শ্বাপদ সনে – নাবিল মুহতাসিম
বাতিঘর প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৬
প্রচ্ছদ : ডিলান
.
লেখকের কথা :
তখন দু’হাজার বারো সাল, কারমাইকেল কলেজের এইচএসসি সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। বাসা থেকে কাছেই কলেজ, হেটেই যাওয়া আসা করতাম বেশিরভাগ সময়। গ্রীষ্মের এক দুপুরে কলেজ থেকে ফিরছি। মাথার ওপর গনগনে সূর্য। রোদে মাথার চাঁদি এমন তেতে গেছে যে ডিম ভেঙে দিলে অমলেট হয়ে যাবে। এমন সময় হঠাৎ চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠলো—যেন সিনেমার ক্লিপিংস-রোদে দরদরিয়ে ঘামতে ঘামতে একটা শুকনো ভুট্টো খেতের মাঝে রাইফেল উঁচিয়ে ঘুরছে এক লোক। এখনই মারাত্মক কিছু ঘটবে ভয়ঙ্কর কিছু একটা এসে দাঁড়াবে তার সামনে।
আর কিছু না। এইটুকুই। এই একটা দৃশ্য থেকেই শুরু। তিন বছর ধরে দৃশ্যটা মাথার ভেতরে নাড়িয়ে চাড়িয়ে নিয়ে যখন প্রথম পেশাগত পরীক্ষার পরে পড়াশোনার চাপ কমলো, তখন লিখে ফেললাম গল্পটা। একটা দৃশ্য থেকেই ডালপালা ছড়িয়ে কল্পনাটি এখন আস্ত একটা উপন্যাস শ্বাপদ সনে।
শ্বাপদ সনে একটা হরর-থুলার। হররের প্রতি বাঙালি পাঠকের অনেকেরই বিতৃষ্ণা আছে-আর এজন্যে দোষ দেয়া যায় না তাদেরকে। হরর বলতে অনেকে ধরে নেন সস্তা প্রেডিক্টেবল ভুত-প্রেতের গল্প, আবার অনেকের কাছে ইংরেজি থেকে দুর্বলভাবে অনুবাদ করা একই ধাঁচের ভ্যাম্পায়ার, অয়্যারউলফ আর জোম্বির কাহিনী। হয়তো বাংলায় ভালো হররের অভাবই এর কারণ। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে অবশ্য।
শ্বাপদ সনে যদি হররের ব্যাপারে আপনাকে অন্যরকম একটা ধারণা দিতে পারে তাহলে আমার কি-বোর্ডের খটখটানি সফল হয়েছে ধরে নেব।
তবে শ্বাপদ সনে’তে পাবেন সুপারন্যাচারাল আর ন্যাচারালের মাঝে একটি সংঘাত। কোনটা জিতলো, সেটা বুঝবেন বইয়ের শেষে। শুভেচ্ছা রইলো।
নাবিল মুহতাসিম
শহীদ ডাক্তার ফজলে রাব্বি হল
ঢাকা মেডিকেল কলেজ
.
উৎসর্গ :
১৯৭১ সালের ২৮শে মার্চে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে লাঠিসোঁটা, তীর-ধনুক, বল্লম আর মরিচের গুঁড়া নিয়ে অত্যানুধিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপরে আক্রমণে অংশ নেয়া প্রায় দু-হাজার শহীদ ও গাজী বাঙালি ও সাঁওতাল শিশু-বৃদ্ধ-রমনী-যুবকদেরকে….
গ্রেকো-রোমান, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, ঈজিপ্সিয়ান, জাপানিজ, পারসিয়ান, ইন্ডিয়ান মিথলজি পড়ে দেখেছি শুধু তাদের বীরত্বের সাথে তুলনা করা যায় এমন কিছুর খোঁজে। পাইনি। সেই পবিত্রভূমি নিশবেতগঞ্জের কয়েক কিলোমিটার দূরে জন্ম আমার। কত বড় সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছি আমি।
হে বীরেরা, এই বই আপনাদেরকে উৎসর্গ করলাম। আর তাদেরকে, যারা রংপুরকে ভালোবাসেন। যাদের আত্মায় রংপুর।
.
মুখ বন্ধ
জামশেদের জবানবন্দি থেকে
কাকটা ডাকতে ডাকতে আমার মাথার এত কাছ দিয়ে উড়ে গেল যে ওটার ডানা ঝাপটানোর শব্দ পরিস্কার শুনতে পেলাম।
“কা! কা! কা!”
চোখের ওপরের কোণা দিয়ে লম্বাটে একটা কালচে ঝলক দেখলাম শুধু। কাকটা। কি কাক ওটা? জানতে ইচ্ছা করছে। সাধারণ পাতিকাক? না গম্ভির, রাজকীয় র্যাভেন? দাঁড়কাক? জানতে ইচ্ছা করছে কেন যেন। মাথাটা সম্ভবত কাজ করছে না আমার। হয়, এমনটা হয় অনেকসময়। বিশেষ করে চরম উত্তেজনার মুহূর্তে। যেমন এখন।
হাত কিন্তু ঠিকই কাজ করছে আমার। রাইফেলের ব্যারেলটা কাঁপছে না। মার্লিন কোম্পানির রাইফেল। অনেক পুরনো। বোল্ট অ্যাকশন। মনের মধ্যে বহুবার ঘুরপাক খাওয়া প্রশ্নটা জেগে উঠলো আবার-দরকারের সময় অস্ত্রটা ঠিকমত কাজ করবে তো?
কাকটা বিদায় নেবার পরে চারপাশটা আবার নিরব। ঠিক যেন মিউট করা একটা সিনেমা। একটুও বাতাস নেই। চারপাশের ভুট্টা গাছগুলোর একটাও কাঁপছে না। আমার চারপাশ ঘিরে একদম স্থির ভুট্টা গাছগুলো। দরদরিয়ে ঘামছি আমি। নিজের মাথায় আর মুখে হাত বোলালাম। আমার সারা মুখ ঘামে ভেজা। যত্ন করে রাখা গোঁফজোড়া আর মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি হাতে ঠেকলো।
মাথার ওপরে ঝাঁ ঝাঁ করছে সূর্যটা। তীব্র রোদ। কিন্তু এই মরা ভুট্টা খেতের গাছগুলোর মাঝে তবুও ছায়া-ছায়া অন্ধকার। দরদর করে ঘামছি
রুমাল বের করে ঘাম মুছবো কি? না, ঝুঁকিটা নেয়া ঠিক হবে না। বন্দুকে হাত রাখাটাই সবচেয়ে নিরাপদ ঠেকছে আমার কাছে। রাইফেল নামানো যাবে না।
এদিক-ওদিকে তাকিয়ে নিলাম একবার। কোনদিকে যাবো, বুঝতে পারছি না। পথ হারিয়ে ফেলেছি ভালোভাবেই। অনিশ্চিতভাবে সামনে বাড়লাম এক পা।
প্রচন্ড রোদ মাথার ওপরে। মগজ ফোটানোর মত গরম রোদ। চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মত রোদ।
সামনের একটুখানি জায়গার ভুট্টাগাছ দু-দিকে সরে আছে যেন খানিকটা। পায়ে চলার পথ?
কার?
মানুষের, না অন্যকিছু?
মানুষের, না…
তবে সন্দেহ নেই, এই পথে যাওয়া আসা করে কোনোকিছু।
আরেকটু সামনে এগোলাম। পায়ের নিচে মচমচ করছে ভুট্টার শুকনো পাতা। অসহ্য নিরবতার মাঝে সেটাই বড় বেশি হয়ে কানে বাজছে।
হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম হঠাৎ। যা হয় হবে, আমি এদিক দিয়েই যাবো। বন্দুকের বাট কাঁধে ঠেকিয়ে নিয়েছি। আমার ভরসা এখন একটাই, আমার গোল্ডমেডেল-জেতা নির্ভুল নিশানা।
দশ পা গিয়েই থমকে গেলাম। আরেকটা পায়ের শব্দ কানে এসেছে। কেউ এদিকেই আসছে। আমি তৈরি। কাঁধে রাইফেল। একেকটা সেকেন্ডকে একেকটা ঘন্টার মতো লাগছে।
পায়ের শব্দটা কাছিয়ে আসছে। বাড়তে বাড়তে সেটা যেন গির্জার ঘন্টার মতো জোরালো হয়ে আমার কানের পর্দা কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
এখনই আমার সামনে এসে দাঁড়াবে জিনিসটা।
Book Content👉
অধ্যায় ১ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ১ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি ঘামছি।
কলম্বোর এই শ্যুটিং অ্যারিনায় যে খুব বেশি লোক আছে, তা না। মোটমাট সিট হবে দুইশোর মত। তার মধ্যে গোটা পঞ্চাশেক দর্শকদের দখলে। শখের দর্শক বলতে গেলে নেই। গুটিকতক সাংবাদিক আছে, আর বাকি সবাই আসলে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া শুটারদের আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধব। উৎসাহ দিতে এসেছে তাদের বন্দুকবাজ বন্ধুকে।
আমি একবার আড়চোখে তাকালাম সামনের সারিতে বসা আমার কোচ খালেকুজ্জামান স্যার আর তার পাশে বসা দুই স্বদেশী শুটার মনির আর সাদেকের দিকে। আমার ফ্রেন্ডস বলতে এই-ই, আর ফ্যামিলির কেউ উপস্থিত নেই। ‘ফ্রেন্ডস’ কথাটাও কতটা যুতসই হলো জানি না। মনির আর সাদেকের চোখেমুখে যেন লেখা আছে, আমি যাতে আমার ফাইনাল শটটায় ভালো না করি। ঘরের শত্রু বিভীষণ। নিজেরা ফাইনালেই উঠতে পারেনি। এখন আমি গোল্ড মেডেলটা না পেলেই তাদের পরাজয়ের ক্ষতে খানিকটা প্রলেপ পড়ে। আচ্ছা, আগে মেডেলটা জিতে নেই। দেশে ফিরে মজা দেখানো যাবে ছোটলোকের বাচ্চাগুলোকে।
একমাত্র খালেকুজ্জামান স্যারের চোখেই খানিকটা সত্যিকারের উৎকণ্ঠা দেখা যাচ্ছে। বরাবরই তাঁর প্রিয় ছাত্র আমি তার স্পেশাল তদবির না থাকলে কখনো- বিকেএসপিতে-না-যাওয়া, এর আগে মাত্র তিনটি-প্রতিযোগিতায়-অংশ-নেয়া আমি কখনো সাফ গেমসে আজকে এই দশ মিটার এয়ার রাইফেলের ফাইনালে উপস্থিত হতে পারতাম না, বন্দুক হাতে যত ভালোই হই না কেন, তার পরও যতটুকু খটকা ছিলো শুটিং ফেডারেশনের, সেটা দূর হয়ে গেছে আমার বাপের নাম শুনে। জন্মকালা ছাড়া এই দেশে আর কেউ নেই যে সফল শিল্পপতি আব্বাস রহমান খানের নাম শোনেনি।
যাহোক, আমার ওপর অনেক আশা ছিলো খালেকুজ্জামান স্যারের। একজন কোচ হিসেবে ছাত্রকে যতরকম সাহায্য করা যায়, করেছেন। তার প্রত্যাশার দাবানলে ঘি হিসেবে পড়েছে আজকে আমার এই ফাইনালে উঠে আসা। গোল্ড মেডেলটা জিতলেই কেবল যোগ্য গুরুদক্ষিণা দেয়া যাবে খেলাপাগল দরিদ্র মানুষটাকে।
ঘাড় ফিরিয়ে সামনে তাকালাম। নিজের স্পটে দাঁড়িয়ে আছি আমি, পরনে স্পেশাল আউটফিট, বুকের একটা কাগজে বড় করে লেখা প্রতিযোগি নাম্বার। হাতে ধরা এয়ার রাইফেলটা স্ট্যান্ডের ওপরে রাখা, জিরিয়ে নেবার সুবিধার জন্য। মাথায় ছাদ-ছাড়া বিশেষ ক্যাপ। ক্যাপ থেকে আমার দুই চোখের পাশে নেমে এসেছে দুটো কাগজের টুকরো। দেখতে কিম্ভুত দেখাচ্ছে বটে, কিন্তু যখন চোখটা রাইফেলের স্কোপে রাখবো তখন কাগজের টুকরোদুটো উজ্জ্বল আলো থেকে বাঁচাবে আমার চোখ দুটো।
আমার সাথের অন্য সাতজন প্রতিযোগিও চেয়ারে বসে জিরিয়ে নিতে নিতে সরু চোখে আমার প্রতিটা নড়াচড়া দেখছে। পাকিস্তানি মোটা ভুরুওয়ালা দু-জনের জেতার সম্ভাবনা অবশ্য সুদূরপরাহত। তাদের শেষ শট নেবার বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে কোনোরকম মেডেল জেতার চান্স। নেপালের ফাইনালিস্টেরও সেই একই দশা। শ্রীলঙ্কান শুটার পেরেরা শেষ শটের পরে এখন ব্রোঞ্জ পজিশনে আছে, মনে প্রাণে সে দোয়া করছে আমি চরম বাজে করে যেন ওকে রূপাটা পাইয়ে দেই। ভারতীয় শুটার আনন্দ পঞ্চম স্থানে, নির্বিকার তাকিয়ে আছে আমাকে ফুঁড়ে আমার পেছনের কোনো এক জায়গায়। আর এখন আসল খেলাটা চলছে আমার আর আরেক ভারতীয় শুটার লাক্সমানের মধ্যে। নিজের সবগুলো শট শেষ করে প্রথম পজিশনে এখন লাক্সমান, দ্বিতীয় পজিশনে থাকা এই আমি শেষ শটটায় একটু খারাপ করলেই গোল্ড মেডেল নিশ্চিত তারই। খারাপ করার কোনো রাস্তা নেই আমার। ১০.২ এর নিচে করলে হারবো, নতুন রেকর্ডসহ মেডেল পাবে লাক্সমান। তবে আমি ১০.৬ কিংবা তারচেয়ে বেশি করলে আবার নতুন রেকর্ড আমার হবে। সাথে গোল্ড মেডেল তো থাকছেই।
একজন স্নাইপার আর স্পোর্টিং শুটারের শত্রু দুটো-দুটোর উৎপত্তিই তার নিজের দেহে। হার্টবিট আর নিশ্বাস। দুটোই কাঁপিয়ে দেয় রাইফেলের ক্রস-হেয়ার। দম আটকে তো থাকা যায়, কিন্তু হার্টবিট সবসময় কন্ট্রোল করাটা কঠিন। বিশেষত এমন একটা চূড়ান্ত মুহূর্তে, যখন গোল্ড মেডেলের দোরগোড়ায় আমি, যখন বিচারক থেকে দর্শক, সবার চোখ একুশ বছরের এই আমার ওপরে।
যেন কোথাও যাবার তাড়া আছে, এমনি ধুকপুক করছে আমার হৃৎপিন্ডটা। একটা লম্বা শ্বাস নিলাম আমি, ছাড়লাম ধীরে ধীরে। হার্টবিটের কোনো হেরফের ঘটাতে পেরেছি বলে মনে হলো না। অথচ এই শটটা পারফেক্ট হতে হবে। বড় বেশি পারফেক্ট হতে হবে।
ডাক্তারি পড়ুয়া আমার কাজিন সামাদের বলা একটা কথা মনে পড়লো। “হার্টবিট বাড়ে সিমপ্যাথেটিক স্টিমুলেশনের কারণে। হার্টবিট কমায় কে? হয় নাই, প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্টিমুলেশন। এই দুটোর কোনোটার ওপরই আমাদের কন্ট্রোল নেই। জামশেদ ভাই, যখন আপনি শুটিং করবেন, তখন চিন্তা করবেন, ভরপেট খেয়েদেয়ে আপনার সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন, পা সামনের টেবিলের ওপরে, স্টেরিওতে হালকা ভলিউমে জন ডেনভারের গান চলছে, আপনার ঘুম ঘুম লাগছে। কাজে দেবে, দেখবেন।”
কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে সামাদের কথামত কাজ করার চেষ্টা করলা, কিছুই হলো না। লাভের থেকে সামাদের ওপর রাগের চোটে হার্টের নাচানাচি আরো বাড়লো।
ভয়টা কমানোর জন্যই বুঝি কোচের দিকে আরেকবার তাকালাম।। খালেকুজ্জামানের দিকে চোখ না পড়ে পড়লো তার পাশের সিটটার দিকে। সেখানে আমার পিতৃদেব বসে আছেন।
আমার বাবা আব্বাস রহমান খান। আমার কোনো জন্মদিনেই যিনি উপস্থিত থাকতে পারেন না। স্কুলের কোনো প্যারেন্টস ডে’তেই যিনি কখনো উপস্থিত হতে পারেননি। যার ব্যস্ততার কারণে সপ্তাহের পাঁচ দিনই আমাকে রাতের খাবার একা খেতে হয়। যার এখন ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুরে থাকার কথা। তিনি আজ এই বুক- দুরুদুরু মুহূর্তে উপস্থিত।
আমাকে ফিরে তাকাতে দেখে বাবা যেন খানিকটা বিরক্তই হলেন। চোখের কোণে কয়েকটা ভাঁজ পড়লো তার, শক্ত চিবুকটা ওঠালেন পাঁচ ডিগ্রি-যার অর্থ, এই দিকে কি দেখছো? সামনে তাকাও। হাতের কাজটা শেষ করো।
আমি পিতৃদেবের আদেশ পালন করলাম। ঝট করে ঘাড়টা সামনে ঘুরিয়ে কাঁধে রাইফেলের বাটটা লাগিয়ে স্কোপের মধ্য দিয়ে টার্গেটের দিকে তাকিয়েই ট্রিগার টানলাম।
রাইফেলটা নামিয়ে আবার তাকালাম টার্গেটের দিকে। প্রথম কয়েক সেকেন্ড কিছুই দেখতে পারলাম না। কোথায় ফুটোটা? এয়ার রাইফেলের প্যালেট যখন কাগজের টার্গেটটাকে ফুটো করে, পরিষ্কার একটা গোল ছাপ দেখা যায় তখন। কই সেটা? টার্গেট একেবারে মিস করলো নাকি?
গোটা অ্যারেনা জুড়ে তালির শব্দ শুরু হবার পরপরই ফুটোটা চোখে পড়লো আমার। টার্গেটের একেবারে কেন্দ্রে। একেবারে মাঝখানে তাই চোখে পড়ছিল না এতক্ষণ।
আমি রাইফেল হাতে নিয়ে স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে, আর খালেকুজ্জামান স্যার কাঁদতে কাঁদতে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।
পুরস্কার বিতরণীর সময় লাক্সমানের চেয়ে উঁচুতে দাঁড়ালাম আমিই। শেষ শটে ১০.৯ করে সোনার মেডেলটা আমার গলাতেই ঝুললো। সেই সাথে সাফের নতুন রেকর্ডও ঢুকে গেল পকেটে।
গতবারের চ্যাম্পিয়ন আমার গলায় যখন সোনার মেডেলটা গলিয়ে দিলো, আর আমি যখন সোজা হয়ে দাঁড়ালাম, দেখলাম, বাবা দূরে দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছেন আস্তে ধীরে। তার কঠিন চেহারায় খানিকটা গর্বের ছোঁয়া যেন। অবশ্য বিরক্তির ভাবটাও কম নয়। ব্যাকগ্রাউন্ডে বাজা জাতীয় সঙ্গিতটাই বোধ হয় এর কারণ। “ট্যাগোর কোনো পোয়েট হলো নাকি? ফকিরের দেশের ফকিরের ভাষা, তার আবার কবি!” আমাদের গাড়ির ড্রাইভার একবার ভুল করে গাড়ির ক্যাসেট প্লেয়ারে রবীন্দ্রসঙ্গিত দিয়ে ফেলায় বলতে শুনেছিলাম তাকে।
আনুষ্ঠানিকতা শেষ হবার পরে বাবা আমাকে ডেকে নিলেন। “ওয়েল ডান। ভাল করবে জানতাম। লেটস সেলিব্রেট। এখান থেকে ফাইভ মিনিটসের ডিসটেন্সে একটা ভালো রেস্টুরেন্ট আছে। কোরাল কিং। ইউ লাইক সি ফুড, রাইট?”
আমি কোনোমতে মাথা নাড়লাম। বাবার মুখ থেকে বের হওয়া প্রথম তিনটে কথা সত্যিই শুনেছি কিনা তা নিয়েই হালকা দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছি। পড়াশোনার কারণে বাহবা শোনা হয়নি কখনো। তাছাড়া বাবা আমাকে খাওয়াতে নিয়ে যাচ্ছেন, এটা শেষ কবে হয়েছে মনে করতে পারছি না।
বাইরে চলে এলাম। ইভেন্ট শুরু হয়েছে বিকেলে, কখন রাত হয়ে এসেছে, বুঝতেই পারিনি। কলম্বোর রাস্তা এত ফাঁকা কেন, বুঝলাম না। একটা ট্যাক্সি রেডিই ছিল। আমরা চড়ে বসতেই স্টার্ট দিল সেটা। বাবার সাথে কেউ নেই কেন, সেটা মনে এল একবার। বাবাকে কখনো একা কোথাও যেতে দেখিনি। বডিগার্ড সাথে না থাকলেও বাবার ডান হাত জব্বার আঙ্কেল তো থাকবেনই।
ভাবাভাবির বেশি একটা সময় পেলাম না বটে। ট্যাক্সি চলতে চলতেই হঠাৎ ঝুপ করে রাস্তার সব ক’টা বাতি নিভে গেল। দোকানপাট আর বাসাবাড়িরও কোনো বাতি জ্বলছে না। কবরের আঁধার নেমে এলো কলম্বো শহরের ওপরে।
অবাক হয়ে এদিক ওদিক দেখার চেষ্টা করছি আমি। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ব্যাপারটার ভয়াবহ দিক এক সেকেন্ড পরেই বুঝতে পারলাম আমি, কেঁপে উঠলাম সঙ্গে সঙ্গে। রাস্তার কোনো বাতিরই হেডলাইট অন নেই এখন। আঁধারের মধ্যেই পাগলা ঘোড়ার মত ছুটে যাচ্ছে আমাদের ট্যাক্সিটা।
আতঙ্কে অসাড় আমি কোনোমতে খামচে ধরলাম ট্যাক্সিওয়ালার কাঁধ স্পিডোমিটারের আলোয় তার অবয়বটা কোনোমতে বোঝা যাচ্ছে। “ড্রাইভার! স্টপ! স্টপ!”
কোনো লাভ হলো না। গাড়ির স্পিড কমে তো নেই-ই, বরং যেন বাঁধাধরা একটা হারে বাড়ছে…যেন ড্রাইভারের অসাড় একটা পা মেঝের সাথে ঠেকিয়ে রেখেছে অ্যাক্সেলেটরটাকে।
আমি পাগলের মতো ড্রাইভারকে আরেকটা ঝাঁকুনি দিতেই আস্তে করে স্টিয়ারিং হুইলের ওপর ঢলে পড়লো লোকটা।
থ হয়ে থাকলাম এক মুহূর্ত। মাথা কাজ করছে না। এসব কি হচ্ছে?
বাবার দিকে ফিরলাম আমি, আর সাথে সাথে শীতল একটা শতপদী যেন কিলবিলিয়ে নেমে গেল আমার শিরদাঁড়া বেয়ে। বাবার শরীরটা মিশে গেছে কালিগোলা আঁধারে, কিন্তু তার চোখ দুটো শুধু ফসফরাসের মতো জ্বলছে একটা সবজেটে আভা নিয়ে, রাতের আঁধারে শিকারে বেরোনো কোনো হিংস্র শ্বাপদের মত। সোজা সামনের দিকে চেয়ে আছে চোখদুটো।
সামনের দিকে চাইলাম আমিও। উইন্ডশিন্ডের সামনে নিরেট যে কালো অবয়বটা লাফিয়ে বড় হচ্ছে, সেটাকে একটা গাছ বলে চিনতে পারার সাথে সাথেই প্রচন্ড একটা….
লাফিয়ে উঠে বসলাম আমি, চেঁচাচ্ছি উন্মত্তের মত। গলা শুকিয়ে কাঠ, খসখস করছে। কতক্ষণ এভাবে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চেঁচিয়েছি জানিনা, নির্ঘাত অনেকক্ষণ হবে। কারণ আমার ঘরের বাতিটা জ্বালানো, ঘুমভাঙা চোখে হাজির হয়েছে আমার চাচাতো ভাই সামাদ, আর আমাদের কর্মচারি আক্কাস মিয়া।
“জামশেদ ভাই? আবার ওই একই স্বপ্ন?” এক পা এগিয়ে জানতে চাইলো সামাদ। ঘুমভাঙা চোখে কেমন বোকাবোকা দেখাচ্ছে ব্যাটাকে।
জবাব দিলাম না, দেবার মুড নেই। কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মুছে বেডসাইড টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলাম পানির গ্লাসের জন্য।
“মরা মাইনষে অনেক সময় এমনি কইরা স্বপ্ন দেখায়।” শুরু হলো আক্কাস মিয়ার বয়ান। “আপনার আব্বার রূহের শান্তি হয় নাই। উনি আপনারে স্বপ্ন দেখাইয়া কিছু কইতে চান। আমার মনে হয়…
“তোমার কি মনে হয় সেটা এখন শুনতে চাচ্ছি না,” কাটাকাটা স্বরে জবাব দিলাম আমি। আর কবে শিখবে আক্কাস মিয়া? আমাদের জন্মেরও আগ থেকে আমাদের বাসায় কাজ করে। এখনো যদি আমার মুড না বোঝে তাহলে সমস্যা।
আমার ধমকে গভির একটা হতাশার ছাপ পড়লো আক্কাস মিয়ার পাকা দাড়িওয়ালা শুকনো চেহারায়। “তবু ছোটসাব, উনি কি কইতেছেন সেটা বোঝার চেষ্টা করেন. হাজার হইলেও বাপ, মইরা গেলেও তারে মান্য করন লাগে…” বলতে বলতে রুম ছেড়ে চলে গেল আক্কাস মিয়া।
বেয়াক্কেল বুড়ো কোথাকার!
সামাদ তখনো অনিশ্চিত ভঙ্গিতে রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আড়চোখে সেটা বুঝতে পেরে ক্ষেপে উঠলাম আমি। কেউ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে প্রচন্ড অস্বস্তি হয়, রেগেও যাই ভীষণ। গাধাটাকে এতবার বলার পরও হুঁশ হলো না!
“যা, রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়গে,” সামাদকে বললাম। “রাত কম হয়নি।” ঘড়ির দিকে আড়চোখে তাকালাম একবার। তিনটা পেরিয়ে গেছে।
“আমার মনে হয় আপনার একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার, জামশেদ ভাই,” শরীরের ওজন এক পা থেকে আরেক পায়ে চাপিয়ে ইতস্তত ভঙ্গিতে বললো সামাদ।
চোখ গরম করে তাকালাম সামাদের দিকে। বেটেখাটো চেহারা, পাঁচ ফুট ছয়ের বেশি হবে না। বংশগুণে ফরসা রংটা পেয়েছে আমাদের। ছলছলে দুটো চোখ, বসে যাওয়া গাল, মেডিকেলের পড়াশোনার চাপে সামনের দিকে পাতলা হয়ে আসা চুল-সব মিলিয়ে আমার পাশে দাঁড়ালে আমার আপন ছোট জ্যাঠাতো ভাই বলে চিনতে কষ্টই হয় সামাদকে। ওর পরনে ঢিলেঢালা পায়জামা আর গেঞ্জি, শুতে যাবার পোশাক। সন্দেহ নেই আমার চিৎকারে জেগে উঠেই নিচতলা থেকে ছুটে এসেছে সে, সাথে করে নিয়ে এসেছে তার পাশের রুমের আক্কাস মিয়াকে।
“ডাক্তারি পাশ করেছিস বলেই সবসময় আমাকে ডাক্তারি জ্ঞান দিতে হবে তোর, এমন কোনো কথা নেই,” আমার হাতে-পায়ে বিশ্রীভাবে পেঁচিয়ে আছে বেডশিটটা, ওটা ছাড়িয়ে নিতে-নিতে ঠান্ডা গলায় বললাম। মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে আছে আমার, ঘুমটাও গেছে ছুটে।
সামাদ আর আক্কাস মিয়ার সামনে স্বভাবমত গরম দেখালেও ভেতরে ভেতরে কাঁপছে আমার কলজেটা। আবার সেই জঘন্য দুঃস্বপ্ন! বিরামহীন পরপর ক’রাত চললো এমনটা, গোণা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু আজকের স্বপ্নটা বাকিগুলোর চেয়ে আলাদা। এত পরিস্কার আর খুঁটিনাটি স্বপ্ন জীবনে কখনো দেখিনি। লুসিড ড্রিম বোধহয় একেই বলে। স্বপ্নের শুরুটা রীতিমত অবাক করে দিয়েছে আমাকে। পাঁচ বছর আগে, ‘৮৮-তে সাফ গেমসে সোনা জেতার মুহূর্তটা এমন বাস্তব হয়ে ফিরে এসেছিল যে ওটাকে আমার ঘুমন্ত মগজের কারসাজি বলে মনে করার কোনো কারণ ছিল না। অ্যাক্সিডেন্টে বাবা মারা যাবার ঘটনাটা গত কয়েক রাত ধরেই লাগাতার স্বপ্নে দেখছি, কিন্তু আমার সোনা জেতার মুহূর্তের সাথে হাইব্রিড হয়ে সেটা ফিরে আসলো কেন, তার কোনো ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই
আর ঘুমোনোর চেষ্টা করে লাভ নেই। বিছানায় উঠে বসে বেডসাইড ড্রয়ার খুলে হুইস্কির বোতলটা বের করলাম। চোখের কোণে সামাদের নড়াচড়া ধরা পড়লো আমার। কোনো ডাক্তার মার্কা উপদেশবাণী দেবার সুযোগ দিলাম না বটে ওকে। বোতল খুলে গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে শীতল চোখে সামাদের দিকে তাকালাম। “ইউ আর নট মাই ডক্টর। নাউ গো ব্যাক টু ইওর ফাকিং বেড।”
মাথা নিচু করে বিদায় নিলো সামাদ।
রাস্তার দিকের বিশাল জানালাটার কাছে এসে দাঁড়ালাম। হাতে সুরাপাত্র। পাল্লা ফাঁক করে দিতেই বিলিতি ধাঁচের জানালা দিয়ে হু-হু করে হাওয়া এসে ভরিয়ে দিল ঘরের ভেতরটা। শেষ রাতের ঠান্ডা বাতাস, আর খালি পেটে পড়া তরল আগুন স্বপ্নের ধকল কাটানোর জন্য এর জবাব নেই। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বাইরের সুনসান রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। গোটা ধানমন্ডি ঘুমে আচ্ছন্ন। গোটা ঢাকা শহর ঘুমিয়ে আছে।
রাস্তার বাতি খানিকটা জায়গা আলোকিত করে রেখেছে, তার বাইরে পুরোটাই অন্ধকার। আলোটার চারপাশে ঘোরঘুরি করছে কয়েকটা পোকা। সেদিকে তাকিয়ে হুইস্কির গ্লাসে একের পর এক চুমুক দিয়ে গেলাম আমি।
অধ্যায় ২ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ২ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
আমার বাসায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পার্টিটা প্রত্যেকবার প্রায় একইভাবে শুরু হয়।
বৃহস্পতিবার বিকালটা আমি দোতলায় আমার রুমে ঘুমিয়েই কাটাই। উঠি সাড়ে ছয়টার দিকে। আমার বন্ধুবান্ধবের আগমন অবশ্য ছয়টার আগে থেকেই শুরু হয়। কখনো কখনো আমাদের কোম্পানির ম্যানেজারও আসে, পুরো সপ্তাহের কাজ বুঝিয়ে দেবার জন্য। পঞ্চাশোর্ধ আনিসুলসাহেব খুবই ভদ্রলোক বটে, কিন্তু ওনার সামনে বসে ব্যবসায়িক প্যাঁচাল শুনতে ইচ্ছা করে না। বাবার মৃত্যুর পর যে কোম্পানির প্রায় পুরো মালিকানা আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে, সেটা নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। প্রায় সময়ই ঘুমের অজুহাতে আমি তার সাথে দেখা করি না। আনিসুলসাহেব কাগজপত্র রেখে চলে যান। সেসব আমার আর পড়ে দেখা হয় না। কখনো কখনো অবশ্য আনিসুলসাহেবের সামনে বসতেই হয়। কোনোমতে হ্যা হুঁ করে সময় পার করে দেই। ম্যানেজারের কথা এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যায়। যখন দেখি উনি কোটের কলার ঠিক করছেন তখনই কেবল একটু চনমনে হয়ে উঠি। উনি কোটের কলার ঠিক করার মানে হচ্ছে চলে যাওয়া।
তো, পার্টিতে বেশিরভাগ সময় সবার আগে আসে আরিফ। বাপ বিজনেস আরিফ ম্যাগনেট। এক্সপোর্ট-ইমপোর্টের ব্যবসা। বাপে যত উন্নতি করছে ব্যবসায়, তত ঝুঁকছে নারী আর মদে। সমস্যা হচ্ছে কয়েক পেগ পেটে পড়ার পরই বিচ্ছিরিভাবে তোতলানো শুরু করে সে। তখন ওর কাছাকাছি থাকলে আপনার চোখেমুখে থুতুর ছিটা পড়বেই। তাছাড়া ব্যাটার হাঁপানি আছে, তবু সিগারেট টানা চাই। একবার তো দম-টম আটকে আমাদেরকে বিপদেই ফেলে দিয়েছিল। সামাদ না থাকলে মহা মুশকিল হতো।
ধীরে ধীরে রিফাত, ফাহাদ চলে আসে এরপরে। রিফাতের বাপের হোটলে বিজনেস। সেই রমরমা। রিফাতকে দেখে অবশ্য বড়লোকের ব্যাটা বলে মনে হবে না আপনার কোনোমতেই। মোটা, কালো, বেঁটে। কুঁতকুঁতে দুই চোখ। শটগ্লাস হাতে নিয়ে যখন হাসে তখন ভুড়িটা কুৎসিতভাবে ওপর-নিচে দুলতে থাকে তার। চট করে রেগে যাবার বদভ্যাস আছে। অবশ্য আমার কাছে এসে ঠান্ডা। আমার বদরাগটা বংশগত। রিফাত একবার আমার সাথে ঘাড়তেড়ামির চেষ্টা করেছিল বটে বিরানব্বই সালের কোনো একসময়, মানে গত বছর। স্রেফ চোখের দৃষ্টি দিয়ে ঠান্ডা করে দিয়েছি। তাছাড়া এমনিতে আমার সাথে সম্পর্ক খারাপ না।
ফাহাদেরা পুরান ঢাকার লোক। বেশ কয়েক পুরুষ ধরে ধনী, ওর চাপা ওর কোন পূর্বপুরুষ নাকি সিরাজউদ্দৌলার দরবারে কি যেন ছিলো। চেহারাটা অবশ্য বেশ। টকটকে ফরসা রং, গোলাপি ঠোঁট, চমৎকার হেয়ারলাইন। অবশ্য চেহারা দিয়েই যে সব হয় না, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ফাহাদ। স্কুলে যখন একসাথে পড়তাম, স্যারেরা ‘মাকাল ফল’ আর ‘সুন্দর গাধা’ বলে ডাকতেন ওকে। অবশ্য ফাহাদের তাতে কিছু আসে যায় বলে মনে হয় না। যার বাপের এত টাকা আর ঢাকায় এত জমি তার ক অক্ষর গোমাংস হলেও সমস্যা নেই। নারীপ্রীতি আর নানান বন্ধুর বাসায় পার্টি নিয়ে সুখেই আছে সে, ইন্টার পরীক্ষা পাশ করুক আর না করুক।
এরাই পার্টির নিয়মিত সদস্য। আরো বেশ কয়েকজন থাকে বটে, তবে তারা অনিয়মিত। তারা নিজ ইচ্ছায় আসে যায়। আমি কিছু বলি না।
সামাদও কিন্তু সবসময় হাজির থাকে এই থার্সডে নাইট ডিলাইটে। কোন্ অদ্ভুত কারণে ও কখনো আমার পিছু ছাড়তে চায় না, বের করতে পারিনি। সেই পিচ্চিকাল থেকে আমাদের বাসাতেই মানুষ ও। তখন যেমন সবসময় আমার পেছনে লেগে থাকতো, মুখে একটা হাত পুরে বড় বড় চোখ করে আমাকে দেখতো, আর ছোট ছোট পায়ে সবসময় আমার পেছনে ঘুরতো, সে স্বভাবের খুব বেশি পরিবর্তন এখনো হয়নি। আমি স্রেফ উপেক্ষা করে যাই ওকে, কিন্তু সামাদ আমার পিছু ছাড়ে না। ডাক্তারি পাশ করে ইন্টার্নিও শেষ করে ফেলেছে, কিন্তু আমাদের বাসা ছাড়ার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি বোধহয় সেজন্যই। পার্টিতে অবশ্য খুব বেশি ড্রিঙ্ক করে না সে। কেবল মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো চুমুক দিতে দেখি গ্লাসে।
বাবা বেঁচে থাকতে বাসায় এমন পার্টি দিতে পারতাম কেবল কালে ভদ্রে। উনি বিজনেস ট্রিপে বাইরে কোথাও গেলে। এখন প্রতি সপ্তাহেই চলে এমনটা। আসলে গোটা ব্যাপারটা কেমন যেন আপনা থেকেই হয়। বাবা মারা যাবার পরে আমার ‘বন্ধুরা’–যদিও কথাটা কতটা যুৎসই হলো জানি না-স্বান্ত্বনা জানাতে আসার পর থেকে কিভাবে কিভাবে সেটা ফি-হপ্তার পার্টিতে গড়ালো সেটা আমিও জানি না।
আজ ড্রয়িরুমে ঢুকলাম একটু দেরি করেই। ঘুমের রেশ তখনো কাটেনি আমার চোখ থেকে। ঘুমটা হয়তো পরের আধাঘন্টাতেও ভাঙতো না যদি ড্রয়িংরুমের বত্রিশ ইঞ্চি কালার টিভিটা হাই ভলিউমে ছাড়া না থাকতো। আমার বন্ধুরা সবাই এমটিভিতে মিউজিক ভিডিও দেখতে ব্যস্ত। কেবল টিভি নামের এই জিনিসের আমদানি হয়েছে আমাদের বাসায় বছরখানেক হলো।
“আরে, মিস্টার পাংচুয়ালিটি!” আরিফের গায়ের সাথে বিপজ্জনকভাবে ঘেঁষটে থাকা মেয়েটা খিলখিল করে হেসে বললো। জেরিন। মুখে এক কেজি মেক-আপ, ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক, চোখের পাতায় রং মাখিয়ে আর কিছু বাদ রাখেনি, চুল আর্টিফিশিয়ালি কার্ল করা, হাতের নখ দুই ইঞ্চি লম্বা লম্বা। আঁটসাঁট টপসের ভি কাট গলা দিয়ে ক্লিভেজ ভালভাবে দৃশ্যমান। ডাইনি কোথাকার।
মাপা একটা হাসিতে সবার ‘হাই-হ্যালো-কিরে দোস্ত সামাল দিয়ে কাউচে আরাম করে বসলাম। জেরিনের উপস্থিতিই বলে দিচ্ছে আজকের পার্টিটা অন্তত আমার কাছে জমবে না।
সামাদ একবার বলেছিল, “জামশেদ ভাই, আপনার রক্তে বোধহয় অ্যালকোহল বাফার আছে। নইলে এত পেগ খান কিভাবে?” বাফার কি জিনিস জানি না, কিন্তু মুড থাকলে পেগের পর পেগ গিলতে পারি। আমি এ জীবনে অ্যালকোহল খেয়ে কখনো বমি করিনি। মাতাল না হয়ে এগারো পেগ পর্যন্ত গিলতে পারি।
মাল খেতে হলে সবসময় বন্ধুবান্ধব পরিবেষ্টিত হয়ে হৈ চৈ করে খেতে হবে, এই তত্ত্বে আমি বিশ্বাসী নই। ব্ল্যাক লেবেলের ছিপি খোলার সময় আমাকে ঘিরে বসে কিসব জিনিস নিয়ে বকবক করছিল ওরা। রিফাত বললো ইউরোপের সব দেশ নাকি এক হয়ে যাচ্ছে, কোনো দেশের আর বর্ডার বলে কিছু থাকবে না। দেশটার নাম নাকি হবে ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন। ফাহাদ ভুরু নাচিয়ে বললো, মাইকেল জ্যাকসনের ব্যাপারে নাকি হট নিউজ আছে ওর কাছে। জ্যাকসন কোন এক কমবয়সি ছেলেকে যৌন হয়রানি করেছে, এখন কোর্টের বাইরে মিমাংসা করছে সেটার। বুঝলাম ওদের খুবই ইচ্ছা আমিও সেই আলোচনায় যোগ দেই, কিন্তু মুড নেই আমার। একটা গ্লাস কানায় কানায় ভরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় ‘এক্সকিউজ মি বলে রিফাতকে সামনে থেকে সরিয়ে দিয়ে আলাদা আরেকটা সোফায় গিয়ে বসলাম।
আমার কড়া মেজাজের সাথে পরিচয় আছে ওদের, কেউ আর ঘাঁটালো না আমাকে। তবে সবসময়ই ওদের সাথে এমন আচরণ করি মনে করলে আমার প্রতি অবিচারই করা হবে। আসলে কালকে রাতে ওই বিচ্ছিরি স্বপ্নটা দেখার পর থেকেই কোনোকিছুতে উৎসাহ পাচ্ছি না। সারাদিন বাইরে বের হইনি একবারও। অথচ বেশ ক’জায়গায় যাবার কথা ছিল আমার। সামাদের সাথে অযথাই খারাপ আচরণ করেছি। আইরিন ফোন করেছিল একবার, খানিকক্ষণ হ্যা-হুঁ করে লাইন কেটে দিয়েছি। স্পষ্টতই মন খারাপ করেছে ও . কিন্তু ওসব মেয়েলি ন্যাকামি আমার সাথে অন্তত খাটে না। গা’টা ম্যাজম্যাজ করেছে সারাদিন। খেতে পারিনি কিছুই।
মুখে স্বীকার করি না করি, আমার মানসিক অবস্থা খুব খারাপ, বুঝতে পারছি। বাবা রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাবার ছ’মাস পরেও তার মৃত্যুর ব্যাপারটা আমার মনে এত চাপ ফেলছে কেন, জানি না। কতজনেরই তো বাবা মারা যায়। ফাহাদকে তো বাপ মরার তিনসপ্তাহ পরেই আবার যে-কে-সেই অবস্থায় ফেরত আসতে দেখেছি। আমার ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না কেন?
আর কালকের স্বপ্নটার মানে কি? মরা মানুষ স্বপ্ন দেখায়, বিশ্বাস করি না আমি। মানুষের স্বপ্নের উৎপত্তি তার নিজের মগজে। তার মানে আমার নিজের মগজের অবস্থা আর যাই হোক শান্ত বলা যায় না। অবশ্য খুব ফুরফুরে মেজাজে থাকার কোনো কারণও নেই আমার। ব্যবসাপাতি চালাতে হবে, কিন্তু মন টানে না মোটেও। আইরিনের সাথেও এই মুহূর্তে আমার সম্পর্ক সি-স মোডে আছে। এই চড়াই তো এই উত্রাই। আজকে দেখা করার কথা ছিল ওর সাথে, করিনি। বোধহয় বড় একটা ভুলই করেছি। কোটিপতির মেয়েরা কারো অবহেলা পেতে অভ্যস্ত নয়। আইরিনও তার ব্যতিক্রম নয়। একে-ওকে সময় দেয়া হচ্ছে না কয়েকদিন যাবত, তার ওপর ওর এক্স বয়ফ্রেন্ড রাশেদ আমাকে শাসানি দিয়ে রেখেছে…
নিজের চিন্তায় তিনহাত ডুবে না থাকলে আর পাকস্থলিতে দুই তিন পেগ ব্ল্যাক লেবেল না থাকলে হয়তো আরো আগেই টের পেতাম যে পার্টিতে নতুন কেউ যোগ দিয়েছে। নাকের ফুটোদুটো নিজের ধরানো সিগারের ধোঁয়ায় বুঁদ না থাকলে আগন্তুকের ট্রেডমার্ক লাল মার্লবোরোর গন্ধও অনেক আগেই পেয়ে যেতাম। কাজেই শিপলু একেবারে আমার সামনে এসে আমার কাঁধে হাত রাখার আগ পর্যন্ত ওর কোনো সাড়াশব্দই পেলাম না।
চমকে মুখ তুললাম আমি। একমাথা ঝাঁকড়া কালো চুল, উজ্জ্বল শ্যামলা রঙ ছয়ফুটের সামান্য কম হাইট, গালে আছে-কি-নেই এমন খোঁচা খোঁচা দাড়ি, মুখে লেগে থাকা রহস্যমাখা হাসি, চোখে বঙ্গবন্ধু ফ্রেমের চশমা আর দু’ আঙুলের ফাঁকে জ্বলতে থাকা মার্লবোরো-শিপলু হাজির আমার সামনে। আদর্শির শাপুর শিপলু। চমৎকার চেক শার্ট, জিনস আর কেডসে হালের নায়ক সালমান শাহের মতই ঝলমলে লাগছে ওকে।
“ইউ নো, ম্যান, টেলিফোন বলে একটা বস্তু আছে, আর সেটা দিয়ে মানুষকে কল দেয়া যায়?” মুখের হাসিটা এক ডিগ্রি বাড়িয়ে নিয়ে বললো শিপলু। পা ছড়িয়ে বসলো সোফায়।
“আহ…..তোর অফিসের নাম্বারে তো কল দিতেই ভয় লাগে, “ মুচকি হেসে বললাম আমি। “যে-রকম ব্যস্ত মানুষ! ভাবলাম নতুন কোনো প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশনে আছিস বুঝি—তাই আর জ্বালাইনি।”
কথাটা বলেই শিপলুর চোখের দিকে তাকালাম। কারণ এইমাত্র যা বললাম সেটা ডাহা মিথ্যা। সারাদিন কাউকে কল দেবার মুডে ছিলাম না কোনোভাবেই। আমি দুনিয়ার সেরা মিথ্যাবাদি নই, ড্রাঙ্ক অবস্থায় তো নই-ই। শিপলু কাঁধ ঝাঁকিয়ে ধপাস করে আমার পাশে বসলো। মুখের হাসি হেরফের হয়নি, আমার মিথ্যেটা ধরতে পেরেছে কিনা বুঝলাম না।
“আরে না!” সামনের বোতলটার দিকে তাকিয়ে বললো শিপলু। ওর নাকটা একটু কোঁচকাতে দেখলাম। আমি জানি ও ড্রিঙ্ক করে না। “নতুন কোনো কেস হাতে থাকলে তো হতই। নেই। এখন সম্পাদকের ফরমায়েশ মত রিপোর্ট করে বেড়াতে হচ্ছে। পরশু টাঙ্গাইলে গিয়েছিলাম একটা খুনের স্টোরি কভার করার জন্য। একটা দৈনিক পত্রিকার নিউজ। কালকে গেলাম এফডিসি-অমুক নায়িকা নাকি এক পরিচালকের সাথে ঘুমাচ্ছে, সেটা নিয়ে নিউজ করতে। আজকে আবার এফডিসি যাত্রা, সেই নিউজের ফলো-আপ করার মাল-মশলা জোগাড়ের জন্য। আর আগামিকাল…” কথা শেষ করতে পারলো না শিপলু, কারণ হো হো করে হাসতে শুরু করে দিয়েছি আমি। আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে-ও যোগ দিলো হাসিতে।
“তবে যাই বলিস—” থেমে গেল শিপলু, হাতের ফুরিয়ে আসা সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে ফেললো, তারপর সময় নিয়ে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে ঝুলালো। প্যাকেটটা আবার রাখলো ঠিক ওই পকেটেই। আরেক পকেট থেকে আবার বেরোলো জিপো লাইটার। ক্লিক করে সেটার ঢাকনা খুলে জ্বালিয়ে নিলো সিগারেট। আয়েশ করে দু-বার ধোঁয়া ছেড়ে আগের কথার খেই ধরলো-”সালমান শাহ কিন্তু কাঁপিয়ে দিচ্ছে। প্রথম ছবিতেই এমন হিট! আর এই বয়সেই! এরকমটা চালিয়ে যেতে পারলে এই একটা ছেলেই এফডিসির স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে পারবে।” ভাবখানা এমন, কথার মাঝে সিগারেট ধরাতে যেন দেড় মিনিট ব্যয়ই করেনি ও। আমি অবশ্য পরিচিত ওর এই অভ্যাসের সাথে। সিগারেট খাওয়াটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে ও। শিপলু আমার দেখা সবচেয়ে বড় চেইন স্মোকার। একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে, দিনে কয়টা খায়। “ত্রিশটা,” জবাব দিয়েছিল ও। আমি শিওর কথাটা ডাহা মিথ্যা। আসল সংখ্যাটা চল্লিশ থেকে ষাটের মধ্যে হবে।
“সো, সিনেমার নিউজ কভার করার খুব আগ্রহ দেখা যাচ্ছে তোর, জনাব সাংবাদিক?” আমার খালি হয়ে আসা গ্লাসের ওপর বোতলটা উপুড় করতে করতে বললাম।
“সিনেমার জগতের মাঝে একটা আলাদা ফিল আছে ম্যান,” আমার গেলাসের দিকে তেরছাভাবে তাকালো শিপলু। ওর চশমার কাঁচের ওপর অদ্ভুতভাবে পড়েছে টিউবলাইটের আলো। কাঁচদুটো যেন জ্বলছে, আড়ালে ওর তীক্ষ্ণ চোখদুটো দেখা যাচ্ছে না। “তোদের এই গোটা সমাজ একপাশে, আর সিনেমাপাড়া আরেক পাশে। তোরা বলবি আমি নায়ক-নায়িকাদের গসিপ লিখে পেট চালাই। নো সমস্যা টু মি। যারা পলিটিক্যাল নিউজ কভার করে তাদের চাইতে ভালো। জনসভার রোদ-ধুলোর মধ্যে নোটবই হাতে ঘোরার চাইতে বা কোনো প্রেস ব্রিফিংয়ে গিয়ে কোনো মন্ত্রির মিথ্যেকথা শোনার চাইতে ভালো।” মুখের ওপর ডান হাতটা রাখলো শিপলু, যেন নিজের মুখ নিজে বন্ধ করতে চাইছে। আসলে ওর তর্জনি আর মধ্যমার ফাঁকে সিগারেট, সেটায় দম দিচ্ছে ও। সাধে কি বলি বিড়ি টানাটাকে আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গেছে ব্যাটা। শিপলুর মত শৈল্পিকভাবে সিগারেট খেতে দেখিনি আর কাউকে।
“তোদের সাপ্তাহিক হালচাল সিনেমা নিয়ে এত মাতলো কবে থেকে?” আরেকটা বড় ঢোকে ওয়াইন গিলে বললাম। গলা দিয়ে জ্বলতে জ্বলতে নেমে গেল তরলটা।
“কারণ গরম খবর যেখানে আছে সেখানেই সাপ্তাহিক হালচাল,” অন্যমনস্কভাবে বললো শিপলু। “ক্রাইম রিপোর্ট, প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন আর সিনেজগৎ-এই নিয়ে সাপ্তাহিক হালচাল। মাঝখানেরটা অবশ্য একান্তই আমার বদৌলতে যোগ হয়েছে।”
শিপলুর কথা সত্য। সাপ্তাহিক হালচালের অসম্ভব রমরমার পেছনে শিপলুর অবদান সবচেয়ে বেশি। শিপলু ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। ঢাকা ভার্সিটি থেকে জার্নালিজম পাশ করার পর ওসব করেই পেট চালাচ্ছে। ফ্রিল্যান্স শব্দটা শুনতে যত সুন্দর, আসল জিনিসটা মোটেই তেমন নয়, শিপলু মাঝে মাঝে বলে। চোদ্দটা পেপার আর ম্যাগাজিনের অফিসে সারাদিন দৌড়াদৌড়ি। কোথায় কোন ব্যাপারটা থেকে মুখরোচক স্টোরি বানানো যাবে, তার অপেক্ষায় থাকা। কষ্টেসৃষ্টে তার মধ্যেও চালিয়ে নিচ্ছিলো, এর মধ্যে একদিন ওর মাথায় একটা নতুন আইডিয়া গজালো। প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন। আধিভৌতিক নানা ঘটনার পেছনের গল্প খোঁজার চেষ্টা করবে ও, তারপর খুঁটিয়ে লিখবে কি কি দেখলো। পুরো ব্যাপারটা স্রেফ গল্পের মত করে বর্ণনা করা হবে। পাঠকের ওপর ভার থাকবে ঘটনাটা অলৌকিক না লৌকিক, সেটা ডিসাইড করার। শিপলুর মেইন চিন্তা ছিল, কোনো পত্রিকার সম্পাদকের কাছে ওর এই আপাত আজগুবি আইডিয়ার পেছনে ব্রিলিয়ান্সটা চোখে পড়বে কিনা।
সাপ্তাহিক হালচালের সম্পাদক হিফজুর রহমান কিন্তু শোনার সাথে সাথে চনমনিয়ে উঠলো। আমি হিফজুর রহমান বলছি, কিন্তু শিপলু বলে, প্রিন্ট মিডিয়ার জগতে সবাই তাকে ‘পাগলা হাফেজ’ নামেই চেনে। লোকটা এক কানের ওপরে একটা সিগারেট গুঁজে রাখে, আরেক কানে আতর মাখানো তুলা। চোখে বোতলের তলার মত ভারি চশমা। ডেস্কে কাগজের স্তুপ, তারই মাঝখানে রাখা একটা নষ্ট
কম্পিউটার। দেশের যেকোনো কোণায় একটা খুন হলেই তার ধারণা, নতুন সিরিয়াল কিলার বের হয়েছে, এটা তার প্রথম খুন। নতুন কোনো রগরগে স্টোরি পেলে নাকি লোকটা হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে সারা রুমের মাঝে লাফালাফি শুরু করে। সেই পাগলা হাফেজ রাজি হবার পরে দুই বছর আগে শিপলুর প্রথম কেস স্টাডি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক হালচালের একত্রিশে অক্টোবর, ১৯৯০ সংখ্যায়। বেরোবার সাথে সাথেই যাকে বলে হিট। রমরমা ব্যবসা সাপ্তাহিক হালচালের সেই সংখ্যার। হালচালের ঠিকানায় একগাদা চিঠি, পরের কেস স্টাডি কবে আসবে। শিপলু দ্বিতীয় কেস স্টাডি ছাপালো এক মাস পরের একটা সংখ্যায়। তারপরে আজ পর্যন্ত বেরিয়েই চলছে এক এক করে প্রতি মাসে। শিপলুকেও আর পেছন ফিরে দেখতে হয়নি। প্রতি মাসে একটা করে প্যারানরমাল কেস স্টাডি ছাপাচ্ছে, আর সাথে আরো বিভিন্ন পত্রিকার জন্য বিভিন্ন ধরণের নিউজ তো আছেই।
শিপলুর সাথে আমার বন্ধুত্বও কিন্তু গাঢ় হয়েছে ওর এই প্যারানরমাল কেস স্টাডির কারণেই। শিপলুর সাথে বেশ কয়েকবার প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশনে বেরিয়েছি আমি গতবছর-আর তাতে ওর সাথে আমার বন্ধুত্ব যতটা স্ট্রং হয়েছে, ততটা আর কারো সাথেই হয়নি। যেসব ঘটনার মুখোমুখি হয়েছি, সেগুলোও একেবারে অদ্ভুতুড়ে, সেগুলোর কোনো ব্যাখ্যাই খুঁজে পাইনি।
ভাবতে ভাবতে খেয়াল করলাম, বোতল শেষ। আরে, ব্যাপার কি? এইমাত্র না নিয়ে বসলাম?
এতক্ষণে খেয়াল করলাম, ঝুঁকে বসে আছি নিজের হাটুর ওপর দুই হাতের ভর দিয়ে। সোজা হয়ে বসলাম আমি। রুমের চারপাশে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কেন যেন কোনো কিছুই পরিস্কারভাবে দেখতে পারছি না। ঝাপসা লাগছে, যেন আউট অব ফোকাস কোনো ক্যামেরার মধ্য দিয়ে তাকিয়ে আছি। যতদূর বুঝলাম ফাহাদ আর আরিফ চড়া গলায় কিছু নিয়ে তর্ক করছে, আর রিফাত হাত-পা ছড়িয়ে বসে সেটা শুনছে। সামাদ টিভির রিমোটটা হাতে নিয়ে খুব মনোযোগের সাথে চ্যানেল চেঞ্জ করছে। সমস্যা হচ্ছে প্রত্যেকটা চ্যানেলই ঝিরঝির করছে। কোনো রিসেপশন নেই। কপাল মুছলাম আমি। এত গরম লাগছে কেন? এসিটা কি কাজ করছে না? হাতের দিকে তাকালাম। হাতের তালু ঘামছে। এমনটা তো কখনো হয়নি আমি একজন শ্যুটার। হাতের তালু ঘামে না দেখেই এতদিন ভালো শুটিং করেছি।
“তুই কি জানিস,” হঠাৎ বলে উঠলো শিপলু, “ইংল্যান্ডে যত রাজহাঁস আছে, সবগুলোর মালিক রাণি এলিজাবেথ?”
“না, জানতাম না,” বললাম আমি, তাকিয়ে আছি শিপলুর দিকে। ওর হুট করে আজগুবি প্রশ্নের কারণে অবাক হইনি। হঠাৎ হঠাৎ অমন প্রশ্ন করাটা ওর স্বভাব। আসল সমস্যাটা অন্যখানে। শিপলুর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারছি, গোটা ব্যাপারটায় কোনো গড়বড় আছে। সোফায় হাত ছড়িয়ে হেলান দিয়ে বসে আয়েশ করে সিগারেট টানছে শিপলু। ওর চশমার কাঁচে আলো পড়ে এমনভাবে চমকাচ্ছে যেন ফসফরাস মাখানো কাগজ। ওর সামনে টেবিলে অ্যাশট্রে।
“কি হলো? এমনভাবে তাকাচ্ছিস কেন?” শিপলুর প্রশ্ন। ওর গলায় খানিকটা উদ্বেগের ছাপ পেলাম। সামনের অ্যাশট্রেতে সিগারেটের ছাই ঝাড়লো ও।
আমি তাকিয়েই আছি। বুঝতে পারছি, শিপলু আমার সামনে এসে বসার পর থেকে কিছু একটা হয়ে গেছে। আমি ধরতে পারছি না কি সেটা।
“আইরিনের সাথে সবকিছু ঠিকভাবে যাচ্ছে তো দোস্ত?” প্রশ্ন করলো শিপলু। একটু সাবধানির ছাপ পেলাম ওর গলায়। “রাশেদ তোকে ফোনে আর হুমকিধামকি দিচ্ছে না তো? আইরিনের এক্স বয়ফ্রেন্ড?”
“না,” শান্ত গলায় বললাম আমি। টের পেলাম, আমার কপাল গড়িয়ে একটা ঘামের ফোঁটা নামছে
“রাশেদের ব্যাপারে সাবধান,” শিপলু বললো। “তোকে আগেও বলেছি বড়লোকের বখে যাওয়া পোলা। পকেটে একটা থার্টি এইট রিভলভার থাকে সবসময়। কথার আগে গুলি চালায়। ইচি ট্রিগার ফিঙ্গার। ওর বাপে মন্ত্রি না হলে তিনটা খুনের মামলায় ফাঁসি হয়ে যেত অ্যাদ্দিনে।”
অন্য সময় হলে বাঁকা হাসি হেসে শিপলুকে বলতাম, এমনকিছু বল যা আমি জানি না। কিন্তু এখন মুখ খুললাম না। শিপলুর দিকে তাকিয়ে আছি। ও সিগারেটের ছাই ঝাড়লো আবার। অ্যাশট্রেটার দিকে তাকালাম আমি। প্রায় ভরে এসেছে ওটা, ছাই আর সিগারেটের মোথা দিয়ে। অথচ আমি হলফ করে বলতে পারি খানিকক্ষণ আগে শিপলু এসে বসার সময়ও ওটাকে খালি দেখেছি।
চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। “ওকে গাইজ, আমি রুমে যাচ্ছি, সি ইউ লেটার।” ঘরের দেয়ালের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে কোনোমতে দরজার দিকে এগোলাম। হাটু কাঁপছে আমার, চোখে ঝাপসা দেখছি, মাথাটা পালকের মত হালকা। বুঝতে পারছি, রক্তে অ্যালকোহলের মাত্রা ভয়াবহরকম বেড়ে গেছে আমার। কিন্তু এ কি করে সম্ভব! বসলামই তো কয়েক মিনিট আগে।
শুনতে পাচ্ছি, পেছন থেকে শিপলু বলছে, “রিল্যাক্স, ম্যান। বস আরো খানিকক্ষণ। রাশেদের সাথে গল্প করে যা।”
হতবাক হয়ে ঘাড় ঘোরালাম। দেখলাম, শিপলুর পাশে কখন যেন এসে বসেছে রাশেদ। সেই বাজে কার্টের দামি স্যুট, সেই আগা চোখা সু পায়ে, সেই চালবাজের মত চেহারা, মুখের পিত্তি জ্বালানো হাসিতে ‘আমার বাপের গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে তাই আমিই ঢাকার রাজা’ টাইপের ভাব।
হেলেদুলে উঠে দাঁড়ালো রাশেদ। স্বভাবসিদ্ধ নষ্ট মাইকের মত হেঁড়ে গলায় বললো, “আজকে আইরিনের কাছে গেসলাম। সোজা ওর রুমে। ডায়রেক্ট কইলাম, এইভাবে আর চলতে পারে না আইরিন। তুমি জামশেদের সাথে লাইন মারবা, আবার আমারেও আশা দিয়া ঝুলায়া রাখবা, সেটা হইতে পারে না। ওই হালা জামশেদের আছে কি? বাপে মরছে, অর কোম্পানিতে অখন লালবাতি জ্বলবো। আর এইদিকে আমরা গাজীপুরের খাশ বনেদি ফ্যামিলি, আমার বাপে বিদেশ থাইকা ল পইড়া আইছে, ‘আমাগো বিরাট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি…কইতে না কইতে তোমার আইরিন সব খুইলা টুইলা ল্যাংটা হইয়া আমারে কয়…”
সামনের দিকে লাফ দিলাম আমি, প্রথমে শূয়োরের বাচ্চার গলা টিপে ধরবো, তারপর অন্য হাতটা দিয়ে শকুনের মত চোখদুটো উপড়ে আনবো। কিন্তু কোনো কিছুতে বাধা না পেয়ে সোজা সোফাটার ওপর গিয়ে পড়লাম, তারপর সেটাসহ গড়িয়ে মেঝেতে।
উঠলাম না আর, পড়েই রইলাম ওখানে। মাথা তুলে দেখি, সবাই উঠে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে আমাকেই। সোফার সাথে সাথে শিপলুও চিৎপটাং। উঠে দাঁড়িয়ে ও একবার তাকালো আমার দিকে, কিছু বললো না। সামাদের দিকে ঘুরে তাকালো অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে
“ওকে, ওকে, এক্সাইটেড হবার কোনো কারণ নেই,” উঠে দাঁড়িয়ে গা ঝাড়তে ঝাড়তে কর্কশ গলায় বললাম। “আম জাস্ট আ লিটল ড্রাঙ্ক, দ্যাটস ইট।”
“অ্যালকোহল ডাজেন্ট কজ দিস, জামশেদ,” শান্ত গলায় বললো শিপলু। সামাদের দিকে তাকালো তারপর। “জামশেদ যা-ই বলুক, কালকে ওকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবে। ওর কি হয়েছে, জানা দরকার। হি ইজ হ্যাভিং হ্যালুসিনেশন। দুঃস্বপ্নের মধ্যে ব্যাপারটা সীমিত নেই আর।”
অধ্যায় ৩ – জামশেদের জবানবন্দিত
অধ্যায় ৩ – জামশেদের জবানবন্দিতে
সাইকিয়াট্রিস্টের চেম্বারে আয়না রাখা কেন? পাগলেরা এসে মুখ দেখবে বলে?
কোনো জুৎসই জবাব খুঁজে পেলাম না, আর তাতে আরো খিঁচড়ে গেল মেজাজটা। আয়নায় আমার প্রতিফলনটার ভুরুদুটো কুঁচকে আছে, দেখতে পাচ্ছি। আয়নার ওপাশের আমির ব্যাকব্রাশ করা চুল, শক্ত চোয়াল, তাতে দু-দিনের না কামানো দাড়ি, পরিপাটি করে ছাঁটা গোঁফ। চোখের নিচে হালকা কালির ছাপ। বেশ কষ্ট করে ভুরু স্বাভাবিক করলাম আমি
চেম্বারে ঢোকার আগে সামাদ কি বলেছিলো, মনে পড়লো। ডঃ শামসুর রহমান, এম.বি.বি.এস, বি.সি.এস (স্বাস্থ্য), এফ.সি.পি.এস. এর চেম্বারের হাতলটা ধরে ঘোরানোর আগে চরম ইতস্তত করে আমার দিকে চেয়ে ও বলেছিলো, “অ্যা…জামশেদ ভাই, শামসুর স্যার কিন্তু নিজেও একটু ইয়ে। উনি…মানে…ওনার সাথে নিউট্রালি বিহেভ করলেই বোধহয় ভালো হয়। ট্রাস্ট মি, হি ইজ আ ভেরি গুড ডক্টর।”
কাজেই আমার মিলিটারি মেজাজটা স্বাভাবিক রাখা উচিত নিজের স্বার্থেই। সামাদ এমনভাবে রিকমেন্ড করলো, না এসে আর পারলাম না। ওর মতে দেশের সেরা সাইকিয়াট্রিস্ট নাকি এই লোক। চেম্বার দেখে সেরকম পসার বোঝা গেল না অবশ্য। আর এই টেকো মাথার হাড়গিলে ডাক্তারের চেহারা দেখলেও সেরকম ভক্তি হয় না। সামাদটা আবারও ডোবাবে মনে হচ্ছে।
পাশের দেয়ালে ঝোলানো আয়নাটা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালাম। টেবিলের ও-মাথায় ডাক্তার, এই মাথায় আমি আর সামাদ। আমার হিস্ট্রি শোনা শেষ ডাক্তারের, খেজুরে আলাপ জুড়েছে এখন সামাদের সাথে। লোকটা সামাদের টিচার ছিলো, কাজেই গল্পের অভাব নেই। তাছাড়া বাইরেও কোনো রোগি নেই, আমরাই সারাদিনে এই লোকের একমাত্র রোগি নাকি কে জানে।
“আপনি কি কোনো ড্রাগস ইউজ করেন?” হঠাৎ গল্প থামিয়ে এমনভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ডাক্তার প্রশ্ন করলেন যে চমকে উঠলাম।
“না,” ঠান্ডা গলায় বললাম। “অ্যাজ আই হ্যাভ টোল্ড ইউ বিফোর, আই হ্যাভ অ্যা ড্রিঙ্কিং প্রবলেম। বাট নো ড্রাগস। নেভার।”
মোটা চশমার আড়াল থেকে তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন ডাক্তার, এবার চোখ নামিয়ে খসখস করে একটা খাতার পাতায় লিখতে শুরু করলেন। কোনো প্যাডে না, একটা ইউনিভার্সিটি খাতার পাতায়।
লেখা শেষ করে খাতার পাতাটা খুব যত্ন করে ভাঁজ করলেন ডাক্তারসাহেব, তারপর ফড়াৎ করে ছিঁড়ে ধরিয়ে দিলেন আমার হাতে। বাহ। যেমন ডাক্তার, তেমনি তার প্রেসক্রিপশন।
“আমার…প্রবলেমটা কি?” কাগজটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করলাম।
“মোস্ট লাইকলি এক্সপ্লেনেশন হচ্ছে ড্রাগস,” বোতলের তলার মত মোটা চশমার কারণে ফুটবল বনা চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ডাক্তার। “কিছু ড্রাগস আছে যেগুলো হ্যালুসিনেশন ঘটায়। কয়েকটা রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ এর মধ্যে পড়ে। কিন্তু আপনি যেহেতু সেটা নাকচ করে দিচ্ছেন, তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। চাইল্ডহুড ট্রমার কথা ভাবতে শুরু করেছিলাম, বাট আপনিই তো বললেন আপনার মায়ের মৃত্যুর কথা আপনার মনে নেই, আর সেটা নিশ্চই আপনার মনোজগতে প্রভাবও বিস্তার করতে পারেনি…”
“চাইল্ডহুড ট্রমা, হু,” নিচু গলায় বিড়বিড় করে বললাম আমি। “কোনো কিছু এক্সপ্লেন না করতে পারলেই তো আপনারা চাইল্ডহুড ট্রমা ঢুকিয়ে দেন।”
“…তাহলে, আপনার বাবার মধ্যেই আপনি আপনার বাবা-মা দু-জনকেই খুঁজে নিতে বাধ্য হয়েছেন। আপনার বাবাও আপনাকে বেশি সময় দিতে পারেননি, সেটা তো বোঝাই যায়, যেহেতু আপনার বাবার নাম আব্বাস রহমান খান।” আমার কথা যেন কানেই ঢোকেনি ডাক্তারের, গড়গড়িয়ে বলে যাচ্ছেন তিনি। লোকটার স্বর পাতলা, কাজেই গুরুত্ব কম, কিন্তু বলার ভঙ্গিতে কি একটা কর্তৃত্বের ভাব আছে, মন দিয়ে কথা না শুনে উপায় থাকে না। “কলম্বোতে গাড়ি দুর্ঘটনায় আপনার বাবা মারা গেলেন। তার মৃত্যুর সময় আপনি কাছেও থাকতে পারলেন না। সেই কলম্বোতেই আপনি আবার সাফ গেমসে সোনা জিতেছিলেন পাঁচ বছর আগে।”
একটু বিরতি নিলেন ডাঃ শামসুর। মোটা চশমার আড়ালে ডাক্তারের চোখ পিটপিট করতে দেখলাম। এক হাতের আঙুলের ভেতর আরেক হাতের আঙুল গলিয়ে থুতনির নিচে রাখলেন তিনি। “আপনার উত্তপ্ত মস্তিষ্ক দুটো ঘটনার অ্যামালগামেশন করে দুঃস্বপ্নটা তৈরি করলো।”
“আর হ্যালুসিনেশন?” আমার মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো।
“নো আইডিয়া।” বলে আমার মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলেন পাগলের ডাক্তার।
কয়েকটা অস্বস্তিকর সেকেন্ড কাটার পরে উঠে দাঁড়ালাম আমি। “তো…যেসব ড্রাগস প্রেসক্রাইব করলেন…
“স্রেফ ঘুমের ঔষধ। জামশেদসাহেব, আপনার স্নায়ু উত্তেজিত। কোথাও থেকে ঘুরে আসুন। বেড়িয়ে আসুন। ভালো লাগবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা কথায় কথায় হাওয়া বদল করতেন, তার সুফলও পেতেন। ঢাকা থেকে দূরে দুটো সপ্তাহ কাটিয়ে আসলে বোধহয় সবারই ভালো হবে। গ্রামের বাসা আছে না? সেখান থেকে ঘুরে আসুন।”
কোনো জবাব না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। আমার জন্ম ঢাকায়, আর সারা জীবন ঢাকাতেই কাটিয়েছি। ঢাকার বাইরে যাইনি কখনো, গ্রাম কাকে বলে কখনো চোখে দেখিনি, দেখার ইচ্ছেও নেই।
চেম্বারের দরজার হাতল ধরে ঘুরিয়েছি কেবল, পেছনে আবার মুখ খুললেন ডাক্তার শামসুল। “তাতে আপনার ঘোরটাও কাটবে আশা করি। আয়নার দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিলেন, সেটা আমার এক পুরনো রোগির কথা মনে করিয়ে দিল। কত বোঝালাম, সে লোক কিছুই শুনলো না। শেষ যেবার খোঁজ নিয়েছিলাম, শুনেছিলাম হেমায়েতপুরে নাকি সিট পেয়েছিল বেচারা। সেখানেও যা ভিড় আজকাল।”
বিকেলে একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছি আইরিনের সাথে। বেইলি রোড
বড় একটা পেস্ট্রি নিয়ে বসেছে আইরিন। চামচে করে একটা-একটা টুকরো মুখে পুরে কথা বলছে ও। মুখে খাবার নিয়ে কথা বলার বদভ্যাস আছে এই মেয়ের গত আধা ঘন্টা যাবত শুনতে হলো ওর বান্ধবি সিনথিয়া নিউইয়র্কের এক সুপারশপে গিয়ে কি বোকামি করেছে তার বিস্তারিত বর্ণনা। পাঞ্চলাইনটা বলার পরে খিখিল করে হাসলো, আমিও হাসার ভান করলাম যথাসাধ্য।
“সো, কোম্পানি নিয়ে খুব বিজি আজকাল?” খানিকক্ষণ চুপ থাকার পরে হালকা চালে প্রশ্ন করলো আইরিন।
আমার সামনে একটা কফির মগ। সেটার হ্যান্ডেল নিয়ে নাড়াচাড়া করছি কিছুক্ষণ যাবৎ, চুমুক দেয়া আর হচ্ছে না। আইরিনের প্রশ্ন শুনে নাড়ানাড়ি থামিয়ে হাত নামিয়ে কোলের ওপরে রাখলাম। চোখ তুলে তাকালাম আইরিনের দিক। বেশ কায়দা করে বাঁধা সোজা কালো চুল, ডিমের মত মুখ, ফর্সা রং, কিশোরির মত চিবুক। আইরিনকে যে ভালো করে চেনা না সে প্রথম দেখায় ওকে লাজুক এক কিশোরি ছাড়া আর কিছু মনে করবে না। ওকে হাঁড়ে হাঁড়ে চিনতে হলে ওর সাথে তিনবছর ধরে প্রেম করতে হবে। আমার মত।
“ইয়েস, কাইন্ড অফ। একটা এক্সপোর্ট ইমপোর্ট কোম্পানির এত কাজ, জানা ছিল না। আমার তো ধারণা ছিল বাবার কাজটা খুব সোজা, হা-হা-হা।” কাষ্ঠ হেসে বললাম।
খিলখিল করে হেসে উঠলো আইরিনও। “হি হি হি। বাট আমার জামশেদ রহমান খান বলে কথা! কোনো কাজই তো কঠিন না তোমার কাছে! ইন ফ্যাক্ট, একটা কোম্পানি চালানোও তোমার কাছে এত সহজ যে, সারাদিন বাসায় বসেই করে ফেলো!”
আমার কাষ্ঠ হাসি ততক্ষণে প্রস্তর হাসিতে পরিণত হয়েছে। আইরিন কিন্তু তখনো একইভাবে হাসছে। ওর বাপকে মন্ত্রি বানিয়েছে কে? মেয়েই তো তার চেয়ে বেশি সেয়ানা।
“দেখো জামশেদ,” হঠাৎ ভোল পাল্টে ফেললো মেয়েটা, চোখে উদ্বেগ নিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে আমার হাতটা ছুঁলো ও, “ড্যাডি আমার বিয়ের চিন্তা করছে। সেদিন আকারে-ইঙ্গিতে আমার কাছ থেকেও জানতে চাইছিলেন আমি বিয়ের জন্য রেডি কি না।”
“তুমি কি বললে?” নিরাসক্ত গলায় জানতে চাইলাম।
“আমিও আকার ইঙ্গিতে তোমার কথা জানালাম। দেখো জামশেদ, আমি শিওর, ড্যাডি তোমাকে অনেক লাইক করেন। তোমার বাবার সাথে ওনার খুব খাতির ছিলো। তোমার বাবার ব্যাপারে সবসময় ভালো বলতে শুনেছি ড্যাডিকে। বাট…..”
কফির মগের হ্যান্ডেলে একটা মাছি বসেছে। সেটা সামনের পা দুটো একসাথে ঘষতে শুরু করেছে, যেন খেতে শুরু করার আগে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করে নিচ্ছে। “বাট?” সেদিক থেকে জোর করে চোখ সরিয়ে আইরিনের কথারই প্রতিধ্বনি করলাম,
“বাট কিছু না।” চোখ ঘুরিয়ে বললো সে। ঠোঁট এখনো ফোলানো। কথায় কথায় ওর ঠোট ফোলানোর কারণ আছে বটে। ওর নিচের ঠোঁটের ডান দিকে একটা তিল।
“তোমার বাবা বলেছে আমি একটা অ্যালকোহলিক, ইরেসপন্সিবল, সো তোমার উচিত পছন্দ চেঞ্জ করা। তাই না?” সহজ গলায় বললাম আমি।
“জামশেদ!” পার্লারে গিয়ে অতি যত্নে স্মোকি শেড দেয়া চোখদুটো বড় বড় করে বললো আইরিন।
“আর এটাও নিশ্চয় বলেছেন, আমার মত বেয়াদব ছেলে উনি জীবনে দুটো দেখেননি।”
“স্টপ ইট!”
“আমার বদমেজাজের কথা তো বলেছেনই। আমি কবে কখন কার মাথা ফাটিয়েছি, হাত ভেঙেছি, কোন বিশিষ্ট কোটিপতি ভদ্রলোকের সাথে বেয়াদবি করেছি, কোন এমপির ব্যাটাকে দিনে দুপুরে রাস্তায় ন্যাংটা করেছি-সব নিশ্চই শুনিয়েছেন তোমাকে?”
“জামশেদ, আই ক্যান নট বিলিভ”
“সবচেয়ে বড় কথা, তোমাদের মাঝে এই কনভার্সেশনটা হয়ইনি। তোমার বাবা তোমাকে বিয়ে নিয়ে একটা কথাও বলেননি।” ঠান্ডা গলায় বোমাটা ছাড়লাম।
আইরিন একদম চুপ, ঠোঁট যেন সুপার গ্লু দিয়ে মেরে দেয়া, টানা টানা চোখদুটো এখন রসগোল্লা।
“রাশেদ ইদানিং তোমার পিছনে আবার ঘোরাঘুরি শুরু করেছে। বোঝাতে চাইছে, এখনো কত ভালোবাসে তোমাকে, তোমাকে ফিরে না পেলে আর বাঁচবে না। আর সেটায় কাজও দিচ্ছে বেশ। এতটাই কাজে দিচ্ছে, তুমি সেটায় এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ছো যে তোমার এখন আমাকে ডেকে বসিয়ে বিয়ের কথা শুনিয়ে নিশ্চিত করতে হচ্ছে, আমি তোমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে করবো।” ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে বলে গেলাম।
আইরিন এখনো কিছু বলতে পারেনি, আগের মতই মোমের পুতুল বনে তাকিয়ে আছে।
আমি মগের হ্যান্ডেলের দিকে তাকালাম। মাছিটা উড়ে গেছে। ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেললাম। “দেখো আইরিন, আমি অতকিছু ভেবে প্রেম করিনি যে, তোমার বাবা মন্ত্রি, তার ব্যাংক ব্যালেন্স এত, তার পাওয়ার অনেক, তার ঢাকায় এতগুলা বাসা। আগে তোমার কার কার সাথে রিলেশন ছিলো সেগুলোও কনসিডার করিনি। তোমাকে ভালো লেগেছিলো-ব্যস, এতটুকুই এনাফ। এখন মনে হচ্ছে, ভুলই করেছি।”
“হাউ ডেয়ার ইউ—” চোখমুখ শক্ত করে বলতে শুরু করলো আইরিন।
“শাট আপ।” চাপা গলায় বললাম আমি।
“আই ক্যান্ট বিলিভ…”
“শাট-আপ। রাশেদের মত একটা থার্ড গ্রেডের রাস্কেলের সাথে যার প্রেম ছিলো, তাকে আমি ভালোবাসতে পারলাম কিভাবে, এটাই তো একটা বড় আশ্চর্যের ব্যাপার। ওকে তুমি ভুলে গেলেও একটা কথা ছিলো-বাস্টার্ডটা এখন বিভিন্ন মেয়ের সর্বনাশ করে হাঁপিয়ে উঠে আবার তোমাকে ফেরত চাইছে-আই গেস তোমার মত ভালো পুসি সে আর কোথাও পায়নি, তাই—” কথা থামাতে বাধ্য হলাম আমি, কারণ পানির গ্লাসটা আমার দিকে ছুঁড়ে মেরেছে আইরিন। সেটা আমার গায়ে লাগেনি অবশ্য, আমার কাঁধের পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গিয়ে মেঝেতে পড়ে গুঁড়ো হয়ে গেছে, কিন্তু পানির ঝাপটাটা ভিজিয়ে দিয়েছে আমাকে।
আইরিন উঠে দাঁড়িয়েছে। চেহারা থেকে লাবণ্যের শেষ ছোঁয়াটাও মুছে গেছে ওর, রাগের চোটে যেন একটা কুৎসিত মুখোশে পাল্টে গেছে ওর মুখটা। কিছু বলার চেষ্টা করছে, পারছে না।
আমি বসেই রইলাম, একইভাবে। গা থেকে পানি মোছারও চেষ্টা করলাম না। চেয়ে আছি আইরিনের দিকে। “কান্ট বিলিভ আই হ্যাভ ডেটেড অ্যা টোটাল বিচ দিস লং।” শীতল, নিচু গলায় বললাম আমি।
মানুষের চোখ দিয়ে আগুন বের হবার সিস্টেম থাকলে আইরিনের চোখের আগুনে এতক্ষণ ভষ্ম হয়ে যেতাম আমি। কয়েক সেকেন্ড ওভাবেই তাকিয়ে রইলো মেয়েটা, কিন্তু আমাকে যে এভাবে দমানো যাবে না সেটা বুঝতে সময় লাগলো না ওর। রেস্তোরাঁ ভরা সবার বিস্মিত চোখের সামনে গটগট করে হেটে বেরিয়ে গেল, যাবার আগে বলে গেল, “এর জন্যে পস্তাতে হবে তোমাকে, জামশেদ।”
তখন গায়েই লাগাইনি কথাটা, হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম।
বাসা ফেরার সময় খেয়াল করলাম, আমার গাড়ির পেছন পেছন আসছে একটা পুরনো খয়েরি মিতসুবিসি। আইরিনের সাথে দেখা করতে আসার সময়ও এই গাড়িটাকেই আমার পিছু পিছু আসতে দেখেছিলাম মনে হয়। কি জানি। ডাজন্ট ম্যাটার।
যদি তক্ষুণি সাবধান হতাম, কে জানে, আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক ঘটনাটার মুখোমুখি হয়তো আর হতেই হতো না।
কেস স্টাডি : ‘অ্যানজাইনা
[বরাবরের মতই মাসিক হালচালে প্রকাশিত হয়েছিল শিপলুর এই ইসভেস্টিগেশনটা। মূল ঘটনার পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া ছিল-সেটা বাদ দিয়ে বাকিটা এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো।]
দুই মাস আগে মাসিক হালচালের ঠিকানায় এসে পৌঁছেছিল একটা চিঠি। ‘বরাবর’ এর নিচে আমার নাম লেখা কাঁপা কাঁপা হাতে। খুললাম। প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন শুরু করার পর থেকে আমার ঠিকানায় বহু আজেবাজে চিঠি আসে বটে, কিন্তু অথেনটিকগুলো চিনতে ভুল হয় না আমার চোখ পেকে গেছে। এই চিঠিটায় একবার চোখ বুলিয়েই বুঝতে পারলাম, চিঠির প্রেরক যা যা লিখেছে তার সবই সত্যি।
চিঠিটা লিখেছে কলেজ পড়য়া এক ছেলে বছর ষোল বয়স। মফস্বলে বাড়ি। ঢাকায় আসা সম্ভব নয়, তার শরীর অসম্ভব খারাপ। কেন খারাপ তার কারণ লেখা আছে দু-তিন লাইনে। সেই দু’তিন লাইনে যা লেখা সেটা পড়ে আমার আর বসে থাকা সম্ভব হলো না। সে-দিন রাতেই ঢাকা থেকে রওনা দিলাম সেই মফস্বল শহরের দিকে। সঙ্গত কারণেই সেই ঠিকানা এখানে লিখছি না।
ছেলেটার নাম, ধরুন, জয়। জয়ের সাথে দেখা করার কথা ছিলো ওদের শহরের এক বিখ্যাত কলেজের শহীদ মিনারে। ঠিক সময়েই হাজির থাকলাম জায়গামত।
দারুণ সুন্দর ক্যাম্পাস। শহীদ মিনারের বেদীতে বসে আছি। চমৎকার আবহাওয়া। গত কয়েকদিনের একটানা বৃষ্টির পর ঝকঝক করছে আকাশটা। বিকেলের সোনালি রোদটায় আরমদায়ক উষ্ণতা।
কলেজ ছুটি দিয়ে দিয়েছে। শহীদ মিনারের সামনের রাস্তাটা দিয়ে শত শত ছেলেমেয়েকে বাইরের গেটের দিকে যেতে দেখলাম। খালি একজনের গতিপথ এই ফাঁকা শহীদ মিনারের দিকে।
সন্দেহ নেই এটাই জয়। রোগা, লম্বা একটা ছেলে, গায়ের রঙ শ্যামলা, মাথায় অবিন্যস্ত চুল। দেখেই বোঝা যায় ছেলেটা সুস্থ নয়। কোটরে ঢোকা চোখের নিচে কালি, মুখ শুকনো, হাত দুটো অস্বাভাবিকভাবে বুকের ওপর আড়াআড়িভাবে রাখা। হাটার ভঙ্গিটা আড়ষ্ট। সবচেয়ে চোখে লাগে ছেলেটার একেবারে নীল হয়ে যাওয়া ঠোঁট।
সোজা আমার সামনে এসে থামলো সে। মাথা নামিয়ে নিচু এতক্ষণ, এবারে মুখ তুলে চাইলো আমার দিকে। “আপনিই?”
