বাংলা উপন্যাসে গণিকা – প্রীতিলতা রায়

KhoriBona


বাংলা উপন্যাসে গণিকা – প্রীতিলতা রায়

বাংলা উপন্যাসে গণিকা – প্রীতিলতা রায়

প্রথম প্রকাশ – বইমেলা, ২০২১

আমার জীবনের পথনির্দেশক
সম্মানীয় প্রফেসর
দীপককুমার রায় মহাশয়ের করকমলে

.

ভূমিকা

‘বাংলা উপন্যাসে গণিকা’ বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন প্রীতিলতা রায়৷ সন্দেহ নেই বিষয় হিসেবে এটি মোটেই সহজসাধ্য, সাধারণ নয়৷ প্রথমেই এমন একটি বিষয় নির্বাচন করার জন্য গবেষিকাকে অভিনন্দন জানাই৷ এই ধরণের বিষয় নিয়ে গবেষণা করলে সমাজ জীবনের বিবর্তন, সমাজের নীতিবাগীশতার আড়ালে দুর্নীতি, অসমদৃষ্টি, প্রান্তিক মানুষের উপর নানা ধরণের নিপীড়নকে আলোচনার বাইরে রাখলে চলে না৷ গবেষকের সমাজদৃষ্টি স্বচ্ছ ও সহানুভূতিশীল হওয়া খুবই প্রয়োজন৷ প্রীতিলতা তাঁর পরিশ্রমী তথ্যনিষ্ঠ গবেষণায় মানবতাবোধকে মিলিয়ে নিয়েছেন—এখানেই এই গবেষণাগ্রন্থের স্বাতন্ত্র্য৷

গণিকাবৃত্তির ইতিহাস অতি প্রাচীন, সমাজ, পরিবার, ধর্মীয় অনুশাসন সবই যখন পুরুষের করতলগত হয়ে পড়ল, পিতৃতন্ত্রের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে নারীর অবস্থান হীনতর হয়ে গেল৷ এঙ্গেলসের বিখ্যাত বিশ্লেষণ সবাই জানেন, ‘the woman was degraded and reduced to servitude, she became the slave of [the man’s] lust and a mere instrument for the production of children.’ গণিকার সম্পর্ক রইল পুরুষের সম্ভোগ ও চিত্ত বিনোদনের সঙ্গে৷ প্রীতিলতা ইতিহাসটি সংক্ষেপে তুলে এনে ভারতে গণিকাবৃত্তির বিবর্তনরেখাটি তুলে এনেছেন৷ এইসূত্রে তিনি প্রাচীন থেকে মধ্য হয়ে আধুনিককাল পর্যন্ত কী কী নামে এই নারীরা পরিচিত হয়ে চলেছেন তার তথ্যপূর্ণ বিবরণ সংযুক্ত করেছেন৷ স্বভাবতই তাঁর কলমে বিশেষ স্থান করে নিয়েছে দেবদাসীপ্রথা, সেবাদাসী সম্ভোগ—একেবারে আধুনিক কাল পর্যন্ত তিনি এইসব বহু প্রচলিত প্রথার শিকড় সন্ধান করেছেন৷

নারীকে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পাত্রস্থ করাই যখন শাস্ত্রের নির্দেশ ছিল, তখন রাষ্ট্রের ব্যয়ে নানাবিধ বিদ্যা ও চৌষট্টিকলায় পারঙ্গমা করে তোলা হত গণিকাদের৷ তার কারণ কর্মক্লান্ত পুরুষকে সঙ্গদানে আনন্দিত করার ক্ষমতা যেন তাদের থাকে৷ যৌবন অপগত হলে অবশ্য কানাকড়িও দাম পেত না তারা৷ প্রীতিলতা ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের চমৎকার বিশ্লেষণ করেছেন৷ বসন্তসেনার দুর্লভ সৌভাগ্যের পাশে চারুদত্তপত্নী ধূতার অসহায় সামাজিক অবস্থান তাঁর চোখ এড়িয়ে যায়নি৷ মহাকাব্য, পুরাণ, বৌদ্ধসাহিত্য, নাটক—সাহিত্যের ভিন্ন ভিন্ন ধারাতে চিত্রিত গণিকাচরিত্র থেকে তিনি সমাজঅন্বেষার একটি ধারাবাহিক ভাষ্য রচনা করেছেন৷ প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের আলোচনাসূত্রে অত্যন্ত দক্ষভাবে বিভিন্ন শব্দের আদি উৎস নির্দেশ গবেষণাগ্রন্থের মর্যাদা বাড়িয়েছে৷

প্রীতিলতা বিশেষ জোর দিয়েছেন উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্যে গণিকা চরিত্রচিত্রণে৷ নতুন গড়ে ওঠা শহরে বিভিন্ন বৃত্তিজীবীর সঙ্গে গণিকাবৃত্তিধারিণীদেরও পল্লী গড়ে উঠতে দেরি হয়নি৷ বিভিন্ন নকশা, প্রধান এবং অপ্রধান উপন্যাসে পতিতা চরিত্রচিত্রণ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, বালবৈধব্য, কৌলীন্যপ্রথা এবং পিতৃ ও স্বামীগৃহের সম্পত্তিতে অধিকার না থাকার ফলে অভাবের তাড়নায় কিশোরী ও যুবতী মেয়েদের কীভাবে নিছক বেঁচে থাকার জন্য দেহব্যবসা গ্রহণ করতে হত৷ উনিশ শতকের নবজাগরণের আলোকছটার পাশে অবক্ষয়ী বাবুসমাজ প্রকাশ্যে কীভাবে বারাঙ্গনাপ্রীতিকে সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি করে তুলল তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা গ্রন্থটিতে আছে৷ তুলনায় কম আলোচিত উপন্যাসসমূহ ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’, ‘এলোকেশী বেশ্যা’, ‘চন্দ্রা’, ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’, ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’, চৌদ্দ আইনের প্রতিক্রিয়ায় লেখা ‘স্বর্ণবাই’ উপন্যাস বিস্তৃতভাবে আলোচনা করে প্রীতিলতা জরুরি একটি কৃত্য সম্পাদন করেছেন৷ গণিকাদের প্রতি মূলধারার মানুষের দৃষ্টিকোণকে এইসব গ্রন্থে লেখকরা নানাভাবে উপস্থাপিত করেছিলেন৷

সমাজের সীমান্তে অবস্থিত এই নারীরা বিংশ শতাব্দীর বাংলা উপন্যাসে বাস্তবতার শর্তপূরণ করে বহুল সংখ্যায় দেখা দিয়েছে৷ নীতিবাগীশের নাসিকা কুঞ্চনের বদলে তাদের অবস্থার প্রতি মানবিক দরদের পরিচয় দিয়েছেন লেখকরা৷ প্রীতিলতা বিংশশতাব্দীর সম্পূর্ণ পরিসর আলোচনায় আনতে পারেননি গ্রন্থের আয়তন বেড়ে যাবার ভয়েই হয়তো৷ তবে প্রধান উপন্যাসগুলি প্রায় সবই তাঁর আলোচনায় এসেছে৷

গবেষণা গ্রন্থটির সবথেকে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল প্রীতিলতা পতিতাদের সার্বিক দুরবস্থার কথা কখনো বিস্মৃত হননি৷ বস্তুত তাঁর গবেষণার প্রধান লক্ষ্যই হল গণিকাদের অবহেলিত, প্রান্তিক জীবনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা৷ বহুবছর আগে সিমোন দ্য বোভোয়া তাঁর বিখ্যাত ‘দি সেকেন্ড সেক্স’ গ্রন্থে পতিতাজীবনের সংকটগুলির অসামান্য বিশ্লেষণ করেছিলেন,


‘It is not their moral and psychological station that makes the prostitutes’ lot hard to bear. It is their material condition that is more often deplorable. Exploited by their pimps and their madams, they live in a state of insecurity and threefourths of them are penniless. After five years of the life, about seventy-five percent have syphilis,… Inexperienced minors, for example are fearfully susceptible to infection. ….Common prostitution is a miserable occupation in which women exploited sexually and economically, subjected arbitrarily to the police, to a humiliating medical supervision, to the caprices of the customers, and doomed to infection and disease, to misery, is truly abased to the level of a thing.’


