেও গ্রাস করেছে। কিছু দেশে ধরা হয় যে বাইবেলের ইংরেজি অনুবাদের নাকি সাধারণ শৈল্পিক মূল্য এই ধর্মগ্রন্থটি অর্থাৎ বাইবেল আচ্ছন্ন করে রাখত মানুষকে কোনো জাদুবিদ্যায়। এই ক্ষমতা অবশ্য ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে কারণ ষোড়শ শতাব্দীর ইংরেজি এক মৃত ভাষা, নতুন অনুবাদগুলি ক্রমশই আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণটা সোজা— পুরোনোটি আর সাধারণ মানুষের মগজে ঢুকছে না। কিছু অনুবাদ সাধারণ মনের খোরাক, তাদের উত্তম বলতেই হয়। আর অন্যগুলি দৈনিক সংবাদপত্রের কচকচির মতো। এই দুই মিলে হঠাৎই বাইবেলের জগতে প্রতিফলিত হল একটি সাধারণ বুদ্ধির পরিবেশ।
তবে এই আধুনিক অনুবাদগুলির উপরে অনেকেই নির্ভর করতে পারেন না, না পেরে তাঁরা বাইবেল পড়া ছেড়েই দেন। নতুন বাইবেলে যাঁরা নিবিষ্ট হন, সে-বাইবেল সৃষ্টির একটি বিরল ঘটনা। তবু তাঁরা চার্চের বাইবেল শোনেন সেই পুরোনো ভাষায়, গুরুগম্ভীর কণ্ঠের নিঃসৃত বাণী। সানডে স্কুলের পড়ুয়াদের বাইবেলের লাইন মুখস্থ করানো হত। পুরস্কার জুটত সেইসব লাইনে ভূষিত ছোটো ছোটো কার্ড। শয়নকক্ষ থেকে নার্সারি স্কুল বাইবেলের বাণী দ্বারা শোভিত থাকত। থাকত নানা নিষেধাজ্ঞা। ব্রিটিশ এবং বিদেশি বাইবেল সোসাইটি বছরে তিরিশ লক্ষেরও বেশি বাইবেল বিলিয়েছে এক শতক ধরে। যদিও সেগুলি মানুষের কাছে হয়ে দাঁড়াত বাড়তি কোনো দ্রব্যের মতন। কোনোদিনই সেগুলির পাতা খোলা হত না। উপহার দেওয়া হত চার্চের ঈশ্বর পিতাদের। তবু এই পদ্ধতিটি চালু ছিল। এখনও সেসব বাইবেলে এমন আইন লিপিবদ্ধ আছে যা রাজনৈতিক মানুষজনও মেনে চলে। সেসব পবিত্রতা ভাঙলে সেটা ধ্বংসাত্মক কাজ বলেই স্বীকৃত হবে। অথচ সেসব বাইবেলে ভৌতিক রাজত্বেরই কর্তৃত্ব। বাইহেল নাকি, নিষ্পাপ, সঠিক এক অভিধান। এই পরিচয়টি বাইবেলে লিপিবদ্ধ করা আছে। যদিও একটি পরিচ্ছেদে ঈশ্বর প্রদত্ত দৈহিক শাস্তিকে সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে। ঈশ্বরের সর্বগ্রাসী প্রভাবকেও। এইসব কথা বেশ জোরালো কণ্ঠে বলা আছে ‘পঞ্চাঙ্কের অধ্যায়’-এ (‘পেন্টাটয়েশ’)।
এই ঘটনার অর্থ দাঁড়ায় যে রাজা প্রথম জেমসের যে অনুবাদ সেটার উৎকর্ষই শ্রেষ্ঠ যদিও রাজার অনুবাদ বলেই এটি বেশি সম্মান পায়। এতে আছে প্রাচীন ইহুদি সাহিত্যের বিষয়বস্তু, তাদের প্রাকৃতিক পরিচয় ও রাজনৈতিক ইতিহাস। সেসব ধরা আছে কবিতায়, নীতিবোধের ধর্মচর্চায় এবং সংগীত গাথায়। সেটাই বাইবেল। অনুবাদে অসাধারণ দক্ষতার আভাস পাওয়া যায়। অনুবাদকের কাছে সেটা শুধু অনুবাদকর্মেরই উদ্দেশ্য ছিল না, প্রেরণা ছিল প্রাচীন গ্রন্থের একটি সংগ্রহ সৃষ্টি করা। তাতে আছে বিভিন্ন সময়ের নানা সংস্কৃতির অবস্থার মূল্যায়ন। তাঁরা চেয়েছিলেন ভাষা হোক স্বর্গীয় সুষমায় ভরা। শ্রদ্ধা ও যত্নে তৈরি হয়েছিল এক অনির্বচনীয় নান্দনিকতা। তাঁরা কোনো চাটুকারিতাকে প্রশ্রয় দেননি। অথচ বোঝানো হয়েছে এটি ঈশ্বরেরই নিজস্ব ভাষা। কে তাকে লঙ্ঘন করবে? মানুষের নিজস্ব বিশ্বাসের সঙ্গে স্বর্গীয় উন্মোচনের কোনো সংঘাত বাধেনি। অনুবাদকেরা কোনো নেতিবাচক দিককে বদল করে ইতিবাচক করতে চাননি। তাঁরা নিজেদের পরিপূর্ণ জ্ঞানী বলে কখনোই মনে করেননি। ভাবেননি তাঁদের ভাষা, হিব্রু ভাষা-জ্ঞানকে টেক্কা দিতে পারবে। যখন হিব্রু ভাষা স্ববিরোধে আক্রান্ত হয়েছে তখনও অনুবাদকেরা সন্দেহ প্রকাশ করেননি। যখন বুঝছেন এই ভাষার বাস্তবতায় ঈশ্বর কর্ণপাত করবেন না, তখনও সেই ভাষাকে অতিক্রম করতে চাননি পাছে সে ভাষাসুষমা কণ্টকিত হয়। একটি উচ্চমার্গের অবস্থান থেকে কৃত এই অনুবাদ। এমন এক এর মহান স্বরমাধুর্য যে এখনও সাধারণ ব্রিটিশেরা কিংবা উত্তর আমেরিকার নাগরিকেরা এই বাইবেলকেই মন থেকে মেনে নিয়ে পূজা করেন। এ যেন একটিমাত্র লেখকের লেখা একটি পুস্তক। তাদের কাছে বইটির লেখক স্বয়ং ঈশ্বর নিজে। এই বইটিতে যে মুক্তির অঙ্গীকার আছে, আছে মহান গরিমার দিক, তা হেন্ডেলের হাতে এক মহান উত্তরণ ঘটেছে। হেন্ডেলই পারতেন নাস্তিককে কাঁদাতে, ভোগবাদীকে পবিত্রতার স্পর্শে রোমাঞ্চিত করতে। ধর্ম যাঁর কাছে এক জাদুকরি ভূতাশ্রিত আত্মা, বাইবেল তাঁর কাছে এক কাগুজে রক্ষাকবচ। বাইবেল তাঁর কাছে এক আশ্রয়স্থল, যে আশ্রয় নাকি সাক্ষীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সত্যকথা কওয়াতে পারে। জাদুকরি মায়ায়। সেই মায়ায় যোদ্ধার বন্দুক পকেটেই রয়ে যাবে, একটা গুলিও খরচ করতে সে পারবেন না। এমনিই এ বাইবেলের ভূতাশ্রয়ী মহিমা। অন্তত এসব মহামূর্খদের ভাবনাচিন্তা।
মানি, বাইবেলের আকাশছোঁয়া পবিত্রতা। তবে বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তার পবিত্র দিকটি অলৌকিকতার ছায়ায় বইটিকে হাস্যকর করে তুলবে। সেটা বিপজ্জনকও বটে। কোনো বই তার বক্তব্যে অভ্রান্ত থাকলে বাঁচবার আগ্রহ প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আমরা অনুভূতিকে আমাদের জীবনে স্বর্গের স্বীকৃতি দিতে পারি। তা সে-বই মোজেসেরই হোক বা এজেকিয়েল, পল, সুইডেনবার্ক, জোসেফ স্মিথ, মেরি বেকার এড্ডি কিংবা কার্ল মার্কস-এরই হোক। তবে বইটি যদি শুধুমাত্র কাল্পনিক হয় তখন সেটা রাজ্যের ভিত্তিমূল বলে যেন স্বীকৃত না হয়। তখন সেটা ব্যথাবেদনা তাড়াবার বড়ি কিংবা আফিম বলেই স্বীকৃত হওয়া উচিত। বেদনাকে অসাড় করে দিয়ে কী লাভ? শুধু শুধুই কি আর নয়া সোভিয়েত রাশিয়ায় গোঁড়া ধর্মীয় নেতারা গ্রিক চার্চের ধর্মকে বাতিল করে? মাদকদ্রব্য ব্যবহার করে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি করে লাভ কী? এই উন্মাদনা ছাড়া আর কিছু জোটে না যদি কেউ বাস্তব থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। এই ধর্মই তখন প্রয়োজন হয়ে পড়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী শাসকগোষ্ঠীর কলুষিত রাজনৈতিক হাতিয়ার। এ ধর্ম এখন ঘুমপাড়ানি গান গেয়ে জনরোষকে স্তব্ধ করতে পারে। (হয়তো সেই কারণেই অত্যাচারীরাই পুরোহিত বনতে পারেন সবথেকে বেশি সংখ্যায়।) আশা রাখা যায় দূর কোনো ভবিষ্যতে সভ্যতা ফিরে পেতে পারে তার সরল সততা। আবার ভরাডুবির সম্ভাবনাও রেখে গেছে।
সম্প্রতি আমরা মহাসংকটে পড়েছি। একটি দল ধর্মকে সম্পূর্ণ বিলোপ করে আনছেন বিজ্ঞানকে। আরেক দল ধর্মকে একটি ধোঁয়াশার মাঝে রেখে দিয়েছেন। দুটি দিক মারমুখী (যদিও বৃথাই)। বার্মিংহামের বিশপ তার চ্যালাদের চোখ রাঙাচ্ছেন, সাধারণ বিজ্ঞানীদের দলবল গির্জার ভক্তদের ডিঙিয়ে যিশুর মহামান্বিত রূপের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। যিশুকে বাঁচাও। আর আমি শুধু বিশপ সেজেই বসে আছি! আমিই তো যত্রতত্র বিজ্ঞানীদের সাবধান করেছি যে তোমাদের মার্কাসাঁটা বিজ্ঞানীদের চেয়ে আমাদের কোয়েকাররা অনেক বেশি বিজ্ঞানমনস্ক তাই কিছুটা ঝুঁকি নিয়েই বলা যায় যে বাইবেলকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে দেওয়া যায় না তাকে সোজাসুজি টেনে আনতে হবে বাস্তবের জমিতে। এটা কী এমন প্রয়োজনীয় বস্তু যে এর নিয়মবিধি ভাঙতে আমরা ভয় পাই।
আমি বিরোধ বাধাতে চাই না। আমি মেনে নিতে রাজি আছি আমার প্রোটেস্টান্ট বন্ধুদের কাছে যে ধোঁয়াশায় ভরা বাইবেল এক সময় কাজে লেগেছে মুক্ত চিন্তার ক্ষেত্রে। সেসময়কার চার্চ ও সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সেসব চিন্তার প্রয়োজন ছিল। এই ধোঁয়াশার জন্যই যোদ্ধা এক হাতে বাইবেল, অপর হাতে অস্ত্র নিয়ে দশজন যোদ্ধার বিরুদ্ধে লড়তে পেরেছেন। সেই বিরুদ্ধ যোদ্ধারা ছিল ক্রমওয়েল অরেঞ্জের উইলিয়াম আর গুস্তাফার্স অ্যাডনর্মাবসস। অতি প্রাচীনপন্থীরা এই ধোঁয়াশার বশেই রোমান্সের স্বাদ পেয়েছিল যেমন আয়রন সাইডে ঈশ্বরকে ত্রাতা হিসেবে মেনেছিল ভক্তিনত চিত্তে। কিংবা মনে করুন জলযুদ্ধের নিনাদ যা লন্ডনভেরিকে আক্রমণ মুক্ত করেছিল কিংবা ডুগাল্ড ডাগগেডিকে নিয়েও একটু উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা যায়। কিন্তু গুয়েলফ ও ঘিবেলাই-এর লড়াই-এর ব্যাপারটা তখন থিতিয়ে গেছে। সে-যুদ্ধের শেষ রক্তাক্ত অধ্যায়টি রাজা গুয়েলফ-এর মন্ত্রীমহোদয়গণ মনে করতে পারেন না। মনে করতে পারেন না রাজার নাম কী ছিল, কী ছিল নামের অর্থ। তাঁরা তাঁকে গিবেলিন কাইজার ও পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের সম্মুখে পরিত্যাগ করেন আর যোদ্ধারা লড়ে গেল এক হাতে মেশিনগান আর অন্য হাতে সেদিনের সংবাদপত্র ধরে। মেশিনগানকে সাধুবাদ যা হাজার লোকের শক্তিকে একা কাজে লাগাতে পারে। আর মহান, পবিত্র বাইবেলের বাণী মুদ্রিত ছিল সেই সংবাদপত্রের পিছনের পাতায়, জোসুয়ার যুদ্ধ করিমার বর্ণনার সঙ্গে। জোসুয়া আমাদের তরবারি লর্ড গিরিয়নের মতো উচ্চ তুলে খ্যাপা কুকুরের মতো আধুনিক অ্যামোলেকাইট ও ক্যানালাইট আর জার্মানদের ছিঁড়ে খেয়েছিল, এই বীরগাথার বর্ণনা ছিল সেই সংবাদপত্রে। যেন সেই নিহত বেচারারা শয়তানের অনুগামী বদমাশ শিশু সন্তানের দল। যদিও রাজা ও রাজত্বজনিত তত্ত্বটি ছিল অন্যরকম, কিন্তু লক্ষ্যটা ছিল এক— মানুষ মারা। লক্ষ্যটি ছিল এক কাল্পনিক দ্বন্দ্ব— জিয়োভার বিরুদ্ধে ব্যালের। জার্মানরাও লড়েছিল তাদের রাজা এবং দেশ নিয়ে। এবং আমাদেরই মতো নিশ্চিত ছিল যে জিয়োভা (Jeova) মহাশক্তিধর এক আশ্রয়দাতাদের লর্ড। জার্মানদের ঈশ্বর। সেই আশ্রয়দাতাদের এমন বলা হয় মহান ব্যাটেলিয়ন। অত্যন্ত আতঙ্কে ভরা ছিল এই যুদ্ধ। মানুষ মানুষকে কসাইখানার প্রাণীর মতো কচুকাটা করেছিল। কিন্তু কী অপরূপ তার বর্ণনা। নিষ্ঠুরতা নাকি অবরোধ প্রক্রিয়া, এইভাবে নিরপেক্ষ বিচার হল। কিন্তু সভ্যতার দেহে যে ক্ষতের সৃষ্টি হল তার প্রাবল্য আমরা জানতে শিখলাম না। শুধু শিখেছি যারা মরল সেটা তাদের নিয়তি। ওল্ড টেস্টামেন্টে একথা সোজাসুজি বলা আছে। ধর্মের ধোঁয়াশায় এই অন্ধকার ও সংস্কারাচ্ছন্ন দিকটি মানুষের ভাবনায় এল না। একমাত্র রাশিয়া সাহস করে ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর সমাচারকে অবজ্ঞা করে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এটা মনে রাখবার মতো ঘটনা। এই কাজের প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েও তারা শিশুদের নিয়ে তৈরি করেছে একটি ‘নাস্তিক’ বাহিনী। অতএব তারা নাকি বঞ্চিত হয়েছে যিশুর কোলে স্থান পাবার সুযোগ থেকে। আর বার্মিংহামের বিশপের একমাত্র বিশ্বাস যে বৈজ্ঞানিক নাস্তিকতা নাকি যিশুর কোলেই শেষপর্যন্ত ভক্তকে স্থান দেয়, যদিও একটু বর্বর ভাবে। আর তাই তো আমরা আমাদের শিশুদের গড়ে তুলেছি সেনা অফিসার করে।
এই অবস্থাটিকে আর তুচ্ছ জ্ঞান করা যায় না। কারণ একটি। বোধহীন দুষ্টু ছেলের গুলতির ঘা খেয়ে জিয়োভার প্রাচীন ভক্তগণ একযোগে সবকটা ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলতে পারত না। আর এখন মেশিনগান, ট্যাঙ্ক, এরোপ্লেন, গ্যাস বোমা এইসব মারছে হাজারো বাসিন্দাকে। আর সেইসব শহরের বাসিন্দাদের মারছে যাদের উপর এরা নির্ভর করে আছে খাদ্যের জন্য, তাপবিদ্যুতের জন্য, উন্নত যন্ত্রাংশের জন্য। এইসব অস্ত্র কাজে লাগিয়ে শিশুরাও পারবে আধঘন্টার মধ্যে কোনো দেশকে ভস্মীভূত করতে। সোজা কথা, বাইবেলকে এরা ত্যাগ করতে শিখবে না। কিন্তু সঠিক ধ্যানধারণায় বুঝতে না শিখলে বাইবেলই আমাদের ত্যাগ করে যাবে। সেজন্য নোয়া কিংবা জোসুয়ার থেকে বেশি শিক্ষিত মনস্ক হওয়া প্রয়োজন। সেইসব ভান-ভণিতাগুলো ধরতে হবে যেখানে সেগুলি লুকোনো আছে নানা কায়দায় ব্যাখ্যায় মানুষের উপর স্বর্গীয় কর্তৃত্বের কথা। এইভাবে বাইবেলের সঠিক বিচার করতে হবে, যেমন করা হয় কোরান, উপনিষদ, আরব্যরজনী। এমনকী আজকের ‘টাইমস’ পত্রিকার প্রধান উপকরণটি, কিংবা গত সপ্তাহের ‘পাঞ্চ’ পত্রিকার ব্যঙ্গচিত্রটি। সব কথাই ভুলভ্রান্তির ঊর্ধ্বে নয়। ইহলোকের যেকোনো লেখকই ভুল মতামত ব্যাখ্যা করে যেতে পারেন তাঁদের কাব্যে।
বাইবেলের আর কী প্রয়োজন সাধারণ মানুষের কাছে? একজন প্রাজ্ঞ মানুষের কাছে এর প্রয়োজন থাকতে পারে। সোভিয়েত দেশের মানুষেরা কেন বাইবেলকে জঞ্জালের স্তূপে ফেলবে না? তবে তার আগে একটু সহৃদয় হওয়া প্রয়োজন। মোজেসের দশটি উপদেশের (Ten Commandments) কথায় আসা যাক। মোজেস এই উপদেশের মাধ্যমে মানুষ বশীভূত করার কাজটি সুসম্পন্ন করতে পারেননি। তিনি ছলছুতোয় বুঝিয়েছেন এই ‘কথা’ গুলি তিনি অলৌকিক উপায়ে লাভ করেছেন। এই বলে, এইভাবেই কিছুটা শ্রদ্ধা ভক্তি আদায় করেছেন। এইসব ‘কথা’র সঙ্গে জুড়তে হয়েছিল লোভিটিকাস এবং ডয়েটেরোনমির অসংখ্য নিয়মকানুন। সেগুলি এখন আর অতি নিয়মনিষ্ঠ ইহুদিও মানে না। সেগুলি না মানলে আমাদের নীতিবোধও তাই রাগান্বিত হয় না। এইসব (Commandments) ‘কথা’গুলি তাই আজ ভাঙা আসবাবের টুকরোর মতো, সূক্ষ্ম শিল্পকলার কিছু জাদু আছে। সেই জাদুগুলি বিপজ্জনক। এর লেখক যদি সুরেলা ভাষার জাদুকর হতেন, নানা দক্ষ উপমার ব্যবহারে, (যা লেখকরা পারেন) তাহলে সে-ভাষা বাইবেলের আদর্শের পরিপন্থী হতে পারত। দশ দশটি ‘বাণী’ মোটেই আর আধুনিক যুগে খাপ খায় না। ওদের কোনো প্রয়োজনই নেই। সেসব ‘বাণী’ ডাকাতি করার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলে না। আর তাই ডাকাতরা তাদের কার্যকলাপ আইনসিদ্ধ করে নিয়েছে। ফলত আমাদের সমাজের নীতির ভিত উপড়ে গেছে। বলছে সব হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ুক, যেন রাশিয়ার মতো তারাও ঘুম ভাঙাতে যায়।
