রুদ্র – খাদিজা মিম ছাপাখানা প্রকাশনী

KhoriBona

রুদ্র – খাদিজা মিম

ছাপাখানা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশঃ বইমেলা, ২০২৪
প্রচ্ছদ: ফাইজা ইসলাম

.

উৎসর্গ

— “জাফনা”
যে বলেছিল এবারের মেলায় রুদ্রকে আনো।

.

ভূমিকা

সাল ২০২২। সে বছর আমার মাথায় একজন নায়ক উঁকি দিলো যার গল্পটা হবে আমার অন্যসব নায়কদের চেয়ে ভিন্ন। যার সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল থাকবে না। বাড়াবাড়ি রকমের কাল্পনিক এক চরিত্র হবে সে এবং তার কাহিনী। বংশ পরম্পরায় সে হবে একইসঙ্গে রাজনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী। প্রচন্ড প্রভাবশালী এবং বেপরোয়া একজন নায়ক হবে সে। রাজনীতি কিংবা ব্যবসায়ের মাঠে দাপিয়ে বেড়ানো অমন একটা চরিত্র যখন জীবনে প্রথম প্রেমে পড়ে তখন তার আচরণ, ভাবনাগুলো কেমন হবে কিংবা ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পেতে, আঁকড়ে রাখতে কতটা বেপরোয়া সে হতে পারে তা-ই ভাবতে ভাবতে লিখে ফেললাম সেই গল্প। নায়কের নামেই তার গল্পের নাম দিলাম, “রুদ্র”।

অতি মাত্রায় কাল্পনিক এই গল্পটি পড়তে গিয়ে পাঠক খুঁজে পাবে, অর্থবিত্ত কিংবা ক্ষমতার মাঝে থেকেও একজন মানুষের একাকিত্ব, অস্থিরতা, মানসিক যন্ত্রণা। তার মাঝে দেখতে পাবে কখনো তার রুদ্ররূপ আবার কখনো ভীষণ যত্নশীল, আবেগী একজন পুরুষ!

নায়ক কেন্দ্রিক এই গল্পটা যখন লিখবো লিখবো করছিলাম তখন বারবার ভাবনায় এসেছিল, অতিরিক্ত কাল্পনিক এই গল্পটা লিখা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? কিংবা চরিত্রের স্বার্থে, গল্পের স্বার্থে ব্যবহৃত কটু শব্দ কিংবা স্পর্শকাতর দৃশ্যগুলো পাঠকের কাছে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে? পরবর্তী সময়ে মনে হলো, ঠিক আছে! বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখেই লিখতে হবে এমন তো কথা নেই! চরিত্র কিংবা গল্পের স্বার্থে যোগ করলাম নাহয় কিছু কটু শব্দ কিংবা সংবেদনশীল দৃশ্য। পূর্বে কি কখনো এমন কিছু হয়নি? হয়েছে তো! তবে রুদ্রের গল্পে কেন নয়? নায়ক যেহেতু মাথার ভেতর উঁকি দিয়েছেই, তাকে আমি লিখবো। সে যেই রূপে উঁকি দিয়েছে সেই রূপেই তাকে লেখা হবে। এর কোনো পরিবর্তন হবে না।

সবশেষে অনুরোধ রইলো, গল্পের প্রতিটি চরিত্র এবং দৃশ্য কাল্পনিক। কোনো ঘটনা যদি কারো জীবনের সঙ্গে মিলে যায়, গল্পের কোনো অংশ অথবা শব্দ কাউকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়, মন্দ লাগার সৃষ্টি করে তবে পাঠক যেন বিষয়টি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন।

রুদ্রের সাথে সময়টা পাঠকের সুন্দর কাটুক। এই কামনায়,

খাদিজা মিম
জানুয়ারি, ২০২৪

.

কাহিনি সংক্ষেপ:

এক জীবনে মানুষ যা চায় তার চেয়ে আরো অনেক বেশি আশীর্বাদপুষ্ট করে স্রষ্টা আমাকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। সব আছে আমার, সব! একটা প্রবাদ আছে না- সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম! আমার বেলায় মনে হয় আমি সোনা নয়, হীরের চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নিয়েছি। টাকা, বাবার বিজনেস, প্রপার্টি, ক্ষমতা… কী নেই আমার! সরকার কোন সিদ্ধান্তটা নেবে মন্ত্রীপদে কারা বসবে সেসব আগে চলতো বাবার সিদ্ধান্তে। বাবার পর সবকিছু চলছে আমার সিদ্ধান্তে। বাসায়, অফিসে মন্ত্ৰী এম.পি.দের আনাগোনা আর তাদের তোষামোদি, দশ প্রজন্ম বসে বসে খেয়ে কাটিয়ে দেবার মতো ব্যাংক ব্যালেন্স, দেশ বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিজনেস… এতকিছুর পরও আমি ভালো নেই। আমার সব আছে অথচ আমি এক বিন্দুও ভালো নেই। রক্ত মাংসে গড়া এই শরীরের ভেতরে যে মনটা আছে, সেটা কখন যেন পাথর হয়ে গেল! আমি কাঁদতে ভুলে গেছি, হাসতে ভুলে গেছি। কখনো কখনো নিজেকে এতটাই অনুভূতিশূণ্য লাগে, মনে হয় যেন আমার মৃত্যুতেও আমার কষ্ট হবে না। আমার নিঃশ্বাস বেরিয়ে যাবার সময় একটা সূচ ফুটানোর কষ্টও আমি অনুভব করতে পারবো না। শেষ কবে আমি সুখের মুহূর্ত কাটিয়েছি আমার মনে নেই। শেষ কবে এক ঘুমে আমার সকাল হয়েছে তাও স্মরণ করতে পারি না। এই জীবনে আমার সব আছে, তবুও আমার আরেকবার জন্ম নিতে ইচ্ছে হয়। নতুন এক জীবন পেতে ইচ্ছে হয়। যে জীবন সহজ হবে। অর্থবিত্তের আধিক্য থাকবে না। মাথার রগে রক্তের বদলে এত এত দায়িত্ব বিষাক্ত তরল দ্রব্য হয়ে ছুটে বেড়াবে না। মুক্তি চাই আমি পাথর হয়ে যাওয়া এই আমিটার কাছ থেকে, প্রচন্ড অসুখী এই জীবন থেকে। কেউ কি নেই এই পৃথিবীতে আমাকে এক মুহূর্তের জন্য সুখ দেবে? এক মুহূর্তের জন্য আমি কে সেটা ভুলিয়ে দেবে? সমস্ত কিছু আমাকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারবে? এক মুহূর্ত, শুধু এক মুহূর্ত! কেউই কি নেই এখানে আমার জন্য?

.

লেখক পরিচিতি

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ২০১৭ সাল থেকে খাদিজা মিমের লেখালেখির শুরু। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, ঢাকায় বেড়ে ওঠা। বর্তমানে স্নাতক সম্পন্ন করে এক পুত্র সন্তানের মা। মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চারটি।

১) বিসর্জন- ২০১৯
২) বাতাসে গুনগুন- বইমেলা ২০২০
৩) মেঘের আড়ালে তুমি- ২০২১
৪) ইট’স কমপ্লিকেটেড- ২০২৩

“রুদ্র” বইমেলা ২০২৪ এ প্রকাশিত লেখকের পঞ্চম বই।

Book Content👉

রুদ্র – ১

শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান চলছে। গেল কিছুদিন আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আজ নব্য সরকারী দলের মন্ত্রীরা শপথ গ্রহন করবেন। এই অনুষ্ঠানে আজই প্রথম এল রুদ্র। এর আগে আসা হয়নি কখনো। বাবা আসতেন সবসময়। অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়ে প্রধানমন্ত্রী আর রাষ্ট্রপতির মধ্যখানের আসনটাতে বাবা বসতেন। সেই পুরোনো রীতি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী ইকবাল মাহমুদ রুদ্রকে বসাতে চেয়েছিলেন তার আর রাষ্ট্রপতি সাইফুল ইসলামের মাঝে। রুদ্র বসেছিল, কিন্তু মিনিট দুয়েক পর হঠাৎ উঠে এল সেখান থেকে।

বললো, “আমি এখানে বসবো না। আপনি মাঝে বসুন, আমি আপনার চেয়ারে বসি।”

বহুদিন ধরে বড্ড কাছ থেকে রুদ্রকে দেখছেন ইকবাল মাহমুদ। ওর মুখ দেখে একটু-আধটু আন্দাজ করতে পারেন কখন মন খারাপ হচ্ছে, কখন রেগে যাচ্ছে, কখন খুশি হচ্ছে। এখন, এই মুহূর্তে ওকে ভীষণ অস্থির দেখাচ্ছে। ভালো লাগছে না হয়তো! বুঝতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি সাইফুল ইসলামকে ইশারা করলেন তিনি। তখনই হাসিমুখে জায়গা ছেড়ে দিলেন রাষ্ট্রপতি।

দূরে দাঁড়িয়ে ছিল রুদ্রের সহচরী শুভ। ওখান থেকেই রুদ্রকে দেখছে সে। তার চাহনী, চেহারার অভিব্যক্তি, একটু পর পর হাত কচলানো সবটা মিলিয়ে শুভ স্পষ্ট বুঝতে পারছে রুদ্রের মনে কী চলছে। মন খারাপ হলো শুভর। প্রতিনিয়ত নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করে এই জীবন বয়ে যাচ্ছে মানুষটা। শত মন খারাপ, কষ্ট বুকের মধ্যে চেপে রেখে বাবার রেখে যাওয়া সমস্ত দায়িত্ব যন্ত্রের মতো পালন করে যাচ্ছে। কেউ সেই কষ্ট দেখছে না, বুঝতে চাইছে না। নিজের চারপাশে এমনভাবে ভয়ের প্রাচীর গড়ে রেখেছে, লোকে শুধু তাকে ভয়ই পায়! ভাবে তার মাঝে মন নেই। আবেগ নেই। বিবেক নেই। আছে ক্ষুরধার বুদ্ধি, অঢেল টাকা, কয়েক সেকেন্ডে সবকিছু পিষে ফেলার ক্ষমতা। ক্ষমতাধর ব্যক্তিরাও তার ক্ষমতাকে ভয় পায়। ব্যবসায় কিংবা রাজনীতির মাঠে সমান দাপটে দাপিয়ে বেড়ায় সে। তাদের কাছে রুদ্র মানে অসুর, দানব। অথচ তারা কেউ জানেই না, এই অসুরটা কতখানি যন্ত্রণার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে আছে। এটুকু বয়সে এতখানি একাই বয়ে চলা, সাধারণ মানুষের

পক্ষে সম্ভব নয়। রুদ্র অসুর বলেই টিকে আছে, নয়তো পিষে যেত বাবার রেখে যাওয়া এই সাম্রাজ্যের যাতাকলে।

রোজকার মতো আজও সারাদিনের ছুটোছুটি শেষে বাসায় ফিরেই মা-বাবার ঘরে এল রুদ্র। গায়ের কোটটা সোফায় ছুঁড়ে মায়ের পাশে এসে বসলো সে। কাঁপা হাতে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন ফেরদৌসী মির্জা।

মুচকি হেসে ছেলেকে বললেন,

— “ক্লান্ত দেখাচ্ছে খুব!”

মায়ের হাত টেনে এনে চুমু খেলো রুদ্র। বললো,

— “একটু চাপ গেল আজ।”

— “খুব কষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তাই না?”

— “নাহ্! এ আর এমন কী। বাবা এরচেয়ে আরো বেশি দায়িত্ব মাথায় সামলে চলতো।”

— “খেয়েছিস?”

— “হ্যাঁ। খেয়েই ফিরলাম। আজ তো শপথ গেল।”

— “দেখেছি টিভিতে তোকে। মনে হলো, তোর বাবাই বসে আছেন।”

— “তুমি খেয়েছো আম্মু?”

মা-ছেলের কথোপকথন দীর্ঘ হতে থাকে। মায়ের মুখের কথা জড়িয়ে আসে। স্পষ্ট বোঝা যায় না অনেকসময়। কেউ কেউ বুঝেই না একদম। একই কথা ৩-৪ বার তাকে দিয়ে বলানো হয়। কিন্তু রুদ্র মায়ের সমস্ত কথা বুঝে নেয়। মায়ের চোখের ভাষা বুঝতে পারে সেই ছোট্টবেলা থেকে। রুদ্রের বাবা বলতেন, “আমার পরে সবচেয়ে বেশি যে তোমাকে বুঝবে, সে হলো তোমার ছেলে’। মা হেসে বলতেন, ‘ও তো তোমারই অংশ। তোমার মতোই হবে’। অথচ স্বভাবে ছিল বাবা-ছেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এতগুলো বছর বাদে মায়ের কথাটা মিলে গেল। বাবার মতোই তাকে হতে হলো। ঠিক বাবার ছায়া! কেউ কেউ বলে আশরাফ মির্জার চেয়ে তার ছেলে শাহরিয়ার মির্জা আরো অনেক বেশি যোগ্য। নয়তো এত কম বয়সে এত সব সামলে চলা কেমন করে সম্ভব! সেসব শুনতে ভালো লাগে না রুদ্রের। যে জীবন কোনোদিন সে চায়নি. সে জীবনের সফলতা নিয়ে প্রশংসা করলে ভালো লাগা তো অনুভব হবে না! তার উপর বাবার সঙ্গে তুলনা! রুদ্রের কাছে বাবা অতুলনীয়। বাবাকে সে শুধু বাবার মতোই কাছে পেয়েছে। কখনো ব্যবসায়ী কিংবা রাজনীতিবিদ আশরাফ মির্জা হিসেবে পায়নি। বাবার তুলনা কখনো হয়নি, কোনোদিন হবেও না; বুঝতে শেখার পর থেকে বাবা ছিল তার রিয়েল লাইফ হিরো। আজও তাই-ই আছে।

কথা বলতে বলতে এই ঘরের দেয়ালে ঝোলানো মা-বাবার বড় ফ্রেমের ছবিটায় চোখ গেল রুদ্রের। বাবা হাসছেন মায়ের দিকে তাকিয়ে। চাহনীতে তার অদ্ভুত মুগ্ধতা। প্রেম-ভালোবাসা কিংবা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নিয়ে বোঝাশোনা হবার পর থেকে মা-বাবার বন্ধন বরাবরই রুদ্রকে স্রষ্টার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে বাধ্য করতো। এত সুন্দর বন্ধন মা-বাবার মাঝে ক’টা সন্তান দেখতে পায়? কোন পুরুষটা তার স্ত্রীর দিকে ওভাবে মুগ্ধ নয়নে তাকায়? হোক মায়ের ঘামে ভেজা মুখ, অসুস্থতা বা ক্লান্তি লেপটানো চেহারা কিংবা মায়ের রাগে ভ্রু কুঁচকে থাকা… সবসময় বাবা ঐ একই মুগ্ধতা নিয়ে মাকে দেখতো। কোনোদিন সেই মুগ্ধতার হেরফের হয়নি। মাকে ওভাবে মুগ্ধ নয়নে দেখবার মতো আর কেউ নেই। বাবার ছবিটা দেখে সে কথা মনে পড়তেই হঠাৎ সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগতে শুরু করলো রুদ্রের। মায়ের সঙ্গে কথার মাঝেই উঠে দাঁড়ালো সে।

— “আম্মু, ক্লান্ত লাগছে। কাল সকালে কথা হবে।”

এক মুহূর্তও আর দাঁড়ালো না রুদ্র। বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।

ফেরদৌসী মির্জা চেয়ে রইলেন দরজার দিকে। বুকচিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার। তিনি জানেন, বোঝেন একমাত্র ছেলের মনের অবস্থা অথচ কিচ্ছু করার নেই তার। তাকে সামলানোর মতো অবস্থায় তিনি আর নেই। তাই বলে কেউই কি নেই? কেন কেউ নেই তার রুদ্রকে সামলে রাখার মতো?

গভীর রাতে ঘুমোনো রুদ্রের অভ্যেস। কোনো কোনো রাত নির্ঘুমও কেটে যায় তার। গতরাতেও ঘুম আসেনি। শেষরাতে কিচেনে গিয়ে স্যান্ডউইচ বানিয়ে, খেয়ে বিছানায় আধঘন্টা এপাশ-ওপাশ করে তারপর ভোরবেলায় চোখের পাতার ঘুম আনতে সক্ষম হয়েছে সে। বেলা এগারোটা কিংবা বারোটা পর্যন্ত ঘুমানোর কথা থাকলেও তা আর হলো না। সাড়ে নয়টা বাজতেই কানের কাছে ফোনটা বাজতে শুরু করলো। কোনোরকম একচোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো ইকবাল মাহমুদের কল। বড্ড বিরক্ত হলো সে। এই সকালে ইনি কেন! ঘুম জড়ানো কন্ঠে রিসিভ করলো সে।

— “জি আংকেল?”

— “ঘুমাচ্ছো তুমি? বিরক্ত করলাম তোমাকে?”

— “সমস্যা নেই। বলুন।”

— “একটু যে বাসায় আসতে হয়, বাবা।”

— “কেন?”

— “আজগর সাহেব এসেছেন। মতিউর আর হাবিব সাহেবও আসছে, সঙ্গে দু’চারজন চ্যালাও আছে।”

— “এইসব ঝামেলায় আমাকে কেন সশরীরে টানছেন আংকেল? এইটুকু কি আপনি সামলাতে পারছেন না?”

— “পারবো অবশ্যই। কিন্তু তুমি এলে ভালো হতো না?”

চটে গেল রুদ্র। ঘুমটাও কেটে গেল চোখ থেকে। শান্ত গম্ভীর স্বরে বললো,

— “ছোটখাটো ব্যাপারগুলোও কি এখন আমাকে সামলাতে হবে? বুঝলাম না বিষয়টা!”

— “ঝামেলা বহুদূর গড়াবে মনে হচ্ছে। ওরা তিনজন কোনো কাঁচা রাজনীতিবিদ না। বহুবছর দলের হয়ে কাজ করেছে, দলের গোপন অনেক কিছু ওদের জানা। তোমাকে নিয়েও কীসব থ্রেট করছে।”

— “তাতে কী?”

— “তুমিও রেগে যাচ্ছো!”

— “ঐ তিনটাকে আরো আগেই সাইজ করে দেয়া উচিত ছিল। তা না! দলে ঝুলিয়ে রেখেছেন এতবছর। আচ্ছা, আসছি আমি।”

— “নাস্তাটা আমার এখানেই করো।”

— “আচ্ছা!”

গতরাতে শুভ বাসায় ফিরেছে বেশ রাত করে। এখনও ঘুমুচ্ছে হয়তো! কল দিয়ে ওকে জাগাতে ইচ্ছে করছে না রুদ্রের। কিন্তু ওকে সঙ্গে নেয়াটাও জরুরি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও শুভকে কল করলো রুদ্র।

— “ঘুমাও?”

— “না ভাই, রেডি হচ্ছি। আপনার ওখানেই আসছি।”

— “ইকবাল সাহেবের ওখানে যেতে হবে।”

— “হঠাৎ! কোনো সমস্যা?”

— “হ্যাঁ সমস্যাই। আমি তৈরী হচ্ছি। তুমি এসো।”

— “আর কাউকে সঙ্গে নিতে হবে?”

— “নাহ্। আমি, তুমি আর গার্ড দু’জন। ব্যস! “ . “ওকে ভাই।”

*****

থ্রি কোয়ার্টার ট্রাউজার আর হাফহাতা টি-শার্ট পরে ইকবাল মাহমুদের বাড়ি যখন এসে রুদ্র পৌঁছালো, তাকে দূর থেকে দেখে হতাশ ভঙ্গিতে মাথা দুলালেন তিনি এই ছেলেটা আর ঠিক হলো না! এইসব গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে কেন যে খাটো প্যান্ট পরে আসে কে জানে! একবার কথার ছলে হাসতে হাসতে বলেছিল ওকে সে কথা। পাত্তাই দিলো না!

আদব কায়দা দেখাবার খুব একটা বালাই নেই রুদ্রের। কাজের কথা ছাড়া খুব একটা কথাও বলে না সে। মেপে কথা বলার অভ্যেস তার। আর এইসব পরিবর্তন হয়েছে আশরাফ মির্জা গত হবার পর থেকে। এর আগে দেখা হলে হাসিমুখে সালাম দিতো, মিষ্টি হেসে কুশলাদি জিজ্ঞেস করতো। এখন সেসবের ধারে কাছেও রুদ্রকে দেখা যায় না। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। দরজায় ইকবাল মাহমুদকে দেখা সত্ত্বেও, কথা না বলে সোজা ভেতরে চলে গেল সে। এখানে ইকবাল সাহেবের ব্যক্তিগত ঘরেই এইসব রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা হয়। রুদ্র, শুভকে নিয়ে ভেতরে যেতেই দরজা আটকে দিলেন ইকবাল সাহেব। বাইরে দরজার দু’পাশে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তার দেহরক্ষী দু’জন।

সোফায় ধুপ করে গা এলিয়ে বসলো রুদ্র।

সিগারেট ধরিয়ে দলের তিনজন প্রাক্তন মন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললো,

— “কী সমস্যা?”

রুদ্রের এসব বেয়াদবি দলের বহু মানুষের অপছন্দ। বিশেষ করে জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের সদস্যদের। এই যে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চোখ ছোট করে জবাবের আশায় তাদের দিকে চেয়ে আছে এটা একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নেতার অপমান নয়? মেজাজ হারিয়ে কথার বলার রুচিই হারালেন মতিউর সাহেব। দলের প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী তেড়ে উঠলেন প্ৰায়।

— “তুমি নিজেরে কী ভাবো?”

— “আপনাদের নিয়ে ভেবেই কূল পাই না। নিজেকে নিয়ে আর কখন ভাববো?”

— “ইকবাল ভাই, কথার ধরণটা দেখেন একটু! আপনার প্রশ্রয়ে এত বাড় বাড়ছে এই ছেলের।”

— “তুমিও তো কম যাও না হাবিব! আমি সামনে বসে আছি, আমার সামনে তোমরা দু’জন এভাবে বাড়াবাড়ি করবে?”

— “ওর উত্তরটা শুনলেন না?”

— “শুরুটা তুমি বাজেভাবে করেছো।”

— “আর কত ইকবাল ভাই? দুইদিনের ছেলে ছোকড়াকে চাটবেন এখন?”

প্রচন্ড রেগে গেলেন ইকবাল মাহমুদ। টেবিলে সজোরে লাথি মেরে বললেন, – “কারে কী বলো তুমি? এত সাহস তোমার!”

হাবিব কিছু বলার আগেই প্রায় মারমুখো হয়ে জবাব দিলো মতিউর।

— “সাহস না থাকলে দল টাইনা এই পর্যন্ত আনতে পারতাম না। রাজপথে দুপুরের কড়া রোদে শুইয়া আন্দোলন করছি, রিমান্ডে পুলিশের মাইর খাইছি। প্রয়োজনে খুন খারাবা, বিরোধী দলের লোকজনকে ফাঁসানো কী না করছি দলের জন্য। আর এখন সেই দল কিনা মন্ত্রীপদ দিতে অস্বীকার কইরলো!”

তখনও শান্ত হয়ে বসে রইলো রুদ্র। হাতের সিগারেটটা এখনো ফুরোয়নি তার। চুপ করে তাদের চেঁচামেচি শুনছে সে। শুভ দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রের মাথার কাছে। রুদ্র মুখ খোলার আগ পর্যন্ত এখানে কাউকে কিছু সে করবেও না, বলবেও না। সে অপেক্ষা করছে রুদ্রের সিগারেটটা শেষ হবার। আজ এই তিনজন একটা ঝামেলা করবে বলে মনস্থির করেই এসেছে। নয়তো সঙ্গে তাদের সবচেয়ে পুরোনো বিশ্বস্ত, তাদের জন্য জীবন দিয়ে দেবে সেইসব চ্যালাপ্যালা আনতো না। কোথাকার জল রুদ্র আজ কতটুকু গড়াতে দেয় দেখা যাক!

গম্ভীর স্বরে দলের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্য আজগর সাহেব বললেন,

— “মন্ত্রীত্ব পাবার দাবিদার আমরা। অথচ সেই দায়িত্ব কিনা দেয়া হলো নতুন যোগ হওয়া কচি ছেলেপেেেলদর? রাজনীতির কী বোঝে ওরা? কী করেছে দলের জন্য?

এত বছর যাদের কাঁধে কাঁধ রেখে চললেন, দল বড় করলেন, আজ তাদের চেনেন না আপনি? সেদিনের আসা এই ছেলের কথায় মন্ত্রী পদের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।” এ্যাশ ট্রেতে সিগারেটের শেষাংশ ফেললো রুদ্র।

মাঝারি দৈর্ঘ্যের চুলগুলো হাত দিয়ে উল্টে দিতে দিতে বললো,

— “বয়োজ্যেষ্ঠরা রাজপথ ছেড়েছে আজ কতবছর হলো হিসেব আছে?”

— “সিনিয়র মেম্বাররা কি রাজপথে নামবে?”

— “যদি দল করার সুবাদে সুযোগ ভোগ করতে পারেন তাহলে দলের প্রয়োজনে রাজপথে কেন নেমে আসবেন না?”

মতিউরের মেজাজ আজ নিয়ন্ত্রণে আসছেই না। ইকবালের পর এখন সে তেড়ে গেল রুদ্রের দিকে।

— “রাজনীতির নিয়ম বুঝো না, দলের সিনিয়র-জুনিয়র এক্টিভিটি বুঝো না। বালের রাজনীতিবিদ হইছো তুমি! তোমার বাপের নামে খালি তোমারে তোষামদ করা হয়। নয়তো তোমার মতো ছেলেরে গোনায় কে ধরে?”

— “এই যে আপনি, আপনারা। গোনায় ধরেন, প্রয়োজনে পায়েও ধরবেন। ইলেকশনের আগে তো আমার বাড়ির মাটি ছাড়েননি। সপ্তাহে দু’দিন তিনদিন করে আমার বাড়িতে আপনার আনাগোনা ছিলই।”

— “হ ছিল। কিন্তু তুমি তো সেটার সম্মান দাও নাই। আমি যে দলের একজন সিনিয়র সদস্য, প্রাক্তন মন্ত্রী তুমি কি সেটার লেহাজ রাখছো?”

— “দলকে যতটা দিয়েছেন তার চেয়ে তিনগুন চুষেও খেয়েছেন। আপনাদের কত কত ক্রাইম ঢেকে রাখা হয়েছে তা আপনাদের ধারণা আছে? ক্ষমতায় আছেন, দুর্নীতি করবেন ভালো কথা; কিন্তু একটা সীমা তো থাকা উচিত! দল করেছেন আপনারা নিজের স্বার্থে, দলের স্বার্থে না। আজগর সাহেব আপনি, দলের সবচেয়ে সিনিয়র পার্সন আপনি, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির ইতিহাসও আপনারই। যেখানে সুযোগ পেয়েছেন সেখান থেকেই কব্জি ডুবিয়ে টাকা সরিয়েছেন। রেল খাত ধ্বংস আপনার কারণে। চাইলে যখন তখন আপনার বিরুদ্ধে স্টেপ নেয়াই যেত। কত সাংবাদিক আপনার বিরুদ্ধে লেগেছে, সেসব সরকার থেকে সামলে নেয়া হয়েছে। তবুও আপনার মন ভরে না। এই বুড়ো বয়সেও পদ চাই আপনার, আরো চুরি করার সুযোগ চাই। মরার আগ পর্যন্ত যদি গদি ধরে বসে থাকেন, তাহলে বিগত ১০-১৫ বছর ধরে যারা দলে খাটছে তাদের কী হবে?”

আবারও উদ্যত হলো মতিউর। বললো,

— “কী হবে মানে? এইসব যুক্তি! কুকুর বিড়ালের মতোন আচরণ করা হইছে আমাদের সঙ্গে।”

বিরক্ত হলেন ইকবাল। বললেন,

— “মেয়েলোকের মতো বাড়িয়ে চড়িয়ে কেন বলছো মতিউর? কে তোমাদের সঙ্গে কুকুর বিড়ালের মতো আচরণ করেছে?”

— “মুখের উপর বলা হয় নাই মন্ত্রীপদে এইবার নতুন সদস্য দেয়া হবে?”

— “যথেষ্ট সম্মান রেখেই তোমাদের জানানো হয়েছে।”

ইকবাল মাহমুদ কথা শেষ করার আগে ফোঁড়ন কাটলো রুদ্র,

— “অথচ যে সম্মানটা আপনারা আসলে ডিজার্ভ করেনই না!”

সমস্বরে হুংকার ছাড়লো আজগর আর হাবিব সাহেব।

— “ডিজার্ভ করি না মানে?”

— “আপনাদের দুর্নীতির চিপায় পড়ে দলের কেমন বদনাম হয়েছে ধারণা আছে আপনাদের?”

— “দলের আর কেউ দুর্নীতি করে না? আর তুমি? তুমি কি একেবারে খুব সাধু? ক্রাইম করো না তুমি?”

— “করি তো আপনাদের বাঁচাতে গিয়ে। দল বাঁচাতে গিয়ে। আপনারা একটা করে অঘটন ঘটান, পুরো দলকে সেটা ভুগতে হয়। দলের প্রত্যেকেই দুর্নীতি করে। কেউ সাধু না। কিন্তু আপনাদের মতো বাড়াবাড়ি কেউ করে না। মতিউর সাহেবের কথাই বলি, যেখানে মেয়ে মানুষ সেখানেই তিনি। নারী কেলেংকারীতে উনার পুরো দেশ জুড়ে তুলনা নেই। কত মেয়েকে ট্র্যাপে ফেলে নিজের বেডরুম পর্যন্ত টেনেছে, হিসেব আছে? দেশের মানুষ সেসব জানে না ভেবেছেন? সবাই সব জানে। বলুন ক্ষমতার জোর দেখিয়ে সব ধামাচাপায় রাখা হচ্ছে। হাবিব সাহেবও একই পথের পথিক। মেয়ে দেখলে কারো হুঁশ থাকে না। দল এবার কিভাবে জিতেছে, কোন জেলায় কয় হাজার লোক খেটেছে সে খবর আছে আপনাদের? গত পাঁচবছর ধরে প্ল্যান করেছি পরবর্তী ক্ষমতা আমরা নেবো। স্টেপ বাই স্টেপ এগিয়েছি। কখন কাকে পথ থেকে কৌশলে সরাতে হবে. সেই ডিসিশন নিয়েছি। গত ছয়মাসে যতরকম ঝামেলা হয়েছে আপনাদের তাতে কোনো সক্রিয় ভূমিকা ছিল? আপনাদের একটা ছেলেও মাঠে নেমেছে? ইলেকশন ফান্ডিং কোথা থেকে কিভাবে হচ্ছে, তার কোনো খবর আছে? দলের কমবেশি সবাই সব খবর জানে। জানেন না শুধু আপনারা তিনজন। আমার মনে হয়েছে আপনারা দলের জন্য মিসফিট। দলের প্রধানকে আমি জানিয়েছি। উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি, সবাই তাতে সম্মতি দিয়েছেন। এতবছর দলের সঙ্গে আপনারা ছিলেন, আমরা তাতে কৃতজ্ঞ। ব্যস! এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করবেন না।

— “উপদেষ্টা, দলের প্রধানের সঙ্গে আলোচনার কী কাজ? তুমিই দলের সব। তোমার কথাই শেষ কথা। তোমার ইশারাতেই, তোমার পছন্দমতো নতুন ছেলেপেলে পদে বসছে।”

— “তো আপনারা এখন কী চাচ্ছেন? ওদের সরিয়ে আপনাদের বসাই?”

— “মান সম্মান ধরে টান দিছো বাবা! শপথের অনুষ্ঠানে আমরা শপথ নেই নাই এরচেয়ে অপমান আর কী আছে? আমাদের সমর্থকরা পিঠ পিছে কানাঘুষা করে। ব্যাপারটা তো সুখের না, তা তুমিও বুঝো!”

— “এসেছেন তো সুখ আদায় করতেই। বলুন, সুখের জন্য কী করতে পারি?”

— “ক্ষমতা চাই।”

— “নয়তো?”

— “দল ডুবাইতে দ্বিতীয়বার ভাববো না।

রুদ্র তখনও শান্ত চোখে চেয়ে রইলো মতিউরের দিকে। ইকবাল মাহমুদ আর শুভ চেয়ে রইলো রুদ্রের উত্তরের আশায়। রুদ্রের শীতল চাহনী ভালো ঠেকছে না। আজগর সাহেবের। পরিস্থিতি খারাপ হবার আগেই বিকল্প প্রস্তাব পেশ করলেন তিনি।

— “অপমান যা করার করেছেন আপনারা। সম্মান ফেরত চাইছি, দিতে চাইছেন না। আমরা ঝামেলা চাইলে করতেই পারি কিন্তু ঝামেলা করে তো লাভ আসলে কারোই হবে না। তার চেয়ে আপোষ করে নেই।”

আজগর সাহেবের আপোষের প্রস্তাবটাও যে বাঁকাই হবে, তা জানা আছে ইকবাল সাহেবের। তবুও জানতে চাইলেন তিনি,

— “কী চান?”

— “তিনজনের একাউন্টে সম্মানী।”

— “কত?”

— “বাৎসরিক ৭২ কোটি। ২৪ কোটি করে প্রতিজনের একাউন্টে ট্রান্সফার করতে হবে। খুব একটা কিন্তু চাইনি। দলের সুবিধার্থে এইটুকু তোমরা করতেই পারো। দলের পুরানো লোক আমরা। আমাদের একেবারে বাদ দিয়াও কিছু করতে পারবা না। সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি। বজায় রাখতে হলে এই সম্মানটুকু করাই লাগবে।”

বিরস বদনে আজগর সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন ইকবাল মাহমুদ।

ফাজলামির সমস্ত সীমা এই লোক পার করে ফেলেছে। শুভর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো রুদ্র। রুদ্রের হাসিতে যা বুঝার বুঝে নিয়েছে সে। এখানে আর কথা বাড়ানোর কিছু নেই। রুদ্রের তরফ থেকে সব কথা শেষ। এখান থেকে সরে গিয়ে দরজা খুলে দাঁড়ালো সে। সোফা ছাড়লো রুদ্র।

ইকবাল মাহমুদকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— “হলোই সমাধান। যা চায়, দিয়ে দিন।”

অবাক হলেন ইকবাল মাহমুদ।

— “মানে কী! তুমি এতে সম্মতি দিচ্ছো?”

— “দিলাম।”

আর কিছু বললো না রুদ্র। বলার সুযোগও দিলো না। বেরিয়ে এল ইকবাল

মাহমুদের বাড়ি ছেড়ে। গাড়িতে উঠে বসতেই শুভকে রুদ্র গুনগুনিয়ে সুর তুলে বললো,

— “মতি! মতি!”

— “আমিও ওকেই টার্গেট করেছিলাম। সবচেয়ে লাফাচ্ছিল ওটাই।”

— “বোকাগুলো এখনও নিজের পায়ের তলার মাটি আন্দাজ করতে পারেনি।”

— “প্ল্যান কী?”

— “সবচেয়ে বেশি যাতায়াত আজকাল যেটার কাছে চলছে, ওটাকে সরিয়ে দাও।”

— “একেবারে?”

— “হ্যাঁ।”

— “মার্ডার কেইসে?”

— “এটা দিয়ে শুরু করে, বাকিগুলো টানা হবে। একটাকে ধরলে বাকি দুটো

— “এমনিতেই মানুষ হয়ে যাবে। নাহলে ঐ দু’টোর জন্যও আলাদা প্ল্যান আছে।”

টিভির স্ক্রিনে হতাশ ভঙ্গিতে চেয়ে আছে রুদ্র। ইকবাল মাহমুদের বাসা থেকে ফিরেছে এক ঘন্টা হলো মাত্র। এরই মধ্যে কল এল তার নাম্বারে, জলদি টিভি অন করো। দেশের প্রতিটা চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজে আদনানের বিরুদ্ধে নারীঘটিত সংবাদ চলছে। ফেসবুক লাইভে এসে আদনানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে সোমা। এত কম সময়ে আজগর এভাবে জাল বিছিয়ে ফেলবে ভাবতেও পারেনি সে! বেছে বেছে সর্বকনিষ্ঠ, সবচেয়ে যোগ্য ছেলেটাকেই টার্গেট করেছে আজগর। ছেলেটার একটাই অপরাধ, রেলমন্ত্রীর জায়গায় আজগরের বদলে এই ছেলেকে রুদ্র দায়িত্ব দিয়েছে। প্রচন্ড রাগে হাসলো রুদ্র।

শুভকে বললো,

— “আজগরকে আন্ডারস্টিমেট করা উচিত হয়নি। পুরোনো খেলোয়ার; বিপক্ষের চোখ দেখে পরবর্তী চাল কী হবে সেটা বুঝে ফেলবে এটাই স্বাভাবিক।”

— “আজগরই? আপনি সিওর?”

— “ও ছাড়া আর কারো মাথা থেকে এত কূটবুদ্ধি বেরোবে না। আমার নেক্সট প্ল্যান কী সেটাও আন্দাজ করতে পারবে না। ও পুরো ছক কষেই আমাদের থ্রেট করেছে।”

— “মতি যেভাবে লাফাচ্ছিল তবুও আপনি কিছু বললেন না। টাকা ডিমান্ড করলো। সেটা শুনেও চুপচাপ সায় দিয়ে চলে এলেন। এটাতেই ও সন্দেহ করেছে।”

— “হ্যাঁ। আমি মুভ করার আগে ও খেলে দিলো। শালা মাদারচোদ।”

— “আদনানের সঙ্গে কথা বলা দরকার না?”

— “কথা বলবো অবশ্যই। দলে নতুন। দায়িত্বও অনেক। চেয়ারে বসতে না বসতেই এসব ফেইস করতে হচ্ছে। ঘাবড়ে যাচ্ছে হয়তো! ওকে ওর পজিশনে রাখতেই হবে। এই ঘটনার সুরাহা করতে হবে সপ্তাহখানেকের মধ্যে। রেল ডিপার্টমেন্ট পুরো ধ্বংস করে দিয়েছিল আজগর। বিরোধী দলের যেটা দায়িত্বে ছিল সেটাও আরেক চোর। উন্নতির নাম করে কম টাকা সরায়নি। উন্নয়নের নামে ঘন্টা করেছে। প্রতিবছর চাকরির বাহানায় কত টাকা যে ঘুষ নিয়েছে, সে হিসেব আর না করি! এদিকে ইলেকশন আসলেই এরা হয়ে যায় ফকির। ফান্ড ম্যানেজ করতে হয় আমাদের। এবার আমি টার্গেট নিয়েই রেখেছি রেল, শিক্ষা, আর খাদ্য বিভাগের পুরোটা গুছিয়ে ফেলবো। দুর্নীতি ঠেকানো সম্ভব না। হবেই। তবে সেটা যেন বিলো দ্যান মিনিমাম হয়। এই ছেলেটা বেশ স্বচ্ছ। ওকে এই দায়িত্ব থেকে সরানো যাবে না।”

— “সেটা নাহয় সামলে নিলাম। কিন্তু আজগর সত্যিই পাগল হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারছেন তো?”

— “হুম।”

— “আরো ঝামেলা করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।”

— “সেটা আমিও ভাবছি। কার কোন সিক্রেট হাতে ধরে বসে আছে কে জানে! বুড়ো হয়েছে তো। জানের ভয় টয় পাচ্ছে না আরকি! ভাবছে মরেই যাবো হুট করে। তারচেয়ে সবাইকে একটু নাকানি চুবানি খাইয়ে মরি।”

— “নেক্সট মুভ কী?”

— “জানি না। ব্রেইন কাজ করছে না। ইলেকশনের আগের তিনমাস কোনো শান্তি পেয়েছি আমি? বসেই ছিলাম ইলেকশন শেষ হলে কিছুদিন সবকিছু থেকে ব্রেক নেবো সেই আশায়।”

চুপ হয়ে গেল শুভ। ঠিকই তো বলছে। দিনভর যে যত কিছুই করুক, দিনশেষে একটুখানি শান্তি সবাই চায়। কিন্তু এই মানুষটার শান্তি কোথায়? কে আছে তাকে শান্তি দেবার? কাছে টেনে সব ক্লান্তি দূর করে দেবার? কেউ নেই তো! দিনভর যত চিন্তা এই ছোট্ট মাথায় নেয়, রাতের বেলা সেসব নিয়েই বিছানায় যায়।

কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর রুদ্র বললো,

— “মতির প্ল্যান আপাতত বন্ধ। কিন্তু সিনথিয়ার উপর যেন ২৪ ঘন্টা নজরদারি চলে। আর ঐ তিনটার উপরও নজরদারি চলবে।”

— “আচ্ছা।”

— “নাস্তা কোথায় আমার?”

— “দিতে বলবো?”

রুদ্র জবাব দেবার আগেই কল এল তার ফোনে। ইকবাল মাহমুদ কল করছে। আদনানের কথা বলতেই হয়তো! এই বিষয়ে আপাতত কথা বলতে ইচ্ছে হলো না রুদ্রের। শুভর হাতে ফোন দিয়ে বললো,

— “এটা সামলাও। আর আমার নাস্তা এখানে পাঠাতে বলো।

কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গেল শুভ। চোখ বুজে মাত্রই খাটে হেলান দিয়েছিলো রুদ্র। তখনই দরজায় নক করে বডিগার্ড সুমন বললো, – “স্যার, আদনান স্যার এসেছেন।”

— “পাঠাও। আর মেইডকে বলো এই ঘরে গেস্ট আছে। কিছু একটা তৈরী করে যেন পাঠায়।”

— “জি।”

উঠে বসলো রুদ্র। আড়মোড়া ভেঙে নিজেকে একটুখানি ফুরফুরে করতে চাইলো সে। হলো না। বিরক্তিতে সব ছেড়েছুড়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে। আধমরা চেহারা নিয়ে ঘরে এল আদনান।

— “আরেহ মন্ত্রী সাহেব! খবর কী তোমার?”

ওকে দেখেই প্রাণখোলা হাসির মিথ্যে নাটক করলো রুদ্র। এমনভাবে কুশলাদি জিজ্ঞেস করছে যেন আজ কিছুই ঘটেনি।

অবাক হলো আদনান। বললো,

— “খবর জানেন না ভাইয়া?”

— “সব জানি।”

— “আপনি বুঝতে পারছেন ব্যাপারটা?”

— “কেন বুঝবো না? তোমাকে সুপরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হচ্ছে।”

— “সোমা এটা করলো কেমন করে? একবারও ভাবলো না আমার ক্যারিয়ারের কী হবে?”

— “বসো এখানে।”

দাঁড়িয়েই রইলো আদনান। তার হাত টেনে খাটে বসালো রুদ্র। প্যাকেট থেকে দু’টো সিগারেট বের করে একটা আদনানের হাতে ধরিয়ে দিলো

খানিকটা সংকোচ হলো আদনানের। বললো,

— “আপনার সামনে?”

— “ভাই ব্রাদার আমরা। স্ট্রেস কিংবা ডিপ্রেশনে একসঙ্গে বসে নিকোটিন নেবো এটাই ভাই-ব্রাদারের নিয়ম।”

দীর্ঘশ্বাস ফেললো আদনান। লাইটারে সিগারেট জ্বালিয়ে মাথা নিচু করে রইলো ও। রুদ্র দেখছে ওকে। মনে মনে ভেঙে পড়েছে ভীষণ। হয়তো অঘটনটা ভালোবাসার মানুষকে দিয়ে করানো হয়েছে তাই ধাক্কা সামলাতে পারছে না। কিন্তু ওকে এভাবে ছাড়া যাবে না। সামলাতে হবে, বুঝাতে হবে, স্ট্রেস ফ্রি করতে হবে। আজগরকে প্ল্যান সাকসেসফুল করার একটুখানি সুযোগও দেয়া চলবে না। মুখের হাসি জারি রইলো রুদ্রের। বললো,

— “তুমি ভেঙে পড়ছো কেন বলো তো? রাজনীতিতে এসব চলে। এত কম বয়স থেকে রাজনীতি করছো, জানো না কিছু?”

— “জানি। কিন্তু নারীঘটিত ব্যাপারে দায়ী হবো, আমাকে নিয়ে নিউজ হবে… ভাবতে পারিনি কখনো! তাও কে অভিযোগ করলো? সোমা, যাকে আমি এত ভালোবেসেছি। ও ছাড়া কখনো কাউকে চোখ তুলে দেখিনি। সেই মেয়েটাই কিনা এখন আমার বিপক্ষে অভিযোগ করলো আমি তাকে ঠকিয়েছি?”

— “বিয়ে করেছো দু’জনে কতবছর হলো?”

— “তিনবছর।”

— “সোমা এখন কী করে?”

— “চাকরি করছে একটা মাল্টিমিডিয়া কোম্পানিতে।”

— “বয়স কেমন?”

— “২৫।”

— “মেয়েটা তো বোনের বাসায় থাকে, তাই না?”

— “হ্যাঁ।”

— “দেখো আদনান, তুমি সোমার অন্যায়টা দেখছো কিন্তু নিজের দায়িত্বে অবহেলা দেখছো না।”

— “কেমন?”

— “তুমি গোপনে একজনকে বিয়ে করেছো। সেই গোপন বিয়ের খবর, বউ, বউয়ের ইতিবৃত্তান্ত জানা তারপর সেই বউকে তোমার বিরুদ্ধে উস্কে দেয়া এসব একদিনে হয়নি, ধীরে ধীরে হয়েছে। তোমার বউ পর্যন্ত ওরা পৌঁছে গেল অথচ তুমি জানোই না, এটা কেমন কথা? তুমি এই মুহূর্তে কার জায়গা দখল করে আছো জানো? আজগরের। ও কেমন খারাপ সেটাও তোমার জানা। যখন তখন তোমার বা

তোমার পরিবারের ক্ষতি সে করতে পারে তা তুমি জানতে। তাহলে কেন তুমি

কী সোমার সিকিউরিটির কথা ভাবলে না? ও কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, কথা বলছে, এসব খেয়াল রাখলে না। সোমাকে তোমার বিরুদ্ধে না উস্কে এমনও তো হতে পারতো ওরা সোমাকে ধরে নিয়ে কোনো ক্ষতি করে দিলো! পারতো কি না বলো?”

— “পারতো।”

— “তাহলে তুমি আমাকে বুঝাও, তোমার নাকের নিচে তোমারই বউকে কাজে লাগিয়ে তোমার বিরুদ্ধে ওরা খেলতে পারছে কিভাবে?”

— “তাই বলে সোমা ওদের কথা শুনে নেবে? আমাকে জানাবে না?”

— “তুমি এখনও সোমাকে ব্লেইম করছো? আমি তোমাকে বেশ ইন্টেলিজেন্ট ভাবতাম!”

ঘরে এল শুভ। তার পেছন পেছন নাস্তা নিয়ে এল গৃহকর্মী। দু’জনের সামনে নাস্তা সাজিয়ে চলে গেল সে।

আদনানকে তাড়া দিয়ে রুদ্র বললো,

— “খাও। খেতে খেতে কথা বলো।”

অনিচ্ছা সত্ত্বেও একটু করে পুডিং মুখে নিলো আদনান। শুভর হাতে কফির মগটা ধরিয়ে দিয়ে রুদ্র বললো,

— “তোমার নাস্তা দিতে বলোনি কেন?”

— “খেয়ে এসেছি।”

— “শুধু কফিই খাবে?”

— “হ্যাঁ। সকালে এটাই খাওয়া হয়নি।”

— “তো আদনান, যা বলছিলাম… সোমার এখানে আমি দোষ তেমন দেখতে পাচ্ছি না। ওকে ব্রেইনওয়াশ করা হয়েছে। মেয়েদের ব্রেইনওয়াশ করা তুলনামূলক সহজ। বিশেষ করে হাজবেন্ডের ব্যাপারে। অবশ্য সুযোগ তুমিই দিয়েছো!”

— “আমি?”

— “বিয়ে করেছো তিনবছর হয়েছে। মেয়ের পড়াশোনা শেষ। তুমি তো ভালোই বিজনেস করছিলে। বউ পালার মতো সামর্থ্য সেই ছাত্রজীবন থেকেই তোমার ছিল। তাহলে কেন তুমি ওকে এখনো ঘরে তোলোনি? এটলিস্ট সবাইকে জানিয়ে এঙ্গেজমেন্ট সেরে রাখা যেত।”

— “আমি চেয়েছিলাম পলিটিক্সে আমার ভালো একটা পজিশন হোক, তারপর সবাইকে জানিয়ে বিয়ের আয়োজন করবো।”

— “কেন? বিয়ের পর কি রাজনীতি করা যায় না? তিনবছর সময়টা কিন্তু কম না! তুমি এতদিন ধরে একটা মেয়েকে গোপনে বউ বানিয়ে রেখেছো, অথচ বউ ঘরে

তোলার মতো পরিস্থিতি তোমার অনুকূলেই ছিল। সেক্ষেত্রে সোমা নিজেকে নিয়ে ইনসিকিউর ফিল করতেই পারে। এছাড়া তোমাদের মাঝে কমিউনিকেশন গ্যাপ আছে অবশ্যই, নয়তো এতবড় কান্ড ঘটে গেল তুমি কেন কিছুই আঁচ করতে পারলে না? আমার তো মনে হয় বেসিক কমিউনিকেশনও তোমাদের মাঝে ঠিকমত হয় না।”

— “হ্যাঁ! ঐ আরকি… ব্যস্ত থাকি।” আমতা আমতা করতে লাগলো আদনান। – “সেটাই আদনান! পুরো সমস্যাটা আসলে তোমার। মাঝ থেকে সুযোগ নিলো ওরা। একটা মেয়ের দায়িত্ব নিয়েছো, দায়িত্ব পূর্ণ করতে শেখো।”

— “তুমি যা কিছু করছো তাতে সোমার এভাবে রিএ্যাক্ট করা খুব স্বাভাবিক। তার উপর ভালো পজিশনে আছো এখন। তোমার ওয়াইফ এমনিতেই তোমাকে নিয়ে দিনরাত এখন সন্দেহে ভুগবে যদি তুমি ওর প্রপার কেয়ার না করো। একটা মানুষের যত্ন নেয়ার জন্য দিনরাত তাকে নিয়ে পড়ে থাকতে হয় না। তুমি খাওয়ার সময় ওকে ডেকে পাশে বসিয়ে খাওয়াচ্ছো কিংবা কল দিয়ে জিজ্ঞেস করছো সে খেয়েছে কি না এটাও যত্ন, আদনান। পুরো চাবি এখনও তোমার ওয়াইফের হাতে আছে। ওর কাছে যাও। ওকে কনভিন্স করো। প্লিজ মেজাজ দেখিয়ে না, যথাসম্ভব ঠান্ডা মাথায় ওকে বুঝাও। এই ঝামেলাটা আর বাড়তে দেয়া যাবে না কোনোভাবেই।”

— “ও লাইভে এসে আমাকে এভাবে ধুয়ে দিলো। কতখানি বিগড়ে আছে বুঝতে পারছেন?”

— “হাজবেন্ড আরেক মেয়ে নিয়ে প্রেমে মেতেছে সে কথা জানলে সব মেয়ে এভাবেই বিগড়ে যাবে। আস্ত রেল সেক্টর সামলানোর দায়িত্ব হাসতে হাসতে নিয়ে নিলে অথচ বউ সামলাতে পারবে না? বাহানা করো না। আমি আজকের মধ্যে সব ঠিক দেখতে চাই।”

— “ও শান্ত হলো। তারপর?”

— “তারপরের হিসেব আমি বুঝবো। তুমি আগে ওকে দেখো।”

দ্রুত মগের কফিটা শেষ করে বেরিয়ে গেল আদনান।

হাসতে হাসতে দুষ্টুমির ছলে শুভ বললো,

— “সব পুরুষ ঘরের বউয়ের কাছে এসে ধরা! সব সামলাতে পারবে, কিন্তু বউ না।”

— “দেখি কী হয়।”

— “কিন্তু এত অল্পতে ঘাবড়ে গেলে চলবে? সামনে আরো কত কী ফেইস করতে হবে!”

— “আদনান একটু বউ উদাসী ছেলে। কিন্তু বউকে ভালোবাসে ও। সত্যিই সোমার বাইরে কখনো কোনো মেয়ের সঙ্গে ওকে দেখা যায়নি। সেই ছেলেকে যখন পুরো দেশবাসীর সামনে তারই বউ পরকীয়ার মতো একটা ব্যাপারে জড়িয়ে দিচ্ছে, ভালোবাসা-বিয়ের মিথ্যে নাটকের অপবাদ দিচ্ছে ওর খারাপ লাগা স্বাভাবিক। বাইরের লোকের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জিতে আসা সহজ। প্রিয় মানুষ, পরিবারের সঙ্গে না। আমার বাবাকেই দেখো! সারাজীবন রাঘব বোয়ালদের মাঝে মাথা উঁচু করে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। কেউ বাবার একটা চুলও বাঁকা করতে পারেনি। অথচ সেই বাবা কিনা মারা গেল আপন ভাইয়ের গাদ্দারিতে। থাক সেসব কথা। এখন বলো তো, আমি তোমার ওখানে গিয়ে দুইদিন থাকতে চাচ্ছি। ভালো লাগছে না এখানে। দু’টো দিন সবকিছু থেকে ডিটাচড় থাকতেই হবে। নয়তো হচ্ছে না আসলে! থাকা যাবে?”

— “অবশ্যই যাবে!”

— “তাহলে অফিসের কাজ শেষ করে রাতে যাচ্ছি তোমার ওখানে।”

রুদ্র – ৫

অফিস থেকে সরাসরি শুভর বাসায় চলে এসেছে রুদ্র। সবাই জানে রুদ্র এখন ঢাকার বাইরে। বডি গার্ড দু’জন আর শুভ ছাড়া চতুর্থ ব্যক্তি কেউ জানে না রুদ্র এই শহরেই আছে। যখনই টানা কাজ করতে করতে মানসিক ক্লান্তি চেপে বসে কিংবা তীব্র বিষণ্নতায় মন ডুবে যায় তখনই রুদ্র চলে আসে শুভর ফ্ল্যাটে ২-৩ দিন থাকবে বলে। এই ২-৩ দিনে ফ্ল্যাটের বাইরে সে বেরোয় না। খুব জোর ছাদ কিংবা গলির মাথায় সিগারেটের দোকান পর্যন্ত যায়। নয়তো সারাদিন ঘরেই বসে কাটায়। মা ছাড়া তেমন কারো একটা কলও রিসিভ করে না। খুব জরুরি না হলে ফোন থেকে দূরেই থাকে রুদ্র। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।

রুদ্র আসবে বলে জলদিই বাসায় ফিরে এসেছিল শুভ। পুরো বাসা গুছিয়ে টিপটপ করে রেখেছে সে। বাসার কাছেই এক ভদ্রমহিলা হোমমেড খাবার বিক্রি করে, তাকে খবর দেয়া হয়েছে সেই দুপুরেই। আজ রাতের খাবারটা তার ওখান থেকে সময়মতো এই বাসায় পৌঁছে দিয়ে যাবে।

শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে বসলো রুদ্র। চারবছর আগে চার বেডের এই ফ্ল্যাটটা শুভকে সে কিনে দিয়েছিল। একা মানুষের জন্য এতবড় ফ্ল্যাটের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। বারবার আপত্তি করছিল শুভ। রুদ্র শোনেনি। বলেছিল, “তোমার মা বোন আসবে মাঝেমধ্যে এখানে বেড়াতে, বিয়ে শাদী হবে একদিন। বারবার তো আর কিনে দেবো না, যা দেয়ার একেবারে দিচ্ছি। শুধু ফ্ল্যাটই না, পুরো বাসা ফার্নিচার দিয়ে সাজিয়েও দিয়েছিল রুদ্রই। বাসাটা এখনও টিপটপ আছে। ব্যাচেলর থাকে এই বাসায় কে বলবে!

— “ভাই, খাবার চলে এসেছে। আমি টেবিলে সার্ভ করছি। আপনি আসুন।”

— “সুমন আর মেজবাহকে ডাকো। একসঙ্গে খেয়ে নেই।”

— “ওরা টেবিলেই আছে।”

— “আসছি আমি।”

পুরো টেবিল ভর্তি রুদ্রের প্রিয় সব খাবার। শুভ জানে, রুদ্র অত খাবে না, তবুও সে অর্ডার করেছে। রুদ্র এই বাসায় এলে যত্ন আর আপ্যায়নের কোনো ত্রুটি রাখে না সে। রুদ্র কিছু চাওয়ার আগে যেন সব হাজির থাকে, সেই বন্দোবস্ত করাই থাকে।

চেয়ার টেনে বসতে বসতে রুদ্র বললো,

— “আমি কি জামাই? এমন জামাই আপ্যায়ন কেন করো প্রতিবার?”

— “আমার ভালো লাগে।”

— “এত কে খাবে?”

— “যতটুকু খাওয়া হবে হোক, বাকিটা কিছুটা একটা করে নেবো।”

— “কাল দুপুরে খাবার আনার বা রান্না করার প্রয়োজন নেই, বক্সে করে রেখে দাও। কাল গরম করে খাওয়া যাবে।”

— “বাসি খাবেন?”

— “খাবার অপচয়ের কোনো মানে হয় না! বাসি খেলে আমি মরে যাবো না। এসবে আমার অভ্যাস ছিল, তা তুমিও জানো।”

কথা বলতে বলতে প্রথম লোকমা মুখে তুলতেই কল এল রুদ্রের নাম্বারে। আদনান কল করেছে। সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ করলো সে।

— “হ্যাঁ আদনান?”

— “ভাইয়া…”

তার কন্ঠ বিমর্ষ শোনাচ্ছিল। ইতিবাচক কিছু শোনার আশা তখন‍ই মিটে গেছে রুদ্রের। আদনানকে জিজ্ঞেস করলো,

— “খবর কী?”

— “খুবই খারাপ! আমি ওর কাছে গিয়ে বসতেই পারছি না। কথা বলতে গেলেই পাগলের মতো আচরণ করছে। বারবার বলছে আমি ওকে ঠকিয়েছি। ওকে মেন্টালি আনস্ট্যাবল মনে হচ্ছে। ভয় লাগছে আমার। সুইসাইড এটেম্পট নিয়ে নেবে না তো!”

— “থ্রেট করছে?”

— “হ্যাঁ। ও সত্যিই স্ট্যাবল না আপাতত। বাজেভাবে ব্রেনওয়াশ করেছে ওর। “উফ আদনান! কেন যে ফ্যামিলির দিকে খেয়াল রাখো না!”

— “ওকে এটাও বলেছে, আমি ওর কাছে আসবো। ক্ষমা চাওয়ার মিথ্যে নাটক করবো। যেন ঝামেলায় না পড়ি সেজন্য ওর সঙ্গে আপোষ করার মিথ্যে আশা দেখাবো। ওকে ঘরে তুলতে চাইবো। আসলে এসব আমার ছল চাতুরী। এই যে আমি এসেছি, ও ধরে নিয়েছে আমি ছল করছি।”

— “সুইসাইড করলে কিন্তু খুব ঝামেলা হয়ে যাবে!”

— “আমিও বুঝতে পারছি কিন্তু চোখে চোখে কতক্ষন রাখা যাবে? ওয়াশরুমে গিয়ে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেললে?”

— “দেখো না আরেকবার! তোমারই তো বউ! কিভাবে বললে কনভিন্স হবে বুঝো না?”

— “পাল্টে গেছে একদম। ওকে বুঝতে পারছি না আমি! মনে হচ্ছে যেন ও আমাকে আর চাইছে না। এত খারাপ ব্যবহার কখনো দেখিনি আগে।”

— “ডোন্ট বি হোপলেস! সিচুয়েশন আউট অফ কন্ট্রোল কোনোভাবেই করা যাবে না। সামলাও সবকিছু আদনান!”

আর কথা বাড়ালো না রুদ্র। বলার মতো আর কিছু ছিলও না। এতটা সময় পেটে খিদে থাকলেও হুট করে খিদেটা মরে গেল।

শুভ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করলো,

— “সুইসাইড পর্যন্ত গড়াবে?”

— “সেটাই ভাবছি।”

— “চোখে চোখে রাখতে হবে আরকি।

— “আদনান যা বললো মনে হয় মেয়ে আর সেন্সে নেই। কারো মাথায় একবার সুইসাইডাল থট চলে এলে সেটা আর সহজে দূর করা যায় না। এরা সুযোগ বুঝে একটা ঘটনা ঘটিয়েই ফেলে। দোয়া করি, এমন কিছু না হোক। আমার মনে হচ্ছে ওকে ব্রেনওয়াশ মূলত দেয়াই হয়েছে যেন ও সুইসাইড করে। আজগরের খুব সূক্ষ্ম বুদ্ধি। খুন খারাবায় গিয়ে নিজের হাত নোংরা করবে না। অন্যভাবে ফাঁসাবে।”

— “এই প্রথম আপনার কোনো প্ল্যান এভাবে আটকে দিতে দেখলাম!”

আর কিছু বললো না রুদ্র। মাথা এভাবে কাজ করা কেন ছেড়ে দিলো কে জানে! এই মুহূর্তে এক সেকেন্ড ব্রেন কাজ করা ছেড়ে দিলেই লস।

দ্রুত খাবার শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রুদ্র। সিগারেট ধরিয়ে চেয়ে রইলো গ্রিলের বাইরে। দম বন্ধ লাগছে ভীষণ। কোনোকিছুতেই শান্তি নেই, সুখ নেই। নিজের নিঃশ্বাস, নিজের কাছে বড্ড বোঝা লাগছে। অক্টোবরের মাঝামাঝি চলছে। এই সময়টাতে শীত না নামলেও, খুব একটা গরমও নেই। সুন্দর আবহাওয়া অথচ কী বিষণ্ণ! মন খারাপের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, বুকের ভেতর হাহাকার জাগায়। অতীত স্মৃতি মনে পড়ে। সরল সুখের দিনগুলো হারিয়ে গেছে, আর কোনোদিন ফিরবে না সে কথা বারবার মনে করিয়ে দেয়। যে জীবন সে কোনদিন চায়নি, সেই জীবনই আজ সে যাপন করছে। ক্ষমতা, অর্থ আর রক্তের খেলায় মেতে উঠেছে। অথচ এই জীবনটা তো পাখির মতো হবার কথা ছিল। সরল সুন্দর সুখের হবার কথা ছিল। হলো না। কিচ্ছু হলো না। প্রথমে বাবা হারিয়ে গেল, তারপর নিজেকে হারালো। বাবা কিংবা নিজের এই হারিয়ে যাওয়া সে মেনে নিতে পারে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে গিয়ে মাঝে মাঝে ভীষণ অস্বস্তি হয়। সে যে আর মানুষ নেই! নিজের সুন্দর সত্তা বিসর্জন দিয়ে অসুর হয়েছে। এই জীবন আর কত দূর লম্বা কেউ কি এসে বলবে তাকে?

হঠাৎ হঠাৎ তীব্র ঝড় যে উঠে বুকের মধ্যে- কেউ কি এসে সে ঝড় থামাবে? কেউ কি কখনো এসে তার অশান্ত মনটা শান্ত করবে? বেঁচে থাকার কঠিন দিনগুলোকে কি সহজ করবে? মনের সমস্ত কথাগুলো অকপটে বলে দেবার প্রশ্রয় কি দেবে? সব শুনে কি তাকে বুকে আগলে রাখবে, হোক সে ন্যায় কিংবা অন্যায়? সবকিছু সামলে নিয়ে দিনশেষে যখন সে ক্লান্ত হবে তখন কেউ কি তাকে সামলে নেবে? এইসব জঞ্জাল, সব মন্দ এক মুহূর্তের জন্য ভুলিয়ে দিয়ে তাকে আশ্রয় দেবে। আছে কি এমন কেউ? নেই! এমন কেউই নেই। কোথাও কেউ নেই! এ জীবন তাকে এভাবেই বয়ে বেড়াতে হবে মৃত্যু অব্দি।

দুপুরে ঘুমোনোর অভ্যেস নেই রুদ্রের। তবুও আজ কেমন করে যেন চোখ লেগে গেছে তিনটার দিকে। সেই ঘুম ভাঙলো সাড়ে চারটায়। মাথা ব্যথা করছে দুপুরে ঘুমিয়ে। শরীরটাও কেমন ভার লাগছে। হাত-মুখ ধুয়ে নিজের জন্য এক মগ আদা লেবু দিয়ে চা বানালো রুদ্র। এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে চায়ের কাপ নিয়ে এসে দাঁড়ালো বারান্দায়। বাইরে থেকে খিলখিল শব্দের হাসি আর হৈ হুল্লোড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। তিনতলার উপর থেকে নিচে উঁকি দিলো রুদ্র। অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক পেছনেই দোতলা বাড়িটার ছাদে তিন সাইজের তিনটা বাচ্চার সঙ্গে একটা বড় মেয়ে ছাদময় ছুটোছুটি করছে। বয়স কত হবে ওর? ২০-২২ হয়তো! এখনও শিশুমন ওকে ছেড়ে যায়নি। নয়তো আজকালকার এই বয়সী মেয়েরা বাচ্চাদের নিয়ে ছাদময় দৌড়ায় নাকি?

সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো রুদ্র। আশপাশটা দেখছে সে। শুভর বাসার সবচেয়ে সুন্দর ব্যাপারটা হচ্ছে এই গলিটা ঘনবসতি না। উঁচু দালানও তেমন নেই। পুরো গলিতে এই একটা এ্যাপার্টমেন্টই সবচেয়ে উঁচু। বেশিরভাগ বাড়িই দোতলা, কিংবা তিনতলা। প্রত্যেকের বাড়ির চারপাশে একটু করে খালি জায়গা আছে। প্রতিটা বাড়িতে অন্তত একটা করে গাছ আছে। পাখির আনাগোনাও তাই বেশি। বাইরে দেখতে ভালো লাগে। মনে হয় যেন প্রকৃতি এখনও এই শহরে মরে যায়নি। আশপাশের বাড়িগুলোর দেয়ালে, গাছের পাতায় নিজের শেষ আলোটুকু লেপ্টে দিয়ে আজকের মতো বিদায় নেবার প্রস্তুতি নিচ্ছে সূর্য। মহিলা, বাচ্চারা গলি ধরে হাঁটছে, খেলছে। সাদা মেঘ মাথায় করে পাখিরা দল বেঁধে কিংবা জোড়া বেঁধে ঘরে ফিরছে। চায়ের কাপে চুমুক, আর সিগারেটে টান দিতে দিতে চুপচাপ সেসব দেখছে রুদ্র। ফাঁকে ফাঁকে দেখছে দোতলার ছাদে ওদের ছুটোছুটি। ভালো লাগছে সবাইকে দেখতে। নিজের ছোটবেলা মনে পড়ে যাচ্ছে। আগে বাবার সঙ্গে বাড়ির সামনের রাস্তায় সাইকেল চালিয়ে বেড়াতো দু’জনে। কখনো প্রতিবেশী বাড়িগুলো থেকে বন্ধুরা আসতো বাসায়। ছাদে কিংবা লনে সবাই মিলে এভাবেই হৈ হুল্লোড় করে ছুটোছুটি করতো। খেলা শেষে সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে মা ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যেত।

বলতো, “হাত-পা ঘষে ঘষে সাফ করো। গেঞ্জিটা বদলাও।”

তারপর ডাইনিং টেবিলে বসিয়ে নাস্তা সামনে দিতো। সঙ্গে মা-ও বসে খেত। যেদিন বাবা বাসায় থাকতো, সেদিন বাবাও সঙ্গে নাস্তা করতো। অসাধারণ সব মুহূর্ত ছিল। জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া অমূল্য কিছু মুহূর্ত! চা আর সিগারেট শেষ করে উঠে এল রুদ্র। বাইরে তখনও হৈ হুল্লোড় চলছে। আর দেখতে ইচ্ছে করছে না। তার জানা মতে আজ ইন্ডিয়া-পাকিস্তানের ম্যাচ আছে। তা-ই দেখতে বসার ঘরে যাচ্ছে সে। পুরোনো স্মৃতি মনে পড়লেই এভাবে পালাতে থাকে রুদ্র। অন্য কিছুতে ব্যস্ত হবার বাহানা খোঁজে। সুন্দর সেইসব দিনগুলো হারিয়ে গেছে চিরতরে, আর কোনোদিন সুন্দর দিন জীবনে ফিরে আসবে না। সুখী রুদ্রকে আর কোনোদিন সে আয়নায় দেখতে পাবে না, সেই ভাবনা মাথার ভেতর ছুটতে থাকে। গলার কাছে কষ্ট দলা পাকিয়ে নিঃশ্বাস রোধ করে। যন্ত্রণা হয় তার খুব!

