মাসুদ রানা ৪৭১ : নরকের শহর

KhoriBona

মাসুদ রানা ৪৭১ : নরকের শহর


মাসুদ রানা ৪৭১ : নরকের শহর

কাজী আনোয়ার হোসেন
সহযোগী – কাজী মায়মুর হোসেন
প্রকাশক – কাজী আনোয়ার হোসেন, সেবা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ২০২৪
রচনা: বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে
প্রচ্ছদ: সালমান হায়দার সাগর

.

এই বইয়ের প্রতিটি ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক। জীবিত বা মৃত ব্যক্তি বা বাস্তব ঘটনার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই।

Book Content👉

নরকের শহর – ১

এক

বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স থেকে পুরো এক বছরের জন্যে ছুটি দিয়ে দেয়া হয়েছে মাসুদ রানাকে। হাতে জরুরি কোন কাজ নেই বলে গত কয়েক মাস ধরে ভবঘুরের মত নানান দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে ও। তবে আগের মত আর পা দিচ্ছে না অনিয়মের ফাঁদে। খুব ভাল করেই জানে, প্রাণপ্রিয় দেশটির বড় কোন বিপদ এলে সেটা রুখে দিতে হলে আবারও গড়েপিটে নিতে হবে নিজেকে। তাই যেখানেই থাকুক, প্রতি ভোরে ঘুম থেকে উঠে পার্ক বা জঙ্গলে গিয়ে বিরতি ছাড়াই দৌড়োচ্ছে টানা দশ মাইল। এরপর শুরু হচ্ছে কঠিন সব ব্যায়াম। প্রশিক্ষণে কোথাও কোন ফাঁকি দিচ্ছে না ও।

গতকাল কলেজের পুরনো বন্ধু গ্রেগরি কার্লটনের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে ছোট্ট বসতি বারবারা জোন্স-এ পা রেখেছে রানা। সঠিক সময়ে হাজির হয়ে গেছে চার্চে। এরপর বন্ধু আর তার প্রেমিকা র‍্যাচেলের বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হতেই উপহার হিসেবে হানিমুনের জন্যে ওদের হাতে তুলে দিয়েছে বাহামায় যাওয়ার বিমানের টিকেট। পঞ্চাশ পদের লোভনীয় বুফে লাঞ্চ সেরে নববিবাহিত দম্পতিকে নিজে পৌঁছে দিয়েছে ছোট্ট এয়ারপোর্টে। তারপর শহরে ফিরে উঠেছে সেরা আবাসিক হোটেল থ্রি-স্টার ওল্ড টাইম্‌স্-এ।

আর আজ ছোট শহর বারবারা জোন্স-এ ওর দ্বিতীয় দিন।

এখন বাজে সকাল নয়টা।

হাতে কোন কাজ নেই বলে ঘরের ডাবল সোফায় বসে

এলইডি স্ক্রিনের দিকে চেয়ে আছে রানা। যদিও আসলে দেখছে না কিছুই। মনে পড়েছে মাস কয়েক আগের বেশ কিছু ঘটনা। তখন আমেরিকার প্রতাপশালী মিলিটারির অত্যাধুনিক সব অস্ত্র লোপাট করে কুখ্যাত এক মেক্সিকান ড্রাগ-লর্ডের কাছে ওগুলো পাচার করত ওকলাহোমার টুসান শহরের মেয়র অ্যারন স্টার্লিংফোর্ড এবং তার ভাড়া করা খুনে ডাকাতেরা। তবে হামলা করে তাদের হাজার হাজার চোরাই অস্ত্রের বড় একটা চালান ধ্বংস করে দিয়েছিল রানা একা। এরপর বিশাল এক র‍্যাঞ্চে নিজের বাবার হাতে খুন হয়ে গিয়েছিল মেয়র।

সে-সময়ে প্রচণ্ড এক ক্রোধের অনলে পুড়ে দুর্নীতিপরায়ণ ক’জন পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রাক্তন দুই মিলিটারি অফিসারকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছিল রানা।

আকস্মিক এসব হামলার নেপথ্যে কে বা কারা আছে, সেটা জানতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে টুসানের পুলিশবাহিনী ও এফবিআই। ভালভাবে তদন্ত করার সুযোগ পেলে তারা জেনে যেত, এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনে আছে বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের বেপরোয়া, দুঃসাহসী এক দুর্ধর্ষ এজেন্ট মাসুদ রানা। কিন্তু তারা আরও খোঁজ-খবর নেয়ার আগেই তাদের বাড়া ভাতে মুঠো ভরা ছাই ঢেলে দেন নুমা বা ন্যাশনাল আণ্ডারওঅটার অ্যাণ্ড মেরিন এজেন্সির চিফ (অব.) অ্যাডমিরাল জর্জ হ্যামিলটন।

যেদিন একের পর এক হামলা চালাল রানা, তার পরদিন ওর কুশল জানতে ফোন করেন তিনি। সে-সময়ে রানার কাছ থেকে টুসান শহরের বিষয়ে বিস্তারিতভাবে সবই জেনে যান। এরপর তাঁর দেরি হয়নি হোয়াইট হাউসে গিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তাঁর বক্তব্যে টুসান শহরের অপরাধ-প্রবণ আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছিল, তাতে সেদিনই এফবিআই চিফ ও ওকলাহোমার পুলিশ চিফকে তলব করেন প্রেসিডেন্ট। রুদ্ধদ্বার কক্ষে বৈঠক শেষে তাঁদেরকে জানিয়ে দেন: এরই ভেতরে যা ঘটে গেছে টুসানে, এরপর যেন আরও ঘোলা না করা হয় কর্দমাক্ত জল। এদিকে নুমার চিফ জর্জ হ্যামিলটন ফোন করে রানাকে বলেন, ‘মনে করি না তোমার আর কোন বিপদ হবে।’

আনমনে এসব ভাবছে রানা, এমনসময় হঠাৎ করে ছোট্ট টি-পয়ের ওপরে ক্রিং-ক্রিং শব্দে বেজে উঠল ল্যাণ্ডফোন। ক্রেডল থেকে রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল ও। ‘হ্যালো’ বলার আগেই শুনতে পেল ওর প্রাণপ্রিয় বন্ধু বিসিআই-এর চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সোহেল আহমেদের কণ্ঠস্বর: ‘তুই বোধহয় এরই ভেতরে সব জেনে গেছিস?’ ওর গলা ভারী।

‘বিষয়টা কী, সেটা তো বলবি?’ সতর্ক হয়ে উঠেছে রানা। মনের ভেতরে কু ডাকছে ওর।

খুক খুক করে কেশে নিয়ে ইতস্তত করল সোহেল, তারপর বলল, ‘শিকাগো শহরে রানা এজেন্সির শাখার চিফ স্নিগ্ধা হাসান আর অপারেটর তুষার মল্লিক আর নেই, রানা।’

বন্ধুর কথায় ভীষণ হোঁচট খেয়েছে রানা। মাত্র ক’দিন আগেও হাসিখুশি স্নিগ্ধা আর কৌতুকপ্রিয় তুষারের সঙ্গে কথা হয়েছে ওর।

‘ওটা কি কোন রোড অ্যাক্সিডেন্ট?’ জানতে চাইল রানা।

‘না, তা নয়। ওদেরকে খুন করা হয়েছে ঠাণ্ডা মাথায়।’

‘কখন আর কোথায়, সোহেল?’ শুকনো গলায় বলল রানা। ‘কে বা কারা ওদেরকে খুন করেছে?’

‘স্থানীয় সময় আজ সকাল আটটায় অফিসের কাছে ওরা যেতেই ব্রাশ-ফায়ার করেছে মুখোশধারী চার গুণ্ডা,’ জানাল সোহেল। ‘আমাদের ধারণা: এসবের পেছনে আছে শক্তিশালী এক ইতালিয়ান মাফিয়া দল।’

‘সেই মাফিয়া দলের নেতৃত্বে এখন কে আছে?’

‘ডন অ্যালডো রসি।’

‘খবরটা কার কাছ থেকে জানলি তোরা?’

‘কয়েক মাস আগে কমপিউটার সফট্ওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শিকাগো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে বিসিআইয়ের জুনিয়র এজেন্ট আতাউল কবীর। স্নিগ্ধা আর তুষারের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ওর। ও ফোন করেছিল আমাদের অফিসে।

চুপ করে আছে রানা।

‘শিকাগো শহরে গত দু’বছর ধরে একের পর এক এশিয়ান আর আফ্রিকান-আমেরিকান শিশুরা উধাও হচ্ছে। তুই বোধহয় জানিস, সেজন্যে বসের নির্দেশ পেয়ে এ-বিষয়ে তদন্ত করছিল স্নিগ্ধা ও তুষার। মেধা আর যোগ্যতা প্রমাণের আদর্শ ক্ষেত্র পেয়ে খুশি হয়েছিল। আর তারপর আজ…’ চুপ হয়ে গেল সোহেল। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমরা ওদের মৃত্যু-খবর পেয়েছি মাত্র বিশ মিনিট আগে। তখনই বাড়িতে ফোন করেছি বসের কাছে। তিনি সব শোনার পর বললেন, তোকে যেন খবরটা পৌঁছে দিই।’

একদম থম মেরে গেছে রানা। বুকে জ্বলতে শুরু করেছে প্রতিশোধের ধিকিধিকি আগুন।

‘রানা, তুই যেখানে আছিস, সেখান থেকে শিকাগো শহর খুব বেশি দূরে নয়,’ বলল সোহেল। ‘আর ডাক্তারের মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী তুই এখন প্রায় ফিট।’

‘আজই শিকাগোয় পৌঁছে যাব,’ দৃঢ়স্বরে বলল রানা।

‘শোন, তুই তো ভাল করে চিনিস আমাদের বুড়োটাকে। তুই টোটালি ফিট না, তাই তোকে অফিশিয়াল কোন নির্দেশ তিনি দেবেন না। শুধু গম্ভীর কণ্ঠে বলেছেন, তাঁর ছোটবেলার বন্ধু রাজীব চৌধুরীর একমাত্র নাতিটাকেও তুলে নিয়ে গেছে মাফিয়ার গুণ্ডারা। শিশু অপহরণের ব্যাপারে গা করছে না শিকাগো পুলিশ। মাফিয়ার গুণ্ডারা বাদামি, হলদে বা কালো রঙের শিশুদের অপহরণ করে নিয়ে গেলেই বা তাদের কী! ওরা তো আর শ্বেতাঙ্গ নয়!’

‘শিকাগোতে আমার কিছু যন্ত্রপাতি লাগবে, সোহেল,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা।

‘তুই ওখানে গেলে সবই পেয়ে যাবি। তোর শুধু যোগাযোগ করতে হবে আতাউলের সঙ্গে।’

‘কোথায় ওর সঙ্গে দেখা হবে?’ জানতে চাইল রানা।

‘বিকেলে রানা এজেন্সির অফিসের বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করবে। তোকে তুলে নিয়ে চলে যাবে আমাদের নতুন সেফহাউসে।’

‘এ-ছাড়া জরুরি বেশ কিছু ইনফরমেশন লাগবে।’

‘আতাউল যা জানে সেটা জানাবে। এদিকে তুই শিকাগো পৌঁছে যাওয়ার আগেই রায়হান রশিদ হয়তো ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করতে পারবে বেশ কিছু তথ্য।’

‘বেশ, তা হলে তোর সঙ্গে পরে কথা হবে।’ বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিল রানা। ওর মনে পড়েছে রানা ডিটেকটিভ এজেন্সি চালু করতেই প্রথম থেকে বিরোধিতা করেছে শিকাগো পুলিশ। ওদের এজেন্সিতে বেশি কাজ ছিল না। তাই দায়িত্বে ছিল মাত্র দু’জন অপারেটর। এই তো ক’দিন আগে তুষার ফোন করে বলল, এক মাফিয়া ডনের বিরুদ্ধে বেশকিছু সূত্র পেয়েছে ওরা। এখন খুঁজছে আরও জোরাল প্রমাণ। তেমন কিছু পেলে পুলিশের সাহায্যে গুটিয়ে আনবে জাল।

আর আজ একটু আগে গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে ওরা। এই দুই হত্যাকাণ্ডের মামলা চাপা দেয়ার জন্যে হয়তো এরই ভেতরে লাখ ডলারে বিক্রি হয়ে গেছে পুলিশের ক’জন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সেক্ষেত্রে রানা এজেন্সির দুঃসাহসী দুই অপারেটরের খুনের তদন্তের ফাইল চিরকালের জন্যে হারিয়ে যাবে নতুন সব ফাইলের নিচে।

অবশ্য স্নিগ্ধা আর তুষারের খুনের মোটিভ খুঁজবে পুলিশ, সে-আশায় চুপ করে বসে থাকবে না রানা। ওর মনের আয়নায় ফুটে উঠল স্নিগ্ধা আর তুষারের তারুণ্যে ভরা মুখের ছবি। ওরা যেন হেসে হেসে বলছে ওকে: ‘জানেন, মাসুদ ভাই, কী অবাক কাণ্ড—আপনার সঙ্গে আর কখনও আমাদের দেখা হবে না!’

মুখের ভেতরটা নিমফলের মত তিতকুটে লাগল রানার। মনে পড়ল রাহাত খানের কঠোর দুটো চোখ। বিসিআই চিফ চান স্নিগ্ধা ও তুষারের মৃত্যুর বদলা নেয়া হোক। এবং… সম্ভব হলে রানা যেন উদ্ধার করে অপহৃত শিশুদেরকে।

মনে মনে শপথ নিল রানা: ‘যারা স্নিগ্ধা আর তুষারকে খুন করেছে, প্রাণে বাঁচতে দেব না তাদেরকে। আর যারা নিষ্পাপ শিশুদেরকে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছে, তারাও কোন ক্ষমা পাবে না আমার কাছ থেকে।’

মাফিয়া ডন অ্যালডো রসি বা তার দলের দুষ্কৃতিকারীরা এখনও জানে না, আজ রাতেই শুরু হবে শিকাগো শহরে ভয়ঙ্কর প্রবল এক বহ্নিঝড়।

দুই

গা হিম করে দেয়া কনকনে শীতল ডিসেম্বর মাস।

আঠারো তারিখ।

শিকাগোর উত্তরদিকে সেকেণ্ডারি এক নির্জন পথ ধরে ছুটে চলেছে তেইশ সালের নীল রঙের এক পোর্শে নাইন ইলেভেন স্পোর্টস্কার। প্রতিবার বাঁক নেয়ার সময় কুয়াশা কেটে ওটার হ্যালোজেন সাদা হেডলাইট গিয়ে পড়ছে আবাসিক সব বাড়ির কারুকাজ করা গেট, দেয়াল বা তুষারে ভরা বাগানের ওপরে।

গাড়িটা ড্রাইভ করছে কঠোর চেহারার এক যুবক নাম তার মাসুদ রানা। ড্যাশবোর্ডের মৃদু আলোয় দেখলে যে-কেউ ভাববে, স্রেফ নিরেট গ্র্যানিট পাথর দিয়ে খোদাই করা হয়েছে ওকে। রানার কুচকুচে কালো মণিদুটোয় কীসের যেন কঠিন এক প্রতিজ্ঞা।

মিনিটখানেক পর ওর স্পোর্টসস্কারের মতই অতি দামি সব গাড়িতে ভরা এক পার্কিংলটে ঢুকল রানা। একদিকে ছাউনি দেয়া একতলা লম্বাটে দালানের কাছে খুঁজে নিল পার্কিং প্লেস। হেডলাইট নিভিয়ে বন্ধ করল গাড়ির ইঞ্জিন। দরজা খুলে না নেমে ফিটনেস সেন্টারের সদর দরজার দিকে চেয়ে রইল রানা। এ-শহরে বিসিআই-এর নতুন সেফহাউসে পৌঁছুবার পর অস্ত্র বেছে নিতে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় নিয়েছে ও। অস্ত্রগুলো আতাউল কবীরের গাড়িতে তুলে সরাসরি হাজির হয়েছে দামি এক রেন্টাল গাড়ির অফিসে। নকল কাগজপত্র দেখিয়ে দশ হাজার ডলার জমা দিয়ে সংগ্রহ করেছে এই পোর্শে গাড়িটা।

বি এইমাত্র নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারের কাঁচের ডাবল- ডোর খুলে দিল ভালুকের মত প্রকাণ্ড এক গার্ড। তাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এল বছর বিশেক বয়সের দুই তরুণ-তরুণী। তারা খেয়াল করল না, পোর্শের ড্রাইভিং সিট থেকে তাদের দিকেই চেয়ে আছে সুঠাম দেহের শ্যামলা বর্ণের এক যুবক।

পোর্শে পাশ কাটিয়ে নিজেদের গাড়ির উদ্দেশে চলেছে তরুণ-তরুণী। নিজেদের ভেতরে জুড়েছে গল্প। প্রচণ্ড শীতে কথা বলার সময় নাক-মুখ দিয়ে ভুসভুস করে বেরে কুয়াশার মত ধূসর বাষ্প। যে-কেউ ভাববে, কষে টান মেরে গাঁজার ধোঁয়া উগলে দিচ্ছে ওরা। পার্কিংলটের দূরপ্রান্তে গিয়ে উঠে পড়ল কালো এক ফেরারি গাড়িতে। হয়তো একমিনিট পেরোবার আগেই হুশ শব্দে পার্কিংলট ছেড়ে বেরিয়ে যাবে তাদের গাড়ি।

পোর্শের ভেতরে বসে ক্লাবের কাঁচের ডাবল-ডোরের ওদিকে চেয়ে আছে রানা। গার্ড লোকটাকে কমিক্সের চরিত্র বাঁটুল দ্য গ্রেট বলে মনে হচ্ছে ওর। অবশ্য এর কানে ছোট্ট দুটো সোনার দুল। লোকটার বুক বেঢপ ফোলা। মাথা ন্যাড়া। পা-দুটো চড়ই পাখির ঠ্যাঙের মত লিকলিকে সরু। লেভি জিন্স প্যান্টের পায়াদুটো যেন বারো বোর বন্দুকের নল। উচ্চতার তুলনায় আমেরিকান বাঁটুলের ওজন অন্তত তিরিশ পাউণ্ড বেশি। একটু পর পর দরজা খুলতে হচ্ছে বলে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগছে তার গায়ে। তাতে কোন বিরক্তি নেই চেহারায়। সরাসরি চেয়ে আছে কম্পাউণ্ডের প্রধান ফটকের দিকে।

পার্কিংলটে ফেরারির ইঞ্জিন গর্জে উঠতেই রানা বুঝল, ফিটনেস সেন্টার ছেড়ে চলে যাচ্ছে সেই দুই তরুণ-তরুণী। পলকের জন্যে ফেরারির হেডলাইট এসে পড়ল পোর্শের ভেতরে, তারপর আলো সরে গেল অন্যদিকে।

কাজে নামার আগে অস্ত্রগুলো চেক করতে লাগল রানা। সেফহাউসে ওয়ালথার পিপিকে ছিল না। সেটার বদলে রানা নিয়েছে নাইন এমএম বেরেটা ৯৩-আর। জ্যাকেটের তলা থেকে নিয়ে পিস্তলের অ্যাকশন পরীক্ষা করে নিল। বার কয়েক ঝড়ের বেগে স্পিড রিগ থেকে নিয়ে আবার রেখে দিল জায়গামত। সেল্‌ফ্ লোডিং পিস্তলটার ফায়ার বাটন সরিয়ে ঠিক জায়গায় রাখলে একবার ট্রিগার টিপলে গুলি বেরোয় তিনটে করে। ফলে প্রতি মিনিটে বুলেট ছুঁড়তে পারে এক শত দশটা। বক্স ম্যাগাজিনে এখন আছে বিশটা গুলি। মাযলে জুড়ে নেয়া যাবে সাপ্রেসর।

অবশ্য আজকের এই রেইডে ডিটাচেবল ম্যাগাজিন বা সাইলেন্সার লাগবে বলে ভাবছে না রানা। বেরেটার মতই লোড করেছে অটোম্যাগ। ওর বামবগলের কাছে বিশেষভাবে তৈরি ফাস্ট-ড্র হোলস্টার থেকে ঝট করে অস্ত্রটা নিল রানা। খেয়াল করল গাড়ির কাঁচের জানালা দিয়ে আসা পার্কিংলটের আলোয় চকচক করছে স্টেইনলেস স্টিলের ৪৪ অটোমেটিক পিস্তল। ওটার ওজন পৌনে চার পাউণ্ড। বুলেটের শক্তি ভারী কোন রাইফেলের গুলির প্রায় সমান। নির্মাতারা অটোম্যাগের রিকয়েল সামলে নেয়ার জন্যে রেখেছে রোটেটিং বোল্ট হেড, নইলে বুলেট পেছনে যে ধাক্কা দিত, তাতে চুরচুর হয়ে ভাঙত শুটারের কবজি। ন্যাটো ৭.৬২ এমএম গুলির প্রায় সমান গতি অটোম্যাগের বুলেটের। নিরেট ইঞ্জিন ব্লক ফুটো করে খতম করতে পারে গাড়িতে বসে থাকা যাত্রীকে। এখন ম্যাগাজিনে আছে ইন্টারনাল গ্যাস প্রেশারাইড্ এক্সপ্লোসিভ বুলেট। প্রচণ্ড ঝাঁকি দেবে বলে শক্তহাতে ধরতে হবে অস্ত্রের বাঁট। পিস্তল বিশেষজ্ঞরা হেসে বলেন, অটোম্যাগ আসলে হাওয়াইয়ার রকেট লঞ্চারের মত।

আরও একবার ড্র করার পর হোলস্টারে অটোম্যাগ রেখে দিল রানা। পোর্শের ড্রাইভিং ডোর খুলে নেমে পড়ল। দরজা লক না করে হেঁটে চলল নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারের ডাবল-ডোর লক্ষ্য করে। পায়ের নিচে কুড়মুড় করে ভাঙছে বরফ হয়ে যাওয়া পিছলা তুষার।

দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ফিটনেস সেন্টারের দিকে কঠোর চেহারার এক যুবককে হেঁটে আসতে দেখছে টাকমাথা গার্ড। যুবকের পরনে কালো প্যান্ট ও জ্যাকেট। নিয়ম মেনে তার জন্যে ডাবল-ডোর খুলে দিল বাঁটুল দ্য গ্রেট। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়ে হেলথ ক্লাব সদস্যদের হাসির আওয়াজ ও কথা শুনছে রানা। মস্ত কামরায় পা রেখে গার্ডকে কোন কিছু না বলে পা বাড়াল লবির দিকে।

টাকমাথা ডোরম্যান অভিজ্ঞ একজন বাউন্সার। নতুন এ- যুবককে আগে কখনও এখানে দেখেনি। নিচু গলায় গালি দিয়ে দু’মুঠো পাকিয়ে ফেলল সে। ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, ‘আপনি তো এই ক্লাবের মেম্বার নন!’

‘তো?’ বলেই ঘুরে খপ করে ডোরম্যানের টি-শার্টের কলার চেপে ধরল রানা। একই সময়ে আরেক হাতে ধরেছে বাঁটুলের কোমরের বেল্ট। ভালুকটার অগ্রগতি কাজে লাগিয়ে তাকে চরকির মত ঘুরিয়ে নিল রানা। পরক্ষণে পিঠে প্রচণ্ড এক ধাক্কা মেরে দরজার কাঁচের ওপরে ফেলল গার্ডকে। ঝনঝন শব্দে ভাঙল পুরু কাঁচ। তাল সামলাতে না পেরে পিছলে গেল বাঁটুল দ্য গ্রেটের দু’পা। হড়কে গিয়ে পাথুরে সিঁড়ির নিচের ধাপে গিয়ে পড়ল সে। ঠাস্ করে ফেটে গেছে নাকের নরম হাড়। তীব্র ব্যথা পেয়ে কুকুরের মত কেঁউ করে উঠল সে। সরসর করে নেমে গেল বরফ-ঢাকা সামনের উঠনে। ভাঙা নাকের তাজা রক্তে ভেসে যাচ্ছে মুখ ও টাক। একবার উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝল, তার শরীরে আর কোন নেই!

মৃদু আলোকিত হেলথ স্পা-র লবির দিকে তাকাল রানা। এখানে-ওখানে দামি অ্যাডিডাস জিম ব্যাগ। ওকে কৌতূহলী চোখে দেখছে সুন্দরী ক’জন তরুণী। দৃষ্টিতে মিশ্র অনুভূতি- রাগ, ভয়, বিস্ময় আর প্রশংসা।

নিউ টাউন হেলথ সেন্টারটাকে সিঙ্গলস্ বার বা নামকরা কোন কাউন্টি ক্লাবের মিশেল বলে মনে হলো রানার। গোপন বাতির আলোয় দেখা যাচ্ছে মেহগনি কাঠ দিয়ে তৈরি দামি আসবাবপত্র। বিস্ময় নিয়ে ওকে দেখছে অন্তত দশজন পুরুষ। যদিও তাদেরকে পাত্তা দিল না রানা। ভাল করেই জানে; মূল্যবান ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহারে পেশিবহুল হয়ে উঠলেও প্রচণ্ড পরিশ্রম করে না এরা। তাই শরীরে নেই পর্যাপ্ত শক্তি। বাজি ধরে বলতে পারবে রানা, কমাণ্ডো সার্ভাইভাল ট্রেনিং-এ নিলে দু’ঘণ্টার ভেতরে এরা হয়ে উঠবে চরম অসুস্থ। নিয়মিত স্কচ উইস্কি আর সোডা গেলার পরেও প্রতিদিন মাত্র একঘণ্টা মেশিনে ব্যায়াম করেই ধরে নিয়েছে, তারা আসলে হয়ে গেছে সত্যিকারের কঠিন পুরুষ।

মাফিয়ার যেসব হেলথ ক্লাব আছে, সেখানে ব্যায়াম করতে আসা প্রখ্যাত ডাক্তার, নামকরা উকিল আর টাকাওয়ালা বিজ্ঞাপন-নির্মাতাদেরকে একদম পছন্দ করে না রানা। লবিতে থেমে পকেট থেকে আপেলের মত কী যেন বের করল ও। সবার চোখ গিয়ে পড়েছে টেনিস বলের মত জিনিসটার ওপরে। পরক্ষণে সবাই বুঝে গেল, ওটা একটা তাজা গ্রেনেড!

হঠাৎ করেই নতুন এই যুবকের প্রতি সমস্ত আগ্রহ হারাল লবির সবাই। সুদর্শন পুরুষ ও সুন্দরী যুবতীদের ভেতরে শুরু হলো তীব্র প্রতিযোগিতা-কে আগে বেরোবে কাছের দরজা দিয়ে!

পিন খুলে সবুজ আপেলটা লবির এককোণে ছুঁড়ে দিল রানা। ওটা মেঝেতে পড়ার আগেই ঘুরে তাকাল অন্যদিকে। ক্লাব ঘরের একদিকে ডেস্কের পেছনে বসে আছে এক তরুণী রিসেপশনিস্ট। ভয়ে জমাট বেঁধে গেছে। ডেস্কের কাছে রানা যাওয়ার আগেই বিকট শব্দে ফাটল গ্রেনেড। কালো ধোঁয়া ছিটকে বেরিয়ে ছেয়ে দিল গোটা ঘর। ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে রানার দিকে চেয়ে রইল রিসেপশনিস্ট, মুখে রা নেই।

আতঙ্ক কমাতে আলতো হাতে তার বাহু স্পর্শ করল রানা। গোলাগুলি শুরু হওয়ার আগেই যেন পালিয়ে যেতে পারে ক্লাবের সাধারণ সদস্যরা, তাই ফাটিয়ে দিয়েছে গ্রেনেড। ‘অ্যালডো রসি,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘তার অফিসটা যেন কোথায়?’

এরই ভেতরে ফাঁকা হয়ে গেছে লবি। কঠোর চেহারার যুবকের প্রশ্ন শুনে আরও ফ্যাকাসে হলো রিসেপশনিস্টের মুখ। করিডরের দূরের এক দরজার দিকে চোখ গেল তার। বিড়বিড় করে বলল, ‘তিনি একটু আগে চলে গেছেন। আপনি আসলে এখানে কী চান? –

জবাব না দিয়ে ওকে কাঁচ ভাঙা দরজা দেখাল রানা। ‘এখানে গোলাগুলি হবে। তুমি নিজেও বরং চলে যাও।’

‘সতর্ক করলেন বলে ধন্যবাদ, স্যর।’ কাউন্টারের কাছ থেকে নড়ল না মেয়েটা। চেয়ে আছে দুর্দান্ত সুদর্শন শ্যামলা যুবকের দিকে। চোখে একরাশ কৌতূহল।

হোলস্টার থেকে অটোম্যাগ পিস্তল বের করল রানা। দ্রুত চলে গেল রিসেপশন ডেস্কের পেছন-দেয়ালের কাছে। কাঁচের বক্সে ফায়ার অ্যালার্মের সুইচ। রানার ৪৪ ক্যালিবারের পিস্তলের বাঁটের বাড়ি খেয়ে ঝনঝন করে ভাঙল গ্লাসের বক্স। সুইচ অন করে দিতেই বিকট শব্দে বেজে উঠল ফায়ার অ্যালার্ম।

চারপাশে স্মোক গ্রেনেডের ঘন কালো ধোঁয়া। রিসেপশন ডেস্কের উল্টোদিকে ঝট করে খুলে গেল একটা দরজা। ঘর থেকে ছুটে লবিতে বেরোল দু’জন লোক। তাদের চেহারা দেখলে যে-কেউ বুঝবে, মায়ের পেট থেকে নেমেই চুরি- ডাকাতি শুরু করে দিয়েছে এরা। লম্বা নলওয়ালা অস্ত্র হাতে কঠোর চেহারার রানাকে দেখে হোলস্টার থেকে পিস্তল নিতে গেল তারা। কিন্তু অস্ত্রের বাঁট ধরার আগেই ফায়ার অ্যালার্ম ছাপিয়ে পর পর দু’বার গর্জে উঠল অটোম্যাগ। বজ্রপাতের বিকট আওয়াজে কানে ঝিঁঝি ধরে গেল রিসেপশনিস্টের। অবাক হয়ে দেখল, হঠাৎ শূন্যে ভেসে উঠে করিডরের দূরের মেঝেতে গিয়ে পড়েছে দুই গুণ্ডা। তাদের বুকে মুঠো ভরে দেয়া যাবে এমন বড় দুই ফুটো। সেখান থেকে ঝরঝর করে ঝরছে তাজা রক্ত।

রিসেপশনিস্টের দিকে ঘুরে তাকাল রানা। হতবাক হয়ে গেছে মেয়েটা। মানতে পারছে না যে চোখের সামনে খতম হয়ে গেছে দু’জন লোক!

‘তুমি বরং বাড়ি ফেরো!’ ফায়ার অ্যালার্মের আওয়াজের ওপর দিয়ে জানাল রানা।

এবার মাথা কাজ করল মেয়েটার। কাউন্টার ঘুরে ঝড়ের বেগে ছুটল কাছের দরজার দিকে। পাঁচ সেকেণ্ডে হারিয়ে গেল ঘন ধোঁয়ার ভেতরে। করিডর ধরে এগিয়ে চলল রানা। সামনে একে একে তিনটে ঘর। কাঁচের এক দেয়ালের ওপাশে সুইমিংপুল। অন্যদিকে র‍্যাকেটবল কোর্ট আর জগিং এরিয়া। সুইমিংপুলে ঢোকার দরজার ওপরে লেখা: অ্যাওরোবিক এক্সারসাইয, সৌনা, হুইর্লপুল, স্টিম অ্যাণ্ড তাই কোয়ান ডো রুম।

করিডর ধরে হেঁটে চলেছে রানা। সামনেই খোলা এক বড় দরজা। ওপাশে আবছা আলোয় ভরা বাররুম। দরজা দিয়ে ঢুকে ঝট করে বামদিকে সরে গেল রানা। কোন গুলি এল না ওর দিকে। দেয়ালে বাতির বৈদ্যুতিক বোর্ড পেয়ে সুইচ টিপে দিল ও। মাথার ওপরে দপ করে জ্বলে উঠেছে কিছু এলইডি বাল্ব। ঘরটার একদিকে বারকাউন্টার, উল্টোদিকে ড্যান্স ফ্লোর। টেবিল আর বারকাউন্টারের ওপরে গোটা পাঁচেক আধখালি গ্লাস।

রানা ছাড়া ঘরের ভেতরে আর কেউ নেই। অটোম্যাগের বাঁট দিয়ে বাতির সুইচ বন্ধ করে করিডরে বেরিয়ে এল ও।

লবির কাছের করিডরে হাজির হয়েছে সশস্ত্র তিন গুণ্ডা।

দু’জনের হাতে পাম্প শটগান, অন্যজনের কাছে নাইন এমএম উযি সাবমেশিন গান। ঘন ধোঁয়ায় খক খক করে কাশছে তারা। এইমাত্র দেখেছে লবির আর্চওয়ের কাছে লাশ হয়ে গেছে দলের দু’জন। মুখ তুলেই সরাসরি রানাকে দেখতে পেল তারা। চট্ করে সরে যেতে চাইল পরস্পরের কাছ থেকে। ওপরে তুলছে অস্ত্রের নল। যদিও দেরি করে ফেলেছে। ‘করিডরের মাঝে থেমে অটোম্যাগের ট্রিগার পর পর তিনবার স্পর্শ করল রানা। ভয়ঙ্কর অস্ত্রটার নলের মুখ চিরে ছিটকে বেরোল কমলা আগুনের দীর্ঘ হলকা। প্রথম গুলি উড়িয়ে দিয়েছে উযির সাবমেশিন গানের মালিকের মাথা। পিছিয়ে গিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে লাশ। বুকে মস্ত গর্ত নিয়ে পাশের দেয়ালে পড়ল দ্বিতীয়জন। পিছলে মেঝেতে নেমে আসার আগেই বেরিয়ে গেছে প্রাণবায়ু। ঘুরে পালিয়ে যেতে চেয়েছে তৃতীয় গুণ্ডা। কিন্তু পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙে তার হৃৎপিণ্ডে ঢুকেছে রানার তৃতীয় বুলেট। বেকায়দা এক হোঁচট খেয়ে লবির কাছে ভূমিশয্যা নিল সে।

লাশ তিনটে একবার দেখে নিয়ে করিডরের শেষমাথা লক্ষ্য করে এগোল রানা। ওদিকের একটা দরজার ওপরে ছিল রিসেপশনিস্টের চোখ। দুটো দরজা পার করে তৃতীয় দরজার ওপরের নেমপ্লেট পড়ল ও অ্যালডো রসি। ম্যানেজিং ডিরেক্টর।

এই লোকটাকেই হাতের মুঠোয় চায় রানা। ভাল করেই জানে, প্রমাণসহ ধরিয়ে দিলেও ক’দিনের ভেতরে আমেরিকার ফস্কা আইনের ফাঁক গলে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসবে সে। তখন নতুন করে চালু করবে ড্রাগ জয়েন্ট, পতিতালয়, পর্নোগ্রাফিক সিনেমা ‘হল; চলবে চুরি-ডাকাতি, খুন আর চাঁদাবাজির মচ্ছব। কিশোর গ্যাংগুলোর হাতে যাবে চোরাই অস্ত্র। রসির নির্দেশে বিনা বিচারে খুন হবে স্নিগ্ধা বা তুষারের মত নিরীহ মানুষ।

সুতরাং মাফিয়া ডন অ্যালডো রসির মত ঠাণ্ডা মাথার খুনির বেঁচে থাকার কোন অধিকার নেই!

ফিটনেট সেন্টারে তার কতজন স্যাঙাত আছে, জানা নেই রানার। বিশাল দালানে চলছে হৈ-চৈ। বোধহয় পরের দু’মিনিটে তারা খুঁজে নেবে ওকে। অবশ্য তাতে কিছুই আসবে যাবে না ওর। এখানে এসেছে রসিকে দুনিয়া থেকে বিদায় দিতে। সেটা করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করতেও আপত্তি নেই ওর। রিসেপশনিস্ট আগেই বলেছে, ক্লাব থেকে চলে গেছে মাফিয়া ডন। সেক্ষেত্রে তার দলের গুণ্ডারা খতম হলে পরিষ্কার একটা বার্তা পাবে সে। বুঝে যাবে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতে শিকাগো শহরে এসেছে বাঙালি এক যুবক। মানুষটা এমনই একজন, যাকে কোনভাবে ভয় দেখাতে পারবে না মাফিয়া ডন।

প্রচণ্ড এক লাথি মেরে ম্যানেজিং ডিরেক্টরের ঘরের দরজা খুলল রানা। একদিকের দেয়ালে ঠাস করে লেগে ভেঙে গেল কবাটের লোহার দুটো কবজা। ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকল রানা, পরক্ষণে সরে গেল একদিকের দেয়ালের কাছে।

দামি আসবাবপত্রে সাজানো ঘরে কেউ নেই এখন। একদিকে প্রকাণ্ড ডেস্ক। আরেকটু বড় হলে রানওয়ে হিসেবে ব্যবহার করতে পারত ৭৭৭ বোয়িং বিমানের পাইলট। বুক পকেট থেকে একটা ভিযিটিং কার্ড নিয়ে ডেস্কের ওপরে রাখল রানা। বেরিয়ে এল করিডোরে।

হঠাৎ করে বিশাল দালানে থেমে গেল ফায়ার অ্যালার্মের আওয়াজ। র‍্যাকেটবল কোর্টে উত্তেজিত ক’জনের কণ্ঠস্বর।

তারা হাজির হবে বলে ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করছে রানা।

একমিনিট পর র‍্যাকেটবল কোর্টের দরজায় উঁকি দিল মাফিয়ার দুই গুণ্ডা, হাতে নলকাটা দুটো শটগান। লবিতে রক্তাক্ত পাঁচটা লাশ দেখে নার্ভাস হয়ে গেছে তারা।

ধূসর ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে তাদেরকে দেখছে রানা। ট্রিগার স্পর্শ করতেই বুম করে উঠল হাতের অটোম্যাগ। র‍্যাকেটবল কোর্টের দরজার কাছে গাছ থেকে পড়া বেলের মত দু’ভাগ হলো একজনের মাথা। অন্যজন ঘরের ভেতরে কাছিমের মত টেনে নিল গলা। সামনে বেড়ে কাছের ফায়ার একযিটের স্টিলের বার-এ লাথি বসাল রানা। কিন্তু একতিল নড়ল না ওটা। লক করে রাখা হয়েছে দরজা।

বদ্ধ জায়গায় অটোম্যাগের গুলির আওয়াজে থরথর করে কাঁপল করিডর। প্রচণ্ড শক্তিধর বুলেট চুরমার করে দিয়েছে ফায়ার একযিটের তালার মেকানিযম। নতুন ম্যাগাযিন অস্ত্রে ভরে দরজা খুলে দালানের বাইরে চলে এল রানা।

আবছা আঁধারে পার্কিংলটের দিকে এগিয়ে পাশ কাটাল দুর্গন্ধময় এক ডাম্পস্টার। তপ্ত অটোম্যাগের নলের মুখ দিয়ে চুইয়ে বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া। আশপাশে শত্রুপক্ষের কাউকে দেখলে গুলি করতে দেরি করবে না রানা। দালানের কোনা ঘুরে পৌঁছে গেল পার্কিংলটের কোণে। আর তখনই দেখতে পেল বিপদগ্রস্ত মেয়েটাকে।

তিন

যুবতীকে টেনে-হিঁচড়ে কালো লিংকন গাড়িটার দিকে নিয়ে যেতে চাইছে তিন গুণ্ডা। এরা যে অ্যালডো রসির লোক, তাতে মনে কোন সন্দেহ থাকল না রানার। দুই গুণ্ডার গায়ে ফারের দামি টপকোট। দু’হাতে যুবতীর দু’বাহু চেপে ধরেছে তারা। মেয়েটার বয়স বড়জোর পঁচিশ। মাথায় কালো দীর্ঘ চুল, পরনে জ্যাকেট ও লেভি প্যান্ট। লিংকন আর একটা ফেরারি গাড়ির মাঝে ওকে নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে তিন মস্তান। রানার মনে আছে, একটু আগেও পার্কিংলটে ছিল না লিংকন। মেয়েটাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে যাওয়ার জন্যেই ওটাতে করে এসেছে গুণ্ডাদের দু’জন।

লিংকন আর ফেরারি ছাড়া পার্কিংলটে এখন আছে শুধু রানার পোর্শে নাইন ইলেভেন। মেয়েটার কাছ থেকে মাত্র পাঁচ গজ দূরে ওটা। এবার কী করবে সেটা ভাবতে শুরু করেছে রানা, তখনই শুনতে পেল দূরে পুলিশের গাড়ির সাইরেন। ক্রমেই এগিয়ে আসছে বিশ্রী আওয়াজটা।

মেয়েটার বাহু শক্ত হাতে ধরেছে যে দুই গুণ্ডা, তাদেরকে সাহায্য করছে নাকফাটা সেই ডোরম্যান। প্রাণপণে নিজেকে ছুটিয়ে নিতে চাইলেও ব্যর্থ হচ্ছে মেয়েটা। হেলথ সেন্টারের দিকে ঘাড় কাত করে ষাঁড়ের মত চেঁচাল ডোরম্যান: ‘আমরা ওকে ধরেছি! জলদি! চলে এসো!’

তবে দালান থেকে সাড়া দিল না কেউ।

রানার ধারণা: আগেই ওর হাতে খুন হয়েছে বেশিরভাগ গুণ্ডা। লুকিয়ে পড়েছে অন্যরা।

এলইডি বালবের আলোয় বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে ডোরম্যানকে। নাকে-মুখে তাজা রক্ত। ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটার দিকে চেয়ে ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে কী যেন ফেরত চাইল।

দালানের ধারে আঁধারে দাঁড়িয়ে আছে রানা। দু’হাতে শক্ত করে ধরেছে অটোম্যাগের বাঁট। মেয়েটার বিপদ হবে না সেটা বুঝতে পারলেই খতম করে দেবে তিন গুণ্ডাকে। লড়তে গিয়ে হাঁফিয়ে গেছে মেয়েটা, তবে তখনই একথোকা থুতু ছুঁড়ল ডোরম্যানের মুখে।

মেয়েটার সাহস দেখে মৃদু হেসে ফেলল রানা। কাঁধের সমস্ত জোর দিয়ে যুবতীর গালে প্রচণ্ড এক চড় বসিয়ে দিল টাকমাথা বাউন্সার। জোরাল ঠাস শব্দটা পরিষ্কার শুনতে পেল রানা। হারামজাদা এতই জোরে মেরেছে, মাথা ঘুরে পার্কিংলটের তুষারে ভরা মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মেয়েটা। দু’দিক থেকে ওর হাতদুটো শক্ত করে ধরেছে অন্য দুই গুণ্ডা। মেঘের মত কালো চুল ঢেকে দিয়েছে মেয়েটার মুখ। বুকের কাছে ঝুলে গেছে চিবুক।

এক সেকেণ্ডের জন্যে রানার মনে হলো, দেরি করে ফেলেছে ও। প্রচণ্ড চড়টা বোধহয় ভেঙে দিয়েছে বেচারির ঘাড়। পরক্ষণে রানা শুনতে পেল প্রাণপণ মেয়েলি চিৎকার।

মেয়েটার আর্তনাদ থামানোর জন্যে চুল খামচে ধরে ওপরের দিকে টান দিল ডোরম্যান। অন্যহাতে পকেট থেকে নিয়েছে সুইচব্লেড ছোরা। সুইচ টিপে দিতেই সড়াৎ করে বেরোল ছ’ইঞ্চি ইস্পাতের ফলা। আলোয় চকচক করছে ওটা। মেয়েটার কণ্ঠনালীতে ছোরার ডগা ঠেকাল বাউন্সার। কী যেন জানতে চাইল ঘড়ঘড়ে গলায়। বিস্ফারিত চোখে তার দিকে চেয়ে রইল মেয়েটা। বারকয়েক মাথা নাড়ল। হয় প্রশ্নের জবাব জানে না, অথবা বলবে না।

যুবতী এখন বসে আছে তুষারে ঢাকা মেঝেতে, আর এ- সুযোগে গুলি করবে ভাবল রানা। মেয়েটার চুল আরও জোরে ওপরে টানল ডোরম্যান। পরক্ষণে ছোরা দিয়ে পটাপট খুলে দিল বেচারির জ্যাকেট আর ব্লাউসের বোতাম। ফর্সা বুকে ছোরা ঠেকিয়ে কী যেন জিজ্ঞেস করল। আর তখনই গুলি করল রানা। দু’ শ’ চল্লিশ গ্রেইন বোটটেইল বুলেটের আঘাতে ঠাস শব্দে কয়েক টুকরো হলো ডোরম্যানের মাথার খুলি। ধপ করে পার্কিংলটের মেঝেতে পড়ল লাশ।

অটোমেটিক পিস্তলের বিকট গর্জনে চমকে গিয়ে যুবতীর হাত ছেড়ে দিয়েছে বামদিকের গুণ্ডা। অস্ত্র বের করতে চাইল সে। এদিকে লিংকন গাড়ি থেকে চেঁচিয়ে উঠেছে এক লোক। তাড়াহুড়ো করে গাড়ির পেছনের সিটে যুবতীকে তুলতে চাইল ডানদিকের গুণ্ডা। বামদিকের গুণ্ডা পিস্তল বের করার আগেই ‘বুম!’ শব্দে আবারও গর্জে উঠল রানার অটোম্যাগ। ওটার বুলেটের প্রচণ্ড আঘাতে পাশের ফেরারি গাড়ির বনেটের ওপরে গিয়ে পড়ল বামদিকের গুণ্ডা, বুকে মস্ত এক গর্ত। বনেট থেকে পিছলে পার্কিংলটের মেঝেতে নেমে এল তার মৃতদেহ।

রানা তৃতীয়বার গুলি করার আগেই মেয়েটাকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়েছে ডানদিকের গুণ্ডা। ধুপ করে আটকে নিল দরজা। চাকা পিছলে রওনা হলো লিংকন, ক্রমেই বাড়ছে ওটার গতি। স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে ব্রেক প্যাডেলে চাপ দিয়ে এক শ’ আশি ডিগ্রি ঘোরানো হলো ক্রু-ওয়্যাগান। পার্কিংলটের গেট লক্ষ্য করে রকেটের বেগে ছুটল গাড়িটা।

এদিকে অটোম্যাগের প্রচণ্ড রিকয়েলের কথা মাথায় রেখেছে রানা। দালানের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে পর পর তিনবার গুলি পাঠাল বুলেটপ্রুফ গাড়িটার দিকে।

লিংকনের বড়িতে পিছলে গিয়ে কমলা আগুন ছিটিয়ে কোথায় যেন চলে গেল তিন প্রজেকটাইল। যুদ্ধের ভারী ট্যাঙ্কের মত পেছনদিক হড়কে রাস্তায় নেমে গেল গাড়িটা। পরের দু’সেকেণ্ডে উধাও হলো রানার চোখের সামনে থেকে।

সরাসরি উত্তরদিকে চলেছে ওটা। একদৌড়ে পার্কিংলটে চলে এল রানা। পোর্শের কাছে পৌছুতে ওর লাগল মাত্র পাঁচ সেকেণ্ড। চট্ করে দেখল বনেট বা বডিতে সন্দেহজনক তার, ডেটোনেটর বা কোন প্যাকেজ আছে কি না।

না, তেমন কিছু নেই।

দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে উঠল রানা। পরক্ষণে চাবিতে মোচড় দিতেই গর্জন ছাড়ল পোর্শে নাইন ইলেভেন। গাড়ির দরজা আটকে নিয়ে পার্কিংলট থেকে বেরোবার জন্যে মিসাইলের গতি তুলল রানা। ভাবছে: মাফিয়াদের ক্লাবে কে বা কারা হামলা করেছে, সেটা এখনও জানে না গুণ্ডারা। অবশ্য বসের টেবিলে ওর ভিযিটিং কার্ড পেলে সবই জানবে তারা।

ডোরম্যান আর এক গুণ্ডার লাশ মাড়িয়ে যাওয়ার সময় দুলে উঠল পোর্শে। পরের তিন সেকেণ্ডে নেমে এল রাস্তায়। কয়েক ব্লক দূরে রানা দেখতে পেল লিংকনের লাল টেইল- লাইট। সাঁৎ করে পিছিয়ে গেল ফিটনেস সেন্টার। ওটার পার্কিংলট, ধোঁয়াভরা লবি আর করিডরে বেশ ক’টা লাশ পাবে পুলিশের লোক। আজকের এই রাত ফুরোবার আগেই হয়তো ওর হাতে মরবে আরও অনেকে। অথবা, রানা নিজেই হয়তো বিদায় নেবে দুনিয়া থেকে।

সামনের মোড়ে গতিহ্রাস না করেই রাবার পুড়িয়ে কর্কশ আওয়াজ তুলে বাঁক নিল রানা। নতুন করে দাবিয়ে দিল অ্যাক্সেলারেটর প্যাডেল। হোলস্টারে রাখল অটোম্যাগ। পরক্ষণে রিগ থেকে নিল বেরেটা। অস্ত্রটা রেখে দিল পাশের সিটে। রাস্তার দু’পাশে সাঁই-সাঁই করে পিছিয়ে পড়ছে বিশাল সব বাড়ি। লিংকনের পেছনে প্রায় উড়ে চলেছে রানার পোর্শে।

একটু আগে দেখা ফেরারির কথা মনে পড়ল ওর। পোর্শের হেডলাইটের আলোয় দেখেছে ওটার লাইসেন্স প্লেট। গাড়িটার মালিক আসলে কে, সেটা অনায়াসে জানতে পারবে পুলিশের লোক। অথচ ওর উপায় নেই সেটা জানার। অবশ্য শিকাগো পুলিশের ডেটাবেজ হ্যাক করে তথ্যটা হয়তো জানাতে পারবে বিসিআই-এর কমপিউটার জাদুকর রায়হান রশিদ।

নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারের লড়াকু সেই মেয়েটার কথা মনে এল রানার। খুন না হয়ে গিয়ে থাকলে সে আছে লিংকন গাড়ির পেছনের সিটে। বেচারিকে উদ্ধার করা এখন নিজের দায়িত্ব বলেই মনে হচ্ছে ওর।

সামনের পথ সোজা চলে গেছে বহু দূরে। অনেক এগিয়ে আছে লিংকন। ওটার ড্রাইভার ব্রেক করতেই জ্বলে উঠল পেছনের লাল বাতি। পরক্ষণে একটা চৌরাস্তা পেরিয়ে উধাও হলো গাড়িটা।

নিজেও তুমুল বেগে চলেছে রানা। চাপা গর্জন ছাড়ছে পোর্শে নাইন ইলেভেনের ইঞ্জিন। কনকনে শীতের ভেতরেও ঘেমে গেছে রানার কপাল। পেছনে শুনতে পেল পুলিশের সাইরেন। কাছে চলে এসেছে গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ। চট্‌ করে রিয়ারভিউ মিরর দেখে নিল রানা। ওর দু’ব্লক পেছনে ছুটে আসছে পুলিশের দুই সুপার চার্জড় ক্রুযার।

লিংকন যেদিকে গেছে, চাকার তীব্র আওয়াজ তুলে সে- পথে বাঁক নিল রানার পোর্শে। অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে গাড়ির গতি আরও বাড়াল ও। মনে আশঙ্কা সামনের কোন এক বাঁকে হারিয়ে যাবে লিংকন। এদিকে ওর পেছনে তীব্র বেগে আসছে পুলিশের দুই গাড়ি।

পরের বাঁক নেয়ার আগে ফুটপাথে উঠে পড়ল পোর্শের সামনের চাকা। রাবার পুড়িয়ে আবার রাস্তায় নামল রানা।’ পোর্শের নিচ থেকে এল চাকা ঘষটে যাওয়ার কর্কশ আওয়াজ। একবিন্দু গতি না কমিয়ে ঝড়ের বেগে সামনের মোড়ে বাঁক নিল ও। দূরে দেখতে পেল কমার্শিয়াল রাস্তা ধরে দ্রুত বেগে চলেছে লিংকন।

এদিকটা বাণিজ্যিক এলাকা, তার ওপরে রাত নেমে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেছে রাস্তার দু’পাশের বেশিরভাগ দোকান ও পেট্রল স্টেশন। মাঝে মাঝে পেছনে পড়ছে একটা-দুটো খোলা জেনারেল স্টোর। ইঞ্জিন থেকে সব শক্তি নিংড়ে নিচ্ছে লিংকনের ড্রাইভার। একই কাজ করছে রানা। ওর পেছনে আসছে পুলিশের দুই সুপার চার্জড় গাড়ি। রাতের আঁধারে চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে সাইরেনের আওয়াজ আর লাল-নীল আলো।

পেছনে চাকার কর্কশ আওয়াজ শুনতে পেল রানা। একটা ক্রুয়ারের পেছনে আসছে অন্যটা। এইমাত্র চৌরাস্তায় বাঁক নিয়ে বাণিজ্যিক রাস্তায় এসে পড়েছে ও-দুটো। লিংকন আর রানার পোর্শে যেন পলাতক দুই খরগোশ, আর পেছনের দুই পুলিশ যার ক্ষ্যাপা দুটো হাউণ্ড।

রানার ধারণা: এরই ভেতরে রেডিয়োতে ব্যাকআপ চেয়েছে পুলিশ অফিসারেরা। ফলে চারদিকের এলাকা থেকে যে-কোন সময়ে আসবে একের পর এক পুলিশ যার, আটকে দেবে সামনের সব পথ। সেক্ষেত্রে আর কিছুই করার থাকবে না ওর। পোর্শের চালককে হাতের মুঠোয় পেলেই খুশি হয়ে উঠবে তারা। জানতেও চাইবে না, লিংকনে করে ধরে নিয়ে গেছে কিডন্যাপড্ এক অসহায় মেয়েকে। এদিকে বেআইনি অস্ত্রসহ ধরা পড়লে গ্রেফতার হবে রানা। আর এ- সুযোগে হাসতে হাসতে উধাও হবে কিডন্যাপারেরা।

আইনরক্ষকদের সঙ্গে গোলাগুলিতে জড়াতে চায় না ও। অথচ প্রতি ব্লকে ওর পোর্শের দিকে এগিয়ে আসছে পুলিশের ক্রুযার। অফিসারেরা শুধু পালন করছে নিজ নিজ দায়িত্ব। সুতরাং নৈতিকভাবে তাদেরকে গুলি করতে পারবে না রানা। বিপদের মাত্রা বুঝে শুকিয়ে গেল ওর গলা।

মাটিতে বিছিয়ে দেয়া ফিতার মত সোজা চলে গেছে রাস্তা। রানার সামনে তুফান বেগে উড়ে চলেছে লিংকন গাড়িটা। এদিকে পেছনে আসছে তীব্র বেগে পুলিশ ব্রুযার।

চট্ করে একবার রিয়ারভিউ মিরর দেখল রানা। আবার সামনে চোখ যেতেই ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। এবার বোধহয় খুলবে ওর কপাল। পথের ধারের এক পার্কিংলট থেকে বেরোচ্ছে পুরনো লম্বাটে এক পিকআপ। ঝোড়ো বেগে ওটাকে পাশ কাটাল লিংকন। পথে উঠে আসার আগেই গাড়িটাকে পেরোতে পারল রানা। ওটার ড্রাইভার মাথামোটা ধরনের মানুষ। ধরেই নিয়েছে, পুলিশের ক্রুযারদুটো আসার আগেই ঘোরাতে পারবে নিজের গাড়ি। জানা নেই কতটা বেগে আসছে পুলিশের ক্রুযার।

পিকআপটা পথে ওঠার আগেই ওটাকে পেরোল পুলিশের সামনের ক্রুযার। কিন্তু পেছনের গাড়ির বাম্পারে বেধে গেল পিকআপের নাক। রানা রিয়ারভিউ মিররে দেখল, পথের মাঝে চরকির মত ঘুরছে পেছনের ক্রুযার। একটা লাইট পোস্টে গুঁতো মেরে থামল ওটা। দু’ভাঁজ হয়ে গাড়ির বনেটে ধুপ করে পড়ল সরু থাম। শীতের রাতে ক্রুয়ারের ভাঙা রেডিয়েটর ভুসভুস করে ছাড়ছে সাদা বাষ্প।

কয়েক সেকেণ্ড পর আবারও রিয়ারভিউ মিরর দেখল রানা। নেমে যার যার গাড়ির ক্ষতি বুঝে নিতে চাইছে পিকআপের ড্রাইভার আর দুই পুলিশ অফিসার। কেউ আহত নয় তারা। এদিকে সঙ্গীরা সুস্থ আছে কি না তা বুঝতে গিয়ে গতি কমিয়ে দিয়েছে রানার পিছু নেয়া ব্রুয়ারের ড্রাইভার।

বাড়তি এ-সময়টা হাতে পেয়ে পেছনের ক্রুযার থেকে বহু দূরে সরে এল রানা। বাঁক নিয়ে লেকশোর ড্রাইভে পড়ল লিংকন ও পোর্শে। সামনে শিকাগোর ডাউনটাউন বিযনেস লুপ। শহরের মাঝারি সব রাস্তার চেয়ে চওড়া। বেশিরভাগ সময় এ-পথে চলে প্রচুর গাড়িঘোড়া। তবে আজ কোন ভিড় নেই। রানার কান কালা করে দিয়ে জোরালো গর্জন ছাড়ছে পোর্শে। একপাশে লেক মিশিগানের বালিভরা সৈকত। এক শ’ ত্রিশ মাইল বেগে গাড়িটাকে পথে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে রানা। এখন মাত্র পনেরো গজ সামনে লিংকন। বামহাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে রেখে ডানহাতে পাশের সিট থেকে রেরেটা ৯৩-আর নিল ও। দেরি না করে অফ করল ওটার সেফটি ক্যাচ। এখন ট্রিগার টিপে দিলেই প্রতিবারে বেরোবে তিনটে করে গুলি।

লিংকন বুলেটপ্রুফ, ওটার ভেতরে গুলি ঢুকবে না। তবে চাকা কখনও গুলি নিরোধক হয় না। যে প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছে, তাতে চাকা ফেটে গেলে যে-কোন সময়ে উল্টে পড়বে গাড়িটা। সেক্ষেত্রে আহত বা নিহত হবে মেয়েটা। অবশ্য এরই ভেতরে হয়তো ওকে খতম করেছে খুনিরা।

লিংকনের ড্রাইভার নিশ্চয়ই চাইবে না ঘটে যাক মারাত্মক কোন দুর্ঘটনা। সুতরাং গুলি করে চাকা ফুটো করা হলে যত দ্রুত সম্ভব গতি কমাবে সে। আর সে সুযোগে খুনিদের হাত থেকে মেয়েটাকে উদ্ধারের চেষ্টা করতে পারবে রানা।

আমেরিকার অন্যান্য শহরের চেয়ে দক্ষ শিকাগোর ট্রাফিক পুলিশ। চারপাশ থেকে জাল গুটিয়ে এনে দু’চার মিনিটের ভেতরে লেকশোর ড্রাইভ বন্ধ করে দেবে তারা। তখন কোনদিকেই যেতে পারবে না রানা। পোর্শের সাইড উইণ্ডো দিয়ে বের করে লিংকনের পেছনের চাকা লক্ষ্য করে বেরেটা তাক করল ও। তারই ফাঁকে দেখল, সামনের গাড়ির পেছনের সিটে ঘুরে জানালা দিয়ে অর্ধেক শরীর বের করেছে মাফিয়ার এক তস্কর। তুমুল বাতাসে এলোমেলো হচ্ছে তার সোনালি চুল ও কালো কোট। লোকটার হাতে নলকাটা পাম্প শটগান। সরাসরি পোর্শের উইণ্ডশিল্ডের দিকে অস্ত্র তাক করল সে।

এবার কী ঘটবে সেটা বুঝে গেছে রানা। দেরি না করে পিছলে নেমে যেতে চাইল ড্রাইভিং সিটের সামনে। একহাতে একটু ঘুরিয়ে নিয়েছে স্টিয়ারিং হুইল। তবে তাতে কোন লাভ হলো না, পোর্শের ইঞ্জিনের ওপর দিয়ে এল বন্দুকের ভোঁতা ‘বুম্!’ গর্জন। হাজার টুকরো হয়ে ঝরঝর করে ওর ওপরে ঝরল সেফটি উইণ্ডশিল্ড। একেক টুকরো যেন ঝলমলে হীরার খণ্ড। উইণ্ডশিল্ড নেই বলে চৌকো ফাঁক দিয়ে হু-হু করে এল শীতল হাওয়া। রানা ঝট করে উঠে বসে টের পেল, কপাল বেয়ে নামছে সরু এক উষ্ণ স্রোত। মুখ না মুছে মাথা একদিকে কাত করল ও। এবার চোখে এসে পড়বে না রক্ত। বামহাত ওপরে তুলে টিপে দিল বেরেটার ট্রিগার।

লিংকনের পেছনের জানালা দিয়ে অর্ধেক দেহ বের করে ওকে দেখছে মাফিয়ার গুণ্ডা। অন্ধকারে তার হাতে সোনালি আগুনের ঝিলিক দেখল রানা। আবারও গুলি করেছে লোকটা। একই সময়ে বেরেটার নাইন এমএম প্যারাবেলাম বুলেট গেঁথে গেল, তার বুকে। হাত থেকে রাস্তায় পড়ে ছিটকে আরেকদিকে গেল শটগান। পরক্ষণে কাত হয়ে গাড়ি থেকে খসে পড়ল মাফিয়ার গুণ্ডার লাশ।

গতি না কমিয়ে শটগান আর ওটার মালিকের ওপর দিয়ে পেরোল পোর্শে। রিয়ারভিউ মিররে রানা দেখল, গোলাগুলি হচ্ছে জেনেও গতিহ্রাস করেনি পুলিশের ক্রুয়ারের ড্রাইভার। এখন আছে মাত্র সিকি মাইল দূরে। পুলিশের অফিসারদেরকে রক্তের গন্ধ পাওয়া ক্ষ্যাপা হাঙরের মত বলে মনে হলো ওর।

ক্রুয়ারের পেছনে আরও ক’টা পুলিশের গাড়ি। ওদিকে লেকশোর ড্রাইভের উত্তরদিক থেকে আসছে বেশকিছু জুয়ার। মিনিট চারেকের ভেতরে ধরা পড়তে চলেছে, বুঝে গেল রানা। লিংকনে এখন আছে শুধু ড্রাইভার আর সেই যুবতী। একদল শয়তানের বিরুদ্ধে বাঘিনীর মত লড়াই করেছে মেয়েটা। এখনও সে বেঁচে থাকলে রানার উচিত তাকে উদ্ধার করা। যদিও সেটা করতে গিয়ে নিজেই হয়তো গ্রেফতার হবে পুলিশের হাতে।

সামনের গাড়ির দিকে এক পশলা বুলেট পাঠাল রানা। লিংকনের পেছনের ডান চাকার রিমে লেগেছে একটা গুলি। রিমে পিছলে কমলা অগ্নিস্ফুলিঙ্গ তৈরি করে চাকার ভেতরে গিয়ে ঢুকল ওটা। সঙ্গে সঙ্গে দুলতে লাগল লিংকন। কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আবারও গাড়িটা সামলে নিল ড্রাইভার। দ্রুত কমছে লিংকনের গতি। পথ থেকে নেমে চলে গেল ঘাসে ভরা এবড়োখেবড়ো জমিতে

একটু দূরে সৈকতের ধারে বরফের মত শীতল মিশিগান লেক। লেকশোর ড্রাইভের ল্যাম্প-পোস্ট আর কোটি নক্ষত্রের মৃদু আলো থাকলেও আজ রাতে আকাশে নেই চাঁদ। লেকের ওদিকের তীরে বহুতল ভবনগুলোর জানালায় ঝলমল করছে বৈদ্যুতিক বাতি।

হোলস্টারে বেরেটা রেখে গাড়ির গতি কমিয়ে নিচু জমিতে নেমে এল রানা। এখন ওর কাছ থেকে মাত্র দশফুট দূরে দাঁড়িয়ে আছে লিংকন। পোর্শে থেকে নেমে ওটার পাশে চলে গেল ও। কালচে সৈকতে দাঁড়িয়ে শুনতে পেল একাধিক সাইরেনের কর্কশ আওয়াজ।

কোটের ভেতর থেকে অটোম্যাগ নিয়ে চাপা স্বরে নির্দেশ দিল রানা, ‘কোন চালাকি নয়! হাত ওপরে তুলে বেরিয়ে এসো!’ কেউ না কেউ গাড়ি থেকে নামবে, ভাবছে ও।

লিংকনের ভেতরে জ্বলল হলদেটে বাতি। পরের সেকেণ্ডে যা বুঝবার সব বুঝে গেল রানা। ধীরে ধীরে খুলে গেছে লিংকনের সামনের দরজা। সামান্য ইতস্তত করে নেমে এল মেয়েটা। অটোম্যাগের ট্রিগার থেকে আঙুল সরিয়ে নিল রানা। মনে সন্দেহ রইল না, এই যুবতী নায়িকা সোফিয়া লরেনের চেয়েও সুন্দরী। যদিও এখন থমথম করছে মুখ। অচেনা এক লোকের হাতে ভয়ঙ্কর-দর্শন পিস্তল দেখে চোখে ভর করেছে আতঙ্ক। ধীরে ধীরে মাথার ওপরে তুলল দু’হাত।

লিংকনের ভেতরে চোখ বোলাল রানা। হলদেটে আলোয় স্টিয়ারিং হুইলের ওপরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ড্রাইভার। ঘাড় আর মাথার সংযোগে গেঁথে গেছে ছোট্ট এক পকেট নাইফ। বাঁচার উপায় ছিল না তার।

রানা যখন শটগানসহ মাফিয়ার গুণ্ডাকে গুলি করে গাড়ি থেকে ফেলল, একই সময়ে পেছনের সিটে একা হয়েছে মেয়েটা। আর তখনই নিয়েছে সুযোগ। ড্রাইভার খুন হতেই সামনের প্যাসেঞ্জার সিটে চলে এসেছে সে। স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে নেমে গেছে সৈকতে।

সত্যিকারের সাহসী মেয়ে, ভাবল রানা। গাড়ির ভেতরের বাতি নিভিয়ে লাথি মেরে বন্ধ করল লিংকনের দরজা। কয়েক পা সরে মুখোমুখি হলো মেয়েটার।

ভয় পেয়ে সরে গেল না যুবতী। নিচু গলায় শুধু জানতে চাইল, ‘কে আপনি? আপনি তো মাফিয়া অথবা পুলিশের কেউ নন!’