তবে বর্জনীয় এইসব দিকগুলির একটি সদর্থক দিকও আছে। আগের বইগুলোর ধর্ম জিজ্ঞাসা ও চর্চা অতি নির্দয় আর নিষ্ঠুর। এক দেবতা দ্বিতীয় জলোচ্ছ্বাসের সময় মানবসমাজটিকে বাঁচিয়েছিলেন সমূলে উৎপাটনের হাত থেকে। সেটাই তাঁর নিষ্ঠুরতা; তাঁকে জংলি বলুন আর যা-ই বলুন। সেই নোয়া (Noah) প্রতিটি জীবকে, প্রত্যেকটি পক্ষীজাতকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরেছিলেন দেবতার পায়ে নিবেদনস্বরূপ। এ ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু মানুষের পোড়া গন্ধ বড়ো সুবাস ঢেলেছিল তাঁর নাসিকায়। এই পূজাচার পরবর্তী বইগুলিতে রূঢ়ভাবে নির্ণীত হয়নি। যেমন মাইকা (Mica) এই নিষ্ঠুরতা মেনে নেননি। এটা তাই প্রমাণ করে যে ইহুদিরা চিন্তায় ও সভ্যতায় কত প্রগতিশীল ছিল। তবে প্রশ্ন থেকে যায় মানুষকে উৎপাটনের হাত থেকে বাঁচালেও এই নিষ্ঠুর বলিদানের একটি ঐতিহ্য রয়ে গেছে। কোনো কোনো দাপুটে রাগী দেবতা মাঝে মাঝেই তার প্রতিশোধস্পৃহা চরিতার্থ করতে এই রক্তপাতের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন, শিখিয়েছেন। ‘নিউ টেস্টামেন্ট’-এ (New Testament) তাই দেখি যিশুর প্রতি নিগ্রহের কথকতা। জেরুজালেমের রোমান গভর্নর নোয়া প্রদর্শিত এই সশ্রদ্ধ বলিদানকে আমরা অম্লানবদনে আদর্শ বলে বিবেচনা করেছি। আমরাও আমাদের বিবেককে কলা দেখিয়ে, নৈতিক দায়িত্বকে দূরে হঠিয়ে সেই কথকতা শুনেছি ও দুষ্কর্মের লজ্জাটিকে ঢাকা দিয়েছি। এইসব পাপাচারকে দিব্যি চাপিয়ে দিয়েছি যিশুর ঘাড়ে। (যিশু ক্ষমা করতে বলেছিলেন পাপীদের।) এর চেয়ে অমানবিক ও অনৈতিক তত্ত্বের কথা চিন্তা করা যায় না। আশ্চর্য ‘বুদ্ধিজীবী সমবায় সমিতি’র কাছেও এই কথকতা তেমন গর্হিত কাজ নয়। জাতিপুঞ্জের কাছেও রোমান ক্যাথলিক চার্চের এই পাপাচার এমন স্বীকৃত যে বাইবেল এক ধরনের স্বাধীন দুষ্কর্ম (যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করে অমরত্ব দান), বাধাবন্ধনহীনভাবে প্রচার করে, আর অবাধ সেই (প্রাণনাশের) বাণী বিতরিত হয়। কোনো সাবধানী আধ্যাত্মিক পরিবর্তনের আবির্ভাব না হওয়া পর্যন্ত সুচেতনার উদ্রেক ঘটে না। মানুষের পাপাচারের জন্য অলৌকিক দাবিগুলি যতক্ষণ না বর্জিত হয় ততক্ষণ এই লীলা চলতেই থাকে।
বাইবেল-বিজ্ঞান আলোচনায় আসা যাক। এই বিজ্ঞান উনিশ শতকের বস্তুবাদী ফ্যাশন। এই ফ্যাশন জীববিজ্ঞানকেন্দ্রিক। জীবনের বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি হয়ে ওঠার সুযোগ রয়েছে এই বাইবেলে। এখানে পদার্থবিদ্যা কিংবা রসায়নকে ঠেলে সরিয়ে নিজের ঠাঁই তৈরির প্রচেষ্টা নেই। কিন্তু এই বাইবেল প্রাক বিবর্তনযুগের। এটাই বইটির হতাশাব্যঞ্জক দিক। এতে আছে জীবসূত্রের গোড়ার কথা, আর নৈতিক বর্ণনা যা আছে তা রূপকথার পর্যায়ে পড়ে। এই বাইবেলের তারকাখচিত সৌরজাগতিক ধারণা শিশুমনের খোরাক। এর জ্যোতির্বিদ্যা রয়েছে পৃথিবীর মাটিতে। এর ইতিহাসচিন্তায় রয়েছে মহাকাব্যিক গল্প সোজা কথায়। যাঁরা এই বাইবেল থেকে শিক্ষা আহরণ করেছেন তাঁরা এত ভুল তথ্যের শিকার যে সমাজকর্মী রূপে তাঁরা নেহাতই অচল। বংশ পরম্পরার ধারায় যে দায়িত্ববোধ প্রবাহিত, সে-প্রভাবের অভাব আছে এঁদের। এঁদের ভোটাধিকার পাওয়ার অধিকার থাকা উচিত নয়। তাই ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’র প্রথম সংস্করণের পাশে এর স্থান হওয়া উচিত। এর কথিত অংশটুকু থেকে এটাই বোধগম্য হয় যে, মানুষ নির্বোধের মতো আগেকার কালে কী বিশ্বাস করত আর আজকের মাপকাঠিতে বিচার করা যাবে আধুনিক মানুষ সেসব অচল বিশ্বাসগুলি কীভাবে পরিত্যাগ করে এগিয়ে এসেছে।
রাশিয়া তবুও বাইবেলকে বর্জন করেনি আজকেও। সে-বাইবেলের বেশ কিছু অংশ আজকের সংবাদপত্রের চেয়েও বেশি সজীব। আজকের পার্লামেন্টের তর্কাতর্কির ভাষা থেকে বেশি প্রাণবন্ত। আজকের চটকদারি ইতিহাস বইয়ের চেয়ে এই বাইবেলের ইতিহাসও কখনো বেশি আকর্ষণীয়। এই বাইবেলের ইতিহাস অংশ আজকের ইতিহাস বইয়ের মতো সাজানো গল্পকথা নয়। এখানে নেই বৈজ্ঞানিক বুলিতে ভরা গালমন্দ কিংবা অবাস্তব যত স্বর্গকল্পনা। আর সেইসব নেই বলেই রাসকিন, কার্লাইন কিংবা মার্কসের পায়ের তলার মাটি সরিয়ে নিয়েছে। এই বাইবেল মহাকাব্যের মহানায়কদের চিহ্নিত করেছে মহাবজ্জাত রূপে। এমনকী হোমারকেও বিরাট কোনো প্রতিভাশালী মনে করারও অবকাশ নেই। এখানে শেক্সপিয়রও ছিটেল বলে প্রতিভাত হন। এতে আছে একটি মহৎ প্রেমগাথা যা একজন নিষ্ঠাবান প্রেমিককেই আনন্দ দেয়। শেলির ‘এপিসাইসিডিয়ন’ এই বাইবেলের কাছে বদহজমের চোঁয়া ঢেকুর ছাড়া আর কিছুই নয়। কিংবা কোনো ভাঙা ঠ্যাঙের প্লাস্টার।
এটি এমন একটি জগতের দৃষ্টান্ত যা তৈরি হয়েছে শিহরন জাগানো সব উদাহরণ দিয়ে। কেন্দ্রে আছেন আদিবাসী সমাজের মালমশলা। সেই মানুষগুলির ছিল বলিষ্ঠ মানসিক ক্ষমতা, কাল্পনিক শক্তি আর ছিল জোর খাটিয়ে স্বয়ম্ভর হবার প্রবণতা। তারা এই মিথ্যাটা সহজেই হজম করেছিল যে তারা ঈশ্বরের বাছাই করা জীব, পৃথিবীর ভোগসুখের অধিকারী। তারা বিশ্বাস করত ভোগসুখের পর স্বর্গবাস করবে শাশ্বত সৌন্দর্যের মাঝে। তাদের কাছে স্বচ্ছ বাস্তবটি হল এইসব মিথ্যার ভিত্তিভূমিটি। তারা জাতিচ্যুত হল, নানা ছলছুতোয় তাদের মরতে হল আর নিয়মনিষ্ঠ মানুষের কাছে। ওইসব নিয়মনিষ্ঠ জাতিরা এই আদিবাসীদের মতোই স্বর্গকে একান্ত নিজেদের রাজ্য বলে আঁকড়েছে আর ইহুদিদের পিঠ চাপড়েছে কারণ ইহুদিরা হিব্রুদেবতা ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টাদের মেনে নিয়েছে বলে। আর অন্য কোনো বিকল্পের চেয়ে এইসব বেশি কাজে লেগেছে উৎকট সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের। তবে এই বন্য মানুষ আর বাইবেল পড়া মানুষের মধ্যে ফারাক বিস্তর যদি পড়ুয়া মানুষটি বাইবেলের রাবিশ টপকে তাঁর পঠনপাঠনকে বিস্তারিত করতে পারেন। যদি এড়াতে পারেন বোকাহাবাদের লেখা ভুল ইংরেজির বাইবেলগুলো। এইসব ভুলে যাওয়া বাইবেলগুলি বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হলে ব্যাপারটা খুব বিপজ্জনক দাঁড়ায়। যারা পড়ুয়া তাদের কাছে তো বটেই, তাদের ধারেকাছের অনুবাদকদের কাছেও। এই পতন ঘটবে বোকাহাবাদেরও যারা অন্তঃসারশূন্য উপন্যাস পড়ে, ফুটবলের হালচাল ও শহুরে চুটকিতে ডুবে থাকে।
যেসব কথা পেশ করা হল তা বাইবেল ভক্তদের খুশিই করবে কিন্তু তারা এই ভেবে স্বস্তি পাবে না যে তাদের পৌত্তিলকতা এবার বুঝি যুক্তির মাটি খুঁজে পেল। ভবঘুরে বালকের চেয়ে নোয়া কি অ্যাব্রাহাম কিংবা একজন আইজাক নিউটন হওয়া ঢের ভালো। কারণ আজকাল অনাথ ভবঘুরে বালকদের আর জনসাধারণের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা নেই। আগে ছিল এটা একটা প্রাথমিক কর্তব্য। ‘জেনেসিস’-এর বিকল্প পুস্তক আর শুধুই অজ্ঞানতা নয়। সেগুলি এইচ জি ওয়েলস-এর ‘আউটলাইনস অফ হিস্ট্রি’র মতো নির্দিষ্ট পত্রিকা যারা বিরাট সাফল্যে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে। শেষ দু-শো বছরের ইতিহাসে যে ইতিহাস, কাব্য, বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা রচিত হয়েছিল, সেই একই রহস্যজনক অনুপ্রেরণায় এই গ্রন্থ রচিত। আজকের বাইবেল পড়া একজন মানুষ অশিক্ষিতের দলেই পড়েন। যদি কথাটা বিশ্বাস না হয় তবে বাইবেলের জ্ঞান থেকে সেই মানুষটিকে একটি চাকরির পরীক্ষায় পাশ করাতে পারেন কি না দেখুন তো! তিনি পারবেন না। আর আপনি যদি ফেল করেন তবে আপনিও ভাগ্যবান। অর্থাৎ আপনি অন্তত উন্মাদ নন। এই প্রশংসাপত্রটি আপনাকে দেওয়া যায়। বাইবেলে নির্ভুলভাবে ধরা ছিল বিজ্ঞানের বিশাল কিছু বিস্তৃতি। এখন নৈরাশ্যজনকভাবে সেই জ্ঞান কিছুটা দমিত হয়ে পড়েছে।
একটিমাত্র ব্যতিক্রম এখনও বেঁচে আছে। তার নাম ঈশ্বর সম্বন্ধীয় বিজ্ঞান। তাও সেগুলি পণ্ডিতজনের হাতে পড়ে আর তল খুঁজে পাচ্ছে না। বস্তুবাদী বিজ্ঞানীরা এটাকে নাক সিটকে বিজ্ঞান বলা অন্যায় বলে ধরে নিয়েছেন। অথচ বস্তুবাদের নানা কর্মকাণ্ড ক্ষমতায় আসীন মানুষগুলির মাঝে অজ্ঞ মনের কদর্য কোনো নিদর্শন কোথাও দেখা যায় না। একমাত্র ঈশ্বর বিজ্ঞানকে ঘৃণা করার ক্ষেত্রে ছাড়া। একজন মানুষ, তিনি যে-ই হোন, গণিতজ্ঞ, প্রযুক্তিবিদ, দুঁদে রাজনীতিবিদ, এমনকী ঘোড়ার মাঠের অতি সফল জুয়াড়ি, তিনি যদি এই সৌরজগতে বাস করেও কখনো প্রশ্ন না তোলেন আকাশভরা সূর্য তারার আয়োজনের অর্থ কী, তবে তিনি একজন ক্যালভিন কথিত পাষণ্ড।
আর এদের জন্যই তাই বাইবেল আজ বিজ্ঞানের কাছে সর্বস্তরেই অচল। বাইবেল আজ শুধুমাত্র ঈশ্বর ধারণার আধার। মনে রাখি না, এই ঈশ্বর ধারণাই কিন্তু প্রথম সভ্য মানুষদলের প্রতিপাদ্য বিষয়। —কোত্থেকে এলাম আমরা, আমাদের অস্তিত্বের উদ্দেশ্যই-বা কী। মানুষের সভ্যতার শুরুর অনুসন্ধিৎসা ছেলেমানুষের মতোই করা উচিত। কে এই প্রেতপুরুষ যিনি বজ্র হয়ে হেঁকে ওঠেন, ভূমিতে কম্পন তোলেন, দুর্ভিক্ষে, মহামারিতে জর্জরিত করেন, চক্ষু অন্ধকার, বর্ণ বধির করা মারণমুখী শক্তি, কে তিনি? কে তিনি যিনি রাত্রির শেষে সূর্যোদয় ঘটান, কার ক্ষমতায় চন্দ্রের ক্ষয়-বৃদ্ধি, চার ঋতুর আনাগোনা আর কোন জাদুবলে সেইসব ঋতু বীজ হয়ে মাঠ ভরে দেখা দেয় শস্যে। তিনি যেন এক নিঃস্বার্থ সাধক কিংবা কোনো পরম প্রেম-প্রীতি ভরা পিতা। তিনি তো দেহ ধারণ করেন না। তিনি জিজ্ঞাসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন বিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রে। তাঁকে নানা বিমূর্ত ধারণায় ধরতে চান পণ্ডিতেরা।
বন্য, অশিক্ষিত, ঈশ্বরবিশ্বাস কীভাবে উচ্চ দার্শনিক অনুসন্ধানে উন্নীত হল তার ইতিহাস অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক। মুক্ত মন ও সত্যিকার বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে সেই ইতিহাসচর্চা করলে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় জানা যায়। কিন্তু আমরা অলস, কুৎসিত অভ্যাসের দাস। পরিশুদ্ধ জল পেলেই আমরা তাকে নোংরা জলের সঙ্গে মিশিয়ে দিই। বাইবেল নানা পরম্পরায় হাজির করে অনেক ঈশ্বর। প্রতিটি ঈশ্বরই তার আগেরটির চেয়ে উন্নততর। এতে বোঝায় মানুষের ঊর্ধ্বগতি, একটি সৎ, মহৎ ‘প্রকৃতি’র ধারণা। প্রতিটি ধাপেই শুদ্ধ হচ্ছে জীবনের বারি। একটিমাত্রই তার লক্ষ্য— জলধারাটি পরিশুদ্ধ করতে নির্যাসটি ঢেলে নেওয়া। যতক্ষণ না ফের আধারটি নূতন শুদ্ধ জলে ভরে ওঠে। কিন্তু হায়, এই আশীর্বাদ ব্যর্থ হয়ে যায় নবীন শুদ্ধ জলে নোংরা জল ঢেলে। এই ভুল করে চলি আমরা বার বার। যতক্ষণ না আমাদের মনগুলি হয়ে ওঠে নোংরা পাঁকের মতো। আর তথাকথিত পরিচ্ছন্ন বুদ্ধির নাস্তিকদের কাছে পরিণত হই করুণার পাত্র রূপে। সেই নাস্তিকেরা দর্শনজ্ঞানশূন্য হয়েও মানুষের পবিত্র ঊর্ধ্বগতিকে খেলো, অর্থহীন প্রচেষ্টা বলে মনে করে। কেজো লোকের কাছে এইধরনের মনে করাটা পাগলামি।
বাইবেলের এই ঊর্ধ্বগতির ধাপগুলো অনুসন্ধান করা যাক। নোয়ার (Noah) দেবতাচিন্তা জোবের (Job) দেবতাচিন্তা নয়। যে দেবতাটি শয়তানকে সঙ্গী করে জোবকে স্বর্গীয় আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত করেন তিনি কি যুক্তিবাদী নন? তিনি কি নন ভবিষ্যৎদ্রষ্টা? যিনি এই দুই দেবতার মধ্যে পার্থক্যটি ধরতে পারেন না তাঁর মগজ বলে কোনো বস্তু নেই, তাঁর দুই ধরনের মানুষকে আলাদা করে চেনবার কোনো শিক্ষা নেই, যদিও জোবের দেবতাটি নোয়ার দেবতার থেকে এক ধাপ এগিয়ে তিনি কিন্তু তার্কিক হিসেবে নেহাতই কাঁচা। তবুও তাঁকে প্রশংসা করতেই হয় তাঁর নিজের পরাজয় বাঁচানোর প্রচেষ্টা দেখে। জোব শয়তানের অস্তিত্বের সমস্যাটি তুলে ধরেছিলেন, বলেছিলেন ঈশ্বর মহিমার বিরুদ্ধাচরণের কথা। তিনি একটি তিমিমাছ সৃষ্টি করতে অপারগ নিরীহ পাখির সঙ্গে খেলা করার মতো তিমির সঙ্গে খেলতে পারেননি। তাই বলে তাঁকে ব্যঙ্গ করার কিছু নেই। নোয়ার দেবতার দেহে একটি সন্দেহের আঁচড় আছে। সেই দেবতা জোবের দেবতার সঙ্গে জটিল সম্পর্কটিকে উপেক্ষা করেছিলেন, তিনি মেনে নিতে পারেননি সত্যিই প্রাণী বলি দেওয়া হয়েছিল (সাতটি ষাঁড় ও সতিটি ভেড়া) আর ইলিহুর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ একটি পবিত্র ‘জোচ্চুরি’ ছাড়া আর কিছুই নয়। আসল তথ্যটি লুকিয়ে ফেলার কায়দা এটি। আসল যে কাব্যোপাখ্যান তা শয়তানকে নিয়ে সমস্যার সমাধান করেনি এবং জোবের সমালোচনারও জবাব দেয়নি। এটি অজানাই থেকে গিয়েছিল যতদিন না সৃষ্টির বিবর্তনতত্ত্ব এটির সমাধান করে।
আমরা দেখি মাইকা কেমন নোংরা জলটি নির্ভয়ে ফেলে দিচ্ছেন। তাঁর দেবতা নোয়ার দেবতা নয়, ষাঁড় ও ভেড়াওয়ালা জোবের দেবতাও নয়। ঈশ্বরতত্ত্বকে তিনি উচ্চতম এক বিন্দুতে উন্নীত করলেন। সেখানে রক্তাক্ত বলিপ্রদানের তীব্র নিন্দাবাদ আছে। আর আছে উৎসাহ উদ্রেককারী সেই দাবি— তোমার ঈশ্বরকে প্রয়োজন শুধুমাত্র ঠিক পথে চলার জন্য। বিকৃত সংস্কারের বিরুদ্ধে হৃদয়বৃত্তির এই জয়ের পূর্বে নোয়া আর জোবের দেবতার দ্রুত পতন ঘটেছিল। পুনর্বার তাদের উত্থান হয়নি। তবু আমাদের ছেলেপুলেদের হৃদয়বৃত্তির এই জয়কে ভালো চোখে না দেখানোর চেষ্টা হয়। এটি যে প্রেতপুরুষের জান্তব ভীতি প্রদর্শনের বিরুদ্ধে বিপুল জয়, তারা তা জানতই না। তাদের শোনানো হয় মাইকার দেবতা, নোয়ার দেবতা, জোবের দেবতা সর্বত্রই এক এবং অদ্বিতীয়। আর তাই তাদের বোঝানো হয় ভালো ছেলেটি হয়ে ন্যায়বিচার, ক্ষমা এবং বিনয়ের মতি রাখো বলিপ্রদত্ত মানুষের পোড়া মাংসের ক্ষুধাটুকুর সঙ্গে। এই ধরনের বুদ্ধিহীন খ্যাপামোই মানুষের ধর্মচর্চা।