প্রীতিলতার গবেষণাগ্রন্থ এই নির্মম জীবনযাত্রাকে বারবার প্রেক্ষণে নিয়ে আসে৷ শুধু সাহিত্য নয় সমাজতত্ত্বের দিক দিয়েও তাঁর এই পুস্তক যথার্থ মূল্যবান হয়ে উঠেছে৷ গণিকাবৃত্তির বিলোপসাধন অথবা তাঁদের জীবনযাপনের উন্নতিসাধন—কোনদিকে মন দেওয়া উচিত, গ্রন্থটি সেই ভাবনা উসকে দেয়৷ মানবাধিকার কর্মীরা বর্তমানে এই পেশা যাতে ন্যূনতম মর্যাদা পায় তা নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন৷

ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, গণিকারা অনেকেই সন্তানলাভ করেন৷ প্রীতিলতার গবেষণায় সমাজ কর্তৃক অবহেলিত এই পুত্রকন্যাদের প্রসঙ্গ এসেছে৷ ‘বাংলা উপন্যাসে গণিকা’ পড়বার সময় একটি অনতিপরিচিত বইয়ের কথা মনে পড়ে গেল৷ ‘যৌনকর্মীদের জীবনসত্য’ বইটি লিখেছিলেন মৃণালকান্তি দত্ত৷ তিনি গোপন করেননি যে তিনি একজন যৌনকর্মীর সন্তান৷ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মন্থন করে মৃণাল গণিকাজীবনের আলোআঁধারির অসামান্য ডকুমেন্টেশন করেছিলেন৷ আজ বইটি বিস্মৃত৷

সামাজিক ছুঁৎমার্গ এখন অনেক প্রশমিত৷ গণিকাদের মানবীরূপে দেখে, মূল্য দিয়ে, তাঁদের জীবনের সমস্যাগুলি সমাধানের একটি সৎচেষ্টা দেখা দিচ্ছে৷ প্রীতিলতা রায়ের বইটি তথ্যসংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও সত্যপ্রতিষ্ঠার জোরে পাঠকের অনুরাগধন্য হবে এই আশা রাখি৷

নমস্কার

গোপা দত্তভৌমিক
প্রাক্তন উপাচার্য, গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়
৫ই ডিসেম্বর ২০২০

Book Content👉

১. প্রাককথন

প্রাককথন

নারীকে ভোগ করার বাসনা সমাজের চিরকালের৷ পুত্র উৎপাদনের জন্য যেমন সমাজ পিতারা ‘বিবাহ’ নামক স্বীকৃতি প্রদান করে বৈধভাবে নারীকে ভোগ করেছে তেমনি নির্বিচারে বহুনারী ভোগ করার জন্য তাদের এক শ্রেণীকে গণিকা হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে৷ অপমান-লাঞ্ছনায় জর্জরিত করে ধীরে ধীরে সমাজের একেবারে প্রান্তসীমায় ছুড়ে দিয়েছে৷ সময়ের প্রবহমান ধারায় সেই ভোগের পথ হয়েছে আরও মসৃণ ও সুগম৷ কত নাম নারীর; কত তার অভিধা৷ সতী, অসতী, কলঙ্কিনী, ব্যভিচারিণী, স্বৈরিণী, রূপদাসী, অপ্সরা, সবশেষে গণিকা, বেশ্যা৷ আর এই অভিধাগুলো অর্জন করতে গিয়ে নারীকে সব সময় যে ঘরের বার হতে হয়েছে, বেশ্যাপল্লীতে অবস্থান করতে হয়েছে—তা নয়৷ স্বামীর অনুকারিণী হয়ে একনিষ্ঠ স্বামী সেবার মধ্যে থেকেও তারা উপাধিগুলি অর্জন করতে পারে—তার জন্য স্বামীর মিথ্যা সন্দেহ, বিয়ে করা স্ত্রীতে অরুচির জন্য তাকে পরিত্যাগ করে অন্য নারী লাভের সুপ্ত বাসনাই যথেষ্ট৷ তারপরে যদি কোনো নারীর পদস্খলন ঘটে তাহলে তো কোনো কথাই নেই—সোজা বেশ্যাগিরি৷ আর এই যে নারীর জন্য এত অভিধা তার পুংলিঙ্গ বাচক কয়টা প্রতিশব্দ পুরুষের জন্য সৃষ্ট হয়েছে তা ভাববার বিষয়৷ তাহলে পুরুষেরা কি অসতী হয় না? আর হলেই দেখার কে আছে—এতসব অভিধা, এতসব বিধিনিষেধ তারা তো নিজের জন্য তৈরি করতে পারে না! অগত্যা যূপকাষ্ঠে বলি হওয়ার জন্য রয়েছে নারীকুল৷ আর বলির প্রসাদ তো সুস্বাদু হয়ই! পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বলি হওয়া নারীরা গণিকা হয়ে যায়; আর পুরুষকুল মহানন্দে বিনা বাধায় সেই নারীমাংস আস্বাদন করে সার্থকতা লাভ করে৷

এই যে আমাদের দেশে-কালে গণিকা নারীর এই অবস্থা তা শুধু আমাদের দেশেরই নয়—সমস্ত পৃথিবীরই তাতে একই রূপ৷ পৃথিবীর প্রধান তিনটি ধর্মেই লক্ষিত হয়েছে নারীর শরীরের প্রতি পুরুষের দুর্বার ভোগাকাঙ্খা৷ নারী পুরুষের জন্য সৃষ্ট৷ পুত্রলাভের জন্য নারীর সাথে রমণ কর৷ নারী দেহ শস্যক্ষেত্র তাকে যত ইচ্ছে কর্ষণ করা যায়৷ তিনধর্মের এই বাণীর মূল কথাই হচ্ছে—নারীদেহকে যথা ইচ্ছে ভোগ করা৷ পুরুষের অবাধ ভোগের নিমিত্ত দেহব্যবসার যন্ত্রণাময় নরককুন্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়া নারীরা তাদের পৈশাচিক যন্ত্রণায় তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়৷ তবু সকলেই তো এক নয়৷ দৈত্যকুলে প্রহ্লাদের মতো পুরুষকুলে এমন কিছু মানুষ আবির্ভূত হন যাঁরা তাঁদের দরদি মন নিয়ে এদের কথা ভাবেন—এদের জীবন যন্ত্রণাকে, সমাজে অবস্থানকে লোকচক্ষুর সম্মুখে তুলে ধরার চেষ্টা করেন৷ যদিও কখনো কখনো সমাজ-সময়ের রক্ষণশীল মানসিকতাকে সহজে কাটিয়ে উঠতে পারেন না৷ গণিকাদের জীবনযন্ত্রণাকে সর্বজনবিদিত করার কারিগর হলেন বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সাহিত্যিকেরা৷ যাঁদের জন্য সমগ্র বিশ্বে গণিকাদের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করা সম্ভরপর হয়েছে৷ আমার গ্রন্থের বিষয় বাংলা উপন্যাসের গণিকাচরিত্র হলেও সমগ্র বিশ্বের বারনারীদের মর্মযন্ত্রণা, শোষণের ইতিহাস যে প্রায় একই তা তুলে ধরার জন্য বিশ্বসাহিত্যে গণিকা প্রসঙ্গে সংক্ষেপে আলোকপাত করার চেষ্টা করবো যাতে গণিকা সংক্রান্ত ধারণায় আরেকটু স্বচ্ছতা আসে৷