“হ্যা, আমিই।” হেসে হাতটা বাড়িয়ে দিলাম। “বসো। তুমি করে বললাম, কিছু মনে করো না।”
“আপনি আমার অনেক সিনিয়র হবেন।” ক্লাস্তভাবে বসতে বসতে বললো জয়। “শুরুতেই আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, ভাই। আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। ঢাকা থেকে ডেকে এনেছি দুইশো মাইল দূরে।”
“চিঠিতে যা লিখেছিলে সেটা যদি বিস্তারিত বলতে পারো তাহলে সেটাকে আর কষ্ট মনে করবো না আমি।” ডেমোক্র্যাটিক পদ্ধতিতে জবাব দিলাম।
“অবশ্যই। অবশ্যই।” মাথার চুল খামচে ধরে নিচু গলায় বললো জয়। “আপনি বোধহয় ভাবছেন, আমি চিঠিতে লিখেছি আমার শরীর খুব খারাপ, এখন আবার আমি কলেজে কি করছি। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, আমি আপনার সাথে কথা বলার জন্যই কলেজে এসেছি আজকে। আপনাকে বাসায় নিতে পারিনি, সরি, আমার ফ্যামিলি একটু কনজারভেটিভ ধরণের। কলেজে আসার জন্য আম্মুকে মিথ্যে বলেছি, আজকে শরীরটা অনেক ভালো লাগছে।” হঠাৎ চোখ তুলে সোজা আমার চোখে তাকালো জয়। “মিথ্যে বলেছি। আজকে আমার শরীর আরো খারাপ। দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। আমি জানি আমি বাঁচবো না। আমি শুধু চাই মরার আগে কেউ আমার কাহিনীটা জেনে যাক।”
আমি কিছুই বললাম না। একটা সিগারেট বের করেছি কেবল পকেট থেকে, চোখে পড়ার সাথে সাথেই চেঁচিয়ে উঠলো জয় ভয়ার্ত গলায়। “না-না! প্লিজ না! প্লিজ না!”
আমি অবাক চোখে তাকাতেই সে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো, “কিছু মনে করবেন না। পুরো কাহিনী শুনলে আমার ওপরে আর রাগ করতে পারবেন না।”
এবার জয় শুরু করলো ওর আসল কাহিনী। পুরোটা ওর ভাষায়ই তুলে দিলাম : বৃষ্টি আমার অনেক ভাল্লাগে সেটা ঠিক-কিন্তু সে বৃষ্টি হতে হবে একটা নির্দিষ্ট সময়ে। সকালের বৃষ্টি খুব ভাল্লাগে, দিনটা শুরু হয় একটা স্বর্গিয় অনুভূতি নিয়ে। দুপুরের বৃষ্টিও খারাপ না, আম্মুর কাছে ঘ্যানঘ্যান করে ভুনা খিচুড়ি বানিয়ে নিয়ে সেটা গপগপ করে খেতে বড্ড মজা। বিকেলের বৃষ্টিটা হাতে কোনো প্রিয় কবিতার বই নিয়ে জানালার পাশে বসে ভাবনার জগতে হারিয়ে যাবার জন্য পারফেক্ট। আর রাতের বৃষ্টি-সে আর না-ই বা বললাম। আব্বু আমাকে রাত জাগতে দেন না, ফজরের নামাজের তাড়ার জন্য, সেজন্য বাড়ির সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন আমি জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে বসে থাকি মূর্তির মতো। এক ঘন্টা-দু’ ঘন্টা-অনেক ঘন্টা। অসাধারণ একটা অনুভূতি হয়, একেবারে স্বর্গীয়। তারপর একসময় আস্তে আস্তে জানালাটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ি। কাঁথা মুড়ি দিয়ে যে ঘুমটা হয়, সেটার দাম লাখ টাকাও না, কোটি টাকা।
আসলে সব সময়ের বৃষ্টিই আমার ভাল্লাগে খালি সন্ধ্যার বৃষ্টিটা বাদে। কারণ তখনই আমি বাইরে আড্ডা দিতে যাই। আর এই আড্ডাটা আমার জন্য খুবই দরকারি!
সেদিন বিকেল বেলাটা রিমঝিম বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে কাটলো স্বপ্নের মত। একেবারে আদর্শ শ্রাবণের বৃষ্টি। আকাশে গুড়গুড় নেই, কেবল ঘন ধূসর মেঘের পাক খাওয়া, আর তা থেকে টানা ক্যাটস অ্যান্ড ডগস বর্ষণ। আমরা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি, বাড়ি টিনশেড। টিনের চালে বৃষ্টির একটা আলাদা শব্দ আছে-নেশা ধরে যায়। যে শোনেনি, সে বুঝবে না কতটা রোমান্টিক এই কলতান।
অবশ্য বিকেল গড়িয়ে যত সন্ধ্যা হতে লাগলো, আমার কবি কবি ভাব উবে যেতে লাগলো ততই। এ-রুম ও রুম ঘুরে সময় কাটালাম খানিকক্ষণ আগে। মনে মনে বললাম, আজকে তো অনেক বৃষ্টি হলো, এবার একটু থামুক! এখনই সব বৃষ্টি হয়ে গেলে বাকি রাতটা কি হবে? বারবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছি, যেন অমনটা করলেই বৃষ্টি কমে যাবে জাদুর মত।
ছয়টা পেরোলো, আমি ততক্ষণে বেশ অধৈর্য হয়ে উঠেছি। মেজাজ খাপ্পা হতে শুরু করেছে। কয়েকবার বিড়বিড় করে ব-বর্গীয় কয়েকটা গালি দিলাম। কাকে, জানি না।
সোয়া ছয়টার দিকে আম্মু চা এনে দিলেন। সেটা খেয়ে অবস্থা আরো খারাপ হলো। হাত কচলাতে কচলাতে অস্থির হয়ে হাটাহাটি করছি এ-ঘর ও-ঘর।
সাড়ে ছয়টার দিকে পাগল হতে আর বাকি থাকলো আমার। বৃষ্টি কমেনি একটুও। এই ধরণের বৃষ্টি একবার শুরু হলে একইভাবে পড়তে থাকে ছয়-সাত ঘন্টা। আমার কাকুতি-মিনতিতে সেটা কমার কোনো কারণ নেই
বারবার কেবল মনে হচ্ছে, এতক্ষণে তারার চায়ের দোকানে এসে পড়েছে হয়তো আমার আড্ডার বাকি সবাই। এত বৃষ্টিতে কি কেউ আসবে? অবশ্যই আসবে! আড্ডার কোনো এক সদস্যের বলা একটা কথা মনে পড়লো : ভাত না খেয়ে থাকা যায়, কিন্তু …
নিজেকে একবার জিজ্ঞেস করলাম, আজ না গেলে হয় না? আবার নিজেই নিজের ওপর গর্জে উঠলাম, না, হয় না! সারা দিনে এই একটাই আনন্দের উপলক্ষ্য আমার। সেটা থেকেও যদি নিজেকে বঞ্চিত করি, তাহলে লাইফে থাকলোটা কি? তাছাড়া আড্ডায় গেলে শুভ আর সিবাতের সাথে দেখা হবে। ওদের সাথে ব্যাচে টিউশনিতে পড়ি আমি। আজ টিউশনিতে যাইনি, ওদের সাথে দেখা হলে আজকে স্যার কি পড়া দিয়েছেন সেটা জানতে পারতাম। অবশ্য এটা যে একটা ছল মাত্র, কুযুক্তি, সেটা জানা আছে আমার।
পৌনে সাতটার দিকে আর পরলাম না। জানালার গ্রিলে ঝোলানো ছাতাটা হাতে নিয়ে বারান্দায় এসে প্যান্ট গোটানো শুরু করলাম। বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে পড়বো।
যা হবার তাই হলো। আম্মু এসে আমার কান্ডকীর্তি দেখে অবাক হয়ে বললেন, “কি ব্যাপার, বাবু, কই যাও?”
“একটু শুভর বাসায় যেতে হবে।” মিথ্যে বললাম। “আজকে শাহজাহান স্যারের প্রাইভেট মিস করেছি। কী যে পড়া দিলেন, কে জানে! সামনে আবার ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল—” বলতে বলতে ফট করে ছাতা মেলে বৃষ্টির মধ্যে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। বেশি কথা বলতে চাই না আম্মুর সাথে, তাহলে বেশি মিথ্যে বলতে হবে। বেশি অপরাধবোধের ঝক্কি।
বাইরে বেরিয়েই মনটা ভালো হয়ে গেল। শ্রাবণের টানা বৃষ্টি, সাথে হিমেল বাতাস। ছাতার ওপরে পটপট করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার শব্দটার তো কোনো তুলনাই নেই। আর তাছাড়া আমি সত্যিই তারার দোকানের আড্ডায় যাচ্ছি। মনটা ফুরফুরে হবারই কথা।
একে তো প্রায় সাতটা বেজে গেছে, তার ওপর মেঘে ঢাকা আকাশ। চারদিকে বেশ অন্ধকার। আমাদের বাসার বাইরের সরু রাস্তাটায় আলো ছড়াচ্ছে কেবল একটা টিমটিমে হলদে বাল্ব, ইলেকট্রিসিটি পোল থেকে।
ছাতা আমার মাথা বাঁচাচ্ছে বটে, কিন্তু প্যান্টের নিচের দিকটা ভিজে শেষ এরই মধ্যে। বৃষ্টির ফোঁটা পায়ের কাছে মাটিতে পড়ে লাফিয়ে ওঠার সাথে সাথে কাদা ছিটিয়ে দিচ্ছে পায়ের পাতা আর প্যান্টে। বিরক্ত হয়ে গলির পাশের পুরনো শ্যাওলা পড়া পাঁচিলটার ওপরে পা তুলে দিয়ে কোনোমতে ভারসাম্য রেখে প্যান্টের নিচটা গুটিয়ে নিলাম।
সারা গলিজুড়ে কাদা। প্যাঁচ প্যাঁচ করে এগিয়ে চললাম অন্ধকার হাতড়ে, মাথার ওপরে ছাতাটা ধরে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। একটা টর্চলাইট নিয়ে আসা উচিত ছিলো, ভুল হয়ে গেছে।
মেইন রোডে উঠে এলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে মেইন রোডটা আমাদের পাড়ার গলিটার চেয়েও আঁধার। গলিতে তা-ও একটা লাইট আছে, এখানে কিচ্ছু নেই। অন্যান্য দিন অবশ্য রাত নামার পরও হুশহাশ করে একের পর এক ট্রাক আর বাস যায় রাস্তাটা দিয়ে, সেগুলোর হেডলাইটের আলোয় পথ চিনতে অসুবিধা হয় না। আজ রাস্তার এ-মাথা থেকে ও-মাথা যতদূর চোখ যায় তাকিয়েও কোনো গাড়িঘোড়ার দেখা পেলাম না। ঘুটঘুটে অন্ধকার সবদিকে, কেবল রাস্তার পাশের গাছগুলোর আউটলাইন কোনোমতে বোঝা যায়।
আমি রাস্তার ওপরে উঠে এলাম। রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাটলেও এখন কোনো সমস্যা হবে না। একটু ভয় ভয় লাগছিল এই নির্জন পরিবেশে, সেটাকে চাপা দেবার চেষ্টা করলাম ‘এই মুহূর্তে আমিই এই রাস্তার রাজা’ ভেবে।
কালকের আড্ডার একটা টপিক মনে পড়লো। রুবেল হতাশভাবে মাথা নাড়তে নাড়তে বলছিল, “কি কও জয়! এই এলাকারই ঘটনা, আর তুমি শোনো নাই?”
আমি আমতা আমতা করছি, শুভ নাকমুখ দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে হেসে উঠলো। “সারাদিন পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকলে যা হয়। এলাকায় একটা লাশ পাওয়া গেল তা-ও জানো না!”
“আমাদের বাড়ির কাছেই সকালে পাওয়া গেছে লাশটা,” স্বভাবসুলভ নিচু গলায় বললো সিবাত, “রাস্তার পাশের নিচু জমিতে। বিএডিসি খামারের পাশে। ওখানটা কেমন নির্জন, জানিসই তো।”
“খুন নাকি?” আগ্রহি গলায় বললাম।
“হ-হ-হইতে পারে,” সৌরভ বললো। “লো-লোকটাকে চিনবা। রিকশা চালাইতো। বাস্তুহারার বস্তিতে থাকতো। রাস্তার পাশে পড়ে ছিলো, মুখ হাঁ, চেহারা দেখে মনে হয় যেন খুব ভয় পাইছিল মরার আগে। সারা শরীর নীল। দুই আঙুলের ফাঁকে আবার একটা সিগারেট ছিলো। সেটা পুড়ে শেষ হয়া আঙুলও পুড়ে গেছিলো। ভয়ানক অবস্থা!”
“কিভাবে মরছে? কোপের দাগ আছে গায়ে?”
“না! কোনো দাগ নাই!” শুভ বলে। “এমনকি গলায় আঙুলের দাগও নাই। তবু মরে কাঠ!” বলতে গিয়ে নিজেই শিউরে ওঠে শুভ।
বাস্তবে ফিরলাম। বেশ ভয় ভয় লাগছে। বৃষ্টির বিরাম নেই। বেশ কয়েক পা এগিয়ে থমকে গেলাম আতঙ্কে। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি। ঘড়ঘড়ে একটা শব্দ। শেকলের শব্দ। শেকলের শব্দ তুলে আমার দিকে এগিয়ে আসছে কেউ! আতঙ্কে জমে জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছি আমি।
আমার দিকে এগিয়ে আসছে একটা লম্বা কালো ছায়া। অন্ধকারে কেবল আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছি ওটার অবয়ব। মূর্তিটা একেবারে আমার কাছে এগিয়ে না আসা পর্যন্ত বুঝলাম না কি ওটা।
এক বুড়ো, প্রাগৈতিহাসিক এক সাইকেলে চড়ে এগিয়ে চলছে হাটার চেয়েও ধীর গতিতে। জ্যাম ধরা সাইকেলের চেন থেকে আসছে ঘড়ঘড়ানির শব্দটা।
বুড়ো আমাকে পেরিয়ে যাওয়ার পরও খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম ওখানেই। নিজেকে একদম বোকা বোকা লাগছে। এতটা ভয় পাওয়া উচিত হয়নি। ধুর।
বুকের ভেতরে হৃৎপিন্ডটা লাফাচ্ছে পাগলের মত। জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিলাম, লাভ হলো না। হার্টবিট কমলো না, রীতিমত ব্যথা করছে বুকটা।
বাকি রাস্তাটা তেমন একটা সমস্যা হলো না অবশ্য। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে দশ-পনেরো মিনিট পরে হাজির হলাম পার্কের মোড়ে।
পার্কের মোড় একটা তেমাথা। তিন রাস্তা যেখানে এক হয়েছে সেখানে একটা তিনকোণা বাঁধানো পার্কের মতো আছে। সেটা ঘিরে বেশ অনেকগুলো দোকানপাট। পার্কের মোড়ের কাছেই একটা বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। কাজেই জায়গাটা ছাত্রদের ভিড়ে জমজমাট থাকে রাত এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত।
কিন্তু আজ সর্বসাকল্যে তিন চারজন লোক দেখা যাচ্ছে গোটা এলাকায়। দু- জনের মাথায় ছাতা, আর বাকিজন এইমাত্র দৌড়ে একটা ইটালিয়ান হোটেলের ছাপড়ার তলায় আশ্রয় নিলো।
দমে গেলাম একটু। তারার দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাম, কিন্তু উৎসাহটা নেই হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মনে হচ্ছে আজ আমার আড্ডার কেউ হাজির নেই।
তারার দোকান স্রেফ একটা বাঁশের তৈরি চায়ের দোকান ছাড়া কিছু না। ভেতরে বেশ অনেকটা জায়গা আছে। সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটা হচ্ছে পেছনের একটা বেঞ্চ—যেটা রাস্তা থেকে দেখা যায় না। এলাকার নতুন সিগারেট খেতে শেখা ছেলেদের কাছে জায়গাটা স্বর্গসম।
তারার দোকানে ঢুকে টপটপিয়ে পানি পড়তে থাকা ছাতাটা গুটিয়ে নিলাম কেউ চোখ চলছে সারা দোকানে। গোটা দোকান লোকে বোঝাই-কেউ বসে, দাঁড়িয়ে। কেউ লেবু চা খাচ্ছে, কেউ সিগারেট টানছে আয়েশ করে। আর বাকি সবাই আসলে দোকানে ঢুকেছে বৃষ্টি থেকে মাথা বাঁচাতে।
এদের মাঝে আমার আড্ডার কেউ নেই। লম্বু শুভ, খাটো শুভ, মাইদুল, সৌরভ, রুবেল বা সিবাত-কেউ না। হুদাই এসেছি।
অবশ্য আড্ডার আয়োজন হয় যেই উদ্দেশ্যে, সেটা আমি একাই করতে পারি এখনো।
দোকানে দাঁড়ানোরও জায়গা নেই ভালোমত। লোকজনের চিপা-চাপা দিয়ে দোকানের সামনের দিকে ছোকরা মালিক তারাজুলের দিকে এগিয়ে গেলাম। তারা তুমুল উৎসাহে চারটা কাপে চা ঢালতে ব্যস্ত।
“ওই, তারা?”
“কন।” তারা চায়ের কাপে কাটা লেবু ঢালতে ঢালতে বলে।
“শুকনা চ্যাংরাটা আসছিল? খাটোটা?”
“না” মাথা নাড়ে তারা।
“চশমা পরা খাটোটা আসছিল?”
“হু, রুবেল আসছিল। চলি গেল একটু আগে।”
রাগে দাঁত কড়মড় করলাম। আমি আসার আগেই চলে গেছে শালা!
মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে নিলাম একবার। লম্বু শুভর বড় ভাই বসে আছেন ওদিকটায়, সিগারেট টানছেন। ওদিকে পিঠ দিয়ে তারাকে নিচু গলায় বললাম, “দুইটা গোল্ডলিফ দাও।”
সিগারেট নিয়ে বেরিয়ে এলাম বাইরে। এতক্ষণে বোধহয় বুঝতে পেরেছেন এই ঝুম বৃষ্টিতে বাইরে বেরোনোর এত তাড়া কেন আমার। নতুন সিগারেট খেতে শিখেছি কলেজে উঠে-না খেয়ে একটা দিনও থাকতে পারি না। সম্ভব হলে সারাটা দিনই সিগারেট টানি।
ছাতা মাথায় আর বুক পকেটে সিগারেট নিয়ে তাড়াতাড়ি হাটছি তারার দোকান থেকে দূরে। লম্বু শুভর বড় ভাই কেমন করে তাকাচ্ছিলেন আমার দিকে। ওনার সামনে সিগারেট খাওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারি না।
বেশ অনেকদূরে আসার পরে হুঁশ হলো। সিগারেট এনেছি, কিন্তু আগুন নেই সাথে। ম্যাচ বা লাইটার, কিছুই না। পিস্তল ছাড়া গুলি নিয়ে ঘোরার মত অবস্থা।
এত ঝুঁকি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে, এত কাদা পানি ডিঙিয়ে শেষ পর্যন্ত এই! রাগে নিজের চুল নিজেই ছেঁড়ার মত অবস্থা হলো আমার।
মেইন রোডের পাশে দাঁড়িয়ে আমি, ঘুটঘুটে অন্ধকারে। আশেপাশে কোনো দোকানও নেই যে সিগারেট জ্বালিয়ে নেব। তারার দোকানে আবার ফেরাও সম্ভব না।
এই সময় একটা জিনিস দেখে ধড়ে প্রাণ ফিরলো আমার। একটা ছোট্ট লাল আগুনের ফুলকি, বাড়ছে কমছে। ওটা একটা সিগারেটের আগুন, আমি নিশ্চিত।
রাস্তা থেকে বেশ দূরে অবশ্য ওটা, বিএডিসি খামারের পাশের গলিতে। গা-টা একটু শিরশিরিয়ে উঠলো আমার, কালকে ওখানেই পাওয়া গিয়েছিল লাশটা। কিন্তু তোয়াক্কা করি না-শরীরের প্রত্যেকটা কোষ চেঁচিয়ে নিকোটিন চাইছে।
কাদা-পানি ছপছপিয়ে ছুটলাম সিগারেটের আগুনটার দিকে। যতই এগোচ্ছি ততই একটা ছাতা মাথায় লোকের অবয়ব পরিস্কার হচ্ছে। আমার দিকে পাশ দিয়ে আছে লোকটা।
হঠাৎ বেশ অনেকটা ঠান্ডা লেগে উঠলো আমার। ওটা কিছু না, ছাতা থাকার পরও বেশ খানিকটা ভিজেছি। ওজন্যই বোধহয় শীত শীত লাগছে।
লোকটার একদম কাছে দাঁড়িয়ে নির্লজ্জের মতো বলে উঠলাম, “ভাই, আগুনটা একটু দিবেন? সিগারেটটা জ্বাআআ-
লোকটা ঘুরেছে আমার দিকে, আর আমার মুখের কথা মুখেই রয়ে গেছে।
এত অন্ধকারে কিছুই স্পষ্টভাবে দেখার কথা না, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি লোকটার মাথায় কোনো চুল নেই, কোঁচকানো কালচে চামড়ায় ঢাকা পুরো খুলিটা। চোখে কোনো মণি নেই—জ্বলছে ওগুলো নীলচে আভায়। নাক আর মুখের জায়গায় দুটো কালো গর্ত।
“সিগারেট,” ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠলো পিশাচটা। “এই সিগারেটই তোদের শেষ করলো। নির্বোধ মানবজাতি-এত কিছুর পরও শিখলি না তোরা!”
আমার হাটু ভাঁজ হয়ে আসছে, হাত থেকে খসে পড়ছে ছাতা। মুখ হাঁ করে আছি আমি, কিন্তু কোনো শব্দ বের করতে পারছি না। হাত পা অসাড়।
“আরেকটা শিকার পেলাম। আরেকটা সিগারেটখেকোর আত্মা!” বলতে বলতে পিশাচটা আমার দিকে একটা ঠান্ডা নীলচে হাত বাড়িয়ে দিলো।
হাতটা আমার বুকে এসে ঠেকেছে। স্পষ্ট টের পেলাম আমার আত্মাটা বুকের ভেতরে ধড়ফড় করে উঠেছে—বেরিয়ে আসতে চাইছে ওটা। সমস্ত জীবনীশক্তি বেরিয়ে যাচ্ছে আমার, ঠান্ডা হয়ে আসছে হাত পা।
আমি টের পাচ্ছি পিশাচটার নাকি আজরাইল বলবো- হাতটা আমার বুকের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে মাখনের ভেতর গরম ছুরি ঢোকানোর মত করে। আমার হৃৎপিন্ডের কাছাকাছি চলে আসছে ওটা।
আমি হাটু ভাঁজ হয়ে পড়ে গেছি মাটিতে। কিন্তু আজরাইলের হাতটা আমার বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেনি বরং আরো গভিরে বসে যাচ্ছে ওটা। আমি টের পেলাম বরফের মতো শীতল আঙুলগুলো সাঁড়াশির মতো আঁকড়ে ধরছে আমার হৃৎপিন্ডটাকে। এ ব্যথা কল্পনার বাইরে। পার্থিব কোনো মানুষ এই নারকীয় যন্ত্রণার কথা কল্পনাও করতে পারে না।
মরণের আগ মুহূর্তে শেষ শক্তিটুকু সঞ্চয় করে কোনোমতে কয়েকটা কথা উগরে দিলাম আমি-”খাবো না। আর কোনোদিন খাবো না।”
“কি বললি?” ঘড়ঘড়ে গলায় বলে উঠলো মৃত্যুদূত।
“আর কখনো খাবো না। আল্লাহর কসম। আর কখনো সিগারেট খাবো না। কখনো না,” আমি কাঁপতে কাঁপতে বললাম।
চোখে আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। কেবল পাগলের মত বলেই যাচ্ছি, “আর খাবো না। আর কখনো খাবো না। দয়া করুন। আরেকটা সুযোগ দিন।”
আমার জান কবচের আগ মুহূর্তে শুনলাম, “একটা মাত্র সুযোগ। মনে থাকে যেন।”
আমার হার্টের ওপর থেকে বরফ-শীতল সাঁড়াশিটা সরে গেছে। আমার গায়ের ওপরে কেউ দাঁড়িয়ে নেই।
একটা সুযোগ দেয়া হয়েছে আমাকে। শেষ সুযোগ।
আমি কাদায় পড়ে থেকে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। নড়ার শক্তি নেই। রাত দশটায় দু-জন পথচারি উদ্ধার করে বাসায় পৌঁছে দিল আমাকে।
*
কাহিনী শেষ। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে জয়। ছায়া ঘনাচ্ছে চারপাশে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে দ্রুত।
“বেঁচে গেছি আমি, শিপলু ভাই,” শুকনো কাঁপা গলায় বললো জয়। “কিন্তু কতদিনের জন্য? কতদিন সিগারেটের নেশা থেকে দূরে থাকতে পারবো আমি? এই নেশার কি কোনো শেষ আছে?”
জয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছি যখন, রীতিমত রাত নেমে এসেছে। বাস স্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে পরপর চারটা সিগারেট ধরাতে হলো আমাকে গল্পটা হজম করার জন্য।
অধ্যায় ৪ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ৪ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
খালেকুজ্জামান স্যারের দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গিটা কাঁচুমাচুর চূড়ান্ত।
হাজার হলেও মানুষটা আমার শিক্ষক। কাজেই আমি বিব্রত হলাম। আর বিব্রত হতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম, এই অনুভূতিটার সাথে, আমার কোনো সম্পর্ক নেই, বিব্রত হলে কি করতে হয় তা জানা নেই। স্বভাবতই রেগে উঠলাম। মোটা গলায় বললাম, “দাঁড়িয়ে কেন স্যার, বসুন।”
নিতান্ত বাধ্য হয়েই যেন সোফাটার কোণায় পা জড়ো করে বসলেন খালেকুজ্জামান স্যার। পরনে ঢলঢলে সস্তা প্যান্ট আর পলিয়েস্টারের শার্ট। ময়লা।
আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি বেশ অবাক হয়েই। খালেকুজ্জামান স্যার আমার খুব পছন্দের একজন মানুষ। পেশা বাংলাদেশের উঠতি শুটারদের কোচিং করা। এর চেষ্টা আর তদবির না থাকলে আমি সাফ গেমসের দলে সুযোগই পেতাম না। প্রথম দিন ট্রায়ালে শুটিং রেঞ্জে আমার শুটিং দেখেই খুব খুশি হয়েছিলেন তিনি। দ্বিতীয় দিনে আমার আরেক দফা ভালো শুটিং, আর স্যারও বলে বসলেন, “জামশেদ, তোমাকে সাফ গেমসে পাঠাবো আমি। হ্যা, আগামি বছরই। এয়ার রাইফেলে সোনা না হোক, তোমার রূপা জেতা কেউ ঠেকাতে পারবে না।” এরপর সবকিছুতেই আমার পাশে ছিলেন তিনি-দিনের পর দিন হাতে ধরে কোচিং করানো থেকে শুরু করে সাফ গেমসের দলে আমাকে নেবার সব আনুষ্ঠানিকতা সারা, গেমসের প্রতিযোগিতার সময়ে আমাকে সাহস দেয়া, সত্যি সত্যি সোনা জেতার পরে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদা।
সোনা জেতার আগেই আমাকে নিয়ে খুব গর্ব করতেন তিনি। আমি নাকি জাত শুটার। কথাটা মনে হয় সত্যি। আমার তেরতম জন্মদিনে আমাকে একটা বি.বি. গান উপহার দিয়েছিলেন বাবা। সেটা নিয়ে বাসার ছাদে গিয়ে প্রথম গুলিতেই উড়ন্ত একটা শালিক মেরেছিলাম। বাবাও খেয়াল করেছিলেন আমার এই বন্দুক-প্রীতি। আঠারো বছর বয়স হবার পরই আমাকে ভর্তি করে দিলেন শুটিং ক্লাবে। উনি নিজেও ওখানকার সদস্য ছিলেন।
শখের বশে দুয়েকটা শুটিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে খুবই ভালো করার পরে আমার মাথায় ভুত চাপলো, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যাবো। শুটিং ফেডারেশনের সাথে যোগাযোগ করলেন বাবা। খালেকুজ্জামান স্যারের কাছে সবক নিতে হলো কয়েক মাস। সাফ গেমসের শুটিং দলের জন্য মনোনীত হলাম। তার পরের গল্প আপনাদের আগেই বলেছি।
সোনা জেতার পর বহু পানি গড়িয়েছে বুড়িগঙ্গায়। সেই খালেকুজ্জামান স্যার আজ পাঁচ বছর পরে এই তেরানব্বই সালে আমার বাসায়?
সরু চোখে লোকটাকে জরিপ করতে করতে উল্টো দিকের সোফায় বসলাম। আমি লোকটা এত বড় গুরুভক্ত নই যে তাকে পাঁচ বছর পর হাজির হতে দেখে হা-হা করে ছুটে গিয়ে পায়ের ধুলো নেব। স্যারের উপস্থিতির নেপথ্যে নিশ্চিত অর্থাভাব। তার হাতের টিপ যতো ভালোই হোক না কেন, সরকারের ট্যাঁক থেকে যথেষ্ট বড় অংকের বেতন খসাবার জন্য তা যথেষ্ট নয়। তাছাড়া তার সংসারে আরো কি কি জানি সমস্যা ছিলো, তখন জানতাম, এখন মনে পড়ছে না।
“তারপর বাবা জামশেদ, সব ভালো তো?” চওড়া একটা হাসি দিলেন খালেকুজ্জামান স্যার, ক্লিষ্ট না-কামানো মুখটাতে পটাপট ভাঁজ পড়লো কয়েকটা। চোখ দুটো ক্ষুধার্ত মানুষের মত জ্বলজ্বল করছে।
“হুঁ,” বলে গোঁফ মোচরাতে মোচরাতে লোকটার দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। স্যার টাকার কথাটা কখন পাড়বেন, শোনার অপেক্ষায় আছি।
“তোমার বাবার ব্যাপারে শুনলাম। খুব খারাপ লাগলো। সত্যিই উনি বড় ভালো মানুষ ছিলেন।”
আমি আরেকটু কাত হয়ে হেলান দিলাম সোফায়। বাহ, আধাপাগলা লোকটা ইদানিং বেশ কথা শিখেছেন মনে হচ্ছে। অভাবে পড়লে যা হয় আর কি। আমার বাবার মৃত্যু দিয়ে কথা স্টার্ট, তারপর বলবেন বাবা তুমি তো কোম্পানির মালিক হইলা, তারপর কথার মোড় দুইদিকে ঘুরতে পারে-তার কোনো আত্মীয়ের চাকরি, কিংবা অর্থ সাহায্য। চাকরির ব্যাপারটা মোস্ট লাইকলি। তার একটা বখে যাওয়া ছেলে ছিল, এখন মনে পড়ছে।
“তোমার বাবা তোমাকে নিয়া অনেক আশা করতেন।”
আমি আমার প্রিয় গোঁফে তা দিতে দিতে মাথা পেছনে হেলিয়ে স্যারের কথা শুনছি। কথার মোড় কোনদিকে ঘুরছে বোঝার চেষ্টা করছি।
“উনি মাঝে মাঝে কোম্পানিতে যাওয়ার রাস্তায় তোমাকে রেঞ্জে নামায় দিতেন, উনি মনে আছে? তোমার বোধহয় জানা নাই, তুমি যখন রেঞ্জে প্র্যাকটিস করতা, অনেক সময় আমাকে ডেকে নিয়া অনেককিছু নিয়া কথা বলতেন। বলতেন, মা মরা ছেলে, খুব মেজাজি, আমি যেন কিছু মনে না করি। বলতেন, আমি ছেলেরে বিদেশে পাঠামু না, পাঠাইলে আমার এত কষ্টের ব্যবসা-বাণিজ্য আর বাড়িঘর কে দেখবে? সেইজন্যে তোমাকে আর বিদেশে পাঠায় নাই, ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াইছে।” খালেকুজ্জামান স্যার পিঠ কুঁজো করে বসেছেন। হাত জড়ো করা। চোখের কোণে কালি।
মাথা তুলে ভালো করে এবার স্যারের দিকে তাকালাম আমি। বাবা এই লোকের সাথে এতক্ষণ কথা বলতেন এসব নিয়ে? নতুন তথ্য বটে।
“বলতেন, ছেলেটার আর কোনোকিছুতে তেমন আগ্রহ নাই কিন্তু শুটিং খুব ভালোবাসে। বলতেন, আমি যেন তোমাকে একটু ভালো কইরা দেখি।”
স্যারের একটাই ছেলে ছিল, এখন মনে পড়ছে। বখাটে না, ভালো ছাত্রই ছিল। “আমি বলতাম, চিন্তা কইরেন না, আপনার ছেলের হাতের টিপের জবাব নাই। সাফে শিওর সোনা জিতবে।”
ছেলেটাকে নিয়ে অনেক আশা ছিল স্যারের, মনে পড়ছে এখন
“তুমি সাফে ঠিকই সোনা জিতলা।”
স্যারের ছেলেটা কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে পানিতে ডুবে মারা গিয়েছিলো, মনে পড়ছে।
“তোমারে নিয়া আমি আরো বড় স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। কমনওয়েলথ, অলিম্পিক! আমার ছাত্র অলিম্পিকে সোনা জিতবে!” স্যারের চোখ এত চকচক করছে কেন? মানুষের চোখ এমন টর্চলাইটের মত চমকাতে পারে নাকি?
সোফায় হেলান দেওয়া মাথায় উঠেছে আমার। শিরদাঁড়া সোজা করে সামনে ঝুঁকে বসেছি আমি এখন। “কি বলতে চাচ্ছেন, স্যার?”
“অলিম্পিকে যাওয়ার সব প্রস্তুতি নিয়াও ফেললা তুমি, তারপরই…’ “স্যার!” কর্কশ গলায় প্রায় চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। “ওই বিষয়ে আর একটা কথাও শুনতে চাচ্ছি না।”
“…তুমি এমন একটা কাজ করে ফেললা…” আমার হুঁশিয়ারি যেন কানেই ঢোকেনি স্যারের। চোখের দৃষ্টি কোন সুদূরে পাঠিয়ে আমার জীবনের সবচেয়ে লজ্জার ঘটনাটা বয়ানে ব্যস্ত তিনি।
“স্যার!” ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে একটা ধমক দিলাম আমি, এমন জোরে যে দরজার কাছে ছুটে এসে দাঁড়ালো আক্কাস মিয়া।
ঘোর কাটলো যেন স্যারের। “মাফ কইরে দিও. বাবা। মাফ কইরে দিও। বয়স হইয়া গেছে তো, কি বলতে কি বলে ফেলি। সেদিন ডাক্তার বললো ডায়াবেটিস হইছে, ওষুদ কিনবো সেই টাকাটাও নাই। আমার ছেলেটা বাঁইচা থাকলে…”
স্যারের আসার উদ্দেশ্যটা পরিস্কার হলো। স্যারের প্রতি আমার অন্যরকম একটা শ্রদ্ধা আছে বটে, কিন্তু তাই বলে আমি এমন লোক না যে বসে বসে তার সুখ-দুঃখের আলাপ শুনবো। তড়িঘড়ি বলে উঠলাম, “আমার চাচাতো ভাইটা ডাক্তার। এই বাসাতেই থাকে। তাকে বলে দিচ্ছি, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।”
“ছেলেটার খুব শখ ছিলো, ইঞ্জিনিয়ার হবে…”
“আপনার ঔষধের খরচ আমি দেবো…” স্যারের কথা চাপা দিয়ে বলার চেষ্টা করলাম।
“অংকও খুব ভালো পারতো…” স্যার যেন ঠিক করেছেন তার মৃত ছেলে নাড়িনক্ষত্র আমাকে না জানিয়ে ছাড়বেন না।
“যত টেস্ট লাগবে সব ফ্রিতে করাতে পারবে সামাদ…”
“কালকে রাতে তোমার বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম।”
আমি বলতে চাচ্ছিলাম তার হসপিটাল বিলও আমি দেব, কিন্তু সেটা আর বলা হলো না, হা-করে তাকিয়ে রইলাম। “কি-কি বললেন?” দু’বার চেষ্টার পরে মুখ খুলতে পারলাম।
খালেকুজ্জামান স্যারের চোখের নিচে কালি, কিন্তু মণিদুটো চকচক করছে টর্চলাইটের মত। “তোমার বাবা…স্বপ্নে দেখলাম। একবারে য্যান জ্যান্ত, খুব পেরেশান লাগলো তাকে। আমারে ডাইকা বললো, আমার ছেলেটার খুব বিপদ, তাকে একটু সাবধান কইরা দিয়েন। আপনার কথা সে শুনবে, আর কারো কথা শুনবে না, আপনি তারে একটু সাবধান করে দিয়েন।”
আগস্টের গোড়ায় সন্ধ্যা সাতটায় এই ঢাকা শহরে নিজ বাসায় বসে আমি টের পেলাম, আমার পিঠের ঠিক মাঝখানটা দিয়ে বরফগলা পানি চালান করে দিল কে যেন। “আ-আর কি বললো?”
“আর কি জানি কইলো…কি জানি কইলো…” দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষটা মাথা নাড়ছে, মনে করার প্রবল চেষ্টায় যন্ত্রণার ছাপ তার মুখে।
এত লং টাইম ধৈর্য ধরে রাখার রেকর্ড আমার নাই। চেঁচিয়ে উঠলাম, “কি বলেছে বলে ফেলেন, ফর গডস সেক!”
আমার দিকে চমকে তাকালেন স্যার। চোখের দৃষ্টিতে বুঝলাম, চিনতে পারছেন না আমাকে। দুই চোখের দৃষ্টিতে অনিশ্চয়তা মেশানো আতঙ্ক। খানিকক্ষণ সেভাবেই আমার দিকে চেয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে বললেন, “বলছে তুমি যেন আসল নকল বিচার করো।”
মানে কি এর? বহু কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বললাম, “এর মানে?”
স্যারকে আরো বিভ্রান্ত মনে হলো। যেন নিজের মুখের কথা শুনে তিনি নিজেই অবাক হচ্ছেন। “বলছেন, তুমি যেন সবকিছুর আসল নকল বিচার করো।”
“কি!”
“আসল নকল বিচার করো। তুমি যেনো সবকিছুর আসল নকল বিচার করো।” স্যার অপ্রকৃতিস্থের মত ভাঙা রেকর্ড বাজিয়েই যাচ্ছেন।
যাদের এই অভিজ্ঞতা হয়নি, তারা বুঝতে পারবেন না এই রকম মুহূর্তে কেমন রাগ লাগে। ধরুন, আপনাকে কেউ একটা কথা বললো, আপনি বুঝলেন না, আপনি বুঝিয়ে বলার জন্য বললেন। তখন সে যদি আবার বার বার সেই বোধের অগম্য কথাটাই বলে যায়, তাহলে কিরকম মেজাজ খারাপ হয়, নিজে তার শিকার না হলে কখনো বুঝতে পারবেন না। আমি জানি স্যার অসুস্থ, জানি তার মাথার ঠিক নেই, তবু লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম সোফা ছেড়ে। সর্বশক্তিতে চেঁচিয়ে উঠলাম, “ধ্যাত মিয়া! পাগল ছাগল কোথাকার! এই সব বালছাল শোনানোর জন্য এখানে এসেছেন!” দম নেবার জন্য এক মুহূর্ত থামলাম, রাগ কমেনি তখনো। “সামাদ! এই সামাদ! এই লোকটাকে পাগলাগারদে রেখে আয়! এক্ষুণি!” শেষের কথাগুলো ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ানো সামাদের জন্য।
ধাঁ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে গটগট করে চলে যাচ্ছি, পেছনে শুনলাম খালেকুজ্জামান স্যার বলছেন, “বাবা, আসল নকল বিচার করবা। খুব জরুরি, বাবা, খুব জরুরি। তোমার সামনে বিরাট বিপদ, বাবা, বিরাট বিপদ!”
*
পরের দিনটা সারাদিন কোম্পানিতেই কাটালাম। সব ডায়রেক্টরদের সাথে কথা বললাম। ম্যানেজার আর সুপারভাইজরদের সাথে কথা বললাম। বিভিন্ন ফ্লোরে ফ্লোরে ঘুরে ঘুরে কাজ দেখলাম, যদিও একটা এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট কোম্পানিতে কি কাজ হয় তা সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই নেই। ডায়রেক্টরদের সবাই বুড়ো বুড়ো, বাপ- চাচার বয়সের, কিন্তু তাতে কি? এই কোম্পানির আটাত্তর ভাগ শেয়ার আমার বাপের উত্তরাধিকারসূত্রে আমার। বলতে গেলে এই কোম্পানির মালিকই আমি। কাজেই দামি স্যুট পরে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে গম্ভির মুখে কোম্পানির ভালো-মন্দ নিয়ে ডায়রেক্টরদের সাথে কথা বললাম, কয়েকটা যুগান্তকারি ডিসিশনে সম্মতি জানালাম, কয়েকজনের চাকরি নট করে দিলাম। একেবারে ব্যস্ত দিন যাকে বলে। অন্যদিনের মতো দুপুর দুটোয় ঘুম থেকে ওঠা জামশেদের কোনো চিহ্ন তাতে নেই।
সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে টাইয়ের নট ঢিলে করে ড্রয়িংরুমে বসে টিভির রিমোট টিপছি, আর চিন্তা করছি দু-হাজার সাল আসতে আসতে আমার বাড়িতে কেল টিভির মতো আরো কি কি আজব বস্তু এসে ঢুকবে, তখনই শিপলু হাজির। লাল-কালো চেকের একটা শার্ট গায়ে, অনেকটা ফ্ল্যানেলের মতো লাগছে, জিন্সের প্যান্ট, আর ঝকঝকে চশমার কাঁচে পুরনো শিপলু
“জামশেদ আলী খানসাহেব আজ কোম্পানিতে গিয়েছিলেন?” আমার দিকে আড়ষ্ট হাসি দিয়ে বললো শিপলু, যেন আসলে মনের মধ্যে অন্য কোনো চিন্তা চলছে ওর।
“হ্যা,” বললাম আমি, কথার ভঙ্গিতে জবাব দেবার ভাবের চাইতে প্রশ্নের ভাবটাই বেশি।
“দুপুরেই এসেছিলাম এখানে,” একটা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো শিপলু। “তোকে পেলাম না। আক্কাস চাচার কাছে শুনলাম কোম্পানিতে গেছিস।”
“ব্যাপার কি?” শিরদাঁড়া সোজা করে বসে বললাম আমি। “কোনো সমস্যা?”
“আগে বল, আইরিনের সাথে তোর সম্পর্ক কেমন যাচ্ছে?”
চোখ কুঁচকে ফেললাম আমি। “সেটা নিয়ে…”
“দরকার আছে, জামশেদ!” অধৈর্য ভঙ্গিতে বলে উঠলো শিপলু।
কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে। “ওর সাথে সম্পর্ক বলতে গেলে নেই এখন।”
“কোনো কিছু নিয়ে ফাইট হয়েছে?”
“হ্যা।” ইতস্তত করে বলে ফেললাম আমি।
“কিরকম? খুব খারাপ?”
“তা বলতে পারিস।” অন্যদিকে চেয়ে বললাম আমি।
আমার দিকে খানিকক্ষণ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থাকার পর বাঁ পকেট থেকে মার্লবোরোর প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ঠোঁটে ঝোলালো শিপলু। পকেটে ফেরত গেল প্যাকেট। ডান পকেট থেকে জিপো লাইটার বের করে ক্লিং করে জ্বালিয়ে নিলো সিগারেট। জিপো লাইটার আবার ফেরত গেল যথাস্থানে। তারপর আয়েশ করে অতি ধীরে সিগারেটে গভির দুটো টান দিলো সে। ততক্ষণে অধৈর্যের চরম সীমায় চলে গেছি আমি, কিন্তু মুখে কিছু বললাম না। বিরাট কিছু বলার আগে শিপলুর পূর্বপ্রস্তুতি এটা, জানা আছে আমার। এখন যদি আমি আমার গান র্যাক থেকে রাইফেল বের করে ওকে গুলি করি তাহলেও বিড়ি ধরানো বাদ দিয়ে আমার সাথে কথা বলবে না ও।
“কালকে একটা কাজে শ্যালে বারে যেতে হয়েছিল,” কথা শুরু করলো শিপলু, কথার সাথে সাথে সিগারেটের ঘন ধোঁয়াও বেরোচ্ছে ওর মুখ থেকে। “এক ইনফর্মারের কাছ থেকে একটা স্টোরির ব্যাপারে গরম খবর পাবার কথা ছিল, তাই গেছিলাম। বসেছি এক কোণার অন্ধকার টেবিলে। খেয়াল করলাম, এক টেবিল দূরে বসেছে আইরিনের এক্স বয়ফ্রেন্ড রাশেদের ডানহাত বোমা মজিদ। পাঁড় মাতাল। সাথে সাঙ্গপাঙ্গ। বোমা মজিদের চেহারা কেমন, জানিসই তো। তেল চকচকে কালো চেহারা, মাথায় ন্যাড়া করার পর সদ্য গজানো চুল, ময়লা দাঁত, পরনে স্কিন টাইট জিন্স আর ঘামে ভেজা গেঞ্জি। মদের নেশায় ভুলভাল বকছিল সে। প্রথমে কান দেইনি, পরে খেয়াল করলাম, ব্যাটারা তোকে নিয়েই কথা বলছে।”
সিগারেটে দম দেবার জন্য থামলো শিপলু। আমি ঠোটে চিমটি কাটতে কাটতে চেয়ে আছি ওর দিকে। নিজের মুখ নিজে চেপে ধরার মত করে সিগারেট ধরা হাতটা মুখের ওপর রেখে লম্বা দুটো টান দিলো ও। সিগারেটের আগুনটা জ্বলজ্বল করছে বিপদসংকেতের মত। “যতদূর শুনে বুঝলাম তোকে হিট করার প্ল্যান করছে ওরা।”
আমার পক্ষে এ মুহূর্তে যা করা সবচেয়ে স্বাভাবিক তাই করলাম আমি-হো হো করে হেসে উঠলাম কর্কশ গলায়। ব্যাঙ্গের দৃষ্টিতে তাকালাম শিপলুর দিকে। “তাই? কবে? কোথায়? ওদের হাতে কি কি অস্ত্র দেখলি? দুয়েকটা কালাশনিকভ রাশিয়া থেকে আমদানি করতে ভোলেনি তো?”
শিপলু কিন্তু একটুও হাসছে না। “আমার মনে হয়, ব্যাপারটা আরেকটু সিরিয়াসলি নিলে ভালো করবি তুই।”
হাসি থামালাম আমিও। “দেখ শিপলু, বোমা মজিদকে তোর চাইতে ভালো চেনা আছে আমার। ও ব্যাটা যত গর্জায় তত বর্ষায় না। এরশাদের আমলে ক্যাম্পাসে দুই একটা ককটেল ফাটিয়ে যে নামটা পেয়েছে, সেটা ভাঙ্গিয়েই খাচ্ছে এখনো।”
“জানি, ওর সাথে তোর বেশি একটা ঝামেলা নেই। কিন্তু রাশেদের কমান্ড সে ফেলতে পারবে না।” শিপলু বললো।
“রাশেদের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই …”
“রাশেদের সাথে কমদিনের ঝামেলা তোর, বল? স্কুলে পড়ার সময়ই নাকি ওর সাথে মারামারি করেছিস ডজনখানেক বার। তারপর ওর গার্লফ্রেন্ডও ছিনিয়ে নিলি! আর মাস তিনেক আগে আইরিনের জন্মদিনে কি কান্ডটা করেছিলি, মনে আছে নিশ্চয়ই?” ধোঁয়া ছেড়ে বললো শিপলু।
মনে না থাকার কোনো কারণ নেই। ডিস্কো চলার সময় আইরিনের সাথে নাচার জন্য পীড়াপীড়ি করছিল রাশেদ। আমি এগিয়ে গিয়ে বলেছিলাম, ও আর তোর গার্লফ্রেন্ড না, সরে যা। রাশেদ আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বলেছিল, “আরে চিল ম্যান। রাগ হস কিল্লাইগা। তর জিনিস তো আমি কুনখানে লইয়া যাইতাছি না। জাস্ট পাঁচ মিনিট নাচুম। জানি, তর বাপে এক্সিডেন্টে ভর্তা হওনের পর থিকা…” কথা শেষ হবার আগেই এক ঘুষিতে ওর নাকটা থেঁতলে দিয়েছিলাম আমি।
“রাশেদ কিন্তু পাল্টা কিছু করেনি,” কথা বলে চলেছে শিপলু। “ভুলবি না, ব্যাটা কমসে কম তিনটা মার্ডারের সাথে জড়িত। রাগ পুষে রেখেছে নিশ্চয়ই। আইরিনের সাথে তোর রিসেন্ট ইনসিডেন্টের শোধ তুলবে এবার।”
“আইরিনের সাথে আমার কিছু হয়েছে, বুঝলি কিভাবে?” চোখ কুঁচকে বললাম আমি।
“বোমা মজিদের কথা শুনে, আবার কিভাবে?” সিগারেটের ছাই ঝাড়লো শিপলু। “টাল হয়ে অনেক কথাই বলছিলো ও, কিন্তু তার মধ্যেও যা বুঝলাম, আইরিন আর তোর মাঝে ফাইট হয়েছে, আইরিন ব্যাক টু রাশেদ, রাশেদ অ্যাংরি উইথ ইউ, রাশেদ ওয়ান্টস রিভেঞ্জ। কমদিনের রাগ না তোর ওপর। কে না জানে, রিভেঞ্জ ইজ অ্যা ডিশ বেস্ট সার্ভড কোল্ড।”
“রাশেদ কচুটা করবে আমার,” ঠান্ডা গলায় বললাম আমি। শিপলুর ওপর আমি রাগিনা কখনো, কিন্তু এ ব্যাটাও দেখছি আমাকে চটিয়ে দিচ্ছে।
“তোর মতো একই কথা ভেবেছিল উঠতি তরুণ ব্যবসায়ি আসগর আলীও। ব্যবসা নিয়ে টেক্কা দিতে গিয়েছিল রাশেদের সাথে। বেশি ড্যাম কেয়ার ছিলো। খেসারতও দিতে হয়েছিল দারুণ। তুরাগে লাশ ভেসে উঠেছিল। কোনো প্ৰমাণ নেই, কিন্তু সবাই জানে কাজটা রাশেদের।” শান্ত গলায়, বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো শিপলু।
সবই জানি, আর শিপলুও যে সত্যিকারের বিপদের কথা বলছে সেটাও বুঝি, কিন্তু কেয়ার করতে ইচ্ছা হচ্ছে না আমার। সারা জীবন এসব ব্যাপারকে কখনো মাথায় আনিনি, আর এখন এসব নিয়ে মাথা ঘামাবো? অসম্ভব। শিপলু এদিকে হাল ছাড়বে না, জানি। ওর কথা বিবেচনায় নিচ্ছি এমন একটা ভাব করে বললাম, “আমার ওপর হিট নেবার চেষ্টা করছে—মানেটা বুঝলাম না। কবে? কখন?”
আমার অভিনয়ে কাজ দিল। শেষ হয়ে আসা সিগারেটটায় কষে টান দিয়ে নড়েচড়ে বসলো শিপলু। “সেটা স্পেসিফিকলি বলতে পারছি না। আসগার আলীর ক্ষেত্রে দেখলে দেখবি, তাকে আগে তুলে নিয়ে গিয়েছিল রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে। সেবারে অন্য লোক দিয়ে কাজ সেরেছিল রাশেদ। কিন্তু এবার বোমা মজিদের হাতে কেস। মনে তো হয় পুরনো স্টাইলেই কাজ সারবে মজিদ। তোকে ফলো করবে, কোনো চিপা-চুপায় যাবার পরে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে অ্যামবুশ।”
এই ঢাকা শহরে আমাকে অ্যামবুশ করবে বোমা মজিদের মত নেশাখোর? হাসি
আটকালাম কোনোমতে। সন্দেহ নেই তিলকে তাল বানাচ্ছে শিপলু। কিন্তু বেচারারই বা কি দোষ। সাংবাদিকদের মগজটাই এমন। দড়িকে সাপ ভাবে সব সময়। তাছাড়া সে তো আমার ভালোর জন্যই বলছে। টিটকিরি করলাম না সেজন্য। “তো এখন আমার করণীয় কি? পুলিশকে জানাবো?”
“পুলিশকে জানিয়েই বা করবি কি? জানি, পুলিশের ওপর অনেক প্রভাব তোদের ফ্যামিলির, কিন্তু সেম প্রভাব কিন্তু রাশেদের ফ্যামিলিরও আছে, ম্যান! আর পুলিশ টাকার দিওয়ানা। কয়েক লাখ পকেটে সেঁধোলেই তোর দিক ছেড়ে ঝুঁকবে রাশেদের দিকে।”
বলতে চাচ্ছিলাম, কোন থানার কোন ওসির সাথে আমার সম্পর্ক কেমন। বললাম না। এসব বকে যদি সুখ পায় শিপলু, পাক না। আমার বন্ধুদের মাঝে এই ছেলেটাকেই সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি আমি, মে বি এই কারণে যে সে অন্যদের মতো বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে না। বাপ বেঁচে থাকতে ছিল কেরাণি, বাপের রেখে যাওয়া কোনো সম্পত্তিও পায়নি বেচারা। সম্পত্তি থাকলেই না পাবে! বাবা মারা যাওয়ার পরে শিপলুর ওপর টানটা আরো বেড়েছে আমার।
“তাহলে? পুলিশের ওপরও ভরসা করতে পারছি না, বোমা মজিদও আমাকে মারার জন্য মুখিয়ে আছে, তাহলে এখন আমি করবোটা কি?”
“আমার মনে হয়, কয়েকদিনের জন্য ঢাকার বাইরে থেকে বেড়িয়ে এলে ভালো করবি তুই।” শেষ হওয়া সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে পিষে ফেলতে ফেলতে বললো শিপলু।
সাইকিয়াট্রিস্টের কথা মনে পড়ে গেল আমার। সে-ও আমাকে বলেছিল ঢাকার বাইরে ঘুরে আসতে। ব্যাটা আমাকে কেমন পাগলের মত ট্রিট করেছে সেটা মনে পড়তেই খাপ্পা হয়ে উঠলো মেজাজটা। “নো ওয়ে। আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
“কেন?” অবাক হয়ে বললো শিপলু।
সাইকিয়াট্রিস্টের ব্যাপারটা শিপলুকে বলিনি। ওর জানার কোনো দরকার আছে বলেও আমার মনে হচ্ছে না। প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম “এমনিই। ইচ্ছা করছে না। তাছাড়া কোম্পানি নিয়ে ব্যস্ত আছি এখন।” শেষের কথাটা যে ডাহা মিথ্যা, সেটা বলাই বাহুল্য।
“কিন্তু দেখ, ব্যাপারটা দরকারি।” পকেট থেকে আবার সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে বললো শিপলু। “রাশেদ হচ্ছে একটা পাগল। নতুন কিছু নিয়ে ভয়ানক মেতে ওঠে, আবার পরে সেটা ভুলতেও সময় লাগে না। তোকে একেবারে জানে শেষ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে এখন, আবার কয়েকটা দিন পেরোলেই দেখবি তোর ব্যাপারে বেমালুম ভুলে গেছে। ভেবে দেখ-স্কুলে ওকে অনেকবার পিটিয়েছিস তুই। ওর গার্লফ্রেন্ড ভাগিয়ে নিয়েছিস। আবার ঘুষি মেরে ওর নাক ভেঙেছিস। প্রত্যেকবারই কয়েকদিন খুব ফুঁসেছে তোর ওপর, শোধ নেবার উপায় খুঁজেছে, আবার মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে উৎসাহে ভাটা পড়তেও সময় – “
“তোর পয়েন্টটা কি, সেটা বল আগে।” হাত তুলে বললাম আমি।
“পয়েন্টটা হচ্ছে,” না-জ্বলানো নতুন সিগারেটটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলতে থাকলো শিপলু, “তুই কয়েকটা দিন বাইরে থেকে ঘুরে আয়, রাশেদের মাথাও ঠান্ডা হোক। আইরিনের সাথে বিয়ের তোড়জোড় ততদিনে শুরু করবে নির্ঘাত। আইরিনের বাপের সম্পদের ওপর ওর লোভটা তো কমদিনের না। তখন তোর ওপর শোধ নেবার পোকা ওর মাথা থেকে দূর হবে। নোবডি গেটস হার্ট, পুলিশও কোনো টাকা খাবার চান্স পাচ্ছে না, আইরিনের ঝামেলাও দূর হচ্ছে তোর ঘাড় থেকে। মেয়েটা তোর ঘাড়ে সিন্দবাদের ভুতের মতোই ঝুলে ছিলো, যদ্দূর জানি।”
“সো বেসিক্যালি তুই বলছিস, আমি রাশেদের মতো একটা গাজীপুরিয়া ছুঁচোর ভয়ে পালিয়ে থাকবো।” ধীরে ধীরে থেমে থেমে বললাম আমি।
“পাগলের কাছে থেকে দূরে থাকাটাকে পালানো বলে না। বুদ্ধিমান লোকে পাগলের কাছে থেকে দৌড় মেরে দূরে সরে যায়। সেটাকে কি পালানো বলা যায় নাকি সেটা তুই-ই ঠিক করবি।”
তোর সাথে যুক্তিতে পারবো না, বাপ-মনে মনে বললাম আমি। টিভির দিকে রিমোটটা তাক করে চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে বললাম, “দেখি। ভাবার সময় দে। ভেবে দেখি।”
স্বস্তির একটা নিশ্বাস ছাড়লো শিপলু। হাতের তালুতে আড়াল করে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললো, “তাছাড়া তোর একটা রেস্ট নেওয়াও হয়ে যাবে। এই সময় তোর একটা ভ্যাকেশন সত্যি বড্ড দরকার।” কয়েক মুহূর্ত কী যেন ভাবলো ও, তারপর বলেই বসলো, “আমাকেও এ সময় একটা কাজে ঢাকার বাইরে থাকতে হবে। প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন।”
আমি শিপলুর সাথে বেশ কয়েকবার প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশনে গিয়েছিলাম খুব আগ্রহের সাথেই, কিন্তু সে সবই বাবা মারা যাবার আগে। এখন ওসব নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। স্রেফ বলার জন্য বললাম, “তো, কেসটা কিসের?” আমার গলায় অন্যমনষ্ক ভঙ্গি, চোখ রঙ্গিন টিভিতে।
শিপলু কিন্তু খুব আগ্রহের সাথেই আমার দিকে ঝুঁকে এলো। কি মনে করে পকেটে হাত ঢোকালো আবার, বের করে আনলো মানিব্যাগটা। সেটা থেকে
বেরোলো একটা আঞ্চলিক পত্রিকার কাটিং। “এই যে দেখ। রংপুরের প্রত্যন্ত এক গ্রামে রহস্যময় জন্তুর আবির্ভাব। সেটা যে কি জানোয়ার, সেটা কেউ বলতে পারছে না। বেশ কয়েকটা গবাদিপশু মারা পড়েছে সেটার হাতে-আর সর্বশেষ, গত সপ্তাহে এক গ্রামবাসি। স্থানীয় পুলিশ কোনো মন্তব্য করেনি এ ব্যাপারে, তদন্ত নাকি চলছে। গ্রামবাসিদের বদ্ধমূর ধারণা, জিনিসটা একটা পিশাচ।”
আমি শিপলুর কথা শুনছিলাম, আবার শুনছিলামও না; কিন্তু শেষ কথাটা ঠিকই আটকে গেল আমার কানে। আর থাকতে পারলাম না। জোরে জোরে হেসে উঠে বললাম, “পিশাচ! ভালোই তো।”
“এক্সাক্টলি!” চটাশ করে দু’ আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলে উঠলো শিপলু, চকচক করছে ওর দুই চোখ। “দ্যাটস দ্য পয়েন্ট! ক্ল্যাসিক প্যারানরমাল কেস! রহস্যময় প্রাণী! মনে আছে জামশেদ, যশোরের গ্রামটার ওই কেসটা, যেবার-”
“হুঁ, আছে,” তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম আমি, ওই ব্যাখ্যাহীন ঘটনার কথা আর ইয়াদ করতে চাচ্ছি না। “বাট, জাস্ট একটা লোকাল পেপারের খবরে এত মাতিস না। এমনও হতে পারে যে পুরো ব্যাপারটাই বোগাস। বানানো খবর। জাতীয় দৈনিকই যেখানে বানানো খবরে ভর্তি, সেখানে একটা আঞ্চলিক পেপার।”
“সেটা তো হতেই পারে,” পেপার কাটিংটা মানিব্যাগে ফেরত পাঠাতে পাঠাতে বললো শিপলু। “বাট ভুলবি না, এভাবেই আমি আমার বেশিরভাগ কেসের হদিস পাই। আর আসল ব্যাপার তো সেটা না। তুই নাহয় কেসের ছলেই আমার সাথে কদিন ঘুরে এলি, মনে কর!”
আমার বিরস বদন দেখে শিপলু বললো, “থাকার জায়গারও সমস্যা নেই। ওই গ্রামে ব্রিটিশদের বানানো একটা বাংলো আছে। কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলা আছে আমার। যেতে চাইলেই জায়গা মিলে যাবে।”
হু-হা করে মাথা নাড়িয়ে প্রসঙ্গটা কাটিয়ে দিয়েছিলাম ওই সময়
অবশ্য আসল ঘটনাটা এড়াতে পারিনি এত সহজে।
অধ্যায় ৫ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ৫ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
“মানুষ সর্বভুক প্রাণী, জানিস তো,” বারের কাউন্টারের ওপর কনুই রাখা শিপলুর, তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে একটা বিয়ারের বোতলের গলা, পেন্ডুলামের মত করে দোলাচ্ছে ওটাকে।
“হুঁ,” বললাম আমি, মার্টিনির গ্লাসটা ঠোঁট পর্যন্ত তুললাম, কিন্তু চুমুক দিলাম না, ওটার কানার ওপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি শিপলুর দিকে। ওর হালচাল বোঝার চেষ্টা করছি। শিপলুর ঘাড়ের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে ওপাশে বসা সামাদকে। স্কচের গ্লাস নিয়ে বসে আড়চোখে এক সুন্দরিকে দেখার চেষ্টা করছে।
“মানুষের সহজাত খাবারের মাঝে কি কি আছে, জানিস?” বলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে শিপলু। ওর চোখের মণি স্থির, চকচক আর ছলছল করছে। আমি অবাক হয়ে ভাবছি মাত্র সাড়ে তিন পার্সেন্ট অ্যালকোহলিক বেভারেজ খেয়ে একটা মানুষ কতটা মাতাল হতে পারে। আমার মাঝে জবাব দেবার কোনো লক্ষণ না পেয়ে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিলো ও, “শষ্য, ফলমূল, মাংস, মদ।”
শেষের জিনিসটার উল্লেখ সত্যিই নৃবিজ্ঞানের বইতে আছে না ওর পেটের ভেতরে থাকা একই বস্তু ওকে দিয়ে বলিয়ে নিচ্ছে, সেটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই আবার মুখ খুলেছে শিপলু। “নাউ নোটিশ, আমি কিন্তু শাক সবজির কথা বলিনি। হ্যা, গুড হেলথের জন্য এটা খাওয়া দরকার যদিও, কিন্তু আমাদের শরীরে কোনো শাক হজমকারি এনজাইম নেই। দ্যাটস দ্য ট্রুথ। আর অন্যদিকে আমিষ, মানে মাংস হজমের কত রকম এনজাইম আছে জানিস? পেপসিন, ট্রিপসিন, কাইমোট্রিপসিন…বাকিগুলোর নাম মনে পড়ছে না। এগুলো কেন আছে? মাংস হজমের জন্য। যাতে আমরা অন্য প্রাণী ধরে খাই সেজন্য। সো, আসলে ভেজিটারিয়ানরা যেমন দাবি করে, তাদের ডায়েটই সেরা, এটাই প্রাকৃতিক নিয়ম, সেই ধারণা ভুল। আরে, তাদের পেটের ভেতরের এনজাইমই তাদের কথাকে সাপোর্ট করে না। ঠিক কিনা?” বলে ঘাড় ঘুরিযে লাল চোখে তাকালো ওর অন্যপাশের টুলে বসা রিফাতের দিকে। ভাবখানা এমন, রিফাতই যেন কোনো ভেজিটারিয়ান।
বেচারা রিফাত ভুঁড়ি ঝুলিয়ে আরামে মদ খাচ্ছিলো, শিপলুর এমন আকস্মিক আক্রমণে হকচকিয়ে গেল। আমার দিকে চাইলো করুণ দৃষ্টিতে। আমি শ্রাগ করে চোখ সরিয়ে নিয়ে মার্টিনির গ্লাসে চুমুক দিলাম।
শিপলু বিয়ারের বোতল হাতে নেয়ায় আমার চেয়ে বেশি অবাক অবশ্য কেউ হয়নি। এসেছিলাম রিফাতদের বারে। নতুন খুলেছে রিফাতের বাপ। সপ্তাহের মাঝখানে সাধারণত এভাবে ড্রিঙ্ক করি না আমি, কিন্তু রিফাতের ইনভাইটেশন ফেলতে পারলাম না। বাসা থেকে বেরোবার জন্য রেডি হচ্ছিলাম, শিপলু এসে হাজির। অবাক হইনি অবশ্য। সেইদিনের পর নিয়মিতই হুটহাট আমার বাসায় আসছে শিপলু, নানান বিষয় নিয়ে গল্প ফাঁদছে, তারপর কথা ঘুরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে রাশেদের দিকে। রাশেদ নাকি আমার ওপর হিট নেবার জন্য ফুললি রেডি। এ নিয়ে আগে কোনো কনফিউশন থেকে থাকলেও এখন নাকি ও পুরোপুরি শিওর। সুযোগ পেলেই নাকি আমার ওপর অ্যাটাক করবে রাশেদ। ওকে বকবক করতে দিয়েছি আমি, বাধা দেইনি। সন্দেহ নেই অযথা চিন্তা করছে শিপলু। রাশেদ একটা পাকা বানচোদ বটে, কিন্তু সে হুট করে একদম জানে মেরে ফেলার জন্য আমার ওপর অ্যাটাক করবে, তা-ও আবার আইরিনের মত একটা মাগির সম্মান রক্ষার্থে, সেটা আমার বিশ্বাস হয়নি। আর তাছাড়া ব্যাপারটা আমার জন্য একটু বিব্রতকরও বটে। কেউ কখনো এভাবে কেয়ার নেয়নি আমার। বাবাও অনেকটা উদাসিন ছিলেন আমাকে নিয়ে। শিপলু ছেলেটা আসলেই মাত্র এই দেড় দুই বছরে আমার সবচেয়ে ক্লোজ ফ্রেন্ড হয়ে গেছে আমার অজান্তেই।
তো শিপলুকেও নিতে হলো রিফাতদের নতুন বার চেখে দেখতে। আমি বেশি গিলবো না ঠিক করেছিলাম, কাজেই দুয়েকটা মার্টিনির পাত্র নিয়ে চুকচুক করছিলাম আর রিফাতের বকবকানি শুনছিলাম, কেমন হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম করে বারটা সাজিয়েছে সে, কিভাবে হ্যান্ড-পিক করেছে ওয়াইনের প্রত্যেকটা ব্র্যান্ড, কিভাবে ইনটেরিয়র ডিজাইন করেছে সেরা ডিজাইনার দিয়ে, তা নিয়ে। আমি টাম্বলারে পিচ্চি চুমুক দিতে দিতে মনে মনে বলছিলাম, ভাই রিফাত, তুমি যদি বোতলগুলো নিজেই খেয়ে ফেলার লোভটা সামলাতে পারো তাহলেই দোকান চলবে, নয়তো তোমার সাধের বারের দামি উড প্যানেলিং বেচেও লোকসান আটকাতে পারবে না।
আমাকে অবাক করে দিয়ে কাউন্টারে আমার পাশে একটা টুলে বসে আমারই মত করে এক হাতের কনুইয়ে কাউন্টারে হেলান দিয়ে বসে তুড়ি দিয়ে একজন বারটেন্ডারকে ডেকে একটা বিয়ারের অর্ডার দিলো শিপলু। দারুণ অবাক হয়েছিলাম এখন শিপলুর কানের পোকা নড়ানো বকবকানি শুনে বুঝতে পারছি ওকে গিলতে দেয়াটা ভুলই হয়েছে।
“আর, যেটা বলছিলাম, মদ।” বক বক করেই চলেছে শিপলু। এটাও মানুষের আদি খাদ্য। মানুষ নানান মিষ্টি ফলমূল খেতো আদ্যিকাল থেকেই। সবসময় কি সেগুলো টাটকা পাওয়া যেতো? না, যেতো না। অনেক সময় গাছতলায় পচা ফল পড়ে থাকতো। শর্করা পচে কি হয়? অ্যালকোহল। মানুষের সেই থেকে অ্যালকোহল খাওয়া শুরু। মানুষ যখন থেকে ধান, গম বা বার্লির মত শষ্য জ্বাল দিয়ে খাওয়া শুরু করলো, তখন দেখলো সেগুলোকে জ্বাল দিয়ে পানিসহ দুয়েক রাত রেখে দিলে….”
শিপলুর বাক্যবাণ থেকে বাঁচতেই টুলের ওপর ঘুরে বসলাম আমি, বারটার ইতিউতি চোখ বোলাচ্ছি। বেশ বানিয়েছে বটে রিফাত, একেবারে পশ্চিমা কোনো পানশালার মতই। বাপের হোটেল-ব্যবসায়ি ব্রেন পেয়েছে বোধহয় ব্যাটা। বেশ সাজিয়েছে। বেশ বড় রুমটার এদিক-সেদিক ছড়ানো অনেকগুলো টেবিল। মৃদু নীলাভ লাইটিংয়ের কারণে রুমের আনাচে কানাচে ছোপ ছোপ অন্ধকার আর আলো আঁধারের খেলা। হালকা মিউজিকের শব্দ ভেসে আসছে লুকোনো স্পিকার থেকে। লোকজন চুপচাপ ড্রিঙ্ক করছে, ড্রেসকোড মেইনটেইন করতে হয়েছে সবাইকে, উচ্চবিত্ত ছাড়া কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেনা বাইরের দশাসই গার্ড, গ্লাসের টুংটাং আর রুমের এদিক ওদিক থেকে মাঝে মাঝে হাসির শব্দ পাচ্ছি….
মার্টিনির গ্লাসটা অন্যমনস্কভাবে ঠোঁটের কাছে আবার তুলতে গিয়েই থমকে গেলাম আমি। হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে আমার কান, নিশ্বাস পড়ছে জোরে জোরে, শরীরের সব কটা পেশি টান টান, প্রতিটা স্নায়ু সজাগ। বুকের মাঝে বাড়ি মারছে হৃৎপিন্ডটা। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সাবধান করে দিচ্ছে আমাকে, বলছে, কোনোখানে কিছু একটা গড়বড় হয়েছে, সাবধান হও।
গোটা রুমটার এদিকওদিক চোখ বোলাতে লাগলাম আমি। সবকিছু স্বাভাবিক ঠেকছে। কিন্তু আমি জানি কিছু একটা অস্বাভাবিক। আমি জানি এখনই কিছু একটা ঘটবে। বাবা বলতো, অলওয়েজ ফলো ইয়োর গাট ইন্সটিংকটস।
গোটা রুমের এদিকওদিক চোখ চলছে আমার। মার্টিনির গ্লাসটা রয়ে গেছে ঠোটের কাছেই। এক কান দিয়ে শুনছি, শিপলু বকে চলেছে, “তুই কি জানিস, হাম্বুরাবি আইনের একটা ধারা অনুসারে, বিয়ারে পানি মেশানোর শাস্তি মৃত্যুদন্ড?”
সবাই ড্রিংক করছে, কথা বলছে, হাসছে। কেউ তাকাচ্ছে না আমার দিকে। সবকিছু স্বাভাবিক। রিফাত টুলে বসে ঢুলছে। শিপলু ওর বিয়ারের বোতলের ভেতরে উঁকি দিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। বারটেন্ডারের মাথার ওপরের আলোটা পড়ে চমকাচ্ছে শিপলুর চশমার কাঁচ।
আমার হার্টবিট কমে আসছে। ফলস অ্যালার্ম। আমার গাট ইন্সটিংকট এবারে কাজে দেয়নি মনে হচ্ছে। আসলে শিপলুর ছোঁয়াচে সাবধানতা রোগ আমাকেও ধরেছে। আর কিছু না।
আর এটা ভাবতে না ভাবতেই আমার পাশে ট্রে নিয়ে যেতে থাকা এক ওয়েটার আমার পাশের লোকটার পায়ে বেধে হুমড়ি খেয়ে আমার গায়ের ওপর পড়ে তিন- চারটা গেলাসের মদে আমাকে একদম ভিজিয়ে দিল।
ওয়েটার মেঝেতে পড়ে থেকে বোকার মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি ভাবছি আমার ইন্সটিংকট তাহলে একেবারে ভুল ছিল না, পকেট থেকে রুমালটা বের করছি. আর এদিকে শিপলু খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠলো, “হাম্বুরাবি আইনে মাটিতে ফেলে বিয়ার নষ্ট করার শাস্তি না জানি কি!”
ওয়েটারকে কড়া করে একটা ধমক দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে এগোলাম আমি জানি দোষটা ওয়েটারের নয়, এত লোকজনের মাঝে কারো পায়ে বেধে পড়ে যাওয়াটা ঠেকানো কঠিন, তবুও ইচ্ছে করছিলো থাপড়িয়ে কান লাল করে দেই ব্যাটার। আমার দামি স্যুটটা কেবল আজই প্রথম পরলাম, আর তাতেই এই কান্ড। এখন নেও ঠেলা। শালাকে কয়েকটা লাথি মারতে পারলে গায়ের রাগটা যেতো। কিন্তু হাজার হলেও রিফাতের কর্মচারি। ওর সামনে ওরই কর্মচারিকে মারাটা রিফাতের স্ট্যাটাসকে ক্ষুন্ন করবে। রাগটা গিলে ফেলতে হয়েছে তাই।
ভেজা রুমালটা দিয়ে ঘাড় ঘষতে ঘষতে ওয়াশরুমের দিকে এগোচ্ছি আমি, এমন সময় মেল ডিভিশন থেকে বেরোতে দেখলাম বোমা মজিদকে। স্রেফ স্বাভাবিকভাবে হেটে বেরিয়ে চলে গেল একদিকে। আমাকে দেখতে পেয়েছে, এমন ভাব করলো না।
কুচকুচে কালো, তেল চকচকে চেহারা বোমা মজিদের। মাথার ছোট করে ছাঁটা চুল আর মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ির দৈর্ঘ্য সমান। লাল চোখে খুনির দৃষ্টি। চেহারার এই হালের জন্যই বোধহয় গায়ের ধূসর স্যুটটা একদম বেমানান লাগছে ব্যাটাকে।
আমি থেমে পড়েছি আমার জায়গাতেই। হার্টবিট বেড়ে গেছে আবার। বোমা মজিদ এখানে? কি করছে সে? আমি যেদিন এখানে এলাম, সেদিনই তাকে এইখানে হাজির হতে হবে কেন? রিফাতই বা তাকে এখানে ঢুকতে দিয়েছে কেন? অবশ্য রিফাত তো আর আমার আর রাশেদের মাঝে চলতে থাকা টানাপোড়েনের ব্যাপারটা জানে না। ওরই বা দোষ কি।
তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে গিয়ে মাথায় আর ঘাড়ে পানির ঝাপটা দিয়ে নিলাম আমি। পেপার টাওয়েলে হাত মুছতে মুছতে বিশাল আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের ওপর চোখ পড়লো আমার। ব্যাকব্রাশ করা কুচকুচে কালো চুল, সযত্নে ছাঁটা গোঁফের দুটো কোণা নেমে এসেছে নিচের দিকে, উদ্বেগ মাখা চোখের কোলে হালকা কালির ছাপ। কপালের ওপরের দিকে, হেয়ার লাইনের কাছে একটা ক্রসের মতো কালো দাগ। আমার বিখ্যাত ‘স্কার জন্ম থেকেই আছে। জন্মদাগ। কুঁচকে আছে ভুরু জোড়া। আমি কি ভয় পেয়েছি? জোর করে নিজেকে বলতে পারি, না। কিন্তু শিপলুর কথাই ঠিক-রাশেদ আর তার সাগরেদরা সবাই খুনে উন্মাদ, তাদের থেকে দূরে থাকাই মঙ্গল। অযথা একগুঁয়েমি করার মানে হয় না। আর আজ এইখানে বোমা মজিদের উপস্থিতি কাকতালিয়ের চাইতেও বেশি কিছু।
জোর পায়ে ফিরে এলাম কাউন্টারের কাছে। শিপলু আরেক বোতল বিয়ার নিয়ে বসেছে। সামাদ একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিন পড়ার চেষ্টা করছে অল্প আলোর মাঝে রিফাত একটা ওয়েটারের কানে কানে কি যেন বলছে। ওকে জড়াতে চাই না এসবের মাঝে, তাই চোখের ইশারায় শিপলুকে একপাশে ডেকে নিলাম। না চাইতে হাজির হয়ে গেল সামাদও।
“কি ব্যাপার?” ঠোটে সিগারেট ঝুলিয়ে বললো শিপলু। ওর দাঁড়ানোর ভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে সাড়ে তিন পার্সেন্ট অ্যালকোহলের কেরামতি।
“বোমা মজিদ। এখানে।” সংক্ষেপে বললাম আমি।
সাথে সাথে শখের নেশা ছুটে গেল শিপলুর। “এখানে?” আমার কথার প্রতিধ্বনি করলো ও। “কোথায়? আমাদের আশপাশে আছে এখন?”