‘আমি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী, নরম সুরে বলল রানা, ‘নাম কী তোমার?’

‘লিউনা, লিউনা গার্ডনার,’ চাপা শ্বাস ফেলল মেয়েটা। লিউনা শকের ভেতরে আছে ভেবে চট করে ওর হাত ধরল রানা। আপত্তি করল না লিউনা।

‘আমাকে তুমি করে বলতে পারো,’ বলল রানা। ‘এসো, পুলিশ আসার আগেই সরে যেতে হবে। নাকি তুমি চাও তাদের সঙ্গে কথা বলতে?’

‘পুলিশের সঙ্গে? নাহ্!’ চমকে গেল মেয়েটা।

লিউনাকে নিয়ে লিংকন থেকে সরে এল রানা। দ্রুত হেঁটে চলেছে লেকশোর ড্রাইভের সবচেয়ে জনবহুল আবাসিক এলাকা লক্ষ্য করে। পুলিশের লোক এদিকের এলাকা ঘিরে ফেলার আগেই তাদের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে।

রানার পাশে নরম বালি মাড়িয়ে ছুটে চলেছে মেয়েটা। মৃদু খস খস আওয়াজ তুলছে জুতো।

‘লোকগুলো তোমার কাছে কী চেয়েছিল?’ জগিঙের বেগে এগিয়ে চলেছে রানা। ডানহাতে ঝুলছে অটোম্যাগ।

‘ধরে ফেলেছিল,’ ছোটার ফাঁকে জানাল লিউনা। ‘আমি আসলে… একটা হোমিং ডিভাইস রেখেছিলাম।’

‘ফেরারি গাড়িটাতে?’

মৃদু মাথা দোলাল লিউনা। ‘হ্যাঁ, ওটা সিনেটরের গাড়ি।’ রানার পেছনে এসেছে যে ব্রুযার, এইমাত্র লিংকন আর পোর্শের কাছে এসে থামল ওটা। গাড়িটার জোরালো আলো এসে পড়েছে লেকতীরের সৈকতে। দূর থেকে দেখে রানার মনে হলো, অন্ধকারে ওর দিকে চেয়ে আছে কোন দানবের জ্বলজ্বলে দুটো চোখ। দু’সেকেণ্ড পর দুই হেডলাইটের সঙ্গে যোগ দিল শক্তিশালী এক স্পটলাইট। মেয়েটার হাত ছেড়ে দিয়ে চাপা স্বরে বলল রানা, ‘বালিতে শুয়ে পড়ো!’

ওর পেছনে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল লিউনা। নিচু গলায় বলল, ‘ভুলেও পুলিশদেরকে খুন কোরো না!’

‘ভেবো না,’ বলল রানা। পরক্ষণে ওর হাতে বজ্রপাতের আওয়াজ তুলল অটোম্যাগ। সঙ্গে সঙ্গে চুরচুর হয়ে ভেঙে গেল স্পটলাইট। দপ করে নিভে গেছে শক্তিশালী আলোটা।

এবার পালিয়ে যেতে হবে সেটা জানাবার জন্যে লিউনার দিকে ফিরল রানা। কিন্তু আশপাশে কোথাও নেই মেয়েটা!

বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ল রানা।

সাইরেন বাজিয়ে পথের ধারে থামল একের পর এক পুলিশের জুয়ার। ধুপধাপ আওয়াজে খুলে যাচ্ছে দরজা। পেভমেন্টে নেমে সৈকত লক্ষ্য করে ছুটে এল অফিসারেরা।

আবছা আলোয় তাদের রাগান্বিত চেহারা দেখতে পেল রানা। সবার হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল।

লেকটাকে পাশে রেখে ক্ষিপ্র চিতার বেগে ছুটে চলল রানা। তারই ফাঁকে ভাবল: সাধ্যমত করেছি মেয়েটার জন্যে। সঙ্গে আসবে না সে। সুতরাং আর কিছু করার নেই।

রাত মোটেই গভীর নয়। যত দ্রুত সম্ভব খুঁজে নিতে হবে মাফিয়া ডন রসিকে। শুধু তা-ই নয়, তার সঙ্গে ইউএস সিনেটরের কীসের সম্পর্ক, সেটাও জানতে হবে। লিউনা বোধহয় বহু কিছু জানত। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনকিছুই জানা গেল না।

এখন ওর প্রথম কাজ হবে পুলিশ কর্ডন এড়িয়ে নিরাপদ কোথাও পৌঁছে যাওয়া। পোর্শে সার্চ করে দেখবে পুলিশের লোক। পরে তল্লাসী করবে লিংকন গাড়িটা। তখন ওটার ভেতরে পাবে লাশ। অফিসারেরা ছড়িয়ে পড়বে সৈকতে। সন্দেহজনক কাউকে পালিয়ে যেতে দেখলে আগে গুলি করে পরে কথা বলবে। সুতরাং, তাদের জাল ভেদ করে বেরিয়ে যাওয়া এখন খুব জরুরি। আর সেজন্যে চাই সামরিক দক্ষতা ও অঢেল সৌভাগ্য। সৈকত মাড়িয়ে আবাসিক এলাকা লক্ষ্য করে প্রাণপণে ছুটে চলল রানা।

চার

স্রেফ কপাল গুণে লেকের তীর থেকে পালিয়ে এসেছে রানা, বিষয়টা তেমন নয়। শত্রু-এলাকায় হামলা করে অক্ষত শরীরে ফেরার জন্যে মাসের পর মাস কঠোর প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে ওকে। তবুও পুলিশের কর্ডন ভেদ করতে গিয়ে ওর লেগেছে পনেরো মিনিট। দু’বার ক’জন পুলিশ অফিসারের তিনফুট দূর দিয়ে যেতে গিয়ে ছুটে গেছে কালঘাম। এক ছায়া থেকে অন্য ছায়ায় সরে গেছে প্রেতাত্মার মত। তারপর রাস্তায় উঠে সহায়তা পেল এক ক্যাব ড্রাইভারের কাছ থেকে। হাত নাড়তেই থামল সে। শহরের মাঝে পৌঁছে গিয়ে ভাড়া মিটিয়ে ক্যাব থেকে নেমে পড়েছে রানা। স্মার্টফোনে আগেই কথা বলেছে আতাউল কবীরের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর সতেরো সালের পোর্শে নাইন ইলেভেন নিয়ে হাজির হলো সে। এটাও ভাড়া করা। গাড়িটা রানাকে বুঝিয়ে দিয়ে বাসে চেপে চলে গেল শহরের অন্যপ্রান্তে। পেছনে ফেউ নেই বোঝার পর ফিরে গেছে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। এদিকে দরকারি জিনিসপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে সেফহাউসে ফিরে এসেছে রানা।

তারপর ওখান থেকে বেরিয়ে একটু আগে হাজির হয়েছে ধনী-এলাকা লেক ফরেস্টে। ওর পরনে কালো স্কিন-স্যুট। ডান ঊরুতে অটোম্যাগসহ হোলস্টার। বুকের পাশে খাপে ভরা কমব্যাট নাইফ। বামবাহুর পাশে স্পিড-রিগে বেরেটা। কোমরে বাড়তি গুলির ক্যানভাস পাউচ। বুকের ওয়েবিঙে কয়েক ধরনের গ্রেনেড। এ-ছাড়া ওর সঙ্গে আছে ইনফ্রারেড নাইট-ভিশন গগল্‌স্‌, তারের মৃত্যু-ফাঁস, দেয়াল বেয়ে ওঠার দড়ি ইত্যাদি।

রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে চোখে নাইট-ভিশন গগল্স্ পরে ষাট গজ দূরে অ্যালডো রসির এস্টেটের মেইন গেট দেখছে রানা। ওর মনে হচ্ছে, মাফিয়া ডনের ম্যানশন যেন মধ্যযুগীয় কোন জমিদারের দুর্গের মত।

এবারের এই রেইডে বিসিআই সেফহাউস থেকে আরও নিয়েছে রানা ম্যাক সাউণ্ড সাপ্রেসরসহ ইনগ্রাম মডেল-১০ এসএমজি। ওর বামকাঁধে ফিতা থেকে ঝুলছে অস্ত্রটা। মাত্র দুই সেকেণ্ডে উঠে আসবে হাতের মুঠোয়। এ-ছাড়া ওর সঙ্গে আছে বিশেষ একটি জ্যামার। ইসরায়েলি আর্মির জন্যে ম্যাচ- বক্সের মত ছোট্ট অত্যাধুনিক যন্ত্রটা তৈরি করেছে আমেরিকান বিজ্ঞানীরা। ওটা চালু করা হলে সত্তর গজের ভেতরে রেডিয়ো, মোবাইল ফোন, সিসি ক্যামেরা ইত্যাদি বিকল হয়ে যায়। কয়েক মাস আগে সিরিয়ায় কঠিন এক অ্যাসাইনমেণ্টে গিয়ে জ্যামারটা হাতে পায় বিসিআই এজেন্ট তুফান আরেফিন। পরের মাসে বিসিআই-এর টেকনিশিয়ানেরা জেনে গেল ওটার ভেতরের গুমর। এরপর একই জিনিস তৈরি করে বিসিআই-এর প্রতিটি সেফহাউসে রাখা হয়েছে একটা করে জ্যামার। দরকার হলে যেন ব্যবহার করতে পারে বাঙালি এজেন্টরা।

গাড়িটা সিকিমাইল দূরে রেখে পায়ে হেঁটে রসির এস্টেটের দক্ষিণে চলে এসেছে রানা। ওর বুঝতে দেরি হয়নি, কোথা দিয়ে ঢুকতে হবে ওকে। স্নিগ্ধা আর তুষারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারে গিয়েছিল। তবে ওখানে ছিল না অ্যালডো রসি। এখন হয়তো বাড়িতেই আছে। সেক্ষেত্রে তাকে খুন করতে দেরি করবে না রানা।

জঙ্গলের ধারে ধনীদের দুর্গের মত সব ম্যানশন। চট্ করে বোঝা যায় না যে কোনদিক থেকে ওগুলো ডনের বাড়ি থেকে আলাদা। নিখুঁত, রুচিশীল ম্যানশনগুলোতে গার্ডবক্স নেই। অথচ রসির বাড়ির ভেতরে আছে শক্তপোক্ত গার্ডবক্স। ওটা দেখলে মনে হবে দুর্গম কোন কারাগার পাহারা দেয়ার জন্যে তৈরি। গেটের ওদিকে অস্ত্র কাঁধে ঝুলিয়ে পায়চারি করছে দু’জন গার্ড। একঘণ্টা আগে নিউ টাউন হেলথ সেন্টারে হামলা হলেও মনে হচ্ছে না মানসিক কোন চাপে আছে তারা। গাড়ি নিয়ে গেট ভেঙে ঢুকলেও বাড়ির দিকে যাওয়া আঁকাবাঁকা পথে গতি তুলতে পারবে না কেউ। দশফুট যাওয়ার আগেই ঝাঁঝরা হবে গার্ডদের রাইফেলের গুলিতে।

বাড়িতে বোধহয় এখন নেই অ্যালডো রসি, ধারণা করছে রানা। নইলে কম্পাউণ্ডে থাকত অন্তত দশজন গানম্যান। মাফিয়া ডন না থাকলেও বাড়িটা সার্চ করবে ও।

পাতাহীন ওক গাছের জঙ্গলের মাঝ দিয়ে এগোল। একটু পর দেখতে পেল রসির বাড়ির গেটের কাছে থেমেছে একটা গাড়ি। চট্ করে নাইট-ভিশন গগল্স্ দিয়ে ওটার লাইসেন্স প্লেট পড়ল রানা। ইঞ্জিন বন্ধ করে হেডলাইট অফ করেছে ড্রাইভার। বোধহয় এবার গাড়ি থেকে নামবে, ভাবল রানা।

দু’মিনিট পেরিয়ে গেলেও সিটেই বসে থাকল লোকটা।

বাড়ির দেয়ালের কাছে কালো প্লাস্টিকের কয়েকটা গার্বেজ ব্যাগ। আগামী ভোরে ওগুলো সরিয়ে নেবে মিউনিসিপ্যালিটির ট্রাক। নাইট-ভিশন গগল্স্ দিয়ে গাড়ির ভেতরে চোখ বোলাল রানা। আর কেউ নেই। সিটে বসে সিগারেট ফুঁকছে লোকটা। গাড়ির পেছন বাম্পারে স্টিকারে লেখা: আমি একজন পুলিশ। আর সেজন্যে আমি গর্বিত।

হঠাৎ এদিকে কেন এই লোক? – ভাবল রানা। আসলে হয়তো চরম দুর্নীতিপরায়ণ। টাকা খেয়ে বিক্রি হয়ে গেছে এমন পুলিশ অফিসারের অভাব নেই শিকাগোতে। ডিউটির পর এসেছে ডনের বাড়ি পাহারা দিতে। আবার হয়তো এই লোক সৎ এক পুলিশ অফিসার। জরুরি তদন্তের জন্যে চোখ রেখেছে রসিদের এস্টেটের ওপরে।

আপাতত জানার উপায় নেই কী তার উদ্দেশ্য।

গাড়ি ও গেটের কাছ থেকে সরে এস্টেটের দক্ষিণ-পশ্চিম দেয়ালের সামনে হাজির হলো রানা। পকেট থেকে নিয়ে চালু করল জ্যামার। মিলিটারি ওয়েবিং থেকে নিল রাবার দিয়ে মোড়া স্টিলের আঁকশিওয়ালা ক্লাইমিং রোপ। মাথার ওপর দু’বার ঘুরিয়ে দেয়ালের ওদিকে ফেলল দড়ি। টান দিতেই দেয়ালের ওদিকে আটকে গেল দুই আঁকশি।

দড়িতে বারদুয়েক টান দিয়ে রানা নিশ্চিত হলো, খুলে আসবে না ওটা। দেয়ালে উঠতে ওর লাগল মাত্র দশ সেকেণ্ড। বাগানের ভেতরে ফেলল দড়ি। তারপর সরসর করে নেমে এল এদিকে। বাগানের ভেতরে অন্ধকারে বসে থাকল ভূতের মত। হাতে ম্যাক-১০। উত্তরদিকে অন্তত এক শ’ গজ দূরে গেট। ওখানে পায়চারি করছে দুই গার্ড। আশপাশে আর কেউ নেই।

বাগানে ফার গাছের মাঝ দিয়ে বাড়ির দিকে গেছে সরু পিচ-ঢালা পথ। একটা বাতি জ্বলছে ম্যানশনের দোতলায়। দেয়ালের কাছ থেকে সরে ঝোপঝাড় ও ফার গাছের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে বাড়ির দিকে চলল রানা। মাঝে মাঝে সতর্ক চোখে দেখছে দুই গার্ডকে। ভাবছে: বোধহয় তার স্যাঙাতদের ওপরে হামলা হওয়ায় গোপন কোন আস্তানায় চলে গেছে অ্যালডো রসি। তার পরিবার সম্পর্কে বেশকিছু তথ্য দিয়েছে আতাউল।

একসময় নামকরা একটা বার অ্যাণ্ড রেস্তোরাঁর দারোয়ান ছিল অ্যালডোর বাবা অ্যাড্রিয়ানো রসি। শিকাগোর দুই মাফিয়া ডনের মধ্যে লড়াই শুরু হলে ফুটসোলজার হিসেবে যোগ দেয় জ্যাকো পেরেলের দলে। দুই ডনের মরণপণ যুদ্ধে বিজয়ী হয় পেরেলের মাফিয়া দল। এরপর পেরেলের মৃত্যু হলে পরের দশ বছরে মগজ খাটিয়ে দলের প্রধান হয়ে ওঠে অ্যাড্রিয়ানো রসি। জন্ম তার ষাট সালে। পঁচিশ বছর বয়সে বিয়ে করেছে ইতালিয়ান এক সুন্দরী তরুণীকে। সাতাশি সালে তাদের পরিবারে এল একমাত্র মেয়ে এলিসা রসি। এরপর তিরানব্বুই সালে জন্মাল ছেলে অ্যালডো রসি।

বাবা-মা-র কথা না শুনলেও বড়বোনের কথা মেনে চলত অ্যালডো। এখনও বিয়ে করেনি তার প্রিয় বড়বোন। মহিলার বয়স এখন সাঁইত্রিশ বছর। অনেকে বলে একত্রিশ বছর বয়সী ভাইটাকে মায়ের মত করে আগলে রেখেছে সে। দু’হাজার দশ সালে তাদের মা হার্ট-অ্যাটাকে মারা গেলে নিজেকে গুটিয়ে নেয় অ্যাড্রিয়ানো রসি। এরপর পাঁচবছর পর মারা যায় ক্যান্সারে। তাদের মাফিয়া দলের ডন হয় অ্যালডো রসি। শোনা যায় বাবার মত নয় সে। যত না ইতালিয়ান পুরুষ, তার চেয়ে বেশি আমেরিকান। ইউনিভার্সিটি থেকে নিয়েছে উচ্চতর ডিগ্রি। নানানদিকে ছড়িয়ে দিয়েছে তাদের ব্যবসা। শিকাগোর রাজনীতিতে আছে তার জোরালো হাত। কেউ কেউ বলে অ্যালডো রসির মতামত না নিয়ে এক পা ফেলেন না একাধিক সিনেটর।

বাড়ির পেছনে এসে নিচতলায় কোন বাতি দেখতে পেল না রানা। এমনকী সামনের বারান্দাতেও আলো জ্বলছে না। অবশ্য অনেক সময়ে নিভিয়ে রাখা হয় মাফিয়া ডনের বাড়ির বেশিরভাগ বাতি, যাতে শত্রুরা মনে করে যে ওটা অরক্ষিত। যদিও ভুল এ-ধারণা করলে চরম মূল্য দিতে হয় যে-কাউকে।

লড়াইয়ের জন্যে পুরো তৈরি রানা। বাড়ির পেছনে সরু এক দরজা দেখে ছায়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে ওখানে পৌঁছে গেল ও। নবে মোচড় দিয়ে দেখল দরজার তালা লক করা। ছোরা বের করে ওটার ডগা দিয়ে তালা খুলতে ওর লাগল বড়জোর দশ সেকেণ্ড। কবাট সরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই শুনতে পেল ওর দিকেই এগিয়ে আসছে কে যেন!

কবাট সামান্য ফাঁক করে রেখে বাইরে উঁকি দিল রানা। বাড়ির অন্য দুই গার্ডের মতই তৃতীয়জনের কাঁধে রাইফেল। বাড়ির পেছনের কোনা ঘুরে হাজির হয়েছে সে। শীতে বারবার মুঠো করছে হাত। নাইট-ভিশন গগল্‌স্‌ দিয়ে পরিষ্কার তাকে দেখছে রানা। সরু দরজার কাছে সে আসতেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল রানা। প্রচণ্ড এক ঘুষি বসাল লোকটার কানের নিচে। অচেতন দেহটা মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ার আগেই দু’হাতে ধরে ফেলল। অভিজ্ঞতা থেকে জানে রানা, হুঁশ ফিরতে অন্তত দেড়ঘণ্টা লাগবে এ-লোকের। দেহটা টেনে নিয়ে ঘন এক ঝোপের ভেতরে গুঁজে রাখল ও। আবার ঢুকল গিয়ে বাড়ির ভেতরে। ডান বাহুর স্ট্র্যাপে রেখেছে ম্যাক-১০। সামান্য ঝাঁকি দিলেই হাতে উঠে আসবে অস্ত্রটা। হোলস্টার থেকে বেরেটা নিয়ে চারপাশ দেখল রানা। এটা বাড়ির কিচেন। আশপাশে কথাবার্তা বা নড়াচড়ার কোন শব্দ নেই। আঁধার কবরের মত থমথম করছে নিচতলা।

বৈদ্যুতিক বাতি না জ্বেলে নাইট-ভিশন গগল্স্ পরে পুরো নিচতলা ঘুরে দেখল রানা। কিচেন, ডাইনিংরুম, লিভিংরুম, ডেন, চারটে বেডরুম আর বড় এক স্টাডিরুম। শেষ ঘর ব্যবহার করে রসি। একদিকে বড় ডেস্ক। ওটার ওপরে প্রাচীন আমলের টেলিফোন। পাশেই ডিরেক্টরি আর প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া নোটবুক।

ডিরেক্টরি নিয়ে কালো স্যুটের ভেতরে গুঁজল রানা। স্টাডিরুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠল দোতলায়। থামল ওপরের করিডরে। দু’পাশে ঘরগুলোর দরজা বন্ধ। ওর ডানে অন্ধকার হলওয়ে গেছে বাড়ির শেষমাথা পর্যন্ত। মাত্র একটা দরজার তলা দিয়ে আসছে হলদে আলো। সেখান থেকে ভেসে এল কথা বলার আওয়াজ।

ওখানে আছে অন্তত দু’জন। পুরো দোতলা ঘুরে দেখার পর আলোকিত ঘরে ঢুকবে বলে মনস্থির করল রানা।

প্রথমতলার চেয়ে বেশি তথ্য দিল দোতলা। মেইন বেড রুমে পুরুষের দামি সব স্যুট দেখতে পেল রানা। খাটের পাশে নাইটস্ট্যাণ্ডে ছোট্ট নোটেশন প্যাড। কী যেন লিখে ছিঁড়ে নেয়া হয়েছে ওটার প্রথম পাতা। পরের পৃষ্ঠায় চেপে বসেছে কলমের নিব। টেবিল থেকে একটা পেন্সিল নিয়ে তেড়চাভাবে দাগের ওপরে শিষ বোলাল রানা। পরিষ্কার দেখতে পেল ভেসে উঠেছে একটা ফোন নাম্বার। বেডের পাশে বসে ফোনের রিসিভার নিল ও। নাম্বারগুলো ডায়াল করতেই কয়েকবার বেজে ওঠার পর ওদিক থেকে বলল এক নারীকণ্ঠ: ‘হার্বার ইয়ট ক্লাব।’

ক্রেডলে রিসিভার রেখে ঘর সার্চ করল রানা। এককোণের অ্যালকোভে বিশাল এক এলইডি স্ক্রিন। পাশের তাকে ডিভিডি প্লেয়ার আর পাহাড়ের মত উঁচু করে রাখা অসংখ্য ডিভিডি ডিস্ক। কয়েকটা খাপের লেখা পড়ে দেখল রানা।

জেনি।

জিমি।

জিনা।

কেন যেন ওর মন বলল, ডিভিডি প্লেয়ারে একটা ডিস্ক ভরে দেখে নেয়া উচিত ওটার কনটেন্ট।

সেটাই করল রানা। মাত্র পনেরো সেকেণ্ডে তেতো হয়ে গেল ওর মন। বাটন টিপে বন্ধ করল ডিভিডি প্লেয়ার। ভাবল, এখনই উচিত গুলি করে যন্ত্রটা চুরমার করে দেয়া।

শীতল রাগে ওর মগজে ধরে গেছে আগুন। ডিস্কে ছিল অসহায় নিষ্পাপ দুটো বাচ্চা মেয়ে। একদম উলঙ্গ। ওদের একজনের ওপরে চড়াও হয়ে রেপ করছে বছর তিরিশেকের এক পাষণ্ড। আর শুয়োরটা স্বয়ং ডন অ্যালডো রসি!

চোয়ালে চোয়াল চেপে নিজেকে শান্ত করতে চাইল রানা। মনে মনে বলল, যে-কাজে এসেছ, ঠাণ্ডা মাথায় সেটা শেষ করো। রসির বেডরুম থেকে করিডরে এসে আলোকিত ঘরের দিকে চলল রানা, হাতের মুঠোয় বেরেটা। সামনের ঘরটা সার্চ করা শেষ হলেই বিদায় নেবে এ-বাড়ি ছেড়ে।

কার্পেট বিছানো করিডরের দু’দিকের দেয়ালে আধুনিক সব দামি তৈলচিত্র। সামনের ঘর থেকে এল চাপা উত্তপ্ত বিতণ্ডা। খেপে গিয়ে বলল নারীকণ্ঠ: ‘সবই বুঝতে পেরেছি! তুমি মিথ্যা বলছ! তোমার ব্লু ফিল্মের নোংরা কোন মাগীর সঙ্গে শুয়েছ! আর সেজন্যেই আজ আমাকে আর শান্তি দিতে পারবে না! কবেই বা দুটো মেয়েকে একই রাতে স্বস্তি দিতে পেরেছ? তুমি আসলে চিরকালই নোংরা নর্দমার কেঁচো!’

‘এমনটা হতে পারে না, আমি হয়তো তোমার অতিরিক্ত খায়েস মেটাতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে গেছি?’ পাল্টা বলল পুরুষকণ্ঠ: ‘প্রতিদিন চার-পাঁচবার এসব কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। অবশ্য তুমি আমাকে ভুল ভাবছ, লিসা। শপথ করে বলতে পারি, অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে শুচ্ছি না।’

‘সেটা হলেই তোমার মঙ্গল, পিট! নইলে বাঁচবে না! আর এখন তো মনে হচ্ছে, তোমার আর কিছু দেয়ারও নেই! তার ওপরে এমনিতেই তোমার যন্ত্রটা চড়ুই পাখির ওটার সমান!’

দরজার সামনে থেমেছে রানা। ভাবছে এখনই ঢুকবে না ঘরে। আগে শোনা যাক এরা জরুরি কিছু বলে কি না।

‘তোমার মস্তানদেরকে দিয়ে ভয় দেখিয়ে কোন লাভ হবে না,’ বলল পিট। ‘মস্ত ভুল করেছি তোমার মত ডাইনীর সঙ্গে বিছানায় গিয়ে! আগে যদি জানতাম প্রতিদিন এতবার করে…’

‘বাজে কথা বাদ দাও, শুয়োর কোথাকার!’ গলা উঁচিয়ে ধমক দিল এলিসা রসি। ‘বরং এটা বলো, আগামী কিছু দিন কেন দেখা করবে না। ভাল কোন ব্যাখ্যা না দিলে খুন হবে আমার হাতে।’

অপেক্ষাকৃত শান্ত স্বরে বলল পিট, ‘তুমি তো জানো আজ কী ঘটেছে হেলথ সেন্টারে। যে পেশায় আছি, যে-কোন সময়ে অচেনা সেই লোকটা হামলা করবে আমার ওপরে।’

‘মাসুদ রানা? সে আবার কী করবে? তুমি পর্নো মুভি তৈরি করলে তাতে তার কী?’ বিরক্ত সুরে বলল এলিসা রসি।

‘কাজটা তো আর ভাল নয়।’

‘তাতে কী?’

‘মাসুদ রানাকে ধরতে গিয়ে নানাদিকে ছান দেবে পুলিশ। আমিও যখন-তখন ধরা পড়তে পারি। সেক্ষেত্রে আমার পেট থেকে তোমার ব্যাপারে বহু কিছুই জেনে নেবে তারা।’

‘যদিও আমার মনে হচ্ছে এসব কথার পেছনে তোমার অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে,’ বলল এলিসা রসি। ‘তুমি আসলে অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছ।’

‘কী যে বলো, লিসা!’

‘তো যা করতে বলছি, কাপড় ছেড়ে সেটা করো। নইলে কচ করে কেটে নেব তোমার নুণ্টি।’

এবার রানা বুঝল, ঘরে লোকটার পরনে পোশাক আছে। কী করবে ভাবতে শুরু করেছে ও, এমনসময় দরজার কাছ থেকে বলল লোকটা, ‘তুমি বরং নিজের জন্যে জোগাড় করো গোটা চারেক মর্দা বাঁদর! আজ কিছুতেই অত পরিশ্রম করতে পারব না।’

খুলতে শুরু করেছে দরজা।

‘খবরদার, পিট!’ গর্জে উঠল এলিসা রসি। ‘আমাকে শান্তি না দিয়ে…’

হঠাৎ নিজে থেকে দরজা খুলে যেতেই লা-জওয়াব হয়ে গেল মহিলা। তার সঙ্গী বিস্মিত চোখে দেখল করিডরে কঠোর চেহারার এক যুবক, হাতে উদ্যত বেরেটা পিস্তল!

‘ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াও,’ হিমশীতল স্বরে বলল রানা।

নরকের শহর – ৫

পাঁচ

নীরবে আদেশ পালন করল পিট। নিউ টাউন হেলথ সেন্টারের লোকগুলোর মতই পেশিবহুল সে। তবে প্রতিনিয়ত অনিয়ম করেছে বলে মুখে অকাল বার্ধক্যের বলিরেখা। দৃষ্টিতে নেই ন্যায়-নীতির বালাই। তাড়া খাওয়া ইঁদুরের মত চেয়ে আছে রানার চোখে।

বিছানার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ইতালিয়ান সুন্দরী উলঙ্গ মহিলা। বয়স হবে অন্তত পঁয়ত্রিশ। অতৃপ্ত যৌন তৃষ্ণায় চিকচিক করছে দু’চোখের নীল মণি।

পিটের নাক বরাবর পিস্তল তাক করে ঘরে ঢুকল রানা। চোখ সরছে না এলিসা রসির ওপর থেকে।

প্রেমিকার পাশে গিয়ে থামল পর্নোগ্রাফার।

করিডর থেকে হামলা এলে সেটা ঠেকাতে তৈরি রানা। কোমরে হাত রেখে লোভী চোখে ওকে আপাদমস্তক চাটছে মিস রসি। ‘এখন কিন্তু অন্য কথা ভাবছি, পিট,’ খসখসে গলায় বলল সে। ‘এই যুবক যদি তোমাকে বাঁচতে দেয়, তো বরং চলেই যাও। এ হয়তো চাইবে আমার সঙ্গে…’

তাকে পাত্তা না দিয়ে পিটের দিকে তাকাল রানা। ‘তোমার পুরো নাম কী?’

ঢোক গিলল পর্নোগ্রাফার। কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। তোতলাতে শুরু করে বলল, ‘পি… পি…পিট! পিট ব্ল্যাক! আপনি আমার দিকে পিস্তল তাক করেছেন কেন?’

অস্ত্রের নল তার দিকে থাকলেও মহিলার দিকে তাকাল রানা। ‘আর আপনি বোধহয় মিস রসি

‘হ্যাঁ,’ মাথা দোলাল মহিলা। চোখ সরছে না রানার সুঠাম দেহের ওপর থেকে। ‘আর তুমি? তুমি কে!’

এলিসা রসি দৃঢ় মনের মানুষ, গলা শুনে বুঝে গেল রানা। ‘আমার নাম মাসুদ রানা।’

‘সেরেছে!’ মুখ শুকিয়ে গেল পিট ব্ল্যাকের।

‘তুমি আমাদেরকে খুন করবে না,’ বলল এলিসা রসি, ‘সেটা চাইলে আগেই করতে। তুমি এসেছ আসলে আমার ভাইয়ের খোঁজে।’

‘সে এখন কোথায়?’

‘তুমি ভেবেছ তোমার মত খুনিকে বলব নিজের ভাইয়ের খোঁজ?’ বলল মহিলা। ‘তুমি কি পাগল নাকি?’

মারা যাওয়ার ভয়ে মাথা বিগড়ে গেছে পিট ব্ল্যাকের। সরাসরি তার নাকের দিকে চেয়ে আছে রানার পিস্তলের মাযল। কাঁপা স্বরে বলল সে, ‘লিসা! সত্যি কথা বলো! আমরা তো জানি না অ্যালডো আসলে কোথায় গেছে! রানার চোখে চোখ রেখেও দৃষ্টি নামাল সে। ‘কিছুক্ষণ আগে সে ফোন করেছিল।’

প্রশংসার চোখে রানাকে দেখছিল মিস রসি। প্রেমিকের কথা শুনে রাগে লাল হয়ে গেল তার মুখ। ‘একদম চুপ, পিট!’

হড়বড় করে বলতে লাগল পর্নোগ্রাফার, ‘আপনিই আজ হেলথ সেন্টারে হামলা করেছেন, তা-ই না? লিসাকে অ্যালডো বলেছে, কিছু দিনের জন্যে আণ্ডারগ্রাউণ্ডে চলে যাচ্ছে সে। কোথায় গেছে সেটা জানি না।’

সামান্য সরল মিস রসি, পরক্ষণে হাঁটু তুলে জোর এক গুঁতো লাগাল পিট ব্ল্যাকের গোপনাঙ্গে। হঠাৎ আক্রমণে লোকটার নাক-মুখ দিয়ে ভুস করে বেরোল শ্বাস। দু’হাঁটু এক করে কুঁজো হলো সে। দু’হাতে চেপে ধরেছে অণ্ডকোষ আর পেনিস। স্লো মোশনে কাত হয়ে পড়ল মেঝের কার্পেটে। বারবার কেঁপে উঠছে ব্যথায়।

পিট ব্ল্যাকের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে রানাকে দে মিস রসি। ‘অ্যালডো কোথায় গেছে তা জানি না। আর যদি জানতামও, তো যত নির্যাতনই করা হোক, বলতাম না।’ আত্মবিশ্বাস নিয়ে রানাকে দেখছে মহিলা। ‘তো এবার কী করবে তুমি? খুন করবে আমাকে?’

ধীরে ধীরে বেরেটার নল নামাল রানা। রাগে জ্বলছে ওর অন্তর। ভুলতে পারছে না অ্যালডো রসির সেই ডিভিডির দৃশ্য। বুঝে গেল ঝগড়াটে মহিলার কাছ থেকে কোন তথ্য পাবে না। এদিকে সে এমন কোন অপরাধ করেনি, যেজন্যে তাকে খুন করা যায়। বেডরুমে চোখ বোলাল রানা। বিছানার উল্টোদিকে ওয়াক-ইন ক্লসিট। বেরেটার নল দিয়ে সেদিকে এলিসা রসিকে যেতে ইশারা করল ও।

মেঝেতে শুয়ে আছে প্রায়-অচেতন পিট, তার দিকে ঘৃণার চোখে তাকাল এলিসা রসি। ‘আর এর কী হবে?’

বেরেটার বাঁট যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে রানার হাতের তালু। ‘শুনেছি পিট ব্ল্যাক তৈরি করে ব্লু ফিল্ম। সেক্ষেত্রে সে কি বাচ্চা ছেলেমেয়েদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে অভিনয় করায়?’

চোখ পিটপিট করল মিস রসি। ‘তুমি কি পাগল? আমি পিটের সঙ্গে ফূর্তি করলেও অমানুষ তো আর নই! শিশুদের ক্ষতি করবে এমন কারও সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’

বেরেটার ট্রিগার থেকে তর্জনী সরিয়ে বলল রানা, ‘আজ এই নোংরা লোকটাকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিলে। যাও, এবার দেরি না করে দু’জনেই গিয়ে ঢোকো ক্লসিটে।’

‘আমি ঢুকব না,’ রেগে গিয়ে বলল মহিলা। ‘বিশেষ করে এই ছ্যাঁচড়া ছুঁচোর সঙ্গে নয়!’

‘অবশ্যই ঢুকবে,’ বলল রানা। পরক্ষণে সামনে বেড়ে পিস্তলের বাঁট ঠকাস্ করে নামাল মহিলার কপালের ওপরে। জ্ঞান হারিয়ে যেতেই উল্টে গেল এলিসা রসির চোখ। হুড়মুড় করে পড়ত মেঝেতে, কিন্তু বিদ্যুদ্বেগে সামনে বেড়ে বামহাতে তার কোমর পেঁচিয়ে ধরল রানা। ডালা খুলে মহিলাকে নামিয়ে দিল কুসিটের মেঝেতে। ফিরল পিট ব্ল্যাকের কাছে। এখনও গোঙাচ্ছে সে। জ্যাকেটের কলার চেপে ধরে টেনে নিয়ে ক্লসিটের ভেতরে তাকে গুঁজল রানা। ঝুঁকে পর্নোগ্রাফারের মাথায় জোরে নামাল বেরেটার বাঁট। তাতে থেমে গেল গোঙানি। জ্ঞান হারাতেই ঘড়ঘড় শব্দে নাক ডাকছে লোকটা।

কুসিটের দরজায় তালা মেরে বিছানার ওপরে চাবিটা ফেলল রানা। ঘর ত্যাগ করে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল একতলায়। কিচেন পার করে বেরোল রাতের আঁধারে। ঝোপঝাড় ও ফার গাছের আড়াল নিয়ে পৌঁছে গেল দেয়ালের কাছে। নেমেছিল বাগানের এখানেই। পকেট থেকে জ্যামার নিয়ে অফ করল যন্ত্রটা। দূরে গেটের কাছে পায়চারি করছে দুই গার্ড। দড়ি বেয়ে দেয়ালে উঠতে দশ সেকেণ্ড সময় নিল রানা। নেমে এল রাস্তার এদিকের জঙ্গুলে জায়গায়। গেটের দিকে চেয়ে দেখল, কখন যেন চলে গেছে পুলিশের গাড়িটা।

পোর্শের দিকে পা বাড়িয়ে পকেট থেকে স্মার্টফোন নিল রানা। কল দিল বিসিআই-এর রায়হান রশিদকে। একবার রিং হতেই ধরল ওর ভক্ত। ‘জী, মাসুদ ভাই! কিছু বলবেন?’

‘শিকাগোয় মাফিয়া ডন রসির বেডরুমে পেয়েছি অসংখ্য ডিভিডি। শিশুদেরকে ধরে এনে পর্নোগ্রাফি তৈরি করছে সে। প্রথমে ভেবেছি স্নিগ্ধা আর তুষারের খুনের প্রতিশোধ নিলেই হবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, শিশুদের দিয়ে যারা এসব ব্লু ফিল্ম তৈরি করছে, সেই গোটা সিণ্ডিকেটের কারও প্রাণে বাঁচার কোন অধিকার নেই।’

‘আপনার ‘কথায় ঢুকেছি আমেরিকান সরকারের কিছু অফিসের কমপিউটারে,’ বলল রায়হান রশিদ, ‘বাদ পড়েনি এফবিআই হেডকোয়ার্টার। তারা কিন্তু মাফিয়ার পয়সা নিয়ে চুপ করে আছে, তা নয়। আসলে তাদের হাত-পা বোধহয় বাঁধা। ওয়াশিংটনে ক্ষমতাশালী কয়েকজন রাজনৈতিক লবিস্ট রেখেছে মাফিয়া দলগুলো।

‘সেটা জানি,’ বলল রানা। ‘আমার চাই এমন একজনকে, যে অ্যালডো রসি আর শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে জড়িত।’ পিট ব্ল্যাকের কথা মনে পড়তেই জানাল, ‘এরই ভেতরে কিছু সূত্র পেয়েছি। হয়তো তাতে পৌঁছুতে পারব অ্যালডোর কাছে।’

‘আমি আরও খোঁজ নিচ্ছি, মাসুদ ভাই,’ বলল রায়হান। ‘আপনার বোধহয় একটা কথা জানা নেই। শিকাগোতে হার্বার ইয়ট ক্লাবে ডনের আছে বিলাসবহুল ইয়ট। ওটার নাম প্ল্যাটিনাম। লোকটা ওখানেও গিয়ে থাকতে পারে।’

ইয়ট ক্লাবের ফোন নাম্বার মনে আছে রানার। ‘এখন ইয়টিং মৌসুম নয়। হয়তো সেজন্যেই ওখানে তাকে পাব। এদিকে তোমার কাজ হবে দুটো গাড়ির লাইসেন্স প্লেট থেকে জেনে নেয়া, ওগুলোর মালিক আসলে কারা।

সিনেটরের ফেরারি ও একটু আগের গাড়িটার লাইসেন্স প্লেটের তথ্য রায়হান রশিদকে দিল রানা।

‘মাসুদ ভাই, আশা করি একঘণ্টার ভেতরে যোগাযোগ করতে পারব।’

‘তথ্য সংগ্রহ করা কঠিন হবে, তবে লিউনা গার্ডনার নামের এক মেয়ের ব্যাপারেও জানতে চাই,’ বলল রানা।

‘আমি আমার সাধ্যমত করব,’ বলল রায়হান রশিদ।

বিদায় নিয়ে ফোন রেখে দিল রানা। পৌঁছে গেছে আতাউলের ভাড়া করা পোর্শের কাছে। গাড়ি নিয়ে লেক মিশিগানের তীর লক্ষ্য করে রওনা হলো রানা। রাগের আগুনে পুড়ছে ওর অন্তর। কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে মাফিয়া ডন রসি। ফলে সহজেই পারছে গুরুতর সব অপরাধ করতে। কিন্তু কিছু কিছু অন্যায়ের কখনও ক্ষমা হয় না, যেমন ফুলের মত শিশুদের জীবন ধ্বংস করে দেয়া। অ্যালডো রসি ভয়ঙ্কর এক শিশু নির্যাতনকারী পিশাচ। আর সেজন্যেই সে এবং তার দলের নরপশুদের বিরুদ্ধে প্রাণপণে লড়বে, প্রতিজ্ঞা করল রানা।

‘এক এক করে খুঁজে নেব,’ ভাবল ও, ‘তোরা রেহাই পাবি না আমার হাত থেকে!’

মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের বক্তব্য অনুযায়ী: শিশু অপহরণের মত গুরুতর অপরাধ মহামারীর মত ছড়িয়ে গেছে গোটা শিকাগোতে। নিরীহ সব পরিবারে নেমে এসেছে চিরকালীন নারকীয় দণ্ড। আর তাদের শাস্তিদাতা হচ্ছে মাফিয়া ডন অ্যালডো রসি এবং তার দলের লোকেরা।

অসহায় শিশুদের ওপরে কী ভয়াবহ নির্যাতন চলছে, সেটা ভাবতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেছে রানার। হঠাৎ করেই টের পেল, খুব জোরে ধরে রেখেছে স্টিয়ারিং হুইল। হালকা করে ওটা ধরল ও। নিয়ন্ত্রণে আনতে চাইল অদম্য ক্রোধ। তিক্ত মনে ভাবল: অ্যালডো রসির মুঠোর ভেতরে আছে বড় কিছু রাজনৈতিক নেতা। হয়তো তার বাড়ি পাহারা দিচ্ছে পুলিশের অফিসারেরা। তবুও মাফিয়া ডনের একটা কথা মনে রাখা উচিত-একবার কেউ খুন হয়ে গেলে তার কোন দাপট থাকে না এই দুনিয়ায়!

আর সেই মেয়ে… লিউনা গার্ডনার? -ভাবল রানা। এসবের ভেতরে কী ভূমিকা তার? এখন কোথায় আছে সে?

গতিসীমার ভেতরে পোর্শের স্পিড নামাল রানা। চট্‌ করে দেখে নিল হাতঘড়ি। এখন বাজে রাত সাড়ে আটটা।

লেকশোর ড্রাইভে বোধহয় আছে শত শত পুলিশ অফিসার। সুতরাং ওদিকে না যাওয়াই ওর জন্যে ভাল।

গাড়ির পেছনের সিটে নানান পোশাক আর আইডি রেখে গেছে আতাউল। একবার পথের ধারে গাড়ি রাখল রানা। শোল্ডার হোলস্টারে অস্ত্র গুঁজে পরে নিল বিশেষ একটা ইউনিফর্ম। ওটার ওপরে চাপাল ওভারকোট। মিনিট সাতেক পর পৌঁছে গেল হার্বার ইয়ট ক্লাবের পার্কিংলটে। পোর্শে থেকে নেমে ডকে গিয়ে খুঁজতে লাগল ডন অ্যালডো রসির ইয়ট।

ছয়

শিকাগো নদীর উত্তরে হার্বার ইয়ট ক্লাব। এখন ইয়টিং সিযন নয়, তাই ভিড় নেই ওখানে। শ্রমিকের কভারল পরনে জেটির দিকে হেঁটে চলেছে দীর্ঘদেহী এক সুঠাম যুবক, দু’হাতের তালুতে কালো গ্রিস। ঢিলা কভারলে চেইন নেই—পটাপট খুলে নিতে পারবে বোতাম। যুবকের কাঁধের হোলস্টারে আছে বেরেটা ৯৩-আর পিস্তল। এ ছাড়া তার কাছে আরও আছে মানুষকে চমকে দেয়ার মত বেশকিছু অস্ত্র।

গোল্ড কোস্ট মেরিনার মত বিলাসবহুল না হলেও এই হার্বার ইয়ট ক্লাবে আছে দামি কিছু ওঅটার ক্রাফ্ট। তারই একটা হচ্ছে অ্যালডো রসির ঝকঝকে সাদা ইয়ট- প্ল্যাটিনাম।

জেটিতে ইয়টগুলোর নাম দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে রানা। কোন জলযানের ডেকে দেখছে না কাউকে। বহুকাল ধরে অপরাধীদের কাছে প্রিয় এলাকা শিকাগো। সুতরাং রাত নামার পরেও নিজের ইয়টে এক বা একাধিক ক্রুকে পাহারায় রাখবে না অ্যালডো রসি, তা হওয়ার নয়।

রেলিং দেয়া গ্যাংপ্লাঙ্ক ধরে হাঁটছে রানা। মিনিটখানেক পর থামল সাদা এক ইয়টের পাশে। গলা চড়িয়ে ডাকল ও, ‘হ্যালো, প্ল্যাটিনাম! ভেতরে কেউ আছ?’

কম্প্যানিয়নওয়েতে, কেবিনের কাছে নড়াচড়া দেখতে পেল রানা। আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর কাঁধ। বিপদ হবে বুঝলে ঝড়ের বেগে বের করবে অটোম্যাগ।

কেবিন থেকে বেরিয়ে কড়া চোখে ওর দিকে তাকাল দশাসই এক লোক। ‘এখানে কী চাই?’

নাম বা চেহারা থেকে নয়, তার আচরণে এক পলকে তাকে চিনে গেল রানা। এই লোক স্বভাবে জাতদস্যু। মেকানিক যুবককে দেখে মনে মনে অবহেলা করছে। হুডওয়ালা আকারে ছোট জ্যাকেটে বেমানান লাগছে লোকটাকে। কোমরের কাছে ফুলে আছে পিস্তল। অবশ্য ওটার দিকে হাত বাড়াল না সে।

তার দিকে চেয়ে আন্তরিক হাসল রানা। ‘এই নৌকায় কি এখন ক্যাপ্টেন আছেন?’

‘এটা কোন নৌকা নয়, আস্ত একটা ইয়ট।’ ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল দস্যু। ‘আমাকে কি ক্যাপ্টেন বলে মনে হচ্ছে? তুমি আসলে এখানে কী চাও?’

‘আমার কোম্পানি আপনাদের হিটিং ইউনিট দেখতে পাঠিয়ে দিয়েছে।’

‘হিটিংয়ের তো কোন সমস্যা দেখি না।’

‘আমার বস্ বলেছে ওখানে সমস্যা আছে’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা। পকেট থেকে কোঁচকানো কাগজ নিয়ে বিড়বিড় করে পড়ল। ‘ডেকেছেন মিস্টার রসি। বলেছেন হিটিং ইউনিট যেন চেক করা হয়। উনি কি এখানেই আছেন? তাঁকে একটু ডেকে দেবেন?’ বিক্ষুব্ধ জলের লেক মিশিগানের দিকে তাকাল ও। ‘যদিও মনে হয় না আজ রাতে এই বাজে আবহাওয়ায় কারও ইয়টিং করা উচিত।’

অনিচ্ছাসত্ত্বেও ভাবতে হচ্ছে বলে আরও কুঁচকে গেল ডাকাতের ভুরু। দ্বিধা নিয়ে কেবিনের দিকে ঘুরে তাকাল। ‘গ্রেগরি? একবার এসো তো!’

পায়ের ধুপধাপ শব্দ তুলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল মুষ্কো এক লোক। সঙ্গীর চেয়ে গ্রেগরিকে বুদ্ধিমান মনে হলো রানার। চোখে সন্দেহ নিয়ে ওকে দেখল সে। আবার তাকাল সঙ্গীর দিকে। ‘কে এই লোক?’

‘বলছে চেক করতে এসেছে হিটিং ইউনিট।’

‘বস্ তো আমাকে এ-ব্যাপারে কিছু বলেননি! তা ছাড়া, এত রাতেই বা মেকানিক কেন আসবে?’

গ্যাংপ্লাঙ্কের ধারে থেমে দু’কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘তোমরা ইয়টে উঠতে না দিলে আমার কোন সমস্যা নেই। অফিসে গিয়ে ফোনে মিস্টার রসিকে জানিয়ে দেব, আপনার লোক আমাকে কাজ করতে দেয়নি।’

‘একমিনিট, একটু অপেক্ষা করো!’ তড়িঘড়ি করে বলল গ্রেগরি। ‘আমি তো বলিনি হিটিং ইউনিট চেক করতে দেব না! উঠে এসো ইয়টে।’

গ্রেগরিরা চিরকাল ধরেই বসের ধমক এড়াতে ব্যস্ত থাকে। মৃদু হেসে গ্ল্যাংপ্লাঙ্ক থেকে ইয়টে উঠল রানা। যদিও এক পা এগোবার আগেই হাতের তালু ওপরে তুলল গ্রেগরি। ‘একমিনিট! তুমি মেকানিক হলে তোমার টুলবক্স কোথায়?’

‘আমি সাধারণ মেকানিক নই, বস্। একজন টেকনিকাল ডায়াগনস্টিকশিয়ান। পার্টস দেখে মেকানিককে বলে দিই কী মেরামত করতে হবে। আমার যন্ত্রপাতি সব এখানে।’ ডানহাতের তর্জনী তুলে মাথার তালুতে টোকা দিল রানা।

‘ও, তাই?’ কী করা উচিত ভাবছে গ্রেগরি। চাইছে বসের কাছে ওর নামে যেন নালিশ করা না হয়।

আত্মবিশ্বাস নিয়ে কম্প্যানিয়নওয়ের দিকে চলল রানা। ওর পিছু নিল দুই গুণ্ডা।

‘আমরা তোমার ওপরে চোখ রাখব,’ ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে সতর্ক করল গ্রেগরি।

‘তাতে আমার কোন সমস্যা নেই,’ বলল রানা। ‘যদিও এটা বুঝলাম না যে এত ভয় কীসের। তোমরা কি ভাবছ যে এই ইয়টে আমি বোমা পেতে রেখে যাব?’

জবাব দিল না লোকদু’জন। একবার চারপাশ দেখে নিয়ে কেবিনের দিকে চলল রানা। সন্ধ্যার পর বছরের এ-সময়ে কেউ থাকে না ইয়ট ক্লাবে। প্ল্যাটিনামের পাশে নোঙর করে রাখা হয়েছে নতুন একটা স্পিডবোট। অন্যদিকে কুচকুচে কালো জলের ছল-ছলাৎ আওয়াজ।

এই দুই গুণ্ডা ছাড়া আশপাশে কেউ নেই। একবার চট্ করে কাঁধের ওপর দিয়ে লোকদু’জনকে দেখল রানা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়ার সময় ওর ঘাড়ের কাছেই থাকল তারা

‘তোমাদের একজন থার্মোস্ট্যাট চালু করো,’ বলল রানা।

‘কাজটা বরং তুমি করো, ববি,’ বলল গ্রেগরি। ‘আমি এর ওপরে চোখ রাখছি।’

‘ঠিক আছে,’ সায় দিল ববি।

সিঁড়ি বেয়ে নেমে ইঞ্জিনরুমের কাছে যাওয়ার পর এদের ওপরে হামলা করবে ভেবেছে রানা। লোকদু’জনকে অচেতন করে ঘুরে দেখবে ইয়ট। হয়তো তাতে এখানে পাবে জরুরি কোন সূত্র। ইয়টে ওঠা সহজ ছিল। যদিও এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এখানে নেই অ্যালডো রসি। লোকটা এরই মধ্যে জেনে গেছে, মেরে ফেলার জন্যে তাকে খুঁজছে মাসুদ রানা নামের এক লোক।

আলাপের সুরে বলল ববি, ‘এই যে ইয়টে উঠলে, এক সেকেণ্ডের জন্যে আমার মনে হয়েছিল যে তুমি হয়তো সেই মাসুদ রানা। সন্ধ্যার পর থেকে যার নাম বারবার শুনেছি।’

সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে সঙ্গীর ওপরে হোঁচট খেয়ে বিরক্ত হয়ে বলল গ্রেগরি, ‘ফালতু কথা বন্ধ করো তো, ববি!

সিঁড়ির ধাপে থেমে গেল রানা। ধীরে ধীরে ঘুরে কৌতূহলী চোখে দেখল দুই গুণ্ডাকে। ‘মাসুদ রানা? যে-লোক আসলে মাফিয়া দলের পাকা খুনি?’

‘না, সে লড়ছে মাফিয়ার বিরুদ্ধে,’ জানাল ববি।

‘চুপ করো তো, ববি,’ ধমক দিল গ্রেগরি। ‘এই লোক কিন্তু গল্প করতে এখানে আসেনি, নিজের কাজ করুক।’

‘তা ঠিক, আমি শুধু বলছিলাম যে…’ থেমে গেল ববি। লেক মিশিগান চিরে ছুটে আসছে একটা স্পিডবোট। ক্রমেই বাড়ছে ওটার ইঞ্জিনের আওয়াজ।

চট করে পরস্পরের দিকে তাকাল গ্রেগরি আর ববি। ঘুরে সিঁড়ি বেয়ে ওপরদিকে রওনা হলো তারা। একবার কাঁধের ওপর দিয়ে রানাকে দেখল গ্রেগরি। ‘তুমি ইঞ্জিন রুমে যাও। আমরা দেখে আসছি এদিকে কে এল।’

‘ঠিক আছে,’ বলল রানা।

ওপরের ডেকে উঠল দুই গুণ্ডা। একটু অপেক্ষা করে তাদের পিছু নিল রানা। শুনতে পেল গ্রেগরির কথা: ‘ওই শালারা আসলে কী করছে!’

কম্প্যানিয়নওয়েতে থেমে একটু দূরে গ্রেগরি আর ববিকে দেখতে পেল রানা। রেলিঙের কাছে গিয়ে থেমেছে তারা। ধূসর শীতল জল কেটে আসছে স্পিডবোট, পেছনে দীর্ঘ ঢেউ। স্পিডবোটে আছে তিনজন লোক। যদিও তারা এত দূরে যে চেহারা দেখতে পেল না রানা। খুব দ্রুত এদিকে ছুটে আসছে স্পিডবোট। দেরি না করে ডেকে উঠে এল রানা। কাঁধের ওপর দিয়ে ওকে দেখল গ্রেগরি। বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমি না বলেছি নিচে ইঞ্জিন রুমে যেতে?’ সে আরও কিছু বলত, কিন্তু চোখের সামনে দেখল কভারলের বোতাম খুলল যুবক। কভারলের নিচে পরনে আঁটোসাঁটো কালো কমব্যাট স্যুট। ডানহাতে শোল্ডার হোলস্টার থেকে ঝড়ের বেগে নিল পিস্তল!

‘ববি!’ চেঁচিয়ে উঠল গ্রেগরি। একই সঙ্গে নিজেদের অস্ত্রের দিকে হাত বাড়াল তারা।

গ্রেগরি আর ববির কথা ভেবে পিস্তল বের করেনি রানা। ওর নজর স্পিডবোটের ওপরে। ওটার সিটে বসে ইয়টের দিকে অটোমেটিক ওয়েপন তাক করেছে দুই যাত্রী। গতি আরও বেড়ে গেছে স্পিডবোটের। ওটার চালক সরাসরি আসছে ইয়টের দিকে।

হঠাৎ করে স্পিডবোটে ঝলসে উঠল কমলা আগুনের ঝিলিক। কর্কশ গর্জন ছাড়ল সাবমেশিন গান। এদিকে স্পিডবোটের দিকে পিঠ দিয়ে রানার ওপরে মনোযোগ দিয়েছে গ্রেগরি ও ববি। কিন্তু পেছনে গুলির আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকাতে গেল তারা। যদিও দেরি হয়ে গেছে তাদের।

ইয়টের কাঠের গানওয়েলে লাগল একপশলা গুলি। পরের সেকেণ্ডে টার্গেট খুঁজে নিল পরের বুলেট। অন্তত দশটা গুলি ফুটো করল ববির পিঠ। বুক ঝাঁঝরা হওয়ায় রক্তাক্ত ছেঁড়া জ্যাকেটসহ ছিটকে বেরোল ক্ষত-বিক্ষত হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের টুকরো। ভীষণ হোঁচট খেয়ে সামনে বেড়ে ধুপ করে ডেকে পড়ল ববি। এক সেকেণ্ডে ডেক ভিজে গেল চটচটে রক্তে।

আর তখনই নিজের ভুলটা বুঝতে পারল গ্রেগরি। যদিও এখন আর কিছু করার নেই। একপাশ থেকে তার কোমর ফুটো করল স্পিডবোটের গানার। হঠাৎ গুলি খেয়ে রেলিঙের ওপরে আছড়ে পড়ল গ্রেগরি। গুরুতরভাবে আহত নয়। কাত হয়ে রানার দিকে তাক করছে পিস্তল। একটা গুলিও পাঠাল, কিন্তু পরক্ষণে তাকে ঝাঁঝরা করল সাবমেশিন গানের অন্তত দশটা বুলেট। রেলিঙের পাশে পড়ল গ্রেগরির লাশ।

ডেকে ঝট করে শুয়ে পড়েছে রানা। মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে অসংখ্য গুলি। শরীর মুচড়ে কভারঅল খুলে হার্নেসে বেরেটা রাখল রানা। বদলে নিল অটোম্যাগ।

এই হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে ঠাণ্ডা মাথায়। ইয়টের রেলিঙের কাছে ছিল গ্রেগরি ও ববি, ফলে স্পিডবোটের গানার আর রানার মাঝে পড়ে খুন হতে হয়েছে তাদেরকে।

ফাঁদ পেতেছে অ্যালডো রসি। ভাল করেই জানত তার বাড়িতে হানা দেবে রানা। বেডরুমে রেখেছে টেলিফোনের নাম্বারের ছাপওয়ালা প্যাড। এটাও জানা ছিল, আজ রাতেই হাজির হবে রানা ইয়টিং ক্লাবে। আর সেজন্যে ক্লাবের বিপরীত তীরের কাছে স্পিডবোটে রেখেছে দলের একাধিক গানার।

ইয়টের কাঠ ঝাঁঝরা করছে শত শত বুলেট। হাত বাড়িয়ে কভারলের গভীর পকেট থেকে ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড নিল রানা। বামহাতে ওটার পিন খুলে গানওয়েলের ওপর দিয়ে উঁকি দিল। সরাসরি ইয়টে গুঁতো লাগবে বুঝে কাত হয়ে অন্যদিকে সরে যাচ্ছে স্পিডবোটের পাইলট। গুলি বন্ধ করছে না দুই গানার। রাতের আঁধারে লেকের জলের ওপরে হলদে জোনাকির মত দপদপ করছে অস্ত্রের মালের আগুন।

ডেকের যেখানে শুয়ে পড়েছে রানা, সে-জায়গা লক্ষ্য করে অজস্র গুলি পাঠাচ্ছে গানাররা। ক্রল করে অন্যদিকে সরে গেল রানা। উঠে বসে পর পর দু’বার অটোম্যাগ থেকে গুলি পাঠাল স্পিডবোট লক্ষ্য করে। দ্রুতগতি বোটে গুলি না লাগলেও রানা যা চেয়েছে, পূরণ হলো সে-উদ্দেশ্য। কাভার নিল গানাররা। আর এ-সুযোগে স্পিডবোটের দিকে গ্রেনেড ছুঁড়ল রানা।

জলযানটার কয়েক ফুট দূরে পড়ল লোহার সবুজ কামরাঙ্গা। ফেনা ভরা পানিতে টুপ করে ডুবে গেল ওটা। পরের সেকেণ্ডে ফেটে যেতেই লেকের তলা থেকে উঠল আগুন ও মস্ত এক পানির তৈরি ফোয়ারা। বোটের ইঞ্জিনের কর্কশ গর্জনের ওপর দিয়ে এল কার যেন আর্তনাদের আওয়াজ। আকাশ থেকে বৃষ্টির মত ঝরঝর করে নামল লেকের জল। কাত হয়ে ইয়টের কাছ থেকে সরে যাচ্ছে স্পিডবোট। থেমে গেছে গানারদের গুলিবর্ষণ। সিটে ছটফট করতে করতে রক্তাক্ত ছেঁড়া মুখোশ খুলতে চাইল এক গানার। বোমা ফাটার সময়ে অন্যজন হারিয়ে ফেলেছে হাতের অস্ত্র।

স্পিডবোটের চালককে লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল রানা। লেকের বিক্ষুব্ধ জলে ছুটে চলেছে স্পিডবোট। ওটাকে পাশ কাটাল অটোম্যাগের বুলেট। পয়েন্ট ফোরটি ফোর অস্ত্রটা তাক করে আবারও গুলি পাঠাল রানা। এবারও বুলেট গেল স্পিডবোটের চালকের মাথার কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে। তিক্ত মনে ভাবল রানা, ইয়ট সার্চ করা খুব জরুরি ছিল। তবে তার চেয়ে বেশি জরুরি এখন এদের কাউকে বন্দি করা। সেক্ষেত্রে তার কাছ থেকে জানা যাবে কোথায় আছে অ্যালডো রসি। তখন আর অন্ধের মত এগোতে হবে না ওকে।

ডেক থেকে কভারঅল তুলে দুটো গ্রেনেড আর কমব্যাট নাইফ হাতে নিয়ে একছুটে ইয়টের অন্যদিকে চলে এল রানা। গানওয়েল টপকে নেমে এল ডকে। তারই ফাঁকে দেখল কাছে নোঙর করা কিছু বোটের ডেকে বেরিয়ে এসেছে ক’জন লোক। অবাক চোখে দেখছে ওকে।

ইয়টের পাশের স্পিডবোট আধুনিক এবং দ্রুতগামী। লাফিয়ে ওটার পাইলটের সিটে নেমে এল রানা। ইগনিশনে পেল না কোন চাবি। থাকার কথাও নয়। ড্যাশবোর্ডের নিচে হাত ভরে কয়েকটা তার খুঁজে নিল ও। ওগুলো মুচড়ে দিতেই কর্কশ শব্দে চালু হলো শক্তিশালী মোটর।

‘অ্যাই! আমার বোটে কী! নামো বলছি!’

কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা।

রেগে গিয়ে দু’হাত ছুঁড়তে ছুঁড়তে ছুটে আসছে এক লোক।

নোঙরের দড়ি কেটে খাপে ছোরা রাখল রানা। পরক্ষণে লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে সিটে বসে ব্যস্ত হয়ে উঠল থ্রটল নিয়ে। ওটা ঠেলে দিতেই রওনা হলো স্পিডবোট। আজ বেশ হাওয়া ছেড়েছে। নাচছে লেকের জল। রানা হুইল ঘুরিয়ে নেয়ায় কাত হয়ে বাঁক নিল স্পিডবোট, ক্রমেই বাড়ছে গতি ।

দূরে ঝড়ের বেগে চলেছে খুনিদের বোট। প্রাণভয়ে নিজেদের হত্যা-মিশনের কথা বেমালুম ভুলে গেছে গানাররা। চাইছে যত দ্রুত সম্ভব পালিয়ে যেতে। বামে শিকাগো নদীর এক অন্তরীপের ওদিকে চলে গেল তাদের স্পিডবোট।

নিজেও থ্রটল খুলে দিল রানা। কয়েক সেকেণ্ডে বাঁক নিয়ে অন্তরীপ পেরিয়ে আবার দেখতে পেল খুনিদের বোট। মসৃণভাবে চলেছে ওর স্পিডবোটের ইঞ্জিন। রাতের হিমঠাণ্ডা হাওয়া যেন ছুরির মত চিরে দিচ্ছে ওর মুখের ত্বক। কয়েক সেকেণ্ড পর বুঝল, সামনের বোটের চেয়ে ওর বোটের গতি বেশি। ধীরে ধীরে কমে আসছে মাঝের ব্যবধান। মাথার ওপর দিয়ে সাঁই করে পিছিয়ে গেল লেকশোর ড্রাইভ ব্রিজ।

লেকের চেয়ে নদীর পানি অনেক শান্ত। দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে দুই বোট। একটু পর সামনে পড়বে মিশিগান অ্যাভিন্যু ব্রিজ। মনের আয়নায় এলাকাটা দেখল রানা। ডাউন টাউনে দুটো শাখা তৈরি করেছে নদীটা। একটা গেছে উত্তরদিকে, অন্যটা দক্ষিণে। ওখানে পৌঁছুলে হয়তো ওকে কাঁচকলা দেখিয়ে পালিয়ে যাবে সামনের বোট। এটা বুঝে থ্রটল আরও খুলল রানা। বেড়ে গেল ইঞ্জিনের গর্জন। প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলেছে স্পিডবোট। ক্রমেই কাছে চলে আসছে সামনের বোট। এখন ওটা আছে মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে। বোটে আহত গানারকে দেখতে পেল না রানা। বোধহয় মেঝেতে শুয়ে আছে সে। হাতে ভারী কী যেন নিয়ে সিটে ঘুরে বসল তার সঙ্গী। ওটার ব্যারেল তাক করেছে রানার বোট লক্ষ্য করে। জিনিসটা কী সেটা বুঝতে পেরে চমকে গেল রানা। এক সেকেণ্ডে শুকিয়ে গেল গলা। হুইল ঘুরিয়ে দ্রুত সরে যেতে লাগল নদীর অন্যদিকে। আর তখনই হুইশ শব্দে লঞ্চার ছেড়ে বেরোল রকেট গ্রেনেড। ওটা সোজা এল ওর বোটের দিকে। রাতের আকাশে ধূসর ধোঁয়ার লেজ নিয়ে ওটা যেন অচেনা কোন ধূমকেতু!

