এড়ানো যায় না – সায়ন্তনী পূততুন্ড .......................................................
(অতিলৌকিক-অতিভৌতিক সংকলন)
বিভা পাবলিকেশন
প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০২০, অগ্রহায়ন ১৪২৭
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচাৰ্য
.
উৎসর্গ
আমার প্রিয় বন্ধু সুমঙ্গল পন্ডিত ও তার কন্যারত্ন গুনু’কে অনেক ভালোবাসাসহ দিলাম।
Book Content👉
অথচ…
অথচ…
১
তখন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। জানলা দিয়ে প্রবল জলীয় বাতাস এসে আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে কাঠের পাল্লার গায়ে। তার দাপটে পাল্লাদুটো দুমদাম করে ক্রমাগতই আছড়ে পড়ছে। বাইরে শুধু নীল ধোঁয়াশা। নীল কুয়াশা মাটি থেকে থরে থরে জমে উঠে যেন আকাশ ছুঁয়েছে! নীলাভ অন্ধকারের মধ্যে বুক চিতিয়ে মাঝেমধ্যেই তলোয়ার শানাচ্ছে বিদ্যুৎরেখা! মেঘাচ্ছন্ন আকাশের বুকে থেকে থেকে যেন শয়তানের ঘোড়ার খুরের শব্দ ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ঝমঝম্ শব্দে পাগলের মতো এদিক-ওদিক সাপটে নিয়ে তীব্র গতিবেগে ঝরে পড়ছে জলধারা। হাওয়ার ধাক্কায় বৃষ্টির ফোঁটাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। কখনও ছাঁট এদিকে আসছে, কখনও ওদিকে। যেন গতিপথ ঠিক করে উঠতে পারছে না!
মাথার ওপরের আলোগুলো দপদপিয়ে উঠল। ইন্সপেক্টর সিন্হা আলগোছে ঠিক মাথার ওপরের বাল্বটার দিকে তাকালেন। হালকা হলুদ ম্যাটম্যাটে আলোটা যেন হঠাৎ করেই উজ্জ্বল হয়ে দপ্ করে জ্বলে উঠল। তারপরই আবার নিষ্প্রভ! থানার ভেতরের খাঁ খাঁ শূন্যতা যেন খেয়ে নিচ্ছে আলোটার অর্ধেক জ্যোতি! যেটুকু অবশিষ্ট, সেটুকুও রেশ রেখেই মিলিয়ে যাচ্ছে অজানা কোনও কৃষ্ণগহ্বরে। ইন্সপেক্টর আস্তে আস্তে চোখ সরিয়ে নেন সেদিক থেকে। আচমকা তাঁর মনে হল, আলোটাকে বুঝি অন্যান্য দিনের চেয়েও আজ বেশি বিবর্ণ মনে হচ্ছে। বৃদ্ধ মানুষের চোখের ঘোলাটে জ্যোতির মতো নিষ্প্রাণ! বাল্বটাকে পালটাতে হবে।
কড়কড় শব্দে আবার ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। দিগন্তসীমাকে ফালাফালা করে দিয়ে একাধিক শিরা-উপশিরা বিস্তৃত করে জ্বলে উঠেই মিলিয়ে গেল। কিন্তু যেটুকু আলো দিয়ে গেল সেটুকুই থানার বাইরে দাঁড়ানো আগন্তুকটিকে দেখার জন্য যথেষ্ট! ক্ষণিকের জন্য ইন্সপেক্টর সিন্হা চমকে উঠলেন। দোষ তাঁর নয়। আগন্তুকের আবির্ভাবটাই চমকে দেওয়ার মতন! পলকের দেখায় মনে হল, কেউ বুঝি হঠাৎ মাটি ফুঁড়ে এসে দাঁড়িয়েছে থানার দোরগোড়ায়। কোনও মানুষ নয়, বরং আবছা একটা সিল্যুয়েট! যার কোনও দেহ নেই! অশরীরীর মতো তার ছায়াময় উপস্থিতি অনুভব করা যায়, কিন্তু কায়াহীন। হয়তো এই সাময়িক ভ্রান্তি আরও কিছুক্ষণ থাকত। কিন্তু তার আগেই ভ্রান্তিজাল ভেঙে দিয়ে গুটিগুটি পায়ে ভিতরের দিকে এগিয়ে এসেছেন ভদ্রলোক।
ইন্সপেক্টর সিন্হা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছেন আগন্তুককে। বেশ সম্ভ্রান্ত ঘরের মানুষ বলেই মনে হল। তবে বয়স্ক। পাটের মতো ধবধবে সাদা মাথার চুল বৃষ্টির জলে ভিজে জবজবে। গায়ের সিল্কের পাঞ্জাবিও খানিকটা ভেজা। ঠুকঠুক করে অস্ফুট একটা শব্দকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে আসছেন ভদ্রলোক। শব্দের উৎস তাঁর ডানহাতে ধরা পালিশ করা লাঠি। তিনি একটু এলোমেলো পা ফেলছেন। যেন অতিকষ্টে হাঁটতে হচ্ছে। কাছে আসতেই দেখা গেল, লাঠিটার মাথাটা সম্ভবত রুপো দিয়ে বাঁধানো। একটা মিষ্টি, অভিজাত সুগন্ধও নাকে এসে ঝাপটা মারল তাঁর। ভদ্রলোককে দেখতে দেখতেই বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ছিল ইন্সপেক্টরের। এমন বর্ষণমুখর রাতে এরকম ধোপদুরস্ত হয়ে ভদ্রলোক করছিলেন কী? তাছাড়া এই ঝড়জলের মধ্যে বুড়ো মানুষটাকে কষ্ট করে লাঠি ঠুকঠুকিয়েই বা থানায় আসতে হল কেন? কোনওরকম অপরাধ সংঘটিত না হলে তো কেউ এমন দুর্যোগ মাথায় করে থানায় আসে না! ইন্সপেক্টরের ভুরু কুঁচকে যায়। কী কেস? ছেলে-মেয়েরা বুড়ো বাপকে বাড়িছাড়া করেছে নাকি? সেই রিপোর্ট করতেই আসছেন? কিন্তু এ কি অত্যাচারিত, অসহায়, বুড়ো বাপের চেহারা! দেখলেই মনে হয় রীতিমতো দুধ, ঘি, মাখন খেয়ে থাকেন! বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ত্বকের জৌলুশ দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়। সুন্দর চওড়া কাঠামো জরায় এখনও ভেঙে যায়নি। টানটান ঋজু চেহারা। তবে হাঁটাটা একটু অস্বাভাবিক। হাতে-ধরা লাঠিটাও অল্প অল্প কাঁপছে।
ভদ্রলোকের আগমনে উপস্থিত সাবইন্সপেক্টর ও হাবিলদাররাও একটু অবাক হয়ে গিয়েছিল। বিস্ময়ের ধাক্কাটা এখনও কাটেনি। ইন্সপেক্টর দেখলেন, অনেকগুলো কৌতূহলী চোখ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সেদিকেই। ভদ্রলোক শ্লথ গতিতে এগিয়ে আসতে আসতেই হঠাৎ যেন একটু টাল খেলেন। হেড কনস্টেবল রতন তাড়াতাড়ি এগিয়ে গিয়ে ওঁকে ধরে ফেলেছে। ও ভদ্রলোকের লাঠিটা ধরতে যেতেই গমগমে গম্ভীর স্বরে প্রতিবাদ করলেন তিনি,
—“লাঠিটা ধরবেন না।” ভদ্রলোক একটু উত্তেজিত স্বরে বলেন, “ওটা এভিডেন্স!”
—“এভিডেন্স!” রতন কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকায়। ইন্সপেক্টর সিনহাসহ সকলেরই চোখে তখন অগাধ বিস্ময়!
—“দেখছেন না!” ভদ্রলোক রতনকে একটু আলগা ধমক দেন, “আমি ভিজে গিয়েছি, কিন্তু লাঠিটাকে ভিজতে দিইনি। ওর বাঁটের ওপর শুকনো রক্তের দাগটাও কি দেখতে পাচ্ছেন না? এটা একটা মার্ডার ওয়েন! নিন সাবধানে ধরুন।”
এ তো বক্তব্য নয়, আদেশ! রতন বিহ্বল দৃষ্টিতে ইন্সপেক্টরের দিকে তাকাল। ইন্সপেক্টরও কেমন যেন হতবাক হয়ে গিয়েছেন। উপর্যুপরি বিস্ময়ের ধাক্কায় ক্ষণিকের জন্য তিনিও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলেন। লাঠিটা মার্ডার ওয়ে! কার মার্ডার হল! তারই রিপোর্ট করতে এসেছেন এই বৃদ্ধ! একেবারে মার্ডার ওয়ে সঙ্গে নিয়ে!
পেশাগত দক্ষতায় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বিমূঢ় ভাব কাটিয়ে উঠেছেন তিনি কড়া গলায় রতনকে লাঠিটাকে এভিডেন্স ব্যাগে ভরতে নির্দেশ দিলেন। রতন যতক্ষণে এভিডেন্স ব্যাগে লাঠিটাকে ভরে ইন্সপেক্টর সিন্হার সামনে আনল, ততক্ষণে ভদ্রলোক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে বসে পড়েছেন ইন্সপেক্টরের সামনের চেয়ারে। মৃদু স্বরে বললেন, “জল!”
ইন্সপেক্টর টেবিলের ওপর থেকে জলের গ্লাসটা নিঃশব্দে এগিয়ে দিলেন তাঁর দিকে। এক চুমুকে পুরো জলটাই নিঃশেষ করে দিয়ে গ্লাসটা যথাস্থানে নামিয়ে রাখলেন ভদ্রলোক। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। যেন গোটা বক্তব্যটা গুছিয়ে বলার জন্য প্রয়োজনীয় সময় চাইছেন।
—“স্যার, উনি ঠিকই বলেছেন,” রতন ইতিমধ্যেই ইন্সপেক্টরের সামনে পেশ করল লাঠিটা, “মাথার কাছে, বাঁটে ব্লাডট্রেস আছে। তাজা নয়। তবে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।”
ইন্সপেক্টর সিনহা ততক্ষণে গ্লাভস পরে নিয়েছেন। লাঠিটাকে অতি সাবধানে নাড়াচাড়া করছেন। বৃদ্ধ ঠিকই বলেছেন। তিনি নিজে বৃষ্টিতে ভিজে গেলেও লাঠিটার ওপরে একবিন্দু জলও পড়তে দেননি! এই দুর্যোগের রাতে এটা কী করে সম্ভব হল কে জানে। কিন্তু লাঠিটার বাঁটের মুখে শুকনো, বাদামি রক্তের দাগ একদম স্পষ্ট! লাঠিটা ভালো করে নিরীক্ষণ করতে করতেই বুঝলেন, হ্যাঁ, এরকম একটা মোক্ষম লাঠি দিয়ে অবশ্যই খুন করা যায়! এই রূপো বাঁধানো শক্ত বাঁটের আঘাতে কারোর মাথা ফেটে চৌচির হওয়া অসম্ভব নয়। এক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই তাই ঘটেছে। তবে সেই খুনটা করার জন্য অপরিসীম শক্তির প্রয়োজন, যা এই শুঁড়িয়ে-চলা ভদ্রলোকের কাঁপা কাঁপা হাতে নেই বলেই মনে হয়।
ইন্সপেক্টর এবার বৃদ্ধ মানুষটির দিকে চোখ তুলে তাকালেন। এখন আর ওঁর চোখে কোনওরকম বিস্ময় নেই, বরং পুলিশসুলভ কাঠিন্য। একটু কড়া স্বরেই বললেন, “কী ব্যাপার? কে খুন হয়েছে?”
ভদ্রলোক প্রশ্নের উত্তরটা দিলেন না। বরং পিছন ফিরে বেশ কয়েকবার তাকালেন। অদ্ভুত ভয়ার্ত দৃষ্টি! যেন ওঁর ঠিক পিছনেই কেউ দাঁড়িয়ে আছে! যখন খানিকটা আশ্বস্ত হলেন যে এই মুহূর্তে সেখানে কেউ নেই, তখন ধীরে ধীরে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে আনলেন একটা ফটো! ইন্সপেক্টরের দিকে ছবিটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “দেখুন তো। ফটোতে আমার পাশে যে মহিলাকে দেখতে পাচ্ছেন, ওঁকে এখন দেখছেন কি না!”
আবার আরেকটা বিস্ময়ের ধাক্কা! সিন্হা কী বলবেন বুঝে পাচ্ছিলেন না। এটা একটা মার্ডার কেস! কিন্তু সে বিষয়ে এখনও পর্যন্ত মানুষটি একটি কথাও বলেননি। এরকম সিরিয়াস একটা ঘটনায় আচমকা এমন আবদার বিরক্তির উদ্রেক ঘটায়। তবু বৃদ্ধের কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যা অগ্রাহ্য করতে পারলেন না ইন্সপেক্টর। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে মানুষটির এই অদ্ভুত খামখেয়ালিপনার পেছনে একটা প্রচণ্ড আতঙ্ক কাজ করছে! চেয়ারে বসেও থেকে থেকে ফিরে ফিরে পিছন দিকে তাকাচ্ছেন! যেন অজান্তেই ওঁকে কেউ অনুসরণ করছে!
তিনি ফটোর দিকে দেখলেন। সামনে বসে থাকা বৃদ্ধকে ফটোতে শনাক্ত করতে অসুবিধে হল না। তাঁর পাশে সহাস্যমুখে দাঁড়িয়ে আছেন এক বৃদ্ধা আটপৌরে ধরনে শাড়ি পড়েছেন। ফরসা টুকটুকে মহিলার মাথার চুলও দুধসাদা। দুই গালে হালকা রক্তাভ আভা। থুতনিতে একটা আঁচিল।
—“উনি আমার স্ত্রী। আপনি কি ওঁকে আগে কখনও দেখেছেন?” ভদ্রলোকের কণ্ঠে উদ্বেগ, “কিংবা এই মুহূর্তে দেখছেন?”
—“মানে?”
এই অদ্ভুত প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে ইন্সপেক্টর কী উত্তর দেবেন ভেবে পেলেন না। অবাক স্বরে বললেন, “আমি ওঁকে আগে কখনও দেখিনি। আর এখনই বা দেখব কী করে?”
—“কেন? আমার আশপাশে ওঁকে একবারের জন্যও কি দেখেননি? উনি কি আমার সঙ্গে আসেননি? আমার পিছন পিছন?” আতঙ্কে কণ্ঠস্বর কাঁপছে ওঁর।
ইন্সপেক্টরের ধৈর্য প্রায় চূড়ান্তসীমায় পৌঁছেছে। লোকটা কি পাগল? এই ঝড়জলের রাত্রে ফাজলামি করতে এসেছে? কিন্তু রক্তাক্ত লাঠিটা যে অন্য ইতিহাস বলছে! অথচ…
তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, “আপনি এখানে একাই এসেছেন। আর এখানে একাই বসে আছেন। আর কেউ আসেনি। আপনার পিছনে পুলিশের লোকেরা ছাড়া আর কেউ নেই।”
ভদ্রলোকের সমস্ত স্নায়ু এতক্ষণ ধরে টানটান ছিল। রুদ্ধশ্বাসে তিনি তাঁর প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় ছিলেন। এবার যেন খানিকটা শিথিল হলেন। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বললেন, “ওঃ ঈশ্বর! তবে সত্যিই খুনটা হয়েছে!”
প্রসঙ্গটা আবার খুনে ফিরেছে। এবার প্রবল কৌতূহলে বৃদ্ধের দিকে ঝুঁকে পড়লেন সিন্হা, “খুন? কবে? কোথায়?”
—“হ্যাঁ, খুনই!” তিনি একটা সজোরে শ্বাস টানেন, “খুন হয়েছে আমার বাড়িতে। একদিন আগে।” বলে একটু চুপ করে থেকে পরক্ষণেই যোগ করলেন, “আমিই আমার স্ত্রী’কে খুন করেছি। ওই লাঠিটা দিয়ে… হ্যাঁ! ওটাই মার্ডার ওয়ে! অথচ…!”
ভদ্রলোক আরও কিছু বলার আগেই একটা নীল আলোর তীব্র ঝলকানি কানের পর্দা প্রায় ফাটিয়ে দিয়ে প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল! তার ধাক্কায় জানলার কাচগুলো থরথর করে কেঁপে উঠেছে। ইন্সপেক্টর কিছু বোঝার আগেই দুম করে চতুর্দিকটা অন্ধকার হয়ে গেল!
পাওয়ার কাট!
২
জেনারেটরটাকে অজ্ঞাত কারণে অন করা গেল না। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও সেটা চলল না। দু-একবার মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের মতো অস্ফুট ঘড়ঘড় শব্দ করতে করতেই যেন শেষ নিশ্বাস ফেলল সেটা। রতনের অদ্ভুত লাগে! আশ্চর্য! আগে তো কখনও এটা এমন করেনি! সে যতটা সম্ভব জেনারেটরটাকে চেক করে দেখে। ব্যাটারি ঠিকই আছে। ফুয়েল যথেষ্ট আছে। কোনওরকম লিকেজও নেই। আর অন্য কোনওরকমের গোলমালও দেখা যাচ্ছে না! তবে কী হল?
—“ছেড়ে দে রতন,” সিন্হা বললেন, “বরং মোমবাতি জ্বালিয়ে দে।”
—“ইয়েস স্যার।”
রতন এবার নির্দ্বিধায় হুকুম তামিল করল। ঘরে এখন বিজলি বাতির তীব্র আলোর বদলে মোমবাতির নম্র, ভীত আলো জ্বলে উঠেছে। সেই কাঁপা-কাঁপা আলোয় বৃদ্ধ ভদ্রলোককে কেমন যেন রহস্যময় মনে হয়! মোমবাতির ভীরু শিখাও যেন তাঁর ওপর আলো ফেলতে ভয় পাচ্ছে। সেই আলো আঁধারের মিশ্রণ মানুষটির মুখের বলিরেখায় কাটাকুটি খেলছে। এখন তাঁর অবয়ব আবছা। কিন্তু চোখদুটো আশ্চর্য উজ্জ্বল!
গলা খাঁকারি দিয়ে থেমে যাওয়া প্রসঙ্গটাকেই ফের টেনে আনলেন ইন্সপেক্টর সিন্হা। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “আপনি আপনার স্ত্রী’কে খুন করেছেন?”
—“হ্যাঁ,” ইন্সপেক্টরের চোখে চোখ রেখে জানালেন তিনি, “করেছি। একদিন আগে।”
—“ঘটনার একদিন পরে থানায় আসার কারণ কী? আগেই এলেন না কেন?”
তিনি অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, “ভেবেছিলাম গোটা ঘটনাটা চেপে যাব। বাড়িতে বুড়ো-বুড়ি দুজনে ছাড়া কেউ নেই। ছেলে-মেয়েরা অবশ্য মাঝেমধ্যেই আসে। প্রতিবেশীরা তেমন খোঁজখবর নেয় না। বুড়ি না থাকলেও কারোর কিছু আসবে যাবে না। নিতান্তই যদি জিজ্ঞাসা করে, তবে বানিয়ে বানিয়ে কিছু একটা বলে দেব। আমাকে ছেলে মেয়েরা কেউ অবিশ্বাস করবে না। ধরা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। বুড়ো বয়েসে জেলের ভাত খেতে কারই বা ইচ্ছে করে…”
শেষ বাক্যটার মধ্যে খানিকটা অনুতাপ, খানিকটা হতাশা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হল। সিন্হা ব্যঙ্গবঙ্কিম স্বরে বললেন, “মিথ্যে কথা বলে ব্যাপারটা যখন চাপা দেবেনই ভেবেছিলেন, তখন হঠাৎ রাজা হরিশচন্দ্রের আত্মা ঢুকে পড়ল কী করে আপনার মধ্যে?”
ভদ্রলোকের চোখদুটো মোমবাতির আলোয় ঝিকিয়ে উঠল। যেন কথাটা শুনে শিউরে উঠলেন। চাপা আতঙ্কিত স্বরে ফিসফিস করে বললেন, “আপনি আত্মায় বিশ্বাস করেন?”
—“না।”
—“যদি বলি আমার কনফেশনের কারণ আত্মাই!”
—“হো-য়া-ট!” বিরক্তি ও বিস্ময় একসঙ্গে মিশল সিন্হার কণ্ঠে, “আপনি বলতে চান আপনার কনফেশনের কারণ আ-ত্মা!”
—“হ্যাঁ! ওঁর আত্মা।” ছবিতে নিজের স্ত্রী’র দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে বললেন তিনি, “ও চায় আমি শাস্তি পাই! তাই ও কিছুতেই আমায় ছাড়ছে না! পিছনে সবসময় লেগেই আছে!”
রতন ফিক্ করে হেসে ফেলে! দাদু তাহলে এই বৃষ্টিঝরা রাতে একটা ভূতের গল্প বলতে এসেছে! বাকিদের মুখেও মৃদু মৃদু হাসি। এতক্ষণে ভদ্রলোকের স্বভাব ওরা সকলেই ধরতে পেরেছে! কী অদ্ভুত প্রাণী এই নিঃসঙ্গ বুড়ো-বুড়িরা! এদের একেকজনের মাথায় উদ্ভট উদ্ভট রকমের খেয়াল চাপে। সম্ভবত জীবনের একঘেয়ে একাকিত্বই এর জন্য দায়ী! অলস মস্তিষ্ক থেকে তাই একের পর এক বৈচিত্রময় এবং আজগুবি কল্পকাহিনি বেরিয়ে পড়ে এইসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের খুব ভালো করেই চেনে ওরা। কারও ধারণা, সংসারের সবাই ষড়যন্ত্র করে তাকে বিষ খাওয়ানোর চেষ্টা করছে। কেউ বা কোনও আজগুবি খুনের ঘটনা বলতে চলে আসেন! তার দৃঢ় ধারণা, তিনি খুনীকে চেনেন ও স্পষ্টভাবে ‘খুনী’ হিসাবে শনাক্ত করেও ফেলেছেন। অথচ অপদার্থ পুলিশগুলো সে ঘটনার আদ্যোপান্ত কিছুই জানে না! ইনিও যে সেই দলেই পড়েন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই!
ইন্সপেক্টর সিন্হা কী বলবেন বুঝতে পারেন না। বুড়োকে ‘ধুত্তোর’ বলে তাড়িয়ে দিতেই পারেন। কিন্তু লাঠির বাঁটের ওপর রক্তের দাগটা তাঁকে নিবৃত্ত করছে। কিছু তো একটা হয়েছেই। বৃদ্ধ হয়তো অন্য কারোর অপরাধ নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিতে চাইছেন! কারণ এই কাঁপা কাঁপা হাতে লাঠি দিয়ে কি এত জোরে মারতে পারেন উনি যে কেউ মরেই যাবে! ইন্সপেক্টর ঠিক করলেন, সত্যি হোক কি মিথ্যে; গল্পটা শুনবেন।
—“ঠিক কী হয়েছিল?” তিনি ‘আত্মা’ থেকে বিষয়টাকে ‘খুনে’র দিকে নিয়ে গেলেন, “কেন মারলেন স্ত্রী’কে?”
—“অসহ্য হয়ে উঠেছিল!” বৃদ্ধের মুখ শক্ত হয়ে ওঠে, “ওর পাগলামি অসহ্য হয়ে উঠেছিল আমার কাছে! মানসিক রোগ তো ছিলই। স্কিজোফ্রেনিয়া। মেডিকেশনের ফলে অনেকটা সুস্থ হয়েও উঠেছিল। ভালোই ছিল, হঠাৎ আচমকা কী হল কে জানে! এক মাস আগে থেকে ওষুধ খাওয়া বন্ধ করে দিল। এমনিতে হয়তো দিব্যি সুস্থ, স্বাভাবিক আছে, কিন্তু পরমুহূর্তেই কথা নেই, বার্তা নেই আমাকে তেড়ে মারতে আসে! ওর ধারণা আমি ওকে খুন করব! একদিন আগে পরিস্থিতি চরমে ওঠে। এমনিতে ঝগড়াঝাটি আমাদের মধ্যে হয়ই। কিন্তু সেদিন ও একটা ছুরি নিয়ে আমার ওপর আক্রমণ করে! আমাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। কিন্তু কিছুতেই ওকে থামাতে পারছিলাম না। ও ডিটারমাইন্ড ছিল আমাকে খুন করবে। তাই বাধ্য হয়ে এই লাঠিটা দিয়ে এক বাড়ি বসিয়ে দিলাম। মারটা একটু জোরে হয়ে গিয়েছিল…!”
ইন্সপেক্টর সাগ্রহে শুনছিলেন। আস্তে আস্তে বললেন, “তার মানে সেল্ফ ডিফেন্সে আপনি এই হত্যাটা করতে বাধ্য হয়েছেন। তাই তো?”
—“সেলফ ডিফেন্সে করেছি ঠিকই,” তিনি ক্লান্ত স্বরে বললেন, “কিন্তু খুন তো খুনই! তাই যখন বুঝতে পারলাম ও মারা গিয়েছে, তখন ভয় পেলাম। প্রচণ্ড ভয়! কিছুক্ষণের জন্য মাথা ফাঁকা হয়ে গেল। কী করব, কী করা উচিত, কিছুই ভেবে পেলাম না।”
সিন্হা সাগ্রহে শুনছেন। বৃদ্ধ তার দিকে একঝলক তাকিয়েই ফের নিজের কথা বলতে থাকলেন। তিনি খুনী হতে পারেন, কিন্তু মনের কথা কাউকে খুলে বলার প্রয়োজন তাঁরও আছে। যে যন্ত্রণা দু’দিন ধরে ভোগ করে চলেছেন, সেই যন্ত্রণার বোঝা কোথাও না কোথাও তো নামিয়ে রাখতেই হবে।
—“আমি কিছুক্ষণ মৃতদেহের পাশে বসে রইলাম। চুপচাপ। অসাড়। মনে হচ্ছিল, এ সময়ের কোনও শেষ নেই! সামনে পড়ে আছে আমার স্ত্রী’র লাশ! লাঠির ঘায়ে মাথাটা চুরমার হয়ে গিয়েছে। ওর মাথা থেকে ঘন রক্ত পড়ছে মেঝের ওপর। কী টকটকে লাল, বীভৎস রক্ত!” বলতে বলতেই বৃদ্ধ যেন দৃশ্যটা কল্পনা করে কেঁপে উঠলেন। একটু চুপ করে থেকে একটা জোরালো শ্বাস টানলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, “কিছুক্ষণ পর আমি সংবিত ফিরে পেলাম। আমার মাথা তখন একটু একটু করে কাজ করছে। বুঝতে পারলাম, কী সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেলেছি। প্রথমে ভীষণ আফসোস হল। তারপরে ভীষণ ভয়! লাশটাকে নিয়ে কী করব! আমি আমার স্ত্রী’কেই খুন করে ফেলেছি জানতে পারলে কি আর রক্ষা থাকবে? কোমরে দড়ি দিয়ে, হাতে হাতকড়া পরিয়ে ধরে নিয়ে যাবে পুলিশ! ছেলে-মেয়েরা ভয়ংকর আঘাত পাবে। হয়তো আমার সঙ্গে সম্পর্কই রাখবে না, বাঁচানোর চেষ্টা তো দূর! তারপর কোর্ট, শাস্তি…”
তিনি আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন, “আমি সেটা হতে দিতে পারতাম না। ঠিক করলাম যেমন করেই হোক ঘটনাটা চাপা দিতেই হবে। এরপর মাথা ঠান্ডা করে আমি লাশটাকে সরিয়ে দিলাম। তখনই কী করব, ভেবে পাইনি। তাই মৃতদেহটাকে কার্পেটে মুড়ে খাটের তলায় লুকিয়ে রাখি। জল দিয়ে ভালো করে ধুয়ে দিই রক্তের দাগও। লাঠিটাকেও পরিষ্কার করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বাঁটের ওপরের দাগটা কিছুতেই উঠল না! তারপর মনে মনে পরিকল্পনা করতে লাগলাম যে কী করব! ছেলে-মেয়েদের কী বলব! প্রতিবেশীরা খুব একটা বাড়িতে আসে না। তাদের নিয়ে চিন্তা নেই। যেমন তেমন করে কিছু একটা বলে দিলেই হবে। কিন্তু আমাদের একটি কাজের মেয়ে আছে। সে সকাল সন্ধ্যা বাড়িতে এসে ঘরের কাজ, রান্নাবান্না করে দিয়ে যায়। সবচেয়ে বড় ভয় হল, মালকিনকে দেখতে না পেলে সে আমাকে কী বলবে! আরও ভয়ের কথা, আমি তাকে কী বলব! যখন আমি লাশ সরাচ্ছিলাম, মেঝের রক্ত পরিষ্কার করছিলাম, তখনই আমার মাথায় এসব চিন্তা আসছিল। সমস্ত কাজ সেরে যখন ধীরেসুস্থে সোফায় এসে বসেছি, আমার স্ত্রী’র নিরুদ্দেশ হওয়ার কারণ হিসাবে কোনও বিশ্বাসযোগ্য গল্প তৈরি করার চেষ্টা করছি, ঠিক তখনই মোবাইলে মেয়ের ফোন এল।
আমি তখনও কিছু বলার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। কী বলব? সত্যি কথাটাকেই ঘুরিয়ে বলে দেব? সবচেয়ে সহজ ছিল সত্যিটাকেই অন্যভাবে দেখানো। বলতে পারি, তোর মা সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে! একথা শুনলে মেয়ে তখনই বাড়িতে চলে আসবে। মায়ের মৃতদেহটাকে হয়তো তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাবে। কিন্তু সেখানে ডাক্তাররা দেখলেই বুঝতে পারবেন যে এটা অ্যাক্সিডেন্ট কেস নয়। ক্ষত দেখে ওদের সন্দেহ হবে, পুলিশ আসবে, পোস্টমর্টেমও হয়তো হবে। সেখানেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। আবারও বলছি, সেই ফাঁদে আমি পড়তে চাইনি। তাই ফোনও বাজতে থাকল। আমিও ভাবতে লাগলাম যে কী গল্প বানাব।
মোবাইলটা বাজতে বাজতেই একসময় চুপ করে গেল। একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে যাব, তার আগেই এবার বাড়ির ল্যান্ডলাইনটা বেজে উঠেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম, এভাবে বেশিক্ষণ অ্যাভয়েড করা যাবে না। মেয়ে হয়তো আমায় ফোনে না পেয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে। এবার যদি ল্যান্ডলাইনটাও না ধরি তবে বলা যায় না, হঠাৎ হয়তো বাড়িতে এসেই হাজির হল। ওর শ্বশুরবাড়ি বেশি দূরে নয়। তাছাড়া ওর নিজের গাড়ি আছে। নিজেই ড্রাইভ করতে পারে। মিনিট পনেরোর মধ্যেই হয়তো চলে আসবে। অনেক প্রশ্ন করবে। জানতে চাইবে ওর মা কোথায়
ভাবতেই সেই ভয়টা আবার আমায় আঁকড়ে ধরল। আমি বুঝতে পারছিলাম যে ফোনটা আমায় ধরতেই হবে! কিন্তু কয়েক মিনিট আমার সঙ্গে কথা বলেই তো ও ওর মা’কে চাইবে। তখন কী করব!”
ইন্সপেক্টর গভীর মনোযোগে ভদ্রলোকের কথা শুনছিলেন। তিনি আস্তে আস্তে বললেন, “শেষপর্যন্ত কী বললেন মেয়েকে?”
মানুষটি রুমাল দিয়ে মুখ মুছলেন। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন,
—“সেটাই তো আসল কথা। আমায় কিছু বলতেই হয়নি! কোনও কৈফিয়ত দিতে হয়নি। শুধু মেয়েকে কেন! কাউকেই কিছু বলতে হয়নি! বলার সুযোগই ছিল না…
—“মানে?”
ভদ্রলোক করুণ স্বরে বললেন, “বলব! সব কথা বলব। বলতেই তো এসেছি! অথচ…!”
—“অথচ?”
—“জানি না আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না।”
৩
—“হ্যালো,”
শেষপর্যন্ত একরকম বাধ্য হয়েই ফোনটা ধরতে হল আমাকে। ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ভয়! গল্পটা এখনও ঠিক মতন বানিয়ে উঠতে পারিনি। কী বলব মেয়েকে? বলব, যে ওর মা নিরুদ্দেশ? ধোঁপে টিকবে না! মেয়ে সোজা চলে যাবে পুলিশস্টেশনে। মিসিং রিপোর্ট লেখাবে। তারপর তীব্র পুলিশি জেরার মুখে কি অবিচল থাকতে পারব! আর ওরা যদি আমার বাড়িটাই সার্চ করে দেখে!
ভাবতেই হৃৎপিণ্ডটা যেন চড়াৎ করে গলার কাছে এসে গিয়েছে। বেশি কষ্ট করতে হবে না পুলিশকে। আমাদের মাস্টার বেডরুমের খাটের নীচেই কার্পেটে মোড়া।
না…না! নিরুদ্দেশ চলবে না। তবে কি বেড়াতে পাঠিয়ে দেব! অনেকদিন ধরে ও হরিদ্বার যাওয়ার বায়না করছিল বটে। ছেলে-মেয়েদেরও বলেছিল, — “তোরা আমাকে হরিদ্বার পাঠানোর বন্দোবস্ত কর। এই ঝগড়ুটে, কুচুটে বুড়োর সঙ্গে সংসার করে অনেক অপরাধ করেছি। হরিদ্বারে গিয়ে সেসব পাপ ধুয়ে আসব।”
ছেলে-মেয়েরা হেসেছে। বলেছে, “তুমিও না মা! পারোও!”
তবে কি বলে দেব, যে তোদের মা হরিদ্বার গিয়েছে? না! সেক্ষেত্রেও অনেক প্রশ্ন উঠবে। কবে গেল? কার সঙ্গে গেল? ওদের মা ছেলে-মেয়েকে কিছু না বলে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার লোক নয়। তাছাড়া সকালেও মেয়ের সঙ্গে মায়ের কথা হয়েছে। তখন কিছু বলেনি, অথচ একবেলার মধ্যেই সে বাক্স-প্যাটরা নিয়ে হরিদ্বার রওনা হয়ে গেল? নাঃ, মেয়ে বিশ্বাস করবে না। তাছাড়া আমাকে ছাড়া একা একা কীকরে যাবে? আমাদের মতন বয়স্ক মানুষেরা কখনই অতদূরে একা যেতে পারে না। ট্র্যাভেল এজেন্সি প্রয়োজন। কিন্তু কোন ট্র্যাভেল এজেন্সির নাম বলব? ওরা যদি খোঁজ নেয়!
ভাবতে ভাবতেই মাথা গরম হয়ে গেল। নাঃ, এটাও চলবে না। তবে কী বলি? কী বললে সেটা বিশ্বাসযোগ্য হবে? ওদিকে টেলিফোনটাও ….
—“হ্যালো।”
এতকিছু ভাবতে ভাবতেই ফোনটা শেষপর্যন্ত তুলেই ফেললাম। ওপাশ থেকে ভেসে এল মেয়ের অধৈর্য, উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর!
—“কী হল! এতক্ষণ ধরে ফোন করছি। ফোনটা ধরছ না কেন?” মেয়ে একেবারে এক নিশ্বাসে গড়গড়িয়ে বলে যেতে থাকল, “তাছাড়া তোমার মোবাইলটা কোথায়? প্রায় বারোবার ট্রাই করেছি। বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে! আমার তো রীতিমতো টেনশন হচ্ছিল! আঃ, মোবাইলটা হাতের কাছে রাখো না কেন? দরকারে-অদরকারে লাগে। তোমরা সত্যি! কিছুতেই বুঝবে না যে আমাদেরও চিন্তা হয়…!”
বুঝতে পারছিলাম যে মেয়ে এখন রীতিমতো একটা ভাষণ দেবে। ওর মায়েরও এই একই স্বভাব। একবার জ্ঞান দেওয়া শুরু হলে আর থামতেই চায় না! অন্যদিন হলে ওকে থামিয়ে দিতাম। কিন্তু আজ ওর অনর্গল কথার স্রোতকে আটকালাম না। ও যতক্ষণ কথা বলবে, ততক্ষণে আমি ধাতস্থ হয়ে কিছু একটা ভেবে ফেলতে পারব।
—“বাবা!”
ও দিক থেকে মেয়ের ধমক ভেসে এল, “আমি ফালতু বকে যাচ্ছি আর তুমি একটা কথাও শুনছ না!”
আমি ধমক খেয়ে একটু কুঁকড়ে গেলাম। কোনওরকমে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতেই বললাম, “না শুনছি তো!”
—“ফোন তুলছিলে না কেন এতক্ষণ?”
কোনওমতে বলি, “একটু টয়লেটে গিয়েছিলাম। বল…”
মেয়ে একটু থেমে কড়া গলায় বলে, “আচ্ছা, তোমরা আর কবে ম্যাচিওর হবে বলো তো? বয়েস তো কম হল না! ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি আছে। এখন যদি মেজাজের ওপর কন্ট্রোল রাখতে না পারো, তবে আর কবে পারবে?”
আমার বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে! ও কী করে জানতে পারল যে এরকম একটা ঘটনা হয়ে গিয়েছে! কেউ ওকে খবর দিল কি? কিন্তু কে? এখন কী বলব? কী করে বোঝাব যে আমি কেন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি! কী করে বোঝাব যে পরিস্থিতি সামলাতে পারিনি…!
মরিয়া হয়ে বললাম, “শোন খুকু, আমি কিছু করতে চাইনি। ইনফ্যাক্ট আমি তোর মা’কে অনেক ঠান্ডা করার চেষ্টা করেছি…”
—“থামো!” মেয়ে উত্তেজিত, “আমি সব জানি। মা আমাকে সব বলেছে!”
আমি থ! কী বলল ও? মনে হল একটা ইলেকট্রিক শক খেলাম! আর সে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ শিড়দাঁড়া বেয়ে সোজা মস্তিষ্কে চলে গেল! মাথার ভেতরটা ঝন্ঝন্ করে ওঠে! এসি চলছে। তার মধ্যেও আমি কুলকুল করে ঘামছি। আমার স্ত্রী মেয়েকে সব বলেছে! কিন্তু কখন বলল? ঘটনার আগে! কিন্তু ওকে তো কোনও ফোন করতে দেখিনি। তাছাড়া মেয়েকে ফোন করে কী বলেছে? খুন হওয়ার আগে তো বলতে পারে না যে ও খুন হতে চলেছে! তবে কী জানে মেয়ে!
—“তোমরা আজ আবার ঝগড়া করেছ! তুমি মাকে উলটোপালটা বলেছ! এমনকী গায়ে হাত তুলতেও গিয়েছিলে! ছিঃ বাবা, এটা তোমার কাছে এক্সপেক্ট করিনি!” মেয়ে একটু থেমে যোগ করল, “বুড়ো মানুষটা যে রেগে-মেগে একবস্ত্রে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, কোন্ চুলোয় গেল সেটাও তো জানার চেষ্টা করোনি! মানুষটা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল, কোনওরকম অ্যাক্সিডেন্টও তো হতে পারত! আজকাল কতরকমের দুর্ঘটনা ঘটছে চতুর্দিকে। সেরকম যদি কিছু হয়ে যেত! কোনও খবর নেওয়ার চেষ্টা করেছিলে যে মা কোথায় গেল!”
আমার মাথায় সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেল। মেয়েটা কী বলছে! ওর মা রেগেমেগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছে! এসব কথা ওকে কে বলল! আর কোন মায়ের কথা বলছে সে! এইমাত্রই তো তার লাশটা আমি লুকিয়ে রেখে এসেছি। নিজের হাতে মাথায় লাঠির বাড়ি মেরে তাকে আমি খুন করেছি… অথচ কার কথা বলছে তবে ও! কার কথা…!
—“খুকু…!” আমি কাতর গলায় ওকে বোঝানোর চেষ্টা করি, “তোর কোনও ভুল হচ্ছে…”
—“কোনও ভুল হচ্ছে না,” সে রাগত ভঙ্গিতে জানায়, “এই তো প্ৰায় মিনিট পনেরো আগে মা আমার কাছে এসে উপস্থিত! এক-কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমি তো দেখে অবাক! আসার পর থেকেই কান্নাকাটি করে যাচ্ছে! তুমি নাকি রাগের মাথায় মাকে লাঠি দিয়ে মারতেও গিয়েছিলে! ছিঃ বাবা! তুমি কী! এই বয়েসে স্বামী-স্ত্রী মিলে কোথায় সুখে শান্তিতে থাকবে, তা নয় কুকুর-বিড়ালের মতো মারপিট করছ! নিজের স্ত্রী’র গায়ে হাত তুলতে যাচ্ছ! কী করে পারলে?”
আমি পাথরের মতো দাঁড়িয়েছিলাম। আমার স্ত্রী নাকি মেয়ের বাড়িতে উপস্থিত! এটা কি আদৌ সম্ভব? নাকি অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটা ঠাট্টা! আমার মনে একটা অদ্ভুত আশঙ্কা ঘনিয়ে এসেছে। বুঝতে পারলাম যে ও সব কিছু জানে! কী করে জানল তা জানি না। কিন্তু নিশ্চয়ই জানে। কায়দা করে আমার মুখ থেকে সত্যিটা বের করতে চায়। আমি অনেক ফিল্মে বা সিরিয়ালে দেখেছি, খুনীর মুখ থেকে স্বীকারোক্তি বের করার জন্য এই কৌশলটা অনেকেই অবলম্বন করে থাকে। আমাদের কথোপকথনটা যে রাস্তায় যাচ্ছিল, তাতে আমার রি-অ্যাকশন অনেকটা এরকম হওয়া উচিত ছিল,
— “খুকু, তোর মা কিছুতেই তোর বাড়িতে যেতে পারে না! তুই এভাবে মিথ্যে বলছিস কেন?”
মেয়ে বলবে, “মিথ্যে কথা বলব কেন? এই তো, মা একেবারে আমার সামনে মুখোমুখি বসে আছে!”
ওর নিষ্ঠুর রসিকতা আমার অসহ্য লাগবে। আমি প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলব, – “ফাজলামিরও একটা সীমা থাকে! তোর মা কিছুতেই তোর বাড়ি যেতে পারে না! অসম্ভব!”
—“কেন অসম্ভব?” মেয়েও উত্তেজিত, “মা কি আমার বাড়ি চেনে না যে আসতে পারবে না? এর আগেও তো এসেছে। যতবার তোমরা ঝগড়া
করেছ, মা রাগ করে ততবার আমাদের কাছে চলে এসেছে! তবে এবার আসতে পারবে না কেন? মা এসেছে, তোমার কীর্তিকাহিনির কথাও শুনিয়েছে! বউয়ের গায়ে হাত তোলার নোংরা অভ্যেসটা তো তোমার কখনও ছিল না বাবা? তবে এবার কী হল?”
আমাদের কথোপকথন ক্রমাগত উত্তেজনার শীর্ষে পৌঁছোবে। আমি ওকে অসংখ্যবার বোঝানোর চেষ্টা করব যে ওর মা কিছুতেই ওর বাড়ি যেতে পারে না! ও আমাকে বারবার বোঝাবে যে ওর মা এই মুহূর্তে ওর নাকের সামনেই বসে আছে এবং কাঁদতে কাঁদতে আমার গুষ্টির তুষ্টি করছে। এরকম অযৌক্তিক ও অতিপ্রাকৃতিক কথা শুনতে শুনতে একসময় আমি আমার কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে ফেলব, এবং চিৎকার করে শেষপর্যন্ত বলে উঠব, “এটা একদম অসম্ভব! ও তোর ওখানে থাকতেই পারে না, কারণ আমি ওকে একটু আগেই খুন…”
নাঃ, কিছুতেই ও ফাঁদে পা দেওয়া চলবে না। আমি নিজেকে অতিকষ্টে শান্ত করি। আস্তে আস্তে বলি, “সরি মা। আসলে মাথাটা একটু বেশিই গরম হয়ে গিয়েছিল। আর কখনও করব না। তুই তোর মাকে বোঝা। আপাতত
আজকের রাতটা ওখানেই থাকুক। কাল সকালেই আমি ওকে নিয়ে আসব।”
—“তোমাকে আসতে হবে না।” মেয়ে যেন এবার একটু নরম হল, “আমিই কাল সকালে অফিসে যাওয়ার পথে মাকে বাড়িতে ড্রপ করে দেব।”
কথাটা শেষ করে বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে এবার অনেক শান্ত গলায় বলল, “বাবা, একটু বোঝার চেষ্টা করো। তোমাদের বয়েস হয়েছে। এই বয়েসে এরকম অশান্তি করতে নেই। তোমার হাই ব্লাডপ্রেশার আছে। উত্তেজনার মাথায় যদি কিছু হয়ে যায়! এখন কি এরকম মারপিট-দাঙ্গা হাঙ্গামা মানায়?”
—“ঠিক আছে!” আমি শান্ত ভাবেই গোটা ব্যাপারটা মেনে নিই, “সব দোষ আমারই। কথা দিচ্ছি আর কখনও তোকে নালিশ করার সুযোগ দেব না।”
আরও দু-একটা কথার পর মেয়ে ফোনটা রেখে দিল। ও যেন একটু হতাশ হল! আমি মিটিমিটি হাসছিলাম। এত সহজে স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারবে না আমার কাছ থেকে। সম্পর্কে আমি তো ওর বাপ! এখন একটু ভয় পেয়ে আছি ঠিকই, কিন্তু বোধবুদ্ধিশূন্য হয়ে যাইনি। এত সহজে আমায় কাত করতে পারবে না! মৃত মানুষ কখনই হেঁটে চলে বেড়াতে পারে না! আমি জানি, ওর মা কখনই ওদের বাড়ি যেতে পারে না। কখনই না! শুধু একটাই প্রশ্ন; এত তাড়াতাড়ি ও খবরটা পেল কী করে! কে দিল!
তবু সেদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে কী মনে করে একবার খাটের তলাটা ভালো করে দেখে নিলাম। হ্যাঁ, লাশটা যথাস্থানেই আছে। সেইভাবেই কার্পেট মোড়া অবস্থায়। কোনও নড়ন চড়ন নেই। মৃতা স্ত্রী’র গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম। শরীরটা ইতিমধ্যেই ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। গোটা দেহ মৃত্যুর স্পর্শে কঠিন!
আমি নিশ্চিত হলাম, মেয়েটা আমাকে মিথ্যে কথা বলে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ওকে আমি সফল হতে দিইনি।”
এই অবধি বলে থামলেন বৃদ্ধ। সিন্হা চুপ করে তাঁর স্বীকারোক্তি শুনছিলেন। এবার বললেন, “তারপর?”
৪
রোজ ঠিক ছ’টার সময়ে আমাদের কাজের মেয়ে কল্যাণী আসে। ও একসঙ্গে অনেক বাড়িতে কাজ করে। ভীষণ পাংচুয়াল। একেবারে ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে মিলিয়ে কাজ করে যায়। ছ’টা থেকে ন’টার মধ্যে বাড়ির তোলা কাজ, রান্নাবান্না সব মিটিয়ে বেরিয়ে যায়। দরজা খুলতে এক সেকেন্ডও দেরি হলে বেল বাজিয়ে বাজিয়ে কানের পোকা নড়িয়ে দেবে। অন্যান্য দিন আমার স্ত্রী-ই উঠে গিয়ে দরজা খোলে। কিন্তু যেহেতু এখন সেটা সম্ভব নয়, সেহেতু সকালে আমাকেই উঠতে হবে। সেজন্য একটু সজাগ ছিলাম।
সে রাতে ঘুমটা তেমন ভালো হল না। যত চেষ্টা করছি, ততই যেন ঘুমটা আমার চোখ থেকে সরে সরে যাচ্ছে। সে বীভৎস অনুভূতির কথা বলা অসম্ভব! কাউকে সে অবস্থা বোঝানো যাবে না! যে বিছানায় শুয়ে আছি, ঠিক তার নীচেই পড়ে আছে একটা মৃতদেহ! একটা শীতল, নিথর লাশ! যে লাশটা কখনও আমার জীবনসঙ্গিনী ছিল। এই শয্যাতেই ছড়িয়ে আছে তার অস্তিত্ব! বালিশে এখনও ফুলেল তেলের মিষ্টি গন্ধ! শোবার ঘরের আলনায় থরে থরে তার শাড়ি সাজানো! ড্রেসিং টেবিলে ওর অজস্র নাম না জানা ক্রিম, চুলের কাঁটা, চিরুনি সাজানো রয়েছে। চিরুনিতে কয়েকগাছি চুল এখনও লেগে আছে। সব কিছু যথাস্থানে মজুত, কিন্তু মানুষটাই নেই!
আলো নিভিয়ে এসি অন করে চোখ বুজে ঘুমোনোর চেষ্টা করছি। অথচ ঘুম আসছে না। প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমার ঠিক পাশেই কার যেন একটা অদ্ভুত নিঃশব্দ উপস্থিতি! কেউ যেন ঠিক আমার পাশটিতেই এসে শুয়েছে! কখনও মনে হল, সে আমাকে দেখছে। কখনও আবার মনে হয় একটা বরফ শীতল হাত আমায় ছুঁয়ে গেল। আমি ধড়মড় করে উঠে বসি। তাড়াতাড়ি খানিকটা সরে যাই! ভেতরে ভেতরে আবার কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম। একটা তীব্র অস্বস্তিও মনের মধ্যে কাজ করছিল। মেয়েটা হয়তো সব জেনে গিয়েছে। এবার সে কী করবে সেটাই চিন্তার বিষয়! ও কাল সকালে হয়তো পুলিশ নিয়ে এসে হাজির হবে! নয়তো…
এসব চিন্তা করতে করতেই ভোরের দিকে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল নেই। যখন ঘুম ভাঙল, ততক্ষণে আটটা বেজে গিয়েছে। ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই তাড়াতাড়ি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। কী সর্বনাশ! এত দেরি করে ফেলেছি! কল্যাণী নিশ্চয়ই বেল বাজিয়ে বাজিয়ে শেষপর্যন্ত বিরক্ত হয়ে চলে গিয়েছে। আজ আর বাড়িতে রান্নাবান্না কিছু হবে না। আমি নিজে রাঁধতেও জানি না যে হাত পুড়িয়ে রান্না করব। সকালে না উঠতে পারার জন্য নিজের ওপরই ভীষণ বিরক্তি হল! এবার ব্রেকফাস্ট থেকে শুরু করে ডিনার অবধি, সব বাইরে থেকে আনিয়ে খেতে হবে। এই বয়সে বাইরের খাবার খাওয়াও ঠিক নয়! তাছাড়া আমার কি এখন চিন্তার শেষ আছে? সকাল হওয়া মানেই কিছু লোকের মুখোমুখি হওয়া! এই মুহূর্তে যেটা কোনওমতেই ইপ্সিত নয়। তাছাড়া লাশটারও তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে তো ঘরে ফেলে রাখা যায় না। হয়তো কয়েক ঘণ্টা পরেই দুর্গন্ধ বেরোতে শুরু করবে। সেই গন্ধ চাপা দেব কী করে?
মনের মধ্যে চাপা বিরক্তি নিয়েই বিছানা ছেড়ে উঠলাম। কিন্তু পায়ের আঙুলগুলো মেঝে স্পর্শ করতেই আবার চমক! মেঝেটা কেমন ভেজা ভেজা লাগছে না? ঠিক যেন এই মুহূর্তেই কেউ মেঝেটা মুছে গিয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গেই নাকে এল ফিনাইলের চাপা গন্ধ! হ্যাঁ, কল্যাণী সপ্তাহে তিনবার ফিনাইল দিয়ে ঘর মোছে। মেঝের অবস্থা দেখে মনে হল, সদ্য-সদ্যই ও ঘর মুছে গিয়েছে!
কিন্তু সেটা কী করে সম্ভব! দরজা কে খুলে দিল! আমি স্তম্ভিত! মাথাটা যেন কাজই করছে না। তবে কি আমিই ঘুমের ঘোরে কোনওমতে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়েছি? অথচ সেরকম কিছুই তো মনে পড়ছে না! অগত্যা কৌতূহলী হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। বেডরুমের বাইরে পা রাখতেই শুনতে পাই কল্যাণীর চাঁছাছোলা কণ্ঠস্বর, “আজকাল সব কিছুরই দাম বাড়তিছে মা! মরদটাকে কতবার বলি, কিছু একটা কাম কাজ করো! তুমি বাবু হয়ে ঘরে বসে থাকবে, আর আমি পাঁচ বাড়ি কাজ করে ইন্তিবিত্তি করে সংসার চালাব, সেটা কেমন কথা বলো! তো সে বাবুর কি শোনার সময় আছে? তিনি শুধু হুকুম করবেন আর মদ গিলবেন! এই মরদ জাতটাই বড় বেইমান মা গো! খাওয়াও-থোয়াও-মাখাও, তবু মানবে নি কো…”
কিচেনের দরজার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে মেঝে মুছতে মুছতেই আপনমনে বকে যাচ্ছিল কল্যাণী! আমাকে দেখতে পেয়েই জিব কাটল। সম্ভবত ‘মরদ’ জাতটাকে গালাগালি দিয়ে ফেলেছে বলে! কিন্তু আমার বিস্ময় তখন ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে। কল্যাণীকে দরজাটা কে খুলে দিল! আর ও কথা বলছেই বা কার সঙ্গে! এ বাড়িতে ‘মা’ বলে ও একজনকেই ডাকে! অথচ… একটা গোটা প্রশ্নচিহ্নের পাহাড় আমার মাথায় ভেঙে পড়ল। মনে হল, কেউ আমার গলা চেপে ধরেছে। তবু কোনওমতে বললাম, “তুই একা একা কার সঙ্গে বকবক করছিস?”
কল্যাণী হেসে ফেলল। ওর কণ্ঠস্বর শুনলে সম্ভবত হাঁড়িচাচাও লজ্জা পাবে। কথা বললে মনে হয়, কেউ বুঝি জোরে জোরে কাঁসার থালা, বাটি বাজাচ্ছে! এবার মনে হল, কাঁসার থালাবাটিগুলো তিনতলা থেকে কেউ ফেলে দিয়েছে। হাসতে হাসতে বলল, “ও মা! একা একা কথা বলব কেন? মায়ের সঙ্গেই তো এট্টু সুখ-দুঃখির কথা বলতেছি! দেখতে পাচ্ছনি কো?”
মা! মানে আমার স্ত্রী! তার সঙ্গে ও সুখ দুঃখের গল্প করছে! অসম্ভব! হতেই পারে না। আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে! কালকে আমার মেয়ে, আজকে কল্যাণী! ওরা সবাই মিলে এসব কী অসম্ভব কথা বলে চলেছে! এখনও বেডরুমে খাটের তলায় লুকোনো আছে লাশটা। কাল রাতেই চেক করেছি! অথচ কল্যাণী নাকি ওর ‘মা’ এর সঙ্গে কথা বলছে! আমি ধমকে উঠলাম, “বাজে কথা বলিস না। কোথায় তোর মা? সে তো এখানে নেই!”
সে তার কাংস্য বিনিন্দিত কণ্ঠে উত্তর দিল, “তোমার চোখটা কি একেবারেই গেছে বাবা! জলজ্যান্ত মনিষ্যিটা সামনে ডেইড়ে আছে, কথা বলতিছে, হাসতেছে; আর তুমি কি না বলো সে এখানে নেই!”
আমি কী বলব কিছুই ভেবে পেলাম না! হঠাৎ বুকের মধ্যে একটা ভয়ংকর সন্দেহ তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। কল্যাণী আমার বেডরুমের মেঝেটা মুছতে গিয়ে লাশটা দেখে ফেলেনি তো? হয়তো ও দেখে ফেলেছে। সব জেনে গিয়েছে। তাই এই নাটক!
কিন্তু ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা যুক্তি দিয়ে চিন্তা করতেই বুঝলাম তা হতে পারে না। কল্যাণীর এত বুদ্ধি নেই। লাশ দেখলে ও হেসে হেসে নাটক করত না। ভিরমি খেত! চিৎকার করত! তাছাড়া তার চেয়েও বড় প্রশ্ন ওকে সকালবেলায় দরজাটা খুলে দিল কে?
আমি আর থাকতে না পেরে প্রশ্নটা করেই বসলাম, “সত্যি করে বল তো। তোকে সকালে দরজা কে খুলে দিল?”
কল্যাণী আমার প্রশ্ন শুনে হেসেই বাঁচে না, “কে আবার খুলে দেবে! যে রোজ খুলে দেয়, সে-ই খুলে দেছে। তুমিও না বাবা! তোমার সিতিভেম হয়েছে!” বলতে বলতেই ও কিচেনে ঠিক ফ্রিজের পাশে তাকাল, “মা, তুমি বাবাকে বাম্মিশাক খাওয়াও। আমিই কাল দিয়ে যাব খনে!” তারপরই শোনাল সাবধানবাণী, “আর হ্যাঁ, ওবেলা রান্নার জন্য এট্টুও তেল নেই। না সাদা তেল। না সষষের তেল! বাবাকে বলো, তেল না আনলে ওবেলা রান্না কত্তি পারব নাকো, এই বলে রাখলাম!”
আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে ফ্রিজের পাশটায় তাকালাম। একরাশ বরফশীতল হাওয়া আমার ওপর দিয়ে বয়ে গেল। যেদিকে তাকিয়ে ও কথা বলছে, সেদিকে কেউ নেই! অথচ ওর দৃষ্টি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক! তাতে কোনও অভিনয়ের ছাপ নেই। একদম সহজ, সরল। যেন সত্যিই কেউ ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। আর ও দিব্যি তার সঙ্গে গল্প করে চলেছে।
কল্যাণী যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ আমি দমবন্ধ করে ছিলাম। আমার সব গুলিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, হয় আমার মেয়ে এবং কল্যাণী, দু’জনেরই মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে, নয়তো আমি নিজেই অসুস্থ! কল্যাণী যেভাবে পুরো সময় আমার স্ত্রী’র সঙ্গে অনায়াস কথোপকথন চালিয়ে গেল, তাতে একসময় আমারই মনে হতে লাগল যে আমি নিজে যা জানি, সব ভুল! কাল রাতের ভয়ংকর ঘটনাটা আসলে ঘটেইনি! গোটাটাই আমার উত্তপ্ত মস্তিষ্কের বিভ্রম মাত্র। আমার স্ত্রী বেঁচে আছে। এবং সত্যি সত্যিই ও রেগে-মেগে কাল রাতে মেয়ের কাছে চলে গিয়েছিল। আজও কল্যাণীর সঙ্গে ও-ই গল্প করছে! খুনের গল্পটা নিছকই আমার মনের অসুস্থতা। একটা ভয়ংকর ভ্রান্তি!
.
ইন্সপেক্টর সিন্হা খুব মনোযোগ সহকারে ভদ্রলোকের বক্তব্য শুনছিলেন। এবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন তাঁর দিকে। মানুষটা হয়তো একটু দম নেওয়ার জন্য থামলেন। সিন্হা ধীরে সুস্থে সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিজে একটা স্টিক নিলেন এবং প্যাকেটটা এগিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ প্যাকেট থেকে সসংকোচে একটা সিগারেট বের করেছেন। সিন্হা নিজের লাইটার দিয়ে ধরিয়ে দিলেন তাঁর স্টিকটা। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, “আপনি ঠিক জানেন যে খুনটা সত্যিই হয়েছে? খুনের গল্পটা সত্যিই আপনার মানসিক অসুস্থতার ফল নয়?”
ভদ্রলোক সিগারেটটায় টান মেরে একমুখ ধোঁয়া ছাড়লেন। তাঁর হাতটা অল্প অল্প কাঁপছে। তিনি মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ অফিসার। খুনটা সত্যিই হয়েছে। আমার সে বিষয়ে যেটুকু সন্দেহ ছিল, সেটুকুরও নিরসন হল একটু পরেই।”
—“বেশ। তারপর?”
৫
কল্যাণী কাজকর্ম সেরে চলে যাওয়ার পরই আমি তাড়াতাড়ি দরজাটা বন্ধ করে দিই। চটপট সমস্ত দরজা জানলাও এঁটে দিলাম। কী জানি, যদি কেউ উঁকিঝুঁকি মারে! সাবধানের মার নেই। কাউকে জানাতে চাই না যে আমি ঘরে একটা লাশ নিয়ে বসে আছি! কিন্তু সত্যিই কি লাশ? কেমন যেন একটা বিভ্রান্তি মনের মধ্যে কাজ করছিল। কাল মেয়ের ফোন! আজ কল্যাণীর অদ্ভুত ব্যবহার! ওরা দুজনেই একসঙ্গে ভুল করতে পারে না। তবে কি ভুল আমারই? আসলে যা ভাবছি, তা নিতান্তই একটা দুঃস্বপ্ন! স্ত্রী’কে আদৌ খুন করিনি। সবটাই আমার কল্পনা মাত্র!
পরীক্ষা প্রয়োজন ছিল। তাই চুপচাপ নিজের বেডরুমে ফিরে এসে খাটের তলায় উঁকি দিয়ে দেখি। হ্যাঁ, কার্পেটটাকে যেমন গোল করে পাকিয়ে রেখেছিলাম, তেমনই আছে। প্রশ্ন হল, ওর মধ্যে কি লাশটাও আছে?
কাঁপা কাঁপা হাতে টেনে বের করলাম কার্পেটটাকে। মনে মনে চাইছিলাম, সব ভুল হোক। হয়তো দেখব ওর মধ্যে কিছুই নেই! স্রেফ কার্পেটটাই পাকানো আছে। ওর মধ্যে কোনও লাশ নেই! কোনও খুন হয়নি। সব ভুল… আমার মেয়ে, কল্যাণীর কথাই সঠিক। ওদের মা জীবিত আছে। সুস্থ আছে। হয়তো একটু পরেই এ ঘরে এসে ঢুকবে…
কার্পেটটা বের করে এনে আমি ধীরে ধীরে খুলতে লাগলাম। একটু একটু করে আবরণ সরাচ্ছি, আর বুকের মধ্যে ক্রমাগত আলোড়ন বেড়ে চলেছে। আছে, না নেই? সত্যি, না মিথ্যে? যদি সত্যিই ওর মধ্যে সেই ভয়ংকর লাশটা থাকে? কিন্তু তা থাকবে কী করে? যদি লাশটা থাকে তবে আমার মেয়ে আর কল্যাণী কার কথা বলছিল! আর ওরা যদি ঠিক বলে থাকে!
কার্পেটের আবরণ খসে পড়তেই আমার মাথায় যেন কেউ হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মারল! এই তো! টানটান হয়ে শুয়ে আছে আমার স্ত্রী’র মৃতদেহটা। একঝলক দুর্গন্ধও নাকে এসে ঝাপটা মেরে গেল! ফ্যাকাশে রক্তহীন মুখ, বরফশীতল কঠিন দেহ! দেহে পচন ধরার ইঙ্গিত এই দুর্গন্ধ! আমার মনে হচ্ছিল পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে! অথবা একটা ভূমিকম্প হচ্ছে! মেঝে কাঁপছে, দেওয়াল কাঁপছে! মাথার ওপরের ছাতটা বুঝি এখনই ভেঙে পড়বে। কোনও রিখটার স্কেলে সে কম্পন পরিমাপ করা সম্ভব নয়! প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতরে! যেন হৃৎপিণ্ডটাকে কেউ খামচে ধরে আছে! চোখের সামনে অন্ধকার করে আসছে… জল… একটু জল…! ওঃ!
বেডরুমের বেডসাইড টেবিলেই থাকে সরবিট্রেটের বড়ি। কী কষ্ট করে যে ওই অবধি পৌঁছেছিলাম তা শুধু আমিই জানি। কোনওমতে একটা সরবিট্রেট জিবের তলায় রেখে দিলাম। আস্তে আস্তে কিছুক্ষণ বাদে চেতনা ফিরে পাই। একটু সুস্থ বোধ হতেই ত্রস্ত হাতে লাশটাকে ফের যথাস্থানে চালান করে দিয়েছি! স্বাভাবিক হতে হবে। বাইরে যে করেই হোক, আমার স্বাভাবিক ব্যবহারটা বজায় রাখতে হবে। কেউ যেন ঘুণাক্ষরেও না বুঝতে পারে যে আমার মধ্যে কী চলছে! জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে আমি নিজেকে বোঝাতে লাগলাম, “যা হয়েছে ভুলে যাও। কিছু হয়নি তোমার। বরং বাইরে বেরোও খোলা হাওয়ায় শ্বাস নাও। সংসারের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখো। পরিচিতদের সঙ্গে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলো। দেখবে, অনেকটাই ভালো লাগবে।
এই বাড়ির, এই হত্যাপুরীর এই ভ্যাপসা পরিবেশ আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। লাশটা যেন আমার গলায় কয়েকমণি পাথরের বোঝা হয়ে ঝুলে আছে। এই লাশটা থেকে দূরে চলে যেতে চাইছিলাম। তাছাড়া কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও কিনে আনতে হবে। তেল না আনলে কল্যাণী রান্না করতে পারবে না বলে হুমকি দিয়েছে। ওদিকে সিগারেটও আনা জরুরি। ক্লান্ত মস্তিষ্ক একটু খোলা হাওয়া আর তামাকের ধোঁয়া চাইছিল। তাই অনতিবিলম্বেই দরজায় তালা ঝুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম।
রাস্তায় নামতেই আবার একটা অস্বস্তিবোধ! মনে হল, সবাই আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে! যেন ওরা সবাই সবকিছু জানে! ওরা জানে, আমি ঠিক কী করেছি! কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, সবটাই আমার মনের ভুল। অপরাধী মন স্বকৃত অপরাধের বোঝা বয়ে চলেছে। আমার সচেতন অপরাধবোধই মানুষের সহজ, সরল দৃষ্টিকে ভুল ভাবে দেখাচ্ছে। নিজের ভুলটা বুঝতে পেরেই মনটা অনেক হালকা হল। বাইরের তাজা ঠান্ডা হাওয়ায় বেশ চনমনে হয়ে উঠলাম। বুকের চাপ অনেকটাই কমে গিয়েছে। আমি এবার শান্ত ভঙ্গিতে শিস দিতে দিতে এগিয়ে গেলাম দোকানের দিকে।
আমার বাড়ির কাছের দোকানগুলোর দোকানিরা সবাই আমাকে চেনে। মাসের মাল যা কেনার তা এইসব দোকান থেকেই কিনে থাকি। বুড়ো মানুষ। তাই বেশিদূর যাওয়ার সামর্থ নেই। একমাত্র কাঁচা বাজারটা কিনতেই একটু দূরে যেতে হয়। তাছাড়া চাল, ডাল, সর্ষের তেল, টুথপেস্ট; মাসের সমস্ত জিনিসপত্র আমি কাছের মুদি দোকানটা থেকেই আনি। তার থেকে দু’পা দূরেই মেডিক্যাল স্টোর্স। ওখান থেকে সারা মাসের ওষুধ কিনি। আর তার ঠিক উলটোদিকেই বেশ বড় একটা পান-কোল্ডড্রিঙ্কস-সিগারেটের দোকান। ওই দোকানি তো আমার প্রায় সুখ-দুঃখের সঙ্গীই হয়ে উঠেছে। মাঝেমধ্যেই সিগারেটের প্যাকেট দিতে দিতে নীচু স্বরে জ্ঞান দিতে থাকে। বলে, “বাবু, এবার এই নেশাটা ছাড়েন। অনেক বয়স তো হল। আর কত বিষ খাবেন? আপনার না একবার বাইপাস হয়ে গিয়েছে? আর কারোও কথা না ভাবেন, গিন্নী মা’র কথা ভেবে দেখেন।”
আমি হেসে বলি, “আমি বিষ না খেলে তোর দোকান চলবে কী করে? আর গিন্নী মা যে জর্দা খায়? সে বেলা দোষ নেই?”