— “জরুরি সময়ে যদি এভাবে চলে যাও, তাহলে চলে? তুমিই বলো?”

— “আমার নিজের ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছু আছে।”

— “আহা! অবশ্যই আছে। তোমার রিফ্রেশমেন্টের ব্যাপার আছে একটা। বেড়াতে গেছ, ভালো কথা কিন্তু কল দিলে অন্তত রিসিভ করো।”

— “করলাম তো।”

দুইদিন পর ইকবাল মাহমুদের কল রিসিভ করলো রুদ্র। ওপাশ থেকে বিরোধী দল, আজগর, মতি ওদের নিয়েই বলে চলছেন তিনি। কথা শুনতে শুনতে আবারও বারান্দায় এসে দাঁড়ালো রুদ্র। মধ্যদুপুর। পেছনের দোতলা বাড়িটা পেরিয়েই চারতলা একটা নীল দেয়ালের বাড়ি। পুরো এলাকায় সাদা, অফহোয়াইট কিংবা পেস্ট কালার বাড়ির ভীড়ে এই একটা বাড়িই আছে একদম ভিন্ন। যে কারো চোখে পড়বেই আলাদাভাবে। প্রতিবার বারান্দায় এসে দাঁড়ালে সবার আগে এই নীল দেয়ালের বাড়িটাতেই না চাইতেও নজর যায় রুদ্রের। এখনও যাচ্ছে। বিশেষ করে ঐ বাড়ির তিনতলার বারান্দায়। ভেজা চুলে লাল জামা পরে একটা মেয়ে এসেছে। কনুইয়ের ভাঁজে তার ভেজা কাপড়। গোসল করে এসেছে মাত্রই। ভালো করে একবার তাকালো রুদ্র। গতকাল বিকেলের মেয়েটাই তো ও! এই বাসায় থাকে বুঝি! ওর দিকে আর মাথা ঘামালো না রুদ্র। চোখ ফিরিয়ে নিলো অন্য দিকে। ইকবাল মাহমুদের সঙ্গে কথা এখনো চলছে। শুনতে শুনতে অজান্তেই আবার চোখ গেল ঐ বারান্দায়। ভেজা কাপড় সব মেলে দেয়া শেষ ওর। সবশেষে ভেজা গোলাপী রঙের অন্তর্বাস রশির একপাশে পাশে মেলে দিলো ও। মাথায় পেঁচানো তোয়ালেটা খুলে ভালোভাবে চুলগুলো মুছে নিচ্ছে মেয়েটা। চোখ আবারও অজান্তেই ফিরিয়ে অন্যদিকে নিলো রুদ্র। তার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো মেয়েটাকে মুগ্ধ হয়ে কিংবা লোলুপ দৃষ্টিতে দেখতো। কিন্তু রুদ্রের সেদিকে খেয়ালই নেই। আকাশে পাখি উড়ে যাবার দৃশ্যের মতোই এই মেয়েটার অন্তর্বাস মেলে দেয়া, ভেজা চুল মুছে নেয়ার ঘটনাও খুব সাধারণ। এতটা সময় আশেপাশে চোখ ঘুরলেও মনোযোগ সব পড়ে ছিল ফোন কলে, ইকবাল মাহমুদের কথায়। হঠাৎ কেমন বিরক্তি ধরে এল রুদ্রের। বারান্দা থেকে সরে এসে সে বললো, – “আংকেল, সব বিষয়ই কি আমার সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি? এতবছর ধরে রাজনীতি করছেন, বুঝেন তো কোথায় কী করতে হবে!”

— “তোমার চেয়ে বিশ্বস্ত, বুদ্ধিমান আপাতত কাউকে চোখে পড়ে না আমার।”

— “আপনি দেখুন কী করবেন। কোনোকিছু প্রয়োজন হলে কল করবেন।

ইকবাল মাহমুদ বুঝে গেলেন রুদ্রের বিরক্তি। এই ছেলের এই এক সমস্যা! হঠাৎ হঠাৎ কী যে হয়! সব ছেড়ে ছুড়ে বসে থাকে তিনদিন, চারদিন কখনোবা এক সপ্তাহ! রাজনীতির খাতায় নাম লেখানোর পর এভাবে চাইলেই উধাও হওয়া যায় না সে কথা কে বোঝাবে ওকে?

*****

— “বুইড়া বাইনচোদ, খুব উড়ছোস, তাই না? এক টানে আকাশ থেইকা মাটিতে আছাড় মাইরা শেষ করমু তোরে।”

— “দুইদিনের বাচ্চা আমারে থ্রেট করে দেখো!”

বড্ড কুৎসিত কায়দায় ফোনের ওপাশে হাসছে আজগর।

— “তোর নবনিযুক্ত মন্ত্রীর বউ তো গলায় দড়ি দিলো রে রুদ্র। খোল খোল, টিভিটা জলদি কইরা খোল!”

দ্রুত রিমোট হাতে নিয়ে টিভি অন করলো রুদ্র। ব্রেকিং নিউজে সোমার আত্মহত্যার খবর। আরো বিকট শব্দ করে আজগর হাসছে। তার হাসির শব্দে প্রচন্ড রাগে গা রি রি করছে রুদ্রের। হেরে যাচ্ছে সে আজগরের কাছে। কোনো পথ খোলা নেই সামনে। এভাবে কিভাবে সম্ভব! এক পা কবরে পৌঁছে যাওয়া একটা বৃদ্ধ লোকের কাছে হেরে যাবে সে! এত দুর্বল নিজেকে কখনো মনে হয়নি। চোখের সামনে তার গা থেকে ধোঁয়া বেরুতে দেখছে সে। মনের সমস্ত জোর, মাথার ভেতরের সব বুদ্ধি ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে শূণ্যে। মুঠোবন্দি করে ধোঁয়া আটকাতে চাইছে কিন্তু পারছে না। ফ্লোরে পড়ে থাকা মোবাইল থেকে এখনও আজগরের বিকট শব্দের হাসি শোনা যাচ্ছে। অসহ্যরকম দিশেহারা হয়ে নিজের চুলগুলো টেনে ছিঁড়ছে রুদ্র।

ঠিক খানিকবাদেই ঘাড়ের উপর নরম হাতের শিহরন জাগানো স্পর্শ অনুভব করলো সে। ঘাড় ফেরাতেই দেখতে পেলো, সামনের বাড়ির ঐ মেয়েটা। পরনে কালো পায়জামা, গোলাপী ব্রা! গায়ে আর কিচ্ছু নেই। ভেজা চুলগুলো কাঁধ গড়িয়ে বুকের একপাশে ছড়িয়ে পড়েছে। ফোঁটা ফোঁটা পানি জমে আছে গলার উপর। সেগুলো ধীর গতিতে নেমে আসছে অন্তর্বাসে চাপানো আধখোলা স্তনের খাঁজে। ওর কাছ থেকে ভেসে আসছে বডিশপের ব্রিটিশ রোজ শাওয়ার জেলের সুবাস। কাম ভরা দৃষ্টিতে মেয়েটা চেয়ে আছে তার চোখে। ঐ চোখে তাকে একান্ত নিজের করে পাবার, এই শরীরের লোমে লোমে ছুঁয়ে দেখার তীব্র বাসনা দেখতে পাচ্ছে রুদ্র। আসন পেতে বসে ছিল সে। শিকারী বেড়ালের ন্যায় ধীর গতিতে হাঁটুতে ভর করে তার কোলে, দু’পাশে পা ছড়িয়ে বসলো মেয়েটা। একঝটকায় ভেজা চুলগুলো বুকের উপর থেকে পিঠে সরাতে গিয়ে, রুদ্রের চোখে-মুখে সজোরে ঝাপটা লাগলো। চোখ বুজে ফেললো রুদ্র। নিজেকে হারাতে বসেছে সে। আজগর, ইকবাল মাহমুদ, দল, ক্ষমতা, মা, বাবা, বাসার ঠিকানা, ফোন নাম্বার সব ভুলে গেছে সে। ভুলে গেছে তার নামটাও! কোলে চড়ে বসা এই মোহিনীর কাছে সব খুইয়ে বসেছে সে। কখন যেন শার্টের বোতাম খুলেছে মেয়েটা! টের পায়নি একদম। তার লোমশ বুকে হাত বুলিয়ে দিতেই টের পেলো সে কথা। মেয়েটা টেনে নিলো তার হাতও। রাখলো স্তনের খাঁজে, যেখানটায় পানি গড়িয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো। কেঁপে উঠলো রুদ্র। চোখ বুজে রইলো তখনও। ওর চোখের পাতায় আলতো হাতে ছুঁয়ে দিয়ে বললো,

— “চোখ মেলে দেখো আমাকে! আমাদের এই মুহূর্তকে।”

চোখ খোলার সাহস তবুও হলো না রুদ্রের। হৃৎস্পন্দন বেড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে নিঃশ্বাস গাঢ় হতে লাগলো তার। চোখ না মেলার দায়ে মেয়েটার বিরক্তির কারণ হলো সে। চোখ বুজেও সে কথা দিব্যি টের পাচ্ছে। ঠিক তার পরমুহূর্তেই বুকের লোমে খামচে ধরে, টেনে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো মেয়েটা। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে শুষে নিতে চাইলো পুরো তাকেই। চোখ মেললো রুদ্র অথচ কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না। মেয়েটার আগ্রাসী চুমুতে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে তার। এক চুমুতেই কি নিঃশ্বাসের অভাবে মরণ হবে তার? অস্থির হলো রুদ্র। শত চেষ্টায়ও নিজেকে ছাড়াতে পারছে না সে। বুকের লোম টেনে রেখেছে এখনো। বুকের ঠিক মধ্যখানো, চামড়ায় ব্যথা লাগছে বেশ। চুমুতে হাঁপিয়ে উঠছে সে। নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে।

কানের কাছে ফোন বাজতেই লাফিয়ে উঠলো রুদ্র। এসি চলছে মাথার উপর। তবুও ঘেমে ভিজে গেছে তার চুলের গোঁড়া, কপাল, শরীর! জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। বুকের মাঝখানে ব্যথা করছে এখনো। গেঞ্জির ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে বুকে হাত বুলাতেই টের পেলো সেখানে দুটো ছোট গর্ত। ডিম লাইটের আলোতে দেখতে পেলো বিছানায়, ঠিক তার শোবার জায়গাটাতে চার্জার রাখা। কখন কিভাবে এখানে এসেছে জানে না সে। এতটা সময় হয়তো উপুড় হয়ে এই চার্জারের উপর শুয়ে ছিল সে। চার্জার পিনগুলো ওভাবে বুকের মধ্যেখানে দেবে গিয়ে দাগ ফেলে দিয়েছে। এখনও নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হচ্ছে না রুদ্রের। কল আসছে আবারও! স্ক্রিনে সাদাত নামটা দেখা যাচ্ছে কিন্তু কোনোভাবেই মনে পড়ছে না কে এই সাদাত!

স্বপ্ন থেকে এখনো বেরোতে পারেনি সে। এত জীবন্ত স্বপ্ন হয় কখনো! মেয়েটার স্পর্শ এখনো নিজের গায়ে টের পাচ্ছে। চোখের সামনে ওর অর্ধনগ্ন নারী শরীরটা এখনো স্পষ্ট! এই ঠোঁট জোড়ায় এখনো ওর ঠোঁটের স্পর্শ, দাঁতের ধার অনুভূত হচ্ছে। শরীর ঘামছে এখনো! নিজেকে শক্তিশূন্য মনে হচ্ছে। ঐ মেয়েটা, আর ওকে ঘিরে এতক্ষণ চলমান সব অনুভূতির বাইরে আর কোনো অনুভূতি কাজ করছে না, আর কিছুই মনে পড়ছে না। স্বপ্নের মতন বাস্তবেও নিজেকে খুইয়েছে রুদ্র একটা কাল্পনিক কিংবা অবাস্তব অনুভূতির কাছে। খাট থেকে নেমে ফ্লোরে শুয়ে পড়লো সে। শরীরের লোমে লোমে শিহরণ জেগে আছে তার। এমন অনুভূতি এর আগে কোনো নারীর কাছে পায়নি সে। প্রথম! এবারই প্রথম তাকে কেউ এতখানি কাবু করেছে, নিজের শরীরে কোনো নারী শরীর এত গাঢ় হয়ে লেপ্টে থাকার অনুভূতি দিচ্ছে। অদ্ভুত এক সুখে হারিয়ে যাচ্ছে রুদ্র। স্বপ্নে সেই চুমু যতটা না যন্ত্রণা দিচ্ছিল, নারী শরীরে স্পর্শ মনের ভেতর যতটা না সংশয়, ভয় সৃষ্টি করছিল, স্বপ্ন থেকে বেরিয়ে আসার পর সবকিছু তার চেয়ে অনেক বেশি মধুময় লাগছে তার। সব ভুলে এই ডুবে থাকা শান্তি দিচ্ছে তাকে। অস্থির মন ধীরে ধীরে স্থির হচ্ছে।

ভোরের আজান হচ্ছে। রুদ্র আর শুভ একই ঘরে ছিল। আজানের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো শুভর। পাশে রুদ্র নেই। ওয়াশরুমের বাতিও নেভানো। কোথায় গেল সে? বিছানা ছাড়তেই টের পেল বারান্দা থেকে সিগারেটের গন্ধ ভেসে আসছে। বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,

— “রাতে ঘুমাননি?”

ঘাড় ফেরালো রুদ্র। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো সে।

— “তুমি জেগে গেলে যে?”

— “আজানের শব্দ শুনে ভাঙলো।”

— “বসো এখানে।”

পাশের টুলে ইশারা করে বললো রুদ্র। শুভর হাতে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে বললো, নাও। সিগারেট ধরিয়ে রুদ্রের দিকে চেয়ে রইলো শুভ। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলতে যাচ্ছে সে। খুব জরুরি কোনো সিদ্ধান্ত বা আলাপের সময় এভাবেই সামনের জনের হাতে সিগারেট ধরিয়ে দেয়া রুদ্রের পুরোনো অভ্যেস। তবে সবার ক্ষেত্রে না. তার পছন্দের কেউ কিংবা কাছের কারো বেলাতেই এমনটা হয়। হয়তো রুদ্রের কাছে কাউকে সঙ্গে নিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে জরুরি সিদ্ধান্ত নেয়া তাকে আলাদা স্বস্তি দেয় কিংবা জটিল আলাপ, সিদ্ধান্ত সহজ করে দেয়। এটা শুভর নিজস্ব মতামত। কখনো রুদ্রকে আলাদা করে জিজ্ঞেস করা হয়নি, কেন সে এমনটা করে?

— “তোমার তো নারীসঙ্গের এক্সপেরিয়েন্স আছে। একটা কথা বলো তো, সেক্স কিংবা ইন্টিমেসি কি স্ট্রেস রিলিফ করে?”

রুদ্রের এমন প্রশ্নের কারণ খুঁজে পেলো না শুভ। নারী কিংবা নারীসঙ্গ এসবে কখনোই রুদ্রের আগ্রহ দেখেনি শুভ। কত উচ্চ পর্যায়ের লোকেরা শুধু নিজের সুবিধা আদায়ের জন্য, তাদের জানাশোনা সেরা লাস্যময়ীকে রুদ্রের কাছে পাঠাতে চাইলো, সামনে এনে হাজির করলো! সেদিকে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে উল্টো মেজাজ দেখাতো। বলতো, মেয়ে মানুষের পাল্লায় আমাকে ফেলতে পারবেন না। জীবনে অনেক খারাপ কাজ করেছি, করছি; কিন্তু এই মন্দে আমি জড়াবো না। আমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইলে আপনার কাজ আর বুদ্ধি আমাকে দেখান। পুরো মন্ত্রী, ব্যবসায়ী মহল জানে রুদ্রের মেয়ে লোকের প্রতি আগ্রহ নেই। তাকে কোনোভাবেই সেদিকে কাবু করা সম্ভব না। তবে আজ কী হলো তার? সে কি নারী সান্নিধ্য চাইছে?

জবাব না পেয়ে রুদ্র আবার বললো,

— “আমি কি খুব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করে ফেললাম?”

— “না, না! আপনি হঠাৎ এই প্রশ্ন! সেটাই ভাবছিলাম আরকি।”

— “বলো।”

— “হ্যাঁ, স্ট্রেস রিলিফ হয়। অনেকটা সময়ের জন্য বেটার ফিল হয়।”

— “জমে যাওয়া বুদ্ধি সব আবার কাজ করতে শুরু করে?”

— “হ্যাঁ ওয়ার্ক স্পিড আসে, ব্রেন ঠিকঠাক কাজ করে। বাট ইট অল ডিপেন্ডস অন ইউর পার্টনার’স পারফরম্যান্স।”

— “আচ্ছা, স্যাটিসফেকশনের একটা ব্যাপার আছে তো!”

— “হ্যাঁ।”

— “ওয়েল, শি পারফর্মড টু গুড!”

ভ্রু কুঁচকালো শুভ। কার কথা বলছে রুদ্র? কবে? কখন? কিভাবে হলো?

বাইরে এখনো আলো ফোটেনি। বারান্দার বাইরেই কয়েক হাত দূরে ল্যাম্পপোস্ট। সে আলো এসে ছড়াচ্ছে বারান্দা পর্যন্ত। শুভর মুখটা স্পষ্ট দেখতে পেলো রুদ্র। রহস্য ভরে হাসলো সে। সিগারেটে টান দিয়ে বললো,

— “ইন মাই ড্রিমস!”

রুদ্রের হাসি আর জবাবে, সৌজন্যতার খাতিরে হাসলো শুভও। তবে সংশয়ভরে। রুদ্রের কথা হাসিতে এত রহস্য কেন? রাতে শোবার আগেও যাকে অস্থির দেখাচ্ছিল, বিষন্ন লাগছিল… কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে কী এমন হলো যে তাকে এতটা শান্ত, স্থির দেখাচ্ছে? তার উপর নারীসঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন!

— “শুভ?”

— “জি?”

— “আমি যদি তোমার এখানে আরো সপ্তাহখানেক স্টে করি, কোনো আপত্তি আছে?”

— “না, আপত্তি কেন হবে?”

— “তোমার ব্যক্তিগত জীবন আছে। আমরা এখানে থাকলে, তিথি এখানে আসবে না। আমার জন্য তোমাদের দু’জনের…”

রুদ্রকে কথা শেষ করতে দিলো না শুভ। তার আগেই সে বলে উঠলো,

— “তিথি কিংবা আমাদের ব্যক্তিগত মুহূর্ত এসব কোনো সমস্যাই না। আপনি ওসব নিয়ে ভাববেন না। যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারেন।”

আর কিছু বললো না রুদ্র। হাতে থাকা সিগারেটটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। তাই হয়তো চুপ আছে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে সামনের দিকে। কিছু একটা ভাবছে হয়তো! শুভও বলছে না কিছু। দ্রুত টানে হাতের সিগারেট শেষ করছে সে। জ্বলন্ত সিগারেটের অবশিষ্টাংশ পায়ের কাছে ফেলে, স্যান্ডেলে মারিয়ে নেভালো রুদ্র। দুই হাত আঙুলবন্দী করে মাথার পেছনে রেখে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসলো সে। তখনও তার নজর সামনের দিকেই

— “মানুষ যতই অমানুষ, বিবেকহীন, পাথর হৃদয়ের হোক না কেন পৃথিবীর কোথাও না কোথাও, কারো না কারো কাছে সে দুর্বল। নিষ্পাপ শিশুর মতন রূপ। এই রূপ পৃথিবীর অন্য কেউ দেখেনি কখনো। যাকে সে তার দুর্বলতা দেখিয়েছে, তার নিষ্পাপ রূপ দেখিয়েছে, তাকে সে নিঃস্বার্থ ভালোবেসেছে এবং তার জন্য সেই মানুষ পুরো পৃথিবী উল্টে ফেলার ক্ষমতা রাখে।”

— “কার কথা বলছেন?”

— “আজগর।”

রুদ্রের দিকে মনোযোগী হলো শুভ।

— “প্ল্যান কী?”

— “প্ল্যান হলো আজগরের দুর্বল রগটাকে চেপে ধরা। বিনিময়ে আজগরকে পৃথিবী উল্টাতে হবে না। দলের বিরুদ্ধে কোথায় কোন এভিডেন্স সে রেখেছে সেগুলো দিয়ে দিলেই চলবে। হিসেব কষে দেখলাম, চাইলে ওকে পথ থেকে সরানোই যায়। কিন্তু আঙুল অবশ্যই দলের দিকে উঠবে, বিরোধী দলের উপর না। মিডিয়া উঠে-পড়ে লাগবে। এই যে আজগরের লোকেরা এখন চুপ করে আছে, সরাসরি ঝামেলায় নামছে না, ওদের গুরুর কিছু হয়ে গেলে ওরা আর চুপ থাকবে না। সঙ্গে যোগ হবে মতি আর হাবিবের দলবল। সংখ্যায় ওরা একেবারে কমও না। তবুও এসব মিডিয়া, ওর চ্যালাদের চাপ হয়তো কোনো একভাবে সামলে নেয়া যাবে। তবে এটা পারফেক্ট টাইম না! সবে দল ক্ষমতায় এসেছে। এখনই দলীয় কোন্দল সৃষ্টি করা যাবে না। বাইরে আমাদের কনফ্লিক্ট নিয়ে চর্চা হচ্ছে, হোক। প্রমাণ তো নেই। কেউ চোখে তো দেখছে না। মুখে মুখে চর্চা হচ্ছে জাস্ট, সেটা লোকের মুখ পর্যন্তই থাকুক। পুরো দেশকে দেখাতে হবে, উই আর ওয়ান। আমাদের একতা আগের মতোই আছে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা, আজগর কাঁচা খেলোয়ার না। ও ভালো করেই জানে ওকে যখন তখন উড়িয়ে দেয়া হবে। সেই মানসিক প্রস্তুতি ও নিয়েই রেখেছে। আগেও বলেছি, মরণের ভয় ওর নেই। যদি ওর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়, তাহলে দলের বিপক্ষে পরবর্তী স্টেপ কী হবে সেটা ও বিশ্বস্ত কাউকে বুঝিয়ে রেখেছে। মুখে মুখে ওরা বদনাম করুক, দলের যত ডার্ক সিক্রেট আছে সব জনসমক্ষে বলে দিক সেসব সমস্যা না। জনগণের আইওয়াশ, ব্রেনওয়াশ করে নেয়া যাবে। কিন্তু প্রমাণ সহ হাজির হয়ে গেলেই বিপদ! সেজন্য ভাবছি আগে প্রমাণ সরাবো, তারপর আজগরকে কী করবো দেখা যাবে।”

— “এভিডেন্সই ওর পাওয়ার। দুর্বল রগে আঘাত করেও কাজ হবে না মনে হয়। এগুলো হাত ছাড়া হওয়া মানে আজগরের সব ক্ষমতা ফুটস।”

— “বললাম তো, এরা যাদের ভালোবাসে সমস্ত পৃথিবী তুচ্ছ করেই ভালোবাসে।”

— “যতদূর বুঝি দুর্বল রগ ওর মেয়ে।”

— “হ্যাঁ। বুড়ো বয়সে এই মেয়েকে জন্ম দিয়েছে। ওর সারা পৃথিবী একদিকে, অদিতি আরেকদিকে।’

— “মেয়েটা এখন লন্ডন আছে, তাই না?”

— “হ্যাঁ।”

— “প্ল্যান কী?”

— “ইনফরমেশন কালেক্ট করো আগে। শুনি, বুঝি তারপর স্টেপ নেবো।” মাথা দুলিয়ে সায় দিলো শুভ। চোখ মুখ কচলাতে কচলাতে রুদ্র বললো,

— “ঘুমিয়ে পড়ো।”

— “আপনি?”

— “যাবো। আদনানের সঙ্গে কথা আছে।”

— “ঠিকাছে। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, কিছু জিজ্ঞেস করি?”

— “সিওর।”

— “হঠাৎ নারীসঙ্গের ব্যাপারে জানতে চাইলেন! আমি কি দেখবো ব্যাপারটা?” দুষ্টুমি ভরে হাসলো রুদ্র।

—”হ্যাঁ, তোমাকেই দেখতে হবে।”

রুদ্রের উত্তরে যেন ধাক্কা লাগলো শুভর। রুদ্র তবে কথার ছলে জানতে চায়নি। সত্যিই চাইছে কাউকে! এত বছরে যেই মানুষটাকে কোনো নারীর দিকে আগ্রহ ভরে চোখ তুলে তাকাতে দেখেনি, সে কিনা চাইছে নারীসঙ্গ! ঠিক বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হলো না শুভ-র। তবুও বরাবরের মতো, মাথা দুলিয়ে “জি ভাই” বলে সম্মতি জানালো শুভ। দু’জনে একসঙ্গে উঠে এল বারান্দা ছেড়ে। শুভ শুয়ে পড়লো নিজ বিছানায় আর রুদ্র চলে গেল বসার ঘরে। বারান্দায় বসে আদনানের সঙ্গে ব্যক্তিগত ব্যাপারে কথা বলা অনুচিত মনে হলো তার।

ভোর হবে আর কিছুক্ষণ বাদে। পুরো দিন অসংখ্য দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তায় কাটানোর পর, রাতটাও কেটেছিল নির্ঘুম। এই শেষ রাতে এসে মাত্রই চোখের পাতা এক হয়েছিল, তখনই কল এল আদনানের নাম্বারে। হুরমুরিয়ে উঠে বসলো সে। এক মুহূর্তেই চোখ থেকে ঘুমের রেশ কেটে গেল তার। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো রুদ্রের নাম।

— “জি ভাইয়া?”

— “কোথায় আছো?”

— “বাসায়।”

— “কোন বাসায়?”

— “আমার।”

— “বউ কোথায়?”

— “ওর বোনের ওখানে।”

— “আলাদা কেন?”

— “সহ্য করতে পারছে না, বললাম না?

— “তাই বলে ওভাবে রেখে চলে আসবে? তোমার বউ তুমি কিভাবে সামলাবে সে কথা এখন তোমাকে আমার শেখাতে হবে?”

— “রেখে এসে আমার কি খুব ভালো লাগছে? টেনশনে ঘুম-খাওয়া কিছু হচ্ছে না আমার। কখন কী যেন করে বসে! অসুস্থ হয়ে গেছে ও। আমাকে দেখলেই এ্যাবনরমাল বিহেভ করে। খুব চিৎকার করে, কাঁদে। ওর বাসার মানুষও আর আমাকে ওর কাছে এলাউ করছে না।”

— “তাই তুমিও বাসায় এসে বসে আছো, তাই তো?”

— “আর কী করবো?”

— “লাখ লাখ মানুষের ব্রেনওয়াশ করার ক্ষমতা তোমার আছে। বক্তৃতার মাঠে তুমি জনগণের একজন প্রিয় মুখ। কঠিন থেকে কঠিন সিচুয়েশন তোমাকে আমি সামলাতে দেখেছি। এমনি এমনি তোমাকে এত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাইনি আমি। তোমার মাঝে যোগ্যতা আছে বলেই এই সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি। দেশের ইতিহাসে ইয়াংগেস্ট মিনিস্টার তুমি। অথচ সেই যোগ্য ছেলেটাই কিনা নিজের বউকে সামলাতে পারছে না!”

— “সত্যিই পারছি না! সোমাকে এতটা কঠিন কখনো দেখিনি আমি। ভালোবাসতো ও আমাকে। আমার খারাপ সময়ে ও খুব সাপোর্ট দিয়েছে। কখনো উঁচু গলায় আমার সঙ্গে চেঁচায়নি। হাজার ঝগড়া হোক, অভিমান-অভিযোগ থাকুক, ও কখনো বলেনি তুমি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও। সোমার কাছে আমার ছায়াটাও প্রিয় ছিল। গলা উঁচালে সোমার কন্ঠ শুনতে কেমন হয় তা এতবছরে জানা হয়নি কখনো আমার! যার চোখে খুব ঝগড়ার মুহূর্তেও শুধু ভালোবাসাই দেখেছি, সেই মেয়েটা আর আমাকে সহ্য করতে পারছে না! ওর চড়া কন্ঠ আর দু’চোখ ভর্তি এত ঘৃণার সামনে দাঁড়ানোর সাহস আমার হচ্ছে না। কাছে যেতে চাইলেই সুইসাইডের হুমকি দিচ্ছে। ওর ঐ কথা শুনলে আমার সাহস, শক্তি আরো ভেঙে পড়ে।”

— “কথা শোনো আমার।

— “জি?”

— “যেই মেয়েগুলো সত্যিই ভালোবাসে ওরা বিনিময়ে লাইফ পার্টনারের এটেনশন চায়। কেয়ার চায়। লাইফ পার্টনার ওদের সমস্ত রেসপনসেবলিটি নেবে এটাই ওদের ডিমান্ড। পার্টনারের পজিশন, ব্যাংক ব্যালেন্স এসব কিছুই ম্যাটার করে না ওদের কাছে। পার্টনার ওকে কতখানি ভালো রাখছে, সবশেষে এটাই ওদের কাছে ম্যাটার করে। সোমা শেষ কবে তোমার কাছে একটু এটেনশন, যত্ন পেয়েছে বলতে পারো? রাজনীতি, দল, লোক এসব করেই দিন পার তোমার। পেছনে একটা মেয়ে যে ফেলে এসেছো তার কী হবে? বিয়ে করেছো ওকে। কিন্তু ওকে ভালো রাখার দায়িত্ব কিন্তু তুমি পালন করোনি। এতদিন ধরে সোমা একাই একটা লাভলেস, কেয়ারলেস রিলেশন টেনে যাচ্ছে। এত অবহেলার মাশুল একটু হলেও গুনতে হবে তোমাকে।”

গালিগালাজ করুক। – “গুনবো। সোমা শাস্তি দিক আমাকে। ইগনোর করুক, প্রয়োজন চড় থাপ্পরও মেনে নেবো। কিন্তু এভাবে মুখ ফিরিয়ে নেবে ও! আত্মহত্যা করতে চাইবে? এই মাশুল তো গোনা যাচ্ছে না।”

— “সোমা তোমাকে দূরে থাকতে বলেছে তুমিও দূরেই গেলে। জোর করে কি কাছে যাওয়া যেত না? ওকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখলে কতক্ষণ আর তোমাকে দূরে সরানোর চেষ্টা করতো বলো? ভালোবাসে ও তোমাকে, হাজারটা অন্যায় করো তবুও ভালোবাসবে। এত সহজে কারো ভালোবাসা ফুরায় না, আদনান। সোমার উইকনেস এখনও তুমিই আছো। ও যা রিএ্যাক্ট করছে সবটা ওর অভিমান। তোমার কাছ থেকে ওর অপ্রাপ্তি, জমে থাকা অভিমানটা এভাবে আজগর কাজে লাগিয়ে নিলো অথচ তুমি ওর ভালোবাসাটা কাজে লাগাতে পারলে না? তুমি ওর হাজবেন্ড। নিজের এই পজিশটা ইউজ কেন করতে শেখোনি তুমি?”

চুপ করে রইলো আদনান।

— “ওর বাসার মানুষের বাঁকা চাহনী কিংবা সোমার ঘৃণা, হুমকি কিচ্ছু দেখার সময় নেই আপাতত। তুমি ওর বাসায় যাও। বের করে নিয়ে এসো ওকে।”

রুদ্রের কথায় চমকে উঠলো আদনান।

— “বের করে নিয়ে আসবো মানে?”

— “তোমার ওয়াইফ এখন থেকে তোমার কাছে থাকবে। বিয়ে করেছো তিনবছর হয়েছে, এবার তো ওর দায়িত্ব নাও!”

— “দায়িত্ব নেবো আমি। এখন, এই মুহূর্তে নেবো। আর কোনো বাহানা করবো না। কিন্তু ও আসতে চাইবে না।”

— “আসতে না চাইলে জোর করে তুলে আনো। এই মুহূর্তে জোর করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।”

— “জোর করে তুলে আনতে গেলে ওর ফ্যামিলি ঝামেলা করবে না?”

— “কিসব বলছো আদনান? ঝামেলা করবে মানে? এসব ঝামেলার পরোয়াও করো তুমি!”

— “এটা বিপক্ষ দল না, আমার শ্বশুরবাড়ি!”

— “যেই মুহূর্তে তোমার ইচ্ছে বিরুদ্ধে যে কেউ বাঁধা হবে সেই মুহূর্তে ঐ লোকটাই তোমার বিরোধী দল। হোক সে তোমার শ্বশুরবাড়ি কিংবা নিজের বাড়ির লোকজন। সঙ্গে লোক নাও। মেয়ে ধরে আনার সময় ফ্যামিলি লোকজন জড়ো করে তোমাকে আটকাতে চাইবে, সেই সুযোগ ওদের দেবে না। এমনকি ওরা যেন চিৎকার করার সুযোগটুকুও না পায়। এলাকার মানুষ যত কম জানাজানি হবে তত ভালো।”

— “চিৎকার চেঁচামেচি তো হবেই!”

— “ঘরের কর্তার কপাল বরাবর মেশিন ঠেকে গেলে সব এমনিই চুপ হয়ে যাবে। আর এখানে, যদি-কিন্তু প্রসঙ্গ টেনো না। যাকে তুলে আনতে যাচ্ছো সে তোমার বউ। পূর্ণ অধিকার তোমার আছে। তুমি কাউকে শ্যুট করছো না, কারো ক্ষতিও করছো না। সংসার বাঁচাতে এসব ঝামেলা একটু আধটু করা যেতেই পারে।”

রুদ্রের কথায় পুরো পরিস্থিতি সামলে নেয়ার মানসিক শক্তি ফিরতে লাগলো আদনানের। লোকটা টনিকের মতো। যখনই দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, মস্তিষ্ক কাজ করা ছেড়ে দেয়, মানসিক শক্তি হারাতে থাকে তখনই সে মন্ত্রের মতো বলতে শুরু করে। পুরো একটা ভেঙে পড়া দলকে নিজের কথার ধারে মুহূর্তে দাঁড় করাবার চমৎকার ক্ষমতা তার আছে। ওপাশ থেকে তখনও বলে চলছে রুদ্র। তার কথায় আরো মনোযোগী হলো আদনান।

— “মেয়েরা সবকিছুতে সিকিউরিটি চায়, বিশেষ করে সংসারে। আর এই সংসারে ওদের কাছে বিগেস্ট সিকিউরিটি, সংসারের সৌন্দর্য আর হাজবেন্ডের লাগাম টেনে রাখার মূল অস্ত্র হলো তাদের সন্তান। ওরা ভাবে কোলজুড়ে একটা বাচ্চা এলেই সবকিছু ওদের কন্ট্রোলে থাকবে। বাচ্চার টানে হলেও হাজবেন্ড সোজা হয়ে চলবে। পরনারীতে আসক্ত হয়ে বেঁকে বসবে না।”

রুদ্রের ইশারা আন্দাজ করতে পারছে আদনান। তার আন্দাজ সত্যি করে পর মুহূর্তেই রুদ্র বলে উঠলো,

— “গেট হার প্রেগন্যান্ট আদনান। ও তোমার কাছে একটা সংসার চাইছে, ওকে দাও। বিয়ে করেছো অনেকদিন হলো, তোমাদের মাঝে একটা বাচ্চা আনার সময় হয়েছে। এবার সংসার শুরু করো পুরোদমে। সোমার খেয়াল রাখো। যেই মেয়েটা তোমার এত অবহেলা পেয়েও তোমাকে ছেড়ে যায়নি, তাকে খুশি রাখা আহামরী কিছু না। তোমার একটু চেষ্টাতেই ও খুশি হয়ে যাবে।”

— “কিন্তু এখনই যদি বাচ্চার কথা বলি ও ভেবে নেবে আমি আমার পজিশন ক্লিয়ার করার জন্য ওকে বাচ্চার লোভ দেখাচ্ছি।”

— “এটা ওর মাথায় তুমি কেন আসতে দেবে? আমি বলছি না আজই গিয়ে ওকে বাচ্চার কথা বলো। এটলিস্ট এক দুইমাস সময় নাও। তোমাদের সম্পর্কটা গুছিয়ে নাও। বাচ্চার কথা আমি বলতাম না। বলছি, কারণ সোমা এই মুহূর্তে ইনসিকিউর ফিল করছে। ওকে সিকিউর ফিল করাও। ওকে বুঝাও এই সংসার আর সোমার প্রতি তুমি লয়্যাল। আর কোথাও তুমি যাচ্ছো না। ওকে নিয়েই সেটেল হতে চাচ্ছো ফর লাইফটাইম।”

এক মুহূর্ত চুপ করে রুদ্রের কথা মাথায় এঁটে নিলো আদনান। লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো,

— “ঠিক আছে।”

— “তুমি আপাতত তোমার পি.এ.- কে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে ডিসকানেক্ট থাকো কিছুদিন। সোমা আর নিজের সম্পর্ককে সময় দাও। এটা সামলে নিলে বাকি সব সামলে নেয়া যাবে। সিলেটে আমার টি স্টেটে চলে যাও দু’জন। কোথায় যাচ্ছো তোমার লোকজন যেন না জানে। আমি আমার লোক সঙ্গে দেবো। তোমাদের সিকিউরিটি, প্রাইভেসি সবকিছু ওরা দেখবে। আর আমার বাংলোর চাবি পাঠাচ্ছি সুমনের হাতে, সঙ্গে গাড়ি আর ড্রাইভারও। তোমার গাড়ি নেবার প্রয়োজন নেই আপাতত। ওটা নিয়ে তারপর সোমার বাসায় যাও। সেখান থেকে সোজা সিলেট।”

— “আচ্ছা।”

— “তেতো শোনালেও একটা কথা বলি, সোমার প্রতি তোমার ভালোবাসার অভাব আছে। যতটা ডেডিকেশন আর ভালোবাসা তুমি তোমার স্বপ্ন পূরণে দিয়েছো ততটা তুমি সোমার জন্য দাওনি। ওকে তুমি এক অর্থে ঠকাচ্ছো।”

— “ওকে আমি ভালোবাসি না বলছেন?”

— “বাসো না, তা বলিনি। তবে ঘাটতি আছে। নিজেকেই একটাবার জিজ্ঞেস করো না! সোমা আজ পর্যন্ত তোমার জন্য যা কিছু স্যাক্রিফাইস করেছে, সব মেনে নিয়েও তোমাকে ভালোবেসেছে, তুমি কি ওর জন্য অতটা করতে?”

চুপ করে রইলো আদনান। সম্পর্কের প্রথম দিন থেকে একে একে সব মনে করার চেষ্টা করতে লাগলো সে। এই সম্পর্কে কার কতটা চেষ্টা ছিল তা-ই স্মরণ করতে থাকলো। ঘুরে-ফিরে মনের ভেতর থেকে বারবার সোমার নামটাই ফিরে আসছে।

আদনানের জবাবের আশায় কিছুটা সময় চুপ ছিল রুদ্র। জবাব না পেয়ে রুদ্র আবার বলতে লাগলো,

— “একটা মানুষ তোমাকে ভালোবাসে, তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না সেই নিশ্চিয়তা পাওয়া মানে তাকে হেলায় ফেলায় এক কোণায় ফেলে রাখা না। যে তোমার সব ধরনের সিচুয়েশনে তোমার পাশে থাকার মানসিকতা রাখে তাকে মাথায় করে রাখা উচিত। এবার ওকে ওর প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিও প্লিজ! এক সপ্তাহের মধ্যে আমি সবকিছু ঠিক দেখতে চাই আদনান। তোমাকে যতটুকু বুঝানোর ছিল, বুঝিয়েছি। তোমার ওয়াইফকে তুমি কিভাবে সামলে নেবে বাকিটা তুমি বুঝে নাও। নয়তো লম্বা ভুগতে হবে তোমাকে।”

রুদ্র – ১০

১০

মেয়েটার ঘর বেশ আলো ঝলমলে। দূর থেকে যতটুকু বুঝা যায় ওর ঘরে দু’টো বড় জানালা। একটা ওর ঘরের বারান্দা মুখী অন্যটা ওর বিছানার মাথার কাছে। দিনের আলোয় ঘরের ভেতরটা খুব স্পষ্ট না দেখালেও জানালার আশপাশের দিকটা বেশ দেখা যাচ্ছে। ঘরের মধ্যেখানে কে হাঁটছে-ফিরছে তাও আবছা দেখা যাচ্ছে। ভোরে আদনানের সঙ্গে কথা বলার পর ঘন্টা দুয়েক ঘুম হয়েছিল রুদ্রের। সাড়ে সাতটায় ঘুম ভেঙে গেল, তারপর আর ঘুম হয়নি। ফ্রেশ হয়ে গরম কফিতে চুমুক দিতে দিতে এল বারান্দায়। তখন থেকেই মিহি দৃষ্টিতে সেই অপরিচিতার জানালায়, বারান্দায় চেয়ে আছে রুদ্র। কখনো মেয়েটা আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছে, কখনো ঘরের একোণ-ওকোণ করছে, আলমারির দরজা খুলছে, বন্ধ করছে, টেবিলের বইপত্র নাড়াচাড়া করছে। মাঝে ঘরের মধ্যে দু’বার কে যেন এল। ওর মা হবে হয়তো! একেবারে স্পষ্ট ঘরের ভেতরটা দেখা না গেলেও অস্পষ্টও লাগছে না। তবে ওর মুখটা স্পষ্ট করে একবার দেখার সাধ হচ্ছে রুদ্রের। ওর ছুটোছুটি দেখে বোঝাই যাচ্ছে ভার্সিটির জন্য বেরোবে ও। আয়নার সামনে একটু আগে দাঁড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণ। সেজেছে বোধহয়! সাজলে কেমন দেখায় ওকে, তা দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ বলে মনে হচ্ছে রুদ্রের। দ্রুত চুমুকে কফিটা শেষ করলো রুদ্র। শোবার ঘরের তোশকের নিচ থেকে দু’টো রিভলবার, ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে সানগ্লাস আর মাস্ক নিয়ে বসার ঘরে গেল রুদ্র।

শুভ আর বডিগার্ড দু’জন কফি খেতে খেতে গল্প করছিল। বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে শুভর দিকে একটা রিভলবার ছুঁড়ে দিয়ে রুদ্র বললো,

— “কফিটা রাখো। এসো আমার সঙ্গে।”

সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো বডিগার্ড দু’জন।

রুদ্র হাত ইশারা করলো,

— “তোমরা না। শুভ আছে আমার সঙ্গে। প্রয়োজন হলে কল করবো।”

— “ওকে ভাই।”

এক প্রকার দৌড়ে সিঁড়ি ভাঙছে রুদ্র। রুদ্রকে পাশ কাটিয়ে তার আগে ছুটলো শুভ। গাড়ি বের করতে হবে।

*****

রাস্তার মাথায় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ আর রুদ্র। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে রুদ্র তাকিয়ে আছে ফেলে আসা গলির দিকে।

গাড়ির ভেতর থেকে শুভ জানতে চাইলো,

— “কার জন্য অপেক্ষা করছেন?”

একটু করে বাঁকানো হাসি ফুটলো রুদ্রের ঠোঁটের বাম কোণে। ঐ তো আসছে মেয়েটা। হাতে টিস্যু পেপারে রোল করা পরোটা। ভেতরে কী আছে? ভাজি নাকি বুন্দিয়া? খেতে খেতে অনেকটা ছুটে আসছে এই রাস্তার দিকে। পাঁচ সেকেন্ডে ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত প্রায় স্ক্যান করে নিলো রুদ্র। পার্পেল কুর্তীর সঙ্গে ম্যাচ করে ঠোঁটে বেবি পিংক লিপস্টিক, কপালে কালো টিপ আর কাঁধ বেয়ে পেট অব্দি নেমে এসেছে বেণী। কান আর কপালে ছড়িয়ে আছে কয়েকগাছি চুল। বাম হাতে কালো বেল্টের ঘড়ি। ব্ল্যাক লেগিংসে পায়ের গড়ন স্পষ্ট মাপতে পারলো রুদ্র। হ্যাংলা- মোটা কিছুই না। একেবারে পারফেক্ট শেইপ! মুখ-হাতের তুলনায় পায়ের পাতা জোড়া যেন একটু বেশিই ফর্সা। চিকন জোড়া নুপুর, টো রিংগুলো যেন পায়ের সৌন্দর্য একটু বেশিই বাড়িয়ে দিয়েছে। ও যখন ছুটে আসছিল ঘাড় থেকে সামনে ঝোলানো স্কার্ফটা দু’পাশে সরে গিয়েছিল বুকের উপর থেকে। সেদিকে চোখ পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে চোখ সরিয়ে নিলো রুদ্র। গতরাতের সেইসব অন্তরঙ্গতা মনে ঢেউ তুলে দিলো তক্ষুণি। এই ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া চলবে না। অন্তত এই মুহূর্তে না। মোবাইল টেপার বাহানায় চোখ নামিয়ে রাখলো রুদ্র।

তার গাড়ির পেছনেই এসে দাঁড়িয়েছে মেয়েটা রিকশা ভাড়া করবে বলে। রুদ্র কান পেতে রইলো সেদিকে মেয়েটার গন্তব্য জানবার উদ্দেশ্যে।

খানিক সময় বাদে গাড়িতে লাফিয়ে উঠলো রুদ্র। শুভকে তাড়া দিলো,

— “ঐ রিকশাটা ফলো করো।”

বিলম্ব না করে শুভও রিকশার পিছু নিলো।

ড্রাইভ করতে করতে শুভ জিজ্ঞেস করলো,

— “এটা কে? মতির নায়িকা?”

— “আমার।”

তৎক্ষনাৎ গাড়ির ব্রেক কষলো শুভ। অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। হাসলো রুদ্র। ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে পেলো ঠিক পেছনের বাইক চালক, রিকশাওয়ালারা উত্তেজিত হয়ে তাদের কিসব যেন বলছে। গালি গালাজই করছে হয়তো!

শুভর পিঠ চাপড়ে রুদ্র বললো,

— “লোকজন ক্ষেপে যাচ্ছে, ঐ মেয়েটাও চলে যাচ্ছে। জলদি করো!” নিজেকে সামলে আবার গাড়ি স্টার্ট করলো শুভ। বললো,

— “কে উনি?”

— “উনি কে, সে খবর তুমি ভালো বলতে পারবে। তোমার প্রতিবেশী।”

— “আমি মুখটা খেয়াল করে দেখিনি।”

— “তোমার ফ্ল্যাট বরাবর নীল দেয়ালের বাড়িটা আছে না? সেটার তিনতলায় থাকে।”

— “আচ্ছা! কিন্তু আপনি চেনেন কেমন করে?”

— “চিনি না। মুখটাই চিনি শুধু। আর কোথায় পড়ে এইমাত্র জানলাম। হোম ইকোনমিক্সের স্টুডেন্ট। নাম কী, কিসে পড়াশোনা করে, বয়স কত, বাবা কে কিচ্ছু জানি না।”

রুদ্রের চোখের ভাষা শুভ পড়ে নিলো এক মুহূর্তেই। মেয়েটাকে সে পেতে চাইছে। চিরতরে একান্ত নিজের করে। তার নামের সঙ্গে নিজের নাম জুড়ে দিতে চাইছে। প্রচন্ড খুশিতে আটখানা লাগছে শুভর। মুখ থেকে হাসি সরছেই না! এবার বুঝি এই মানুষটার জীবন গোছানোর পালা! নির্ঘুম রাত শেষ হবার পালা। নিজেকে ভেঙেচুড়ে কারো হাতে তুলে দেবার পালা। এত খুশি হয়তো নিজের প্রেমটা হবার সময়ও অনুভব হয়নি শুভর।

রুদ্রের দিকে একনজর তাকিয়ে, প্রশস্ত হাসিতে সে জানালো-

— “সন্ধ্যার মধ্যে সব ইনফরমেশন জানাচ্ছি।”

— “শুধু ইনফরমেশন না, এখন থেকে আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত লোকদের মাঝ থেকে একজন ওর সঙ্গে ছায়ার মতো থাকবে।”

— “শিশিরকে কল দিচ্ছি আমি।”

— “তুমি খোঁজ নেয়ার পর বাসায় প্রস্তাব পাঠাবো।”

— “মুরুব্বি লাগবে একজন। নিজের প্রস্তাব নিজে নিয়ে যাওয়া চলবে না। আপনি যেই ফ্ল্যাটের কথা বলছেন, জানামতে ঐ ফ্ল্যাটে বাড়িওয়ালা থাকে। জুম্মার নামাজে দুই তিনবার দেখা হয়েছিল উনার সঙ্গে। কথার প্রসঙ্গে জানতে পেরেছিলাম ঐ বাড়ির বাড়িওয়ালা উনি। রিটায়ার্ড গভঃ অফিসার। এর বাইরে তেমন কিছু জানি না। পরিবার নিয়ে কথা হয়নি কখনো। ভদ্রলোক আদব কায়দার ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক। কিন্তু কথা বলেন খুব নরম স্বরে, হাসিমুখে। তাই বলছি আরকি, মুরুব্বি দিয়ে প্রস্তাব পাঠালে ভালো হয়। খালাম্মা আসতে পারবে না। আপনি আমি প্রস্তাব নিয়ে গেলে উনি হয়তো পজিটিভলি না-ও নিতে পারেন।”

— “মুরুব্বির অভাব?”

— “কাকে পাঠাবেন?”

— “ইকবাল মাহমুদ আছে কেন? উনি ছাড়াও আমার তো লোকের অভাব নেই। সেসব পরে ভাবা যাবে. আগে ইনফরমেশন নাও।”

১১

সন্ধ্যার দিকে মুড়িমাখা খাচ্ছিল রুদ্র। টিভিতে নিউজ দেখছে সে। আদনানের বিরুদ্ধে টিভিতে কোনো নিউজ এখনো দেখানো হয়নি। দুপুর থেকে তাই প্রতি ঘন্টার নিউজে খোঁজ রাখছে সে। আদনান তবে ভালোভাবেই সোমার পরিবারকে সামলেছে। আজগরের কানেও হয়তো এখনও খবর যায়নি। নয়তো একটা কারসাজি এতক্ষণে হয়েই যেত।

ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজছে। মেজবাহ গিয়ে দরজা খুললো। শুভ ফিরেছে। দুপুরে বেরিয়েছিল বাসা থেকে। বাসা থেকে বেরোবার আগে যতটা হাসিখুশি লাগছিল, এখন ততটাও হাসিখুশি লাগছে না। ক্লান্তও লাগছে বেশ।

রুদ্র সুমনকে ডেকে বললো,

— “ওকে এক গ্লাস পানি দাও তো।”

রুদ্রের পাশে এসে গা ছেড়ে বসলো শুভ। কৌতূহলী হয়ে রুদ্র জানতে চাইলো,

— “শরীর খারাপ নাকি তোমার?”

— “না।”

— “তাহলে?”

— “সুরভীর জন্ম থেকে আজ অব্দি যতটা জানা সম্ভব সব খোঁজ নিয়ে এলাম।”

— “ওর নাম সুরভী?”

— “হ্যাঁ।”

আবারও গত রাতের দৃশ্য মনে পড়তে লাগলো রুদ্রের। নাকের ডগায় স্বপ্নে সুরভীর গা থেকে ভেসে আসা সেই ঘ্রাণ টের পেল। হঠাৎ সে হারিয়ে যেতে লাগলো এই মুহূর্ত থেকে স্বপ্নে। চোখের সামনে থেকে মেজবাহ, শুভ ঘোলা হতে লাগলো। মাথা মৃদু ঝাঁকিয়ে লম্বা দু’টো নিঃশ্বাস নিলো রুদ্র। নিজের লাগাম টানা জরুরি ছিল, নয়তো মন হারিয়ে সুরভীর কথা আর শোনা হতো না মনোযোগ দিয়ে।

সুমন এল গ্লাস হাতে। শুভকে গ্লাসের দিকে ইশারা করে রুদ্র বললো,

— “পানিটা খাও।”

খেলো না শুভ। সুমনের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে টি টেবিলের উপর রাখলো সে।

— “ঝামেলা আছে ভাই। সুরভীকে পাওয়া সম্ভব না!”

ভ্রু কুঁচকালো রুদ্র।

— “কেন?”

— “সুরভীর বিয়ে ঠিক। ১৪ দিন পর বিয়ে।”

— “আচ্ছা!”

— “তার উপর বয়ফ্রেন্ড আছে। নেক্সট উইক পালিয়ে বিয়ে করার প্ল্যান করছে।”

— “ওহ্ হো, টুইস্ট!”

— “হ্যাঁ ভাই টুইস্ট!”

বড্ড হতাশ ভঙ্গিতে বললো শুভ। এসব খোঁজ খবরের পালা আসার আগ পর্যন্ত প্রচন্ড খুশিতে মনে মনে রীতিমতো লাফাচ্ছিল সে। রুদ্র ভাই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ভাবা যায়! প্রতিদিন নিয়ম করে মনে-প্রাণে যার সুখ কামনা করে, সেই মানুষটার সুখের একটা গতি হচ্ছে সে আনন্দেই কত কী ভেবে ফেলছিল মনে মনে। কত আনন্দ হবে বিয়েতে! নিজে দায়িত্ব নিয়ে বিয়ের সব কাজ দেখাশোনা করবে সে। অথচ হলোটা কী? জীবনে প্রথম যাকে চোখে ধরলো, সেই মেয়েটাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ালো।

শুভর হতাশা চোখ এড়ালো না রুদ্রের। গ্লাসটা ওর হাতে তুলে দিয়ে হাসলো রুদ্র। বললো,

— “টুইস্টময় জীবন সুরভীর! প্রেমিক আছে, বাগদত্তা আছে। সিরিয়ালে এখন

আবার আমিও আছি। বিয়েটা ওর হবে। নেক্সট উইকেই হবে, তবে আমার সঙ্গে। ওর লাইফের সবচেয়ে বড় টুইস্ট হলাম আমি। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ওর জীবনটা সম্পূর্ণ অচেনা পথে মোড় নেবে। একেবারে আনএক্সপেক্টেডে কারো সঙ্গে ওর বিয়ে হতে চলেছে সেটা নিশ্চয়ই ও দুঃস্বপ্নেও কখনো দেখেনি।” রুদ্রের কথায় এক নিমিষেই হতাশা উড়ে গেল শুভর।

— “তার মানে আপনি ওকেই বিয়ে করবেন?”

— “কেন করবো না?” অবাক স্বরে জানতে চাইলো রুদ্র।

এক নিঃশ্বাসে পুরো পানির গ্লাসটা খালি করে ফেললো শুভ। হাতের তালুতে ঠোঁটের আশপাশ মুছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে।

— “আমি ভেবেছিলাম আপনি হয়তো আর পা বাড়াবেন না। বয়ফ্রেন্ড আছে, ফিয়ন্সে আছে। এসব শুনে হয়তো ফিরে যাবেন।

— “সুন্দরী মেয়েদের বয়ফ্রেন্ড থাকা খুব নরমাল। আমিও মোটামুটি সিওর ছিলাম ওর বয়ফ্রেন্ড আছে। এটা কোনো সমস্যাই না। লাইফ থেকে বয়ফ্রেন্ড দূর হবে, হাজবেন্ড আসবে। আর রইলো কথা ওর ফিয়ন্সের, সেটা তো আরো ঝামেলা ছাড়া বিষয়। কারণ সুরভী ওকে পছন্দই করে না। কোনো প্রকার ইমোশনাল এটাচমেন্টই নেই। তাই ওটাকে গোণায় ধরার কোনো মানে হয় না। লাথি মেরে দু’টোকে সরিয়ে দেয়া দুই মিনিটের কাজ।”

— “হয়ে যাবে। কোনো ঝামেলা, হল্লা ছাড়াই মিটিয়ে ফেলবো।”

— “ওকে আমার লাগবে শুভ। ওকেই লাগবে। অন্য কাউকে দিয়ে চলবে না। সুরভী যদি ডিভোর্সি কিংবা দুই বাচ্চার মা-ও হতো সেসবও আমার কাছে ম্যাটার করতো না।”

— “আপনি যতটুকু বলেছেন, এটাই যথেষ্ট। আর কিছু বলতে হবে না।”

— “ওর সম্পর্কে বলো কিছু।’

— “হোম ইকোনমিক্সের স্টুডেন্ট, তা তো আপনি দেখেই এলেন। ফ্যাশন ডিজাইনিং ডিপার্টমেন্ট, ফাইনাল ইয়ার।”

— “বাহ্!”

— “দুই ভাইবোনের মাঝে উনি ছোট। বড় ভাই পি.এই.ডির জন্য আপাতত জার্মানি আছে। আমার বাসার পেছনের যে দো’তলা বাড়িটা দেখছেন এটা উনার ফুফুর বাড়ি। তার পাশের বাড়িটা ছোট চাচার। উনার জন্ম, বেড়ে উঠা সব এখানেই। এলাকার পুরোনো বাসিন্দা সবাই উনাদের চেনে। এস.এস.সি কমপ্লিট করেছে ভিকারুননিসা থেকে। এইচ.এস.সি শেষ করেছে টাঙ্গাইল থেকে।’

— “কুমুদিনী কলেজ?”

— “না, ভারতেশ্বরী হোমস। ব্রাইট স্টুডেন্ট, মানুষ হিসেবেও চমৎকার। বেশ সহজ স্বভাবের। এলাকার মুরুব্বিদের ভাষায় লক্ষ্মী বাচ্চা। ছোটবেলায়ও কখনো খেলতে গিয়ে কারো সঙ্গে ঝগড়া করেনি, ঝগড়ার মুহূর্ত এলে নিজে চুপ হয়ে যেত। বিকেলে খেলার সময় উনার বাবা খাওয়ার জন্য হাতে কিছু দিলে সব বান্ধবীদের সঙ্গে ভাগ বাটোয়ারা করে খেত। হাসি ছাড়া কখনো কেউ কথা বলতে দেখেনি। এলাকার কুকুর বিড়ালদেরও প্রিয় মুখ উনি। প্রতিদিন রাতে বাড়ির পাশে খাবার রেখে দেয় ওদের জন্য আলাদা করে। উনার দেখাদেখি এলাকার অনেক

ছেলেমেয়েরাও যার যার বাড়ির পাশে খাবার রাখে।”

— “কাইন্ড হার্টেড! ওর মাঝে এখনো চাইল্ডিশ বিহেভিয়ার আছে। গত পরশু দেখলাম পেছনের বাড়ির ছাদে দুটো বাচ্চা নিয়ে হৈ হুল্লোড় করছে। বোধহয় বাচ্চা দু’টো ওর কাজিন।”

— “না। কাজিনের বাচ্চা ওরা।”

— “আচ্ছা! যাই হোক, এই বয়সী মেয়েরা সাধারণত এভাবে ছুটোছুটি করে খেলে না। বাচ্চামি করা মানুষগুলো হয়তো একটু বোকা হয় কিন্তু জটিলতা নেই। কাইন্ড হয় খুব!”

— “পুরো বাসার মানুষ ভালো। এলাকা জুড়ে কোথাও ওদের চারজনের নামে একটা বাজে কথাও শোনা যায়নি। উনার ভাইটাও বোনের মতোই। আন্টিও সহজ সরল। উনাদের বাসা থেকে কখনো কোনো মিসকিন খালি হাতে ফেরে না। মাসে অন্তত একদিন দুপুরে পাঁচ-দশজন গরীব ডেকে রীতিমতো পোলাও-কোর্মা রেঁধে মেহমানদের মতো আপ্যায়ন করেন উনি। কেউ বিপদে পড়লেও যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করেন। এই এলাকায় অনেক ফ্ল্যাট পাবেন বহুদিন ধরে ভাড়া হচ্ছে না, কিন্তু শরীফ আংকেলের বাড়ি কখনো খালি হয় না। ভাড়াটিয়ারা বাসা ছাড়তে চায় না। কম ভাড়ায় ভালো ফ্যাসিলিটি পায় সবাই, উনাদের আচরণও অসম্ভব রকমে অমায়িক। শরীফ আংকেল বাংলাদেশ ব্যাংকের জয়েন্ট ডিরেক্টর ছিলেন রিটায়ার্ড করেছেন তিন বছর হলো। সেখানেও উনার বেশ সুনাম। মোটকথা একেবারে নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার। কোথাও কোনো স্ক্যান্ডেল কিংবা ঝামেলার মাঝে এদের কাউকে পাওয়া যাবে না।”

হাসলো রুদ্র। বললো,

— “উপরওয়ালা কখনো কাউকে ঝামেলাহীন জীবন দেয়নি। দিবেও না। একটা না একটা ঝামেলা কাঁধে ঝোলাবেই।”

রুদ্রের কথার ইঙ্গিত বুঝে ফেললো শুভ। নিঃশব্দে মাথা দুলিয়ে হাসলো সে।

— “ঝামেলায় জড়াতে জড়াতে আমি নিজেই আপাদমস্তক একটা ঝামেলা হয়ে গেছি। এত ডিসেন্ট ফ্যামিলিতে এমন বদের হাড্ডি জামাই জুটছে, যার জীবনের মূল কাজই হলো ঝামেলা লাগানো আর ছুটানো। উপরওয়ালার হিসেব নিকেশ বোঝা বড় দায়! আমাকে জানার পর হয়তো ভদ্রলোক কোনো এক জুম্মাবারে মসজিদে বসে বসে হিসেব কষবে, কী এমন করেছিলাম যে এমন একটা পাত্ৰ আমাদের ঘরে এনে ঢুকালে মাওলা?”

অট্টহাসি হেসে উঠলো উপস্থিত চারজনই। রুদ্রকে ওভাবে সচরাচর হাসতে দেখা যায় না। ভালো লাগছে শুভর রুদ্রকে দেখতে। শুনেছিল, একটা সময় এই মানুষটা ভীষণ রসিক মেজাজের, সদা হাস্যোজ্জ্বল ছিল। মা বলে, মেয়েরা নাকি পুরুষের জীবনে লক্ষ্মী। নিজের কর্মগুণে জীবনসঙ্গীর ভাগ্যদুয়ার খুলে দেয়। যত্নে পুরুষকে গড়ে দেয়। সুরভীও কি তবে আসার আগেই প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে রুদ্রের উপর?

— “এবার ওর বয়ফ্রেন্ডটাকে নিয়ে কিছু বলো তো?”

— “বয়ফ্রেন্ডের খোঁজ আলাদা করে নেইনি। ভেবেছিলাম এখানে আর কিছুই হবে না, তবে মালটাকে নিজ চোখে দেখে এসেছি আমি। দুপুরে শিশির আর আমি এক সঙ্গেই ছিলাম ওদের ঠিক পেছনের টেবিলে।”

— “আজ মিট করেছিল ওরা?”

— “হ্যাঁ। নেক্সট উইক পালিয়ে বিয়ে করবে, সে খবর তো ওখানেই জেনে এলাম।”

— “আচ্ছা, খোঁজ নাও। ওর ফুল ইনফরমেশনও প্রয়োজন। ইনফরমেশন ছাড়া কোন পাছায় লাথিটা মারতে হবে সেটা বোঝা যাবে না।”

— “ইনফরমেশন নাহয় নেয়া যাবে। তবে চোখে মেপে যা বুঝলাম ছেলে সুবিধার না।”

— “কেমন?”

— “কথা শুনে মনে হচ্ছিল চিটার। শিশির আর আমার দু’জনেরই মনে হলো। থাকে না কিছু পুরুষ, বউয়ের কাছ থেকে টাকা নিতে পছন্দ করে?”

— “হুম।”

— “ঐ ধাঁচের।”

— “সুরভীর কাছে টাকা চেয়েছে?”

— “টাকা চায়নি, টাকা নিয়ে হা হুতাশ করছিল। সেলারী হয়নি, বাবার ট্রিটমেন্টে প্রায় সব সেভিংস খরচ হয়ে গেছে। বিয়ের খরচটা আপাতত উঠানোর মতো এ্যাবিলিটি তার নেই।”

— “তাহলে বিয়ে হবেটা কিভাবে?”

— “সুরভী খরচ করবে। ওর সেভিংস আছে কিছু। সেসব নেবে পালানোর সময়, সঙ্গে গোল্ডও নেবে।

— “সর্বনাশ! এ তো দেখছি অন্ধ প্রেম।”

— “হ্যাঁ। এমনকি খাবারের বিলটাও সুরভীই দিলো।”

— “কিছু করে নাকি ও? পার্ট টাইম জব বা টিউশনি?”

— “টিউশনি করায় দু’টো।”

— “টিউশনের টাকা দিয়ে বয়ফ্রেন্ড পালে, তাই তো?”

— “তেমনই মনে হলো। ছেলেটাকে এক দেখাতেই মনে হয়েছে সুবিধার না। আপনি দেখলে বুঝতে পারবেন। যাই হোক, খোঁজ নেই। সঙ্গে একটা ছবিও কালেক্ট করে দিচ্ছি। প্রয়োজনে ওকে ধরে নিয়ে আসবো।”

— “ঐ ছেলের ভালো গুণে আমার মিনিমাম ইন্টারেস্ট নেই। খুঁজে খুঁজে খারাপগুলো বের করো। যত খারাপ অভ্যেস বেরোবে, তত আমার জন্য সুবিধা। শিশির এখনো ফলো করছে না সুরভীকে?”

— “হ্যাঁ।”

— “কল দাও। জিজ্ঞেস করো, বাসায় ফিরেছে কি না?”

— “ফিরেছে হয়তো! বিকেলের দিকে রেস্টুরেন্ট থেকে সোজা স্টুডেন্টের বাসায় চলে গিয়েছিল। এই তো ৪ নাম্বার গলিতে। এতক্ষণে ফিরেছে বোধহয়!”