মাথা না নাড়িয়ে কেবল চোখ ঘুরিয়ে যতদূর সম্ভব আমাদের আশপাশটা জরিপ করে নিলাম আমি। “এখন তো দেখছি না। একটু আগেই ছিল।’
কাঁধ ঝুলিয়ে দিল শিপলু। মুখের শক্ত ভাবটাও কেটে গেল ওর। “ঠিক দেখেছিস তো, এমনও হতে পারে…”
“ক্লিয়ার অ্যাজ ডেলাইট, শিপলু! আমি ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছিলাম, সেখান থেকে বের হতে দেখলাম ওকে।” চাপা গলায় গর্জে উঠলাম আমি।
সামাদ দুই পকেটে দুটো হাত গুঁজে বলে উঠলো, “এখানে থাকাটা আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না। জামশেদ ভাই, চলেন বাসায় যাই। অনেক হয়েছে। চলেন।”
আমিও মনে মনে এটাই ভাবছিলাম। বোমা মজিদ নিশ্চই একা আসেনি। ওর চামচারা ছড়িয়ে আছে ওদিক ওদিক। চোখ রাখছে আমার ওপর। এখানে সবার সামনে হয়তো আমার ওপরে কোনো অ্যাটেম্পট নেবার চেষ্টা করবে না ওরা, কিন্তু এখানে আর স্বস্তিতে থাকা সম্ভব নয় আমার জন্য। গোটা পরিবেশটা বিষিয়ে গেছে।
“চল,” চাপা গলায় বললাম আমি, এগোলাম রিফাতের দিকে। ওকে কিছু একটা ছুতো দেখিয়ে বিদায় নিতে সময় লাগলো না।
টেবিলগুলোর মাঝ দিয়ে রাস্তা করে নিয়ে এগোলাম আমি, আমার পেছনে পেছনে শিপলু আর সামাদ। কোনোদিকে তাকাচ্ছি না। বাইরে চলে এলাম, পার্কিংলটে রাখা আমার গাড়িটার কাছে। সামাদের হাতে গাড়ির চাবি, ও পেছনের দরজাটা খুলে দিলো আমার জন্য। রাত হয়ে যাবে বলে ড্রাইভারকে সাথে নেইনি আজকে, সামাদই ড্রাইভ করছে। গাড়ির পেছনের সিটে বসে হাতঘড়িতে চোখ বুলিয়ে নিলাম আমি। প্রায় একটা বাজে।
চট করে ড্রাইভিং সিটে চলে গেল সামাদ, তার পাশের সিটে শিপলু। সিটে বসেই সবার আগে গ্লোভ কম্পার্টমেন্টটা খুলে সেটার ভেতরে হাত গলিয়ে দিলো শিপলু। ওখানেই আমার লাইসেন্স করা রিভলভারটা রাখা।
ঘুরে রিভলভারটা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো সে। “জাস্ট ইন কেস,” বিড়বিড় করে বললো ও।
ইঞ্জিন স্টার্ট দিলো সামাদ। আর তখনই দ্বিতীয় আরেকটা গাড়ির ইঞ্জিন স্টার্ট নেবার শব্দ পেলাম আমি। ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি, আমাদের থেকে খানিক দূরে পার্ক করা খয়েরি একটা মিতসুবিসির হেডলাইটদুটো জ্বলে উঠেছে। এইমাত্র বন্ধ হয়ে গেল ওটার প্যাসেঞ্জার ডোর। গাড়ির ভেতরে অন্তত জনা চারেকের কালো কালো মাথা দেখা যাচ্ছে।
লক্ষণ ভালো ঠেকছে না।
শিপলু আর সামাদেরও কোনোকিছু চোখ এড়ায়নি। পার্কিংলটের সোডিয়াম ল্যাম্পের আলোয় হতবুদ্ধি দেখাচ্ছে শিপলুর মুখটা। চশমার কাঁচে হলুদের ঝলকানি। “সামাদ, ড্রাইভ,” মাথা ঝাঁকিয়ে ঘোর কাটিয়ে বললো ও।
সামাদ ছেলেটার মুখ কম চললেও হাত ভালোই চলে। স্টিয়ারিং হুইলের ওপর ওর কেরামতিতে আরো অনেকগুলো গাড়ির মধ্য থেকে আমাদের গাড়িটাকে ঠিকই ড্রাইভওয়েতে বের করে আনলো ও মুহূর্তের মাঝে। রিয়ার ভিউ মিররে দেখি, মিতসুবিসিটাও নড়াচড়া শুরু করে দিয়েছে।
রাস্তায় উঠে এলো আমাদের গাড়ি। “আজকে আমার বাড়ি থেকে বেরোনোই উচিত হয়নি,” বিড়বিড় করলাম আমি।
আরো কয়েকটা ‘উচিত হয়নি’ মাথায় এলো আমার। শিপলুর কথা হেসে উড়িয়ে দেয়া উচিত হয়নি। ওর সাবধানবাণীকে পাগলামি ভেবে নাকচ করে দেয়া উচিত হয়নি। ওর সাথে নতুন কেসের ইনভেস্টিগেশনে যাওয়ার প্রস্তাবে সেকেন্ড থট না দিয়ে এক কথায় বাতিল করে দেয়াও উচিত হয়নি। ওর সাথে এই মুহূর্তে দূরের কোনো জেলায় থাকলে সত্যিই একশো একটা ঝামেলা এড়ানো যেত।
রাস্তা ফাঁকা। অন্য কোনো সময় হলে ক্যাসেট প্লেয়ারে ম্যাডোনা বা জ্যাকসনের গান ছেড়ে দিয়ে সিটে মাথা হেলান দিয়ে চোখ বুজে বাসায় ফেরার অপেক্ষা করতাম। কিন্তু আজ সে উপায় নেই। খোলা রাস্তায় পড়েই এক্সেলেরেটর দাবিয়ে ধরলো সামাদ, শিপলু আর আমি রিয়ার ভিউ মিররে চোখ রেখেছি অন্য গাড়িটার গতিবিধি বোঝার জন্য।
ঝাড়া মিনিট দুয়েক পেছনে কিছুই দেখলাম না। রাতের এই সময়ে রাস্তায় গাড়ি নেই বললেই চলে। পেছনে যে গাড়িগুলো দেখলাম সেগুলোর একটাও সেই খয়েরি মিতসুবিসি না। আমি কেবল শিপলুকে বলতে যাবো যে ব্যাটারা বোধহয় আদৌ বোমা মজিদের দল নয়, গোটা ব্যাপারটাই কাকতালিয়, এমন সময় হুট করে রিয়ার ভিউ মিররে আবির্ভাব খয়েরি মিতসুবিসির। গতি বাড়ছে ওটার। কাছিয়ে আসছে।
সামাদও দেখতে পেয়েছে নিশ্চয়ই, গতি আরো বাড়িয়ে দিলো ও। ঢোক গিললাম আমি, রিভলবারের হাতলে চেপে বসলো হাতটা। রাতের ফাঁকা মেইন রোডে স্রেফ গতি বাড়িয়ে পার পাওয়া যাবে না, ওদের গাড়িটার ইঞ্জিনও বেশ পাওয়ারফুল মনে হচ্ছে।
সেই পাওয়ারফুলটা যে কত পাওয়ারফুল, টের পেয়ে গেলাম আধা মাইলের মধ্যে। দুই গাড়ির মাঝে দূরত্ব বাড়ার তো কোনো নামগন্ধই নেই, বরং কমছে। এভাবে চলবে না। শিপলু কয়েকবার পেছনে দেখার পর সামাদকে বলে বসলো, “মেইন রোডে টিকতে পারবো না, ধরে ফেলবে। কোনো চিকন রাস্তা বা গলি-টলি দিয়ে ঢুকিয়ে দাও।”
সামাদকে কেবল বিড়বিড়িয়ে বলতে শুনলাম, “আপনারা দু-জন সিটবেল্ট বেঁধে নিন।”
ধন্যি বটে সামাদের ড্রাইভিং! আরো খানিকদূর একইরকম স্পিডে যাবার পরে হঠাৎ গতি কমিয়ে দিল ও, তারপর বামে আচানক একটা টার্ন নিয়ে ঢুকে পড়লো একটা গলিতে।
অন্ধকার এবড়োথেবড়ো রাস্তা, দু’পাশে ঘিঞ্জি বাড়িঘর। হেডলাইটের আলোতেও আঁধার দূর হতে চাইছে না। রাস্তার খানাখন্দে পড়ে লাফাতে লাফাতে ছুটছে আমাদের গাড়ি। একটা ময়লা-উপচে-পড়া ডাস্টবিনের পাশে শুয়ে থাকা একটা কুকুর আর এক ভিখিরি অবাক চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকাতে না তাকাতেই ওদেরকে বুলেটের বেগে পাশ কাটিয়ে গেলাম আমরা।
পেছনের গাড়িটা এখনো আছে কিনা দেখার জন্য ঘাড় ঘোরাতে যাবো, এমন সময় আরেকটা শার্প টার্ন নিয়ে আরেকটা পাতি-গলিতে ঢুকে পড়লো আমাদের গাড়ি। খানিক বাদে আরেকটা টার্ন। আরেক গলিতে আমাদের গাড়ি। ভাগ্যিস কোনো জনপ্রাণী নেই কোনোটাতে, নইলে এতক্ষণে কতজন যে মরতো গাড়িচাপা পড়ে।
ঢাকা শহরেই থেকেছি আজীবন। ঢাকার রাস্তাঘাট সম্বন্ধেও ভালো ধারণা আমার আছে বলে মনে করেছিলাম, কিন্তু এখন আমরা কোথায় আছি, কোন পাড়ায়, কোন রাস্তায়-কিছুই বুঝতে পারছি না। কারো মুখে কথা নেই। বাঁকের পর বাঁক নিচ্ছে সামাদ, শিপলু আরেকটা সিগারেট ধরিয়েছে, আমি প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছি আমার থার্টি এইট রিভলভারটা নিয়ে-এই রাত একটায় গোটা ব্যাপারটা কেমন সুররিয়েলিস্টিক ঠেকতে থাকে আমার কাছে।
আরেকটা বাঁক ঘুরলো শিপলু। গলিটার শেষ মাথায় হলদেটে আলোর বন্যা দেখা যাচ্ছে, সোডিয়াম ল্যাম্পের আলো। নিশ্চয়ই ওটা কোনো মেইন রোড। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম আমি। মেইন রোডে পড়ার পরে গাড়ি টান দিয়ে বাসায় চলে যেতে সময় লাগবে না। মিতসুবিসিটাকে পেছনে ফেলতে পেরেছি সন্দেহ নেই। সামনের রোডে পড়ার পরে কেউ আমাদেরকে আর আটকাতে পারবে না।
সামাদকে কেবল বলতে যাচ্ছিলাম সার্জনের হাত দিয়ে এত ভালো গাড়িও চালনো যায় সেটা আমি জানতাম না, এমন সময় গলির শেষ মাথায় হলদে আলোর সামনে একটা কালো ছায়া পড়তে দেখলাম। একটা গাড়ি এসে থেমেছে ওখানে, আমাদের রাস্তা আটকানোর জন্য।
ব্রেক কষলো সামাদ। রাস্তার সাথে টায়ারের ঘষা খাওয়ার ক্রিহঁহঁহঁচ শব্দটা কান থেকে মিলিয়ে যাবার আগেই পেছনে আরেকটা গাড়ির শব্দ শুনলাম আমি। ঘাড় না ঘুরিয়েই আমি বলতে পারি গাড়িটা দেখতে কেমন। খয়েরি মিতসুবিসি।
আটকে ফেলা হয়েছে আমাদেরকে। ফাঁদে পড়েছি আমরা।
টায়ারের আর্তনাদের শব্দ শুনে বুঝলাম, আমাদের পেছনে থেমেছে মিতসুবিসিটাও। তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের থেকে গজ বিশেক পেছনে ওটা। থামতে না থামতেই ওটার দরজা খুলে গেছে, চার প্যাসেঞ্জারই একসাথে নামছে গাড়ি থেকে।
আর ভাবার কোনো সময় নেই। গাড়িতে বসে থাকলে কোনো লাভ নেই। পিস্তল আমার হাতেই, গোল্ড মেডেল জেতা শুটার আমিই, যা করার আমাকেই করতে হবে। শিপলু আর সামাদকে “গাড়িতেই থাক,” বলে গাড়ির দরজা খুলে বেরোতে যাবো, এমন সময় গাড়ির পেছনের কাঁচটা গুঁড়োগুঁড়ো করে দিল একটা বুলেট। তারপরই গাড়ির বডিতে বাউন্স করে ছিটকে যেতে শুনলাম আরো দুটোকে। শস্তা চাইনিজ পিস্তলের গুলি।
আমার শরীরটা অর্ধেক বেরিয়ে এসেছে ততক্ষণে গাড়ির দরজা দিয়ে। গাড়ির ভেতরে ফেরত যাবার কোনো চেষ্টা করলাম না আমি, বরং সামনে ঝুঁকিয়ে দিলাম নিেেজকে, মাটির দিকে। আমার দু-হাতের তালু আর কপাল একসাথে মাটিতে লাগার সাথে সাথে পা দুটো শূন্যে তুলে নিলাম আমি, সম্পূর্ণ করলাম ডিগবাজিটা। দরকার ছিলো এটা, কারণ এক সেকেন্ড আগে আমি যেখানে ছিলাম সেখানকার বাতাস এই মাত্র বৃথাই ফুঁড়ে বেরিয়ে গেল দুটো বুলেট।
একটা ডাস্টবিনের আড়ালে আমাকে নিয়ে এসেছে ডিগবাজিটা। চমৎকার কভার। চোখের পলকে সেফটি ক্যাচটা অফ করেই পিস্তল ধরা হাতটা বাইরে বের করে ফায়ার করলাম আমি। দেখার দরকার পড়লো না, গগনবিদারি একটা আর্তনাদই জানিয়ে দিলো যে আমার গুলিটা মিস করেনি।
ওই পক্ষের গোলাগুলি থেমে গেছে। হতভম্ব হয়ে পড়েছে ওরা কয়েক মুহূর্তের জন্য। এই সুযোগটা ছাড়লাম না আমি, লাফিয়ে বেরিয়ে এলাম ডাস্টবিনের আড়াল থেকে। পেছনের গাড়িটা থেকে চারজনই বেরিয়ে এসেছিল আমাদের ওপর ওপেন ফায়ার করবে বলে, আর সেটা করতে গিয়ে নিজেদের কভার হারিয়েছে পুরোপুরি। একজন মাটিতে, আমার গুলি খেয়ে কোঁকাচ্ছে। আবছা আলোয় বোমা মজিদের শেপটা চিনতে ভুল হলো না আমার। রিভলভারটা তুলে ফায়ার করলাম আমি। কিন্তু তার আগেই সরে গেছে বোমা মজিদ, ওর পেছনের জন এমনভাবে ছিটকে মাটিতে পড়লো যেন অদৃশ্যমানবের ঘুষি খেয়েছে।
আমার কানের পাশে প্রচন্ড একটা গানফায়ারের শব্দ শুনে আরেকটু হলেই হার্ট অ্যাটাক করতাম আমি। না, কই, কোনো বুলেট আমাকে ফুঁড়ে যায়নি তো! ঝট করে ঘুরে দেখি আমার পাশে চলে এসেছে শিপলু, গাড়ির খোলা দরজাটার কাভার নিয়ে গুলি করছে উল্টোদিকের গাড়িটার দিকে, গলির মাথা আটকে আছে যে গাড়িটা। ওটা থেকে বেরোতে চাওয়া একমাত্র যাত্রিকে মাটিতে উল্টে পড়তে দেখলাম।
আর এক সেকেন্ড সময় পেলেই ধীরে-সুস্থে তাক করে বোমা মজিদের খুলিটা উড়িয়ে দিতে পারতাম আমি, কিন্তু এখনো ওর পাশে রয়ে গেছে একজন, তার ফায়ারের মুখে আবার ডাস্টবিনের আড়ালে চলে আসতে বাধ্য হলাম।
বোমা মজিদ কিন্তু গুলি করার কোনো চেষ্টা করছে না আমাদেরকে, বরং নিজের গাড়ির ভেতরে শরীরটা অর্ধেক ঢুকিয়ে দিয়েছে সে। পালের গোদার এই পিছু হটার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না আমি সেই মুহূর্তে। পালানোর চেষ্টা? নাকি গাড়ির ভেতর থেকে কোনোকিছু বের করার চেষ্টা করছে সে?
পরের কথাটা মাথায় আসতেই বুঝে গেলাম ব্যাপারটা।
বোমা মজিদ তার নামের সার্থকতা প্রমাণ করতে চলেছে। এরশাদের আমলে ভার্সিটি ক্যাম্পাসে যত বোমা ফেটেছে তার সিংহভাগের সাপ্লাইদাতা ছিলো বোমা মজিদ। তার মত বোমা বানানোর হাত নাকি আর কারো নেই ঢাকা শহরে। নিজেও অসংখ্য বোমা ফাটিয়েছে ছাত্র সমাজ করার সময়।
গুলি খাওয়ার ভয় নেই হয়ে গেল আমার, এক লাফে বেরিয়ে এলাম ডাস্টবিনের আড়াল থেকে। বোমা মজিদের একমাত্র অক্ষত সঙ্গি নিজের পিস্তল রিলোডে ব্যস্ত। হাটুতে এক গুলি করে শুইয়ে দিলাম তাকে।
এখন খালি বোমা মজিদই বাকি। আবছা আলোয় শরীরের কালো অবয়বটাই কেবল দেখা যাচ্ছে তার। নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। দু-পা ফাঁক করা। দুই হাত শরীরের দু-দিকে, তাতে গোল কিছু ধরা, সে দুটোর সলতে থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে আগুনের ফুলকি। ঠিক যেন সদ্য ম্যাচের কাঠি ছোঁয়ানো পটকা।
বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো আমার কেন যেন, শিরশিরিয়ে উঠলো মেরুদন্ডটা। বোমা মজিদকে নিয়ে শোনা অনেকগুলো গল্প মনে পড়ে গেল একসাথে। কোনো অস্ত্রে নাকি তার ক্ষতি করা যায় না। যতই পেটানো হোক, কোনো ব্যথা নাকি পায় না। তার বিপক্ষ দলের এক ছেলের কাছে শুনেছিলাম, ক্যাম্পাসে শুটআউটের সময় নাকি পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে বোমা মজিদের বুকে গুলি করেছিল সে, কিছুই হয়নি। হাকিম চত্বরে বোমাবাজি করতে গিয়ে নাকি বোমা মজিদের হাতেই ফেটেছিল একটা বোমা। কিছুই হয়নি।
আমার থার্টি এইটটা সোজা বোমা মজিদের বুকের দিকে তাক করা, কিন্তু ট্রিগার টানতে পারলাম না কেন যেন, কে যেন জমিয়ে দিয়েছে আমার ট্রিগার ফিঙ্গার। স্রেফ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম, ডান-হাতটা ওপরে তুললো বোমা মজিদ, এখনি ছুঁড়ে মারবে বোমাটা।
আমার হাতের ভেতরে যেন আপনা থেকেই গর্জে উঠলো থার্টি এইটটা। বোমা মজিদের গাড়ির উইন্ডশিল্ডে গর্ত তৈরি হলো আরেকটা।
মিস করেছি আমি!
বেসবল ছোঁড়ার ভঙ্গিতে হাতটা ততক্ষণে বাড়িয়ে দিয়েছে বোমা মজিদ। আবছা আঁধারে একটা আলোর রেখা তৈরি করে ছুটে এলো সলতে জ্বালানো বোমাটা।
চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম, “জামশেদ-সাবধান!” বলে গাড়ির ভেতরে ঝাঁপ দিয়েছে শিপলু। আমিও নড়তে চাইলাম, পারলাম না। শরীরের সব মাংসপেশীর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছি যেন। চেয়ে চেয়ে দেখলাম বোমাটা উড়ে এলো, ঠং করে ঠোকর খেল আমার গাড়ির বডির সাথে, মাটিতে পড়লো তারপর। একদম আমার সামনেই। সলতে শেষ হয়ে এসেছে, ফাটবে এখনই।
সামাদের মুখে অনেকবার শুনেছি ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ রেসপন্সের কথা। সেই জিনিস অ্যাক্টিভেটেড হলো আমার মাঝে ধাঁ করে। প্রবল একটা ঝাঁকি দিয়ে সম্বিৎ ফিরলো আমার, কি করছি তা না বুঝেই ডানপায়ের একটা লাথিতে টেপ প্যাঁচানো উঁচুনিচু বলের মত বোমাটাকে রাস্তার পাশের ড্রেনটায় ফেলে দিলাম আমি, তারপর খোলা দরজাটা দিয়ে ঝাঁপ দিলাম নিজের গাড়ির ভেতরে।
আমার হাতের কনুইদুটো সিটের সাথে লাগতে না লাগতেই যেন আকাশ ভেঙে পড়লো আমাদের চারপাশে।
প্রচন্ড শব্দে ফেটেছে বোমাটা। শকওয়েভের ধাক্কায় মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে গেছে আমাদের গাড়ি, সেইসাথে আমিও। গাড়ির অবশিষ্ট গ্লাসগুলো ভেঙে টুকরোগুলো চাকভাঙা মৌমাছির মত ছোটাছুটি করছে এদিক ওদিক। কানে তালা লেগে গেছে আমার, ধোঁয়ায় চোখ জ্বলছে, ভাঙা কাঁচ লেগে কেটে গেছে হাতে-মুখে এখানে ওখানে, বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেছে সবটুকু দম-কিন্তু মরিনি। বেঁচে আছি।
বোমাটা ড্রেনে পড়াতেই রক্ষা।
কোনোমতে উঠে বসার চেষ্টা করলাম সিটের ওপরে। খচাখচ হাতে ফুটছে কাঁচের টুকরো—চটচটে একটা তরল বিছিয়ে আছে পুরো সিটের ওপরে। আমার সারা গায়েও লেপ্টে আছে সেই জিনিস। রক্ত নাকি! কিন্তু কই, আমার গায়ের কোনোখানে সেরকম মারাত্মকভাবে লেগেছে বলে তো মনে হচ্ছে না! নাকি লেগেছে, টের পাইনি?
ভাবার সময় নেই অত। বোমা মজিদের হাতে আরো একটা বোমা আছে-আমার মাথাজুড়ে কেবল এই একটাই চিন্তা। সামনের সিটের নিচে পড়ে থাকা শিপলু ভাঙা গলায় কি যেন বলে চেঁচিয়েই যাচ্ছে-আমার ঝাঁকি খাওয়া মগজ সেটার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারছে না।
থার্টি এইট পিস্তলটা এখনো হাতেই রয়ে গেছে আমার। সেটা তাক করে উঁকি দিলাম আমি গাড়ির পেছনের কাঁচবিহীন জানালা দিয়ে। বোমা মজিদ অন্য বোমাটা ছোঁড়ার জন্য তৈরি-হাতটা ওপরে তুলতে শুরু করেছে। এবারে মিস করবে বলে মনে হচ্ছে না, গাড়ি সহ উড়িয়ে দেবে আমাদের তিনজনকেই। আমাদের জীবন আর মৃত্যুর মাঝে পার্থক্য গড়ে দিতে পারে কেবল আমার গোল্ড মেডেল জেতা নিশানা।
নাক-মুখ দিয়ে বিরাট একটা নিশ্বাস নিয়ে খালি হওয়া ফুসফুসদুটো ভরিয়ে নিলাম আমি, দু-হাতে ধরলাম পিস্তলটা, স্কোপের সামনে বোমা মজিদকে পাওয়ার সাথে সাথেই টেনে দিলাম ট্রিগার।
একটা ঝাঁকি খেয়ে পেছনে উল্টে পড়লো কুখ্যাত বোমারু বোমা মজিদ। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই লাফ দিয়ে সামনে এগোলো আমাদের গাড়িটা, হুমড়ি খাইয়ে দিল আমাকে।
শিপলুর চেঁচানির মর্মার্থ বুঝলাম এতক্ষণে। চেঁচাচ্ছিল ও সামাদের উদ্দেশ্যে, “সামাদ-ড্রাইভ! ড্রাইভ! ড্রাইভ!” বলে।
গলির মুখ আটকে থাকা গাড়িটা ছিটকে একদিকে সরে গেল আমাদের গাড়ির বাম্পারের ধাক্কা খেয়ে। সামনে রাস্তা ক্লিয়ার, মেইন রোডে উঠে এসেছি আমরা। বেসামালভাবে দুলতে থাকা গাড়িটা সামলানোর জন্য স্টিয়ারিংয়ের ওপর রীতিমত চড়াও হয়ে শক্তহাতে সেটাকে ঘোরাচ্ছে সামাদ। এতক্ষণ নিজের সিটের নিচে
ঢুকে ছিলো ও, তিনজনের মাঝে সবচেয়ে ভালো শেপে আছে ও-ই। গাড়ির নাক সোজা হবার সাথে সাথেই এক্সেলেটর একেবারে মেঝের সাথে দাবিয়ে ধরেছে সামাদ।
আবার আমরা ফাঁকা রাস্তা ধরে ছুটে চলেছি তীব্ৰ গতিতে।
গাড়ির ভাঙা জানালা, এখানে ওখানে গুলির দাগ, বডির এখানে-ওখানে তুবড়ে যাওয়া আর বাম্পার ভেঙে রাস্তার সাথে ঘষা খাবার ব্যাপারটা না থাকলে বলতে পারতাম, একটু আগের ব্যাপারটা যেন ঘটেইনি।
আমি এখনো সেই চটচটে তরলে মাখামাখি। দু-পা ফাঁক করে সিটে বসে আছি আমি, হাতে এখনো ধরা আছে গুলি প্রায় ফুরোনো থার্টি এইট রিভলভারটা। সিটের ওপরও সেই চটচটে তরলের আস্তর।
গালে হাত বুলিয়ে নাকের সামনে ধরলাম আমি। উৎকট একটা গন্ধ নাকে লাগলো। না, রক্ত নয়, মগজও নয়, তরলটা আসলে ড্রেনের থকথকে ময়লা।
সামনের সিটে স্পিকটি নট হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে সামাদ, তার পাশের সিটে বসা শিপলু ইতোমধ্যে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছে। গাড়ি চলছে, আমাদের মুখে কোনো কথা নেই।
আমার মাথায় চলছে চিন্তার ঝড়। ওখানে কতজন মারা গেছে কে জানে। গোটা ব্যাপারটা সামনে বিরাট জট পাকাবে। রাশেদ কি তার অন্য কোনো চামচাকে দিয়ে আমার ওপর আবার অ্যামবুশ করবে? করতেই পারে। রাশেদ কি তার পকেটে থাকা কোনো ওসিকে বিরাট অংকের ঘুষ খাইয়ে এমনভাবে মামলা সাজাবে যে আমিই আসলে বোমা মজিদের ওপর অ্যাটাক করেছি? করতেই পারে। দূরে কোথাও চলে যেতে হবে, তারপর ব্যাপারটা ঠান্ডা হবার সময় দিতে হবে।
অনেক অনেকক্ষণ পরে মুখ খুললাম আমি। “শিপলু, তোর সেই রহস্যময় প্রাণী না কোথায় দেখা গেছে রে?”
সিগারেটে আরো দুটো টান দেবার পরে মুখ খুললো শিপলু। “রংপুরে।”
অনেক অনেকক্ষণ পরে বললাম, “শিপলু, বাঘের মুখোমুখি হবার আগে একজন গোল্ড মেডেল জেতা শুটারকে সাথে নিস।”
অধ্যায় ৬ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ৬ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
চায়ের কাপটায় সশব্দে একটা চুমুক দিলো শিপলু। নামালো না, কাপ থেকে ধোঁয়া উঠে ওর বঙ্গবন্ধু ফ্রেমের চশমার কাঁচ ঘোলা করে দিচ্ছে। কাপের কোণার ওপর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, মুচকি হাসি ব্যাটার মুখে।
“দেশের দুই প্রেসিডেন্টের জন্মস্থান,” পরম আত্মতৃপ্তির সাথে বললো শিপলু। “মহিয়সী নারী বেগম রোকেয়ার জন্মস্থান। দেশের প্রথম ছাপাখানা এসেছে এখানেই। ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা মহান নেতা নুরুলদীনের জন্মস্থান।” থামলো ও একটু। “কিন্তু এখন যে অবস্থা দেখছি! শহর তো না, শহরের ধ্বংসস্তূপ মনে হচ্ছে। উন্নয়নের হ্রস্ব উ-ও দেখছি না।” মুখের ভাব বদলে গেছে ওর।
আমি জবাব দিলাম না। এই মুহূর্তে আমরা রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের বাইরের যে ভাঙাচোরা চায়ের দোকানটায় বসে আছি, সেখানটায় বড্ড ভিড়। একপাশে টুলের ব্যবস্থা, আরেক পাশে চা-ওয়ালার কাউন্টার। চা-ওয়ালার মুখের সামনে ঝুলছে পলিথিনে বন্দি পাঁউরুটি-কেক আর পাকা সাগরকলার ছড়া। এই মুহূর্তে আমার একেবারে মুখের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশাওয়ালা গোছের এক ময়লা লুঙ্গি পরা লোক কলার দামদর করছে। চা-টা ভালো হওয়া সত্ত্বেও সেটা আরাম করে খাওয়া শিকেয় উঠেছে আমার।
হঠাৎ কাপের বাকি চা-টুকু ছুঁড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো শিপলু। “নাহ, এতো কাজ পড়ে আছে আর আমি স্টেশনে বসে চা খাচ্ছি! আক্কেল আর কবে হবে আমার?”
হনহন করে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো সে, হতভম্ব আমিও পেছন পেছন চলে এলাম। রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে বেশ খানিকটা এলাকা জুড়ে ঘিঞ্জি বাজার। রাস্তাটা পুরান ঢাকার গলির মত চিপা। রিকশা আর মানুষজনের ভিড় বাঁচিয়ে জোর কদমে কে জানে কোনখানে ছুটে চলে শিপলু, পেছন পেছন আমি। হাটতে হাটতে রাস্তার দু-পাশে নানা রকম দোকানপাট চোখে পড়ে আমার। নূরানী রেস্তোরাঁ, ঘড়ি মেরামত কেন্দ্র, মেসার্স শিকদার এন্ড সন্স, স্টেশন বাজার দোকান মালিক সমিতি, মালা বেকারি, ইস্ট বেঙ্গল লাইব্রেরি, সিঙ্গারা হাউজ, নেহাল হোটেল, লালিয়া টেইলার্স আর আরও কত শত দোকান পেরিয়ে দুদ্দাড় করে হেটে চলে শিপলু। আমি ওর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠি। বলি, “শিপলু, একটু আস্তে হাট না! এত তাড়া কিসের?”
হাঁটার গতি না কমিয়েই ঘাড় ঘোরায় সে। শেষ বিকেলের সোনালি আলো ঝলসে ওঠে ওর বঙ্গবন্ধু ফ্রেমের চশমায় লেগে। “লেট হয়ে যাচ্ছে রে। একটা কেস স্টাডি আছে। সে লোক তো আজই আসতে বলেছিল। একদম ভুলে গিয়েছিলাম, ধুত্!”
আমি প্রায় দৌড়ে চলেছি শিপলুর পেছর পেছন, আর ভাবছি, রংপুরের এত কিছু চিনলো কিভাবে? ও তো লক্ষীপুরের ছেলে। তবে ও নাকি এর আগে কয়েকবার এসেছিল রংপুর, নানান কাজে। তার মাঝেই এত কিছু চিনে ফেলেছে? এত অলিগলি?
আবার ঘাড় ঘোরায় শিপলু। “জানিস, এই শতকের শুরুতেও রংপুরে তুষারপাত হতো?”
জানা ছিলো না। ট্রিভিয়া-ম্যান শিপলুর কল্যাণে আমার জ্ঞানের ভান্ডার দিন দিন বাড়ছে।
আমি কেস স্টাডির দিকে প্রসঙ্গ ঘোরাই। “কিসের কেস রে? কোন ক্যাটাগরি?”
“গেলেই দেখতে পাবি।” নাক বরাবর হাটা থামায় না শিপলু।
বাজার ছাড়িয়ে চলে এসেছি আমরা। রাস্তার দু-পাশে একতলা-দুতলা পাকা বাড়ি। সবগুলোই পুরনো ফ্যাশনের। পাকিস্তান আমলের পরে রংপুরে আর কোনো নতুন দালানকোঠা বানানো হয়নি নাকি? দ্রুত সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, কিন্তু কোনো বাড়ির জানালাতেই আলো জ্বলতে দেখলাম না।
“কারেন্ট নেই,” বলে উঠলো শিপলু। ভয়ানক চমকে গেলাম আমি। আমার মনের কথা জানলো কি করে ও?
“মফস্বল শহরের এই এক জ্বালা,” ঠোটের এক কোণা দিয়ে সিগারেট চেপে ধরে আরেক কোণা দিয়ে বললো ও। হাটতে হাটতেই লাইটার বের করে ধরিয়ে নিলো সিগারেট। “যখন তখন কারেন্ট গন! বিশেষ করে সন্ধ্যায় কারেন্ট না থাকলে যা বিরক্ত লাগে!”
একটা তেমাথায় চলে এলাম আমরা। একটা মাজার দেখা যাচ্ছে। “ঘোড়াপীরের মাজার,” আপনমনে বললো শিপলু, যেন আমাকে না, নিজেকেই শোনাচ্ছে। “অনেকদিন আগে ইন্তেকাল করেছেন। অনেক গালগল্প শোনা যায় ওনার নামে। ঘোড়ায় চড়ে নাকি এসেছিলেন এই রংপুরে। কিন্তু কেউ জানে না উনি কোথা থেকে এসেছিলেন। খুব নাকি গরম মাজার। এইখানে এসে কোনো ভুলভ্রান্তি করলে নাকি সেই মুরিদের আর রক্ষা নেই।”
ছোট্ট পাকা মাজার। ওপরে লালশালু বিছানো। তা পাশে বসে আছে দড়ির মত শুকনো এক লোক, মাথায় পাগড়ি, লম্বা চুলদাড়ি। লোকটা একবার চোখ তুলে তাকালো আমার দিকে। শিরদাঁড়া বেয়ে একটা স্রোত নেমে গেল আমার। মানুষের চোখ যে এত শীতল হয়. জানা ছিল না।
ঘোড়াপীরের মাজারের পাশের রাস্তাটা ধরে দ্রুত এগিয়ে চললো শিপলু, আর তার পেছন পেছন আমি। আলো কমে আসছে দ্রুত, সন্ধ্যা নামছে। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে একবার ধোঁয়া ছাড়লো শিপলু। “দেরি হয়ে যাচ্ছে রে। জোরসে পা চালা!”
নির্জন রাস্তা একটাও জনমনিষ্যি নেই। খাদ্যগুদামের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলাম আমরা, তারপর একটা গলিতে ঢুকে পড়লো শিপলু, তারপর আরেকটায়, তারপর আরেকটায়। প্রতিটা কদমে যেন গতি বাড়ছে ওর, এই অ্যাথলেটিক আমিও ওর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছি। কতক্ষণ বাদে জানি না, ছোট্ট একটা পুরনো ধাঁচের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো ও। বাড়িটার সামনে ছোট্ট বারান্দা, সেখানে কম পাওয়ারের একটা বাল্ব জ্বলছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে আশেপাশে আর কোনো বাড়িঘর দেখতে পেলাম না আমি, খালি ঝোপ-ঝাড়। বাড়িটার পেছনে রীতিমত একটা জঙ্গলই আছে মনে হলো।
সিগারেটটা পায়ের তলে পিষে ফেলে বাড়িটার দিকে এগোলো শিপলু, বিড়বিড়িয়ে ‘চল’ বললো আমায়। আমি বিনা দ্বিধায় ওর পিছু নিলাম।
কলিংবেল টিপলো শিপলু। সাড়া নেই। এক মুহূর্ত থামলো ও। ঝুঁকলো দরজার দিকে, আবার চাপলো কলিংবেল।
বাড়িটার ভেতরে, যেন বহুদূরে পাখির ক্ষীণ কিচিরমিচির শুনলাম। কলিংবেলের টিউন। কিন্তু ওই পর্যন্তই, দরজা খুললো না।
একবার আমার দিক তাকালো শিপলু। নার্ভাস লাগছে ওকে। “এই ঠিকানাই তো,” বিড়বিড় করতে শুনলাম ওকে একবার করবো-কি-করবো না ভঙ্গিতে হাতটা কলিংবেল পর্যন্ত তুললো শিপলু। সুইচে ছোঁয়ালো। টিপতে যাবে, ঠিক এই সময়ে বাড়ির ভেতরে কারো পায়ের শব্দ পেলাম। পা ছেঁচড়ে হাটার শব্দ। স্যান্ডেলের ফিতা ছিঁড়ে গেলে মানুষ যেভাবে হাটে, সেভাবে। এগিয়ে আসছে শব্দটা। ক্রমশ বাড়ছে। যেন অনন্তকাল ধরে এগিয়ে আসার পরে দরজার সামনে এসে থামলো পায়ের শব্দটা। খুট করে একটা শব্দ, করে একটা শব্দ, তারপরে ক্যাঁচ। দরজা খুলে গেছে।
আমাদের সামনে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, তার চল্লিশের এদিক-ওদিক বয়স। বেঁটেখাটো। মাথার সামনের চুল পাতলা হয়ে আসছে। চোখে বাইফোকাল লেন্সের চশমা। চোখের দৃষ্টিতে মিশে আছে জিজ্ঞাসা, অসহায়ত্ব আর আতঙ্ক। আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে বোধহয় কোনো ভরসা পেলো না অসিফের কেরাণিমার্কা চেহারার লোকটা, শিপলুর মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলো।
শিপলুর মুখে ততক্ষণে বিশাল একটা হাসি চলে এসেছে। হাসিটা ধরে রেখেই বললো, “আমিই শিপলু। প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটর। আপনার সাথেই তো চিঠিতে আলাপ হয়েছিল, না? আলতাফসাহেব?”
সাথে সাথে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরলো গোবেচারা লোকটার। অস্বাভাবিক উঁচু গলায় বলে উঠলেন, “হ্যা-হ্যা-হ্যা! শিপলুসাহেব! আরে আমার কি সৌভাগ্য! আপনি সত্যি সত্যি এসে গেছেন। আরে আমার কি সৌভাগ্য!” বাড়ির ভেতরের দিকে মুখ ফেরালেন আলতাফসাহেব। “এই বিন্তির মা! বিত্তির মা! দেখি যাও কাঁয় আসছে! তুমি না কইছিলা আমার চিঠি উনি পড়িয়াও দেখবে না!” তারপর আবার আমাদের দিকে ঘুরলো লজ্জামেশানো হাসি নিয়ে। “আপনারা আসায় কী যে ভালো লাগছে আমার! বুকে নতুন বল পেলাম ভাই। এই কয়টা দিন যে কিভাবে কেটেছে, উফ! চলুন চলুন, ভেতরে চলুন, বিশ্রাম নিতে নিতে সব শুনবেন।”
একটা প্রায়ান্ধকার করিডোর পেরিয়ে ছোট্ট বসার ঘরে এসে ঢুকলাম আমরা। হলুদ একটা চল্লিশ ওয়াটের বাল্ব ঝুলছে ছাদে। বেতের সোফা আছে বসবার জন্য। টিয়া সবুজ রঙের দেয়ালে কয়েকটা নকশা করা কাপড় বাঁধিয়ে ঝোলানো। পুরো ডেকোরেশনটা বলছে আমার ডিডাকশন ঠিকই ছিলো, লোকটা অফিসের কেরাণির চাইতে বেশি কিছু না।
বসলাম আমরা। আলতাফসাহেব গদগদ স্বরে বলছেন, “আজকে কিন্তু না থেকে আপনারা যেতে পারবেন না। রাতের খাওয়া তো সারবেনই।”
“হাতে সময় থাকলে সেটা সাগ্রহেই করতাম,” ভদ্রতাসূচক একটা হাসি হেসে বললো শিপলু। “কিন্তু আমাদের হাতে সময় বড্ড কম। আপনাদের বাসা থেকে বেরিয়েই আবার চল্লিশ কিলো দূরের একটা গ্রামে যেতে হবে…তো, যত তাড়াতাড়ি কাজে লেগে পড়া যায়, আলতাফসাহেব…”
“অবশ্যই অবশ্যই,” অতিরিক্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন আলতাফসাহেব। “আপনারা বসুন, আমি ভেতরে বলে আসছি। আর আপনারা চা না খেয়ে কিন্তু যেতে পারবেন না, আমি কিছু শুনবো না…” বলতে বলতে তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরের দিকে চলে গেলেন তিনি।
সোফায় বসে পড়লাম আমরা। গোটা ব্যাপারটা একটু গোলমেলে লাগছে আমার কাছে, তাই আলতাফসাহেব আমাদের কথা শুনছেন না এটা নিশ্চিত হয়ে বললাম, “ব্যাপার কি, দোস্ত? লোকটার বাসায় অলৌকিক কোনো ব্যাপার-স্যাপার চলছে, বুঝলাম। কিন্তু সেটা তোকে দেখানোর জন্য এত ব্যস্ত কেন তিনি? তোর সাথে যে কয়বার ইনভেস্টিগেশনে বেরিয়েছি আমি, আর তোর যে কয়টা লেখা পড়েছি, তাতে পরিষ্কার বোঝা যায়, যাদের ভাগ্যে এইসব ব্যাপার ঘটে তারা ওগুলো প্রকাশ করতে চায় না। বিশেষ করে অচেনা একজনের কাছে তো না-ই।”
“তার কারণ তাকে আমি বলেছি, তার সমস্যাটা আমি সমাধান করে দিতে পারবো।” অন্যমনস্কভাবে বিড়বিড়িয়ে বললো শিপলু।
অবাক হলাম আমি। “শিপলু, কোনো সিনেমার পরিচালককে মদ খাইয়ে মাতাল বানিয়ে তার কাছ থেকে বিখ্যাত নায়িকার স্ক্যান্ডালের খবর বের করা এক ব্যাপার, আর এরকম গোবেচারা ছাপোষা একটা লোকের কাছে নিজেকে ওঝা সাজিয়ে পত্রিকার স্টোরি জোগাড় করা…”
“দোস্ত,” আমার দিকে ঘুরে বসলো শিপলু। “অকাল্ট নিয়ে আমার আগ্রহটা আর যে কোনো কিছুর চাইতে পুরনো। ক্লাশ সিক্সে থাকতে প্রথম সুপারন্যচারাল অভিজ্ঞতা হয় আমার। তারপর থেকে যেখানে যত অকাল্টের বই পেয়েছি, পাগলের মত পড়েছি। বিদেশ থেকে বই আনিয়েছি। লাইব্রেরিতে গিয়ে সারাদিন অকাল্ট নিয়ে রিসার্চ করেছি। বাদ দিইনি কিছুই। তারপর যখন একটু বড় হলাম, তখন গোটা দেশে ঘোরা শুরু করলাম অকাল্টের খোঁজে-অদ্ভুত আর অলৌকিক ঘটনার খোঁজে। প্যারনরমাল কেস স্টাডি লিখছি আর ক’দিন হলো, কিন্তু ইনভেস্টিগেশন কিন্তু আমি আট-ন’ বছর আগে থেকেই করছি। যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই নীতিতে চলেছি। কোথায় কোন গ্রামের শ্মশানে ভুত থাকে, কোথায় একটা অভিশপ্ত পোড়ো বাড়ি আছে, কোথায় একটা মেয়ের ওপর জ্বিনের আছর পড়েছে—চেক আউট করেছি সবই।”
“সবই জানি, দোস্ত। অনেকবার বলেছিস এসব আমাকে,” শান্ত গলায় বললাম আমি।
“তাহলেই বোঝ। শুনলে হাসবি, বাট আমি মনে করি অকাল্ট বিষয়ে এই দেশে আমি একজন অথরিটি। আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরের অন্ধকার জগতে যেসব জিনিস বাস করে, তাদের আচার আচরণ খুব ভালোভাবেই শেখা হয়ে গেছে আমার। ভেবে দেখ, সামাদ কিভাবে ডাক্তারি পাশ করেছে? প্রথমে রোগের ব্যাপারে বিশদ জেনেছে, তারপর না রোগের দাওয়াই শিখেছে! আমার ব্যাপারটাও ঠিক ও-রকম। আগে স্রেফ অতিপ্রাকৃত ব্যাপার-স্যপার তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। এখন সেগুলোর প্রতিকার করতে পারি আমি-আমার বিশ্বাস।” বুকে দু-হাত বেঁধে শ্রাগ করলো শিপলু।
প্যারানরমাল ব্যাপার নিয়ে আমার মনটা বরাবরই বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলায় দোলে, কাজেই কথাটা একটু ঘোরানোর জন্যই বললাম, “রংপুরে আগেও এসেছিস মনে হয়? সব চিনিস দেখি।”
“কয়েকবার এসেছি,” শিপলু বললো। “এখানে এসেছিলাম এক তান্ত্রিকের খোঁজে। জানিসই তো, যেখানে যত ওঝা, তান্ত্রিক, জ্বিন তাড়ানো হুজুরের খোঁজ পেয়েছি, সবার পিছনেই ঘুরেছি। আর শিখেছিও প্রচুর। এই রংপুরেই এক শ্মশানে এক তান্ত্রিকের সাথে যে কত রাত কাটিয়েছি! সে লোক প্রেতচর্চা করতো, আর আমি…”
দরজার পর্দাটা নড়ে উঠলো হঠাৎ। ও-দিকে তাকিয়ে দেখি দুই পর্দার মাঝখান থেকে ছোট্ট একটা সুন্দর মুখ তাকিয়ে আছে। বাচ্চা একটা মেয়ে, বয়স সাত-আটের বেশি হবে না। পিচ্চি-পাচ্চা ডিল করার অভ্যাস আমার একদম নেই, ওটা শিপলুর ডিপার্টমেন্ট। আমার চেহারা দেখে বাচ্চাটা বেশি ভরসা পায়নি স্বভাবতই, শিপলু হেসে কাছে ডাকার পরে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো। একটা ফ্রক পরনে, মাথার চুলে বেণী। চোখের নিচে কালি ওর, যেন কয়েকদিন যাবত ঘুম হচ্ছে না ঠিকমত। এগিয়ে এসে বড় মানুষের মত গম্ভিরভাবে শিপলুর উল্টোদিকের বেতের সোফাটায় বসলো।
শিপলু মেয়েটার সাথে ভাব জমানোর চেষ্টা করলেও লাভ হলো না, ও কেবল বড় বড় কালো চোখ মেলে চেয়ে থাকলো, জবাব দিলো না। কে জানে বাচ্চাটাকে সারাদিন এই ভুতুড়ে বাসার ভেতর আটকে থাকতে হয় কিনা। সেক্ষেত্রে বেচারির মানসিক বিকাশের কোনো সুযোগ নেই।
আলতাফসাহেব ঘরে ঢুকলেন আরো দুই মিনিট পরে। ঘামছেন কুলকুল করে, ঘাড়ের ওপর দিয়ে বাসার ভেতরের দিকেও তাকালেন দুই-তিনবার। অবাক হলাম আমি। আমাদের দেখে লোকটার মাঝে যে সাহস ফিরেছিলো, সেটা ইতোমধ্যেই একেবারে নেই হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। কেন? শিপলুর চেহারা দেখে বুঝলাম ও-ও খেয়াল করেছে ব্যাপারটা।
“বিন্তির সাথে কথা বলছেন? বেশ, বেশ,” একটা রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে কাঁপা গলায় বললো লোকটা। “মেয়েটার মা যে কোথায় গেল! কে জানি, পাশের বাসায় বেড়াতে-টেড়াতে গেছে বুঝি। মহিলা মানুষ, হে-হে।”
আমি আর শিপলু মুখ চাওয়া-চাউয়ি করলাম। বাসায় ঢোকার সময় লোকটা বউকে ডেকে আমাদের আসার কথা জানাচ্ছিল, তার মানে বিন্তির মা তখন বাসাতেই ছিলেন। এই মিনিট দুই-তিনের মাঝে আবার যাবেন কোথায় তিনি? বেরোতে হলে তো বসার ঘরটা পেরিয়েই বাইরে যেতে হবে। আর পাশের বাসা? এই বাসার আধ মাইলের মধ্যে কোনো বাসা আছে বলে তো দেখিনি আসার সময়।
“আচ্ছা, তাহলে কাজের কথায় আসা যাক, ভাই,” একটা বেতের সোফায় প্রায় ধসে পড়ে বসে বললেন আলতাফসাহেব। লোকটার মুখ এই মুহূর্তে কাগজের মতো সাদা। “আমার মেয়ে… বিন্তি। ওর কিছু সমস্যার কথা চিঠিতে লিখেছিলাম।”
“হ্যা,” স্বাভাবিক গলায় বললো শিপলু। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি চশমার ঝকঝকে কাঁচের আড়ালে ওর চোখদুটো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জরিপ করছে ভদ্রলোকের প্রত্যেকটা নড়াচড়া।
“বেশ কয়েকমাস যাবত ও রাতে চিৎকার করে ঘুম থেকে জেগে ওঠে,” আলতাফসাহেব বললেন।
“সেটা অস্বাভাবিক কিছু না। সব বাচ্চাই লাইফের কোনো না কোনো স্টেজে স্বপ্নের মাঝে কন্সট্যান্টলি ভয় পায়। ভয়ানক সব দুঃস্বপ্ন দেখে। বিশেষ করে মেয়ে বাচ্চারা। প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি তাদের বোঝাতে চায় যে…”
“আমি স্বপ্ন দেখি না তো।” রিনরিনে একটা কণ্ঠ বলে উঠলো।
ঝট করে সবাই তাকালাম বিন্তির দিকে। এতক্ষণ শিপলুর এত চেষ্টাতেও কোনো কথা না বলা মেয়েটা এবার নিজে কথা বলে উঠেছে।
“তো তুমি ভয় পাও কেন, মা?” আদুরে স্বরে প্রশ্ন করলো শিপলু
বড়বড় কালো চোখগুলো নামিয়ে নিলো মেয়েটা। নিজের বেণীর একটা প্রান্ত নার্ভাসভাবে নাড়াচাড়া করছে হাতে। “আমাকে ভয় দেখায়। আমাকে জাগায়ে তোলে তারপর ভয় দেখায়। আমি ভয় পাই।”
“রাতের বেলা? কে ভয় দেখায়, মা?” শিপলুর প্রশ্ন।
“ওইযে কালো লোকটা। লাল লাল চোখ। মাথায় চুল নাই। ছাদ পর্যন্ত লম্বা।” বিন্তির সরল স্বীকারোক্তি
শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল আমার। শিপলু পর্যন্ত থমকে গেছে। আলতাফসাহেব দু-হাতে রুমালটা মুখের কাছে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছেন, বারবার ফিরে তাকাচ্ছেন ঘরের দরজার দিকে। ঝোপজঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট এই বাড়িটাকে যেন হঠাৎ অন্ধকার কোনো জগৎ গ্রাস করতে শুরু করেছে।
“সেই বিচ্ছিরি লোকটা তোমাকে ভয় দেখায়?” সামলে নিয়ে প্রশ্ন করলো শিপলু।
“না।” শিপলুর দিকে চোখ তুলে তাকালো বিন্তি। “সে লোকটা ভয় দেখায় না। আমার বন্ধু হইতে চায়। আমার সাথে খেলতে চায়। কিন্তু তার চেহারা দেখে আমি ভয় পাই। আমি আম্মুকে বলি আমি তাদের সাথে শুব কিন্তু আম্মু শুইতে দেয় না। তখন লোকটা আসে। আমার রুমের কাঠের আলমারিটা থেকে বের হয়।”
আমি থ হয়ে তাকিয়ে আছি ছোট্ট মেয়েটার দিকে।
শিপলুর চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেছে। “এইটুকুন মেয়েকে আপনারা একা একটা ঘরে থাকতে দেন?”
“আ-আসলে ওটা ওর মায়ের আইডিয়া,” হড়বড়িয়ে বলে উঠলেন আলতাফসাহেব, দরদরিয়ে ঘাম নামছে তার কাগজের মত সাদা মুখটা বেয়ে। “ব- বলে, মেয়েতো অনেক বড় হয়েছে, এখন আলাদা ঘরে—”
“হ্যা, বেশ বড়ই তো হয়েছে, আট বছর বয়স, এই বয়সে আমি কলেজে যেতাম!” ব্যাঙ্গের সুরে বলে উঠলো শিপলু। “ওর মা’কেও দেখার খুব শখ হচ্ছে, কেমন মা তার মেয়েকে—”
“উনি তো আমার আসল আম্মু না,” সহজ গলায় বলে উঠলো বিন্তি। “আমার আসল আম্মু আ-কা-শে চলে গেছে। তারপর নতুন আম্মু আসছে। নতুন আম্মু একদম পচা।”
শিপলুর অনেককিছু বোঝা হয়ে গেছে, আমারও। থমথম করছে শিপলুর মুখটা, ওকে এত রাগতে দেখিনি কখনো। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো ও আলতাফসাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে তীব্রদৃষ্টিতে। “অলৌকিক না? যত্তসব! যা শুনলাম তাতেই বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা সৎ মায়ের কাছে কেমন অবহেলা আর অনাদরে আছে। আপনারও কোনো মাথাব্যথা নেই সেটা নিয়ে-নইলে মেয়েটা রাতে ভয় পাওয়া নিয়ে এরকম গল্প বানাতো না! পুলিশের গুঁতো খেলেই আবার মা-মা করে কোলে তুলে নেবেন বেচারিকে, সন্দেহ নেই! তবে তার আগে আপনার বউকে ডাকুন। মহিয়সী নারীকে দুয়েক কথা না শুনিয়ে বিদায় নিচ্ছি না আমি এ বাড়ি থেকে।”
আলতাফসাহেব হড়বড়িয়ে বলে উঠলেন, “বিশ্বাস করেন ভাই, বিশ্বাস করেন-আমি সারাদিন অফিসে থাকি. বিন্তি ওর মায়ের সাথে থাকে…আমি জানবো কি করে ওর কেয়ার ঠিকমতো হচ্ছে কিনা…সালেহা তো ওর সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করে না আমার সামনে কত আদর করে, কত কিছু…”
“ও-সবই লোক দেখানো!” অধৈর্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়লো শিপলু। “আপনার চোখে ধুলো দেবার জন্য। কিছু মনে করবেন না ভাই, আমার তো মনে হয় একটা বানর মাথায় পরচুলা পরে মানুষ সেজে এলেও সেটা ধরতে পারবেন না আপনি, বরং তাকে খাতির করে চা খেতে বসাবেন!”
দরদরিয়ে ঘামতে থাকা আলতাফসাহেব আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, শিপলু ট্রাফিক পুলিশের মতো হাত তুলে থামিয়ে দিলো তাকে। “ফ্যাচফ্যাচ করবেন না। এখান থেকে বেরিয়ে চাইল্ড নেগলিজেন্সের অভিযোগ করবো আমি পুলিশের কাছে। এখানকার সদর থানার ওসির সাথে ভালো খাতির আছে আমার, রংপুর এলেই একসাথে বসে চা-বিড়ি খাই। তারপর আবার চল্লিশ কিলো দূরের এক গ্রামে যেতে হবে। আপনার বউকে ডাকেন, যান, আমাদের সময় নাই।”
লোকটার চেহারা এতক্ষণ নিউজপ্রিন্টের মতো ছিলো, এবারে হয়ে গেল হোয়াইটপ্রিন্ট। “ওর মা, সালেহা তো, মানে, ইয়ে, মানে পাশের বাসায়…”
“মিথ্যা বলছেন। আমরা বাসায় ঢোকার সময় আপনি বিন্তির মা-বিন্তির মা বলে ডাকডাকি করছিলেন। যান, তাকে বাড়ির ভেতর থেকে ডেকে আনেন, নইলে আমিই যাচ্ছি।” ঠান্ডা গলায় বললো শিপলু। তাকিয়ে আছে আলতাফসাহেবের চোখে।
সেই দৃষ্টি দেখে হাটু কাঁপতে শুরু করলো আলতাফসাহেবের। আমি অবাক হলাম ভীষণ। লোকটা দরজা খোলার সময়ও কেমন স্বাভাবিক ছিলো, তারপর বাসার ভেতরে যাবার পর এমন কি হলো যে ভয়ে মারা যাচ্ছে সে?
বিন্তির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিলাম একবার। হতভাগিনি মেয়েটা চোখ বিস্ফোরিত করে সবকিছু দেখছে। দুনিয়ার সব সুষমা যেন ছোট্ট মুখটায়
“বিশ্বাস করুন,” ধরা গলায় বললেন আলতাফসাহেব, “আপনারা আসার আগের মুহূর্তেও বিন্তির মা’কে দেখেছি। আমরা একসাথে টিভি দেখছিলাম। দরজা খুলে দেবার পর ওকে ডাকতে গিয়ে দেখি…” কথা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে আলতাফসাহেবের, “নেই! গায়েব!”
চোখেমুখে অবিশ্বাস নিয়ে আলতাফসাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে শিপলু। তারপর একবার বিন্তির দিকে তাকালো ও। “জামশেদ! তাড়াতাড়ি আয়!” বলে ছুটলো তারপরই বাড়ির ভেতরের দিকে। আমি কোনো কথা না বলে ওর পিছু নিলাম।
প্রথম যে ঘরটায় এসে ঢুকলাম, সেটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার। শিপলু থমকে দাঁড়িয়েছে, আমি প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়লাম ওর গায়ে। সামলে ওঠার পরপরই খেয়াল করলাম ব্যাপারটা। গোটা রুমটা বরফের মত ঠান্ডা।
“টেল-টেল সাইন!” বিড়বিড়িয়ে উঠলো শিপলু। “পিচ্চিটার গল্প নেহাত গল্প নয় বোঝা যাচ্ছে!”
“লাইটের সুইচটা কোথায়?” বললাম আমি। হাঁপাচ্ছি।
“লাইট কাজ করবে না এখন।” শান্ত গলায় বললো শিপলু। “দাঁড়া!” এক সেকেন্ড পরেই শিপলুর পকেট টর্চলাইটটা জ্বলে উঠলো
পেছনে নড়াচড়া টের পেলাম। আলতাফসাহেব আর বিন্তি এসে দাঁড়িয়েছে আমাদের পেছনে।
“আলতাফসাহেব!” শিপলুও টের পেয়েছে ওদের উপস্থিতি, কিন্তু ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকালো না ও। টর্চের আলো ফেলে জরিপ করছে সবকিছু। ঘরটা বেডরুম কাম লিভিংরুম বলে মনে হলো। “আপনার ওয়াইফকে শেষ কোথায় দেখেছেন? এই রুমেই?”
“হুম।” ভয়ে প্রায় বুজে আসা গলায় জবাব দিলেন ভদ্রলোক।
যে দরজা দিয়ে এই রুমে ঢুকেছি, সেটা ছাড়াও আরো দুটো দরজা দেখতে পাচ্ছি রুমে। “এই দরজাটা কিসের?” হাতের ডানের দরজাটা দেখিয়ে বললো শিপলু।
“ডাইনিং রুম…ডাইনিং রুম!” কোনোমতে বললেন আলতাফসাহেব। ভদ্রলোককে দোষ দিয়ে লাভ নেই। পাগলা ঘোড়ার মত লাফাচ্ছে আমার নিজের হৃৎপিন্ডটাও। ঠান্ডাটা চামড়া-মাংস ভেদ করে হাঁড়ে কামড় বসাচ্ছে একেবারে।
ডাইনিং রুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেল শিপলু পায়ে পায়ে। আমি ওর ঠিক পেছনেই।
ডাইনিং রুমের দরজা দিয়ে ভেতরে আরো ফেললো শিপলু। ভেতরে যেন পরতে পরতে সাজানো ঘন অন্ধকার, টর্চের ক্ষীণ আলো সেটাকে ভেদ করতে পারছে কমই। সবকিছু দেখাচ্ছে কালো কালো ছায়ার মতো। স্নায়ু ওপর প্রচন্ড চাপ বসাচ্ছে।
ঘরের কোণে লম্বা একটা ছায়া দাঁড়িয়ে আছে। শিপলু ঝট করে আলো ফেললো ওটার ওপরে। নাহ, স্রেফ ফ্রিজ একটা। ডাইনিং টেবিলের নিচে আলো ফেললো, নেই কিছু ওখানে।
“যা ঘটার সব বিন্তির ঘরেই ঘটছে। ওখানে যাবার আগে শিওর হয়ে নিলাম,” আমাকে শোনানোর জন্য নয়, স্রেফ আপন মনেই বললো শিপলু। ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে এগোলো অন্যদিকের ঘরটায়। বিন্তির ঘর ওটা। আমাদের পেছনে বিন্তি আর ওর বাবা।
খোলা একটা ডিপ ফ্রিজের মত হু-হু করে হাড় কাঁপানো শীতল বাতাস বেরোচ্ছে বিন্তির শোবার ঘর থেকে। গায়ে কাঁটা দিলো আমার। দু-হাতে নিজেকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণতা পাবার চেষ্টা করলাম খানিকটা।
শিপলুর নাক থেকে বেরোনো নিশ্বাস ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে টর্চের আলোর সামনে। ও এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে নিকষ আঁধারে ছাওয়া রুমটার দিকে। দরজাটার মুখে দাঁড়ালো, আলো ফেললো ভেতরে।
টর্চটার আলো বেশি নয়, কিন্তু তাতেই যা দেখার দেখে নিয়েছি আমরা।
রুমটা বেশি বড় নয়, দশ ফিট বাই দশের বেশি হবে না। তারই মধ্যে চাপাচাপি করে ঢোকানো হয়েছে একটা ছোট্ট খাট, একটা পড়ার টেবিল আর একটা কাঠের আলমারি। আলমারিটার দরজা খোলা। রুমের মাঝখানে ছোট একটা ফাঁকা জায়গা।
সেখানে খড়ের পুতুলের মত জবুথুবু হয়ে পড়ে আছে শাড়ি পরা এক মহিলা। আর তার ওপর চার হাত পায়ে ভর দিয়ে ঝুঁকে আছে বিন্তির বন্ধু।
জিনিসটার বর্ণনা কিভাবে দেব জানা নেই। মানুষের মতই দেখতে, কিন্তু চামড়ার রং কালচে ধাতব নীল, মাথায় কোনো চুল নেই, লম্বা-লম্বা হাত পা পাটকাঠির মত সরু।
আমাদের সাড়া পেয়ে মুখ তুলে তাকালো জিনিসটা।
কানের কাছে একটানা সাইরেনের মত বাজছে আলতাফসাহেব আর বিস্তির আতঙ্কিত চিৎকার।
চোখদুটো একদম গোল জিনিসটার, টকটকে লাল রং সেগুলোর। নাকের জায়গায় দুটো গর্ত। মুখের ভেতরে বড়বড় দাঁত, রক্তে মাখামাখি। বিন্তির সৎ মায়ের গলা থেকে রক্ত খাচ্ছিলো ওটা
শিপলু আছে সবার সামনে, কিন্তু জিনিসটা যেন সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকেই
হাত পা ভাঁজ করলো নারকীয় জিনিসটা, যেন ঝাঁপ দেবে এখনই।
আমি নড়তে পারছি না। সোজা আমার দিকে ঝাঁপ দিলো ওটা।
আমার শুধু এটুকুই মনে আছে—গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছি আমি, শরীরের প্রত্যেকটা পেশিতে খিঁচুনী, সারা গা ঘেমে নেয়ে গেছে, গলার ভেতরটা শুকনো খটখটে। হাত নড়াতে পারছি না, বজ্রমুষ্ঠিতে সেগুলো ধরে আছে কে যেন। নিজের শরীরটা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, বুঝতে পারছি আমি, কিন্তু নিয়ন্ত্রণটা ফিরে পাবার কোনো উপায়ও দেখতে পাচ্ছি না। নিজের চেঁচানোর শব্দে কান ঝালাপালা আমার, কিন্তু সেই শব্দ ছাপিয়েও শুনতে পাচ্ছি অন্য কারো চিৎকার। কন্ঠটা কার, কি বলছে, জানি না আমি, কিন্তু আবছাভাবে টের পাচ্ছি কন্ঠটা আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিছু। কি হচ্ছে এসব? কোথায় আমি? চারপাশে এত অন্ধকার কেন? আমার চোখ কি অন্ধ হয়ে গেছে? কিভাবে? ওই জিনিসটা…ওহ, ওই কুৎসিত, ভয়ানক জিনিসটা!
তারপর হঠাৎ করেই সবকিছু স্বাভাবিক। আমার চেঁচানি থেমে গেছে, হাতে- পায়ে আর খিঁচুনি নেই। টের পাচ্ছি, আমার দুই হাতের কব্জি জোর করে ধরে আছে কেউ। ডান পাশে তাকালাম। শিপলু। শিপলু ধরে আছে আমাকে, ভয়ের ছাপ ওর চোখেমুখে, চোখ পিটপিট করে দেখছে আমাকে। আমার পাশেই বসে আছে ও। আমরা দু-জনই বসে আছি একটা ঝরঝরে গাড়ির ব্যাক সিটে।
সামনে তাকালাম। ড্রাইভারের সিটে সামাদ। রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে উদ্বিগ্ন চেহারায় তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
অন্ধকার ফুঁড়ে হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে গাড়িটা। মাঝে মাঝে দুয়েকটা গাড়ি হুশহাশ করে চলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে।
গাড়িতে কিভাবে এলাম আমি? একটু আগেই না ওই অভিশপ্ত বাড়িটায়…
“দুঃস্বপ্ন দেখছিলি তুই,” বললো শিপলু। “ঘুমের মাঝে হঠাৎ চেঁচাতে চেঁচাতে হাত-পা ছোঁড়া শুরু করলি। যাতে আঘাত না পাস সেজন্যে তোকে ধরে ছিলাম।” আমার হাতদুটো ছেড়ে দিলো ও।
আমি কোলের ওপর টেনে নিলাম হাতদুটো, জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। একটা দুঃস্বপ্ন এত ভিভিড হয়? লুসিড ড্রিমিংয়ের কেবল নামই শুনেছিলাম এতদিন, আজকে দেখলাম প্রথম। তাই বলে এত রিয়েলিস্টিক! বাসাটার ভেতরের আটপৌরে গন্ধটাও যেন এখনো আমার নাকে লেগে আছে!
“আর কতক্ষণ পরে গ্রামটায় পৌঁছাবো?” কপালের ঘাম মুছতে মুছতে মৃদু স্বরে প্রশ্ন করলাম।
“ঘন্টাখানেক।”
“নাম যেন কি গ্রামটার?”
“জগদানন্দপুর।”
“সত্যিই যাচ্ছি তাহলে? না গেলে কি চলতো না?” বিড়বিড়িয়ে বললাম আমি।
গাড়ির ভেতরের আবছা আলোতে দেখতে পাচ্ছি, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শিপলু। “কি হলো?” আপনা থেকেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো জিজ্ঞাসাটা।
“সকালে ঢাকা ছেড়ে আসার আগে একটা খবর পেয়েছিলাম। তোকে বলা হয়নি। বলা ভালো তোকে বলতে চাইনি ওই সময়ে।” প্রায় ফিসফিসিয়ে বললো শিপলু। ওর চশমার কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে ড্যাশবোর্ডের আলো।
আমি তাকিয়ে আছি। শুনছি।
“বোমা মজিদ হাসপাতালে নেবার পথে মারা গেছে।
কেস স্টাডি : ‘পাঁচ তলা
[শিপলুর সবচাইতে বিখ্যাত কেস স্টাডির মধ্যে এটা একটা। বরবরের মত মাসিক হালচালে প্রকাশিত হয়েছিল এটাও। মূল ঘটনার পরে অতিলৌকিক দৃষ্টিকোণ থেকে নানান ব্যাখ্যা দিয়েছিল শিপলু-সেসব বাদ দিয়ে বাকিটা এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো।]
হাসপাতালের কেবিন ফ্লোরে উঠে একটু খুঁজতেই ৫০৮ নম্বর কেবিনটা পেয়ে গেলাম। ওটার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই নিজে থেকে দরজা খুলে গেল ওটার। তরুণ এক ডিউটি ডাক্তার বেরিয়ে এলেন হাতের স্টেথোস্কোপটা ঘাড়ের ওপর রাখতে রাখতে। সন্ধ্যের রাউন্ড সারলেন নিশ্চয়ই। আমার দিকে একবার তাকিয়ে চলে যাচ্ছিলেন ডাক্তার, আমি থামালাম ওনাকে। “এক্সকিউজ মি!”
“বলুন।” ডাক্তার বললেন, হাবেভাবে ব্যস্ততার ছাপ।
“এই কেবিনে নোভা (ছদ্মনাম) নামের একটা মেয়ে অ্যাডমিটেড না?” জিজ্ঞেস করলাম ডাক্তারকে।
“হ্যা,” জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বললেন ডাক্তার।
“ওর অবস্থা কেমন দেখলেন?”
“মেন্টালি আনস্টেবল।” অনেক চিন্তাভাবনা করে জবাব দিলেন ডাক্তার।
“গোটা সমস্যাটাই কি মানসিক? তার সাথে শারীরিক কোনো সমস্যা যোগ হয়ে…”
“গায়ে তো হাতই দিতে দিচ্ছে না ভাই। কিভাবে বলি?” একটু হাসার চেষ্টা করলেন ডাক্তার। নিজে থেকেই বললেন, “আমরা মেন্টাল হসপিটালে রেফার করে দিচ্ছি। সিজোফ্রেনিয়া হতে পারে। হ্যালুসিনেশনের হিস্ট্রি আছে। মনোম্যানিয়ার লক্ষণ স্পষ্ট। সেদিন থেকেই খালি একটাই কথা, হালচাল পত্রিকার শিপলু ভাইকে ডেকে দেন। তার নাকি একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতা হয়েছে, সেটা শিপলুকে না বলে সে কোথাও যাবে না।”
কথাবার্তার মাঝেই কেবিনের দরজা খুলে গেল আবার। বছর পঁয়তাল্লিশের এক ভদ্রমহিলা উদ্বিগ্ন চেহারায় বেরিয়ে এসে সরাসরি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনিই কি হালচাল পত্রিকার …”
“জি, আমিই।” বিনীত ভঙ্গিতে বললাম।
“তাড়াতাড়ি ভেতরে চলুন। ডাক্তাররা ওকে অনেক আগেই মেন্টাল হসপিটালে নিতে বলেছিলেন, কিন্তু আমার মেয়ে যাবে না, আপনাকে গল্প না শুনিয়ে কোথাও যাবে না! কি যে হলো আমার মেয়েটার, সোনার টুকরো মেয়ে…” ধরা গলায় আরো অনেককিছু বলতে থাকেন ভদ্রমহিলা, আমি ধৈর্য ধরে শুনতে থাকি। তরুণ ডাক্তার অদ্ভুত চোখে আমাকে একবার জরিপ করে কেটে পড়লেন।
ভদ্রমহিলা শান্ত হয়ে আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।
বেডের ওপরে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে পনের-ষোল বছর বয়সের একটা মেয়ে। মিষ্টি চেহারা। চোখের কোলে কালি, মাথার চুল এলোমেলো। আমাকে দেখেই চোখ চকচকিয়ে উঠলো কিশোরির। “আপনিই বুঝি! ও আল্লা আপনি দেখি আমি যেমন কল্পনা করেছিলাম ঠিক সেরকমই দেখতে!”
মেয়ের মা অবাক হয়ে একবার আমার দিকে আকেবার মেয়ের দিকে তাকাচ্ছেন দেখে বুঝলাম এহেন স্বাভাবিক আচরণ গত কয়েকদিনের মাঝে ও করেনি।
চওড়া হাসি দিলাম একটা। “ভালোই হলো! প্রথম দেখাতেই যদি তোমাকে হতাশ করতাম, নোভা, তাহলে তো আমার একটা ফ্যান কমে যেত—”
“মোটেই না!” হাত নেড়ে ঝলমলিয়ে হেসে উঠলো নোভা। “আপনার সব লেখা আমি পড়েছি! আপনি যদি এত হ্যান্ডসাম না হতেন তবুও আমি-”
পরের পনের মিনিটে নোভার সাথে গল্প করলাম পুরনো ইনভেস্টিগেশনগুলো নিয়ে-কোনটা আমার নিজের ফেভারিট, কোনটা করতে গিয়ে আমি নিজেই ভয়ে শেষ হয়ে গিয়েছিলাম, এসব। আমি যখন ভাবছি ওর নিজের অভিজ্ঞতার কথা তুলবো কিভাবে, তখন হঠাৎই বলতে শুরু করলো ও।
বাইরে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে আনছে, আর আমি ব্লিচিং পাউডারের গন্ধে ভরা হাসপাতালের কেবিনে বসে শুনছি আমার জীবনে শোনা সবচে’ ভয়ংকর ঘটনার একটা।
শিপলু ভাইয়া, আমরা শহরেই থাকি। আমি (বিখ্যাত গার্লস স্কুলের নাম বললো) স্কুলে পড়ি। এবার এস.এস.সি. দেবো। আমরা থাকি (দক্ষিণ ঢাকার একটা কলোনির নাম বললো) কলোনিতে। আমার এক্সপেরিয়েন্সটা এই কলোনিকে নিয়েই।
দেখেছেন মনে হয়, কলোনির বাসাগুলো একেবারে গায়ে গায়ে ঘেঁষা নয়। একটু ডিসটেন্স থাকে। আমরা যে বিল্ডিংটায় থাকি, সেটা আবার এককাঠি বাড়া। কলোনির সবচেয়ে কোণার দিকে ওটা। আশপাশটা ঝোপঝাড়ে ভরা। জায়গাটা দিনের বেলাও একেবারে নিজ্ঝুম থাকে।
আমাদের বিল্ডিংটা পাঁচতলা। ওটার চারতলায় আমরা থাকি। পাঁচ তলায় কেউ থাকে না। কেন থাকে না, সেটা আমার কাছে রহস্য। অন্যসব বিল্ডিংয়ে যখন ঠাসাঠাসি অবস্থা, তখন এটার গোটা একটা তলা ফাঁকা কেন?
আমি সময় পেলেই ছাদে যাই। ভালো লাগে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে যখনই পাঁচ তলায় পৌঁছাই, তখন ল্যান্ডিংয়ে পেরোনোর সময় চোখে পড়ে দুইপাশে দুটো ফ্ল্যাটের কাঠের দরজা—দুটোতেই তালা মারা। তালার ওপরে ধুলো জমেছে। দেখলেই কেন যেন গা ছমছমিয়ে ওঠে।
আমি আবার ভুতের গল্পের পোকা, জানেন? বাংলায় মনে হয় এমন কোনো ভুতের গল্প লেখা হয়নি যেটা আমি পড়িনি! ভিডিওর দোকানে যত ভুতের ছবি আসে সব আমার দেখা চাই-আম্মু খুব রাগ করে যদিও। হালচাল পত্রিকায় আপনার ইনভেস্টিগেশন বেরোনো শুরু হবার পর হলো কি, আমাদের বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলা নিয়ে আগ্রহ আরো বাড়লো আমার। ঢাকা শহরে এইরকম গা ছমছমে ভুতুড়ে জায়গা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন, জানেনই তো!
আমরা নিচের তলাতেই থাকি। চার তলাতে। রাত গভির হলে নানারকম শব্দ শুনতে পাই, পাঁচ তলা থেকে আসে। মনে হয় কে যেন পা টেনে হাটছে। একদিন পরিস্কার শুনলাম একটা গোঙানির শব্দ। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পায় না এসব।
ওই দুটো ফ্ল্যাটে কেউ থাকে না কেন, খোঁজ নেবার চেষ্টা করেছি। কেউ ঠিকঠাক বলতে পারেনি। তবে কলোনির গার্ড মনসুর চাচা বলে, কয়েক বছর আগে ওইদুটো ফ্ল্যাটের একটাতে নাকি কে একজন সুইসাইড করেছিল। তারপর থেকে গোটা পাঁচ তলায় কেউ থাকে না। কেউ নাকি থাকতে পারে না। কেন থাকতে পারে না, সেটা অবশ্য মনসুর চাচা বলতে পারলো না।
কাজেই সেদিন বিকেলে ছাদে যাবার সময় যখন দেখলাম একটা ফ্ল্যাটের দরজাটা খোলা, তখন ধড়াস করে উঠলো বুকটা
বেশ অবাক হয়ে ল্যান্ডিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকলাম খানিকক্ষণ। তালাটা গায়েব। এক-দুইঞ্চি ফাঁক হয়ে আছে দরজার পাল্লাটা। যতদূর দেখা যাচ্ছে, ভেতরটা বেশ অন্ধকার।
কৌতুহলে মরে যাবার মত অবস্থা আমার তখন! পাঁচ তলায় কি আছে, সেটা দেখার শখ আমার বহুদিনের। আজকে না চাইতেই সেই শখ মিটে যাবার সুযোগ এসেছে। ভেবে দেখলাম, এই সুযোগ ছাড়া উচিত হবে না।
কিন্তু ফট করে একটা অচেনা জায়গায় তো ঢুকেও পড়া যায় না! আম্মু যদি জানতে পারে, রেগে আগুন হয়ে যাবে। তাছাড়া, তালাটা নিশ্চয়ই আপনা থেকে খোলেনি। কেউ না কেউ খুলেছে। কিন্তু কে? কলোনির কারো কাছে এটার চাবি নেই, জানি, আমি অনেক খোঁজ নিয়ে দেখেছি। নতুন কোনো ফ্যামিলি এসেছে ওঠার জন্য? উঁহু, হতেই পারে না, নতুন কেউ আসলে সেটা আগে থেকেই জানতে পারতাম।
তাহলে কে?
অল্প ফাঁক হয়ে থাকা দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। “এই যে, কেউ শুনছেন?” ফাঁকটার কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বললাম ভয়ে ভয়ে।
কোনো সাড়াশব্দ নেই।
আরো দু-বার ডাক দিলাম। বেশি জোরে ডাকার সাহস পাচ্ছি না অবশ্য আম্মু শুনে ফেলার ভয়ে। নিচের তলাতেই আমরা থাকি তো।
এবারও কেউ সাড়া দিল না।
আমার বেশ ভয়-ভয় লাগছে, কিন্তু আজকে পাঁচতলার ভেতরটা দেখার সুযোগ পেয়েছি, এই সুযোগ কি আর হাতছাড়া করা যায়! একটু এগিয়ে গিয়ে দরজাটার ওপরে হাত রাখলাম। বুক ধড়াস ধড়াস করছে। একটা ঢোক গিলে দরজাটায় ঠেলা দিলাম কাঁপা হাতে।
মরচে ধরা কব্জায় ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তুলে অনেকটা খুলে গেল দরজাটা। বহুদিনের পুরনো বাতাসে বদ্ধ জায়গার গন্ধ। ভেতরটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার।
আমি চোখ পিটপিট করে দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দেখা গেলা না কিছুই।
গল্পের বইতে কি পড়েছি, সেটা মনে পড়লো। আমি এতক্ষণ আলোতে ছিলাম, তাই অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছি না। কিছুক্ষণ যদি অন্ধকারে থাকি তাহলে আঁধারের সাথে মানিয়ে নেবে চোখ, তখন বেশ পরিষ্কার দেখতে পারবো। আর দ্বিধা থাকলো না। চট করে ঢুকে পড়লাম ভেতরে।
ভেতরটায় অন্ধকার-বেশ অন্ধকার কিন্তু তবু যেন হালকা হালকা দেখা যায়। যতদূর বুঝলাম মাঝারি সাইজের একটা ঘরের ভেতরে আছি। ঘরের ওই কোণায় লম্বাটে কি যেন একটা আছে। বিছানা সম্ভবত।
আমি আরেকটু ভালো করে দেখার জন্য আস্তে আস্তে রুমের প্রায় মাঝামাঝি হাজির হয়েছি, এমন সময় ঘটনাটা ঘটলো। পরিষ্কার টের পেলাম আমার পেছনে দরজাটা দড়াম করে লেগে গেল। নিজে থেকে।
এক মুহূর্ত বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলাম-তার পরই লাফ দিয়ে গিয়ে পড়লাম দরজাটার ওপরে। পাগলের মত হাতড়াচ্ছি কোনো হাতল বা সেই জাতীয় কিছু ধরার জন্য-কিন্তু তেমন কিছু নেই দরজাটার গায়ে।
মরিয়া হয়ে ধাক্কাতে শুরু করলাম দরজাটা, লাথি মারতে শুরু করলাম। চেঁচাচ্ছি ফুসফুস ফাটিয়ে। “কে আছেন! শুনছেন! কে আছেন! আমি এখানে! আমি এখানে! বাঁচাও! বাঁচাও!”
ঝাড়া মিনিট পাঁচেক এমনটা করার পর মাথায় ঢুকলো কেউ আমাকে আসলে শুনতে পাচ্ছে না। কেন শুনতে পাচ্ছে না জানি না, কিন্তু শুনতে পাচ্ছে না, এটা নিশ্চিত। নিচের তলাতেই আমাদের বাসা। বাসায় আম্মু আছে। যেভাবে ট্যাড়া পেটাচ্ছি, আম্মুর পরিষ্কার শুনতে পাবার কথা। কিন্তু পাচ্ছে না।
আর দরজা ধাক্কিয়েও লাভ নেই। এই দরজা ভেতরের দিকে খোলে, বাইরের দিকে না। আর বাইরের দিকে খুললেও ওটা ভাঙার মত শক্তি আমার নেই। ইতোমধ্যেই হাত-পা ব্যথা হয়ে গেছে।
জোরে একটা শ্বাস নিলাম আমি। খুব অদ্ভুত কিছু হচ্ছে এখানে। সাহস হারালে চলবে না আমার।
ঘুরে দাঁড়ালাম। চোখ এখনো মানিয়ে নেয়নি অন্ধকারের সাথে। তবে হালকা একটু আলো আসছে যেন কোথায় থেকে। ভালো করে দেখে বুঝলাম, বন্ধ একটা জানালা আছে ওদিকের দেয়ালে। পেরেক দিয়ে তক্তা মেরে দিয়ে বন্ধ করা। তবে ওটার ফাঁক ফোকর দিয়ে হালকা আলো আসছে, অন্ধকারে কোনোমতে দেখার জন্য যথেষ্ট।
ঘরের ওই দিকে একটা লম্বাটে জিনিসের কথা বলেছিলাম খানিক আগে। এখন ওটা আরো পরিষ্কার হয়েছে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, একটা খাটই বটে ওটা। আর ওটার ওপরে কিছু একটা শুয়ে আছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে আমার। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি মানুষের মত একটা আকৃতি।
রাস্তায় আসতে যেতে যেরকম নোংরা কিছু দেখলে আমরা চোখ ফেরাতে পারি না, সে-রকম অবস্থা হয়েছে আমার। চোখ ফেরাতে পারছি না লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা আকৃতিটার দিকে।
শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের কাছে হার মানলো আতঙ্ক। এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলাম কালচে আকৃতিটার দিকে। সাদাটে একটা বিছানা অস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি। তার ওপরে শুয়ে আছে কালচে অবয়বটা
এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি আমি, আর ধীরে ধীরে অবয়বটার বিকৃত রূপ আরো ভালোভাবে দেখতে পারছি। শেষে আর থাকতে না পেরে একেবারে কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম জিনিসটার। যাতে চেঁচিয়ে না উঠি, সেজন্যে একটা হাত চাপা দিয়ে রেখেছি মুখের ওপর
জিনিসটা দেখতে মানুষের মত। শুয়ে আছে লম্বা হয়ে। গর্তে বসা চোখ বন্ধ। যেন ঘুমাচ্ছে। জিনিসটা অনেক লম্বা। সাত আট ফুট হবে। গায়ের রং ছাইয়ের মতো। মাথায় কোনো চুল নেই। ভুরুও নেই। যেন ক্যান্সারের রোগি। হাত পা লিকলিকে কাঠির মতো সরু। পাঁজরের হাঁড় স্পষ্ট হয়ে ফুটে আছে। সারা গায়ে কোনো কাপড় নেই। জিনিসটার নাকের ফুটো বড় বড়। দাঁতের ওপর থেকে ঠোঁট সরে আছে। বড় বড় দাঁত দেখা যাচ্ছে।
মানুষের মত দেখতে ওই জিনিসটার দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম, বলতে পারি না। হয়তো কয়েক সেকেন্ড, হয়তো বা কয়েক ঘন্টা। শেষে একসময় ঘোর কাটলো। তীব্র আতঙ্কে মাথা গুলিয়ে আসছে।
এক পা এক পা করে পিছিয়ে এলাম জিনিসটার কাছ থেকে। ভয় হচ্ছে, এখনি জেগে উঠবে ওটা, আর ভয়ংকর কিছু করবে আমার সাথে।
মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে রেখেছি বটে আমি, কিন্তু ইচ্ছে করছে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে। তাহলে যদি আবার জিনিসটা জেগে ওঠে? কিন্তু আমি যখন একটু আগে দরজা ধাক্কাধাক্কি করলাম, তখন জিনিসটা জাগেনি কেন? ওটা কি মরে গেছে?
