খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ওয়াসিকা নুযহাত

KhoriBona

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ওয়াসিকা নুযহাত ...............................................................................................................

প্রকাশক – সৈয়দ রবিউজ্জামান, বইবাজার প্রকাশনী
প্রকাশকাল – প্রথম প্রকাশ: ২০১৬
প্রচ্ছদ – মাহামুদুল হাসান আসিফ

উৎসর্গ

আমার আব্বুকে
এবং
আমার লেখালেখিতে অনুপ্রেরণাদাত্রী আম্মুকে,
যিনি পাশে না থাকলে এই উপন্যাসটি
লেখা এবং প্রকাশ করা কোনটিই সম্ভব হতো না।

Book Content👉

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ১

পেটের কাছে কিসের যেন একটা খোঁচা লাগল। অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ছিপছিপে দেহের এক মেয়ে ওর ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। ভর দুপুরের বাসে এখন পিঁপড়ার মতো মানুষ ভিড় করেছে। হেমন্ত শেষ হয়ে এলো প্রায়, কিন্তু শীতের বিন্দুমাত্র উপস্থিতি নেই। বাতাসে কটু গন্ধ। ঘামে ভেজা জামা পরা বাস কন্ডাক্টর ভিড় ঠেলে লোকজনের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করছে। সবার মুখে বিরক্তি আর ক্লান্তির ছাপ। অয়নের পরনে একটা সাদা পাঞ্জাবী। ঘামে ভিজে লেগে আছে শরীরের সাথে। এই এত মানুষের শরীরের ঘাম, তাপ, গন্ধের মাঝে ঘাড়ের কাছে একটা মেয়ের লেপ্টে লেগে থাকাটা আরো বেশি অস্বস্তিতে ফেলে দিল অয়নকে। মেয়েটা আবার অয়নের পেটের কাছে তার শীর্ণ, শিরা ভেসে থাকা, ময়লা নখের হাতটা রেখে নাটুকে গলায় বলল, ‘দে ব্রাদার! দশটা টাকা দে!’

অয়ন এবার ভালো মতো তাকালো মেয়েটার দিকে। তাকিয়েই ভুলটা ভাঙলো। যাকে সে এতক্ষণ মেয়ে ভাবছিল সে আসলে কোনো নারীও না, পুরুষও না। তৃতীয় লিঙ্গ অর্থাৎ হিজড়া। শক্ত পোক্ত চোয়াড়ে চেহারা। হিজড়ারা সাধারণত দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু এর সাথে আশেপাশে কোনো সঙ্গীসাথী দেখা গেল না। অয়ন পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে এগিয়ে দিল। টাকাটা হাতে নিয়ে হিজড়া সামনে দাঁড়ানো চল্লিশের কোটার এক টাকমাথা ভদ্রলোককে ঠিক একই ভাবে পেটে গুঁতা মারলো। ভদ্রলোক রক্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো, বজ্রসম কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার? গুঁতা মারতাসো কেন?’ হিজড়া সুরেলা গলায় বলে, ‘দে ব্রাদার! দশটা টাকা দিয়া যা!’ টাকমাথা বাসের ভেতর বিস্ফোরণ ঘটায়, ‘যা ঐদিকে! দূরে যা! একটা টাকাও দিমুনা! দূরে গিয়া খাড়ায় থাক!’ হিজড়ার গলাও সপ্তমে চড়ে যায়, ‘ও বাবা! কি দেমাগ! আরে কিপটারে কিপটা! দশটা টাকা দিতে তোর এত কষ্ট!’ টাকমাথা বাস কন্ডাক্টরের ওপর চড়াও হয় এবার, ‘কি মিঞা, এইসব লোকজনরে বাসে উঠাও ক্যান?’ বাস কন্ডাক্টর এগিয়ে এসে ভিড়ের ভেতর থেকে হিজড়াকে হিড় হিড় করে টেনে বের করল। হিজড়াটারও কম তেজ না। সে বাস কন্ডাক্টরের হাতটা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘ক্যারে? আমগো উঠতে দিবিনা ক্যা?’

ভিড়ের ভেতর থেকে আরেকটা পুরুষ কন্ঠ ধমক দিয়ে উঠল, ‘এই চুপ থাকো!’

— ‘আপনে চুপ থাকেন!’

লেডিস সিটে বসে থাকা এক মাঝবয়সী মহিলা চাপা গলায় বলে উঠল, ‘কী, হচ্ছেটা কী এসব! ভদ্রলোকের জায়গা তো এটা নাকি!

মহিলার গলার আওয়াজ কন্ডাক্টরের কেরোসিন মাখা রাগে আগুন ধরিয়ে দিল। সে ঘোষণা দিল ‘ওই! পরের স্টপেজেই নাইমা পড়বি তুই, বুঝছস?’

হিজড়া কোনো কথা বলল না। বাশের কঞ্চির মত লম্বা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। একটা থমথমে অপমানের ছায়া ভেসে উঠল তার পুরুষালী চেহারায়। বাসটা কিছুক্ষণের মাঝে ফার্মগেট চলে আসল। হুড়মুড় করে লোক নামতে থাকল। একজন আরেকজনের পা মাড়িয়ে ছুটতে লাগল। বাস কন-ডাকটর হিজড়াটাকে এবার পারলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দেয় বাস থেকে। হিজড়া চিৎকার করে হাত পা ছুঁড়তে থাকে। সে কিছুতেই নামবে না বাস থেকে। টাকমাথা ভদ্রলোক গলা চড়িয়ে গালাগাল দেয়া শুরু করে। সামনের সিটে বসে থাকা দুটো অল্প বয়সী ‘ছোকরা’ এবার নৈতিক দায়িত্ব মনে করে বসা থেকে উঠে হিজড়াটাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে নামানোর কাজে লিপ্ত হয়ে যায়।

— ‘আরে আরে! করছেন কী!!’

ভিড়ের মাঝখান থেকে ভেসে আসা ভরাট একটা কণ্ঠস্বর বাসের ভেতরের ঘর্মাক্ত উষ্ণ বাতাসটাকে হঠাৎ থমকে দেয়। চমকে যাওয়া মুখগুলো এক দু সেকেন্ডের জন্য তাকায় অয়নের দিকে। লাভ হয়না খুব একটা আবার যে যার কাজে মগ্ন হয়ে যায়। অয়ন এবার তার প্রায় ছয়ফুট লম্বা শরীরটা নিয়ে ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে এসে বলল, ‘আচ্ছা এই মানুষটা আপনাদের কী প্রবলেম করছে বলুনতো! কেন একে বিরক্ত করছেন?’

টাকমাথা ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ জোরালো হলো, ‘আরে ভাই আপনি দেখলেন না, টাকা দেন টাকা দেন কইরা সবাইরে পাগল বানায় ফেলতেসে? কী প্রবলেম হইসে সেইটা আপনি চোখে দেখেন না?’

লোকটার কথা শেষ হবার আগেই হিজড়া সুযোগ পেয়ে বাপ মা তুলে গালাগাল দেয়া শুরু করে। অয়ন তার দিকে তাকিয়ে ঝাঁঝালো গলায় বলল,

— ‘আহ! চুপ করুনতো! আপনি কোথায় নামবেন?’

হিজড়া অবাক চোখে তাকায় অয়নের দিকে। এই ভদ্রলোকের মত জামা পরা, ফর্সা, লম্বা চওড়া প্রায় দেবতার মতন দেখতে যুবকটি তাকে আপনি সম্বোধন করছে এ যেন এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। তার শক্ত পোক্ত লোহার গড়নের মুখ খানায় কোত্থেকে যেন হঠাৎ একটু নম্রতা চলে আসে, আমতা আমতা গলায় উত্তর দেয়, ‘মহাখালী’

— ‘ওকে ফাইন, মহাখালী পর্যন্ত আপনি এই বাসেই যাবেন কিন্তু কারুকে কোনো বিরক্ত করবেন না। একজন সাধারণ যাত্রীর মত চুপচাপ ভদ্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন, স্টপেজ আসলেই নেমে পড়বেন।’ খুব রাশভারী গলায় কথাগুলো বলল অয়ন।

হিজড়া অস্বস্তি নিয়ে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো শুধু, মুখে কিছু বলল না।

অয়ন বাস কন্ডাক্টরের পিঠে হাত রেখে বলল, ‘আরে মিঞা, এমন কোনো ব্যাপার না, এত অস্থির হইওনা। বাস ছাড়তে কও, টাকমাথা ভদ্রলোক এবং তার সাগরেদরা হই হই করে উঠল, ‘এরা কি ভদ্রলোকের মত থাকতে জানে? আপনি ভাই বাঙালরে হাইকোর্ট দেখাইতেসেন। বাসে যে উঠসে বাসের ভাড়াটা পর্যন্ত দিবোনা আপনি জানেন?’

অয়ন বাস কন্ডাক্টরের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘ওর ভাড়াটা আমি দিয়ে দেব, আপনি বাস ছাড়ুন।

কথাটা শোনা মাত্র কন্ডাক্টর তড়িৎ গতিতে ড্রাইভারকে বাস ছাড়ার নির্দেশ দিল। বাস চলতে শুরু করল। মারমুখো লোকজনগুলো কিছুক্ষণ নিজেদের মাঝে হইচই করে চুপ করে গেল। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো হিজড়াটা হঠাৎ করেই একেবারে নিপাট ভদ্র যাত্রী সেজে গেল। টু শব্দটি করল না বাকি পথ। মহাখালী আসতেই হুরমুড়িয়ে যাত্রীরা নামতে শুরু করল। হিজড়া নামার আগে একবার শুধু তাকালো অয়নের দিকে। ‘কিছু বলবেন?’ প্রশ্ন করল অয়ন।

একটু ইতস্তত করে কী যেন একটা চিন্তা করে নিয়ে হিজড়া বলল, ‘না, কিছুনা!’ বলেই নেমে পড়ল।

বাস আবারও চলতে শুরু করে। জানালা দিয়ে আসা গরম বাতাস নিশ্বাসের সাথে সাথে বুকের ভেতরটাকে শুষে নিতে থাকল। একটা সিট খালি হয়েছিল। অয়ন বসবার জন্য এগিয়ে যেতেই বয়স্ক এক ভদ্রলোক যেন ওর সাথে টেক্কা দিয়েই সেদিকে ছুটে গেল। কিন্তু জিতে গেল অয়ন। লোকটা কাছাকাছি আসার আগেই ঝপ করে বসে পড়ল সিটটায়। লোকটা ক্রুর চোখে তাকাল অয়নের দিকে। দৃষ্টি বাণে যেন ঝলসে দিতে চাইছে অয়নকে। অয়ন একটু মুচকি হাসল সেদিকে তাকিয়ে। বেচারা লোকটার চেহারায় সারা দিনের ক্লান্তির ছাপ। চোখের কোণে কালি। সব মিলিয়ে বড় অসুখী একটা মুখ তার। সেদিকে তাকিয়ে অয়নের হঠাৎ কেমন মায়া হলো। বলতে কী তারা মানুষ হয়েও দিন দিন কেমন ইট, পাথর গাছের মত অনুভূতি শুন্য হয়ে পড়ছে। সবাই শুধু নিজের কথা ভেবে যাচ্ছে। অন্য একজনের সুখ দুঃখের কথা কেউ কখনো ভাবেনা। একটু ভালো থাকার জন্য, একটুখানি সুখের জন্য দিন রাত জীবন যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে থাকা, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা মানুষগুলো তবুও সুখের দেখা পায় না শেষ অবধি। রাস্তায় নামলেই দেখা যায় ক্লান্ত, অসুখী বিধ্বস্ত চেহারার মানুষগুলিকে। কষ্ট হয়, অয়নের বড় কষ্ট হয় এই বোকাসোকা, সহজ সরল অথচ পরিস্থিতির চাপে ধূর্ত হয়ে উঠতে চাওয়া মানুষগুলির জন্য। অয়নের মনটা অবশ্য আজ অন্য একটা কারণেও বেশ বিষণ্ণ। আজ বাবার জন্মদিন। একটা সময় এই মানুষটার জন্মদিন ঘটা করে পালন করা হতো। এখন আর হয় না। বাবা যে আর আগের মতো নেই! আগের বাবা আর এই বাবাতে যে অনেক তফাৎ! বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। একটু বাদে বাসটা বনানী এসে থামে। অয়ন উঠে দাঁড়ায়। কেমন একটা অস্বস্তি খেলা করে তার চেহারায়। চিন্তার রেখা ফুটে উঠে কপালে। সচরাচর সে তার মায়ের অফিসে যায় না। আজ একটা বিশেষ দরকারে যেতে হচ্ছে। কিছু স্মৃতি মনে পড়লেই রোমকূপে রোমকূপে শুয়োপোকারা কামড়াতে শুরু করে। রাগে রি রি করে সারা শরীর। নিজের মধ্যে নিজেকে বেঁধে রাখা দায় হয়ে ওঠে তখন।

আহির দিলশাদের সিরিয়াল নম্বর হয়। এখন তিন চলছে। জীবনে প্রথমবার ইন্টারভিউ দিতে এসেছে সে। এটা একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী। আয়শা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। আহির শুনেছে এই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী ছাড়াও প্রতিষ্ঠানের মালিকের দেশের তিনটি টুরিস্ট স্পটে বিলাসবহুল হোটেল আছে। সাবান তৈরীর কারখানা আছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানের মালকিন আয়শা খানম এ বছর বাংলাদেশ বিজনেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। পত্রিকায় নাম দেখেছে আহির। তার মানে অবস্থা বেশ রমরমা।

পোস্টটা যদিও একেবারেই যা তা। ফ্রন্টডেস্ক রিসিপশনিস্ট। মাইনে বিশ হাজার। মাইনেটা তার জন্য নেহাৎ কম নয়। ঝড়ে বকে চাকরিটা পেয়ে গেলে একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে সে। এখানে কাজ করতে করতেই বিসিএস পরীক্ষাটা দিয়ে দেয়ার প্ল্যান আছে। যদিও চাকরী করে পড়াশোনা করা একটু ঝামেলার হয়ে যাবে। দশ তলার ওপরে এয়ার কন্ডিশন ঘেরা ওয়েটিং রুমের চেয়ারে বসে দুশ্চিন্তায় ঘামতে ঘামতে এইসব হাবিজাবি ভাবছিল আহির। আজকে ইন্টারভিউ উপলক্ষ্যে সে তার সবচেয়ে পছন্দের জামাটা পরেছে। ইস্ত্রি করা, সদ্য ভাঁজখোলা, অফ-হোয়াইট কালারের সুতার কাজ করা একটা সালোয়ার কামিজ। গত বছর ঈদের সালামীর টাকা জমিয়ে কেনা শখের হেয়ার স্ট্রেটনারটা দিয়ে ঢেউ খেলানো চুলগুলোকে সোজা করেছে। মুখে হালকা ফেস পাউডার দিয়েছে। হাই হিল স্যান্ডেল পরেছে। লম্বায় অবশ্য অতটা খাটো না সে। পাঁচ ফুট চার, তবুও হাই হিল জুতোর সাথে স্মার্টনেসের একটা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলে তার ধারণা। সে নিজে যদিও খুব ভালো মতোই জানে যে যথেষ্ট স্মার্ট সে না। তবে তার চেহারায় এক ধরনের ব্যক্তিত্বের ছাপ আছে। কাটা কাটা নাক আর টানা চোখের মুখটায় একটা অসাধারণত্বের দাবী লুকোনো আছে। যেটা কোনো বুদ্ধিমান লোকের চোখ কখনো এড়াবেনা। এছাড়াও তার নজর কাঁড়া একটা হাসি আছে। হাসলে তার গজদন্ত ঝিলিক দেয়। ভারি মায়া লাগে।

আহিররা বসে ছিল কনফারেন্স রুমের সামনে, করিডোরে। মেঝেতে আয়নার মত ঝকঝকে টাইলস। নানা রকমের পেইন্টিং দিয়ে দেয়াল ঘেরা। বিশাল লম্বা আর প্রশ্বস্ত করিডোরটার দুপাশ বাহারী ফুলের টব দিয়ে সাজানো। টবে শোভা পাচ্ছে অর্কিড আর নানা জাতের পাতাবাহার। সিলিঙে ঝুলছে ঝাড়বাতি। আহির মুগ্ধ হয়ে দেখছিল চারপাশটা। ঠিক সেই সময় ওদের সামনে দিয়ে পঁচিশ কি ছাব্বিশ বছরের এক দীর্ঘকায় যুবাপুরুষ বেশ দ্রুত পায়ে ঝড়ের বেগে কনফারেন্স রুমের দিকে এগিয়ে গেল। যুবকের পরনে সাদা পাঞ্জাবী। দরজার বাইরে একটা পিয়ন দাঁড়ানো ছিল। সে হন্তদন্ত হয়ে যুবকের পথ আটকে দিয়ে বলল, ‘স্যার, ভিতরে ইন্টারভিউ হচ্ছে, এখন যাওয়া যাবেনা!’

যুবক হুঙ্কার ছাড়ল, ‘আরে কিসের ইন্টারভিউ! আয়শা খানমকে ডাকো! বল আমি আসছি, এখনই দেখা করতে বল! আমার টাইম নাই!’

পিয়নটা হুঙ্কার শুনে ভয়ে জবুথবু হয়ে ঘরের ভেতর ছুটে গেল বার্তা নিয়ে। মিনিট দুয়েক পর ফিরে এসে বলল, ‘ম্যাডাম বলছেন একটু অপেক্ষা করতে।

যুবক যারপরনাই বিরক্ত হলো। পিয়নটার দিকে একবার জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অস্থির চিত্তে করিডোরের ভেতর পায়চারী করা শুরু করল। চেয়ারে বসে থাকা এবং এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলে মেয়েগুলোর দৃষ্টি তার দিকে নিবদ্ধ হলো। যুবক সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করল না। নিজের ভাবনায় মগ্ন হয়ে রইল। ভ্রু কুঁচকানো, ঘামে ভেজা কাপড় পরা, অস্থির এলোমেলো যুবকটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল আহির। নিঃসন্দেহে সুপুরুষ কিন্তু এর আচার আচরণে কোথায় যেন একটা অসংলগ্নতা আছে। কোথাও কিছু একটা গোলমাল আছে।

আরো মিনিট দশেক পর ছেলেটা ইন্টারভিউ রুমের দরজার ওপর হামলে পড়ল। এবারেও পিয়ন পথ আটকালো। একটা বিকট চিৎকারে ফেটে পড়ল পুরো অফিস।

— ‘কিসের ইন্টারভিউ!! কোনো ইন্টারভিউ টিউ হবেনা এইখানে, যান যান! ভাগেন এইখান থেকে!

ঘরের ভেতরে যেন বজ্রপাত হলো। একটা অস্থিরতার ঢেউ খেলে গেল সবার মাঝে। পাগল ছেলেটা সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, ‘আরে! কী বললাম! যেতে বললাম না আপনাদের? এখানে কোনো ইন্টারভিউ হবেনা!

কথায় কাজ হচ্ছেনা দেখে ছেলেটা একটা চেয়ার তুলে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো মেঝেতে। একটা দুটো মেয়ে ভয়ে আৰ্তনাদ করে উঠল। এবার ফুলের টব ছুঁড়ে মারল। চিনে মাটির দামী ফুলের টবটা ঝকঝকে টাইলসের মেঝেতে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ছেলে মেয়ে গুলো দ্রুত পায়ে ছাড়তে লাগল জায়গাটা। আহির বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে ছিল পাগলটার দিকে। কিন্তু নড়তে পারছিল না। ঘটনার আকস্মিকতায় কেমন পাথর হয়ে গেছে সে। ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে একটা হুঙ্কার ছেড়ে বলল, ‘কি? কথা কানে যায়না? যান এখান থেকে!!’

আহির বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো। দম বন্ধ করে এক নিশ্বাসে ছুটে এলো লিফটের দিকে। একি পাগলের পাল্লায় পড়ল! বাপরে বাপ!!!

রুদ্ধশ্বাসে বেরিয়ে আসলো অফিস থেকে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বুক ধড়ফড় করছে। জীবনের প্রথম ইন্টারভিউর দিনের অভিজ্ঞতাটা বেশ ভালোই হলো। একেবারে ইউনিক বলা চলে। ভবিষ্যতে নিজের ছেলে পুলে নাতি নাতনীদের সাথে বহুকাল এই গল্পটা করতে পারবে সে। একটা মুদির দোকান থেকে হাফ লিটারের ঠান্ডা পেপসি কিনে ঢক ঢক করে গলায় ঢাললো এবং ঠিক তখনই টের পেল তার প্রাণাধিক প্রিয়, বড় সাধের স্যামসাং গ্যালাক্সী এস ফাইভ ফোনটা সাথে নেই। হাতে ছিল। কিন্তু এখন দু হাতই খালি। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসলো। হৃদপিন্ডটা ধড়াস ধড়াস করে লাফাতে থাকল বুকের ভেতর। এখন কী হবে? এভাবেই গায়েব হয়ে যাবে তার এত কষ্টের টিউশনীর টাকা জমিয়ে কেনা জীবনের প্রথম এবং একমাত্র স্মার্ট ফোনটা! মনে হচ্ছিল কষ্টে কলিজাটা ছিঁড়ে যাবে। এই একটা ফোনের মাধ্যমেই পুরো দুনিয়ার সাথে সে কানেক্টেড বলা যায়। অসহায় একটা বোধ পুরো মনটাকে ছেয়ে ফেলল। খুব সম্ভবত যে চেয়ারটায় সে বসেছিল সেই চেয়ারটাতেই ফেলে এসেছে ফোনটা কিংবা এমনও হতে পারে ওই পাগলটার তাড়া খেয়ে দৌড়ে আসার সময় বেখেয়ালে হাত থেকে পড়ে গেছে মাটিতে। হায় খোদা! এখন কী হবে!! ওই পাগল পাড়ায় তো আবার ফিরে যাবার কোনো প্রশ্নই আসেনা! রাগে, দুঃখে, অপমানে চোখে পানি এসে গেল আহিরের। বেশ খানিক্ষণ তেজী রোদটা মাথায় নিয়ে হাভাতের মতো দাঁড়িয়ে থেকে আহির শেষ মেষ কী যেন ভেবে নিয়ে আবারও অফিসের দিকে এগিয়ে গেল। মোটা কাঁচের দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো, যার হাতলের কাছে গোটা গোটা অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা আছে, ‘Pull’ ঢুকতেই মোচওয়ালা এক গাট্টা গোট্টা সিকিউরিটি গার্ডকে সামনে পেয়ে গেল সে।

— ‘শুনুন!’

— ‘বলুন!’

— ‘আমার ফোনটা আপনাদের অফিসে ভুলে ফেলে এসেছি, দশ তলায়, আপনাদের কনফারেন্স রুমের সামনে, আপনি কি একটু বলবেন, কী করে ফোনটা ফেরত পেতে পারি?’ সিকিউরিটি উদাস ভাবে তাকালো আহিরের দিকে। তার তাকানো দেখে মনে হলো, ফোন হারিয়ে যাবার মত সস্তা এবং গুরুত্বহীন ঘটনা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। সে ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘কী মোবাইল?’

— ‘কী মোবাইল মানে?’

— ‘মানে কী সেট?’

সেটের নামটা বলল আহির।

সিকিউরিটি এবার রিসিপশনে গিয়ে কিছু একটা বলল। রিসিপশনের মেয়েটা প্রায় মিনিট দশেক পরে ফোনের রিসিভার হাতে নিয়ে খুব সাধারণ গলায় বলল, ‘ওয়েটিং রুমে একটা মোবাইল পাওয়া যায় নাকি দেখতো, স্যামসাং এর সেট’ আরো পনেরো কী বিশ মিনিট পর খবর আসল, না কোনো মুঠোফোন সেই দশতলার ওয়েটিং রুমে পাওয়া যায়নি। আহিরের চোখ ফেটে জল গড়িয়ে আসলো নিজের অজান্তেই।

অয়নের ডাক পড়ল ভেতরে। বিশাল কনফারেন্স রুমটা এখন ফাঁকা বললেই চলে। শুধু লম্বা টেবিলটার এক কোণে চিন্তিত মুখে বসে আছেন আয়শা খানম। এই পাওয়ারফুল এসির হিম বাতাসের ভেতরেও তাঁর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তিনি ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন এবং সম্পূর্ণ বিনা কারণে একটু পর পর নাক টানছেন। যে কেউ দেখে ভাববে যে তার জ্বর, ঠান্ডা বা সর্দি হয়েছে বলে এই ঘন ঘন নাক টানা। কিন্তু ব্যাপার আসলে তা না। তিনি কোনো বিষয় নিয়ে অত্যাধিক চিন্তিত থাকলে বেখেয়ালে এই কাজটা করে থাকেন। আজকে তাঁর পরনে একটি লেমন কালারের সিল্কের শাড়ি। গলায় কানে ম্যাচ করা পাথরের দুল। উঁচু করে খোপা বাঁধা। ফর্সা গায়ের রঙ্গে হালকা লালচে আভা। একবার তাকালেই বোঝা যায়, যৌবনে এই মহিলা বেশ সুন্দরী ছিলেন। যার রেশ এখনো এই বায়ান্নর কোঠায় এসেও রয়ে গেছে।

ধুপ ধাপ শব্দে বন্য জন্তুর মতো তেড়ে এসে সামনে দাঁড়ালো তার একমাত্র বখাটে এবং ক্ষ্যাপাটে স্বভাবের অবাধ্য ছেলেটা। যে ছেলেটা একাই তার সমস্ত মান, সম্মান, প্রভাব, প্রতিপত্তি এক লহমায় গুঁড়িয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট।

আয়শা তাকালেন ছেলের দিকে। অয়ন ক্রুর দৃষ্টিতে তাঁকেই দেখছিল। আয়শার বুক থেকে দীর্ঘঃশ্বাস বেরিয়ে গেল। কত কত দিন কেটে গেল ছেলেটা তার দিকে মায়া ভরা চোখে তাকায় না। কে বলবে সামনে দাঁড়ানো কুটিল আগুন ঝরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছেলেটা তাঁর নিজের নাড়ী ছেঁড়া ধন! মায়ের দিকে কেউ এভাবে তাকায়!!

— ‘চাবিটা দিন!!’ অয়ন হুঙ্কার ছাড়ল।

আয়শা খুব ঠান্ডা স্বরে বললেন, ‘না, ওটা তোমাকে দেয়া যাবেনা!’

অয়নের ভ্রু দুটো আরো বেশি কুঁচকে গেল। দাঁত কিড়মিড় করে সে বলল, ‘ওটা আমার চাই!’

ছেলের সামনে আজকাল কিছুটা নার্ভাস বোধ করেন তিনি। পৃথিবীতে এই একটা মাত্র মানুষ! যার সামনে আয়শা খানম নার্ভাস হয়ে পড়েন!

— ‘একবারই বলেছি, দেয়া যাবেনা।’

— ‘কিন্তু কেন?’ অয়ন চিৎকার করে উঠল।

— ‘উনি অসুস্থ’

— ‘আপনি নিজেকে কী ভাবেন বলুন তো? কে আপনি? হু দা হেল আর ইউ? আমার বাবার সাথে আপনি আমাকে দেখা করতে দেবেন না!’

— ‘অয়ন! তুমি এখন যেতে পারো! অযথা সময় নষ্ট করছ। আর হ্যাঁ, আজকে যে ব্যবহারটা তুমি করেছ আমার অফিসের লোকজনদের সাথে ভবিষ্যতে আর কখনো এমনটা করার চেষ্টা করো না, খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি!’

— ‘আমাকে চাবিটা এই মুহূর্তে না দিলে আমি ওই ঘরের দরজা ভাঙতে বাধ্য হব!’ দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল অয়ন।

আয়শা ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করলেন। তিনি জানেন, অয়ন যা বলছে ঠিক তাই করবে। এই ছেলেকে আটকানোর মতো কোনো ক্ষমতা ঈশ্বর তাকে দেননি।

একটুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,

— ‘অয়ন! আমি জানি আজকে তোমার বাবার জন্মদিন, কিন্তু এসব কিছুই বোঝার মতো অবস্থা তার নেই। অবস্থা এখন আরো খারাপ হয়েছে। তুমি সইতে পারবেনা।’

— ‘আমি সইতে পারব কী পারবনা সেটা আমার ব্যাপার! আপনি আমাকে আমার বাবার ঘরের চাবিটা দিন!’

আয়শা একটা বড় নিশ্বাস ফেললেন। হতাশ গলায় বললেন, ‘বাসায় যাও, মেইডের কাছে চাবি আছে, আমি ফোন করে দিচ্ছি, দরজা খুলে দেবে’। অয়ন আর দাঁড়ালো না।

দরজাটা খুলতেই স্যাঁতস্যাঁতে গুমোট একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল। বন্ধ জানালার ফাঁক গেলে বেলা শেষের মরা আলো মেঝেতে এসে পড়েছে। সেই আলোতে কোনো কিছুই স্পষ্ট দেখা যায়না। কোথাও কোনো শব্দ নেই। শুধু মাথার ওপর সাঁই সাঁই শব্দে ঘুরছে সিলিং ফ্যান।

— ‘বাবা!’

অয়ন ডাকল। কোনো সাড়া শব্দ নেই। অয়ন আবার ডাকল,

— ‘বাবা!’

এবার ঝন ঝন শব্দে কিছু একটা নড়ে ওঠার আওয়াজ পাওয়া গেল। খুব ভারী একটা লোহার শেকল। যেই শেকলটা বাবার পায়ের সাথে বাঁধা আছে। আবছা আলো আঁধারে অয়ন দেখল মেঝেতে পড়ে থাকা একটা দেহ ধীরে ধীরে উঠে বসলো। অয়ন আলো জ্বালালো। আলো জ্বেলে ওঠার সাথে সাথে পুরো ঘরটা একটা তীব্র আর্তনাদের ধাক্কায় ফেটে পড়তে চাইল। অয়ন চকিতে দেখল মাটিতে পড়ে থাকা তার বাবার শরীরে কোনো কাপড় নেই। তিনি আর্তচিৎকারে গলা ফাটিয়ে নিজের দুচোখ ঢেকে রেখেছেন। মুখ দিয়ে অদ্ভূত কিছু শব্দ গোঙানির মত বেরিয়ে আসছে। যার অর্থ অয়নের কাছে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য। অয়ন চট করে বাতিটা নিভিয়ে দিল। প্রকট চিৎকার থামল কিন্তু গোঙানি বন্ধ হলো না। সামনে এগিয়ে আসল অয়ন। হাঁটু গেড়ে বসলো বাবার সামনে। পকেট থেকে একটা দিয়াশলাইয়ের কাঠি বের করে আগুন ধরালো। বাবার মুখটা একটুক্ষণের জন্য স্পষ্ট হয়ে উঠল লালচে আগুনের আলোয়।

মুখ ভর্তি দাঁড়ি গোফ। চোখে ভয়াবহ অসহায়ত্ব। ঠোঁটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা। বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। চাপা গলায় বলল,

— ‘বাবা… তুমি কেমন আছ?’

বাবা কোনো উত্তর দিলেন না ‘উঁ’ করে শুধু অদ্ভূত একটা শব্দ করলেন মুখ দিয়ে।

— ‘বাবা আমি অয়ন! তুমি আমাকে চিনতে পারছ না?’

বাবা তার থর থর করে কাঁপতে থাকা ডান হাতটা তুলে অয়নের আঙ্গুল ছুঁয়ে দিল। ছোট বেলায় সে বাবার আঙ্গুল ঠিক এইভাবে ধরত। মনে আছে শীতের সকাল গুলোতে বাবার আঙ্গুল ধরে মর্নিং ওয়াক করতে যাওয়াটা অয়নের সবচাইতে প্রিয় কাজ ছিল। আজকে বাবার এই আলতো হাতে আঙ্গুল ছুঁয়ে দেয়া দেখে সেই ছবিটা চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল। অয়ন হাসল, প্রশ্রয়ের হাসি। উষ্ণ গলায় বলল,

— ‘শুভ জন্মদিন বাবা!’

বাবা কী বুঝলেন কে জানে, অয়নের আঙ্গুল দুটো নিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে চেড়ে খেলা করলেন যেন কিছুক্ষণ। এরপর আকস্মিক একটা জোরালো কামড় বসিয়ে দিলেন অয়নের কানি আঙ্গুলে। অয়ন কঁকিয়ে উঠল ব্যথায়। বাবার দাঁতে জোর আছে বলতে হবে। হাতটা ছাড়িয়ে ছিটকে দূরে সরে আসল অয়ন। আঙ্গুলের চামড়া ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে গেছে। নিজের ঠোঁট দিয়ে রক্তাক্ত জায়গাটা শুষে নিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘এ কী করলে তুমি? কেন করলে?’

বাবা নিশ্চুপ। বড় বড় দুটো চোখ ফেলে তাকিয়ে আছেন অয়নের দিকে। সামনে দাঁড়ানো এই ছেলেটাকে যেন তিনি চেনেনইনা। ছেলেটা যেন কথা বলছে কোনো অজানা বিদেশী ভাষায়। যে ভাষা তার কাছে পুরোপুরি দুর্বোধ্য।

অয়ন এবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘কেন তুমি এসব করছ? কেন পাগল সাজতে চাইছ!!’

অয়নের চিৎকার শুনে বাবা যেন একটু অবাক হলেন। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো ছেলের কথায় তিনি ব্যথা পেয়েছেন মনে। কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার বন্য জন্তুর মত আক্রোশে ফেটে পড়ে অয়নের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলেন। বাঁধ সাধলো পায়ে বাঁধা লোহার শেকল। শেকলে টান খেয়ে এবারে লুটিয়ে পড়লেন মেঝেতে। ঘরের দরজাটা খোলা ছিল। দরজার সামনে বহু বছরের পুরনো চাকর রহিম মিঞা দাঁড়ানো ছিল। রহিম মিঞা অয়নের হাত ধরে তাকে টেনে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করল। বলল, ‘সাহেবের খাবার সময় হয়েছে! খাবার সময় হলে উনার পাগলামো বেড়ে যায়। সামনে যা পায় তাই কামড়াতে চায়। আপনি চলে আসুন। আমি ওনার খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

অয়ন হেরে যাওয়া মন নিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে আসলো। নিচতলার সবচেয়ে কোণের দিকের ঘর এটা। বসার ঘর আর খাবার ঘর থেকে যথেষ্ট দূরে। বাবাকে ইচ্ছে করেই মূল বাড়ি থেেেক একটু দূরবর্তী ঘরে রাখা হয়েছে যাতে বাইরের লোকজন বেড়াতে আসলে পাগলের চিৎকার শুনে হচকিয়ে না যায়। ঘরটার সামনেই একটা চৌকস বারান্দা। বারান্দা পার হলে চাকরদের দুটো বড় বড় ঘর সাথে রসুই ঘর। সেই ঘরের শেষে ছোট এক টুকরো উঠান। তারপর একটা লম্বা করিডোর গিয়ে মিশেছে বসার ঘরের সাথে। করিডোরের সাথেই লাগোয়া একটা ঘুরানো সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়।

এবার প্রায় মাস দুয়েক পর আসা এ বাড়িতে। অয়ন হঠাৎ হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে উধাও হয়ে যায়। প্রযুক্তির কোনো ডিজিটাল ফাঁদে তখন সে ধরা দেয়না। অয়নদের তিনতলা বাড়িটা বেশ পুরনো ধাঁচের হলেও একটা খানদানী ছাপ আছে। বোঝা যায় এদের পূর্বপুরুষদের বেশ জমিদারী হাল ছিল। এক পুরুষ যতটা কামিয়েছে তা দিয়ে পরবর্তী দুই তিন পুরুষ হেসে খেলে কাটিয়ে দিতে পারার মতো অবস্থা। হয়েছেও তাই। একটা সময় এমন ছিল যখন এ বংশের পুরুষরা বাইরে কোনো কাজ করত না। তাদের একমাত্র পেশা ছিল ভাড়ার টাকা আদায় করা এবং জমি বিক্রি করা। অয়নের নিজের দাদা অবশ্য এই করেই সহায় সম্পত্তি সব খুইয়ে পথে বসেছিলেন। শেষমেষ এই একটা বাড়িই কোনো রকমে বেঁচে যায়। যদিও জমিদারী চালটা এখনো এদের মাঝে বেশ খানিকটা রয়ে গেছে।

সিঁড়ি ঘরের কাছে এসে বুশরার সাথে দেখা হয়ে গেল। বুশরা, অয়নের একমাত্র ছোট বোন। অয়নের চেয়ে বয়সে বছর পাঁচেকের ছোট হবে। ভাই বোনের মাঝে সচরাচর যেমন মধুর একটা সম্পর্ক থাকে, তাদের সম্পর্কটা ঠিক সে রকম নয়। একটা সময় অবশ্য বুশরা অয়নের বেশ ন্যাওটা ছিল। ছোট্ট, ফরসা, সিল্কি চুলের তুলতুলে ফুটফুটে বুশরা দেখতে অনেকটা বারবী ডলের মত ছিল। ভাইয়ু ভাইয়ু করে সারাটা দিন অয়নের পেছনে আঠার মত লেগে থাকত। অয়নেরও বেশ আদরের ছিল তার একমাত্র ছোট বোনটা। কিন্তু বাবার অসুস্থতার পর থেকেই সব কিছু বইয়ের পাতার মতো পাল্টে যেতে থাকল। বুশরার সাথে দূরত্বটাও সেই সময় থেকেই ঘনীভূত হচ্ছে। বুশরা অবশ্য এখন আর সেই ছোট্ট বারবী ডলটি নেই। এখন সে একুশ বছরের উঠতি যুবতী। একটি বেসরকারী বিদ্যালয়ে বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষে আছে সে।

বুশরা আসতেই চারপাশটা দামী পারফিউমের উগ্র গন্ধে ম ম করে উঠল । একটা রয়েল বসু কালারের আঁটসাঁট টপস তার পরনে আর কালো রঙের ঢোলাঢালা একটা অদ্ভুত প্যান্ট। মনে হয় নতুন কোনো ফ্যাশন হবে। পায়ে হাই হিল স্যান্ডেল। অয়ন আগাগোড়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল তার বোনটিকে আজকাল অয়নের দিকে চোখ পড়লেই বুশরা নাক কুঁচকে তাচ্ছিল্যের একটা ভাব করে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ভাবটা এমন যেন অয়নের গা থেকে ময়লা দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। আজ অবশ্য একটু ব্যতিক্রম হলো। অয়নকে দেখে বুশরা চোখ কপালে তুলল,

— ‘তুই? এত দিন কোথায় ছিলি?’

অয়ন আলস্য ভরা একটা গলা নিয়ে বলল, ‘এইতো, ছিলাম আরকি!’

— ‘সব কিছুর একটা লিমিট থাকে ভাইয়া! পুরো দুইটা মাস তুই বাড়ি থেকে উধাও!’

— ‘হুম’

— ‘হুম মানে কী? এবার কী মতলবে এসেছিস? থাকবি কটা দিন? নাকি আবার ফুটুশ?’

অয়ন হাসলো। আজকে বাবার জন্মদিন! বুশরা সেটা বেমালুম ভুলে গেছে। সে নিজেও বুশরার মত হতে পারলেই বোধহয় ভালো হত। বেশ হেসে খেলে কাটিয়ে দেয়া যেত এই একটা জীবন। অয়নের কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে বুশরা অধৈর্য গলায় বলল,

— ‘কী, কথা বলছিস না কেন? তুই জানিস আমরা কি পরিমান দুশ্চিন্তায় ছিলাম তোকে নিয়ে? দাদীমার তো শরীরটা খারাপ করে গেল তোর চিন্তায়, মা ও ভীষণ দুশ্চিন্তা করছিলেন!’

অয়ন কাঠ কাঠ হাসলো, ‘কেন? তোর মায়ের আবার কিসের দুশ্চিন্তা?’

— ‘এভাবে বলিস কেন? মা কি শুধু আমার একার? তোরও তো মা!’ অয়ন ঠোঁট উল্টে উদাস গলায় বলল, ‘নাহ! আমার কোনো মা, টা নাই!’

— ‘ভাইয়া! তুই দিন দিন একটা যাচ্ছেতাই হচ্ছিস। ছিঃ! তোকে নিজের ভাই বলতে আমার লজ্জা করে।’

বুশরা একটু থেমে আবার বাঁকা সুরে বলে, ‘নিজেকে দেখেছিস আয়নায়? দাড়ি গোঁফ রেখে একি বানর সেজেছিস? তোর চেহারা খানা ভালোই ছিল। তুই ঠিক হয়ে যা ভাইয়া, আবার আগের মতো হয়ে যা!’

— ‘কিছুই আর আগের মতো হবে না রে, কোনো দিনও হবে না… তোকে বলছি, তুই নিজেও বেরিয়ে আয় ওই ব্ল্যাক ম্যাজিক থেকে, তোর জীবনটাও শেষ করে দেবে ওই কালো জাদুকর, কোন দিন দেখবি তুই নিজেও বদ্ধ পাগল হয়ে গেছিস, এরপর তোর জায়গা স্থানান্তরিত হয়ে প্রাসাদ থেকে নিচে নেমে চাকরদের ঘরে হবে।’

বুশরার চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। ঘেন্নায় মুখ বাঁকিয়ে বলল,

— ‘নিজের মাকে নিয়ে কেউ এমন কথা বলতে পারে!! ছিঃ! তুই মানুষ না!!’

বাসায় ফিরতেই দেখা গেল বসার ঘরে বাড়িওয়ালার গোবেচারা ছেলেটা বেশ তেলতেলে মুখ নিয়ে সোফার ওপর বসে আছে। রান্নাঘরে উঁকি মারার সাথে সাথেই মায়ের নিত্য দিনকার রেডিওটা বিনা নোটিশে চালু হয়ে গেল।

— ‘এসেছেন আমাদের নবাবজাদী! ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলেন তিনি! বলি কেমন দেশ উদ্ধার করলেন আপনি ইন্টারভিউ দিয়ে?’

মায়ের সাথে আহির সচরাচর তর্কে যায়না। মা নিজের মতো নিজে বক বক করে যান, আহির শুনে যায়। আজকে আহিরের মেজাজটা আগে থেকেই তিরিক্ষি হয়ে আছে। সে অধৈর্য গলায় বলে উঠল, ‘উফ মা! চুপ করবে তুমি! কোনো ইন্টার ভিউটিউ হয়নি, উল্টা আমার মোবাইলটা খুইয়ে এসেছি।’

মা রান্নাঘরে টুং টাং শব্দে হাড়িপাতিল মাজছিলেন, আহিরের কথা শুনে বিষম খেলেন তিনি। হাতের কাজ ফেলে রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে চোখ কপালে তুলে বললেন,

— ‘সেকি! কীভাবে?’

আহির ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানির একটা বোতল হাতে নিয়ে গলায় ঢক ঢক করে পানি ঢালল। এরপর ডান হাতের উল্টো পাশ দিয়ে মুখ মুছে নিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমার এত সাধের ফোনটা! আহ! কী কষ্টটা যে লাগছে মা!!’

— ‘আহা, হলো কীভাবে, তা তো বলবি!’

— ‘একটা পাগল! পাগলের পাল্লায় পড়েছিলাম! ওই পাগলটার জন্যই আমার ফোনটা হারালো! ওই হারামজাদা কে যদি সামনে পাই না কোনো দিন! উফ!! কী যে করব!! খুন করে ফেলব!

আহির রাগে গজ গজ করছিল। মা একটু সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গীতে বললেন, ‘থাক, যা গেছে তা গেছে, জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছিস সেই ঢের, কেন যে এইসব আজে বাজে জায়গায় যাস! তোর মতো মেয়ের কি চাকরীর অভাব হবে?’

আহির ফুঁসতে ফুঁসতে তার বেডরুমে আসল। মা হাতের কাজ ফেলে খুব ব্যস্ত হয়ে আহিরের পেছন পেছন এসে ফিস ফিস করলেন,

— ‘বাড়ি ওয়ালার ছেলে এসেছে ভাড়া নিতে, তুই গিয়ে একটু কথা বার্তা বল’

আহির খুব বিরক্ত হলো, ‘আমি কেন কথা বলতে যাব? ভাড়া নিতে আসছে, ভাড়া নিয়ে চলে যাবে, এত আদিখ্যেতার কী আছে?’

— ‘আমি বলছি আমার কথা শোন। ইয়ে, আমার মনে হয় এই ছেলের তোর প্রতি ইন্টারেস্ট আছে’

আহির চাপা আর্তনাদ করে উঠল, ‘উফ মা! ওর ইন্টারেস্ট থাকলেই কী আর না থাকলেই কী! আমার ওই হাঁদারামটাকে একটুও ভালো লাগে না। দেখলেই বোঝা যায় যে এইটা একটা ফার্স্ট ক্লাস বেকুব’

মা আবার ফিসফিস করলেন ‘আস্তে বল, শুনবে তো!’

— ‘শুনুক কিচ্ছু আসে যায়না’

মা আহত চোখে আহিরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অপরাধীর মতো মুখ করে চলে গেলেন। মায়ের এই মুখটা দেখলে মন খারাপ হয় এ কথা সত্য। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। আহির জানে মা মনে মনে বাড়ি ওয়ালার ছেলেকে নিয়ে আকাশ কুসুম কল্পনা করে বসে আছেন। অথচ তুষারের সাথে আহিরের সম্পর্কের কথা মা খুব ভালো করে জানেন। ওদের সম্পর্কটা এখন অনেকটা ওপেন সিক্রেট হয়ে গেছে। সবাই সবকিছু জানে, বুঝে কিন্তু ভাবটা এমন দেখাবে যে কিচ্ছু জানেনা।

তুষারের সাথে আহিরের প্রথম পরিচয় পাঁচ বছর আগে, কলেজ থেকে অংশগ্রহণ করা জাতীয় পর্যায়ের একটা বিতর্ক প্রতিযোগিতায়। ডিবেটে আহিরের পারফরমেন্স সবসময়ই খুব ভালো। রশিদ স্যার বলতেন ‘ট্রিমেনডাস পারফরমেন্স’ শেষ মেষ পুরো কলেজে আহিরের নাম হয়ে গিয়েছিল ট্রিমেনডাস আহির। রাস্তাঘাটে কলেজের বন্ধুদের সাথে আজও দেখা হলে দূর থেকে চেঁচিয়ে উঠে বলে আরে ট্রিমেনডাস আহির না? বসার ঘরের শো কেসটার বেশ বড় একটা অংশ দখল করে আছে তার ডিবেট করে পাওয়া বিভিন্ন পুরস্কার আর সন্মাননায়। আহির সেবার গ্রুপ লিডার ছিল। যথারীতি ‘ট্রিমেনডাস আহির’ তার যুক্তি খন্ডন দিয়ে সকলকে মুগ্ধ করল এবং প্রতিপক্ষ দলের তৃতীয় বক্তা তুষার আহমেদ তার অসাধারণ যুক্তিখন্ডন দেখে একেবারে ‘প্রেমের মরা জলে ডুবেনা’ টাইপ প্রেমে পড়ে গেল। আহির কিন্তু তেমন একটা খেয়ালও করেনি হ্যাংলা পাতলা, লম্বাটে মুখের লাজুক তুষারকে। কিন্তু তুষার কী করে যেন আহিরের বাসার ল্যান্ড ফোনের নম্বর যোগাড় করে ফেলল। সে সময় আহিরের নিজস্ব কোনো মুঠোফোন ছিল না। তাই ল্যান্ড ফোনটাই তুষারের একমাত্র সম্বল হয়ে ধরা দিল।

প্রথমে ব্যাপারটা লক্ষ্য করল ছোট ভাই আশিক। কদিন ধরে ঘটনাটা বার বার ঘটছে। ফোন ধরার সাথে সাথেই গলার আওয়াজ শোনা মাত্র ওপাশ থেকে লাইন কেটে দেয়া হয়। আচ্ছা যন্ত্রণা তো! আশিক বাবাইয়ের কাছে গিয়ে সরাসরি নালিশ করল, ‘বাবাই তুমি খুব দ্রুত ফোনটা কলার আইডি করো, কারা যেন ফোন দিয়ে তামশা করে।’

বাবাই একটু চিন্তিত হয়ে বললেন, ‘আচ্ছা এরপর ফোন আসলে আমি ধরব, তোরা ধরিসনা।’

ফোন আসল এবং বাবাই রিসিভ করতেই খুট করে লাইনটা কেটে গেল। বাবাই থমথমে মুখে মাকে বললেন, ‘এরপর তোমার পালা’

মা কিছু চিন্তাভাবনা না করেই বলে ফেললেন, ‘বাড়িতে জোয়ান মেয়ে থাকলে ওরকম রহস্যজনক ফোন এসেই থাকে’

বাবাই তার স্বভাব সুলভ আমুদে গলাটাকে গম্ভীর করার চেষ্টা করে বললেন, ‘তা সেই জওয়ান মেয়েছেলেটা কে? তুমি নও তো? তোমার মুখটা অমন শুকিয়ে গেল কেন শুনি?’