— “মাগরিবের সময়ও আমি চেক করলাম। ওর ঘরের বাতি নেভানো ছিল তখনও।”

— “আচ্ছা আমি দেখছি।”

ততক্ষণে তর সইলো না রুদ্রের। নিজেই উঠে গেল বারান্দায়। ঘরে বাতি জ্বলছে। সুরভী ফিরেছে। একটা গোলাপী গেঞ্জি আর কালো প্লাজো পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে ও। কোমর সমান লম্বা চুল ওর। রুদ্রের মনে পড়ে গেল গতরাতে চোখে মুখে লেগে যাওয়া ওর চুলের ঝাপটা। গা শিউরে উঠলো তার। ঠিক সেই অনুভূতিটাই পুরো গায়ে খেলছে! কেউ নেই তার আশপাশে, সুরভীও একা। দু’জনের মধ্যবর্তী এই দূরত্বটাকে ঠিক দূরত্ব মনে হলো না রুদ্রের। মনে হচ্ছে যেন, সুরভী তার সামনে দাঁড়ানো, একদম কাছাকাছি। নাকের ডগায় সেই শাওয়ার জেলের ঘ্রাণ ভেসে আসছে বুঝি! এবার আর সুরভীকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে ইচ্ছে হলো না ওর। থাকুক কিছুক্ষণ। মস্তিষ্কের ভেতর, শরীরের প্রতিটা লোমে লোমে গাঢ় অনুভূতি হয়ে।

১২

কলেজে এসেছে সুরভী। গতকালের মতো আজও শুভকে সঙ্গে নিয়ে ওর পিছু পিছু চলে এসেছে রুদ্র। আজ আর সুরভী ক্লাসে চলে যাওয়া মাত্র বাসায় ফিরে যায়নি রুদ্র। বিয়ের প্ল্যান আছে নেক্সট উইক। হয়তো আজও প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করবে। জরুরি কোনো আলাপ সারবে কিংবা টাকা পয়সা প্রেমিকের হাতে ধরিয়ে দেবে! ওর প্রেমিকটাকে একবার সামনাসামনি দেখার বড় সাধ হলো রুদ্রের, তাই বসে আছে সে সুরভীর অপেক্ষায়, কলেজের অপর প্রান্তে আজিমপুর কলোনীর ভেতর। কলেজ গেটের ঠিক বাইরেই বসিয়ে এসেছে শিশিরকে। সুরভী বের হওয়া মাত্র কল করবে তাকে। এদিকে বড় একটা আমগাছের গোড়া সিমেন্টের ঢালাইয়ে চওড়া করে পাকা করা। তারই উপর বসে ব্যক্তিগত আলাপ চলছিল রুদ্র আর শুভর। আশপাশে যাতায়াতরত মানুষেরা সন্দেহের নজরে দেখছে ওদের। মুখে মাস্ক, চোখে কালো চশমা পরে দু’টো লোক এভাবে গাছতলায় বসে নিচুস্বরে গল্প করছে! অনেকটা সময় বাদে দু’জন লোক এগিয়ে আসছিল ওদেরই দিকে। দূর থেকে রুদ্র, শুভ খেয়ালও করলো তাদের। উদ্দেশ্য কী, তা-ও ঠিক বুঝে নিল। মনে মনে উত্তরও গুছিয়ে নিচ্ছিল ওরা। কিন্তু তার ঠিক আগ মুহূর্তেই কল চলে এল শিশিরের।

শুভ রিসিভ করতেই শিশির ওপাশ থেকে জানালো, “উনি বের হয়ে গেছে। কলেজের বাইরে বয়ফ্রেন্ডও চলে এসেছে, রিকশা পেলেই উঠে পড়বে।” শুভ ছুটতে লাগলো। শুভর পিছুপিছু রুদ্রও দৌড়াতে লাগলো। লোক দু’টো হতভম্ব হয়ে ওদের দৌড়ে পালানো দেখলো। এভাবে দৌড়াতে দেখে তারা ধরেই নিলো মাস্কধারী লোক দু’টোর উদ্দেশ্য ভালো না, ধরা পরার ভয়েই এভাবে পালিয়েছে। মসজিদের মাইকে এনাউন্স করে এলাকাবাসীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিতে হবে।

কলোনীর গেট দিয়ে বের হতেই রুদ্র, শুভ দু’জনেই দেখলো সুরভী ঠিক উল্টোদিকেই দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্র দাঁড়িয়ে পড়লো সেখানেই। পাশের ছেলেটাই কি তবে ওর প্রেমিক? পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো রুদ্র। খানিকবাদেই শুভ এল গাড়ি নিয়ে। ততক্ষণে সুরভীরাও রিকশায় উঠে বসেছে। একটু পরেই রিকশার হুড উঠে গেল। ছেলেটার হাত দেখা গেল সুরভীর পিঠ জড়ানো অবস্থায়। মুহূর্তেই চোয়াল শক্ত হলো রুদ্রের। শুভ আড়চোখে একবার দেখলো রুদ্রকে। ঠিক যেমনটা ভেবেছিল সে- প্রচন্ড রাগে কপালের দু’পাশের রগ স্পষ্ট হয়েছে রুদ্রের। চাইলেই ছেলেটাকে এখনি রিকশা থেকে ধরে আনা যায় কিংবা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে কল করে সামনের সিগনালেই ট্রাফিক দিয়ে কোনো অযুহাতে তাকে বেদম পিটুনি খাওয়ানো যায়। কিন্তু আপাতত সেসব সমীচীন মনে হলো না শুভর। রুদ্রকে সামলানোও জরুরি। তৎক্ষনাৎ গাড়ি ঘুরিয়ে ফেললো সে। আর যাবে না সুরভীর পিছু। রুদ্রও বুঝে নিলো গাড়ি ঘুরিয়ে নেবার কারণ। অনেকটা সময় দু’পক্ষই চুপচাপ থাকার পর রুদ্র মুখ খুললো,

— “এই ছেলেটার ইতি বৃত্তান্ত চেয়েছিলাম।”

— “যোহর নাগাদ খবর চলে আসবে।”

বাসায় ফিরে রুমের দরজা লক করে পড়ে রইলো রুদ্র। অসহ্য লাগছে সবকিছু। পরশু রাত থেকে অদ্ভুত ভালো লাগায় মনটা ছেয়ে ছিল, তার কিচ্ছু অবশিষ্ট নেই আপাতত। হিংসায় পুঁড়ছে সে। তার একান্ত ব্যক্তিগত মানুষটাকে ওভাবে কেউ ছুঁয়ে দিলো তারই সামনে, এই দৃশ্য মেনে নেয়া অসম্ভব! সুরভী তার। শুধুমাত্র তার। পরশু রাত থেকে সুরভীকে যতটা না নিজের মনে হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি অধিকার খাটিয়ে নিজের বলে দাবি করতে ইচ্ছে করছে আজকের ঐ মুহূর্ত থেকে। সেই থেকে যন্ত্রণাও হচ্ছে ভীষণ। ইচ্ছে করছে সুরভীকে এক্ষুনি, এই মুহূর্তে তুলে এনে ওর সারা গায়ে ছুঁয়ে দিতে। তার হাতের স্পর্শে পুরোনো সব স্পৰ্শ মুছে দিয়ে নিজের একচ্ছত্র অধিকার খাটাতে। অথচ সম্ভব না! একদম না। সুরভীকে এখনই জোর করে তুলে আনা সম্ভব না, সেই সীমাবদ্ধতাটুকু যেন সারা গায়ে হুল ফোঁটাতে লাগলো। ক্রোধে অন্ধ হয়ে পারফিউমের বোতল ছুঁড়ে মারলো ড্রেসিং টেবিলের উপর।

ভেতর থেকে বিকট শব্দে গ্লাস ভাঙার আওয়াজ পেলো শুভ, সুমন আর মেজবাহ। সুমন, শুভকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— “শেষবার ভাই ভাঙচুর করেছিল অফিসে। মনে আছে আপনার?”

— “ঐ ঘটনা ভুলি কেমন করে! উনার শান্ত হতে সময় লেগেছিল বেশ কয়েকদিন।”

— “দেড়বছর পর আবার ভাঙচুর! এবারে শান্ত হবে কতদিনে, কে জানে?” গালে হাত দিয়ে বসে রইলো শুভ। সঠিক সময়ের আগে সমাধানও সম্ভব না। অপেক্ষা করা ছাড়া আপাতত আর কিই বা করার আছে?

অনেকটা সময় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো রুদ্র। এক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল ভাঙা কাঁচের টুকরার দিকে। চোখের সামনে থেকে সরছিলই না সেই দৃশ্য। কল এল তার মোবাইলে, তখনি দেয়াল ছেড়ে খাটের গায়ে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসলো

সে। লন্ডন থেকে কল এসেছে। কলটা রিসিভ করে, সিগারেট ধরালো রুদ্র। শান্ত হতে হবে তাকে!

— “হুম। খবর কতদূর?”

ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট থাকার দরুন অস্পষ্ট শোনালো রুদ্রের কথা। তবুও স্পষ্ট বুঝে নিলো জামিল- রুদ্রের পুরোনো গুপ্তচর। রুদ্র রাজনীতিতে পা রাখার পর থেকেই কাজ করছে তার জন্য। ছেলেটা কাজ করতো আগে সি আই ডি-তে। ভীষণ চতুর আর বিশ্বস্ততার গুণ দেখেই তাকে সেখান থেকে সরিয়ে এনেছে রুদ্র। বিভিন্ন দেশে এমন বারোজন সদস্য ছড়িয়ে আছে তার। তাদের মাঝে জামিল একজন। মূলত লন্ডনে থিতু হলেও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বিশ্বস্ত সব কাজ সামলে নেয়াই জামিলের কাজ। রুদ্রের ফরমায়েশ অনুযায়ী অদিতির সমস্ত খোঁজ নিয়েছিল সে। সেই খবর জানাতেই কল করেছে সে।

— “অল ডান।”

— “বলতে থাকো।”

— “এতদিন ছিল খালার বাসাতেই, কিন্তু এখন আলাদা থাকছে। খালার বাসা থেকে প্রায় দুই কি:মি: দূরে একটা অ্যাপার্টমেন্টে আজগর সাহেব ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন ওকে। সেখানে একাই থাকছে এখন।”

— “হুম।”

— “তবে মাঝেমধ্যে দু’জনও থাকে। আই মিন বয়ফ্রেন্ড। যতটা বোকা, চুপচাপ, ভাজা মাছ উল্টে খেতে না পারা টাইপ লুক সে পুরো দুনিয়াকে শো করে, আসলে সে ততটাও ভদ্র না। বয়ফ্রেন্ড আছে দু’জন। একটার সঙ্গে কমিটেড। সে ইন্ডিয়ান। বেশ বনেদী পরিবারের ছেলে। অন্যটা ওর ছুটা বয়ফ্রেন্ড। এই মহাশয় আবার আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলে। এখানে পড়াশোনা করতে এসে খাতির হয়েছে ওর সঙ্গে। দু’জনের সঙ্গেই ও ফিজিক্যালি এটাচড।”

— “হাহ্” আওয়াজ তুলে ম্লান হাসলো রুদ্র। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জানতে চাইলো.

— “ওর প্রেমিকেরা জানে এই খবর?”

— “ওর রিয়েল বয়ফ্রেন্ড জানে না। তবে আমাদের মন্ত্রী সাহেবের ছেলে সব জানে।

— “ “কী নাম যেন ছেলেটার?”

— “ইমরান।”

— “ওটা একটা ছাগল জন্ম নিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘরে! বাংলা উচ্চারণটা পর্যন্ত স্পষ্ট করে করতে পারে না। ওকে আমার পুরুষ ভাবতেই ইচ্ছে করেনি কখনো। যাক, ড্রাগসের অভ্যেস আছে?”

— “না। এছাড়া আর কোনো সমস্যা দেখিনি। মন দিয়ে পড়ালেখা করছে। সবসময় হাসিখুশি থাকছে, বয়ফ্রেন্ড দু’জনকেই খুশি রাখছে। মাসে এক দুইবার ফ্রেন্ডদের সঙ্গে গোটা দিনের জন্য কোথাও বেড়াতে চলে যাচ্ছে। এই তো! বেশি সুখী জীবনযাপন ওর। বয়ফ্রেন্ড ইস্যুটা ছাড়া চোখে পড়ার মতো আর কিছু নেই।”

— “আচ্ছা, দেখছি আমি।”

কল কেটে, খাটের উপর মাথা কাত করে ফেলে রাখলো রুদ্র। খুব সহজ একটা চাল একদম চোখের সামনেই আছে। জামিলের বয়ফ্রেন্ড সম্পর্কিত ইনফরমেশনের মাঝেই আছে ষষ্ঠ ইন্দ্রীয় বারবার সে কথা বারবার জানান দিচ্ছে। অথচ ঠিক ধরতে পারছে না সে। মাথা কাজ করছে না একদম। অদিতির জায়গায় বারবার সুরভী চলে আসছে। পিঠের উপর হাত রাখার দৃশ্যটা চলে আসছে। মেজাজ হারানোর সঙ্গে সঙ্গে মস্তিষ্ক শূন্য হবার এই মুহূর্তটা আলাদারকমে পীড়া দিতে লাগলো তাকে। শান্তি চাই তার। এক্ষুনি, এই মুহূর্তে। শেষবার তার বিক্ষিপ্ত মন সুরভী স্বপ্নে এসে শান্ত করেছিল। সুখের ভেলায় ভাসিয়ে স্থির করেছিল তার মন। এবারও সুরভীকেই করতে হবে। চোখ বুজে রুদ্র সেই স্বপ্নে আবার ডুব দিলো। একদম প্রথম থেকে স্মৃতিচারণ করতে লাগলো সুরভীর সঙ্গে তার বিশেষ মুহূর্তটার।

১৩

শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। শান্ত এবং স্থির। এখানে দাঁড়িয়েই আজগরের সঙ্গে পুরো খেলার ছকটা কষে নিয়েছে সে। সুরভীর প্রেমিকটাও আর পীড়া দিতে পারছে না তাকে। সুরভীর বাহুডোরে নিজেকে অনুভব করতেই মনে হলো এই মেয়েটা তার। শুধুই তার। দিন শেষে সুরভী তার হয়েই রয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো পুরুষ ওকে পাবে না। নিজেকে শান্ত করার জন্য এতটুকু যথেষ্ট ছিল। শাওয়ার অফ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল, মুখ মুছে নিচ্ছে সে। নিজেকে দেখতে দেখতে মনে হলো, শুধু স্বপ্ন কিংবা কল্পনার অনুভূতিতেই যদি একজন মেয়ে তাকে এতখানি স্বস্তি দেয়, তার অস্থির সত্তাকে স্থির করে, সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে কয়েকশো মাইল দূরে সরিয়ে আনতে পারে, তবে সত্যিকারের বাহুবন্দী যেদিন হবে সেদিন কতটা স্বস্তি দেবে ও? সে কথা মনে পড়তেই আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না রুদ্র। আধভেজা শরীরে কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়ে এল সে। ততক্ষণে ঘর সাফ হয়ে গেছে, ভাঙা ড্রেসিং টেবিল সরিয়ে নেয়া হয়েছে। রুদ্রের ফরমায়েশ অনুযায়ী টাকা নিয়ে সুমন বেরিয়েও গেছে ড্রেসিং টেবিল আনতে। ডাইনিং রুমে

শুভ আর মেজবাহ তখন দুপুরের খাবার সাজাতে ব্যস্ত। একটা চেয়ার টেনে সেখানে বসে পড়লো রুদ্র

শুভ আর মেজবাহকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— “এশার নামাজের সময় পুরো এলাকার ইলেক্ট্রিসিটি আমি অফ চাই। রাস্তার একটা ল্যাম্পপোস্টও যেন না জ্বলে।”

— “জি ভাই” বলে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলো দু’জনই।

— “শুভ, তুমি আর আমি ঐ সময়টায় সুরভীর বাসায় যাচ্ছি।”

রুদ্রের আবদারে এক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে গেল শুভ। সঙ্গে সঙ্গেই সে আবার মাথা দুলিয়ে রুদ্রের এই কথায়ও সায় দিলো। রুদ্র আর কিছু বলছে না। শুভ ভেবেই নিলো আজই সুরভীকে বাসা থেকে বের করে আনা হবে। তার পরবর্তী গন্তব্য কোথায় হবে জানতে চাইলো শুভ।

— “উনাকে নিয়ে তারপর কোথায় যাবো? আপনার বাসায় নাকি অন্য কোথাও?”

— “যাবো কেন? ওকে উঠাতে যাচ্ছি না। একটু প্রয়োজন আছে আমার।”

— “ওহ্!”

ক্ষীণ হলো শুভর স্বর। মেজবাহ চেয়ে আছে তারই দিকে। রুদ্রের প্রয়োজনটা ঠিক কী ধরণের হতে পারে, বুঝতে বাকি রইলো না কারো। একটুখানি গভীরেই ভাবনা চলে যাচ্ছে তাদের।

শুভ আর মেজবাহর মুখ দেখে তাদের মনে চলমান ধারণা স্পষ্ট বুঝে নিলো রুদ্র। হাতের ভাঁজে থাকা সিগারেটটা ঠোঁটের ভাঁজে নিতেই শুভ পকেট থেকে লাইটার বের করে জ্বালিয়ে দিলো।

নিকোটিনের ধোঁয়া উড়িয়ে দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো,

তোমরা যতখানি ভাবছো তেমন কিছুই না। আই নো মাই লাইনস, এ্যান্ড আই ওন্ট ক্রস দ্যাট!”

হেসে ফেললো শুভ।

— “যে যেমন অন্যদের তেমন ভেবে নেয়াই স্বাভাবিক। পুরো এলাকার ইলেক্ট্রিসিটি অফ করে হবু বউয়ের বাসায় যাবো অথচ একটু লিমিট ক্রস করবো না সেটা অন্তত আমাদের দিয়ে হবে না। লিমিট আমরা ক্রস করতামই।”

শুভর উত্তরে মুখে হাত চেপে হেসে ফেললো মেজবাহ্ত্ত। ডানে-বামে মাথা দুলিয়ে মুচকি হাসিতে রুদ্রও তাকালো দু’জনের দিকে।

— “ভাই, ঐ ছেলেটার ব্যাপারে সব খোঁজ নেয়া শেষ।”

— “অদিতির ব্যাপারেও।”

— “জামিল ভাই কল করেছিল?”

— “হ্যাঁ। ওটার ছক কষা শেষ। তুমি ঐ ছেলের খবর বলো।”

— “নাম আসিফ। পড়াশোনা বাদ দিয়েছে আরো বছর তিনেক হলো। গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেনি। ভবঘুরে। কখনো-সখনো শখ করে এলাকার ছেলেদের সঙ্গে মিলে সিদ্ধি সাধনও করে, তবে রেগুলার না। বাবা-মা দুজনই সরকারী চাকরি করে। সুরভী জানে না ও পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছে কিংবা ও আসলে চাকরি বাকরি কিছুই করে না। অন্য মেয়েদের নেশাও নেই। জীবনে নারী বলতে একমাত্র সুরভীই। ক্লাস টেন থেকে প্রেম ওদের। একই কোচিংয়ে পড়তো, সেখান থেকে আলাপ। সুরভী জান-প্রাণ দিয়ে এই ছেলেটার পেছনে পড়ে আছে কারণ ও চায় ছেলেটা জীবনে ভালো কিছু করুক। নিয়মিত ছেলেটা ওকে নিজের দুঃখগাঁথা শুনিয়ে মানসিকভাবে কাবু করে রাখে।”

— “কেমন দুঃখগাঁথা?”

— “ওর বাবা অসুস্থ। চাকরিটা আর নেই। মায়ের একার ইনকামে বাসা ভাড়া সংসার চলে না। বোনের খরচ তাকে উঠাতে হচ্ছে। টাকা-পয়সার ভীষণ টানাটানি। সুরভী লয়্যাল। বিবেক প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই কাজ করে। বয়ফ্রেন্ডের খারাপ সময়ে ছেড়ে চলে আসা ওর মতো মানুষকে দিয়ে সম্ভব না। প্রতিমাসে বেতনের অর্ধেক টাকা এই ছেলের পকেটে ঢোকে। তারপর সেই টাকা উড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ছেলেটা আমোদ-ফূর্তি করে আর সুরভীর বোকামি নিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। থাকে না কিছু মেয়ে, একটা পুরুষের জীবন গুছিয়ে দেয়ার জন্য সবকিছু করে ফেলে, গোছানোর আগ পর্যন্ত থামে না- সুরভী সেরকম একজন। কিন্তু ভুল জায়গায় এতবছর নিজের ইমোশন, সময়, টাকা পয়সা সব নষ্ট করছে আর কি!”

— “মেয়েটার রুচি খুবই খারাপ শুভ! আমি ছেলেটাকে দেখার পর দুই সেকেন্ড নাম্ব ছিলাম। ওর মতো মেয়ে এমন একটা ছেলের সঙ্গে কেন ঘুরবে? ওকে দেখেই বোঝা যায় ক্লাসলেস ফালতু একটা ছেলে! ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস আর ক্লাসলেস হবার মাঝে তফাৎ আছে। ওকে দেখে আমার একবারও মনে হয়নি ও কোনো ক্রাইসিসে আছে। মনে হয়েছে, একটা ফালতু, ম্যানারলেস ছেলে। রুচি খারাপ না হলে, দেখেশুনে ২২-২৩ বছর বয়সী একটা শিক্ষিত মেয়ে এর মতো ছেলের সঙ্গে কিভাবে ঘুরবে!”

— “ছোটবেলার প্রেম তো! মায়া বসে গেছে হয়তো। তাই ছাড়তে পারে না।”

— “ছুটাচ্ছি প্রেম! রাতে ওটাকে অফিসে নিয়ে এসো। আজকেই ওর হিসেব শেষ করছি।”

— “হয়ে যাবে।”

— “অদিতির ব্যাপারটা কী হলো?”

— “লাঞ্চের পর রুমে এসো। বলছি।”

১৪

রুদ্রের হিসেব মোতাবেক এশার আজানের পরপরই নামাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে সুরভীর বাবা। বাসায় রইলো শুধু সুরভী আর ওর মা। মেজবাহ আর সুমন দাঁড়িয়ে আছে বাসার নিচে। সুরভীর দরজা বরাবর দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। তিনতলার সিঁড়ি ঘরে সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে শুভ। তার সঙ্গে লাইনে আছে বিদ্যুৎ অফিসের লোক। কে দরজা খুলবে জানা নেই রুদ্রের। সুরভীর মা-ও দরজা খুলতে পারে। তবুও এই ঝুঁকিটা নিলো রুদ্র। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে সুরভীই দরজা খুলে বেরোবো। বাসার কলিংবেল চেপেই একপাশে সরে দাঁড়ালো রুদ্র। হালের জনপ্রিয় ইংরেজি গানের সুর গুনগুন করতে করতে এদিকে আসছে একজন। শুভকে ইশারা করলো রুদ্র। সুরভীই আসছে। ছিটকিনি খোলা মাত্র কারেন্ট চলে গেল পুরো এলাকার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো পুরো এলাকাবাসী। সুরভী তৎক্ষনাৎ হাতে থাকা মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে দরজার বাইরে ধরলো। চোখের পলকে সুরভীর হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলো রুদ্র। অন্য হাতে সুরভীর দুই হাতসহ শক্ত করে জড়িয়ে বুকের মাঝে আটকে রাখলো কয়েক সেকেন্ড। চুল থেকে ভেসে আসছে শ্যাম্পুর ঘ্রান। ওর চুলে এক মুহূর্তের জন্য নাক ডোবালো রুদ্র। চোখ বুজে, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। নেশা ধরে যাচ্ছে তার। মন লাগামহীন হবার আগে, আরো কিছু করে বসবার আগেই বুকের মাঝখানে ছটফট করতে থাকা সুরভীকে ছেড়ে দিলো রুদ্র।

সিঁড়ির দিকে পা বাড়িয়েও আবার ফিরে এল রুদ্র। সুরভী এখনো হতভম্ব হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর দুই বাহু ধরে কাছে টেনে মাথার উপর চুমু খেয়েই এক দৌড়ে শুভকে নিয়ে নিচে নেমে এল সে। এতক্ষণে উপর থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছে। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মা’কে ডাকছে সুরভী। মুখ হাত চেপে ফিক করে হেসে উঠলো দু’জনই।

দৌড়ে সুরভীর বাসার সীমানা পেরোতে পেরোতে রুদ্র শুভকে বললো,

— “এতক্ষণে গাধা মেয়েটার হুঁশ ফিরেছে।”

— “সাবধান! বিয়ের পর এসব গাধা-টাধা বলা যাবে না একদম। আপনার মগজ কলিজা সব চিবিয়ে খেয়ে নেবে। পারসোনাল এক্সপেরিয়েন্স থেকে বলছি।”

— “যেই মেয়ে বাটপার বয়ফ্রেন্ডের জন্য বাসা থেকে গোল্ড নিয়ে পালাবার মতো ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, সেই মেয়ে আর কতটুকু মগজ কলিজা খাবার ক্ষমতা রাখে, নিজেই একটু আন্দাজ করে নাও না!”

— “তা ঠিক!”

— “বিদ্যুৎ অফিসে কল দাও। ইলেক্ট্রিসিটি অন করতে বলো। আর মেজবাহকে দিয়ে উনার পেমেন্টটা পাঠিয়ে দাও।”

— “মেজবাহর হাতে টাকা দেয়া আছে, কারেন্ট আসা মাত্র ও অফিসে গিয়ে দিয়ে আসবে।”

— “লোক পাঠিয়েছো আসিফের ওখানে?”

— “হ্যাঁ আধঘন্টার ভেতর অফিসে হাজির হবে।”

— “গাড়ি বের করো, টাকা রেডি আছে না?”

— “জি ভাই।”

বাইরেই দাঁড়িয়ে রইলো রুদ্র। দুই মিনিট বাদেই পুরো এলাকার ইলেক্ট্রিসিটি ফিরলো। শুভ গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে করতে একবার সুরভীর বারান্দায় তাকালো রুদ্র। এখান থেকে শুধু ঐ বারান্দা, আর রশিতে ঝোলানো কাপড়গুলোই শুধু দেখা যায়, ঘরের ভেতরটা না। নিজের বুকে একবার হাত বুলালো রুদ্র। শান্তি লাগছে ওখানটায়। বুকের মাঝখানে ওকে বেঁধে রাখার পর থেকে যেন সমস্ত শক্তি ফিরে এসেছে। এলোমেলো হিসেবনিকেশগুলো মাথার ভেতর সহজ হয়ে আসছে। বাবা সবসময় সবাইকে বলে বেড়াতো- ফেরদৌসী আমার পাওয়ার হাউজ। আমার সমস্ত ক্লান্তি, জড়তা, সলিউশন খুঁজে না পাওয়া সবকিছু ওর কাছে এসে ঘুচে যায়। বাবার সমস্ত দায়িত্ব ভাগ্যজোরে তার কাছে এসেছে। তবে বাবার মতন জীবনসঙ্গীও কি ভাগ্যজোরে তার হবে?

ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটলো রুদ্রের। পাশেই গাড়ি এসে থামলো। সুমন দ্রুত এগিয়ে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালো। গাড়িতে চড়ে বসার সময়ও রুদ্রের চোখ আটকে রইলো সুরভীর বারান্দায়।

*****

রুদ্রের অফিসে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে আসিফ। এলাকায় এক বন্ধুর বাড়ির ছাদে বসে গাঁজার আসরে সুখটান নিচ্ছিল সে। প্রতিটানে একটু একটু করে অন্য দুনিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছিল। তখনই কোথা থেকে ছয় সাতজন লোক এসে পিস্তলের মুখে তাকে তুলে এনেছে এখানে। এটা কোথায়? ডিবি অফিস? এরা কি ডিবির লোক? সামান্য গাঁজার কারণে এভাবে তুলে আনবে তাকে? ড্রাগ ডিলারও তো সে নয়! শুধু মাঝেসাঝে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে একটুখানি ফূর্তির ছলে গাঁজার আসরে শরীক হয়। এ আসরে আরো তো বন্ধু বান্ধব ছিল, কই তাদের তো ধরা হলো না। শুধু তাকেই কেন? মন থেকে ভয় কাটছে না, মাথা থেকে প্রশ্ন দূর হচ্ছে না। জীবনে এবারই প্রথম এতটা ভয় লাগছে! কী আছে আজ তার ভাগ্যে? ছোটবেলায় হুজুর বিপদে পড়ার দোয়া শিখিয়েছিল। পড়া হয়নি কখনো। চর্চার অভাবে ভুলে গেছে সেই দোয়া ছোটবেলাতেই। শত চেষ্টায়ও কোনো সুরা, দোয়া কিচ্ছু মনে এল না। মনে আছে যা সৃষ্টিকর্তার এক নাম! তা-ই একমনে জপতে জপতে জিহ্বা গলা শুকিয়ে ফেলছে সে।

ঝড়ের গতিতে চারজন মানুষ এসে ঢুকলো অফিসে। সামনে যে জন দাঁড়িয়ে সে আঙুলে ইশারা করলো তাকে ভেতরে যেতে। সঙ্গে সঙ্গে এখান থেকে একজন তাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ভেতরের এক রুমে। ইশারাকারী ব্যক্তিটা কে? ডিবির প্রধান? নাকি উচ্চপদস্থ কোনো অফিসার? কী করা হবে তাকে রুমে নিয়ে? রিমান্ডের পিটুনি দেয়া হবে না তো? ভয়ে, আশংকায় ওখানেই বসে পড়ল আসিফ। কান্নাকাটি জুড়ে বললো,

— “ভাই ভাই! আমি আর জীবনে গাঞ্জা টানমু না ভাই। আমারে ছাইড়া দেন ভাই। ওয়াদা করতাছি আমি জীবনেও ঐদিকে আর যামু না।”

কোনো প্রকার পাত্তাই দেয়া হলো না তাকে। এভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না দেখে পেছন থেকে আরেকজন এল। দু’জনে মিলে হেঁচড়ে তাকে নিয়ে গেল রুদ্রের কেবিনে। তার মুখোমুখি এসে বসলো রুদ্র। আসিফের মুখ বরাবর সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বললো,

— “এখনি ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। আগে কথা শোনো, বুঝো, মানো। যদি মানতে ইচ্ছে না হয় তখন নাহয় ভয় পেও।”

একটু পর পর ঢোক গিলছে আসিফ। এসিতেও কাজ হচ্ছে না। দরদর করে ঘামছে সে। রুদ্রের কথার অর্থ কিছুই মাথায় আঁটলো না তার। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো শুধু।

— “সুরভীর সঙ্গে তো বহু বছরের প্রেম তোমার, তাই না?”

উপরে নিচে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলো আসিফ।

— “চাকরি বাকরি করো না, নেশা করো, পড়ালেখারও ভবলীলা সাঙ্গ করেছো। তোমার প্রেমিকা জানে সেসব?”

— “না।”

— “কেন?”

— “জানলেই জ্ঞান দেবে। সারাক্ষণ একটা মানসিক চাপে রাখে। এটা করতে হবে, ওটা করতে হবে। তোমাকে ভালো একটা পজিশনে যেতে হবে। আমি গর্ব করে বলতে পারব আমার হাজবেন্ড অমুক প্রফেশনে আছে। আরো কত কী!”

— “তাই বলে এত এত মিথ্যা বলবে?”

— “দিনভর ক্যাচক্যাচ কান্নাকাটি শোনার চেয়ে দু’টো মিথ্যা বলে চুপ করে বসিয়ে রাখা ভালো।”

— “তোমার ভালোর জন্যই বলে।”

— “কিসের ভালো? আমার ভালো আমি বুঝি। আমার এত অফিসার হবার শখ নেই। আমি কী হবো না হবো সেটা ও কেন ঠিক করে দেবে?”

ধীরে ধীরে আসিফের ভয় কাটছে, কন্ঠ রূঢ় হচ্ছে।

সুরভীর প্রসঙ্গ টানতেই এত রূঢ় হবার কারণ কী? তাহলে কি ছেলেটার অপ্রিয় হয়ে গেছে সুরভী?

রুদ্র ভালোভাবে একবার তাকালো ছেলেটার চোখে।

— “কথা শুনে মনে হচ্ছে ব্যাপক তিক্ততা পুষে রেখেছো গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে!”

— “সারাক্ষণ জ্ঞান দিলে কার ভালো লাগবে? আমি জীবনে কী করবো না করবো সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।”

— “তো ছাড়ছো না কেন ওকে? বিয়ের সিদ্ধান্তও নিয়ে নিলে!”

— “বিয়ের সিদ্ধান্ত আমি নেইনি, ও একাই নিয়েছে।”

— “সায় তো দিচ্ছো!”

— “না দিয়ে উপায় কী? বিয়ে না করলে হাতছাড়া হয়ে যাবে।”

— “লস হয়ে যাবে?”

— “লসই বলতে গেলে প্রায়। কিছু করি টরি না। চাকরি করার ইচ্ছে নেই।

ব্যবসাপাতি করবো কিছু। কিন্তু বাসা থেকে টাকা দেবে না। সুরভী বলেছে কিছু গয়নাপাতি আছে, সেসব দেবে আমাকে ভালো একটা চাকরি হওয়ার আগ পর্যন্ত ব্যবসা করার জন্য।”

— “যাকে নিয়ে এত তিক্ততা তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে ব্যবসা করতে ভালো লাগবে তোমার?”

— “খারাপ লাগার কিছু নেই। এত বছর সময় দিয়েছি ওর পেছনে, বিনিময়ে এতটুকু ওর কাছ থেকে নিতেই পারি।”

— “তো সংসারে যাবার পর ও যখন জানবে তুমি এতসব মিথ্যা বলেছো তখন ঝামেলা করবে না?”

— “তখন বুঝে নেয়া যাবে।”

হাসলো রুদ্র। আসিফের খুঁতনি টেনে ধরলো সে।

— “আর বুঝতে হবে না খোকা! এতবছর সময় দিয়ে বড় ধন্য করেছো সুরভীকে। আর কিছুই করা লাগবে না। যত সময় দিয়েছো তার বিনিময় তোমাকে দিয়ে দিচ্ছি।”

টাকা ভর্তি ব্যাগের চেইন খুলে আসিফের সামনে রাখলো সুমন

রুদ্র বললো,

— “এখানে ৫০ লাখ আছে। এই শহর ছেড়ে, সুরভীকে ছেড়ে তুমি কালই চলে যাচ্ছো।”

স্তব্ধ হয়ে ব্যাগের দিকে তাকিয়ে রইলো আসিফ। মানুষের জীবনে মিরাকেল হয় শুনেছিল, আজ নিজের সঙ্গে ঘটে যেতে দেখছে। বিশ্বাস হচ্ছে না তার! কে এই লোক? সুরভীকে ছেড়ে যাবার বিনিময়ে এতগুলো টাকা কেন দিচ্ছে তাকে? আসিফের চোখে মুখে সন্দেহের ছাপ দেখে রুদ্র বললো,

— “তুমি টাকা গুনে নিতে পারো।”

— “আপনি এতগুলো টাকা কেন দিচ্ছেন আমাকে?”

— “সুরভীকে নিজের জীবনের মহামূল্যবান সময় তুমি দিয়েছো, তাই!”

— “কে আপনি?”

— “আমার পরিচয় জানা তোমার জন্য জরুরি কিছু না। টাকার কথা ভেবেই সুরভীকে নিয়ে পড়ে আছো। টাকা দেয়া হয়েছে তোমাকে। সুরভী তোমাকে যা দিতো তার দশগুণ বেশি দিয়েছি। এবার সুরভীকে কল করে জানাও তুমি ওকে বিয়ে করছো না, সম্পর্ক রাখতেও তুমি ইচ্ছুক না। তুমি এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছো।”

এখনও সন্দেহ দূর হচ্ছে না আসিফের। হিসেবটাও একদম মিলছে না। স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে সবটা। রুদ্রের যা কিছু বলার সব বলে ফেলেছে সে। এখানে রাতভর আসিফের সঙ্গে বসে, তাকে আর কিছু বুঝানোর সময় কিংবা ইচ্ছে কোনোটাই তার নেই। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে।

আসিফের কপালে আঙুল ঠেকিয়ে নিজের লুকোনো রূপে ফিরলো সে,

— “টাকা গুনে, বুঝে নিয়ে বিদায় হও। আজ রাতের পর সুরভীর জীবনে তোমাকে আমি আর দেখতে চাই না। আজ রাতের মধ্যে সব মিটিয়ে না নিলে কাল সকাল থেকে তোমাকে আর কেউ কোথাও কখনো দেখবে না।”

রুদ্র – ১৫

১৫

রাত প্রায় দশটা। অফিস থেকে সোজা ইকবাল মাহমুদের বাসায় চলে এল রুদ্র। তিনিও মাত্রই বাসায় ফিরেছেন। রুদ্রকে বসিয়ে ভেতরে গিয়েছিলেন ফ্রেশ হতে। জলদি গোসল সেরে, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে রুদ্রের সামনে এসে বড্ড আয়েশে আসন পেতে সোফায় বসলেন তিনি

— “তোমাকে বললাম রাতের খাবারটা চলো একসঙ্গে খাই। শুনলে না। তুমি কখনোই আমার এখানে খাওয়া দাওয়া করতে চাও না।”

— “কারো বাসায় খেতে ভালো লাগে না আসলে!”

— “কেন যে লাগে না! আচ্ছা ফিরলে কবে তুমি? ঘুরাফেরা কেমন কাটলো?”

— “ফিরেছি গতকাল। ঘুরাফেরা দারুণ কেটেছে।”

— “সব ঠিক আছে তো, তাই না?”

— “এই সময় হঠাৎ করে চলে এলাম তাই জিজ্ঞেস করছেন?”

— “তুমি অগ্রীম খবর না দিয়ে কখনো আসো না।”

— “হ্যাঁ, একটা জরুরি কাজেই এসেছি।”

— “বলো?”

— “আমার মায়ের অবস্থা তো জানেনই। মা ছাড়া আপাতত আমার সবচেয়ে কাছের মুরুব্বি আপনিই আছেন যাকে আমি আমার ব্যক্তিগত কোনোকিছুর দায়িত্ব দিতে পারি।”

— “অবশ্যই পারো।”

— “আপনি পরশু আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাচ্ছেন।’

এক মুহূর্ত রুদ্রের দিকে অবাক চোখে চেয়ে রইলেন ইকবাল মাহমুদ। সঙ্গে চেহারায় তার আনন্দ ছটা।

স্নেহভরে জানতে চাইলেন,

— “বিয়ে করবে তুমি! ইচ্ছে হলো তবে নতুন কাউকে জীবনে আনার? প্রেম ভালোবাসা চলছিল নাকি বাবা?”

— “হ্যাঁ হলো আরকি! প্রেম-ট্রেম না। শুভর প্রতিবেশী। দেখেছি, ভালো লেগেছে। মনে হলো, ওকেই লাগবে আমার। অন্য কাউকে না।”

— “ওকেই পাবে। তোমার কাছে কে না মেয়ে দেবে? বিরোধী দলের কারো মেয়ে হলে আবার আলাদা হিসেব।”

বলে নিজেই হাসতে লাগলেন ইকবাল মাহমুদ। মুচকি হেসে রুদ্রও তার হাসিতে তাল মেলালো।

— “মেয়ের পরিবার এসব রাজনীতি থেকে দূরে। খুবই সাধারণ সাদামাটা পরিবার।”

— “মেয়ে কী করে? মেয়ের বাবা কী করে?”

সুরভীকে নিয়ে গল্প করছে রুদ্র। খুব মনোযোগে তার কথা শুনছেন ইকবাল মাহমুদ। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে শুভ দেখতে থাকলো রুদ্রকে। সুরভীকে নিয়ে বলতে গিয়ে চোখের চাহনি বলার ধরণটাই বদলে গেছে তার। যেন তার সব মনোযোগ, সমস্ত খুশির মূলবিন্দু এখন শুধুই সুরভী।

হাসলো শুভ। রাজনীতির কিংবা ব্যবসায়ের মাঠে রুদ্রের দৌড় খুব কাছ থেকে দেখেছে সে। একচ্ছত্র নায়কের মতো মাথা উঁচু করে দাপিয়ে বেড়িয়েছে সবসময়। হোক তা বিরোধীদলের সরকার আমল কিংবা নিজ দলীয়। কোনোকিছুই তাকে আটকাতে পারেনি। এবার নাহয় প্রেমিক রুদ্রকে দেখার সুযোগ হবে! দেখা যাক এই মামলায় কতখানি দাপুটে হয় সে।

১৬

— “ছয় বছরের সম্পর্ক আমাদের! এভাবে ভেঙে দিবে তুমি?”

— “আমি পারবো না তোমাকে বিয়ে করতে। আমার কাঁধে এখন অনেক দায়িত্ব। সেগুলো পালন করা আমার কাছে বেশি জরুরি।”

— “আমি কোনো আর্থিক চাপ তোমাকে দেবো না, তুমি জানো সেটা।”

— “তবুও! একজন মেয়ের দায়িত্ব নেয়া অনেক বড় একটা ব্যাপার।”

— “এমন তো কথা ছিল না আসিফ! সবকিছু ঠিক ছিল আমাদের। হঠাৎ কেন এমন করছো তুমি?”

— “আমি দ্বিধায় ছিলাম।”

— “কিসের দ্বিধা! এই কয়দিনে বলোনি তুমি একবারও।”

— “ছিলাম। বলা হয়নি তোমাকে।”

— “এখন বললে তো হবে না। তুমি…” সুরভীর কথা কাটলো আসিফ।

— “হোক বা না হোক, এটাই আমার সিদ্ধান্ত। আবেগের বশে ভুল কিছু করতে চাই না। এই মুহূর্তে এই বিয়েটা আমার ফ্যামিলি মানবে না। তাদের ছেড়ে আমি

কোথাও যেতে পারবো না। বাবা অসুস্থ। আমি চাই না এই মুহূর্তে বাবার উপর কোনো মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে।

— “আসিফ! কী বলছো, বুঝতে পারছো?”

— “বুঝেই বলছি। ভালো ঘরে বিয়ে হবে তোমার। এসব আবেগ মুছে যেতে সময় লাগবে না।”

— “এত সহজ?”

— “সহজ ভাবলেই সহজ।”

— “তোমার কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে তুমি আমাকে ভুলেই গেছ!”

— “মনে রাখার মতো পরিস্থিতি নেই সুরভী। এরচেয়ে বেশি আর কিছু ব্যাখ্যা করতে পারবো না। আমি কাল অন্য শহরে চলে যাচ্ছি। নতুন চাকরি হয়েছে আমার। তুমি আর আমার জন্য অপেক্ষা করো না। মা-বাবা যেখানে চাইছে সেখানেই বিয়ে করে নিও।”

রেগে গেল সুরভী। এতক্ষণ কাঁদছিল ও। হঠাৎ কান্না থেমে গেল ওর। চাপা স্বরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

— “পাঁচ বছর! গুনে গুনে পাঁচ বছর তোমাকে আমি দিয়েছি। তোমার সব সমস্যা শুনেছি, জেনেছি। কখনো কোনোকিছুর আবদার করিনি। গিফট, রেস্টুরেন্টে খাওয়া এসব কিছু চাইনি আমি। তোমার ফ্যামিলি ক্রাইসিসে যতটা সম্ভব হেল্প করেছি আমি। কেন করেছি এতসব? ভালোবাসি বলেই তো! এত বছর পর সমস্ত ভালোবাসা, এফোর্টের বিনিময়ে একটা সংসার চাইছি আর তুমি কিনা এই শেষ মুহূর্তে এসে সবকিছু শেষ করে দিতে চাইছো? আসিফ লাস্ট টাইম আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করছি, আমাকে ছেড়ে যাবার কারণ কি এটাই? নাকি অন্য কোনো সমস্যা যা তুমি আমাকে বলতে চাইছো না?”

— “আমার ফ্যামিলি প্রবলেমটা কি তোমার প্রবলেম মনে হচ্ছে না?” ধমকে উঠলো আসিফ।

নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে সুরভীর।

‘আসিইইইফ’ বলেই আবারও কেঁদে উঠলো ও। আরো রূঢ় হলো তার প্রেমিক। প্রেমিকার কান্না, আবেগ কিংবা অনুরোধ কিছুই তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। চোখের সামনে তার পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আর নতুন জীবনের ঝকমকে স্বপ্নের সামনে সুরভীকে একটা আস্ত দেয়াল ছাড়া কিছু ভাবতে পারছে না সে। মেজাজ চড়ছে ভীষণ। কোন কুক্ষণে এই মেয়েটার সঙ্গে ভাব ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েছিল, কে জানে! এতদিন জ্বালিয়েছে জ্ঞান দিয়ে, আর এখন তো তার ভবিষ্যৎটাই নষ্ট করে দিতে চাইছে! ভবিষ্যৎ তো পরের ব্যাপার। এই জীবনটা বাঁচানো যাবে কি না তা-ই ঠিক নেই। কখন এসে গুম করে দেয়! অধৈর্য্য লাগলো আসিফের। কঠিন স্বরে স্পষ্ট করে সুরভীকে সে জানিয়ে দিলো,

— “তোমাকে আর বলার কিছুই নেই। শুধু এতটুকুই বলি, মাফ করো আমাকে। আমি এই সম্পর্কটা টেনে নিতে মোটেও ইচ্ছুক নই। আমার সঙ্গে তোমার নাম জড়িয়ে কোনো সিনক্রিয়েট করো না প্লিজ! রাখছি।”

হতভম্ব হয়ে ফোন হাতে বসে রইলো সুরভী। মাথার ভেতরটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। আসিফের বলা প্রতিটা কথা মেলানোর চেষ্টা করছে ও। এই তো সন্ধ্যেবেলায়ও কথা হলো। কাল কিছু জামা, দু’টো চেইন আর পাঁচ জোড়া ছোট কানের দুল ব্যাগে ভরে আসিফের কাছে রেখে আসার কথা হলো। বাকি গয়না আর জামা কাপড় বাসা ছেড়ে পালানোর দিন সঙ্গে নিয়ে বের হওয়ার কথা ছিল। এই চার পাঁচঘন্টায় কী হয়ে গেল! হঠাৎ ধাক্কায় মাথার বাম পাশে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে সুরভীর। আসিফের নাম্বারে আবার ডায়াল করলো ও। এভাবে আসিফ ওকে ছুঁড়ে ফেলতে পারে না। কোনোভাবেই না!

*****

রাত দুইটা। রুদ্র বসে আছে বারান্দায়, সঙ্গে আছে শুভও। একটু পর পর কানে ফোন নিয়ে অস্থির পায়ে সুরভীর পায়চারী দেখছে বারান্দায়। আসিফকেই কল করছে হয়তো! এতক্ষণে ঘটা করে বিচ্ছেদ করে নিয়েছে আসিফ। তাই সুরভীর এই অস্থিরতা, ঠিক বুঝে নিলো রুদ্র। আচ্ছা, ও কি কাঁদছে? হঠাৎ এক আশংকায় বুকের মধ্যে ভয় হলো রুদ্রের। নির্বাচন পরবর্তী অবস্থা নিয়ে কথা বলছিল শুভ। সেদিকে এতক্ষন মনোযোগ থাকলেও, কয়েক সেকেন্ড ধরে মনোযোগটা আর রইলো না শুভর প্রতি, আশংকাতে আটকে গেল।

শুভর কথার মাঝে রুদ্র বলে উঠলো,

— “শুভ একটা ভুল হয়ে গেছে বোধহয়!”

শুভ অবাক স্বরে জানতে চাইলো,

— “ভুল! কী ভুল?”

— “সুরভী কতটা স্ট্রং তা তো আমরা জানি না। আসিফকে একবার জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল।”

রুদ্রের সন্দেহ বুঝে নিলো শুভ। অমূলক কিছু না। রুদ্র অস্থির হয়ে উঠছে সে কথাও তার কণ্ঠেই বুঝা যাচ্ছে।

— “আসিফকে কল করে বলবো সুরভীর সঙ্গে কথা বলতে?”

দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়ালো রুদ্র।

— “কোনোভাবেই না! যা গেছে, গেছেই। ওটার ছায়াও আর আমি দেখতে চাচ্ছি না।”

শুভর সন্দেহ হলেও রুদ্রকে আশ্বস্ত করতে চাইলো সে।

— “কান্নাকাটি করবে। খুব জোর খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে একটু অসুস্থ হতে পারে। কিন্তু সুইসাইড এটেম্পট নেবে না। এত ছোটও না, বড় হয়েছে তো! এতবড় ভুল ডিসিশন নেয়ার আগে ভাববে অন্তত একবার।”

— “কোনটা সঠিক কোনটা ভুল সেটা বুঝার মতো সেন্স ওর আছে বলে মনে হয় তোমার? থাকলে ওরকম একটা ফালতু ছেলের সঙ্গে কোনোভাবেই পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিতো না।”

— “পালিয়ে যাওয়া আর সুইসাইড ডিসিশনের মাঝে তফাৎ আছে না!”

— “রিস্ক নেয়া যাবে না কোনোভাবেই।”

— “তাহলে?”

— “বারান্দায় যতক্ষণ আছে, থাকুক। আমার চোখের সামনে আছে। রাতে ওর বারান্দার দরজা খোলাই থাকে। যদি দরজা, জানালা লক করে দেয় সোজা ওর বাসায় চলে যাবো।”

— “সিন ক্রিয়েট হবে!”

— “হু কেয়ারস! সুরভীর লাইফ রিস্কের ব্যাপার। ওসব ঝামেলা টামেলা গুনবো আমি?”

মাথা দুলিয়ে সায় দিলো শুভ। নিজের কথায় মনে মনে হাসলো সে। রোজ রোজ শ’খানেক ঝামেলা করা মানুষটা কিনা বলছে, সিন ক্রিয়েট হবে!

রাত বাড়ছে। কিছুক্ষন আগেই গাড়ি গ্যারেজ থেকে বাসার সামনের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে এসেছে শুভ। সুরভীর ঘরের বাতি জ্বালানো। কাঁদছে ও। দূর থেকে টিস্যুতে ওর নাক মোছা, চোখ মোছা দেখেই আন্দাজ করে নিলো রুদ্র আর শুভ। কেউ কাউকে কিছু বলছে না। চুপচাপ বসে সুরভীকে দেখছে। যতক্ষণ পর্যন্ত ওকে দৃষ্টি সীমানায় দেখা যায় এভাবেই থাকবে তারা। অপেক্ষা করছে সুরভী না দরজা আটকে দেয়! আটকে দেয়া মাত্রই দু’জনে মিলে সরাসরি ওর রুমে গিয়ে, ওকে বের করে সোজা হসপিটাল চলে যাবে। এক সেকেন্ডও নষ্ট করা যাবে না। মেজবাহ আর সুমনকে বলা আছে, ঝামেলা হওয়া মাত্র যেন স্থানীয় পুলিশকে কল করে সামলে নেয়া হয়। রুদ্রকে খেয়াল করছে শুভ। যতবার সুরভী ঘরে যাচ্ছে ততবার উঠে দাঁড়িয়ে পড়ছে সে, যেন এখনই ছুটবে সে ঐ বাসায়। রুদ্রকে এতখানি অস্থির শেষ কবে দেখেছিল মনে পড়ছে না শুভর। আদৌ কখনো দেখেছিল কী! নির্বাচন, খুন, দাঙ্গা, রাজনীতি-ব্যবসায়ের মারপ্যাঁচসহ কত জটিল সব পরিস্থিতি সমাধান করে ফেললো আজ পর্যন্ত! অথচ আজ কিনা এই মেয়েটা তাকে আতংক দিয়ে শেষ করে ফেলছে! যার সঙ্গে আজ পর্যন্ত কথা হয়নি, যার ভালোবাসা কিংবা একটু চাহনীও এখন পর্যন্ত ভাগ্যে জোটেনি তার জন্য এত টান! যেদিন থেকে এই মেয়েটাও তাকে ভালোবাসতে শুরু করবে, আপন করে নিবে, কী হবে তখন? এই মায়া-টান কিংবা তার পাগলামি কোথায় গিয়ে ঠেকবে? কোন কপালের জোরে এমন পাগল জুটলো সুরভীর, কে জানে!

১৭

ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে হাঁটু ভেঙে ফ্লোরে বসে আছে ইমরান। অমন দাপুটে বাবার ছেলের এমন ভীতু চেহারা দেখে হাসি পেয়ে গেল জামিলের। সারা দেশের জেলায় জেলায় ঘুরে, মঞ্চে উঠে, মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাদেক খান যেভাবে হুংকার ছেড়ে বিরোধীদলের নেতাদের হুমকি ধমকি দেন, ছেলেটাকেও যদি তেমনি করে একটুখানি তেজ দেখানো শেখাতেন আরকি!

রুদ্র ঠিকই বলেছিল- এই ফুলবাবুটার জন্য একজন লোকই যথেষ্ট। কপাল বরাবর পিস্তল ঠেকালেই কাজ হয়ে যেত। খামোখা পাঁচজনের দলসহ এসে হাজির হয়েছে ওর বাসায়। এতটা সময় ওর পুরো বাসা ঘুরে ঘুরে দেখেছে জামিল। সুন্দর, সাজানো গোছানো। এই বাসায় একা ব্যাচেলর একটা ছেলে থাকে, তা দেখে বোঝার উপায় নেই। ঘুরতে ঘুরতে ইমরানের মুখোমুখি এসে বসলো জামিল। তখনও অস্ত্রধারী বাকি চারজন ঘিরে রেখেছে ওকে। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল ইমরানের। ওর চুলগুলো আলতো করে গুছিয়ে দিচ্ছে জামিল।

— “তখন বললাম না একটা বিশেষ কাজে এসেছি?”

উপরে নিচে মাথা ঝাঁকালো ইমরান।

নিজের মোবাইলে ভিডিও অন করে ইমরানের হাতে দিলো জামিল। ক্রমশ চোখ বড় হচ্ছে তার। কখন, কীভাবে ধারণ করা হলো এই ভিডিও? কী চায় এরা?

টাকা? কত টাকা? জামিলের সামনে বসে প্রেমিকার সঙ্গে কাটানো নগ্ন মুহূর্ত দেখার রুচি হলো না ইমরানের। ভিডিও অফ করে দ্রুত এর বিনিময় মূল্য জানতে চাইলো সে,

— “কত চান?”

হাসলো জামিল। তখনও ইমরানের চুল হাতড়ে চলছে সে। দারুণ সুন্দর ঝলমলে চুল ছেলেটার। মেয়েদের মাথায়ও অমন চুল দেখা যায় না। ভালো লাগছে চুলগুলো গুছিয়ে দিতে। সোফার উপর পড়ে ছিল একটা রাউন্ড ব্যান্ড। যত্ন করে ইমরানের সামনের চুলগুলো ব্যান্ডে আটকে দিয়ে জামিল বললো,

— “সবকিছুর বিনিময় কি টাকা দিয়ে হয়? টাকা ছাড়াও কত কী আছে বিনিময় করার মতো!”

— “কী চান?”

— “ভিডিয়ো।’

— “মানে?”

— “একটু আগে যে ভিডিয়োটা দেখলে সেটা লিক হলে কী হবে, জানো তো? বাবার রেপুটেশন উড়ে যাবে একদম। বাবা তোমাকে ভীষণ আদর করে, তার মানে এই না তার মান-সম্মান পুরো দেশবাসির সামনে ধ্বংস করে দেয়ার পরও তোমাকে ভালোবাসবে। দেশের মানুষের মন-মানসিকতা কেমন, তা জানা আছে নিশ্চয়ই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলের ন্যাংটা ভিডিয়ো পেয়ে কেমন আনন্দ উল্লাস যে করবে তা টের পাচ্ছো তো? লোকের অমন নোংরা উল্লাসের খোড়াক হতে চাও?”

গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো ইমরানের। প্রেমিকার সঙ্গে নগ্ন মিলনে আগ্রহ আর অভিজ্ঞতা আছে, তবে তা বহুনারী নয়। কিংবা খোলামেলাও নয়। এই জীবনে মাত্র দু’জন নারীর সংস্পর্শেই গিয়েছে সে। নিজের ব্যক্তিগত জীবন সে এতটাই গোপন রাখতে পছন্দ করে যে, বন্ধুমহলেও সে কথা অজানা। আর আজ কিনা অতি স্পর্শকাতর মুহূর্তটাই পুরো দেশবাসীর সামনে খোলাসা হয়ে যাওয়ার হুমকি মিলছে! কান্না চেপে বসছে খুব।

অসহায় ভঙ্গিতে সে বললো,

— “কী চান, বলুন না?”

— “বলছি। তার আগে শুনে নাও এই ভিডিয়ো ভাইরাল হবার পর আর কী হতে পারে? তোমার সঙ্গে যে আছে সে আজগরের মেয়ে। আজগর কেমন অমানুষ, তা একটু হলেও জানো নিশ্চয়ই?”

— “কিন্তু আমি অদিতিকে ফোর্স করিনি। ইট ওয়াজ মিউচুয়াল!”

— “সে খবর তুমি আমি জানি, অদিতি জানে। আজগরও জানবে তবে প্রমাণ করবে অন্য কিছু। নিজের মেয়ের দিকে আঙুল তোলার বিন্দুমাত্র সুযোগ কাউকে ও দিবে না। এসব মামলায় বরাবর ছেলেরা ফাঁসে, সেটা মিউচুয়াল সেক্স হোক কিংবা রেইপ। লোকের কানে আসা মানে ছেলেটাই কিছু করেছে। আজগর সেটার পুরো ফায়দা নেবে। মানে যতটা তুমি ভাবছো তার চেয়ে আরো বেশি বাজেভাবে তুমি ফাঁসতে যাচ্ছো।”

জামিলের বলা কথাগুলো স্পষ্ট দৃশ্য হয়ে চোখের সামনে ভাসতে লাগলো ইমরানের। আসন্ন বিপদের কথা ভেবে লজ্জা আর ভয়ে কেঁদেই দিলো সে। এক সেকেন্ড দেরী না করে ফটাফট পাঁচ ছয়টা টিস্যু একটানে বক্স থেকে বের করে নিলো জামিল। আলগোছে ইমরানের চোখের কোণ মুছতে মুছতে রুদ্রের তরফ থেকে আসা প্রস্তাব রাখলো সে।

— “আহা! এখনই কেন কান্নাকাটি? সমাধান আছে তো!”

— “কী?”

— “অদিতির ভিডিয়ো।”

জামিলের প্রস্তাব ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না ইমরান। কান্না থামিয়ে সে জানতে চাইলো,

— “মানে?”

*****

ভোর হয়ে গেছে। পাড়ার মসজিদে মসজিদে ফজরের আজান চলছে। সুরভীর ঘরে ওর মাকে দেখা যাচ্ছে। এতটা সময়ে যেহেতু কিছু করেনি, আর করার সম্ভাবনাও আপাতত নেই। শুভকে ঘুমুতে পাঠিয়েছে আরো দেড়ঘন্টা আগেই। এবার তারও একটুখানি ঘুমানো উচিত। আজ বিকেলে প্রস্তাব নিয়ে যাবে হবু শ্বশুরবাড়ি। না, ঘুমিয়ে বিধ্বস্ত হওয়া চেহারা নিয়ে যাওয়া চলবে না! একটু হলেও ঘুম প্রয়োজন। বারান্দা ছেড়ে উঠে আসতে ইচ্ছে করছিল না রুদ্রের। সুরভীটা তো ঘুমুবে না! তবুও উঠে এল সে।

বিছানায় গা এলাতেই কল এল জামিলের।

— “হ্যাঁ বলো?”

— “ডান।”

— “ঝামেলা করেনি তো?”

— “ভয়েই শেষ!”

— “বলেছিলাম না?”

— “এতটাও হবে তা বুঝিনি।”

— “কাজ হবে কবে নাগাদ?”

— “পরশু ওদের মিট করার কথা, সেদিনই।”

— “আজ কালের মধ্যে করা যায় কিনা দেখো না! যত দ্রুত হবে তত ভালো।’

— “আচ্ছা দেখছি তাহলে কথা বলে।”

১৮

আজ বিকেলে সুরভীর বাসায় যাবে রুদ্র। সব আয়োজন তার শেষ। আসিফকে পথ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল তাদের সঙ্গেও আলাপ শেষ। শুভকে নিয়ে আজ সকালেই গয়না, শাড়ী আর দুই লাগেজ ভর্তি সুরভীর জন্য বিয়ের উপহার কিনেছে সে নিজেই। এখন পর্যন্ত বডিগার্ড দু’জন, শুভ, সে নিজে, ইকবাল মাহমুদ আর ধর্মমন্ত্রী শাহীন আহমেদ ছাড়া আর কেউ জানে না এ ব্যাপারে। যত ঘটা, যত লোকজন জানানো, তত ঝামেলা। সুরভীর আর তার মাঝে একটা সূক্ষ্ম কাঁটাও সে আপাতত দেখতে রাজি না। তবে মাকে ছাড়া এই বিয়ে অসম্ভব! তাই তো কেনাকাটা শেষে সোজা চলে এল মায়ের কাছে।

দুপুরবেলার খাওয়া চলছে মায়ের। অস্থির হয়ে একবার সে মায়ের পাশের চেয়ারে বসছে তো আবার উঠে মায়ের আশপাশ দিয়ে হাঁটছে। ছেলেকে লক্ষ্য করছেন ফেরদৌসী। এতটা অস্থির তার ছেলে না। ভীষণ স্থির হয়েছে বাবা যাওয়ার পর থেকে। চোখ কিংবা চেহারা কিছুই দেখে বোঝার উপায় নেই তার মনে কী চলছে? একদম না! সেই ছেলেটাকে আজ এত অস্থির দেখাচ্ছে, কিছু তো একটা ঘটেছেই! তাকে সার্বক্ষনিক দেখাশোনা করা নাজনীনকে ইশারা করলেন তিনি।

আপত্তি করলো নাজনীন,

— “জি না। খাবার শেষ করতেই হবে খালামনি।”

অন্য ঘোরে ছিল রুদ্র। নাজনীনের কথা শুনে মায়ের দিকে তাকালো সে।

— “খাওয়াটা শেষ করো আম্মু।”

— “খাবার আমি যখন তখন খেতেই পারবো, আগে তোর কথা শুনি। চল, আমার ঘরে চল।”

— “বলবো তো, আগে তুমি খাও।”

— “বলছি তো আমি আর খাবো না। তোকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না আমার। তোর কথা না শুনে আমিও শান্তি পাবো না।”

মায়ের সঙ্গে আর জোর করলো না রুদ্র। সত্যিই ভীষণ অস্থির লাগছে। যত সময় ঘনিয়ে আসছে তত অস্থিরতা বাড়ছে। জলদি করে মায়ের সঙ্গে কথা শেষ করে তৈরী হতে হবে। ইকবাল মাহমুদ চলে আসবেন চারটা নাগাদ। এখান থেকে একসঙ্গে রওয়ানা হবে সবাই। সময় হাতে খুব একটা নেইও!

নাজনীনকে অবলম্বন করে নিজের ঘরে এলেন ফেরদৌসী। পেছন পেছন এল রুদ্র। ফেরদৌসীকে বিছানায় বসিয়েই বেরিয়ে গেল নাজনীন। রুদ্র গুটিগুটি পায়ে মায়ের পায়ের কাছে, ফ্লোরে আসন পেতে বসলো। নিজের মাথার উপর মায়ের হাতটা রেখে বললো,

— “আম্মু আমি একাই খুব বড় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি।”

চিন্তা হলো ফেরদৌসীর। এমন অদ্ভুত কায়দায় কথা বলছে কেন ছেলেটা? ছেলের গালে কপালে হাত বুলাতে লাগলেন তিনি

— “কী হয়েছে বাবা? কোথায় ছিলি তুই? ফিরে এসেই কেন এমন করছিস?”

— “আমি বিয়ে করবো আম্মু। আজই।”

স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন নাজনীন। খুশি হবেন না কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। মায়ের চেহারা ঠিক পড়তে পারলো রুদ্র।

আবারও তার হাতটা মাথার উপর টেনে নিয়ে বললো,

— “ব্যাপারটা শকিং, আমি জানি। আগে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু, ঐ তো…। ধুর! আমি কথা গুছাতে পারছি না। আমার সব এলোমেলো লাগছে।”

— “এলোমেলোই বল, আমি বুঝে নিবো।”

— “অনেক ঝামেলা ছিল, ওগুলো সুরাহা করতে হয়েছে।”

— “কী ঝামেলা?”

— “বকা দিও না প্লিজ!”

— “কবে বকেছি তোকে?”

— “ওর নাম সুরভী। শুভর এলাকায় থাকে। দেখেছি, ভালো লেগেছে। ওকেই লাগবে আমার। লাগবে মানে লাগবেই। ওকে ছাড়া চলবে না আম্মু। আমার পুরো মাথাটা এই মেয়ে দখল করে ফেলেছে। নিজেকে এডিক্টেড মনে হয়। দিনভরে ওকে দেখলেও বোধহয় আমার তৃষ্ণা মিটবে না!”

ছেলের কথায় সজোরে হেসে উঠলেন ফেরদৌসী। সেই ছোট্টবেলাতেও এমন পাগলামি করতে দেখেননি ছেলেকে।

ছেলের চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে তিনি বললেন,

— “যা কাঠখোট্টা একটা মুখ করে বেড়াস সারাদিন! আমি তো ভেবেছিলাম তোর মন থেকে হাসি, মায়া, প্রেম, টান সব মুছে গেছে! এখন তো দেখছি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম-ট্রেম সবই চলছে।”

— “প্রেম! কিসের প্রেম?”

— “না?”

— “না তো!”

— “তাহলে এই হুটহাট বিয়ের কারণ? আর তুই না বললি দেখেছিস, ভালো লেগেছে?”

— “ভালো লাগা, ভালোবাসা সব শুধু আমার দিক থেকে। সুরভী আমাকে চেনেও না। আজ পর্যন্ত আমার সঙ্গে এক শব্দের কথাও ওর হয়নি।”

— “কী বলছিস রুদ্র!”

— “ওকে এক প্রকার ধরে-বেঁধে বিয়ে করবো আম্মু।”

— “কেন? কার মেয়ে ও? বিরোধী দলের কেউ?”

— “না। খুব সাদাসিধে ঘরের মেয়ে। ওর অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক ছিল। নেক্সট উইক ওর বিয়ে। আমি পাত্রপক্ষকে হুমকি ধমকি দিয়ে বিয়ে ক্যান্সেল করেছি।” চোখ রাঙিয়ে কপট রাগ দেখালেন ফেরদৌসী।

— “এই বুড়ো বয়সে এসব ছেলেমানুষী কেন রুদ্র? একটা মেয়ের বিয়ে ভেঙে দিবি তুই?”

— “তুমি বুঝতে পারছো না! ওকে আমার লাগবেই। আজ যাবো। ওর বাবা যদি বিয়ে দিতে রাজি না হয়, তাহলে ওকে তুলে আনবো।”

— “এতসব বাড়াবাড়ি কেন রে বাবা?”

— “বাড়াবাড়িই! ওকে চোখ বুজে অনুভব করলেই আমার সমস্ত স্ট্রেস, খারাপ লাগা মুছে যায়। আমার অমিমাংসিত সব সমস্যার সমাধান হতে থাকে। আমি কতগুলো বছর ধরে যন্ত্রণায় ছটফট করছি আম্মু। কোথাও আমার শান্তি নেই। তুমি বুঝো না? আমি আমার শান্তি খুঁজে পেয়েছি আম্মু। পৃথিবীর সমস্ত কিছুর বিনিময়ে হলেও আমি ওকে চাই।”

ছেলের আকুতিতে বুকে কাঁপন ধরলো মায়ের। চোখের কোণে পানি জমলো একটু করে। সত্যিই তো! শেষ কবে ছেলেটাকে স্বস্তিতে দেখেছেন, প্রাণখুলে হাসতে দেখেছেন মনে পড়ছে না তার। ছেলে যদি নিজের সুখ খুঁজে পায় তবে তিনিও মনে প্রাণে চান সেই সুখ তার ছেলের হোক। হোক তা সমস্ত কিছুর বিনিময়ে কিংবা জোর করে ছিনিয়ে। রুদ্রের থুতনিতে আলতো করে আদর করে দিলেন ফেরদৌসী।

— “আচ্ছা নিয়ে আয় বউ। কিন্তু তুই এত অস্থির হয়ে আছিস কেন?”

— “সুরভীর বাবা এই বিয়েতে আপত্তি করার সম্ভাবনা প্রবল।”

— “কেন? নিজের পরিচয় দিবি তুই। তোর পরিচয় জানার পর কে না রাজি হবে মেয়ে দিতে?”

— “সঙ্গে ইকবাল আংকেলকে নিচ্ছি। শাহীন ভাইও যাবে। মুরুব্বি কাউকে তো লাগবে।”

— “স্বয়ং পি এম যেখানে প্রস্তাব নিয়ে যাবে সেখানে আপত্তি কে করবে রুদ্র?”