ভারতীয় সাহিত্যে যে সময়ে গণিকাদের আগমনি সংকেত মর্মগোচর হয়েছে বিশ্বসাহিত্যে তা আরও বেশি এগিয়ে৷ এ পর্যন্ত সাহিত্যে আবিষ্কৃত প্রথম গণিকার উল্লেখ পাওয়া যায় সুমেরীয় মহাকাব্য ‘গীলগামেশের কাহিনি’-তে৷ এর রচয়িতা অজ্ঞাত৷ এটি রচিত হয়েছিল প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনীয় ভাষায় এবং কিউনিফর্ম লিপিতে৷ রচনাটি প্রাচীনতম মহাকাব্য হিসেবেও সম্মানিত৷ গল্পটি হল—উরুক রাজ্যের অধিপতি গীলগামেশ প্রজাবৎসল রাজা হয়েও নগরের চারপাশে প্রাচীর বানাবার নেশায় উন্মত্ত হয়ে কর্মরত প্রজাদের উপর অত্যাচার শুরু করে৷ তারা সে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সেই কষ্ট থেকে উদ্ধারের জন্য দেবতাশ্রেষ্ঠ ‘আণু’-কে আহ্বান করতে থাকে৷ তাদের আর্তকান্নায় বিচলিত হয়ে আণু তাঁর সহচর আরুরুকে আদেশ দেন গীলগামেশের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে কাউকে গড়তে৷ আণুর নির্দেশে আরুরু প্রকৃতির সর্বশক্তিতে শক্তিমান, পরাক্রমশালী, বনচর এবং পশুদের বন্ধুরূপে সৃষ্টি করলেন এনকিডু নামের এক পুরুষ৷ এনকিডুর কথা শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ে গীলগামেশ৷ তার পরামর্শদাতা ও গ্রাম প্রধানেরা তাকে বুদ্ধি দেয় কোনো রমণীর দ্বারা এনকিডুকে বশীভূত করে নগরে এনে শক্তি হরণ করতে৷ সেই অনুযায়ী ঈশতার মন্দিরের প্রধান পুরোহিতকে অনুরোধ করে কার্য সম্পন্ন করার জন্য এক রমণী চেয়ে নেওয়া হয়৷ সেই রমণী বা দেবদাসী যথা সময়ে তার সমস্ত ছলাকলা দেখিয়ে বশ করে এনকিডুকে৷ সাত দিন সাত রাত ধরে চলে তাদের উদোম দেহ সম্ভোগ৷ এই বারাঙ্গনার মোহে মোহিত এনকিডু বন ছেড়ে শহরে এসে পড়ে৷ মদ-মাংস-নারীতে ভাসিয়ে দেয় নিজেকে৷ বল্কল ছেড়ে তার গায়ে উঠে ঝলমলে পোশাক৷ গীলগামেশের সহচর হয়ে যে বনের পশুরা একসময় তার বন্ধু ছিল নির্বিচারে শিকারের নামে তাদের হত্যা করতে থাকে৷ কিন্তু সে ভাব তার বেশিদিন থাকে না৷ প্রকৃতির নিয়ত হাতছানিতে নগরজীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পুনরায় বনে ফিরে যায়৷ বনচারী প্রাণীরা তাকে আর বন্ধু হিসেবে মেনে নিতে পারে না৷ তাকে দেখে ভয়ে পালাতে থাকে৷ ভগ্নহৃদয় এনকিডু আবার শহরে ফিরে আসে৷ ক্রমে শক্তিহীন হয়ে রোগগ্রস্ত হয়ে পড়ে৷ তার সমস্ত দুরবস্থার জন্য দায়ী করে সেই বারাঙ্গনাকে৷ তাকে অভিশাপ দেয়, পথ হবে তার আশ্রয়, নগরের প্রাচীরের পাশে অর্থাৎ একেবারে প্রান্তসীমায় হবে তার আলয়, ব্রাত্য ও ঘৃণিতরা তাকে আঘাত করবে এবং চরম ক্লান্তিতে ভরা থাকবে তার সম্পূর্ণ জীবন৷ এই নিষ্ঠুর অভিশাপে ভীত হয়ে সেই বারনারী শরণাপন্ন হয় শামশেরের৷ শামশের এনকিডুকে অনুরোধ করে তার অভিশাপকে একটু নমনীয় করতে৷ তখন এনকিডু তার অভিশাপ বাণীর মধ্যে আরেকটু সংযোজন করে বলে—শুধু ব্রাত্য ও ঘৃণিতরাই নয়, রাজা, রাজপুত্র ও গণ্যমান্যরাও তার প্রেমিক হবে এবং তাদের জন্য সেই পুরুষেরা তাদের মা ও পুত্রবতী স্ত্রীদেরও পরিত্যাগ করবে৷ তারপর থেকে এনকিডুর সেই অভিশাপবাণী যুগযুগ ধরে ভোগ করে আসছে গণিকারা৷ কাহিনির পাঁচহাজার বছর অতিক্রান্ত হলেও তার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি৷ সমাজ কেমন করে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য নারীকে পণ্য করেছে, কীভাবে সেই নারী পরের মঙ্গলের জন্য নিজের জীবনকে ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়েছে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ বহন করে ‘গীলগামেশের কাহিনি’-টি৷

খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০ অব্দে মিশরের প্যাপিরুসে লিখিত একটি কাহিনিতে দেববেশ্যার প্রতি এক রাজপুত্রের আকাঙ্খার কি পরিণতি হয়েছিল তা জানা যায়৷ কাহিনিটির নাম ‘দি স্টোরি অব সেতনা’৷ দুঃসাহসী ও পারদর্শী পুরুষ সেতনা ছিল মিশরের বিখ্যাত ফ্যারাও রামেসিসের পুত্র৷ সে পিটার মন্দিরের পুরোহিতকন্যা টিবুবুইকে দেখে কামনায় উন্মত্ত হয়ে উঠে তাকে পাওয়ার জন্য৷ টিবুবুই তাকে বাড়িতে আসতে বলে যথাযথ আপ্যায়নের সঙ্গে তাকে এও স্মরণ করিয়ে দেয় যে সে সাধারণ গণিকা নয়—সে ‘হিয়েরোডিউল’ বা পবিত্র দেবকন্যা৷ তার পরেও অধীর সেতনা তার সঙ্গ প্রার্থনা করলে টিবুবুই তার শরীরের মূল্য স্বরূপ সমস্ত সম্পত্তি ও তার সন্তানদের কেটে টুকরো টুকরো করে কুকুরের মুখে ছুঁড়ে দেওয়ার কথা বলে৷ সেতনা তাতে রাজী হলে সমস্তটা লিখিয়ে নিয়ে তার সুদৃশ্য মেহগণির খাটে সেতনাকে আকর্ষণ করার সঙ্গে সঙ্গে একটা অস্বাভাবিক চিৎকার করে সেতনা জ্ঞান হারায়৷ তারপর জ্ঞান ফিরে দেখে এক বিশাল পুরুষের পদপ্রান্তে পড়ে আছে সে এবং তার শরীর সম্পূর্ণ বিবস্ত্র৷ এই কাহিনিটিতে যেমন দেবগণিকাদের প্রেমিকের সর্বস্ব কেড়ে নেওয়ার ছবি রয়েছে তেমনি গণিকা সংসর্গে পুরুষের কি শোচনীয় পরিণাম হতে পারে সে সম্পর্কে ভীতিকর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে৷

এই সময় পর্বে আর তেমন কোনো দেবদাসী বা উচ্চশ্রেণীর গণিকার সন্ধান মেলে না৷ যেসব কাহিনি পাওয়া যায় তারা সাধারণ বারনারী—নগরের প্রাচীরের ধারে বা প্রধান সরকের পাশে যাদের আস্তানা৷ বাইবেলের পুরোনো নিয়মের কিছু গল্পকাহিনিতে এই শ্রেণীর গণিকার সন্ধান মেলে৷ যেমন—‘জেনেসিস’ (৩৮)-এ গণিকারা যে কোনো ভদ্রঘর থেকে এসে নগরের প্রাচীর বা মহাসরকের ধারে মুখ ওড়নায় আচ্ছাদিত করে খদ্দেরের আশায় বসে থাকত এবং বিশেষ করে গণিকাদের চেনার উপায়ই ছিল মুখ ওড়নায় ঢেকে রাখা তা জুদা ও তামারের গল্প থেকে বোঝা যায়৷ রাহাব নামের এক সুচতুরা, সহৃদয়া গণিকার উল্লেখ রয়েছে জোশুয়া-(২)-তে৷ রাহাব জোশুয়ার লোকেদের তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল এবং অনুরোধ করেছিল তারা যখন জেরিকো নগরী আক্রমন করবে তখন যেন তার বাবার বাড়িটি ধ্বংস না করে৷ ইসরায়েলীদের মধ্যে গণিকা বিবাহ এবং স্বামীদের সঙ্গে লম্বা সফরের সঙ্গিনী হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে জাজেস (১৯)-এ৷ এজিকিয়েল (২৩) তে ওহোলা ও ওহোলিবা নামের দুজন গণিকার সন্ধান পাওয়া যায় যারা তাদের প্রবল লোভের কারণে পোষক বাবুর সঙ্গ ছেড়ে বহুপুরুষের অঙ্কশায়িনী হয় এবং প্রেমিকদের হাতে নির্মম মৃত্যু বরণ করে৷ সমাজে গণিকাবৃত্তির বাড়-বাড়ন্ত রূপের ইঙ্গিত দান করে এই কাহিনিগুলি৷ ধর্মগুরুরা বা সমাজপ্রভুরা মানুষের ব্যভিচার দমন করার উদ্দেশ্যে এই কাহিনিগুলির অবতাড়না করেছেন বলে মনে হয়৷