ও উত্তরে হেঁ হেঁ করে হাসে। কিন্তু ঠিক পরের বারই আবার জ্ঞান দিতে ভোলে না।
সেদিন সংসারের খুঁটিনাটি বাজার করতে করতে বুঝলাম, সবটাই আমার কল্পনা নয়। সত্যিই কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে। সমস্ত দোকানিই অদ্ভুত দৃষ্টিতে বারবার আমার পেছন দিকে তাকাচ্ছে। বোধহয় ওখানে কেউ দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাঝেমধ্যে এমনভাবে হাসছে বা মাথা নাড়ছে যেন কোনও অশ্ৰুত কথা বা ঠাট্টা-তামাশা বুঝি ওদের কানে গিয়েছে। তার জবাবেই মৃদু হাসি, বা আলতো মাথা ঝাঁকানি।
আমার অস্বস্তি ক্রমাগতই বাড়ছিল। ওদের ওই চাউনি বরদাস্ত করতে পারছিলাম না। অসহ্য ঠেকছিল! সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। অনেক প্রয়োজনীয় জিনিসই মাথা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলস্বরূপ মুদি দোকানে গিয়ে আমি সব কিছু বললেও যথারীতি তেলের কথা বলতে একদম ভুলে গিয়েছিলাম। মনে পড়ল মেডিক্যালস্টোরে গিয়ে! কোনওমতে ওষুধগুলো কিনেই ফের হুড়মুড় করে দৌড়োলাম মুদির দোকানের দিকে। সে তখন আরেক কাস্টমারকে ডাল মেপে দিতে ব্যস্ত। তাড়াতাড়ি বললাম, “ভাই, দু’প্যাকেট সয়াবিন অয়েল আর দু প্যাকেট সর্ষের তেল।” একটু অপ্রস্তুত হেসে যোগ করলাম, “আগে বলতে একদম ভুলে গিয়েছি।”
মুদি আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকায়। বিস্মিত গলায় বলে, “আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন দাদু? দিদা তো একটু আগেই চার প্যাকেট তেল নিয়ে গেল!”
এবার মনে হল গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ড কাঁপছে! এরা সবাই কি আমায় নিয়ে রসিকতা করছে! ওরা সবাই কি সব জেনে গিয়েছে? যেমন করে মাকড়সা একটু একটু করে জাল বিস্তার করে শিকার ধরে, ওরাও তাই করছে না তো! না না! এতগুলো লোক কীকরে একসঙ্গে সব জানবে। তবে কি ওরাও আমার মেয়ে আর কল্যাণীর মতো কিছু একটা ভুল করছে? কিন্তু তা কী করে হয়! আমার মেয়ে, কল্যাণী আর এই মুদি— তিন জনেই সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ কেউ কাউকে চেনে না। তবে?
আমার পা দুটো কাঁপছিল। এক পাও এগোতে পারছিলাম না। তবু আস্তে আস্তে এগোলাম। এখনই একটু সিগারেট খাওয়া দরকার। দরকার পড়লে একটা কোল্ডড্রিঙ্কও খাব। গলাটা শুকিয়ে কাঠ! ডাক্তার কোলড্রিঙ্কস খেতে বারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু নিকুচি করেছে ডাক্তারের!
কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে রাস্তাটা পার হলাম। যদিও মনে হচ্ছিল, এই মুহূর্তেই বুঝি পড়ে যাব। হাঁটার শক্তি আর নেই আমার। মাথার ভেতরে অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তা কাজ করছে। ঘটনাটা ঠিক কী ঘটছে আমার সঙ্গে? এ কি অতিপ্রাকৃতিক কোনও ঘটনা? নাকি সম্পূর্ণ মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ! কাল রাতে আমি আমার স্ত্রী’কে খুন করেছি! অথচ এখনও পর্যন্ত একটি লোককেও ওর অনুপস্থিতির কারণ বলতে হয়নি আমাকে! কেউ একবারও জানতে চায়নি, ঘরে যে আরেকটা মানুষ ছিল, সে গেল কোথায়? যে প্রশ্নটার মুখোমুখি হতে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত ছিলাম, সেই প্রশ্নটাই কেউ করেনি! কিন্তু তার জন্য আমি একটুও শান্তি পাচ্ছিলাম না। বরং এখন মনে হল, ওই প্রশ্নটাই সবাই করলে বোধহয় ভালো হত। যে মানুষটার অনুপস্থিত থাকার কথা, তার অনাকাঙ্ক্ষিত উপস্থিতি আমায় আরও অনেকগুণ বেশি ভয়ার্ত করে তুলছিল! আমি ভয় পাচ্ছিলাম! ভীষণ ভয়…!
কোনওমতে ক্লান্ত দেহটাকে টেনে আস্তে আস্তে পান সিগারেটের দোকানের দিকে যাই। আমার সেই চিরপরিচিত শুভাকাঙ্ক্ষী দোকানি তখন নিজের দোকানে বসে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে পান সাজছে। ওর চোখে চোখ রাখতে পারি না। বুকের ভিতরটা ঢিবঢিব করছে। বেশি কথা বলতে চাই না! কী জানি, এ ও আবার কী বলে বসবে!
—“একটা কোল্ড ড্রিঙ্ক দে তো।”
ও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকায়। এতগুলো বছরে কোনওদিন ওর দোকান থেকে কোল্ডড্রিঙ্কস কিনে খাইনি। এইসব ঠান্ডা পানীয় আমি কখনই খুব একটা পছন্দ করি না। আগে যদিও বা কালেভদ্রে একটা-দুটো খেতাম, হৃদযন্ত্রের সমস্যা ধরা পড়ার পর সেটুকুও বাদ দিয়েছি। কিন্তু এই মুহূর্তে কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়াটা খুব দরকার। আকণ্ঠ কাঠের মতো শুকিয়ে গিয়েছে! মনে হচ্ছে, কয়েক যুগ ধরে আমি একফোঁটা জলও খাইনি।
দোকানি একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকেই জানতে চাইল, “কী কোল্ডড্রিঙ্ক দেব বাবু?”
—“দে যে কোনও একটা।”
সে আমার দিকে কিছুক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকল। তারপর ফ্রিজ থেকে একটা সাদা রঙের ঠান্ডা পানীয়ের বোতল বের করে আনল। এই পরিস্থিতির মধ্যেও দেখে খুশি হলাম যে সে আমার স্বাস্থ্যের খেয়াল রেখেছে। ডাক্তার আমায় কালো রঙের কোল্ডড্রিঙ্কস খেতেই বারণ করেছেন বটে। কোনও কথা না বাড়িয়ে চটপট ঝাঁঝালো তরল খানিকটা গলায় ঢেলে দিলাম। ঢকঢক করে বেশ খানিকটা কোল্ডড্রিঙ্ক খাওয়ার পর মনে হল, একটু চাঙ্গা হয়েছি। আস্তে আস্তে নিজেকে ফিরে পাচ্ছি।
দোকানি ততক্ষণে আমার ব্র্যান্ডের সিগারেটের প্যাকেট সামনে এনে রেখেছে। আমি সিগারেট আর কোল্ডড্রিঙ্কের দাম মিটিয়ে দিই। হঠাৎ সে নীচু গলায় বলল, “বাবু, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?”
আমি তখন অনেকটাই সুস্থ বোধ করছি। ধাতস্থ হয়ে জানতে চাইলাম,
—“কী?”
—“গিন্নী মা’র সঙ্গে কি আপনার কিছু হয়েছে?”
চমকে উঠলাম। প্রশ্নটার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ ও এমন প্রশ্ন করল কেন? তবে কি সত্যিই সবাই ঘটনাটার কথা জেনে গিয়েছে! ওরা কি সব জানে?
টের পাচ্ছিলাম হাত-পায়ের কম্পনটা আবার ফিরে আসছে। কোনওমতে বলি, “কেন?”
—“না। রোজ তো আপনারা একসঙ্গেই আসেন। দিব্যি পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটেন। কিন্তু আজ…”
বলতে বলতেই ও থামল। আমি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করি, “আজ কী?”
—“আজ শুরু থেকেই লক্ষ্য করছি, আপনি যেখানেই যাচ্ছেন, মা জননী আপনার কয়েক হাত পেছন থেকে উঁকি মারছেন! আপনি আগে আগে! আর উনি পিছন পিছন! এখনও…”
ওর কথা শেষ হল না! তার আগেই বিদ্যুৎবেগে আমি পিছনে ফিরেছি। পিছনে কেউ নেই। ওখানে শুধু একরাশ শূন্যতা আমায় ব্যঙ্গ করে গেল! আর কিছু নেই… আর কিছু না!
আর অগ্র-পশ্চাত কিছুই চিন্তা না করে দৌড়তে শুরু করলাম! বয়েস হয়েছে। পা দুটো কাঁপছে। শরীরটা কেমন একটা করছে। পিছন থেকে ভেসে এল দোকানির চিৎকার, “ও বাবু, আপনার সিগারেট যে পড়ে রইল!”
পড়ে থাক! সারা বিশ্ব পড়ে থাক। আমি শুধু এইটুকু জানি, আমাকে পালাতে হবে। যে করেই হোক, সবার চোখের আড়ালে চলে যেতে হবে! যে পাপ আমার পিছু ধাওয়া করছে, তার আওতা থেকে দূরে চলে যেতে হবে… যেতেই হবে।”
বৃদ্ধ এবার বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন! এতক্ষণ তাঁর কণ্ঠস্বরে শুধু চূড়ান্ত ভয় ফুটে উঠেছিল। এখন কান্নাবিকৃত স্বরে দুই হাতজোড় করে বলেন, “আর কোনও উপায় নেই। ও আমাকে ছাড়বে না। একমাত্র জেলের কুঠুরিটাই আমার কাছে নিরাপদ! আমি খুনী। স্বীকার করছি আমি আমার স্ত্রী’কে খুন করেছি… আমায় গ্রেফতার করুন… গ্রেফতার করুন…!”
ইন্সপেক্টর তাঁর দিকে অপলকে তাকিয়েছিলেন। গল্পটা যথারীতি ওঁর বিশ্বাস হয়নি। তা সত্ত্বেও ভদ্রলোক যখন বলেছেন খুন হয়েছে, তখন তদন্ত করতেই হবে। তিনি আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলেন, “লাশটা কি এখনও আপনার বাড়িতেই আছে?”
বৃদ্ধ অশ্রুভেজা মুখ তুলে তাকালেন, “হ্যাঁ। বাড়িতেই আছে।”
—“আপনার বাড়ি কোথায়? ঠিকানা?”
৬
—“আপনার কী মনে হয় স্যার?” গাড়ির পিছনের সিট থেকে রতন ফিসফিসিয়ে ইন্সপেক্টর সিন্হাকে বলে, “আদৌ কি ওঁর বাড়িতে কোনও লাশ পাওয়া যাবে?”
ইন্সপেক্টর সিগারেটটায় শেষ সুখটান মেরে আড়চোখে পাশে বসে-থাকা বৃদ্ধের দিকে তাকালেন। তাঁর মন সম্ভবত এদিকে নেই। তিনি জানলার কাচের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবছেন। সিন্হা নীচু স্বরে বললেন, “দেখা যাক।”
—“কিন্তু দাদু যে স্রেফ একটা ভূতের গল্প বললেন!” রতন ফের ফিসফিসায়, “গপ্পোটা আপনার একটুও বিশ্বাস হয়েছে?”
—“বিন্দুমাত্রও হয়নি।” তিনি আগের মতোই চাপা কণ্ঠে বললেন, “উনি যা বলছেন, তা সম্ভব নয়। কিন্তু একটা কথা বারবার জোর দিয়ে বলছেন। খুন একটা হয়েছে। ওঁর এই উদ্ভট গল্পের পেছনে নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। কী কারণ সেটাই আমাদের খুঁজে বের করতে হবে।”
—“আপনার বুড়োটাকে পাগল মনে হয়নি?”
কোনও উত্তর না দিয়ে এবার তিনি কটমট করে তাকালেন। রতন চুপ করে গেল। ইন্সপেক্টরের নিজেরও ভদ্রলোককে একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু উন্মাদ মনে হয়নি। অথচ উনি এরকম আজগুবি গল্প তৈরি করলেন কেন তা বুঝে উঠতে পারছেন না। ইন্সপেক্টর নিজে যদি খুন করে বসতেন, তবে এর থেকে অনেকগুণ ভালো ও বিশ্বাসযোগ্য গল্প তৈরি করতেন। কিন্তু এ বৃদ্ধ মানুষটি যা বলছেন, তা একেবারেই অবিশ্বাস্য!
—“ওই যে!” ভদ্রলোক এতক্ষণ চুপ করে বসেছিলেন। এবার সামনের একটি অট্টালিকার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন, “ওটাই আমার বাড়ি।”
গাড়িটা এতক্ষণে শহরতলী থেকে একটু দূরে এসে পড়েছিল। এদিকে ঘন জনবসতি নেই। বরং অনেকখানি দূরে দূরে দু-একটা বাংলো প্যাটার্ণের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত যারা নিরিবিলিতে বাস করতে চান, তারাই এখানে ঘর বেঁধেছেন। ঘড়িতে রাত দশটা বেজে গিয়েছে। তাই দোকান-পাটও সব বন্ধ। রাস্তাঘাট জনবিহীন। বোঝাই যায়, এ জায়গার মানুষজন এখনও ‘নাইটলাইফ’ নামক বস্তুটিতে বিশ্বাসী নন। একটু আগের তুমুল বৃষ্টিতে পিচের পথঘাট ধুয়ে চকচকে হয়ে গিয়েছে। তবে এখন আর তেমন বৃষ্টি নেই। বৃষ্টির তোড় কমে গিয়ে দু-এক ফোঁটা টিপটিপ করে পড়ছে। গাড়ির ওয়াইপার বিন্দু বিন্দু স্ফটিকের গুঁড়োর মতো বৃষ্টির ফোঁটাকে মুছে ফেলছে সামনে থেকে
তার মধ্যেই স্পষ্ট দেখা গেল বাড়িটাকে। দোতলা সাদা রঙের বিরাট বাড়ি। একটু পুরোনো আমলের গড়ন হলেও খুব সযত্নরক্ষিত। সামনে একটা মস্ত লোহার গেট। গেটের দু’পাশে পাথরের স্তম্ভে সিংহের মুখ খোদাই করা। আইভি লতার ঝাড় গেটের ওপরের দিকে বেয়ে উঠে চমৎকার একটা ইংরেজি ‘ইউ’ অক্ষরের মতন তোরণ সৃষ্টি করেছে।
পুলিশের গাড়িটা ঠিক লোহার গেটটার সামনেই থামল। ইন্সপেক্টর স্মার্ট ভঙ্গিতে নেমে এলেন গাড়ি থেকে। সাব-ইন্সপেক্টর, রতন ও বৃদ্ধ ভদ্রলোকও নামলেন তাঁর পিছু পিছু।
গেট খুলতেই সামনে মোরামের রাস্তা। বৃষ্টিতে রাস্তাটাও ধুয়ে গিয়েছে। তার ওপর দিয়ে কয়েক জোড়া পুলিশি বুট খটখট করে এগিয়ে গেল বাড়ির মূল দরজার দিকে! হাঁটতে হাঁটতেই একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হল ইন্সপেক্টর সিন্হার। যতক্ষণ গেটের বাইরে ছিলেন ততক্ষণ বৃষ্টিভেজা হাওয়াটা তাজা ছিল। কিন্তু গেটের ভেতরে ঢুকতেই মনে হল বদ্ধ হাওয়ার মধ্যে এসে পড়েছেন! এ হাওয়া হিমশীতল, কিন্তু আর্দ্র নয়! যেন বহুবছর ধরে একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে! এ হাওয়ায় কোনও চাঞ্চল্য নেই।
—“ও কী!” বাড়ির দিকে এগোতে এগোতেই ভদ্রলোক থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর কয়েক কদম পিছিয়ে ভয়ার্ত স্বরে বললেন, “বাড়িতে আলো জ্বলছে কেন?”
—“কেন? আপনি লক্ষ্য করেননি? আমরা যখন আসছিলাম তখন রাস্তাতেই তো কারেন্ট এসে গিয়েছিল।”
— ‘সে জানি!” ওঁর কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট আতঙ্ক, “কিন্তু আমার বাড়িতে কেন আলো জ্বলবে! আমি যে সেই সকালে বেরিয়েছিলাম, আর তো এ মুখো হইনি। আমার পরিষ্কার মনে আছে, তখন ফ্যান, এসির সমস্ত সুইচ অফ করে বেরিয়েছিলাম। লাইটের সুইচ অন করার তো প্রশ্নই ওঠে না। দরজায় তালাও দিয়েছিলাম! এই দেখুন তার চাবি। তবে এখন ভেতরে আলো কে জ্বালল!”
ইন্সপেক্টরও এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে পড়লেন। সত্যিই তো! বাড়ির ভেতরে দিব্যি আলো জ্বলছে। ভদ্রলোকের বয়ান অনুযায়ী তিনি সকালে তালাচাবি দিয়ে সেই যে বেরিয়ে গিয়েছিলেন, ভয়ের চোটে আর বাড়িই ফেরেননি! তবে সন্ধেবেলায় বাড়ির সমস্ত আলোগুলো জ্বেলে দিল কে! কাজের মেয়ে! কিন্তু সে-ই বা তালাবন্ধ বাড়িতে ঢুকবে কী করে!
তাঁর কপালে ভাঁজ পড়ল। কিন্তু তিনি সেই চিন্তাটাকে বেশি আমল দিলেন না। কে আলো জ্বেলেছে, কী বৃত্তান্ত এখনই বোঝা যাবে। সিন্হা দৃঢ়পায়ে এগিয়ে গেলেন বাড়ির দিকে।
—“এ কী দাদু!” হেড কনস্টেবল রতনের বিস্মিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল,
—“আপনি পিছনে কোথায় লুকোচ্ছেন?”
বৃদ্ধ ততক্ষণে কাঁপতে কাঁপতে রতনের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন, “আমার … আমার ভয় করছে! আপনারা এগোন। আমি আপনার পিছন পিছন আসছি।”
রতন মুখভঙ্গী করে। যতসব পাগল ছাগল লোক নিয়ে কারবার! এতক্ষণ বসে বসে কীসের গল্প শোনাল কে জানে! গল্পটা খুনের না ভূতের তা বুঝে উঠতে পারেনি সে! এইসব লোককে জেলে নয়, মানসিক হাসপাতালে রাখা উচিত। সিন্হা স্যার খামোখাই ওর পাল্লায় পড়ে পন্ডশ্রম করছেন। তার ওপর এখন আবার পেছনে গিয়ে লুকিয়েছে! বদ্ধ পাগল!
ইনস্পেক্টর সিন্হা এবার বাড়ির মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। দরজাটার ওপরে চোখ বুলিয়েই তিনি অবাক গলায় বললেন, “আশ্চর্য! দরজায় তো কোনওরকম তালা নেই! এটা ভেতর থেকে বন্ধ! ভেতরে কেউ আছে!”
বৃদ্ধ মানুষটি তখন রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছেন। কোনওমতে প্রায় দমবন্ধ গলায় বললেন, “ভেতরে কেউ কীকরে থাকবে? আমি তো তালা দিয়ে গিয়েছিলাম!”
সিন্হা এবার কোমরে হাত দিয়ে তাঁর দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, “এটা আপনারই বাড়ি তো? আপনি শিওর যে খুনের মামলায় ফাঁসবার ভয়ে আমাদের মিসগাইড করার জন্য ভুল বাড়িতে নিয়ে আসেননি!”
—“অফিসার,” তিনি কান্নাজড়ানো গলায় জানান, “তেমন উদ্দেশ্য থাকলে আমি নিজের অপরাধ কবুল করব কেন? আমি তো খুনের কথা নিজের মুখে স্বীকার করেই নিয়েছি। স্বীকারোক্তি দিয়েছি। আমার বিরুদ্ধে প্রমাণও দিয়েছি। এমনকি মার্ডার ওয়েপ্নটাও দিতে ভুলিনি। তবে কেন?”
—“হুঁ”। সিন্হা একটু চুপ করে থেকে জানতে চান, “আপনার বাড়ির চাবি আর কারোর কাছে থাকে? আপনার ছেলে, কিংবা মেয়ে?”
—“হ্যাঁ… হ্যাঁ।” ভদ্রলোকের চোখে এবার যেন খানিকটা আশার আলো ফুটল, “ওদের দু’জনের কাছেই এক সেট করে এ বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবি আছে। হয়তো ওদের মধ্যেই কেউ এসেছে। আলোগুলোও তাই জ্বলছে। আমি এদিকটা ভেবেই দেখিনি! মিছিমিছিই ভয় পাচ্ছিলাম।”
—“ও.কে.”। ইন্সপেক্টর ঘুরে দাঁড়িয়ে কলিং বেল বাজালেন। ভিতরে বেলের সুরেলা সুর স্পষ্ট শোনা গেল। কিন্তু তখনই দরজা খুলল না। ভিতর থেকে কোনও মানুষের উত্তরও ভেসে এল না। তিনি উৎকর্ণ হয়ে ছিলেন। যদি কোনও পায়ের আওয়াজ শোনা যায়। কিন্তু তাও নেই! আশ্চর্য! স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে ভেতরে লোক আছে! তবু কোনও সাড়া নেই কেন? সিন্হা অধৈর্য হয়ে আরও কয়েকবার বেল টিপলেন।
এবার কাজ হল। ইন্সপেক্টর শুনতে পেলেন একটা পায়ের আওয়াজ খুব আস্তে আস্তে এদিকেই আসছে। একটা হালকা কাশির শব্দও শোনা গেল। কয়েক মুহূর্তের অপেক্ষা! তারপরই খুট করে একটা শব্দ। কেউ দরজা খুলেছে! দরজার পাল্লাটা এবার ধীরে ধীরে খুলে গেল। দরজার ওপ্রান্তে ভেসে উঠল একটা অবয়ব। যিনি দরজা খুললেন তাঁকে দেখেই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো আচমকা কয়েক কদম পিছিয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর সিন্হা। মনে হল, তাঁর মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়েছে! এ কে! সামনে কে দাঁড়িয়ে আছে! এঁকেই তো কিছুক্ষণ আগে দেখেছেন তিনি। বৃদ্ধের দেওয়া ছবিতে ইনিই তো ভদ্রলোকের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ইন্সপেক্টর ঘোর অবিশ্বাসে, প্রচণ্ড সংশয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখছেন। নাঃ, কোনও সন্দেহ নেই! ইনিই তিনি! পরনে সেই আটপৌরে শাড়ি! সেই ফরসা টুকটুকে গোলগাল মুখ! সেই দুধসাদা চুল! দুই গালে হাল্কা রক্তাভ আভা! থুতনিতেও সেই আঁচিলটা স্পষ্ট! কোনও সন্দেহ নেই, ইনিই ভদ্রলোকের স্ত্রী। সেই স্ত্রী, যাঁর খুনের গল্প একটু আগেই শুনেছেন! যাঁর লাশটা খুঁজতেই এ বাড়িতে আসা! সেই ভদ্রমহিলাই এখন তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে! জলজ্যান্ত!
বৃদ্ধা কিন্তু পুলিশ দেখে একটুও ঘাবড়ালেন না। বরং দরজার সামনে থেকে সরে গিয়ে বললেন, “আসুন। আপনাদের অপেক্ষাই করছিলাম। তবে আপনারা এত তাড়াতাড়ি চলে আসবেন, ভাবিনি। জাস্ট পাঁচ মিনিট আগেই থানায় ফোন করেছিলাম।” তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যোগ করলেন,
—“লাশটা ওইখানে আছে।”
তিনি আঙুল দিয়ে সামনের দিকে নির্দেশ করলেন! ইন্সপেক্টর এবং তাঁর সঙ্গীরাও বিস্ময়াভিভূত! ইনি তবে খুন হন্নি! তবে কোন্ লাশের কথা বলছেন ভদ্রমহিলা! ওদের কারোর মুখে কথা ফুটছে না! সবাই কেমন কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে!
ওদের মধ্যে সিন্হাই প্রথম সম্বিত ফিরে পেলেন। এখন তাঁরও কেমন যেন সব অলীক বলে মনে হচ্ছে। তবু এক-পা এক-পা করে এগিয়ে গেলেন বৃদ্ধার দিকনির্দেশ লক্ষ্য করে। এবং কয়েক পা এগোতেই দেখতে পেলেন লাশটা!
হ্যাঁ! লাশই বটে! ইন্সপেক্টরের অভ্যস্ত চোখ বলে দিল, প্রায় চব্বিশ ঘন্টা আগেই মৃত্যুটা হয়েছে। লাশের বুকে আমূল একটা ছুরি বসানো! ওটাই মার্ডার ওয়ে! বেশ খানিকটা রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে আছে মেঝের ওপর! পুলিশি জীবনে বহুবার লাশ দেখেছেন ইন্সপেক্টর সিন্হা। এর থেকেও অনেক বেশি বীভৎস লাশ দেখেও তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া হয়নি। সেই তুলনায় এই মৃতদেহ কিছুই না! কিন্তু এই মরদেহটি দেখেই তাঁর মুখ থেকে একটা অদ্ভুত চিৎকার বেরিয়ে এল!
—“হ্যাঁ। আমিই আমার স্বামীকে খুন করেছি!” বৃদ্ধা স্বগতোক্তির মতো আপনমনে বিড়বিড় করলেন, “ওঁকে খুন করতে চাইনি। কিন্তু বাধ্য হয়েই…. স্কিজোফ্রেনিয়া ছিল ওঁর! উলটোপালটা দৃশ্য দেখতেন। ভুলভাল আওয়াজ শুনতেন। মাঝেমধ্যেই চিৎকার করে বলতেন, আমি নাকি ওঁকে খুন করতে চাই। একদিন আগে পরিস্থিতি চরমে ওঠে। এমনিতে ঝগড়াঝাটি আমাদের মধ্যে হয়ই। কিন্তু সেদিন উনি ওঁর লাঠিটা নিয়ে আমার ওপর আক্রমণ করেন! আমাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। কিন্তু কিছুতেই ওঁকে থামাতে পারছিলাম না। উনি আমার মাথায় লাঠিটা দিয়ে বাড়ি মেরেছিলেন। আরও কয়েকটা বাড়ি মারতেন! তার আগেই এই ছুরিটা ওঁর বুকে বসিয়ে দিলাম।
ইন্সপেক্টর বিহ্বলের মতন দেখলেন মেঝেতে পড়ে আছেন সেই ভদ্রলোক! নাঃ, কোনও ভুল নেই! তিনিই বটে! পরনে সেই সিল্কের পাঞ্জাবি। দুধসাদা চুল তখনও পরিপাটি করে আঁচড়ানো! হাতে সেই রূপো বাঁধানো লাঠিটা ধরা। তিনি বিদ্যুৎগতিতে পিছন ফিরে রতনের দিকে তাকালেন। একটু আগেও বৃদ্ধের ছায়া ছায়া অবয়ব রতনের পিছনে দাঁড়িয়েছিল। বয়স্ক মানুষটা ভয় পাচ্ছিলেন! কিন্তু এখন সেখানে কেউ নেই!
সিন্হা কী বলবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না! আচমকা তাঁর চোখ পড়ল একদম সরাসরি দাঁড় করানো বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নার দিকে। সেদিকে তাকাতেই ভয়ার্ত আর্তনাদ করে লাফিয়ে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন সিন্হা! তাঁর মুখের সব রক্ত যেন শুকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে! অজান্তেই বুঝি দেখে ফেলেছেন মূর্তিমান কোনও বিভীষিকা! তারপর কাউকে কিছু না বলেই উন্মাদের মতো পিছন ফিরে দৌড় মারলেন। পিছন থেকে রতনের চিৎকার ভেসে এল, “স্যার! স্যা-র! কোথায় যা-চ্ছে-ন!”
কিন্তু তিনি থামলেন না। কিছুতেই থামবেন না ইন্সপেক্টর! এ বাড়িতে আর নয়… আর এক মুহূর্তও থাকা চলবে না এখানে! এখনই পালাতে হবে… পালাতেই হবে!
বেলজিয়াম গ্লাসের আয়নায় তখন তাঁদের সবার প্রতিফলন পড়েছিল। তখনও সাব-ইন্সপেক্টর এবং রতনের বিহ্বল, উদভ্রান্ত প্রতিবিম্ব জ্বলজ্বল করছিল সেই আয়নায়। হিসেবমতন এই বৃদ্ধারও প্রতিবিম্ব সেই আয়নায় পড়ার কথা।
অথচ…!
হ্যালুসিনেশন
হ্যালুসিনেশন
—“ডক্টর… আমি কি বেঁচে আছি?”
প্রশ্নটা শুনে ডাক্তারবাবুর ভুরুতে সামান্য ভাঁজ পড়ল।
মাথার উপরে একটা টিমটিমে আলো জ্বলছে। তাতে সামনের মানুষটাকে স্পষ্ট দেখতে না পেলেও তার অস্পষ্ট ছায়া ছায়া অবয়ব বোঝা যাচ্ছিল। নাকের উপর ভারি চশমার কাচ ওই আধা আলো আধা অন্ধকারেই চকচক করে উঠছে। মুখের চাপদাড়ির জঙ্গল বুঝতেও অসুবিধা হচ্ছিল না।
মনস্বত্ববিদের ঘর যেমন হয়, এ ঘরটাও তেমনই। আলোর চেয়ে অন্ধকারই বেশি। ডাক্তারবাবু টেবিলের ও প্রান্তে বসে আছেন, আর রোগি এ প্রান্তে। কাউকেই বিশেষ স্পষ্ট দেখার উপায় নেই। শুধু দেওয়ালে দুটো ক্ষীণ ছায়া মাঝে মাঝে নড়েচড়ে উঠছে।
ডক্টর সিন্হা প্রশ্নটায় বেশ কৌতুকবোধ করলেন। আস্ত একটা জলজ্যান্ত লোক জিজ্ঞাসা করছে যে সে বেঁচে আছে কি না!
—“এমন মনে হচ্ছে কেন আপনার?”
লোকটা যেন একটু ইতস্তত করল। একটু উশখুশ করে উঠে বলল, “একটা সিগ্রেট খেতে পারি?”
এখানে ধূমপান মানা হলেও লোকটার অবস্থা দেখে ডাক্তারবাবুর দয়া হয়। অসম্ভব ভয়ে সে জড়োসড়ো! গলার স্বর কাঁপছে! একটু যেন ফ্যাসফ্যাসেও!
—“নিশ্চয়ই,”
সে কাঁপা কাঁপা হাতে সিগ্রেট ধরাল। হাত দুটোও থরথর করে কাঁপছে লাইটার জ্বালাতেই ডাক্তারবাবু তার চোখ দুটো একঝলক দেখতে পেলেন। কালো কুচকুচে চোখ। যেন অন্ধকার জমে আছে চোখে! একবারের জন্য যেন মনে হল, লোকটার চোখের মণিটা নেই!
মুহূর্তের জন্য হলেও চমকে উঠেছেন তিনি। পরমুহূর্তেই সামলে নিয়েছেন। নাঃ, হয়তো লাইটারের সামান্য আলোয় তার চোখের ভুল হয়েছে। একটা স্বাভাবিক মানুষের চোখ এমন হতেই পারে না।
একেই বলে ইল্যুশন!
লোকটা সিগ্রেটে উত্তেজিত কয়েকটা টান মেরে যেন একটু শান্ত হয়। বলে,
—“ডক্টর, আপনি একটু দেওয়ালের দিকে তাকাবেন প্লিজ?”
এমন উদ্ভট আবদারে তিনি অবাক ও বিরক্ত দুই-ই হলেন। কিন্তু মনস্ত্বত্ববিদের চটে যাওয়ার উপায় নেই।
—“কেন?”
সে ফিসফিস করে বলে, “দেখুন তো দেওয়ালে ক-টা ছায়া দেখা যাচ্ছে?”
—“আপনি নিজেই তো দেখে নিতে পারেন…”
—“আমার ভয় করছে,” অসম্ভব ভীত, সন্ত্রস্ত গলা তার, “বলুন না। ক-টা দেখা যাচ্ছে?”
তিনি আরও অবাক, “সে কী! ক-টা আবার দেখা যাবে! দু’জন আছি, তা-ই দুটোই দেখা যাচ্ছে!”
—“তিনটে নয় তো?”
—“তিনটে! তিনটে কেন থাকবে?”
লোকটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, “থ্যাঙ্কস। তাহলে তিনটে নেই…”
এবার বোধহয় ডক্টর সিন্হা ভদ্রলোকের বিষয়ে কৌতূহল বোধ করলেন। লোকটার হাবভাব কেমন যেন উদ্ভট! ত্রিশ বছরের কেরিয়ারে অনেক উদ্ভট রোগির দেখা তিনি পেয়েছেন। কিন্তু এমন রোগি দেখেননি। ওকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার সময় দিলেন। তারপর আলতো গলা খাঁকারি দিয়ে বলেন,
—“কী হয়েছে আপনার? কী সমস্যা?”
— “বলব,” সে আস্তে আস্তে বলে, “বলব বলেই তো এসেছি। কিন্তু সমস্যাটা অন্য জায়গায়।”
—“কোথায়?”
লোকটা এবার অদ্ভুতভাবে তাকায় তার দিকে। ডাক্তারবাবুর মনে হল লোকটার চোখ যেন হঠাৎ জ্বলে উঠল,
—“আপনি আমার কথা বিশ্বাস করবেন তো?”
—“কেন করব না?”
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “তবে শুনুন, আমার নাম তপন মিশ্র। আমিও একজন ডাক্তার! সার্জেন। হেলথ কেয়ার নার্সিংহোমটা আমারই…।”
ড. তপন মিশ্রের কথা :
—“সেদিন রাত্রে খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। বাইরে ঝড়ের দাপাদাপি! মাঝে মাঝেই প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ছে! এমন সময় হঠাৎ লোডশেডিং!
আমি বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিলাম। ঘুম আসেনি। পাশেই আমার স্ত্রী ও একমাত্র ছেলে ঘুমিয়ে কাদা। কিন্তু আমি ঘুমোতে পারছি না। কী যেন অস্বস্তি কাজ করছিল মনের মধ্যে। আমার বেডরুমের জানলার কাচে মাঝেমধ্যেই বিদ্যুতের নীল আলো ঝলসে ঝলসে উঠছে। বাইরে যেন একটা নীল কুয়াশা কখন আস্তে আস্তে এসে জমাট বাঁধছিল। বৃষ্টির জলটাকেও যেন নীল মনে হয়।
ঘরে একটা মোমবাতি জ্বলছিল। তখন সেটার ও প্রায় ফুরিয়ে আসার সময় হয়েছে। নীল শিখাটা ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই একটু একটু করে ক্ষীণ রশ্মিটুকুও মুছে যাচ্ছিল।
মোমবাতিটা যখন প্রায় নিবতেই চলেছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই, একদম স্তিমিত আলোয় হঠাৎ মনে হল কেউ যেন আমার ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে!
অসম্ভব! কাউকেই তো দেখতে পাচ্ছি না! চোখের সামনে কেউ নেই! অথচ দেওয়ালে ওটা তবে কার ছায়া!”
আখ্যানের শুরুতেই ড. তপন মিশ্র ঘেমে উঠলেন। সামনের গ্লাস থেকে একচুমুক জল খেলেন। ড. সিন্হা তাকে সময় দেওয়ার জন্যই হয়তো নিজেও একটা সিগ্রেট ধরালেন।
একটু দম নিয়েই ফের বলতে শুরু করলেন ড. মিশ্র,
—“সন্দেহ হল চোর-টোর ঢুকল কি না। ঘরে দামি জিনিস মানে, দামি ফার্নিচার তো আছেই। এছাড়াও গিন্নীর কিছু গয়না আর ক্যাশ কিছু টাকা ছিল।
বিছানার পাশেই একটা বন্দুক থাকে। লাইসেন্সড। নিজের সেফটির জন্যই রেখেছি। পয়সাওয়ালা ডাক্তার মানেই তার শত্রুর শেষ নেই। চোর-ডাকাতরা প্রায় টার্গেট করেই বসে থাকে। দুষ্কৃতকারীরাও আজকাল খালি হাতে আসে না। তাই এই ব্যবস্থা।
বন্দুক আর টর্চ হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, ঠিক তখনই মোমবাতিটা দপ্ করে একবার জ্বলে উঠে নিবে গেল।
জমাট অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মাথাটা কেমন যেন গুলিয়ে যায়! হাতেই টর্চটা ছিল। জ্বালাতে পারতাম। কিন্তু তার আগেই মনে হল, আমার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে! তার গরম নিশ্বাস আমার গায়ে এসে পড়ছে! মনে হল অন্ধকারের মধ্যেও একজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে!
— ‘কে?’
টের পেলাম নিজের গলাই কাঁপছে! টর্চ জ্বালানোর সাহসও পাচ্ছি না! কারণ আমি জানি সেই চোখ দুটো আমার দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে আছে! অন্ধকারেও তার অস্তিত্ব টের পাচ্ছিলাম। এমনকি তার ছায়া ছায়া অবয়বও দেখতে পাই! ঠিক আমারই দৈর্ঘ্যের, একই প্রস্থের, এমনকী আমার মতোই গাউন পরা একটা ছায়ামূর্তি! আর কী ঠান্ডা তার দৃষ্টি! কী শীতল তার উপস্থিতি! যেন একটা মৃতদেহ! রিগর মর্টিস হওয়া দু’হাতে ক্রমশই আমায় জড়িয়ে ধরছে!
আমার কী হল জানি না। সে দৃষ্টি সহ্য করতে পারছিলাম না! চতুর্দিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার! তবু ঠিক আন্দাজ করতে পারছি তার চোখদুটো! কী করে, কীভাবে, কিছুই জানি না!
দপ্ করে হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে দিলাম! আশ্চর্য! সামনে, পিছনে, পাশে— কোথাও কেউ নেই! দেওয়ালে আমার নিজেরই ছায়া পড়ছে… আর ঠিক তার পাশেই অবিকল আমার ছায়ার মতো আরেকটা ছায়া! যেন দুটো ছায়াই আমার। প্রথমটার মালিক আমি। দ্বিতীয় ছায়ার মালিক নেই! কোত্থাও নেই… অথচ ছায়াটা ক্রমশই যেন দেওয়াল ছেড়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমার বিস্মিত চোখের সামনেই ধরছে অস্পষ্ট অবয়ব…
চিৎকার করে উঠেছিলাম। সপাটে টর্চের এক বাড়ি বসিয়ে দিলাম ওর মাথা লক্ষ্য করে… আমার কপালটাও সঙ্গে সঙ্গে ঝনঝন করে উঠল। তারপর আর কিছু মনে নেই…”
ফের থামলেন ড. তপন মিশ্র। ড. সিন্হা তার কথা খুব মন দিয়ে শুনছিলেন। কৌতূহলী স্বরে বললেন, “তারপর?”
—“পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল। কপালে প্রচণ্ড যন্ত্রণা। মাথায় হাত দিতেই টের পেলাম, একটা ব্যান্ডেজের উপস্থিতি! আমার কপালে কেউ ব্যান্ডেজ করে রেখেছে!
— ‘কী হয়েছিল কাল রাতে?’ আমার স্ত্রী অপর্ণা বেড টি দিতে এসে প্রশ্ন করলেন, ‘অমন চেঁচিয়ে উঠেছিলে কেন?
কালকের ঘটনার কথা ভেবে নিজেরই অবিশ্বাস্য লাগছিল। একটা ছায়া কাল রাতে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার সামনে, অথচ কোথাও কোনও মানুষ ছিল না! তখন ভয় পেয়েছিলাম। এখন ভাবতেই গোটা ঘটনাটা উষ্ণ মস্তিষ্কের হাবিজাবি মনে হল।
কিন্তু মাথার চোটটা! এটা কীভাবে লাগল!
যাই হোক, ব্যাপারটা চেপেই গেলাম। স্ত্রী’কে বললাম রাত্রে উঠতে গিয়ে, অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পড়ে এই বিপত্তি!
স্ত্রী আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়েছেন, ‘তোমার হাতে তো টর্চ ছিল। জ্বালাওনি কেন?’
প্রশ্নটাকে কোনওমতে এড়িয়ে যাই। ভাবলাম, ওটা দুঃস্বপ্ন! ভুলে যাওয়াই ভালো।
তখন কে জানত যে দুঃস্বপ্নটা এখনও শেষ হয়নি! সবে শুরু হল! সেদিন গোটা দিনটাই যেন একের পর এক দুঃসংবাদ নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আগের দিন এক পেশেন্টের গল-স্টোন অপারেশন হয়েছিল। রাত্রেও দেখেছি সে ঠিক আছে। সামান্য ব্রিদিং প্রবলেম ছাড়া আর কিছু প্রবলেম ছিল না।
অথচ নার্সিংহোমে ঢুকতে না ঢুকতে সেই রোগির আত্মীয়রা আমার উপর প্রায় চড়াও হল! লোকটা মারা গেছে!
আমি তখনও বুঝে উঠতে পারিনি যে সে মারা গেল কী করে! কালও তো বেঁচে ছিল। অপারেশন সাকসেসফুল! তবে!
মৃত মানুষটির আত্মীয় স্বজনেরা আমায় ঘিরে প্রায় তান্ডব করছিল। সিকিউরিটি গার্ডরা ছুটে এসে কোনওমতে উদ্ধার করল। মাথায় তখনও কিছুই স্পষ্টভাবে ঢুকছে না। তাড়াতাড়ি নিজের কেবিনে ঢুকে নাইট শিফটের ডাক্তারদের আর মেট্রনকে ডেকে পাঠাই। লোকটার মৃত্যুর কারণ জানা দরকার।
— ‘অক্সিজেন ডেফিশিয়েনসি স্যার।’ নাইট শিফটের ডাক্তার মাথা নিচু করে জানায়, ‘অক্সিজেন মাস্ক খুলে নেওয়ার পরই লোকটা মারা যায়।
— ‘কী আশ্চর্য! অক্সিজেন মাস্ক খোলা হল কেন?’, রাগে প্রায় কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতোই চেঁচিয়ে উঠি, ‘যখন দেখা যাচ্ছিল যে ব্রিদিং ট্রাব্ল সামান্য হলেও হচ্ছে, তখন মাস্ক খুলতে তোমাদের কে বলেছিল?’
—‘আপনিই বলেছিলেন স্যার,’ ও আমার দিকে তাকায়, ‘ওটা অপারেশন থিয়েটারের অক্সিজেন সিলিন্ডার ছিল। আপনিই বলেছিলেন রিপ্লেস করতে।’
—’রিপ্লেস করতে বলেছিলাম। একেবারে খুলে দিতে তো বলিনি!’
—’নতুন কোনও ভরা সিলিন্ডার ছিল না অ্যাট দ্যাট মোমেন্ট।’ ডাক্তারটি আরও নম্র, ‘আপনাকে আমিই জানিয়েছিলাম যে নতুন সিলিন্ডার এসে পৌঁছোতে মিনিট দশ লাগবে। সিলিন্ডার না এসে পৌঁছোনো অবধি পেশেন্টের অক্সিজেন রিপ্লেস করবো কি না। কিন্তু আপনার আরেকটা আর্জেন্ট অপারেশন ছিল। ও.টি’র সিলিন্ডারটা দরকার ছিল। তাই আপনিই অর্ডার দিয়েছিলেন ও.টি’র সিলিন্ডারটা ফেরত আনতে।’
কী বলতে চায় ও? লোকটার মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী! অপারেশন থিয়েটারে অক্সিজেন সিলিন্ডারের উপস্থিতিটা বেশি জরুরি। দশ মিনিট পরেই তো নতুন অক্সিজেন চলে আসত। এমন তো নয়, যে আমি লোকটাকে মারার জন্যই ওকে অক্সিজেন দিতে বারণ করেছি! দশটা মিনিট যদি সে অক্সিজেন ছাড়া বাঁচতে না পারে, তবে আমার কী করার আছে!
মাথাটা দপ করে গরম হয়ে গিয়েছিল। কোনওমতে ঠান্ডা করি। এখন সামনে অনেক লড়াই। নার্সিংহোমে চিকিৎসার ত্রুটিগত কারণে মৃত্যু হলে তার দায়ভার অনেক! যে কোনও মুহূর্তে প্রেস এসে পৌঁছোতে পারে। তাদের কী বলব? কীভাবে চাপা দেব এই ঘটনাটাকে!
— ‘রিপোর্টে লিখে দাও যে লোকটির অবস্থা সিরিয়াস ছিল। গলব্লাডারে বেশিদিন ধরে স্টোন থাকার কারণে গ্যাংগ্রীন হয়ে গিয়েছিল। তাই অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো যায়নি,’ আঙুল তুলে বলি, ‘কিন্তু অক্সিজেন ডেফিশিয়েন্সির কথা কোনওভাবেই যেন ফাঁস না হয়।’
— ‘কিন্তু স্যার, পোস্টমর্টেম হলে…’
— ‘আমি সামলে নেব, ‘
টাকা আর ক্ষমতার জোরে যে পোস্টমর্টেম রিপোর্টকে পালটে দেওয়ার ক্ষমতা রাখি আমি, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই সবাইকে বিদেয় দিয়ে একা কেবিনে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। যাক, কোনওভাবে সামলে নেওয়া যাবে। বিশেষ চিন্তার কিছু নেই!
কিন্তু চিন্তার তখনও কিছু ছিল।
কেবিনে বসে চা খেতে খেতেই আবার সেই অস্বস্তি! দুটো চোখ খুব তীব্র দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে! অদ্ভুত সেই চাউনি! সামনাসামনি কেউ নেই, ঘরে আমি একা! অথচ সেই অশরীরী চোখ অনুভব করতে পারছি।
হঠাৎ কী যেন সন্দেহ হল, রিভলভিং চেয়ারটাকে ঘুরিয়ে পিছনদিকে তাকাই। নাঃ, সেখানে কিছু নেই! কেউ নেই…! একদম ফাঁকা!
একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সামনের দিকে ঘুরতে যাব, চোখে পড়ল পেছনের দেওয়ালে আমার ছায়া পড়েছে। কিন্তু একটা নয়! দুটো ছায়া! পাশাপাশি, দেওয়ালের সমান্তরালে দুটো একইরকম ছায়া। একটা আমার! আরেকটা আমার নয়! হতেই পারে না!
আমার বোধহয় মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। বিদ্যুৎগতিতে সামনের আয়নায় তাকালাম!”
ড. তপন মিশ্র সাইকিয়াট্রিস্টের হাত চেপে ধরলেন, “যা দেখলাম তা বিশ্বাস করবেন না। কেউ বিশ্বাস করে না।”
—“কী দেখলেন?”
—“দেখলাম আয়নায় আমার প্রতিচ্ছবি পড়ছে। আর আমার ঠিক পিছনেই আরেকটা লোক! তার পোষাক পরিচ্ছদ একদম আমার মতো! এমনকী তাকে দেখতেও হুবহু আমার মতোই! শুধু চোখদুটোয় কোনও মণি নেই! একদম ফাঁকা! অন্ধকার কোটরের মতো শূন্য চোখে তাকিয়ে সে হাসছে! অথবা আমিই হাসছি আমার দিকে তাকিয়ে!
একি অদ্ভুত রহস্য! কী অদ্ভুত যন্ত্রণা! কাউকে বলার উপায় নেই! অথচ সহ্য করাও যায় না! ওই হাসির মধ্যে যত না ব্যঙ্গ, তার থেকেও বেশি ঘৃণা! ইচ্ছে হল ওর গলা টিপে ধরি! আমি ডাক্তার… কাউকে খুন করা আমার পেশা নয়… কিন্তু, ওই মুহূর্তে… আমি… আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম…
ছায়াটার গলা টিপে ধরতেই মনে হল, লোহার মতো মজবুত দুটো হাত আমারও গলা সাপটে ধরেছে! শ্বাসবন্ধ হয়ে আসছে… চোখে অন্ধকার দেখছি… অক্সিজেন… একটু অক্সিজেন…!
— ‘এ কী! এ কী স্যার! কী করছেন… কী করছেন!’
কানে এল চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ! বেশ কিছুক্ষণ চেতনা ছিল না। জলের ঝাপটায় হুঁশ ফিরল। চোখ মেলতেই প্রথম নজরে আসে মেট্রনের মুখ। সে উদ্বিগ্ন। জানতে চায়, ‘স্যার, আপনি নিজেই নিজের গলা অমন ভয়ানকভাবে টিপে ধরেছিলেন কেন?”
আবার একটু থামলেন ড. মিশ্র। কী যেন একটু ভেবে নিয়ে ফের বলতে শুরু করেছেন, “আমি বুঝতে পারছিলাম না যে কী করব। তবে এইটুকু বুঝেছিলাম যে ওকে আক্রমণ করতে গেলে সে আঘাত আমার উপরই পড়ছে। ওর মাথায় বাড়ি মারলে, আমার মাথায় চোট পড়ে, ওর গলা টিপে ধরলে আমার শ্বাস বন্ধ হয়। যাই হোক না কেন, নিজেকে বাঁচাতে গেলে ওকে মারা চলবে না।
সেই হিসেব মতোই চলতে শুরু করলাম। অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করলাম প্রাণপণে। কিন্তু যখনই চোখ পড়ে তখনই দেখি আমার সঙ্গে সঙ্গে দুটো ছায়া তাল মিলিয়ে চলেছে। একটা আমার, অন্যটা আমার নয়। রোগি দেখি, অপারেশন করি, সবই চলছে নিয়ম মতো। অথচ একমাত্র আমি জানি যে, কিছুই ঠিক নেই। সবসময় সেই ছায়া আমার পেছনে ওঁত পেতে বসে থাকে। তার সদাসতর্ক নজর আমার ওপর। ও আমায় পায়ে পায়ে ফলো করছে। ওকে ছেড়ে যাবার উপায় আমার নেই! অথচ সহ্য করার ক্ষমতাও নেই। সবসময় ভয়ে শিঁটিয়ে থাকি, যদি কেউ ওকে দেখে ফেলে। যদি জানতে চায়,
— ‘ডঃ মিশ্র, আপনার দুটো ছায়া পড়ছে কেন?’
এর মধ্যেই আরেক ঝামেলা এসে ঘাড়ে পড়ল। একটি বছর দশের বাচ্চা ছেলে হার্টের সমস্যা নিয়ে নার্সিংহোমে এসে ভরতি হয়েছিল। হার্ট রিপ্লেসমেন্ট করাতে হবে। ছেলেটির ভারি মিষ্টি চেহারা। ডাক্তার, নার্স, ওয়ার্ডবয়, সকলেই তাকে পছন্দ করে। কিন্তু শুধু পছন্দ করলে তো চলবে না! তার বাবার অপারেশন করানোর পয়সা নেই। সে খালি কাঁদে আর আমার পায়ে ধরে,
— ‘ডাক্তারবাবু, আমার ছেলেটা যে দিনদিন নেতিয়ে পড়ছে! ওর অপারেশনটা করে দিন। আমি আপনার কেনা গোলাম হয়ে থাকব।’
আচ্ছা মুশকিল! লোকটাকে বোঝানোই যায় না যে, আমার পায়ে ধরলে ওর ছেলে সুস্থ হবে না। ইমিডিয়েটলি সার্জারি করতে হবে। প্রয়োজন মতো হার্টও পাওয়া গেছে। কিন্তু সার্জারির ফি জমা না দিলে অপারেশন হবে কী করে?
সে কথা বলতেই সে ফের কেঁদে ফেলেছে, ‘আমি গরিব মানুষ। অত টাকা একসঙ্গে কোথায় পাবো? আপনি অপারেশনটা করে দিন। আমি একটু একটু করে সব টাকা শোধ করে দেব।’
আমার মাথা ফের গরম হয়ে যায়। মামাবাড়ির আবদার পেয়েছে! চিকিৎসা করানোর সময়ে নামকরা ঝাঁ চকচকে নার্সিংহোম! আর টাকা দেওয়ার বেলায় দাতব্য হাসপাতাল! কীভাবে এরা! এত আধুনিক যন্ত্রপাতি, এত নামিদামী ডাক্তার, এত মেইনটেনেন্স, উন্নত পরিষেবা— এসব কী হাওয়া থেকে আসে!
ভাবছিলাম কেবিন থেকে লোকটাকে ঘাড় ধরে বের করে দিই। কিন্তু পারলাম না। সামনের আয়নায় চোখ পড়তেই দেখি, অন্য আমিটা ঠিক আমার পিছনেই এসে দাঁড়িয়েছে! ওর চোখের অন্ধকার কোটর থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ছিল! আমি কী ভাবছি, তা ও জানতে পেরেছে, বুঝতে পেরেছে! ভয় করছিল… ভীষণ ভয় করছিল! আমি পালাতে চাইছিলাম। ওর কাছ থেকে নিষ্কৃতি চাইছিলাম। একটা মানুষ, যে আমার মতোই দেখতে… যে আমার ভিতরের সমস্ত কথা, সমস্ত অভিসন্ধি জেনে ফেলছে, তাকে সহ্য করা বড্ড কঠিন!
— ‘স্যার…’
যখন ভাবছি ছেলেটার বাবাকে কী বলে বিদেয় দেব, ঠিক তখনই এক জুনিয়র ডাক্তার হুড়মুড় করে এসে ঢুকল আমার ঘরে। তার হাবেভাবে আশঙ্কা।
— ‘স্যার, তিনশো চারের পেশেন্ট কোলাপ্স করছে। প্লিজ ইমিডিয়েটলি আসুন।’
তিনশো চার মানে সেই বাচ্চা ছেলেটা। ওর বাবাও দেখলাম কথাটা শুনেই বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াল। কথাটার অর্থ সেও বুঝেছে।
মাত্র পনেরো মিনিট সময় দিয়েছিল বাচ্চাটা! ওর জীবনীশক্তি শেষ হয়ে গিয়েছিল আগেই। খাবি খেতে খেতে একসময় সে নিথর হয়ে গেল। আমি শুধু দেখলাম ওর নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁট! শেষমুহূর্তে বোধহয় কিছু বলতে চেয়েছিল।
ওর বাবা তখন পাথর! প্রয়োজনীয় টাকা জমা না দিলে যে সন্তানের লাশটা পাওয়া যাবে না সেটা বারবার বুঝিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু লোকটা যেন কিছুই বোঝে না! হাবা কালার মতো কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল! তারপর হঠাৎই চোখ তুলে তাকাল আমার দিকে!
আমি দেখলাম, ওর চোখ দুটো নেই! তার জায়গায় দুটো বীভৎস শূন্য কোটর আমার দিকে তাকিয়ে বীভৎস অট্টহাসি হাসছে। আশপাশের ওয়ার্ডবয়, সিস্টার, ডাক্তাররাও আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়েছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন… বিশ্বাস করুন… তাদের কারুর চোখের মণি ছিল না! সবার চোখে শুধু জমাট অন্ধকার, যেন ওদের চোখ কেউ খুবলে তুলে নিয়েছে! অবিকল অন্য আমিটার মতো!
আমি পালিয়ে আসি। ওই শূন্য চোখ আমার কাছে বিভীষিকা! সেদিনও খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। আমার গাড়ি কোথায় ছিল কে জানে! চাবিটাও দৌড়োতে গিয়ে পড়ে গেল। গাড়ি ছাড়াই আমি পাগলের মতো রাস্তার উপর দিয়ে দৌড়োচ্ছি। পালাতেই হবে… পালাতেই হবে ওই বীভৎস চোখের কাছ থেকে।
রাস্তায় তখন অনেক মানুষের ভিড়! আমার চতুর্দিকে ওয়াটারপ্রুফে ঢাকা অনেকগুলো মুখ ঘুরে বেড়াচ্ছে! ছাতা মাথায় দিয়ে বাচ্চা ছেলে মেয়েরা হেঁটে যাচ্ছে। তার মধ্যে দিয়ে, জনস্রোত ভেঙে কোন ঠিকানায় দৌড়োচ্ছিলাম কে জানে! অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ে যাচ্ছে। ভিজে যাচ্ছিলাম, তবু থামিনি। থামব কেন? আমি অবধারিতভাবেই জানতাম ওই ওয়াটারপ্রুফগুলোর অন্ধকারে বা ছাতার তলায় যে মুখগুলো লুকিয়ে আছে, তার একটারও চোখ নেই! আমি জানতাম… একদম নিশ্চিতভাবে জানতাম!
দৌড়োতে দৌড়োতে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন রাত হয়ে গেছে। নিজের বাড়িটাকে দূর থেকে দেখে বড় কান্না পেয়ে গেল। ওই তো আমার শান্তির আশ্রয়! ওইখানে আমার স্ত্রী আছে, আমার সন্তান আছে। আমার বেঁচে থাকার অন্যতম কারণ, আমার পরিবার এখানে থাকে! আজ থেকে আর নার্সিংহোম নয়, অন্য কোথাও নয়, পার্টি নয়, পেশেন্ট নয়। আমি শুধু আমার পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাব। পিকনিক করব, বেড়াতে যাব, শপিং মলে শপিং করব। বাবাইকে কিনে দেবো তার মনমতো খেলনা। অপর্ণাকে পছন্দমতো শাড়ি…
দরজায় সজোরে নক করি। এই মুহূর্তে ভালোবাসার মানুষদের উষ্ণতা খুব প্রয়োজন। ভালবাসার কাছে আসতে পারে না অন্ধকার চোখেরা। প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যে তাড়া করে না দুঃস্বপ্নরা। আমি নিরাপদ বোধ করছিলাম…. ভীষণ ভীষণ নিরাপদ! আর কেউ আমাকে ভয় দেখাতে পারবে না! আর দৌড় করাতে পারবে না!
অনেকক্ষণ ধরে নক করার পর দরজা খুলল বাবাই। আমার একমাত্র সন্তান। সঙ্গে সঙ্গে জাপটে ধরে ওর ছোট্ট বুকে মুখ গুঁজে দিয়েছি। আঃ! কী শান্তি! কী উষ্ণতা!
— ‘বাবা, এত তাড়াতাড়ি ফিরলে যে!’ বাবাই প্রশ্ন করল, ‘তোমার গাড়ি কোথায়?’
আমি প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ তুলে ওর দিকে তাকাই। ঠিক তখনই কাছেই প্রচন্ড শব্দে একটা বাজ পড়ল! তার নীল আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, বাবাইয়ের চোখদুটো নেই! একদম ফাঁকা! অন্ধকার জানলার মতো…”
ড. তপন মিশ্র বলতে বলতেই বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। ড. সিন্হার হাত ধরে বললেন, “বিশ্বাস করুন ডক্টর, আমি আর পারছিলাম না, আমার জীবনে এমন একটা রহস্য এসে পড়েছে যার হাত থেকে নিষ্কৃতি নেই যাকে প্রত্যেকমুহূর্তে সঙ্গে নিয়ে হাঁটছি আমি। কখনও সে আমার নিজের ছায়ায় দেখা দেয়, কখনও অন্যের মধ্যে। কখনও আয়নায় দাঁড়িয়ে হাসে, কখনও নানা রূপ ধরে ঘুরে বেড়ায়। আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম, নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলেছিলাম। একটা অস্বাভাবিক জীবনে কোনওমতে বেঁচে আছি। টের পাচ্ছিলাম একটু একটু করে মানসিক ভারসাম্য হারাচ্ছি। হসপিটালে যেতেও ভয় করছিল… ওরা আমার দিকে আবার ওইভাবে তাকাবে। তা-ই আজ বিকেলে…”
ড. সিন্হা মন দিয়ে শুনছিলেন, “আজ বিকেলে কী?”
—“আজ বিকেলে ঠিক করলাম যে এভাবে বেঁচে থাকার কোনও মানে হয় না। অন্য আমিটাকে মারার একমাত্র উপায়, যদি আমি নিজেই মরে যাই।” ড. মিশ্র মুখ মুছলেন, “তা-ই আজ আমি…”
তার কথায় বাধা দিলেন ড. সিন্হা, “বুঝেছি। আপনার সমস্যা খুব গুরুতর নয়। আসলে এটা হ্যালুসিনেশনের প্রবলেম। চিন্তা করবেন না, সেরে যাবে। শুধু কিছুদিন ট্রিটমেন্ট দরকার।”
টিমটিমে বাতিটার পাশেই একটা বড় আলো থাকে। রোগিরা সবসময় অন্ধকার পছন্দ করে বলেই বড় আলোটা জ্বালান না তিনি। এবার প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য বড় আলোটার দরকার পড়ল!
কিন্তু আলোটা জ্বালিয়েই… চিৎকার করে উঠলেন ডক্টর সিন্হা!
সব যেখানে থাকার, আছে। দেওয়ালে দুটো ছায়া তখনও মুখোমুখি বসে আছে! তপন মিশ্রের ধরানো সিগ্রেটটা তখনও জ্বলছে!
কিন্তু… শূন্যে!
আর কেউ নেই!
ড. সিনহা অজ্ঞান হয়ে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে শুনতে পেলেন, কে
যেন ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলল,
—“ডক্টর… আমি কি বেঁচে আছি?”
ডার্করুম
ডার্করুম
১
—“দাদার মৃত্যুটা কি সত্যিই স্বাভাবিক ছিল ডক্টর?”
ডঃ ব্যানার্জী মুখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছেন আমায়। অনড় ট্র্যাফিক সিগন্যালের মতো অপলক দৃষ্টি! সে দৃষ্টির সামনে নড়াচড়া যায় না। শ্বাসপ্রশ্বাস স্তব্ধ হয়ে যায়। আমি রুদ্ধশ্বাসে বসেছিলাম। আরও কতক্ষণ ওভাবেই নিশ্চল, স্থবির হয়ে বসে থাকতে হত কে জানে। আচমকা ঘরের টিউবটা দপদপ করে উঠল! ভোলটেজের তারতম্যের সাথে সাথেই চোখের পাতা ফেললেন তিনি। তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ঢিমে উচ্চারণে বললেন,
—“তুমি এত সন্দেহপ্রবণ কেন দীপঙ্কর? সন্দেহটা ঠিক কোন্ বিষয়ে? তোমার দাদার মৃত্যুর বিষয়ে? না আমার ডাক্তারিবিদ্যের উপরে?”
আমি মাথা নিচু করেছি। হয়তো আমার সন্দেহ করা উচিত নয়। অথবা সন্দেহ হলেও চেপে যাওয়াই বাঞ্ছনীয় ছিল। ড. ব্যানার্জী নিজের অধীত জ্ঞানের বিষয়ে ভয়াবহ স্পর্শকাতর। বুঝলাম, তাঁর অহংবোধকে স্পর্শ করে ফেলেছি আমি।
—“শেষ কয়েকটা দিনের অ্যাক্টিভিটি লক্ষ্য করো দীপঙ্কর,” তিনি আমায় বোঝাতে শুরু করলেন, “পার্শিয়াল প্যারালাইসিস। যার জন্য তোমার দাদা জল খেতে পারছিলেন না। জল দেখলেই আঁতকে উঠছিলেন! গলায় খিঁচ ধরছিল।”
মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেল, “কিন্তু দাদা তো কখনও বলেনি যে ওর জল খেতে কষ্ট হচ্ছে বা গলায় খিঁচ ধরছে! ও শুধু জল দেখলেই ভয় পেত!”
ডাক্তারবাবুর মুখ বিরক্তিতে বেঁকে গেছে, “তোমার দাদা আদৌ কি তার সুবিধে-অসুবিধের কথা জানানোর মতো মানসিক অবস্থায় ছিলেন? ডোন্ট মাইন্ড দীপ, বাট একজন সাইকায়াট্রিক পেশেন্টের কাছে তুমি কী আশা করো? শেষ দু’বছর যে মানুষ কমিউনিকেট করার পর্যায়েই ছিল না, মৃত্যুর আগে সে কী করে নিজের কষ্টের কথা এক্সপ্রেস করবে? কষ্ট হচ্ছিল বলেই জল দেখে ভয় পাচ্ছিলেন। জল খেতে চাইছিলেন না।”
আমি চুপ করে থাকি। দাদার শেষ মুহূর্তের চিৎকারগুলো মনে পড়ে যায়! কী যন্ত্রণাময় আর্তনাদ! অত কষ্ট পাচ্ছিল বলেই কি ….
— “তাছাড়া ডিল্যুশন, হ্যালুসিনেশন, কনফিউশন, ইনসমনিয়া এগুলোও তো তোমার দাদার ছিল। এগুলো সবই হাইড্রোফোবিয়ার লক্ষণ। তোমার দাদা ঘুমোতেন না। ভয় পেতেন। উলটোপালটা জিনিস দেখতেন, সবচেয়ে বড় কথা যে জল খেতে পারছিলেন না, বা চাইছিলেন না।”
—“কিন্তু ডক্টর,” আমি তাঁর বক্তৃতায় বাধা দিয়ে বলি, “তবে যে দাদা সন্দেহ করত, তাকে কেউ বিষ খাওয়াচ্ছে!”
—“কী মুশকিল!” ড. ব্যানার্জী আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন গোটা একখানা ডিকশনারি লিখে ফেলার পর তাঁকে আমি ‘এ, বি, সি, ডি’ লিখতে বলেছি। স্বাভাবিক! আমার মতো লোক যদি ডাক্তারের সঙ্গে ডাক্তারি নিয়ে তর্ক করে, তবে বিরক্ত হওয়াই অবধারিত। নেহাত উনি আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ও নিপাট ভদ্রলোক বলে এখনও গলাধাক্কা দিয়ে চেম্বার থেকে বের করে দেননি! চেম্বারের বাইরে রুগি গিজগিজ করছে। আর আমি এখানে বসে ভদ্রলোকের সঙ্গে হ্যাজাচ্ছি।
—“ওয়েল দীপ, জলাতঙ্কের ওটাও একটা সাইন। ডিল্যুশন অব পার্সিকিউশন বা নির্যাতনমূলক ভ্রান্তি বলতে পারো। তার চেয়েও অবশ্য পার্ফেক্ট টার্ম ‘প্যারানইয়া’। তুমি তো জানোই, একজন প্যারানয়েড সবসময়ই অকারণে ভয় পায়। ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে! এবং সবসময় সন্দেহ করে যে তাকে ঘিরে কোনও ষড়যন্ত্র হচ্ছে! কেউ তাকে মেরে ফেলতে চায়! তোমার দাদা ‘বিষ… বিষ’ করে হিস্টিরিক হয়ে উঠতেন। প্যারানইয়া ইজ অলসো আ সিম্পটম অব হাইড্রোফোবিয়া! এর বেশি আর কী প্রমাণ দেব?”
আমি নিস্তব্ধ হয়ে ড. ব্যানার্জীর কথা শুনে যাই। উনি একের পর এক জলাতঙ্কের সিম্পটম বলে যাচ্ছেন। সত্যিই ভদ্রলোক অনেক কিছু জানেন। উনি ভুল বলছেন না। দাদার সিম্পটমগুলো সবই হাইড্রোফোবিয়ার। ওঁর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ঠিকই ধরেছেন। জলাতঙ্কের রোগিদের মধ্যে এই বিশেষ লক্ষণগুলো দেখা যায়।
কিন্তু একটা কথা উনি জানেন না। অথচ আমি জানি। এ বিষয়ে ওঁর থেকে আমার জ্ঞান স্বাভাবিকভাবেই বেশি! কথাটা ড. ব্যানার্জীকে বলাই যেত। কিন্তু মায়ের নিষেধ!
জলাতঙ্কের ভাইরাস, র্যাবিস, কোনও মানবদেহে সরাসরি আসতে পারে না। কোনও র্যাবিস আক্রান্ত কুকুর-বিড়ালের কামড় বা আঁচড়ের মাধ্যমেই আসতে হয় তাকে! এটা আমি বা ড. ব্যানার্জী ছাড়াও পৃথিবীর সমস্ত মানুষই জানে।
অথচ আমি জানি যে-কোনও কুকুর বা বিড়ালের আঁচড় বা কামড় দাদা কখনও খায়নি! আঁচড়, কামড় তো দূর, কোনও কুকুর বা বিড়ালের সংস্পর্শে সে কোনওদিনই থাকত না! শেষ কয়েকবছর ঘরবন্দী অবস্থাতেই কাটিয়েছে। যেদিন থেকে ওর মাথার গোলমাল প্রকট হয়ে ধরা পড়ল, সেদিন থেকেই লোকসমাজে আর পা রাখেনি! যে আড়ালে সে শেষ কয়েকটা বছর কাটিয়ে গেছে, সেখানে উটকো মানুষের চোখও তাকে স্পর্শ করতে পারত না। কুকুর-বিড়াল তো দূর অস্ত!
কিন্তু সেই দাদাই শেষপর্যন্ত মারা গেল হাইড্রোফোবিয়ায়!