— “ওরা খুব সাধারণ পরিবার। ঝুট ঝামেলায় নেই। আমাদের জীবনের আগা গোড়াই ঝামেলা। যতটুকু জেনেছি সেই ক্যালকুলেশনে মনে হচ্ছে ওর বাবা আপত্তি করবে। আপত্তি শুনতে আমার একদম ভালো লাগবে না আম্মু। মাথার রগ ছিঁড়ে যাবে আমার। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো কি না তখন তা-ও জানি না। সব মিলিয়ে কেমন যেন লাগছে আমার। স্থির হয়ে আপাতত কিছু ভাবতে পারছি না।”

— “সব ভালো হবে। ইকবাল ভাই বুদ্ধিমান মানুষ। তুইও তো আর গাধা না। উনার চেয়ে তুই আরও বুদ্ধিমান। পরিস্থিতি সামলাতে জানিস। এটাও পারবি আপোষে সেড়ে নিতে।”

— “হুম।”

— “কিন্তু আমি ভীষণ রাগ করেছি।”

— “কেন?”

— “ইকবাল ভাই, শাহীন তোর বিয়ের ঘটনা আগে থেকে জানে। অথচ আমাকে কিনা জানালি সবার শেষে!”

অপরাধী ভঙ্গিতে মায়ের দিকে তাকালো রুদ্র।

— “সিচুয়েশনটা ঠিক বুঝাতে পারছি না। সব ঝামেলা মিটলোই গতকাল। আমি…”

রুদ্রের কথা ফুরাবার আগেই হাসলেন ফেরদৌসী।

— “আর ব্যাখ্যা করতে হবে না। তুই তোর সুখের চাবি খুঁজে নিয়েছিস, তাতেই আমার শান্তি।”

মলিন হাসলো রুদ্র। মায়ের হাতে চুমু খেয়ে বললো,

— “ওকে তুমি বরণ করবে না আম্মু?”

— “আমার ছেলের বউ আমি বরণ করবো না? নতুন গয়না পরিয়ে বরণ করবো! এদিকটা তোর ভাবতে হবে না। বউ ঘরে আসবে, আমি আমার মতো ঠিক আয়োজন করে নেবো।”

— “উঠি আমি তাহলে। গোসল করে রেডি হবো।”

— “কী পরবি?”

— “নরমাল গেটআপ, শার্ট-প্যান্ট।”

— “পাঞ্জাবি পর।”

— “ইচ্ছে করছে না।”

— “এটা কেমন কথা!”

— “এটাই তো শেষ না আম্মু, হবে তো আয়োজন। সুরভী আসুক। আমার সঙ্গে, এই বাড়িতে ওকে এডজাস্ট হতে দাও। তারপর সব হবে।”

১৯

সুরভীকে সেই ভোর থেকে দেখছে ওর মা। ওর ঘরের আলমারীতে জরুরি কিছু কাগজ ছিল, সেগুলোই আনতে গিয়েছিলেন। তখন সজাগ ছিল সুরভী। পুরো রাত না ঘুমিয়ে, কেঁদেকেটে চোখ মুখ ফুলে গিয়েছিল ওর। ছেলেমেয়েকে বকাঝকা করা কিংবা তাদের মন খারাপের মুহূর্তে আরো মানসিক চাপ সৃষ্টি করা কখনোই সুরভীর মা মিতার মাঝে ছিল না। আজও নেই। সামনের সপ্তাহে মেয়ের বিয়ে। জানা মতে মেয়ের কখনো কারো সঙ্গে প্রেম ছিল না। কিন্তু এই শেষ মুহূর্তে এসে সেই বিশ্বাসটুকু আর নেই মিতার। আজ ভোরের কথা কিংবা সারাদিনে মেয়ের মানসিক অবস্থায় তিনি ঠিক আন্দাজ করে নিয়েছেন সুরভী কারো সঙ্গে সম্পর্কে আছে। কিন্তু ও কাউকে কেন কিছু বলেনি? এই মুহূর্তে এসে বিয়ে ভাঙার কথা বললেই তো আর ভেঙে ফেলা যাবে না। মেয়ের দুশ্চিন্তায় আধমরা লাগছে মিতার। ভয়ে স্বামীকেও কিছুই এখন পর্যন্ত জানাননি তিনি। বড় ছেলেকে কল করেছিলেন এই ব্যাপারে কথা বলবেন বলে, রিসিভ করেনি সে। কলব্যাকও করেনি। মাহিনের সঙ্গে কথা না বলে সুরভী কিংবা তার স্বামী কারো সঙ্গেই আপাতত তিনি কিছু বলতে চাইছেন না।

আসরের নামাজ শেষে, নামাজের বিছানায় বসেই মেয়েকে নিয়ে এলোমেলো খেয়ালে ডুবে ছিলেন মিতা। বাসার সামনে হৈ-চৈ, ২-৩ টা গাড়ির একত্রে বেজে উঠা সাইরেনের শব্দে কৌতূহলী হলেন তিনি। নামাজের বিছানাটা উঠিয়ে রেখে, জানালা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখতে পেলেন আট দশটা গাড়ি এক সিরিয়ালে এসে তার বাসার সামনে দাঁড়িয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী আর ধর্মমন্ত্রী। তাদেরকে কড়া পাহাড়ায় ঘিরে রেখেছে কয়েকজন। একটু দূরেই আরেক গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে আরো একটা পরিচিত মুখ। টিভিতে মিতা তাকে দেখেছেন কয়েকবার, কিন্তু তার পরিচয় জানেন না মিতা। তবে উনারা এখানে কেন? কই সারাদিনে তো কারো কাছে শোনেনি এই এলাকায় কোথাও সভা হবে? এসব ভাবতে ভাবতেই আরো চমকে উঠলেন তিনি। সবাই তারই বিল্ডিংয়ে ঢুকছে! কার বাসায় এসেছেন উনারা? এবারে তার বাড়াবাড়ি রকমের কৌতূহল হলো। দরজা খুলে সিঁড়ির ফাঁক দিয়ে নিচে চেয়ে রইলেন তিনি, কার বাসায় তারা এসেছে সে কথা জানতে। ক্রমশ সবাইকে উপরে উঠতে দেখে নিজের ঘরে দরজার আড়ালে দাঁড়ালেন তিনি। উপরতলায় যাবে হয়তো! অথচ একটু বাদেই তাকে বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিয়ে তারই বাসার বেল বাজালো অস্ত্রধারী একজন। কেমন ভয় ধরে যাচ্ছে মিতার! দরজার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখলেন, প্রধানমন্ত্রী হাসিমুখে দরজায় দাঁড়িয়ে, ঠিক পেছনেই ধর্মমন্ত্রী। দু’জনেই দুই সেকেন্ড আগে পরে সালাম দিলেন মিতাকে। কন্ঠে জড়তা নিয়ে সালামের উত্তর করলেন মিতা। তার ফ্যাকাশে মুখটা দেখেই মনের ভেতরের কৌতূহল, সংশয়, ভয় সব বুঝে নিলেন ইকবাল মাহমুদ। মুখে তখনও তার হাসি লেগে আছে।

ভীষণ বিনয়ে তিনি অনুমতি চাইলেন মিতার কাছে,

— “আপা, ভেতরে আসি?”

নিজের নির্বুদ্ধি আচরণে লজ্জায় পড়ে গেলেন মিতা। তড়িৎ গতিতে দরজা ছেড়ে তিনি বললেন,

— “আসুন, আসুন! আমিও কেমন বোকার মতো দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছি।” ধর্মমন্ত্রীর পরই সেই পরিচিত মুখের ছেলেটা তার সামনে এল। পা ছুঁয়ে সালাম করবে বলে নিচু হতেই লজ্জা, দ্বিধায় সরে পড়লেন মিতা।

— “কী করছো বাবা! সালাম কেন?”

রুদ্র সেখানেই বসে রইলো। চোখ তুলে মুচকি হেসে তাকালো মিতার দিকে। শুভ এগিয়ে এসে বললো,

— “তাতে কি আন্টি? আপনি মুরুব্বি, পা ছুঁয়ে সালাম করাই যায়। আসুন না? সামনে আসুন।”

ভেতর থেকে রুদ্রকে মিতার পা ছুঁয়ে সালাম করতে দেখে মাথা দুলিয়ে হাসলেন শাহীন আহমেদ।

ইকবাল মাহমুদের কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,

— “দেখছেন অবস্থা? পুরো মন্ত্রীসভাকে দৌড়ের উপর রাখে যে ছেলেকে আজ পর্যন্ত কাউকে সালাম পর্যন্ত দিতে শুনিনি, সেই ছেলে কিনা পায়ে ধরে সালাম করছে!”

— “প্রতিটা মানুষ কোথাও না কোথাও আটকায়। কোনোদিন মাথা না নোয়ানো মানুষটাও কোনো একজনের হাঁটুর কাছে ঠিকই মাথা নত করে। সবখানে দাপিয়ে বেড়ানো রুদ্র, এই ছোট্ট একটা এলাকায় বেড়ে উঠা খুব সাদাসিধে, চাকচিক্যহীন একটা মেয়ের কাছে আটকে গেছে। ওর জন্য রুদ্র সব করবে। প্রয়োজনে মাথা নোয়াবে, প্রয়োজনে মাথা কেটে আলাদাও করবে।”

ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল সুরভী। এই প্রথম রুদ্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ পড়েছে ওর। অনুভূতির দোটানায় ভুগতে লাগলো রুদ্র। একদিকে প্রথম চোখে চোখ পড়ার সুখ অন্যদিকে সুরভীর বিধ্বস্ত চেহারায় মন খারাপ হওয়া। তবুও যেন সুখের পাল্লাটাই বেশি ভারী। এই তো আর কিছুক্ষণ বাদেই সুরভীকে নিজের করে নেবে সে। একান্তই নিজের। তারপর থেকে সুরভীর সবকিছু তার দায়িত্বে। এইসব মন খারাপ, কষ্ট, চোখের পানি কিছুই আর ছুঁতে পারবে না ওকে। সব মুছে দেবে সে। আগলে রাখবে সুরভীকে সবসময়, সারাজীবন!

কী করবেন, কী করবেন না ভেবে যখন মিতা দিশেহারা হচ্ছিলেন তখন সুরভীকে সামনে পেয়ে যেন একটুখানি দিশা পেলেন তিনি। মেয়েকে ইশারা করলেন জলদি করে একটুখানি চা-নাস্তার আয়োজন করতে। মায়ের ইশারায় মাথা দুলিয়ে সায় দিয়ে আবারও রুদ্র আর শুভকে, বাইরে দাঁড়ানো বডিগার্ডদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখতে লাগলো সুরভী। কারা এরা? কেন এসেছে?

নামাজ শেষে বাসায় ফিরলেন শরীফ সাহেব। বাসার নিচ থেকে শুনে এসেছেন তার বিল্ডিংয়ে মন্ত্রীরা এসেছে। দরজার সামনে এসে দেখলেন মন্ত্রীরা তার ঘরেই এসেছে। বোকা বোকা হাসিতে ঘরে ঢুকেই সালাম দিলেন আগত মেহমানদের। ইকবাল মাহমুদ, শাহীন আহমেদ স্বেচ্ছায় উঠে এসে হাত মেলালেন তার সঙ্গে। মিতার একটুখানি সাহস হলো স্বামীকে পেয়ে। নয়তো এতটা সময় ধরে নিজের ঘরে নিজেকেই কেমন মেহমানের মতো লাগছিল। রুদ্রের পাশের খালি সোফাটায় গিয়ে বসলেন শরীফ সাহেব।

অন্য প্রসঙ্গে না গিয়ে সরাসরি কথা শুরু করলেন শামীম আহমেদ।

— “আপনারা হয়তো ভাবছেন, হঠাৎ আমরা এতগুলো মানুষ আপনার বাসায় কী কারণে এলাম!”

— “একটু তো অবাক হয়েছিই। আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের ঘরে স্বয়ং মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী চলে আসবে, তা তো ভাবিনি কখনো।”

— “ভাই, আমরা এসেছি বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে।”

মিতা সঙ্গে সঙ্গে তাকালেন রুদ্রের দিকে। ঘটনা তবে এই! সেজন্যই ছেলেটা পা ধরে সালাম করলো? শরীফ সাহেব তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না প্রস্তাব আসলে কার জন্য? তার বড় ছেলের নাকি সুরভীর?

— “কার বিয়ের ব্যাপারে বলছেন?”

— “আপনার সুরভীর সঙ্গে ওর।”

চোখের ইশারায় রুদ্রকে দেখালেন শামীম আহমেদ।

— “ও রুদ্র। আশরাফ মির্জার নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই?”

— “জি।”

— “আশরাফ ভাইয়ের একমাত্র ছেলে ও। বর্তমানে আশরাফ মির্জার পুরো ব্যবসা ও দেখছে। দলের উপদেষ্টাদের মাঝে একজন ও। সর্বকনিষ্ঠ বটে, তবে বুদ্ধির জোর আমাদের সবার চেয়ে একটু বেশিই! যোগ্য বাবার যোগ্য সন্তান বলতে আমরা যা বুঝি আরকি।”

মুচকি হাসলেন শরীফ সাহেব। বিনয়ের সঙ্গে জানালেন,

— “আমার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, সামনের শুক্রবার বিয়ে।”

ইকবাল মাহমুদ বললেন,

— “জানি। আমরা জেনেই এসেছি। আপনাদের সম্পর্কে প্রতিটা খবর আমাদের কাছে আছে।”

— “জানেন যেহেতু তাহলে আমি আর কী নতুন করে বলবো?”

— “বলার আছে অবশ্যই। বিয়ে ঠিক হয়েছে, হয়ে তো আর যায়নি। মেয়ের জন্য এত ভালো ঘর, এত ভালো ছেলে পেয়েছেন একটু তো বিবেচনা করবেন অবশ্যই।”

— “কিছু মনে করবেন না। এখানে বিবেচনা করার কিছু নেই। আমি ঐ পক্ষকে কথা দিয়ে ফেলেছি। এই মুহূর্তে যত ভালো প্রস্তাবই আসুক না কেন সেদিকে আমি নজর দিতে পারবো না।”

স্বামীর সঙ্গে মাথা দুলিয়ে সায় দিলেন মিতা। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকালো ইকবাল মাহমুদের দিকে। শামীম আহমেদ ইশারায় শান্ত হতে বললো তাকে। বারবার তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে আনা হয়েছে, মাথা গরম করা চলবে না। ঠান্ডা মাথায় সামলাতে হবে, তবুও ছেলেটা রেগে যাচ্ছে!

মাথা নিচু করে ফেললো রুদ্র। মাথায় সত্যিই রক্ত চড়ে যাচ্ছে। জানা ছিল, সুরভীর বাবা-মা রাজি হবে না। মানসিক প্রস্তুতিও ছিল তার। তবুও মেজাজ সামলে রাখা যাচ্ছে না!

ইকবাল মাহমুদ উঠে এসে শরীফ সাহেবের পাশে বসলেন। তার হাতের মাঝে শরীফ সাহেবের হাত চেপে বললেন,

— “দেখুন, রুদ্রের বাবা নেই। ওর বাবার জায়গায় আমি এসেছি। আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে, আপনার মেয়ে রাণী হয়ে থাকবে রুদ্রের কাছে।”

— “ভাই এভাবে বলবেন না দয়া করে! কথার একটা মূল্য তো আছে, তাই না? যার সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছি তার চেয়ে ধনী . প্রভাবশালী পরিবার পেয়েছি বলে বিয়ে ভেঙে দিবো? এই অনৈতিকতা আমাকে দিয়ে হবে না।”

শুভকে ইশারা করলো রুদ্র। তার কিছুক্ষণ বাদেই পাত্রপক্ষ থেকে কল এল শরীফ সাহেবের ফোনে। তিনি কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সাফ জানানো হলো, এই বিয়েটা হচ্ছে না। পাত্রের পছন্দ আছে নিজস্ব, ওখানেই বিয়েটা করবে সে। শরীফ সাহেব কথা বাড়াতে চেয়েও পারলেন না। মুখের উপর কল কেটে দিলো পাত্রপক্ষ। ঘটনার আকস্মিকতায় খেই হারালেন তিনি। মনে তীব্র সন্দেহ কড়া নাড়লো তার, এই বিয়ে ভাঙার পেছনে এদের হাত নেই তো?

ইকবাল মাহমুদ আবার বলতে লাগলেন,

— “দেখুন ঝামেলা কিন্তু মিটে গেছে। এবার আপনি আমাদের প্রস্তাবটা বিবেচনা করতেই পারেন।”

নিজেকে এক প্রকার জোর করেই সামলে নিলেন শরীফ সাহেব। ঘরে চলমান পরিস্থিতি সামলাতে হবে।

— “পারি, তবে করবো না। দেখুন, আমি খুব সাধারণ মানুষ। ছেলেমেয়েগুলোকে বড় করেছি সাধারণভাবেই। এই বাড়িটা করেছি বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির উপর ব্যাংক লোন নিয়ে। সম্পত্তি বলতে এই একটা বাড়ি আর কিছু ব্যাংক ব্যালেন্স আছে আমার। এর বাইরে আর কিছুই নেই। আশরাফ মির্জাকে আমি চিনি তবে তার সম্পর্কে জানি না। তার ধন-সম্পদ সম্পর্কে পুরো জ্ঞান না থাকলেও আন্দাজ ঠিক করতে পারি। এতবড় বাড়িতে আমি আমার মেয়ে বিয়ে দেবো না।”

এবারে মুখ খুললো রুদ্র। যথাসম্ভব নিচুস্বরে বললো,

— “প্রপার্টির সঙ্গে বিয়ে না দেয়ার সম্পর্কটা ঠিক বুঝলাম না, আংকেল!”

— “দেখো বাবা, দু’পক্ষ সমান হওয়া জরুরি। তোমার সঙ্গে আমার একেবারেই পাহাড় জমিন অবস্থা। আমার মেয়ে কিংবা আমরা সেই পাহাড় বেয়ে এই সম্পর্কটা ঠিকঠাক ব্যালেন্স করতে পারবো না।”

শামীম আহমেদ বললেন,

— “কিছু ব্যালেন্স করতে হবে না আপনাকে। কোনো দাবি-দাওয়া নেই আমাদের। আমরা শুধু মেয়ে নিবো, ব্যস! একটা সুতাও মেয়ের সঙ্গে দিতে হবে না।”

— “আমার যা সাধ্য তা আমি আমার মেয়েকে দিবোই। আর সাধ্যের ভেতরেই

থাকবো। সাধ্যের বাইরে কোনো সম্পর্কে আমি যেতে চাচ্ছি না। এই সম্পর্কটা আমরা সত্যিই সামলাতে পারবো না!”

রুদ্র আবারও বলে উঠলো,

— “এখানে সামলানোর কিছু নেই আংকেল। আমি নিজে এসেছি প্রস্তাব নিয়ে। সুরভীকে ভালো লেগেছে বলেই এসেছি। ওকে ছাড়া কিছু চাই না আমি। রইলো কথা ব্যালেন্স করার, কেন করা যাবে না? আমি আপনাদের ছেলের মতোই থাকবো।”

রুদ্রের সঙ্গে আর কথা বাড়ালো না শরীফ সাহেব। ইকবাল মাহমুদের দিকে ফিরে আরো বিনয়ী হয়ে বললেন,

— “রাগ করবেন না প্লিজ! রাজনীতি থেকে আমি দূরে থাকতে পছন্দ করি। সহজ সাদামাটা জীবন পছন্দ আমার। ছেলেমেয়েগুলোকে অমন ঘরেই দেবো। রুদ্রকে চিনি আমি। টুকটাক খবর ওকে নিয়েও লোকমুখে চর্চা হয়, পত্রিকায় ছাপা হয়। কতটা সত্যি, কতটা মিথ্যা তা আমি জানি না। যাচাই করার প্রয়োজন মনে হয়নি কখনো। কিন্তু ওর কাছে মেয়ে বিয়ে দেবার প্রশ্ন এলে তখন সেসব খবর আমার ভাবতেই হবে। আমি বলছি না যা শুনেছি, পড়েছি সব সত্য। মিথ্যাও হতে পারে। কিন্তু মেয়ের ব্যাপারে আমি কোনো রিস্ক নিবো না। আমি কোনো পলিটিশিয়ানের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিবো না।”

রুদ্রের দিকে একবার তাকালেন ইকবাল মাহমুদ। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এভাবে হাতে ধরে মেয়ে চাইছে, এই লোকের জায়গায় অন্য কেউ হলে নাচতে নাচতে মেয়ে দিয়ে দিতো। কিন্তু এই লোকটা রাজি হচ্ছে না। হবেও না, সে কথা বুঝে গিয়েছেন ইকবাল মাহমুদ। হাসলেন তিনি। তবে কন্ঠে সেই বিনয়টা আর ধরে রাখলেন না। শরীফ সাহেবের হাতের উল্টোপিঠে, হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ইকবাল মাহমুদ বললেন,

— “সামান্য দু’টো খবরে রুদ্রকে মাপা অসম্ভব! ওর সঙ্গে চলাফেরা করেও ঠিকঠাক ওকে বুঝা দায় এমন গোলকধাঁধা ও। রুদ্র সম্পর্কে আপনার কোনো ধারণাই নেই শরীফ ভাই!”

— “আপনার কথার সুরে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন।”

ঠিক তখনই চা-নাস্তার ট্রে হাতে ঘরে এলো সুরভী। শুভ দ্রুত ওর হাত থেকে ট্রে নিতে চাইলে সুরভী আপত্তি করলো,

— “না! আপনি কেন? আমি সার্ভ করছি।’

শুভকে ইশারায় থামিয়ে দিলো রুদ্র।

সুরভীকে সে বললো,

— “টে টা রাখো টেবিলের উপর।”

— “না, আমি দিচ্ছি সবাইকে।”

সুরভীর হাত থেকে ট্রে নিয়ে টেবিলের একপাশে রাখলো রুদ্র। ওর হাত টেনে শরীফ সাহেবের পাশে বসিয়ে, নিজে বসলো টেবিলের উপর। এরপর বললো,

— “আপনার কেন মনে হলো ও আমার কাছে ভালো থাকবে না?”

— “আমি বলিনি ও তোমার কাছে ভালো থাকবে না। কিন্তু আমার নিজস্ব পছন্দ- অপছন্দ বলতে কিছু আছে।”

— “সরাসরি হয়তো বলেননি কিন্তু কথার ইঙ্গিত সম্পূর্ণটা সেদিকেই যাচ্ছে। আমার চেয়ে বেশি ভালো কে রাখবে ওকে? এত খেয়াল কে রাখবে ওর? আপনি ওর বাবা। আপনি নিজেও ওর এতটা খেয়াল কখনো রাখেননি যতটা আমি রাখবো।”

ভ্রু কুঁচকালেন শরীফ সাহেব। একজন বাবার যত্নে আঙুল তুলছে এই ছেলেটা!

শরীফ সাহেব কিছু বলার আগেই রুদ্র বললো,

— “ভ্রু কুঁচকানোর আগে একটা কথার জবাব দিন আমাকে, আপনার মেয়ে মুখটা আজ সারাদিনে দেখেছেন একবার? ও ঘুমায়নি সারারাত তা খেয়াল করেছেন?”

মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন শরীফ সাহেব। সত্যিই অসুস্থ লাগছে ওকে! খেয়ালই করা হয়নি সারাদিন।

— “আপনার মেয়ের এমন আরো বহু খোঁজ আমার জানা, যা আপনি জানেন না। ওকে ভালো লেগেছে, জীবনসঙ্গী করতে চাই, আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটুকু ওর দখলে দিতে চাই; তাই ওর খেয়াল রাখি, চোখে চোখে রাখি। চাইলে আপনার মেয়েকে কবেই ধরে নিয়ে যেতে পারতাম। কারো কিছুই করার সাধ্য ছিল না। কিন্তু আমি নেইনি। আপনার সঙ্গে ঝামেলা করার ইচ্ছে আমার নেই। আপনি ওর বাবা। একটাই মেয়ে আপনার, আমি চাইনি আপনার মেয়ের বিয়ে আপনার অনুপস্থিতিতে হোক। আমি আপনাকে সম্মান দিতে চেয়েছি, আপনি সম্মান নিতে না চাইলে আমাকে অন্য পথ ধরতে হবে। ওকে এক্ষুনি, এই মুহূর্তে আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো। দেখি আমাকে কে আটকায়?”

ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো মিতার। ছুটে এসে মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। অসহায় চোখে ইকবাল মাহমুদের দিকে তাকালেন শরীফ সাহব। মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে আড়চোখে রুদ্রকে দেখছে সুরভী। আসিফের ধাক্কাটা এখনো কাটেনি। তাই এসব হুমকি-ধমকি, বিয়ের আলাপ মাথায় ঠিকঠাক খেলছে না। মা- বাবার মতো নিজেকে অসহায়ও লাগছে না। কিন্তু কে ইনি? কবে থেকে ওর পেছনে পড়ে আছে? চোখে পড়েনি তো কখনো?

শরীফ সাহেবের কাঁধ চাপড়ালেন ইকবাল মাহমুদ।

— “নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসুন। এত ভালো ঘর, বর মেয়ের জন্য কোথাও পাবেন না আপনি।”

— “এভাবে আমার মেয়েটাকে জোর করে নিতে চাইবেন, তাই বলে?”

— “জোর তো প্রথমে ও করতে চায়নি। আপোষেই সমাধান চেয়েছিল। আপনাকে আমি হুমকি দিচ্ছি না, জাস্ট রিয়েল ফ্যাক্ট এক্সপ্লেইন করছি। মেয়ে যদি আপনি ওর কাছে না দেন, মেয়েকে আর কোথাও দিতে পারবেন না। ও সত্যিই মেয়ে বাসা থেকে নিয়ে যাবে। আমি বলবো জীবনে কোনো পূণ্য করেছেন বলেই মেয়ের এমন ভাগ্য উপরওয়ালা নিজে সাজিয়ে দিয়েছে। আপনার মেয়েকে মাথায় করে রাখবে ও।”

— “আংকেল. আমি আপনার সিদ্ধান্তের অপেক্ষা করবো না। বেরিয়ে আসার সময় মাকে বলেছি বউ আনতে যাচ্ছি। আমি বউ নিয়েই মায়ের কাছে ফিরবো। এখন আপনি সিদ্ধান্ত নিন মেয়েকে নিজে আমার হাতে তুলে দেবেন নাকি আমি ওকে নিজ দায়িত্বে নিয়ে নেবো?”

নিজেকে টালমাটাল লাগছে সুরভীর। আসিফের চলে যাওয়া, হুট করে এই লোকটার উড়ে এসে জোর-জবরদস্তি, সবকিছু মাথার উপর গেলেও জোর করে পুরো মুহূর্তটা একবার মাথায় আঁটতে চাইলো ও।

শান্ত-দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিবাদ করলো,

— “আপনার কেন মনে হলো আপনি আমাকে জোর করে বিয়ে করতে চাইলেই আপনাকে আমি বিয়ে করবো?”

সুরভীর কথায় মাথা নিচু করে হাসলো রুদ্র। প্রথমবারের মতো সুরভী তাকে কিছু বলছে। বলছে না ঠিক, প্রতিবাদ করছে। এটাও ভালো! ঘরের বউরা কখনো স্বামীর কথায় গলা মেলায় নাকি! ওরা উল্টো বলবে, চলবে, প্রতিবাদ করবে এই-ই

তো ঘটে আসছে যুগ যুগ ধরে।

— “আপনি হাসছেন কেন?”

— “বিয়ে করতে চাও না আমাকে?”

— “না! চিনি না, জানি না আপনাকে কেন বিয়ে করবো? তার উপর আমার ঘরে ঢুকে আমার বাবার সঙ্গে এভাবে বেয়াদবি করছেন! আপনাকে আমি বিয়ে করবোটা কেন, সেটা বলুন?”

— “বাবার কথা এত ভাবো তুমি?”

— “অবশ্যই ভাবি।”

সুরভীকে একটানে মায়ের বুক থেকে সরিয়ে নিলো রুদ্র।

আর্তনাদ করে উঠলেন মিতা,

— “আমার মেয়েটাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?”

ভয়ে গলা ধরে এলো শরীফ সাহেবেরও।

— “ক্ষমতার বলে এভাবে অন্যায় করবেন আমাদের উপর?”

ইকবাল মাহমুদের বিরক্তি ধরে এল। কন্ঠের সেই নমনীয়তা হারালেন তিনি। ভ্রু জোঁড়া কুঁচকে এল তার।

— “কেন এভাবে কান্নাকাটি করছেন? আমরা কি একাত্তরের হানাদার বাহিনী যে ঘর থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে সম্ভ্রম নষ্ট করবো? এসেছি একটা পবিত্ৰ কাজে। কী চমৎকার একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি! কোথায় রাজি হবেন, খুশি হবেন… তা না করে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে কান্নাকাটি জুড়ে দিচ্ছেন। এসবের কোনো অর্থ হয়? নেহাৎ এটা রুদ্রের প্রসঙ্গ, নয়তো আপনি এভাবে বারণ করার পর আমি আর এক

সেকেন্ডও এখানে বসতাম না। আত্মসম্মান আছে আমার, আর আমাদের ছেলেও কোটিতে একটা! এই ছেলের জন্য মেয়ের অভাব নাকি!”

— “তাই বলে এভাবে হুমকি ধমকি দিয়ে?”

— “রুদ্রের ক্ষমতা আছে, তাই হুমকি দেয়। আপনার থাকলে আপনিও দিতেন।”

সুরভীর ঘরে ওকে নিয়ে মুখোমুখি বসলো রুদ্র। নিচু স্বরে বললো,

— “কার জন্য বিয়েটা করতে চাও না? আসিফ?”

গতরাতের জট বুঝি এবারে খুললো। আসিফের হঠাৎ সরে যাবার কারণ কি এই লোকটা? ইনি কিছু করেছে আসিফকে? খাট থেকে এক লাফে উঠে দাঁড়ালো সুরভী। রুদ্রের উপর চড়াও হলো ও।

— “আপনি কী করেছেন আসিফকে?”

সুরভীকে একটানে আবার খাটে বসালো রুদ্র। মোবাইলটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

— “চিৎকার করার আগে এটা দেখে নাও।”

গতরাতের পুরো মুহূর্তটা ভিডিয়ো করেছিল শিশির, আসিফের অজান্তে। নিঃশব্দে সুরভী কাঁদছে। দুই গাল গড়িয়ে পানি ঝরছে ওর চোখ থেকে। চোখ জোড়ায় কাউকে হারাবার ব্যথা আর দেখছে না রুদ্র। এই কান্না কারো প্রতি কষ্টের কান্না না। এই কান্না প্রতারিত হয়ে নিজের জন্য মায়া হওয়ার কান্না। প্রতারকের প্রতি রাগে অন্ধ হবার কান্না।

রুদ্রের ইচ্ছে করছে সুরভীর চোখজোড়া মুছে দিতে। সুরভীর চোখে হাত বাড়িয়েও ফিরিয়ে নিলো রুদ্র। কাঁদুক। এই মুহূর্তটায় কারো সহানুভূতি ছাড়া একাই কষ্টের সঙ্গে লড়াই করুক। একা লড়াই না করলে অপরপক্ষের প্রতি ঘৃণাটা ঠিক জমে না!

ভিডিয়ো শেষে মোবাইলটা রুদ্রকে ফিরিয়ে দিলো সুরভী। মাথা নিচু করে কাঁদছে ও। রুদ্র দেখছে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে আসা, নখ দিয়ে নিজের হাত খামচে ধরা। নিজের পক্ষে এবারে একটুখানি সাফাই গাইতে শুরু করলো রুদ্র।

— “না জেনেই এভাবে ব্লেইম করা উচিত না। ছেলেটা তোমাকে এতগুলো বছর ধরে ইউজ করছিল জাস্ট। আর তুমি কিনা ওর জন্য মা-বাবা সব ফেলে চলে যেতে চেয়েছিলে! আবার সেই তুমিই তখন আমাকে শাসিয়ে বলছিলে, তোমার বাবাকে আমি অসম্মান করছি, তুমি আমাকে বিয়ে করবে না? বাবাকে নিয়ে তুমি কখনোই এত ভাবো না সুরভী! যদি ভাবতে, এভাবে বিয়ের আগ মুহূর্তে তুমি বাসা থেকে গয়না নিয়ে পালাবার ডিসিশন নিতে পারতে না।”

সুরভী ডুকরে কেঁদে উঠলো। হয়তো অপরাধবোধে! ওর দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো রুদ্র।

— “চোখটা মোছো। তোমার কান্নাকাটি দেখতে আমার ভালো লাগে না।”

উত্তর করলো না সুরভী। রুদ্রর কথা কানে স্পষ্ট পৌঁছালোও না। আসিফ এখনও মাথায় ঘুরছে। যে মানুষটা তাকে ভালোবাসে না তার জন্য সব ছেড়ে যেতে চাইছিল ও! আসিফ শুধু এতগুলো বছর টাকার জন্য ওর কাছে এত অপ্রেম নিয়ে পড়ে রইলো? আর সেই টাকার কাছেই কিনা ওর পাঁচটা বছরের সমস্ত আবেগ, ভালোবাসা, সময় বেচে দিয়ে এভাবে হারিয়ে গেল! এত নিষ্ঠুর, বিবেকহীন লোকও হয় এই পৃথিবীতে? মুহূর্তেই ঘেন্না ধরে এল সুরভীর। সমস্ত আবেগ সবটাই বুঝি ফুরিয়ে গেছে। আসিফের নামের সঙ্গে জুড়ে থাকা কোনো মায়া, ভালোবাসা কিচ্ছু খুঁজে পাচ্ছে না সুরভী।

— “আমাকে বিয়ে করতে তোমার এখন আর কোনো আপত্তি নেই আশা করি!” রুদ্রের কথায় নিজ ভাবনায় ছেদ পড়লো সুরভীর। সামনের লোকটাকেও তার বিবেকহীনই লাগছে। নয়তো এমন মুহূর্তে একজন মানুষকে কেউ বিয়ের কথা কী করে বলতে পারে? মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করবে না? নাকি সেই বোধটুকুই পৃথিবী থেকে চিরতরে উঠে যাচ্ছে? কান্না জড়ানো দৃঢ় স্বরে সুরভী অমত জানালো, – “আমি কোথাও বিয়ে করবো না।”

— “কেন? এখনও সমস্যা কী তোমার?”

— “আপনি কি ইমোশনলেস? সমস্যা কোথায় বুঝতে পারছেন না আপনি? একটা মানুষ এভাবে আমাকে ঠকিয়ে চলে গেল আর আমি তক্ষুনি আপনাকে নাচতে নাচতে বিয়ে করে নেবো?”

— “জানি তোমার খারাপ লাগছে। তুমি এই বিয়েতে রাজি না হলে আমারও খারাপ লাগবে।”

ছলছল স্থির চোখে রুদ্রের দিকে চেয়ে রইলো ও। আবদারের একটা সীমা থাকা উচিত! সুরভীর আরো খানিকটা কাছে এগিয়ে বসলো রুদ্র।

— “আসিফের কাছে তুমি একটা সুন্দর সংসার চেয়েছিলে, ভালোবাসা চেয়েছিলে। সব মেয়েই চায় অমনটা। আমি দেবো তোমাকে। ভালোবাসা, যত্ন, সংসার, সোশ্যাল স্ট্যাটাস সব! আমার ঘরে রাজত্ব করবে তুমি। আমার উপর কেউ কথা বলার সাহস করে না সুরভী। তোমাকে আমি সেই অধিকারটা দিতে চাইছি। নিবে না তুমি?”

— “আমি এই মুহূর্তে কাউকে বিয়ে করার অবস্থায় নেই। বুঝতে কেন পারছেন না?”

— “পারছি তো! তোমার কষ্ট হচ্ছে সে কথা আমি বুঝবো না? কিন্তু এই বিয়েটা খুব জরুরি। হতেই হবে। আজই। তোমার সঙ্গে আমার নাম জুড়ে দেবার আগ পর্যন্ত আমি কোনো কিছুতে শান্তি পাবো না। এত এত দায়িত্ব আমার, আমি শান্তিতে না থাকলে সেসব পালন করবে কে? তুমি শুধু কবুল বলো সুরভী। তুমিটাকে আমাকে দিয়ে দাও, আমি সব সামলে নেবো। তোমার মন খারাপ, অস্থিরতা সব!”

কী বলবে ভেবে পেলো না সুরভী। সম্পূর্ণ অচেনা অদেখা কোনো মানুষ এভাবে উড়ে এসে জোর করে বিয়ের বায়না করলে তাকে কী করে ফেরাতে হয়, ঠিক কোন কথাটা বলে তাকে থামানো যায়, তা জানা নেই সুরভীর। সুরভীর হাত আলতো করে চেপে ধরলো রুদ্র।

— “তুমি কী চাও শুধু বলো আমাকে? সব করবো আমি তোমার জন্য।”

সুরভী এখনও চুপ। ওর চোখে স্পষ্ট বারণ। ও রাজি না এই সম্বন্ধে। কোনোভাবেই না। রুদ্রের আর ধৈর্য হলো না। শীতল চোখে সুরভীর দিকে তাকালো সে।

ভীষণ শান্ত ভঙ্গিতে বললো,

— “তুমি যদি আমার হও, আমার এই মাথাটা তোমার সামনে নুইয়ে দেবো। এবার তুমি হাত বুলাও, চুমু খাও, চড়ে বসো কিংবা চিবিয়ে খাও তোমার ইচ্ছে। আমি সব হাসতে হাসতে মেনে নেবো। তবে যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও, তোমাদের মাথায় আমি চড়ে বসবো। রুদ্রের কারো মাথায় চড়ে বসার পরিণাম ভালো হয় না সুরভী। সহ্য করতে পারবে না। মৃত্যু যন্ত্রণাও এরচেয়ে সহজ মনে হবে। আমার এত চাওয়ার মানুষটাকে এভাবে কষ্ট দিতে আমারও ভালো লাগবে না। রাজি হও, নয়তো আরো অনেক উপায় আছে তোমাকে রাজি করানোর।”

— “থ্রেট করছেন?”

— “উহুঁ! যা কিছু হবে তা-ই বলছি।”

— “আমি আপনাকে চিনি পর্যন্ত না!”

— “রাস্তা থেকে উঠে আসা কোনো ছেলে আমি না, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?”

— “রাস্তা থেকে উঠে আসুন কিংবা প্রাসাদ থেকে নেমে আসুন, আপনাকে নিয়ে আমার ধারণা একই থাকবে

— “কেমন? খারাপ?”

— “ভালো ধারণা হবার মতো কিছু কি করছেন আপনি? চিনি না জানি না হুট করে ঘরে ঢুকে বিয়ের জন্য জোর করছেন। সঙ্গে মন্ত্রী, একগাদা বডিগার্ড, পুলিশ নিয়ে এসেছেন। কোনো সন্ত্রাসী আর আপনার মাঝে খুব একটা তফাৎ আমি দেখছি না! সব কিছুতেই জোর চলে না। বিয়ে একটা মনের ব্যাপার। হতেই পারে আপনার অনেক ক্ষমতা, টাকা, আপনি সুন্দর, শিক্ষাগত যোগ্যতাও অনেক উঁচু। কিন্তু তবুও সেখানে ইচ্ছে কিংবা সম্মতির ব্যাপারটা আসেই। হয়তো আপনার কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে অনেকেই ইচ্ছুক কিন্তু আমার ফ্যামিলি কিংবা আমি আমরা কেউই ইন্টারেস্টেড না।”

সুরভীর বলা প্রতিটা কথা গায়ে বিধলেও ভালো লাগা, ওকে পাবার আকাঙ্ক্ষা যেন আরো তীব্র হলো। অন্য দশটা মেয়ের মতো টাকা, ক্ষমতার মোহে ডুবে গিয়ে জীবনসঙ্গী হবার মানসিকতা এই মেয়েটা রাখে না। ওর কাছে ব্যক্তি, তার মানসিকতা, অনুরাগ মূখ্য। এমন একজনই তো চেয়েছিল সে বহুবছর আগে যখন প্রেম-ভালোবাসার অনুভূতি এই মনে ছিল। চমৎকার একটা জীবনসঙ্গীকে সাথে নিয়ে দূরে কোথাও ঘর বাঁধার স্বপ্ন এই দু’চোখে ছিল। দাদী প্রায়ই একটা কথা বলতেন, “উপরওয়ালা যখন দেয়, ঝুলি ভরে দেয়”। তবে কি উপরওয়ালা এবার সুরভীকে দিয়ে তার সুখের ঝুলি পূর্ণ করবেন?

আরেকটুখানি কঠিন হলো রুদ্র। দুইহাতের মাঝে সুরভীর হাতটা নিয়ে শক্ত করে চেপে বললো,

— “এই যে হাত ধরে রেখেছি, কারো সাধ্য নেই আমার হাত থেকে তোমার হাতটা ছাড়িয়ে নেবার। তোমাকে আমার লাগবেই। এবার তোমার এই বিয়েতে মত থাকুক কিংবা না থাকুক।”

রাগে কান্না পেলো সুরভীর। হচ্ছেটা কী এসব? প্রথমে আসিফ, তারপর এই লোকটা। একই সঙ্গে এতসব ঝামেলা হবার খুব প্রয়োজন ছিল কি? ছলছল চোখে, কান্না চাপা স্বরে সুরভী বললো,

— “কী সুখ পাবেন আপনি আমার কাছে? এভাবে আমাকে জোর করলে না আমি ভালো থাকবো, না আপনাকে ভালো রাখতে পারবো।”

— “দেখা যাক! এখন চলো আমার সঙ্গে। মা-বাবার সামনে গিয়ে বলবে এই বিয়েতে তুমি রাজি।”

— “আমি রাজি না!”

আর বাক্যব্যয়ের রুচি হলো না রুদ্রের। গলা উঁচালো সে,

— “শুভ!”

রুদ্রের চিৎকার এই ঘর অব্দি এল। শুভ ছুটলো পাশের ঘরে। শরীফ সাহেবের হাত চেপে ধরলেন মিতা। ভীতি, শঙ্কা আরো চেপে ধরলো যেন দু’জনকে। বিড়বিড়

করলেন ইকবাল মাহমুদ, “শুধু শুধু পাগল ক্ষেপাচ্ছে”।

শাহীন আহমেদ নিজে সোফা ছেড়ে উঠে এসে শরীফ সাহেবের পাশে দাঁড়ালেন। কাঁধে হাত রেখে নিচু স্বরে বললেন,

— “আপনি কেন এমন গো ধরে আছেন বুঝতে পারছি না আমি। সম্বন্ধটা তো ভালো। মেনে নিয়ে দেখুন একবার। না মানলেই রাজ্যের সমস্যা আপনার ঘাড়ের উপর ভেঙে পড়বে। কেন বুঝতে চাইছেন না?”

দিশেহারা লাগছে শরীফ সাহেবের। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। মেয়ে নিয়ে এতবড় বিপদে পড়বেন তা দুঃস্বপ্নেও আসেনি কোনোদিন।

সুরভীর ঘরে এল শুভ। রুদ্রের পাশে দাঁড়াতেই সে বললো,

— “মাহিনের ওখানে লোক পৌঁছেছে?”

— “জি।”

— “ওকে…”

মাহিনের নাম শোনা মাত্র বুকের ভেতর মোচড় কাটলো সুরভীর। রুদ্রের কথা কাটলো ও।

— “ভাইয়াকে কী করবেন আপনি?”

— “একটু পরই খবর পাবে ওকে কী করেছি।”

— “আমার জন্য ওর ক্ষতি কেন করবেন?”

— “কারণ ও তোমার ভাই।”

অসহায় চোখে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো সুরভী। দু-চোখ বেয়ে পানি ঝরছে ওর। আর একবিন্দু মানসিক চাপ নেবার ক্ষমতা ওর নেই। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। নিজ হাতে ওর চোখজোড়া আলতো করে মুছে দিয়ে রুদ্র বললো,

— “সিচুয়েশন তুমিই জটিল করছো। একটা মানুষ তোমাকে এত করে চাইছে, সে নিশ্চয়ই তোমাকে খারাপ রাখবে না। এতটুকু বোঝার মতো বয়স তোমার হয়েছে সুরভী! আমার লোক দাঁড়িয়ে আছে। বলো, তুমি কি এখনই কবুল বলবে নাকি আমি রাফ ডিসিশনে যাবো?”

আর এক মুহূর্ত সময় নিলো না সুরভী। কোন দূরদেশে ভাইটা একা পড়ে আছে। আত্মীয়স্বজন কেউ নেই ওখানে। ওর বিপদে কে দেখবে ওকে? ভাবতেই মাথা ঘুরতে লাগলো ওর। রুদ্রের চোখে তাকিয়ে নিচু স্বরে বললো,

— “আমি রাজি।”

রুদ্র – ২০

২০

ছোট ভাই-বোনদের উপস্থিতিতে আজ সন্ধ্যার পর মেয়ে বিয়ে দিলেন শরীফ সাহেব। কোনো আয়োজন নেই, খুশি নেই। একমাত্র মেয়ের বিয়েটা এমন কুৎসিত কায়দায় হলো সে কথা যতবার মনে পড়ছে, ততবার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। এমন মানুষের নজরে তার মেয়েটা পড়লো কেমন করে! সোফায় গা এলিয়ে শুয়ে আছেন তিনি। পাশ থেকে ছোট ভাই, বোনজামাই কী কী যেন বলছে তাকে! কানে কিছুই পৌঁছাচ্ছে না। কানে বাজছে শুধু রুদ্রের হুমকি, চোখে ভাসছে মেয়ের কান্না। তার স্ত্রী নিচুস্বরে বিলাপ করে কাঁদছে। ছোটবোন, ভাইয়ের বউ ভাতিজিরা মিলে তাকে শান্ত করতে চাইছে। মুহূর্তে বেড়ে যাওয়া হাই প্রেশার, তেঁতুল গোলানো পানি খাইয়ে আর মাথার তালু তেল পানিতে ভিজিয়ে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। কোনোকিছুতেই স্থির হতে পারছেন না তিনি। এভাবে বলে কয়ে ঘর থেকে মেয়ে তুলে নিয়ে কে যায়!

মোবাইল বাজছে শরীফ সাহেবের। ঘোলা চোখে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলেন মাহিনের নাম। রিসিভ করেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি,

— “বাবা! আমার সুরভী …”

মির্জামহলে সানাই বাজছে। বাড়ির মূল ফটকে চেয়ারে বসে আছেন ফেরদৌসী মির্জা। বিয়েটা ভীষণ অনাড়ম্বর হয়েছে সে কথা জানেন তিনি। তবে ছেলের বউ কোনো আয়োজন ছাড়াই শ্বশুরবাড়ি প্রথম পা রাখবে, তা কিছুতেই হওয়া চলবে না। বিকেলে ছেলে বেরিয়ে যাবার পর তক্ষুনি বাড়ির কর্মচারীদের ডেকে তিনি সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছেন। তার আদেশ মতে পুরো বাড়িতে আলোকসজ্জা করা হয়েছে, রুদ্রের ঘরটা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে, সানাই আর ঢাকের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। বউ বরণের জন্য বংশ পরম্পরায় পাওয়া হারটার সঙ্গে কিনে আনিয়েছেন আরো একসেট গয়না। বাড়ির রান্নাঘরে এখনো চলছে নতুন বউ আগমন উপলক্ষ্যে বাহারী রান্না। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে তার সবসময়ের সঙ্গী নাজনীন, ছোট ভাইয়ের বউ আর ছোট বোন। তাদের কেউ ধরে রেখেছে শরবত- মিষ্টির ট্রে, একজনের হাতে গয়নার বাক্স, অন্যজনের হাতে ফুল।

গাড়ি বাড়ির সামনে এসেছে মিনিট পাঁচেক হলো। এখনও বর-বউ কেউ গাড়ি থেকে নামছে না। কেন যে নামছে না, কে জানে! সুরভীকে একনজর দেখবেন বলে অস্থির লাগছে ফেরদৌসীর। তার অস্থিরতা টের পেয়ে নাজনীন এগিয়ে যেতে চাইলো গাড়ির দিকে। তখুনি থেমে গেল সে। বউ নামছে!

ফেরদৌসীর মুখ থেকে হাসি সরছেই না। এই তো তার একমাত্র ছেলের বউ! এই বাড়ির নতুন কর্ত্রী। তার ছেলের বহু শখের মানুষটা! যার মাঝে তার ছেলে সুখের চাবি পেল তাকে তিনি মাথায় করে রাখবেন।

সুরভী কাছে এসে সালাম করে উঠে দাঁড়াতেই ওর মুখটা দেখলেন ফেরদৌসী। মুখে কোনো সাজ নেই। কেঁদে চোখ-নাক ফুলিয়ে রেখেছে। একটুখানি হাসি মিলিয়ে গেল তার। মেয়েটার বড্ড মন খারাপ! ওর জীবনের সবচেয়ে বড় দিনটা আরো অনেক সুন্দর হতে পারতো। ছেলেটা যে কেন অমন অদ্ভুত আচরণ করলো কে জানে! তবে ছেলে সব সামলে নেবে, সে বিশ্বাস আছে তার। তাই আর মাথা ঘামালেন না তিনি। গায়ের হালকা গয়না, গাঢ় বেগুনী কাঞ্জিভারামে ভারী মিষ্টি লাগছে ওকে।

সুরভীর গালে আলতো করে হাত বুলিয়ে ফেরদৌসী ভাই-বউ, বোনকে বললেন,

— “দেখো তো কেমন বাচ্চা একটা বউ নিয়ে এসেছে রুদ্র! এত এত দায়িত্ব কেমন করে ওরে ঘাড়ে চাপাবো আমি? আমার তো ইচ্ছে হবে ওকে দুই বেণী করে দিয়ে কোলে বসিয়ে রাখি।”

ফেরদৌসীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসলো সবাই। সুরভীর পেছন থেকে সামনে সরে এল রুদ্র। মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করলো সে। ছেলের চোখে মুখে খুশির ছটা দেখতে পাচ্ছেন তিনি। অদ্ভুত এক সুখময় স্থিরতা খেলা করছে তার মাঝে। ছেলেকে কবে এমন খুশি দেখেছিলেন, সুখী হতে দেখেছিলেন মনে নেই ফেরদৌসীর। ছেলের এই মুখটা দেখার জন্যই তো এতগুলো বছর কাতর হয়ে ছিলেন তিনি।

সুরভীর মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে, ওর মাথায় দু-হাত চেপে ছলছল চোখে দোয়া করলেন তিনি,

— “তুমি সুখে থাকো। পৃথিবীর সমস্ত সুখ তোমার হোক। দুঃখ কোনোদিন তোমাকে স্পর্শ না করুক। ভালো থাকো মেয়ে তুমি।”

শাশুড়ির কান্না জড়ানো কন্ঠে চোখ তুলে তার দিকে তাকালো সুরভী। ছেলের বিয়েতে মায়েরা কাঁদে? জানা ছিল না তো! সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। রুদ্র কে, সে কথা জানা নেই সুরভীর। তবে আন্দাজ করাই যাচ্ছে নাগালের বাইরের একজন মানুষ সে। চাইলে দেশের সেরা সুন্দরী, বনেদী ঘরের মেয়েকে বিয়ে করতেই পারতো। ধরে ধরে ওকেই কেন? তাও এমন বাজে কায়দায়! এমন ঘরে বিয়ে দেবার স্বপ্ন তো মনে হয় কোনোদিন মা বাবাও দেখেনি! কেন ঘটছে এসব? রুদ্রের রাজনৈতিক কোনো চালের অংশ কি এই বিয়েটা?

*****

মায়ের কথামত আজ নতুন বউকে ভীষণ যত্নে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়েছে রুদ্র। প্রতিবার সুরভীর মুখে খাবার তুলে দেবার সময় তার মনে হয়েছে, ও আমার বড্ড আদরের কেউ, যার যত্নে কোনো হেলা চলবে না! খাওয়া-দাওয়া শেষে যখন মামী খালা আর কাজিনরা তার পেছন পেছন আসছিল নতুন বউকে বাসর ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দেবে বলে, তখনই সুরভীর হাত কাঁপতে শুরু করলো। সবার চোখ এড়ালেও, রুদ্রের চোখ এড়ালো না। তাদের বাসর নিয়ে দুষ্ট খুনসুটিতে মেতে উঠা ভাই-বোনদের চোখ রাঙিয়ে তক্ষুনি থামিয়ে দিলো সে।

সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— “এত ঘটা করে ঘর অব্দি যাওয়ার কিছু নেই। এটা ওর ঘর। ও একাই যেতে পারবে। ঘরে চলো সুরভী।”

রুদ্রের কন্ঠের কঠোরতা বড্ড কানে লাগলো সুরভীর। লোকটা কি এভাবেই কথা বলে সবার সঙ্গে? ভাই-বোনদেরও কেমন চোখ রাঙালো! সবাই তার এক চোখের ইশারায় চুপ হয়ে গেল, মুরুব্বিরা থেমে গেল। বিয়ের সময়ও বারবার করে ঐ দু’জন সতর্ক করছিল, ঝামেলা করলেই বিপদে পড়বেন। সবাই উনাকে এত ভয় পায় কেন?

রুদ্রকে ঘিরে ভাবতে ভাবতে তার পেছন পেছন তারই ঘরে যাচ্ছে সুরভী। এতটা সময়ে নিজের নতুন ঘরটা দেখা হয়নি। বরণ করে শাশুড়ির ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তখন। এক পা দুই পা করে নিজের ঘরে যত এগোচ্ছে তত ভয় চেপে ধরছে ওকে। হাতের কাঁপুনিটা থামছেই না!

ঘরে ঢুকে, দরজার পাশে মাথা নিচু করে সুরভী দাঁড়িয়ে রইলো। ফুলের ঘ্রাণে চারপাশ মাতোয়ারা। চোখ তুলে এখনো দেখা হয়নি এই ঘর আজ কী কী ফুলে সেজেছে? সামনেই রুদ্র দাঁড়িয়ে। অস্বস্তি আর ভয়ে একটুখানি নড়াচড়াও করতে পারছে না। কয়েক মুহূর্ত খাটের পাশে দাঁড়িয়ে সুরভীকে দেখলো রুদ্র। সে চাইছিল সুরভী চোখ তুলে তাকাক। অন্তত একবারের জন্য হলেও তাকাক। অথচ ও তাকাচ্ছে না কিছুতেই! এগিয়ে এসে সুরভীর হাত টেনে খাটে বসালো সে। ওর কাঁপতে থাকা হাতজোড়া, নিজের দু’হাতের মুঠোবন্দি করে চেপে ধরলো রুদ্র। এই বুঝি লোকটা স্বামীর অধিকার চাইলো বলে! সেই আতংকে হৃৎস্পন্দন দ্রুত হলো ওর। গলা শুকিয়ে কাঠ হলো মুহূর্তেই! জোর করে বিয়ে পর্যন্ত নাহয় সহ্য করা গেছে, তাই বলে এই অপরিচিত লোকটার সঙ্গে বাসর! এতখানিও মেনে নেয়া সম্ভব না। সহ্যসীমা পেরিয়ে যাচ্ছে এবার। ঠোঁট চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো সুরভী।

এক মুহূর্ত সময় নিলো না রুদ্র। সঙ্গে সঙ্গে সুরভীর হাত ছেড়ে খানিকটা দূরে সরে বসলো।

কন্ঠ নামিয়ে সুরভীকে বললো,

— “তুমি যা ভাবছো এমন কিছু হবে না সুরভী। এসব বাসর, ফুল-টুল এগুলো আম্মুর করা। ভেবেছে, ছেলে বিয়ে করেছে, বাসর ঘর সাজাতেই হবে। আম্মু এতসব বুঝেনি। বিয়ে জোর করে করেছি কিন্তু তোমার আমার অন্তরঙ্গতা তোমার অনুমতি ছাড়া হবে না। আমি খারাপ। সত্যিই আমি খারাপ। তবে জোর করে একটা মেয়েকে বিছানায় টানবো এতটাও খারাপ আমি না। হোক সে বাইরের কেউ কিংবা আমার বিয়ে করা বউ। কন্সেন্ট ম্যাটারস! বিয়েটাও জোর করতাম না, কিন্তু তোমাকে যে আমার চাই! তুমি ছাড়া আমাকে আমি ভাবতেই পারছিলাম না। সবকিছু কেমন থেমে গিয়েছিল আমার। আমার সমস্ত দুশ্চিন্তার মাথা খেয়ে বসেছিল তোমার দুশ্চিন্তা যদি তোমাকে আমার করে না পাই! বিয়ে করেছি, তুমি এখন আমার। ব্যস! এটুকুতেই আমার শান্তি। এবার যখন ইচ্ছে হবে তখন আমায় ভালোবেসো। যখন ইচ্ছে হবে আমার কাছে এসো। আমি কখনো তোমার কাছে ভালোবাসা কিংবা ইন্টিমেসি কিছুই চাইবো না। তবে শুধু বলবো, আমাকে ছেড়ে কখনো যেও না। তোমার মনে যদি কখনো কাউকে রাখতে চাও সেই মানুষটা যেন শুধু আমি হই। আমার যখন ভীষণ অস্থির লাগবে, কোথাও শান্তি খুঁজে পাবো না, তখন আমার পাশে বসে আমাকে একটু সময় দিও। তুমি আমার হয়ে আছো, আমার আশপাশে আছো এতেই আমার সুখ।

সুরভীর হাত আর কাঁপছে না। ভয়, অস্বস্তি কিছুই লাগছে না। মনে শুধু একটা অনুভূতিই উপস্থিত আছে, বিস্ময়! এই মানুষটার মুখে এই কথাগুলো বড্ড বেমানান লাগছে না? বিকেলে যতটা কঠোর রূপ দেখেছিল, কোথায় গেল সেই রূপ? এতটা কোমল স্বরে কথা বলতেও জানেন তিনি? ভালোবাসা কিংবা সঙ্গমের মতো তীব্র আকাঙ্ক্ষার ব্যাপারে ধৈর্য্য রাখতে জানেন তিনি?

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রুদ্র।

লম্বা দেহখানি সুরভীর সামনে সামান্য নুইয়ে বললো,

— “জরুরি কাজ আছে, বেরোবো এখন। ফিরতে হয়তো দুইটা কিংবা তিনটা বাজবে। তুমি ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আরেকটা কথা, আমি সোফায় ঘুমাতে পারি না। ফ্লোরেও ঘুমাবো না। খাটেই ঘুমাবো। অবশ্যই দূরত্ব বজায় রাখবো। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে পাশে আমাকে দেখে ঘাবড়ে যেও না।”

বলেই একগাল হাসলো রুদ্র। বেরিয়ে যাবার আগে আলতো করো সুরভীর মাথায় হাত বুলিয়ে গেল।

রুদ্র চলে গেছে। এখনও দরজায় চেয়ে আছে সুরভী। একটা মানুষের মাঝে এত রহস্য কেন থাকবে?

২১

ঘড়ির কাঁটা প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই। রাতের খাবার শেষে, সিগারেট হাতে মাত্রই জানালার ধারে এসে বসতে যাচ্ছিলেন আজগর, তখনই দেখলেন বাড়ির বাইরে রুদ্রের গাড়ি ভেতরে ঢুকবে বলে অপেক্ষা করছে। এত রাতে এখানে এসেছে যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ কারণ তো অবশ্যই আছে। আদনান সম্পর্কিত কিছু? ঐ ছোকড়াকে তো বউসহ কোথায় যেন লুকিয়ে রেখেছে! লুকিয়ে রেখে আর কতদিন? তাছাড়া এ তো সবে শুরু। সামনে আরো কত কী দেখতে হবে দলকে, সে কথা রুদ্র বেশ জানে। কূল-কিনারা করতে পারছে না হয়তো, তাই বুঝি এই রাতে

একটা সুরাহা করতে। ভাবতে ভাবতে একাই হাসলেন আজগর, দুইদিনের বাচ্চা এসেছে কিনা তার সঙ্গে লড়তে!

সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বড্ড আয়েশে উপর থেকে নেমে লিভিং রুমে এলেন তিনি। ততক্ষণে এখানে এসে গেছে রুদ্র আর শুভ। প্রশস্ত হাসিতে জানতে চাইলেন,

— “কী ব্যাপার! এতরাতে আমার বাড়ি?”

— “খুব জরুরি কথা আছে আংকেল।” বিষন্ন মুখ করলো রুদ্র, যেন তার ঘোর বিপদ!

রুদ্রের বিষণ্ন চেহারায় খুশি হতে পারলেন না আজগর। পাহাড় সমান সমস্যা মাথায় ভেঙে পড়লেও চেহারায় সে কথা প্রকাশ করার ছেলে রুদ্র না। মাটিতে একেবারে পিঠ মিশে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সিংহের মতো গর্জন করে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষ ও। নিশ্চিত কোনো ফন্দি করে এসেছে! মুখের হাসিটা আর টিকলো না আজগরের। না চাইতেও চোখেমুখে চিন্তার ছাপ একটু হলেও প্রকাশ পাচ্ছে।

মনে মনে হাসলো শুভ। ভ্রু যুগলের মাঝে কয়েকটা ভাঁজ ফেলে বললো,

— “আহা আংকেল! এখনই চিন্তায় পড়ে যাচ্ছেন! আগে পুরো ঘটনা তো শুনুন। এই সমস্যার সমাধান শুধু আপনার কাছেই আছে। আপনাকেই মাথা ঠান্ডা রেখে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”

এগিয়ে এসে আজগরের কাঁধ জড়িয়ে ধরলো রুদ্র।

— “উপরে চলুন আংকেল। আপনার শোবার ঘরে। স্পর্শকাতর বিষয়! যেখানে সেখানে আলোচনা করা চলবে না।”

— “এত হেঁয়ালী করছো কেন? এখানে বলে দিলেই পারো।”

— “আপনার ঘরের ইজ্জতের ব্যাপার! আমি আপনাকে অপছন্দ করি তা ঠিক। কিন্তু আপনার ইজ্জতের বারোটা বাজাতে আমি একদম চাই না। মিনিমাম মোরালিটি আছে তো আমার!”

— “নতুন করে খেলা সাজালে নাকি, বাবা?”

— “খেলা সাজিয়েই টিকে থাকতে হয়। নয়তো রাজনীতির মাঠে টিকে থাকা যায় নাকি? বাঁচতে দেবেন আপনারা?”

রুদ্রের সঙ্গে চলতে চলতে মনে মনে বিভিন্ন দিক থেকে হিসেব কষছেন আজগর কোন দিক থেকে আক্রমণ আসবে? কেউ কি গাদ্দারী করলো? মতিকে ঠিক বিশ্বাস করা যায় না সেভাবে। ও কি ভেতরের খবর পাচার করে রুদ্রকে সুযোগ করে দিলো? কিন্তু কী? নীরবে লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছেন তিনি। বয়স বাড়ছে। হুটহাট এমন চাপ মাথায় চড়লে তৎক্ষনাৎ নিজেকে স্বাভাবিক রাখা একটু মুশকিল আজকাল। তবুও যথাসাধ্য নিজেকে সংযত রাখার চেষ্টা করছেন আজগর। মরণ সামনে এলেও নিজের দুর্বলতা, ভয় কিচ্ছু বুঝতে দেয়া চলবে না!

আজগরের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো রুদ্র। বাইরে শুভ দাঁড়িয়ে, ভেতরে আনেনি তাকে। মোবাইল ফোনটা আজগরের হাতে ধরিয়ে তার মুখোমুখি বসলো রুদ্র।

— “হার্ট মি! হার্ট মি!”

বাহারী অন্তর্বাস পরে অদিতি দুই পা ফাঁক করে শুয়ে আছে। খাটের সঙ্গে ওর দু’হাত হ্যান্ডকাফে আটকানো। চোখজোড়া লাল কাপড়ে বাঁধা। হেরোইন সেবনকারীরা একটুখানি হেরোইনের জন্য যতটা অস্থির হয়ে উঠে, অদিতি ঠিক তেমন করছে। ঠোঁট কামড়াচ্ছে, গাঢ় নিঃশ্বাসে বুক উঠানামা করছে। একটা পুরুষালী হাত ওর নগ্ন পেট ছুঁয়ে দিতেই ভিডিয়ো অফ হলো।

অক্টোবরের শেষ সময় চলছে। গরম খুব একটা নেই। মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। তবুও ঘামছেন আজগর। মাথার টাকে, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে তার। মোবাইল স্ক্রিনে মেয়েকে এই অবস্থায় দেখে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আজগরের। অদিতিকে কী করেছে এরা? মেয়েটা ব্যথা পাবার জন্য এভাবে মরিয়া কেন হয়ে উঠেছে? কোথায় আছে তার মেয়ে? কে ওর গায়ে হাত দিলো? মেয়ের দুশ্চিন্তায় সমস্ত প্রশ্ন গলা পর্যন্তই আটকে রইলো। রুদ্রকে আর জিজ্ঞেস করা হলো না। মুখ ফুটে একটা শব্দও বেরোচ্ছে না তার। হা করে শ্বাস নিচ্ছে সে। তার দিকে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিলো রুদ্র।

— “এই বয়সে এভাবে প্যানিক করলে বিপদ। মরে যাবেন তো!”

— “অদিতিকে কী করেছো তুমি?”

— “আমি কিছু করিনি। আমার লোকেরা ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে গাড়িতে তুলে নিয়ে ড্রাগ দিয়েছে ওকে। আপনার মেয়ে এখন পুরুষ শরীরের সঙ্গ পাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছে। একটু পর পর চিৎকার করছে, হার্ট মি! হার্ট মি! প্লিজ স্যাটিসফাই মাই থার্স্ট! আরো কী কী সব উগ্র কথাবার্তা! উফ বাবা!”

ঘটনার আকস্মিকতায় সমস্ত কথা, মানসিক জোর হারালেন আজগর। পৃথিবীতে এই একজনই তো আছে যার কাছে আজগর আটকায়, যাকে সে প্রাণাধিক ভালোবাসে। আজ কিনা তার রাজনীতির চালের বলি তার সন্তানকে হতে হচ্ছে? তাও এভাবে! অসহায় চোখে আজগর চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে।

ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো রুদ্র। আজগরের ক্লিন শেইভড তেলতেলে গালে হাত বুলিয়ে বললো,

— “এখনই এমন লুক দিচ্ছেন? সামনে আরো কী সব যে ঘটবে সেসব সামলাবেন কেমন করে? কী সব বলতে কী কী হবে লেট মি এক্সপ্লেইন। বিদেশ বিভূঁইয়ে নানা ঢঙে নারী পুরুষের মিলন হয়। আপনার মেয়ের এই ভিডিয়ো ভাইরাল হবার পর লোকে জানবে প্রাক্তন রেলমন্ত্রীর মেয়ে অদিতি বিদেশ গিয়ে ওসবই এক্সপেরিমেন্ট করছে। ঘূণাক্ষরেও কেউ জানবে না ওকে ড্রাগ দেয়া হয়েছে। আর হ্যাঁ, আপনি বাবা তাই গায়ে কাপড় চোপড় কিছু রাখা হয়েছে। দেশের লোক যখন দেখবে একটা সুতাও থাকবে না কিন্তু!”

রুদ্রের কলার চেপে ধরলো আজগর। কথা বলতে গিয়ে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তার। গুছিয়ে কিচ্ছু বলতে পারছে না! নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টাও করছে না রুদ্র। বসেই রইলো সে আজগরের মুখোমুখি, চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে। এই চাহনী মানুষের না, সাক্ষাৎ অসুরের। যে সমস্ত কিছু মুহূর্তে ধ্বংস করে দিতে জানে। ওর চোখে তাকিয়ে ভীতি গাঢ় হলো আজগরের। ধীরে ধীরে কলার থেকে হাত নেমে আসছিল তার। তখনই তার হাত শক্ত মুঠোয় পুরলো রুদ্র।

— “পাড়া দেয়ার আগে বুঝে নিতে হয় লেজটা কার? ছাগলের নাকি সাপের? সাপের লেজে পা রাখার পরিণাম ভালো হয় না। এতদিন রাজনীতি করে এতটুকু মাথায় ঢুকলো না? আমি ইকবাল না, আমি রুদ্র। আশরাফের ছেলে আমি। বাবার মাঝে মনুষ্যত্ব যা-ও ছিল, আমার সেটাও নেই। পিষে এমনভাবে মাটির সঙ্গে মেশাবো না, দুনিয়ায় আজগর নামের কেউ ছিল সেটাই লোকে ভুলে যাবে।”

— “অদিতি কি সেইফ আছে?”