প্রাচীন মিশরে রাজপরিবারের কন্যারাও যে নিজের প্রবৃত্তি দমনে অথবা পিতার আদেশে অর্থাগম বা প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করতো সে সম্পর্কিত দু-একটি কাহিনি হেরোডোটাস লিপিবদ্ধ করে গেছেন৷ যেমন মিশরের রাজা রামসিনিটাস তাঁর গুপ্ত প্রকোষ্ঠের চুরি যাওয়া ধনসম্পদের হদিস পেতে এবং চোর ধরার জন্য আত্মজাকে গণিকা বানিয়ে গণিকালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিল৷ কারণ গণিকালয়ই অপরাধীদের শ্রান্তি ও ক্লান্তি বিমোচনের অন্যতম স্থান৷ রাজকন্যা গণিকা হয়ে সেই চোরকে করায়ত্তও করেছিল৷ রামসিনিটাসের পর সিংহাসনে বসেন অত্যাচারী রাজা খেওপ বা খুফু৷ বিলাস-ব্যসনে রাজকোষ শূন্য করে শেষ পর্যন্ত নিজকন্যাকে গণিকালয়ে পাঠান অর্থ-রোজগারের জন্য৷ কন্যার দেহবিক্রির অর্থ দিয়ে শুধু আমোদ-প্রমোদই চালিয়ে যাননি এই মহান পিতা—নিজের কবরের জন্য পিরামিডও তৈরি করান মেয়েকে দিয়ে৷ শুধু পিতার জন্যই নয় শরীর বিক্রির উপার্জন দিয়ে সে নিজের জন্যও একটি ‘ওবেলিস্ক’ তৈরি করায়৷ ইতিহাসের জনক হেরোডটাসই প্রথম ব্যক্তি যিনি ইতিহাসে সামাজিক চিত্রকে যত্ন করে ঠাঁই দিয়েছিলেন যার দ্বারা তৎকালীন সমাজে গণিকা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যায়৷ হেরোডটাস র‍্যাডোপি নামের এক বিখ্যাত গণিকার নামও উল্লেখ করেছেন যে কিনা ক্রীতদাসী হয়ে তার প্রভুর সঙ্গে থ্রেস থেকে মিশরে এসে উপস্থিত হয়েছিল৷ নিজের রূপলাবণ্যের দ্বারা দেহব্যবসা করে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে নিজের জন্য একটা ‘ওবেলিস্ক’ পর্যন্ত তৈরি করেছিল৷

আনুমানিক খ্রিস্ট্রিয় তৃতীয় শতকে অ্যাথেন্স নউক্রাটিস ‘ডেইপনোসোফিস্ট’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন যেখানে গ্রীসদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে সে দেশের একটি বিশেষ সময়ের সামাজিক ও নৈতিক জীবনের সুস্পষ্ট বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন৷ গ্রন্থটিতে মোট পনেরোটি অধ্যায় তার মধ্যে শুধুমাত্র ত্রয়োদশ অধ্যায়ে গণিকাদের কথা আলোচনা করেছেন৷ অধ্যায়টির নাম ‘কটির্জানস’৷ এখানে তিনি তিন ধরনের গণিকার কথা বলেছেন—হটেরা, আউলেট্রিডেস এবং পরনোই৷ ‘হটেরা’রা শিক্ষিত, কলাবিদ্যায় পারদর্শী এবং বিধুজনের মনোরঞ্জনে দক্ষ৷ শ্রেণী হিসেবে এদের স্থান উচ্চে৷ গ্রীক বিদ্বজ্জনের জীবনে বিশেষ স্থান ছিল এদের৷ এরা প্রেরণাদাত্রী সখি, কলাবিদ, বয়স্যা হিসেবে সম্মাননীয় ছিল৷ ‘হটেরা’ একটি বিশেষ যুগের ফসল; পরবর্তী কোনো যুগেই এমন শিল্পগুণসম্পন্ন বারবনিতা পাওয়া যায়নি৷

এই অধ্যায়ে গ্রীসদেশের সব নামকরা গণিকাদের যেমন উল্লেখ আছে তেমনি তাদের প্রণয়ী হিসেবে যুক্ত বীর-যোদ্ধা জাতীয় বিখ্যাত ব্যক্তিদের কথাও বলা হয়েছে৷ যেমন—ফ্রাইন-এর রূপমুগ্ধ ছিলেন প্রখ্যাত ভাস্কর প্র্যাক্সিটেলেস; যিনি ফ্রাইনের আদলে তাঁর অবিস্মরণীয় মূর্তি ‘স্নিডিয়ান ভেনাস’ নির্মাণ করেছিলেন৷ গণিকা অ্যাসপাসিয়া বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস এবং গ্রীসের প্রবাদপুরুষ পেরিক্লেস-এর প্রণয়িনী ছিল৷ প্লোটের প্রেমিকা বারবনিতা আরকায়ানাসা, এপিকিউরাসের লেওনাটিয়াম, অ্যারিস্টটলের হারপিলিস স্বনামধন্য বিখ্যাত গণিকা৷ গ্রীক রাজ-রাজড়াদেরও অনেকানেক গণিকা প্রণয়িনীর কথা জানা যায়৷ যেমন—ফিলিন্না ছিল ম্যাসিডনের রাজা ফিলিপের প্রেমধন্যা৷ ফিলিন্নার গর্ভজাত পুত্র অ্যারিডেয়াস আলেকজাণ্ডারের পর কিছুদিন রাজত্বও করেছিল৷ আলেকজাণ্ডারের প্রেমভাগিনী হয়েছিল গণিকা থাইস, সেলুকাসের মিসটা ও নিয়াসা, অ্যান্টিগোনাসের ডেমো-ও বারবিলাসিনী রূপে বিখ্যাত ছিল৷ অ্যান্টিগোনাসের পুত্র ডেমেট্রিয়াস একাধিক বারনারীর সঙ্গী হয়েছিল৷ তারা হল—মানিয়া, লেয়ানা, লামিয়া, মিরহিনা প্রমুখরা৷ বীর সাইরাসের বেশ্যাসঙ্গিনী হল ফোসিয়া৷

এই গ্রন্থে যেমন বিখ্যাত সব গণিকার কথা রয়েছে তেমনি রয়েছে দালালদের কথা যারা বাররামাদের নানা শারীরিক ত্রুটি ঢেকে খরিদ্দারের সামনে তাদের নিখুঁত হিসেবে জাহির করত৷ ধনী প্রেমিকেরা গণিকাদের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিত, তাদের মূর্তি, স্মৃতিসৌধ ইত্যাদি বহু অর্থব্যয়ে যত্রতত্র স্থাপন করে প্রেমে দক্ষিণা দিত৷ সেই সময়কার সমাজে গণিকারা নানাভাবে প্রশ্রয় ও অনুমোদন পেত বলেই বিখ্যাত বহু মানুষদের গণিকাপ্রীতি সর্বজনবিদিত হয়ে পড়েছে৷

গ্রীক রচয়িতাদের নানা হাস্যরসাত্মক নাটকে গণিকা চরিত্রের রূপায়ণ লক্ষ করা যায় খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে৷ গ্রীক শাসনকর্তা সোলোন যখন সরকারিভাবে গণিকালয় স্থাপন করেন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গ্রীক সমাজে তখন থেকেই গণিকার প্রাদুর্ভাব ঘটে৷ গ্রীক কমেডিতে গণিকাদের টুকরো টুকরো ছবিকে প্রথম যিনি চিত্রিত করেছিলেন তিনি হলেন অ্যারিস্টোফানেস৷ যদিও তিনি তাদের সরাসরি মঞ্চে আনেন নি৷ তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে গ্রীক কমেডিতে আত্মপ্রকাশ করেন মেনান্দার৷ তাঁর নাট্টরূপের যে অসম্পূর্ণ খণ্ডাংশগুলি পাওয়া গেছে তাতে একাধিক বাররামার উপস্থিতি দেখা যায়৷ তাঁর ‘সামিয়ার’ নাটকের নায়িকা ক্রিসিস এবং ‘এপিট্রেপনটেস’-র হাব্রোটোনন উল্লেখযোগ্য গণিকা চরিত্র৷