—“এত কথার পরেও যদি তোমার বিশ্বাস না হয়, তবে জানিয়ে রাখি যে তোমার দাদার মৃত্যুর কিছু আগেই স্কিন স্যাম্পল নিয়েছি আমি। পলিমেরাস চেইন রি-অ্যাকশন, মানে পি সি আর টেস্টের পর ফাইনালি জানা যাবে রোগটা সঠিকভাবে হাইড্রোফোবিয়া কি না! যদিও আমি এখনই চোখ বুজে বলে দিতে পারি….”
—“ডাক্তারবাবু, স্কিন স্যাম্পল টেস্ট থেকে তো বিষের ট্রেসও পাওয়া যেতে পারে, তা-ই না?”
ড. ব্যানার্জী বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন! যেন ‘বিষ’ শব্দটা শুনে মুহূর্তের জন্য শিউরে উঠলেন! কোনওমতে স্খলিত গলায় বললেন, “দীপঙ্কর! তুমি কি…”
মা বললেন, “নাঃ, থাক…”
২
আজকাল বাড়িটা ক্রমশ আমার অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মনে হয় দীর্ঘ তিরিশ বছর এ বাড়িতে থেকেও আসলে কিছুই, কাউকেই চিনতে পারিনি। কোথাও কিছু অপ্রকাশিত ছায়ারা লুকিয়ে ছিল, যারা আজকাল মাঝে মধ্যেই দুম করে বেরিয়ে আসে। তখন একটা অদ্ভুত বিস্ময় মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে উঠে আসে। আজন্ম পরিচিত বাড়িটা একনিমেষে অন্ধকূপ হয়ে যায়।
এইমুহূর্তে তেমনই একটা ছায়া মায়ের মুখে উঁকি দিয়েই মিলিয়ে গেল, যখন মা বললেন সেই শব্দটা, “নাঃ, থাক।”
—“কেন থাকবে? ড. ব্যানার্জীকে জানালে ক্ষতি কী?”
মা উত্তর দিলেন না। তার নীরব চলে যাওয়ায় ভেসে ওঠে আরও একটা উদাসীন ছায়া!
অসহ্য লাগে এই নীরবতা! দাদাও ছবি হয়ে গিয়ে সদ্য সদ্য নীরবতা শিখেছে। যখন বেঁচে ছিল তখনও অবশ্য খুব বেশি কথা বলতে দেখিনি। শুধু জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিলেই,
—“বিষ! বিষ! বিষ আছে, জলে বিষ আছে, পাপ আছে… পাপ…! ঢাকনাটা খুলিস না খোকন, খুলিস না…”
সেই চিৎকার! এখনও আমার কানে ভাসে! কী প্রচণ্ড আতঙ্ক!
শেষ দিকে দাদার চোখে শুধু দুটো অনুভূতিই ছাপ ফেলত। ঘৃণা আর ভয়। চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে যেত। মুখ বেয়ে পড়ত লালা! কখনও মনে হত এই বুঝি সব ওলট-পালট করে দুমড়ে মুচড়ে দেবে! আবার কখনও যেন ভীষণভাবে কুঁকড়ে যেত! হ্যাঁচোড়-পাচোড় করে খুঁজত একটা আশ্ৰয়। শামুকের মতো একটা মানবখোল! শেষ কয়েকদিন দাদাকে জাপটে ধরে ভুলিয়ে ভালিয়ে শান্ত করতে হত। দাদা আমায় আঁকড়ে ধরে ঘুমোনোর চেষ্টা করত। তখন ওর হৃৎস্পন্দন বুকের উপর টের পেয়েছি! একটা শক্তিশালী টারবাইনের মতো হৃৎপিণ্ডটা ধুকপুক করে যাচ্ছে! প্রতিটা স্পন্দন নিরাপত্তাহীনের মতো চিৎকার করতে করতে বলত, “খুলিস না… খুলিস না… খুলিস না…”
কী ছিল গ্লাসের মধ্যে! বিষ! অসম্ভব! কে বিষ মেশাবে? তাহলে? পাপ আছে? কার পাপ? জল কেন খেতে চাইত না সে? কাকে ভয় পেত? কাকেই বা ঘৃণা? নাকি গোটাটাই এক মানসিক বিকারগ্রস্ত রোগির প্রলাপ? দাদা নেই আজ প্রায় দু’সপ্তাহ হল। তার আগে আরও পনেরো দিন তার এই উন্মত্ত প্রলাপ শুনেছি। মর্মার্থ আজও বুঝে উঠতে পারিনি!
—“জল! খালি চতুর্দিকে জল! খোকন, ও আমায় টেনে নেবে জলের ভেতর! খোকন, খুলিস না! ঢাকনাটা…”
দাদার আতঙ্ক এই বাড়ির দেওয়ালে অনুরণিত হতে হতে আজ ঘুমিয়ে পড়েছে! কীভাবে সে যেন অজান্তেই তার মনের অন্ধকার ঘরটায় চলে গেল, আর আলোয় ফিরল না!
এখন এই ঘরটাও নীরব। পায়ে বাঁধার শিকলটাও ঝনঝনানির বাচালতা ছেড়ে নিঃশব্দ ঘুমে মগ্ন! সন্ধ্যার নরম লালচে শেষ আলোটুকু এসে পড়েছে জানলার ফাঁক দিয়ে। নিষ্প্রভ আলো ছড়িয়ে পড়ছে বাড়ির পিছনের এঁদো পুকুরটায়। কচুরীপানাগুলোর সবুজ রং ফ্যাকাশে হলুদ আভায় বিচিত্রবর্ণ ধারণ করেছে! পাশের কুয়োটার অবস্থাও তথৈবচ! কতদিন আগে ওটার জল ব্যবহারযোগ্য ছিল কে জানে! আমি অবশ্য জন্মাবধি বাড়িতে টিউবওয়েলের ব্যবহার দেখে আসছি। তারপর এল ট্যাপ কল! কুয়োটার কোনও কাজ ছিল না! ওটা একটা প্রাগৈতিহাসিক প্রাণীর ফসিলের মতো আজও বিরাট অন্ধকার হাঁ করে বসে আছে! ভিতরের জল কর্দমাক্ত! বিষের মতো পিঙ্গল!
আগে এই ঘরটাতেই দাদা থাকত। একসময় আমার ফটোগ্রাফার হওয়ার খুব শখ ছিল। ভেবেছিলাম, এই ঘরটাকেই ডার্করুম করব। এমনিতে সব দিক দিয়েই ঘরটা ডার্করুমের উপযুক্ত। অন্যান্য ঘরের তুলনায় বেশ বড়। আলোর উৎস হিসাবে থাকার মধ্যে আছে একটা ছোট জানলা। ওটাকেও বেশ টাইট মেরে বন্ধ করে দিয়েছিলাম। সহজে খোলা যেত না! কিন্তু ডার্করুম করা শেষপর্যন্ত আর হয়ে উঠল না। দাদা এই ঘরটাতে এসে ঠাঁই নিল! ওর আলো সহ্য হত না। চোখে তীব্র আলো পড়লেই খেপে উঠত! হাতের কাছে যা পেত ছুড়ে মারত! দু-একবার বউদির উপরেও হিংস্রভাবে চড়াও হয়েছে। আঁচড়ে, কামড়ে প্রায় ফালাফালা করে ছেড়েছে। তাই বাধ্য হয়েই তাকে আমার শখের ডার্করুমটা ছেড়ে দিতে হল। দাদার দু’পায়ে শিকল পড়ল। যাতে যখন তখন কাউকে আক্রমণ না করতে পারে।
এখন যে বিছানাটার উপরে বসে আছি, সেটাতে কিছুদিন আগেও চুপ করে বসে থাকত দাদা। ভয়ে সিঁটিয়ে ফিসফিস করে বলত, “দেখেছিস খোকন! দেওয়ালে কে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে!”
আমি অবাক। প্লাস্টার অব প্যারিসের সাদা ধবধবে দেওয়ালে শুধু আমাদের দু’জনের হালকা ছায়া! দাদার চড়া আলো সহ্য হয় না বলে এ ঘরে মা আলোর বন্দোবস্ত করেননি। সন্ধে হলেই এককোণে একটা কেরোসিনের বাতি মৃদু রশ্মি ছড়াত। সেই রশ্মিতেই দু’জনের ছায়া দেওয়ালে ফুটে উঠেছে। স্পষ্ট নয়, শিখার সঙ্গে থেকে থেকে কেঁপে উঠছে!
অথচ দাদা সেই দেওয়ালের দিকে তাকিয়েই চিৎকার করত! কখনও হিংস্র অথচ অসহায় কণ্ঠে বলত, “কেন এসেছ? কেন এসেছ? আমি ভয় পাই না! যাও, চলে যাও! আর আসবে না! কক্ষনও আসবে না!” কখনও বা হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে জাপটে ধরত আমায়, “খোকন, ওকে চলে যেতে বল! ও আমায় ভয় দেখায়! সবসময় ভয় দেখায়। ওকে তাড়িয়ে দে! তাড়িয়ে দে!”
আমি বুঝে উঠতে পারতাম না কাকে তাড়াব! কেউ থাকলে তবে তো তাড়াব তাকে! শূন্য সাদা দেওয়ালে নিজের ছায়া দেখেই দাদা চমকে উঠত। ভয় পেত। আমায় আরও জোরে চেপে ধরত, “শুনছিস? ও চিৎকার করছে? আমি… আমি পারছি না! আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে! ওকে তাড়িয়ে দে খোকন… নয়তো… নয়তো…” বলতে বলতেই জোরে জোরে মাথা ঠুকত দেওয়ালে! যেন তখনই নিজের মাথাটা দু’টুকরো করে ছাড়বে!
কোনওমতে তখন তাকে সামলাতে হত। দাদা প্রথমে ভেঙে পড়ত! তারপর আকস্মিক ভাবেই খেপে উঠে বলত, “কী ভেবেছে? এভাবে আমায় মারবে? দেওয়ালে যখন তখন ঘুরে বেড়াবে! আমি গোটা দেওয়ালটাই কালো করে দেব! কালোয় কিচ্ছু দেখা যাবে না! সাদা দেওয়াল বলে মাজাকি মারছ! দেওয়াল কালো হয়ে গেলে কী করবে? কী করবি শুয়োরের বাচ্চা! আমি দেওয়াল, ছাত, দরজা সব কালো করে দেব!”
সত্যিই তাই করেই ছেড়েছিল দাদা। মা নিজে দাঁড়িয়ে থেকে ঘরটার দেওয়াল ছাত সব লোক দিয়ে কালো রং করে দিয়েছিলেন। সেই দিনটা দাদাকে ভীষণ শান্ত দেখেছিলাম। এখন আর দেওয়ালে কিছু দেখা যাবে না ভেবে সে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল!
এখনও এ ঘরের দেওয়ালটা কালো! আক্ষরিক অর্থে ডার্করুম! কিন্তু সেই ডার্করুমও দাদার মৃত্যু ঠেকাতে পারল না। ড. ব্যানার্জী ঠিকই বলেছেন। সবটাই দাদার হ্যালুসিনেশন ছিল। হয়তো ওঁর কথা মতো হাইড্রোফোবিয়ার লাস্ট স্টেজের সিম্পটম!
দাদা বেঁচে থাকতে এই জানলাটা খোলা হত না। এখন আমি খুলে দিয়েছি। এই জানলাটা দিয়েই একসময় সূর্যাস্ত দেখা যেত। সূর্যটা বেশ হাঁসের ডিমের কুসুমের মতো লাল হয়ে যেতে যেতেই টুপ করে ডুব দিত ঝিলে। মনে আছে যখনই সূর্যাস্ত হত তখনই সন্ধ্যার লোকাল ট্রেন ঝমঝম করে চলে যেত। তার শব্দ এখান থেকেই শোনা যেত তখন। এক ফোঁটা এদিক-ওদিক হতে দেখিনি কখনও। আর ঠিক তার ভোঁ-এর সঙ্গেই সুর মিলিয়ে তুলসিতলায় মায়ের শাঁখ বেজে উঠত।
এখন আর সে দৃশ্য দেখা যায় না! শব্দও শোনা যায় না। ঝুপ ঝুপ করে একগাদা বাক্সবাড়ি উঠে পড়ে প্রকৃতিকে বড় কৃপণ করে ফেলেছে!
—“ঠাকুরপো!”
বউদি কখন ঘরে এসে ঢুকেছে ঠিক টের পাইনি। শাঁখা-সিঁদুরহীন বউদিকে কেমন যেন অদ্ভুত লাগছিল। একটা স্বচ্ছ মোমের প্রলেপের মতো মুখে কীসের যেন ছায়া! মৃত্যু আর শোকের একটা প্রলেপ আছে। সঠিক বলতে পারব না। আমার অনেকটা নীলচে সাদা ছায়ার মতো মনে হয়। গাঢ় নীল নয়। অনেকটা বরফে ঢাকা শৃঙ্গের নীলচে শিরা-উপশিরার মতো। অথবা বার্নারের নীল শিখার আভার মতো! তেমনই একটা ছাপ!
মনে হচ্ছিল বউদি নির্লিপ্ততার মুখোশ পড়েছে! এটা ঠিক তার নিজের মুখ নয়! মুখোশই বটে! দাদাকে নিয়ে কোন্ সুখেই বা ছিল বউদি যে তার মৃত্যুতে শোকগ্রস্ত হবে? দাদাকে ভালোই বা বেসেছে কবে! বিয়ের কয়েক মাস বাদেই যে মেয়ে আবিষ্কার করে যে তার স্বামী পাগল, তার কি আর ভালোবাসার ক্ষমতা থাকে? অন্য কোনও মেয়ে হলে ডিভোর্স অবধারিত ছিল। কিন্তু বউদি গরীব ঘরের মেয়ে। সে বড় মেয়ে। এরপরে আরও চারটে বোন বিয়ের সারিতে আছে। তাই ফিরে যেতে পারেনি। বরং অন্য রাস্তা ধরেছিল…
বউদি বলল, “তুমি এখন চা খাবে?”
আমি বউদিকে স্থির দৃষ্টিতে জরিপ করছিলাম। মেয়েরা কি জন্মগতই অভিনেত্রী হয়? এখন দেখলে কেউ বলবে যে এই মহিলাই একদিন নিজের দেওরের বক্ষলগ্না হয়ে বলেছিল,
—“ওই লোকটা না থাকলেই ভালো হত, তা-ই না?”
আমিও জানতাম, না থাকলেই ভালো হত। মনে মনে কয়েকবার ভাবিনি যে তাও নয়। কিন্তু বউদির মুখ থেকে কথাটা শুনে কেমন যেন আহত হয়েছিলাম। কোথায় আঘাত লেগেছিল? বিবেকে? ঠিক জানি না! আমি লোভী, ইতর, পরস্ত্রীলোভী লম্পট হতে পারি— কিন্তু খুনী নই। সবচেয়ে বড় কথা হল যে তার সঙ্গে সঙ্গে আমি মহান ভন্ডও বটে! নিজের উন্মাদ দাদার স্ত্রীয়ের সঙ্গে শারীরীক ভাবে মিলিত হতে কোন আপত্তি নেই। অথচ যখন সেই মহিলাই এই কথা বলল তখন আমি বলেছিলাম, “ছিঃ!”
আমার অহঙ্কার ছিল আমি অন্তত খুনী নই। নিজের দাদাকে খুন করা তো দূর, সে কথাও ভাবতে আমার আপত্তি! তাই সেদিন ভ্রষ্টা স্ত্রীলোককে ‘ছিঃ’ বলতে আটকায়নি! অথচ সেই মহা ধার্মিকতার পিছনে কী ছিল? চূড়ান্ত কাপুরুষতা?
—“খোকন! পাপ! পাপ আছে! বিষ… বিষ আছে জলে, বিষ!” হঠাৎ টের পেলাম একটা অদ্ভুত সরীসৃপ আমার বুকের ভিতরের পাকদন্ডী বেয়ে উঠে আসছে। কার পাপ? কীসের পাপ? কে বিষ দেবে? কার ভয়? কাকে ঘৃণা! তবে কি দাদা সব জানত? বউদিই দাদাকে বিষ দেয়নি তো! সেকি তবে আমার পাপ! আমারই? অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল।
—“চা দেব?”
আমি তখনও আঁতিপাতি করে কী যেন খুঁজে ঢলেছি। প্রত্যেকটা ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত ঝেড়েঝুড়ে, তন্নতন্ন করে হাতড়িয়ে দেখছি, কোথাও কোনও অদৃশ্য ছায়া ছিল কি? কলঘরের অন্ধকারে, রাতের বিছানায়, চিলেকোঠার নিঃসঙ্গ একান্ত ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে কোনও চোখ কিছু দেখে ফেলেনি তো! দাদাকে তখনও তো বেঁধে রাখার প্রয়োজন পড়েনি। আমাদের চূড়ান্ত আনন্দের প্রতিটা পল, প্রতিটি মুহূর্ত আমার কাছে অসহ্য ঠেকছিল। ছিল? কেউ ছিল কি? অনভিপ্রেত কোনও চোখ?
—“কী হল?”
আমি বউদির দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গেই চোখ পড়ল সামনের আয়নায়। নিজের মুখ দেখে নিজেই চমকে যাই! এই কি আমার মুখ! এত অবিশ্বাস কোথায় জমেছিল এতদিন? এমন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বউদির দিকে তাকিয়ে আছি কেন? চোখের রক্তাভ কোল থেকে ঝরে পড়ছে সন্দেহ!
—“না…”
—“তোমায় কেমন লাগছে,” বউদি পট করে আমার কপালে হাত রেখেছে। মুখে উদবেগ। ভুরুর সামান্য ভাঁজে উৎকণ্ঠা স্পষ্ট!
আমি সঙ্গে সঙ্গেই হাতটা কপাল থেকে সরিয়ে দিই,
—“না, আমি ঠিক আছি।”
—“তাহলে এমন লাগছে কেন?”
—“কেমন লাগছে?”
—“কেমন শুকনো শুকনো…”
শুকনো শুকনো! এত দিনের পরিশ্রমের পর কি গায়ে-গতরে লাগবে? একটা কঠিন জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেলাম। চোখে পড়ল দরজার সামনে মা কখন যেন গোধূলির মতোই নিশ্চুপে এসে দাঁড়িয়েছেন। জানলার গরাদে তবু পূরবীর বিষণ্ণ ছায়া নেমে এসেছে। মায়ের অস্তিত্ব ছায়াহীন!
—“মা!” আমি তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াই। ধরা পড়ার ভয় মুখে খানিকটা হয়তো ছাপ ও ফেলেছিল। সেটা কাটিয়ে ওঠা খুব সহজ নয়। তবু প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে করতেই বলি, “বাইরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বলবে?”
মা হিম শীতল দৃষ্টিতেই আমাদের দু’জনকে মেপে নিলেন! চোয়ালটা একটু যেন শক্ত হয়ে উঠেছে। একটা ঘোলাটে অপ্রস্তুত হাসি দিয়ে বললেন,
—“না…থাক।”
আবার সেই একই শব্দগুচ্ছ!
৩
অদিতি চলে গেছে আজ একমাস হতে চলল। অদিতি চলে যাওয়ার পর দাদাও হিংস্র হয়ে উঠল! তারপর থেকে মা ও রহস্যময়ী হয়ে উঠেছেন! কখনও কখনও মনে হয় কিছু যেন বলতে চান। কিছু একটা বলার আকুতি তার মুখে স্পষ্ট হয়ে ছায়া ফেলে। আবার পরক্ষণেই সরে যায়। কিছু জানতে চাইলে বলেন, “নাঃ, থাক।”
অদিতি আমার জ্যেঠতুতো বোন। জ্যেঠু মারা যাওয়ার পর একেবারেই অনাথ, অসহায় হয়ে পড়েছিল। টগবগে সুন্দরী যুবতী। চমৎকার দেহের গড়ন। চট করে দেখলে যক্ষিণীমূর্তি বলে ভুল হত। মা তাকে একা একা জ্যেঠুর প্রাচীন বাড়িটায় থাকতে দিতে চাননি। মানুষের মনের নাগাল পাওয়া ভার। আর পুরুষের স্বভাবে গুণের তো শেষই নেই। জ্যেঠুর মৃত্যুর পর অদিতির জানলায় অনেক হাত এসে হাতছানি দিয়ে গেছে। হায়না, নেকড়ের ভিড়ে ওকে একা ফেলে রাখতে মা নারাজ ছিলেন। তাই শেষপর্যন্ত সে আমাদের বাড়িতেই আশ্রয় পেয়েছিল।
এখন ভাবলে হাসি পায়। মা অদিতির নিরাপত্তার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু দুনিয়ায় যে হায়না-নেকড়ের অভাব নেই তা হয়তো জানতেন না। ফলস্বরূপ এক বকাটে ছোঁড়ার সঙ্গে অদিতি একদিন পালিয়ে গেল! কোথায় গেল কেউ তা জানে না। পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু লাভ কিছু হয়নি।
অদিতির কী হয়েছিল কেউ সে খবর রাখে না। কিন্তু দাদা তারপর থেকেই আরও অসুস্থ হয়ে পড়ল। মেয়েটাকে বড় ভালবাসত। যেমন শিশু তার খেলার পুতুলটাকে ভীষণ স্বার্থপর আর ঐকান্তিকভাবে ভালোবাসে, দাদার ভালোবাসাও ঠিক তেমনই ছিল। নারী বলতে সে বউদিকে কখনই বোঝেনি। কারণ বউদি রক্তমাংসের কামনা-বাসনায় ভরা নারী। দাদা ওকে ভয় পেত। আর অদিতি বড় আদরের খেলার পুতুল! তাকে নিয়ে যা খুশি করা যায়। তার উপর একাধিপত্য বিস্তার করা যায়। বহুদিন দেখেছি দাদা অদিতির কোলে শুয়ে আপনমনে হাবিজাবি বকে চলেছে। আর মেয়েটাও হাসিমুখে সেসব অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে যাচ্ছে। বউদি যা পারেনি, অদিতি তা পেরেছিল। দাদা তাকে নিজের মতো করে সাজাত। কখনও ঠোঁটে কাজল আর চোখে লিপস্টিক দিয়ে তাকে ভয়ংকর কুদর্শনা করে তুলত। কখনও তার চুল নিয়ে খেলা করতে করতে জট পাকিয়ে একসা করত। অদিতির তা নিয়ে কোনও অভিযোগ ছিল না। কোনওদিন দাদার অত্যাচারে তাকে বিরক্ত হয়ে উঠতে দেখিনি! বরং দাদাই এমন এক একটা কাজ করে বসত যে আমরাই লজ্জা পেয়ে যেতাম! অথচ অদিতিকে লজ্জা পেতে দেখিনি। সে যেন দাদাকে সন্তানস্নেহে গ্রহণ করেছিল।
একদিন দেখি দাদা অদিতির সারা গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছে। নারীদেহের প্রত্যেকটি চড়াই-উৎরাই, গোপন ভাঁজ ছুঁয়ে যাচ্ছে তার আঙুল। ওর বুকে হাত পড়তেই দাদা অবাক! সরল শিশুর মত প্রশ্ন করল, “এটা কী? তোমার আছে, আমার নেই কেন?”
অদিতি হেসে কী জবাব দিয়েছিল, আজ আর মনে নেই! শুধু মনে আছে বউদি বারান্দায় দাঁড়িয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সেদিকেই! দু’চোখ বেয়ে যেন বিষ ঝরে পড়ছে! ঈর্ষাকুটিল সে দৃষ্টি! সে চাউনি দেখে আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে গিয়েছিল! অব্যক্ত একটা ভয় বুকে জাঁকিয়ে বসেছিল! এ যে খুনীর চোখ! নিজের অভিপ্সিত বস্তু অন্যের হাতে চলে যাচ্ছে দেখলে মেয়েরা প্রাণ দিতে পারে, নিতেও পারে! প্রতিহিংসাপরায়ণা নারীর চেয়ে বিষাক্ত আর কিছু নেই।
আর তারপরই একদিন অদিতি চলে গেল। কে জানে, হয়তো রক্তমাংসের মানবী তার মধ্যেও জেগে উঠেছিল। খেলাঘর ভেঙে সেও বাস্তবের পুরুষ, বাস্তবের প্রেম আর বাস্তব ঘর-সংসার চেয়েছিল। তাই একরাতে পালিয়ে গেল পাশের বাড়ির ছেলেটির সঙ্গে। অবশ্য জানি ঘটকালিটা বউদিই চুপিচুপি করেছিল। বিশ্বসংসারকে ফাঁকি দিতে পারে এ নারী। আমাকে নয়! আমি জানি, বউদিই প্রচণ্ড প্রতিশোধে একটা বিশ্ববকাটে ছেলের হাতে তুলে দিয়েছিল অদিতিকে! জ্ঞানবৃক্ষের বিষময় ফল বউদিই খাইয়েছিল ওকে! নিজে দূতীর কাজটা গোপনে সারলেও আমার চোখ বউদির পরিবর্তন ধরে ফেলেছিল!
এরপরের ইতিহাস খুব সংক্ষিপ্ত। অদিতির অন্তর্ধান আমাদের মধ্যে খুব বেশি আলোড়ন তুলতে পারেনি। কিন্তু দাদাকে যেন তছনছ করে দিয়ে গেল। এরপর আর হাতে গোনা কয়েকটা দিনই দাদা আমাদের সঙ্গে ছিল! অজানা ভয়ে কুঁকড়ে থাকল! দেওয়ালে কাকে যেন হাঁটতে দেখত সে! জল খেতে ভয় পেত। জলের গ্লাস দেখলেই বলত,
—“বিষ! বিষ! বিষ আছে, জলে বিষ আছে, পাপ আছে… পাপ…! ঢাকনাটা খুলিস না খোকন, খুলিস না…”
লক্ষ্য করেছি ঠিক তখনই বৌদির সারামুখে একটা অদ্ভুত তৃপ্তির ছাপ ভেসে উঠত! সে তৃপ্তি প্রতিহিংসার! সে তৃপ্তি একজন খুনীর! যে মানুষ বিষের বীজ গোপনে পুঁতে দিতে সফল হয়েছে, সে-ই এমনভাবে হাসতে পারে! আচ্ছা, দাদা কি সত্যিই প্রলাপ বকছিল? না তার কথার পিছনে লুকিয়েছিল আসল সত্যটা! সত্যিই জলে বিষ ছিল না তো! অদিতি চলে যাওয়ার পরই দাদার অসুখ বাড়ল কেন? দাদাকে বউদি বিষ দেয়নি তো? অথবা অদিতি? অদিতিকে কি বউদি দাদাকে বিষ দিতে বলেছিল? তাকে কি বুঝিয়েছিল যে এই মানুষটি বেঁচে থাকতে সে স্রেফ খেলার পুতুল হয়েই থাকবে! বেঁচে থাকতে দাদা তাকে কোথাও যেতে দেবে না! রক্তমাংসের নারী হয়ে উঠতে পারবে না সে!
তাহলে কি অদিতি? না বউদি?
৪
তন্নতন্ন করে সারা বাড়িটা খুঁজে চলেছি।
আজ সকালেই বউদি আর মা মন্দিরে গেছে। ওদের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়েই তল্লাশি চালাচ্ছি। বউদির ঘর, মায়ের ঘর, কিচেন— কিচ্ছু বাদ রাখিনি নাঃ, সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়েনি। ইঁদুর মারার বিষ, বেগন স্প্রে’র মতো মারাত্মক বিষ আছে বটে, তবে এগুলো সবই খুব দ্রুত কাজ করে। সায়ানাইড, স্ট্রিকনিন বা ওইজাতীয় বিষ হলে তো কথাই নেই! দাদা দু’সপ্তাহ তো দূর, দু’মিনিটও বাঁচত না!
অনেক ভেবে দেখলাম যে এমন কোনও বিষ খোঁজা উচিত যা খুব ধীরে ধীরে কাজ করে। যেমন, আর্সেনিক, থ্যালিয়াম বা রাইসিন জাতীয় স্লো পয়জন আজকাল আবার নানারকম ড্রাগও আছে যা ব্যবহার করলে মানুষ বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়। ড. ব্যানার্জী যেমন বলেছেন, তেমন সিম্পটমও দেখা দেয়। কিন্তু তেমন ড্রাগের কথা এ বাড়িতে কে জানবে? মা? বিষ বলতে তিনি শুধু ইঁদুর মারার বিষই বোঝেন! বউদি সারাজীবনেও বিষ চোখে দেখেছে কি না কে জানে!
এ বাড়িতে দু’জন লোকই বিষের খোঁজ রাখতে পারে। একজন আমি। যার কাজ ডাক্তারদের ঘাড়ে পড়ে ওষুধ গছানো। অর্থাৎ মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ! আর অদিতি! যার বিষয় ছিল কেমিস্ট্রি! একজন কেমিস্ট্রির স্টুডেন্টের পক্ষে বিষের খোঁজ রাখা খুবই সহজসাধ্য! কোনটা কত পরিমাণে দিলে কী হতে পারে তা তার বেশ ভালোই জানা ছিল! তবে কি অদিতি?
আমি অদিতির ঘরে ঢুকলাম। সন্দেহ-কুটিল চোখে দেখে বেড়াচ্ছি তার ঘর! অদিতির উপস্থিতিতে এ ঘরে কখনও ঢুকিনি। একেই বউদির অদ্ভুত একটা ঈর্ষা ছিল তার উপরে। তার উপর আমাকে এ ঘরে দেখলে রক্ষে থাকত না! অদিতিকে নিয়ে আমাদের মধ্যে কম ভুল বোঝাবুঝি হয়নি! একবার অদিতির জন্মদিন উপলক্ষ্যে একটা দামি শাড়ি কিনে এনেছিলাম। অদিতি খুশি হয়েছিল। মাও খুশি হয়ে শাড়িটা তাকে পরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার দেওয়া শাড়ি পরে সেদিন মহানন্দে পাড়া ঘুরে বেরিয়েছিল সে। সবাইকে জানিয়েছিল,
—“এটা আমায় দীপদা দিয়েছে। সুন্দর না?”
সেরাতে চরম মুহূর্তে হঠাৎ সরে গিয়েছিল বউদি! আমি পারছিলাম না! নারীরা অজগরের চেয়ে কিছু কম নয়! বড় মোহনীয় আর আগ্রাসী বেষ্টনে ধরে। পার্থক্য একটাই। অজগর যখন পরম যত্নে মানুষকে গিলতে থাকে তখনও মানুষটা ছাড়া পাওয়ার জন্য আপ্রাণ সংগ্রাম করে যায়। আর নারী যখন কোনও পুরুষকে গিলে নেয়, তখনও সে সংগ্রাম করে। ছাড়া পাওয়ার জন্য নয়, আরও গভীরে প্রবেশ করার জন্য!
আমি হাঁকপাক করছিলাম। কোনওমতে বলি, “কী হল? এসো?”
ছনছনিয়ে উঠল বউদি, “এখন আমাকে কেন? পেয়ারের বোনকে ডাকো!”
—“মানে?” দরদর করে ঘামছি। গোটা শরীরটা ফুঁসে ফুঁসে উঠছে। তবু বললাম, “কার কথা বলছ?”
—“কেন?” বউদির মুখটা অবিকল ডাইনির মতো দেখাচ্ছিল, “আজ যাকে আদর করে শাড়ি পরাচ্ছ, কাল তারই শাড়ি খুলবে তো! তোমাদের গোটা জাতটাকেই আমার চেনা হয়ে গেছে!”
আমি স্তম্ভিত! বউদির মনে এত বিষ! কখনও তো টের পাইনি! এসব কী উদ্ভট কল্পনা করছে! কেনই বা করছে!
—“শোনো,” বউদি আমার বুকে বুক ঘষতে ঘষতে বলল, “কাকে চাও? আমাকে না ওকে?”
—“আঃ… তোমাকে… তোমাকে!”
সে তখন আমার দুই উরুর উপরে বসে পড়েছে, “কে বেশি সুন্দর? আমি না ও?”
—“তুমি, তুমি!”
— “বেশ!” বউদি আবার ফিরে এল। আমাকে গ্রাস করতে করতে বলল, “তবে আমার দিব্যি রইল। ও মেয়ের দিকে তুমি তাকাবে না। তাকালে….”
—“তাকাবো না। প্লিজ!”
আমি নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলাম। বুকের উপর পরম সুখে এলিয়ে পড়েছে বউদি। বিড়বিড় করে বলল, “মনে থাকে যেন।”
মনে ছিল। অদিতির চোখে কখনও চোখ রাখিনি। ও অবশ্য ‘দীপদা, দীপদা’ বলে চারপাশে ঘোরাঘুরি করত। হয়তো কাছে আসতেও চাইত। কিন্তু বউদি আসতে দেয়নি। আমার রক্ষণাবেক্ষনের জন্য রীতিমতো পাহারাদারি করত সে।
আজ সেই অদিতির ঘরেই এসে দাঁড়িয়েছি। ঢুকতেই হালকা একটা মেয়েলি গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারল। অদিতি চলে গেলেও তার গন্ধটা এ ঘর থেকে এখনও যায়নি। কুমারী মেয়ে আর বিবাহিতা নারীর গন্ধের একটা পার্থক্য আছে। অদিতির ঘরের গন্ধটা ধূপের মতো। আর বউদির গা থেকে নাগচম্পার গন্ধ আসে! কে জানে, অদিতির গায়ে এখনও ধূপের সৌরভ খেলা করে কি না! এখনও এ ঘর পরিপাটি করে সাজানো। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসার টুলটা এখনও বুঝি কারোর উষ্ণ স্পর্শের প্রতীক্ষা করছে। সাদা ধবধবে চিরুনি, মুখে মাখার ক্রিম, কয়েকগাছি ইমিটেশনের চুড়ি আর হালকা একটা ইমিটেশনের চেইন এমনভাবে পড়ে আছে যেন তাদের মালকিন এখনই নিজের দেহে সযত্নে তুলে নেবে তাদের। হেনাগন্ধী চুলে দাঁত বসাবে চিরুনি। চন্দনরঙা মুখে আলতো আঙুলের স্পর্শের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে ক্রিম! সব প্রস্তুত। কিন্তু আসল মানুষটাই নেই!
ড্রেসিং টেবিলের পাশে তার লেখার টেবিল। এখান থেকে বিষ্ণুদের বাড়ির বেডরুম দেখা যায়। বিষ্ণু, তথা সেই এঁচোড়ে পাকা অপদার্থ ছেলেটা! যার সাথে বেপাত্তা হয়েছে অদিতি! হয়তো এই জানলা থেকেই তাদের পূর্বরাগ। তারপর একের পর এক দানপর্ব-স্নানপর্ব-তাম্বুলপর্বটর্বও হয়েছে কি না কে জানে! বড়াই দূতী তো বাড়িতেই ছিল! অতএব শেষ পর্যন্ত মিলনপর্ব ঘটেছে অদিতির কপালে। মা জানতে পারলে সে বেচারির কপালে স্রেফ মাথুর পর্বই নাচছিল!
আমি অদিতির লেখার টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালাম। লাল গোলাপের ছবি আঁকা রাইটিং প্যাডটা তখনও যথাস্থানেই রয়েছে। হয়তো অনেক প্রেমপত্রের সাক্ষী সে। এখনও সাদা বুকে কলমের আঁচড় পড়ার আশায় প্রতীক্ষারত!
সময় প্রায় পায়ের তলায় চাকা লাগিয়ে স্যাৎস্যাৎ করে এগিয়ে চলেছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না। যে-কোনও মুহূর্তে মা আর বউদি ফিরে আসতে পারে! মা আমাকে এ ঘরে দেখলে অবাক হবেন। বউদি অনর্থ ঘটাবে। তাই যত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করা যায় ততই ভালো।
সময় নষ্ট না করে উঠেপড়ে খোঁজা শুরু করলাম। কী খুঁজছি, কীসের সন্ধানে চোখদুটো প্রতিটা বর্গফুট মেপে নিচ্ছে তা আমিও জানি না। খুঁজছি অন্য কিছু। কিন্তু মন চলে যাচ্ছে অন্যদিকে। যতই ঘর হাতড়াচ্ছি, ততই বিস্ময় বাড়ছে! অদিতির আলমারিতে এখনও ভরতি শাড়ি, সালোয়ার কামিজ! সে এসব নিয়ে যায়নি! আশ্চর্য! তার লকারে দু’গাছা সোনার চুড়ি, কানের দুল সুরক্ষিত! যে মেয়ে এক নিঃসম্বল যুবকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল, সে নিজের স্ত্রী-ধনটুকুও নিয়ে যায়নি!
সবচেয়ে চমকে গেলাম আলমারির ড্রয়ার খুলে! ওখানে গোটা তিনেক পুতুল শুয়ে আছে। এই তিনটে পুতুলকেই আমি চিনি! এই নরম পশমের কুকুরটার নাম রাস্টি! হাততালি দেওয়া ভালুকটার নাম বিল্লু! আর বারবিটার নাম অ্যাঞ্জেল! এই তিনটে পুতুলই দাদার ভীষণ প্রিয় ছিল! রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে তিনটে পুতুলকে ঘুম পাড়িয়ে তবেই সে ঘুমোতে যেত! এই তিনটে পুতুল অদিতির ঘরে কী করছে! দাদা কি অদিতিকে পুতুলগুলো দিয়ে দিয়েছিল? রাস্টি, বিল্লু আর অ্যাঞ্জেল তার প্রাণের চেয়েও প্রিয়। দাদা নিজের অধিকারবোধ সম্পর্কে চিরকালই ভয়ানক একগুঁয়ে। যা তার নিজের, তা কিছুতেই অন্যকে দেবে না!
পুতুলগুলো হাতে নিয়েই খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। দাদা তখন একদম স্বাভাবিক। তবু তার চরিত্রে একটা অদ্ভুত ক্রুরতা ছিল। এমনিতে আপাতদৃষ্টিতে সে নিষ্ঠুরতা দেখা না গেলেও কখনও কখনও ওর নরম-সরম স্বভাবের মধ্য থেকেই ঝিলিক দিয়ে উঠত শানিত ক্রুরতা! ছোটবেলায় মা ঠাট্টা করে বলেছিলেন যে আর একটু হলেই সে নাকি আমার, অর্থাৎ তার সদ্যোজাত ভাইয়ের গলা টিপে মারছিল!
আমি অবাক, “কেন মা?”
মা হাসছিলেন, “কেন আর! নেহাতই ছেলেমানুষী। ও ভেবেছিল ছোট ভাই এলে ওর মা আর ওকে ভালোবাসবে না। ছোট ভাইকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। তাকেই ভালোবাসবে।”
আমিও তখন ছোট। দাদার কাণ্ড শুনে ভয় পেয়েছিলাম। বিস্ময় আর আশঙ্কা মিশিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “মা, দাদা কি এখনও আমাকে মারবে?”
মা হেসে ফেললেন, “পাগলের কথা শোন! এখন আর মারবে কেন? দাদা এখন নিজেই তোকে ভালোবাসে না?
সত্যিই দাদা আমায় খুব ভালোবাসত। তার চরিত্রে তখনও কিছু অস্থিরতা ছিল। কিন্তু যাকে সে ভালোবাসত, একেবারে প্রাণ দিয়েই ভালোবাসত! স্কুলে কেউ আমায় ধরে মারলে, দাদা উলটে তাকে মারতে যেত! অসুস্থ হয়ে পড়লে মা, বাবার উদ্বিগ্ন মুখের পাশে দাদার ব্যাকুল মুখটা সবসময়ই চোখে পড়ত। এর, ওর বাগান থেকে ফল চুরি করে এনে খাওয়াত। আমার ভুলের শাস্তি নিজের ঘাড়ে টেনে নিয়ে বাবার হাতে কতবার মারও খেয়েছে!
অথচ সেই দাদার সাথেই একরাতে প্রায় হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম! দাদার একটা লাল টুকটুকে খেলনা গাড়ি ছিল। আমার বড় লোভের জিনিস ছিল খেলনাগাড়িটা। আমি ঘ্যানঘ্যান করে বায়না জুড়েছিলাম, “দাদা, গাড়িটা আমায় একটু দে না! খেলব।”
দাদা মুখ বেঁকিয়ে বলল, “তোর নিজের গাড়ি দিয়ে খেল গে! এটা বড়দের খেলনা। ছোটরা খেলে না!”
ওর জ্ঞানগর্ভ কথা শুনে আমার রাগ হল। কী আমার গুরুঠাকুর এসেছেন রে! মোটে তো পাঁচ বছরের বড়! তাতেই এত বড় বড় কথা! ব্যস, লেগে গেল হাতাহাতি! দাদাও গাড়িটা দেবে না। আমিও নিয়েই ছাড়ব! এই করতে করতে একসময় দাদা হঠাৎ কেমন যেন খেপে গেল! হিসহিসিয়ে বলল,
—“আমার গাড়ি তুই নিবি? দাঁড়া! এই নে … ‘
কথাগুলো বলতে বলতেই সে তার প্রিয় খেলনাগাড়িটাকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল কুয়োর মধ্যে! একটা ছপাৎ করে শব্দ! তারপর কুয়োর অন্ধকারে, জল কাদার ভিতরে কোথায় যে মিলিয়ে গেল গাড়িটা কে জানে!
তখনই মনে হয়েছিল, এই দাদাকে আমি ঠিক চিনি না! এই অদ্ভুত নিষ্ঠুর দাদা আমার আজন্মপরিচিত মানুষটা নয়। দু’চোখে ক্রুর দৃষ্টি নিয়ে সে তখনও সাপের মতো হিসহিস করছে, “নিবি? নিয়ে নিবি আমার খেলনা? যা নিয়ে আয়!”
আমি ভয় পেয়ে কেঁদে উঠলাম! মা তাড়াতাড়ি ছুটে এলেন। বাবা দাদার কান পেঁচিয়ে ধরেছেন। কিন্তু দাদার মুখে অদ্ভুত তৃপ্তি! যা তার নিজের ছিল, সে জিনিস সে অন্য কারোর হাতে তুলে দেবে না! কিছুতেই না…!
সেই দাদা অদিতিকে তার প্রাণের চেয়েও প্রিয়তর পুতুলগুলো দিয়ে দিয়েছিল! কেন?
—“ঠাকুরপো!”
বউদির গলার স্বরে সংবিৎ ফিরে পেলাম। কী সর্বনাশ! ওরা ফিরে এসেছে! বউদি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মা চৌকাঠে পা রেখে ইতস্তত করছেন!
— “তুমি এ ঘরে?”
হাতের পুতুলগুলো সাজিয়ে রাখতে রাখতে অপ্রস্তুতের মতো হাসলাম, “এই পুতুলগুলো দেখতে এসেছিলাম।”
— “ও,” বউদি আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছে, “এটা রাখো। কুয়োর পাশ থেকে তুলসীমঞ্চ অবধি আগাছায় ভরে গেছে। মা বলছিলেন, তুমি যদি সাফ করে দাও। ওঁর পায়ের বাতের ব্যথাটা আবার বেড়েছে। নয়তো নিজেই করতেন।”
প্যাকেটটা একটা উইডকিলার বা হার্বিসাইডের। এমন প্যাকেট তিন-চার মাস অন্তর অন্তর এ বাড়িতে আসে। মা-ই আনান। কুয়োর চতুর্দিকটা আগাছার জঙ্গলে ভরে গেছে। সেই জঙ্গল তুলসীমঞ্চ অবধি এসে পৌঁছোয়। তাই উইডকিলার দিয়ে মা নিজেই আগাছা সাফ করেন।
কোনওদিন প্যাকেটটা মন দিয়ে দেখিনি। আজ প্যাকেটের পিছনদিকটা চোখে পড়তেই চমকে উঠলাম! উইডকিলারের পিছনের লেভেলে আর্সেনিকের ভালো পার্সেন্টেজ খোদাই করা! এত কাছে ছিল জিনিসটা! মায়ের ঘরে এর একটা খালি প্যাকেটও দেখেছি। পাত্তা দিইনি! অথচ হাতের কাছেই ছিল আর্সেনিকের মতো ভয়ংকর বিষ! জানতেও পারিনি!
আকস্মিকভাবেই দাদার মৃত্যুর কিছুদিন আগের কথা মনে পড়ে গেল! মা দক্ষিণেশ্বরে পুজো দিতে গিয়েছিলেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে শুনেছিলাম মা বিড়বিড় করে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করছেন, “এভাবে আর ছেলেটাকে কষ্ট দিও না ঠাকুর। ওকে মুক্তি দাও… মুক্তি দাও!” তবে কি শেষপর্যন্ত স্বয়ং মা-ই এনে দিয়েছিলেন সেই ইপ্সিত মুক্তি?
আমার দু’চোখে তখন তীব্র সন্দেহ। মা বোধহয় কিছু আঁচ করেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে যেন কিছু বলবেন বলে মনে হল। তাঁর অধর কিঞ্চিৎ ফাঁক হল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ফিরে এল আবার সেই শব্দটাই,
—“নাঃ, থাক!”
৫
—“সব মানুষই অল্পবিস্তর পাগল দীপঙ্কর! আমাদের মনের মধ্যেই দুটো সত্ত্বা লুকিয়ে থাকে। ঠিক দুটো ঘরের মতো। একটা আলোকিত ড্রয়িংরুম। মানুষ সচেতন অবস্থায় ওই আলোকিত ঘরেই থাকে। ওখানেই তার বেশিরভাগ ঘোরাফেরা। আরেকটা ঘরের কথা সে নিজেই জানে না। ওই ঘরটাই আসলে ডার্করুম। মানুষের মনের অন্ধকার ঘর। একমাত্র অবচেতন মনই তার খোঁজ জানে। অচেতনে সে উঁকিঝুঁকি মারে ওই ডার্করুমে! তখনই অবচেতনের কথা স্বপ্ন হয়ে উঠে আসে। কিন্তু আলোকিত মন তাকে অগ্রাহ্য করেই চলে। তবে কিছু কিছু মানুষের মন একেবারে ঢুকে যায় ওই ডার্করুমে। আর বেরিয়ে আসতে পারে না। ডার্করুমের দরজা একবারই খোলে। মানুষ সেখানে প্রবেশ করতে পারে বটে, কিন্তু বেরিয়ে আসতে পারে না! তোমার দাদাও তেমনই একটা ডার্করুমে ঢুকে পড়েছেন। বেরোবার পথ নেই!
আমি ঘামছিলাম। অসহ্য গরম লাগছিল। ড. ব্যানার্জী আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন, “এই যেমন এখন তুমি উঁকি মেরেছ নিজের ডার্করুমে! দেখো, কত কালিঝুলি জমে আছে ঘরের কোণে কোণে! এই কালিঝুলি সাফ করলেও ওঠে না দীপঙ্কর! ওই দেখো, তোমার দাদা কী করছেন।”
আমি চমকে তাকালাম! ঘরটা ভীষণ অন্ধকার। মানুষদের ঠিকমতো দেখা যায় না। যেটুকু দেখা যায়, সেটুকু অবিকল নেগেটিভের ছায়া মানুষদের মতো! যেন এখনও ফিল্ম ডেভেলপ করা হয়নি। বউদিকে দেখতে পাচ্ছি! কিন্তু তাকে মানুষের মতো লাগছে না! দেখছি একটা সাপ হিসহিস করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে! আমি নিশ্চিত জানি ওটা বউদিই!
—“খোকন!”
আমি চমকে তাকালাম! দাদার হাতে ওটা কী ঝুলছে? অবিকল অদিতির মতো দেখতে মানুষটাকে! অদিতির চুল ধরে তাকে কুয়োর মুখে ঝুলিয়ে রেখেছে দাদা। তার চোখে লিপস্টিক! ঠোঁটে কাজল। অদিতির মুখে যন্ত্রণার ছাপ নেই। বরং ভীষণ নিস্পৃহ! তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা ছেলে। কে ওটা?
ছেলেটার দিকে তাকাল দাদা। ফিসফিস করে বলল, “নিবি? আমার পুতুল নিবি? অ্যাঁ? আয়, নিয়ে যা!”
ছেলেটা কয়েক পা এগোলো। আমি প্রাণপণে চিৎকার করে ওকে বারণ করতে চাইলাম। কারণ আমি জানি এরপর কি ঘটতে চলেছে! এ ঘটনা আমার শৈশবেও ঘটেছিল। ছেলেটাকে সতর্ক করে দিতে চাই। কিন্তু আশ্চর্য! গলা দিয়ে কোনও আওয়াজই বেরোলো না!
—“আমার পুতুল নিবি?” কুয়োর মুখে অদিতির ঝুঁটি ধরে অল্প অল্প দোলাচ্ছে দাদা। ছেলেটি হাত প্রসারিত করে বলল, “দাও।”
—“এই নে!” আমার চোখের সামনেই অদিতিকে কুয়োয় ফেলে দিল দাদা। হো হো করে অট্টহাসি হেসে বলল, “নে। এবার নিয়ে যা। নিয়ে যা। নিয়ে যা-আ-আ-আ!”
মোবাইলটা সশব্দে বেজে উঠেছে!
ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসি! এতক্ষণ তবে স্বপ্ন দেখছিলাম! কিন্তু স্বপ্ন এত বাস্তব হয়ে ওঠে কী করে! তখনও যেন কানের মধ্যে বাজছে দাদার চিৎকার, “খোকন… ঢাকনাটা খুলিস না! জলে বিষ আছে… পাপ! পাপ আছে! ও আমায় জলে টেনে নেবে!”
গলার কাছটা ভীষণ শুকিয়ে গেছে। জলের গ্লাসটার দিকে হাত বাড়িয়েই শিউরে উঠি! গ্লাসটাকে অবিকল কুয়োর মতো লাগছে না! অবিকল সেইরকমই দেখতে। মুখের কাছটা হাঁ করা! তলাটা সমান্তরাল ভাবে নেমে গেছে, যেমন কুয়োরও…! কয়েক মুহূর্তের জন্য রক্তজল হয়ে যায়। গ্লাসের উপরের ঢাকনাটা খুললে কী দেখব? ওই জলের মধ্যে কী আছে! দাদার পাপ! প্রেতরূপী অদিতি? অথবা অদিতির সঙ্গে বিষ্ণুও…! সেদিন রাতে কী হয়েছিল? রাতের কাজ সারার অছিলায় অদিতি কলতলায় গিয়েছিল। বিষ্ণু ও হয়তো এসেছিল! তারপর? তারপর কী? হলদেটে জলের নীচে কি বিষাক্ত শ্বাস ফেলছে দাদার কৃতকর্ম! সেই জন্যই কি জলে বিষ? জলে পাপ?
মোবাইলটা তখনও বেজে চলেছে। আমি বিমূঢ়ের মতো সেলফোনটা তুলে নিই
—“হ্যালো?”
ওপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে ড. ব্যানার্জীর কণ্ঠস্বর, “আই কান্ট বিলিভ দিস দীপ! তোমার দাদার রিপোর্টে হাইড্রোফোবিয়া ধরা পড়েনি!”
নির্লিপ্ত স্বরে জানাই; “জানি”
—“তোমার কথামত বিষের ট্রেসও খুঁজেছিলাম। কিন্তু কোনও বিষের অস্তিত্ব নেই!”
—“জানি,”
—“তবে?” ড. ব্যানার্জী উত্তেজিত, “তবে কি ভুল ডায়গনোসিস করলাম?”
— “না। ঠিকই ধরেছেন,” আমি ক্লান্ত ভাবে বলি, “দাদার হাইড্রোফোবিয়াই ছিল।”
—“মানে?”
একবার ভাবলাম স্বপ্নের কথাটা ওঁকে বলি। কোনও স্বপ্ন এরকম বাস্তব ছবি আগে কখনও দেখিয়েছে কি? মিলছে, সব মিলছে। দাদার জলাতঙ্কের কারণ, গ্লাস দেখলেই ভয় পাওয়া, বারবার বিষ আর পাপের কথা বলা, সব মিলছে! আমার ডার্করুমে দাদার অন্ধকার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। এখন ইচ্ছে করলেই ড. ব্যানার্জীকে সব কথা খুলে বলতে পারি। লোক ডেকে কুয়োটা পরিষ্কার করাতে পারি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস অন্তত দুটো লাশ ওই কুয়োর অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে আছে! আছেই! নিজের কৃতকর্মের শকটা নিতে পারেনি দাদা! তার ডার্করুমে ঘুরে বেড়াচ্ছিল গোপন পাপ, অদিতির বিষাক্ত অভিশাপ!
কী করব? বলব সব কথা? আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে যাই। অবিকল মায়ের মতো করেই বলি,
—“নাঃ, থাক।”
ফ্যাসিনেটিং
ফ্যাসিনেটিং
১
চতুর্দিকে এক অদ্ভুত মৃত্যুর মিছিল! যেন মরণ তার দীঘল ডানায় ভর করে চক্কর কাটছে অবিরত। ক্রমাগতই তার ঈগলের মতো শ্যেনদৃষ্টি দিয়ে মেপে নিচ্ছে প্রায় কঙ্কাল হয়ে আসা মানুষগুলোকে। আর ভাবছে, আজ ওদের মধ্যে কার প্রাণ ছোঁ মেরে তুলে নেবে নিজের হিংস্র নখরে! ক্ষুধার্ত-দুর্ভিক্ষপীড়িত দেহগুলোতে এমনিতেই জীবন বিশেষ অবশিষ্ট নেই। ওদের চোখের চাউনি মৃত মানুষের মতোই ঘোলাটে, নিষ্প্রভ। দেখলে মানুষ বলেও মনে হয় না! ক্ষুধায় অবশ হয়ে আসা সার সার হাড় আর চামড়ার খোলস মাত্র। শুধু যখন শ’য়ে শ’য়ে হাড়-শিরা বের করা হাত বুভুক্ষুর মতো একটু খাবারের আশায় এগিয়ে আসে, তখনই বোঝা যায় যে ওরা জীবিত! নয়তো জীবন্ত লাশ ছাড়া ওরা আর কিছুই নয়। হৃৎপিণ্ড যেটুকু প্রাণের স্পন্দন এখনও টিকিয়ে রেখেছে, যে কোনও মুহূর্তে তা থেমে যেতে পারে। সেটা শকুনের পালও খুব ভালোভাবেই জানে। তাই পরমোল্লাসে আকাশে নিয়ম করে টহল দিচ্ছে।
ওরা কারা তা নিয়ে আদৌ মাথাব্যথা নেই খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী অরিত্র সান্যালের। ওরা তাঁর কাছে কোনও অস্তিত্ব নয়। স্রেফ সাবজেক্ট! তাঁর ছবির এগজিবিশনের নতুন থিম! এবারের থিম ক্ষুধা, তথা ‘হাঙ্গার’। বেশ কয়েকবছর ধরে এই প্রদর্শনীর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। বিশেষ করে শুধু এই ছবিগুলো আঁকার জন্যই অনেকদিন যাবত সোমালিয়া ও সাউথ সুদান চষে বেরিয়েছেন! চোখের সামনে দেখেছেন সোমালিয়ার প্রাণঘাতী দুর্ভিক্ষ! সাউথ সুদানের ক্ষুধার হাহাকার তাঁর তুলিতে জীবন্ত রূপ পেয়েছে। এই মারাত্মক ক্ষুধার বিকৃত রূপ তাঁর প্রত্যেকটি ছবিতে বীভৎসভাবে প্রকট! যে কোনও মানুষ সেসব ছবি দেখলে আঁতকে উঠবে! দর্শকের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার জন্য একদম পারফেক্ট প্রোডাক্ট!
অরিত্র মনে মনেই হাসলেন। এখনও যে কোনও শিল্পের ক্ষেত্রে চরমতম আবেদনময় বিষয় হল ক্ষুধা! মানুষের ক্ষুধাকে বিক্রি করেই মানুষ কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে! আর মাত্র কয়েকটা দিন। তারপরেই সম্ভবত তাঁর জীবনের বৃহত্তম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিত্রপ্রদর্শনীটি শুরু হবে। দিল্লীর সবচেয়ে বড় আর্ট গ্যালারিতে প্রায় মাসাধিক কাল জুড়ে সাজানো থাকবে অরিত্রর ছবির সম্ভার। লাখ লাখ টাকায় বিক্রি হবে এক একটা অতুলনীয় ছবি। এমনিতেই অরিত্রর ছবি বাজারে পড়তে পায় না! এবার তো আরও বেশি লাভ হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা। কারণ এই বিরাট এগজিবিশনে প্রচুর বিদেশি মানুষ আসবেন। তা-ই এবার লাখে নয়, সম্ভবত কোটিতে বিক্রি হবে তাঁর ছবিগুলো। কড়কড়ে ডলারে বিকিয়ে যাবে শিল্প। বিকিয়ে যাবে ক্ষুধা! কারণ সাহেব-মেম সমঝদারেরা আর কিছু না বুঝুক, ক্ষুধার ভাষা খুব ভালোই বোঝে! হাড় জিরজিরে মৃতপ্রায় শিশু, দুর্ভিক্ষপীড়িত ভুখা মানুষের হাহাকার, কান্না ইত্যাদি দেখলেই তাদের চোখ দিয়ে গঙ্গা, ভলগা, টেমস, মিসিসিপি এবং নাইলের মিলিত জলপ্রবাহ দরদরিয়ে পড়তে থাকে! টিস্যু পেপারে নাক-চোখ বারবার মুছতে মুছতে হীরে, প্ল্যাটিনামের দরে ছবি কিনে নিয়ে যায় তারা! তবে এবার অবশ্য ব্যাপারটা টাকার থেকেও আরও কিছুটা বেশিই গুরুত্বপূর্ণ। রয়েছে এক অভাবনীয় সুযোগের সম্ভাবনাও। দিল্লীর সেই বিশেষ আর্ট গ্যালারিতে আসবেন এই শতাব্দীর সেরা আর্টিস্ট ড্যানিয়েল গ্রে! ড্যানিয়েলের যদি তাঁর কাজ পছন্দ হয়ে যায়, তবে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অরিত্রর সঙ্গে স্বয়ং এই পৃথিবীখ্যাত চিত্রশিল্পীর যুগ্ম চিত্রপ্রদর্শনী হবে! ভাবতেই তাঁর গায়ে কাঁটা দেয়। ড্যানিয়েল গ্রে’র সঙ্গে এগজিবিশনে ছবি দেওয়ার সৌভাগ্য খুব কম শিল্পীরই বরাতে জুটেছে। অনেক প্রখ্যাত আর্টিস্টের কাছে এই সুযোগ অদ্ভুত এক অধরা স্বপ্নের মতো। অথচ সেই সুযোগ অরিত্র সান্যালের সামনে দরজা খুলে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
—“আপনার কফি স্যার,”
অরিত্রর তিনতলা বাড়ির গোটা একতলাটাই ব্যক্তিগত স্টুডিও। স্টুডিওর একনিষ্ঠ কর্মী শ্রুতি হাতে কফি আর স্ন্যাকসের ট্রে নিয়ে এসে ঢুকল তাঁর ঘরে। মেয়েটার আঁকার হাত মন্দ নয়। ভাবনা চিন্তায় সামান্য ঘাটতি রয়েছে ঠিকই, তবে সেটুকু অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পূরণ হয়ে যাবে। অরিত্র ওর ওপর খুব ভরসা করেন। শিল্পী হিসাবে না হোক, চিত্রসমালোচক হিসাবে শ্রুতি অত্যন্ত তুখোড়। ওর মতামত তাঁর কাছে মূল্যবান!
—“থ্যাঙ্কস ডিয়ার,” অরিত্র সদ্যসমাপ্ত ছবিটি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে শ্রুতির দিকে তাকালেন। তাঁর চোখে একটু অন্যমনস্কতা। অসন্তুষ্টভঙ্গীতে বললেন, “ছবিটা বেশ কিছুক্ষণ হল কমপ্লিট হয়েছে। কিন্তু কিছু একটা গোলমাল আছে! সেটা যে কী, কিছুতেই বুঝতে পারছি না। একবার দেখবে?”
শ্রুতি কফির কাপ, চিজ বিস্কুট আর স্যান্ডউইচের প্লেট অরিত্রর সামনের টেবিলে সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল, “আমি কি বুঝতে পারব স্যার? বিশেষ করে এবারে আপনার ছবিগুলো বড় বেশি ডিভাস্টেটিং! দেখলেই ভয় করে। রাতে ঘুম হয় না। এত ভয়ংকর থিম রাখা কি খুব দরকার ছিল?”
—“হাঙ্গার মাই ডিয়ার! ক্ষুধা!” স্যান্ডউইচে একটা বড়োসড়ো কামড় বসিয়ে বললেন তিনি, “এর থেকে মারাত্মক সাবজেক্ট আর দুনিয়ায় নেই। ভেরি ফ্যাসিনেটিং!”
হাঙ্গারের মধ্যে ফ্যাসিনেশন! শ্রুতি কয়েকমুহূর্তের জন্য নির্বাক হয়ে যায়। ক্ষুধার মধ্যে কী সৌন্দর্য আছে তা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সে চতুর্দিকে সাজানো ছবিগুলোর দিকে তাকায়। এগুলো আপাতত প্রদর্শনীর জন্য অপেক্ষা করছে। ক্যানভাসে উলঙ্গ, ক্ষুধার্ত ও মৃত মানুষের মিছিল! মরণাপন্ন মানুষের ক্রন্দনবিকৃত হাঁ করা মুখের মধ্যে কোন্ সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে, তা আজও সে বোঝেনি! বোঝেনি বলেই হয়তো পরিপূর্ণ শিল্পী হয়ে উঠতে পারেনি। এই ছবিগুলো দেখলেই তার বুকের মধ্যে এক অব্যক্ত কষ্ট আঁচড় কাটে। অসম্ভব নির্মম মনে হয়। অথচ স্যার বলছেন, “ফ্যাসিনেটিং!”
অরিত্র তখনও ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন সদ্যসমাপ্ত ছবিটির দিকে। হ্যাঁ, ছবির মতো ছবি হয়েছে বটে! এই ছবিটার জন্যই চিত্রশিল্পী অরিত্র সান্যাল অমর হয়ে যেতে পারেন! এটাই হয়ে উঠতে পারে তাঁর মাস্টারস্ট্রোক। সব ঠিক আছে, অথচ মনে হচ্ছে, কী যেন নেই! মনে হচ্ছে, কোথাও কিছু একটা ভুল হয়েছে! ছবিটা ফুঁসে উঠতে গিয়েও যেন কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ঝিমিয়ে পড়েছে! এমন তো হওয়ার কথা নয়!
তিনি অতৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, “প্লিজ শ্রুতি, টেক আ লুক। কিছু একটা ত্রুটি রয়েছে যা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।”
—“শিওর।”
মুখে ‘শিওর’ বললেও শ্রুতি একটু ভয়ে ভয়েই ক্যানভাসের দিকে তাকায়। স্যার এবার যেসব ছবি এঁকেছেন, সেগুলো দেখার অভিজ্ঞতা তার কাছে বিশেষ সুখকর নয়। তবু এতবড় শিল্পী যখন অনুরোধ করেছেন, তখন একবার দেখতেই হয়। তাই অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছবিটার দিকে তাকাল সে।
ক্যানভাসে তখন নিষ্প্রভ রঙে ফুটে উঠেছে এক মর্মান্তিক ছবি! চতুর্দিকে মৃত গরুর গলিত, খাওয়া-আধখাওয়া কঙ্কাল! তার কেন্দ্রে এক মৃত কঙ্কালসার শিশুকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে একপাল শকুন। আর শিশুটির হাড় জিরজিরে ক্ষুধার্ত মা আপ্রাণ বাধা দিচ্ছে তাদের! কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবে না কোলের সন্তানকে! দু’হাত দিয়ে ধরে রেখেছে ছোট্ট শিশুটির মরদেহ। সেই নারী প্রায় নগ্ন! সত্যি কথা বলতে কী তাকে নারী বলে চেনাই দায়! দেহ নগ্ন হলেও কোনওরকম পেলবতা, উত্থান-পতন নেই। শুধু যেন একরাশ হাড়ের একটি কাঠামো! গৃধ্রদলের সঙ্গে অসমযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত! কান্নাবিকৃত মুখ, দু’চোখে আতঙ্ক! কী ভয়ংকর!
মুহূর্তের জন্য চোখ বুজে ফেলল শ্রুতি। নাঃ, আঁকার দিক দিয়ে কোনওরকম ত্রুটি নেই। প্রতিটি রেখা যেন অগ্নিশিখার মতো লেলিহান ভঙ্গিমায় নেচে নেচে উঠছে। সাবলীল স্ট্রোক! শকুনদের হিংস্রতা ও এক মরণাপন্ন মায়ের অন্তিম লড়াই এত বেশি জীবন্ত যে ভয় করে! এই ছবি দেখতে ইচ্ছে করে না তার। বড্ড হিংস্র…বড় বেশি নিষ্ঠুর…
—“দেখলে? কেমন লাগল?”
অত্যন্ত আগ্রহ সহকারে জানতে চান অরিত্র। শ্রুতি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “অসাধারণ! কিন্তু আকাশটা স্যার!”
—“আকাশটা কী?” তিনি একঝলক ছবিটার দিকে তাকালেন। ছবির আকাশে কোনওরকম ত্রুটি আছে কি? না তো! রীতিমতো নির্মল নীল আকাশ, সাদা সাদা মেঘও উড়ে যাচ্ছে। তার মধ্যেই ডানা মেলেছে করাল মৃত্যু! অরিত্র জিজ্ঞাসু হয়ে ওঠেন, “তোমার মনে হয় ডিফেক্টটা আকাশে?”
—“ইয়েস।” সে মাথা নাড়ল, “ছবিটা মোটেই ব্রাইট নয় স্যার। আই মিন, সুন্দর নয়। বরং ভয়ংকর! কিন্তু এ ছবির সঙ্গে নীল, সুন্দর আকাশ মানাচ্ছে না। আকাশের সাদা মেঘও নয়!”
—“ব্রাভো! এক্সেলেন্ট মাই ডিয়ার!” অরিত্র উচ্ছ্বসিত হয়ে শ্রুতির কাঁধ চাপড়ে দিলেন, “অ্যাবসোলিউটলি রাইট! আকাশটা গ্লুমি বা কালো হওয়া উচিত ছিল। সেইজন্যই বারবার মনে হচ্ছে, কী যেন একটা মিসিং! কী যেন একটা অসঙ্গতি আছে! গ্রেট শ্রুতি! আমার দৃঢ় বিশ্বাস, তুমি একদিন অনেকদূর যাবে।”
শ্রুতির ভয়বিবর্ণ মুখে এতক্ষণে রক্তসঞ্চার হল। সে স্মিত হেসে বলে,
—“থ্যাঙ্কস,”
—“আসলে দোষ আমারও নয়,” তিনি এবার চিজ বিস্কুট তুলে নিয়ে বললেন, “দৃশ্যটা বাস্তবে ঠিক যেমন ছিল, আমি অবিকল তেমনই এঁকেছি। প্রকৃতি তো আর তুচ্ছ মানুষের কথা চিন্তা করে রঙ বদলায় না। তাই আসল দৃশ্যে আকাশটা এমন নীলই ছিল। বাস্তব আর শিল্পে সামান্য ফারাক থাকে। আমার বোঝা উচিত ছিল যে ছবিতে নীল আকাশ মানাবে না…”
বলতে বলতেই থেমে গেলেন অরিত্র। বলা ভালো, থামতে বাধ্য হলেন। শ্রুতি তাঁর দিকে স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টিতে ভয়, অবিশ্বাস আর অনেকখানি বিস্ময় মেশানো। যেন কোনও ভূত দেখছে! তিনি অবাক,
—“কী হল?”
—“আপনি…” সে কাঁপা গলায় বলে, “আপনি নিজের চোখে এ দৃশ্যটা দেখেছেন! এটা বাস্তবে ঘটেছিল?”
—“অফ কোর্স!” অরিত্র কফির মাগে চুমুক দেন, “শিল্প তো আকাশ থেকে পড়ে না! বাস্তবের সঙ্গে তার যোগ নিবিড়। আমি যখন সোমালিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম, তখন এই এক্সক্লুসিভ দৃশ্যটা চোখে পড়ে গিয়েছিল। আমি সঙ্গে সঙ্গেই একটা পেপারে রাফ স্কেচটা করে ফেলেছিলাম। বাকিটা অবশ্য পরে ধীরেসুস্থে করেছি। কিন্তু মেইন স্ট্রাকচারটা তখনই করেছিলাম।”
—“মানে!” শ্রুতির কণ্ঠস্বর তখনও কাঁপছে, “যখন মৃত শিশুর শবদেহ নিয়ে অর্ধমৃত ক্ষুধিত মা শকুনের সঙ্গে লড়াই করছিল, তখন আপনি সেই দৃশ্যটা বসে বসে আঁকছিলেন!”