এরপর এলেন যিশু। তিনি এদের চেয়ে উচ্চমার্গে উঠতে ভয় পান। তিনি বললেন মানুষের মাঝেই বিরাজ করেন দেবতা। উদাহরণ তিনি নিজে। সঙ্গেসঙ্গে এই বাণীতে আতঙ্কিত হয়ে শ্রোতারা তাঁকে পাথর ছুড়ে মারতে লাগল। তারা বুঝে ফেলল এই বাণীর মধ্যে যিশু নিজেকে দুর্বৃত্তের মতো জিয়োভায় (Jeova) পরিণত করতে চাইছেন। এই যে ভুল বোঝাবুঝি, নোংরা জলের এই যে ধর্মবিজ্ঞান তাকে আঠারোশো বছর পরে এমানুয়েল সুইডেনবার্গ ধর্মের প্রতিপাদ্য বিষয় করে তুলেছিলেন।
কিন্তু যিশুর নির্ভেজাল উপদেশাবলি মাইকার ঈশ্বরচিন্তার এক ধাপ উপরে। কারণ মাইকা অতি সবিনয়ে নতমস্তকে সত্যিকার ঈশ্বরের সম্মুখে চলে ফিরে বেড়াচ্ছেন। তিনি সেই মানুষটির কাছে নিতান্তই হীন, তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন ঈশ্বরের একটি আধার। তাঁকে পরিচালিত করছে শুধুমাত্র তাঁর অন্তরের একটি স্ফুলিঙ্গ। বাইবেলে ওল্ড টেস্টামেন্ট আর নিউ টেস্টামেন্টের মধ্যে এইটি সবচেয়ে বড়ো ব্যবধান। তবুও হায়, সেই নোংরা জলটি অর্থাৎ ব্যবধানটি নিতান্তই নিষ্ফলা করে তুলেছে বাইবেলকে। কারণ, দেখাই যাচ্ছে পল যিশুকে এফেসিয়ানদের কাছে তুলে ধরছেন ‘ঈশ্বরের প্রতি নিবেদিত মিষ্টি এক সুস্বাদু ‘বলি’ হিসাবে। এইভাবেই খ্রিস্টধর্মকে টেনে ফের নামিয়ে আনছেন নোয়ার পর্যায়ে। এই স্তর থেকে কোনো ধর্মগুরুই উন্নীত হতে পারছেন না। ফলে মাইকা ও যিশু যেটুকু উন্নতি সাধন করলেন, তা বাতিল হয়ে গেল। পড়ে রইল ঐতিহাসিক এক খ্রিস্টধর্ম যার সৃষ্টি জিয়োভার হাঁড়িকাঠে, যিশু সেখানে পলির পাঁঠা।
মাইকা এবং যিশু যদি কোনোদিন ফিরে আসেন তবে তাঁরা দেখবেন তাঁদের নাম ও কৃতিত্ব জড়িয়ে রয়েছে তাঁদের ঘৃণিত পূজ্যপাদের সঙ্গে। যিশুর বদনাম করতেই হয়, কারণ তিনি নির্বিচারে যত মূর্খ-শিশু বাছাই করেছিলেন। এই নিন্দাবাদের আগে আমাদের এই বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন যে যিশুর ঠিক ঠিক শিষ্য বাছাই করার ক্ষমতা ছিল। এমন কথা উল্লেখের লোভ সম্বরণ করা যায় না যে এমন সব মুহূর্ত আছে যখন তিনি বাছলেন এমন এক শিষ্য যে খ্রিস্টান নয়। এবং এও বলা যায় একমাত্র জুডাসের মধ্যেই ছিল সত্যকার বিবেচনা বোধের আভাস। যিশুর মানসিক ক্ষমতা ও অন্তর্দৃষ্টি ছিল তাদের বোধের অতীত। তারা তাঁকে মহামানব এবং অলৌকিক ক্ষমতাশালী কোনো জীব বলে পুজো করত। তারা যিশুকে তাদের কিছু অর্থহীন আবেগের বস্তুতে পরিণত করেছিল। তারা যিশুর মধ্যে দেখেছিল ‘পিউরিটান’ গোষ্ঠীর প্রতি মাথা নত করার মনোভাব। এই মনোভাবের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সাধারণ স্তরের ন্যায়নীতি বোধ ও মাথা পেতে শাস্তি মেনে নেওয়ার প্রকৃতি। যদিও ওসব আবেগের কিছু কিছু শোভন ও সৎ তবু তারা কোনোদিন পৌঁছোল না যিশুর বুদ্ধিবৃত্তির স্তরে। সবচেয়ে কদর্য প্রতিফলন ঘটল ধর্মযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। টর্কুমাডার ইহুদি নিধনে, মেকি নকল চার্চের বর্বরতায় যখন সেইসব চার্চ ক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে বসল।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হল যিশুর মৃত্যু; যা যিশুরই মতবাদকে কদর্যতায় ভরিয়ে দিল এবং মতবাদটি অধরাই রয়ে গেল। রোমানরা তাদের রাজনৈতিক পাপীদের টারপিয়ন পর্বত থেকে ছুড়ে ফেলে মারলেও ক্রুশবিদ্ধ করে ক্রীতদাসদের শাস্তি দিতে লাগল। তারা ছ-হাজার বিপ্লবী ও স্পার্টাকাস অনুগামী গ্ল্যাডিয়েটরদের ক্রুশবিদ্ধ করে মারল যখন যিশুকে একই গোত্রের বিপ্লবী বলে একশো বছর আগে ইহুদিদের ঊর্ধ্বতন পুরোহিত নিন্দাবাদ করেছিল! একইভাবে যিশুকে নিপীড়িত হতে হল এবং নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করতে হল। এবং আশ্চর্য, সেই ক্রুশ ও অত্যাচারের সরঞ্জামগুলো তিনশো বছর পরে হয়ে উঠল যিশুখ্রিস্টের আইনি প্রতীক! সমস্ত খ্রিষ্টান রাজ্য জুড়ে অত্যাচারের ক্রুশটাই হল ধর্মের বিধিসম্মত অঙ্গ। মোমের ঘর যেমন আগুনের কাছে এক ভয়ংকর অবস্থান, ক্রুশবিদ্ধ নৃশংসতাও তেমন ভয়ংকর এক অবাধ আকর্ষণ হয়ে দাঁড়াল। ভয়ংকরতা হয়ে উঠল প্রাপ্তমনস্ক খ্রিস্টানদের এক আরাধ্য বস্তু। যিশুর পবিত্র জীবনবারি পূতিগন্ধময় হয়ে উঠল। সেই দুর্গন্ধ জল বয়ে এল আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে। আর আমাদের ধর্মযাজকরা বাইযাপাস ও পন্টিয়াস পদ্ধতিকে সেই আরাধ্য বস্তু করে তুলল তাদের ঘৃণিত ও বর্জিত ‘পূজার বলি’টির নামে। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি আরও ঘোরালো হয়ে উঠল যিশুর জন্যই। নৃশংসতাজনিত যিশুর হতাশা, কূটনৈতিক অকর্মণ্যতা, নানা ভুলত্রুটির জন্য আক্ষেপ ইত্যাদিতে জর্জরিত যিশু। এই জর্জরতায় আক্রান্ত হলেন সুইফট, রাসকিনের মতো অনেকেই। তাঁদের যুক্তিবাদ পীড়িত হল মানবতার এই অবমাননায়। এই হতাশা বোধে আক্রান্ত হয়েই যিশু পিটারকে বোঝালেন যে স্বয়ং তিনি পরিত্রাতা; মৃত্যু তাঁকে রুখতে পারবে না এবং তাঁর ‘পুনর্জাগরণ’ (resurrection) ঘটবে এবং পৃথিবীতে কায়েম হবে তাঁরই রাজত্ব। এবং তা চিরকালের জন্য। শিষ্যদের যা বুদ্ধির বহর তাতে যিশুর এই অলীক কল্পনা সমাজে বেশ ভালোভাবে গেঁথে গেল। যিশুর সমাজতত্ত্ব তাঁদের মাথায় ঢুকলই না। যিশুর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল ‘ক্রাইস্ট’ নয় ‘ক্রুশ’-এর তত্ত্বে; যাকে বলে ‘খ্রিস্টানিবি’। তারপর এক গাঁজাখোরের বর্ণনায় প্রতিষ্ঠিত হল ‘উন্মোচন’ তত্ত্ব। এই তত্ত্ব বলে, যিশু তাঁর শপথ অনুযায়ী এক হাজার বছর পরে ফিরে আসবেন এই ধরিত্রীতে। ১০০০ সালে তাঁর সেই আগমনের দিনটি পার হয়ে গেল। কিন্তু এই বিলম্বও তখন মানুষের এতই গা সওয়া হয়ে গেছে যে তারা এই দিনটিকে বদল করে দ্বিতীয় একটি দিন ঘোষণা করল যেদিন যিশুর আবির্ভাব ঘটবে। সেদিনও যিশু এলেন না। আশ্চর্য, যিশুর আবির্ভাবের বিষয়টি কিন্তু সন্দেহাতীত! এই হল এখন এক কায়েমি খ্রিস্টধর্ম।
সমগ্র প্রক্রিয়াটিই একটি আজগুবি জগাখিচুড়ি। যিশুর আবির্ভাবের পরেই সভ্যতার পতন নেমে এল এবং এই বিভ্রান্তিটি উত্তমরূপে প্রচারিত হয়ে গেল, যিশুর মতবাদ নাকি সবার ঊর্ধ্বে এই বিভ্রান্তিকর প্রচারটির জন্যই দায়ী নয়। মধ্যযুগের অন্ধকার, আর এই অন্ধকার থেকে আমাদের ক্রমমুক্তি ঘটছে যিশুরই প্রগতিশীল সব চিন্তার সূত্রকে আঁকড়ে ধরে। এইভাবেই আমরা সভ্যতাকে বাঁচাতে চাইছি। যিশুর চ্যালাদের জগাখিচুড়ি থেকে।
যিশুর মৃত্যুর দু-শো বছর মহম্মদ প্রতিষ্ঠা করলেন ইসলাম ধর্ম। নিষ্প্রাণ পাথরপ্রতিমা পুজোকে পিছে ফেলে ইতিহাস অনেকটা এগিয়ে গেল। তিনি জয়ী নৃপতিরূপেই মৃত্যুবরণ করেন। তবুও তিনি বুঝে গিয়েছিলেন আরবদের নিয়ন্ত্রণ করার তার নেই যতক্ষণ না ধার্মিকদের প্রাণে এক রমণীয় জীবন বিশ্বাস সৃষ্টি করা যাচ্ছে। বলেছিলেন, পাপীকে তার মৃত্যুর পর এক শাশ্বত শাস্তির ভয় দেখিয়ে বশে আনতে হবে। তবে কিছু কিছু অহিংসা প্রতিবাদের পর তাঁর শিষ্যদের শিশুসুলভ কিছু কুসংস্কার মেনে নিতে হবে। এইসব কারণে মহম্মদকেও নূতন করে আবিষ্কারের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। যতক্ষণ না ‘ইসলাম’ একটি প্রাণবন্ত ধর্মে পরিণত হচ্ছে। আর এখন তাই মনে হচ্ছে ‘শ্যামাঙ্গী’র ঈশ্বর-অভিযানটির ব্যাপারে আর ধন্দ রইল না। এই অভিযানের গন্ধ কোনো শ্বেতচর্মের মহিলার নাসিকায় ঢুকবে না। কারণ তিনি জন্মাবধি মেকি খ্রিস্টান চার্চে জারিত হয়ে এসেছেন। আমি ধরে নিচ্ছি গল্পের ধার্মিক মানুষটি হল মানবের প্রেত বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে একটি নিরপেক্ষ বাইবেলের মূল্যায়নে, একের পর এক ঈশ্বরের ক্রমান্বয়ে যতক্ষণ না তার ধ্যানধারণা বদল হয়। ঈশ্বর হয়ে ওঠেন প্রেতপুরীর প্রাণীর থেকে শ্রদ্ধেয় এক পিতা। অবশেষে মেয়েটির উত্তরণ দেহ, কামনা-বাসনা থেকে হৃদয়ের জমিতে। এবং সর্বশেষে সেই হৃদয় থেকেই উৎসারিত হয় ‘ভালোবাসাই ঈশ্বর’ বাণীটি। প্রাচীন দুই ঈশ্বর দমনে মেয়েটির মুগুরটি যথেষ্ট। কিন্তু সে যখন সন্ধানের শেষ সীমায় পৌঁছোচ্ছে তখন তাকে বুঝতে হচ্ছে ভালোবাসাই সব নয় (এডিথ ক্যাভেলের দেশপ্রেম সম্বন্ধে এই একই ধরনের আবিষ্কারের মত)। ভলতেয়ারের উপদেশটি গ্রহণীয়। বাগান পরিচর্যা করে তার কালো কালো দুধের শিশুগুলোকে বড়ো করে তোলাই শ্রেয়। হাতের মুগুর নিয়ে সৌরজগতের রহস্য খুঁজে পাওয়ার শপথ গ্রহণ করে ঘুরে বেড়ানো সমীচীন নয়।
কিন্তু মুগুরটির মূল্য ফুরোয়নি। পথ সীমা করার কাজে সেটা লাগবেই। ধর্ম বিদ্রোহী হওয়াটাই সব নয়। নব্য সভ্যতার যুগে নোয়ার ঈশ্বরকে মেনে নেওযার প্রশ্ন উঠলে আমাদের সন্তানসন্ততি পাপমুক্ত হতে সেই ঈশ্বরের পায়ে নিজেকে সঁপে দেবে; নাকি নিজেকে আরও সস্তা প্রতিপন্ন করে আরও একজনের আড়ালে ঠাঁই নেবে যিনি ঈশ্বরের প্রতি উৎসর্গীকৃত প্রাণ? এই প্রশ্নের মুখোমুখি হলে মুগুরটি সরিয়ে রেখে বাহুবলকে তুচ্ছ করা হাস্যকর ঘটনা। যে বা যিনি এই শক্তিপ্রয়োগে অপারগ, আধুনিক রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থায় তার স্থান নেই। এই উপদেশটির মূল্য আজকের পৃথিবীতে এতই জরুরি যে আমার প্রেরণার গহনে তা উপলব্ধি করে এই কাহিনিটিকে মঞ্চের হাস্যকৌতুকের সঙ্গে নাট্যসাহিত্যকে ভারাক্রান্ত না করে গল্পের আকারেই প্রকাশ করতে হল।
শ্যামাঙ্গী চিত্রণের সন্ধানে একটি চরিত্র – সৌম্যেন পাল
শ্যামাঙ্গী চিত্রণের সন্ধানে একটি চরিত্র – সৌম্যেন পাল
১৯৩০-৩১-এর কোনো একটা সময়। হাতে বেশ মোটা মোটা কাগজের তাড়া নিয়ে বহু প্রকাশকের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এক আর্টিস্ট। কাগজের তাড়ায় রয়েছে বই-চিত্রণের রকমারি সূক্ষ্ম কাজের নমুনা— নতুন ভাবনায়, নতুন পদ্ধতিতে করা। তাতে scraper-board ব্যবহার করে কাঠ খোদাই-এর ছাপ চিত্রণের ছোঁয়া— সূক্ষ্মতা, দক্ষতার সংমিশ্রণ। কিন্তু কে এসব বোঝে, কারই-বা এত সময় আছে যত্ন করে দেখার! আবার সামান্য দেখেই হয়তো কেউ বলে দেয় ‘এত খরচ করে book illustration অসম্ভব, বই-এর দামে পোষাবে না। আরে এসব না করে বই-এর জ্যাকেট বানাও— সেটা বরঞ্চ নেওয়া যেতে পারে।’ The Adventures of the Black Girl in Her Search for God-এর চিত্রশিল্পী John Farleigh ধীরে ধীরে ভাবতে আরম্ভ করে দিলেন, আর নয়, যে সঠিক সিদ্ধান্তটা এবার নিতেই হবে। সেটা ঠিক কী হবে? শুধু কি wrapper design করেই ক্ষান্ত থাকবেন না কি নতুন পদ্ধতি নতুন চিন্তাভাবনার book illustration নিয়ে জীবিকার সন্ধানে ছুটে বেড়াবেন? শিল্পের নতুন পদ্ধতির প্রয়োগকে মূলধন করে আর কত প্রকাশকের দোরে দোরে ছুটে বেড়ানো যায়! এক চূড়ান্ত অবসাদের শেষ সীমায় পৌঁছে Farleigh ভাবছেন, ‘Shall I abandon illustration and leave the publishing world to its own inertia, or shall I try yet a few more calls?’ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবার মুহূর্তে Soho Square-এ এক প্রকাশন সংস্থার মালিক Garfield Howe-এর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে বেশ কিছু book wrapper-এর কাজ করলেন, যাতে নিজস্ব উদ্ভাবন পদ্ধতিতে scraper board-এ wood-engraving-এর দক্ষতার প্রকাশ ছিল। সেই চরম সিদ্ধান্তের দিনটি ৮ মে ১৯৩২, Howe হাতে করে নিয়ে এলেন একটা চিঠি, যে চিঠি মোড় ঘুরিয়ে দিল Farleigh-এর জীবনের। শৈল্পিক চিন্তাভাবনার এবং গ্রন্থচিত্রণের ধারণার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হল। চিঠিটা ছিল এইরকম
১
Whitehall Court
8th May 1932
Dear Sir,
As I am old and out of date I have not the privilege of knowing you or your work. But Mr. William Maxwell, of Clark’s of Edinburgh, tells me that you can design, draw, and engrave pictures as parts of a printed book, which, you will understand, is something more than making a picture and sticking it into a book as an ‘illustration’. The idea is that you and I and Maxwell should co-operate in turning out a good-looking little volume consisting of the story contained in the enclosed proof sheets (please hold them as very private and confidential) and, say, a dozen pictures.
Are you sufficiently young and unknown to read the story and make one trial drawing for me for five guineas? That is, if the job interests you.
faithfully,
G. BERNARD SHAW
চিঠির উলটোপিঠে ছবির নির্দেশ
Suggested Subjects
1. The Black Diana (not a Hottentot) going for Jehovah (as in Raphael’s Ezekiel picture) with her knobkerry.
2. The same going for the god in Blake’s Job.
3. The same accosting Koheleth, a very beautiful juvenile Plato.
4. The lion— ‘maneless’, like Landseer’s lions in Trafalgar Square. There used to be a delightful one named Dick in the Zoo who would let you handle him as in the story.