এঁকেবেঁকে সরে যাচ্ছে রানা। তিন সেকেণ্ড পর ওর স্পিডবোটের ওপর দিয়ে গিয়ে পেছনের নদীতে ডুব দিল গ্রেনেড। বিকট আওয়াজে বোমাটা ফেটে যেতেই আকাশে ছিটকে উঠল প্রচুর পানি। দূর থেকেও শকওয়েভের ধাক্কা টের পেল রানা। কাত হয়ে আবার সোজা হলো ওর বোট।

এখনও চল্লিশ গজ দূরে রয়ে গেছে শত্রু-বোট। হোলস্টার থেকে অটোম্যাগ নিয়ে গানারকে লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল রানা। এদিকে গ্রেনেড লঞ্চার রেখে হাতে রাইফেল নিয়েছে লোকটা। এ-ব্যাটা বোধহয় অস্ত্রের দোকান লুঠ করে এনে বোটে এসে উঠেছে! -তিক্ত মনে ভাবল রানা। গানারের গায়ে ওর গুলি না লাগলেও ওটা বিধেছে বোটের পেছনে। রানা চাইছে যেন বিকল হয় সামনের বোট। সেক্ষেত্রে হয়তো কাউকে বন্দি করতে পারবে। দেখতে পেল গানারের রাইফেলের মাযল থেকে বেরোল কমলা আগুন। পরক্ষণে ওর বোটের কাউলিং-এ তৈরি হলো বিশ্রী এক ফাটল। দ্রুতগতি বোট থেকে গুলি করছে লোকটা। সে-তুলনায় রীতিমত চমকে দেয়ার মত নিশানা তার।

শত্রু-বোটের গানারকে আহত করতে পাল্টা গুলি পাঠাল রানা। মনে মনে চাইছে ভয় পেয়ে যেন কাভার নেয় লোকটা।

সামনের বোট এখন আছে মাত্র ত্রিশ গজ দূরে। আরেকটু কাছে পেলে পাইলটকে গুলি করবে রানা। সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গতি হারাবে শত্রু-বোট। অনায়াসে তখন ওটার পাশে গিয়ে বন্দি করতে পারবে তাদেরকে।

এখন মাত্র বিশ গজ দূরে শত্রু-বোট। নদীর এদিকে অন্য কোন জলযান নেই। ঝোড়ো বেগে ওদের দিকে এল মিশিগান অ্যাভিন্যু ব্রিজ। সাঁই করে ওটা পেছনে ফেলল দুই বোট। নদীর দক্ষিণ তীরের দিকে চোখ গেল রানার। ওদিকে ঝলমল করছে কিছু বাতি। ওয়্যাকার ড্রাইভে জড় হচ্ছে একের পর এক পুলিশ যার। হার্বার ইয়ট ক্লাবের সদস্যরা ফোন করে ডেকে এনেছে পুলিশদেরকে। নদীতীরের রাস্তা ধরে বোটের পেছনে ছুটে আসছে তাদের গাড়ি।

রানার কাছ থেকে মাত্র দশ গজ দূরে আছে শত্রু-বোট। রাইফেল হাতে ওর দিকে তাকাল গানার। চোখে-মুখে তীব্র ঘৃণা। আবারও গুলি করার জন্যে কাঁধে অস্ত্র তুলল সে।

দেরি না করে তাকে লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল রানা।

কাঁধের হাড়ে বুলেট বিঁধে যেতেই কাত হয়ে সিট থেকে পিছলে পাইলটের ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ল গানার। ভয়ে মুখ বিকৃত করে তাকে গা থেকে সরিয়ে দিল হেলসম্যান।

আর মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে শত্রু-বোটের পাশে পৌঁছে যাবে রানা। তবে গোলাগুলিতে ব্যস্ত ছিল বলে অন্যদিকে খেয়াল ছিল না ওর। কখন যেন নদীর এদিকে হাজির হয়েছে ধীরগতি পেটমোটা মস্ত এক কমার্শিয়াল ট্যুর বোট!

ওটার ডেকে আতঙ্কিত ট্যুরিস্টদেরকে দেখতে পেয়ে বাঁক নিয়ে সরে যেতে লাগল রানা। পিছিয়ে পড়ছে মাফিয়া- বোটের কাছ থেকে। এদিকে ট্যুরিস্ট বোট এড়াতে গিয়ে গতি কমায়নি অ্যালডো রসির বোটের পাইলট। সোজা গিয়ে চেপে বসল ছোট্ট এক ডিঙি নৌকার ওপরে। ফলে উল্টে গেল ডিঙি।

রানা ভেবে পেল না রাতের নদীতে কী করছে দুই যুবক। গতি আরও কমিয়ে দিল ও। উল্টে যাওয়া ডিঙি ধরে ভাসছে তারা। ভিজে গেছে কালো মাথা দুটো।

‘কোন ক্ষতি হয়নি তো?’ ইঞ্জিনের ওপর দিয়ে জানতে চাইল রানা।

ভেজা চুল মুখ থেকে সরিয়ে মাথা নাড়ল একজন। পরক্ষণে চমকে গেল। রাতের আঁধারে কালো পোশাকে হাত- কামানের মত মস্ত এক পিস্তল হাতে তার দিকেই চেয়ে আছে কঠোর চেহারার এক লোক!

‘আ… আ… আমরা খুবই সুখে আছি, স্যর, বেসুরো কণ্ঠে বলল যুবক।

‘নৌকায় আরও কেউ ছিল?’ জানতে চাইল রানা।

মাথা নাড়ল দুই যুবক।

শত্রু-স্পিডবোটের দিকে ঘুরে তাকাল রানা। বহু দূরে চলে গেছে ওটার পাইলট। দুই সাঁতারুকে দেখল ও, পরক্ষণে থ্রটল খুলে বলল, ‘সরি, আপাতত সাহায্য করতে পারছি না!’

তিন সেকেণ্ডে পেছনে পড়ল উল্টে যাওয়া ডিঙি। পেছন থেকে রানার দিকে চেয়ে রইল দুই যুবক। পিস্তল হাতে লোকটা যে চলে যাচ্ছে, তাতেই তারা খুশি। তা ছাড়া, দু’চার মিনিটের ভেতরে কেউ না কেউ এসে উদ্ধার করবে ওদেরকে।

নতুন উদ্যমে শুরু হলো দুই স্পিডবোটের রেস। যদিও গতি এখন আগের মত নয়। রাতের নদীতে এখানে-ওখানে দেখা যাচ্ছে নানান ধরনের আলোকিত জলযান।

গানারকে আহত করতে পেরে খুশি হয়েছে রানা। নিরীহ মানুষজনের ভেতরে ওদের গোলাগুলি চলুক, সেটা চাইছে না।

দুই স্পিডবোটকে রকেট বেগে রেস করতে দেখে নানান জলযান থেকে আসছে আপত্তির চিৎকার। কেউ কেউ জানতে চাইছে: কী হচ্ছে আসলে। মানুষগুলো অতি কৌতূহলী বলে তাদেরকে দোষ দিতে পারছে না রানা।

সামনে পয়ঃবর্জ্যে ভরা বিশাল এক বার্জ দেখে কপালে উঠল ওর দু’চোখ। ভক করে নাকে এসে লাগল ভয়াবহ বাজে দুর্গন্ধ। বাঁক নিয়ে নৌযানটা থেকে সরে গেল ও। আপাতত উধাও হয়ে গেছে সামনের স্পিডবোট। অবশ্য বার্জ পেরোবার আগেই আবারও ওটাকে দেখতে পেল রানা। মাফিয়ার স্পিডবোট তুমুল বেগে আসছে সরাসরি ওর দিকেই!

হুইল ঘুরিয়ে স্টারবোর্ডে সরে গেল রানা। ওর একফুট দূর দিয়ে পার হচ্ছে পায়খানায় ভরা প্রকাণ্ড বার্জ। সামনের বোটের পাইলটের রাগে বিকৃত চেহারা দেখতে পেল রানা। বারবার পালাতে গিয়ে বিরক্ত হয়ে গেছে লোকটা।

বার্জ থেকে কে যেন চেঁচিয়ে উঠল, ‘সাবধান!’

বার্জের কয়েক ইঞ্চি দূর দিয়ে পেরোল রানার স্পিডবোট। ওদিকে ওর মাত্র কয়েক ফুট পাশ দিয়ে গেল মাফিয়ার বোট। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাল রানা।

মিশিগান লেকের দিকে ফিরে চলেছে শত্রু-বোট। হুইল ঘুরিয়ে তীরবেগে ওটার পিছু নিল রানা। নতুন করে পেরিয়ে এল বার্জ। বর্জ্যে ভরা জলযানের ডেক থেকে কী ঘটেছে সেটা জানতে চাইছে কর্মীরা। খোলা জলের দিকে ফেরার সময় আগের চেয়ে বেশি শীত লাগছে রানার। কানের কাছে কর্কশ শব্দ করছে স্পিডবোটের মোটর। হু-হু করে মাথার চুলের ভেতর দিয়ে বইছে হিমঠাণ্ডা হাওয়া।

একটু পর আবার সামনে পড়ল নদীর দুই শাখা। ওর বোটের গতি বেশি বলে স্পিডবোটের ঘাড়ের কাছে পৌঁছে যেতে পারবে রানা। মেরিনা এরিয়া থেকে সরে গেছে ওরা। তীব্র বেগে চলেছে দুই স্পিডবোট। একবার তীরের দিকে তাকাল রানা। নদীতীরে আর রাস্তায় জ্বলছে পুলিশের গাড়ির অসংখ্য হেডলাইট ও লাল-নীল বাতি।

এইমাত্র সান-টাইম্স বিল্ডিং পাশ কাটাল সামনের বোট ওটা এখন আছে রানার বোট থেকে কমপক্ষে সত্তর গজ দূরে। আরও সামনে নদীতে পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ইনসিগনিয়াসহ শক্তিশালী এক ক্রুযার। ওটার বো থেকে কড়া আলো এসে পড়েছে মাফিয়া বোটের ওপরে। দিনের মত ফর্সা হয়ে গেছে রাত। নদীর চারপাশে ছড়িয়ে গেল বুলহর্নের বিকট আওয়াজ। ভারী গলায় কথা বলছে এক পুলিশ অফিসার: ‘এই যে, দুই স্পিডবোট! থামো! তীরে এসে ভেড়ো! আমরা পুলিশ! আবারও বলছি, গতি কমিয়ে থেমে যাও!’

অফিসারের কথা শুনছে না দুই স্পিডবোটের চালক। গতি কমল না কারও। থ্রটল পুরো ঠেলে দিয়ে হোলস্টারে অটোম্যাগ রেখে দিল রানা। দু’হাতে ধরেছে বোটের হুইল- দরকার হলে চট করে সরে যাবে যে-কোন দিকে। দেখতে পেল, আবারও সিটে উঠে বসেছে আহত সেই গানার। লাল রক্তে ভেসে যাচ্ছে দেহের বামদিক। অবশ্য তার অক্ষত ডানহাতের মুঠোয় এখন একটা পিস্তল।

‘কমপ্লিট গাধা!’ বিড়বিড় করল রানা।

পুলিশ ব্রুয়ারের দিকে বারকয়েক গুলি পাঠাল লোকটা। ফাঁকা জায়গায় আওয়াজটা ছোট পটকার মত শোনাল রানার কানে। পুলিশ ক্র্যারের রেলিঙের ধারে দাঁড়িয়ে ছিল ফ্লেক জ্যাকেট পরনে কয়েকজন অফিসার। মাফিয়ার আততায়ী গুলি করছে বুঝতে পেরে এদিকে-ওদিকে ঝাঁপ দিয়েছে তারা। তাদের মাথার ওপর দিয়ে গেছে কয়েকটা বুলেট। এর ফলে মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে ফায়ারিং পযিশনে উঠে বসে পাল্টা গুলি পাঠাল পুলিশ অফিসারেরা। মাফিয়া বোট লক্ষ্য করে গেছে শত শত বুলেট। রানা দেখল, অটোমেটিক রাইফেলের গুলিতে চুরচুর হয়ে ভাঙল সামনের স্পিডবোটের উইণ্ডশিল্ড।

নিজের বোটের গতি কমিয়ে সামনের স্পিডবোটের পাইলটকে সিটে পিঠ দিয়ে পড়তে দেখল রানা। পরক্ষণে হুইলের ওপরে হুমড়ি খেল লাশটা। শত বুলেটের আঘাতে গানওয়েল টপকে ঘোলাটে নদীতে পড়ল গানারের মৃতদেহ।

পাইলটের লাশের চাপে হুইল ঘুরে যেতেই প্রচণ্ড বেগে উত্তরদিকের একটি পিয়ারে গিয়ে উঠল সামনের স্পিডবোট। সংঘর্ষে চুরমার হয়ে যেতেই ওখান থেকে এল বোমা ফাটার মত আওয়াজ। আগুন ধরে যাওয়ায় বিস্ফোরিত হলো স্পিডবোটের পেট্রল ট্যাঙ্ক। কালো আকাশে ভুস করে ভেসে উঠল লাল-কমলা আগুনের ফুটবল। পরক্ষণে ওপর থেকে ঝরঝর করে ঝরল ভাঙা ধাতব টুকরো। সেগুলোর ভেতরে আছে মানুষের বিচ্ছিন্ন দেহাবশিষ্ট।

এক শ’ গজ দূর থেকে সব দেখছে রানা। ভাল করেই বুঝে গেছে, এখন আর কারও কাছ থেকে কোন তথ্য পাবে না। বিধ্বস্ত স্পিডবোট লক্ষ্য করে ছুটে গেল কিছু ইমার্জেন্সি ভেহিকেল। পুলিশ জুয়ার থেকে রানার দিকে তাক করা হলো আগ্নেয়াস্ত্র। বুলহর্নের মাধ্যমে বলা হলো: ‘দ্বিতীয় বোট! যেখানে আছ, ওখানেই থাকো! হাতদুটো মাথার ওপরে তোলো! কথা না শুনলে আমরা বাধ্য হব গুলি করতে!’

পুলিশের অসংখ্য গাড়ি থেমেছে নদীর দু’তীরে। এখন চাইলেও নদী পার করে লেক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারবে না রানা। হঠাৎ খুব জোরে শুরু হলো একটা সাইরেন। আওয়াজটার দিকে ঘুরে তাকাল ও। নদীর শাখা থেকে বেরিয়ে দ্রুত ওর দিকে এল বড় একটা জলযান। ওর বুঝতে দেরি হলো না যে পুলিশের দুই ক্রাফটের মাঝে আটকা পড়ে গেছে ও!

হুইল ঘুরিয়ে থ্রটল ঠেলে দিয়ে নদীতীর লক্ষ্য করে এগোল রানা। দু’তীরে ঝলমল করছে বাতি। তারই ফাঁকে রাতের আঁধারে আছে কিছু স্কাইস্ক্র্যাপার। নদীর ধারে পুলিশের যেসব গাড়ি এসে থেমেছে, তার মাঝে আঁধার কোন জায়গা আছে কি না, সেটা বুঝতে চাইছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর ওর মনে হলো, আশপাশে এমন কোন জায়গা নেই, যেদিক দিয়ে নিরাপদে তীরে উঠতে পারবে ও। অবশ্য ট্রেনিং ওকে বলে দিচ্ছে, কোথাও না কোথাও ত্রুটি আছে পুলিশের লাইনে। আর সেটা পেলেই বেরোতে পারবে এই গাড্ডা থেকে।

পাঁচ সেকেণ্ড পর নদীর তীরে আঁধার এক ডক দেখতে পেয়ে ওদিকে চলল রানা। তীরে ওয়্যাকার ড্রাইভে বিশাল এক বিল্ডিঙের পাশ দিয়ে গেছে সরু একটা পথ। ডকের পাশে পৌঁছে লাফ দিয়ে বোট থেকে নেমে পড়ল রানা। ঝেড়ে দৌড় দিল অফিস বিল্ডিঙের দিকে। ওকে দেখতে পেয়ে হৈ- হৈ করে পিছু নিল একদল পুলিশ অফিসার। ধমক দিয়ে থামতে বলা হচ্ছে ওকে।

কালো স্যুটের কমব্যাট ওয়েবিং থেকে স্মোক গ্রেনেড নিয়ে পিন খুলে তাদের মাঝে ছুঁড়ল রানা। ওটা উড়ে আসতে দেখে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল অফিসারেরা। মাটিতে পড়ে ঘন ধোঁয়া ছড়াতে ছড়াতে গড়ান দিচ্ছে স্মোক গ্রেনেড। প্রাণরক্ষায় ব্যস্ত ওদিকের পুলিশ। এ-সুযোগে অন্যদিকের অফিসারদের দিকে ছুট দিল রানা। পুলিশের লোকেরা বুঝে গেছে, আরও গ্রেনেড আছে ওর কাছে। কাভার নিয়ে কয়েকজন অফিসার দেখতে পেল, সরাসরি তাদের দিকেই আসছে কালো পোশাক পরা লোকটা। সামনের দিকের এক অফিসার পিস্তল বের করে ধমকে উঠল, ‘থামো! খবরদার!’

ছুটতে ছুটতে টের পেল রানা, ধুপধাপ শব্দে পাঁজরে এসে লাগছে ওর হৃৎপিণ্ড। পেছনে ধোঁয়ার ভেতরে খক খক করে কেশে চলেছে দু’জন অফিসার। দৌড় না থামিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে ওদিকে তাকাল রানা। ঘন ধোঁয়া থেকে বেরোল কয়েকজন অফিসার। দু’হাতে কচলে নিচ্ছে চোখ। তারই ফাঁকে রানাকে লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল তাদের একজন।

রানার কানের পাশ দিয়ে গেল বুলেট। পরেরটা হয়তো বিধবে ওর পিঠে!

কানের কাছে বুলেটের গুঞ্জন শুনে ডাইভ দিয়ে মাটিতে পড়েছে দ্বিতীয় দলের এক অফিসার। ঘাড় কাত করে দেখল, তাদের দলের কেউ গুলিবিদ্ধ হয়েছে কি না। একটু আগে রানাকে ধমকে উঠেছে যে অফিসার, সে এবার চিৎকার করে বলল: ‘থাম্, শালারা! তোরা তো আমাদেরকেই খুন করছিস!’

এমনটিই হবে সেটা আশা করেছে রানা। উড়ে চলল কাছের দালান লক্ষ্য করে।

অন্ধকার বাড়িটার নিচতলায় অসংখ্য জানালা। নদীর দিকে লবি ও পেছনের উঠান। জানালাগুলোর কাঁচ ধূসর ধোঁয়াটে রঙের। তারই মাঝে প্রথমতলায় ঢোকার বড় এক ডাবল-ডোর। ওটা পাশ কাটিয়ে বাঁক নিয়ে বাড়ির সামনের পার্কিংলটের দিকে উড়ে চলল রানা। মনে মনে আশা করছে, ওদিকে পাবে কোন গাড়ি। পেছনে শুনতে পেল নানাদিকে চিৎকার আর ছোটাছুটির ধুপধাপ আওয়াজ। বাড়ির দিকে আসছে একাধিক সাইরেন। রানা বুঝে গেল, সন্ধ্যায় যে ঝামেলায় পড়েছিল লেকশোর ড্রাইভে, এখন তার চেয়ে ঢের বড় বিপদে আছে। যেসব অফিসার আগেরবার ওকে ধরতে না পেরে বোকা বনে গেছে, এবার সুযোগ ছাড়তে রাজি নয় তারা দরকার হলে দ্বিধা করবে না রক্ত ঝরাতে।

ছুটতে ছুটতে বাড়ির সামনের পার্কিংলটে চলে এল রানা। মাত্র আশি গজ দূরে উসেন বোল্টের মত তুমুল বেগে ছুটে আসছে এক পুলিশ অফিসার।

ব্যস্ত হয়ে চারদিকে চেয়ে বুঝে গেল রানা, এমন কোন গাড়ির দরজা নেই যেটা লক করা নয়। দু’সারি গাড়ির মাঝে কুঁজো হয়ে পার্কিংলটের শেষমাথা লক্ষ্য করে চলল ও। তবে ওদিকের গাড়িগুলোর কাছে গেলেও চারদিক থেকে ওকে ঘিরে নেবে অফিসারেরা। গাড়ির সারির মাঝে এক লোককে লুকিয়ে থাকতে দেখলে হাসতে হাসতে খুন হয়ে যাবে তারা।

আত্মরক্ষা করতে গিয়ে তখন হয়তো বাধ্য হয়ে গোলাগুলি করতে হবে রানাকে। তবে সেক্ষেত্রে শিকাগো শহরে এমন কোন পুলিশ থাকবে না যে কি না ওকে খুন করতে চাইবে না।

থেমে একটা গাড়ির পাশে শুয়ে পড়ে শরীর ছেঁচড়ে ওটার তলায় ঢুকল রানা। পিঠ আর মাথায় লোহার যন্ত্রপাতির ঠোক্কর খেয়ে বিরক্ত। মাত্র তিন সেকেণ্ড হলো গাড়ির নিচে ঢুকেছে, এমনসময় শুনতে পেল কাছেই গর্জে উঠেছে একটা গাড়ির ইঞ্জিন। ঘাড় কাত করে ডানে তাকাল রানা। পার্কিংলট থেকে বেরোবার জন্যে ধীরে ধীরে ব্যাক করে এদিকে আসছে গাড়ির মালিক। যে-গাড়ির নিচে আছে রানা, হাঁচড়েপাঁচড়ে ওটার তলা থেকে বেরিয়ে এল ও। উঠে দাঁড়িয়ে দেখল একটু দূরে মিটসুবিশি মিরাজ জি ফোরের স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে বসে আছে কমবয়সী এক মেয়ে।

পাঁচ কদমে তার পাশে পৌঁছে গেল রানা। দরজার হ্যাণ্ডেল ধরে হ্যাঁচকা টানে খুলল ড্রাইভিং দরজা। গায়ের কাছে কালো পোশাক পরা কঠোর চেহারার লোকটাকে দেখে ভয়ে ফ্যাকাসে হলো মেয়েটার মুখ। ভাবছে: এবার খুন হব ভয়ঙ্কর খুনিটার হাতে!

আমেরিকার পচে যাওয়া নষ্ট সমাজের নোংরা চিত্র আগেও বহুবার দেখেছে রানা। বেচারি মেয়েটা ধরে নিয়েছে গাড়ি ডাকাতি করার জন্যে ওকে খুন করতেও দ্বিধা করবে না হাইজ্যাকার। জরুরি সুরে তাকে বলল রানা, ‘সরি, জরুরি কাজে তোমার গাড়িটা দরকার। পরে ফেরত পাবে। আমি তোমার কোন ক্ষতি করতে আসিনি।

খুন হবে না শুনে স্বস্তির ছাপ পড়ল মেয়েটার মুখে। বড় একটা ঢোক গিলে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। একলাফে ড্রাইভিং সিটে চেপে বসল রানা। ব্যাক গিয়ার দিয়ে পিছিয়ে নিল জাপানি গাড়িটা। রিয়ারভিউ মিররে দেখল, তীরবেগে আসছে পুলিশের ইউনিফর্ম পরা নকল উসেন বোল্ট। গাড়িটা তার দিকেই আসছে দেখে ছুটতে ছুটতে থেমে যেতে চাইল সে। ফলে হারিয়ে ফেলল ভারসাম্য। দু’হাতে খামচে ধরতে গেল গাড়ির ব্যাকডালা। আর তখনই ফার্স্ট গিয়ার ফেলে অ্যাক্সেলারেটর মেঝেতে দাবিয়ে দিল রানা। লাফিয়ে এগোল মিটসুবিশি মিরাজ জি ফোর। রিয়ারভিউ মিররে দেখল রানা, পা পিছলে হুমড়ি খেয়ে মেঝেতে পড়ল অফিসার। কয়েক সেকেণ্ড পর উঠে দাঁড়িয়ে দু’হাতে ঝাড়তে লাগল ইউনিফর্মের ধুলোবালি।

পার্কিংলটের যে গেট দিয়ে বেরোতে চায় রানা, ‘ওখানে এসে থামল একটা স্কোয়াড কার। ওটার আলো এসে পড়েছে সামনের গাড়িগুলোর ওপরে। দেরি না করে একসারি গাড়ি পাশ কাটিয়ে পার্কিংলটের অন্যদিকে চলল রানা। জোরাল সাইরেন বাজিয়ে ওর পেছনে ধেয়ে এল স্কোয়াড কার।

দ্রুতবেগে পার্ক করা গাড়ির সারির শেষমাথায় পৌঁছে বাঁক নিল রানা। কর্কশ আওয়াজে হড়কে গেল গাড়ির চার চাকা। এক শ’ আশি ডিগ্রি ঘুরে পরের সেকশনে ঢুকতে গিয়ে আরেকটু হলে উল্টে যেত মিরাজ জি ফোর। পেছনে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বাঁক নিয়েছে স্কোয়াড কার, একদিকের দেয়ালে ধুম্ শব্দে লেগে থেমে গেল ওটা।

পার্কিংলটের এদিকে কংক্রিটের দেয়াল, অন্যদিকে উঁচু সবুজ হেজ ঝোপ। ওদিকেই ওয়্যাকার ড্রাইভের রাস্তা। পার্কিংলটের একটি দিয়ে বেরোবে সে-উপায় আর নেই। গেট জুড়ে এসে থেমেছে দ্বিতীয় স্কোয়াড কার। গাড়ি নিয়ে হেজ ঝোপ লক্ষ্য করে ছুটল রানা। মনে শঙ্কা: হয়তো ঝোপের ওপাশে আছে পাকা দেয়াল। মিরাজ জি ফোরের নাকের গুঁতো খেয়ে ঝরঝর শব্দে দু’দিকে সরে গেল ঝোপ। সামনে কোন কলাম, দেয়াল বা বেড়া নেই। ঝড়ের বেগে পার্কিংলট থেকে ফুটপাথে নেমে এল রানা। একটু দূরের বাঁকে পার্ক করা কিছু গাড়ি। মিরাজ জি ফোরের গতিহ্রাস করে হর্ন টিপে ধরল রানা। সামনে ফুটপাথে হেঁটে চলেছে কয়েকজন পথযাত্রী। পেছনে হর্ন শুনে ঘুরে তাকাল তারা। পরক্ষণে প্রাণের ভয়ে লাফ দিয়ে নেমে গেল রাস্তায়। তাদেরকে পাশ কাটিয়ে নিজেও ফুটপাথ থেকে নেমে এল রানা। পরের ব্লকে বাঁক নিয়ে ঢুকে পড়ল ওয়্যাকার ড্রাইভে।

সামনে ধীরগতি গাড়ির জ্যাম। চালকেরা এদিকে-ওদিকে চেয়ে বুঝতে চাইছে এত আওয়াজ কীসের। পরক্ষণে দেখতে পেল তাদেরকে পাশ কাটিয়ে এঁকেবেঁকে ছুটে চলেছে নতুন এক গাড়ি! চালকদের ব্রেক করার আওয়াজ শুনছে রানা। তাদের আবিষ্কৃত দু’চারটা মারাত্মক গালি শুনে লাল হয়ে গেল ওর কান। কোন গাড়িতে আঁচড় না কেটে এগিয়ে চলল মিরাজ। বামে স্টেট স্ট্রিট দেখে ওদিকে ঢুকে পড়ল রানা। এ-পথে হালকা জ্যাম থাকলেও সমস্যা হচ্ছে না এগোতে। একবার রিয়ারভিউ মিররে দেখল রানা। পেছনের দিকে আরও বেশি জ্যাম বেধে যাওয়ায় ওর পিছু নিতে পারবে না পুলিশের স্কোয়াড কার।

একটু পর শহরতলীর দিকে চলল ওর মিরাজ। পকেট থেকে স্মার্টফোন নিয়ে ম্যাপ দেখে নিল রানা। ভাল করেই বুঝে গেছে, ওকে মৃত্যু-ফাঁদে ফেলেছিল অ্যালডো রসি। ওর মনে পড়ল শিশুদের সেই ব্লু ফিল্ম। তাতে আরও তেতো হয়ে গেল ওর মন। ফোন করল রায়হান রশিদের নাম্বারে। ওদিক থেকে কল ধরতেই জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু জানলে লিউনা গার্ডনারের ব্যাপারে?’

‘না, মাসুদ ভাই। বাংলাদেশের ইন্টারনেট কচ্ছপের মত স্লো, আমার তো মনে হচ্ছে আমি আছি হাজার হাজার কোটি আলোকবর্ষের ওদিকে অ্যান্ড্রোনামিয়ায়। অবশ্য অন্যদুটো ব্যাপারে খোঁজ নিতে পেরেছি।

‘ফেরারি গাড়ির কথা বলছ?’

‘জেনেছি ওয়াশিংটনে কে আসলে অ্যালডো রসির কানেকশন।’ কয়েক সেকেণ্ড ভাবল রায়হান রশিদ। ‘ফেরারিটা শিকাগোর সিনেটর জাস্টিন পিটারের ব্যক্তিগত সম্পত্তি।’

‘আর অ্যালডোর বাড়ির সামনে যে স্টিকারওয়ালা গাড়ি, ওটার লাইসেন্স প্লেট থেকে কিছু জানলে?’

‘ওটার মালিক সার্জেন্ট বার্কলে এবার্টন। কাজ করে কুক কাউন্টি অর্গানাইড্ ক্রাইম টাস্ক ফোর্সে।

‘তার ব্যাপারে আরও কিছু জেনেছ?

‘বাড়ির ঠিকানা আর কোথায় চাকরি করে সেটা ছাড়া নতুন কিছু পাইনি। এদিকে মনে হচ্ছে শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে অ্যালডো রসির সম্পর্ক থাকতে পারে। সে পতিতালয় চালু রাখা, পর্নো সিনেমা তৈরি করা, পর্নো সিনেমা হল চালানো, জুয়ার আড্ডা বসানো, বেআইনি অস্ত্র ব্যবসা করা আর মানুষের কাছ থেকে চাঁদা আদায়ের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।

‘তুমি আরও খোঁজ নাও লিউনা গার্ডনারের ব্যাপারে। ওটা তার সত্যিকারের নাম না-ও হতে পারে। এদিকে আমি দেখা করব সার্জেন্টের সঙ্গে। টেক্সট্ করো তার বাড়ির ঠিকানা।’

‘আপনি হয়তো চাইবেন সিনেটরের সঙ্গেও কথা বলতে। আজ রাতে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ফাগু রেইয়িং ডিনার থ্রো করেছে। আরেকটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি, মাসুদ ভাই-শিশুদের ডে-কেয়ার সেন্টার আর অ্যামিউযমেন্ট পার্ক তৈরি করার জন্যে টাকা তুলছে ওই লোক।’

‘সিনেটরের ডিনারে গিয়ে তার ব্যাপারে খোঁজ নেব,’ বলল রানা, ‘এদিকে সার্জেন্ট এবার্টনের সঙ্গে মাফিয়া ডন রসির খাতির আছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।’

‘মাসুদ ভাই,’ বলল রায়হান রশিদ, ‘তেমন কিছু হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এখন তার বাড়ির ঠিকানা পাঠাচ্ছি। নতুন কোন তথ্য পেলে আপনাকে ফোন দেব।’

বিদায় নিয়ে স্মার্টফোন পাশের সিটে রাখল রানা। বিড়বিড় করল, ‘আমি জানতে চাই এবার্টন আসলে মানুষ নাকি পশু!’

সাত

তিক্ত হয়ে গেছে বার্কলে এবার্টনের মন। ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে দেহ। এমনিতেই কাজের চাপে মরার দশা, তার ওপরে বড়কর্তারা বলে দিয়েছেন, অ্যালডো রসির হেলথ সেন্টারে যে হামলা করেছে, সে লোক সম্ভবত রানা এজেন্সির মালিক মাসুদ রানা। খুনের এলাকায় মিলেছে তার ভিযিটিং কার্ড। কাজেই নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব যেন গ্রেফতার করা হয় তাকে। তবে সে গোলাগুলি শুরু করলে কোন ঝুঁকি না নিয়ে খুন করতে হবে।

আজকের মত বাড়ি ফিরছে এবার্টন। মন থেকে মুছে দিতে চাইছে মাসুদ রানা নামের ভয়ঙ্কর লোকটাকে। মনস্থির করেছে, আগামীকাল পুরো সময়টা দেবে স্ত্রী জেনিফারকে। লাঞ্চ সেরে নেবে কাছের কোন রেস্তোরাঁয়, তারপর ঘুরে ফিরে দেখবে চিড়িয়াখানা। ওখানে যেতে পছন্দ করে জেনিফার। ক্ষণিকের জন্যে মগজ ফাঁকা হতেই আবারও রানার নাম মনে পড়ল এবার্টনের। আবারও তিক্ত হয়ে গেল অন্তর। গাড়ি রেখে সোজা ঢুকে পড়ল নিজের ছোট্ট একতলা বাড়িটাতে। একই সময়ে কিচেন থেকে বেরোল জেনিফার। স্বামীকে দেখে মিষ্টি করে হাসল সে।

গা থেকে ওভারকোট খুলে হুকে ঝুলিয়ে দিল এবার্টন। ঘুরে কয়েক পা গিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরল স্ত্রীকে। আজকাল জেনিফারের কথা ভাবলেই বুকের ভেতরে কেমন যেন হুতাশ আসে এবার্টনের। মনটা ওকে যেন বলে, কেন এমন হলো ওদের জীবন! সে যদি আর দশজন মানুষের মত জীবন পেত! ঠিক সময়ে ফিরত কাজ শেষে বাড়িতে। কাজ শেষে মনের ভেতরে থাকত না কোন দুশ্চিন্তা। আজকাল কেন যেন মাঝে মাঝে মনে হয়, চিরকাল ধরে ভালবাসার মেয়েটাকে ঠকিয়ে এসেছে সে।

ছোটবেলা থেকে ওদের প্রতিবেশী ছিল জেনিফারদের পরিবার। ভালবেসে বিয়ে করেছে ওরা। সুন্দরী জেনিফারের বয়স চল্লিশ হয়ে গেলেও এখনও ওকে দেখলে আনচান করে ওঠে এবার্টনের মন। বলতে ইচ্ছে করে: ভালবাসি, আমি তোমাকে ভালবাসি, জেনি!

এক পা পিছিয়ে স্বামীর চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল জেনিফার। নরম সুরে বলল, ‘কোথাও কোন সমস্যা?’

জোর করে হেসে মাথা নাড়ল এবার্টন। ‘না তো!’ স্ত্রীর কোমরের বাঁকে হাত রাখল সে। মিথ্যা কথা বলতে গিয়ে পড়ে গেছে অস্বস্তির ভেতরে। ভাবছে, মাসুদ রানার ব্যাপারে জেনিফার কিছু জেনে গেলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলবে, ‘তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’

যদিও কথাটা হবে আসলে ডাহা মিথ্যা।

মাফিয়া ডন অ্যালডো রসির বিরুদ্ধে লড়ছে বাংলাদেশি দুর্ধর্ষ যুবক মাসুদ রানা। এরই ভেতরে খুন করেছে মাফিয়া দলের কয়েকজন গুণ্ডাকে। এবার হয়তো তার হাতে খুন হবে অ্যালডো রসি। আর সেটা ঠেকাতে গিয়ে নিজেও হয়তো মারা পড়বে এবার্টন! সেক্ষেত্রে খুব অসহায় হয়ে যাবে জেনিফার।

শিকাগোর তৃতীয় প্রজন্মের আইরিশ পুলিশ এবার্টন। পদোন্নতি পেয়ে হয়েছে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট। এ-শহরের এশিয়া থেকে আসা মানুষগুলোকে আইনগত সহায়তা দেয়ার জন্যে নিয়োগ করা হয়েছে ওকে। কয়েক বছর আগেও সবই ভালভাবে চলছিল। কিন্তু তারপর শুরু হলো ভয়ঙ্কর বাজে সমস্যা। তাতে নাক না গলিয়ে উপায় থাকল না এবার্টনের। আর সেজন্যে হয়তো যে-কোন সময়ে খুন হবে ও।

গত ক’মাস ধরেই নীরবে যেন বলছে জেনিফার: যা-ই ঘটুক, তোমার পাশে আছি। কী হচ্ছে সেটা দয়া করে আমাকে খুলে বলো।

বড় হয়ে গেছে জেনিফার আর এবার্টনের দুই সন্তান। ওরা পড়ছে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে। নিজের এখন আর বাড়তি কোন কাজ নেই জেনিফারের। তাই স্বামীর দিকে চলে এসেছে ওর সমস্ত মনোযোগ। এবার্টনের ভেতরে সামান্য পরিবর্তন হলেও চট করে সেটা বুঝে যায়।

এবার্টন বুঝেছে, ওকে নিয়ে খুব বেশি ভাবছে জেনিফার। অথচ ওর উচিত নিজের দিকে খেয়াল দেয়া। সেণ্ট মিচেলসের চিরকালের সেরা সুন্দরী হলেও ছোটবেলা থেকেই জেনিফারের রিউমেটিক ফিভার। তার ওপরে আবার অপারেশন করাতে হবে ফুসফুসে। সেজন্যে আগামী সপ্তাহে ভর্তি হবে, হাসপাতালে। অপারেশনটা খুব বিপজ্জনক। এদিকে চিকিৎসা নিতে গিয়ে হুড়মুড় করে ফুরিয়ে যাচ্ছে ওদের জমা করা সব টাকা।

এবার্টনের চাকরিতে বড় কোন সমস্যা হচ্ছে, সেটা ভেবে দুশ্চিন্তায় পড়েছে জেনিফার। অবশ্য কী ঘটেছে সেটা জানার জন্যে স্বামীর ওপরে কোন চাপ তৈরি করছে না। আর সেজন্যে মনে মনে ওর প্রতি কৃতজ্ঞ এবার্টন।

স্বামীর গালে চুমু দিয়ে আবার কিচেনে গিয়ে ঢুকল জেনিফার। গলা উঁচিয়ে বলল, ‘একটু পর ডিনার।’

দরজার মাঝের কাঁচের ভেতর দিয়ে সামনের উঠান দেখল এবার্টন। ল্যাম্প-পোস্টের আলোয় পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে রাস্তা। ফুটপাথে হেঁটে চলেছে এক বা দু’জন পথচারী। ধীরগতি তুলে আসছে-যাচ্ছে একটা-দুটো গাড়ি।

এই এলাকা বিলাসবহুল না হলেও ভাল লাগে এবার্টনের। ঝামেলা বা হৈ-চৈ নেই। যে-যার মত আছে প্রতিবেশীরা। তাদের মাথা-ব্যথা নেই যে পাশে থাকে এক পুলিশ অফিসার। বরং কোন বিপদ হলে এসে আলাপ করে, যাতে সহজে মিটিয়ে নেয়া যায় সমস্যা।

এবার্টন পরিবারের মাথার ওপরে আছে নিরাপদ ছাত। পেটে আছে খাবার। ডাক্তারের কাছে গিয়ে নিতে পারছে চিকিৎসা। মধ্যবিত্তের যে কাপড়চোপড় লাগে, তা কিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে না। আর ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচ মিটিয়েও হাতে যা থাকছে, প্রতিমাসে সেটা সঞ্চয় করা যাচ্ছিল।

সেক্ষেত্রে একজন পুরুষের এক জীবনে আর কী লাগে? তারপর শুরু হলো জেনিফারের অসুস্থতা। সেটাও হয়তো কাটিয়ে ওঠা যাবে। কিন্তু অন্য এক কারণে আজকাল এবার্টনের মনে হচ্ছে, যে-কোন সময়ে হয়তো চিরকালের জন্যে এখান থেকে বিদায় নিতে হবে তাকে। আর সেটা হবে সময়ের আগেই। ঠাঁই হবে অন্ধকার কোন শীতল কবরে।

জানালা দিয়ে উঠনের দিকে চেয়ে আছে সে। আবারও মনে পড়ল মাসুদ রানার কথা। নিজের কর্মচারীদের খুনের বদলা নিতে মাঠে নেমেছে বেপরোয়া যুবক। আর সেটা করতে গিয়ে হয়তো যে-কোন সময়ে নিজেই খুন হবে।

প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ঠোঁটে ঝোলাল এবার্টন। লাইটারের আগুনে জ্বেলে নিল শলা। তার মনে পড়ল, আজ রেডিয়োতে বলেছে শিকাগোতে ভারী তুষারপাত হবে। অবশ্য তুষারপাত ঠেকাতে পারবে না দুর্ধর্ষ মাসুদ রানাকে। আগেও এমন মানুষ দেখেছে এবার্টন। প্রাণের ভয় থাকে না এদের।

সামনের রাস্তায় এসে থামল একটা সেডান গাড়ি। ওটা কোন প্রতিবেশীর নয়। ঠোঁটে সিগারেট ঝুলিয়ে ওদিকে চেয়ে রইল এবার্টন। গাড়ি থেকে নেমে ওর বাড়ির গেটে থামল অপরিচিত যুবক। দৈর্ঘ্যে প্রায় ছয় ফুট সে। পরনে ওভারকোট। ট্রেনিং পাওয়া চোখে এবার্টন খেয়াল করল, যুবকের পায়ে কমব্যাট বুট। গেট খুলে বাগানের মাঝের পথ ধরে এসে বাড়ির সদর দরজার সামনে দাঁড়াল সে। শিরশির করে শীতল অনুভূতি মেরুদণ্ড বেয়ে নেমে গেল এবার্টনের। বুঝে গেছে, ওর বাড়িতে হাজির হয়েছে মাসুদ রানা!

হয়তো সে জেনে গেছে মাফিয়া ডন রসির বাড়ির সামনে নিয়মিত গিয়ে বসে থাকে সে। তাই ধরে নিয়েছে দুর্নীতিতে জড়িয়ে গেছে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট।

এখন সে নিজে খুন হয়ে গেলে জেনিফারের কী হবে, সেটা ভাবতে দিয়ে একবার শিউরে উঠল বার্কলে এবার্টন। মনে মনে মাফ চেয়ে নিল স্ত্রীর কাছ থেকে। ‘তোমায় সুখী করতে পারিনি। যদি সময়ের আগেই চলে যাই, তো মাফ করে দিয়ো, জেনিফার।’

দরজার পাশের কলিংবেল বাজাল যুবক।

পানি থেকে তোলা মাছের মত একবার খাবি খেল বার্কলে এবার্টন। মনে পড়েছে হেলথ সেন্টারের লাশগুলোর রক্তাক্ত ছবি। দরজা না খুললে ওটা ভেঙে ঢুকবে যুবক। কাজেই ছিটকিনি খুলে কবাট সরাল এবার্টন। শুকনো গলায় বলল, ‘আপনি কী করে জানলেন যে আমি এই বাড়িতে থাকি?’

ওভারকোটের পকেটে বেরেটার বাঁট ধরে রেখেছে রানা। কোন ঝুঁকি নিচ্ছে না। ‘কাজটা কঠিন নয়। একজনের কাছ থেকে জেনে নিয়েছি।

ঢোক গিলল সার্জেন্ট এবার্টন। ‘আমার বোধহয় আপনাকে গ্রেফতার করা উচিত?’

‘আমার তা মনে হয় না,’ মৃদু মাথা নাড়ল রানা।

ওভারকোটের পকেটে যেখানে আছে রানার হাত, সেখানে গিয়ে চোখ থামল এবার্টনের। আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে পিস্তলের অবয়ব। চাপা শ্বাস ফেলে বলল সে, ‘দয়া করে আমার স্ত্রীর কোন ক্ষতি করবেন না।’

‘ভাববেন না, আমি তেমন কিছু করব না। আমরা বরং বাড়ির ভেতরে গিয়ে কথা শেষ করি।’

দরজা থেকে নড়ল না এবার্টন। ‘আমি চাই না বাড়ির ভেতরে আমাকে খুন করা হোক।

‘তা হলে উঠানে বেরিয়ে আসুন।’

‘আপনি আসলে কী চান আমার কাছে?’

‘কিছু প্রশ্নের জবাব,’ বলল রানা, ‘যেগুলো জানতে হবে আমার।’

‘অবাক লাগছে,’ বিড়বিড় করল এবার্টন। ‘একটু আগেই আপনার কথা ভাবছিলাম।’

সার্জেন্ট আর কিছু বলার আগেই কিচেন থেকে বেরিয়ে এল জেনিফার। ধীরপায়ে এসে থামল স্বামীর পেছনে। ‘হঠাৎ করেই বুঝলাম দরজা খোলা হয়েছে। বাতাস আসছে বাড়ির ভেতরে। তাই দেখতে এলাম।’

ফ্যাকাসে হয়ে গেছে এবার্টনের মুখ।

কেউ এসেছে বুঝতে পেরে স্বামীর পাশ থেকে দরজার দিকে তাকাল জেনিফার।

‘আমি একটু ব্যস্ত, জেনি,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল এবার্টন। ‘আসুন, ভেতরে আসুন, মেজর রানা। ‘

সার্জেন্ট দরজা থেকে সরে যেতেই বাড়িতে পা রাখল রানা। মৃদু হাসল মহিলার দিকে চেয়ে। নিচু গলায় বলল, *আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, মিসেস এবার্টন।’

‘অফিসের কাজ, জেনি,’ নরম সুরে বলল এবার্টন। ‘আমরা ডেন-এ গিয়ে বসছি। বেশিক্ষণ লাগবে না।

সার্জেন্টের কথায় সামান্য আশার সুর টের পেল রানা।

‘খুশি হলাম আপনার সঙ্গে পরিচিত হয়ে, মেজর।’

‘জী, ম্যাম।’

আবার কিচেনে গিয়ে ঢুকল জেনিফার। তার চোখে অনিশ্চয়তা দেখতে পেয়েছে রানা। বুদ্ধিমতী মহিলা বুঝে গেছে, স্বামী আর মেজরের সম্পর্ক ভাল নয়।

মহিলা আলাপে নাক গলাবে না, সেটা বুঝেছে রানা। ওর এবার জানতে হবে অ্যালডো রসির শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে কোনভাবে জড়িত কি না সার্জেন্ট এবার্টন।

‘এদিকে,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল সার্জেন্ট।

তার পিছু নিয়ে সরু এক দরজা পার হয়ে বুকশেলফে ভরা এক ঘরে ঢুকল রানা। মেঝেতে মাঝারি মানের কার্পেট। এককোণে ছোট্ট টিভি। দেয়ালে কিছু ছবি। ঘরটা আরামদায়ক হলেও বিলাসবহুল নয়। পেছনে দরজা আটকে দিল রানা।

‘আপনি আসলে কী চান?’ নিচু গলায় কর্কশ সুরে জানতে চাইল এবার্টন। রানাকে বসতে বলেনি সে।

‘আমি অ্যালডো রসিকে খুঁজছি।

নাক দিয়ে ঘোঁৎ করে আওয়াজ করল এবার্টন। ‘আমিও তাকে খুঁজছি। তবে পাচ্ছি না।’

‘আজ কোথায় আছে সে?’

‘আমার এখন অফ ডিউটি,’ বলল এবার্টন। ‘আপনি যা-ই ভাবুন, আমি কিন্তু ওই লোককে আমার বিছানার নিচে লুকিয়ে রাখিনি।’

‘তা হয়তো রাখেননি, তবে দু’জনে মিলে সাঁতার কাটছেন একই পুকুরে,’ শীতল সুরে বলল রানা।

ফ্যাকাসে হলো এবার্টনের মুখ। ‘তা হলে বলতে হবে যে আপনি ভুল ভাবছেন, মেজর। ভবিষ্যতে মুখ সামলে কথা বলবেন।’

‘আমার চোখ কিন্তু খোলা। আজ রাতে অ্যালডো রসির বাড়ির সামনে আপনি ছিলেন।’

বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ল সার্জেন্ট। ‘আমি দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ অফিসার নই। সেটা বিশ্বাস করুন বা না করুন।’

‘আজ কেন অ্যালডো রসির বাড়ির সামনে গিয়েছিলেন?’

‘আপাতত সেটা বলতে পারব না,’ মাথা নাড়ল সার্জেন্ট বরফ-শীতল চোখে তাকে দেখল রানা। ‘বলতে চাইছেন যে আপনি অ্যালডো রসির পকেটে নেই। অথচ বলবেন না কেন গেছেন তার বাড়ির সামনে। এবার বলুন, এমন কোন প্রমাণ আছে, যেটা থেকে আমি বুঝব যে আপনি একজন অপরাধী পুলিশ নন।’

রাগ-ভয় মিশ্রিত চোখে ওকে দেখল এবার্টন। ‘আপনি যা খুশি ধরে নিন। আমি এখন যা-ই বলি, সেটা আপনার মনোভাব পাল্টে দেবে না।’

‘চেষ্টা করে দেখুন।’

‘তার চেয়ে গুলি করে আমাকে মেরে এখান থেকে বিদায় হোন।’

লোকটার ভেতরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা আর ভয়ের ছাপ দেখছে রানা। আগেও অস্ত্রের মুখে বহু লোককে রেখেছে ও। তাই ভাল করেই জানে, নানান ধরনের হয় মানুষের ভয়। দোষী পুলিশ ভাবে যে ধরা পড়বে তার অপরাধ। যেটা মৃত্যুর চেয়েও কষ্টকর। কিন্তু এবার্টনের চোখে লজ্জা বা পাপের ছাপ নেই।

‘আমাকে দেখেও অবাক হননি আপনি,’ বলল রানা, ‘কিন্তু সেটা কেন?’

কাঁধ ঝাঁকাল এবার্টন। ‘অফিসে আপনার প্রতিটি অপরাধ মনিটর করেছি। প্রথমে হেলথ সেন্টারে হামলা করলেন। খুন হলো একদল গুণ্ডা। অ্যালডো রসির টেবিলের ওপরে রেখে এলেন নিজের ভিযিটিং কার্ড। তখনই মনে হলো অ্যালডো রসির বাড়িতেও আপনি যাবেন। তাই ওদিকে গেছি আপনাকে ধরার জন্যে।

‘অথচ প্রথম থেকেই একদল নৃশংস অপরাধীর বিরুদ্ধে লড়ছি আমি,’ বলল রানা। ‘আপনার কথা অনুযায়ী আপনিও তা-ই করছেন। আপনার পথ একরকমের, আমারটা অন্য রকমের।’

নাক দিয়ে আবারও ঘোঁৎ আওয়াজ করল এবার্টন। ‘আপনিও রসির মতই বেআইনি কাজ করছেন। আইন বা নিয়মের তোয়াক্কা করছেন না। আমার শহরে আপনার মত লোক আমি চাই না। কাজেই প্রথম সুযোগে আপনাকে গ্রেফতার করব।’

‘আইন কখনও কখনও ক্ষমতাধরের পক্ষে কাজ করে। আর সে-সময় সাধারণ মানুষ অত্যাচারিত হয়।’

‘হ্যাঁ, কখনও কখনও,’ বলল এবার্টন। ‘কিন্তু আপনি যে আমার বাড়িতে এসে হুমকি দিচ্ছেন, সেটাও চরম অন্যায়। আপনার আর আমার ভেতরে যা-ই ঘটুক, সেসব থেকে আমার স্ত্রীকে দূরে রাখবেন।’

‘কেন মনে হচ্ছে যে আমি আপনার কথা রাখব?’

‘আমি খোঁজ নিয়েছি। কখনও কাউকে কোন কথা দিলে সেটা আপনি রাখেন।’

পকেট থেকে বেরেটা নিয়ে শোল্ডার হোলস্টারে রাখল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘বেশ, মাফিয়া ডন অ্যালডো রসির বিষয়ে আপাতত আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করব না।’

জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাল এবার্টন। ‘তাই বলে ধরে নেবেন না, আপনার প্রতি পাল্টে গেছে আমার মনোভাব। আমি আইনের লোক। আর আপনি ঠিক তার উল্টো পথের মানুষ। এই যে অস্ত্র হাতে আমার বাড়িতে এসে ঢুকলেন, তারপর হয়তো একটু পর বিদায়ও নেবেন, কিন্তু তাতে আমি ধরে নেব না যে আপনি আসলে অপরাধী নন।’

এ-লোক বোধহয় আসলেই অপরাধে জড়িত নয়, মনে মনে বলল রানা। ‘আমি আপনাকে মনোভাব বদলে নিতে বলছি না,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল ও। ‘আর আপনার বাড়িতে না এসে আমার কোন উপায়ও ছিল না। সেজন্যে আমি দুঃখিত।’

‘আরও কিছু বলবেন?’ চাপা স্বরে বলল এবার্টন।

‘আপনি কি পিট ব্ল্যাক নামের কাউকে চেনেন?’

সার্জেন্টের চোখে কীসের যেন ছাপ। ‘হ্যাঁ, বলা যায় যে তার ব্যাপারে আমি কিছুটা জানি।’

‘দয়া করে তার সম্পর্কে আমাকে একটু ব্রিফ করুন।’

‘ওই লোক চিরকালের হারামি। সে তৈরি করে ছায়াছবি।’

‘টিভি কমার্শিয়াল?’

‘না, নোংরা ফিল্ম। কোন ভদ্রলোক ওসব দেখবে না।’

‘ঠিক জানেন তো?’

‘জেনেবুঝেই বলছি।’

‘কখনও গ্রেফতার করেছেন তাকে?’

মাথা নাড়ল এবার্টন। ‘আপনার জানা থাকার কথা, নোংরা এসব ফিল্ম যারা তৈরি করে, তারা রয়ে যায় আওতার বাইরে। সবসময় ধরা পড়ে নিচের পর্যায়ের কর্মীরা। হয়তো সে কলেজ ছাত্র, সেমিস্টারের টাকা জোগাড় করতে গিয়ে বাধ্য হয়ে বিক্রি করছে বেআইনি টিকেট।’

মাথা দোলাল রানা। ‘হ্যাঁ, ওরা যাবে জেলে। চিরকালের জন্যে তাদের নাম উঠবে পুলিশের খাতায়।

‘ঠিকই ধরেছেন। আর তাদের বদলে একই কাজ করবে কলেজের অন্য কোন ছাত্র।’

এবার্টন এখনও অপরাধ না করলেও যে-কোন সময়ে অন্যায়ে জড়াতে পারে, ভাবল রানা। অনেক সময় চোখ বুজে থাকার বিনিময়ে কেকের কত বড় টুকরো পাচ্ছে, সেটাই বড় কথা হয়ে ওঠে পুলিশের অফিসারদের কাছে।

‘অ্যালডো রসির সঙ্গে কীভাবে ভিড়ল পিট ব্ল্যাক?’

‘যারা পর্নোগ্রাফি তৈরি করে, তারা সুসম্পর্ক রাখে ডন অ্যালডো রসির সঙ্গে।’ কাঁধ ঝাঁকাল এবার্টন। ‘রসির পরিবার সিনেমা তৈরি করা আর সেটা বিতরণের সঙ্গে জড়িত। যদিও আগেই এসব আপনি জেনে নিয়েছেন, মেজর।’

‘মিস রসির ব্যাপারে কিছু জানেন?’

ভুরু কুঁচকে ফেলল এবার্টন। ‘কী জানব?’

‘শুনেছি পিট ব্ল্যাকের সঙ্গে তার দৈহিক সম্পর্ক আছে।’

কয়েক সেকেণ্ড কী যেন ভেবে বলল এবার্টন, ‘হতে পারে। কানাঘুষায় এ-কথা আগেও শুনেছি। মহিলা নাকি পর্নোগ্রাফির নতুন পুরুষ অভিনেতা এলেই তাকে চেখে দেখে। যদিও এ- বিষয়ে আমাদের হাতে কোন ধরনের প্রমাণ নেই।’

‘বলুন তো, এখন কোথায় পাব পিট ব্ল্যাককে?’

‘লুপের কাছে শহরতলীতে তার অফিস,’ বলল এবার্টন। ‘যদিও বেশিরভাগ সময় ওখানে থাকে না। এ-ছাড়া তাকে পাওয়া যায় তার স্টুডিয়োতে। না বলে পারছি না, প্রচুর কাজ করে সে। গত কয়েকমাসে তৈরি করেছে একের পর এক ব্লু ফিল্ম।’

‘ঠিকানা দুটো দেবেন?’

টেবিল থেকে প্যাড আর কলম নিয়ে খস খস করে শিকাগোর দক্ষিণ এলাকায় স্টুডিয়ো আর অফিসের ঠিকানা লিখল সার্জেন্ট এবার্টন। তবে কাগজটা না নিয়ে তথ্যগুলো মুখস্থ করে নিল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘আপনি কি ভাবছেন রসির হেলথ ক্লাবে যা ঘটল, পিট ব্ল্যাকের স্টুডিয়োতেও তেমন কিছু ঘটবে?’

‘আপনি আমার বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর আমি হয়তো যোগাযোগ করব পুলিশ স্টেশনে,’ বলল সার্জেন্ট এবার্টন। ‘সেক্ষেত্রে স্টুডিয়োতে গেলে ধরা পড়বেন আপনি।’

‘অথবা, হয়তো ভাববেন ব্ল্যাকের মত পর্নোগ্রাফারকে শায়েস্তার একটা পথ আপনি খুঁজে পেয়ে গেছেন।’

রানা দেখতে পেল চকচক করছে পুলিশ অফিসারের দুই চোখ। নরম স্বরে বলল এবার্টন, ‘তেমনটা তো হতেই পারে!’

‘পিট ব্ল্যাক কি শিশুদের নিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করে?’

ভাবতে গিয়ে গম্ভীর হয়ে গেল সার্জেন্ট। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ‘সে তেমন কিছু করলে সবার আগে আইন ভাঙব আমি।’

‘তো আপনি বলবেন না রসির বাড়ির কাছে কেন গেছেন। মনে করি না আমাকে গ্রেফতার করতে সেখানে যান।’

দৃঢ়বদ্ধ হলো সার্জেন্টের চোয়াল। ‘কোন দিনই বলব না। মরে গেলেও না। ওটা অন্য একটা কেস। তবে মনে রাখবেন, মেজর রানা, ফুরিয়ে আসছে আপনার সময়। কাজেই যা করার দ্রুত করতে হবে আপনাকে।’

রানার পেছনে খুলে গেল ডেনের দরজা। ঘুরে বেরেটার জন্যে কোটের ভেতরে হাত ভরল রানা। ধারণা করেছে ঘরে পা রেখেছেন মিসেস এবার্টন।

ওর ধারণাই সঠিক।

স্বামী আর রানার উদ্দেশে মৃদু হাসল মহিলা। ‘সরি, মেজর রানা। ড্রিঙ্ক দিতে ভুলে গিয়েছি। এখন কি দেব?’

‘আমি ডিউটিতে আছি, ম্যাম,’ হালকা সুরে বলল রানা। ‘আমাদের সঙ্গে ডিনার করবেন না? একটু পর সব রেডি হয়ে যাবে।’

‘আজ নয়,’ মাথা নাড়ল রানা, ‘এবার দেরি না করে কাজে যেতে হবে।’ ঘুরে এবার্টনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল ও। ‘সময় দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ, সার্জেন্ট। পরে আপনার সঙ্গে আবারও আলাপ সেরে নেব।

হ্যাণ্ডশেক করবে না স্থির করেছে এবার্টন।

‘ঠিক আছে, পরে কথা হবে,’ হাত কোটের পকেটে ভরল রানা।

‘সত্যিই হয়তো আবার দেখা হবে,’ বলল এবার্টন।

মিসেস এবার্টনের দিকে মাথা দুলিয়ে ডেন ছেড়ে বেরিয়ে এল রানা। বাড়ি ত্যাগ করার সময় কোন তাড়াহুড়ো করল না। চাইছে না প্রতিবেশীদের কারও মনে কৌতূহল তৈরি হোক। একই সঙ্গে চাইছে এই এলাকা থেকে দ্রুত সরে যেতে।

যখন তখন নিজের মনোভাব পাল্টে স্টেশনে ফোন দেবে সার্জেন্ট এবার্টন। এরই ভেতরে বোধহয় ওর গাড়ির লাইসেন্স প্লেট মুখস্থ করে নিয়েছে। এ-গাড়ি আর ব্যবহার করতে পারবে না রানা। অবশ্য তাতে কোন ক্ষতিও নেই। কয়েক ব্লক দূরে গিয়ে উঠে পড়বে এলিভেটেড স্টেশনে। তখন চট্‌ করে ওকে খুঁজে নিতে পারবে না কেউ।

ডিটেকটিভ সার্জেন্টের কথা মন থেকে দূর হচ্ছে না ওর। এটা স্পষ্ট: ডন অ্যালডো রসির সঙ্গে কোন না কোন যোগাযোগ আছে তার। নইলে সেই বাড়ির কাছে গাড়ি রেখে বসে থাকত না। তাকে দেখেও কিছু বলেনি বাড়ির গার্ডেরা। এ থেকে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, আগে বা পরে এরার্টনের সঙ্গে আবারও মোকাবিলা হবে ওর।

এদিকে খোঁজ নিতে হবে সিনেটর পিটারের ব্যাপারে। তাতে হয়তো জানা যাবে অনেক কিছু। তবে আপাতত ওর প্রথম কাজ হবে পিট ব্ল্যাকের স্টুডিয়োতে যাওয়া। যেহেতু মাফিয়া ডনের বোনের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক আছে লোকটার, তাই তাকে চাপ দিলে হয়তো জানবে জরুরি সব তথ্য।

আট

শিকাগোর দক্ষিণে বস্তির মত এক জায়গায় কাঠের ছোট কিছু বাড়িতে চলছে ড্রাগস, মদ, জুয়া আর পতিতাদের দেহদানের রমরমা ব্যবসা। এদিকে তেমন চলাচল নেই গাড়িঘোড়ার। যে ঠিকানা দিয়েছে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট এবার্টন, সে অনুযায়ী বস্তি থেকে সিকিমাইল দূরে জনবিরল এলাকায় পরিত্যক্ত সব অফিস ও গুদামের পাশে পিট ব্ল্যাকের স্টিলের ওয়্যারহাউস। ফেটে যাওয়া কাঠের ফুটপাথ ধরে সেদিকে হেঁটে চলেছে রানা।

এবার্টনের কথা সত্যি হলে আবর্জনার এই ভাগাড়ের ভেতরে গোপনে নোংরা সিনেমা তৈরি করছে পর্নোগ্রাফার। অথবা ওকে মিথ্যা বলেছে সার্জেন্ট। সেক্ষেত্রে এটা মাফিয়ার পেতে রাখা কোন মৃত্যু-ফাঁদ।

ফাঁকা রাস্তার ধারে পরিত্যক্ত এক অফিসের পাশে থেমে ব্ল্যাকের ওয়্যারহাউসের ওপরে চোখ রাখল রানা।

থমথমে রাতে কেউ নেই আশপাশে।

এটা কি সত্যিই ফাঁদ? -নিজেকে জিজ্ঞেস করল রানা। মন থেকে পেল না কোন জবাব। একটু পর কাঁধ ঝাঁকিয়ে ভাবল, এত দূরে এসে এখন পিছিয়ে যাওয়ার কোন মানে হয় না। মাফিয়া ডন রসিকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্যে যে- কোন ঝুঁকি নিতে রাজি আছে ও।

আধ ইঞ্চি পুরু বোর্ড দিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে ব্ল্যাকের ওয়্যারহাউসের সব জানালা। এক ইঞ্চি বোর্ড মেরে বন্ধ করেছে লোডিং ডকের দরজা। ছায়া থেকে বেরিয়ে ওয়্যারহাউসের দেয়ালের দিকে চলল রানা, হাতে অটোম্যাগ।

এই ব্লকের শেষমাথায় টিমটিম করে জ্বলছে রোড ল্যাম্পের হলদেটে বাতি। সেই আবছা আলোয় প্রায় কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লোহার দেয়ালের পাশে থেমে কোথাও কোন বিপদ আছে কি না তা জানতে চারপাশে তাকাল ও, সতর্ক। বহু দূর থেকে এল শিকাগোর আবছা গুঞ্জন। ঝিকঝিক করছে এলিভেটেড মেট্রোরেলের ট্রেন। বাজল পুলিশের সাইরেন। যদিও এদিকে আসছে না। এ-এলাকা যেন পরিত্যক্ত কোন বন্দর।

ওয়্যারহাউসের দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে রানা, পরনে ওভারকোটের নিচে কালো স্যুট। ভেতরে কীভাবে ঢুকবে সেটা বোঝার জন্যে আশপাশে তাকাল। বিশাল লোডিং ডোরের পাশেই সরু এক দরজা। কিন্তু ওদিক দিয়ে ঢুকতে চাইছে না ও। বাঁক নিয়ে ওয়্যারহাউসের পেছনে সরু গলিতে চলে এল রানা। পেছনের উঠনে পুরনো দুটো কমদামি গাড়ি আর একটা প্রায় নতুন সুজুকি জিপ। শেষেরটা বোধহয় পিট ব্ল্যাকের, ভাবল রানা।

ওয়্যারহাউসের ওপরদিকে একসারিতে বেশকিছু জানালা। যদিও ওগুলো নাগালের বাইরে। আরেকটু এগোবার পর মাটি থেকে আট ফুট ওপরে ছোট্ট এক জানালা দেখতে পেল রানা।

একটু দূরে পেছনের উঠানের ওদিকে বিশাল আকারের কয়েকটা ওয়্যারহাউস। কোথাও কোন নড়াচড়া নেই।

ওভারকোট খুলে মাটিতে ফেলে লাফ দিয়ে ছোট্ট জানালার নিচের অংশ দু’হাতে ধরল রানা। টেনে তুলল নিজেকে। জানালার নোংরা কাঁচে একরাশ ধুলো। ওদিকের ঘরে উঁকি দিয়ে রানা দেখল, ওটা খুব ছোট একটা বাথরুম। ভেতরে কেউ নেই। অথবা বসে আছে দেয়াল-ঘেঁষা কমোডে। বামহাতে জানালার কাঁচ সরাতে চাইল রানা। কিন্তু তাতে কোন লাভ হলো না। জানালার কাঠের ফ্রেম ফুলে গেছে বলে ফেঁসে গেছে কাঁচের দুই পাল্লা।

জানালার বাইরের দিকের সরু অংশে হাতের তালু রেখে বেকায়দাভাবে ঝুলছে রানা। ভারসাম্য ধরে রাখার জন্যে দেয়ালে ঠেকাল বুটের দুই ডগা। বামহাতে হোলস্টার থেকে নিল অটোম্যাগ। ওটার বাঁট দিয়ে ঠুকঠুক করে বাড়ি দিল জানালার কাঠের ফ্রেমের মাঝে। তাতে একটু পর ভাঙা কাঠ থেকে খসে এল কাঁচের একটা প্যানেল। এতে শব্দ হলেও সেটা খুব জোরাল নয়। ধারেকাছে কেউ থেকে থাকলে আওয়াজটা শুনেছে। তবে এই ঝুঁকি না নিয়ে উপায় ছিল না। হোলস্টারে অটোম্যাগ রেখে দ্বিতীয় প্যানেলের পাশে ঠেস দিয়ে কাঁচের প্যানেল রাখল রানা। জানালার সরু জায়গাটা দিয়ে ঢুকতে চাইল। আরেকটু হলে ফ্রেমের ভেতরে আটকা পড়ত চওড়া কাঁধ। বাথরুমের দু’দিকের দেয়াল ধরে ঊরু পর্যন্ত ঢুকল ও। এরপর দু’পা ভেতরে টেনে নিয়ে লাফিয়ে নামল মেঝেতে। বাসি প্রস্রাবের ভয়াবহ বাজে গন্ধে বমি এল ওর। তিক্ত মনে ভাবল: এই কমোড কোনকালেই ফ্লাশ করে না ব্লু ফিল্মের শালা-শালীরা!