মার মুখটা দেখার মতো ছিল। ক্লাস এইটে পড়ুয়া উঠতি বয়সের ছেলের সামনে এহেন মশকরার কোনো মানে হয়? আহির পাশের ঘরে পড়ার টেবিলে বসে এইসব কথোপোকথন শুনে খুব হাসছিল। মা রেগে গিয়ে বললেন, ‘আমাদের সময় বাপু আমরা ঘরের বাইরেই পা রাখতামনা গার্জিয়ান ছাড়া, আমার কথা ছেড়ে নিজের আদরের কন্যাটির কথা একবার ভাবো, তাকেই ডেকে বল ফোনটা ধরতে, আমার তো মনে হয় সে কলেজে গিয়ে এর মাঝেই কোনো রোমিও জুটিয়ে ফেলেছে, সেই রোমিও এখন আমাদের ঘুম হারাম করছে

বাবাই উদাস গলায় বললেন, ‘আমার মেয়ের পেছনে দু একটা রোমিও ঘুরে বেড়াবে এটাই স্বাভাবিক, এতে অন্যায় কিছু নেই, তবুও দেখি ডাকো তাকে, ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে যাক’

আহির পাশের ঘরে বসে এমন কোনো রোমিওর চেহারা মনে করতে পারল না। গিয়ে বসলো বাবাইয়ের পাশে। ফোন আসল, আহির ধরল, কিন্তু দেখা গেল ওটা ছোট খালার গলা। সেই রহস্যময় ফোনটা আর সে রাতে আসল না। আসল পরদিন সকালে। সবাই যখন নাশতার টেবিলে একটা হুড়োহুড়ির মাঝে মুখে খাবার ঢুকাচ্ছে সে সময়। বাবাই একটা সরকারি কলেজের ইংরেজির লেকচারার। সকাল দশটায় তার ক্লাস শুরু। আহিরের নটায় আর ছোট ভাইটার সাড়ে নটায়। সে রকম একটা নাকে মুখে ওঠা সময়ে ফোনটা আসল। মা হিমশিম খাওয়া গলায় ফোন তুলে ‘হ্যালো’ বলতেই ওপাশ থেকে একটা ঘ্যাস ঘ্যাসে গলা খুব নরম সুরে বলল,

— ‘স্লামালিকুম! আন্টি! আহির আছে?’

— ‘তুমি কে?’ মা হুঙ্কার ছাড়লেন। কোনো ছেলে এই প্রথম আহিরকে ফোন

করে চাইল। ওই পাশের গলার স্বর আরো নরম হলো,

— ‘জ্বি, আমি ওর ক্লাসমেট!’

— ‘ক্লাসমেট? কিসের ক্লাসমেট? ওদের কলেজে তো ছেলেরা পড়েনা। ‘জ্বি, আমি ওর সাথে কোচিং এ পড়ি’

— ‘ও! তো কী দরকার তোমার ওর সাথে?’

ছেলেটা একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘ইয়ে, ক্লাসের ব্যাপারে একটু কথা ছিল, ওকে কি একটু দেয়া যাবে?’

মা মুখখানা মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর বানিয়ে আহিরকে ডাকলেন, ‘এই, তোর ফোন’,

আহির ফোন ধরল, হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে হড়বড় করে যান্ত্রিক ভাবে একটা গলা কথা বলে উঠল,

— ‘আহির শোনো, আমি তুষার, তোমার কলেজের গেটের সামনে আজ পৌনে নটার দিকে দাঁড়িয়ে থাকব। আমি কালো শার্ট পরে থাকব, কথা আছে, প্লিজ, একটু সময় দিও, ওকে বায়!’

আহির স্তব্ধ হয়ে কথাগুলো শুনে যাচ্ছিল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। ফোনটা রাখতেই তিন মূর্তি তার দিকে এমন অদ্ভূত ভাবে তাকিয়ে রইল যে সে নিজেকে কোথায় লুকাবে বুঝে পেল না।

গেটের সামনে কালো শার্ট পরা কম পক্ষে তিনজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। এদের মাঝে একজন অবশ্য বয়স্ক ভদ্রলোক। বাকি দুজন ছোকরার মাঝে কোনটা যে সেই ফোনের ছেলেটা, আহির তা বুঝতে পারছিল না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢোকার মুহূর্তেই একজন পথ আটকালো।

আহির দেখল হ্যাংলা পাতলা, লাজুক লাজুক চেহারার একটা ছেলে। চোখের মাঝে এমন একটা অদ্ভূত ভালোমানুষীর ছাপ আঁকা আছে যে দেখলেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। ছেলেটা ওকে প্রথম যে কথাটা বলেছিল তা হলো,

— ‘তুমি কি ফেসবুকে আছ?’

হতবাক আহির অনেক কষ্টে উত্তর দিয়েছিল, ‘হুম, আছি, বাট অতটা একটিভ না’

ছেলেটা যেন চাঁদ হাতে পেল, উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘রিয়েলি! আমি তোমাকে এত খুঁজলাম, পেলাম না কেন? কী নামে আছ?’

আহিরের যেন এতক্ষণে একটু বোধদয় হলো সে পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘আপনাকে বলব কেন?’

ছেলেটা সাদাসিধে গলায় বলল, ‘আমি তোমার সাথে… আই মিন তোমার সাথে কথা বলতে চাই’

আহির বলল,

— ‘বলুন কী বলবেন?’

— ‘না মানে এভাবে না, ফ্রেন্ডশিপ করতে চাই।’

আহির হঠাৎ খুব কঠোর হয়ে বলল, ‘হাঁটুন!’

— ‘সরি?’

— ‘বললাম, হাঁটুন, আমি ফ্রেন্ডশিপের দোকান খুলে বসিনাই!’

আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আহির হাঁটা দিল। এই ছিল তুষারের সাথে তার প্রথম সাক্ষাতের গল্প। এরপর অবশ্য দীর্ঘ দুই বছর তুষার আহিরের পেছনে জোঁকের মত লেগে ছিল। শেষ মেষ একটা সময় আহির নিজেও পটে গেল। মা প্রথমটায় ঘোর আপত্তি তুললেন। বরিশালের লোকের সাথে তিনি সম্পর্ক করবেন না। তুষারের একমাত্র দোষ তার দাদার বাড়ি বরিশাল, এই দোষে দুষ্ট বলে মা তাকে মেয়ের জামাই করতে নারাজ। আহিরের নিজের বাড়ি সিলেট। মা সিলেটের ছেলের সাথেই সম্বন্ধ করতে চান।

জীবনের ঘোর সংকটের সময় প্রতিবার বাবাই আহিরের একমাত্র সহায় হয়ে ওঠেন। এবার অবশ্য ঘটনা ব্যতিক্রম। মেয়ের প্রেমিককে তিনি কোন দৃষ্টিতে দেখবেন আহির সেটা নিয়ে একটু দ্বিধায় ছিল। বাবাই সব শুনে টুনে আহিরকে ডেকে বললেন,

— ‘কাহিনী কী? আম্মাজান?

আহির মিনমিনে গলায় বলল, ‘বাবাই, তুষার আমাকে খুব ভালোবাসে, খুব, আর কেউ কখনো আমাকে ওর মত করে ভালোবাসতে পারবেনা’

বাবাই চিন্তিত গলায় বললেন, ‘বেশ ভালো কথা, কিন্তু ও তোকে কতটা ভালোবাসে সেটা আমি জানতে চাইনি। আমি জানতে চেয়েছি তুই তাকে কতটা চাস? সেটাই আমার কাছে ইম্পর্টেন্ট’।

আহির কী বলবে ভেবে পেলনা। এভাবে সে কখনো চিন্তা করেনি। তুষারের চাওয়াটা বরাবরই এত বেশি ছিল যে সেই চাওয়ার ভারে তার নিজের চাওয়া পাওয়ার ব্যাপারটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। সে মুহূর্তে আহির কোনো উত্তর দেয়নি বাবাইকে। সারারাত ভেবেছে। ভেবে ভেবে কোনো কূল কিনারা পায়নি। আসলেই সে তুষারকে ভালোবাসে কিনা সেই টপিকের ওপর বান্ধবীদের সাথে বেশ কবার গোলটেবিল বৈঠক বসালো এবং শেষমেষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, তুষারের সাথে সময় কাটাতে তার ভালো লাগে, তুষারের সাথে দেখা করতে, কথা বলতে ভালো লাগে, দু একদিন তুষারের সাথে দেখা না হলেই তার মনটা ছটফট করে, এর মানে সে তুষারকে ভালোবাসে। এই উপলব্ধির পর বাবাইকে বুক ফুলিয়ে সাহসের সাথে বলল, ‘বাবাই, তুষার কেই চাই আমার, তুমি মাকে বুঝাও’

বাবাই চিরকাল আহিরের বড় বাধ্য। মাকে বোঝানোর দায়িত্বটা তিনি পুরোপুরি নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিলেন। কিন্তু হায় মা আজও বুঝে উঠতে পারলেন না। পারলে কি আর বাড়িওয়ালার ছেলেকে নিয়ে এই বাড়াবাড়িটা করতেন?

বসার ঘরে ছাগলটা এখনো বসে আছে। আহির মাকে গিয়ে বলল, ‘ভাড়ার টাকা দাওনি তুমি এখনো ওর হাতে?’

— ‘দিয়েছি তো!’ মা থমথমে গলায় বললেন।

— ‘তাহলে বসে আছে কেন এখনো?’

— ‘আমি কী জানি!’

— ‘চা নাস্তা কিছু দেবার থাকলে দিয়ে দাও, খেয়ে দেয়ে বিদায় হোক’ মা একটু চুপ করে থেকে অপরাধীর গলায় বললেন, ‘আমি দুপুরে আমাদের সাথে খেতে বলেছি ওকে’

আহিরের মেজাজটা তড়াক করে সপ্তমে চড়ল। আজকের দিনটাই একটা কুফা। ধুর ছাই!

গট গট করে সে বাসা থেকে বেরিয়ে আসল। ওপর তলায় চৈতিদের বাসায় গিয়ে বরং বসে থাকা ভালো এই গাধাটার সাথে লাঞ্চ করার চাইতে। বের হবার মুহূর্তেই গাধাটা মিনমিনে স্বরে বলে উঠল, ‘ইয়ে, আহির! কোথায় যাচ্ছ?’

আহির মুখটা বাঁকা করে বলল ‘ডেটিং এ!’

বেচারার চেহারাটা মুহূর্তে ছাইবর্ণ হয়ে গেল। চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল। সে কোনো রকমে বলল,

— ‘মানে?’

— ‘মানে আমার বিএফের সাথে মিট করতে যাই!’

ছেলেটার মুখে তখন গভীর বিষাদের ছায়া। আহির নিষ্ঠুরের মত সেই বিষাদ মাখা মুখটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে হাঁটা দিল।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ৫

দাদীমা সন্ধ্যার মুখে মুখে চলে আসলেন। অয়নকে দেখা মাত্র পিলে চমকে উঠলেন

— ‘তুই ফিরলি শেষমেষ? কোথায় ছিলি এতদিন!!’ উত্তেজনার বশে কথা বলতে গিয়ে ঘাড়ের রগ ফুলে উঠল বৃদ্ধার। দেখে মায়া হলো অয়নের।

সে ফ্যাকাসে হাসলো। সংসারে এই একটা মানুষের সামনে দাঁড়ালে এখনো তার ভেতরটা নড়বড়ে হয়ে যায়। এই বৃদ্ধা রমণীটির ছায়া তার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকে যত দূরেই সে যাকনা কেন। অয়ন এগিয়ে এসে দাদীমাকে জড়িয়ে ধরল। দাদীমার শরীর কী নরম তুলতুলে! মনে হয় যেন গায়ের সাথে মিশে যাবে। গা থেকে কী সুন্দর একটা পবিত্র গন্ধ ছুটে আসে। অয়নের বেশ লাগে। দাদীমা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অয়নের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, ‘না না! এইসব সোহাগে আমি ভুলছিনা, আগে বল তুই কোথায় গিয়েছিলি? অন্যান্য বার পাঁচ ছ দিনের ভেতরেই ফেরত চলে এসেছিস, এবার মাস গড়ালো কেন শুনি? আর কত জ্বালাবি তুই আমাদের, হ্যাঁ?’

অয়ন শান্ত গলায় বলল, ‘আহা দাদীমা! এতদিন পর দেখা হলো, তুমি প্রথমেই ঝাড়া শুরু করলা!’

ছেলের জন্মদিন উপলক্ষ্যে দাদিমা নিজের হাতে কেক বানিয়েছেন। এখন সেই কেক কাটা হবে। যে মানুষটাকে নিয়ে এত আয়োজন সেই মানুষটা এই বাড়িতে, এত কাছাকাছি থেকেও কিছুই টের পাচ্ছেনা। বেঁচে থেকেও সে মৃত।

রাতে খাবার পর দাদীমার ঘরে ডাক পড়ল। গিয়ে দেখা গেল বুশরাও আছে।

— ‘এতদিন কোথায় ছিলি?’ প্রশ্নটা দাদীমার। বাড়ি ফেরার পর তৃতীয়বারের মতো একই প্রশ্নের মুখোমুখি হলো অয়ন।

— ‘প্রথম কয়েকদিন ছিলাম উত্তরায়, এক ফ্রেন্ডের বাসায়, এরপর কুষ্টিয়া’

— ‘কুষ্টিয়া কোথায় উঠেছিলি? কার বাসায়?’

— ‘কারো বাসায় না, ছিলাম লালনের মাজারে

— ‘সে কী! এই এতগুলো দিন তুই মাজারে পড়ে ছিলি? পাগল নাকি?’ অয়ন ঠাট্টার সুরে বলে, ‘আমাদের পাগলের বংশ, পাগল হতে আর কতক্ষণ!’

দাদীমা রাগ হয়ে যান এ কথা শুনে, ‘হাবিজাবি কথা বলিস কেন? ওখানে শুনেছি লোকে গভীর রাতে গাঞ্জা টানে, নেশা করে, তুইও এসব অনর্থ করে এসেছিস নাকি?’

অয়ন মিট মিটিয়ে হাসে। কিছু বলেনা। বুশরা খোঁচা মারার ঢঙে ফোড়ন কাটলো, ‘পাগল না, তোমার নাতি মনে হয় ফকির দরবেশ টাইপের কিছু হয়ে যাচ্ছে দাদীমা! মাজারে মাজারে ঘুরে বেড়ায়! বাপরে! দারুণ ব্যাপার!’

অয়ন বেশ মজা পেল বুশরার কথায়, নাটকীয় ভাবে বলল,

‘কিঞ্চিত ধ্যানে মহাদেবও, সে তুলনা কি আর দেব
লালন বলে গুরু ভাব যাবেরে মনের ধোকা
ওরে যাবেরে মনের ধোকা
পাবে সামান্যে কি তাঁর দেখা!’

বুশরা বিরক্তিতে মুখ চোখ কুঁচকে ফেলল। অয়ন দাদীমার কোলের ওপর মাথাটা রেখে বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে ছিল। দাদীমার বিছানাটা বেশ বড়, সেই পুরনো দিনের খাটের মতো। যেমন আয়তনে বড় তেমনি উঁচু। চারপাশে মশারী টাঙ্গানোর জন্য লম্বা লম্বা কাঠের স্ট্যান্ড।

দাদীমা অয়নের মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন,

— ‘এবার তোর একটা বিয়ে দেব আমরা, সুন্দর দেখে একটা পুতুল বউ নিয়ে আসব’

— ‘আনলেই পারো, খুব বেশি দাম হবেনা, বাড়ির পাশের মার্কেটেই পেয়ে যাবে।’

দাদীমা ওর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বললেন, ‘খুব ফাজলামো হচ্ছে, না?’ অয়ন গাট্টা খেয়ে নিজের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, ‘তুমিই তো বললে পুতুল বউ আনবে, সে তো কিনতেই পাওয়া যায়!’

বুশরা বলল, ‘ওর সাথে বিয়ে দিয়ে কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট করো না’

অয়ন বরাবরই বুশরাকে ক্ষ্যাপাতে ভালোবাসে, সে ঠাট্টার গলায় বলল, ‘দাদীমা, বুশরার কোন ফ্রেন্ড যেন আমার জন্য পাগল, তুমি ওই মেয়েটাকে একবার দেখতে পারো’

দাদীমা বেশ মনোযোগী হয়ে উঠলেন ‘তাই নাকি? কোনটা বলতো? দেখতে কেমন? বাবা কী করে?’

বুশরা মুখ বাঁকালো, ‘ভ্যাট, এখন তোমার নাতিকে দেখলে লেজ তুলে পালাবে, এক কালে পছন্দ করতো, এখন সেটা রুপকথা’

অয়ন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু দরজার কাছটায় একটা ছায়া মূর্তির আকস্মিক আগমন তার মুখের কথা কেঁড়ে নিল। আয়শা ফিরেছেন মাত্র অফিস থেকে। এখনো বাসি জামা কাপড় ছাড়েননি। চোখে মুখে ক্লান্তির স্পষ্ট ছাপ। বাড়ি ফিরেই এক কাপ কফি খাওয়া তার অনেক দিনের অভ্যাস। সেই কফি তিনি নিজের হাতে বানান। বাড়ির চাকরদের কোনো প্রকার সাহায্য এ সময়টায় তিনি নেন না। আজকেও তার হাতে কফির মগ। তিনি ঘরে ঢুকে দেখলেন পরিবারের সবাই একত্রে বসে গল্পে মেতে আছে। বিছানায় তার একমাত্র ছেলে দাদীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। ছেলের মুখ হাসি হাসি।

আজ কতদিন পর ছেলেটাকে নিজের বাড়িতে দেখতে পেলেন তিনি! দৃশ্যটা দেখা মাত্র মন ভালো হয়ে গেল। অফিসে ঘটে যাওয়া দুপুরবেলার ঘটনাগুলো মুহূর্তে ভুলে গেলেন। যদিও অয়নের সামনে তিনি আজকাল বেশ খানিকটা আড়ষ্ট বোধ করেন। অদৃশ্য একটা দেয়াল তাদের মা ছেলের মাঝে তৈরী হয়ে গেছে সেটা তিনি টের পান।

আয়শা ঘরের ভেতর ঢুকে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। বুশরা গদ গদ গলায় বলে উঠল, ‘মা তুমি এসেছ? গ্রেট! তোমাকেই মিস করছিলাম এতক্ষণ’।

অয়নের চোয়াল ততক্ষণে শক্ত হয়ে গেছে। হাত হয়ে গেছে মুষ্টিবদ্ধ। চোখের দৃষ্টি অস্থির। দাদিমা আয়শাকে বললেন, ‘আজকে রাস্তায় জ্যাম ছিল নাকি খুব, বৌমা?’

— ‘জ্বি মা, খুব জ্যাম ছিল। প্রায় দেড় ঘন্টা লেগে গেল আমার এ পর্যন্ত পৌঁছুতে

অয়ন শক্ত হয়ে রইলো বেশ কিছুক্ষণ। উঠে দাঁড়ালো। বেরিয়ে এলো ঘরটা থেকে কাউকে কিছু না বলেই। আয়শা তার ধারে কাছে আছে, এই ব্যাপারটা সে আজকাল সহ্য করতে পারেনা।

রাস্তায় নেমে পকেট থেকে সিগারেট বের করতে গিয়ে হাত পড়ল মোবাইল সেটটার ওপর। মনে পড়ল আজ দুপুরে অফিসে ওয়েটিং রুমের চেয়ারে ফোনটা পেয়েছিল সে। কেউ হয়ত তাড়াহুড়ায় ফেলে গেছে। ফোনটা অন করতেই স্ক্রীনে একটা মেয়ের চেহারা ভেসে উঠল। খুব সাধারণ একটা চেহারা। কাটা কাটা নাক, টানা চোখ, গায়ের রংটা একটু কালোর দিকে। হাসছে। হাসিটা বড় সুন্দর। একটু খেয়াল করতেই সৌন্দর্যের কারণটা ধরতে পারলো অয়ন। হাসির ফাঁকে গজদাঁত উঁকি দিচ্ছে। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। মনে পড়েছে। একেবারে কোনার দিকের চেয়ারটায় বসে ছিল মেয়েটা। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভয়ের চোটে নিজের সেল ফোনটাই ফেলে রেখে চলে গেছে। নিজের মনে হেসে ফেলল অয়ন। বেচারী ইন্টারভিউ দিতে এসে খুব শিক্ষা হয়ে গেছে। সে যাই হোক, ফোনটা ফিরিয়ে দেয়া দরকার। অয়ন ডায়াল লিস্টে গিয়ে দেখতে পেল মা নামে একটা নম্বর সেভ করা আছে। আগেপিছে কিছু চিন্তা না করে অয়ন কল করে ফেলল। খুব সম্ভবত মেয়েটার মা ই ফোন ধরবে। রিং পড়তে লাগল।

ভর দুপুরে চৈতিদের বাড়িতে হানা দেয়ায় চৈতির আম্মা বুঝি কিছুটা বিরক্ত হলেন। টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিলেন তিনি। চৈতি মুখে ফেস প্যাক লাগিয়ে রোবটের মত মুখ করে বসে আছে একটা চেয়ারে। আহিরকে দেখে তার চোখ দুটো আনন্দে চক চক করে উঠল। ফিক করে হেসে ফেলতে গিয়ে শুকনো খড় খড়ে ফেস প্যাকে টান পড়ল। ব্যথায় হালকা কঁকিয়ে উঠল সে। এরপর ছুট দিল ওয়াশরুমে মুখ ধুয়ে আসার জন্য। আহির চৈতির আম্মাকে একটা সালাম দিয়ে চৈতির ঘরে ঢুকে গেল। তাদের বাসার প্ল্যান আর এই বাসার প্ল্যান পুরোপুরি একই বলতে গেলে। দুটা বেডরুম আর ড্রইং ডাইনিং। এই ফ্ল্যাটে শুধু চৈতির আব্বা বাড়িওলাকে বলে একটা সার্ভেন্ট টয়লেট বানিয়ে নিয়েছেন। আজ প্রায় বছর দশেকের মতো হয়ে গেল চৈতিদের পরিবার আর আহিরদের পরিবার পাশাপাশি আছে। এ বাড়িতে এসেই চৈতির সাথে আহিরের প্রথম পরিচয়। একই ক্লাসে পড়ার কারণে ওদের মাঝে বন্ধুত্বটাও হয়ে গেল খুব তাড়াতাড়ি। চৈতি বেঁটে খাটো কিন্তু মিষ্টি দেখতে একটা মেয়ে। ভীষণ হাসি খুশি আর আমুদে স্বভাবের। আহির তাই মন থেকেই খুব পছন্দ করে মেয়েটাকে।

চৈতির ঘর প্রতিদিনের মতোই এলোমেলো। বিছানার ওপর ছড়ানো ছিটানো বইয়ের লহর। কাপড়ের স্তুপ চেয়ারের ওপর। এমনকি ঘরের ভেতর একটা উটকো গন্ধ। অন্য কোনো মেয়েকে আহির এতটা নোংরা হয়ে থাকতে দেখেনি কখনো। সে বুঝে পেলনা কোথায় একটু বসা যায়। চৈতি মুখ ধুয়ে এসে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিয়ে বলল,

— ‘দেখ তো, ফর্সা ফর্সা লাগে নাকি? এই ফেস প্যাকটা নতুন কিনসি’

আহির পানসে মুখে বলল, ‘তুই তো এমনিই ফর্সা, এর বেশি ফর্সা হয়ে কি ভূত সাজতে চাস?’

চৈতি গলায় আক্ষেপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল, ‘আর ফর্সা হলেই বা কী হবে ভাই? আমাদের তো ভাত নাই, ভাত তো তোর, বাড়িওয়ালার বেকুবটা পর্যন্ত তোর দিকেই গেল, কই আমার ফর্সা রং তো কাউকে টানছেনা দেখছি!’

আহির হেসে ফেলল, ‘বেকুবটা এখন আমাদের বাসায় বসা, তুই চাইলে গিয়ে আলাপ করতে পারিস

চৈতি চক চকে চোখ নিয়ে বলল, ‘সেকি! সে তোদের বাসায় কী করছে?’

— ‘কী আর করবে, সোফায় বসে বসে পা দুলাচ্ছে’।

— ‘ওহ!! দেখতে শুনতে একটু ভালো হলে দেখতি ঠিকই বাগে নিয়ে আসতাম, কিন্তু যা একখান সুরত! ইচ্ছা করেনা। তা তুষার সাহেব কেমন আছেন?’

— ‘তোর ফোনটা দে তো, তুষারকে একটা ফোন দিতে হবে, আজকে জানিসনা তো কী কান্ডটা হয়েছে!’

— ‘কী হয়েছে?’ রহস্যের গন্ধ পেয়ে চৈতি উদ্বেগ নিয়ে বলল।

— ‘পরে বলছি, আগে তুষারকে ফোন লাগা!’

— ‘হ্যালো তুষার?’

— ‘হ্যাঁ, মিটিং এ আছি, কী বলবে তাড়াতাড়ি বল’

আহির ঢোঁক গিলল। আমতা আমতা করে বলল,

— ‘ইয়ে, আমার ফোনটা হারিয়ে গেছে, তুমি আমাকে ফোন করে পাবেনা, এটা জানাতে চাইছিলাম’

তুষার নিরুত্তাপ গলায় বলল,

— ‘ও, আচ্ছা!’

অবাক হলো আহির, বারে! ফোন হারানোটা যেন নিত্যদিনের ঘটনা। একটু চুপ থেকে তুষার বলল,

— ‘ওকে, আমি তোমাকে টিএনটিতে ফোন দিব, তখন বিস্তারিত শুনব, এখন খুব ব্যস্ত আছি সোনা! ছাড়ছি বায়, লাভ ইউ!’

ফোন কেটে গেল। তুষার এ মাসেই স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাঙ্ক এ জয়েন করল, এ কথা সত্য সে আজকাল ভীষণ ব্যস্ত থাকে, তবু আহিরের এত বড় একটা দুঃসংবাদ শোনার পরেও কী তার কাছে কাজই বেশি হয়ে গেল? মনটা খারাপ হয়ে যায় আহিরের। গত কাল রাতেও তুষার এই ইন্টারভিউ সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করেনি। কোথায় অফিস, কি সমাচার কিছুই জানতে চাইল না। ব্যস্ততা মানুষকে এতটা বদলে দেয়?

একটু বাদেই মায়ের ডাক পড়ল। চৈতির ফোনে। যাবার সময় চৈতি বলল,

— ‘বিকেলে ছাদে আসিস পারলে, খুব গল্প করব

আহির একটা হাসি দিয়ে সম্মতি সূচক মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসল। বাসায় আসতেই মা হইচই লাগিয়ে দিলেন।

— ‘ফোন এসেছিল, ফোন এসেছিল!’

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি

আহির অবাক, ‘কার ফোন, কিসের ফোন?’

— ‘তোর নম্বর থেকে

— ‘সেকি!’

মায়ের উত্তেজিত কন্ঠস্বর থেকে বেরিয়ে আসা শব্দগুলো দ্বারা যা বোঝা গেল তা হলো, কোনো এক হৃদয়বান ব্যক্তি তার ফোনটা খুঁজে পেয়েছেন, এখন সেই হৃদয়বান ফোনটা ফিরিয়ে দিতে চান, আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় শাহবাগ মোড়ে সে অপেক্ষায় থাকবে।

মাথা মুন্ডু বুঝে উঠতে আহিরের একটু সময় লেগে গেল। ফোনটা কার হাতে যেতে পারে! ইন্টারভিউ দিতে আসা পাশে বসে থাকা ছেলেটা নয় তো? কিংবা ওই অফিসেরই কোনো কর্মচারী হতে পারে। এই আজগুবী ফোনের ওপর বিশ্বাস করে কাল শাহবাগ মোড়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটা আসলে কতটা যুক্তিযুক্ত হবে আহির সেটা বুঝতে পারছেনা।

মা বললেন, ‘তুই একা যাসনা, একা মেয়ে পেয়ে আবার কী না কী শয়তানী করে, তুই বরং তুষারকে সঙ্গে নিয়ে যা, সেই ভালো হবে’

আহির একটু চমকে তাকালো মায়ের দিকে। মা কবে থেকে আবার তুষারকে বিশ্বস্ত ভাবা শুরু করেছেন! বাব্বাহ! সূর্য কোনদিকে উঠল আজ? সে যাই হোক মায়ের মুখে আস্থার সাথে তুষারের নামটা শুনতে পেয়ে ভালো লাগল। ফোনটা আবার ফিরে পাবার একটা আশা দেখতে পাওয়াতেও মনটা একটু নেচে উঠল। একটু আগের বিষণ্ণ ভাবটা এখন আর কাজ করছেনা।

রাস্তায় নামার পর থেকেই শীতটা টের পাওয়া যাচ্ছে। অয়নের গায়ে একটা পাতলা পাঞ্জাবী। সেই পাঞ্জাবী ভেদ করে একরোখা হাওয়া শরীরে চাবুক বসাচ্ছে। কুয়াশায় আবছা হয়ে আছে রাজপথের ফ্লুরোসেন্ট আলো। রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানটা খোলা। অবশ্য রাত খুব বেশি একটা হয়নি। দশটা বাজে মাত্র।

অয়ন এক কাপ চা দিতে বলে বেঞ্চিতে বসলো পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে। চায়ের দোকানদার অয়নকে দেখে একগাল হাসি দিয়ে বলল,

— ‘মামা কই আসিলেন এদ্দিন? অনেক দিন পর দেখতাসি’

অয়ন হাসে, ‘এইতো মামা! আমার আর থাকা না থাকা, আমি পাগল মানুষ, আমার কি ঠিক আছে কিছু?’

কাঁধের কাছে একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে চমকে তাকায় অয়ন। বেশ পরিচিত একটা মুখ হাসি হাসি চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অয়নের আজকাল চেনা লোকের সংখ্যা এত বেশি বেড়ে গেছে যে রাস্তা ঘাটে হঠাৎ দেখায় কারও নাম মনে করতে পারেনা সে। নাম গুলিয়ে ফেলে। ভুল নাম বলে শেষ মেষ লজ্জায় পড়তে হয়। মনে হচ্ছে এই ছেলেটার নাম তানিম। এ পাড়াতেই থাকে, খুব চেনা মুখ। ছেলেটা হাস্যজ্জ্বল মুখে বলল,

— ‘অয়ন ভাই! কী অবস্থা?’ অয়ন হাসলো, বেঞ্চের এক কোণে সরে এসে ছেলেটাকে বসার জায়গা করে দিয়ে বলল,

— ‘ভালো, তুমি কেমন আছ?’ বসে পড়ল ছেলেটা,

  • ‘ভালো, আপনাকে অনেক দিন পর দেখলাম’

— ‘হুম, ঢাকার বাইরে ছিলাম’

নাহ, ছেলেটার নাম নিয়ে কনফিউশন কাটছেনা। আসলেই কি এটা তানিম নাকি অন্য কেউ? যতদূর মনে পড়ে তানিমের গালে সারা বছর ব্রণ উঠে ভরে থাকে। চুল ঘাড় অবধি লম্বা। কিন্তু এই ছেলের গাল পরিষ্কার। রাস্তার আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চুল ছোট করে ভদ্রলোকের মতো কাটা। নাহ তবে এটা তানিম না। নাম না জেনে আলাপ চালিয়ে যাওয়াটা বেশ বাজে একটা ব্যাপার। আবার হুট করে এখন নাম জিজ্ঞাসা করে বসাটাও অভদ্রতা হয়ে যাবে। অয়ন যার পর নাই একটা অস্বস্তি নিয়ে চায়ের কাপ হাতে নিল। ছেলেটাকে চায়ের অফার করতেই টুপ করে রাজি হয়ে গেল। অয়ন গলা চড়িয়ে হাঁক দিল, ‘মামা! আরো এক কাপ দাও’

ছেলেটা হঠাৎ বেশ সরল গলায় বলে উঠলো, ‘ভাইয়া মনে হয় আমাকে চিনতে পারেননি’

অভিনয়টা ধরা পড়ে যাওয়ায় অয়ন একটু লজ্জা পেয়ে গেল। অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল, ‘ইয়ে, তোমার নামটা! আমি আসলে আজকাল বড্ড ভুলে যাই বুঝলে, কিচ্ছু মনে থাকেনা, তোমার চেহারাটা খুব চেনা চেনা লাগছে কিন্তু নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছিনা, সরি!’

ছেলেটা প্রসন্ন হাসলো, ‘সরি হবার কিছু নেই, আপনি ব্যস্ত মানুষ, মনে না থাকারই কথা, আমি তুষার, কাছাকাছিই থাকি। এ পাড়ায়ই থাকি।

— ‘এবার মনে পড়েছে, তুমি তো স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডে জয়েন করেছ শুনেছিলাম, কেমন চলছে চাকরী? বাই দ্যা ওয়ে, তুমি আমার চাইতে বেশি ব্যস্ত, জব টব কর, আমি তো টো টো কোম্পানীর ম্যানেজার’

— ‘চাকরি ভালোই চলছে, মাত্র তো ঢুকলাম এখনো বুঝে উঠতে পারছি না আসলে সইবে কী সইবেনা, অনেক প্রেসার! আপনার কী খবর, কিছু করছেন না কেন ভাইয়া? আপনার মতো একটা ব্রাইট ছেলে যদি এভাবে বসে থাকে তাহলে কী করে চলবে?’

অয়ন হাসলো। তুষারকে এখন খুব ভালো মতোই মনে পড়েছে। ওর চেয়ে বছর দুয়েকের ছোট হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং এর ছাত্র। অয়ন ছিল ফার্মেসী ডিপার্টমেন্টে। এক বিকেলে আড্ডা শেষ করে করে হল থেকে ফেরার সময় ছাত্রলীগ আর ছাত্র দলের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মাঝে ফেঁসে গিয়েছিল অয়ন। সেই সময় এই তুষারের সাথে দেখা। একই পাড়ায় থাকার সুবাদে তুষার আগে থেকেই কিছুটা চিনতো অয়নকে। অয়নের মনে আছে সেদিন তুষারের দয়াতেই প্রচন্ড হাঙ্গামার ভেতরও রেহাই পেয়ে গিয়েছিল সে। তুষার সে সময় মন প্রাণ দিয়ে রাজনীতি করত। মনে পড়তেই অয়ন প্রশ্ন করল,

— ‘আমার কথা ছেড়ে দাও, তোমার খবর বল, পলিটিক্স কেমন চলছে?’ তুষার হাসলো। হাসলে হালকা পাতলা লাজুক লাজুক ছেলেটাকে বেশ মিষ্টি লাগে। মুখে এখনো কচি কচি ভাবটা রয়ে গেছে।

— ‘পলিটিক্স তো ভাইয়া আমার রক্তে মিশে আছে, কিন্তু এখন আর কই সময় পাই বলুন? চাকরি বাকরি এইসব হাবিজাবিতেই টাইম চলে যায়। সামনে হয়ত বিয়েটাও করে ফেলতে হতে পারে

— ‘গ্রেট! খুব ভালো, তা তোমার নিজের পছন্দে বিয়ে করছ? নাকি পরিবারের পছন্দে?

— ‘নিজের পছন্দ,’

— ‘বাহ, কী করে মেয়ে? তোমার সাথেই পড়াশোনা করেছে?

— ‘নাহ, ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইকোনমিক্সে অনার্স করেছে,

এখন চাকরী খুঁজছে, যুতসই পাচ্ছেনা,’

অয়ন চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলল, ‘দারুণ! খুব তাড়াতাড়ি তাহলে আমরা একটা বিয়ে খাচ্ছি, এবার তাহলে একটু রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে মনুষ্যনীতি কর, সেই ভালো’

তুষার ম্লান ভাবে বলল,

— ‘রাজনীতির প্রতি আপনার আক্ষেপটা তাহলে এখনো যায়নি ভাইয়া’

— ‘আক্ষেপ না কী আসলে তা ঠিক বলতে পারবনা, শুধু এতটুকু বলতে পারি যে রাজনীতি করে কখনো দেশের মানুষের পাশে সত্যিকার অর্থে দাঁড়ানো যায়না। রাজনীতি হলো রাজরাজড়াদের নিয়ম কানুন, সাধারণ মানুষের এখানে কোনো স্থান নেই’

— ‘সরকার তো দেশের মানুষই ভোট দিয়ে নির্বাচন করে, তাইনা? দেশের মানুষগুলোর জন্যই তো গণতন্ত্র!’

অয়ন হাসলো, of the people, by the people, for the people, এই শব্দগুলো এখন মিউজিয়ামে তোলা আছে বুঝলে, কোনো প্রয়োগ নেই, আচ্ছা বলতো এই যে এতগুলো দিন পলিটিক্স করছ, কখনো এই শীতের রাতগুলোতে রাস্তার পাশে শুয়ে থাকা কোনো পথ শিশুকে তুলে নিয়ে নিজের আরামের বিছানাটা ছেড়ে দিয়েছ তার জন্য? বলো দিয়েছ?’

তুষার একটু অপ্রস্তুত হয়ে যায়। সে জানে এই ছেলেটার মাথায় একটু ছিট আছে। তবুও কোনো এক অজানা কারণে এই মানুষটাকে সে সম্মান করে। একটা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল,

— ‘নাহ, তা তো করিনি, পলিটিক্স করি ভাই, মানবাধিকারের কাজ করিনা’ বলেই তুষার খুব হাসলো। যেন অনেক উঁচুমানের একটা রসিকতা করে ফেলেছে সে।

অয়ন একটু ভারী গলায় বলল, ‘ডেমোক্রেসির বেসিক নিশ্চয়ই তোমার জানা আছে। respect for human rights and fundamental freedoms মানবাধিকার নিয়েই যদি না ভাবলে তো কিসের রাজনীতি কর তোমরা ভাই?’

— ‘ধীরে ধীরে সবই হবে ভাইয়া, দেখুন এই ক বছরে উন্নতি কিন্তু কিছু কম হয়নি, গ্রামে গঞ্জে প্রতিটা ঘরে ঘরে বিদ্যুত গেছে, প্রতিটা স্কুল ঘরে কম্পিউটার গেছে, ইন্টারনেট এখন গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছেও সহজলভ্য। পুরো পৃথিবীটা হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। সত্যিকার অর্থে ডিজিটাল হয়ে উঠছে দেশটা, এই দিক দিয়ে একটু ভাবুন ভাইয়া! একটু ভাবলেই বুঝতে পারবেন আওয়ামী লীগ আসলে কী কাজটা করছে দেশের জন্য’ অয়ন পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটে চেপে ধরল। শীতটা ভালোই পড়ছে। কাল থেকে আর চাদর গায়ে দেয়া ছাড়া বেরোনো যাবেনা বাসা থেকে।

সিগারেটে আগুন ধরিয়ে একটা টান দিয়ে অয়ন বলল,

— ‘তোমাদের সমস্যা কি জানো তুষার? দেশ বলতে তোমরা সবসময় আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি বোঝো, ভাই এইসব দল টল থেকে এবার বেরিয়ে আসো, শুধুমাত্র নিজের দেশটাকে নিয়ে ভাবো, দেশের মানুষগুলোকে নিয়ে ভাবো। আমি কোনো দলের হয়ে কথা বলতে চাইছিনা।

— ‘যে উন্নয়নটা হচ্ছে সেটা কি দেশের মানুষের জন্যই নয়? সরকার তো জনগণের থেকে আলাদা কিছু না, সরকার যা করছে জনগণের জন্যই করছে’

অয়ন একটা শ্লেষের হাসি হাসলো,

— ‘যে দেশে worth of humanity নাই সে দেশের আবার উন্নয়ন! এই যে শীত আসছে, দেখবে রাস্তা ঘাটে কুকুরের পাশে মানুষগুলোও ঠান্ডায় জমে গিয়ে কুঁকড়ে পড়ে আছে। আচ্ছা তোমাদের ওই গদিতে বসে যে লোকগুলো দেশ চালাচ্ছে, তারা কি কখনো রাস্তায় নামেনা? হাঁটেনা? চোখ মেলে দেখেনা? মনে হয় দেখেনা, যদি দেখতো তাহলে দেশের সর্বোচ্চ সিংহাসনে বসে থেকে এরা দুশ্চিন্তা আর আত্মগ্লানিতে ঘুমাতে পারতো না।’

— ‘দারিদ্রতা যতদিন আমাদের বুক আঁকড়ে পড়ে থাকবে, ততদিন এসব থেকে বেরিয়ে আসা কি সম্ভব? ওসব বাদ দিয়ে একটু পজেটিভ চিন্তা করুননা ভাইয়া, এই যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে, জাতি কলঙ্কমুক্ত হচ্ছে, কত বড় একটা স্বার্থকতা!’

— ‘হ্যাঁ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে সেটা খুব ভালো কথা, কিন্তু জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করা এত সহজ কথা না, এক অর্থে, এ দেশের আনাচে কানাচে, অলিতে গলিতে আরো কত কত রাজাকার ঘাপটি মেরে বসে আছে তা আমাদের জানা নেই! এদের সবকটাকে খতম না করলে দেশ কখনো কলঙ্কমুক্ত হবেনা, তবে একটা ব্যাপার কি জানো? মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা জানতাম যে আমাদের শত্রু পক্ষ কারা। কিন্তু এখন… এখন আসলে আমরা বুঝেই উঠতে পারছিনা যে কাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে!’

তুষার একটু নড়ে চড়ে বসলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খানিকটা বিরক্ত। তবুও বুঝি নেহাৎ ভদ্রতার খাতিরেই বলল,

— ‘ভাইয়া, আপনি কথা বলেন খুব সুন্দর, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, কিন্তু সবসময় আসলে আপনার কথার সাথে আমি একমত হতে পারিনা, মাফ করবেন’

— ‘আরে না, মাফ করার কিছু নাই, আমি জাস্ট আমার ভাবনাটা শেয়ার করলাম তোমার সাথে’

তুষার হাসল, অয়ন উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

— ‘আসি ভাই, অনেক কথা বললাম, hope you wouldn’t mind!’

— ‘কী যে বলেন ভাইয়া, মাইন্ড করার প্রশ্নই আসেনা। চাকরি বাকরি কিছু একটা ধরুন ভাইয়া, এভাবে আর কদ্দিন চলবে!’

— ‘আরে না, চাকরি বাকরি আমার দ্বারা হবেনা, দাসবৃত্তি পছন্দ করিনা আমি!’

— ‘তাহলে আপনার আম্মার বিজনেসে ঢুকে যান, স্বাধীন থাকবেন’

— ‘নারে ভাই, স্বাধীনতা কোথাও নেই, ব্যবসা বল আর চাকরি বল, সেই অর্থের কাছে, টাকা পয়সার কাছে দাসত্ব স্বীকার করতেই হবে, আমি ঠিক করেছি কিছুই করবনা, খেয়ে না খেয়ে পার করে দেব, এই একটা জীবন!’

তুষার হাসে। এতটাও আবোল তাবোল মানুষ হয়?

আকাশে পেঁজা তুলো মেঘ। চাঁপা ফুল রঙের মিষ্টি একটা আদুরে রোদ্দুর ছড়িয়ে আছে ধূলোমাখা গাছগাছালিতে, উঁচু দালানের কার্নিশে, ব্যস্ত রাস্তার গায়ে গায়ে। আহির দাঁড়িয়ে আছে শাহবাগের ফুলের দোকানগুলোর সামনে। তার গায়ে হালকা বেগুনী রঙের সালোয়ার কামিজ। তার ওপর ম্যাচিং করা পাতলা চাদর। চুলগুলো এলো করে খোলা পিঠের ওপর। মিষ্টি রোদটা গালে এসে পড়ায় তার বাদামী গায়ের রং চিক চিক করছে। সুন্দর দেখাচ্ছিল আহিরকে। রাস্তার মানুষগুলোর নজর আটকে ছিল ওর ওপর। পুরোপুরি আজগুবি একটা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই পর্যন্ত চলে আসায় নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছিল। কিন্তু হারানো জিনিস ফিরে পাবার আশায় এই রিস্কটুকু নেবার লোভ সামলাতে পারেনি সে। মায়ের মোবাইলটা সাথে ছিল। ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে নিয়ে নিজের হারানো নম্বরে কল করলো। রিং পড়ছে কিন্তু ধরছেনা কেউ। মনটা খারাপ হয়ে গেল। নেহাৎ কেউ একজন ফাজলামো করেছে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে। আর মা সেটা বেকুবের মত বিশ্বাস করেছে। প্রায় আধা ঘন্টা হয়ে গেছে সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে। তুষারের আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটা কাজ পড়ে গেল। তুষার সাথে থাকলে সময়টা এত বাজে কাটত না। শেষ বারের মতো আশেপাশে চোখ বুলালো আহির। খুব কাছেই একটা জটলা তৈরি হয়েছে। মেরুন কালারের একটা এলিয়েন গাড়িকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে ভিড়টা। লুঙ্গি গেঞ্জি পরা দোকানদার ধরনের লোকজন ঘিরে আছে গাড়িটাকে। গাড়ির সামনেই একটা রিকশা দাঁড়ানো। মনে হচ্ছে রিকশাওয়ালার সাথেই কোনো ঝামেলা হয়েছে গাড়ির মালিকের। বেশ চড়া গলায় হইচই হচ্ছে। একটু মনোযোগ দিয়ে তাকাতেই আহির দেখল ড্রাইভিং সিটে ষোল কী সতেরো বছরের এক কিশোরী বসে আছে।

আহির গা বাঁচাতে একটু দূরে সরে আসলো। রাস্তাঘাটের এসব গন্ডগোল দেখলে কেমন ভয় ভয় লাগে আজকাল। দেশের পরিস্থিতি যা হয়েছে, এক মুহূর্তের ভরসা নেই। কখন কী হয়ে যায়। আরেকবার তাকাতেই এই এতগুলো পিপীলিকার মতো মানুষের ভিড়ের মাঝে একটা চেহারার ওপর চোখ আটকে গেল। কালো ফতুয়া গায়ে দেয়া। আহির কোথায় যেন দেখেছে এর আগে এই চেহারাটা। কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছেনা। খুব চেনা চেনা লাগছে। উঁচু গলায় কথা বলছে ছেলেটা। মনে হচ্ছে যেন এই আকস্মিক গন্ডগোলের মূল হোতা সে নিজেই। ঠিক সেই সময় চেনা চেনা মুখের ছেলেটার চোখ পড়ল আহিরের দিকে। চোখে চোখ পড়তেই আহিরের মনে পড়ে গেল, আরে এইটা তো সেই পাগলটা!!!

হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠল। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চাইল। এতক্ষণে বুঝতে পারল আহির এই ভিড় ভাট্টার কারণ কী। পাগলটা নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা বাঁধিয়েছে। আহির আর কোনো কিছু চিন্তা না করেই ফেরার পথে পা বাড়ালো। নাহ এখানে আর একটা মুহূর্তও না। জান নিয়ে পালাতে হবে। সেদিনের মত ভাংচুর করে বিপদ ঘটানোর আগেই।

— ‘এই যে! এই যে শুনুন!’

আহির পেছন ফিরে তাকালো, ওমা একি!! পাগলটা তাকেই ডাকছে!!! কিছু না শোনার ভান করে আহির হাঁটতে লাগল। সামনে একটাও খালি রিকশা নেই যে চট করে উঠে যাবে। বিপদ আসলে সব দিক থেকে একসাথে আসে! হায় খোদা এখন কী হবে!

— ‘এই যে ম্যাডাম! আপনি শুনতে পাচ্ছেননা?’

এবারে গলার আওয়াজ একেবারে ঘাড়ের কাছে পাওয়া গেল। আহির চমকে তাকালো। পাগল ছেলেটা তার দিকে খুব অবাক চোখে চেয়ে আছে। যেন আহির মানুষ না, চিড়িয়াখানার কোনো চিড়িয়া।

বুকটা কাঁপছিল, তবুও কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে আহির বলল, ‘কী চাই?’

— ‘আশ্চর্য! আপনি পালাচ্ছেন কেন?’ সোজা সাপটা প্রশ্ন। আহির একটু কেমন থতমত খেয়ে গেল। পাগলটা পাগল হলেও কিন্তু ভীষণ স্মার্ট! কথায় ধার আছে। ভেতরে ভেতরে কেমন একটু কুঁকড়ে গেল আহির। তবুও গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘কী চাই আপনার?’

— ‘স্ট্রেঞ্জ!’ বলল পাগলটা। যদিও এখন তার আচার আচরণ মোটেও পাগলের মতো না।

একটু থেমে কিছু একটা চিন্তা করে নিয়ে ছেলেটা নাটুকে গলায় বলল, ‘আমি ভাই কিছুই চাইনা আপনার কাছ থেকে, আপনার ফোনটা শুধু আপনাকে ফেরত দিতে চাই, আপনি দয়া করে আপনার ফোনটা ফেরত নিয়ে আমাকে ধন্য করুন’

বিষম খেল আহির। শেষমেষ এর হাতেই গেছে তার ফোন! সত্যি বিশ্বাস হচ্ছিল না। মুখটা একটু হা হয়ে গেল আহিরের। ছেলেটা পকেট থেকে ফোনটা বের করতে করতে বলল, ‘এ জন্যই জ্ঞানী লোকেরা বলে গেছেন, মেয়েদের উপকার করতে নেই!’

আহিরের মুখ খানা ছাইবর্ণ হয়ে গেল। ছিঃ কি কান্ডটা হলো। বেচারা পাগল ছাগল ছেলেটা তার হারানো ফোন ফিরিয়ে দেবার জন্য ডাকছিল আর সে কিনা কী দুর্ব্যবহারটাই করে ফেলল। আহির কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। কে বলবে স্কুল কলেজে পড়াকালীন সময়ে এই মেয়েটা কী দুর্দান্ত বিতার্কিক ছিল। এখনো অবশ্য আহিরের সাথে যুক্তিতে খুব কম লোকই পারে কিন্তু আজকে সবকিছু কেমন একটু বেসামাল হয়ে গেল। কাঁপা হাতে নিজের ফোনটা হাতে নিল সে।

— ‘এক্সকিউজ মি!’