—“নয়তো কী?” অরিত্র নির্বিকারভাবে বলেন, “সেটাই তো আমার কাজ। আই অ্যাম আ প্রোফেশনাল! আমার যা করণীয়, সেটাই তো করব। দেখো না, সাংবাদিকরা কীভাবে বন্যাবিধ্বস্ত লোকদের ছবি তোলে! তারা শুধু ছবিই তোলে। রেস্কিউ করতে যায় না। ওটা ওদের কাজ নয়!”
—“কিন্তু আপনি কি মেয়েটিকে কোনওভাবে হেল্প করতে পারতেন না?”
—“কাম অন ডিয়ার,” অরিত্র মাথা ঝাঁকালেন, “ইমোশন আলাদা আর প্রফেশনালিজ্ম আলাদা। তাছাড়া আমি কী করতে পারতাম? হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মরছিল! কতজনকে বাঁচাতে পারতাম?”
“কিন্তু আপনি সেই মৃতপ্রায় মানুষগুলোর ছবি আঁকতে পেরেছেন!” শ্রুতির চোখের কোণ চিকচিকিয়ে ওঠে। সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
—“কনগ্র্যাট্স্ স্যার। এই ছবিগুলো সত্যিই আপনাকে অমর করে রাখবে।” কথাগুলোর মধ্যে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ ছিল কিনা ঠিক বোঝা গেল না। থাকলেও তাতে কিছুই আসে যায় না। শ্রুতির বয়েস এখনও অনেক কম। কাঁচা মাটির মতো মন। তাই একটু আবেগপ্রবণ। শিল্পীর নির্লিপ্তি আসতে সময় লাগবে। তাই ওর কথায় কিছুই মনে করলেন না অরিত্র। মৃদু হেসে বললেন,
— “এনিওয়ে, থ্যাঙ্কস ফর দ্য কফি।”
২
—“আই চাওয়ি… আই চাওয়ি সাইডো…”
শব্দটা কিছুটা এই জাতীয়ই ছিল। সঠিক উচ্চারণ এটাই, না অন্যকিছু তা বোঝা অসম্ভব। তবু এরকমই কিছু শব্দগুচ্ছ বারবার শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু তখন অর্থটা বোঝেননি। সেই মেয়েটি চিৎকার করে এরকমই কিছু বলে যাচ্ছিল। আর প্রবল বিক্রমে লড়ে যাচ্ছিল শকুনগুলোর সঙ্গে। ওর কোলের শিশুটি যে মরে কাঠ হয়ে গিয়েছে তা বুঝতে বাকি ছিল না! এবং ওকে দেখেও স্পষ্ট বোঝা যায় যে ওর আয়ুও বেশিক্ষণ নেই! কালো কুচকুচে চামড়া মাংস পেশীর অভাবে ঝুলে গিয়েছে। অনাবৃত দেহের শুষ্ক স্তনগ্রন্থিটুকু চোখে না পড়লে বোঝাই দায় যে ও নারী না পুরুষ। চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে ধরেছে গৃধ্রুবাহিনী। তাদের নখের আঁচড়ে, ঠোকরে রক্তাক্ত হতে হতেই চিৎকার করে যাচ্ছিল সে, “আই চাওয়ি… আই চাওয়ি…”
কিন্তু সে ডাকে সাড়া দেননি অরিত্র। বরং গাড়ির সিটে বসে এই এক্সক্লুসিভ দৃশ্যটার কাঠামোটাকে খাতাবন্দী করতে ব্যস্ত ছিলেন। তিনি জানতেন, এমন দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না। আর এই অভূতপূর্ব মডেলও কোনওদিন পাওয়া যাবে না। জান্তব ক্ষুধার এমন বীভৎস প্রকাশ আজ পর্যন্ত আর কোথাও দেখা যায়নি। এই অদ্ভুত ছবিটাই যে তাঁর এগজিবিশনের অমূল্য মাস্টারপিস হতে চলেছে, তা বুঝতে দেরি হয়নি অরিত্র সান্যালের। তাই দ্রুত, অভ্যস্ত হাতে ছবিটার খসড়া করে নিয়েছিলেন….
পরবর্তীকালে অবশ্য ওই দুর্বোধ্য শব্দগুলোর অর্থ বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। সোমালি ভাষায় ‘আই চাওয়ি’ মানে ‘হেল্প’। মেয়েটি তার কাছে সাহায্যের আবেদন করছিল। কিন্তু কী করার ছিল তাঁর! কীভাবেই বা সাহায্য করতে পারতেন!
মনে মনে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন অরিত্র। আজ রাতেই ছবিটাকে শেষ করে ফেলতে হবে। দু’দিন পরে গ্যালারির লোক এসে নিয়ে যাবে তাঁর এতদিনের সাধনার ধনগুলোকে। এই ছবিগুলোই সম্ভবত তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ প্রমাণিত হতে চলেছে। তাই নিজের বুকের পাঁজরের থেকেও বেশি যত্নে রেখেছেন। কোথাও যেন এতটুকুও ত্রুটি না থাকে, সেদিকে তাঁর শ্যেনদৃষ্টি। হাতে আর বেশি সময় নেই। তাই শেষ ছবিটায় নীল আকাশের সৌন্দর্য সরিয়ে দিয়ে একটা বীভৎস কালো বা ঘোলাটে আকাশ আঁকছেন। এইটুকু হয়ে গেলেই ছবিটা একদম নিখুঁত হয়ে যাবে!
ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত দুটোর ঘণ্টা পড়ল। ঘড়ির আওয়াজে সংবিত ফিরে পেলেন তিনি। আর তখনই চোখ পড়ল সামনে রাখা ক্যানভাসের ওপরে! এতক্ষণ ধরে এই ছবিটাকেই ঠিক করছিলেন অরিত্র। আঁকতে আঁকতে কখন যে অদ্ভুত একটা ঘোরে ডুবে গিয়েছিলেন তা টের পাননি মনে পড়ে গিয়েছিল সেই মেয়েটির কথা…
ক্যানভাসের দিকে চোখ ফেরাতেই হঠাৎ চমকে উঠলেন শিল্পী! এ কী! এতক্ষণ ধরে কী এঁকেছেন অরিত্র সান্যাল! এমন হওয়ার তো কথা নয়! যতদূর মনে পড়ছে, তিনি শুধু আকাশটাকেই নতুন করে আঁকছিলেন। অথচ গোটা ছবিটাই যে বদলে গিয়েছে! কখন আঁকলেন এই ছবি! এ তো সেই পরিচিত ছবিটা নয়! শকুনের পাল চতুর্দিকে উড়ছে! তাদের সঙ্গে মৃত সন্তানকে বুকে নিয়ে লড়ছে সেই নারী! এই পর্যন্ত সব ঠিক। কিন্তু কী অদ্ভুত ম্যাজিকে তার মুখটা ঘুরে গিয়েছে সামনের দিকে। চোখে যন্ত্রণা, অসহায়তা আর নেই। বরং চোখদুটো আগুনের মতো দপদপ করে জ্বলছে! যেন তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে অরিত্রর দিকেই। আর ডান হাতটা সাপের উদ্যত ফণার মতো উঠে এসেছে সামনে। তর্জনী উঁচিয়ে সে কিছু একটা নিৰ্দেশ করছে, কিছু বলতে চাইছে অথবা অন্য কিছু!
অরিত্র স্তম্ভিত! আচমকা মনে পড়ল, অবিকল এই ভঙ্গিটা তিনি আগেও কোথাও দেখেছেন! রবি বর্মার একটি ছবিতে ঋষি দুর্বাসা শকুন্তলাকে অভিশাপ দিচ্ছিলেন। এই নারীর অবয়বটাও একদম সেই ছবির দুর্বাসার মতো! জ্বলন্ত দুই চোখে তীব্র দৃষ্টি! সেই উদ্যত তর্জনী! কোনও অভিশাপবাক্য তার মুখে নেই; থাকা সম্ভবও নয়। অথচ মনে হচ্ছে কোনও এক অশ্রুত অভিশাপ তার ঠোঁট চুঁইয়ে পড়ছে! অদ্ভুত! ছবিটার তো এমন হওয়ার কথাই নয়! এ ছবি তিনি আঁকেননি!
বিমূঢ়ের মতো কিছুক্ষণ বসে থাকলেন অরিত্র সান্যাল। ছবিটা পালটে গেল কী করে? কে পালটাল! তবে কি এসব শ্রুতিরই কারসাজি! ওই ক্ষুধার্ত, মৃতপ্রায় লোকগুলোর জন্য তার দরদের শেষ নেই। সে-ই কি তবে ছবিটাকে পালটে দিয়ে গিয়েছে? নাঃ, তা-ই বা কীকরে সম্ভব? যতক্ষণ শ্রুতি স্টুডিওতে ছিল, ততক্ষণ অরিত্র এই ছবিটার সামনেই ঠায় বসেছিলেন। শ্রুতির পক্ষে ক্যানভাসে একটি আঁচড় কাটারও সুযোগ ছিল না। তবে?
আচমকা একটা পরিচিত অথচ অসম্ভব অনুভূতি টের পেলেন অরিত্র। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘আনক্যানি ফিলিং’। এটা এমন কিছু ভুতুড়ে ব্যাপার নয় ঠিকই; অথচ এই মুহূর্তে আদৌ এই অনুভূতিটার থাকার কথা নয়। তিনি অনুভব করলেন যে পেটের ভেতরটা চিনচিন করছে! অর্থাৎ তাঁর খিদে পেয়েছে! খিদে মানুষের অত্যন্ত স্বাভাবিক এক প্রবৃত্তি। তাতে আপাতদৃষ্টিতে আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই!
তবুও বিস্মিত হলেন তিনি! কারণ আজ রাতের খাওয়াটা বেশ জম্পেশ হয়েছিল। তাঁর কুক হরি ডিনারে চমৎকার বাসন্তি পোলাও এবং পাঁঠার কষা মাংস রান্না করেছিল। ফলস্বরূপ খাওয়াটা পরিমাণে একটু বেশিই হয়ে গিয়েছে। ঘণ্টাদুয়েক আগেও পেট আইঢাই করছিল। তাছাড়া অরিত্র যখন কাজ করেন তখন সময়ে-অসময়ে কাপের পর কাপ কফি, আর কুকিজ বা সল্টেড কাজু খেয়ে থাকেন। হরিই একটা ফ্লাস্কে কফি রেখে দিয়ে যায়। যতদূর মনে পড়ছে, আধঘণ্টা আগেই কফি আর কুকিজ খেয়েছেন। এখন কোনওমতেই খিদে পাওয়া উচিত নয়! কিন্তু খিদে পাচ্ছে যে!
ভুরু কুঁচকে গেল তাঁর। সত্যিই কি খিদে? নাকি গুরুপাক খাবার খেয়ে অম্বল হল! কিন্তু গ্যাস বা অম্বলে পেট জ্বালা করতে পারে, এরকম চিনচিন তো করে না। এ যে খিদেরই লক্ষণ! নিজের পাকস্থলীর মধ্যে একটা অস্বাভাবিক শূন্যতা টের পাচ্ছেন! নাঃ, গ্যাস বা অম্বল নয়, তাঁর খিদেই পেয়েছে।
একটু বিরক্ত হয়েই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। একেই ছবিটার অস্বাভাবিক পরিবর্তনে মাথাটা কেমন গুলিয়ে গিয়েছে। কীভাবে ছবিটা পালটে গেল তা ঈশ্বরই জানেন! নিজের অবচেতন মন থেকে এঁকে ফেলেছেন কি? কিন্তু তেমন হলেও তো মনে থাকত। অনেক সময় অবশ্য অনেক শিল্পীই একরকম ভরে পড়ে ছবি আঁকেন! অনেক প্রখ্যাত স্রষ্টা অসামান্য সৃষ্টি করার পর জানিয়েছেন যে সেই সৃষ্টি নাকি তাদের নয়! কেউ যেন ঘাড় ধরে তাঁদের দিয়ে সৃষ্টিটা করিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ওসব তত্ত্বে অরিত্র বিশ্বাসী নন। তিনি খুব ভালোভাবেই জানেন স্রষ্টা নিজের অন্তরের তাগিদ থেকেই সৃষ্টি করেন। কোনওরকম অতিলৌকিক শক্তি তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করে না। তবে এই মুহূর্তে যেটা ঘটল সেটা ঠিক কী!
অরিত্র বুঝলেন আজ রাতে আর ছবিটা শেষ করা যাবে না। যা পরিবর্তন হয়েছে, সেটা যেভাবেই ঘটুক না কেন, ইপ্সিত নয়। তার ওপর মাথাটা কেমন ভার ভার লাগছে। কাল আবার ছবিটাকে নিয়ে নতুনভাবে পড়তে হবে। হাতে বেশি সময়ও নেই। প্রদর্শনী শুরু হতে আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। সেই মতন গোটা গ্যালারিকে সাজিয়ে তুলতে হবে। গ্যালারির মালিক মি. বাজোরিয়া বারবার তাগাদা দিচ্ছেন। ছবিগুলো চাইছেন। এত বড় প্রদর্শনীর আয়োজন করতেও তো খানিকটা সময় লাগে! তাছাড়া ড্যানিয়েল গ্রে-ও তিনদিন পরেই এসে পৌঁছোচ্ছেন। তাঁকেও ইমপ্রেস করার একটা বিষয় আছে। একবার যদি ড্যানিয়েল তাঁর কাজ পছন্দ করে ফেলেন, তারপরই খুলে যাবে এক বিশাল দরজা! এখন অরিত্রর আর কিছু ভাবার অবকাশ নেই। সামনে শুধু ড্যানিয়েল এবং ব্রিটিশ মিউজিয়ামের প্রদর্শনী!
—“ওঃ!”
পেটের ভেতরটা যেন মোচড় দিয়ে উঠল। খিদেটা এই কয়েকমুহূর্তের মধ্যেই কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে! পাকস্থলিটা জ্বলছে! হল কী! এত খিদে! এরকম ভয়াবহ খিদে আগে কখনও টের পাননি তিনি। হঠাৎ এমন ভয়ঙ্করভাবে ক্ষুধার উদ্রেক হল কেন! অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলেই কি দেহের সমস্ত সিস্টেম উলটোপালটা কাজ করছে? কে জানে! যাই হোক, এখন কিছু পেটে দেওয়া দরকার। খিদেটা বড্ড জ্বালাচ্ছে।
অরিত্রর রান্নার লোক হরি সবসময়ই ফ্রিজ ভর্তি করে খাবার মজুত রাখে। তাঁর সংসারে হরির অবদান অনস্বীকার্য। মাঝেমধ্যেই অরিত্র বলে থাকেন,
— “যেদিন তোর ভাঁড়ার শূন্য হবে, সেদিন বোধহয় আমি হার্টফেল করব : তুই হচ্ছিস মা অন্নপূর্ণার মেল ভার্শন,”
যথারীতি আজও ফ্রিজ খুলতেই চোখে পড়ল থরে থরে খাবার। ইনস্ট্যান্ট নুডলস থেকে শুরু করে সসেজের প্যাকেট, ব্রেড, দুধ, ফল, ডিম, ফলের রস; সবই স্টোর করা আছে ফ্রিজের অভ্যন্তরে। অরিত্র একসঙ্গে বেশ কয়েকটা ইনস্ট্যান্ট নুডলসের প্যাকেট তুলে নিলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তৈরি হয়ে যাবে। নুডলস তৈরি করা এমন কিছু হাতি-ঘোড়া কাজ নয়। তিনি ওভেনে পরিমাণমত গরম জল চাপিয়ে দিয়েছেন। ফুটে উঠতেই ঢেলে দিলেন নুডলস। আর তো মাত্র কয়েকটা মিনিট। তারপরেই….
—“ও মাই গড!”
এবার পেটের ভেতরটা যেন কামড় দিয়ে উঠল! কী মারাত্মক খিদে! অপ্রতিরোধ্যভাবে চাগাড় দিয়ে উঠেছে। তাঁর মাথাটা পাক দিতে থাকে। চিলড এসির মধ্যেও দরদর করে ঘামছেন প্রখ্যাত শিল্পী! এ কী! এ যে ক্রমাগত অসহ্য হয়ে উঠছে! এইভাবে খিদে পায় নাকি! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কী করে এভাবে পেটে আগুন জ্বলতে থাকে! তা-ও অমন রাক্ষুসে ডিনারের পর! তারপরেও বেশ কয়েকবার কফি আর কুকিজ পেটে পড়েছে। সব বেমালুম হাওয়া হয়ে গেল কী করে! মনে হচ্ছে, অন্তত কয়েকদিন তিনি কিছুই খাননি। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। শরীর অবশ লাগছে। এত খিদে কোথা থেকে এল! এ যে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক ব্যাপার!
ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে নুডলস। খাবারের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে কিচেনে। এবার একটু মশলা ঢেলে দেওয়া দরকার। অরিত্র ইনস্ট্যান্ট নুড্লসে মশলা একটু বেশি পরিমাণেই দেন। তাঁর ভালো লাগে।
অথচ আজ মশলার কথা মনেই এল না! এমনকী সসপ্যান থেকে নুডলস বাটিতে ঢালার সময়টুকুও ব্যয় করলেন না তিনি। সস্প্যানটা নামিয়েই উত্তপ্ত নুডলস হাতে করে বুভুক্ষুর মতো গপগপ করে খেতে শুরু করলেন। হাতে রীতিমতো ছ্যাঁকা লাগল। হয়তো ফোসকাও পড়বে। কিন্তু সেদিকে কোনও খেয়াল নেই অরিত্রর! কাঁটা-চামচের বালাই নেই! যে অরিত্র সান্যাল টেবল্ ম্যানার্সের জন্য প্রসিদ্ধ, যিনি কাঁটা চামচ ছাড়া খান না, খাওয়ার সময় কোনওরকম শব্দ করেন না, সেই মানুষটিই সমস্ত বিদেশি আভিজাত্য ভুলে নিতান্তই অশিক্ষিত লোকের মতো হাত দিয়ে গবগবিয়ে নুড্লস খাচ্ছেন! যেন বহুদিন মানুষটার কোনওরকম খাদ্য জোটেনি! অনেকদিনের উপবাসী, হাভাতে মানুষ যেমন করে খাদ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তেমনভাবেই তিনি আঙুল চেটে চেটে খাচ্ছেন!
চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই নুডলস শেষ হয়ে গেল। কিন্তু অরিত্রকে দেখে মনে হল, তিনি এখনও তৃপ্ত নন। কপালে অতৃপ্তির ভাঁজ। মুখে অসন্তুষ্টি! এ কী! খিদেটা তো মিটল না! বরং পেটের মধ্যে অনির্বাণ জ্বালাটা রাবণের চিতার মতো লকলকিয়ে উঠল! নুড্লস তো কম খাননি! অথচ পাকস্থলীর একাংশও পূর্ণ হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না! অমন এক সসপ্যান ভরতি নুডলস তবে কোথায় গেল! তিনিই তো খেয়েছেন! নাকি তিনি খাননি! অন্য কেউ খেয়েছে! তাঁর কি স্মৃতিভ্রম হল? এসব কী হচ্ছে! এ কী জাতীয় সর্বনেশে ক্ষুধা!
অরিত্র শূন্য সসপ্যানটার দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়েছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ ভাবার সময় পেলেন না। আবার! আবার পেটটা মোচড় দিয়ে উঠল! খিদে! ভয়ানক খিদে! গোটা পেট মুচড়ে মুচড়ে উঠছে। যেন এক বিরাট দৈত্য তান্ডবনৃত্য নেচে বেড়াচ্ছে তাঁর জঠরে।
তিনি তড়িৎগতিতে এক লিটারের ফ্রুটজুসের কনটেনার বের করে আনলেন। কিছু ভাবার সময় নেই। ছিপিটা খুলে তৎক্ষণাৎ ঢেলে দিলেন গলায়। ঢকঢক করে পান করে ফেললেন গোটাটাই। কেক, পেস্ট্রি যা মজুত করা ছিল চেটেপুটে শেষ করলেন। কিন্তু কই? খিদে তো কমছে না! বরং খিদের আগুনে যেন ঘি ছিটিয়ে দিল কেউ! পরম উল্লাসে লকলকিয়ে উঠল দুরন্ত ক্ষুধার লেলিহান শিখা! কী করবেন! কী করবেন অরিত্র! খাবেন? … আরও খাবেন?
তাঁর মাথা থেকে মুছে গেল এগজিবিশনের কথা! ভুলে গেলেন ছবিগুলোকে। ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও ড্যানিয়েল গ্রে অদৃশ্য হয়ে গেলেন! পেটটাকে খামচে ধরে মেঝেতে বসে পড়েছেন তিনি। কোনওমতে ফ্রিজ থেকে বের করে আনলেন যাবতীয় খাদ্যসামগ্রী। খেতে হবে। খেতে হবে তাঁকে! এই মুহূর্তে দুনিয়ায় আর কিছুই নেই খাদ্য ছাড়া। আর সব মিথ্যে… সব মিথ্যে!
কোলের ওপর সমস্ত খাবার রেখে নিরূপায়ভাবে কাঁচা পাউরুটি চিবোতে শুরু করলেন অরিত্র। এখন স্লাইস বা টোস্ট করার সময়ও নেই! খিদের চোটে চোখে অন্ধকার দেখছেন তিনি। তাই গোটা রুটিটাই শেষ হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে! এত খিদে কোথায় জমেছিল? সত্যিই খিদে?… নাকি অন্যকিছু…! রুটির পর ডিম! হ্যাঁ কাঁচাই! ওমলেট বা পোচ করতেও সময় লাগে। কে অপেক্ষা করবে? বুভুক্ষু উদর ওই সামান্য সময়টুকুও দিতে রাজি নয়। তারপর ঠান্ডা কাঁচা দুধ, কাঁচা সসেজ…! পাগলের মতো যা পাচ্ছেন, সবকিছুই দু’হাতে মুখে পুরছেন অরিত্র! ঢকঢক করে গলায় ঢালছেন! কষ বেয়ে পড়ে যাচ্ছে পানীয়!
খিদে কিন্তু কমছে না!
৩
রোজ সকালে হরি একেবারে কাঁচা বাজার সেরে তবেই অরিত্রর বাড়িতে ঢোকে। এটা তার প্রাত্যহিক অভ্যাস। অরিত্র নিজে বাজার করা পছন্দ করেন না। তার ওপর আবার বড় ভুলো মনের মানুষ। তিনি বাজার করলে অর্ধেক প্রয়োজনীয় সামগ্রীই ঘরে আসবে না! দোকানিরা তাঁকে অনভিজ্ঞ লোক পেয়ে ঠকিয়েও দেয়। পচা মাছ বা খুঁতো ফল-সব্জি গছিয়ে দেয় অনায়াসেই। তা-ই হরি দৈনন্দিন কাঁচা বাজারটাও নিজের হাতেই করে। বেছে বেছে নিয়ে আসে তাজা মাছ, মাংস বা অন্যান্য শাক-সব্জি। এ বিষয়ে সে এক্সপার্ট! গোটা বাজার চক্কর কেটে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট জিনিসটাই নিয়ে আসবে। তার তীক্ষ্ণ নজরকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই।
প্রাত্যহিক নিয়মমতো আজও হরি দুই ব্যাগ ভরতি বাজার নিয়ে এসে হাজির হল অরিত্রর বাড়ির সামনে। তার মনটা বেশ খুশি খুশি। আপনমনেই শিস দিয়ে হিন্দি গানের সুর ভাঁজছে। সকাল সকাল চমৎকার বাগদা চিংড়ি উঠেছিল বাজারে। হরি হাতছাড়া করেনি। বাবুর আবার চিংড়ির মালাইকারি বা কালিয়া ভারি পছন্দ। সঙ্গে চিকেনও আছে। একদম ফ্রেশ মুর্গীর মাংস।
সে হিন্দি গানের কলির সুরে শিস দিতে দিতেই বাইরের দরজাটা চাবি দিয়ে খুলল। অরিত্র এইসময় গভীর ঘুমে থাকেন। তাই একসেট ডুপ্লিকেট চাবি হরির কাছেই থাকে। অনেকদিনের বিশ্বস্ত কর্মী সে। রোজ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেই চটপট ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে লেগে যায়। অরিত্র ঘুম থেকে ওঠার আগেই তৈরি হয়ে যায় ব্রেড-বাটার, অমলেট এবং সসেজ। কখনও কখনও পরোটা বা লুচিও বানিয়ে ফেলে। বাবু আঙুল চেটে চেটে খান, আর তারিফ করে বলেন, “হরি, তোর মতো শিল্পীও খুব কম আছে! আমার আঁতুড়ঘর স্টুডিও, আর তোর কিচেন!”
অত বড় বড় দার্শনিক কথা বোঝে না হরি। এইটুকু বোঝে যে তার হাতের রান্না ছাড়া আর কিছু বাবুর মুখে রোচে না। সেজন্য সে নিজেও বেশ গর্বিত! ওই টিভির সাজুগুজু করা দিদিমণিরাও রান্নায় তাকে হারাতে পারবে না! বাবু বলেন, “রান্নায় তুই দ্রৌপদীর নাতি!”
দরজা খুলতেই সামনে বিরাট ড্রয়িংরুম। দু’হাতের ভারি ব্যাগ সামলাতে সামলাতে হরি কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়। ড্রয়িংরুমের ঘড়িতে এখন প্রায় আটটা বাজতে চলেছে। ন’টার মধ্যেই করে ফেলতে হবে ব্রেকফাস্ট। সে মনে মনে ভাবতে থাকে, আজ ব্রেকফাস্টে কীভাবে বাবুকে চমকে দেবে! জমিয়ে আলুর পরোটা বানাবে? নাকি ছোলা-বাটোরা? অথবা স্ক্র্যাম্বল্ড্ এগ, চিকেন রোস্ট কিংবা বেকন?
মনে মনে নানারকম মেনু ভাবতে ভাবতেই সে কিচেনে ঢুকে পড়ে। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তার মাথায় যেন বজ্রাঘাত হল! কী সর্বনাশ! রান্নাঘরের এহেন দশা হল কী করে! এখানে কি কোনওরকম সাইক্লোন হয়ে গিয়েছে? নাকি কাল রাতে ডাকাত পড়েছিল! হরি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল চতুর্দিকে খাদ্যবস্তু ও উচ্ছিষ্টের ছড়াছড়ি! ফ্রিজ খোলা! ভেতরটা শূন্য! কিচ্ছু নেই! মেঝের ওপর ইতস্তত পড়ে আছে কাঁচা পাউরুটির অবশিষ্টাংশ, প্রায় একডজন কাঁচা ডিমের ভাঙা খোলা, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দুধ, কাঁচা সবজির অভুক্ত উচ্ছিষ্ট, বিস্কুট-কুকিজের টুকরো! সাদা মারবেলের ওপরে একদিকে আটা, ময়দা, চাল এবং অন্যদিকে গাঢ় কালো গুঁড়ো কফির স্তর অদ্ভুত বৈপরীত্যে ছড়িয়ে আছে! পরোটা বা অন্যকিছু বানাবে কী করে! সবকিছুই কেউ খেয়ে, ছড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে! কর্ণফ্লেক্স, বিস্কুটের শূন্য প্যাকেট ও শূন্যগর্ভ ফ্রিজ হতভম্ব হরির দিকে তাকিয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছে। যেন বলছে, “অনন্ত ক্ষুধার কাছে তোমার অন্নপূর্ণার ভাঁড়ারও ফেল পড়ে গেল যে!”
হরি বিহ্বল দৃষ্টিতে দেখছিল চতুর্দিকটা! তার মাথা তখন কাজ করা ছেড়ে দিয়েছে! কাল রাতেও তো সব ঠিক ছিল! বাবুকে খাইয়ে দাইয়েই সে বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। তাহলে এসব কাণ্ড করল কে! দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে কেউ খিদের জ্বালায় হাতের কাছে যা পেয়েছে, তাই খেয়েছে! যতটা খেয়েছে, ততটাই ছড়িয়েছে! কাঁচা কর্নফ্লেক্স নিঃশেষ করেছে! কাঁচা আটা, ময়দা, চালও গোগ্রাসে গিলেছে! এমনকী কফির গুঁড়োকেও ছাড়েনি! এ কী আদৌ কোনও মানুষ করেছে! নাকি প্রচণ্ড ক্ষুধিত কোনও জানোয়ার এসে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে সব!
হরি বিস্ময়বিমূঢ়ভাবে সেদিকেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই মনে পড়ল অরিত্রর কথা। বাবু ঠিক আছেন তো? তাঁর কোনও বিপদ-আপদ হল কি? আর একমুহূর্তও দেরি না করে সে তড়িৎগতিতে অরিত্রর বেডরুমের দিকে দৌড়োয়! আর্তস্বরে ডাকে, “বাবু… বা-বু!”
বেডরুমের বন্ধ দরজার ভেতর থেকেই ঘড়ঘড়ে স্বরে উত্তর এল, “আমার খিদে পেয়েছে! …খি-দে!”
জীবনে এই প্রথমবার অরিত্রর অনুমতি ছাড়াই দরজা খুলে তাঁর বেডরুমে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ল হরি। নক করার সৌজন্য তখন তার মাথায় উঠেছে! কিন্তু ভেতরে গিয়ে যা দেখল তাতে তার চক্ষু চড়কগাছ! মনে হল, পায়ের তলার মাটি কাঁপছে! কোনওমতে স্খলিত স্বরে বলল, “বা-বু!”
অরিত্র তার দিকে তাকালেন! সে দৃষ্টি আদৌ স্বাভাবিক নয়! রাগ, যন্ত্রণা আর বিহ্বলতা মেশানো এক অদ্ভুত উন্মত্ত চাহনি! সম্ভবত সারা রাত ঘুমোননি! চোখদুটো জবাফুলের মতো টকটকে লাল। চুল অবিন্যস্ত! তাঁর পরনের পাঞ্জাবিতে, সারা মুখে কাঁচা ময়দা, কালো কফির গুঁড়ো তখনও লেগে আছে। খিদের জ্বালায় পাগলের মতো যা পেয়েছেন, তা-ই খেয়েছেন! তখনও পেটের মধ্যে সেই দাবানল থামেনি। বরং যতই খাচ্ছেন, ততই আগুনটা আরও বেশি মাত্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে! কয়েক সেকেন্ডও স্থির থাকতে দিচ্ছে না! কোন্টা খাওয়ার যোগ্য, কোন্টা নয়— সেই চিন্তার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন। মনে হচ্ছে কয়েক হাজার বছরের ক্ষুধা তাঁর পাকস্থলিতে এসে জমেছে। অথবা কোনও ব্ল্যাকহোলের সৃষ্টি হয়েছে জঠরে। যা-ই পড়ছে, সেই কৃষ্ণগহ্বর সমস্ত গ্রাস করে কোথায় পাঠিয়ে দিচ্ছে কে জানে!
এই মুহূর্তে তাঁর সামনে পড়ে আছে অন্তত গোটা দশেক পিৎজার খালি বাক্স! কোনওমতে ফোন করে আনিয়েছেন। একটা গোটা পিৎজা খাওয়াই যাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না, তিনি দশটা আস্ত পিৎজা খেয়ে ফেলেছেন! সেই খাওয়ার মধ্যে কোনও তৃপ্তি পাননি! কী খাচ্ছেন তাও বোঝেননি। বোঝেননি তার স্বাদ, তৃপ্তিদায়ক সুগন্ধ! শুধু এইটুকু বুঝেছেন যে কিছু একটা গ্রাসনালী বেয়ে নামছে। তার আস্বাদ নেওয়ার মতো মানসিক অবস্থাও নেই। ভোজনরসিক মানুষটি আজ রাক্ষসের মতো সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছেন! মাথার ভেতরে কে যেন ফিসফিস করে বলছে, “এভরিথিং হিয়ার ইজ এডি! ক্ষুধার কাছে কোনও বাছবিচার হয় না! খাও… খাও… খেয়ে যাও!”
অথচ ক্ষুধা প্রশমিত হয়নি! অরিত্রর মনে হচ্ছিল চতুর্দিক থেকে একটা কালো অন্ধকার তাঁকে ঘিরে ধরেছে! সেই অন্ধকারে জমে রয়েছে অনির্বাণ ক্ষুধা। কতগুলো শুকনো বিকৃত দেহ তাঁর আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের কঙ্কালসার হাতের তর্জনী উদ্যত হয়ে রয়েছে ওঁরই দিকে! অবিকল সেই ভঙ্গি! দুর্বাসা অভিশাপ দিচ্ছেন।
ক্ষুধার যন্ত্রণায় পেট আঁকড়ে ধরে আছেন তিনি। কোনওমতে কাতর কণ্ঠে বললেন, “হরি! প্লিজ হেল্প মি! আমার খিদে পেয়েছে। ভীষণ খিদে…”
হরি বিস্ময়ে, ভয়ে প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। কী করবে, কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। কিচেনে আর কিছু বাকি নেই যা সে এই ক্ষুধার্ত মানুষটিকে খেতে দিতে পারে। এ কী হল বাবুর! এ কীরকম কাণ্ড করছেন! এখন কী করবে সে! বাড়ির বাইরে বড় বড় রেস্টোর্যান্ট আছে ঠিকই। কিন্তু সে তো সকাল দশটার আগে খুলবে না। তবে?
এবার রীতিমতো কেঁদে উঠলেন অরিত্র, “দুমুঠো খেতে দে আমায়। আমি যে মরে যাচ্ছি!”
সে তাড়াতাড়ি বলল, “এক্ষুনি দিচ্ছি বাবু। এক মিনিট সময় দিন!”
—“এক মিনিট!” তিনি রাগে উন্মত্ত হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “এক মিনিট ও সময় নেই। এখনই আমায় খেতে দে, নয়তো… নয়তো…”
বলতে বলতেই প্রায় পাগলের মত ছুটে গেলেন কিচেনের দিকে। এখানেই সবে মাত্র কাঁচা বাজারের থলে এনে রেখেছে হরি। অরিত্র ব্যাগদুটোকে টেনে নিয়েছেন। হরি হাঁ হাঁ করে ওঠার আগেই বের করে এনেছেন কাঁচা মাছ-মাংস। তার বিস্ময়বিস্ফারিত দৃষ্টির সামনেই বুভুক্ষু কুকুরের মতো কাঁচা মুরগির মাংস ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছেন! তাঁর খাওয়ার একটা জান্তব শব্দ কানে এসে ধাক্কা মারল। মটমট করে চিবোচ্ছেন হাড়গুলো। কাঁচা বাগদা চিংড়িও খোলা শুদ্ধই কড়মড়িয়ে…. ওঃ!
হরি ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়েছিল। তার বুঝি নড়ার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে। এমন বীভৎস দৃশ্য সে আগে কখনও দেখেনি। চোখের সামনে যা দেখছে, তাতে রক্ত হিম হয়ে যাওয়ার উপক্রম। অরিত্রকে এই মুহূর্তে মানুষের মতো লাগছে না! বরং ক্ষুধার্ত কোনও মাংসাশী পশু বা পিশাচের সঙ্গে তাঁর মিল অনেক বেশি। হরির পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। তবু পালাতে পারছে না। বহু বছরের বিশ্বস্ততা, ভালোবাসা তাকে অরিত্রকে ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দেয় না। ভয় করছে। কিন্তু এই অসহায় লোকটাকে কি এভাবে ফেলে যেতে পারে?
যা যা সযত্নে বাজার করে এনেছিল হরি, তাতে একটা মানুষের বেশ কয়েকদিন চলে যায়। আজ আধঘণ্টার মধ্যেই সব শেষ! রাক্ষুসে খিদের সামনে উড়ে গেল সব কিছু। অরিত্র যেন ক্রমাগত হিংস্র হয়ে উঠছেন! তিনি হিংস্র, উন্মত্ত দৃষ্টিতে হরির দিকে তাকালেন। ঘড়ঘড়ে কর্কশ কণ্ঠে বললেন,
—“আর নেই?”
হরির মুখ দিয়ে কোনও শব্দ বেরোচ্ছিল না। কোনওমতে কাঁপা গলায় বলল, “আমায় একটু সময় দিন। সামনের রেস্টোরেন্টটা এখনই খুলবে। আমি আপনার পছন্দসই সব খাবার নিয়ে আসব বাবু। শুধু একটু সময়…”
অরিত্র বন্য জন্তুর মতো তার দিকে তাকিয়ে আছেন। হরি যা দেখতে পাচ্ছেন না, তিনি তা স্পষ্ট দেখছেন! দেখছেন, হরির চতুর্দিকে উড়ে বেড়াচ্ছে শকুন! একদল উলঙ্গ-কঙ্কালসার মানুষ তাঁকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে আছে। তাদের দু’চোখ যেন জ্বলছে! ছায়াশরীরগুলো অরিত্রের চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আর ক্রমাগত চিৎকার করে বলছে, “খিদে পেয়েছে, খেতে দাও। খেতে দা-ও!”
হরির ঠিক পেছনেই যে এসে দাঁড়াল তাকে দেখে আঁতকে উঠলেন তিনি! এই তো সেই মেয়েটি! সেই মা যে নিজের সন্তানের মৃতদেহ নিয়ে শকুনের সঙ্গে লড়াই করছিল! মেয়েটার দু’চোখে যেন দাবানলের আগুন। একটি কথাও না বলে সে উদ্যত তর্জনী তুলে ধরল তাঁর দিকে। মেয়ে নয়, যেন মূর্তিমতী অভিশাপ! আর সেই অভিশাপ এখন সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছে অরিত্রর অভ্যন্তরে। জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে দিচ্ছে! খিদে, কী প্রচণ্ড খিদে! ওঃ! মরে যাচ্ছেন অরিত্র! এখনই কিছু খেতে না পেলে মরে যাবেন! ক্ষুধা তাঁর প্রদর্শনীর থিম! কিন্তু তখন কি বুঝেছিলেন যে তার মূল্য এভাবে দিতে হবে?
দাঁতে দাঁত চেপে হরির দিকে এগিয়ে গেলেন অরিত্র। এখন আর হরিকে দেখতে পাচ্ছেন না! চতুর্দিক অন্ধকার হয়ে আসছে। শুধু নাকে আসছে মাংসের গন্ধ। খাবারের গন্ধ। হরির বদলে একতাল মাংস দেখছেন তিনি। সেই মাংস যা তাঁর ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটাতে পারে। তিনি শুকনো ঠোঁট লোভাতুর জিব দিয়ে চেটে বললেন, “আমার খিদে পেয়েছে!”
হরি সভয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পারল না! তার আগেই বাঘের মতো তার ওপর লাফিয়ে পড়েছেন অরিত্র।
একটা মর্মান্তিক আর্তচিৎকার! তারপরই সব শেষ!
৪
দিল্লীর গ্যালারিতে আর অরিত্র সান্যালের একক প্রদর্শনী হয়নি! ড্যানিয়েল গ্রে এসেছিলেন ঠিকই, কিন্তু অরিত্র’র সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতও সম্ভব ছিল না। শ্রুতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কী যে হয়েছিল লোকটার কে জানে! শেষ ছবিটাকে নিখুঁত করে গড়ে তুলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু ওই একটি ছবি ছাড়া আর কোনও ছবি অবশিষ্ট ছিল না। যখন গ্যালারির লোকেরা নির্দিষ্ট দিনে ছবিগুলো আনতে গেল, তখন ছবির বদলে ওই বাড়িতে দু-দুটো লাশ আবিষ্কার করল! একটি লাশকে চেনাই যায় না। মনে হয়েছিল কোনও মাংসাশী হিংস্র জন্তু তাকে ছিঁড়ে খেয়েছে। অন্য মৃতদেহটি স্বয়ং অরিত্রর। তাঁর দেহ দেখেই বোঝা গিয়েছিল যে স্টুডিওতে একটি ছাড়া আর কোনও ছবি নেই কেন! অরিত্রর মুখ ঠাসা ছিল কাগজে! পুলিশ তাঁর মুখ থেকে যা টেনে বের করেছিল তা ক্যানভাসের কাগজ ছাড়া আর কিছুই নয়! যিনি ওঁর পোস্টমর্টেম করেছিলেন, সেই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞও স্তম্ভিত! কারণ অরিত্রর পাকস্থলীতে শুধু কাগজ ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি! পুলিশের অনুমান, কোনও কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন শিল্পী। সেজন্য নিজের আঁকা ছবিগুলোই শেষ পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছিলেন!
পুলিশ অবশ্য এখনও এই সন্দেহজনক জোড়া খুনের তদন্ত করছে। আর অরিত্র সান্যালের একক প্রদর্শনীর বদলে অন্যান্য শিল্পীদের ছবির মিলিত প্রদর্শনী হচ্ছে এই গ্যালারিতে। শুধু সব ছবির মধ্যে জ্বলজ্বল করছে অরিত্রর অন্তিম সৃষ্টি, হাঙ্গার! এই ছবিটাই একমাত্র বেঁচে গিয়েছিল। এই সেই ছবি যেখানে শকুনের উদগ্র ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়ছে এক অসহায় কঙ্কালসার মা। এর মধ্যেই অসম্ভব প্রশংসিত হয়েছে এই সৃষ্টি। সমালোচকেরা প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, “প্রয়াত চিত্রশিল্পী অরিত্র সান্যালের ‘হাঙ্গার’ ছবিটি এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্প।”
শ্রুতি একদৃষ্টে তাকিয়েছিল ওই ছবিটারই দিকে। মৃত্যুর আগের দিন তার ফোনে একাধিক মেসেজ করেছিলেন অরিত্র। সব মেসেজেই লেখা ছিল দুটি শব্দ, ‘খিদে পেয়েছে!’ সে স্যারের পাগলামি ভেবে পাত্তা দেয়নি। ভেবেছিল, উনি তো মাঝেমধ্যেই এরকম খামখেয়ালিপনা করেন…
—“হাঙ্গার! মাই গড!”
সে সচকিত হয়ে দেখে এক বিদেশি স্বর্ণকেশী তরুণী এসে দাঁড়িয়েছে ঠিক ওই ছবিটারই সামনে। উচ্ছ্বসিত স্বরে তার স্বামীকে সম্বোধন করে বলল,
—“লুক হনি! সো ফ্যাসিনেটিং!”
—“ইয়া সুইট পি! ভেরি ফ্যাসিনেটিং,” তার স্বামী জবাব দেয়, “ইউ ওয়ান্ট দিস?”
শ্রুতির আচমকা মনে হয়, ছবির মধ্যে কঙ্কালসার মায়ের চোখদুটো যেন মুহূর্তের মধ্যে দপ করে জ্বলে উঠেছে! অগ্নিদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে শ্বেতবর্ণা বিদেশিনীর দিকে! তার তর্জনী নিমেষে উদ্যত হয়ে উঠল….
সত্যিই কি তাই? নাকি স্রেফ চোখের ভুল!
বীরেনবাবুর প্রশ্ন
বীরেন বাবুর প্রশ্ন
১
লোকটাকে প্রথম দর্শনেই কেমন যেন অদ্ভুত মনে হয়েছিল বীরেনবাবুর। দেখলেই মনে হয়, ও হয়তো মানুষ নয়। কিংবা মানুষের খোলসে অন্য কিছু!
জামাকাপড় পরার মতো করেই একটি মানবদেহ পরে ঘুরছে! বয়স আন্দাজ সত্তরের ওপরে। গায়ের রঙ আলকাতরা কালো। হাসলে সাদা ঝকঝকে দাঁত দেখা যায়। কিন্তু দু’প্রান্তের দুটি শ্বদন্ত আশ্চর্য রকমের তীক্ষ্ণ। বীরেনবাবু সভয়ে লোকটির ধারালো দাঁতের দিকে তাকিয়েছিলেন। তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরেই হয়তো লোকটা বলে উঠল, “আমার নিরামিষ খাওয়ার দাঁত নেই। আমি মাংসাশী কি না!”
তিনি রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। কী কুক্ষণে যে অতিপ্রাকৃতিক বিষয় নিয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়েছিলেন! এতদিন দিব্যি মনের সুখেই ছিলেন। হঠাৎ সুখে থাকতে ভূতের কিল পড়ল! মৃত্যুর পর ঠিক কী হয়, আত্মা আছে কি না, ইত্যাদি সব প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘনিয়ে আসতে শুরু করল। অনেকরকম বই পড়লেন, প্যারাসাইকোলজিস্টদের সঙ্গে আলোচনা করলেন, কিন্তু তবুও সব প্রশ্নের জবাব পেলেন না। মনে হল, অনেক কিছুই অধরা থেকে যাচ্ছে। বিশেষ করে একটা প্রশ্নের উত্তর বড় ভাসা-ভাসা পাচ্ছেন। সেই প্রশ্নটার উত্তর তাঁর চাই।
এই লোকটির নাম গণপতি হাজরা। একাধারে প্যারাসাইকোলজিস্ট। তার ওপরে আবার ব্ল্যাক ম্যাজিকের চর্চাও করেন। এসব বিবরণ শুনেই যথেষ্ট আগ্রহ বোধ করেছিলেন তিনি। তিনদিনের মধ্যেই গণপতি হাজরার টেলিফোন নম্বরও খুঁজে বের করে যোগাযোগ করেছেন। গণপতি হাজরা তাঁকে নিজের ঠিকানাটা দিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিয়েছিলেন। সেই কথামতোই আজ রাত্রে এসে উপস্থিত হয়েছেন ভদ্রলোকের ডেরায়।
কিন্তু এ বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে বীরেনবাবুর। সবই ঠিক আছে, অথচ কিছুই যেন ঠিক নেই! বাড়ির দরজায় পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর শরীরটা ছ্যাৎ করে উঠেছিল। বাইরে প্রচণ্ড গরম। গ্রীষ্মের দাবদাহে পুড়ে যাওয়ার উপক্রম। অথচ এই বাড়ির ভিতরটা আশ্চৰ্য রকমের ঠান্ডা! এতটাই ঠান্ডা যে তাঁর মনে হচ্ছিল, তিনি কোনও মর্গের ভেতরে ঢুকে পড়েছেন! কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার! কোথাও কোনও এসি বা নিদেনপক্ষে একটা কুলারও চোখে পড়ল না! তাহলে বাড়ির ভিতরটা এত ঠান্ডা কেন?
—“ঠান্ডা লাগছে?” গণপতি তাঁর ধবধবে সাদা তীক্ষ্ণ দাঁতগুলো বের করে হাসলেন, “তা একটু ঠান্ডা তো লাগবেই। জানেনই তো, মৃত মানুষেরা গরম পছন্দ করে না।”
বীরেনবাবু চমকে উঠলেন। বুকের মধ্যে একটা ভয়ও গুড়গুড় করে উঠল। লোকটা নিজে যেমন অদ্ভুত, তেমন অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, যখন থেকে এসেছেন, তখন থেকেই মনে হচ্ছে তাঁর আশপাশে বুঝি অসংখ্য মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথা থেকে যেন একটা হাড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া থেকে থেকে স্পর্শ করে যাচ্ছে তাঁকে। হাওয়াটাও স্বাভাবিক নয়! বীরেনবাবুর মনে হল, হাওয়ার ভেতর থেকেই কেউ ফিসফিসিয়ে কিছু বলছে! কী বলছে তা বুঝতে পারছেন না। কিন্তু কিছু একটা বলছে এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত!
—“আপনি বোধহয় বুঝতে পেরেছেন যে এ ঘরে আমরা ছাড়াও আরও অনেকেই আছেন।”
আশ্চর্য! গণপতি তাঁর মনের কথাটা অবিকল বুঝে নিয়েছেন। এ লোকটা কি অন্তর্যামী! বীরেনবাবুকে আরও ঘাবড়ে দিয়ে বললেন তিনি, “কান পাতলে অনেক কিছুই শুনতে পাবেন। ওরা প্রায়ই প্যারালাল ওয়ার্লডের বর্ডার ক্রস করে এদিকে চলে আসে। বুঝতে পারে না যে এদিকে আসতে নেই, এটা ওদের জায়গা নয়!”
বীরেনবাবু গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, “তার মানে সত্যিই একটা প্যারালাল ওয়ার্লড আছে?”
—“আছে,” বৃদ্ধ মানুষটি হাসলেন, “সেটা অবিকল আমাদের দুনিয়াটার মতোই। এবং এই দুনিয়ার সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। মৃত্যুর পর আত্মারা সেখানেই বসবাস করে। দুটো ওয়ার্লডই একটা অদৃশ্য বর্ডারলাইনের মাধ্যমে বিভক্ত। ঠিক যেন দুটো দেশ। আমরা ওই বর্ডারলাইন ক্রস করে প্যারালাল ওয়ার্লডে ঢুকতে পারি না। কিন্তু ওরা প্রায়ই অনুপ্রবেশকারীদের মতো এখানে এসে পড়ে। দুটো বিশ্বের মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে পারে না।”
বীরেন দত্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। গণপতি হাজরার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে যেন জরিপ করছেন মানুষটিকে। তারপর আস্তে আস্তে জানতে চাইলেন, “ওপারের জগতটা ঠিক কীরকম? যাকে বলছিলেন প্যারালাল ওয়ার্লড? আপনি দেখেছেন কখনও?”
গণপতি হাজরা তাঁর দিকে অদ্ভুতদৃষ্টিতে তাকালেন। হয়তো এ প্রশ্নটাই তিনি আশা করেছিলেন। এই বৃদ্ধ মানুষটিকে সচরাচর নানারকম আলোচনাসভায় এইরকম প্রশ্নেরই মুখোমুখি হতে হয়। তাঁর চোখে ঝিকমিক করে কৌতুক খেলা করে উঠল। প্রশ্নটার সরাসরি জবাব না দিয়ে হেসে বললেন, “আপনার বয়েস কত? চল্লিশ পেরিয়েছে?”
— “আজ্ঞে!” বীরেন সবিনয়ে জবাব দিলেন, “এই সদ্যই পেরিয়েছে।”
—“তবে এই প্রশ্ন আপনার করা উচিত নয়,” বৃদ্ধ মিটিমিটি হাসতে হাসতে বললেন, “এই বয়সটা জীবনকে উপভোগ করার। মৃত্যু এবং তৎপরবর্তী বিষয় নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার জন্য তো গোটা বার্ধক্যটাই পড়ে রয়েছে।”
—“তবু…” তিনি নাছোড়বান্দা, “বলুন না, আপনি জানেন যে ওপারের দুনিয়াটা ঠিক কেমন?”
—“আপনি সত্যিই জানতে চান?” গণপতির মুখের হাসি মুছে গিয়েছে। গম্ভীর স্বরে বললেন, “এই প্যারালাল ওয়ার্লডটাকে সত্যিই কি এক্সপেরিয়েন্স করতে চান?”
— “চাই।”
—“ব্যাপারটা কিন্তু মোটেই ছেলেখেলা নয়। যথেষ্ট ঝুঁকি আছে।” বৃদ্ধ তাঁকে সতর্ক করলেন।
—“তবু আমি জানতে চাই,” বীরেনবাবু দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, “সম্ভব?”
—“সম্ভব,” তিনি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। ওঁর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার কপাল ভালো। আজ অমাবস্যা। একটু অপেক্ষা করুন। আসছি।”
তারপর ধীর পায়ে ভেতরের ঘরের দিকে চলে গেলেন।
২
সামনে-রাখা অঙ্গার পাত্রে আগুন ধমকে ধমকে জ্বলে উঠছে। সেই লেলিহান শিখার মধ্যে মুঠো করে কিছু একটা ফেললেন গণপতি। জিনিসটা কী তা ঠিক বোঝা গেল না। তবে সেটা সুগন্ধী কিছু। পোড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সুগন্ধে ঘর ভরে গেল। এখন ঘরে শুধু গমগম করছে তাঁর কণ্ঠস্বর। মৃদু অথচ সুরেলা গলায় মন্ত্রোচ্চারণ করতে করতে বৃদ্ধ মাটির ওপর রঙিন খড়ি দিয়ে কীসব চিহ্ন আঁকছেন। মন্ত্র পড়তে পড়তেই থেমে গিয়ে বললেন, “এই কর্মকাণ্ডের জন্য প্রয়োজনীয় সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। যা-ই ঘটুক না কেন, আপনি যে আসনে বসে আছেন সেখান থেকে একচুলও নড়বেন না। উঠে পড়ার চেষ্টা তো একেবারেই করবেন না। যে শক্তিগুলোকে নিয়ে আমি কাজ করছি তাদের সঠিকমতন চালনা না করতে পারলে বিপদ ঘটতে পারে। বুঝেছেন?”
—“আজ্ঞে, বুঝেছি।”
বীরেনবাবু মাথা নাড়লেন। যদিও এই মুহূর্তে তাঁর বেশ ভয় ভয় করছে। ঘরে এখন অঙ্গারপাত্রের জ্বলন্ত আগুন ছাড়া অন্য কোনও আলো নেই। মনে হচ্ছে, আশপাশের অন্ধকার বুঝি আরও জমাট হয়ে ঘিরে ধরছে তাঁকে। চতুর্দিকে ছায়া ছায়া কাদের যেন অবাঞ্ছিত অস্তিত্ব। তাঁর আচমকা মনে হল, ছায়াগুলো বোধহয় কিছু বলতে চাইছে। বারবার হাত নেড়ে নিষেধ করছে।
—“অন্যদিকে তাকাবেন না।” গণপতি গম্ভীর গলায় বললেন। তাঁর কণ্ঠস্বরে স্পষ্ট আদেশের সুর, “এদিকে মনোসংযোগ করুন।”
—“হ্যাঁ”
দেওয়ালের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আগুনের দিকে তাকালেন বীরেনবাবু এখনও বৃদ্ধ বিড়বিড় করে কীসব মন্ত্র পড়ে চলেছেন। আগুনটা ক্রমশ উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে! যত উজ্জ্বল হচ্ছে, তার গনগনে রক্তিম রঙটা মুছে গিয়ে নীলাভ আভা ফুটে উঠছে। প্রথমে মনে হয়েছিল, হয়তো তাঁরই চোখের ভুল! কিন্তু এখন ভালোভাবে দেখে নিশ্চিত হলেন। নাঃ, কোনও ভুল নয়। আগুনটা সত্যিই এখন নীলাভ শিখায় জ্বলছে। কী মোহনীয় সে নীল রঙ! গণপতি নিশ্চয়ই আগুনের ভেতরে এমন কিছু ফেলেছেন যার ফলে এমন নীলাভ আভা ঠিকরে পড়ছে।
—“আমার হাতে হাত রাখুন।” গম্ভীর স্বরে আদেশ করলেন গণপতি বীরেনবাবু যে ওঁর এসব যজ্ঞের ব্যাপারে সঠিক কিছু বুঝতে পারছিলেন, তা নয়। কিন্তু তিনি যা যা বলছিলেন নীরবে তা পালন করে চলেছেন। ওঁর কথামতই এবার বৃদ্ধের হাতে হাত রাখলেন। কিন্তু স্পর্শমাত্রেই চমকে উঠেছেন! একটা বিদ্যুত্তরঙ্গ বয়ে গেল তাঁর দেহে! কী ঠান্ডা হাত গণপতির! বীরেনের মনে হল, তিনি একটা কঙ্কালের হাতে হাত রেখেছেন। সে হাতে কোনও মাংস, পেশী, চামড়ার অস্তিত্ব নেই! শুধু যেন কয়েকটা হাড় অবশিষ্ট!
গণপতির কণ্ঠস্বর এবারে উচ্চগ্রামে পৌঁছেছে! বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল! এ তো উচ্চারণ নয়, আর্তনাদ! মানুষের আত্মা যখন বিনষ্ট হয়ে যেতে বসে তখনই বোধহয় কোনও মানুষ এইভাবে মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারে। বীরেনবাবুর দেহ ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ছিল। তিনি টের পেলেন একটা প্রচণ্ড চৌম্বকশক্তি তাঁকে টেনে নিয়ে চলেছে অন্য কোথাও! তাঁর আত্মাকে দেহ থেকে টেনে বের করে নিচ্ছে কেউ! অঙ্গারপাত্রটা এখন ভলকে ভলকে উগরে দিচ্ছে ধোঁয়া। ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে আসছিল বীরেনবাবুর। কোনওমতে বললেন, “এটা কী হচ্ছে! আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন?”
গণপতি খলখল করে হেসে উঠলেন। এ হাসি শয়তানের হাসি! হাসতে হাসতেই বললেন, “আর কয়েক সেকেন্ড কষ্ট পাবেন! তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।”
—“কিন্তু …”
শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। চোখে প্রায় অন্ধকার দেখছেন। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে ওঠেন তিনি, “আপনি আমার সঙ্গে এটা কী করলেন?”
গণপতির হিংস্র দাঁতগুলো ঝিকিয়ে উঠল, “কিছুই না। শুধু আত্মা বদল করছি মাত্র। আত্মা কী জানেন? পাখি! প্রাণপাখি বলে না? আর দেহ হল খাঁচা। আমার পাখিটা এই জরাজীর্ণ খাঁচায় আর থাকতে চাইছে না। দু’বার স্ট্রোক হয়ে গিয়েছে। তৃতীয়বার হলে বাঁচব কিনা সন্দেহ। অথচ বাঁচার প্রবল ইচ্ছে! আমার আত্মার একটা নতুন, তাজা, শক্তপোক্ত খাঁচা দরকার। তা-ই আমি আপনার দেহটা ধার নিচ্ছি। আপনার সদ্য চল্লিশ পার করা সুস্থ, সবল দেহে এখন আমি থাকব। আর আমার এই বৃদ্ধ, অশক্ত দেহে আপনি। এতবছর ধরে ব্ল্যাক ম্যাজিকের সাধনা করে আমি এই মন্ত্র পেয়েছি। আজ তার সদ্ব্যবহার করলাম।”
বীরেনবাবু ততক্ষণে মাটির ওপর লুটিয়ে পড়েছেন। তাঁর চতুর্দিকে ঝলমল করছে নীলাভ জ্যোতি! কোনওমতে বললেন, “বিশ্বাসঘাতক!”
গণপতি মৃদু হাসলেন। বীরেনবাবুর জন্য মায়াও হল তাঁর। লোকটা কী করে বুঝবে যে একটা নিরীহ প্রশ্নের জালে এমন করে ফেঁসে যাবে! একটা কৌতূহলের দাম এমন সাংঘাতিক হবে তা কে জানত! আস্তে আস্তে তিনি চোখ বুজলেন। শুয়ে পড়লেন মেঝেতে। এবার ওই দেহে যাওয়ার সময় এসে গিয়েছে… অনেকদিন এই বুড়ো, ভারি এবং রোগগ্রস্ত দেহটাকে টেনে বেরিয়েছেন। এখন একটা সুস্থ দেহ তাঁর প্রতীক্ষারত। ওই দেহে এখনও অনেকদিন বাঁচবেন তিনি…! মুক্তি! আঃ…
কিন্তু এ কী! বীরেনবাবুর দেহটা কোথায় গেল! গণপতির নিজের দেহ থেকে বেরিয়ে এসেছে নীলাভ উজ্জ্বল জ্যোতির মতো তাঁর সূক্ষ্ম শরীর। বেরিয়ে আসার আগেও দেখেছেন বীরেন দত্তর দেহটা পড়ে আছে মাটির ওপরে। অথচ এখন সেখানে কিছুই নেই! তবে প্রবেশ করবেন কোথায়!
তিনি বিহ্বল হয়ে দেখলেন তাঁর নিজের দেহটা এবার আস্তে আস্তে উঠে বসেছে। গণপতির দেহ থেকে বীরেনবাবুর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “বড়ই দুঃখের কথা গণপতিবাবু। আপনি আমাকে চিনতে পারলেন না! শেষপর্যন্ত দেহবিনিময় করার জন্য একজন অশরীরীকেই বেছে নিলেন, যার কিনা দেহই নেই! দুঃখজনক!”
গণপতির সূক্ষ্ম দেহ তখনও ছটফট করে চলেছে। এ হতে পারে না! কিছুতেই হতে পারে না! একটু আগেও তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন ওঁকে! এত বড় ভুল হল!
—“দুমাস আগেই আমার ক্যান্সার ধরা পড়ে,” গণপতিবাবুর দেহে বীরেনবাবুর আত্মাটি বলে উঠল, “তখন থেকেই আমি মৃত্যু এবং তার পরবর্তী বিষয়ে কৌতূহলী হয়ে পড়ি। কিন্তু সে কৌতূহল আমার জীবদ্দশায় মিটল না। কাল রাতেই আমার মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু শেষ কৌতূহলটা মেটেনি বলে ওপারে যেতে পারিনি। এখানেই রয়ে গিয়েছি!”
গণপতির সূক্ষ্ম দেহ তখন একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে! নিয়তির অলঙ্ঘ্য বিধানে আর তিনি এ পারের বাসিন্দা নন। তাঁকে ওপারে চলে যেতেই হবে। তবু তিনি প্রাণপণ চেঁচিয়ে ওঠার চেষ্টা করেন, “না। আমি যাবো না…. কিছুতেই না…”
যেতে তো আপনাকে হবেই। এখন আপনার নিজের খাঁচায় ফেরার উপায় নেই। কারণ এখন আমি আরও কিছুদিন বাঁচব। আপনার দেহ অধিকার করে বেঁচে থাকব আমি। তবে কোনওদিন যদি বর্ডারলাইন ক্রস করে এপারে চলে আসেন, তবে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাবেন।” বীরেনবাবু হাসলেন। তাঁর পরিবর্তিত দেহের শ্বদন্ত দুটি ফের ঝিলিক দিয়ে ওঠে। গমগমে স্বরে প্রশ্ন করেন,
—“ওপারের দুনিয়াটা ঠিক কেমন?”
বিড়াল
বিড়াল
১
কালো বিড়ালটাকে আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না। হুলো হলে তবু কথা ছিল। কিন্তু ও মেনি!
এমনিতে ওর সঙ্গে আমার কোন দুশমনি নেই। ও কখনও কাঁচাগোল্লা হয়ে, আবার কখনও বা সরলরেখা হয়ে কার্নিশে রোদ পোয়ায়। আর আমি বারান্দায় বসে পেপার পড়ি। ও থাবা চাটতেই ব্যস্ত থাকে, আর আমি চোখ দিয়ে মেয়ে চাটি।
যখন উলটোদিকের বাড়ির সীমাবৌদি নাইটি পরে জানলার সামনে এসে ঝুল ঝাড়েন, আর তার স্লিভলেস নাইটির ফাঁক দিয়ে ওয়াক্স করা বগল, বুক— এইসব মালপত্তর দেখা যায়, তখন আর পেপারের দিকে চোখ থাকে না! সেদিকেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখে পড়ে কালো বিড়ালটা আমার দিকেই নিষ্পলকে তাকিয়ে আছে!
ভয় পাওয়া উচিত নয়, তবু…
ওর চোখে চোখ পড়লেই বুকের ভিতরটা খস খস করে ওঠে। মনে হয় ধূসর রঙের চোখদুটো অদ্ভুত রাগ নিয়ে আমার দিকে একদৃষ্টে দেখছে, যেন অন্তর্যামী… যেন একেবারে ভিতর অবধি দেখে ফেলছে ওর ওই অসহ্য ধূসর চোখ!
আমার এক দাদা কাম বন্ধু, শান্তনুদা বারবার বলত, “বুঝলি কৌশিক, মেয়েরা হল বিড়ালের জাত। বিড়ালের মতোই নরমসরম। আদর পেলেই মাথায় চড়ে। কথায় কথায় রোঁয়া ফুলিয়ে ফ্যাসফ্যাস করে ঝগড়া করে। কিন্তু … “
—“কিন্তু…?”
শান্তনুদা রহস্যময় হাসি হাসে, “নরম-সরম হলেও কখনও পাঙ্গা নিতে যাবি না। বিড়াল আর মেয়েদের সিক্সথ সেন্স খুব প্রবল। দু’জনেই থাবার মধ্যে নখ লুকিয়ে রাখতে ওস্তাদ! একবার থাবা মেরেছে কি ফুলটু কেলো!”
প্রথমে কথাটা ইয়ারকি হিসাবেই নিয়েছিলাম। পরে যখন মালিনীর সঙ্গে মাখামাখি হল তখন লক্ষ্য করে দেখলাম যে শান্তনুদা নেহাত মিথ্যে কথা বলেনি। মালিনীর গায়ের রঙ কুচকুচে কালো ছিল। চোখদুটো উজ্জ্বল ধূসর রঙের, মনে হত কন্ট্যাক্ট লেন্স পরে বসে আছে। বিড়ালের মতোই পাছা দুলিয়ে হাঁটতো। বেশ আদুরেও বটে। চিলেকোঠায় বা সিঁড়ির তলায় সামান্য আদর পেলেই আহ্লাদে পুরো আইসক্রিম!
কিন্তু থাবার মধ্যে লুকিয়ে রাখা নখের আঁচড় খেতেও বেশি সময় লাগল না।
এক সুন্দর সন্ধ্যায়, গঙ্গার ঘাটে বসে বলল, “তুমি আর কখনও আমায় ফোন কর না।”
অবাক হয়ে বলি, “যাঃ শালা! কেন?”
নির্মম উত্তর, “পরের মাসেই আমার বিয়ে।”
এর চেয়ে মাথায় একটা হাতুড়ির বাড়ি বসিয়ে দিলেও বোধহয় এত যন্ত্ৰণা হত না। অনুভব করছিলাম একটা পিন মাথার মধ্যে ক্রমাগতই বিঁধছে। তিরতির করে হয়ে চলেছে রক্তক্ষরণ।
মুখ থেকে বেরোল শুধু একটাই শব্দ, “কেন?”
মালিনী ধূসর চোখদুটো তুলে নিষ্পলকে তাকাল। অদ্ভুত এক্স রে দৃষ্টি। যেন ভিতরের অস্থিমজ্জা মায় গোটা ‘আমি টাকে দেখে নিচ্ছে!
অসহ্য লেগেছিল ওই চাউনি! ভীষণ ইচ্ছে করছিল ওকে খুন করে ফেলি। ও আস্তে আস্তে জবাব দেয়, “পাড়ার বউদি আর কাজের মাসির এঁটো খেতে চাই না আমি। এতদিন জানতাম না। জানলে আগেই সম্পর্কটা শেষ হত। বাট, বেটার লেট দ্যান নেভার।”
মালিনী আমায় চড় মারেনি। কিন্তু গালটা চিড়বিড় করে উঠেছিল। যেন কেউ আঁচড়ে দিয়েছে নখ দিয়ে! ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে অদৃশ্য রক্ত!
সেই নখের আঁচড়ের জ্বালা কোনওদিন ভুলিনি। অসহ্য ক্ষোভে ছটফট করতে করতে ভেবেছি, মালিনী মরে গেলে ভালো হত! ওর লাশ দেখতে পেলে খুশি হতাম আমি। একটা অন্ধরাগ ভেতরে ভেতরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। মালিনী মরে গেলে খুব ভালো হয়, মরে যাক… ও মরে যাক…!
ভগবান আজকাল বোধহয় কানে বিশেষ শোনেন না। কিন্তু মালিনী মরে গিয়েছিল। বিয়ের আগের রাতেই ট্রেনে কাটা পড়ে দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। কী করতে ও ট্রেন লাইনের কাছে গিয়েছিল তা কেউ জানে না। ধূসর মার্বেলের মতো চোখ দুটো বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কী যেন নিষ্পলকে দেখেছিল। শেষ সময়েও সেই অন্তর্ভেদী চোখ দুটো বোজেনি।
২
বলাই বাহুল্য, মনে বড় শান্তি পেয়েছিলাম।
সেদিন আস্ত একটা মালের বোতল শেষ করি। কাজের মেয়ে পরীকে নিয়ে একটা নৃশংস রাত কাটিয়ে মনে হয়েছিল, আমিই শালা এই পৃথিবীর রাজা! আমায় আঘাত দেওয়ার শাস্তি মৃত্যু!