হোলস্টার থেকে অটোম্যাগ নিয়ে কান পাতল দরজায়। বাইরে যখন ছিল, কোন আওয়াজ পায়নি। ওয়্যারহাউসের ভেতরে এখন চলছে মৃদু বাজনা। ব্লু ফিল্ম তৈরি করার জন্যে বোধহয় ওয়্যারহাউস সাউণ্ডপ্রুফ করে নিয়েছে পিট ব্ল্যাক।

বামহাতে দরজার নব ঘুরিয়ে কবাট খুলল রানা। দরজার ওদিকে আবছা আলো। ভাপসা পরিবেশে কিছু পচে যাওয়ার দুর্গন্ধ। যদিও সেটা বাথরুমের প্রস্রাবের মারাত্মক শুয়োরী কুবাসের চেয়ে ঢের ভাল।

ধারেকাছে কেউ নেই সেটা বুঝে বাথরুম থেকে বেরোল রানা। পেছনে আটকে দিল দরজা। বাইরে থেকে ওয়্যারহাউস পরিত্যক্ত আর ফাঁকা মনে হলেও বাস্তবে তা নয়। চারপাশে ইকুইপমেন্ট আর প্লাস্টারবোর্ড। শেষেরগুলো দিয়ে তৈরি করা হয় সিনেমার দৃশ্য। দরকার ফুরিয়ে গেলে স্টেজ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। রানা বুঝল, পাশের প্লাস্টারবোর্ড কোন না কোন বেডরুমের অংশ। এ-ছাড়া আছে লিভিংরুম আর প্রাকৃতিক দৃশ্যের সব ডিযাইন।

এক ছায়া থেকে অন্য ছায়ায় ঢুকছে রানা। ওয়্যারহাউসের নিচতলার সেট-এ বাজনা ও আলো দেখে সেদিকেই চলেছে। কিছুটা যেতেই দেখতে পেল, সামনে নানান আসবাবপত্র। তার মাঝে বিশাল এক ওঅটার বেড। দু’দিক থেকে ওটার ওপরে জোরাল আলো ফেলেছে অসংখ্য বাতি।

ওঅটার বেডে দুই মেয়েকে দু’দিকে রেখে রাজার মত বসে আছে উলঙ্গ এক মোটকু ভাঁড়। মেয়েদুটোও পুরো উদোম। তারা যে দারুণ ফূর্তিতে আছে, সেটা বোঝাতে চাইছে ক্যামেরার সামনে। যদিও রানা দেখল, ঘেমেনেয়ে প্রায় সেদ্ধ হয়ে গেছে তিন পারফর্মার। চোখে-মুখে চরম ক্লান্তি। বড় এক ক্যামেরার পেছনে কুঁজো হয়ে ঝুঁকে আছে এক ক্যামেরাম্যান। পাশে সতর্ক শয়তান পিট ব্ল্যাক। অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকে মাঝে মাঝে নির্দেশ দিচ্ছে সে। ‘কোমর একটু ওপরে তোলো! চুমু দাও কানের লতিতে! খবরদার! ভুলেও ক্যামেরার অ্যাঙ্গেল ব্লক করবে না!’

এই ব্যাটাই আসলে ডিরেক্টর, ভাবল রানা। মেয়েদের ঘামের বুনো গন্ধ আর পুরুষের বীর্যপাতের বাজে গন্ধে নাক কুঁচকে গেল ওর।

ডাবিং পরে হলেও এসব নোংরা মুভিতে বড় কোন ভূমিকা থাকে না সাউণ্ড-ট্র্যাকের। তবুও ক্যামেরার পেছনে বাজছে স্টেরিয়ো সেটে মিউযিক। এটা করা হচ্ছে অভিনেতা- অভিনেত্রীদের চাঙ্গা করে তুলতে। যদিও তাতে কোন ফায়দা হচ্ছে না।

ঘণ্টাখানেক আগে বিচিতে এলিসা রসির হাঁটুর জোর গুঁতো আর মাথার ওপরে রানার পিস্তলের বাঁটের বাড়ি খেলেও এখন ভাল মুডে আছে পিট ব্ল্যাক। পুরো মন তার দৃশ্য গ্রহণে। তার নির্দেশনায় ওঅটার বেডে বসে খুশি-খুশি ভাব করছে পারফর্মারেরা।

অন্যদিকে গেল রানার চোখ। ব্ল্যাকের পেছনে চারজন লোক। তাদের তিনজনকে মাফিয়ার গুণ্ডা বলে মনে হলো, ওর। ষাঁড়ের মত দেহ। চোখে-মুখে বুদ্ধির ছাপ নেই। গভীর আগ্রহ নিয়ে দেখছে অনৈতিক যৌনক্রিয়া। অবশ্য চতুর্থজন একেবারেই আলাদা। তার পরনে দামি পোশাক। চোখ হিসাব-রক্ষকের।

সার্জেন্ট এবার্টন ঠিকই বলেছে, মনে মনে স্বীকার করল রানা। পিট ব্ল্যাকের নীল ছবি তৈরির ব্যবসায় নাক গুঁজে দিয়ে লাখ লাখ ডলার লুটে নিচ্ছে মাফিয়ারা। খরচ আরও কমাতে এখানে এসেছে হিসাব-রক্ষক, যাতে আরও বেশি মুনাফা করতে পারে অ্যালডো রসি।

পিট ব্ল্যাকের কাছ থেকে অ্যালডো রসির ব্যাপারে খোঁজ নেবে বলে এখানে এসেছে রানা। তবে বাজে সিনেমার এই পরিচালককে যে চট্ করে হাতের মুঠোয় পাবে, সে-সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ।

‘ঠিক আছে, এ-দৃশ্য শেষ,’ বলল ব্ল্যাক, ‘আরেকটু ভাল করলে তোমরা পেয়ে যাবে অ্যাকাডেমি পুরস্কার!’

দেয়াল টপকে ওঅটার বেড থেকে উঠল ভোঁতা চেহারার গণ্ডারের মত মোটা অভিনেতা। পুরো উলঙ্গ বলে বিব্রত বোধ করছে সে। তিক্ত সুরে বলল, ‘তোমার কি মনে হয় আস্ত দুটো ডাইনীর সঙ্গে এসব করতে আমার ভাল লাগে, পিট? পারলে তোমরা নিজেরা আমার মত উদয়-অস্ত খেটে দেখো!’

রাগী চেহারায় ওঅটার বেড ছাড়ল দুই মেয়ে। তাদের একজন খেপে গিয়ে বলল, ‘কুত্তার বাচ্চাটা বলে কী! আমরা বলে ডাইনী? নিজের নেই মুরোদ!’

ডানহাত তুলে এক পা এগোল গণ্ডার। মেয়েটার গালে চড় দেবে। অবশ্য ব্ল্যাকের পেছনে তিন গুণ্ডাকে নড়ে উঠতে দেখে থেমে গেল সে। মাথা নাড়ল ব্ল্যাক। ‘মাথা ঠাণ্ডা রাখো, কড়ি। অভিনয়ে তোমাকে না নিলেও, র‍্যাচেল আর ট্রেসিয়াকে ছাড়া আমার কোনভাবেই চলবে না।’

‘আসলে সৃষ্টিশীল কাজ তুমি মোটেই বোঝো না,’ বিড়বিড় করল কড়ি। একটা চেয়ার থেকে তোয়ালে তুলে ঢেকে নিল শরীর।

পিট ব্ল্যাকের সামনে গিয়ে থামল মেয়েদুটো। আগের মেয়েটা হাত রাখল ব্ল্যাকের বাহুতে। ‘তুমি কি আমাদের কথা কখনও ভাববে না, পিট? এই শুয়োরটার সঙ্গে অভিনয় করছি, সেটাই তো মস্তবড় শাস্তি। তার ওপরে তুমি আমাদের কাজ দেখাতে ডেকে এনেছ হাঁদা চেহারার তিন ডাকাতকে! মাফিয়ার তিন পাণ্ডাকে আঙুল তুলে দেখাল সে।

ওর দিকে চেয়ে মুচকি মুচকি হাসছে গুণ্ডারা।

ব্ল্যাক ঘুরে তাকাল দামি পোশাক পরা লোকটার দিকে। উলঙ্গ দুই মেয়েকে দেখেও অস্বস্তি নেই তার। কাঁধ ঝাঁকাল ব্ল্যাক। ‘ইয়ে… ট্রেসিয়া, আমরা না হয় পরে এসব নিয়ে আলাপ করব। দুশ্চিন্তা কোরো না, ঠিক সময়ে বেতন পেয়ে যাবে।’

বিরক্ত হয়ে চেয়ার থেকে তোয়ালে নিয়ে আরেকদিকে চলে গেল ট্রেসিয়া। বুকের ওপরে তোয়ালে রেখে তার পিছু নিল দ্বিতীয় মেয়েটা। পেছন থেকে তাদেরকে টিটকারির সুরে কী যেন বলল তিন গুণ্ডার একজন।

‘যথেষ্ট, আর একটা কথাও নয়!’ কঠোর চোখে তার দিকে তাকাল হিসাব-রক্ষক। পরক্ষণে ব্ল্যাকের উদ্দেশে বলল, ‘ব্ল্যাক, অফিসে চলো। জরুরি কথা আছে।’

‘জী, মিস্টার লেস্টার,’ লোকটাকে ভয় পায় বলে একটু দ্রুত কথাটা বলেছে পিট ব্ল্যাক।

দূরে কাঠের নড়বড়ে এক ড্রেসিংরুমে ঢুকল ট্রেসিয়া আর র‍্যাচেল। আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকল তিন গুণ্ডা। বোধহয় ভাবছে, একটু পর আবার দেখতে পাবে উলঙ্গ মেয়েদেরকে। স্টেজ ছেড়ে ওয়্যারহাউসের কোণে কাঁচে ঘেরা ছোট এক অফিসের দিকে চলেছে পিট ব্ল্যাক আর মিস্টার লেস্টার। তারা জানে না, অন্ধকারে নানান সেট এড়িয়ে নিঃশব্দে ছায়ার মত তাদের পিছু নিয়েছে এক যুবক।

মিনিট খানেক পর অফিসে ঢুকে দরজা বন্ধ করল ব্ল্যাক আর লেস্টার। ডেস্কের পেছনের চেয়ারে বসল হিসাব-রক্ষক। নিজের চেয়ার ছেড়ে দিতে হয়েছে বলে কোন আপত্তি নেই ব্ল্যাকের।

অন্ধকার থেকে কাঁচ-ঘেরা অফিসে উঁকি দিল রানা। ওয়্যারহাউসের যেখানে আছে তিন গুণ্ডা, ওখান থেকে অফিসে চোখ রাখতে পারবে না তারা। রানার বড় সমস্যা হচ্ছে, অফিসের মোটা কাঁচ। ওটার জন্যে প্রায় কিছুই শুনছে না ও।

বেশিরভাগ কথা বলছে লেস্টার। রাগে লাল হয়ে গেছে তার মুখ। ডেস্কের সামনে অস্বস্তি নিয়ে বারবার পা বদল করছে পিট ব্ল্যাক। মাঝে মাঝে জবাব দিচ্ছে। মুখে অসহায় ভাব।

অফিসের অন্যদিকে সরে এল রানা। পেছনে সেট ভাঙা বেডরুমের দেয়াল। মেঝেতে কয়েক সারি ইলেকট্রিকের কেই। স্টুডিয়োর তুলনায় অফিস ছোট হলেও সেটা বেশ আধুনিক। মেঝেতে পুরু কার্পেট। দেয়ালে দামি চিত্রকর্ম। চেয়ার-টেবিল বিলাসবহুল। একদিকের দেয়ালের র‍্যাকে সারি সারি উইস্কির বোতল। সিনেমা তৈরি করতে কেপ্পনের মত কম খরচ করলেও ব্ল্যাক যে মদের ব্যাপারে উদারহস্ত, তা বুঝে গেল রানা।

আপাতত খুব মানসিক কষ্টে আছে লোকটা।

‘আর এক পয়সাও নয়,’ কড়া গলায় বলল হিসাব-রক্ষক লেস্টার। ‘বারবার বাধা পড়ছে কাজে। তাতে বেড়ে গেছে খরচ। এদিকে ডিলারেরা বারবার তাড়া দিচ্ছে, যাতে নতুন সিনেমা দেয়া হয়।’

‘তবে আপনি তো জানেন শিল্পীরা আসলে কেমন হয়, ‘ থেমে থেমে বলল ব্ল্যাক। মোটা কাঁচের জন্যে ভোঁতা শোনাচ্ছে কণ্ঠস্বর। ‘আগে ওদেরকে তেল দিয়ে তবে আদায় করতে হয় অভিনয়।

‘তুমি কীভাবে কী করবে সেটা তোমার ব্যাপার, ব্ল্যাক। আমাদের চাই নিয়মিত ভাল সিনেমা।’ চেয়ারে হেলান দিল লেস্টার। কোটের পকেট থেকে নিল প্লাস্টিকের স্বচ্ছ, ছোট এক প্যাকেট। ওটার ভেতরে সাদা গুঁড়ো। আস্তে করে টেবিলে প্যাকেট রাখল সে। ‘এবারের চালান। এতেই ওদের কয়েক দিন খুশি থাকার কথা।

প্যাকেট হাতে নিয়ে হাসল ব্ল্যাক। ‘হ্যাঁ, এবার কাজ হবে। আমার হয়ে মিস্টার রসিকে ধন্যবাদ দেবেন, স্যর।’

‘তোমার ধন্যবাদ শুনতে বসে নেই ডন রসি। তিনি চান সুন্দর অভিনয়। আর সেটা তাঁকে দিতে হবে।

যথেষ্ট শুনেছে রানা। অফিসে ঢুকবে বলে দরজার দিকে এক পা বাড়াল। আর তখনই ওর পেছন থেকে কাঁচভাঙা গলায় চিৎকার জুড়ল এক মেয়ে: ‘আরে! এখানে কী করো! … কে তুমি?’

চরকির মত ঘুরল রানা। কোত্থেকে যেন হাজির হয়েছে নীল ছবির অভিনেত্রী র‍্যাচেল, বুকের ওপরে তোয়ালে। রানাকে চিনতে না পেরে চমকে গেছে। যুবকের হাতে আবার বিশাল সাইযের এক পিস্তল! ঘুরেই চিলের মত বিশ্রী চিৎকার ছেড়ে অন্ধকারে পালিয়ে গেল মেয়েটা।

ভাগ্যকে মনে মনে অভিশাপ দিল রানা। লেস্টার আর ব্ল্যাকের কথা শুনতে এত ব্যস্ত ছিল ও, টের পায়নি এত কাছে হাজির হয়ে গেছে মেয়েটা। এখন আর কিছু করার নেই। অফিসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্টেজ লক্ষ্য করে অটোম্যাগ তাক করল রানা। নারীকন্ঠের চিৎকার আর ধুপধাপ দৌড়ের আওয়াজে অফিসের দিকে ছুটে আসছে তিন মস্তান। এরই ভেতরে হোলস্টার থেকে বের করেছে পিস্তল।

অন্ধকার থেকে ভূতের মত বেরিয়ে সামনে অটোম্যাগ পিস্তল বাড়িয়ে ধরেছে রানা। অস্ত্রের নল থেকে ছিটকে বেরোল লাল স্ফুলিঙ্গ। ওয়্যারহাউসের বদ্ধ পরিবেশে ভয়ঙ্কর আওয়াজ তুলল অটোম্যাগ। পাশাপাশি অফিসের দিকে ছুটে এসেছে তিন গুণ্ডা। রানার প্রথম গুলিতে বামদিকের মস্তানের গলা থেকে উড়ে গেল আস্ত মাথা। কয়েক ফুট ছুটে ধুপ করে মেঝেতে পড়ল তার লাশ। ঠনঠনাৎ শব্দে মেঝেতে পিছলে অন্যদিকে গেল হাতের পিস্তল।

নল ডানে ঘুরিয়ে পর পর দুবার বুলেট পাঠাল রানা। ভারী ক্যালিবারের গুলি বিধল অন্যদুই মস্তানের বুকে। দেরি না করে চরকির মত অফিসের দরজার দিকে ঘুরল রানা। এদিকে বাইরে গুলির শব্দ শুনেও লেস্টার আর ব্ল্যাক ভেবেছে সব সামলে নেবে মাফিয়ার মস্তানেরা। কিন্তু তিন-তিনটে গুলির শব্দে দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে তারা। দরজা খুলে আগে বেরোল লেস্টার, হাতে খাটো নলের ছোট্ট কোল্ট রিভলভার। এদিকে প্রাণের ভয়ে আঁধারে ঝেড়ে দৌড় দিল পিট ব্ল্যাক।

সামনে কালো পোশাক পরা অচেনা এক লোককে দেখে পা হড়কে থেমে গেছে হিসাব-রক্ষক। চালু মাল সে। রানার বুকের দিকে রিভলভার তাক করেই টিপে দিল ট্রিগার। কানের পাশ দিয়ে বুলেট যাওয়ার শোঁ আওয়াজ শুনল রানা। নিজেও দেরি করেনি, কষ্ট করে অটোম্যাগ ঘুরিয়ে টিপে দিয়েছে ট্রিগার।

লেস্টারের ছোট্ট রিভলভারের গুলির শব্দ চাপা পড়েছে অটোম্যাগের প্রচণ্ড আওয়াজে। কুড়াল দিয়ে মানুষের মাথা দু’ফাঁক করলে যা হবে, সেটাই করেছে .৪৪ বুলেট-স্রেফ দু’ভাগ হয়েছে হিসাব-রক্ষকের মাথা। পেছনে অফিসের কাঁচের দেয়ালে ছলাৎ করে লাগল হলদেটে মগজ। পিছিয়ে ছিটকে মেঝেতে পড়ল লোকটার মৃতদেহ।

ব্ল্যাককে খুঁজতে ছায়ার ভেতরে চোখ বোলাল রানা। ওয়্যারহাউসের পেছনে কার যেন ছুটন্ত পদশব্দ। ওদিক থেকে চিৎকার করল এক মেয়ে: ‘একমিনিট! আমাদেরকে ফেলে যেয়ো না! একটু থামো! প্লিয! ব্ল্যাক!’

স্টুডিয়োর পেছনে খুলে গেল একটা দরজা। আওয়াজটা পেয়ে ওদিকে ছুটল রানা। শুনতে পেল খটাং শব্দে আটকে গেল কোন গাড়ির দরজা। গর্জে উঠেছে জিপের ইঞ্জিন। ব্ল্যাককে যেভাবে হোক ধরতে হবে, ভাবল রানা।

‘একমিনিট!’ চেঁচিয়ে উঠল একটা মেয়ে।

অটোম্যাগ হাতে ঘুরে তাকাল রানা। ছায়া থেকে বেরিয়ে এসেছে সিনেমার ক্যামেরাম্যান। প্রথম গুণ্ডার হাত থেকে পড়ে যাওয়া পিস্তল এখন তার হাতে। অস্ত্র হাতে থরথর করে কাঁপছে তরুণ। রানার বুকে তাক করেছে মাযল।

‘পিস্তল মেঝেতে রাখো,’ কড়া গলায় বলল রানা। ‘আমার লড়াই কিন্তু তোমার সঙ্গে নয়। খুন হয়ো না।’

‘আপনি বলছেন আমার সঙ্গে আপনার কিছু হয়নি?’ ঢোক গিলল ক্যামেরাম্যান। ‘আপনি তচনচ করে দিয়েছেন স্টুডিয়ো। তাতে আমার সত্যিই কিছু না। আমি শুধু এখান থেকে পালিয়ে যেতে চাই।’

‘তো পিস্তল ফেলে বিদায় হয়ে যাও,’ বলল রানা।

‘কিন্তু আপনি আমার পিঠে গুলি করলে, তখন?’

কয়েক সেকেণ্ড তরুণ ক্যামেরাম্যানের দিকে চেয়ে রইল রানা, তারপর হোলস্টারে রেখে দিল অটোম্যাগ। ‘এবার খুশি? তুমি তো ক্যামেরা চালাও। সেজন্যে তোমাকে খুন করবে না কেউ।

‘পরে আবার সত্যি সত্যি গুলি করে দেবেন না তো?’

‘বাঁচতে চাইলে ভাগো! এসবে আর থেকো না।’

রানার কঠোর মুখ দেখে বারকয়েক ঢোক গিলল ক্যামেরাম্যান। মেঝেতে পিস্তল রেখে তীরবেগে ছুটল কাছের দরজার দিকে। তার পিছু নিল রানা। সামনে ফাঁদ আছে ভেবে সতর্ক। প্রায় পৌঁছে গেছে পেছনের সরু দরজার কাছে, এমনসময় ওর গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল এক অভিনেত্রী।

এই মেয়ের নাম ট্রেসিয়া। রানাকে দেখে ডুকরে কেঁদে উঠল সে। দু’হাত মুঠো করে কিল দিল ওর বুকে। কিল দিচ্ছে আর নিজেই বলছে, ‘ছেড়ে দে, শয়তান! আমাকে ছেড়ে দে!’

‘তুমিই বরং আমাকে রেহাই দাও, বাপু!’ বলল মহাবিরক্ত রানা। ভাবছে: বাঙালি সিনেমার বস্তাপচা এই ডায়ালগ আমেরিকায় এল কীভাবে! শক্ত হাতে মেয়েটার কবজি ধরল ও। ‘আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না। বলতে পারো কোথায় গেছে পিট ব্ল্যাক?’

খুন হবে না শুনে শরীরে তোয়ালে জড়াল মেয়েটা। রাগী গলায় বলল, ‘কুত্তার বাচ্চা আমাদেরকে ফেলে পালিয়ে গেছে! অথচ বলেছিল: স্টুডিয়োতে রেইড হলে, সব সামলে নেব! শুয়োরটা কত্ত বড় মিথ্যুক!’

‘সে কি চলে গেছে, নাকি এদিকেই কোথাও লুকিয়ে আছে?’

‘নিজের চোখে দেখেছি, জিপগাড়ি নিয়ে পালিয়ে গেল! কয়েকটা গার্বেজ ক্যানের ওদিকে গাড়ি রাখে। হারামজাদা যেমন নোংরা কেঁচো, আবর্জনাতেই ওর থাকা উচিত!’

‘তুমি আর র‍্যাচেল বোধহয় বান্ধবী?’

কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল ট্রেসিয়া। ‘এত ভয় পেয়েছে যে ড্রেসিংরুম থেকে বেরোচ্ছে না। ওদিকে গুলির আওয়াজে খাটের নিচে গিয়ে ঢুকেছে শুয়োর কড়ি! …বলো তো, তুমি আবার সত্যিই পুলিশ নও তো?’ এক পা পিছিয়ে গেল মেয়েটা।

‘আমি এসেছি ব্ল্যাকের সঙ্গে কথা বলতে, আশ্বস্ত করল রানা।

তাতে গায়ের কাঁপুনি থামল ট্রেসিয়ার। নিচু গলায় বলল, ‘আমরা গুলির আওয়াজ শুনেছি। কিছুই দেখিনি। তাই তোমার ব্যাপারে পুলিশকে কিছুই জানাতে পারব না। আর আমি তো তোমাকে কোনকালে দেখিইনি!’

‘আমিও তোমাদের কোন ক্ষতি করতে আসিনি,’ বলল রানা। ‘এবার বলো তো, এখান থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছে ব্ল্যাক?’

‘ভয় পেলে যেখানে গিয়ে ওঠে। রুবা আর সিম্পসনের বার অ্যাণ্ড ফিটনেস জিমে। একটু আগে যেভাবে পালিয়ে গেল, এখন সোজা গিয়ে লুকাবে রুবার পেছনে।’

‘সিম্পসন আর রুবা কি বেআইনি কোন জয়েন্ট চালায়?’ মাথা দোলাল ট্রেসিয়া। ‘হ্যাঁ। আমার মনে হয় ব্ল্যাকের এসব সিনেমা তৈরি করার পেছনে আছে মিস্টার রসি, সিম্পসন আর রুবা।’

এক পা সামনে বাড়ল রানা।

তোয়ালে বুকের ওপরে টেনে নিল মেয়েটা।

‘রসি সম্পর্কে কিছু জানো?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘মাঝে মাঝে এখানে আসে,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল ট্রেসিয়া। ‘তবে এসব নিয়ে বোধহয় আমার কিছু না বলাই ভাল।’

‘ট্রেসিয়া, এখানে কি ব্ল্যাক বা অন্য কেউ শিশুদের দিয়ে ব্লু ফিল্ম তৈরি করে?’

ভয় ভুলে রেগে গেল মেয়েটা। জ্বলজ্বল করছে দু’চোখ। ‘দেখো, আমরা ভাল মেয়ে নই। খাবার আর বাড়ির খরচ অনেক। তাই বাধ্য হয়ে পয়সার জন্যে এত নিচে নেমে যেতে হয়েছে। তবে আমরা তো আর নরপশু নই!’

‘এদিকে কখনও শিশুদের দিয়ে ব্লু ফিল্ম তৈরি করা হয়েছে, এমন কিছু শুনেছ?’

মাথা নাড়ল ট্রেসিয়া। ‘তেমন কিছু কখনও শুনিনি। আর তেমন কিছু জানলে জীবনেও এসব কুকুরের বাচ্চাদের সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতাম না!’

মেয়েটার কথাগুলো নিয়ে দ্রুত ভাবল রানা। ওয়্যারহাউস এলাকা ছেড়ে হয়তো যায়নি পিট ব্ল্যাক। দোতলা বা এদিকের কোথাও লুকিয়ে আছে। বাইরে ফাঁদ পেতেছে তার দলের লোক। যদিও মনে হচ্ছে না যে মিথ্যা বলছে মেয়েটা। পিট ব্ল্যাক ওয়্যারহাউস ত্যাগ করতেই গর্জে উঠেছে গাড়ির ইঞ্জিন। দ্রুত চলে গেছে জিপ।

‘বান্ধবীকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাও,’ বলল রানা ‘একটু পর হাজির হবে পুলিশের লোক।’

ড্রেসিংরুমের দিকে ছুটল ট্রেসিয়া।

নীল ছবির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা এখান থেকে বেরিয়ে গেলে ইনসেনডিয়ারি গ্রেনেড ফাটিয়ে রসির ওয়্যারহাউস মাটিতে মিশিয়ে দেবে, ভাবল রানা। পুলিশ আসার আগেই চলে যাবে বহু দূরে। সামনে পড়ে আছে ওর প্রচুর কাজ। রুবা আর সিম্পসনের বার অ্যাণ্ড ফিটনেস সেন্টারে গিয়ে ধরতে হবে পিট ব্ল্যাককে। তার কাছ থেকে বের করতে হবে হাঁড়ির খবর। এরপর ডন অ্যালডো রসির আস্তানায় পৌঁছে যাবে রানা।

নয়

বহুকাল পর এত ভয় পেয়েছে পিট ব্ল্যাক। ব্লু ফিল্মের স্টুডিয়ো থেকে বেরিয়ে সোজা এসেছে সিম্পসনের বারের কাছে। এক ব্লক দূরে গাড়ি রেখে নামতেই টের পেল, ঠক- ঠক করে কাঁপছে তার দু’পা। তবুও দৌড়ে চলল সিম্পসনের বারের দিকে। চোখের সামনে এখনও দেখছে মাসুদ রানার কঠোর মুখ। লেস্টার আর ও অফিস থেকে বেরোতেই যে দৃষ্টিতে ওদেরকে দেখেছে লোকটা, তাতে আরেকটু হলে ছ্যার ছ্যার করে প্রস্রাব করে দিত ব্ল্যাক। বারবার ওর মনে হচ্ছে, এবার সবকিছু ফেলে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে যেতে হবে।

কী করবে সেটা পরে ভাববে, আগে চাই ঢক ঢক করে একগ্লাস উইস্কি গিলে নেয়া। এরপর লুকিয়ে পড়বে কোথাও। একবার এলিসা রসির কথা ভাবল ব্ল্যাক। ব্যথায় টনটন করছে অণ্ডকোষ। বহুৎ কষ্ট করে ক্লসিট থেকে বেরিয়ে এসেছে ওরা। তারপর একটা কথাও বলেনি এলিসা রসি।

না, তার কাছে সাহায্য চেয়ে কোন লাভ হবে না। চড়ই পাখির লেজের মত তিরতির করে কাঁপছে দু’হাঁটু। ব্ল্যাক বুঝতে পারছে, শুধু যে মাসুদ রানার হিট লিস্টে আছে, তা নয়, নিজের হিট লিস্টেও ওর নাম তুলেছে ডন রসি। এটা ভাবতে গিয়ে মাথা ঘুরছে তার। হতাশ হয়ে ভাবল, মাত্র একটা দিনের ভেতরে কীভাবে সব বদলে গেল?

মুখে লাগছে কনকনে হাওয়া, ওটা পাত্তা না দিয়ে নিয়ন বাতি দিয়ে সাজানো ভারী দরজা পেরিয়ে তড়িঘড়ি করে সিম্পসনের বারে ঢুকে পড়ল ব্ল্যাক।

কাঠের চারতলা বাড়ি সাদা চুনকাম করা। একদিকে বার, অন্যদিকে রুবার জিমনেশিয়াম।

পেছনে দরজা বুজে যেতেই ভাবল ব্ল্যাক: এবার এখানে এসে ওকে বোধহয় ধরতে পারবে না মাসুদ রানা।

কর্মচারীদের বন্দুক দিয়েছে সিম্পসন। বার কাউন্টারের নিচে ওগুলো লুকিয়ে রাখে তারা। কেউ মাতাল হয়ে ঝামেলা করলে বের করে। রুবার কর্মচারীরাও ঝামেলা হলে যে- কাউকে রুখে দেয়। এই দুই দলের সবার অ্যাপ্রনের নিচে থাকে পিস্তল বা রিভলভার। বিশেষ করে সিম্পসনের বার- এ। নামকরা সব মাফিয়া নেতারা আসে। তাই তাদেরকে নিরাপত্তা দেয়ার কাজও সিম্পসনের কর্মচারীদের হাতে।

বারের ছাত বেশ নিচু। দেয়ালে কালো কাঠের প্যানেল। এসব করা হয়েছে আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করার জন্যে। এখানে এলে কেমন এক নিরাপত্তার অনুভূতি টের পায় সাধারণ মানুষ। আর এখন পিট ব্ল্যাক নিজেও চাইছে নিরাপদ এক জায়গা, যেখানে হাজির হবে না মাসুদ রানা।

একটা বুথে বসে তর্জনী তুলে বারটেণ্ডারের দিকে ইশারা করল ব্ল্যাক। এই বার-এর কর্মচারীরা ভাল করেই চেনে ওকে। মিনিট তিনেকের ভেতরে ওর সামনের টেবিলে নির্জলা উইস্কি দিয়ে গেল এক ওয়েইট্রেস।

সন্ধ্যার পর বরাবরের মতই বার-এ আছে একদল মাতাল। এত মানুষের ভেতরে মনে মনে স্বস্তি পেল ব্ল্যাক। ইচ্ছা হলেই এখানে এসে সবার চোখের সামনে পিস্তল বের করে যা খুশি করতে পারবে না মাসুদ রানা। এই বার শুধু মাফিয়ার জন্যে নয়, নিরপরাধ মানুষও ড্রিঙ্ক করতে আসে, তাই গোলাগুলি হলে অনেকে আহত হবে, এটাও মাথায় রাখতে হবে কঠোর চেহারার লোকটার।

গ্লাস খালি করে আঙুল তুলে এক ওয়েইট্রেসকে ডাকল ব্ল্যাক। খাটো স্কার্ট আর নিচু ব্লাউস পরনে মেয়েটা এসে টেবিলে রাখল পুরো এক বোতল পাসপোর্ট উইস্কি। তাতে খুশি হয়ে আদর-আদর এক ভঙ্গি করে ওয়েইট্রেসের নিতম্বে চিমটি কাটল ব্ল্যাক। তাতে রেগে গিয়ে মনে মনে ওর চোদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে বারের অন্যদিকে গেল মেয়েটা।

বোতল থেকে গ্লাসে উইস্কি ঢেলে সরাসরি তরল-গরল পেটে চালান দিল ব্ল্যাক। গরম হয়ে উঠেছে তার শরীর। একবার ভাবল সে, স্মার্টফোন দিয়ে কাছের কোন বন্ধুকে কল দেবে। ওর চাই এমন কাউকে, যে কি না কিছু দিনের জন্যে ওকে লুকিয়ে রাখবে। মাসুদ রানার কথা ভাবলেই এখনও গা শিরশির করছে ওর।

কোটের পকেট থেকে স্মার্টফোন নিয়ে ওটার সুইচ অফ করে আবারও রেখে দিল পকেটে। বোতল থেকে আরও দুই আউন্স সোনালি তরল গ্লাসে ঢেলে ঢক ঢক করে চালান দিল পেটে। মনের ভেতরে বাড়ছে অ্যালকোহলের তৈরি করে দেয়া নকল সাহস। এত আওয়াজের ভেতরে কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতে পারবে না। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল ব্ল্যাক। বুথ থেকে বেরিয়ে বার-এর একদিকের দরজা খুলে চলে এল পাশের করিডরে। ডানে ছোট কয়েকটা টয়লেট। দরজাগুলো এখন খোলা। কফি আর মদ মিশ্রিত প্রস্রাবের গন্ধে নাক কুঁচকে গেল ওর। করিডরের মাঝে বামদিকে আছে চওড়া এক দরজা। ওদিক দিয়ে ঢুকতে হয় রুবার জিমনেশিয়ামে। দরজার আগে দেয়ালে তিনটে পে-ফোন। স্মার্টফোনের যুগে আজকাল কেউ ওগুলো পারতপক্ষে ব্যবহার করে না। আজ অবশ্য সাধারণ কোন দিন নয়। কে জানে, পর্নো স্টুডিয়োয় মানুষ খুন হওয়ায় ওকে হয়তো খুঁজছে মাফিয়া বা পুলিশের লোক। তার চেয়েও খারাপ কথা, একবার ধরতে পারলে হয়তো এক গুলিতে ওকে খতম করে দেবে মাসুদ রানা। লোকটা আসলে আস্ত এক যমদূত!

কাছের পে-ফোনের সামনে থেমে কোটের পকেট থেকে কয়েন নিল ব্ল্যাক। স্লটে কয়েন ফেলে রিসিভার কানে ঠেকাতেই শুনতে পেল ডায়াল টোনের গুঞ্জন। লাল ফোনের ডিজিট টিপতে শুরু করবে, তখনই ওর ডানকাঁধে এসে পড়ল শক্ত একটা বড় থাবা!

.

মিশিগান অ্যাভিন্যু ও স্টেট স্ট্রিটের লুপের মাঝে চওড়া রাস্তা রাশ স্ট্রিট। গরিব ও ধনীর জন্যে এদিকে-ওদিকে পছন্দমত সব বার ও ক্লাব। এ-ছাড়া আছে নানান দেশের খাবারের একের পর এক রেস্টুরেন্ট। চারপাশে গাড়ির জ্যাম। চোরাই এক পুরনো নীল ফোক্সভাগেন বিটল-এ চেপে রাশ স্ট্রিট ধরে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে রানা। ওর চোখ খুঁজছে সিম্পসনের বার আর রুবার জিমনেশিয়াম।

আগেও শিকাগোতে বহুবার এসেছে রানা। কখনোই জায়গাটা ভাল লাগেনি ওর। আমেরিকা মহাদেশের এই এলাকার মানচিত্র আঁকা হয়েছে ষোলো শ’ তেয়াত্তর সালে। এরপর আঠারো শ’ তিন সালে গড়ে তোলা হলো ফোর্ট ডেয়ারবর্ন। দ্রুত বড় হচ্ছিল শিকাগো শহর। তবে আঠারো শ’ একাত্তর সালে পুড়ে ছাই হয়ে গেল কাঠের বাড়িগুলো। বলতে গেলে কিছুই রক্ষা পেল না। তাতে দমে গেল না ইউরোপিয়ান শ্বেতাঙ্গরা। নতুন করে গড়ে নিল ইঁট-পাথরের বিশাল এক অরণ্য। এরপর উনিশ শ’ ঊনষাট সালে সামুদ্রিক বন্দরের জন্যে শিকাগো হয়ে উঠল পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যস্ত এলাকা। চারপাশ ছেয়ে গেল থিয়েটার, সিনেমা হল, সিম্ফোনি অর্কেস্ট্রা, শিল্প অ্যাকাডেমি, নানান ইউনিভার্সিটি ও জাদুঘরে। একই সঙ্গে এ-শহরের আণ্ডার-ওঅর্ল্ডে ঘাঁটি গাড়ল শক্তিশালী সব মাফিয়া দল। এই এলাকা হয়ে গেল তাদের নিরাপদ স্বর্গের মত।

জ্যাম ঠেলে এগোচ্ছে ফোক্সভাগেন বিটল। পথের দু’দিকে চোখ রেখেছে রানা। বারবার মনে পড়ছে স্নিগ্ধা আর তুষারের হাস্যরত মুখ, অ্যালডো রসির বেডরুমে ডিভিডির বিকৃত সিনেমার কথা। আরও তিক্ত হচ্ছে ওর মন। ভাবছে, যেভাবে হোক খতম করে দেবে মাফিয়া ডনকে। অবশ্য লোকটাকে হাতের মুঠোয় পেতে হলে আগে খুঁজে নিতে হবে নীল ছবির পরিচালক পিট ব্ল্যাককে। তার কাছ থেকে হয়তো সিনেটর পিটারের ব্যাপারেও কোন তথ্য পাওয়া যাবে। ডন রসির সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িত সেই লোক।

রাশ স্ট্রিট ধরে আরও বিশ গজ যেতেই ফুটপাথের ওদিকে সিম্পসনের বার অ্যাণ্ড রুবা’স জিমনেশিয়াম অ্যাও ম্যাসেজ পার্লারের নিয়ন বাতির সাইনবোর্ড দেখতে পেল রানা। ব্যস্ত রাস্তার পাশে কোন পার্কিংলট নেই। আরও এক ব্লক এগিয়ে তারপর গাড়ি রাখার জায়গা পেল রানা। টার্গেট এরিয়া থেকে গাড়ি এত দূরে রাখতে হচ্ছে বলে খচখচ করছে ওর মন।

গাড়ি থেকে নেমে দরজা লক করে উঠে এল ফুটপাথে। শত মানুষের ভিড়ে মিশে এগিয়ে চলল সিম্পসন আর রুবার আস্তানার দিকে।

.

কাঁধে চাপড় খেয়ে আরেকটু হলে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলত পিট ব্ল্যাক। ঢকাস্ করে গলার কাছে উঠে এসেছে অস্থির হৃৎপিণ্ড। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল সে। ধরেই নিয়েছে চোখের সামনে দেখবে মস্ত এক পিস্তল হাতে নিষ্ঠুর চেহারার মাসুদ রানাকে। কিন্তু তার বদলে লাল চুলের সুন্দরী যুবতী রুবাকে দেখে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল ব্ল্যাক। ‘ওহ্, রুবা! আমি খুব ভয় পেয়েছি!

‘এত ভয় পেলে কেন?’ জানতে চাইল রুবা। ব্ল্যাকের চেয়ে ছয় ইঞ্চি উঁচু সে। পেটা দেহ ভারোত্তোলকের। খদ্দেরদের কেউ ঝামেলা করলে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তাকে। স্ট্যামিনার অভাব নেই রুবার। ওর সঙ্গে একে একে বিছানায় গিয়ে চাহিদা মেটাতে না পেরে হতক্লান্ত হয়ে ওঠে আট-দশজন পুরুষ। নিজের তিনটে ব্লু ফিল্মে রুবাকে নিয়েছে ব্ল্যাক। তবে সমস্যা হচ্ছে অভিনয় জানে না মেয়েটা, নইলে অনেক নাম করত পর্নো ইণ্ডাস্ট্রিতে।

‘আসলে হয়েছেটা কী?’ তীক্ষ্ণ চোখে ব্ল্যাককে দেখল রুবা। ‘আগে কখনও তো তোমাকে এত ভয় পেতে দেখিনি।’

‘আগে তো কখনও মাসুদ রানা নামের ভয়ঙ্কর এক পিশাচ আমার পেছনে লাগেনি!’ ফোঁস করে শ্বাস ফেলল ব্ল্যাক।

‘ওই লোকের নাম কখনও শুনিনি! আর সে যে-ই হোক, তুমি হলে গিয়ে আদার ব্যাপারী, সে পিশাচ হলেও তার সঙ্গে আবার তোমার কীসের সম্পর্ক?’

‘সম্পর্ক না থাকলেই তো ভাল ছিল,’ তিক্ত চেহারা করল ব্ল্যাক। ‘ইয়ে… রুবা, তুমি আর সিম্পসন কি আমাকে কয়েক দিনের জন্যে কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারবে? ব্যাপারটা খুব জরুরি। আমি হঠাৎ করে মরে যেতে চাই না।’ আরও কিছু বলবে কি না ভাবতে গিয়ে চুপ হয়ে গেল ব্ল্যাক। ভাবতে শুরু করেছে, ওর উচিত হচ্ছে রুবাকে বিশ্বাস করা? সে যদি খবর দিয়ে দেয় ডন রসিকে?

‘আমার ঘরেই থেকো, লাভার বয়,’ হাসল রুবা। ‘তবে তা হলে রাতে আর ঘুমাতে পারবে না।’

চুপ করে আছে ব্ল্যাক। একবার ভাবল, বলবে কি না যে আরেকটু হলে অণ্ডকোষ ছেঁচে দিয়েছিল এক হারামি মহিলা, তাই আগামী দু’চার দিন বিশ্রাম নিতে হবে ওকে

‘ঠিক আছে, শেলিকে বলে চলে যেয়ো আমার অফিসে। এদিকে আমি কথা বলব সিম্পসনের সঙ্গে। ওর জানা থাকা দরকার, তুমি আমার ওখানে থাকছ।’ পিট ব্ল্যাকের পিঠে বন্ধুত্বপূর্ণ একটা চাপড় মেরে তাকে প্রায় টলিয়ে দিয়ে বার- এর দিকে চলল রুবা।

‘অনেক ধন্যবাদ, রুবা,’ পেছন থেকে বলল ব্ল্যাক।

‘বন্ধু তা হলে কীসের জন্যে? একটু পর ফিরে এসে তোমার কথা শুনব।’ দুনিয়ার কাউকে তোয়াক্কা করে না রুবা। লয়েটার্ড পরনে করিডর পার করে ঢুকে পড়ল বার-এ।

এদিকে একটু দূরের দরজায় ঝুলছে পুঁতির মালা। ওগুলো সরিয়ে রুবার এলাকায় পা রাখল ব্ল্যাক। এ-বাড়ির একতলা আর দোতলায় আছে ম্যাসেজ পার্লার। প্রতি তলায় কয়েকটা ছোট ঘরে খদ্দেরদের কাছে দেহ ভাড়া দেয় পতিতারা। দোতলায় মিটমিট করে জ্বলছে স্বল্প ওয়াটের বাতি। বাতাসে সিগারেটের ধোঁয়া। ধুপ-ধুপ করে দেয়ালে কম্পন তৈরি করছে সিম্পসনের বার-এর জুকবক্সের বাজনা। নিচতলায় একদল মাতালের হৈ-চৈ থাকলেও দোতলায় উঠে জায়গাটা কেমন যেন ভুতুড়ে বলে মনে হলো ব্ল্যাকের।

তৃতীয়তলার আসবাবপত্র ও পর্দায় বিলাসিতার ছাপ। ব্ল্যাকের জানা আছে, এখানে নানান বেআইনি কাজ করার সুযোগ করে দেয়া হয় বড়লোকদের ছেলেমেয়েদেরকে। আর চতুর্থতলায় আছে রুবার অফিস ও বেডরুম। নিজে সে নীল ছবির পরিচালক, সেই সুবাদে আগামী কয়েক দিন রুবার ঘরে আরামসে থাকতে পারবে।

তৃতীয়তলার লবিতে ডেস্কের পেছনে বসে আছে শেলি। খোলা টোগার জন্যে দেখা যাচ্ছে ওর শরীরের প্রায় সবই। মেয়েটার সামনে গিয়ে থামল ব্ল্যাক।

‘রুবা আমাকে বলেছে অফিসে গিয়ে বসতে।’

মাথা দুলিয়ে ব্ল্যাককে নিয়ে এলিভেটরে উঠল পতিতা মেয়েটা। কয়েক সেকেণ্ড পর এলিভেটরের দরজা খুলে যেতেই চতুর্থতলার করিডরে বেরিয়ে এল ওরা।

‘আমি কি আরও কিছু করে দেব, মিস্টার ব্ল্যাক?’ জানতে চাইল শেলি। তার মেয়েলি ঘামের গন্ধ পেয়ে শিরশির করছে ব্ল্যাকের তলপেট। যদিও বুঝে গেল, বিচির ব্যথা নিয়ে ফূর্তি করার উপায় নেই ওর। তার ওপরে মাথা থেকে কোনভাবেই দূর করতে পারছে না অবিবেচক মাসুদ রানার প্রতি ভয়।

‘না, আপাতত কিছু লাগবে না।’

‘ঠিক আছে।’ ফিরতি পথে রওনা হয়ে গেল শেলি।

করিডরের মাঝে রুবার অফিসের চওড়া দরজা। ওটা পেরিয়ে চারদিকে তাকাল ব্ল্যাক। রাস্তার আলো যেন এদিকে না আসে, সেজন্যে কালি লেপে কালো করা হয়েছে জানালার কাঁচ। রুবার ঘরটা শুধু অফিস নয়, ব্যক্তিগত জিমনেশিয়াম। একদিকে ডেস্ক ও চামড়ামোড়া চেয়ার। যৌন মিলন ছাড়া অন্য কোন অ্যাওরোবিক্স পছন্দ নয় রুবার, তাই ঘরে রেখেছে বড় কেবিনেটে সারি সারি ওজন তোলার যন্ত্রপাতি। দেয়ালে ঝুলছে তার সুইমিং স্যুট পরা ছবি। তাতে দেখা যাচ্ছে গোপন অঙ্গের দিকে আঙুল তাক করেছে সে।

পুরু কার্পেট মাড়িয়ে ডেস্কের পাশে থামল ব্ল্যাক। চট্ করে বুঝে গেল, গত কিছু দিনের ভেতরে সাউণ্ডপ্রুফ করা হয়েছে এ-ঘর। ডেস্কে টেলিফোন দেখে ওটার রিসিভার তুলে নিতে গিয়েও হাত পিছিয়ে নিল ব্ল্যাক। শিকাগো পুলিশ, মাফিয়া ডন রসি, বা রুবা হয়তো ট্যাপ করবে এই ফোন। স্মার্টফোনের চেয়ে ল্যাণ্ড ফোনে কথা বলা কম ঝুঁকিপূর্ণ হলেও অস্বস্তি লাগছে ব্ল্যাকের। বারবার করে মন বলছে: এমন কোথাও লুকাও, যেখানে তোমাকে পাবে না মাফিয়া ডন রসি আর মাসুদ রানা!

নরকের শহর – ১০

দশ

নীল ছবির স্টুডিয়োতে জানালা দিয়ে ঢোকার আগে গা থেকে ওভারকোট খুলে মাটিতে ফেলে রেখে গেছে রানা, তাই ওটাতে লেগেছে একগাদা ধুলোবালি। এখন সিম্পসনের বার- এ পা রাখার আগে ওভারকোট চাপড়ে নিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল ও।

হাড়-কাঁপা শীতে বারের খদ্দেরদের গায়ে ওভারকোট। ওগুলো ওরটার চেয়ে ঢের পরিষ্কার। রানার অবশ্য মনে হলো না যে তারা ধরে নেবে, পাটখেত থেকে উঠে এসেছে ও।

ঘরের ভেতরে দমবদ্ধ পরিবেশ। বাতাসে ভাসমান ধূসর ধোঁয়া ঘোলা করে দিয়েছে বৈদ্যুতিক বাতি। বিকট আওয়াজে জুকবক্সে বাজছে মিউযিক। ওটা ছাপিয়ে মদ খেতে খেতে নিজেদের ভেতরে হৈ-চৈ করছে একদল মাতাল।

আতাউলের তথ্য অনুযায়ী এই বারের মালিক আসলে মাফিয়া ডন রসি। ম্যানেজার হিসেবে এখানে বহু দিন ধরে চাকরি করছে সিম্পসন। আবার রুবার জিমনেশিয়াম আর ম্যাসেজ পার্লারের মালিকও ডন রসি।

মাতালদের ভিড় ঠেলে বার কাউন্টারের কাছে গেল রানা। চোখাচোখি হতেই ওকে ইস্পাতের মত কঠিন দৃষ্টিতে দেখল বারটেণ্ডার। তাকে বিয়ার দিতে বলল রানা। শিরশির করছে ওর মেরুদণ্ড। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানাতে শুরু করেছে: এই জায়গা তোমার জন্যে একদম নিরাপদ নয়!

একটু দূরে আলাপ করছে এক লোক আর এক যুবতী। সোনালি চুলের বেঁটে মধ্যবয়সী লোকটার চেহারায় বিরক্তি। তার সঙ্গিনীর মাথার চুল আগুনের মত টকটকে লাল। মেয়েটার পরনে সংক্ষিপ্ত পোশাক। হাতে-পায়ে দড়ির মত পেশি। ঝুঁকে সঙ্গীর কানে কানে কী যেন বলছে সে।

রানার সামনে কাঠের কাউন্টারে ঠকাস করে বিয়ারের গ্লাস রাখল বারটেণ্ডার। তার কাছে জানতে চাইল রানা, ‘পিট ব্ল্যাক কি এদিকে আছে?’

এই নামের কাউকে চিনি না,’ অলস সুরে বলল বারটেণ্ডার। সোনালি চুলের বেঁটে লোকটার দিকে ঘাড় কাত করে দেখাল। ‘উনি এই জয়েন্টের বস্। কিছু জানতে চাইলে তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করো। ইচ্ছে হলে তিনি জবাব দেবেন।

বিয়ার স্পর্শ না করে ক’জনকে পাশ কাটিয়ে সিম্পসনের সামনে গিয়ে থামল রানা। লোকটার চোখে চোখ রেখে বলল, ‘আমি পিট ব্ল্যাককে খুঁজছি।’

ওর কথায় বিস্ফারিত হলো সিম্পসনের চোখ। কুঁচকে গেছে নাক-মুখ। একই সময়ে ঘুরে রানার দিকে তাকাল লাল চুলের যুবতী। পরক্ষণে কাঁধের সমস্ত শক্তি দিয়ে রানার থুতনি লক্ষ্য করে ঘুষি মারল সে।

রানা ভাবতেও পারেনি উসকানি ছাড়াই ওর ওপরে হামলা করবে যুবতী। একটু দেরি হলেও ঝট করে একদিকে সরিয়ে নিল মাথা। ওর চোয়াল ঘষে পিছলে গেল ঘুষিটা। ভারসাম্য হারিয়ে দু’পা পেছাল রানা। ওদিকে সামনে বেড়ে বাতাসে ভেসে উঠে কোমর ঘুরিয়ে প্রচণ্ড এক লাথি ওর বুকে বসাতে চাইল রুবা।

লাথিটা আসতে দেখে দ্রুত আরও দু’পা পেছাল রানা। এদিকে লাথি মারতে না পেরে রেগে গেছে রুবা। মাটিতে তার পা পড়তেই সামনে বেড়ে আবারও আক্রমণে গেল সে। কোমর ঘুরিয়ে লাথি দিল রানার পাঁজর লক্ষ্য করে। তবে এবার তৈরি রানা খপ করে ধরল গোড়ালি। পা-টা মোচড় দিয়ে ওপরে ঠেলে দিতেই ভারসাম্য হারাল রুবা। কাত হয়ে কাঠের শক্ত মেঝেতে হুড়মুড় করে পড়ল সে।

এদিকে বারের ভেতরে মারামারি শুরু হয়েছে দেখে যে- যার গ্লাস হাতে সরে যাচ্ছে খদ্দেরেরা। ঘাড় ফিরিয়ে কাউন্টারের দিকে তাকাল রানা। বারের নিচের এক তাক থেকে নল-কাটা বন্দুক নিয়েছে বেঁটে সিম্পসন। ওর দিকে ব্যারেল ঘুরিয়ে ডানহাতের তর্জনী ভরল ট্রিগার গার্ডে। সত্যি গুলি করা হলে ছররা লাগবে আশপাশের অনেকের গায়ে!

ব্যাটার মাথা বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে, ভাবল রানা। শোল্ডার হোলস্টার থেকে ঝড়ের বেগে ওর হাতে উঠে এল বেরেটা ৯৩-আর। সিম্পসনের বন্দুক আগুন ঝরাবার আগেই গর্জে উঠল রানার পিস্তল। সেকেণ্ডের বিশভাগের একভাগ সময়ে সিম্পসনের নাকের গোড়ায় বিধল নাইন এমএম বুলেট। খুলির ভেতরে ঢুকে ছেতরে দিল মগজ। প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে পেছনের বার কাউন্টারের ওপরে গিয়ে পড়ল লোকটা। ওখান থেকে নামল বন্দুকসহ মেঝেতে। ঝনঝন করে ভেঙে গেছে অসংখ্য মদের বোতল। মৃত ম্যানেজারের তর্জনীর চাপে ‘বুম্!’ শব্দে গর্জন ছেড়েছে নল-কাটা বন্দুক। ছররা লেগে বিচ্ছিন্ন হলো সিম্পসনেরই ডান গোড়ালি।

এদিকে বারের ভেতরে শুরু হয়েছে চরম হুলুস্থুল। আরও গুলি করা হবে ভেবে ঘর থেকে বেরোতে চাইছে খদ্দেরেরা। এদিকে কাউন্টারের তাক থেকে বন্দুক নিতে কুঁজো হয়েছে দুই বারটেণ্ডার। গোলাগুলি এড়াতে গিয়ে খদ্দেরদের মধ্য দিয়ে ছুট দিল রানা। মাত্র পাঁচ সেকেণ্ডে পৌঁছে গেল পাশের দরজা পার হয়ে করিডরে। চট্ করে বুঝে গেল এই প্যাসেজের বামের দরজার ওদিকে রুবার ম্যাসেজ পার্লার।

দরজার দিকে যাওয়ার আগে একবার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা। করিডরে ঢুকে পড়েছে দুই বারটেণ্ডার। ডানের লোকটার হাতে বন্দুক। ট্রিগার টিপে দিতেই বিকট আওয়াজ তুলল তার অস্ত্র। অবশ্য এক সেকেণ্ড আগেই এক লাফে রুবার ম্যাসেজ পার্লারের দরজার ওদিকে চলে গেছে রানা। করিডরের একদিকের দেয়ালে বিঁধেছে বেশকিছু হুররা। কাঠের দেয়ালের এক জায়গায় এখন মুঠোর আকৃতির ফুটো। ঘুরেই দরজার ওপাশে তাকাল রানা। পরক্ষণে ওর হাতে লাফিয়ে উঠল বেরেটা। তিন রাউণ্ড বুলেটের একটা ফস্কে গেলেও অন্যদুটো ছিঁড়ে দিল বন্দুকওয়ালার অর্ধেক ঘাড়। পেছনদিকে ঝর্নার মত ছিটকে গেল লাল রক্তের স্রোত। লাশটা মেঝেতে পড়ার আগেই ঘুরে প্রাণভয়ে দৌড় দিল দ্বিতীয় বারটেণ্ডার। এখন আর লড়াই করার ইচ্ছে নেই তার।

এদিকে খুলে গেছে করিডরের বামের দুটো দরজা। চেহারায় ভয় নিয়ে উঁকি দিচ্ছে উলঙ্গ কয়েকজন লোক। বন্দুক আর পিস্তলের আওয়াজে শুকিয়ে গেছে সবার মুখ।

এটা পুলিশের রেইড ধরে নিয়ে করিডরে বেরোল উদোম তিন মেয়ে, হাতে যার যার পোশাক। প্রাণপণে ছুটল বারের দিকে। গোলাগুলি থেমে গেছে বুঝতে পেরে ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েদের পিছু নিল উলঙ্গ খদ্দেরেরা, হাতে যার যার পোশাক। ঘুরে রুবার ম্যাসেজ পার্লারের লবির দিকে তাকাল রানা। রিসেপশন ডেস্কের পেছন থেকে এল বুলডোযারের মত ভারী শরীরের এক তরুণী। লবির পাশে ছোট কয়েকটা কিউবিকল থেকে বেরোল গোটা চারেক লোক। কোন দিকে না চেয়ে রানাকে পাশ কাটিয়ে ছুটে চলে গেল করিডরের দূরে। তরুণী করিডরে পা রাখার আগেই খপ্ করে তার কবজি ধরল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘পিট ব্ল্যাক এখন কোথায়?’

চোখ তুলে ওকে দেখল তরুণী। পরক্ষণে ঘাড় কাত করে দেখাল ওপরতলা। তার মাথায় এল জরুরি প্রশ্ন। ভয়ে ভয়ে বলল, ‘আপনি আসলে কে?’

‘আমি এমন একজন, যে ব্ল্যাককে খুঁজছে,’ বলল রানা। ‘ওকে দেরি না করে সরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’

‘আপনি তার বন্ধু, না? উনি আছেন রুবার অফিসে।’

সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলা থেকে নামছে ক’জন লোক আর পতিতারা। রুবার অফিস ওপরতলায়, আগেই আন্দাজ করেছে রানা। লবির কোণে এলিভেটর দেখেও একেকবারে তিনধাপ করে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ছুটল ও। চওড়া কাঁধের সুঠাম যুবককে দেখে পথ ছেড়ে দিচ্ছে সবাই।

তৃতীয়তলায় উঠে কোন অফিস দেখতে পেল না রানা। আবারও উঠতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। চতুর্থতলার করিডরে ডানে দেখতে পেল বড় এক দরজা। ওটার ওদিকেই বোধহয় রুবার অফিস। বেরেটা হাতে দরজার কাছে পৌঁছে প্রচণ্ড এক লাথি মেরে দড়াম করে দুই কবাট খুলল ও। ঘরের ভেতরে রুবার ডেস্কের পেছনের চেয়ারে বসে আছে পিট ব্ল্যাক। হাতে ফোনের রিসিভার। হঠাৎ করে রানাকে যমদূতের মত হাজির হতে দেখে বরফের মূর্তি হয়ে গেছে সে।

ব্ল্যাকের বুকে পিস্তল তাক করে ধমকের সুরে বলল রানা, ‘খবরদার, একটুও নড়বে না!’

‘আ… আ… আপনি এখানে এলেন কীভাবে?’ মস্ত ঢোক গিলল ব্ল্যাক। ধরেই নিয়েছে যে এবার আর বাঁচবে না।

হাতে যথেষ্ট সময় পাবে না, বুঝে গেছে রানা। নিচতলায় নিজেদেরকে সামলে নিতে পারলেই ওকে খুঁজতে শুরু করবে মাফিয়ার গুণ্ডারা। তার আগেই এখান থেকে বেরোতে হবে ওর। ‘বাঁচতে চাইলে ফোন রাখো,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা।

ক্রেডলে রিসিভার রাখল ব্ল্যাক। কাঁপা গলায় বলল, ‘কিন্তু আপনি আমার কাছে কী চান?’

‘প্রথমবার দেখা হলে নেংটো মেয়েলোকটার পাশে দাঁড়িয়ে বলতে ভুলে গেছ, তুমি আসলে ডন রসির ব্লু ফিল্মের ভাড়াটে পরিচালক,’ বলল রানা। ওর বেরেটা সরাসরি চেয়ে আছে ব্ল্যাকের কপাল লক্ষ্য করে।

‘আ… আমি… আপনার কথা বুঝতে পারিনি,’ দুর্বল হাসি দিল ব্ল্যাক। ‘ওই বাড়িতে গেছি রসির বড়বোনের খোঁজ-খবর নিতে। সামাজিক মানুষ হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। কারও তো কোন ক্ষতি করিনি। আমি আসলে তাদের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানি না।’

‘বাজে কথা বাদ দাও, ব্ল্যাক,’ কড়া চোখে তাকে দেখল রানা। ‘অ্যালডো তোমার বস্। তার টাকায় পর্নোগ্রাফি তৈরি করো তুমি।’

‘ইয়ে… এটা তো সাধারণ ব্যবসা,’ চট্‌ করে বলল ব্ল্যাক। ভয়ে করমচার মত লাল হয়ে গেছে মুখ। ‘শপথ করে বলতে পারি, ওটা ছাড়া তার আর কোন কিছুতেই আমি নেই।

‘শিশুদেরকে দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরির ব্যাপারে কী বলবে? তুমি এসবে জড়িত নও?’

হাঁ হয়ে গেল পিট ব্ল্যাক। তিরতির করে কাঁপছে ডান গাল। তার আতঙ্কিত চেহারা দেখে রানার মনে হলো, যে- কোন সময়ে জ্ঞান হারাবে লোকটা। তারপর তুতলে উঠে বলল ব্ল্যাক: ‘বা….. বাচ্চাদের পর্নোগ্রাফি? এসব কী বলছেন আপনি! এত নোংরামিতে আমি কখনও নাক গুঁজে দিইনি। এমনিতেই বয়স্কগুলোকে দিয়ে অভিনয় করাতে গিয়ে পাছার গু মাথায় উঠে যায়!’

মুখের ভেতরে তেতো ভাব টের পেল রানা। পিট ব্ল্যাক এত বেশি ভয় পেয়েছে, মনে হচ্ছে না মিথ্যা বলছে সে। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে এর কাছ থেকে শিশু কিডন্যাপিং বা শিশু পর্নোগ্রাফির বিষয়ে কিছুই জানতে পারবে না।

‘মিথ্যা বলছ, ব্ল্যাক! তুমি কিন্তু আমার হাতে খুন হবে! পাণ্ডুর হয়ে গেল লোকটার মুখ। ঘন ঘন মাথা নাড়ল। ‘খোদার কসম! ইবলিশের কিরা! আমি কখনও কোন বাচ্চার কোন ক্ষতি করিনি! তার চেয়ে মরে যাওয়াও তো ভাল!’

কঠোর দৃষ্টিতে ব্ল্যাককে দেখল রানা। ‘সিনেটর জাস্টিন পিটার সম্পর্কে বলো।’

‘কার কথা বললেন?’