ওরা দুজনেই খানিকটা চমকে তাকালো। কিশোরী মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে, যে এতক্ষণ গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে ছিল। হ্যাংলা পাতলা মেয়েটা লম্বায় প্রায় পাঁচ ফুট পাঁচ ছাড়িয়ে গেছে। গায়ে একটা বাদামী রঙের ফুল হাতা সোয়েটার। কালো জিন্স। রঙ করা চুল। টকটকে ফরসা গায়ের রং। একবার তাকালেই চোখে ধাঁধা লেগে যায়। আহির সত্যি বলতে খুব মুগ্ধ হলো মেয়েটাকে দেখে। এত কম বয়সেই এর পার্সোনালিটি দেখার মত। তার ওপর রূপের চমক তো আছেই!

— ‘শিওর!!’ অয়ন বলল।

বাচ্চা মেয়েটা একটু হেসে একবার আহিরকে আপাদমস্তক দেখে নিয়ে অয়নকে বলল,

— ‘ইওর গার্লফ্রেন্ড?’

— ‘না না!’ ছেলেটা আঁতকে উঠল। একটু লাল হল আহির। মেয়েটা হাসলো আবার, ছেলেটাকে বলল,

— ‘ওহ সরি! বাই দ্যা ওয়ে, উমমম, মে আই হ্যাভ ইওর ফোন নাম্বার?

— ‘ইয়েস ইউ মে, বাট সরি টু সে, যে ফোনটা বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে!’ মেয়েটাকে দেখে মনে হলো সে কথাটা বিশ্বাস করল না। চোখ দুটোতে হালকা অবিশ্বাস চকচক করে উঠল। মুখে তখনও লটকে আছে সেই হাসিটা। একটুও বিচলিত না হয়ে বলল, ‘তাহলে যেটা সবসময় খোলা থাকে সে নম্বরটাই দিন, কিংবা কোনো মেসেঞ্জার! যেটাতে আপনি এভেইলেবল!’

— ‘আমার কোনো কিছুই নেই’

আহির বেশ মজা পাচ্ছিল। চেনেনা জানেনা হুট করে কোনো ছেলের কাছে কোনো মেয়েকে ফোন নম্বর চাইতে এই প্রথম দেখল সে। এই জেনারেশনটা সত্যি খুব অন্যরকম হয়ে বেড়ে উঠছে। ভাবতে অবাক লাগে।

মেয়েটা এবার কৌতুকের স্বরে বলল, ‘আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? আমি খুব বেশি বিরক্ত করব না, আসলে আজকে আপনি আমার অনেক বড় উপকার করলেন তো! আমি… আমি জাস্ট আপনার সাথে কানেক্টেড থাকতে চাইছি।’

ছেলেটা হাসলো,

— ‘এটা এমন কিছুনা, আমি না থাকলে অন্য কেউ হেল্প করত আপনাকে, তবে একটা কথা বলি, লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর সাহস আর করবেন না। আর বয়সও একেবারে কম আপনার। অ্যাডাল্ট হয়ে উঠুন তারপর না হয় এসব রিস্ক নেবেন! আজকে রিকশায় বসে থাকা মহিলাটার যদি কিছু হয়ে যেত তো আপনার খবর ছিল!’

— ‘ওকে স্যার! আপনার কথা গুলো মনে থাকবে! ফোন নম্বরটা মনে হয় দেবেন না আপনি!’

— ‘না না! দেবোনা কেন? উমমম আসলে আমার ফোন নম্বর আমার মনে নেই, আপনি আপনারটা বলুন আমি মিস কল দিচ্ছি।’

আহির মিটিমিটি হাসছিল আর এই ফোন নম্বর আদান প্রদানের খেলাটা দেখছিল। ফোন নম্বর নেয়া হলে মেয়েটা বলল,

— ‘আপনি সত্যি খুব অদ্ভূত মানুষ। নিজের নম্বর নিজের মনে থাকেনা!! বাই দ্যা ওয়ে, আপনার নামটা জানা হলো না!’

  • ‘অয়ন’ নিজের নামটা বলল ছেলেটা। আহির শুনলো।

মেয়েটা এবার আহিরকে ইঙ্গিত করে অয়নকে বলল,

— ‘আপনার বন্ধু বুঝি?

অয়ন কিছু বলল না, তবে মুখে একটা হ্যাঁ সূচক হাসি লটকে রাখল। মেয়েটা আহিরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল,

— ‘আমি তিয়ানা! ডু ইউ নো সামথিং এবাউট ইওর ফ্রেন্ড? হি ইস আ ব্রেভ ম্যান, আই এম টোটালি ইম্প্রেসড!’

মেয়েটির চটক দেখে আহির তখন অবাক সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। কোনো রকমে হাত বাড়িয়ে দিয়ে নিজের নামটা বলল, ‘আহির।’

অয়ন চোখ তুলে দেখল একবার আহিরকে। ‘আহির!’ এ আবার কেমনতর নাম!

— ‘ওকে, বায়! হ্যাভ ফান!’ বলেই মেয়েটা তার অতি সরু কোমর খানা

দুলিয়ে দুলিয়ে হাই হিল জুতো ঠক ঠকিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। আহির হা হয়ে তাকিয়ে ছিল। সাঁই করে চোখের সামনে দিয়ে প্রায় উড়ে গেল গাড়িটা। উড়ার সাথেসাথেই দুজনে ঠিক এক সাথে বলে উঠল, ‘বাহ!’

এরপর চমকালো দুজনেই। হেসে ফেলল। অয়ন বলল,

— ‘আরে জানেন না তো! স্পিডে গাড়ি চালাতে গিয়ে একটা রিক্সার সাথে

লাগিয়ে দিয়েছিল ধাক্কা। রিকশায় বসা ছিল এক মহিলা। সেই মহিলা রিকশা থেকে নেমে এই মেয়েকে কী যে ধমক। রাস্তার লোকজনও মজা পেয়ে মহিলার হয়ে খুব দালালী শুরু করল। আমি গিয়ে থামালাম। বাচ্চা মেয়ে! কী দরকার মোড়ে মোড়ে গাড়ি চালানোর!’

— ‘হুম তাই তো দেখছিলাম, খুব হইচই হচ্ছিল। তা বেশতো! মেয়েটা একেবারে আপনার ডাই হার্ট ফ্যান হয়ে গেছে!’ কৌতুকের গলায় বলল আহির।

সন্ধ্যে হয়ে আসছিল। কুয়াশা গভীর হয়ে চেপে বসছে ধুলোমাখা শহরের গায়ে। ওরা ফুটপাথ ধরে কিছুটা সময় হাঁটলো। কেউ কোনো কথা বলছিল না। একটা খালি রিকশা সামনে পেয়ে গেল। আহির অয়নকে বলল, ‘আমি তাহলে আসি’ এই প্রথম ছেলেটার চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, একে সে বহুকাল ধরে চেনে। সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষকে হঠাৎ এই সন্ধ্যেবেলার বাদামী আলোয় কেন এত চেনা চেনা লাগছে!

আহির রিকশার ভাড়া ঠিক করে তাতে উঠে বসলো। অয়ন দাঁড়িয়ে ছিল তখনও। আহির অয়নের দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় বলল,

— ‘আসলে, আপনাকে কী বলে যে ধন্যবাদ দেব! ভাষা খুঁজে পাচ্ছিনা’ অয়ন হাসলো শুধু, কিছু বললনা।

— ‘এহ: নাক বোঁচা আর কপালটা বিশাল বড়, দেখলে মনে হয় চুল নাই মাথায়’ অয়ন বলল বিষঢালা গলায়। সে পা তুলে বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে বুশরার বিছানায়। জানালা গেলে মেঝেতে এসে পড়েছে মৃদু হিম জড়ানো সকাল বেলার মিষ্টি রোদ। বারান্দার রেলিঙের ধারের বেল গাছটার ডালে বসে দু তিনটা পাতি চড়ুই বেশ অনেকক্ষণ হলো জোরে- সোরে ঝগড়া করছে। অয়নের কটাক্ষ ভরা উক্তিতে বুঝি ওদের ঝগড়াতেও ব্যাঘাত ঘটল। হঠাৎ চুপ করে গেল ওরা। দাদীমা কিছু বললেন না। শুধু ভ্রুটা একটু কুঁচকে ফেললেন। বুশরা কম্পিউটার টেবিলে বসে ছিল। দাদীমা নির্দেশ দিলেন,

— ‘নেক্সট!’

বুশরা বাধ্য মেয়ের মত মাউস ঘুরিয়ে নেক্সট বাটনে ক্লিক করল। সবুজ শাড়ি পরা একটা ঝলমলে মেয়ের ছবি ভেসে উঠল আঠারো ইঞ্চির এলইডি মনিটরে। বুশরা আর দাদীমা দুজনই তাকালো অয়নের দিকে। অয়ন বেশ মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখার ভান করল। দু এক মিনিট সময় নিয়ে দেখে বলল,

— ‘ইশশ!! দেখো দাদীমা, মেয়েটার চেহারার মধ্যে একটা কেমন যেন জম্বি জম্বি ভাব আছে।’

দাদীমা এক রাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘সেটা আবার কী জিনিস? তোদের এসব কথা বার্তা বাপু আমি বুঝিনা। এই মেয়ে ডাক্তার, মেয়ের বাবা মা ডাক্তার, খুবই ভালো পাত্রী! আমার মনে হয় এ ক্ষেত্রে আমরা এগোতে পারি।

অয়ন খিক খিক করে হেসে উঠে বলল, ‘এই ডাক্তার মেয়ে আমার মতো বেকার ভাদাইম্যা একটা ছেলেকে কেন বিয়ে করবে, বল তো দাদীমা?’

— ‘করবেনা আবার! করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে, আমার নাতী কী যেন তেন নাকি? হাজারে একটা!’

বুশরা একটু জ্বালা ধরা গলায় বলল, ‘তুমি বরং তোমার নাতীর জন্য ঐশ্বরিয়া রাই কে নিয়ে আসো দাদীমা, তোমার নাতীর কোনো সাধারণ মেয়ে পছন্দ হবেনা’

— ‘নাহ, ঐশ্বরিয়া না, এলিসা কুথবার্টকে ভালোলাগে, ওই রকম মেয়ে পেলে বিয়ে করব, প্রমিজ!’

দাদীমা বোকাটে একটা চেহারা বানিয়ে কি যেন চিন্তা করলেন কিছুক্ষণ। এরপর খুব সিরিয়াস ভঙ্গীতে কথা বলা আরম্ভ করলেন, যেন চাইলেই এলিসা কুথবার্টকে তাঁর নাতবউ বানানো যায় এবং ব্যাপারটা বুঝি আসলেই খুব ভাববার বিষয়।

— ‘এইসব নায়িকা টায়িকা নিয়ে সংসার করা যায়না বাপু, সংসার করার জন্য চাই শালীন এবং ঘরোয়া মেয়ে, বলে দিলাম আগে থেকেই! ‘

বুশরা বলে, ‘ফর গড সেক দাদীমা, তোমার এই বাউন্ডুলে নাতীটার সাথে বিয়ে দিয়ে কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট করোনা।

দাদীমা রসিকতার গলায় বললেন,

— ‘একবার বিয়েটা হয়ে গেলেই দেখবি, সব ঠিক হয়ে যাবে, তোর দাদাভাই ও বিয়ের আগে ঠিক অয়নের মতোই ছিলেন, অয়নকে দেখি আর আমি অবাক হই, ঠিক যেন ওই মানুষটাই খানিকটা মুখোশ পাল্টে ফেরত এসেছেন আমাদের মাঝে’

বুশরা বলল,

— ‘দাদাভাই তোমাকে খুব ভালোবাসতেন, তাইনা?’

দাদীমার চোখ দুটো চক চকে হয়ে উঠল। সম্মোহনের গলায় বললেন,

— ‘তোর দাদাভাই মানুষটা ছিলেন খুব অদ্ভূত। তার মনের ভেতর কী চলতো তা কেউ কোনোদিন টের পেত না।’

— ‘তুমিও না?’ বুশরার প্রশ্ন। দাদীমার সাতাত্তর বছর বয়সের কাঁপা কন্ঠটা আকস্মিক কেমন চাপল্যে ভরে উঠল,

— ‘আমি বুঝতাম যে তিনি আমাকে মনে মনে কতটা পছন্দ করতেন… হে হে, সে সব কথা তো আর তোমাদের বলা যাবে না গো!’

অয়নও বেশ মজা পাচ্ছিল। সে ঢং করে বলল,

— ‘কেন গো? বলা যাবেনা কেন গো? দাদীমা ফোকলা দাঁতে হাসলেন। বললেন,

— ‘তখন আমার বয়স তেরো, সেই তেরো বছর বয়সে তোদের বাড়ির বউ হয়ে আসলাম।’

এই খবরটা ওদের দুজনেরই জানা আছে। দাদীমার মুখেই শুনেছে। কিন্তু তাঁর আজকাল ভুলে যাবার রোগ হয়েছে। এক কথা মনের ভুলে চোদ্দ বার বলতে থাকেন। প্রতিবারই পুরনো গল্পটা নতুন উদ্যমে বলা শুরু করেন। যেন সম্পূর্ণ গোপন কোনো তথ্য শেয়ার করছেন তিনি। বুশরা অবশ্য তাঁর গল্প বলায় কখনো বাঁধা দেয়না। প্রতিবারই খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে এমন একটা ভান করে। অয়ন ভান করতে পারেনা বললেই চলে। সংসারে প্রিয়জনদের খুশি করতে হলে

যে মাঝেমধ্যে একটু আকটু মিথ্যে অভিনয় করতে হয়, এই কায়দাটা তার জানা নেই। সে ভোঁতা মুখে বলল,

— ‘হুম জানি, এই গল্প একশ বার করসো, বিয়ের আগে দাদাভাইকে দেখার সৌভাগ্য তোমার হয়নি’

দাদীমা ফোড়ন কাটলেন, ‘আমি দেখতে চাইও নি!’

অয়ন অবহেলার গলায় বলে, ‘ওই একই, এরপর বিয়ের প্রথম রাতে, আই মিন তোমাদের বাসর রাতে দাদাভাইকে দেখে তোমার রাজকাপুরের কথা মনে পড়ল, কারণ দাদাভাই দেখতে একদম রাজকাপুরের মতো ছিলেন, সেই রূপ আমরা কেউ পাইনি, বাবাও না, আমিও না! উফ, একটা মানুষ নিজের বরের প্রশংসা করতে এত ভালোবাসে কী করে?

দাদীমা খিট খিটে গলায় বললেন, ‘তা তোর এত হিংসা হচ্ছে কেন শুনি?’ অয়নের মোবাইলটা বাজছিল। একটা অপরিচিত নম্বর। অয়ন বিরক্তির সাথে ফোন ধরল।

— ‘হ্যালো!’ একটা নারী কন্ঠ কথা বলে উঠল

— ‘হ্যাঁ, কে?’ অয়নের কটমটে প্রশ্ন।

— ‘অয়ন বলছেন?’

— ‘বলছি’

— ‘গতকাল সারাটা দিন আপনার ফোন বন্ধ পেলাম!’

— ‘আরে আজব! আপনি কে সেইটা তো আগে বলেন!’

ধমক শুনে ওপাশের মেয়েটা একটু বিষম খেল।

— ‘আমি তিয়ানা’

— ‘তিয়ানা? কে তিয়ানা?

তিয়ানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অস্বস্তি নিয়ে বলল,

— ‘সেই যে আমার গাড়ি একটা রিক্সাকে মেরে দিল, রাস্তার লোকজন আমাকে গণপিটুনি দেবার জন্য তৈরী হচ্ছিল, আর আপনি এসে বাঁচালেন, এর মাঝেই ভুলে গেলেন দেখি! বাহ!’

অয়নের মনে পড়ল। অবাক লাগল ওর। মেয়েটা এমন ধুম করে ফোন দিয়ে ফেলবে ভাবতেই পারেনি সে। ফোনটা নিয়ে দাদীমার সামনে থেকে সরে আসলো সে।

— ‘ওহ! সরি! আসলে আপনার কন্ঠ চিনতে পারিনি, আর আপনার নামটাও চট করে মাথায় ক্লিক করেনি’

— ‘এপোলজি একসেপটেড’ তিয়ানা হাসলো।

— ‘মাই পেস্নজার’

— ‘আজকে বিকেলে ফ্রি আছেন?’

— ‘কেন বলুনতো?’

— ‘মিট করতে চাই’

অয়ন একটু ভড়কালো। অপ্রস্তুত গলায় বলে ফেলল,

— ‘কেন?’

— ‘আসলে আপনাকে না আমার খুব পছন্দ হয়েছে, আমি কিন্তু সোজাসাপ্টা কথা বলতে ভালোবাসি, প্লিজ অন্যভাবে নেবেন না, আমি… আমি কি আপনার বন্ধু হতে পারি?’

খাইছে! পিচ্চি কয় কী!! অয়ন ভ্রু কুঁচকালো। হতবাক গলায় বলল, ‘বন্ধু!!’

— ‘হ্যাঁ, বন্ধু।’

— ‘আপনার বয়স কত?’ চট করে প্রশ্নটা করে ফেলল অয়ন।

— ‘সুইট সিক্সটিন!’ দারুণ স্মার্ট উত্তর দিল তিয়ানা।

— ‘আর আমার কত জানো? ছাব্বিশ হলো এ বছর!’

— ‘তাতে কি? ইউ আর ইয়াং! আপনার বয়সী কত এডমায়ারার আছে আমার জানেন? বড্ড সেকেলে লোকদের মতো কথা বলছেন আপনি! একটা চান্স নিয়ে দেখুন না! গড প্রমিজ, বোর হবেন না আপনি

অয়ন হেঁসে ফেলল। নাহ, খারাপ লাগছেনা বাচ্চা মেয়েটার কথাগুলো শুনতে। বেশ তো, একটা চান্স নিয়ে দেখাই যাক না! কী আছে জীবনে!

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ১০

১০

আজ সকালে ঘুম ভাঙ্গলো একটা দুঃসংবাদ পেয়ে। বাড়িওয়ালা নোটিশ পাঠিয়েছে। এক মাসের ভেতর বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে। বাড়ি ওয়ালার মেয়ে বিদেশ থেকে ফেরত আসছে দেশে। এসে এই ফ্ল্যাটেই উঠবে। এর জন্য তাড়াহুড়ো করে এক মাসের ভেতরেই বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে আহিরদের। সকাল থেকে বাবাইয়ের মুখখানা বিষণ্ণ। কলেজ যাননি তিনি আজ। সাত সকালে এই নোটিশের কারণে দুশ্চিন্তায় পেয়ে বসেছে তাকে। খবরের কাগজ মুখের সামনে ধরে রেখে স্নান মুখে কিসব ভেবে যাচ্ছেন তিনি। মা রান্নাঘরে কাজের ফাঁকে লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ মুছছেন। আহির সমস্তটাই টের পাচ্ছে।

ছোট ভাইটা সকালে ঘুম থেকে উঠে কোচিং এ গেছে। এই খবর সে জানেনা এখনো। জানলে নির্ঘাত মুখটাকে হাড়ির মতো বানিয়ে ঘুরতো। বুকের ভেতর একটা অসহায় হাহাকার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। কী হবে এখন? কী হবে? এই একটা মাসের ভেতর নতুন বাড়ি কোথায় খুঁজে পাবে তারা? যে হারে বাড়ি ভাড়া বাড়ছে। দুই বেডরুমের এত বড় কোনো নতুন ফ্ল্যাটে উঠতে গেলে কম করে হলেও বিশ হাজার টাকা ভাড়া পড়বে। এখন তারা পনেরো দেয়। বাবাইয়ের মাসিক বেতন পঁচিশ হাজার। এর মাঝে বড় একটা অংক বাড়ি ভাড়াতেই চলে যায়। সংসারের বাকি খরচ গুলো তিনি দু’একটা টিউশনী করে বাড়তি কিছু টাকা উপার্জন করে কোনো রকমে চালান। বাড়ি ভাড়ার পরিমাণ যদি এর থেকে বেড়ে যায় তো না খেয়ে থাকতে হবে তাদের। এবার তবে আরো ছোট ফ্ল্যাট খুঁজতে হবে। এদিকটায় পাওয়া যাবেনা এত কম ভাড়ায় মোটামুটি মানসম্মত বাড়ি। অন্যদিকে খুঁজতে হবে। এদিকে আবার তুষার আসার কথা। একটু আগেই ফোন করে বলল, মিনিট দশেকের ভেতর আসছে। আহির আর না করতে পারল না। কিন্তু বাসার এরকম একটা আবহাওয়ায় তুষারের হুট করে চলে আসাটা কতটা মানানসই হবে বুঝে উঠতে পারছিল না সে।

রান্নাঘরে গিয়ে একটা কোকোলা নুডলসের প্যাকেট ছিঁড়ে অনভ্যস্ত হাতে রান্নায় লেগে গেল। তুষার আসলে কিছু না কিছুতো সামনে দিতে হবে। মায়ের মনের যা অবস্থা, এখন কোনো আয়োজন করতে বলাটা অন্যায় হয়ে যাবে। মা নিজের মনে বটি পেতে তরকারী কুটছিলেন। আহিরকে দেখে বাঁকা গলায় বললেন,

— ‘কথা বললে তো তুমি কথা শোননা, সেদিনকে বললাম, বাড়িওয়ালার ছেলেটার সাথে বস, বসে দু দন্ড কথা বল, এক সাথে লাঞ্চ কর, তা না মহারানী ডাট মেরে মুখ ফিরিয়ে চলে গেলেন, বলি এখন গেল কোথায় আপনার ডাট শুনি? হা: ….ছাল নাই কুত্তার বাঘা নাম!! পথে বসিয়ে দিলি তুই আমাদের!’

মায়ের গলার স্বর কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল, ‘এবারে পথে নামতে হবে, বস্তিতে গিয়ে থাকতে হবে, হায় খোদা সহায় হও তুমি!’

কেউ যেন ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বুকটা রক্তাক্ত করে দিচ্ছিল। আহির কান কাটার মত হয়ে কাজ করে যাচ্ছিলো। সে জানতো মা ঠিক এই ইঙ্গিতটাই করছেন মনে মনে। এবার মুখ ফুটে বলেই ফেললেন। সত্যি অভাব মানুষের স্বভাব একেবারে নষ্ট করে দেয়। মা তাহলে পরোক্ষ ভাবে এটাই বলতে চাইছেন যে এ বাড়িতে টিকে থাকার জন্য আহিরের উচিত ছিল ওই ছেলের সাথে গিয়ে ফস্টি নস্টি করা কিংবা যে কোনো ভাবে ওই ছেলেকে প্রশ্রয় দিয়ে যাওয়া। এতে আহিরের চরিত্রের ওপর দাগ পড়ল তো পড়ুক, তাতে কিচ্ছু আসে যায়না। আহিরের চোখ ফেটে জল আসতে চাইছিল।

তুষার এসে পড়ল কিছুক্ষণের মাঝেই। আজ শনিবার। অফিস ছুটি। তবুও সকাল সকাল একেবারে ফিট বাবুটি সেজে এসেছে সে। ফুলহাতা শার্ট, কালো প্যান্ট, জেল দিয়ে পাট করে চুল আঁচরানো। ভালো লাগলো তুষারকে দেখে। দম বন্ধ করা গুমোট ভাবটা একটু হালকা হতে শুরু করল বুঝি ও আসাতে।

বাবাই নিজের ঘরে খবরের কাগজ পড়ছেন। মা রান্না ঘরে। তুষার তাদের দুজনকে সালাম দিয়ে এসে বসার ঘরে বসল।

— ‘শোনো, খুব জরুরী কথা আছে’ তাগাদা দিল তুষার।

আজকাল জরুরী কথা আছে, এই বাক্যটা শুনলেই বুক ধক করে ওঠে। নাহ, আর ভালো লাগেনা! আহির কিছু বলল না। বিষণ্ন চোখে তাকাল তুষারের দিকে।

— ‘তুমি আঙ্কেলকে একটু বুঝিয়ে বল, বিয়ের আগে আমাদের ঘরে, মানে তোমার আমার বেডরুমে একটা ওয়াল কেবিনেট করে দিতে পারলে খুব ভালো হয়, আব্বা আম্মা সেটাই চাইছেন আর একটা খাট আর ড্রেসিং টেবিল, ব্যাস এতটুকুই, তুমি একটু ম্যানেজ করো লক্ষ্মীটি!’ কত অকপটে বলে ফেলল তুষার কথাগুলো। ভারী অবাক লাগল আহিরের।

— ‘বিয়ের তো এখনো ছ, সাতমাস বাকি আছে, এত আগে এসব বলছ কেন?’

— ‘ছ, সাতমাস খুব বেশি সময় না,’

— ‘এখনো তো তারিখও পড়েনি!’

— ‘তা পড়েনি, কিন্তু পড়তে কতক্ষণ, তোমায় বলে রাখলাম আগে ভাগেই কারণ তোমাদের তো আবার সমস্যা আছে। সব কিছুকে বেশি প্যাঁচাও তোমরা। আগে থেকেই প্রিপেয়ার থাকো, মানে প্রিপেয়ার করো আঙ্কেল আন্টি কে’

আহির শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আর যদি বলি পারব না?

— ‘কী আজব! পারবেনা কেন? এভারেস্ট জয় করতে তো বলিনি তোমাকে! আর এতটুকু একেবারে না পারলেই নয়, মান ইজ্জতের সাওয়াল হয়ে যাবে, আমাদের ফ্যামিলির মানুষ জনের কাছে কী জবাব দেব? সবাই তো দেখতে চাইবে মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে কী কী জিনিস আসলো!’

— ‘তুমি কি এসব বলার জন্য আসছ তুষার?’

— ‘হ্যাঁ… তা এসেছি এসব বলার জন্যই, তবে তোমাকে দেখতেও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল’

— ‘তাহলে এবার তুমি যেতে পারো’ ঝাঁঝালো গলায় বলল আহির। তুষার আহত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আহিরের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

— ‘ওভার রিঅ্যাক্ট করছ কেন?

— ‘আমার ইচ্ছে হয়েছে, তাই করছি!’ আহির কঁকিয়ে উঠল। উঠে দাঁড়াল তুষার। মৃদু গলায় বলল, ‘তুমি বদলে যাচ্ছ! খুব বদলে যাচ্ছ!’

আহির দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে মূর্তির মত বসে রইল। নড়ল না অনেকক্ষণ। সেই পুরনো ইচ্ছেটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আজ অনেকদিন পর। দূরে কোথাও হারিয়ে যাবার অদম্য ইচ্ছেটা। এই সমাজ সংসার ছেড়ে, বহু দূরে কোনো এক অচিন পুরে চলে যেতে খুব ইচ্ছে করে। যেখানে এ পৃথিবীর টুকরো টুকরো মৃত্যুগুলো থাকবেনা, থাকবেনা কোনো পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ, মান অভিমান, হৃদয়ের টানাপোড়েন, ভালোবাসার মিথ্যে অভিনয়। কোথায় আছে গো এমন জায়গা?

১১

শীতকালের এই এক সমস্যা। বিকেলটা একেবারে ছোট। দুপুর বেলা ভাত খেয়ে উঠে এক দুবার আড়মোড়া ভাঙতে না ভাঙতেই বেলা ফুরিয়ে যায়। মাত্র কিছুটা সময় সূর্যদেব পশ্চিমের আকাশে বিরক্তি নিয়ে ঢলে থাকেন। এরপর সুযোগ বুঝে দৌড়। ঝপ করে ভারী কুয়াশার চাদর গায়ে দিয়ে নেমে আসে সন্ধ্যা। আজ বিকেলে তিয়ানার সাথে দেখা করার কথা অয়নের। দুপুরে খেয়ে দেয়ে বিছানায় একটু গা রেখেছিল। কম্বলের নিচে শুয়ে পড়তেই দুচোখ দখল করে আস্তানা গড়লো দুপুরবেলার বড় আদরের শৌখিন ঘুমটা। ঘুম ভেঙে দেখলো ঘড়িতে সারে চারটা বেজে গেছে। মোবাইলে তিয়ানার সাত আটটা মিসড কল। অয়নকে অবশ্য তেমন একটা বিচলিত হতে দেখা গেল না। তার ভাব দেখে মনে হলো, তিয়ানার তার জন্য অপেক্ষা করা এবং এত এত বার ফোন দেয়াটা অতি স্বাভাবিক ঘটনা। সে আরো খানিকক্ষণ বিছানায় ইচ্ছে মতো গড়িয়ে নিল। এরপর বাথরুমের গীজার অন করে গরম পানি দিয়ে আরাম করে গোসল করল। দাদীমার নিজের হাতের বানানো দুধ চিতই পিঠা খেলো। সাথে গরম গরম চা। এত সব রাজকীয় কাজ সমাধা করতে করতে ঘড়িতে বেজে গেল সাড়ে পাঁচটা। মসজিদে তখন মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। গায়ে সাদা টি শার্ট আর ধুসর রঙের মোটা উলের চাদর জড়িয়ে রাস্তায় নেমে সে আয়েশী ভঙ্গিতে তিয়ানাকে ফোন করল।

— ‘হ্যালো’ তিয়ানার গলা থমথমে।

— ‘হুম, ফোন দিয়েছিলে?’

— ‘আশ্চর্য! কোথায় ছিলেন আপনি?’ তিয়ানা রাগে ফেটে পড়ল।

— ‘আমি? আমি তো ঘুমাচ্ছিলাম!’ অয়ন বলল উদাসীন ভাবে।

তিয়ানা চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘কী করছিলেন?’

— ‘ঘুমাচ্ছিলাম!’

— ‘মানে?’

ফোনের ওপাশে বোমা পড়ল যেন। তিয়ানার চিৎকারটা পুরোপুরি কানের পর্দা ভেদ করে মগজের ভেতর ঢুকে গেল। মোবাইল হাত থেকে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল অয়ন। কোনো রকমে বলল, ‘কী আশ্চর্য! ঘুমাতে পারব না আমি?’ বেশ ইনোসেন্ট শোনালো ওর প্রশ্নটা।

— ‘আপনার আমার সাথে দেখা করার কথা বিকেল চারটায়, আমি আপনার জন্য ওয়েট করছি আর আপনি ঘুমাচ্ছেন!!!’

অয়ন কী বলবে খুঁজে পেল না। বেশ অনেক দিন হয় তাকে কেউ এমন ধমকের সুরে কথা বলেনা। এ লেভেলে ম্যাথস পরীক্ষার আগের দিন ক্রিকেট খেলতে যাবার অপরাধে বাবার কাছ থেকে শেষ বারের মতো রাম ধমক খেয়েছিল। বাবা অসুস্থ হয়ে যাবার পর অয়নকে ধমক দেবার মতো লোকের সংখ্যা খুব একটা থাকল না। দাদীমা মাঝে মাঝে কঠিন হতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত পেরে ওঠেন না। এ ছাড়া অয়নের আর আছে কে? বড্ড স্বাধীন জীবন তার। কোনো পিছুটান নেই। আজ তাই হঠাৎ করে এই পুঁচকে মেয়ের কথা বলার ধরন দেখে অয়ন রীতিমত বিষম খেয়ে গেল। মাথার ভেতর সব কেমন তাল গোল পাকিয়ে গেল। খুব হালকা গলায় বলল,

— ‘ইয়ে… তুমি এখন কোথায় আছ? আমি কি আসব?’

লাইন কেটে গেল, কিংবা কেটে দেয়া হলো। অয়ন রাস্তার ওপর কিছুক্ষণ বেক্কলের মত দাঁড়িয়ে থাকল। মাথা চুলকে, গাল ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ি গুলো হাতড়ে আকাশ কুসুম ভাবল। এরপর ডায়াল করল আবার তিয়ানার নম্বরে।

— ‘হ্যালো!’ অভিমানে মেয়েটার গলা কাঁপছে।

— ‘হ্যালো! ইয়ে… মানে, একচুয়ালী, সরি! ইটস টোটালি মাই ব্যাড! তুমি কোথায় আছো বল তো! আমি আসছি’

— ‘শংকর’

— ‘ওহ, আচ্ছা তুমি থাকো, আমি আসছি’

— ‘আপনাকে শংকর আসতে হবেনা, বত্রিশ নম্বরে আসুন

— ‘ওকে ফাইন!’

বারিধারা থেকে ধানমন্ডি পৌঁছুতে বেশ অনেকটা সময় লেগে গেল। অয়ন বত্রিশ নম্বরের ব্রীজের ধার ধরে হাঁটছিল। বাতাসে শীতল ছোবল। চাদরটা দিয়ে মাথা মুড়িয়ে নিল সে। দু কান ঢেকে ফেলল। এই হাঁড় কাঁপানো শীতেও ঢাকার রাস্তায় রাজ্যের ভিড়। মানুষের ভিড়, যানবাহনের ভিড়, জীবনের ভিড়! এত এত মানুষ!! ছোট, বড়, ছেলে, বুড়ো, সব বয়সের মানুষ। সবার গায়ে নানা রঙের, নানা রকমের শীতের পোশাক। সারাটা বছর রোদের তেজে, গরমে পুড়তে থাকা মানুষ গুলোর চেহারায় পৌষ মাসের হাওয়া বুঝি একটু চাকচিক্য এনে দিয়েছে। শীতে কুঁকড়ে গেলেও সেই কোঁকড়ানোতে কোথায় যেন একটা শান্তির ছোঁয়া আছে। এরই মাঝে ফুটপাথে বসে থাকা শীতে কাবু হওয়া ছেঁড়া কাপড়ের হত দরিদ্র লোক গুলোর দিকে হঠাৎ তাকালে একটু কেমন বেমানান মনে হয়। সত্যি আমরা মানুষেরাই নিজেদের মাঝে নিজেরা কতটা বিভেদ তৈরি করে ফেলেছি। মনুষ্যত্ব বোধটাকে পকেটে পুরে নিয়ে, চোখ বন্ধ করে চলাটাই আজকাল ভদ্রতা এবং সভ্যতার সংজ্ঞা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

— ‘ভাইজান, দুইটা ট্যাকা দিয়া যান, ভাত খামু!’

কথাটা শুনে অয়ন ধরা ধামে অবতীর্ণ হলো। দেখলো শীতে মরে যাওয়া খসখসে চামড়ার ছোট্ট একটা হাত তার দিকে এগিয়ে আছে। দশ কী এগারো বছরের একটা বাচ্চা ছেলে। গায়ে একশত ফুটো ওয়ালা একটা সোয়েটার আর হাফ প্যান্ট। ছেলেটার নাক দিয়ে সর্দি গড়িয়ে পড়ছে। ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে সেই সর্দি মুছে নিয়ে পুনরায় সেই হাত নিজের প্যান্ট এই ঘষলো সে।

অয়ন বলল,

— ‘এই সন্ধ্যা বেলা তুই ভাত খাবি?’

প্রশ্ন শুনে বাচ্চাটা ফিক করে হেসে দিল, ফোকলা দাঁতে

— ‘হ খামু!’

— উঁহু, মিথ্যে বলছিস, সত্যি করে বল, টাকা দিয়ে কী করবি?’

ছেলেটা এবার কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেলল, ‘পিডা খামু, পিডা!’

অয়ন দেখল সত্যিই রাস্তার ধারে একটা বয়স্ক লোক বসে গরম গরম ভাপা পিঠা বানাচ্ছে। দেখে তার নিজেরও লোভ হয়ে গেল। সেদিকে এগিয়ে যেতে যেতে অয়ন বলল, ‘আয় আমার সাথে, পিডা খাওয়াই তোরে।’

বাচ্চা ছেলেটা আনন্দে নেচে উঠে অয়নের পেছন পেছন দৌড় লাগালো। রাস্তা বোঝাই গাড়ি আর রিকশা। কয়েকটা সিএনজিও আছে। গাড়ির হর্ণ, ইঞ্জিনের শব্দ, মানুষের কোলাহল সব কিছু মিলিয়ে একটা বিশাল হট্টগোল তৈরি হয়েছে। এই সন্ধ্যা বেলায় ঢাকার রাস্তা যেমন থাকে আর কী! যান্ত্রিক ব্যস্ততা।

— ‘ঠান্ডার মধ্যে হাফ প্যান্ট পরে আছিস কেন, শীত করেনা?’

ছেলেটা অদ্ভূত হাসে। যেন এমন মজার প্রশ্ন সে জীবনে কখনো শোনেনি।

— ‘শীত করে, কিন্তু ফুল প্যান্ট নাই, গত বসরের শীতে আব্বায় একটা কিনা আনছিল, হেইডা চুরে নিয়া গেসে’

অয়নের মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে নিজে একটা বয়স্ক মানুষ জিন্সের প্যান্ট আর মোটা চাদরে সমস্ত শরীর ঢেকে রেখেছে আর এই বাচ্চা ছেলেটা কনেকনে ঠান্ডার ভেতর হাফ প্যান্ট পরে আছে। চিন্তা করা যায়! অয়নের মনে হলো সে অপরাধ করছে। গুরুতর কোনো অপরাধ। শরীরের প্রতিটা রক্তবিন্দুতে কেমন একটা পাপবোধ জন্ম নিতে লাগল। হঠাৎ করে তার চেহারাটা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দোষী সাব্যস্ত আসামীর মতো হয়ে গেল। সে বেকার মানুষ। পকেটে হয়তো টেনে টুনে দুইশ কী তিনশ টাকা থাকতে পারে। এই যৎসামান্য টাকা বিলিয়ে দিলে তার কাছে আর কিছুই থাকবেনা। নইলে বাচ্চাটাকে একটা প্যান্ট কিনে দেয়ার কথা ভেবে দেখা যেত। ভাপা পিঠায় কামড় বসিয়ে অয়ন ছেলেটাকে বলল,

— ‘আমিও… আমিও অনেকটা তোর মতোই’

গরম ধোঁয়া ওঠা পিঠা নিয়ে ছেলেটা তখন যারপরনাই ব্যস্ত। তবুও কোনো রকমে বলল,

— ‘কী কন? আপনে আমার মতো কেমনে হইলেন!’

অয়ন উদাস গলায় বলল,

— ‘গরীব! তোর মতোই গরীব আমি!’

ছেলেটা ফিক করে হেসে ফেলল, চোখ দুটোতে ফুটে উঠল গভীর বিস্ময়। অয়নের মতো এহেন চিড়িয়া সে জীবনে আর দুইটা দেখেনি সেটা তার চোখের ভাষাই বলে দিল। ফোকলা দাঁত নিয়ে হেসে উঠে সে বলল, ‘কী কয়!’

অয়ন হাসে, বড় দুর্বোধ্য হাসি, সুর করে বলে,

‘আপন ঘরে বোঝাই সোনা
পরে করে লেনাদেনা।
আমি হলাম জন্মকানা
না পাই দেখিতে’

ছেলেটা শব্দ করে হেসে ওঠে। একটা পিঠা খাওয়া শেষ করে বলে ‘আরেকটা খামু!’

অয়ন আরো একটা পিঠার অর্ডার দেয়। হাঁটা দেবার আগে নিজের গায়ের চাদরটা খুলে পরিয়ে দেয় বাচ্চাটাকে।

লেকের দিকে আসতেই তিয়ানার সাথে দেখা হয়ে গেল। আজকে তিয়ানার সাথে গাড়ি নেই, আছে সাইকেল। পরনে সাদা লেদারের জ্যাকেট, কালো জেগিংস। মাথায় কান টুপি। চুলগুলো কানের ওপর দিয়ে এসে ঝুলে আছে ঘাড়ের ওপর। অয়ন মেয়েটার চেহারা সত্যি বলতে ভুলেই গিয়েছিল। ওর এই এক দোষ। এক দুবার দেখলে কোনো চেহারা মনে থাকেনা। আজকে মেয়েটার দিকে ভালো মত তাকিয়ে বোঝা গেল আর বছর কয়েক পরে এই মেয়ে নামকরা সুন্দরীদের খাতায় নাম লেখাবে। এখন এই বয়সেই রূপের তেজ ঝিলিক দিচ্ছে। অবশ্য বেশ অনেকদিন হয় তার কোনো মেয়েকে দেখে বুক কাঁপেনা। মাঝে মাঝে মনে হয় বুকের ভেতরে মন নামের জিনিসটাই আর বাস করেনা।

তিয়ানা সাইকেল থেকে নামতে নামতে চমকে ওঠা গলায় বলল,

— ‘সে কি! আপনার গায়ে কিছু নাই কেন? এইরকম ফ্রিজিং ওয়েদারে আপনি জাস্ট একটা টি শার্ট পরে আছেন! রিডিকিউলাস!’

অয়ন হেসে বলল, ‘প্রায়শ্চিত্য করছি!’

— ‘কিসের প্রায়শ্চিত্য?’

— ‘পাপের!’

তিয়ানা হাসলো, ‘কী পাপ করেছেন আপনি, শুনি?’

— ‘সে কত পাপই তো করলাম এ জীবনে! হিসেব কি আছে?’

সাইকেলটা দু হাত দিয়ে টেনে নিয়ে হাঁটছিল তিয়ানা অয়নের পাশে। এদিকে লেকের ধারটায় বেশ অন্ধকার। সরু হাঁটার পথটা দিয়ে লোকজন আসা যাওয়া করছে। সাদা কুয়াশা ঘাপটি মেরে বসে আছে গাছের ফাঁকে ফাঁকে।

শীতটা জানান দিচ্ছিল এবার। পাতলা টি শার্ট ভেদ করে একদম পাঁজরের হাড়ে গিয়ে কামড় বসাচ্ছে ঠান্ডা হাওয়া। অয়ন হালকা কাঁপছিল।

— ‘আপনি কিন্তু বেশ অদ্ভুত আছেন!’ তিয়ানা নীরবতা ভাঙ্গলো।

— ‘হম.. তা আছি!’

— ‘যাই হোক, কী ঠিক করলেন?’

— ‘কী বিষয়ে?’

— ‘এই যে আমার সাথে বন্ধুত্ব করবেন, কি করবেন না?’

অয়ন হেসে ফেলল। মেয়েটা সত্যি বাচ্চা। একটু বোকাও মনে হয়। অয়ন ঢং করে বলল,

— ‘বন্ধুত্ব কী করে করতে হয় জানিনা তো! শিখিয়ে দাও!’

তিয়ানা জেদী গলায় বলল, ‘ফাজলামো হচ্ছে?’

— ‘না সিরিয়াসলি! যেহেতু তুমি প্রশ্নটা করলে যে আমি তোমার সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই কি চাই না, এর মানে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম কানুন অবশ্যই আছে যেটা করলে তুমি বুঝতে পারবে যে আমি তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করতে চাই, রাইট?’

তিয়ানা একটু লাজুক গলায় বলল, – ‘আপনি খুব ভালো মতো বুঝতে পেরেছেন যে আমি কী বলতে চেয়েছি’

অয়ন হাসলো। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তুমি থাকো কোথায়?’

— ‘লালমাটিয়া’

— ‘শংকর কী করছিলে?’

— ‘ফ্রেন্ডের বাসায় ছিলাম’

— ‘ওহ’

— ‘আপনি কী করছেন এখন? জব করেন?’ তিয়ানার প্রশ্ন।

— ‘কিছুই করিনা, খাই, দাই, ঘুমাই… হাঁটি, আর চিন্তা করি’

— ‘মানে? কিছুই করেননা আপনি? পড়ালেখা, চাকরি বাকরি কিছুইনা?

— ‘নাহ!’

— ‘কেন? আপনি বসে আছেন কেন?’

— ‘কী করব?’ অয়ন যেন খুব অবাক।

  • ‘কী করবেন আবার, জব করবেন, ফারদার স্টাডি করবেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবেন!’

— ‘কেন এসব করতে যাবো? ধ্যুর!’

তিয়ানা বেশ অবাক হয়ে তাকালো অয়নের দিকে। বলল, ‘তাহলে আপনি করেন কী? সময় কাটে কী করে?’

— ‘বললাম না, খাই, ঘুমাই আর ভাবনা চিন্তা করি’

— ‘হিমু হতে চান?’

অয়ন এবার শব্দ করে হেসে ফেলল, ‘হা হা! ভালো বলেছ, হিমু!… রাইট! হিমু হওয়ার জন্য একটা চেষ্টা চালানো যায়!’

— ‘আঙ্কেল কী করেন?’ তিয়ানা ফট করে প্রশ্নটা করে ফেলল এবং এই প্রথমবারের মতো অয়ন তিয়ানার সামনে বিব্রত বোধ করলো। একটা অস্বস্তির ছায়া এসে ঢেকে দিল তার মুখ। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে বেশ সময় নিয়ে আগুন ধরালো। চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বলল,

— ‘কিছু করেনা

তিয়ানা ভারি অবাক হয়ে বলল, ‘কেন?’

অয়ন কী বলবে খুঁজে পেলনা। তার বাবা পাগল, বদ্ধ উন্মাদ। পৃথিবীতে শুধুমাত্র এই একটা সত্য কথা তার স্বীকার করতে প্রচন্ড বাঁধে। এই একটা সত্যের মুখোমুখি হতে সে সর্বদা ভয় পায়। ব্যাপারটা মনে পড়লেই বুকের বাম পাশটায় চিনচিনে ব্যথা হয়। হৃদপিন্ডের গতি কমে যায়। হাঁস ফাঁস লাগে।

অয়ন স্তিমিত গলায় বলল,

— ‘অসুস্থ, আমার বাবা অসুস্থ’

— ‘ওহ্, স্যাড! কী হয়েছে আঙ্কেল এর?’

— ‘সব কথা একদিনেই শুনে ফেলবে? এখন বরং তুমি বল, তোমার কথা শুনি

এই পর্বটা বুঝি তিয়ানার খুব পছন্দ হলো, ঝলমলিয়ে উঠে সে বলল, ‘আমি এবার ও লেভেল দিচ্ছি, আব্বু- আম্মু দুজনই আমেরিকায় থাকেন, এখানে শুধু আমি আর আমার বড় বোন আছি, আমার ফাইনাল হয়ে গেলে খুব তাড়াতাড়ি ফ্লাই করব, ভিসার প্রসেসিং চলছে।’

— ‘বাহ! বাবা মা সাথে নেই, সীমাহীন স্বাধীনতা! হ্যা!’

তিয়ানা মিষ্টি হাসলো, একটুক্ষণ কী যেন ভেবে নিয়ে বলল, ‘একটা ব্যাপার জানেন?’

অয়ন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো, কিছু বললনা। তিয়ানা উচ্ছ্বাস ভরা কন্ঠে বলল, ‘ইউ আর আ ড্যাম হ্যান্ডসাম ম্যান! ওহ মাই গড! আর আপনি কথাও বলেন দারুণ।’

অয়ন বোকার মতো হাসলো। ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, ‘রিয়েলি!’

— ‘রিয়েলি! আমার বয়ফ্রেন্ড কে আপনার কথা বলেছি লাস্ট ডেটে, হি ওয়াস কাইন্ডা জেলাস, ইউ নো!’

অয়ন চোখে সর্ষে ফুল দেখছিল, মাথার ভেতরটা ভোঁ ভোঁ করছে। বলল কোনরকমে, ‘ওহ, এটা ভালো লাগারই বয়স, বয়সটাই এমন’

তিয়ানা জেদী গলায় বলল, ‘মোটেও না! আমার বয়স চল্লিশ হলেও আমি আপনাকে লাইক করতাম, আর আমাকে অত কচি খুকি ভাবাটা ঠিক হচ্ছেনা আপনার। ষোলো তে পড়লাম এবার, আপনি রাগ করলেননা তো আবার?’

— ‘না না, রাগ করব কেন, এ ধরনের কমপিস্নমেন্ট পাওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার, আমি হ্যাপী!’

তিয়ানা খিল খিল করে হেসে উঠলো, ‘তাই বুঝি? আপনাকে দেখে কিন্তু একটুও মনে হচ্ছেনা আপনি হ্যাপী, বরং মনে হচ্ছে আপনি ভয় পেয়েছেন।’

অয়ন কী বলবে খুঁজে পেলনা। তিয়ানার সামনে হঠাৎ নিজেকে বড্ড গেঁয়ো আর আনস্মার্ট মনে হতে লাগল। মিন মিনে গলায় বলল, ‘এবার যাওয়া দরকার, আমার তো আবার বাসা অনেক দূরে।’

১২

এক লোকমা ভাত মুখে তুলতেই বোঝা গেল তরকারিতে একটা ফোটা লবণ দেয়া হয়নি। ছোট চিংড়ি মাছ দিয়ে শিমের তরকারী, ডাল আর রুই মাছ। মা সচরাচর এহেন ভুল করেননা। বোঝা যাচ্ছে আজ তার কাজে মন নেই। ভুলক্রমে কখনো যদি এমনটা হয়েও যায় বাবাই খাবার টেবিলে খুব মেজাজ করেন। আজকে বাবাইয়েরও কোনো রিঅ্যাকশন দেখা যাচ্ছে না। নিষ্প্রভ চেহারা নিয়ে তিনি ভাতের গ্রাস তুলে যাচ্ছেন মুখে। আশিক পানসে মুখে বলল, ‘ইশশ! মা! কী রান্না করেছ এসব? লবণ হয়নি।’ মা বিষণ্ণ চোখ দুটো তুলে আশিককে একবার দেখলেন। এরপর বিষাক্ত গলায় বললেন, ‘যেমন আছে, তেমনই খেয়ে নে, বেশি ফট ফট করিসনা। তোদের জন্য এই খাবারই ঠিক আছে, তোরা তো ফকিরের জাত, মাইনসে তোদের লাথি দিয়া ঘর থেকে বের করে দেয়, তোদের আবার এত ফুটানি কিসের?’