5. St. Peter carrying a full-sized Gothic cathedral on his shoulders, with the black girl rushing to help him (rather like Blake’s little boy rushing after a butterfly).
6. Sundry faces from the Caravan of the Curious, like the Vanity Fair jury in the Pilgrim’s Progress—if you have a weakness for the ugly-grotesque.
7. The black girl and Christ at the well: proffering the cup. Christ poor and humble, but unaffected and kindly.
8. Christ posing on the cross for sixpence an hour with the image maker (say yourself) at work, and Mahomet, very handsome, looking on.
9. The black girl and Mahomet scrutinizing a miniature Venus of Milo (no bigger than a big hourglass).
10. Voltaire (after Houdon) digging, with the girl looking at him over the garden gate.
11. The Irishman’s dash for liberty: V. and the girl pursuing.
12. Family piece. The girl with all her children at home, with the Irishman digging, visible through the open door.
জর্জ বার্নার্ড শ-এর এই প্রথম চিঠিতে প্রথমেই লক্ষ করার বিষয় হয়ে ওঠে পাঁচ গিনি মূল্যের সই করা চেক-এর প্রসঙ্গের উল্লেখ। লেখক সম্মানদক্ষিণা প্রাপককে অগ্রিম পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এরপর কত নিখুঁতভাবে কোন কোন ঘটনার ছবি আঁকতে হবে তার লিখিত নির্দেশ, সঙ্গে বইয়ের সমস্ত খসড়া। লেখক-চিত্রকর মেলবন্ধন-এর সুদৃঢ় পদক্ষেপ প্রথমেই শ করে নেন তাঁর অপরিসীম চিন্তনীয় দক্ষতায়। শ-এর চিত্রণ-চিন্তার এক মূল্যবান পর্যবেক্ষণ ৮ ও ৯ নং নির্দেশ দুটি। Farleigh-এর নিজের ভাষায় ‘With unerring skill he had painted word pictures that would stimulate the excitement of any illustrator, and the same skill had, in this one introductory letter, made the whole job so clear that I was able to begin work without any further discussion.’ একজন লেখক নিজের লেখা ছাড়া, সমস্তটাই যে কীভাবে সচিত্রকরণ হতে পারে তা একজন অদেখা চিত্রকরকে প্রথমেই সরলভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন— এ এক অসামান্য দক্ষতার পরিচয়।
Farleigh এরপর খসড়া করতে শুরু করেন এবং প্রথমেই বেছে নেন সেই ৮নং নির্দেশটি যেখানে তাঁকে মডেলের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হবে না কারণ তিনি নিজেই চরিত্র চিত্রণের মডেল!
তারপর যা হয়, বার্নার্ড শ-এর মতো সু-কুখ্যাত মানুষের লেখার ছবি আঁকতে হাত তো কাঁপেই, বুক দুরু দুরু করে বার বার। সব কিছুকে একসঙ্গে করে Farleigh এঁকে ব্লক করে, ঠিক জায়গায় লাগিয়ে সঙ্গে আরও বেশ কিছু আনুষঙ্গিক খসড়া করে ২২ মে শ কে পাঠিয়ে দেন। প্রথম কাজ দু-সপ্তাহের শারীরিক এবং মানসিক মেলবন্ধনের উত্তর চলে আসে ২৪ মে-তেই। এই চিঠিতে শ এক অসাধারণ অনুমতি দেন Farleigh কে যা আবার লেখক-চিত্রকর সম্পর্কের এক নতুন পরিচয় বহন করে। এটাই তো ‘শ’কীয়তা! Farleigh পরের কিছু কাজ আর চিঠির উত্তর দেওয়ামাত্র প্রায় সঙ্গেসঙ্গেই চলে আসে শ-এর প্রত্যুত্তরও। এর কিছুদিন পরেই Farleigh-এর কাছে আসে এক চমকপ্রদ টেলিগ্রাম।
Whitehall Court
24th May 1932
Dear Mr. Farleigh,
Good: I think you can make a real job of it. I want the book to fit into my standard edition; and when I return to London on Sunday I will send you one of the volumes, though we shall probably have to use a thicker paper as the story is so short. The print will be as in the proofs.
And now, business. I shall want the right to reproduce all over the globe during the whole term of copyright as illustrations to the book* for a lump sum, payable in such advances as you may need, and the balance on completion. You must give me an outside estimate, as I have to calculate what I can afford to sink in the book. The estimate can be either for the whole job or per page illustrated. You must give me a date for completion. This is the most irksome part of the affair; but it’s got to be done. So sit down and get it over.
The Germans are pressing me hard to let them have a German illustrator, especially one who has been imprisoned for blasphemy, and richly deserved it for his hideously clever work. We must show them how it should really be done.
faithfully,
G. BERNARD SHAW
* You need not assign your copyright to me. You can license me to reproduce, and retain your right to reproduce, exhibit, and sell the pictures as drawings apart from my story if you have occasion to do so.
৩
Whitehall Court
27th May 1932
That is all right, of course; so go ahead. I am just off to Oxford for a few days and will put the affair into proper shape when I return.
G. B. S.
৪
এর কিছুদিন পরেই Farleigh-এর কাছে আসে এক চমকপ্রদ টেলিগ্রাম।
10th June 1932
Will you lunch with me at Whitehall Court to-morrow 1.15 to discuss page and print?
BERNARD SHAW
Farleigh তৈরি হলেন ‘to discuss page and print’-এর জন্য।
‘মুখোমুখি বসিবার দু-দণ্ড’-র ১৫মিনিট আগেই Farleigh চলে আসেন ট্রাফালগার স্কোয়ারে সিংহ মার্কা ফোয়ারার ধারে। এই সেই সিংহ যা শ প্রথম চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন। শ-এর চিঠি, তাঁর নাটক-এর কথা, তাঁর ব্যক্তিত্বের কথা সব ভিড় করে আসে Farleigh-এর মাথার মধ্যে। Farleigh-এর মনে হতে থাকে তাঁর মনের মানুষটির সম্বন্ধে এতদিনের জানা সমস্ত চিন্তা আর তথ্য যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে; মস্তিষ্কের সমস্ত অংশ আচ্ছন্ন করে তাঁকে এক অদ্ভুত দোদুল্যমান পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন শ। প্রথমবার সামনাসামনি দেখা হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে Farleigh ভাবছেন:
‘Then I found myself talking to Mrs. Shaw in a room that seemed to look over the whole of the Thames— such vistas were consistent with my state of mind, a state that might have resulted in a vertigo but for the skill of Mrs. Shaw’— ভাগ্যিস ম্যাডাম ছিলেন!
এরপরেই অতিবাস্তবীয় নাটকের মঞ্চে যেন এক অদ্ভুত পরাবাস্তব এক দীর্ঘকায় চরিত্রের রূপ নিয়ে প্রবেশ করল— উপস্থিত হলেন Farleigh-এর সামনে জর্জ বার্নার্ড শ—’শ’ শরীরে। তারপরে সময় বহিয়া যায়— ওয়াটারলু যুদ্ধ থেকে বর্তমানের আর্ট অ্যান্ড ক্রাফট মুভমেন্ট-এর মধ্যে দিয়ে রাস্কিন, মোরিস, লেথবে হয়ে শিল্প সাহিত্য, গান, নাটক, ভাস্কর্য-র ডালপালা বেয়ে লন্ডন ব্রিজ না থাকলে কত ভালো হত, আর থেকেই-বা কত ভালো হচ্ছে সে-আলোচনায় পাতায় পাতায় ফুলে ফলে কুঁড়িতে অনায়াস দক্ষতায় ঘুরে বেড়ানো হয়ে যায়। কিন্তু যে কাজের জন্য আসা সেকথার প্রসঙ্গ আর আসে না। ‘Time was passing— so much had been talked off, but no mention of The Book. It was only afterwards that I realized the skill of my host and hostess, who had by their conversation established a friendly and conversational footing that made the subsequent discussion of work a simple affair.’ অর্থাৎ অবলীলাক্রমে সঙ্গে রুটিতে মাখন মাখানো শেষ। এরপর ঘড়ি ধরে কাঁটায় কাঁটায় মাত্র ১৫ মিনিট Farleigh-এর সঙ্গে শ-এর আলোচনা চলে বই নিয়ে, ছবি নিয়ে। Farleigh-এর কথায়—
2.45 pm. Shaw produced some alternative pages of type and asked which I preferred.
Myself: I prefer the page that I have already worked to since I have visualized the book in that form now, and scaled my engraving to the type.
Shaw: But a more open page will make the book thicker—a thing every publisher and bookseller wants.
Myself: I would rather make it a thin book. It will be worth having, even as a thin book. Incidentally, I wish to remove headlines.
Shaw: But people will not know what book they are reading.
Myself: They’ll know all right, without being reminded on every page.
Shaw: Look here! Do it yourself.
‘শ-অধিবেশন’ সেরে Farleigh আবার এসে দাঁড়ালেন ফোয়ারার ধারে সিংহর সামনে— এবার হঠাৎ Farleigh-এর মনে হতে থাকে সিংহটা যেন তাঁর বন্ধু হয়ে উঠেছে। ঘণ্টা দুয়েক আগের সব আলোচনা মাথার মধ্যে মিলেমিশে ছবির পর ছবি তৈরি করে যাচ্ছে; তবে দারুণ কৌতূহল নিয়ে শ’-এর ঘরে যেটা লক্ষ করেছিলেন সেটা ছিল একটা ‘টোটেম’। Farleigh এতই আকৃষ্ট হয়েছিলেন ওই টোটেমটার প্রতি, যে বার বার চিন্তা করছিলেন কী করে ওই টোটেমটাকে ছবির অলংকরণের মধ্যে এনে ফেলা যায়।
এরপর হ্যামস্টিডে ফিরে Farleigh-এর প্রথম কাজ হল সমস্ত galley proof গুলোকে এনে, একদম ঠিকঠাক জায়গায় ছবিগুলোকে বসানো— বেশ কঠিন কাজ। Text-এর লাইন যাতে না নড়ে যায়, এ পাতার লেখা যেন ও পাতায় চলে না যায়, ঠিক যেখানে যে ছবি দরকার, মাপমতো সেই ছবিকে সেখানে বসানো। সমস্ত বইয়ের লেখা সাজানো galley proof-এ একদম ঠিক হবার পরে সমস্ত ছবি ব্লক করে ছেপে লাগানো হল। শ চেয়েছিলেন এই বইয়ের নামপত্র, Farleigh যেন নিজেই নিজের মতো করে দেন। ঘন বনের মধ্যে শ্যামাঙ্গী যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে এইরকম চিন্তা করে Farleigh, line drawing-এ নামপত্র এঁকে পাঠালেন। সেই বনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনে God-এর প্রতিমূর্তি ছড়িয়ে রয়েছে যার মধ্যে একটি হল আবার সেই শ-এর ঘরে থাকা টোটেমটা। Farleigh, মাথার মধ্যে কুরে কুরে খেতে থাকা টোটেম-এর চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়ে দেন শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধানের নামপত্রেই। ‘শ’কে পাঠিয়ে দেন এই নামপত্র, সঙ্গে এক চিঠিতে Farleigh অনুরোধ করেন যে ওই টোটেমটা ‘শ’ যদি তাঁকে একবার পাঠিয়ে দেন তাহলে খুব ভালো করে, কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করে নিখুঁত প্রতিচ্ছবি করে ফেলতে পারেন। প্রত্যুত্তরে শ-এর চিঠি আসে, নামপত্র সুদ্ধু এবং সঙ্গে সশরীর টোটেমও এসে হাজির হয়। এ ছাড়াও চরম অথবা পরম প্রাপ্তি হয় শ-এর নিজের হাতে আঁকা নামপত্রের খসড়া ছবি। চমকে যান Farleigh— এই প্রথম শ’ লিখিত নির্দেশ ছাড়াও নিজে এঁকে ছবিতে নির্দেশ পাঠাচ্ছেন। যেকোনো চিত্রকরের পক্ষে এর থেকে শিক্ষণীয় আর কী হতে পারে।
৫
15th June 1932
This is all right as a design. But the girl looks a bit wooden and tubby. I enclose a classical design which goes to the other extreme. Try striking an average.
Excuse my draughtsmanship.
I send the totem—a better one than the mask at Whitehall Court—by the post.
G. B. S.
??? You might bung in the lion looking over her hip.
‘Clarity of purpose must overcome technical efficiency as well as technical difficulties.’ পরবর্তীকালে শ আরও এঁকে তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন— যা দেখে Farleigh-এর মনে হয়েছিল দিনের পর দিন শ-এর আঁকার হাতেরও উন্নতি হচ্ছিল। শ এসব শুনে বলতেন, ‘I did not set out to be Shakespeare, but Michelangelo!’ Farleigh এরপর বহুরকম পরীক্ষানিরীক্ষা করে tone, character, form সব কিছুরই চূড়ান্ত রূপ দিয়ে শ-কে পাঠাতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যে শ অনুরোধ করেন বেশ অলংকরণ সমৃদ্ধ একটি প্রচ্ছদ করতে ‘decorated paper’ ব্যবহার করে। Farleigh নিজস্ব ভাবনা থেকে সৃষ্টি করেন সেই decorated paper, আর তার সঙ্গে শ্যামাঙ্গীর এক বড়ো প্রতিকৃতি ব্যবহার করে অন্যরকম একটা প্রচ্ছদও শ-কে পাঠিয়ে দেন। শ-এর প্রত্যুত্তরও আসে। চিঠিতে শ-এর তীক্ষ্ন চোখের পরিচয় যেমন পাওয়া যায় তেমনি সেইসঙ্গে পাওয়া যায় book design-এর অন্যতম element প্রতি পাতার headline রাখা না রাখা সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য। Decorated paper-এর design-এ line block-এর repeat pattern ব্যবহার করলে যে জোড়ার দাগ আসে সেটা নিয়ে Farleigh যথেষ্ট পরীক্ষা করে দক্ষতার সঙ্গে এক নতুন অলংকরণ বানান যাতে সেই দাগ চোখেই না পড়ে। শেষ পর্যন্ত এই decorated paperটা বইয়ের endpaper হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বড়ো পোর্ট্রেট দেওয়া ছবিটা প্রচ্ছদের রূপ পায়, সঙ্গে অন্য কয়েকটা ছবির পরিবর্তনের নির্দেশও শ পাঠান চিঠিতে— নির্দেশের সঙ্গে নিজের হাতে আঁকা কিছু খসড়া ছবিও।
Whitehall Court
6th July 1932
Dear Mr. Farleigh,
Yes: the portrait cover of course. What about the other for endpapers?
Just consider whether she is not—for so critical a god-seeker—a little too brutish. It is a quality that justifies itself completely on the purely artistic side; and I hesitate to suggest anything in the nature of a literary and intellectual irrelevance; but still, recollectiong that Michelangelo placed himself at the head of all the artists by making all his subjects geniuses, I am not sure that the slightest gathering up of the corners of her mouth and squaring of the outside ridges of her brows would really damage her. I am a critic myself, and have that outside life of my brows emphasized by what are almost secondary moustaches; and without them I should look as brainless as the Sistine Madonna. I enclose a couple of picture postcards to show what I mean.
As to headlines have it your own way; only do nothing for the sake of consistency alone: consistency is the enemy of enterprise just as symmetry is the enemy of art. I should have a different rule for every page if it were worth bothering to that extent. Maxwell could not run his establishment without rules, but we can do as we like, short of disgracing him with his Guild.
faithfully,
G. BERNARD SHAW
Farleigh আশ্চর্য হয়ে যান— শ এত ব্যস্ততার মধ্যেও এইরকমভাবে, এত গভীরভাবে text আর drawing-এর মেলবন্ধনে ডুবে যাচ্ছেন! শ-এর লেখা চিঠি একের পর এক আসতে থাকে আর Farleigh শ-এর নির্দেশ মেনে কাজ করতে করতে ‘আশ্চর্য’-র সীমানা ছাড়িয়ে ক্রমেই ‘স্তম্ভিত’ হতে থাকেন। রোমান সৈন্যর দাঁড়ানোর পদ্ধতি, আরবীটির সামনে শ্যামাঙ্গীর দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা বা holy cup নিয়ে যিশুর সামনে দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা কী হতে পারে, সেইসব ভঙ্গিমার খসড়া-ছবি, সঙ্গে চিঠিতে তার প্রকৃত ব্যাখ্যা পাঠাতে থাকেন শ। চিন্তায় কতটা গভীরতা আর স্বচ্ছতা থাকলে একজন লেখকের পক্ষে এই ধরনের সচিত্র সটীক নির্দেশ চিত্রকরকে দেওয়া যায় চিঠিগুলি পড়লেই তা বোঝা যায়।
৭
Whitehall Court
13th July 1932
Dear Mr. Farleigh,
Don’t bother about me: it is your job; and being an artist myself in my own line, I know better than to find a good man and interfere with him. The only thing I can suggest is that the label on the cover need not be foursquare if it would please your fancy to scroll it. I’ve stuck a bit of paper on to show what I mean. But I am not clear as to whether this admirable design (I did not spot the lovely black girl in it at first) is now to be an endpaper with the big face as the picture cover. Do not forget that there will presumably be a jacket with a striking design. If so, I am for black and white, and not for red and yellow. What about the big face for it?
I rather hanker after a picture of the Roman soldier on guard beside the cross before the arrival of the black girl. Instead of I.N.R.I., S.P.Q.R. And a bucketful of nails, scourges, thorn crowns, etc. The soldier, very imperial and imposing, might have his foot on a torn-up scroll with the inscription still legible on the four pieces. Judge not that ye be not judged. It would serve him right if a knobkerry, grasped in a black hand, appeared over his unconscious head like the sword of Damocles.
However, I repeat, let yourself rip, and do not let me hamper or distract you.
G. B. S.
Farleigh বইয়ের back cover-এর কথা তুললেই শ এঁকে পাঠান সেই আশ্চর্য বুড়োর ছবি— যা আসলে তাঁরই আত্মপ্রতিচ্ছবি। Farleighও আশ্চর্য পরিমিতিবোধের সঙ্গে সব কিছুর মেলবন্ধন করে শ-কে ছবিগুলি engrave করে পাঠান। Farleigh-এর কথায় ‘Shaw’s drawings are mature and highly skilful in thought and intention; their value to me lay in their intellectual clarity.’
যিশুর ছবিটাই Farleigh-এর কাছে এই বইয়ের সবথেকে শক্ত ছবি বলে মনে হতে থাকে এবং এর মধ্যে যে একটা ধাঁধা জড়িয়ে আছে Farleigh তা বুঝতে পারেন— ‘The problem of christ and the cup was an interesting one. I suggest that every illustrator should try to make a drawing of one figure giving an object to another. It is not easy, as I discovered, to convey which is the giver and which is the receiver.’ চিত্রশিল্পী হিসেবে Farleigh সেই পরীক্ষাতেও ‘শ-সম্মানে’ উতরে যান; শ-এর চিঠিতেই তার প্রমাণ মেলে এবং পঞ্চাশ পাউন্ডের চেক সেই কৃতিত্বের পুরস্কার। মাইকা এবং পাভলভ-এর ছবিতে Farleigh পরিবর্তন করেন শ-এর শ-চিত্র নির্দেশনামা পড়ে।
৮
18th July 1932
Dear John Farleigh,
This chap is wrong: he is standing at ease and looking quite reassuring and good natured, which destroys all the symbolism. Besides, artistically he is secondhand: the Italian Renaissance pictures have that very soldier all over them.
My fellow should be rigid, straight, inhuman, threatening, ruthless, with a horrible sort of clean beauty and athletic training to emphasize his mechanical cruelty. You must straighten up his knees and square his shoulders and give him Egyptian breadth of chest and slimness of flank.
My own drawings, which I offer rather as a warning than an example, suggest the pretentious futility of Cheltenham, not the pride of Rome.
ever,
G. B. S.
I don’t dislike your soldier, all the same. He composes nicely; but he seems to see the joke.