‘জাস্টিন পিটার।’

চোখ পিটপিট করল ব্ল্যাক। ‘সিনেটর?’ কণ্ঠে দ্বিধা। ‘মাঝে মাঝে তাঁকে দেখি টিভিতে। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সামনা- সামনি কখনও দেখা হয়নি।’

‘তার আর অ্যালডো রসির ভেতরে কীসের সম্পর্ক?’ বলল রানা। ‘সে ব্যাপারে বলো।’

বেরেটার নলের দিকে চুপ করে চেয়ে আছে পিট ব্ল্যাক। নিচতলা থেকে এল কয়েকজনের হৈ-চৈ।

‘আমি এসব ব্যাপারে কিছুই জানি না,’ বলল ব্ল্যাক। ‘আজকে বাচ্চাদের জন্যে ফাণ্ড সংগ্রহ করতে এক হোটেলে ডিনারের আয়োজন করেছেন। আপনি বরং নিজেই তাঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলুন।’

‘হয়তো তা-ই করব,’ বলল রানা। ‘কিন্তু তার আগে ডন রসিকে চাই। সুতরাং বলো সে এখন কোথায় আছে।’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল ব্ল্যাক। ‘আমি যদি জানতাম, তো আপনাকে বলে দিতাম। বিশ্বাস করুন, তার ব্যাপারেও কিছুই জানি না। আমাকে মেরে ফেললেও কিছু জানাতে পারব না।’

তার চোখ দেখে রানার মনে হলো, যা বলেছে লোকটা, তার চেয়ে ঢের বেশি জানে। কিন্তু তাকে জেরা করার মত সময় এখন ওর হাতে নেই।

বেরেটা নামিয়ে নিল রানা। বিরক্ত স্বরে বলল, ‘তোমাকে একটা উপদেশ দিচ্ছি, ব্ল্যাক। এলিসা রসির কাছ থেকে দূরে থেকো। কারণ আজ রাতে এ-শহরে অনেকের রক্ত ঝরবে। যদি বাঁচতে চাও, ভুল কোথাও পা রেখো না।’

ঢকাস্ করে বড় ঢোক গিলল ব্ল্যাক। করুণ চোখে চেয়ে রইল রানার দিকে।

‘ওয়্যারহাউসে যে ড্রাগস্‌ পেয়েছিলে, সে-ব্যাপারে কী বলবে? কোত্থেকে এসেছে ওগুলো? রসি পাঠায়নি?’

‘তা ঠিক জানি না। হলিউডের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মতই পর্নোগ্রাফির ওরাও ড্রাগস্‌ ছাড়া কাজ করতে চায় না।’

‘বুঝলাম। বাঁচার একটা সুযোগ দিচ্ছি। মরতে না চাইলে পালিয়ে যাও শিকাগো ছেড়ে। দরজার দিকে পিছিয়ে গেল রানা। আর তখনই ওকে সতর্ক করল ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়- পেছনে চলে এসেছে কেউ না কেউ!

ঝট করে ঘুরেই দরজার দিকে পিস্তল তাক করল রানা। চৌকাঠে এসে থেমেছে লাল চুলের সেই যুবতী। অবশ্য তার হাতে কোন অস্ত্র নেই।

‘সাহস থাকলে খালি হাতে লড়ো,’ বলল রুবা। ‘লড়ব শুধু তুমি আর আমি। বুকে সাহস আছে?’

ভাল বিপদে পড়েছি তো, ভাবল রানা।

‘নামিয়ে রাখো তোমার পিস্তল,’ বাঁকা হাসল রুবা। ‘খালি হাতে লড়বে। নিচতলায় সবাই অপেক্ষা করছে। তুমি আমার হাতে মার খেয়ে খুন হলে এসে লাশ সরিয়ে নেবে।’

ডেস্কের পেছন থেকে বিড়বিড় করল ব্ল্যাক, ‘বোকামি কোরো না, রুবা! এ-লোক ভয়ঙ্কর! বাঁচতে চাইলে নিচতলা থেকে কয়েকজনকে ডেকে আনো!’

‘ভয় পেয়ো না, ব্ল্যাকি বয়,’ নরম সুরে বলল রুবা। ‘কারও সাহায্য লাগবে না। এই লোক যদি নিরস্ত্র এক মেয়েকে গুলি করে, তো সেটা আলাদা কথা। নইলে পিটিয়ে ভাঙব ওর সব হাড়গোড়।’ একবার রানা আর ওর হাতের পিস্তল দেখল যুবতী। ‘কী? সাহস আছে লড়াই করার? নাকি ধরে নেব তুমি দুনিয়ার সেরা কাপুরুষ!’

বেরেটার নল রুবার হৃৎপিণ্ড বরাবর তাক করল রানা। মুখে কোন কথা নেই। যদিও ওর চোখ সব পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছে রুবাকে। প্রাণভয়ে ঘুরেই দৌড় দিয়ে করিডরে বেরোল যুবতী। লাইন অভ ফায়ার থেকে সরে কর্কশ স্বরে চেঁচাল, ‘এবার ওকে শেষ করে দাও!’

রানা আগেই বুঝেছে, পিস্তল নামালে করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে নির্দেশ দেবে রুবা, যাতে তারা এসে বন্দুক দিয়ে ঝাঁঝরা করে ওকে। করিডরে শুনতে পেল ছুটন্ত পায়ের শব্দ। একবার কাঁধের ওপর দিয়ে রুবার ডেস্কের দিকে তাকাল রানা। মুখ বিকৃত করে চেয়ারে গ্যাঁট মেরে বসে আছে ব্ল্যাক। ধরে নিয়েছে এবার খুন হবে সে।

ব্ল্যাকের পেছনে কালো কালিতে লেপা কাঁচের জানালা। ওদিকে ধাতব ফায়ার এস্কেপ। একবার সেদিকে চেয়েই ঘুরে তাকাল রানা। দরজার কাছে চলে এসেছে এক লোক, হাতে পয়েন্ট ফোরটি ফাইভ ক্যালিবারের রিভলভার। রানার গুলিতে ফুটো হলো তার ডানকাঁধ। আলগোছে হাত থেকে খসে পড়ল তার অস্ত্রটা। ভীষণ ব্যথায় বামহাতে আহত ডানকাঁধ চেপে ধরে উদ্দাম নাচে মেতে উঠল গুণ্ডা টাইপের লোকটা।

ঘুরেই কয়েক পা গিয়ে একলাফে ডেস্কে উঠল রানা। পিছলে যেতে দিল পা। ওর হাতে খুন হবে ভেবে কুঁই-কুঁই শব্দে কাঁদতে শুরু করেছে পিট ব্ল্যাক। ডেস্ক থেকে লাফিয়ে কাঁচ ভেঙে সরাসরি ফায়ার এস্কেপের সিঁড়ির ধাতব পাটাতনে নামল রানা। শুনতে পেল দূর থেকে আসছে একাধিক পুলিশের গাড়ির সাইরেন। এই এলাকায় যে গোলাগুলি হয়েছে, দেরিতে হলেও সে খবর গেছে পুলিশের কাছে। হোলস্টারে বেরেটা রেখে ছুটতে ছুটতে ফায়ার এস্কেপের ধাপ ভেঙে নামতে লাগল রানা। জানালা-পথে বেরিয়ে ওর মাথার ওপর দিয়ে গেল কয়েকটা গুলি। বিষয়টা বিপজ্জনক মনে হওয়ায় ধাপ বেয়ে নামা বাদ দিয়ে রেলিঙে চেপে বসল রানা। নেমে চলেছে সাঁই-সাঁই করে। বুঝে গেছে নিচতলায় নেমে যেতে একমিনিটও লাগবে না ওর।

ভাঙা জানালায় উঁকি দিচ্ছে কয়েকজন গুণ্ডা। রানার দিকে গুলি পাঠাল তারা। ধাতব ধাপে লেগে স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে নানান দিকে গেল বুলেট। পরের দুটো ল্যাণ্ডিং পার করে রেইলিং টপকে নিচের গলিতে খসে পড়ল রানা। তীরবেগে চলল রাশ স্ট্রিটের বাতিগুলোর দিকে।

কিন্তু পথরুদ্ধ করে গলির মুখে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে!

সে জিমনেশিয়াম ও ম্যাসেজ পার্লারের রুবা। সামনের রাস্তার আলোয় আগুনের মত দেখাচ্ছে তার মাথার লাল চুল।

‘যাবে কোথায়?’ টিটকারির সুরে বলল যুবতী। ‘পিটিয়ে তোমার হাড়গোড় ভেঙে দেব!’ সামনে বেড়ে মার্শাল আর্টের কঠিন সব কৌশল রানার ওপরে প্রয়োগ করতে চাইল সে।

বাধ্য হয়ে কয়েকবার পেছাল রানা। বেশিরভাগ ওজন উত্তোলনকারী মেয়ের মত ভারী নয় রুবার শরীর। গতি তার বৈশাখী ঝড়ের মত। এদিক-ওদিক সরে ধুপধাপ ঘুষি ও লাথি মারছে। আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে কয়েক সেকেণ্ডে বিরক্ত হয়ে গেল রানা। এড়াল পরের ঘুষি। কিন্তু এর পরের ঘুষিটা নিল বামবাহুর ওপরে। একই সঙ্গে সামনে বেড়ে চলে এল রুবার খুব কাছে। যুবতী পরের আক্রমণে যাওয়ার জন্যে তৈরি হওয়ার আগেই একটু ঝুঁকে গেল রানা, পরক্ষণে প্রায় মাটি থেকে তুলে এনে রুবার থুতনির নিচে ঝেড়ে দিল প্রচণ্ড এক আপারকাট। ওর ঘুষির জোর এতই বেশি, ঝটকা খেয়ে মাটি ছেড়ে তিন ইঞ্চি ভেসে উঠল রুবার দু’পা। উড়ে গিয়ে গলির মুখে ধড়াস করে পড়ল যুবতী। জ্ঞান নেই।

একবার তার নাকের কাছে হাত নিয়ে রানা বুঝল, ভালভাবেই শ্বাস নিচ্ছে মেয়েটা। তখনই পেছন থেকে এল একটা গুলি। ওর বামকানের পাশ দিয়ে গেল ওটা। পিস্তল হাতে খড়মড় আওয়াজে ফায়ার এস্কেপ বেয়ে নেমে আসছে রুবার লোকজন। জবাব দেয়ার জন্যে অটোম্যাগ বের করে পর পর তিনবার পাল্টা গুলি পাঠাল রানা।

বদ্ধ গলিতে কামানের শব্দ তুলেছে শক্তিশালী পিস্তল। ফলে মৃত্যুভয় ঢুকে গেল সামনের দুই গুণ্ডার মনে। কড়া ব্ৰেক কষে ঘুরেই দৌড়ে আবার গিয়ে ঢুকল অন্ধকারে। দলের ক’জনের মধ্যে হলো মুখোমুখি সংঘর্ষ। এদিকে রানার গুলি বুকে নিয়ে ফায়ার এস্কেপের রেইলিং টপকে নিচে পড়েছে একজন। এখন আর একদম নড়ছে না।

গলিতে দাঁড়িয়ে থাকা যুবক ভীষণ পাজি, বুঝে গেছে সিম্পসন ও রুবার দলের গুণ্ডারা। তাই থেমে গেছে তাদের তরফ থেকে গোলাগুলি। ছুটে আসছে না কেউ। গলির ভেতরে কোন হৈ-চৈ নেই।

এ-সুযোগে অচেতন রুবাকে টপকে ফুটপাথে উঠল রানা। গুলির শব্দে এখন সিম্পসনের বারের ধারে-কাছে কেউ নেই। হোলস্টারে অটোম্যাগ রেখে চোরাই গাড়ির দিকে চলল রানা। এক ব্লক পার হওয়ার আগেই বুঝে গেল, সাহস করে পেছনের গলি থেকে বেরোয়নি কেউ।

ফোক্সভাগেন নিয়ে স্বাভাবিক বেগে রওনা হলো রানা। দেখতে পেল ওকে পাশ কাটিয়ে বারের কাছে গিয়ে থামল পুলিশের কয়েকটা ব্রুযার। ঝটপট ওগুলো থেকে নেমে পড়ল অন্তত দশজন অফিসার

এরা মাসুদ রানা নামের এক যুবককে খুঁজছে, যে একের পর এক হামলা করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে গোটা শিকাগো পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে। হাতে অস্ত্র বাগিয়ে হুড়মুড় করে সিম্পসনের বার-এ গিয়ে ঢুকল বেশ ক’জন অফিসার।

রাশ স্ট্রিট পেরিয়ে ভাবল রানা, দরকার হলে একটা একটা করে উল্টে দেখবে এ-শহরের প্রতিটা পাথর। আজই দেখা করবে সিনেটর পিটারের সঙ্গে। মাফিয়া ডনের হেলথ সেন্টারে ছিল লোকটার ফেরারি। এ থেকে ধরে নেয়া যায়, ডন রসির সঙ্গে গভীর কোন সম্পর্ক আছে সিনেটরের। সুতরাং তার কাছ থেকে হয়তো জানা যাবে বহু কিছুই।

এগারো

সিনেটর পিটারের ডিনার পার্টি একটু পর শেষ হবে, এমনসময় ফোর অ্যাণ্ড হাফ স্টার ইন্টারকন্টিনেন্টাল শিকাগো হোটেলের বলরুমে পা রাখল রানা। এদিকে আসার পথে বড় এক মার্কেটে থেমে নামকরা এক পোশাকের দোকান থেকে কিনে নিয়েছে আকাশী রঙের শার্ট, লাল টাই আর দুই পিসের দামি স্যুট। ওভারকোট ও ব্যাটল ড্রেস খুলে গাড়িতে বসে পরে নিয়েছে নতুন পোশাক। এখন বুকের ট্যাগে লেখা: শিকাগো মান্থলি টাইম্‌স্ ডাইজেস্ট। নিচে ওর নাম: জার্নালিস্ট রুস ওয়ালি। সমাজের উঁচুতলার মানুষের অনুষ্ঠানে পাহারায় থাকবে পুলিশ ও প্রাইভেট সিকিউরিটির লোক, তাই তাদের হাতে যাতে ধরা না পড়ে, সেজন্যে গাড়িতে রেখে এসেছে অটোম্যাগ। অবশ্য বেরেটা আছে কাঁধের হোলস্টারে।

দামি ডেয়ার্ট শেষ করে ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছে নিচ্ছেন নিমন্ত্রিত অতিথিরা। বিশাল বলরুমের একদিকে উঁচু মঞ্চের কাছে ভিড় করেছে কয়েকটি টিভি কোম্পানি আর দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিকেরা। ভিডিয়ো ক্যামেরা আর সাধারণ ক্যামেরা দিয়ে তোলা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের ছবি। এই অনুষ্ঠান লাইভ দেখানো হচ্ছে ইলিনয় রাজ্য জুড়ে।

টেবিলে যারা বসে আছেন, তাঁদের বেশিরভাগের পরনে দামি টুক্সেডো। আজ বিশেষ এ-রাতে মহিলাদের পরনে দুর্মূল্য ইভিনিং গাউন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝিলিকে দশগুণ রশ্মি ছড়াচ্ছে তাদের হীরার অলঙ্কার। ঘরে চোখ বুলিয়ে রানা বুঝে গেল, এখানে এমন কোন অতিথি নেই, যার বার্ষিক আয় বিশ লাখ ডলারের নিচে।

বলরুমের পেছন-সারিতে গিয়ে থামল রানা। এখানে জড় হয়েছে কিছু সাংবাদিক। তাদের গায়ে বড়লোকদের মত দামি পোশাক নেই।

সামনের টেবিলে বসেছে সিনেটর জাস্টিন পিটার। ওটা অন্য টেবিলের চেয়ে সামান্য উঁচু। নানানদিক থেকে তার ছবি তুলছে একদল ক্যামেরাম্যান। সিনেটরের সঙ্গে আছে তার দলের শিকাগো শহর ও ইলিনয় রাজ্যের রাজনৈতিক সব ব্যক্তিত্ব।

মন দিয়ে জাস্টিন পিটারকে দেখছে রানা। সত্যিই দুর্দান্ত সুপুরুষ লোক সিনেটর। একটু চিকন হলেও দীর্ঘদেহী। কপালের ওপরদিক ঢেকে রেখেছে ধূসর চুল দিয়ে। মুখে মৃদু হাসি। তার পাশেই ন্যাড়া মাথার বয়স্ক এক লোক। দুই কানের ওপরে দু’গোছা বালিরঙের চুল। চোখে ভারী কাঁচের দামি চশমা। মণিদুটো হালকা নীল। মুখে প্রশান্তিময় হাসি। যে-কারও মনে হবে, ইনি কারও না কারও প্রিয় একজন চাচা।

সাংবাদিকদের পাশ থেকে রানা দেখল, হঠাৎ চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল বয়স্ক এক রাজনীতিবিদ। হাতের গ্লাসে চামচ দিয়ে ঠুং-ঠুং শব্দ তুলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে। ‘লেডিয অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, আপনাদের জন্যে এবার দু’চার কথা বলবেন আমাদের সিনেটর জাস্টিন পিটার।’

কৌতূহলী চোখে রানাকে দেখছে কয়েকজন সাংবাদিক। ওকে চিনতে না পেরে পরস্পরের দিকে তাকাল তারা। অবশ্য কেউ কিছু জিজ্ঞেস করছে না। সিনেটর পিটার উঠে দাঁড়াতেই তার বক্তৃতা নোট করার জন্যে কোট থেকে প্যাড ও কলম নিল রানা।

‘আজ শুধু এটাই বলব, আপনাদের সঙ্গে এখানে দেখা হলো বলে আমি খুব আনন্দিত,’ মসৃণ কণ্ঠে জানাল সিনেটর। ‘আপনারা এসেছেন নিষ্ঠুর এই পৃথিবীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে। আপনারা আপনাদের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন গরিব শিশুদের দিকে। এটা সত্যিই খুব বড় একটি বিষয়। আপনারা দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়েছেন, ফুলের মত কোমল হৃদয়ের শিশুদের জন্যে আপনাদের মনে রয়েছে অশেষ ভালবাসা।’

কিডন্যাপড্ শিশুদের কথা ভেবে দৃঢ়বদ্ধ হলো রানার চোয়াল। এদিকে গড়গড় করে বলে চলেছে সিনেটর পিটার, ‘আপনারা ভাল করেই জানেন, দুনিয়ার বেশিরভাগ মানুষ আজ হয়ে গেছে অন্তরহীন বিবেকশূন্য সব যান্ত্রিক রোবট। চারপাশে চলেছে পর্নোগ্রাফি, নানান অপরাধ আর খুনোখুনির ভয়ঙ্কর এক জোয়ার। তবুও আমরা যারা এখনও মানুষের মত করে ভাবতে চাই, অবশ্যই তাদের এক হয়ে গড়তে হবে প্রতিরোধ। আজ আপনারা খুবই ভাল একটি কাজের জন্যে লাখ লাখ ডলার দান করেছেন। আর এই টাকায় শত শত এতিম বাচ্চাকে আমরা মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তুলতে পারব। আর আমরা যদি সেটা না-ও পারি, অন্তত নিজেদের অন্তরের কাছে সবসময় পরিষ্কার থাকতে পারব।’

সিনেটরের কথা শুনে হাততালি দিল অতিথিরা । জাস্টিন পিটারের দিকে চেয়ে আছে রানা।

বলরুমে নীরবতা নেমে আসতেই বলল সিনেটর, ‘আমরা এরই ভেতরে এ-শহরের শিশুদের খেলার জন্যে তৈরি করছি একাধিক বিনোদন পার্ক। আর তাতে ভবিষ্যতে শিশুদের আর কখনও রাস্তায় গাড়ির ভিড়ভাট্টার ভেতরে ঝুঁকি নিয়ে খেলতে হবে না। ওরা থাকবে নিরাপদে। আর দুরূহ এই কাজটি যিনি করে দিচ্ছেন, সেই ভদ্রলোক আজ আমাদের এই সমাবেশে উপস্থিত হয়েছেন।’

একটু দূরে বসে থাকা টাকমাথা লোকটাকে ঘাড় কাত করে দেখাল জাস্টিন পিটার।

‘লেডিয অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, আসুন, বিশিষ্ট ভদ্রলোক জন ওয়েস্টনের জন্যে একবার হলেও আমরা হাততালি দিই। তিনি শিকাগো শহরের শিশুদের জন্যে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছেন। …মিস্টার জন ওয়েস্টন, আপনি কি দয়া করে একবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াবেন?’

ধীরে ধীরে চেয়ার ছাড়ল লাজুক মানুষটা। এত মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে বিব্রত বোধ করছে। তার জন্যে বজ্রপাতের মত আওয়াজে হাততালি দিল শত শত মানুষ।

‘দয়া করে আমার পাশে আসুন, স্যর,’ বলল সিনেটর। ‘প্লিয, আমাদের জন্যে দু’চার কথা বলুন।’

সিনেটরের পাশে থেমে কোটের পকেট থেকে ছোট একটা কাগজ নিল জন ওয়েস্টন। পডিয়ামের একপাশে সরে গেল জাস্টিন পিটার। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে নরম সুরে বলল মিস্টার ওয়েস্টন, ‘আপনাদের সঙ্গে দেখা হলো বলে আমি খুশি। আমি তো আসলে ভাল করে কথা গুছিয়ে বলতে পারি না, তাই বেশি কিছু বলতে চাই না। শুধু এটা বলব, আমাদের প্রিয় সিনেটরের কাছে আমার তরফ থেকে এই চেকটা দিচ্ছি।’

হাত বাড়িয়ে চেক নিল সিনেটর পিটার। টাকার অঙ্কের পরিমাণ দেখে বিস্ফারিত হলো তার দুই চোখ।

‘আমরা শিশুদের জন্যে যেসব প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি, সেজন্যে মিস্টার ওয়েস্টন দিয়েছেন পুরো বিশ লাখ ডলার!’

হাততালির প্রচণ্ড আওয়াজে যেন ভেঙে পড়ল বলরুম। হাত বাড়িয়ে জন ওয়েস্টনের সঙ্গে করমর্দন করল সিনেটর পিটার। ক্যামেরার ফ্ল্যাশের আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে চারপাশ।

‘আমি কি তবে বেশি কম দিয়ে ফেলেছি?’ লজ্জা পেয়ে বলল জন ওয়েস্টন।

‘দুনিয়ার কেউ এ-কথা বলতে পারবে না, স্যর,’ আন্তরিক হাসল সিনেটর। ‘আমাদের তরফ থেকে আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার ওয়েস্টন!’

পডিয়াম থেকে নেমে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল মানুষটা।

‘বলুন তো, কে এই জন ওয়েস্টন?’ পাশের সাংবাদিকের কাছে জানতে চাইল রানা।

ওর কথা শুনে ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল রিপোর্টার। ‘বলুন তো দেখি আপনি কোথা থেকে উদয় হয়েছেন? উনি জন ওয়েস্টন! মস্তবড় ব্যবসায়ী! এ-রাজ্যের হাজার হাজার গরিব মানুষের জন্যে কী-ই-না করেছেন? অন্তত বিশটা এতিমখানা চালান। নিজে থেকে দিয়ে দেন এতিমদের স্কুল-কলেজের সমস্ত খরচ। অবশ্য তিনি বড় বেশি একাকী। স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে কোনদিন কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে দেখেননি। তাঁর স্ত্রী হওয়ার জন্যে মুখিয়ে আছে শিকাগো শহরের দারুণ রূপসী সব মেয়ে।’

রানাকে আরেকবার তাচ্ছিল্য-ভরা চোখে দেখে নিয়ে পডিয়ামের দিকে মনোযোগ দিল সাংবাদিক।

সত্যিই হয়তো সমাজ-কল্যাণে কাজ করে চলেছে জন ওয়েস্টন, ভাবল রানা। সে যে অত্যন্ত বিনয়ী, তাতে কোন সন্দেহ নেই। লাজুক মুখে চুপচাপ বসে আছে নিজের চেয়ারে।

পরবর্তী পনেরো মিনিট টানা বক্তৃতা দিল সিনেটর পিটার, তারপর প্রবল হাততালির মাধ্যমে শেষ হলো তার কথা।

ভদ্রলোক পডিয়াম থেকে নেমে পড়তেই ভিড়ের ভেতর দিয়ে তার দিকে এগোল রানা।

এটা রাজনৈতিক মিটিং নয়, তাই বলরুমের সিকিউরিটি বেশ শিথিল। বেরোবার দরজাগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে ভাড়া করা কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী

জাস্টিন পিটারের কাছে পৌঁছে গেল রানা। দেখা করতে আসা লোকগুলোর সঙ্গে একে একে হাত মেলাচ্ছে সিনেটর। তাদের পেছনেই থাকল রানা। ভিড় কমে গেলে কয়েক পা সামনে বেড়ে বলল, ‘মাফ করবেন, সিনেটর, আমি কি আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে পারি? বড়জোর পাঁচ মিনিট নেব, স্যর।’

সিনেটর পিটার ধরে নিয়েছে রানা একজন সাংবাদিক। নরম সুরে বলল সে, ‘দুঃখিত, ইন্টারভিউ নিতে হলে আগামীকাল সকালে আমার প্রেস এইডের অফিসে যোগাযোগ করুন।’

‘আমার মনে হয় না অত সময় অপেক্ষা করতে পারব, মিস্টার সিনেটর,’ বলল রানা। ‘আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই অ্যালডো রসির বিষয়ে।

ঘাড় কাত করে ওর দিকে তাকাল জাস্টিন পিটার। ‘বলুন তো, আপনি আসলে কে?’

‘মাত্র পাঁচ মিনিট সময় নেব আপনার কাছ থেকে, স্যর, ‘ বলল রানা।

এবার . বহুবার প্র্যাকটিস করা হাসি উপহার দিল সিনেটর। ‘অসুবিধে কী? চলুন, আলাপ সেরে নিই।’ আশপাশে যারা আছে, তাদের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমাকে একটু মাফ করবেন। একটু পর ফিরব। প্রেস যখন বিনে পয়সায় প্রচারে সাহায্য করছে, তো মানা করি কী করে!’

জবাবে মুচকি হাসল কয়েকজন ভদ্রলোক।

বলরুমের পেছন-দরজার দিকে রানা পা বাড়াতেই ওর পাশে হাঁটতে লাগল সিনেটর। বরাবরের মতই মুখে ধরে রেখেছে মৃদু হাসি। যদিও রানা দেখল তার কপালে ফুটেছে বিন্দু-বিন্দু ঘাম।

‘আশা করি জরুরি কোন কথা বলবেন,’ নিচু গলায় বলল সিনেটর। ‘সময় নষ্ট করতে চাই না। আরেকটা কথা, অ্যালডো রসি সম্পর্কে আমি তেমন কিছুই জানি না।

বলরুমের পেছন-দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে ক’জন ভদ্রলোক। তাদের কাছে পৌঁছুবার আগেই বলল রানা, ‘ফালতু কথা বাদ দিন। মুখে হাসি ধরে রাখুন। আপনি নিশ্চয়ই চান না লাখ লাখ ভোটার হারাতে, সিনেটর?’

পলকের জন্যে রাগী চোখে ওকে দেখল জাস্টিন পিটার। হাসি-হাসি মুখে ভদ্রলোকদের মাঝ দিয়ে হেঁটে পেরিয়ে গেল পেছনের দরজা। সামনে খাটো করিডর গিয়ে মিলেছে একটা ডাবল সুইং-ডোরে। ওপাশে হোটেলের কিচেন থেকে আসছে প্লেট ও চামচের টুং-টাং শব্দ।

করিডরের মাঝে থমকে দাঁড়িয়ে রানার দিকে তাকাল সিনেটর। চোখে-মুখে বিরক্তি। ‘এবার বলুন কী বলবেন? আমার হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই।’

‘আপনি হয়তো জানেন, অ্যালডো রসির হেলথ সেন্টারে গোলাগুলি হয়েছে। সিনেটর…’

‘হ্যাঁ, এটা জানি যে ওটা একটা হেলথ ক্লাব, রানার কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেছে জাস্টিন পিটারের মুখ।

‘ওটার মালিক কি অ্যালডো রসি?’

‘তা-ই তো জানি।’ মাথা নাড়ল সিনেটর। ‘কিন্তু গোলাগুলির সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? আপনি আসলে কী বলতে চান?’

‘আপনি অনায়াসে হেসে হেসে মিথ্যা বলেন, সিনেটর, তা-ই না? পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে আপনাকে বলা হয়নি যে ওখানে ছিল আপনার ফেরারি গাড়ি? পুলিশ আসার আগে আমি নিজেই তখন ওখানে ছিলাম।’

চোখ সরু করল সিনেটর পিটার। ‘তার মানে আপনি সাংবাদিক নন? তা হলে আপনি আসলে কে?’

‘আপনিই বরং বলুন আমি কে?’ কড়া চোখে তাকে দেখল রানা। হাতে বেরিয়ে এসেছে বেরেটা।

আগ্নেয়াস্ত্র দেখে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে সিনেটরের মুখ। ‘আপনি কে সেটা তো আমার জানার কথা নয়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমি সেই হেলথ ক্লাবের সদস্য। মিস্টার রসি ওটা কিনে নেয়ার পর থেকে সেখানে শরীরচর্চা করি। ব্যস, এটুকু সম্পর্ক আছে মিস্টার রসির সঙ্গে আমার। আইন মেনে ক্লাব করেছে সে। তাতে কোন দোষ তো দেখি না। কাজেই ওখানে আমার ফেরারি গাড়ি থাকলেও সেটা নিয়ে আমাকে বিরক্ত করা উচিত নয় আপনার।’

বামহাতে সিনেটরের ডানকবজি ধরল রানা। মুঠোর ভেতরে গুঁজে দিল কী যেন।

ভিযিটিং কার্ডটা পড়ে নিয়ে একবার ঢোক গিলে রানাকে দেখল সিনেটর। ‘আপনিই তা হলে রানা এজেন্সির চিফ? আগেও অনেকের মুখে আপনার কথা শুনেছি। পুলিশ ধারণা করছে যে আপনিই হামলা করেছেন হেলথ সেন্টারে।’

‘আমি এটা জানি, আপনি আছেন রসির পকেটে,’ নিচু গলায় বলল রানা। ‘এবার বলুন, আমি সন্ধ্যায় ওখানে যাওয়ার আগে আজ অ্যালডোর সঙ্গে কোথায় গিয়েছিলেন? পরে আপনাকে এই হোটেলে নামিয়ে দিয়ে গেছে সে।’

‘আমি তার ব্যাপারে প্রায় কিছুই জানি না, মিস্টার রানা, সামান্য কেঁপে গেল রাজনীতিকের গলা।’

‘তো বলতে চাইছেন আপনি শিশু পর্নোগ্রাফির সঙ্গে জড়িত নন?’

মাথা নাড়ল সিনেটর। ‘ওটা তো ভয়ঙ্কর ঘৃণ্য অপরাধ!’

‘কিন্তু কোন না কোন অপরাধ করে ধরা পড়েছিলেন আপনি। আর সেজন্যে আপনাকে চলে যেতে হয়েছে রসির পকেটে। বলুন, শুনি কী ছিল সেই অপরাধ?’

চুপ করে আছে জাস্টিন পিটার।

‘রসির জন্যে ওয়াশিংটনে লবিং করেন কেন? স্রেফ টাকার জন্যে?’

এবারও জবাব দিল না লোকটা।

‘আপনার মত রাজনৈতিক নেতাদেরকে কিনে নিচ্ছে সে। তার চাই আরও ক্ষমতা। আর সেটা যেন পায়, সেজন্যে তার হয়ে কাজ করছেন আপনারা। কিন্তু সেটা কেন করছেন?’

জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটল সিনেটর পিটার। ‘কয়েকবার রসির বিরুদ্ধে আইন ভঙ্গের অভিযোগ এলে আমি শুধু অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিয়েছি। আর কিছুই করিনি।’

‘নিজের ভোটারদেরকে ঠকিয়ে দিয়েছেন,’ বলল রানা। ‘আর সেটা বড় ধরনের অপরাধ।’

রানার চোখে ঝড় দেখে আরেকবার ঢোক গিলল জাস্টিন পিটার। তার বুকের দিকে চেয়ে আছে বেরেটার মাযল।

‘আপনি কি আমাকে খুন করবেন? প্লিয! আমি তো কোন দোষ করিনি! রসির সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই!’

‘মিথ্যা বলবেন না!’ চাপা স্বরে বলল রানা। ‘রসির বিরুদ্ধে শক্ত প্রমাণ না পেলে এখানেই হয়তো আপনাকে খতম করব।’

টুং-টাং শব্দ হোটেলের কিচেনে। বলরুমে মানুষের চাপা গুঞ্জন। বেঁটে করিডরে পা রাখেনি অন্য কেউ। তবে রানা বুঝে গেল, যে-কোন সময়ে সিনেটরকে খুঁজতে এদিকে চলে আসবে কেউ না কেউ। সুতরাং বেশিক্ষণ সময় পাচ্ছে না ও।

‘আমার কানে এসেছে কিছু গুজব,’ থমকে থমকে বলল সিনেটর পিটার। ‘সেসব সত্যি কি না সেটা জানি না।’

‘আপনি যা জানেন সেটা বলুন।’

‘ঠিক আছে, বলছি। ইয়ে… শুনেছি রসির মাফিয়া দলের প্রধান আসলে সে নিজে নয়। দলটা চালায় তার বড়বোন এলিসা রসি। আপনি তো জানেন, গুণ্ডারা কোন মেয়ের কাছ থেকে নির্দেশ নিতে চায় না। তাই অ্যালডো রসিকে সামনে রেখে দল চালায় সেই মহিলা।’

‘অ্যালডো রসির ব্যাপারে আর কী জানেন?’

‘জীবনে মাত্র দুয়েকবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। কথাও হয়েছে ফোনে বড়জোর তিনবার।’

লোকটা মিথ্যা বলছে কি না সেটা জানার উপায় নেই, ভাবল রানা। সত্যিই হয়তো রসির মাফিয়া দলের চালিকা- শক্তি এলিসা রসি। তা হতেই পারে। তবে তাতে কিছুই বদলে যাচ্ছে না। জানা সম্ভব হচ্ছে না কোথায় লুকিয়ে পড়েছে অ্যালডো রসি। স্নিগ্ধা আর তুষারের খুনের বদলাও নেয়া যাচ্ছে না। আর শিশুদের কিডন্যাপ করাও ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। ওর চারপাশে আসলে আছে এখন একরাশ ছেঁড়া সুতো।

বলরুমের দরজা বারবার দেখছে সিনেটর। পিস্তল হাতে ডাকাতের মত লোকটা তাকে খুন করবে কি না, সেটা নিয়ে ভয়ে আছে সে।

‘এবার কি আমি যেতে পারি?’ নরম স্বরে জানতে চাইল সিনেটর, ‘আমার তো আর কিছু জানা নেই।’

খর চোখে তাকে দেখল রানা। ‘যেতে পারেন। তবে আপনার ব্যাপারে আমি পরে খোঁজ নেব।’

বড় করে শ্বাস ফেলল সিনেটর। ‘কী বিষয়ে খোঁজ নেবেন, মিস্টার রানা?’

‘আজ বলরুমে যা বললেন, সেটা সত্যি কি না সেটা জেনে নেব,’ বলল রানা। ‘এটাও জানব যে আপনি শিশুদের জন্যে কাজ করেন, নাকি করেন না। পরে যদি দেখি যে একের পর এক মিথ্যা কথা বলেছেন, তো আরেকবার দেখা করব আপনার সঙ্গে। আর সে-সময় আপনি প্রাণে বাঁচবেন না।’

‘আমি তো কখনও মিথ্যা কথা বলি না,’ কাঁপল সিনেটরের গলা।

‘আমি হোটেল থেকে বেরোবার আগে কোন ঝামেলা করবেন না। নইলে খুন হবেন আমার হাতে।’

‘কাউকে কিছু জানাব না,’ ফিসফিস করল সিনেটর।

হোলস্টারে বেরেটা রেখে আতঙ্কিত লোকটাকে পেছনে ফেলে দৃঢ়পায়ে বলরুমে গিয়ে ঢুকল রানা।

বারো

সারা জীবনে যত পাপ করেছে, মাসুদ রানার সামনে দাঁড়িয়ে একে একে সবই মনে পড়েছে জাস্টিন পিটারের। গরম হয়ে গেছে কানের লতি। শুকিয়ে গেছে গলা। ধকধক করছে হৃৎপিণ্ড। মাথা নিচু করে মেঝের দিকে চেয়ে আছে সে। কিছুক্ষণ পর মুখ তুলে দেখল করিডরে সে ছাড়া আর কেউ নেই। নীরবে বিদায় নিয়েছে যমদূতের মত লোকটা।

এবার কী করা উচিত, ভাবতে চাইল সিনেটর পিটার। কোট থেকে সিল্কের রুমাল বের করে মুছে নিল ঘর্মাক্ত মুখ। মনে মনে বলল, আর কখনও মুখোমুখি হতে চাই না তার।

হঠাৎ করে খুলে গেল বলরুমের দরজা। আরেকটু হলে ভয়ে লাফিয়ে উঠল সিনেটর। চট করে ওদিকে তাকাল।

‘এই যে, মিস্টার সিনেটর, আপনি তা হলে এখানে? ভাবছিলাম হঠাৎ কোথায় গেলেন। ধীরপায়ে সিনেটরের দিকে এল জন ওয়েস্টন।

লালচে হয়ে গেছে সিনেটর পিটারের মুখ।

‘হায়, ঈশ্বর! আপনার আসলে কী হয়েছে?’ উদ্বিগ্ন স্বরে জানতে চাইল ওয়েস্টন। ‘আমার তো মনে হচ্ছে যে আপনি অসুস্থ হয়ে গেছেন। আমি কি ডাক্তার ডেকে আনব?’

হাত বাড়িয়ে মুঠোয় রাখা কার্ড দেখাল সিনেটর। শুকনো গলায় বলল, ‘মাসুদ রানা এসেছিল।

পুরু কাঁচের ওদিকে বিস্ফারিত হলো ওয়েস্টনের চোখ। নিচু গলায় বলল সে, ‘আপনার ব্যাপারে সব জেনে গেছে?’

মাথা নাড়ল সিনেটর। ‘তবে সন্দেহ করছে।’

‘আর আমার ব্যাপারে?’

‘কিছু বলেনি।’

ঠোঁট মুচড়ে ফেলল জন ওয়েস্টন। ‘কু ডাকছে আমার মন। আপনি আসলে তাকে কী বলেছেন?’

‘তেমন কিছুই না,’ ঢোক গিলল সিনেটর পিটার। ‘তবে লোকটা ভয়ঙ্কর। বারবার মনে হয়েছে সবই জানে সে।’

ওয়েস্টন দ্রুত ভাবছে, সেটার ছাপ পড়েছে তার মুখে। ‘মাসুদ রানা অতি চালাক লোক। আমরা এরই ভেতরে সেটা জেনেছি। তবে আসলে তেমন কিছুই জানে না। এখানে এসে আপনার কাছ থেকে কিছু জানার চেষ্টা করেছে। তবে তাতে কোন লাভ হবে না। আপনি তো কিছু বলেননি, তা-ই না?’

মাথা নাড়ল সিনেটর পিটার।

‘তবু ঝামেলা আরও করার আগেই তাকে সরিয়ে দেব, ‘ সহজ সুরে বলল ওয়েস্টন।

‘কী করতে চান?’ উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল পিটার। ‘সে কিন্তু খুব বিপজ্জনক।’ ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দিতে চাইছে সব দায়িত্ব।

‘কতক্ষণ আগে এখান থেকে বেরিয়ে গেছে সে?

‘একমিনিট হবে। করিডরে আসার সময় আপনার সঙ্গে হয়তো দেখাও হয়েছে। ভান করছে সে একজন সাংবাদিক।’

কী যেন ভেবে নিয়ে বলল ওয়েস্টন, ‘আমি হোটেলের সিকিউরিটিকে বলছি, অচেনা এক লোক ঢুকেছে বলরুমে। সিনেটরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছে টাকা-পয়সা। ওদিকে আমাদের লোকেদের জানাব, এখানে ঘুরঘুর করছে মাসুদ রানা।

‘মাফিয়ার লোক কি এই হোটেলে আছে?’

‘অবশ্যই। ওদের ছাড়া হোটেলে পা রাখতাম? আমার মত বড় ব্যবসায়ী এমন ঝুঁকি নেয় নাকি?’

‘অ্যালডো রসির ব্যাপারে কী করবেন?’

‘সেটা পরে দেখব। অত ভাববেন না। শিকাগো থেকে প্রাণ নিয়ে বেরোতে পারবে না মাসুদ রানা।’

অস্বস্তি নিয়ে মাথা দোলাল সিনেটর পিটার। এখনও ভয় লাগছে তার, যে-কোন সময়ে হাজির হবে মাসুদ রানা। আর, তখন গুলি করে ঝাঁঝরা করবে ওয়েস্টন আর তাকে।

‘আশা করি যা করার ভেবেচিন্তে করবেন,’ মিইয়ে যাওয়া গলায় বলল সিনেটর।

মৃদু হাসল ওয়েস্টন। এক পলকে হয়ে গেছে জন মানুষ। ‘ঠিক আছে, সিনেটর, এবার আমাকে নিজের কাজে যেতে হবে। আমারই তৈরি এক এতিমখানায় যাওয়া জরুরি। আগামীকাল ওখানে ভলিবল ফাইনাল। বাচ্চাদের মন তো আর ভেঙে দিতে পারি না।’

সিনেটর কিছু বলার আগেই ঘুরে বলরুমের দিকে চলল ওয়েস্টন। পেছন থেকে তার দিকে চেয়ে রইল জাস্টিন পিটার। ভাবছে: ইঁদুরের মত খুদে এক লোক কী করে এত হারামি হয়? বাচ্চাদের নিয়ে যে কুকীর্তি করে চলেছে, সেটা আসলেই অকল্পনীয়। নিজে এসবে জড়িয়ে গেছে বলে মনে মনে ভাগ্যকে গালি দিল সিনেটর। ভাল করেই বুঝতে পারছে, একবার সব জেনে গেলে তাকে আর প্রাণে বাঁচতে দেবে না মাসুদ রানা।

.

বলরুমের মেইন ডোর পেরিয়ে করিডর ধরে হোটেলের লবির দিকে চলেছে রানা। দু’পাশে ছোট কিছু মিটিং রুম। ওগুলো পেছনে ফেলে কারুকাজ করা বিলাসবহুল বিশাল লবিতে এসে ঢুকল রানা। মস্ত এই ঘরের সিলিং তিনতলা উঁচু। কয়েকতলা বারান্দার একদিকে কাঁচের তৈরি দেয়াল। ওদিক দিয়ে উঠছে- নামছে একাধিক এলিভেটর। লবির মাঝে প্রকাণ্ড ফোয়ারা। এলিভেটরের উল্টোদিকে দীর্ঘ কাউন্টারে অতিথিদের চেক-ইন আর চেক-আউটের জন্যে বসে আছে কয়েকজন ক্লার্ক।

কাউন্টারের শেষমাথায় সিকিউরিটি অফিস।

ফোয়ারের কাছে যেতেই সিকিউরিটি অফিস থেকে হন্তদন্ত হয়ে সুঠামদেহের তিনজন লোককে বেরোতে দেখল রানা। তাদের একজনের পরনে স্যুট, অন্যদের গায়ে রেন্ট- এ-কপ ইউনিফর্ম। লবির এদিকে-ওদিকে দেখছে তারা।

রানা বুঝে গেল, ওকেই খুঁজছে এরা।

অতিথিদের চেক-ইন আর চেক-আউটের জন্যে বেশ ব্যস্ত লবি। তার ওপরে ফাও রেইয়িং ডিনারের অতিথিরাও অনেকে চলে এসেছে এদিকে। কোথাও না থেমে ফোয়ারা ঘুরে সোজা সিঁড়ির দিকে চলল রানা। আকাশ-ছোঁয়া উঁচু সর হোটেলে সিঁড়িতে কখনও ভিড় থাকে না, তাই নিচের বেসমেন্টের গ্যারাজে নেমে যেতে পারবে বলে ভাবছে রানা। ওখান থেকে পায়ে হেঁটে সদর রাস্তায় গিয়ে উঠবে। আবার এসে ঢুকবে হোটেলের পার্কিংলটে, গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে যাবে।

সিনেটর পিটারকে সৎ লোক বলে মনে হয়নি ওর। একই কথা খাটে পিট ব্ল্যাকের ব্যাপারে। এদের ব্যাপারে কি আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল, নিজেকে জিজ্ঞেস করল রানা। মন থেকে কোন জবাব পেল না।

স্টেয়ারওয়েলের দরজায় পৌঁছে একবার কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল রানা। বুঝে গেল, ওকে দেখতে পায়নি সিকিউরিটির লোক। সুইং ডোর খুলে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল আণ্ডারগ্রাউণ্ড গ্যারাজের দিকে। কিন্তু নিচতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে দু’জন লোক, পরনে হোটেল সিকিউরিটি গার্ডের পোশাক। বোধহয় চলেছে লবিতে। উৎকণ্ঠার ছাপ তাদের চেহারায়। হোলস্টারে রাখা পিস্তলের বাঁটের কাছে ঝুলছে ডানহাত। চারপাশে তাকাচ্ছে সন্দেহ নিয়ে।

‘এদিকে কী হয়েছে?’ নিরীহ সুরে জানতে চাইল রানা। ‘হোটেলে ডাকাত পড়েছে?’

‘আর এক পা-ও নড়বেন না, ওখানেই দাঁড়ান!’ ওকে নেমে আসতে দেখে বলল বামের সিকিউরিটি গার্ড। ‘আমাদেরকে বলা হয়েছে সিনেটরের কাছ থেকে টাকা-পয়সা ছিনতাই করতে চেয়েছে এক লোক। আর যে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, সেটা পুরো মিলে যাচ্ছে আপনার সঙ্গে!’

দুঃখিত চেহারায় মাথা নাড়ল রানা। ‘সরি, আপনারা কী বলছেন সেটা বুঝলাম না। মিটিং করব বলে তাড়া আছে। আপনারা অন্য কাউকে খুঁজছেন।’

আবারও সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল রানা।

হাতের ইশারায় ওকে থামতে বলল ডানের সিকিউরিটি গার্ড। ‘আপনি আপাতত কোথাও যাচ্ছেন না। আমাদের আগে জানতে হবে আপনি সেই ছিনতাইকারী কি না। আমাদের সঙ্গে সিকিউরিটি অফিসে আসুন। তারপর দেখব কে আসলে কী।’ কথা শেষ করেই কোমরের হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করতে গেল সে।

‘গার্ডস্, আপনাদের বড় কোন ভুল হচ্ছে,’ দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে বলল রানা। পরক্ষণে সাঁই করে কাছের লোকটার ঘাড়ে নামল ওর ডানহাতের তালুর একপাশ।

ব্যথায় কাতরে উঠে হাঁটু গেড়ে সিঁড়ির ধাপে বসে পড়ল লোকটা। অবশ্য হ্যাঁচকা টানে বের করেছে হোলস্টার থেকে পিস্তল। রানার জোর লাথি খেয়ে লোকটার হাত থেকে উড়ে গেল অস্ত্র। ঠং-ঠনাৎ শব্দে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল বেসমেন্টে ওদিকে ঘুরেই দ্বিতীয় গার্ডের কোমরে কষে একটা লাথি বসিয়ে দিয়েছে রানা। হোঁচট খেয়ে সঙ্গীর ওপরে পড়ল সিকিউরিটি গার্ড। সিঁড়ির ধাপে গড়াতে শুরু করে নিচের গ্যারাজের মেঝেতে গিয়ে থামল ‘দু’জনের দেহ। রানার মনে হলো, এবার ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াবে লোকগুলো। সুতরাং ওর আর উপায় নেই যে বেসমেন্ট দিয়ে বেরোবে।

ল্যাণ্ডিঙে থেমে সামনের করিডর ধরে তীরবেগে ছুট দিল রানা। করিডরের শেষমাথায় ধাতব বন্ধ দরজা। হ্যাণ্ডেল মুচড়ে বুঝতে পারল যে ওটা তালা বদ্ধ নয়। ধীরে ধীরে কবাট সামান্য খুলল রানা। ওদিকের ঘর হোটেলের কিচেনের গুদাম। দেয়ালের পাশের র‍্যাকে খাবারের ভারী কন্টেইনার। ঘরের অন্যদিকে বিশাল এক দরজা। ওপাশে বোধহয় কিচেন। আপাতত কেউ নেই গুদামঘরে।

দরজা পার হয়ে গুদামের শেষমাথায় চলে এল রানা। নির্বিকার চেহারায় দরজা খুলে ঢুকে পড়ল বিশাল কিচেনের ভেতরে। না থেমে হনহন করে হেঁটে চলল অন্যদিকের দরজা লক্ষ্য করে। কিচেনে ব্যস্ত চারজন বাবুর্চি। অবশ্য কারও মাথায় শেফের টুপি নেই। সবার পরনে সাদা পোশাক। একজনের হাতে ভয়ঙ্কর চেহারার এক কাটারী।

পাশ কাটাবার আগে বাবুর্চিদের দিকে চেয়ে আন্তরিক হাসি দিল রানা। ‘হেলথ ইন্সপেকশন। তোমরা কাজ করো। ভয়ের কিছু নেই।’

কয়েক পা সরে রানার পথরুদ্ধ করল কাটারী হাতে বাবুর্চি। ‘এসব চাপা মেরে কোন লাভ হবে না। মাঝরাতে আবার কীসের হেলথ ইন্সপেকশন? তেড়িবেড়ি না করে বলে ফেলো কেন কিচেনে এসে ঢুকেছ!’

‘শর্টকাট নেয়ার জন্যে কিচেনটা ব্যবহার করছি,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। চেহারায় এখন হাসি-হাসি ভাবটা নেই। ‘নিজের ভাল চাইলে পথ ছেড়ে দাও।’

ওর কথায় রেগে গিয়ে চোখ গরম করল রাঁধুনি। ‘তুমি হচ্ছ সে-লোক, যাকে খুঁজছে সিকিউরিটির সবাই!’ এক সহকর্মীর দিকে তাকাল সে। ‘সিকিউরিটির লোক ডাকো তো, ন্যাব! আমি ততক্ষণ একে আটকে রাখছি!’ কাটারী নাচিয়ে রানার দিকে তাকাল সে। ‘খবরদার! আর এক পা-ও নড়বে না!’

‘ও, তুমি ঝামেলা করতে চাও?’ অর্ধেক ঘুরে কাঁধ ঝাঁকাল রানা, পরক্ষণে বাবুর্চি কিছু বোঝার আগেই তার কাটারীর ওপর দিয়ে গেল ওর ডানহাতের মুঠো।

নাকে প্রচণ্ড এক ঘুষি খেয়ে পিছিয়ে চকচকে মেঝেতে ছিটকে পড়ল রাঁধুনি। হাত থেকে খসে গেছে কাটারী। ঝনঝন শব্দে দূরে সরে গেল ওটা।

ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল অন্য বাবুর্চিরা। কারও মনে সন্দেহ নেই, এই খুনি লোকটা এসেছে স্রেফ নরক থেকে!

কিচেন থেকে বেরোবার প্রধান দরজার দিকে চলল রানা, জানে না ওদিকে কী আছে। চওড়া কবাট খুলে সামনে দেখতে পেল আবছা আলোর এক করিডর। একবার পেছনে তাকাল রানা। ভাল করেই বুঝে গেছে, কিচেনের রাঁধুনিরা এখন হন্যে হয়ে ডাকছে সিকিউরিটির লোক। এদিকে নিশ্চয়ই সিঁড়ি থেকে গ্যারাজে পড়া সিকিউরিটির দুই লোক সামলে নিয়েছে নিজেদেরকে। লবিতে বোধহয় ওকে খুঁজছে তাদের দলের অন্যরা। কাজেই ওর হাতে বাড়তি এক সেকেণ্ডও নেই!

করিডর শেষ হলো সরু এক গলিতে। ওটার একদিকের দেয়ালের পাশে বড় দুটো গার্বেজ ক্যান। আপাতত কেউ নেই এদিকে। গলির দু’দিকে সরকারি রাস্তা। দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে একের পর এক গাড়ি।

হঠাৎ করেই গলিতে ঢুকে সরাসরি রানার দিকে এল একটা গাড়ি। চালক বোধহয় চাপা দিতে চাইছে ওকে!

হেডলাইটের জোর আলোয় দিন হয়ে গেছে গলির ভেতরে। হোলস্টার থেকে নিয়ে উইণ্ডশিল্ড লক্ষ্য করে বেরেটা তাক করল রানা। অবশ্য গুলি করার আগেই কড়া ব্রেক কষে রাবার পুড়িয়ে ওর পাঁচ ফুট দূরে থামল গাড়িটা। ঝট করে খুলে গেল ড্রাইভিং দরজা। কে যেন বলে উঠল, ‘রানা! জলদি! গাড়িতে ওঠো!’

তেরো

‘রানা, কুইক!’ আবারও গাড়ি থেকে এল নারীকণ্ঠ।

লিউনা গার্ডনার!

কেন যেন রানার মনে হয়েছিল, আবারও মেয়েটার সঙ্গে দেখা হবে। দ্রুত পায়ে টয়োটা করোলা গাড়ির ড্রাইভিং দরজার পাশে চলে গেল ও। ‘তুমি পাশের সিটে সরে বোসো।’

এক সেকেণ্ডের জন্যে ওর মনে হলো, প্রতিবাদ করবে লিউনা। কিন্তু সেটা না করে গাড়ির কন্ট্রোল কন্সোল পার হয়ে চলে গেল প্যাসেঞ্জার সিটে। চট্ করে ড্রাইভিং সিটে উঠে ধুপ শব্দে দরজা আটকে নিল রানা। গিয়ার ফেলে মেঝের সঙ্গে চেপে ধরল অ্যাক্সেলারেটর। চাকা পিছলে তীরবেগে ছুটল গাড়িটা। গার্বেজ ক্যান পেছনে ফেলে চলে এল গলির মুখে। চলমান গাড়ির স্রোতে ফাঁকা এক জায়গা দেখে সেখানে ঢুকে পড়ল রানা। ব্রেক করতে হয়েছে বলে হর্ন দিল পেছনের গাড়ির বিরক্ত ড্রাইভার।

ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের আবছা আলোয় লিউনা গার্ডনারের দিকে তাকাল রানা। গম্ভীর মুখে বসে আছে মেয়েটা। ‘তুমি জানলে কী করে যে আমি হোটেলে আছি?’ জানতে চাইল রানা।

‘তোমার জন্যে ওখানে যাইনি। তবে ফোক্সভাগেন গাড়ি নিয়ে তোমাকে হোটেলের পার্কিংলটে ঢুকতে দেখেছি। আগে থেকেই চোখ রেখেছি চ্যারিটি ডিনারের আয়োজক সিনেটর পিটার আর আরেকজনের ওপরে।’

‘আবারও তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে ভাল লাগছে, লিউনা,’ মৃদু হাসল রানা।

‘আজই আমার প্রাণরক্ষা করেছ। সে ঋণ শোধ করে দিতে পেরে আমারও ভাল লাগছে।’ রানার দিকে চেয়ে মিষ্টি হাসল মেয়েটা। ‘দেখলাম তুমি গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে ঢুকলে। পরে বলরুম থেকে বেরিয়ে দেখি তোমার গাড়ির দরজার লক খোলা। আর তখনই প্রথম টের পেলাম, তোমাকে খুঁজতে শুরু করেছে হোটেলের সিকিউরিটির লোকেরা। তাই দেরি না করে ফোক্সভাগেন থেকে তোমার দরকারি জিনিসপত্র, গায়ের কাপড়চোপড় আর বিরাট পিস্তলটা আমার গাড়ির পেছনের সিটে এনে রেখেছি তারপর সময় নষ্ট না করে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছি সরু সেই গলিতে। গাড়ি রেখে তোমাকে খুঁজতে যাব, এমনসময় হাজির হলে তুমি।’

চট করে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনের সিটে চোখ বোলাল রানা। ওর দরকারি সবই ওখানে দেখে অবাক হয়েছে।

সামনে হালকা হয়ে গেছে গাড়ির ভিড়। পুবে চলল রানা। একটু পর পড়ল আইযেনহাওয়ার এক্সপ্রেসওয়েতে। এরই ভেতরে স্থির করেছে, আপাতত ড্রাইভ করবে উদ্দেশ্যহীনভাবে। তারই ফাঁকে জেনে নেবে মেয়েটার কাছ থেকে কিছু তথ্য।

‘এবার বলো, লিউনা, কেন সিনেটর পিটারের ওপরে চোখ রেখেছিলে? আগেই বলেছ, তার গাড়িতে হোমিং ডিভাইস প্ল্যান্ট করতে হেলথ সেন্টারে গিয়েছিলে। কিন্তু সেটা করলে কেন? আমার মনে হচ্ছে তোমার লিউনা নামটা হয়তো নকল। আমি কি সঠিক ভেবেছি?’

‘না, এটাই আমার আসল নাম। তোমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর যখন নিজের নাম বললে, ওটা মনে রেখেছি। পরে ইণ্টারনেট ঘেঁটে দেখেছি তোমার ব্যাপারে। তুমি রানা এজেন্সির চিফ। সত্যিকারের এক অ্যাডভেঞ্চারার। পাহাড়ে, মরুভূমিতে, সাগরে হারিয়ে যাওয়া বহু মানুষকে উদ্ধার করে এনেছ। আর তাই তোমাকে নিজের ব্যাপারে বলতে কোন দ্বিধা নেই আমার। …হোটেলে জন ওয়েস্টন নামের এক লোক ছিল। তাকে কি তুমি দেখেছ?’

মাথা দোলাল রানা। মনে পড়েছে বয়স্ক চাচা টাইপের লাজুক চেহারার লোকটাকে। ‘পডিয়ামের কাছের এক টেবিলে ছিল। পরে সিনেটরের অনুরোধে মাইকে কথা বলে। তার ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছে তুমি?’

‘শিশু কিডন্যাপিঙের সঙ্গে সে জড়িত, উইণ্ডশিল্ড ভেদ করে দূরের বাতির দিকে তাকাল লিউনা। ‘কীভাবে জড়িত, এখনও জানি না। তবে এতে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই।’

‘একটু খুলে বলবে?’ নরম সুরে বলল রানা।

‘চার মাস আগের কথা। কাজ করতাম ওয়েস্টনের এক ডে-কেয়ার সেন্টার-এ। ম্যানেজার ছিলাম।’

গাড়ির জানালা সামান্য খুলল রানা। হু-হু করে ভেতরে ঢুকল শীতল হাওয়া। তাতে ভাল লাগল ওর।

‘চার মাস আগে কী হয়েছিল?’

জবাব দেয়ার আগে দ্বিধা করল লিউনা, তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘একই দিনে সেন্টার থেকে চুরি হলো তিনটে বাচ্চা। আমি হতবাক হয়ে গেলাম। ভেবে পেলাম না যে ওদের অভিভাবকদেরকে কী জবাব দেব।’

‘ঠিক কী হয়েছিল সে-দিন?’ জানতে চাইল রানা।

দূরে চেয়ে রইল লিউনা। কথা বলার আগে গুছিয়ে নিচ্ছে সব। ‘বাচ্চারা সে-দিন দুপুরের খাবার খেয়ে শুয়ে পড়েছিল। ম্যানেজার হলেও লোকবলের অভাবে চোখ রাখছিলাম ওদের ওপরে। জ্বর ছিল বলে আসেনি দু’জন বেবি সিটার। সেন্টারে তখন বড়মানুষ বলতে শুধু আমি। দুপুরের শেষদিকে ফোন এল অফিসে। ক্রিংক্রিং আওয়াজে বাচ্চাদের ঘর ছেড়ে গিয়ে ঢুকলাম ওখানে। ফোন করেছিল জন ওয়েস্টন। তাকে জানালাম সেন্টারে এখন বাচ্চাদের দেখাশোনার জন্যে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। কথা শুনে লোকটা বলল, তা হলে যেন দেরি না করে বাচ্চাদের ঘরে ফিরে যাই। পরে ফোন করবে সে। অফিস থেকে বেরিয়ে ঢুকলাম বাচ্চাদের ঘরে। আর তখনই বুঝতে পারলাম যে ঘর থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে দুটো ছেলে আর একটা মেয়ে। ওদের বয়স বড়জোর চার বা পাঁচ।’ শেষদিকে কথা বলতে গিয়ে ভেঙে গেছে লিউনার কণ্ঠস্বর।

‘বাচ্চাদেরকে ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞেস করলাম অন্যরা কোথায়। তবে ওরা কিছু বলতে পারল না। যে বা যারা এসেছিল, তারা ভাল করেই জানত কখন বাচ্চা তিনটেকে তুলে নিয়ে যেতে পারবে। আরও খারাপ দিক হচ্ছে, জন ওয়েস্টনের অন্যান্য ডে-কেয়ার সেন্টার থেকে আগেও বাচ্চা চুরি হয়েছে। ওই একই দল এসব করেছে।’

লিউনার কথা শুনে শীতল অনুভূতি হচ্ছে রানার বুকের ভেতরে। ‘তারপর কী হলো?’

‘পুলিশে খবর দিলাম। কিন্তু তাদের সব সন্দেহ এসে পড়ল আমার ওপরে। খবর পেয়ে হাজির হলো জন ওয়েস্টন। তারও ধারণা: এসবে হাত আছে আমার। অবশ্য নরম সুরে বলল: সেন্টারে যা ঘটে গেছে, তারপর বাধ্য হয়ে আমাকে চাকরি থেকে বের না করে দিয়ে তার আর কোন উপায় নেই, নইলে অভিভাবকেরা নিজেদের বাচ্চাদেরকে অন্য কোন ডে-কেয়ার সেন্টারে ভর্তি করাবে। সত্যি কথাই বলেছে সে। দৈনিক পত্রিকায় কিডন্যাপ হয়ে যাওয়া তিনটে বাচ্চার ছবির সঙ্গে ছাপা হলো আমার হাফ পেজ ছবি। বিশাল আর্টিকেল করল কয়েকটা সংবাদপত্র। লাইভ প্রোগ্রাম হলো টিভি চ্যানেলে। কোথাও মুখ দেখাবার উপায় থাকল না আমার। বুঝে গেলাম এই রাজ্যের কোথাও কোন চাকরি আর পাব না।’

নীরবে কাঁদতে শুরু করেছে মেয়েটা।

ওকে সান্ত্বনা দিল না রানা। বুঝতে পারছে, এখন প্রতিটি সেকেণ্ড খুব জরুরি। ‘তুমি কীভাবে জানলে যে জন ওয়েস্টনের অন্য ডে-কেয়ার সেন্টার থেকে আগেও বাচ্চা চুরি করা হয়েছে?’

হাত তুলে চোখ মুছল লিউনা। ‘কয়েক বছর ধরে ডে- কেয়ার সেন্টারে কাজ করেছি। তাই অনেককে চিনি। তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব জেনেছি। এদিকে কয়েক দিন আমার ওপরে চোখ রাখার পর হাল ছেড়ে দিল পুলিশের লোক। আর আমিও বুঝলাম, বাচ্চারা কিডন্যাপ হয়ে গেলেও তাদের তদন্ত করার কোন গরজ নেই। আর তখন থেকেই আমি নিজে তদন্ত করতে শুরু করেছি।

চুপ করে আছে রানা। বুঝে গেছে, নিজে থেকেই সব বলবে লিউনা।

‘প্রথমে চোখ রাখলাম জন ওয়েস্টনের ওপরে। জানি না কেন সেটা করলাম। অবশ্য আমার মনে হয়েছিল তার ভেতরে অস্বাভাবিক কিছু আছে। প্রথমেই লোকটার সম্পত্তির ব্যাপারে খোঁজ নিলাম হল অভ রেকর্ডস-এ। আর তখনই বুঝলাম, এত সম্পত্তির মালিক আসলে সে নয়।

ভুরু কুঁচকে ওকে দেখল রানা। ‘তা হলে মালিক কে?’

‘একটা করপোরেশন। আগে ওটার নাম শুনিনি। ফাইভ স্টার নামের সেই সংগঠনের চিঠি জমা হয় পোস্ট অফিসের এক মেইল-বক্সে। তদন্ত করতে গিয়ে সেই করপোরেশনের ব্যাপারে পেলাম বেশকিছু তথ্য। ওটার সঙ্গে সম্পর্ক আছে আণ্ডার-ওঅর্ল্ডের। আমার ধারণা করপোরেশনটা চালায় এক মাফিয়া দল। আর সেটার নেতা অ্যালডো রসি। এমনকী ওয়েস্টন যে বাড়িতে অফিস করে, ওটার মালিকও তারা। ডে-কেয়ার সেন্টার, এতিমখানা থেকে শুরু করে সবকিছুর মালিক আসলে মাফিয়ারা। এসব জেনে এখন তোমার ঠিক কী মনে হচ্ছে, রানা? ‘

‘অপরাধে নাক ডুবিয়ে দিয়েছে ওয়েস্টন,’ বলল রানা।

ঘন ঘন মাথা দোলাল লিউনা। শুধু তা-ই নয়, নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টার আর লাভজনক বেশকিছু ব্যবসায়িক সংস্থার মালিক এই ফাইভ স্টার করপোরেশন। ওটার বেশিরভাগ শেয়ারের মালিক অ্যালডো রসি। আর করপোরেশনের বোর্ডের কর্মকর্তাদের ভেতরে একজন হচ্ছে সিনেটর পিটার। আসলে সেজন্যেই তাকে অনুসরণ করে নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারে গিয়ে তার গাড়িতে হোমিং ডিভাইস রেখেছি।’

‘তুমি সঠিক কাজই করেছ,’ বলল রানা। ‘আমারও মনে হয়েছে যে সিনেটর পিটারকে নিজের পকেটে পুরে রেখেছে অ্যালডো রসি। হোটেলে লোকটা মিথ্যা বলেছে, ভাবছে ও। নিউ টাউন ফিটনেস সেন্টারের সাধারণ সদস্য নয় সিনেটর। অপরাধের কূপে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে সে। তাকে ভালভাবে জেরা করা উচিত। আজ হোটেলে সেটা করার মত সময় ওর হাতে ছিল না।

‘আরও তদন্ত করব সিনেটরের ব্যাপারে,’ বলল লিউনা, ‘তবে আগে জানতে হবে শিশু অপহরণের ঘটনার সঙ্গে কতটা জড়িত জন ওয়েস্টন। তাকে আইনের হাতে তুলে দিতে হলে আগে লাগবে শক্ত প্রমাণ।’

‘তুমি নিজে কিন্তু মস্ত বিপদে আছ,’ বলল রানা।

‘জানি। তবে কখনও জেনেবুঝে কোন পাপ করিনি। তাই অপরাধীদের শাস্তি দিতে গিয়ে যদি মরেই যাই, তো আফসোস করব না। এমনিতেই আমার জীবন নরক করে দিয়েছে এরা।

‘জন ওয়েস্টনের ব্যাপারে কী করতে চাও তুমি?’ জানতে চাইল রানা।

‘তার অফিস একটা এতিমখানায়,’ বলল লিউনা, ‘আগে একসময়ে সেখানে কাজ করেছি। বিশেষ করে কোন কর্মচারী অসুস্থ হলে বাড়তি ডিউটি দিতাম। আর পরে যখন ওয়েস্টন আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিল, এতিমখানায় ঢোকার একটা সাইড ডোর আর তার অফিসের দরজার চাবি ফেরত নিতে ভুলে গেছে। তাই ভাবছি আবারও একবার ঢুকব ওখানে।’

‘তুমি কি চাকরি চলে যাওয়ার পরেও লোকটার অফিসে গোপনে ঢুকেছ?’