তারপর থেকে বেশ ফূর্তিতেই ছিলাম। কখনও শিল্পাবউদি, আবার কখনও পরীর অনুদানে সুন্দর রাতগুলো কেটে যাচ্ছিল।
সেদিন দুপুরবেলা সিনটা ভালোই জমেছিল। বেশ ম্যারাথন চুমু খেয়ে বউদিকে গরম করছি। আস্তে আস্তে পারফিউমের গন্ধ সরে গিয়ে নাকে কাঁচা মাংসের খুশবু। জন্মদিনের পোষাক পরে সবে ‘গাদি’ খেলতে শুরু করেছি…
ঠিক তখনই চোখ পড়ল জানলায়!
সেই কালো বিড়াল! আপাদমস্তক কালো! ধূসর মারবেলের মতো জ্বলজ্বলে চোখ মেলে এদিকেই তাকিয়ে আছে! মূর্তির মতো স্থির হয়ে উঁকি মারছে জানলায়। ওর ডান হাতের থাবা থেকে আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে ধারালো নখ… হিংস্র, তীক্ষ্ণ ফলা!
সেইদিনই প্রথম জানলাম ভয় কাকে বলে। গিরগিটির মতো একটা ফ্যাকাশে ভয় আমার পিঠ বেয়ে নেমে গেল নীচের দিকে। মনে হল, বিড়ালটা সব জানে! সব কিছু…
আমি ওর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারি না… চুম্বকের মতো ও টেনে রাখে আমার দৃষ্টি! টের পেলাম আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে যাচ্ছি আমি… মড়া মাছের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছি… চোখের সামনে আর কিছু নেই, শুধু দুটো ধূসর চোখ জ্বলজ্বল করছে…
সেদিন থেকেই দুঃস্বপ্নের মতো তাড়া করতে শুরু করেছে সেই চোখ, আর আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসা উদ্যত থাবার গুপ্ত নখ!
বিড়ালটা কি আমায় পাহারা দেয়? কী আছে ওর মার্বেলের মতো চোখে? ঘেন্না? রাগ? প্রতিহিংসা?…কী?
হুলো হলে চিন্তার কিছু ছিল না, কিন্তু শালি মেনি! মেনি বলেই চিন্তা! মেনি বলেই সহ্য করতে পারি না ওকে! সহ্য করতে পারি না ও কালো বলে! কী আশ্চর্য! শরীরে একটা সাদা দাগ থাকলে কোন মহাভারতটা অশুদ্ধ হত? চোখদুটো কি সবুজ বা নীল হতে পারত না? ধূসরই হতে হল?
যতই ভাবি, ততই মনে হয় কেউ বুঝি অলক্ষ্যে আমার উপর নজর রাখছে। ভয় হয়… বড় ভয় হয়…
৩
—“তুমি আজকাল কেমন বদলে গেছ।”
এলোমেলো শাড়ি ঠিক করতে করতে শিল্পাবউদি বলল, “আগের মতো আর গরম নেই…”
গরম থাকব কী বে! নিজে তো একেবারে ফার্নেস! একবার ঢুকলে জান কয়লা করে ছেড়ে দেয়। আমি মানুষ না গোরিলা!
এসব কথা বলাই যেত। কিন্তু যেখানে মাল্লু, সেখানে কথা বলা যায় না। শিল্পাবউদির বর মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। মালদার লোক। শিল্পা বউদির হাতেও তাই পয়সার চুলকানি। আমার মাল, সিগারেটের খরচটা ওখান থেকেই আসে। তাই বেশি কিছু বলতে পারি না।
আমার ব্যাগে বেশ কয়েকটা কড়কড়ে নোট রাখতে রাখতে বউদি বলল,
–“পরের বার আরেকটু ভালো চাই। ক’দিন ধরে ভালো লাগছে না।”
আমি উত্তরে তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার আগেই চোখ পড়ল জানলায়।
বিড়ালটা …!
ধূসর চোখদুটো থেকে যেন আগুন ঠিকরে পড়ছে। স্থির হয়ে সে দেখছে এদিকেই…
উদ্যত চুমুটা স্থগিতই থেকে গেল। শিল্পাবউদি অবাক, “কী হল?” বুকের ভিতরে একটা অসহ্য ঘূর্ণিঝড় ক্রমশই পাক খাচ্ছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। বিড়ালটা ওখানে কতক্ষণ আছে?…ও কি সব দেখেছে…! ও কি সব জানে…?
একটা হিংস্র অসহায়তা টের পাই! বিড়ালটাকে হাতের কাছে পেলে শেষ করে ফেলতাম। অসহ্য… অসহ্য… এই সিঁটিয়ে সিঁটিয়ে বেঁচে থাকা। তার চেয়ে যদি ওর গলা টিপে মেরে ফেলতে পারি!
ও কি আমার উপর নজর রাখছে? যখনই জানলার বাইরে চোখ পড়ে তখনই দেখি হয় জানলায় থাবা রেখে ভিতরে উঁকি মারছে, নয়তো কার্নিশে চুপ করে বসে এদিকেই তাকাচ্ছে! আজকাল ওর ভয়ে বারান্দায় যেতে পারি না। পরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে পারি না। কারণ প্রত্যেকবার চরম মুহূর্তে কোথা থেকে উদয় হয় কে জানে! কুঁকড়ে যাই… শেষপর্যন্ত আর টিকে থাকতে পারি না। উত্তেজনার বদলে ঠান্ডা হিমবাহের স্রোত নেমে আসে শরীর বেয়ে….
তারপরই একটা অসহ্য রাগ আমার মনে দানা বাঁধে। একটা ভীষণ হিংস্রতা। আমার সঙ্গে ইয়ারকি! শালা, মেরে দু’টুকরো করে ফেলে দেব! ওর ওই অসহ্য চোখ… ওই চোখ যদি উপড়ে না ফেলি তো…
আমি প্রচণ্ড রাগে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। কিন্তু আশ্চর্য! বিড়ালটা একটু ও ভয় পায় না! বরং আগের মতোই স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। ওর চোখ একবারের জন্যও নড়ে না। পলক পড়ে না। তেড়ে গেলে বরং আস্তে আস্তে চলে যায়। কার্নিশ থেকে লাফ মেরে নেমে যায় নীচে। চলে যেতে যেতেও ঘুরে একবার তাকায় আমার দিকে।
বিড়ালরা হাসতে পারে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখি বিড়ালটার মুখে একটা অদ্ভুত হাসির আমেজ ভেসে উঠেছে। একটা অদ্ভুত রহস্যময় হাসি। গা শিরশির করে ওঠে!
ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? এমন নয় যে ওকে আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলেছি। বরং প্রাণীদের একটা সহজাত ক্ষমতা থাকে। সেই ক্ষমতায় ও বুঝতে পারে যে আমি ওকে অপছন্দ করি। অথচ তা সত্ত্বেও আমার আশপাশেই ঘুরঘুর করে! কাছাকাছি থাকে!
অসাধারণ কিছু তো নয়। সামান্য বিড়াল! লক্ষ লক্ষ মানবেতর প্রাণীর মধ্যে একটা! অথচ মনে হয় ওকে খুব ভালো করে চিনি…
৪
সেদিন পরী দুপুরে মাছ ভেজেছিল।
বাজারে আজকে খুব ভালো জাতের মাছ পেয়েছিলাম। একদম রুপোলি আঁশের তাজা ইলিশ। দেখেই লোভ হল। লোভ এতটাই বেশি হল যে দামটা গলাকাটা হলেও কিনেই ফেললাম। কী মনে হতেই আরও কিছু কেনাকাটা করে ফেলি। মুগ ডাল, গোবিন্দভোগ চাল, মোটামোটা তাজা বেগুন। ইচ্ছে ছিল দুপুরে সলিড খিচুড়ির সঙ্গে জমিয়ে খাবো। খিচুড়ির সঙ্গে বেগুনভাজা আর ইলিশমাছ ভাজা। ভাবতেই জিবে জল আসছিল। এত আয়েশ করার সামর্থ্য আমার সবসময় হয় না। কিন্তু এখন পকেট গরম আছে। শিল্পাবউদির দেওয়া নোটগুলো এখনও কড়কড় করছে।।
বাজার করে ফেরার পথেই শান্তনুদার সঙ্গে দেখা। সে একটা ঢাউস ব্যাগে শাকপাতা ভর্তি করে ফিরছে।
কী মনে হল কে জানে, ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।
—“কী রে!” ও আমার দিকে তাকিয়ে হাসে, “নদের চাঁদ, ভালোই তো কসাইখানা খুলে বসেছিস। ক’টা পাঁঠা কেটে ঝোলালি?”
এইজন্যই শালার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মুখ তো নয়, নর্দমা!
তবু আজ ওর কাছেই আমার দরকার ছিল। একটু দেঁতো হেসে প্রশ্নটা এড়িয়ে যাই। তারপর একটু কিন্তু কিন্তু করে প্রশ্নটা করেই ফেলি,
—“আচ্ছা শান্তনুদা, তুমি বিড়াল সম্পর্কে আর কী কী জানো?” শান্তনুদা কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। পরক্ষণেই সজোরে হেসে উঠেছে,
—“যাঃ শালা, মাগীবাজি ছেড়ে এখন কি বিড়ালবাজি শুরু করেছিস? কামসূত্রের প্রশ্ন থাকলে কর। বিড়াল নিয়ে এত মগজমারি কেন?”
কথাগুলো শুনে ঝাঁট জ্বলে গেল। তা সত্বেও হজম করে নিয়েই বললাম,
—“না, তুমি বলছিলে না, যে মেয়ে আর বিড়াল প্রায় একরকম…”
“হ্যাঁ…. প্রায় একরকম নয়…” বিরক্ত মুখে শান্তনুদা বলে, “একেবারেই একরকম। আদর দিয়েছিস কি তোর বাপ-চোদ্দোপুরুষের তেরোটা বাজিয়ে ছাড়বে। কিছু বললেই ফ্যাসফোঁস শুরু হল। যত্তসব…”
সে আরেকটা অশ্লীল শব্দ বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই তাকে থামিয়ে দিয়েছি, “তুমি বিড়াল সম্পর্কে আর কী কী জানো?”
শান্তনুদা অদ্ভুতভাবে আমার দিকে তাকাল, “তোর কী হয়েছে কৌশিক? সকাল থেকেই বিড়াল বিড়াল করছিস? বিড়াল পুষবি নাকি? না পাগল হয়েছিস?”
বুঝলাম ওকে ঘাঁটিয়ে বিশেষ লাভ নেই।
বাড়িতে এসে যা কোনওদিন করিনি তাই করতে শুরু করলাম। গুগল সার্চ খুলে বিড়াল সম্পর্কে পড়তে শুরু করলাম। মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের সময় এত পড়লে বোধহয় এতদিনে দিগগজ হয়ে যেতাম। কিন্তু এখন মনে হল, বিড়াল সম্পর্কে জানাটা বেশি জরুরী।
পড়তে পড়তে শিরশিরে ভাবটা আরও বাড়তে লাগল। বিড়ালকে এতদিন একটা আদুরে প্রাণী বলেই জানতাম। যখন খুশি কোলে নিয়ে আহ্লাদ করা যায়। আবার যখন খুশি ক্যাৎ করে এক লাথিও মারা যায়।
অথচ ইতিহাস অন্য কথা বলে! প্রাচীন মিশরের ইতিহাসে দেবী বাস্টের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে বিড়ালের ইতিহাস! বাস্টের মন্দির বুবাস্টিসে শতাধিক বিড়ালের মমি আছে। সসম্মানে মানুষের মতোই তাদের ওখানে সমাধিস্থ করা হয়েছে। এবং দেবীর মূর্তিটাই আসলে এক বিড়ালরূপী নারীমূর্তি! মিশরীয়রা এই বিড়ালের দেবীকে রীতিমতো পুজো করে ও ভয় পায়!
বোঝো! বিড়ালের এত ফান্ডা আছে কেউ জানত!
বিড়ালকে দেবী ফ্রেয়ার বাহনও বলা হয়; এবং ফ্রেয়া যাদুর দেবী! অর্থাৎ বিড়ালের সঙ্গে যাদুর যোগাযোগও আছে। এই যাদুই আবার ডাইনিদের কাছে ব্ল্যাক ম্যাজিকের রূপ ধারণ করেছে। সেখানেও বাহন হিসাবে এক ও অদ্বিতীয়ভাবে হাজির বিড়াল!
সবমিলিয়ে বিড়াল এক রহস্যময় প্রাণী! যতই পড়ছি ততই ভয়টা আমায় চেপে ধরছে। কোথাও বিড়াল পবিত্রতার প্রতীক, কোথাও ভয়ের! কোথাও ভীষণ অমঙ্গল ডেকে আনে, কোথাও আবার কালোযাদুর বাহক
এমনকি মৃত ব্যক্তির আত্মাও বহন করতে পারে এই বিড়ালই! পড়তে পড়তেই ক্রমশ একটা অমঙ্গলের আশঙ্কা চেপে ধরতে শুরু করল আমায়। যা সন্দেহ করছিলাম, তাই যেন এখন অমোঘ সত্য বলে মনে হচ্ছে। আর প্রত্যেক ক্ষেত্রেই নারী কোনও না কোনও ভাবে জড়িত বিড়ালের সঙ্গে! এ কি নিতান্তই কাকতালীয়…!
—“বাবু… খাবে এখন?”
খুব মন দিয়ে আর্টিকলগুলো পড়ছিলাম। হঠাৎ পরী সামনে এসে দাঁড়াতেই চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে গেল।
—“হ্যাঁ, দে।”
সে বিনাবাক্যব্যয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। পরক্ষণেই থালাবাসন উলটে পড়ার ঝনঝন শব্দ! সঙ্গে সঙ্গেই পরীর পরিত্রাহি চিৎকার।
আমি ছুটে যাই রান্নাঘরে …
সেই হতভাগা বিড়াল! সেই বিড়াল… মুখে মাছভাজা! ধূসর চোখদুটো যেন সকৌতুকে তাকিয়ে দেখছে: পরী মেঝের উপর… তখনও চিৎকার করছে!
“শা-লি… মেরেই ফেলব আজকে…”
এতক্ষণ ধরে পড়া আর্টিকলগুলো মাথা থেকে বেরিয়ে গেল। বিড়ালটা গ্যাসের টেবিলের উপরে দাঁড়িয়ে ব্যঙ্গাত্মক ভাবে আমায় দেখছিল। পালাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও নেই। আমি তড়াক করে লাফিয়ে ওকে ধরে ফেলি। প্রায় জাপটেই ধরে ফেলেছিলাম ওকে। কিন্তু ও কী ভাবে যে হাতের ফাঁক গলে সুড়ুৎ করে বেরিয়ে গেল কে জানে! আমি হতবুদ্ধি হয়ে দেখলাম বিড়ালটা তিড়িক করে বিদ্যুতের মতো শূন্যে লাফিয়ে উঠল! ফ্যাস করে একটা শব্দ পরক্ষণেই ডানগালে প্রচণ্ড জ্বালা! থাবার ভেতর থেকে গুপ্ত নখ বেরিয়ে এসে গভীর আঁচড় কেটে গেল গালে
আমি অসহ্য যন্ত্রণায় অক্ষমের মতো দেখলাম মাছভাজাটা মুখে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে ও। মুখে যেন ব্যঙ্গের হাসি!
গাল কেটে গিয়ে রক্ত পড়ছিল। ডাক্তারের কাছে দৌড়োতে হল।
ডাক্তারবাবু বললেন, —“বিড়ালের আঁচড়! তাও আবার গালে! খেলেন কী করে!”
কোনওমতে সমস্ত ঘটনা বলার পর তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। তিনি ক্ষতস্থান ধুয়ে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে দিয়ে বললেন, “ঘরের বিড়াল হলে চিন্তা ছিল না। কিন্তু একেই বাইরের বিড়াল, তার উপর আঁচড়ে রক্ত বের করে দিয়েছে। চান্স নেবেন না। ইঞ্জেকশন নিয়েই নিন।”
গালটা তখনও চিড়বিড় করে জ্বলছিল। তার চেয়েও বেশি জ্বালা ছিল ভিতরে। অমন দামি ইলিশ মাছের সর্বনাশ করল। বিড়ালের এঁটো আর খেতে পারবো? তার উপর মোক্ষম আঁচড়! বিড়ালটার উপর ভীষণ বিদ্বেষে জ্বলছিলাম আমি। অসহ্য জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে ভাবি, মরে যাক বিড়ালটা… নিকুচি করেছে মিথের… ওগুলো সব গপ্পো ছাড়া আর কিছু না… মরে যাক বিড়ালটা… মরে যাক…. মরে যাক….
ভগবান হয়তো এবারও প্রার্থনা শুনতে পেলেন না।
কিন্তু বিড়ালটা সত্যিই মরে গেল! পরদিন রাত্রে কে যেন তাকে বস্তাবন্দী করে ফেলে দিয়েছিল রেল লাইনের উপরে। ট্রেনের চাকায় দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল সে!
তবু তার সেই ধূসর চোখ দুটো খোলাই ছিল! মৃত্যুও সে চোখ বোজাতে পারেনি।
৫
এত আনন্দ অনেকদিন অনুভব করিনি।
আপদ গেছে! বুকের উপর থেকে যেন একটা ভার সরল। আর কেউ জানলার কাছে এসে গুঁড়ি মেরে বসবে না। আর কেউ কটা চোখ নিয়ে বিচারকের ভঙ্গিতে তাকিয়ে থাকবে না। খুব বাঁচা বেঁচেছি।
পরী আর শিল্পাবউদি ছাড়া আজকাল ফূর্তির আরও একটা উৎস হয়েছে। কৃষ্ণকলি। ইন্টারনেটে আলাপ। সেক্স চ্যাট করতে ওস্তাদ। আমার নোংরা নোংরা কথা শোনে। আর পালটা রগরগে কথা বলতেও জানে। কথাতেই যে এত গরম করে, না জানি সে বিছানায় কতটা করবে।
একদিন মুখ ফসকে সে কথা বলতেই বলল, “বেশ তো, চলে এসো আমার ফ্ল্যাটে। লেটস্ এনজয়।”
আমি অবাক হই না। কলকাতাতে এমন মেয়ের অভাব নেই। তবু ভদ্রতাবশত একটু কিন্তু কিন্তু করি, “তোমার বাড়িতে? কিন্তু তোমার মা বাবা?”
—“আমার মা-বাবা এখানে থাকেন না,” তার স্বচ্ছন্দ উত্তর, “আমি একাই থাকি। আর আমার দেখাশোনা করার জন্য আমার মেড থাকে।
এমন সুযোগ পেয়ে কেউ ছাড়ে? আমিও ছাড়িনি।
কৃষ্ণকলি বেশ বড়লোকের মেয়ে বলেই মনে হয়। সাউথ সিটির বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকে সে। বাড়িতে ওর কাজের মেয়ে ঝরনা ছাড়া আর কেউ থাকে না। তার কথা মতো, সে এখানে একটা কল সেন্টারে মোটা মাইনের চাকরিও করে।
কৃষ্ণকলি নামটার মধ্যেও একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। শুনলেই কেমন বুকের ভিতরে আকুলিবিকুলি টের পাওয়া যায়। আর বন্যতার নমুনা তো আগেই তার কথায় পেয়েছি। বলাইবাহুল্য তাকে দেখার জন্য উদ্গ্রীব হয়েছিলাম।
তার ফ্ল্যাট নম্বর, ফ্লোর নম্বর এবং ফোন নম্বর তিনটেই জানা ছিল। সুতরাং খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধে হল না। ফ্ল্যাটের সামনেই নেমপ্লেটে জ্বলজ্বল করছে সোনালি হরফে, কৃষ্ণকলি চ্যাটার্জী। বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই একটা অদ্ভুত উত্তেজনা বোধ করি। মাথায় জেল মেখে যথেষ্ট স্টাইল মেরেই এসেছি। তবু আরেকবার ছোট চিরুনিটা বের করে আরেকবার মাথায় বুলিয়ে নিই। উত্তেজনা যথাসম্ভব গোপন করেই কলিংবেল বাজালাম। একবার… দু’বার…!
ভিতরে সুরেলা কলিংবেল বেজে উঠেছে। কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা তারপরই দরজা খুলে গেল।
ভেবেছিলাম হয়তো কৃষ্ণকলি দরজা খুলবে। আমি তাকে দেখার জন্য যতটা অধীর, সে-ও কি নয়? তাই রীতিমতো ওভার কনফিডেন্ট ছিলাম যে সে-ই হয়তো দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করবে।
কিন্তু দরজা যে খুলল তাকে দেখে আমি হতভম্ব! এক মধ্যবয়সী মহিলা! গাল ভরতি ব্রণর দাগ। শরীরে চর্বি ঝুলে পড়েছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে রীতিমতো বিষম খেতে যাচ্ছিলাম। তার আগেই সে হেসে বলে, “আসুন, দিদিমনি ভিতরের ঘরে আছেন। আপনাকে বসতে বললেন।”
যাক, বাঁচা গেল। এতক্ষণে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলি। এ তবে কৃষ্ণকলি নয়, ঝরনা।
ফ্ল্যাটের ভিতরটা বেশ সুন্দর করে সাজানো। দেওয়ালে সুন্দর সুন্দর অয়েলপেইন্টিং। রট আয়রনের টেবিল, দামী সোফায় সুসজ্জিত আর নরম কার্পেটে মোড়া ঘর। মাখনের মতো দেওয়ালের রং। মাথার উপর ছোট্ট অথচ সুন্দর দামী কাচের ঝাড়বাতি। একপাশে শোকেসে শো-পিস সাজানো। দেওয়াল আলমারিতে থাকে থাকে বই। কৃষ্ণকলি বই পড়তে ভালোবাসে। আলতো করে চোখ বোলাতেই হঠাৎ একটা বই চোখে আটকে গেল।
—“স্কেয়ারি হ্যালোউইন ব্ল্যাক ক্যাট মিথ!”
কালো বিড়াল! এখানেও! কৃষ্ণকলিও কি তবে বিড়াল নিয়ে চর্চা করে? আমি নিতান্তই কৌতুহলবশত উঠে যাই বইয়ের আলমারির দিকে। ভালো করে দেখি ভেতরের বইগুলোকে। আমার বিস্মিত দৃষ্টি বইগুলোর নামের উপর দিয়ে সরে সরে যায়…
ক্যাট মিথোলজি… ব্ল্যাক ক্যাটস… দ্য ডেভিল… ইজিপশিয়ান ক্যাটস… দ্য মিথ অফ চাইনিজ ক্যাট… ক্যাটস ক্যান রিমেম্বার…
সব বিড়ালের উপর বই!
একটা অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ! তার সঙ্গে চুড়ির মিষ্টি আওয়াজ। পেছন থেকেই ভেসে এল একটা রিনিরিনে কণ্ঠস্বর, “ওখানে কি দেখছ কৌশিক? আমি এখানে।”
চমকে উঠে পিছনে তাকাই। পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে এক যুবতী। হাতে হুইস্কির বোতল আর কাচের গ্লাস!
এ কে? কৃষ্ণকলি!
আপাদমস্তক কুচকুচে কালো। বিড়ালের মতো পিচ্ছিল চিকন শরীর। নরম নরম গড়ন। কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে সামনে এল, অবিকল বিড়ালের মতো! টের পেলাম, আমি ঘামছি! হৃৎপিণ্ডটা দ্বিগুণ বেগে চলতে শুরু করেছে! আমার থেকে সামান্য দূরত্বে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেয়েটা। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর দুটো চোখ।
একদম ধূসর মার্বেলের মতো…! জ্বলজ্বল করে জ্বলছে! একদম নিষ্পলক চাউনি!
সে দৃষ্টি দাবানলের মতো জ্বলছে… নির্দয় বিচারকের মতো…
বিড়াল রহস্যময়… বিড়ালের গোপন নখ আছে… বিড়াল নিয়ে ছেলেখেলা করা যায় না।
কৃষ্ণকলি অবিকল একটা বিড়ালের মতো গুটিগুটি এগিয়ে এল। আমার বুকের উপর হাত রেখেছে ও। বুকে একটা অব্যক্ত কষ্ট! যেন বুকের চামড়া ফুঁড়ে হৃৎপিণ্ডের দিকে কিছু একটা চলে যাচ্ছে একটু একটু করে! ধারালো কিছু! ওর আঙুলের লুকিয়ে রাখা তীক্ষ্ণ নখগুলো কি এবার আস্তে আস্তে বেরিয়ে আসছে? গোপন নখ? ও কি আমায় শাস্তি দেবে? ও কি সব জানে? সব জানে…?
—“কে?” আমি প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। কথা বলার শক্তি ছিল না। তবু অতিকষ্টে বলি, “কে তুমি?”
কৃষ্ণকলি হাসল। মুখটা আমার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বলল,
—“মাছভাজা খাবে?”
জীবন্ত প্রস্তর
জীবন্ত প্রস্তর
১
তখন গভীর রাত। যতদূর চোখ যায় শুধু অন্ধকারের একচ্ছত্র বিস্তৃতি। কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। কোথাও একবিন্দু আলো নেই, কোনও শব্দ নেই! নেই জীবনের বিন্দুমাত্র প্রকাশও! রাতচরা পাখির ডাক, কিংবা কুকুরের ঘেউ ঘেউ এমনকী গাছের পাতা খসে পড়ার খসখস, কোনও জাগতিক আওয়াজই শোনা যায় না! এ কেমন নিস্তব্ধতা! কেমন অন্ধকার! যেন কেউ একটা কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছে সমস্ত দৃশ্য, সমস্ত শব্দ! পর্দার ও প্রান্তে যা আছে তা যেন প্রকাশ্যে আসতে চায় না।
ড. ইথান ওলসেন সতর্কদৃষ্টিতে একবার চতুর্দিকটা দেখে নিলেন। আজ অমাবস্যা। আকাশে জমাট অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই নেই। আশপাশে শুধু হাড়-পাঁজর বের করা ধ্বংসস্তূপের কঙ্কাল! শূন্য চক্ষুকোটরের মতো হাঁ করে আছে জানলাগুলো! বেশিরভাগ বিল্ডিংগুলোই ধ্বসে পড়েছে। বিশেষ কিছুই বাকি নেই। সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল, বুঝি রস-রূপ-গন্ধ ভরা পৃথিবী থেকে বহুদূরে এসে পড়েছেন তিনি। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতে! যেখানে নৈঃশব্দও বড় বিষণ্ণ
ইথানের মনের মধ্যেও যেন সেই বিষণ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বের অন্যতম সেরা প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর হিসাবে তিনি পৃথিবীখ্যাত। দুনিয়ায় এমন কোনও কুখ্যাত ভৌতিক স্থান নেই, যেখানে তিনি তদন্ত করতে যাননি। অভিশপ্ত অ্যাসাইলাম থেকে শুরু করে রহস্যময় টানেল, মেট্রো স্টেশন, ভুতুড়ে বাড়ি ও ম্যানসন, এমনকি কুখ্যাত ঐতিহাসিক জায়গাগুলোকেও ছাড়েননি। কোথাও প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিটির প্রমাণ পেয়েছেন, আবার কোথাও বা পাননি। কিন্তু তাঁর বহুদিনের অভিজ্ঞতা বলছিল যে, এই অভিশপ্ত দূর্গের কাহিনি হয়তো অন্যরকম। আপাতদৃষ্টিতে কোনও কিছুই অস্বাভাবিক মনে হয় না। সঙ্গে আনা সেন্সরগুলোও কোনওরকম অতিলৌকিকের উপস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে না। অথচ তাঁর দেহ ও মন বলছে, এই কেল্লার ছত্রে ছত্রে অস্বাভাবিকতা রয়েছে। এবং যথেষ্ট পরিমাণেই রয়েছে। শুধু ধরা দিচ্ছে না!
ইথান যখনই প্রথম এই দুর্গের সিঁড়িতে পা রেখেছিলেন, তখনই এক অদ্ভুত শৈত্যে ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল তাঁর দেহ! অথচ এমন হওয়ার কথা নয়। এখন গরমের মরশুম চলছে। ফোর্টের বাইরে যখন দাঁড়িয়েছিলেন, তখনও বেশ গরমই লাগছিল। খন্ডমুহূর্তের মধ্যেই সেই ভ্যাপসা গরমভাব এমন অস্বাভাবিক শীতলতায় রূপান্তরিত হতে পারে না! তাঁর দেহ সেই মুহূর্তেই বলে উঠেছিল,
“সামথিং ইজ রঙ উইথ দিস প্লেস!”
কিন্তু আশ্চর্য বিষয়! তাঁর ইনফ্রারেড থার্মোমিটার এখনও কোনওরকম অস্বাভাবিকতা দেখায়নি! ইথান প্রত্যেকটি জায়গায় গিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করেছেন। তবুও থার্মোমিটার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড ডিটেক্টরও কোনও অদৃশ্য উপস্থিতির কথা জানায়নি। ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডারও ব্যর্থ হয়েছে। ইথান দুর্গের প্রত্যেকটি ভাঙাচোরা ঘরে ঢুকে কোনও অলৌকিক মানুষের উদ্দেশে বারবার প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। যাকে বলে ‘ইলেক্ট্রনিক ভয়েস ফেনোমেনা’ সেশন। কিন্তু গোটা ইভিপি সেশনেও রেকর্ডারে কিছুই রেকর্ড হয়নি! কোনও কথা তো দূর, সামান্য শব্দও নয়! অর্থাৎ তাঁর প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি কেউ। দূর্গের প্রতিটি নির্জন কোণায়, সিঁড়িতে, আশপাশের ফাঁকা ঘরে ছড়িয়ে রেখেছেন ‘মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টর’। কোনওরকম অস্বাভাবিক বা আপাতঅদৃশ্য গতিবিধি অনুভব করতে পারলেই অ্যালার্ম বেজে উঠবে! কিন্তু এখনও পর্যন্ত সব চুপচাপই আছে। অন্য কেউ হলে, হতাশ হয়ে এতক্ষণে হাল ছেড়ে দিত। অথবা ঘোষণা করে দিত এই অভিশপ্ত দূর্গে কোনওরকম অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু ইথান সে পথে হাঁটেননি। তাঁর সেন্সর ও গ্যাজেটগুলো বলছে যে, এখানে কোনও প্যারানর্মাল অ্যাক্টিভিটি নেই। কিন্তু তিনি নিজে দেহে ও মনে যা অনুভব করছেন, তাকে অস্বীকার করেন কী করে! যে স্থির শৈত্য তাঁকে ছুঁয়ে আছে, যে নৈঃশব্দ তাঁকে নিজের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটুকুও শুনতে দিচ্ছে না, যে অজ্ঞাত কারণে তাঁর মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে, এক বহু শতাব্দীর পাথরচাপা দীর্ঘশ্বাস গুমরে মরছে বুকে—তা মোটেই স্বাভাবিক নয়। গ্যাজেট ভুল করতে পারে। কিন্তু দেহ ও মন ভুল করে না।
ইথানের কপালে চিন্তার ভাঁজ। তাঁর সেন্সর ও গ্যাজেটগুলো কি ঠিকমতো কাজ করছে না? নাকি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে গ্যাজেটগুলোকে বিভ্রান্ত করছে? তাদের সঠিক নির্দেশ দিতে কেউ বাধা দিচ্ছে কি? নাকি এখনও সময় হয়নি? তিনি নিজের ঘড়ির রেডিয়াম ডায়ালের দিকে তাকালেন। রাত্রি তিনটে বেজে তিরিশ মিনিট। সূর্যোদয় হওয়ার আগে তাঁকে সেই প্রত্যেকটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে যা আজ পর্যন্ত বিজ্ঞান দিয়ে উঠতে পারেনি। খুঁজতে হবে সেই অজানাকে যার জন্য এই দূর্গের কপালে ‘মোস্ট হন্টেড প্লেস’-এর তকমা জুটেছে।
আস্তে আস্তে আরও কিছুটা সময় কাটল। অন্ধকার, নিঃশব্দ রাত এখনও মৌনতাভঙ্গ করেনি। ইথানও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। দূর্গের ভাঙাচোরা সিঁড়িতে বসে কখন যে অজান্তেই দু’চোখের পাতা লেগে এসেছিল তাঁর, তা নিজেও বুঝতে পারেননি। আচমকাই ঘুম ভাঙল একটা তীব্র শব্দে!
তৎক্ষণাৎ লাফ মেরে উঠে বসলেন তিনি। মুহূর্তের মধ্যেই কানে এল ‘মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টর’ এর প্রবল চিৎকার! কোথাও কোনও রহস্যময় গতিবিধি ধরা পড়েছে! অবশেষে! এত প্রতীক্ষার পর শেষপর্যন্ত একটা ইঙ্গিত এল তবে! কিন্তু আওয়াজটা আসছে কোথা থেকে! ইথান তড়িৎগতিতে ছুটে গেলেন এম ভি ডিটেক্টরের আওয়াজ লক্ষ্য করে। তাঁর হাতের টর্চ দূর্গের আঁকাবাঁকা পাথুরে রাস্তার ওপর আলো ফেলছে। ইতস্তত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে, কখনও হোঁচট খেয়ে, কখনও লাফ মেরে সিঁড়ি টপকে তিনি দৌড়ালেন শব্দের উৎসের দিকে।
কিন্তু দৌড়াতে দৌড়াতেই আচমকা চমকে উঠলেন ইথান। এতক্ষণ মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টর স্বাভাবিক আওয়াজেই অ্যালার্ম দিচ্ছিল। হঠাৎই সেই একঘেয়ে অ্যালার্ম থেমে গিয়ে চতুর্দিক কাঁপিয়ে হাসির শব্দ ভেসে এল। তিনি স্তম্ভিত হয়ে শুনলেন, সেটা কোনও নারীর হাসি! কোনও নারী যেন তীব্রস্বরে খিলখলিয়ে হেসে উঠেছে। আর সেই হাসি ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরছে দূর্গের প্রতিটি ভাঙা দেওয়ালে! নারীর হাসিই বটে; কিন্তু যেন অসম্ভব নিষ্ঠুর!
সামান্যই এক নারীর হাসি! কিন্তু আসছে মোশন অ্যান্ড ভাইব্রেশন ডিটেক্টরের মধ্য থেকেই! তার স্বাভাবিক অ্যালার্ম টোনের বদলে বাজছে এই ভয়ঙ্কর হাসি! ইথান বুঝতে পারলেন তিনি দরদরিয়ে ঘামছেন! নিস্তব্ধতাকে চিরে আসা সেই তীব্র তীক্ষ্ণ হাসি শুনে রক্ত হিম হয়ে গেল তাঁর। কোনওমতে স্খলিত স্বরে বললেন, “ওঃ! ক্রা-ই-স্ট!”
২
— “শেষপর্যন্ত ভানগড় ফোর্ট! ইউ মিন, আলোয়াড়, রাজস্থানের ভানগড়! নো ওয়ে! তুই আর কোনও জায়গা পেলি না?”
সুজনের প্রস্তাবটা শুনে ওর সঙ্গীদের প্রাথমিক অভিব্যক্তি এটাই ছিল। দেবযানী তো প্রায় লম্ফ মেরে উঠে বলেছিল, “জাস্ট ফরগেট ইট! তোর ধারণা আছে, তুই ঠিক কী করতে চাইছিস? রাতের বেলা ভানগড় ফোর্টে ঢুকে মূর্তি ভেঙে নিয়ে আসতে হবে! হালুয়া-পুরী নাকি! আমি এই প্রোজেক্টে নেই!”
সুজন ওর দিকে নিস্পৃহ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। সে জানত দেবযানী শুরুতেই চেঁচামেচি জুড়ে দেবে। প্রত্যেকটা কন্ট্রাক্টের শুরুতেই ও এরকম তা-না-না-না করে। কিন্তু টাকার অঙ্কটা শুনলে কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজি হয়ে যায়। সুজন তাই একটুও উত্তেজিত না হয়ে বলল, “কী করব বল? কাজটা তো দিনের আলোয় করা সম্ভব নয়! তাছাড়া এরকম অনেক ফোর্টে, অনেক মন্দিরে আমরা গভীর রাতে ঢুকে কাজ করেছি। করিনি কি?”
সুরেশ বেশি কথা বলার মানুষ নয়। সে একটা কিংসাইজ সিগারেট ধরিয়ে বলে, “করেছি। কিন্তু ভানগড় ফোর্টের ব্যাপারটা আলাদা।”
—“এগজ্যাক্টলি!” দেবযানী চোখ গোলগোল করেছে, “তুই এমন একটা জায়গার কথা বলছিস যেটা ইন্টারন্যাশনালি কুখ্যাত। শুধু ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের অন্যতম অভিশপ্ত জায়গা! ইন্টারনেটে সার্চ করে দ্যাখ। ওয়ার্ল্ডের মোস্ট হন্টেড প্লেসের তালিকায় প্রথম পাঁচটার মধ্যেই ভানগড় ফোর্টের নাম আসবে! আর তুই কিনা সেই জায়গায় গিয়ে মূর্তি কাটার কথা ভাবছিস! তাও আবার রাতে! আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া ওখানে বিরাট নোটিস বোর্ড টাঙিয়ে রেখেছে। সূর্যাস্ত থেকে সূর্যোদয় অবধি কেউ ওখানে ঢুকতে পারে না। গেটে একটা মস্ত তালা ঝোলে! কোনও নাইটগার্ডও ওখানে থাকতে চায় না! আজ পর্যন্ত যারা ওখানে রাতে ঢুকেছে, বেশিরভাগ লোকই ফেরেনি! আশপাশের গ্রামগুলোর লোকেরা ভুলেও সন্ধ্যার পর ভানগড়ের ছায়াও মাড়ায় না। এমনকি বিশ্ববিখ্যাত প্যারানর্মাল ইনভেস্টিগেটর ইথান ওলসেনের অভিজ্ঞতা পড়েছিস? ভাইরাল হয়ে গিয়েছে তাঁর লেখাটা। দিস ইজ নট আ ম্যাটার অফ জোক সুজন! ভানগড় ফোর্ট এমনি এমনি আন্তর্জাতিকভাবে কুখ্যাত হয়নি! ওটা আপাদমস্তক একটা ভৌতিক জায়গা!”
—“আই নো!” সুজন হাসল, “ভানগড় যে অভিশপ্ত ও হন্টেড সেটা পৃথিবীর সবাই জানে। কিন্তু ডেঞ্জারাস বলেই তার দামটাও ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে আকাশ ছোঁওয়া! ভানগড়ের একটা মূর্তি আন্তর্জাতিক বাজারে কীরকম শোরগোল ফেলে দেবে তার ধারণা আছে তোদের? মি. ও’কোনরও ভানগড়ের হিস্ট্রি জানেন। ক্রেডিট গোজ টু ইথান। এবং সেইজন্যই তিনি যে টাকা দেবেন— তাতে আমরা কেন, আমাদের পরবর্তী চোদ্দো পুরুষ ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বিরিয়ানি-পোলাও খেতে পারবে।”
দেবযানী হাত তুলে দেয়, “দ্যাখ ভাই, বেঁচে থাকলে তবে তো বিরিয়ানি পোলাও খাব! আমি নেই।”
সুরেশ একমুখ ধোঁওয়া ছেড়ে বলল; তাছাড়া ভানগড়ে মূর্তি কোথায়? গোটা ফোর্টটাই তো ভেঙেচুরে গিয়েছে! সেটার কারণও অবশ্য কেউ জানে না। অতবড় শক্তপোক্ত দুর্গটা কী করে একরাতের মধ্যেই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেল, ভেতরের লোকগুলোই বা কোথায় গেল— আজ পর্যন্ত কেউ সেটা বলতে পারেনি। গোটা ব্যাপারটাই মিস্টিরিয়াস! আর ওই ধ্বংসস্তূপের ভেতরে তুই মূর্তি কোথায় পাবি?”
সুজন হেসে ফেলল। সে রিসার্চ না করে কোনও কথাই বলে না। মৃদু হেসে বলল, “মূর্তি আছে। ভানগড় ফোর্টটা একরাতের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু কোনও অজ্ঞাত কারণে ফোর্টের ভেতরের মন্দিরগুলোর গায়ে সামান্য আঁচড়ও পড়েনি! মন্দিরগুলো এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। তার ভেতরে বিগ্রহ নেই ঠিকই, তবে মন্দিরের দেওয়ালে খোদাই করা আছে সব অসাধারণ মূর্তি! বিশেষ করে পুরোনো গোপীনাথমন্দিরের দেওয়ালে অপূর্ব সব যক্ষিণী মূর্তি, নানা দেবী ও দেবতার মূর্তিতে ভরা। সবাই বলে, যক্ষিণী মূর্তিগুলো সব তৎকালীন সুন্দরী নর্তকীদের মডেল করে তৈরি করা হয়েছিল। আর তাদের মধ্যে প্রধান ও সবচেয়ে বড় যে দেবীমূর্তিটি, সেটি নাকি ভানগড়ের কিংবদন্তী সুন্দরী রাজকন্যা রত্নাবতীর আদলে তৈরি! ভানগড়ের অভিশপ্ত হওয়ার পেছনের গল্পে যে আসল নায়িকা, সেই রত্নাবতী। ওই মূর্তিটা কাটতে পারলে কী হবে ভাবতে পারছিস?”
সুরেশের ভুরু কুঁচকে যায়। রাজকন্যা রত্নাবতীর গল্পটা সে জানে। রাজকন্যার দাসী যখন বাজারে সুগন্ধি তেল কিনতে যায়, এক দুষ্ট তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়া ছলে-বলে-কৌশলে সেই তেলকে মন্ত্রপূত করে দেয়। কিন্তু রত্নাবতী নিজেও তন্ত্র চর্চা করতেন। চক্রান্তটা বুঝতে পারেন এবং সেই তেল একটি বিরাট পাথরের ওপর ফেলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই পাথর ছুটে যায় সিঙ্ঘিয়ার দিকে। তান্ত্রিক সেই পাথরের নীচে চাপা পড়ে মারা গিয়েছিল। কিন্তু মারা যাওয়ার আগে অভিশাপ দিয়ে গিয়েছিল যে, এই নগর ধ্বংস হবে। মৃত্যুপথযাত্রী তান্ত্রিকের অভিশাপেই নাকি ভানগড় রাতারাতি ধ্বংস হয়ে যায়!
সুজনের কথা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত। ওরা জানে কাজটা নিষিদ্ধ এবং আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটাই ওদের পেশা। আসলে ওরা ‘ভ্যান্ডালস্’! আর যে কাজটা করে, তাকে বলে ‘ভ্যান্ডালিজ্ম’। কোনও শিল্পকীর্তিকে ধ্বংস করে দেওয়া অনৈতিক কাজ। ধরা পড়লে কঠোর থেকে কঠোরতম সাজা হবে। তবু পেটের দায়ে, প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে প্রাচীন মন্দিরের গা থেকে কেটে নিয়ে আসে অপূর্ব সব প্রাচীন মূর্তি। ওরা সে কাজে রীতিমতো এক্সপার্ট। মাখন তোলার মতো পাথুরে দেওয়ালের গা থেকে একদম অবিকৃতভাবে মূর্তি কেটে নেয়। বিদেশের বাজারে সেসব কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হয়। আর ওদের এ কাজে সাহায্য করেন মি. জেমস্ ও’কোনর। উনিই ওদের প্রোজেক্ট দেন। যেমন এবার ভানগড়ের কাজটা দিয়েছেন। সুজন যা বলছে তা মিথ্যে নয়। অভিশপ্ত ভানগড়ের ইতিহাসে রাজকন্যা রত্নাবতী ‘মিথ’। তাঁর মূর্তির দাম যা হবে সেটা ওরা স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। তা সত্ত্বেও এবারের প্রোজেক্টটা ঠিক ভালো লাগছে না সুরেশের। এতদিন ধরে ওরা বহু মন্দির বা গুম্ফা থেকে মূর্তি এনেছে। সেক্ষেত্রেও ঝুঁকি ছিল। কিন্তু ভানগড় সম্পর্কে যা শুনেছে, তাতে দিনের বেলাতেই সেখানে ঢুকতে ভয় লাগে! রাতে ঢোকা তো দূর!
সে আস্তে আস্তে বলে, “তুই যা-ই বলিস, এবার রিস্ক ফ্যাক্টর অনেক বেশি।”
—“রিস্ক ফ্যাক্টর বেশি বলেই তো টাকাটাও কয়েকগুণ বেশি হবে।” সুজন নাছোড়বান্দা, “তাছাড়া ওই অভিশপ্ত হওয়ার বদনাম থাকার ফলে দুর্গের ত্রিসীমানায় রাতে কেউ আসবে না। পাহারাদারও সন্ধে হতে না হতেই কেটে পড়ে। পুরো ফাঁকা মাঠ। আমাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই!”
—“সত্যিই কি কেউ নেই?” সুরেশ অন্যমনস্কভাবে বলে, “সুজন, ওখানে কিছু তো আছে! সামথিং মিস্টিরিয়াস, যার কোনও ব্যাখ্যা নেই! তাছাড়া কারণ যাই হোক, ভূমিকম্প, তান্ত্রিকের অভিশাপ বা মোগল আক্রমণ, যেখানে অত মজবুত রাজপ্রাসাদ, দোকান-পাট, রাস্তা-ঘাট সব একরাতের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেল; সেখানে মন্দিরগুলোর কিচ্ছু হল না! ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়? তাছাড়া ইথান ওলসেনের লেখাটা পড়েছিস? উনিও কিন্তু স্পষ্ট বলেছেন, মন্দিরের মধ্যেই নেগেটিভ এনার্জি সবচেয়ে বেশি মাত্রায় আছে!”
—“তুই বিশ্বাস করবি কিনা জানি না…” দেবযানী ফিসফিস করে বলে,–“কিন্তু অনেকেই বলে যে, ভানগড় ফোর্টের মন্দিরের পাথর নাকি জীবন্ত! ওরা নিজেরাই নিজেদের ঠিক করে নিয়েছিল। যার জন্য ওই শতাব্দী প্রাচীন মন্দিরগুলোয় আজ পর্যন্ত একটা চিড়ও ধরেনি। মন্দিরগুলোর পাথর নিজেরাই নিজেদের রিকনস্ট্রাক্ট করতে পারে। কোনওভাবে ভেঙে গেলে বা ফাটল ধরলে নিজেই সেসব সারিয়ে তোলে।”
কথাটা শুনে সুজনেরও দেহে মুহূর্তের মধ্যে একটা হিমেল স্রোত বয়ে গেল। কিন্তু সেটা কাটিয়ে উঠে সে সজোরে হেসে বলল, “জীবন্ত মন্দির! কীভাবে একটা পাথরের দেওয়াল নিজেকেই নিজে জোড়া দিতে পারে? অপারেশন করে?”
—“তা জানি না,” দেবযানী সন্দিগ্ধভাবেই জানায়, “কিন্তু কিছু তো রহস্য আছেই। নয়তো ভানগড় ফোর্টকে ইথানের মতো একজন বিখ্যাত বিশারদ ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস’ বলতেন না।”
শব্দটা শুনে সুজনের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ে। মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস! সে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, “ননসেন্স।”
৩
—“ননসেন্স নয়, স্যার,”
ছেলেটার চোখদুটো কোটরাগত! মুখটা চোঁয়াড়ে। একটা ডবল ডেকার বাস বোধহয় ওর নাকের ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে। কান দুটো ইঁদুরের মতো খাড়া খাড়া। সব মিলিয়ে দেখতে মোটেই ভালো নয়। তবু ওর বিড়ালের মতো পিঙ্গল কটা চোখে কী যেন আছে! না, ভুল হল। বলা ভালো, ওর চোখে যা থাকা উচিত তার কোনওটাই নেই! প্রথম প্রথম ওর দিকে তাকালেই অদ্ভুত একটা অস্বস্তি টের পাচ্ছিল সুজন। বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ্য করার পর বুঝল যে লোকটার চোখ আছে ঠিকই, কিন্তু দৃষ্টি নেই! সে চোখ ভীষণ শীতল ও অভিব্যক্তিহীন। ও হাসছে ঠিকই, কিন্তু সে হাসির লেশমাত্রও ছায়া পড়ছে না ওর চোখে। চট করে দেখলে ভ্রান্ত ধারণা হয় যে, ওর চোখদুটো বুঝি পাথরের! অথচ সে আদৌ অন্ধ নয়! এই ভানগড় ফোর্টের একজন গাইড। ওর নাম অতুল। বেশ হাসিখুশি, আলাপি ছেলে। তা সত্ত্বেও সুজন ওর উপস্থিতিতে অস্বস্তি বোধ করছিল।
—“আপনারা আধুনিকমনস্ক মানুষ সাহেব। তাই এসব কথায় বিশ্বাস করেন না। ভাবেন গাঁজাখুরি,” অতুল ভানগড় ফোর্টের ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে হাঁটছে। ‘নাচন কি হাভেলি’ তথা নর্তকীদের বাড়ি ছাড়িয়ে জহুরিবাজারের রাস্তায় চলতে চলতে বলল, “কিন্তু বাই’সা যা শুনেছেন, তা আমরাও সত্যি বলেই জানি। ভানগড়ের মন্দিরগুলোর মধ্যে কোনও অলৌকিক শক্তি নিশ্চয়ই আছে। নয়তো একরাতের মধ্যে রীতিমতো মজবুত একটা কেল্লা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল, অথচ মন্দিরগুলো একদম অটুট থাকল কী করে?”
সুজন, সুরেশ এবং দেবযানীর সামনে এখন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে চির-রহস্যময়, অভিশপ্ত ভানগড় দূর্গ। প্রথম দর্শনেই গা ছমছম করে উঠেছিল ওদের। যখন দূর থেকে পাহাড়ের ওপরে ভানগড়ের টানা পাথরের বিরাট পাঁচিল দেখতে পেল, তখনই মনে হয়েছিল যে এক অতিকায় সরীসৃপ বুঝি কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে পাহাড়কে পেঁচিয়ে ধরে। যে মুহূর্তে তার ঘুম ভাঙবে, সেই মুহূর্তেই তার শ্লথ, বিরাট দেহ গিলে খাবে সবকিছু। অদ্ভুত এক রহস্যময়তা কুয়াশার মতো ঘিরে আছে দুর্গটাকে। সেই ইতিহাসের কুয়াশা ভেদ করে ভানগড়ের বাস্তবতাকে আজ পর্যন্ত কেউ উদ্ধার করে উঠতে পারেনি। কী ঘটেছিল সেই অভিশপ্ত রাতে! ভূমিকম্প, তান্ত্রিকের অভিশাপ না মোগল আক্রমণ! কী করে একটা আলোকোজ্জ্বল, অপূর্ব সুন্দর নগর একরাতেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল? তার বাসিন্দাদের পরিণতিই বা কী হয়েছিল, কেউ তা আজও ঠিক করে বলতে পারেনি। আর রাজকন্যা রত্নাবতী? তিনিই বা কোথায় গেলেন?
এসব প্রশ্নের কোনও উত্তর পায়নি ওরা। গাড়িতে আসার পথে ভানগড়ের নিকটবর্তী গ্রামগুলোয় জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ভানগড় ফোর্টের নাম শুনলেই স্থানীয় বাসিন্দারা কোনও কথা না বলে স্রেফ দ্রুত পায়ে কেটে পড়ে। যেন ওই অভিশপ্ত দুর্গের নামোচ্চারণ করলেই বিপদ অনিবার্য। দু-একজন সাহসী মানুষ অবশ্য ওদের বারবার সতর্ক করেছে। বলেছে, “ওটা বহুশতাব্দীর অভিশপ্ত, কিলাণ সাহেব। ওর থেকে দূরে থাকাই ভালো।”
সুজন কৌতূহলী, “কেন বলুন তো! কী এমন আছে ওখানে?”
—“কী আছে, তা দেখিনি সাব। দেখার সাহস কোনওদিন হয়নি,” অত্যন্ত সন্তর্পণে উত্তর এল, “কিন্তু কিছু তো আছে। ভানগড় দিনে একরকম, রাতে অন্যরকম। আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছে শুনেছি যে, রাত্রে নাকি ভানগড় জেগে ওঠে। বহু মানুষের চেঁচামেচি শোনা যায়। মেয়েদের খিলখিল হাসি, ঘুঙুরের শব্দ; আরও অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসে ‘কিলা’র ভেতর থেকে।”
সুরেশ জানতে চায়, “এসব গল্প তো তোমাদের পূর্বপুরুষদের অভিজ্ঞতা। কিন্তু নিজের কানে কিছু শুনেছ বা দেখেছ?”
—“রাম! রাম!”
লোকগুলো তৎক্ষণাৎ যেন পালিয়ে বাঁচল। ওরা প্রত্যেকেই বুঝল যে এর বেশি আর কোনও কথা গ্রামবাসীরা বলবে না। অভিশপ্ত দূর্গের ভয় ওদের ভেতরে এতটাই প্রবল যে, কোনওমতেই তার সম্পর্কে কিছুই বলতে চায় না। সুজন অবশ্য ওদের ভয় দেখে অনেকটাই আশ্বস্ত হয়েছে। ভালোই হয়েছে। একটা মূর্তিকে কেটে বের করতে গেলে রীতিমতো শব্দ হয়।ম্যানুয়াল হ্যাক স’, চিজেল বা ছেনি-হাতুড়ির আওয়াজ নির্জন দুর্গে বেশ জোরে শোনা যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যেহেতু রাতে ভানগড়ের ত্রিসীমানায় কেউ আসে না, সুতরাং আওয়াজ হলেও ধরা পড়ার চান্স একেবারেই নেই। যদি দৈবাৎ কেউ শুনেও ফেলে, তবে ভৌতিক শব্দ ভেবে পিঠটান দেবে। ফলস্বরূপ ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার মত কাজটা অতি সহজেই হয়ে যাবে।
—“এখানে কি একটা বিল্ডিঙও আস্ত নেই?”
দেবযানী অতুলের পেছন পেছন হাঁটছিল। চতুর্দিকে খালি হাড়-পাঁজর বের করা ধ্বংসাবশেষ আর পাথুরে দেওয়াল দেখতে দেখতে মেয়েটা বিরক্ত হয়ে উঠেছে। নর্তকীদের ‘হাভেলি’তে স্রেফ কয়েকটা মজবুত থাম আর ভাঙা পাথরের চাঁই ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। জহুরিবাজার হয়তো কোনও সময়ে জমজমাট কোনও বাজার ছিল। এখন শুধু ভাঙা পাথরের অবশেষ সেই ইতিহাসের সাক্ষ্য দেয়।দেবযানী যথারীতি প্রথমে আপত্তি করলেও টাকার অঙ্কটা শুনে রাজি হয়ে গিয়েছে। তবে সুজনকে এ-ও বলে রেখেছে যে এই কাজটা করার পর সে এ পেশা ছেড়ে দেবে। যে টাকাটা ও পাবে, তা দিয়ে কোনও ব্যবসা শুরু করবে। সুরেশেরও প্ল্যানিং তেমনই।
—“আছে তো! এই দেখুন, মোরোঁ কি হাভেলি।
ওদের গাইড অতুল সামনের একটি দালান দেখিয়ে বলল, “রাজকন্যা রত্নাবতী ময়ূর পুষতেন। সেজন্য ময়ূরদের একটা হাভেলিই তৈরি করা হয়েছিল। এখন অবশ্য ওখানে ময়ূর থাকে না। বাদুড় চামচিকেরা ওখানেই ঘাঁটি বানিয়েছে।”
দেবযানীর ঠিক পেছনেই সুরেশ হাতে হাই ডেফিনিশন ক্যামকর্ডার নিয়ে হাঁটছিল। সে এখন ভানগড়ের দৃশ্য ক্যামেরায় তুলতে ব্যস্ত। কথাটা শুনেই ফোড়ন কাটল, “রাজকীয় শখ! মানুষের জায়গা হয় না; আবার ময়ূরের জন্য আস্ত হাভেলি!”
—“তা বটে স্যার!” বলতে বলতেই সে মূল রাজপ্রাসাদের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে, “ওইটা ছিল রাজপ্রাসাদ। এখন তো দেখছেনই, তেমন কিছুই নেই! শুধু রত্নাবতীর মহলটা কোনওমতে টিকে আছে।”
সুজনের অবশ্য অত মহল-টহল নিয়ে বিশেষ উৎসাহ নেই। সে মন্দিরগুলোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছিল। ভানগড়ের চতুর্দিকে মন্দিরের ছড়াছড়ি! এবং আশ্চর্যভাবে সেগুলো সম্পূর্ণ অক্ষত! মেইন গেট দিয়ে ঢোকার সময়ই শ্বেতপাথরের তৈরি হনুমান মন্দির দেখেছে। সেখানে একজন পূজারীও আছেন। কিন্তু শ্বেতপাথরের হনুমানের বিগ্রহ তাকে তেমন আকর্ষণ করেনি। এছাড়াও দেখেছে সোমেশ্বরের মন্দির, মঙ্গলাদেবী মন্দির, নবীন মন্দির এবং গণেশমন্দির।পরের মন্দিরগুলো এখন ফাঁকা। বিগ্রহও নেই। দেওয়ালে কিছু ভাস্কর্য আছে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো তেমন জাঁকালো কিছু নয়। সে সতর্ক দৃষ্টিতে চতুর্দিকটা দেখছিল। অর্জুনের পাখির চোখের মতো তারও এখন একটাই লক্ষ্য। গোপীনাথ মন্দির ও রত্নাবতীর আদলে তৈরি দেবীমূর্তি!
বেশ কিছু সঙ্কীর্ণ পাথুরে সিঁড়ি ভেঙে রত্নাবতীর মহলে ঢুকতে না ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা ও চামচিকের চিমসে গন্ধ ওদের ঘিরে ধরল। মহলের ভেতরে কয়েকটি ঘর এখনও অবশিষ্ট আছে। পাথরের মজবুত মহলগুলো কিছু গোপন ইতিহাস বুকে নিয়ে টিঁকে রয়েছে। বাকিটা ধ্বংসস্তূপ। দেখলেই কেমন যেন অলৌকিক অনুভূতি হয়! হাড়-পাঁজর বের করা দেওয়াল, কালো কালো ছোপওয়ালা ছাত যেন কিছু বলতে চাইছে! সুরেশ দুর্গটাকে যত দেখছে, ততই অবাক হচ্ছে! আপাদমস্তক পাথরে তৈরি এই দুর্গকে কামানের গোলাও ভাঙতে পারত না। তবে কী এমন শক্তি এই মজবুত দুর্গকে একেবারে আগাপাশতলা দুমড়ে মুচড়ে দিল—কে জানে!
দেবযানী লক্ষ্য করল, রত্নাবতীর ঘরে একটি পাথরের তাকের ওপরে সাজানো রয়েছে প্লাস্টিকের চিরুনি, কাচের চুড়ি, পুঁতির হার আর ঝাঁঝর! অতুল তার কৌতূহলী দৃষ্টি লক্ষ্য করে হাসল।
—“ওগুলো স্থানীয় বাসিন্দারা রেখে গিয়েছে বাইসা। ওদের বিশ্বাস রাজকন্যা রত্নাবতীর আত্মা এখনও এই দুর্গে ঘুরে বেড়ায়। তাই তাঁর শৃঙ্গারের সরঞ্জাম রেখে যায় ওরা।”
সুরেশ ক্যামকর্ডার দিয়ে এতক্ষণ ভিডিও তুলতেই ব্যস্ত ছিল। কথা নেই, বার্তা নেই আচমকা তার নাকের সামনে দেবযানী এসে হাজির! পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে খোলা জানলা দিয়ে কী যেন দেখছে সে! ক্যামেরার লেন্সে ধরা পড়েছে তার অপূর্ব ঘন কালো লম্বা চুল! হাওয়ায় সেই রেশমী চুল অল্প অল্প উড়ছে! বেচারি সুরেশ মন দিয়ে মহলের ভিডিয়ো তুলছিল, এরকম বাধা পেয়ে বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, “অ্যাই দেবযানী, সামনে থেকে সর! তোর এলোকেশী রূপ তোলার জন্য আমি মোটেও ভিডিয়ো তুলছি না”
—“কীসব ভুলভাল বকছিস!” সুরেশের পেছন থেকে শোনা গেল দেবযানীর শাণিত কণ্ঠস্বর, “আমি তো তোর পেছনে। তাছাড়া এলোকেশী মানে? আমি রীতিমতো টপনট বেঁধে রেখেছি।”
—“হো-য়া-ট!”
সুরেশ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো পেছনে ঘোরে! তার দু’চোখে গভীর বিস্ময়! তাই তো! দেবযানী আদৌ তার সামনে নেই, বরং ঠিক পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ক্যামেরায় ওর ইমেজ আসা সম্ভবই নয়। তবে একটু আগে সে ক্যামেরায় যাকে দেখল, সে মেয়েটি কে! সে তৎক্ষণাৎ সামনের দিকে ফিরল! কই! সামনে কেউ নেই তো! কোথায় সেই এলোকেশী যে একটু আগেই লেন্সের একদম সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল! নেই!
সুরেশ তার বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত ভয় টের পেল। তার বিস্মিত দৃষ্টি ছুঁয়ে গেল দেবযানীর মাথার চুল। সত্যি! সে একদম শক্ত করে টপনট বেঁধেছে। তবে সেই মেয়েটি কে যে একেবারে কোমর ছাপানো ঘন মেঘের মতো একরাশ কাজলকালো চুল নিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল! অথচ দেবযানী ছাড়া এই মুহূর্তে অন্য কোনও নারী এ ঘরে নেই! অন্য ট্যুরিস্ট পার্টির কোনও সদস্যা হতে পারত। কিন্তু সেকেন্ডের ভগ্নাংশে সে তবে গেল কোথায়! হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি?
সুজন দেখল সুরেশের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। সে জানতে চায়, “কী হল রে! আর ইউ ওকে?”
সুরেশ তখন রীতিমতো ঘামছে। সে রিওয়াইন্ড করে একটু আগের তোলা ভিডিও ফুটেজটা দেখল! আশ্চর্য! সেখানে কোনও নারীই নেই! পাগলের মতো ফুটেজের মধ্যে সেই অদেখা মেয়েটিকে খুঁজছে যার শুধু পেছনটাই ধরা পড়েছিল তার চোখে। কিন্তু কোথায়! কেউ নেই! শুধু রত্নাবতীর মহলের দৃশ্যই রয়েছে। আর কেউ নেই! কিছু নেই!
সে ঘাবড়ে গিয়েছিল। কিন্তু গোটা ব্যাপারটাই চেপে গেল। যদিও তখন তার বুকের ভেতরে হৃৎস্পন্দন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে, তবু নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল সে। ঢোঁক গিলে বলল, “আই অ্যাম ফাইন।”
তার অবস্থা দেখে গাইড অতুল যেন একটু ব্যঙ্গবঙ্কিম হাসল। তার হাসিটা বেশ অর্থপূর্ণ ও রহস্যময়। সে আস্তে আস্তে বলে, “চলুন স্যার। এবার গোপীনাথ মন্দিরটা দেখে নিন। ওটা অবশ্য তালা দেওয়া থাকে। ভেতরের গর্ভগৃহে যেতে পারবেন না। তবে বাইরে থেকে দেখতে পাবেন। তাছাড়া সন্ধ্যা হয়েও আসছে। আর বেশিক্ষণ থাকা ঠিক নয়।”
—“ভেতরে কেন যাওয়া যাবে না?” সুজন আগ্রহ চেপে রাখতে পারে না, “অন্যান্য মন্দিরগুলো তো খোলা ছিল।”
অতুল মৃদু হাসে, “আসলে গোপীনাথ মন্দিরে রাজকন্যা রত্নাবতীর আদলে তৈরি একটি অতুলনীয় দেবীমূর্তি আছে। অনেক মূর্তিচোরের ওর ওপর নজর ছিল। বেশ কয়েকবার মূর্তিটা ভেঙে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও হয়েছে। তাই সরকার থেকে মন্দিরটাকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”
—“কেউ মূর্তিটাকে চুরি করতে পারেনি?”
—“নাঃ,” সে বলল, “চেষ্টা হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বললাম না, এ মন্দিরগুলো সব জাগ্রত! চোরেরা ভাঙার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু মন্দিরের পাথরগুলো নিজেই সেইসব ভেঙে যাওয়া অংশ মেরামত করে নিয়েছে। এ পাথর মেরামতি করার ওষুধ জানে স্যার। এ পাথরে প্রাণ আছে।”
সুজন স্থিরদৃষ্টিতে গাইডের দিকে তাকায়। ওর হঠাৎ মনে হল, এই ছেলেটা বোধহয় জানে যে ওরা কী উদ্দেশে এসেছে! ওর ঠোঁটের কোণের হাসিটা ভীষণ রহস্যময়! তাছাড়া মুখটাও কেমন যেন চেনা চেনা। সে চোখ কুঁচকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে ছেলেটার দিকে তাকায়। আগে কোথাও ওকে দেখেছে কি?
—“একটা কথা বলব?” অতুল তার পাথরের মতো শীতল চোখদুটো সুজনের চোখের ওপর রাখল। তারপর গলা নামিয়ে আস্তে আস্তে অনুরোধের সুরে বলল, “আর যাই করুন, মূর্তির গায়ে ভুলেও হাত দেবেন না স্যার। প্লিজ, ওটা করবেন না।”
—“মানে?”
তিন জনই একসঙ্গে যেন তড়িদাহতের মতো কেঁপে ওঠে। কী বলতে চাইছে অতুল! ও কী অন্তর্যামী! সুজন নিজেকে সামলে নিয়ে রুক্ষ কণ্ঠস্বরে বলে, “কী সব উলটোপালটা বলছ! হাউ ডেয়ার ইউ?”
অতুল তখনও তাদের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। দেবযানীর গা শিরশিরিয়ে ওঠে। ও লক্ষ্য করল, ছেলেটা একবারও চোখের পলক ফেলে না! ওর দৃষ্টি একদম স্থির! অবিকল পাথরের চোখের মতো!
—“চলুন। গোপীনাথ মন্দিরটা দেখে নিই। অতুল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সন্ধে হয়ে আসছে। রাত হয়ে গেলে আবার কী হয় ঠিক নেই।”
৪
ভানগড় ফোর্ট থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ওরা কোনও কথা বলল না। দেবযানী তার স্বভাবগত প্রগলভতা যেন ভুলে গিয়েছে। সুরেশ তখনও বারবার রাণী রত্নাবতীর মহলের ভিডিয়োটা দেখছে। আর সুজনের কপালে গভীর চিন্তার ভাঁজ। তার চোখদুটো অন্যমনস্ক। নিবিষ্ট চিত্তে কী যেন ভেবে চলেছে সে।
ওদের গাড়ির ড্রাইভারের নাম দীননাথ। সে ভানগড় ফোর্ট থেকে তিন কিলোমিটার দূরের একটা গ্রামে থাকে। ওরা তিন জন দীননাথের বাড়িতেই থাকবে। তেমনই ব্যবস্থা হয়েছে। দীননাথও মি. ও’কোনরেরই লোক। একরকম এজেন্টই। এমনিতে সাধারণ দর্শন এক যুবকই বটে, কিন্তু অত্যন্ত চটপটে ও বুদ্ধিমান। দূর্গ থেকে ফেরার পথে সে-ই ওদের মধ্যে প্রথম মুখ খুলল। হেঁড়ে গলায় জানাল, “স্যার, ম্যাডাম, আপনাদের থাকার ব্যবস্থা আমার বাড়িতেই হয়েছে ঠিকই, কিন্তু হোটেলের আরাম, বিলাসব্যসন কিন্তু পাবেন না। জলের অভাব আছে। আর খাওয়াদাওয়া আমার বাড়িতেই হবে, তবে খাওয়ার খরচ আলাদা। আগেই বলে রাখলাম। পরে বাহানা করবেন না।”
সুজন কথাটা শুনেও পাত্তা দিল না। ওরা এখানে বেড়াতে আসেনি। বরং একটা গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন কাজে এসেছে। ফাইভ স্টার হোটেলের অ্যাকোমোডেশন না পেলেও চলবে। সুরেশ কথাটা শুনল কিনা কে জানে! সে তখনও ভিডিও ফুটেজটাই বারবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে চলেছে। খুব নিস্পৃহভাবে একটা আলগা ‘হুঁ’ বলে ফের ফুটেজে মন দিল। একমাত্র দেবযানীরই ভুরু অসন্তোষে বেঁকে যায়। সে যথারীতি বিরক্ত, “কেন? আশপাশে কোনও ভালো হোটেল নেই?”