— “আছে।”

— “কী চাও?”

— “এভিডেন্স। যা কিছু আছে দলের, সব চাই।”

নিজের ল্যাপটপ, আর আলমারী খুলে বেশ কিছু ফাইল সব রুদ্রের হাতে তুলে দিলেন আজগর।

— “যা কিছু আমার কাছে প্রমাণ ছিল, সব এতে দিয়ে দিয়েছি।”

— “আর আপনার মগজ, যেটাতে সব ঘটনা কপি করা আছে। সেটা কী করবো?”

— “মেরে ফেলতে চাও?”

— “না না! কথায় কথায় লোক ধরে মেরে ফেললে চলবে নাকি! আপনি একটু দুষ্টুমি করবেন, আমি একটু করবো এভাবেই বেঁচে থাকবো আমরা। শুধু খেয়াল রাখবেন দুষ্টুমি যেন বেশি না হয়ে যায়! এই তো। আপনি একদিকে মুখ খুলবেন অন্যদিকে আপনার মেয়ে হাওয়া হয়ে যাবে, এবার যতই পাহারা বসান না কেন!”

ল্যাপটপ আর ফাইলগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলো রুদ্র। দরজায় গিয়ে আবার পিছু ফিরলো সে।

— “দ্বন্দ্ব আমাদের মাঝে ছিল। আমাদের পরিবারের মেয়েদের মাঝে টেনে এনে কাজটা ঠিক করেননি। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ আপনি। রাজনীতি আপনাদের দেখেই আমরা শিখি। নোংরামি শেখালে নোংরামিই করবো। সীমা ছাড়াতে শেখালে সীমাই ছাড়াবো। এবং সেটা আপনার চেয়ে দ্বিগুন হবে।”

ঘর থেকে বেরিয়ে এল রুদ্র। পেছন পেছন যাচ্ছে শুভ। তার ফোন থেকে কল গেল লন্ডন, জামিলের কাছে। একবাক্যে শুভ কথা সারলো,

— “অদিতিকে ছেড়ে দাও।”

*****

গাড়িতে চড়ে বসা মাত্রই কল এল আদনানের।

— “কেমন আছেন ভাইয়া?”

এপাশ থেকে কণ্ঠ শুনেই রুদ্র আন্দাজ করে নিলো সোমা-আদনানের সম্পর্ক থেকে অস্থিরতা বিদায় নিয়ে শিথিলতা এসেছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রুদ্র। আদনানকে ঘিরে পুরো ব্যাপারটা এ ক’টাদিন গলার কাঁটা হয়ে ছিল যেন! আদনানের জবাব না দিয়েই পাল্টা প্রশ্ন করলো সে,

— “তোমার খবর বলো? সোমাকে মানানো গেল?”

— “সে কথা বলার জন্যই কল করলাম। সবকিছু ফিক্স হয়ে গেছে। আপনি যেভাবে বলেছেন এক্সাক্ট সেটাই করেছি।”

— “দেখলে? সময় কিন্তু বেশি লাগেনি। ভালোবাসে বলেই তোমার কথা মেনে নিয়েছে। যত্নে রেখো ওকে। ওর প্রাপ্য সম্মানটুকু ওকে বুঝিয়ে দিও।”

— “আর ভুল হবে না। আমার মন্ত্রীত্ব বাতিল হওয়া, মিডিয়া জনগনের প্রেশার এসব হয়তো আমি সামলে নিতে পারতাম, কিন্তু সোমা আমাকে ফেলে চলে গেলে সত্যিই মেনে নিতে পারতাম না! আপনি আপন বড় ভাইয়ের মতো ঐ কঠিন মুহূর্তটায় সাপোর্ট করেছেন। থ্যাংকস ফর এভ্রিথিং ভাইয়া!”

— “এবার ধুমধাম করে বউ ঘরে তোলো।”

— “অবশ্যই তুলবো। কিন্তু নেক্সট প্ল্যান কী?”

— “থাকো ওখানে আরো তিন-চারদিন। তারপর ঢাকায় ফেরো, তখন কথা হবে। এখন শুধু সোমাকে সময় দাও।”

আরো কিছু কথোপকথন শেষে ফোন রাখলো রুদ্র। পাশেই শুভ কথা বলছে ফোনে। হুম হ্যাঁ তে পুরো ফোনালাপ সীমাবদ্ধ তার। আদনানের সঙ্গে কথা চলাকালীন সময় থেকেই খেয়াল করছে রুদ্র। নতুন কোনো খবর হাত লেগেছে হয়তো!

খানিকসময় বাদে কল কাটার পরই রুদ্রকে শুভ বললো,

— “ভালো খবর আছে।”

— “কী?”

— “মতির প্রেমিকা প্রেগন্যান্ট।”

— “মডেলটা?”

— “হ্যাঁ।”

— “বাহ্! চাচা হবো।”

— “তার আগেই লাশ বানিয়ে দেয়ার সুপারিশ চলে এসেছে।”

— “কাকে দিলো?”

— “ফয়েজকে।”

— “সবচেয়ে কনফিডেন্সিয়াল লোক তো ও-ই আছে। কিন্তু খবর লিক হলো কেমন

করে? ও তো মুখ খোলার মানুষ না!”

— “কাহিনিতে টুইস্ট আছে। ফয়েজের মেয়ে-টেয়ের নেশা আছে, তা তো জানেনই। তো যে পাড়ায় যায় সেখানে এক মেয়েকে ওর মনে ধরেছে। খুচরো ইমোশন না, সত্যিই ভালোবাসে মেয়েটাকে। জান-প্রাণ দিয়ে দেবে অবস্থা। সেই মেয়ের সামনে ফোনে কথা হয়েছিল মতির সঙ্গে। সেভাবে ঘটনা আমাদের নন্দীর কানে চলে এসেছে।”

— “ওটারও তো ওদিকে যাওয়ার নেশা আছে।’

— “হ্যাঁ!”

— “সব কথা সবার সামনে বলতে হয় না, এই জ্ঞানটুকু না থাকলে ধ্বংস অনিবার্য। ঝামেলা একটা হবেই। ফয়েজ এক্সপার্ট। ক্ষুরধার বুদ্ধি ওর। মুহূর্তে প্ল্যান ছাড়া পারফেক্ট মার্ডার, কিডন্যাপিংয়ে ও মাস্টার। অথচ দেখো, এই বেসিক সেন্সটা ও রাখে না।”

— “ভালোবেসে অন্ধ হয়ে গেছে।” ফিক করে হেসে ফেললো শুভ।

মুচকি হাসলো রুদ্র। গাড়ির সিটে গা এলিয়ে বললো,

— “তবে লাভটা আমাদেরই হলো। এত পারফেক্টলি সব কিছু ঘটে যাচ্ছে আজ! একদিনে চারটা প্রবলেম সলভড হলো আমার। আমার বিয়ের দিনটা অসাধারণ যাচ্ছে!”

— “তাহলে মতির বিষয়টা কী করবো?”

— “একটা প্রেগন্যান্ট মেয়েকে তো জেনেশুনে আর মরতে দিবো না। তবে ওকে নিয়ে একটুখানি রাজনীতি করাই যায়!”

রুদ্রের ইশারা ঠিক বুঝে নিলো শুভ। মাথা দুলিয়ে সায় দিলো সে।

— “অর্ডার কবে?”

— “আটদিন পর।”

— “কাল বিস্তারিত আলাপ করবো। আজ আর এসব ঘাটাতে ইচ্ছে করছে না। অসম্ভব ভালো মেজাজে আছি।”

— “একটা হিসেব ঠিক ধরতে পারলাম না!”

— “কোনটা?”

— “অদিতির ভিডিয়োটা ওর অজান্তে ওরই প্রেমিক করেছে। তখনও অদিতিকে কিডন্যাপ করা হয়নি, ড্রাগ দেয়া তো পরের হিসেব। যা ঘটেছে সব ওর ইচ্ছেতে, তাহলে কেন ওর বাবাকে মিথ্যা বললেন?”

— “মেয়েকে রেইপ করা হচ্ছে আর মেয়ে স্বেচ্ছায় কোনো ছেলের সঙ্গে সেক্স করছে দু’টোর মাঝে তফাৎ আছে তো! মেয়ে আনন্দে আছে সেটা আজগরকে খুব একটা পীড়া দেবে না। হয়তো সাময়িক রাগ হবে, আবার নাও হতে পারে। মেয়ে দেশের বাইরে কী করছে সে সম্পর্কে একেবারে কিছু অজানা তো ওর নেই। ওর মেয়ের ভিডিয়ো ভাইরাল করে দেবো ঐ হুমকিটা খুব একটা কাজে নাও আসতে পারতো। তবে মেয়ে রেইপ হবে সেটা সব বাবার জন্য সীমাহীন পীড়ার। ডোজ যেহেতু দেবোই, ভালো করেই দেবো।”

— “অদিতি আজ সেন্সলেস ছিল। যদি ওর বাবা কিছু জিজ্ঞেসও করে, কিছুই গুছিয়ে বলতে পারবে না।”

— “হ্যাঁ। সব পার্ফেক্টলি হয়েছে এটাই শান্তি। আজগর মনে হয় না আর বাড়াবাড়ির দুঃসাহস দেখাবে। অদিতিকে নিয়ে কোনো রিস্ক ও নেবে না। মতিকেও সাইজ করে দেবো। জেল থেকে বের হওয়ার আর চান্স নেই। রইলো বাকি হাবিব, দু’জনের এই হাল দেখার পর মনে হয় না ও আর কিছু করার সাহস করবে।”

— “সেটা দেখা যাবে নাহয়!”

— “গাড়ির এসিটা বন্ধ করে, জানালাগুলো খুলে দাও। গায়ে একটু বাতাস লাগাই।” জানালার কাচ নামিয়ে দিলো শুভ। রাস্তা প্রায় শূণ্য। বাইরে ঠান্ডা বাতাস গায়ে এসে লাগছে। মাথা হেলিয়ে বাইরে চেয়ে আছে রুদ্র। গুনগুন করে গাইছে সে। গানের কথা বুঝার চেষ্টা করছে শুভ। শুনেছিল কোনো একসময় এই মানুষটা গানকে ঘিরে নিজের জগত তৈরী করতে চেয়েছিল। বিধিবাম, সে জগত আর তৈরী হয়নি। গান এখন আর রুদ্রের কন্ঠে বাজে না। খুব সম্ভবত তিন বছর পর আজ রুদ্রকে গুনগুন করতে শুনলো শুভ।

— “রাস্তায় কোথাও চাপ নানরুটির দোকান খোলা পেলে গাড়ি দাঁড় করাও। খেতে ইচ্ছে করছে।”

— “ভাবী ঘরে একা। ফিরবেন না?”

— “শি নিডস স্পেস। খুব জোর জবরদস্তি করলাম, মানসিকভাবে ভীষণ এলোমেলো আর অস্থির হয়ে আছে। একা থাকুক কিছুক্ষণ। হিসেব নিকেশ করে পুরো ঘটনাটার সঙ্গে খাপ খাওয়াক।”

২২

পরশু রাতে ঘুম হয়নি গোটা রাত। সেই সঙ্গে গতকালের ধকল মিলিয়ে ক্লান্তি চরমে ঠেকেছিল সুরভীর। রাতে কাপড় বদলে বিছানায় শুতেই দুনিয়া ভেঙে ঘুম নেমে এল চোখে। তারপর রাত সাড়ে তিনটায় রুদ্রের এই ঘরে আসা, ওর পাশে শোয়া, কপালে আলতো চুমু কিছুই টের পেল না সুরভী। সকালে বেলা গড়িয়ে যখন প্রায় নয়টা তখন কপালের উপর কারো স্পর্শে ঘুম ভাঙলো সুরভীর। পিটপিট চোখে তাকিয়ে দেখলো রুদ্র ওর দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো ও। তাড়াহুড়ো করে বুক থেকে সরে যাওয়া ওড়নাটা খুঁজতে লাগলো। হাসি পেল রুদ্রের। নিজের মনেই বলে উঠলো, স্বপ্নে যা ভেলকি দেখিয়েছো না সোনা! এখন আর গায়ে ওড়না না জড়ালেও চলবে।

সুরভীর পায়ের কাছ থেকে ওড়না নিয়ে নিজেই সুরভীর গায়ে পেঁচিয়ে দিলো রুদ্র। অবুঝের মতো মুখ করে তার দিকে চেয়ে রইলো সুরভী। লোকটা সত্যিই কাছে আসার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করছে না। চাহনীতে কোনোভাবেই কাম প্রকাশ পাচ্ছে না। যথাসাধ্য দূরত্ব বজায় রেখে যত্নের ভাষা প্রকাশ করছে, আগলে রাখতে চাইছে। তবে গতকাল এমন কেন করলো?

— “তোমার আজ ইম্পরট্যান্ট কোনো ক্লাস আছে? ভার্সিটিতে যেতে চাও?”

— “না।”

— “সিওর?”

— “হ্যাঁ।”

— “আমি অফিসের জন্য বেরোবো, ভাবলাম তুমি ভার্সিটিতে গেলে তোমাকে ড্রপ করে যাবো।”

— “ওহ!”

— “আম্মু তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছিল। ফ্রেশ হয়ে দেখা করো আম্মুর সঙ্গে।”

— “আমি উঠতে খুব দেরী করে ফেললাম বোধহয়!”

— “এসব কোনো ব্যাপারই না! যেভাবে ভালো লাগে, থাকো। আম্মু কিংবা আমি আমরা কখনোই তোমার ভালো লাগা, স্বাধীনতায় নাক গলাবো না। শুধু আমার গতকালের রিকুয়েষ্টটা মনে রেখো। তাহলেই হবে।”

কিছু বললো না সুরভী। মাথা নিচু করে রুদ্রের কথা শুনলো শুধু। বিছানা ছেড়ে উঠে যাবার সময় চুলগুলো উঁচু খোপায় বাঁধতে লাগলো ও। রুদ্রের চোখ পড়লো ওর ঘাড়ে। ধীরে ধীরে চুল সরে গিয়ে হলদে ফর্সা বর্ণের ত্বকটা স্পষ্ট হচ্ছে। মোহনীয় ভীষণ! দেখলে ছুঁয়ে দেয়ার লোভ হবে এমন। রুদ্রেরও হচ্ছে কিন্তু সে ছোঁবে না। সুরভী একটুখানি সহজ হবার আগ পর্যন্ত ওর কাছে যাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা সে করবে না।

চোখ ফিরিয়ে নিলো রুদ্র। সুরভীকে ডাকলো পেছন থেকে,

— “শোনো?”

— “জি?”

— “তোমার মা-বাবা, চাচা, ফুফুদের আম্মু কল করে দাওয়াত করেছে। আজ বিকেলে আসবেন উনারা। আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো। এখানে চা নাস্তা করবেন, সঙ্গে ডিনারটাও। আম্মু দেখছেন পুরো আয়োজনটা, তবুও তোমার যদি মনে হয় মেন্যুতে কোনো চেঞ্জ আনতে হবে বা কিছু এড করতে হবে তুমি আম্মুকে বলো। হেসিটেশনের কিছু নেই। আর যদি বেশিই অস্বস্তি হয় আম্মুকে বলতে, তাহলে আমাকে বলো।

চোখ চকচকে হয়ে উঠলো সুরভীর।

— “আম্মু-আব্বু আসছে!”

— “হ্যাঁ। মেয়ের কোথায় বিয়ে হলো দেখবেন না উনারা? তাই আম্মু দাওয়াত করলো।”

— “কথা হয়ে গেছে সব? কই আম্মু তো আমাকে কিছু জানালো না!”

— “কল করেছিল একঘন্টা আগে। তুমি ঘুমুচ্ছিলে, তাই কলটা আমি রিসিভ করেছি।”

— “ওহ!”

— “ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি ওয়েট করছি। নাস্তা করে আমাকে অফিসে যেতে হবে।”

— “আপনি খেয়ে নিন। আমার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।’

ভ্রু কুঁচকালো রুদ্র।

— “কেন?”

রুদ্রের অসন্তোষ চোখে পড়লো সুরভীর। এই মানুষটার উপর থেকে ভয় এখনো কাটেনি। তার অসন্তোষ সুরভীর আতংক বাড়ালো। সুরভীর চোখে স্পষ্ট সে খবর রুদ্র পড়তে পারছে। মুচকি হেসে এগিয়ে এল সে।

— “আমাকে ভয় কেন পাচ্ছো?”

কিছু বললো না সুরভী। ওর কানের পাশে চুল গুঁজে দিলো রুদ্র।

— “গতকালের ঘটনা ধরে রেখো না সুরভী। গতকালের পর তোমার আমার একটা সম্পর্ক হয়েছে, পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে গেছে। তুমি কি বুঝতে পারছো না একদম? আমি তো বলেছি এই মাথাটা তোমার সামনে নুইয়ে দেবো। সত্যিই দেবো। মাত্রই এলে। সময় যাক। সব সহজ হবে। বুঝে নেবে। তুমি একটু স্বাভাবিক হও প্লিজ। আমার রাগ, ধমকে কিংবা বিরক্তিতে এভাবে ঘাবড়ে গেলে হবে না তো! আরো দ্বিগুন রাগ, বিরক্তি নিয়ে আমার উপর চড়াও হতে হবে, নয়তো তোমার সঙ্গে সংসার করে সুখ পাবো না আমি।”

ঠোঁট চেপে হাসলো সুরভী। কিছু না বলেই চলে গেল ওয়াশরুমে। এই ঘরে সবকিছু ওর জন্য গোছানো আছে। ব্রাশ থেকে শুরু করে, তোয়ালে, পরনের জামা, কসমেটিকস সবকিছু। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করতে করতে রুদ্রকে নিয়ে, নতুন এই জীবন নিয়ে ভাবতে লাগলো সুরভী। রুদ্র লোকটাকে ধাঁধার চেয়েও জটিল লাগছে। দেখতে লোকটা ভারী সুদর্শন। শ্যামলা বর্ণের, উঁচু সুঠাম গড়নের সে। কথা বলার সময় ঠোঁটের চেয়ে চোখ কথা বলে বেশি। যার চোখ এতটা অভিব্যক্তিপূর্ণ, তার চোখই তো সবার নজর আগে কেড়ে নেবে। পুরো মানুষটাকে যদি বাহ্যিকভাবে বিবেচনা করা হয়, যে কেউ তার চোখ আর চুলের প্রশংসায় মুখর হবেই। এমন সুদর্শন পুরুষটা হুট করে কোথা থেকে এসে তাকে ধরে নিয়ে এল, রাজকীয় এক জীবন তাকে দিলো। কিন্তু কেন? কোনো কিছুরই হিসেব মিলছে না সুরভীর। একদম না! ঘোরই কাটছে না! ওদিকে শুধু ব্যক্তি রুদ্রকে নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে। ভয় যদিও কাটছে না, তবে সহজ লাগছে আগের চেয়ে। কথার ভঙ্গি, চাহনী ধীরে ধীরে সহজ করে নিচ্ছে পরিস্থিতি, মনের অবস্থা।

২৩

অফিসে নিজের রুমে কাজ সারছিল রুদ্র। শুভ হঠাৎ বাইরে থেকে ছুটে এসে টিভি অন করলো। ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে টিভিস্ক্রিনে তাকালো রুদ্র। ব্রেকিং নিউজে আজগরের স্ট্রোকের খবর জানানো হচ্ছে, সঙ্গে রিপিট টেলিকাস্ট চলছে হসপিটালে আজগরকে ঢুকানোর দৃশ্য।

আবার কাজে মন দিলো রুদ্র।

টিভি অফ করে তার মুখোমুখি বসলো শুভ।

— “একেবারে মরার ঘাটে পৌঁছে গেছে দেখছি।”

— “দুর্বল রগে চেপে ধরলে লোকে অমন মরার ঘাটেই পৌঁছায়। জ্ঞান ফিরলে একটা ফ্লাওয়ার বুকে পাঠিয়ে দিও।”

মাথা দুলিয়ে হাসলো শুভ। গম্ভীর মুহূর্তে সূক্ষ্ম তামাশা করা রুদ্রের পুরোনো অভ্যেস। হসপিটালের বেডে পাঠিয়েও শান্তি হলো না। এবার তাকে সেখানে খোঁচানোর কথাও ভাবছে! সম্ভব হলে হয়তো মরে যাবার পর কবরে গিয়েও খোঁচাতো।

— “রাতে কিন্তু আমার ওখানে খাবে। সঙ্গে তিথিকেও নিয়ে এসো।”

— “রাতের বেলা ওকে বের হতে দেবে না একা।”

— “এখনও বাসার লোকেরা তোমার কথা জানে না কেন? জানাতে বলো।”

— “রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এমন ছেলের সঙ্গে কোনোভাবেই মেয়ে দেবে না। সরকারী চাকরি করে, ডিসেন্ট ছেলে দেখে ওকে বিয়ে দেবে।”

— “বাবা-মায়েরা আর সরকারী চাকরির গন্ডি থেকে বেরোতে পারলো না!”

— “ওর পড়া শেষ হোক। দেখি কী হয়!”

— “তাহলে অন্য একদিন নিয়ে এসো সময় করে। সুরভীর সঙ্গে পরিচয় করাবে না! আম্মুও জিজ্ঞেস করছিল কয়েকদিন আগে তিথির কথা।”

— “ওর পরীক্ষা চলছে। শেষ হোক নিয়ে আসবো একদিন।”

*****

শাশুড়ির ঘরে বসে আছে সুরভী। আলমারী থেকে একটা চেইন বের করে সুরভীর পাশে এসে বসলেন তিনি

— “লকটা খোলো তো!”

দ্রুত চেইন হাতে নিয়ে লকটা সুরভী খুলে দিলো। ম্লান হাসলেন ফেরদৌসী। – “ডান হাতটা ঠিকঠাক নাড়াতে পারি না। এই হাতে কাজ করা একটু মুশকিল! আগের মতো আর নেই আমি। পঙ্গু হয়ে এমন দিন কাটাচ্ছি বহুদিন।” মায়া হলো সুরভীর। এসেছে পর থেকে দেখছে সার্বক্ষণিক একজন মহিলা নির্ভর উনার জীবনযাপন। তার সাহায্যে দিব্যি চলে যাচ্ছে সবকিছু। তবুও তো, পরনির্ভরশীল জীবনে সুখ কোথায়? অচল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ টেনে আর কতটুকু ভালো থাকা যায়?

সুরভীর গলায় চেইনটা পরিয়ে দিলেন ফেরদৌসী।

— “লকটা লাগাও তো মামণি!”

সুরভীর গলা হাতড়ে দেখছেন ফেরদৌসী।

— “ভীষণ মানিয়েছে।”

সুরভী প্রত্যুত্তর করলো না। লাজুক হাসলো শুধু।

— “আমার সবকিছু তোমারই সুরভী। তবুও এটা আমি নিজ হাতে পরালাম কেন জানো? এটা আমার কাছে খুব স্পেশাল। বিয়ের রাতে তোমার শ্বশুর আমাকে এটা পরিয়ে দিয়েছিল। আমার বিবাহিত জীবনের প্রথম গিফট এটা।”

— “আমাকে দিয়ে দিলেন!”

— “তুমিও আমার কাছে বিশেষ একজন। আমার রুদ্র খুব আশা নিয়ে তোমাকে বউ করেছে। রুদ্রের সুখ যার কাছে, সে আমার কাছে শিরোমণি। তোমার শ্বশুর মারা যাওয়ার পর এটা আমি আর পরিনি। তুলে রেখেছিলাম। আজ থেকে এটা তুমি যত্নে রেখো, তোমার কাছে।”

— “আপনি ভালোবেসে আপনার এত ভালোবাসার জিনিসটা আমাকে দিলেন, আমি এটা খুব যত্নে রাখবো সবসময়।”

— “আমার ছেলেটাকেও দেখে রেখো। যত্নে রেখো। ও মানুষটা খুব ভালো। রাজনীতি করে, হয়তো ওর অনেক অনেক খারাপ দিক তোমার চোখে পড়বে। সেসব দেখে তুমি রুদ্রকে ভুল বুঝো না যেন! ও তোমাকে ভীষণ ভালো রাখবে, দেখে নিও তুমি।”

কথা বলছে না সুরভী। মাথা নিচু করে বসে আছে।

তার মাথায় হাত বুলালেন ফেরদৌসী।

— “এভাবে তোমার বিয়েটা তুমি এখনও মেনে নিতে পারছো না এটাই স্বাভাবিক। তবে বলবো, রুদ্রকে একটু সুযোগ দাও। মনের দরজাটা বন্ধ করে রেখো না। দেখবে, সব সহজ হবে। তোমার সমস্ত প্রশ্নের জবাব তুমি পাবে।”

— “গল্প করছো তোমরা?” দরজার ফাঁকে উঁকি দিয়ে আছে রুদ্র।

হাসলেন ফেরদৌসী।

— “ভেতরে আয়?”

— “নাহ্। গল্প করো তোমরা। আমি ফ্রেশ হতে যাই।”

রুদ্র যেতেই ফেরদৌসী, সুরভীকে বললো,

— “আচ্ছা, তুমি গিয়েছিলে রান্নাঘরে? সব ঠিকঠাক আছে তো?”

— “আমি আবার কেন দেখতে যাবো? আপনি বলেছেন যেহেতু, সবকিছু পারফেক্টই হবে।”

— “তাই বলে তুমি একবার চেক করবে না?”

— “না! আমি কেন?”

— “আমি কেন মানে? তুমি কি গেস্ট? তুমি এই বাড়ির মালকিন। তোমার বাবার বাড়ির মানুষ আসছে তোমার বাড়িতে। এসব তদারকী তোমাকেই করতে হবে। অসুস্থ শাশুড়ি তোমার, এতকিছু দেখে রাখার জো আর নেই। বউকে খাটে বসিয়ে আস্তে ধীরে দায়িত্ব ছাড়বো ঐ অবস্থাও নেই। খুব জোর কাল পর্যন্ত আমি এসব দেখবো। পরশু থেকে চাবি বুঝিয়ে দেবো। ব্যস, আমি এবার শান্তি।”

— “আমি এতকিছু কিভাবে কী করবো?”

— “আমাকেও এভাবে দায়িত্ব ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছিল। তোমার চেয়েও বয়সে ছোট ছিলাম, করতে করতে শিখে গেছি। তোমারও হয়ে যাবে।”

— “যদি ভুল করি?”

— “ভুল করলে করবে। তোমার হাজবেন্ড আর শাশুড়ি তো জাদরেল না যে ভুল করলেই কথা শোনাবে। রিল্যাক্সে সব করবে তুমি। ভুল হলে তা থেকে শিখবে।”

অসহায় ভঙ্গিতে ঘাড় বাঁকিয়ে সম্মতি দিলো সুরভী। এতবড় বাড়ি, এত এত কর্মচারী এসবকিছু কিভাবে সামলাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না ও। তার উপর এই বাড়িটাই তো ঠিকমতো দেখা হলো না। কোন কর্মচারীর কী দায়িত্ব, সেটাও ওর জানা নেই। এই ঘরের মানুষ কী খায়, কী খায় না, পছন্দ-অপছন্দ কিচ্ছু জানা নেই ওর। মনে হচ্ছে যেন মাঝ সমুদ্রে পড়ে গেছে ও!

সুরভীর চিন্তা দেখে হাসলেন ফেরদৌসী।

— “চিন্তায় মরে যাবার কিছু নেই, রিল্যাক্স থাকো। আছি তো। সব সহজ করে দেবো তোমার জন্য। এবার ঘরে যাও, সন্ধ্যা হতে সময় বেশি নেই। তোমার মা বাবা চলে আসবে কিছুক্ষণ পরই। সুন্দর একটা শাড়ী পরো, কানে গলায় গোল্ড পরো, একটু সাজো। দুঃখী দুঃখী মুখ করে থেকো না। তোমার মা-বাবা বড্ড দুশ্চিন্তায় আছে তোমাকে নিয়ে। তুমি সেজেগুজে আছো, হাসিখুশি ঘুরছো দেখতে পেলে তোমার মায়ের মনটা একটুখানি শান্ত হবে।”

২৪

রুদ্রের শ্বশুরবাড়ির লোক এসেছে আজ। আপ্যায়নে কোনো কমতি রাখেননি ফেরদৌসী। সেই সঙ্গে আপ্রাণ অমায়িক আচরণ তো তার আছেই। দেখে মনে হচ্ছে যেন তিনিই মেয়েপক্ষ। ফুল দিয়ে বরণ করেছেন তিনি বেয়াই বাড়ির লোকদের। টেবিল বাহারী নাস্তায় ভরপুর করে রেখেছেন। এত খাবার দেখেই পেট ভরে গেছে মিতার। মেয়ে নিয়ে গুরুতর দুশ্চিন্তায় গতকাল থেকে তার খাওয়া বন্ধ। মেয়েকে বাহ্যিকভাবে ভালো দেখালেও আদৌ মেয়েটা ভালো আছে কি না সে খবর ওর মুখ থেকে না জানার আগ অব্দি শান্তি পাবেন না তিনি। রুদ্র সবাইকে নিয়ে গেছে পুরো বাড়িটা ঘুরিয়ে দেখাতে। মিতা যাননি। অস্থির হয়ে তিনি সুযোগ খুঁজছেন মেয়ের সঙ্গে একটু আলাদা বসে কথা বলবেন বলে। ফেরদৌসী গল্পের ফাঁকে বুঝলেন মায়ের অস্থিরতাটুকু। কাজের বাহানায় বসার ঘর ছাড়লেন তিনি। যাবার আগে সুরভীকে বললেন,

— “মাকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। বেয়াইন একটু আরাম করে বসুক। তোমার ঘরটাও দেখুক।”

ফেরদৌসী চোখের আড়াল হওয়া মাত্র মেয়ের হাত চেপে ধরলেন মিতা,

— “জলদি চল, কথা আছে তোর সঙ্গে।”

ভাই-বোনরা, তাদের পরিবারেরা হতবাক হয়ে পুরো বাড়ি দেখছে। বাড়ির ব্যাকইয়ার্ডে বাচ্চারা ছুটছে। সেসবে বিন্দুমাত্র মন নেই শরীফ সাহেবের। তার সমস্ত নজর আটকে আছে রুদ্রে। তার চলন-বলনে বড় সূক্ষ্ম নজরদারি করছেন তিনি। ওর পরিবার বলতে শুধু মা। মা-ছেলে বাদে এই ঘরে আর কোনো সদস্য নেই। বাকি যারা আছে সব কর্মচারী। আত্মীয়স্বজনও হয়তো তেমন নেই। থাকলেও হয়তো যোগাযোগ নেই। বলা চলে মা-ছেলের বেশ একাকিত্মের জীবনযাপন। মায়ের আচরণ ভীষণ অমায়িক আর মিশুক প্রকৃতির। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে মেয়ে ধরে এনেছে তার ছেলে, এই নিয়ে ন্যূনতম আক্ষেপ, ক্ষোভ কিংবা অসন্তোষ কিছু দেখা যায়নি তার মাঝে। আচরণ মুগ্ধ হওয়ার মতো বটে। তার কাছে সুরভী নিরাপদ। কিন্তু যার সঙ্গে বিয়ে হলো সে? কানকথায় রুদ্রের নামে পথে-ঘাটে, চায়ের দোকানে মাঝেমধ্যে চর্চা শুনেছেন আগে। প্রচন্ড তুখোড় সে। মন্ত্রী আমলারা তাকে দশবার সালাম ঠুকে। গতকাল যে রূপ সে দেখালো তাতে কোনোভাবেই ওকে ভালো বলা চলে না। কিন্তু আজ যাকে দেখছেন সে ভীষণ ভদ্র। এখানে এসে এমন আচরণ পাবেন, তা একদম আশা করেননি। এই ছেলেটাকে ঠিক বুঝতে পারছেন না শরীফ সাহেব। খুবই সাধারণ পরিবারের সাদাসিধা একটা মেয়েকে কেন এমন একজন ছেলে এভাবে ঝামেলা ফ্যাসাদ করে একবেলার মধ্যে বিয়ে করলো, এর পেছনে কারণ কী, তাও ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। শার্টের হাতায় টান লাগলো তার। ঘাড় ফেরাতেই তার কানের কাছে ফিসফিসিয়ে উঠলো ছোটবোন আফসানা।

— “তোমার মেয়ের কী কপাল দেখছো! রাজঘরে বিয়ে হয়েছে ওর। এমন বাড়ি, এমন পাত্রের চিন্তা আমরা কল্পনায়ও আনার দুঃসাহস করি না ভাইয়া। অযথা চিন্তায় মরছিলে তুমি।”

বোনের কথায় মত-অমত কিছুই করলেন না শরীফ সাহেব। চুপচাপ শুনলেন শুধু। তার দুশ্চিন্তা বুঝার মতো অবস্থায় কেউ নেই। মেয়েটা তার। বাইরের যে চাকচিক্য দেখে সবাই মুগ্ধ হচ্ছে, সেই চাকচিক্য দেখে তার আতংক আরো বাড়ছে। হিসেব আরো গরমিল লাগছে। এখানে, এইবাড়িতে সুরভীর বিয়ে কী করে সম্ভব?

মেয়ের ঘরে ঢুকেই তার হাতে ধরে কেঁদে ফেললেন মিতা।

— “তুই ঠিক আছিস তো মা?”

মায়ের কান্নায় চোখে পানি ধরে রাখতে পারেনি সুরভীও। মেয়ের চোখে পানি দেখে মিতা আঁতকে উঠলেন,

— “তোকে কী করেছে ছেলেটা?”

— “না, না! আমাকে কী করবে?”

— “কাঁদছিস যে!”

— “তুমি কাঁদছো তাই।”

— “ঠিক করে বল না মা! ভয় পাচ্ছিস? ভয়ে সত্যি লুকাচ্ছিস না তো?”

— “সত্যি বলছি আম্মু! সবকিছু ঠিক আছে। বরং প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই ঠিক।”

— “কেমন?”

— “সবকিছু এত পারফেক্ট! এত পারফেক্ট কিছু হয় না আম্মু।”

— “খুলে বল তো?”

উঠে গিয়ে আলমারী খুললো সুরভী।

— “দেখো কান্ড! আলমারী ভর্তি শাড়ী, কুর্তী, লেগিংস, কামিজ। ওয়েস্টার্নও আছে। ড্রেসিং টেবিলটা দেখো একটু! ফ্রেঞ্চ পারফিউম, জাপান থেকে আনা সব স্কিন কেয়ার প্রোডাক্ট, মেকআপ আইটেমগুলো লন্ডনের। ওয়াশরুমেও একই অবস্থা। এক্সপেন্সিভ সব জিনিসে ঘর ভরিয়ে রেখেছে। এই যে দেখো আমার গলায়, এই সেটটা গতকাল আমার শাশুড়ি বরণ করার সময় আমাকে পরিয়ে দিলো।”

— “বিয়ের সময়ও তো ভারী একসেট দিলো তোকে।”

— “হ্যাঁ। সেটাই বলছি। স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে সবকিছু।”

— “আর রুদ্র?”

— “একদম অন্য মানুষ। সফট টোনে কথা বলছে, আমার মেন্টাল স্টেট, ইমোশন বুঝে কথা বলছে, মিশছে।”

— “কাছে আসার ব্যাপারটা?”

— “একদম না। আমাকে বলেছে তোমার অনুমতি ছাড়া আমি কাছে যাবো না।”

ভ্রু কুঁচকালেন মিতা,

— “সত্যিই?”

— “অবাক করা বিষয় না, বলো?”

— “তোকে যেভাবে গতকাল তুলে আনলো, এই কথা কাউকে বললে কে বিশ্বাস করবে?”

— “আমারও বিশ্বাস হয়নি।

— “ওর আর বউ-টউ নেই তো, তাই না?”

হেসে ফেললো সুরভী।

— “না আম্মু, এখনো চোখে পড়েনি।”

— “হাসবি না। চিন্তায় পুরো রাত আমি ঘুমাইনি জানিস!”

— “জানি।”

— “পুরো রাত নামাজ পড়েছি আর দোয়া করেছি। কী যে অসহায় লাগছিল নিজেকে! তোর সঙ্গে এই ছেলেটা কী করছে, কোনো টর্চার করছে নাকি, এসব! তার উপর বারবার শুধু মনে হচ্ছিল ওর তো বউ-বাচ্চাও থাকতে পারে। থাকে তো এমন নেতা-টেতাদের। থাকে না বল?”

— “এখন পর্যন্ত যতটুকু জানি, একমাত্র বউ আমিই। আর কেউ নেই।”

— “তার উপর সকালে কল করলাম, তোর বর রিসিভ করলো। আমার দুশ্চিন্তা

আরো বাড়লো। ভেবেছি ও ইচ্ছে করে তোর সঙ্গে আমাকে কথা বলতে দিলো না।

যদি ওর বিপক্ষে আমাকে কিছু বলে দিস, তাই।”

— “সব ঠিকঠাক আছে।”

— “ঠিকই বলেছিস। প্রয়োজনের চেয়ে সবকিছু একটু বেশিই ঠিক মনে হচ্ছে।”

— “সেজন্যই আমার হিসেব, ঘোর কিচ্ছু কাটছে না।”

— “সময় লাগবে এই ঘটনা থেকে বেরোতে। তবে বিয়ে তো বিয়েই। যেভাবেই হোক, হলো তো। রুদ্র তোর বর, এটা তোর শ্বশুরবাড়ি এটা আমাদের মেনে নিতে হবে। তোরও ধীরে ধীরে দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে।”

— “দায়িত্বের কথা বলছিলেন আমার শাশুড়ি।”

— “এতবড় ঘর, এত চাকরবাকর, ভিন্ন জীবনধারা, এদের দায়িত্বই বা পালন করবি কেমন করে? তুই এমন জীবনযাপনে তো অভ্যস্ত না। মেয়েরা শ্বশুরবাড়িতে প্রশংসা না কুড়াতে পারলে মায়েদের লজ্জার সীমা থাকে না। তুই কিভাবে যে কী করবি! ধুর ছাই! দুশ্চিন্তার পর দুশ্চিন্তা!”

*****

ডাইনিং টেবিলে রাতের খাবার সাজানো হচ্ছে। একটু পরই খেতে বসার ডাক আসবে, তারপর খেয়ে দেয়ে বাসায় ফেরার প্রস্তুতি। তার আগেই কথা সারতে চাইলেন শরীফ সাহেব। নতুন বেয়াইন আর মেয়ে জামাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

— “বিয়ের পরদিন মেয়েকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার নিয়ম। আমরা সুরভীকে আজ সঙ্গে নিয়ে যেতে চাই।”

ফেরদৌসী কিছু বলার আগেই রুদ্র বাঁধ সাধলো।

— “ও আপাতত কোথাও যাবে না। থাকুক কিছুদিন, তারপর নিয়ে যাবেন।”

বলেই সুরভীর দিকে তাকালো রুদ্র। এতটা সময় সুরভী চেয়ে ছিল রুদ্রের দিকেই।

চোখে চোখ পড়া মাত্র চোখ নামিয়ে নিলো সুরভী।

মেয়ে জামাই কর্তৃক এমন প্রত্যাখ্যানে অপমানিত বোধ করলেন শরীফ সাহেব। চেহারায় তা স্পষ্ট হতে দেননি। দ্বিতীয়বার কিছু বলতেও আত্নসম্মানে টান লাগছিল খুব। উনি কিছু বলার আগেই মিতা অনুরোধ করলেন,

— “এটা তো নিয়ম বাবা! হঠাৎ করে চলে এল, ওর মনও বসছে না হয়তো

এখানে। দুদিন বাসায় থেকে এলে আমাদেরও ভালো লাগতো।”

মিতার সঙ্গে তাল মেলালেন ফেরদৌসী।

— “ঠিকই তো! তুই বারণ কেন করছিস বুঝলাম না!”

— “ও অবশ্যই যাবে। ওর বাবার বাড়িতে ও যাবে না? কিন্তু আপাতত না। থাকুক আরো কিছুদিন। আমি নিজে গিয়ে রেখে আসবো ওকে। টেবিলে খাবার রেডি। চলুন আপনারা।”

আর কিছু বলার সুযোগই দিলো না রুদ্র। গোমড়া মুখে নতুন জামাইর আবদার মেনে নিলো শরীফ-মিতা দম্পতি।

রুদ্র – ২৫

২৫

জানালার ধারে মাথা ঠেকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল সুরভী। ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে আছে। কখন রুদ্র এই ঘরে এসে, খাটের এক কোণায় ওর এলোমেলো শাড়ীটা সরিয়ে সোফার উপর রাখলো, গয়নাগুলো ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে নিয়ে বাক্সে গুছিয়ে রাখলো, কিছুই জানে না সে। প্রায় ১৫মিনিট পর রুদ্র জানালার আরেক প্রান্তে, বুকে দুইহাত ভাঁজ করে, মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়ানোর পর তার উপস্থিতি চোখে পড়লো সুরভীর। সৌজন্যতার খাতিরে হাসলো ও। ম্লান হাসি।

— “সুরভী।”

— “জি?”

— “তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ফর্মালিটিজ মেইনটেইন করে চলার মতো না। আমরা দু’জন আমাদের “র ভার্সন” নিয়ে দু’জনের কাছে ধরা দেবো এটাই এই সম্পর্কের নিয়ম। তুমি আমার বিজনেস ক্লায়েন্ট না, আমি তোমার পাশের বাসার ভাই লাগি না। তোমাকে আমি যেতে দেইনি, তোমার মন খারাপ হয়েছে সেটা আমাকে বুঝাও। বুঝতে না দিলে যে বাড়তি প্যাম্পার আমি তোমাকে করবো সেটা তুমি পাবে না। আমি শুধু তোমার ভালোবাসা চাই না। আমি গোটা সুরভীকেই চাই। আমি সুরভীর রাগ চাই, হাসি চাই, সবরকম পাগলামি-বাচ্চামি দেখতে চাই, মন খারাপ, রাগ, গালি, বকা সব চাই। সব। এসব ভয়, ফর্মালিটিজ ছাড়ো। মাথা পেতে দিয়েছি, চড়ে বসো তাতে। আবদার করতে শেখো। আমি কতকিছুই না করবো, তাই বলে তুমি চুপচাপ মেনে নেবে? আমার কাছ থেকে আদায় করে নেবে না? তুমি যদি একটু ঢঙ করে বা রাগ করে আমাকে বলতে আমি বাবার ওখানে যাবো খুব জোর মিনিট পাঁচেক আমি তোমাকে বারণ করতাম। কারণ আমি সত্যিই চাচ্ছি না তুমি যাও। কিন্তু তুমি জেদ করলে আমি তোমাকে বারণ করতাম না কখনোই। আমি তোমার মুখ দেখছিলাম বারবার, কিছু বলবে নাকি দেখতে চাইছিলাম, অথচ তুমি বললে না। সবসময় আমি যা বলি সেটাই মেনে নিলে চলবে নাকি? আমার উল্টোটা বলতে হবে। নিজের ইচ্ছে প্রকাশ করতে হবে। তোমার যুক্তি আমাকে দেখাতে হবে। নয়তো এভাবে সংসার করা যাবে নাকি? বোর হবো না আমি?”

জড়তাহীন হাসলো সুরভী। ভালো লাগায় মন পূর্ণ হলো রুদ্রের। সুরভীর মাথার চুলগুলো হাতের আঙুলে এলোমেলো করে দিয়ে রুদ্র বললো,

— “এতক্ষণে মনে হচ্ছে আমার ওয়াইফ ঠিকঠাকভাবে হাসছে।”

রুদ্রের চোখে তাকানোর সাহস হলো সুরভীর। রুদ্র নিজেই তাকে দিয়েছে এই সাহসটুকু। “আমার ওয়াইফ “ শব্দটায় আলাদা ভালো লাগা আছে। বিয়েটা এখনও মন থেকে মানতে পারেনি যদিও, তবুও ভালো লাগা এই মনটাকে একটু হলেও স্পর্শ করছে। সেই প্রথম আলাপ থেকে রুদ্র বারবার করে বলছে, বুঝাতে চাইছে তুমি আমার। চূড়ান্ত অধিকারবোধ নিয়ে বারবার দাবি করে যাচ্ছে সে কথা। গতকাল অধিকার দাবির সঙ্গে চোখ জোড়ায় যে আধিপত্য বিস্তারের নেশা স্পষ্ট ছিল, আজ সেই একই চোখ জোড়ায় সুরভী নমনীয়তা খুঁজে পাচ্ছে। আকুল হয়ে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পণ করা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সুরভী। এই চাহনি কি মিথ্যা? আপন জীবনের গন্ডিটা ভীষণ ছোট। অনেক মানুষ কিংবা খুব ঘটনবহুল জীবন তার না। মানুষ চেনাটা ঠিক ওকে দিয়ে হয়নি কোনোদিন। তবে এই চাহনী মিথ্যা না। এই চাহনী সত্য। রুদ্রের চোখ যা বলে তা সত্য, এতটুকু বুঝে গেছে সুরভী। রুদ্রের চোখজোড়াই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে। কোনোরকম অবিশ্বাসে মন সায় দিচ্ছে না। তবে এই কাতরতার শুরু কবে? একচ্ছত্র অধিকার দাবির গোড়াটা ঠিক কোনদিন থেকে? কিচ্ছু জানা নেই সুরভীর। দূর থেকে সম্পূর্ণ অচেনা একজন মানুষ এত গাঢ় অনুভূতি নিয়ে দিন পার করছে তা কোনোদিন টেরই পাওয়া হলো না!

চোখ বরাবর সুরভীর চেয়ে থাকা যেন রুদ্রকে আরেকটু কাছে যাবার, সম্পর্কে আরেকটুখানি বোঝাপড়া বাড়াবার প্রশ্রয় দিলো। এই সময়টা, সুযোগটা হাতছাড়া করবে না রুদ্র।

চট করে সুরভীর সামনে বাহানা হাজির করলো সে,

— “পুরো বাড়ি ঘুরে দেখা হয়েছে?”

— “উঁহু। এই ঘর থেকে মায়ের ঘরে যেতে যতটা জায়গা পেরোতো হয় ঠিক ততটুকুই দেখা। এরবাইরে এক ইঞ্চিও না।”

— “ঘরের প্রতিটা কোণ তোমাকে চিনতে হবে। এই বাড়ির কোন দেয়ালে কয়টা করে পেরেক গাঁথা আছে তা জানতে হবে। এখন থেকে এই ঘর, সবকিছুর দায়িত্ব তো তোমারই। তবে সবার আগে আমি।”

সুরভীর হাত টেনে নিজ বাহুতে জড়িয়ে, ঘর ছেড়ে বেরোতে বেরোতে সে বললো, – “আমি যখন তোমাকে আমার পাশে চাইবো তখনই আমার কাছে চলে আসবে। যত ব্যস্ত তুমি হও, যত কাজের চাপই থাকুক। সব ফেলে আমার কাছে চলে আসবে। অপেক্ষা করাবে না একদম!”

সুরভী খুব টের পাচ্ছে, রুদ্র চাইছে তার হাতটা ও শক্ত করে আঁকড়ে ধরুক। সংকোচ হচ্ছে ভীষণ, তবে আপত্তি নয়। খুব একটা দাবি দাওয়া উনি করেনি। কিছুক্ষণের জন্য হাত জড়িয়ে রাখার আবদার সে তার বিবাহিতার কাছে করতেই পারে! রুদ্রের দাবি আর নিজ সংকোচের ডামাডোলে, সুরভী তাকে আঁকড়ে ধরছে না আবার ছাড়াতেও চাইছে না। সুরভীকে পড়তে পারছে রুদ্র। ছাড়াতে না চাওয়াটাই যেন আকাশ সমান স্বাধীনতা দিলো তাকে। সুরভীকে কাছে টেনে হাত ধরে রাখা, গায়ের একপাশে সুরভী লেগে থাকা এ যেন তার কাছে স্বর্গসুখ। গোটা সুরভীটাকে এখনও পাওয়া যায়নি। কবে নাগাদ পাওয়া যাবে তা-ও জানা নেই। তবে সেই ভাবনা মাথাতেই আসছে না রুদ্রের। এই যে সুরভী একান্ত তার হয়ে গেছে, পাশে গা ঘেঁষে ঘরময় হাঁটছে এই প্রাপ্তিও কি কম? এত বছরের এই জীবনে আজ পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এটাই!

২৬

আয়নার সামনে বসে সাজগোজে ব্যস্ত সুরভী। বাবার বাড়ি যাবে ও। এই বাড়িতে পা রাখার পঞ্চম দিন আজ। গতরাতে অফিস থেকে ফেরার পরই বায়না করলো, আম্মু আব্বুর কাছে যাবো। মনটা একটু খারাপ দেখাচ্ছিল। নিজের বাসা, নিজের মানুষদের জন্য মনটা ছুটে গেছে সে কথা স্পষ্ট বুঝে নিলো রুদ্র। আর আপত্তি করেনি। তখনই বললো, “কাল সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরি, তারপর তুমি যেও।”

আয়নায় রুদ্রকে দেখা গেল। দরজা ঠেলে ভেতরে এসেছে। অফিস থেকে ফিরলো মাত্র। ঘাড় ফিরিয়ে মুচকি হাসলো সুরভী।

—” ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কাজের চাপ ছিল খুব?”

— “একটু তো ছিলই।”

— “আমি কিন্তু রেডি।”

— “ব্যাগ গোছগাছ শেষ?”

— “সব গোছানো হয়ে গেছে। আপনি জলদি ফ্রেশ হয়ে নিন না!

— “তোমাকে গাড়িতে তুলে তারপর ফ্রেশ হবো।”

ভ্রু কুঁচকালো সুরভী।

— “গাড়িতে তুলে দিয়ে মানে? আপনি যাবেন না সঙ্গে?”

— “না।”

— “কেন?”

— “কাজ আছে।”

— “আপনি আমার সঙ্গে যাবেন। ডিনার করে চলে আসবেন। ব্যস!”

— “তুমি যাও। আমি পরে আসবো।”

— “এমন হয় নাকি! বিয়ের পর প্রথম যাচ্ছি আমি। আপনি সঙ্গে না গেলে কেমন দেখাবে?”

— “আমাদের বিয়েটাই তো কেমন যেন! কোনো নিয়মকানুন হয়েছে নাকি?”

— “তখন হয়নি বলে এখন কিছুই হবে না?”

— “জেদ করো না সুরভী। তুমি যাও। আমি পরে সময় করে আসবো। সত্যিই কাজ আছে আমার।”

— “একটা দিন কি এডজাস্ট করা যেত না?”

— “হচ্ছে না আসলে।”

বিষন্ন হলো সুরভী। এতক্ষণের উচ্ছ্বাসটা চোখে ধরা পড়ছে না আর। খারাপ লাগলো রুদ্রের। তবুও মুখে হাসি ধরে রইলো।

— “চলো, গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি তোমাকে।”

— “সত্যিই যাচ্ছেন না?”

— “উঁহু।” ডানে বামে মাথা নাড়লো রুদ্র।

*****

শাশুড়ীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এল সুরভী। গাড়িতে উঠে বসেছে ও। গাড়ির জানালায় ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র।

— “আপনি সঙ্গে এলে ভালো লাগতো।”

— “সত্যিই ভালো লাগতো আমি তোমার সঙ্গে গেলে?”

— “হ্যাঁ।”

— “আমাকে এক্সেপ্ট করতে পারছো সুরভী?”

— “হয়তো।”

— “আমাকে পুরোপুরি মেনে নিতে, আমার জন্য মায়া জন্মাতে আরো সময় লাগবে, তাই না?”

উত্তর করলো না সুরভী। মাথা নিচু করে ফেললো ও।

সুরভীর গাল টানলো রুদ্র।

— “মুখ লুকানোর কী আছে? মুখের উপর ধমক দিতে পারো না আমাকে? বলবে, হারামজাদা ধরে এনে বিয়ে করেছিস, চারদিনেই ভালোবাসা খুঁজিস কেমন করে?”

সজোরে হেসে উঠলো দু’জনই।

— “আমি ধমক দিতে জানি না।”

— “শিখতে হবে তো! আমাকে লাঠির উপর না রাখলে বখে যাবো না? আমাকে শাসন করার কেউ নেই তো! তোমাকে কি শুধু আদর যত্ন পাবো বলে ধরে এনেছি? শাসন পাবো বলেও তো এনেছি। আমি তোমার সব চাই সুরভী।”

মুখ সরিয়ে লাজুক হাসলো সুরভী। বললো,

— “আপনি এত ফ্লার্ট করেন উফ! মাথা ধরে যায় আমার।”

— “ভালোবাসা জেঁকে ধরে না?”

— “আপনি যান তো!”

গাড়ি ছেড়ে সরে দাঁড়ালো রুদ্র।

— “নিজের খেয়াল রেখো।”

ডানে মাথা হেলালো সুরভী। ঠোঁটের কোণে মুগ্ধ হাসি লেপ্টে আছে ওর। গাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে মির্জা বাড়ির প্রাঙ্গন। মূল ফটকের কাছাকাছি যেতেই জানালা দিয়ে মাথা বের করে পেছনে উঁকি দিলো সুরভী। রুদ্র এখনো ওখানেই দাঁড়িয়ে ওর চলে যাওয়ার পথে চেয়ে ছিল। সুরভী তাকাতেই হাত উঁচিয়ে বিদায় দিলো সে। ঠোঁটজুড়ে তার প্রশস্ত হাসি জানান দিচ্ছে, সুরভীর একটাবার পিছু ফিরে তাকাবার অপেক্ষাতেই সে ছিল।

২৭

ফয়েজের মাথার চারদিকে চারটা পিস্তলের নল ঠেকানো। সামনে টেবিলের উপর রাখা আছে ২৫ লক্ষ টাকা। ভ্রু কুঁচকে শুভর দিকে তাকিয়ে আছে সে। বিশমিনিট ধরে এই খেলাই চলছে ফয়েজের বাসায়। হুট করে এইরাতে ছয় জনের দল নিয়ে রুদ্র এসে হাজির হয়েছে এখানে। রুদ্র সচরাচর সশরীরে কোথাও যায় না। তাকে দেখে তখনই সন্দেহ হয়েছিল ফয়েজের। নিশ্চিত কোনো বড়সড় ঘাপলা আছে! ভেবেছিল নতুন কোনো সুপারিশ হাতে এল বুঝি! কিন্তু তার মাথায়ই যে এভাবে পিস্তল ঠেকানো হবে কে জানতো?

— “পিস্তল কি ধরেই থাকবে নাকি ওরা? সমাধান করেন না জলদি!” ফয়েজকে তাড়া দিলো শুভ।

ফ্রিজে কিছু ফল ছিল। ঘরে ঢুকেই কিছু না বলে রুদ্র সোজা চলে গেল ফ্রিজ চেক করতে। একটা আপেল বের করে এখন সে ঘরময় হাঁটছে আর আপেল চিবুচ্ছে।

অসহায় কণ্ঠে রুদ্রকে ডাকলো ফয়েজ,

— “ভাই…”

— “বলো ভাই।”

তখনও ঘরময় হাঁটছেই রুদ্র। একটাবার ফয়েজের দিকে তাকাচ্ছেও না। চেহারা কুঁচকে এল ফয়েজের।

— “তাকান না একটু?”

— “আগের মতো বাঁদরমুখোই আছো তুমি, নতুন করে তোমাকে দেখার কিছু নেই।”

ঘরে হাসির রোল পড়লো। তাতে বিন্দুমাত্র অপমানবোধ করলো না ফয়েজ। সে জানে সে সুন্দর এবং স্মার্ট। লোকে ধরতেই পারবেনা এই পর্যন্ত ২৩টা খুন সে অবলীলায় করে ফেলেছে। তার মনের মানুষ সবসময় গাল টেনে আদর করে বলে, “তুমি খুনী! আমার তো লাগে তুমি মডেল। বুকে ধুকুরপুকুর উঠানো রূপ তোমার!”

রুদ্রের এসব বলার কারণ সে জানে। রুদ্রের কথায় সায় ব্যতীত আর একটা শব্দও রুদ্র শুনতে চাইছে না।

তবুও নিজ নীতির কথা জানালো সে,

— “এইটা কিন্তু হইতাছে না ভাই। মানুষ ফালানোর সুপারিশ নেয়া আমার কাজ। আপনার হইয়াও তো কাজ করলাম। করি নাই? কাকপক্ষী জানছে কোনোদিন? আমি খুনী হইতে পারি কিন্তু নীতি বলতে কিছু আছে তো আমার। বিশ্বস্ত না হইলে আমি কাস্টমার পামু?”

— “প্রতি মার্ডারে মিনিমাম ১০লক্ষ করে গুনেছো তুমি। ভিক্টিম যত হাই প্রোফাইলের, তোমার এমাউন্ট তত বেড়েছে। ব্যাংক ব্যালেন্স তো আর কম করোনি। আর কাস্টমার দিয়ে কাজ কী? এবার আলোর পথে এসো।’

— “আমার মাথায় পিস্তল ঠেকায়া আমারে আলোর পথে আসতে বলতাছেন? পিস্তল

ঠেকানো আলোর পথযাত্রীর কাজ?”

আবারও হাসির রোল পড়লো ঘরে।

মেজাজ খারাপ হলো ফয়েজের। তার সামনে চেয়ার টেনে বসলো রুদ্র।

— “আপেলটা মজা ছিল। খুব মিষ্টি!”

— “ভাই!”

— “সিনথিয়াকে খুন করার জন্য ১৫ লক্ষ পাবার কথা, আমি তোমাকে ২৫ দিচ্ছি। তবুও কেন আপত্তি তোমার?”

— “প্রসঙ্গ টাকার না। প্রসঙ্গ নীতির।”

— “যাকে খুন করার সুপারিশ এসেছে, জানো তার সম্পর্কে?”

— “জানি। ফেমাস মডেল। মতি ভাইর প্রেমিকা সিক্রেট কিছু জাইনা গেছে। ব্ল্যাকমেইল করতাছে। তাই রাস্তা থেইকা সরাইবো।”

— “মিথ্যা। মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। চারমাস চলছে। ও মতির কাছে সামাজিক স্বীকৃতি চায়। বাচ্চাটাকে সুস্থ সুন্দর একটা জীবন দিতে চায়, বাবার নাম দিতে চায়। মতির ঘরে বউ বাচ্চা আছে, ও কখনোই এসব মেয়েকে ঘরে তুলবে না। তাই পথ থেকে সরাতে চাইছে।”

মাথা নিচু করে রইলো ফয়েজ। শুভ ইশারা করলো তার লোকদের সরে দাঁড়াবার জন্য। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নিচু করেই গালি দিলো ফয়েজ,

— “খানকির পোলা! যে দুনিয়াতেই আসলো না ঐ মাসুমরে আমার হাতে মারাইতে চাইলো!”

— “তোমাকেও কিন্তু ধোঁকাই দিলো।”

— “হ দিলোই তো। জানলে কি আমি জীবনে এই কেইস হাতে নেই নাকি? আপনি টাকা নিয়া যান। লাগবে না এটা। কী ইনফরমেশন লাগবে, সব বইলা দিবো।”

— “শুধু ইনফরমেশন না। তোমার সঙ্গে আরো জরুরি কাজ আছে। ফ্রীতে করাবো না নিশ্চয়ই!”

— “কী কাজ?”

— “আগে তথ্য দাও, প্ল্যান কী ছিল?”

— “বাসা থেকে মতি ওরে বের করতো, জরুরি কথার বাহানায় ওরে গাড়িতে বসায়া মতি বের হইয়া যাইতো। তারপর গাড়িতে ঢুইকা ওরে অজ্ঞান কইরা গাড়িতেই সাইজ করতাম। তারপর মুখে এসিড ঢাইলা চেহারা নষ্ট করতে বললো।”

— “কী হারামী! যে রূপের প্রেমে মজে ঘরের বউকে ঠকিয়েছে, সেই চেহারাটাই নাকি এসিডে ঝলসে দিতে চাইছে!”

— “হ্যাঁ।”

— “তারপর?”

— “তারপর আর কী? লাশ নিয়ে শীতলক্ষ্যায় ছুঁইড়া মারো।”

— “এই এক নদী আর কত লাশের ঠিকানা যে হবে! মেয়েগুলো এত বোকা কেমন করে হয় বুঝি না আমি। টাকা, ক্ষমতা দেখলেই শুয়ে পড়ে কেন ওরা? মিনিমাম আত্মসম্মান বোধটুকু বাঁচিয়ে রাখে না। কিসব বুড়ো বাচ্চার বাপেদের সঙ্গে ফিজিক্যালি এটাচড হয়। প্রেগন্যান্ট হয়ে তারপর শুরু করে বিবাদ- দায়িত্ব নাও, বিয়ে করো। এরা কি বিয়ে করে দায়িত্ব নেবার লোক? এদের কাছে বেঁচে থাকার মিনিমাম সেইফটি পাবে কি না সেটা নিয়ে ভাবে না একবার! যাই হোক, প্ল্যান এক্সাক্ট সেইম থাকবে। কিন্তু লাশ সিনথিয়ার বদলে থাকবে অন্য কারো।”

— “বিস্তারিত বলেন।”

— “সিনথিয়া আজ চেকআপের জন্য বেরিয়েছে। চেম্বার থেকেই ওকে উঠিয়ে আনবে। ছেলেপেলেরা আছে ওখানে। ওকে বিস্তারিত জানানো হবে। যেদিন মার্ডার প্ল্যান, সেদিনই মার্ডার হবে। মতি গাড়ি থেকে নেমে যাওয়ার পর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকবে না নিশ্চয়ই?”

— “না। এলাকা ছাড়বে তৎক্ষনাৎ।”

— “সিনথিয়াকে আমরা সরিয়ে নেবো। তুমি প্রতি বিশমিনিট পরপর মতিকে কল করে আপডেট দেবে সিনথিয়ার। অজ্ঞান করলাম, খুন করলাম, এসিড দিলাম। গুছিয়ে বলবে কলে। ঐ রাতে তোমার নাম্বার মতির কল লিস্টে থাকা চাই।”

— “আচ্ছা।”

— “ফার্স্ট টার্গেট থাকবে বিকৃত চেহারার কোনো মহিলার বেওয়ারিশ লাশ বের করা যার বডি হাইট সিনথিয়ার সঙ্গে ম্যাচ হয়।”

— “না পাইলে?”

— “কোনো বেওয়ারিশ লাশের চেহারা বিকৃত করতে হবে। কিছু করার নেই। সিনথিয়ার পরনের জামা ওকে পরানো হবে। মার্ডারের দুইদিন পর লাশ ভাসবে নদীর পাড়ে। সেখান থেকে থানা, পুলিশ, মিডিয়া।”

— “পোস্ট মর্টেমেই ধরা পড়ে যাবে এই বডি আরো পুরানা। তখন?”

— “প্রশাসন সামলানো কোনো সমস্যাই না। কল যাবে, টাকা যাবে ব্যস! সমস্যা হলো মিডিয়া, জনগন, বিরোধী দল। এদের আইওয়াশ দিতেই এত নাটক।”

— “বুঝলাম।”

— “শেষ খেলাটা তোমার খেলতে হবে ফয়েজ।”

— “কী?”

— “সাক্ষ্যী।”

— “কী সেটা?”

— “মার্ডার লোকেশনের পুরো এলাকায় সিসিটিভি ক্যামেরা সেট করবো। ওর গাড়িটা ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়াবে, সেখানে অবশ্যই ক্যামেরা থাকবে।”

— “জায়গা তো অন্ধকার। ক্যামেরায় ওকে দেখা যাবে না।”

— “আশপাশে বাসা বাড়ি আছে তো?”

— “আছে।”

— “গায়েবী আলো চলে আসবে। নন্দী দেখবে সেটা। ঐ এলাকার দু’জন লোক ওখানে থাকতে হবে। মতি গাড়ি থেকে বেরোচ্ছে তার চাক্ষুষ প্রমাণ থাকা জরুরি। আমাদের কোনো একজন লোক ঐ দুইজনকে কথার ছলে সেখানে নিয়ে যাবে। মতি বেরিয়েছে তার খানিক সময় বাদে তুমি গাড়িতে বসছো সেটা ক্যামেরায় থাকা চাই। পুলিশ যখন তোমার জবানবন্দি নেবে, তুমি বলবে, খুন মতি করেছে। তুমি শুধু লাশ সরিয়েছো। ওদিকে সিনথিয়াকে বলে দেবো, বের হওয়ার আগে অন্তত তিনজনকে কথায় কথায় জানিয়ে বের হবে মতি তোমাকে নিয়ে বেরোচ্ছে। ইদানীং তার আচরণ সন্দেহজনক। কখন কোন ক্ষতি করে বসবে!”

— “এসব কইরা মতিরে আটকাইতে পারবেন?”

— “এই দিয়ে শুরু হবে। মতি আজ পর্যন্ত কম মেয়ের ক্ষতি তো আর করলো না। মিডল ক্লাস ফ্যামিলির বহু মেয়েকে চাকরির লোভ দেখিয়ে বা কখনো জোর করে তুলে এনে ও আর ওর ঘনিষ্ঠ চামচারা রেইপ করেছে এমন কেইস অন্তত ৫০টার উপর আছে। সব কয়টা এবার টানবো। সাংবাদিক, নারী সংস্থা, সোশ্যাল মিডিয়া সবকটাকে উল্কাবো। দেখি ও কেমন করে বের হয়!”

— “তারপর সিনথিয়ারে কী করবেন? মরা মানুষ তো জিন্দা হইয়া ঘুরতে পারবো না।”

— “ওকে চোরাই পথে ইন্ডিয়া পাচার করে দিবো। সেখান থেকে লন্ডন।”

— “এত ঝামেলার চেয়ে মতিরে ধরে নিয়ে মাইরা ফেললেই হয়।”

— “দলের লোক। চাইলেই ধরে নিয়ে মেরে ফেলা যাবে না। হিসেব নিকেশ আছে।”

— “এত বছরে পুলিশের কাছে সারেন্ডার করা লাগে নাই। এই চেহারার কোনো দাগ নাই, এখন দাগ ফালায়া দিতে বলতাছেন?”

— “তোমাকে জেলের ভাত খাওয়াবো নাকি? সাক্ষ্য দেয়া মাত্র জেল থেকে বের করবো তোমাকে। সর্বোচ্চ একসপ্তাহ থাকবে তুমি। মাথার চুল, দাঁড়ি সব ছেটে ফেলো, পরিচিতরা চিনতে অসুবিধা হবে। চেষ্টা করবো মিডিয়ার সামনে একবারের বেশি তোমাকে না আনার। তাও সেটা খুবই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য।”

— “তবুও….”