তাঁর দুই শতাব্দী পরে রোমান নাট্যকার প্লটাস ও টেরেন্স তাঁরই বিষয়বস্তু নিয়ে একাধিক নাটক রচনা করেছিলেন৷ তাঁদের বিশেষ প্রতিভাস্পর্শে গণিকাচরিত্রগুলি অনন্য মাত্রা লাভ করেছিল৷ তারপরে গ্রীসের সামাজিক চিত্র গণিকাদের দ্বারা বা ব্যভিচারের বাড়-বাড়ন্তে কলুষিত হতে থাকে৷ গণিকাবৃত্তি তার প্রাচীন সম্মান থেকে অনেকটাই নীচে নেমে পরিণত হয় বানিজ্যিক গণিকাবৃত্তিতে৷ পানশালা জাতীয় ক্ষেত্রে তারা জায়গা করে নেয় এবং সমাজে গণিকাদের এই পরিবর্তিত দিকগুলিই সাহিত্যে উপস্থাপিত হতে থাকে৷ খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতকে লুসিয়ান সামোসাটা নামের একজন রচনাকার (প্রথমে মিশরীয় কিন্তু পরে গ্রীক নাগরিক) সাধারণ স্তরের গণিকাদের নিয়ে লিখলেন ‘ডিয়ালোগ হটেরা’৷ এখানে পনেরোটি কথোপকথনে গণিকাদের জীবনের নানা সুখ-দুঃখ, অনুভব-অনুভূতির কথা খোলাখুলি ব্যক্ত করেছেন৷ এখানে রূপজীবিনীদের পেশাগত নানা কৌশল, অর্থ আদায়ের বিভিন্ন উপায়, প্রেমিকদের বশ করবার নানা ছলাকলা ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ে দিকনির্দেশ ঘটেছে৷

লুসিয়ানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে অ্যালসিফ্রন (জন্মসূত্রে আসীরীয়, বাসসূত্রে গ্রীক) নামের একজন রচনাকার পত্র রচনার মধ্যে গণিকাদের স্থান দিয়েছেন৷ পেরিক্লেসের যুগের সব বিখ্যাত গণিকাদের শ্রুত-অশ্রুত নানা কাহিনিকে অবলম্বন করে তাদের দিয়ে বিখ্যাত সব পুরুষদের পত্র লিখিয়েছেন৷

ইউরোপের অন্ধকার যুগের (৬ষ্ঠ শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত) তমসাচ্ছন্ন সাহিত্য সৃষ্টির যুগে যে দু-একটি উজ্জ্বল তারকা জ্বলজ্বল করে আলো ছড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতমা হলেন সন্ন্যাসিনী রোজউইথা৷ তিনি জার্মানির স্যাক্সানি প্রদেশের গ্যাণ্ডার শেইম মঠে সন্ন্যাসিনী হিসেবে যুক্ত ছিলেন৷ তাঁর রচিত ছয়টি নাটকের সন্ধান পাওয়া যায়, তার মধ্যে সর্বশেষটি অর্থাৎ ‘পাফনুটিয়াস’ নামক নাটিকাটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি৷ থাইস নামের এক পণ্যাঙ্গনার খ্রিস্ট সাধনা দিয়ে পাপের পথ থেকে উত্তরণ এর বিষয়বস্তু৷ অর্থাৎ গণিকাদের যৌনবৃত্তির পাপ থেকে মুক্তির পথনির্দেশ করেছেন তিনি৷

ফ্রান্সে গণিকাদের অস্তিত্ব প্রকট হয়ে উঠেছিল ত্রয়োদশ শতক থেকে৷ সাধারণ পানশালা, রাস্তাঘাট এবং শহরের নানা অলিতে-গলিতে এদের দেখা যেত৷ ক্রমে সাহিত্যের নানা উপকরণে এরা জায়গা নিতে থাকে৷ সেন্ট লুই অত্যন্ত ঘৃণা পরবশ হয়ে তাদের রাজ্য থেকে বের করে দেওয়ার আদেশ দেন এবং বারাঙ্গনাদের যথাসর্বস্ব বাজেয়াপ্ত করার কথাও বলেন৷ পরে জনসাধারণের প্রতিবাদে তিনি নরম হয়ে ধর্মীয় স্থান থেকে দূরে নগরীর বাইরে তাদের থাকার নির্দেশ দেন৷ তাঁর সময়ে পণ্যনারীরা কুষ্ঠরোগীর মত ঘৃণ্য হিসেবে পরিগণিত হয়, তাদের চিহ্নিত করার জন্য বোনা দড়ির মতো একটা জিনিস কাঁধ থেকে ঝুলিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা হয়৷ তারপর চতুর্দশ শতকের মাঝামাঝি থেকে পঞ্চদশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ফ্রান্সের নানা শহরে আইনসিদ্ধ গণিকালয় বা ‘প্রস্টিবিউলাম পাব্লিকাম’ প্রতিষ্ঠিত হলে গণিকারা অন্তত মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পায়৷ এই গণিকা নারীদের দুঃখ-যন্ত্রণার ইতিহাস অত্যন্ত দরদ দিয়ে যিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর নাম ফ্রাঁসোয়া ভিয়োঁ—সমালোচকরা যাঁকে অভিহিত করেছেন ‘পোয়েট অব প্রস্টিটিউশন’৷ তিনি গণিকালয়ে অবস্থান করে অত্যন্ত কাছ থেকে তাদের জীবনকে দেখেছেন এবং তা তাঁর রচনায় স্থান দিয়েছেন৷ তিনি নিঃসন্ধিগ্ধভাবে পরবর্তী যুগের পথ প্রদর্শক৷ ভিঁয়োই প্রথম ব্যক্তি যিনি বিগতযৌবনা গণিকাদের দুঃখ দুর্দশার কথা ভেবেছিলেন৷ তাঁর রচনাগুলি হল—‘দ্য রিগ্রেটস অব অলমের’, ‘ব্যালাডস অব লেডিজ অব বাইগন টাইমস’, ‘দিস ইস দি ব্রথেল হয়ার উই প্লাই আওয়ার ট্রেড’ ইত্যাদি৷

শেক্সপীয়ারের রচনাতেও বহুভাবে গণিকাপ্রসঙ্গ উপস্থাপিত হয়েছে; বিশেষ করে কমেডিগুলির ক্ষেত্রে৷ তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণী দৃষ্টিতে ধরা পড়েছিল এলিজাবেথীয় ইংল্যাণ্ডের সমাজজীবনে যুদ্ধব্যবসায়ী সৈনিকদের এবং উচ্চশ্রেণীর ব্যক্তিদের গণিকাসঙ্গের অপরিহার্যতা৷ সে সময় গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে, গণিকাসঙ্গ উপভোগকারী পুরুষের বিরুদ্ধে কঠিন আইন প্রচলিত থাকলেও সরাইখানা, বিশেষ কিছু পল্লী এমনকি সাধারণ উদ্যানেও বারবনিতাদের সতত আনাগোনা ছিল৷ দূতী, দালাল শ্রেণীর মানুষেরা খোলাখুলি ঘোরাফেরা করতো৷ অর্থাৎ আইন-কানুন যাই থাকনা কেন, যত কঠোর শাস্তিই দেহব্যবসা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে ধার্য করুক না কেন বৃত্তিটিকে কিন্তু কেউ বন্ধ করতে পারেনি৷ শেক্সপীয়ার তাঁর কিছু নাটকে গণিকাদের পেশা ও ভাষাকে একেবারে জলজ্যান্ত করে তুলে ধরেছেন৷ তাঁর উল্লেখযোগ্য গণিকাচরিত্র সম্বলিত নাটকগুলির মধ্যে অন্যতম হল—‘হেনরি দ্য ফোর্থ’, ‘পেরিক্লেস’, ‘প্রিন্স অব টায়ার’, ‘মেজার ফর মেজার’ ইত্যাদি৷

শেক্সপীয়ার তাঁর নাটকে গণিকা চরিত্রের উপস্থাপন করে পরবর্তী যুগের রচনাকারদের সামনে একটা বন্ধ দরজা খুলে দিয়েছিলেন৷ তাঁর যুগে বা সে সময়ের কিছুটা পরেও গণিকাদের সামাজিক অবস্থান ভালো ছিল না৷ দুঃখ-যন্ত্রণা-বঞ্চনা, প্রেমিকের দয়ার উপর জীবন ধারণ করা ভবিতব্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মর্যাদা ছিল না৷ এই সর্ববঞ্চিত নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল দৃষ্টিতে কলম ধরেন বিভিন্ন শতকের বিভিন্ন সাহিত্যিকেরা৷ তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন নাট্যকার ডেকার, আফ্রা বেন, কথাসাহিত্যিক ড্যানিয়েল ডিফো, চার্লস ডিকেন্স প্রমুখরা৷ এঁদের হাতে গণিকা নারীরা একটি বিশেষ রূপে দেখা দিয়ছিল৷ যেমন টমাস ডেকার গণিকাদের নিয়ে লিখেছেন ‘দ্য অনেস্ট হোর’৷ এর নায়িকা বেলাফ্রন্ট দুশ্চরিত্র লম্পট ম্যাথিওর রক্ষিতা ছিল৷ সে বেলাফন্টকে ঠিকমত পয়সা দিত না৷ যার জন্য তাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করতেও বাধেনি বেলাফন্ট-এর৷ কিন্তু ক্রমে ক্রমে তার অর্থলোভী রূপটা ঢাকা পড়ে যায়—অন্তরের ঔদার্য ও নারীজনোচিত সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ হয়ে উঠে সে৷ লেখক এক গণিকা নারীর মহৎ গুণকে প্রকাশিত করেছেন রচনাটিতে৷