৯
Whitehall Court
22nd July 1932
Dear John Farleigh,
As to the beanstalk I could only express the subject by a blatant comic cut, but as to the treatment it struck me that a repeated design like a miniature wall-paper, consisting of strips of beanstalk with lots of foliage and repetitions of a tiny professor clinging on between a pretty lizard-like crocodile and a dainty thread of a striking snake, might appeal to you as a pretty pattern suggested (to me) by the repetitions of the black girl in the endpaper, which are so very decorative.
The single beanstalk on an otherwise blank page looks a trifle bare and empty after the rich black front cover, and somehow the page does not make quite the right frame for it, though the leaves flow and hang very nicely.
The Calvary soldier is now perfect. Many thanks.
. . . . . . . .
. . . . . . . .
After this coming Sunday I shall be at the Malvern Hotel, Great Malvern, Worc.
ever,
G. B. S.
১০
Malvern Hotel
25th August 1932
Dear John Farleigh,
Many apologies for my delay. I have been cobbling up my play, and could not get my mind on to the drawings in a properly leisurely way.
The lion and the Job are perfect. The other three need slight modifications. Ecclesiastes look dead, like a figure in a frieze, because he is not looking at the girl. He also looks flat, like a profile cut in cardboard. All you have to do is to turn his head away from the spectator and towards the girl and all this will come right.
In the picture of the cathedrals you have produced an effect like Hogarth’s Marvels of Perspective by not leaving a clear space between the girl’s right hand and the tiny church in the distance. The result is that the girl seems to be carrying the church. Just shift the church up so that both it and the man’s leg are clear of the girl’s hand and arm and all will be well. You see, you cannot get aerial perspective in black-and-white, and are therefore dependent on scale and complete detachment.
Most important is the Christ. You have curiously reversed the relation between him and the girl. In the story he presents the cup to her; and he would obviously—since it is both a funny conjuring trick and an act of kindness—smile as he did it. But in the picture it is the girl who is the humorous conjurer with the kindly smile, and he who is accepting the cup; so you must contrive to turn the situation inside out.
The smiling Christ is a great chance for you. Most artists are so utterly floored by the problem of what Christ’s face ought to express that they just make it express nothing at all and cover up the failure with a sort of abstract holiness that makes him acutely dislikeable. The first painter who is sensible and human enough to paint a Suffer Little Children with Christ smiling at a child standing on his knee will completely snuff out Holman Hunt’s ‘Light of the World’. If you can paint in oils, here is your chance.
If you are not satisfied with the cover, try the effect of making the breasts a little more virginal as they are so prettily in the subject pictures. That is all I can suggest.
As to the book, clearly it should have the title JOB on it.
I shall be here for at least another fortnight.
ever,
G. B. S.
১১
Malvern Hotel
10th August 1932
With Bernard Shaw’s compliments.
Just catching the post. Will write when you send the next batch.
The tree endpaper is perfect.
G. B. S.
১২
Malvern Hotel
29th August 1932
Dear John Farleigh,
You will see by the enclosed masterpiece what is wrong with the drawing of the flight of the labourer. My face is like the photographs they stick on to a ready-made body to amuse Bank Holiday trippers. Also it is drawn from one of the old photographs taken on ordinary plates without a colour filter, which represented me as a dark man instead of a very blond. The expression has not a trace of frantic terror, and the hat is an absurdity. The man is a very sophisticated metropolitan critic, and not a raw youthful labourer. Compare your own splendid portrait, full of dramatic energy and purpose, in the modeller’s picture. However, you will see it all in my versions; for though I am an execrable draughtsman I am a skilled and observant stage manager, always on the look-out for the right expression and movement. Keep me young, callow, fair, and scared out of my wits. Any photograph of a hurdle race will supply a study: I think he must have one leg over the gate: nothing else will give the necessary impression of headlong flight.
In the modelling picture, which is a triumphant improvement, keep Mahomet as handsome as you can: he was a princely genius. He is all right in the picture which shows him as discussing the Venus with the Black Girl. By the way, he abhorred images, and took the second commandment au pied de la lettre.
In the garden gate picture, if Voltaire had a small implement—a trowel or snipper or something—in his left hand, slightly raised, it would give him a perfect air of being taken by surprise in the act of gardening by the Black Girl’s call. As it is, he looks as if they were old friends and had been talking there for years. Stage management again!
In the caravan picture the expression of the girl is lovely: and the Vanity Fair jurymen are all that could be desired; but the man with the moustache is very like some public man—I can’t remember whom—but we may chance his taking proceedings.
I shall consider the wording of the colophon, and its form. I am inclined to describe the story as invented by me. Why shouldn’t the pictures be drawn and cut in boxwood by you? On Friday I visited the Gregynog Press and saw some lovely wood-cutting work by Agnes Miller Parker. She blackens the block to begin with, and traces the design on the black with a red carbon paper. As the cuts leave the colour of the wood she has the whole thing in black and white without having to make trial impressions. Is this your way?
I am off to pay some country visits and shall not be back here in Malvern until Wednesday.
ever
G. B. S.
১৩
Malvern Hotel
7th September 1932
These are now perfect; But I want to suggest a trifling alteration in the silver cup one, and haven’t time to do it before the post goes.
G. B. S.
১৪
Malvern Hotel
8th September 1932
Dear John Farleigh,
The enclosed, just cut out of Punch, seems to give the correct position for a hurdle jumper’s hind leg.
The well of Samaria makes a very nice picture; but somehow it does not tell the story; and I think that the sacred trinity of Holbein, Altdorfer, and Hogarth demands that the story should be told by the gesture. It still looks as if the cup were provided for public use (somebody having stolen the chain) and that the conjurer were taking it at the suggestion of the Black Girl, who is saying ‘After you, please’.
The remedy is, I think, to lift the arm from the elbow or stretch it out from the shoulder and have the girl taking it with her right hand. This can be done without spoiling the composition. There is more life in the straight arm; but there may not be room for it. The proffering hand should be still proffering, though she has lifted the cup an inch or two off it.
By the way, since you draw cathedrals so featly, why not let yourself go on a regular holy grail of a cup? Pity there is no use for a German fifteenth-century ciborium.
That is all I can suggest.
I have been heavily overdriven here for the last week or so. I hope I have not hung you up by my delay in returning the drawings.
faithfully,
G. BERNARD SHAW
১৫
Malvern
12th September 1932
Dear John Farleigh,
That has done the trick perfectly.
I have to write a postscript to the tale, explaining its theology, but don’t know yet whether it will invite illustration.
I return to London to-morrow.
I have lost count of the number of pictures; but I enclose £50 to go on with.
In haste, packing.
G. BERNARD SHAW
১৬
Whitehall
24th September 1932
Dear John Farleigh,
Call it . . . in round figures, as there may be some odd jobs to be done in concert with Maxwell—perhaps even a drawing for the postscript if some very tempting subject cropped up.
I enclose a form of receipt (subject, of course, to your approval), the effect of which will be that you retain your copyright subject only to a restraint on your sale of proofs until 30th June 1934. After that you can do what you like, except prevent me from using the illustrations as such: that is, I cannot sell impressions apart from the book.
I will tell Constable to send you 25 copies of the book for your private needs. As the published price will be half-a-crown only you may turn an honest penny by buying extra copies and selling them to collectors with your autograph at fantastic prices.
One fearful mistake has been discovered.
Aircraftman Shaw, alias Colonel Lawrence, Prince of Damascus, etc., etc., who is among other things a keen book fancier, saw yesterday the set of proofs you sent me (many thanks) and highly approved of them, but made the devastating remark that no Arab ever sat with his legs crossed. We shall have to assume that Mahomet was an exception to all rules.
I have noticed in my travels that Moors and such like never look well when they modernize themselves by sitting in our fashion, and are extraordinarily dignified crosslegged.
I shall be at Ayot St. Lawrence, Welwyn, Herts, until Wednesday afternoon.
faithfully,
G. BERNARD SHAW
১৭
Whitehall
17th October 1932
Dear John Farleigh,
I don’t think it would do any harm to print two or three of the pictures in the new monthly: quite the contrary. It would be an advertisement.
But on going through the proofs sent me by Maxwell I don’t feel that the story is illustrated enough. It needs two more pictures: Pavlov sitting on the crocodile, and Micah, with a flame shooting from his roaring mouth, and the Black Girl and the lion flying for their lives in divers directions.
If it would amuse you to do these I will spree another . . . guineas.
What do you think about it?
ever
G. BERNARD SHAW
১৮
Welwyn
26th October 1932
I have only just received Micah and Pavlov, too late to deal with them to-day; so Maxwell must wait.
Make a note to address letters as above for delivery on Saturday afternoons to Wednesday afternoons. Thursday to Saturday mornings, Whitehall Court. Otherwise there is a day’s delay, as they have to be forwarded.
G. B. S.
Welwyn
30th October 1932
It is Sunday; and the letter containing the Micah design will not fit into the receptacle of the closed post office.
In the cross headings for the preface, if you like still life you can put in anything of a literary nature except an inkstand, which won’t go with a typewriter. Extra books can be Writing Made Easy; How to Spell; and /or Inge’s Outspokesn Essays. If you prefer animals you can fill the grass round the B. G. with them.
G. B. S.
২০
Welwyn
31st October 1932
I think the carrion bird was a mistake of mine. It destroys the sense of space in the sky instead of suggesting it.
In my sketch, which was too sketchy to be clear, the professor had his hands folded on his left knee and his right knee swinging over them. This would pull the arms straight and take away from the stockiness of the figure: but it would give an unaccountable silliness to him which might be worth it. Just draw two or three lines and see whether it would be any use.
Otherwise O.K.
G. B. S.
২১
This is too comic. The preface explains.
The prophet seems to be swallowing a colossal banana because the girl has not her fingers in her ears, and might be running to post a letter. One must always connect the figures by some gesture that knits the parts of the picture into a story.
The lion is too obscene for so sublime a moment. He should not be degraded from the king Dick picture.
G. B. S.
২২
I also have a weakness for this Micah. But if you study his wrinkles and nostrils you will see that they indicate a strong biting action. If you can get the uplift into his eyes and mouth, the substitution of the flames for the banana will make another man of him.
ever
G. B. S.
২৩
Welwyn
8th November 1932
I see no harm in exhibiting a selection: not, perhaps, the lot. If before publication, all the better.
G. B. S.
বই শেষ পর্যন্ত যখন ছাপতে যায় তখন যাতে সর্বোৎকৃষ্ট বা ‘শ’-র্বোৎকৃষ্ট ভাবে ছবি ছাপা হয় তার জন্য ‘A meeting of Maxwell, paper maker, ink maker, machine man and myself, reached a conclusion that made it possible to achieve a successful unit’— চিত্রকর Farleigh-এর কথায়। Farleigh কয়েকটি engraving Wood Engraving Society-র বার্ষিক প্রদর্শনীতে ব্যবহার করার জন্য শ-এর অনুমতি চাইলে শ উদারভাবে তাও দিয়ে দেন। শুধু বই বা বইয়ের ছবি ভালো করে ছাপা নয়, বই কীভাবে বাঁধানো হবে, paperback হবে না hardbound হবে সে নিয়েও শ বা Farleigh-এর চিন্তাধারায় মিল-অমিল দুইই ছিল। Hardbound হবে কিন্তু jacket cover হবে না, বাঁধাবার board-এ pasting cover হবে, ভিতরে decorated endpaper থাকবে— এই ছিল Farleigh এবং শ-এর ইচ্ছে। আবার back cover-এ সেই অসামান্য ঝুলন্ত, কুমিরখেকো বুড়োর চিত্রশৈলী থাকবে। প্রকাশক, লেখক, চিত্রশিল্পীর আশ্চর্য শৈল্পিক মেলবন্ধনের পরিচয় এই বই। বইয়ের নামপত্র বা টাইটেল পেজও চিত্রবিভূষিত, মাদকতাময়।
সবই তো হল, কিন্তু শেষমুহূর্তে আবার Farleigh-এর মনে হল কিছু কোথাও একটা সমস্যা হচ্ছে বইয়ের layout-এ। আসলে শ এরপর লিখতে শুরু করেন তাঁর বিখ্যাত postscript অংশটি এবং সেটার জন্যও Farleighকেই কিছু ছবি আঁকতে বলেন— সেইখানেই কি তবে কিছু গোলমাল? Farleigh-এর কথায় দেখা যাক কী হয়েছিল— ‘Before the postscript was added I had intended the harp design to appear as a tailpiece. This had now to be shifted to the end of the book— in otherwords it became a tailpiece to the postscript. The script at the end of the story finished with only two or three lines of type on the last page. As the block was engraved there was nothing for it but to ask Shaw to write a few more lines. It was obviously easier to ask that than to ask him to leave out some of his story.’ এর প্রত্যুত্তরে শ জানালেন
২৪
Welwyn
9th November 1932
Page 58 is horrid, I shall write in 20 lines to bring the letterpress over from p. 57 and shift the picture down to the base line.
The harp must come on p. 75 as a tailpiece.
Then I think the thing will be as good as we can get it.
G. B. S.
২৫
Whitehall
13th November 1932
Dear John Farleigh,
At last the book has gone to press. It isn’t half a boad job, is it? The girl makes a charming Leitmotif running through all the pictures. Anyhow, it’s been a bit of fun.
Is the enclosed all right for the extra illustrations?
faithfully,
G. BERNARD SHAW
শ-এর সঙ্গে তাঁর মানসিক মেলবন্ধন এত সহজ অথচ এত গভীর যে বার বার Farleigh তা অনুভব করেছেন।
Postscript চিত্রণের সময় শিরোচিত্র বা headpiece কী দিয়ে শুরু হবে একটি postcard-এ শ তা এঁকে পাঠান, তাতে টাইপরাইটারের পাশে কী কী বই থাকবে সেই তালিকাও তিনি দেন। টাইপরাইটারের সঙ্গে কালির দোয়াত, নাকি কিছু বাড়তি বই— কোনটা সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে সে-নির্দেশও দেন শ। বইয়ের একদম শেষের আগের পাতায় শ্যামাঙ্গীর শুয়ে থাকার ভঙ্গিমাও শ এঁকে দেন। শ যে বইগুলি দাঁড় করিয়ে রাখা থাকবে বলে পরিকল্পনা করেছিলেন, তা ছিল ১) Genesis ২) JOB ৩) Micah ৪) Matthew ৫) Mark ৬) Luke —সবই সেই ঈশ্বরসন্ধানের হলদে হয়ে যাওয়া ছেঁড়া পাতার সংকলন। ‘Old Testament’ বাইবেলের প্রথম বই তো ছিল Genesis, যেখানে God কী করে পৃথিবী সৃষ্টি করলেন তার বর্ণনা রয়েছে। শ-এর আঁকা টাইপরাইটার এবং Farleigh-এর আঁকা টাইপরাইটার দেখলে চমকে উঠতে হয় ব্যঙ্গাত্মক মুখের অবয়বের হাসিতে। আড়াআড়ি পড়ে থাকা বইয়ের মধ্যে ছিল Writing Made Easy, Inge’s Outspoken Essays আর How to Spell— দাঁড়ানো এবং শুয়ে থাকা বইয়ের মধ্যে কী চূড়ান্ত ব্যঙ্গ— অথচ একজন ‘ধার্মিক নাকি অধার্মিক’ লেখকের কাছে দুটোই প্রয়োজনীয়। এমনকী শ শেষে শ্যামাঙ্গীর ছবিতে সামঞ্জস্য রাখার জন্য অন্য জন্তু কী ব্যবহার করতে হবে তারও নির্দেশ দেন। বই ছাপার পর এক মজার ঘটনা দেখা যায়— যা Farleigh-এর কথায় ‘. . . I made a serious spelling error. In the first edition Genesis appeared as Genisis. I altered the block in a later edition at Shaw’s request, as the new spelling of the word was assumed to be his invention, and he warned me, over the phone, of the threat to his correspondence on this matter.’
৫ ডিসেম্বর ১৯৩২। বই ছেপে প্রকাশিত হবার নির্ধারিত দিন। তার আগে আবার প্রকাশক, চিত্রকর, ছাপার লোক সবাই একসঙ্গে বসে বার বার page layout দেখে নিশ্চিন্ত হতে চান— এই মেলবন্ধনই তো সৃষ্টি করে সর্বোচ্চ মানের, সর্বোচ্চ মাত্রার গ্রন্থ নির্মাণ। Farleigh-এর ভাষায় ‘The artist and printer are component parts in the design of a book. If the work of these two craftsmen is brought together only at the end of a job, it is like a marriage where the bride and groom have not met previous to the ceremony; it is successful only by accident.’ বই বেরোনোর আগেই, প্রচার এবং Farleigh-এর চিত্রণের মোহে কত যে বই বিক্রি হতে পারে তার হিসাব যা জানান চিত্রকরকে— একঘর প্রশংসায়!
২৬
Whitehall
30th November 1932
Dear John Farleigh,
Many thanks for the proofs. Wilson (of Bumpus) might like the decorative design for an advertisement board in Oxford Street if the sale proves torrential. Even a sandwitch man—!
By all means let . . . reproduce to illustrate a review . . . They must wait for the 5th December before reviewing.
I shall look in at the . . . to-day if possible. When the question of reproduction arises with reference to the management of the publishing—to illustrate, for instance, you had better just refer the inquirers to Constable & Co. Newspapers and magazines are very touchy on the point of all having equal privileges, and any favours should be handed out impartially by the publishers . . .
ever,
G. B. S.
P.S. Kyllmann (Constable) reports that the first edition of 25,000 is already sold to the booksellers. He adds ‘Great excitement about John Farleigh’.
Farleigh-এর কাছে advance copy হিসেবে ২৫টি বই এবং আরও ২৫টি অর্ডার দেওয়া বই এসে যায়, যার থেকে সব ৫০টি বই-ই Farleigh তাঁর বন্ধুদের উপহার হিসেবে পাঠিয়ে দেন—ব্যস Farleigh-এর ভাঁড়ার শূন্য! এরপর Farleigh-এর কথায়, নিজের দিনলিপি থেকে. . .
5th December. I passed a newspaper placard announcing ‘Bernard Shaw and the Bible’. I went into a shop at 10 o’clock to get some copies: there were none left! At mid-day I tried again without success. On Tuesday I heard rumours that copies were being sold at IOS., for the first edition had apparently sold out and the next one could not be ready until Wednesday. I discovered a small shop with a few honest copies left and so managed to save a few first editions for myself.
The second edition came out on Wednesday to be followed by the third on Friday—it makes a nice little story from beginning to end—the romance of a book.
In two weeks I had received sufficient offers of work to keep me busy for two years. Letters poured in; while the press poured out lavish praise. Cuttings from the press of the whole world are pasted in two volumes. After that I abandoned the task of collecting press opinions. I know well enough whether my work is good or bad and do not wish to see indiscriminate praise any longer.
‘She was attractive’
‘alluring’
‘pleasing’
and all the rest of the adjectives, including
‘delightful, but why nude?’
‘embellished with exquisite engravings which depict a heroine remarkably bathykolpous and kallipygous’
‘pretty little picture book’
18th December. ‘Sixth Impression printing’ (advert. in The Observer)
February 1933. ‘The pulpits of Liverpool and Manchester translate the Black Girl to their congregations.’
A psychological magazine reviews the book and finds much sexual symbolism, especially in the last engraving. ‘We wonder if Mr. Farleigh was aware of this.’
24th February. America announces the publication of an American edition.
I hope America will forgive me if I say that her edition of the book was a travesty of the English edition.
18th March. A letter sent to the press, signed as might be expected:
Sir,
I can understand the critics ‘sitting’ on Mr. Shaw for his recent book, but the way in which they have, with one exception, allowed Mr. Farleigh’s drawings to go unchallenged is another example of that simple and press-like innocence, or is it ignorance, that newspaper critics adopt towards all illustrated books—unless for some reason an art critic is brought in.