আশিক চুপসে গেল। সে বাড়ি ফিরেছে একটু আগে। ঘটনা কিছুই তার জানা নেই। হতবাক চোখে সে একবার মায়ের দিকে তাকালো আরেকবার বাবাইয়ের দিকে। কোনো উত্তর না পেয়ে শেষমেষ আহিরের শরণাপন্ন হলো। মায়া লাগল আহিরের ছোট ভাইটার জন্য। বেচারার কাল বাদে পরশু পরীক্ষা। ওকে এভাবে আঘাত দিয়ে কথা বলার কোনো মানে হয়? ওর কী দোষ? আহির এবার মুখ খুলল,

— ‘আহ! থামো তো মা!! কি শুরু করলা তুমি সকাল থেকে? ওরে এইসব বলতেছো কেন? ওর কি দোষ?’

মা আক্রোশে ফেটে পড়লেন, ‘তুই চুপ থাক! বেয়াদব কোথাকার! আমার ছেলের সাথে আমি কী বলব সেটা তোর শিখিয়ে দিতে হবে?’

বাবাইয়ের চিরদিনের স্বভাব এইসব সাংসারিক ঝগড়াগুলোর সময় মার পক্ষ নেয়া। আজকেও তিনি ঠিক তাই করলেন। বিরক্তি মাখা গলায় হঠাৎ উচ্চস্বরে আহিরকে বলে উঠলেন, ‘আহা থামতো! এত কথা বলিস কেন? চুপচাপ খেয়ে নে’

আহিরের এবার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।

— ‘কেন চুপ করে থাকব বাবাই? বিপদটা আমাদের সবার ওপর এসেছে তাই না? মায়ের একার তো বিপদ না! আমাদের সাথে চোটপাট করে কী হবে তাই তো বুঝতে পারছিনা’

আশিক তারস্বরে বলে উঠল, ‘আহা হয়েছে কী সেটা তো শুনি!’

আহির খাবার টেবিল থেকে উঠে পড়ল। বাড়িটা দিন দিন বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। ঝুটা হাত বেসিনে ধুয়ে নিয়ে সে নিজের ঘরে চলে আসলো। আশিকও আসলো পেছন পেছন। আজ আর কারো খাওয়া হলো না।

— ‘বুবু! কাহিনী কী বল তো?’ আহির বলল। সংক্ষেপে যতটা বলা যায়। আশিক থ বনে যাওয়া গলায় বলল, ‘হঠাৎ করে এমন করল কেন? মানে আমরা এতদিন ধরে এ বাড়িতে আছি, ওদের কোনো রাইট নেই এভাবে এত অল্প দিনের নোটিশে তাড়িয়ে দেয়ার

— ‘এসব কথা তুই আর আমি বললে তো হবেনা। বাবাইয়ের কান্ডটা দেখেছিস? সকাল থেকে মুখের ভেতর ডিম নিয়ে বসে আছে। কোনো কথা বলছেনা। লাইফে বিপদ আপদ আসতেই পারে। সবাই এক সাথে ডিসকাস করে ডিসিশন নিয়ে সেই বিপদ মোকাবেলা করতে হবে তাইনা? আর মা আমাকে সমানে ঝাড়ি মেরে যাচ্ছে, তার ধারণা আমি বাড়িওয়ালার ছেলের সাথে ফ্লার্ট করিনাই বলে এই শাস্তি দেয়া হচ্ছে। উফ! এই বাসার মানুষ গুলা সব এরকম কেন? পাগল হয়ে যাব আমি!’ আশিক ভ্রু কুঁচকালো, ‘তুমি কেন ওই ছেলের সাথে ফ্লার্ট করবা, আজব!’

— ‘তোর কী মনে হয়, আমার কি বাড়িওয়ালার ছেলের সাথে গিয়ে কথা বলা উচিত? গিয়ে জিজ্ঞাসা করব হঠাৎ করে কেন এইসব করল?’

— ‘না না কোনো দরকার নেই’ আশিক বেশ পরিণত বয়সের মানুষের মতো বলল কথাগুলো।

— ‘তাহলে কী করবো?’ আহির অসহায়ের মত প্রশ্ন করে।

— ‘কথা বাবাইকে বলতে হবে, বলতে হবে যে আমরা যাব তো অবশ্যই, কিন্তু এত কম সময়ের মধ্যে সম্ভব না, কম পক্ষে তিন মাস সময় চাই।’

আহির একটু চিন্তিত গলায় বলল, ‘কিন্তু বাবাই কে সকাল থেকে খুব আপসেট দেখছি, তুই একটু কথা বলবি ওঁর সাথে?’

— ‘হুম, তা তো বলতেই হবে, তুইও চল’

মা জোহরের নামাজ পড়ছেন মেঝেতে জায়নামাজ বিছিয়ে। বাবাই টেবিলে বসে পরীক্ষার খাতা কাটছিলেন। আহিরদের দেখে একটু মেকী হাসলেন। তাঁর চোখের নিচে চিন্তার গভীর ছাপ। ঠোঁট দুটো শুকনো। এ কয়েক দিনে চেহারা আরো ভেঙ্গে গেছে। তাকালেই বড় মায়া হয়।

— ‘কিরে কিছু বলবি?’ আশিক একবার আহিরের দিকে তাকালো। আহির চোখের ইশারায় কিছু একটা বলতেই সে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,

— ‘ইয়ে, বাবাই, আমি বলি কি, তুমি একটু বাড়িওয়ালা আঙ্কেলের সাথে কথা বল। উনাকে বুঝায়ে বল যে আমরা বাসা ছেড়ে দেবো, অবশ্যই ছেড়ে দেবো কিন্তু সময় দিতে হবে, কমপক্ষে তিন মাস সময় চেয়ে নাও’

বাবাই স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে বললেন- ‘হ্যাঁ, সেটা না হয় বলা যাবে, কিন্তু তোরা এত ভাবছিস কেন? কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে, তোদের এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।’

— ‘না ভেবে করব কী বাবাই? মা সকাল থেকে কি করছে তুমি দেখছনা? সব দোষ তো আমার ওপরেই চাপাচ্ছে।’

বাবাই হাসার চেষ্টা করলেন, ‘তোর মার কথা বাদ দে, সে বেশি বেশি দুশ্চিন্তা করে, যাই হোক, আহির মা, তোর সাথে আমার একটু কথা ছিল।’

— ‘বল’

— ‘তুষারের আব্বা ফোন করেছিলেন।’

বুকটা ধক্ করে উঠল আহিরের। স্নায়ু টান টান হয়ে উঠল। কান হয়ে উঠল খাড়া।

— ‘তাই নাকি? কী বললেন তিনি?’ শীতল গলায় বলল আহির। বাবাই কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন,

— ‘উনি বললেন তোদের বিয়ের আগে একটা ওয়াল কেবিনেট বানিয়ে দিতে তুষারের ঘরে, মানে তোদের ঘরে, সাথে খাট, ড্রেসিং টেবিল এইসব আসবাবপত্র আর কী! ‘

আহিরের মুখে আগুনের গরম হলকার মতো কী যেন এসে লাগল। কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। আক্রোশ মাখা কন্ঠে বলে উঠল,

— ‘আশ্চর্য! তোমাকে ফোন করে এসব বলার মানে কী! লোকটার সমস্যা কী?

বাবাই একটু গম্ভীর হয়ে বললেন,–’থাক বাদ দে, যার যেমন কালচার আর কী!

আহির ঝড়ের মতো বের হয়ে আসল ঘর থেকে। ফোনটা হাতে নিয়ে তুষারের নম্বর ডায়াল করল। দুই তিনটা রিং পড়তেই তুষার ‘হ্যালো’ বলল ওপাশ থেকে।

— ‘এই, তুমি কোথায়?’

— ‘এইত, বাসায়, আজকে তো ছুটির দিন, কোথায় আর যাব!!’

— ‘শোনো, তুমি আমার সাথে একটু দেখা কর তো! কথা আছে!’

— ‘আবার কী হলো! কী কথা?’ তুষারের গলায় আতঙ্ক স্পষ্ট।

— ‘আরে বলবই তো, সামনা সামনি দেখা হইলে বলব’

— ‘কোথায় আসব?’

— ‘টিএসসি’

— ‘ওকে’

আহির যখন টিএসসি এসে তুষারের মুখোমুখি দাঁড়ালো, তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত নেমেছে। বাতাসে শীতের দাপট। আহির সুতির কামিজের ওপর একটা ফুলহাতা কালো সোয়েটার আর ধূসর রঙের পশমিনি শাল জড়িয়ে রেখেছে গায়ে।

— ‘তোমরা এইসব কী শুরু করেছ?’

— ‘মানে?’ তুষার অবাক!

— ‘তোমার আব্বা আমার বাপকে ফোন দিয়া যৌতুক চায় কেন?’ আহির প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে। তুষার একটু হকচকিয়ে উঠে বলল,

— ‘যৌতুক? যৌতুক হবে কেন?’

— ‘তাহলে কী? যৌতুক না তো কী?

— ‘গিফট! কাইন্ড অফ গিফট’

— ‘বাহ! প্রশংসা করতে হয় তোমার দৃষ্টিভঙ্গির, চমৎকার! যৌতুকের মডার্ন ভার্সন তাহলে গিফট তাইনা? তা আমি তো আমার ইহজন্মে কাউকে চেয়ে চেয়ে গিফট নিতে শুনিনি, গিফট দেয় মানুষ নিজের ইচ্ছেয়, আমার বাপের গিফট দিতে ইচ্ছে হলে নিজের পছন্দ মতো যা খুশি দিবে, তোমরা কেন বলে দিবা?’

তুষার এবার একটু চুপসে যাওয়া কণ্ঠে বলল, ‘তুমি বাড়াবাড়ি করছ, এত বাড়াবাড়ি কর কেন সব কিছু নিয়ে?’

— ‘বাড়াবাড়ি করছি আমি? তোমার কাছে এটা বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে?’

— ‘তা নয়তো কী? আমার আব্বা যা মন চায় বলুক তোমার আব্বাকে তাতে তোমার এত কী? গালিগালাজতো আর করেনাই তাই না?’ তুষারের গলা চড়ে গেল।

— ‘তুমি!! তুমি কী করে বলতে পারছ কথাগুলো? লজ্জা করেনা তোমার? ছি:’

— ‘না লজ্জা করেনা, লজ্জা করার মত কিছু নাই এখানে, বিয়া দিবে তোমার বাপ আর এই অল্প কিছু ডিমান্ড ফুলফিল করতে পারবেনা, এইটা কেমন কথা!

আহির বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তুষারের দিকে। যেন সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। কেউ একজন ধারালো ফলা দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে বুকের ভেতরটা। কান্না জড়ানো গলায় বলে উঠল,

— ‘আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা! তুমি এতটা! এতটা নিচে নামতে পারো! আমি… আমি তোমাকে বিয়ে করবো না… আজকে থেকে সব শেষ! তুমি আমার সাথে যোগাযোগ করার কোনো চেষ্টা করবেনা, বুঝলে?’

তুষার কাঁধ নাচিয়ে বলল, ‘আচ্ছা যাও যাও, তোমাকে বিয়ে করার সাধ আমার মিটে গেছে, প্রতিটা জিনিস নিয়া হাউ কাউ না করলে তোমার পেটের ভাত হজম হয়না না? ফালতু! যাও যাও! ভাগো!’

বাড়ি ফিরে নিজের ঘরের দরজা আটকে অনেকক্ষণ শুয়ে থাকলো আহির। রাতের খাবারও খেলনা। কারো সাথে কোনো কথাও বলল না। তার কান্না পাচ্ছিল না। বুকের ভেতর শুধু একটা ভারী বোঝা সাঁড়াশির মত আটকে আছে। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। বাবাই কয়েকবার দরজা নেড়ে ডেকে গেলেন। আহির কোনো সাড়া দিল না। তুষারের সাথে তাহলে সব চুকে বুকে গেল। কথাটা মাথায় আসতেই গা শির শির করে উঠল। তুষার! তুষারকে ছাড়া সে সত্যি থাকতে পারবে? পুরো একটা জীবন! মাথাটা ওলট পালট লাগছিল। অনেক রাতে তুষারের ফোন আসল। আহির কাঁপা হাতে ফোনটা ধরতেই তুষার ভাঙ্গা গলায় বলে উঠল, ‘তোমার কী হয়েছে বল তো? এমন করছ কেন তুমি আমার সাথে?

আহির আর পারলনা। ডুকরে কেঁদে উঠল ফোন হাতে নিয়ে। তুষার কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘প্লিজ লক্ষ্মীটি! কান্না করোনা, সব ঠিক হয়ে যাবে, তুমি দেখো, আমি সব ঠিক করে ফেলব।’

১৩

একটা দাঁড় কাক উড়ে এসে বসেছিলো বারান্দার রেলিঙে। কর্কশ সুরে ডেকেই যাচ্ছে। অয়ন চেয়ারে বসে আছে। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে সে কাকটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘ওই ব্যাটা, কী সমস্যা তোর?’ কাকটা কী বুঝলো কে জানে, অয়নের প্রশ্ন শুনে নতুন উদ্যমে বুক ফুলিয়ে কা কা করে ডাকতে থাকলো। অয়ন আবার ধমক লাগালো, ‘চুপ থাক! ফাজিল কাক কোথাকার!’ কাক মহাশয় নির্বিকার। ডেকেই যাচ্ছেন, কা, কা, কা!

তখনও ভোরের আলো ফোটেনি পুরোপুরি। সাদা কুয়াশার চাদর মুড়িয়ে রাতের আবছা অন্ধকারে ডুবে আছে এখনো থমথমে ভোরবেলাটা। অয়ন বারান্দায় বসে একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। কাল সারা রাত ঘুম হয়নি। ঘুম না আসার কোনো নির্দিষ্ট কারণ নেই। দ্যা বুক থিফ নামে একটা বই পড়তে গিয়ে রাত দুটো বেজে গেল। এরপর আর ঘুম আসলোনা। অয়ন টিভি দেখেনা, তার কোনো পার্সোনাল কম্পিউটার নেই। টেলিফোনে অযথা বক বক করার মতো কোনো বন্ধু নেই। গান শোনে মাঝে মাঝে। কিন্তু সেটা হঠাৎ হঠাৎ। খুব মন দিয়ে একটার পর একটা পছন্দের গান গুলো শুনে যায়। কিন্তু মূলত বই পড়া ছাড়া তার অন্য কোনো কাজ নেই। শুধু এই একটা কাজ করতেই সে খুব ভালোবাসে, স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বইয়ের মধ্যে ডুবে গিয়ে পার করে দেয় ঘন্টার পর ঘন্টা। কিন্তু বই কিনতেও পয়সা লাগে। আজকাল তাই বই পড়ার পরিমানটা একটু কমে এসেছে বলতে হবে। হঠাৎ হাতে কিছু টাকা পয়সা চলে আসলে সে পটাপট বেশ কিছু বই কিনে ফেলে। কিন্তু হঠাৎ হাতে টাকা আসার সম্ভাবনা আজকাল একেবারে নেই বললেই চলে। দাদীমা তাকে মাসে একটা লাম সাম হাত খরচ দেয়। তাই দিয়ে কোনো রকম চলে তার। কিন্তু দাদিমার ওপর আর কত দিন এভাবে ডিপেন্ড করা যাবে? আজ নয়তো কাল তাকে তো নিজের পেটটা অন্তত চালাতে হবে! এছাড়া সে যে হারে সিগারেট খায়! এই ছাই পাস কেনার জন্যও তো টাকা চাই! নইলে বাঁচবে কী করে? কিন্তু করবেটা কী অয়ন! সকাল সন্ধ্যা চাকরী করা দাসত্বের জীবন সে কখনই মেনে নিতে পারবেনা। টাকার পেছনে ছুটে বেড়ানোর মত হীন কাজ পৃথিবীতে আর একটা আছে বলে তার মনে হয়না। অর্থের আদান প্রদানই মানুষের মানবিক বিপর্যয়ের এক মাত্র কারণ। এই একটা জিনিস তৈরি করেছে মানুষের ভেতর বৈষম্য, লোভ, লালসা। ‘The same knife cuts bread and fingers!’ ব্যাপারটা ঠিক তাই। মানব সমাজ এই অভিশাপ থেকে কবে বেরিয়ে আসতে পারবে কে জানে! এই সব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে রাতটা কেটে গেল। শেষ মেষ অবশ্য অয়ন একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে। সে ঠিক করেছে টিউশনি করবে।

পাশের মসজিদে ফজরের আজান পড়ল। বহুদিন এত ভোর দেখা হয়না তার। শেষ রাতের দিকে রাজ্যের ঘুম চোখে নেমে আসে। আজ অনেক দিন পর তাই এই পৌষ মাসের ভোরের কনকনে হাওয়াটা বেশ লাগছে। হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হলো। অয়ন মৃদু চমকালো। চারপাশে তাকিয়ে দেখল। কোনো মানুষজন নেই। দোতলায় তার ঘরের বারান্দাটা থেকে বাড়ির উঠোন দেখা যায়। গ্যারেজ দেখা যায়। এখন পুরো জায়গাটা খালি। সুপারি গাছ আর কাঁঠাল গাছের ফাঁকে ফাঁকে অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসে আছে। কুয়াশায় আবছা হয়ে আছে বাড়ির মূল ফটক। শব্দটা আরেকবার হতেই অয়ন ঘুরে তাকালো। এবারে বুঝতে পারল শব্দটা আসছে তার ঘরের ভেতর থেকে। ঘরের সাথে লাগোয়া পেছনের বারান্দার দরজাটা বন্ধ। বুকটা হালকা ধুপুক্ করে উঠল। এই রাতভোরে তার খালি ঘরে এটা কিসের শব্দ? দরজা ভেতর থেকে লক করা। কেউ ভেতরে ঢুকতে পারারও কথা না! চোর টোর নয়তো আবার! অয়ন সন্তর্পণে বারান্দার দরজাটা খুলল। ঘরের বাতি নেভানো। অন্ধকার জেঁকে বসে আছে পুরো ঘরটায়। বারান্দার দরজা খুলতে একটু ফিকে হলো চারপাশটা। অয়ন অবাক হয়ে দেখল ঘরের ঠিক মাঝখানে একটা ছায়া মূর্তি দাঁড়িয়ে। চাদর দিয়ে মাথা মোড়ানো। অয়নকে দেখে ছায়া মূর্তি কেঁপে উঠল একটু। এরপর এক ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। কেউ কিছু বলল না, কিন্তু অয়ন কী করে যেন টের পেলো, ছায়া মূর্তিটি আর কেউ নয়, আয়শা।

অয়ন মনে করতে পারলো না রাতে ডিনার করে ঘরে আসার পর দরজা লক করা হয়েছিল কিনা। মনের ভেতর একটা ধোঁয়াটে রহস্যের জাল দানা বাঁধতে থাকে। তার হঠাৎ মনে হলো এই মুহূর্তে যদি সে জেগে না থেকে ঘুমিয়ে থাকতো তাহলে কোনো দিনও জানতে পারতোনা যে আয়শা এই ঘরে এসেছিল। এর মানে কি মাঝে মাঝেই আয়শা গভীর রাতে তার ঘরে আসে? কিন্তু কেন? কী আশ্চর্য! কেন??

১৪

কিছু কিছু দিন শুরুই হয় খুব সুন্দর ভাবে। সেই দিন গুলোতে কোনো খারাপ সংবাদ আসেনা, কেউ অযথা রাগ হয়না, খারাপ ব্যবহার করেনা। টিভিতে পছন্দের অনুষ্ঠান দেখার সময় হুট করে কারেন্ট চলে যায়না, গোসলের সময় কলে পানি থাকে, এমনকি মায়ের অল টাইম রেডিওটা পর্যন্ত সেদিন বিধাতার নির্দেশে একটু ধীর গতি সম্পন্ন হয়ে পড়ে। আহিরের মনে হলো আজকে সেরকম একটা দিন। ঘুম ভাঙতেই চোখের সামনে ঝলমলে একটা সকাল। আকাশ নীল। রোদ্দুরে তেজ নেই, গাছের শুকনো পাতায় হালকা হাওয়ার নাচন। সোনালি কাঁচের টুকরোর মত মিঠে রোদটা জানালা দিয়ে বিছানায় এসে পড়েছে। চুপটি করে শুয়ে আছে আদুরে বেড়ালের মত আহিরের লেপের ওপর। দেখেই মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। দরজার কড়া নড়ছিল। আহির দরজা খুলে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছেন। আজকে তাঁর মুখ খানা হাসি হাসি। ঘুম থেকে উঠতেই মায়ের হাসি মুখ দেখতে কী যে ভালো লাগে! আহির মায়ের দিকে তাকিয়ে হাসলো। মা এগিয়ে এসে নরম গলায় বললেন,

— ‘হ্যাঁ রে! তুষারের সাথে ঝগড়াটা মিটেছে তো?’

আহির অবাক গলায় বলল, ‘তোমার কাছেও চলে গেছে এই খবর! বাহ!’

— ‘তুই নাকি ফোন বন্ধ করে রেখেছিলি, ছেলেটা আমার কাছে কত আকুলি-বিকুলি হয়ে ফোন করল, তোর সাথে যাতে একবার কথা বলিয়ে দেই। তোকে এসে ডাকলামও কতবার, সাড়াই দিলিনা! তোর বাবাও ডেকে গেছে অনেকবার।’

— ‘ওহ!’ আহির অস্ফুট স্বরে বলল।

মা হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলে উঠলেন, ‘ছেলেটাকে কখনো কষ্ট দিস নারে! তোকে খুব ভালোবাসে!’

আহির একটু লজ্জা পেয়ে তাকালো মায়ের দিকে। মা কখনো এভাবে বলবে ভাবতেও পারেনি সে! বোঝা যাচ্ছে ঠিক এই মুহূর্তে বাবা মাও চাইছেন না তুষারের সাথে তার সম্পর্কে কোনো রকম চির ধরুক। হাজার হোক তুষার ভালো ছেলে। বিয়ের বাজারে আজকাল ওরকম ছেলে পাওয়া সত্যিই বড় কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায় তুষারের সাথে আহিরের বিয়েটা না হলে বাবা মা বেশ সমস্যায় পড়বেন বলা যায়। আহিরের বয়সও তো একেবারে কম হলো না। চব্বিশ হয়ে গেল। নিজেরা দেখে শুনে বিয়ে দিতে হলে কম কাঠখড় পোড়াতে হবেনা।

আহির মাকে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল, ‘কষ্ট তো আমি দেইনা মা, সে আমাকে কষ্ট দেয়!’

মা এবার একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, ‘সে কী! কেন? কী করে সে? নেশা টেশা করেনা তো আবার?’

আহির ফিক করে হেসে দিল। মায়ের হিসাব কত সোজা! কষ্ট দিতে হলেই যেন নেশা করতে হবে। নেশাগ্রস্ত মানুষ ছাড়া অন্য কেউ যেন কখনো কষ্ট দিতে পারেনা। মা কত সহজ, কতটা সরল! পুরো দুনিয়াটা কেন তার মায়ের মতো সহজ হলো না?

— ‘না মা, নেশা টেশা করেনা, কোনো নেশা না করেই কষ্ট দেয়ার অদ্ভুত নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে সারাক্ষণ।’

— ‘এ আবার কেমনতর কথা!’ মা বললেন বিছানা গুছাতে গুছাতে।

আহির মায়ের গালটা একটু টেনে দিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। এই একটু বাদেই তুষারের সাথে দেখা করার কথা তার। আজকে তারা যমুনা ফিউচার পার্ক যাবে। মার্কেটটা হয়েছে অনেক দিন, কিন্তু আহিরের এখনো যাওয়া হয়ে ওঠেনি। ওটা যেহেতু তুষারের বাসার কাছে তাই আহির তুষারের বাসার ওদিকটায় চলে যাবে সোজা।

সে ঠিক করলো আজকে খুব সাজবে। এমন সুন্দর একটা দিনে একটু ভালো মতো না সাজলে কি হয়?

একটা জলপাই সবুজ রঙের সালোয়ার কামিজ পরল। মনে হলো এই রঙের একটা চাদর হলে ভালো হত। কিন্তু নেই। হাতে গোনা তিনটা উলের শালের মধ্যে দুটা কালো আর একটা বেগুনী। সাজতে গিয়ে দেখা গেল আই লাইনার শেষ হয়ে গেছে। কেমন মেজাজটা খারাপ লাগে! আজকের দিনে তো এমনটা হবার কথা ছিল না! আজ হলো সব ভালো হবার দিন। চোখ খুলেই আহির সেটা টের পেয়েছে। কিন্তু এই ঘটনাটা মনের ভেতর একটু খচ খচানি ভাব এনে দিল 1 শুধু কাজল দিয়ে চোখের মেকআপ শেষ করল সে। আজকাল প্রায়ই মনে হয় তার গায়ের রংটা আরেকটু ফর্সা হলে বোধহয় ভালো হত। শ্যামলা গায়ের রঙে সাজগোজ করে আরাম নেই। আহির নিজের মনে নিজে ধ্যুর!’ বলে মেকআপের সরঞ্জামগুলো একপাশে সরিয়ে রাখল। ফুরফুরে মনটা একটু কেমন বেসামাল হয়ে পড়ল। নাহ! সাজটা মনের মতো হল না। প্রতিটা মেয়ের জীবনেই বোধহয় এমন একটা দিন আসে, যেদিন তার নিজেকে নিজের অসম্ভব রূপবতী হিসেবে দেখতে ইচ্ছে হয়। শুধু মাত্র নিজের জন্য, অপ্সরা সাজতে ইচ্ছে করে এবং সেই ইচ্ছেটা বেশির ভাগ মেয়েরই অপূর্ণ থেকে যায়। আহিরেরও আজ ঠিক তাই হলো।

সে যাই হোক। সকাল দশটার দিকে আহির তুষারের বাসার কাছাকাছি চলে আসলো। মাঘ মাসের মিহি সকালটায় তখন রিম ঝিম করা সোনালি রোদ। গাছের পাতা মৃদু দুলছে। আবছা হয়ে ঝুলে আছে পাতলা একটা কুয়াশার চাদর। আকাশ পরিষ্কার। তুষার রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানটায় বসে ছিল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কার সাথে যেন গল্পে মশগুল। আহির সিএনজি’র ভাড়া চুকিয়ে কয়েক পা হেঁটে এগিয়ে আসলো। তুষার কথা বলতে এতই ব্যস্ত যে অন্য কোনো দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। একটা অদ্ভুত ছেলে!

সকাল সকাল বলে চায়ের দোকানটায় তেমন একটা মানুষ জন নেই এখন। তুষারের পাশে শুধু একজন বসে আছে বেঞ্চের ওপর। গেরুয়া রঙের চাদর পরা একটা বেশ লম্বা চওড়া ছেলে। চোখ পড়তেই চোখ আটকে গেল সেদিকে। ছেলেটার মাথা ভর্তি উস্কো খুস্কো চুল। মুখে কয়েকদিনের অবহেলার দাড়ি। ফরসা মুখে রোদ পড়ায় চিক চিক করছে গাল। চোখ দুটোতে কেমন অদ্ভূত গভীরতা। তুষারের আগে সেই ছেলেটাই দেখলো আহিরকে। চারটা চোখ একত্রিত হলো। কেউ জানলোনা দুটো মানুষ কয়েক সেকেন্ডের জন্যে হারিয়ে গেল বিস্মৃতির তীরে। আশেপাশে কোনো শব্দ নেই শুধু মস্তিষ্কের নিউরনে স্ক্যান করে যাবার মতো টি টি টি একটা শব্দ। দেখেছে…. কোথায় যেন দেখেছে আহির এই চেহারাটা এর আগে। ভালো মতো তাকাতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে, মনে হয় যেন অনেক অনেক দিন আগে, এই জন্মে না, আর এক জন্মে এই মানুষটার সাথে বুঝি ছিল তার অন্তরের গভীরতম সখ্যতা। এই জন্মে তাই ওই মুখটা এত বেশি চেনা চেনা লাগছে।

— ‘তুমি এসেছ?’ তুষারের কথার দমকে আহির ধরাধামে অবতীর্ণ হলো। একটু লজ্জা পেয়ে গিয়ে ব্ৰিত একটা হাসি দিল। তুষারের পাশে বসা ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ে চট করে আহিরকে বলে বসলো,

— ‘আপনার সেল ফোনটা ভালো আছেতো?’

আহির অনেক কষ্টে হাসি সামলালো এবার। মনে পড়ে গেছে তার। আগের

জন্ম না, এই জন্মেই পাগলটা তাকে কম জ্বালায়নি। সেই যে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে এই পাগলটার পাল্লায় পড়েছিল! পরে অবশ্য তার সৌজন্যেই হারানো

ফোনটা খুঁজে পেয়েছিল আহির। তুষার বেশ অবাক করা গলায় বলল,

— ‘কাহিনী কী? তোমরা কি পরিচিত নাকি?

অয়ন একটু কাব্যিক গলায় বলল, ‘হ্যাঁ তুষার, তোমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে আমার পুরনো একটা হিসেব ছিল, তা অবশ্য চুকে বুকে গেছে’

আহির আবারও মিষ্টি হাসলো। ঝিলিক দিলো তার গজদন্ত। তুষারের মুখে তখনও কৌতূহল খেলা করছিল। অয়ন হাত বাড়িয়ে তুষারের সাথে হ্যান্ড শেক করে বলল,

— ‘আমি আসছি, তোমরা এনজয় করো, হ্যাভ আ নাইস ডেট!’

অয়ন চোখের আড়ালে সরে যাবার সাথে সাথেই তুষার আহিরকে জেঁকে ধরলো,

— ‘তুমি চেনো উনাকে?

— ‘একই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি! তুমি চেনো উনাকে?’ বেশ ধারালো ভাবে বলল আহির।

— ‘আমি চিনবোনা কেন? আমার পাড়ার বড় ভাই, কত বছর হয়ে গেল আমরা এক সাথে আছি!’

— ‘ও আচ্ছা! কখনো শুনিনি তো তোমার কাছে ওনার নাম!

— ‘আজব! আমার এলাকায় তো কত বড় ভাইই আছেন তাইনা? সবার নাম তোমাকে শোনানোটা কি খুব জরুরী?’ তুষার একটু রেগে যাচ্ছিল। আহির সামলে নিলো পরিস্থিতিটা, নরম গলায় বলল,

— ‘না না, জরুরী কিছুই নয়, যাই হোক, উনি মানুষ কেমন?’

— ‘ভীষণ ব্রাইট! কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকায় বেচারা একটু কেমন ওলটপালট হয়ে গেছে’

— ‘হুম, আমারও তাই মনে হয়েছে, কিছু একটা প্রবলেম আছে ছেলেটার ভেতর।’

আত্রি সংক্ষেপে ইন্টারভিউর দিনের ঘটনাটা খুলে বলল। শুনে তুষার খুব হাসলো। হাসতে হাসতেই একটা সময় হঠাৎ গম্ভীর হয়ে পড়ে বলল,

— ‘ঝামেলাটা ওনার মায়ের সাথে, আমি যতদূর জানি উনার নিজের মায়ের সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। বাবাও বেঁচে নেই। লোকে এসব নিয়ে নানা কথা বলে, বলতে ভালোবাসে। আমি অবশ্য পার্সোনালি মানুষটাকে খুব পছন্দ করি।’

আহির কিছু বলল না। কিন্তু মনের ভেতর একটা অদ্ভূত নিষিদ্ধ ইচ্ছা ঘুরপাক খাচ্ছিল। কেন যেন ওই এলোমেলো ছেলেটার কথা আরো জানতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। মনে হচ্ছিল সারাটা জীবন ধরে ওই পাগলের গল্প শুনতে থাকলেও সে কখনো বোর হবে না।

ফিউচার পার্কের সামনে এসে দেখা গেল আজ বেজায় ভিড়। শনিবার। ছুটির দিন। সেই সুবাদে অনেকেরই পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা। গেটের কাছে জমে আছে মেয়ে, ছেলে, বুড়ো নানা বয়সের মানুষ। বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব চারপাশে। ভালো লাগছিল আহিরের।

ঢোকার মুহূর্তে তুষারের সাথে এক অপরিচিতা মহিলা ধাক্কা খেলো। অপরিচিতার চোখে রোদ চশমা, গায়ে কালো সিল্কের শাড়ি, মুখে বেশ উগ্ৰ সাজ। তুষার সরি বলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। মেয়েটা চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘তুমি? তুমি এখানে কী করো?

তুষারের মুখখানা মুহূর্তে ছাই বর্ণ হয়ে গেল, আমতা আমতা করে বলল, ‘এইতো আসলাম!’

— ‘এইতো আসলাম মানে কী! সকাল থেকে তোমারে ফোন দিতেসি, তোমার ফোন বন্ধ!’

আহির দেখলো মেয়েটা কথা বলছে খুব পরিচিত ভঙ্গীতে। যেন তুষার তার অনেকদিনের বন্ধু। মেয়েটা এবার আহিরের দিকে অবহেলায় তাকালো।

— ‘এই মেয়ে কে?’

তুষার আর কোনো কথা না বাড়িয়ে আহিরের হাত ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে ভিড়ের মাঝে মিশে গেল। আহির পেছন ফিরে মেয়েটাকে আরেকবার দেখার চেষ্টা করল। খুঁজে পেলনা। দাঁড়িয়ে পড়ে এক ঝটকায় হাতটা তুষারের মুঠো থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জোরালো গলায় বলে উঠল,

— ‘কী ব্যাপার? মেয়েটা কে?’

— ‘আরে! আর বলোনা! আমার পিছে লাগসে!’ তুষার বলল, আহিরের চোখের দিকে না তাকিয়েই।’

— ‘তোমার পিছে লাগসে মানে কী! তুমি কোনখানকার কোন শাহরুখ খান আসছো শুনি?’

— ‘আহ! সিনক্রিয়েট করোনা তো!’ তুষার বিরক্তি নিয়ে বলে উঠল। আহির ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল। খচ করে যেন কেউ একজন বুকের ভেতর ধারালো কাঁটা বিধিয়ে দিয়েছে। নিজেকে সামলে উঠতে পারছিল না সে।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ১৫

১৫

— ‘হুম বলো!’

— ‘কী বলব!’ রিকশায় অয়নের পাশে বসে অবাক গলায় বলল তিয়ানা।

— ‘এত জরুরী তলব কেন?’ শেষ বিকেলের বিষণ্ন, ধূসর আকাশটার দিকে তাকিয়ে তিয়ানা উদাস গলায় বলল,

— ‘ওহ! এমনি!’

— ‘মানে কী! তুমি এমন ভাবে ফোনে কথা বললে যে আমি ভাবলাম কোনো বিপদ আপদ হয়েছে তোমার।’ অয়ন বেশ বিরক্ত হলো।

— ‘ওভাবে না বললে আপনি আসতেন বুঝি!

অয়নের কপালে একটা চিন্তার ভাঁজ পড়ল। কথাটা অবশ্য তিয়ানা ঠিকই বলেছে। ওরকম আঁকু পাকু হয়ে ফোন না দিলে অয়ন কিছুতেই আজ এমুখো হতোনা। সে যাচ্ছিল মিরপুর, তার বাল্যবন্ধু শাহজাহানের আজ সকালে একটা ছেলে সন্তান হয়েছে। শাহজাহান এই বয়সেই ছেলে পুলে বানিয়ে পাক্কা সংসারী হয়ে উঠেছে। এটা বেশ আনন্দের খবর। অয়ন বেশ ফুরফুরে মন নিয়ে বন্ধুর বাসায় যাবার জন্য তৈরী হয়েছিল। সেই সময় হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো এই মেয়ে ফোন দিয়ে শুরু করল, মেকী কান্না। এই মুহূর্তেই নাকি তার অয়নকে দরকার! জীবন মরণ সমস্যা। অয়ন আর কিছু ভাববারই সময় পেলনা। তাড়াহুড়ো করে ছুটে আসলো।

— ‘এত রাগছেন কেন? কুল ডাউন ম্যান! আপনাকে ডাকার পেছনে প্রয়োজন যে একবারে ছিল না তা না! একটা প্রয়োজন ছিল!’

— ‘প্রয়োজনটা কী ছিল?’ বরফ শীতল কণ্ঠে বলল অয়ন।

তিয়ানা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আজকে কিচ্ছু ভালো লাগছিল না সকাল থেকে। বাবা মা দেশের বাইরে, বোনের সাথে ঝগড়া হলো, দিনটাই খারাপ গেল। বাট এট দ্যা এন্ড অফ দ্যা ডে, আপনার কথা মনে পড়ল। মনে হলো, আপনার মতো একজন বন্ধুকেই আমার দরকার এই মুহূর্তে’

একটু থেমে অয়নের থমথমে মুখটার দিকে তাকিয়ে করুণ গলায় বলল, ‘আর ইউ শ্যাটার্ড?’

অয়ন ভাবলেশহীন চোখে তাকালো তিয়ানার দিকে। ষোলো কী সতেরো বছরের উঠতি বয়সের ঝলমলে একটা মেয়ে। তাকালেই মায়া লাগে। মনে হয় পৃথিবীর কোনো অশুভ শক্তি আজ পর্যন্ত এই মেয়েটাকে স্পর্শ করতে পারেনি। তার বাস এই ধুলো মাখা জগৎটাতে নয়, অন্য কোথাও। এই ফুলের মতো বাচ্চা মেয়েটা কেন তার মতো একটা ছন্নছাড়া, অপদার্থ, পাগল ছাগল বিপজ্জনক মানুষের বন্ধু হতে চাইছে?

— ‘এত বয়সের ডিফারেন্সে বন্ধু হওয়া যায় না তিয়ানা! তোমার সাথে আমার অনেক তফাৎ!’

তিয়ানা পরনের শালটা ভালো করে মাথায় জড়িয়ে নেয়। মাঘ মাসের হিম জড়ানো বাতাসের ধাক্কায় হালকা কেঁপে কেঁপে ওঠে। নরম চোখে অয়নের দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

— ‘ডিসটেন্স ডাজন্ট ম্যাটার!’

— ‘আমি… আমি মানুষটা ঠিক স্বাভাবিক না, বেশ পাগল আছি আমি। যে কোনো সময় পাগলামোর বশে তোমার ক্ষতি করে ফেলতে পারি!’

তিয়ানা খিল খিল করে হেসে উঠল, ‘মিথ্যে বলছেন আপনি! আপনি কখনো কারো ক্ষতি করতেই পারেননা! আপনি তো অনেক কিউট আর অনেক ইনোসেন্ট!

অয়ন প্রসঙ্গ ঘোরালো,

— ‘চলো, তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।

— ‘ওকে!’ তিয়ানা এক কথায় রাজি হয়ে গেল।

তিয়ানার ফ্ল্যাটে এসে দেখা গেল, পুরো ফ্ল্যাট খালি। বাসায় একটা চাকর পর্যন্ত নেই। অয়ন তো অবাক! বিস্ময় নিয়ে বলল,

— ‘সেকি! পুরো বাসা খালি কেন? লোকজন সব কই?’

— ‘বাবা মা তো আমেরিকায়, বড়বোন আছে ওর শ্বশুর বাড়িতে, আমি এখানে একাই!’ নির্বিকার ভাবে কথাগুলো বলে ফেলল তিয়ানা।

অয়নের মুখটা হা হয়ে গেল, ‘তুমি এখানে একা থাকো!!’

— ‘মাঝে মাঝে থাকি একা, থাকতে হয়!’

— ‘বল কী!’

—হুম, ইউজুয়ালি আমি আমার বোনের সাথে থাকি, কিন্তু যখন বোনের সাথে ঝগড়া হয় তখন এখানে এসে উঠি, খারাপ লাগেনা, আমি একা থাকাটা এনজয় করি।

অয়ন তখনও ধাক্কাটা সামলে উঠতে পারেনি। তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না প্রায় তিন হাজার স্কয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাটে এত বাচ্চা একটা মেয়ে একা থাকতে পারে। তিয়ানা অয়নকে একটা সোফা দেখিয়ে দিয়ে বলল,

— ‘বসুন তো! বসুন, ওয়েলকাম হোম! মি কাসা। সু কাসা! (মাই হোম ইজ ইওর হোম)

অয়ন বসলো। মাথাটা ঠিকমতো কাজ করছিল না। সে ভেবেছিল মেয়েটাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে কেটে পড়া যাবে। কিন্তু চালাকী করতে গিয়ে আরো বেশি ফেঁসে যাওয়া হলো।

তিয়ানা অয়নের পাশে বসে বলল, ‘বলুন, ডিনার কী করবেন? আমি খুব ভালো পাস্তা বানাতে পারি!’

অয়ন দীর্ঘশ্বাস চাপলো। বিপন্ন গলায় বলল, ‘তিয়ানা! আমার খুব কাছের এক বন্ধুর আজকে প্রথম সন্তানের জন্ম হয়েছে। আমি না গেলে ভীষণ কেলেঙ্কারী হয়ে যাবে’

তিয়ানার ঝলমলে মুখখানা নিভে গেল হঠাৎ। চোখ দুটোয় পড়ল কিসের যেন গভীর ছায়া। অয়ন একটু চমকালো ওই চোখের দিকে তাকিয়ে। সে জানে, এই বয়সটা খারাপ। যে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেবার জন্য এই বয়সের ছেলে মেয়েরা এক মুহূর্তও বিলম্ব করেনা। এই বয়সের একটা মেয়েকে এভাবে একা ফেলে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তিয়ানার ঠোঁট দুটো হঠাৎ অভিমানে কেঁপে উঠল,

ভারী গলায় বলল, ‘ওকে ফাইন! যান, চলে যান!’

— ‘তুমিও চলো, তোমাকে তোমার আপুর বাসায় রেখে আসি।’

— ‘মাথা খারাপ! মরে গেলেও না! আজকে ওর সাথে ঝগড়া হয়েছে আমার!’

— ‘আহ তিয়ানা! যা বলছি শোনো, পাকামো করোনা,’

— ‘নো ওয়ে!’

অয়ন হঠাৎ বুনো মোষের মতো তেড়ে এসে তিয়ানার একটা হাত শক্ত করে

চেপে ধরে বলল,

— ‘চলো, আর একটা কথাও না! তোমাকে বলেছি না যে আমি পাগল? তুমি কি আমার পাগলামী দেখতে চাও?’

তিয়ানা বেশ ঘাবড়ে গেছে অয়নের এই আকস্মিক আক্রমণে। কিছুক্ষণ বোকার মত অয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করে বললো, ‘সে কি! আপনি আমাকে জোর করছেন!’

— ‘হ্যা, করছি, কথা না বাড়িয়ে এখনই বের হও এখান থেকে।’

রিক্সায় উঠেই তিয়ানা প্রশ্নটা করে ফেললো ফট করে, ‘আচ্ছা! আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই?’

অয়ন অপ্রস্তুত হলো কিছুটা। গম গম করে উত্তর দিল, ‘নাহ!

তিয়ানা যেন আকাশ থেকে পড়ল, সেকি! নো গার্লফ্রেন্ড?’

— ‘নো গার্লফ্রেন্ড’ অয়ন বলল।

— ‘স্টপ মেসিং উইথ মি!’

অয়ন কিছু বলল না। মেয়েটা একটু বেশি পাকামো করছে। এবার কড়া গলায় একটা ধমক লাগাতে হবে।

— ‘ওকে, কিন্তু কেন? মেয়েদের প্রতি আপনার ইন্টারেস্ট নেই? বাই দ্যা ওয়ে আপনার অন্য কোনো সমস্যা নেই তো? আই মিন, গে’ নন তো আপনি?’

বলেই হো হো করে হাসিতে ফেটে পড়ল তিয়ানা। অয়ন জ্বলন্ত চক্ষু নিয়ে তাকালো ওর দিকে। তিয়ানা ভ্রুক্ষেপও করল না। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি চলে আসার উপক্রম। অয়নকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আবার বলে উঠল, ‘অর বাই এনি চান্স, আপনি ইম্পোর্টেন্ট নন তো?’

— ‘জানিনা’ কাঠ কাঠ গলায় বলল অয়ন। এই মেয়েটা কি ফাজিল? অসভ্য? নাকি বোকা?

তিয়ানা এবার একটু সিরিয়াস হবার চেষ্টা করে বলল, ‘জানেন না? এর মানে আপনি এখনো ভার্জিন?’

— ‘ডেফিনিটলি!’

তিয়ানা ভীষণ অবাক চোখে তাকালো অয়নের দিকে। এরপর হঠাৎ বাঁধ ভাঙ্গা হাসিতে ফেটে পড়ে বলল, ‘ওহ মাই গড, ইউ আর স্টিল ভার্জিন! শেইম অন ইউ।’

অয়নের রিকশা থেকে পড়ে যাবার উপক্রম হলো। কী বলছে এই মেয়ে এইসব? মাথাটা কি একেবারে গেছে নাকি!

১৬

আজ সকালে চৈতির ফোনটা পেয়ে আহির রীতিমত ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। ভুল শুনছে নাতো সে? তার কান ঠিক আছে তো?

— ‘আহির শোন, একটা জরুরী কথা আছে!’

— ‘বলে ফ্যাল’, আহির তখনও ঘুমে ঢুলুঢুলু। গলা ভারী

— ‘আরে শোন না, ইম্পর্টেন্ট কথা’

— ‘আরে বল না কী? কী হইসে?’

— ‘আমার তো বিয়া!’

আহিরের ঘুম ভাবটা চকিতে পালালো, ‘হ্যাঁ! কি বলিস!’

— ‘ঠিক বলছি’

— ‘কার সাথে?’

— ‘তোকে বলেছিলাম না, ঐ যে মেন্টরসের ছেলেটার কথা।’ আহির মনে করার চেষ্টা করল। হ্যাঁ, কদিন আগে চৈতি বলেছিল একটা কম বয়সী ছেলের কথা।

— ‘ওই পিচ্চিটার সাথে?’

— ‘হুম’

— ‘মানে কি! কীভাবে সম্ভব?’

— ‘সবই সম্ভব বন্ধু! তুমি চট করে চলে আসো বাসায়, সামনা সামনি বলবো।’

আহির পড়ি মরি করে ছুটে গেল চৈতির ফ্ল্যাটে। উত্তেজনার বসে কথা খুঁজে পাচ্ছিলনা সে। চৈতিই কথা বলল প্রথম, ‘কিরে ওরকম থাম্বু খেয়ে গেলি কেন?’

— ‘তুই কী বলছিলি?’

— ‘বলছিলাম আমার বিয়ে!’

— ‘ওই ছেলেটার সাথেই?’

— ‘হ্যা!’

আহির বিস্ময়ে ফেটে পড়ল, গলাটা খাদে নামিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

— ‘কিন্তু ওই ছেলেতো বয়সে তোর চেয়ে ছোট!’

— ‘এত ফিসফিস করার কিছু নেই আহির! ব্যাপারটা বাবা মা জানেন, হ্যাঁ বয়সে বছর দুয়েকের ছোট হবে, কী এসে যায়!’

— ‘আঙ্কেল আন্টি রাজি?’

— ‘রাজি, রাজি করাতে যদিও বেগ পেতে হয়েছে, তবুও শেষমেষ রাজি হয়েছে এটাই স্বস্তির খবর। ‘

আহিরও এবার একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, ‘যাক! তাহলেতো ভালোই, তোর সুখেই আমাদের সুখ।’

— ‘সত্যি আমি খুব সুখীরে আজ! নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে বিয়ে হওয়ার চেয়ে সুখের আর কিছু কি হতে পারে রে এই দুনিয়ায়?’

চৈতির চোখ দুটো চকচক করে উঠল। মুখে প্রশান্তি এঁকে দিল স্বৰ্গীয় রূপ! আহির মুগ্ধ হয়ে গেল দেখে। সত্যি ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করার মাঝে এত নির্ভেজাল আনন্দ মিশে থাকে? সেও তো তুষারকে বিয়ে করবে কদিন পরেই, কিন্তু কই সেই ভাবনা তো কোনদিন তার মাঝে এতটা সুখ এনে দিতে পারেনি? আহির একটু আনমনা হলো, সে মানুষটা এমন কেন? তুষারকে ভালোবেসে কেন সে চৈতির মতো বুক ফুলিয়ে বলতে পারেনি কোনদিন, সত্যি, আমি খুব সুখীরে আজ! আহিরেরও বড় সাধ জাগে, চৈতির মতো করে বলতে, পারবে কি কখনো আহির?

— ‘আজকে কী করছিস? বাইরে যাবি আমার সাথে?’ ভাবনায় ছেদ পড়ল চৈতির কথায়।

— ‘তেমন কোনো প্ল্যান নেই, পড়তে বসবো, পরীক্ষার আর বেশি দেরি নেই তো!’

— ‘কী পরীক্ষা?’

— ‘বিসিএস’

— ‘ওহ! এবার মনে হচ্ছে তুই চান্স পেয়েই ছাড়বি!’

— ‘আরে ধুর! আমার ভাগ্যটা কখনো আমার সঙ্গ দেয়না, আমি কি আর তোর মত চাঁদ কপাল নিয়ে জন্মেছিরে?’

শেষের লাইনটা নিজের কানেই কেমন বেখাপ্পা ঠেকলো আহিরের কাছে। সে কি চৈতিকে হিংসে করতে শুরু করেছে? নইলে অমন ছোটলোকের মতো কথাটা বলতে গেল কেন? একটা পাপবোধ আচ্ছন্ন করে ফেলল তাকে। ধ্যুর ছাই! আজকাল কী যে হচ্ছে তার সাথে!

চৈতি ভ্রু দুটো ত্রিভূজের মতো করে বলল, ‘তোর মনটা কি খারাপ নাকি রে আজ?’

আহির কী বলবে, সে নিজেও জানেনা মন খারাপ নাকি ভালো। শুধু এটুকু বোঝা যায় ভেতরটা কেমন থ মেরে আছে। কিছু ভালো লাগেনা, নাহ কিচ্ছুনা! কী হয়েছে আহিরের? গভীর কোনো অসুখ?