পিছিয়ে আসতে আসতে আমার পিঠের সাথে লাগলো কাঠের দরজাটা। যতদূর সম্ভব কম শব্দ করে ওটা খোলার চেষ্টা করলাম আবার। পারলাম না। হ্যান্ডেল ছাড়া দরজা কখনো খোলা যায়?
এই সময় চোখে পড়লো, ঘরের উল্টো দিকের দেয়ালেও একটা দরজা আছে। দরজাটা সম্ভবত পাশের ঘরে যাবার। পা টিপে টিপে ওটার দিকে এগোলাম। বিছানায় শুয়ে থাকা ওই জিনিসটার সাথে একই ঘরে আর বেশিক্ষণ থাকতে হলে পাগল হয়ে যেতাম আমি!
এই দরজাটায় হাত দিতেই খুলে গেল। আগের ঘরটার সমান আকারের
আরেকটা ঘরে হাজির হয়েছি আমি। ঘরটায় কোনো দরজা নাই। কোনো জানালা নাই। কোথাও কিছু নেই, শিপলু ভাইয়া, তবু কেমন একটা ধূসর হালকা আলো সারা ঘরে। কেবল কোণাগুলোয় অন্ধকার।
গোটা ঘরটা খালি। কেবল ছাদে একটা ফ্যান ঝুলছে। ফ্যানটার কেবল দুইটা পাখা। আরেকটা নাই। সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপারটা হচ্ছে ফ্যানটার সাথে একটা দড়ি ঝুলছে। দড়িটার শেষ মাথায় একটা ফাঁস।
যেন কেউ ফাঁসির দড়ি ঝুলিয়েছে দুই ব্লেডওয়ালা ফ্যানটা থেকে।
আর সেটার ঠিক নিচেই মেঝের ওপর একটা কাঠের চেয়ার।
গোটা ঘরটার মধ্যে এমন অশুভ, এমন নারকীয় একটা কিছু ছিল, শিপলু ভাইয়া, যে আমি পারলে তখনই দৌড়ে পালিয়ে আসতাম ওখান থেকে। কিন্তু আর যাবার জায়গা কই? এই ঘরটার পরে আর কোনো ঘর নেই। আগের ঘরটায় ফেরত যাওয়া সম্ভব না। ওই জিনিসটার সাথে এক ঘরে আবার থাকতে হলে মরে যাবো।
দেয়ালের সাথে ঘেঁষে এলাম আমি। ইচ্ছে করছে একটা কোণায় বসে পড়ে ফিটাল পজিশনে গুটিশুটি মেরে থাকতে। সেটাই করতাম, কিন্তু তখনই চোখে পড়লো ওদেরকে। ঘরটায় কোণায় কোণায় অন্ধকার বলে এতক্ষণ দেখতে পাইনি।
ওরা সংখ্যায় চারজন। মেঝেয় বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে পা গুটিয়ে হাটুর মাঝে মুখ গুটিয়ে বসে আছে। আমার সাড়া পেয়ে মুখ তুললো সবাই একসাথে। ভাইয়া, ওদের ওই চেহারা আমি জীবনে ভুলবো না। ওদের গায়ের রং মড়ার মত ফ্যাকাসে। ওদের সবার মাথা ন্যাড়া, মুখের জায়গায় গোল একটা ফুটো, চোখ নেই, চোখের জায়গায় কেবল চামড়া। ওদের সারা গায়ে কোনো কাপড় নেই।
আমি জানি না সারি বেঁধে ঘরের কোণায় বসে থাকা ওই নগ্ন জিনিসগুলো কি ছিল। আমি চেঁচানোর চেষ্টা করলাম, পারলাম না, মুখ হাঁ করেছি কিন্তু কোনো শব্দ হচ্ছে না।
জিনিসগুলো আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে আছে, কিন্তু আমি জানি ওরা আমাকে দেখতে পারছে না, কারণ ওদের চোখ নেই। কিন্তু ওদের চামড়ার চোখের দৃষ্টি আমি সহ্য করতে পারছি না। আমার মনে হচ্ছে যেন আমাকে ছুরির মত ফুঁড়ছে ওদের চোখের চাহনি।
আমি কোনো শব্দ করতে পারার আগেই ওরা সবাই এক সুরে মেয়েলী গলায় বলে উঠলো, “কে? কে? কে?”
বলতেই থাকলো। একঘেয়ে সুরে বলতেই থাকলো। বলতেই থাকলো। আমি কানের ওপর দু-হাত চেপে ধরলাম। তবু শোনা যাচ্ছে ওদের আর্তনাদ। ওদের স্বর ততক্ষণে গোঙানীতে পরিণত হয়েছে। খানিক বাদে গোঙানি থামিয়ে ওরা একসাথে বলে উঠলো, “কেন এসেছো? কেন এসেছো? কেন এসেছো?” বলতেই থাকলো। বলতেই থাকলো।
ওরা আর কিছুক্ষণ ওভাবে বলতে থাকলে আমি নিশ্চিত পাগল হয়ে যেতাম, তখনই পেছনের ঘরটা থেকে একটা জান্তব ঘড়ঘড়ানির শব্দ পেলাম।
সাথে সাথেই সুর পাল্টে গেল মেঝের কোণায় বসে থাকা জিনিসগুলোর। জড়ানো গলায় বলে উঠলো, “ওটা উঠেছে। ওটা ওটা ওটা ওটা উঠেছে। ওটা আসছে। ওটা আসছে। ওটা আঙ আঙ আঙ আঙ আঙ…”
আমি ডুকরে কেঁদে উঠলাম—টের পাচ্ছি, ভয়ের চোটে মরে যাবো যে কোনো সময়ে। এসব কি হচ্ছে? পাঁচ তলার একটা পরিত্যক্ত ফ্ল্যাটে এসব কি? ওই ঘর থেকে কি আসছে? আর এই ঘরে মেঝের কোণায় বসে থাকা এই জিনিসগুলো কি?
পেছনের ঘরটা থেকে একটা থপথপ শব্দ আসা শুরু হলো। আমি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে ঘরের অন্য কোণায় সরে গেলাম।
অন্য ঘরের থপথপ শব্দটা এগিয়ে আসছে। শিপলু ভাইয়া, তখন মেঝেতে বসে থাকা ওই জিনিসগুলো মুখ লম্বা করে এক ধরণের শব্দ করা শুরু করলো। জিনিসগুলোর চোয়াল লম্বা হয়ে বুকের সাথে লেগে গেছে, মুখের হাঁ-টা এক হাত বড় হয়ে আছে। ওই শব্দটা কি রকম ছিলো সেটা আপনি না শুনলে বুঝবেন না। যেন পৃথিবীর বাইরের অন্ধকার একটা জগৎ থেকে আসছে এটা। পৃথিবীর কোনো মানুষ এমন শব্দ কল্পনাও করতে পারে না।
হঠাৎ শব্দ করা থামিয়ে দিলো জিনিসগুলো। আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলতে থাকলো, “চেয়ারে ওঠো। চেয়ারে ওঠো। ঝুলে পড়ো। ঝুলে পড়ো। ওটার হাত থেকে বাঁচার আর কোনো উপায় নেই। ঝুলে পড়ো। ঝুলে পড়ো। ঝুলে পড়ো। ঝুলে পঙঙঙঙঙঙ….”
আবার শুরু হলো সেই গা রি রি করা শব্দ। আমি থ হয়ে বোঝার চেষ্টা করছি পুরো ব্যাপারটা, কাঁদতে কাঁদতে। ওরা আমাকে ফাঁসিতে ঝুলে পড়তে বলছে!
ঠিক এই সময়ে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো ছাদ পর্যন্ত লম্বা জিনিসটা। ঘুম ভেঙে উঠে এসেছে ওটা আমাকে ধরতে। ছাইয়ের মতো গায়ের রঙ। টকটকে লাল কামুক চোখ। নগ্ন। কাঠির মতো লিকলিকে হাত পা। পাঁজর বেরোনো শরীর। দু- পায়ের মাঝখানের জিনিসটা বিশাল।
মেঝেতে বসা জিনিসগুলো আবার ভাষা ফিরে পেলো। “ঝুলে পড়ো। ঝুলে পড়ো। নাহলে ওটা তোমার সাথে খুব খারাপ করবে। খুব খারাপ করবে। খুব খারাপ করবে। খুব খুব খঁ খ খ খ খঁ …”
আমি হঠাৎ বুঝতে পারলাম মেঝের কোণায় বসে থাকা জিনিসগুলো মিথ্যে বলছে না। ওটার হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই। ঘরটা থেকে বের হবার কোনো রাস্তা নেই। আমার হাতে কেবল একটাই উপায় আছে।
লম্বা জিনিসটা ওটার ল্যাগবেগে হাত পা নেড়ে নেড়ে এগিয়ে আসতে আসতে আমি লাফিয়ে চেয়ারটার ওপরে উঠে পড়লাম। এক মুহূর্তও দ্বিধা না করে ফাঁসটা পরে নিলাম গলায়।
মেঝের কোণার জিনিসগুলো মুখটা কুকুরের মত লম্বা করে গঁ গঁ গঁ গঁ করে চলছে।
লম্বা জিনিসটা ততক্ষণে আমার একেবারে সামনে চলে এসেছে। হাঁড়সর্বস্ব একটা বরফশীতল লম্বা হাত বাড়িয়ে দিলো ওটা, আমার একটা বুক খামচে ধরলো। ওটার নারকীয় মুখটা ঠিক আমার মুখের সামনে।
আমি মরিয়া হয়ে পায়ের নিচ থেকে ধাক্কা দিয়ে চেয়ারটা সরিয়ে দিলাম।
টের পেলাম আমার গলার ওপর ভীষণভাবে এঁটে বসছে দড়িটা।
তারপর এই হাসপাতালে জেগে উঠলাম। আমি নাকি সিঁড়ির ওপরে পড়ে ছিলাম, আম্মু খুঁজে পেয়েছিল। পাঁচ তলার ফ্ল্যাটের বাইরে।
নোভার গল্প শেষ হবার পরে বেশিক্ষণ থাকলাম না, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম একটা কিছু ছুতো দেখিয়ে। এতবড় মানসিক শক পাওয়া বাচ্চা মেয়েটাকে ছেড়ে আসতে খারাপ লাগছিলো-কিন্তু কিছু করার ছিলো না, ওই ঘরে আর থাকা সম্ভব হচ্ছিলো না আমার।
নোভা দেখতে পাচ্ছিলো না, নোভার মা-ও না-কিন্তু আমি স্পষ্ট দেখছিলাম, নোভার বিছানার নিচে অন্ধকারে বসে আছে ওর বলা সেই মেঝের কোণায় বসে থাকা কুৎসিত জিনিসগুলোর একটা, ফিসফিস করে বলছিলো, “ও আবার আসবে। জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো। জানালা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ো। জানালা দিয়ে আঙ আঙ আঙ আঙ আঙ…”
অধ্যায় ৭ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
অধ্যায় ৭ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
রাস্তাটা কাঁচা। বেশ উঁচুনিচু। খানাখন্দে পড়ে বারবার লাফিয়ে উঠছে গাড়িটা।
মেইন রোড থেকে নেমে এসে কাঁচা একটা অন্ধকার রাস্তা ধরে চলেছে ওটা। গাড়ির সামনে হেডলাইটের আলো বাদে এই দুনিয়ায় আর কোনো আলো আছে বলে মনে হচ্ছে না।
শিপলু আর সামাদের মুখে কোনো কথা নেই। শিপলু এমনকি সিগারেটও খাচ্ছে না অনেকক্ষণ যাবত। গাড়ির জানালার ওপর একটা হাত আলগোছে রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। সামাদ রোবটের মত গাড়ি চালাচ্ছে। গাড়িতে ওঠার পর থেকে আমার সাথে কোনো কথা হয়নি ওর।
নাকি হয়েছে?
গাড়িতে কখন উঠেছি, কয়টার সময়, সাথে কি কি নিয়েছি, বাসা ছেড়ে আসার সময় আক্কাস মিয়াকে কি বুঝ দিয়েছি—কিছুই মনে আসছে না।
কিচ্ছু না।
গাড়িতে ওঠার আগের আমার সর্বশেষ স্মৃতি হচ্ছে গলির ভেতর ওই শুটআউট। যাতে বোমা মজিদকে খুন করেছি আমি। ব্যাপারটা মনে হতেই পাকস্থলিটা মোচড় দিলো আমার। একটা মানুষকে মেরে ফেলেছি আমি! হ্যা, বোমা মজিদ আমাকে একেবারে তুচ্ছ এক কারণে মারতে এসেছিলো—সেটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে একেবারে মেরেই ফেলেছি ওকে! একটা মানুষ খুন কোনোমতেই ‘চাইলাম, ভুলে গেলাম টাইপের ব্যাপার নয়। গোটা ব্যাপারটা আমাকে বহুদিন তাড়িয়ে বেড়াবে। না, ভুল বললাম। বহুদিন নয়, সারা জীবন।
বিবেকের তাড়না-ফাড়না বাদ দেই…কিন্তু আইন? বোমা মজিদ যত বড় খুনিই হোক না কেন, আই অ্যাম নট দ্য জাজ, জুরি অ্যান্ড এক্সিকিউশনার। আইন নিজের হাতে তুলে নেবার কোনো অধিকার তো আমার নেই। পুলিশ ধরতে আসবে না আমাকে?
আসতে পারে। আবার না-ও আসতে পারে।
আসতে পারার পক্ষে যুক্তি কি? যুক্তি একটাই, আমি তাকে খুন করেছি। সত্যি খুন করেছি। পুলিশ ভুঁড়ি কাঁপিয়ে না ঘুমিয়ে একটু ভালোভাবে তদন্ত করলেই আমার সাথে ওই তুমুল শুটআউটের সম্পর্ক বের করে ফেলতে পারবে।
কিন্তু আমাকে ধরে ফেলাটা এত সহজ হবে না। আমি যে খুন করেছি, তার সাক্ষি কে দেবে? বোমা মজিদের তিন বা চার জন আহত সঙ্গি, আর শিপলু-সামাদ গোটা ঘটনাটার প্রত্যক্ষদর্শি। শিপলু সামাদ বাদ। বাকি যে কয়জন থাকলো, ওরা আর কি সাক্ষী দেবে? ওরা নিজেই তো আসছিলো আমাকে মারতে। বিশ্বাসযোগ্য গল্প খাড়া করানো কঠিন হবে ওদের পক্ষে। নিজেদেরকে বাঁচাতে পারবে না।
কিন্তু রাশেদ? পুলিশকে প্রচুর টাকা যদি সে খাওয়ায়, ধরুন কোটি দুয়েক…এই ‘৯৩ সালেও দুই কোটি টাকা অনেক কিছু।
মাথা থেকে চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম আমি। হ্যা, আমার মাথার ওপর বিপদের খড়গ ঝুলছে, সেটা ঠিক। এখন ঢাকা থেকে দূরে থাকাটাই ভাল। রংপুরে কয়দিন কাটিয়ে অ্যালিবাইটা যদি কয়েকদিন পিছিয়ে দেখাতে পারি, নানাজনকে টাকা খাইয়ে মুখ বন্ধ রেখে, তাহলে কোর্টকে দেখাতে পারবো গোলাগুলির রাতে আমি ছিলাম ঢাকা থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে। সুতরাং চলে এসে ভালোই করেছি।
নিজের গোঁফে তা দিয়ে খানিকটা সময় পার করলাম। গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে হু হু করে বাতাস এসে মুখে লাগছে, দারুণ অনুভূতি। সামাদ ঠিকই বলেছিলো, গ্রামে কয়েকটা দিন কাটিয়ে আসা দরকার আমার। বিশেষ করে এই সময়ে।
কিন্তু সব কথার শেষ কথা হচ্ছে, এই যে এতদূর রাস্তা ক্রস করে দেশের আরেক মাথায় আসলাম, সেই দীর্ঘ যাত্রার কোনোকিছুই আমার মনে নেই কেন? সকালে কখন গাড়িতে উঠলাম? ঢাকা কখন ছাড়লাম? যমুনা নদীর ফেরি কখন পার হলাম?
ওইসব স্মৃতির বদলে শিপলুর সাথে বিচ্ছিরি এক বাড়িতে গিয়ে ভয়ানক একটা জিনিস দেখার স্মৃতি কেন আমার মাথায়? সুস্থ স্বাভাবিক কোনো মানুষের তো এমনটা হয় না।
সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে সাক্ষাতের কথা মনে হলো আমার। লোকটার কথাগুলো আরেকটু গুরুত্ব দিয়ে শোনা উচিত ছিলো।
সত্যিই কি আমার কোনো মানসিক সমস্যা দেখা দিচ্ছে?
কমনওয়েলথে যাবার আগে যে ঘটনাটা ঘটিয়েছিলাম। আমার বাবার মৃত্যু। আইরিনের সাথে ঝামেলা। আর কালকে রাতে বোমা মজিদকে…আমার মগজে চাপ দেবার মতো কম ঘটনা ঘটেনি।
“এবার কোনদিকে, শিপলু ভাই?” সামাদের প্রশ্ন। হেডলাইটের আলোতে দেখতে পাচ্ছি কাঁচা রাস্তাটা এক চৌরাস্তায় এসে পড়েছে। চৌরাস্তাটা ঘিরে একটা গ্রাম্য বাজারের মত, যতদূর বুঝতে পারলাম। সব দোকানের ঝাঁপ বন্ধ অবশ্য। কোথাও জনমনিষ্যি নেই।
“ডানের রাস্তাটা দিয়ে যেতে থাকো,” শিপলু মাথা বাড়িয়ে বাইরে দেখে বললো।
ডানের রাস্তাটায় মোড় নিলো গাড়ি। এই রাস্তাটার দু-পাশে মোটা মোটা গাছ, নিঃশব্দে উল্টো দিকে সরে যাচ্ছে।
আরো কিছুক্ষণ যাবার পরে হঠাৎই হেডলাইটের আলোয় ভোজবাজির মত উদয় হলো একটা বাড়ির অবয়ব। যতদূর বুঝলাম, বৃটিশ ধাঁচের পুরনো ইঁটের তৈরি দালান, লাল টালির ছাদ। দালানটার সামনে ঝোপঝাড়ে ভরা, অন্ধকার, বেশ কয়েকটা গাছও আছে। সম্ভবত এককালে পুরো বাংলোটা ঘিরে একটা খাটো প্রাচীরের মত ছিলো, এখন সেটার ধ্বংসাবশেষ আছে মাত্র। বোঝাই যায় এইদিকে মানুষের পা খুব একটা পড়ে না।
“এই বাংলোটার কথাই বলেছিলাম,” আমাকে না, যেন বাতাসকে বললো শিপলু।
প্যাঁ প্যাঁ করে হর্ন বাজালো সামাদ। কয়েক সেকেন্ড পরই হারিকেন হাতে বাংলোর বারান্দায় উদয় হলো সাদা দাড়িওয়ালা পাঞ্জাবি আর লুঙ্গি পরা এক লোক। বাংলোর কেয়ারটেকার হবে হয়তো।
গাড়ি দাঁড় করিয়েছে সামাদ। শিপলু দরজা খুলে নেমে এগিয়ে গেল হারিকেনওয়ালা বুড়োর দিকে। বারান্দায় উঠে বুড়োকে কি কি যেন বললো ও, বুড়ো মাথা নেড়ে হারিকেনটা নামিয়ে রেখে এগিয়ে এলো। দরজা খুলে নেমে গিয়ে গাড়ির ট্রাঙ্কটা খুলে দিল সামাদ। মালপত্র নামাতে লাগলো বুড়ো।
গাড়ি থেকে নামলাম আমিও। শরীর খুব একটা ভালো লাগছে না, মাথাটা যেন ঘুরছে একটু-একটু। আমি কি ড্রিঙ্ক করছিলাম? তা-ও মনে নেই! অ্যামনেশিয়া বলবো এটাকে, না ব্ল্যাকআউট? এমনটা কখন হয় মানুষের? সামাদের কাছ থেকে কৌশলে জেনে নিতে হবে।
বাতাসটা বেশ তাজা। বুক ভরে কয়েকবার দম নিলাম আমি। মাথাটা একটু একটু করে পরিস্কার হচ্ছে যেন। খিদেও লেগেছে বেশ।
বাংলোটার দিকে তাকালাম। ওটার জানালাগুলো অন্ধকার, যেন তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে অশুভ দৃষ্টিতে। বারান্দায় শিপলুর কাছে এগিয়ে গেলাম আমি। ও আরেকটা সিগারেট টানার জোগাড়যন্তর করছে।
“এদিকে এখনো ইলেকট্রিসিটি আসেনি দেখছি।” যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বলার চেষ্টা করলাম আমি। গাড়িতে যে কান্ডটা করেছিলাম, সেটার পর থেকে এখনো শিপলু আর সামাদের সামনে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি না।
“দেশের কত জায়গায় কারেন্ট আছে আর কত জায়গায় নেই, সেটার রেশিও করলে অবাক হয়ে যাবি, মনে হবে কারেন্ট থাকাটাই অস্বাভাবিক,” হেসে বললো শিপলু। “আশা করি দুই হাজার সাল আসতে আসতে দেশের সব জায়গায় কারেন্ট পৌঁছাবে।”
হারিকেনটা তুলে নিলো শিপলু। “চল একটু ভেতরটা কেমন, দেখে নেই। বহু পুরনো যদিও, তবু আশা করি কয়েকটা দিন ভালোমতই থাকতে পারবো।” কাঠের দরজাটায় ঠেলা দিল ও। ক্যাঁচকোঁচ শব্দে খুলে গেল ওটা।
হারিকেনের হলদে আলোয় প্রথমের ঘরটা একটা বসার ঘর বলে মনে হলো। কয়েকটা মলিন সোফা পড়ে আছে। দেয়ালে কয়েকটা চেনার অযোগ্য পেইন্টিং ঝুলছে। এদিক ওদিক দেখতে দেখতেই ঘরে এসে ঢুকলো সামাদ, আর সেই বুড়োটা। শিপলু বললো, “ইনি এই বাংলোর কেয়ারটেকার, আমজাদ আলী। খুব কাজের মানুষ।”
লোকটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। শকুনের মতো জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চাহনিতে অদ্ভুত এক ভাব, যেটাকে ঠিক কিসের সাথে তুলনা করবো জানি না। আমার বিস্মিত চেহারা দেখেই যেন স্বাভাবিক হলো বুড়ো। বললো, “আসেন, আপনাদেক গোছলখানা দ্যাখে দেই। হাত মুখ ধুয়া নেন, আমি খাবার দাবার গুলা সাজে থুচ্ছি।”
বুড়ো এগিয়ে গেল। আমি ওর পিঠের দিকে তাকিয়ে আছি।
*
“রান্না কাকে দিয়ে করিয়েছ, আমজাদ আলী?” মুরগির হাঁড় চিবুতে চিবুতে বললো শিপলু।
“হালিমের মা। এই গ্রামোতে থাকে। কেউ বাংলোয় থাকবার আইলে রান্না-বান্না করি দেয়।”
“যাক, আমার মানি অর্ডার পেয়েছো তাহলে। এইটা নিয়েই টেনশনে ছিলাম।” শিপলু বললো।
“হ। সময়মতোই আসছে। মুরগি কিনি থুইছি আরো দুইটা। কাইল খাওয়াবো ঘাঘট নদীর মাছ।” শিপলুর প্লেটে আরেকটু ভাত তুলে দিতে দিতে বললো আমজাদ আলী। আর এই কাজ শেষে করেই আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো সে। চোখে সেই শকুনের মত দৃষ্টি। ডাইনিং টেবিলের ওপরে রাখা হারিকেনটার আলোয় চোখদুটো যেন জ্বলছে তার।
বেশ আরাম করেই খাচ্ছিলাম, খাওয়া মাথায় উঠলো আমার। বুড়ো এইভাবে আমার দিকে দেখছে কেন? কারণ কি? কেউ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, বিশেষ করে খাওয়ার সময়ে। আমাদের বাড়ির আব্বাস মিয়া বহুবার ধমক খেয়েছে সেজন্য। আব্বাস মিয়ার চোখের দৃষ্টিতে তাও মা-মরা এই আমার জন্য স্নেহ মেশানো থাকতো, কিন্তু এই বুড়োর চোখের দৃষ্টি কুটিল।
রেগেমেগে কিছু একটা বলেই বসতাম, কিন্তু শিপলুর দিকে চোখ পড়লো হঠাৎ। ও চোখ দিয়ে ইশারা করছে, চুপ থাক। আমি ভুরু কোঁচকাতেই ও স্বাভাবিক গলায় বললো, “আমজাদ মিয়া, শিকারিসাহেব আজকে ক্লান্ত, বুঝলে? কালকে গোটা গ্রামটা ঘুরে দেখবো আমরা। তুমিও কালকে শিকারিসাহেবের কাছ থেকে বাঘ মারার গল্প শুনো। এখন না।”
প্রথম কয়েক সেকেন্ড বুঝতেই পারলাম না কিসের কথা বলছে শিপলু। তারপরই মাথায় ঢুকলো ব্যাপারটা। আমাকে শিকারি হিসেবে পরিচয় দিয়েছে শিপলু। গ্রামবাসির সমাদর আর বাংলোতে জায়গা পাওয়াটা নিশ্চিত হয়েছে বটে তাতে, কিন্তু এই পরিচয়টা আমার নিজের কাছে এত কিম্ভুত মনে হলো যে ভাত গিলতেও ভুলে গেলাম কয়েক মুহূর্ত। বিষম খাওয়ার হাত থেকে বাঁচতে পানির গ্লাসের দিকে হাত বাড়াতে হলো।
কেয়ারটেকার আমজাদ আলী অবশ্য এখনো তাকিয়ে আছে আমার দিকে, একইভাবে। অবশ্য তার ওইরকম দৃষ্টির অর্থ আমার কাছে এখন স্পষ্ট, কৌতূহল। নির্বোধটার ধারণা তার গ্রামকে একটা রহস্যময় জন্তুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এখানে এসেছি আমি, আর তাতেই আমাকে নিয়ে এত কৌতূহল তার।
“সাহেব অনেক বাঘ মারছেন বুঝলাম,” বললো আমজাদ আলী, একইভাবে তাকিয়ে আছে, কণ্ঠে চাপা উত্তেজনা। “কিন্তু হামার গ্রামের এখান তো বাঘ না! অন্যকিছু! উয়্যাক চোখ দিয়া দেখা যায় না, এমন জোরে দৌড়ায়! দৌড়াইলে কোনো শব্দ হয় না! বিলাই দৌড়াইলেও শব্দ হয়, কিন্তু এই পিচাশ দৌড়াইলে হয় না, বোঝনেন বাহে?”
পিচাশ, মানে কিনা পিশাচ। আমার হাসি পেল। ব্যাটারা কোন যুগে বাস করে? উনিশশো তেরানব্বইতে, না আঠারোশো তেরানব্বইতে?
“কয়জন মারলো পিশাচটা?” স্বাভাবিক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো শিপলু।
চোখ ঘুরিয়ে তেরছাভাবে ছাদের দিকে চাইলে আমজাদ আলী, গভির ভাবনার ছাপ চোখে-মুখে। যেন সে মস্ত বড় কোনো মহাকবি, নিজের লেখা মহাকাব্য স্মরণ করার চেষ্টা করছে গোড়া থেকে। “সবার পোথমে তো মরলো আপনার রাজ্জাক মিয়ার পোষা গাই গরুটা। সবায় আমরা খুব দোক্ষ পাইছলাম বাহে। গরীব মানুষ, তায় গরুটা পুষছিল এইবারবহুত আশা করিয়া, বোলে যদি এখান বাছুর হয় তাইলে দুধও বেচাইবে, বাছুরটাকো পালবে…”
“গরুটা কিভাবে মরলো তাই বলো,” তাড়া দিলো শিপলু।
“হ হ। গরুটাক চরাবার নিয়া গেছিল খালি ভিটাত। সে গরুও আছিল চঞ্চল, বোঝনেন, কতা শুনবার চায় নাই। খালি দড়ি ছিড়ি পালাবার চাছিল। সেদিনও দড়ি ছিড়িয়া গেছিল জঙ্গলের ওপাকে। সইন্ধ্যাবেলা সবায় সবার গরু নিয়া গেল, রাজ্জাক মিয়া তো আসি তার গরু পায় না। শ্যাষে খোঁজতে-খোঁজতে-খোঁজতে-খোঁজতে পাইলো জঙ্গলের সাইডোত। কাঁইবা গরুটাক মারি অর্ধেকটা খায়া গেইছে!” গায়ে কাঁটা দেয় আমজাদ আলীর।
“মোট গরু কয়টা মারা গেছে?” মহাকাব্য এড়ানোর জন্যই বললো শিপলু।
“সাতটা। পোথমে হইলো আপনার রাজ্জাক মিয়ার, তারপর ছদরুলের…” আঙুলের কড়া গুনতে গুনতে বলে আমজাদ আলী।
“আর ছাগল?” তাড়াতাড়ি বলে শিপলু।
“সেখানের তো হিসাব থুই নাই। মেলা মরছে। দশটার উপরে হইবে। “ “মানুষ কয়টা মারা গেছে?” সামাদের ঠান্ডা, শীতল গলা বলে। সারাদিনে মনে হয় এই প্রথম কথা বললো ও।
“তিনজন,” আমজাদ আলী কাঁপা কাঁপা গলায় বলে। “পোথথোমে মরি পাতা কুড়ানি চেংরিটা, অমিছা। এমনিতে ওমার দুঃখের শ্যাষ নাই, ওমার বাড়িত থাকে খালি দু-জন, অর মা আর অঁয়, মাইয়াটা সিয়ানা হছিল, কেবল বিয়ার বয়স হছিল…’
“আর?” আমি বাধা দেই।
“সিদ্দিকের বউয়ের দুধের ছইলটা। বয়স ছয়-সাত মাস হইবে। সিদ্দিকের বউ বাচ্চাটাক থুয়া কেবল খালি পানি আইনবার গেইছে পুকুর থাকি, সিদ্দিক তখনো আইসে নাই, কিষানের কাজ কইরবার গেছিল চেয়ারমেনের জমিত, আসি দেখে ছইলটা নাই! সে কি কান্দন সিদ্দিকের বউয়ের, বড় গলায় কান্দা শুরু করছিল….”
“বাচ্চাটাকে পাওয়া গেছে?” বলেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারলো শিপলু। “মানে, বাচ্চাটার…”
“হ, বাহে। খালিভিটাত। জঙ্গলের সাইডোত। একবারে ছিড়িবিড়ি শ্যাষ করি ফালইছল বাহে, হায়রে মাসুম দুধের বাচ্চা…”
“আর শেষেরজন?” সামাদের প্রশ্ন।
“চেয়ারমেনের ছোট ব্যাটা। রিপন। বাউদিয়া আছিল। নেশারু। জুয়া খ্যালে বেড়াছিল এ গ্রামোত ও গ্রামোত। রাইতোত বাড়িত থাইকবার চাইতো না। এই তিন চাইরদিন নিখোঁজ আছিল। এই গত জুম্মাবার খালিভিটাত পাওয়া গেছিল উয়্যার লাশ।” আমজাদ আলী কাঁপা গলায় বলে। “টুটি একেবারে ছিড়ি থুয়া গেছিল। কল্লা আলাদা হয়া গেল হয় আরেকনা হইলে।”
লোকটা বারবার খালিভিটা-খালিভিটা করছে। কে জানে কি চিজ ওটা। খাওয়া শেষ আমার, হাত ধুতে ধুতে বললাম, “খালিভিটাটা আবার কি জিনিস, আমজাদ মিয়া?”
“খাস জমি। হামার গ্রামোত যে জঙ্গলখ্যান আছে না, সেটার সাইডোত বড় একখান খাস জমি আছে, কেউ অটে যায় না। অটে…”
“জঙ্গল?” প্রায় শোনা যায়না এমনভাবে বললো সামাদ।
“হ!” চোখ বড় বড় করে বললো আমাজাদ আলী। “পিচাশটা তো অটে থাকে!” নিঃসীম অন্ধকারে জেগে উঠি আমি। প্রথম কয়েক মুহূর্ত বুঝতে পারি না কোথায় আছি। গোটা মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
আমি কোথায়? কিভাবে এলাম এখানে? আমি কি আমার বাসায়? লোডশেডিং চলছে নাকি? কিন্তু তাহলে জানালা দিয়ে রাস্তার আলো চোখে পড়ছে না কেন?
আমি কি…
তারপরই হঠাৎ মনে পড়ে যায় সব। বোমা মজিদের সাথে শুটআউট। শিপলু আর সামাদের সাথে পালিয়ে চলে আসা। ঘন অন্ধকারে ছাওয়া এক প্রত্যন্ত গ্রাম। সেখানে একের পর এক মানুষ খুন।
কারেন্টবিহীন বাংলোর নিকষ কালো বেডরুম। কিন্তু আমার ঘুম ভাঙলো কেন? কেউ কি আমাকে ডেকেছে?
অনিশ্চিতভাবে ‘কে’ বলতে যাচ্ছিলাম, বলা আর হলো না। আমার ভোকাল কর্ড কাঁপিয়ে কথাটা বেরেনোর আগেই টানা টানা একটা চিৎকার ভেসে এলো বাতাসে।
আমি থমকে গেছি, আর সেই সাথে রাতের শীতল বাতাসও।
আবার এলো চিৎকারটা। টানা টানা। প্রলম্বিত। যেন একটা নেকড়ে অস্তিত্ববিহীন কোনো পূর্ণিমার চাঁদকে স্বাগত জানাচ্ছে কোনো টিলার ওপরে উঠে আকাশের দিকে মুখ তুলে। কিংবা অপরিসীম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কোনো আতঙ্কিত মানুষ। কিংবা রক্তপিপাসু একটা পিশাচ আরেকবার ক্ষুধার্ত হয়েছে।
আমি হাঁপাচ্ছি, যেন দৌড়ে এসেছি অনেকটা পথ। ঘামছি দরদরিয়ে, মাথা আর কাঁধ বেয়ে দরদরিয়ে নামছে ঘামের ধারা।
আমার একটা আলো চাই। এই অন্ধকার অসহ্য লাগছে। একটা দেশলাই চাই। পকেট হাতড়াতে গেলাম আমি। নেই। যে রাতের পোশাকটা পরেছি সেটাতে পকেটই নেই।
মাথা কাজ করছে না আমার, দিক বিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। আর্তনাদ-নাকি চিৎকার বলবো ওটাকে এখনো চলছে।
স্নায়ুর ওপর প্রচন্ড চাপ ফেলছে আমার। মানুষ চোখে না দেখলে যে এত অসহায় হয়ে পড়ে, জানা ছিল না।
পাগলের মত বালিশের নিচে হাত চালালাম আমি। আছে! পেয়ে গেছি একটা দেশলাই! প্রথম কাঠিটা ধরাতে পারলাম না আমি। তুলতেই পারলাম না আসলে আঙুল দিয়ে, এতই কাঁপছে আমার হাতটা। পরের কাঠিটা বাক্সের গায়ে ঠুকতে গিয়ে ভেঙে গেল। আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে জ্বলে উঠলো তৃতীয় কাঠিটা।
ছোট বেডরুমটা চোখে পড়লো। দু-পাশে দুটো বেড। ওপাশের বেড়ে শিপলু ঘুমে অচেতন। আমার দুই কানে ঝংকার তুলছে চিৎকারের শব্দটা। আমার বন্দুক কোথায়?
সামাদ বলছিল, আমার ফেভারিট তিনটা হান্টিং রাইফেল আর পর্যাপ্ত অ্যামুনিশন আনা হয়েছে। কিন্তু কোথায় ওগুলো?
লাফ দিয়ে খাট থেকে নামলাম আমি। বসে পড়লাম খাটের পাশে। ওই তো খাটের নিচে একটা লাগেজ দেখা যাচ্ছে… আউচ!
কাঠিটা পুড়তে পুড়তে আমার হাতে ছ্যাঁক দিয়েছে। আরেকটা কাঠি জ্বাললাম আমি কাঁপা হাতে। খাটের নিচে একটা লাগেজ দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু তাতে কোনো রাইফেল আঁটবে না। লাগেজটা ধাক্কা দিয়ে সরালাম আমি। ওইতো, আরেকটা লাগেজ! লম্বা! লাগেজটা খোলার আগে বেডসাইড টেবিলের ওপর রাখা হারিকেনটা জ্বালিয়ে নিলাম আমি। তারপর তাড়াহুড়ো করে খুলে ফেললাম লম্বা লাগেজটার ডালা।
আমার তেল-চকচকে উইনচেস্টার মডেল নাইন্টিফোর রাইফেলটা যেন হাসছে আমার দিকে তাকিয়ে।
আমি ছোঁ মেরে তুলে নিলাম ওটা। একটা আঙুল চলে গেল ট্রিগারে।
আমার প্রত্যেকটা পেশি টানটান। আমি তৈরি।
অধ্যায় ৮ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ৮ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
এরকম ঝাঁ ঝাঁ রোদের সকালে বিছানায় শুয়ে থাকা চলে না। চোখ মেলে জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকিয়েই তড়াক করে উঠে বসলাম।
হাতমুখ ধুয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখি, শিপলু একটা বেতের চেয়ারে বসে আছে। পা পদ্মাসনের মত ভাঁজ করা। হাতে একটা সিগারেট। টানছে না, হাতটা মুখের কাছে ধরে আছে কেবল।
ওর পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লাম। “কি রে? কি করিস?”
“দেখছি,” সামনে তাকিয়েই জবাব দিলো শিপলু।
আমিও সামনে তাকালাম। বাংলোর সামনের জায়গাটা, যেটা এককালে হয়তো লন ছিলো, আগাছা আর ঝোপজঙ্গলে ভরা। তাদের ওপরে আলো-আঁধারির ঝালর ফেলেছে অগোছালোভাবে বেড়ে ওঠা কয়েকটা আম-লিচু আর নাম না জানা গাছের পাতার ছাউনি। সবকিছু ছাপিয়ে দূরে বিস্তির্ণ ধানখেত দেখা যাচ্ছে। এইসবের মাঝে দেখার কি আছে কে জানে।
চোখ কুঁচকে শিপলুর দিকে তাকাতেই ও বললো, “দুনিয়াটা বড়ই ডিসিভিং। কোনোকিছুর আসল রূপ বোঝার উপায় নাই।”
চোখ কুঁচকে ফেললাম আমি। “সাত সকালে হঠাৎ এই ফিলসফি?”
“আজকের সকালটার কথাই দেখ। আবহাওয়াটা কেমন লাগছে তোর কাছে?”
“চমৎকার।”
“রিফ্রেশিং?”
“হুমম।”
“কিন্তু আমি যে সবকিছুতে একটা অশুভ গন্ধ পাচ্ছি,” ফিসফিস করে বললো শিপলু। আস্তে আস্তে সিগারেটটা লাগালো ঠোঁটে।
অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো আমার। শিপলুর কথায় ভয় পেয়ে নয়, প্রসঙ্গটার কারণেই। শিপলুর সাথে দেড় বছরের বন্ধুত্ব আমার, ওর সাথে বেশ কয়েকটা অ্যাডভেঞ্চারও করা হয়ে গেছে, কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমি অলৌকিকের ব্যাপারে এখনো সংয়শবাদী। নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে লাথি মেরে এসেছে চব্বিশ বছর আগে, যখন আমার বয়স এক। এখনকার এই জমানায় ভুত-জ্বিন-স্কন্ধকাটা- অয়্যারউলফের কিস্সা হাস্যকর লাগে। শিপলুর সাথে এতগুলো কেস দেখার পরেও।
“অনেক অশুভ সংকেতই বুঝতে পারি আমি,” যেন আমার মনের কথা বুঝেই বললো শিপলু। “ছোটবেলায় মানুষের অনেক রকম হবি থাকে। গল্পের বই পড়া, ডাকটিকেট জমানো, মুদ্রা জমানো, পছন্দের নায়ক বা নায়িকার ছবি কেটে দেয়ালে লাগানো। আমার এইরকম কোনো ফ্যাসিনেশন ছিলো না। স্কুলে যেতাম-আসতাম। বিকালে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলতাম। আর কিছু না। আমার মত নির্লিপ্ত, কৌতুহলবিহীন ছেলে আর দুটো ছিল কিনা জানি না। কিন্তু হঠাৎ একদিন সবকিছু পাল্টে গেল। তখন আমি সিক্সে পড়ি…
“একদিন রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, আমার বিছানার পাশে আব্বু-আম্মু দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের চেহারায় ভয়। আমি নাকি ঘুমের মাঝে চেঁচাতে চেঁচাতে বিছানায় উঠে বসেছি। অথচ আমার কোনো স্বপ্ন দেখার কথা মনে নেই। স্বপ্নের মাঝে কি দেখে অমন ভয় পেয়েছিলাম, তাও জানা নেই।
“পরের রাতেও এই রকম হলো। তার পরের রাতেও। এইভাবে প্রায় একমাস যাবত প্রতি রাতে আমি রাত ঠিক তিনটা পাঁচ মিনিটে চেঁচাতে চেঁচাতে জেগে উঠতাম। আব্বু ততদিনে ডাক্তার দেখাতে দেখাতে শেষে মরিয়া হয়ে কবিরাজ দেখানো শুরু করেছেন। কেউ কিছু করতে পারছে না।
“তারপর হঠাৎ একদিন সবকিছু ঠিক হয়ে গেল। রাতের বেলা চেঁচিয়ে ঘুম ভাঙা বন্ধ হয়ে গেল আমার। তবে সবকিছু কিন্তু আগের মতো হয়ে গেল না। একটা জিনিস চেঞ্জ হয়ে গেল চিরতরে। আমি। অলৌকিক আর অতিপ্রাকৃত নিয়ে মেতে উঠলাম ভীষণভাবে। অকাল্ট নিয়ে কত বই পড়েছি, তা তো বলেছিই। কিন্তু সত্যিকারের কাজের কাজটা করলাম যখন সারা দেশে ঘুরে বেড়ানো শুরু করলাম। মানুষের মুখে শুনে হোক, বা সস্তা ট্যাবলয়েড পত্রিকা থেকেই হোক, যেখানেই কোনো খাপছাড়া ঘটনার কথা জানতে পারতাম, ছুটে যেতাম। কয়েকদিন পরে শুরু করলাম পীর- ফকির-ওঝা-তান্ত্রিকের পিছু নেয়া।”
“আর তখনই দুঃখের সাথে খেয়াল করলি, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই আসলে ভন্ড।” ঠান্ডা গলায় বললাম আমি। শিপলুর কাছে এই গল্প আগে বহুবার শুনেছি। আসলে লম্বা ভূমিকা না দিয়ে কথা শুরু করতে পারে না ও।
“হ্যা। স্বভাবতই চরম হতাশ হয়েছিলাম। কিন্তু হাল ছাড়লাম না। ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে দেশের প্রত্যন্ত এক জেলার এক শ্মশানে এক তান্ত্রিকের দেখা পেলাম। সারা শরীর ছাই মাখা, মাথায় বিশাল জটা, পেট পর্যন্ত দাড়ি। চোখ জবা ফুলের মত লাল। কথা বলে হিন্দিতে। নিজেকে দাবি করলো অঘোরি সাধু হিসেবে, ইন্ডিয়া থেকে নাকি এসেছে বর্ডার টপকে।” শেষ হয়ে আসা সিগারেটটা ফেলে দিলো শিপলু। “বেশ ভড়ংও জানে দেখলাম। মড়ার খুলিতে করে পানি আর মদ খায়। গাঁজার কল্কেতে এমন দম দেয় যে দেখলে তোরই দম আটকে আসবে। যাহোক, সে লোকের কাছে মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম আমি। তান্ত্রিকটা ভ্রুক্ষেপই করলো না, যেন আমার কোনো অস্তিত্বই নেই। তিন দিনের দিন রাতে সেই লোক একটা আগুনের কুন্ড জ্বালিয়ে সাধনা শুরু করলো।
“সেই রাতে আমি কি দেখেছিলাম জিজ্ঞেস করিস না। কিন্তু এইটুকু বলতে পারি, সেইদিনের পর থেকেই আমার মাঝেও অনেক ক্ষমতা জন্মেছে। অনেক কিছু বুঝতে পারি। অনেক কিছুর অস্তিত্ব টের পাই।” একটু থামলো শিপলু। “কালকে রাতে যখন আসছি, তখনই টের পাচ্ছিলাম অশুভ কোনোকিছুর উপস্থিতি। তখন পাত্তা দেইনি। ভেবেছিলাম ফলস অ্যালার্ম। কিন্তু আজ সকালে…”
“টের পাচ্ছিস চারপাশে থিকথিক করছে অশরীরি?” কন্ঠের ব্যাঙ্গের সুরটা কাটানোর কোনো চেষ্টা করলাম না আমি।
কোনো জবাব দিলো না শিপলু। হঠাৎ মাথা ঘোরালো আমার দিকে। “কালকে রাতে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি।”
আমজাদ আলী ট্রে-তে করে চা নিয়ে এসেছে। সেখান থেকে একটা কাপ তুলে নিলাম আমি। চুমুক দিতে দিতে বললাম, “চিৎকারটা নার্ভের ওপরে চাপ দিচ্ছিলো। তার ওপরে নতুন একটা জায়গায় হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া, তার ওপর…” থেমে গেলাম আমি, গত পরশু রাতের কথা মনে পড়ে গেছে।
“তোর হাতে তো বন্দুক ছিলো,” চায়ে চুমুক দিয়ে মলিন একটা হাসি হাসলো শিপলু। “সাহসটা অন্তত ফিরে পেয়েছিলি। আমার কথা চিন্তা কর। ঘুম থেকে উঠে দেখি সারা ঘরে হারিকেনের মৃদু আলো, দূরে কোথাও পিশাচটা ডাকছে, তুই ঘরের মাঝখানে উবু হয়ে আছিস, হাতে অ্যান্টিক রাইফেল! কলজে কেঁপে উঠেছিল!”
“বোকামি হয়েছিল, স্বীকার করছি,” বললাম আমি। “অত রাতে সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় আরো বেশি অজানা এক জানোয়ারের পিছু নেবার চিন্তাটা একেবারে পাগলামি ছিলো।’
শেষের কথাটা আমার নিজের কানেই ঝনঝন করে উঠলো।
একেবারে পাগলামি ছিলো।
একেবারে পাগলামি ছিলো।
একেবারে…
গত কয়েক দিন যাবত এসব কি হচ্ছে আমার সাথে? কালকের ওই ডিমেনশিয়া আর ওই ভয়ংকর স্বপ্নের কোনো ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে পারি নি। এমনকি কালকে রাতে শিপলু আর সামাদ আমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিছানায় পাঠানোর পরও ছাড়া ছাড়া অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি অনেকক্ষণ। কোনো আগা মাথা নেই কোনো স্বপ্নেরই। একবার দেখলাম আমার কোচ খালেকুজ্জামান স্যার আমার দিকে রাইফেল তাক করে দাঁত বের করে হাসছেন। তারপরই আমি সুন্দরবনে একটা গাছের ওপরে, মাচায়। টোপ ফেলে বাঘ মারতে এসেছি। বাঘ এলো, কিন্তু বাঘটা পূর্ণবয়স্ক না, বাচ্চা…তারপরই দেখলাম বাবা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছেন, তার চারপাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “জামশেদ, কখনো ভুলবে না আমি কে ছিলাম। খুব সাবধান। আসল নকল বিচার করবা, বাবা, আসল নকল বিচার করবা….” এরপরই আমি কমনওয়েলথে, সোনা জিতেছি, মেডেল নেবার জন্য প্ল্যাটফর্মেও উঠেছি, কিন্তু পদক না, কর্তৃপক্ষ যা নিয়ে আমার কাছে এসেছে, সেটা একটা হাতকড়া…সোনার হাতকড়া…
একটা ভট ভট শব্দে চিন্তার সুতো ছিঁড়লো আমার। তাকিয়ে দেখলাম, একটা মটরসাইকেল এগিয়ে আসছে এদিকেই। খানিক বাদেই বাংলোর আঙিনায় চলে এলো ওটা। মটর সাইকেলটার সাইলেন্সার নষ্ট নিশ্চয়ই, কারণ ওটার আশি সিসি ইঞ্জিনের ভটভট শব্দে কান পাতা দায়, কিন্তু সেটা নিয়ে ভাবার সময় নেই আমার। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছি মটরসাইকেলের আরোহীর দিকে।
পুলিশ।
খাকি ইউনিফর্ম পরা একজন পুলিশ।
রিভলভারওয়ালা একজন পুলিশ।
মাথায় ঝড়ের বেগে চিন্তা চলছে আমার। হচ্ছেটা কি? কালকে এত রাতে এলাম, আর আজ সকালেই পুলিশ হাজির? তাহলে কি পুলিশ সব জেনে গেছে? কে জানালো? রাশেদ? কিন্তু বোমা মজিদের সাথে তার অ্যাসোসিয়েশনের কথা ফাঁস হয়ে যাবার ঝুঁকি সে কেন নিলো? তাহলে কি বোমা মজিদের সাথে থাকা কেউই পুলিশকে ইনফর্ম করেছে? যে-ই ইনফর্ম করে থাকুক, আমি যে এখানে আছি, জানলো কি করে? পুলিশ ঢাকা থেকে সাড়ে তিনশো কিলোমিটার দূরে আমাকে ফলো করে এলো কি করে?
শিপলুর দিকে তাকালাম। একদম ফ্যাকাশে মেরে গেছে ও-ও। বিড়বিড় করে কেবল বললো একবার, “পুলিশ!”
পুলিশটা বারান্দার কাছাকাছি এসে মটরবাইকটা দাঁড় করিয়ে আয়েশ করে ভুঁড়ি দুলিয়ে নামলো ওটা থেকে। বেশ নাদুস নুদুস চেহারা লোকটার। কুচকুচে কালো গায়ের রং। মাথার সামনের দিকে টাক। টুপিটা কাঁধের শোল্ডার ব্যাজের ভেতরে গুঁজে রাখা, কেন কে জানে। ঘামছে সে, পকেট থেকে রুমাল বের করে টাকের ঘাম মুছলো। তার যে মাত্র কয়েক হাত দূরে বারান্দায় আমরা বসে আছি, সেটা যেন চোখেই পড়েনি তার। মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আমাদের গাড়িটাকে জরিপ করলো বেশ আগ্রহ নিয়েই।
“কথা যা বলার আমাকেই বলতে দিস,” ফিসফিসিয়ে বললো শিপলু।
বাংলোর বাইরের সবকিছু যেন চোখের ভেতরে গেঁথে নিয়ে শোল্ডার ব্যাজের ভেতর থেকে টুপিটা বের করে মাথায় দিলো সে, তারপর বারান্দায় উঠে এসে সরাসরি দাঁড়ালো আমাদের সামনে।
লোকটার শরীর-স্বাস্থ্য দশাসই হলেও, চোখের দৃষ্টি ছুরির মত ধারালো। সেই চোখে একবার আমার দিকে, আরেকবার শিপলুর দিকে তাকালো সে। আমরা দু- জনই চায়ের কাপ হাতে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে আছি।
পালা করে তিন-চার বার আমার আর শিপলুর মুখের দিকে দেখার পরে আমার দিকে চেয়ে হঠাৎ হেসে হাতটা এগিয়ে দিলো সে।
“আপনিই মনে হয় শিকারিসাহেব?” রংপুরিয়া টানে বলে উঠলো সে, মুখে একান-ওকান জোড়া দন্ত বিকশিত হাসি।
গোটা ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে সম্বিত ফিরতে ফিরতে সেকেন্ড দুয়েক খরচ করে ফেললাম আমি, তারপরই তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে লোকটার হাত ধরলাম। “আ- আপনি?”
“দারোগা মফিজ উদ্দিন।” মুখে হাসি ধরে রেখেই বললো লোকটা। “কালকে রাইতে আপনারা আসছেন শুনলাম। অত রাইতে তো আর দেখা করা যায় না। তাই বিহান বেলা চলি আইলাম।”
লোকটার আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারছি এখন। শিপলু আমার শিকারি স্ট্যাটাসটা বেশ ভালোভাবেই চাপিয়ে দিয়েছে, আর যাই হোক। বুকের ওপর থেকে যেন এক মণ সাইজের একটা পাথর নেমে গেছে আমার। চোরের মন যে আসলেই পুলিশ পুলিশ, হাঁড়ে হাঁড়ে টের পেয়ে গেলাম সেটা।
আমি পরের কথাটা কি বলবো ভাবছি, এমন সময় পর্দা ঠেলে বারান্দায় হাজির সামাদ। ওর মুখে কখনো এক্সপ্রেশন ভালোভাবে আসে না, সব সময় গম্ভির। কিন্তু মফিজ দারোগাকে দেখে তার চেহারাটা হলো দেখার মতো। ভুত দেখার মতো ফ্যাকাশে মুখ, চোখ বিস্ফোরিত, কাঁধ ঝুলে পড়েছে হাল ছেড়ে দিয়েছে যেন, জেলে গিয়ে পঁচিশ বছর ধরে পাথর ভাঙার নিয়তি মেনে নিয়েছে। শিপলু তাড়াতাড়ি “সামাদ, আরো দুইটা চেয়ার দিতে বলো তো আমজাদ আলীকে,” বলে ওকে ভেতরে পাঠিয়ে না দিলে ও যে আরো কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতো, কে জানে।
গোটা ব্যাপারটা সামলে নিয়ে আরেকদফা চা নিয়ে বারান্দায় সামাদসহ আমরা চারজন জেঁকে বসতে আরো দশ মিনিট পেরিয়ে গেল।
মফিজ দারোগা চায়ের কাপে ফড়ফড় করে একটা চুমুক দিয়ে চিন্তিত চোখে তাকালো আমার দিকে। “জামশেদসাহেব, গ্রামের মানুষ কি যে ভয় পাইছে, আপনাক কয়া বুঝাবার পারবো না। সবার মাথা খারাপের অবস্থা। সন্ধ্যার পর বাড়ি থাকি বাইর হওয়া তো বাদ দিছে কবে। এখন তো দিনের বেলাও বাইর হইতে ভয় পায়। আমি আর কি সাহস দেবো। তিনটা মানুষ মরলো, কিছু কইরবার পারলাম না। আমার কতা মানুষ কেন শুনবে কন?”
আমি ফিলানথ্রপিস্ট না, মানুষ ডিল করা নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই আমার। বিশেষ করে তারা যদি দেশের দরিদ্রতম জেলার অশিক্ষিততম মানুষ হয়। কথাটা এড়িয়ে গিয়ে বললাম, “জন্তুটা না থাকলে ওদের ভয় থাকবে না। সাহসও ফিরবে।”
“জন্তু?” চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে ঝুঁকে এলো মফিজ দারোগা। “শিকারিসাহেব, আপনি এত শিওর হইতেছেন কেমন করি যে ওইটা কোনো জন্তু?”
ভুরু দুটো ওপরে তুলে লোকটার তেলতেলে কালো মুখের দিকে তাকালাম আমি। “দেখুন আপনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন না যে…”
“আমি কি বিশ্বাস না করি সেটা তো ব্যাপার নাসাহেব!” মফিজ দারোগার চোখ চকচক করছে। “বাস্তবতাটা দেখেন। তিন তিনটা লোক মরলো, কিন্তু কেউ পিশাচটাক চউখেও দেখতে পারলো না। ব্যাপারটা…’
জিম করবেটের বই স্কুলে থাকতেই পড়ে ঝাঁঝড়া করে ফেলেছিলাম। সে জ্ঞান কাজে লাগলো এখন। “ভাই আমরা এখানে কি নিয়ে ডিল করছি, সেটা আগে দেখতে হবে। প্রাণীটা সম্ভবত বিড়াল শ্রেণীর। মানে বাঘ টাইপের। এদের শরীরের ডিজাইনটাই এমন যে হাটাচলা করতে পারে কোনো শব্দ ছাড়াই। পায়ের নিচে প্যাডের মতো থাকে। আপনার পেছন পেছন এক মাইল হেটে আসবে, টেরও পাবেন না। এদের চোখের পাওয়ারও অন্যরকম। রাতের বেলা সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পারে।”
“আপনি কইতে চাইতেছেন রংপুরে বাঘ আছে?” এখনো আমার দিকে চকচকে তাকিয়ে আছে মফিজ দারোগা।
“রয়েল বেঙ্গল টাইগার, মোস্ট প্রোব্যাবলি নট।” ছোট বাচ্চাকে বোঝানোর মত করে ধীরে ধীরে বললাম আমি। “কিন্তু রয়েল বেঙ্গল তো দুনিয়ার একমাত্র বাঘ না। ফেলাইন গোত্রীয় প্রাণীর বংশতালিকা বিশাল। আমাদের বাড়িতে পোষা বিড়াল থেকে শুরু করে সুন্দর বনের বাঘ আর আফ্রিকার সিংহ, সবাই এরমধ্যে আছে। এই গ্রামের জন্তুটা মেছোবাঘ-চিতা-গেছোবাঘ টাইপের কিছু একটা হবে। অন্তত আমার যতদূর মনে হয়।”
“কিন্তু এইখানে আপনার মেছোবাঘই বা আসবে কোন্টে থাকি?”
“মেছোবাঘ দেশের কমবেশি অনেক জায়গাতেই পাওয়া যায়। সেগুলো যে সব সুন্দরবনে সেঁধিয়ে আছে, তা নয়।”
“সেটাও বুঝলাম, সাহেব।” মফিজ দারোগা মিটিমিটি ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বললো, “কিন্তু মেছোবাঘ মাছ না খাইয়া মানুষ খাইতে আসবে কেন?”
আমার হয়ে জবাবটা দিয়ে দিল সামাদ। “আসতেই পারে, যদি তার র্যাবিস হয়।”
“কি হয়?” অবাক হয়ে বললো মফিজ দারোগা।
“র্যাবিস। জলাতঙ্ক। এই রোগের জীবাণুর কাজই হচ্ছে মাথা খারাপ করে দেওয়া। সেটা মানুষ বা কুত্তা বা মেছোবাঘ যা-ই হোক।” স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে মাথাটা ঝুঁকিয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে সামাদ, যেন চশমার ওপর দিয়ে অবাধ্য ছাত্রের দিকে কটাক্ষ করা হেডমাস্টার। “তখন যাকে সামনে পায় তাকেই কামড়ানো শুরু করে।”
“আপনাদের কথায় আমার তো খটকা লাগতেছে ভাই।” মাথা নাড়তে নাড়তে বললো মফিজ দারোগা।
“খটকা লাগার কি আছে?” ঝাঁঝের সাথে বললাম। “আমি তো যুক্তির কথা বলছি। বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার।”
মফিজ দারোগা লাল চোখে তাকালো আমার দিকে। আমিও ছাড়লাম না, কটমট করে তাকিয়ে আছি সোজা তার চোখের দিকেই। লোকটার মেন্টালিটি বুঝতে পারছি অল্প-অল্প। স্থানীয় থানার দারোগা সে, বেশ কয়েকটা গ্রামের মানুষের কাছে সে স্বয়ং মূর্তিমান আইন। তার কথায় এখানে অনেককিছুই চলে। কিন্তু আমার কাছে পাত্তা চাইতে এসে তো লাভ নেই।
শিপলু এতক্ষণ চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে সবার কথা শুনছিলো। পরিবেশ গরম হয়ে উঠছে বুঝতে পেরে গৌতম বুদ্ধের ভঙ্গিতে একটা হাত তুললো ও। “এত কথায় তো কোনো কাজ নেই। আগে গোটা জায়গাটা সরেজমিন ঘুরে দেখতে হবে, তাহলে অন্তত সিনারিওটা আরেকটু পরিষ্কার হবে। দুপুর হতে অনেক দেরি আছে। রোদ এখনো চড়েনি। আমরা এখনই যদি বেরিয়ে পড়ি তো বেশ হয়।”
উঠে দাঁড়ালাম আমরা। কেউ কোনো কথা না বলে বারান্দার সিঁড়ি বেয়ে নামছি,, শুনলাম মফিজ দারোগা বিড়বিড় করে বলছে, “সব তো ঠিক আছেসাহেব। আমাক শুধু কন, কোন বাঘ রাইতের বেলা ওইরকম করি চিল্লায়?”
ঘাড়ের কাছটা শিরশির করে উঠলো আমার, তারপর শামুকের গতিতে একটা ঠান্ডা স্রোত নামতে লাগলো শিরদাঁড়া বেয়ে। কালকে রাতের বিভীষিকার কথা মনে পড়ে গেছে।
থমকে দাঁড়ালাম আমি, সেই সাথে অন্যরাও। “আমার বন্দুকটা মনে হয় সাথে নেয়া দরকার।” কথাটা বলার সময় গলা কেঁপে উঠলো আমার, অনেক চেষ্টার পরও।
*
মাথার ওপর ঝাঁ ঝাঁ করছে শরতের কড়া রোদ।
এই মুহূর্তে জগদানন্দপুরের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া উঁচু মেঠো পথটা ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা। আমরা চারজন বাদে রাস্তাটা ফাঁকাই বলতে গেলে। কেবল একটা লোক তার মান্ধাতার আমলের হারকিউলিস সাইকেলের ফ্রেমের মাঝের তিনকোণা জায়গাটায় একটা স্বাস্থ্যবান ধানের বস্তা চাপিয়ে কে জানে কোথায় যাচ্ছিলো, আমাদেরকে দেখে থতমত খেয়ে সাইকেল থামিয়ে নেমে পড়লো। মফিজ দারোগার চোখের ইশারায় অবশ্য আবার বুক সমান উঁচু জংধরা সাইকেলটায় চড়ে বসতে দেরি করলো না সে।
“গ্রামে কয়ঘর মানুষের বাস?” শিপলুর প্রশ্ন। আমার মাথাতেও কথাটা ঘুরছিলো বেশ অনেকক্ষণ যাবত।
“অনেক কম।” কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বললো মফিজ দারোগা। “আঠারো বিশ ঘরের বেশি হবান্নয়।।”
একটা গ্রামের জনসংখ্যা কেমন হয় তা নিয়ে আমার ধারণা নেই বটে, কিন্তু শিপলুর মুখ দেখে বুঝলাম এই গ্রামের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক রকম কম
“এত কম!” অবাক হয়ে বললো শিপলু।
“দেশের জনসংখ্যা দশ কোটি পেরোতে চললো, আর এইখানে এত কম যে?” আমার প্রশ্ন।
“আর কইয়েন না। এই গেরামের ভাগ্যেই কুফা।” মফিজ দারোগা পিচিক করে মাটিতে থু থু ফেলে বললো। “আগে থাকি এই গেরামখ্যান আছিলো ম্যালেরিয়ার আড্ডা। বিটিশ আমলে মঙ্গা হইলো। কত যে মানুষ মরছিলো ঠিক নাই। মানুষ নাকি ওই সময় খিদায় মাটিও খাইছে, এমন কথা শুনছি আমার দাদার কাছে। যাই হউক, পাকিস্তান হইলো। এই গেরামের আর উন্নতি হইলো না। কয়েক বছর পর পর কলেরা হয়। দেখার কেউ নাই। ম্যালেরিয়া তো আছেই। কিন্তু একাত্তরের সাথে আর কোনো কিছুর তুলনা চলে না ভাইজান। এই গেরাম আছিল হিন্দুপ্রধান। ভদ্র মোসোলমান পরিবারও আছিলো, হিন্দুদের সাথে মিলিমিশি থাকতো। সেইটায় হইলো কাল। খান সেনারা আসিয়া…” চুপ করে গেল মফিজ দারোগা। অবশ্য নীরবতাটাও যথেষ্ট অর্থপূর্ণ। একটু চুপ থেকে বললো, “রাজাকাররাই নিয়া আসছিলো এইদিক পাকিস্তানি আর্মিরে। এই গেরামে আশ্রয় নিতে আসছিলো শহরের এক ফেমিলি। কারমাইকেল কলেজ আছে না রংপুরে? তার বাংলার পোরফেসর। পোরফেসরসাহেব আছিলেন জয় বাংলার ভক্ত। ওনাদের গেরামের বাড়ি আছিলো এই গেরামে। তেনারা আসিয়া কিন্তু বাঁইচবার পারলো না। কারমাইকেলেরই আরেক মাস্টার আছিলো, পোরফেসরসাহেবের শত্রু, রাজাকারে যোগ দিছিলো। পোরফেসরসাহেবের ফেমিলির পিছন পিছন আসিয়া …” মফিজ দারোগা আরেকবার কথা অসমাপ্ত রেখে দিল। হাটার গতি কমে এসেছে। সামনের দিকে একটা আঙুল তুললো সে। “হুই যে।”
আমরা যে উঁচু মাটির রাস্তাটা দিয়ে এগোচ্ছিলাম এতক্ষণ, সেটা থেকে আরেকটা সরু কাঁচা রাস্তা নেমে গেছে। মফিজ দারোগার পেছন পেছন আমরা নেমে গেলাম সেটা ধরে। রাস্তা না বলে পায়ে-চলা পথ বলে ডাকাই বোধহয় ভালো, মাটির আলের উন্নত ভার্সন। দু-পাশে দুটো পতিত জমি। তাতে আগাছা আর ঝোপঝাড়। সামনে কয়েকটা বাঁশের ঝাড়। সেখানে পায়ে চলা পথটা বেঁকে গেছে। বাঁকটা ঘোরার পরই বুঝলাম মফিজ দারোগা আমাদেরকে কোথায় নিয়ে এসেছে।
জায়গাটার একটু বর্ণনা দেয়াটা সঙ্গত কারণেই দরকার। হাতের বামে বিস্তির্ণ পতিত জমি, তাতে ছাড়া ছাড়াভাবে নানান জায়গায় ভুট্টা আর ধান চাষের চেষ্টা করা হয়েছে। ফসল পেকে ঝরে গেছে অনেক আগেই, কেটে ঘরে তোলার চেষ্টা যে কেউ করেনি সেটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। জমিটা বহুদূরে ওইদিকে গিয়ে হঠাৎ নেই হয়ে গেছে, ওদিকে সম্ভবত একটা নদী আছে। হাতের ডানে প্রথমে খানিকটা ঘন ঝোপঝাড়, তারপর প্রায় একটা দুর্ভেদ্য দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘন জঙ্গলের প্রান্তভাগ। দিনের বেলাতেও ছায়া-ছায়া অন্ধকার সেখানটায়।
সন্দেহ নেই এটাই জগদানন্দপুরের খালিভিটা
“খালিভিটা,” বিড়বিড় করে বললো সামাদ। একটা গাছের নিচে দাঁড়ানোয় ওর অন্ধকার মুখটা আরো অন্ধকার দেখাচ্ছে।
“দেশের মানুষ রাতের বেলা কোথায় শুবে সেই জায়গা পায় না, আর এইখানে এতখানি জমি পড়ে থাকার কারণ?” পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে জিজ্ঞেস করলো শিপলু।
“যুদ্ধের আগে এই সবই চাষের জমি আছিলো,” মফিজ দারোগা চোখ কুঁচকে আছে, সেটা শরতের তীব্র রোদের কারণে হতে পারে। “খান সেনারা যখন গেল, এই সব জমি নেওয়ার মতো কাঁয়ো বাঁচি ছিলো না। বুঝলেনসাহেব?” শিপলুর বাড়িয়ে দেয়া প্যাকেট থেকে তিনটা সিগারেট বের করে নিলো সে। শিপলুর ভুরু দুটো ওপরে উঠে গিয়েই আবার নেমে গেল। “বাইশ বছর যাবত পড়ি আছে। মাঝে মাঝে কাঁয়ো কাঁয়ো চাষ করার চেষ্টা করে। এইবারও করছিলো। কিন্তু ফসল কাটার আগেই পিচাশটার উৎপাত শুরু হইলো। যা ধান ভুট্টা হছিলো সব জমিতে পড়ি আছে, দ্যাখেন না? কাটি নিয়া যাওয়ার সাহস নাই কারো।”
“আর জঙ্গল?” আঙুল তুলে দেখালাম। “আমাজনের ছোটভাই মনে হচ্ছে।”
“এই গ্রামের সবচেয়ে বুড়া লোকটার নাম হইলো পচা শেখ,” সিগারেট ধরিয়ে নিয়ে বললো মফিজ দারোগা। কথা বলার সময় ভকভকিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে তার নাক মুখ দিয়ে। “একশো বিশ বছর বয়স। তাক জিজ্ঞাস করছিলাম এই জঙ্গল কখন থাকি আছে। সে কইছিলো সে জানে না, কিন্তু তার দাদারা যখন এইদিকে বাড়ি বানায়, তখন থাকিয়া এই জঙ্গলটা দেখতেছে। যখন এই এলাকাত মানুষ থাকতো না,সাহেব, তখনো এই জঙ্গল ছিলো।”
“মানুষ কেটে সাফ করে না কেন?”
মফিজ দারোগা এমনভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমার মাথাটা গেছে, এই মুহূর্তে আমাকে হেমায়েতপুরে পাঠিয়ে শক ট্রিটমেন্ট শুরু করা দরকার। “কী যে কনসাহেব! মাইনষের জানের ভয় নাই?”
“জানের ভয় মানে?”
“এই জঙ্গলোত ঢুকিয়া আইজ পর্যন্ত কেউ বত্তা বাইর হইতে পারে নাই। “ থমথমে গলায় বললো মফিজ দারোগা।
বত্তা শব্দটার মানে নিশ্চয়ই জীবিত। কী আর বলবো এই কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোককে? কেবল বললাম, “তাই নাকি?”
“হ।” গম্ভির মফিজ দারোগা কষে টান দিলো সিগারেটে, সুঁচালো বানিয়ে ফেললো সিগারেটের সামনের আগুনটাকে। তারপরই এক কাঠুরের গল্প শুরু করলো, পেটের দায়ে পড়ে সাহস করে এই জঙ্গলে কাঠ কাটতে ঢুকে কি বীভৎস মৃত্যু হয়েছিল তার। এইধরণের গল্প দেশের সব গ্রামের মানুষের ঝুড়িতেই একটা-দুইটা আছে, শিপলুর সাথে ঘুরে জানা হয়ে গেছে আমার। কাজেই কান দিলাম না বড় একটা। হুঁ-হাঁ করতে করতে বরং চারপাশটা দেখে নিতে লাগলাম যতদূর সম্ভব। কারণ পাগলা জন্তুটা যদি কোথাও থেকে থাকে তো সেটা নিশ্চিতভাবেই এই জঙ্গল। জায়গাটার সাথে ভালোভাবে পরিচিত হওয়াটা খুবই দরকার।
হাতের বামের পতিত জমিটা জরিপ করার দরকার আছে কি? আছে, কারণ ওটার বেশিরভাগ জায়গা ঢাকা ঘন ভুট্টা গাছের সারির আবরণে। বেশিরভাগ গাছই মরে শুকিয়ে ঝুনো হয়ে গেছে। ভুট্টা পেকে-টেকে মাটিতে পড়ে একাকার। ওইখানে জানোয়ারটার আস্তানা থাকতেই পারে। ভুট্টার খেতকে বন ভেবে নিয়ে সেখানে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানানো একটা শেয়ালের জন্য খুবই সম্ভব। মেছোবাঘ হয়তো পছন্দ করবে না। তার জন্য ভালো জায়গা হবে উল্টোদিকের বনটা। মফিজ দারোগা তো বলছেই, গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষজন জঙ্গলের এদিকটায় মোটেই আসে না। ওইদিকেই মনোযোগ দেয়া যাক।
মফিজ দারোগাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে জঙ্গলের কিনারায় হাটাহাঁটি শুরু করলাম আমি। গোটা জিনিসটা কতটা জায়গা জুড়ে আছে, তার আন্দাজ পাবার চেষ্টা করছি। আর ভাগ্যক্রমে কোনো ট্র্যাক পাওয়া গেলে তো কথাই নেই।
যেন আমার হয়েই সামাদ নিচু গলায় প্রশ্ন করলো, “বনটার সাইজ কেমন হবে?”
“চাইর-পাঁচ কিলোমিটার হইবে,” মফিজ দারোগা গম্ভির গলায় বললো। তার গল্পে আমার কান না দেবার ধৃষ্টতা নিশ্চয়ই হজম করতে বেগ পেতে হচ্ছে তার। “এইপাকে দেখেন। ভুট্টার জমিটা ওইদিক যায়া আর নাই, দেখেন? ওইপাকে একটা ছোট নদী আছে। ঘাঘট নদী। নদীটা ওইপাকে যায়া একটা বাঁক নেছে। জঙ্গল এপাকে শুরু, ওপাকে নদীর সাইড পর্যন্ত যায়া শ্যাষ। নদীর ওইপাড়ে আবার আছে শ্মশানঘাট।”
“এই পতিত জমিটা, যেখানে এখন ভুট্টাখেত, সেখানে বোধহয় গণকবরও আছে, তাই না?” শিপলুকে বলতে শুনলাম।
জঙ্গলের সামনে অগোছালোভাবে বেড়ে ওঠা ঝোপঝাড়ের মধ্যে একটা জায়গার ঘনত্ব একটু অদ্ভুত মনে হলো। সেইদিকে এগিয়ে গেলাম আমি। কাঁধে স্ট্র্যাপে ঝোলানো ছিল রাইফেল, সেটা এখন নামিয়ে হাতে নিলাম আমি।
“হ।” অবাক গলায় বললো মফিজ দারোগা। “আপনি জানলেন কেমন করি?”
“অনুমান করলাম।” তৃপ্ত স্বরে বললো শিপলু। “উত্তরাঞ্চলের মানুষ সহজ-সরল বটে, কিন্তু ফাঁকা পড়ে থাকা চাষের জমি দখল না করে ফেলে রাখার মতো বোকা নিশ্চয়ই নয়। যেটুকু ভুট্টাগাছ আছে তা দেখলে বোঝা যায়, কয়েকটা জায়গা সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে চারা পোঁতা হয়েছে। যেসব জায়গায় ভুট্টা গাছ নেই সেগুলো খুঁড়তে গিয়ে কঙ্কাল বেরিয়ে এসেছিল নিশ্চয়ই, আর সেজন্য জমিটার পুরো দখল নেয়নি কেউ, পতিত পড়ে আছে।”
“হুম।” বললো মফিজ দারোগা। “নদীর সাইডে মানুষ দাঁড়া করায়া গুলি করি মারছিলো পাকিস্তানি শোহোরের বাচ্চারা। কিছু লাশ পানিত ভাসি গেছিল। যেইগলা যায় নাই, সেইগলা গ্রামের মানুষেই মাটিত গর্ত করি পুঁতি থুছিল।”
দোমড়ানো ঝোপটার কাছে গিয়ে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল আমার। ঝোপটার মাঝ দিয়ে একটা ট্রেইল দেখা যাচ্ছে। সন্দেহ নেই এইদিক দিয়ে কোনো কিছু চলাফেরা করে। নিয়মিত চলাফেরা করে। কারণ ঝোপটার মাঝের ফাঁকটা একদিনে তৈরি হয়নি।
নিজের হাতের দিকে তাকালাম আমি। কাঁপছে ওটা। বেশ কয়েকবছর আগে থেকে এই সমস্যা আমার, সেই কমনওয়েলথের বাছাইতে বাদ পড়ার পর থেকে।
সব সমস্যারই সমাধান থাকে। আমার সমস্যারও আছে। আমি রাইফেলটা দ্রুত কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে পকেট থেকে আমার চ্যাপ্টা ফ্লাঙ্কটা বের করে ছিপি খুলতে শুরু করলাম।
সঙ্গে সঙ্গে আমার হাতটা বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরলো কে যেন। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখি কখন যেন ঠিক আমার পেছনে হাজির হয়েছে মফিজ দারোগা। লোকটা বেড়ালের মত নিঃশব্দে চলাফেরা করে দেখছি।
“করেন কি!” দম আটকানো বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো সে। চোখদুটো যেন ঠিকরে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে ওর। “মদ খাইতেছেন! করতেছেন কি ভাই!”
আমি কোনো রকম ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যে গেলাম না। “হাত ছাড়ন!”
“ছাড়বো মানে!” পাল্টা চেঁচিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা। “আপনি কোন কাজে এইখানে আসছেন ভাই? মাল খায়া কি সেই কাজ হয়?”
“আপনি আমার হাত ছাড়বেন কিনা বলেন।” আমি শান্ত কণ্ঠে বললাম। “আপনার কাজ আপনি করেন, আমার কাজ আমাকে করতে দিন।”
“আশ্চর্য!” খেঁকিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা। “আপনি মাতাল অবস্থায় একটা বন্দুক নিয়া গ্রামের মধ্যে বেড়াইবেন, আবার কইবেন আপনার কাজ আপনি করতেছেন? মাইনষের সেফটির দিকটা আমাক দেখতে হবে না?” আর এই কথাটা বলার পরপরই ঝিকিয়ে উঠলো তার চোখদুটো। “আপনার বন্দুকের লাইসেন্স তো দেখি নাই! লাইসেন্স আছে তো? লাইসেন্স দেখান! যতক্ষণ না লাইসেন্স দেখাইবেন ততক্ষণ ছাড়বো না!”
জানি দারোগার কথায় যুক্তি আছে, একজন পুলিশ অফিসার সিভিলিয়ানের বন্দুকের লাইসেন্স দেখতে চাইতেই পারে, কিন্তু এ-ও আমার জানা আছে মফিজ দারোগা ঠিক এই মুহূর্তে লাইসেন্স দেখতে চাইছে আমাকে অপমান করার জন্য, আর কিছু নয়। নাহলে কথাটা আগেও তুলতে পারতো সে, বন্দুকটা প্রথমবার বের করার সময়ই। তাছাড়া এই গ্রামে এসেছিই তো শিকার করতে মফিজ দারোগার কালচে গোল আলুর মত মুখটা বেপরোয়া দাপটে কুঁচকে আছে দেখে রাগে অন্ধ হয়ে যাবার অবস্থা হলো আমার। কোথাকার কোন পাণ্ডববিবর্জিত থানার দু-পয়সার দারোগার এত তেজ-স্রেফ এটা তার এলাকা, এইজন্য? মনে হলো যেন আমার হাত না, আমার কলার ধরে আছে লোকটা। আমি বরফ শীতল গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, “দারোগাসাহেব, হাত ছাড়েন, নইলে ভালো হবে না।”
“জামশেদ!” হঠাৎ ঘড়ঘড়ে গলায় চেঁচিয়ে উঠলো শিপলু।
শিপলু আর সামাদ এতক্ষণ চোখ ছানাবড়া করে কান্ডকীর্তি দেখছিল, কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না। আমাকে চটানোর সাহস ওদের নেই, আবার দারোগার কথার পাল্টা জবাব কিভাবে দেবে, সেটাও নিশ্চয়ই মাথায় আসছিলো না। কিন্তু শিপলুর গলা দিয়ে এমন শব্দ বেরোতে শুনিনি কখনো ঝট করে ওর দিকে মাথা না ঘুরিয়ে পারলাম না।
কাঠের পুতুলের মত আড়ষ্ট ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে শিপলু আর সামাদ, চোখ বিস্ফোরিত। শিপলুর একটা হাত সামনের দিকে তোলা, কাঁপছে ওটা, তর্জনিটা নির্দেশ করছে আমার পেছনের কোনো কিছুর দিকে।
মফিজ দারোগা হুমকির সুরে কিছু একটা বলছিলো, কিন্তু সেদিকে কান নেই আমার, ঝট করে মাথা ঘোরালাম শিপলু যেদিকে দেখাচ্ছে সেদিকে।
মফিজ দারোগা আমার সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু করার আগে যে-ট্রেইলটা খুঁজে পেয়েছিলাম, সেটার গোড়াতেই এখন দাঁড়িয়ে আছি আমি। শিপলু দেখাচ্ছিল ওইদিকেই। ওদিকে তাকিয়ে প্রথমে কিছুই চোখে পড়লো না আমার-এতক্ষণ রোদ- ঝলসানো খালিভিটার দিকে তাকিয়ে থাকায় জঙ্গলের ছায়া-ছায়া অন্ধকারে ভালোমত কিছু দেখতে পারছি না। আর তার এক সেকেন্ড পরেই অবয়বটা চোখে পড়লো।
চারপেয়ে কোনোকিছুর অবয়ব। আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে ওটা। আর এইদিকে আমার বন্দুক-ধরা হাত আটকা পড়ে আছে দুর্নীতিবাজ এক পুলিশের হাতে। আরেক হাতে মদের ফ্লাঙ্ক।
জানোয়ার ঠিক কি, সেটা বুঝতে পারছি না আমি, কিন্তু বুঝতে পারছি গুঁড়ি মেরে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে ওটা, আর ওটার গলার গভির থেকে বেরিয়ে আসছে একটা ঘড়ঘড়ে শব্দ
মফিজ দারোগা কিছুই দেখেনি, কিছুই জানে না। ঘৃণায় বিকৃত মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে, লোহার সাঁড়াশির মত শক্ত হাতে ধরে আছে আমার হাত।
আমি ঝটকা দিলাম একটা, কিন্তু ছাড়িয়ে আনতে পারলাম না আমার হাত। শিপলু আর সামাদ চেঁচাচ্ছে মফিজ দারোগার উদ্দেশে, কিন্তু ওরা তো আমারই লোক, তাদের কথায় আমার হাত কেন ছাড়বে সে?