Mr. Shaw shields himself behind his ‘inspiration’, and to do him justice he did not intend to be insolently irreverent. Mr. Farleigh was in no such mediumistic state when he illustrated the book, and is insolently irreverent whenever he is given the slightest chance. His conception of the Black Girl is physical rather than spiritual—she shows none of the tragedy of the black races, but more of the characteristics of and impertinent English girl who has been badly spoilt.
The Christ at the well is a dull Victorian conception, and the illustration showing the artist himself astride the cross, smoking a cigarette, is a clear indication of the artist’s insolent attitude rather than the aloof one intended by the book.
I should be surprised if the illustrations have not done more harm than the text.
It is a pity the critics were not up to the other side of their job, when they could have harassed the artist as well as the author so that they might enjoy a well deserved burning together.
I am, etc.,
CRITICAL
বই এবং ছবি মিলে যে সাফল্য তৈরি হল সেই সাফল্যর এক মজার অভিজ্ঞতা হল Farleigh-এর — ‘While the dizziest height of fame was reached when Vogue, in one of its fashionable woman, placed a copy of the book in her hand.’
এরপর আরও একটি মজার ঘটনা ঘটল একটি বই আর তার ছবিকে কেন্দ্র করে। তার আগে জর্জ বার্নার্ড শ কেমনভাবে বা কোন পরিস্থিতিতে এই গল্পটি লেখা শুরু করলেন, সেটা দেখে নেওয়া যাক।
১৯৩১-এর ২৯ ডিসেম্বর মিসেস শ এবং জর্জ কেপটাউনের উদ্দেশে রওনা দিলেন। শ-এর মাথায় ভূত চাপল তিনি নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে শার্লোটকে নিয়ে যাবেন— কারণ তিনি নিজেকে যথেষ্টই ভালো ড্রাইভার বলে মনে করতেন। দস্তুর মতো জোরে গাড়ি চালিয়ে যাবার সময় পোর্ট এলিজাবেথের কাছে এক জায়গায় এসে শ গাড়ি থামানোর জন্য ব্রেকে পা না দিয়ে ভুল করে অ্যাক্সিলারেটরে পা দিলেন (যা তাঁর এক বদ অভ্যাস ছিল) এবং ভয়ংকর দুর্ঘটনা ঘটালেন। নিজে প্রাণে বাঁচলেন ভাগ্যক্রমে। কিন্তু শার্লোট ছিলেন পিছনের সিটে— আঘাত পেয়েছিলেন কতটা সে-সম্বন্ধে শ ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২-এ লেডি এস্টরকে পেনসিলে এক চিঠিতে লিখছেন
সামান্য একটু-আধটু আঘাত ছাড়া আমার তেমন কিছু হয়নি, আমার পাশে যিনি বসেছিলেন তাঁরও নয়, গাড়িটারও নয়। কিন্তু, আহা বেচারি শার্লোট! মোটঘাটের স্তূপ থেকে তাকে যখন উদ্ধার করছি তখনই মনে হল বিপত্নীক হলাম বুঝি। এমন সময় সে আমরা আহত হয়েছি কিনা জানতে চাইল। ওর মাথাটি ভেঙেছে, চশমার রিম চোখে ঢুকেছে, বাঁ-হাতের কবজি মচকেছে, পিঠটা ছড়ে গেছে বিশ্রীরকম, আর ডান দিকের পায়ের গোড়ালিটায় একেবারে গর্ত হয়েছে। এখান থেকে হোটেল পনেরো মাইল দূর।
এসব আটদিন আগেকার ঘটনা, এখন আর তেমন উদবেগ নেই। তবু এখনও উনি শয্যাশায়ী, পায়ের এই গর্তটার যন্ত্রণা আছে, কাল ১০৩০ জ্বর উঠেছিল (আমার প্রাণ যাকে বলে ওষ্ঠাগত)। যাক, আজ অবস্থা ভালো, জ্বর ১০০০তে নেমেছে। বড়োই কাহিল হয়ে আছে।
এই চিঠি তোমার হাতে পৌঁছানোর আগেই হয়তো আমরা ওয়াইলডারনেসে গিয়ে হাওয়া বদল করব। আমি তার না করলে জেনো আমরা সব কুশলেই আছি।
এই রয়্যাল হোটেল, ক্লিসনা-তে প্রায় একমাস শার্লোটকে শয্যাশায়ী থাকতে হল; আর শ তখন প্রত্যেকদিন The Adventures of the Black Girl in Her Search for God লিখছেন— যে স্বল্প-আয়তন উপন্যাস এর পরে বছরে দু-লক্ষেরও বেশি বিক্রি হবে! শ-এর সেক্রেটারি শ্রীমতী ব্লাঞ্চি প্যাচ বলছেন, ‘মানুষ বাইবেলের বদলে যেন বড়োদিনের উপহার হিসেবে Adventures of the Black Girl কিনতে লাগল, ডিসেম্বরেই পাঁচবার পুনর্মুদ্রণ হল। জনৈক ক্যাথলিক ভক্ত শ-কে এই বই বিক্রি বন্ধ করতে বললেন।— কিন্তু শ তাঁকে জানালেন এই ক-দিনেই সে-বই এক লক্ষের বেশি বিক্রি হয়ে গেছে, পাঠক পড়েছে; তাতে যদি কিছু ভুল ত্রুটি থাকে তা থাকুক— প্রচার, বিক্রি চলছে চলুক। ক্যাথলিকের অভিযোগের উত্তরে শ লিখলেন
—You think you believe that God did not know what he was about when he made me and inspired me to write the Black Girl, for what happened was that when my wife was ill in Africa, God came to me and said— ‘There are women plaguing me night and day with their prayers for you. What are you good for any how?’ So I said I could write a bit but was good for nothing else. God said then ‘take your pen and write what I shall put on your silly head’— and that was how it happened.
এই অভিজ্ঞতাই Farleigh বলে গেছেন— ভয় দেখিয়ে দোকান থেকে সব বই কিনে, দোকানের সামনে আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন ‘a charming old lady’. কিন্তু তাতেও শ্যামাঙ্গীর অস্তিত্ব বিপন্ন হচ্ছে না— আবার, আবার, আবার, বার বার ছাপার যন্ত্র থেকে ছেপে বেরিয়ে আসছে The Black Girl আর লক্ষ লক্ষ মানুষ কিনেই চলেছেন। যেন সব মানুষই চলেছে ঈশ্বর সন্ধানে— শ-এর বইয়ের, Farleigh-এর ছবির মধ্যে তাঁকে খুঁজতে— এক বিপুল আনন্দে। যা আনন্দ তাই তো ঈশ্বর, আর সেই আদর্শের প্রতীক যেন ওই শ্যামাঙ্গী না কি ‘শ-মাগী’।
তথ্যসূত্র —
• John Farleigh, Graven Image : An Autobiographical Textbook, Newyork, Macmillan, 1940
• ভবানী মুখোপাধ্যায়, জর্জ বার্নার্ড শ, বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৩৬৬
• ঋষি দাস, বার্নার্ড শ একটি মানুষের কাহিনী, ওরিয়েন্ট বুক, কলকাতা
দ্বন্দ্বের নিরসন অথবা সূত্রপাত – কাবেরী বসু
দ্বন্দ্বের নিরসন অথবা সূত্রপাত – কাবেরী বসু
কর্ম ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। এমনকী কর্ম থেকে বিরত থাকা, যা হচ্ছে হোক বলে ছেড়ে দেওয়া— সেটাও এক ধরনের কর্ম . . . কর্ম ও নিষ্কর্মের মধ্যে সে যে একটিকে বেছে নেয় তা নয়; প্রকৃতপক্ষে বেছে নেয় জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে একটিকে।
—ক্রিস্টোফার কডওয়েল।
ঠিক এই কারণেই বার্নার্ড শ-এর The Adventures of the Black Girl in Her Search for God শুরু হয়েছিল— জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যে একটিকে বেছে নিয়েছিল মেয়েটি— চলেছিল প্রশ্নমুখর জীবনের পথে।
বার্নার্ড শ-এর বইটি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের অসামান্য সুখপাঠ্য অনুবাদে হয়ে উঠেছে ‘শ্যামাঙ্গীর ঈশ্বর সন্ধান’। আখ্যানের প্রথম পাতাটি খোলার আগেই ‘Black’-এর পরিবর্তে এই ‘শ্যাম’ একটু ধন্দে ফেলে। অভিধানের সাহায্যেও কূল মেলে না। সংসদের ‘বাংলা-ইংরেজি’ অভিধান জানাচ্ছে এর পরিবর্ত একগুচ্ছ ইংরেজি শব্দ— cloud-coloured, dark-blue, bottle-green, green dark-coloured, jet-black— অদ্ভুত! একই শব্দার্থে green আর jet-black? মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। এবার বাঙালির শাব্দিক ব্যাপকতা বিচার করলে বলা যায় তান্ত্রিক হম্বিতম্বির চেয়ে রামপ্রসাদ আমাদের অনেক আপনার। কেননা যে শব্দ বা শব্দাবলিতে নিজেদের অন্তস্থল উন্মুক্ত করি তার উৎসে রয়েছে আমাদের দিন-প্রতিদিনের বেঁচে-থাকা— শুধু বর্তমানের নয়— নিকট অতীত থেকে দূর অতীতে অসংখ্য পূর্বজর বিবিধ অভিজ্ঞতার নির্যাস ধারণ করে আছে প্রতিটি শব্দ। তাদের অর্থে মিলেমিশে থাকে আমাদের গোষ্ঠীজীবনের আরব্ধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞান। বঙ্গদেশে হিন্দুধর্মের (চলতি অর্থে) ভাবজগতের আওতায় বেড়ে উঠেছেন যিনি, তাঁর মননে ‘শ্যাম’ শব্দে ‘কালো’-র চেয়ে সুন্দরের ব্যঞ্জনাই প্রধান। আরও বিশদে বললে ‘শ্যামা মা কি আমার কালো রে!/কালো রূপে দিগম্বরী হৃদিপদ্ম করে আলো রে।’ ‘কালো’ অর্থে এখানে একাধারে অন্ধকার এবং আলো। আর এরই অনুষঙ্গে ‘শ্যামা’ হয়ে যায় ‘কালী’ অথবা বিপরীত অভীষ্টে ‘কালী’-ই শ্যামা। অন্যার্থে কৃষ্ণও কালো নয়, শ্যামসুন্দর। দৃশ্যমান বর্ণ থেকে অনায়াসে চলে-যাওয়া ভাগবত দ্যোতনায়। সম্ভবত সেই ধারাবাহিকতায় বার্নার্ড শ-এর The Black Girl বাঙালির আদরে হয়ে উঠেছে ‘শ্যামাঙ্গী’।
একটি বাক্যের (পড়ুন শব্দগুচ্ছের) মৌল উপাদানগুলি কীভাবে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে আছে তার ওপরেই নির্ভর করে তার অর্থ।
—নোয়াম চমস্কি
শুধু তাই নয়, প্রতিটি শব্দর (মৌল উপাদান) সঙ্গে তার অর্থ যে অনন্য আত্মীয়তার সম্পর্কে বাঁধা, সেটি কোনোভাবেই মৃত নয় (যতই প্রাচীন হোক সে-শব্দ) কিংবা অন্যভাবে বললে যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের চিন্তাকে সেই সম্পর্কে ধরে রাখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত তারা প্রাণবন্ত, সজীব। সে-কারণে আখ্যানের মূল শরীরে পৌঁছোতে অনেক অনেক পাহাড় পেরোতে হয়। শিরোনামী শব্দার্থে কেমন করে নির্দিষ্ট আখ্যানের মর্মার্থ আনাচেকানাচে উঁকিঝুঁকি মারে তার সুলুকসন্ধান সর্বাগ্রে জরুরি। শুধু সন্ধানী টর্চের আলো নয়, ব্যবচ্ছেদী টেবিলে ছুরি-কাঁচির যথেচ্ছ ব্যবহারে এর যথাযথ পোস্টমর্টেম ছাড়া আখ্যান তার রাজপুরীর সিংহদরজাটি মোটেই খোলে না। অলমিতি বিস্তরেণ . . . হাত থাকতে মুখে কেন . . . ইত্যাদি . . . ইত্যাদি।
অন্ধকার কথা কয়— আকাশের তারা কথা কয়
তারপরে— সব গতি থেমে যায়— মুছে যায়
শক্তির বিস্ময়
—জীবনানন্দ দাশ
মনে হতেই পারে যেন বার্নার্ড শ-এর এই আখ্যানটির প্রতিক্রিয়ায় এমন কথা লিখলেন জীবনানন্দ— কয়েকটি বাক্যে ছুঁয়ে ফেললেন ‘The Black Girl’-এর সম্পূর্ণ অভিযাত্রা। কিন্তু যে অন্ধকার কথা কয় সে কি কালো? তাহলে কেমন করে তার উৎসে ‘আলো’ উৎসারিত হয়! এমনই কি জীবনপ্রবাহের দ্বান্দ্বিক চলন? অনেক অধিবিদ্যক প্রশ্নে পাঠককে উদবেল করে তোলে এই আখ্যান। আবার কেউ হয়তো এর মধ্যে খুঁজে পাবেন দর্শনের ইতিহাস ও বিবর্তন। কিন্তু পা দুটি মাটিতে স্থির রাখি যদি তবে প্রথমেই জানতে ইচ্ছে করে ‘অন্ধকার’ আর ‘কালো’— এরা কি সমার্থক? তাহলে ‘কালো’-র বিপরীতে কখন লিখব ‘আলো’ আর কখনই-বা ‘সাদা’!
‘Black’-এর শব্দার্থ সন্ধানে যদি পৌঁছোই তার ইন্দো-ইউরোপীয় উৎসে তাহলে রীতিমতো চমকে উঠতে হয়— শব্দটি সেখানে blac— অর্থ pale (পাণ্ডুর), colourless (বর্ণহীন) অথবা albino। অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষাসমূহের প্রাচীন পর্বে এর রূপ— ফরাসিতে Blanc, ইতালিয় এবং স্প্যানিশে Blanco, Bianca, Bianco, Bianchi— প্রাচীন ইংরেজিতে ‘blac’ অর্থে ফর্সা রং (fair)— কিছুটা বর্ণহীন। এরই ধারাবাহিকতায় আজও ‘blanc’ শব্দটির অর্থ সাদা বা ফর্সা মানুষজন। আশ্চর্যজনকভাবে ষোড়শ শতাব্দীর পর এই শব্দার্থ একেবারে ৩৬০০ ঘুরে গেল— এটা ঘটল অর্থের দ্বিধাবিভক্তিতে— একটি আক্ষরিক অন্যটি ভাবগত। আক্ষরিক অর্থে ‘blac’-এর ক্রিয়ার রূপে বোঝাল ‘বর্ণহীন করা’ বা ‘সাদা/সোনালি/পাণ্ডুর’ করে তোলা আর ভাবার্থে কারোর ‘সুনাম নষ্ট করা’, তাকে ‘যশহীন করা’ অর্থাৎ তার ভবিষ্যৎ ‘অন্ধকার’ করে দেওয়া। এই সূত্রায়ণে নেতিবাচক বিবর্তনে ‘blac’-এর আক্ষরিক অর্থ হয়ে গেল ‘রাত্রির রং’— অন্ধকার। এরপর এরই বিস্তারে ‘black magic’ বা ‘black death’— এরও কিছুকাল পরে শব্দটির শেষে জুড়ে গেল ‘k’— blac থেকে black— এবং বিশেষণ থেকে এটি হয়ে গেল বিশেষ্য— রানির ‘Black Enemy’ থেকে শুরু করে একটা গোটা জনগোষ্ঠী তখন— ‘Blacks’. এরই ভাবার্থে ইউরোপীয় সাদা মানুষের মুখে আরও অনেক শব্দের আমদানি Niggers, Coloureds, Negros, Africans ইত্যাদি ইত্যাদি এবং সবই black-এর সমার্থক। এতেও অবশ্য অর্থের দ্বিচারী প্রস্তাবনা একেবারে বাতিল হল না— ‘কালো’ এবং ‘অন্ধকার’ দুটিই তার শরীরে মিলেমিশে রইল।
বাংলা ভাষাতে এই বিবর্তনের ইতিহাস একটু অন্যরকম। আমাদের যেহেতু একজন ‘রবীন্দ্রনাথ’ আছেন, তাই এর বিস্তৃতিও বিশিষ্ট এবং অনন্য। কবির বিস্তার বাদ দিলে অন্যত্র অর্থাৎ আমাদের পুরাণ-কথা থেকে শুরু করে হাল আমলের বাংলা ধারাবাহিক— সবই এমনতরো অসংখ্য উদাহরণে পুষ্ট। পুরাণের দুষ্টু লোক অর্থাৎ অসুর এবং ঠাকুমার ঝুলি-র দানব বা রাক্ষস-খোক্কস— সকলেই নিকষ কালো। ‘কালো’-র অর্থ এখানে অধঃপতিত, খারাপ, নীচজাতীয়। টিভির ধারাবাহিকে অধুনা আরেক ধাপ এগিয়ে যেকোনো ভিলেন গোছের চরিত্র (বিশেষত নারী)— তাদের পোশাকের রং (টিপ, অলংকার সমেত) কালো— এবং মজার কথা আমাদের চোখে সেটি মোটেই বিসদৃশ লাগে না। কেননা বাঙালি হিন্দুর যেকোনো মঙ্গল অনুষ্ঠানে ‘কালো’ যেকোনো কিছু নিষিদ্ধ। এমনকী বিয়ের কনের চুল ‘কালো’ ফিতে দিয়ে বাঁধা হয় না। এমনটা যে কেন হল মননের গভীরতর ব্যঞ্জনায়, এমন অর্থ ঘাঁটি গেড়ে কেন বসল, যেখানে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর গায়ের রং মোটের ওপর কালোই, সেকথা বোঝা শক্ত। শাসকের আরোপিত গূঢ়ার্থ বললেও স্পষ্ট হয় না; কেননা প্রাণের অঙ্কুরোদ্গম যে অন্ধকারেই, অভিজ্ঞতায় এই সত্য সকলেরই জানা। তবে সেই অন্ধকার— সেই কালো এমন অশুভ, এমন অশুচি কেন? সেখানে চোখের আলোয় কিছু দেখা যায় না, সেখানে আকারের সীমা শেষ, সেখানে এক অজানা পৃথিবীর আহ্বান— সেইজন্যই কি! এই ভাবনাতেই কি ‘সুদর্শনা’ ‘অন্ধকার’কে দেখতে চেয়েছিল আলোর মধ্যে? তবে বলতে হয় মানুষ আলোর মধ্যে তার পারিপার্শ্বিকের স্পষ্ট ধারণা পায়; তাই ‘শুভ্রতা’ শুচি এবং শুভ। নিজের বুদ্ধিমতো বাঁচার যে নিয়মকানুন সে বানিয়েছে— হোঁচট খাওয়া থেকে পিছু-ডাকা ইস্তক— সবই মঙ্গলের জন্য। যা কিছু রহস্যময়, যাকে সে কবজা করতে পারে না, যা থাকে মননের অন্ধকারে, তার মুখোমুখি হতে সে ভয় পায়— এই অজানা অনিশ্চিত ‘কালো’ তাই এত অশুভ।
বিজ্ঞানীর বিচার অবশ্য অন্যরকম। তার কাছে ‘অন্ধকার’-এর বিশেষ মর্যাদা— সেই ‘অজানা’ গবেষণার দাবিদার। যেকোনো ধাতুর বর্ণালীতে যে অন্ধকার অংশ থাকে সেখানেই গোপন তার বিশিষ্টতার পরিচয়— বিজ্ঞানী সেকথা জানে তাই ‘কালো’ তার কাছে অনুঘটক— এর শুভাশুভের কোনো নৈতিকতা বিজ্ঞানীকে বিচলিত করে না। অবশ্য এমনতরো নৈর্ব্যক্তিকতায় অনেক সামাজিক বিপর্যয় নেমে আসে— একটা হিরোশিমা— একটা নাগাসাকি হয়ে যায়। যদিও সে-প্রশ্ন এখানে অবান্তর। বিজ্ঞানীর বীক্ষার কথা বাদ দিয়ে কবির বয়ানে আসা যাক। ‘দিনের বেলাটা মর্তলোকের, আর রাত্রিবেলাটা সুরলোকের। মানুষ ভয় পায়, মানুষ কাজকর্ম করে, মানুষ তার পায়ের কাছের পথ স্পষ্ট করে দেখতে চায়, এইজন্যে এত বড়ো একটা আলো জ্বালতে হয়েছে। . . . অসীম অন্ধকার দেবসভার আস্তরণ।’ (‘জাপান যাত্রীর ডায়েরী’/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) কিন্তু সুসভ্য মানুষ, বাণিজ্যিক সভ্যতার লেনদেনে নিমগ্ন মানুষ সেই ‘আস্তরণ’-কেও রেয়াত করে না। মানুষ যখন ‘আলোকের খুঁটি’ গেড়ে দেবতার অন্ধকারকে ‘আলো দিয়ে ফুটো করে দেয়’ তখন সে ‘অন্ধকারকেও অশুচি করে তোলে।’ সাংঘাতিক ভাবকল্প! কেননা কবির দৃষ্টিতে ‘দিন আলোকের দ্বারা আবিল, অন্ধকারই পরম নির্মল। অন্ধকার রাত্রি সমুদ্রের মতো, তা অঞ্জনের মতোই কালো কিন্তু তবু নিরঞ্জন। আর দিন নদীর মতো; তা কালো নয় কিন্তু পঙ্কিল।’ অথচ কবির এই ‘নির্মল’ অন্ধকার আর ‘পঙ্কিল’ দিনের ব্যঞ্জনা দৈনন্দিনতার আবছা আভাসে ধরা গেলেও মননের গভীরে প্রোথিত হতে পারে না। সেখানে ঘাঁটি আগলে বসে থাকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নৈতিকতা। অবশ্য শব্দার্থের অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিমুখ প্রায় গোপনই রয়ে যায় লেখকের নির্দিষ্ট বয়ানে। কেননা যে চিন্তা বা যুক্তির প্রেক্ষিতে আখ্যান নির্মিত হয় অর্থাৎ লেখকের গভীর প্রকল্প, সেটি প্রকাশিত বয়ানে কখনোই সম্পূর্ণ বিধৃত হয় না। ভাষার এই সীমাবদ্ধতা মেনে নিতেই হয়। অতএব আক্ষরিক এবং ভাবগত অর্থের দ্বিচারী দ্যোতনাকে সঙ্গী করেই মূল আখ্যানের পাতায় মনোনিবেশ করতে হয়— হাঁটতে হয় শ্যামাঙ্গীর পায়ে পায়ে।