হোটেল?” দীননাথ ফিক্ করে হাসল, “এ কি গোয়ার সমুদ্র পেয়েছেন বাইসা, যে হাতের কাছেই হোটেল পাবেন? দিল্লী থেকে দু’শো পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে রয়েছেন আপনি। এটা ভানগড় ফোর্ট! হোটেল তো দূর, এর ত্রিসীমানায় কোনও গ্রামই নেই! সব শুনশান!”
— “সে কী!” দেবযানী অবাক, “ফোর্টের আশপাশেই তো কিছু ঘর দেখলাম যেন মনে হল!”
সে বিষণ্ণভাবে মাথা ঝাঁকায়, “হ্যাঁ। শুধু ঘরই আছে। কিন্তু লোক দেখেছেন কি? দেখবেন না। কারণ লোক নেই। ঘরগুলোও সব ভাঙা ও পরিত্যক্ত!”
—“সে কী! কেন?”
দীননাথ একমুহূর্তের জন্য কী বলবে ভেবে পায় না। তারপর একটু দ্বিধাজড়িত স্বরে বলে, “কী জানি বাই’সা। বেশ কয়েকবার কিছু মানুষ ফোর্টের ধারেকাছে গ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কোনওবারই টেকেনি। গ্রামের সব ঘর হয় আচমকা ভেঙে পড়ে, নয়তো মহামারীতে গাঁ উজাড় হয়ে যায়! শেষমেষ হাল ছেড়ে দিয়ে প্রাণের দায়ে মানুষেরা এখান থেকে চলে গিয়েছে। ঘরগুলো বহুবছর ধরে পরিত্যক্তই পড়ে রয়েছে। ওখানে কেউ থাকে না।”
—“কেন?” দেবযানী কৌতূহলী, “হঠাৎ কোথাও কিছু নেই, আচমকা ঘর ভেঙে যাবে কেন? ঝড়-টড় বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ…
— “কিচ্ছু না বাই’সা। দীননাথ সংশয়ান্বিত, “বিশ্বাস করুন। আজ পর্যন্ত এখানে কেউ বাস করতে পারেনি। যেমন ভানগড় কী কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল; সেটা আজও অজানা রয়ে গিয়েছে, তেমনি তার আশপাশের গ্রামগুলোও কীভাবে ধ্বংস হয়ে যায়;তাও কারোর জানা নেই। সবাই বলে যে ভানগড়ের অভিশাপের ছায়া নাকি আজও গ্রামগুলোর ওপর কায়েম আছে।”
—“কার অভিশাপ?”
খুব অন্যমনস্কভাবে প্রশ্নটা করল সুজন। তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একঝলক দেখে নিল দীননাথ। আস্তে আস্তে বলল, “কী বলব স্যার, অনেকরকম কথাই আছে। কিন্তু যত গল্প আছে তার সবকণটার মধ্যে একটা জিনিসই এক। অভিশাপ আর ব্ল্যাক ম্যাজিক। যেটা সবচেয়ে ফেমাস সেটা তো জানেনই। রত্নাবতী আর তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়ার কালোযাদুর গল্প। সিঙ্ঘিয়া পাথর চাপা পড়ে মরেছিল। আর তার অভিশাপেই নাকি ভানগড় ধ্বংস হয়। অনেকেই বলে, সিঙ্ঘিয়া আর রত্নাবতীর আত্মা এখনও ঘুরে বেড়ায়। এখনও ওঁদের মুক্তি হয়নি। এছাড়াও আরেকটা গল্পও আছে।”
—“ কীরকম?” দেবযানী কৌতূহলী।
দীননাথ আস্তে আস্তে বলে, “ভানগড়ের প্রতিষ্ঠাতা মাধো সিং যেখানে ভানগড় দূর্গ তৈরি করছিলেন, তার একটু কাছেই গুরু বালুনাথ নামের এক সন্ন্যাসী থাকতেন। মাধো সিং গুরু বালুনাথের কাছে ফোর্ট তৈরি করার অনুমতি চান। বালুনাথ অনুমতি দিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর একটা শর্ত ছিল। তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, দুর্গ তৈরি হলেও রাজপ্রাসাদের ছায়া যেন তাঁর সাধনপীঠে না পড়ে। যদি কোনওভাবে মহলের ছায়া তাঁর ধ্যান করার জায়গায় এসে পড়ে, তবে তৎক্ষণাৎ ভানগড় ধুলোয় মিশে যাবে।” বলতে বলতেই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, “মাধো সিং কথা রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরবর্তী শাসকেরা গুরু বালুনাথের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। রাজমহল বহরে বাড়তে থাকে। আর যথারীতি তার ছায়া গুরু বালুনাথের সাধনপীঠের ওপর পড়ল। সেই রাতেই নাকি ভানগড় শেষ হয়ে গিয়েছিল।”
—“রিয়েলি?” সুজনের কথায় ব্যঙ্গের সুর মিশল, “তাহলে আসল অভিশাপের মালিক কে? সিঙ্ঘিয়া না বালুনাথ?”
দীননাথ হাসল, “সেটা বলা মুশকিল স্যার! লোকে অনেকরকম কথাই বলে। আমি নিজেই ছোটবেলা থেকে অন্তত দু-তিনটে গল্প শুনে এসেছি, যার মধ্যে এ দুটোই ফেমাস। গুরু বালুনাথের কথা সত্যি হলেও হতে পারে। কারণ ওই ভাঙা দুর্গে তাঁর সমাধিও আছে। তবে আরও দুটো কারণ শুনেছি।”
—“মোগল আক্রমণ, রাইট?”
সে মাথা ঝাঁকায়, “হ্যাঁ স্যার। কেউ কেউ বলে মোগল আক্রমণের ফলে ভানগড়ের সর্বনাশ হয়। আবার কেউ বলে ভানগড়ের প্রতিবেশী রাজ্য আজবগড়ের সঙ্গে যুদ্ধে ভানগড় বিলুপ্ত হয়। কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক জানি না!”
—“থ্যাঙ্ক গড!” সুজন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, “অন্তত দুটো কারণ তো পাওয়া গেল যা যুক্তিযুক্ত। নয়তো ব্ল্যাক ম্যাজিক, অভিশাপ আর জ্যান্ত মন্দিরের ঠ্যালাতেই তো চোখে অন্ধকার দেখছিলাম!”
—“হালকাভাবে নেবেন না স্যার,” দীননাথ চাপাস্বরে বলে, “আমাদের গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা বলেন, রাত হলেই নাকি ভানগড় জেগে ওঠে। আবার সেই অতীতে ফিরে যায়। যা যা ভেঙে গেছে, সব গড়ে ওঠে। রাজমহল সেজে ওঠে। সেজে ওঠে জহুরীবাজারও। আর প্রেতাত্মারা নাকি ঘুরে বেড়ায়! বাইরে থেকে অনেকেই নাকি মেয়েদের হাসি, গান-বাজনা, ঘুঙুরের আওয়াজ শুনেছে!”
সুজন এককথায় উত্তর দিল, “রাবিশ!”
—“কিন্তু ভানগড়ের সামনে ওই বোর্ড? আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার ওই বিরাট নিষেধাজ্ঞাটা তবে কেন আছে? কেন সন্ধে না হতেই সরকার ফোর্টের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়?”
দেবযানীর সংশয় তবু কাটে না। সুজন মৃদু হাসল, “সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? ভানগড়ের লোকেশনটা দ্যাখ! ফোর্টটা আরাবল্লির ‘সরিস্কা টাইগার রিসার্ভের’ বর্ডারে! ফোর্টের চতুর্দিকে এত জঙ্গল যে সেখান থেকে বন্যপ্রাণী যখন তখন চলে আসতে পারে! আর সন্ধের পরেই সচরাচর বাঘ বা অন্যান্য মাংশাসী প্রাণীরা বেরোয়। সেজন্যই ট্যুরিস্টদের সেফটির কথা ভেবেই বোর্ড আর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ভূতের জন্য নয়! বুঝেছিস? ভানগড়ের আশেপাশের গ্রামগুলোও গড়ে উঠতে পারেনি সম্ভবত ওই কারণেই। নিরাপত্তার অভাব। কোনও অভিশাপ-টাপ নয়। ওসব স্রেফ গল্প।”
দেবযানী কী বুঝল কে জানে! তবে তার মুখ দেখে খুব আশ্বস্ত হয়েছে বলে মনে হল না। সুরেশ এতক্ষণ ভিডিয়ো ফুটেজ দেখতেই ব্যস্ত ছিল। এবার মুখ তুলে বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি এখন?”
—“গোলা কা বাস।” দীননাথ উত্তর দেয়, “আমার গ্রামে। ওখানেই আজকের দিনটা রেস্ট নেবেন। যা করার কাল রাত থেকে শুরু করবেন। তবে আমি আর আপনাদের গাড়ি করে পৌঁছে দিতে পারব না। গোলা কা বাস থেকে পায়ে হেঁটেই আপনাকে ভানগড় দূর্গে আসতে হবে। ট্যুরিস্টরাও বেশিরভাগ তাই-ই আসে।”
একটা আলতো উত্তর দিয়ে ফের চিন্তামগ্ন হয়ে গেল সুরেশ। সে তখনও ভেবে চলেছে; ক্যামেরায় যে মেয়েটাকে সে পেছন থেকে দেখেছিল সে কে! কোথায় ভ্যানিশ হয়ে গেল! আদৌ ঠিক দেখেছে? না পুরোটাই ভ্রান্তি! যদি সত্যিই ওখানে কোনও মেয়ে থাকত তাহলে রেকর্ডেড ফুটেজে তাকে নিশ্চয়ই দেখা যেত। কিন্তু ফুটেজে কেউ নেই! তবে?
দেবযানী আড়চোখে তাকিয়ে দেখল সুজনের মুখের হাল্কা হাসিটাও মিলিয়ে গিয়েছে। সে ও বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছে। তার মনেও একটা চিন্তাই বারবার ঘাঁই মেরে উঠছে।
অতুলকে অত চেনা চেনা লাগছিল কেন? আগে কোথাও দেখেছে কি? কোথায়!
৫
আজ পূর্ণিমার রাত। রুপোলি জ্যোৎস্নায় চতুর্দিক ভেসে যাচ্ছে। পূর্ণ চাঁদের আলো মায়াবী আভায় ধুইয়ে দিচ্ছে ভানগড় ফোর্ট সংলগ্ন অরণ্যকে। আরাবল্লির পাথুরে দেও চিকচিক করে ওঠে জ্যোৎস্নার ইশারায়। আকাশ সম্পূর্ণ মেঘমুক্ত। গাঢ় নীল প্রেক্ষাপটে টুপটুপ করে চোখ মেলছে নক্ষত্রের দল। দেখলেই মনে হয়, এক রাশ অভ্র ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে আকাশের বুকে। তাদের জ্যোতি যতটা শান্ত, ঠিক ততটাই রহস্যময়! যেন বহু আলোকবর্ষের অভিজ্ঞতা নিয়ে উদগ্র কৌতূহলে তাকিয়ে আছে! বুকের মধ্যে চাপা আশঙ্কার আগুন জ্বলছে তাদের; কে জানে, কী হয়!
আপাতত চতুর্দিকে ছায়া ছায়া মহীরুহের নিশ্চুপ উপস্থিতি। প্রাচীন গাছগুলো যেন রাজকীয় দম্ভভরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কখনও কখনও মৃদু হাওয়া শিরশির করে উঠে তাদের পাতায় পাতায় দুর্বোধ্য কিছু সংলাপ বিনিময় করছে। এছাড়া আর কোনও শব্দ নেই! চারিদিক থম্, নিশ্চুপ! কখনও কখনও মনে হয় গাছের ফাঁক দিয়ে বুঝি কোনও ছায়া সাঁৎ করে সরে গেল! আশঙ্কা হয়, এই নিঃঝুম রাত্রির পেছনে হয়তো কোনও রহস্যাবৃত অন্ধকার ওঁত পেতে আছে! এখনই সমস্ত নীরবতাকে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে বেরিয়ে আসবে! সে এক প্রবীণ অন্ধকার। যে সব কিছু জানে, সব কিছু দেখেছে!
ঠিক তার মাঝখানেই প্রাগৈতিহাসিক দৈত্যের মতো বিরাট কলেবর নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কুখ্যাত ভানগড় ফোর্ট। দাম্ভিক, রহস্যময় অথচ ভীষণ বিষণ্ণ! দূর্গ নয়, ইতিহাসের হাহাকার! ভানগড়ের রাজমহলের ঠিক মাথার ওপরেই রুপোর থালার মতো ষোড়শী চাঁদ দেখা দিয়েছে। কিন্তু দেখলেই মনে হয়, সে বড় ভয়ে ভয়ে উঁকি মারছে। চাঁদের আলো এসে ছুঁয়েছে ভানগড়ের ভাঙাচোরা দেহ। পেশীবহুল হাতের মতো পাথুরে প্রাচীর এলিয়ে আছে হতাশায়। জ্যোৎস্নাও যেন তার স্বভাবগত চাপল্য হারিয়ে ফেলেছে ভানগড়ের রাজমহলকে স্পর্শ করে। তার উচ্ছ্বসিত আলো দূর্গের কাছে এসেই বিষণ্ণতায় হারিয়ে গিয়েছে। জ্যোৎস্না নয়, যেন এক ফ্যাকাশে পিঙ্গল বিষণ্ণতা চুঁইয়ে পড়ছে ভানগড় ফোর্টের পাথুরে শরীর থেকে। চতুর্দিকে শুধুখাঁ খাঁ করা শূন্যতা! ধ্বংসস্তূপগুলো এক বিরাট কঙ্কালের হাড়-পাঁজরের মতো পড়ে রয়েছে। পাথরের জানলা, দরজাগুলো হাঁ করে রয়েছে ক্ষুধার্ত মানুষের মতো অপেক্ষা করছে একবিন্দু সুখের। পেলেই যেন গিলে নেবে গোটা বিশ্ব-চরাচরের সমস্ত সুখ, সমস্ত আনন্দকে। অথচ শূন্যতা ছাড়া তার পাওয়ার আর কিছুই নেই! সেই শূন্যতাকে পূর্ণতা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে জ্যোৎস্নার আলো! কিন্তু ব্যর্থ হচ্ছে। তার স্তিমিত আভা গিলে নিচ্ছে জমাট অন্ধকার। চতুর্দিকের থমথমে নৈঃশব্দ যেন মুখর হয়ে বলে উঠতে চাইছে, “এ দুনিয়া জীবিত মানুষের জন্য নয়। দুনিয়া জাগতিক কোনও অনুভব বা বস্তুর জন্য নয়! এ অন্য পৃথিবী!”
—“লুকস্ ক্রিপি!” সুরেশ একটা শ্বাস টেনে বলল, “কেমন অদ্ভুত লাগছে না দূর্গটাকে? হরর মুভি শ্যুট করার জন্য আইডিয়াল!”
ওরা তিন জন এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে রয়েছে দূর্গের মেইন গেটে। দেবযানী একঝলক ভানগড়ের বিরাট বহরটাকে মেপে নিল। দিনের বেলাতেই দূর্গটা দেখলে খুব অস্বস্তি হয়। এখন অস্বস্তির সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা ভয়ও অনুভব করল সে। এই সেই ভানগড়! সেই কুখ্যাত ঐতিহাসিক স্থল, যেখানে নাকি আজও অতৃপ্ত আত্মারা ঘুরে বেড়ায়! এই সেই অভিশপ্ত কেল্লা যার সম্পর্কে স্বয়ং ড. ইথান ওলসেন লিখেছেন, ‘মোস্ট ডেঞ্জারাস প্লেস!’
সুজনের অনুভূতিটা অবশ্য অন্যরকম। তার বুকের মধ্যে একটা অজ্ঞাত গভীর বেদনা জমেছে।এই বেদনার কোনও উৎস নেই! ভানগড়ের দৃশ্যটা দেখে হঠাৎই তার মনে হল, দুনিয়ায় আনন্দ বলে আসলে কিছুই নেই! ‘সুখ, ‘আশা’, ‘স্বপ্ন’ নামের কোনও বস্তু আসলে হয় না! ওসব মরীচিকা!
অথচ এমনটা হওয়ার কথা নয়! একটু আগেও সে অর্থপ্রাপ্তির কথা ভেবে উত্তেজিত ছিল। কিন্তু আচমকাই সেই উত্তেজনার বদলে এক অদ্ভুত হতাশা ঘিরে ধরল তাকে। কেন? কারণটা অজ্ঞাত!
সুরেশ ফস্ করে একটা সিগারেট ধরাল। দেবযানী ও সুজন ভানগড়ের দিকে তাকিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। লাইটারের আলোর ঝিলিকে সংবিত ফিরে পেল। সুরেশ আয়েশ করে একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “কাজ শুরু করা যাক।”
—“শিওর।”
এতক্ষণে সুজন নিজেকে পুরোপুরি ফিরে পেয়েছে। সে তার হাতের এমার্জেন্সি লাইটটাকে মাটিতে নামিয়ে রেখে দুর্গের গেটের তালা খুলতে মন দিল। বলাই বাহুল্য যে এই ডুপ্লিকেট চাবিটা ওদের দীননাথ এনে দিয়েছে। এমনকি গোপীনাথ মন্দিরের তালার চাবিও সে দিয়ে দিয়েছে। কোথায় পেল জিজ্ঞাসা করতেই মৃদু হেসেছিল সে। মুচকি হেসে জানিয়েছিল, “টাকা ছড়ালে বাঘের দুধও পাওয়া যায় স্যার; এ তো সাধারণ কয়েকটা চাবি!”
ওরা আর কথা বাড়ায়নি। স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে মি. জেমস ও’কোনর এই প্রোজেক্টের জন্য প্রচুর টাকা ছড়িয়েছেন। দীননাথও সেই হরির লুট থেকে বাদ যায়নি। চাবিগুলো সেই ইনভেস্টমেন্টেরই ফলাফল। তাই নির্বিবাদে দুটো চাবিই নিয়ে নিয়েছিল।
গেটের তালা খুলতে অবশ্য বেশি বেগ পেতে হল না। সুজন তালায় চাবিটা ঢোকাতে না ঢোকাতেই প্রাচীন ও বিরাট তালাটা সশব্দে কড়াৎ করে খুলে গেল! দেবযানী অবাক হয়ে বলল, “ওয়াও! সো ফাস্ট! এত তাড়াতাড়ি তো আমার বাড়ির তালাও খোলে না! আর এটা তো বহু পুরনো তালা! ফ্র্যাকশন অব সেকেন্ডে খুলে গেল!”
— “কী হল?”
এমার্জেন্সি লাইটের আলোয় সুজনের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। সে নিজেও কেমন যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। সুরেশ সেটা লক্ষ্য করেই বলে, এনিথিং রং?”
সুজন একটু ইতস্তত করে বলল, “বুঝতে পারছি না তালাটা এত তাড়াতাড়ি খুলল কী করে!”
—“মানে!”
দেবযানী ও সুরেশ দু’জনেই একসঙ্গে শব্দটা বলে ওঠে। ওদের দিকে তাকিয়ে একটু নার্ভাস হাসি হাসল সুজন, “নট আ বিগ ডিল! কিন্তু আমি সবে চাবিটা ঢুকিয়েছিলাম। ঘোরাইনি। ঘোরানোর আগেই তালাটা এরকম শব্দ করে খুলে গেল! স্ট্রেঞ্জ!”
ওরা তিন জনেই তিনজনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর সুরেশ সশব্দে হেসে ওঠে, “এর মধ্যে স্ট্রেঞ্জের কিছু নেই। তালাটা দেখেছিস? বহুদিনের মরচে পড়া তালা। দেখতেই অমন জগদ্দল, আসলে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গিয়েছে। ওটার জন্য চাবি লাগে না। আমার ধারণা তুই স্রেফ একটা টান মারলেই ওটা খুলে যেত। চাবির দরকারই ছিল না।”
—“হয়তো।”
সুজন আর বিশেষ পাত্তা দিল না। চাবি সমস্যার সমাধান করা ছাড়া তার এখনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। যে কাজটা ওরা করতে এসেছে সেটাতেই মনোনিবেশ করা ভালো। এমনিতেই এই জাতীয় দুর্গে মূর্তি কাটার কাজটা যথেষ্টই পরিশ্রমসাধ্য ও সময় সাপেক্ষ। ড্রিল বিট্স বা গ্রাইন্ডিং স্টোনের মতো অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করার উপায় নেই। কারণ ওগুলো ব্যবহার করতে হলে ইলেকট্রিসিটির প্রয়োজন হয়। এই জাতীয় পরিত্যক্ত দূর্গে যা সম্ভবই নয়। আর জেনারেটর ঘাড়ে করে নিয়ে মূর্তি কাটতে যাওয়ার কনসেপ্ট নিতান্তই হাস্যকর! সুতরাং ওদের পুরোনো ও সনাতন পদ্ধতিই অবলম্বন করতে হবে। অর্থাৎ ছেনি-হাতুড়িই ভরসা।
আপাতত তিন জনের কাঁধেই তিনটে ভারি ব্যাকপ্যাক ঝুলছে। তার মধ্যে রয়েছে চিজেল বা ছেনি, হাতুড়ি, এচিং টুলস, মার্কার, ম্যানুয়াল হ্যাক স এর মতো ‘ভ্যান্ডালস টুলস্’। এছাড়াও আছে টর্চলাইট, মেজারিং টেপ, নাইট ভিশন হাই ডেফিনিশন গগল্স, ডাস্ট মাস্ক, সেফটি গগল্সের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। সুজনের ব্যাকপ্যাকে অবশ্য এসব ছাড়াও একটি লাইসেন্সড গান রয়েছে। রাত্রে কোনও প্রেতাত্মা আসবে কি না জানে না, কিন্তু বন্যপশুর আসার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। আজ রাতে ওদের দীননাথ পৌঁছে দেয়নি। গোলা কা বাস থেকে তিন কিলোমিটার হেঁটেই এসেছে ওরা। হেঁটে আসাটা খুব বড় ব্যাপার নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওদের হেঁটেই অপারেশনে যেতে হয় কিন্তু ভানগড় ফোর্টের পথটা একটু আলাদা। একেই শুনশান পাহাড়ি রাস্তা, তার ওপর বন্যজন্তুর ভয়। তাই লাইসেন্সড রিভলবারটা সঙ্গেই নিয়েছে সুজন ভানগড় ফোর্টের পাথুরে রাস্তা দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সুজন। পেছনে সুরেশ আর দেবযানী। সুজনের স্মৃতিশক্তি প্রায় কম্পিউটারের মতো কোনও জায়গা একবার দেখলে সে ভোলে না। অতুল যখন ওদের গোপীনাথ মন্দিরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে গোটা রাস্তাটা পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জরিপ করে নিয়েছে। অবশ্য সঙ্গে ভানগড়ের ম্যাপটাও আছে। অতুল ওদের হনুমান গেট দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। একটু এগোতেই হনুমান মন্দিরটাও চোখে পড়ল। তবে এখন মন্দির বন্ধ। অর্থাৎ পূজারীও অনুপস্থিত। অতুলই জানিয়েছিল, সন্ধ্যে ছ’টার পর এখানে আর কেউ থাকে না। এমনকী গেটকিপারও নয়। তাই ভানগড় এখন সম্পূর্ণ জনশূন্য।
অতুল ওদের একটু ঘুরপথে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সুজন সোজা পথটাই ধরল। হনুমান মন্দির একটু ছাড়িয়ে যেতেই ডান দিকে পড়ল সেই ভগ্নস্তূপ। এখানে কী ছিল, ভগবানই জানেন। কোনও মহল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু আগেরদিন যেটা তেমন প্রকটভাবে অনুভব করেনি, রাতের বেলায় সেটাই প্রবলভাবে দেখা দিল! একটা চূড়ান্ত দুর্গন্ধ এসে ঝাপ্টা মারল ওদের নাকে! প্রথমদিকে অতটা বোঝা যায়নি, কিন্তু যত এগোচ্ছে, দুর্গন্ধটা ততই বাড়ছে। বাঁ দিকে ‘মোরোঁ কী হাভেলি’ এসে পড়তেই সেই পচা গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল ওদের। পাকস্থলীর ভেতরটা যেন পাক দিয়ে উঠল!
—“ওঃ!” দেবযানী আর থাকতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গেই মুখে রুমাল চাপা দেয়, “কী জঘন্য গন্ধ! এ তো ক্রমশই বাড়ছে! আগে জানলে পারফিউম নিয়ে আসতাম!”
সুরেশ হাতের সিগারেটটা ছুড়ে ফেলে দিয়ে নাক কুঁচকোয়, “এ কীরকম দুর্গন্ধ রে! কাল দিনের বেলায় তো পাইনি!”
—“আশপাশে কোনও ইঁদুর বা অন্য কোনও প্রাণী মরেছে বোধহয়!” সুজন কিন্তু নিস্পৃহ, “তারই পচা গন্ধ পাচ্ছিস।”
—“টেরিল স্মেল! মরা ইঁদুরের গন্ধ এত মারাত্মক!” দেবযানী কোনওমতে নিজেকে সামলায়, “আমার অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে আসছে।” সুরেশ আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, “উঁহু! কোনও মরা ইঁদুর বা অন্য কোনও প্রাণীর পচনের গন্ধ এরকম হয় না। আমি এই গন্ধটা চিনি। মনে হয় যে…”
—“কী মনে হয়?”
সুজনের প্রশ্নে সে একটু থমকে গেল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “যদিও প্র্যাকটিক্যালি ব্যাপারটা অসম্ভব, তবু মনে হয় যে এক নয়, একাধিক মানুষ মারা গিয়েছে। আর তারই এত দুর্গন্ধ! আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে একটা গোটা ফ্যামিলি আত্মহত্যা করেছিল। প্রথমে কেউ নোটিস করেনি। তোর মতোই সবাই ভেবেছিল যে কোনও জীব-জন্তু মরেছে। কিন্তু দু’দিন পরেই দুর্গন্ধের চোটে সবার টনক নড়ল। তখন পাশের ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে…”
—“তুই বলতে চাইছিস যে এটা মরা মানুষের পচা গন্ধ?” সুরেশকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বলল সুজন, “পুরো ইললজিক্যাল! এখানে মানুষ কোথা থেকে আসবে!”
সুরেশ চুপ করে যায়। দেবযানী একটু চুপ করে থেকে বলে, “মানুষ তো ছিল একসময়ে! তাদের কী হয়েছিল কেউ জানে না! ভানগড় যেদিন ধ্বংস হয়েছিল, সেদিন কত মানুষ এই ধ্বংসস্তূপের নীচে চাপা পড়েছিল কে জানে!”
বলতে বলতেই সে সামনের ধ্বংসস্তূপের দিকে তাকায়। রহস্যময় জ্যোৎস্নায় নীলাভ হয়ে আছে সেই ধ্বংসস্তূপ! ইঁট আর পাথরের পেল্লায় চাঁইগুলো দেখলেই ভয় করে! ওর নীচে কী আছে কে জানে! কয়েকশো বছর কেটে গিয়েছে, কেউ এই পাথরগুলোকে সরায়নি। হয়তো কোনওদিন ওর নীচেই চাপা পড়ে দমবন্ধ হয়ে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার হতভাগ্য মানুষ। কেউ তাদের সাহায্য করেনি! কেউ তাদের উদ্ধার করতে আসেনি। কে জানে! আজও হয়তো তারা ওখানেই সমাধিস্থ হয়ে আছে!
ইতিহাসের ভগ্নস্তূপের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল দেবযানী। আচমকা একটা কনকনে ঠান্ডা দমকা হাওয়া তাকে ছুঁয়ে গেল! কেঁপে উঠল সে!
দেবযানী!” সুজন পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে, “তুই কি ভয় পাচ্ছিস? কাঁপছিস কেন?”
ততক্ষণে এক অদ্ভুত শীতলতা ঘিরে ধরেছে দেবযানীকে। সে নিজেও আবহাওয়ার এই আকস্মিক পরিবর্তনে অবাক হল। আশ্চর্য বিষয়! একটু আগেও তো রীতিমতো গরম লাগছিল! প্রচন্ড ঘামছিল বলেই জ্যাকেটটা খুলে ব্যাকপ্যাকে ঢুকিয়ে দিয়েছে। তবে হঠাৎ করে এই বরফশীতল হাওয়া এলো কোথা থেকে! দেবযানী টের পেল, তার প্রচন্ড ঠান্ডা লাগছে। কিন্তু সুজন কোনওরকম দুর্বলতা পছন্দ করে না। না মানসিক, না শারীরীক। তাই কোনমতে সামলে নিয়ে বলল, “না, তেমন কিছু নয়। সামান্য ঠান্ডা লাগছে।”
—“ঠা-ন্ডা!” সুজন তাকে এমনভাবে দেখছে যেন দেবযানী এই মুহূর্তে মঙ্গলগ্রহ থেকে এল। অদ্ভুত সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল, “এই ভয়ংকর গরমে তোর ঠান্ডা লাগছে! জ্বর-টর বাঁধাসনি তো? তুই লাস্ট মোমেন্টে ডোবাবি দেখছি!”
— “না না…” দেবযানী একটু কুণ্ঠিত হয়ে কিছু বলতেই যাচ্ছিল, তার আগেই সুরেশ এগিয়ে এল তার দিকে। কোনও কথা না বলে দেবযানীর পিঠের ব্যাকপ্যাক ঘেঁটে বের করে আনল জ্যাকেটটা। তারপর তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “এটা পরে নে। আর দুর্গন্ধ বেশি মনে হলে আমার কাছে থ্রি এম সিক্স থাউজ্যান্ড ওয়ান অর্গানিক ভেপার কার্টরিজ আছে, নিয়ে নে। মরা জন্তু জানোয়ারের গন্ধ আমারও সহ্য হয় না। সুজন তো সবাইকেই নিজের মতোই ভাবে!”
দেবযানী সকৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে সুরেশের দিকে তাকিয়ে জ্যাকেটটা গায়ে পরে নিল। সুরেশ মৃদু হেসে মাস্কটাও এগিয়ে দেয়। সুজন ভ্রূ ভঙ্গি করে ব্যাপারটা দেখল। মুখভঙ্গিতেই স্পষ্ট যে ব্যাপারটা আদৌ তার পছন্দ হয়নি। যে কোনওরকম দুর্বলতাকে সে অপছন্দ করে। তার মতে, পাথরের কারবারিকে পাথরের মতোই শক্ত হতে হয়। ঝড়, জল, রোদ— কোনওরকম দুর্যোগই তাকে টলাতে পারে না। সে নিজেও সেই নিয়মই মেনে চলে। রোগ, প্ৰতিকূল পরিস্থিতি, ভয়, কোনওকিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। এই সামান্য দুর্গন্ধে পিছু হটার পাত্র সে নয়। তাই এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলল, “হয়েছে? তাহলে এগোনো যাক?”
—“আয়ে আয়ে স্কিপি!” সুরেশ হেসে ফেলে, “আফটার ইউ।” রাতের ভানগড়ের রাস্তা দিয়ে ফের হেঁটে চলল ওরা তিন জন। অন্ধকার গায়ে মেখে নিঃশব্দে এগিয়ে চলল গন্তব্যের দিকে। সুজনের একহাতে টর্চ, অন্য হাতে এমার্জেন্সি লাইট। এমার্জেন্সিটা অবশ্য এখন অফ করা রয়েছে। বেশি আলো জ্বেলে এখন কাজ নেই। মানুষ যদি ভূতের ভয়ে না ও আসে, কোনও বন্যপ্রাণী আসবে না এমন গ্যারান্টি নেই।
সুজনের ঠিক পেছনেই দেবযানী। তার হাতেও টর্চ। সুরেশ যথারীতি তার হাই ডেফিনিশন ক্যামকর্ডার নিয়ে রাতের ভানগড়ের দৃশ্য তুলছে। ওর ক্যামকর্ডারটা আবার নাইট-ভিশন। সে এখন বাঁ দিকে জহুরি বাজারের ছবি তুলতে ব্যস্ত। এক সময়ে এখানে এক আলো ঝলমলে, জনবহুল ও ব্যস্ত বাজার বসত। এখন শুধুই কতগুলো চৌকো ইট আর পাথরের ভগ্নাবশেষ পড়ে রয়েছে। প্রাচীন হলেও গাঁথুনি দেখলেই বোঝা যায় ঠিক কতখানি শক্ত-পোক্ত ছিল! কয়েক শতাব্দীর প্রাচীন ধ্বংসস্তূপ হওয়ার দরুণ শ্যাওলার কালশিটে পড়েছে শুধু। বাকিটা এখনও মজবুত কাঠামোর ওপরে দাঁড়িয়ে আছে।
সে আস্তে আস্তে দূরে পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে-থাকা অন্ধকার রাজমহলের দিকে ক্যামেরা জুম করল! এখনও দেখলে আন্দাজ করা যায় কোনওসময়ে কী রাজকীয় গরিমা ছিল তার। আজ কিছুই নেই! তবু দেখামাত্রই গা শিরশিরিয়ে ওঠে।
সুরেশ চলতে চলতেই টের পেল, পেছনে নিশ্বাসের শব্দ। ঠিক তার পিছনেই লঘু পায়ের আওয়াজ পেয়ে বুঝল, দেবযানী নির্ঘাত পিছিয়ে পড়েছে। সে ক্যামেরা থেকে চোখ না সরিয়েই হাসল, “দেবযানী, একটু পা চালিয়ে। নয়তো সুজনের ঝাড় তোর কপালে নাচছে!”
—“ঝাড় তো তুই খাবি মড়া!”
সুরেশের কিছুটা সামনে থেকেই দেবযানীর হাসিমাখা কণ্ঠস্বর ভেসে এল। সুরেশ চমকে সেদিকেই তাকাল! স্তম্ভিত হয়ে দেখল, দেবযানী তার পেছনে নয়, বরং বেশ খানিকটা এগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে! সে হাসতে হাসতেই বলল, “ভিডিয়োর চক্করে তুই-ই আমাদের থেকে পিছিয়ে পড়েছিস! তাড়াতাড়ি আয়।”
—“তুই সামনে! তবে!” বিদ্যুৎবেগে পিছনদিকে ফিরল সুরেশ। কিন্তু সেখানে শুধুই আবছা অন্ধকার আর শূন্যতা! আর কেউ নেই! এবার বিস্ময়ের ধাক্কাটা এত জোরালো মাত্রার ছিল যে বেশ কয়েক সেকেন্ডের জন্য সে বাকশক্তি হারাল। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বিহ্বলভাবে বলল, “তবে… তবে পেছনে কে?”
—“স্বপ্ন দেখছিস নাকি?” সুজন এবার রেগে যায়, “কখনও দেবযানীকে সামনে দেখছিস, কখনও পেছনে! শুরুটা করেছিস কী?”
—“কিন্তু আমি স্পষ্ট পায়ের শব্দ শুনেছি! নিঃশ্বাসের শব্দও পেয়েছি, কেউ ছিল! কেউ পিছনে ছিল!”
সুরেশ টের পেল, তার স্নায়ুকে কাঁপিয়ে একটা ভয়ের স্রোত উঠে আসছে। সে আরেকবার বিভ্রান্তদৃষ্টিতে পেছনের দিকে তাকায়। সুজন তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে হাতের টর্চ তুলে ধরে সেদিকেই আলো ফেলল। কঠিন গলায় বলল, “দ্যাখ, আছে কেউ?”
টর্চের আলোয় শুধু ভানগড়ের পাথর বাঁধানো রাস্তা দেখা গেল। আর ভাঙা কালো কালো পাথরের চাঁই! জহুরিবাজারে ছাতহীন দালানগুলো যেন মুন্ডুহীন কবন্ধের মতো কৌতুকে ‘হো হো’ করে হেসে উঠল!
আর কেউ নেই! কিছু নেই!
৬
গোপীনাথ টেম্পল সম্ভবত ভানগড় ফোর্টের বৃহত্তম মন্দির। অন্যান্য মন্দিরগুলোর তুলনায় অনেকটা জায়গা ছড়িয়েও আছে। দিনের বেলায় আপাদমস্তক হলুদ পাথরে তৈরি মন্দিরটি সূর্যের সোনালি আভায় ঝলমল করে। সামনে অগুনতি পাথরের সিঁড়ি ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে মন্দির অবধি। ওরা দিনের বেলায় মন্দিরটিকে দেখে রীতিমতো অবাক হয়ে গিয়েছিল। যেখানে গোটা দূর্গটাই প্রায় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ধুলোয় মিশে গিয়েছিল, সেখানে গোপীনাথ মন্দির এখনও সম্পূর্ণ অক্ষত ও অবিকৃত অবস্থায় আছে! মন্দিরচূড়ার সূক্ষ্ম কারুকার্য ও স্থাপত্যশিল্প দেখলে হতবাক হয়ে যেতে হয়। মন্দিরটির সর্বমোট তিনটি গর্ভগৃহ। যার মধ্যে দুটো গর্ভগৃহ ওরা দেখেছে। তৃতীয়টিই প্রধান ও আভ্যন্তরীণ। সেটাই এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন আর দেখা যায় না। কিন্তু বাইরের দুটো গর্ভগৃহ দেখলেই বোঝা যায়যে সেটি কী বস্তু হবে! সরকার সম্ভবত ভানগড় ফোর্ট সম্বন্ধে উদাসীন। তাই অন্যান্য দুর্গের মতো এই দুর্গটির পুনর্নির্মাণ হয়নি। আর সেই উদাসীনতার কারণেই গোপীনাথ মন্দিরের গর্ভগৃহগুলির ছাতের সৌন্দর্য ও সৌকর্য খানিকটা নষ্ট হয়েছে। প্রধান স্তম্ভের গায়ে চমৎকার এক নৃত্যরতা যক্ষিনীমূর্তির ভাস্কর্য ছিল। তবে অবহেলায় আর কালের আঘাতে মূর্তিটির মাথা ও দুই হাত ভেঙে গিয়েছে। নষ্ট হয়েছে ভাস্কর্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও যা রয়েছে, তাও যথেষ্টই বিস্ময়কর! দেবযানী তো দেখেই রীতিমতো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। বলেছিল, “ফ্যান্টাস্টিক আর্কিটেকচার! অনেকটা সাউথ ইন্ডিয়ার বিজয়নগরের মন্দিরগুলোর মতো না? এক্সোটিক ওয়ার্ক উইথ রাজপুতানা আর্কিটেক্ট!”
সুজন সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেও তার সতর্ক চোখের নিষেধাজ্ঞা পড়তে পেরেছিল দেবযানী। তারা যে মন্দিরের স্থাপত্য ও সৌন্দর্য সম্পর্কে রীতিমতো ওয়াকিবহাল তা সে প্রকাশ করতে চায় না। বিশেষ করে অতুলের সামনে। অগত্যা দেবযানী চুপ করে গিয়েছিল। কিন্তু মনে মনে গোপীনাথ মন্দিরের আভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহটি দেখার জন্য আরও বেশি ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। যা প্রকাশ্যে আছে তাতেই যদি এত কারুকাজ হয়, না জানি অপ্রকাশ্য শিল্পটি আরও কতগুণ সুন্দর হবে! অতুল অবশ্য মৃদু হেসে বলল, “গোপীনাথ কৃষ্ণের আরেক নাম। আগে শ্রী রাধিকার সঙ্গে বংশীধারী কৃষ্ণের চমৎকার যুগলমূর্তি ছিল শুনেছি। তবে এখন নেই। হয়তো কোনও মূর্তিচোর ফাঁকেতালে সরিয়ে নিয়েছে।”
বলতে বলতেই তার মুখে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ বঙ্কিম হাসি ভেসে উঠল। সুজন দাঁতে দাঁত পিষে চাপা গলায় বলেছিল, “পারলে এই ব্যাটার মাথাতেই ছেনি আর হাতুড়ি ছুঁড়ে মারি। অসহ্য!”
এই প্রথম সুজনের কথায় সম্পূর্ণ একমত হয়েছিল দেবযানী। সত্যিই অসহ্য! তার থেকেও অসহ্য ওর এই নিষ্পলক চাউনি! একেবারে মরা মাছের মত চোখ! সে লক্ষ্য করে দেখেছে, লোকটা একবারের জন্যও চোখের পলক ফেলে না! আশ্চর্য!
ওরা সেদিন দিনের আলোয় দেখেছিল মন্দিরটাকে। আর আজ, গভীর রাতে!
নরম জ্যোৎস্না অলৌকিক ইশারায় গলে গলে পড়ছিল গোপীনাথ মন্দিরের চূড়া বেয়ে। দিনের আলোয় এর রহস্যময়তা বোঝা যায়নি। কিন্তু রাতের আলো-আঁধারিতে মন্দিরটাকে দেখে কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল দেবযানীর! কোনও এক দৈবীশক্তি যেন মাথা উঁচু করে ঘুমিয়ে আছে! পাথরের স্তম্ভগুলোর কারুকাজ যেন আরও জীবন্ত। চাঁদের আলো ছলকে পড়ছে পাথরের মসৃণ গায়ে! ভেতরের অন্ধকার গর্ভগৃহ যেন ইশারায় কাছে ডাকছে ওদের। কী যেন এক অব্যক্ত সম্মোহনী শক্তি চুম্বকের মত টানছে!
—“সুরেশটা আবার কোথায় গেল?”
সুজন একটু বিরক্তিমিশ্রিত গলায় বলল, “আমাদের পেছন পেছনই তো আসছিল। এখন কোথায় গায়েব হল!”
দেবযানী প্রমাদ গোণে। সুরেশের এই এক বদভ্যাস। একবার ভিডিয়ো তুলতে শুরু করলে তার আর হুঁশ থাকে না। নির্ঘাৎ জ্যোৎস্নালোকিত ভানগড় ফোর্টের ভিডিয়ো তুলতে তুলতে পিছিয়ে পড়েছে! এই প্রথম নয়, এর আগেও সে এরকম কাণ্ড করেছে। একবার এক প্রাচীন গুম্ফায় ঢুকে ঠিক এভাবেই হারিয়ে গিয়েছিল। শেষপর্যন্ত দেবযানী আর সুজন যখন তাকে গরুখোঁজা খুঁজে হতক্লান্ত, তখনই ক্যামেরা হাতে বাবু এসে হাজির! এসেই ভারি নিরীহ গলায় বলেছিল, “আমায় খুঁজছিলি?”
সেদিন সুজন তাকে মারতে বাকি রেখেছিল। আজও বিরক্ত হয়েই বলল, “এই ছেলেটা কিছুতেই সিরিয়াস হবে না! ওর কী মনে হয়? এইসব জায়গা রাতের বেলা খুব সেফ? ও কি কনডাক্টেড ট্যুরে এসেছে নাকি! সব জোগাড়যন্ত্র মাটি করবে দেখছি! প্রত্যেকবারই এই এক কেস।”
রেগেমেগে আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল সুজন। কিন্তু একটা অস্বাভাবিক শব্দ শুনে থেমে গেল! ওটা কীসের আওয়াজ? জলের নয়? স্থির নৈঃশব্দের মধ্যে একটা জোরালো ছলছল শব্দ কানে আসতেই চমকে উঠল ওরা! মন্দিরের ডান দিকে একটা ড্রেইন আছে। তাতেই জলের শব্দ হচ্ছে! কিন্তু জলের শব্দ হচ্ছে কেন! যে মন্দির পরিত্যক্ত, যেখানে বিগ্রহ নেই, বিগ্রহকে স্নান করানো হয় না বা পুজো করা হয় না, সেখানে জল যাওয়ার এমন কুলকুল আওয়াজ হতেই পারে না! এক প্রাচীন ধ্বংসস্তূপের ভেতরে এত রাত্রে তবে কাকে স্নান করানো হচ্ছে? সে কি কোনও দেবতা? না!
—“শুনলি?”
দেবযানীর কণ্ঠস্বর কেঁপে গেল। তার হৃৎপিণ্ড এখন প্রায় টারবাইনের গতিতে চলতে শুরু করেছে। সুজনের মুখেও এই প্রথম সামান্য ভয়ের আভাস দেখা গেল। সে আস্তে আস্তে বলল, “শুনলাম!”
— “এত রাতে হন্টেড ফোর্টে জলের আওয়াজ! মন্দিরে কেউ আছে!” দেবযানী উত্তেজিত, “সুজন, আমি তোকে আগেই বলেছিলাম, এটা হন্টেড প্লেস! ইথানও বলেছিলেন।”
—“সে তো দীননাথও বলেছিল যে রাত হলে ভানগড় জেগে ওঠে, প্রাচীন ভগ্নস্তূপ মেরামত হয়ে যায়, ভূতেরা মিটিং করতে আসে, নাচে-গায়; তেমন কিছু দেখেছিস কি?”
সুজনের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। সে এবার টর্চটা রেখে দিয়ে ফট্ করে জোরাল এমার্জেন্সি লাইটটা জ্বেলে দিল। দেবযানী ভয়ার্ত ও বিস্ময়াভিভূত দৃষ্টিতে দেখল তার লাইসেন্সড গানটাও হাতে উঠে এসেছে। তারপরই একদম গট্ করে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে, “আমার ধারণা কেউ আমাদের সঙ্গে গেম খেলছে। আমি এর শেষ দেখেই ছাড়ব।”
দেবযানী প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, “যাস না সুজন। কেউ, কিছু তো আছেই! দাঁ-ড়া!”
সুজন শুনল না। বরং একহাতে এমার্জেন্সিলাইট ও অন্য হাতে উদ্যত বন্দুক নিয়ে একরকম দৌড়েই উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। দেবযানী সভয়ে দেখল, সুজন মিলিয়ে গেল সার সার স্তম্ভের মাঝখান দিয়ে। প্রাথমিকভাবে শুধু তার এমার্জেন্সি লাইটের আলো দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু মন্দিরের অভ্যস্তরস্থ জমাট অন্ধকার বুঝি হাঁ করেই ছিল। সে একেবারে দানবের মত গ্রাস করতে শুরু করল আলোকে। এমার্জেন্সির আলো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে হতে মিলিয়েই গেল অন্ধকারের মধ্যে।
দেবযানীর বুকের ভেতরের কাঁপুনিটা আরও বাড়ছে। সুজন কোথায় গেল! এখন তার হাতের আলোটাও আর দেখা যাচ্ছে না। সুরেশও কোথায় কে জানে! অপরিসীম অন্ধকারের মধ্যে, নিঃসঙ্গ মেয়েটির মনের মধ্যে আঁচড় কাটছে ভয়! সে একবার গোপীনাথ মন্দিরের চূড়ার দিকে তাকাল। এখন এই পাথুরে স্থাপত্যকেও ভীষণ জীবন্ত মনে হচ্ছে। অতুল বলেছিল, মন্দিরগুলো জীবন্ত! তার কথাকে প্রায় হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিল সুজন। কিন্তু এখন সেই কথাটাকেই চরম সত্যি বলে মনে হচ্ছে। দেবযানীর চোখ একবার ছুঁয়ে গেল চতুর্দিকের ধ্বংসপ্রাপ্ত দালানগুলোকে। চাঁদের আলোয় কেমন যেন রহস্যময় ছায়ামূর্তি মনে হচ্ছে তাদের। এত শক্তিশালী, এত দাম্ভিক দূর্গকে কোন্ বিধ্বংসী শক্তি এমনভাবে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল! অথচ মন্দিরগুলোর কিছুই হল না! কেন?
হঠাৎই তার মনে পড়ল অতুলের কথা। সে বলেছিল, “ভানগড়ের মন্দিরগুলোর মধ্যে কোনও অলৌকিক শক্তি নিশ্চয়ই আছে। নয়তো একরাতের মধ্যে রীতিমতো মজবুত একটা কেল্লা ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেল, অথচ মন্দিরগুলো একদম অটুট থাকল কী করে?”
কথাটাকে চিরসত্য বলেই মনে হল দেবযানীর। সে ভয়ার্ত, ব্যাকুলস্বরে ডাকল, “সু-জ-ন!”
কিন্তু তার ডাকের কোনও প্রত্যুত্তর এল না। মন্দির নিশ্চুপ। দেবযানীর মনের মধ্যে আশঙ্কার মেঘ গুড়গুড়িয়ে ওঠে। তার মনে হল,
শীতটা যেন ক্রমশই বাড়ছে। তারসঙ্গে বাড়ছে দুর্গন্ধের প্রকোপও। তার মুখের মাস্কও সে প্রাণান্তিক দুর্গন্ধকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না! গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও সে সমস্ত শক্তি নিংড়ে দিয়ে আবার চেঁচিয়ে উঠল, “সু-জ-ন!”
তাও কোনও উত্তর নেই! সে নিরূপায় হয়ে এগিয়ে গেল মন্দিরের সিঁড়ির দিকে। সুজনকে সে এভাবে ছেড়ে যেতে পারে না। ওরা বহুবছর ধরে একসঙ্গে একই কাজ করে আসছে। আজ এই চূড়ান্ত মুহূর্তে তাকে একলা ছেড়ে দেবযানী পালিয়ে যেতে পারে না।
গোপীনাথ মন্দিরের সামনে সারসার পাথরের প্রাচীন সিঁড়ি জ্যোৎস্নায় ঝকমক করছে। সে আস্তে আস্তে সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করল। সিঁড়ির সংখ্যা খুব বেশি হওয়া উচিত নয়। সর্বসাকুল্যে পঁচিশ কী ত্রিশটি সিঁড়ি রয়েছে। কিন্তু আজ বেশ কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙেই হাঁফ ধরে গেল দেবযানীর! নিজের অবস্থা দেখে সে নিজেই বিস্মিত! এ তো কিছুই নয়, এরকম খাড়া, পাথুরে কয়েকশো সিঁড়ি ভেঙে ওরা কত মন্দিরে ঢুকেছে অনায়াসেই। হাঁফ ধরা তো দূর, সামান্য ক্লান্তিও বোধ করেনি। অথচ আজ মাত্র কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙেই ক্লান্ত হয়ে পড়ল!
দেবযানী অপরিসীম জেদে দাঁতে দাঁত পিষল। সেও এর শেষ দেখেই ছাড়বে। গোঁয়ারের মতো একের পর এক সিঁড়ি ভেঙে উঠতেই থাকল মন্দিরের দিকে। দম ধরে আসছে, হাত-পা ভারি হয়ে আসছে, বুকের ওপর একটা প্রচণ্ড ভার টের পাচ্ছে, যেন কেউ একটা পাথর বসিয়ে দিয়েছে বুকের ওপরে, তবু থামছে না। আর তো মাত্র কয়েকটা সিঁড়ি, তারপরেই…
কিন্তু সামনের দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল সে! একী! এখনও তো সামনে অদম্য, উদ্ধত সিঁড়ির অগুনতি ধাপ! পঁচিশ কী ত্রিশটা নয়! এ একেবারে সীমাহীন! গোপীনাথ মন্দিরের সামনে এত সিঁড়ি কবে এল! কখনই বা এল!এর যে শেষই দেখা যায় না! কোথায় গিয়ে থেমেছে এ সিঁড়ি? দেখলে তো মনে হয় একেবারে নিরুদ্দেশের পথে চলেছে! কোথায় মন্দিরের কারুকার্যমন্ডিত চূড়া! কোথায় পাথরের স্তম্ভ! কিছুই দেখা যায় না। সামনে শুধু সারে সারে পাথরকাটা সিঁড়ি যার শেষ নেই! তবে শুরু কোথায়?
নীচের দিকে দেখতেই রক্ত হিম হয়ে যায় দেবযানীর! এ কী! তার পেছনেও তো অগুনতি সিঁড়ি ধাপ কেটে কেটে নেমে গেছে! সে আপ্রাণ নীচের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে তার মাথা ঘুরতে শুরু করল! কী সর্বনাশ! এ সিঁড়ির যেন শুরুও নেই! কয়েকশো নয়, অন্তত কয়েকহাজার তো বটেই! এতগুলো সিঁড়ি সে কখন ভাঙল! কখন থেকেই বা হেঁটে চলেছে! নীচের কোনও দৃশ্যই চোখে পড়ছে না! কিচ্ছু নেই! শুধু সামনে আর পেছনে ধাপে ধাপে সিঁড়ির সার ব্যঙ্গ করে চলেছে! না এগোনোর উপায় আছে, না পিছোনোর!
দেবযানীর মনে হচ্ছিল তার হাত-পা ক্রমাগত ভারি হয়ে আসছে! যেন এ তার নিজস্ব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নয়। ভারি পাথরের তৈরি হাত-পা! বুকের ভিতরে ভীষণ কষ্ট! মনে হয়, হৃৎপিণ্ডটাও ক্রমশ পাথর হয়ে যাচ্ছে! সে আপাদমস্তক পরিণত হচ্ছে এক পাথরের মূর্তিতে যাকে বয়ে নিয়ে যাওয়া তার পক্ষে অসম্ভব! যত এগোচ্ছে ততই যেন একটু একটু করে তাকে গ্রাস করছে পাষাণ! প্রতি পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমাগত ভারি হয়ে উঠছে তার দেহ। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে বুঝতে পারল, তার দেহের তাপমাত্রা ক্রমাগতই কমছে। শিরার মধ্যে রক্তসঞ্চালন ধীর হয়ে আসছে আস্তে আস্তে। শীত করছে, অসম্ভব শীত করছে তার!
জ্যোৎস্নার আলো একঝলক এসে পড়ল দেবযানীর দুই হাতের ওপর। সেই সামান্য আলোতেও সে ভয়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল, তার হাতদুটো আস্তে আস্তে হলুদবর্ণ ধারণ করছে! অবিকল সেই হলুদ পাথরের মতো, যে পাথর দিয়ে বানানো হয়েছে গোটা গোপীনাথ মন্দির! দেবযানী ভয়ে পিছিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তার পা একচুলও নড়ল না! যেন চিরকালের জন্য গেঁথে গিয়েছে পাথরের মধ্যে।
সে ভয়ে চিৎকার করে উঠতে চায়! কিন্তু আশ্চর্য, একটু শব্দও বেরোল না তার মুখ থেকে। শুধু এইটুকু বুঝতে পারল, সে আস্তে আস্তে পাথরের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে!
পাথরের মতো হিমশীতল!
৭
সুরেশ রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিল।
এমনিতেই সে অসম্ভব ভয় পেয়েছিল। সুজনকে সেকথা বারবার বলেছে। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে, সত্যিই তার পেছনে কেউ ছিল! কোনও মানুষের দ্রুত নিঃশ্বাসের শব্দ, হেঁটে আসার আওয়াজ সে স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে! কোনও সন্দেহই নেই, যে কেউ তাদের ফলো করছে!
কিন্তু সুজন তার একটা কথাও বিশ্বাস করেনি। উলটে হেসে বলেছে, “ওসব পাবলিকের গাঁজাখুরি গল্পের এফেক্ট! তুই হ্যালুসিনেট করছিস।”
সুরেশের কয়েকমুহূর্তের জন্য মনে হয়, হয়তো সুজনই ঠিক বলছে। ভানগড় সম্পর্কে নানারকম ভৌতিক ও অলৌকিক গল্প শুনতে শুনতে তার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক উদ্ভট উদ্ভট কল্পনা করছে। হয়তো তার পিছনে সত্যিই কেউ ছিল না। অন্য কোনও প্রাকৃতিক শব্দ শুনে সে খামোখাই চমকে উঠছে। ব্যাপারটার একটা যুক্তিসঙ্গত সমাধান খুঁজে পেয়ে তখনকার মতো সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। আশ্বস্তও হয়েছিল।
কিন্তু দেবযানী আর সুজনের পিছনে যেতে যেতেই হঠাৎ থমকে গেল সে! আবার! আবার সেই শব্দ! শুধু পায়ের শব্দই নয়, এবার যেন কারোর পায়ে ধাক্কা লেগে নুড়ি-পাথরের গড়িয়ে যাওয়ার আওয়াজ! শুধু তাই নয়; পোষাকের খসখসও একদম পরিষ্কার শুনতে পেল সে! না, কোনওরকম ভ্রান্তি নয়। পেছনে কেউ আছে! কেউ তাদের অজান্তেই ফলো করছে!
—“কে?”
সে তৎক্ষণাৎ সপাটে পিছনে ফিরল। নাঃ, তার সন্দেহ অমূলক নয়! ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে কেউ! তার আবছায়া সিল্যুয়েট রাতের প্রেক্ষাপটে একদম পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। সে যেই হোক, এবার আর লুকিয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি।
—“কে আপনি? আমাদের ফলো করছেন কেন?”
হিন্দিতে ধমকে উঠল সুরেশ। কিন্তু ছায়া কোনও উত্তর দিল না। সে চুপ করে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।
সুরেশ ক্যামকর্ডারটাকে মাটিতে রেখে তাড়াতাড়ি ব্যাকপ্যাক থেকে নিজের টর্চটা বের করল। সেটা অন করে আলো ফেলতেই আবার একটা বিস্ময়ের ধাক্কা! যেখানে ছায়াটা দাঁড়িয়েছিল, সেখানে এখন কেউ নেই! টর্চের সাদা আলো শুধু পাথুরে পথ আর ইতস্তত ছড়ানো দুর্গের ভাঙাচোরা অবশেষটুকুই দেখাল।
পালিয়ে গেল! সুরেশ রীতিমতো অবাক হল। ক্যামকর্ডার রেখে টর্চটা বের করতে তার এমন কিছু সময় লাগেনি। তার মধ্যেই একটা আস্ত মানুষ কোথায় হাওয়া হয়ে গেল! দৌড়ে যাওয়ার ধুপধাপ শব্দও তো কানে আসেনি তার! সে টর্চের আলো ইতস্তত ফেলে দেখার চেষ্টা করল যে মানুষটা এই ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই কোথাও লুকিয়েছে কি না। কিন্তু কাউকেই আশপাশে দেখা গেল না!
সুরেশের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। আস্ত মানুষটা নিমেষে এমন লোপাট হয়ে গেল কী করে! নাকি আবার তারই ভুল হল! ভাবতেই সে মাথা নাড়ে নাঃ, এতখানি ভুল করতেই পারে না। স্পষ্ট দেখেছে একটা ছায়ামূর্তি তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে! কোনও চতুষ্পদ নয়, কোনও বন্যজন্তুও নয়। নিঃসন্দেহে সে মানুষ। আর ও যে তাদের ফলো করছিল, সে বিষয়েও কোনও সন্দেহ নেই।
সুরেশ নিজের অজান্তেই একবার তার জ্যাকেটের পকেটটা স্পর্শ করল। ওখানে একটা ফোল্ডিং নাইফ রয়েছে। ওদের কাজটা যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আত্মরক্ষার্থে সবসময়ই ছুরিটাকে পকেটে রাখে। সেটার উপস্থিতি টের পেতেই যেন একটু শান্তি পেল। তারপর ক্যামকর্ডারটাকে তুলে নিয়ে ব্যাগে ভরে এগোনোর জন্য পা বাড়াল। আবার যদি সেই আগন্তুক এসে হাজির হয়, তবে দেখা যাবে। এবার ওকে দেখে নেবে সে।
কিন্তু এগোতে গিয়েই ফের চমক! সুজন আর দেবযানী কোথায় গেল! একটু আগেও তো সামনেই হাঁটছিল ওরা দুজন! কিন্তু এখন তার দৃষ্টিপথের মধ্যে ওরা কেউ নেই! সুরেশ বিপন্ন বোধ করল! এতক্ষণ সুজনই ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছিল। ভানগড় ফোর্টের ম্যাপটাও ওরই কাছে। অথচ ওরা কেউ ধারে কাছে নেই! এমনকী ওদের টর্চের আলোও দেখা যাচ্ছে না! সুজন তো কোনওকালেই কেয়ার করে না, কিন্তু দেবযানীও কি ভুলে গেল সুরেশের কথা! একবারও কি পিছু ফিরে দেখেনি যে সে সঙ্গে নেই!
সুজন আর দেবযানীর এরকম ব্যবহারে স্বাভাবিকভাবেই রাগ হয়ে গিয়েছিল তার। কিন্তু আস্তে আস্তে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনে। এখন মান-অভিমানের সময় নয়। হয়তো কাজের উত্তেজনায় ওরা লক্ষ্যই করেনি যে সুরেশ ওদের থেকে পিছিয়ে পড়েছে। অনেক সময় লক্ষ্য করেও না। দূর্গের রাস্তা একদম সোজাই চলে গিয়েছে। নাক বরাবর দ্রুত হাঁটলে হয়তো খুঁজেও পাওয়া যাবে ওদের। খুব বেশিদূর এগিয়ে গিয়েছে বলে মনে হয় না। যাই হোক, এখন উত্তেজিত হওয়ার সময় নয়; বরং ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে।
সুরেশ এবার নিজের টর্চ জ্বালিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। তার পাশাপাশি চলেছে জহুরী বাজারের কালো ছোপ ছোপ ইট-পাথর! বহু বছরের শ্যাওলা জমে রয়েছে ভগ্নাবশেষের গায়ে। বহু বছরের রহস্যও বটে…
—“খস… খস… খস!”
আবার! আবার সেই আওয়াজ! সূক্ষ্ম রেশমী কাপড় ঘষা খেলে যেমন শব্দ করে ঠিক তেমনই একটা খসখস ধ্বনি! তার সঙ্গে পায়ের শব্দ এবার আরও বেশি পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে! ফলো করছে! সে আবার ফলো করছে! সুরেশ টের পেল তার ঠিক ঘাড়ের কাছে কেউ যেন বরফশীতল নিঃশ্বাস ফেলল! অর্থাৎ আগন্তুক এবার আরও কাছে! তার হিমশীতল নিঃশ্বাসে কেঁপে উঠল সে!
— “কৌন হ্যায়! হু দ্য হেল আর ইউ?”
বলতে বলতেই সে অ্যাবাউট টার্ন নিয়ে বিদ্যুৎবেগে টর্চের জোরালো ফোকাস ফেলল ঠিক তার পিছনেই! কিন্তু…
ছায়ামূর্তিটাকে এখনও দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে তার দেহরেখা স্পষ্ট! মাথা, কাঁধের আউটলাইন, দুটো হাতের রেখাও স্পষ্ট দৃশ্যমান! কিন্তু যেখানে টর্চের আলো ফেলেছে সুরেশ সেখানে ছায়ার মালিকের বুক বা পেটের অংশ থাকা উচিত! অথচ সেরকম কিছুই নেই! টর্চের তীব্র আলো যেন ছায়ামূর্তিটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে গিয়ে পড়ল শূন্য দূর্গের চারদিকে! অথবা কোনও অজ্ঞাত সুড়ঙ্গের মধ্য দিয়ে গিয়ে আলোটা মিশে গেল শূন্যতায়!
ভয়ে সুরেশের রক্তহিম হয়ে যায়।সে বুঝতে পেরেছে, ওটা কোনও মানুষ নয়! হাড়-মাংস-পেশীযুক্ত কোনও প্রাণীই নয়। বরং ও শুধুমাত্রই একটা ছায়া! যাকে অনায়াসে ভেদ করে চলে যাচ্ছে টর্চের আলো! এ কী করে সম্ভব! অসম্ভব ব্যাপার! একটা ছায়া তার পেছন পেছন আসছিল। অবিশ্বাস্য!
একমুহূর্তের জন্য শ্বাস টানল সুরেশ! পরক্ষণেই প্রবল গতিতে দৌড়তে শুরু করল। যে করেই হোক, এই অলৌকিক ছায়ার হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতেই হবে তাকে! ছুটতে ছুটতেই সে টের পেল পিছনের পায়ের আওয়াজও ক্রমাগত জোরালো হচ্ছে! অর্থাৎ সেই ছায়ামূর্তি যে-ই হোক না কেন, এখনও তাকে দুরন্ত গতিতে ধাওয়া করছে। সেই ছায়াও হাল ছাড়েনি! সুরেশের মনে হল তার দেহের সমস্ত রক্ত বুঝি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে! এ কী অদ্ভুত ছায়া! এর থেকে বরং কোনও দৈত্য তেড়ে এলেও সে এত ভয় পেত না। ভানগড় ফোর্টের কিংবদন্তীতে যেসব ভূত-দর্শনের কথা আছে, তেমন কেউ সামনে এসে দাঁড়ালেও বোধহয় এর চেয়ে ভালোই হত! অন্তত তাদের একটা মূর্তি থাকত, কায়া থাকত। কিন্তু যার কোনও মূর্তিই নেই, যে সম্পূর্ণ কায়াহীন, সেই আতঙ্কের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবে কী করে!
পেছনে ছুটে আসার শব্দ এখন আরও জোরে শোনা যাচ্ছে। নিরূপায়, বিপন্ন সুরেশ সামনেই যে রাস্তা পেল তাতেই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করল। যে আতঙ্ক তাকে চেজ করে চলেছে, তার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার অন্য কোনও উপায় জানা নেই তার। মানুষ হলে ছুরি কাজে আসত। কিন্তু ছায়া…
দাঁতে দাঁত চেপে সুরেশ তার গতিবেগ বাড়াল। জোরে, আরও জোরে, আরও আরও বেশি জোরে দৌড়ে চলেছে সে। ভাঙা ভাঙা সিঁড়ি টপকে, কখনও চড়াই ভেঙে, কখনও উৎরাই বেয়ে দৌড়চ্ছে। কিন্তু কোথায় চলেছে সে নিজেই জানে না! কখনও পায়ের তলায় পাথুরে রাস্তা, কখনও বা নরম ঘাস দলিত মথিত করে এগোচ্ছে। এই মুহূর্তে তার পাশ দিয়ে স্যাৎ স্যাৎ করে চলে যাচ্ছে ভাঙাচোরা মহল, মাথাকাটা ভেঙে পড়া দালান, বিপর্যস্ত ধ্বংসস্তূপ! আর চলেছে ভানগড়ের শক্তিশালী পেশল দেওয়াল! প্রাচীন এক বিরাট সরীসৃপের মতো সেও এঁকেবেকে সুরেশের পাশাপাশি দৌড়োচ্ছে। সুরেশের মনে হল, ওগুলো নেহাত ধ্বংসস্তূপ নয়; এ প্রাচীন দেওয়ালও আসলে নিছক দেওয়াল নয়! এরা প্রত্যেকেই এক একটা জীবন্ত ছায়া। যে কোনও মুহূর্তে ওরাও ‘রে রে’ করে তেড়ে আসবে তার দিকে!
দেহের সবশক্তিটুকু জড়ো করে দৌড়াতে দৌড়াতেই আচমকা পাথরে হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সুরেশ। তার হাত থেকে টর্চ ছিটকে পড়ে গড়গড় শব্দ তুলে কোথায় গড়িয়ে গেল কে জানে! চতুর্দিকে এখন শুধু অন্ধকার আর নৈঃশব্দ! যে ছায়া তার পেছনে আসছিল, তাকেও আর দেখা গেল না! সে যেন অন্ধকারের মধ্যেই আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেছে!
পড়ে গিয়েই ভয়ের চোটে চোখ বুজে ফেলেছিল সে! কোনও এক অজানা ও ভয়ঙ্কর পরিণামের জন্য দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছিল। কিন্তু নিঃশব্দ কিছু মুহূর্ত চলে যাওয়ার পরে কিছুটা স্বস্তি পেল সুরেশ। সেই ছায়া হয় তাকে অতিক্রম করে অন্যদিকে চলে গিয়েছে, নয়তো তার পিছু করা ছেড়ে দিয়েছে।
সে এবার কোনওমতে উঠে বসে। হাতের তলায় ঠান্ডা পাথরের স্পর্শ। অর্থাৎ ও পাথরের ওপরেই পড়েছিল। মাথায় প্রবল যন্ত্রণা! মাথাটা পাথরে ঠুকে গিয়েছে। সুরেশ হাত দিয়ে কপালে একটা চটচটে তরল অনুভব করল। রক্ত পড়ছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, এখন সে আছে কোথায়?
অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে আসতেই সুরেশ এদিক ওদিক তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল লোকেশনটা। এবং আবিষ্কার করে হতচকিত হল যে তার ঠিক সামনেই ভানগড়ের রাজপ্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। এখানেই রত্নাবতীর মহল দেখতে এসেছিল ওরা। কিন্তু যতদূর সে জানে, রয়্যাল প্যালেসটা গোপীনাথ টেম্পল ছাড়িয়ে গেলে দেখা যায়। অর্থাৎ সে কান্ডজ্ঞানহীনভাবে দৌড়াতে দৌড়াতে ঘুরপথে অনেকটা এগিয়ে এসেছে। এখান থেকে একটু পিছিয়ে গেলেই গোপীনাথ মন্দিরটা পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবে দেবযানী ও সুজনকেও।
সুরেশ আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। তার ব্যাকপ্যাকটা একটু দূরেই পড়েছিল। সে সযত্নে সেটাকে তুলে নিল। এই মুহূর্তে ভয়ে তার বুক রীতিমতো কাঁপছে! অসহায় ছেলেটার কাছে টর্চটাও নেই। সেটা কোথায় গেছে কে জানে! সুরেশ বাঁ দিকের হিপপকেট থেকে বের করে আনল লাইটার। কাঁপা কাঁপা হাতে লাইটারটাকে জ্বালানোর চেষ্টা করছে।প্রথমবার চেপে ধরতেই নীলাভ শিখা দপ্ করে জ্বলে উঠল। কিন্তু সে ক্ষণস্থায়ী! লাইটারের দুর্বল শিখাও কাঁপতে কাঁপতে ঝুপ করে নিভে গেল। ভয়ার্ত মানুষটা বার বার চেষ্টা করল। কিন্তু লাইটার আর জ্বলে না!
ভয়ে সুরেশের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। সে কী করবে, কোথায় যাবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। তার প্রায় কান্না পেয়ে গেল! সুজন আর দেবযানী কি এখনও তাকে খুঁজছে না! এই নিঃসঙ্গ দুর্গে কতক্ষণ অলৌকিক শক্তির সঙ্গে একা যুদ্ধ করবে সে? কার সঙ্গেই বা করবে? প্রতিপক্ষ যেখানে অদৃশ্য, সেখানে তার কী করার আছে? এখন তো এক পাও এগোতে ভয় করছে তার।
হঠাৎই একটা প্রবল গড়গড় শব্দে সচকিত হয়ে উঠল সে! কীসের শব্দ ওটা! কোথা থেকে আসছে? কী প্রচণ্ড আওয়াজ! যেন ভয়ংকর কোনও প্রলয় ছুটে আসছে তারই দিকে। কিন্তু জিনিসটা কী!
শব্দের উৎস খুঁজতে গিয়ে এদিক ওদিক তাকাতেই তার চোখে পড়ল জিনিসটা! একটা বিরাট জমাট অন্ধকার ওপরের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে আসছে নীচের দিকেই! শুধু কি অন্ধকার! না, অন্ধকার নয়; ওটা বিরাট একটা পাথর! দুর্নিবার, অদম্য বেগে ছুটে আসছে তাকে লক্ষ্য করে!
সেই ক্ষণেই তার একটাই নাম মনে পড়ল! তান্ত্রিক সিঙ্ঘিয়া! যে লোকটা
কালো যাদুর মাধ্যমে রাজকন্যা রত্নাবতীর প্রসাধনীকে মন্ত্রপূত করে দিয়েছিল। তার মূল্য সে নিজে দিয়েছিল নিজের প্রাণ দিয়ে! আর সুরেশরাও সেই রত্নাবতীর মূর্তিকেই ভাঙতে এসেছে। আজ আবার সেই পাথর তার প্রতিশোধ নেবে। পাথরের কারবারিদের বিরুদ্ধে স্বয়ং পাথরেরাই রুখে দাঁড়িয়েছে! কেউ বাঁচবে না! সুরেশ, দেবযানী এমনকি সুজনও রক্ষা পাবে না পাথরের প্রতিশোধের হাত থেকে! কেউ বাঁচবে না!
বিশালাকৃতি কালান্তক পাথরটা উল্কার বেগে ছুটে আসছে সুরেশের দিকে। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এসে পড়বে তার ওপরে। সেই অন্তিম মুহূর্তে মনে পড়ে গেল অতুলের কথা। বাক্যটা ভেবেই পাগলের মতো মর্মান্তিকভাবে হেসে উঠল সুরেশ!
—“এ পাথরে প্রাণ আছে!”
৮
গোপীনাথ মন্দিরের মূল গর্ভগৃহটা দেখে চমকে গেল সুজন। কী আশ্চর্য ভাস্কর্য! কী অদ্ভুত সব মূর্তি! দেখেই তার চক্ষুস্থির। অতুল ঠিকই বলেছিল। গর্ভগৃহে পাথরের বেদী রয়েছে। কিন্তু কোনও বিগ্রহ নেই। কিন্তু থাকারই বা দরকার কী! যা রয়েছে তার মূল্য বিদেশের বাজারে কয়েকশো কোটি অবধি হতে পারে। এক একটা যক্ষিণী মূর্তিই দেখার মতো। কী তাদের অবয়ব, কী তাদের ভঙ্গিমা! কে জানত যে এই পরিত্যক্ত, ভগ্ন দূর্গের মধ্যে এমন রাজৈশ্বর্য লুকিয়ে আছে!
জল পড়ার আওয়াজ শুনে তার মনে হয়েছিল, হয়তো ভেতরে কেউ আছে! সেজন্যই সে দেবযানীকে ওখানে রেখেই তড়িঘড়ি ভেতরে চলে গিয়েছিল। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করার পরও কোনও মানুষের অস্তিত্ব টের পায়নি। এমনকী জলের শব্দটাও আচমকা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তা-ই আর তদন্ত না করে সে সরাসরি ঢুকে গিয়েছে প্রধান ও অভ্যন্তরীণ গর্ভগৃহে। ডুপ্লিকেট চাবি তার কাছে আগেই ছিল। তাই দরজা খুলতে কোনও অসুবিধে হয়নি।
এমার্জেন্সি লাইটের আলোয় চতুর্দিকটা দেখতে দেখতে তার দৃষ্টি স্থির হয়ে দাঁড়াল দেওয়ালের ঠিক কেন্দ্রে। সেখানে এক নারীমূর্তির ভাস্কর্য! কিন্তু সে ভাস্কর্যের সৌন্দর্য বর্ণনা করা অসম্ভব! হলুদ পাথরের ওপর ভাস্কর নারীমূর্তি খোদাই করেননি, বরং পৃথিবীর যাবতীয় সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছেন! নারীটি শৃঙ্গাররতা। পদ্মের মতো দুটি হাত একঢাল চুলে ফুল গুঁজতে ব্যস্ত! দেহবল্লরী যেন চরম লাস্যের মূর্ত প্রকাশ! যদিও মুখটা ঠিক স্পষ্ট নয়! বদ্ধ ঘরে থাকার দরুন ধুলোও জমেছে। তবু তার অভ্যস্ত চোখ দেখামাত্রই বলে দিল, এ মূর্তি ওদের সবাইকে আরবপতি করার ক্ষমতা রাখে! কোনও সন্দেহই নেই যে এটাই রাজকন্যা রত্নাবতীর মূর্তি!
মনে মনে মি. ও’কোনরের রুচির প্রশংসা না করে পারল না সুজন। সে আর একমুহূর্তও দেরি করতে চায় না। রত্নাবতীর মূর্তিটাকে যতক্ষণ না কেটে বের করছে, ততক্ষণ শান্তি নেই। সে এমার্জেন্সিটা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল বাইরে। দেবযানী আর সুরেশের সহায়তা ছাড়া এ মূর্তি ভাঙা যাবে না এতক্ষণে নিশ্চয়ই সুরেশও এসে হাজির হয়েছে। এরকম প্রাচীন মূর্তি অবিকৃতভাবে কাটা অসম্ভব যদি না ওদের দু’জনের প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ হাত না থাকে।
কিন্তু ত্রস্তব্যস্ত পায়ে মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে গেল সুজন। দেবযানী সেখানে নেই! এমনকী সুরেশও এসে উপস্থিত হয়নি! শূন্য মন্দিরপ্রাঙ্গণ যেন তার বোকাটে মুখটা দেখে নিঃশব্দ হাসি হাসল! সুজন মনে মনে একটু বিরক্ত হয়। সুরেশ তো চিরকালীন ভ্যাগাবন্ড। কিন্তু দেবযানী গেল কোথায়! পাঁচ মিনিটও হয়নি তাকে রেখে সে মন্দিরে ঢুকেছে। শেষ যতটুকু মনে পড়ছে, দেবযানী মন্দিরের সিঁড়ির নীচেই দাঁড়িয়েছিল। ভেতরে ঢুকতে ভয় পাচ্ছিল। কিন্তু এখন সে গেল কোথায়! সুজন পাঁচমিনিটের জন্য একটু চোখের আড়াল হওয়া মাত্রই কি সে একা একা অ্যাডভেঞ্চারে বেড়িয়েছে নাকি! এ বেলায় আর ভয় লাগল না!
এক অসহনীয় রাগে মস্তিষ্কের প্রতিটি কোণা উত্তপ্ত হয়ে উঠল সুজনের। এরা পেয়েছেটা কী! শুরু থেকেই দেখছে এই ভানগড়ের অ্যাসাইনমেন্টটা নিয়ে দেবযানী ও সুরেশ; দু’জনেরই সমান অ্যালার্জি! ভানগড়ে এসে ওই ইডিয়ট অতুল আর স্টুপিড দীননাথের উল্টোপাল্টা গল্প শুনে দু’জনেরই মাথা গেছে! একজন দিনদুপুরে ভুলভাল দেখছে, অন্যজন কথায় কথায় ভয় পাচ্ছে। এদের দিয়ে কাজ হয়? ড্যাম ইট!
সে মন্দিরের ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে ডাকল, “দেবযানী, অনেক হয়েছে। এখানে আয় বলছি।”
কথাগুলো যথারীতি মন্দিরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে গেল। কিন্তু কোনও উত্তর এল না।
তার চোয়াল শক্ত হল। নির্ঘাৎ সুরেশ আবার ফিরে এসে দেবযানীকে নিয়ে গোটা ফোর্ট ‘এক্সপ্লোর’ করতে গিয়েছে! এর আগেও অন্য একটি দূর্গে অবিকল এমনই ঘটেছিল। এসব দূর্গে মোবাইল কাজ করে না কারণ টাওয়ার নেই। যোগাযোগ করার উপায়ও নেই। ওরা কিছুতেই বুঝবে না যে প্রত্যেকটা মুহূর্ত সুজনের কাছে মূল্যবান। এটা ওদের পেশা, রুজি-রুটি; ফাজলামি নয়!
কিন্তু পরক্ষণেই দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল সুজনের মুখে। ওরা কি সত্যিই কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে? কোনওরকম বিপদ হয়নি তো? দূর্গের অলৌকিক, বা ভৌতিক ইতিহাসে বিন্দুমাত্রও বিশ্বাস নেই তার। তবে বন্যপ্রাণীকে ভয় আছে। তেমন কিছু অঘটন…!
ভাবতে ভাবতেই মাথা নাড়ল সে। নাঃ, তেমন কিছু হলে দেবযানীর ভয়ার্ত চিৎকার নিশ্চয়ই কানে আসত তার। কিংবা সুরেশের গলা পেত। অথচ তেমন কোনও শব্দই পায়নি! তার মানে দুটোই সম্ভাবনা রয়েছে। হয় সুরেশ এসে দেবযানীকে নিয়ে ‘এক্সপ্লোর’ করতে গিয়েছে, নয়তো দুটো ভীতুর ডিমই ষড়যন্ত্র করে তাকে একলা রেখে পালিয়েছে। সুজন হতাশাজনকভাবে মাথা ঝাঁকায়। এর অর্থ, আজ রাতে তাকে একাই কাজ করতে হবে! সুরেশ আর দেবযানী ফিরে এলে ভালো, নয়তো কাল সকালে ওদের দেখে নেবে!
সে বিড়বিড় করে বলল, “ওয়ার্থলেস পাবলিক!” তারপর ফের ধীর পায়ে হাঁটা দিল মূল গর্ভগৃহের দিকে। তার হাতের এমার্জেন্সির আলো একঝলক পিছলে পড়েছিল মন্দিরের প্রধান স্তম্ভের গায়ে। সেদিকে তাকিয়েই একটু যেন বিস্মিত হল সুজন। আরে! এই নৃত্যরতা যক্ষিণীমূর্তিটা ভাঙা ছিল না? যতদূর মনে পড়ছে, কালকেই এই মূর্তিটা ভালো করে দেখেছিল ওরা। তখন সুন্দরীর মাথা আর দুটি হাত ভাঙা ছিল। অথচ এখন একদম অক্ষত, নতুন ভাস্কর্যের মতো চকচক করছে। যেন রাতারাতিই কেউ মেরামত করে দিয়েছে। এত তাড়াতাড়ি কীকরে মেরামত হয়ে গেল মূর্তিটা! কে-ই বা করল!
সুজন একটু সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। যক্ষিণীমূর্তিটা কি আদৌ এরকম ছিল? কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে না? মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, মুখের সুডৌল গড়নটাও যেন বড় পরিচিত। এরকম মূর্তি আগে কোথাও দেখেছে কি?
—“সু-জ-ন!”
পাথরের ভেতর থেকে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠের বুকফাটা হাহাকার! ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে গিয়ে সুজন লাফিয়ে দু’কদম পিছিয়ে গেল। কী হচ্ছে! এসব কী হচ্ছে! আওয়াজটা কোথা থেকে এল! এই স্তম্ভের ভেতর থেকে কি! ইম্পসিবল! অসম্ভব!
সুজনের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে! এইমাত্র যা শুনল তা কি সত্যি? না কোনও দুঃস্বপ্ন দেখছে! এক অদ্ভুত সন্দেহ তার মনের মধ্যে ঘনিয়ে এল! অব্যক্ত এক আশঙ্কায় সে এমার্জেন্সি লাইটটার আলো ফেলেছে নৃত্যরতা যক্ষিণীর দিকে। আর যক্ষিণীর মুখ স্পষ্ট হতেই যেন কয়েকহাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক ছ্যাঁকা খেল সুজন! এ তো অবিকল দেবযানীর মূর্তি! নিঃসন্দেহে সে-ই! সেই টপনট, সেই মুখের আদল, এমনকি চিবুকের কাটা দাগটাও হুবহু এক! দেবযানী!
—“সুজন!”
পাথরের ভেতর থেকে ভেসে এল দেবযানীর কান্না, “আমায় এখান থেকে বের কর! আমার ভয় করছে!”
—“দেবযানী!” সুজন ব্যাকুলভাবে যক্ষিণীমূর্তির ওপর হাত রাখল;
–“কোথায় তুই! অ্যাঁ?”
—“আমি জানি না।” কান্নাবিকৃত কণ্ঠে জবাব এল, “এখানে ভীষণ অন্ধকার!”
সুজন কী করবে বুঝে পায় না! দেবযানী কোথায় আছে, মূর্তিটা তার মতো দেখতে কী করে হল, কিংবা স্তম্ভের মধ্য থেকে তার কণ্ঠস্বর কীভাবে ভেসে আসছে তা সমস্ত যুক্তি ও বুদ্ধির বাইরে। কিন্তু জীবনে এই প্রথম সে ‘আতঙ্ক’ কাকে বলে তা টের পেল! সুজনের কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘামের বিন্দু দেখা দিয়েছে। সে বিহ্বল, বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে সেই যক্ষিণীমূর্তির দিকে।
— “আমি আগেই বলেছিলাম স্যার, এ মন্দিরগুলো জীবিত! বলেছিলাম, এ পাথরে প্রাণ আছে। আপনারা শোনেননি।”
সারা মন্দির কাঁপিয়ে ভেসে এল শব্দগুলো। কিন্তু কণ্ঠস্বরটা চিনতে ভুল হল না সুজনের। অতুল!
সে অসহ্য রাগে, ভীষণ অসহায়তায় হিসহিস করে বলল, “তাহলে এসব তোমার ষড়যন্ত্র! কোথায় রেখেছ দেবযানীকে?”
কণ্ঠস্বর হেসে উঠল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “দেবযানীকে যেখানে দেখছেন, ও সেখানেই আছে। এবং চিরদিন সেখানেই থাকবে।”
—“বাজে কথা,” সুজন গর্জন করে ওঠে, “এসব লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোয়ের কারিকুরি। নির্ঘাৎ কোনও সাউন্ডবক্স বসানো আছে আশপাশেই। সব তোমার চক্রান্ত!”
অতুল আবার সজোরে হেসে ওঠে, “এই ভাঙা দূর্গে কষ্ট করে কে আর লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শো করবে স্যার! আর দিনের বেলা আপনি গোটা দূৰ্গ, গোটা মন্দির দেখেছেন। কোথাও এমনকিছু আপনার চোখে পড়েছে কি? “ সুজন এবার আলো ফেলে গোটা মন্দিরটা দেখে নেয়। কোথা থেকে আসছে এই কণ্ঠস্বর! অতুল কোথা থেকে কথা বলছে? দেবযানীর কান্না এখন আর শোনা যাচ্ছে না। কিন্তু এবার অবাক হয়ে আবিষ্কার করল সে, অতুলের কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে মন্দিরের পাথুরে দেওয়াল থেকে!
—“আপনি আমাকে বোধহয় চিনতে পারেননি!” অতুল গম্ভীরভাবে বলল, “কিন্তু মি. ও’কোনর আমাদের দু’জনের আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। মনে আছে?”
মস্তিষ্কের ভেতরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল সুজনের। এবার পরিষ্কার মনে পড়ল মুহূর্তটা! হ্যাঁ, তা-ই তো! অতুল মি. ও’কোনরের অফিসেই বসেছিল। জেমস্ ওদের দু’জনের আলাপও করিয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “ও হচ্ছে অতুল মেহতা। এখনও পর্যন্ত ওর আনা মূর্তিই নিলামে হায়েস্ট রেট এনেছে। ওর স্টাইলই হচ্ছে বিপজ্জনক জায়গা থেকে মূর্তি তোলা! মেইনলি হন্টেড হাউস অ্যান্ড দ্য ফোর্টস! এমনকী ও পুতুলবাড়ি থেকেও একটা স্কাল্পচার নিয়ে এসেছে! ক্যান ইউ বিলিভ ইট?”
মনে পড়ছে। একদম স্পষ্ট মনে পড়ছে! কিন্তু তখন অতুল যেন একটু অন্যরকম দেখতে ছিল। হ্যাঁ, ওর চোখদুটো। ওর চোখদুটো এমন ভয়াবহ ছিল না! বরং স্বাভাবিক গাঢ় বাদামি রঙের চোখ ছিল। কিন্তু এখন তো পিঙ্গল! অবিকল এই মন্দিরের পাথরের মতো।
—“আমি আপনাকে সাবধান করেছিলাম স্যার!”
দেওয়াল থেকে ভেসে এল কথাগুলো, “বারবার সতর্ক করেছিলাম! আপনারা শুনলেন না!”
—“তার মানে তোমাকেও ভানগড়ের অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছিলেন মি. ও’কোনর!” বিস্মিতভাবে প্রশ্ন করল সুজন, “তুমিও একজন ভ্যান্ডাল!”
— “হ্যাঁ,” কণ্ঠস্বর উত্তর দিল, “যেদিন আপনি অ্যাসাইনমেন্টটা পেয়েছিলেন, তার পনেরোদিন আগে আমিও…”
–“ও!” তার কথা শেষ হওয়ার আগেই উত্তেজিতভাবে বলে উঠল সে, “তার মানে তুমি আমাদের এভাবে ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করতে চাও! মি. ও’কোনরের অফারের চেয়েও বড় টাকার অফার পেয়েছ, তা-ই না?”
দেওয়াল বেয়ে একটা জোরালো দীর্ঘশ্বাসের শব্দ এল। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। তারপর শোনা গেল একটাই শব্দ, ‘না!’
—“ড্যাম লায়ার!” উন্মত্তের মতো চেঁচিয়ে উঠল সুজন, “তুমি কীভাবে এসব ট্রিক করছ জানি না! কিন্তু এভাবে আমায় ভয় দেখান যাবে না! রত্নাবতীর মূর্তি আমিই এখান থেকে নিয়ে যাব! যেভাবেই হোক, নিয়েই ছাড়ব! কেউ আমাকে আটকাতে পারবে না। তুমিও না!”
কণ্ঠস্বর নিরুত্তর! দেওয়াল থেকে আর কোনও প্রত্যুত্তর ভেসে এল না। সুজন আর উত্তরের অপেক্ষাও করল না। তার মাথায় যেন রক্ত চড়ে গিয়েছে। চুলোয় যাক দেবযানী, গোল্লায় যাক সুরেশ। সে কারোর পরোয়া করে না! একজন মূর্তিচোর বা ভ্যান্ডালের কোনও আত্মীয় নেই। কোনও বন্ধু নেই! তার বন্ধুত্ব একমাত্র টাকার সঙ্গে! তার একমাত্র আত্মীয় মোটা অঙ্কের চেক। আর কেউ নয়!
সে নিজের ব্যাকপ্যাক নিয়ে দৌড়ে গেল মূল গর্ভগৃহে। এমার্জেন্সি লাইটটাকে মেঝেতে রেখে দ্রুত হাতে বের করতে শুরু করল ভ্যান্ডালস টুলস! সচরাচর কোনও মূর্তি কাটার আগে সযত্নে সেটাকে ব্রাশ দিয়ে মুছে নিতে হয়। তারপর মেজারিং টেপ দিয়ে দৈর্ঘ্য প্রস্থ মেপে নিয়ে মার্কার দিয়ে আউটলাইন এঁকে নেওয়া জরুরি। কিন্তু এতদিনের সমস্ত শিক্ষা, সমস্ত পদ্ধতি ভুলে গেল সুজন। কথা নেই বার্তা নেই, পাগলের মতো ছেনি বসিয়েই
হাতুড়ির এক জোরালো ঘা মেরে দিল।
মন্দিরের দেওয়াল থেকে একটুকরো পাথর ভেঙে ছিটকে পড়ল তার সেই ভীষণ আঘাতে! সুজন টের পেল, তার হাত কাঁপছে। তবু সে নিজের জেদে অনড়। পাগলের মতো হাতুড়ির বাড়ি মেরেই যাচ্ছে। ঘা এর পর ঘা! যেন পণ করেছে, যতক্ষণ না মূর্তিটা খুলে বেরিয়ে আসছে, ততক্ষণ হাল ছাড়বে না! আঘাতে আঘাতে মূর্তিটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে! চটলা উঠে যাচ্ছে। তবু থামছে না সুজন! আজ হয় এই মূর্তি ধ্বংস হবে, নয়তো এটাকে সঙ্গে নিয়েই ফিরবে সে। এস্পার কী ওস্পার!
হঠাৎ যেন এমার্জেন্সিটা অলৌকিকভাবে একটু সরে গেল! অথবা তার সোজা আলো কীভাবে যেন বক্ররেখায় গিয়ে পড়ল রাজকন্যা রত্নাবতীর মূর্তির মুখে! জোরালো আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল ভাস্কর্যের মুখ! সেদিকে চোখ পড়া মাত্রই ভয়ে আর্তনাদ করে ওঠে সুজন। তার হাত থেকে নিমেষে পড়ে যায় ছেনি ও হাতুড়ি!
এই সুন্দরীর দেহে এ কার মুখ! এই মুখ পরমাসুন্দরী রাজকন্যা রত্নাবতীর হতেই পারে না! আদতে এ কোনও নারীর মুখই নয়! এ এক পুরুষের মুখ! কোটরাগত চোখে পিঙ্গল আভা, চোয়াড়ে মুখ! নাকটা যেন আধখানা বসে গিয়েছে! এই মুখের মালিক তার পরিচিত! এই মূর্তির মুখ হুবহু অতুলের মতো!
ঠিক তখনই দপ্ করে নিভে গেল এমার্জেন্সিটা! অন্ধকার গর্ভগৃহ কাঁপিয়ে খলখলিয়ে হেসে উঠল এক নারী! তার হাসির দমকে লাস্য আছে। তার চেয়েও বেশি আছে নিষ্ঠুরতা!
এ সেই হাসি যা এক অন্ধকার রাত্রে ইথান ওলসেন শুনেছিলেন! নিষ্ঠুর, বড় নিষ্ঠুর!
৯
ভানগড় ফোর্টের মূল প্রবেশপথে দাঁড়িয়েছিল দুই যুবক। সূর্যের প্রখর রশ্মিতে ভানগড় ফোর্টের ধ্বংসস্তূপ দেখে বেড়াচ্ছে কৌতূহলী পর্যটকেরা। যুবকদুটি একটু সন্তর্পণে মেপে নেয় চারদিক। সতর্কতা তাদের চোখের চাউনিতেই স্পষ্ট। ইতিউতি তাকিয়ে কিছু যেন খুঁজছে! সম্ভবত গাইডের সন্ধানে আছে।
একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল একটি একলা মানুষ। তার দৃষ্টিও যুবকদুটির ওপরেই নিবদ্ধ। একটু ইতস্তত করে অবশেষে সে এগিয়ে গেল ওদের দিকে। ইংরেজিতে জানতে চাইল, “আপনারা কি গাইড খুঁজছেন?”
যুবকেরা তাকে একটু বিস্মিতদৃষ্টিতে দেখল। মানুষটাকে কী অদ্ভুত দেখতে! আপাতদৃষ্টিতে অবশ্য কোনও অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু ওর চোখদুটো অদ্ভুত! পিঙ্গল কটা চোখ, নিষ্পলক দৃষ্টি! মানুষটি হাসছে ঠিকই, কিন্তু তার চোখে সে হাসির আভাসমাত্রও নেই। যেন ওর চোখদুটো পাথরের তৈরি!
একজন যুবক একটু আমতা আমতা করে বলল, “হ্যাঁ। গাইডই খুঁজছি। আপনি?”
মানুষটি আবার রহস্যময় হাসল। মাছের মতো অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমি সুজন। আপনাদের গাইড।”
আমি জানি যা হয়েছিল
আমি জানি যা হয়েছিল
১
বাইরে প্রবল শব্দে বাজ পড়ল। কোনওরকম অশনি সংকেত ছাড়াই হঠাৎ করে যেন গর্জন করে উঠল গোটা আকাশ। পরক্ষণেই চোখ ঝলসে দিয়ে নীলাভ আগুনের গোলা সশব্দে আছড়ে পড়ল মাটিতে।
জানলার কাচ প্রবল আওয়াজের ধাক্কায় মুহূর্তের জন্য থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে। সেই কম্পন বুঝি আস্তে আস্তে এবার ছড়িয়ে পড়ছে দেওয়ালে দেওয়ালে। মসৃণ ক্রিম রঙের দেওয়ালের তলায় যেন ইটগুলোও কাঁপছে। শুক্লার মনে হল, শুধু বাজের আওয়াজ নয়, দেওয়ালে দেওয়ালে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আরও কিছু অস্ফুট শব্দ, যা সঠিকভাবে শ্রুতিগোচর হয় না! অদ্ভুত কিছু ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে তার চতুর্দিকে। তিনি শুনতে পাচ্ছেন, কিন্তু বুঝতে পারছেন না।
.
শুক্লা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকালেন তার স্বামী প্রণবের দিকে। প্রণবকে এই অনুভূতির কথা আগেও অনেকবার জানিয়েছেন। বহুবার মনে হয়েছে, হঠাৎ করে ছুঁয়ে যাওয়া একপশলা হিমেল ঝোড়ো হাওয়া বুঝি ফিসফিস করে কিছু বলে গেল। অথবা ভোররাতের শিশির টুপটাপ করে বলে যায় কোনও এক রহস্যময় কাহিনী। জোনাকির সবুজাভ আলো অদ্ভুত ইঙ্গিতে বলতে চায় কিছু অপ্রকাশিত ইতিহাস যার খোঁজ মেলেনি আজও। কিন্তু সব কিছুই যেন রহস্যের কুয়াশায় মোড়া। ধরা দিয়েও অধরাই থেকে যায়। বড় অস্পষ্ট সে ইঙ্গিত। শুক্লা বুঝে উঠতে পারেন না, কিন্তু অনুভব করতে পারেন সে অলৌকিক উপস্থিতিকে। মনে হয় একজোড়া অদৃশ্য চোখ সবসময়ই নজর রাখছে তার ওপরে! কোনও ছায়া তাকে প্রতি মুহূর্তে নীরবে অনুসরণ করছে!
কিন্তু প্রণবকে বারংবার বলা সত্ত্বেও কোনও লাভ হয়নি। তিনি কিছুতেই কোনওরকম অতিলৌকিকে বিশ্বাস করবেন না, উলটে বলবেন, “সবটাই তোমার মনের ভুল। তুমি ঐ ওষুধগুলো একটু বেশিই খাচ্ছ। বেশিদিন ধরে অ্যান্টিডিপ্রেশান্ট ট্যাবলেট খেলে লোকে এমন উদ্ভট জিনিসই দেখে আর শোনে। আর গত তিনমাসে তো মুড়ি-মুড়কির মতো ওষুধ খেয়ে চলেছ। এসব তারই সাইড এফেক্ট। কতবার বলেছি, এত ওষুধ খেও না। কিন্তু তুমি কিছুতেই শুনবে না!”
বাইরে ততক্ষণে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রেক্ষাপট এখন ঝাপসা। এক লহমায় প্রকৃতি মুছে ফেলেছে সমস্ত রং, সমস্ত সৌন্দর্য। সুবিশাল কালো এক পর্দায় ঢাকা পড়ে গিয়েছে বিশ্বচরাচর! কোথাও কিছু নেই। যেন কোনওদিনই ছিল না! শুধু বাইরের বিশালদেহী বটগাছটার সঙ্গে আচমকা ধেয়ে আসা প্রভঞ্জনের অসম লড়াইয়ের আভাসটুকু পাওয়া যায় মাত্ৰ।
ওই ঝড়ের হাওয়ার দাপটে বিধ্বস্ত গাছটার মতো শুক্লারও মনের মধ্যে কিছু আশঙ্কা আছাড়ি-পিছাড়ি খাচ্ছে। মাঝেমধ্যেই অশুভ চিন্তায় মনের ভেতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে তার। চার মাস দশ দিন! আজ থেকে ঠিক চার মাস দশ দিন আগে ছেলেটা নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল! সেই যে চলে গেল, আর ফিরল না! এমনভাবে অদৃশ্য হয়ে গেল যেন তার অস্তিত্ব ছিলই না কখনও! কতদিন তার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠস্বর শোনেননি তারা! কতদিন সে নাকি স্বরে নতুন কোনও বায়না করেনি। যে দুষ্টুমিভরা খিলখিলে হাসির জলতরঙ্গ বাড়ির প্রতিটা কোণে অনুরণিত হয়ে ফিরত, আজ সে নীরব!
ভাবতে ভাবতেই শুক্লার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ল। বাড়িটা চার মাস দশ দিন ধরে বড় নীরব হয়ে পড়ে আছে। কেমন যেন বোবা বিমূঢ় মানুষের মত নিরুত্তাপ নৈঃশব্দ গ্রাস করে নিয়েছে তাকে। এত শূন্যতা কেন? কোথায় হারিয়ে গেল পাহাড়ি ঝর্ণার মতো অনাবিল উচ্ছ্বাস! সে কি আর ফিরবে না?
অমঙ্গল আশঙ্কাটা মনে হতেই কোনওমতে নিজেকে সামলে নেন শুক্লা। নাঃ, সন্তানের বিষয়ে অশুভ চিন্তা করতে নেই। কোনওমতে চোখের জল সামলে দেওয়ালের দিকে তাকান তিনি। সেখানে ঘরের আলোয় উদ্ভাসিত এক বালকের ছবি। ঝলমলে কমলা রঙের টি-শার্ট পরে বারো বছরের সৃজন বন্দ্যোপাধ্যায় দুষ্টু হাসি হাসছে। শুক্লা ও প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়ের একমাত্র সন্তান। শুক্লা পেশায় শিক্ষিকা এবং প্রণব নামজাদা আইনজ্ঞ। প্রণব আজ পর্যন্ত একটি কেসেও হারেননি। তার দৌলতে শাস্তি পেয়েছে অনেকেই। তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রণবের শত্রুর শেষ নেই। সৃজন বাবার বড় আদরের ছেলে! তল্লাটের সবাই জানে, সৃজন প্রণবের প্রাণ!
তাই যখন সে নিখোঁজ হয়ে গেল, তখন বহুবার পুলিশ জিজ্ঞাসা করেছে প্রণবকে, “আপনার বিশেষ কোনও শত্রু আছে যে সৃজনকে কিডন্যাপ করতে পারে?”
প্রণব আর্দ্র, অসহায় চোখে তাকিয়েছিলেন। একজন উকিলের কি আদৌ একজন বিশেষ শত্রু থাকে! তার পেশাটাই যে শত্রু তৈরির কারখানা ভারপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার হয়তো তার নীরবতার মধ্যেই উত্তরটা খুঁজে নিয়েছিলেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলেন, “আচ্ছা, সেদিন ঠিক কী হয়েছিল বলতে পারেন?”
প্রণবের উত্তর দেওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। শুক্লা বিমূঢ়ের মতো জানতে চেয়েছিলেন, “মানে?
—“মানে…” প্রশ্নটাকে আরও একটু সরল করে দিয়েছেন অফিসার,
–“ছেলেমানুষ তো! পড়াশোনা বা মার্কস নিয়ে আপনাদের মধ্যে কোনওরকম মনোমালিন্য হয়েছিল? আই মিন, কোনও কারণে বকাঝকা খেয়েছিল কি? কিংবা রাগ করার কোনও কারণ? ইউ নো, টিন এজারস! এই বয়েসটা খুব অভিমানী। এমনও হতে পারে যে হয়তো আপনাদের ওপর রাগ করে নিজেই কোথাও চলে গিয়েছে।”
—“ইম্পসিবল অফিসার!” প্রণব মাথা নেড়ে কোনওমতে বলেন, “বাবি রাগ করে বড়জোর চেঁচাতে পারে, কান্নাকাটি করতে পারে, এমনকি না খেয়েও থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের ছেড়ে যাওয়ার কথা কিছুতেই ভাববে না।”
অফিসার তখনও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। প্রণব একটু থেমে ফের যোগ করলেন, “ও সারাজীবনে কখনও আমাদের ছাড়া কোথাও থাকেনি। আমার ফিরতে একটু লেট হলেই সে টেনশনে পায়চারি করতে শুরু করে দেয়। যতক্ষণ না আমি ফিরছি, সে খাবে না, শোবেও না। কোনও কেসের কারণে শহরের বাইরে গেলে কেঁদে-কেটে অস্থির হয়। আর মায়ের গায়ে লেপ্টে না থাকলে তার শান্তি হয় না। মায়ের হাতের রান্না ছাড়া সে খেতে পারে না, ও গায়ে হাত বুলিয়ে না দিলে ছেলের ঘুম হয় না। এরপরও আপনার মনে হয় যে বাবি সামান্য রাগ বা জেদ করে বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে?”
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার মৃদু সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকালেন। যে ছেলে মা বাবার প্রাণ, যে একমুহূর্তও নিজের পরিবারকে ছেড়ে থাকতে পারে না, তার চরিত্রে আচমকা রাগ করে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার থিওরি ঠিক বসে না। তদন্ত করে যতটুকু জেনেছেন, তাতে সৃজনকে বাপ-মায়ের অত্যন্ত আদুরে ছেলে বলেই মনে হয়েছে। দুনিয়ায় বোধহয় এমন কিছু নেই যা প্রণব বা শুক্লা সৃজনকে দিতে পারেন না। তবু রুটিনমাফিক জানতে চেয়েছিলেন, “পড়াশোনা বিষয়ক কোনওরকম স্ট্রেস?”
স্বামী-স্ত্রী দুজনেই একসঙ্গে বলে ওঠেন, “না!”
সত্যিই পড়াশোনা নিয়ে কখনও সৃজনকে কোনও কড়া কথা বলেননি ওরা। বলতে হয়নি। সে একটু ছটফটে হলেও অত্যন্ত মেধাবী। আর রেজাল্ট কিংবা মার্কস নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ি করা প্রণবের স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি নিজে পড়াশোনায় সাঙ্ঘাতিক কিছু ভালো ছিলেন না। অথচ ফার্স্ট বেঞ্চারদের তুলনায় অনেক বেশি প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। শুক্লাও শিক্ষিকা হওয়ার দরুন জানেন ও বিশ্বাস করেন, পরীক্ষার নম্বরই মানুষের একমাত্র পরিচয় নয়। তাছাড়া সৃজন ফার্স্ট বয় না হলেও তার রেজাল্ট চিরকালই ভালো। তাই তার মার্কস বা পার্সেন্টেজ নিয়ে দু-জনের কারোরই তেমন মাথাব্যথা ছিল না। অফিসার তাদের উত্তর শুনে একটু চুপ করে থাকেন। তারপর আবার সেই একই প্রশ্ন করেন, “সেদিন এগজ্যাক্টলি কী হয়েছিল তা জানেন?”
কী হয়েছিল! কী হয়েছিল!… সেদিন ঠিক কী হয়েছিল?…
বারবার এই প্রশ্নটাই উদ্ধত জিজ্ঞাসাচিহ্ন নিয়ে শুক্লার মস্তিষ্কে গেঁথে যায়। সেদিন কী হয়েছিল? কিছুই তো হয়নি! না কোনওরকম মনোমালিন্য, না কোনওরকম রাগারাগি! আর পাঁচটা দিনের মতই স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়েছিল রোদ ঝলমলে দিনটা। সকাল সকাল প্রণব কোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। কোভিড নাইন্টিনের তান্ডবে কোর্ট বহুদিন বন্ধ থাকার পরে সেদিন খুলেছিল। প্রণবের বেশ কিছু কেস পেন্ডিং থাকার দরুন তাকে সেদিন কোর্টে যেতেই হয়েছিল। সকাল থেকে শুক্লা ব্যস্ত ছিলেন অনলাইন ক্লাস নিয়ে। সৃজনও নিজের ঘরে বসে নির্বিঘ্নে অনলাইন ক্লাসই করছিল।
দুপুরবেলা মা-ছেলে একসঙ্গে বসে লাঞ্চও করেছে। মা আর ছেলে একসঙ্গে খেতে বসা মানেই দু-জনের সারাদিনের গল্পে ভরে থাকবে পারিবারিক মুহূর্তগুলো। বিশেষ করে সৃজনের অনলাইন ক্লাসের গল্প। তার কোন স্যার ক্লাস শুরু হওয়ার মিনিট পাঁচেক আগে অসতর্কভাবে স্যান্ডো-গেঞ্জি পরে বসে হাতপাখায় হাওয়া খাচ্ছিলেন, কিংবা কোন ম্যাডাম পড়াতে পড়াতেই আচমকা চিৎকার করে উঠে কাউকে বলেছেন, “কতবার বলব চিঁড়েভাজার কৌটোটা টেবিলের ওপরে আছে!” এসব মজাদার গল্পই মূল বিষয়বস্তু। শুক্লা শোনেন ও হাসতে হাসতে বিষম খান। সমগ্র শিক্ষকপ্রজাতি এখনও অনলাইন ক্লাসে এক্সপার্ট হয়ে উঠতে পারেনি। আর এই ছোটোখাটো প্রমাদগুলো তারই প্রতিফল। এর মধ্যে বিশুদ্ধ মজা ছাড়া আর কিছুই নেই। তাই সৃজন যখন অভিনয় করে দেখাচ্ছিল, যে স্যান্ডো-গেঞ্জি পরা স্যার যে মুহূর্তে আবিষ্কার করলেন যে তাঁকে গোটা ক্লাস দেখছে তৎক্ষণাৎ তাঁর মুখভঙ্গি ঠিক কেমন হয়েছিল; তখন হাসতে হাসতে শুক্লার চোখে জল চলে এসেছিল। তখন কে জানত, শেষপর্যন্ত কী হতে চলেছে! কে জানত হাসির ছলে চলে আসা অশ্রুই ভবিতব্য হয়ে দাঁড়াবে!
সারা সকাল অনলাইন ক্লাস নিয়ে ক্লান্ত শুক্লা রোজই দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেন। আর সৃজন সেই ফাঁকে ঠিক ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে অতনুদের বাড়িতে খেলতে যায়। না, ক্রিকেট বা ফুটবলের মতো আউটডোর গেম নয়। কোভিডের জন্য বাচ্চারা আর বাইরে খেলাধুলো করে না। অতনুর বাবা বিরাট বিজনেসম্যান। তিনি নিজের বাড়ির মধ্যেই আস্ত ভিডিয়ো গেম-পার্লার বসিয়ে দিয়েছেন! আছে টেবল টেনিস বা দাবা খেলার ব্যবস্থাও। রোজ দুপুরে খাওয়ার পরে সৃজন সেখানেই বন্ধুদের সঙ্গে খেলা করে। সে টেবল টেনিস চ্যাম্পিয়ন। ভিডিয়ো গেমেও ওস্তাদ। শুক্লাও বারণ করেন না। করোনা ভাইরাসের জ্বালায় বাচ্চাগুলোর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। এখনও পর্যন্ত এ চত্ত্বরে ভাইরাস সংক্রমণ হয়নি। আর খেলাধুলোর সবটাই তো বাড়ির ভেতরে। অতনুর বাবাও অত্যন্ত খুঁতখুঁতে মানুষ। গোটা বাড়িটাকেই ঘন্টায় ঘন্টায় স্যানিটাইজ করেন। তাই আপত্তির বিশেষ জায়গা নেই।
সেদিনও অতনুদের বাড়িতে খেলতে গিয়েছিল সৃজন। আর ফিরে আসেনি! সে-কথা মনে পড়তেই অসম্ভব আত্মগ্লানিতে ভোগেন শুক্লা। সারাদিনের ক্লান্তিতে এমন কালঘুমে পেয়েছিল তাকে যে অন্ধকার নেমে আসার আগে জানতেও পারেননি যে সৃজন বাড়িতে ফেরেনি! এতটাই প্রগাঢ় ঘুমে তলিয়েছিলেন যে বাড়ির সর্বক্ষণের কাজের লোক ভোলা একরকম হাঁকডাক করেই তার ঘুম ভাঙিয়েছিল। তিনি চোখ মেলে তাকাতেই ভোলা উদ্বিগ্নকণ্ঠে জানায়, “মা, ছোড়দা যে এখনও ফিরল না!”
নিদ্রাজড়িত চোখে ঘড়ির দিকে তাকিয়েই প্রায় লাফিয়ে উঠেছিলেন তিনি! সে কী! সাতটা বেজে গিয়েছে! এতক্ষণ ঘুমিয়েছেন! আর ভোলাই বা কী বলছে! বাবি এখনও অতনুদের বাড়ি থেকে ফেরেনি! কেন! এতক্ষণে তো তার ফিরে আসার কথা। আর যদি না ফেরে, তার মানে এখনও হয়তো সে খেলাতেই ব্যস্ত। তবে ভোলার কন্ঠস্বরে এমন চাপা উদ্বেগই বা কেন!
শুক্লা একটু বিহ্বলভাবে জানান, “এখনও খেলছে হয়তো। অতনুদের বাড়িতে যা। ওকে ডেকে আন।”
ভোলা ভয়ার্ত স্বরে বলল, “আমি গিয়েছিলাম মা। কিন্তু অতনুদাদাবাবুদের বাড়িতে ছোড়দা নেই!”
—“মানে!”
প্রায় বজ্রাহতের মতো বললেন শুক্লা। অতনুদের বাড়িতে সৃজন নেই! তবে সে গেল কোথায়? বাড়িতেও তো ফেরেনি! পরের কয়েকঘন্টায় তন্ন তন্ন করে সৃজনকে চতুর্দিকে খুঁজলেন শুক্লা ও ভোলা। যেখানে যেখানে তার থাকার সম্ভাবনা আছে, সেই প্রত্যেকটি বাড়িতেই খোঁজ করলেন। কিন্তু নাঃ, সৃজন কোথাও নেই! কোত্থাও নেই! কোনও বন্ধুর বাড়িতে সে যায়নি। কোনও আত্মীয়ের বাড়িতেও নয়।
ভয়ার্ত শুক্লা ফোন করলেন প্রণবকে। তিনি তখন বাড়ির দিকেই রওনা হয়েছেন। শুক্লার কথা শুনে উত্তেজিত হয়ে বললেন, “বাবিকে পাওয়া যাচ্ছে না মানে! তোমরা এখনও চুপচাপ বসে আছ! আমি এখনই পুলিশকে ফোন করছি।”
এরপর পুলিশ রীতিমত চিরুনি তল্লাশি শুরু করল। অতনু এবং সৃজনের অন্য বন্ধুরা জানাল যে সৃজন নাকি সেদিন একটু আগেই খেলা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল। বেচারি টেবল টেনিসে হেরে যাচ্ছিল বলে মুড বেজায় অফ ছিল। রীতিমত বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া করে, হাতের র্যাকেট ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গজগজ করতে করতে চলে গিয়েছিল সে। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে, কিংবা কারোর সঙ্গে যাচ্ছে কিনা তা কেউই খেয়াল করেনি। স্বাভাবিকভাবেই সবাই ধরে নিয়েছে যে সোজা বাড়িতেই যাবে সৃজন। কিন্তু ছেলেটা তো বাড়িতে ফেরেইনি! তবে গেল কোথায়?
এ প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। পুলিশ আশপাশের সমস্ত পুকুরে, জলাধারে রীতিমত জাল ফেলে খানা-তল্লাশি করেছে। হিস্ট্রিশিটার ও কিডন্যাপারদের তুলে নিয়ে পিটিয়ে একসাও করেছে। ছেলে অন্ত প্রাণ দম্পতি প্রতি পলে পলে দগ্ধে মরছেন। টিভিতে, খবরের কাগজে সৃজনের ছবিসহ ‘সন্ধান চাই’ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে নিজের হাতে সৃজনের পোস্টার লাগিয়েছেন স্বয়ং প্রণব। শুক্লা প্রথমে অন্নজল ত্যাগ করেছিলেন। পরে প্রণবের কাতর অনুরোধে অনশন ভাঙলেও আস্তে আস্তে হয়ে উঠেছেন ডিপ্রেশনের রোগী! আর সেই ওষুধের মাত্রা যতই দিন যাচ্ছে, ততই বেড়ে চলেছে! শুক্লাকে পাগলের মতো ওষুধ খেতে দেখে প্রণব বহুবার বকাবকি করেছেন। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি! আজ চারমাস দশদিন হয়ে গেল, দু-জন নীরবে ফোনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন অনন্ত প্রতীক্ষায়! যদি পুলিশের ফোন আসে। যদি তারা খুঁজে পায় সৃজনকে! অথবা তার কোনও খবর পাওয়া যায়! কিংবা যদি কিডন্যাপারদের র্যানসম্ কলও আসে!
অন্তত এইটুকু তো বোঝা যায় যে বারো বছরের ছেলেটা কোথায় গেল! যে প্রশ্নটা বারবার পুলিশ করেছে তার উত্তরটাও যদি জানা যেত! আদতে কী হয়েছিল তার সঙ্গে! সৃজনের কী হল! কোথায় আছে সে!
বাইরে ঠিক বটগাছটার মাথায় বিদ্যুতের তরবারি আবার ঝলসে উঠল! পরক্ষণেই সমস্ত চিন্তাসূত্র ছিন্ন করে দিয়ে দরজায় সজোর করাঘাতের শব্দ! শান্ত নয়, অশান্ত ও মুহূর্মুহু করাঘাত! বুঝি দরজাটা এবার ভেঙেই যাবে!
সেকেন্ডের ভগ্নাংশে প্রায় স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো লাফিয়ে উঠলেন শুক্লা। যেদিন থেকে সৃজন হারিয়ে গিয়েছে তারপর থেকে প্রায়ই চমকে চমকে ওঠেন তিনি। ডোরবেল বা করাঘাতের শব্দ এলেই প্রাণপণ ছুটে যান সেদিকে। ভোলাকে প্রায় ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে দ্রুতহাতে দরজা খুলে দেন। বুকের ভেতর একটাই প্রত্যাশা। যদি সে ফিরে আসে। যদি সৃজন আবার এসে দাঁড়ায় বন্ধ দরজার সামনে! তাকে তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিতে হবে না?
আজও তিনি সবেগে দরজার দিকে ছুটলেন। পিছন পিছন প্রণব ও দ্রুতহাতে মুহূর্তের মধ্যে দরজা খুলে ফেলেছেন শুক্লা! বাইরে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছায়া ছায়া অবয়ব! আগন্তুকের সারা দেহ থেকে চুঁইয়ে পড়ছে জল। ক্ষীণ আলোয় চোখে পড়ল আপাদমস্তক ভেজা খাকী উর্দি!
—“অফিসার!”
প্রণব এবার সাগ্রহে এগিয়ে যান আগন্তুকের দিকে। বাইরে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি ঘনিষ্ঠ বন্ধু না হলেও একদম অপরিচিতও নন। তিনি সৃজনের ‘মিসিং’ কেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসার!
শুক্লার হৃৎপিণ্ড প্রায় লাফিয়ে উঠল। এই ঝড়জলের রাতে আচমকা স্বয়ং ইনভেস্টিগেটিং অফিসার এসে উপস্থিত কেন! তার মুখে যেন কয়েক হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠে। তবে কি এতদিনে সৃজনের কোনও খবর পাওয়া গেল? সেই সংবাদই কি শোনাতে এসেছেন অফিসার?
শুক্লার মুখের কথাই প্রায় ছিনিয়ে নিলেন প্রণব, “এত রাতে আপনি? বাবির কোনও খোঁজ পেলেন?”
উর্দিধারী অবনত মুখে একটু রুক্ষস্বরেই জানালেন, “আমি জানি যা হয়েছিল!”
—“কী!
উপস্থিত দু-জনেই চমকে উঠলেন! অফিসার তো কখনও এমন নিরুত্তাপ অথচ খসখসে স্বরে কথা বলেন না! তাছাড়া উনি বলছেনই বা কী! উনি জানেন কী হয়েছিল! এর অর্থ?
ইনভেস্টিগেটিং অফিসার আস্তে আস্তে এবার মুখ তুলে তাকান। ভদ্রলোকের সারা মুখ বেয়ে তখনও জলবিন্দু ঝরে পড়ছে। কিন্তু তার চোখে চোখ পড়তেই অস্ফুট আর্তনাদ করে কয়েক পা পিছিয়ে এলেন শুক্লা! প্রণব যা দেখলেন তাতে ভয়ে রক্তহিম হয়ে গেল! অফিসারের চোখের মণি দুটো সম্পূর্ণ সাদা! এ কী আদৌ মানুষের চোখ! এবং কী অদ্ভুত তার দৃষ্টি! সে দৃষ্টিতে কোনও প্রাণ নেই। যেন দুটো ভয়াল পাথরের চোখ অনিমেষে তাকিয়ে আছে!
তিনি এবার সজোরে সেই একই বাক্যের পুনরাবৃত্তি করলেন। তার জোরালো কণ্ঠস্বরে কেঁপে উঠল গোটা ঘর। ফের উচ্চারিত হল সেই কথাগুলো!
—“আমি জানি যা হয়েছিল!”
শুক্লা ভয়ে, বিস্ময়ে বাকশক্তিহীন! ততক্ষণে সেখানে এসে পড়েছে ভোলাও। সে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে হাঁ করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে! প্রণব কোনওমতে বলেন, “কী বলছেন! অফিসার?”
অফিসার তখনও বীভৎস সেই সাদা চোখে মরা মাছের মতো তাকিয়ে আছেন। কিন্তু তার কণ্ঠস্বরে যেন এবার মর্মান্তিক হাহাকার! ক্রন্দন উচ্ছ্বসিত-কণ্ঠে এবার তিনি সজোরে চিৎকার করে উঠলেন, “আ–মি–জা—নি যা হ—য়ে—ছিল!”
উপস্থিত সবাই বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল অফিসার বিদ্যুৎবেগে বের করে আনলেন তার সার্ভিস রিভলবার। কেউ কিছু বোঝার আগেই নিজের কপালেই আগ্নেয়াস্ত্রটি ঠেকিয়েছেন তিনি! প্রণব আর্তচিৎকার করে উঠলেন,
—“এ কী! কী করছেন আপনি!”
কিন্তু কেউ আর কিছু করার আগেই গর্জে উঠল রিভলবার! অফিসারের প্রাণহীন দেহ লুটিয়ে পড়ল মাটিতে!
ঠিক সেই মুহূর্তেই বিরাট বটগাছটাও ঝড়ের দাপট সহ্য করতে না পেরে সশব্দে হুড়মুড়িয়ে উলটে পড়ল।
২
—“তোদের চোখের সামনেই ভদ্রলোক সুইসাইড করলেন দিদিভাই!” সুচরিতার কথায় আস্তে আস্তে মাথা নাড়লেন শুক্লা। কাল রাতের ঘটনার পর থেকে তিনি বাকশক্তিরহিত। কথা বলার শক্তিটুকুও বাকি নেই। এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না তার সামনে দাঁড়িয়ে এক পুলিশ অফিসার নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন! চোখের সামনে ভাসছে সেই ভয়ংকর মুহূর্ত! কী ভয়াবহ ছিল সেই সাদা দুটো চোখ! কী ভয়ংকর তার সেই অন্তিম শব্দগুলো! এখনও মস্তিষ্কের ভেতরে ধাক্কা খেয়ে ফিরছে তার বলা বাক্যটা,
—“আমি জানি যা হয়েছিল!” সুচরিতা সেই মারাত্মক শব্দগুলোই আবার উচ্চারণ করল, “এর মানে কী! উনি কী জানতেন? আর কিছু বলেছেন কি?”
শুক্লা কেঁপে উঠলেন। এখন এই বাক্যটা শুনলেই তার ভয় করছে। কিছুই তো নয়! নিতান্তই কয়েকটা নিরীহ শব্দ মাত্র! কিন্তু প্রত্যেকটা শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আতঙ্ক! সেই আতঙ্ককে প্রকাশ করা যায় না, বর্ণনা করা যায় না। মানুষটা কি সত্যিই আত্মহত্যা করল? নাকি গোটাটাই একটা ভয়াল দুঃস্বপ্ন?
—“বারবার একই কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন সুচরিতা!” প্রণব বিরক্ত হয়ে বলেন, “তোমাকে তো আমি আগেই সব বলেছি। অফিসার তিন বার একটাই কথা বলেছেন। তার বেশি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি! আমার কথা কি তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে দিদিকে দিয়ে করোবরেট করাচ্ছ? কেন? আমরা কি কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছি?”
সুচরিতা সম্পর্কে শুক্লার পিসতুতো বোন ও প্রণবের জুনিয়র। জামাইবাবুর ধমক খেয়ে আমতা আমতা করে বলল, “তা নয় প্রণবদা। আমি জাস্ট এমনিই….”
—“এমনি এমনি কী!” আবার ধমকে ওঠেন প্রণব, “তোমার দিদির অবস্থা দ্যাখো! কাল সারারাত ঘুমোয়নি। ভয়ে কাঁপছে। জড়োসড়ো হয়ে আছে। পুলিশ ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করে বা এসে আমাদের জেরা করছে। তোমাকে ডাকলাম ওকে মেন্টাল সাপোর্ট দিতে, আর তুমি উলটে ভয় দেখাচ্ছ!”
জামাইবাবু কাম সিনিয়রের ভর্ৎসনায় সুচরিতা একটু বিব্রত হয়েই চুপ করে যায়। কী বলবে বুঝে পায় না। এই মুহূর্তে বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের ওপর দিয়ে রীতিমতো ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একে তো তাদের একমাত্র সন্তান সৃজন নিখোঁজ, তার ওপর খোদ ‘মিসিং’ কেসের ইনভেস্টিগেটিং অফিসারও মারা গেলেন! তাও আবার এইভাবে। পুলিশের জেরায় জেরায় বিধ্বস্ত প্রণব। কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল, কীভাবে হয়েছিল; সব পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিতে হচ্ছে। পুলিশ মানতেই চাইছে না যে অফিসার আত্মহত্যা করেছেন! এমনকি তার বলা শেষ কথাটাও বিশ্বাস করছে না তারা। বলছে “আমি জানি যা হয়েছিল। এর অর্থ কী!”
প্রণব অতিকষ্টে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে জানিয়েছেন, “এর অর্থ আমিও জানি না। যিনি জানতেন তাঁকে জিজ্ঞাসা করার উপায়ও নেই। কিন্তু আমরা তিনজনেই যা দেখেছি ও শুনেছি, তাই বলছি। উনি রিপিটেডলি একটা কথাই বলে গিয়েছেন। কোট-আনকোট, আমি জানি যা হয়েছিল”।
—“কী হয়েছিল? ঠিক কীসের কথা বলছিলেন তিনি?”
—“আমি জানি না।”
ওসির চোখ সন্দেহে সরু হয়ে যায়, “মিঃ ব্যানার্জী, আপনিও একজন ল অফিসার। অনেক সন্দিগ্ধ ব্যক্তিকে জেরা করেছেন কোর্টে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন আপনাদের বক্তব্য রীতিমতো অবিশ্বাস্য! অফিসার এলেন, আপনাদের সঙ্গে কথা বললেন এবং কথা নেই বার্তা নেই, নিজের মাথাতেই আরামসে গুলি মেরে আত্মহত্যা করলেন! মরার আগে কী বলে গেলেন? আমি জানি যা হয়েছিল! সম্পূর্ণ অর্থহীন কথাবার্তা! এ বয়ান যে ধোপে টিকছে না!” প্রণব ও শুক্লা পরস্পর দৃষ্টিবিনিময় করেন। প্রণব নিজেও জানেন, তিনি যা বলছেন তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কোর্টে এ স্টেটমেন্ট দিলে তাকে রীতিমতো মানসিক রোগী বলে সন্দেহ করা হবে। কিন্তু বলবেন টা কী? তাদের তিনজনের চোখের সামনে যা ঘটেছে, তাকে কোনওমতেই বিশ্বাসযোগ্য গল্পের আকার দেওয়া যাবে না! তা ও ভাগ্যিস, সাদা চোখের ব্যাপারটা বলেননি। ওটা বললে হয়তো গোটা পুলিশ সম্প্রদায় অট্টহাস্য করে উঠত ও তাদের সবাইকে ধরে মেন্টাল অ্যাসাইলামে পুরে দিত!
—“আপনি কি আমাদের সন্দেহ করছেন?”
তার কণ্ঠস্বর একটু রুক্ষ। ওসি মৃদু হাসলেন, “দেখুন স্যার, সন্দেহ করাই স্বাভাবিক। যদি মেনেও নিই যে অফিসারের মরার শখ হয়েছিল ও কোনও কারণে তাঁর মাথায় আত্মহত্যার ভূত চেপেছিল, সেক্ষেত্রেও তিনি বেছে বেছে আপনার বাড়িতে এসে, আপনাদের তিন জনকে সাক্ষী রেখে মরবেন কেন? সুইসাইড তো মানুষ দেখিয়ে দেখিয়ে করে না। আদৌ কোনও লজিক পাচ্ছেন এ ঘটনার?”
তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলেন, “আই মাস্ট অ্যাডমিট, নাঃ!”
—“আপনি কিছু চেপে যাচ্ছেন না তো স্যার?” ওসি খুব শান্ত ভঙ্গিতেই বলেন, “আপনি নিজেও জানেন পুলিশের কাছে কিছু গোপন করে যাওয়ার ফল কী হতে পারে।”
তার চেয়েও শান্ত ও কিছুটা ক্লান্ত ভঙ্গিতে জানালেন প্রণব, “জানি। আমরা কিছুই গোপন করছি না।”
—“আপনার ছেলের মিসিং কেসটার কোনও ডেভলেপমেন্ট হয়েছিল? তদন্তকারী অফিসার কি সে বিষয়ে কিছু বলেছেন?”
—“না। উনি শুধু একটা কথাই বলেছেন। আর সেটা অলরেডি আমি আপনাদের জানিয়েছি।”
—“আমি জানি যা হয়েছিল!” এবার ওসির ভুরুতে সামান্য ভাঁজ পড়ল। দৃষ্টিও সংশয়ান্বিত। তারপরেই বললেন, “আপনার নিজের কোনও লাইসেন্সড গান আছে?”
ইঙ্গিত স্পষ্ট। প্রণব আর কথা না বাড়িয়ে নিজের লাইসেন্সড রিভলবারটি ওসির হাতে তুলে দেন। আপাতত সেটাই বাজেয়াপ্ত করে সাময়িক বিরতি দিয়েছে পুলিশ।
—“পুলিস আমাদেরই সন্দেহ করছে তাই না?”
দীর্ঘ নীরবতার পরে শুক্লা অত্যন্ত ক্ষীণ কণ্ঠে এই প্রথম কথা বললেন। ঘরে উপস্থিত দুই উকিলের মধ্যে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি-বিনিময় হল। প্রণব সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেন, “পুলিশের কাজই হল সন্দেহ করা। ওরা নিজের বাড়ির লোকদেরও সন্দেহ করে।”
—“ওদের কাজ কি শেষ হয়েছে?”
— “নাঃ!” দুদে উকিল অভিজ্ঞ কণ্ঠেই জানান, “যতদূর আমি পুলিশকে চিনি, তাতে বলতে পারি ওরা আমাদের বয়ানে আদৌ বিশ্বাসই করেনি। আবার আসবে। আবার খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একই প্রশ্ন করবে।”
তিনি আস্তে আস্তে বলেন, “ওরা ভাবছে আমরা অফিসারকে খুন করেছি, তাই না? নয়তো তোমার রিভলবারটা চাইল কেন?”
প্রণব দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। হয়তো বা প্রশ্নটাকে এড়িয়ে যেতেই চাইছিলেন। কিন্তু শুক্লা তার দিকে নাছোড়বান্দা ভঙ্গিতে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছেন দেখে একরকম বাধ্য হয়েই বলেন, “ভাবলেই তো হল না। কোর্টে প্রমাণ করতে হবে তো! ওদের কাছে আমাদের বিরুদ্ধে কোনওরকম প্রমাণ নেই। ইভেন ফরেনসিকও বলবে যে গুলিটা ওঁর সার্ভিস রিভলবার থেকেই একদম পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জে চলেছিল, আমার রিভলবার থেকে নয়।”
—“কিন্তু তাহলেও তো প্রমাণ হয় না যে আমরা ওঁকে মারিনি।” প্রণব এবার একটু বিরক্ত, “না হয় না। কিন্তু এটাও প্রমাণ হয় না যে ওঁকে আমরা মেরেছি। তুমি অনেকক্ষণ ধরে রেস্টলেস হয়ে আছ। এবার একটু রেস্ট নাও। সু, প্লিজ্ দ্যাখো!”
সুচরিতা বুঝে গিয়েছে তাকে কী করতে হবে। সে তার দিদির হাত ধরে টান মারে, “আয় দিদিভাই, কিছু খেয়ে নে। তারপর একটু বিশ্রাম…”
শুক্লা অন্যমনস্কভাবে ফের বাইরের দিকে তাকান। ঝড়ে ভূ-পাতিত বটগাছটার দিকে তাকিয়েই গা শিরশির করে উঠল তার! বটগাছটা অবিকল অফিসারের প্রাণহীন দেহটার মতই পড়ে আছে! এক পলকের জন্য মনে হল, ওটা গাছ নয়, বরং কোনও মানুষেরই মৃতদেহ!
তিনি আলতো করে মাথা ঝাঁকান। নাঃ, গোটাটাই তার দৃষ্টিভ্রম। কিন্তু বটগাছটাকে এমন জীবন্ত মনে হচ্ছে কেন?
৩
শহরের ইট-কাঠ-পাথরের পাঁজরে এক চিলতে সবুজ মরুদ্যান এই চিলড্রেন্স পার্ক। মখমলি সবুজে ঘেরা এই ছোট্ট পার্কের নাম চিলড্রেন্স পার্ক হলেও অনেক বয়স্ক মানুষ সকালে বিকালে এখানে হাঁটতে আসেন। মাঝখানে একটুকরো স্বচ্ছ নীল জলের জলাশয়কে কেন্দ্র করে চতুর্দিকে গড়ে উঠেছে এক মনোরম সবুজ উদ্যান। ছোটোদের জন্য দোলনা, সি-স, স্লাইড ছাড়াও রয়েছে ছোটো ছোটো বেঞ্চ। সেখানে অনেক প্রকৃতি-প্রেমিকই এসে বসেন। ভোরবেলা জগিং করতে আসে অনেকেই। বৃদ্ধরা একপাশে আবার লাফিং ক্লাব খুলেছেন। সকাল বিকেল শিশু ও বৃদ্ধদের হাসির আওয়াজে ভরে থাকে গোটা উদ্যান।
এখন অবশ্য গোটা পার্কই শুনশান। করোনা ভাইরাসের দৌলতে শিশুরা এখন আর মুক্ত প্রকৃতির বুকে খেলে বেড়াতে পারে না। বৃদ্ধরাও সংক্রমণের ভয়ে বাড়ির বাইরে বেরোচ্ছেন না। তাই পার্কে মানুষজনের চিহ্ন নেই। তবে প্রচুর পাখির কলকাকলিতে ভরপুর! পাখিদের তো আর রোগের ভয় নেই। সকাল ও সন্ধেবেলায় প্রচুর পাখির ভিড় জমে। তাদের বিচিত্র কলরবে ভরে থাকে চিলড্রেন্স পার্ক।
সারি সারি গুলমোহরের গাছ কিছুদিন আগেও লালে লাল ছিল। দেখলেই মনে হত, আগুন জ্বলছে। কিন্তু এখন ফুলের সিজন নয়। তাই সবুজ পাতা মেলেই চিরহরিৎ গাছগুলো দাঁড়িয়ে রয়েছে। ঝাঁকড়াচুলো অমলতাস কিন্তু এখনও হলদে সোনালি রঙ ছড়িয়ে চলেছে। সেদিকে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়।
পার্কের চতুর্দিকে ইটের পাঁচিল। সেখানে অনেক পোস্টার লাগানো। তবে খুঁজলে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যাবে সৃজনের ছবির পোস্টার। রোজ বিকেলে প্রণব ও শুক্লা একগাদা পোস্টার নিজেদের হাতে সর্বত্র লাগাতে থাকেন। সবাই আশা ছেড়েছে! পুলিশও আস্তে আস্তে নিশ্চেষ্ট হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তারা হাল ছাড়েননি। কে বলতে পারে, হয়তো বা এই পোস্টার দেখেই কেউ চিনে ফেলল সৃজনকে! হয়তো এই ছবির মাধ্যমেই চলে আসতে পারে কোনও খবর। সেই আশাতেই বুক বেঁধে রোজ এই দম্পতি পোস্টারে পোস্টারে ভরিয়ে ফেলেন গোটা এলাকা। যেখানেই পুরনো পোস্টার বিবর্ণ হয়ে যায় বা খসে যায়, সেখানেই সঙ্গে সঙ্গে নতুন পোস্টার লাগিয়ে দেন! এই নিয়মের ব্যতিক্রম কখনও হয় না।
আজ বিকেলেও প্রাত্যহিক নিয়মমতই গাড়ির ডিকিতে সৃজনের একগাদা পোস্টার নিয়ে বেরিয়েছিলেন প্রণব। তবে আজ তার সঙ্গে শুক্লা আসেননি। কালকের বিভীষিকাময় রাতটা তার দুর্বল মনের ওপর অসম্ভব চাপ ফেলেছে। অনেক কষ্টে তাকে সামান্য খাবার খাইয়ে, ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়েছে সুচরিতা। শুক্লা মানসিক দিক দিয়ে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত! এই মুহূর্তে তার বিশ্রাম প্রয়োজন। বিশ্বস্ত ভৃত্য ভোলা আপাতত তার কাছে রয়েছে। আর প্রণবকে সাহায্য করতে এসেছে সুচরিতা।
পার্কের পাঁচিলের গায়ে ছেলের পোস্টার লাগাতে লাগাতেই আচমকা থমকে গেলেন প্রণব। সুচরিতা দেখল, তিনি আলতো করে ছবির গায়ে হাত বোলাচ্ছেন। যেন নিজের ছেলেকেই পরম স্নেহে আদর করছেন। সমবেদনায় সুচরিতার চোখ জলে ভরে আসে। শুক্লার সামনে নিজের দুর্বলতা প্ৰকাশ করার সুযোগ প্রণব কখনও পাননা। স্ত্রী-র যা মানসিক অবস্থা, তাতে তার সামনে যদি স্বামীও ভেঙে পড়েন তবে শুক্লার পক্ষে তা অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। সুচরিতা জানে, কতখানি শক্তিতে নিজের বুকে পাথর রেখে স্থির হয়ে আছেন প্রণব। কিন্তু যতই যা হোক, মানুষ তো! কতক্ষণ আর নিজেকে শক্ত রাখতে পারবেন!