— “শুনেছি নতুন নতুন প্রেমে পড়েছো। বয়সও বাড়ছে। এসব খুন খারাবা করে আর কতদিন? নতুন জীবন শুরু করো।”

— “প্রেমিকা রাজি হয় না।”

— “রাজি করাও। তার বন্দোবস্ত আমি করে দেবো। ইউরোপের যেকোনো দেশে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সঙ্গে থাকা, নতুন চাকরি বাকরির বন্দোবস্তও করে দিচ্ছি। বিয়ে শাদী করো, বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে সুখে ঘর করো। হয়তো এখনের মতো কামাই হবে না, তবে সুখের একটা জীবন তো পাবে। ঐ মেয়েটাও এমন জীবনের লোভ

কোনোভাবেই ছাড়বে না। জিজ্ঞেস করো ওকে।”

সামিরাকে সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছে ফয়েজ। ওর সঙ্গে সংসারের স্বপ্নটা একদম শুরু থেকে। আজ রুদ্র সেই স্বপ্নে ছোট ছোট বাচ্চা যোগ করে দিলো। চোখের সামনে দুই বেণী করে, গোলাপী ফ্রক পরা দুটো বাচ্চা ছুটছে। এই স্বপ্ন নিজ নাগালে পেতে অস্থির লাগছে ফয়েজের। এই সুন্দর মুহূর্তটা তার চাই। অবশ্যই, অবশ্যই চাই। আর সাত পাঁচ ভাবলো না ফয়েজ। মাথা দুলিয়ে বললো,

— “পুরোটা হয়ে যাবে। ভাববেন না।”

২৮

রাতের খাওয়া শেষে বারান্দায় ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছে সুরভী। রাতের আকাশের তারাদের পানে চেয়ে ভাবছে নিজেকে নিয়ে, অতীত আর বর্তমান নিয়ে। ভীষণ ভালোবাসা, বহুবছরের লালিত মায়া এক মুহূর্তে মন থেকে মুছে যেতে পারে, তা জানা ছিল না সুরভীর। নিজেকে দিয়ে প্রমাণ হলো তা। যাকে নিয়ে এতগুলো বছর ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখেছিল সেই স্বপ্নপুরুষ চোখের পলকে হলো মন ভাঙা খলনায়ক। মানুষটা ওকে ভালো না বাসতেই পারে, মনের উপর জোর নেই। সে কথা মুখোমুখি বলে দিলেও চলতো। তবে এই প্রতারণা! এই প্রতারণা মেনে নেবার মতো উদারতা তো তার নেই! আসিফের প্রতারণাই সমস্ত ভালোবাসা, মায়া মুছে দিলো মুহূর্তেই। এখন এই মন তন্নতন্ন করে খুঁজেও কেউ কোথাও আসিফকে পাবে না!

বাবার বাড়িতে দ্বিতীয় দিন আজ সুরভীর। সেদিনের পর আসিফকে মনে পড়েনি আর। মন থেকে উঠে যাবার ব্যাপারটাই হয়তো এমন। দুঃখ শোক যা-ও ছিল, বিয়ের ধাক্কায় তা-ও কেটে গেছে। জীবন লীলায় পাওয়া নতুন অধ্যায় সামলে বুঝে নিতেই টালমাটাল হচ্ছে ও। গত দুইদিনে রুদ্র মনের দরজায় কড়া নেড়েছে বারবার। ভালোবাসা নেই তার প্রতি, তবে ভালো লাগা জন্মাচ্ছে। যত্নের কোনো কমতি নেই মানুষটার কাছে। রুদ্র কেন তাকে বিয়ে করেছে সেই হিসেবটা আর

চাহনী কষতে ইচ্ছে করছে না। শুধু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে রুদ্রের এই যত্ন, কিংবা ভালোবাসায় মাখামাখি কথাগুলো কোনোটাই মিথ্যে নয়। সব সত্যি। ঐ বাড়িতে কাটানো চারদিনে হয়তো রুদ্রের সঙ্গে গাঢ় কোনো মুহূর্ত নেই, কিন্তু ছোট ছোট মুহূর্তগুলো মনের ঘরে গাঢ় দাগ কেটে গেছে। জীবনে বহু পুরুষের গল্প শুনেছে সুরভী, কখনো কাজিনদের, কখনো বান্ধবীদের কাছে। রুদ্র কারো মতো নয়। রুদ্র ভিন্ন। তার চাহনী ভিন্ন, বলার ধরণ ভিন্ন, মানসিক অন্তরঙ্গতা তৈরীর পারদর্শীতা ভিন্ন। তাকে দেখলে পুরুষের প্রতি নারীর চিরায়ত ধারণাটাই বদলে যাবে।

— “কী করছিস?”

মা এসেছে। পেছন ফিরে মুচকি হাসলো সুরভী।

— “কিছু না, এসো।”

ঘর থেকে একটা চেয়ার টেনে আনলেন মিতা। তাতে পা তুলে বেশ আয়েশ করে বসলেন তিনি।

— “জামাই ফোন করেছিল?”

— “হ্যাঁ। একঘন্টা আগেও কথা হলো।”

— “ও এল না। আমি মানতে পারছি না বিষয়টা।”

— “আমারও কেমন লাগছে।”

— “একটা কথা মাথায় এল, তাই তোকে বলতে এলাম।”

— “কী?”

— “সেদিন তোর শ্বশুরবাড়ির দাওয়াতে গিয়ে একটা ভুল করেছি আমরা। এত মানসিক চাপে খেয়ালই ছিল না একদম।”

— “কী সেটা?”

— “আমরা শুধু তোকে সঙ্গে আনতে চেয়েছি। নিয়ম অনুযায়ী জামাইসহ মেয়েকে বাপের বাড়ি আনতে হয়। রুদ্রকে আমরা বলিইনি সে কথা।”

— “তাই তো! উনিও আমাকে কিছু বললো না এই নিয়ে।”

— “ভুলই হলো। তারপর আমি কল করলাম গতকাল, পরে আসবে বললো। এটারও একটা কারণ আছে মনে হয়। কারণটা তোর বাবা। ও কল করেনি এখনো রুদ্রকে।”

— “পয়েন্ট!”

— “এখন তোর বাবাকে বলবো, বেয়াইনকে কল দিয়ে পরশু দুপুরের দাওয়াত করতে। ছেলের শ্বশুরবাড়ি উনারও তো দেখা চাই।”

— “হ্যাঁ। মা তো দেখলোই না কিছু। বিয়েটাও না।”

— “তোকে ওরা সবই দিয়েছে। জামাইকে উপহার দেয়া দূরের কথা, ঠিকঠাক আপ্যায়নই করলাম না, অথচ আমরা গিয়ে দাওয়াত খেয়ে এলাম। লজ্জার ব্যাপার! ভাবছি ওকে স্যুট, ঘড়ি, আংটি আর চেইন গিফট করবো। তোর শাশুড়ীকেও গোল্ডের চেইন, আংটি আর শাড়ী উপহার দেবো।”

— “তা দেয়া যাবে। আগে দাওয়াত তো করো।”

— “তোর ওখানে ভালোই লাগে, তাই না?”

— “হ্যাঁ। কেমন কেমন লাগাটা আর নেই। মা আর উনি খুব সহজ করে ফেলেছে আমার জন্য পুরো ব্যাপারটা। পুরোপুরি খাপ এখনো খাওয়াতে পারিনি। তবে যতটা পেরেছি ভালোভাবে থাকার জন্য যথেষ্ট।”

— “তোর বাবা এখনও গাল ফুলিয়ে আছে। আজ বিকেলেও তোর চাচা বুঝিয়ে বলছিল তাকে। মুখে মুখে হুম হ্যাঁ বললেও, মন থেকে মেনে নিচ্ছে না এখনও।

তবে আমি কী ভাবছি, জানিস? বিয়ে হয়ে গেছে। এটাই এখন তোর বর্তমান, তোর ভবিষ্যৎ। যত দ্রুত মেনে নিবি, যত দ্রুত রুদ্রকে আর এই সংসারটাকে আঁকড়ে ধরবি, ততই তোর জন্য ভালো। পুরুষ মানুষ বেশিদিন দূরে সরিয়ে রাখতে নেই। তার উপর যা অবস্থা ওর! গিয়ে দেখ বনেদী ঘরের মেয়েরাই ওর পেছনে বিবাহিত জেনেও লেগে থাকবে। তোর এমন ঘরে বিয়ে হবে ভাবিনি কখনো। জোর করে হলেও ভালো সম্বন্ধ জুটে গেছে এ-ই অনেক। তোকে দেখছি পর থেকে সব দ্বিধা, সংশয় কেটে গেছে আমার। রুদ্র তোকে কেমন করে বিয়ে করলো সেটা আর ভাবতে চাই না। ওটা অতীত। তুই এখন কেমন আছিস সেটা আমি দেখবো। তুই ভালো আছিস মানে ওরা তোকে ভালো রাখছে। তোর চাচী ফুফুরা তো এই নিয়ে গল্প করেই কূল পাচ্ছে না। সবার একই কথা, যা হবার হয়েছে। এবার মেনে নিয়ে সুরভী আগে বাড়ুক। সবকিছু সামলে চলতে জানলে ওর সুখের সীমা থাকবে না। তুই আমার কথা বুঝতে পারছিস তো?”

মায়ের ইঙ্গিত স্পষ্ট বুঝলো সুরভী। বাইরে চোখ ফিরিয়ে, মাথা দুলিয়ে, লম্বা নিঃশ্বাস নিলো ও। শরীরী অন্তরঙ্গতার পার্ট কবে চুকবে, কবে মন পুরোপুরি সায় দেবে তা জানা নেই সুরভীর। তবে রুদ্র যেহেতু আপাতত চাইছে না, থাকুক না সেসব। এখন যেমন চলছে তা ভীষণ ভালো। এই সময়টা, এই অনুভূতিটা থাকুক আরো কিছুদিন। সময় যাক, যা কিছু গাঢ় হওয়ার সময়ের তালে, অনুভূতির জোয়ারে ভেসে সবটা আপনাআপনি হয়ে যাবে।

মিতা আরো কিছু বলতে চাইছিল, তখনই কল এল রুদ্রের।

— “হ্যালো?

— “খাওয়া দাওয়া শেষ?”

— “হ্যাঁ। আপনার?”

— “উঁহু।”

— “এখনো বাইরে?”

— “সুরভী …”

— “জি?”

— “আমাকে মনে পড়ে তোমার?” ঠোঁট চেপে হাসলো সুরভী।

— “নাহ।”

— “বাট আই এ্যাম মিসিং ইউ এ্য লট! দেখতে ইচ্ছে করছে খুব। পাশে বসে তোমার সঙ্গে গল্প করতে ইচ্ছে করছে। আমি তোমার বাসার নিচে সুরভী। আসবে আমার কাছে?”

— “আপনি নিচে দাঁড়িয়ে!”

একসঙ্গে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো মা-মেয়ে। গ্রিলের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলো সত্যিই রুদ্র বাসার নিচে। গাড়ির উপর বসে কানে ফোন লাগিয়ে কথা বলছে। এক ছুটে স্বামীর কাছে গেলেন মিতা। জামাই এসেছে! তাকে বাসায় আনতে হবে।

— “চলো কোথাও থেকে একটু বেরিয়ে আসি। আমি তোমার সঙ্গে একটু সময় কাটাতে চাই।”

দ্বিধায় পড়ে গেল সুরভী। রুদ্রকে বাসায় ডাকবে নাকি বাইরে যাবে সে দোটানায় পড়ে গেল ও। পাঁচ সাত সেকেন্ড চুপ থেকে, দ্রুত ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো ও। – “বাইরে না। বাসায় আসুন। আমার ঘরে বসে গল্প করবেন।”

— “না। তুমি ঝটপট জামাটা পাল্টে নেমে এসো।”

— “আসবো না, আপনি আসবেন।”

রুদ্র আবারও কিছু বলতে যাবে তখনই নিচে নেমে এল শরীফ সাহেব আর মিতা। উপর থেকে মা-বাবাকে দেখলো সুরভী। গায়ে কোনোরকম ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে এক দৌড়ে নিচে নেমে এল সে।

বাবা-মা মিলে রুদ্রকে পীড়াপীড়ি করছে উপরে আসার জন্য। তাদের সঙ্গে সুরভীও তাল মেলালো।

— “চলুন না, এত করে বলছে!”

— “আজ না।”

— “এক কাপ চা অন্তত আমার সঙ্গে খেয়ে যাও।”

— “আসবো বাবা। অন্য একদিন সময় নিয়ে আসবো। আজ সুরভীকে নিয়ে একটু বেরোবো। জরুরি কাজ আছে।”

বলেই সুরভীর হাত টেনে ধরলো রুদ্র।

স্বামী-স্ত্রী মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। এক মুহূর্ত নীরব থেকে রুদ্রের ইচ্ছেতেই সায় দিলেন শরীফ সাহেব।

— “আচ্ছা! কাজ আছে যেহেতু, যাও তাহলে।”

মেয়েকে গাড়িতে তুলে দিয়ে চরম বিরক্তি নিয়ে স্বামীর পেছন পেছন এলেন মিতা। ঘরে ঢুকেই রাগ ঝাড়তে লাগলেন তিনি।

— “তুমি যেতে দিলে কেন?”

— “ও আসতে চাইছে না। সুরভীকে নিয়ে বাইরে যেতে চাইছে। তাই যেতে দিলাম।”

— “বাহানা করো না। এই বিয়ে আর মেয়েজামাইকে তুমি এখনো মেনে নিতে পারছো না, জানি আমি। তোমার অভিমান স্পষ্ট বুঝা যায়।”

— “মেনে না নিতে পারা কি স্বাভাবিক না?”

— “এই মুহূর্তে স্বাভাবিক না। সুরভী তো ভালোই আছে। সৌভাগ্য নিজে এসে

মেয়ের কাছে ধরা দিয়েছে। এমন পাত্র তুমি আমি খুঁজেও তো মেয়ের জন্য আনতে পারতাম না।”

— “এমন পাত্র আমি খুঁজতামও না। আমি সাধারণ, মেয়েকেও সাধারণ ঘরেই বিয়ে দিতাম।”

— “যা হবার তা তো হয়ে গেছে মাহিনের আব্বু। রুদ্রই এখন সুরভীর বর। বদলে ফেলা যাবে সে কথা?”

— “যাবে না, কিন্তু মেনে নিতে একটু সময় তো লাগবে।”

— “সময়-টময় বুঝি না আমি। মেয়ে জামাইরা ঘরের মুকুট, তাকে সেই সম্মানই দিতে হবে। মেয়ে একা এসেছে বেড়াতে, এমন হয় তুমিই বলো? তুমি কালই ওর আত্মীয়সহ ওকে দাওয়াত করবে। পরশু এসে মেয়েকে ওরা নিয়ে যাবে।”

— “এসেছেই মাত্র, এখনই কেন চলে যাবে?”

— “যাওয়া জরুরি তাই যাবে। বাসা তো আর ঢাকার বাইরে না। ইচ্ছে হলে চলে আসবে যখন খুশি।”

— “তবুও, থাকতো না হয় আরো কয়েকটা দিন।”

— “তুমি এত কেন ভাবছো? ভালো আছে ওখানে সুরভী। ও নিজ মুখে বলেছে আমাকে। মেয়েকে তুমি দেখতে পাও না?”

— “এসব ছাড়ো বুঝলে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখো, থাকো। কাল সকালেই তুমি রুদ্র আর ওর মাকে কল করে দাওয়াত করবে। তারপর সোজা বাজার। আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকেরা প্রথম মেহমান হয়ে আসবে, তাদের আপ্যায়নে ত্রুটি থাকা চলবে না।”

মিতা একাই বলে চলছে। শরীফ সাহেব চুপচাপ শুনছেন সেসব। সুরভী ভালো আছে মেয়েকে দেখেই বুঝে গেছেন তিনি। তবুও কোথায় একটা গিয়ে যেন বারবার আটকে যান। এই সম্পর্কটা মানতে গিয়েও ঠিক মেনে নিতে পারছেন না।

গাড়ি ছুটছে উদ্দেশ্যহীন। গন্তব্য রুদ্রের জানা ইেন। গাড়ি আজ সে-ই ড্রাইভ করছে। পেছন পেছন ছুটছে বডিগার্ডের গাড়ি। শুভ আজ পেছনের গাড়িতে। ছায়ার মতো লেগে আছে ওরা রুদ্রের পেছনে।

— “আমরা কি এভাবেই রাস্তায় ঘুরতে থাকবো?”

— “হ্যাঁ।”

— “তারচেয়ে বাসায় বসলে ভালো হতো না?”

— “বিরক্ত লাগছে?”

— “একদম না! বিরক্ত কেন লাগবে? তবে একটু মন খারাপ লাগছে। আপনি আমাদের বাসায় যেতেই চাচ্ছেন না!”

— “আহা! সময় কি চলে যাচ্ছে? যাবোই তো।”

— “সত্যি করে একটা কথা বলুন তো?”

— “কী?”

— “আপনাকে আলাদা করে বাবা দাওয়াত করেনি, তাই আসছেন না, তাই না?” এক মুহূর্ত চুপ করে রইলো রুদ্র। পর মুহূর্তেই মুচকি হেসে বললো,

— “হ্যাঁ উনি আসলে আমাকে মেনে নিতে পারছেন না। এটা নিয়ে আমার অভিযোগ নেই একদম। এমন হওয়াই স্বাভাবিক। আমি জাস্ট স্পেস মেইনটেইন করছি। যাক কিছু সময়। উনি ব্যাপারটা সহজভাবে নিক। তারপর যাওয়া-আসা সব হবে। তোমাকে সেদিন মা-বাবার সঙ্গে আসতে দেইনি এই একই কারণে। আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারবো না। আগেরদিন মাত্র আমার ঘরে এলে, ঠিকমতো তখনো কথাই হলো না আমাদের। ঐ মুহূর্তে কী করে বাপের বাড়ি যেতে দেই তোমাকে? ভালো লাগতো না আমার একদম। তাই যেতে দেইনি।”

— “এখনও তো আমি নেই। ভালো লাগছে?”

— “আমাকে দেখে একদম বুঝতে পারো না তুমি? কেমন থাকলে একটা মানুষ কাজ ফেলে এই রাতে তোমাকে দেখার জন্য হুট করে ছুটে চলে আসে? তোমার অভ্যেস হওয়ার মতো সময় আমাদের একসাথে কাটানো হয়নি। তবুও তুমি নেই, ঘরে ফিরে তোমাকে পাচ্ছি না, ভালো লাগে না আমার। ফিরে এসো না জলদি! নয়তো রোজ সমস্ত কাজ শেষ করে তোমার বাসায় আসতে হবে তোমাকে দেখতে।” রুদ্রের চোখে তাকালো সুরভী। চাহনীর মাঝে তার প্রতি দুর্বলতা স্পষ্ট ধরা দিচ্ছে। এই চাহনীতে মন গলে যাওয়া কি খুব স্বাভাবিক না?

বাইরে চোখ ফেরালো সুরভী। কারণে অকারণে বহু অবহেলা পেয়েছে সে আসিফের কাছে, তবুও সম্পর্ক আঁকড়ে রেখেছিল ভালোবাসে বলে। বারবার একটুখানি ভুল হয়ে গেছে ভেবে তাকে ক্ষমা করেছে। বিনিময়ে কী পেল তার কাছে? শুধু প্রতারণা। পৃথিবীতে কারো কর্তৃক শুধুই ব্যবহৃত হবার চেয়ে অপমান হয়তো আর কিছুই নেই। আর এই মানুষটা! চেনা নেই, জানা নেই। কখনো কিছুই দেয়নি যাকে, সেই মানুষ কিনা তাকে পাবার জন্য এত মরিয়া? প্রয়োজনে সবকিছু উল্টে পাল্টে ফেলবে শুধুমাত্র তার জন্য? এত চাওয়া উপেক্ষা করা কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত না। ভালোবাসা থাকুক বা না থাকুক, তার এই চাওয়াটুকুকে সম্মান করাই যায়। এই মানুষটাকে অনেক যত্নে রাখা যায়। জীবনের নতুন মোড় যেহেতু না চাইতেও এসে গেছে, তবে সে মোড় ধরেই নাহয় নতুন করে পথচলা শুরু হোক। তবে তার আগে পুরোনো এক হিসেব বরাবর করার বাকি আছে। রুদ্রের কাছে বিনা সংকোচে আবদার রাখলো সুরভী।

— “একটা জিনিস চাওয়ার ছিল। আসিফ যেখানে আছে আমাকে সেখানে নিয়ে চলুন। শেষ একটা হিসাব বাকি আছে ওর সঙ্গে। ওটা মিটিয়ে ফেলতে চাই।” তৎক্ষনাৎ ব্রেক কষলো রুদ্র।

— “কিসের হিসাব?”

— “এতবড় ধোঁকা দিয়েও একেবারেই শাস্তি না পেয়ে আয়েশের জীবন কাটাবে, তা তো হতে পারে না।”

— “তো কী চাও? ওকে আবার আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনি?”

— “নাহ! থাকুক। ওসব কাফ্ফারা হয়ে থাকুক। ওর কাছে গেলে সারাজীবনের জন্য যা কিছু ভুগতে হতো তা থেকে বেঁচে গেছি সেইসব কিছুর কাফফারা এসব।”

— “তো কী চাও?”

— “চড়।”

— “দিতে চাও?”

— “হ্যাঁ।”

— “ওকে ডান। রাজশাহী আছে। ফ্লাইট বুক করে কালই নিয়ে যাবো।”

২৯

সুসজ্জিত ফ্ল্যাট। খুব একটা বড় না, কিন্তু একা মানুষের জন্য যথেষ্টের চেয়ে বেশি। চোরমুখো হয়ে বসে আছে আসিফ। ঘাড়ই তুলছে না। ভয়টা সুরভী না, আসল ভয় হলো সুরভীর পাশে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টির লোকটা। মনে হচ্ছে যেন ঘাড় তুলে সুরভীর দিকে তাকানো মাত্র এক কোপে শরীর থেকে ঘাড়টা আলাদা করে ফেলবে।

বসার ঘরে, সোফায় বসে ঘরের মধ্যে চোখ যতদূর যায় ততটুকুই দেখলো সুরভী। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এল ওর। আসিফের চুলের মুঠো ধরে, মাথা টেনে উপরে তুলে মনের ভেতর জমে থাকা সমস্ত রাগকে শক্তি করে সজোরে তার গালে চড় কষালো। মুখ টিপে হাসলো রুদ্র। মনের ভেতর যেন দখিন হাওয়া বইছে।

রাগে সুরভী কাঁপছে। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। রুচি হচ্ছে না এই প্রতারকটার সঙ্গে কথা বলতে। আসিফের মুখ বরাবর একদলা থুতু মেরে বেরিয়ে এল সুরভী। এক দৌড়ে গাড়িতে উঠে বসলো ও। পেছন পেছন ছুটে এল রুদ্রও। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। সুরভীর চোখের পানি অস্থির করে তুললো রুদ্রকে। সুরভী আসিফের জন্য কাঁদছে! এখনো অনুভূতি রয়ে গেছে ঐ ছেলেটার জন্য? মানতে ইচ্ছে করছে না একদম। ইচ্ছে করছে আসিফকে এই পৃথিবী থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে।

রুদ্রের রাগ তুঙ্গে উঠার মুহূর্তে একাই সুরভী বলতে লাগলো,

— “আমার নিজের জন্য ভীষণ আফসোস হয়। এমন একটা মানুষের পেছনে নিজের এতগুলো বছর কী করে দিয়ে দিলাম? আব্বু-আম্মুকে ঠকানোর প্ল্যানটাও করে ফেলেছিলাম। বিয়ের বউ বাসা থেকে পালিয়ে গেছে, সে কথা জানাজানি হলে আব্বু-আম্মু আর কখনো কারো সামনে মুখ দেখাতে পারতো না। একটা অমানুষের পেছনে সমস্ত আবেগ ইনভেস্ট করেছি আমি। আব্বু-আম্মু খুব ভালো মানুষ। কখনো কাউকে কষ্ট দেয়নি, সবাইকে যথাসাধ্য সাহায্য করেন। আত্মীয়দের খুশি রাখার চেষ্টা করেন। তাদের পূণ্যের জোরে আমি বেঁচে গেছি। নয়তো ঐ অমানুষটার কাছে আমাকে একটু একটু করে রোজ মরতে হতো।”

বলেই আবারো ডুকরে কেঁদে উঠলো সুরভী। ওর কান্নার কারণ এবারে স্পষ্ট হলো রুদ্রের কাছে। রাগের জায়গাটুকু মুহূর্তেই মায়া দখল করে নিলো। ওকে কাছে টেনে নিলো রুদ্র। তার বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদছে সুরভী। দু’হাতে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রইলো রুদ্র

*****

স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সিনথিয়া। দু’গাল নোনাজলে সিক্ত। শুভ তার দিকে টিস্যু এগিয়ে দিলো।

— “আপনার এই মুহূর্তে স্ট্রেস নেয়া উচিত হবে না। আমরা দেখবো পুরো ব্যাপারটা। কিছু হবে না আপনার।”

আরো কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকার পর মুখ খুললো সিনথিয়া,

— “আপনাকে যদি কিছু বলি আপনি কি সেটা বিশ্বাস করবেন?”

— “কী?”

— “আই রিয়েলি লাভড হিম! হ্যাঁ, প্রথমদিকে ক্যারিয়ারে গ্রো করার জন্য মতিকে আমি ইউজ করতে চেয়েছিলাম। সবাই যেমন ভাবে, মডেল মানেই খারাপ পরিবার থেকে উঠে আসা মেয়ে, মডেল মানেই ইমোশনলেস। সবসময় তা না! খোঁজ নিলে জানতে পারবেন আমিসহ আরো অনেকে আছে যারা রিলিজিয়াস ফ্যামিলি থেকে বিলং করে বা আমাদের বেড়ে উঠা খুবই সুন্দর পরিবেশে হয়েছে। ইমোশন আমাদেরও আছে। ক্যারিয়ারের প্রথম দিকটায় নিজের ভালো দিকগুলো নৈতিকতাগুলো টিকিয়ে রাখতে পারাই চ্যালেঞ্জ। শোবিজের চাকচিক্য, নতুন নতুন ফেইম এসব দেখে প্রথম প্রথম কারোই মাথা ঠিক থাকে না। তখন মনে হয় উপরে উঠতেই হবে, তাতে আমার নৈতিকতা বিসর্জন হোক কিংবা সম্ভ্রম। আমিও টিকতে পারিনি। কিন্তু যখন সুপার মডেল হলাম, খ্যাতি, সম্মান, টাকা সব হলো, তখন এসে মনে হলো অনেক কিছু খুইয়েছি, যার সামনে এই খ্যাতি তুচ্ছ। মোহ কেটে গেছে। আবেগ, নৈতিকতা আবারো অনুভব করতে শিখেছি। তার মাঝে কী করে যেন মতিকে ভালোবেসে ফেলেছি। অনেক দিনের একটা প্রেম ছিল আমার, মিডিয়ায় আসার আগে। খুব লক্ষ্মী ছেলে ছিল সে। মডেলিংয়ে পা রাখা মাত্র ওর সঙ্গে আমি ব্রেকআপ করলাম। কষ্ট পেয়েছিল খুব। সুইসাইড এটেম্পটও নিয়েছিল। কপাল গুণে বেঁচে গেছে। সেই অন্যায়ের শোধটাই বোধহয় উপরওয়ালা নিলেন। কখনো কোনো পুরুষের সঙ্গে অন্তরঙ্গ হবার গল্প আমার নেই। আমার এক্সের সঙ্গেও না। মতির সঙ্গে শুরু থেকে এটাচড ছিলাম। তাই কেউ ওসব প্রস্তাব দেবার সাহস করেনি। কোনো পুরুষ আমার এত কাছে এসেছে বলেই হয়তো ওর জন্য এই ভালোবাসা, মায়ার জন্ম। যাক, বেশ প্রতিদান পাচ্ছি আমি!”

দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো সিনথিয়া। কেমন বুক ভাঙা কষ্ট হচ্ছে শুভর। মাকে মনে পড়ছে। তার জন্মের ঠিক বারো বছর পর মা তৃতীয়বারের মতো গর্ভবতী হয়েছিল। বাবা আর নিতে চায়নি তারাসহ নতুন বাচ্চার দায়িত্ব। মায়ের কান্নাভেজা চোখ, চাপা বিলাপ শুনে নীরবে মুখ লুকিয়ে কাঁদতো সেও। কী বিভীষিকার সেইসব দিনরাত্রি! তারপর এক সকালে পেটে থাকা সেই ভাইটা মারা গেল। হয়তো মায়ের কষ্টের বোঝা ঐ ছোট্ট শরীরটা নিতে পারেনি। তিন ভাইবোনের মাঝে সে-ই তো ছিল মায়ের ভেতর। কষ্টটাও অনুভব করেছি সবচেয়ে বেশি সে-ই।

এখানে আর বসতে ইচ্ছে হলো না তার। সিনথিয়ার মাথায় আলতো করে হাত রেখে চলে এল সে।

পেছন পেছন বেরিয়ো এল নন্দী। বললো,

— “মেয়ে মানুষের রুচি এত খারাপ! কিসব খাটাশ পুরুষদের জন্য জীবন দিয়ে দেয়া প্রেম ওদের। ছিঃ!”

রুদ্র – ৩০

৩০

শ্বশুরবাড়ি থেকে আজ বউ নিয়ে ফিরেছে রুদ্র। আয়োজনে কোনো কমতি তারা রাখেনি, বরং প্রয়োজনের চেয়ে বেশিই মনে হলো রুদ্রের। মেয়ে তো নিয়েই এসেছে তাদের, এবার সারাজনমে একগ্লাস পানি না খাওয়ালেও কখনো মনে হবে না কেন তাকে শ্বশুরবাড়িতে একগ্লাস পানি কেউ সাধেনি? তবে সুরভীটা কি একটুখানি বদলেছে? মনে হচ্ছে তেমনই। এই বাড়িটা, তার মাকে আর তাকে সহজভাবে মেনে নিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। সন্ধ্যেবেলা ফিরেই মায়ের ঘরে চলে গেল, এখনো ফেরেনি। মাঝে একবার মায়ের ঘর থেকে ওর হাসির শব্দ শুনতে পেয়েছিল রুদ্র। কী নিয়ে হাসছে জানা নেই তার। কাজে ব্যস্ত ছিল, তাই উঠে জিজ্ঞেস করা হয়নি। এদিকেও এসেছিল মাঝে দু’বার। প্রথমবার এল, কফি খাবে কিনা জিজ্ঞেস করতে। পরেরবার এল, কিছু লাগবে কিনা জানতে। তাতেই যেন সব পাওয়া হলো রুদ্রের। লোকে শুনলে হয়তো বলবে, এইসব সাধারণ খোঁজে এতখানি খুশি হওয়ার কী আছে? কিন্তু তাদের কে বুঝাবে, সুরভী চোখ তুলে তাকালেই ভালো লাগে। সুরভী নিজ থেকে কিছু বললেই জাদু মন্ত্রের মতোন লাগে। ওর মুখটা কল্পনায় ভাসতেই অজান্তেই ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো রুদ্রের। ল্যাপটপ বন্ধ করে সে চললো মায়ের ঘরে।

*****

সিনথিয়ার হাতে মাংস কাটার চাপাতি। ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে আছে ও। হাঁপাচ্ছে। গাল, গলা বেয়ে ঘাম ঝরছে। শীতল চোখে তাকিয়ে আছে মতির দিকে। রক্তের মাঝে পড়ে আছে তার দেহ। শেষ নিঃশ্বাস যাই যাই করছে। আবারও দ্বিগুন ক্রোধে উঠে এল সিনথিয়া। বুক বরাবর অনবরত কোপাতে থাকলো সে, “মর তুই। মর! মর!”

*****

মায়ের ঘরে বসে স্ত্রী আর মায়ের গল্প শুনছিল রুদ্র। তবে শোনার চেয়ে দেখছে বেশি সুরভীকে। আজ দুপুরে সেজেছিল ও। বাসায় ফিরে সাজ ধুয়ে ফেলার সময় কাজল চোখে লেপ্টে গেল। লেপ্টানো কাজলে দারুণ লাগছে ওকে। খোলা চুলগুলো বারবার কানের পাশ ছেড়ে মুখের উপর এসে পড়ছে। নিজ হাতে সরিয়ে দেবার ইচ্ছে হলো কয়েকবার। চাইলেই ওর পাশে বসে ওর গালে, কানে আঙুলের ছোঁয়া লাগিয়ে চুলগুলো গুঁজে দেয়া যায়, কিন্তু রুদ্র তা করবে না। সবসময় কাছে যেতে নেই। কখনো সৌন্দর্য ছোঁবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দূর থেকে দেখার মাঝে এক বর্ণনাতীত মুগ্ধতা থাকে।

কল এল রুদ্রের। শুভ করেছে। মা আর স্ত্রীর গল্পে হাসছিল সে-ও। হাসতে হাসতেই ফোনটা ধরলো,

— “হ্যাঁ শুভ?”

ক্রমশ হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে রুদ্রের। সুরভী আর ফেরদৌসী দেখলো রুদ্রের হাসি মিলিয়ে যাওয়া। নিশ্চুপ তারা চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে।

— “আলতাফ হাশিমি সিনথিয়াকে ডিফেন্ড করবে। কথা বলো তার সঙ্গে।”

মায়ের ঘর ছেড়ে উঠে চলে গেল রুদ্র।

ফেরদৌসী নিচুস্বরে সুরভীকে বললেন,

— “ওকে দেখো! যাও।”

শাশুড়ীর ঘর থেকে বেরিয়ে রুদ্রকে কোথাও দেখতে পেলো না সুরভী। তাদের ঘরেও নেই। স্টাফদের জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল রুদ্র ছাদে গেছে। সুরভীও দৌড়ে ছাদে উঠলো। এক কোনায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে সে। পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখলো সুরভী। পেছন ফিরলো না রুদ্র। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সুরভীর হাতটা চেপে ধরলো।

— “কী হয়েছে?”

— “যা প্ল্যান করেছিলাম উল্টে গেছে।”

— “খুব এলোমেলো হয়ে গেছে? গোছানো সম্ভব না?”

পেছন ফিরলো রুদ্র। সুরভীর চুলগুলো ঘাড়ের পেছন থেকে ধীরে সামনে এনে দিতে দিতে বললো,

— “সম্ভব! রুদ্রের কাছে অসম্ভব বলে কিছু নেই।”

— “তাহলে অস্থির কেন লাগছে আপনাকে?”

— “কাছে থাকো আমার।”

— “আমি থাকলে স্বাভাবিক লাগবে সব?”

— “হ্যাঁ।”

— “আছি।”

সিগারেটের ধোঁয়া বেরিয়ে এল রুদ্রের নাক, ঠোঁট ভেদ করে। দু’জনের মাঝে সাদা ঘোলাটে ধোঁয়া উড়ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলো যেন আরো আবছা হলো। তবুও সুরভী দেখতে পাচ্ছে রুদ্রের চোখ। কী এক বিষণ্ণতা তার দু’চোখ জুড়ে! ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো রুদ্র। সুরভীর দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

— “আমার পাশে গা ঘেঁষে দাঁড়াবে? ভালো লাগবে আমার।”

রুদ্রের হাত জড়িয়ে তার পাশে এসে দাঁড়ালো সুরভী। পাশাপাশি দু’জনে দাঁড়িয়ে রইলো কয়েক মুহূর্ত। নিশ্চুপ। হাতের সিগারেটটা তখনও ফুরোয়নি। বড্ড সময় নিয়ে ফুঁকছে সে। খানিক সময় বাদে, তর্জনী আর মধ্যমার ভাঁজে সিগারেট রেখে, অনামিকা আর কনিষ্ঠায় সুরভীর চুল কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে বললো,

— “তুমি একটা ঘোর সুরভী। আমাকে ডুবিয়ে ফেলো তুমি। আমার খারাপ মুহূর্তে, তুমি আমার গা ছুঁয়ে থাকলে নেশা নেশা লাগে আমার। মনে হয় কোথায় ভেসে যাচ্ছি, হারিয়ে যাচ্ছি।”

কিছু বললো না সুরভী। চোখ বুজে কানের পাশে রুদ্রের স্পর্শ, রুদ্রের কথা অনুভব করছে ও।

রুদ্রের আঙুল কানের পাশ ছেড়ে সুরভীর গালের উপর বিচরণে ব্যস্ত। আরেকটুখানি মাতাল স্বরে সুরভীকে ডাকলো রুদ্র,

— “সুরভী …”

— “হুম?”

— “ভালোবাসি।’

৩১

— “দলের পুরোনো সদস্য। দলে নেই যদিও, তবুও প্রবীন নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা তো ছিলই। আলতাফ হাশিমি যার-তার কেইস লড়ে না। শিল্পপতি, পলিটিশিয়ানদের সুপারিশ ছাড়া এসব মডেল, অভিনেত্রীদের কেইস ও লড়বে না, প্রত্যেকে জানে। যতই চাপিয়ে রাখতে চাও না কেন, খবর জানাজানি হবেই সিনথিয়ার জন্য আলতাফকে তুমি হায়ার করছো। আবার দলীয় কোন্দল শুরু হবে।”

— “এই খবর আপনি, আমি, শুভ আর হাশিমি ছাড়া আর কেউ জানে না। হাশিমি মুখ খুলবে না, শুভও না। বাকি রইলেন আপনি। দলে খবরটা আপনি প্রচার করবেন?”

বিরক্ত হলেন ইকবাল মাহমুদ। বেশ অভিমান জড়িয়ে ইকবাল মাহমুদ বললেন,

– “তোমার বয়সী ছেলেটা আমার মরে গেছে। আমার বয়সী তোমার বাপটা মরেছে। তোমাকে দেখলে আমার ইমতিয়াজের কথা মনে পড়ে। তোমাকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসি। অথচ তুমি খোঁচাতে ছাড়ো না। কেমন করে বললে আমি তোমার খবর প্রচার করবো?”

ইকবাল মাহমুদের অভিমানে হেসে ফেললো শুভ আর রুদ্র।

সিগারেটটা অ্যাশ ট্রেতে ফেলে ইকবাল মাহমুদের কাঁধ জড়িয়ে বললো,

— “বয়স হয়ে যাচ্ছে আপনার। বুড়োদের মতো আবেগী আর অভিমানী হয়ে যাচ্ছেন দিনদিন।”

— “ভেবেছিলাম বিয়েশাদী করিয়ে দিলে, মেয়ে লোকের ছোঁয়া লাগলে চ্যাটাং চ্যাটাং কথার ধাতটা বদলাবে। একটু নমনীয়তা, সভ্যতা ফিরবে। হলো না! বিয়েটাই বৃথা মনে হচ্ছে এখন।”

— “আপনার এই মুখে মুখেই আমাকে যত ছেলে ভাবা। আসলে তো ভাবেন না আপনি! বউ নিয়ে এসেছি পর একবারও আন্টি আর ইরা, নীরাকে নিয়ে গেছেন বাসায় বউ দেখতে?”

— “যা একটা ঝামেলা করে বউ আনলে! মেয়েটার স্বাভাবিক হতেও তো সময় লাগবে। তার উপর দলবেঁধে ওকে দেখতে গেলে কেমন না! ইরা, নীরা তো শুনেই বলেছিল দেখতে যাবে। মিসেস আর আমিই বারণ করলাম।”

— “সব ঠিক আছে। সময় করে ওদের নিয়ে যাবেন নয়তো ওদের পাঠিয়ে দেবেন। “ – “তা দিবো। কিন্তু দলে আপাতত ঝামেলা চাচ্ছি না। কী দরকার ছিল ঐ

মেয়েটার পক্ষ নেবার? মতি মরে গেছে, শেষ তো লেনদেন। ঐ মেয়ে ওর মতন ফেঁসে জেলে যাবে। ব্যস!”

— “মেয়েটা প্রেগন্যান্ট।”

— “এমন অহরহ প্রেগন্যান্ট আছে জেলের ভেতর।”

ইকবাল মাহমুদের নরম সুরে বিরোধিতা ভালো লাগছে না রুদ্রের। ভ্রু কুঁচকানো চেহারা দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে। খানিকটা কর্কশ হলো সে,

— “আছে। কিন্তু সিনথিয়ার হিসেব ভিন্ন। মতি আর সিনথিয়ার মাঝে আমি জড়িয়ে গেছি। মতি সম্পর্কে কিছু না জানালে আজকে এই খুনটা সিনথিয়া করতো না। হয়তো ও মরে যেত। কিন্তু এই অবস্থায় জেল তো আর খাটা লাগতো না।”

— “তা হিসেব ঠিকই আছে তোমার।”

— “আরো হিসেবও আছে এখানে।”

— “কী?”

— “আগেই বলে নিচ্ছি ভীতুর মতো আচরণ করবেন না। আপনি আজকাল

কোনোভাবেই দক্ষ রাজনীতিবিদের মতো আচরণ করছেন না। এভাবে চলবে না আংকেল।”

— “সবে দল ক্ষমতায় এসেছে। এখনই দলীয় কোন্দল ভালো হবে না। তাই এত ভাবি।”

— “বিশ্বাস করেন না আপনি আমাকে?”

— “অবশ্যই করি।”

— “মতিকে নিয়ে আমার প্ল্যান ছিল ওকে মার্ডার মামলায় ফাঁসিয়ে ওর সমস্ত রেইপ কেইস, দুর্নীতি টেনে আনবো। ওর ম্যাক্সিমাম চ্যালারা নারীঘটিত কেলেংকারীতে জড়িত। সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে মতির এলাকায়, ওর ছত্রছায়ায়। সব কয়টাকে জেলে ঢুকাতাম, কয়েকটাকে ক্রসফায়ারে দিতাম। ক্রাইমের উপর সেটা ডিপেন্ডেবল ছিল। টাকা-পয়সা নিয়ে দুর্নীতি পর্যন্ত মানা যায় আংকেল। বাট রেইপ? নেভার! মতি, হাবিব আর আজগর এই তিনজন মিলে দলের যা কলংক করেছে তা ওদের মরণ ছাড়া সাফ সাফাই হওয়া সম্ভব না। রাঘব বোয়াল মেরে হজম করতে বেগ পেতে হতোই। তাই কিছু করছি না। নয়তো কিছু কীট পতঙ্গ দুনিয়া থেকে মুছে ফেলাই ভালো। চুনোপুঁটিগুলোকে কিছু একটার জেরে গিলে ফেলা যাবে। তাই আপাতত টার্গেট ওরাই। দলের জন্য যতদিন খেটেছে, ততদিন আমরাও ওদের পুষেছি। কিন্তু দলের নাম ভাঙিয়ে কুকর্ম করে বেড়াবে, তারপর ইলেকশনে গিয়ে নাকানিচুবানি খেতে হবে আমাদের, তা হবে না। স্ট্রেইট গায়েব করে ফেলা হবে সব। এবারের ইলেকশন আপনার আমার জন্য শিক্ষা ছিল। কেমন বেগ পেতে হয়েছে সিট দখল দিতে, তা আশা করি ভুলবেন না আর ভবিষ্যতে সেভাবেই এগিয়ে যাবেন।”

— “তা ভুলি কেমন করে!’

— “এটাই মনে রাখতে হবে আংকেল। সিস্টেম বদলানো সম্ভব না। চুরি, দুর্নীতি সব হবে, তবে অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে। কোনো প্রমাণ থাকা চলবে না কোনোভাবেই। যার কারণে দলের উপর বাজে প্রভাব পড়বে তাকেই সরিয়ে দিতে হবে। হয় জেলে, নয়তো নির্বাসনে, নয়তো কবরে।”

— “এখন কাকে কবরে পাঠাতে চাইছো সেটা বলো।”

— “মতির সাতটা চ্যালা আছে, মতির এলাকার ওসির কাছ থেকে লিস্ট নেয়া। এগুলোকে সরিয়ে ফেলতে হবে। আর ২৫জনকে আপাতত জেলে ঢুকানো হবে।

সব হবে সিনথিয়ার কেইসে। মতির জের ধরে ওগুলোকে টানবো সাক্ষী প্রমাণ সহ। বাকিগুলোকে ঢুকাবো আরো কয়দিন পর। সবাইকে এখনই একসঙ্গে জেলে টানা সম্ভব না। সাতজনকে এখনই একসাথে এনকাউন্টারে দেয়া যাবে না। সময় বুঝে সব সাইজ করা হবে। তবে সিনেমা শুরু হবে এখনই।

— “সব ঠিকঠাক সামলে নিলেই হলো!”

— “আপনি আজকাল স্ট্রেস নিচ্ছেন বেশি। ইলেকশন পর্যন্ত একদম ঠিক ছিলেন। আজগরের হুমকি ধমকির কেমন চুপসে গেছেন। ইকবাল মাহমুদের এই চুপসানো চেহারা দেখে আমি অভ্যস্ত নই। বিরক্ত ধরে যায় আমার। আগের ফর্মে ফিরুন তো জলদি!”

হাসলেন ইকবাল মাহমুদ।

— “একটু আগে তুমিই তো বললে বুড়ো হয়ে গেছি।”

— “ক্ষমতায় বসলে বুড়ো হওয়া যায় না। জোর করে নিজেকে ধরে রাখতে হয় নয়তো ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হয়।”

— “রাখবো। কিন্তু আজগরকে কী করেছো বলো তো? বাকি কথা আমাকে কিন্তু তুমি বলোনি!”

— “থাকুক না। এত জেনে আর কী হবে? ওর চ্যাপ্টার ক্লোজ। আমি আজ উঠি। রাত অনেক হয়েছে. ফিরতে হবে।”

ইকবাল মাহমুদকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেল রুদ্র। তাকে আর আটকালেন না ইকবাল নিজেও। নতুন বিয়ে শাদী করেছে, বাসায় ফেরার জন্য অস্থির হবে, রাত এগারোটার আগে বাসায় ফিরবে এই তো স্বাভাবিক! ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি উঁকি দিলো তার। নিজ দাম্পত্যের প্রথম দিকের সময়গুলো মনে নাড়া দিচ্ছে। আহা, জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া সেইসব মধুর স্মৃতি!  

গাড়িতে বসতেই আদনানের কল এসেছিল। এতটা সময় তার সঙ্গেই কথা বলছিল রুদ্র। কল কাটতেই শুভ জিজ্ঞেস করলো,

— “ঐ প্ল্যান তাহলে ক্যান্সেল ভাইয়া?”

— “আপাতত হ্যাঁ। মতিকে নিয়ে মিডিয়া গরম। এই মুহূর্তে আদনান আর ওর ওয়াইফকে সামনে আনা অযৌক্তিক। যাক আরো এক সপ্তাহ, তারপর সোমাকে মিডিয়ার সামনে আনবো।”

— “ওদের মাঝে এখন সব ঠিক?”

— “একদম! আদনান ছেলেটা রাজনীতি ভালো বুঝে। সংসার, প্রেম এসবে একদম কাঁচা। সোজা কথায় জঘন্য হাজবেন্ড ও। এত সোজাসাপ্টা বউকে সামলাতে জানে না ঠিকঠাক। বুঝিয়ে শুনিয়ে দিয়েছি, এবার থেকে বুঝে-বুঝিয়ে চললেই হয়। নেক্সট মান্থ আয়োজন করে বউ ঘরে তুলবে।”

— “আর আপনি? একটু আনন্দ করার সুযোগ পাবো না?”

— “সব হবে, একটু গুছিয়ে নেই। সুরভী আরেকটু স্বাভাবিক হোক। তারপর ওর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে সপ্তাহ বেঁধে আয়োজনের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেলবো।

*****

বাইরের জগত ছেড়ে একান্ত সুরভীর মানুষটা হয়ে ঘরে ফিরলো রুদ্র। মিনিট দশেক আগেই কল করেছিল সুরভী- কখন ফিরছে জানতে। ঘরে ঢুকে রুদ্র দেখলো, সুরভী খাটে বসে অস্থির হয়ে পা দোলাচ্ছে। রুদ্রকে দেখা মাত্রই ছুটে এল তার কাছে, যেন তারই অপেক্ষায় ছিল এতটা সময়। ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো রুদ্র। গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে বললো,

— “আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?”

রুদ্রের নাক বরাবর পারফিউমের কৌটা তুলে ধরলো সুরভী।

— “আপনার পারফিউম কালেকশনগুলো দেখছিলাম, এটা পেলাম তখন।”

— “আচ্ছা! ভালো লেগেছে এটা?”

— “রিসেন্টলি একটা ইন্সিডেন্ট হয়েছিল। কে যেন বাসার বেল চাপলো আর তখনই বাসায় কারেন্ট চলে গেল। আমি গেট খুলতেই আমার হাত চেপে জড়িয়ে ধরলো। এই পারফিউমটাই সেই অজানা লোকের গায়ে ছিল। সেই অজানা মানুষটা আপনি ছিলেন, তাই না?”

সজোরে হেসে উঠলো রুদ্র। গায়ে পারফিউম স্প্রে করে সুরভীকে বললো,

— “কাছে এসো, তোমার হাত চেপে জড়িয়ে ধরি। তারপর নাহয় মিলিয়ে নিও আমিই সেই মানুষটা কি না!”

কপট রাগ দেখাতে গিয়েও হেসে ফেললো সুরভী।

— “আপনার এত দুঃসাহস!”

— “তোমার জন্য এই সামান্য একটু সাহস করাই যায়।’

— “আমি কেমন ভয় পেয়েছিলাম জানেন?”

— “আহা! তখন বুঝতে পারলে আরও দুটো চুমু দিয়ে আসতাম। চুমু খেলে ভয় কেটে যায়।”

— “ধুর! আপনি গোপনে গোপনে কত কী করে ফেললেন, অথচ আমাকে নিয়ে কেউ এত ভাবছে সে খবরটাই আমি জানলাম না!”

— “জানলে কী করতে? প্রেম করতে?”

— “কী জানি! হতেও পারতো একটা দুর্দান্ত প্রেমের গল্প।”

— “এখনও হতে পারে।”

— “হ্যাঁ, পারে।”

— “ধরে নিলাম তুমি আমার প্রেমিকা। কী করবে তোমার প্রেমিকের জন্য?”

— “তাকে তার প্রিয় কিছু উপহার দিতে পারি।”

— “যদি প্রেমিক তোমার কাছে সময় চায়? বিশেষ কিছু মুহূর্ত চায়?”

— “দেবো। আর প্রেমিক? সে কী করবে?”

— “প্রেমিক একটু অসভ্য! শুধু মিষ্টি মিষ্টি প্রেম দিতে পারবে না। মিষ্টির সঙ্গে দুষ্টুমিও থাকবে।”

রুদ্রের ইশারা খুব টের পেল সুরভী। এতটা সময় রুদ্রের চোখে চোখ রেখে খুনসুটিতে মাতলেও চোখ নামিয়ে নিলো তক্ষুনি। সুরভীর লাজুক চোখজোড়া রুদ্রের দেখতে ইচ্ছে হলো ভীষণ। দু’হাতে সুরভীর মুখ আঁজলা করে তুলে ধরলো। বৃদ্ধাঙুলিতে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে তার গালজুড়ে। কী এক আবেশে সুরভীর চোখ বুজে আসতে চাইলো। তবুও চোখ জোর করে টেনে ধরে রইলো ও। সুরভীর চোখে মাদকতা দেখতে পাচ্ছে রুদ্র। এই মুহূর্তটা হাতছাড়া করতে ইচ্ছে হলো না তার। সুরভীর পিঠ জড়িয়ে আরো কাছে টেনে নিলো সে।

— “সারাদিন পর ফিরেছি, আমি যখন থাকি না আমাকে মনে পড়ে তোমার?” মাথা দুলিয়ে সায় দিলো সুরভী।

— “বলো না কেন আমাকে? জানতে ইচ্ছে হয় তো আমার! সুরভী আমাকে মিস করছে, আমাকে দেখতে চাইছে তা কেন আমার অজানা থাকবে? হুম?”

— “লজ্জা পাও বলতে?”

— “কী জানি!”

— “আমি তোমার জন্য মরি অথচ তুমি কিনা লজ্জায় পড়ে আমার মনের খোড়াকটুকু আমাকে দাও না! কেন?”

— “হুট করে ধরে নিয়ে বিয়ে করে ফেললে এমনই হয়।”

— “শাস্তি দিচ্ছো?”

— “হ্যাঁ।”

— “শাস্তি ভোগ করছি তো! এই যে এত কাছে তুমি, তবুও রোজ সকাল বিকাল নিয়ম করে জড়িয়ে ধরছি না। এখন পর্যন্ত একটা চুমু দেইনি। তোমার নগ্ন কোমরে হাত রাখিনি, বুকে ছুঁয়ে দেখিনি; অথচ সবকিছুর ইচ্ছে তো আমার হয়। কখনো কখনো নেশা চেপে ধরে। তবুও চেয়েছি একবারও? নিজেকে নিজে সামলে নিচ্ছি বারবার। কঠিন তপস্যা বললে ভুল হবে না! এরচেয়ে কঠিন শাস্তি আর কী আছে বলো? তবুও তুমি আরো আরো শাস্তি দিতে চাও। মেরে ফেলবে আমাকে?”

রুদ্রের চুলগুলো গুছিয়ে দিতে লাগলো সুরভী। বললো,

— “যা ইচ্ছে হয় তা কেন চান না?”

— “চাই না জোর করতে।”

— “কেন? সম্মান নাকি ভালোবাসা?”

— “দুটোই।”

— “খুব ভালোবাসেন?”

— “বাসি।”

ভালোবাসা জন্মেছে কি না সে কথা এখনো অজানা সুরভীর। তবে এখন এই মুহূর্তে মনে হলো, রুদ্রকে অবশ্যই জড়িয়ে ধরা উচিত। অন্তত একবারের জন্য, এক মুহূর্তের জন্য হলেও তাকে জড়িয়ে ধরা চাই! রুদ্রের গায়ের সঙ্গে মিলিয়ে গেল সুরভী। চোখ বুজে রইলো তার বুকে। রুদ্র আষ্টেপৃষ্টে ধরে রেখেছে ওকে। এই হাতজোড়ায় বন্দী হয়ে যেন আশ্রয় খুঁজে পেল সুরভী। মনে হচ্ছে যেন এই আশ্রয় জন্ম-জন্মান্তরের।

৩২

দেখতে দেখতে নভেম্বরের মাঝামাঝি পেরিয়ে যাচ্ছে। এই বাড়িতে সুরভীর আজ বাইশতম দিন। প্রকৃতিতে শীত নেমে এলেও, রুদ্রের সঙ্গে সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়ছে রোজ। রুদ্রের যত্ন, ভালোবাসা, প্রতিদিন একটু একটু করে কাছে টেনে নেয়া… সবকিছু সুন্দর! কোনো পুরুষের মাঝে এতখানি ধৈর্য্য থাকতে পারে বলে জানা ছিল না সুরভীর। নয়তো এতদিনেও দু’বার গাঢ় চুমু ছাড়া আর কিছুই চাইবে না, তা কখনো হয় নাকি! রুদ্রের চোখে তাকিয়ে তার চাওয়া খুব বুঝতে পারে সে। রুদ্র অধিকার খাটিয়ে তার চাওয়া পূরণ করলেও সুরভী বিন্দুমাত্র অমত করবে না। তবে সে কথা এখনও বুঝতে দেয়নি ও। যেভাবে চলছে, এগোচ্ছে এই স্মৃতিগুলো ভীষণ মিষ্টি। একবার ছুটে গেলে আর পাওয়া হবে না। হয়তো কাছে আসার সুখ পাওয়া যাবে, ভালোলাগা-ভালোবাসা সব থাকবে। তবে এই একই অনুভূতি কি আর থাকবে? এই ভেবেই এতগুলো দিন পেরোলো তাদের দাম্পত্যের। গতরাতে রুদ্র চুমুর মুহূর্তে অজান্তেই জামায় হাত গলিয়ে, তার পিঠে এলোমেলো হাতড়াতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই কেঁপে উঠেছিল সে। টের পাওয়া মাত্র রুদ্র ছিটকে গেল দূরে। কাজের বাহানায় পড়ে রইলো অন্য ঘরে। কয়েকবার ডাকা সত্ত্বেও এল না এই ঘরে। পুরো রাত ঘুম হয়নি সুরভীর। এপাশ-ওপাশ করে কেটে গেছে সারা রাত। কয়েকবার রুদ্রকে গিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়েছিল, আমি তো তোমারই। যা চাইছো তা আদায় করে নিতে পারো। আপত্তি নেই তো আমার!

তবুও কী এক সংকোচে বলা হয়নি মুখ ফুটে। সকালে রুদ্র ঘরে এল। সুরভী তখনও বিছানা ছাড়েনি। রুদ্রের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র লাফিয়ে উঠলো সে বালিশ ছেড়ে।

— “তুমি ঘুমাওনি রাতে?”

ডানে-বামে মাথা নাড়লো সুরভী।

ভ্রু কুঁচকে এল রুদ্রের।

সুরভীর পাশে বসে, মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

— “কেন?”

— “আপনি গতকাল এভাবে বেরিয়ে কেন গেলেন?”

— “কাজ ছিল।”

— “রাগ হয়েছেন আমার উপর?”

— “কিসের রাগ?”

কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সুরভী।

রুদ্র বুঝে নিলো সবটা।

ঠোঁটের পাশে আলতো চুমু খেয়ে বললো,

— “সামান্য একটা ঘটনায় রাগ করবো? তোমার উপর রাগ করে থাকতে পারবো আমি? আমি তো বলেছিই তুমি যতদিন না নিজে এসে ধরা দেবে ততদিন আমি দূরেই থাকবো। সিদ্ধান্তটা আমারই। তাহলে রাগের প্রসঙ্গ আসছে কেন?”

— “মনে হলো রাগ করে চলে গেছেন।”

— “তাই ঘুমাওনি?”

— “আসেনি।”

সুরভীর মাথার পেছনে, চুলের গোড়ায় রুদ্রের স্পর্শ আরো গাঢ় হলো। নেশাতুর

চাহনীতে চেয়ে রইলো সুরভীর চোখে। জানতে চাইলো,

— “আমার অভিমান, রাগ তোমাকে ভাবায় খুব?”

— “ভাবালো তো! অস্থির হয়ে শুধু এপাশ ওপাশ করেছি।”

— “কেন ভাবায়? কেন অস্থির হও আমার জন্য? ভালোবাসো?”

— “না।”

হাসলো রুদ্র। সুরভীর ঠোঁট, নিজের ঠোঁটে ভিজিয়ে দিলো সে।

— “রাখো চেপে যতদিন পারো। যখন আর চেপে রাখতে পারবে না, দম বন্ধ লাগবে সেদিন নিজেই ছুটে এসে বলে দেবে। আমি নাহয় ভালোবাসি শোনার অপেক্ষায় রইলাম!”

৩৩

— “কেইস ফার্স্ট হিয়ারিংয়েই ডিসমিস করে দেবো।”

— “প্রুফ সব এই ফাইল আর পেনড্রাইভে আছে। আরো কিছু প্রয়োজন হলে জানাবেন।”

— “অবশ্যই। হাতে আরো চারদিন সময় আছে। আজ রাতেই আমি আর আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট সব চেক করবো। যদি কিছু প্রয়োজন হয়, কাল সকালে জানাবো।”

— “সিনথিয়া আদালতে ঠিকঠাক অভিনয়টা করে যেতে পারলেই হয়!”

— “পারবে। আসলে ও এমনিতেও পুরোপুরি স্ট্যাবল না। সাইকিয়াট্রিস্টের আন্ডারে ছিল একবছর যাবৎ। তবে এই কন্ডিশন দেখিয়ে পার পাওয়া সম্ভব না। টোটালি আউট অফ সেন্স হওয়া জরুরি। প্রথমে খুব একটা হেলদোল দিচ্ছিলো না। মানে, বিচার হলে হোক। তাতে ওর কিছু আসে যায় না। পরে বাচ্চার কথা, ওর ভবিষ্যতের কথা বলে পাক্কা তিনঘণ্টা ধরে কাউন্সেলিং করলাম। এখন ঠিকঠাক আছে সব। মতির হয়ে কেইস লড়বে কে জানো?”

— “শুনেছি। সাফিনা আমিন।”

— “ওর জন্যই স্টং ড্রামা সাজাতে হচ্ছে। শি ইজ টাফ।”

— “নট মোর দ্যান ইউ। নয়তো ওকেই হায়ার করতাম।”

— “তবুও! অপনেন্টকে কখনো আন্ডারস্টিমেট করতে হয় না।”

হুইস্কির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে আলতাফ হাশিমির সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত রুদ্র। এরই মাঝে কল এল সুরভীর।

— “হ্যাঁ সুরভী?”

— “ফিরছেন কখন?”

— “আমি এখন একটা মিটিংয়ে আছি, সেখান থেকে যাবো বন্ধুর পার্টিতে। ফিরতে আরো তিনঘন্টা।”

— “এত দেরী?”

— “অপেক্ষা করছো?”

— “একটু আধটু করছি আরকি।”

— “করো। ফিরছি বারোটার মধ্যে।”

*****

রুদ্রের ফিরতে রাত দেড়টা বাজলো। এই প্রথম কথার হেরফের হলো তার। গাল ফুলিয়ে প্রচন্ড অভিমানে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো সুরভী। আজ রাতটা বিশেষ হবার কথা ছিল। মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল রুদ্রের কাছে নিজেকে সঁপে দিতে। ঘরটা নতুন বেডশিট আর কিছু ফুলে সাজিয়েছিল নিজেই। গায়ে জড়িয়েছিল রুদ্রের প্রিয় কালো রঙের শাড়ী আর ছোট্ট ডায়মন্ডের গয়না। সেই সকাল থেকে কতশত কল্পনায়, অনুভূতিতে বারবার লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়া, ভালো লাগায় ভেসে যাওয়া আরো কত কী! অথচ মানুষটা সময় মতো আসেনি। দশটার পর আর একটা কলও রিসিভ করেনি। রাগে একটু আগে কেঁদেই দিয়েছিল সুরভী। রুদ্রের উপস্থিতি টের পাওয়া মাত্র চোখের পানি মুছে স্বাভাবিক হলো ও।

টলতে টলতে ঘরে এল রুদ্র। চোখের সামনে সুরভী দাঁড়িয়ে। কী দারুণ লাগছে ওকে দেখতে! কালো শাড়ীতে গায়ের রং যেন খোলতাই হয়েছে। গলাটা কী সুন্দর লাগছে। ইশ্! শাড়ীর ফাঁক গলে বেরিয়ে আছে পেটের উন্মুক্ত অংশ; মনে পড়ে গেল সেই রাতের কথা। ওর গলা বেয়ে বুকের খাঁজে গড়িয়ে নেমে আসা বিন্দু বিন্দু পানি। সুরভীর বুকে চোখ গেল রুদ্রের। ওখানটায় আজ পর্যন্ত কোনো খাঁজের দেখা মেলেনি। কেন দেখতে দেয় না মেয়েটা? কেন অমন ঢেকেঢুকে সামনে আসে সবসময়? অধৈর্য্য হলো রুদ্র। ওর কাছে এগিয়ে, কোমরে চেপে ধরে গলায় চুমু খেল রুদ্র।

— “তুমি পারো না আমার সামনে বোরকা পরে আসো! কেন সুরভী? আমার তোমাকে দেখতে ইচ্ছে হয়। গায়ে ওড়না, জামা, ব্রা কিচ্ছু থাকবে না সেই সুরভীকে আমার দেখতে ইচ্ছে হয়।”

রুদ্রের কথা জড়িয়ে আসছে। গা থেকে বাজে গন্ধ ভেসে আসছে। রুদ্র মদ খেয়ে মাতাল হয়ে ফিরেছে, সে কথা সুরভীর বুঝতে বাকি নেই। এতটা সময়ের রাগ ঝেড়ে সামলাতে চাইলো তাকে। রুদ্রকে সোফায় বসিয়ে ছুটতে চাইলো রান্নাঘরে লেবুপানি আনবে বলে। আনা হলো না সুরভীর। একটানে সুরভীকে নিজের কোলের উপর বসালো রুদ্র। দু’হাতে সুরভীর কোমর জড়িয়ে বললো,

— “সেদিন রাতের সুরভীকে আমি চাই।”

— “কবেকার?”

— “ঐ তো দুপুরে গোসল করে ব্রা বারান্দায় শুকাতে দিলে, আমি শুভর বাসায় দাঁড়িয়ে দেখলাম। তারপর রাতে ঐ ব্রা পরে আমার কোলে বসে পড়লে। বুকের অর্ধেক দেখিয়েছিলে আমাকে সেদিন। তোমার গলা বেয়ে পানি বেয়ে পড়ছিল তোমার ক্লিভেজে। নিজে হাত টেনে তোমার বুকের খাঁজে রেখেছিলে।” সুরভীর গলা থেকে বুকের মধ্যখান পর্যন্ত তর্জনীতে ছুঁয়ে দিলো রুদ্র। অসহ্য লাগছে সুরভীর, তবুও বসে রইলো ও। পুরোটা শুনতে হবে, বুঝতে হবে।

— “কেমন পাগলের মত চুমু খেয়েছিলে আমার ঠোঁটে। ব্যথা পাচ্ছিলাম আমি। আমাদের চুমুটা শেষ হয়নি। আমাদের আরো কাছে আসা হয়নি। তার আগেই ঘুম ভেঙে গেল, কিন্তু আমার ঘোর কাটলো না। তোমাকে পাবার নেশা ছড়িয়ে গেল আমার শিরায় শিরায়। মনে হলো, তোমাকে না পেলে আমার সবকিছু তুচ্ছ হয়ে যাবে। তোমাকে চাই-ই। এবার তুমি আমার হয়ে যাও প্লিজ! সেই রাতের চুমুটা শেষ করো। আরো কাছে টেনে নাও আমাকে, আমার তৃষ্ণা মেটাও।”

এবারে সবকিছু স্পষ্ট হলো সুরভীর। হুট করে তার জীবনে রুদ্রের আসা, তাকে পাবার জন্য এত উন্মাদনা, অস্থিরতা সবকিছুর কারণ স্পষ্ট হলো। এখানে ভালো লাগা, ভালোবাসা কিচ্ছু নেই। আছে শুধু মোহ। এই শরীরের প্রতি, কামবাসনার প্রতি। নিজেকে কেমন ছোট মনে হলো সুরভীর। একজন এসেছিল টাকার লোভে অন্যজন এল শরীরের লোভে। সত্যিকারে শুধুই মানবী সুরভী কি প্রেমিকের প্রেম পাবার অযোগ্য? কারো কি কখনো ইচ্ছে হয়নি এই মেয়েটাকে আবেগের জায়গা থেকে ভালোবেসে দেখি, কাছে চেয়ে দেখি?

আরো কিসব এলোমেলো বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়লো রুদ্র। মুখে হাত চেপে চিৎকার করে কাঁদছে সুরভী। এসব যত্ন ভালোবাসা সব মিথ্যা। সব! তৃষ্ণা মিটে গেলেই সব মুছে যাবে। হয়তো মুছে যাবে চিরতরে রুদ্রের মন থেকে সে নিজেও।

৩৪

সকালের আলো মুখে পড়তেই ঘুম ভাঙলো রুদ্রের। নিজেকে আবিষ্কার করলো সোফার উপর। তীব্র মাথাব্যথা নিয়ে শোয়া থেকে উঠলো সে। ড্রেসিং টেবিলের গায়ে হেলান দিয়ে, সুরভী বসে ঘুমুচ্ছে। বিধ্বস্থ দেখাচ্ছে ওকে। পরনে কালো শাড়ী। চোখের আশপাশে আইলাইনার লেপ্টে কালো হয়ে আছে। ঠোঁটের লাল লিপস্টিকটাও মুছে গেছে প্রায়। মুখ ফুলে আছে। দেখে বুঝাই যাচ্ছে কেঁদেছে খুব। মনে মনে আঁতকে উঠলো রুদ্র। গতরাতের কথা স্পষ্ট কিছু মনে নেই তার। কখন বাসায় ফিরেছে, কী হয়েছে কিছুই না! অজান্তেই কি সুরভীকে সে…

ছুটে এল সে সুরভীর কাছে। গাল ছুঁয়ে দিয়ে ডাকলো,

— “এই সুরভী?”

ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল সুরভীর। রুদ্রের ডাকে চোখ মেললো ও।

— “তুমি এভাবে এখানে কেন?”

কিছু বললো না সুরভী। ব্যথাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রুদ্রের চোখে। রুদ্রের ভয় বুঝি আরো গাঢ় হলো। সুরভীর মাথায় হাত বুলিয়ে জানতে চাইলো,

— “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন তুমি? কী করেছি আমি গতকাল? বলো আমাকে!”