শ্যামাঙ্গী চলেছে ‘God’-এর সন্ধানে। হাতে মুগুর আর মগজে বিজবিজ করছে অন্তহীন প্রশ্নের পোকা। একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেননি তার ‘মেমদিদি’— শুধু খুব পুরোনো একটা বাইবেল— পাতা উলটোলেই সেগুলো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে, হাওয়ায় উড়ে যায়। ‘কেননা ষোড়শ শতাব্দীর ইংরাজী এক মৃত ভাষা। নতুন অনুবাদগুলি ক্রমেই আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কারণ অতি সোজা— পুরোনোটি আর সাধারণ মানুষের মগজে ঢুকছে না।’ (বার্নার্ড শ— ভূমিকা) এখন বাইবেলটি নতুন বা পুরোনো যাই হোক না কেন, কালো মেয়েটির এই ‘God’ খ্রিস্টীয় প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতিভূ— মেয়েটির প্রতিটি প্রশ্নেই তা প্রাঞ্জল হয়। কিন্তু কিছুতেই সে সন্তুষ্ট হয় না। এক হাতে বাইবেল আর অন্য হাতে মুগুর নিয়ে সে যে চলেছে ‘সত্যি’ God-এর সন্ধানে। স্থির বিশ্বাস তার, মুগুরের ঘায়ে ভেঙে ফেলবে সমস্ত প্রতিবন্ধকতা— হটিয়ে দেবে মিথ্যে ‘God’দের। এই ‘God’— ঈশ্বর/ভগবান/আল্লা কোনোটিরই সমার্থক নয়। মেয়েটির স্বভূমি আফ্রিকা এবং আমাদের উপমহাদেশ— দুটি স্থানই ‘হোমোসেপিয়ান’ প্রজাতির প্রাথমিক চলন প্রত্যক্ষ করেছে। প্রাচীন সে-ভাবনায় এমন প্রথাগত ঈশ্বর-এর কোনো প্রকল্প কোথাও ছিল না। ছিল কিছু ভয়াবহ প্রাকৃতিক শক্তি যাদের কাজকর্মের থই পাওয়া যেত না। সন্ত্রস্ত মানুষ তাই স্তুতিতে তাদের সন্তুষ্ট রাখতে চাইত— নানান প্রতীকে (আইকন), অভিজ্ঞানে (চিহ্ন)— কখনো গাছ, কখনো-বা একটুকরো এবড়োখেবড়ো কাঠ, আবার কখনো বিচিত্র আকারের, রঙের পাথর কিংবা নিত্য ব্যবহারের নানান উপাদান— সেখানেই ওই অজ্ঞাত শক্তিদের অধিষ্ঠান কল্পনা করত। ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর’— এই প্রকল্পটি ‘সর্বেশ্বরবাদী’ ঐতিহ্যের অতীত যার আছে, তেমন কোনো ধর্ম প্রচারকের চিন্তনেই স্বাভাবিক। এখানেই ‘black’ শব্দটির আক্ষরিক এবং ভাবগত অর্থ অতিক্রম করে তার ঐতিহাসিক এবং নৃতাত্ত্বিক অতীতকে প্রধান ভিত্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়। আমার স্ববাসে বর্ণহিন্দুর ব্রাহ্মণ্যবাদের ধাক্কায় এই সর্বেশ্বরবাদী আইকন-পূজারি জনগোষ্ঠী ‘আদিবাসী’ এবং নিম্নবর্গ বিধায়ে অচ্ছুত। সর্বগ্রাসী প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম হাড়িডোমের ‘ধর্মঠাকুর’কে এক ধাক্কায় ‘শিবঠাকুর’ করে দিল— অবশ্য ‘শিব’, বলা যায়, আরও প্রাচীনকালের হাতবদল। এত সব ধান-ভানা কিন্তু একটা সিদ্ধান্তকে বিশিষ্টতা দেবার জন্য। চামড়ার রং ‘কালো’ হলেও এই উপমহাদেশের মানুষ ওই আফ্রিকান অভিযাত্রীর প্রতিতুলনায় প্রাচীন ধর্মীয় ‘অভিজ্ঞান’ থেকে অনেকাংশেই বিচ্যুত। সেখানে ‘God’-এর অন্যতর একটি ব্যঞ্জনা অধিবিদ্যক ব্যাখ্যায় রূপায়িত— তিনি ‘ব্রহ্ম’— যার শুরু নেই যার শেষ নেই— যিনি অজ্ঞেয় অথচ পরিব্যাপ্ত। অবশ্য এই চেতনার অংশীদার হবার অধিকার একমাত্র যারা এর প্রবক্তা সেই ক্ষুদ্র শাসকগোষ্ঠীর। তবু এরই মধ্যে আর একজন এমন সন্ধানীর কথা মনে আসে— তিনি গার্গী। তিনিও উত্তরোত্তর জানতে চেয়েছিলেন ব্রহ্মের স্বরূপ। কিন্তু কোনো উত্তরেই তাঁর ধোঁয়াশা কাটছিল না (কাটার কথাও নয়)। তখন যাজ্ঞবল্ক্য একটি মোক্ষম ধমকে তাঁকে থামালেন— ‘আর একটি প্রশ্ন উচ্চারণ করলে তোমার মাথা খসে পড়বে।’ অতএব থামতে হল গার্গীকে, কেননা আদতে তিনি শাসকগোষ্ঠীরই একজন, ক্ষমতার অংশভাগী। ওই কালো মেয়েটির মতো মুগুর হাতে বেপরোয়া পরিব্রজ্যা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। এ প্রসঙ্গে মৈত্রেয়ীর কথা মনে আসতে পারে, কিন্তু তিনি স্বামীর অনুগমন করেছিলেন মাত্র। বিপরীতে ওই কালো মেয়েটি— তার সামাজিক অবস্থানে অনন্য— সে ওই অধিকৃত শ্রেণির একজন, যাদের শ্রমে সাদা চামড়ার মানুষের বৈভবের প্রাসাদ গড়া। বস্তুত এই অভিযাত্রায় এমনই একদল আত্মজনের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মেয়েটির। অতএব তার কিচ্ছুই হারাবার নেই, সে অকুতোভয়। যদিও কালচক্রে সাদা মানুষের জালেই সে ধরা পড়ে শেষমেষ।
চলার পথে মেয়েটির সঙ্গে এককালে দেখা হয় খ্রিস্ট এবং মোহম্মদের। এ বড়ো চমকপ্রদ প্রস্তাবনা। এই বাদবিসংবাদের প্রথম অংশে মেয়েটি নীরব। যদিও পৃথিবীর নবীনতম এবং সর্বশেষ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ইসলাম এবং তার শরীরে খ্রিস্টধর্মের মতোই প্রাচীন ইহুদি ধারণার অবশেষ। তবু ‘আল্লা’ বাইবেল-এর ‘God’ নন। প্রাক-ইসলামি যুগে আরবের হেজাজ অঞ্চলে (যেখানে মক্কা ও মদিনা অবস্থিত) অধিবাসীদের প্রধান দেবতা ছিলেন আল্লা। তখন আল্লাত, ওজ্জা ও মানাত নামে তিন দেবীকে আল্লার কন্যারূপে পুজো করা হত— এঁদের বলা হত বানাতাল্লাহ বা আল্লার কন্যা। কোরানে এঁদের উল্লেখ ছিল এবং কাবা-ঘরেও এঁদের মূর্তি ছিল। অর্থাৎ ইসলামি অভিযোজনের প্রতিতুলনায় খ্রিস্টীয় অভিযোজনটির সঙ্গে আমাদের তেমন পরিচয় নেই। সে-কারণে এদের চাপান-উতোরে মেয়েটির নীরবতা সহজেই অনুমান করতে পারি। বুঝতে পারি কেন এই অভিযাত্রায় আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর একজন মানুষকেই শ-এর প্রয়োজন ছিল। কেননা ‘ওল্ড টেস্টামেন্ট’-এর অনুশাসনের ছায়ায় বেড়ে-ওঠা আরবী এবং ইউরোপীয় ধর্মীয় গোষ্ঠী আর খ্রিস্ট ও ‘বাইবেল’-এর ‘নিউ টেস্টামেন্ট’-এ দু-হাজার বছর ধরে নিমগ্ন ইউরোপীয় সমাজ— এদের কারোর পক্ষেই খ্রিস্টীয় দর্শনে বিধৃত নিরাকার অথচ পৌত্তলিক— এহেন বিপরীতমুখী দ্বিবিধ চলনের ধন্দ থেকে সহজে মুক্ত হওয়া সম্ভব নয়। সেজন্যেই এই অভিযাত্রায় এমন একজন মানুষের প্রয়োজন ছিল যিনি সম্পূর্ণ বেপরোয়া হতে পারবেন। প্রাক এবং উত্তর-বাইবেলীয় প্রতিটি অধিবিদ্যক অভিযোজনকে সরাসরি টেনে আনতে পারবেন বাস্তবের জমিতে। এতে যদি কোনো অনুশাসন— কোনো নিয়মবিধি ভেঙে পড়ে তার তোয়াক্কা তিনি করবেন না। যিনি কথার কচকচিতে সত্যকে আবিষ্কার করবেন না, প্রয়োজনে প্রাচীন অসভ্যদের মতো মুগুরের ঘায়ে সব বানানো কূটতর্কের মীমাংসা করে ফেলবেন। সেই আদিম সরল সততায় ঋদ্ধ যে মানুষ, তাঁকেই প্রয়োজন। অতএব প্রাচীন সভ্যতার একজন প্রতিনিধিকেই শ বেছে নিয়েছেন। এই পর্বে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এই প্রথম অভিযাত্রীটি ‘নারী’ হিসেবে কোনো পুরুষের (আরব) মুখোমুখি হয়। সঙ্গেসঙ্গে প্রশ্ন ওঠে, কোন অনুষঙ্গের প্রয়োজনে শ একজন কালো ছেলের পরিবর্তে ‘মেয়ে’কে বাছলেন! এর একটা সরল উত্তর আখ্যানের শেষে অবশ্য পাওয়া যায়। কিন্তু এই ‘চেনা’ প্রস্তাবনা ছাড়াও আরও গভীর এক অভিমুখ এই আখ্যানে নিহিত। এর সন্ধানে আবার ইতিহাসের পাতা উলটোতে হয়।
শাসকের হাতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপে স্থিত হবার আগে গোষ্ঠীবদ্ধ মানুষের যে ধর্মাচরণ, সেখানে পুজো অর্থে কিছু রিচুয়াল, আচার-অনুষ্ঠান এবং সমস্ত পূজ্য প্রাকৃতিক শক্তির নানাবিধ আইকন— মানবসদৃশ কোনো মূর্তি নয়। এখনও আদিবাসী সাঁওতাল সমাজের নানান ক্রিয়াকর্মে অসংখ্য চিহ্ন বিশেষ গূঢ়ার্থে আঁকা হয়। সাঁওতালি ভাষার যে লিপি (অলচিকি) রঘুনাথ মুর্মু তৈরি করেন, সেখানেও এই চিহ্নগুলির বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে। এমনকী অন-আদিবাসী সমাজেও গোষ্ঠীজীবনের এই সমস্ত আইকন মেয়েলি আচার এবং ব্রতকথায় এমনকী আলপনায় আপন অস্তিত্বে আজও উজ্জ্বল। প্রাচীনকালে মূলত মেয়েরাই ছিল এই সমস্ত রিচুয়াল বা ধর্মীয় আচার-আচরণের উদ্যোক্তা এবং অংশগ্রহণকারী— একমাঠ ফসলের আকাঙ্ক্ষা অথবা বর্ষার আবাহন কিংবা নয়াবীজ বপন— সবেতে তারাই ছিল অনুষ্ঠানের চালিকাশক্তি। গোষ্ঠীধর্ম যখন শাসকের হাতে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল তখন আইকনের স্থলে এল মূর্তি কল্পনা (রাজার এবং শাসকের সাদৃশ্যে) আর মেয়েরা হারাল পুজোর অধিকার— পৌত্তলিকতায় পুরুষই পুরোহিত। তবুও আমাদের রোজকার যাপনায় জড়িত থাকে অজস্র আইকন। যেমন ‘তুলসী’— দুটি আখ্যানের জন্ম একে ঘিরে। ভগবান (!) বিষ্ণু তুলসীর সতীত্ব নষ্ট করেন তার অসুর স্বামীকে হত্যা করার জন্য অথচ সেই তুলসীর পাতা ছাড়া নারায়ণ শিলার (বিষ্ণুর আইকন) পুজো হয় না। আবার সেই পবিত্র তুলসীর গায়ে কুকুর প্রস্রাব করে (সীতার অভিশাপে) তবু তার পবিত্রতা নষ্ট হয় না। আসলে নিয়ত বদলে-যাওয়া এই পৃথিবীতে মানুষ তার চারপাশ এবং নিজের অবস্থান সম্পর্কে যেসব ধারণা গড়ে তোলে, তাদেরই অভিজ্ঞান এক-একটি আইকন। সেখানে পবিত্র-অপবিত্র, শুচি-অশুচির কোনো নৈতিক সিলমোহর নেই। সে-কারণেই ‘শিবলিঙ্গ’ নামক আইকনটি যে প্রকৃত প্রস্তাবে লিঙ্গ-যোনির সংগম-প্রতীক সে-বোধ ব্যতিরেকেই ভক্তের দল অনায়াসে তাকে স্পর্শ করে, অর্ঘ্য নিবেদন করে। মোদ্দা কথা নারীর মানসে আজও সেই প্রাচীন আইকনিক পূজার্চনার প্রতিভাস অধিষ্ঠিত। তার পক্ষেই সম্ভব প্রাতিষ্ঠানিক এবং আরোপিত এই ‘God’-এর সমস্ত ফাঁকি এবং তর্কের জাল ছিঁড়ে ফেলা। অতএব শ-এর অভিযাত্রী একটি মেয়ে— কালো মেয়ে।
দুটি বিশেষণ ছাড়া মেয়েটির চেহারার কোনো বর্ণনা আখ্যানে নেই। মেয়েটি কালো, বড়িয়া চিজ এবং মোহম্মদের বয়ানে সে আকর্ষণীয়— এরই বিস্তারে একদল মেমসাহেবের আলাপ-সালাপে সে ‘ছেলেদের মাথা খেতে’ পারে! (আশ্চর্য! একজন মেয়ে কবে যে পুরুষের চোখে না দেখে শুধু নিজের চোখে অন্য একটি মেয়েকে দেখতে শিখবে!) অথচ বার্নার্ড শ-এর নির্দেশানুসারে আঁকা যেসমস্ত ছবি আখ্যানে সংশ্লিষ্ট তার মধ্যে দু-একটিতে বোঝাই যায় না শরীরটি নারীর না পুরুষের। বাকিগুলিতে নারীশরীরের ভাঁজ স্পষ্ট। মজার কথা, মেয়েটি যে নিরাবরণ, আখ্যানে তার কোনো উল্লেখ নেই। অর্থাৎ আখ্যান আর চিত্র পরস্পরের পরিপূরক। মেয়েটির এই পোশাক-না-থাকার একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন অনুবাদক স্বয়ং। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বললে ‘উলঙ্গের কোন পরিচয় নেই, বানিয়ে-তোলা কাপড়ে কেউ-বা রাজা, কেউ ভিখারী।’ যেকোনো পোশাকই কোনো-না-কোনো শ্রেণি বা গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে। অতএব নিরাবরণ না হলে মেয়েটি কখনোই সাধারণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারত না। খুবই গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা সন্দেহ নেই। তবে আমার ভাবনায় এই পোশাকহীনতার অন্যতর একটি ব্যঞ্জনা রয়েছে। যেহেতু মূল আখ্যানটি ইংরেজিতে, সেইহেতু বলা যায় nude (নগ্ন) এবং naked (উলঙ্গ বা ল্যাংটো) বহিরঙ্গে সদৃশ হলেও অন্তর্গত অর্থে আলাদা। ‘নগ্নতা’ প্রকৃতপক্ষে আকারের বিশুদ্ধ প্রকাশ বা অভিব্যক্তি। যেমন ‘নগ্ন নির্জন হাত’— এখানে ‘হাত’-এর স্থলে ‘ঘর’ শব্দটি বসালেও বিশেষণ দুটি বাতিল হয় না। বিপরীতে ‘উলঙ্গ’ বা ‘ল্যাংটো’ শব্দে পাই এক নির্লজ্জ অবাধ আত্মপ্রকাশ। এই শব্দার্থের আধারে ‘পোশাক’ বা ‘আবরণ’-এর যে ধারণা বা concept জনমানসে ব্যাপ্ত সেটি হল, শীতগ্রীষ্মের প্রকোপ থেকে বাঁচার জন্য নয়, ‘পোশাক’ সভ্যতার প্রতীক; যেখানে ‘আসল’ আমি-কে ঢাকতে হয়— না হলে লজ্জিত হতে হয়। পরে লিঙ্গভেদের নিরিখে এর সঙ্গে আরেকটু সংযোজিত হল। লজ্জা নারীর ভূষণ আর নির্লজ্জতা পুরুষের অহংকার। হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় বাতাবরণে বেড়ে-ওঠা আমার মননে এই কালো ল্যাংটো মুগুর-হাতে মেয়েটি যেন খড়গ-হাতে কালীর চিত্র এঁকে দেয়। বার্নার্ড শ চেয়েছেন তাঁর ঈশ্বরসন্ধানী অভিযাত্রী ‘সভ্যতা’র এই বিশিষ্ট উপাদানটি বর্জন করে, অসংকোচ আত্মপ্রকাশে পথ চলুক।
মেয়েটির প্রশ্ন মোটের উপর দুটি। ঈশ্বর যিনিই হোন না কেন এমন বদখত পৃথিবী কেন গড়লেন যখন ইচ্ছে করলেই যা খুশি তাই করা যায় অর্থাৎ চাইলে যখন সর্বাঙ্গসুন্দর একটা পৃথিবীই গড়তে পারতেন তিনি! অবশ্য ‘ইচ্ছে করলেই পারা যায় না’— গোছের উত্তরকে সে নস্যাৎ করেছে এই বলে যে ও উত্তর মানুষের, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের নয়। এই প্রশ্নটি শহিদ ভগৎ সিংহ-ও করেছিলেন ফাঁসির কিছুদিন আগে জেলখানায়। তাঁর নাস্তিক হবার কার্যকারণের ব্যাখ্যায়। তাঁর বক্তব্য ছিল— ‘বোলো না এ তাঁর লীলা . . . তবে তিনি একজন নিরো, তাঁর সঙ্গেই আমার লড়াই।’ মেয়েটি অবশ্য এত কথা খরচ করেনি, স্রেফ মুগুর তুলেই মিথ্যে ‘God’-এর প্রবক্তাদের হাওয়া করে দিয়েছে। কিন্তু এরই বিস্তারে তার দ্বিতীয় প্রশ্ন— ঈশ্বর কেন পিতা? স্রষ্টার এই পুংলিঙ্গভিত্তিক ধারণা সব ধর্মেই প্রতিষ্ঠিত। খ্রিস্টধর্মে তো বটেই, এমনকী আল্লা (আরবী) অথবা খোদা (ফরাসি) নামবাচক বিশেষ্য— কোনো দ্বিবচন বহুবচন নেই এবং কোরানে নিজের সম্পর্কে তিনি পুরুষবাচক ক্রিয়া, বিশেষণ এবং সর্বনাম ব্যবহার করেছেন। বাংলায় অবশ্য সর্বনাম এবং ক্রিয়ার লিঙ্গ রূপ নেই— সংস্কৃতে ক্রিয়ার লিঙ্গান্তর হয়, সর্বনামের হয় না— তবু ধন্দ যেন কাটতেই চায় না। জগৎস্রষ্টার প্রায় সবকটি বিশেষ্যের— ব্রহ্ম (ব্রহ্মণী), ঈশ্বর (ঈশ্বরী), ভগবান (ভগবতী) ইত্যাদি ইত্যাদি স্ত্রী লিঙ্গান্তর হয়। ব্যতিক্রম ‘ঠাকুর’— সেটি লিঙ্গহীন— যেকোনো দেবদেবীর সঙ্গেই জুড়ে দেওয়া যায়। তবু সর্বশক্তিমান নিরাকার স্রষ্টা অধিকাংশের ধারণায় ‘পুরুষ’ হিসেবেই চিহ্নিত। বাঙালি কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক ভক্তিবাদে একটা অন্য সমাধান দিয়েছেন— ‘জগৎজননী মা যদি না হতো দোপাটি পেতো কি ফোঁটা/গোলাপ পেতো কি রাঙা চেলি আর চামেলী গরদ-গোটা।’ এখানে অবশ্য মেয়েটি একটা প্রশ্ন তুলতেই পারত। ‘বেশ, সুন্দর সুন্দর সব কিছু না হয় মায়ের সৃষ্টি; কিন্তু বদখত তিমি, উদ্ভট বেবুন— এগুলো যাঁর হাতে গড়া তিনি তবে পিতা?’ অর্থাৎ ঈশ্বর একাধারে নারী এবং পুরুষ। ক্রমে গভীর এক অধিবিদ্যক সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ছি। বিবেকানন্দের ‘দ্বৈতাদ্বৈত’ কলাকৌশলেও সেখান থেকে বেরোনো যাবে না। অতএব সাধু সাবধান— আখ্যানে ফেরা যাক। সেখানে মেয়েটি ‘God’-এর পিতৃ-রূপ প্রত্যাখ্যান করেছিল, কেননা তার বাস্তব অভিজ্ঞতায় ‘বাবা’রা খারাপ, কেবল মারে। কিন্তু এমন একটি প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছাড়াও অন্য একটি চিরায়ত অভিজ্ঞতার কথাও বলা যায়— ‘নারী’ শরীরে যেহেতু বিবর্তন দৃশ্যমান, বারেবারেই নানাভাবে প্রকট, এবং যেহেতু সেটি ভ্রূণের আধার (আগার) তাই সর্বশক্তিমান, নিরাকার স্রষ্টার অব্যয়ী রূপকল্পনায় স্ত্রী-শরীর আসেই না। কেননা সেক্ষেত্রে স্বীকার করতে হয় এ শরীর সৃজনশীলতায় ‘God’-এর সমার্থক। অথচ এই শরীরই অবশেষে থামিয়ে দেয় মেয়েটির পরিব্রজ্যা— মাঝপথে আচমকা।
Life only is sacred . . .