মাথা দোলাল লিউনা। ‘জানি কাজটা ছিল খুব বিপজ্জনক। আমার দায়িত্বে থাকা শিশুদেরকে তুলে নিয়ে গেছে, সেটা ভাবতে গিয়ে প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করিনি। ওয়েস্টনের অফিস থেকে নিয়েছি অন্তত বিশটা ফাইল। আর সেগুলোতে চোখ বুলিয়ে বুঝেছি, শিকাগো থেকে চুরি করা হয়েছে শত শত শিশু। পরে আর তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। যদিও এসব ফাইল যে ওয়েস্টনের, সেটা প্রমাণ করতে পারব না।

আড়ষ্ট হয়ে গেছে রানার পেটের পেশি। সেটা ভয়ের জন্যে নয়। শীতল আগুন জ্বলে উঠেছে ওর বুকের ভেতরে। ‘বাচ্চাগুলোকে কোথায় সরিয়ে নেয়?’ জানতে চাইল রানা।

‘আমার জানা নেই। তবে গোটা অপারেশনের সঙ্গে জড়িত জন ওয়েস্টন। সেদিন জানত ডে-কেয়ার সেন্টারে আমি ছাড়া কর্মচারী বলতে অন্য কেউ নেই। অফিসে ফোন করে বাচ্চাদের ঘর থেকে আমাকে সরিয়ে নেয় সে। একই সময়ে তার লোক বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যায়। এতে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই।’

‘সহজেই কাজটা করতে পেরেছে,’ বলল রানা। লিউনার দিকে তাকাল। ‘বড় ধরনের অপারেশনে নেমেছে। তবে তুমি যখন সন্দেহ করলে, তখন পুলিশের কাছে গেলে না কেন?’

মাথা নাড়ল লিউনা। ‘নিজেই তো দেখলে ওয়েস্টনকে। আমি ছিলাম তার একজন কর্মচারী, যাকে দায়িত্বজ্ঞানহীনতার অভিযোগে চাকরি থেকে বের করে দিতে বাধ্য হয়েছে দয়ালু এক চাকরিদাতা। যে-কেউ বলত, চাকরি হারিয়ে তার পেছনে লেগেছি আমি। পুলিশের কাছে গেলে আমার একটা কথাও শুনত না। তা ছাড়া, বিপদ হলে সহজেই দরকারি সব ডকুমেন্ট তৈরি করে নিত ওয়েস্টন। তার কমপিউটারে বা ফিযিকাল ফাইলে কোথাও কোন ত্রুটি থাকত না। মাঝখান থেকে বোকা বনে যেতাম আমি পুলিশের কাছে।’

‘ওয়েস্টনের ফাইল হাতে পাওয়ার পর ভাবলে সিনেটর পিটারের ওপরে চোখ রাখবে,’ বলল রানা। ‘অর্থাৎ বদলে নিলে আক্রমণের অ্যাঙ্গেল।’

‘এ-ছাড়া উপায় ছিল না। ততক্ষণে বুঝেছি, খুঁজে নিতে হবে এই র‍্যাকেটের সবচেয়ে দুর্বল লোকটাকে। তার ব্যাপারে সংগ্রহ করতে হবে জোরাল প্রমাণ, নইলে আমার একটা কথাও শুনবে না পুলিশের লোক। এটাও আমি ভেবেছি, সিনেটরকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারলে অনেক কিছুই জানা যাবে।’

কথাটা শুনে মাথা নাড়ল রানা। ‘তার ধারে-কাছে যাওয়ার আগেই খুন হবে। তুমি আসলে না বুঝে নেমে পড়েছ খুব বিপজ্জনক এক খেলায়।’

ঘুরে ওকে দেখল লিউনা। ‘কিন্তু এটা তো স্বীকার করবে, এখন পর্যন্ত খারাপ করিনি?’

‘তা ঠিক।’ মৃদু হাসল রানা। ‘তবে এরপর হয়তো ভাগ্যের সহায়তা আর পাবে না।’

‘তুমি আসলে কী বলতে চাইছ?’

‘এরপর থেকে যা করার সেটা আমাকে করতে দাও।’

‘কী করবে তুমি?’ চোখে প্রশ্ন নিয়ে তাকাল লিউনা।

‘আমি ছিঁড়ে দেব এদের জাল,’ হিমশীতল শোনাল রানার কণ্ঠ। ‘এরই ভেতরে তুমি অনেক সাহায্য করেছ। অ্যালডো রসিকে খতম করতে গিয়ে তোমার সঙ্গে পরিচয়। আর তাতে চিনলাম ওয়েস্টন আর সিনেটরকে। এসব তথ্য আমার অনেক কাজে আসবে। এদের তিনজনের একজন মাফিয়া ডন, দ্বিতীয়জন নোংরা মনের রাজনীতিক আর তৃতীয়জন হচ্ছে শিশু অপহরণের সঙ্গে জড়িত এক পচে যাওয়া ব্যবসায়ী। তবে এখন যেহেতু চিনে গেছি, তাই এবার আমার কাজ হবে এদেরকে উপযুক্ত শাস্তি দেয়া।’

‘আমি হয়তো তোমার পাশে থেকে সাহায্য করতে পারব,’ অনেকটা অনুরোধের সুরেই বলল লিউনা।

‘এরই ভেতরে প্রিয় দু’জন মানুষকে চিরকালের জন্যে হারিয়ে বসেছি,’ বলল রানা। ‘তাই চাই না তুমিও খুন হও।’

‘এ-লড়াই তো আমারও, রানা!’ রেগে গিয়ে বলল লিউনা। থমথম করছে মুখ। ‘প্রথম থেকেই জানি বিপদটা কত বড়। তবে আমি তো আর এসব শুরু করিনি। যখন দেখলাম কিছুই করবে না পুলিশের লোকেরা, তখনও হাল ছেড়ে দিইনি। আর তুমি এখন চাইছ আমি যেন এ-লড়াই থেকে সরে যাই। কিন্তু আমি কেন সেটা মেনে নেব?’

লিউনার কথার ভেতরে দৃঢ়তা টের পেল রানা। এ-ও বুঝে গেল, অনুরোধ করলেও শুনবে না এই মেয়ে। কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ ভাবল রানা। ওর মনের ভেতরে কু ডাকছে: বড় কোন ক্ষতি হবে লিউনার! তবুও একবার বড় করে শ্বাস ফেলে বলল ও, ‘ঠিক আছে, একটা পর্যায় পর্যন্ত তুমি আমার সঙ্গে থাকবে। কিন্তু গোলাগুলি শুরু হলে নিরাপদ কোথাও লুকিয়ে পড়বে। এ-ব্যাপারে যদি কথা দাও, তো তোমাকে সঙ্গে রাখতে পারি।

‘তা-ই নাকি?’ টিটকারির সুরে বলল লিউনা।

‘হ্যাঁ, তা-ই। হয় এতে রাজি হবে, নইলে এখনই তোমার কাছ থেকে বিদায় নেব।

ওর গম্ভীর চেহারা দেখে লিউনা বুঝল, ওর দ্বিতীয় কোন অনুরোধ রাখবে না এই যুবক।

‘ঠিক আছে, রানা, তোমার কথাই রইল,’ নরম সুরে বলল লিউনা।

নীরবতা নামল গাড়ির ভেতরে।

রানা ভাবছে অপহৃত শিশুদের কথা। ওদের করুণ পরিণতি আর অসহায় বাবা-মার সীমাহীন কষ্টের কথা ভাবতে গিয়ে তিক্ত হয়ে গেছে অন্তর। তীব্র ঘৃণা বোধ করছে মাফিয়া ডন রসি, সিনেটর পিটার আর ব্যবসায়ী ওয়েস্টনের প্রতি। বিড়বিড় করে বলল, ‘নরকের পিশাচ! এই দুনিয়ায় এসে ক্ষতি করছে সমাজের!’

‘কিছু বললে?’ জানতে চাইল লিউনা।

‘আমার মাতৃভাষা, বাংলা,’ বলল রানা।

‘খুব মিষ্টি শোনাল! ইংরেজির মত খটমটে নয়।’

‘বাংলা ভাষার মাধুর্য হাজারগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ আর পল্লীকবি জসীম উদ্দীন।’

‘সত্যিই যদি কখনও সুযোগ হয়, একবার ঘুরে আসব তোমাদের দেশ থেকে।’

‘তুমি চাইলে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব,’ বলল রানা।

চুপ করে কী যেন ভাবতে লাগল লিউনা।

 আবারও নীরবতা নামল গাড়িতে।

জরুরি কিছু সূত্র পেয়েছি, ভাবছে রানা। এবার বদলা নেব স্নিগ্ধা আর তুষারের মৃত্যুর। খুঁজে বের করব অসহায় অপহৃত শিশুদেরকে। প্রথম সুযোগে চরম শাস্তি দেব অপরাধীদের। আজ রাতেই যাব কয়েক জায়গায়। তাতে হয়তো খুন হবে কিছু নরপশু। অথবা তাদের হাতেই শেষ হব। ঘটনা যা-ই হোক, কখনও নিজের দায়িত্ব থেকে পিছাব না।

মনের আয়নায় বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের কঠোর চেহারা দেখতে পেল রানা।

গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বস বললেন, ‘কাজ শেষে দেখা করবে। জরুরি কথা আছে।’

কট্টর বুড়োর কথা ভেবে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল রানা। ভাবছে, কতকাল স্যরকে দেখি না! এখনও কি আগের মত আমাকে ভালবাসেন? অন্যদের কাছে সে-ভালবাসা প্রকাশ হয়ে গেলে আগের মতই বিব্রত হন? ও নিজে দেশে না থাকলে উদ্বিগ্ন হয়ে সেই রাগ ঝেড়ে দেন এমনকী সোহানার ওপরেও?

আনমনে হাসল রানা। ওর বুকের কৃতজ্ঞতা দু’ফোঁটা অশ্রু হয়ে ঝরল চোখ থেকে। মনে মনে বলল: ‘এই মিশন থেকে ফিরলে প্রথম সুযোগে দেখা করব আপনার সঙ্গে, তখন যেন আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না, স্যর!’

চোদ্দ

চাকরি জীবনের শুরু থেকেই অফিসে বসে ডেস্ক-জব করতে বিরক্তি বোধ করত বার্কলে এবার্টন। বিশাল ঘরে হয়তো বাজছে রেডিয়োর গান, খটাখট আওয়াজে লেখা হচ্ছে কি বোর্ডে রিপোর্ট, অথবা আড্ডা জমিয়ে হৈ-চৈ করছে ক’জন অফিসার মিলে। সন্দেহভাজন কোন লোককে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে অফিসে। আসলেই কেমন যেন বাজে এক পরিবেশ বিরাজ করে পুলিশ হেডকোয়ার্টারে। আর আজকের এ-রাত আরও বিশ্রী। ক্যাপ্টেন ডিউটিতে ডেকে না নিলে এখন বাড়িতে স্ত্রীকে সময় দিত এবার্টন। ক’দিন পর জেনিফারের ফুসফুসে জটিল অপারেশন। মেডিকেল বোর্ড থেকে জানিয়ে দিয়েছে, ওর বাঁচার সম্ভাবনা পঞ্চাশ পার্সেন্ট।

অবশ্য বাড়িতে রয়ে গেলেও অস্বস্তি বোধ করত এবার্টন। আর সেজন্যে সম্পূর্ণভাবে দায়ী রানা এজেন্সির চিফ মাসুদ রানা। তার কারণে নড়েচড়ে গেছে শিকাগোর আণ্ডার-ওঅর্ল্ড ঘুষখোর পুলিশ অফিসারদেরকে চাপ দিচ্ছে বড় বড় সব অপরাধী: ‘জলদি গ্রেফতার করুন উন্মাদ মাসুদ রানাকে!’

অর্গানাইযড ক্রাইম টাস্ক ফোর্সের ক্যাপ্টেন রন হাওয়ার্ডকে খেপা কুকুরের মত কামড়ে দিতে চাইছে মেয়র গ্রেগরি বার্নস্টেবল। ফোন করছে প্রতি আধঘণ্টা পর পর।

মস্তবড় অফিসে চলছে চরম হৈ-চৈ আর হুলুস্থুল। তারই ভেতরে মাথা-ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে চাইছে এবার্টন। বাড়ি থেকে মাসুদ রানা’ বেরিয়ে যেতেই নীতিগতভাবে ওর উচিত ছিল পুলিশে যোগাযোগ করা। সেটা সে করেনি। নিজেকে এসবে জড়াতে না চাইলে অন্য কোন ফোন থেকেও খবর দিতে পারত হেডকোয়ার্টারে। একটা রুমাল দিয়ে রিসিভার চেপে ধরে কথা বললে কেউ বুঝত না কে কল করেছে। চাইলে দিতে পারত রানার পরনের পোশাক আর গাড়ির বর্ণনা। যদিও এতক্ষণে পোশাক বা গাড়ি পাল্টে নিয়েছে লোকটা ঝামেলা এড়াতে গিয়ে দূরের কোন থানাতেও ফোন করতে পারত এবার্টন। কোনভাবেই কেউ রানার বিষয়ে জড়াতে পারত না তাকে।

ফোঁস করে শ্বাস ফেলল এবার্টন। এসব কিছুই করেনি সে। আর তাতে বিপদ হবে তেমন সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। ইন্টারনাল অ্যাফেয়ারের কমিশনার বা এফবিআই এজেন্টরা মাসুদ রানাকে জেরা করলেও অনায়াসে নিজের দায় অস্বীকার করতে পারবে এবার্টন। কারও হাতে প্রমাণ নেই যে আইন ভেঙেছে সে। আসলে এ-ধরনের অনৈতিক কাজ করেছে স্রেফ জেনিফারের কথা ভেবে। প্রাণের চেয়েও বেশি স্ত্রীকে ভালবাসে সে। আমেরিকার আদালতের চরম ব্যর্থতা আর দুর্বলতার ব্যাপারে জেনিফারের মনোভাব জানে বলেই দ্বিধা করেনি আইনকে কাঁচকলা দেখাতে। একবার ডেস্ক থেকে মুখ তুলে স্কোয়াড রুমে চোখ বোলাল এবার্টন। একটু পর পর ফোন এলে ব্যস্ত হয়ে উঠছে অফিসারেরা। নানান রিপোর্ট আসছে মাসুদ রানার বিষয়ে। গোটা শিকাগো শহর যেন হয়ে গেছে যুদ্ধ এলাকা!

অবশ্য অর্গানাইড্ ক্রাইম ইউনিটের কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবে না, মাসুদ রানার হাতেই খুন হচ্ছে আণ্ডার- ওঅর্ল্ডের অপরাধীরা। অন্তর থেকে এবার্টন মেনে নিয়েছে, যোগ্য এই বাঙালি যুবক আসলেই যেন সত্যিকারের মৃত্যুদূত!

ডেস্কের ওপরের ড্রয়ার খুলে ওটার ভেতর থেকে এককৌটা অ্যান্টাসিড নিল সার্জেন্ট এবার্টন। ক্যাপ খুলে চারটা ট্যাবলেট নিয়ে মুখে ফেলে কুড়মুড় করে চিবিয়ে গিলে নিল। নদীর চরাঞ্চলের মত শুকিয়ে গেছে মুখ। লিনোনিয়াম মেঝের দিকে চেয়ে ভাবতে চাইল; এরপর কী করা উচিত তার? মুখ তুলে দেখতে পেল মুখোমুখি ডেস্কে বসে এদিকেই চেয়ে আছে তার পার্টনার শ্যন সিমন্স, চোখে কৌতূহল।

শ্যন সিমন্স বেঁটে ও মোটা ধরনের মানুষ। মাথার চুলগুলো সোনালি। মাত্র সাত বছর হলো চাকরিতে ঢুকেছে। বেশ কয়েক বছর ধরে একই সঙ্গে কাজ করেছে বলে সে বুঝে গেছে, বড় ধরনের কোন ঝামেলায় আছে সিনিয়র পার্টনার।

হাতের কাগজ ডেস্কে রেখে চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়াল শ্যন সিমন্স। ‘আমি কফি নেব, এবার্টন। আপনার জন্যে কি এক কাপ আনব?’

ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে মুখে আরেকটা অ্যান্টাসিড চালান দিল এবার্টন। ‘না, খালি পেটে কফি খেলে স্টমাক ওয়াল পুড়ে যাবে।’

‘ঠিক আছে,’ ঘুরে কফি মেশিনের দিকে চলল সিমন্স। ভাবছে, কোন না কোন কারণে খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছে এবার্টন। বড় এক ফাইল কেবিনেটের ওপরে আছে কফি মেকার। পাশেই স্টাইরোফোমের কাপ। একটা কাপ নিয়ে মেশিনের কলের নিচে ধরল সিমন্স। কলের ওপরে চাপ দিতেই কাপে এসে পড়তে লাগল কড়া কালো কফি। কাপ ভরে নিয়ে কল থেকে হাত সরিয়ে গরম কফিতে চুমুক দিল সে। চিনি বা কফিমেট নেই বলে ভীষণ তেতো লাগছে কফি। কুঁচকে গেল তার মুখ। পুলিশদের অফিসে সবসময় বাজে কফিই থাকে, বিরক্ত হয়ে ভাবল। পাকা সব অপরাধীকে ধরে এনে তাদের অপরাধের পরিমাণ বুঝতে পেরে এই কফির মতই তিক্ত হয়ে যায় ওদের সবার মন। বিশাল ঘরের অন্যদিকে দাঁড়িয়ে আবারও দেখতে পেল কানে মোবাইল ফোন ঠেকিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে এবার্টন। চুপ করে তার দিকে চেয়ে রইল সিমন্স।

খুব নার্ভাস দেখাচ্ছে সার্জেন্ট এবার্টনকে। নিচু গলায় কী যেন বুঝিয়ে বলছে ওদিকের লোকটাকে। কেউ শুনছে কি না, সেটা দেখার জন্যে মাঝে মাঝে তাকাচ্ছে এদিকে-ওদিকে।

যার সঙ্গে কথা বলছে, তার ফোন নাম্বার পেলে ভাল হতো, ভাবল সিমন্স। শার্টে যাতে ছলকে কফি না পড়ে, সেজন্যে সাবধানে ধরল আগুনের মত গরম কাপ। ব্যস্ত হয়ে ঘরের নানাদিকে ছুটছে অর্গানাইড্ ক্রাইমের অফিসারেরা। তাদেরকে এড়িয়ে সার্জেন্ট এবার্টনের ডেস্ক লক্ষ্য করে চলল সার্জেণ্ট সিমন্স।

তাকে ফিরতে দেখে ফোন কেটে দিল এবার্টন। তাতে মনে মনে রেগে গেল সিমন্স। তারা যেহেতু দু’জন পার্টনার, তাই এবার্টনের উচিত সবকিছু শেয়ার করা। বছরের পর বছর মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পরস্পরের প্রাণরক্ষা করেছে তারা। কাজেই পার্টনার সবসময় সততার সঙ্গে চলবে, স্বাভাবিকভাবেই সেটা দাবি করতে পারে অপর পার্টনার।

এবার্টন হয়তো ব্যক্তিগত বা সাংসারিক ঝামেলায় পড়েছে, ভাবল সিমন্স। তার জানা আছে এবার্টনের স্ত্রী অনেক দিন ধরেই অসুস্থ। আবারও হয়তো শুরু হয়েছে ফুসফুসের ব্যথা। অবশ্য সেটাই যদি হবে, তো হঠাৎ করে আজকে এবার্টনের মুখে অপরাধের ছাপ কেন? আবার গিয়ে নিজের চেয়ারে বসল সিমন্স। ‘রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে এই মাসুদ রানা, তা-ই না?’ আলাপ করার ইচ্ছে থেকে বলল সে। ‘তা-ই তো মনে হচ্ছে,’ বিরক্তির সুরে বলল এবার্টন। ‘লোকটা ভয়ঙ্কর একটা তুষার-ঝড়ের মত। আমরা তো তার কোন খোঁজই পাচ্ছি না! মাসুদ রানা যে আসলে খুনি, সেটাও জানি না। সে শিকাগো থেকে বিদায় হলে বাঁচতাম।’

‘এত সহজে যাবে না সে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল এবার্টন।

তীক্ষ্ণ চোখে তাকে দেখল সিমন্স। পরক্ষণে তাকাল মস্ত ঘরের অন্যদিকে। সেখানে টেলিফোন বেজে উঠতেই কল রিসিভ করেছে এক অফিসার। কয়েক সেকেণ্ড পর দেয়ালে ঝুলন্ত শিকাগো শহরের ম্যাপের মাঝে কয়েকটা পিন থেকে খানিক দূরে আরেক এলাকায় নতুন একটা পিন গুঁজল সে।

‘অন্তত এটা বলতে পারি, নিরীহ কারও ওপরে হামলা করছে না,’ বলল সিমন্স। এরা যারা খুন হচ্ছে, প্রত্যেকে সবাই পাকা কালপ্রিট।’

আবারও কৌটা থেকে নিয়ে দুটো অ্যান্টাসিড মুখে পুরল এবার্টন। ‘তা হয়তো ঠিক। কিন্তু তাতে কী? সে তো আর কোন আইন মেনে চলছে না।’

আগে কখনও এবার্টনকে এতটা অসহায় হতে দেখেনি সিমন্স। হঠাৎ করেই সে যেন হয়ে গেছে নিয়তিবাদী এক সাধু!

‘ইয়ে, এবার্টন, বলল সিমন্স, ‘আপনাকে যদি কোনকিছু বিব্রত করে থাকে, বা যদি কোন সমস্যায় পড়ে থাকেন, পার্টনার হিসেবে আমার সঙ্গে সে-বিষয়ে আলাপ করতে পারেন। অন্য কেউ জানবে না।’

বাতাসে হাত নাড়ল এবার্টন। ‘আমাকে নিয়ে ভেবো না, কিড। আসলে আমার খারাপ লাগছে, কোনভাবেই মাসুদ রানাকে হাতের মুঠোয় পাচ্ছি না আমরা। একটু আগে তুমি বললে, সে যেন ভয়ঙ্কর একটা তুষার-ঝড়ের মত। কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। সে আসলে প্রচণ্ড এক টাইফুন। ওটার গতিপথে পড়লে রেহাই নেই কারও। আমরা এ-ও জানি না যে এরপর কোথায় হামলা করবে সে। আর তাতে মানসিকভাবে অস্বস্তিতে পড়ে গেছি আমি।’

‘ঠিকই বলেছেন।’ মাথা দোলাল সার্জেন্ট সিমন্স। সহজ সুরে বলল, ‘একটু আগে যেন কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন?’ সরাসরি জানতে চাওয়াই বোধহয় ভাল, ভাবছে সে।

‘কথা বলেছি জেনিফারের সাথে,’ বলল এবার্টন, ‘বাড়েনি ওর ফুসফুসের ব্যথা। ওকে জানিয়ে দিয়েছি, আজকে হয়তো সারারাত অফিসে ডিউটি দিতে হবে।’

জবাবটা অযৌক্তিক নয়। সিমন্সের অবশ্য মনে হলো ডাহা মিথ্যা বলেছে ওর পার্টনার। স্ত্রীকে ফোন করেনি এবার্টন। আর সত্যি যদি স্ত্রীর কাছে কল দিয়ে থাকে, তা হলে কী বিষয়ে কথা হয়েছে তাদের ভেতরে?

ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্সের অফিসারের সঙ্গে এ-বিষয়ে কথা বলবে কি না ভাবতে শুরু করেছে সিমন্স। কিন্তু সত্যিই যদি অভিযোগ করে, সেক্ষেত্রে কী নালিশ করবে-আমার পার্টনার উদ্ভট আচরণ করছে?

দিনের পর দিন চাপের মুখে পড়ে বেশিরভাগ পুলিশ কোন না কোন সময়ে অস্বাভাবিক আচরণ করে, এটা নতুন কিছু নয়। শিকাগোর অপরাধীদেরকে একে একে শেষ করে দিচ্ছে ভয়ঙ্কর এক খুনি, আর সেটা পুলিশ অফিসার হিসেবে হজম করা খুব কঠিন কাজ। যে-কারণেই হোক অস্বাভাবিক আচরণ করছে এবার্টন। তবে তাতে ধরে নেয়ার কোন কারণ নেই যে, বেআইনি কোন কিছুর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সে।

এখন থেকে বিপজ্জনক মিশনে নিজের প্রাণরক্ষার ব্যাপারে এবার্টনের ওপরে আর ভরসা করব না, ভাবল সিমন্স। মানসিক কোন সমস্যা হয়েছে বলেই নিজের মনের ভেতরে ডুব দিয়েছে সে। আর সেটা ধীরে ধীরে হয়েছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে।

ভয়ঙ্কর এক খুনির আবির্ভাব হওয়ার পর, এখন বিপদে- আপদে হয়তো পার্টনারের সহায়তা পাব না, ভাবল সিমন্স। মনে মনে নিজেকে শোনাল: এখন থেকে আরও সতর্ক হও!

নরকের শহর – ১৫

পনেরো

অফিসের রেজিস্ট্রি খাতা থেকে চোখ তুলে ছোটভাইকে দেখল এলিসা রসি। ‘তুমি আসলে কী করতে চাও, অ্যালডি?’

‘এসব পুড়িয়ে দেবে? ভাবছ, তাতে আর কোন প্রমাণ থাকবে না?’ বলল অ্যালডো রসি।

‘তুমি হলে কী করতে?’ ভাইয়ের দিকে তাকাল এলিসা।

বোনের কথায় ইতস্তত করছে অ্যালডো।

ছোটভাইয়ের সুদর্শন চেহারা ফ্যাকাসে হতে দেখে একটু নরম হলো এলিসা রসি। বাবার কথা মনে পড়ল তার। প্রায় বাবার মতই দেখতে হয়েছে অ্যালডি। অবশ্য ওদের বাবার মত করে দলে শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারেনি সে। অ্যাড্রিয়ানোর মত হিংস্র আর আক্রমণাত্মকও নয়। আর সেজন্যেই প্রতিটি পদে ওকে আগলে রাখতে হয় এলিসার।

‘তুমি ভাবছ এ-বাড়িতে পুলিশ রেইড করবে?’ জানতে চাইল অ্যালডি।

‘ঝুঁকি নেব কেন?’ সোজাসাপ্টা জবাব দিল এলিসা। ‘পুলিশের কথা ভাবছি না। আমাদের আসল শত্রু হচ্ছে সেই হারামজাদা মাসুদ রানা।’

‘মাসুদ রানা?’ হাসল অ্যালডো। ‘তার কথা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলছে শিকাগোর সবাই!’

ছোটভাইকে একবার গরম চোখে দেখে নিয়ে বলল এলিসা রসি, ‘কখনও কখনও মনে হয় কোথায় আছে তোমার মগজ-মাথায়, নাকি পোঁদের ভেতরে! আগেই তো বলেছি আজ সন্ধ্যার পর এখানে রেইড দিয়েছে সে। আর তখন তুমি বাড়িতে থাকলে খুন হতে লোকটার হাতে।’

বড়বোনের ধমকে মেঝেতে চোখ নামাল অ্যালডো রসি। নিচু স্বরে বলল, ‘আমি দুঃখিত। আমার উচিত ছিল বাড়ির সিকিউরিটি দশগুণ বাড়িয়ে দেয়া।’

‘এরপর কী ঘটেছে ইয়ট ক্লাবে?’ বলল এলিসা। ‘ওখানেও হামলা করেছিল মাসুদ রানা, তা-ই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘এ-বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর পর ওখানে যায় সে। কিন্তু সেটা করল কেন? কারণ তুমি নিজেই এখানে সূত্র রেখে গেছ। যদিও ইয়টে তোমাকে খুঁজে পায়নি সে।’

‘এলিসা, তুমি তো জানো আমি কোথায় ছিলাম।’

মাথা দোলাল এলিসা। ‘তুমি মেরিনায় ফাঁদ পেতেছিলে। জানতে এ-বাড়ি থেকে তথ্য পেয়ে ওখানে যাবে সে। আর এ-ও জানতে, আমি আছি পিট ব্ল্যাকের সঙ্গে। অথচ সিকিউরিটি বাড়ানোর জন্যে কিছুই করোনি।’

আবারও মেঝে দেখল অ্যালডো রসি। ‘আমি আসলে ভাল করেই জানতাম তুমি নিজেকে রক্ষা করতে পারবে। বিপদ হলে হবে কুত্তার বাচ্চা মাসুদ রানার।’

‘পিট ব্ল্যাক মার খেয়ে ঘাবড়ে গেছে।

বাঁকা হাসল অ্যালডো। ‘কুত্তাটার মার খাওয়া জরুরি ছিল। মাসুদ রানা না মারলেও আমি ওকে ধরে পেটাতাম।’

ভাইয়ের কণ্ঠে ঈর্ষা আছে কি না বুঝতে গিয়ে কয়েক সেকেণ্ড নিল এলিসা রসি। না, তেমন কিছু নেই। নরম সুরে বলল, ‘দেখো, অ্যালডি, আমরা নানাধরনের ঝামেলায় পড়ে গেছি। এখন যদি সতর্ক না হই, আমাদের দলের ওপরে কুঠারের কোপ নামাবে মাসুদ রানা।’

‘আর সেজন্যেই তো উধাও করে দিচ্ছ সব প্রমাণ। অবশ্য কথা হচ্ছে… আজ রাতের শিপমেন্টের কী হবে?’

‘নিয়ম অনুযায়ী ঠিক সময়ে মাল পাচার হবে,’ সহজ সুরে বলল এলিসা। ‘এরই ভেতরে আমার সঙ্গে কথা বলেছে জন ওয়েস্টন। জায়গামত পৌঁছে গেছে শিপমেন্ট। যদিও আমার মনে হচ্ছে, আপাতত এ-ধরনের অপারেশন বন্ধ রাখা উচিত । অন্তত মাসুদ রানা এই শহর থেকে বিদায় না নেয়া পর্যন্ত।

চুপ করে মাথা দোলাল অ্যালডো রসি। কী যেন ভাবছে। একটু পর বলল, ‘যা খুশি করতে শুরু করেছে লোকটা। তবে সময়মত তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হবে। হেলথ সেন্টারে নিজের ভিযিটিং কার্ড রেখে গেছে। তাতে আমার ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। প্রথম সুযোগে আমার লোক খতম করে দেবে তাকে।’

‘আমি তার চোখে চোখ রেখে দেখেছি, অ্যালডি,’ বলল এলিসা রসি। ‘বুঝতে দেরি হয়নি যে আমাদেরকে লড়তে হবে হিমালয়ের মত বড় কিছুর বিরুদ্ধে। মাসুদ রানার ব্যাপারে আরও খোঁজ নিয়েছি-তার সঙ্গে যারা লড়তে গেছে, কেউ এখন আর বেঁচে নেই। তোমার উচিত হবে না তার মুখোমুখি হওয়া।’

‘আমার লোক তাকে দুনিয়াছাড়া করবে,’ রাগের ছাপ পড়ল অ্যালডোর মুখে। ‘তুমি আমাকে কী মনে করো, এলিস? আমি কি রাস্তার মস্তানের মত তার সঙ্গে গোলাগুলি করব?’

‘না, তা তুমি করবে না। কথাগুলো বলেছি, যাতে তুমি সতর্ক হও।’

ডেস্কের ওপরে ধুম করে ঘুষি মারল মাফিয়া ডন। ‘তুমি আসলে কী বলতে চাইছ? আমি কি কিছুই করব না?’

ছোটভাইয়ের দিকে চেয়ে হাসল এলিসা। অ্যালডির মতই একই প্রশ্ন করেছে সিনেটর পিটার। হোটেলে নাকি তাকে কোণঠাসা করেছিল মাসুদ রানা। পরে ফোন এল জন ওয়েস্টনের কাছ থেকে। চিন্তিত কণ্ঠে লোকটা জানাল, এবার দেরি না করে শেষ করতে হবে রাশ স্ট্রিটের কাজটা।

সবাই এখন চেয়ে আছে এলিসার মুখের দিকে।

ক্যান্সার আক্রান্ত অ্যাড্রিয়ানোর মুখের দিকে এভাবেই চেয়ে থাকত দলের সদস্যরা। গুরুতর রোগ নিয়েও অন্যান্য মাফিয়া দলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত অ্যাড্রিয়ানো রসি। ভয় লাগিয়ে দিত সবার বুকে। অবশ্য বুঝে গিয়েছিল যে আর বেশি দিন নেই সে। বেশিরভাগ সময় পাগলের মত চেঁচাত তীব্র ব্যথায়। তারই ফাঁকে মেয়েকে শেখাত, কীভাবে আড়ালে থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে মাফিয়া সদস্যদেরকে। আর সে- সময়ে সাইনবোর্ড হিসেবে অ্যালডোকে ব্যবহার করবে এলিসা।

কীভাবে নিজেদের পারিবারিক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে রাখবে, সেটা বাবার কাছ থেকে শিখে নিয়েছে সে। এরপরের ইতিহাস শুধু উন্নতির সোপানে ওঠার। এমনকী সিনেট থেকে তদন্ত করার সময়েও অন্যান্য মাফিয়া দলের হাত থেকে ওরা কেড়ে নিয়েছে লাভজনক সব ব্যবসা।

গতকাল পর্যন্ত তাদের প্রতিটি ব্যবসা ছিল এলিসার নিয়ন্ত্রণের ভেতরে। কিন্তু তারপর আজ সন্ধ্যায় হেলথ সেন্টারে হামলা করল মাসুদ রানা। নিজের বেডরুমে একটা প্যাডে ইয়ট ক্লাবের ঠিকানা লিখে রেখে তার সঙ্গে টক্কর দিতে চাইল বোকা অ্যালডি। এ-কাজে বড়বোনের অনুমতি নেয়নি সে। ক্রমেই হয়ে উঠছে বিদ্রোহী। ভাবছে নিজেই চালাতে পারবে পারিবারিক বিশাল সাম্রাজ্য। অথচ সত্যি কথা হচ্ছে, মাত্র কয়েক দিন অ্যালডির হাতে সব ছেড়ে দিলে, হেগেমুতে সব মাখিয়ে নেবে সে। অবশ্য সেটা হতে দেবে না এলিসা।

অন্তর থেকে বড়বোনকে ভালবাসে অ্যালডি। শ্রদ্ধা করে। এলিসা নরম সুরে বুঝিয়ে বললে, তার সময় লাগে না যুক্তি বুঝে নিতে। ‘ঠিক আছে, তো এবার শোনো আমরা কী করব,’ ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়াল এলিসা রসি।

তার চোখে চেয়ে রইল অ্যালডো। সে যে আপত্তি তুলবে, বুঝে গেছে এলিসা। দু’পা সামনে বেড়ে দু’হাত রাখল অ্যালডির দু’কাঁধে। সরাসরি তাকাল ভাইয়ের চোখে। ‘আগের প্ল্যান অনুযায়ী রওনা হবে আজকের শিপমেন্ট। তবে এরপর আমরা নষ্ট করব প্রতিটা প্রমাণ। ডুব দেব কিছু দিনের জন্যে।’

‘কিন্তু…’

ডানহাতের তর্জনী আলতো করে ভাইয়ের ঠোঁটে রাখল এলিসা। মাথা নেড়ে বলল, ‘আপত্তি কোরো না। আমি জানি কাজটা লাভজনক। তবে আপাতত আমাদের বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রমাণ ধ্বংস করে দিতে হবে। পরে অন্যান্য ব্যবসা থেকে এরচেয়ে ঢের বেশি মুনাফা তুলে নেব। আগে শিকাগো থেকে বিদায় হোক মাসুদ রানা। একটু আগেই তো তোমাকে বলেছি, কিছু দিনের জন্যে আড়ালে চলে যাচ্ছি আমরা।’

‘কী ধরনের প্রমাণ আমরা নষ্ট করব?’

‘যেমন ধরো, বাচ্চাদের অপহরণ করতে যাদের ব্যবহার করি, তাদের কাউকে কাউকে বিদায় করব দুনিয়া থেকে।’

‘যেমন জন ওয়েস্টন?’

‘ব্ল্যাকের কথাও ভুলো না,’ দ্বিধাহীনভাবে বলল এলিসা। কী করবে আগেই ভেবেছে। মাসুদ রানার সামনে কাপুরুষের মত ভেঙে পড়ার পর কোনভাবেই রেহাই দেয়া যাবে না নীল ছবির পরিচালককে।

‘আর রানার কী হবে?’ জানতে চাইল অ্যালডো রসি।

‘তার খোঁজে শিকাগোয় চিরুনি চালাবে পুলিশের লোক আর আমাদের ছেলেরা। তাকে পেলে সঙ্গে সঙ্গে খুন করবে। এদিকে আমাদের দু’জনকে পাহারা দেবে দলের ত্রিশজন গানম্যান। মাসুদ রানা জানে না, কোথা থেকে রওনা হবে বাচ্চাদের শিপমেন্ট। আজ রাতে একটু পর ওখানে যাব আমরা।’ ছোটভাইয়ের গালে হাত বোলাল এলিসা। ‘ভয় নেই, অ্যালডি। ওই লোক টোকাও দিতে পারবে না তোমার গায়ে।’

আশা করি সব বুঝেশুনে কাজে নেমেছ।’

এক পা বেড়ে ভাইয়ের মাথা নিজের কাঁধে নিল এলিসা। হাত বুলিয়ে দিল তার মাথা-ঘাড়ে। ভাল করেই জানে, এবার ওর সব কথা শুনবে ভাই। আধঘণ্টা আগে ফোন করে তাকে বাড়িতে ফিরতে বলেছে সে। তারপর তার নাম ভাঙিয়ে খুনিদের নির্দেশ দিয়েছে, অপ্রয়োজনীয় লোকগুলো যেন বিদায় নেয় পৃথিবী থেকে।

ষোলো

শিকাগোর দক্ষিণে মধ্যবিত্তদের এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে দ্য ফাদার’স অর্ফানেজ। প্রায় বিনা পয়সায় সরকারের কাছ থেকে লিয নেয়া হয়েছে গোটা একটা ব্লক। কম্পাউণ্ডের সামনে দীর্ঘ ‘এল’ শেপের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিল্ডিং। পেছনে চারটে ডরমিটরি। এ-ছাড়া পেছনে আছে জিমনেশিয়াম আর শিশুদের খেলার মাঠ।

এতিমখানার সাংগঠনিক দালানের উল্টোদিকে চওড়া রাস্তা। সেখানে লিউনার গাড়িটা রেখে চারপাশ দেখে নিল রানা। ওর মনে হলো না রাতের এ-সময়ে জেগে আছে বাচ্চা ছেলেমেয়েরা।

একতলা দালান ছাড়া অন্য কোথাও বাতি নেই। সামনের রিসেপশনের দুটো জানালা দিয়ে আসছে বৈদ্যুতিক আলো। পাহারা দেয়ার জন্যে ওখানে বোধহয় জেগে আছে এক বা একাধিক গার্ড। এ-ছাড়া দালানের অন্যদিকের এক জানালা ভেদ করে ঘাসে এসে পড়েছে সাদা নিয়ন বাতির আলো।

রানার পাশের সিটে বসে সরাসরি নিয়ন বাতির জানালার দিকে চেয়ে আছে লিউনা। নিচু গলায় বলল, ‘বেশিরভাগ সময় অনেক রাত পর্যন্ত জাগে ওয়েস্টন। ওটাই তার অফিস।’

‘তা হলে হয়তো আমাদের কপাল ভাল,’ গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করল রানা। ‘তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমার ফিরতে বেশিক্ষণ লাগবে না।’

স্কার্টের পকেট থেকে কী যেন নিয়ে রানার নাকের কাছে ধরল লিউনা। ‘এই যে চাবি। অন্য এক দরজা দিয়ে ঢুকতে হবে। আমার মনে হয় না নিজের এলাকায় বেআইনি কিছু করবে ওয়েস্টন। যত বড় অপরাধী হোক, সে চাইবে না এতিমখানা চালাবার আইনি বৈধতা হারিয়ে ফেলতে।’

মনে মনে কথাগুলো নেড়েচেড়ে দেখল রানা।

লিউনা বুদ্ধিমতী। নিজের কাজে নিবেদিতা

‘তুমি ঠিকই বলেছ,’ বলল রানা। ‘বেশ, এবারের মত আমার সঙ্গে এসো। তবে, প্লিয, খুব সতর্ক থাকবে।’

‘প্লিয’ কথাটা শুনে আস্তে করে রানার হাত ধরল লিউনা। দু’জনের কেউ স্বীকার করবে না, তবে এই স্পর্শের কারণে বিদ্যুতের মত এক তরঙ্গ যেন বয়ে গেছে ওদের দেহে।

‘তুমিও সাবধানে থেকো, রানা,’ ফিসফিস করল লিউনা। ‘অসহায় শিশুরা জানে না, তবে তোমাকে ওদের খুব দরকার। আমারও প্রয়োজন তোমাকে।’

আস্তে করে হাত সরিয়ে নিল লিউনা। গাড়ি থেকে নেমে পড়ল ওরা। বেশিক্ষণ লাগল না ছায়ার ভেতর দিয়ে গিয়ে দালানের দূরের এক দরজার সামনে গিয়ে থামতে আলোকিত রিসেপশনের দরজার উল্টোদিকে এই দরজা।

হোলস্টার থেকে বেরেটা বের করেছে রানা। সতর্ক চোখে দেখল চারপাশে। কোথাও কোনকিছু নড়ছে না। ওর মনে হলো না কোন গার্ড হঠাৎ করে এসে হামলে পড়বে ওদের ওপরে। নিজের কাছে রয়ে যাওয়া চাবি দিয়ে দরজা খুলল লিউনা। চট্ করে উঁকি দিল করিডরে। আশপাশে কোন গার্ড নেই। হাতের ইশারা করল রানাকে। ফিসফিস করে বলল, ‘এদিকে কেউ নেই।’

মেয়েটার পিছু নিয়ে দালানে ঢুকল রানা। কোন আওয়াজ না করে আটকে দিল দরজা। এই করিডর সোজা গিয়ে শেষ হয়েছে দালানের সামনে রিসেপশন রুমের কাছে। করিডরের দু’দিকে একের পর এক কবাট বন্ধ দরজা।

করিডর ধরে এগোল রানা ও লিউনা। রিসেপশন রুম থেকে করিডরের মেঝেতে এসে পড়েছে আলো। বোধহয় জেগে আছে নাইট গার্ড। মৃদু শব্দে মিউযিক শুনছে কেউ।

করিডরের শেষমাথায় পৌঁছে বামে বাঁক নিল রানা ও লিউনা। নতুন এই করিডরের মাঝে চওড়া এক দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে এল সাদা আলোর রেখা। নিঃশব্দে ওদিকে আঙুল তুলে দেখাল লিউনা। ওটাই ওয়েস্টনের অফিস।

দরজার সামনে গিয়ে থামল রানা। দেহের পাশে ঝুলিয়ে রেখেছে বেরেটা। বামহাতে আস্তে করে মোচড় দিল দরজার গোল নব-এ। ওটা লক করা নয়। নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে ঝড়ের বেগে অফিসে ঢুকল রানা। পেছনেই লিউনা।

অলাভজনক দাতব্য সংগঠনে যা হয়, অফিসে আসবাবপত্র নেই বললেই চলে। ধাতব ভারী ডেস্ক, খটখটে কয়েকটা চেয়ার আর স্টিলের দুটো কেবিনেট। ডেস্কের পেছনের চেয়ারে বসে ব্রিফকেসে কয়েকটা ফাইল ভরছে জন ওয়েস্টন। মুখ তুলে সরাসরি তাকাল রানা ও লিউনার দিকে। পিস্তল হাতে অচেনা যুবককে দেখে বিস্ফারিত হলো তার দু’চোখ। এরই ভেতরে চিনে গেছে লিউনাকে।

‘এসবের মানে কী?’ রাগী গলায় বলল সে। ‘মিস গার্ডনার, তুমি কিন্তু এরই ভেতরে অনেক ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে গেছ। দয়াবশত তোমাকে তুলে দিইনি পুলিশের হাতে।’ এবার রানাকে চিনল সে। এতই চমকে গেছে যে ফ্যাকাসে হলো তার চেহারা।

‘তুমি ভাল করেই জানো আমি কে,’ নিচু গলায় বলল রানা।

ওর পাশ থেকে বলল লিউনা, ‘মাসুদ রানাকে দেখলে যে-কেউ দ্বিতীয়বার মনে রাখবে, তা-ই না, মিস্টার ওয়েস্টন? এই ব্যাপারে আপনার কিছু বলার আছে?’

নার্ভাস হয়ে ঢোক গিলল লোকটা। ‘জানি না তুমি আসলে কী বলছ। কখনও দেখিনি এই লোককে। তবে তোমরা এখান থেকে বিদায় না হলে পুলিশ ডাকব। তারা এসে গ্রেফতার করবে তোমাদেরকে।’

‘বাজে কথা বাদ দাও, ওয়েস্টন,’ বলল রানা। ‘আমরা জানি, ডে-কেয়ার সেন্টার আর এতিমখানা থেকে শিশুদের চুরি করো তুমি। ওদেরকে তুলে দাও রসিদের হাতে। তারা তৈরি করে শিশু পর্নোগ্রাফি। লাখ লাখ ডলারে ব্ল্যাক মার্কেটে বিক্রি হয় অসহায় শিশুরা। এ-ছাড়া আরও কী করো, সেটা এবার খুলে বলবে তুমি।’

একবার রানা আরেকবার লিউনাকে দেখছে ওয়েস্টন। বারকয়েক ঢোক গিলল। কথা বলতে বড় করে হাঁ মেলল। তার বিকৃত চেহারা দেখে রানা বুঝে গেল, খুব ভয় পেয়েছে লোকটা। অবশ্য ওয়েস্টন কিছু বলার আগেই করিডরে ওরা শুনতে পেল পায়ের আওয়াজ। ঝট করে ঘুরে তাকাল রানা। চমকে উঠে ডেস্কের আরেক দিকে সরে গেছে লিউনা

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে ওয়েস্টন। একহাতে তার কাঁধ ধরে ডেস্কের পেছনের চেয়ারে তাকে ঠেলে ফেলল রানা। চাপা স্বরে বলল, ‘একদম নড়বে না!’ ডেস্কের পাশে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে তাকাল ও। ওভারকোটের পকেটে ঢুকে গেছে বেরেটা। ‘এটা মাথায় রেখো, তুমি খুন হলেও আমার কিছুই যায় আসে না।’

পদশব্দের মালিক হয়তো ঢুকবে না অফিসে। এদিকটা ঘুরে দেখে যাচ্ছে গার্ড। যদিও রানার মন বলছে, সামনে বড় ধরনের বিপদ!

ডেস্কের একদিকে ও, অন্যদিকে লিউনা। চেয়ারে পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে ওয়েস্টন। হঠাৎ করে অফিসের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে এসে পড়ল ছোট একটা জিনিস। করিডর থেকে দীর্ঘ দুটো হাত এসে টেনে আটকে দিল দরজা। লোকটার ছুটন্ত পদশব্দ করিডরে তৈরি করল প্রতিধ্বনি।

ডেস্কের ওপরে এসে পড়েছে মাঝারি আকারের কামরাঙ্গার মত আকৃতির গ্রেনেড। আরেক ড্রপ দিয়ে চলে গেল ঘরের কোণে। দেয়ালে বাড়ি খেয়ে আবার ফিরল দরজার দিকে।

রানা বুঝে গেছে ওটা ফ্র্যাগমেন্টেশন গ্রেনেড!

ওটা কী সেটা বুঝে গেছে ওয়েস্টন। চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দরজা লক্ষ্য করে ছুট দিল সে। এদিকে ডানহাত বাড়িয়ে খপ করে লিউনার জ্যাকেটের কলার ধরল রানা। পরক্ষণে গায়ের জোরে ওকে নিয়ে এল ডেস্কের এপাশে। মেঝেতে ফেলে দিয়ে নিজের শরীর দিয়ে ঢেকে দিল লিউনাকে।

পরের সেকেণ্ডে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড।

প্রচণ্ড শকওয়েভে চমকে গেল রানা। খটাখট শব্দে ডেস্কে এসে লাগল অজস্র শ্যাপনেল। কয়েক সেকেণ্ড পর মাথা তুলে এদিকে-ওদিকে তাকাল ও। ঝনঝন করছে ওর দু’কান। ভারী লোহার ডেস্কের দিকে চেয়ে বুঝে গেল, স্রেফ কপালের জোরে আজ বেঁচে গেছে ওরা। মৃত্যুবাহী শ্যাপনেল ভেদ করেনি ডেস্কের পুরু লোহার পাত। রানার ওজন গা থেকে সরাতে চাইছে লিউনা। ঘরে ভাসমান প্লাস্টারের মিহি ধুলোয় কাশতে শুরু করেছে মেয়েটা।

উঠে দাঁড়িয়ে ডেস্কের কিনারা একহাতে ধরল রানা। মুচড়ে ভেতরের দিকে চলে গেছে লোহার টেবিলের সামনের দিক। কেউ বুঝবে না ওটা একসময়ে ছিল কোন ডেস্ক। কপাল ভাল, মেঝের সঙ্গে বল্টু দিয়ে আটকানো ছিল, নইলে উল্টে পড়ে চ্যাপ্টা করে দিত ওদেরকে।

কপাল মন্দ ওয়েস্টনের। চার হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে আছে দরজার কাছে। অসংখ্য শ্যাপনেলের আঘাতে কিমা হয়ে গেছে তার দেহ। যে-কারও বুঝতে কষ্ট হবে, মাংস-চর্বি-রক্ত আর হাড়ের স্তূপটা একসময় একজন মানুষ ছিল।

প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজের পর চারপাশে নেমে এসেছে থমথমে নীরবতা। সেটা ভেঙে গেল শিশুদের হৈ- চৈয়ে।

হড়হড় করে বমির আওয়াজ পেল রানা।

উঠে দাঁড়িয়ে ওয়েস্টনের বীভৎস বিকৃত দেহের ওপরে চোখ পড়েছে লিউনার। এখন আবর্জনা ভরা রক্তাক্ত মেঝে ভাসিয়ে দিচ্ছে বমি করে। হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধ ধরল রানা। আশা করছে কেটে যাবে বেচারির শক। জরুরি সুরে বলল ও, ‘লিউনা, ডন রসির মৃত্যু-তালিকায় ছিল ওয়েস্টন। এবার এসো, দেরি না করে এখান থেকে চলে যেতে হবে!’

ধীরে ধীরে মাথা দোলাল লিউনা। ওয়েস্টনের লাশ থেকে চোখ তুলে তাকাল রানার দিকে। কিছুই যেন বুঝতে পারছে না। অবশ্য কয়েক সেকেণ্ড পর ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। কাঁধ থেকে রানার হাত সরিয়ে দিয়ে ছুট দিল দরজার দিকে। ‘বাচ্চারা! ওদেরকে বাঁচাতে হবে!’

এক দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল লিউনা।

ঘরে বিস্ফোরিত হয়েছে শক্তিশালী বোমা। মেঝেতে পড়ে আছে রক্তাক্ত লাশ। লিউনা যে শকের ভেতরে আছে, সেটা খুব অস্বাভাবিক নয়। আগেও বহু মানুষের ভেতরে এমন প্রতিক্রিয়া দেখেছে রানা।

ঘরে কয়েক সেকেণ্ড চোখ বুলিয়ে নিয়ে লিউনার খোঁজে করিডরে বেরোল ও। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওর ডানকানের পাশ দিয়ে গেল একটা বুলেট। বেরেটা হাতে থমকে দাঁড়াল রানা। করিডরের শেষমাথায় পিস্তল হাতে এক লোক। এক পা সামনে বাড়ল সে। একই সময়ে তাকে লক্ষ্য করে পর পর দু’বার গুলি পাঠাল রানা।

সরাসরি লোকটার বুকে বিঁধেছে বেরেটার দুই বুলেট। কয়েক পা পিছিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকাল আততায়ী। পরক্ষণে পিছলে মেঝেতে নেমে এল তার লাশ।

চারপাশে তাকাল রানা।

কোথাও নেই লিউনা!

বোমা বিস্ফোরণ আর গুলির শব্দে ভীষণ ভয় পেয়েছে শিশুরা। হৈ-চৈ করছে রিসেপশন রুমে। বড়দের কারও কথায় ওখানে জড় হয়েছে ওরা। দালানের বাইরে অটোমেটিক অস্ত্রের গুলির আওয়াজ। রিসেপশনে না ঢুকে একছুটে পাশের সেই দরজার কাছে চলে এল রানা। কবাট খুলে বেরোল রাতের আঁধারে। মাত্র কয়েক ফুট দূরে দেখতে পেল এক লোককে। এতিমখানার সরু রাস্তার ধারে পড়ে আছে সে। ছটফট করছে তীব্র ব্যথায়। একবার চারপাশ দেখে নিয়ে তার পাশে হাঁটু গেড়ে বসল রানা। জরুরি সুরে বলল, ‘গুলি কোথায় লেগেছে?’

লোকটার গলায় স্টেথোস্কোপ। পরনে সাদা অ্যাপ্রন। রানা বুঝে গেল, ইনিই এতিমখানার নিয়মিত ডাক্তার।

কালো ওভারকোট পরনে কঠোর চেহারার যুবককে দেখে ঘাবড়ে গেছে সে। যুবকের হাতে আবার পিস্তল!

‘মাফ করুন… বাচ্চাদের কোন ক্ষতি করবেন না! ওদের তো কোন দোষ নেই!’ কাতর সুরে অনুরোধ করল ডাক্তার।

‘আমি ওদের ক্ষতি করতে আসিনি,’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল রানা। ‘আপনার কোথায় গুলি লেগেছে?’

দাঁতে দাঁত চেপে বামপা দেখাল ডাক্তার। তার ঊরু বেয়ে দরদর করে ঝরছে রক্ত। ‘খুব ব্যথা! বিস্ফোরণের আওয়াজ পেয়ে বেরোতেই গুলি করল একজন। হাতে ছিল সাবমেশিন গান।’ আস্তে করে রানার বাহু ধরল সে। ‘আপনি কি তাদেরকে ঠেকাতে এসেছেন?’

‘হ্যাঁ।’

‘তো, স্যর, দেরি করবেন না! আমার কথা ভাববেন না! ওরা কয়েকটা বাচ্চাকে তুলে নিয়ে গেছে!’

তার কথায় উপলব্ধি করল রানা, ওয়েস্টনের এতিমখানা বা ডে-কেয়ার সেন্টারের বেশিরভাগ কর্মচারী নিরপরাধ। লিউনার কথা মনে পড়ল ওর। একটু পর হাজির হবে পুলিশ, তার আগেই ওকে নিয়ে সরে যেতে হবে।

মাত্র কয়েক মিনিট আগে এতিমখানা থেকে শিশুদের চুরি করেছে একদল বদমাশ। নিশ্চয়ই এরই ভেতরে বেশি দূরে যেতে পারেনি। ডাক্তারকে বলল ও, ‘ঠিক আছে, একটু পর সাহায্য পৌঁছুবে। আমি দেখছি কিডন্যাপারদের ধরতে পারি কি না।’ উঠে দালানের সামনের দিকে চলল রানা। ভাবছে, যে-কোন সময় দেখবে এতিমখানার কোন কর্মকর্তার লাশ।

রাস্তার দিক থেকে কোন গুলি এল না। দালানের কোনা ঘুরে রিসেপশনের কাছে ফিরল রানা। ঘরের ভেতরে আছে এতিমখানার আয়ারা ও কেয়ারটেকার। শিশুদের আগলে রেখেছে তারা। অবশ্য কৌতূহলী হয়ে রিসেপশনের খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সোনালি চুলের পিচ্চি এক মেয়ে। বয়স বড়জোর পাঁচ বছর। পরনে গেঞ্জি ও পায়জামা। হাতে তুবড়ে যাওয়া পুতুল। রিসেপশনে বড়দের কেউ খেয়াল করেনি অন্যদের সঙ্গে নেই পিচ্চি। রাস্তার দিকে চেয়ে আছে ও।

রানা গিয়ে সামনে থামলেই চকচকে চোখে ওকে দেখল মেয়েটা। নিচু গলায় জানতে চাইল, ‘আঙ্কেল, তুমি কি মিস লিউনার সঙ্গে এসেছ?’

হাঁটু গেড়ে পিচ্চির মুখোমুখি হলো রানা। ‘তুমি কি মিস লিউনাকে দেখেছ?’

ঘন ঘন মাথা দোলাল পিচ্চি। ‘আণ্টি যতবার এসেছেন, সবসময় আমার সঙ্গে লুকোচুরি খেলেছেন। কিন্তু আজকে রাতে আর খেললেন না। তাঁকে তো খেলতেই দিল না ওরা!’ বড় করে শ্বাস নিল রানা। ‘ওরা আন্টিকে কোথায় নিল?’

‘দূরে কোথাও। ওরা ভাল না।’ রাস্তার দিকে তাকাল পিচ্চি। ‘আণ্টি ফিরলে খেলতে পারতাম। আন্টিকে আমার খুব ভাল লাগে। তুমিও কি খারাপ লোকগুলোর একজন?’

মাথা নাড়ল রানা। ‘না তো, আমি বোধহয় অতটা খারাপ নই। তুমি আবার আমাকে ভয় পেয়ো না।’ পিচ্চির বাহু নরম হাতে ধরে রিসেপশন রুমের দরজার দিকে চলল রানা কবাটের সামনে থেমে বলল, ‘তুমি এখন ভেতরে চলে যাও। আজকে আর বেরিয়ো না।’

‘ঠিক আছে, আঙ্কেল।’ মাথা দুলিয়ে রাজি হলো পিচ্চি।

ঘুরে লন মাড়িয়ে লিউনার করোলার দিকে ছুটল রানা। গাড়িতে উঠে দেখল এখনও রিসেপশন থেকে বেরোয়নি কেউ। আবছাভাবে শুনল শিশুদের কণ্ঠস্বর। গ্রেনেড বিস্ফোরণের ফলে ওয়েস্টনের অফিসের ভাঙা জানালা দিয়ে ভকভক করে বেরোচ্ছে সাদা মিহি ধুলো।

তিক্ত হয়ে গেছে রানার মন। গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে ভাবল, এমন কোন সূত্র নেই যে বুঝব অপহৃত শিশু বা লিউনাকে কোথায় নিয়ে গেছে মাফিয়ার গুণ্ডারা।

পিচ্চি যেদিকে চেয়ে ছিল, সেদিকে তাকাল রানা। কী গাড়িতে করে এসেছে কিডন্যাপাররা, জানা নেই। তবে এটা নিশ্চিত, রসি পরিবারের হাতে বন্দি হয়েছে লিউনা। ওয়েস্টন খুন হওয়ার পেছনে আছে অ্যালডো রসি বা তার বড়বোন এলিসা রসি। নিজেদের সব অপরাধ আড়াল করতে গিয়ে সব ধরনের সূত্র নষ্ট করছে তারা, যাতে তাদের কাছে পৌঁছাতে না পারে রানা।

আরও অনেক জটিল হয়ে গেছে পরিস্থিতি।

অপহৃত শিশুদের লুকিয়ে রাখবে রসিরা, তারপর আজ রাতেই হয়তো পাচার করে দেবে। খুন হওয়ায় ওয়েস্টনকে নিয়ে আর ভাবতে হবে না। রয়ে গেল রসি পরিবার আর তাদের গুণ্ডারা। আরও আছে সিনেটর পিটার আর নীল ছবির পরিচালক ব্ল্যাক। হয়তো সার্জেন্ট এবার্টনের সঙ্গে আবার দেখা হবে ওর। এদিকে যেভাবে হোক খুঁজে নিতে হবে লিউনাকে।

এতিমখানা পেছনে ফেলে ঝোড়ো বেগে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল রানা। মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে পরের কাজগুলো।

সতেরো

ম্যাসেজ পার্লারের চারতলায় নিজের অফিসে বসে আছে রুবা। শুকিয়ে গেছে গলা। ধড়ফড় করছে বুক। বুঝে গেল যে কয়েক ঢোক উইস্কি এখন না নিলেই নয়।

সন্ধ্যার পর এখানে হামলা করেছে মাসুদ রানা। সে চলে যাওয়ার পর ভ্যাকিউম ক্লিনার দিয়ে কার্পেট থেকে তোলা হয়েছে ভাঙা কাঁচ। নিচতলা আর ওপরে রক্ত মুছিয়ে ভালভাবে চারপাশ পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছে রুবা।

এখন ফোলা থুতনি ও চোয়ালের টনটনে ব্যথায় ওর মনে হচ্ছে, আলগোছে মরে গেলেই বুঝি ভাল ছিল! তোয়ালের ভাঁজে বরফের খণ্ড রেখে শীতল সেঁক দিতে দিতে ভাবল: খুব জোরে ঘুষি মেরেছে মাসুদ রানা। অমানুষটা আস্ত একটা চামার, নইলে কোন যুবতী মেয়ের গায়ে হাত তোলে কেউ!

চেয়ার ছেড়ে র‍্যাকের কাছে গেল রুবা। ওখানে আছে গাজর, টমেটো আর আপেলের জুসের ক্যান। নিচের তাকে এক সারিতে মদের বোতল। মদ আসলে বিষ, ওসব খেলে শরীরের ক্ষতি হয়, তাই পারতপক্ষে ছুঁয়েও দেখে না রুবা। কিন্তু এখন ব্যথা কমাতে হলে ওটাই গিলতে হবে। তা ছাড়া, ওটা কাজে লাগবে পরাজয়ের গ্লানি সামাল দেয়ার জন্যে।

যতবার চোখ বুজছে রুবা, দেখতে পাচ্ছে গুলি করে সিম্পসনের মগজ উড়িয়ে দিচ্ছে মাসুদ রানা!

গ্লাসে টমেটোর জুস ঢেলে ওটার ভেতরে তিন পেগ উইস্কি মেশাল রুবা। ঢকঢক করে গিলল তরলটুকু। গলা পুড়িয়ে মদ নেমে যেতেই উত্তপ্ত হয়ে উঠল ওর বুক ও পেট। হাতের চেটো দিয়ে ঠোঁট মুছতে গিয়ে দেখল, আবারও দরজায় এসে থেমেছে অলক্ষুণে সেই মাসুদ রানা!

বিপদের মাত্রা বুঝে বুক কেঁপে গেল রুবার। ডেস্কের ড্রয়ারের ভেতরে একটা বাটন টিপে দিলে অ্যালার্ম বাজবে সিম্পসনের বার-এ। ওকে বাঁচাতে ছুটে আসবে দু’জন বারটেণ্ডার। অন্তত এতকাল তা-ই হয়েছে। কিন্তু আজকের পর বদলে গেছে সব।

দরজায় ভীষণ গম্ভীর চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে মাসুদ রানা। চোখে শীতল দৃষ্টি। পিস্তল বের না করলেও ওভারকোটের পকেটের কাছে ঝুলছে হাত। যখন-তখন বের করবে অস্ত্র।

এখন এমন কেউ নেই যে সাহায্য করবে রুবাকে। সিম্পসন খুন হওয়ায় বার বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশের লোক। ঘাড় ধরে বিদায় করেছে বারটেণ্ডারদেরকে।

নিজেকে মনে মনে বলল রুবা: ভয় পেলেও সেটা প্রকাশ কোরো না!

‘আবার কী চাও?’ কড়া গলায় বলল রুবা, ‘তোমার কারণে সর্বনাশ হয়ে গেছে আমার!’

‘পিট ব্ল্যাক এখন কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।

ব্যথা-ভরা চোয়াল ও থুতনি ডলল রুবা। ‘তুমি জাহান্নামে যাও!’

‘আমি ওকে বাঁচাতে এসেছি,’ বলল রানা।

‘হ্যাঁ। তুমিও বললে আর আমিও বিশ্বাস করলাম!’

‘জন ওয়েস্টন নামের কাউকে চিনতে?’

দু’সেকেণ্ড ভেবে নিয়ে মাথা নাড়ল রুবা। ‘তার কথা আগে শুনলেই বা কী? তুমি এখান থেকে বিদায় হও! যে জাহান্নাম থেকে এসেছ, সেখানে ফেরত যাও!’

‘যেখান থেকে এসেছি, এখন আর সেখানে যেতে পারব না,’ বলল রানা। ‘রুবা, ওয়েস্টন কিন্তু আমার হাতে খুন হয়নি। কাজটা করেছে অন্য কেউ।’

আরও তিক্ত হলো রুবার মন। ‘বিদায় হও আমার অফিস থেকে! দেখো, ব্ল্যাক সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না! শুধু এটা বলতে পারি, সে এখানে নেই। কোথায় যাবে সেটাও জানতে চাইনি। গায়ে পড়ে কিছু জানতে চাওয়া আমার অভ্যেস নয়।

‘কতক্ষণ আগে সে চলে গেছে?’