— ‘কিরে চুপ করে রইলি কেন? কী নিয়ে ভাবছিস বলে ফেল, আমার সাথে শেয়ার কর, দেখবি বলে ফেললে ভালো লাগবে।’

আহির ঝিম ধরা গলায় বললো, ‘কিছু হয়নি, কিচ্ছুনা, তুই বল তোর বিয়েটা হচ্ছে কবে?’

— ‘ফেব্রুয়ারিতে’

— ‘তবে তো আর বেশি দেরী নেই’

— ‘হ্যাঁ ঠিক, তার এক মাস পরেইতো তোর বিয়ে, তাইনা?’

— ‘হুম, মার্চে হতে পারে তবে এখনো তারিখ পড়েনি

— ‘আমার পড়েছে, ১৪ই ফেব্রুয়ারী, ভ্যালেনটাইনস ডে!’ বলেই এক গাল হাসলো চৈতি।

আহিরও হাসলো। চৈতির আনন্দটা দেখতে এখন ভালো লাগছে। নাহ, এতক্ষণে নিশ্চিন্ত হওয়া গেল চৈতিকে সে হিংসে করেনি। এই উপলব্ধিটা মনের মাঝে একটা প্রশান্তি এনে দিল। হিংসে কি আদৌ করেছে সে কারুকে কোনো দিন? মনে পড়েনা। কিন্তু অমন ধোয়া তুলসী পাতাও তো সে নয় যে এই এতটুকু জীবনে কোনদিন কাউকে হিংসে হয়নি। হয়েছে নিশ্চয়ই, আহির তা টের পায়নি।

— ‘যাবি নাকি নিউমার্কেট? একটু কেনাকাটা ছিল।’

— ‘আজ মঙ্গলবার, মার্কেট বন্ধরে!’

— ‘ওহ, তাই বল, তাইতো সকালে রাস্তা এতো ফাঁকা দেখলাম’

— ‘সকালে বেরিয়েছিলি?’

— ‘হম, কোচিং এ গিয়েছিলাম’

— ‘ও আচ্ছা’ আহির বললো, দায়সারা গলায়। চৈতি বাতাসে রহস্যের গন্ধ পেয়ে বলল,

— ‘এই মেয়ে তোর হয়েছে কী? ঝগড়া করেছিস তুষার ভাইয়ের সাথে?’ আহির পাশ কাটানো উত্তর দিল, ‘আরে না, শোন আজ আমি উঠি, এমনিতেও বাড়িতে অনেক কাজ, বাড়ি বদলানো মানেই বিরাট ঝামেলা’

— ‘ও হ্যারে, তোরা কবে যাচ্ছিস?’

— ‘সামনের মাসেই’

— ‘তুই চলে গেলে আমার কী হবে?’ চৈতি এবার সত্যি কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। মেয়েটা আহিরকে বাস্তবিকই ভালোবাসে। আহির হেসে বলল,

— ‘তুই ও তো চলে যাবি শ্বশুরবাড়ি, অত মন খারাপ করা কেন?

১৭

আজকে অয়ন বাড়ি ফিরে একটি চমকপ্রদ খবর শুনতে পেল। তার বাবার শরীর আজ কিছুটা ভালো। তিনি ভদ্রলোকের মতো কাপড় জামা পরেছেন। চেয়ার টেবিলে বসে দুপুরে ভাত খেয়েছেন এবং আরো আশ্চর্যজনক ঘটনা হলো তিনি অয়নের নাম ধরে দু একবার ডেকেছেন, অয়নকে খুঁজেছেন।

খবরটা শোনা মাত্র অয়ন কয়েক সেকেন্ড থ মেরে রইলো। এরপর এক ছুটে দৌড়ে গেল বাবার ঘরের দিকে। বুকের ভেতর হৃদপিন্ড লাফাচ্ছে। আহা! অয়ন কত কত দিন ধরে আশা পুষে রেখেছে, কোনো এক মায়াবী বিকেলে সে বাড়ি ফিরে এসে বাবাকে আবার সেই আগের মতো করে ফিরে পাবে।

বাবার ঘরটি আজ আলোকময়। ১০০ ভোল্টের বাল্ব জ্বলছে। স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধটিও নেই। কটকটে একটি এয়ার ফ্রেশনার দিয়ে ঘরটিকে সুগন্ধময় করে রাখা হয়েছে। ঠিক মাঝখানে, যেখানে শেকল দিয়ে এতদিন বাঁধা ছিলেন বাবা, সেই জায়গাটায় একটি চকি পাতা হয়েছে। বাবা সেখানে বসে আছেন। তার পরনে একটি আকাশী রঙের গেঞ্জি এবং লুঙ্গী। শেকলটির অস্তিত্ব নেই আশেপাশে কোথাও। বাবা বসে আছেন খুব সাধারণ ভঙ্গীতে। একটু কুঁজো হয়ে। তার দাড়ি কামানো হয়েছে। বেশ ভদ্রলোকের ছাপ এসেছে চেহারায়। শুধু চোখে মুখে একটা ভয় খেলা করছে। চোখ জুড়ে ছেলেমানুষী। ভীত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন এদিক সেদিক এবং আকাশ পাতাল ভাবছেন যেন নিতান্তই অপরিচিতের বাড়িতে তিনি চলে এসেছেন হঠাৎ করে। বাবার এক পাশে দাদীমা বসেছেন। অন্য পাশে আয়শা দাঁড়িয়ে আছেন। মনোযোগ দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন তার পাগল স্বামীটিকে। অয়ন সামনে এসে দাঁড়াতেই আয়শা একটু তটস্থ হলো। দাদী মা’ও। নির্বিকার হয়ে রইলেন কেবল বাবা। অয়নের দিকে একবার তাকালেন। কী যেন বিড়বিড় করলেন নিজের মনে। এরপর আবার মগ্ন হয়ে গেলেন তার নিজস্ব চিন্তায়। একটা তীব্র ব্যথা বুকের ভেতর ঘুরপাক খেয়ে নিশ্বাস আটকে দিল অয়নের। বাবা কি তাকে চিনতে পারেনি? তাহলে ওরা যে বলছিল তিনি তার নাম ধরে ডেকেছেন!

অয়ন এগিয়ে এসে বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো মাটিতে। অয়ন কাছে আসতেই আয়শা একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালেন। তিনি জানেন অয়ন তার উপস্থিতি আজকাল একেবারেই সহ্য করতে পারছেনা। ঘরে বাড়ির চাকর বাকররাও উপস্থিত আছে, এসময় একটা হই হট্টগোল বাঁধিয়ে দিলে তিনি লজ্জিত হয়ে পড়বেন সবার সামনে। এরচেয়ে দূরত্ব বজায় রাখাই শ্রেয়।

— ‘বাবা!’ অয়ন ডাকলো। বাবা শুনলেন কিনা বোঝা গেলনা। ভাবলেশহীন চোখে মাথার উপর ঘুরতে থাকা সিলিং ফ্যানটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। যেন এহেন আশ্চর্য বস্তু তিনি ইহজন্মে দেখেননি

— ‘বাবা!’ অয়ন আবার ডাকলো।

বাবা তাকালেন। ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবলেন গভীরভাবে। অয়নের চোখ দুটো একটু ভিজে আসছিল। কান্নার একটা ঢোঁক গিলে সে বলল,

— ‘বাবা তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ? আমি অয়ন!’

বাবা নাকটা সুঁচালো করলেন একবার, বিড়বিড় করলেন তার নিজস্ব ভাষায়, এবং খুব স্বাভাবিক ভঙ্গীতে আবার তাকালেন সিলিং ফ্যানের দিকে। হঠাৎ একটা তীব্র আক্রোশে পেয়ে বসলো অয়নকে। রোমকূপে রোমকূপে সেই বিষাক্ত পোকার ছোবল। দাঁতে দাঁত ঘষে সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তুমি আমাকে চিনতে পারছনা?’ বাবা নির্বিকার। অয়ন এবার ফেটে পড়ল আর্তনাদে, ‘তুমি চিনতে পারছো না? আমাকে চিনতে পারছনা?’ বলেই টেবিলের ওপর রাখা কাঁচের গ্লাসটা হাত দিয়ে তুলে ছুঁড়ে মারলো। চোখের সামনে ভেঙ্গে চুরে টুকরো টুকরো হয়ে গেল গ্লাসটা। দাদিমা আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘একি সর্বনাশ! করছিস কী?’

অয়ন বন্য মোষের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। নিজের ঘরে এসে সটান শুয়ে পড়ল। মাথার ভেতর চিনচিনে ব্যথা। বুকটা ভারী। একটা বোবা কান্না গলায় আটকে আছে। নিচতলার ওই কোণের ঘরের উন্মাদ লোকটা যেদিন তার জীবন থেকে চলে গিয়েছিল সেদিন থেকে সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেল। তার বাবা হারিয়ে গেছে, মরে গেছে কিংবা উধাও হয়ে গেছে, ওই অপ্রকৃতস্থ জড় বস্তুর মতো লোকটা কোনভাবেই তার বাবা হতে পারেনা। আচ্ছা! অয়নই বা কেন এত দিনেও এই সত্যটিকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিতে পারছেনা? যেভাবে দাদীমা মেনে নিয়েছেন, যেভাবে বুশরা মেনে নিয়েছে ঠিক সেভাবে অয়ন কেন মানতে পারছেনা! অয়ন তো জানে পরিবর্তন প্রকৃতির সবচেয়ে মৌলিক বৈশিষ্ট্য। কোনো কিছুই স্থির নয়। একবার এক বইতে পড়েছিল একই নদীতে আসলে কেউ দুবার গোসল করতে পারেনা। দ্বিতীয়বার যখন নদীতে নামা হয় তখন নদী বা নদীতে নামা মানুষটি কোনটিই আগের মতো নেই। এ গতিশীলতাই জগৎকে টিকিয়ে রেখেছে। ঠিক যেভাবে প্রতিটা বস্তু পরিবর্তিত হয় প্রতিনিয়ত, ঠিক সেভাবেই বাবাও বদলে গেছে। এই সহজ কথাটা অয়ন কেন মেনে নিতে পারছেনা! অয়ন নিজেকে বোঝায়, দিন রাত বোঝাপড়া করে নিজের সাথে কিন্তু অবাধ্য মনটা মানতে চায়না। কেবলই মনে হয় এ সব কিছুর পেছনে শুধু একটা মানুষ দায়ী!

নিচতলার ঘর থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। তার সাথে বিকট চিৎকার। অয়ন উঠল না। ঝিম ধরে শুয়ে রইল।সে জানে পাগলের তান্ডব শুরু হয়েছে। এখনই আবার শেকল পরানো হবে। পুরোপুরি বেঁধে ফেলে বন্দী করে রাখা হবে খাঁচার ভেতর। যাতে বাইরের দুনিয়ার একটি ধুলো কণাও জানতে না পারে এ বাড়িতে একটি বদ্ধ উন্মাদ বাস করে।

ঘরের দরজা খোলা ছিল। আলো না জ্বালানোয় ভেতরটা অন্ধকার। বুশরা কখন এসে দাঁড়িয়েছে টের পায়নি অয়ন। ঝাঁঝালো কন্ঠের ঝাপটা এসে কানে লাগল।

— ‘কি শুরু করেছে দেখেছিস? উফ! এইসব চলতে থাকলে কিন্তু আমিও তোর মতো একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে যাব!’

অয়ন নির্বিকার ভাবে বলে,

— ‘যা না, যেতে মানা করেছে কে তোকে?’

বুশরা রাগে ফোঁস ফোঁস করে,

— ‘লোকটা মরে না কেন? আর কতদিন এইসব সহ্য করতে হবে!’

অয়ন নড়ে চড়ে উঠে বসে। গলা খাকারি দিয়ে বলে, ‘এক কাজ করনা, তুই আর তোর মা মিলেমিশে একটা প্ল্যান করে পাগলটাকে বিষ খাইয়ে দে, তাহলে তোদের জ্বালা জুড়াবে!’

— ‘যদি পারতাম! তবে আমি তাই করতাম!’ বুশরা রাগে গজগজ করতে করতে হাঁটা দেয়। যেদিকটায় গেছে সেদিকে ওর ঘর না, ছাদে যাবার সিঁড়ি। অয়নের বুশরার জন্য একটু চিন্তা হয়। বুশরা কি বেশি হতাশ হয়ে পড়ছে ব্যাপারটা নিয়ে? নেশা টেশা করছে নাতো আবার? কিংবা কোনো খারাপ সঙ্গ? কে জানে!

১৮

বাবাই বসার ঘরে একটা পুরনো ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছিলেন, চশমাটা নাকের ডগায়। আহিরকে দেখে একটু চমকানো গলায় বললেন, ‘কিরে? কী হয়েছে তোর?’ আহির একটু বেসামাল হলো, – ‘কই? কিছু হয়নিতো!

বাপ মেয়ের কথার মাঝখানে মা এসে হাজির হলো ঝড়ের মতো, ‘আশিকের কান্ডজ্ঞানটা দেখেছিস?’

— ‘কেন সে আবার কী করলো?’ আহিরের প্রশ্ন।

— ‘তার নাকি ল্যাপটপ চাই, এইমাসের মধ্যেই চাই! তুই বল, তোর বাবার কি এই মূহুর্তে এইসব বিলাসিতা করার কোনো সুযোগ আছে?’

বাবাই খানিকটা ন্যাতানো গলায় বলল, ‘থাক! এ নিয়ে আর তুমি চোটপাট করোনা! ছেলে মেয়েরা আহ্লাদ করে কিছু চাইলে আমি দিতে পারিনা, এ আমার ব্যর্থতা, ওদের ই বা কী দোষ বল?

আশিক ঘরের কোনে ডিভানে গুটিশুটি মেরে শুয়ে ছিল। মায়া হলো আহিরের ভাইয়ের জন্য। তার নিজের কম্পিউটারটা গেল বছর নষ্ট হয়ে গেল। বড় ফুপু জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন। খুব জরুরী কাজগুলো এখন সে চৈতীর কম্পিউটারে সেরে ফেলে। আশিক এইচএসসি পরীক্ষা দিবে আগামী বছর। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে। এ সময় একটা কম্পিউটার যে সত্যি কতটা জরুরী আহির তা বুঝতে পারে। ওর বন্ধুদের সবার নিশ্চয়ই পার্সোনাল কম্পিউটার বা ল্যাপটপ আছে, দামী মোবাইল আছে। বন্ধুবান্ধব নিয়ে হ্যাংআউট করার মতো পকেটে ভালো হাত খরচ আছে। বেচারা তার ভাইটা সবদিক থেকেই ঠটো হয়ে বসে আছে।

— ‘কিন্তু মা, আমার কাছে মোটেও মনে হচ্ছেনা আশিক কিছু মাত্র বিলাসিতা করছে। ওর পড়াশোনার জন্য একটা কম্পিউটার খুব দরকার’

আহিরের কথাগুলো কানে যাওয়া মাত্র আশিক বুঝি শরীরে বল ফিরে পেল। নড়ে চড়ে উঠে বসে সে অভিযোগ করার সুরে বলল, ‘দেখলি বুবু, ওরা কি ভীষণ প্রি-ডেটেড কথা বার্তা বলছে! আচ্ছা বাবাই তুমি একজন শিক্ষক হয়ে কী করে এমন একটা কথা বললে বল তো?’

বাবাই অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, ‘আমি পড়াই ইংরেজি, সেখানে তো কম্পিউটারের কোনো আবশ্যকতা আমার নজরে পড়েনা।’

— ‘উফ! তোমরা বুঝবেনা, সে যাই হোক, আমি নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নিয়েছি তোমাদের চিন্তা করতে হবেনা।’

আশিকের কথাটা মাটিতে পড়তে পারলোনা, তার আগেই মা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘সে কি! কী করেছিস তুই? চুরি ডাকাতি করেছিস নাকি?’

মায়ের বলার ঢঙে আশিক হেসে ফেলল, বিজয়ীর মতো বলল, ‘না সেসব কিছুই করিনি। তুষার ভাই বলেছেন এবারের বার্থডে তে উনি আমাকে একটা ল্যাপটপ গিফট করবেন।’ আহিরের কান দুটো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। সে আগুন ঝরা কন্ঠে বলল, ‘মানে কী! তুষার কেন তোকে কম্পিউটার দিবে?’

আশিক ভারী অবাক হলো যেন, ‘কী আজিব! সে আমার হবু দুলাভাই! দুলাভাই শালাকে ভালো কিছু উপহার দিতেই পারে! শালাকে দেবেনা তো কাকে দেবে?’ মায়ের চোখ দুটো ততক্ষণে চকচকে হয়ে উঠেছে, বিগলিত হয়ে বলল, ‘সত্যি?’ বাবাই একটু মিন মিন করল, ‘কী দরকার তার এত টাকা খরচ করার!

ব্যাস এটুকুই! আহিরের সমস্ত শরীরে একটা প্রচন্ড প্রতিবাদের ঢেউ বয়ে গেল। এদের কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? দুলাভাই হয়ত শালাকে আদর করে কিছু না কিছু উপহার দিতেই পারে। কিন্তু আহির নিজেও জানেনা তার কেন মনে হচ্ছে তুষারের কাছ থেকে এই গিফট নেয়া আর ভিক্ষা নেয়ার মাঝে কোনো তফাৎ নেই। আহির ঠোঁট কামড়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তার পরিবারের বাকি তিন সদস্যের চোখে মুখে এক বিগলিত আভা। জামাইয়ের বদান্যতায় তারা অতি আনন্দিত! হায়! আহিরের মনে হলো যদি মাটি দু ফাঁক হয়ে গর্ত হয়ে যেত, আর সে যদি সেই গর্তে লুকাতে পারত!

১৯

ঠিক সেই মুহূর্তেই তার মনে পড়ল কাল সকালে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির কথা। আচ্ছা! ওই মেয়েটার সাথে তুষারের কী সম্পর্ক! তুষারের মাঝে একটা লুকোচুরির ভাবই বা আহির কেন টের পেয়েছিল? বুক দুরু দুরু করতে থাকে। একটা অজানা ভয় জাপটে ধরে চারপাশ থেকে।

দাদীমা প্রায় জোর করে অয়নকে আয়শার ঘরে নিয়ে আসলেন। অয়নকে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েই তিনি কেটে পড়লেন। এই বৃদ্ধা মহিলার সম্মোহনী শক্তি দেখে অয়ন আজও অবাক হয়। সে না পারতে এসে দাঁড়ালো আয়শার সামনে, ক্ষ্যাপাটে গলায় বলল, ‘আপনি আমাকে ডেকেছেন?’

আয়শা তাকালেন ছেলের দিকে। ছেলেটা দেখতে ঠিক কার মতো হয়েছে তা আজও তিনি ঠাওর করে উঠতে পারলেন না। বাবার সাথে মিল আছে, কিন্তু ছেলে হয়েছে বাবার চাইতেও বেশি রুপবান। দেবতার মতো দেখতে। কিন্তু হলে কী হবে, চলাফেরা হয়েছে উজবুকের মতো। গাল ভর্তি দাড়ি, ময়লা কাপড়, পায়ে চপ্পল, মুখে দার্শনিক উদাসীনতা, সব মিলিয়ে দৈন্যতার লালন। এ যেন এক শৌখিন দৈন্যতা। অয়নের দৃষ্টি ছিল মেঝেতে নিবদ্ধ। আয়শাও ছেলের চোখে চোখে তাকান না। চারপাশে অস্বস্তি দানা বাঁধতে থাকে। বাতাস ভারি হয়ে ওঠে।

— ‘একটু জরুরী কথা ছিল তোমার সাথে, সময় হবে?’

অয়ন যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সেভাবে দাঁড়িয়ে থেকেই বলল, ‘বলুন’। বাইরে তখন ঝিম ধরা দুপুর। জানালা গলে ঘরের ভেতর এসে পড়েছে শেষ মাঘের মিষ্টি রোদ্দুর। আয়শার গায়ে একটা গেরুয়া রঙের পাতলা চাদর। চুলগুলো চুড়ো করে বাঁধা। বসে আছেন বিছানায়। হাতে খবরের কাগজ। আজ ছুটির দিন বলে তিনি দুপুরবেলায় বাড়ি আছেন। অয়ন এ ঘরটায় দীর্ঘ দিন পর আসলো। বাবা সুস্থ থাকা অবস্থায় শেষবার এসেছিল। ঘরের সাজসজ্জা তেমন একটা পরিবর্তন হয়নি। পর্দাগুলোর রং পাল্টেছে শুধু আর পুবদিকের দেয়ালে একটা বাঁধাই করা নতুন ছবি। ছবিতে সাত কি আট বছর বয়সের ছোট্ট অয়ন। বারবি ডলের মতো দেখতে চার বছর বয়সী বুশরা, মাঝখানে বাবা তার অপূর্ব হাসিটি মুখে ঝুলিয়ে জমিদারী ভঙ্গীতে বসে আছেন। এই ছবিতে আয়শা নেই। তার ঠিক পাশের ছবিটিতে আয়শা দাঁড়িয়ে আছেন দুই বা তিন বছর বয়সের অয়নকে কোলে নিয়ে। অয়ন ফোকলা দাঁত বের করে হাসছে আয়শার দিকে তাকিয়ে। আয়শা ও হাসছেন ঠোঁট টিপে। সেই ছবির দিকে চেয়ে অয়নের হঠাৎ মনে হলো, আহা ছোটবেলাটা বড় ভালো ছিল। কত কতকাল অয়ন ঐভাবে হাসেনা!

‘বসো’ আয়শা বললেন। অয়ন বসলোনা। একটা আড়ষ্টতা গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

আয়শা গলাটা একটু কেশে পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা! বুশরা আজকাল কি করছে কিছু জানো? আই মিন, ও আসলে কাদের সাথে মিশছে, কোথায় যাচ্ছে, এসব কি কিছু জানো তুমি? বেশ কদিন যাবৎ ওকে একটু কেমন অন্যরকম লাগছে, সেদিন দেখলাম বাড়ি ফিরল খুব রাত করে।’

জানালায় একটা বাচ্চা চড়ুই এসে বসেছে। কিচিরমিচির শব্দে জানান দিচ্ছে তার আগমনী বার্তা। অয়ন সেদিকে তাকিয়ে একটা বিদ্রুপের হাসি হাসল, এরপর নাটকীয় ভঙ্গীতে বলল, ‘বুশরা কোথায় যায়, কী করে বা কাদের সাথে মিশে তা আমি জানিনা, তবে এটুকু জানি যে বড়লোকের বখে যাওয়া মেয়েরা কী করতে পারে, বা কতটা নিচে নামতে পারে, বুশরাও যেহেতু বড়লোকের বখে যাওয়া মেয়ে বৈ আর কিছুইনা, তাই অন্তত ধারণা করতে পারি যে তার গতিবিধি কী ধরনের হতে পারে’ আয়শার মুখখানা দপ করে নিভে গেল, ‘নিজের বোনকে নিয়ে এভাবে কথা বলছ তুমি? তুমি কি মানুষ?’

অয়ন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, ‘আমাকে দেখতে যদিও মানুষের মতো! কিন্তু ভেতরটা আসলে মানুষের মতো নেই। ‘

— ‘দেখতেও তুমি মানুষের মতো নও, মানুষ এভাবে থাকে না! ভেতরে আর বাইরে আগাগোড়া একটা অমানুষ তুমি! তোমাকে ডেকেই আমি ভুল করেছি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম, তুমি নষ্ট হয়ে গেছ! এখন মনে হচ্ছে বুশরাও তোমার পথ বেছে নিয়েছে, তুমি কানপড়া দিচ্ছ না তো ওকে? শেষ হয়ে গেছে এই সংসারটা, পঁচন ধরেছে এই সংসারে।’

অয়ন তাকাল আয়শার দিকে, তীক্ষ্ণ গলায় বলল- ‘শেকড়ে পঁচন ধরলে, ডাল পালায় তো তার প্রভাব পড়বেই, তাই না?’

আয়শা আরেকবার কুঁকড়ে গেলেন। অয়ন সেই কুঁকড়ে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট ভাবে বলল, ‘অবাক লাগল এটা জেনে যে এই সংসারটা পঁচে গলে নষ্ট হয়ে গেছে, সেই উপলব্ধিটা আপনার এতদিনে হলো! আপনি কি সত্যি এতটাই বোকা? নাকি বোকা সাজার অভিনয় করেন?

আয়শার চোখের কোণে কয়েকবিন্দু জল চিক চিক করছিল। তিনি হঠাৎ দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। এরপর অস্থির ভাবে বললেন, ‘তুমি… তুমি কি আমাকে ঘেন্না করো?

অয়ন কয়েক সেকেন্ড আয়শার দিকে চেয়ে থেকে, কিছু একটা খুব কঠিন ভাবে বলতে গিয়েও বলল না, ঢোঁক গিলে ফেলল, শুধু বলল, ‘চলি’।

আয়শা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘ধন্যবাদ তোমাকে, তুমি জাননা উত্তরটা না দিয়ে তুমি আমার কত বড় উপকার করলে!’

বুশরাকে দেখা গেল তার ঘর থেকে বেরোতে। হাই হিল জুতোর টিক টিক আওয়াজ তুলে, মুখে রাজ্যের কসমেটিকস মেখে এই ভর দুপুরবেলা সে কোথায় যাচ্ছে কে জানে? অয়ন সেধে বুশরার সাথে খুব একটা কথা বলেনা। কিন্তু আজকে বলল।

— ‘এই, কই যাস তুই?’

বুশরা ভারি অবাক হলো অয়নের প্রশ্ন শুনে, চোখ কপালে তুলে বলল, ‘কী?’

— ‘কোথায় যাস?’ অয়ন টেনে টেনে স্পষ্ট ভাবে প্রশ্নটা আরেকবার করল। ‘বাইরে!’ বুশরার নির্বিকার উত্তর।

— ‘বাইরে কোথায়?’

— ‘তোকে বলতে হবে কেন?’

— ‘তো কাকে বলবি?’

— ‘যাকেই বলি না কেন, তোকে কেন বলব? হু দা হেল আর ইউ?’ অয়নের মাথায় হঠাৎ রক্ত চড়ে গেল। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘কী ব্যাপার? এভাবে কথা বলছিস কেন?

বুশরা আকাশ থেকে পড়ার ভঙ্গীতে বলল,

— ‘লুক, হু ইজ টকিং! তুই নিজে আগে ঠিক হ, তারপর আমার ওপর জাসুসি করতে আয়, ওকে?’

— ‘আমি বেঠিক আছি সেটা তোকে কে বলল?’

— ‘কাউকে বলতে হবেনা, আমি নিজেই টের পাই, আর তুই যে একটা পাগল, সেটা সবাই জানে, সো প্লিজ! নিজের রাস্তা নিজে দেখ, আমাকে নিয়ে মাথা ঘামাস না!’

— ‘খুব কথা বলতে শিখেছিস দেখছি?’ অয়ন কঠোর হবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু ভেতরটা ওলট পালট লাগছিল। বুশরা এতটা বদলে গেল কবে? এতটা ডেয়ারিং তো ও আগে ছিল বলে মনে পড়েনা। বুশরার এই চারিত্রিক পতনের পেছনে কি অয়নের একেবারেই হাত নেই? অয়ন যদি অতটা উদাসীন না হত, অতটা পাগলামো না করত তাহলে কি বুশরা এই সাহস কোনদিনও পেত! বুশরার যদি কিছু একটা হয়ে যায়, অয়ন কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে কখনো?

— ‘যেতে দে ভাইয়া, অযথা ঝামেলা করিস না!’ বুশরা বলল যারপরনাই বিরক্ত হয়ে। কথা কাটাকাটি বাড়ছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময় রহিম মিয়া ছুটে আসলো ঝড়ের মতো সিঁড়ি ভেঙ্গে, ‘অয়ন বাবা! সাহেবকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, তার ঘরে শেকলটা শুধু পড়ে আছে, কিন্তু তিনি নেই!’

হৃদপিন্ডটা লাফিয়ে উঠলো, অয়ন নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘কী বলছেন আপনি? বাবা কোথায়?

— ‘তা তো বুঝতাসিনা, পাওয়া যাইতেসেনা কোথাও!’ অয়ন এক ছুটে নিচে নেমে আসলো। বুকের ভেতর দুম দুম শব্দে কে যেন তখন হাতুড়ি পিটাচ্ছে।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ২০

২০

মাঝে মাঝে কিচ্ছুতে মন বসেনা আহিরের। বেকার জীবনের চাইতে জঘন্য আর কিছু হতে পারে? সারাদিন এই চার দেয়ালের মাঝে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ানো। কোনো কাজ নেই, দায়িত্ব নেই, ব্যস্ততা নেই। আর ভালো লাগছেনা আহিরের এই ঘটনাবিহীন জীবনটা বয়ে নিতে।

বিসিএস এর গাইড বইটা সামনে নিয়ে বসে থাকল বেশ খানিক্ষণ। কোনো লাভ হলোনা। মাথাটা কেমন ভোঁতা ভোঁতা লাগছে। খানিক বাদে মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল,

— ‘আহির শুনছিস? আজকে যা পারিস কিছু একটা রান্না করে ফেল তো! আমি একটু বের হচ্ছি, জরুরী কাজ আছে!’

— ‘তোমার আবার কী কাজ? আর আমি কী রান্না করব’ আহির আকাশ থেকে পড়ল। মা তেড়ে আসলেন,

— ‘আমার আবার কি কাজ! সেই তো! রাজ্যের কাজ তো সব তোমাদের থাকবে, আমি তো হলাম গিয়ে সংসারের সবচেয়ে অকাজের মানুষটা! এত বয়স হলো এখনো যদি বল কী রান্না করব, তাহলে চলবে কী করে হ্যাঁ? পড়াশোনা নাই, চাকরি বাকরি নাই, সারাদিন ধেই ধেই করে ঘুরে বেড়াচ্ছ, লজ্জা লাগেনা তোমার? দুটা রেঁধে দিলেতো তাও আমাদের কিছু উপকার হয়’

আহির বেসামাল গলায় বলল,

— ‘না মানে, বাড়ির বাইরে তো তোমার খুব একটা কাজ থাকেনা’

— ‘থাক আমার ব্যাপারে আর অত দাদাগিরি করতে এসোনা, যা বললাম তাই করোগে যাও, আজকের খাবারের যোগানটা তুমিই করো, তোমার বাবা বিকেল নাগাদ ফিরবেন, আর আশিক দুপুরে এসেই খেতে চাইবে

আহির বুঝলো মায়ের রাগ ধরে গেছে। রাগ ধরলে মা ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’ তে নেমে যান। চমৎকার ভাবে কথাগুলো শুনিয়ে দিলেন মা। আহির যে দিন কে দিন একটা বোঝা বই অন্য কিছুই হচ্ছেনা সেই সত্যটা চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বুকের চাপটা আরো বাড়ল আহিরের। পড়ার টেবিল থেকে উঠে রান্নাঘরে উঁকি মারলো। আজকে ঠিকা ঝি টা আসেনি। সব কাজ নিজেরই করতে হবে। মা বেরিয়ে গেল মিনিট দশেকের মধ্যে। কোথায় যাচ্ছে কে জানে!

কাজ করতে গিয়ে দেখলো অতটা খারাপ লাগছেনা। বিষণ্ণ মনটা একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। শীতকালে রান্নাঘরটা মোটামুটি আরামদায়ক থাকে। আহির ভাত চড়ালো চুলায়। বরবটি ভাজি করল। ডাল রাঁধল যত্ন করে, আর আলু দিয়ে মুরগীর মাংস। রান্না তখনও চুলায়। আর একটু হলেই মুরগীর মাংসটা নামিয়ে আহির গোসলে যাবে। ঠিক সেই সময় বিরক্তিকর ডোর বেলটা বেজে উঠল। একটা পাখি অনবরত টিউ টিউ করে ডাকতে থাকে। কানে লাগলেই কেমন গা রি রি করে ওঠে। পাখির ডাকও এত কর্কশ হয়!

ঘড়িতে দুটো। বাড়ির মানুষগুলো ফিরতে শুরু করেছে। মা অথবা আশিক হবে। দরজা খুললো আহির। বেশ চমকালো। তুষার দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে ফুল হাতা ফর্মাল শার্ট, গলায় টাই। বোঝা যাচ্ছে অফিস থেকে এসেছে।

— ‘তুমি!’

— ‘হ্যাঁ, আমি!’

আহির বিব্রত বোধ করল। এই অসময়ে না বলে কয়ে কেউ আসে? তুষারের যদি একটু আক্কেল বুদ্ধি থাকত।

— ‘কী হলো, ভূত দেখার মতো চমকে উঠলে কেন?’

— ‘না, ইয়ে, শোনো তুষার, বাড়িতে কেউ নেই, আজকে তোমাকে ফিরে যেতে হবে’

তুষার এক গাল হাসলো, ‘বাহ, চমৎকার, তাহলে তো আর কথাই নেই, আজ শুধু তুমি আর আমি!’

— ‘না তুষার, তুমি চলে যাও, বাবা মা ফিরে এসে খালি বাড়িতে তোমাকে দেখতে পেলে ভীষণ মাইন্ড করবেন’

— ‘কেন যাবো? না আমি যাবনা! আমার বুঝি তোমাকে একলা পেতে ইচ্ছে করেনা?’

আহির শিউরে উঠলো। তুষারের গলার এই স্বরটা সে চেনে। এই ছেলেকে আজ ফেরাতে পারবে বলে মনে হচ্ছেনা। অসহায়ের গলায় বলল,

— ‘তুষার প্লিজ! এখন যাও, তুমি বরং বিকেলে এসো একবার

তুষার এবার ভারী তেজী ভাবে বলল, ‘কেন বলো তো তুমি সবসময় আমাকে কেবল দূরে ঠেলে দাও? এত দিন ধরে প্রেম করছি, আজ পর্যন্ত শান্তিতে তোমাকে একটিবার চুমু পর্যন্ত খেতে পারলাম না, রিকশায় কিছু করা যাবেনা, রাস্তায় না, নিজের বাড়িতে না, তুমি কী, মানে তোমার প্রবলেমটা কী বলতো?’

দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কী সব হাবিজাবি কথা বলে যাচ্ছে তুষার। কেউ শুনে ফেললে? আহির ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আস্তে বলো, কেউ শুনবে!’

তুষার ডাকাতের মতো ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল, ‘উঁহু, আজ আমি কোনো মানা শুনবো না, দু দিন পর তুমি আমার বিয়ে করা বউ হতে যাচ্ছ, এখনো এত কিসের বাঁধা শুনি?’

আহির নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, ‘তুষার, লক্ষী আমার! একটু বোঝার চেষ্টা করো, আজ নয়, কদিন পরে, অন্য কোথাও! কথা দিচ্ছি!’

তুষার বাচ্চা ছেলের মতো হেসে বলল, ‘সত্যি? কথা দিচ্ছ? প্রমিজ?’ মায়া লাগলো আহিরের। নরম স্বরে বলল, ‘প্রমিজ!’

খবরটা দিল আশিক। তুষারের বাবা, মা দেশের বাড়ি গেছে, বরিশাল। দু দিনের জন্য হঠাৎ করেই। আশিক কী করে জানলো খবরটা? জিজ্ঞাসা করতেই জানা গেল তুষার নিজেই বলেছে আশিককে। আহির চট করে প্ল্যানটা করে ফেলল। আজ তাহলে তুষারকে সে সারপ্রাইজ দেবে। ঠিক যেমনটা তুষার দিয়েছিল তাকে সেদিন। যেহেতু তুষারের বাবা মা আজ কালের মাঝে ফিরছেন না তাই অন্য কোনো ধরনের ঝামেলা হবার সম্ভাবনা নেই।

সেই বিকেলে খুব যত্ন করে সাজলো আহির। একটা হালকা গোলাপী রঙের সিল্কের শাড়ি পরল। গলায় কানে মুক্তোর গয়না। সুন্দর দেখাচ্ছিল আহিরকে। মনটাও বেশ ফুরফুরে। আজকে খুব চমকে দেবে সে তুষারকে! কিন্তু হায়! সে যদি জানত জীবনের সব চাইতে বড় চমকটা সেদিন তার জন্যই অপেক্ষা করছিল।

সন্ধ্যে সন্ধ্যে বাড়ি ফিরে আসে তুষার অফিস থেকে। আহির তুষারের বাড়ি পৌঁছে গেল সন্ধ্যের মুখে মুখে। বেল টিপলো বেশ কবার, কেউ দরজা খুললনা। প্রায় মিনিট সাতেক ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর আহির ক্রমাগত ডোর বেল চাপতে লাগল। তুষার বাড়ি আছে, এই খবরটা গার্ডদের কাছ থেকেই পাওয়া গেছে। তাহলে এতক্ষণ লাগছে কেন দরজা খুলতে?

দরজাটা খুলে গেল। কিন্তু তুষার নয়। দরজা খুললো একটি মেয়ে। কোথায় যেন দেখেছে আহির মেয়েটাকে। খুব চেনা! কিন্তু কে এই মেয়ে? তুষারের বাসায় তার কী কাজ? আহিরকে দেখে মেয়েটা ভালোই চমকালো। মুখে কোনো রা নেই। ঠোঁট দুটো হালকা ফাঁক করে সে অস্ফুট স্বরে বলল, ‘আপনি?’

মাথাটা হঠাৎ টলে উঠল। পায়ের তল থেকে সরে যেতে থাকল মাটি। মনে পড়েছে আহিরের, মেয়েটাকে কোথায় দেখেছে সে। সেই যে যমুনা ফিউচার পার্কে তুষারের সাথে ধাক্কা খেলো, হ্যাঁ, এই সেই মেয়ে! কিন্তু এই মেয়ে এখানে কী করছে? কী করছে এখানে? তুষারের বাসায়? ফাঁকা বাসায়? পেছনে তুষারের মুখখানা দেখা গেল। বিস্ফারিত কন্ঠে তুষার বলল, ‘আহির তুমি!

আহিরের হাত পা কাঁপছিল। কষ্ট হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে। সে ঝড়ের মতো ঘুরে দাঁড়ালো। টল মল পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে থাকল। তুষার পেছন থেকে ডাকছিল, ‘আহির! শুনে যাও, শুনে যাও বলছি!’

কান্নার একটা স্রোত আহিরের, গাল বেয়ে গড়িয়ে গলা ভিজিয়ে দিচ্ছে তখন। তুষার তাকে ঠকিয়েছে! এত বড় ধোঁকা!

২১

ধুপধাপ সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসল অয়ন। ওর পেছন পেছন আয়শা আর দাদীমা। বাবার ঘরটা ফাঁকা। মেঝেতে পড়ে আছে শেকলটা। ঘরের জানালা বন্ধ দরজাও বন্ধ ছিল। কী করে উধাও হয়ে একটা জলজ্যান্ত মানুষ?

অয়ন মাথায় হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। আজ কি তবে সে সত্যিকার অর্থে পিতৃহারা হলো? পাগল হোক অপ্রকৃতস্থ হোক, যেমনি হোক না কেন ওই মানুষটার জন্যই অয়নের বার বার এ বাড়িতে ফিরে আসা। আজ কি তবে এ বাড়ি থেকে তার শেষ পিছুটানটিও নিশ্চিহ্ন হলো?

পুরো বাড়িতে খুঁজে দেখা হলো। বাবা নেই। থানায় জানানো হয়েছে। পুলিশও খোঁজা শুরু করেছে। আয়শা তার নিজস্ব ক্ষমতাবলে প্রায় জনা পঞ্চাশেক লোক এর মাঝেই লাগিয়ে দিয়েছেন তার স্বামীকে উদ্ধারের কাজে। দাদিমা গলা ফাটিয়ে কাঁদছেন। অয়ন শুধু নির্বাক ছিল। এক আকস্মিক নাম না জানা শোক যেন তাকে পাথর করে দিয়েছে।

অনেক রাত অবধিও বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন কাকডাকা ভোর। অয়নের মনে হলো এ বাড়িটির প্রতি তার আসলে আর কোনো দায় নেই। বাবা কোনো একভাবে না থেকেও তার সমস্তটা জুড়ে ছিল। এ বাড়ির প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে শুধু তার বাবারই স্মৃতি। পরিবারটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। কিছু টাকা ছিল দাদীমার কাছ থেকে পাওয়া। তাই নিয়ে বেরুলো সে। খোলা আকাশটা টানছিল তাকে। চার দেয়ালের বন্দী ঘরটায় নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।

২২

আহিরের মুখ খানা দেখে মা চমকে উঠলেন,

— ‘একি! কী হয়েছে তোর?’

আহির কোনো উত্তর না দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। বসার ঘরে আশিক আর তার এক বন্ধু খুব ব্যস্ত হয়ে কিছু একটা করছে। আহিরকে দেখেই আশিক কলকলিয়ে বলে উঠল,

— ‘বুবু, দেখ আমার কম্পিউটার চলে এসেছে, তুষার ভাই পাঠিয়ে দিয়েছে’।

কথাটা শুনে আহির বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলো। চকিতে একবার তাকালো টেবিলের ওপর রাখা জাদুর বাক্সটার দিকে। তার মুখে স্পষ্ট যন্ত্রণার ছাপ ফুটে উঠল। এক ছুটে পালিয়ে গেল নিজের ঘরে। বিছানায় লুটিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে উঠল। আর না! কোনো দিন না! আর কোনোদিন সে কোনো পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করবেনা। ছিঃ! পুরুষ মাত্রই স্বার্থপর, নিষ্ঠুর আর কামুক! এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা! আহির কী বোকা! কী ভীষণ বোকা! সেদিন যমুনা ফিউচার কী পার্কে মেয়েটার সাথে দেখা হবার পরেও কিছুই ঠাওরে উঠতে পারেনি সে। পাপ করেছিল আহির? বিধাতা এ কোন পাপের শাস্তি দিলেন তাকে?

দরজায় ক্রমাগত ধাক্কা পড়ছে। মা ডাকছেন, বাবা ডাকছেন, আশিক ডাকছে। আহির শুনতে পাচ্ছে সবই। কিন্তু নড়তে পারছেনা, কিছু ভাবতে পারছেনা। তার ভেতর বাহিরে, সমস্ত শিরা উপশিরায় এক প্রবল বিদ্রোহের সুর বেজে উঠছে। দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকলো ওরা তিনজন। আহির বালিশে মুখ গুঁজে ছিল। মা এগিয়ে এসে ওর মাথায় হাত রেখে নরম সুরে বলল, ‘কিরে কী হয়েছে? কিছু হয়েছে কি?

আহির নড়লনা। কিছু বলল না। একটু বাদে বাদে শুধু কান্নার দমকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল তার শরীর। মা একটা সময় বাকিদের বললেন, ‘তোমরা একটু এসো তো, আমি দেখছি ওকে’।

বাবাই আর আশিক বাধ্য ছেলের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মা একটু সময় দিল আহিরকে স্বাভাবিক হবার। আহির অবশ্য সে রকম অর্থে স্বাভাবিক হলোনা, শুধু কান্নাটা একটু ধরে আসলো।

— ‘আহির, মা আমার, কী হয়েছে বল তো! তুষারের সাথে আবার ঝগড়া করেছিস?’

আহির উঠে বসলো শোয়া থেকে। মাকে ঘটনাটা খুলে বলতে হবে। না, এত বড় ঘটনা সে চেপে রাখতে পারবে না।

— ‘না, মা ঝগড়া নয়, এবারে সব কিছুই চুকে বুকে গেল, তুষারের সাথে আর আমি নেই’

মা আঁতকে উঠল, ‘কী বলছিস? কেন?’

আহির পুরো ঘটনাটা খুলে বলল। মায়ের মুখটা বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। বেশ খানিক্ষণ মা কোনো কথা বলতে পারলোনা। আহিরের কষ্ট হলো মায়ের জন্য। সে জানে তুষারকে ঘিরেই তাদের পরিবারটা একটা স্বপ্ন বুনতে যাচ্ছিল। বাবা মায়ের স্বপ্ন ছিল আহির তুষারকে বিয়ে করে একটা পরিচ্ছন্ন সংসার করবে।

যে সংসারের অভিধানে অন্তত অভাব বলে কোনো শব্দ থাকবেনা। আহিরের চোখ উপচে জল গড়িয়ে আসলো। আহা! বাবা মায়ের এই একটি স্বপ্ন ও সে পূরণ করতে পারলো না, সংসার যে তার আর কোনো দিন হবেনা, সে যে জীবনে আর কখনো কোনো পুরুষ মানুষকে বিশ্বাস করতে পারবেনা! শেষ হয়ে গেল, সব কিছু শেষ হয়ে গেল।

মা একটা সময় বলল, ‘তুই কী বলছিস? ছেলেটা তোকে এত ভালোবাসতো! সেই ছেলে কী করে এমন করে? হ্যারে, তুই ঠিক দেখেছিস তো?’

আহির কিছু বললনা। ওর চোখ থেকে শুধু কয়েক ফোটা জল গলা বেয়ে বুকে নেমে আসলো।

একটু বাদেই বাড়িতে তুষার এসে হাজির হলো। আহির দরজা খুললনা। মা একবার ডাকতে আসলেন। আহির কঠোর স্বরে শুধু একবার বলল, ‘মা! মরে গেলেও আমি ওই ছেলের সাথে দেখা করব না, তুমি ওকে চলে যেতে বল!’

এরপর তুষার গেল না থাকলো আহির তার কিছুই জানেনা। সে গুম হয়ে বসে রইলো। কতক্ষণ কে জানে, একটা সময় দরজার ওপাশ থকে বাবাইয়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, ‘আহির মা, দরজা খোল!’

বাবাইয়ের মুখটা ভারী শুকনো। আহিরের মন কেমন করে ওঠে। একটা কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠে হৃদপিন্ডের ওপর চেপে বসে। বাবাই বলল, ‘একটু খাবি আয়’।

আহির পাল্টা কোনো কথা না বলে পেছন পেছন এগিয়ে আসলো। ডাইনিং টেবিলে বসে প্লেটে ভাত তুলে নিলো। খাওয়ার পাট-টা চুকে বুকে গেল নির্ভেজাল ভাবেই। রাতে শুতে যাবার আগে বাবাই তার ঘরে ডেকে পাঠালেন আহিরকে।

— ‘বোস মা, আমার পাশে এসে বোস’ আহির বসলো। বাবাইয়ের পাশে মা কায়দা করে বসে পান চিবুচ্ছে। আহির জানে বাবাই এখন যা বলবে তা একটু আগে মা বাবাকে পই পই করে মুখস্থ করিয়েছেন। বাবাই এখন সেই মুখস্থ বিদ্যা খুব ভালোভাবে আওড়াবেন। আহির কান পাতল।

— ‘আমি সবই শুনেছি, তোর মায়ের কাছে শুনলাম, তুষার ছেলেটাও এসেছিল, ওর সাথেও কথা হলো’ এটুকু বলে বাবাই থামল। আহির কিছু বলল না। চোখ দুটো নিচের দিকে নামিয়ে রাখল।

— ‘শোন মা, আমি বলছিলাম কি, ভুল তো মানুষই করে তাইনা? মানুষকে ভুল শোধরানোর সুযোগ দিতে হয়। আর সেই সুযোগটা মানুষই মানুষকে করে দেয়।’

আহির চমকে তাকালো বাবাইয়ের দিকে। নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছেনা তার। এ কথাগুলো বাবাই বলছে? আহির হতবাক গলায় বলল,

— ‘তুমি কী বলতে চাইছ আমি বুঝতে পারছিনা, তোমরা কি বলছ এই এত বড় একটা ঘটনার পরেও আমি ওই ছেলেকে ক্ষমা করে দেই? ওকে বিয়ে করি?’

বাবাই একটু হোঁচট খাওয়া গলায় বলল, ‘না আসলে, ছেলেটা অনেক কান্নাকাটি করেছে, সে বাস্তবিকই তোকে ভালোবাসে’

— ‘অসম্ভব! এগুলো সব ওর নাটক, আমাকেই যদি ভালোবাসতো তাহলে ওই মেয়ের সাথে কী করছিল? সেই প্রশ্ন করোনি তোমরা?’

— ‘মানুষ মাত্রই ভুল করে মা, ক্ষমা করে দিতে হয়, ছেলেটা এমনি মাটির মানুষ, বড় অমায়িক!’

আহির ঘেন্না জড়ানো গলায় বলল, ‘তোমার মেয়েকে যে এভাবে ধোঁকা দিল, তাকে তুমি অমায়িক বলছ! বুঝতে পারছিনা, তুষার কি তোমাদেরকে তাবিজ টোনা করলো নাকি?’

মা এতক্ষণে মুখ খুলল, ‘শোন আহির, তুষারের সাথে আমাদের অনেকক্ষণ কথা হয়েছে, সে নাকে খত দিয়ে বলেছে, এরকম ভুল আর জীবনেও হবেনা,

— ‘আমি বিশ্বাস করিনা, বিশ্বাস ভেঙে গেছে মা, কাঁচের টুকরোর মত ঝন ঝন করে ভেঙে গেছে, আর জোড়া লাগবেনা’

মা এবার একটু ধমকের সুরে বলল, ‘পাগলামো করিস না আহির! এই সম্বন্ধ ভেঙে গেলে আর কোনো ভালো সম্বন্ধ আসবেনা তোর জন্য, আমাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালোনা, তুই তো সব জানিস, তুষারের মতো একটা যোগ্য ছেলেকে পায়ে ঠেলে দিবি, বলি কোন রাজপুত্র অপেক্ষা করছে তোর জন্য?’