Life only is freedom
Why is she not alive
Oh, Womb! I fear you!
লিখেছিল ভেনেজুয়েলার ইভলিন। ১৯৮৮— অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে ‘ভারতবর্ষ’ সম্পর্কে তার কয়েক মাসের অভিজ্ঞতা ইভলিন লেখায়, রঙে আর রেখায় প্রকাশ করেছিল। আজও আমাকে নাড়িয়ে দেয় ওর শেষ লাইন ‘ও আমার গর্ভ! তোমাকে ভয় করি আমি।’ একথা সত্যি যে প্রজননই কোনো প্রজাতির টিকে থাকার প্রধান শর্ত। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো জীবের প্রজননে (বা সংগমে) যৌনতা নেই— সেটি তাদের বিশেষ প্রাকৃতিক ক্রিয়া (খাওয়া, ঘুম অথবা বর্জ্যত্যাগের মতো)— বড়োজোর তীব্র এক স্নায়বিক ক্রিয়া। কিন্তু মানুষ যেহেতু psychosomatic animal— মনন বা চিন্তন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত তার ক্রিয়া, তাই সে নির্মাণ করেছে এক বিশিষ্ট ধারণা বা concept —যৌনতা। এরই আধারে মানুষের লিঙ্গ নির্মাণ।
যৌনাঙ্গের প্রকৃতি-নির্ধারিত অবস্থান, আকার এবং ক্রিয়ার নিরিখে পুরুষের যৌন-সুখ এবং গর্ভসঞ্চার-ক্রিয়া প্রায় সমার্থক। যদিও নারীর ক্ষেত্রে দুটি ক্রিয়ার পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কোনো সাধারণ ক্ষেত্র প্রায় নেই বললেই চলে। অথচ সমাজ নির্ধারিত যৌনতার সংজ্ঞায় নারীর যৌনতা মাতৃত্বেই সমাহিত। শিশুর জন্ম অবশ্যই কোনো মানবগোষ্ঠীর টিকে-থাকার প্রধান স্তম্ভ। সেক্ষেত্রে কুমুদরঞ্জন যতই গদগদ স্বরে বলুন না কেন ‘ছেলেমেয়েদের খেতে দিতে পারে/পারে সে সোহাগ দিতে/টিপ কাজলেতে সাজাইতে পারে/দেখি নি তো হেন পিতে!’ মানতেই হবে শিশুর জন্ম দেওয়া এবং প্রতিপালন দুটো সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। অথচ এ দুটিকে অবিচ্ছিন্ন একটা উপাদান হিসেবে ‘মাতৃত্ব’-র সংজ্ঞায় মোড়ক-বন্দি করা হয়েছে। আরোপ করা হয়েছে নতুন অভিধা— নারীত্বের পূর্ণ বিকাশ বা সাফল্য মাতৃত্বে। নারীপুরুষ নির্বিশেষে এই উপাদেয় শরবতটি পান করে তৃপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। এই একটি ম্যাজিক মন্ত্রে নারীর সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা যেন অলীক প্রস্তাবনা। নিজের শরীরই নারীর সম্পূর্ণ অধিকারে নেই, তো স্বাধীনতা! কষ্ট কল্পনায় যদি এমনটা ভাবি যে, পৃথিবীর প্রতিটি সক্ষম নারী সন্তানের জন্ম দিতে অস্বীকার করল— হ্যাঁ এ এক চরম উৎকেন্দ্রিক পরিস্থিতি— তবু যদি এমন করে তারা, তখন রাষ্ট্র কী করবে? প্রয়োজনে সে নারী-শরীরে ভ্রূণ-সঞ্চারের আগ্রাসনে নামবে না! গর্ভের অধিকার পরিস্থিতির শর্তাধীনে নারীর। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে কখনো ‘চতুর্থ’ সন্তানের জননী আবার কখনো ‘একের পর আর একটিও না’— এমত স্লোগানে নারী পুরস্কৃত হবে। অতএব সন্তানের জন্ম শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আবেগসঞ্জাত একটি ক্রিয়া নয়— সামাজিক প্রয়োজন। একে সামাজিক উৎপাদনের সঙ্গে এক সারিতে বসিয়ে ‘নারীর সামাজিক শ্রমদান’ চিহ্নিত করার কথা। তেমনই করা হয়েছে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের আইনে। সবেতন মাতৃত্বকালীন ছুটি থেকে শুরু করে প্রসূতি মা এবং গর্ভস্থ ভ্রূণের দেখভাল সংক্রান্ত নানান বিষয় রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে চিহ্নিত। কিন্তু চিন্তনের এই যুক্তি-শৃঙ্খলা চরমে পৌঁছোলে নারী শুধু ‘সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে (যেমন সামন্ততন্ত্রে, হিটলারের জার্মানিতে, উগ্র ইসলামি আর হিন্দুত্ববাদীদের নানান প্রস্তাবে) ও ‘মানুষ’ হিসেবে নারী তার কর্মদক্ষতার প্রয়োগ ও সৃজনের মৌলিক অধিকার হারাবে। কীভাবে ‘নারী’ মানবিক সমস্ত ক্ষমতা বিকাশের পরিপূর্ণ সুযোগ পাবে, কীভাবে তার শরীর, তার গর্ভ সম্পর্কে ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছার অধিকার অর্জন করবে অথচ সমাজে নতুন শিশুজন্মের ভারসাম্য জনসংখ্যার নিরিখে ঠিকঠাক হারেই নিয়ন্ত্রিত হবে— সে বড়ো জটিল রসায়ন। আপাতত আমার বলার কথা এইটুকু— বিষয়টা এত গোলমেলে বলেই ‘মাতৃত্ব’-র জয়গানে আকাশবাতাস সর্বদা ভরিয়ে রাখতে হয়। বোধ হওয়া অবধি একটি শিশু (যেকোনো লিঙ্গের) যেন এই কথা জেনে-বুঝে, অনুভব করে বড়ো হয় যে ‘মা’ সে-এক ঐশ্বরিক প্রতিবেদন, এক মহিমান্বিত অবস্থান; যাতে প্রয়োজনে এই ধারণাকে নিজের কাজে (উভয়ত) ব্যবহার করতে পারে। আরোপিত সব ধারণার মতো এখানেও থাকে কিছু ফাঁক। যার নিদানে বৃদ্ধা ‘মা’ গলগ্রহ হলে তাকে বাড়ির বাইরে বের করে দেওয়া এমনকী খুন করার মতো সামাজিক থুড়ি ব্যক্তিগত ক্রিয়ায় কোনো অসুবিধা হয় না। সন্তান ধারণের এই ক্ষমতাই পেল্লায় ফানুস হয়ে নারীকে স্বার্থপর এবং সংসার নামক যাপনার ঘেরাটোপে বন্দি হবার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল করে তোলে। ‘নারীত্ব’-র সংজ্ঞায় একাকার হয়ে যায় মাতৃত্ব-গার্হস্থ্য এবং সার্থকতা। শুধু কি সামাজিক নৈতিকতা? সাহিত্যে, ছবিতে, গানে, কবিতায়— সর্বত্র— কোথাও গণেশজননী— কোথাও-বা যশোদা-মা, মেরির কোলে যিশু (লক্ষণীয় সন্তানটি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছেলে)।— রবিবাবু তো ‘সীমাস্বর্গের ইন্দ্রাণী’ বলেই ক্ষান্ত হলেন না; ‘জাপান যাত্রীর ডায়েরি’তে একেবারে নির্দিষ্ট করে দিলেন বাইরের জগতে পা রাখলেও সেখানে কোন কাজটি মেয়েদের— যেখানে ‘উদ্ভাবনী শক্তি’-র কোনো প্রয়োজন হয় না শুধু ‘অভ্যাস’ আর ‘নিষ্ঠা’-তেই কাজ চলে যায় সে-ক্ষেত্রটিই ‘মেয়েদের’। কেননা ‘দেহযন্ত্রটার’ দেখভাল করাটা ‘ওদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি’। অর্থাৎ এটা জিনে বহন করেই ওরা জন্মায়। তর্কের খাতিরে যদি মেনেও নিই ‘কথাটা সত্যি’, তাহলে বলতে হয়, মানবিক ক্ষমতার বিকাশে যদি বাধা দেয় অন্তর্গত কোনো DNA তবে সেটা কীটদষ্ট। ভ্রূণেই তার চিকিৎসা প্রয়োজন। যাইহোক, এই যশোগানের ধাক্কায় চার দেওয়ালের বাইরের যেকোনো কাজই নারীর কাছে অপরের (পড়ুন পুরুষের)। সময়সুযোগ থাকলে কিংবা নিজের (পড়ুন ঘরের) কাজকর্ম মিটিয়ে অবকাশে সে ‘অপর’-এর কাজটি করে। কিন্তু ‘আসল’ কাজটির ডাক এলে কখনো অনায়াসে আবার অনেক সময় চোখের জল ফেলতে ফেলতে ‘নিজের’ কাজে ফিরে যায়। না, না, সাংসারিক কাজকর্ম— প্রতিটি খুঁটিনাটি অত্যন্ত জরুরি। তবে কিনা সেসব ব্যক্তির দৈনন্দিন জীবননির্বাহের চাহিদা— এক ছাদের নীচে একত্রে যাঁরা বসবাস করবেন এর বিলিবন্দোবস্ত তাঁরাই মিলেমিশে ঠিক করে নেবেন— এগুলোকে ‘নারী’র কাজ হিসেবে লেবেল মারাই হাস্যকর। আর শিশুর জন্ম দেওয়া— সে-এক অপরূপ অভিজ্ঞতা। শরীরের ভেতরে একটি জ্যান্ত মানুষের নড়াচড়া, বেড়ে-ওঠা— দশ দশটা মাস তাকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচা তারপর একাধারে উদবেগ-আকাঙ্ক্ষা, যন্ত্রণা-আনন্দ-র বিপরীত সম্মিলনে সেই ছোট্ট মানুষটাকে হাতের মধ্যে পাওয়া। কিন্তু এ তো মেয়েমানুষের সামগ্রিক ব্যক্তিত্বের একটা অংশমাত্র— একে সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রকাশ বললে মানব কেন? অথচ আমরা মেয়েরা তাই করি— সম্মোহিত হই— ক-জনই-বা এসময়ের প্রথিতযশা পদার্থবিজ্ঞানী ড রোহিনি গডবলে-র মতো বলতে পারি— ‘I am a scientist— happen to be a woman’— ক-জনই এমন করে প্রাঞ্জল করতে পারি এমনকী নিজের কাছেও কাজের কোনো লিঙ্গ নির্ধারণ হয় না (শিশুর জন্ম-দেওয়া কাজ নয়— বিশেষ প্রাকৃতিক অভিব্যক্তি)— হয় ‘পারা-না-পারা’ আর কিছু নয়। পারি না তো! অনেক চেষ্টাতেও এমন কথা বলতে পারি না। নিজের অজান্তেই ওই মহিমার শৃঙ্খল কখন যেন অলংকার হয়ে গেছে। খুলে ফেললে নিজেকে শ্রীহীন, ব্যর্থ মনে হয়। এ কোনো যুক্তির ব্যাখ্যান নয়, এ আমার অভিজ্ঞতা, সারা জীবনের অনুভব এবং যন্ত্রণা।
একবার ড রোহিনি গডবলে-র কাছে সাংবাদিকেরা জানতে চেয়েছিলেন— শিক্ষাক্ষেত্রের প্রথম দিকের ধাপগুলোতে (বিজ্ঞানের) এমনকী স্নাতকোত্তর স্তরেও মেয়েরা ছেলেদের সমানে-সমানে বা অনেক ক্ষেত্রে খানিকটা এগিয়েই থাকে। অথচ পরে— গবেষণাসংক্রান্ত কৃতির ক্ষেত্রে তাদের প্রায় খুঁজেই পাওয়া যায় না, এমনটা কেন হয়। উত্তরে ড গডবলে বলেন, ‘কেননা যাদের দেখতে পেতেন তারা পাঁচ বছর আগেই অন্যক্ষেত্রে— ঘরে না হলেও এমন কোনো মানানসই কাজ যেখানে থাকলে সংসারকে সময় দেওয়া যায়— সেখানে চলে গেছে আর ফেরেনি।’ এমনটি তো কালো মেয়ের জীবনেও ঘটল। ‘ঈশ্বর-ধর্ম-সত্য’ এসব অধিবিদ্যক আলাপ-আলোচনা মুলতুবি থাক। মোদ্দা কথা মেয়েটির অভিযাত্রা শেষ হয়ে গেল— আচমকা। নচিকেতা দৃঢ়প্রতিজ্ঞায় পৌঁছে গিয়েছিল যমের কাছে। আর এ মেয়েটি লক্ষ্যে পৌঁছোনো দূরে থাক লক্ষ্যের কথাই বেমালুম ভুলে গেল। এত পথ পেরিয়ে, এত পাহাড় ডিঙিয়ে কৃষির কাছে সে থিতু হল— মাতৃত্বের সার্থকতায় হয়তো নিজেকেই ভেবে নিল স্রষ্টা বা ঈশ্বর। একবার এ প্রশ্ন সে নিজেই তুলেছিল— ‘এমন ভাবা কি অন্যায়?’ তবু বাচ্ছাদের পরিচর্যার সময় কখনো-সখনো মনে পড়ত তার সেই অনুসন্ধানের কথা— ওদের কাছে জানতে চাইত, এখন ‘যদি ঈশ্বরকে পেয়ে যাই, তাঁর সঙ্গে জীবন কাটাই, তোদের বাপ রেগে যাবে না তো!’
এখানেই শেষ হতে পারত আখ্যানটি। সত্যিই তো, আর কোনো গন্তব্যই অবশিষ্ট নেই। হলে হত কিন্তু সেখানে বার্নার্ড শ-কে খুঁজে পাওয়া যেত না। অতএব শেষ কয়েক বক্যে সেই যথাবিহিত শ্যভিনিস্ট কামড়।
বাচ্ছাগুলো যখন বড়ো হয়ে গেল— কাজের অবসরে সে একা— তখন মনে পড়ত তার অসমাপ্ত অভিযাত্রার কথা। ‘কিন্তু তখন আর শক্তি নেই তার দেহে। ডাণ্ডাটা সে এখন আর তুলতেই পারে না।’ ড গডবলের সেই ‘হতে পারত অথচ হল-না’ বিজ্ঞানীদের দল— তাদের মতো কালো মেয়েটিও আর ফিরতে পারল না তার অভিযাত্রায়।
আমরা যা কিছুই করি অন্যের ওপর তার ফলাফল বর্তায় . . . সমস্ত কর্মের সঙ্গেই ফলাফল জড়িত। আর মানুষের কর্তব্যই হল এইসব ফলাফলগুলির সন্ধান করা এবং সেই অনুযায়ী কাজ করা।
—ক্রিস্টোফার কডওয়েল।