সপ্তদশ শতকের মহিলা নাট্যকার আফ্রা বেন গণিকাজীবন সম্বলিত কিছু নাটক লিখেছিলেন যেখানে গণিকারা তাদের বঞ্চনাময় জীবনের নানা সমস্যা নিয়ে উপস্থাপিত হয়েছে৷ তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল—‘দ্য জেলাস ব্রাইডগ্রুম’, ‘দ্য ডাচ লাভার’, ‘দ্য রোভার’, ‘টাউন ফপ’, ‘দ্য সিটি এয়ারেস’ এবং ‘দ্য রাউন্ড হেডস’৷ এগুলির উল্লেখযোগ্য গণিকারা হল—বেটি ফনটিট, এঞ্জেলিক, বিয়াঙ্কা, মোরেট্টা, লুসেট্টা প্রমুখরা৷

অষ্টাদশ শতকের ইংল্যান্ডের সাহিত্যিকদের যাঁদের হাতে গণিকাচরিত্র বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তাঁরা হলেন—ডিফো, ডিকেন্স, অ্যানসওয়াথ প্রমুখরা৷ ডিফো এক উচ্চাকাঙ্খী বারবনিতার জীবনসংগ্রাম ও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে তার বাঞ্ছিত প্রতিষ্ঠা লাভ দেখিয়েছেন ‘মল ফ্ল্যান্ডার্স’ গ্রন্থে৷ এর গণিকা চরিত্র হল মল৷ এক বারবনিতার নামে নামাঙ্কিত করেছেন রচনাটি৷ আবার ডিকেন্স নারীজীবনের নানা অধঃপতনের জন্য, দেহব্যবসার মতো বৃত্তিতে আত্মনিয়োগ করার জন্য পুরুষ, সমাজ ও পরিবেশকে যেমন দায়ী করলেন, সেই পঙ্কে থেকেও রূপোপজীবিনীদের মনুষত্বের মহিমায়, নারীত্বের স্বাভাবিকগুণে বিকশিত করতেও গ্লানিবোধ করলেন না৷ তাঁর ‘অলিভার টুইস্ট’-এর অমর গণিকাচরিত্র ন্যান্সি, ‘ডেভিড কপারফিল্ড’-এর এমিলি, ‘ডম্বে অ্যান্ড সন্স’-এর অ্যালিস সকলেই পুরুষ ও সমাজের নির্মম বঞ্চনার শিকার৷ কিন্তু কেউই কোনোভাবেই তাদের মানবিক গুণগুলিকে নষ্ট হতে দেয়নি৷

ঊনবিংশ শতকের তিরিশের দশক থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কিছু রচয়িতার রচনায় বারাঙ্গনারা তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে দৃঢ় আত্মমর্যাদায় একটু একটু করে প্রতিষ্ঠালাভের চেষ্টা করেছে৷ এ সময়পর্বের উল্লেখযোগ্য গণিকারা হল—মিসেস এলিজাবেথ গ্যাসকেল রচিত উপন্যাস ‘রুথ’-এর নায়িকা রুথ, অ্যান্টনি ট্রোলোপ রচিত ‘দ্য ভাইকার অব বুলহাম্পটন’-এর ক্যারি ব্রাটল ও ‘অ্যান আই ফর অ্যান আই’-এর কেট, হারা, এলিয়টের ‘অ্যাডাম বীড়’ গ্রন্থের হেটি সোরেল, উইলকি কলিনসের ‘নিউ ম্যাগডেলান’ ও ‘ফলেন লীভস’-এর মার্সি মেরিক, সিম্পল স্যালি, জর্জ গিসিং-এর ইভা স্টার (আনক্লাসড), জি,এ, মূরের ‘এস্থার ওয়াটারস’ রচনার এস্টার প্রমুখেরা৷ এই বারনারীদের সবাই যে সমাজের প্রতিকূলতায় বেশ্যাবৃত্তি গ্রহণ করেছে তা নয়, কেউ অনায়াসে, অল্প পরিশ্রমে অর্থ রোজগারের বাসনাতেও সেই নারকীয় পথের পথিক হয়েছে৷

ফরাসী সাহিত্যে ফ্রাঁসোয়া ভিয়োঁর হাত দিয়ে গণিকা নারীদের যে ব্যাপ্তি শুরু হয়েছিল অষ্টাদশ শতকে ভলতেয়ার তাদের বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করতে দ্বিধাবোধ করেননি৷ তিনি একজন সমাজ সচেতক ব্যক্তিত্ব৷ তিনি ‘কঁদিদ’ গ্রন্থে বারবনিতা প্যাকেৎ-এর মর্মবেদনাকে যেভাবে অঙ্কিত করেছেন তা ঊনবিংশ শতকের রচয়িতাদের প্রধান অবলম্বন হিসেবে পরিগণিত হয়৷ প্যাকেৎ যে নির্মম পৈশাচিকতার শিকার হয়ে গণিকাজীবনে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে, বেশ্যা হয়ে তাদের প্রতি সমাজের নিদারুণ অনাচারকে প্রত্যক্ষ করেছে এবং বৃদ্ধ বয়সের শোচনীয় পরিণতিতে হাহাকার করে উঠেছে তা ভলতেয়ার যেভাবে তুলে ধরেছেন সর্বদেশের সর্বসমাজে সেই রূপ একই৷

ঊনবিংশ শতকের সাহিত্যে আরেক বিশেষ ধরন সারা বিশ্বের সাহিত্যিকদের সচকিত করে তোলে৷ তা হল প্রচলিত যা কিছু সুন্দর, সুষম, দৃষ্ট ও শ্রুতিনন্দন তাকে নির্মমভাবে পদপিষ্ট করে বিশৃঙ্খল-বিশ্রী-বীভৎসের সাধনা৷ যার কেতাবি নাম ‘রিয়্যালিজম’৷ এই অসুন্দরের সারস্বত সাধনায় প্রতারিত ঘৃণিত, অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিত নারীগুলি তাদের সমস্ত কদর্যতা সমেত, জীবনের অভিব্যক্তি সমেত সাহিত্যিকের কলমে জায়গা করে নেয়৷ সে সময় বিখ্যাত হয়েছিল—জুল গোঁকুরের ‘জার্মিনি ল্যাসার্তো’, এমিল জোলার ‘লাসোমোয়া, ‘নানা’, ভিক্টর হুগোর ‘মারিও দ্য লোর্ম’, আলেকজান্ডার দুমার ‘দাম’, ‘ক্যামেলিয়া’, অ্যাব প্রভোস্তের ‘মানো লেস্কে’ প্রভৃতি গণিকা চরিত্র সম্বলিত সাহিত্য রূপগুলি৷

এই বাস্তবতার যুগেও গণিকাচরিত্রে আত্মত্যাগ ও ঔদার্য দেখিয়েছেন বালজ্যাক৷ তাঁর ‘পো দ্য শ্যাগ্রাঁ’-র বিয়াট্রিস, ‘সপ্লেন্দার ও মিজের দ্য কুর্তিজান’-এর এস্তার গবসেক প্রমুখ পণ্যনারীরা প্রেমাস্পদের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি৷ চার্লস লুই ফিলিপ, মঁপাসাঁও কোথাও কোথাও গণিকা চরিত্রে মহত্ত্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন৷ শুধু ঔদার্যগুণই নয় তাদের যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনের গভীরে গিয়ে ডুবুরির মতো অনুসন্ধান করে সত্যকার স্বরূপটিকে বাস্তববাদী ও প্রকৃতিবাদী রচয়িতারা যেভাবে বের করে দেখালেন তাতে স্তম্ভিত না হয়ে পারা যায় না৷ এডমন্ড গোঁকুরের ‘লা ফিই এলিজ্যা’-র হুইসম্যাঁ তাঁর ‘মার্থ’, দোদোর ‘স্যাফো’-তে বাস্তব যন্ত্রণাক্লিষ্ট বাররামাদের জীবন চিত্রিত হয়েছে৷ মঁপাসাঁ সাহিত্যজগতে সার্থক ছোটগল্পকার৷ তিনি ‘মাদমোয়াজেল ফিফি’, ‘বুল দ্য সুইফ’, ‘পলস মিসট্রেস’, ‘লা মেজঁ’ এবং ‘দ্য মাদাম তাইয়ে’ গল্পগুলিতে বারযোষিতদের জ্বালাযন্ত্রণা-জটিলতাহীন অস্তিত্বসমেত দেখিয়েও প্রত্যেকের আলাদা আলাদা ব্যক্তিত্ব অটুট রেখেছেন৷ আনাতোল ফ্রাঁস বাস্তব পরিবেশের বাইরে গিয়ে ঐতিহাসিক বারবধূদের জীবনকে উপজীব্য করলেন তাঁর রচনায়৷ তাঁর ‘থাইস’ উপন্যাসটি মিশরের র‍্যকোটিস শহরের বিখ্যাত গণিকা থাইসের জীবননাট্যের চিত্ররূপ৷ ফরাসী সাহিত্যিকদের গণিকা নিয়ে সাহিত্য রচনা পরবর্তীসময়ে বিভিন্ন দেশের সাহিত্যিকদের প্রভাবিত করেছিল৷