— “সত্যিটা বলে দিয়েছেন।”

— “কোন সত্যি?”

— “বিয়ে কেন করেছেন।”

— “বিয়ের পেছনে আবার কোন সত্যি?”

— “স্বপ্নে যা দেখেছিলেন।”

সুরভীর মাথার উপর থেকে হাত সরিয়ে নিলো রুদ্র এক মুহূর্ত নীরব বসে রইলো সে।

— “স্বপ্ন তো স্বপ্নই সুরভী। আমি ইচ্ছে করে তো দেখিনি।”

— “আমার বাসার বারান্দায় আমি আন্ডারগার্মেন্টস শুকাতে দিচ্ছি তা দেখেই আপনার কামনা জেগে গেল?”

— “আর ইউ আউট অফ সেন্স? সামান্য একটা ভেজা ব্রা দেখে রুদ্রের সেক্স ডিসায়ার হবে? রাস্তার থার্ড ক্লাস লোক আমি?”

— “নয়তো এমন রগরগে স্বপ্ন দেখেন কী করে?”

— “লেট মি এক্সপ্লেইন সুইটহার্ট। ঠান্ডা মাথায় শোনো আমার কথা তুমি। মাথার উপর তখন আমার পাহাড় সমান চাপ সুরভী! এত স্ট্রেস আমি আর নিতে পারছিলাম না। নিজের বাসা, বিজনেস সব ফেলে শুভর বাসায় মুখ লুকিয়ে পড়েছিলাম। তখন জাস্ট দুদিন দেখেছি তোমাকে। ঠিকমতো তোমাকে খেয়ালও করিনি। হতে পারে স্ট্রেসের কারণে ওসব হাবিজাবি দেখেছি স্বপ্নে। বাট বিলিভ মি, তোমার ব্রা দেখে তোমাকে নিয়ে বিন্দুমাত্র কু-ইচ্ছা আমার মনে আসেনি।”

— “কিন্তু তারপর তো পেতে ইচ্ছে করলো! নগ্ন শরীরটা হাতড়ে দেখার শখ হলো। নিজেই বলেছেন গতকাল।”

— “কী বলেছি?”

— “ওড়না, জামা, ব্রা ছাড়া আমাকে দেখার ইচ্ছে হয়। জাস্ট এই শরীরটার জন্য বিয়ে করলেন আমাকে? আমি মানুষটাকে পাবার কোনো ইচ্ছে নেই? সব চাওয়া মিটে গেলে ছুঁড়ে ফেলবেন আমাকে?”

— “রাবিশ! কথা না বুঝে উল্টাপাল্টা বলো না প্লিজ। সেই স্বপ্নের পর আমি তোমাকে চেয়েছি তা ঠিক, বাট নট ফর মাই ফিজিক্যাল ডিমান্ড। আমি তোমাকে চেয়েছি আমার শান্তির জন্য। এ ঘটনার আগে আমি দিশেহারা হয়ে ছিলাম। ব্রেন হ্যাং ছিল আমার। অস্থিরতার কথা আর না বলি। তুমি স্বপ্নে এলে, আমার মনে হলো সবকিছু থেকে দূরে কোথায় আমাকে তুমি ভাসিয়ে নিয়ে গেলে। আমি সবকিছু ফেলে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছি। নতুন করে সবকিছু ভাবার এনার্জি পেয়েছি। বহুবছর আমি স্বস্তি পাইনি সুরভী। বিশ্বাস করো! হন্যে হয়ে একটু স্বস্তি খুঁজেছি যদিও শুনতে উইয়ার্ড লাগছে, কিন্তু এটাই সত্যি। আমার শুধু তোমার শরীরটা না, গোটা তোমাকেই লাগবে এমনটাই ফিল করেছি। সেদিন, সেই মুহূর্তের পর থেকে আমি এক মুহূর্তের জন্যও তোমাকে অন্য কারো ভাবতে পারিনি। বারবার মনে হয়েছে আমার ওকে চাই। লাগবেই। যাকে চোখ বুজে কল্পনা করে, দূর থেকে একনজর দেখে আমার অশান্ত মন শান্ত হয়, তাকে কাছে পেলে আমি কেমন সুখী হবো সেই লোভ থেকেই তোমাকে আমি বিয়ে করেছি। আর রইলো কথা তোমাকে ওড়না, জামা ছাড়া দেখতে চাওয়া, আমি কি অন্যায় কিছু চেয়েছি সুরভী? তুমি আমার লিগ্যালি ওয়েডেড ওয়াইফ। তোমাকে নিয়ে এই ইচ্ছে হওয়া কি খুব অমূলক? হবেই। স্বাভাবিক। তাই বলে চাপিয়ে তো দেইনি কিছু! ইট’স আওয়ার টুয়েন্টি ফোর্থ ডে অফ ওয়েডিং এ্যান্ড আ’ম স্টিল ওয়েটিং ফর ইউর কন্সেন্ট! তবুও তুমি বলছো আই জাস্ট ম্যারিড ইউ ফর মাই সেক্সুয়াল ডিসায়ার! হাহ্!”

এক টানা সমস্তটা বলে ফেলে লম্বা নিঃশ্বাস নিচ্ছে রুদ্র। সুরভীর অপবাদ যেন বুকের ঠিক বাঁ পাশে খোঁচাচ্ছে। প্রচন্ড অভিমানে চেয়ে রইলো সে সুরভীর চোখে।

তবুও থামলো না সুরভী। কোনো যুক্তিই যেন ওর মাথায় খেলছে না!

— “সত্যিই ভালোবাসেন আমাকে?”

— “তুমি স্টিল কনফিউজড? সিরিয়াসলি!”

— “হ্যাঁ। আই থিংক আপনার ভ্রম হচ্ছে। কাম আর ভালোবাসাটা গুলিয়ে ফেলছেন। নিজেও পার্থক্য করতে পারছেন না। দূরে গিয়ে মেপে নেয়া উচিত আসলেই ভালোবাসা আছে কি না?”

— “আবোলতাবোল বকছো কেন? দূরে গেলে কাম মুছে যাবে?”

— “সুন্দরী মেয়েদের মাঝে ক’টাদিন থেকেই দেখুন না আমাকে ছাড়া। তফাৎটা তখনই টের পাবেন।”

— “তুমি বলছো না তোমার ব্রা দেখে আমার কাম জেগেছে? দেশে বিদেশে ঘুরে আসা মানুষ আমি। বিকিনি পরা মেয়ে বিচে, বারে কম দেখিনি। কোনোদিন একবারের বেশি দু’বার তাকাতে পর্যন্ত ইচ্ছে হয়নি। কত সুন্দরী মেয়েরা সেধে কোলে এসে বসতে চেয়েছে, কাউকে আমি গ্রহণ করিনি। আর আমার ওয়াইফ কিনা আমাকে এসব বলছে? ঠিক আছে, চাইছো তো দূরে গিয়ে যেন মাপি! তোমার কথাই রাখবো আমি যাবো, কিন্তু নিজেকে মাপতে না, তোমাকে মাপতে। দেখি আমার এবসেন্স তোমাকে কিছু রিয়েলাইজ করায় কি না? আমাকে ছাড়া থাকতে পারো কি না দেখো।”

রুদ্র – ৩৫

৩৫

প্রচন্ড অভিমানে আজ সকালে ঘর ছেড়েছে রুদ্র। সুরভী ছাড়া কেউ জানে না তার ঘর ছাড়ার কারণ। প্রত্যেকে জানে রুদ্র সিলেট গিয়েছে কী এক কাজে। সুরভীও আটকায়নি তাকে। জেদ ধরে বসে ছিল সে-ও। তখন একদম গায়ে লাগেনি, কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে যেন গায়ে হুল ফুটছে। কয়েকবার ফোন চেক করা হয়ে গেছে রুদ্রের কল কিংবা টেক্সটের আশায়। এই কয়দিনে কাজের ফাঁকে ফাঁকে রুদ্রের টেক্সট, কলের অভ্যেস হয়ে গেছে খুব। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে নামলো বলে অথচ কল, টেক্সট কিছুই এল না। কী এক হাহাকারে ভারী হয়ে আছে মন। তার উপর শীতের এই শুষ্ক হাওয়া, আরো খানিকটা মন খারাপ বোধ হয় সে-ও বয়ে বেড়ায় দুপুরের পর থেকে। অজানা এক বিষন্নতা আশপাশ জুড়ে! রুদ্রকে ভাবতে ভাবতেই ছাদের এপাশ-ওপাশ হাঁটছিল সুরভী। সময় যাচ্ছে, আর মানুষটাকে নির্দোষ মনে হচ্ছে। আবার হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে গতরাতে করা ধারণাটাই ঠিক! জীবনের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা যার দখলে তাকে নিয়ে মনের এত দোটানা বয়ে বেড়ানো বড্ড কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে চোখ ভিজে আসছে শুধু!

— “ভাবী?” কাজের লোকের ডাকে ঘাড় ফেরালো সুরভী।

— “হুম?”

— “ম্যাডাম নিচে ডাকছে আপনাকে।”

শাশুড়ীর ডাকে সবসময় দৌড়ে হাজির হলেও, আজ যেন গায়ে সেই জোরটাও মিলছে না। হাত-পা সব বুঝি ভেঙেচুরে আসছে। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেই চলছে তার দুনিয়াদারি।

অনেকটা সময় নিয়ে ধীর পায়ে নিচে নেমে এল সুরভী। ফেরদৌসী ডাইনিং টেবিলে বসে। ওকে দেখামাত্রই টেবিল ভর্তি নাস্তা ইশারা করে বললেন,

— “সকালে নাস্তা করোনি, দুপুরেও ঠিকমতো খাওনি। খাওয়ার রুচিটা বোধহয় নষ্ট হয়েছে। সব এখন বাইরে থেকে আনিয়েছি। ফুচকা, দইবড়া, পাপড়ি চাট, চিকেন তন্দুরিসহ আরো পাঁচটা আইটেম আছে এখানে, সব আলীর দোকানের। ওকে কল করে বলেছি যা আছে সবগুলো মেন্যু থেকে আমার সুরভীর জন্য পাঠাও। যা ভালো লাগে খাও আমার সামনে বসে।”

ম্লান হাসলো সুরভী।

— “আপনি এনেছেন আমি খুব খুশি হয়েছি মা। কিন্তু কিছুই খেতে ইচ্ছে করছে না, সত্যি!”

সুরভীর চোখে-মুখে লক্ষ্য করলেন ফেরদৌসী। অরুচির কারণ শারীরিক অসুস্থতা কিংবা সাময়িক কোনো ব্যাপার নয়। সমস্যা সুরভীর মনে। বাম হাতে সুরভীকে টেনে পাশে বসালেন ফেরদৌসী। নাজনীনকে ইশারা করলেন দইবড়া বাটিতে তুলে দিতে। আজ সারাদিনে চুলে চিরুনিও লাগায়নি সুরভী। কী এলোমেলো লাগছে ওকে! তার চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিতে দিতে ফেরদৌসী বললেন, – “এই ঘরে কিন্তু তুমি একা না। আমি তো আছি, কখনো মন খারাপ হলে চলে আসো না কেন আমার কাছে? সমাধান না করতে পারি, অন্তত শুনতে তো পারবো।”

মাথা নিচু করে রইলো সুরভী। ফেরদৌসীর প্রত্যুত্তরে বললো না কিছু।

কাঁপা হাতে সুরভীর মুখের সামনে চামচ ধরলেন তিনি।

— “নিজেই এই হাতে খেতে পারি না অথচ তোমাকে খাইয়ে দিতে চাইছি। ফিরিয়ে দেবে?”

শাশুড়ীকে ফেরানোর সাধ্য হলো না সুরভীর। খাবার মুখে তুললো সে।

— “আমার ছেলে বাসায় থাকলে তোমাকে খাইয়ে দিতো। নেই যেহেতু তাই আমাকেই খাওয়াতে হবে। এভাবে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলে হবে নাকি? রুদ্র এসে যদি দেখে তুমি শুকিয়ে গেছ, আমাকে ও বলবে তোমার খেয়াল রাখিনি আমি। শুনতে ভালো লাগবে আমার?”

সুরভীর দু’গাল বেয়ে পানি ঝরছে। মন খারাপের কারণ তবে রুদ্র!

সুরভীর হাত চেপে ধরলেন তিনি। বললেন,

— “আমাকে ঘরে নিয়ে চলো তো! আর নাজনীন, দই বড়াটা আমার ঘরে নিয়ে এসো।”

মুখোমুখি অনেকটা সময় সুরভীকে নিয়ে বসে রইলেন ফেরদৌসী। কেউ কিছু বললেন না। একটু একটু করে বাটির খাবারটুকু সুরভী শেষ করা পর্যন্ত ওর দিকে চেয়ে রইলেন। খাওয়া শেষে ওরদিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,

— “রুদ্র চলে গেছে বলে এত খারাপ লাগছে? মনে পড়ছে খুব?”

ফেরদৌসীর জিজ্ঞেস মিথ্যে নয়। মনে তো পড়ছে সত্যিই! ভীষণ মনে পড়ছে। তবুও স্বীকার করতে ইচ্ছে হলো না।

মাথা দুলিয়ে অস্বীকৃতি জানালো ও।

— “তবে কি ঝগড়া হয়েছে দু’জনের মাঝে?”

ফেরদৌসীর দিকে একবার চোখ তুলে তাকালো সুরভী। কিছু বলতে চেয়েও পারছে না। হয়তো সম্পর্কের দিক থেকে দ্বিধায় পড়ে আছে সে!

সুরভীকে দ্বিধামুক্ত করতে চাইলেন ফেরদৌসী।

— “দেখো আমি টিপিক্যাল শাশুড়ী না, তা এ কয়দিনে বুঝেছো নিশ্চয়ই? আমার ছেলের মন্দটা তুমি আমাকে চাইলে বলতে পারো। তোমাদের দু’জনের মাঝের দ্বন্দ্বটাও আমি শুনবো উইদাউট এ্যনি জাজমেন্ট। তুমি তোমার মাকে যা কিছু বলতে পারো, আমাকে ঠিক তা বলতে পারো। শোনার সময় আমি ভুলে যাবো আমাদের সম্পর্ক কী! আমি তোমার শাশুড়ী না কিংবা তুমি আমার ছেলের বউ না। পুরোটা সময় আমি শুধুই ফেরদৌসী আর তুমি সুরভী হয়েই থাকবে আমার কাছে। তবুও যদি মনে হয় আমাকে বলতে তুমি কমফোর্টেবল না, তাহলে বলো না। কোনো আপত্তি নেই তাতে। তোমার মা আছেন, বান্ধবীরা আছেন; যাকে ভালো লাগে তাকেই বলো।”

— “আমি খুব দ্বিধায় আছি উনাকে নিয়ে।”

প্রায় আট মাস পর সিলেটের বাংলোতে এসে পা রাখলো রুদ্র। ইচ্ছে ছিল এখানে পরবর্তী যাত্রা সুরভীকে সঙ্গে নিয়ে হবে। হলো না। ভীষণ মনে পড়ছে ওকে। সুরভী এই জীবনে পা রাখার আগে ওকে ছাড়াই চলছিল সবকিছু। নিজস্ব সব অশান্তি, অস্থিরতা মন্দ লাগা নিয়েই চলছিল জীবন। এখন মনে হচ্ছে সুরভী সঙ্গে না থাকার যন্ত্রণা সমস্ত যন্ত্রণাকে হার মানাচ্ছে। কোনো কাজে মন বসছে না। সবকিছুতেই ভীষণ অনীহা আর বিতৃষ্ণা! বিয়ের পর থেকে প্রতিঘন্টায় অন্তত একটা টেক্সট করে হলেও সুরভীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। সুরভী আছে, কথা হচ্ছে এটাই যেন তার সমস্ত শক্তির আঁধার, সমস্ত অস্থিরতার টনিক হয়ে ছিল এ ক’টাদিন। আজ গোটাদিনে সুরভী নেই, শক্তিও নেই, শান্তিও হারিয়ে গেছে। কয়েকবার ফোন হাতে নিয়েও রেখে দিলো রুদ্র। কোনো প্রকার যোগাযোগ সে করবে না। সে নিজেও দেখতে চায় সুরভীকে নিয়ে শূণ্য শূণ্য অনুভূতি কোথায় গিয়ে ঠেকে? ঠিক কতখানি পর্যন্ত সহ্য করার ক্ষমতা তার আছে?

বিনা প্রশ্নে এতটা সময় ধরে সুরভীর সমস্ত কথা শুনলেন ফেরদৌসী সব শেষে মুচকি হেসে জানতে চাইলেন,

— “সব বলা শেষ?”

— “হ্যাঁ।”

— “কেঁদেকেটে কী হাল করেছো! এখন আর কান্না দেখতে চাই না, প্লিজ! আমার কথা শোনো, এর মাঝেই তুমি তোমার জবাব পাবে।”

চোখ মুছে মুখ তুলে তাকালো সুরভী জবাবের আশায়।

— “তুমি যেই রুদ্রকে দেখো, গোটা পৃথিবী কিন্তু তা দেখে না। আমার ছেলেটা অমানুষ হয়ে গেছে আরো বহু আগেই। অথচ কী মিষ্টি স্বভাবের ছিল একটা সময়! সেই রুদ্র আর এই রুদ্রকে চেনার উপায়ই নেই। ওর বাবা ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। আমার শ্বশুর, তার বাবা উনারা সবাই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। তারই জের ধরে আশরাফেরও রাজনীতিতে আসা। ব্যবসা আর রাজনীতি ওদের রক্তে আছে। অথচ রুদ্রটা হলো ভিন্ন। ওর বাবার এত প্রাচুর্য, ক্ষমতার লোভ কিছুই ওকে কখনো স্পর্শ করতো না। ও বরাবরই বাসার বাইরে থাকতে চাইতো। ওকে ধরে বেঁধে স্কুল পর্যন্ত আমরা বাসায় রাখতে পেরেছি। কলেজ জীবন থেকে ও বাসার বাইরে থাকতে শুরু করলো। শুধু বাসার বাইরে কী বলছি! ও এই শহরই ছেড়ে দিলো। সাদামাটা জীবন ওর বড্ড পছন্দ! সাধারণ মানুষ, প্রকৃতি, পশু-পাখি এসবের মাঝে থাকতেই ও পছন্দ করতো। এমনকি ও কার ছেলে সেই কথাটা পর্যন্ত ও বলতে চাইতো না। প্রচন্ড কাইন্ড, সফট হার্টেড ছেলে ছিল ও। ইচ্ছে ছিল মিউজিশিয়ান হবে। খুব ভালো গান, সুর করতো ও। আমি আর আশরাফও কখনো আপত্তি করিনি তাতে। রুদ্রের জীবন, সেটা ওর পছন্দ মোতাবেকই হবে। ও খুব সুখী একজন মানুষ ছিল জানো? খুব হাসিখুশি, সবখানে আনন্দ বিলিয়ে বেড়ানো একজন মানুষ। বনে বাঁদাড়ে ঘুরে বেড়ানো ছিল ওর নেশা।”

— “উনি গান করতো?”

— “হ্যাঁ।”

— “আজ পর্যন্ত একটু গুনগুনও করতে শুনিনি!

— “ওর সমস্ত গান মুছে গেছে!”

— “কী হয়েছে?”

— “একটাই ছেলে ও আমাদের। ভালোবাসার কোনো কমতি কোনদিন আমরা রাখিনি। আশরাফ খুব ব্যস্ত মানুষ ছিল। কিন্তু ছেলের জন্য তার সময়ের কখনো অভাব হয়নি। একেবারে বুকে আগলে মানুষ করা বলতে আমরা যা বুঝি, আশরাফ ঠিক ওভাবেই রুদ্রকে বড় করেছে। আশরাফ ছিল রুদ্রের পৃথিবী। সারাদিন পর বাবার সঙ্গে ঘন্টা ধরে কথা না বললে ও ভীষণ অস্থির হয়ে যেত। ও বাসা ছেড়েছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের ছাড়েনি। দিনে কতবার যে কল করতো আমাকে! ওর বাবাকেও। ছেলেমেয়েরা সাধারণত বড় হয়ে গেলে মা-বাবার প্রতি আকর্ষণ কমে আসে। নিজের আলাদা জগত তৈরী করে সেখানেই নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পছন্দ করে। অথচ রুদ্র ছিল আলাদা। ওর সমস্ত অপরাধের কথা ওর বাবা জানে। কবে কোন মেয়েকে ভালো লেগেছে, কবে কোথায় কার সঙ্গে ড্রিংক করেছে, উইড স্মোক করেছে সে কথাও ওর বাবার জানা। এই সখ্যতা অবশ্য পুরোটা আশরাফের তৈরী করা। ওর বরাবরই একটা কথা ছিল, আমার ছেলের ভালো দিক, মন্দ দিক বাইরের লোক জানার আগে আমি জানবো। আশরাফ ছিল রুদ্রের অক্সিজেন। সারাদিন যেখানেই ঘুরুক ফিরুক, দিনশেষে বাবাকে তার চাই –ই চাই। রুদ্রের জীবনে সবকিছু পার্ফেক্টলি চলছিল। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বাবার কাছে বিজনেসটা একটু একটু করে বুঝে নিচ্ছিলো। একটাই উত্তরাধিকারী আমাদের। ওর অমত থাকলেও, ও নিজেও বুঝতো ও ছাড়া আর তো কেউ নাই বাবার এসব ধরে রাখার। মিউজিকের পাশাপাশি বিজনেসটাও ধরতে চাইলো। কিন্তু পলিটিক্সে একদম না! রুদ্রের সবচেয়ে অপছন্দের জায়গা হলো রাজনীতি।”

— “কিন্তু এখন সেই রাজনীতিই তো করছে।”

— “আশরাফ মারা যাবার পর। ওর সাধারণ মৃত্যু হয়নি। খুন করা হয়েছিল ওকে।”

— “হ্যাঁ টেলিভিশনে দেখেছিলাম। তবে এতটাও খেয়াল করে দেখা হয়নি। বিস্তারিত জানি না কিছু।”

— “আশরাফকে খুন করেছে আমারই দেবর। আশরাফের ভীষণ আদরের আজহার। জানো তো সুরভী, আমাদের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষটাই করে। কারণ তারা কাছে আসার সুযোগ পায়। তোমার শ্বশুরের বেলায়ও ঠিক তাই হয়েছে। ওর শত্রুর অভাব ছিল না। কিন্তু কেউ কোনোদিন একটা আঁচড় দিতে পারেনি। অথচ সেই লোকটাকে কিনা মেরে ফেললো তারই ভাই।”

— “কেন?”

— “ক্ষমতার লোভ। রাজনীতির সঙ্গে আজহারও জড়িত ছিল। কিন্তু আশরাফের সম্মানটা ছিল বরাবরই আলাদা। তাই বলে আজহারকে কেউ ছোট করেছে তা কিন্তু না! ওর প্রাপ্য সম্মান ওকে দেয়া হতো সবসময়, তবুও ওর ক্ষোভ ছিল সবসময়। অপজিশন পার্টি তারই সুযোগ নিলো। আজহারকে উস্কে আশরাফকে খুন করালো। আমি সামনে ছিলাম, আমাদের বেডরুম ছিল এই করিডোরের শেষ ঘরটা। ওখানে আমার সামনেই আশরাফকে গুলি করলো ও। তোমার শ্বশুর স্পট ডেড। বিয়ের পর থেকে এই মানুষটাকে আমি ভীষণ যত্নে আগলে রেখেছিলাম। আমি থাকতে আশরাফের জ্বর আসবে, সর্দি হবে সেটাই মেনে নিতে পারতাম না। মনে হতো আমার দায়িত্বে কোনো অবহেলা রয়ে গেল না তো! আমার এত ভালোবাসার মানুষ, যার সঙ্গে আমি ৩০ বছর কাটিয়েছি সেই মানুষটা আমারই চোখের সামনে এভাবে মরে গেল! মানতে পারিনি আমি। সেদিনই স্ট্রোক করেছিলাম আমিও। ফেরার কথা ছিল না আমার, তবুও ফিরেছি। পুরো ২৯দিন আই সি ইউ তে লাইফ সাপোর্টে থাকার পর উপরওয়ালা আমাকে এই পৃথিবীতেই ফেরত পাঠিয়েছেন। আশরাফ চলে যাবার সেই রাতের পর রুদ্র আর রুদ্র নেই। একদিকে বাবার রক্তমাখা লাশ, মা ওদিকে যাই যাই করছে এসব যথেষ্ট ছিল ওকে অমানুষ বানানোর জন্য। হসপিটাল থেকে ফিরে এসে আমি আমার ছেলেকে আর খুঁজে পাইনি। আশরাফের সঙ্গে রুদ্রও মরে গেছে। তারপর কী ভেবে যে ও রাজনীতিতে এল, জানি না আমি ঠিক! তবে কারণ যাই হোক, পুরোটা ও করছে জেদের বশেই। রুদ্র এখন যে জীবন কাটাচ্ছে, এই জীবন ও কখনো চায়নি। অনেকগুলো অনাকাঙ্ক্ষিত দায়িত্ব ভরা জীবন ও টেনে যাচ্ছে আজ ছয় বছর। এতগুলো বছরে আমি ওকে ঠিকঠাক হাসতে দেখিনি, রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে দেখিনি। সেই সরল রুদ্রটাকে আমি দেখিনি। যার জীবনে আনন্দের কোনো কমতি ছিল না, মন খারাপ যাকে কখনো ছুঁতে পারেনি, তার জীবন থেকে হাসি আনন্দ মুছে গেছে, তা আমি মা হিসেবে কত কষ্টে মেনে নিয়েছি জানো? আমি ওর জন্য কিছু করতে পারিনি। আশরাফকে হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতেই আমার লেগে গেল বছরখানেক। প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলাম দেড় বছর। এই দেশ, সেই দেশ ঘুরে, চিকিৎসা করিয়ে হাঁটাচলার উপযুক্ত হতে লেগে গেল আরো একবছর। রুদ্রকে আমার আর সামলানো হলো না, ও হারিয়ে গেল ওর মতোন করে। রুদ্রের সব আছে, ছিল না শুধু শান্তি। দিনশেষে কারো কাছে নিজের সমস্ত গল্প করার মতো একটা মানুষ ছিল না, যার কাছে ভেঙেচুরে ও নিজেকে সঁপে দিতে পারবে নিজের মতো করে। সবার সবকিছু সামলে নেয় যে, দিনশেষে সেও একজন চায় যে তাকে সামলে নেবে, আগলে রাখবে। রুদ্রও খুব করে চাইতো। আমি বুঝতাম এই জীবনটা টেনে নেয়া সত্যিই অসহ্য ঠেকছে ওর কাছে। ভাগ্যক্রমে সেই চাওয়া গিয়ে ঠেকলো তোমার কাছে। কী করে হলো, কেমন করে হলো এত কথা জানতাম না আমি। ও বলেনি আমাকে। আজ তোমার কাছে জানলাম। আমি তোমাকে মোটেও জাজ করছি না কিংবা রুদ্র আমার ছেলে বলে ওর পক্ষও টানবো না। যা সত্যি তাই বলবো। ও সত্যিই তোমাকে চায় সুরভী। এই নিয়ে সন্দেহ করো না। তবে তুমি যেমনটা ভাবছো সেভাবে না, গোটা তুমিটাকেই ও চায়। জানো, যেদিন আমাকে ও বললো তোমার কথা সেদিন ওর চোখে, কন্ঠে, চাওয়ার মাঝে ভীষণ কাতরতা খুঁজে পেয়েছিলাম। বলছিল, ওকে আমার লাগবেই আম্মু। ওকে ছাড়া চলবে না। মনে হলো যেন রুদ্র তার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে, যে আশ্রয় হন্যে হয়ে খুঁজছিল ও। ওর চাহনীতে, চাওয়ার মাঝে সত্যি বলতে কোনো খারাপ ইন্টেশন আমি দেখিনি। তার চেয়েও বড় কথা, রুদ্রের ইচ্ছে যদি শুধু তোমার শরীরেই আটকে থাকতো তাহলে বিয়ে করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। যখন তখন তোমাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে ওর যা খুশি করতেই পারতো। সেই ক্ষমতা ওর আছে। কিন্তু ও তোমাকে বিয়ে করেছে। এখনো কোনো প্রকার জোর তোমাকে করেনি। তবুও কেন এসব সন্দেহ করছো তুমি?”

অপরাধবোধে ভুগছে সুরভী। রুদ্রও সকালে বলে গেল একই কথা। তবুও শুনতে ইচ্ছে হলো না, বুঝতে ইচ্ছে হলো না। কেন? রুদ্র ওভাবে ধরে নিয়ে বিয়ে করেছে তাই?

— “একজন পুরুষের বিবাহিতা স্ত্রী তুমি। তাছাড়া নারীর প্রতি পুরুষের আকর্ষণ থাকাই স্বাভাবিক। হয়তো তোমার প্রতি রুদ্রের আগ্রহের কারণটা অসম্ভব রকমে অদ্ভুত। কিন্তু হয়ে গেছে সেটা, কিছু করার তো নেই! রুদ্র কিন্তু অন্যায় কিছু করেনি তোমার সঙ্গে। হ্যাঁ বিয়েটা হয়তো জোর করে করা উচিত হয়নি। কিন্তু ও তোমাকে ভালো রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু করবে। ও তোমাকে কাছে পেতে চায় এটা ভুল না। লজিক্যালি ভেবে দেখো একবার, ওর চাওয়ায় অন্যায় কিছু তো নেই। তুমি নিজেও কি ওর কাছাকাছি যেতে পছন্দ করো না? হয়তো মুখে বলো না, কিন্তু ওর সান্নিধ্য তোমারও প্রিয়। একটুও কি দুর্বলতা তুমি খুঁজে পাও না ওর মাঝে?”

— “পাই।”

— “তাহলে কেন উল্টাপাল্টা ভেবে নিজে কষ্ট পাচ্ছো, ওকেও দিচ্ছো? ও তোমার কাছে আশ্রয় চায় সুরভী। ও চায় যখন ওর মন খারাপ হবে, রাগ হবে, অস্থির হবে তখন তুমি ওকে সামলে নাও, আগলে রাখো। ও তোমার উপর নির্ভর হতে চায়। তোমার ভালোবাসা চায়। অনেক আশা নিয়ে ও তোমাকে আপন করেছে সুরভী। ওর বাবার পর এখন তুমিই আছো যাকে ও ভরসা করে নিজেকে ভেঙেচুরে সঁপে দিতে চায়। ওকে তোমার কাছে আশ্রয় দিও, সামলে নিও প্লিজ!” ফেরদৌসীর চোখে চোখ তুলে তাকালো সুরভী।

মুচকি হেসে বললো,

— “নিবো।”

— “কী করবে এখন? কল করবে ওকে?”

— “হ্যাঁ।”

— “না। দূরে থাকো একটু। দুই চারদিনের একটা গ্যাপ ভীষণ প্রয়োজন আপাতত। ছোটখাটো দূরত্ব মাঝেমধ্যে আমাদের সম্পর্ক আর মানুষটার গুরুত্ব বোঝায়। ভালোবাসা, টান আরো গাঢ় হয়। গুরুত্ব বুঝে গেলে ভুলভাল ভাবনা মাথায় আসে না।”

— “কিন্তু আমার যে খারাপ লাগছে!”

— “লাগতে দাও। যখন মনে হবে আর পারছো না তখন কল দিও।”

— “উনি আমার সঙ্গে কথা বলবে তো?”

— “বোকা মেয়ে! কেন বলবে না? ও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে নাকি! সময় হলে নিজেই ছুটে আসবে তোমার কাছে। দূরত্বের পর কাছে আসাটা কিন্তু ভীষণ সুন্দর হয়। তোমাদেরও হবে। সম্পর্ক নতুন মোড় পাবে। দেখে নিও তুমি।”

৩৬

‘সাবেক সড়ক মন্ত্রী মতিউর রহমান হত্যা মামলায় মডেল সিনথিয়াকে তার মানসিক অবস্থা বিবেচনায় বেকসুর খালাস করেছে উচ্চ আদালত।’

টিভি চলছে। প্রতিটি চ্যানেলে লাইভ টেলিকাস্ট চলছে আদালত প্রাঙ্গন থেকে। মতিউর হত্যার সমস্ত আলাপ-আলোচনা আজ থেকে এখানেই থেমে যাবে। প্রচন্ড ক্ষোভে টিভি অফ করলো হাবিব। হসপিটালে আজগরের পাশে বসে আছে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো আজগর।

— “মতির সঙ্গে যখন আমার আলাপ হয় তখন বয়স একেবারে কম। আরো ৩২ বছর আগের গল্প। কতকিছু করলাম একসঙ্গে। আরো কত কী করার ছিল একসঙ্গে। সব শেষ!”

— “আস্ত একটা মানুষ গিলে খেয়ে নিলো শালা! এক মাসের মধ্যে কেইস ডিসমিস।”

— “রুদ্রকে ভাঙার সময় হয়েছে।”

— “তাকেই ভাঙা যায় যার দুর্বলতা আছে। ও তো মানুষই না, দুর্বলতা আসবে কোথা থেকে?”

— “অমানুষ যে মজনু হয়ে গেছে সে খবর রাখো?”

— “মানে?”

— “এক মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে, জোর করে সেই মেয়েকে বিয়ে করেছে। মাথায় করে রাখে বউকে। বউ ছাড়া ও অন্ধ!”

— “বিয়ে করেছে! কিছুই তো শুনলাম না। আপনি জানেন কেমন করে? “খোঁজ রাখতে হয় হাবিব। শত্রু সেকেন্ডে কয়টা নিঃশ্বাস নিলো সেই খোঁজ রাখতে হয়। নয়তো শত্রু গিলে খায়।”

হেরে যাবার তীব্র হতাশা ক্রমশ গিলে খাচ্ছিল হাবিবকে। আজগরের কথায় একটুখানি আশার আলো মিললো বোধহয়! নড়েচড়ে বসলো সে।

— “নেক্সট টার্গেট ওর বউ?”

— “দেখা যাক!”

সকালের নাস্তা আজ সময়মতো করা হয়নি। শুধু আজ কেন? ঢাকা ছাড়ার পর থেকেই খাবারে অনীহা! গতকাল থেকে একেবারেই আর গলা দিয়ে কিছু নামছে না। দেড়টার দিকে শুভ এক প্রকার জোর করেই ধরে এনে খাবার টেবিলে বসিয়েছে। সামনে প্রিয় সব খাবার। অথচ কিছু মুখে তুলতে ইচ্ছে হলো না তার। খাবার ফেলে আবারও উঠে গেল সে। এভাবে তাকে দেখতে আর ভালো লাগছে না শুভর। চাইলেই যে সমস্যার সমাধান হয়ে যায়, কেন অযথা জেদ করে তা ঝুলিয়ে রাখছে ভেবে পেলো না সে। কষ্টে নীল হয়ে যাচ্ছে মানুষটা, তবুও জেদ ছাড়ছে না। ওদিকে বউটাও হয়েছে একই। ঝগড়ার কারণ তার জানা নেই। তবুও যাই হোক, একটা কল তো অন্তত করতে পারতো! ওপাশের একটা কলেই সব সমাধান হয়ে যেত তৎক্ষণাৎ।

উপায়ন্তর না পেয়ে রুদ্রকে বাড়ি ফেরার কথা নিজেই বললো সে,

কী এক জেদ নিয়ে পড়েছেন! এভাবে খাওয়া-ঘুম সব ছেড়ে দিয়ে কতদিন আর সুস্থ থাকবেন? ভালো লাগছে না এভাবে। ঢাকায় চলুন।”

সুরভীকে ছাড়া আজ এই চতুর্থদিনে নিঃশ্বাস আটকে আসছে রুদ্রের। সিনথিয়ার জামিন হয়ে গেছে এই নিয়ে বিন্দুমাত্র আনন্দও অনুভব হচ্ছে না তার। ধূসর লাগছে সবকিছু। সামনে মেয়র ইলেকশন। অনেক প্ল্যানিং, কাজ মাথার উপর। কিচ্ছু হচ্ছে না তাকে দিয়ে। খাওয়া, ঘুম সব এলোমেলো হয়ে আছে ওকে ছাড়া। এভাবে আর এক মুহূর্তও না! সুরভীকে সে ভালোবাসে এর চেয়ে সত্যি এই জীবনে আপাতত আর কিচ্ছু নেই। সুরভীকে এই বুকে তার চাই, এক্ষুনি চাই। এই চাওয়ার চেয়ে বড় আর কোনো চাওয়া এই মুহূর্তে তার নেই।

শুভকে ডাকলো সে,

— “টিকিট বুক করো। বাসায় ফিরবো আমি।”

৩৭

দুপুরের ফ্লাইটে ঢাকা ফিরলো রুদ্র। বাড়ির সদর দরজা খুলতেই সে দেখলো সুরভী ড্রইংরুমে। কাজের লোকেরা লাইন ধরে সব দাঁড়িয়ে আছে। সুরভী কী যেন বলছে ওদের। এটা বসার ঘর, কাজের লোকেরা এখানে, বসার ঘরের চার কোণায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো, সিকিউরিটিরা ক্যামেরায় বসে এই ঘরের সমস্ত কিছু দেখছে সেসব কিছু ভাবতে ইচ্ছে করলো না রুদ্রের। একটা চুমুর তৃষ্ণায় প্ৰতি মুহূর্তে খুন হচ্ছে সে। ঝড়ের গতিতে ঘরে ঢুকে, কাজের লোকদের ঠেলে সুরভীর কোমর দু’হাতে চেপে ধরলো সে। হঠাৎ রুদ্রের চলে আসা, এভাবে আঁকড়ে ধরায় খানিকটা আঁতকে উঠলো সুরভী। ওর চোখে চোখ রেখে কাতর হয়ে রুদ্র বললো,

— “ভালোবাসি কি না জানতে চেয়েছিলে না?”

— “… … … … … …”

— “আমাকে পুঁড়িয়ে মারছো তুমি। সাতটা দিনও পার করতে পারিনি আমি। কী অসহ্য যন্ত্রণা! উফ্! জ্বরের মতো মাথায় চড়ে বসেছো আমার। রুদ্র ভালোবেসে পুঁড়ে মরছে!”

ঝড় আসার পূর্বাভাস শুভ টের পেল। রুদ্র সজ্ঞানে নেই। লোকলজ্জার বালাই নিয়ে ভাবার মতো বোধটুকুও নেই তার। মানুষটা রীতিমতো মরছে তার ব্যক্তিগত নারীর জন্য। কাছে টেনে নেয়ার এই পর্ব আরো গভীরে যাবার আগেই উপস্থিত সব কর্মচারীদের তুড়ি বাজিয়ে সরে যেতে ইশারা করলো শুভ। সদর দরজা আটকে নিজেও দাঁড়িয়ে রইলো বাড়ির বাইরে রুদ্রকে এভাবে এত কাছে পেয়ে খানিকের জন্য ঘোর লেগেছিল সুরভীর। ঘোর কাটতেই দু’হাতে জড়িয়ে ধরতে চাইলো সে রুদ্রকে। তার আগেই সুরভীর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে গোটা সুরভীকেই যেন শুষে নিতে চাইলো সে। যেন বহু জনমের তৃষ্ণা মেটানোর সুযোগ নাগালে এল! পুরোদমে সায় এল সুরভীর কাছ থেকেও। উল্টো পায়ে শোবার ঘরের দিকে যাচ্ছে সুরভী। রুদ্র এখনো ছাড়েনি ওকে। দু’হাতে কোমর, ঠোঁটে ঠোঁট বন্দী করে রেখেছে এখনো। ওভাবেই এক পা, দু’পা করে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তাকে নিজ ঘরে।

নিজেকে আজ বিলীন করে দেবার তীব্র নেশা দু’জনকেই পেয়ে বসেছে। ঘরে এসেই বিছানায় সুরভীর গায়ে নিজের গা এলিয়ে দিলো রুদ্র। দরজা খোলা, পর্দা বন্ধ করা হয়নি সেদিকে খেয়াল নেই কারো। বুকের উপর থেকে ওড়না সরিয়ে সুরভীর গলায়, কাঁধে অবিশ্রান্ত চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে রুদ্র। সুরভীর তরফ থেকে কোনো বাঁধা নেই, আপত্তি নেই। সাদরে গ্রহণ করছে সে সবটা। রুদ্রকে কাছে পাবার, প্রাণ ভরে ওর গায়ের ঘ্রাণ নেয়ার আকাঙ্ক্ষা যে গিলে খাচ্ছিলো তাকেও!

হঠাৎ থেমে গেল রুদ্র। সুরভীর গলায় মুখ গুঁজে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলো সে। এভাবে থেমে যাবার কারণ খুঁজে পেলো না সুরভী। দরজা, জানালা খোলা তাই? নাকি অন্যকিছু? এক মুহূর্ত বাদে রুদ্র ফিসফিসিয়ে বললো,

— “স্যরি!”

— “কেন?”

— “অনেকদিন পর কাছে পেয়েছি তোমাকে। মাথা ঠিক ছিল না। কী থেকে কী করে ফেলছি, নিজেও বুঝিনি!”

সুরভীকে ছেড়ে উঠে গেল রুদ্র। বিরক্তি ধরে এল সুরভীর। ভালোমানুষির একটা সীমা থাকা উচিত! বোকামিরও! এই লোক কি একদম অবুঝ? সম্মতি আছে কি নেই একদম বোঝে না? মুখ ফুটে বলতে হবে এখন?

৩৮

বাসায় ফেরার পর থেকে রুদ্র আজ সুরভীর পিছুই ছাড়ছে না। সমস্ত কাজ ফেলে, ফোনের সুইচ অফ করে পড়ে আছে সুরভীর পেছনে। বেশ লাগছে সুরভীর। কানের কাছে রুদ্রের অকারণ ফিসফিসিয়ে কথা বলা, খোলা চুল আঙুলে পেঁচিয়ে ওকে কাছে টেনে নেয়া, ঠোঁটে গলায় খানিক পর পর ছুঁয়ে দেয়া সবকিছুই যেন কেটে যাচ্ছে সুখ-ঘোরের মাঝে। মা ঠিক বলছিলেন, রাগের পর ফিরে আসার মুহূর্তটা অসাধারন হয়!

সুরভীর কানে নাক ঘষলো রুদ্র। সুরসুরিয়ে উঠলো কানের চারপাশ। ঘাড় হেলিয়ে কাঁধে কান আড়াল করতে চাইলো ও। পারলো না। রুদ্র কোনোভাবেই মুখ সরালো না। নিচু স্বরে বললো,

— “চলো গায়ে একটুখানি কুয়াশা মেখে আসি।”

— “কোথা থেকে?”

— “ছাদে।”

ছাদের এককোণায়, খুঁটি বেয়ে উপরে লতাপাতা ছড়িয়েছে নীল অপরাজিতার গাছটা। সুরভীর চোখে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকছে রুদ্র। ওর চোখের দিকে নজর নেই সুরভীর। সমস্ত মনোযোগ রুদ্রের সিগারেটের ধোঁয়ায়। কুন্ডলি পাকিয়ে কেমন মেঘের মতন করে উপরের দিকে ভাসছে, তারপর বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে একবার ধরতে চাইলো ও। হাসলো রুদ্র।

— “ধোঁয়া কখনো নাগালে আসে?”

— “উঁহু। তবুও ধরতে ইচ্ছে হলো একটু! ভালো লাগছে দেখতে।”

— “তুমিও নাগালে আসো না। তবুও পেতে ইচ্ছে হয়, ভালোবাসি তাই।”

রুদ্রের চোখে তাকালো সুরভী। কী গভীর চাহনিতে চেয়ে আছে মানুষটা! চোখের সমস্তটা মাদকতায় আচ্ছন্ন। কাছে পাবার তীব্র নেশা রুদ্র চাহনীতেই স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে।

— “আমাকে তোমার মনে পড়েনি সুরভী?”

— “ভীষণ!”

— “একটা কল কেন করলে না?”

— “দেখতে চাইছিলাম আপনাকে ছাড়া কতখানি যন্ত্রণা হয় আমার। বুঝতে চাইছিলাম যন্ত্রণার কারণ কী?”

— “খুঁজে পেলে?”

— “পেলাম।”

— “কী?”

— “সব বলে দেবো না। থাকুক আরো কিছুক্ষণ গোপন।”

— “আর কত?”

— “দেখা যাক!”

সুরভীর রহস্যে হাসলো রুদ্র। উত্তর তার জানা। তবুও সে চায় সুরভী তার চোখে চোখ রেখে নিজে সে কথা জানাক।

সুরভী যেখানে দাঁড়িয়ে তার ঠিক পেছনেই অপরাজিতার গাছ। খুব কাছাকাছি ঝুঁকে, ওর পেছন থেকে একটা ফুল ছিঁড়ে নিলো রুদ্র। আঙুলের ভাঁজে অপরাজিতা রেখে, তার রন্ধ্রে জ্বলন্ত সিগারেট ঢুকিয়ে বললো,

— “সুরভী?”

— “হুম?”

— “তোমার অপরাজিতায় আমার অধিকারটুকু দেবে আমাকে?”

গোটা শরীরে সুখময় শিহরণ দোলা দিয়ে উঠলো সুরভীর। লজ্জা, সংকোচ কিছুই আর বাঁধা হলো না ওর সামনে।

দু’পা সামনে এগিয়ে, রুদ্রের কলার চেপে সুরভী বললো,

— “মুখে সবকিছু বলে দেয়া জরুরি? বোঝেন না কিছু?”

— “বুঝি। তবুও তোমার মুখ থেকে জানতে চাই!”

— “দিলাম অধিকার।”

— “আজ?”

— “এখনই।”

এক মুহূর্ত দেরী করলো না রুদ্র। হাতের সিগারেট নিচে ফেলে, পায়ে পিষে আগুন নিভিয়ে সুরভীর হাত ধরে নিজের ঘরে চললো সে কামনার আগুন মেটাতে!

৩৯

আজ প্রথম মিলনের রাত। নেই কোনো জাঁকজমক, কিংবা ফুলসজ্জা। বিশেষ  কোনো ছোঁয়াও নেই সুরভীর অঙ্গসজ্জায়। বাসায় পরনের জামা, পাঞ্চক্লিপের বাঁধন পেরিয়ে বেরিয়ে আসা অবাধ্য কিছু চুল, লিপবামে ভেজানো হালকা তেলতেলে ঠোঁট; এই-ই যেন রুদ্রের কাছে হুরের চেয়েও ঢের! একান্ত নিজস্ব রূপেই সুরভী তার কাছে বহু আরাধ্য, যাকে দেখলে কাম আর ভালোবাসা দু’টো একসঙ্গে ঘাড়ে চেপে বসে।

দরজা আটকে ধীর পায়ে সুরভীর কাছে এগিয়ে এল রুদ্র।

রুম হিটার চালু করে সুরভীকে বললো,

— “আমার গায়ের গেঞ্জিটা খুলে দাও।”

আজ আর কোনকিছুতেই আটকাবে না সুরভী, না রুদ্রকে বাঁধা দেবে। শেষ চারদিনে রুদ্রের অনুপস্থিতিতে ওকে বুঝিয়ে দিয়েছে এই লোকটাকে ওর চাই। পুরোপুরি নিজের করে চাই। ভালোবাসা কিংবা গভীর ছোঁয়া অথবা গাঢ় চুমুতে ঠোঁট জোড়া শুষে নেয়া সবকিছু বড্ড ভুগিয়েছে রুদ্রের না থাকা শেষ ক’টাদিন। বুকের মাঝে বড্ড তৃষ্ণা জমেছিল তার ভালোবাসা ফিরে পাবার, এই শরীরে তার স্পর্শ পাবার। সারাদিনে রুদ্রের বারবার কাছে এসেও ফিরে যাওয়া যেন সেই চাওয়াটাকে আরো তুঙ্গে তুলে ছেড়েছে। কোনো দ্বিধা সংকোচই আর তার মাঝে ঠাই পাচ্ছে না। ঠাই পাচ্ছে রুদ্র। শুধুমাত্র রুদ্র আর তাদের ভালোবাসা। সামনে দাঁড়ানো এই পুরুষটা তার। শুধুমাত্র তার। আজ নিজের সমস্তটা বিলিয়ে দেবার, ব্যক্তিগত পুরুষের সবটা আদায় করে নেবার রাত!

একটানে রুদ্রের গেঞ্জি খুলে নিলো সুরভী। ওর ঘনঘন নিঃশ্বাস স্পষ্ট রুদ্রকে জানান দিচ্ছে নিজেকে সঁপে দিতে পুরোপুরি প্রস্তুত ও। অধিকার নিয়ে সুরভীর গা থেকে ওড়না সরালো রুদ্র। তারপর খুলে নিলো ওর জামা। গলা থেকে পেট অব্দি নজরে ওকে গিলে খাচ্ছে রুদ্র। ডান স্তনের উপর অংশের ছোট্ট তিল, নাভির কাছে বাদামী জন্ম জড়ল কিংবা বাহুতে কাটা দাগ সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্ম দাগ, আঁচড়ও রুদ্রের চোখের আড়াল হচ্ছে না। আজ এই মুহূর্তে সুরভীর ঠোঁট নিজের দখলে নিতে চাইলো না রুদ্র। আঙুলের উল্টোপিঠে সুরভীর থুতনি, ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে দাবি করলো অন্যকিছু।

— “ওয়ান্না লাভ ইউর ইচ স্কারস এ্যান্ড মোলস ফার্স্ট!”

সুরভী চোখ বুজে অপেক্ষায় রইলো গায়ের প্রতিটা তিলে, দাগে রুদ্রের ঠোঁটের স্পর্শ অনুভব করতে। এক হাতে সুরভীর কোমর পেঁচিয়ে অন্যহাতে সুরভীর পায়জামার ফিতা খুলে দিলো রুদ্র। ফ্লোরে পড়ে রইলো তার নিম্নাঙ্গের বস্ত্র। খুঁজে খুঁজে প্রতিটা দাগে, তিলে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে রুদ্র। প্রথমে বাহুর দাগ থেকে ঘাড়ের বসন্তের দাগে, তারপর স্তনের উপর, আর তারপর নাভির পাশে; ধীরে ধীরে তার ঠোঁট নেমে এল উরু আর হাঁটুতে। প্রতি চুমুতে কেঁপে কেঁপে উঠছে সুরভী। গায়ের টাল সামলে দাঁড়িয়ে থাকা বড্ড দায় হয়ে গেছে। দেয়ালের সাহায্য নিতেই সুরভীকে টেনে নিজের বাহুবন্দী করলো রুদ্র। গলায়, কাঁধে চুমু দিতে দিতে বিছানায় উপুড় করে শুইয়ে দিলো ওকে। পিঠে, কোমরে, পায়ে কোথায় কোন দাগটা, কোন তিলটা বাকি রয়ে গেল, তা খুঁজতে লাগলো সে। পুরো শরীরজুড়ে অভিযান শেষে রুদ্র ফিরে এল সুরভীর মুখোমুখি। অধর চুমুতে সুরভীকে মাতাল করে ধীরে তার হাতজোড়া নিয়ে গেল সুরভীর পিঠে। রুদ্রের চাওয়া বুঝতে পারলো সুরভী। পিঠ খানিকটা উঁচিয়ে ওর কাজ আরেকটু সহজ করে দিলো। ব্রায়ের হুঁক খুলে সে ছুঁড়ে ফেললো ফ্লোরে। পেট, কোমর ছুঁয়ে তার হাত নেমে এল নিম্নাঙ্গের অন্তর্বাসে। কালবিলম্ব না করে ফ্লোরে ছুঁড়ে দিলো সেটাও। সুরভীকে ছেড়ে উঠে এল রুদ্র। কোনো নগ্ন নারী শরীরের অভিজ্ঞতা তার ছিল না কখনো। আজই প্রথম! মুগ্ধ হয়ে দেখছে সে। এ তো শুধু শরীর নয়, যেন শ্রেষ্ঠ কবির হাতে লেখা কোনো কাব্য! সুরভীর পাশে, কনুইয়ের উপর ভর করে মাথা রাখলো রুদ্র। অন্য হাতের আঙুলগুলো আপনমনে খেলছে সুরভীর নাভি বিবরে। সুরভীর চুলগুলো ফুঁ দিয়ে কপালের উপর থেকে সরিয়ে দিলো রুদ্র। ঠোঁটের কোণে ওর লাজুক হাসি। মুখ ফিরিয়ে, চোখ বুজে রেখেছে ও। কানের পাশে চুমু খেল রুদ্র।

আদুরে কণ্ঠে ডেকে বললো,

— “এভাবে চোখ বুজেই থাকবে তুমি? এত সুন্দর মুহূর্তটা নিজে চোখে না দেখলে স্মৃতির ঝুলিতে রাখবে কী?”

চোখ মেলে তাকালো সুরভী। প্রতিটা সেকেন্ড মনে-প্রাণে ওকে সুখী করছে তা যেন ওর পুরো চেহারা জুড়েই স্পষ্ট হয়েছে! আঙুলগুলো আর নাভি বিবরে নেই। সেই সীমানা ছেড়ে, একটু একটু করে উঠে এসেছে বুকে। স্তনবৃন্তের আশপাশটা আলতো ছুঁয়ে দিতে দিতে সে বললো,

— “ঠিক যেন সূর্যমুখী!”

সুরভীর চোখে চেয়ে রইলো রুদ্র অনেকটা সময়। আরো কাছে পাবার, সর্বোচ্চ গভীরে নিজেদের নতুন করে আবিষ্কার করার কামনা ওর চোখে ফুটে উঠেছে। সুরভীর চাহনীতে প্রশ্রয় পেয়ে সাহস বাড়লো রুদ্রের। আলতো ছোঁয়া বদলে গেল শক্ত মুঠোর পেষনে। ওর কানে নাক-মুখ ঘষে রুদ্র বললো,

— “যদি আমি এখন মৌমাছি হই?”

সুরভীর জবাবের অপেক্ষা করলো না রুদ্র। মুখ ডোবালো সুরভীর বুকে। মৃদু শিৎকারে রুদ্রের চুল নিজ মুঠোয় টেনে ধরে রইলো সুরভী।

পৃথিবীতে সে বুঝি আর নেই! সুখের ভেলায় ভাসিয়ে রুদ্র তাকে নিয়ে গেছে স্বর্গে কিংবা স্বর্গ নেমে এসেছে চার দেয়ালের এই কামড়ায়! রাত বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সুখ। এই রাতটা আর না ফুরোক। এই স্বর্গ সুখের মুহূর্ত শেষ না হোক। এই চার দেয়ালে বন্দী হয়ে, একান্ত রুদ্রের হয়ে কেটে যাক অনন্তকাল!

রুদ্র-৪০

৪০

মনের কানায় কানায় তৃপ্ত করা আদর আর মিলন শেষে ঘুমোতে ঘুমোতে বেশ রাত হয়েছিল ওদের। গত চার রাতের নির্ঘুম রাত আর গতকালের ক্লান্তি মিলিয়ে বেহুঁশের মতো ঘুমোলো দু’জন। বেলা গড়িয়ে যখন দশটা তখন ঘুম ভাঙলো রুদ্রের। বুকের উপর সুরভী ঘুমিয়ে আছে। ওর কপালে আলতো চুমু খেয়ে গাল ছুঁয়ে দিতেই চোখ মেললো সুরভী। মুচকি হেসে সঙ্গে সঙ্গেই আবার চোখ বুজলো ও। আরো একটুখানি শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুদ্রকে।

সুরভীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে রুদ্র জিজ্ঞেস করলো,

— “ভালোবাসো আমাকে?”

এক মুহূর্ত দেরী করলো না সুরভী। শোয়া থেকে উঠে বসলো রুদ্রের গা ঘেঁষে।

— “তুমি করে বলি?”

— “অবশ্যই!”

— “তুমি চলে যাবার পর শুধু কি তুমি একাই পুঁড়েছো? আমাকে পোঁড়াওনি? তুমি আমাকে কাঁদিয়েছো রুদ্র! প্রতি মুহূর্তে তোমাকে মনে পড়েছে আমার। তোমার কথা, তোমার হাসি, তোমার যত্ন সবকিছু! নিজেকে অচল লাগছিল ভীষণ। মায়ের পর এত যত্নে তুমিই তো আমাকে আগলে রেখেছিলে এতগুলো দিন। অভ্যেস হয়ে গেছে তোমার যত্নের। এত যত্নে যেই মানুষটা আমাকে আগলে রাখতো সে হঠাৎ নেই। কী প্রচন্ড শূণ্যতায় তুমি আমাকে ভুগিয়েছো, তা তুমি জানো না রুদ্র। এইসব মন খারাপ, শূণ্যতা, কান্না পাওয়ার কারণটাও উপলব্ধি করেছি এই ক’দিনে।”

— “কী?”

রুদ্রের ঠোঁট নিজের বৃদ্ধাঙুলীতে ছুঁয়ে দিতে দিতে সুরভী বললো,

— “ভালোবাসি তোমাকে!”

লম্বা নিঃশ্বাস নিলো রুদ্র। বহু প্রতীক্ষার শব্দটা আজ সুরভীর কন্ঠে বাজছে! মনের ভেতর দখিন হাওয়া কেমন দাপটে তাকে এলোমেলো করছে একবার যদি ওকে দেখানো যেত! খাট থেকে নেমে এল সে।

ফ্লোরে বসে বললো,

— “পা দু’টো দাও আমাকে।”

ভ্রু কুঁচকালো সুরভী।

— “কেন?”

— “দাও না!”

পা দু’টো নিচে নামিয়ে দিলো সুরভী। ওর পায়ের পাতাজোড়া এক করে বুকে জড়িয়ে ধরলো রুদ্র।

কাতর হয়ে বললো,

— “তুমি আমাকে কী দিলে, তা তুমি নিজেও জানো না সুরভী! এই মুহূর্তটার জন্য আমি কত মরেছি তাও তোমার জানা নেই। এ আমার পরম প্রাপ্তি! এরচেয়ে বড় পাওয়া আমার জীবনে আর কিচ্ছু নেই। বলেছিলাম তোমাকে রাণী করে রাখবো। রাণী আমাকে ভালোবেসেছে, নিজেকে আমার কাছে সঁপে দিয়েছে। আমি শুধু রাণীর মন না, তার পা দু’টোও এভাবে বুকে আগলে রাখবো। তার কাছে মাথা নত করে থাকবো সারাজীবন।”

সুরভীর বৃদ্ধাঙুলি জোড়ায় চুমু খেলো রুদ্র। স্তব্ধ হয়ে সুরভী চেয়ে রইলো রুদ্রের মুখে। এই মুহূর্তে কী বলা উচিত, কী করা উচিত ভেবে পাচ্ছে না ও!

— “এখন থেকে আমার দিন শুরু হবে তোমার পায়ে চুমু খেয়ে। আমি চোখ মেলে তোমাকে দেখতে চাই সুরভী। পুরো পৃথিবী গোল্লায় যাক, তুমি আমার সামনে থাকবে ব্যস!”

মাথা নুইয়ে রুদ্রের কপালে চুমু দিলো সুরভী। মাথার চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বললো,

— “কেমন সব পাগলামি তোমার?”

— “আমার সমস্ত পাগলামি তো তোমার জন্যই সুরভী! তুমি আমার ঘর। আমার ঘরে আমি পাগলামি করবো, নাচবো, গাইবো, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রুদ্র হয়ে থাকবো। যে রুদ্রকে কেউ দেখে না. কেউ জানে না।”

৪১

— “আমি আদনানের বিবাহিতা স্ত্রী। তিনবছর হয়েছে আমাদের বিয়ের, সেসব মিথ্যে নয়। তবে আদনানের বিপক্ষে আমি যা কিছু বলেছি, তা মিথ্যে। আমারই ইচ্ছায় আদনান এতদিন বিয়ের কথা কাউকে জানায়নি। ক্যারিয়ার গড়ে তারপর বিয়ের কথা জানানোর ইচ্ছে ছিল আমার। তবে আমার সেই লাইভের দিন সকালে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায় আমার এবং আমার পরিবারের সঙ্গে। আমাদের জিম্মি করা হয়। হত্যা করার হুমকি দেয়া হয়। জিম্মির মুখে লাইভে এসে এসব বলতে হয়েছে আমাকে। আদনানকে জানাবার সুযোগ আমি পাইনি। কারো কাছে সাহায্য চাইবো সেই সমস্ত পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। এমনকি সেই লাইভের পর আমাকে অপহরণ করা হয় আমারই বাসার সামনে থেকে। মুক্তিপণ বাবদ দাবি করা হয় আমার হাজবেন্ড যেন তার মন্ত্রীপদ থেকে পদত্যাগ করে। আর সে কারণেই আদনান নিজেও এতদিন সবকিছু থেকে দূরে ছিল।”

একঝাঁক সাংবাদিকের মাঝ থেকে একজন প্রশ্ন করলো,

— “মাননীয় রেলমন্ত্রী এখনো পদে বহাল আছেন। পরবর্তীতে নেগোশিয়েটের ব্যাপারটা কী হলো?”

— “আর প্রয়োজন হয়নি। যার নির্দেশে এতকিছু ঘটেছে তিনি একমাস আগে খুন হয়েছেন।”

— “ম্যাম নামটা যদি উল্লেখ করতেন!”

— “সাবেক সড়ক ও যোগাযোগ মন্ত্রী মতিউর রহমান।”

হৈচৈ পড়ে গেল কনফারেন্স রুমে। একের পর এক প্রশ্ন নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সাংবাদিকরা। ফেইসবুক লাইভে চলছে সাধারণ মানুষের কমেন্টের ঢল!

মতি হত্যা মামলা রায়ের আজ একসপ্তাহ ফুরোলো। রায়ের পরবর্তী তিনদিন পরই পত্রিকায়, টেলিভিশনে এই নিয়ে আলোচনা থেমে গেছে। সামনে আসছে মেয়র ইলেকশনের পালা। পরবর্তী সপ্তাহ থেকেই শুরু হবে মেয়র ইলেকশন নিয়ে সংবাদ প্রচার। মাঝের এই ফাঁকা সময়টাকে কাজে লাগালো রুদ্র। ল্যাপটপের স্ক্রিন অফ করলো সে। আদনানের খেলাটা এই পর্যন্তই ছিল। গাছের নিচে ছায়ায় চেয়ারে বসে, অন্য চেয়ারে পা তুলে এতটা সময় আদনান-সোমার প্রেস কনফারেন্স দেখছিল সে।

ল্যাপটপ থেকে চোখ সরাতেই নজর গেল সুরভীর দিকে। বাড়ির পেছনের গাছের টবগুলোতে কী যেন করছে ও। ঝুঁকে আছে নিচের দিকে। ওড়না বুক থেকে সরে গেছে অসতর্কতাবশত। জামার গলাও আলগা হয়ে আছে গা থেকে। হাসলো রুদ্র। ওখানে বসেই কল করলো সুরভীকে। কানে ইয়ারপড গুঁজে ছিল সুরভী। কল রিসিভ করে আবারও কাজে মন দিলো ও।

— “আমাকে দেখেছো তুমি?”

— “হ্যাঁ। দেখেছি তো অনেক আগেই। তখন তুমি ল্যাপটপে চোখ ডুবিয়ে রেখেছো। তা এটুকু দূরত্বে কল করার কারণ?”

— “আমার চোখ কিন্তু এখন ডুবে আছে অন্য কোথাও!”

— “কোথায়?”

— “ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে।

চোখ নামিয়ে নিজের অবস্থা দেখতেই চট করে ওড়না টেনে নিজেকে গুছিয়ে নিলো সুরভী।

— “খেয়ালই করিনি আমি!”

— “সে যাই হোক, বুকে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। এখন ঝড় শান্ত করতে হবে।”

রুদ্রের ইঙ্গিত বুঝে নিয়ে কপট রাগ ঝাড়লো সুরভী।

— “একদম না। কাজ আছে আমার।”

বলেই উঠে চলে যাচ্ছিল সুরভী, কোল থেকে ল্যাপটপ সরিয়ে ছুটলো রুদ্র। চিৎকার করে বললো,

— “তুমি বারণ করলেই আমি শুনবো নাকি!

এক দৌড়ে সুরভীও চলে গেল বাড়ির ভেতর। রুদ্র আসার আগেই সে পৌঁছে গেল রান্নাঘরে। থেমে গেল রুদ্র। কলটা তখনও কাটেনি কেউই।

নিচু স্বরে সে বললো,

— “বেঁচে গেলে। কিন্তু কতক্ষণ? রান্নাঘরে তো আর গোটাদিন কাটিয়ে দেয়া যাবে না।”

— “কাজ আছে সত্যিই। মা আমার হাতের মুরগির ঝোল খেতে চেয়েছে। রান্নাটা শেষ করে আসছি।”

কল কেটে রান্নায় মন দিয়েছিল সুরভী। খানিক বাদেই একজোড়া হাতের জামার ভেতর অবাধ্য বিচরণে পেট ছুঁয়ে বুকে এসে পৌঁছেছে। সেই সঙ্গে ঘাড়ের উপর অনুভব হচ্ছে গরম নিঃশ্বাস। প্রচন্ড আবেশে গা ছেড়ে দিলো সুরভী। রুদ্রের বুকে লেপ্টে রইলো ও।

তার কানে ফিসফিসিয়ে রুদ্র বললো,

— “বেঁচে যাওয়া এত্ত সহজ? তোমাকে চাই মানে চাই। লাগবেই তোমাকে এখনই। বাড়িটা আমার। আমার বাড়িতে আমার ওয়াইফকে আমি যখন যেখানে যেভাবে চাইবো সেভাবেই পাবো। বাসায় গেস্ট বসে আছে নাকি সার্ভেন্ট সেসব কোনো ব্যাপারই না! এক ইশারায় সরিয়ে দেবো সব।”

পান চিবুতে চিবুতে পুরো প্রেস কনফারেন্স শেষ করলেন আজগর। পিকদানীতে পানের অবশিষ্টাংশ ফেলে ডায়াল করলেন হাবিবের নাম্বারে।

— “পেয়াদাদের সামনে আনো। চাল বাড়ানোর সময় হয়েছে।”

৪২

রোজকার নিয়মে ঘুম ভাঙলো রুদ্রের। সুরভী ঘরে নেই। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে এল তার। কেন নেই ও?

গলা ছেড়ে তাকে ডাকলো রুদ্র,

— “সুরভী… এই সুরভী।”

বাইরে থেকে একজন কর্মচারী কড়া নাড়লো দরজায়।

ভেতর থেকে অনুমতি দিলো রুদ্র,

— “এসো।”

— “ভাবী বসার ঘরে আছেন। হাত কেটে গেছে উনার। ব্যান্ডেজ…’

কর্মচারীর কথা ফুরোবার আগেই রীতিমতো বসার ঘরে উড়ে হাজির হলো রুদ্র। ব্যথায় চেহারা কুঁচকে রেখেছে সুরভী। হাত গড়িয়ে রক্ত ঝরছে ওর। দুজন কর্মচারী মিলে রক্ত থামাবার চেষ্টা করছে। ফেরদৌসী সুরভীর অন্য হাত চেপে ধরে বসে আছেন। মুহূর্তেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে এল রুদ্রের। কর্মচারী দুজনকে সরিয়ে সুরভীর হাত টিস্যুতে চেপে ধরলো রুদ্র।

চিৎকার করে ড্রাইভারকে ডাকলো,

— “জাহিদ, গাড়ি বের করো এক্ষুনি।”

কাতর হয়ে সুরভীকে জিজ্ঞেস করলো,

— “কষ্ট হচ্ছে খুব?”

রুদ্রের অস্থিরতা দেখে স্বাভাবিক হলো সুরভী। হাতে আর ব্যথা অনুভব হচ্ছে না। রুদ্রকে শান্ত করতেই ব্যস্ত হলো ও।

— “তেমন কিছুই না। একটু স্যাভলন দিয়ে ব্যান্ডেজ করে নিলেই হবে।”

— “না, হসপিটাল যেতে হবে।”

ওপাশ থেকে ফেরদৌসী বললেন,

— “বারবার বলি কাটাকাটি তোমার করতে হবে না। মাঝেমধ্যে শখের বশে রান্না করো ঠিক আছে। কিন্তু কাটা বাছা সব করবে কাজের লোক। কথা কেন যে শুনতে চাও না?”