— ‘অসম্ভব! এমন দুশ্চরিত্র লোককে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব না’

— ‘সংসারে কয়টা লোক চরিত্রবান হয় শুনি? মেয়েদের জীবনটা এমনই, মানিয়ে চলতে হয়, আর তুষার আমাদেরকে বলেছে মেয়েটা তার আত্মীয়া ছিল। এরপরও তুই এতটা বাড়াবাড়ি কেন করছিস শুনি?’

আহির উঠে পড়ল। মাথার ভেতরটা এলোমেলো লাগছে। কিছু ভাবতে পারছেনা সে। সে রাতে ঘুম হলোনা। খুব ভোরের দিকে আহিরের হঠাৎ মনে হলো, এই পরিবারের মানুষগুলো আসলে প্রকৃত অর্থে তাকে ভালোবাসেনা। সবাই কেবল নিজস্ব চিন্তায় মগ্ন। সমাজের আর দশটা মানুষের মতোই এই পরিবারের মানুষগুলো ও শুধুই সামাজিক। আত্মিক সম্পর্ক বলে আসলে কিছু নেই এদের সাথে তার। তখন কাকডাকা ভোর। আহির একটা ব্যাগে দু’তিনটা কাপড় আর সাতশটা টাকা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। সে জানেনা কোথায় যাবে। শুধু মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে না পারলে সে মরে যাবে।

২৩

ট্রেনটা যখন হেলে দুলে চলতে শুরু করল আহির তখনও জানেনা সে কোথায় যাচ্ছে। বাসা থেকে বের হবার আগে শুধু মাকে একটা চিরকুট লিখে এসেছিল,

— ‘মা, আমি কয়েকটা দিন বাড়ির বাইরে থাকব। এখানে, এই চার দেয়ালের ভেতরে আমার দম আটকে আসছে। কতদিনের জন্য যাচ্ছি জানিনা। কোথায় যাচ্ছি তাও জানিনা তবে কথা দিচ্ছি ফিরে আসব। তোমরা ভালো থেক।

আহির বসেছে জানালার পাশে। মাঘ মাসের সকালের ঘন, পুরু কুয়াশার সাদা চাদর ভেদ করে ট্রেনটা হুইসেল ছেড়ে এগিয়ে চলেছে। জানালা দিয়ে শন শন করে ধেয়ে আসছে হিম জড়ানো শীতল হাওয়া। বহুদিন এমন ভোর দেখেনি সে। নাক, কান, গলা সব ঢেকে ফেলেছে একটা মোটা শাল দিয়ে। শালটা মায়ের। বড় ফুপু গত বছর এনে দিয়েছিলেন কাশ্মির থেকে। মায়ের শাল থেকে একটা মা, মা গন্ধ আসছে। অথচ মা এই শালটা পরেছে খুব কম। তবুও মনে হচ্ছে যেন মাকে খুব কাছ থেকে জড়িয়ে ধরে আছে সে। আহির একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ঘুম থেকে উঠে মা চিরকুটটা আবিষ্কার করার পর কী হবে? খুব ভেঙে পড়বে কি? হাউ মাউ করে কাঁদবে কি? আহির চোখ জোড়া বন্ধ করল। সারা রাত ঘুম হয়নি বলেই হয়তো মাথাটা ধরেছে এখন। কপালের দুপাশের রগ টনটন করছে।

চোখে মুখে একটু পানির ঝাপটা দেবার জন্য ওয়াশরুমের খোঁজে উঠে দাঁড়ালো। বগির একেবারে শেষ মাথায় টয়লেট। হেঁটে অপর বগিতে যাবার প্যাসেজের বাম পাশের দরজাটা খোলা। সাঁই সাঁই শব্দ তুলে ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে ট্রেন। কানে তালা পড়ে যাবার উপক্রম। বাতাসে হেলে দুলে উঠছে ভারী লোহার পাল্লা। দরজার কাছেই একটা লুঙ্গি পরা লোক, দাঁড়িয়ে আছে হাতে বিড়ি নিয়ে। আহির সেখানটায় যাওয়া মাত্র একটা বিশ্রী নজর দিল সে। গা গুলিয়ে উঠল। ভাগ্যিস টয়লেট ফাঁকা পাওয়া গেল। নইলে এই খাচ্চর লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু সমস্যাটা দেখা দিল টয়লেট থেকে বের হবার সময়। ছিটকিনিটা খুলে দরজা টান দিতে গিয়েই দেখা গেল দরজা আটকে গেছ। খুলছেনা। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসল। ট্রেনের দুলুনিতে পা টলছে আহিরের, ঘুরছে মাথা। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লোহার পাল্লাটা খোলার চেষ্টা করছে সে। পারছেনা। হায় খোদা, এখন কী হবে? কী করে বেরোবে আহির? দরজাটা খোলা যাচ্ছেনা কেন? সে প্রাণপনে চেঁচালো কয়েকবার, ‘এই যে! কে আছেন? দরজাটা খুলুন প্লিজ!’

চারপাশে শুধু ইঞ্জিনের সাঁ সাঁ গোঙানির শব্দ। গর্জনের তোড়ে আহিরের কন্ঠস্বর চাপা পড়ে গেল। ঘামতে লাগল সে। ঘন কুয়াশার হিম জড়ানো সকাল বেলায় দর দর করে তার কপাল পেয়ে ঘাম ঝরতে থাকল। চোখ ফেটে গড়িয়ে আসলো জল। একটা সময় সে দরজার হাতল ছেড়ে দিয়ে হত বিহবল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।

কতক্ষণ কে জানে। দরজাটা কেউ একজন খুলল। দরজার বাইরে এক যুবক দাঁড়িয়ে। লম্বা শরীর, গায়ে চাদর জড়ানো। আহির ঝড়ের বেগে বেরিয়ে আসলো। ট্রেনের দুলুনীতে টালমাটাল হলো সে। সামনে দাঁড়ানো মানুষটার গায়ের ওপর প্রায় ছিটকে পড়তে যাচ্ছিল। সামলে নিল নিজেকে। ঘন ভারী নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে সে তাকালো মানুষটার দিকে। তাকানো মাত্রই মনে হলো আগে কোথাও দেখেছে সে মুখটা। এই চোখ জোড়া। মনে হয় যেন এই জন্মে না আর জন্মের কোনো এক সময় এই মানুষটার সাথে ছিল তার গভীর কোনো সখ্যতা!

বিস্মিত নয়নে চেয়ে আছে অয়ন আহিরের দিকে। বাথরুমের দরজাটা বাইরে থেকে আটকানো ছিল। তাই যদি হয়, তাহলে এই মেয়েটা ভেতরে কী করছিল? বাইরে থেকে দোরটা লাগালোই বা কে? আহিরও চোখ জোড়া ছানাবড়া করে অয়নের চোখে চোখ রেখে মুখ হা করে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল।

— ‘ইটস ওকে, কুল ডাউন, আপনি এখন নিরাপদে আছেন, আর ভয় নেই’

অয়ন আহিরকে আশ্বস্ত করতে চাইল। ট্রেনের ঝিক ঝিক গর্জনের মাঝে যদিও অয়নের কথাগুলো অস্পষ্ট শোনালো। আহির কয়েক মিনিট সময় নিয়ে সামলে নিল নিজেকে। ঢুলতে ঢুলতে পা বাড়ালো সামনে, নিরুত্তাপ গলায় অয়নকে বলল,

— ‘দরজাটা কি বাইরে থেকে আটকানো ছিল?’

— ‘হ্যাঁ, আমি তো এসে তাই দেখলাম!’

আহির অবাক হলো। খোলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সিগারেট হাতের লোকটাই কি তাহলে এই কাজ করেছে? কিন্তু কেন? তাকে বাথরুমে আটকে রেখে তার লাভটা কী হলো? কী আশ্চর্য আর বিকৃত মানসিকতা! আহির অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না।

টলমল পায়ে এগিয়ে চলল নিজের সিটের দিকে। পেছনে অয়নও। আহির সিটের কাছটায় এসে আবিস্কার করলো তার বসার জায়গাটা এর মাঝেই দখল হয়ে গেছে। পাশের সিটের মহিলার দশ বারো বছরের বাচ্চাটা পা ছড়িয়ে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে মায়ের কোলে মাথা রেখে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। যেহেতু কোনো টিকেট নেই তাই ওই সিটের মালিকানা প্রমাণ করার কোনো উপায় আহিরের কাছে নেই। ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে তুলে দিতেও এই মুহূর্তে বিবেকে বাঁধছে। মহা ঝামেলায় পড়া গেল!

অয়ন আহিরকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি, কোনো সমস্যা?’

আহির বলতে গিয়েও কিছু বললনা অয়নকে। চুপ করে রইল। অয়নই কথা বলল আবার, ‘কী হলো? দাঁড়িয়ে রইলেন যে? আপনি বসেছেন কোথায়?’

আহির হাত উঁচিয়ে দেখিয়ে দিল। অয়ন সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওহ! আপনার সিট তো দখল হয়ে গেছে!’ ঠিক সেই সময় আহিরের মাথায় ব্যাপারটা ক্লিক করল। এই ছেলে এখন টিকেটের খোঁজ করলেই তো সে পড়বে মস্ত বিপাকে। টিকেট ছাড়া ট্রেনে উঠে পড়ার কারণ কী করে বোঝাবে সে এই ছেলেটাকে? সে জানে তুষারের সাথে এর ভালো যোগাযোগ আছে। হুট করে যদি ফোন দিয়ে তুষারকে কিছু জানিয়ে দেয়? যদিও ছেলেটা বেশ পাগল আছে। আহির শুনেছে এর সাথে কখনো মোবাইল টোবাইল থাকেনা। সর্বদাই সে আউট অফ নেটওয়ার্ক থাকতে পছন্দ করে।

আহির অয়নকে আর ব্যাপারটা নিয়ে না ঘাটাতে দিয়ে নিজেই এগিয়ে গিয়ে মহিলাটির সাথে কথা বলল। মহিলা কিন্তু নির্দ্বিধায় ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে ফেলল। আহির হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ধপ করে বসে পড়ে তাকালো একবার অয়নের দিকে। অয়নের চোখে রাজ্যের ক্লান্তি। খুব আপনজন হারালে মানুষের চেহারায় যেমন একটা চাপা হাহাকার লুকিয়ে থাকে, অয়নের মুখ খানায় সেই হাহাকারটা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়ে আছে। দেখলে মায়া লাগে। আহির গোপনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তুষারের কাছে অয়নের গল্প শুনে মনে হয়েছিল একদিন ছেলেটাকে সামনাসামনি পেলে খুব করে শুনবে ছেলেটার জীবনের গল্পগুলো। কেন সে এতটা ছন্নছাড়া, কেন এই উদাসীনতা? কী এমন ঘটনা ঘটেছে তার জীবনে যা তাকে এমন উদ্ভ্রান্ত করে তুলেছে, কিন্তু হায় আজ দেখা হলো এমন একটা সময়ে, যখন এ পৃথিবীর আর কোনো খবরই আহিরকে ভাবান্বিত করে তুলবেনা। হোক না সেটা যতই চমকপ্রদ। আজ আর কোনো কিছু নিয়েই তার কোনো কৌতূহল নেই। শেষ, সব শেষ। তবুও সে জোর করে একটু হাসলো অয়নের দিকে তাকিয়ে। অয়ন হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে একটু উঁচু গলায় কথা বলল, যেন ইঞ্জিনের শব্দ ছাপিয়ে ওর কথা গুলো আহিরের কান পর্যন্ত যায়, ‘আপনি… আপনি তুষারের গার্লফ্রেন্ড না?’

প্রশ্নটা শোনা মাত্র দপ করে নিভে গেল আহির, ম্লান গলায় বলল, ‘গার্লফ্রেন্ড ছিলাম। এখন আর নেই!’ কথাটা বলেই মনে হলো, যাচ্চলে, এই মুহূর্তে এই তথ্যটা দেবার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। মাঝে মাঝে নিজের বোকামিতে নিজেই অতিষ্ঠ হয়ে যায় সে।

অয়ন একটু ভড়কালো। সে বুঝতে পারলনা এ ধরনের একটা খবর শোনার পরে আসলে কী বলা উচিত! তুষার এই মেয়েটাকে এত বেশি ভালোবাসতো যে খবরটা সত্যি অবিশ্বাস্য ঠেকছে। তা ছাড়া অয়ন যতটুকু জানে মেয়েটাও বেশ সিরিয়াস ছিল এই সম্পর্কটি নিয়ে। হঠাৎ এমন কী হলো? হয়তো সাময়িক ঝগড়া। সে যাই হোক, কারো ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোটা অয়নের ধাতে নেই। সে শুধু একবার বলল, ‘ও!’ এর চেয়ে বেশি কিছু বলার মতো সহজ সম্পর্কও আসলে মেয়েটির সাথে তার নেই। তাই এটুকু বলে থেমে যাওয়াই উত্তম। আহির মুখ ফিরিয়ে নিল জানালার দিকে। এড়িয়ে যাবার চেষ্টা। তুষারের কানে খবর চলে গেলে ঝামেলায় পড়তে হবে। সে চাইছেনা আপাতত কেউ তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করুক।

নতুন একটা দুঃশ্চিন্তা পেয়ে বসলো তাকে। এই ছেলে তুষারকে আবার ফোন করে কিছু বলে বসবে নাতো? নাহ, আর কোনো দুশ্চিন্তা করতে চায়না সে। মুক্তি চায়, মুক্তি! বাইরে কুয়াশায় আবছা দিগন্তের দিকে চোখ রেখে সে আজ মনের মাঝে প্রবল এক মুক্তির আস্বাদ টের পায়। এই মাঘ মাসের কুয়াশা ভেজা ভাঙাচোরা ট্রেনের কামরায় আজ সে মুক্ত, বিহঙ্গ। কিন্তু একা, বড্ড একা। সম্পর্কগুলো থেকে মুক্ত হলেই কি মানুষ সত্যিকারের স্বাধীনতা পায়? সম্পর্কের পিছুটানই কি মানুষকে সর্বদা বন্দী করে রাখে? একটা মানুষ কি কখনো সম্পূর্ণভাবে সকল সম্পর্কের ঊর্ধে যেতে পারে? হয়তো পারে, মানুষ হয়তো মানবিক সম্পর্কগুলো, চাওয়া পাওয়া গুলো অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু পৃথিবীর সাথে যে সম্পর্ক তার জন্ম জন্মান্তরের জন্য হয়ে গেছে সেই সম্পর্ককে কী করে অস্বীকার করবে? পৃথিবীর সাথে মানুষের যে আশ্চর্য বাঁধন, সেই বাঁধনের ঊর্ধে কে কবে যেতে পেরেছে? বাপ মায়ের থেকে পালানো যায়, সংসার ছেড়ে পালানো যায়, এমনকি নিজের থেকে নিজেও পালিয়ে বেড়ানো যায়, কিন্তু এই পৃথিবীকে ধোঁকা দিয়ে পালানোর কোনো সুযোগ নেই। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া। কিন্তু মৃত্যু তো কখনো মুক্তি হতে পারেনা। মৃত্যু মানে সমাপ্তি। সমাপ্তি কি কখনো স্বাধীনতার স্বাদ দিতে পারে? কে জানে! হয়তো মৃত্যুতেই সত্যিকারের মুক্তি মেলে মানুষের অন্তরাত্মার!

২৪

ট্রেনে উঠলেই অয়নকে টইয়া ভূতে পায়। সে এক বগী থেকে অন্য বগীতে অনবরত ঘুরে বেড়ায়। কোথাও স্থির হয়ে বসতে চায়না। আউল বাউল পাগল মনটায় আরো দুটো পাখনা বেশি গজিয়ে ওঠে। ছটফট করতে থাকে। এদিকটায় একটা সিট খালি পেয়ে সে বসলো একটু। ঘড়িতে সকাল সাড়ে ছটা। আকাশ পিঙ্গল। রুক্ষ বাতাসের সাথে ধুলোর মিছিল চারপাশে। অয়ন তবুও জানালা ঘেষে বসলো। বাতাসের ধারালো ঝাপটা ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে হাওয়ায় হাওয়ায় মনের ভার কিছুটা কমে আসছে। কোন লোহার বোঝা যেন কেউ তার বুকের ওপর চাপিয়ে দিয়ে চলে গেছে। একটা সংকেত টের পাচ্ছে অয়ন। মন বলছে বাবা আর ফিরবে না। প্রকৃতি কোনো এক রহস্যজনক উপায়ে মানুষের মনের দুয়ারে কিছু খবর পৌঁছে দেয়। সবাই সেই খবর টের পায়না। এই সুবিশাল প্রকৃতির সাথে মানুষের মনের ভেতরের মনটার কোথায় যেন একটা যোগাযোগ আছে, একটা সম্পর্ক আছে। সেই সম্পর্কটা হঠাৎ হঠাৎ টের পায় অয়ন। আজও পাচ্ছে, বাবা ফিরবেনা, বাবা আর ফিরবেনা কোনো দিনও। কোথায় গেল বাবা? এই অসহায় পাগল অসুস্থ লোকটা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে একা একা?

বুক পকেটে হঠাৎ একটা কম্পন অনুভূত হলো। অয়ন চমকে উঠল। হাত দিয়ে দেখল মোবাইলটা বাজছে। এই ভুলটা অয়ন করলো জীবনে প্রথমবারের মতো। বাড়ি ছেড়ে বেরোনোর সময় কখনো মোবাইল সাথে রাখেনা সে। আজ ঘটনার আকস্মিকতায় খেয়ালই ছিলনা এই যন্ত্রনাদায়ক যন্ত্রটাকে বাড়ি ফেলে আসার কথা। স্ক্রীনে অচেনা নম্বর। অয়ন রিসিভ করল না। টানা অনেকক্ষণ রিং টোন বেজে থামল। ফোনটা সুইচ অফ করতে যাবে ঠিক সে সময়ই স্ক্রীনে ভেসে উঠল একটা মেসেজ। লেখা,

‘প্লিজ, আনসার দা কল, ইমার্জেন্সী! তিয়ানা’

সেকেন্ড না গড়াতেই আবার বেজে উঠল রিং টোন। অয়ন কুঞ্চিত ভ্রু নিয়ে খানিকটা সময় তাকিয়ে থাকল মোবাইলটার দিকে। অনীহা নিয়ে ফোনটা ধরল। কে জানে হয়তো কোনো বিপদে পড়ে ফোন করেছে। ইমার্জেন্সী বলল যেহেতু।

— ‘অয়ন!’

  • ‘হুম তিয়ানা, বলো’

— ‘অয়ন আপনি কোথায়? আমি গত একটা সপ্তাহ ধরে আপনাকে খুঁজছি বাট রিচই করতে পারছিনা আপনাকে, আপনি কী বলুনতো!’

তিয়ানা বড্ড চেঁচাচ্ছে। ট্রেনের শব্দে এমনিতেই কানে তালা লাগার উপক্রম। অয়ন বিরক্ত গলায় বলল,

— ‘হুম’

— ‘হোয়াট হুম? অয়ন? আপনি ভীষণ খারাপ! আপনার বন্ধু আপনাকে খুঁজে চলেছে দিনের পর দিন আর আপনি লাপাত্তা!’

বন্ধু! শব্দটা কানে লাগলো অয়নের। ও হ্যাঁ, তিয়ানা তো তার সাথে কোনো এক রকমের বন্ধুত্ব করেছিল। সেই বন্ধুত্বের দাবীতেই এত বক বক! ওরে বাবা! অয়ন কী বলবে খুঁজে পেলনা। বোকার মতো চুপ করে রইল।

— ‘অয়ন!’

— ‘হুম!’

— ‘আজ বিকেলে মিট করুননা আমার সাথে, প্লিজ!’

— ‘তিয়ানা, আমি ঢাকা ছেড়ে যাচ্ছি আজ, সম্ভব না’

— ‘কী বলছেন? কেন?

— ‘কাজে’

— ‘কী কাজ?’

— ‘উফ! এত প্রশ্ন করছ কেন? তোমার কী হয়েছে তাই বল, দেখা করতে চাইছো কেন?’

তিয়ানা একটু চুপ করে থেকে আহত কন্ঠে বলল,

— ‘আপনার কী হয়েছে অয়ন? ইজ এভরিথিং অলরাইট?

— ‘আবার শুরু হয়েছে পাকামো, তোমার প্রবলেমটা কী বলতো? সরাসরি উত্তর দিতে পারোনা? কী চাই তোমার? কেন মিট করতে চাও?’

— ‘বারে!, বন্ধুর সাথে বন্ধুর কি দেখা করার জন্য কোনো কারণ লাগে? আমার বুঝি আপনাকে দেখতে ইচ্ছে হয়না? আর আপনার? আপনার কি আমাকে কখনো দেখতে ইচ্ছে করেনা?

— ‘উফ! তিয়ানা, কাম অন! আমার কখনো কাওকে দেখতে ইচ্ছা করেনা! ভালোবাসতে ইচ্ছে করেনা, আমি একটা অমানুষ… বুঝতে পেরেছ?

তিয়ানা ওপাশ থেকে কিছু একটা বলল, অয়ন শুনতে পেলনা। শোনার চেষ্টাও করল না। ফোনটা কেটে দিল। এরপর একেবারে সুইচড অফ। উঠে দাঁড়ালো সে। নিজের সিটে ফিরে যাওয়া দরকার। একটু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। ক্ষিদেও পেয়েছে হালকা। পকেটে যে টাকা আছে তা দিয়ে হয়তো দিন পনেরো চলা যাবে। ট্রেনটা যাচ্ছে চিটাগাং। কক্সবাজারের ওই ছোট্ট দ্বীপটা টানছে তাকে। সীমাহীন জলরাশির উপর ভেসে থাকা এক টুকরো দ্বীপ মহেশখালী। অয়নের ভারি পছন্দের জায়গা। অয়ন ফিরে যাচ্ছিল। ফেরার সময় আবার সেই মেয়েটার সাথে দেখা। টিকেট কালেক্টারের সাথে কী নিয়ে যেন বাদানুবাদ হচ্ছে। পাশে বসে থাকা পরিবারটা এখন নেই, খুব সম্ভবত আগের স্টেশনে নেমে গেছে। অয়ন একটু কাছে যেতেই শুনতে পেল, টিকেট চেকার বলছে, ‘আপনি নামবেন কোথায়?’ মেয়েটা ইতস্তত করছে, উত্তর দিতে পারছেনা। লোকটা আবার একই প্রশ্ন করলো, এবার অনেকটা ধমকের সুরে। মেয়েটা ভারী নিষ্পাপ গলায় বলল, ‘এই… এই ট্রেনটা যাচ্ছে কোথায়?’ আসেপাশে যতগুলো কান এই বাক্যটি শুনতে পেল তারা প্রত্যেকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকালো মেয়েটার দিকে। টিকেট চেকার মনে হল একা মেয়েমানুষ বুঝতে পেরে এবার একটু আমোদ আমোদ আঁচ পেতে লাগল। সে হো হো করে ডাকাতের মতো হেসে উঠে বলল, ‘কই যাইতাসেন সেইটাই জানেন না? আপনের মাথা ঠিক আসে তো ম্যাডাম?’ পাশের সিটে বসা কয়েকজন অল্প বয়স্ক ছেলে বিষয়টায় ব্যাপক বিনোদন খুঁজে পেল। একজন বলে উঠল, ‘মেন্টাল হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসেছে নাকি?’ বাকিরা তার কথা শুনে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

— ‘কী ব্যাপার? হচ্ছেটা কী এখানে?’

টিকেট চেকার অয়নের দিকে তাকালো, ‘আপনি কে?’

— ‘আগে বলুন, এখানে হচ্ছেটা কী?’

— ‘কী আর হবে, এই মেয়েটা টিকেট ছাড়া উঠেছে, তার ওপর এটাও বলতে পারছে না যে সে যাচ্ছেটা কোথায়! একলা মেয়েছেলে নিয়ে এখন কী মুশকিলে পড়লাম বলেন!

— ‘এত মুশকিলের কী আছে? উনার কাছ থেকে টিকেটের টাকা নিয়ে নিন এখন, ব্যাস হয়ে গেল তো!’

— ‘না মশাই এত সহজ না, উনি টিকেট ছাড়া উঠে যাবেন, একা একা, শেষে একটা কেলেঙ্কারী ঘটে গেলে দায়িত্ব নেবে কে?

— ‘আপনার অত ভাবা লাগবেনা, উনি একজন প্রাপ্ত বয়স্কা মানুষ, একা নাকি দোকা, সেটা সম্পূর্ণ উনার নিজস্ব ব্যাপার, আপনি টাকা নিয়ে কেটে পড় ন!’

লোকটা মুখ সুঁচালো করে অয়নের দিকে তাকিয়ে সন্দেহের গলায় বলল, ‘কিন্তু আপনি কে? আপনি কি উনার সাথে আছেন? আপনার টিকেট কই, দেখি?’

— ‘আরে, মিয়া আপনি খালি খালি প্যাঁচ করতেসেন কেন, বললাম তো টাকা নিয়ে কেটে পড়েন!’

অয়ন নিতান্তই দেখতে লম্বা চওড়া, সুঠাম দেহী এবং সচরাচর বাঙালী পুরুষদের মতো নয় বলে অপরিচিত লোকেরাও তাকে খানিকটা সমঝে চলে। ভারি গম গমে গলায় দু একটা কড়া কথা বললেই সাধারণ লোকেরা একটু ভয় পেতেও আরম্ভ করে। এই লোকটাও একটু ভড়কালো। আহিরের কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জায়গাটা ছাড়ল। আহির টাকাগুলো দেবার সময় প্রমাদ গুনছিল। বাসা থেকে বের হয়েছে মোটে সাতশো টাকা নিয়ে। এর মাঝে চারশো টাকাই চলে গেল এই টিকেটের পেছনে। কী করে চলবে সামনের দিনগুলো?

আশেপাশের লোকগুলো যারা এতক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে তামাশা দেখছিল এবং নানা রকম মশকরা করছিল, তাদের মধ্যেই একজন বলে উঠল, ‘খাইছে! নায়কের আবির্ভাব!’

আরেকজন বলল, ‘আরে, বয়ফ্রেন্ড মনে হয়, দুইজন মিলা বাড়ি থিকা পালায় আসছে!’

অয়ন দাঁত মুখ খিঁচে শুনছিলো সব আর আহিরের দিকে বেশ কড়া চোখে তাকিয়ে ছিল। আহির অপ্রস্তুত হাসলো সেদিকে তাকিয়ে। অয়ন হাসলোনা। হেঁটে এসে আহিরের মুখোমুখি চেয়ারটায় বসে, মাথাটা আহিরের দিকে ঝুঁকিয়ে এনে চাপা গলায় বলল, ‘কী ম্যাডাম? কেসটা কী?’

আহিরের চুলগুলো হাওয়ার ঝাপটায় বড্ড এলোমেলো হয়ে ছিল। হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে আহির বলল, ‘কই, কিছুনা!’

অয়ন বিরক্ত হলো, ‘কোনো কারণ ছাড়াই না জেনে, না শুনে একটা ট্রেনে উঠে গেলেন? আপনার মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে?’

আহির চুপ করে রইল। দৃষ্টি রাখলো জানালার বাইরে। চারিদিকে ধূলোমাখা সবুজ। শুকনো পুকুর আর খাল। প্রকৃতি বড় জরাজীর্ণ এখন অনেকটা তার নিজেরই মতো। আহির চুল বেঁধে নিয়ে পুরো মাথাটা পরনের চাদর দিয়ে ঢাকলো কপাল পর্যন্ত। মুখের ওপর খেলছে হাওয়ায় তির তির করে কাঁপা শীতের সকালের মিষ্টি রোদ।

— ‘আচ্ছা! আপনার নামটা যেন কী?’

— ‘আহির’

— ‘মিহির?’

— ‘আহির!’

— ‘সরি?’

আহির কটমটে চোখে তাকালো অয়নের দিকে, ‘আপনি সত্যিই বয়রা? নাকি বয়রা সাজার ভান করছেন?’

— ‘না, সিরিয়াসলি! আমি বুঝতে পারছিনা’

আহির এবার কাটা কাটা গলায় বলল, ‘আহির দিলশাদ! অয়ন যেন খুব বোঝা বুঝেছে এমন ভাবে ঠোঁট দুটো গোল করে বলল, ‘ও!’

এরপর একটু থেমে বলল, -’আহির দিলশাদ, কী কিছু বলছেন না যে? আমি কি তুষারকে একটা ফোন করব?

কথাটা কানে ঢোকা মাত্র আহির অগ্নিদৃষ্টিতে তাকলো অয়নের দিকে, উত্তেজিত গলায় বলল ‘কী আশ্চর্য! কেন?

— ‘কেন আবার? আপনি একটা বিপদে পড়েছেন, ওকে জানানোটা কি জরুরী নয়?

— ‘না জরুরী নয়, ভারি অবাক কান্ড! আপনি সেই তখন থেকে তুষার তুষার করছেন কেন বলুন তো?’ অয়ন কী বুঝলো কে জানে। খানিকক্ষণ কিছু একটা চিন্তা করে নিয়ে স্মিত গলায় বলল, ও আচ্ছা! তাহলে আপনার আম্মার নম্বরটা দিন, উনাকে ফোন দিয়ে বলি’

আহির ঝগড়াটে ভঙ্গীতে প্রশ্ন করল, ‘বলবেনটা কী শুনি?’

— ‘বলবো যে আপনার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে, আউলা বাতাসে পাইছে আপনাকে। কিছু না জেনে শুনেই একটা ট্রেনে উঠে পড়েছেন, আপনার সম্মুখে এখন সমূহ বিপদ।’

— ‘কে বলেছে আপনাকে আমার সম্মুখে সমূহ বিপদ? হ্যা? কেন নাক গলাচ্ছেন আমার ব্যপারে?’

অয়ন অপ্রস্তুত হলো, ‘নাক গলাচ্ছি?’

— ‘নয়তো কী?’

— ‘আপনি নেহাত তুষারের গার্লফ্রেন্ড বলেই… ‘অয়ন কথা শেষ করতে পারল না। আহির হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠল, ‘আর একটা বার যদি আপনি তুষারের নাম ধরেছেন তো দেখবেন!

— ‘ওরে বাবা কী দেখবো?’ -’দেখবেন আমি কী করি!’

অয়ন হেসে ফেলল, ‘বুঝেছি, খুব ভালো মতোই ঝগড়াটা বাঁধিয়েছেন, কিন্তু ম্যাডাম! শুনেছি ভালোবাসা ঝগড়া ঝাঁটি আর বিরহ হলে পরেই মজবুত হয়, তাই বলছি, যান বাড়ি ফিরে যান, দু দিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর আমাদের এই দেশটা এখনো মেয়েদের জন্য ততটা নিরাপদ নয়। একা একা এমন উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরবেন তো, হঠাৎ কোনো বিপদে জড়িয়ে যাবেন বলে রাখলাম।’

— ‘দেখুন, আপনাকে কেউ আমার দায়িত্ব নিতে বলেনি। আপনারা পুরুষেরা একলা মেয়েছেলে দেখলেই নিজের সম্পত্তি ভেবে মাতব্বরী শুরু করেন। ঘেন্না হয় আমার!’

অয়ন বিস্মিত হয়ে বলল, ‘সেকি! আপনি তো দেখছি ভীষণ অকৃতজ্ঞ একজন মানুষ! সেধে এসে আপনার উপকার করলাম আর আপনি কিনা মূহুর্তের মাঝেই ভেল্কি দিয়ে পাল্টে গেলেন?’

— ‘উপকার করেছেন তো আমাকে উদ্ধার করেছেন, এবার আসুন প্লিজ!’ অয়ন চট করে উঠে দাঁড়ালো, ‘এ জন্যই লোকে বলে, মেয়েদের উপকার করতে নেই!’

অয়নকে উঠতে দেখে পাশে বসে থাকা এক দঙ্গল ছেলেগুলোর ভেতর থেকে কেউ একজন উঁচু গলায় বলে উঠল, ‘প্রেম শেষ? আহ, নায়ক তো সুবিধা করতে পারল না!’

আরেকজন বলল, ‘নায়িকা মেন্টাল পেশেন্ট হলে যা হয় আর কী! যাক তাও ভালো, এবার আমরা একটু চান্স নিয়ে দেখবো, যদি লাইগা যায়!

কথাগুলো কানে যেতেই অয়নের পায়ের গতি একটু শ্লথ হলো। পেছন ফিরে আহিরকে দেখলো একবার অয়ন। কপাল অবধি মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে গুটিশুটি হয়ে বসে আছে সে। পেছন থেকে আবার কে যেন শিস দিয়ে গান গেয়ে উঠল, ‘একা একা কেন ভালো লাগে না….’ অয়ন দাঁড়িয়ে পড়ল। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসল। শরীর রি রি করে উঠল রাগে। ক্রুর চোখে তাকালো দলটার দিকে, চেঁচিয়ে বলল, ‘কী সমস্যা?’

ছেলেগুলো হাসি থামাল না। অয়নের কথা খুব একটা পাত্তা দিল বলেও মনে হলো না। একজন শুধু বলল, ‘ব্রাদার, রাগ করেন কেন? আমরা জাস্ট একটু মজা করছি!’

— ‘এগুলো কোন ধরনের মজা শুনি?’ অয়ন উত্তেজিত। আহির একটু তটস্থ হয়ে গেল। সে জানে এই ছেলেটা রেগে গেলে ভয়ংকর কান্ড করে বসে। ইন্টারভিউর দিনের ঘটনাটা তার সম্পূর্ণ মনে আছে। আবার সেরকম কিছু করে বসবেনা তো? এখানে ওই ছেলে গুলোর দল ভারী। কিছু একটা গোলমাল লেগে গেলে অয়নের একার পক্ষে সামলানো মুশকিল হবে। আহির চট করে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে এসে অয়নের পেছনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আহ! এদের সাথে কথা বলে লাভ নেই, চলুন তো, সামনে চলুন!’

অয়ন অন্য লোকের কথা কদাচিৎ শোনে। তার স্বভাবটাই ঘাড়ত্যাড়া। নিজে কিছু করবে বলে ঠিক করলে তা করেই ছাড়ে। কিন্তু আজকে সে আহিরের কথাটা শুনলো। সত্যি এসব ছিঁচকে ছেলেপেলের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে কোনো লাভ নেই ক্ষতি ছাড়া। আর যেহেতু আহির বিপদটা টের পেয়ে নিজেই উঠে এসেছে, সুতরাং আপাতত চিন্তার কিছু নেই। অয়ন পা বাড়ালো। ট্রেইনের দুলুনীতে অতটা জোরে হাঁটতে পারছিল না ওরা। হাঁটার পেসেজটা নিতান্তই সরু। দুজন মানুষ পাশাপাশি হাঁটলে গায়ে গা লেগে যায়। আহির তাই অয়নের পেছন পেছন হাঁটছিল।

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ২৫

২৫

ট্রেনটা চট্টগ্রাম স্টেশনে এসে যখন থামল, বাইরে তখন রূপো রঙের দুপুর তেজী রোদ আর ধূলোমাখা বাতাস। স্টেশন জুড়ে মানুষের কোলাহল। কুলিদের ছুটোছুটি। বেঁচে থাকার তাগিদে দুরন্ত গতিতে ছুটছে এই পার্থিব জীবন! সারাটা পথ অয়ন আহিরের সাথে আর কোনো কথা বলেনি। আহিরও না।

দুজন দুজনের নিজস্ব চিন্তায় বুঁদ হয়েছিল। ট্রেন থেকে নামার পর আহির শুধু একবার বলল, ‘চললাম!’

— ‘তা চললেন কোথায়?’

—’দেখি!’

অয়ন চোখ কপালে তুলে বলল, ‘শুনুন, আপনি নিজেকে যতটা স্মার্ট মনে করেন, ততটা স্মার্ট আপনি নন, তাই বলছি, ফিরে যান। আহির কিন্তু এবার রাগলো না। দুর্বল গলায় বলল, ‘আসলে, আমি কটা দিন বাড়ির বাইরে থাকব’।

— ‘বেশ ভালো কথা, তা থেকে আসুন না কয়েকটা দিন আপনার কোনো রিলেটিভের বাড়িতে, খোলা রাস্তায় নেমে পড়লেন কী বুঝে?’

আহির একটু অপ্রস্তুত হলো – ‘আপনি… আপনিও তো নেমেছেন খোলা রাস্তায়’

— ‘ম্যাডাম!, আমার রাস্তায় ঘুরে ঘুরে অভ্যাস আছে,আপনার যে এক বিন্দুও অভ্যাস নেই, তা ট্রেনের ভেতরে যেভাবে আমার সাথে জোঁকের মতো লেগে ছিলেন তাতেই বুঝেছি, এখন প্ল্যানটা কী বলুনতো? আমার পিছু ছাড়ছেন নাকি ছাড়ছেন না?’

— ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’

— ‘কক্সবাজার’

— ‘বাহ!’ নিজের অজান্তেই শব্দটা বেরিয়ে গেল আহিরের ঠোঁট দিয়ে।

— ‘খুব লোভ হচ্ছে বুঝি? জি না, আমি আপনাকে নিতে পারব না, আর তাছাড়া আমার কিছুর ঠিক নেই, আমি হয়তো চলতে চলতে রাস্তায় রাত পার করে দেবো, এমনকি ফুটপাতেও শুয়ে পড়তে পারি!’

— আমিতো একবারও বলিনি আমি আপনার সাথে যেতে চাই! নিজেকে যে কী ভাবেন আপনি! উফ!

আহির কথাটা শেষ করে পা বাড়ালো। ছেলেটা কী ভাবছে কে জানে। মান সম্মান বলতে কিছু আর রইল না তার। কোথাও না কোথাও একটা জায়গা হয়ে যাবে। এ পৃথিবীই তার আশ্রয়। সুবিশাল পৃথিবীর বুকে আহির কয়েকটা দিন নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াবে। সময় দেবে নিজের ভেতরের নিজেকে।

— ‘আহির দিলশাদ!’ পাগলটা ডাকছে। শুধু আহির না, আহির দিলশাদ। কেউ তাকে কখনো পুরো নাম ধরে ডাকেনা। একটু চমক লাগল আহিরের। ঘুরে দাঁড়ালো।

— ‘কী?’

—আমার এক কাজিনের বাসা আছে এখানে, আন্দরকিল্লায়, আপনি চাইলে ওখানে আপনার থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’

— ‘হুম’

— ‘হুম মানে কী? কথা বলুন!’

— ‘ওকে’ বলে ভারী লজ্জা হলো আহিরের। ইশ! নিজেকেই নিজের কাছে বোঝা বলে মনে হচ্ছে।

আন্দরকিল্লা অয়নের কাজিনের বাসায় এসে দেখা গেল বাড়ি খালি। তারা ব্যাংকক গেছে। অয়ন এবার সত্যি ভীষণ বিরক্ত হলো, ‘ধ্যাত! শালারা আর ব্যাংকক যাওয়ার টাইম পাইলোনা।’

আহিরের মুখ খানা দুশ্চিন্তায় ছোট হয়ে গেল। টাকা পয়সা কিছু সাথে নেই, সব মিলিয়ে তিনশো টাকা ব্যাগে আছে। থাকার জায়গা নেই, কোনো গন্তব্য নেই, আহির যাবে কোথায়, থাকবে কোথায়? খাবে কী? এতটা অসহায় সে কেন হলো? বোকার মতো কিছু না বুঝে শুনেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে যে কী পাগলামোটা করলো সে! অয়ন আহিরের দিকে তাকিয়ে ছিল কুঞ্চিত ভ্রু,

তীক্ষ্ণ চোখ নিয়ে। আহির সেই দৃষ্টির সামনে আরো বেশি সংকুচিত হয়ে যাচ্ছিল। তার চোখ ফেটে জল গড়িয়ে আসছিল। অনেক কষ্টে সামলে নিল সে। অয়ন হঠাৎ সুর পাল্টে বলল, ‘যাই হোক, চলুন, কিছু খাওয়া যাক, পেটের ভেতর ছুঁচো দৌড়াচ্ছে।’

ওরা একটা রেস্তোরায় এসে বসলো। দুপুর বেলার প্রচন্ড ভিড়। একটা টেবিল খালি পাওয়া গেল। অয়ন অর্ডার দিল, ভাত, ডাল আর মুরগীর মাংস। আহির ওয়াশ রুমে এসে হাত মুখ ধুয়ে নিল। তার চোখে মুখে রাত জাগার ক্লান্তি। চুল হয়ে আছে ধুলো আর বাতাসের সংস্পর্শে আঠালো। এক বিচ্ছিরি অবস্থা। তবুও মনে হচ্ছে এই ধকলটার প্রয়োজন ছিল। এই যে এই সংকটময় মুহূর্তটা তো কিছুটা সময়ের জন্য হলেও ভুলতে সাহায্য করছে তার জীবনে মাত্র ঘটে যাওয়া বিশ্রী ঘটনাটাকে। এই বা কম কী?

আহির এসে দেখল খাবার চলে এসেছে। অয়ন গোগ্রাসে গিলছে। পাঞ্জাবির হাতা কুনুই পর্যন্ত গুটিয়ে নিয়ে বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে। পুরুষ মানুষদের গপ গপ করে খেতে দেখলে আহিরের খুব বিশ্রী লাগে, সে তার বাবাইকেও বলে প্রায়ই কথাটা, ‘বাবাই, ধীরে ধীরে খাও, অত তাড়াহুড়োর কী আছে? কেমন রাক্ষসের মতো লাগছে!’ বাবাই হাসে, বলে, রাক্ষসের মতো না খেলে খাবার আনন্দ আছে নাকিরে? বাবাইয়ের কথা মনে পড়তেই বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠল, কী করছে এখন ওরা?কেমন আছে? অয়নও ঠিক রাক্ষসের মতোই খাচ্ছে। আহির মনের অজান্তেই বেশ গম্ভীর গলায় বলে ফেলল, ‘বাপরে বাপ!’ অয়ন খাওয়া থামিয়ে আহিরের দিকে নির্লিপ্তভাবে তাকালো একবার, কী হলো?’

— ‘নাহ কিছুনা!’

— ‘মনে হলো, বিদ্রূপ করলেন!’

— ‘না না, বিদ্রূপ করবো কেন?’

অয়ন আবার খাওয়া শুরু করল, ঝড়ের গতিতে। আহির নাক কুঁচকে তাকালো একবার অয়নের দিকে। অয়ন বলল, ‘খেয়ে নিন, খেয়ে নিন, আবার কখন খেতে পান ঠিক নেই, যাযাবর জীবনটা অত সহজ নয় খাবার দেখলে ফকিরের মতো গলা পর্যন্ত খেয়ে নিতে হয়, যাতে অনেকক্ষণ পর্যন্ত পেটে থাকে।’

আহিরেরও বেশ ক্ষিদে পেয়েছিল। তবুও অয়নের মতো গপগপ করে খেতে পারছিল না সে। একটু ভাত নিয়ে অনেকক্ষণ নাড়াচাড়া করছিল। রুচি নেই মুখে। অয়ন খুব মনোযোগ দিয়ে খাওয়া শেষ করল। তৃপ্তির সাথে একটা ঢেকুর তুলে বলল, ‘কী ঠিক করলেন?’

— ‘কী বিষয়ে?’

— ‘করবেনটা কী? ফিরে যাবেন নাকি আমার পিছে পিছেই ঘুরবেন’

— ভাবছি… এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেই নি

— ‘তাড়াতাড়ি ভাবুন, ঐ যে বললাম, যাযাবর জীবনটা অত সহজ নয়। আমি যাব কক্সবাজারের একটা দ্বীপে মহেশখালী, সেই দ্বীপে যেমন মানুষ আছে, সাপ খোপও আছে। জঙ্গলে শেয়াল আছে। খাওয়া দাওয়ার ঠিক থাকবেনা, রাতে থাকার জায়গা থাকবেনা। খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হতে পারে…’

— ‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’

—ঠিক তা নয়, বাস্তব সম্পর্কে আইডিয়া দিচ্ছি, আর তার চেয়েও জরুরী কথা হলো আমি ভীষণ একা থাকতে পছন্দ করি, আসলে একা থাকার জন্যই বাড়ি থেকে এরকম হুট হাট বেরিয়ে পরা, আমি চাইনা কেউ আমার সাথে সারাক্ষণ জোঁকের মতো লেগে থাকুক, আর এবার আমার মনটা বিশেষ খারাপ, আমি হয়তো আর কোনদিনও বাড়ি ফিরবো না।’

শেষের কথাটা খুব লাগল আহিরের, বলল,

— ‘হ্যাঁ, আমার তো আর কাজ নেই আপনার সাথে জোঁকের মতো লেগে থাকব!’

— ‘আপাতত তো আপনার আর কোনো কাজ দেখছিনা আমি’, অয়ন বলল অকপট ভাবে।

আহিরের মুখ খানা বেলুনের মতো চুপসে গেল। ঠান্ডা ভাতগুলো নাড়তে নাড়তে ভাবতে লাগল সে। বাড়ি ফিরে যাবার পর আসলে কী ঘটনাটা ঘটতে পারে? বাবাই আর মা ভীষণভাবে ক্ষেপে আছেন তার ওপর। হয়ত আহিরকে ফিরে পেয়ে তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবেন তবে সব কিছু কি ঠিক আগের মত হবে? আর তুষার? তুষারকে নিয়ে বাবা মায়ের আদিখ্যেতা কি কমবে? নাকি জোর করে তুষারের সাথে বিয়ের পিঁড়িতে বসানোর তোর জোড় শুরু করবে? সেই গদবাঁধা জীবনে ফিরে যাওয়া, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কষা। স্বপ্নগুলোকে চোখের সামনে মুখ থুবড়ে নিঃশেষ হতে দেখা! কিন্তু এর বাইরেই বা আছে কী? এই যে সুবিস্তৃত আকাশের নিচে হাজার হাজার মানুষের মিলেমিশে ঘুরপাক খাওয়া, হরেক রকম জীবিকায়, আশায়, মতলবে! কারণে অকারণে আমরণ ছুটে চলা! কোথাও প্রাণের তাগিদ নেই, কেবল প্রয়োজনের তাগিদ। কোথায় যাবে আহির? কী করবে? কোথায় গেলে একটু স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলবে সে?

আহির খেতে পারল না কিছুই ঠিক মতো। ঝুটা হাত নিয়েই বসে রইল বেশ খানিক্ষণ গুম হয়ে। অয়ন হঠাৎ ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠল, ‘মাই গড! আপনি আবার সুইসাইড করার কথা ভাবছেন না তো?’ আহির শুন্য দৃষ্টিতে অয়নের দিকে তাকালো, ‘আমার অত সাহস নেই’।

অয়ন আহিরের চোখ দুটোতে কী যেন খুঁজে নিয়ে বলে, ‘থাক, আপনাকে এখনই ফিরতে হবে না, থাকুন আমার সাথে, বাট বিরক্ত করবেন না একদম, অযথা কথা বলবেন না।’

২৬

অয়ন ভারি বাজে রকম একটা পরিস্থিতিতে পড়েছে। সে বুঝতে পারছেনা মেয়েটা আসলে কী চাইছে। বোঝা যাচ্ছে তার জীবনে এমন কিছু একটা ঘটেছে যা কিনা তাকে মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে তুলেছে। কিন্তু এর দায় কেন অয়ন নেবে? এ কথা সত্য তার এই এতটুকু জীবনে যেখানে সুযোগ পেয়েছে সে অপরকে সাহায্য করেছে। অন্যকে সাহায্য করার একটা সহজাত প্রবৃত্তি তার ভেতরে আছে। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। জাগতিক কোনো কিছুতেই তার আর মন বসছেনা। এ জীবনটা তার কাছে বোঝা হয়ে গেছে। যতক্ষণ আছে শুধু গাধার মতো টেনে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। এমন একটা সময়ে এ কেমন তর ঝামেলা তার কাঁধে এসে পড়ল? তার ওপর মেয়েটা তুষারের বান্ধবী। তুষার ছেলেটা এক কথায় চমৎকার। নম্র-ভদ্র, এ যুগে এরকম ছেলে পাওয়াই যায়না। মেয়েটার যদি কিছু হয়ে যায় সে তুষারকে কী জবাব দেবে?

ওরা একটা নন এসি বাসে উঠেছে। গন্তব্য কক্সবাজার। দুজন পাশাপাশি বসেনি। আহির সামনের দিক থেকে তিন নম্বর সিটে বসেছে আর অয়ন পেছন দিকের সিটে। দুপুর গড়িয়ে গেছে তখন। শেষ মাঘের মিষ্টি রোদ রাস্তা জুড়ে সোনালী পাটি বিছিয়েছে। ধুলো মাখা গাছের পাতায় হাওয়ার নাচন। পাশে এক বয়স্ক ভদ্রলোক বসেছেন। ভদ্রলোক মোবাইলে কথা বলায় বেজায় ব্যস্ত। বাসে ওঠার পর থেকেই তার মোবাইলে একটার পর একটা ফোন এসে যাচ্ছে। তিনি কথা বলে যাচ্ছেন। এই লোকের বকবকানির জ্বালায় অয়ন ঘুমাতে পারছেনা। সে ভেবেছিল বাসে উঠে একটা ঘুম দেবে। ঘুমোলে মাথার ভেতরে অনবরত কিলবিল করতে থাকা হরেক রকম দুশ্চিন্তার পোকাগুলোও ঘুমিয়ে পড়ে। তার নিজের চাইতেও ওদের ঘুমটা বেশি জরুরী। অয়ন জানালা দিয়ে মাথা বের করে রুক্ষ আকাশটাকে দেখছিল। পাশের লোকটা হঠাৎ অয়নকে কুনুই দিয়ে একটা গুঁতো দিয়ে বলল, ‘আপনাকে ডাকছে’ অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলো আহির দাঁড়িয়ে আছে। চুল আলুথালু, ঠোঁট শুকনো।

— ‘একটু শুনুন!’