রাশিয়ার সাহিত্য জীবনে বাস্তববাদ বা প্রকৃতিবাদ পদসঞ্চার করেছিল তার নিজস্ব মননের পথ ধরে৷ আর বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবশ্যম্ভাবীভাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল গণিকারা৷ এই চরিত্র নির্মাণে কর্ণধার ছিলেন ডস্টয়েভস্কি, টলস্টয়, টুর্গেনিভ, গোগল, গোর্কি প্রমুখরা৷

ডস্টয়েভস্কির ‘লেটার ফ্রম দ্য আন্ডার গ্রাউন্ড’, ‘দ্য ইডিয়ট’, ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, ‘ব্রাদার্স কারমাজোভ’ গ্রন্থ চতুষ্টয়ে পণ্যরমণীদের বিচিত্ররূপের প্রকাশ ঘটেছে৷ তিনি তাঁর তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের দ্বারা দারিদ্র্য, সমাজের অন্যায়, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার এবং তারই পটভূমিকায় কীভাবে পতিতা নারীর সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটে এবং সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে তাদের চরিত্রের বিকাশ ইত্যাদিকে তুলে ধরেছেন৷

গণিকা চরিত্রের মধ্যে ব্যক্তিত্ব আরোপ করে তাকে বৃহৎ কর্মজগতের বিস্তৃত পরিসরে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন টলস্টয় ‘রেজারেকশান’-এ৷ এর বিখ্যাত গণিকা চরিত্র কাটিয়ে মাসলোভা৷ উপন্যাসটি সারাবিশ্বের মানুষের মধ্যে বিশেষ করে সাহিত্য পাঠকের মধ্যে সাড়া জাগিয়ে দিয়েছিল৷ এই গ্রন্থটির সমগুরুত্বপূর্ণ আরেকটি গ্রন্থ হল—রঁম্যা রল্যাঁর ‘জঁ ক্রিসতফ’৷ এরও মূল উপজীব্য কদর্য দেহজীবিকার গ্লানি থেকে উত্তরণ৷

আবার ম্যাক্সিম গোর্কি গণিকাদের আদর্শ চরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত না করেও বারবিলাসিনীদের নিত্য বঞ্চনা-অপমান-অবমাননা ও জীবন ধারণের কঠোর সংগ্রামের মধ্যে থেকেও তাদের মধ্যে মানব হৃদয়ের শ্রেষ্ঠ বিকাশকে দেখাতে ভোলেননি৷ তাঁর ‘লোয়ার ডেপথ’-এর নাস্টিয়া, ‘ওয়ান অটাম’-এর নাতাশা, ‘ক্রিপি ক্রলার’-এর মাশকা ফ্রলিকা, ‘নীলুশকা’-র ফেলিজোতা প্রমুখরা সকলেই রাজতন্ত্রশাসিত দেশ ও সমাজের আর্থিক বৈষম্যের ফল; তারপরেও সহজাত মানবিকগুণগুলিকে কেউই পরিত্যাগ করতে পারেনি৷

ঊনবিংশ শতকের বিবিধ রুশ সাহিত্যিকের কলমে বিচিত্র রূপ বৈচিত্র্য নিয়ে বারবধূদের যে আত্মপ্রকাশ ঘটছিল তার সামগ্রিক রূপচিত্র পাওয়া যায় বিংশ শতকের প্রথম পাদে আলেকজান্ডার কুগ্রিনের ‘ইয়ম দ্য পিট’ উপন্যাসে৷ সেখানে গণিকাদলের নেত্রী ম্যাডাম মারকোভনা তার পার্লারে জেনকা, মানকা, লিউবকা, নিউরা, তামারা প্রভৃতি নারীকুলকে দিয়ে নাচ-গান-দেহব্যবসা চালায়৷ এই বারযোষিৎদের প্রত্যেকেরই পতনের একটা করে মর্মন্তুদ কাহিনি উপস্থাপন করেছেন রচনাকার৷ তারা দলের মধ্যে থেকেও আলাদা আলাদা করে প্রস্ফুটিত হয়েছে৷ গণিকাদের জীবনচিত্র ব্যাখ্যানে উপন্যাসটি এক অনবদ্য দলিল৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ভারতীয় সমাজে গণিকাদের যেরূপ অবস্থান সমগ্র বিশ্বেও তার ব্যতিক্রম নয়৷

নারীজীবনের সবচেয়ে নির্যাতিত, সবচেয়ে অবহেলিত এবং সর্বদিক থেকে নিষ্পেষিত নাম ‘বেশ্যা’৷ শারীরীক গঠনে এরা নারী শ্রেণীর প্রতিনিধি হলেও মর্যাদায় নারী নয়—মানুষও নয়; শুধু শরীর৷ কামার্ত পুরুষসমাজ নারীকে ইচ্ছেমত উপভোগ করার জন্য তার নারীত্বকে হত্যা করে; রাখে শুধু শরীরটাকে৷ তারপর সমস্ত অধিকার ও মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে বেশ্যার তকমা দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেহসুখ আস্বাদন করে—ইচ্ছেমত পীড়নও করে৷ আর শুধু শরীর সম্পন্ন মানুষেরা নিক্ষিপ্ত হয় সমাজের প্রান্ত সীমায়, লোকচক্ষুর আড়ালে; তাদের আবাসস্থল পরিণত হয় নিষিদ্ধপল্লীতে৷ শোষক পুরুষের তাতে আরও সুবিধা৷ তার নারীদেহ ভোগকারী পৈশাচিক মূর্তিটা তাহলে কিছুটা হলেও আড়াল হতে পারে৷

পুরুষের নারীদের এই ভোগের বাসনা, ভোগের ক্রিয়াকলাপ বহু প্রাচীন৷ বেশ্যাবৃত্তির প্রাচীনত্বের কোনো সীমা পরিসীমা খুঁজে পান না সমাজতাত্ত্বিকেরা৷ তবে মানবসমাজে সভ্যতার সূচনালগ্নে এ বৃত্তি যে ছিল না তা অনুমিত হয়েছে৷ ধর্ম যতবেশি সমাজকে গ্রাস করেছে; ধর্মপিতারা যত বেশি নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি যত্নবান হয়েছে ততই ঘটতে থেকেছে নারীর অবমূল্যায়ন৷ মানুষ যখন স্বাভাবিক যৌন অনুভূতির পরিপূরকতায় নারীকে গ্রহণ না করে নটী, ঊর্বশী করে তোলে আর তার পথ ধরেই সৃষ্টি হয় গণিকা৷

প্রাচীনসমাজে গণিকাদের প্রতি সমাজ প্রতিভূদের দ্বৈতমনষ্কতার পরিচয় খুবই তাৎপর্যপূর্ণ৷ তারা গণিকাদের ঘৃণা করে এসেছে নরকের দ্বার হিসেবে চিরকালই, আবার বৃত্তিটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বর্ষণ করছে নানা উপদেশাবলী৷ ‘কামশাস্ত্র’, ‘অর্থশাস্ত্র’-তে শাস্ত্র নির্দেশ দেয় রাজা, ধনী, বণিক, সকলকে অকুন্ঠ গণিকাগমনে, ‘বিষ্ণুপুরাণ’ এদের জন্য স্বতন্ত্র্য এক বিধানের কথা বলেছে যার নাম ‘অনঙ্গব্রত’; অনঙ্গ অর্থাৎ কামদেবের আরাধনা, যাতে তার বৃত্তি সাফল্যমণ্ডিত হয়, ‘মনুসংহিতা’-য় গণিকাগমনকে সর্বোতভাবে পরিত্যজ্য বলা হয়েছে, গণিকাগমনজনিত পাপের প্রাজাপত্য প্রায়শ্চিত্ত বিধানও অনেক ধর্মকার দিয়েছেন৷ অর্থাৎ গণিকাদের জন্য সমাজে স্পষ্ট দুটি মনোভাব লক্ষিত হয়—প্রথমত গণিকাবৃত্তি একটি প্রয়োজনীয় অশুভবৃত্তি আর দ্বিতীয়ত গণিকা সর্বতোভাবে অশুভ ও পরিহার্য৷