‘বেশিক্ষণ হবে না।’

‘মিথ্যা বললে, রুবা।’ মাথা নাড়ল রানা। ‘বিপদ হলেই সবসময় সিম্পসন আর তোমার কাছে আসে। এখন তুমি ছাড়া আর কারও কাছে গিয়ে লুকাতে পারবে না। ওকে খুন করার জন্যে খুঁজছে রসির লোকেরা।’

ঘরের প্রতিটি ইঞ্চি জহুরীর চোখে দেখছে রানা।

মনে আতঙ্ক নিয়ে নিজেকে বলল রুবা: এ বোধহয় সবই জানে!

‘রসিরা কেন ওকে খুন করাবে?’ জানতে চাইল রুবা। ‘রসিরা যখন জানবে যে ব্ল্যাককে লুকিয়ে রেখেছ, তখন দেরি করবে না তোমাকে খুন করতে, বলল গম্ভীর রানা। ‘আবর্জনা পরিষ্কার করছে ওরা। একঘণ্টা আগে খুন হয়েছে ওয়েস্টন। তাদের পরের টার্গেট পিট ব্ল্যাক।

পর্দা দেয়া এক ক্লসিট থেকে বেরিয়ে ধুপধাপ আওয়াজে ঘরের আরেক দরজার দিকে ছুটল এক লোক। এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল ক্লসিটের পর্দার ওদিকে।

ঘরে ঢুকে রুবাকে পাশ কাটিয়ে ঝড়ের গতি তুলল রানা। ব্ল্যাক ওদিকের দরজার কাছে যাওয়ার আগেই চেপে ধরল তার দু’কাঁধ। একটানে ঘুরিয়ে নিল তাকে। পরক্ষণে কনুইয়ের ভাঁজে আটকে ফেলল নীল ছবির পরিচালকের ঘাড়। ‘যাও কই, ডিরেক্টর সাহেব?’

দু’হাতে কিল মেরে রানার হাত ছোটাতে চাইল ব্ল্যাক। জবাবে তার ঘাড়ে চাপ বাড়াল রানা। যে ধমনি মগজে পৌঁছে দেয় রক্ত ও অক্সিজেন, আটকে দিয়েছে ওটা। ফলে মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে নেতিয়ে পড়ল ব্ল্যাক।

‘এই তো, লক্ষ্মী ছেলে,’ তার কানের কাছে বলল রানা। ‘সহজ হয়ে দাঁড়াও। আমি তোমাকে ব্যথা দিতে চাই না।’ ঘাড়ের চাপ কমাল ও। চাইলে এখন কথা বলতে পারবে ব্লু ফিল্মের ডিরেক্টর। রুবার ওপরে এক চোখ রেখেছে রানা।

তোয়ালে মোড়া বরফ থুতনি ও চোয়ালে ডলছে যুবতী। কৌতূহলী চোখে দেখছে ব্ল্যাক আর রানাকে।

ঘাড়ের ব্যথা কমতেই বড় করে শ্বাস নিল ব্ল্যাক। ‘ক্- ক্… কী চান আপনি?’

ঘাড় ছেড়ে এক পা পিছিয়ে গেল রানা। ভারসাম্য হারিয়ে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল ব্ল্যাক। ঘড়ঘড় আওয়াজে গলার ভেতরে ঢুকছে বাতাস।

‘তুমি এখানে ফিরলে কেন?’ জানতে চাইল রানা।

‘আপনি কি খুন করবেন আমাকে? আগেই বলেছি, আমার কোন দোষ নেই। বাচ্চাদের ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না!’

‘জানতে চাইছি এখানে এসেছিলে কেন?’

‘না ফিরে উপায় ছিল না। এখানে রেখে গেছি আমার সব টাকা আর বেশিরভাগ ফিল্মের মাস্টার কপি। মিস্টার রানা, আপনার বলা সব কথাই তো শুনেছি। কারা যেন খুন করেছে ওয়েস্টনকে। এবার খুন করবে আমাকে। তাই চাইছি পালিয়ে যেতে। আর কখনও এই শহরে ফিরব না।’

‘এ-শহরে রয়ে গেলে সত্যিই খুন হবে,’ বলল রানা। ‘চলে যেতে পার, তবে তার আগে কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে।’

‘বেশ,’ হতাশ সুরে বলল ব্ল্যাক। ‘দয়া করে বেশিক্ষণ আটকে রাখবেন না, নইলে কুকুরের মত গুলি করে আমাকে খুন করবে রসির খুনিরা। আমি মরতে চাই না। ওদের হাঁড়ির খবর না জানলেই বোধহয় ভাল ছিল।’

‘হাঁড়ির খবরটা আসলে কী?’

তিক্ত হাসল ব্ল্যাক। ‘রসিদের মাফিয়া দলের মত আরও যে-ক’টা দল আছে, সবাই জড়িত কালোবাজার, পতিতালয়, জুয়া আর ড্রাগসের কারবারে। ভাল নয় কেউ। কিন্তু তারা আবার রসিদের মত অতটা খারাপ নয়।’ কথা শেষ করে ঢোক গিলল ব্ল্যাক।

‘তুমি বোধহয় বলতে চাইছ, শিশুদের কিডন্যাপ করা বা ওদেরকে পর্নোগ্রাফিতে ব্যবহার করার মত চরম অপরাধ করে না অন্যরা,’ বলল রানা।

বড় করে ঢোক গিলল ব্ল্যাক। কথা বলতে গিয়ে বিকৃত হলো চেহারা। ‘ঠিকই ধরেছেন। অ্যালডো রসি নিজে শিশু পর্নোগ্রাফিতে অভিনয় করে। ধরে এনে অন্যসব শহরে জোগান দেয় ওদেরকে। একবার রাতের মদের আসরে মাতাল হয়ে আমাকে সব বলে দিয়েছিল তার হিসাব-রক্ষক লেস্টার। তবে শপথ করে বলতে পারি, আমি কখনও অত নোংরামিতে নামিনি! এমনকী আমার সিনেমায় কোনদিন বাচ্চাদের কোন দৃশ্যও রাখিনি।’

‘শিশুদের কিডন্যাপ করার পর তাদেরকে কী করা হয়?’ জানতে চাইল রানা।

ওর চোখ থেকে আগুন ঝরতে দেখে এক পা পেছাল ব্ল্যাক। আরও পেছাত, কিন্তু পেছনে বন্ধ দরজা। ‘আমি শুধু এটুকু জানি, প্রতিবছর চারবার শিকাগো থেকে ওদেরকে কিডন্যাপ করে রসিরা। এরপর কোথায় পাচার করে তা জানি না।’

নরকের এই শহরে স্বর্গের দেবশিশুরা চরম লাঞ্ছিত, ভাবল রানা। ব্ল্যাকের কাছে জিজ্ঞেস করল, ‘আগে যখন দেখা হলো, সে-সময়ে এই কথা বলোনি কেন?’

‘কারণ… তখন এলিসা আর তার গুণ্ডাদেরকে আপনার চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছি,’ স্বীকার করল ব্ল্যাক।

বাবার মাফিয়া দলের যোগ্য নেত্রী এলিসা, ভাবল রানা। শিশু অপহরণের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। তার সঙ্গে আঁতাত আছে সিনেটর পিটারের। মহিলার নির্দেশেই বোধহয় খুন হয়েছে জন ওয়েস্টন।

‘পরের শিপমেন্ট কখন হবে বা কোথায় যাচ্ছে, তোমাকে কিছু বলেছে মিস রসি?’

‘এজন্যেই তো ওরা এত নার্ভাস,’ বলল ব্ল্যাক। রানাকে খুশি করতে চাইছে। ‘এখন ছেঁড়া সুতো গিঁঠ দিচ্ছে। আজ রাতেই অন্তত বিশটা বাচ্চা পাচার হবে।’

ব্ল্যাক এমন কিছুই বলবে, ভেবেছিল রানা। কঠোর চোখে তাকে দেখল ও। ‘তা হলে আজ রাতে?’

‘এলিসা রসি সেটাই বলেছে।’

অর্থাৎ আজই শিকাগো থেকে সরিয়ে নেবে অপহৃত শিশুদেরকে। নিশ্চয়ই গোপন কোথাও রাখা হয়েছে ওদেরকে। আর সেখানেই লিউনাকে রেখেছে অ্যালডো আর তার বড়বোন এলিসা

যেহেতু কোটি টাকার শিপমেন্ট, কাজেই দু’ভাই-বোনের অন্তত একজন থাকবে তদারকিতে। শিশুদের রওনা করিয়ে দেয়ার আগে হয়তো লিউনাকে জেরা করবে সে। মাফিয়াদের জিজ্ঞাসাবাদ মানেই দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন করা। তীব্র ব্যথায় আর্তনাদ করবে লিউনা, বারবার ভাববে মারা গেলে বেঁচে যেত। ভয়ঙ্কর কষ্ট দিয়ে তিলতিল করে ওকে খুন করবে দানবেরা।

ঠিক কোথা থেকে রওনা হবে ওরা?’ জানতে চাইল রানা।

ঘন ঘন মাথা নাড়ল ব্ল্যাক। ‘জানি না। তবে এটা বলতে পারি, কার কাছ থেকে জেনে নিতে পারবেন।

‘সে কে?’

‘আর কে, সিনেটর পিটার। সবই জানে সে।’ লোকটার ব্যাপারে কথা বলার সময় অবজ্ঞা প্রকাশ পেয়েছে ব্ল্যাকের গলায়। ‘চিরকাল ধরেই বিকৃত মনের মানুষ সে। এলিসা আমাকে বলেছে, ক’দিন পর পর তারা বাচ্চাদেরকে চালান দেয় সিনেটরের কাছে। ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায় সেসব শিশুর লাশ।’

অর্থাৎ চরম অপরাধে নিমজ্জিত হয়ে আছে সিনেটর! ‘সে আসলেই সত্যিকারের পিশাচ,’ বলল ব্ল্যাক। ভয়ে মৃদু কাঁপছে তার দেহ।

মাথা দোলাল রানা। হিমশীতল গলায় ব্ল্যাককে বলল, ‘ঠিক আছে, এবার এ-শহর ছেড়ে পালিয়ে যাও। আর সেটা করবে আমি মনোভাব পাল্টে নেয়ার আগেই।’

ভয়-ভরা মুখে স্বস্তির ছাপ পড়ল পিট ব্ল্যাকের। রানাকে দৌড়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল করিডরে। পায়ের আওয়াজ দূরে মিলিয়ে যেতেই ঘুরে আগুনের মত লাল চুলের যুবতীর দিকে তাকাল রানা।

রুবার পরনে এখনও সংক্ষিপ্ত পোশাক। হাতের তোয়ালে দিয়ে চেপে ধরেছে ফোলা থুতনি আর চোয়াল। ‘আজ রাতে এখানে আর কোন বিপদ হবে না,’ বলল রানা। ‘কিন্তু আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম, প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতাম শিকাগো থেকে।’

‘আমিও একই কথা ভেবেছি,’ অন্তর থেকে বলল যুবতী।

‘যাওয়ার আগে ভুলেও কাউকে কিছু বলতে যেয়ো না।’

‘তা তো বটেই,’ মাথা দোলাল রুবা।

পিছিয়ে গিয়ে অফিসের দরজা পেরিয়ে করিডরে এল রানা। ঘুরে দ্রুত পায়ে চলল সিঁড়ির দিকে।

চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল রুবা। চেয়ে আছে খোলা দরজার দিকে। বড় করে শ্বাস ফেলে ঘুরে চলে গেল ডেস্কের পেছনে। ডানের ড্রয়ার খুলে হাতে নিল ভারী একটা বোতল। সোনার মত চকচকে ওটার ভেতরের তরল। গাজর বা টমেটো জুসের সঙ্গে উইস্কি খেয়ে মুখের ব্যথা যায়নি। বোতলের ছিপি খুলে ঢকঢক করে গিলল বারো বছর ম্যাচিউর করা শিভাস রিগাল। ভাবছে, বহু বছর ছিলাম এ-শহরে। এখন সব ছেড়ে পালিয়ে যেতে হবে। এ-জীবনে হয়তো অন্য কোথাও এত আরামে থাকতে পারব না। তবে অন্তত বেঁচে তো থাকব!

মন স্থির করার জন্যে চেয়ারে বসে থাকল রুবা।

.

একেকবারে তিনধাপ সিঁড়ি ভেঙে নেমে এল রানা। দালানের সরু এক দরজা দিয়ে বেরোল পাশের গলিতে। রাস্তার কাছে যেতেই প্রচণ্ড এক বিস্ফোরণে থরথর করে কাঁপল মাটি। বিকট আওয়াজ মিলিয়ে যেতেই রাশ স্ট্রিটে বেরোল ও। রাত হয়ে যাওয়ায় এখন আর রাস্তায় গাড়ির জ্যাম নেই।

সিম্পসনের বার আর রুবার ম্যাসেজ পার্লারের দু’বাড়ি দূরে ব্ল্যাকের জিপ দেখতে পেল রানা। ওটা দেখেই বুঝেছিল লোকটা আছে রুবার অফিস বা বেডরুমে। এখন দাউদাউ করে জ্বলছে জিপ। ওটা চেটে আকাশে উঠছে লাল আগুনের জিভ। জিপটাকে ঘিরে জড় হয়েছে কিছু মানুষ। প্রচণ্ড তাপ থেকে বাঁচতে মুখের সামনে রেখেছে দু’হাত। কারও সাধ্য নেই যে আর এক পা এগোবে।

মুচড়ে যাওয়া গাড়ির ভেতরে ড্রাইভিং সিটে ঝুঁকে বসে আছে পুড়ে যাওয়া পিট ব্ল্যাক।

সত্যি ভীষণ কালো।

কী ঘটে গেছে সেটা বুঝতে সময় লাগেনি রানার।

ব্ল্যাক আবারও রুবার ম্যাসেজ পার্লারে ফিরতেই তার গাড়ির ইগনিশনের তারে বোমা রেখে গেছে রসিদের গুণ্ডারা। এতকাল যে কালসাপের মুখে দুধ-কলা জুগিয়ে দিয়েছে ব্ল্যাক, শেষমেশ ওটারই ছোবলে খতম হয়ে গেছে।

আরেকবার পোড়া লাশটা দেখে নিয়ে লিউনার গাড়িটার দিকে চলল রানা।

আঠারো

বড় রাস্তায় আর নদীতে গোলাগুলি করে উধাও হয়েছে মাসুদ রানা, আনমনে ভাবছে সার্জেন্ট শ্যন সিমন্স। শুধু তা-ই নয়, গোটা শহর জুড়ে লাশের পর লাশ ফেলেছে লোকটা। অথচ তাকে যে ধরা যাবে, তেমনটাও মনে হচ্ছে না।

মরা কাঠের মত শুকিয়ে গেছে সিমন্সের গলা। মনে মনে নিজেকে বলল, আরও সতর্ক থাকতে হলে লাগবে আরও কয়েক কাপ কফি।

অর্গানাইড্ ক্রাইম ইউনিটের স্কোয়াড রুমে সার্জেন্ট এবার্টনের ডেস্কের উল্টোদিকের ডেস্কে বসে আছে সে। একবার এদিক-ওদিক দেখে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে রওনা হলো কফি মেকারের দিকে। ডেস্ক থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে বাটন টিপছে এবার্টন। দূর থেকে তাকে দেখল সার্জেন্ট সিমন্স। ভাবল, একই ফোন-নাম্বারে কল দিচ্ছে? কী যেন কুরে কুরে খাচ্ছে ওর পার্টনারের মন!

কিন্তু বিষয়টা আসলে কী?

সারারাত ফোনে কথা বললেও জানার উপায় নেই কার সঙ্গে আলাপ করছে এবার্টন, যদি না সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় তাকে। গত কয়েক বছরে তার সঙ্গে বন্ধুত্বের যে বাঁধন তৈরি হয়েছে, তাতে ব্যক্তিগত বিষয়েও তো জিজ্ঞেস করতে পারে সিমন্স!

কিছুক্ষণ আগে জন ওয়েস্টনের একটি এতিমখানা থেকে হেডকোয়ার্টারে ফিরেছে ওরা। ওখানে ছিল ভীষণ ভয় পাওয়া কিছু ছোট ছেলেমেয়ে। তাদের মধ্যে ছোট্ট এক মেয়ে বলেছে, সে দেখেছে মাসুদ রানাকে। নিখুঁত ছিল পিচ্চির বর্ণনা। একই কথা বলেছে এতিমখানার আহত ডাক্তার।

‘ছায়ার মত এল,’ বলেছে ডাক্তার। ‘তার নাম তা হলে মাসুদ রানা? আমার অবশ্য মনে হয়নি সে এত ভয়ঙ্কর ঘটনা করে গেছে। তা ছাড়া, তাকে আমার হিংস্র মানুষ বলেও মনে হয়নি।’

এতিমখানায় শিশুদের সঙ্গে একটা কথাও বলেনি এবার্টন, মনে আছে সিমন্সের। বাইরে দাঁড়িয়ে চুষে খেয়েছে একের পর এক অ্যান্টাসিড। কী যেন ভাবছিল। হেডকোয়ার্টারে ফিরে আসার পরেও বুজে রেখেছে মুখ।

কড়া কফিতে চুমুক দিল সিমন্স। ভাবছে, এবার সময় হয়েছে সব জেনে নেয়ার। কাপের শেষটুকু কফি গিলে স্টাইরোফোমের কাপ ওয়েস্ট-বাস্কেটে ফেলে সোজা এবার্টনের ডেস্কের দিকে চলল সে।

তাকে আসতে দেখে ফোনের কল কেটে মুখ তুলে তাকাল এবার্টন।

কার সঙ্গে কথা বলছে সেটা গোপন করছে সার্জেন্ট, ভাবল সিমন্স। কথাটা চিন্তা করে রেগে গেল। সোজা গিয়ে থামল পার্টনারের ডেস্কের সামনে। ঝুঁকে দু’হাত রাখল ডেস্কের কাঁচের ওপরে। কড়া গলায় বলল, ‘আমার মনে হয় এবার আপনার মুখ খোলার সময় হয়েছে।’

সিমন্সের দিকে তাকাল এবার্টন। ‘কী বিষয়ে?’

‘কোন কিছু গোপন করবেন না, এবার্টন। কোন না কোন ঝামেলায় পড়েছেন আপনি। আর সেটা কী ধরনের, তা জানতে চাইছি।’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল এবার্টন। ‘তুমি আসলে আমাকে ভুল ভাবছ, সিমন্স।

‘তা হলে ভাঙিয়ে দিন আমার ভুল। বলুন, আসলে কী হয়েছে। আপনি আমার পার্টনার। মৃত্যু-ঝুঁকি নেয়ার সময় আপনার ওপরে নির্ভর করতে হয় আমাকে। কাজেই আপনার মনে কী চলছে, সেটা আমার জানা থাকা দরকার।’

কড়া চোখে তার দিকে তাকাল এবার্টন। ‘তুমি কি ভাবছ অনেকের মত ঘুষ খেয়ে পচে গেছি আমি?’

‘আমি সেটা বলিনি, পার্টনার,’ দ্রুত জবাব দিল সিমন্স। ‘কিন্তু গত কয়েক ঘণ্টা ধরে খুব অস্বাভাবিক লাগছে আপনার আচরণ। গোপনে ফোন করছেন রহস্যজনক কাউকে। আপনি যেন নিজের ভেতরে নেই। কিন্তু সেটা কেন?’

‘তোমার তো জানা আছে, সবসময় বিশ্বাস করতে হয় পার্টনারকে,’ অভিযোগ আর দুঃখ প্রকাশ পেল এবার্টনের কণ্ঠে। ‘আপাতত শুধু মনে রেখো, কোন অন্যায় করছি না।’

‘আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে চাই, এবার্টন। কিন্তু সেটা করা কঠিন করে তুলেছেন আপনি। এদিকে শহর তোলপাড় করছে মাসুদ রানা। তার ওপরে…

বিরক্ত চেহারায় চেয়ার ছেড়ে ডেস্কের ওপরে দু’হাত রাখল এবার্টন। ঝুঁকে এল সিমন্সের দিকে। এখন দু’জনের নাকের মাঝে দূরত্ব মাত্র দু’ইঞ্চি।

‘দেখো, সিমন্স, এমনিতেই একটু পর তোমাকে সব খুলে বলতাম। কিন্তু তার আগেই আমাকে সন্দেহ করলে তুমি।’

‘যদি সন্দেহ করে থাকি, তো সে দায় কি আসলে আমার?’

‘আমি যা করছি, তার পেছনে উপযুক্ত কারণ আছে। আর সেটা তোমাকে বলতে কোন আপত্তিও নেই।

‘তা হলে বলুন। আমি শুনছি।’

ওদের দু’জনের গলা চড়ে গেছে দেখে কৌতূহলী চোখে এদিকে চেয়ে আছে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের কয়েকজন অফিসার। ডেস্ক থেকে পিছিয়ে দাঁড়াল এবার্টন ও সিমন্স। নিচু গলায় বলল সিনিয়র সার্জেন্ট, ‘তুমি তা হলে সব জানতে চাও, তা-ই না? তা হলে আমার সঙ্গে এসো!’

‘কোথায়?’

‘ক্যাপ্টেনের অফিসে।’

চোখ বিস্ফারিত হলো সিমন্সের। ‘ক্যাপ্টেনের অফিসে?’

‘হ্যাঁ, সময় হয়েছে তাঁকে বলার।’ ঘুরে স্কোয়াড রুমের অন্যদিকে ক্যাপ্টেনের অফিস লক্ষ্য করে এগোল এবার্টন। কয়েক সেকেণ্ড দ্বিধা করে তার পিছু নিল সিমন্স।

কৌতূহলী চোখে ওদের দেখছে কয়েকজন অফিসার। ক্যাপ্টেনের অফিসের ঘষা কাঁচের দরজায় টোকা দিল এবার্টন। ওদিক থেকে এল ঘড়ঘড়ে গলা: ‘কাম ইন, প্লিয!’

সিমন্সকে একবার দেখে নিয়ে নব ঘুরিয়ে ক্যাপ্টেনের অফিসে ঢুকল এবার্টন। তার পিছু নিল সিমন্স।

কাগজের স্তূপের ওদিকে কী যেন পড়ছেন ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ড। বুলডগের মত মুখটা তুলে ভুরু কুঁচকে এবার্টনের দিকে তাকালেন তিনি। ‘বলো কী চাও, এবার্টন? আমি কিন্তু এখন খুব ব্যস্ত। নষ্ট করার মত সময় নেই।

‘এসেছি মাফিয়াদের বিষয়ে কথা বলতে,’ জানাল সার্জেন্ট এবার্টন। ‘এ-ব্যাপারে জরুরি কিছু তথ্য আপনার জানা থাকা দরকার।’

উনিশ

ট্রাক কোম্পানির ডিরেক্টরের অফিসঘরে দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে রাতের আঁধারে চেয়ে আছে অ্যালডো রসি।

‘জানালার সামনে থাকা বুদ্ধির কাজ নয়, অ্যালডি,’ নরম সুরে বলল এলিসা রসি। ‘তুমি জানো না কোথায় লুকিয়ে আছে স্নাইপার।

বড়বোনের কথা শুনেও জানালা থেকে সরল না অ্যালডো রসি। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা পরিবেশ। শহরের বাইরে সাধারণ সব শিপিং বিযনেসের মতই এই ট্রাক কোম্পানি। গভীর রাতে অফিসের কর্মচারীরা কেউ উপস্থিত নেই। বৈদ্যুতিক বাতির আবছা আলোয় দূরে দেখা যাচ্ছে এখানে-ওখানে ট্রেইলার ট্রাক আর লোডিং ইকুইপমেন্ট। চারপাশে আলোর চেয়ে ছায়া বেশি।

‘তুমি রানার কথা ভাবছ,’ নিচু গলায় বলল অ্যালডো।

‘ঠিকই ধরেছ,’ বলল এলিসা। ‘কেউ জানে না অন্ধকারে রাইফেল নিয়ে অপেক্ষা করছে কি না। হয়তো ঠিক এখন সাইটের ভেতর দিয়ে দেখছে তোমার মাথা। চাই না তোমার মগজ নিয়ে পেছনের দেয়ালে লাগুক বুলেট। সাবধান হও, অ্যালডি।’

তিক্ত হলো অ্যালডোর চেহারা। ‘জানতাম না যে আমার জন্যে এত বেশি ভাবো তুমি।

কড়া চোখে ছোটভাইকে দেখল এলিসা রসি। আস্তে করে কাঁধ ঝাঁকাল।

আপাতত কিছু দিন শিশুদের শিপমেন্ট নেই। সেজন্যে মনে মনে খুশি এলিসা। এই ব্যবসাটা খুবই লাভজনক। রসি পরিবারের অন্যান্য ব্যবসার মতই এই ধরনের শিপমেন্টের সময় নিজে উপস্থিত থাকে সে। কিন্তু মাসুদ রানার কারণে এখন একদম বদলে গেছে পরিস্থিতি।

বাইরে শক্তিশালী এক ট্রাক্টর রিগের সঙ্গে দীর্ঘ ট্রেইলার জুড়ছে নাইট শিফটের ফোরম্যান। একটু পর ট্রেইলারে তোলা হবে অপহৃত শিশুদেরকে। ওদেরকে এখন পাহারা দিচ্ছে রসিদের সৈন্যরা। গোটা কম্পাউণ্ডের চারদিকে কাঁটাতার বেড়ার কাছে টহল দিচ্ছে দলের আরও বেশ কয়েকজন।

একবার হাতঘড়ি দেখে নিল এলিসা রসি

এখন বাজে রাত পৌনে বারোটা।

কাজে পিছিয়ে নেই ওরা। মাঝরাতে বাচ্চাদেরকে পেটে নিয়ে রওনা হবে ট্রাক্টর ট্রেইলার।

‘আজকের রাত পেরোলে এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না, ‘ মন্তব্য করল এলিসা রসি।

ঘুরে ওকে দেখল অ্যালডো রসি। ‘আমি এত নিশ্চিত নই। তখনও শিকাগোতে রয়ে যাবে রানা।

পার্স খুলে ওটার ভেতর থেকে রুপার কেস নিল এলিসা। ঢাকনি খুলে দু’আঙুলে ধরে তুলল একটা সিগারেট। ঠোঁটে ওটা ঝুলিয়ে নিতেই লাইটার বাড়িয়ে সিগারেটে আগুন জ্বেলে দিল অ্যালডো রসি।

‘তার হাতে আমাদের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই,’ বলল এলিসা। ‘ভাবছে তার ডিটেকটিভ এজেন্সির কর্মচারীদেরকে আমরা খুন করেছি। সে যা খুশি ভাবলে ভাবুক। আগামী বেশকিছু দিনের জন্যে ডুব দেব আমরা। চিরকাল তো আর শিকাগোতে থাকতে পারবে না লোকটা। আমার কথা বুঝতে পেরেছ? জরুরি কাজ পড়লে আগে বা পরে চলে যেতে হবে তাকে।’

‘হয়তো তোমার কথাই ঠিক। তবে আমাকে খুন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে সে। তাকে শেষ করার জন্যে গোটা শহরে ছড়িয়ে রেখেছ আমাদের লোক। তার ওপরে তাকে খুঁজছে শিকাগো পুলিশ। এসব দিকেই চোখ আছে তোমার। দেখা যাক, শেষমেশ ধরা পড়ে কি না সে।’

‘ওয়েস্টন আর ব্ল্যাক আর নেই,’ আবেগহীন স্বরে বলল এলিসা রসি। ‘সিনেটর পিটারও জানে, মুখ খুললে খুন হবে। সুতরাং বাধ্য হয়ে আমাদেরকে সাহায্য করবে সে। একই কাজ করবে ওয়াশিংটনের কুকুরগুলো।’

নিজের সিগারেটের প্যাকেট বের করে একটা শলাকা নিয়ে লাইটার দিয়ে জ্বেলে নিল অ্যালডো। ছাতের দিকে একরাশ ধোঁয়া ছুঁড়ে বলল, ‘মাসুদ রানাকে সামলাতে পারব, কারণ আমাদের আছে আর্থিক সক্ষমতা আর রাজনৈতিক শক্তি।’

‘আরও বড় কথা হাতের মুঠোয় আছে লিউনা গার্ডনার, ‘ বলল এলিসা রসি। ‘মনে হয় না মাসুদ রানা চাইবে মেয়েটা খুন হোক। কাজেই আমাদেরকে ঘাঁটাতে চাইবে না সে। দেখা যাক, এবার কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়।’

অফিসের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ভারী চোয়ালের এক লোক। মাথায় উল্টো করে পরেছে বেসবল ক্যাপ। ‘আমাদের ট্রাক রওনার জন্যে তৈরি, মিস্টার রসি।’

‘গুড,’ খুশি হলো অ্যালডো। ‘সময়ও তো ঘনিয়ে এল।’

‘অন্য কোন কাজ আছে, যা করে দিতে পারি, স্যর?’

‘না, লাগবে না। অবশ্য এটা দেখবে যেন ট্রেইলারে সবাই ওঠার পর সঠিক সময়ে রওনা হয় ট্রাক্টর।’

ক্যাপের বিল স্পর্শ করে মাথা দোলাল ফোরম্যান। দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে গেল ওয়্যারহাউসের দিকে।

একেও বাঁচতে দেব না, ভাবছে এলিসা। এই লোক ওদের সৈনিক নয়। মাঝে মাঝে বেআইনি কাজে তাকে ডেকে নিতে হয়। যেমন আজকের রাতে।

ডেস্কের কাছ থেকে সরে গেল এলিসা। তার পরনে খুব নরম কাপড়ের গাঢ় নীল দামি ড্রেস। ওটার ওপরে পরেছে ফারের হাজার ডলারের জ্যাকেট। ফলে তাকে মনে হচ্ছে আরও সুদর্শনা। গলা ও কবজিতে ঝিলিক দিচ্ছে হীরার অলঙ্কার। হাতের গ্লাভ্স্‌ খুলতেই ঝিকিয়ে উঠল অনামিকায় দুর্মূল্য হীরা খচিত আঙটি। ‘অ্যালডি, চলো, ওদেরকে গিয়ে বিদায় দিই,’ সহজ সুরে বলল সে। ‘ওরা রওনা হওয়ার আগে আরেকবার কথা বলতে হবে মিস গার্ডনারের সঙ্গে।’

‘আমার মনে হয় না সে কিছু বলবে,’ বলল অ্যালডো।

তার কথায় হাসল এলিসা। ‘হয়তো বহু কিছুই বলবে। এসো।’

ছোটভাই অফিসের দরজা খুলে দিতেই বাইরের ঠাণ্ডায় বেরিয়ে এল এলিসা। তার আগে আগে হাঁটতে লাগল অ্যালডো রসি। অফিসের সামনের অ্যাসফল্টের রাস্তা পার করে চলে এল ওয়্যারহাউসের দরজার কাছে। উত্তর থেকে হু- হু করে আসছে ঠাণ্ডা হাওয়া। ওয়্যারহাউসের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অ্যালডো রসির এক সৈনিক, হাতে উযি সাবমেশিন গান। মাফিয়া ডনকে দেখে এক পা পিছিয়ে মৃদু মাথা দোলাল সে।

ভাইকে ওয়্যারহাউসে আগে ঢুকতে দিল এলিসা, তারপর পিছু নিল। সৈনিক দেখল মাফিয়া ডনের পেছনে হাঁটছে তার বড়বোন। তার জানা নেই, দলের সবার সামনে গুরুত্বের সঙ্গে প্রতি পদে ভাইকে এগিয়ে রাখে নিষ্ঠুর এই মহিলা।

শিশুদের পাহারায় যারা আছে, তাদের দিকে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলেছে অ্যালডো রসি। দলের লোকগুলো কয়েক গজ দূরে থাকতেই তাদের উদ্দেশে বলল, ‘সব ঠিক আছে তো?’

‘জী, ডন, কোথাও কোন সমস্যা নেই,’ বলল কিডন্যাপার দলের নেতা। কনুইয়ের ভাঁজে শটগান। ‘বাচ্চারা কোন ঝামেলা করেনি।’

ওয়্যারহাউসের একদিকের দেয়ালের কাছে দাঁড়িয়ে আছে অন্তত ত্রিশজন ছেলেমেয়ে। ওরা এতই ছোট, কোন গোলমাল করবে, সেই সাধ্য নেই। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কনকনে শীতে কাঁপছে ওরা। যদিও ঘটনা তেমন নয়। সবার পরনে পুরু জ্যাকেট। বয়সে কেউ পাঁচ বছরের বেশি নয়। ওরা অসুস্থ হলে রসিদের বড় অঙ্কের টাকা গচ্চা যাবে, তাই কেউ যেন অসুস্থ না হয়, তাই ওদেরকে করানো হয়েছে ডাক্তারি প্রতিটি পরীক্ষা

কাঁদতে শুরু করলে দু’একটা চড় দেয়া ছাড়া আর কোন ক্ষতি করা হয়নি ওদের। বেচারাদের চোখে অসহায় দৃষ্টি। বুঝতে পারছে যে আর কখনও ফিরতে পারবে না বাবা-মার কাছে। জানা নেই লোকগুলো এবার কোথায় ধরে নিয়ে যাবে।

এটা আসলে ভাল দিক যে আগেই মন ভেঙে গেছে ওদের, ভাবল এলিসা। জেদ করা বাচ্চা পছন্দ করে না খদ্দেরেরা। তারা ইচ্ছেমত যা কিছু করবে, আর সেটাই মেনে নেবে বাচ্চারা, নইলে বাঁচবে কী করে!

‘গুলিয়ান বলেছে ট্রাক তৈরি হয়ে গেছে,’ শটগান হাতে কঠোর চেহারার লোকটাকে বলল অ্যালডো। ‘তা হলে তাকে বলো লোডিং ডকের কাছে ট্রাক্টর নিয়ে আসুক।’

‘আপনি যা বলেন, ডন।’

ওয়্যারহাউস পাহারা দিচ্ছে একডযন সৈনিক। তাদের কারও কারও চোখ ওর ওপরে, টের পেল এলিসা। তবে ওরা কেউ বলছে না যে সে এখানে কেন। মাঝে মাঝে দলের দু’চারজন নিজেদের ভেতরে আলাপ করে, বড়বোনকে কেন প্রতিটা কাজে রাখেন মাফিয়া ডন রসি। যদিও ডালপালা ছড়াতে পারেনি কথাগুলো।

এসব ফুট সোলজার কী ভাবছে, তাতে কিছুই যায় আসে না এলিসার। দরকার হলে ওয়েস্টন বা ব্ল্যাকের মত করেই এদেরকেও খরচের খাতায় তুলে দেবে সে।

‘ওই মেয়ে কোথায়?’ অপহরণকারী দলের নেতার কাছে জানতে চাইল অ্যালডো। ‘আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।’

ঘাড় কাত করে শিশুরা যেখানে আছে, তার উল্টোদিকে ছোট এক অফিস দেখাল লোকটা। ‘হাত-পা বেঁধে টয়লেটে ফেলে রেখেছি।

‘নিয়ে এসো ওকে।’

‘জী, মিস্টার রসি।’

কিছুক্ষণ পর গুণ্ডাদের একজন দুর্গন্ধময় টয়লেট থেকে বের করল লিউনাকে। ডানহাত এত জোরে চেপে ধরেছে, ব্যথায় কুঁচকে গেছে ওর মুখ। অ্যালডো আর এলিসা রসির সামনে ওকে হাজির করল গুণ্ডা।

কঠোর আচরণ করা হয়েছে লিউনার প্রতি। আর সেটা দেখে খুশি হয়ে গেল এলিসা। কয়েক জায়গায় ব্লাউস ছিঁড়ে গেছে মেয়েটার। লাল হয়ে আছে ডান গাল। খুব জোরে ওখানে চড় দেয়া হয়েছিল। ঠোঁটের কোণে শুকিয়ে গেছে কয়েক ফোঁটা রক্ত। অভিযোগের দৃষ্টিতে দুই ভাই-বোনকে দেখছে লিউনা। রাগী কণ্ঠে বলল, ‘তোমরা আমার কী করবে সেটা তোয়াক্কা করি না। ভাল চাইলে বাচ্চাদের ছেড়ে দাও!’

জবাবে হাসল এলিসা। নরম সুরে বলল, ‘প্রিয় লিউনা, তুমি বোধহয় এরই ভেতরে জেনেছ, জরুরি তথ্য পাব বলে তোমাকে এখনও বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। সেটা মাথায় রেখো। আর বাচ্চাদের ব্যাপারে? সেটা তো অন্য হিসেব।’

মনের ভেতরে মৃত্যু-ভয় কাজ করলেও খেপে আছে লিউনা। কড়া চোখে দেখল অ্যালডো রসিকে। ভুলে গেছে ওর হাত মুচড়ে ধরে রেখেছে মাফিয়ার গুণ্ডা।

‘তোমরা আসলে পাগল হয়ে গেছ! হয়তো খুন করবে আমাকে, কিন্তু ঠেকাতে পারবে না মাসুদ রানাকে! সে খুঁজে নেবে তোমাদেরকে! আর তখন একজনও বাঁচতে পারবে না!’

ডানহাতে কষে লিউনার মুখে চড় দিল অ্যালডো। মাথা ঘুরে মেঝেতে বসে পড়ল মেয়েটা। শক্ত হাতে ওর বাহু ধরে রেখেছে মাফিয়ার গুণ্ডা। পরক্ষণে হ্যাঁচকা টানে দাঁড় করাল ওকে।

‘রানার ব্যাপারে আর একটা কথাও নয়!’ ধমকের সুরে বলল অ্যালডো রসি। ‘কুকুরটা এই ওয়্যারহাউসের ধারে কাছে এলে সঙ্গে সঙ্গে খুন হবে! তবে সে এটা জানে না যে কোথায় আছি আমরা।’

একটুকরো হাসি ফুটল লিউনার মুখে। নিচু গলায় বলল, ‘তোমরা আসলে জানতে চাও এ-জায়গা কীভাবে চিনবে রানা। তো শোনো, কীভাবে চিনবে সেটা জানি না, তবে ঠিক সময়ে এখানে হাজির হবে সে।’

সামনে বেড়ে ওর মুখোমুখি হলো এলিসা রসি। গ্লাভ্স্ পরা হাতে স্পর্শ করল লিউনার ডানগাল। বলল, ‘অ্যালডোর সঙ্গে সাবধানে কথা বলবে। ভুলো না যে আমি তার বড়বোন।

‘সত্যিই দুঃখিত,’ বলল লিউনা। ‘আমার ভুল হয়েছে। ‘এই তো নিজের ভুল বুঝতে পেরেছ,’ বলল এলিসা। তার মুখে একরাশ থুতু ছুঁড়ল লিউনা। ‘আমার উচিত তোমাদেরকে বলা: তোমরা আসলে জন্মেছ সত্যিকারের কোন হারামি কুত্তীর পেটে!

দু’পা পিছিয়ে পার্স থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে মুখ মুছল এলিসা। বড় করে শ্বাস নিল। ‘লিউনা, তুমি দেখি ভদ্রতা বলতে কিছুই শেখোনি! তাই বাধ্য হয়ে সামান্য শিক্ষা দেব।’

‘কঠিন কোন শিক্ষা,’ তাল দিয়ে বলল অ্যালডো রসি। লিউনার হাত ধরে রাখা লোকটার দিকে ইশারা করল সে।

শটগান কনুইয়ের ভাঁজ থেকে নিয়ে ওটার কুঁদো দড়াম করে লিউনার পিঠে নামাল মাফিয়াসো।

প্রচণ্ড ব্যথায় ধুপ করে সিমেন্টের মেঝেতে পড়ল লিউনা ওর কনুই ছেড়ে দিয়েছে লোকটা।

সবই দেখছে শিশুরা। লিউনার করুণ পরিণতি দেখে কেঁদে ফেলল কেউ কেউ। বদ্ধ ঘরে তৈরি হলো ক্রন্দনের অদ্ভুত এক ভৌতিক আওয়াজ। অনেকে ওরা চেনে আণ্টিকে। তাকে এত ব্যথা পেতে দেখে ঘাবড়ে গেছে ওরা।

হাত তুলে গুণ্ডাটাকে আর না মারতে ইশারা করল অ্যালডো রসি। জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে নিয়ে বলল, ‘আগে শেষ হোক ব্যবসার কাজ, তারপর দেখব ওকে নিয়ে কী করা যায়।’ সামনে বেড়ে লিউনার থুতনি ধরল সে। মুখটা টান দিয়ে ওপরে তুলে সরাসরি তাকাল ওর চোখে।

‘কুত্তীর বাচ্চা!’ রাগী গলায় বলল লিউনা।

‘আমার কাজ শেষ হলে বুঝবে যে তুমি আর মানুষ নও, ‘ সরীসৃপের মত হিসহিস করল অ্যালডো রসি। ‘বারবার মাফ চাইবে যেন তোমাকে মেরে ফেলা হয়।’

লিউনা কিছু বলার আগেই বাইরে থেকে এল ইঞ্জিনের ভারী আওয়াজ। রেইলে ক্রিচক্রিচ শব্দে সরে যাচ্ছে লোডিং ডোরের দরজা। পিছিয়ে এসে ওয়্যারহাউসের ভেতরে লোডিং ডকে এসে থামল বড় এক ট্রাক। লোডিং ডকে উঠল ট্রাকিং কোম্পানির ফোরম্যান। গলা চড়িয়ে বলল, ‘আমরা মাল তুলতে তৈরি, মিস্টার রসি!’

লিউনার প্রতি মনোযোগ হারাল অ্যালডো। চট্ করে তাকাল বড়বোনের দিকে।

জবাবে মৃদু মাথা দোলাল এলিসা।

‘তো ওদের ভরো ভেতরে। পরে দেখব হারামজাদীর তেজ কীভাবে কমাতে হবে,’ বলল অ্যালডো।

নরকের শহর – ২০

বিশ

অভিজাত এলাকা এভানস্টনে কোন হৈ-চৈ বা আওয়াজ নেই। রাতে থমথম করছে চারপাশ। ম্যানিকিউর করা বিশাল বাগানের ওদিকে আধুনিক সব অপূর্ব সুন্দর ম্যানশন। গাছে ছাওয়া বুলেভার্ডের সামনের পথ ধরে আসছে-যাচ্ছে একটা-দুটো গাড়ি।

সিনেটর পিটারের বাড়ি থেকে এক ব্লক দূরে বাতিহীন এক অন্ধকার বাড়ির কাছে লিউনার গাড়ি রেখেছে রানা। আগেই আতাউলের কাছে ফোন করে জেনে নিয়েছে, সিনেটরের বাড়িতে থাকে মাত্র তিনজন মানুষ। রাজনীতিক নিজে, তার স্ত্রী আর তাদের তরুণী মেয়েটা।

গাড়ি থেকে দরকারি কিছু জিনিস নিয়ে রাস্তার ওদিকের ঘন ঝোপগুলোর ভেতরে ঢুকল রানা। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বুঝে নিল আশপাশে কেউ নেই।

ইজরায়েলি জ্যামার চালু করে পরের তিন মিনিটে দেয়াল টপকে নেমে এল সামনের বাড়িটার উঠনে। বাড়ির পেছনের কাঠের বেড়া বেশ উঁচু। ওটা পার হলেই সিনেটরের বাড়ির বাগানে নামতে পারবে রানা।

পরের দু’মিনিটে বাড়ির পেছনদিকে চলে এল রানা। দড়ি বেয়ে উঠে পড়ল বেড়ার ওপরে। চুপ করে অপেক্ষা করল মিনিটখানেক। আশপাশে কোথাও কোন আওয়াজ বা নড়াচড়া নেই। তারপর দূরে জোরে আটকে দেয়া হলো একটা দরজা। ঘেউ-ঘেউ করে উঠল কোন বাড়ির কুকুর। পেরিয়ে গেল আরও কিছুক্ষণ। জাস্টিন পিটারের বাড়ি থেকে বেরোল না কেউ।

দড়ি ওদিকে ফেলে তরতর করে সিনেটরের বাগানে নেমে এল রানা। চারপাশে চিরহরিৎ গাছের ফলের বাগান। চোখে নাইট-ভিশন গগল্‌স্ পরে বাড়িটার দিকে চলল রানা। শীতের কনকনে হাওয়ার স্ আওয়াজে আরেকটু হলে চাপা পড়ত ওর পেছনে চলে আসা লোকটার বুটের শব্দ।

একেবারে শেষ সময়ে সতর্ক হয়ে গেছে রানা। ঝট করে একদিকে সরে বসে পড়ল মাটিতে। ভাল করেই বুঝে গেছে, পেছনের লোকটা খুব দক্ষ। যেখানে থাকার কথা ওর বুক, সেখান দিয়ে সাঁই করে ঘুরে গেছে আততায়ীর ছোরা। চরকির মত ঘুরেই লোকটার পেট লক্ষ্য করে ডানহাতি ঘুষি মারল রানা। তলপেটে মুঠো গেঁথে যেতেই ঘোঁৎ করে উঠেছে খুনি। পরক্ষণে আবারও সামনে বেড়ে একপাশ থেকে চালাল ছোরা।

ধারালো ফলা হাত বাড়িয়ে ব্লক করতেই ডানবাহুতে যেন আগুন ধরে গেল রানার। একই সময়ে বামহাতে হ্যাঁচকা টানে বের করল খাপ থেকে গার্বার এমকে টু। উঠে দাঁড়িয়ে পিছিয়ে গেল কয়েক পা। প্রায় নাচের ভঙ্গিতে ছোরা হাতে ওর দিকে এল আততায়ী। সুযোগ বুঝে সামনে বেড়ে তার হাঁটুর বাটির ওপরে জোরাল একটা লাথি ঝাড়ল রানা।

ব্যথায় ‘উফ্’ বলে থমকে গেছে আততায়ী। ঝড়ের বেগে সামনে বেড়ে তার ঘাড় ডানহাতে পেঁচিয়ে ধরল রানা। পরক্ষণে ওর ছোরা ঢুকে গেল আততায়ীর পিঠ ভেদ করে হৃৎপিণ্ডে। মাত্র দু’বার রানার হাতের ভেতরে ঝাঁকি খেল লোকটা, তারপর শিথিল হয়ে গেল।

শীতল মাটিতে মৃতদেহ নামিয়ে রাখল রানা। লাশের পোশাকে রক্ত মুছে খাপে রেখে দিল ছোরা। সার্চ করে দেখল লোকটার শোল্ডার হোলস্টারে আছে কোল্ট .৪৫ পিস্তল। পকেটে আইডি কার্ড। ওটা অনুযায়ী তার নাম লু এফ. লে। এ-ছাড়া আছে গান লাইসেন্স। সেখানে লেখা: লু এফ. লে ফাইভ স্টার করপোরেশনের সিকিউরিটি, কোয়ার্ডিনেটর। সরকার থেকে তাকে গোপনে পিস্তল বহন করার অনুমতি দেয়া হলো।

রানার বুঝতে দেরি হলো না, এই লোক মাফিয়া দলের সদস্য। সিনেটর আর তার পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়ার জন্যে একে রেখেছিল অ্যালডো রসি।

বাগানে লাশ ফেলে রেখে সিনেটরের বাড়ির পেছনে চলে এল রানা। ওর দশ সেকেণ্ড লাগল পেছনের দরজা খুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকতে। ঘরে আগুনে পোড়া কাঠের বুনো এক প্রাচীন সুবাস। কেমন উদাস করে দেয় মন।

নাইট-ভিশন গগলসের কল্যাণে একটু দূরে কারুকাজ করা স্টেয়ারকেস দেখতে পেল রানা। কোথাও ঠোকর না খেয়ে চলে গেল ওটার কাছে। সিঁড়ির প্রথম ধাপে পা দিতেই চোখের কোণে দেখল বেসমেন্টের দরজার তলা দিয়ে আসছে হলদে আলো। সিঁড়ির ধাপ থেকে নেমে নিঃশব্দে বেসমেন্টের দরজার সামনে চলে এল রানা। হ্যাণ্ডেল ধরে ধীরে ধীরে মোচড় দিল নিচের দিকে। দরজা খুলে যেতেই সামনে দেখতে পেল খাড়া ধাপের কাঠের সরু এক সিঁড়ি।

একবার বড় করে শ্বাস নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল রানা। বিলাসবহুল আসবাবপত্র দিয়ে গুছিয়ে নেয়া হয়েছে বেসমেন্ট। একটু দূরে মাঝারি একটা বার। ওখানে যত মদ আছে, তাতে অন্তত পাঁচ শ’জনের তৃষ্ণা মেটানো যাবে।

বারের ওদিকে আধখোলা এক দরজা দিয়ে আসছে মৃদু আওয়াজ। সাবধানে ওদিকে চলল রানা। একটা পুল টেবিল পাশ কাটিয়ে চোখ থেকে খুলল নাইট-ভিশন গগল্স। এরই ভেতরে বুঝে গেছে, এটা বাড়ির স্টাডিরুম। আর এখানেই আছে সিনেটর পিটার। দোতলায় বোধহয় ঘুমিয়ে আছে তার স্ত্রী আর মেয়ে। নিঃশব্দে অর্ধেক খোলা দরজায় গিয়ে ভেতরে উঁকি দিল রানা। ওর দিকে পিঠ দিয়ে পুরু গদির দামি আর্মচেয়ারে বসে আছে সিনেটর পিটার। ডানহাতে সোনালি তরলে ভরা ক্রিস্টালের গ্লাস। বিশাল এক এলইডি টিভির দিকে মনোযোগ দিয়েছে লোকটা।

টিভিতে কী ধরনের সিনেমা চলছে, সেটা মোটা গলায় পুরুষের শীৎকারের আওয়াজে বুঝে গেল রানা। টিভির দিকে চেয়ে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে সিনেটর। বামহাতে এদিক-ওদিক নাড়ছে উত্থিত গোপনাঙ্গ।

টিভির পর্দার দিকে চোখ গেল রানার।

সিনেমার নায়িকার বয়স বড়জোর আট। ক্যামেরার পেছন থেকে কারা যেন ভয় দেখাচ্ছে ওকে। বেচারির চোখে- মুখে ভীষণ আতঙ্ক। ওর ওপরে চড়াও হয়েছে হিংস্র চেহারার বয়স্ক এক লালচে দাড়িওয়ালা লোক। টিভির পর্দা থেকে চোখ সরাল রানা। মন চাইছে, সিনেটরের মাথায় অটোম্যাগের ম্যাগাজিন খালি করতে। তবে প্রচণ্ড রাগ চেপে রাখল ও।

পিচ্চি মেয়েটার ওপরে এতই মনোযোগ সিনেটরের, এখনও টের পায়নি বেসমেন্টে এসে ঢুকেছে অন্য কেউ। তার কাঁধের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে রিমোট কন্ট্রোলের স্টপ বাটন রানা টিপে দিতেই বন্ধ হলো ব্লু ফিল্ম। টিভির স্ক্রিন কালো হয়ে যেতেই চমকে গিয়ে ঘাড় কাত করে পেছনে তাকাল জাস্টিন পিটার। রানাকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েও বসে পড়ল সে। পাশের টেবিলে রাখতে গিয়ে পুরু কার্পেটে ফেলে দিল মদের গ্লাস। চারপাশে ছড়িয়ে গেল অ্যালকোহলের কড়া গন্ধ। চেয়ারটা ঘুরে সরাসরি সিনেটরের মুখোমুখি হলো রানা। বামহাতে খপ করে ধরল লোকটার চোয়াল। ডানহাতে গলা ধরে ঠেলে তাকে গেঁথে দিল চেয়ারে।

ভীষণ ভয়ে বিস্ফারিত হলো সিনেটরের দু’চোখ। তার মুখ থেকে হাত সরাল রানা। হিমশীতল কণ্ঠে বলল, ‘একবার চিৎকার দিলেই খুন হবে!

রানা যে মিথ্যা বলছে না, সেটা বুঝতে দেরি হলো না সিনেটরের। বিস্ফারিত চোখে চাইল ওর দিকে। ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মুখ। থরথর করে কাঁপছে গোটা শরীর। দু’হাতে চেপে ধরেছে চেয়ারের হাতল। ‘ক্ব-কী চাও তুমি?’ কাঁপা গলায় জানতে চাইল সে।

‘তুমি তো দেখি দারুণ সব সিনেমা দেখো, সিনেটর! কোথায় পেলে এই ডিভিডি?’

বড় দ্রুত বলল লোকটা, ‘ভাড়া করেছি।’

‘তা-ই? সিনেমার ডিভিডি যেসব দোকানে বিক্রি হয়, তেমন কোথাও থেকে কিনেছ?’

‘আমার এক বন্ধু দিয়েছে।’

‘কী নাম তার?’

‘নাম মনে নেই।’

রাগের আগুনে পুড়ছে রানার বুক। ডানহাতে এত জোরে কষে চড় দিল যে জাস্টিন পিটারের ঠোঁট ফেটে ফিনকি দিয়ে বেরোল রক্ত। মুখ থেকে খসে পড়ল ক্যাপ করা মুক্তোর মত সুন্দর দুটো দাঁত। মারের তোড়ে পিছিয়ে গেছে ভারী আর্মচেয়ার। সিনেটরের সামনে বিশাল পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে আছে রানা। রাজনীতিকের উপায় নেই যে চেয়ার ছাড়বে।

‘জানতাম যে তুমি মিথ্যা বলবে,’ রাগ চেপে বলল রানা, ‘তে। আবারও প্রথম থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাক। এখন প্রথম প্রশ্ন: কোথায় রাখা হয়েছে শিশুদেরকে!’

‘কীসের শিশু? এসব কী বলছ!’ হাত তুলে ফাটা ঠোঁট থেকে রক্ত মুছল জাস্টিন পিটার। ‘আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! শিশু নিয়ে আবার কীসের কথা?’

‘অ্যালডো আর তার বোনের ব্যাপারে সবই আমি জানি, ‘ বলল রানা, ‘এ-ও অজানা নয়, ওয়েস্টন এতকাল তাদেরকে বাচ্চা সাপ্লাই দিয়েছে। আর আজ রাতে ওদের শিপমেন্ট পাঠিয়ে দেয়া হবে দূরে কোথাও। এটাও জানি, বহুকাল আগেই নিজের আত্মা বিক্রি করে দিয়েছ তুমি। নরকের এক দানবের মত রয়ে গেছ পৃথিবীর বুকে। কিন্তু এসব নিয়ে কথা বলার মত সময় এখন আমার হাতে নেই। জানতে চাইছি: ঠিক কখন কোথা থেকে রওনা হবে শিপমেন্ট। এবার আমার কথা বুঝতে পেরেছ? বাচ্চাদের ব্যাপারে তোমাকে মুখ খুলতে হবে।’

বারকয়েক মাথা নাড়ল জাস্টিন পিটার। ফাটা ঠোঁট থেকে টপটপ করে শার্টের বুকে পড়ছে রক্ত। ‘আমার… আমার তো কিছুই জানা নেই… সত্যি কথা বলছি!’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রানা। ‘ভুল লোকের পা চাটতে গেছ, সিনেটর। জন ওয়েস্টন জানত কোথা থেকে রওনা হবে শিশুদের শিপমেন্ট। তাই মাফিয়ারা তাকে মেরে ফেলেছে। প্রাণে বাঁচতে পারেনি পিট ব্ল্যাকও।’

‘ওয়েস্টন… মারা গেছে?’

‘জানি, তোমার কাছে কাদের পাঠায় অ্যালডো বা এলিসা। শিশুদের সাপ্লাই দিয়ে তোমাকে পকেটে রেখেছে তারা।’

সরাসরি ওর চোখ দেখল লোকটা। এক পলকে বুঝে গেল সবই জানে কঠোর চেহারার যুবক। চেয়ারের গদিতে গেঁথে গেল নরপশুটা। বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, সত্যিই আমি একটা দানব! তবে তুমি হয়তো বুঝবে না, শিশু পর্নোগ্রাফি দেখতে আমার কত ভাল লাগে!’ দু’চোখে অশ্রু এল তার। ‘বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের সিনেমা। বয়স্ক অভিনেতারা যখন ওদেরকে চেপে ধরে ভীষণ কষ্ট দেয়… আমার মনে হয় আমিও যেন…’ একবার ফুঁপিয়ে উঠে দু’হাতে মুখ ঢাকল সে। ফিসফিস করল, ‘আসলে, রানা… আমার ভেতরে বাস করে একই সঙ্গে দু’জন মানুষ। আমার স্ত্রী আর মেয়েকে ভালবাসি। জান দিতে পারি ওদের জন্যে। কিন্তু এই ধরনের সিনেমা না দেখলে অস্থির হয়ে যাই। আমি আসলে মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষ। আর তাই ফাঁদে ফেলে আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে রসিরা। ওরা আসলে কোনকালেই মানুষ ছিল না। ওদের হাত থেকে আমাকে রক্ষা করুন ঈশ্বর, যাতে আবারও সুস্থ হয়ে উঠতে পারি আমি!’

‘ওরা কোথা থেকে শিশুদের রওনা করিয়ে দেবে আজ?’ নরম সুরে জানতে চাইল রানা।

চোখে অশ্রু নিয়ে ওকে দেখল জাস্টিন পিটার। ‘স্কাই ট্রাকিং কোম্পানির হেডকোয়ার্টার থেকে।’ নিচু গলায় রাস্তার নাম ও অফিসের ঠিকানা জানাল সে। ‘ওই কোম্পানির মালিক অ্যালডো রসি।

‘কখন রওনা হবে শিপমেন্ট?’

‘মাঝরাতে।’

চট করে হাতঘড়ি দেখল রানা।

ঘড়ির কাঁটা বলছে এখন বাজে এগারোটা বিশ।

চল্লিশ মিনিট পর বারোটা বাজবে, অর্থাৎ মাঝরাত।

‘রানা… তুমি এখন আমার ব্যাপারে কী করবে?’ থমকে থমকে ফিসফিস করে জানতে চাইল সিনেটর পিটার।

‘নিয়ে যাব তোমার মোবাইল ফোন আর ট্যাব।’ গলা টিপে খুন করতে হলে গায়ে হাত দিতে হবে এই নোংরা কীটের, ভাবল রানা। তখনই দেখতে পেল, পাশের ছোট্ট টেবিলের ড্রয়ারের দিকে হাত বাড়াচ্ছে কেঁচোটা।

ভালই তো, সমানে সমান সুযোগ পাবে!

ড্রয়ার থেকে হাত বের করছে জাস্টিন পিটার। মুঠোয় ছোট্ট একটা পিস্তল।

যথেষ্ট সুযোগ পেয়েছে নর্দমার কীট। রানার হাত ঝড়ের বেগে নড়ে উঠতেই হোলস্টার থেকে ঝটকা দিয়ে বেরোল বেরেটা পিস্তল। বেসমেন্টের ভেতরে মৃদু খুক আওয়াজ তুলল ওটা। নাইন এমএম স্টিংগার বুলেট চেয়ারে গেঁথে দিল সিনেটরকে। একবার ঝাঁকি দিয়ে ডানদিকের কাঁধে হেলে গেল তার মাথা।

ঘুরে ডিভিডি আর টিভি সেট দেখল রানা। প্লেয়ার থেকে শিশু পর্নোগ্রাফির ডিভিডি নিয়ে রেখে দিল মৃত সিনেটরের বুকে। ঘর থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে চলে এল বাড়ির পেছনের দরজার কাছে। কবাট খুলে দেখে নিল এদিক-ওদিক। কেউ নেই আশপাশে। বাগান পার হয়ে বেড়ার দিকে যাওয়ার সময় সিনেটরের স্ত্রী আর মেয়েটার জন্যে খারাপ লাগল ওর।

সকালে লাশ দেখলেই সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে যোগাযোগ করবে তারা। কিছুক্ষণ পর এ-বাড়িতে এসে মৃতের বুকের ওপরে শিশু পর্নোগ্রাফির ডিভিডি পাবে কর্তৃপক্ষ। তাদের করা রিপোর্ট অনুযায়ী আরও নোংরা সব বিষয় মাটি খুঁড়ে বের করবে সাংবাদিকেরা। সমাজে আর কখনও মুখ দেখাতে পারবে না জাস্টিন পিটারের স্ত্রী আর মেয়ে।

জন ওয়েস্টন, পিট ব্ল্যাক আর জাস্টিন পিটার আর বেঁচে নেই। দুনিয়ায় রয়ে গিয়ে আরও পাপ করবে না তারা। অবশ্য এখনও ফূর্তিতে আছে অ্যালডো রসি আর এলিসা রসি। তারা অন্যদের চেয়ে বড় পাপী। অসহায় নিষ্পাপ শিশুদেরকে চিরকালের জন্যে পাঠাচ্ছে স্রেফ নরকে। কিন্তু আজ রাতে রানা বেঁচেবর্তে থাকলে এ-পৃথিবী ত্যাগ করতে হবে তাদেরকে।

বাড়তি সময় নেই রানার হাতে। ট্রাকে করে শিশুদেরকে রওনা করিয়ে দেয়ার আগেই যেতে হবে ট্রাকিং কোম্পানিতে।

কিছু বিষয় এখনও অপরিষ্কার ওর কাছে।

মি এসবে কীভাবে জড়াল সার্জেন্ট এবার্টন?

সে কি ঘুষের টাকার জন্যে বিক্রি হয়ে গেছে?

ওদিকে মাফিয়ার গুণ্ডারা কোথায় নিল লিউনাকে?

মস্ত বিপদে আছে মেয়েটা।

ওকে উদ্ধার করতে পারবে তো রানা?

সিনেটরের বাড়ি থেকে বেরিয়ে লিউনার গাড়িতে ফিরল রানা। জ্যামার, দড়ি আর অন্যান্য জিনিস রেখে দিল পেছনের সিটে। গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে ইউ টার্ন নিয়ে ঝড়ের বেগে চলল শহরতলী লক্ষ্য করে। ওর পরের গন্তব্য সিনেটরের বলে যাওয়া সেই স্কাই ট্রাকিং কোম্পানির হেডকোয়ার্টার।

একুশ

‘আপনার বিসিআই এজেন্ট, যাকে সন্তানের মত ভালবাসেন, সে কিন্তু গরম করে ফেলেছে শিকাগো শহর,’ এনক্রিপটেড ফোনে বললেন এফবিআই চিফ।

‘তুমি কি নিশ্চিত যে এসব করছে রানা?’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে জানতে চাইলেন বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান।

‘তা হলে আর কার সাধ্যি যে গোটা শহরের আণ্ডার- ওঅর্ল্ড এভাবে কাঁপিয়ে দেবে?’

বিশ্বযুদ্ধে মেজর রাহাত খানের অধীনে কাজ করেছেন এফবিআই চিফ হ্যারি হ্যারল্ড। ফ্রান্স ও জার্মানিতে ঢুকে নাৎসি বাহিনীর ঘাঁটিতে হামলা করেছেন তাঁরা। তখন হ্যারল্ড ছিলেন আমেরিকান মেরিনের একজন ক্যাপ্টেন।

‘তোমার কথা অনুযায়ী এসব করছে রানা,’ বললেন রাহাত খান। ‘কিন্তু ওর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ আছে তোমাদের হাতে?’

মৃদু হাসলেন এফবিআই চিফ হ্যারল্ড। ‘তা নেই। তবে কাজের ধরন দেখে সবই বুঝেছি। বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়ের কথা মনে পড়ে গেছে আমার। আর যাই হোক, আপনি বোধহয় নিজের হাতে রানাকে ট্রেনিং দিয়েছেন।’

‘তোমার বক্তব্য আসলে কী, হ্যারল্ড?’ আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন রাহাত খান। ‘আমাকে ফোন করেছ কী উদ্দেশ্যে?’

‘কিছু কারণে। আমিও চাই সাফ হোক শিকাগোর শত বছরের নোংরামি। আর সেজন্যে আমার ছেলেদেরকে বলেছি, আপাতত ওরা যেন ওদিকে পা না রাখে।’

‘শুধু এটা বলতে ফোন করেছ?’

‘না। আরও কিছু কথা আছে।’

‘বলো, কী বলবে।’

‘শিকাগোর পুলিশ ডিপার্টমেন্টে মাফিয়াদের কাছে বিক্রি হয়ে গেছে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার। তাই বলে পচে যায়নি সবাই। আর তাদেরই একজন সার্জেন্ট বার্কলে এবার্টন তলে তলে আণ্ডার-ওঅর্ল্ড আর দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ অফিসারদেরকে ধরতে তার সঙ্গে চুক্তি করেছি আমরা। আর আজ রাতে তার সঙ্গে দেখা করেছে রানা। ন্যায়পরায়ণ এক বা একাধিক পুলিশ অফিসারের হাতে সে ধরা পড়লে কোনভাবেই রেহাই পাবে না। কাজেই ওকে সতর্ক করা উচিত।’

‘অথচ তুমি চাও নিজের কাজ শেষ করুক রানা। তারপর যেন ত্যাগ করে শিকাগো?’