— ‘বলুন!’ অয়নের পাশেই বয়স্ক ভদ্রলোক বসা। আহিরের কথা বলতে হচ্ছে ওই লোককে ডিঙিয়ে। আর অয়ন সেখানে বসে থেকেই কথা শোনার জন্য কান পেতে দিয়েছে। আশ্চর্য ছেলে!

— ‘আহা, শুনুন না!’

–‘বলুন না!’

— এভাবে নয়, ইয়ে, একটু গোপন কথা’

অয়ন অবাক হলো। কী আবার অত গোপন কথা! মতলবটা কী মেয়েটার! সে পাশের লোকটার দিকে তাকিয়ে বেশ ইনোসেন্ট গলায় বলল, ‘আঙ্কেল! কাইন্ডলী আমার সিটে এসে বসবেন, জাস্ট কিছুক্ষণের জন্য’।

ভদ্রলোক কোনো বাক্যব্যয় না করে উঠে পড়লেন। অয়ন এ পাশের চেয়ারে এসে বসতেই আহির অয়নের গা ঘেষে দাঁড়িয়ে মুখটা যতটা সম্ভব ওর কানের কাছে নিয়ে খুব আস্তে করে বলল, ‘শুনুন, বাসটা কি কোথাও থামাবে? আমার একটু ওয়াশরুমে যাওয়া দরকার’

অয়ন এহেন আশ্চর্য কথা যেন জীবনে শোনেনি। ঠোঁট দুটো হা হয়ে গেল তার, চক্ষু চড়কগাছ। ঠোঁট দুটো অনেক কষ্টে নেড়ে বলল, ‘আমি এখন ওয়াশরুম কোথায় পাব?’

— ‘ইশ! আস্তে বলুন না! লোকে শুনবে তো!’ অয়ন একবার ‘ও’ বলে আশেপাশে দেখে নিয়ে গলাটা খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘ওয়াশরুম কোথায় পাব?’

— ‘দেখুনতো ড্রাইভারকে বলে, আমার বাবাইয়ের সাথে লং জার্নিতে বের হলে, এসব কোনো সমস্যাই হয়না, বাবাই কী করে যেন ম্যানেজ করে ফেলেন।’

অয়ন ভারি বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমি আপনার বাবা নই, আর আমি পারব না এসব করতে, আপনি ওয়েট করুন, খুব বেশিক্ষণ লাগবেনা, পৌঁছে যাবো’।

— ‘কতক্ষণ লাগবে?’

— ‘ঘন্টা দেড়েক’

আহির কিছু বলল না। নড়লও না জায়গাটা থেকে। অয়ন মিনিট দেড়েক পর বাধ্য হয়ে উঠে দাঁড়াল। কী বলল সামনে গিয়ে কে জানে একটা পেট্রোল পাম্পের সামনে বাস থামল। আহির নামল, সাথে অয়নও।

— ‘আগেও বলেছি, যাযাবর জীবনে অনেক সমস্যা, এইসব শৌখিন টয়লেট সমস্যা কাটিয়ে উঠুন, নইলে সারভাইভ করতে পারবেন না।’

— ‘দেখা যাবে, সারভাইভ করতে পারি কী পারিনা, সময়ই বলে দেবে, আপনি অত পক পক করছেন কেন?

— ‘পক পক করছি কারণ এটা একটা বিগ প্রবলেম, আপনি যেখানে সেখানে বলে বসবেন, ওয়াশরুম চাই, না আমি তো অল দা টাইম আপনাকে এইসব প্রোভাইড করতে পারব না! আহির একটু লাল হলো,

— ‘আপনি লোকটা কিন্তু ভারি অসভ্য!’

—আপনারা মেয়েরা ছেলেদের অসভ্য ডাকতে খুব ভালোবাসেন তাই না? একটা কৌতুক আছে না? এক মেয়ে তার বান্ধবীকে প্রশ্ন করল, এই ছেলেরা কী নিয়ে কথা বলেরে? বান্ধবী উত্তর দিল, কী নিয়ে আবার, আমরা যা নিয়ে কথা বলি, তাই নিয়ে, মেয়েটা আঁতকে উঠে বলে উঠল, ছি ছি! ছেলেরা কি অসভ্য!

আহির হেসে ফেলল। ঝিলিক মারল ওর গজদাঁত। অয়নের মনে হলো এই মেয়েকে সে এর আগে কখনো হাসতে দেখেনি। সে খুব সহজে মুগ্ধ হয়না। জন্মগত ভাবেই তার মুগ্ধ হবার ক্ষমতা কম। কিন্তু হাসলে মেয়েটাকে ভালো দেখায়। অয়ন তাকিয়ে ছিল। তার চোখে কিছু একটা ছিল, মুগ্ধতা না ভালো লাগা কে জানে!

২৭

সমুদ্র টানছিল। আহির সমুদ্র দেখেনা বহুদিন! উত্তাল সীমানাহীন সমুদ্রের বুকে স্পীডবোটটা সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছিল, সূর্য ডুবতে বসেছে। লালিমায় ঘেরা আকাশের প্রতিচ্ছবি বিস্তৃত সমুদ্রে। বাতাস বন্য। আহির এক অদ্ভুত দুরন্ত ভালোলাগায় বুঁদ হয়ে ছিল। শুধু ছুটে চলার মাঝে এত তীব্র আনন্দ! এভাবেই, হ্যাঁ এভাবেই সে এক ছুটে পালিয়ে যেতে চাইছিল ওই জীবনটা থেকে। মনে হচ্ছে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে সাথে, স্পীড বোটের ঝাঁকুনির সাথে, একটা একটা করে কষ্টগুলো খুলে খুলে পড়ে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে নোনা জলে। আহ! জীবন এখানে বড় সুন্দর! যে জীবনে সে শুধু নিজের জন্যেই নিঃশ্বাস নেবে। নিজের কথাই ভাববে। প্রয়োজন নয়। জীবিকা নয়। স্বার্থ নয়। শুধু মনের দাবীতে এই বেঁচে থাকা।

এটা রাখাইন পল্লী। বড় ছিমছাম, সুন্দর আর সাধারণ। ছোট একটা গ্রাম কিন্তু তার মাঝে যে এত প্রাণের প্রাচুর্য। অয়ন বলেছিল কোথায় থাকবে, কী করে রাত কাটাবে, কী খাবে তার কোনো কিছুরই ঠিক নেই। সেই শর্তেই রাজি হয়েছিল আহির। কিন্তু এই পাহাড়িয়া দ্বীপে এসে, শহুরে যান্ত্রিকতা কে অনেক দূরে ফেলে এসেও মাথার ওপর একটা ছাদ পেয়েছে সে। একটা টিনের চালার ঘর, পাহাড়ের গা ঘেঁষে। একটি ছোট পরিবার। বাবা মা এবং এক মাত্র মেয়ে নূড়ি। মেয়েটি দুর্দান্ত রূপবতী। পাতলা ছিপছিপে দেহ, কাঁচা হলুদ গায়ের রং, লম্বা রেশমী চুল। লম্বাটে মুখে নাক, চোখ খুঁতনি সব যেন তুলি দিয়ে আঁকা। নাকটা একটু ছোট, পাহাড়ীদের যেমন হয় আর কী! কোনো প্রসাধন নয়, সাজ পোশাকের আড়ম্বর নয়, শুধু একটা লুঙ্গি আর টপ পরে আছে তবুও কী অপূর্ব লাগছে! অয়নকে কী করে যেন এরা চেনে। আহিরকে নিয়ে যখন এখানে আসলো মেয়েটা ভারি অবাক হয়ে বলল, ‘বাবু বিয়ে করলেন নাকি?

অয়ন চমকে ওঠা গলায় বলল, ‘না! না!… উনি, উনি এই গ্রামে একটা কাজে এসেছেন, একটা দুটা দিন থাকবেন এখানে, তোমাদের জায়গা হবে?’ সুন্দর করে গুছিয়ে বলল অয়ন। বিশাসযোগ্য মনে হলো।

— ‘হ্যাঁ, তা হবে’

আহির চোখ ঘুরিয়ে দেখলো, জায়গা আর তেমন কী। ছোট দুটা ঘর। একটায় চকি বিছানো, অন্যটায় মাদুর। দারিদ্রতার ছাপ ষোলো আনা স্পষ্ট। বাইরে বাঁশ দিয়ে তৈরী করা একটা বারান্দা আছে কিন্তু ওটাতে তাঁতের তৈরী বস্ত্র আর উলের শীতকালীন পোশাক দিয়ে বোঝাই। এটাই বোধহয় ওদের জীবিকা নির্বাহের উপায়। কুপি বাতি জ্বলছে। সারা ঘরে একটা ধুপজ্বালা গন্ধ। কত অপ্রশস্ত, অনাড়ম্বর অথচ কত মনোরম!

আহির গোসল সেরে কাপড় পাল্টে নিল। একটা সুতির সালোয়ার কামিজ। গায়ে জড়ালো মায়ের মোটা উলের শালটা। শহরে শীত প্রায় পালাতে বসেছে। কিন্তু এখানে টের পাওয়া যাচ্ছে মাঘ মাসের প্রকোপ। অয়ন আহিরকে রেখে সেই তখন যে পালালো আর দেখা নেই। ছেলেটা বড় অদ্ভূত! মাটির চুলায় ভাত চড়ানো হয়েছে। সবজি রাঁধার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। বাড়ির পুরুষ সদস্যটি নিতান্তই অলস প্রকৃতির। সন্ধ্যে থেকে নাক ডেকে ঘুমোচ্ছে। আহির মাদুরের ওপর বসে ওদের কাজ দেখছিল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল কে জানে। দু চোখের পাতা জুড়ে রাজ্যের ঘুম চেপে বসলো। ঘুম ভাঙ্গলো রাখাইন মেয়েটির ডাকে, ‘দিদি, খেতে আসেন’। আহির হকচকিয়ে উঠল। উঠার পর একটু সময় লাগল সব কিছু মনে পড়তে। যখন মনে পড়ল, তখন না চাইতেও ভাবনাটা মাথায় এসে গেল, বলল, ‘উনি? উনি কোথায়?’

— ‘দাদার কথা বলছেন? ওনার কোনো ঠিক নেই। রাতে ফিরতে পারেন, নাও ফিরতে পারেন, কিন্তু আমি জানি, উনি কোথায় আছে’।

মেয়েটা রহস্যময় হাসে। আহির সন্দেহের গলায় প্রশ্ন করে?’ কোথায় আছেন?’

— ‘পাহাড়ের ওপরে, মন্দিরের পাশে’

— ‘কী করে জানলে?’

— ‘উনি যতবার আসেন, সেই জায়গাটায় বসেই রাত কাটান, কেমন যেন অদ্ভুত মানুষ, কোনো ভয় ডর নেই। ‘

— ‘তা, উনি কি প্রায়ই আসেন এদিকটায়?’

— ‘এর আগে আরো তিনবার এসেছেন, প্রথমবার আসলেন ওনার এক বন্ধুর সাথে, ওনার বন্ধুর সাথে আমাদের বিজিনেস ডিল ছিল, এখান থেকে তাঁতের জিনিস লটে নিয়ে যেতেন তিনি।’

— ‘ওহ, তাই বল’

— ‘আপনি যাবেন?’

— ‘কোথায়?’

— ‘পাহাড়ের ওপর?

আহির না করতে পারল না, ‘হ্যাঁ যাব, তুমি নিয়ে যাবে আমায়?’ মেয়েটা মিষ্টি হাসলো, ‘খেয়ে নিন, তারপর নিয়ে যাচ্ছি’।

পাহাড়টির নাম মৈনাক পাহাড়। কুয়াশায় সাদাটে ভূত হয়ে আছে চারপাশ। এর চুড়োয় আদিনাথ মন্দির। পাহাড়ের গা কেটে সাপের মতো হয়ে ওপরে উঠে গেছে সিঁড়ি। এক পাশে কাটা আধখানা পাহাড়ের মাটির শরীর। অন্যপাশে বন্য ঝোপ। ঝোপ জঙ্গলে ভরা পথটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে অনেক নিচ পর্যন্ত। নদীর কাছাকাছি।

অন্ধকারের একটা নিজস্ব ভাষা আছে, আলো আছে। সেই আলোয় পথ চেয়ে চেয়ে ওরা উপরে উঠছিল। কোথাও কোনো শব্দ নেই, শুধু অবিরাম ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক আর পাতায় পাতায় টুপ টুপ করে শিশির ঝরার ফিসফিসানি বাতাসে উড়ছে হিম। হাড় কাঁপানো শীত। আহিরের মনে হলো জোনাকী থাকলেই ষোলো কলা পূর্ণ হতো, কিন্তু শীতকালে যে জোনাকী জ্বলেনা। আরো খানিকটা ওঠার পর মন্দিরের ঘরটা উঁকি দিল। এই রাত্তির বেলায়ও স্থানীয় লোকজন মন্দিরে ঘুরঘুর করছে। কেউ পূজো করছে, বাইরে বসে গান করছে। শ্বেতপাথরে বাঁধানো পরিচ্ছন্ন সিঁড়ি। আহিররা ওদিকে গেল না। মন্দিরটা ফেলে একটা সরু রাস্তা ধরে এগোলো ওরা। পাহাড়ের ওপরে একটি সোনালি মাথার গম্বুজ। তার চারিপাশে চারটি সিংহমূর্তি রাজকীয় ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারেও তাদের গাম্ভীর্য টের পাওয়া যায়। আহিরের ঠিক সেই সময় হঠাৎ চোখ পড়ল, ওমা একি! আকাশ ভরা তারা!! এত তারার মেলা সে জীবনে কোনো দিন দেখেনি। মনে হচ্ছে পুরো আকাশটা ভেসে যাচ্ছে নীলচে আলোর ঝলকানিতে!

২৮

“আর কি হবে এমন জনম, লুটবি মজা মনের মতন
বাবার হোটেল ভাঙবে যখন, খাবি তখন কার বা শালে।”

অয়ন গুন গুন করছিল শিশির ভেজা ঘাসের ওপর বসে। গায়ে একটা লেদারের জ্যাকেট পরা আছে। তবুও হিম হাওয়া শরীরে ঢুকে পড়ে কামড় বসাচ্ছে। বাবার হোটেল ভাঙবে যখন, খাবি তখন কার বা শালে…. বাবার হোটেল ভেঙে গেছে, সে এখন কার শালে খাবে এটি একটি গভীর চিন্তাযুক্ত ব্যাপার। বেঁচে থাকলে পেট পূজো করতেই হবে। না খেয়ে থাকার চাইতে আত্মহত্যা করে মরে যাওয়া ভালো। এই মুহূর্তে যদি অয়ন এই পাহাড়ের ওপর থেকে লাফ দেয় তাহলেই ল্যাঠা চুকে যায়। এপার আর ওপারের মাঝে জীবন মরণের তফাৎ। কিন্তু এই তফাৎটা অতিক্রম করতে কয়েক সেকেন্ডও লাগেনা। জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে হরেক রকম ভান ভণিতার রঙে মোড়ানো এই ঠুনকো জীবন। কোনো মানে নেই এ জীবনের। আজ যদি সে স্মৃতি ভ্রষ্ট হয়, তাহলে কী করে জানবে যে সে কে, কার ছেলে, কী বা তার পরিচয়?

তবে এ পৃথিবী তার বড় প্রিয়। মানুষগুলোর সাথে আজও তার বন্ধন মজবুত হলোনা, কিন্তু এই তারা ভরা আকাশ, বন্য পাহাড়ি গন্ধ, দূরদূরান্ত অবধি বিস্তৃত হয়ে পড়ে থাকা লোনা জলের সমুদ্র, আঁকা বাঁকা বয়ে যাওয়া নদী, ডানা ঝাপটানো গাংচিলের শব্দ! রাতের গায়ে টুপ টুপ করে পড়া শিশিরের অস্তিত্ব, ভর দুপুরের মিষ্টি রোদে পাতি চড়ুইয়ের ঝগড়া, এই সবকিছুর সাথে যে তার আত্মার বন্ধন, জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন! এই বন্ধন ছিন্ন করার সাহস যে এখনো হয়নি!

ঘাসের ওপর কারো পায়ের চলার শব্দ শোনা গেল। এদিকটায় খুব একটা কেউ আসেনা। রাখাইন মরদরা জঙ্গলের ভেতর গিয়ে শীতের রাতে আগুন জ্বালিয়ে মদ খায়। গান ধরে, মাদল বাজায়। এইপাশটা নিরিবিলি বলে অয়নের বেশ পছন্দ।

— ‘কী করছেন?’ আহির প্রশ্নটা করতে করতে ঘাসের ওপর অয়নের পাশে বসলো। কথাগুলো নিঃশব্দ বনস্থলীতে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে যেন প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার ক্রমাগত ডাক ছাড়া চারপাশে আর কোনো শব্দ নেই তখন।

— ‘এইতো, কিছুনা’

— ‘দুঃখিত, কথা দিয়েছিলাম আপনাকে বিরক্ত করব না, তবুও চলে আসলাম বিরক্ত করার জন্য।

অয়ন একটু ফ্যাকাসে হাসলো, ‘কিন্তু জানলেন কী করে আমি এখানে আছি?’

— ‘ঐ যে, মেয়েটা নিয়ে এলো, নুড়ি নাম’

— ‘ও’ এটুকু বলেই অয়ন চুপ হয়ে ঝিম মেরে গেল। এখন ভাঙা চাঁদ উঁকি দিচ্ছে।

একটা পাতলা নীলচে আলো আকাশ থেকে নেমে এসে কুয়াশার সাথে মিশে গেছে। রাত তেমন গভীর নয়, তবুও পাহাড়ের বুক চিরে রাত্রির গভীর নিঃশ্বাস। আহির শাল মাথায় তুলে দিয়ে কান ঢেকে আপ্লুত কন্ঠে বলল, ‘এত তারা একসাথে আমি কোনো দিনও দেখিনি জানেন?

—হুম

— ‘আপনাকে একটি ধন্যবাদ দিতে চাই, নেবেন?’ অয়ন চোখ তুলে তাকালো আহিরের দিকে। এই প্রথম কেউ তার কাছ থেকে ধন্যবাদ দেবার জন্য অনুমতি চাইলো। ব্যাপারটা দারুণ তো! এভাবে আগে কখনো ভাবা হয়নি। আমরা কেন ধন্যবাদের বোঝাটা সর্বদা অপর লোকে না চাইলেও ঘাড়ে চাপিয়ে দেই?

— ‘যদি না নেই?’

— দেব না’

অয়ন হাসলো, ‘এখন নয়, পরে কোনো এক সময় দিয়েন। এই মুহূর্তে ধন্যবাদটি রাখার কোনো জায়গা নেই। কিছু ধন্যবাদ ডিলিট করে একটু স্পেস খালি হলে পরে আপনার ধন্যবাদটি নেব।’

— ‘ফান করছেন?’

— ‘বাহ, আপনি ধন্যবাদ দেবার জন্য পারমিশন চাইতে পারবেন, আর আমি একটু ফান করতে পারব না, তা কি হয়?’

— ‘না ব্যাপারটা আসলে একটু অন্যরকম, আপনি মানুষটা তো অদ্ভুত। তাই ভাবলাম না বলে কয়ে একটা ধন্যবাদ দিয়ে দেবার পর যদি আপনি আবার বিরক্ত হয়ে যান, ফিরিয়ে দেন বা বেঁকে বসেন, তখন আমিই ইনসাল্ট ফিল করব। তাই অনুমতি চাইলাম।’

ওপাশের জঙ্গলে, যেদিকটায় মাটি উত্রাই হয়ে নেমে গেছে বাঁকখালী নদীর কাছাকাছি, সেইদিকটায় কিছু একটা সরে যাওয়ার আওয়াজ হলো। শুকনো পাতা মড় মড়িয়ে উঠল। আহির চকিতে তাকালো। এখন কেউ নেই। অন্ধকারে সাদা কুয়াশার ভেতর শুধু গাছের ডাল নড়ছে।

— ‘মেয়েটা এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল।’

— ‘কোন মেয়ে?’

— ‘নুড়ি’

— ‘ওহ!’

— ‘খুব সম্ভবত সে আমাদের কথা শোনার চেষ্টা করছিল। আমার সাথে আপনার সম্পর্ক নিয়ে তার মনে একটি ক্ষীণ সন্দেহ দেখা দিয়েছে’

অয়ন হাসলো। আহির অন্ধকারে না দেখেও সে হাসিটা কী করে যেন টের পেল।

— ‘মেয়েটা দেখতে কিন্তু দারুণ! এত সুন্দর মেয়ে আমি কদাচিৎ দেখেছি’

— ‘তাই নাকি?’

— ‘হ্যাঁ তাই তো! কেন আপনার মনে হয়নি?’

— ‘আসলে ওভাবে নোটিস করিনি কখনো। আর যেহেতু নজরে আসেনি তার মানে সৌন্দর্যটা তেমন নজর কাড়া নয়’

— ‘কী যে বলেন? এতো স্নিগ্ধ একটা রূপ আপনার নজর কাড়লোনা? আপনার কি মন বলে কিছু নেই?’

— ‘There is no exquisite beauty… without some strangeness in the proportion…’

— ‘কী যে বলেন, আবোল তাবোল, বুঝিনা, সে যাই হোক, আপনি সারাক্ষণ অত কী ভাবেন বলুন তো?’

অয়ন হাসে, গুনগুন করে-

“ভবরঙ্গে থাকি মজে, ভাব দাঁড়ায় না হৃদয় মাঝে।
গুরুর দয়া হবে কিসে, দেখি ভক্তিবিহীন পশুর ছন্দ।
মনের হলো মতিমন্দ…
তাইতে হয়ে রইলাম আমি জন্ম- অন্ধ”

— ‘আপনি রহস্য করতে খুব ভালোবাসেন তাইনা?’

— ‘চারপাশে এত এত রহস্য, নতুন করে আর কী রহস্য করব বলুন? এই যে এই জায়গাটায় এর আগে কত রাত কাটিয়েছি একদম একা, শুধু ভাবনার ভেতর ভাবনা মিশিয়ে দিয়ে, অথচ আজকে আপনি আমার পাশে, অন্য কেউ নয়, চেনা কেউ নয়, কোনো বন্ধু নয়, আত্মীয় নয়, আপনি, যেই আপনাকে আমি কোনদিনই চিনতাম না… যেই আপনি আমার পাড়ার ছোট ভাইয়ের বান্ধবী, আপনার সাথে কি আমার এইখানটায় দেখা হওয়ার কথা ছিল কখনো? এটাও কি একটা রহস্য নয়?’

— ‘আত্মার সাথে আত্মার যোগ ঘটলেই তো আত্মীয়, তাইনা? সে অর্থে কে কখন কার আত্মীয় হয়ে যায় তার তো কোনো ঠিক নেই’

— ‘এটা ভালো বলেছেন, তবে তা বড় কঠিন ব্যাপার।

আহির হঠাৎ অন্য রকম গলায় বলে, ‘জানেন, এ জায়গাটা না ভারি মায়াবী, কেমন স্বর্গের মতো লাগছে, ভালো কিছু দেখলে, ভালো কিছুর সংস্পর্শে আসলেই আপনজনের কথা মনে পড়ে, বাবাই আর মায়ের ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি, অথচ এই মুহূর্তে ওদের ভীষণভাবে মিস করছি, মিস করছি আমার ছোট ভাইটিকেও।’

— ‘তাই?’

— ‘হ্যা, আপনারও কি এমন হয়?’

অয়ন একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার জীবনটা আসলে ঠিক আর দশজনের মতো স্বাভাবিক নয়, আমি মানুষটাও স্বাভাবিক নই’

— ‘ওটা আপনার স্টাইল, খুব স্বাভাবিক আছেন আপনি, নিজেকে অস্বাভাবিক ভাবতে ভালোবাসেন শুধু’।

অয়ন চমকে তাকালো আহিরের দিকে। কেউ কখনো এভাবে বলেনি তো! অন্ধকার কুয়াশায় আহিরকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কী ভাবছে, কী দেখছে তার কিছুই বোঝা যায়না। অয়ন সেই ঝাপসা আহিরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কথাটা আপনি খারাপ বলেননি, তবে হান্ড্রেড পার্সেন্ট সত্য নয়। আসলে এভাবে থাকতে থাকতে এই জীবনটায় অভ্যস্থ হয়ে গেছি, অন্য কিছু আমার ধাতে আসেনা’

— ‘আপনি আপনার বাবাকে মিস করেন, তাই না?’ কথাটা বলেই আহির বাতাস গিলল, এই যা, প্রশ্নটা একটু ব্যক্তিগত হয়ে গেল।

অয়ন বিস্মিত গলায় বলল, ‘আপনি কী করে জানলেন?

— ‘তুষার বলেছে, আপনার বাবা নেই, হারিয়েছেন ছোট বেলায়’

— ‘না, কথাটা ভুল, হারিয়েছি ঠিক, কিন্তু ছোটবেলায় নয়, একদিন আগে ত ‘কী বলছেন? আমি শুনেছি আপনার বাবা মারা গেছেন বহু বছর আগে’

— ‘লোকে তাই জানে, এটাই জানানো হয়েছে তাদের’

আহির বাতাসে রহস্যের গন্ধ পায়, উদ্বেগ নিয়ে বলে, ‘কিন্তু কেন?

অয়ন কী যেন গভীরভাবে চিন্তা করে। তারপর চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বলে ‘আমার বাবা পাগল’

— ‘মানে?’

— ‘হুম, পাগল, বদ্ধ উন্মাদ, গেল শুক্রবারে শেকল খুলে ফেলে কী করে যেন পালিয়ে গেল, কোথায় গেল কে জানে! সম্পূর্ণ নিখোঁজ।’

— ‘ওহ! সরি!’

—না সরি হবার কিছুই নেই, আসলে এই কথাটা আমি আজ অবধি কাউকে কখনো বলিনি, কিন্তু আজকে এই খোলা আকাশের নিচে বসে, প্রকৃতির এত কাছাকাছি এসে, এত বিশুদ্ধতায় ডুবে গিয়ে, আপনি যখন প্রশ্নটা করলেন, কেন যেন না বলে থাকতে পারলাম না’

আহির স্তিমিত গলায় বলল, এতটা খারাপ অবস্থা হলো কী করে? ট্রিটমেন্ট চলছেনা?’

—প্রথম দু বছর ট্রিটমেন্ট কাজে এসেছে। আমার জানা মতে সে ক্ষেত্রে কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু দু বছর পর ডাক্তার বলে দিলেন আর আশা নেই। মেন্টাল হসপিটালে রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন। আমি রাজি হইনি। বাসায় একজন ডাক্তার নিয়ম করে আসতেন। শেষ দিকে, তিনিও আসা বন্ধ করে দিলেন।’

— খোঁজ লাগান, অসুস্থ মানুষ কোথায় আর যাবেন? ঠিক খুঁজে পাবেন দেখবেন?

— ‘আমার মন মাঝে মাঝে আমাকে কিছু সিগন্যাল দেয়, আমি সিগন্যাল পাচ্ছি, বাবা আর ফিরবেন না’ অয়নের গলাটা এই প্রথম একটু ভারী শোনালো আহিরের কাছে।

আহির কী বলবে খুঁজে পেল না। কারো বাবা বেঁচে থেকেও হারিয়ে গেলে, না থাকলে কেমন লাগে তা তার জানা নেই। তার বাবাই আছে, মা আছে এরপরেও তাদের ফেলে আহির এত দূরে না বলে কয়ে চলে আসল। তারা শুধু তাদের মেয়ের একটি সুনিশ্চিন্ত ভবিষ্যত চাইছিল এটাই কি তাদের দোষ? বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল আহিরের। কিন্তু একটা দুশ্চরিত্র, লম্পট লোকের সাথে আহির যে কোনো দিনও ভালো থাকবেনা, যে ছেলে প্রথম জীবনেই এত বড় একটা ধোঁকা দিয়ে ফেলল সে সারাটা জীবন কী করে সুফী হয়ে থাকবে বাবা মায়ের মনে এই প্রশ্নটা কেন একটিবারের জন্যও উঁকি দিল না? তুষার যে আহিরকে কত বড় সর একটা ধোঁকা দিল, বিশ্বাস নিয়ে খেলল, এই অপরাধের কি কোনো শাস্তি হবেনা?

আহির হতবিহবল হয়ে প্রশ্ন করে, ‘আর মা? আপনার মা কোথায়? মাকে ফেলে চলে আসলেন যে? বলে এসেছেন?’

অয়ন কাঠ কাঠ গলায় বলল, ‘আমার কোনো মা নেই’

— ‘সে কী! আমি তো শুনেছি আপনার মা ভীষণ ক্ষমতাধর মহিলা, আর হ্যাঁ, আমি যতদূও জানি আপনার মায়ের অফিসেই ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম, যেখান থেকে আপনি তাড়িয়ে দিলেন, মনে আছে?’

— ‘হ্যাঁ মনে আছে’

— ‘সে মহিলা তবে কে হন আপনার?’

অয়ন মুচকি হাসে, বরফ শীতল গলায় বলে, ‘কেউ না! পেটে ধরলেই কি মা হওয়া যায়?’

— ‘কী বলছেন অয়ন? কী বলছেন আপনি?’ আহির বিস্মিত

—কি বলছি?’

— ‘যে মানুষটা আপনাকে দশ মাস পেটে ধরে এই পৃথিবীর আলো দেখালেন! সেই মানুষটা আপনার কেউ হয়না? কী করে বললেন এ কথাটা? অন্যায়, এ ভারি অন্যায়!’

— ‘পৃথিবীর আলো দেখানোই যদি সবটা হয়, তবে আলোটা চোখে প্রবেশ করার সাথে সাথে গলা টিপে মেরে ফেলল না কেন?’

— ‘আপনি ভুল করছেন।’

— ‘আপনি সবটা জানেন না

— ‘জেনে থাকলেও আমি এই কথাটিই বলব, আপনি ভুল করছেন। নিজের মা কে নিয়ে কেউ এমন কথা বলে?’

— ‘ওই মানুষটা ঠান্ডা মাথায় আমার বাবাকে খুন করেছে। বাবার এই অবস্থার পেছনে শুধু ওই একটা মানুষই দায়ী।’

— ‘আপনার বাবা বেঁচে আছেন অয়ন, তাকে খুন করা হয়নি’

অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার ভেতর একটা কেমন ঘোর কাজ করছে। চিরকাল সে ঘন্টার পর ঘন্টা নিজের মনের সাথে কথা বলে। সে নিজেই তার নিজের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। অন্য কারো সামনে সে এতটা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মুখ খোলেনা কখনো। আজকে কী হলো? সামনে বসা মানবীটি কি তার মনেরই প্রতিচ্ছবি? এই অনুভূতি তার জীবনে প্রথম। মনে হচ্ছে ভেতর থেকে তার নিজেরই একটি অংশ বুঝি বের হয়ে সামনে বসে আছে। সেই অংশের সাথে অনায়াসে সব কথা বলা যায়।

— ‘ছোটবেলায় মাকে জড়িয়ে ধরে না ঘুমোলে আমার ঘুম হত না রাতে। কিন্তু মা শুধু ওই রাতের বেলার সময়টুকুতেই আমার ছিল। বাকি সময়গুলো মা ছিল বাইরের জগতের জন্য বরাদ্দ। উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা দাদাভাইয়ের রাজপ্রাসাদ তুল্য বাড়িটার মালিক হয়েছিলাম। সুবিশাল বাড়িটির কারণেই আমরা ছোট বেলা থেকে নিজেদের বড়লোক বলে জানতাম। দাদিমা তখন ফুপুর সাথে অস্ট্রেলিয়ায় থাকতেন। রোজ খাবার টেবিলে আমরা শুধু দুটা মানুষ খেতে বসতাম, আমি আর আমার বাবা। আমার ছোট বোনটির তখন বছর তিনেক বয়স। সে বেশ সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ে। তাকে খাওয়ানোর দায়িত্বটিও ছিল আমার বাবার। মা নামক মানুষটা বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত এগারোটা কী বারোটা বেজে যেত। তিনি তখন চাকরি করতেন একটি প্রাইভেট ফার্মে। এত রাত অবধি তার কী কাজ থাকত তা আমার বাবা কখনো জানতে চেয়েছিলেন কিনা আমি জানিনা। ছুটির দিনগুলোও তার কাজকর্ম আর অফিসিয়াল মিটিং দখল করে রাখত। আমার মনে পড়েনা মায়ের হাতের বানানো কোনো চমৎকার খাবারের কথা কিংবা কোনো একটা স্মৃতিময় দিন, যখন সারাটাদিন আমি আমার মায়ের কোল দখল করে ছিলাম।

বলতে কী আমার বাবা মানুষটা একটু বোকা সোকা ছিলেন। নানাজান হয়তো দাদাভাইয়ের এককালের প্রভাব প্রতিপত্তি দেখেই আমার মাকে বিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু পরবর্তিতে সে প্রতিপত্তি আর কোনো কাজে আসেনি। বাবার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম ছিল। দু একবার ব্যবসা করতে গিয়ে ধরা খেলেন। এত বড় ফ্যামিলির ছেলে হয়ে যেখানে সেখানে চাকরি করার মানসিকতাও হয়ে উঠল না। সারাদিন ঘরে বসা। কিন্তু এর বাইরে আমার বাবা মানুষটি ছিলেন চমৎকার। পুঁথিগত বিদ্যা না থাকলেও তার জ্ঞানের ভান্ডার ছিল সমৃদ্ধ। তিনি আমাকে শিখিয়েছিলেন এ জগতে সবচাইতে বেশি দাম হলো একজন ভালো মানুষের, একটা ভালো মনের আর একটি প্রাণখোলা হাসির। তিনিই প্রথম শিখিয়েছিলেন আশেপাশের মানুষগুলোর বাইরেও বিশেষ কিছু আপনজন আমাদের সর্বক্ষণ ঘিরে রেখেছেন, যেমন: লালন সাঁই, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ।’

অয়ন অনেকগুলো কথা একসাথে বলে থামল। অন্ধকারে কথা বলার একটু সুবিধা আছে। অপর জনের মুখ দেখা যায়না, মুখের অভিব্যক্তি বোঝা যায়না। অনায়াসে সব কথা বলা যায়। আহির নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল। কটা বাজে কে জানে। ঘড়ি নেই ওদের কাছে। আধুনিক যান্ত্রিক বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ দূরে ওরা এখন। একটা তিতির ডাকছিল আশেপাশের কোনো একটা ঝোপ থেকে।

— ‘তারপর?’ আহির বলল হালকা ভাবে।

— ‘ধীরে ধীরে বাবাই আমার সবটা হয়ে গেল, বাবা, মা, বন্ধু, সব! আমরা দু ভাইবোন বলতে গেলে বাবার কাছেই বেড়ে উঠেছি। মা শুধু রোজ সকালে স্কুলে যাবার সময় বেশ কিছু উপদেশ দেয়া ছাড়া আর কোনো ধরনের দায়িত্ব পালন করার প্রয়োজন বোধ করতেন না। আমার এ নিয়ে কোনো আফসোস ছিল না। বরং স্কুলে একটু উঁচু ক্লাসে ওঠার আগ পর্যন্ত আমার ধারনা ছিল বুঝি এটাই নিয়ম, বাবারা ঘরে থাকবে, ঘরের কাজ করবে আর মায়েরা বাইরে। কিন্তু একটু বড় হবার পরেই ভুলটা ভাঙ্গতে লাগল। একটু একটু করে আমি বুঝতে শিখলাম আমাদের পরিবারটা আসলে ঠিক আর দশটা পরিবারের মত নয়। মায়ের চাকরিতে তখন উন্নতি হচ্ছে। আমরা দু ভাইবোন ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়া শুরু করেছি, ভালো খেতে শুরু করেছি, ভালো পরছি, বাজারের সবচেয়ে দামী খেলনাটা আমাদের বাড়িতে আসছে। উইকেন্ডে দামী রেঁস্তোরায় ডিনার করছি। কিন্তু মায়ের বাইরের জগৎটা দিনকে দিন আমার চক্ষুশূল হয়ে উঠতে লাগল। বাবার কোনো বিকার ছিল না। একদিন আর না পেরে বাবাকে বলেই ফেললাম, তুমি কেমন মানুষ, তোমার বউ সারাদিন বাইরে থাকে আর তুমি ঘরে বসে ডিম পারো, নিজে কিছু করলেও তো পারো। বাবার মুখটা সেদিন দেখার মতো হয়েছিল। আমার কাছ থেকে এ ধরনের কথা শুনবেন এটা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি। বাবা কিছু বললেন না। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম আমার ওই কথাটা বাবাকে সেদিন থেকে ভেতরে ভেতরে কুরে কুরে খেতে লাগল।

ঘটনাগুলো ঘটলো খুব দ্রুত। মা চাকরী ছেড়ে ব্যবসা ধরলেন। যেখানে হাত দিচ্ছেন সোনা ফলাচ্ছেন। মায়ের কৃতিত্বে সবাই গর্বিত। গর্বে আটখানা হয়ে আমার দাদীমা দেশে ফিরে আসলেন। সব কিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু কেউ জানলোনা, কেউ দেখলোনা মা যতবেশি বাইরের পৃথিবীর হতে লাগল, বাইরের লোকের সাথে যতটা তার সংযোগ বাড়তে থাকল, আমার সাথে তার দূরত্বটাও ততটাই মজবুত হতে থাকল। একদিন এক কান্ড ঘটলো। আমার তখন এ লেভেল এক্সাম চলছে। বিদেশ থেকে মায়ের বায়ার এসেছে। সেই দুপুরে আমাদের বাড়িতে তাদের নেমন্তন্ন। দুজন বিদেশী ভদ্রলোক এবং একজন বাংলাদেশী। বাংলাদেশী ভদ্রলোক বেশ নামকরা। টিভিতে প্রায়ই তাকে বিভিন্ন টকশোতে দেখা যায়। তা যা হবার ছিল তাই হলো, অতিথিরা বাড়িতে এসেই বাড়ির কর্তাটির খোঁজ করলেন। আমি আর বাবা একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিলাম। মা তার জীবনের সব চাইতে নিষ্ঠুরতম কাজটা বোধহয় সেদিন করলেন। মুখের ওপর বলে বসলেন, ‘তিনি নেই’। বাংলাদেশী ভদ্রলোক মুখ দিয়ে অস্ফুট শব্দ করে বললেন, ‘ওহ! সরি, সরি!’

বাবা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সেই প্রথম বাবার মুখে আমি অপমানের রেখা দেখতে পেলাম। এত বড় একটা বয়স্ক লোক আমার চোখের সামনে শিশুর মতো লজ্জায় লাল হয়ে গেলেন। আমার শিরা উপশিরায় সেই পাগলাটে শুয়োপোকার কামড়টা সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম। রাগে আমার গা জ্বলতে থাকল। অতিথিরা চলে গেলে সরাসরি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, ‘তুমি মিথ্যে বললে কেন?’ আমার চোখে চোখ না রেখে বলল, ‘প্রয়োজন ছিল’ আমি দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললাম, ‘কী প্রয়োজন শুনি?’ সে চিৎকার করে বলে উঠল,

— ‘তোমাকে বলতে বাধ্য নই আমি!’ আমার সামনে একটা জার্মান কাচের দামী ফুলদানী সাজানো ছিল। প্রচন্ড রাগে আমি সেই ফুলদানিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিলাম। টের পেলাম আমার ভেতরে একটা বন্য আক্রোশ তিলে তিলে জমা হয়ে মহীরুহর আকার ধারণ করেছে। এবারে ধ্বংস অনিবার্য। বেরিয়ে গেলাম বাড়ি ছেড়ে। সেই প্রথম বারের মতো। তিন চারদিন এখানে সেখানে ঘুরে যখন বাড়ি ফিরলাম, তখন আর বাবাকে আগের মতো পেলাম না। বাবা কেমন আবোল তাবোল হয়ে গেছেন। সারা বাড়ি একা একা ঘুরে বেড়ান। নিজের মনে কথা বলেন। হঠাৎ হঠাৎ ভয়ে চিৎকার করে উঠে সারা বাড়ি মাথায় তোলেন। বছর দুয়েক এভাবেই চলল, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকল পাগলামো।’

একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস অয়নের বুক চিরে বেরিয়ে এলো, ‘এবার বলুন? আমার বাবার এই অবস্থার পেছনে কে দায়ী? এটা কি খুনের চাইতে কিছু কম?’

আহির অনেকক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। একটা সময় অয়ন অধৈর্য হয়ে বলে উঠল, ‘কথা বলুন!’

— ‘দেখুন অয়ন, হাতের পাঁচটা আঙুলতো সমান হয়না। সবার মাকেই যে এক রকম হতে হবে, সাংসারিক হতে হবে, ঘর কুনো হতে হবে এমনতো কোনো কথা নেই। আপনার মা হয়ত স্রোতের বিপরীতের একজন। কিন্তু তিনি যা কিছু করেছেন সবটাতো আপনাদের দু ভাই বোনের জন্যই করেছেন তাইনা? আপনার বাবা যা করতে পারেননি মা তাই করে দেখিয়েছেন। একটু পজিটিভলী নিন না ব্যাপারটা! ক’জন মহিলা পারেন এমন সফল হতে বলুন?’

— ‘আমি যে এত সফল মা চাইনি। একজন রক্ত মাংসের সত্যিকারের মা চেয়েছিলাম। যে মা ঘরে থাকে বলেই ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে।

— ‘আমি শিওর, আপ্লুনার মা আপনার জন্য আজও ঘরে বসে অপেক্ষা করছেন, আপনি শুধু বুঝতে পারছেন না, আপনি… আপনি ভুল বুঝছেন’

অয়ন তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো, ‘এখন আর কোনো কিছুতেই কিছু আসে যায়না, ওই মানুষটার জন্য আমি আমার বাবাকে হারিয়েছি, আমার ছেলেবেলা হারিয়েছি, আজকে আমার পুরো জীবনটা ওলট পালট হয়ে গেছে।’

মন্দিরের ওপাশটায় কারো চলাচলের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আহির একটু সচকিত ভঙ্গীতে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘কে?’

— ‘কে আবার, হয় মনুষ্য, নয় সাপ খোপ বা বেজী’

— ‘সাপ?’

— ‘হ্যাঁ সাপ, সাপ অবশ্য নিঃশব্দে চলাচল করে, সাপ কখন আসবে আপনি তা টেরও পাবেন না’

আহির ভয় খেলো এবার। ঢোঁক গিলে বলল, ‘আপনি… আপনি শুধু শুধু আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন’

— ‘মোটেও না, এই জংলার ভেতরে সাপ আছে, সাপ আছে মন্দিরের ওদিকটায়, জঙ্গলের ভেতর শেয়ালও আছে। হঠাৎ হঠাৎ তাদের মর্জি মতো বেরিয়ে আসে’।

কথাটা শোনা মাত্র আহির সচেতন ভঙ্গীতে এপাশ ওপাশ তাকাতে লাগল।

অয়ন বলল,

— ‘ভয় পাচ্ছেন কেন, বাড়ি ঘর সব ছেড়ে ছুঁড়ে দিয়ে চলে এসেছেন, মরলেই কী আর বাঁচলেই কী?’

— ‘তাই বলে… তাই বলে সাপের কামড় খেয়ে মরতে হবে?’

অয়ন এবার শব্দ করে হেসে উঠল। ঘোর ঘন পাহাড়ি বন্য রাতে সেই হাসি গায়ে কাঁটা ধরায়। ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল সে। ভেজা শিশির শরীরে লাগতেই গা শিরশিরিয়ে ওঠে। জোরে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘আরে ম্যাডাম! ভয় টয় বাদ দিন, ওপরে বিস্তৃত আকাশ আর নিচে আপনি প্রকৃতির সাথে মিশে আছেন। আজকে প্রকৃতির মতোই আকাশের সাথে আপনার দিগন্তজোড়া সম্পর্ক। এই অনুভূতির কোনো তুলনা হয়না।’

আহির কিছু বলল না। সে জানে এমন রাত হাজার বছরে একটা আসেনা। অন্তত তাদের শহুরে যান্ত্রিকতার ভেতর তো এহেন আকাশ পাওয়া দুর্লভ। কিন্তু তার যে বড় সাপের ভয়। এই ছেলেটা এত কিছু থাকতে সাপের নাম ধরতে গেলো কেন? ভয়ে আঁট সাঁট হয়ে বসে রইল আহির। অয়ন চোখদুটো প্রসারিত করে আকাশে হীরের টুকরোর মতো জ্বলতে থাকা তারা গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল-

টুইঙ্কেল টুইঙ্কেল লিটল ষ্টার, হাও আই ওয়ান্ডার হোয়াট ইউ আর! জেন টেইলর যখন ১৭৮৩ সালে এই ছড়াটা প্রথম লিখেছিলেন তখন অবধি পৃথিবীর মানুষ আকাশের তারা দেখে মুগ্ধ হতো, ছোট শিশুরা চমকিত হতো, এখন আর হয়না! যত দিন যাচ্ছে আমাদের আশ্চর্য হবার, মুগ্ধ হবার ক্ষমতা কমছে। সে যাই হোক, আহির দিলশাদ, আপনার গল্পটা শোনা হলো না।’

আহির একটু নড়ে চড়ে বসলো, বলল, ‘কী আর বলব, আপনার বন্ধুর কীর্তি- কলাপের কথা।’

— ‘আমার বন্ধু?’

— ‘হুম, তুষার।’

— ‘ও, তুষার আমার বন্ধু নয়, পাড়ার ছোট ভাই, বয়সে বছর দুয়েকের ছোট হবে।’

— ‘ওই হলো’

—কী করেছে সে?’

আহির একটু সময় নিয়ে কথাগুলো নিজের মনে সাজালো। তারপর খুলে বলল সবটা। অয়ন শুনে বিস্মিত,

— ‘তুষার এমনটা করেছে! কী বলছেন আপনি? বাট আমি তো দেখেছি সে আপনার জন্য কতটা ডেডিকেটেড ছিল, কী করে সম্ভব!’ আহির কথাগুলো বলতে গিয়ে শেষেরদিকে কেঁদে ফেলেছিল। অয়ন থতমত খেয়ে উঠে পড়ল শোয়া থেকে, ‘একি আপনি কাঁদছেন কেন?’ আহির আর কোনো কথা বলতে পারল না। প্রায় অনেকটা সময় নিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল। অয়ন বসে রইল বোকার মতো। মেয়েদের চরিত্রের এই দিকটাই সব চাইতে বেশি বিরক্তিকর। কারণে অকারণে ফিচ ফিচ কান্না। আজ পর্যন্ত কোনো মেয়ে অবশ্য তার সামনে বসে এভাবে কাঁদেনি। অয়ন তাই কী করবে, কী বলবে কিছুই খুঁজে না পেয়ে একেবারে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কিছুটা সময় পার হলে আহির ধাতস্থ হলো, বলল,

— ‘আমাদের পরিবারে শুধু একটিই সমস্যা ছিল সর্বদা। অর্থাভাব। বাবার স্বল্প রোজগারের চাকরী। খুব বেশি বিলাসীতা আমরা কখনোই চোখে দেখিনি। তবুও কি জানেন? আমরা সুখী ছিলাম একটা সময়ে। বাঁধা ধরা মাইনে দিয়ে আমাদের পড়াশোনার খরচ, বাড়ি ভাড়া, খাওয়া দাওয়া, সব কিছুই টান টান ভাবে হয়ে যাচ্ছিল। একটু বড় হবার সাথে সাথে আমাদের চাহিদা বাড়তে থাকল, প্রয়োজন বাড়তে থাকল, কিন্তু বাবার আয় বাড়ল না। আমাদের ওই টানাটানির মধ্যবিত্ত সংসারে তাই তুষার একটা সময় আশির্বাদ হয়ে আসলো। বাবা মা তাই তুষারকে কোনো ভাবেই হাত ছাড়া করতে চাইছেন না। অর্থাভাব তাদের নৈতিকতাবোধটুকু পর্যন্ত ধুয়ে নিয়ে গেছে। আজ তারা অন্ধ! বাহ্যজ্ঞান রহিত। আমি এখন কী করব? আল্লাহ আমার ভাগ্যেই কেন এমনটা লিখে রাখলেন? কী পাপ করেছিলাম আমি?’

অয়ন স্তিমিত গলায় বলল,

— ‘আপনার বাবা মার দোষ নেই, আসলে কী, এই মুহূর্তে আপনার বিয়ে দিতে পারলেই তারা বাঁচেন। তুষারের ব্যপারে মোটামুটি একটা মাইন্ড সেট আপ তাদের হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে তুষারকে বাদ দিয়ে আবার নতুন করে বিয়ের সম্বন্ধ খোঁজ করা একটা হেসেল হবে তাদের জন্য’

— ‘তাই বলে আমার দিকটা একটু দেখবেনা ওরা? যে ছেলেটাকে আমি ঘেন্না করতে আরম্ভ করেছি, তাকে আমি কী করে বিয়ে করবো? কী করে তার সাথে সারাটা জীবন কাটাবো?’

— ‘দেখুন, আমার মনে হয় তুষারকে আপনার একটা চান্স দেয়া উচিত। লেট হিম ডিফেন্ড হিমসেলফ!’

— ‘আমার ঘেন্না হচ্ছে’

— ‘লুক, একটা ব্যাপার কি জানেন, ফিজিক্যাল নিড তো থাকতেই পারে, তাইনা?’

আহির বিস্ফারিত নয়নে তাকালো, ‘কী করে বললেন আপনি? আপনারা পুরুষেরা… আপনারা এভাবেই চিন্তা করেন তাই না? ছি! এতটা শরীর সর্বস্ব কেন আপনারা?’