জানোয়ারটা খুব কাছে এগিয়ে আসছে। ওটার ঘড়ঘড় শব্দটা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি এখন-আমার থেকে দশ ফুট দূরেও আর নেই ওটা।
“ছাড়েন বলছি!” মফিজ দারোগার মুখের ওপর চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। “আপনি বুঝতে পারছেন না-”
“কি বুঝবার পারতিছি না?” পাল্টা খেঁকিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা। “লাইসেন্স না দেখাইলে-”
মরিয়া হয়ে প্রচন্ড একটা ঝটকা দিলাম আমি, কোনোমতে ছাড়িয়ে আনলাম আমার হাত, একই সাথে ঘুরে গেলাম বামদিকে, জানোয়ারটা আছে ওদিকেই।
রাইফেলটা শুধুই ডানহাতে ধরা আমার, কিন্তু একহাতে গুলি করতে পারবো না, সম্ভব না। বাম হাতে ধরা মদের ফ্লাঙ্কটা ফেলে দিয়েই রাইফেল ধরলাম, বামে ঘুরছি এখনো। রোদে ধাঁধানো চোখে পরিস্কার দেখতে পাচ্ছি না বলে প্রচন্ড অসহায় লাগছে নিজেকে।
আমার আধপাক ঘোরাটা সম্পূর্ণ হয়েছে, জানোয়ারটার মুখোমুখি এখন আমি। কেবল আউটলাইনটা দেখতে পাচ্ছি ওটার, আর তাতেই বুঝতে পারছি, এক্ষুণি ঝাঁপ দেবে।
রাইফেলের বাটটা কাঁধে ঠেকতে না ঠেকতেই ট্রিগার টানলাম আমি।
অধ্যায় ৯ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ৯ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
কান ফাটানো সনিক বুম, ব্যারেলের ডগায় আগুনের ঝলকানি, পোড়া করডাইটের গন্ধ আর কাঁধে তীব্র রিকয়েল।
গুলি লেগেছে কি-না দেখার সময় নেই, যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে ঝটকা দিয়ে পাশে সরে গেলাম আমি আগে, কারণ গুলি মিস হয়ে থাকলে ঠিক এখনটাতেই হামলে পড়বে জানোয়ারটা। হাতদুটো কাঁপছে আমার, জানি, কিন্তু সেটাকে পাত্তা দেবার সময় এখন নয়, জামশেদ, চেম্বারে একটা গুলি এখনো আছে-পাশে সরতে সরতে বোল্টটা টানো তুমি। হ্যা, এইতো। হাত কাঁপছে? ব্যাপার না, পাত্তা দিও না। এবার কাঁধে রাইফেলটা তোলো আবার, রোদে ধাঁধানো চোখ নিয়েই দেখার চেষ্টা করো জানোয়ারটা কোথায়, তোমার প্রথম গুলিটা লেগেছে কি- না।
যে জায়গায় জানোয়ারটা লাফিয়ে এসে পড়বে ভেবেছিলাম, সেখানেই রাইফেলটা তাক করলাম আগে। নেই।
ঝট করে রাইফেল ঘোরালাম ঝোপের ফাঁকটার দিকে। এইমাত্র কি কোনোকিছুকে ঝোপঝাড় ভেঙে উল্টো দিকে দৌড়ে যেতে শুনলাম? নাকি সবটাই আমার কল্পনা? গুলির শব্দে ঝালাপালা কানে ভুল শুনছি না তো?
ঝোপের ফাঁকটা দিয়ে ট্রেইলের ভেতরের দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলাম দ্রুত। রাইফেল তৈরি, চোখ মাটির দিকে। ছায়ার ভেতরে চলে এসেছি, কম আলোর সাথে চোখ মানিয়ে নিচ্ছে দ্রুত।
কয়েক ফুট জায়গা খুঁজতেই চোখে পড়লো জিনিসটা। এক গুচ্ছ লোম। বাদামি- খয়েরি রং। আর তার পাশেই শুকনো পাতার ওপর পানের পিক ফেলার মত একটা দাগ।
রক্তের ছোপ।
জিনিসটাকে গুলি লাগাতে পেরেছি আমি।
শিপলু চলে এসেছে পেছন পেছন। লোমগুলো হাতে তুলে নিলো ও ঝুঁকে পড়ে। “মসৃণ, মিহি, দেড় থেকে দুই ইঞ্চি লম্বা। কি মনে হয় রে, কিসের লোম?”
“রং দেখে মনে হচ্ছে শেয়ালের,” শিপলুর হাতের তালুতে রাখা লোমগুলোর দিকে একঝলক তাকিয়ে আবার সামনে চোখ রাখলাম আমি রাইফেলের সাইটের মধ্য দিয়ে। জানোয়ারটা ফিরবে এমন সম্ভাবনা নেই, জানি, তবু সাবধানের মার নেই। আশপাশের ঝোপক’টা জরিপ করছি তীক্ষ্ণ চোখে। হাত কাঁপছে আমার, তবু প্রাণপণে চেষ্টা করছি যাতে রাইফেলটা সোজা থাকে।
কোথাও কোনো নড়াচড়া চোখে পড়লো না। বাতাসে মৃদু কাঁপছে কেবল কয়েকটা ঝোপ। গুলির শব্দে তল্লাটের সব পাখি গাছের ডাল ছেড়ে আকাশে পাখা মেলেছিল, এখন সেগুলো সাহস করে একটা দুটো করে ফিরতে শুরু করেছে, আর উত্তেজিত স্বরে কিচিরমিচির করে জানতে চাচ্ছে- “ঘটনা কি? কে কাকে গুলি করে? ব্যাপার কি?”
জানোয়ারটা পালিয়েছে নিশ্চিত হবার পরে রাইফেল নামিয়ে নিলাম আমি, কাঁধে ঝোলালাম স্ট্র্যাপে করে। ঘুরলাম তারপরে, গটগট করে সোজা হেটে গেলাম মফিজ দারোগার সামনে। তার একেবারে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম আমি, কেবল দুইঞ্চি ফারাক থাকলো লোকটার ভুঁড়ির সাথে আমার পেটের। নাকের সাথে নাক প্রায় লাগিয়ে দিয়ে চোখের দিকে তাকালাম আমি ভষ্ম করা দৃষ্টিতে। “আমার কাজে নাক গলাতে আসার ফলটা কি হলো দেখলেন তো?” ঠান্ডা গলায় বললাম আমি। “লাগাতে পারলাম না। আর তার পুরো দোষটাই আপনার। নেক্সট টাইম এরকম আর না হয় যেন। বোঝা গেল?” বলেই ঝট করে মুখ ঘুরিয়ে আবার ফেরত গেলাম ট্রেইলের দিকে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব মফিজ দারোগা কাতল মাছের মত মুখটা কয়েকবার খোলা-বন্ধ করলো কেবল, কোনো শব্দ বের হলো না গলা দিয়ে।
সামাদও পায়ে-পায়ে এগিয়ে এসেছে রক্তের ছোপওয়ালা জায়গাটার দিকে। শিপলু মাটিতে উবু হয়ে বসে খুঁটিয়ে দেখছে আশপাশটা। আমি মাটি থেকে আমার মদের ফ্লাঙ্কটা কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ওদের পাশে।
“কি মনে হয়, কতটুক ঘায়েল হয়েছে?” সামাদকে জিজ্ঞেস করলাম আমি, সেই সাথে এক ঢোক তরল পেটে চালান করে দিলাম ফ্রাঙ্কটা থেকে। সামাদের ডাক্তারি নলেজ এই ব্যাপারে কাজে লাগবে ভালো।
জবাব দিল না সামাদ। তার বদলে শিপলুর সাথে যোগ দিলো ভূমি জরিপে। ওর এই অভ্যাস অবশ্য পুরনো-কোনো ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে মুখ খোলে না ও কক্ষণো। বিরক্তিটা চেপে রেখে আরো বড় দু’ঢোক হুইস্কি খেয়ে নিলাম। গলা দিয়ে আগুন ধরাতে ধরাতে নেমে গেল যেন তরলটুকু।
আগে মুখ খুললো শিপলুই। “এইদিকে আরো রক্তের ছোপ আছে। জঙ্গলের ভেতরের দিকে চলে গেছে। বেশ পরিষ্কার ট্রেইল।”
সামাদও উঠে দাঁড়ালো। “খবর ভালো না, জামশেদ ভাই। বড়জোর ফ্লেশ উন্ড। মাংস ফুটো করে বের হয়ে গেছে গুলি, ক্রিটিক্যাল স্ট্রাইক করতে পারেনি। কিংবা ভাগ্য খারাপ হলে স্রেফ চামড়া ছিঁড়েছে খানিকটা, লোম উঠেছে, আর তেমন কিছু হয়নি।”
“হুম।” ফ্লাঙ্কে আরেকটা চুমুক দিলাম। “তোরা কেউ ভালো করে দেখতে পেরেছিস, জিনিসটা কি? আমার চোখ রোদে এমন ধাঁধিয়ে গিয়েছিল, আর এত তাড়াতাড়ি সব হয়ে গেল যে ভালোমত দেখারও চান্স পাইনি।”
“সেম হিয়ার,” শিপলু বললো, “ঝোপের অন্ধকারে কেবল ওটার অবয়বটা দেখতে পাচ্ছিলাম। কোনো ডিটেইলস চোখে পড়েনি।”
“যতটুকু মনে হয়েছে, শেয়াল একটা,” নিচু গলায় বললো সামাদ, “অস্বাভাবিক রকম বড় একটা শেয়াল।” এক মুহূর্ত থামলো ও। “তারমানে যা ভেবেছিলাম। র্যাবিসওয়ালা শেয়াল।”
হঠাৎ নিজের হাতের ওপর চোখ পড়লো আমার। এতক্ষণ তিরতির করে কাঁপছিলো ওগুলো, এখন ঠিক হয়ে এসেছে। কাঁপছে না একদম। সম্পূর্ণ আমার নিয়ন্ত্রণে এখন ওগুলো। ঠিক এইরকম স্টেডি হাত নিয়েই ‘৮৮ সালের সাফ গেমসে সোনা জিতেছিলাম টেন মিটার এয়ার রাইফেল ইভেন্টে।
সাথে সাথে আমার মাথার ভেতরে কে যেন বলে উঠলো, যা করার এখনই করে ফেল। এই মুহূর্তে।
ফ্লাঙ্কটার ছিপি বন্ধ করে কোমরে গুঁজে কাঁধ থেকে রাইফেলটা নামালাম আমি। চেম্বারে থাকা বুলেটটা চেক করলাম, তারপর বেল্টের সাথে লাগানো পকেট থেকে কাট্রিজ বের করে লোড করলাম রাইফেলে। বোল্ট টানলাম কান জুড়ানো ক্লিক শব্দে।
এতক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে ছিল শিপলু, শব্দ পেয়ে অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে। “ব্যাপার কি?”
“শেয়ালটার পেছন পেছন যাচ্ছি।”
চোখ বড়বড় করে ফেললো শিপলু। “পাগল হলি নাকি? আহত একটা বুনো জানোয়ারের পিছু নিবি এই জঙ্গলের মাঝে?”
“ওটা জাস্ট একটা শেয়াল, শিপলু।” শান্ত গলায় বললাম।
“র্যাবিসওয়ালা শেয়াল,” রুক্ষ গলায় শুধরে দিলো শিপলু।
“স্টিল, জাস্ট আ ফক্স,” বললাম আমি। “রক্তের ট্রেইল তো আছেই। সেটা ধরে এগিয়ে গেলেই চলবে। মনে হয় না বেশিদুর গেছে।”
“ওটার র্যাবিস হয়েছে, জামশেদ ভাই,” সামাদ বললো নিচু গলায়। “ওটা এমনিতেও আর বাঁচবে না।”
“আর তার আগে যদি আরেকটা মানুষকে মেরে রেখে যায়?” আমি খেঁকিয়ে উঠলাম
অকাট্য যুক্তি। চুপ হয়ে গেল সামাদ-শিপলু।
আমি গোড়ালিতে ভর করে পাঁই করে ঘুরলাম জঙ্গলের দিকে। “তাহলে আর কি? আমি যাচ্ছি ওটার পেছনে। ওটা বেশিদূর গেছে বলে মনে হচ্ছে না। এ স্টিচ ইন টাইম সেভস নাইন।”
সামাদ খুব সাবধানে একটা হাত তুললো। “জামশেদ ভাই, এখন আপনার যাওয়া ঠিক হচ্ছে না, মানে, আপনার বোধ হয়…”
“তুই বলতে চাচ্ছিস আমি বেশি গিলে ফেলেছি?” মুখ খিঁচিয়ে বললাম আমি। “তোর মাথা! এই মুহূর্তে আমার নিশানা যতটা সোজা আছে ততটা যদি…” কমনওয়েলথের বাছাইপর্বের তিক্ত অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেল আমার। মাথা ঝাঁকি দিয়ে ব্যাপারটা ভুলে থাকার চেষ্টা করলাম। “তোরা এখানে অপেক্ষা কর। আমি যাবো আর আসবো।”
রাইফেল বাগিয়ে জঙ্গলের ভেতর দিকে যাওয়া শুরু করলাম আমি। যাবার আগে শেষবার পেছনে তাকিয়ে দেখলাম, নার্ভাস ভঙ্গিতে জঙ্গলের কিনারায় দাঁড়িয়ে আছে শিপলু আর সামাদ, আর তাদের বেশ কিছুটা পেছনে থুতনিতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মফিজ দারোগা, গভিরভাবে চিন্তা করছে কোনোকিছু। দুইচোখে কুটিল দৃষ্টি, সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
জঙ্গলের ভেতরটা চুপচাপ, আর অন্ধকার।
আমার কাঁধে রাইফেলটা তোলা। আঙুল ট্রিগারে। সম্পূর্ণ প্রস্তুত আমি।
সতর্ক দৃষ্টি চালাচ্ছি চারপাশে। বেশ ঘন জঙ্গলটা—মোটা মোটা গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে কোনো প্রাচীন গ্রীক স্থাপত্যের থামের মতো, তাদের পেঁচিয়ে ওপরে উঠে গেছে লতা পাতা, আর তার গোড়ায় ঝোপ-ঝাড়ের রাজত্ব।
মাথা ওপরে তুললাম আমি। আকাশ ঢাকা পড়ে আছে উঁচু গাছগুলোর পাতার চাঁদোয়ায়। সেগুলোর ফাঁকফোকর দিয়ে উজ্জ্বল আকাশের ছিটে ফোঁটা দেখা যাচ্ছে। চারপাশটা ওইজন্যেই ছায়া-ছায়া অন্ধকার।
আমার চোখ এখনো মানিয়ে নেয়নি অন্ধকারের সাথে। দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি, চেপে বন্ধ করে রাখলাম চোখ দুটো কয়েক সেকেন্ড। তারপর খুললাম আবার। হ্যা, এবার কাজ চালানোর মত দেখা যাচ্ছে চোখদুটো দিয়ে।
কোথায় যেন একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকা একটানা ডেকে যাচ্ছিলো, এইমাত্র চুপ করলো ওটা।
আমি বোঝার চেষ্টা করছি ট্রেইলটা কোনদিকে গেছে। দেখলেই বোঝা যায়, বড় কোনো জন্তুর চলাচলে তৈরি হয়েছে ট্রেইলটা। মানুষের তৈরি হতে পারে কি? না, মফিজ দারোগা জোর দিয়ে বলেছে এ জঙ্গলে কেউ আসে না। সে লোকাল লোক, তার কথা সত্য হবার সম্ভাবনা বেশি। তাহলে বন্য জন্তুর অপশনটাই বাকি থাকলো। আর এই জঙ্গলে বন্য জন্তু বলতে শেয়ালই হতে পারে, আর কোনো কিছু হবার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হচ্ছে না। তো ধরে নেওয়াই যায় এই পথেই শেয়ালটা গেছে।
কান খাড়া রেখে ধীরে ধীরে মাটিতে বসলাম আমি হাটু ভাঁজ করে। মাটি বলতে মাটি নয় আসলে—সবকিছুতে শুকনো পাতা আর শ্যাওলার পুরু আস্তরণ। সেগুলো জরিপ করতে লাগলাম চোখ সরু করে। যা চাচ্ছি সেটা পেতেও সময় লাগলো না। তাজা রক্তের দাগ, সাদা হয়ে যাওয়া একটা পাতার ওপর ফুটে আছে পরিষ্কার হয়ে। হ্যা, শেয়ালটা এদিক দিয়েই গেছে।
আমি উঠে দাঁড়ালাম আবার। ধীরে ধীরে সামনে এগোতে শুরু কললাম আগের মত।
কাজটা সহজ নয়। একবার মাটির দিকে চোখ রাখতে হয়-রক্তের দাগ চেক করার জন্য, আরেকবার আবার চোখ রাখতে হয় সামনে।
শেয়ালটা কি আরো কোনো দাগ রেখে যাচ্ছে? না, পায়ের ছাপ সম্ভব না। পাতাগুলো শুকনো। সেগুলোতে পা রেখে চাপ দিয়ে পা আবার তুলে নিলে সেগুলো আবার আগের অবস্থায় চলে যায়।
আশেপাশের ঝোপের ভাঙা ডাল? না। শেয়ালটা এদিক দিয়ে নিয়মিতই আসা যাওয়া করে। ডাল যা ভাঙার আগেই ভেঙেছে। তাজা কোনো ভাঙা ডাল পাওয়া যাবে না।
শেয়ালটা মরে সামনে কোথাও পড়ে আছে, এই সম্ভাবনা আছে কি? মনে হয় না। সামাদ যা বললো সেটাই মানতে হচ্ছে, কারণ ও ডাক্তার, কাটা-জখমের ব্যাপারে ও-ই বেশি জানে। আমি শেয়ালই চোখে দেখছিলাম না, শেয়ালের কোথায় গুলি লেগেছে সেটা তো দূরের ব্যাপার।
শেয়ালটা ঘুরে পাল্টা অ্যাটাক করতে পারে, এই সম্ভাবনাটা হঠাৎ মনে পড়লো আমার।
একটা সুস্থ শেয়াল কখনো একজন মানুষকে ঘুরে আক্রমণ করবে না। কিন্তু র্যাবিসের জীবাণুভয়ংকর। আক্রান্ত প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্র বিগড়ে দেয় ওরা। প্রচন্ড যন্ত্রণায় মৃত্যুর অপেক্ষা করতে থাকা জীবটা তখন পরিণত হয় ওদের কন্ট্রোল করা জোম্বিতে যাকে সামনে পায়, তাকেই কামড়ে দেবার চেষ্টা করে। কারণ র্যাবিসের জীবাণু তখন কামড়ের মাধ্যমে আরেকটা দেহে ছড়ানোর সুযোগ পায়! ভয়ংকর ব্যাপার। সামাদের কাছে যখন প্রথম শুনেছিলাম তখন গা রি-রি করে উঠেছিল।
সমস্যা নেই, যেমন কুকুর তেমন মুগুর। শেয়ালটার র্যাবিস আক্রান্ত মাথাটা আক্ষরিক অর্থেই উড়িয়ে দেবার মত ফায়ারপাওয়ার আমার বন্দুকের আছে।
আরেকটু এগোতেই কানে পড়লো শব্দটা। থমকে গেলাম আমি।
কিসের শব্দ? শেয়ালটা—
আমার চিন্তার সুতো ছিঁড়ে গেল শব্দটা আবার হওয়াতে। দম আটকে ফেললাম আমি। কানে কি ভুল শুনছি?
ফিসফিসানির শব্দ! এই জঙ্গলে ফিসফিস করবে কে?
বিভ্রান্ত আমি পেছনে তাকালাম একবার। আমার সাথীদের কেউ শব্দ করছে না তো? সাথে সাথেই অবশ্য বাতিল করে দিলাম চিন্তাটা। ওরা অনেক পেছনে পড়ে গেছে। আর তাছাড়া ওরা আমাকে কিছু বলতে হলে ফিসফিস করবেই বা কেন?
আবার!
ফিসফিসানিটা শুনতে পেলাম আবারও।
ওটার উৎসটা কোথায় বোঝার জন্য মাথা ঘোরাতে গিয়ে বোকা বনে গেলাম। শব্দটা চারদিক থেকেই আসছে বলে মনে হচ্ছে।
যেন আমার চারপাশ ঘিরে ফিসফিস করছে অদৃশ্য কেউ
তীক্ষ্ণ চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি আমি। না, কোথাও কেউ নেই।
ঠিক যেন মনে হচ্ছে আমার মাথার ভেতরে ফিসফিস করছে কেউ।
কথাটা মনে পড়তেই থমকে গেলাম।
গত কয়েকদিনে অদ্ভুত সব ব্যাপার হয়েছে আমার সাথে। বাবার মৃত্যুর পরে। সামাদের কাছে স্বীকার না করলেও, ব্যাপারটা যে কোনো না কোনো রকমের মানসিক সমস্যা, সেটা জানি আমি। এবং এটাও জানি, সমস্যাটা ক্রমশ বাড়ছে। আমি যতই ঢেকে রাখার চেষ্টা করি না কেন।
এটাও নতুন কোনো সিম্পটম নয়তো?
আবার শুনতে পেলাম ফিসফিসানিটা। অদ্ভুত আর খাপছাড়া সব স্বপ্ন দেখা। নিজের মেজাজের ওপর যে সামান্য নিয়ন্ত্রণটুকু ছিলো সেটাও হারানো। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে সেই অদ্ভুত ভিজিট
গোলাগুলির পরে প্রায় আঠারো ঘন্টার অ্যামনেশিয়া।
গাড়ির মধ্যে ঘুম ভাঙার আগে দেখা আরেকটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন।
আবার শোনা যাচ্ছে ফিসফিসানি। কিন্তু এটাকে তো বড় বেশি বাস্তব লাগছে। আর এখন ওটাকে চারপাশে না, একটা নির্দিষ্ট দিকেই শুনতে পাচ্ছি। আমি আস্তে আস্তে চলতে শুরু করলাম শব্দটার উৎস আন্দাজ করে।
নিচের দিকে তাকিয়ে দেখে নিলাম একবার। এক ফোঁটা রক্ত। শেয়ালটাও এদিকেই গেছে।
তাহলে শব্দটা লক্ষ্য করেই এগোনো যাক। শব্দটা যেন আমাকে টেনে নিয়ে যেতে চাচ্ছে কোনো দিকে। আমি সতর্ক পায়ে যতই এগোচ্ছি, শব্দটার জোর যেন ততই বাড়ছে। এখন মনে হচ্ছে একটা কন্ঠ নয়, অনেকগুলো কন্ঠ ফিসফিস করছে ওদিকে।
মন্ত্রমুগ্ধের মত এগিয়ে চললাম আমি। শরীরের প্রত্যেকটা পেশি টানটান, রাইফেল কাঁধে, হাত ট্রিগারে। মাটির দিকে চোখ রাখছি মাঝে মাঝে। জঙ্গলে ঢোকার পর প্রায় বিশ পঁচিশ মিনিট কেটে গেছে অল্প আলোর সাথে একদম মানিয়ে নিয়েছে আমার চোখ। পরিষ্কার দেখতে পারছি এখন সবকিছু। মাঝে মাঝে একটা দুটো রক্তের ফোঁটা চোখে পড়ছে এখনো।
ফিসফিসানিটা বাড়ছে, বাড়ছেই। বাড়তে বাড়তে ফুল ভলিউমে ছাড়া আনটিউনড রেডিওর হোয়াইট নয়েজের মত তীব্রতা ধারণ করেছে ওটা-তিন চারটা কন্ঠ শুনতে পারছি আলাদাভাবে কিন্তু পরিস্কারভাবে বুঝতে পারছি না কি বলতে চাইছে ওগুলো।
আমার দুই কান জুড়ে ফিসফিসানিটা ছাড়া আর কিছু নেই।
সামনে জঙ্গলটা যেন অনেক ঘন হয়ে এসেছে একটা জায়গায়, এমন ঘন বুনটে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো যে ওগুলো পেরিয়ে কোনোকিছু দেখার জো নেই। ফিসফিসানিটা ওদিকেই টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। ওদিক থেকেই আসছে ফিসফিসানিটা।
এতক্ষণ ভ্যাপসা গরম লাগছিল আমার, ঘামছিলাম অল্প অল্প। কিন্তু আর কয়েক পা এগোতেই এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে।
হাঁড় কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া। যেন বরফের চাঁই ছুঁয়ে এসেছে বাতাসটা। আমি এগিয়ে চললাম ঘন, অন্ধকার জায়গাটার দিকে। কয়েক পা এগোতেই হোঁচট খেলাম কোনোকিছুর সাথে। জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে পড়লো আমার। জিনিসটা শ্যাওলা মাখানো, ভাঙা, এবড়োথেবড়ো-তবু পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, একটা ইঁট ওটা।
আমি চোখ তুললাম সামনে, আর চোখে পড়লো ভাঙা মন্দিরটা।
আসলো গোটা সময়টাই ওটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি, কিন্তু এমনভাবে গাছ, শ্যাওলা আর লতাপাতা জড়িয়ে আছে ওটাকে, যে চিনতেই পারিনি। মনে করেছিলাম জঙ্গলের ঘন অংশ
শিপলুর সাথে ঘুরতে বেরিয়ে যশোরে এরকম একটা মন্দির দেখেছিলাম। ভালোমত তাকাতেই গোটা অবয়বটা পরিস্কার ফুটে উঠলো চোখের সামনে। মন্দিরটার ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি নিশ্চয়ই-কারণ মুখ ব্যাদান করা একটা দরজাকৃতি ফাঁক দেখা যাচ্ছে আমার চোখের সামনে, ওটাই হয়তো ফটক ছিলো এককালে। ফটকের ওপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে মন্দিরের ওপরের গম্বুজটা। মুসলিম স্থাপত্যের গম্বুজ স্তনাকৃতি হয়, কিন্তু এটা ঘন্টার আকৃতির, তার মানে মন্দিরই বটে এটা। গম্বুজটার ওপরে গজিয়েছে বিশাল একটা বট না-হয় পাকুড় না-হয় অশ্বত্থ গাছ, শেকড় ছড়িয়ে দিয়েছে মাটি পর্যন্ত, যেন শিবের মাথার বিশাল জটা।
আরেক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া লাগলো আমার গায়ে। মন্দিরের ভেতর থেকেই আসছে ওটা। সাথে একটা ভ্যাপসা পচা গন্ধ। আর ফিসফিসানি। যেন পাগল হয়ে গেছে কণ্ঠগুলো। বলতে চাইছে আমাকে কোনোকিছু, কিন্তু পারছে না, কারণ ওদের কথা বলার ক্ষমতা নেই।
আমি নিচের দিকে তাকালাম। যেন আমাকে দেখানোর জন্যই এক ফোঁটা রক্ত পড়ে আছে ফটকের গোড়াতেই। বড় করে একটা শ্বাস নিলাম, তারপর ঢুকে পড়লাম ভেতরে। এতদূর এসে আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না। সাথে সাথে যেন নতুন সাড়া পড়লো ফিসফিসাতে থাকা কন্ঠগুলোর মাঝে। আর তার সাথে যোগ দিয়েছে আরেকটা নতুন শব্দ। অনেকগুলো মাছি ভনভন করলে যেমন শোনায়, তেমন।
আমার কানদুটো ঝালাপালা করে দিচ্ছে শব্দদুটো।
জঙ্গলের ভেতরটা এমনিতেই অন্ধকার, আর মন্দিরের ভেতর তো আলো ঢোকার কোনো উপায়ই নেই। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না কোনোকিছুই। আর কিছু না, স্রেফ আন্দাজের ওপর ভর করেই এগোচ্ছি আমি।
ভুল বললাম। শব্দটা যেন বশ করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাকে। আর তীব্র পচা গন্ধটাও।
মন্দিরে ঢোকার পরই প্রথমে একটা বড়সড় ঘরের মত জায়গায় পড়েছি আমি। এটার দু-পাশে দুটো ভাঙাচোরা জানালার মত আছে, সেটা দিয়ে যে আলো আসছে তাতে বুঝলাম এই ঘরটায় কেবল ঝোপঝাড় ছাড়া কিছু নেই। ঘরটার পেছনে আরেকটা দরজা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলাম সেটার দিকে।
সাথে সাথে শিউরে উঠলাম ঠান্ডায়। বাইরের চাইতে এই জায়গার তাপমাত্রা অন্তত দশ ডিগ্রি সেলসিয়াস কম বাড়িয়ে বলছি না।
বাতাসের আরেকটা ঝলক বয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ভক করে পচা গন্ধটা নাকে লাগলো। নাড়িভুড়ি পাক দিয়ে উঠলো আমার।
পেছনের দরজাটা দিয়ে একটা করিডোরের মত জায়গায় এসে পড়েছি আমি। প্রায় রাতের বেলার মত আঁধার এখানে। দু-পাশে আরো ঘর আছে, বুঝতে পারছি, কিন্তু সেগুলো দেখার কোনো প্রয়োজন মনে করছি না। আমি যত এগোচ্ছি,
ফিসফিসানির শব্দটা আরো জোরালো হচ্ছে। আমি জানি, যা থাকার, সামনেই আছে।
পচা গন্ধটাও বাড়ছে। আর বাড়ছে ঠান্ডা। যেন প্রতি পদক্ষেপে ধীরে ধীরে একটা ডিপ ফ্রিজের মাঝে সেঁধিয়ে যাচ্ছি আমি। ঠান্ডাটা অসহ্য হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে-মাংস ভেদ করে হাড়ে কামড় বসাচ্ছে যেন। মাঘের তীব্রতম শৈত্যপ্রবাহও এত ঠান্ডা হয় না।
আমার দাঁতে দাঁত লেগে খটখট শব্দ ওঠা শুরু হয়েছে। আমার নাক-মুখ দিয়ে বেরোনো নিশ্বাস জমে কুয়াশার মতো হয়ে যাচ্ছে। ফিসফিসানিটা যেন ফাটিয়ে দেবে দুই কানের পর্দা। আর সেই সাথে মাছি ওড়ার ভন-ভন।
যখন মনে হচ্ছে আমার হাতটা জমে যেতে শুরু করেছে, বাড়িয়ে ধরা রাইফেলটা আর অনুভব করতে পারছি না, ঠিক তখনই আবছা একটা দরজার মতো চোখে পড়লো করিডোরের শেষে। বরফের মত ঠান্ডা বাতাসটা আসছে ওখান থেকেই। আমি এক পা-এক পা করে এগিয়ে গেলাম ওটার দিকেই। আঙুল ট্রিগারে।
মৃদু একটা গরগর শব্দ শুনতে পাচ্ছি কি? নাকি ফিসফিসানির তীব্র শব্দের মাঝে ভুল শুনছি কানে?
আমি ঢুকে পড়লাম।
আরেকটা বড়সড় ঘরের মাঝে হাজির হয়েছি। যেদিক দিয়ে এসেছি ওটার উল্টোদিকে একটা ভাঙাচোরা জানালা আছে-আর তার আলোতেই দেখে নিলাম যা দেখার।
মেঝেতে পড়ে আছে কিছু একটা সম্ভবত একটা মরা ছাগল, আর সেটার ওপর ঝুঁকে আছে বিশাল একটা প্রাণী। আমার দিকে পিঠ দেয়া ওটার।
কোনো শেয়াল এত বড় হয় না। কোনো শেয়াল এই রকম বাঘের মত বড় হয় না।
ঘরটার তাপমাত্রা যেন শূণ্যেরও নিচে-হাত-পা স্থির রাখতে পারছি না আমি। আমার মুখের সামনে নিশ্বাসের ধোঁয়া।
আমার সাড়া পেয়ে আস্তে আস্তে ঘুরলো জানোয়ারটা, আর সেই সাথে যেন পাগল হয়ে উঠলো ফিসফিসাতে থাকা কন্ঠগুলো, কানে তালা লাগিয়ে দিচ্ছে।
আমার দিকে তাকালো জানোয়ারটা। লাল অঙ্গারের মত জ্বলজ্বল করছে ওটার চোখদুটো। ঠোঁট সরে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে একসারি ঝকঝকে ধারালো দাঁত।
এ-পর্যন্তই দেখেছিলাম। সোজা ওটার মাথার দিকে তাক করলাম। তারপরই টান দিলাম ট্রিগারে।
মিস করেছি আমি!
জানোয়ারটা ঘুরে দাঁড়িয়ে পেছনের জানালাটা দিয়ে লাফিয়ে চোখের পলকে হাওয়া হয়ে গেল। আমিও ঘুরলাম উল্টোদিকে। আর পারছি না। মাথা ঘুরছে। তীব্র পচা গন্ধে নাড়ি-ভুড়ি পাক দিয়ে উঠছে। ঠান্ডায় হাত পা অসাড়।
টলতে টলতে ফিরে চললাম বাইরের দিকে। টের পাচ্ছি, কমে আসছে ঠান্ডাটা, ফিসফিসানি আর ভনভন শব্দ মিলিয়ে আসছে। হারিয়ে যাচ্ছে পেছনে।
মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে এসেই হুড়হুড়িয়ে বমি করে দিলাম।
কেস স্টাডি : ‘তদন্তম’
[বরাবরের মতই মাসিক হালচালে প্রকাশিত হয়েছিল শিপলুর এই ইনভেস্টিগেশনটা। মূল ঘটনার পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া ছিল—সেটা বাদ দিয়ে বাকিটা এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো]
এই ঘটনাটা আমার নিজের জীবনের।
আমি অলৌকিক ঘটনা নিয়ে প্রথম আগ্রহি হই ছোটবেলাতেই। ক্লাস সিক্সে থাকতে ব্যাপারটার শুরু।
বলছি সত্তুরের দশকের শেষ দিকের কথা। আমি অসাধারণ কোনো ছেলে ছিলাম না। সব কিছুতেই মাঝারি-পড়াশোনা বলুন, খেলাধুলা, দস্যিপনা, মারামারি বলুন-সবকিছুতেই। আমার অনেক বন্ধুর অনেক রকম হবি ছিল-আমার কিছুই ছিল না। ওয়াহেদ ডাকটিকেট জমাতো-দুনিয়ার প্রায় সব দেশের ডাকটিকেট ছিলো ওর কাছে, সবাইকে দেখিয়ে মজা পেতো। আলম বাগান করতো, যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতো আদরের বাগানটা। ফাহিম ছিলো বইয়ের পোকা, বিশেষ করে মহাকাশ সম্বন্ধে ফ্যাসিনেশন ছিলো ওর, আর্মস্ট্রং আর গ্যাগারিনকে ঈশ্বর জ্ঞান করতো। আমি এইসব কিছুই করতাম না।
তবে হঠাৎই সব পাল্টে যেতে শুরু করলো।
এক রাতে ঘুম ভেঙে গেল হঠাৎ। আবিষ্কার করলাম, খাটের ওপরে সোজা বসে আছি আমি, চেঁচাচ্ছি গলা ফাটিয়ে। চেঁচাতে চেঁচাতে খাটের কিনারে চলে এসেছি একেবারে। আমার ঘরে ছুটে এসেছে আব্বু, আম্মু আর ছোট ভাই। সবাই উদ্বিগ্ন।
আশ্চর্য, আমি কিন্তু বলতে পারলাম না স্বপ্নে কি দেখে ভয় পেয়েছি।
ঘড়িতে তখন রাত তিনটা পাঁচ। এর পরের রাতেও একই ঘটনা। তার পরের রাতেও।
একমাস ধরে চললো এমনটা। ততদিনে আব্বু আমাকে ডাক্তারের কাছে নিতে নিতে কাহিল হয়ে শেষে কবিরাজ-ঝাড়ফুঁকের দ্বারস্থ হবেন ভাবছেন। এমনি সময় হঠাৎ একদিন ঠিক হয়ে গেল সব। আর দুঃস্বপ্ন দেখে জাগলাম না, প্রতি রাতে চমৎকার ঘুম হতে লাগলো। সব আগের মত হয়ে গেল, কেবল একটা জিনিস বাদে। আমি। আমি চিরতরে পাল্টে গেলাম।
অলৌকিকের ব্যাপারে তুমুল নেশা জন্মালো। যেখানে যত ভুতের গল্পের বই পেলাম, এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলতে শুরু করলাম। তাতেও নেশা মেটে না। কয়েকদিন পর শুরু করলাম নানান ভুতুড়ে জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। গোরস্তান, পোড়োবাড়ি, শ্মশান। কখনো একাই যাই, কখনো আমার সাথে থাকে ফাহিম-বইয়ের পোকা ফাহিম। অদ্ভুত যে কোনো কিছুতে উৎসাহ ওরও।
আমাদের জেলায় দেখার মত প্রায় সব ভুতুড়ে সেমি ভুতুড়ে জায়গা দেখা শেষ, এমন সময় মনে পড়লো -লাশ কাটা ঘরটাই দেখা হয়নি। কুখ্যাত লাশ কাটা ঘর।
আমাদের জেলায় মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছিলো না। লাশ কাটা, মানে ময়না তদন্তের কাজটা হতো একটা আলাদা একটা ভবনে, সদর হাসপাতাল থেকে একটু দূরে। ভবন বলতে আহামরি কিছু না, বারান্দাওয়ালা এক রুমের ইঁটের দালান। দালানটা খাস জমির ওপরে রাস্তা থেকে একটু দূরে। চারপাশে ঝোপঝাড় আর গাছপালা। দিনের বেলাও অন্ধকার হয়ে থাকে। সঙ্গত কারণেই ওখানে মানুষ জনের আনাগোনা কম, কেউ বেশি একটা ঘেঁষতে চায় না ওদিকটায়।
ওখানেই একদিন রওনা দিলাম ফাহিমের সাথে। ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন। অক্টোবর মাস।
বিকেল পড়ে আসছে। খেলতে যাবার কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম আমি। ফাহিম অপেক্ষা করছিলো পাড়ার রাস্তার মোড়টাতে। দু-জনে কাছাকছি এসে একে অন্যের চোখের দিকে তাকালাম কুচক্রির মতো- তারপর হাটতে শুরু করলাম কোনো কথা না বলে।
“টর্চ এনেছিস?” খানিক পরে বললো ফাহিম।
“হুঁ,” জবাব দিলাম
“টাকা-পয়সা?”
“আছে দশ টাকার মতো।”
তখন দশ টাকাই অনেক ছিলো। খুশি হয়ে উঠলো ফাহিম।
লাশ কাটা ঘরটা আমাদের পাড়া থেকে একটু দূরে, রিকশায় গেলে ভালো হয়। আমরা অবশ্য হেটেই চললাম। হেমন্তের বিকেলে বন্ধুর সাথে প্রিয় শহরের অলিগলিতে হাটার মধ্যেও আলাদা মজা আছে।
ফাহিম বইয়ের পোকা। দুনিয়ার বই পড়ে-আর সেগুলোর রিভিউ দেয় আমাকে। এমনিতে ক্লাশের মাঝে বড্ড চুপচাপ ও, কিন্তু প্রিয় কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে খই ফুটতে থাকে ওর মুখে। ওর সাথে থেকে অবশ্য একটা লাভ হয়েছিল আমার প্রচুর ক্লাসিক বইয়ের ব্যাপারে জেনেছিলাম ওর কাছে থেকেই, একজন সাধারণ মানুষ যেগুলোর নাম হয়তো সারাজীবনেও শোনে না। বই ছাড়াও, নতুন যে কোনো কিছু নিয়ে চরম উৎসাহ ওর। যেমন আমার ঘোস্ট-হান্টিং।
হাটছি, আর কথা বলছি আমরা। একটা হেরিং বোন রাস্তা ধরে এগোচ্ছি বড় রাস্তার দিকে। ফুরফুরিয়ে বাতাস বইছে। রাস্তার পাশে একটা খেলার মাঠ, ফুটবল খেলছে আমাদের বয়সি ছেলেপেলেরা। গালের একপাশে নরম সোনালি রোদ এসে পড়েছে আমার, বড্ড আরাম লাগছে।
“তো তারপর! রাশিয়ানরা তো স্পেস স্টেশন বসালো কক্ষপথে, স্যালিউট-১, কিন্তু সেখানে তো মানুষ পাঠাতে হবে! পাঠালোও তারা, তাদের বিখ্যাত সয়ুজ রকেটে করে। সয়ুজ—১০। তারা কিন্তু স্পেস স্টেশনের কাছে গেল, কিন্তু উঠতে পারলো না-রকেটের সাথে স্পেস স্টেশনের হ্যাচ ঠিকমতো জোড়েনি, তাই। পরের মিশন-সয়ুজ ১১। ছয় জুন ১৯৭১-এ লঞ্চ করলো রকেটটা, স্পেস স্টেশনের কাছে গেল, জুড়লোও-তিন কজমোনট তেইশ দিন পার করলেন সেখানে। ফেরার তারিখ ঘনিয়ে এলো। সোভিয়েত রাশিয়ার কাজাখস্তানে ল্যান্ড করলো সয়ুজের ল্যান্ডিং পড়। সফট ল্যান্ডিং। রেসকিউ টিম পৌঁছানোর পরে স্পেসক্র্যাফটের গায়ে নক করলো। কোনো সাড়া নেই। ক্র্যাফটের ঢাকনি খোলা হলো। ভেতরে মরে পড়ে আছে তিন কজমোনট, যেন ঘুমিয়ে আছে। তিন বীরের নাম গর্গি ডোবরোভলস্কি, ভ্লাদিস্লাভ ভলকভ, ভিক্তর পাতসায়েভ। সেদিন ৩০ জুন, ১৯৭১। একটা এয়ারভাল্ব ঠিকমতো কাজ না করায় সব বাতাস বেরিয়ে যায় তাদের স্পেসক্র্যাফট থেকে, মহাশূণ্যে থাকতেই মারা যায় তারা। মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে একাকি মৃত্যু।”
এইসব বলতে বলতে গলা ভারি হয়ে আসে ফাহিমের। আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য একটা দোকানে দাঁড়িয়ে কয়েকটা সিগারেট কিনি। হ্যা, ওই বয়সেই প্রায়-চেইন স্মোকার হয়ে উঠেছিলাম আমি।
কাছাকাছি চলে এসেছি। বড় রাস্তায় চলে এলাম। ওটা পেরিয়ে ওপাশে গেলে সদর হাসপাতাল। পেরিয়ে এলাম ওটাও। আরো মিনিট দুয়েক হাটার পরে একটা শ্যাওলা পড়া লাল ইঁটের দেয়াল চোখে পড়লো।
“এসে গেছি,” রুদ্ধশ্বাসে বললাম।
একটা জং ধরা লোহার গেট দিয়ে ভেতরে ঢোকার ব্যবস্থা। কেউ নেই আশপাশে। সুট করে ঢুকে পড়লাম আমি আর ফাহিম।
প্রাচীর ঘেরা জায়গাটার ভেতরে একপাশে অটোপসি রুমটা, চলতি ভাষায় যেটাকে বলছিলাম লাশ কাটা ঘর। একেবারে সাধারণ দেখতে একটা এক ঘরের একতলা পাকা ঘর, সামনে একটা ছোট বারান্দা আছে। ওখানেই অটোপসি হয়। ছোট শহর, খুব বেশি খুন-খারাপি হয় না, আর অস্বাভাবিক মৃত্যুর কেস থাকলেও সেগুলো চলে যায় পাশের জেলার মেডিকেল কলেজের মর্গে। কাজেই বেশিরভাগ দিনে আমি বন্ধই পড়ে থাকতে দেখেছি লাশ কাটা ঘরটাকে।
আশেপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। লাশ কাটা ঘরের বারান্দার গ্রিলের দরজাটাও যথারীতি বন্ধ। তালামারা।
“একটু আড়ালে যাই,” ফহিম বললো। “লোকজন নেই হয়তো এখন, কিন্তু আসতে পারে। আর আমাদের বয়সি ছেলেপেলে দেখলেই মানুষ মনে করে কোনো বদ মতলব নিয়ে এসেছে! হাজার বলেও বোঝাতে পারবো না।”
অটোপসি রুমের পেছন দিকে চলে এলাম আমরা। জায়গাটা অন্ধকার, ঝোপঝাড়ে ভরা, আর দুনিয়ার মশা।
ঘরটার পেছন দিকে একটা জানালা আছে। কাঁচের। সেটা অবশ্য না থাকারই মতো। বানানোর পর থেকে আজতক খোলা হয়েছে বলে মনে হয় না। পরতের পর পরত ধুলো জমে ভেতরে দেখার কোনো উপায় নেই। তবু আমি ঘষাঘষি করে একটু জায়গা পরিস্কার করালাম। বিধি বাম। ভেতরে অন্ধকার। স্পষ্ট করে কোনোকিছু দেখার জো নেই। তবু একটা লম্বাটে আকার চিনতে পারলাম। সেটাকে একটা খালি স্ট্রেচার বা লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা লাশ—যে কোনো কিছু বলে কল্পনা করা যায়।
গা-টা ছমছম করে উঠলো। ফাহিমের দিকে তাকিয়ে দেখি ওরও একই অবস্থা।
“কতক্ষণ থাকবি? সন্ধ্যে তো প্রায় হয়ে আসছে।” ফাহিম জিজ্ঞেস করলো।
“সন্ধ্যের পরও আধা ঘন্টা, ধর,” ঘড়ি দেখে বললাম, “সারা রাত থাকতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু বাড়িতে কোনোভাবেই এক্সপ্লেন করতে পারবো না। সন্ধ্যের পর আধাঘন্টা বাইরে কি করছিলাম, সেটা বোঝাতেই জান বেরিয়ে যাবে!”
যে জায়গাটায় আমরা দাঁড়িয়েছি সেটা লাশ কাটা ঘরের পেছনটা আর সীমানা প্রাচীরের মাঝের একটা চিপা জায়গা। একটা নাম-না-জানা মোটা গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ালাম আমরা দু-জনে। একটা সিগারেট ধরালাম। চুপচাপ অপেক্ষা করছি আমি আর ফাহিম। চোখ ঘুরছে চারপাশে।
এই যে বিকেলবেলা আমাদের লাশ কাটা ঘর দেখতে আসা, লাশ কাটা ঘরের পেছনে দাঁড়িয়ে ‘ভৌতিক কোনোকিছু দেখার অপেক্ষা করা-এসব বড্ড ছেলেমানুষি মনে হতে পারে আপনাদের কাছে। ভুলবেন না, তখন আমরা তা-ই ছিলাম। অন্তত আমাদের বয়সি অন্য ছেলেপেলেদের থেকে আলাদা কিছু তো করছিলাম, আর যাই হোক।
খানিক বাদে মাগরিবের আজান শুনলাম। ততক্ষণে দিগন্তে লাল আলো ছড়িয়ে সূর্যটা গায়েব হয়ে গেছে। চারপাশে দ্রুত আঁধার ঘনিয়ে আসছে।
জায়গাটা গাছপালায় ঘেরা, আগেই বলেছি। খানিক বাদেই দেখা গেল চোখের সামনে মেলে ধরা হাতটাও স্পষ্ট দেখতে পারছি না।
মশার কামড়ে অতিষ্ঠ হয়ে গেল সে খানিক পরেই। চারপাশে আর কোনো লোকজন নেই বলেই বোধহয় আমাদের দু-জনকে ছেঁকে ধরেছে ঝাঁক ঝাঁক মশা। শরীরের সবখানে কামড়াচ্ছে। কোনো কোনো অতি উৎসাহি মশা শার্টের কলার পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে আমার পেটের রক্তও খেয়ে এল। ভূত দেখবো কি, গায়ের এখানে-ওখানে চাপড় মারতে মারতেই অবস্থা খারাপ। আর তাদের সে-কি গান! তাজা রক্ত খাওয়ার আনন্দেই মনে হয় ব্যাটাদের পাখায় এমন গান খুলেছে।
ফাহিম অনেকক্ষণ ধরেই উসখুশ করছিলো। এবার আর থাকতে না পেরে বলে উঠলো, “দোস্ত। শিপলু।”
আমি কানের পাশে গান গাইতে থাকা দুটো মশাকে হাত নেড়ে তাড়িয়ে দিয়ে বললাম, “বল।”
“অনেকক্ষণ তো হলো মনে হয়.” অসহায় গলায় বললো ফাহিম।
আমি ঘড়ি দেখলাম। সূর্য ডোবার পর প্রায় বিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। এর মাঝে কিছুই অস্বাভাবিক চোখে পড়েনি এই পান্ডববর্জিত জায়গায়। গা-টা হয়তো ছমছম করছিলো, কিন্তু সেটা তো মানসিক ব্যাপার
“যাবি?” কাঁচুমাচু করে বললাম।
“আ…যাওয়া উচিৎ মনে হয় দোস্ত। এখন থেকে বাসা পর্যন্ত যেতেও সময় লাগবে, ভুলিস না,” ফাহিম বললো।
কথা সত্য। আমিও আর দাঁড়ানোর কোনো অর্থ দেখলাম না। “চল,” বললাম ফাহিমকে।
লাশ কাটা ঘরের পেছন থেকে বেরিয়ে সামনের দিকে আসতে শুরু করলাম দু- জনে। মনটা খারাপ আমার। এর আগে যতখানে গেছি, কিছু না কিছু অন্তত চোখে পড়েছে, যেটা দিয়ে অন্তত নিজেকে বুঝ দিতে পেরেছি যে অলৌকিক কিছু দেখেছি। কিন্তু আজকে মনে হয় মশার কামড় খাওয়াই সার হলো, আর কিছু না। অথচ একটা সত্যিকারের হন্টেড জায়গায় গেলে, অতিপ্রাকৃত কোনোকিছুর আভাস পেলে যেমন গাট-ফিলিং হয় আমার, সেটা পুরোদমেই হচ্ছিলো, এখনো হচ্ছে। আমার মনে বলছে এখানে অপার্থিব কোনোকিছু আছে।
হয়তো তাই, কারণ আর কয়েক পা এগোতেই আবছা একটা মূর্তি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম আমাদের থেকে কয়েক হাত সামনে।
আমি জমে গেছি জায়গাতেই। ফাহিমও দেখতে পেয়েছে নিশ্চয়ই, থ হয়ে গেছে ও-ও। এই আঁধারে কোনোকিছু ঠিকমতো বোঝার উপায় নেই বটে, কিন্তু তবুও কোনোমতে দেখা যাচ্ছে, মূর্তিটা আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করেছে।
আমার হাত পা কাজ করছে না। কি করবো বুঝতে পারছি না। কি ওটা? আর ওটা আমাদের দিকে আসছে কেন? দৌড় দেবো? কিন্তু পাঁচিল ঘেরা জায়গাটা থেকে বেরোনোর লোহার গেটটা কোনদিকে?
মূর্তিটা আরো এগিয়ে এসেছে আমাদের দিকে। একটা ভারি নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি আমি।
এমন সময় আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে জ্বলে উঠলো ফাহিমের হাতের টর্চটা।
চোখ পিটপিটিয়ে তাকিয়ে বোকা বনে গেলাম।
একটা বাহাত্তুরে বুড়ো চোখের সামনে এক হাত তুলে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আরেক হাতে একটা লাঠি। বুড়োর পরনে একটা লুঙ্গি, কিন্তু গায়ে খাকি চৌকিদারের পোশাক।
“চোখের সামনে থাইকা লাইট সরা!” বুড়ো খেঁকিয়ে উঠলো। “বজ্জাতের দল! এত রাইতে এইখানে কি?”
আমি আর ফাহিম বোকার মতো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকালাম। এমন অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স! ধুস শালা!
ঘুরে জোরে হাটা দিলাম জং ধরা লোহার গেটটার দিকে।
পেছনে বুড়ো চেঁচাচ্ছে, “ওই, তোরা কারা? তগো বাপের নাম কি?”
দৌড়ে বড় রাস্তায় আসার পরে গোটা ব্যাপারটার মজার দিকটা মাথায় ঢুকলো আমাদের। হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের গায়ে ঢলে পড়তে শুরু করলাম আমি আর ফাহিম। পেটে ব্যথা হয়ে গেল হো-হো করে হেসে।
“অনেকদিন মনে থাকবে, দোস্ত,” চোখের পানি মুছে বললাম ফাহিমকে। “লাশ কাটা ঘরে ভুত দেখতে এসেছিলাম, আর দেখলাম এক বুড়ো চৌকিদারকে!”
বাড়ির দিকে ফিরতে শুরু করলাম। একটু পর পর হাসি আসছে, হাসতে হাসতে কুঁজো হবার অবস্থা।
সবগুলো পাড়া অন্ধকার। কারেন্ট গেছে মনে হয়। সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। আর্লি এইটটিজে লোডশেডিং জিনিসটা আরো কমন ছিলো
ফাহিমদের বাড়ির কাছে চলে এলাম। বাড়িতে ঢোকার আগে ঘুরে দাঁড়ালো ফাহিম। “সেদিনের বইটা পড়া শেষ,” বললো ও। “অ্যালান পো’র গল্পের বাংলা অনুবাদ। দারুণ বই! নিবি আজকেই? আয়, ভেতরে এসে নিয়ে যা।”
“দেরি হয়ে যাচ্ছে দোস্ত,” মাথা চুলকে বললাম। “বাসায় যাই না-হয়। কাল স্কুলে নিয়ে আসিস বইটা।”
“আরে, আমার বাসার সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছিস,” হেসে বললো ফাহিম। আঁধারের মাঝে আবছা দেখা গেল কেবল ওর দাঁত। “আয় ভেতরে। বইটা দিচ্ছি তোকে।”
আমি এক পা দু-পা করে ফাহিমের পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম। হকচকিয়ে গেলাম ভেতরে ঢুকে। লোডশেডিং চলছে ঠিকাছে কিন্তু এত আঁধার কেন? ওদের বাড়িতে কেউ আলো জ্বালেনি?
“এই দিকে,” ফাহিম বললো। “আমার পেছন পেছন আয়।”
হাতড়ে হাতড়ে ফাহিমের ঘরের ভেতরে এসে ঢুকলাম উঠোন পেরিয়ে। “দোস্ত, কিছু তো দেখি না চোখে।”
“দেখবি, দেখবি। আর অন্ধকার থাকবে না একটু পরে।” ফাহিম হঠাৎ হেসে উঠে বলে।
আমি কেন যেন অস্বস্তিতে ঘামতে শুরু করি। এক বিন্দু আলো দেখতে পেলেও শান্তি পাবো এখন। কিন্তু টর্চটা তো ফাহিমের হাতে।
পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেই আমি। একটা দেশলাই আছে। ওটা মুঠো করে ধরি। “দোস্ত, বইটা দে, আমি চলে যাই।”
“পাবি, পাবি। এত অধৈর্য কেন?” ঠান্ডা গলায় বলে ফাহিম।
খড়খড় করে একটা শব্দ, তারপর ফস-স্-স্-স্। আমি দেশলাইয়ের একটা কাঠি জ্বালিয়েছি।
দেখলাম, ফাহিমের ঘর না, আমরা দাঁড়িয়ে আছি ছোট একটা ঘরে, যার এখানে-ওখানে পড়ে আছে দু-তিনটে ডিসেকটিং টেবিল। টেবিলের পাশে ছোট ট্রে’তে নানারকম ইন্সট্রুমেন্ট রাখা।
সেই আলোতে দেখা গেল ফাহিমকে। আমার সামনেই দাঁড়িয়ে। খালি গা। থুতনি থেকে তলপেট পর্যন্ত চেরা। নাড়িভুড়ি বেরিয়ে এসে লুটাচ্ছে মেঝেতে।
ফাহিমের চোখে খুনে দৃষ্টি। দৃশ্যটা দেখেছিলাম বড়জোর এক সেকেন্ড। তারপরই ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটতে শুরু করলাম। চোখের পলকে বেরিয়ে এলাম বাইরে, গাছপালা ঘেরা একটা জায়গায়। এই জায়গা আমি চিনি। লাশ কাটা ঘরের সামনের প্ৰাঙ্গন।
ওইদিন আমি যত জোরে দৌড়েছিলাম, জীবনে আর কখনো তত জোরে ছুটিনি। চোখের পলকে আলো ঝলমলে সদর হাসপাতালের গেটে চলে এলাম। থামলাম না ওখানেও। দৌড়ে চলে এলাম আমাদের পাড়ায়। শরীরের প্রতিটা কোষে তখন ক্লান্তি।
একটু শান্ত হয়ে বাসায় এসে ঢুকলাম। কাউকে কিছু বলিনি।
পরের দিন খবরটা পেলাম সকালে। ফাহিমের লাশ পাওয়া গেছে লাশ কাটা ঘরের পেছনে। থুতনি থেকে তলপেট পর্যন্ত চেরা, নাড়িভুড়ি সব বেরিয়ে এসেছে বাইরে।
অনেকদিন পেরিয়ে গেছে তারপর। পুলিশ অনেকদিন তদন্ত করেছিল, আমাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে অনেক।
কিন্তু কে বা কারা ফাহিমকে নৃশংসভাবে খুন করেছিল, আজ পর্যন্ত বের করা যায়নি।
অধ্যায় ১০ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
অধ্যায় ১০ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
ভেবে রেখেছিলাম, দুপুরের খাবার সারার পরে দুটো থেকে চারটা পর্যন্ত একটু ঘুমিয়ে নেব। কিন্তু বিছানায় গড়গড়িই সার হলো, ঘুম আর ধরে না। শেষে আর না পেরে বারান্দায় এসে পড়লাম। বারান্দায় কাঁচা সোনার মত ঝলমল করছে বিকেলের রোদ, আর তার মাঝে দুটো বেতের চেয়ারে বসে আছে শিপলু আর সামাদ। গলা নামিয়ে কি নিয়ে যেন গুজগুজ করছিল ওরা, আমাকে দেখে সোজা হলো। আমি পাশের একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। মাথাটা ভার ভার হয়ে আছে, কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
শিপলুর হাতে একটা সিগারেট, সেটায় একটা টান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো ও। ওর চশমার দুই কাঁচে হলদে আলো পড়ে চমকাচ্ছে। “এমনটা হয় অনেক সময়। খুব ক্লান্ত হয়ে পড়লে ঘুম আসতে চায় না মানুষের।”
“মে বি।” আমজাদ আলীকে ডেকে চায়ের অর্ডার দিলাম আমি।
“সো, তখন হলোটা কি?” আগ্রহে সামনে ঝুঁকে পড়ে বললো শিপলু। “গেলি… মন্দিরটা চোখে পড়লো, তারপর?”
সকালের ঘটনার পরে জঙ্গল থেকে বের হয়ে ভেতরে কি দেখেছি সেটা নিয়ে বেশি আলোচনা করিনি আমি, ইচ্ছা বা শক্তি কোনোটাই ছিল না তখন। সোজা বাংলোতে চলে এসেছিলাম। এখনও যে সেই গা শিরশিরে অভিজ্ঞতা নিয়ে খুব বেশি খোঁচাখুঁচি করার ইচ্ছে আছে আমার, তা না, কিন্তু না বলাটা খুব বেশি উদ্ভট হয়ে যাবে। কাজেই বললাম যতটুকু পারি, অবশ্যই ফিসফিসানি, ভনভনানি আর ঠান্ডার কথা বাদ দিয়ে।
“গুলি করলি, তা-ও কিছু হলো না?” চকচকে চোখে বললো শিপলু। বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো, এতক্ষণ সামনে ঝুঁকে ছিল।
“মিস করেছি,সন্দেহ নেই,” দুই হাতের তালু উল্টে বললাম আমি। “ওখানে দারুণ অন্ধকার ছিলো। কেবল শেয়ালটার চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম, আঁধারে জ্বলছিল, আর ওটার দাঁত, আবছাভাবে।”
“ওটার সাইজ বুঝতে পেরেছেন?” খসখসে গলায় প্রশ্ন করলো সামাদ।
মেরুদন্ড দিয়ে শিরশিরে একটা অনুভূতি বয়ে গেল আমার। মন্দিরের ভেতর আবছাভাবে দেখা জানোয়ারটার বিশাল সাইজের কথা মনে পড়ে গেছে। অত চওড়া কাঁধ কোনো শেয়ালের হয় না। কোনো শেয়ালের দুই চোখের মাঝখানে অতটা দূরত্ব থাকে না। নিজেকে যতই ফাঁকি দেবার চেষ্টা করি না কেন, আমি জানি ওটা শেয়াল নয়। আমি জানি না ওটা কি, তবে কোনো শেয়াল নয়। এতটুকু নিশ্চিত
“হ্যা, আবছাভাবে,” ইতঃস্তুত করে বললাম আমি। “বেশ বড় শেয়াল। এত বড় আগে কখনো দেখি নি। বেশ অন্ধকার ছিলো তো ওখানে।”
মুখ দিয়ে পটাপট কয়েকটা ধোঁয়ার রিং ছাড়লো শিপলু উত্তম কুমারের ভঙ্গিতে। “তো, শেয়াল। র্যাবিস। শেয়ালটা আর কতদিন বাঁচবে মনে হয়, সামাদ?”
“এখনো যে বেঁচে আছে সেটাই আশ্চর্য,” খসখসে গলায় বললো সামাদ। একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে লাগলো।
“তাহলে, শেয়াল শেষ, সোনার বাংলাদেশ,” সিগারেটের নিঃশেষিত গোড়াটা ফেলে দিয়ে মাথার পেছনে দুই হাতের তালু ঠেকিয়ে আরামসে হেলান দিলো শিপলু। “বাকি সময়টা কি করি?” তারপর নিজেই জবাব দিলো হাসিমুখে, “আর কি? গ্রামে একটু ঘুরি, কে কে মারা গেছে, কিভাবে মারা গেছে সে বিষয়ে একটু ডাটা কালেক্ট করি, লেখার খসড়া সাজিয়ে ফেলি, তারপর আরো কিছুদিন ঘুরেটুরে ঢাকায় ফেরত যাই।” মস্ত একটা হাই তুললো ও কথা শেষে
কিন্তু আমি যে ওর মত রিল্যাক্সড হতে পারছি না, কারণ আমি, আমি জঙ্গলে ঢুকেছিলাম, ওই প্রাচীণ মন্দিরে ওই ভয়ংকর জিনিসটার মুখোমুখি হয়েছিলাম। আমি জানি ওই জিনিসটা র্যাবিসে মরবে না। আমি জানি এই অভিশপ্ত গ্রামে আমাদের কাজ শেষ হওয়া এখনো অনেক, অনেক বাকি।
“তা আপনারা দু-জনই শুধু এই বাড়িতে থাকতেন?” মাটিতে পিঁড়ি পেতে বসা শিপলু পান চিবুতে চিবুতে বললো। ওর সামনের পিঁড়িতে আড়ষ্টভাবে বসতে বসতে মাথায় ছেঁড়া আঁচলটা তুলে দিল অমিছার মা। প্রায় শোনা যায় না এমন স্বরে বললো, “হ।”
পাঁচটা বাজতে চললো। আমরা এই মুহূর্তে খালিভিটার সবচেয়ে কাছে যে বাড়িটা, সেটায়। যদি এটাকে বাড়ি বলা যায় আরকি। গ্রামের সব বাড়ি জঙ্গল থেকে যথাসম্ভব দূরে কাছাকাছি ঘেঁষে বানানো, কিন্তু এই কুঁড়ে ঘরটা তাদের থেকে অনেকটাই দূরে, জঙ্গলের বেশ কাছাকাছি। বাড়ির হাল দেখে জসীমউদ্দীেেনর আসমানীদের বাড়ির কথা মনে পড়লো। খড়ের তৈরি বাড়িটা এখনো কিভাবে দাঁড়িয়ে আছে সে রহস্য সমাধানের জন্য শার্লক হোমসকে ভাড়া করা যেতে পারে। বাড়ির আশপাশে অবশ্য বাঁশের কঞ্চি আর শুকনো কলাপাতা দিয়ে আব্রু রক্ষার একটা চেষ্টা করা হয়েছিল। সেটায় এখন বেড়ালের পা পড়লেও ভেঙে যাবে।
“আপনার স্বামি কি করতেন?”
“জমিত্ কামলা খাটতো।”
“এন্তেকাল করলো কবে?”
“অমিছা হওয়ার পরের বছর।”
“তারপর থেকে আপনারা এখানে একাই থাকতেন?”
“হ। হামার তিনকুলত আর কেউ আছিলো না বাবা।”
“অমিছার বিয়ে দেবার কথা তো ভাবতেছিলেন, না খালা?”
“হ। ওপাকের বেণীপুর গেরামের সালাম মিয়ার বেটা আবুলের সাথে বিয়ার কতা হছিলো।”
“অমিছাকে যেদিন…মানে ধরলো আরকি, সেইদিনের ব্যাপারটা একটু বলতেন।”
একইভাবে সিদ্দিকের বউয়ের বাচ্চাকে কিভাবে ‘পিচাশ’ নিয়ে গিয়েছিল, সেটা জানতে সিদ্দিকের বাড়িতেও যাওয়া হলো। আমার একটু খটকা লাগছিলো, সবাই সিদ্দিকের বাচ্চা না বলে সিদ্দিকের বউয়ের বাচ্চা বলছিলো কেন, কিন্তু সবার সাথে কথা বলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো। সিদ্দিকের বউয়ের এটা দ্বিতীয় বিয়ে। বাচ্চাটা ছিল আগের পক্ষের স্বামির। বাচ্চাটাকে হারিয়ে এখন সিদ্দিকের বউ পাগলপ্রায়। সিদ্দিক লোকটাকে অবশ্য খুব সেয়ানা মনে হলো। মিশমিশে কালো রং, শক্তসমর্থ চেহারা, নাকের ওপরে সরু গোঁফ। শিপলু যত না প্রশ্ন করলো, সে করলো তার চাইতে বেশি, আর গোটা সময়টা সরু চোখে তাকিয়ে রইলো আমাদের দিকে।
বাকি থাকলো আরেক ভিক্টিম-চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে। চেয়ারম্যানসাহেবের বাড়িতেও যাওয়া হলো। গোটা গ্রামের মাঝে এই বাড়ির অবস্থাই সবচেয়ে ভালো, আধা পাকা। চেয়ারম্যানসাহেব অতি বৃদ্ধ, কিন্তু খুব ভালো লোক। আমাদের অনেক যত্ন-আত্তি করালেন, কিন্তু সেসবের বর্ণনা এখানে দেয়া অবান্তর। বাড়ির উঠোনে চেয়ার পেতে বসালেন আমাদের, এখানে এটাই বোধহয় রীতি, তারপর অনেক গল্প করলেন ছেলের ব্যাপারে, শিপলুকে তেমন কিছু জিজ্ঞেস করতে হলো না। ছেলেকে নিয়ে অনেক দুঃখ করলেন, মানুষ করাতে পারেননি তিনি তাকে। অন্য ছেলেরা বড় বড় পাশ দিয়ে শহরে চাকরি করতেছে, আর ছোট ব্যাটাটা কিনা খারাপ সঙ্গে পড়ে নেশা করা, জুয়া খেলা শিখলো! একেবারে উচ্ছন্নে চলে গিয়েছিলো, কারো কথা শুনতো না, জেলেও গিয়েছিল কয়েকবার, মেয়েদেরকে বিরক্ত করতে গিয়ে পিটুনি ও খেয়েছিলো, বাসার সবার সাথে খুব খারাপ আচরণ করতো, অনেক রাতে বাসাতেই ফিরতো না। আর সেজন্যই, খালিভিটাতে ঘুরতে গিয়ে যখন নিখোঁজ হলো, তখন প্রথমে কেউ কিছু সন্দেহই করেনি। আসল ব্যাপারটা টের পাওয়া গেছিলো দুই দিন পরে। সবকিছু বিস্তারিত বলে-টলে বৃদ্ধ চেয়ারম্যান কাঁদতে শুরু করলেন, দীর্ঘ সাদা দাড়ি বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো অশ্রু।
চলে আসার আগে আমাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন চেয়ারম্যানসাহেব। “আপনার বাবার নামটা কি, শিকারিসাহেব?” আমি জবাব দেবার পরে তিনি কান্নাভেজা চোখে অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। গোটা ব্যাপারটার কোনো মানে বুঝলাম না।
তিন ভিক্টিমের ব্যাপারে তথ্য নেয়া শেষে বাজারের দিকে হাটা দিলো শিপলু। “আজ হাটবার,” বললো ও। “গ্রামের হাটের একটা আলাদা একটা ফ্লেভার আছে। না দেখলে মিস করবি।”
“শুধু হাট দেখবার জন্য আমাকে নিয়ে যাচ্ছিস না নিশ্চয়ই।”
“আলবত না। গ্রামের লোকজনের সাথে কথা বলতে হবে। এই কেসের ব্যাপারে তো বটেই, আরো কোনো নতুন কেসের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যায় কিনা দেখবো—কারণ ঢাকায় তো ফিরছি না এত তাড়াতাড়ি।” শিপলুর গলায় উৎসাহের সুর।
“এই কেসটা নিয়ে তো অনেক বড় একটা স্টোরি হবে, তাই না শিপলু ভাই?” সামাদের প্রশ্ন।
“রাইট!” চোখ চকচক করছে শিপলুর। “বড় মানে আক্ষরিক অর্থেই বড়। মাসিক হালচালের ছিয়ানব্বই পেজের মধ্যে বত্রিশ পেজ আমাকে দিতে হবে-সম্পাদক পাগলা হাফেজকে বলে রেখেছি আমি। খুশিতে বগল বাজাচ্ছে পাগলা হাফেজ। গ্রামের ব্যাকগ্রাউন্ড, প্রত্যেকটা ভিক্টিমের খুঁটিনাটি, ভিক্টিমের পরিবারের সাক্ষাৎকার, সাথে ছবি তো থাকছেই…” গলায় ঝোলানো ক্যামেরাটা দেখালো ও। “মেগা স্টোরি!”
“কিন্তু রহস্যময় জন্তু?” সামাদের প্রশ্ন। “সেটার ব্যাপারে কি লিখবেন?”
“আমরা তো খুব বড় গলায় বলছি ওটা র্যাবিসে আক্রান্ত শেয়াল,” ডিপ্লোম্যাটিক গলায় বললো শিপলু, “কিন্তু দেখো—সেটার সপক্ষে কোনো প্রুফ পেয়েছি কি? এই যে আমাদের জামশেদ সবচেয়ে বেশিবার দেখেছে ওটাকে দু-বার। এমনকি সে -ও কি শিওর ওটা কি? জামশেদ?”
“না,” বলতে বাধ্য হলাম। মন্দিরের অভিজ্ঞতা মনে পড়ে যাওয়ায় এই সোনালি বিকেলও কেমন শিরশির করে উঠলো গা-টা।
“তাহলেই দেখো। তাছাড়া গ্রামেরও কেউ চাক্ষুস দেখেনি ওটাকে। আক্ষরিক অর্থেই রহস্যময় জন্তু ওটা। কাজেই এটা নিয়ে বিরাট কলেবরের একটা প্যারানরমাল কেস স্টাডি হতেই পারে। তিন-তিনটা মানুষ মারা গেছে, কম তো না।”
“সত্যিই, পাগলা হাফেজের সবচেয়ে বড় সম্পদ তুই,” হাসতে হাসতে বললাম আমি।
“তুই কি জানিস,” বললা শিপলু, “পিশাচের ইংরেজি কি? একটা সিনোনিম হচ্ছে ghoul। এটা আবার আরবি শব্দ থেকে এসেছে। আকাশে একটা তারা আছে-অ্যালগল-ওটার নাম এসেছে আরবি ফ্রেজ ‘রা’জ আল ঘুল’ থেকে, যার মানে শয়তানের মাথা। তারাটার আলো বাড়ে কমে, শয়তানের চোখের মত চকচক করে, তাই এমন নাম। আসলে তো ওটা একটা এক্লিপসিং বাইনারি স্টার।”
ট্রিভিয়া-ম্যান শিপলু।
গ্রামের সবচেয়ে উঁচু আর চওড়া মেঠো পথ ধরে এগিয়ে চলেছি আমরা হাটের দিকে। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম একবার ব্যাকগ্রাউন্ডে মুখ ব্যাদান করে আছে জঙ্গলটা। ওদিকে আর না তাকিয়ে মন দিলাম সামনের দিকে। বিকেলটা একদম মরে এসেছে, তীর্যক সোনালি রোদ বিদায় নিলো এইমাত্র। রাস্তার দু-পাশে ধানের খেত, ফসল পেকে এসেছে, আসছে হেমন্তে ধান কাটার মৌসুম শুরু হবে। খেতগুলো আক্ষরিক অর্থেই দিগন্তবিস্তৃত, বহু বহু দূরে দিগন্তের কাছে নীলচে কুয়াশার মাঝে মিলিয়ে গেছে ওগুলো। পশ্চিমের আকাশে টকটকে লাল রং, সূর্যটাকে পোচ করা ডিমের কুসুমের মত দেখাচ্ছে।
হাটের কাছে পৌঁছে গেলাম। বিশাল একটা ডালপালা ছড়ানো কয়েকশো বছরের পুরনো বটগাছ ঘিরে বসে হাটটা। হাটবারে বেশ সরগরম জায়গাটা, দেখা গেল। বটগাছটার নিচে অস্থায়ি দোকান পেতে বসেছে অনেকে। শাক-সব্জি, মাছের দোকানের পাশাপাশি মহিলাদের শখের চুড়ি-ফিতা, সস্তা ছিটের কাপড়ের দোকানও আছে। টিন-বাঁশ-কাঠের স্থায়ি দোকানগুলো একটু বাইরের দিকে। অনেক লোকজন ঘোরাফেরা করছে, গমগম করছে পুরো জায়গাটা।
হাটুরে লোকজনের মাঝে বেশ ব্যস্ততা দেখলাম, সম্ভবত সন্ধ্যে নামার পরে হার্ট বন্ধ হয়ে যায়, ইলেকট্রিসিটি তো নেই। সবাই বেশ অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে আমাদের দিকে, নিজেদের মাঝে ফিসফাস করছে, আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে। গ্রামে শিকারি আসছে—এই খবর জানা ছিলো সবার, এখন চাক্ষুস দেখে কৌতূহল মিটিয়ে নিচ্ছে। সম্পূর্ণ দিগম্বর একটা বাচ্চা আমাদের সামনে এসে মুখে বুড়ো আঙুল পুরে দাঁড়িয়ে রইলো।
পুরো হাটটা চক্কর দিলাম একবার বেশ কৌতূহলের সাথেই। শিপলু ঠিকই বলেছে, ব্যাপারটার একটা আলাদা ফ্লেভার আছে। মনে পড়ে গেল, আমারও তো শেকড় পোঁতা উত্তরবঙ্গের গ্রামেই। আমার দাদাবাড়ি ছিলো জয়পুরহাট জেলাতে। দাদা ছিলেন মাদ্রাসার শিক্ষক। বাবা আর জ্যাঠা অবশ্য খুব কম বয়সেই ঢাকায় চলে এসেছিলেন ভাগ্যের সন্ধানে। জ্যাঠা নানান ব্যবসার ফিকির করতে লাগলেন, আর বাবা পড়াশোনা করতে থাকলেন জ্যাঠার টাকায়। বাবা পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন নানান চাকরির ধান্ধা করলেন, কিছুদিন নাকি শিক্ষকতাও করেছিলেন বগুড়া না রংপুরের কোনো এক কলেজে, কিন্তু স্বাধীনতার পরে তিনিও ঢাকায় চলে এসে ব্যবসায় যোগ দেন জ্যাঠার সাথে। জ্যাঠাই নাকি খাটতেন বেশি। বিয়েও করেছিলেন তিনি বাবার পরে, সামাদ তাই আমার চেয়ে বয়সে ছোট। তার মৃত্যুর ব্যাপারটা খুব দুর্ভাগ্যজনক-চিটাগং বন্দরে ইমপোর্ট মালসামানের তদারক করছিলেন, সেখানে ক্রেন থেকে হঠাৎ একটা কার্গো মাথায় পড়ে সাথে সাথে তার মৃত্যু হয়। জ্যাঠি খবর শুনে অসুস্থ হয়ে পড়েন, হাসপাতালে নেবার পরে তিনিও পরের দিন কেন যেন মারা যান, সম্ভবত হার্ট অ্যাটাকে। জ্যাঠা তার ব্যবসার ভাগ বাবাকেই দিয়ে গিয়েছিলেন। সামাদ তার পর থেকে আমাদের বাসাতেই মানুষ।
খানিকক্ষন ঘোরাফেরা করে শিপলু বললো, “চল, একটু বসা যাক। ওই যে একটা সুন্দর চায়ের দোকান দেখছি। ওখানে বসলে আশেপাশের চোদ্দো গ্রামের যত খবর মিলবে, চোদ্দো বছর সার্ভে করলেও সেটা পাবি না।”
গ্রামের চায়ের দোকানের একটা মজার ব্যাপার হচ্ছে, এগুলো অনেকটা হোটেলের মত। বসবার জন্য সারিবাঁধা নড়বড়ে কতগুলো বেঞ্চ আর টেবিল থাকে, মেসিয়ার থাকে, সে-ই ওয়েটার, কাউন্টারও আছে, সেটাতে ক্যাশবাক্সের ওপর একটা হাত রেখে গম্ভিরভাবে বসে থাকে দোকানের মালিক। তার সামনে লাল ঢাকনিওয়ালা কাঁচের বয়ামে সাজানো থাকে বিস্কুট আর টোস্ট। শিপলুর দেখানো চায়ের দোকানটাও সে-রকমই। আমরা এগিয়ে গেলাম সেদিকেই।
আমাদের আসতে দেখেই সাড়া পড়ে গেল দোকানের মালিক আর ভেতরে বসে গল্প করতে থাকা চা-সেবি আট দশজনের মাঝে। মালিকের নাম শুনলাম আনসার আলী, সে বেচারা কিভাবে আমাদের অভ্যর্থনা করবে ভেবে পাচ্ছে না। বিপুল উৎসাহ-উদ্দিপনার মধ্য দিয়ে দোকানে গিয়ে বসালো আমাদের, পেছন পেছন ঢুকলো আরো আট-দশজন। তাদের মধ্যে গেরুয়া কাপড় পরা এক চোখ কানা এক বাউলও আছে।
শিপলু থাকতে মজলিস জমতে দেরি লাগে না। এটা অবশ্য ওর একটা ট্রিক। গ্রামের মানুষ বাইরের কারো সামনে মুখ খুলতে চায় না, কিন্তু জড়তা কেটে গেলে প্রচুর কথা বলে। খানিকবাদেই দেখা গেল শিপলু এক হাতে মার্লবোরো আর আরেক হাতে চায়ের কাপ নিয়ে কথার তুবড়ি ছুটিয়েছে মুখ দিয়ে, তার সাথে সমানতালে যোগ দিয়েছে গ্রামবাসি। দশ-পনের মিনিটের মাঝে কালামের মেয়ের বিয়ের খবর নিয়ে ফেললো ও, ইদরিস মিয়ার ধানের চিটারোগের প্রতিকার বাতলে দিলো, রহিমের মা’কে রংপুর মেডিকেলে বড় ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিলো। চাপে পড়ে আমাকেও সুন্দরবনে বাঘ শিকারের গল্প শোনাতে হলো, সেটা অবশ্য পচাব্দী গাজীর শিকার কাহিনী থেকে মেরে দেয়া। সকালে জঙ্গলের ভেতরের অ্যাডভেঞ্চারও শোনাতে হলো বাধ্য হয়ে।
“বাপরে! তোমরাগুলা এইগলা কি শোনইনেন বাহে!” আমার গল্প শেষ হবার পর চরম বিস্ময়ের সাথে বলে উঠলো ইদরিস আলী। সবার মাঝে তাকেই একটু চালাক চতুর বলে মনে হচ্ছিলো আমার। “তোমারগুলার সাহস আছে বাহে! ওংকা করি জঙ্গলোত ঢুকিয়া…” শিউরে ওঠে সে। বাইরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে, বাইরের গ্রাম থেকে আসা হাটুরেরা বিদায় নেওয়ায় চারপাশ নিশ্চুপ। আঁধার দূর করছে আমাদের সামনে বসানো একটামাত্র কেরোসিন ল্যাম্পের আলো, সেটাও বাতাসে কাঁপছে তিরতির করে, কালো ধোঁয়ার মোটা ধারা ছাড়ছে ওপরের দিকে। “সেই জিনিসের সামনোত গেছিলেন, ফির বাঁচিয়াও ফেরছেন!” তারপরই সবার মাঝে আলোচনা শুরু হয়ে গেল ‘জিনিস’টা কি, তা নিয়ে। শিপলুও চরম আগ্রহে যোগ দিলো সেই আলোচনায়, এবং আমি আর সামাদ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে দেখলাম শিপলুও ওটাকে একটা ‘পিচাশ’ বলে প্রমাণ করার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছে।
“তোমরা তো হামার চাইতে বয়সোত অনেক ছোটো, বাহে, তোমরাগুলা আর কি দেখছেন!” প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ ভঙ্গিতে সবাইকে ঠান্ডা মেরে দেয় পচা শেখ। লোকটা একেবারে লোলচর্ম বৃদ্ধ, এত বুড়ো মানুষ বাপের জন্মে দেখিনি আমি। তবু খোনা গলার আওয়াজ বাজখাঁই একেবারে। “মোর বয়স একশও বিশ বছর হইছে। বহুত জিনিস দেকচোঁ জেবনে। আঠেরোশো সপ্তানব্বই সালোত যেবার ভূমিকম্প হয়া মাটি ফাটি কই মাছ বাইর হইলো তখন মুই লতিফের বেটা হারুণের সমান। তখন বাঘ আছিল ওই জঙ্গলোত, বাঘ! সে বাঘ গরু ছাগল খাইতো মাজে মদ্যে, কই কখনো তো শুনি নাই মানুষ মাচ্চে! কিন্তুক এই গেরামের ভগ্যত কুফা লাগা শুরু হইলো কুনদিন থাকি, জানেন?”