মেজাজ সপ্তম আকাশে চড়লো রুদ্রের। চিৎকার শুরু করলো বাড়ির প্রত্যেকের উপর,

— “তোমরা থাকতে ও কেন কাজ করবে? কাজ না করতে পারলে বের হও সব আমার বাসা থেকে। আমি আজই নতুন লোক আনিয়ে নেবো।”

লজ্জায় পড়ে গেল সুরভী। অকারণে সবাইকে বকা শুনতে হচ্ছে। রুদ্রের মাথায় হাত বুলিয়ে ও বললো,

— “কারো কোনো দোষ নেই! ক্যারট জুস করতে চাচ্ছিলাম। বোকার মতো হাতের উপর রেখে কাটতে গেছি আর তখনই লেগে গেল। ওরা বলছিল বারবার আমি যেন না করি। আমিই আসলে…”

— “চুপ করো তুমি। কী একটা অবস্থা করেছো হাত কেটে! ধ্যাত!”

মূল ফটকের সামনে এসে গাড়ি দাঁড়িয়েছে।

রুদ্র সুরভীকে বললো,

— “চলো।”

— “বাসায় করলে হয়ে যেত না?”

— “আর একটা শব্দ তুমি করবে না। চলো আমার সঙ্গে।”

*****

ব্যান্ডেজ শেষে, হসপিটাল থেকে ফিরলো রুদ্র। কাপড় পাল্টে সে বেরিয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। কাজের চাপ যাচ্ছে ভীষণ। সঙ্গে চলছে মেয়র ইলেকশনের প্রস্তুতি। সব মিলিয়ে রুদ্রের দিনরাত কেমন করে কাটছে, কখন বেলা ফুরোচ্ছে কিছুই টের পাচ্ছে না সে। কখনো শান্ত হয়ে কাজ করছে তো, কখনো মাথা গরম হচ্ছে। আর আজকের দিনটা তো শুরুই হলো কুৎসিত এক ঘটনা দিয়ে। বাসা থেকে বেরোবার আগে কঠিন আদেশ জারি করে গেছে সুরভীসহ প্রত্যেকের উপর, হাত ভালো হওয়ার আগ পর্যন্ত সুরভী কিছু করবে না। রান্নাঘরে পা রাখা

একেবারেই নিষেধ! ও শুধু খাবে, মায়ের সঙ্গে গল্প করবে আর ঘুমাবে। রুদ্রের আদেশ পাত্তাই দিলো না সুরভী। সে চলে যেতেই ঘরময় ঘুরে ঘুরে এটা সেটা গোছাচ্ছে। শাশুড়ী, কর্মচারীরা শত বলা সত্ত্বেও কারো কথা শুনছে না ও। সারাদিন এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় নাকি!

ঘন্টা দুয়েক পর কল এল রুদ্রের। বেশ গম্ভীর শোনাচ্ছে তাকে। কল রিসিভ করেই টের পেল সুরভী। বললো,

— “কী হয়েছে তোমার? রেগে আছো কী নিয়ে?”

— “কতগুলো ছাগল এসে দলে যোগ দিয়েছে। যেটাকে নমিনেশন দেয়া হয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ থেকে, একঘন্টা আগেই বিশাল ব্লান্ডার করে বসে আছে। পেয়েছে এক ফেসবুক। মূর্খের মতো যা পায় তাই পোস্ট করে, যা ইচ্ছে তাই স্ট্যাটাস দেয়। জঘন্য যতসব! এদিকে অফিসেও একটা এমপ্লয়ির ঝামেলার কারণে বড় সাপ্লাইটা আটকে গেছে। কতগুলো টাকা ইনভেস্ট আমার! এটা সুরাহা করতে লাগবে আরো ১০-১২ দিন। আজকের দিনটাই আমার খারাপ সুরভী! যেখানে আমার দিনের শুরু হয় তোমার পায়ে চুমু খেয়ে সেখানে আজ দিনের শুরুই হয়েছে তোমার হাত কাটা দিয়ে! বারবার বলি সকালে আমার চোখের সামনে থাকবে। নড়বে না কোথাও। আমি অফিস চলে গেলে যাও যেখানে খুশি! শুনতেই চাও না আমার কথা। এত চোখে চোখে রাখি কখন আবার কোন অসুখ বাঁধাও, ব্যথা পাও! তবুও তোমার ঘুরেফিরে ওদিকেই যাওয়া চাই।”

এক নিঃশ্বাসে রুদ্র বলেই চলছে। চুপচাপ সব শুনলো সুরভী। কিছু বললো না। রুদ্র ফোন রাখতেই জামাটা বদলে ও বেরিয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে।

*****

অফিস এমপ্লয়িদের নিয়ে কনফারেন্স রুমে মিটিংয়ে ব্যস্ত রুদ্র। কোনো প্রকার নক ছাড়াই ভেতরে চলে এল সুরভী। রুদ্রের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে সুরভী সবার উদ্দেশ্যে বললো,

ww

— “এক্সকিউজ আস প্লিজ!”

চোখের পলকে পুরো রুম খালি হয়ে গেল। সবাই চলে যাবার পর, ম্যানেজারও বেরিয়ে যাবার আগে দরজা লক করে গেল। রুদ্রের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সুরভী। ঠোঁটের কোনে লেগে আছে হাসি। ওর চোখে স্বস্তি ভরা নজরে চেয়ে রইলো রুদ্র।

— “তোমাকে এখন ভীষণ প্রয়োজন ছিল।”

— “জানি তো!”

রুদ্রের দিকে হাত বাড়ালো সুরভী।

— “তোমার রুমে চলো। বিজি শিডিউল থেকে আজ আধঘন্টা আমি চুরি করবো।” সুরভীকে সঙ্গে নিয়ে নিজের রুমে এল রুদ্র। বাইরে রেখে এল একঝাঁক আলোচক। পুরো অফিসে ফিসফাস চলছে সুরভীকে নিয়ে। এই প্রথম বসের মিসেস অফিসে পা রেখেছেন। তিনি দেখতে কেমন, কথা বলার ভঙ্গি কেমন, স্যারের সঙ্গে তার সম্পর্ক কেমন হতে পারে এই নিয়েই গোটাদিন আলোচনা চলবে এই অফিসে।

তিন সিটের সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে সুরভী। ওর বুকে পিঠ ঠেকিয়ে, গলার কাছে মাথা রেখে চোখ বুজে শুয়ে পড়লো রুদ্র। তার ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট রেখে, লাইটারে তা জ্বালিয়ে দিলো সুরভী নিজেই। বুকের উপর থেকে গুনে গুনে তিনটা বাটন খুলে, শার্টের ভেতর রুদ্রের লোমশ বুকে হাতড়ে দিচ্ছে সে। সুরভীর হাতের উপর হাত রাখলো রুদ্র। বললো,

— “আমাকে বুঝতে শিখে গেছ তুমি।”

— “ভালোবাসি তোমাকে। তোমার মনে কী চলছে, কী চাইছো বুঝবো না আমি?”

— “সত্যিই তোমাকে খুব করে চাইছিলাম। কাজের চাপে বাসায় যেতে পারছিলাম না।”

— “সেজন্য আমিই চলে এলাম।”

— “সুরভী আমার সব স্ট্রেস একদিকে, তোমার স্ট্রেস আরেকদিকে। নিজের একটু খেয়াল রেখো প্লিজ!”

— “সামান্য একটু কেটেছেই যা! এত রিএ্যাক্ট কেন করছো তুমি?”

— “করবোই। এসব বুঝবে না তুমি। তোমার কিছু হলে আমার ভালো লাগে না। ইলেকশনের ঝামেলা. অফিসের ঝামেলা এসব আমি ম্যানেজ করে ফেলবো। কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠেই এসব দেখলাম। আমি এখনও মাথা থেকে ঝাড়তে পারছি না।”

রুদ্রের মাথায় থুতনি রাখলো সুরভী,

— “ছাড়ো না রুদ্র! যা হবার হয়েই গেছে।”

— “আর যেন না হয়।”

— “আছো তো তুমি আমার খেয়াল রাখার জন্য। তুমি থাকতে আমার কী হবে?”

৪৩

দুপুরের খাবার শেষে বিছানায় একটুখানি গড়াগড়ি করছিল সুরভী। দরজায় কড়া পড়লো ওর। উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেল নাজনীন প্রায় কান্নামুখো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রায় আঁতকে উঠলো সুরভী,

— “কী হয়েছে আপু? মা ঠিক আছেন?”

— “আমি একটা ঝামেলা করে ফেলেছি ভাবী।”

— “কী ঝামেলা?”

ঘরের ভেতর ঢুকে দরজা আটকে দিলো নাজনীন।

— “আমি আন্টির আংটি হারিয়ে ফেলেছি ভাবী। গত বছরই ভাইয়া আন্টিকে এটা গিফট করেছিল।”

— “কখন? কিভাবে?”

— “আন্টি গতকাল রাতে আমাকে বললো এটা আলমারীতে তুলে রাখো। আমি কথা বলছিলাম ফোনে, আমার হাতেই ছিল তখনও। তারপর কথা বলতে বলতে কোথায় যে রেখেছি মনে করতে পারছি না।”

— “আলমারিতে খুঁজেছেন?”

— “হ্যাঁ। সবখানে খুঁজছি গতরাত থেকে। পাইনি কোথাও।”

— “মাকে বুঝিয়ে বলবো আমি। উনি রাগ করবেন না। জানেনই তো মা কেমন মানুষ!”

সুরভীর হাত ধরে ঝরঝর করে কেঁদে দিলো নাজনীন।

— “আন্টির সামনে ছোট হয়ে যাবো ভাবী। প্লিজ উনাকে এটা জানাবেন না। আমি অন্য একটা উপায় ভেবে রেখেছি।”

— “কী?”

— “ভাইয়া কোন দোকান থেকে আংটিটা নিয়েছে জানি আমি। একই ডিজাইনের নতুন আরেকটা কিনে আনবো। আমার জমানো টাকা আছে। অনায়াসে হয়ে যাবে।”

— “এতগুলো টাকা অকারণে খরচ করার মানে হয় না। ভুলবশত হয়ে গেছে, ব্যস! মাকে বললেই হবে।”

— “না ভাবী! আমি আন্টি. ভাইয়ার সামনে ছোট হতে পারবো না। আপনি চলুন না আমার সঙ্গে! এতগুলো টাকা নিয়ে একা বের হওয়ার সাহস হচ্ছে না।”

কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো সুরভী। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না।

— “ভাবী? চলুন না?

— “আচ্ছা আমি তৈরী হয়ে আসছি।

ভাগ্যক্রমে সেই দোকানেই হারানো আংটির ডিজাইন খুঁজে পাওয়া গেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো নাজনীন। আংটি কিনে নিচে নামার সময় ও বললো,

— “আমি ওয়াশরুমে যাবো ভাবী।”

— “হ্যাঁ যান আপনি। আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি।”

— “ওদিকটা বেশ নীরব, একা যাবো না। কিছু মনে না করলে আপনি দাঁড়াবেন বাইরে?”

— “সিওর!”

ওয়াশরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সুরভী। সত্যিই এদিকটায় কেউ নেই। একেবারে সুনশান। নাজনীন ফিরে আসতে আসতে দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে একটুখানি নিউজ ফিড স্ক্রল করে নিচ্ছিলো সুরভী।

ঠিক তখনই হঠাৎ আসিফ এসে বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। ঘটনার আকস্মিকতায় নিজেকে থিতু করতে এক মুহূর্ত সময় নিলো সুরভী। আসিফ এখন জীবনের চরম অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষ। এই সময়ে এখানে তার উপস্থিতিটাও অনাকাঙ্ক্ষিত। তার এই আচরণের বিপরীতে বোধ ফিরতেও দু’দন্ড সময় লাগলো সুরভীর। শরীরের সমস্ত শক্তিতে এক ধাক্কায় আসিফকে সরিয়ে দিলো সে। কোনো প্রশ্ন, জবাবদিহিতা না চেয়ে সরাসরি চড় কষালো তার গালে। দ্বিতীয়বারের মতো চড় খেয়ে মেজাজ হারালো আসিফও। শুরু হলো দু’জনের বাকবিতন্ডা।

মাত্রই বাসায় ফিরেছে রুদ্র। পুরো ঘর সুরভীকে খুঁজেও পাওয়া গেল না। কেউই ওর খোঁজ দিতে পারছে না। বাড়ির সিকিউরিটিরা শুধু দেখেছে নাজনীনকে সঙ্গে নিয়ে সুরভী বেরিয়েছে। সঙ্গে দু’জন গার্ড যেতে চেয়েছিল। সুরভী এক প্রকার জোর করে তাদের রেখে গেছে। রাগ হলো রুদ্রের। ও কি কোনোদিনও শুধরাবে না? বারবার ওকে বলা হয়েছে কখনো গার্ড ছাড়া বাসা থেকে বেরোবে না। সেইফটির দিকটা মাথায় রাখবে সবসময়। কাউকে তো সঙ্গে নিলোই না! আবার কাউকে জানিয়েও গেল না কোথায় যাচ্ছে।

ঘুমে ছিলেন ফেরদৌসী। রুদ্রের ডাকে জেগেছেন তিনি। তারও জানা নেই নাজনীন আর সুরভী কোথায় গেছে। এমন কান্ড নাজনীন কখনো করে না। আজ কী হলো ওর?

সুরভীকে কল করবে বলে মোবাইল পকেট থেকে বের করতেই হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ এল তার। অন করে দেখলো আসিফের বুকে তার স্ত্রী। দেখেই রুদ্রের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে এল। হাতের কাছে থাকা ফুলদানীটা আছাড় মারলো সে ফ্লোরে। কর্মচারীরা যে যার মতে আতংকে বসার ঘর ছেড়ে পালালো। শুভ আর ফেরদৌসী উদ্যত হলো তার ক্ষোভের কারণ জানতে।

অনবরত দু’জন দু’পাশ থেকে সম্ভাব্য সমস্ত কারণ তাকে জিজ্ঞেস করছে। মোবাইলে কার মেসেজ এসেছে তার কারণ জানতে চাইছে। কারো কথার কোনো জবাব দিচ্ছে না রুদ্র। সোফায় পায়ের উপর পা তুলে, মাথা হেলিয়ে বসে আছে সে। চেহারা কঠিন রূপ নিয়েছে। এই রূপ শুভর বেশ চেনা। আজ কার কপালে যে শনি নেমে আসছে কে জানে!

*****

মাগরিব আজানের আগ মুহূর্তে ঘরে ফিরেছে সুরভী। রুদ্রকে দেখতে পেয়ে হাসিমুখে তার দিকে পা বাড়াচ্ছিল, তখনই ওর চোখ পড়লো ফ্লোরে ছিটিয়ে থাকা কাচে। রুদ্রও স্বাভাবিক নেই। খানিক দূরেই দাঁড়িয়ে আছে শুভ। পাশে বসে আছে শাশুড়ী। তাদের দুজনকে কেমন ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ফেরদৌসী ইশারায় কী যেন বলতে চাইলো ওকে। বুঝলো না সুরভী। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রুদ্রের কাছে এসে দাঁড়ালো ও।

কপালে হাত রেখে জানতে চাইলো,

— “কী হয়েছে তোমার?”

সুরভী কিছু বুঝে উঠার আগেই ওর ডানগালে সজোরে চড় বসালো রুদ্র। গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সুরভী। ঠোঁটের কোণ ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে ওর। হা হয়ে রুদ্রের দিকে চেয়ে আছে শুভ। সুরভীকে চড় মারলো উনি! সত্যিই? পেছন থেকে ছেলেকে কঠিন স্বরে শাসালেন ফেরদৌসী,

— “এতবড় স্পর্ধা তোমার! বউর গায়ে হাত তোলো তুমি? আশরাফ কখনো

মেয়েদের এভাবে অসম্মান করতে শিখিয়েছে তোমাকে?”

— “বাবা আমাকে সম্মানের উপযুক্ত মানুষকেই সম্মান দিতে শিখিয়েছে। কোনো প্রতারক চরিত্রহীনকে নয়।”

রুদ্রের দিকে পাহাড়সম বিস্ময় নিয়ে তাকালো সুরভী।

— “চরিত্রহীন কাকে বলছো তুমি?”

— “নিজেকে চিনতে পারছো না সুরভী?”

— “কী বলছো বুঝতে পারছো তো?”

সুরভীর দিকে ফোন এগিয়ে দিলো রুদ্র। আসিফের বুকে নিজেকে দেখে আঁতকে উঠলো ও।

— “এই ছবি কে তুললো?”

— “ধরা পড়ে গেছো তাই না? কী বাজেভাবে আমাকে তুমি ঠকালো সুরভী! এত ভালোবাসা, এত যত্ন দিয়েও তোমাকে বাঁধতে পারলাম না! তোমার ঐ থার্ডক্লাস প্রেমিকের জন্য এখনও মন পড়ে আছে তোমার!”

কান্না জুড়ে দিলো সুরভী। এগিয়ে এসে রুদ্রের হাতটা একবার ধরতে চাইলো ও। ধাক্কা মেরে রুদ্র তাকে দূরে সরিয়ে দিলো।

— “দূরে থাকো তুমি। তোমার স্পর্শ আমি কোনোভাবেই চাই না।”

— “ভুল বুঝছো তুমি!”

— “কী ভুল বুঝছি? কোনটা আমার ভুল বলো?”

— “আমি কোনো প্রতারণা করিনি। আমার পুরো কথাটা শুনবে তো তুমি!”

— “যা দেখার দেখেছি। শোনার রুচি আমার নেই।”

ছেলেকে ধমকালেন ফেরদৌসী।

— “তুই এক তরফা বলেই যাচ্ছিস, বলেই যাচ্ছিস। আগে শুনবি তো ও কী বলতে চাইছে।”

— “কিচ্ছু শুনবো না আমি। দিনভর আমাকে ভালোবাসি বলে, গোপনে প্রেমিকের সঙ্গে তোমার দেখা করতে যাওয়া! এমন মেয়ে আমি আমার ঘরে রাখবো না। বেরিয়ে যাও তুমি। এক্ষুনি।”

বাড়াবাড়ি সীমা ছাড়াচ্ছে। আর চুপ থাকতে ইচ্ছে হলো না শুভর। সুরভীর হাত থেকে রুদ্রের ফোন নিয়ে, ছবিটা একবার দেখলো সে।

— “ভাই, কে পাঠিয়েছে এই ছবি?”

— “জানি না।”

— “স্পষ্ট বুঝাই যাচ্ছে পুরো সিনটা প্রি প্ল্যানড। নয়তো ছবি তোলার জন্য কে দাঁড়িয়ে থাকবে ওখানে?”

শুভর কথা কানেই তুললো না রুদ্র। প্রচন্ড রাগে চোখ-কান সব বন্ধ হয়ে আছে তার। সুরভীর গাল চেপে ধরলো সে। প্রচন্ড ঘৃণা ভরে তাকালো সুরভীর চোখে।

— “আমি আর তোমার এই নোংরা চেহারাটা দেখতে চাই না। এক্ষুনি বের হবে তুমি। আর কোনোদিন আমার সামনে এসো না। আজ যেভাবে প্রেমিকের বুকে মিশে ছিলে, সেভাবেই প্রেমিকের বুকে মাথা রেখে শহর ছাড়বে তুমি। আমার চোখের সামনে দু’টোর একটাকেও যদি দেখি না, একদম টুকরো করে ফেলবো।”

পৃথিবীর সমস্ত অসহায়ত্ব আজ সুরভীর চোখ জুড়ে। বাড়ির কর্মচারীরা রান্নাঘরের ওদিক থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে ওকে। কান পেতে শুনছে রুদ্রের সমস্ত অপবাদ। যে মানুষটা রাণী করে রেখেছিল সেই মানুষটা তাকে চরিত্রহীন অপবাদ দিতে দ্বিতীয়বার ভাবলো না? তাও এতগুলো লোকের সামনে? এই অপমানের গ্লানি সয়ে যাবার ক্ষমতা ওর নেই। ভালোবাসার মানুষটার অমন কুৎসিত প্রত্যাখ্যানের পর এই জীবন বয়ে যাওয়া বড্ড কঠিন হবে। প্রতিটা নিঃশ্বাস যেন আজ নিজের ওজনের চেয়েও ভারী মনে হচ্ছে। আর কোনো সাফাই সুরভীর দিতে ইচ্ছে হলো না। চরিত্রহীন অপবাদের কলঙ্ক নিয়েই খালি পায়ে বেরিয়ে এল ও রুদ্রের বাড়ি ছেড়ে। পেছন থেকে শাশুড়ীর ডাক শুনতে পাচ্ছে ও। তবুও থামলো না। যাকে কেন্দ্র করে এই বাড়িতে আসা, সে আর তাকে চায় না। সমস্ত সম্মান খোয়ানো শেষ। কিছুই নেই এখানে আর অবশিষ্ট। ফেরার পথও নেই।

পেছন পেছন আসছে শুভ। কতভাবে বুঝিয়ে বলছে, “থেকে যান। কেউ ষড়যন্ত্র করেছে। খুঁজে বের করে সব ঠিক করে দেবো আমি।”

তবুও থামলো না সুরভী। তৃতীয়পক্ষের ষড়যন্ত্রের কাছে হেরে যাবে এতটাও ঠুনকো সম্পর্ক তো ছিল না তাদের। একটা ছবিকে কেন্দ্র করে চরিত্রহীনের অপবাদ দিয়ে দিলো এত ভালোবাসার মানুষটা! এই অপমানের কাছে শুভর আশ্বাস তুচ্ছ!

৪৪

মা-বাবার কাছে ফিরে এসেছে সুরভী। দরজা খুলে মেয়ের অমন বিধ্বস্থ চেহারা, কাটা ঠোঁট দেখেই চিৎকার শুরু করলেন মিতা।

— “মাহিনের আব্বু? আমার মেয়েটার কী হলো গো?”

স্ত্রীর চিৎকারে রীতিমতো ছুটে এলেন শরীফ সাহেব।

— “কী হয়েছে মা তোর?”

মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই বাবার বুকে আছড়ে পড়লো সে। চিৎকার করে কাঁদছে।

— “ও আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে আব্বু। বলেছে আমি চরিত্রহীন। কিন্তু আমি তো চরিত্রহীন না আব্বু। তুমি তো জানো! জানো না? এতবড় অপবাদ ও আমাকে কী করে দিলো আব্বু? এক মুহূর্তে রাণী বানিয়ে আবার অন্য মুহূর্তে এভাবে ও আমাকে পথে ছুঁড়ে মারলো কেমন করে, বলো না আমাকে?”

মেয়েকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন শরীফ সাহেব। তিনি জানতেন এই সংসার টিকবে না। এভাবেই একদিন তার মেয়েকে রুদ্র ছুঁড়ে দেবে, প্রভাবশালী ধনীরা এমনটাই করে। তার মেয়েকে রুদ্র কোনোদিন ভালোবাসেনি। কোনোদিনও না। খেলার পুতুল বানিয়ে ঘরে সাজিয়ে রেখেছিল দুইমাস। খেলা শেষ, তাই ছুঁড়ে ফেললো এভাবে। চোখের কোল বেয়ে অশ্রু গড়ালো তার। চাপা দীর্ঘশ্বাসে সৃষ্টিকর্তার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়লেন তিনি, “কোন পাপের শাস্তি ছিল এটা?”

— “অই হই হই রঙ্গীলা, রঙ্গীলা রে
রিমঝিম ঝিম বরষায় মন নিলা রে…”

কালজয়ী নায়ক রাজ্জাক আর নায়িকা শাবানা অভিনীত গান বাজছে আজগরের টেলিভিশনে। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে পা দুলিয়ে গান শুনছে সে। মনে আজ তার যুদ্ধ জয়ের খুশি। যে রুদ্রকে নিজ ইশারায় নাচানো ছিল সমুদ্রকে বোতলবন্দী করার মতো অসম্ভব, সেই রুদ্রকে নিজ ইশারায় নাচাচ্ছে সে! পাশেই বসে ছিল হাবিব। খপ করে তার হাতটা ধরলো আজগর।

বিজ্ঞের ন্যায় বলতে লাগলো,

— “মানুষের সবচেয়ে বড় দোষ কী, জানো?”

— “কী?”

— “সে তার দুর্বলতার জায়গায় অন্ধ, বধির। তার দুর্বলতা নিয়ে বাইরের লোক একশো নিন্দা করুক, সে কখনো তা যাচাই করবে না। সত্যটা দেখলেও না দেখার ভান ধরে বসে থাকবে। অন্যায় দেখলেও মেনে নেবে। গলা উঁচিয়ে সবার কাছে নিজের দুর্বলতাকে শ্রেষ্ঠ, নির্দোষ প্রমাণ করতে চাইবে। কিন্তু সেই দুর্বলতাই যখন তার সঙ্গে প্রতারণা করবে, মুখ ফিরিয়ে নেবে তখন আর সেটা মানুষ যাচাই করে না, সত্যিই কি প্রতারণা করলো? নাকি তার ভ্রম? নাকি এর পেছনে গুরুতর কোনো কারণ আছে? তৎক্ষনাৎ মানুষ অন্ধ-বধির হয়ে যায়। রাগ, ক্ষোভ আর কষ্ট ছাড়া আর কিছুই নিজের মাঝে অবশিষ্ট থাকে না। হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়। দুর্বলরা কাঁদে, নিজেকে ভাঙে। সবলরা প্রতিশোধ নেয়, যে প্রতারণা করলো তাকে ভাঙে। নিজের সঙ্গে হওয়া প্রতারণা মানুষ হজম করতে পারে না। সমস্ত যুক্তি, সত্যের উর্ধ্বে থাকে তাদের কষ্ট আর ক্ষোভ। তারপর যখন সময় গড়ায়, ধীরে ধীরে মানুষ শান্ত হয়, তখন যুক্তি সত্য তার মাথায় আঁটে। কিন্তু ততদিনে তো সব শেষ। সম্পর্ক শেষ, ভালোবাসার মানুষও শেষ।”

— “ঠিক। সবাই না হলেও, বেশীরভাগ মানুষই এমন।”

— “সেই বেশিরভাগের মাঝে আমাদের রুদ্রও একজন!” হাসলো হাবিব। বললো,

— “পাহাড়ের মতো বুক চিতিয়ে যে দাঁড়িয়ে থাকতো সবসময়, কোনোদিন যাকে কেউ টলাতে পারেনি, হারাতে পারেনি সেই ছেলেটা কিনা একটা মেয়ের কারণে এভাবে আমাদের কাছে হারলো!”

— “আমার আনন্দ ওর হার নিয়ে না। ওর পতন নিয়ে, ওর ভাঙন নিয়ে, রুদ্র এখনো অন্ধ হয়ে আছে। টের পাচ্ছে না কিছুই। কিন্তু যখন জানবে ওর সমস্ত কিছু ভুল ছিল, এত ভালোবাসার মানুষটাকে ঘরভর্তি চাকর বাকরের সামনে চরিত্রহীনের সিল লাগিয়ে ঘরছাড়া করেছে, সেই অপমান সইতে না পেরে বউ আত্মহত্যা করেছে; তার স্ত্রীর মৃত্যুর কারণ সে নিজে। এই উপলব্ধির পর বাঁচবে ও? ভেতরে ভেতরে মরে যাবে চিরজীবনের জন্য। পুরুষ মানুষের ভালোবাসা বড় কঠিন, যাকে একবার মনের সবটা দিয়েছে তার কাছে নিজেকেই সঁপে দিয়েছে। এই ধকল রুদ্র নিতে পারবে না। আমার অর্জনটা ঠিক এখানেই।”

— “সুপারম্যান হয়ে আদনানের বউকে বাঁচিয়েছে। জামাই বউ দুটোকে উধাও করে সব ঠিক করে ফেলেছে। এখন নিজের বউকে বাঁচাবে কে?”

— “জিজ্ঞেস করো গাধা মজনুটাকে!” অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো দু’জনই।

*****

নিজের ঘরে দরজা আটকে বসে আছে রুদ্র। সন্ধ্যের পর আর দরজা খোলেনি। শুভও রয়ে গেছে এখানেই। আসিফের অপেক্ষায় আছে। নন্দীকে পাঠিয়েছে তাকে খুঁজে বের করতে। এখনও খোঁজ পাওয়া যায়নি তার। তাকে পেলেই পুরো জট খুলে যাবে। নাজনীন আজ ফোনে ভীষণ ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পরপর কাকে যেন টেক্সট করছে। চোখ এড়ালো না ফেরদৌসীর। কালে কালে বয়স তো আর কম হয়নি I এই দু’চোখে মানুষও কম দেখা হয়নি। সেই সন্ধ্যে থেকে হিসেব কষছিলেন। এই বেলা এসে হিসেব বুঝি মিলেই গেল!

দরজায় দাঁড়িয়ে শুভকে ডাকলেন ফেরদৌসী,

— “শুভ…”

— “জি আন্টি?”

— “ঘরে এসো তো বাবা!”

ফেরদৌসীর ইশারা মতে ঘরের দরজা আটকে তার পাশে বসলো শুভ।

— “ঐ ছেলেটাকে পেলে?”

— “এখনও না।”

— “বিভীষণকে বোধহয় আন্দাজ করতে পারছি।”

— “কে?”

— “নাজনীন।”

— “কী করেছে?”

— “রুদ্রের বিয়ের পর থেকে ওর আচরণে বেশ পরিবর্তন দেখছিলাম। সারাক্ষণ বিষণ্নতা, উদাসীনতা। জোর করে হাসে, কথা বলে। অনেকবছর ধরে আমার সঙ্গে আছে তো! বুঝি আমি এসব। কারণ জিজ্ঞেস করেছি, বলেনি ও কখনো। সুরভীকে নিয়ে বহুবার আমার কান ভারী করতে চেয়েছে। মেয়েটাকে আমি অনেক আদর করতাম। কিন্তু সুরভীকে নিয়ে উল্টাপাল্টা বলার কারণে ও আমার মন থেকে একটু হলেও উঠে গেছে।”

— “জেলাসী?”

— “হ্যাঁ।”

— “সকাল থেকে দেখছি ও ফোনে খুব ব্যস্ত। এখনও বাইরে কথা বলছে ফোনে। সুরভী নাকি ওকে নিয়ে শপিংমলে গিয়েছিল, আমার বিশ্বাস হয়নি। ওকে নিয়ে সুরভীর শপিংমলে যাবার প্রশ্নই আসে না। তাও আবার কাউকে না জানিয়ে!”

— “সেটাই তো! প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গেলে নাজনীনকে কেন নেবে? একাই যেত।”

— “প্রশ্ন তো এখানেই শুভ!”

এক সেকেন্ড আর দেরী করলো না শুভ। দরজা খুলে বেরিয়ে গেল বাড়ির পেছনে। একটানে নাজনীনের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিলো সে।

ভয়ে চিৎকার করে উঠলো নাজনীন। চেহারা জুড়ে তার শুধুই আতংক।

দাঁতে দাঁত চেপে শুভ বললো,

— “এত কিসের ভয় তোমার? হুঁ?”

কল লিস্ট চেক করে দেখলো হাবিবের নাম্বার, আসিফের নাম্বার। আর কিছু বুঝতে বাকি রইলো না তার। নাজনীনের চুলের মুঠি টেনে ধরলো শুভ।

— “কার জীবনে বিষ ঢালতে চেয়েছিস, জানা আছে তোর? ঢাল হয়ে এই মানুষটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আজ পাঁচবছর। হোক সেটা কারো বন্দুকের গুলি কিংবা ষড়যন্ত্র, কোনোকিছুই যেন তাকে ছুঁতে না পারে সেই কাজটাই জান প্রাণ দিয়ে করছি এতদিন ধরে। আর তুই কিনা নাকের নিচে বসে এতবড় কান্ড সেরে ফেললি?”

চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল রুদ্র। পেছনের লিভিংয়ে ততক্ষণে জড়ো হয়ে গেছে বাড়ির অন্যান্য কর্মচারীরা। ধীর পায়ে এদিকে এসে পৌঁছে গেছেন ফেরদৌসীও।

— “কী হয়েছে শুভ?”

নাজনীনের গলায় পিস্তল ঠেকালো শুভ।

— “বল কী করেছিস? নয়তো গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবো!”

হেঁচকি তুলে কাঁদছে নাজনীন। ভয়ে সমস্ত কথা হারিয়ে গেছে ওর। শুভর হাতে নাজনীনের ফোন। ওখানেই কিছু আছে হয়তো!

আন্দাজবশত শুভর হাত থেকে মোবাইল নিলো রুদ্র। কল লিস্ট দেখে চোখ

কপালে উঠে গেছে তার। ইনবক্স চেক করে পাওয়া গেছে সুরভীকে পাঠানো চারটা মেসেজ। প্রতিটা মেসেজের সারমর্ম, পুরো বাড়িজুড়ে সুরভীর নামে শুধুই ছিঃ ছিঃ চলছে। এই রটনা বাইরে রটতেও সময় লাগবে না। রুদ্র নিজ দায়িত্বে সব রটাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মা-ও! তার ছায়াও আর কেউ দেখতে চায় না। বেঁচে থাকতে এই মুখ আর সে দেখাবে কোথায়?

ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে চারটা মেসেজের মূল ভাবার্থ একটাই যেখানে পরোক্ষভাবে সুরভীকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করা হচ্ছে ঠিক যেমনটা হয়েছিল সোমার বেলায়।

চোখে সব ঝাপসা হতে লাগলো রুদ্রের। নাজনীনের গাল চেপে ধরলো সে.

— “বিনিময়ে কী দিয়েছে তোকে?”

— “বিনিময়ে শুধু আপনাকে চাই। আর কিছু না! এতগুলো বছর ধরে আপনার চোখের সামনে ঘুরছি, আপনার মাকে নিজের মায়ের চেয়ে বেশি আগলে রাখছি। আপনার পুরো সংসারের খেয়াল রাখছি, মেহমান এলে নিজে দাঁড়িয়ে আপ্যায়ন করছি। কেন করছি এতসব? শুধুই মাস শেষে টাকা পাবো বলে? না! আমি আপনাকে চাই। আপনার জন্য করেছি সব।”

পিনপতন নীরবতা নেমে এল এখানে। কেউ কোনো শব্দ করছে না। স্তব্ধ আট জোড়া চোখ চেয়ে আছে নাজনীনের দিকে। হাউমাউ করে কাঁদছে ও।

এসব কিছু পেরিয়ে রুদ্রের মনে পড়লো সুরভীর কথা। ঠিকঠাক আছে তো ও? বেঁচে আছে কি? ভয়ে বুঝি হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে এল তার। নিঃশ্বাস আটকে আসছে! নাজনীনকে দেখার সময় আপাতত ওর নেই। সুরভীর কাছে যেতে হবে। শুভর হাত টেনে ছুটলো রুদ্র।

— “জলদি সুরভীর বাসায় চলো, কিছু একটা ঘটে যাবে নয়তো!”

ফিনাইলের বোতলটা মুখে নেবার আগে আরেকবার মেসেজগুলোতে চোখ বুলালো সুরভী। যার দিকে কেউ কোনোদিন আঙুল তুলে কথা বলতে পারেনি, আজ তাকেই কিনা এতগুলো মানুষ চরিত্রহীনা বলে ধিক্কার জানাচ্ছে? আর কিছুদিন বাদে রুদ্র তালাকের নোটিশ পাঠাবে। সবার সামনে কারণ হিসেবে তাকে চরিত্রহীনাই উল্লেখ করা হবে। মা-বাবার কেমন অপমানবোধ হবে সেদিন! আর ভাবতে পারলো না সুরভী। ক্যাপ খুলে বোতলের ফিনাইল ঢেলে দিলো গলায়।

রুদ্র – ৪৫

৪৫

সুরভীর বাসার নিচে গাড়ি নিয়ে পৌঁছুতেই রুদ্র দেখলো সুরভীকে ধরাধরি করে সিএনজিতে তুলছে ওর বাবা, চাচাতো ভাইয়েরা। বিলাপ করে বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদছে সুরভীর মা।

— “আমার মেয়ে মরে গেছে। ছেড়ে চলে গেছে আমাকে!

গাড়ির ভেতর থেকে সুরভীর নিথর দেহটা দেখলো রুদ্র। সমস্ত পৃথিবী বুঝি ওখানেই শেষ তার। একটা আঙুল নাড়াবার শক্তিও আর তার নেই। গাড়ির সিটে শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দিলো সে।

বিড়বিড় করে বললো,

— “শেষ!”

মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো শুভর। দৌড়ে সে নেমে এল গাড়ি থেকে। সি এন জির কাছে যেতেই সুরভীর বাবা কঠিন হুঁশিয়ারী দিলেন তাকে,

— “দূরে থাকো। এক পা এগোবে না আমার মেয়ের কাছে।”

— “আংকেল রাগ করার সময় এটা না, উনাকে হসপিটাল নিতে হবে।”

— “মেয়েকে এই বুকে রেখে বড় করেছি, বাকি পথটাও আমিই দেখবো। সরো সামনে থেকে।”

সুরভীকে নিজের কোলে শুইয়ে সিএনজি নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন শরীফ সাহেব। আবারও গাড়িতে ছুটে এল শুভ। তাদের পিছু হসপিটাল যেতে হবে তাকে।

স্তব্ধ রুদ্রের কাঁধ চাপড়ালো শুভ,

— “ভাইয়া, বেঁচে আছে এখনো!”

শুভর কথায় মাথা তুলে বসলো রুদ্র।

— “ওর মা যে তখন বলছিল!”

— “জানি না কেন বলেছে? কিন্তু আছে এখনো। কিছু হবে না। সময়মতো পৌঁছাতে পারলেই চলবে।”

— “সত্যি করে বলো?”

— “সত্যি বলছি!”

পথ যেন আজ ফুরোচ্ছেই না! মনে প্রাণে সৃষ্টিকর্তার দুয়ারে ফরিয়াদ জানাচ্ছে সে, “কোনোদিন যদি পূণ্য করে থাকি, সেই সমস্ত পূণ্যের বিনিময়ে হলেও ওকে ফিরিয়ে দাও। ওকে ফিরতেই হবে! আমাদের সমাপ্তি এভাবে হতে পারে না। কোনোভাবেই না।”

৪৬

রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে। সুরভীর জ্ঞান এখনো ফেরেনি। পুরো রাত জায়নামাজ ছাড়েননি দুই মা। আকুল হয়ে স্রষ্টার দুয়ারে একটা প্রার্থনাই করে গেছেন, সুরভীর প্রাণ ভিক্ষা। অবজারভেশন রুমের বাইরে গোটা রাত অপেক্ষা করেছে ছয়জন মানুষ- রুদ্র, শুভ, সুরভীর বাবা, চাচা আর চাচাতো ভাইয়েরা। এক মুহূর্তের জন্যও নড়েনি কেউ। চোখের সামনে পিশাচটাকে অসহ্য ঠেকলেও সয়ে গেছেন শরীফ সাহেব। মেয়ের এই সংকটাবস্থায় বাকবিতন্ডা নিরর্থক তার কাছে। সারারাত সুরভীর মাথার কাছে বসে ছিল দু’জন ডাক্তার। ঘুমোয়নি তারাও। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নির্দেশ এসেছে তাদের উপর।

ফজরের নামাজ শেষে যখন আকাশে ভোরের আলো ফুটতে লাগলো, সেই মুহূর্তে স্রষ্টা ফিরিয়ে দিলেন সুরভীকেও। চোখ মেলেছে ও। ভেতর থেকে খবর আসতেই রুদ্র ছুটতে চাইলো সুরভীর কাছে।

তার সামনে বাঁধা হয়ে দাঁড়ালেন শরীফ সাহেব।

— “আমার মেয়ের গায়ে তোমার ছায়াও আমি দেখতে চাই না। পুরো রাত তোমাকে আমি সহ্য করেছি। আর না! চলে যাও তুমি।”

পুরো রাতের এতখানি মানসিক চাপের পর শরীফ সাহেবের এই বাঁধা অসহ্য ঠেকলো রুদ্রের। সুরভীকে দেখার জন্য মরছে সে। আর এদিকে এই লোকটা কিনা বলছে চলে যেতে! সম্পর্ক ভুলে বেঁকে বসলো সে।

— “যাবো না, এখানেই থাকবো।

রুদ্রের গালে চড় কষালেন শরীফ সাহেব। রাগে পুরো শরীর কাঁপছে তার বড্ড শীতল প্রতিক্রিয়া জানালো রুদ্র,

— “মেরেছেন? শান্তি এখন? সরুন এবার। আপনার সঙ্গে এই মুহূর্তে সিন ক্রিয়েট করতে ভালো লাগছে না আমার। সুরভীর কাছে যাবো আমি।”

— “তোকে ওর জীবনে আবার দেখার চেয়ে ওর মৃত্যু মেনে নেয়া সহজ আমার কাছে।”

নিজের কন্ঠনালীতে আঙুল চেপে ধরলো রুদ্র। চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে তার। শরীফ সাহেবের মুখের কাছাকাছি ঝুঁকলো সে,

— “আপনার মেয়েকে দেখার জন্য এইখানে নিঃশ্বাস আটকে আছে আমার। কেমন যন্ত্রণায় আছি বুঝতে পারছেন আপনি? বাড়াবাড়ি করবেন না। নয়তো তান্ডব হবে আজ!”

এগিয়ে এল শরীফের সাহেবের ছোট ভাই। কানে কানে বললো,

— “ও মানুষ সুবিধার না। ভেতরে যেতে দিন। আমাদের মেয়ে এখনো অসুস্থ, এটা আমাদের মাথায় রাখতে হবে। নতুন করে ওর উপর চাপ পড়বে এমন কিছু করা যাবে না।”

থেমে গেলেন শরীফ সাহেব।

রুমে ঢুকেই ডাক্তারদের বেরিয়ে যেতে ইশারা করলো রুদ্র। সুরভীর পাশে এসে বসলো সে। সুরভীর হাত টেনে নিজের গালে মেশালো। তার চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে সুরভীর হাত। চোখ মেললো সুরভী। নিস্তেজ চোখ জোড়া রাজ্যের সমস্ত শীতলতা নিয়ে চেয়ে আছে তার চোখে। ওর চাহনী বুকে বিঁধলো রুদ্রের। মুখে কিছু না বলেও কত কী বলে দিচ্ছে ওর চোখ দু’টো।

কাঁপা স্বরে সে বললো,

— “এভাবে তাকিও না প্লিজ! ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছি আমি।”

ম্লান হাসলো সুরভী।

— “নোংরা চেহারাটা দেখতে এসেছো রুদ্র?

সুরভীর মাথার কাছ থেকে সরে ওর পায়ে মুখ গুঁজলো রুদ্র। ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে। খানিকবাদে পা সরিয়ে নিলো সুরভী। কথা বলতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওর। তবুও নিজের সঙ্গে জোর করেই বললো,

— “চলে যাও রুদ্র।

— “যাবো না আমি।”

— “আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমাকে তুমি আর দেখতে চাও না। আমি সেটা মেনেই বেরিয়ে এসেছি। তোমার সামনে আমি এক মুহূর্তের জন্যও দাঁড়াতে চাই না। তোমাকে এই নোংরা চেহারা দেখানোর চেয়ে মরে যাওয়া সহজ!”

শ্বশুরের কথার পুনরাবৃত্তিই করলো তার স্ত্রী। যে কথা শুনে শ্বশুরের উপর সে চড়াও হয়েছিল, সেই একই কথায় পুরো পৃথিবীটাই যেন অন্ধকার হয়ে এল তার। সুরভীর কণ্ঠের শীতলতা, এভাবে মুখ ফিরিয়ে কথা বলা, স্পষ্ট তাকে জানান দিচ্ছে সে তাকে আর চায় না। চিরতরে সরে যেতে চাইছে তার কাছ থেকে।

সুরভীর কাছে উঠে এল রুদ্র। ওর গলায় মুখ গুঁজে কাঁদছে ভীষণ।

ফোঁপাতে ফোপাঁতে সে বললো,

— “তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে সুরভী? তুমি আমাকে দূরে ঠেলে দিলে আর কোথায় যাবো আমি? কে আমাকে সামলাবে?”

— “দূরত্ব তুমি চেয়েছো।”

— “মাফ করে দাও না! আমার মাথা কাজ করছিল না তখন! তুমিই না বলো আমাকে ভালোবাসো। আমি না বলতেই আমার সব কথা তুমি বুঝে ফেলো! আমি কেন এমন করলাম একটু বুঝে নাও প্লিজ! এবারের মতো আমাকে মাফ করো।”

— “আমি তোমাকে আর চাই না। এক মুহূর্তের জন্যও না। তুমি চলে যাও।” দুর্বল শরীরে অবশিষ্ট সমস্ত শক্তি দিয়ে রুদ্রকে ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইলো সুরভী। ওর হাত যতটা না ভারী ছিল তারচেয়ে বেশি ভারী লাগলো ওর অভিমান, ঘৃণা ভরা প্রত্যাখ্যান। ঝাপসা চোখে ওর দিকে তাকালো রুদ্র। সত্যিই তাকে আর সুরভী চাইছে না। তার উপস্থিতি, স্পর্শ সুরভীকে কেমন ভোগাচ্ছে তা সুরভীর চেহারায় স্পষ্ট পড়তে পারছে রুদ্র।

শেষবারের মতো তবুও একবার জানতে চাইলো সে,

— “সত্যিই আর চাও না আমাকে? একেবারে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছো তুমি?”

— “চাই না। আমাকে মুক্ত করো এবার।”

স্তব্ধ হয়ে সর্বহারার মতন রুদ্র চেয়ে রইলো সুরভীর দিকে। আজকের এই দিনটা, এই মুহূর্তটা কি মৃত্যু যন্ত্রণাকেও হার মানাচ্ছে না?

অসুর রূপে বেরিয়ে এল রুদ্র। ভেতরে ফেলে এল তার আরেক সত্ত্বাকে যার মাঝে এখনও ভালোবাসা, মায়া, আবেগ, বিবেক বিদ্যমান। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে রুদ্র শুভকে বললো,

— “কাল সকালের মধ্যে দু’টো লাশ আমার চাই।”

— “হয়ে যাবে।”

— “সুরভী আমাকে আর চায় না।”

— “যা কিছু ঘটেছে উনার জন্য কঠিন ছিল, সময় দিন। আস্তে ধীরে সামলে নেয়া যাবে সব।”

— “পারবো না। সুরভীর চোখে আমার জন্য ঘৃণা দেখেছি আমি। ওর চোখে ঘৃণা সয়ে প্রতি মুহূর্তে মরার চেয়ে, একেবারে মরে যাওয়া ভালো। কিন্তু আমি তো মরতে চাই না শুভ। ওকে নিয়ে আরো বহুবছর বাঁচার আছে আমার!”

— “সব হবে। ধৈর্য্য ধরতে হবে কিছুদিন।”

— “আজ একটু আগে যা দেখেছি, যা শুনেছি তারপর আর একদিনও অপেক্ষা করবো না আমি। আমার সুরভীকে আমি আমার সঙ্গে চাই, আজই চাই ব্যস! কাল সকালের সূর্য ওকে ছাড়া আমি দেখতে চাই না।”

— “জোর করতে গেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হবে।”

— “জোর কে করবে? কেউ জোর করবে না ওকে। ও ফিরবে ওর নিজের ইচ্ছেতে।”

— “কিভাবে?”

জবাব দিলো না রুদ্র। গাড়িতে বসেই ইকবাল মাহমুদ আর রাষ্ট্রপতি সাইফুল ইসলামকে কল কনফারেন্সে নিয়ে এল সে।

৪৭

গালে হাত রেখে বসে আছেন রাষ্ট্রপতি। অপেক্ষায় আছেন প্রধানমন্ত্রী আপত্তি জানাবেন সেই আশায়। অথচ তাকে চমকে দিয়ে ইকবাল মাহমুদ পুরো পরিকল্পনায় সায় দিয়ে দিলেন।

হতাশ ভঙ্গিতে তিনি রুদ্রকে বললেন,

— “বয়স হয়েছে। চোখের সামনে নয়জনকে গুলি করে ঝাঁঝরা করা হবে, সেটা দেখে সুস্থ থাকা সম্ভব না।”

ভ্রু কুঁচকালো রুদ্র।

— “যুদ্ধ করেছেন, গুলিও খেয়েছেন। ছাত্র রাজনীতি করা কালীন সময়ে গোলাগুলিও করেছেন।”

— “তখন রক্ত গরম ছিল। এখন তো বয়স হয়েছে রে বাবা। আমাকে এই প্ল্যান থেকে বাদ দাও না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে আনো। ওর বুকভরা সাহস।”

— “আপনাকেই লাগবে।”

প্রধানমন্ত্রী বললেন,

— “প্ল্যান যা করছে একটু ভয়ংকর বটে, তবে ব্যাপার না। দু’চারটা কেউটে মারতে গেলে একটু দুঃসাহস দেখাতেই হয়। আমারই ভুল হয়েছে। পানি মাথায় চড়ার আগেই সামলানো উচিত ছিল।”

— “চাইলে ওদেরকে বাসা থেকে তুলে এনে টুকরো করে সমুদ্রে গায়েব করে দিতে পারতাম। কিন্তু তাতে আমার বউ তো ফিরে আসবে না।”

হাসলেন রাষ্ট্রপতি। ইকবাল মাহমুদের পিঠে খোঁচা মেরে বললেন,

— “এই ছেলে যখন ছোট ছিল, গিয়েছিলাম ওদের বাড়ি। দেখি রোমান্টিক গানে তাল মিলিয়ে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হেলেদুলে হাঁটছে। তখনই ওর বাবাকে বলেছিলাম, এই ছেলে বড় হয়ে মজনু হবে। আশরাফ আমাকে পাত্তাই দিলো না! হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। বেঁচে থাকলে ওকে বলতাম, ভুল হয়েছে আমার। তোমার ছেলে মজনু না, মজনুর বাপ হয়েছে!”

ফিক করে হেসে ফেললেন ইকবাল মাহমুদ।

— “গুরুতর মুহূর্তে আপনার রসিকতার স্বভাব গেল না সাইফুল ভাই!”

কপাল থেকে ভাঁজ সরছে না শুভর। জীবনে ভয়ংকর কত কান্ড একাই সামলেছে সে। অথচ আজ জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর দায়িত্বটাই যে রুদ্র সঁপে দিলো তার হাতে!

বোঝার সুবিধার্থে পুরো পরিকল্পনা আবার আউরাতে লাগলো রুদ্র,

— “আবার বলি, মন দিয়ে শুনুন। হাবিব আর আজগর দু’জনকেই ইকবাল আংকেল কল করবে। আমি নেগোশিয়েট করতে চাচ্ছি সেই বাহানায় আজগরের নরসিংদীর ফার্ম হাউজে দেখা করতে বলবে। মন্ত্রী পরিষদ নিয়ে আলোচনার কথা বললে ওরা কখনোই ইকবাল আংকেলের ডাক ফেরাবে না। কারণ ওদের ডিমান্ডই মন্ত্রীত্ব। তার উপর সঙ্গে থাকবে সাইফ আংকেল। ওদের বারণ করার প্রশ্নই আসে না। আমরা সবাই যাবো সেখানে। যার যার বডিগার্ডও থাকবে সেখানে উপস্থিত। হাবিব আর আজগরের সঙ্গে এখন শুধু একজন করে বডিগার্ড থাকে। দু’জনের সঙ্গে আমার বডিগার্ড সুমনকে পাঠাবো বাইরে খাবার, হার্ড ড্রিংকস এসব আনতে। এই কাজটা করবে ইকবাল আংকেল। ওরা বেরিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত একেবারেই বুঝতে দেয়া চলবে না পরিস্থিতি সেখানে কী হতে যাচ্ছে। ওরা বেরিয়ে যাবার পর এনকাউন্টার লিস্ট থেকে বাছাই করা সাতজন জঙ্গিকে বাড়ির ভেতর ঢুকানো হবে। তারপরই কল যাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। আমাদের জিম্মি করা হয়েছে। মুক্তিপণ হিসেবে তারা ইকবাল মাহমুদের ক্ষমতা হস্তান্তর চায়। সেইসঙ্গে মিডিয়ার কানেও খবর পৌঁছানো হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রেস কনফারেন্স করবেন। সেখানে তিনি জানাবেন হাবিব আর আজগর জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সংযুক্ত। তাদের হাতেই আমরা এখন জিম্মি। সবশেষে দেখানো হবে পুলিশ এবং র‍্যাবের সম্মিলিত অভিযানে ওরা নয়জন স্পটডেড এবং আমি জঙ্গীদের গুলিতে আহত।”

— “ঐ নয়জনকে শ্যুট করবে মূলত কারা?”

— “আজগর, হাবিবকে অবশ্যই আমি। বাকিদের প্রশাসন, আর আমাকে শুভ।” আপত্তি জানালো শুভ।

— “আমাকে দিয়ে হবে না ভাই। র‍্যাব, পুলিশ যাকে দিয়ে ইচ্ছে হয় করান। আমাকে বাদ দিন।”

— “মেরে ফেলতে বলিনি শুভ, গুলি করতে বলেছি শুধু।”

— “এটাই কেন হতে হবে? অন্য কোনো উপায় কি নেই?”

— “গুরুতর অপরাধের জন্য গুরুতর শাস্তি। আমি যা করেছি ধরে নাও তারই প্রায়শ্চিত্ত!”

রুদ্রের দিকে চেয়ে রইলেন ইকবাল মাহমুদ। বললেন,

— “তোমার এই রূপ দেখার ভাগ্য হবে ভাবিনি কখনো! এই গল্পটা আমার মেয়েদের খুব শোনাতে ইচ্ছে করবে। কিন্তু আফসোস, ওদের আমি কিছু জানাতে পারবো না। তবে রুদ্র, মা সবসময় একটা কথা বলতো- নারী এমন জাত, চাইলে পুরুষকে বাদশাহ করতে পারে, আবার রাস্তার মিসকিনও করতে পারে। আজ কথার সত্যতা দেখছি। একটা মেয়ের জন্য রুদ্র কিসব ঘটিয়ে ফেলছে!”

— “আপনি ইকবাল মাহমুদের কাছে আমি কোনো সুখ পাই না। পাই শুধু টেনশন আর স্ট্রেস। তবুও কত কী করছি! ঐ মেয়েটা আমার জীবনে স্বর্গ নামিয়ে এনেছে, ওকে ধরে রাখার জন্য যত যাই করি সবই তুচ্ছ। এবার যান, আপনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সব বুঝিয়ে দিন। আজগর, হাবিব সামলান। আমি প্রশাসন দেখছি। কালকের সূর্য কোনোভাবেই আমি আমার সুরভীকে ছাড়া দেখবো না। এটাই ফাইনাল!”

৪৮

গুলিতে ঝাঁঝরা হওয়া লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফার্মহাউজের এখানে সেখানে। বাড়ির বাইরে অপেক্ষা করছে মিডিয়া, ফায়ার সার্ভিস আর পুলিশ, র‍্যাবের কয়েকটা ফোর্স। পেছনের দরজা দিয়ে ভেতরে পৌঁছেছে র‍্যাবের স্পেশাল ফোর্স। ভেতরে চলছে তুমুল গোলাগুলি। কে বাঁচবে, কে মরবে বাইরের কারো জানা নেই সেই কথা। গোটা দেশের মানুষ চেয়ে আছে টিভির স্ক্রিনে। ঘন্টাখানেক আগে খবর পেয়ে অসুস্থ শরীর নিয়েই হসপিটাল ছেড়ে রুদ্রের বাড়ি চলে এসেছে সুরভী। মা এখানে একা। এই মুহূর্তে আপনজনের সঙ্গ ভীষণ জরুরী! সুরভীকে পেয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েছেন ফেরদৌসী। বারবার গতকাল ঘটে যাওয়া ঘটনা আওড়াচ্ছেন। তার ছেলে ভুল বুঝতে পেরেছে, কষ্ট পাচ্ছে সে কথা বারবার বলছেন। দু’চোখ বেয়ে পানি ঝরছে সুরভীর। শাশুড়ীর হাত চেপে অধীর অপেক্ষায় চেয়ে আছে সে টিভির স্ক্রিনে। রুদ্র বেঁচে ফিরবে তো? গতকাল প্রচন্ড অভিমানে বলা কথাগুলো সত্যি হয়ে যাবে না তো? দূরে চলে যাবে না তো ও?

— “টাইম ওয়েস্ট হচ্ছে। শ্যুট মি, শুভ।”

হাত কাঁপছে শুভর। বুক ঢিপঢিপ করছে ইকবাল মাহমুদেরও।

— “আমাকে দিয়ে হবে না।”

— “আমাকে মুমূর্ষু অবস্থায় না দেখলে সুরভী গলবে না। বুঝতে পারছো না কেন?”

— “হচ্ছে না। সত্যিই!”

— “ধুর!”

ছোঁ মেরে শুভর হাত থেকে পিস্তল কেড়ে নিলো রুদ্র। নিজের বুক আর কাঁধের মাঝামাঝি গুলি করে নিজেকেই রক্তাক্ত করলো সে।

দশমিনিট বাদে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রেসকিউ টিম।

দলের প্রধান ছোট্ট করে ক্যামেরার সামনে জানিয়ে গেলেন,

— “অপারেশন সাকসেসফুল। সাবেক মন্ত্রী আজগর এবং হাবিবসহ জঙ্গী সদস্য প্রত্যেকে স্পর্টডেড। ভেতরে জিম্মি ব্যাক্তিরা সুরক্ষিত আছেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা শাহরিয়ার মির্জা ছাড়া। তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।”

মিডিয়াকে আর কোনো প্রশ্নের সুযোগ না দিয়েই ভেতরে চলে গেলেন রেসকিউ টিম হেড। হেলিকপ্টার উপস্থিত হয়েছে ফার্মহাউজের পেছনের মাঠে। তাতে করেই ঢাকায় পৌঁছানো হবে আহত রুদ্র, প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতিকে।

টেলিভিশনে লাইভ চলছে পুরো দৃশ্য। পুলিশ এবং র‍্যাবের কড়া নজরদারি পেরিয়েও দু’একজন ক্যামেরাম্যান নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টায় পুরো দৃশ্য সরাসরি পৌঁছে দিচ্ছে টিভির পর্দায়। কান্নায় ভেঙে পড়লো সুরভী। ফেরদৌসীকে আঁকড়ে চিৎকার করে সে বলছে,

— “ওর কাছ থেকে দূরে যেতে চেয়েছিলাম। ওর মৃত্যু তো আমি চাইনি মা! ও ফিরবে তো?”

রুদ্র – ৫০

৪৯

সুরভীর জীবনের সবচেয়ে কুৎসিত রাতটা কেটেছে গতকাল। নিজের অসুস্থতা ভুলে গোটা রাত বসে ছিল এই আই সি ইউ তে। রুদ্রের পাশে।

শুভ বলছিল, “জ্ঞান ফেরার আগ পর্যন্ত শুধু আপনাকে এক নজর দেখার মিনতি করেছে মানুষটা।”

সেই থেকে একবারের জন্যও রুদ্রের পাশ থেকে নড়েনি সুরভী। অস্থির হয়ে চেয়ে ছিল রুদ্রের দিকে। কখন জ্ঞান ফিরবে তার? কখন হবে আবার তাদের দেখা, কথোপকথন?

সাত ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো রুদ্রের। চোখ মেলেই সে দেখতে পেলো সুরভীকে। সে ছুটে গিয়ে ডাক্তারকে ডাকতে যাচ্ছিল, তার হাত টেনে আটকালো রুদ্র।

— “বসো এখানে।”

— “ডক্টরকে আসতে বলি, এখনই একবার চেকআপ করতে হবে তো!”

— “কিচ্ছু লাগবে না আমার। তুমি বসো কিছুক্ষণ আমার পাশে।”

মাথা নিচু করে বসে রইলো সুরভী। ঠোঁট চেপে কাঁদছে ও। – “আমাকে মাফ করেছো তুমি?”

— “কিসব বলছো তুমি! এখনও এসব কথা বলা জরুরি?”

— “হ্যাঁ জরুরি। গায়ে শ’খানেক বুলেট সয়েও বেঁচে ফিরতে পারবো আমি। তবে তোমার অভিমান, প্রত্যাখ্যান নিয়ে এক মুহূর্তও না। মরে যাবো আমি সুরভী!” রুদ্রের হাত বুকে জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সুরভী।

— “আমি ভেবেছিলাম তুমি আর ফিরবে না। আমাদের আর দেখা হবে না। আমি গতকাল যা কিছু বলেছি, সব সত্যি হয়ে যাবে।”

— “বলো না ক্ষমা করেছো আমাকে?”

— “না করলে বসে বসে কাঁদছি কেন আমি? এই সাতঘন্টা বসে আছি কেন তোমার পাশে।”

— “সেজন্যই ফিরে এসেছি। এখনও ভালোবাসো, এখনও আমাকে চাও তাই বেঁচে আছি। নয়তো সত্যিই মরে যেতাম। অসুর কখনো অসুরের অস্ত্রে মরে না সুরভী, অসুর মরে দেবীর আঘাতে। আজগর আমাকে মারতে পারবে না। মারতে পারবে তুমি। তোমার ভালোবাসা না পেলেই আমি মরে যাবো।”

রুদ্রের হাতের উপর মাথা রেখে কাঁদছে সুরভী। বুকের উপর ব্যান্ডেজে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ও। চোখ বুজে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে রুদ্র। জীবন থেকে বিশ্রী এক অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো। হয়তো সুরভীকে ঠকিয়েছে সে মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে। তাতে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই তার। সুরভীকে নিজের করে রাখতে, আজীবন ওর ভালোবাসায় ঠাঁই পেতে সব করতে পারবে সে, সব! হোক তা ছলচাতুরী, মিথ্যা কিংবা খুন! তাতে কোনোদিনও অনুশোচনা হবে না তার।

৫০

ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট রেখে লাইটার খুঁজছিল রুদ্র। হঠাৎ কোথা থেকে সুরভী লাইটার হাতে এসে সিগারেটটা জ্বালিয়ে দিলো। মুচকি হাসলো রুদ্র।

— “জীবনটা স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে বুঝলে? না চাইতেই সবকিছু হাতের সামনে এনে হাজির করো। কখন কী চাই বুঝে ফেলো। আ’ম টুলি ব্লেসড। নয়তো কারো বউ এভাবে লাইটার খুঁজে এনে সিগারেটে আগুন ধরিয়ে দেবে নাকি?”

ভেংচি কাটলো সুরভী।

— “তোমার ঢঙ যতসব!”

পাশেই শুভ বসে আছে। মুখ আড়াল করে হাসছে সে। রুদ্রের ভীষণ ঘনিষ্ঠ হবার সুবাদে এই দম্পতিকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ মেলে তার। সুরভীর প্রশংসায় কোনোদিন কার্পণ্য করে না এই মানুষটা। ভালোবাসতেও না। নিজ অনুভূতির সবটা নিংড়ে দিয়েছে সে সুরভীর ঝুলিতে। ভালোবাসা প্রকাশেও নেই তার লোকলজ্জার ভাবনা। ঘরভর্তি লোকের মাঝে বসেও সামনে উপস্থিত স্ত্রীর মাঝে পুরোপুরি খুইয়ে যেতে পারে বোধহয় এই লোকটাই। গালে হাত রেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সে শুনতে থাকে তার স্ত্রীকে, এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে স্ত্রীর দিকে। আশপাশে কে কী বলছে সেসব আর তার কানে কিছু ঢোকে না। সুরভীকে সে দেখতেই থাকে, দেখতেই থাকে। কারণে অকারণে সবার সামনে ভালোবাসি বলতেও এতটুকুন দ্বিধা নেই তার। এমনকি কথা বলার প্রিয় বিষয়ও সুরভীই। বাইরের জগতে স্বল্পভাষী এই লোকটাও মুখরা হয়ে উঠে আলাপের মাঝে সুরভীর প্রসঙ্গ এলে। তাকে নিয়ে রুদ্র বলেই চলে ক্লান্তিহীনভাবে। এই মানুষটাকে এখন আর মন খারাপ করতে কিংবা মানসিক চাপে সব ছেড়ে লুকিয়ে থাকার জন্য অস্থির হতে দেখা যায় না। রাত জাগার ছাপ চেহারায় বুঝা যায় না। গুনগুনিয়ে গান গাইতে শোনা যায়, প্রাণখুলে হাসতে দেখা যায়। প্রচন্ড একাকী জীবনটার জন্য সঙ্গী পেয়েছে সে। জীবনে ছন্দ ফিরে এসেছে, স্বস্তি এসেছে। রুদ্রের এইসব সুখের দিনগুলোর সাক্ষীই তো শুভ হতে চেয়েছিল এতগুলো বছর ধরে!

রুদ্রের ঘরে বসে এতটা সময় ধরে টিভিতে চোখ ডুবিয়ে রেখেছিল রুদ্র আর শুভ। রুদ্রের সঙ্গে দু-চারটে আলাপ শেষে সুরভী পেছন ফিরতেই দেখলো টক শো চলছে টিভিতে। আলোচনার বিষয়বস্তু আজগর। স্টেজের ব্যাকস্ক্রিনে আজগরের ছবি ভাসছে। দেখেই বিরক্তিতে চেহারা কুঁচকে গেল সুরভীর। রিমোট হাতে নিয়ে তক্ষুনি টিভি অফ করে দিলো সুরভী।

— “এই অমানুষটাকে এত মন দিয়ে দেখার কী আছে? ওর হাতে গুলি খেয়ে সাধ মেটেনি? আরো দেখতে হবে ওকে?”

— “ভাগ্যিস গুলি করেছিল। নয়তো ফিরতে নাকি আমার কাছে?”

বেরিয়ে গেল সুরভী। একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো রুদ্র আর শুভ। কেউ কিছু উচ্চারণ করলো না। ঠোঁট চেপে হাসলো শুধু।

পুরো বাড়ি সাজানো হচ্ছে। আসছে শুক্রবার সুরভী রুদ্রের রিসিপশন। আর চারদিন পর থেকে শুরু হবে বিয়ের সব রীতি-অনুষ্ঠান। বাড়ির কোথায় কিভাবে সাজানো হবে তা পুরো বাড়ি ঘুরে নির্দেশনা দিচ্ছে সুরভী নিজেই। ওদিকটা দেখতেই রুম থেকে বেরুলো ও। শুভ চেয়ে রইলো সুরভীর চলে যাবার পথে। রুদ্র যতটা প্রকাশ করে তার চেয়ে বেশি মরে তার জন্য, সেই আবগেটুকু কি উনি অনুভব করতে পারে পুরোপুরি? তাদের বিয়ের দিন ইকবাল মাহমুদ বলেছিল, এই মেয়ের জন্য রুদ্র প্রয়োজনে মাথা নোয়াবে, প্রয়োজনে মাথা কেটে আলাদাও করবে। ষোলোআনা সত্যি ছিল সে কথা! তাকে ফিরে পাবার জন্য রুদ্র কত কী যে ঘটালো, নিজেকে কেমন শাস্তি দিলো তার অজান্তে, সে কথা আজীবন রুদ্রের রানির অজানাই থাকবে! স্রষ্টার আশীর্বাদপুষ্ট কি শুধু রুদ্রই? সুরভীও তো! নয়তো এত ভালোবাসা, এতখানি আগলে রাখা, আঁকড়ে ধরা সবার ভাগ্যে জোটে নাকি?

(সমাপ্ত)

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(60)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!
Do you have any doubts? chat with us on WhatsApp
Hello, How can I help you? ...
Click me to start the chat...