—“আমার জন্য…” সৃজনের ছবির গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে প্রচণ্ড আফসোসে এবার ভেঙে পড়েন তিনি, “সব আমার জন্য হল। সব আমার জন্য!”
সুচরিতা সহানুভূতি-মাখা কণ্ঠে বলে। “কীসব বলছ প্রণবদা! তোমার জন্য কী হবে!”
—“আমার পেশাটাই কাল হয়েছে। এত শত্রু বাড়িয়েছি, এত লোককে শাস্তি দিয়েছি…” বিকেলের পড়ন্ত রোদের বিষণ্ণতা মুখে মেখে প্রণব ফুঁপিয়ে ওঠেন, “ঈশ্বর জানেন, কোন্ পাপের শাস্তি পাচ্ছি এখন! কারোর যদি বদলা নেওয়ারই থাকত তবে আমাকেই কেন মেরে ফেলল না! বাবি কেন! হোয়াই! …. হোয়াই!”
তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না। উচ্ছ্বসিত কান্নায় ভেঙে পড়েছেন তথাকথিত অপরাধীদের আতঙ্ক প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়। কান্না-জড়ানো কন্ঠে বললেন, “বাবার অপরাধের শাস্তি ছেলেকে কেন দিচ্ছে! ছেলেটা হারিয়ে গেল, শুক্লা ড্রাগের ওভারডোসেজ নিতে নিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আমার যে সব শেষ। তার চেয়ে আমিই কেন মরে যাই না….”
সুচরিতা পরম স্নেহে তার হাত ধরে ফেলল, “তুমি এসব ভেবে মিথ্যেই কষ্ট পাচ্ছ প্রণবদা। তোমার জন্য কিচ্ছু হয়নি। বাবিকে ঠিক পাওয়া যাবে।”
—“কবে?” অশান্ত ক্ষতবিক্ষত পিতৃহৃদয় হাহাকার করে ওঠে, “আর কতদিন? চোখের সামনে নিজের স্ত্রীকে একটু একটু করে পাগল হয়ে যেতে দেখছি। তুমি জানো, ও আজকাল অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শুনতে পায়? ওর মনে হয় কেউ ওকে ফলো করছে। মুঠো মুঠো ঘুমের ওষুধ খায়, তারপরও রাতে ঘুমোতে পারে না। সবসময় ভয়ে থাকি, গোটা ফয়েলটাই না কোনওদিন খেয়ে ফেলে! আর কতদিন এ যন্ত্রণা সইতে হবে বলতে পারো? আর যে পারছি না!”
সুচরিতা ভাষা খুঁজে পায় না। ব্যথা-জর্জরিত পিতৃহৃদয়কে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কোনও কথাই যথেষ্ট নয়। সামনের এই পুত্রশোকার্ত, ব্যথাসন্তপ্ত মানুষটিকে কী বললে তিনি একটু শান্ত হবেন তা তার জানা নেই। সে খুব কোমলস্বরে বলল, “তুমিও ভেঙে পড়লে চলবে কী করে? সব ঠিক হয়ে যাবে দেখো।”
—“কী ঠিক হবে!” প্রণবের চোখ এবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। টপটপ করে কয়েকফোঁটা অশ্রুবিন্দু ঝরে পড়ল তার চোখ থেকে। কোনওমতে শুধু বললেন, “ওকালতি ছেড়ে দেব আমি! দরকার পড়লে বাড়ি, গাড়ি, আর যা যা আছে সব বিক্রি করে দেব। যদি নিজেকেও বিক্রি করতে হয়, তবে তাই সই। যত টাকা লাগে দেব, কিন্তু ওরা শুধু আমার বাবিকে ফিরিয়ে দিক!”
এবার সমবেদনায় নয়, একটু সবিস্ময়ে বলল সে, “ওরা কারা? কাদের কথা বলছ?”
—“জানি না!”
হাতের পোস্টার সরিয়ে রেখে এবার ক্লান্ত-ভঙ্গিতে পার্কের বেঞ্চে বসে পড়েছেন প্রণব। দু-হাতে মুখ ঢেকে বললেন, “শুধু জানি সব আমার জন্য হয়েছে। সব আমার জন্য।”
এ কাতরোক্তির কোনও ব্যাখ্যা হয় না। এ অনুতাপও অর্থহীন। তবু সুচরিতার মনে ছাপ ফেলে যায় এক গভীর সন্দেহ। প্রণবের কথা অনুযায়ী এই ‘ওরা’ কারা? তবে কি তিনি সত্যিই কিছু চেপে যাচ্ছেন! এমন নয়তো যে কিডন্যাপারদের ফোন পেয়েছেন উনি? কিন্তু তাদের হুমকির ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারছেন না? নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সে জানে কিডন্যাপারদের প্রথম কথাটাই হয়, “কাউকে কিছু বললে ছেলেকে আর দেখতে পাবি না. … “
চিলড্রেন্স পার্কের নির্জন পরিবেশে ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল সুচরিতার। প্রণব দু-হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কাঁদছেন। কিন্তু তার কথাগুলো ভুলতে পারছে না সে। ক্রমাগত মস্তিষ্কের ভেতরে তোলপাড় হচ্ছে। ঠিক কী বলতে চাইলেন প্রণব? এই ‘ওরা’ কারা? সত্যিই কি তিনি কিছু জানেন না? পুরোটাই অনুতপ্ত হৃদয়ের বিলাপ! নাকি এই কথাগুলোর অন্য কোনও মানেও আছে? নিজের সর্বস্ব বিক্রি করে দেওয়ার কথা উঠছে কোথা থেকে!
—“প্রণবদা!” সন্দিগ্ধ স্বরে বলল সে, “তুমি কি কিছু জানো?” কথাটা শোনামাত্রই বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো মুখ তুলে তাকালেন প্রণব। পড়ন্ত আলোয় তার মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেল সুচরিতা। যদিও মুহূর্তের ভগ্নাংশে নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। স্খলিত গলায় বললেন, জানব?”
—“আমি জানি যা হয়েছিল!”
পার্কে এতক্ষণ ঘরে ফেরা পাখির আওয়াজ ছাড়া আর কিছু শোনা যায়নি। সুচরিতা ও প্রণব ছাড়া তৃতীয় কোনও মানুষের অস্তিত্বও ছিল না। কিন্তু দু-জনে এতটাই শোকার্ত ও বিভ্রান্ত যে খেয়ালই করেনি ওদের কথোপকথনের মধ্যেই একজন অপরিচিত মানুষ হাঁটতে হাঁটতে এইদিকেই আসছিল। এবার সে এসে দাঁড়িয়েছে প্রণবের ঠিক পেছনেই। কিছু বোঝার আগেই দ্বিতীয়বার উচ্চারিত হল সেই অমোঘ শব্দগুলো,
—“আমি জানি যা হয়েছিল!”
তড়িৎগতিতে পিছন দিকে ঘুরলেন প্রণব। সুচরিতাও ঘাবড়ে গিয়ে তাকাল বক্তার দিকে। পুরোপুরি অন্ধকার এখনও নেমে আসেনি। সূর্যাস্তের নরম আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল আগন্তুককে। বয়েস চল্লিশের মধ্যেই, গাঁট্টাগোট্টা গড়ন, পরনে সাধারণ ডোরাকাটা শার্ট আর ট্রাউজার। মুখে গোঁফ-দাড়ির জঙ্গল। শত বাধা-নিষেধ সত্ত্বেও মুখে মাস্ক নেই। একদমই সাধারণ ও বিশেষত্বহীন চেহারা। কিন্তু… এ কী!
তার চোখ দুটো! তার চোখ দুটো যে সম্পূর্ণ সাদা! ওর চোখে কি মণি নামক বস্তুটিই নেই! সুচরিতা টের পেল, ভয়ে সে রীতিমতো ঘামছে। এই মারাত্মক বাক্যটা আগেই শুনেছিল। সাদা চোখের বর্ণনাও তার অজ্ঞাত নয়। কিন্তু এ কী অদ্ভুত অমানুষিক চোখ! কোনও মানুষের এমন চোখ হয় না, হতে পারে না! আর কেমন যেন অপলক দৃষ্টি। কোনও জীবন্ত মানুষ এভাবে তাকাতে পারে না। এ কে? তার থেকেও বড় কথা, এ আসলে ঠিক কী! মানুষ না শয়তান!
—“কী?” প্রণব প্রায় উন্মত্তের মতো লাফিয়ে ওঠেন, “কী বললেন?” লোকটার মুখ এবার খানিকটা বিকৃত হয়ে যায়। যেন হৃদয়ের অতল থেকে উঠে আসা কান্নাকে অতি-কষ্টে দমন করতে চাইছে। কিন্তু আশ্চর্য! তার সাদা চোখের পলক পড়ছে না! সে পার্কের নির্জনতাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে, “আ-মি জা-নি যা হ-য়ে-ছি-ল!”
পাখিগুলোও বুঝি আসন্ন বিপদের সংকেত পেয়ে পরিত্রাহি চিৎকার করে উঠেছে। তাদের ডাকে এখন মাধুর্য নেই। বরং স্পষ্ট অশুভ ইঙ্গিত! সুচরিতার বুকের ভেতরটা ধ্বক্ করে ওঠে। পাখিগুলো এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন! এতক্ষণ দিব্যি ডালে বসে ডাকাডাকি করছিল। এবার চিল চিৎকার করে উন্মত্তের মতো ডানা ঝাপটাচ্ছে। মনে হয়, হয়তো কোনও অজানা বিভীষিকার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছে!
লোকটার পাথরের মতো দৃষ্টি তখনও ওদের দু-জনের ওপর নিবদ্ধ! প্রণব পাগলের মতো তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। উত্তেজনার চোটে বোধহয় শিষ্টাচারও ভুলে গিয়েছেন। আগন্তুকের কলার চেপে ধরে বলেন, “কী জানিস! কী জানিস তুই!”
লোকটা একটুও উত্তেজিত না হয়ে এবার রহস্যময় মুচকি হাসল। পরক্ষণেই প্রণবকে সজোরে ধাক্কা মেরে দৌড়!
প্রণব ভাবতেও পারেননি লোকটা এভাবে হাত ফস্কে পালাবে। ধাক্কা খেয়ে কিছুটা বেসামাল হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ততক্ষণে তারও রোখ চেপে গিয়েছে। অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করে তিনিও দৌড়োলেন আগন্তুকের পিছন পিছন। সুচরিতা স্তম্ভিতের মতো দেখল, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা লোকের পিছনে বিষম জেদে দাঁতে দাঁত পিষে দৌড়োচ্ছেন প্রণব! সে প্রমাদ গুণল। কে জানে, এটা কোনওরকম ট্র্যাপ কিনা! সে চেঁচিয়ে ওঠে, “প্রণবদা, দাঁ-ড়া-ও! যে-ও-না-আ-আ!”
সুচরিতার কণ্ঠস্বর প্রণবের কান অবধি পৌঁছোল কিনা কে জানে। কিন্তু তিনি থামলেন না। সামনের ব্যক্তি দুরন্ত গতিতে দৌড়চ্ছে। তার স্পিড দেখে ক্রমাগতই বিস্মিত হচ্ছিলেন। কোনও মানুষের পক্ষে কি আদৌ এত জোরে দৌড়োনো সম্ভব! এ তো দৌড়োচ্ছে না, উড়ছে!
তবু তিনি হাল ছাড়লেন না। লোকটা দৌড়োতে দৌড়োতে পার্ক ছাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মেইন রোডের দিকে। প্রণবের কেমন যেন ধাঁধা লেগে যায়। কখনও মনে হচ্ছে ওকে দেখতে পাচ্ছেন, কখনও মনে হচ্ছে বুঝি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে! ও কি আদৌ কোনও জাগতিক প্রাণীর মত দৌড়চ্ছে! নাকি ওর দুই পায়ে আলোর গতিবেগ ভর করল! আর এমন আচমকা হঠাৎ হঠাৎ মিলিয়েই বা যাচ্ছে কোথায়! সত্যিই কি মিলিয়ে যাচ্ছে, না গোটাটাই তার চোখের ভুল!
প্রণব কোনওদিনই অতিলৌকিকে বিশ্বাসী নন। কিন্তু আজ একটা শিরশিরে শীতল ভয় তার মনের মধ্যে কামড় বসাচ্ছে। এসব কী হচ্ছে! পুলিশ অফিসারটির মৃত্যুর পর চব্বিশ ঘন্টাও কাটেনি, সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি লোক এসে আবার সেই একই কথা বলল! অবিকল সেই একই টোন! হুবহু এক যান্ত্রিক ভঙ্গি। সর্বোপরি সাদা বীভৎস দুটো চোখ! এমনকী বাক্যটাও একই!
আমি জানি যা হয়েছিল!
কী হয়েছিল? কারই বা হয়েছিল! এই বাক্যটার পেছনে আসলে কোন্ রহস্য লুকিয়ে আছে? এর পিছনে কি কোনও মানুষের চক্রান্ত উপস্থিত, না কোনও…!
অবিশ্বাস্য সম্ভাবনাটার কথা মনে আসতেই চিন্তাটা মন থেকে উড়িয়ে দিলেন প্রণব। তিনিও কি তবে শুক্লার মতই আস্তে আস্তে পাগল হয়ে যাচ্ছেন! দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় তার চোয়াল কঠিন হয়ে ওঠে। মানুষ হোক কী শয়তান, ছেড়ে দেওয়া যাবে না। লোকটাকে যে করেই হোক ধরতেই হবে! এর শেষ দেখেই ছাড়বেন।
দৌড়োতে দৌড়োতে প্রণবের হাঁফ ধরে যাচ্ছে। তিনি পেশায় উকিল, পুলিশ নন যে দৌড়ে আসামীকে ধরার অভ্যাস থাকবে। তার ওপর এই ব্যক্তিকে ধরার ক্ষমতা পুলিশ কেন, সম্ভবত কোনও দৌড়বীরেরও নেই! কী অসম্ভব বেগে দৌড়োচ্ছে লোকটা! তবু তিনি হাল ছাড়েন না! চিৎকার করে ডেকে ওঠেন,
—“এ-ই! থা-ম্!”
আগন্তুক ক্ষণিকের জন্য যেন থমকে দাঁড়ায়। প্রণব সবিস্ময়ে দেখলেন, সে ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মেইন রোডে এখন তেমন গাড়ির ভিড় নেই। শুধু দু-একটা গাড়ি, কখনও বা কিছু ট্রাক হুশহাস করে চলে যাচ্ছে।
লোকটা প্রণবের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। তিনি সবিস্ময়ে দেখলেন, প্রবল গতিতে উলটোদিক থেকেই ধেয়ে আসছে এক মহাকায় মালবাহী ট্রাক। মানুষটা সম্মোহিতের মতো সেদিকেই তাকিয়ে আছে। এর পরবর্তী ঘটনা কী ঘটতে পারে আন্দাজ করেই প্রণবের হাত-পা অবশ হয়ে আসে। পুলিশ অফিসারও ধরা দেননি। এ লোকটাকেও ধরা যাবে না। ঠিক গুণে গুণে তিন বার ওই বাক্যটা বলাই সম্ভবত ওদের জীবনের অন্তিম লক্ষ! আর ওরা একটি শব্দও খরচ করবে না!
ট্রাকটা দুরন্ত বেগে ক্রমাগতই এগিয়ে আসছে। আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই…
— “না! দাঁ-ড়া-ও!”
প্রণবের অসহায় শেষ চেষ্টা দেখে সে যেন অর্থপূর্ণ হাসল। ট্র্যাকটা দুর্নিবার গতিতে আসছে! এলো…এলো! এসেই পড়ল!
—“না!”
প্রণবের কথাকে বিন্দুমাত্রও পাত্তা না দিয়ে মানুষটা সবেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল রাস্তায়। ট্রাকের ড্রাইভার এমন ঘটনার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিল না! তার করারও বিশেষ কিছু নেই। প্রণবের চোখের সামনে একটা জগদ্দল ট্রাক গোটা মানবদেহকে সম্পূর্ণ পিষে দিয়ে চলে গেল, অথচ কারোর কিচ্ছু করার ছিল না!
সুচরিতা ততক্ষণে হাঁফাতে হাঁফাতে এসে পৌঁছেছে অকুস্থলে। একটু আগেই দেখা জলজ্যান্ত মানুষটার তালগোল পাকানো রক্তাক্ত বীভৎস মৃতদেহটা দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারল না
সে রাস্তার ওপরেই হড়হড়িয়ে বমি করে ফেলল।
৪
চোখের সামনে গভীর অন্ধকার। খাতার সাদা পাতার ওপর কালো কালির দোয়াত উলটে পড়লে যেমন গোটা পাতাটাই কালো হয়ে যায়, ঠিক তেমনই নিকষ কালো রং ছড়িয়ে আছে চতুর্দিকে। এমন বেদনাময় অন্ধকারে দম বন্ধ হয়ে আসে। নির্জীব আঁধারে প্রাণের কোনও সাড়া পাওয়া যায় না। বরং যে কোনও মানবমন এই তমিস্রার হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়।
ঠিক তেমনই শ্বাসরোধকারী অন্ধকারে ছটফট করছিলেন শুক্লা। এক করাল অন্ধকূপ তাঁকে চতুর্দিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। তিনি অনুভব করছিলেন সুনিবিড় এক নিরাপত্তাহীনতা আস্তে আস্তে জড়িয়ে ধরছে তাঁকে। খুঁজছিলেন এক বিন্দু আলোর রশ্মি! কোথাও কি একটু আলো নেই?
শুক্লার শীত করছিল। এই গুমোট গরমের দিনে এত ঠান্ডা লাগছে কেন! তার হাত, মুখ আস্তে আস্তে হয়ে উঠছে বরফশীতল। অবিকল মৃত মানুষের মতো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছেন তিনি। উষ্ণতা!…একটু উষ্ণতা বড় প্রয়োজন! কিন্তু তিনি আছেন কোথায়? সত্যিই কি কোনও পার্থিব জগৎ তাকে ঘিরে রেখেছে, না কোনও অলৌকিক জগতে আছেন! যেখানেই থাকুন, এখান থেকে বেরোবার রাস্তা তাকে খুঁজে নিতেই হবে।
অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে আসতেই শুক্লার মনে হল, তিনি একা নন আরও কেউ আছে এখানে! সেই অজ্ঞাত মানুষটির নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছেন! কেউ একটা জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে।
—“কে?”
শুক্লা টের পেলেন তার গলা সামান্য কাঁপল। শীতলতার মাত্রা ক্রমশই বাড়ছে। এসি তো আজ দুপুরে অন করেননি! তবে এই হিমেল অনুভূতির উৎস কোথায়!
এবার শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ নয়, আবছা একটা ছায়ামূর্তিও চোখে পড়ল। ছায়া ছায়া এক মানুষের দেহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে তারই দিকে। তিনি আবার বললেন, “কে! কে ওখানে!”
আর কিছু বলার আগেই একজোড়া সবল হাত চেপে ধরেছে তার গলা! দুটো লৌহকঠিন হাত সজোরে পিষছে কণ্ঠনালী! তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না! হাতদুটোর মালিককে ঠিকমতো দ্যাখা যায় না। মানুষ নয়, হয়তো বা অন্ধকারই করাল থাবায় চেপে ধরেছে তার টুটি। শুক্লার মনে হল, তিনি এবার মরেই যাবেন! দমবন্ধ হয়ে আসছে… ফুসফুসে একফোঁটাও অক্সিজেন নেই। আপ্রাণ যুদ্ধ করছেন অজ্ঞাত প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে, কিন্তু এই নিষ্ঠুর হাতের নিষ্পেষণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার শক্তিও তার নেই। প্রচন্ড যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে নিথর হয়ে যাচ্ছেন! অন্ধকার… বড়ো অন্ধকার …
প্রায় ঘর্মাক্ত কলেবরে ধড়মড়িয়ে বিছানায় উঠে বসেন শুক্লা! স্বাভাবিক প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় তার হাত দুটো স্পর্শ করল নিজের গলা। নাঃ, সেখানে সেই দুর্বৃত্ত হাতের কোনও চিহ্ন নেই। হাঁফাতে হাঁফাতে সজোরে নিঃশ্বাস নিলেন তিনি। ওঃ, ঈশ্বর! নিতান্তই দুঃস্বপ্ন! অথচ ক্ষণিকের জন্য হলেও মৃত্যুর স্বাদ পেয়েছিলেন! একবারের জন্যও মনে হয়নি গোটাটাই স্বপ্ন! স্বপ্ন এমন বাস্তব কী করে হয়ে উঠতে পারে!
শুক্লা বুক ভরে শ্বাস নিতে নিতে কপালের ঘাম মোছেন। হৃৎপিণ্ডটা এখনও ধড়ফড় করছে। ভয়ের ধাক্কায় কাঁপছে চোখ মুখের পেশীও। আশেপাশে এক ঝলক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিলেন। বাইরে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। তার ঘরে হালকা আলো জ্বলছে। সম্ভবত ভোলাই এসে জ্বালিয়ে দিয়ে গিয়েছে। বাইরের আবছা অন্ধকারে আরও কালো হয়ে এখনও পড়ে আছে বটগাছটা। ওর দিকে তাকালেই কেমন যেন গা শিরশির করে। বড় বিষণ্ণতা নির্জীব গাছটার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে! এক বিরাট মহীরুহের কী ট্র্যাজিক পরিণতি!
বাবি যখন ছোটো ছিল, তখন ঐ গাছটায় একটা দোলনা বেঁধে দিয়েছিলেন প্রণব। সে মহানন্দে গাছটায় বসে দোল খেত। সঙ্গে সঙ্গে বটগাছটার ঝুরিও যেন মহানন্দে দুলত। পাতায় পাতায় ছোট্ট শিশুর উচ্ছ্বাস খেলা করে বেড়াত। বটগাছটা বাবির অনেকদিনের সঙ্গী।
দোলনাটা অনেকদিন আগেই ছিঁড়ে গিয়েছে। গাছটাও শেষ হয়ে গেল। বাবি কোথায় কে জানে! ভাবতেই ভীষণ কান্না পেয়ে গেল শুক্লার। বুকের ভেতরে এক প্রচণ্ড ভার! নিজেকে সামলাতে না পেরে প্রচণ্ড কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি। অজ্ঞাত কোনও এক মর্মবেদনায় আপনমনেই কান্না-জড়ানো গলায় বললেন, “সব দোষ আমার! সব দোষ আমার… আমারই!”
— ‘ধপ্…ধপ…ধপ্…’
আচমকা অদ্ভুত একটা আওয়াজ শুনে সচকিত হয়ে উঠলেন শুক্লা। দোতলার ঘরে ও কীসের শব্দ! একটা জোরালো আওয়াজ ধাক্কা মারছে কর্ণেন্দ্রিয়ে। উৎকর্ণ হয়ে শব্দটা শুনছেন তিনি। আওয়াজটা একবার এদিকে আসছে। পরক্ষণেই যেন অন্যদিকে যাচ্ছে। তীক্ষ্ণ নয়, একটানা ভোঁতা আওয়াজ, ‘ধপ্…ধপ…ধপ…!’
দোতলায়, এই ঘরের ঠিক ওপরেই একটা পরিত্যক্ত স্টোররুম। এ বাড়ির সমস্ত প্রাচীন ও অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ওখানেই রাখা হয়। আশ্চর্য! এখন
তো ও-ঘরে কোনওরকম শব্দ হওয়ার কথা নয়! বহু বছর হয়ে গেল স্টোররুমটায় কেউ কোনও প্রয়োজনেই ঢোকে না। মাঝেমধ্যে অবশ্য ইঁদুরের উৎপাত হয়। তখন ভোলা দায়িত্ব নিয়ে নেমে পড়ে সাফাই অভিযানে। কিন্তু এ কোনও মানুষের স্বাভাবিক পায়ের আওয়াজ বলে মনে হয় না। হাঁটার বা দৌড়োনোর আওয়াজ তো নয়ই। বরং এক পায়ে লাফালে খানিকটা এমনই শব্দ হয় বটে! স্টোররুমে কে এক পায়ে লাফাবে!
আওয়াজটা ক্রমাগতই বাড়ছে। শুক্লা বিস্মিত হলেন। স্টোররুমে এখন আবার কে গেল? প্রণব বা সুচরিতা ও ঘরে ঢুকবেন বলে মনে হয় না। তবে কি ভোলা!
তিনি বিছানা থেকে নেমে আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে এলেন। তার ঘরে আলো জ্বলছে ঠিকই, কিন্তু হলঘর অন্ধকার। শুধু হলঘর নয়, গোটা বাড়িটাই অন্ধকার। শুক্লা বিস্মিত হলেন! ভোলা এখনও বাড়ির আলোগুলো জ্বেলে দেয় নি? রোজই তো সন্ধে নেমে আসার পর সব ঘরের আলো জ্বেলে দেওয়া তার রুটিন। কারণ বাড়ির কর্ত্রী মনে করেন যে সন্ধেবেলায় বাড়ি অন্ধকার করে রাখা অমঙ্গলসূচক। তাই বহুবছর ধরেই এই কাজটা করে আসছে ভোলা। আজ কি তবে ভুলে গেল! নাকি ফিউজ উড়ে গেল কোথাও!
এদিক-ওদিক, কোনও দিকেই কারোর চিহ্নমাত্র নেই! প্রণব বা সুচরিতাকে দ্যাখা যাচ্ছে না। এমনকি শোনা যাচ্ছে না তাদের কণ্ঠস্বর বা কথোপকথনও শ্মশানের মতো নিস্তব্ধ হয়ে আছে গোটা বাড়ি। ভোলারও কোনও সাড়াশব্দ নেই। সবাই গেল কোথায়!
মাথার ওপরের আওয়াজটা সাময়িক বিরতি দিয়েছিল। এবার দ্বিগুন জোরে শুরু হল। সেই একটানা ধপ্ ধপ্! কীসের শব্দ! কে-ই বা পরিত্যক্ত স্টোররুমে অসময়ে ঢুকল! দেখতেই হচ্ছে!
শুক্লা হাত বাড়িয়ে হলঘরের আলোটা জ্বেলে দিলেন। ফিউজের কোনও সমস্যা নেই, মুহূর্তের মধ্যে আলোকিত হল গোটা ঘর। হলঘরের একপাশে টেবিলে রাখা ছিল টর্চ। সেটাই তুলে নিয়ে অদম্য কৌতূহলে তিনি এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে। ঘরের আলোর খানিকটা উপছে পড়ে আলোকিত করেছে সিঁড়ি। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কোণে কোণে, বাঁকে বাঁকে ওঁত পেতে আছে অন্ধকার। আর অন্ধকার দেখলেই আজকাল বুক কাঁপে তার। তবু সাহসে বুক বেঁধে ওপরের দিকে উঠতে শুরু করলেন শুক্লা! হাতের টর্চটাও জ্বেলে দিলেন।
দোতলাতেও এই মুহূর্তে কোনও আলো নেই! কী আশ্চর্য! ভোলা তার নামের সার্থকতা রেখে সত্যিই ভুলে গেল? না সে বাড়িতেই নেই? এরকম ঘটনা আজ পর্যন্ত এ বাড়িতে হয়নি। বিস্মিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছুটা বিরক্তও হলেন তিনি। তাকে ঘরে একা রেখে সবাই কোন রাজ-কার্যে গিয়েছে! আর দোতলায় এমন শোরগোলই বা করছে কে!
শুক্লা সাবধানে সিঁড়ি পেরিয়ে এসে দোতলার সুসজ্জিত ড্রয়িংরুম ক্রস করলেন। টর্চের আলো সরলরেখায় ধীরে ধীরে ছুঁয়ে যাচ্ছে দেওয়াল, সোফা, আসবাবপত্র। তারপরই লম্বা করিডোর। দু-পাশের দেওয়ালে সাজানো নানাধরনের অয়েল পেইন্টিং। প্রণবের শখ। মাঝেমধ্যেই নানারকম দামি দামি অয়েল পেইন্টিং কিনে এনে ঘর সাজান। এখন ঘরের দেওয়াল কম পড়েছে বলে করিডোরও সাজিয়েছেন।
চতুর্দিক ডুবে আছে অন্ধকারে। তার মাঝখান দিয়ে এক নিঃসঙ্গ ছায়ামূর্তি হাতে টর্চ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কিছু নেই, অথচ প্রত্যেকটি পদক্ষেপের সঙ্গে বাড়ছে শব্দের জোর! আগে দুটো আওয়াজের মধ্যে কয়েক সেকেন্ডের বিরতি ছিল। কিন্তু আওয়াজটাও এখন যেন উত্তেজিত হয়ে একদম বিরতিহীন দ্রুত লয়ে চলছে। শুক্লার মনে হল, তার হৃৎপিণ্ডও বুঝি ঐ শব্দের সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে! টের পেলেন দরদর করে ঘামছেন! অসম্ভব ভয় করছে তার। টর্চ ধরা হাতটা সামান্য কাঁপছেও বটে। তা সত্ত্বেও এগিয়ে গেলেন স্টোররুমের দিকে।
শুক্লা টর্চের আলোয় ভালোভাবে দেখতে পাননি। যখন তিনি আস্তে আস্তে এগোচ্ছিলেন, তখন প্রত্যেকটা ছবির সামনে দিয়ে চলে যাওয়া মাত্রই সেগুলো একটা একটা করে নিঃশব্দে সম্পূর্ণ নীচের দিকে ঘুরে যাচ্ছিল। ঠিক যেন অদৃশ্য কেউ রসিকতা করে অয়েল পেইন্টিংগুলোকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে! আর সেই বাঁধানো পেইন্টিং এর কাচে শুধু শুক্লা নয়, তার পিছন পিছন আরেকটা মানবমূর্তির প্রতিফলনও পড়ল! অথচ সেই মানব-মূর্তি সম্পূর্ণ স্বচ্ছ! যেন রক্তমাংস নয়, বায়বীয় পদার্থে গড়া এক মানুষ চুপিসাড়ে পিছু নিয়েছে তার!
কে সে!
৫
পরিত্যক্ত স্টোররুম তখন ডুবেছিল বিস্মৃতির অতলে।
একরাশ ধুলো বালি ও মাকড়সার জালে আচ্ছন্ন ঘরটাকে দেখলেই বোঝা যায় যে, বহুদিন কেউ পা রাখেনি এখানে। শেষ কবে ভোলা এখানে এসেছিল তা ভগবানই জানেন। চতুর্দিকে শুধু বাতিল জিনিসপত্রের স্তূপ। তিন বছর আগে প্রণব গোটা বাড়িটাকেই রি-ইনোভেট করিয়েছিলেন। পুরোনো আসবাবপত্র তার পছন্দ হচ্ছিল না। এই বাড়িটা প্রণবের বাবার। স্বাভাবিকভাবেই সব ফার্ণিচারই মান্ধাতার আমলের ছিল! আজকাল বাড়িতে কেউ অত ভারি ভারি ফার্ণিচার রাখে না। আবার প্রাণে ধরে ফেলেও দেওয়া যায় না কারণ ওই আসবাবগুলোর সঙ্গে বহুদিনের স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। তাই সেগুলোর স্থান হয়েছে এই ঘরে।
শুক্লা সুইচবোর্ডে হাত রাখতেই দপ্ করে বাল্ব জ্বলে উঠল। বাল্বটার চতুর্দিকে মাকড়সার জাল তার সোনালি আলোকে কিছুটা ম্লান করেছে। তা সত্ত্বেও ঘর আলোকিত হল।
কী নেই এই স্টোররুমে! বহু পুরনো পালঙ্ক, আকবরী আমলের ড্রেসিং টেবিল, ভাঙা চোরা অযত্নলালিত টিভি, গুচ্ছের ভাঙা শো-পিস, অপ্রয়োজনীয় আসবাব, জং ধরা করাত, মাথা ভাঙা হাতুড়ি, বিবর্ণ পর্দা থেকে শুরু করে সৃজনের শৈশবের কাঠের রকিং হর্স, পুতুল অবধি সবই রয়েছে। কিছু জিনিস সাদা কাপড়ের তলায় মূক হয়ে আছে, কিছু ধুলোর আস্তরণে ধূসর।
শুক্লা এ ঘরে পা রাখতে না রাখতেই ধপ্ ধপ্ আওয়াজটা থেমে গিয়েছিল। এই মুহূর্তে আর কোনও শব্দ নেই। গোটা ঘরটাই নীরবতায় আচ্ছন্ন। তিনি সবিস্ময়ে একবার চতুর্দিকটা জরিপ করলেন। আওয়াজটা তো এখান থেকেই আসছিল! অথচ কোথাও কিছুই নেই! তবে কী হল? তিনিই কি ভুল শুনলেন? এত বড় ভুল তো কখনও হয় না। যখন এদিকে আসছিলেন তখনও আওয়াজটা শোনা যাচ্ছিল। এখন কোথায় গেল!
চিন্তাটা মাথায় আসতেই যতটুকু সময় লেগেছে! শুক্লা একটু বিভ্রান্ত হয়ে স্টোররুমের আলো নিভিয়েই দিতে যাচ্ছিলেন। আচমকা তার পেছন দিক দিয়ে ফের জাগ্রত হল সেই ধ্বনি! ‘ধপ্…ধপ্…ধপ…!
বিদ্যুৎবেগে পিছনে ফিরলেন শুক্লা। সঙ্গে সঙ্গেই আবিষ্কৃত হল শব্দের উৎস! সৃজনের বহু পুরোনো একটা ফুটবল! বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখলেন, পুরনো ফুটবলটা নিজে থেকেই মেঝের ওপরে লাফাচ্ছে! অর্থাৎ বাউন্স করছে। যেন কেউ তাকে সজোরে আছড়ে ফেলছে স্টোররুমের মেঝেতে। পরক্ষণেই বলটা বাউন্স ব্যাক করে লাফিয়ে উঠছে শূন্যে! আবার কোনও অদৃশ্য শক্তি খেলাচ্ছলে তাকে থাবড়ে ফেলছে মাটিতে। বলটা আবার লাফিয়ে উঠছে!
এই অদ্ভুত খেলারই আওয়াজ হচ্ছে, ধপ্ ধপ্! অথচ সেখানে কেউ নেই! কেউ বলটাকে নিয়ে খেলছে না! ওটা নিজে থেকেই একবার লাফিয়ে উঠছে, পরক্ষণেই পড়ছে! আবার লাফাচ্ছে, আবার আছড়ে পড়ছে। আবার!
ভয়ার্ত শুক্লা কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ফুটবল কখনও নিজে নিজে এভাবে লাফাতে পারে! তিনি কিছু করার আগেই সাঁই করে তার দিকেই ছুটে এল বলটা! কেউ বুঝি সকৌতুকে বল ছুঁড়ে দিয়েছে তাকে লক্ষ করে।
শুক্লা খপ্ করে বলটাকে ধরে ফেললেন। সৃজনের শৈশবের বড় প্রিয় খেলা ছিল বল ছোঁড়াছুঁড়ি। যেমন দুষ্টুমি করে সে ফুটবলটাকে মায়ের দিকে ছুঁড়ে দিত, অবিকল তেমনভাবেই যেন কেউ ছুঁড়ে দিল বলটা! তিনি স্তম্ভিত! হৃৎপিণ্ডটা এবার যেন কয়েক হর্সপাওয়ারের মেশিনের মতো চলতে শুরু করেছে। দরদর করে ঘামছেন শুক্লা। এ কী! যা দেখছেন তা কি বাস্তব! না এটাও দুঃস্বপ্ন!
মুহূর্তের নীরবতা! পরক্ষণেই সমস্ত নৈঃশব্দকে ভেঙে দিয়ে খিল খিল করে হেসে উঠল কে যেন! শুক্লা প্রায় আঁতকে উঠে সামান্য পিছিয়ে গেলেন! তার গোটা দেহই এবার শিউরে উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে কে এমন পাগলের মত খলখলিয়ে হাসছে! এ কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের হাসি নয়। বরং কোনও দুষ্টু শিশু ভারি মজা পেয়ে খটখট্ করে হেসে উঠলে এরকম শোনায়। তিনি উদভ্রান্তের মত এদিক ওদিক দেখছেন। কে হাসছে! কে! কোথায়? কেন!
খুঁজতে খুঁজতেই ঘরের এককোণে দৃষ্টি গেল তার। সৃজনের লাফিং ডল! সচরাচর এই জাতীয় লাফিং ডলকে কেউ স্পর্শ করলে পুতুলটা পাগলের মত হাত-পা ছুঁড়ে হাসতে থাকে। তার হাসির আওয়াজ অবিকল একটি শিশুর মত। এখনও পুতুলটা ভারি মজা পেয়ে হাত-পা ছুঁড়ে খিল্ খিল্ করে হাসছে! অথচ আদৌ তার হাসার কথাই নয়! কারণ কেউ তাকে স্পর্শ করেনি। এখানে শুক্লা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও মানুষ নেই।
হাসতে হাসতেই পুতুলটা খন্ড মুহূর্তের জন্য থামল। তারপরই আবার হাসতে শুরু করল! বোধহয় কেউ বারবার পুতুলটাকে সবার অগোচরে ছুঁয়ে যাচ্ছে। যখনই সে হাসতে হাসতে থামছে, তখনই আবার টুক করে তাকে স্পর্শ করছে। ফলস্বরূপ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে পুতুলটা! সে হাসি অদ্ভুত নিষ্ঠুর! শিশুর হাসির মতো সুন্দর জিনিস খুব কমই আছে। কিন্তু শুক্লার মনে হল, শিশুর হাসির মতো ভয়ংকর জিনিসও খুব কম! ভয় পাচ্ছেন তিনি। ভীষণ ভয় পাচ্ছেন!
তার কপাল বেয়ে টপটপ করে ঘামের ফোঁটা চুঁইয়ে পড়ে। এসব কী হচ্ছে! যা ঘটছে তা বাস্তব নয়! হতে পারে না! ফুটবল নিজে থেকেই ড্রপ করতে পারে না। লাফিং ডল নিজে থেকেই হাসতে পারে না। অসম্ভব!
পুতুলটা হাসি থামাতে না থামাতেই ফের একটা কড়কড়ে আওয়াজ! এবার আর দিক চিহ্নিত করতে ভুল হয়নি। শুক্লা সটান তাকালেন ঠিক তার ডান দিকে। সেখানে ধূলি-ধূসরিত আদ্যিকালের রেডিয়ো পড়ে ছিল। তিনি সভয়ে আবিষ্কার করলেন, এখন রেডিয়োটাই এই অদ্ভুত যান্ত্রিক আওয়াজ করছে। কেউ যেন অন করে দিয়েছে ওটাকে! বহু পুরনো রেডিয়ো! অনেকদিন আগেই খারাপ হয়ে গিয়েছিল, আর মেরামত করা যায়নি। প্রায় একযুগ ধরে নীরব হয়েছিল রেডিওটা। আজ, বহুবছরের নিস্তব্ধতা কাটিয়ে বলে উঠল, “নমস্কার,” রেডিয়োর ভেতর থেকে ভেসে এল ঘোষকের গমগমে কণ্ঠস্বর, “আপনারা শুনছেন কলকাতা ক। আর আমি…”
এবার যা হল তা অবিশ্বাস্য! সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রেডিয়োর ঘোষকও বলে উঠলেন, “আমি জানি যা হয়েছিল।”
ভয়, বিস্ময়ের সীমা সহ্যশক্তির অন্তিম পর্যায় পেরিয়ে গেল। শুক্লার মনে হল, তিনি এখনই হার্টফেল করবেন! যে রেডিয়ো অচল, আজ তার ভেতর থেকেই গম্ভীর আওয়াজ আসছে, “আমি জানি যা হয়েছিল!…আমি জানি যা হয়েছিল….আ-মি জা-নি যা হ-য়ে-ছি-ল!”
তীব্র আওয়াজে কানের পর্দা প্রায় ফেটে যাওয়ার উপক্রম! বদ্ধ ঘরের মধ্যে প্রতিটা ইট-কাঠ-পাথর ফুঁড়ে, প্রতিটা প্রাচীন আসবাবের মধ্য দিয়ে ভেসে আসছে চিৎকার! না, ঠিক চিৎকার নয়; আর্তনাদ! একটাই বাক্য! একটাই বক্তব্য, “আ-মি জা-নি যা হ-য়ে-ছি-ল!”
আর সহ্য হচ্ছে না! আর সহ্য করা সম্ভব নয়! এবার বোধহয় মাথাটাই ফেটে যাবে! মস্তিষ্কের শিরা উপশিরা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম! দু-হাতে নিজের কান চেপে ধরেছেন শুক্লা। হাত থেকে টর্চটা গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। অসম্ভব ভয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। ভয়তাড়িত মানুষটি অন্ধকারের তোয়াক্কা না করে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়োলেন। অন্ধকার করিডোরের আলো কারোর ইশারায় দপদপিয়ে জ্বলে উঠল। আশপাশের যত ঘর অন্ধকারে ডুবেছিল, সর্বত্র এবার আলো জ্বলছে। শুধু জ্বলছে না, আবার নিভছেও। কে-যেন খামখেয়ালি আঙুলে লাইটগুলোকে সুইচ অন, সুইচ অফ করছে! জ্বলছে… নিবছে… জ্বলছে… নিবছে… জ্বলছে!
কোনওমতে হুড়মুড়িয়ে দোতলা থেকে নেমে এলেন শুক্লা! প্রায় প্রাণ হাতে করে পড়ি-কী-মরি ছুটছেন। পালাতে হবে। যে করেই হোক, এখান থেকে পালাতেই হবে তাকে! হাঁফাতে হাঁফাতে নীচের হলঘরে নেমে এলেন। তিনি কি সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছেন! যা দেখছেন, যা ঘটছে; সবটাই কি তার কল্পনা হতে পারে? চূড়ান্ত ভয়ের সঙ্গে একটা অসহায় কান্নাও তাকে গ্রাস করছে। দু-একবার শাড়িতে পা বেজে সপাটে আছড়ে পড়লেন মাটিতে। হাতে, পায়ে ব্যথা পেলেন! কিন্তু তবু থামলেন না। পালাতেই হবে! আর উপায় নেই।
পাগলের মতো দৌড়োতে দৌড়োতেই তিনি সজোরে ধাক্কা খেয়েছেন কারোর সঙ্গে। ভয়ার্ত, বিধ্বস্ত মানুষটি দেখলেন, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অতি পরিচিত একটা মুখ। দীর্ঘকালের বিশ্বস্ত ভৃত্য ভোলা! সে ঐ সুপ্রাচীন বটগাছটার মত একটা নিরাপদ আশ্রয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উঃ! অবশেষে একজন আপন মানুষ! একটু উষ্ণতা… একটু স্বস্তি!
—“ভো-লা!” এতক্ষণ আতঙ্কে, প্রবল নিরাপত্তাহীনতায় বোধহয় সমস্ত অনুভূতিই মুছে গিয়েছিল। এবার ভোলাকে ছেলেমানুষের মত দু-হাতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন শুক্লা। কোনওমতে বলললেন, “ভোলা!… ও-ওই ঘরে ওই ঘরে কেউ আছে। কিছু আছে! ভোলা, আমায় বাঁচা!… প্লিজ বাঁ-চা!”
ভোলা মুখ নীচু করে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে আস্তে চোখ তুলে তাকাল কর্ত্রীর দিকে। শুক্লা তার মুখের দিকে তাকিয়েই তড়িদাহতের মত কেঁপে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন! এ কী! ভোলার চোখ দুটো যে সম্পূর্ণ সাদা! অবিকল সেই অফিসারের পাথরের চোখ দুটো কেউ বসিয়ে দিয়েছে তার চোখে! একদম ফকফকে সাদা চোখে তাকিয়ে আছে সে।
যন্ত্রচালিতের মতো বলল ভোলা, “আমি জানি যা হয়েছিল!”
ভোলার ঠিক পেছন থেকেই আরও একটি কণ্ঠ বলে উঠল সেই একই কথা! একই বাক্য! ভয়বিহ্বল দৃষ্টিতে শুক্লা দেখলেন, এক জন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে হলঘরে। তার পরনে ডাক্তারের অ্যাপ্ৰণ। হাতে সার্জিক্যাল নাইফ! চোখ দুটো সাদা। ভোলার হাতেও একটা ছুরি! কিচেন নাইফ!
দু-জনেই হাতের দুটো ছুরি সামান্য তুলে ধরে তোতাপাখির মতো সমবেতস্বরে বলল, “আ-মি জা-নি যা হ-য়ে-ছি-ল…”
৬
ঠিক রাত তিনটে।
গোটা বাড়িটা এখন নিঝুম। ঘণ্টা চারেক আগেও এখানে পুলিশের দাপাদাপি চলছিল। অ্যাম্বুলেন্সের গগনবিদারী চিৎকার, পুলিশদের জোরালো বুটের খটখট, উচ্চস্বরের জেরায় উচ্চকিত হয়েছিল গোটা পরিবেশ। দু-দুটো লাশ পাওয়া গিয়েছে এ বাড়িতে। একটা দেহ ভোলার। অন্যটা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের অপরিচিত হলেও পুলিশ তাকে শহরের নামকরা ডাক্তার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ডাক্তারবাবুর সম্পূর্ণ নাম ডঃ পূর্ণেন্দু সেন। পাওয়া গিয়েছে চিলড্রেন্স পার্কের সেই অজ্ঞাতপরিচয় লোকটির হদিশও। সে নামকরা হিস্ট্রিশিটার। শহরের অন্যতম দাগী সুপারি-কিলার রাশিদ মন্ডল। কিন্তু হঠাৎ করে সে আত্মহত্যা করল কেন তা এখনও অজ্ঞাত। যেমন অপরিচিত ডাক্তার ও ভোলার আত্মহত্যার পিছনেও কোনও কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি!
হ্যাঁ, ভোলা এবং আগন্তুক দু-জনেই আত্মহত্যা করেছে। দু-জনেই হাতের ছুরিটা নিজের বুকেই গেঁথে দিয়েছিল। কেন, কী জন্য কেউ জানে না! যখন সুচরিতা ও প্রণব বাড়িতে ফিরে এসেছিলেন, তখনই আবিষ্কার করেছিলেন ব্যাপারটা। হলঘরে দু-দুটো মৃতদেহের মাঝখানে নির্বাক পুতুলের মতো জড়োসড়ো হয়ে বসেছিলেন শুক্লা! কিন্তু কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল; কিছুই বলতে পারছেন না। পুলিশও তার মুখ থেকে কোনও কথা বের করতে পারেনি। তিনি শুধু মেঝেতে গুটিশুটি বসে হী হী করে কাঁপছেন আর একটা কথাই বিড়বিড় করে বলছেন।
—“আমি জানি যা হয়েছিল!”
চব্বিশ ঘণ্টাও হয়নি একের পর এক লাগাতার মৃত্যু। শুরু হয়েছিল ইনভেস্টিগেটিং অফিসারকে দিয়ে। কিন্তু আদৌ শেষ হয়েছে কিনা বলা দায় চব্বিশ ঘন্টায় চার জন! তা ও অদ্ভুত পদ্ধতিতে আত্মহত্যা! যদিও এখন পুলিশ আত্মহত্যার থিওরিতে বিশ্বাস করছে না। তবু এক অসহায়, মানসিকভাবে পর্যুদস্ত ও ক্ষীণকায় শিক্ষিকা ছুরি দিয়ে নিজেরই বাড়ির চাকর ও এক জন অজ্ঞাত-পরিচয় ব্যক্তিকে মারবেন. তা-ও বিশ্বাসযোগ্য নয়। আর সুপারি-কিলার রাশিদ যে নিজেই ট্রাকের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তা প্রতিষ্ঠিত সত্য। ট্রাক ড্রাইভার তাৎক্ষণিকভাবে পালিয়ে গেলেও পরে তাকে ধরতে পেরেছে পুলিশ। তার বয়ান প্রণব ও সুচরিতার সঙ্গে হুবহু মিলে গিয়েছে। ট্র্যাফিক সিগন্যালের সিসিটিভি ফুটেজেও যতটুকু দেখা গেল তাতেই স্পষ্ট, লোকটা নিজেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ট্রাকের সামনে। সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
তবু তারা একের পর এক প্রশ্ন করে গিয়েছে শুক্লাকে। ঘটনাটা কখন ঘটেছে, কীভাবে ঘটেছে, এর পিছনের কারণ সম্পর্কে শুক্লার কোনওরকম ধারণা আছে কিনা ইত্যাদি রুটিন প্রশ্ন। আর প্রত্যেকবারই বিড়বিড় করে একই কথা বলে গিয়েছেন শুক্লা।
—“আমি জানি যা হয়েছিল, আমি জানি যা হয়েছিল, আমি জানি…!” অবশেষে কিছুই বুঝতে না পেরে ওদের সাময়িক নিষ্কৃতি দিয়েছে পুলিশ। শুক্লাকে ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান এসে দেখেও গেছেন। তার শারীরিক ও মানসিক অবস্থা দেখে কিছু ওষুধ ও সেডেটিভ প্রেসক্রাইব করে দিয়েছেন। আপাতত সেই সেডেটিভের কল্যাণেই গভীর ঘুমে হয়তো বা প্রশান্তি খুঁজে পেয়েছেন তিনি। তার অবস্থা দেখে সুচরিতাও আপাতত এ বাড়িতেই থেকে গিয়েছে।
এক তলার গ্র্যান্ডফাদার ক্লকে ঢং ঢং করে ঠিক তিনটে ঘন্টা পড়ল। চতুর্দিক জনহীন। শুধু দু-একটা বেওয়ারিশ কুকুর মাঝেমধ্যে কেঁদে উঠছে। কুকুরের কান্না অশুভ। তার ওপর এত রাতে দূর থেকে ভেসে আসা করুণ ডাক কেমন যেন অলৌকিক লাগছে! আকাশে আজও মেঘ জমে আছে। কালো রঙের থরে থরে জমাট বাঁধা অন্ধ মেঘগুলোকে দেখলে ভয় করে। মেঘ নয়, প্রকৃতির ভ্রূকুটি।
—“উঁ…ঊ…উঁ…উঁ!”
দূর থেকেই আবার কুকুরের কান্না ভেসে এল। অসহ্য কাঁদুনি! শুনলেই অস্বস্তি লাগে! এমনভাবে কাঁদছে যেন জাগতিক প্রাণী নয়, কোনও অতৃপ্ত প্রেতাত্মা গুমরে গুমরে কেঁদে মরছে! তার সঙ্গেই একটা খস্থস্ শব্দ! অন্ধকারের মধ্যেই প্রকট হল এক আবছায়া মূর্তি। কিছুক্ষণের প্রতীক্ষা তারপরেই দপ্ করে আলো জ্বলে উঠেছে। ছায়াটার বাঁ হাতে একটা টর্চ। ডান হাতেও ধাতব কিছু একটা চকচক করে উঠল। তবে এখনও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না যে ওটা কী!
ছায়ামূর্তি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ভূপতিত মহীরুহের দিকে। কাঠের গায়ে একটা ধাতব ধারালো জিনিসের কোপ পড়ার শব্দ! কুড়ুল! ছায়াদেহ ভীষণ উত্তেজিত! বটগাছটার শাখা-প্রশাখায় এক হাতেই কুড়ুল ধরে কোপের পর কোপ মারছে। এই গাছটাই যত নষ্টের গোড়া! এটাকে এখনই ঝড়ের আঘাতে উলটে পড়তে হল! তা-ও এমনভাবে পড়েছে যে নির্দিষ্ট জায়গাটা খুঁজে বের করাই প্রায় অসম্ভব! লোকজন ডেকে সাফ করানোও বিপজ্জনক। কে জানে, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যদি কেউটে বেরিয়ে আসে! এখনই যা করার করে ফেলতে হবে। গাছটা সরানো যাবে না, তবু যদি কোনওভাবে একটু ডালপালা সরিয়ে দিয়ে জিনিসটা বের করে আনা যায়…
—“পারবে না!”
ছায়ামূর্তির ঠিক পিছন থেকেই ভেসে এল একটি বালকের তীব্র স্বর! তার হাতের টর্চটা হঠাৎ করে কেমন যেন পাগলামি শুরু করল! টর্চের আলো হঠাৎই প্রচণ্ড তীব্র হয়ে জ্বলে উঠে পরমুহূর্তেই ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হতে শুরু করেছে। ক্ষীণ হতে হতেই আবার দপ্ করে উজ্জ্বল হয়ে উঠল! আলোটা রীতিমতো নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে।
ছায়ামূর্তি একটু ঘাবড়ে গিয়েই ঘুরে দাঁড়ায়। টর্চের আলোর আওতার বাইরে সুস্পষ্ট একটি ছোট্ট মানুষের অন্ধকারাচ্ছন্ন দেহ-রেখা। বোঝা যায়, যে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে এক বালক! ছোট্ট মূর্তিটা নড়ল না ঠিকই, তবে আবার শোনা গেল তার শান্ত কণ্ঠস্বর!
—“বাবা, আমি জানি সেদিন যা হয়েছিল!”
—“বাবি!”
অন্ধকারের মধ্যেই স্পষ্ট শোনা যায় প্রণবের গলা, “বাবি, তুই!”
—“তুমি পারবে না বাবা!” বালকের গলায় অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী,
–“সেদিনও তুমি পারো নি! এখনও পারবে না।”
প্রণব স্নেহাদ্র কণ্ঠে বলে, “কী বলছিস বাবা!”
— “আমি জানি সেদিন যা হয়েছিল!” বালকের কণ্ঠস্বর কয়েক পর্দা চড়ল,
— “সেদিনও হয়নি! আজও হবে না।”
প্রণব কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন সেই বালকের আবছায়া মূর্তির দিকে। তারপর আস্তে আস্তে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। অসম্ভব অনুতাপ, প্রচণ্ড যন্ত্রণা-মাখা কণ্ঠে বললেন, “বাবি, আমার ভুল হয়ে গিয়েছে! বিশ্বাস কর! ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট!”
আবার ভেসে এল সেই একই বাক্য, “আমি জানি সেদিন যা হয়েছিল!”
—“আমি তোকে মারতে চাইনি!” এবার কান্না-বিকৃত শব্দগুলো কোনওমতে উচ্চারণ করলেন তিনি, “ওটা শুধু একটা অ্যাক্সিডেন্ট।”
—“মা-কে মারতে চেয়েছিলে। সেটা অ্যাক্সিডেন্ট নয়, মার্ডার ছিল!” মুহূর্তের মধ্যে প্রণবের চোখের সামনে ভেসে উঠল ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দৃশ্য! মনে পড়ল সেই সুপারি-কিলার রাশিদের কথা! লোকটা খুব মৃদুস্বরেই বলেছিল,
—“এত মগজমারির কী আছে উকিলসাহেব? এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার তো লিগ্যাল! সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত পারমিশন দিয়ে দিয়েছে। আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন। এরকম মারাত্মক কাজ করছেন কেন? ম্যাডামকে বলে দিন-না!”
—“ম্যাডামকে কী বলব?” ঝাঁঝিয়ে উঠেছিলেন প্রণব, “বলব, যে তোমার বোন সুচরিতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আছে? বলব, যে পিল নেওয়া সত্ত্বেও সে প্রেগন্যান্ট হয়েছে! এখন বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু কয়েক মাস পরেই বোঝা যাবে! ওর পেটের বাচ্চাটা আমার! এইসব বলব ম্যাডামকে!”
—“আরে তা-লে ডিভোর্স দিন না! খামোকা কিচাইনের কোনও মানে হয়?” সুপারি-কিলার ব্যঙ্গ-বঙ্কিম হাসে, “শালিকে বিয়ে করতে হলে বৌ-কে খুন করতে হবে এমন মাথার দিব্যি কে দিল!”
—“আর ইউ ইনসেন রাশিদ?” প্রণব বিরক্ত, “শুক্লাকে ডিভোর্স দেব কোন্ গ্রাউন্ডে? তার দিক দিয়ে কোনও ত্রুটি নেই। তাছাড়া ডিভোর্স দিলেও তাকে খোরপোশ দিতেই হবে। সবচেয়ে বড় কথা, আমার ছেলে বাবি। সে এখন সব কিছু বোঝে। ডিভোর্স হলে ছেলের কাস্টডি শুক্লা পাবে। বাবি আমাকে ভালোবাসলেও মা-কে ছেড়ে থাকতে পারবে না। আর এসব জানার পর তো আমার সঙ্গে আরও থাকবে না! বাবিকে ছাড়া আমিও থাকতে পারব না।”
—“লেঃ হালুয়া!” রাশিদ হাসতে হাসতে মাথা চুলকোয়, “আপনাদের বড়ো মানুষদের ব্যাপার স্যাপার শ্লা বহুত গড়বড়ের! বউয়ের কোনও খুঁত নেই, ছেলেকে ছাড়া থাকতে পারবেন না! তবে শালির সঙ্গে ইন্টুপিন্টু করতে গেলেন কেন? আমরা অশিক্ষিত পাব্লিকরা তো বউয়ের খুঁত থাকলে তবেই অন্য মেয়েছেলে-মুখো হই। আপনারা শা, এমনি এমনিই! কোনও অশান্তি নেই, কিচ্ছু নেই… অথচ…! মজায় আছেন!”
রাশিদের কথাগুলো যেন সপাটে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিয়েছিল প্রণবের মুখে! একটা সুপারি কিলার তাকে ধর্মের পাঠ পড়াচ্ছে! সত্যিই তো! বহু বছরের দাম্পত্য জীবনে শুক্লার দিক থেকে কোনও অভিযোগ করার সুযোগ পাননি তিনি। শুক্লা পারফেক্ট ঘরণী, পারফেক্ট স্ত্রী এবং অবশ্যই এক জন পারফেক্ট মা ও বটে। কিন্তু পারফেক্ট প্রেমিকা নন! সুচরিতার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কারণ ওই একটাই। সে দামাল, শুক্লার মতো লাজুক নয়। সুচরিতা অনেক বেশি সাহসী এবং বুদ্ধিমতী। কোর্টে সিংহের উপযুক্ত সিংহীর মতো লড়তেও জানে। বহু বছর একঘেয়ে উত্থান-পতনহীন দাম্পত্য জীবনে অভ্যস্ত প্রণব তার মধ্যে রোমাঞ্চ খুঁজে পেয়েছিলেন! আর সুচরিতা খুঁজছিল সম্পর্কের পরিচয়। বারবার বলছিল, “অনেক হয়েছে। আর কত দিন এমন লুকিয়ে লুকিয়ে চলবে সব? এবার তুমি দিদিভাইকে ডিভোর্স দিয়ে আমায় বিয়ে করো।”
কিন্তু সেটাই তো পেরে উঠছিলেন না প্রণব। শুক্লার শান্ত, আনন্দিত মুখ, ছেলের সঙ্গে মায়ের নিবিড় ভালোবাসার সম্পর্ক তাকে কিছুতেই ভাঙনের কথা বলতে দিচ্ছিল না। দিনের পর দিন বাধ্য হয়েই এক পারফেক্ট স্বামীর অভিনয় করে চলেছিলেন। ওদিকে সুচরিতা ঘোষণা করল, “আমি প্রেগন্যান্ট প্রণবদা!”
প্রণব একদিকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আদর্শ স্বামীর অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এবার দুনিয়ার সব রাগ গিয়ে পড়ল শুক্লার ওপরে! এই নারীর জন্য কিছুতেই তিনি সুচরিতাকে বিয়ে করতে পারবেন না! এই নারীর জন্য তাকে হয়তো সন্তান-সুখ থেকেও বঞ্চিত হতে হবে! এই নারী নিজেকে আদর্শ স্ত্রী প্রমাণ করে প্রণবকে লম্পট প্রমাণ করে দেবে। বাবি তাকে ঘেন্না করবে, সমাজ তাকে ঘেন্না করবে! সবাই বলবে, –“বৌ-টা বড় ভালো ছিল, লোকটাই…!” বাবি বলবে, “আমার বাবা চরিত্রহীন!”
আর সহ্য করতে পারছিলেন না প্রণব। সন্তান, সমাজ, সুনাম; সবকিছু বাঁচানোর একটাই উপায়। শুক্লাকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া! আইনি পথে নয়, বেআইনি পথে!
বহুদিনের পুরোনো ভৃত্য ভোলাকে নরমে-গরমে পথে এনেছিলেন তিনি। ভোলা সেদিন শুক্লার খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিল। তিনি নিজে চলে গিয়েছিলেন কোর্টে। কারণ খোদ আদালতে উপস্থিত থাকার চেয়ে বড়ো অ্যালিবাই আর নেই। রাশিদকে প্রচুর টাকা দিয়েছিলেন। প্রণব জানতেন, লাঞ্চের পর শুক্লা নিজের ঘরে বিশ্রাম নেবেন। ঘুমের ওষুধ খাওয়ার দরুন তার ঘুম ভাঙবে না। বাবি নিজের রুটিন অনুযায়ী অতনুদের বাড়িতে খেলায় ব্যস্ত থাকবে। ভোলাকে তো আগেই হাত করেছিলেন। পুরো ফাঁকা মাঠ! সুপারি-কিলার রাশিদ ঠিক নিজের কাজটা করে দেবে। এক দুর্বল নারীর গলা টিপে মারতে তার হাতও কাঁপবে না। তার কেস-ফাইল থেকে জেনেছিলেন, খুনের কোনও প্রমাণ রাখে না রাশিদ। এমনকি, গলায় হাতের ছাপও থাকবে না। তারপর স্বাভাবিক মৃত্যুর সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য ডঃ পূর্ণেন্দু সেন তো আছেনই!
একদম পারফেক্ট প্ল্যানিং করেছিলেন প্রণব বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানতেন, এটাই সোশ্যাল ইমেজ রক্ষা করে, ছেলের কাছে নিজের সম্মান বাঁচিয়ে শুক্লার হাত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একমাত্র উপায়। কিন্তু এটা জানতেন না, যে ঠিক সেদিনই সৃজন টেবল টেনিসে হারবে! সেদিনই মুড অফ হবে তার!
এবং সেদিনই সে বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া করে সময়ের অনেক আগেই বাড়িতে ফিরে আসবে! আর ফিরেই যে সটান মায়ের ঘরে হানা দেবে, তাই বা কে জানতো!
আজ ছোট্ট ছায়াটার সামনে হাঁটু-গেড়ে বসে অনুতাপে কাঁদছিলেন তিনি। কী করে জানবেন যে শুক্লাকে খুন করতে আসা রাশিদকে সৃজন দেখে ফেলবে! কী করে বুঝবেন, যে ছেলের জন্য এতকিছু সেই ছেলেকেই নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে খুন করে ফেলবে নিষ্ঠুর সুপারি কিলার! রাশিদ প্ল্যানমাফিক শুক্লার ঘরে ঢুকেছিল। তাকে সাহায্য করেছিল ভোলা! কিন্তু শিকারকে মারার আগেই সে ঘরে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল সৃজন! আর নিষ্ঠুর খুনী প্রত্যক্ষদর্শী ছেলেটিকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বারো বছরের বালককেই গলা টিপে মেরে ফেলল!
—“সব শেষ হয়ে গেল!… সব শেষ! আমি তোকে মারতে চাইনি বাবি!” বালকের ছায়ামূর্তি নীরব। ভূ-লুণ্ঠিত বটগাছটা যেন একটু নড়ে উঠল। এই গাছটার তলায় নিজের হাতে সন্তানের নিথর দেহটা পুঁতে দিয়েছিলেন প্রণব। বাবির হস্তক্ষেপে সেদিনের পুরো পরিকল্পনাই ভেস্তে গিয়েছিল। শয়তান খুনীটা বাবিকে খুন করে পালিয়েছে দেখে ভয়ার্ত ভোলা ফোন করেছিল প্রণবকে তিনি প্রথমে অসম্ভব শোকে কী করবেন, কী বলবেন বুঝতে পারেননি। ভোলা উপায়ান্তর না দেখে সৃজনের মৃতদেহটাকে গভীর রাত অবধি লুকিয়ে রেখেছিল স্টোররুমে! বাতিল, বৃদ্ধ ফার্ণিচারের তলায় সযত্নে রাখা ছিল তার লাশ! পুলিশ যখন বাইরে তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে, তখন নিজের বাড়ির স্টোররুমেই শুয়ে ছিল প্রাণহীন সৃজন। গভীর রাতে সুযোগ বুঝে প্ৰণব ও ভোলা তাকে ঠিক বটগাছটার তলাতেই সমাহিত করেন!
—“তুমি আর পারবে না বাবা! মা-কে মারতে তুমি আর কখনই পারবে না! আমাকেও সরাতে পারবে না। আমি সবসময় এখানেই থাকব।” স্পষ্ট কাটা কাটা উচ্চারণে বলল বালক, “মায়ের কাছে।”
প্রণব বুঝলেন, তার বিদেহী সন্তান সত্যিই সব জানে! ওর কাছ থেকে আর কিছু লুকোনো যাবে না। যেমন লুকোনো যায়নি ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের শ্যেনদৃষ্টি থেকে। অফিসার জানতে পেরেছিলেন সবই। প্রচুর টাকা খাইয়ে তার মুখ বন্ধ করতে হয়েছিল প্রণবকে। সুচরিতাকেও অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ভ্রূণ নষ্ট করতে রাজি করিয়েছিলেন। সুচরিতা এই সব প্ল্যানের কথা জানত না। তাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, শুক্লাকে ডিভোর্স দিয়ে ওকেই বিয়ে করবেন। কিন্তু শুক্লাকে আর সহ্য হচ্ছিল না! মনে হচ্ছিল, রাশিদ নয়, এই নারীই তার সর্বনাশ করেছে! ওর জন্যই সৃজনকে হারিয়েছেন তিনি। এমনিতেই মানসিকভাবে শুক্লা চরম বিপর্যস্ত ছিলেন! কী হবে, যদি ড্রাগের ওভার ডোজে তিনি মারা যান? অথবা অবসাদ সহ্য করতে না পেরে প্রচুর স্লিপিং পিল খেয়ে আত্মহত্যা করেন? সন্তানকে তো প্রণব হারিয়েছেনই! তবে এই নারীর বেঁচে থাকার অর্থ কী!
ভোলার দায়িত্ব ছিল শুক্লার খাবারে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেওয়ার। কিন্তু তার আগেই একের পর এক আত্মহত্যা! চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে চার চারটে মানুষ শেষ…!
—“আমি জানি কী হয়েছিল!” বিদেহী ছায়া হিসহিসিয়ে বলল, “একজন এখনও বাকি আছে। মাস্টারমাইন্ড! তুমি আর কোনওদিন আমার মায়ের দিকে হাত বাড়াতে পারবে না!”
—“বা-বি!”
প্রণব কিছু বলে উঠতে গেলেন! কিন্তু তার আগেই তার নিজের হাতের কুড়ুলটাই যেন জীবন্ত হয়ে লাফিয়ে উঠল! সেকেন্ডের ভগ্নাংশে অমানুষিক জোরে শানানো ফলাটা বসে গেল প্রণবেরই কন্ঠনালীতে! তিনি একটা আর্তনাদ করে ওঠারও সময় পেলেন না। বিস্ফারিত চোখ দুটোয় আস্তে আস্তে নেমে এল মৃত্যুর অন্ধকার। ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মহামহিম বটগাছটার মতই তিনিও লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে! শরীরটা থরথর করে শেষবারের মত কেঁপে উঠল। পরক্ষণেই সব শেষ!
শুক্লা তখন নিজের ঘরে গভীর ঘুমে মগ্ন ছিলেন। তিনি স্বপ্ন দেখছিলেন। নাঃ, কোনও দুঃস্বপ্ন নয়। দেখছিলেন, বটগাছটার নীচে দাঁড়িয়ে আছে সৃজন খিলখিল করে হাসছে আর চিৎকার করে আবৃত্তি করছে তার প্রিয় কবিতা,
—“রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা
এমন কেন সত্যি হয় না, আহা।
ঠিক যেন এক গল্প হত তবে,
শুনত যারা অবাক হত সবে,
দাদা বলত ‘কেমন করে হবে,
খোকার গায়ে এত কি জোর আছে?’
পাড়ার লোকে সবাই বলত শুনে,
‘ভাগ্যে খোকা ছিল মায়ের কাছে।”
ঘুমের মধ্যেই শুক্লা মিষ্টি হাসলেন। বটগাছটার পাতা শিরশিরিয়ে একঝলক আর্দ্র হাওয়া বয়ে গেল।
***