পরের পাঁচ মিনিটে একনাগাড়ে একটা অদ্ভুত গল্প বলে গেল পচা শেখ, রংপুরিয়া ভাষায়, তার কিছু বুঝলাম, কিছু বুঝলাম না। তবু যা বোঝা গেল সেটা হচ্ছে : বহু বহু দিন আগে, ব্রিটিশ আমলে এই গ্রামে এক জটা-জুটোওয়ালা কৌপিন পরা সাধুর আগমন হয়। অন্তত প্রথমে তাকে সবাই সাধুই ভেবেছিলো বটে। কিন্তু সাধুর ঝোলা থেকে জড়িবুটির পাশাপাশি যখন মানুষের খুলি আর হাঁড়গোড় বেরোলো, চোখ কপালে উঠলো তখন সবার। বোঝা গেল লোকটা তান্ত্রিক, এবং খারাপ ধরণের তান্ত্রিক। জঙ্গলের উল্টো দিকে নদীর ধারের শ্মশানে এক অমাবস্যার রাতে দেখা গেল, একটা মড়ার ওপর বসে সাধনা করছে তান্ত্রিক, সামনে অগ্নিকুন্ড। পর পর কয়েক রাতে এই দৃশ্য দেখার পরে গ্রামের মানুষ ঠিক করে, আর না, এইবারে একটা ফয়সালা করতে হয়। সবাই লাঠিসোঁটা আর মশাল হাতে মারতে যায় তাকে। এর পরে ঠিক কি হয়েছিল, কেউ ঠিক মত জানে না, সব চেয়ে প্রচলিত গল্পটা হলো তান্ত্রিক সবার চোখের সামনেই একটা বিশাল নেকড়ে বাঘের মত জিনিসে পাল্টে গিয়ে এক লাফে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। আর তার পর থেকেই এই গ্রামের ভাগ্যে কুফা-মঙ্গা, ম্যালেরিয়া, কলেরা, আর একাত্তরের যুদ্ধে আশপাশের দশটা গ্রামের চাইতে অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি। এখন আবার পিশাচের উপদ্রব!
“যুদ্দের সময় তো এক্কেবারে ইবলিছ শয়তানের চোখ পড়ছিলো গেরামের ওপরোত!” উত্তেজিত স্বরে বলে ওঠে ইদরিস আলী। “এই গেরামের একজন মানুষে কেবল শিক্ষিত আছিল, আলতাফ উদ্দীন গাজীর বেটা বরকত উদ্দীন গাজী। সে রংপুর শহরোত থাকতো, কারমাইকেল কলেজের পোরফেসর আছিল। সে বেচারা আছিল জয় বাংলার ভক্ত। যুদ্ধ যখন শুরু হইলো সে চলি আইলো গেরামোত। কিন্তুক তার পেছনোত পেছনোত আর্মি নিয়া আইলো কারমাইকেলের আরেক মাস্টার, চেংরা বয়স, সে শোহোরের বাচ্চার নাম মুই জানো কিন্তু তার নাম মুখত নেলে মোর মুখ নোংরা হয়া যাইবে। তার পর তো…” অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকালো সে, বিশেষত আমার মুখের দিকে একটু বেশি সময়ই তাকিয়ে থাকলো, কেন কে জানে।
হঠাৎ চোখে পড়লো, সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকেই, চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। ল্যাম্পের হলদেটে আলোয় অদ্ভুত দেখাচ্ছে সবাইকে। মনে পড়ে গেল, অনেকক্ষণ যাবত কোনো কথা বলছি না আমি। মজলিসে হাজির হয়ে কথা কম বলার নিয়ম বোধহয় নেই গাঁও-গেরামের কুটুম্বের। কি বলবো, মাথায় আসছে না এই মুহূর্তে, অথচ বলতে তো হবে। পিশাচের কথা তুলে মন্দিরের অভিজ্ঞতা মনে করার কোনো কারণ নেই। গসিপ হলে কেমন হয়? “সিদ্দিকের ব্যাপারটা একটু বলেন তো,” ভেবেচিন্তে বললাম, “যে সিদ্দিকের বউয়ের বাচ্চাকে পিশাচ খাইলো, সেই সিদ্দিক। সিদ্দিকের এইটা প্রথম বিয়ে, অথচ, তার বউয়ের দ্বিতীয়, ব্যাপারটা কি?”
“কি আর কইমেন লজ্জার কথা,” অস্বস্তিতে নড়েচড়ে বললো চা-দোকানের মালিক আনসার আলী। “সিদ্দিকের সাথে ওইপাকের বালাটারি গ্রামের বাতেনের বউয়ের খারাপ সম্পর্ক আছিল। বাতেনের বউয়ের ছইল হইলো, তবু বাতেনের ওপর কোনো মায়া হইলো না, ছইল কোলোত নিয়ায় চলি আইলো সিদ্দিকের কাছে। আর বাতেন বিষ খায়া মরলো।” তার গলা নিচু হয়ে আসে। “সিদ্দিকোক আমরা কেউ দেইখবার পারি না। বাজারোত আসলে আমরা অর কাছে কিছু বেচি না।”
সবাই অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে বসলো। আমিও পড়লাম ফাঁপরে-নারীঘটিত জিনিস তোলা ঠিক হয়নি দেখছি। সিদ্দিক নামের লম্পটের কারণে গোটা গ্রামকে লজ্জায় পড়তে হচ্ছে।
চালাক চতুর ইদরিস আলী গলা তুললো। “ও শ্যামাদাস বাউল!”
আমাদের সাথেই বসে ছিল গেরুয়া জামা, পাগড়ি আর একতারা ওয়ালা একচোখ কানা শ্যামাদাস বাউল। এতক্ষণ চুপচাপ থাকার পরে মুখ খুললো সে, “হু, ইদরিস ভাই!”
“চুপচাপ যে!”
“কি কইম, কন।” লাজুক হাসি হাসে বাউল।
“কি কবা মানে? হামার গেরামোত মেহমান আইলো, আর তোমরাগুলা এলাও গান না শোনেয়া চুপ করি আছেন?”
“কি গান গাইম?” কানা বাউল হাসিমুখে বলে। “বাঘ নিয়া একটা গান বান্ধিছলাম, মনে আছে? ওইটাই শুনাই শিকারিসাহেব আর তেনার বন্ধুদেক?”
“হ হ! ওইটায় ভালো হইবে!” সবাই যেন একটু বেশি উৎসাহের সাথে বলে ওঠে।
বাউলের আশপাশে যারা ছিল তারা সরে জায়গা করে দিলো তাকে। বাউল উঠে দাঁড়ালো, পরনের গেরুয়া কাপড় ঠিকঠাক করলো গম্ভিরভাবে, গায়কের মুডে চলে গেছে সে।
শিপলু সিগারেট টানছে, ল্যাম্পের আলোয় চকচক করছে ওর চশমার কাঁচ, সামাদ আর সব সময়ের মত মুখ কালো করে তাকিয়ে আছে বাউলের দিকে, গ্রামবাসি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। চায়ের দোকানের ভেতরে ল্যাম্পের আলো, বাইরে নিকষ কালো রাতের আঁধার। শ্যামাদাস বাউল সেই পরিবেশে সেই অভিশপ্ত প্রাগৈতিহাসিক গ্রামে যে গানটা গেয়েছিলো সেটা কোনোদিন ভুলবো না :
সয়না জ্বালা, তুমি বিনে, চইলাম আমি শ্বাপদ সনে ॥
বন্ধুর স্মৃতি ভুলতে না’রি বনের মাঝে দিনু পাড়ি।
গাছের শাখে পাখি ডাকে দুঃখের কথা কইবো কাকে।
সওয়ার হয়্যা পঙ্খির ডানায় বন্ধুর বাড়ি যাইতে মন চায়।
দোলা লাগে ঝাউয়ের বনে কত কতা ছিল মনে।
প্রকাশি না কইতে পারি চলিয়া গেলাম ঘর ছাড়ি।
বনের মাঝে জোছনোরো বান নামিল য্যান স্বর্গের বাগান।
ব্যাঘ্র সঙ্গি আমার হইলো মনের কতা আমায় কইলো।
পশু-পক্ষি হইলো সাথি সুখেই কাটে দিবা রাতি।
বন্ধুর কথা ভুলবো বলি শ্বাপদ সনে আইলাম চলি।
সয়না জ্বালা, তুমি বিনে চইল্লাম আমি শ্বাপদ সনে ॥
গান শেষ, সবাই বাহবা দিচ্ছে শ্যামাদাস বাউলকে, আমি মানিব্যাগ বের করে একটা একশো টাকার নোট বের করে দিতে যাচ্ছি, এমন সময় চোখ পড়লো ভিড়ের পেছনে, চায়ের দোকানে ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে। মফিজ দারোগা। অন্ধকারের সাথে মিশে কতক্ষণ যাবত ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল লোকটা, জানি না।
সোজা আমার দিকে তাকিয়ে আছে মফিজ দারোগা। চোখে শীতল দৃষ্টি। এমন দৃষ্টি আজ সকালেই আরেকবার দেখেছি আমি। জঙ্গলের ভেতরে, মন্দিরে।
দিনটা যদি ওখানেই শেষ হতো, তবু ওটা হতো আমার জীবনের সবচেয়ে ঘটনাবহুল দিনগুলোর একটা। কিন্তু বাইরে থেকে কলকাঠি নাড়তে থাকা কারো মতলব ছিলো আলাদা।
বাংলোয় ফিরে রাতের খাওয়া সারতে সারতে দেরি হয়ে গেল। ক্লান্তি লাগছে না ততটা অত সহজে ক্লান্ত হবার লোক আমি নই, কিন্তু কেমন অদ্ভুত একটা অবসাদ বোধ হচ্ছে। বিছানায় শুয়েছি, শিপলু হারিকেনের আলোয় সারাদিনে জমা করা ওর নোটস সাজাচ্ছিল কোনোমতে, সামাদ বোধহয় পাশের রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে, এমন সময় বারান্দায় গটগট করে ভারি পায়ের শব্দ, আর তারপরই বাইরের দরজায় দড়ামদড়াম শব্দ। কেউ যেন প্রচন্ড তাড়ায় আছে, এখনই ভেতরে ঢুকতে হবে তাকে।
কেয়ারটেকার আমজাদ আলী আমাদের রুমে এস ভয়ার্ত গলায় বললো, “সাব, কাঁয় জানি আলছে।” যেন দরজার কান ফাটানো শব্দটা আমরা শুনতেই পাই নি।
আমি আর শিপলু মুখ চাওয়া চাওয়ি করছি, এমন সময় দরজার ওপাশ থেকে অধৈর্য কন্ঠে বলে উঠলো মফিজ দারোগা, “জামশেদসাহেব! তাড়াতাড়ি দরজা খোলেন!”
আমজাদ আলী দরজা খুলে দিল, আর ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকলো মফিজ দারোগা। “তাড়াতাড়ি চলেন! আরেকজনক্ ধরছে!”
“মানে?”
“সিদ্দিক! রাইতে পায়খানা করতে বাইর হইছিলো, পিচাশটা ধরছে! টানি নিয়া গেছে জঙ্গলের দিকে! সিদ্দিকের বউয়ের চিল্লানি শুনিয়া মানুষ আমাক খবর দিছে! আমি সোজা এইখানে আসছি! আমার সাথে চলেন,সাহেব, দেখেন এখনো কিছু করা যায় কিনা!”
আমি যেতে চাই না। জঙ্গলের ভেতরে যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে তার পরে আবার ওটার মুখোমুখি হবার কোনো শখ আমার নেই-কিন্তু কিভাবে এড়াবো মফিজ দারোগার ডাক? গ্রামের মানুষ জানে, আমি তাদেরকে বাঁচানোর জন্যই এসেছি! অন্তত নিজের কভারটা বজায় রাখার জন্য হলেও আমাকে যেতেই হবে—ইচ্ছা যতই না করুক। বলে দিলাম, “আসছি। এক মিনিট সময় দিন-রাইফেলটা বের করতে হবে।”
“আমিও যাবো,” শিপলু বললো। আমি মাথা নেড়ে মেনে নিলাম সেটা। ওর সাথে তর্ক করার কোনো মানে হয় না, ও যাবেই। গভির রাতে পিশাচের পেছনে ছোটার জন্যই ও এই গ্রামে এসেছে।
“ভালো, যত লোক বাড়ে তত ভালো,” বিড়বিড় করে বললো মফিজ দারোগা। লোকটা ভয় পেয়েছে নির্ঘাত, চেহারায় এমনকি কুটিলতার ছাপটাও আর নেই।
“আমিও যাচ্ছি,” সামাদ বললো। নিজের লাগেজের ভেতর থেকে কি যেন বের করছে ও ব্যস্ত হাতে।
“প্রশ্নই আসে না। শুধু শুধু রাত বিরেতে জঙ্গল ঠেঙ্গিয়ে কাজ নেই তোর।” খেঁকিয়ে উঠলাম আমি।
“জামশেদ ভাই, সিদ্দিককে পাওয়া গেলে তার হয়তো মেডিকেল কেয়ার দরকার হবে,” শান্ত কণ্ঠে বললো সামাদ, ফার্স্ট-এইড বক্সটা হাতে নিয়ে সোজা হলো। “আর আশেপাশে চল্লিশ মাইলের মধ্যে আমিই সম্ভবত একমাত্র এমবিবিএস ডাক্তার।”
কথা সত্য। আমার রাইফেলও বের করা হয়ে গেছে। বুলেটের থলেটা বেল্টের সাথে লাগিয়েই আর দেরি করলাম না। “চল!” বলে বেরিয়ে পড়লাম রাতের আঁধারে, সম্বল কেবল কয়েকটা টর্চের আলো।
ঢুকে পড়লাম দুঃস্বপ্নের চেয়েও ভয়ংকর বাস্তবের আরেক অধ্যায়ে।
অধ্যায় ১১ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
অধ্যায় ১১ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
কবে অমাবশ্যা, কবে পূর্ণিমা—এসবের খবর আমি কখনোই রাখতাম না। কিন্তু সেদিন রাতে বাংলোর বাইরে বেরিয়েই মনে হলো, আজ অমাবশ্যা। আকাশের দিকে একবার তাকানোর লোভ সামলাতে পারলাম না। একটা ছোট্ট চাঁদ আছে বটে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে একদম শেষ। কালই নিশ্চয়ই অমাবশ্যা।
কালিগোলা অন্ধকার চারপাশে, সেটা ফুঁড়ে যাবার বৃথা চেষ্টা করছে আমাদের চারটে টর্চের আলো। আমিই সবার সামনে। রাইফেলটা আপাতত ঝুলিয়ে রেখেছি কাঁধে।
বাংলোর চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে মুশকিলে পড়ে গেলাম। কোনদিকে কি-কিছু বুঝতে পারছি না। এই গ্রামে এসেছি মাত্র একদিন হলো-এর মাঝে রাস্তাঘাট চিনেছি যৎসামান্য, আর এখন তো ঘুটঘুটে আঁধার।
মাথা ঘুরিয়ে মফিজ দারোগাকে জিজ্ঞেস করতে যাবো, তার আগেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠলো সে, “এই দিকে। এই দিকে আসেন। আমার পেছনে।” সরে জায়গা করে দিলাম আমি তাকে সামনে যাবার।
তার পরের দশ মিনিটে শুধুই মফিজ দারোগার ছুটে চলা, আর তার পেছন পেছন আমরা। কাজটা মোটেই সহজ নয়। মফিজ দারোগা দশাসই শরীর নিয়ে হড়বড়িয়ে ছুটছে, আর তার পেছন পেছন এবড়োথেবড়ো মাটির রাস্তা দিয়ে আমরা তিনজন।
শিপলুকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম, “কোনো শেয়াল মানুষকে কামড়ে টেনে নিয়ে যেতে পারে না!”
যখন কেবল ভাবতে শুরু করেছি এই দৌড় কোনোদিন শেষ হবে কিনা, এমন সময় চোখে পড়লো দূরে হ্যারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন গ্রামবাসি। কি করবে বুঝতে না পেরে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবাই, চোখে মুখে তীব্র আতঙ্কের ছাপ। আমাদের দলবলকে দেখে যেন ধড়ে প্রাণ ফিরলো লোকগুলোর।
হ্যারিকেন ওয়ালাকে চিনতে পারলাম, আজকে চায়ের দোকানে পরিচয় হওয়া ইদরিস আলী। “এইদিকত্!” আমরা কাছাকাছি যেতেই উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠলো সে। “এই দিকে দিয়ায় নিয়া গেইছে জঙ্গলের দিক!”
“শিওর তো?” আমি বলে উঠলাম। একশোভাগ নিশ্চিত হবার আগে জঙ্গলের দিকে যাবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই এই নিশুতি রাতে।
“হ হ!” সজোরে মাথা ঝাঁকালো ইদরিস আলী। “সিদ্দিক পায়খানা কইরবার বাইর হছিলো, বাড়ির পেছনোত কেবল গেইছে, আর নাই ধরি ফেলাইছে! সিদ্দিক কেবল একটা চিল্লান দিবার পারছে। সেটা শুনিয়া সিদ্দিকের বউ চিল্লানি শুরু করছে, তার পর হামরা ঘর থাকি বাইর হছি। হারিকেনখ্যান নিয়া কেবল দৌড় দিছি, আন্ধারের মধ্যত কোনোমতে দেখনু কি বা অ্যাখান জিনিস, বাঘের মতন বড়, খয়ের জর্দার মতন অং. সিদ্দিকের গলা কামড়ে ধরিয়া…” আর বলতে পারে না ইদরিস আলী, ঠোঁট নড়ে, কিন্তু শব্দ বের হয় না ভয়ে বিবশ গলা থেকে।
ইদরিস আলীরা যেদিকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সেদিকে টর্চের আলো ফেললাম আমি, আর সাথে সাথে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল আমার পিঠ দিয়ে। জঙ্গলের একদম কিনারে দাঁড়িয়ে আমরা। একটু পরেই ঝোপঝাড় শুরু, সেগুলো পেরিয়ে নিরেট অন্ধকারে ছাওয়া জঙ্গলটা। ইদরিস আলীরা কেন আর না এগিয়ে এখানেই দাঁড়িয়ে এতক্ষণ যাবত ভয়ে কাঁপছে, সেটা বোঝা হয়ে গেল আমার।
জঙ্গলে ঢুকতে বাধ্য হবার আগে মরিয়া আমি শেষ একটা চেষ্টা করে দেখতে চাইলাম। “আপনারা শিওর তো, জঙ্গলের দিকে গেছে? জঙ্গলের পাশের ভুট্টার খেতটাতে নিয়ে যায়নি তো, যেটাকে আপনারা খালিভিটা বলেন?”
ভয়ার্ত গ্রামবাসি অনিশ্চিতভাবে মাথা নাড়ে। ইদরিস আলীর পেছনের মুখচেনা একজন বলে, “হামরা তো আন্ধারের মধ্যত অত বুঝবার পারি নাই বাহে। এই জায়গা পর্যন্ত আসিয়াই আমরা শ্যাষ।”
“এইখান থাকি দুই জাগাতেই যাওয়া যাইতে পারে,” মফিজ দারোগা কপালের ঘাম মুছে বললো।
“পারে, কিন্তু যদি সেটা জঙ্গলের ভেতরে হয়, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই,” শীতল গলায় বললাম আমি।
“তার মানে?” হুংকার দিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা। এতক্ষণ বোধহয় ভয়ের কারণেই আসল রূপটা চুপসে গিয়েছিল লোকটার, এখন ধীরে ধীরে আসল মফিজ দারোগা ফিরে আসছে।
“মানে হচ্ছে, এই রাতে ওই জঙ্গলে ঢোকা সম্ভব নয়, কারণ—” ঠান্ডা গলায় থেমে থেমে বলতে শুরু করলাম আমি।
“আপনাক এইখানে আনা হইছে কেন!” আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত তীব্র ঘৃণায় চোখ বোলালো মফিজ দারোগা। “আপনার যে কাজ সেইটা আপনাক করাই লাগবে! জঙ্গলে যাবেন না মানে! একশো বার যাইতে হইবে!”
“না জেনে উজবুকের মত কথা বলবেন না!” দাঁত খিঁচিয়ে বলে উঠলাম আমি, রাগে জ্বলে যাচ্ছে গা। “এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে জঙ্গলে ঢুকে নিজের প্রাণটা খোয়াবো নাকি? পৃথিবীর কোনো শিকারিই এই পরিস্থিতিতে ওখানে যাবে না। আর আমি যদি এখন যাইও, সাথে করে আপনাদের সবাইকে নিয়ে যেতে হবে, কারণ বেশি লোক না থাকলে জানোয়ারটা ভয় পাবে না। আর তখন সেই আঁধারে কি থেকে কি হয়ে যাবে বলা তো যায় না-হয়তো দেখা গেল আমাদেরই কারো খুলি উড়িয়ে দিলাম ভুলে, হয়তো আপনারই!”
মফিজ দারোগার চেহারা তীব্র রাগ আর ঘৃণায় যেন কুৎসিত একটা মুখোশের আকার ধারণ করেছে, চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে, ঠোঁটদুটো পেছনে সরে গিয়ে হলদেটে দাঁত আর কালচে মাড়ি বেরিয়ে এসেছে। এক সেকেন্ডের জন্য আমার মনে হলো লোকটা আমার ওপর ঝাঁপিয়েই পড়বে কিনা। কিন্তু না, নিজেকে সামলে নিলো সে। জানতাম এমনই হবে। বুদ্ধিমান লোক সে জানে আমার কথাই এই মুহূর্তে শুনতে হবে তাকে।
“সবাই মাথা ঠান্ডা রাখেন! মাথা ঠান্ডা!” একটা হাত সামনে তুলে আমার আর মফিজ দারোগার মুখের দিকে চাইলো শিপলু
“মাটিতে ট্রেইল দেখলেই তো হয়-” সামাদ বলে উঠলো, “ওনারাই তো বললো, ঘাড় কামড়ে ধরে নিয়ে গেছে, মাটিতে দাগ পড়তে বাধ্য।”
এই সহজ কথাটা মাথায় আসেনি কেন আমার? ডিনারের পরে দুই পেগ গিলেছি বলেই?
“সামাদ ঠিক বলেছে,” শান্ত কণ্ঠে বললাম আমি। কাউকে কিছু বলতে হলো না, সবাই সরে দাঁড়ালো, আর সব ক’টা টর্চের আলো গিয়ে পড়লো মাটির দিকে।
আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানটায় আমাদের পায়ের ছাপ ছাড়া অন্য কিছু পাবার আশা করাটা বাতুলতা। কয়েক পা এগিয়েই অবশ্য পেয়ে গেলাম যা খুঁজছিলাম। পথের ধারের মিহি ধুলোর ওপরে বড় কিছু টেনে নিয়ে যাবার দাগ। লালচে দাগও দেখা যাচ্ছে, রক্তের ফোঁটা পড়েছিল ওখানটায়, শুষে নিয়েছে ধুলো। সবকিছু যেন সাজিয়ে রাখা হয়েছে আমাদের দেখার জন্যই। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো আমার, ভয়ে নয়, উত্তেজনায় নয়, অন্য কোনো কারণে।
ট্রেইলটার ওপরে আলো ফেলে কয়েকফুট যেতেই বুঝতে পারলাম কোনদিকে গেছে ওটা। জঙ্গলের দিকে নয়, জঙ্গলের সামনের পতিত ভুট্টাজমিটায়, খালিভিটা বলে যেটাকে। একাত্তরের বধ্যভূমি।
“জলদি!” বললাম আমি, নতুন উৎসাহে এগিয়ে চললাম সামনে। আমার পেছনে বাকি তিনজন। গ্রামবাসিরা আর এগোনোর সাহস পায়নি, দাঁড়িয়ে আছে ওখানেই।
আরো কিছুদূর যাবার পরেই কিন্তু ট্রেইলটা হারিয়ে ফেললাম। একটা পরিত্যাক্ত ধানখেতে, বলা ভালো ধানখেতের ধ্বংসস্তূপের মাঝে এসে ঢুকেছে ওটা। এখানে খানিকটা জায়গায় ধানের চারা লাগিয়েছিল হয়তো গ্রামের ভূমিহীন কোনো বাসিন্দা, সে গাছ বড় হয়ে তাতে ধান এসেছিলো, পেকেওছিলো, কিন্তু কেটে নিয়ে যাওয়া আর হয়নি রহস্যময় জানোয়ারের ভয়ে। এখন বাকি আছে শুধু শুকিয়ে দমকা হাওয়ায় দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া হাটু সমান উঁচু ধানখেত।
বাঁকাচোরা মরা ধানগাছগুলোর মাঝ দিয়ে কোনোকিছু গেছে কিনা বলা মুশকিল, তবু একটা জায়গায় আলো ফেলে চেঁচিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা, “এইদিকটা দেখেন তো! একটু অন্যরকম লাগতেছে!”
এগিয়ে গিয়ে আলো ফেললাম আমি। হ্যা, এইদিক দিয়ে ভারি কিছু টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নিশ্চিত, আর রক্তের দাগও আছে একটা। ধন্যি বটে মফিজ দারোগার চোখ। আরেকবার আমার কলজেটা লাফিয়ে উঠলো-আর সেটা ভয়ের কারণে নয়।
একবার ট্রেইল খুঁজে পাবার পরে আর এগিয়ে যেতে সমস্যা হলো না। সামনে আলো ফেলে দেখলাম, ধানখেত পেরিয়ে সামনের মরা ভুট্টার খেতের মাঝে ঢুকেছে ট্রেইলটা। যেদিক দিয়ে ঢুকেছে সেদিকে বিশাল এক ফাঁক। কপালে ঠান্ডা ঘাম ফুটলো আমার। ভুট্টা গাছগুলো ছয়-সাত ফুট উঁচু। ওগুলোর মাঝে ঢোকা আর জঙ্গলের মাঝে ঢোকার মাঝে বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই।
আমি ভুট্টার খেতে ঢোকার আগ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঘুরলাম পেছনে।
শিপলু প্রফেশনাল স্টাইলে কাঁধের কাছে ধরে আছে টর্চটা, ওর চশমার দুই কাঁচ যেন ফসফরাসের মত জ্বলছে। সামাদের গম্ভির মুখ দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই ওর মনের ভেতর কি চলছে। মফিজ দারোগা দরদর করে ঘামছে। হোলস্টারে হাত দিলো সে, বের করে আনলো রিভলভারটা। সোজা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো আমার।
“ওয়েল, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো,” বিড়বিড় করলাম আমি। “একটা বন্দুকের চাইতে দুটো ভালো। আমিই সামনে থাকবো। মফিজসাহেব আমার বামে থাকবেন, পেছনে না, পাশে। শিপলু, সামাদ, তোরা দু-পাশে চোখ রাখবি।”
আমার টর্চটা নিভিয়ে ফেললাম, রাইফেলটা তুলে নিলাম কাঁধে। আমার বামে মফিজ দারোগা, এক হাতে টর্চ, আরেক হাতে রিভলভার।
ঢুকে পড়লাম ভুট্টাখেতের ভেতরে।
সাথে সাথেই প্রবল অস্বস্তিতে ঘামতে শুরু করলাম।
আমি নিজে প্রায় ছয়ফুট লম্বা, কিন্তু ভুট্টাগাছগুলো আরো এককাঠি সরেস। যেদিকে চোখ চালাচ্ছি, সেদিকেই সারি সারি শুকনো ভুট্টাগাছ। সেগুলোর ভেতর দিয়ে টর্চের আলো গিয়ে হাজারটা ছায়া নাচানাচি করছে পেছন দিকে, কোনটা একটা নির্দোষ মরা ভুট্টাগাছের ছায়া আর কোনটা রক্তলোভি একটা পিশাচ, বলা কঠিন। ভুট্টাগাছগুলো বহু আগেই কেটে ফেলার কথা, কিন্তু পিশাচের উপদ্রব শুরুর পরে এ- মুখো আর হয়নি কেউ। শুকনো ভুট্টাগাছগুলোকে দেখাচ্ছে মিশরের ফিতে খোলা মমির মত। ভুট্টাগুলো পেকে দানা খসে পড়েছে, দানাবিহীন ভুট্টার কঙ্কালগুলো যেন এই অভিশপ্ত গ্রামের উপযুক্ত মুখপাত্র।
অতি সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছি আমরা। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ভুট্টাগাছগুলোর মাঝের ফাঁকটা তেমন বড় না, পাশাপাশি দু-জন চলাই কঠিন। আমাকে আর মফিজ দারোগাকে প্রায় গা ঘেঁষে হাটতে হচ্ছে।
আর কয়েক পা যাবার পরেই তীব্র এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া কাঁপিয়ে দিয়ে গেল আমাকে। হতভম্ব আমি থমকে দাঁড়াতেই আরেক ঝলক হাওয়া। থামলো না ওটা, বইতেই থাকলো আমার হাঁড়-মাংস কাঁপিয়ে দিয়ে।
“কি ব্যাপার? থামলি কেন?” আমার পেছন থেকে বলে উঠলো শিপলু।
“বাতাসটা টের পাচ্ছিস না?” আমি কোনোমতে দাঁতের খটখটানি থামিয়ে জবাব দিলাম।
এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইলো শিপলু, যেন কিছু একটা বোঝার চেষ্টা করছে, তার পরেই একটু অনিশ্চিতভাবে বললো, “হ-হ্যা।”
আমি মুখ ঘোরালাম সামনে। ঠান্ডায় দাঁত কপাটি লেগে যাচ্ছে আমার, হাত জমে আসছে। কিন্তু আমি আর টু শব্দটাও করলাম না এটা নিয়ে।
আর দু-পা এগোনোর পরপরই শুনতে পেলাম ফিসফিসানির শব্দ। যেন দূরে, বহু দূরে ফিসফিস করছে কেউ, আর আমার কানে আবছাভাবে আসছে সেটা।
ঢোক গিললাম আমি। সবকিছুর পুনরাবৃত্তি হচ্ছে যেন-জঙ্গলের মাঝে যা যা অনুভব করেছিলাম, সব যেন ফিরে আসছে।
সামনে দুই ভাগ হয়ে গেছে ট্রেইলটা, টর্চের আলোয় দেখতে পেলাম। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে থেমে গেলাম আমি। দুটোর যে কোনোটাতে যেতে পারে সিদ্দিককে টেনে নিয়ে যাওয়া জানোয়ারটা।
“এখন?” ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলো মফিজ দারোগা।
“মাটিতে আলো ফেলুন,” বললাম আমি, ঠান্ডার চোটে কথা বলতেই কষ্ট হচ্ছে।
মাটির দিকে ঘুরে গেল সব ক’টা টর্চ। সবখানে ছড়িয়ে আছে ভুট্টার ঝরে পড়া শুকনো পাতা আর বাকল। সেগুলোর ওপর বিশেষ কোনো চিহ্ন দেখতে পেলাম না। না রক্তের দাগ, না অন্যকিছু।
“দু-দিকই চেক করতে হবে,” বললাম আমি, রাইফেলটা নামিয়ে রাখলাম আমার পায়ের সাথে হেলান দিয়ে। তার বদলে পকেট থেকে বের করে আনলাম চ্যাপ্টা ফ্লাঙ্কটা। কাঁপা হাতে ছিপি খুললাম। আগে হাতের কাঁপুনি থামাতে হবে আমার, নইলে বিপদে পড়বো চারজনই। সিদ্দিকের কথা ভাবছি না, তাকে এর মাঝেই ফেলে দিয়েছি খরচের খাতায়।
আমি বড় দুই ঢোক হুইস্কি গেলার সময় আগুনে চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো মফিজ দারোগা। কিন্তু কিছু বলার সাহস হলো না তার, সম্ভবত পরিস্থিতির কারণেই। সামাদ কিছু বললো না, কমনওয়েলথের বাছাইয়ের সময় আমি কেমন সময়ের মাঝ দিয়ে গেছি, সেটা ওর দেখা আছে।
ফ্লাস্কটা পকেটে পুরে রাইফেলটা তুলে নিলাম আমি আবার। শরীর গরম হয়েছে খানিকটা, হাতের কাঁপুনি কমতে শুরু করেছে। কেবল ফিসফিসানিটা একই রকম আছে। বরং বাড়ছে।
“দুটো দলে ভাগ হয়ে যাই আমরা। শিপলু, আয় আমার সাথে। দারোগাসাহেব, আপনি সামাদের সাথে যান। দুই দলেই একটা করে বন্দুক থাকলো তা হলে,” বললাম আমি, কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বামের ট্রেইলটা ধরে এগিয়ে গেলাম।
আমার পেছনেই রইলো শিপলু। ওর ভারি শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কোনোকিছু শোনা যাচ্ছে না।
“আমি রাইফেলটা কোনদিকে তাক করে রাখি সেটা লক্ষ্য রাখ।” ফিসফিস করে বললাম আমি আমার নিজের কানের ফিসফিসানি ছাপিয়ে। “টর্চের আলো সেইদিকে ফেলবি।”
“গট ইট,” বিড়বিড়িয়ে বললো শিপলু।
যত যা-ই বলুক, শিপলু কিন্তু টর্চের আলো সোজা রাখতে পারছে না। আমার কাঁধের পাশ দিয়ে দিয়ে গিয়ে নাচানাচি করছে আলোর বীমটা সামনে, ভুট্টার গাছগুলোর মাঝের আলো-আঁধারী বাড়িয়ে দিয়েছে।
ঠান্ডা লাগছে আমার। খুব ঠান্ডা লাগছে।
যতই সামনে এগোচ্ছি, ফিসফিসানির শব্দটা বাড়ছে। এইমাত্র তার সাথে যোগ দিলো একটা ভনভনানির শব্দ। যেন অনেকগুলো মাছি উড়ছে কোনো পচা লাশকে ঘিরে।
সামনে অনেকটা জায়গা যেন ফাঁকা, আবছাভাবে দেখতে পাচ্ছি আমি। হয় ওখানে একটা গণকবর আছে, ভুট্টাগাছ লাগানো হয়নি, না-হয় ভুট্টাগাছগুলো মাটিতে পড়ে গেছে কোনো কারণে। আর ওদিকেই নিয়ে চলেছে আমদেরকে ট্রেইলটা।
আমার দুইকানে ফিসফিসানিটা বাড়তে বাড়তে এখন কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে, কিন্তু তার মাঝেও খচমচ শব্দ শুনলাম একটা।
কিসের শব্দ ওটা?
কেউ হাটছে ভুট্টাগাছগুলোর মাঝ দিয়ে?
নাকি শিকারের হাড় থেকে মাংস ছাড়িয়ে আনছে একটা পিশাচ?
এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি ফাঁকা জায়গাটার দিকে। এখন খুব অল্প অংশই দেখতে পাচ্ছি জায়গাটার, ট্রেইলটা শেষ হয়ে ফাঁকা জায়গাটায় গিয়ে হাজির হবার আগে এর বেশি চোখে পড়বে না।
“আলোটা স্থির রাখবি,” শিপলুকে বললাম আমি। নাকি নিজেকেই বললাম নিজের হাত সোজা রাখতে? প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মত ঠান্ডা হাওয়া হু-হু করে আসছে সামনের দিক থেকে।
আমি এগিয়ে গেলাম সামনের দিকে। আর এক পা এগোলেই এসে পড়বো ফাঁকা জায়গাটায়। ফিসফিসানিটা একটা আকার পাচ্ছে যেন এখন। কি যেন বলতে চাচ্ছে। কি যেন বোঝাতে চাচ্ছে।
একটা ভুট্টা গাছ সামনে ঝুঁকে ছিলো, সেটা রাইফেলের ডগা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সাবধানে সামনে বাড়লাম আমি। শিপলু ঠিক আমার পেছনেই, টর্চের আলো ফেললো ও সামনে।
ভুট্টাগাছগুলোর মাঝের ফাঁকা জায়গাটা বিশ ফুট বাই বিশ ফুট হবে। শিপলুর টর্চের আলো সেটার অন্ধকার দূর করতে পারছে না। কিন্তু এই মুহূর্তে যে জিনিসটার ওপর টর্চের আলো পড়েছে, সেটা ছাড়া আর কোনো কিছু দেখার নেই ওখানটায়।
সিদ্দিকের সাথে আজকেই দেখা হয়েছে। চায়ের দোকানে আজকেই কথা হয়েছে তার ব্যাপারে, কিভাবে পাশের গ্রামের বাতেনের বউকে বাচ্চাসহ ভাগিয়ে এনেছিল সে। মনে পড়ছে, তার সৎ ছেলে পিশাচের হাতে মরার ব্যাপারে যখন তার বউয়ের সাথে কথা বলার জন্য তার বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন কিভাবে চোখ সরু করে আমাদের দিকে তাকিয়েছিলো সরু গোঁফওয়ালা কালো লোকটা।
এখনো সেই চোখগুলো তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে, কিন্তু সেই চোখে এখন তীব্র আতঙ্কের ছাপ, যেন নিজের মৃত্যুকে এগিয়ে আসতে দেখেছিল সে মরার আগমুহূর্তে।
সিদ্দিক পড়ে আছে খোলা জায়গাটার মাঝে, হাত-পা ছড়ানো, রক্তে মাখামাখি পুরো শরীর। পরনে লুঙ্গি নেই, খুলে পড়ে গেছে নিশ্চয়ই টেনে আনার সময়। গলা আর কাঁধ ছিন্নভিন্ন। একই অবস্থা দু-পায়ের মাঝের জায়গাটার-কেউ যেন টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে লোকটার পুরুষাঙ্গ, গোড়া থেকে।
লাশটার পাশে দাঁড়ালাম আমি, একবার চিন্তা করলাম লোকটার পালস চেক করবো কি না, কিন্তু স্থির হয়ে থাকা খোলা চোখগুলো…
একটা খচমচ শব্দে চোখ তুললাম আমি, ভুট্টা গাছ মাড়িয়ে কেউ আসছে এদিকেই। টর্চের আলো। মফিজ দারোগা আর সামাদের ট্রেইলটাও এখানেই এসে ঠেকেছে দেখছি।
আমি মুখ খুলে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলাম, পারলাম না, তার আগেই আমার মুখের ওপর গর্জে উঠলো মফিজ দারোগার রিভলভার।
অধ্যায় ১২ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ১২ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
এক মুহূর্তের জন্য, আমি মারা গিয়েছিলাম।
কিংবা আমি ভেবেছিলাম, আমি মারা গিয়েছিলাম।
তারপরই টের পেলাম, আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে আছি, কানে প্রতিধ্বনি তুলছে গুলির শব্দটা, শিপলু আর সামাদ একসাথে কথা বলে উঠে মহা শোরগোল তুলেছে, আর আমার কানের পাশ দিয়ে শিষ কাটার যে শব্দটা পেয়েছি সেটাও নিশ্চয়ই একটা বুলেট। না, মরিনি আমি, মফিজ দারোগার গুলি আমাকে মিস করেছে কয়েক ইঞ্চির জন্য।
“স্যরি! আমি স্যরি!” মফিজ দারোগা ভাঙা গলায় চেঁচাচ্ছে। তারপরই আমার দিকে এগিয়ে এলো সে। “জামশেদসাহেব! আপনার লাগেনি তো? কোনো ক্ষতি হয়নি তো?”
আমি তাকিয়ে আছি মফিজ দারোগার মুখের দিকে। অল্প আলোয় যা বুঝলাম, লোকটার কালোপনা মুখে উদ্বেগ আর অনুশোচনার ছাপ, যেন নিজের ভুলে মাথা চাপড়ানোর অবস্থা তার। লোকটার এই অভিব্যক্তি কতটা সত্যি? কি চলছে ওই মোটা খুলিটার ভেতরে? তাকে দুই পয়সাও দাম দেইনি আমি, সেটা ঠিক, তাই বলে আমাকে গুলি করার চেষ্টা করবে সে? আমি গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম, “না, কিছু হয়নি আমার।” রাইফেল মাটিতে নামিয়ে ভর দিলাম সেটার ওপরে। হঠাৎ বড় ক্লান্ত লাগছে নিজেকে।
অত্যন্ত আন্তরিক ভঙ্গিতে আমার কাঁধে হাত দিলো মফিজ দারোগা। “মাথাটা খুব গরম হয়া ছিলোসাহেব! মাফ করে দিবেন! সবসময় ভয়ে ছিলাম পিশাচটা কখন সামনোত আইসে! হটাৎ যখন সামনোত সিদ্দিকের লাশটা দেইখলাম, আঙুলের চাপ পড়িয়া গুলিটা বাইর হয়া গেল। কি কয়া যে ক্ষমা চাবো আপনার কাছে, লজ্জায়…”
“ক্ষমা চাইতে হবে না আর, যান!” খেঁকিয়ে উঠলাম আমি। “যা করার তো করেই ফেলেছেন! মাথাটাই উড়িয়ে দিতেন আরেকটু হলে আমার, বেয়াক্কেল লোক কোথাকার!” রাগে গলা কাঁপছে আমার। “এই বকরির ঘিলুওয়ালা লোককে পুলিশ বানিয়েছে কে, সেটাই এখন দেখার বিষয়! যান তো এখন, সরেন মুখের সামনে থেকে! সরেন বললাম!”
মুখ কালো করে আমার সামনে থেকে সরে গেল মফিজ দারোগা।
সামাদ বসে পড়ে চেক করে দেখছে সিদ্দিকের দেহাবশেষ। “কি অবস্থা?” জিজ্ঞেস করলাম ওকে।
“এই রকম ইনজুরি নিয়ে ও বেঁচে থাকলে সেটা নিয়ে লন্ডনের কোনো মেডিকেল জার্নালে আর্টিকেল লিখে বিখ্যাত হয়ে যেতাম,” বিড়বিড়িয়ে বললো সামাদ। হাত গুটিয়ে এনেছে লাশটা থেকে।
“এখানে থেকে আর লাভ নেই,” শিপলু বললো। “জিনিসটা আশেপাশে আছে কিনা কে জানে। আমাদের গ্রামে ফিরে গিয়ে লোকজসহ আবার আসাটাই ভালো হবে। মফিজসাহেব!”
মফিজ দারোগার ঘোর এখনো কাটেনি। “উঁহ?” আড়ষ্ট ভঙ্গিতে জবাব দিল সে, চোখ সরাতে পারছে না সিদ্দিকের লাশটা থেকে। তার হাটুতে এক ফোঁটা রক্তের দাগ, নিচু হয়ে মোছার চেষ্টা করলো সেটা।
“আপনি থানায় চলে যান। আইনগত যত ব্যাপারস্যপার আছে সেরে ফেলুন।” শিপলু চশমা অ্যাডজাস্ট করতে করতে বললো।
“ঠিক… ঠিক বলছেন।” মফিজ দারোগা বললো, যেন মাথায় অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা চলছে তার।
“আমরা একসাথে ফিরি, চলুন, “ সামাদ বললো। “সেটাই বেটার।”
এই কথায় রাজি হয়ে গেলাম সবাই সাথে সাথে। মরা ভুট্টা খেতের মাঝখানে বিভৎস একটা লাশের সাথে আর এক মুহূর্ত থাকারও ইচ্ছা নেই কারো।
সিদ্দিকের ছেঁড়াখোঁড়া লাশটা পেছনে ফেলে রেখে তড়িঘড়ি করে আবার জগদানন্দপুর গ্রামের দিকে রওনা দিলাম আমরা।
রাইফেল কাঁধে আমি সবার সামনে। চিন্তার ঝড় চলছে মাথায়। মফিজ দারোগা আমার ওপর গুলি চালালো কনে? ভুল করে? এমন ভুল মানুষ করে? নাকি ইচ্ছে করে? সেটাই বা হবে কেন?
আবার যদি ইচ্ছে করেই হয়, তবে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে মিস করলো কেন?
অনেক সময় মানুষ স্বপ্নের মাঝেই বুঝতে পারে সে স্বপ্ন দেখছে। সে-রাতে তেমনটাই হলো আমার। একেই মনে হয় বলে লুসিড ড্রিমিং। আমি একটা কুয়াশাঘেরা জায়গায়। চারদিকে ঘন কুয়াশা। এত ঘন কুয়াশা আমি কোনোদিন দেখিনি।
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম এতক্ষণ। এবার হাটতে শুরু করলাম। আমার চারপাশে কুয়াশাগুলো পাক খেয়ে খেয়ে সরে যাচ্ছে। পথ করে দিচ্ছে আমাকে।
আমি ভাবলাম, কুয়াশাটা সরে যাক। ভাবতে না ভাবতে সেটা সরেও গেল।
তবে পুরোটা না। আমার সামনে করিডোরের মত একটা জায়গা বানিয়ে সরে গেল ওটা। যেন মোজেসের সামনে সরে যাওয়া ভূমধ্যসাগর। নাকি লোহিত সাগর?
করিডোরের শেষে একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। কাঠের দরজা।
আমি দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম। দরজাটা চেনা চেনা লাগছে আমার। একটা তুচ্ছ দরজা কারো চেনা চেনা লাগার কথা নয়। আমার কাছে লাগছে।
আমি দরজাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। হাতলটা ধরতে গিয়েও হাতটা সরিয়ে নিলাম। আমি এর আগেও এই দরজার সামনে দাঁড়িয়েছি। আমি জানি গোটা ব্যাপারটা কোন দিকে যাচ্ছে। আর আমি এটাও জানি যে আমি স্বপ্ন দেখছি।
আমি কি এই স্বপ্নটা থেকে জেগে উঠতে পারি না? ওই দরজার ভেতরে কি আমাকে ঢুকতেই হবে?
আমি নিজের হাতে চিমটি কাটলাম। ডান-হাত দিয়ে বাম হাতে। ব্যথাও পেলাম। কিন্তু কিছুই হলো না। জেগে উঠলাম না আমি। স্বপ্ন দেখছি।
জেগে ওঠার একমাত্র উপায় হচ্ছে ওই দরজার ভেতরে গিয়ে পরিস্থিতিটা মোকাবেলা করা।
আমি হাতলটা ঘুরিয়ে সাবলীল ভঙ্গিতে দরজাটা খুলে ঢুকলাম এসি রুমটার ভেতরে।
ধানমন্ডি থানার ও.সি. বিশাল ডেস্কটার পেছনে বসে একটা ফাইল খুলে কয়েকটা কাগজপত্র নাড়াচাড়া করছিলেন। আমাকে দেখে হাসলেন তিনি। হাসিটা আসল না, মেকি। “জামশেদ রহমান খান।” ডেস্কের উল্টোদিকের একটা চেয়ার দেখালেন তিনি। “বসো।”
আমি তার সামনে বসতে চাই না। আমি দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে চাই। আমি এই স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। কিন্তু তার বদলে ‘৮৯-র হাল ফ্যাশনে কাটা নিজের ঝাঁকড়া চুলে হাত বোলালাম আমি। আরেক হাতে একটা অদরকারি ঝাঁকুনি দিলাম গায়ের কালো চামড়ার জ্যাকেটে। ঝাঁঝের সাথে বললাম, “আমাকে আপনি করে বলবেন।”
ওসির মুখের হাসিটা একটু ছোট হলো, সেভাবেই থাকলো এক সেকেন্ড, তারপর ফিরে গেল আবার আগের সাইজে। “অবশ্যই বলবো, মিস্টার জামশেদ রহমান খান। আপনি বসুন। পিলিজ।”
আমি ইচ্ছে করে বেশি শব্দ করে চেয়ারটা টান দিয়ে ঠ্যাং ফাঁক করে বসলাম। হাবেভাবে চরম বিরক্তির ছাপ।
অনেক সময় নিয়ে ফাইলের কাগজপত্রগুলো সাজালেন ওসি। ফাইলটা বন্ধ করে দু-হাতের আঙুল একটা আরেকটার ফাঁকে ঢুকিয়ে তার নিচে চাপা দিলেন ফাইলটা। আমার দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন, “তো, আপনার কমনওয়েলথের প্রস্তুতি কেমন যাচ্ছে?”
“ভালোই।” ভারি গলায় বললাম আমি।
“সোনা জেতার আশা করছেন এবারো নিশ্চয়ই।” ওসি মজলিশি ঢঙে বললেন।
চরম বিরক্তির সাথে মুখ বাঁকালাম আমি। “হ্যা-হ্যা-হ্যা। আশা করছি। আর আমি এটাও আশা করছি, আপনি আমার কমনওয়েলথের প্রস্তুতি শোনার জন্য আমাকে থানায় ডেকে আনেনি।”
“না-না-না, তা কেন হবে?” ওসিসাহেব আহত স্বরে বললেন।
“তাহলে যা বলার-”
“আপনার কমনওয়েলথে যাওয়া হচ্ছে না।” মুখের হাসিটা ধরে রেখেই বললেন ওসি।
কয়েক মুহূর্ত তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি। “মানে?”
“কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ শুটিং ফেডারেশন আপনার ফিজিক্যাল টেস্ট করেছিল। মনে আছে?”
“হ্যা,” বিড়বিড় করে বললাম আমি, একটু একটু বুঝতে পারছি ব্যাপারটা কোনদিকে গড়াচ্ছে।
“সেখানে আপনার ব্লাড আর ইউরিন টেস্ট করা হয়েছিল, মনে আছে?”
“উমম…হ্যা।”
“টেস্টে আপনার ব্লাডে…” ফাইল খুলে একটা কাগজ দেখতে লাগলেন ওসি, “হেরোইন, কোকেনসহ আরো কিছু রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ তো ছিলোই, সাথে ছিলো…’ কাগজ থেকে পড়ছেন তিনি, পারফর্ম্যান্স এনহ্যান্সিং ড্রাগস, অ্যাম্ফেটামিন, মেথ…
কি লিখছে…মেথঅ্যাম্ফেটামিন, এফেড্রিনসহ…” ফাইল বন্ধ করলেন তিনি, মুখ থেকে উধাও হয়েছে হাসিটা। “ড্রাগের ব্যাপারে অনেক কড়াকড়ি শুরু হয়েছে দুনিয়া জুড়ে। কমনওয়েলথের আগে সব দেশকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে খুব কড়কড়ি করে ডোপ টেস্ট করতে। সে-টেস্টেই এতসব ধরা পড়েছে। কি ভেবেছিলেন, এসব কেউ জানবে না?”
আমি কাঁপছি। আমার হাত কাঁপছে। কয়েক ঢোক অ্যালকোহল পেটে যাবার আগে কাঁপুনি থামবে না-কোনো একটা ড্রাগের বিচ্ছিরি সাইড ইফেক্ট এটা। সাফের আগে এই সমস্যা ছিলো না। এক হাত দিয়ে আরেক হাত চেপে ধরে আমি খসখসে গলায় বললাম, “এতে পুলিশের ইনভল্ভমেন্ট কেন?”
“কারণ শুটিং ফেডারেশনের লোক আপনাকে ভালোভাবেই চেনে। ওখানকার কতজনকে ধরে কতবার পিটিয়েছেন আপনি, মনে পড়ে? এক স্টাফের তো হাতই ভেঙে দিয়েছিলেন একবার। ওরা ঠিক লোককে দিয়েই অ্যাপ্রোচ করেছে, আমি বলবো!” পাথরের মত শক্ত মুখে বললেন ওসি। “আর আপনার বাবারও সম্মতি নেয়া হয়েছে এই ব্যাপারে। তিনিই আমাকে বলেছেন আপনাকে এখানে ডাকতে।”
আমি স্থির চোখে তাকিয়ে আছি ওসির দিকে। চোখের আগুনে ভস্ম করার চেষ্টা করছি লোকটাকে।
“ডোপপাপি জামশেদ.” দাঁত কেলিয়ে বললেন ওসি। “কেমন শোনাবে কালকের পেপারের হেডলাইন-সাফ গেমসে সোনাজয়ির ড্রাগ কেলেংকারি! ডোপপাপি জামশেদ!”
আমার হাতের কাঁপুনি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। আমার মেজাজটাও। আমি যদি এই মুহূর্তে বেরিয়ে না যাই-
আমি জানি এর পরের মুহূর্তে আমি কি করেছিলাম, আজ থেকে চার বছর আগে, উনিশশো উননব্বই সালে, ও.সি.র রুমে। ঝটকা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলাম চেয়ারটা উল্টে দিয়ে, গটগট করে হেটে বেরিয়ে গিয়েছিলাম তারপর গায়ের জোরে দরজাটা খুলে।
ভেবেছিলাম স্বপ্নেও এমনটা হবে, কিন্তু আমাকে চমকে দিয়ে খুলে গেল ঘরের দরজাটা।
আমার বাবা আব্বাস রহমান খান ঢুকলেন ভেতরে। পুরোদস্তুর স্যুট-টাই পরনে। “বাবা!” আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, চোয়াল ঝুলে পড়েছে।
“তুমি যা দেখছো তার কিছুই বাস্তব না, জামশেদ।” পকেটে হাত পুরে শান্ত কন্ঠে বললেন বাবা। আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন।
“আমি জানি, বাবা,” হতভম্ব আমি বললাম, “আমি স্বপ্ন দেখছি। এ-সবই স্রেফ স্বপ্ন।”
“তা তো বটেই,” বললেন বাবা, “শুধু সেটা না, আমি এটার কথাও বলছি।”
“এটা?” বোকার মতো বললাম আমি।
“এটা,” বললেন বাবা, জাদুকরের ভঙ্গিতে দুটো হাত ছড়িয়ে দিলেন দু-দিকে। আমি চারপাশে তাকালাম। সবকিছু বদলে গেছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি খালিভিটাতে। জঙ্গলের উল্টোদিকে, ভুট্টাখেতের পাশে, শুকিয়ে যাওয়া ধানখেতের মাঝখানে।
“চোখের সামনে যা দেখছো, সেটাকে হুট করে সত্য বলে ধরে নেবে না,” বাবা বললেন। “ইলিউশন বড় মারাত্মক জিনিস।”
আমি তাকিয়ে আছি তার দিকে। আমি জানি উনি এরপরে কি বলবেন। “আসল নকল বিচার করবে,” বিড়বিড় করে বললাম আমি।
“আসল নকল বিচার করবে,” বললেন বাবা।
আর তারপরই ঘুমটা ভেঙে গেল আমার।
সারা সকাল আর দুপুরটা খুব একঘেয়ে কাটলো। আমি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে আমার হান্টিং রাইফেল তিনটে পরিস্কার করলাম, আর বাকি সময়টা রবার্ট লুডলামের একটা উপন্যাস পড়ে কাটিয়ে দিলাম। শিপলু ওর নোটস নিয়ে স্টোরি দাঁড়া করাতে ব্যস্ত। সামাদ দুপুরের খাবারের আগপর্যন্ত বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে রইলো, মাঝে মাঝে উঠে দাঁড়িয়ে অস্থিরভাবে পায়চারি করা ছাড়া। ওর সবসময়ের গম্ভির মুখটা আরো কালো হয়ে রইলো পুরোটা সময়।
দুপুরের খাবারটা আমরা শেষ করলাম প্রায় কোনো কথাবার্তা আদান-প্রদান না করেই। কেবল শিপলু একবার বললো যে ও চায় আমি একবার বিকেলবেলা রাইফেল সমেত খালিভিটা আর জঙ্গলের আশপাশটা ঘুরে আসি, জাস্ট রুটিন চেক হিসেবে। রাজি হয়ে গেলাম।
খাওয়াদাওয়ার পরে শুয়ে পড়লাম বিছানায়। ভেবেছিলাম শুলেই ঘুম আসবে কিন্তু দুচোখের পাতা এক করতে পারলাম না কেন যেন। বহুক্ষণ শুয়ে এপাশ-ওপাশ করলাম, কাজ হলো না। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষ নির্দিষ্ট একটা সময়ে বুঝে যায় যে আর গড়িয়ে লাভ নেই, এবার বিছানা ছেড়ে ওঠার পালা। আমার ক্ষেত্রে এই রিয়েলাইজেশনটা এলো প্রায় এক ঘন্টা পরে। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম বিরক্ত আমি। শিপলুর বিছানার দিকে ঘুরে দেখলাম, ঘুমে অচেতন ও বেচারা। চশমা ছাড়া অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওকে।
প্যান্ট পরে নিয়ে বাংলোর বাইরে বেরিয়ে এলাম। চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। বাজারের দিকে যাবো।
গাঁয়ের ফাঁকা রাস্তায় ঝাঁ ঝাঁ রোদ। খানিকদূর গিয়ে মনে হলো, বের না হলেই ভালো করতাম। কিন্তু অর্ধেক রাস্তা চলে এসেছি। আর পেছনে ফিরলাম না।
বাজারের চেহারা কালকের থেকে একেবারেই ভিন্ন। কাল ছিল বাজার, অনেক লোকজন এসেছিল, আর আজ এই কড়া রোদের সদ্য বিকেলে এক-দুটো লোকের দেখা পাওয়াই কঠিন। একবার সন্দেহ হলো চায়ের দোকানটা আদৌ খোলা আছে কিনা।
আছে। আনসার আলী কাউন্টারের পেছনে বসে ঘুমে ঢুলছে। আমার সাড়া শব্দ পেয়ে চট করে উঠে দাঁড়ালো হাসিমুখে। লজ্জিত মুখে বললো, “আরে শিকারিসাহেব যে! আইসেন। চা বসে দেই নাই এখনো, দুপুরের খাওয়া খায়া আসি কেবল দোকান খুললাম, বোঝনেন…” বলতে বলতে কেতলি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে।
আমি কিছু না বলে একটা বেঞ্চে বসে পড়লাম। কাজ নেই, কাজেই আনসার আলীর কাছ থেকে একটা গোল্ডলিফ সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরিয়ে টানতে লাগলাম। আনসার আলী চা তুলে দিল। আমি নিজের ভাবনা ব্যস্ত, কিন্তু আনসার আলী আমার চা নিয়ে খুবই কনসার্নড, একটু পর পর কেবল বলছে, “এই তো হয়া গেছে। আর এক মিনিট।” যদিও আমি তাকে কোনো তাগাদা দিচ্ছি না।
আবোল তাবোল ভাবতে ভাবতেই ধাঁ করে একটা নতুন আইডিয়া মাথায় এল আমার। আচ্ছা, যদি—
ঠিক এমনি সময় গুলির শব্দটা কানে এল।
টাশশ। টাশশ।
পর পর দু’বার
এক মুহূর্ত বোকার মত তাকালাম আমি এদিক-ওদিক। মাথায় কিছুই আসছে না।
তারপরই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম এক ছুটে। গুলির শব্দ কোনদিক থেকে আসছে, বুঝতে পারছি। বাংলোর দিক থেকে। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছি না। কেন, কি কারণে-
গ্রামের রাস্তায় ছুটে বেরিয়ে এলাম আমি। খাঁ খাঁ করছে চারদিক। যতদূর চোখ যায়, কিছু দেখলাম না।
ভরা বিকেলে গ্রামের রাস্তায় হয়তো এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু আমার কাছে সেটা মনে হলো না। থমথম করছে যেন চারদিক। অস্বস্তিতে ঘামতে শুরু করলাম আমি। আর তারপরই, অনেক দূরে থাকতেই চোখে পড়লো জিনিসটা। শহরের দিকে যে রাস্তাটা গেছে, তার পাশে। আমি ছুটতে শুরু করলাম ওদিকে।
আমাদের গাড়িটা। রাস্তার পাশের খাদে পড়ে আছে ওটা। বাজারের দিকে আসার চেষ্টা করছিল ওটা, তারপর বাজার ক্রস করে নিশ্চয়ই যেতো শহরের দিকে…
আমি হাঁফাতে হাঁফাতে গিয়ে থামলাম ওটার পাশে।
দেখে মনে হচ্ছে, কেউ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে ছিটকে গিয়েছিল গাড়িসমেত। কিংবা তাকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করা হয়েছিল।
আমি হড়বড়িয়ে রাস্তা থেকে নেমে পড়লাম গাড়িটার পাশে।
গাড়িটার প্যাসেঞ্জার ডোর খোলা। ভেতরে কেউ নেই। খালি খানিকটা রক্ত আর কাঁচ পড়ে আছে সিটের ওপরে। আমার হার্টটা রেসের ঘোড়ার মত ছুটছে এখন। আমি ড্রাইভিং ডোরটার দিকে তাকালাম। গুলির চিহ্ন!
কেস স্টাডি : ‘রিগর মর্টিস
[বরাবরের মতই মাসিক হালচালে প্রকাশিত হয়েছিল শিপলুর এই কেস ইনভেস্টিগেশনটা। মূল ঘটনার পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া ছিল-সেটা বাদ দিয়ে বাকিটা এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো]
সাবজেক্টের নাম ডা: মো: আলতাফুর রহমান (নাহিদ), এম.বি.বি.এস, বিসিএস (স্বাস্থ্য)। বয়স আনুমানিক বিয়াল্লিশ বছর।
ঘটনাটা লিপিবদ্ধ করেছি ডাক্তারসাহেবের বাড়িতে বসেই, আগস্টের এক বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়। বাইরে তখন ঝোড়ো হাওয়ার মাতামাতি। মোমবাতির আবছা আলোয় ডাক্তারসাহেবের স্টাডি রুমটাকে রহস্যময় লাগছে। আড়চোখে একবার চেয়ে নিলাম ঘরটার অন্ধকার এক কোণে ঝোলানো আস্ত কঙ্কালটার দিকে। চা’টা শেষ করে সোফায় হেলান দিয়ে ছাদের দিকে আনমনে তাকিয়ে শুরু করলেন ডাক্তার। এখানে পুরো ব্যাপারটা হুবহু তার জবানবন্দিতেই তুলে দিচ্ছি।…
আমার প্রথম কর্মস্থল… হাসপাতালে যখন পৌঁছলাম, সন্ধ্যা তখন হব-হব করছে। পনের বছর আগের কথা। হাসপাতালটা যে-শহরে, সেটা তখনো ততটা সরগরম হয়ে ওঠেনি, শহরতলি-শহরতলি গন্ধ তখনো তার গায়ে। সন্ধ্যের পরে শহরের আর সব জায়গার মত ফাঁকা হয়ে আসছে বিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটার প্রাঙ্গন, বহির্বিভাগটা বন্ধ, এদিক-সেদিক উদ্দেশ্যহীনভাবে কেবল হাটাহাটি করছে জনাকয়েক মানুষ।
বিশাল হাসপাতালটার অবয়ব কেবল গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে সন্ধ্যার ছায়ার মাঝে। ওটার দিকে আনমনে চাইলাম আমি। জানি না কেন, বুকের ভেতরটা ছলাৎ করে উঠলো হঠাৎ। পাত্তা দিলাম না অবশ্য। বিশাল জার্নি করে এসেছি, রেস্ট দরকার। সোজা চলে গেলাম জুনিয়র আবাসিক ডাক্তারদের ডর্মিটরিতে।
পরেরদিন সাতসকালে কাজে যোগ দিলাম। ডিরেক্টরসাহেবকে গিয়ে নাম বলতেই বললেন, “ডা. আলতাফুর রহমান? ওয়ার্ড নং তিনশো আট। প্রফেসর রফিকের আন্ডারে। চারতলায় উঠে যান।”
হাত দিয়ে অ্যাপ্রনের বোতাম সোজা করতে করতে সিঁড়ির দিকে চললাম। ডাক্তার হবার পরে অ্যাপ্রন সবসময় না পরলেও চলে, কিন্তু আমার অভ্যাসটা যায়নি।
হাটতে হাটতে খেয়াল করলাম, হাসপাতালটা বানানো হয়েছে পুরনো ভবনের সাথে নতুন ভবন জুড়ে দিয়ে। আমার ওয়ার্ডটা পড়েছে পুরনো ভবনেই।
বাংলাদেশের হাসপাতাল যেমন হয় আরকি। ব্লিচিং পাউডার, ঘাম আর বমির একটা মিশ্র গন্ধ বাতাসে, স্যাঁতসেঁতে দেয়াল, করিডোরের দু-পাশেই মেঝেতে শুয়ে আছে রোগি, নাহয় রোগির আত্মীয় স্বজন। কেউ কেউ আবার এরই মধ্যে টিফিন বাটি খুলে খেতে বসেছে। ভারি গুমোট বাতাসে ভেসে বেড়ানো দুর্গন্ধে যোগ হয়েছে একটা নতুন মাত্রা।
চারতলায় উঠে এলাম। সার্জারি ওয়ার্ড। এখানেই আমার ডিউটি।
এইখানে একটা কথা বলে রাখি। চারতলায় পা দেবার সাথে সাথেই একটা অদ্ভুত অনুভূতি হলো আমার। পা যেন চলতে চাইছে না, শিরদাঁড়ায় একটা শীতল অনুভূতি। গোটা ওয়ার্ডের বাতাস যেন থমথম করছে। দিনের বেলাতেও কেমন আলো আঁধারী পুরো জায়গাটা। ওয়ার্ডের ভেতরে যন্ত্রণায় কঁকাচ্ছে কয়েকজন রোগি। করিডোরে পড়ে থাকা এক রোগির পায়ের হলদেটে ব্যান্ডেজের ওপরে ভনভন করছে কয়েকেটা মাছি। অসুস্থতার গন্ধ চারপাশে।
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে আড়ষ্ট ভাবটা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। অ্যামপুটেড পা নিয়ে মেঝেতে শুয়ে থাকা একটা শুকনো বাচ্চা ঘোরলাগা চোখে আমাকে অনুসরণ করছে। মরফিনের ফল মনে হয়।
এক নার্সের সাথে কথা বলে জানলাম, প্রফেসর রফিক অপারেশন থিয়েটারে, গ্যাস্ট্রো জোজুনোস্টমির অপারেশন করছেন একটা। তার সাথে কথা বলার আগে ডিউটি বুঝে পাবার আশা নেই, কাজেই আমি সময় কাটানোর জন্য অ্যাপ্রনের পকেটে হাত ঢুকিয়ে পায়চারি শুরু করলাম আস্তে ধীরে।
হাসপাতালের যে কোনো ওয়ার্ডের পরিবেশ যে কোনো নন-মেডিকেল পারসনের কাছে ডিজগাস্টিং মনে হবে। হলদে আলো, বমি আর ব্লিচিং পাউডারের গন্ধ, অসুস্থ মানুষজন শুয়ে আছে, কারো পায়ের ঘা পচে গেছে, কারো পেটে অবিশ্বাস্য রকম বড় সেলাই, এইমাত্র কেউ মরে গেল। কিন্তু একজন ডাক্তার বা মেডিকেল স্টুডেন্টের কাছে ওয়ার্ডের চাইতে বড় বন্ধু আর কেউ না। ওয়ার্ডে হাটাহাটি করলেও জ্ঞান বাড়ে। আমার মেডিকেলের পেডিয়াট্রিকসের প্রফেসর বলেছিলেন, “ওয়ার্ডে বই না আনলেও চলে। যে দুইশো জন পেশেন্ট দেখছো, এরা সবাই একেকটা বই। এদের কাছ থেকে যত শিখতে পারবে, ততটা আমিও শেখাতে পারবো না।”
স্যারের কথা বেদবাক্য হিসেবে নিয়েছিলাম এবং ফল পেয়েছিলাম ছাত্রজীবনে। যতটা সম্ভব সময় কাটাতাম ওয়ার্ডে। রোগি ইক্সামিন করতাম। এমবিবিএস পাশ করার পরেও অভ্যাসটা যায়নি। ইনটেস্টিনিয়াল পারফোরেশনের কারণে পেট ফুলে ঢোল হওয়া এক পেশেন্টের দিকে আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, এমন সময় বিষম একটা ধাক্কা খেয়ে উল্টে পড়ার অবস্থা হলো।
কোনোমতে সামলে নিয়ে সোজা হতে হতেই শুনলাম, “স্যরি স্যরি স্যরি! আই অ্যাম সো স্যরি! ব্যথা পেয়েছেন?”
ভালো করে তাকিয়ে দেখি এক রোগামত অ্যাপ্রন পরা ছেলে অপ্রস্তুত চোখে তাকিয়ে আছে। ঘাড়ের ওপর বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ঝুলে আছে একটা স্টেথোস্কোপ, যে কোনো সময়ে খসে পড়ে যেতে পারে। মাথায় এলোমেলো চুল, চশমায় ঢাকা ঘুমহীন লালচে চোখ। ইন্টার্নি ডাক্তার হবে নিশ্চয়ই। “আপনার ব্যথা লাগেনি তো?” আবার বললো সে।
“না, না, আমি ঠিক আছি।” আমি আশ্বস্ত করলাম ছেলেটাকে।
“মাফ করবেন! আজকে ওয়ার্ডের রেজিস্ট্রার আসেনি, তার ওপর কালকে ছিলো অ্যাডমিশন, নতুন নতুন রোগি এসেছে, আর সব কাজ চেপেছে আমার মাথায়, কাল সন্ধ্যা থেকে ডিউটি করছি…” হরবড়িয়ে বলে যেতে থাকে সে। আমি হেসে আশ্বস্ত করি, ইটস ওকে, আমি নিজেও ইন্টার্নি থাকা অবস্থায় প্রায়ই এরকম অবস্থায় পড়তাম।
“ওহ আচ্ছা! আপনিই বোধহয় নতুন রেসিডেন্ট ডক্টর?” হাত বাড়িয়ে দেয় তরুণ ডাক্তার। “আমি ডক্টর প্রতুল। এ-বার এমবিবিএস পাশ করেছি, সার্জারি ওয়ার্ডে এসেছি দু-সপ্তাহ হলো।”
ইউনিটের হেড রফিক স্যারের আসতে দেরি হবে, কাজেই সে সময়টা বসে না থেকে প্রতুলকে রোগি দেখায় হেল্প করলাম। কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনেক কথা হলো প্রতুলের সাথে। বেশ চমৎকার আর ব্রিলিয়ান্ট ছেলে। প্লেস করেছে সব প্রফেশনাল এক্সামেই। প্রতুলের সাথে খাতির হয়ে যেতে সময় লাগলো না আমার। ইন্টার্নি ডক্টরদের হাজারো জিজ্ঞাসা, সেসব প্রশ্নের উত্তর দিলাম খুশিমনেই
ওয়ার্ডে প্রথম দিনটা ভালোই কাটলো। প্রফেসর রফিক খুব কড়া মানুষ, কিন্তু ডিউটি ঠিকমত করলে নাকি তার মতো ভালো আর নেই। শুরুতেই একগাদা রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন শুনিয়ে দিলেন আমাকে। আমি অবশ্য ঘাবড়ালাম না। নিজের মেডিকেলে ডিউটি করার সময় থেকেই পরিশ্রমের অভ্যাস আছে আমার।
প্রথম দিনে আমার ডিউটি সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত। প্রতুল লাঞ্চের সময়ই চলে গিয়েছিল, আমি বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় ও ঢুকলো ঢুলতে ঢুলতে। “নাইট ডিউটি আছে ভাই,” চিঁ চিঁ করে বললো ও। “পর পর দুইদিন নাইট ডিউটি দিয়েছেন রফিক স্যার! আর আমি এদিকে ঘুমে চোখ খোলা রাখতে পারছি না, কি জ্বালা!”
আমি হেসে ওকে স্বান্ত্বনা-টান্ত্বনা দিয়ে চলে এলাম আবাসিক ডক্টরদের ডর্মিটরিতে। রাতের খাওয়া সেরে নিলাম তাড়াতাড়ি। ঘড়িতে দেখি কেবল সাড়ে নয়টা বাজে। এত তাড়াতাড়ি শোয়ার অভ্যেস নেই-হলে থাকার সময় তো রাত বারোটার আগে শত চেষ্টাতেও চোখের পাতা এক করতে পারতাম না।
বারান্দায় এসে একটা সিগারেট ধরালাম। ফুরফুরে বাতাস। চমৎকার আবহাওয়া। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাটতে হাটতে ডর্মিটরির গেটের কাছে চলে এলাম। বুড়োমত এক দারোয়ান লাঠিহাতে পাহারা দিচ্ছিলো। গল্প জুড়ে দিলাম তার সাথে। নতুন কোনো জায়গায় গিয়ে যদি একটু আরামে থাকতে চান তাহলে সবার আগে সেখানকার কর্মচারিদের সাথে খাতির জমাতে হয়-এটা রুল নাম্বার ওয়ান।
দারোয়ান মতি মিয়া দেখলাম হাসপাতালের নাড়ির খবর রাখে। আমি কোন ওয়ার্ডে আছি সেটা শুনেই বলে উঠলো, “ও আপনে ডাক্তার শহীদ সাবের বদলে আইছেন। বুঝতে পারছি।”
“ও, আমার পোস্টে আগে ডক্টর শহীদ ছিলেন? তিনি কি প্রমোশন পেয়ে চলে গেছেন?”
“উঁহু,” গম্ভিরভাবে মাথা নাড়লো মতি মিয়া। “উনি আছিলেন বেশিদিন হয় নাই। মাসখানেক হইবো। তারপর তাড়াহুড়া কইরা বদলি হইয়া চইলা গেলেন।”
“তাড়াহুড়া করে কেন? কাজের চাপের সাথে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না নাকি?” জিজ্ঞেস করলাম। মনে মনে বললাম, যে লোক স্ট্রেসের সাথে কুলিয়ে নিতে পারে না, সার্জারি তার জন্য না।
“না,” মুখচোখ গম্ভির করে রহস্যমাখা গলায় বললো মতি মিয়া 1
“তাহলে?” জিজ্ঞেস করলাম সাথে সাথে।
আমার কৌতূহল বুঝতে পেরেছে মতি মিয়া। বল এখন তার কোর্টে। ভাঁজ পড়া মুখটা আরো গম্ভির করে ধীরে ধীরে মাথা দোলালো সে, নিরবতাটা আরো গভির করো আমার আগ্রহ আরো বাড়িয়ে তুলতে চাইছে। শেষে যখন আমি অধৈর্য হয়ে ওকে তাগাদা দেবার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছি তখন সে বলে উঠলো, “সেইটাই তো হইলো গিয়া আপনের রহস্য।”
রহস্যটা কি, সেটা শোনার জন্য আমি মরে যাচ্ছি বটে, কিন্তু ঠিক করলাম আর কিছু জিজ্ঞেস করবো না। দেখি মতি মিয়া কতক্ষণ পরে নিজে থেকে বলে।
যা ভেবেছিলাম তাই হলো। আমি আর কিছু জানতে চাইছি না দেখে মতি মিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে কিছুক্ষণ, তারপর বলেই ফেললো, “উনি খুব ভয় পাইছিলেন।”
“ভয় পাইছিলেন?”
“হ।” বলে চোখ সরু করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো বুড়ো গল্পবাজ দারোয়ান।
“কিসের ভয়? এলাকার গুন্ডা-মাস্তানের ভয়?
“নাহ।” যেন কোনো আগ্রহই নেই এমন ভঙ্গিতে বললো মতি মিয়া। “গুন্ডা- পান্ডা তো হইলো এই জগতের জিনিস। ওনার ভয়ের জিনিস আছিল আলাদা জগতের।”
বুঝলাম গল্পটা কোন খাতে বয়ে নেবার চেষ্টা করছে মতি মিয়া। হালকা স্বরে বললাম, “ডর্মিটরিতে তাহলে ভুত আছে?”
“নাহ। এইখানে কই পাইবেন।” গলা নামিয়ে নেয় মতি মিয়া তারপর, “উনি ভয় পাইছিলেন হাসপাতালে। আপনে যে ওয়ার্ডে এখন, সে ওয়ার্ডে।”
“ওয়ার্ডে?” আমি আরেকটা সিগারেট ধরাই। “ঝেড়ে কাশো তো মতি মিয়া গোটা গল্পটা বলো।”
মতি মিয়া যা বললো তার সার-সংক্ষেপ হচ্ছে, ডাক্তার শহীদের একদিন নাইট ডিউটি ছিলো ওয়ার্ডে। ডিউটি স্টেশনে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে সে—চোখ খুলে দেখে, গোটা ওয়ার্ডে এক অপার্থিব আবছা আলো। লাইট-ফ্যান সব বন্ধ। সে বাদে আর কোনো মেডিকেল পার্সন গোটা ওয়ার্ডে নেই। ব্যাপার কি সেটা দেখার জন্য বাইরে বের হতে গিয়ে দেখে সব দরজা জানালা বন্ধ, বেরোনোর কোনো উপায় নেই। মনের মধ্যে একটা সন্দেহ জেগে ওঠার পরে একটা রোগিকে পরীক্ষা করে দেখে, সে রোগি বেঁচে নেই, চোখ উল্টে মরে পড়ে আছে। আরেকটা রোগিকে পরীক্ষা করে দেখে, সে-ও পটল তুলেছে। একে একে দেখা গেল সব রোগিই মরে কাঠ হয়ে আছে কোনো অজানা কারণে। ঠিক এমন সময় কোনো একটা কিছু দেখে প্রচন্ড ভয় পায় সে। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। এক ওয়ার্ড বয় এসে জাগিয়ে তোলে তাকে-ডাক্তার শহীদ চোখ খুলে দেখে সব স্বাভাবিক, ওয়ার্ডের রোগিরাও বেঁচে বর্তে আছে বহাল তবিয়তে। এর পরও অবশ্য ডিউটি চালিয়ে যায় সে। কিন্তু পর পর তিনদিন একই তরিকায় ভয় পাবার পরে আর থাকা সম্ভব হয়নি তার, বলা যায় ডিরেক্টরসাহেবের হাতে পায়ে ধরে বদলি হয়ে যায় আরেকটা অপেক্ষাকৃত বাজে হাসপাতালে।
“ইন্টারেস্টিং,” বললাম আমি থুতনি ডলতে ডলতে। মনে মনে অবশ্য ভাবছি ডাক্তার শহীদ দিনে কয় ছিলিম গাঁজা টানতো, বা কয় বোতল বাংলা সাবাড় করতো। নিরস গলায় বললাম, “কি দেখে ভয় পেতো, সেটা বলেনি?”
“না, সেইটা কয় নাই,” মতি মিয়ার গলায় স্পষ্ট হতাশা। “তয় যাওয়ার আগে আমারে কয়া গেছিলো, তিনি এমন একটা কাজ করছিলো যেটা তার করা উচিত হয় নাই।”
“সেই কাজটা কি সেটা বলছিলেন?”
মতি মিয়া বলতে পারলো না। আরো কিছুক্ষণ গল্প-টল্প করে মতি মিয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলাম, শুয়ে পড়বো এবার। কাল লম্বা ডিউটি আছে।
চলে আসবো, এমন সময় মতি মিয়া অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, “সাব, একটু সাবধানে থাইকেন হাসপাতালে। বহুদিন আছি আমি এইখানে, বহুত কিছু শুনছি—এই হাসপাতাল ভালা না।”
পরের দিন সকালে ওয়ার্ডে গিয়েই দেখি প্রতুল এক রোগির বেডের কাছে দাঁড়িয়ে রেগেমেগে কিসব বলছে। ব্যাপারটা খতিয়ে দেখার জন্য কাছে এগিয়ে গেলাম।
“পাগলামি করবেন না তো!” প্রতুল ধমকের ভঙ্গিতে বলছে এক রোগিকে। “অপারেশন না করলে আপনি মরে যেতে পারেন, এটা বারবার বলার পরেও বুঝতে চাচ্ছেন না কেন?”