‘ঠিকই ধরেছেন। ওর কাজ শেষ হলে মাঠে নামবে আমার ছেলেরা।’

‘অর্থাৎ প্রাণের ঝুঁকি নেবে রানা, আর পরে হাসতে হাসতে গিয়ে সব কৃতিত্ব নেবে তোমার ছেলেরা।’

‘এ-ছাড়া কোন উপায়ও তো নেই, স্যর,’ নরম সুরে বললেন এফবিআই চিফ। ‘আমি ফোন করেছি, যাতে আপনি রানাকে বলেন, আগামীকাল ভোরের আগেই যেন শিকাগো ত্যাগ করে ও।’

‘তোমার মনে ‘হচ্ছে যে রানা আমার কথা শুনবে, হ্যারল্ড?’ চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাহাত খান।

সেক্ষেত্রে মস্ত বিপদে পড়বে ও। একবার গ্রেফতার হলে আগামী বিশ বছরেও আর জেল থেকে বেরোতে পারবে না।’

‘তোমার কথা তো শুনলাম। বেশ, চেষ্টা করব ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তবে আমার ভুল না হয়ে থাকলে ফোন বন্ধ করে কাজে নেমে পড়েছে ও।

‘আপনি ওকে সতর্ক করবেন মনে সে আশা নিয়েই ফোন দিয়েছি, স্যর,’ বললেন এফবিআই চিফ। ‘এটা দায়িত্ব বলেই মনে হয়েছে আমার। আমেরিকার তো কম উপকার করেনি রানা। তাই চাই না আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর হাতে হঠাৎ খুন হোক ও।’

‘এভাবে ভেবেছ সেজন্যে তোমাকে ধন্যবাদ, হ্যারল্ড।’

‘আপনি ভাল থাকবেন, স্যর। গুরুতর আহত আমাকে কাঁধে তুলে নিয়ে শত্রুদের ফাঁকি দিয়ে চার মাইল হেঁটে পৌঁছে দিয়েছিলেন ফ্রান্সের ফ্রাঁসোয়া ব্রা হসপিটালে। সেটা কখনও ভুলব না।’

ফোন রেখে ভুরু কুঁচকে দেয়ালের দিকে চেয়ে রইলেন বিসিআই চিফ। ভাল করেই জানেন, একবার কাজে নেমে গেলে কখনও পিছিয়ে যাবে না রানা।

.

শহরতলীতে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে স্কাই ট্রাকিং কোম্পানির হেডকোয়ার্টার আর একাধিক ওয়্যারহাউস। গা কাঁপানো হিমশীতল রাতে ট্রাকের একটা ইঞ্জিনের গর্জন ছাড়া কোথাও কোন আওয়াজ নেই। সাদা বরফে চাঁদের রুপালি আলো পড়ে তৈরি করেছে ফ্যাকাসে অদ্ভুত আভা। কাঁটাভরা বড় এক বেরি বুশের নিচে পাথরের মত পড়ে আছে রানা। নাইট- ভিশন গগল্‌স্ পরা চোখদুটো চেয়ে আছে সামনের কাঁটাতারের ওদিকে।

চরম শীতেও ওভারকোট খুলে কমব্যাট স্যুট পরে নিয়েছে রানা। মুখে ক্যামোফ্লেজ কসমেটিক। ইনফ্রারেড নাইট-ভিশন গগলসের জন্যে ওকে দেখলে যে-কেউ ভাববে, আকাশ থেকে নেমে এসেছে বিদঘুটে এক এলিয়েন! ওর ডান ঊরুর হোলস্টারে অটোম্যাগ, বামকাঁধের হোলস্টারে বেরেটা। বুকের মিলিটারি ওয়েবিঙে অ্যামিউনিশন, গ্রেনেড আর ডানহাতের স্ট্র্যাপের লুপে ম্যাক-১০ এসএমজি।

আশপাশে বিশাল খোলা জমি নিয়ে যেসব ওয়্যারহাউস আর কারখানা, সেসব থেকে অনেক আলাদা অ্যালডো রসির ট্রাকিং অ্যাণ্ড শিপিং কোম্পানি-কাঁটাতারের উঁচু বেড়া দিয়ে ঘেরা। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে ওটার তিরিশ ফুট দূরে পৌঁছে গেছে রানা।

কম্পাউণ্ডের দূরে দূরে বৈদ্যুতিক থামে জ্বলছে শক্তিশালী বাতি। অবশ্য ওসবের মাঝে রয়ে গেছে ঘন কালো ছায়া। আর তেমনই এক অন্ধকার অংশের দিকে এগিয়ে চলল রানা। মিনিট দুয়েক পর পৌঁছে গেল কাঁটাতারের বেড়ার পাশে। ছোট কিন্তু দামি এক ওয়াওয়ায়ার কাটার দিয়ে কুটকুট শব্দে কেটে একমিনিটে তৈরি করল কাঁটাতারের বুকে বড় একটা ফুটো। পরের দশ সেকেণ্ডে ঢুকে পড়ল কম্পাউণ্ডে। উঠে একছুটে গিয়ে থামল একটা ওয়্যারহাউসের পাশের ছায়ায়।

একটু দূরে ট্রাকিং কোম্পানির একতলা অফিস দালান। চেইন লিঙ্ক দিয়ে ঘেরা উঠনের মত জায়গায় ডযনেরও বেশি ট্রেইলার ট্রাক। একেকটা যেন লোহার তৈরি ভয়ঙ্কর সব বিশাল দানব। নিশুতি রাতে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে এক ওয়্যারহাউসের ভেতরে ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলছে ভারী কোন ট্রাকের ইঞ্জিন।

চামড়ার জুতো পরনে মচমচ শব্দ করে রানার দিকেই এল কে যেন!

লোকটা অ্যালডো রসির দলের গুণ্ডা।

ওয়্যারহাউসের কোনা ঘুরেই বিপদে পড়ল সে। মাটিতে শরীর গড়িয়ে সরাসরি চলে গেছে রানা তার সামনে। লোকটার দু’হাঁটু ধরে বামহাতে হ্যাঁচকা টান দিল ও।

রানার পাশে ধুপ করে পড়ল গার্ড। চেঁচিয়ে ওঠার আগেই তার মাথার পেছনে লাগল রানার ডানহাতি প্রচণ্ড এক ঘুষি। জ্ঞান হারাতেই শিথিল হয়েছে লোকটা দেহ। পাশেই পড়ে আছে রাইফেল। লোকটার সঙ্গে আরও কেউ আছে কি না, সেটা বুঝতে আরও কয়েক সেকেণ্ড নিল রানা।

না, আর কেউ নেই।

উঠে চারপাশে দেখে নিল ও। বুঝতে দেরি হয়নি, পৌঁছে গেছে ঠিক জায়গায়। গার্ডদের মোকাবিলা করতে তৈরি হয়ে আছে। কিন্তু তারা বোধহয় অপ্রস্তুত।

অ্যালডো আর এলিসা জানে না, ওয়েস্টনের মৃত্যু-খবর শুনে ভয় পেয়ে শিশু অপহরণের ব্যাপারে সবই ফাঁস করে দিয়েছে সিনেটর। তারপর খুন হয়ে গেছে ওর হাতে।

ওয়্যারহাউসের কোনায় থেমে পরের দালানের দিকে তাকাল রানা। দূরে চেইন লিঙ্কের ওদিকে একের পর এক ট্রাক। বাড়তি নিরাপত্তার জন্যে ওখানে দু’সারি তারকাঁটার বেড়া। উঁচু দরজাওয়ালা এক দালানের সামনে এক ডযনেরও বেশি ট্রাক্টর ট্রেইলার। দালানের দরজাটা এখন বন্ধ। রানা আন্দাজ করল, ওটার ভেতরে আছে ট্রাকের পার্টস আর যন্ত্রপাতি। এক ওয়্যারহাউসের ওপরে গিয়ে থামল ওর চোখ। দালানের ভেতর থেকে এল ট্রাকের ইঞ্জিনের আওয়াজ। এইমাত্র লোডিং ডকের দিকে পিছিয়ে গেছে যন্ত্রদানবটা।

চট্ করে হাতঘড়ি দেখল রানা। মাত্র দশ মিনিট পর ঘড়ির মিনিটের দীর্ঘ কাঁটা স্পর্শ করবে রাত বারোটা।

ওয়্যারহাউসের খোলা দরজা দিয়ে মানুষের নড়াচড়া দেখতে পেল রানা। কালো কমব্যাট স্যুটের পকেট থেকে ছোট্ট বিনকিউলার নিয়ে ওটার ভাঁজ খুলে চোখে লাগাল। একলাফে নাকের কাছে চলে এল দৃশ্যটা।

ওয়্যারহাউসের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চা কয়েকটা ছেলেমেয়ে। যারা বাবা-মার কাছ থেকে ওদেরকে কেড়ে নিয়েছে, তাদের প্রতি তীব্র ঘৃণায় বুকে আগুন ধরল রানার।

দরজা আধখোলা। ওয়্যারহাউসের পুরো দৃশ্য দেখতে . পাচ্ছে না রানা। যদিও যা দেখেছে, তাতে বুঝতে দেরি হয়নি, নানান জাতের শিশু ধরে এনেছে এরা। বাচ্চাদের সবার চোখে ভীষণ ভয়। কাঁদছে কেউ কেউ। শটগান হাতে দুই লোক একে একে ওদেরকে তুলে দিচ্ছে মস্ত এক ট্রাকের ট্রেইলারের ভেতরে।

বছর পাঁচেকের এক ছেলে হাঁটতে গিয়ে পিছিয়ে গেছে। ওর ঘাড় চেপে ধরে জোরে সামনে ঠেলল এক গার্ড। ভারসাম্য হারিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল ছেলেটা। ঝুঁকে দু’হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে ওকে তুলল গার্ড। রাগে বিকৃত হয়েছে তার মুখ। এত দূর থেকে বক্তব্য না শুনলেও বুঝে গেল রানা, জঘন্য সব গালি বাচ্চাটাকে দিচ্ছে লোকটা।

এক সেকেণ্ডের জন্যে রানার মনে হলো অটোম্যাগ বের করে গুলি করতে করতে ঢুকবে ওয়্যারহাউসের ভেতরে। পরক্ষণে সামলে নিল নিজেকে। যুদ্ধের কৌশলে ভুল করার কোন উপায় আসলে নেই ওর।

এখন ঝড়ের বেগে ওয়্যারহাউসে ঢুকলে শুরু হবে ক্রস ফায়ার। ফলে গোলাগুলিতে মরবে শিশুদের অনেকে। সুতরাং এখন চাই সবার মনোযোগ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার মত ভাল কোন পথ। ওয়্যারহাউস থেকে সরে পরের দু’মিনিটে ছায়ার ভেতর দিয়ে হেঁটে ট্রাক রাখার উঠনের পেছনে চলে এল রানা। কম্পাউণ্ডের সামনে শক্তিশালী বাতি থাকলেও এদিকে আছে স্রেফ ঘন ছায়া। ট্রাকের উঠনের পেছনে তারকাঁটার বেড়ার মাঝে ছোট একটা দরজা দেখতে পেল রানা। অবশ্য ওদিক দিয়ে ঢোকার কথা ভাবছে না ও। থামের নিচে জোরাল আলোয় দাঁড়িয়ে আছে দু’জন গার্ড। নিরস্ত্র করতে হবে তাদেরকে। বেরেটা দিয়ে গুলি করলে কেউ না কেউ দেখবে যে খুন হয়ে গেছে তারা।

বেড়ার পাশ দিয়ে হেঁটে প্রায়ান্ধকার এক জায়গায় গিয়ে থামল রানা। চেইন লিঙ্কে টান দিয়ে তৈরি করল মৃদু ঠুং-ঠাং আওয়াজ। আড়ষ্ট হয়ে গেছে দু’গার্ডের একজন। ঘাড় ঘুরিয়ে রানার দিকে তাকাল সে। পাশের জনকে বলল, ‘শুনলে?’

মাথা নাড়ল দ্বিতীয় গার্ড। ‘কিছুই শুনিনি।’-

‘আমি শুনেছি। ওদিকটা দেখে আসি।’ সাবমেশিন গান শক্ত হাতে ধরে ধীরপায়ে বেড়ার ছায়াময় জায়গার দিকে এল সে। পেছন থেকে বিড়বিড় করে কী যেন বলল তার সঙ্গী।

ছায়ার ভেতরে মূর্তি হয়ে গেছে রানা। লোকটা পাঁচ ফুটের ভেতরে আসতেই তার গলায় বেরেটা দিয়ে গুলি করল ও।

উযি সাবমেশিন গান ফেলে দু’হাতে ঘাড় ও গলা চেপে ধরেছে গার্ড। আঙুলের ফাঁক দিয়ে ফিনকি দিয়ে বেরোচ্ছে টকটকে লাল রক্ত। দেহের ওজন ধরে রাখতে না পেরে ধুপ করে মাটিতে পড়ল সে। বারকয়েক ছটফট করে থেমে গেল।

সাইলেন্সার্ড বেরেটার ‘খক’ শব্দ না পেলেও সাবমেশিন গান পেভমেন্টে পড়ার ঠং-ঠনাৎ আওয়াজ শুনতে পেয়েছে দ্বিতীয় গার্ড। ফলে হয়ে গেছে সতর্ক। যেদিকের ছায়ায় গেছে সঙ্গী, সাবমেশিন গানের মাল ওদিকে তাক করল সে।

‘এরিক?’ নিচু গলায় ডাকল। ‘ওদিকে কী? এরিক!’

জবাব দিচ্ছে না এরিক। আরও কয়েক সেকেণ্ড পর রানার দিকে এল লোকটা, খুব নার্ভাস।

চুপচাপ আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে রানা।

ছায়ায় ঢুকে হঠাৎ করে সঙ্গীর দেহ দেখতে পেয়ে থমকে গেল দ্বিতীয় গার্ড। উযি হাতে শত্রুকে গুলি করতে এদিকে- ওদিকে ঘোরাল মাযল। ঘন ছায়ায় নড়ছে না কিছু। এরিকের লাশের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল লোকটা। আর তখনই বিন্দুমাত্র ব্যথা ছাড়াই খতম হয়ে গেল সে। রানার বেরেটার নাইন এমএম গুলির আঘাতে উড়ে গেছে তার মাথার তালু। উধাও হয়েছে মগজের বড় অংশ। চেইন লিঙ্কের বেড়ার পাশে পড়ল তার লাশ।

ছায়ায় দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকাল রানা। ওর মনে হলো না যে কারও কানে গেছে কোন শব্দ। চিৎকার করেনি কেউ। কেউ ছুটে আসেনি এদিকটা দেখার জন্যে।

মাঝের ওয়্যারহাউসের লোডিং ডকে ব্যস্ত অ্যালডো রসির গুণ্ডারা। এরিক নামের গার্ডের লাশ চিত করল রানা। লোকটার পরনে ওভারকোট। মাথায় ফারের ফ্ল্যাপ দেয়া ক্যাপ। আধমিনিটে ওভারকোট ও ক্যাপ খুলে নিয়ে নিজে পরল রানা। ছায়া থেকে বেরিয়ে হেঁটে চলল ট্রাক রাখার উঠনের দিকে। যে-কেউ দেখলে বুঝবে, কাউকে তোয়াক্কা করে না এ-লোক।

ট্রাক রাখার উঠনের কাছে যেতেই অফিস দালান থেকে রানার দিকে এল এক গার্ড। খুশি-খুশি স্বরে বলল, ‘কী, এরিক? কোন সমস্যা? লিয়ো কোথায়?’

না থেমে পেছনের বেড়ার দিকে বুড়ো আঙুল তাক করল রানা। চাপা স্বরে বলল, ‘ওদিকে। অসুস্থ।’

ওর পাশে এসে হাঁটতে লাগল তৃতীয় গার্ড। ‘কী হয়েছে ওর?’

জবাবে কাঁধ ঝাঁকাল রানা। আর মাত্র ক’ফুট দূরে ছায়ার ভেতরে বিশাল সব ট্রাক। খপ্ করে রানার বাহু ধরল লোকটা। ‘আমাদের দেখা উচিত না যে কী হয়েছে ওর?

‘তুমি গিয়ে দেখো।’ আলোকিত জায়গা থেকে ছায়ায় ঢুকল রানা। এখনও পাশে হাঁটছে গার্ড। তাকে ছায়ার ভেতরে পাওয়ার জন্যেই অপেক্ষা করেছে রানা। কণ্ঠার ওপরে প্রচণ্ড এক ঘুষি খেল গার্ড। চুরমার হয়ে গেছে অ্যাডাম্‌স্‌ অ্যাপল। শ্বাস আটকে গেলেও সাবমেশিন গান ওপরে তুলতে চাইল লোকটা। পরক্ষণে তার নাকে-মুখে ম্যাক-১০ এসএমজির নল দিয়ে জোর খোঁচা দিল রানা। বিশ্রী রক্তাক্ত ক্ষত তৈরি হয়েছে গার্ডের মুখে। পরের সেকেণ্ডে অস্ত্রের বাঁট দিয়ে তার চোয়ালে গায়ের জোরে মারল রানা। খুব দ্রুত পেছনে গেল গার্ডের মাথা। কড়াৎ আওয়াজে ভেঙে গেছে ঘাড়। ঝুপ করে মাটিতে পড়ল লোকটার লাশ।

ম্যাক-১০ হাতে চারপাশে দেখে নিল রানা।

কেউ নেই এদিকে।

ওভারকোট আর ক্যাপ খুলে মাটিতে ফেলল ও। কাঁধে ঝুলিয়ে নিল এসএমজি। কুঁজো হয়ে ঢুকে পড়ল আঠারো চাকার বিশাল এক ট্রাকের নিচে। বেল্টে ঝুলন্ত প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে নিল সাদা কেকের মত কী যেন। যে-কোন দেশের মিলিটারির দক্ষ যোদ্ধা বলবে ওটা প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ। ট্রাকের পেট্রল ট্যাঙ্কের নিচে একটুকরো বোমা সেট করে ওটার গায়ে ছোট্ট টাইমার গেঁথে দিল রানা। সময় স্থির করেছে মাত্র চার মিনিটের জন্যে।

এরই ভেতরে বোধহয় ওয়্যারহাউসে ট্রাকের ট্রেইলারে তোলা হয়েছে শিশুদেরকে। আর ওদের কথা ভেবে বোমার টাইমারে বাড়তি সময় সেট করতে পারেনি রানা। একের পর এক ট্রাকের তলায় ঢুকছে ও। চতুর্থ ট্রাকের ট্যাঙ্কের নিচে বসিয়ে দিল শেষ বোমা। টাইমারের সময় আগের মতই। সব মিলিয়ে চারটে ট্রাকের নিচে বোমা বসাতে গিয়ে রানার লেগেছে মাত্র আড়াই মিনিট।

এবার উদ্ধার করতে হবে শিশুদেরকে।

এই কম্পাউণ্ডে ঢুকে মাফিয়া ডন অ্যালডো রসি আর তার বোন এলিসা রসিকে দেখতে পায়নি রানা। এ-ও জানে না, এখানে আছে কি না লিউনা। অবশ্য ওর মন বারবার বলছে, কাছেই আছে মেয়েটা।

— দূরের এক ট্রাকের পাশে গিয়ে বসল রানা। বোমা ফাটলে তীরবেগে ছুটবে ওয়্যারহাউস্ লক্ষ্য করে। যদিও কয়েক সেকেণ্ড পর যা দেখল, তাতে বাধ্য হয়ে পাল্টে নিল প্ল্যান।

বিশাল লোডিং ডকের পাশে খুলে গেছে সরু এক দরজা। বেরিয়ে এল একে একে চারজন। কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে নিচু একতলা অফিসের দিকে চলল তারা। আগে আগে হাঁটছে অ্যালডো রসি। মাফিয়া ডনের পেছনেই এলিসা রসি তাকে আগেরবার ডনের বাড়িতে উলঙ্গ দেখেছে রানা। এখন তার পরনে শীতের অভিজাত পোশাক। মহিলার পেছনে হাঁটছে লিউনা, পাশেই রাস্তার এক মস্তান। লিউনার কবজি শক্ত করে ধরে প্রায় হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে সে।

রানার মনে পড়ল, একটু আগে ওয়্যারহাউসের ভেতরে বাচ্চা এক ছেলের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে এক গুণ্ডা।

মগজের ঘড়ির প্রতিটি সেকেণ্ড এখন গুনছে রানা। অফিসের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল অ্যালডো, এলিসা, লিউনা আর মাফিয়ার মস্তান। আটকে গেল দরজা। ঝড়ের বেগে অফিসের দিকে ছুটল রানা। এখন কেউ দেখে ফেলবে কি না, সেটা নিয়ে ভাবছে না।

অফিসের ভেতরে শেড নামানো জানালার ওদিকে জ্বলে উঠেছে বৈদ্যুতিক বাতি। যত্নের সঙ্গে শেড টেনে নেয়া হয়নি বলে নিচে রয়েছে সামান্য ফাঁক। অফিসের জানালার সামনে থেমে ভেতরে উঁকি দিল রানা।

স্টিলের ডেস্কের ওপরে বসেছে এলিসা। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে অ্যালডো রসি। দু’জনই চেয়ে আছে মস্তানের দিকে। ডেস্কের একটু দূরে জোর করে পিঠসোজা এক চেয়ারে লিউনাকে বসিয়ে দিয়েছে লোকটা।

জানালা থেকে সরে দরজার সামনে পৌঁছে গেল রানা। কবাটে কয়েকবার টোকা দিয়ে কাঁধের স্লিং খুলে হাতে নিল ইনগ্রাম ম্যাক-১০। ক্রস ড্র করেছে বলে ওর বামহাতে উঠে এসেছে অটোম্যাগ। পরক্ষণে কাঁধ দিয়ে জোর এক গুঁতো মেরে দরজার কবজা ভেঙে ঘরের ভেতরে ঢুকল রানা।

হুড়মুড় করে দরজা খসে পড়তেই চমকে গিয়ে ওর দিকে তাকাল রসিদের দলের গুণ্ডা। ভুলে গেছে লিউনার কথা। দু’হাতে শটগান ওপরে তুলতে চাইল সে। কিন্তু বন্দুকের বাঁট কাঁধে তোলার আগেই এসএমজির ট্রিগার স্পর্শ করল রানা। ‘একরাশ গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হলো লোকটার বুক। পিঠের ফুটো দিয়ে কয়েক ধারায় ছিটকে বেরোল রক্ত। পিছিয়ে অফিসের আরেকদিকের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে পড়ল সে। অবশ হাত থেকে খসে গেছে শটগান। মৃত্যুর দু’সেকেণ্ড আগে থরথর করে কাঁপল লোকটার দেহ।

চমকে গিয়ে ডেস্ক থেকে নেমে পড়েছে এলিসা রসি। এতই বিস্মিত যে বিকৃত দেখাল তার সুন্দর মুখ।

রানাকে দেখে হতবাক হয়ে গেছে লিউনা। ওর মুখ ঢেকে দিয়েছে একরাশ কালো চুল। হাত দিয়ে ওগুলো সরিয়ে রানাকে দেখল লিউনা, সাগর-নীল চোখে স্বস্তির ছাপ।

এদিকে আগের জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে অ্যালডো রসি। অস্ত্র বের করার জন্যে কোটে ভরেছে ডানহাত। রানার হাতে .দুটো আগ্নেয়াস্ত্র দেখে বিস্ফারিত হয়েছে তার দু’চোখ।

‘একদম নড়বে না!’ ধমকের সুরে বলল রানা। অটোম্যা তাক করেছে অ্যালডো রসির মাথায়। এদিকে এলিসা রসির বুকের দিকে চেয়ে আছে ইনগ্রামের মাযল।

‘রানা!’ ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলল লিউনা। ‘বোঝাতে পারব না তোমাকে দেখে কতটা ভাল লাগছে!’

দু’ভাই-বোনের ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে বলল রানা, ‘তুমি ঠিক আছ তো, লিউনা?’

‘ভাল আছি।’ চেয়ার ছেড়ে ওর পাশে চলে এল মেয়েটা। কণ্ঠে প্রকাশ পেল জরুরি ভাব: ‘বাচ্চারা এখানেই আছে, রানা! ওদেরকে বাঁচাতে হবে! একটু পর কোথায় যেন নেবে একটা ট্রাকে করে!’ রসি পরিবারের দুই দুশ্চরিত্র ভাই-বোনের দিকে তাকাল লিউনা। ‘এরা মানুষের বাচ্চা না! কুত্তার বাচ্চারাও এদের চেয়ে অনেক পবিত্র!’

লিউনাকে উপেক্ষা করে রানার দিকে তাকাল এলিসা রসি। সহজ সুরে বলল, ‘এত নাটকের কিছু নেই। মিস্টার রানা, এখানে এসে তোমার কোন লাভ হলো না। আমাদের সঙ্গে আছে কমপক্ষে ত্রিশজন সৈনিক। ‘

বড়বোনের কথায় শান্ত হয়ে গেছে অ্যালডো রসি। ঘর্মাক্ত চেহারায় টিটকারির হাসি ফুটল তার। মাথা দুলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি খুন হয়ে গেছ, রানা! যদিও সেটা জানো না!’

মাফিয়া ডন অ্যাড্রিয়ানোর ছেলেমেয়েদের সাহস সত্যিই দেখার মত, ভাবল রানা। বিশেষ করে এলিসা রসির। ‘আমার নিজের আসলে তেমনটা বলে মনে হচ্ছে না,’ বলল রানা।

‘মানে?’ কিছুটা সংশয়ের সুরে বলল এলিসা।

জবাব না দিলেও চলে সেটা বুঝেও বলল রানা, ‘আমি এসেছি স্নিগ্ধা আর তুষারের মৃত্যুর বদলা নিতে। সুতরাং খুন যদি হয়েই যাই, তার আগে খতম করে দেব তোমাদেরকে।’

অ্যালডো ও এলিসার দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে রানা, এমনসময় হঠাৎ করেই একের পর এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল চারপাশ। বাইরে ছিটকে উঠেছে আগুনের বিশাল সব হলকা। রক্তিম হয়ে গেছে রাতের আকাশ।

বাইশ

রানা বাদে অন্যদের ধারণা: বিস্ফোরিত হয়েছে প্রচণ্ড শক্তিশালী কোন নাপাম বোমা। অফিসের ভেতরে চমকে গেছে অ্যালডো, এলিসা আর লিউনা। অবশ্য চট করে নিজেকে সামলে নিল অ্যালডো রসি। রানাকে গুলি করবে বলে শোল্ডার হোলস্টার থেকে বের করতে চাইল পিস্তল। আর তখনই আর্তনাদ করে উঠল এলিসা রসি, ‘অ্যালডি! খবরদার! নাহ!’

মাফিয়া ডনের হাতে পিস্তল উঠে আসতেই তার মুখ লক্ষ্য করে অটোম্যাগের গুলি পাঠাল রানা। হাত-কামানের বুলেটের আঘাতে মেঝে ছাড়ল অ্যালডোর দু’পা। ঘরের কোণে গিয়ে ছিটকে পড়ল মুণ্ডহীন দেহটা।

বাইরে আরও বিস্ফোরণের আওয়াজ। একে একে ফাটছে অক্ষত ট্রাকের পেট্রল ট্যাঙ্ক। লাফ দিয়ে আকাশ চেটে দিচ্ছে নীল আগুনের হলকা। ছোটভাইয়ের মুণ্ডহীন দেহের দিকে চেয়ে আছে এলিসা রসি। কয়েক সেকেণ্ড পর ঘুরে তাকাল রানার দিকে।

চোখ বুজে রানার কাঁধে মুখ গুঁজল লিউনা। ডানহাতে ওকে জড়িয়ে ধরেছে রানা। অন্যহাতে ইনগ্রাম এসএমজি। অস্ত্রটা তাক করা আছে মাফিয়া দলের সত্যিকারের বস এলিসার দিকে। সে-ই আসলে সব অপরাধের মূল হোতা।

‘তুমি… তুমি খুন করেছ আমার ভাইকে!’ ফিসফিস করল এলিসা। ‘আমার ছোট্ট ভাইটাকে খুন করলে!’

‘আজ পর্যন্ত কত শিশুকে ধরে এনে পাচার করেছ, মিস রসি?’ বরফের মত ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল রানা।

ওর কথায় মনে মনে হোঁচট খেল মহিলা। বিড়বিড় করে বলল, ‘অ্যালডি একসময়ে খুব নিষ্পাপ ছিল। হাসিখুশি একটা ছেলে। আমার কথার এদিক-ওদিক কখনও করত না।’

‘সেটাই ছিল তার মস্তবড় ভুল,’ কঠোর সুরে বলল রানা।

কথাটা শুনে বিকৃত হলো এলিসার চোখ-মুখ। ভাল করে দেহে জড়িয়ে নিল ফারের কোট। রাজকীয় ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি বাড়ি ফিরছি। জানি, বাধা দেবে না। তোমাকে চিনি, মাসুদ রানা, নিরস্ত্র কোন মহিলাকে গুলি করবে না তুমি।’

মুখ তুলে রানার চোখ দেখল লিউনা। বুঝে গেল দ্বিধায় পড়েছে সিংহ হৃদয়ের মানুষটা।

এদিকে রানার মনে এল ওয়্যারহাউসে বাচ্চা ছেলেটাকে হ্যাঁচকা টানে তোলার দৃশ্য। একবার পিচ্চিটাকে পাচার করে দিলে প্রচণ্ড নির্যাতনের মধ্যে পড়বে বেচারা। ওর মত নিষ্পাপ শিশুদেরকে দিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করত অ্যালডো আর এলিসা। ভিডিয়োগুলো পাঠাত সিনেটর পিটারের মত একদল পশুর কাছে। না, এরা আসলে সত্যিই মানুষের পর্যায়ে পড়ে না! শত শত বাবা-মার বুক খালি করে দিয়েছে স্রেফ টাকার জন্যে। কখনও ভাবেনি কী হবে বাচ্চাগুলোর ভবিষ্যৎ। আর এসবের পেছনে যে পিশাচী, সে এখন বলছে তাকে গুলি করতে পারবে না রানা!

‘শিশু কিডন্যাপ করে মহিলাদের সম্পর্কে আমার ভাবনা পাল্টে দিয়েছ তুমি,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল রানা। ও ইনগ্রামের ট্রিগার টিপে দেয়ার আগেই অস্ত্রটা কেড়ে নিল লিউনা।

এসএমজির নল ঘুরিয়েই পুরো ম্যাগাজিন খরচ করল এলিসা রসির বুক-পেটে। কয়েক হোঁচট খেয়ে পিছিয়ে কাঁচের জানালার ওপরে পড়ল মহিলা ডন। কাঁচ ভেঙে জানালার এদিকে রইল তার কোমর, বাকি অংশ বাইরে। বুক-পেট ও পিঠ থেকে ঝরঝর করে ঝরছে রক্ত।

রানার কাঁধে মুখ না লুকিয়ে মহিলার লাশের দিকে চেয়ে রইল লিউনা। ওর কাছ থেকে অস্ত্রটা নিল রানা। বাটন টিপে ম্যাগাযিন মেঝেতে ফেলে ভরে নিল নতুন ক্লিপ

‘আমি কোন অন্যায় করিনি, তা-ই না?’ কৌতূহলী চোখে রানাকে দেখল লিউনা।

মাথা দোলাল রানা। ‘ঠিকই বলেছ। এসো, এখনও অনেক কাজ পড়ে আছে।’ হোলস্টার থেকে নিয়ে লিউনার হাতে দিল বেরেটা। তুমি লড়তে চাও, তা-ই না? এবার সে- সুযোগ পাবে।

‘তুমি দেখো, মাফিয়ার গুণ্ডাদের মাথা উড়িয়ে দেব!’

কীভাবে পিস্তল চালাতে হবে সেটা লিউনাকে শিখিয়ে দিল রানা। ওরা অফিস থেকে বেরোবে, তার আগেই ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকল এক যুবক। ‘ডন রসি…’ ঘরের ভেতরে লাশ দেখে কড়া ব্রেক কষে থামল সে। পিস্তল বের করবে, কিন্তু তার আগেই ইনগ্রামের তিনটে নাইন এমএম বুলেট দু’টুকরো করে দিল ইতালিয়ান যুবকের মাথা।

লিউনার হাত ধরে লাশ টপকে অফিস থেকে বেরিয়ে এল রানা। ট্রাকগুলোর ট্যাঙ্ক ফেটে গ্যালনের পর গ্যালন পেট্রল গড়িয়ে গেছে চারদিকে। দাউ-দাউ করে জ্বলছে উঠনে রাখা ট্রাক ও ট্রেইলার। রাতের কালো আকাশে উঠছে আগুনের লাল-নীল-বেগুনি স্তম্ভ। চারপাশে প্রচণ্ড তাপ।

তরল আগুন ঢুকে গেছে মেইনটেন্যান্স গ্যারাজে। এরই ভেতরে পুড়ছে সামনের দেয়াল। পাশের ওয়্যারহাউস অবশ্য এখনও অক্ষত। ওখানে আছে অপহৃত শিশুরা। লোডিং ডকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ট্রাক্টর ট্রেইলার।

কে বা কারা হামলা করেছে সেটা না জানলেও, উঠনে ছোটাছুটি করছে এলিসার মাফিয়াসোরা। ট্রাকের ট্যাঙ্কের পেট্রল ছিটকে পড়ে আগুন ধরে গেছে কয়েকজনের শরীরে। তাদেরকে জীবন্ত মশাল বলে মনে হলো রানার। দ্বিতীয়বার ওদিকে না চেয়ে ওয়্যারহাউসের দিকে ছুটল লিউনা আর ও।

মস্তবড় দরজার কাছে পৌঁছে গেছে, এমনসময় ওদেরকে দেখে চিৎকার করে উঠল এক গার্ড। ‘ওই যে! এরাই আগুন দিয়েছে!’

রানার দিকে সাবমেশিন গানের নল ঘোরাল সে, কিন্তু গুলি করার আগেই তার বুকে বিঁধল ইনগ্রামের তিনটে গুলি। কাত হয়ে মেঝেতে পড়ল লোকটা। মৃত্যু-যন্ত্রণায় ট্রিগারে চেপে বসেছে তর্জনী। অস্ত্র থেকে আকাশে গেল কিছু গুলি।

ওয়্যারহাউসের ভেতরে লোডিং ডকে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। হঠাৎ করে রানা আর লিউনাকে দেখে ওদেরকে লক্ষা করে বন্দুকের দুই নল খালি করল সে। তাড়াহুড়ো করে বলে ওদের কয়েক ফুট দূর দিয়ে গেল এলজি বুলেট।

থমকে থেমে বেরেটা থেকে গুলি করল লিউনা। ওর অস্ত্রটা আছে থ্রি-শট মোড-এ। আগুনের শোঁ-শোঁ গর্জন আর মাফিয়ার গুণ্ডাদের চেঁচামেচিতে হারিয়ে গেছে পিস্তলের হুঙ্কার। ট্রাকের দরজার কাছে পেটে তিনটে গুলি নিয়ে দু’ভাঁজ হয়ে লোডিং ডক থেকে নিচে পড়ল বন্দুকওয়ালা। একতিল নড়ছে না আর। উঠনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে নিজেদের ভেতরে চিৎকার করে কথা বলছে গুণ্ডারা।

একদৌড়ে লোডিং ডকের কাছে পৌঁছে গেল রানা আর লিউনা। সিঁড়ি বেয়ে না উঠে লাফিয়ে লোডিং ডকে উঠল রানা। সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে মেঝেতে পিছলে গেল ও। আর সেজন্যেই বেঁচে গেল প্রাণে। এক সেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল, সেখান দিয়ে গেল অটোমেটিক পিস্তলের কয়েকটা গুলি।

উঠে বসেই ঘুরে পাল্টা গুলি পাঠাল রানা। ইনগ্রামের নল দিয়ে বেরোল একনাগাড়ে কমলা আগুন। অস্ত্রের চেম্বার থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে খরচ হয়ে যাওয়া গুলির তামার শেল। পর পর কয়েকটা গুলির আঘাতে ঝাঁঝরা হলো ওয়্যারহাউসের মেঝেতে দাঁড়িয়ে থাকা গুণ্ডার বুক।

ঝট করে ডানে সরে গেল রানা। এক সেকেণ্ড আগে যেখানে ছিল, ওখানে লাগল বেশ কয়েকটা বুলেট।

লোডিং ডকের সিঁড়ি বেয়ে উঠেছে লিউনা। একপাশে সরে গিয়ে পর পর কয়েকটা গুলি পাঠাল দুই গুণ্ডার দিকে। রানাকে লক্ষ্য করে গুলি করছে তারা। লিউনার দিকে সাবমেশিন গান ঘোরাবার আগেই নাইন এমএম বুলেটের আঘাতে মেঝেতে ছিটকে পড়ল তারা দু’জন। একজন এখনও জীবিত। ফুটো হওয়া পেটের প্রচণ্ড ব্যথায় গলা ফাটিয়ে আর্তনাদ ছাড়ছে।

ইনগ্রাম থেকে একপশলা গুলি করে যন্ত্রণা থেকে তাকে রেহাই দিল রানা। ওর অস্ত্রের নলের মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে ধূসর ধোঁয়া। বাটন টিপে খালি ক্লিপ ফেলে নতুন ম্যাগাযিন ভরে নিল। রানার কাছে এসে দাঁড়াল লিউনা। পরস্পরের দিকে পিঠ রেখে শত্রুদেরকে খুঁজছে ওরা।

জ্বলন্ত ট্রাকগুলোর কাছ থেকে লোডিং ডক লক্ষ্য করে ছুটে এল দুই গুণ্ডা। রানার ইনগ্রামের দু’দফা গুলি বুকে বিধতেই মাটিতে পড়ে গেল তারা।

শিশুদের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল রানা আর লিউনা। ট্রাকের দিকে চোখ যেতেই দেখল, এরই ভেতরে ট্রেইলারে তুলে দেয়া হয়েছে শিশুদেরকে। বিকট আওয়াজে ভয় পেয়ে দরজার কাছ থেকে সরে আরও ভেতরে গেছে ওরা। চুপ করে আছে কেউ কেউ। আবার কারও চোখ বেয়ে ঝরছে অশ্রু। ক’জন গলা ছেড়ে কাঁদছে। আতঙ্কে থরথর করে কাঁপছে ওরা সবাই।

ছুটে গিয়ে ট্রাকের ট্রেইলারে ঢুকল লিউনা। স্টিলের বদ্ধ বাক্সের মত জায়গায় ফাঁপা শোনাল ওর পায়ের আওয়াজ। ওকে দেখে ভয় পেয়ে সরে যেতে চাইল কয়েকটা শিশু। কিন্তু ওদের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাত দু’দিকে ছড়িয়ে দিতেই লিউনার বুকে এসে মাথা গুঁজল ওরা। চিনে গেছে ওদের প্রিয় আণ্টিকে।

‘কিচ্ছু হয়নি, সোনামণিরা,’ বুজে আসা কণ্ঠে বলল লিউনা। চোখ বেয়ে দরদর করে ঝরছে অশ্রু। ‘তোমাদের কোন ক্ষতি হবে না। কেউ ক্ষতি করতে পারবে না। এই যে আমি চলে এসেছি!’

ট্রাকের পেছনে ইনগ্রাম এসএমজি হাতে তৈরি হয়ে আছে রানা। শত্রুপক্ষের কেউ এদিকে এলে গুলি করবে। দেখতে পেল, ড্যাব-ড্যাব করে ওকে দেখছে পিচ্চিরা। ওদের একজনের বয়স বড়জোর পাঁচ। ছেলেটা অবাক চোখে দেখছে কালিঝুলি মাখা লোকটাকে। পিচ্চির দিকে চেয়ে ডানচোখ টিপল রানা। তাতে মস্ত এক ফোকলা হাসি দিল উপমহাদেশীয় ছেলেটা। ‘আমি কিন্তু তোমাকে ভয় পাই না, আঙ্কেল!’

মাথার পাশ দিয়ে বুলেট যেতেই চমকে গিয়ে ঘুরে দাঁড়াল রানা। পরক্ষণে গর্জে উঠল ওর ইনগ্রাম। সিঁড়ি বেয়ে উঠছিল দুই গুণ্ডা, বুকে গুলি খেয়ে মাঝ সিঁড়ি থেকে নিচের মেঝেতে গিয়ে পড়ল তাদের লাশ।

অস্ত্র হাতে রানার পাশে এসে দাঁড়াল লিউনা। তবে মাথা নেড়ে ট্রেইলারের দিকে ইশারা করল রানা। ‘ওখানে থাকো! ওদের কাছে! ওরা সবাই ঠিক আছে তো?’

ঘুরে ট্রেইলার দেখল লিউনা। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ঘন ঘন মাথা দোলাল কয়েকটা পিচ্চি।

‘ওরা ঠিক আছে,’ বলল লিউনা।

ডানকাঁধে ইনগ্রাম ঝুলিয়ে হোলস্টার থেকে অটোম্যাগ নিল রানা। গলা চড়িয়ে বলল, ‘তোমরা সবাই সামনের দিকে গিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ো!’

দু’চোখ বিস্ফারিত হলো লিউনার। বুঝে গেছে, এবার কী করতে চাইছে রানা। ওয়্যারহাউসে আগুন ধরলে বিস্ফোরিত হবে পেট্রল ট্যাঙ্ক। সেক্ষেত্রে বাঁচবে না কেউ। তার চেয়ে ট্রাক নিয়ে বেরিয়ে গেলে ট্রেইলারের লোহার দেয়াল গোলাগুলি আর আগুন থেকে আড়াল দেবে শিশুদেরকে।

লোডিং ডক থেকে লাফিয়ে নিচের মেঝেতে নামল রানা। ছুটে চলে গেল ট্রাকের সামনে। ট্রাক রাখার উঠনে দাউ-দাউ করে জ্বলছে লেলিহান আগুন। মাফিয়ার গুণ্ডাদের কয়েকজন পুড়ে মারা গেছে ওখানে। অন্যরা জেনে গেছে এখন আর বেঁচে নেই তাদের ডন। কম্পাউণ্ড ছেড়ে পালিয়ে যাবার জন্যে চেইন লিঙ্কের বেড়ার দিকে সরে গেছে তারা। অবশ্য ট্রাক নিয়ে রানা বেরিয়ে যেতে চাইলে ভুল করবে না গুলি করতে।

ট্রাকের ক্যাবে উঠে দরজা বন্ধ না করে স্টিয়ারিং হুইলের সামনের মেঝেতে বসল রানা। ক্যাব আর ট্রেইলারের স্টিলের বডিতে খটাখট শব্দে লেগে পিছলে গেল কিছু গুলি। কয়েকটা বুলেট ঝনঝন করে ভাঙল ক্যাবের উইণ্ডশিল্ড। ছিটকে ভেতরে এসে রানার মুখ-গায়ে-হাতে লাগল কাঁচের অজস্র টুকরো। ড্রাইভারের দরজা এখনও খোলা। ওটার জানালা ধরে নিজেকে স্টিয়ারিং হুইলের সামনে টেনে তুলল রানা। একটা বুলেট লাগতেই ওর হাতসহ থরথর করে কাঁপল ধাতব দরজা।

অলসভাবে চলছে ট্রাকের ইঞ্জিন। বামপায়ে ক্লাচ চেপে অ্যাক্সেলারেটর দাবিয়ে দিল রানা। লোডিং ডক পেছনে ফেলে ওয়্যারহাউসের দরজার দিকে ছুটল দানবীয় ট্রাক। দ্রুত গিয়ার ফেলে গতি তুলছে রানা। ক্যাবের ভেতরটা ভরে গেছে শক্তিশালী ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় আওয়াজে।

ওয়্যারহাউস থেকে বেরিয়ে স্টিয়ারিং হুইল ঘুরিয়ে ট্রাকিং কোম্পানির মেইন গেটের দিকে চলল রানা।

গেটের কাছে জড় হয়েছে ক’জন গুণ্ডা। এমনিতেই বেরিয়ে যেত এই কম্পাউণ্ড থেকে, তার ওপরে তাদের দিকে বিশাল ট্রাক তেড়ে আসছে দেখে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গেল তারা। অবশ্য দুই বোকা গুণ্ডা ভেবেছে, গুলি করে থামিয়ে দেবে ট্রাক।

ক্যাব ও ট্রেইলারের স্টিলের দেয়াল ভেদ করতে না পেরে পিছলে যাচ্ছে গুলি। একহাতে স্টিয়ারিং হুইল ধরে হোলস্টার থেকে অটোম্যাগ নিল রানা। পর পর কয়েকটা গুলি করল দুই গুণ্ডাকে লক্ষ্য করে। ট্রাক গায়ের কাছে চলে এসেছে দেখে একেবারে শেষ সময়ে গেটের বাঁদিকে ঝাঁপ দিল তারা। কিন্তু ভুল করে বসেছে হিসাবে। সরাসরি দুই গুণ্ডাকে নাকের ডগায় তুলে দড়াম করে গেটের ওপরে চড়াও হলো ট্রাক। ভারী ইঞ্জিনের আওয়াজের ওপর দিয়ে দুটো করুণ আর্তনাদ শুনতে পেল রানা। পিঁপড়ের মত পিষে গেছে দুই নির্বোধ।

কম্পাউণ্ডের মেইন গেটের সাধ্য নেই যে ঠেকিয়ে দেবে ছুটন্ত ভারী ট্রাক। প্রচণ্ড এক গুঁতো খেয়ে ছিঁড়ে গিয়ে দু’দিকে গিয়ে পড়েছে দুই কবাট। ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় আওয়াজ তুলে আগুনে ভরা কম্পাউণ্ড পেছনে ফেলে ছুটে চলেছে ট্রাক। দূরের রাস্তায় একসারিতে অনেকগুলো নীল-লাল আলো দেখতে পেল রানা। ওর বুঝতে দেরি হলো না, এসব বাতি পুলিশের ক্রুবারের। প্রতিটি গাড়িতে কমপক্ষে দু’জন অফিসার থাকলেও রসির গুণ্ডাদের চেয়ে সংখ্যায় তারা অনেক বেশি। পালিয়ে যাওয়ার উপায় নেই মাফিয়ার গুণ্ডাদের।

নিজেও আর বেশিদূর যেতে পারবে না রানা। গতিহ্রাস করে রাস্তার পাশে ট্রাক রাখল ও। ওকে পাশ কাটিয়ে সাইরেন বাজিয়ে আগুনে ভরা ট্রাকিং কোম্পানির দিকে গেল অন্তত পনেরোটা পুলিশের জুয়ার। দূর থেকে এল আরও ভারী সাইরেনের শব্দ। ওগুলো ফায়ার ব্রিগেড আর অ্যাম্বুলেন্সের।

ট্রাকের ইঞ্জিন বন্ধ করে ক্যাব থেকে নেমে পড়ল রানা। ট্রেইলারের পেছনে গিয়ে দরজা খুলে দেখল ভেতরে। ভয়- ভরা চেহারায় ধুলোময় মেঝেতে বসে আছে অন্তত ত্ৰিশটা শিশু। আর তাদের মাঝে রাজকুমারীর মত বসে আছে লিউনা। রানাকে দেখে ওর মুখে যে হাসি ফুটল, ওটা বোধহয় বিশ লাখ ওয়াটের বালবের আলোর চেয়ে বেশি উজ্জ্বল। শিশুদের দিকে চেয়ে বলল, ‘বলেছি না, তোমাদের রানা আঙ্কেল আমাদেরকে বিপদ থেকে সরিয়ে নেবে?’

রানার চোখে তাকাল লিউনা, চোখে খুশির অশ্রু।

দূরে একটা-দুটো পিস্তলের গুলির আওয়াজ শুনল রানা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল ট্রেইলারের দরজার কাছে হাজির হয়েছে সিভিলিয়ান পোশাকে ডিটেকটিভ সার্জেন্ট বার্কলে এবার্টন। মস্ত এক রিভলভার সরাসরি ওর বুকে তাক করেছে সে!

‘জানতাম যে এসবের পেছনে আপনি আছেন,’ কড়া গলায় বলল সার্জেন্ট, ‘ধরে নিন আপনার জেল হবে বিশ বছরের। ঠিক আছে, প্রাণে বাঁচতে চাইলে হাত থেকে অস্ত্র ফেলে দিন!’

তেইশ

মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর শুকনো গলায় বলল, ‘তো বাচ্চাদের দায়িত্ব নেবে এমন কাউকে ডাকুন, সার্জেন্ট।

ওকে অস্ত্রের মুখে রেখেছে এবার্টন। অ্যালডো রসির ট্রাকিং কোম্পানির ধসে পড়া গেটের দিকে রাইফেল হাতে ছুটছে ইউনিফর্ম পরা এক পুলিশ অফিসার। তাকে নাম ধরে ডাকল সার্জেন্ট। তাতে ঘুরে তার দিকে এল যুবক।

‘মাইকেল, কয়েকজনকে নিয়ে এসে বাচ্চাদেরকে পাহারা দাও, যাতে কেউ ক্ষতি করতে না পারে।’

ট্রাকিং কোম্পানির দিকে চলল পুলিশ অফিসার।

ওদিকে ট্রাক রাখার উঠনে এরই ভেতরে গ্রেফতার হয়ে গেছে মাফিয়ার কয়েকজন গুণ্ডা।

ওর জীবনের শেষ লড়াইটা এভাবে সমাপ্ত হবে, ভাবতে পারেনি রানা। টেইলার থেকে নেমে এল লিউনা। সার্জেন্ট এবার্টনের পাশে এসে থেমেছে আরেক ডিটেকটিভ সার্জেন্ট।

‘অ্যাই, মেয়ে, তুমিও হাত থেকে অস্ত্র ফ্যালো,’ লিউনার হাতে বেরেটা ৯৩-আর পিস্তলটা দেখে নির্দেশ দিল এবার্টন।

‘আপনি কিন্তু জানেন না আমরা কারা,’ বোঝানোর সুরে বলল লিউনা। ‘একটু আগে আমরা দু’জন উদ্ধার করে এনেছি বাচ্চাদেরকে।’

‘আমরা কোন ঝামেলা চাই না,’ দ্বিতীয় সার্জেন্টের হাতে অটোম্যাগ আর এসএমজি দেয়ার পর বুক থেকে অ্যামিউনিশন বেল্ট খুলে তার কাছে দিল রানা।

ছোঁ দিয়ে লিউনার বেরেটা কেড়ে নিল সার্জেন্ট এবার্টন। সন্তুষ্ট হয়ে মাথা দোলাল। রিভলভারের নল দিয়ে দেখাল একটু দূরের এক সাধারণ গাড়ি। ওদিকে চলুন।

ট্রেইলার থেকে সরে গাড়িটার দিকে চলল রানা ও লিউনা, পেছনে দুই ডিটেকটিভ সার্জেন্ট। ওদের একটু দূর দিয়ে গেল রাইফেল হাতে ইউনিফর্মড ক’জন পুলিশ অফিসার। ট্রেইলারে উঠে নরম সুরে বাচ্চাদেরকে শান্ত করতে চাইল তারা। ট্রেইলারের কাছে এসে থামল একটা অ্যাম্বুলেন্স। ওটা থেকে স্ট্রেচার নিয়ে নামল দু’জন মেডিক।

এরই ভেতরে ট্রাকিং কোম্পানির কম্পাউণ্ডে ঢুকে আগুন নেভাতে শুরু করেছে ফায়ার ব্রিগেডের অফিসারেরা। দূর থেকে এল গুলির আওয়াজ। ওখানে পুলিশের ঘেরাওয়ের ভেতরে আছে রসিদের দলের কয়েকটা গুণ্ডা। অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ না করলে গুলি খেয়ে মরবে।

‘ঠিক আছে, এবার যা বলার বলুন, মিস্টার রানা,’ নিজের গাড়ির কাছে থেমে বলল সার্জেন্ট বার্কলে এবার্টন।

রানার চোখ চলে গেল ট্রাকিং কোম্পানির উঠনে। ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে বেশকিছু পোড়া মৃতদেহ। একটু পর এসে লাশ সংগ্রহ করবে করোনারের অফিসের লোক।

ওর দৃষ্টি অনুসরণ করল সার্জেন্ট এবার্টন। কড়া গলায় জানতে চাইল, ‘ওরা পঁচিশ না ত্রিশজন ছিল?’

‘আমার জানা নেই,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। সন্ধ্যা থেকে যত ধরনের ঝামেলার ভেতর দিয়ে গেছে, তাতে শ্রান্তিতে ওর এখন মনে হচ্ছে শুয়ে পড়তে। ‘আপনি আমাকে গ্রেফতার করতে চাইলে করতে পারেন, আমার কিছু বলার নেই।’

অন্তত একমিনিট কঠোর চোখে ওকে দেখল এবার্টন, তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘সত্যিই জানি না কী করা উচিত। একসপ্তাহ ধরে জানতাম অপহৃত শিশুদেরকে এ-শহর থেকে সরিয়ে নেবে রসিরা। তাই তাদেরকে বাধা দেয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম। তারপর আজ এসে সব গুবলেট করে দিলেন আপনি। যাই হোক, এবার খুলে বলুন আরও কত ধরনের আইন আপনি ভেঙেছেন।’

রসিরা অপহরণ করে বাচ্চাদেরকে পাচার করবে, সেটা যদি জানতেনই, তো ওদেরকে উদ্ধার করলেন না কেন?’ রেগে গিয়ে জানতে চাইল লিউনা।

‘আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে, যাতে ঠিক সময়ে অপরাধীদেরকে প্রমাণসহ গ্রেফতার করতে পারি,’ বলল এবার্টন। ‘সংগ্রহ করেছি নানান ধরনের তথ্য। আর তারপর মাফিয়া ডনের আস্তানা কোথায় সেটা জেনে নিয়ে আজ হানা দেব, এমনসময় পড়ে গেলাম মস্ত বিপদে।’ ঘাড় কাত করে সঙ্গী ডিটেকটিভ সার্জেন্টকে দেখাল সে। এমনকী আমার পার্টনারও ভেবেছে যে আমি ঘুষখোর এক কুত্তার বাচ্চা!’

‘শিকাগো পুলিশের অনেকেই ঘুষ খায়, এটা নতুন নয়, বলল সার্জেন্ট সিমন্স, ‘সন্দেহ করেছি বলে আমাকে দোষ দেয়া যায় না।’

‘আমার যোগাযোগ ছিল এফবিআই অফিসারদের সঙ্গে,’ বলল এবার্টন, ‘তারা বেশকিছু তথ্যও দিয়েছে। তাদের কথায় চোখ রাখতে শুরু করি অ্যালডো রসির প্রতিষ্ঠান আর তার বাড়িতে। সেজন্যেই আজ গিয়েছিলাম তার বাড়িটার সামনে।’

চুপ করে আছে রানা।

‘জানতাম শিশুদের কেসটা খুব সিরিয়াস,’ বলল এবার্টন। ‘তাই অফিসের কারও সঙ্গেই আলাপ করিনি। এদিকে জানি না শিশুদেরকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছে অ্যালডো আর এলিসা রসি।’ চোখ সরু করে রানাকে দেখল সে। ‘আমাকে সব যার খুলে বলার কথা, আজ সন্ধ্যায় হেলথ ক্লাবের হামলায় খুন হয়ে গেছে সে। আর সেজন্যেই জরুরি কোন তথ্য আর পেলাম না। তারপর কিছুক্ষণ আগে এদিকের এক কোম্পানির গার্ড ফোন করে বলল, বিশাল এক আগুন জ্বলছে এখানে। এরপর আমার আর বুঝতে দেরি হলো না, এসবের পেছনে আছেন আপনি, মিস্টার রানা। ফলে ক্যাপ্টেনকে বলে অফিসের সবাইকে নিয়ে ছুটে এসেছি রেইড দিতে।’

বিধ্বস্ত ট্রাকিং কোম্পানির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ট্রেইলার দেখল রানা। একে একে নামানো হচ্ছে শিশুদেরকে। মৃদু হেসে সার্জেন্ট এবার্টনকে বলল ও, ‘আপনি যা করতেন, সেই একই কাজ আমিও করেছি। আপনি সফল হলে রসির দলের সবাই আদালত থেকে জামিন পেত। তাতে মোটা অঙ্কের টাকা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে দামি ক’জন উকিলের।

‘আপনি কোন আইন মানেননি,’ বলল এবার্টন, ‘আমরা পুলিশের লোক সেটা করি না। গণতান্ত্রিক দেশ এভাবেই চলে। আর আপনার মত মানুষ সবসময় বুড়ো আঙুল দেখান আইনের শাসনকে।’

‘চোখের বদলে চোখ উপড়ে নেয়ার বিষয়ে কী যেন লেখা আছে আপনাদের বাইবেলে?’ জানতে চাইল রানা।

‘বাইবেল নয়, শিকাগো পুলিশ মেনে চলে আইনের বই,’ জোর দিয়ে বলল সার্জেন্ট এবার্টন।

তার দিকে তাকাল সার্জেন্ট সিমন্স। ‘অবশ্য আমার মনে হচ্ছে, কখনও কখনও পুলিশেরও উচিত চোখ বুজে থাকা।’

স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে দুর্বল শিশুদের। একজন মেডিকের হাত ছুটিয়ে হঠাৎ ছুটে এল উপমহাদেশীয় ছোট্ট এক ছেলে। মুখে ফোকলা হাসি নিয়ে কড়া ব্রেক কষে থামল রানার সামনে। ‘আঙ্কেল? তোমাকে অনেক ধন্যবাদ! তুমি কিন্তু সবসময় ভাল থাকবে!’

‘তোমার নাম কী, বাবু?’ ক্লান্ত হাসল রানা।

‘রাগিব চৌধুরী, বুক ফুলিয়ে বলল পিচ্চি। কিন্তু দাদু বলেন আমি কক্ষণও রাগিবো না!’

‘বাড়ি ফিরে দাদুকে বোলো, রানা আঙ্কেলের সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছিল, কেমন?’ নরম সুরে বলল রানা। হঠাৎ করেই হালকা হয়ে গেছে ওর হৃদয়। এখানে এসেছিল স্নিগ্ধা আর তুষারের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে। বসের নীরব অনুরোধে লড়াই করেছে শিশু অপহরণকারী একদল পিশাচের বিরুদ্ধে। এখন আর কিছুই করার নেই ওর। বার্কলে এবার্টন বা তার সঙ্গীকে আহত করে পালাতে গেলে গুলি করে ওকে খুন করবে পুলিশ অফিসারেরা।

‘নিশ্চয়ই বলব, আঙ্কেল! তুমি কিন্তু আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবে! আমরা একসঙ্গে লুকোচুরি খেলব! আর সেই সঙ্গে খেলব ক্রিকেট!’

‘নিশ্চয়ই খেলব, আঙ্কেল!’

যার হাত ছুটিয়ে রানার কাছে এসেছে পিচ্চি, সেই মেডিক এসে ওকে নিয়ে গিয়ে সাবধানে তুলে দিল একটা অ্যাম্বুলেন্সে।

বিড়বিড় করে কী যেন নিজেকে বলল সার্জেন্ট এবার্টন। ঘুরে তাকাল সার্জেন্ট সিমন্সের চোখে। নিজেও এক পা এগিয়ে এসেছে সিমন্স। হাতে অটোম্যাগ, ইনগ্রাম আর অ্যামিউনিশন বেল্ট। অন্তর থেকে চাইছে আবারও রানার হাতে অস্ত্র তুলে দিতে।

‘চোখে বালি পড়েছে বলে কিছুই তো দেখছি না,’ বহু দূরে চেয়ে হোলস্টারে রিভলভার পুরল সার্জেন্ট এবার্টন। ‘মিস্টার রানা, আপনি বরং চলে যান শিকাগো থেকে। আমরা চুপ করে থাকলেও এফবিআই আপনাকে রেহাই দেবে না।’

‘আমরা আজ মিস্টার রানাকে দেখিইনি!’ অস্ত্রগুলো রানার হাতে গছিয়ে দিল সার্জেন্ট সিমন্স। ঘুরে তাকাল পার্টনারের দিকে। এখন দু’জনের মুখেই আন্তরিক, সহৃদয় হাসি।

‘আজ এখানে যা ঘটল, তাতে দুর্দান্ত এক কাহিনী শুনবেন ক্যাপ্টেন,’ হাসিটা আরও চওড়া হলো এবার্টনের। বেরেটা ধরিয়ে দিল লিউনার হাতে। ‘ঠিক আছে, আমাদের গাড়ি চুরি করে নিয়ে গেছে অ্যালডো রসির দলের এক ক্রিমিনাল। এবার রওনা হয়ে যান, মিস্টার রানা। সঙ্গে করে নেবেন সুন্দরী এই মেয়েটাকে। নইলে কোথা থেকে এল সেটা নিয়ে নানান কথা উঠবে। … আরেকটা কথা, স্যর, আমরা একই বইয়ের পাঠক না হলেও, আপনি কিন্তু পাঠক হিসেবে বইয়ের কাহিনী দারুণভাবে পড়ে শেষ করেছেন!’

মাসুদ রানা পেশায় পুলিশ না হলেও এই দুনিয়ায় তার মত মানুষের বড্ড দরকার, ভাবছে সার্জেন্ট শ্যন সিমন্স।

গাড়িতে উঠবে রানা, এমনসময় পেছন থেকে ওকে ডাকল সার্জেন্ট এবার্টন। ‘একমিনিট, স্যর! আমার বাড়ি থেকে বিদায় নেয়ার সময় হ্যাণ্ডশেক করতে চেয়েছিলেন। তখন সেটা করিনি, কারণ চিনতে পারিনি আপনাকে। এখন নিজেই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি। আপনি কি দয়া করে একবার হ্যাণ্ডশেক করবেন আমার সঙ্গে? খুব সম্মানিত বোধ করব, স্যর।’

গাড়ির পেছনের সিটে অস্ত্রগুলো রেখে ঘুরে দাঁড়াল রানা। ওর দিকে এক পা এগিয়ে এসেছে দুই সার্জেন্ট। এক এক করে রানার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল তারা।

‘এবার চলো, সিমন্স, মেলা কাজ পড়ে আছে,’ তাড়া দিল বার্কলে। ‘দুই জায়গায় তো আর একই সঙ্গে থাকতে পারব না!’

‘কথা ঠিক,’ মাথা দোলাল সিমন্স। ‘আমরা তো আর কম চেষ্টা করিনি, মাসুদ রানার টিকির হদিসও খুঁজে পেলাম না!’

আগুনে ভরা ট্রাকিং কোম্পানির উঠনের দিকে চলল দুই ডিটেকটিভ পুলিশ অফিসার। এরই মধ্যে কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হয়েছে বেশিরভাগ শিশুকে। রসিদের দলের ক’জন গুণ্ডাকে গ্রেফতার করে উঠনে জড় করেছে পুলিশের লোক। দালান ও ওয়্যারহাউসের আগুন নেভানোর জন্যে হোস পাইপ হাতে ছুটোছুটি করছে ফায়ার ব্রিগেডের সদস্যরা।

গাড়িতে ওঠার আগে একবার ওদিকে তাকাল রানা। অ্যালডো আর এলিসার লাশ যে অফিসে ছিল, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ওটা।

লিউনাকে ইশারায় গাড়িতে উঠতে বলে ড্রাইভিং সিটে বসল রানা। ওর পাশের সিটে উঠে দরজা আটকে নিল লিউনা। একবার চেয়ে দেখল শিশুদেরকে। নিচু গলায় বলল, ‘দুনিয়ার সব বাচ্চাকে যদি এভাবে নিরাপদে রাখতে পারতাম! আজ ইবলিশগুলোর হাত থেকে যারা বেঁচে গেল, ওদের কপাল খুবই ভাল। চিকিৎসা পেয়ে ফিরে যেতে পারবে স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু সবার ভাগ্য তো এত ভাল হয় না।’

‘প্রতিটি দেশের মানুষ সতর্ক হলে আর কখনও ফণা তুলে ছোবল দিতে পারবে না অ্যালডো বা এলিসার মত কাল- সাপেরা,’ বলল রানা। ‘প্রার্থনা করো, আমরা যেন তেমনই এক পৃথিবী দেখে যেতে পারি।

ঘুরে ওর দিকে তাকাল লিউনা। ‘বলো তো, আমরা এবার কোথায় যাব?’

মেয়েটার চোখে কেমন এক ঘোর দেখতে পেল রানা। মৃদু বাতাসে ওর নাকে ভেসে এল লিউনার চুলের মিষ্টি সুবাস। তাতে আছে অদ্ভুত এক মাদকতা। ‘আমরা হয়তো শহরের বাইরে ছোট কোন হোটেলে গিয়ে উঠব,’ বলল রানা।

‘আমরা কি একই রুমে থাকব?’ বলল লিউনা, ‘যেখানে থাকবে ডাবলবেড?’

‘হয়তো।’

‘কিন্তু আমরা তো পরস্পরকে ভাল করে চিনিই না। অবশ্য আজকের বিশেষ এই রাত হতে পারে চিনে নেয়ার।

সার্জেন্ট এবার্টনের গাড়ির ড্রাইভিং দরজা বন্ধ করল রানা। ইঞ্জিন চালু করে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল। এখনও এদিকে আসছে একের পর এক পুলিশের ক্রুযার। তবে ওদেরকে থামাবার জন্যে ইশারা দিল না কেউ।

ঝোড়ো বেগে শহরের দিকে চলেছে রানা। তবে কিছুক্ষণ পর ছোট এক জঙ্গলের ধারে থেমে এই গাড়ি ফেলে রেখে উঠে পড়বে লিউনার করোলা গাড়িটাতে। যত দ্রুত সম্ভব ত্যাগ করবে শিকাগো শহর। হঠাৎ করেই রানা টের পেল, ওর উরুর ওপরে হাত রেখেছে লিউনা।

মুখে কিছু না বললেও বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মত কী যেন বয়ে গেল ওদের শরীরে। পরস্পরকে দেখল ওরা। দু’জনই অনুভব করল, আজ নয়, সহস্র বছর ধরেই একে অপরকে চেনে।

রানার কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিস করে বলল লিউনা, ‘পথ দেখিয়ে নিয়ে যাব আমার গ্রামের বাড়িতে। খুব খুশি হব ওখানে তুমি কয়েকটা দিন রয়ে গেলে।

গাড়ির গতি কমিয়ে লিউনার কপালে চুমু এঁকে দিল রানা।

***

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(60)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!
Do you have any doubts? chat with us on WhatsApp
Hello, How can I help you? ...
Click me to start the chat...