অয়ন থতমত খেয়ে গেল, মিন মিন করে বলল, ‘আমি আবার কী করলাম!’

— ‘ঐ যে বললেন, ফিজিক্যাল নিড? যতসব অসভ্য চিন্তা ভাবনা’

অয়ন হো হো করে হেসে ফেলল, ‘আপনি কিন্তু বড্ড সেকেলে! মিডেল ক্লাস সেন্টিমেন্ট।’

— ‘খুব ভালো হয়েছে, আপনি থাকুন আপনার আপার ক্লাস সেন্টিমেন্ট নিয়ে।’ ঝাঁঝালো গলায় বলল আহির।

— ‘চেতলেন নাকি? বলছিলাম, শরীর আর মন দুটো আলাদা জিনিস! মনটাই আসল, শরীর কিছু না। সউল ইজ এটার্নাল। তুষার যদি আপনাকে ভালোবেসে থাকে মন দিয়ে, তাহলে আমি বলব ওই জিনিস দুর্লভ, সামান্য একটা ভুলকে কেন্দ্র করে ওটা হারাবেন না।’

আহির দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আপনার কাছে যেটা সামান্য ভুল, আমার কাছে সেটা সামান্য নয়! আর ভালোবাসলে আমাকে ধোঁকা দিতে বাঁধলোনা কেন তার? আপনার ভালোবাসার মানুষটি যদি আপনার সাথে এহেন কান্ড করতো তাহলে আপনি কী করতেন? বলুন কী করতেন?

অয়ন আহিরের দিকে কিছুটা সময় নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে চোখ নিচের দিকে নামিয়ে বলল, ‘জানিনা!’

—জানবেন না কেন? ভেবে দেখুন একবার! আপনি প্রেম টেম করেননি জীবনে?’

অয়ন হাসলো, ‘প্রেম করিনি, তবে প্রেম প্রেম ভাব হয়েছিল, আমাদের পাশের বাড়িতে এক খ্রিস্টান মেয়ে থাকত, মিশনারী তে পড়ত। খুব ভালো লাগত আমার। ঠিক করেছিলাম বড় হয়ে ওকে বিয়ে করব।’

— ‘বেশ তো, তা সে কোথায় এখন?’

— ‘আরে, ধ্যুর জানিনা’

— ‘ব্যাস এ টুকুই?’

— ‘হ্যাঁ এটুকুই’

— ‘বলেন কী?’

— ‘সত্যি বলছি’

— ‘সন্ন্যাসী হবেন নাকি?’

— ‘এখন তো সেটা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছিনা! সন্যাস জীবনই একমাত্র পাথেয়।

— ‘আর কি হবে এমন জনম, লুটবি মজা মনের মতন

বাবার হোটেল ভাঙবে যখন, খাবি তখন কার বা শালে!’

— ‘আপনি লালনের খুব ভক্ত তাইনা?’

অয়ন গভীর গলায় বলে, ‘তা আর বলতে! এমন দর্শন এ পৃথিবীতে বিরল!

“আট কুঠুরী নয় দরজা আঁটা, মধ্যে মধ্যে ঝরকা কাঁটা।
তার উপরে সদর কোঠা, আয়না মহল তায়।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়?”

মানুষ আমরণ এক অচিন পাখিকে পোষার চেষ্টা করে। তবে কজনই সত্যিকারের পোষ মানাতে পারে এই রহস্যময় অচিন পাখিকে?’

“মন তুই রইলি খাঁচার আশে
খাঁচা যে তোর কাঁচা বাঁশে
কোনদিন খাঁচা পড়বে ধসে
লালন ফকির কয়।”

দেহ নামক মাটির পিঞ্জরে পাখিটির অবাধ চলাফেরা, কিন্তু বেঁধে রাখা দায়। পাখিটি উড়াল দিলে পিঞ্জরের আর কোনো অস্তিত্ব থাকেনা।

আহির কিছু বলল না। ভাঙ্গা চাঁদটা পশ্চিমের আকাশের হেলে পড়েছে। রাত বাড়ছে। শীত বাড়ছে। নিশুতি প্রাণীরা সচল এবং সজাগ হয়ে উঠছে। হিম ধরা হাওয়ায় নিঃশব্দে হেলে দুলে ঢেউ খেলছে, শীতকালের রুগ্ন বাঁকখালী নদী। রূপের অহংকারে মজে গিয়ে প্রকৃতি তার নিজেকে নিয়ে বড় বেশি ব্যস্ত। দুটি যুবক যুবতী আকাশের কোলে জনমানবহীন পাহাড়ে নিশ্চিন্তে বসে আছে। বড় মোহময় এই রাত। পৃথিবীর বুকে চির জাগুরুক হয়ে থাকুক এমন রাত!

আহিরের একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। একটা বনমোরগের কর্কশ ডাকে ওর ঘুম ভাঙ্গলো। পূবের আকাশে গোল বলের মতো সূর্যটার মাথা উঁকি দিয়েছে। লালচে আকাশের নিচে ঝুলে আছে সাদা কুয়াশার চাদর। সেই চাদর ভেদ করে সোনা রঙা পবিত্র ভোর মাত্র অবতরণ করেছে পাহাড়ের বুকে। এক গুচ্ছ রেশমী হাওয়া সঙ্গে নিয়ে। আকাশের কাছাকাছি নানা রকম পাখি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে। পান্থ- পরিযায়ী পাখি ওরা। কোন দেশ থেকে এসেছে আবার কোন দেশে যাবে কে জানে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে এখনো অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে। মন্দিরে কেউ একজন ঘন্টা বাজাচ্ছে। ঘন্টা শুনে একটা সঙ্গীহীন জলপাই সবুজ পাখনার টুনটুনি ঝোপের কাছ থেকে ডানা ঝাপটে উড়াল দিল। অয়ন ঘুমুচ্ছে তখনও গুটিশুটি মেরে আদুরে বেড়ালের মতো। সোনামোড়ানো নরম আলো এসে পড়েছে ওর গালে। সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে। আহির ওর হাতটা একটু ঠেলে দিয়ে বলল, -’অয়ন!’

— ‘হুম?’

— ‘অয়ন উঠুন

— ‘হুম’

— ‘উঠুন না!’ অয়ন চোখ খুলল। আহিরের মাথায় এখন কাপড় জড়ানো নেই। চুলগুলো এলো করে খোলা পিঠের ওপর। ওর ঠিক মাথার পেছনেই সূর্যদেব উঁকি দিয়ে কিরণ ছড়াচ্ছেন। পান পাতার মতো লম্বাটে মুখটা ভোরের আলোয় উদ্ভাসিত। রাতের অন্ধকারে এই মানবী অদৃশ্য ছিল। অর্ধেক মানবী ছিল অর্ধেক কল্পনা। ভোরের পবিত্র আলোয় তার সম্পূর্ণ রূপ বিকশিত হলো। অয়ন কিছুক্ষণ আহিরের অপার্থিব রূপের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবালু কণ্ঠে

বলল,

“আজকে ভোরের আলোয় উজ্জ্বল
এই জীবনের পদ্মপাতার জল;
তবুও এ জল কোথা থেকে এক নিমিষে এসে
কোথা চলে যায়;
রাত ফুরুলে পদ্মের পাতায়।”

আহির হাসলো, হেসে পরের পংক্তিটা ধরলো,

“আমার মনে অনেক জন্ম ধরে ছিল ব্যথা
বুঝে তুমি এই জন্মে হয়েছ পদ্মপাতা;
হয়েছ তুমি রাতের শিশির –
শিশির ঝরার স্বর”

অয়ন শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে পরের তিনটা লাইন আবৃত্তি করল,

“জীবন ক্ষণস্থায়ী তবু হায়।
এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল;
পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল।”

আহির পুনরাবৃত্তি করল,

‘পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল!’

অয়ন উঠে দাঁড়ালো। আহিরও। পাহাড়ের কিনারে এসে দাঁড়ালো দুজন। ঢালু হয়ে বন বনানী আর পায়ে হাঁটার মাটির রাস্তা নিয়ে তিনশ ফুট নিচে নেমে গেছে আদিনাথ মন্দিরের পাহাড়। উত্তাল ফুলগন্ধি হাওয়ায় জীবন এখানে মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন রূপ পাচ্ছে। আহির বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, ‘নাহ! জীবন অতটা খারাপ না’ অয়ন হাসলো। এই মুহূর্তে তাকে দেখে মনে হলোনা তার ভেতরে কোনো খেদ আছে, কষ্ট আছে।

আহির লাজুক গলায় বলল, ‘অয়ন! আমি কি আপনার হাতটা ধরতে পারি?’

অয়ন একটু লাল হলো। মেয়েদের হাত ধরার অভ্যাস নেই তার। মুখে কিছু বলল না। হাত বাড়িয়ে আহিরের হাতটা নিজের হাতে নিল। নরম বাচ্চা খরগোশের মতো তুলতুলে একটা হাত! মেয়েদের হাত বুঝি এত নরম হয়!

একটা সময় আহির আলতো স্বরে বলল, ‘অয়ন, আপনি আপনার মা কে ক্ষমা করে দিন, কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। একজন মাকে এত কষ্ট দিয়েন না।

— ‘বলছেন?’

— ‘বলছি’

— ‘চেষ্টা করব, আপনিও… হ্যাঁ আপনিও তুষারকে আরেকটা চান্স দিন, বেচারা সত্যি চায় আপনাকে

আহির হাসলো। ঝিলিক মারলো ওর গজদাঁত, বলল ‘ঠিক আছে’

— ‘আহির দিলশাদ! বলেছিলাম না? There is no exquisite beauty… without some strangeness in the proportion? আপনার দাঁতগুলোর স্ট্রেঞ্জ প্রপর্শনের কারণেই আপনার হাসিটি এত বেশি সুন্দর।’ আহির চোখ লুকালো। কিছু বলতে পারল না। মনের ভেতরটায় এত আলোড়ন এর আগে কোনদিন হয়নি। এ কেমন এক আশ্চর্য অনুভূতি। এই অনুভূতির নাম কী?

২৯

— ‘তুই ফিরেছিস?’ দাদিমা অয়নকে দেখে প্রায় দৌড়ে আসলেন। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে দিলেন। ‘আমি ভেবেছিলাম তুই আর কোনোদিন ফিরবি না’

অয়ন দাদীমার চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

— ‘কেঁদোনা দাদীমা! এইতো আসলাম আমি ‘

— ‘তোর বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি অয়ন, কেউ খুঁজে পায়নি, আমার পাগল ছেলেটা কোথায় চলে গেল, কোথায় আছে, কেমন আছে! এসব চিন্তা করে আমি আর বাঁচতে পারছিনা। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, আমি আর পারছিনা!’ দাদীমা বাচ্চা মেয়ের মতো অয়নকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললেন, আর তোর মা, তোর মায়ের শরীর খারাপ, প্রেশার প্রচন্ড হাই ছিল গত দুদিন, হসপিটালে ভর্তি ছিল, আজ সকালে বাড়ি ফিরল।’

— ‘তুমি শান্ত হও দাদীমা, এতটা ভেঙে পড়োনা’

অয়ন তার নিজের ঘরে যাবার আগে, আজকে অনেক অনেক দিন বাদে স্বইচ্ছায় আয়শার ঘরে উঁকি দিল। আয়শা শুয়ে আছেন বিছানায়। মাথার কাছটায় বুশরা বসে আছে। অয়নের হঠাৎ মনে হলো ঠিক এই মুহূর্তে তার বাড়ি ফিরে আসাটা খুব দরকার ছিল। আহিরকে একটা ধন্যবাদ দেয়া খুব জরুরী হয়ে পড়েছে। কিন্তু কী করে দেবে? কমলাপুর স্টেশনে ওদের রাস্তা যখন পৃথক হয়ে গেল, তখনও একটা বারের জন্যও মাথায় ক্লিক করেনি যে ফোন নম্বরটা নিয়ে রাখা দরকার। ফোন নামের যে একটা যন্ত্র আছে, এটাই সে ভুলে গিয়েছিল। শুধু ফোন কেন, ফেসবুক, টুইটার না কোনো ঠিকানাই নিয়ে রাখেনি অয়ন।

অয়ন ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। শেষ বিকেলের মরা আলো এসে মেঝেতে পড়েছে। আয়শা চোখ বুজে রেখেছেন। বুশরা অয়নকে দেখে বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারল না। কয়েকটা থমকে যাওয়া সেকেন্ড কেটে যাবার পর অয়ন মুখ খুলল, ‘কী অবস্থা?’

আয়শা বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন অয়নের গলা শুনে। চোখ খুলে তাকালেন। তার চোখের নিচে রাত জাগার ক্লান্তি। মুখটা একটু ফুলে গেছে কোনো কারণে। চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি সুস্থ নেই। আয়শা উঠে বসার চেষ্টা করলেন। বুশরা এগিয়ে গিয়ে মা কে ধরলো। অয়ন বিছানার পাশে পেতে রাখা চেয়ারে বসলো। মা মেয়ে হতবাক দৃষ্টিতে পরস্পরের মুখের দিকে চাইল। দুজনের চোখেই বিস্ময় ফেটে পড়ছে। অয়ন নিজের ইচ্ছেয় এই ঘরে এসেছে, বসেছে। এ যেন অবিশ্বাস্য ব্যাপার।

— ‘কেমন আছিস তোরা?’

— ‘ভাইয়া, বাবাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি’

— ‘জানি’

— ‘কী করে জানিস?’

— ‘টের পাই’

— ‘তুই কী মনে করে বাড়ি ফিরলি?’ ঝাঁঝালো গলায় প্রশ্ন করে বুশরা। -’সেই কৈফিয়ৎ তোকে দিতে হবে?’

— ‘এমন একটা বিপদের মুহূর্তে তুই আমাদের ফেলে চলে গেলি, এখন এসেছিস ঢং করতে?’ আয়শা ধমক লাগলেন বুশরাকে, ‘আহ! চুপ কর তো! ও কী বলতে চায়, তা তো আগে শুনতে দে!’ বুশরা মায়ের ধমক খেয়ে সাময়িক চুপ করল, কিন্তু তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে রাগে তার সারা শরীর জ্বলছে। আয়শা অয়নের চোখে শীতল দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘বলো!’

অয়ন আয়শার দিকে তাকালো। তার মনে পড়েনা শেষ বার সে কবে তার মায়ের চোখে চোখ রেখেছিল। কিন্তু আজ এই এতদিন পরে, এই বিকেল শেষের আলোতে, ছেলেবেলার স্মৃতিতে ভরা পুরোনো ঘরটায় বসে থেকে অয়নের হঠাৎ মনে হলো, এই মাকে সে একদিন ভালোবাসতো! একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে সে বলল,

— ‘না ভাবছিলাম! ফাইনালি, বাবা আমাদের জীবন থেকে পুরোপুরিই সরে পড়লো। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে, একটা অসুস্থ মানুষকে এভাবে বোঝার মতো বয়ে নিয়ে যাওয়াটা.. আসলে… আসলে অনেক কষ্টকর একটা ব্যাপার।’

কথাটা শোনা মাত্র আয়শা থর থর করে কেঁপে উঠলেন। তার দুচোখ বেয়ে স্রোতের মতো জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। বুশরা জাপটে ধরল মাকে। তারস্বরে বলল, ‘ভাইয়া, আমরা এমনিতেই ভালো নেই, খুব খারাপ আছি, তুই উড়ে এসে জুড়ে বসে আমাদের কষ্টটা আর বাড়াস না’

অয়ন বুশরার কথাটা শুনেও না শোনার ভান করল। আয়শার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কাঁদছ কেন? তোমার মনে নেই সেই দিনটার কথা?’ আয়শা চকিতে তাকালেন তার ছেলের দিকে। ছেলে আপনি থেকে তুমিতে নেমেছে। টানা চার বছর পর ছেলে তাকে তুমি সম্বোধন করছে। আয়শা নিজের দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বললেন ‘কোন দিন?’

— ‘যেদিন তুমি তোমার ইম্পর্টেন্ট বায়ারদেরকে বলেছিলে, বাবা নেই, কারণ তুমি চাইছিলেনা আমার স্বল্পশিক্ষিত, আনস্মার্ট, বোকা বাবা তোমার পার্টনারদের সামনে দাঁড়িয়ে তোমার ইমেজ খারাপ করুক। তাই জীবিত একজন মানুষকে তুমি নেই বানিয়ে দিলে! পরে আমি জানতে পেরেছিলাম বাড়ির কাজের লোকদের পর্যন্ত তুমি শিখিয়ে রেখেছিলে ওরা যেন ভুলেও সেই দিন অতিথিদের সামনে বাবার উপস্থিতির কথা না বলে। কী করে পেরেছিলে তুমি? এত বড় জঘন্য একটা কাজ করতে!’

অয়ন একটু থেমে বলল, ‘আসলে কি জানো? আমার বাবা… আমার বাবা সেদিনই মরে গিয়েছিল। চোখের সামনে বাবার সেই মুখটা আজও ভাসে! একটা জীবিত মানুষ যে কী করে দিনকে দিন মৃত্যুর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যায় তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানেনা।’

আয়শার কান্নার দমক বাড়লো। কান্না জড়ানো গলায় তিনি সজোরে মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানি তুই আমাকে ঘেন্না করিস, সব আমার দোষ, সব আমার দোষ! সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। তোরা… তোরা আমাকে গলা টিপে মেরে ফেল’ আয়শা সত্যিই বুশরার হাত দুটো খামচে ধরে নিজের গলার ওপর চাপিয়ে দিলেন। বুশরা আর্তনাদ করে উঠল, ‘আরে মা করছ কী! করছ কী তুমি!’

অয়ন উঠে এসে মায়ের পাশে বসল। মায়ের কপালের কাছে পড়ে থাকা এলোমেলো একগাছি চুল কানের পেছনে আটকে দিয়ে বলল, ‘কী দরকার ছিল এত অর্থবিত্তের? তোমার ওই অর্থের পেছনে ছুটে চলা আমার শৈশবটাকে কেড়ে নিয়েছে, আমার পরিবারটাকে কেড়ে নিয়েছে।

— ‘অয়ন, সংসার চালানোর মতো কোনো ক্ষমতা তোর বাবার ছিল না! আমি আজীবন গাধার মতো খাটুনি খেটে পয়সা উপার্জন করেছি বলেই তোরা মানুষ হয়েছিস।’

অয়ন হাসলো, ‘মানুষ! মানুষ কি হয়েছি সত্যি? আর এই মানুষ হবার জন্য যদি এত বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, তাহলে সেই মনুষ্যত্বের কোনো দাম নেই আমার কাছে। সে যাই হোক, যা গেছে, তা তো চলেই গেছে, আমি তোমাকে যে কথাটা বলতে এসেছি তা হলো…’

— ‘কী? কী কথা?’

অয়ন নিস্প্রভ গলায় বলল

— ‘মা, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি’

আয়শা বিস্ময় ভরা চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। অনেক অনেক দিন বাদে অয়ন তাকে মা ডাকল। মনে হলো ধু ধু মরু প্রান্তরে বহু বহু দিন পর তিনি এক ফোটা জলের ছোঁয়া পেলেন। এই জল টুকুর জন্য তার অন্তরাত্মা জ্বলে পুড়ে খাঁক হয়ে যাচ্ছিল। ছেলের মাথাটা বুকে চেপে ধরে কান্না জড়ানো গলায় বললেন, ‘ক্ষমা করিস না বাবা, ক্ষমা পাবার যোগ্য আমি নই, এভাবেই শুধু নিজের মাকে, মা বলে ডাকিস!’ অয়ন দু হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের গায়ের গন্ধ একটুও পাল্টায়নি। সেই ছোটবেলার মতোই আছে। পৃথিবীর অন্য কোথাও এই ঘ্রাণটি নেই। হঠাৎ কী হলো কে জানে অয়ন বাচ্চা ছেলের মতো হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলল। কান্না জড়ানো গলায় বলতে লাগল, ‘আমার অনেক কষ্ট মা! অনেক কষ্ট! তুমি বুঝলেনা কেন? কেন বুঝলেনা তুমি?’

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি – ৩০

৩০

আহির জানতো একটা রাম থাপ্পড় তার পাওনা হয়ে আছে এবং পেয়েও গেল বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথেই। মা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে তেড়ে মেড়ে এসে থাপ্পড়টা বসিয়ে দিলেন। এ এক অদ্ভুত মহিলা! মেয়ে বাড়ি ফিরেছে সেই আনন্দে আনন্দিত হবে, তা না, রাগ দেখাচ্ছে! বেশ হতো যদি একেবারেই না ফিরত আহির। যত্তসব। তড়াক করে মেজাজটা সপ্তমে চড়লেও আহির মুখে কিছু বলল না। চড় খেয়ে জ্বলতে থাকা গালে একটা হাত চেপে রেখে নিজের ঘরে চলে আসলো। আশিক আর বাবাই দুজন বিস্ময়ে ফেটে পড়া সিনেমার দর্শকের মতো তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই বাড়ির মানুষগুলো এমন অদ্ভূত কেন? উফ!

— ‘কোথায় ছিলি এ দুদিন?’ মা হুঙ্কার ছাড়লেন। কোমরে হাত রেখে।

আহির মিনমিনে গলায় বলল, ‘বাইরে’

— ‘বাইরে কোথায়?’ বাঘের মতো গর্জে উঠছে মা। সমস্যাটা কী? আহির ঘুরে দাঁড়িয়ে শীতল গলায় বলল, ‘তুমি এরকম করছ কেন? এরকম করলে কিন্তু আমি আবার চলে যাব, আর কোনদিন ফিরব না বললাম!’

আহিরের কথা বলার ঢঙে মা একটু বিচলিত হলো বলে মনে হলো। বাবাই এগিয়ে এসে বলল, ‘এটা কোনো কথা হলো! একটা মেয়ে মানুষ এরকম না বলে কয়ে হঠাৎ বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়? আমাদের উপর দিয়ে কী গেছে তুই একটা বার চিন্তা করেছিস? তোর যদি কোনো বিপদ হতো? আজকাল কত রকম দুর্ঘটনার খবর ছাপা হচ্ছে প্রতিদিন খবরের কাগজে! তোর কি একটুও বুক কাঁপলো না?’

আহির বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ে, অধৈর্য ভাবে বলল,

— ‘বাবাই, আমি আর পারছিলাম না, আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, একবার ভাবলাম সুইসাইড করব, কিন্তু সাহস হল না।’

ওই ‘সুইসাইড’ একটা শব্দ বাবাই আর মায়ের মুখশ্রী ভেলকি দিয়ে পাল্টে দিল। মা ছুটে এসে আহিরকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কী আবোল তাবোল বলছিস? অত ভেঙে পড়ার মতো তো কিছুই হয়নি, তোর যা মন চাইবে তাই করবি। কেউ তোকে জোর করবেনা’

আহিরের চোখ দুটো ভিজে উঠল, ‘এ জন্যই ফিরে এসেছি মা, এই যে তোমরা এভাবে জড়িয়ে ধরবে, আর আমি আবার বেঁচে থাকার প্রেরণা পাব!’

বাড়ির সদস্যগুলোর মুখে দ্যুতি ছড়াচ্ছে। কাল বাদে পরশু তাদের নতুন বাসায় ওঠার কথা। আহির ছিল না বলে সব কাজ পড়ে ছিল, থমকে ছিল।

মা খুব যত্ন করে রান্না করলেন। আহিরের পছন্দের খাবার, বেগুন ভর্তা, আলুর ভর্তা, ভাত, ডাল। ওপরতলা থেকে চৈতী ছুটে আসলো। এসেই হইচই লাগিয়ে দিল। উত্তেজনায় তার কেঁদে ফেলার উপক্রম। অনেক দিন পর আপনজনদেরকে সত্যিকারের আপনজন বলে মনে হচ্ছিল আহিরের। মনটা কাছের মানুষগুলোর ভালোবাসার উত্তাপে ভরে উঠছিল। কিন্তু এইসব কিছু ছাপিয়ে অন্য একটা মানুষের ভাবনা আহিরের মুখ থেকে কথা কেড়ে নিচ্ছিল। এলোমেলো করে দিচ্ছিল। ঘরভর্তি মানুষের মাঝেও একা করে তুলছিল। অনেক চেষ্টা করেও আহির ফোন নম্বরটা চাইতে পারল না চলে আসার আগের মুহূর্তে। এখন ভারি আফসোস হচ্ছে! লজ্জার মাথা খেয়ে ফোন নম্বরটা চেয়ে বসলেই হতো। আর যদি কখনো দেখা না হয়? আর যদি কখনো কথা না হয়! মনে হতেই আহিরের সমস্ত মনটা খন্ড বিখন্ড হয়ে গেল। এমন কেন লাগছে? অয়ন তার কেউ নয়, বন্ধু নয়, আত্মীয় নয়, অনেক দিনের চেনা পরিচিতও নয়, তবুও কেন মনে হচ্ছে ওই মানুষটা তার আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে?

অয়নের সাথে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তুষার। কিন্তু তুষারের কাছে আহির কোনভাবেই অয়নের খোঁজ করতে পারবেনা। তুষার ব্যাপারটাকে সহজ ভাবে নেবেইনা। মনে পড়ল আহিরের। তুষারকে একটা সুযোগ দিতে হবে, অয়নকে কথা দিয়েছিল সে।

তুষার সে রাতেই আসলো। কী করে যেন খবর পেয়েছে সে। শুকিয়ে মুখটা আধখানা হয়ে গেছে। আহিরের দেখে মায়া হলো। মনে হলো, ছেলেটাকে বোধহয় সে এখনো ভালোবসে। হয়তো এই অনুভূতিকে এখন আর ঠিক ভালোবাসা বলা যাবেনা। দীর্ঘদিন একসাথে থাকতে থাকতে একটা মমত্ববোধ জন্মে গেছে, মায়া জন্মে গেছে। কিন্তু শুধু এই মমত্ববোধ আর মায়াকে পুঁজি করেই কি বিয়ে করে সুখী হওয়া যায়? হয়তো যায়, হয়তো এ সংসারে টিকে থাকার শুধু একটিই মন্ত্র ‘মায়া…’। যদিও চারবছর আগের তুষার আর এই তুষারের মাঝে ঢের তফাৎ। তুষার ঠুনকো হয়ে গেছে আহিরের কাছে। হেরে গেছে কামনার কাছে, প্রবৃত্তির কাছে। হেরে যাওয়া, বহুকামী, হ্যাংলা পুরুষমানুষ আহিরের কোনদিনও পছন্দ না। বাবা মা’কে তুষার বলেছে ওই মেয়েটার সাথে তার কোন অবৈধ সম্পর্ক ছিল না। মেয়েটা তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়া। আহির তুষারকে ভুল বুঝেছে। কে জানে সত্য না মিথ্যা! আহির আর কিছু জানতেও চায়না। একটা দুটো সত্য না জেনেই কেটে যাক না এই একটা জীবন! আহির তবুও ক্ষমা করলো তুষারকে। তুষার যখন হামলে পড়ে আহিরের পা ধরে, কান্নায় ভেঙে পড়ে মাফ চাইল, আহির তখন ক্ষমা না করে পারল না। সুখে থাক তুষার, সুখে থাক বাবাই, মা, আশিক, আশেপাশের মানুষগুলো। তাদের সুখ থেকেই আহির সুখ খুঁজে নেবে।

৩১

অয়নের একটা চাকরি হয়েছে। যার এত ক্ষমতাধর মা থাকে, তার জন্য যে চাকরি আসলেই ছেলের হাতের মোয়া তা আরেকবার প্রমাণিত হয়ে গেলো। একটা ওষুধ তৈরির কোম্পানি। জয়েনিং সেলারিই দেবে পঞ্চাশ হাজার টাকা। অয়ন খবর শুনে অনেক্ষণ হাসলো। প্রাণ খোলা হাসি। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে সে বলল, ‘আচ্ছা? তোমাদের কি মনে হয় আমার দ্বারা চাকরি হবে? আমি মানুষটা অতটা সাধারণ না, রোজ নিয়ম করে অফিস যাব, আসব, সময় মতো ঘুমাব, তা আমার দ্বারা কোনোদিনও হবে না।’

—’তাহলে মায়ের বিজনেসটা দেখলেই পারিস’ বুশরা বলে।

দাদীমা বুশরার কথায় সায় দেয়,

— ‘ঠিকই তো বলেছে, ব্যবসাটা ধরে ফেল। এরপর দেখে শুনে একটা লক্ষ্মী দেখে মেয়ে বিয়ে করে ঘরে তোল, আমি একটু শান্তিতে মরি।’ অয়ন মিটমিট হাসে। কিছু বলেনা। সে জানে বিয়ে শাদি, চাকরি, ব্যবসা, কোনটাই আসলে তাকে দিয়ে হবেনা। স্রোতের বিপরীত দিকটিই তার গন্তব্য। যে কটা দিন বেঁচে থাকবে এভাবেই চলবে। কিন্তু পড়তে বা পড়াতে এখনো ভালো লাগে অয়নের। হয়তো আর কিছু না করলেও ওই একটা কাজ করা যায়। তবে আজকাল একটা অদ্ভূত রোগ হয়েছে তার। কেবলই মনে হয়, সে আর আগের মতো একা নেই, সর্বক্ষণ তার সাথে আরেকজন আছে। একাকী সময়গুলোও এখন সম্পূর্ণ তার নিজের না। প্রতিটি কাজে, প্রতিটি ভাবনায় অন্য একজনের দখল। অয়ন তো এমন ছিল না! কাল রাতে একটা আবোল তাবোল স্বপ্ন দেখার পর মনটা বিষাদে ভরে গেছে। নিজেকে নিজেই চিনতে পারছেনা। এমন একটা স্বপ্ন কেন দেখল সে? দেখলো তার নিজের ঘরের বিছানায় একটা মেয়ে বসে আছে। কাছে যেতেই বোঝা গেল মেয়েটা আহির। আহির তার বিছানায় কী করছে? চমকে উঠে এক পা দূরে সরে গেল সে। আহির খিল খিল করে হেসে উঠে বলল, ‘যাচ্ছ কোথায় আমাকে ফেলে? কোথাও যেতে পারবেনা, আরে বোকা, তুমিই তো আমি আর আমিই তো তুমি! পালিয়ে যাবে কোথায়?’ অয়ন ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো। তার গলা শুকিয়ে গেছে। কপাল ঘামছে। তুমিই তো আমি আর আমিই

তো তুমি! লালনের গান মনে পড়ল,

“আমি আর সে অচিন একজন
এক জায়গাতে থাকি দুজন।
ফাঁকে থাকে লক্ষ্য যোজন না পাই দেখিতে।
সাধ্য কিরে আমার সেরূপ চিনিতে
অহর্নিশি মায়ার ঠুসি জ্ঞানচক্ষেতে।”

নিজের ভেতর কি অন্য কেউ বাস করতে পারে? নিজের আত্মার সাথে, মনের সাথে হয় কি বাসস্থান একই সাথে অন্য একজনের? হয়, হয়, নিশ্চয়ই হয়। এ জগৎ অন্তহীন রহস্যে ঘেরা। রহস্যের কূল কিনারা নাই।

শীতের প্রকোপ কমে গেছে। গাছে গাছে হলদে পাতা উঁকি দিচ্ছে। কোকিল ডাকছে হরহামেশা। প্রকৃতি তার যৌবন ফেরত পাচ্ছে। সন্ধ্যের দিকে দক্ষিণের আকাশ ঝির ঝির করা হাওয়া ছাড়ে। মানুষের সাথে এখানেই তার বিশদ পার্থক্য। মানুষের যৌবন একবার গেলে আর ফেরত আসেনা, প্রকৃতির যৌবন বার বার আসে।

এমনই এক স্নিগ্ধ হাওয়ার বাসন্তী বিকেলে অয়ন গেল তিয়ানার সাথে দেখা করতে। বনানীর এক অভিজাত, দামী রেস্তোরায়। তিয়ানা একটা সবুজ গাউন পরেছে। গলায় কানে সবুজ পাথরের সেট। ওকে দারুণ দেখাচ্ছিল। কথার ফুলঝুড়ি ছড়াচ্ছিল তিয়ানা। অয়ন কথা বলছিল কম, শুনছিল বেশি। শুনতে শুনতে হঠাৎ মনে হলো, এই মেয়েটির সাথে তার প্রেম হলো না কেন কখনো? এই দুরন্ত, সুন্দরী, মেধাবী বালিকাটি যে তার প্রতি কতটা মোহাবিষ্ট, কতটা আসক্ত এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পেরেও তার হৃদয় কেন একটি বারের জন্য কাঁপলোনা? অথচ তুষার কেন একজনের সাথে দায়বদ্ধ থাকার পরেও কামনার বশে অন্য নারীর স্মরনাপন্ন হলো? মানুষে মানুষে এত তফাৎ কী করে আসে? কোত্থেকে আসে? দেহের সাথে আত্মার যোগ ঘটলে কি কখনো দেহকে আত্মা থেকে আলাদা করা যায়? আর যদি যায়ই তবে পশুর সাথে মানুষের পার্থক্যটা কোথায়? তবে কি বেশির ভাগ মানুষই তার ভেতরের স্বত্তাটার সাথে যোগাযোগ স্থাপনে অক্ষম? নিজেকেই যদি না জানল, না চিনল, তবে এই মানবজন্মের অর্থ কী? অয়ন তাকিয়ে থাকে তিয়ানার দিকে কিন্তু তার মন চলে যায়, তিয়ানাকে ছাড়িয়ে, তার নিজেকে ছাড়িয়ে অনেক অনেক দূরে।

সন্ধ্যায় তুষারের সাথে দেখা হয়ে গেল রাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানে। অয়ন কেন যে ছেলেটাকে দেখে ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেল কে জানে। সে কেন তুষারের চোখে চোখ রাখতে পারছেনা? কোথায় বাঁধছে তার? কিন্তু তুষার খুব খুশি হলো অয়নকে দেখে।

— ‘আরে অয়ন ভাই যে, আছেন কেমন?’

— ‘এইতো চলছে, তোমার?’

— ‘আমার তো বিয়েটা এগিয়ে আসলো ভাইয়া, তারিখ পড়ে গেছে, আগামী মাসের পনেরো তারিখ’। অয়নের নিশ্বাস ভারী হয়। মুখটা একটু রক্তশুন্য দেখায়। তবুও চমৎকার সামলে নিল নিজেকে। হেসে বলল, ‘খুব ভালো, খুব ভালো, কনগ্রাচুলেশনস!’

— ‘বিয়েতে আসবেন কিন্তু ভাইয়া, কার্ড ছাপা হলেই আপনাকে দাওয়াত দেব।’

— ‘অবশ্যই আসবো!’ অয়ন আর কথা বাড়ায়না। পায়ে হেঁটে তুষারের কাছ থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পালিয়ে যেতে চায়। এ কী হচ্ছে তার সাথে? নিজের সাথেই নিজের একটা বোঝাপড়া দরকার। ঠান্ডা লড়াই দরকার।

সেই রাতে খবরটা আসলো। বাবার লাশ পাওয়া গেছে ঢাকার একটি ব্যস্ত তম মহাসড়কে। বাস চাপা দিয়ে গেছে। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা মায়ের ফোনে ফোন দিয়ে খবরটা জানিয়েছেন। সোহ্রাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে লাশ আছে, হস্তান্তর করবে আগামীকাল সকালে।

খবরটি পাবার পর অয়ন কোনো উচ্চবাচ্য করল না। এক ফোটা চোখের জলও ফেলল না। অনেক রাত অবধি ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াল। হয়তো বাবার মতো তার দেহটাও প্রাণ হারিয়ে একদিন এই শহরেরই আনাচে কানাচে পড়ে থাকবে। দেহ থাকবে, প্রাণ থাকবেনা। প্রাণ পাখিটি উড়াল দেবে খাঁচা থেকে। কেমন হবে সেই মুহূর্তটি? বাবার কেমন লেগেছিল? বাসটা যখন তার গায়ের ওপর দিয়ে চলে গেল? বাবা যতদিন ছিল, তার নিজের বেঁচে থাকার একটা কারণ ছিল, এখন অয়ন কী নিয়ে বাঁচবে?

হাঁটতে হাঁটতে বহুদূর চলে যায়। ঢাকার বাইরে যেতে মন চায়, আবার চায়ও না। ঢাকার বাইরে গেলেই এখন অন্য একটা মানুষকে খুব বিশেষ ভাবে মনে পড়বে। সেই বিশেষ ভাবে মনে পড়াটাকে ভয় পায় অয়ন। মন বলে দেখা হবে। এই শহরেরই কোথাও আবার তার সাথে দেখা হবে। নিশ্চয়ই দেখা হবে। দেখা হবে হারানো মানুষগুলোর সাথে। আহিরের সাথে, বাবার সাথে। হয় এই জন্মে, নয় পরজন্মে। মৃত্যুর পরে যে জীবনের সূচনা ঘটে। মনে হয় ওই দেখা হওয়ার জন্যই এই ছুটে চলা। প্রহর গোনা। একটা রিক্সা একদল ছেলেকে নিয়ে পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। এক রিক্সায় চার পাঁচজন বোঝাই হয়ে বসেছে। গান গাইছে, খালি গলায়। সুমনের গান,

“ও গানওয়ালা, আর একটা গান গাও”

অয়ন ফুটপাতের ওপর বসে পড়ল। একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে আসলো। হায়, জীবনটা বড় লক্ষ্যহীন হয়ে গেছে তার। সে কেন এমন হলো? সে কেন আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক হলো না? আকাশ গুমোট হয়ে আছে। গাছের পাতা নড়ছেনা। গভীর রাতের শহর রাস্তার ধারের ফ্লুরোসেন্ট আলোয় আলোকিত। খুব একটা শব্দ নেই কোথাও, শুধু দূর থেকে ছেলেগুলোর গানের আওয়াজ ভেসে আসে, গভীর রাতের গায়ে গায়ে মিশে যেতে থাকে গানের সুর!

“ও গানওয়ালা, আর একটা গান গাও
আমার আর কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছু করার নেই
ছেলেবেলার সেই, বেহালাবাজানো লোকটা
চলে গেছে বেহালা নিয়ে, চলে গেছে গান শুনিয়ে!”

৩২

বিসিএস প্রিলিতে আহিরের হয়ে গেছে। দারুণ খুশির একটা খবর। এই ঘটনাটি মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছে। জীবনের প্রতি নতুন করে টান অনুভব করছে সে। এবারে লিখিত পরীক্ষার জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। কিন্তু সময় কই? বাড়িতে আনন্দের ধুম পড়ে গেছে। বিয়েবাড়ির আনন্দ। আজ সকালে আহিরের শাশুড়ি এসে বিয়ের গয়না দিয়ে গেল। দশ ভরি ওজনের সীতাহার, সাথে কানের ভারী দুল। হাতের বালা, সব মিলিয়ে তেরো ভরি ছাড়িয়ে গেছে। তুষারের ঘরটিতে বাবাই কেবিনেট তৈরী করিয়ে দিয়েছেন। মিস্ত্রী গতকাল কাজ শেষ করল। এ ছাড়াও একটা খাট এবং ড্রেসিং টেবিল দেয়া হচ্ছে। বাবাইয়ের জমা যা আছে সব আহিরের বিয়ের পেছনেই খরচ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। আহির কতবার বারণ করল, ‘বাবাই কিছু টাকা রেখে দাও,আশিকের পড়াশোনার জন্য লাগবে। কখন কী বিপদ হয় বলা যায়না’ বাবাই বুঝি কারো কথা শোনার বান্দা। তার একটাই কথা, ‘আমার দশটা না, পাঁচটা না, একটা মাত্র মেয়ে, এক মাত্র মেয়ের বিয়ে ধুমধাম করে হবেনা তা কি করে হয়!’

প্রায় দিন আহির চৈতির সাথে শপিং এ চলে যায়। হরেক রকম রং বেরঙের জিনিসের ভিড়ে মনটা ভালো হয়ে যায়। স্বপ্নেরা উঁকি দেয়। একটা ছিমছাম সুন্দর সংসার। একটা ভালো চাকরি। তার মধ্যবিত্ত সহজ সরল জীবনটায় এর চেয়ে বেশি আর কী চাই?

নতুন বাসাটা ছোট হলেও মন দিয়ে সাজিয়েছেন মা। দুটা বেডরুম, ড্রইং, ডাইনিং, আর দক্ষিণে চমৎকার একটা ঝুল বারান্দা। সাত তলার ওপরের বারান্দায় দাঁড়ালে মনে হয় যেন আকাশের কোলে ভাসছে। মাঝে মাঝেই গভীর রাতে চুপি চুপি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আহির। মাঝরাতের আকাশটা খুব কাছের মনে হয়। ঝির ঝির হাওয়া দেয়। ভালো লাগে। পাহাড়ের ওপরে কাটানো সেই রাতটার কথা মনে পড়ে। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন থেকে ছুটি নিয়ে আবার সেই পাহাড়ে পালিয়ে গেলে কেমন হয়? বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে যায়। মানুষটা কেমন আছে? কেন জানতে ইচ্ছে হয় তার কথা? একটাবার খবরও নিল না! আহির বাঁচলো কী মরলো! অদ্ভুত মানুষ। তবু মন বলে দেখা হবে। একদিন ঠিক দেখা হবে।

দেখা হয়েও গেল একদিন। সেদিন শ্রাবণ মাস। বিকেলের দিকে আকাশ জুড়ে মেঘ করল। বৃষ্টি নামলো ঝেঁপে। দুপুরে এক বান্ধবীর বাসায় দাওয়াত খেয়ে আহির মহাখালী বাস স্টান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল তুষারের অপেক্ষায়। তুষারের অফিস এদিকেই। দুজনে একসাথে বাড়ি ফিরবে। বাস স্ট্যান্ডের ছাউনিতে বুক চাপা ভিড়। উত্তাল হাওয়া চুল উড়িয়ে নিচ্ছে, গায়ের ওড়না উড়ছে পতাকার মতো। সেই হরেক লোকের ভিড়ের মাঝে একটা চেনা মুখ দৃষ্টি কাড়লো। বৃষ্টিতে চুল ভেজা, পরনের টি-শার্ট ভিজে শরীরের সাথে লেগে আছে। চোখে চোখ পড়ল। স্থির হয়ে রইল বেশ খানিক্ষণ চারটি চোখ। বুক কাঁপতে থাকল। হৃদপিন্ডে ক্রমাগত ধুক পুক ধুক পুক। চারিদিকে যেন আর কেউ নেই, কিছু নেই, শুধু বৃষ্টির নিবিড় রিমঝিম আর চারটি চোখের পরস্পর আটকে থাকা

ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসলো অয়ন। হাওয়ায় অনেক জোর। অয়ন বলল,

— ‘এদিকে ভিড়, চলুন সামনে এগিয়ে যাই।’

আহির কোনো কথা না বলেই এগিয়ে গেল। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মেলে ধরল। বলল,

— ‘ছাতার ভেতর আসুন, ঠান্ডা লেগে যাবে’। অয়ন হাসে,

— ‘আমার এসবে অভ্যাস আছে, কিচ্ছু হবেনা’

— ‘কেমন আছেন?’

— ‘চলছে, আপনি?’

— ‘ভালো’

— ‘শুনলাম আপনার বিয়ে’

— ‘ঠিক শুনেছেন

— ‘কনগ্রেচুলেশনস’

— ‘থ্যাংক ইউ, আমি বেশিদূর যাব না, এদিকেই থাকতে হবে।’ বলে আহির দাঁড়িয়ে পড়ল।

— ‘এদিকে কোনো কাজ ছিল?’

— ‘বান্ধবীর বাসায় দাওয়াত ছিল, এখন তুষারের জন্য অপেক্ষা করছি, একসাথে বাড়ি ফিরব।’

— ‘ও! তাই বলেন’ বলে অয়ন চুপ করে যায়। কেউ কোনো কথা খুঁজে পায়না। দুজন দুজনকে আড়চোখে দেখে। ভাবে। কী যেন বলতে চায়, আবার বলেনা। একটা সময় আহির বলল, ‘কী করছেন এখন?’

— ‘দুটা টিউশনী ছাড়া কিছুইনা, ও হ্যাঁ, আমার বাবা মারা গেছেন

এই প্রথম অয়ন কাউকে তার বাবার মৃত্যুর খবরটা দিল। তার পৃথিবীতে যেন আর কেউ নেই যার সাথে এই কষ্টটি ভাগ করে নেয়া যায়।

— ‘বলছেন কী? কী করে?’

— ‘রোড এক্সিডেন্টে

শুনে আহির বেশ কিছুক্ষণ গুম মেরে রইল। বৃষ্টির তেজ তখন কমে গেছে। টিপ টিপ করে ঝরছিল শুধু। আহির ছাতাটা ভাজ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে অয়নের দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনার খুব কষ্ট হয়েছে, তাইনা অয়ন?’

অয়ন একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল, ‘এখন আর কোনো কিছুতেই কিছু এসে যায়না, বললাম না, সব কিছু অভ্যাস হয়ে গেছে!’

— ‘জীবনটাকে একটু গুছিয়ে তোলেন না কেন? আর কত দিন বলুন তো এভাবে চলবে?’ অয়ন হাসে, আহিরের চোখে চোখ রেখে বলে, ‘কার জন্য গুছিয়ে তুলব? কে আছে আমার?’

আহির ঢোঁক গিলল, ‘নিজের জন্য’

— ‘নিজের জন্য কিছু করতে ইচ্ছে হয়না’

— ‘আপনার মায়ের জন্য অয়নের যেন হঠাৎ মনে পড়ল, ‘ও হ্যাঁ, মায়ের সাথে প্যাঁচআপ করে ফেলেছি’

শুনে আহির খুশি হয়, ‘বেশ ভালো, ভীষণ ভালো খবর!’

— ‘মায়ের জন্য জীবন গুছিয়ে তোলার কথা বলছেন? মা তার ছেলেকে ফেরত পেয়েই খুশি, আর কিছু চায়না’ বলে অয়ন ফিচেল হাসি হাসে।

— ‘সিরিয়াসলী! আপনি এত ব্রাইট একটা ছেলে, কেন নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছেন বলুন তো? এবার একটু ঘুরে দাঁড়ান মশাই! একটা ভালো চাকরি খুঁজে নিন, বিয়ে শাদী করুন।

— ‘সবাইকে দিয়ে সব কিছু হয়না। আমার দ্বারা হবেনা, আর বিয়ে করবেই বা কে আমাকে? আমি তো পাগল!’

— ‘আপনি মোটেই পাগল নন, আর আপনাকে তো যে কেউ বিয়ে করবে।’

— ‘যে কেউ?’

— ‘যে কেউ!’

অয়ন দুর্বোধ্য হাসে। কিছু বলেনা। বৃষ্টির তোড় আবার বাড়তে থাকে। বৃষ্টির জন্যই রাস্তায় লোকজন কম। ফুটপাতটা খালি খালি লাগে। ছাতা খুলে মেলে ধরার আগেই বৃষ্টির ধারালো ফোটা বন্য দস্যুর মত হামলে পড়ে শরীর ভিজিয়ে দেয়। দুরন্ত হাওয়ায় উড়ে ভেজা মাটির ঘ্রাণ। ভালো লাগতে থাকে। আহির হঠাৎ অন্য সুরে বলে ওঠে, ‘আপনার মনে আছে, অয়ন?’ কেন বলল কে জানে। শুনে অয়ন একটু চমকে গেল। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, ওর চোখের দিকে গভীর ভাবে চেয়ে থেকে বলল, ‘আমার মনে আছে, আহির দিলশাদ! আমার সব কিছু মনে আছে’

অয়নের ওই দৃষ্টি আহিরের বুকের ভেতরের সমস্তটা ওলটপালট করে দিল। অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘মনে থাকলে এত দিন কোনো খবর নেন নি কেন? মরেও তো যেতে পারতাম!’

— ‘খোঁজ নেবার কোনো উপায় ছিল না, কিন্তু মনে মনে ঠিক বুঝেছিলাম, আপনি ভালো আছেন।’

আহির অভিমানের গলায় বলল, ‘ছাই বুঝেছেন

মোবাইলটা বাজছিল। তুষারের ফোন। হয়ত কাছাকাছি চলে এসেছে। আহির ফোনটা কেটে দিয়ে বলল,

— ‘আবার কবে দেখা হবে?’

— ‘হয়ে যাবে, চিন্তার কিছু নেই। বলেছিনা? সোউল ইজ এটার্নাল! দেখা হতেই হবে, এ জীবনে না হলেও ওপার জীবনে হবে।

বলে হাসে অয়ন। আহিরও হাসে। ঝিলিক মারে ওর গজদাঁত। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। বৃষ্টির মাঝেও চোখের জলের রং খালি চোখে স্পষ্ট ধরা পড়ে। কিছুটা সময় দুজনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।

— ‘যাই’ আহির বলে।

— ‘আসুন।’

আহির ধীর পায়ে হেঁটে ধোয়াটে বৃষ্টির সাথে ঝাপসা হয়ে যায়, মিলিয়ে যায়। শুন্য পথটিতে শুধু শন শন শব্দে বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ে। অয়ন নিষ্পলক চেয়ে থাকে সেদিকে। নিজের মনে বিড়বিড় করে,

“কপালের ফের নইলে কী আর
পাখিটির এমন ব্যবহার
খাঁচা ভেঙ্গে পাখি আমার কোন খানে পালায়।
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি ক্যামনে আসে যায়!”

***

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(60)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!
Do you have any doubts? chat with us on WhatsApp
Hello, How can I help you? ...
Click me to start the chat...