রোগির বাম পায়ে দগদগে গ্যাংগ্রিন। গন্ধে কাছে যাওয়াই কঠিন। মধ্যবয়ষ্ক লোকটা তবু চিঁ চিঁ করে বলছে, “অপারেশন তো করবেন বুঝলাম। কিন্তু সেই অপারেশনে যদি আমার পা আগের মতো ভালা হইয়া যাইতো, তাইলে এক কতা ছিল, কিন্তু ডাক্তার সাব, আপনে তো আমার গোটা পাওটাই কাইটা ফেলনের কথা বলতেছেন…”
রোগি বোকামি করছে অবশ্যই। পায়ের যে অবস্থা, আজকের মধ্যে অ্যামপুটেশন না করলে তাকে বাঁচানোই কঠিন হয়ে যাবে। এরকম পরিস্থিতিতে রোগির সাথে হালকা কাউন্সেলিং করতে হয়। আমি এগিয়ে গিয়ে প্রতুলের সাথে মিলে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সে-লোক কিছুতেই রাজি না, পা সে কাটবেই না। গাঁয়ের মোড়ল বা নেতা টাইপের কিছু ছিল বোধহয় সে, গোঁয়ার গোবিন্দ।
অন্য রাস্তা ধরলাম। রোগির অ্যাটেনডেন্টকে ডেকে আনলাম তার মেয়ে। মেয়েকে খানিকক্ষণ বোঝানোর পরে সরে এলাম। এবারে কাজ দেবার কথা।
দূর থেকে দেখছি, বাবা-মেয়ের মাঝে আবেগের খেলা চলছে। মেয়ে কান্নাজড়িত স্বরে কি যেন বললো লোকটাকে অনেকক্ষণ, কয়েক ফোঁটা চোখের জলও খরচ হলো, শেষে দেখলাম গ্যাংগ্রিনের রোগি কাঁদো কাঁদো চেহারায় মেয়ের মাথায় হাত বোলাচ্ছে। এর খানিক বাদে মেয়ে আমাদের কাছে এসে বললো, তার বাবা আমাদেরকে ডেকেছে, কিছু বলতে চায়। খুশিমনে এগিয়ে গেলাম। মেয়ে অবশ্য আমাদের সাথে এলো না।
রোগির পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। “আমার মেয়েরে কি বুঝাইছেন জানি না,” হলদে চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললো সে, “কিন্তু সে পাগল হইয়া গেছে আমার পা কাটনের লাইগা। পাগলি মাইয়া আমার, আপনারা উল্টাপাল্টা যা বুঝাইছেন তাই বুঝছে। বাপের পাও কার্টনের কথা কইতেছে! ঠিকাছে, পা আমি কাটামু। আপনে অপারেশনের জোগাড়যন্ত্র করেন। কিন্তু ডাক্তার সাব, কাজটা কিন্তু আপনে ভালো করলেন না। আমার পা এমনেই ঠিক হইয়া যাইতো। আপনে হুদাই আমার ভালো পা-টা কাটাইতেছেন।”
চলে আসার আগে শুনলাম রোগি আবার বললো, “কাজটা ভালো করলেন না, ডাক্তার সাব।”
লাঞ্চের সময় হাসপাতালের বাইরের পে-ফোন বুথে এসে ঢুকলাম। নিজেকে বোকাবোকা লাগছে, কিন্তু তবুও বহু কষ্টে জোগাড় করা একটা নাম্বার ঘোরালাম স্লটে কার্ড সেঁধিয়ে।
লং ডিসটেন্স কল, বহুক্ষণ লাগলো লাইন পেতে। যাকে চাচ্ছি তাকে পেতে সময় লাগলো আরো। পেলাম অবশ্য শেষতক। “ডাক্তার শহীদ বলছেন?” ওপ্রান্তে
হ্যালো শোনার পর বললাম।
“জি। আপনি…”
“আমাকে চিনবেন না। আমি আপনার জায়গায় এসেছি অমুক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, তমুক ওয়ার্ডে। আপনার ব্যাপারে…”
“খুব সাবধান,” ঠান্ডা গলায় ওপাশের কন্ঠটা বললো। “ওয়ার্ডে খুব সাবধানে কাজ করবেন।”
থতমত খেয়ে বললাম, “মানে…”
“কোনো রোগি যদি কোনোকিছু করতে মানা করে, সেটা করবেন না। আপনার কাজটা যত দরকারিই হোক না কেন। আর তারপরও যদি করে ফেলেন, আর যদি…’
লাইনে খড়খড় শব্দ। ওপ্রান্তের কথা কিছু শোনা যাচ্ছে না। আমি আর্লি এইটটিজের কথা বলছি, ওখন এ-সব সমস্যা খুবই কমন ছিলো। “হ্যালো, হ্যালো’ করলাম।
আবার শোনা গেল ডাক্তার শহীদের কন্ঠ। “তাহলে হসপিটাল ছেড়ে চলে আসবেন। যে করেই হোক। না হলে কিন্তু আপনার বিশাল ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। খুব সাবধানে থাকবেন, ওখানে আমি যা দেখেছি সেটা ব্যাখ্যার অতীত।”
লাইনে বিপ বিপ শব্দ। লাইন কেটে গেছে।
ফোন করতে আসার আগে নিজেকে বোকা মনে হচ্ছিলো। আর ফোন করে ফেরার সময় নিজেকে মনে হলো মহা বোকা।
একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ঘুম ভাঙলো আমার।
রাতের ডিউটি করছিলাম। ডিউটি স্টেশনে বসে ডেস্কে কখন মাথা ঠেকে গেছিলো, আর কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, জানি না। এমনটা হয়েই থাকে রাতের ডিউটিতে—কারণ রাতে গোটা ওয়ার্ড চুপচাপ থাকে, রোগিরা ঘুমায়। ডাক্তারও তো মানুষ, তারও ঘুম আসে।
কিন্তু আসল ব্যাপার সেটা না।
গোটা ওয়ার্ডে চোখ বোলাচ্ছি অবাক হয়ে। কারেন্ট গেছে নাকি? কোনো লাইট জ্বলছে না কেন? ফ্যানগুলোও তো বন্ধ। পুরো ওয়ার্ডে কবরের নিস্তব্ধতা। আমি নিজের নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাচ্ছি।
এদিক ওদিক তাকালাম। চারপাশে একধরণের আবছা আলো, হালকা বেগুনী রঙের। যেন ডিম লাইট জ্বালানো হয়েছে। কিন্তু ওয়ার্ডে তো কোনো ডিম লাইট নেই। ওয়ার্ডের বাতিও কখনো নেভানো হয় না-রাতেও না। তো আলোটা আসছে কোথা থেকে?
ব্যাপারটা বোঝার জন্য গলা উঁচিয়ে একটা ওয়ার্ড বয়কে ডাক দিলাম। “এই মনসুর! মনসুর!”
কোনো সাড়া নেই।
আমার ঘুম ততক্ষণে পুরোপুরি কেটে গেছে। ডেস্কের পেছন থেকে বেরিয়ে এলাম। পা চালিয়ে হেটে গেলাম ওয়ার্ডের দরজা পর্যন্ত। বন্ধ ওটা। কোনোভাবেই খুলতে পারলাম না। ওয়ার্ডের জানালাগুলো কখনোই লাগানো হয় না। এখন সেগুলোও বন্ধ দেখছি
মেরুদন্ড বেয়ে কুলকুল করে ঠান্ডা একটা স্রোত বয়ে গেল আমার।
ঝট করে ঘুরলাম। সবচেয়ে কাছে যে রোগিটা আছে তার বিছানার পাশে গিয়ে রেডিয়াল পালস দেখার জন্য হাত চেপে ধরলাম।
হাতটা বরফের মত ঠান্ডা, কাঠের মত শক্ত। পালসের নামগন্ধও নেই। মরিয়া আমি তবু পকেট থেকে টর্চ বার করে রোগির চোখে আলো ফেললাম। মরা ছাগলের মত ঘোলাটে চোখে কোনো পিউপিলারি রিফ্লেক্স নেই। লোকটা বহু আগেই মরে গেছে।
পাগলের মতো আরেকটা রোগি পরীক্ষা করলাম আমি। মরা। তারপর আরো দুটো। মরা। মরা।
গভির রাতে হাসপাতালের ওয়ার্ডে আটকা পড়েছি আমি। পঞ্চাশটা ডেডবডির সাথে।
ডাক্তার শহীদের সাবধানবাণী মনে পড়লো আমার।
আর সাথে সাথেই একটা শব্দ কানে এলো আমার।
থপ থপ থপ। থপ।
আমি মাথা ঘোরালাম। যা দেখলাম সেটা জীবনে ভুলবো না।
একটা…
একটা জিনিস হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে। চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে।
জিনিসটার একটা ধড় আছে-ইংরেজিতে টরসো বলে যাকে-তার সাথে সেলাই করে লাগানো দুটো হাত, আর দুটো পা। মাথা নেই। পা আর হাতের জয়েন্টেও সেলাই। ধড়টার পেটে-পিঠে অসংখ্য সেলাইয়ের দাগ, যেন অজস্র সার্জারির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে।
নরক থেকে উঠে আসা জিনিসটা হামাগুড়ি দিয়ে আমার কাছে এগিয়ে এলো। আমি নড়তেও ভুলে গেছি—গোটা শরীর অবশ। একটা পেশি নাড়ানোরও ক্ষমতা নেই আমার।
জিনিসটা আমার কাছে এসে থামলো। কাটা গলাটা উঠছে এখন আমার দিকে সোজা হচ্ছে জিনিসটা, দু-পায়ে দাঁড়াচ্ছে। হাত পা গুলো শুঁয়োপোকার মত এঁকেবেঁকে উঠছে ওটার প্রত্যেকটা নড়চড়ার সাথে সাথে। একটা নাড়িওল্টানো পচা গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার।
জিনিসটা এখন সোজা হয়েছে। মানুষের মত দাঁড়িয়ে আছে এখন ওটা দু’পায়ে ভর দিয়ে।
ওটার মাথা নেই, কাজেই মুখ নেই। কিন্তু আমি পরিস্কার শুনলাম ওটা কথা
বলছে। কথা বলছে আমার সাথে।
“আজকে পা পেয়েছি। আজকে পা পেয়েছি। আজকে পা পেয়েছি। আজকে পা পেয়েছি।” একঘেয়ে সুরে বলে যাচ্ছে ওটা। আমি কোনোমতে চোখ নামিয়ে জিনিসটার একটা পায়ের দিকে তাকালাম। পচা, গ্যাংগ্রিন ধরা একটা পা। এই পা আমি চিনি। প্রফেসরসাহেব আজকে বিকেলে এই পা-টা কেটে বাদ দিয়েছেন অনিচ্ছুক এক রোগির থেকে। আমি অপারেশনের সময় ছিলাম।
রোগিকে নিমরাজি করেছিলাম আমিই।
ডাক্তার শহীদের সাবধানবাণী মনে পড়লো-কোনো রোগি যদি কোনোকিছু করতে মানা করে, সেটা করবেন না।
“কালকে মাথা চাই। কালকে মাথা দিবি। আমাকে মাথা দিবি। আমাকে মাথা দে। আমাকে মাথা দে। আমাকে মাথা দে দে দে দে দে…”
জ্ঞান ফিরলো হাসপাতালের বেডেই। ভোরের দিকে এক ওয়ার্ডবয় আমাকে মেঝেতে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়েছিল।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েই তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালালাম। জানি, এজন্য কর্তৃপক্ষের কাছে অনেক জবাবদিহিতা করতে হবে আমাকে, অনেক শো-কজ করতে হবে-কিন্তু আমি পরোয়া করি না। আগে জানটা বাঁচাই। আর কখনো ওই হাসপাতালে ফেরত যাইনি আমি।
ডা. আলতাফুর রহমান নাহিদ থামলেন। কপালে হালকা ঘাম তার।
“তাহলে ওই জিনিসটা-” বলতে শুরু করলাম আমি, কিন্তু ড. আলতাফ থামিয়ে দিলেন আমাকে।
“আমার কাহিনী এখনো শেষ হয়নি,” ভারি গলায় বললেন ডাক্তারসাহেব। “আমি চলে আসার তিনদিন পরে সংবাদপত্রে একটা খবর দেখি-সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষানবিশ চিকিৎসক নিহত।
আমি কোনো কথা না বলে ডাক্তারসাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।
“নিহতের নাম প্রতুল কুমার রায়। অ্যাক্সিডেন্টে ওর মাথা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।”
আমি এবারও কিছু বললাম না।
“খোঁজ নিয়ে শুনেছিলাম, মর্গে প্রতুলের লাশের দুই টুকরোই আনা হয়েছিল বটে, কিন্তু দাহ করার সময় চিতায় ছিলো শুধু ধড়টা। প্রতুলের মাথাটা মর্গ থেকে হারিয়ে যায়।”
অধ্যায় ১৩ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
অধ্যায় ১৩ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
আমি শান্তভাবে চিন্তা করতে পারছি না কিছু।
মাথার মধ্যে তিনটা প্রশ্ন ঘুরছে কেবল-কে? কাকে? কেন?
কে গুলি করেছে? কাকে গুলি করেছে? কেন গুলি করেছে?
দিশেহারার মত ব্যাক সিটটা চেক করলাম আমি। কেউ নেই ওখানটায়।
ড্রাইভিং ডোরের পাশের মাটির দিকে তাকালাম আমি। ধ্বস্তাধ্বস্তির চিহ্ন ওখানটায়।
আর পড়ে আছে কয়েক ফোঁটা রক্ত।
আমার মাথা কাজ করছে না। পাগলা ঘোড়ার মত লাফাচ্ছে আমার হৃৎপিন্ড।
আগে আমাকে বুঝতে হবে এখানে ঠিক কি হয়েছিল।
একটা সম্ভাবনা হচ্ছে, কেউ এই গাড়িটাতে করে শহরের দিকে যাচ্ছিলো-যে কারণেই হোক—তারপরে জানোয়ারটা অ্যাটাক করে গাড়িটার ওপরে। গাড়ির যাত্রি গুলি ছোঁড়ে। সে গুলি যে জায়গামত লাগেনি, সেটা ড্রাইভিং ডোরের গায়ে গুলির চিহ্ন দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ভুললে চলবে না যে শিপলুর একটা পিস্তল আছে। সেক্ষেত্রে এদিকের রাস্তায় একটা লোকও না থাকার ব্যাখ্যা মেলে। জানোয়ারটাকে দিনে দুপুরে দেখার পরে সবাই দুয়ারে খিল দিয়ে ঘরের ভেতরে বসে কাঁপছে।
আরেকটা সম্ভাবনা হচ্ছে… কালকে যে সন্দেহটা উঁকি দিয়েছিল আমার মাথায়। আমি আর ভাবতে পারলাম না। এক দৌড়ে চলে এলাম বাংলোয়। দম ফুরিয়ে এসেছে, তবু কাহিল ফুসফুস নিয়েই গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম- “শিপলু! সামাদ!”
কোনো সাড়া নেই।
সাড়া পাবার আশাও করিনি অবশ্য। কেয়ারটেকারেও কোনো হদিস পেলাম না। পরের দেড় মিনিটের মধ্যে বাংলোর প্রত্যেকটা ঘর চেক করা শেষে খাটের নিচ থেকে একটানে বের করলাম রাইফেল রাখার লাগেজটা। প্রিয় অ্যান্টিক মার্লিন রাইফেলটা আর মুঠোভর্তি কার্ট্রিজ নিয়ে নিলাম নিমেষের মাঝেই।
তারপর এক দৌড়ে বেরিয়ে এলাম বাংলোটা থেকে। ঘরদরজা খোলাই পড়ে রইলো।
আই ডোন্ট কেয়ার।
আমার সন্দেহ সত্যি হলে এই বাংলোতে ফেরত আসতে হবে না আর আমাকে কোনোদিন।
ছুটতে শুরু করলাম জঙ্গলের দিকে যাওয়া রাস্তাটা ধরে। জানি, ও-দিকে যাওয়াটা একদম বৃথা হতে পারে, আমার গোটা সন্দেহটাই হয়তো আকাশ কুসুম কল্পনা, কিন্তু তবুও ওদিকে যাওয়াটা দরকার। তাছাড়া আমার প্রথম সন্দেহটা সত্যি হলে শিকারকে টেনে নিয়ে গেছে জানোয়ারটা ওদিকেই।
জানোয়ারটা বলবো? নাকি পিশাচটা?
শরতের কড়া সোনালি রোদের বিকেল। অভিশপ্ত এক গ্রামের মাটির রাস্তা ধরে ছুটছি আমি রাইফেল হাতে। আশপাশে যতদূর চোখ যায়, জনমনিষ্যির কোনো সাড়া নেই। ঘামছি আমি, মুখের ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ। নিস্তব্ধ রাস্তায় থপথপ শব্দ তুলছে আমার পা।
হঠাৎ মনে হতে থাকে. এ-সবের কিছুই বাস্তব না। ভয়ংকর এক দুঃস্বপ্ন এটা হাহ। সেটা হলে তো বেঁচেই যেতাম।
ওই তো চোখে পড়ছে জঙ্গল। আর খালিভিটা। ভুট্টাখেত আর একাত্তরের বধ্যভূমির মিশেল।
আমি হঠাৎ বুঝে গেলাম আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি না। কারণ আমি যে পৈশাচিক বিপদে পড়েছি, তেমনটা স্বপ্নেও সম্ভব না। দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। হাঁপাচ্ছি। আমাকে ওই ভুট্টা খেতে ঢুকতে হবে।
জানি, পিশাচটা জঙ্গলে থাকে, কিন্তু যত জন মানুষ মারা গেছে, সবার লাশ পাওয়া গেছে ভুট্টা খেতে, বা ধানখেতে। কাজেই ভুট্টাখেতেই আগে ঢুকতে হবে আমাকে। কথাটা ভাবতেই শিরশির করে উঠলো আমার পিঠের মাঝখানটা। পাক দিয়ে উঠলো পাকস্থলি।
পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালাম পরিত্যক্ত ধানখেতটার কাছে। কখনো-না-কাটা শুকনো ধানখেতটা পেরোলেই সামনে ভুট্টার খেত। ধানখেতের মাঝখানে কোনোকিছু নাড়াচাড়া করছে। একটা কাক। বিশাল একটা দাঁড়কাক।
শিপলু দুই চোখে কাক দেখতে পারে না। বিশেষ করে দাঁড়কাক। ওরা নাকি যত দুঃসংবাদ বয়ে আনে।
আমি আরেক পা এগোতেই উড়াল দিলো দাঁড়কাকটা। রাইফেল উঁচিয়ে ধীরে ধীরে পেরিয়ে এলাম ধানখেতটা। মাথার ওপর ঝাঁ ঝাঁ করছে তীব্র রোদ। আমার হাত কাঁপছে। আমি পকেটে হাত দিয়ে চ্যাপ্টা ফ্লাস্কটা বের করে আনলাম। ছিপি খুলে মুখের ওপর উপুড় করে ধরলাম ওটা।
পেটে চালান করে দিলাম অনেকটা অ্যালকোহল। জ্বলতে জ্বলতে নেমে গেল ওটা পাকস্থলিতে।
আর কাঁপবে না আমার হাত। আমি রাইফেলটা উঁচিয়ে ধরলাম আবার। তারপর পা দিলাম ভুট্টা খেতের ভেতরে। এদিক দিয়ে কোনোকিছু গেছে মনে হচ্ছে।
মাথার ওপরে কাকের ডাক শুনতে পেলাম আমি।
কাকটা ডাকতে ডাকতে আমার মাথার এত কাছ দিয়ে উড়ে গেল যে ওটার ডানা ঝাপটানোর শব্দ পরিষ্কার শুনতে পেলাম।
“কা! কা! কা!”
চোখের ওপরের কোণা দিয়ে লম্বাটে একটা কালচে ঝলক দেখলাম শুধু। কাকটা।
কি কাক ওটা? জানতে ইচ্ছা করছে। সাধারণ পাতিকাক? না গম্ভির, রাজকীয় র্যাভেন? দাঁড়কাক? জানতে ইচ্ছা করছে কেন যেন।
মাথাটা সম্ভবত কাজ করছে না আমার। হয়, এমনটা হয় অনেকসময়। বিশেষ করে চরম উত্তেজনার মুহূর্তে। যেমন এখন। হাত কিন্তু ঠিকই কাজ করছে আমার। রাইফেলের ব্যারেলটা কাঁপছে না।
কাকটা বিদায় নেবার পরে চারপাশটা আবার নিরব। ঠিক যেন মিউট করা একটা সিনেমা।
একটুও বাতাস নেই। চারপাশের ভুট্টা গাছগুলোর একটাও কাঁপছে না।
আমার চারপাশ ঘিরে একদম স্থির ভুট্টা গাছগুলো।
দরদরিয়ে ঘামছি আমি। নিজের মাথায় আর মুখে হাত বোলালাম। আমার সারা মুখ ঘামে ভেজা। যত্ন করে রাখা গোঁফজোড়া আর মুখের খোঁচা খোঁচা দাড়ি হাতে ঠেকলো। মাথার ওপরে ঝাঁ ঝাঁ করছে সূর্যটা। তীব্র রোদ। কিন্তু এই মরা ভূট্টা ক্ষেতের গাছগুলোর মাঝে তবুও ছায়া-ছায়া অন্ধকার।
দরদর করে ঘামছি।
রুমাল বের করে ঘাম মুছবো কি? না, ঝুঁকিটা নেয়া ঠিক হবে না। বন্দুকে হাত রাখাটাই সবচেয়ে নিরাপদ ঠেকছে আমার কাছে। রাইফেল নামানো যাবে না। এদিক-ওদিকে তাকিয়ে নিলাম একবার। কোনদিকে যাবো, বুঝতে পারছি না। পথ হারিয়ে ফেলেছি ভালোভাবেই। অনিশ্চিতভাবে সামনে বাড়লাম এক পা। প্রচন্ড রোদ মাথার ওপরে। মাথার মগজ ফোটানোর মত গরম রোদ। চোখ ধাঁধিয়ে দেবার মত রোদ। সামনের একটুখানি জায়গার ভুট্টাগাছ দু-দিকে সরে আছে যেন খানিকটা।
পায়ে চলার পথ? কার? মানুষের, না অন্যকিছুর? মানুষের, না…তবে সন্দেহ নেই, এই পথে যাওয়া আসা করে কোনোকিছু।
আরেকটু সামনে এগোলাম। পায়ের নিচে মচমচ করছে ভুট্টার শুকনো পাতা। অসহ্য নিরবতার মাঝে সেটাই বড় বেশি হয়ে কানে বাজছে।
হাটার গতি বাড়িয়ে দিলাম হঠাৎ। যা হয় হবে, আমি এদিক দিয়েই যাবো।
বন্দুকের বাট কাঁধে ঠেকিয়ে নিয়েছি। আমার ভরসা এখন একটাই, আমার গোল্ডমেডেল-জেতা নির্ভুল নিশানা।
দশ পা গিয়েই থমকে গেলাম। আরেকটা পায়ের শব্দ কানে এসেছে। কেউ এদিকেই আসছে। আমি তৈরি। কাঁধে রাইফেল।
এতক্ষণ গরমে ঘামছিলাম আমি, এবারে হাড় কাঁপানো একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল আমার ওপর দিয়ে। কানের কাছে শুরু হলো ফিস ফিস আওয়াজ। আর সেই সাথে হালকা একটা ভন ভন শব্দ, যেন পচা কোনোকিছুর ওপর ঘুরছে মাছির ঝাঁক। I একেকটা সেকেন্ডকে একেকটা ঘন্টার মতো লাগছে।
পায়ের শব্দটা কাছিয়ে আসছে। বাড়তে বাড়তে সেটা যেন গির্জার ঘন্টার মতো জোরালো হয়ে আমার কানের পর্দা কাঁপিয়ে দিচ্ছে।
এখনই আমার সামনে এসে দাঁড়াবে জিনিসটা।
অধ্যায় ১৪ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ১৪ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
শিপলু!
শিপলু এসে দাঁড়িয়েছে আমার সামনে!
হতবাক আমি রাইফেল নামিয়ে নিলাম। “শিপলু! তুই এখানে!”
শিপলু দাঁত বের করে হাসছে আমাকে দেখে। আমার প্রশ্নে জবাবে কিছু বললো না অবশ্য। কপালে ঘাম ওর, ঘামছে ও দরদরিয়ে। ওর প্যান্টের হাটুতে মাটির ছাপ।
“কি করছিলি তুই এখানে?” জিজ্ঞেস করলাম আমি
“এই তো, একটু ইনভেস্টিগেশন,” ইতস্তত করে জবাব দিলো শিপলু। পকেটে হাত দিলো ও, বের করে আনলো একটা মার্লবোরো সিগারেটের প্যাকেট। আরেক পকেট থেকে লাইটার বের করে ধরালো ব্যস্ত হাতে।
কিছুই মাথায় ঢুকছে না আমার। হাঁ করে তাকিয়ে আছি শিপলুর দিকে। “এই রোদের মধ্যে কিসের ইনভেস্টিগেশন?”
“ওমা, রোদের মধ্যে করবো না তো রাতের বেলা করবো নাকি?” হাসার চেষ্টা করলো শিপলু, কিন্তু হাসিতে প্রাণ নেই। চোখের কোণা দিয়ে বামদিকে কি যেন দেখার চেষ্টা করছে ও।
আর ঘামছে। শিপলুকে এতটা ঘামতে দেখিনি আর কখনো।
শিপলু সিগারেট ধরা হাতটা মুখের কাছে তোলার সময় খেয়াল করলাম, ওর হাত কাঁপছে।
কোনোকিছুতে বিশাল একটা গড়বড় আছে। বিশাল একটা গড়বড় আছে কোনোকিছুতে।
আমি রাইফেলটা শক্ত হাতে চেপে ধরলাম। “শিপলু! কি হচ্ছে এখানে?”
ফ্যাকাশে একটা হাসি হাসলো শিপলু। সিগারেট ধরা হাতটা এতো কাঁপছে যে ছাই ঝরে পড়ছে ওটা থেকে। “কি হচ্ছে আবার?” ধরা গলায় বললো ও।
“সামাদ কই? আমাদের গাড়িটার ওই অবস্থা কেন?” চাবুকের মত শপাং করে প্রশ্ন করলাম আমি।
শিপলুর দিকে সোজা তাকিয়ে আছি আমি। ঠোঁট কাঁপছে ওর, চোখের মেকি স্বাভাবিকত্বটা সরে গিয়ে বেরিয়ে আসছে তীব্র আতঙ্কের ছাপ, মুখ হাঁ হয়ে দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে ওর।
আমার বামে একটা খচমচ শব্দ হলো। আমি সেদিকে তাকানোর আগেই ওদিকে ঝট করে মুখ ফিরিয়েছে শিপলু, তার পরেই আমার গায়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ও। আমি আর শিপলু একসাথে মাটিতে পড়ার আগেই চারপাশের থমথমে নিস্তব্ধতা খানখান করে গর্জে উঠলো একটা পিস্তল।
কয়েকটা মুহূর্ত আমার মাথাটা ফাঁকা হয়ে রইলো। কোত্থেকে কি হয়ে গেল, কিছুই বুঝতে পারছি না।
শুকনো ভুট্টার পাতায় ছাওয়া মাটিতে পড়ে আছি, গায়ের ওপরে শিপলু।
কে গুলি করলো? আমার কি গুলি লেগেছে? বা শিপলুর?
আমার মুখ সোজা আকাশের দিকে ফেরানো-শরতের উজ্জ্বল আকাশের তীব্রতায় চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আমার। হাত থেকে কোথায় যেন ছিটকে পড়েছে রাইফেলটা। কতক্ষণ পড়ে ছিলাম জানি না, কেবল টের পেলাম শিপলু উঠছে আমার গায়ের ওপর থেকে, কাউকে বলছে, “প্লিজ, মারবেন না আমাদেরকে। প্লিজ। আমরা কাউকে কিছু বলবো না। বিশ্বাস করুন।”
জবাবে বিশ্রীভাবে হেসে উঠলো কেউ। টিটকিরির হাসি। এই হাসি আমি চিনি।
ধীরে ধীরে মাথাটা ঘোরালাম আমি শিপলু যার সাথে কথা বলছে তার দিকে। আমার ধাঁধিয়ে যাওয়া চোখে প্রথমে দেখতে পেলাম না কিছু। তারপর চোখটা ভুট্টাখেতের ভেতরের ছায়া-ছায়া আঁধারের সাথে মানিয়ে নেবার পরে ধীরে ধীরে লোকটার অবয়ব ফুটে উঠলো চোখের সামনে।
মফিজ দারোগা!
হাতের পুলিশ রিভলভারটা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মফিজ দারোগা। ঠোঁটে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি। একবার চোখ নামিয়ে দেখলো আমার দিকে. তারপর আবার তাকালো শিপলুর দিকে।
“প্লিজ,” অনুনয়ের সুরে বললো শিপলু। দু-হাত জোড় করে তাকিয়ে আছে মফিজ দারোগার দিকে। “আমরা ভালোয় ভালোয় চলে যাবো এখান থেকে। কেউ কোনোদিন জানবে না এই গ্রামে কি হয়েছিল।”
“সেটা পরে দেখা যাবে,” মফিজ দারোগা মুখে একটা একপেশে হাসি হেসে বললো। গ্রাম্য পুলিশের ভাবটা চলে গেছে তার হাবভাব থেকে, চোখা একটা ডাঁট চলে এসেছে সেখানে কোথা থেকে। “আগে তোর ডোপ পাপি বন্ধুকে দাঁড়া করা। শিকারি, হাহ! খুন করে খুব তো পালিয়ে এসেছিস ঢাকা থেকে!”
সত্যি বলছি, মফিজ দারোগার প্রথম বাক্যটা শুনে লাফিয়ে তার গায়ের ওপরে পড়ে তার জিহ্বাটা টেনে ছিঁড়ে নেবার প্রস্তুতি নিয়েই নিয়েছিলাম প্রায় আমি তার হাতে পিস্তল থাকা সত্ত্বেও। ক্লাস এইটে পড়ার সময় এক এম.পি’র ব্যাটা আমাকে ‘জ্যাম শেড’ বলার পরে এক লাথিতে তাকে স্কুলের দোতলা থেকে ফেলে দিয়েছিলাম। আমি এই চিজ। কিন্তু মফিজ দারোগার পরের কথাটা জমিয়ে দিয়েছে আমাকে। নড়তে-চড়তেও ভুলে গেছি।
সেদিন রাতে গোলাগুলির পর সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন আছি বলতে গেলে। খবরের কাগজ বা টিভির নিউজ তো দূরে থাক, একটা টেলিফোনের আওতারও বাইরে এখন আমি। কাজেই সেদিনের শুটআউটের ফল কি, সেটা জানা ছিলো না। এখন জানলাম-আর সেটাও এমন ভয়ানক একটা মুহূর্তে!
“অত অবাক হবার কিছু নেই। ইটস অল ওভার দ্য নিউজ,” ঝাঁঝের সুরে বললো মফিজ দারোগা। “এখন উঠে দাঁড়া। উঠে দাঁড়া বলছি!”
আমি ধীরে-ধীরে উঠে দাঁড়ালাম। মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। চোখে ঝাপসা দেখছি।
“তোদের বুদ্ধিকে খাটো করে দেখা উচিত হয়নি আমার,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললো মফিজ দারোগা শিপলুকে। “ভেবেছিলাম, ঢাকায় থাকিস, তোদের শহুরে বালছাল নিয়েই ব্যস্ত থাকিস-এদিকে ঘিলু বলতে কিছু নাই মাথায়। নাহ, তোদেরকে অতটা বোকা ভাবাটা উচিত হয়নি।” আমার দিকে তাকালো সে নাকের ওপর দিয়ে। “জামশেদের মোটা খুলিতে অবশ্য অত প্যাঁচঘোচ ঢোকেনি।”
খুব কষ্ট করে নিজেকে শান্ত রাখলাম আমি। “তুই যা বোঝাতে চাচ্ছিস সেটা কালকেই সন্দেহ হয়েছিল আমার। কেবল প্রমাণের অভাবে শিওর হতে পারছিলাম না।”
“তাই নাকি?” টিটকিরির হাসি হাসলো মফিজ দারোগা। “কি বোঝাতে চাচ্ছি আমি, ডোপ পাপি জামশেদ?”
“দ্যাট উইল বি গোল্ড মেডেল উইনার জামশেদ,” শীতল গলায় বললাম আমি। মাথা ঘুরছে আমার, তবু নিজের ঝাঁঝটা ধরে রাখার চেষ্টা করছি, সেটা যতটা না মফিজ দারোগাকে ইনটিমিডেট করতে, তারচে’ বেশি নিজেকে সাহস দিতে।
“কি বোঝাতে চাইছি আমি?” আরো নিচু গলায় বললো মফিজ দারোগা। লোকটার বেসাইজ কালো মুখে একপেশে হাসি লেগে আছে একটা। তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে সে আমার দিকেই। ঘামের ফোঁটা গড়িয়ে নামছে তার কপাল বেয়ে।
কখনো-না-কাটা শুকনো ভুট্টা খেতের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি আমরা তিনজন। মাথার ওপরে তীব্র রোদ। মাথার ঘিলু ফোটানোর মত তীব্র। অসম্ভব নিশ্চুপ চারদিকটা। হঠাৎ একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকা ডাকতে শুরু করলো কোথা থেকে।
“কোনো পিশাচ মারেনি ওই চারজনকে,” বিড়বিড় করে বললাম আমি। “মফিজ দারোগা, তুই মেরেছিস ওদেরকে!”
আমার পাশে দাঁড়ানো শিপলু একবার আমার মুখের দিকে আর আরেকবার মফিজ দারোগার মুখের দিকে তাকাচ্ছে। ও ব্যাপারটা আগে বুঝতে না পারলেও আমাদের বাংলোর ওপর মফিজ দারোগা অ্যাটাক করার পরে গোটা ব্যাপারটা ক্লিয়ার হয়ে গেছে ওর কাছে।
আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত স্থির চোখে তাকিয়ে থাকলো মফিজ দারোগা, তারপর ভুঁড়ি দুলিয়ে হাসতে শুরু করলো। হাসি না বলে অট্টহাসি বলা ভালো ওটাকে—ভুঁড়ি দোলানো বিচ্ছিরি অট্টহাসি।
হঠাৎ হাসি থামিয়ে আমার দিকে তাকালো সে। “কেন ভাবলি এমনটা?”
“ডোন্ট কেয়ার অ্যাবাউট ইয়োর মোটিভস,” অস্থিরভাবে বললাম আমি। “তুই-ই যে খুনগুলো করেছিস, ব্যাপারটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছিল আমার অবচেতন মনে।” কথাটা শেষ করেই জিজ্ঞেস করলাম, “সামাদ কোথায়? কি করেছিস ওকে?”
আমার কথা যেন কানেই ঢোকেনি মফিজ দারোগার। “মোট মানুষ মারা গেছে চারজন।” ধীরে ধীরে, শান্তভাবে বললো সে। “প্রথমে গরীব ঘরের মেয়ে অমিছা। বয়স ষোল। পাতা কুড়িয়ে পেট চালাতো। জঙ্গলের কিনারা থেকে খড়ি কুড়িয়ে মানুষের কাছে সেটা বিক্রি করতো। কি মনে হয়, এ-রকম গরীব ঘরের একটা অসহায় মেয়েকে খুন করবো আমি? তোর শহুরে জাজমেন্ট এই বলে?”
“সামাদ কোথায়?” আবার প্রশ্ন করলাম আমি।
“দুই নাম্বার, সিদ্দিকের বউয়ের প্রথম স্বামির বাচ্চাটা।” আমাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলে চলেছে মফিজ দারোগা। “ছয়-সাড়ে ছয় মাস বয়স। নাদুস-নুদুস সুন্দর একটা ছেলে শিশু। কেবল উঠে বসতে শিখেছে। যাকেই দেখতো, ফোকলা মুখে হাসতো তার দিকে তাকিয়ে। কি মনে হয়? একটা নিষ্পাপ বাচ্চার রক্তে কোনো কারণ ছাড়া হাত রাঙাবো আমি?”
“আমি জানি না। তোর দ্বারা সব সম্ভব,” অধৈর্য গলায় বললাম তাকে। “আগে বল, সামাদ কোথায়? সামাদকে কি করেছিস?”
“আগে বল, কে কাকে খুন করেছে, কেন খুন করেছে, তারপর আমি তোকে বলবো কোথায় তোর জ্যাঠাতো ভাই।” মুখে মুচকি একপেশে হাসিটা ধরে রেখে বললো মফিজ দারোগা।
“সামাদ কই!” গায়ের জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। তারপর উন্মত্তের মত ডাকতে শুরু করলাম, “সামাদ! সামাদ!”
“চোপ!” ধমকে উঠলো মফিজ দারোগা। “কথা কানে যায়নি? আগে আমাকে বল কে কাকে মেরেছে, তারপর তোর ভাইয়ের খোঁজ পাবি!”
“সামাদ কোথায়, শিপলু? শিপলুর দিকে তাকিয়ে হিসহিসে স্বরে জানতে চাইলাম আমি। কিন্তু শিপলু স্রেফ বোকার মত তাকিয়ে আছে আমার দিকে, অধিক শোকে পাথর, জবাব জোগাচ্ছে না মুখে।
“চোপ!” আমার মুখের ওপর পিস্তল ধরে খেঁকিয়ে উঠলো মফিজ দারোগা। “আগে তোর মুখ থেকে শুনতে চাই কে কাকে মেরেছে, তা না-হলে সোজা দোজখে পাঠিয়ে দেবো!”
“ফাইন!” মফিজ দারোগার দিকে পাঁই করে ঘুরে গর্জে উঠলাম আমি। শোনার এতই শখ তোর? শোন তাহলে! পাতাকুড়ুনি মেয়ে অমিছাকে খুন করেছিল চেয়ারম্যানের ছোট ব্যাটা রিপন। ধর্ষণের পর হত্যা। খুনের পর অমিছাকে জঙ্গলের পাশে এমনভাবে কেটেকুটে ফেলে রেখেছিল রিপন, যাতে সবাই মনে করে কাজটা কোনো বন্য জন্তুর। আর এই আইডিয়া সিদ্দিকের মাথাতেও দ্রুত ক্যাচ করে। লম্পট সিদ্দিক অন্যের বউকে ভাগিয়ে এনেছিল বটে, কিন্তু সাথে কাবাব মে হাড্ডি হিসেবে এসে জুটেছিল তার বউয়ের আগের পক্ষের স্বামির একটা দুধের বাচ্চা। কাজেই উটকো ঝামেলা দূর করলো সে নিজের হাতেই। বাচ্চাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ছিন্নভিন্ন করে জঙ্গলের পাশে ফেলে রাখলো, আরো পাকাপোক্ত করলো পিশাচের গল্পটা।” চেঁচাচ্ছি আমি, থুথু এসে গেছে মুখে। “আর বাকি দুইটা…
“হ্যা, বাকি দুইটা।” আত্মতৃপ্তির হাসি মফিজ দারোগার মুখে। “চেয়ারম্যানের ব্যাটা রিপন আর সিদ্দিক নিজেই। এই দুটোকে আর কেউ না…”
“তুইই মেরেছিস,” মফিজ দারোগার মুখের কথাটা শেষ করে দিলাম আমি।
“দুইটা কুলাঙ্গারকে দূর করেছি,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললো মফিজ দারোগা। “এই দুই শূয়োরের বাচ্চাকে যদি আমি গ্রেপ্তার করতাম, কি হতো তাতে? মামলা চলতো আট-দশ বছর ধরে। বা আরো বেশি। শেষে কোনো এক ঝানু উকিল রাষ্ট্রপক্ষের বোকাচোদা উকিলকে কলা দেখিয়ে প্রমাণ করে দিত ওরা নির্দোষ, কাজটা আসলেই কোনো এক অজানা বন্য জন্তুর! হাহ! কিংবা অভিযোগ প্রমাণিত হলেও জেল হতো পাঁচ ছয় বছর, আর ফাঁসি যদিও বা হতো, রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা তো আছেই, খুন করেও হাসতে হাসতে বেকসুর খালাস নিয়ে বেরিয়ে আসতো নরপশু দুটো!” তীব্র ঘৃণায় মাটিতে থুথু ফেললো মফিজ দারোগা। “তার চাইতে যা করার, সেটা নিজ হাতেই করেছি আমি! ওদের বানানো পিশাচের গল্পের ফাঁদে ফেলেছি ওদেরকেই। রিপনকে মেরেছি আগেই। যথাসম্ভব বেশি কষ্ট দিয়ে। তোরা আসার পর মারলাম সিদ্দিককে। ওর পুরুষাঙ্গ যখন খালি হাতে গোড়া থেকে টেনে ছিঁড়ে আনছিলাম, তখন যদি তোরা খালি দেখতি!” মফিজ দারোগার মুখে প্রবল আনন্দের ছাপ। আমি হতভম্ব হয়ে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বলে কি!
“গ্রামবাসির সাপোর্ট আছে তাহলে এতে?” প্রশ্ন করলাম আমি, যদিও জানাই আছে জবাবটা।
“ফুল সাপোর্ট,” মফিজ দারোগা বললো। “যা যা বললাম, সবই জানে তারা। এই পান্ডববর্জিত গ্রাম বহুত ঝড়ঝাপ্টার মধ্যে দিয়ে গেছে। একটা থ্রেশহোল্ড লিমিট কাটানোর পরে মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয় নির্দ্বিধায়। জগদানন্দপুরের মানুষ সেই লিমিট কাটিয়ে এসেছে বহুত আগেই। আমি এই গ্রামেরই ছেলে। পলিটিক্যাল পাওয়ারের জোরে বহুদিন যাবত এই থানাতেই আছি। আমার সব কাজে তাদের ফুল সাপোর্ট আছে। সেজন্যই চেয়ারম্যানের ছেলেকে নিকেশ করার পরও টু শব্দটা করেনি সে। এই কমিউনিটির প্রতি এটা তার দায়িত্ব, আর তাছাড়া সে নিজেও কুলাঙ্গার ছেলের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিল—”
“তার মানে কোনো পিশাচ নেই? একেবারেই না?” আমার জিজ্ঞাসা। সতর্ক চোখে তাকিয়ে আছি মফিজ দারোগার হাতে ধরা অধৈর্য রিভলভারটার দিকে।
“এটা সত্য, গ্রামে কয়েক মাস ধরে রাতের বেলা উৎপাত করছে কি যেন একটা, বেশ কয়েকটা গরু ছাগলও মেরেছে,” অ্যাজ-এ-ম্যাটার-অব-ফ্যাক্ট টাইপ গলায় বলে চলেছে মফিজ দারোগা। “আর সেটা থেকেই অমিছাকে মারার পরে পিশাচের আইডিয়াটা মাথায় আসে চেয়ারম্যানের ব্যাটা রিপনের-”
“আমাকে গুলি করেছিলি কেন?” মফিজ দারোগাকে ছাপিয়ে বলে উঠলাম আমি।
“মাঝে মাঝে নিজের টেম্পার লুজ করি আমি, উইচ ইজ নট গুড,” একটা
ভুরু ওপরে তুলে বললো মফিজ দারোগা। “সেদিন রাতে যখন সিদ্দিকের লাশের পাশে তোকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম তখন হঠাৎ মনে হলো দেই তোকে শেষ করে, পরে সবাইকে বললেই হবে যে পিশাচটাকে মনে করে ভুলে তোকেই গুলি করে দিয়েছি! পরের মুহূর্তেই অবশ্য প্ল্যানটার অনেকগুলো ফাঁক মনে পড়ে গিয়েছিল আমার, কিন্তু ততক্ষণে ট্রিগারে চাপ পড়ে গেছে।” শ্রাগ করে মফিজ দারোগা।
“এক মিনিট!” কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠলো শিপলু মফিজ দারোগাকে ছাপিয়ে। একবার আমার দিকে, আরেকবার মফিজ দারোগার দিকে তাকাচ্ছে সে উদভ্রান্তের মত। “আমাদেরকে এসব বলছে কেন ও, শিপলু? কেন শোনাচ্ছে এসব আমাদেরকে?” নিজের কানের ওপর দু-হাত চাপা দিল ও, “ও নিশ্চই মেরে ফেলবে আমাদেরকে! শুনিস না শুনিস না-”
“যা শোনার সব তো শুনেই ফেলেছিস,” মাথা নাড়তে নাড়তে বললো মফিজ দারোগা।
হতবিহ্বল চোখে একবার আমার দিকে, আরেকবার মফিজ দারোগার দিকে তাকালো শিপলু। “না! বিশ্বাস করুন, আমরা কাউকে কিছু বলবো না। আমাদেরকে চলে যেতে দিন, আমি-আমরা কথা দিচ্ছি, আমরা কাউকে কিছু বলবো না! কাউকে না! কেউ জানবে না-
“আচ্ছা?” শয়তানি হাসিটা মুখে ধরে রেখে বললো মফিজ দারোগা। “আর আমি কিভাবে বুঝবো যে তুই সত্য বলছিস? কিভাবে বুঝবো যে তুই শহরে ফিরে গিয়েই আমার কথা চাউর করবি না? তুই তো আবার সাংবাদিক!”
শহরে ফিরে গিয়ে কেন সে কাউকে কিছু বলবে না, তার পক্ষে যুক্তি দেখানোর জন্য মুখ খুলেছিল শিপলু, কিন্তু তার পরেই মফিজ দারোগার কথার মর্মার্থ মাথায় ঢুকলো ওর। মুখটা হা-অবস্থাতেই রয়ে গেল ওর, দুই চোখে ফুটে উঠলো তীব্র আতঙ্কের ছাপ। ০০০০০০০০
আর ঠিক তখনই গর্জে উঠলো মফিজ দারোগার পিস্তল।
পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে ছোঁড়া গুলি। প্রায় ছিটকে পেছনের ভুট্টাগাছগুলোর মাঝে হারিয়ে গেল শিপলু। কেবল পা দুটো দেখা যাচ্ছে ওর, নড়ছে না সেগুলো।
আমার দিকে পিস্তল ঘোরালো মফিজ দারোগা। মুখে বিজয়ের হাসি। আয়রনিটা ধরতে পারলাম আমি-শিপলুকে খুন করার পরের মুহূর্তেই আমাকে শেষ করেনি মফিজ দারোগা কারণ আমি ওর বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ হয় দাঁড়িয়েছিলাম-আমাকে রসিয়ে রসিয়ে মারতে চায় সে।
“এবার তুই,” জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো দারোগা। “তুই কি ভেবেছিলি-”
আমি এমনিতেও গেছি, ওমনিতেও গেছি। কাপুরুষের মত মরার চাইতে চেষ্টা করে মরা ভালো।
কাঁধ নিচু করে মফিজ দারোগার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
অধ্যায় ১৫ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ১৫ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
আমার বাম কাঁধটা যে মুহূর্তে মফিজ দারোগার সোলার প্লেক্সাসে লাগলো, ঠিক সেই মুহূর্তেই ট্রিগারে চাপ দিয়ে ফেলেছে সে। আমার কানের পাশে প্রচন্ড শব্দে ফুটলো দিকভ্রষ্ট গুলিটা।
পরের মুহূর্তেই মফিজ দারোগাকে নিয়ে মাটিতে পড়লাম আমি।
মাথা তুলেই সবার আগে মফিজ দারোগার ডান হাতটা চেপে ধরলাম আমার বাম হাত দিয়ে, ওই হাতেই আছে ওর পিস্তলটা। কোনোমতে নিজের হাটুর ওপরে ভর দিয়ে সোজা হয়েই শরীরের সমস্ত শক্তিতে দুটো ঘঁষি হাঁকালাম মফিজ দারোগার চোয়ালে।
আমার প্রচন্ড গুঁতোয় আগেই বুকের সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গিয়েছিল মফিজ দারোগার, আর এখন পর পর দুটো ঘুঁষির ধাক্কা সামলাতে মাথা ঝাঁকাচ্ছে সে। তৃতীয় ঘুষিটা ছোঁড়ার আগে এক সেকেন্ডের দ্বিধায় বাতাসে দুলছিল আমার হাতটা। খপ করে সেটা ধরে ফেললো মফিজ দারোগা, হ্যাচকা টানে কাছে এনে ফেললো আমাকে, তারপরেই আমার নাকের ওপর একটা জোরালো টুশ।
চোখে অন্ধকার দেখছিলাম আমি-কিন্তু সেটা এতটা না যে দেখবো না দারোগা আমার মাথার দিকে তাক করছে তার ছাড়িয়ে নেয়া পিস্তলটা। পেছন দিকে পড়ে যাচ্ছিলাম, তার আগ মুহূর্তে কোনোমতে বামহাতের এক ঝটকায় ছিটকে ফেলে দিলাম পিস্তলটা।
মফিজ দারোগার টুশটা ভালোই কাহিল করেছে আমাকে, সন্দেহ নেই। উল্টে পড়েছি আমি পেছন দিকে, মাথাটাকে মনে হচ্ছে তুলোর মত হাল্কা। নাক ভেঙে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে আমার, টের পাচ্ছি সেটা। কিন্তু সেসব নিয়ে ভাববার সময় নেই এখন। বহু কষ্টে মাথাটা তুললাম আমি, দেখলাম মফিজ দারোগা হাঁচড়ে পাঁচড়ে সোজা হবার চেষ্টা করছে, ফুট দশেক দূরে ছিটকে পড়া পিস্তলটার দিকে তার চোখ। ওটার দিকে ছুটতে পারি আমিও-কিন্তু দেরি হয়ে যাবে, মফিজ দারোগা পৌঁছে যাবে আগেই।
ঝট করে পেছনের দিকে মাথা ঘোরালাম। ওই তো আমার রাইফেলটা! মরিয়া আমি চার হাত পায়ে ভর দিয়ে সামনে ছুঁড়ে দিলাম নিজের শরীরটা। ভাগ্য ভালো ছিলো রাইফেলের ওপরেই পড়লো হাতটা।
বসে-বসেই রাইফেলটা তুলে নিলাম আমি, একই সাথে শরীরের ওপরের অংশটাতে ঘোরাচ্ছি সামনের দিকে। রাইফেলের বাটটা কাঁধে ঠেকানো শেষ আমার।
মফিজ দারোগা তখনো হামাগুড়ি দিয়ে পিস্তলটার দিকে এগোতে ব্যস্ত। আমার বোল্ট টানার শব্দে মাথাটা পেছনে ফেরালো সে। দুই চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি।
রাইফেলের স্কোপের মাঝে পেয়ে গেছি দারোগার মাথাটা। ধীরে-সুস্থে সেটাকে আরো অ্যাডজাস্ট করে নিলাম আমি।
একটা হাত তুললো মফিজ দারোগা। “জামশেদ”
মফিজ দারোগার বাকি কথাটা শোনা হলো না আমার, কারণ ততক্ষণে ট্রিগার টেনে দিয়েছি আমি।
মফিজ দারোগার হাতটা তোলা অবস্থাতেই থেকে গেল-চোয়ালের অর্ধেকটা আর একটা কানসহ মাথার বামদিকটা স্রেফ উড়ে গেল তার ঘিলু আর খুলি-চামড়াসহ।
কাজ শেষ। ফেলে দিলাম রাইফেলটা-বলা ভালো আমার হাত থেকে পড়ে গেল ওটা। হাটুর ওপর ভর দিয়ে বসে আমি, যেভাবে নিল-ডাউন হয়ে থাকে ক্লাশের দুষ্ট ছাত্ররা, ল্যাগব্যাগ করে হাত দুটো ঝুলছে আমার শরীরের দু’পাশে। মাথাটা যেন ঘাড় ছেড়ে আকাশে ভেসে যেতে চাচ্ছে, এতই হালকা লাগছে ওটা। কাঠফাটা রোদ, তবু আঁধার দেখছি চোখে। বুঝতে পারছি জ্ঞান হারাতে চলেছি আমি, কাটা কলাগাছের মত মুখ থুবড়ে পড়তে যাচ্ছি মাটির ওপর
বন্ধু আর শত্রুর লাশ দু’পাশে নিয়ে খনিকক্ষণ বেহুঁশ হয়ে থেকে বাস্তবতা থেকে পালাতে পারলে ভালই লাগতো আমার, কিন্তু হঠাৎ বুঝতে পারলাম সেটা সম্ভব না এই মুহূর্তে। বহু দূরে একটা হইচইয়ের শব্দ শুনতে পেলাম। একদল লোক উত্তেজিতভাবে কথা বলছে যেন কোথায়।
ডিহাইড্রেশন আর মারের চোটে মাথাটা গুলিয়ে না থাকলে শোনার সাথে সাথেই বুঝতাম কিসের গোলমাল ওদিকে।
গ্রামবাসি!
অভিশপ্ত জগদানন্দপুরের লোকজন বুঝতে পেরেছে-সেটা যেভাবেই হোক—তাদের ডার্ক নাইট মফিজ দারোগা সফল হতে পারেনি, কোনো একটা ভজঘট বাধিয়ে ফেলেছে।
রাইফেলের শব্দের পর আর কোনো শব্দ হয়নি। শেষ আওয়াজটা পিস্তলের হলে গ্রামের লোকজন বুঝতো শহুরে শত্রু নিকেষ হয়েছে। রাইফেলের আওয়াজে ওরা বুঝে গেছে, ডাল মে কুছ কালা হ্যায়।
আর কোনো সন্দেহ নেই, এই মুহূর্তে এদিকেই ছুটে আসছে সবাই।
নিজের ভালো পাগলেও বোঝে। বিপদের গুরুত্বটা অনুধাবন করতে পেরে ধাঁ করে হুঁশে ফিরলাম আমি। হার্টবিট বেড়ে গেছে, ব্রেনে রক্ত পৌঁছাচ্ছে, কাজেই অজ্ঞান হবার ভয় আর নেই আপাতত। কিন্তু মাথা ঘোরাটা গেল না। পরোয়া করলাম না অবশ্য। টেনে হিঁচড়ে নিজেকে খাড়া করালাম নিল-ডাউন অবস্থা থেকে। মাথায় চিন্তা চলছে ঝড়ের বেগে। গ্রামবাসির হাতে ধরা পড়া যাবে না কোনোমতেই। আইন নিজের হাতে তুলে নেবার ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ আছে এই গ্রামের লোকদের-ওদের হাতে ধরা পড়লে…শিউরে উঠলাম আমি। ওদের ডার্ক নাইটের মাথা ফাটা তরমুজ বানিয়ে দিয়েছি আমি, ওরা চাইবে কড়ায় গন্ডায় সেটার শোধ তুলতে। অ্যাংরি মব খুব খারাপ জিনিস। বেনিতো মুসোলিনির পরিণতি মনে পড়লো আমার। নিজের প্রিয় শহর মিলানে ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল তার লাশ, মানুষ আবার সেটার দিকে ঝাঁটা, থুথু আর ঢিল মেরেছে ইচ্ছেমত। গা হিম হয়ে গেল আমার, ওরা যে আমার সাথেও তেমনটা করবে না সেটা কোনো কেতাবে লেখা নেই।
মফিজ দারোগার লাশের কয়েক ফুট সামনে পড়ে থাকা পিস্তলটার দিকে চোখ গেল আমার। এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো, নিজের ব্রেনে একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেওয়াটাই বেস্ট পলিসি।
গ্রামবাসির উত্তেজিত হইচই আরো অনেকটা এগিয়ে এসেছে। হাতে মোটেই সময় নেই। আমি ঠিক করে ফেলেছি কি করবো। এই জীবনে নিজের কাছে নিজে আমি হেরে গেছি বহুবার কিন্তু অন্য কারো কাছে হারিনি কখনো। আজও হারবো না।
লম্বা দু-পায়ে এগিয়ে গিয়ে মফিজ দারোগার রিভলভারটা তুলে নিলাম আমি। একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে ডান কানের সামনে ব্যারেলটা ঠেকিয়ে টেনে দিলাম ট্রিগারটা।
খটাস।
খালি চেম্বারে বাড়ি খেয়েছে হ্যামারের মাথা।
মাথা থেকে সরিয়ে সামনে এনে এক মুহূর্ত বোকার মত তাকিয়ে রইলাম হাতে ধরা রিভলভারটার দিকে। ছুঁড়ে ফেলে দিলাম তারপর সেটা।
সুইসাইডের চেষ্টা ঝোঁকের মাথায় করিনি, বুঝেশুনেই করেছি। কিন্তু কি আর করা, ওই যে লোকে বলে, কপালে লেখা নেই।
এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো, ঈশ্বর সেকেন্ড চান্স দিচ্ছেন আমাকে। পরের মুহূর্তেই মাথা থেকে ঝেঁটিয়ে দূর করলাম আজগুবি ভাবনাটা। কখনো এসব বিশ্বাস
করিনি, আজও করবো না। তার বদলে রাইফেলটা হাতে তুলে নিলাম। না, মরার আগে যতটাকে সম্ভব নিয়ে মরবো তত্ত্বতে চলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। ভুট্টাখেতের ওইদিকটা একদম জঙ্গলের কাছ পর্যন্ত চলে গেছে—ওটা ধরে জঙ্গলে গিয়ে লুকানো যেতে পারে। তার পরের স্টেপ জঙ্গলে বসেই ভাবা যাবে নাহয়।
জানি হাতে সময় নেই, প্রতিটা মুহূর্তই মূল্যবান, কাছিয়ে আসছে গ্ৰামভৰ্তি ফ্যানাটিক লোকজন, তবু একটু পিছিয়ে গিয়ে শিপলুর দিকে না তাকিয়ে পারলাম না আমি। যেভাবে ভুট্টাগাছের দঙ্গলের মাঝে গিয়ে পড়েছিল শিপলু, সেভাবেই পড়ে আছে। বুকের ওপরটা রক্তে মাখামাখি। প্রাণহীন চোখ দুটো খোলা। আমার দেখা সবচেয়ে একসেন্ট্রিক আর প্রাণচঞ্চল ছেলেটা মারা গেছে!
আর দেখার কিছু নেই। ঘুরে দাঁড়িয়ে ছোটা শুরু করলাম আমি জঙ্গলটা কোনদিকে সেটা আন্দাজ করে। রাইফেল একহাতে। মাথা ঘোরার ব্যাপারটা সরিয়ে রাখার চেষ্টা করছি একধারে।
সামাদের কথা ভুলিনি আমি। কিন্তু ওর খোঁজ করার সময় একেবারে নেই আমার। গাড়ি নিয়ে পালানোর চেষ্টার সময় সামাদই ছিলো ড্রাইভারের সিটে, ড্রাইভার ডোর ফুটো করা গুলিটা ওর শরীরই ফুঁড়ে গেছে। তাছাড়া একটু আগে সামাদের কথা জিজ্ঞেস করার সময় শিপলু যেভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েছিলো, তাতেই নিশ্চিত, খবর ভালো না। সামাদ এখনো না মরে থাকলে আর বেশিক্ষণ টিকবেও না।
দৌড়াচ্ছি আমি, কিন্তু এক সেকেন্ডর জন্য বুকের গভিরে কোথায় যেন চিনচিন করে উঠলো আমার। তিনকুলে ওই একটা—
কোনোকিছু একটার সাথে হোঁচট খেয়ে প্রায় উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়লাম আমি। রাইফেল ছিটকে গেছে দূরে, দুই হাঁটু আর কনুইতেও চোট পেয়েছি জবরদস্ত। কোনোমতে হাঁচড়ে পাঁচড়ে মাথা ঘুরিয়েই দেখতে পেলাম কিসের সাথে ঠোক্কর খেয়েছিলাম।
সামাদের শক্ত হতে শুরু করা লাশ। চিৎ হয়ে পড়ে আছে। ফ্যাকাশে মুখের কোণে ভনভন করছে একটা মাছি।
যা ভেবেছিলাম তাই গাড়িতে বসে খাওয়া গুলিটাই ফ্যাটাল হয়েছিল সামাদের জন্য। হয়তো মফিজ আর শিপলুর সাথে এখানে কোনোমতে এসেই বেঘোরে মারা পড়েছে ও।
এই দুনিয়ায় আমার সর্বশেষ আত্মীয়ের লাশটা আঁকড়ে ধরে কাঁদতে পারতাম ইচ্ছে করলে। কিন্তু তাতে আমার বংশের প্রদীপ নেভার চান্সটাই প্রবল হবে কেবল-কারণ হই হট্টগোলের শব্দেই বোঝা যাচ্ছে উত্তেজিত গ্রামবাসির দল খালিভিটার খুব কাছে এসে গেছে। এখন ইমোশনের সময় নয়। কাজেই রাইফেলটা তুলে নিয়েই ঝেড়ে দৌড় দিলাম আবার।
এক মিনিটের মধ্যেই বোঝা গেল আমার গেস ভুল ছিল না, ঠিক দিকেই যাচ্ছি। ভুট্টাগাছের ফাঁকের ভেতর দিয়ে ঝোপজঙ্গলের সূচনা দেখা যাচ্ছে। তার পরেই আঁধারে ছাওয়া জঙ্গল।
দেড় মিনিটের মাঝে জঙ্গলের ভেতরে চলে এলাম আমি। সূর্য ঢলে পড়েনি এখনো। আগামি দুই ঘন্টায় পড়বেও না। কিন্তু বনের ভেতরে এরই মধ্যে নামতে শুরু করেছে সূচীভেদ্য অন্ধকার। আর এই অন্ধকারেই আমাকে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে হবে পালানোর সুযোগের অপেক্ষায়।
*
ঘুমিয়ে পড়েছিলাম নিশ্চয়ই। হঠাৎ ভেঙে গেল চটকা।
ঝট করে চোখ মেলে চারদিকে তাকিয়ে নিলাম আমি। খাড়া হয়ে গেছে কান। কোনো শব্দ পেলাম না যদিও।
জঙ্গলের বেশ অনেকটা ভেতরে ঢুকে বড়সড় একটা গাছের গায়ে হেলান দিয়ে ছড়ানো শেকড়ের ওপর বসে পড়েছিলাম। গাছটার গোড়ার আশপাশে বেশ ঝোপঝাড়ের মতন ছিল, তার মাঝে বসলে বাইরে থেকে দেখা যাবে না-এই ভরসায় চুজ করেছিলাম। পিঠ আর মাথা গাছের গায়ে ঠেকিয়ে রাত নামার অপেক্ষা করতে করতে কখন চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল, টেরই পাইনি।
কিন্তু এখন ঘুম ভাঙলো কি জন্যে?
গ্রামবাসি প্রতিহিংসার নেশায় তাদের ট্যাবু ভুলে জঙ্গলের ভেতরেও চলে এসেছে নাকি?
কম সময় পেরোয়নি। সন্ধে তো পুরোদমে নেমেছেই—রাতই বলা যায় রীতিমত এখন। আঁধারের মাঝেই চোখ সরু করে দেখার চেষ্টা করছিলাম কোনোমতে, আর তখনই ঘাড়ের কাছে শীতল স্পর্শটা পেলাম আবার।
আমার ঘাড় ছেড়ে এখন কাঁধে নামছে শীতল স্রোতটা। আলসে, ধীর নড়াচড়া ওটার। কোথাও যাবার তাড়া নেই যেন।
দাঁতে দাঁত চেপে ধরে আছি আমি। একেবারে নট-নড়নচড়ন। না তাকিয়েও বুঝতে পেরেছি জিনিসটা কি।
জিনিসটা আমার কাঁধ-পিঠ ছেড়ে উরুর ওপরে, আর তারপর মাটিতে নামলো মিনিট দেড়েক খরচ করে—যদিও আমার কাছে সময়টা মনে হলো অনন্তকালের মত।
আমার কোলের ওপর দিয়ে শেষ সুড়সুড়িটা চলে যাবার পরও এক মিনিট কাঠ হয়ে বসে রইলাম আমি।
সাপ।
কি সাপ, সেটা বুঝতে পারিনি আঁধারে, কিন্তু আকারে অন্তত ফুট ছয়েক হবে ওটা, নিশ্চিত। সুন্দরবনে গিয়ে জীবনের প্রথম সাপ দেখি আমি। বেশ দূর থেকে দেখা, তবু গা কাঠ হয়ে গিয়েছিল আমার, পুরো শরীর ঘিনঘিন করছিল ঘৃণায়। সামাদ পরে বলেছিল, সাপকে ভয় পাওয়ার মন্ত্র মানুষের ডিএনএ-তেই লেখা আছে। সাপকে না ভয় পাওয়াটাই প্রতিবন্ধির লক্ষণ। আজ হাড়ে হাড়ে বুঝলাম কথাটার সত্যতা। বুকের খাঁচায় ধপাধপ বাড়ি মারছে হৃৎপিন্ডটা, সাথে ঠান্ডা ঘামও ছুটে গেছে আমার।
সামাদের কথা মনে হতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল আমার। শিপলুর হাসিমুখও মনের পর্দায় ভেসে উঠলো, ঠোঁটের কোণে ঝুলছে মার্লবোরো। ওরা আর নেই!
মাথা ঝাড়া দিয়ে ওসব ইমোশনাল চিন্তাভাবনা জোর করে তাড়ালাম আমি। নিজেকে বাঁচাই আগে। আপনে বাঁচলে বাপের নাম। আর তাছাড়া আমি না বাঁচলে এই গ্রামে কি হয়েছে—সেটা কেউ কোনোদিন জানবে না। সাত-সাতজন মানুষ মরেছে মোটমাট। ব্যাপারটা বড় সহজ নয়। বোমা মজিদ হত্যা মামলা? কেয়ার করি না। ওটা পরে দেখা যাবে। এই গ্রামে যে কান্ড হয়েছে তার তুলনায় ও-ব্যাপারটা বলতে গেলে ছেলেখেলা।
ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে। উঠে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চাইলাম-কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। আজ নিশ্চিত অমাবশ্যা। ঘোর অমাবশ্যা।
পকেটে হাত দিয়ে ধড়ে প্রাণ ফিরলো। টর্চটা আছে! তাড়াতাড়ি বের করে সুইচ টিপে দেখলাম, জ্বলছে। মফিজ দারোগার সাথে দাপাদাপিতে তাহলে ভাঙেনি বাল্ব।
জ্বালিয়েই অবশ্য সাথে সাথে নিভিয়ে ফেললাম টর্চটা। আলো দেখিয়ে গ্রামভর্তি ফ্যানাটিক লোকজনকে টেনে আনার কোনো খায়েশ নেই আমার। তাদের ডার্ক নাইটকে খুন করা এই আমার টর্চের আলো জঙ্গলের ভেতরে জ্বলতে দেখলে রাগের মাথায় বাপ-দাদার সংস্কার ভেঙে এই জঙ্গলে ছুটে চলে আসা আশ্চর্য নয় ফ্যানাটিকগুলোর জন্য। যদিও জঙ্গলের এতটা ভেতরে যদি আমি তিন ব্যাটারির ছোট টর্চের বদলে ফ্লেয়ার জ্বালাই তবুও তাদের দেখতে পাবার কথা নয়, তবু সাবধানের মার নেই।
রাইফেলটা কাঁধে ফেলে চরম উৎসাহে পা ফেলতে গিয়ে থমকে গেলাম আমি। সাপের থেকে দূরে পালানোর উৎসাহে খুব তো উঠে পড়েছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, এখন যাবোটা কোন দিকে?
মফিজ দারোগার খুলি ওড়ানোর পরে জঙ্গলে এসে ঢুকেছি। তখন লক্ষ্য ছিলো একটাই—জঙ্গলের আরো ভেতরে ঢোকা, নিজেকে আরো আড়াল করে ফেলা। তারপর বসেছি গাছের নিচে। ঘাড়ের ওপর দিয়ে সাপ পেরোনোর পরে জাগলাম। ততক্ষণে দিক-বিদিক জ্ঞান হারিয়েছি ভালোভাবেই।
এখন?
যাবো কোনদিকে?
মাথার ভেতর দ্রুত কিছু হিসেব নিকেশ করার চেষ্টা করলাম আমি। জঙ্গলের ভেতরে ঢুকেছি এদিক দিয়ে, আর খালিভিটাটা ওদিকে, আর নদীটা জঙ্গলটাকে বেষ্টন করে গেছে দুইদিক থেকে, আর ওইদিকটায় নদীর একপাশে জঙ্গল আর একপাশে শ্মশান। শ্মশানের দিকে যাওয়াটাই বেস্ট শট। আমি যদি এখন এদিকে মুখ করে থাকি, তাহলে মনে হয় শ্মশানটা ওদিকে….
হাল ছেড়ে দিলাম আমি। যা ভাবছি সবই স্রেফ আন্দাজ। দিনের আলো থাকলে নাহয় একটা কথা ছিলো। এখন এই আঁধারে ঠিক দিকে যাওয়ার আশা করাটা বাতুলতা।
তাহলে কি করবো? দাঁড়িয়েই থাকবো স্রেফ? রাত পোয়ানোর অপেক্ষা করবো?
কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। কালিগোলা অন্ধকারটা যেন বাড়তে বাড়তে গ্রাস করার চেষ্টা করছে আমাকে, নিস্তব্ধতা প্রচন্ড চাপ দিচ্ছে স্নায়ুতে, ঘাড়ের কাছটা এমন শিরশির করছে যেন এক্ষুণি ড্রাকুলা দাঁত বসিয়ে দেবে সেখানটায়, বা কেউ বড়বড় নখওয়ালা হাত দিয়ে খামচে ধরবে। নাহ, এভাবে এখানে থাকাটা কোনোমতেই সম্ভব না। এমনিতেই যে প্রচন্ড মানসিক চাপের ওপর দিয়ে যাচ্ছি, তার ওপর আবার এই জঙ্গলে সারা রাত থাকতে হলে সকালে আমি বাইরে বেরিয়ে আসবো বন্ধ উন্মাদ হয়ে, জন্মদিনের পোশাক পরে হাসতে হাসতে নিজের চুল নিজে ছিঁড়তে ছিঁড়তে। গ্রামের লোককে আর কিছু করতে হবে না।
যা হয় হবে ভেবে হাঁটতে শুরু করে দিলাম আন্দাজে, নদীতীরের শ্মশানটা কোনদিকে হবে সেদিকে।
কাজটা সহজ নয়। কেন সহজ নয় সেটার পক্ষে ঝুড়ি ঝুড়ি যুক্তি দেখাতে পারি আমি। চোখে না দেখলে মানুষ যে কতটা অসহায় একটা প্রাণী, সেটা আজ পষ্ট হলো আমার কাছে। গাছের শেকড়ে হোঁচট খাচ্ছি বারবার, ডালপালার বাড়ি লাগছে গালেমুখে, ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছি সহজেই। মাথা ঘোরার ব্যাপারটা কাটেনি।
গলা শুকিয়ে কাঠ। পানি খাওয়া হয়নি বহুক্ষণ। সাথেও নেই পানির ক্যান্টিন। আরেকটা তরল আছে অবশ্য। চ্যাপ্টা ফ্লাঙ্কটা বের করে ওটার ভেতরে যতটুকু অ্যালকোহল ছিলো, পুরোটা ঢেলে দিলাম গলায়।
আরেকটু যাবার পরে বুঝলাম, টর্চ না জ্বেলে উপায় নেই। এভাবে চলা সম্ভব না আর। জঙ্গলের অনেকটা ভেতরে আছি, বাইরে আলো যাবার সম্ভাবনা খুব কম। রাইফেলের স্ট্র্যাপটা কাঁধে আরেকটু জুত করে বসিয়ে নিয়ে পকেট থেকে টর্চ বের করে জ্বাললাম।
তিন পা যাবার পরে শুরু হলো ব্যাপারটা।
প্রথমে পাত্তা দিলাম না ওটাকে। তারপরে যখন বাড়লো, আরো বাড়লো, তখন স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, কানের কাছে ফিসফিসানি শুনতে পাচ্ছি একটা।
আর একটা মৃদু ভন ভন শব্দ। যেন মাছি উড়ছে কোনো পচা লাশকে ঘিরে।
এতক্ষণ ভ্যাপসা গরম টের পাচ্ছিলাম, আর এবার এক ঝলক কনকনে ঠান্ডা
হাওয়া বয়ে গেল আমার গায়ের ওপর দিয়ে। এর আগে দু-বার এমনটা হয়েছিল। দু- বারই ওই তথাকথিত পিশাচের কাছাকাছি গিয়েছিলাম আমি।
এবারও কি …..
পিশাচ বলতে কিছু নেই, জানি আমি। জীবনে কখনো কোনো অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত জিনিসে বিশ্বাস করিনি আমি, শিপলুর সাথে কয়েকটা প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেশন করার পরও। কিন্তু এবারের ব্যাপারটা সত্যি ভীষণ গোলমেলে।
ভীষণ গোলমেলে।
আমি সামনে এগিয়ে চলছি এক পা দু-পা করে। টর্চের আলোটা নড়ছে হাটার সাথে তাল মিলিয়ে। সেই সাথে বাড়ছে ফিসফিসানি। আর ঠান্ডা। আর ভনভন।
আমার মাথার মধ্যে দু-রকম চিন্তা চলছে। আমার মগজের একটা অংশ বলছে এই গ্রামে কোনো পিশাচ নেই। যে চারটা খুন হয়েছে সেগুলো মানুষেরই করা। দুটো ক্রাইম, আর দুটো এক্সিকিউশন। মগজের আরেকটা অংশ বলছে, তাহলে বিশাল যে জিনিসটার মুখোমুখি হয়েছিলাম আমি, সেটা কি? জঙ্গলের কিনারায় একবার। জঙ্গলের ভেতরে ভাঙা মন্দিরটায় একবার। আর সিদ্দিকের সাজানো লাশের কাছেও নিশ্চয়ই ঘুরতে এসেছিল ওটা, সেজন্যই….
কানের কাছে ফিসফিসানিটা বাড়তে বাড়তে একটা প্যাসিভ অ্যাগ্রেসিভ গর্জনে পরিণত হয়েছে।
আমার মাথা ঘিরে ভনভন করছে যেন অনেকগুলো অদৃশ্য নীলমাছি।
সামনের দিক থেকে বরফ-ছোঁয়া দমকা হাওয়া আসছে থেকে থেকে।
আমার টর্চের আলোর সামনে হঠাৎ ভেসে উঠলো বিশাল কাঠামোটা। শ্যাওলা পড়া ইঁটের দেয়াল। ওপর থেকে নেমে এসেছে অশ্বত্থর শেকড়। বনের ভেতরে কয়েকশো বছর ধরে পড়ে থাকা অজানা মন্দিরটার সামনে হাজির হয়েছি আমি আবার। কানের কাছে ফিসফিসাতে থাকা কন্ঠগুলো যেন পাগল হয়ে গেল সাথে সাথে। যেন কিছু বলতে চায় ওরা আমাকে, কিন্তু পারছে না, কারণ ওদের কথা বলার ক্ষমতা নেই।
আরেকটু এগিয়ে গেলাম। ওই তো মুখ ব্যদান করে থাকা অন্ধকার ফটকটা। ওটার থেকেই হাড়কাঁপানো ঠান্ডা হাওয়া আসছে হু-হু করে।
ওটাই ওই বিশাল জিনিসটার ডেরা।
আমি রাইফেলটা তুলে কাঁধে ঠেকালাম। ডানহাতে থাকলো রাইফেলটা, আর বামহাতে টর্চ। বামহাতের কব্জির ওপরে রাইফেলের ব্যারেল। ঠান্ডায় রীতিমত গা শিউরে উঠছে আমার। ফিসফিসানিটার মাঝে যেন কয়েকটা শব্দ আলাদা করে শুনতে পাচ্ছি-কিন্তু সেটা নিশ্চয়ই আমার মনের ভুল।
আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। হয় এসপার, নয় ওসপার। ওই জিনিসটাকে এড়িয়ে যাবো না আমি। ফয়সালা হবে মুখোমুখি।
ঢুকে পড়লাম মন্দিরের ভেতরে।
ফিসফিসানির শব্দটা বাড়তে বাড়তে সমুদ্রের গর্জনে পরিণত হয়েছে ততক্ষণে। আমার নাক-মুখ থেকে বেরোনো নিঃশ্বাস জমে ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে।
আমি এগিয়ে চললাম।
প্রথমেই এসে পড়েছি সেই বড় ঘরটাতে। গোটা ঘরটাতে ঝোপজঙ্গল ছাড়া কিছু নেই। কানার চোখের মত তাকিয়ে আছে দুটো ভাঙা জানালা। চারপাশে একবার মাত্র টর্চের আলো বুলিয়ে নিয়ে ঘরটার ওই মাথার দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি গতবারে ঢুকে মন্দিরটার যে লে-আউট দেখেছিলাম সেটা মনে পড়ছে স্পষ্টভাবে।
হু হু করে মাঘের শৈত্যপ্রবাহের মত ঠান্ডা হাওয়া আসছে কালো ফোকরের মত দরজাটা থেকে। ভক করে একটা পচা গন্ধ নাকে লাগতে নাক কুঁচকে ফেললাম আমি।
দরজাটা আমাকে নিয়ে এসেছে একটা করিডোরের মত জায়গায়। দু-পাশে কয়েকটা পরিত্যক্ত ঘরের মতো আছে। আমি টর্চটা রাইফেলের সাথে ঠেকিয়ে দ্রুত আলো ফেললাম একটার ভেতরে।
ফাঁকা।
এই মুহূর্তে পেছনের ঘরটার দরজা ঠিক আমার পিঠের কাছে। মনে পড়তেই শিরশিরিয়ে উঠলো ঘাড়ের কাছটা। গোড়ালিতে ভর দিয়ে পাঁই করে ঘুরলাম আমি, আলো ফেললাম ঠিক পেছনের ঘরটায়। একটা কালো মূর্তি ধাঁ করে ভেসে উঠলো টর্চের হলদেটে আলোর সামনে। আমার বুকের ভেতরে হৃৎপিন্ডটা এত জোরে লাফিয়ে উঠলো যে রীতিমত ব্যথা লাগলো আমার।
রাইফেলের ট্রিগার টানতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলাম আমি। কালো মূর্তিটা আক্ষরিক অর্থেই একটা কালো মূর্তি ছাড়া আদপে কিছু নয়। শ্যাওলা পড়ে-টড়ে অবস্থা খারাপ, চেনার যোগ্য নয়।
টর্চের আলো আবার সামনে ঘুরিয়ে নিলাম আমি। বাকি ঘরদুটো চেক করতে গিয়ে থমকে গেলাম। আমার দুই কানে ফিসফিসানি আর ভনভনানির শব্দ বাড়তে বাড়তে সমুদ্রের গর্জনের মত প্রবল আকার ধারণ করেছে-কিন্তু সেগুলো ছাপিয়েও একটা গরগর শব্দ পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি আমি।
ওটা সামনে থেকে আসছে।
আমার মাংস ভেদ করে হাড়ে কামড় বসাচ্ছে কনকনে ঠান্ডাটা। মুখের সামনে জমে কুয়াশা হয়ে যাচ্ছে নিঃশ্বাস। কানের পাশে ফিসফিস করতে থাকা কন্ঠগুলো যেন পাগল হয়ে গেছে। প্রতি পদক্ষেপে যেন স্পষ্ট হচ্ছে ওগুলো, ওরা কি বলতে চাচ্ছে সেটা যেন আস্তে আস্তে বুঝতে পারছি আমি।
আমি এক পা এক পা করে এগিয়ে গেলাম সামনে।
হাত ব্যথা হয়ে যাচ্ছে, তবু সোজা করে ধরে আছি রাইফেলটা। টর্চটা ওটার সাথে ঠেকানো। টর্চটা যা দেখবে, রাইফেলের মুখ সেদিকেই ফেরানো থাকবে।
গরগর শব্দটা আরো জোরালো হচ্ছে।
আমি করিডোরের শেষ মাথায় গিয়ে পৌঁছলাম।
বড় ঘরটার কোণায় দাঁড়িয়ে এখন আমি। আর কানের পর্দা যেন ফাটিয়ে দেবে প্রবল ফিসফিসানির শব্দ। সেই সাথে মাছি ওড়ার মত ভনভন। না, ভুল বললাম। ফিসফিস নয়। কারণ কণ্ঠগুলো কি বলতে চাইছে, সেটা বুঝতে পারছি আমি।
পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি।
আমি টর্চের আলো সোজা ফেললাম ঘরটার মাঝখানে।
কন্ঠগুলো কয়েকটা শব্দই ঘুরেফিরে বলছে। টর্চের আলোয় চকচকিয়ে উঠলো ভাঁটার মতো দুটো চোখ। শ্বাপদের চোখ।
বিশাল জন্তুটাকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমি। লালচে খয়েরি রং ওটার, আকারে একটা পূর্ণবয়ষ্ক বাঘের মতো বড়। মুখের চামড়া সরানো ওটার, কালচে মাঢ়ি আর ঝকঝকে ধারালো দাঁত দেখা যাচ্ছে পরিস্কার। জিনিসটার সবচেয়ে বড় অস্বাভাবিকত্ব ওটার মাথাটা। একটা শেয়ালের শরীরের বেজির মাথা বসিয়ে দিলে যেমন দেখাবে, ঠিক তেমন দেখাচ্ছে ওটাকে। আর চোখ-ওহ, ওটার চোখ! না, ওগুলো কেমন অশুভ আর কুৎসিত, সেটার কোনো বর্ণনা দেবার চেষ্টা করবো না আমি, কারণ কোনো শব্দই ব্যাখা করতে পারবে না কেমন বিশ্রী আর অশুভ আর ঘৃণ্য ওগুলো।
আমি জানি ওটা আর এক সেকেন্ড পরেই আমার ওপরে লাফ দেবে। ফিসফিসাতে থাকা কন্ঠগুলো কি বলছে সেটা পরিস্কার শুনতে পাচ্ছি আমি। রাইফেলের স্কোপটা ফেললাম শ্বাপদটার দুই চোখের ঠিক মাঝখানে।
একটা কথাই বারবার বলছে কণ্ঠগুলো।
আসল নকল বিচার করো। আসল নকল বিচার করো।
আমি ট্রিগারের ওপর আঙুলের চাপ বাড়ালাম।
আসল নকল বিচার করো।
আসল নকল বিচার করো।
আসল নকল বিচার করো।
শ্বাপদটা নড়ে ওঠার আগেই ফায়ার করলাম আমি।
দোজখের মত জ্বলতে থাকা চোখগুলোর আভা নিভে গেল সাথে সাথেই।
বুলজ আই! ঠিক দুই চোখের মাঝখানে লেগেছে আমার গুলি।
বিশাল প্রাণীটা একটা শব্দ করারও সুযোগ পেল না। স্রেফ ঢলে পড়লো যেখানে ছিলো, সেখানেই।
আসল নকল বিচার করো।
আমি রাইফেলটা নামিয়ে নিলাম ক্লান্তভাবে
কি হলো? স্বরগুলো থামছে না কেন? আরো বরং জোরালো হচ্ছে কেন সেগুলো? ঠান্ডায় হাত পা অবশ হয়ে আসছে কেন আমার?
যা করার, তাই তো করেছি আমি! নিজের ভয়কে মোকাবেলা করেছি, শেষ করেছি শ্বাপদটাকে। ওই তো পড়ে আছে ওটার লাশ, রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওটার মাথা!
তবু চলে যাচ্ছে না কেন লক্ষণগুলো?
তাহলে কি সমস্যাটা ওই জানোয়ারটার সাথে নয়? সমস্যাটা কি আমার সাথে? আমার মাথা খারাপ হওয়াটা কি ষোলোকলা পূর্ণ করেছে? বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হচ্ছি কি আমি?
হ্যা, হয়তো তাই।
নইলে আমার পেছনে পায়ের শব্দ পাবো কেন আমি?
কেউ যেন হেটে আসছে আমার দিকে। ধীরে-সুস্থে। যেন কোনো তাড়া নেই ওর। পায়ের শব্দটা যেন একেবারে পেছনে এসে গেছে আমার। ধীরে ধীরে ঘুরলাম আমি। টর্চের আলো ফেললাম আগন্তুকের ওপরে।
“হ্যালো, জামশেদ।” বলে উঠলো আগন্তুক।
কেস স্টাডি : চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন’
[বরাবরের মতই মাসিক হালচালে প্রকাশিত হয়েছিল শিপলুর এই ইসভেস্টিগেশনটা। মূল ঘটনার পরে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া ছিল-সেটা বাদ দিয়ে বাকিটা এখানে হুবহু তুলে দেয়া হলো]
আমার কিছু কেসের সন্ধান পাই পরিচিতজনের কাছ থেকে। সারাদেশ টো-টো করে ঘুরেছি কয়েক বছর ধরে, নানান জেলায় অনেকের সাথে সখ্যতা হয়েছে এভাবে। একদিন পত্রিকা অফিসে বসে কাজ করছি, এমনি সময় একটা ফোন এল। ফোনটা আমারই জন্য-এসেছে উত্তরবঙ্গের এক জেলা থেকে। নানান কাজে বহুবার ওদিকটায় যেতে হয়েছে আমাকে, একটা মেসে কিছুদিন থাকার সময় এক চাকুরিজীবি ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় হয়েছিল। ফোনটা করেছেন তিনিই। অদ্ভুত এক সমস্যায় পড়েছেন ভদ্রলোক-আর সেটা জানানোর জন্যই আমাকে ফোন করা। ফোনে বেশি কিছু বললেন না, কিন্তু যেটুকু বললেন সেটুকু শুনেই ঠিক করে ফেললাম, যাবো। এরকম একটা কেস সরেজমিনে না দেখলে একজন প্যারানরমাল ইনভেস্টিগেটরের ক্যারিয়ারই বৃথা।
ঢাকায় কয়েকদিনের কাজ গুছিয়ে রেখে দুই দিনের মধ্যেই রওনা দিলাম ভদ্রলোক যে জেলায় থাকেন, সেখানে। রাতের বাসে রওনা দিয়েছি, সারারাত জার্নি করে সকালে নামলাম বাস টার্মিনালে। নেমেই মনটা ভালো হয়ে গেল। যে ভদ্রলোকের ডাকে এসেছি, তিনি আমাকে রিসিভ করার জন্য এই সাত সকালে এসে বসে আছেন বাস টার্মিনালে।
ভদ্রলোকের নাম জব্বার শিকদার। জব্বারসাহেব আমাকে দেখে বিশাল একটা হাসি দিয়ে হাত মেলানোর জন্য এগিয়ে এলেন, “আরে, শিপলুভাই যে! কতদিন পর দেখা। কষ্ট দিলাম ভাই. কষ্ট দিলাম। কিন্তু কি করবো বলেন-যে সমস্যায় পড়েছি!”
কুশল বিনিময়ের পরই ভদ্রলোক আমাকে তার বাসায় নিয়ে চললেন। একটা রিকশায় চড়ে বসলাম দু-জনে।
মফস্বল শহরের রাস্তায় রিকশা চলছে ঢিমেতালে। সকালের বাতাসে একটা তাজা তাজা গন্ধ। যেতে যেতে অনেক কথা শুনলাম। জব্বারসাহেব আমার চাইতে প্রায় দশ বছরের বড় হলেও মানুষ হিসেবে খুবই মিশুক। আর হাসিখুশি-সব সময় শিশুর মত পবিত্র একটা হাসি লেগেই আছে মুখে। এই কারণেই মেসে থাকতে খাতির ছিল তার সাথে। কয়েক মিনিট কথা বলেই সেই পুরনো জব্বারসাহেবকে খুঁজে পেলাম।
জানালেন, আগের চাকরিটা ছেড়েছেন, এখন বেশ ভালো বেতনের একটা চাকরি পেয়েছেন একটা সওদাগরি কোম্পানিতে। শহরে একটা ভাড়া বাসায় উঠেছেন প্রায় তিন সপ্তাহ হলো।
“পরিবার এনেছেন?” জানতাম, জব্বারসাহেবের স্ত্রী আর একটা ছোট ছেলে গ্রামের বাসায় থাকে।
“এরই মাঝে আনার ইচ্ছে ছিল, ভাই। চলে আসার জন্য চিঠি প্ৰায় দিয়ে দিয়েছি, এমন সময়ই তো সমস্যা শুরু হলো।” টাক পড়তে থাকা মাথাটা অনিশ্চিতভাবে চুলকাতে চুলকাতে বললেন ছাপোষা মানুষটা। বিড়বিড় করে একবার বললেন, “আমার বাসার ঠিকানা চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন। চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন।”
সমস্যাটা কি, সেটা টেলিফোনে খানিকটা বলেছিলেন জব্বারসাহেব। আমি আর ঘাঁটালাম না। ভাড়াবাসায় গিয়েই সেটা দেখা যাবে। বাকি রাস্তাটা আর তেমন কথা বললাম না তার সাথে ইচ্ছা করেই। জব্বারসাহেব মাথা নিচু করে গম্ভির হয়ে রইলেন, আর আমি একটা মার্লবোরো ধরিয়ে টানতে লাগলাম।
খানিকবাদে মেইন রোড ছেড়ে খড়খড়িয়ে একটা ভাঙাচোরা সরু পাকা রাস্তায় ঢুকে পড়লো রিকশাটা। শহরের আবাসিক এলাকা এটা, দেখলেই বোঝা যায়। নামেও পরিচয়-কেরানিপাড়া, আদর্শপাড়া, মুন্সিপাড়া। মফস্বলের এইসব এলাকায় একটা আলাদা ফ্লেভার থাকে। ছোট ছোট একতলা-দোতলা বাসা, সুন্দর করে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, পাঁচিলের ওপরে কাঁচের ভাঙা টুকরো বসানো। তার ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে গাছের সবুজ পাতা। এক ভদ্রলোক নিজের বাসার গেটে দাঁড়িয়ে ঘুমঘুম চোখে দাঁত ব্রাশ করছেন লুঙ্গি পরে। রাস্তার ওপরে সোনালি রোদ পড়েছে বাঁকা হয়ে।
আরো কয়েকটা লেন তস্য লেন পেরিয়ে একটা সরু গলিতে ঢুকলাম। গলির দু- পাশে দোকানপাটের সারি। মুদি দোকান, স্টেশনারি দোকান, পান-সিগারেটের দোকান, লন্ড্রি, একটা রেস্টুরেন্ট যার সাইনবোর্ডে সমান আকারের একটা খাসি আর একটা মুরগী আঁকা। খাসিটার অসমান চার পায়ের নিচে ‘বনবিহারীলাল লেন’ লেখা দেখে বুঝলাম প্রায় এসে গেছি।
জব্বারসাহেব অবশ্য এই রেস্টুরেন্টটার সামনেই রিকশা থামালেন। বললেন, “বাসায় আমি একাই থাকি ভাই, খাবার-দাবারের ব্যবস্থা নাই। এই রেস্টুরেন্টেই খাই। আপনাকেও এখানেই খাওয়াচ্ছি, কিছু মনে করবেন না। আগে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেন, তারপর একবারে ঢুকবো চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনে।”
হাতমুখ ধুয়ে পরাটা আর মুরগির গিলা কলিজি খেতে বসলাম দু-জনে। একটা কথা এর মাঝে না বলে পারলাম না জব্বারসাহেবকে যদিও তিনি কি জবাব দেবেন সেটা জানাই ছিলো। “বাসাটা ছাড়লেই পারেন।”
“সে সামর্থ্য থাকলে কি আর আপনাকে ডেকে আনি, ভাই!” একটা বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জব্বারসাহেব। “বাড়িটার ভাড়া একই মানের অন্য সব বাড়ির চাইতে অর্ধেকেরও কম। এত কম ভাড়ায় এত ভালো বাড়ি তো আজকের বাজারে পাওয়া মহা ভাগ্যের ব্যাপার। কিভাবে ছাড়ি বলেন? সেইজন্যে আগে আপনাকে ডাকলাম ভাই। আপনার কথাই আগে মনে পড়লো। আপনার কাছে পুরো ব্যাপারটা বুঝে নেই আগে। আমারও উপকার হবে, আপনারও একটা ইনভেস্টিগেশন হবে। সমস্যা নাই, চিন্তা করবেন না, আপনাকে আমি ফি দেবো। তবে আপনি যদি বলেন যে ছাড়তে হবে তাহলে কি আর করা…”
মনে মনে বললাম, কবে বুঝবেন, কম বাসার ‘ভালো’ বাড়িতে সব সময় একটা না একটা ঘাপলা থাকে? আমি হাসলাম। “ফি-টি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না রে ভাই। আমি এইসব নিজের শখেই করি। আর পত্রিকা অফিস থেকে যতটুকু পাই সেটা যথেষ্টরও অনেক বেশি। যাতায়াতের খরচও পাই। সে যাকগে, খাওয়া তো শেষ, চলেন ওঠা যাক।”
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলাম। দেড় মিনিটের মাঝে হাজির হলাম চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনের সামনে।
আশপাশের আর দশটা বাড়ির সাথে এটার তেমন পার্থক্য নেই। বাড়িটা বছর পনেরর পুরনো। বাইরের গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম আমরা। বাড়ির বারান্দার সামনে লোক দেখানো এক টুকরো বাগানের মতো আছে, সেটার অবস্থা অবশ্য আগাছা-টাগাছা গজিয়ে নাজেহাল। ছায়া-ছায়া ঠান্ডা বারান্দাটায় এসে দাঁড়ালাম জব্বারসাহেবের সাথে। সঙ্গে সঙ্গে হাতের লোমগুলো সরসরিয়ে দাঁড়িয়ে গেল আমার। সন্দেহ নেই, বৃথা আসিনি এখানে। এই বাসায় অদ্ভুতুড়ে কোনোকিছু আছে। এই পৃথিবীর বাইরের কোনোকিছু।
কোনো কথা বলছেন না জব্বারসাহেব-একদম চুপচাপ। বারান্দার দরজাটা খুলে বসার ঘরে ঢুকলেন আমাকে নিয়ে। লাইট জ্বাললেন।
প্রথমেই বসার ঘরটা। সেখানেই দাঁড়িয়ে আছি আমরা। এক সেট সস্তা বেতের সোফা আর একটা ঢাকনিবিহীন টেবিল ছাড়া কিছু নেই গোটা ঘরটাতে।
আমি এক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকলাম ঘরের ঠিক মাঝখানে। ধীরে ধীরে দম নিলাম একটা। তারপর আস্তে আস্তে একটা আঙুল তুললাম সোফাটার দিকে। “এটাও?”
“দেখতে হবে,” বিড়বিড়িয়ে বললেন জব্বারসাহেব। সোফার একটা হাতলের কাছে গিয়ে ভালো করে দেখলেন মাথা নামিয়ে। “না, এখনো হয়নি এটা। নাম সাইন করে রেখেছিলাম সাইনপেন দিয়ে-সেটা এখনো আছে।”
জব্বারসাহেব আমাকে নিয়ে মেইন বেডরুমে ঢুকলেন। আঙুল দিয়ে দেখালেন খাটটা। “এইটা।” একটা চেয়ার ছিলো ঘরে। সেটা দেখালেন। “এটাও।” তারপর আঙুল তুলে দেখালেন একটা চেয়ার। বেডসাইড টেবিল। টেবিলের ওপরে একটা ছবির ফ্রেম। একটা ফুলদানি। টেবিল ক্লক। তার ওপরে কয়েকটা বই। বলতে গেলে মেইন বেডরুমের সবকিছুই।
“রান্নাঘরে কিছু হাঁড়িপাতিলসহ আরো আনুষঙ্গিক জিনিস কিনে রেখেছিলাম, আপনার ভাবি কয়েকদিন পরে আসবে সেটা ভেবে। সেগুলোও সব…” থমথমে গলায় বললেন জব্বারসাহেব।
বসার ঘরে এসে বসলাম। জব্বারসাহেব চা করে আনলেন রান্নাঘর থেকে। হীটারে এই একটা জিনিসই রান্না করতে শিখেছেন তিনি। চা’টা অবশ্য বেশ ভালো হয়েছে।
“প্রথম কবে বুঝতে পারেন?” চা’য়ে একটা লম্বা চুমুক দিয়ে বললাম।
“বাসায় ওঠার হপ্তাখানেক পরে,” থুতনি ডলতে ডলতে বললেন জব্বারসাহেব। “একদিন অফিস থেকে বাসায় আসলাম, বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে একটা প্রিয় বই টেনে নিয়ে প্রথম পৃষ্ঠা খুলতেই খাট থেকে পড়ে যাওয়ার অবস্থা হলো। ভাই, বইটা জীবনানন্দের একটা কবিতার বই-আমার এক বন্ধু আমাকে গিফট করেছিল। বইয়ের প্রথম পাতায় কয়েকটা সৌজন্যমূলক কথা লেখা ছিল-’জব্বারের শুভ জন্মদিনে শফিক’ টাইপের-কিন্তু আমি যে বইটা হাতে ধরে আছি সেটায় কিচ্ছু নেই। প্রথম পাতাটা সাদা।
“বিছানায় খাড়া হয়ে বসে গোটা বইটা উল্টে পাল্টে দেখলাম। বইটায় আমার কিছু প্রিয় কবিতা ছিল, সেগুলোর কোনো কোনো লাইন আন্ডারলাইন করে রেখেছিলাম। সেসব দাগ বেমালুম গায়েব!
“অর্থ্যাৎ আমার হাতে এখন যে বইটা আছে সেটা আমার বেডসাইড টেবিলের ওপরে সচরাচর যে বইটা থাকতো তার একটা কপি।
“প্রথমেই মনে হলো, এই বইটা কেউ হয়তো মজা করার জন্য এখানে রেখে গেছে আগের বইটা সরিয়ে রেখে। তারপরই বুঝতে পারলাম চিন্তাটা কেমন অবান্তর। বাসায় ফিরে দেখেছি তালা-টালা সবকিছু ঠিকই ছিলো। কে এত ঝামেলা করে তালা খুলে ভেতরে ঢুকে বই রেখে আবার তালা লাগিয়ে রেখে যাবে? প্রশ্নই আসে না। কোনো ব্যাখ্যাই খুঁজে পেলাম না আমার এই বইটার কপি কিভাবে চেঞ্জ হয়ে গেল।
“পরের দিন অফিস থেকে এসে আরেকটা বই নিয়ে খুললাম। এই বইটার প্রথম পাতায় আমার নাম লেখা ছিল। হ্যা, এটাতে সেই লেখা আছে ঠিকই কিন্তু বানানটা ভুল! আর বইয়ের ভেতরে যেসব জায়গায় দাগ-টাগ দেয়া ছিলো সেগুলোও সব ভুল জায়গায়।
“আবার কিভাবে যেন আমার একটা বই কপি হয়ে গেছে!
“এরপর টের পেলাম টেবিলক্লকটাও কপি হয়ে গেছে। ক্লকটা পড়ে গিয়ে এক কোণায় দাগ পড়ে গিয়েছিল। সে-দাগ এটায় নেই।
“আর সন্দেহ থাকলো না। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম: আমার অনুপস্থিতিতে আমার জিনিসপত্র সব কিভাবে যেন কপি হয়ে যাচ্ছে। সবগুলোর আসলটা বদলে গিয়ে একটা নকল পড়ে থাকছে ঠিক সেই জায়গায়। তবে সেসব নকল আবার ঠিক- ঠিক নকল না। কিছু না কিছু ভুল আছে সেগুলোতে। কেমন যেন একটা অশুভ ব্যাপারও জড়িয়ে আছে সেগুলোর সাথে।
“নানান জিনিসের ওপর নাম লিখে রেখে পরীক্ষা করে দেখলাম। সবকিছুই কপি হয়ে যাচ্ছে স্রেফ সময়ের ব্যাপার। একদিন বা দুইদিন পরে। কোনো কোনোটা দু’বার তিনবার কপি হয়ে যাচ্ছে। যেমন টেবিল ক্লকটা চারবার কপি হবার পর শেষ যে কপিটা হয়েছে, সেটা অনেকটাই আলাদা আসলটার চাইতে।”
অনেকক্ষণ কথা বলার পর থামলেন জব্বারসাহেব। আমার চা ততক্ষণে শেষ, সিগারেট ধরিয়েছি। অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন জব্বারসাহেব।
“দেখুন ভাই, গোটা ব্যাপারটাতে আমার কোনো সরাসরি সমস্যা হচ্ছে না, কিন্তু…” কথাটা শেষ করলেন না তিনি।
আমি কিছু বললাম না। হ্যা, কোনো সমস্যা হচ্ছে না বটে, কিন্তু আপনি একটা বাসায় একা থাকেন, অফিস সেরে এসে দেখলেন বাসার সবকিছু নকল হয়ে অন্য কিছু একটা হয়ে বসে আছে-চিন্তাটাই মেরুদন্ড দিয়ে একটা শিরশিরে অনুভূতি বইয়ে দেয়। তারপর একটা জিনিস খেয়াল করলাম,” বলতে বলতে সোফা থেকে উঠলেন জব্বারসাহেব। ছোট যে আরেকটা বেডরুম আছে বাসাটায়, গেস্ট বেডরুম, সেটায় নিয়ে চললেন আমাকে।
“রুমটায় স্রেফ একটা খাট, আর একটা বহু পুরনো পোকায় কাটা ঝুলপড়া কাঠের আলমারি। কালো রঙের। জব্বারসাহেব নিজে আলমারিটার কাছে গেলেন না। আঙুল তুলে আলমারিটা দেখালেন তিনি। কাঁপা গলায় বললেন, “খুলে দেখুন।”
আমি এক পা এগিয়ে গিয়ে একটা পাল্লায় হাত রাখলাম। দম নিলাম একবার আস্তে করে, তারপর ধীরে ধীরে টান দিলাম পাল্লাটাতে। ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে খুলে গেল পাল্লাটা।
ওপরের তাকগুলো সব খালি। সবচেয়ে নিচের তাকটাতে কেবল পড়ে আছে কয়েকটা দোমড়ানো মোচড়ানো বইয়ের পাতা, কয়েক টুকরো ভাঙা কাঁচ, একটা কাগজের ফুল, একটা বয়ামের ঢাকনিসহ আরো কিছু ফেলনা জিনিস। জব্বারসাহেবকে কিছু বলতে হলো না। বুঝে গেলাম নিজে থেকেই।
যেসব জিনিস কপি হয়েছে তার টুকরো টাকরা পড়ে আছে এখানে।
“এই আলমারিটা বাড়ি ভাড়া নেবার পর থেকেই আছে,” বিড়বিড়িয়ে বললেন জব্বারসাহেব। “গোটা বাড়ি ফাঁকা ছিলো, কেবল এই ঘরে এই আলমারিটা ছাড়া। জিনিসপত্র সব কপি হতে শুরু হওয়ার কয়েকদিন পরে একদিন খুটখাট শব্দ হতে শুনলাম এই ঘরে অনেক রাতে। এসে লাইট জ্বালিয়ে দেখি কেউ নেই। পাল্লা খুলে দেখি এই অবস্থা। এখন পর্যন্ত যা কিছু কপি হয়েছে তার সবকিছুর একটা না একটা টুকরো টাকরা এখানে এসে জমেছে কিভাবে যেন। আমার পরিবার কয়েকেদিন পরে এখানে থাকতে আসবে ভাই, আর এই বাসায়…” ধরা গলায় চুপ করে গেলেন জব্বারসাহেব।
“এইসব কি হচ্ছে ভাই এখানে?” একটু সামলে নিয়ে আমাকে প্রশ্ন করলেন তিনি।
আমি কিছু বললাম না। জানলে তো জবাব দেব।
পাল্লাটা বন্ধ করার আগে একটা জিনিস চোখে পড়লো আমার। একটা ইঁদুরের লেজ পড়ে আছে। কাটা ইঁদুরের লেজ। জানি না বুকের ভেতরটা হঠাৎ কেঁপে উঠলো কেন।
ঘুমটা হঠাৎ ভেঙে গেল।
চোখ মেলার সাথে সাথে সজাগ হয়ে উঠলাম একদম। বহুদিনের অভ্যাসের ফল। উঠে পড়লাম না অবশ্য তখনই।
সারা ঘরে অন্ধকার। চোখে দেখছি না কিছুই। কান খাড়া করলাম। সন্দেহ নেই কোনো শব্দের কারণেই ঘুমটা ভেঙেছে।
সারাটা দিন চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনেই কাটিয়েছি। গোটা ব্যাপারটা সময় নিয়ে তলিয়ে না দেখলে চলবে না। আজ শুক্রবার, জব্বারসাহেবের অফিস ছিলো না। বিকেলে একবার বাইরে গিয়ে থেকেছি দু-জনে ঘন্টাদুয়েক, সময় দিয়েছি চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনকে। ফিরে আসার পর আবিষ্কার করলাম জব্বারসাহেবের আস্ত সোফা সেটটা নকল হয়ে গেছে।
রাতের খাওয়াদাওয়ার পরে শুয়েছিলাম গেস্টবেডরুমে, আর এখন ঘুম ভেঙে দেখি এই অবস্থা।
চুপচাপ মিনিট দুয়েক শুয়ে থাকার পরও আর কোনো শব্দ পেলাম না। চট করে সোজা হলাম বিছানার ওপরে। নেমে পড়লাম তারপরে। পুরোদস্তুর জামাকাপড় আমার পরনে। অচেনা জায়গায় ঘুমাই এভাবেই।
ঘরের লাইটের সুইচটা কোথায়, শোবার আগে সেটা ভালোভাবে দেখে রেখেছিলাম। হাত চলে গেল সেদিকেই। লাইট জ্বললো না। হয় কারেন্ট নেই, নয়তো অন্যকিছু। পকেটে টর্চ আছেই। বের করে জ্বাললাম। ব্যাটারি বোধহয় কমে গেছে-হলদে আলো ছড়িয়ে পিটপিটিয়ে উঠলো ওটা।
প্রথমেই আলো ফেললাম পুরনো ঝুরঝুরে কালো কাঠের আলমারিটায়। নট- নড়নচড়ন অবস্থায় পড়ে আছে ওটা। খানিকক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে থেকে পা টিপে টিপে পাশের রুমের দিকে চললাম।
জব্বারসাহেব শুয়েছেন মেইন বেডরুমে। ওটার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দ্বিধা করলাম এক মুহূর্ত। নিজেকে বোঝালাম এই বাড়িতে সাধারণ ম্যানারের স্থান নেই। জব্বারসাহেবের কোনো বিপদ হতেও পারে। ঠেলা দিয়ে খুলে ফেললাম দরজাটা। আলো ফেললাম জব্বারসাহেবের বিছানার ওপর।
কেউ নেই ওখানটায়। বিছানা ফাঁকা।
বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম বাড়ি পড়ছে আমার। রেডিয়ামওয়ালা ঘড়িতে সময় দেখলাম—রাত প্রায় দুটো। এমন সময় কোথায় গেছেন ভদ্রলোক?
ঘুরেই চমকে উঠলাম ভীষণভাবে।
জব্বারসাহেব এসে দাঁড়িয়েছেন আমার সামনে। পরনে লুঙ্গি গেঞ্জি। ঘুমঘুম চোখ। একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
“কি ব্যাপার ভাই? এত রাতে?” চোখ ডলে প্রশ্ন করলেন আমাকে।
“কোথায় গেছিলেন?” পাল্টা প্রশ্ন করলাম আমি জবাব না দিয়ে।
“এই তো, বাথরুমে,” বললেন জব্বারসাহেব। আমার চোখের দিকে তাকালেন সরাসরি। “কি ব্যাপার ভাই?” কোনো সমস্যা?”
“না, কিছু না,” বললাম আমি। “কী যেন একটা শব্দ পেয়ে ঘুম ভেঙে গেল।”
“ও তেমন কিছু না,” বাতাসে হাত নাড়লেন জব্বারসাহেব। “পুরনো বাড়িতে নানা রকম শব্দ হয়েই থাকে। আমি তো রোজ রাতেই শুনি।”
পুরনো বাড়িতে হওয়া যে সব শব্দ শুনে মানুষ “কিছু না’ বলে উড়িয়ে দেয়, সেসব আসলে কিসে করে, সেটা বলে পিলে চমকে দিতে পারতাম জব্বারসাহেবকে। কিন্তু কিছু বললাম না। তাকিয়ে আছি তার মুখের দিকে।
“যান, শুয়ে পড়ুন,” ক্লান্ত গলায় বললেন জব্বারসাহেব। “কালকে কথা হবে। যে হুজুরের কথা বিকেলে বলেছিলেন, তাকে দিয়ে ঝাড়ফুঁক করাবো দরকার হলে।”
আমি তখনো তাকিয়ে আছি তার দিকে। “শব্দটা আমার ঘরেই হচ্ছিলো, এমনটাও হতে পারে।”
জব্বারসাহেবের মুখে স্পষ্টতই বিরক্তির ছাপ। “বললাম তো, হয়তো তেমন কিছুই না। হয়তো ইঁদুরের শব্দ। গোটা বাসা ইঁদুর দিয়ে বোঝাই।”
আমি শান্ত স্বরে বললাম, “চলুন না, একটু দেখে আসি। হতে পারে শব্দটা ওই আলমারি থেকে আসছে।”
“কি জানি ভাই,” বিরক্ত গলায় বললেন জব্বারসাহেব। “না-ও হতে পারে। আচ্ছা, ঠিক আছে, আপনার দেখার এত শখ যখন, চলেন দেখা যাক।”
এক টুকরো বাঁকাহাসি কি ফুটে উঠেছে জব্বারসাহেবের ঠোঁটের কোণায়? না আমিই ভুল দেখেছি?
আমি আস্তে আস্তে ঘুরলাম। এগোলাম গেস্ট বেডরুমের দিকে। আমার পেছনে জব্বারসাহেব। ঘাড়ের ছোট ছোট চুলগুলো হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল কেন যেন আমার
গেস্ট বেডরুমের ঘুটঘুটে আঁধারে কোনোমতে দৃষ্টি চলছে আমার টর্চের মিটমিটে হলদে আলোয়। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম কাঠের কালো আলমারিটার দিকে।
পাল্লাটায় হাত রাখার আগে একবার পেছনে তাকিয়ে দেখে নিলাম-আমার ফুট দুয়েক পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন জব্বারসাহেব। চোখদুটো চকচক করছে আঁধারে।
পাল্লাটায় হাত দিলাম আমি। টান দিয়ে খুললাম।
ওপরের তাকগুলো খালি। নিচের তাকে একগাদা দোমড়ানো বইয়ের পাতা, ভাঙা কাঁচের টুকরো, একটা কলমের ক্যাপ, এক টুকরো ছেঁড়া কাপড়, কয়েকটা দেশলাইয়ের কাঠি সহ আরো নানারকম টুকিটাকি জিনিস-আর একটা মানুষের কাটা মাথা।
জব্বারসাহেবের মাথা।
গলার কাছটা যেন অতি সূক্ষ্মভাবে কেটে নেয়া হয়েছে ঘাড় থেকে, তারপর বসিয়ে রাখা হয়েছে এখানে। কপি হওয়া অন্য সব জিনিসের টুকরোর মতই, জব্বারসাহেবের টুকরো।
কাটা মাথাটার চেহারায় তীব্র আতঙ্কের ছাপ।
ওটা যদি জব্বার সাহেবের মাথা হয়, তাহলে আমার পেছনে এটা কে?
আমার ঘাড়ের পেছনে রক্ত পানি করা গলায় গর্জে উঠলো জব্বার সাহেবের নকল। ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো নকলটা। বরফের মত ঠান্ডা আঙুল দিয়ে খামচে ধরলো আমাকে।
মরিয়া হয়ে পেছন দিকে ঘুরিয়ে মারলাম হাতের টর্চটা। ভাগ্য ভালো, খটাস করে লাগলো সেটা নকল জব্বারের কপালে। টর্চের বাল্ব ভেঙে গেছে-ঘুটঘুটে আঁধার নেমে এলো সাথে সাথে কিন্তু টের পেলাম, মাটিতে উল্টে পড়েছে নকল জব্বার।
পাঁই করে ঘুরেই ছুটলাম দরজা আন্দাজ করে।
অন্ধকারে পুরোপুরি ঠিক ছিলো না আন্দাজটা। ডান কাঁধটা ভয়ানকভাবে ঠুকে গেল দরজার চৌকাঠের সাথে। বলতে গেলে ছিটকে পড়লাম করিডোরের ওপর।
সামনে আরেকটা দরজার আবছা অবয়ব। কোনোমতে ছুটে সেটা পেরিয়ে বসার ঘরে হাজির হলাম, হাঁপাচ্ছি। পেছনে একটা গর্জনের শব্দ শুনলাম, নকল জব্বার উঠে দাঁড়াচ্ছে সম্ভবত।
অন্ধের মত হাতড়াতে হাতড়াতে সামনে এগোলাম আমি, হাত পড়লো দরজার ওপরে। এই দরজা দিয়ে বেরোতে পারলেই চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন থেকে মুক্তি।
থপথপ করে শব্দ পাচ্ছি পেছনে। নকল জব্বার এগিয়ে আসছে।
ছিটকানিটা খুঁজে পেলাম ভাগ্যের জোরে, খুলেও ফেললাম চট করে। গায়ের জোরে দরজাটায় ধাক্কা দিলাম তারপর।
খুললো না দরজাটা। পাথরের তৈরি যেন, নড়ার কোনো লক্ষণ নেই।
নকল জব্বারের পায়ের শব্দ অনেকটা কাছিয়ে এসেছে।
ধাক্কা দিয়ে লাভ নেই, জানা আছে।
“যেতে দাও আমাকে,” চেঁচিয়ে উঠলাম, “আমি আর কখনো আসবো না। কথা দিচ্ছি!”
দরজা খুললো না।
নকল জব্বার একেবারে পেছনে চলে এসেছে আমার।
ঘোরারও সময় পেলাম না। আমার গলার ওপর এসে পড়লো বরফের মত ঠান্ডা দুটো হাত, চেপে ধরলো সাঁড়াশির মতো।
দম আটকে আসছে আমার। শক্তি শেষ হয়ে আসছে দ্রুত। জানি, আর কিছুক্ষণ এভাবে কাটলেই মারা পড়বো।
নকল জব্বার পাগলের মত হেসে চলেছে।
চেঁচানো সম্ভব নয় আর। মনে মনে প্রাণপণে বলে উঠলাম, আমাকে যেতে দাও। আমি কখনো কাউকে বলবো না তোমার ব্যাপারে…আর তুমি তো জানোই, আমি কার উপাসনা করি!
জাদুর মতো কাজ হলো। টের পেলাম, কে যেন আমার শরীরটা প্রচন্ড শক্তিতে ছুঁড়ে দিলো। এক সেকেন্ড পরই নিজেকে আবিষ্কার করলাম জনশূণ্য বনবিহারীলাল লেনে, চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনের বাইরে। পড়ে আছি মাটিতে।
উঠে দাঁড়ালাম। মানুষ দূরে থাক, চারপাশে একটা কাকপক্ষীও নেই এই নিশুতি রাতে। সব দোকানপাট বন্ধ।
সোজা সামনে হাঁটছি, একবারও তাকালাম না চার নম্বর বনবিহারীলাল লেনের বাড়িটার দিকে।
কিন্তু পরিষ্কার টের পেলাম আমার দিকে তাকিয়ে আছে চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন।
অধ্যায় ১৬ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ১৬ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
শিপলু!
আমার পাঁচফুট সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, যার চোখের বঙ্গবন্ধু ফ্রেমের চশমা আমার ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় ঝকঝক করছে, যার ঠোটের এককোণে হাসি আর আরেক কোণে জ্বলন্ত সিগারেট, যার এক হাত পকেটে পোরা আর আরেক হাতে একটা দা—সে শিপলুই বটে।
আমার ভাঙা নাক দপদপ করছে, আমার মাথা ঘুরছে, আমার দুই কানে অসংখ্য কন্ঠ উন্মত্তের মত চেঁচাচ্ছে ‘আসল নকল বিচার করো আসল নকল বিচার করো আসল নকল বিচার করো-কিন্তু তবু, এই অবস্থাতেও আমার মগজ সকল হিসেব একসাথে কষে ফেললো মুহূর্তেই, দুয়ে দুয়ে চার মেলানো হয়ে গেল নিমেষেই। যত খটকা ছিলো সব দূর হয়ে গেছে, যত লুজ এন্ডস ছিলো সব জোড়া লেগে গেছে। সবকিছু দিনের আলোর মত পরিষ্কার এখন আমার সামনে।
আমি ক্লান্ত কণ্ঠে বললাম, “শিপলু।” যেন বলার জন্যই বলা। যেন কয়েক ঘন্টা আগে গুলি খেয়ে বুক ঝাঁঝরা হয়ে মরতে দেখা বন্ধুর বেঁচে উঠে জঙ্গলের মাঝের এক ভাঙা মন্দিরে আমার সামনে হাতে দা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখাটা বড়ই স্বাভাবিক।
অস্বাভাবিক ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে শিপলুর মুখটা। চুলে আর গায়ে লেগে আছে ভুট্টার শুকনো পাতা আর খড়কুটো। যেন একটা বেওয়ারিশ মড়া হঠাৎ জীবন ফিরে পেয়ে চলে এসেছে।
“জামশেদ,” খুব জরুরি গলায় বললো শিপলু, ওর ঠোঁটের কোণে নাচছে মার্লবোরোটা, “তুই কি জানিস ঘাড় থেকে মাথা আলাদা করার পর সেটা বিশ সেকেন্ড পর্যন্ত সচেতন থাকে? কি মনে হয়, ওই বিশ সেকেন্ড ওটার ব্রেনের মধ্যে কি চিন্তা চলতে থাকে?”
ট্রিভিয়া-ম্যান শিপলু!
“চোখের সামনে থেকে টর্চটা সরা।” অধৈর্য গলায় বললো শিপলু, তারপরেই আবার জুড়ে দিল, “কি মনে হয়, মফিজ দারোগার গুলিটা আমার হার্ট ফুঁড়ে যাবার সময় আমার মগজে কি চিন্তা চলছিল? হা-হা-হা!”
আমি এবারও কিছু বললাম না। সোজা তাকিয়ে আছি শিপলুর দিকে। টর্চটাও সরাইনি। ওটার আলোয় ফসফরাসের মত জ্বলছে শিপলুর চশমার কাঁচ, সেটা ছাপিয়ে ওর চোখগুলো দেখার চেষ্টা করছি আমি। রাইফেলটা সোজা তাক করা শিপলুর বুকের দিকে। বাতাসে রক্তের গন্ধ।
“কি হলো? কথা বলছিস না কেন? চুপ মেরে গেলি যে আমাকে দেখে?” যেন খুব অবাক হয়েছে, এমনভাবে বললো শিপলু। তারপরই যেন খুব দরকারি কিছু মনে পড়লো ওর। “ওহ আচ্ছা আচ্ছা, তুই মনে হয় আশা করছিস সামাদও মরা থেকে বেঁচে হেটে চলে আসবে আমার মত? না হে ভাই! সেটি হচ্ছে না। ও বেচারার তো আমার মত অলৌকিক ক্ষমতা ছিলো না! কি আর–”
“অলৌকিক ক্ষমতা না ছাই!” খেঁকিয়ে উঠলাম আমি। মাথাটা দপদপিয়ে উঠলো আমার, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলাম অনেক কষ্টে। “শোন, তোর অতিপ্রাকৃত হোকাস পোকাসে কোনোদিন তেমন একটা বিশ্বাস ছিল না আমার। আর আজ তো নিশ্চিত হলাম-”
আস্তে করে দুই হাত দু-দিকে ছড়িয়ে দিলো শিপলু। “আমার দিকে তাকা। লুক অ্যাট মি, জামশেদ, লুক অ্যাট মি! আমি মরে গেছিলাম- তুই নিজের চোখে দেখেছিস! আর আমি এখন তোর সামনে দাঁড়িয়ে! আর কোনো প্রমাণের দরকার আছে তোর? মৃত্যুকে জয় করেছি আমি! জিশু যা করেছিল সেটা করে দেখিয়েছি আমি, শিপলু!
জবাব দিলাম না আমি। রাইফেলও নামালাম না। শান্ত গলায় বললাম, “তোর জোচ্চুরি আর দুই নম্বরির তালিকা করতে গেলে এই মরা থেকে বেঁচে ফেরাটা স্রেফ আরেকটা এন্ট্রি মাত্র।
হাসছে শিপলু। দুই হাত দোলাচ্ছে সামনে পেছনে। ডান হাতে ধরা একটা দা। ঠোঁটের কোণের সিগারেটটা পুড়ে প্রায় শেষ।
দেশের এককোণার এই পান্ডববর্জিত গাঁয়ের দু’শ বছর ধরে পরিত্যক্ত এক জঙ্গলের ভেতরের মন্দিরে আমি দাঁড়িয়ে আছি আমার সেই বন্ধুর সামনে, যাকে তিন ঘন্টা আগে নিজ চোখে মরতে দেখেছি। গোটা ব্যাপারটা হঠাৎ একটা দুঃস্বপ্নের মত লাগতে থাকে আমার কাছে।
“দাটা কেন তোর হাতে, শিপলু?” চিবিয়ে চিবিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি।
“আরে হাতে কিছু একটা না নিয়ে জঙ্গলে আসা যায় নাকি!” হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছে শিপলু, যেন আমরা শ্যাওলা-ওঠা স্যাঁতসেঁতে এই মন্দিরের ভেতরে নেই, আছি আমাদের বাসার ড্রয়িংরুমে, আড্ডা দিচ্ছি। “আর এই গ্রামের জঙ্গলের যে ছিরি! একা-একা এখানে আসাটা মোটেই উচিত হয়নি তোর, জামশেদ। জান ফিরে পাবার পরে আমি তোর সামনে বেমক্কা হাজির হইনি ভয় পাবি বলে। ভুট্টাখেতে একটা দা খুঁজে পেলাম বোধহয় এটা দিয়েই মফিজ দারোগা সিদ্দিকের দফারফা করেছিল…”
“কথা,” শিপলুর গলা ছাপিয়ে জোরে বলে উঠলাম আমি
শিপলু থেমে গেছে, এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমি কি বলছি সেটা মাথায় ঢুকছে না ওর।
“কথা,” আবার বললাম আমি, টর্চ আর রাইফেল এখনো তাক করা সোজা শিপলুর দিকে। “কথা দিয়েই তো আমাকে বোকা বানিয়ে রেখেছিলি দেড় বছর ধরে। শুধু আমাকে কেন? মাসিক হালচালের লক্ষ লক্ষ পাঠককেও! তোর সাথে পরিচয় ছিল, এমন সবাইকেই বোকা বানিয়েছিস তুই-তোর আসল রূপটা দেখতে দিসনি!”
“তুই যত যা-ই বলিস,” চিবিয়ে চিবিয়ে বললো শিপলু, “আমি জানি আমিই ঠিক। কোনো ভুল করিনি আমি। তুই জানিস আমি মহাশক্তি লাভের কতটা কাছে চলে এসেছি? আমি-”
“মহাশক্তি লাভ!” মাটিতে থুথু ফেলে চোখ সরু করে বললাম আমি। “তাহলে নিজেকে এটাই বুঝিয়েছে তোর বিগড়ে যাওয়া মগজ! হেমায়েতপুরে-”
“মূর্খ!” আহত বাঘের মত খেঁকিয়ে উঠলো শিপলু। “তোর জানা নেই আমার ক্ষমতা কত, আমি কতটা করার সামর্থ্য রাখি! তোর জানা নেই কতগুলো ধাপ পেরিয়ে আজকের শক্তি আমি পেয়েছি! এতদিন আমার সাথে ঘুরেও বুঝতে পারলি না, এই জগতের বাইরেও আরেকটা অন্ধকার জগৎ আছে? এতদিনেও কি তুই সেই মহাশক্তিধরের শক্তির আঁচ পেলি না, যার উপাসনা আমি করি?”
থ হয়ে শিপলুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি আমি। ভেবেছিলাম ওর হাঁড়ির খবর জেনে গেছি-কিন্তু কল্পনাও করতে পারিনি যে…
“আমার প্রত্যেকটা ইনভেস্টিগেশন শুধু মাসিক পত্রিকার পাতা ভরানোর জন্য নয়, জামশেদ!” শিপলুর চশমার কাঁচ ভেদ করে দেখতে পাচ্ছি আমি, নরকের আগুনের মত লকলকিয়ে জ্বলছে ওর দুই চোখ। “প্রতিটা ইনভেস্টিগেশন ছিল আমার উপাসনার একেকটা ধাপ। প্রত্যেকটা ঘটনার খুঁটিনাটি জানার মাধ্যমে তার শক্তির স্বরূপ জানতে পেরেছি আমি, তাঁর হাতের কাজ নিজ চোখে দেখতে পেরেছি!”
“তিনি?” দুর্বল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম আমি অবশ ঠোঁটে। “তুই বোঝাতে চাচ্ছিস….”
“হ্যা,” সাপের মত হিসহিসিয়ে উঠলো শিপলু, “তোরা যাঁকে শয়তান বলিস, তারই উপাসনা করি আমি!”
হঠাৎ নিজের হাতদুটো বড় দুর্বল লাগলো আমার, যেন রাইফেল আর টর্চটা এখনি খসে পড়বে মাটিতে।
“দেশের প্রত্যন্ত এক গ্রামের শ্মাশানে এক শয়তান-উপাসক তান্ত্রিকের সাথে সাধনা করতে গিয়ে প্রথম তার দেখা পাই আমি। তিনি এক, অদ্বিতীয়, কিন্তু তিনি সদাবিরাজমান, অন্তর্যামি, মহাশক্তিমান! ঈশ্বরকে চ্যালেঞ্জ করার ক্ষমতা একমাত্র তিনিই রাখেন। আর তাকে যে পাবে, অন্য যেকোনো মরণশীলের চাইতে বেশি ক্ষমতাধর হবে সে! অমর তো হবেই!” নিশ্বাসের সাথে হিসহিসিয়ে শব্দগুলো বেরিয়ে আসছে শিপলুর মুখ দিয়ে, ঠোঁটের কোণে ফেনা, দুই চোখে যেন নরকের আগুন। ওই এক মুহূর্তের জন্য ওকে শয়তানের পুজারি না, স্বয়ং শয়তানের মত লাগলো আমার।
“আর নিজেকে এটা বুঝিয়েই সারা দেশে কতগুলো আজগুবি কেসের পেছনে ছুটে বেড়িয়েছিস তুই? শয়তানের আরো কাছাকাছি যাবার জন্য?” কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম আমি।
“হ্যা,” বললো শিপলু। চেহারার সাথে সাথে স্বরও পাল্টে গেছে ওর, পশুর মত গরগর শব্দ বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। “কিন্তু এখনও একটা দরকারি ধাপ বাকি আছে। আর সে জন্যই তোর সাথে বন্ধুত্বের অভিনয়টা দরকার ছিলো, জামশেদ।’
“নরবলি,” কোনমতে শব্দটা গলা দিয়ে বেরোলো আমার।
“হ্যা,” চেনার অযোগ্য ঘড়ঘড়ানিতে পাল্টে যাচ্ছে শিপলুর কণ্ঠ, চোখদুটো জ্বলছে ঠিক আমার পেছনে মরে পড়ে থাকা পিশাচটার মতো। “নরবলি। আর সেটা যে কোনো জায়গায় হলে চলবে না, যে কাউকে বলি দিলে চলবে না। বলি দিতে হবে অমাবশ্যার রাতে, শয়তানের মন্দিরে-ঠিক যেমন আমরা আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, তেমন কোনোখানে।”
এই অভিশপ্ত মন্দিরটা তাহলে একটা পরিত্যক্ত শয়তানের মন্দির!
“মন্দিরটা খুঁজে পেতে সারা দেশ চষে বেড়াতে হয়েছে আমাকে,” বলেই চলেছে শয়তানের পুজারি, “অবশেষে পেলাম এই গ্রামের জঙ্গলে! আর প্রভু আমার পক্ষে ছিলেন বলেই, তার অশুভ অপবিত্র হাতের কারসাজিতেই এই গ্রামে চলছিল আরেক নাটক—যেটার মূল হোতা ছিল মফিজ দারোগা। যেটা তুই জেনে গেছিস এতক্ষণে।”
আচ্ছা, তাহলে এই ব্যাপার! মফিজের সাথে হাত মিলিয়েছিল শিপলু আগেই, যেবারে মন্দির খুঁজতে এই গ্রামে এসেছিল, তখনই।
“গ্রামের বাংলোটা আছে না?” শয়তানের পুজারি শিপলুর ঘড়ঘড়ে স্বর ক্রমেই চেনা আরো কঠিন হয়ে যাচ্ছে, “সেটা আসলে বাংলো না, কোনোকালে ছিল না-ওটা ছিলো মফিজ দারোগার বাপের বাড়ি। গল্পটা শুনিসনি-এক প্রফেসর একাত্তরে এসেছিল এখানে আশ্রয় নিতে, তার পেছন পেছন মিলিটারি নিয়ে এসেছিল এক তরুণ রাজাকার? ওই প্রফেসর ছিলো মফিজ দারোগার বাবা! ওদের ফ্যামিলির একমাত্র সারভাইভিং মেম্বার ছিলো মফিজ দারোগা! সাধে কি আর ওর মাথা বিগড়েছে? আমি-”
“তুই মফিজ দারোগাকে বোঝালি যে আমিই ওই রাজাকারের ছেলে, আর তুই আমাকে এনে দিতে পারবি ওর নাগালের মধ্যে,” ফিসফিসিয়ে বললাম তাকে। সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগছে আমার কাছে।
“হ্যা,” ঘড়ঘড়ে গলায় বললো শিপলু। “বাকি থাকলো তোকে সত্যি সত্যি এখানে আনা। রাশেদকে চটালাম তোর নামে, বোমা মজিদকে লাগালাম তোর পেছনে-তোর ওপর আমার এতটুকু বিশ্বাস ছিলো, ও তোর সাথে লাগতে আসলে তুই ওকে খুন করবি-তোকে খুনের আসামি বানালাম। তোকে এই গ্রামে নিয়ে আসার রাস্তা অনেকটা পরিস্কার হলো। বাকি থাকলো সবচেয়ে বড় সমস্যাটা তুই নিজে। তুই সুস্থমস্তিষ্কে কখনো এই গ্রামে আসতি না, দুনিয়া উল্টে গেলেও।”
“আর সেই জন্যে আমার ওপর ড্রাগস প্রয়োগ করলি তুই,” বললাম আমি অনেকটা যেন নিজেকেই। শিপলু আর না বললেও চলবে, বাকিটা বোঝা হয়ে গেছে আমার ভালোভাবেই।
“হ্যা! কাজটা সহজ, কারণ তুই হেভি ড্রিংকার! এমন ড্রাগ আমাকে চুজ করতে হয়েছে যাতে তোর শরীর ঠিক থাকে, তুই নিজ ইচ্ছায় আমার সাথে আসিস, কিন্তু তোর বিচারবুদ্ধি যেন গুলিয়ে যায়! সুতরাং? তোর মদের সাথে খানিকটা এলএসডি, আর প্রাচীন একটা হ্যালুসিনোজেনিক ভেষজ-ম্যানড্রেক! প্রথম ডোজ তোর ওপর দিলাম থার্সডে নাইট ডিলাইটের পার্টিতে! তোর বাবা মরার পর তোর মাথায় এমনিতেই গোলমাল, সেজন্য জাদুর মত কাজ করলো ড্রাগটা। তার পরে কি কি করিয়ে নিয়েছি আমি তোকে ওই হ্যালুসিনোজেনিক ড্রাগ দিয়ে, সেটা তোর জানা আছে!”
হ্যা, আমার জানা আছে। আমার ভাল জানা আছে। রংপুর আসার পথে বিশাল অ্যামনেশিয়া। অদ্ভুতুড়ে সব স্বপ্ন। জঙ্গলে ঢোকার পরে প্রবল অডিও-ভিজুয়াল- সেনসরি হ্যালুসিনেশন, কারণ হাত কাঁপা থামাতে প্রত্যেকবারই বড় ডোজে অ্যালকোহল নিয়েছিলাম, সেই সাথে মেশানো ড্রাগও। আর সেজন্যই….
“সাধারণ একটা শেয়ালকে তোর কাছে লাগছিল বিশাল, হিংস্র পিশাচের মত, “ ঘড়ঘড়িয়ে বললো শিপলু। চেহারাই বদলে গেছে ওর এখন। প্রভু শয়তানের সাথে বোধহয় আর কোনো তফাত নেই ওর চেহারার এখন।
“কিন্তু আমি কেন?” দুর্বল গলায় প্রশ্ন করলাম। “কেন আমাকেই বলি দিতে হবে তোর?”
“কারণ তোর সবকিছু মিলে যায়,” পৈশাচিক একটা হাসি মুখে ঝুলছে শিপলুর।
“নিউমোরলজি দিয়ে বিচার করে দেখেছি আমি, অ্যাস্ট্রোলজি দিয়েও। তোর জন্ম তারিখ, লগ্ন, রাশি, জাতকের চরিত্র, সবকিছু মিলে যায়—এমন বলিই চান আমার প্রভু! আর বিশেষ করে ওটা!” আমার কপালের জন্মদাগটার দিকে দেখালো শিপলু। “সাথে তোর কপালের জন্মদাগ!”
“তার মানে পত্রিকায় আমার ছবি দেখে আমাকে খুঁজে পেয়েছিস তুই!”
“হ্যা!” উন্মত্তের মত হেসে উঠেই থেমে গেল শিপলু। “ড্রাগ কেলেংকারি করলি যখন, তখন পেপার-পত্রিকা ভেসে যাচ্ছিলো তোর ছবি দিয়ে, তখনই আমি একটা ছবিতে দেখি তোর কপালের জন্মদাগটা। তখনই বুঝতে পারি, আমার প্রভুর কাছে উৎসর্গ করার জন্য তোর চেয়ে উপযুক্ত আর কেউ এই দেশেই নেই!”
“কিন্তু সব ভজকট করে দিতে শুরু করেছিল মফিজ দারোগা, তাই না?” তেতো গলায় বললাম আমি।
“হ্যা! তোকে মারতে চায় ও নিজেই! কথার জালে ফেলে দমিয়ে রেখেছিলাম বটে বেশ কিছুটা সময়, কিন্তু তুই যখন বিকেলে হাটে গেছিস তখন সে মেজাজ হারিয়ে বাংলোতেই অ্যাটাক করে বসলো তোকে মারতে! বাকিটা তো তুই জানিস-গাড়িতে করে পালাতে যাচ্ছিলাম, গুলি করলো মফিজ দারোগা, সামাদের পেট ফুঁড়ে চলে গেল সেটা, গাড়ি কাত, মফিজ দারোগা আমাদেরকে খালিভিটায় নিয়ে গেল কারণ সে জানতো তুই আমাদের খোঁজে আসবিই-”
“তারপরে আমি গেলাম, ছোট্ট একটু নাটকও হলো, আর তারপরে আমরা এখানে।” তীব্র ব্যঙ্গের সুরে বলে উঠলাম আমি। থুথু ফেললাম মাটিতে।
“হ্যা।” হাসার চেষ্টা করলো শিপলু, নারকীয় সেই হাসি দেখে ঘৃণায় গা রি-রি করে উঠলো আমার। “মফিজ দারোগা আমাকে মেরে ফেললো, কিন্তু মহান শয়তানের দয়া আছে আমার ওপরে, আমি মৃত্যু থেকে বেঁচে চলে এসেছি তোকে প্রভুর বেদিতে বলি দিতে!” দা ধরা হাতটা ধীরে ধীরে ওপরে উঠছে ওর।
আসল নকল বিচার করো। আমার কানে কাছে আবার বলে উঠলো কেউ। আমি মুচকি হাসলাম। এখন আমি জানি, ওটা কোনো অশরীরি আত্মার কন্ঠ নয়, বরং আমার নিজের অবচেতন মন আমাকে পুরোটা সময় সাবধান করতে চাইছিল, তুমি চোখের সামনে যা দেখছো সেটা সত্য না, মায়া, হ্যালুসিনেশন। তুমি কোনটা আসল আর কোনটা নকল সেটা আলাদা করতে শেখো-আসল নকল বিচার করো। সন্দেহ নেই খালেকুজ্জামান স্যারের প্রলাপ থেকেই কথাটা ক্যাচ করেছে আমার ব্রেন।
“আসল নকল বিচার করতে শিখেছি আমি, শিপলু।” মুখে হাসিটা ধরে রেখেই বললাম।
শিপলুর পৈশাচিক চেহারাটা বিভ্রান্ত দেখালো এক মুহূর্তের জন্য। “কি বললি?”
“আমি যদি বলি, মফিজ দারোগার রিভলভারের সবগুলো গুলি আসল ছিলো না?” আমি চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম।
শিপলু টকটকে লাল চোখদুটো বড়বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ফেনা বেরোনো মুখে কোনো কথা নেই।
“আমি যদি বলি, আমার রাইফেলের সবগুলো গুলি আসল নয়?” সোজাসুজি শিপলুর জান্তব চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে আছি এখন।
এবারও রা নেই ওর মুখে। থুতনি গড়িয়ে পড়ছে ফেনা। লাল চোখদুটোয় অপরিসীম ঘৃণা।
“গুলিগুলো বদলে দিয়েছিল কে? তুই, নরকের কীট কোথাকার!” গর্জে উঠলাম আমি। “ব্ল্যাঙ্ক কাট্রিজ ভরে দিয়েছিলি আমার আর মফিজ দারোগার বন্দুকে। কিন্তু সবগুলো না—দুয়েকটা আসল গুলিও রেখে দিয়েছিলি! কি জন্য? তোর কল্পিত প্রভু বোধহয় শত্রুর কাছ থেকে সব সুযোগ কেড়ে নেওয়ার পক্ষে না, তাই না?”
লাল টকটকে চোখে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকাটা যদি সম্মতির লক্ষণ হয় তাহলে শিপলু হ্যা-ই বলছে বটে।
“আর যে দুই-একটা আসল বুলেট রেখে দিয়েছিলি, তারই একটা আমার ভাই সামাদের জীবনটা কেড়ে নিয়েছে, ম্যানিয়াক কোথাকার!” রাগে কাঁপছে আমার গলা। “আমার রাইফেলের একটা আসল বুলেট মফিজ দারোগার শয়তানি শেষ করে দিয়েছে। ব্ল্যাঙ্কগুলো অযথা ফায়ার করেছি শেয়ালকে পিশাচ ভেবে!”
কাঁপতে কাঁপতে মুখ খুললো শিপলু। লাল চোখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছে ওর-মুখটা বদলে গেছে ঘৃণার মুখোশে। “কিন্তু আমি…”
“মরা থেকে বেঁচে ফিরেছিস, তাই তো?” খেঁকিয়ে উঠলাম। “মফিজ দারোগার ওই বুলেটটাও ছিলো ব্ল্যাঙ্ক! আর রক্ত?” শিপলুর শার্টের সামনে বুকে শুকনো লাল দাগটার দিকে টর্চের আলো নাচালাম আমি। “তোর এফডিসিতে খুব আনাগোনা, সেটা ভুলেছি ভেবেছিস? গুলি খাওয়ার নকল ইফেক্ট কি করে দেখাতে হয় সেটা শিখেছিস ওখানেই, দরকারি কিটস আর রঙও জোগাড় করেছিস! গোটা ব্যাপারটাই স্রেফ চিপ পার্লার ট্রিকস!”
চোখ দিয়ে আগুন বের করার চেষ্টা করছে যেন শিপলু, ভষ্ম করার চেষ্টা করছে আমাকে। শিউরে উঠলাম আমি-উন্মাদটার মুখ দিয়ে ফেনা পড়ছে, মুখের চামড়া কুকুরের মত সরে গিয়ে মাঢ়িসহ দাঁত দেখা যাচ্ছে সবগুলো, লাল টকটকে চোখদুটো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে গোল দুটো অঙ্গারের টুকরোর মত।
“আর তোর কেস স্টাডিগুলো,” প্রায় ফিসফিসিয়ে কথা বলছি আমি এখন, “সেগুলোর কথা শুনতে চাস? তোর ধারণা, যেগুলো তোকে তোর প্রভু শয়তানের আরো কাছাকাছি নিয়ে গেছে? সেগুলোরও আসল ব্যাখ্যা আমার জানা আছে, শিপলু! শোন তাহলে!” আমাকে কথার নেশায় পেয়ে বসেছে। “তোর কয়েকটা ফেমাস কেসের কথা বলি। যেমন ‘অ্যানজাইনা।’ যে ছেলেটার কথা তুই বলেছিলি, তার আসলে হার্ট ডিজিজ ছিলো। জন্মগত! সিগারেট খেতে শেখার পরে সেটা বেড়ে গেছিলো। স্বয়ং মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখাটা জাস্ট একটা মায়োকার্ডিয়াল ইনফ্রাকশন হবার সময়ের হ্যালুসিনেশন!”
শিপলুকে রিয়্যাক্ট করারও টাইম দিলাম না। বললাম, “আর “পাঁচ তলা!” অসহায় মেয়েটা পাঁচ তলাতে কারো রেপের শিকার হয়েছিল সম্ভবত তার রিলেটিভ কারো কাছে-তারপর তার মস্তিষ্ক তাকে বুঝিয়েছে যে রেপের ব্যাপারটা আসল না, সে আসলে অতিপ্রাকৃত কোনো জীবের খপ্পরে পড়েছিল! সিভিয়ার ট্রমার পেশেন্টদের ক্ষেত্রে এসব হয়। মেয়েটা সুইসাইডাল হয়ে উঠেছিল ওই ট্রমার কারণেই। আর….হ্যা, ‘তদন্তম্! বেচারা ফাহিম ছিল তোর প্রথম খুন, না? পুলিশ তোকে ধরতে পারেনি, কারণ ফেঁসে যেতে পারিস এরকম কোনো কু রাখিসনি তুই, ওই বয়সেও বড্ড চালু ছিলি, শয়তানের বাচ্চা শিপলু! কেন মেরেছিলি বেচারাকে? আর একটা, ‘রিগর মর্টিস!’ ডাক্তার নাহিদ দায়িত্বে অবহেলা করে একটা পেশেন্টকে মেরে ফেলার পর ওই হাসপাতাল থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল। কাটা অঙ্গ জোড়া লাগিয়ে তৈরি হওয়া পিশাচ স্রেফ একটা বোগাস ছেলে ভোলানো গল্প! আরো একটা ফেমাস কেস তোর… চার নম্বর বনবিহারীলাল লেন!’ তোর প্রাক্তন মেসের রুমমেট চাকরি বাকরি হারিয়ে পাগল হবার পরে তোকে যে প্রলাপ শুনিয়েছিলো সেটা মনের মাধুরি মিশিয়ে লিখে মাসিক হালচালে ছাপিয়ে লক্ষ লক্ষ লোককে বোকা বানিয়েছিস, তাই না?”
শিপলুর মুখের চওড়া হাসিটা একেবারে নেই হয়ে গেছে। মাথাটা নিচু করে ঠান্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ও। যে চশমার চকচকানি ওকে অসাধারণ করে তুলেছিল, সেটা গায়েব। ফ্রেমের ওপর দিয়ে কেবল দেখা যাচ্ছে ওর শীতল কালো চোখ।
“এই এক্সপ্লেনেশনগুলো আমাকে দিয়েছিল সামাদ…আমার ভাই,” গলা কেঁপে গেল আমার বলতে গিয়ে। “আর এগুলোর ওপর বেজ করেই তো নিজেকে অকাল্ট সায়েন্সের গুরু ভেবে নিয়েছিলি তুই, না? অলৌকিক বিষয়ের সবজান্তা! হাহ! যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই, সেটা আবার বিজ্ঞান হয় কি করে? সুস্থ মাথার যে কেউ বুঝবে এটা-তুই বুঝিসনি-বরং নিজের তৈরি করা ইলিউশনে নিজেই ডুবেছিলি তুই, নিজেই নিজেকে ধোঁকা দিয়েছিস। কারণ কি, জানিস?” এক মুহূর্ত থামলাম আমি, “কারণ তুই একটা সাইকোপ্যাথ, শিপলু! তোর রক্তেই আছে খুনের নেশা!”
দম নিলাম লম্বা করে। “অনেক শয়তানি করেছিস তুই, শয়তানের বাচ্চা, ধীরে ধীরে শান্ত সুরে বললাম আমি। “কিন্তু ভুলিস না-পাপের সাজা এই দুনিয়াতেই পেতে হয়।” কথাগুলো খেলো। ফাঁকা বুলি। আসলে গোটা ব্যাপারটা তলিয়ে দেখার চেষ্টা করছি আমি ঘোলা মাথা নিয়েই।
আমার সাতফুট সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাইকো শিপলু। হাতে একটা ধারালো দা-ওটা দিয়ে কোপালে একটা হাত আলগা হয়ে আসবে যে কারো। আমার কাঁধে অবশ্য রাইফেল আছে, কিন্তু চেম্বারে যে বুলেটটা আছে সেটা আসল না শিপলুর দেয়া ব্ল্যাঙ্ক, বোঝার উপায় নেই।
আর শিপলু আমার ওপরে ঝাঁপানোর আগে আমি একটা গুলি করারই সুযোগ পাবো।
শিপলুও সেটা জানে। গনগনে লাল চোখে একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ও, মুখে ধীরে ধীরে ফুটছে একটা শয়তানি হাসি।
“চালা গুলি,” চেনার অযোগ্য ঘড়ঘড়ে জান্তব স্বরে বলে উঠলো শিপলু, “তোর বুলেটগুলোর মাঝে মোট তিনটে আছে আসল, আর বাকিগুলো ব্ল্যাঙ্ক! এর মাঝে দুটো খরচ করে ফেলেছিস তুই….”
আমার বুকের মাঝে দ্রিম দ্রিম করে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে যেন। ঠিকই বলছে শিপলু।
একটা গুলিতে মফিজ দারোগার খুলি উড়িয়ে দিয়েছি আমি।
আরেক গুলিতে আমার পেছনের শেয়ালটা পটল তুলেছে।
কিন্তু আরো কয়েকটা গুলিও তো করেছি আমি!
জঙ্গলের ধারে একবার।
জঙ্গলের ভেতরে শয়তানের মন্দিরে প্রথমবার ঢুকে একবার।
সে-দু’বার শেয়ালের গায়ে গুলি লাগেনি। সেগুলো কি সত্যিই ব্ল্যাঙ্ক ছিলো, নাকি সেগুলোর মাঝে একটা রিয়েল বুলেটও ছিলো? আমিই মিস করেছি? আমার কাছে কি এখন সব ব্ল্যাঙ্ক?
চেম্বারে এখন একটাই বুলেট আছে। একটা গুলি করারই সুযোগ আছে আমার। সেটা যদি ব্ল্যাঙ্ক হয়ে থাকে, তাহলে আর এক সেকেন্ডও সময় পাবো না আমি, গর্দানটা যাবে শিপলুর দা-য়ের কোপে।
যা কিছু বললাম, সব ভাবনা আমার মাথায় খেলে গেল এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মাঝেই, কারণ অতটা সময়ই আমি পেয়েছিলাম শিপলু ওর দাঁতগুলো খিঁচিয়ে ঘড়ঘড়ে গলায় গর্জে উঠে দা-টা দু-হাতে ওপরে তুলে আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে।
আপনা-আপনিই ট্রিগারে চাপ পড়লো আমার আঙুলের।
শিপলু জোম্বির মতো ছুটে আসছে আমার দিকে-সোজা ওর বুকের ওপর ফুটলো রাইফেলের গুলি।
কিছুই হলো না!
ব্ল্যাঙ্ক!
মরিয়া হয়ে রাইফেল-টর্চ সব ফেলে বাঁ হাতটা তুলতে না তুলতেই শিপলুর কোপটা এসে পড়লো আমার কাঁধের ওপরে।
অধ্যায় ১৭ – জামশেদের জবানবন্দি থেক
অধ্যায় ১৭ – জামশেদের জবানবন্দি থেকে
প্রবল উত্তেজনার সময় মানুষ ব্যথা পায় না। আমিও পেলাম না।
শিপলুর দাটা বসে গেছে আমার কাঁধে-সেটা ঠিক কিন্তু শেষ মুহূর্তে বাঁ হাতটা তুলতে পেরেছিলাম আমি, অনেকটা ঠেকিয়ে দিতে পেরেছি কোপের তীব্রতা।
আমার হাত খালি এখন। রাইফেল আর টর্চ-দুটোই ফেলে দিয়েছি। বামহাতে ঝটকা দিলাম একটা, কাঁধের ওপর থেকে সরিয়ে দিলাম শিপলুর দা ওয়ালা হাতটা। ভোঁতা একটা ব্যথা জানান দিল যে মাংসের ভেতর থেকে বেরিয়ে গেল দা-য়ের ফলাটা।
মাটিতে পড়া টর্চটার বাল্ব ভাঙেনি। একবার এদিকে আরেকবার ওদিকে গড়িয়ে নানান দিকে আলোর ঝলকানি ফেলছে ওটা।
শিপলুর মুখটা এখন একদম সামনে আমার। ডান হাতটা মুঠো পাকিয়ে গিয়েছিল আগেই, সরাসরি ওটাকে ছুঁড়ে দিলাম শিপলুর চোয়ালে।
শরীরে কম শক্তি রাখি না আমি-কিন্তু ড্রাগ আর মারের চোটে ঘুষিটা জোরালো হলো না তেমন। আর শিপলুর ওপরে শয়তান ভর করেছে, ঘুষিটা অনায়াসে হজম করে নিলো ও, মাথাটা ঝট করে ঘোরালো আমার দিকে। আগুনে দৃষ্টি লাল টকটকে দুচোখে। গলা দিয়ে বেরোচ্ছে জান্তব গরগর।
চোখের কোণা দিয়ে দেখলাম, দা’ ধরা হাতটা আবার ওপরে উঠে যাচ্ছে শিপলুর। আরেকটা কোপ খেলেই আমি শেষ। মরিয়া হয়ে ডান পা তুলে একটা লাথি কষালাম ডেভিল ওরশিপারের পেটে। ছিটকে মাটিতে পড়লো শিপলু, অনিচ্ছাকৃত উল্টো ডিগবাজিও খেল একটা। মাটিতে পড়া টর্চের দুলতে থাকা আলোয় দেখতে পেলাম শিপলুর হাত থেকে দাটা ছিটকে পড়েছে।
চার হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে উপুড় শিপলু। এই-ই সুযোগ। ধাঁ করে ঝুঁকলাম আমি, মাটিতে পড়ে থাকা রাইফেলের ব্যারেলের ডগার দিকটা ধরলাম, ওটা তুলে নিয়ে সোজা হলাম তারপর।
ফুট দশেক দূরে ছিটকে পড়া শিপলু যতক্ষণে সোজা হচ্ছে, ততক্ষণে আমি রাইফেলটা মুগুরের মত করে তুলে ধরেছি, কুঁদোর দিকটা রয়েছে ওপরে।
অবিশ্বাস্য দ্রুততায় খাড়া হলো শিপলু, খেপা ষাঁড়ের মতো কাঁধ নিচু করে ছোটা শুরু করলো আমার দিকে।
আমি তৈরিই ছিলাম। বেসবল হাঁকানোর মত করে রাইফেলের কুঁদোটা সরাসরি বসিয়ে দিলাম ওর মাথায়।
ভেবেছিলাম, একটা মারই যথেষ্ট হবে। কিন্তু শয়তানের শক্তিতেই হোক বা জখমি কাঁধওয়ালা আমার মারের দুর্বলতার জন্যই হোক, মারটার যেন কোনো প্রভাবই পড়লো না ওর ওপরে। মারের মোমেন্টামে ঝটকা দিয়ে মাথাটা ঘুরে গেল ওর-কিন্তু ওই পর্যন্তই। সুইংগিং ডোরের মত পাঁই করে ঘুরলো আবার ও আমার দিকে।
ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য থমকে গেছিলাম আমি। ভুত-জিনের মত শয়তানেও বিশ্বাস নেই আমার, কিন্তু সত্যি বলছি, এক সেকেন্ডের জন্য আমার মনে হচ্ছিলো যার মুখোমুখি আমি হয়েছি সে খোদ শয়তান। রক্ত মাংসের মানুষ না।
আমার ঘোর কাটার আগেই পা বাড়িয়ে একটা লাথি মারলো শিপলু, রাইফেলটা উড়ে গেল আমার হাত থেকে। পরের লাথিটা পড়লো আমার পেটে। সব বাতাস বেরিয়ে গেল আমার বুক থেকে, “হুঁক’ করে একটা শব্দ করে কুঁজো হয়ে গেলাম আমি।
তিন নাম্বার লাথিটা পড়লো ঠিক আমার কানের ওপর। কাত হয়ে মাটিতে পড়ার সময়টাও পেলাম না আমি, চার নম্বর লাথিটা ছুঁড়ে দিলো আমাকে পেছনে। চিৎ হয়ে আছড়ে পড়লাম মাটিতে।
ভেজা, আঁষটে গন্ধওয়ালা কোনোকিছুর ওপর পড়েছি আমি। শেয়ালটার জমাট রক্ত! এমনিতেই চারদিকে আলো-আঁধারি, তার ওপরে আরো বেশি অন্ধকার দেখছি আমি চোখে, ঝিমঝিম করছে মাথাটা। ওঠার শক্তি নেই। কাঁধ ইতিমধ্যেই ভিজে গেছে রক্তে।
কোনোমতে মাথাটা একটু উঁচু করে দেখি, দাটা মাটি থেকে তুলে নিচ্ছে শিপলু। ও ঝুঁকতেই টর্চের আলোয় ঝিকিয়ে উঠলো ওর চশমা-কিন্তু শুধু একটা লেন্স। অন্যটা ভেঙে গেছে আমার রাইফেলের মারে।
ঝাপসা চোখে দেখছি, দাটা তুলে নিয়ে খাড়া হলো শিপলু। তারপর একপা একপা করে হেটে আসতে শুরু করলো এদিকে।
আমি মাটিতে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে থাকতে চাই না। আমি চাই উঠে দাঁড়াতে, উন্মাদটার সাথে লড়াই করতে। কিন্তু শরীর কথা শুনছে না আমার। এলএসডি- ম্যানড্রেকের বিষক্রিয়ার পরে এমন প্রচন্ড মার আর রক্তক্ষরণ…
আরেক পা এগিয়ে এলো শিপলু। পড়ে থাকা টর্চের আলোটা পেছন থেকে পড়ছে ওর ওপর-মুখটা দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ওর চোখগুলো জ্বলছে ফসফরাসের মত। এক চোখের চশমা ভাঙা। ওর মাথার ওপরে ওই দুটো কি? শিংয়ের মত?
শিউরে উঠলাম আমি। আমার মগজ বলছে এ-সবই হ্যালুসিনেশন, কিন্তু মন বলছে যে আজ স্বয়ং শয়তানের মুখোমুখি পড়ে গেছি আমি এই শয়তানের মন্দিরের ভেতরে।
আরেক পা এগিয়ে এলো সাক্ষাৎ শয়তান। মাথায় চোখা দুটো শিং। পেছনে সাপের মত পাক খাচ্ছে একটা লেজ! আবছাভাবে শুনতে পাচ্ছি, ওটার গলার গভির থেকে বেরিয়ে আসছে একটা হালকা গুনগুন শব্দ। ধীরে ধীরে বাড়ছে সেটা শয়তানটা এগিয়ে আসার সাথে সাথে।
যেন গুনগুনিয়ে গান গাইছে ওটা। কিন্তু আমি জানি ওটা গান না।
আমাকে বলি দেবার আগে প্রভু শয়তানের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা সঙ্গিত গাইছে শিপলু। আমার নাড়িভুড়ি শীতল হাতে খামচে ধরলো কে যেন।
আমার পায়ের কাছে এসে থামলো শয়তানটা। দুর্বোধ্য ভাষায় প্রার্থনা সঙ্গিত গাইছে সুর করে। দুই চোখ জ্বলছে লালচে ফসফরাসের মত আভা নিয়ে।
আমি স্রেফ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছি।
আরো উঁচু থেকে উঁচু হচ্ছে ওটার গলা।
সেইসাথে ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে হাতদুটো। সে দুটোর মাঝে শক্ত করে ধরা ঝকঝকে দাটা। ধীরে ধীরে বাম হাতটা নামিয়ে আনলো শিপলু। এখন শুধু দা’ ধরা ডান-হাতটা ওঁচানো ওর।
সাথে সাথে মন্দিরের কালো ছাদ ফুঁড়ে নামলো চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বল একটা লালচে-সাদা আলোর রশ্নি, এসে ঠেকলো দাটার সাথে। শয়তান যেন সরাসরি নরকের আগুনের একটা স্রোত পাঠিয়ে দিয়েছে শিপলুর হাতে, মঞ্জুর করেছে তার প্ৰাৰ্থনা!
শোঁ শোঁ করে দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে শিপলুকে ঘিরে। যেন একটা ঘূর্ণিঝড়ের কেন্দ্রে রয়েছে ও, ঝড়টা পাক খাচ্ছে ওকে ঘিরেই। কালো কী যেন কয়েকটা ফট ফট করে ডানা ঝাপটে উড়ছে সেই বাতাসে, প্রদক্ষিণ করছে অন্ধকার জগতের রাজপুত্র আর্দশির শাপুর শিপলুকে। ঠিক চিনতে পারলাম না জিনিসগুলোকে। দাঁড়কাক, না হয় বাদুড়।
টের পাচ্ছি, আমার চারপাশ ঘিরে যেন খলখলিয়ে হাসছে শত শত অশরীরী কণ্ঠ। নরক থেকে শয়তানের সব চ্যালা যেন চলে এসেছে শিপলুকে উৎসাহ দিতে। আমার মাথাটা কাটার পরই মহা শক্তিধর একজন হিসেবে শিপলুকে ওদের মাঝে বরণ করে নেবে ওরা যেন।
একেবারে ওপরে উঠে গেছে শিপলুর দাটা—ওখানেই ওটাকে স্থির করে ধরে চড়া সুরে মন্ত্র পড়ছে ও। নরকের আগুনের স্তম্ভটা এসে ঠেকেছে সেটায় গায়ে। আর বুঝি বেশি বাকি নেই শয়তানের কাছে শক্তিভিক্ষা চাওয়া শেষ হতে।
আমার হাত-পা জমে আসছে। বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম করে পড়ছে হাতুড়ির বাড়ি। আমি ভয় পেয়েছি। কোনো সন্দেহ নেই আমি ভয় পেয়েছি। পরাজয়ের চূড়ান্ত দোরগোড়ায় আমি—এমন সময় হঠাৎ আমার মাথার ভেতরে কি যেন হয়ে গেল।
“শিপলু!” শরীরের সমস্ত শক্তিতে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি।
শয়তান উপাসকের প্রার্থনা সঙ্গিত থেমে গেল সাথে সাথে। দাটা মাথার ওপরে তুলে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে রইলো ও আমার দিকে। চোখা মাথাওয়ালা লেজটা সাপের মত মোচড় খাচ্ছে পেছনে।
“শয়তান বলতে কিছু নেই!” হিসহিসিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। প্রচন্ড রাগে কাঁপছে সারা শরীর। এতদিনের জমানো সব ক্রোধ যেন উগরে দিতে চাইছি একসাথে। “তোর করা সব ইনভেস্টিগেশনের মত শয়তানও মিথ্যা! বানোয়াট! মানুষই শয়তান হয় শিপলু-মানুষই!”
জানোয়ারের মত গর্জে উঠলে সে, দাঁতের ওপর থেকে সরে গেছে ঠোঁট। রক্ত পানি করা একটা হুংকার ছেড়েই দাটা নামিয়ে আনলো ও আমার ঘাড়ের ওপর।
মাথার ওপরে একটা হাত তুলে দিয়েছি আমি, আর ডান পাটা স্প্রিংয়ের মত ছুটে গেছে সামনে, সরাসরি শিপলুর হাটুতে।
একেবারে মোক্ষম মার। আমার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়লো শিপলু-কয়েক ইঞ্চির জন্য মিস করেছে আমার ঘাড়টা।
আমার শিরায় শিরায় মোটা ধারায় বইছে অ্যাড্রেনালিন-ড্রাগের প্রভাব নেই হয়ে গেছে প্রচন্ড রাগের চোটে। শিপলু আমার গায়ের ওপরে পড়তে না পড়তেই এক ঝটকায় ছুঁড়ে ফেলে দিলাম ওকে চার হাত দূরে।
স্প্রিংয়ের মত লাফিয়ে সিধে হলাম পরের মুহূর্তেই। ডান-হাতটা দপদপাচ্ছে ব্যথায়। ওটা চোখের সামনে তুলতেই হার্টটা গলার কাছে চলে এলো আমার-তিনটে আঙুল নেই ওটাতে! আমার ডান-হাতের বুড়ো আঙুল, তর্জনি আর মধ্যমা স্রেফ নেই হয়ে গেছে শিপলুর দায়ের কোপে।
হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে টের পেলাম আমার শরীরের সব রক্ত চড়চড়িয়ে মাথায় উঠে যাচ্ছে। দপদপ করছে মাথার প্রত্যেকটা ধমনি। একটা আগ্নেয়গিরিতে যেন পাল্টে গেছি আমি-ফেটে পড়ার জন্য তৈরি।
রাইফেলটা কাছেই পড়ে ছিল, উল্টো করে তুলে নিলাম ওটা-ব্যারেলের দিকটা ধরে। কাটা হাতের তোয়াক্কা করলাম না।
শয়তানের পুজারি শিপলু কেবল শিঙওয়ালা মাথাটা একটু তোলার চেষ্টা করছিল, হাতে দা ধরা। ডানপায়ে শরীরের সব ভর চাপিয়ে দিয়ে সমস্ত শক্তিতে রাইফেলের কুঁদোটা সরাসরি বসিয়ে দিলাম ওর চাঁদিতে।
পাকা নারিকেল ফাটার মত ফটাস করে শব্দ হলো একটা। মারের চোটে মাটিতে ফুটবলের মত ড্রপ করে আবার লাফিয়ে শিপলুর শয়তানি মাথাটা-আর তখনই পড়লো আমার পরের মার, সোজা মুখের ওপর।
থামলাম না। আবার মারলাম। আবার। আবার। আবার। আবার।
থামলাম যখন, তখন শিপলুর মাথাটা আর মাথা বলে চেনার জো নেই, রক্ত- মাংস-হাঁড়-মগজের একটা দলায় পাল্টে গেছে স্রেফ। না, কোনো শিং নেই ওর চাঁদির ওপরে, কোনো লেজ নেই পেছনে।
ঝোড়ো হাওয়া গায়েব। সেই সাথে বাদুড়-দাঁড়কাকের দলও। ছাদ ফুঁড়ে নামা নরকের আগুনের স্তম্ভটাও হাওয়া।
সব হ্যালুসিনেশন কেটে গেছে।
আসল নকল বিচার করতে শিখেছি আমি।
হাঁফাচ্ছি আমি। রাইফেলটা ফেললাম না হাত থেকে, হাঁটার সময় লাঠির কাজ করবে ওটা, ভর দিতে পারবো ওটার ওপরে। পকেট থেকে রুমালটা বের করে কাটা হাতের ওপর বাঁধলাম ধীরে-সুস্থে। কাঁধটা ব্যথা করছে বটে, তবে ও কিছু না, রক্ত পড়া থেমে যাবে। হয়তো।
আস্তে আস্তে হেটে গেলাম টর্চটার দিকে, মাটি থেকে তুলে নিলাম ওটা।
পেছনের দিকে আর একবারও তাকালাম না। সোজা হাটা দিলাম বাইরের অন্ধকারের দিকে। টর্চটা বগলে চেপে ধরা। রাইফেলটা ব্যবহার করছি হাটার লাঠির মত করে।
অলৌকিক শিপলুকে শেষ করে বেরিয়ে এলাম আমি, লৌকিক জামশেদ।
উপসংহার
জামশেদ থেমেছে। এতক্ষণ একদৃষ্টে তার দিকে তাকিয়ে ছিলেন পুলিশ ইন্সপেক্টর বোরহান মওলা, এবারে মুখ তুলে তাকালেন এই ভিআইপি কেবিনের দরজার দিকে I নাম ধরে ডাকতেই ভেতরে চলে এল দরজার কাছে পাহারা দিতে থাকা দুই কন্সটেবল। “যাও, ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এসো।” হুকুম দিলেন ইন্সপেক্টর বোরহান মওলা। “হ্যা, দু-জনই যাও।”
দুই কনস্টেবল গায়েব হওয়ার দশ সেকেন্ড পরে মুখ খুললেন বোরহান মওলা। “নদীর তীর পর্যন্ত পৌঁছলেন কি করে?”
হসপিটালের এই ভিআইপি কেবিনটা এয়ারকন্ডিশন্ড, তবু জামশেদের কপালে হালকা ঘাম। বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে ও। ব্যান্ডেজ করা হাতটা কোল থেকে নামিয়ে রাখলো পাশে। “আন্দাজ করে অনেকক্ষণ হাঁটতে হাঁটতে গাছপালার ফাঁক দিয়ে আলো দেখতে পেলাম। শ্মশানে চিতা জ্বলছিল। নদীর তীরে জঙ্গলের ওধারে একটা শ্মশান ছিলো, আগে বলেছিলাম মনে হয়। ওখানে যারা ছিলো তাদেরকে মুখে কিছু বলতে হয়নি। আমাকে দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। জগদানন্দপুরের কান্ডকাহিনী ওদেরও খানিকটা জানা ছিলো। কিন্তু এ-দেশে প্রমাণ না থাকলে কিছুই হয় না।”
“প্রমাণ থাকলেও কিছু হয় না।” মুখের পেশি না কাঁপিয়ে বললেন ইন্সপেক্টর বোরহান মওলা।
জামশেদ মলিন একটা হাসি হেসে মুখ আরেক দিকে ফিরিয়ে নিলো। ওর জবানবন্দি দেবার ছিলো, ও দিয়েছে। এখন বাকি কাজ পুলিশের।
বোরহান মওলা তাকিয়ে আছেন। পুলিশকে মানুষ এত বোকা ভাবে কেন? জামশেদের বিশাল একটা গল্প বলেছে। ফ্যাক্টগুলো কিন্তু জগদানন্দপুরে ঘটে যাওয়া ঘটনার সম্পূর্ণ অন্য একটা ব্যাখ্যার দিকেও ইঙ্গিত করে। তিনি সেটা ধরতে পারছেন, যে কোনো ঘিলুওয়ালা পাবলিকই পারবে। তবে তিনি সামান্য ছাপোষা অফিসার মাত্র। এ-সব ব্যাপারে হাত দেবার ক্ষমতা তার নেই। জামশেদ টাকা নিয়ে সবকিছু কিনে নিতে পারবে দুই সেকেন্ডে
কিংবা হয়তো জামশেদের কথাই সত্য। সে আসলেই হয়তো এক নির্দোষ ভিক্টিম। শয়তানের উপাসক শিপলু আর প্রতিহিংসায় পাগল মফিজ দারোগার অসহায় শিকার সে। সেই রাজাকারের ছেলে নয়, যে রাজাকার জগদানন্দপুরকে পাল্টে দিয়েছিল নরকের ছোট্ট একটা টুকরোয়।
হয়তো।
ডাক্তার চলে এসেছে। ইন্সপেক্টর উঠে দাঁড়ালেন। “যাই, খানসাহেব।” বললেন বটে তিনি, কিন্তু জামশেদ কোনো সাড়া দিলো না। ও মিউট করা রঙ্গিন টিভিটার দিকে তাকিয়ে আছে।
রুম থেকে বেরোনোর সময় ইন্সপেক্টরের কানে পড়লো, গুনগুনিয়ে গাইছে জামশেদ। গানটা আগে শোনেননি তিনি, কিন্তু সুরটা যেন বহুদিনের চেনা। যেন আগেও শুনেছেন গানটা। কি এক ভয়ানক বিষাদ আর একাকীত্ব মিশে আছে তাতে।
“সয়না জ্বালা, তুমি বিনে
চইলাম আমি শ্বাপদ সনে।’
***