কোনো নারী জন্ম থেকেই গণিকা হয় না৷ তার সমাজ-পরিবেশ-প্রতিবেশ তাকে ঠেলে দেয় এই বৃত্তির অন্ধকূপে৷ সমাজের অন্যান্য বৃত্তির মতোই এই নিষ্ঠুর বৃত্তিও সমাজের এক অংশের পুরুষের চাহিদা মেটানোর জন্য তৈরি হয়েছিল বললে অত্যুক্তি হয় না৷ যদিও অধিকাংশ গণিকাবৃত্তিধারিণীই রূপে গুণে হীন ও উপার্জনে স্বভাবতই দীন ছিল৷ তারপরেও যে কজন শিক্ষিতা সুন্দরী রুচিবান বিনোদিনীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে কুলরক্ষক পুরুষেরা নিজেদের অর্থ উপার্জন প্রায় নিঃশেষ করে ফেলে তার সমস্ত দোষ গিয়ে বর্তায় সেই দেহজীবার কাছেই৷

যে সমাজ নারীকে চরিত্র সংযমের কঠিন আবর্তে পাক দিয়ে গেছে, যে সমাজে ‘সতী’ শব্দের কোনো পুংলিঙ্গ প্রতিশব্দ নেই, যে সমাজ ‘চরিত্র’ বলতে শুধুমাত্র যৌনশুচিতাকেই বুঝিয়েছে সেখানে মুহূর্তের সামান্যতম ভ্রান্তিতে নারী নিক্ষিপ্ত হয়েছে গণিকালয়ে৷ আর পুরুষের যৌন প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে নারীদের এই অপমান অব্যহত থেকেছে৷ তাই উজ্জয়িনীর নগরলক্ষ্মী বলে যে বসন্তসেনা অভিহিত ছিল তাকেই বিটের মুখ দিয়ে নাট্যকার দেহজীবা বলে সচেতন করে দিয়েছে, ‘বিষ্ণুপুরাণ’, ‘পরাশর সংহিতা’, ‘অত্রি সংহিতা’-য় গণিকাগমনের প্রায়শ্চিত্তের কথা আছে, রামায়ণ-মহাভারতে এত সংখ্যক নারীদের পুরুষের সেবার জন্য দান করার পরেও তাদের সম্পর্কে অনেক নিন্দাসূচক মন্তব্য বিবৃত হয়েছে৷ বলা হয়েছে গণিকা সংসর্গ পাপ, নগরের দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ যমের দিকে গণিকালয় নির্মাণ করাবার কথা৷ মধ্যযুগের ‘মানোসোল্লাস’ নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে নগরের প্রান্তদেশে অর্থাৎ লোকালয়ের সীমার বাইরে থাকবে বেশ্যাপল্লীগুলো৷ যে শিক্ষা, কলা, চরিত্র, গাম্ভীর্য সর্বোপরি সর্বাঙ্গীন শিক্ষিত রূপবতী নারীরা তাদের বিদ্যাবুদ্ধির আকর্ষণ-মাধুরী দিয়ে গণিকাধক্ষের দ্বারা ‘গণিকা’ আখ্যা পেত (কামশাস্ত্র) তাদের প্রতি যদি সমাজের এত ঘৃণাসূচক ব্যবহার লক্ষিত হত তাহলে অগুনতি সেই দাসী হয়ে যাওয়া গণিকাবৃত্তিধারী শিক্ষা-সৌন্দর্য রুচিহীন নারীদের কি পরিণতি হতো তা ভাবতে গা শিউরে ওঠে৷

গণিকাকে ঘৃণা করতো সমাজ কিন্তু তার উপার্জন, তার অর্থসম্পদকে নয়৷ তাইতো তাদের রাজস্ব দিয়ে রাষ্ট্রের কোষাগার স্ফীত হয়ে থাকতো, কৌটিল্য, বাৎস্যায়ণ যার প্রমাণ রেখে গেছেন৷ বৌদ্ধ সাহিত্যের আম্রপালী বৌদ্ধভক্তদের জন্য ‘আমবাগান’ই দান করেছিল, জৈন সাহিত্যের বিত্তবান গণিকা চিত্রশালা প্রতিষ্ঠা করে, জৈন মঠে প্রচুর দান ধ্যান করে জনহিতকর নানা কাজে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে৷ সমাজ অকপটে এদের দান গ্রহণ করে গেছে কিন্তু তাদেরকে গ্রহণ করতে পারেনি৷

গণিকারা মহাপাপী৷ কিন্তু পৌরাণিক সংস্কারে দেখা যায় যে দুর্গাপ্রতিমা নির্মাণের জন্য গণিকালয়ের মাটি অত্যন্ত আবশ্যিক উপাদান৷ এ রহস্যের সমাধান কিছুটা পাওয়া যায়—মহাব্রতা যাগে পুংশ্চলীর সঙ্গে ব্রহ্মচারীর সংলাপ কিংবা ব্রাত্যস্তোমে৷ যৌনতার মধ্য দিয়ে প্রজননধারা যেমন অব্যাহত থাকে তেমনি গণিকাবৃত্তিও যৌনতারই পরিপোষক৷ তাই কোথাও কোথাও যেন যৌনতা, প্রজনন, গণিকা এক হয়ে যায়৷ তাই উর্বরাতত্ত্বের নানা লৌকির আচারাদি প্রসঙ্গে নৃতাত্ত্বিক বিভিন্ন গ্রন্থাদিতে লক্ষ করা যায় ক্ষেত্রের উপর নরনারীর মিলন, উত্তরবঙ্গের রাজবংশী লোকাচারে ‘হুদুমদেও’ বা ‘জলমাঙ্গা’-র গানে বিবস্ত্র নারীগণের রাতের গভীর অন্ধকারে ক্ষেত্রের মধ্যে উদ্দাম লাস্যনৃত্য৷ অর্থাৎ এই যৌন ইঙ্গিত উর্বরা তন্ত্রের পরিপোষক৷ গণিকারা যৌনতার প্রতীক হিসেবে নানা যজ্ঞীয় অনুষ্ঠানে স্থান পেয়েছে৷ অপরদিকে কোথাও কোথাও শষ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী দুর্গার সঙ্গে যৌনশক্তি তথা উর্বরতার প্রতীক গণিকাদের সহধর্মীতার সাদৃশ্যে দুর্গামূর্তিতে বারাঙ্গনার গৃহমৃত্তিকা আবশ্যিক বলে গৃহিত হয়েছে৷ যদিও গণিকার জননীত্ব গৌণ তবু তার যৌনত্বই উর্বরতার আবহ বহন করে বলে বেদ থেকে দুর্গাপূজা পর্যন্ত কৃষিজীবি সমাজে তার এই স্থান বলে মনে করেছেন প্রাবন্ধিক সুকুমারী ভট্টাচার্য৷ মানুষ তার সুবিধা আদায়ের জন্য গণিকাদের যতটুকু কাজে লাগানোর দরকার ততটুকুই করেছে তার বাইরে বেশ্যারা অপাংক্তেয়৷ আর যৌনতার জন্যই এরা পরিণত হয়েছে প্রান্তিক মানুষে৷ এই অসহায় চিরবঞ্চিত, লাঞ্ছিত নারীরা জীবনভর শুধু অপমানই ভোগ করেছে, ধনীরা তাদের উদ্বৃত্ত অর্থের বিনিময়ে অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তুর মতই নারীশরীর ক্রয় করেছে, নির্বিচারে উপভোগ করেছে তার পর ছুড়ে ফেলে দিয়েছে৷ নারীর এই ভয়াবহ পরিণতিতে চরমতম দুরবস্থায় সমাজ মুখে কুলুপ এটে পৌরুষের জয়গান গেয়েছে৷

এই গণিকা বা বেশ্যাদের মর্মান্তিক জীবনধারা নিয়ে কিছু একটা করার বাসনা আমার অনেক দিনের পুরোনো অর্থাৎ যখন বুঝতে পারি যে বেশ্যা কাদের বলে৷ ছোটবেলায় সচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল পাগল স্বামী ও শিশুপুত্র নিয়ে সহায়-সম্বলহীন অসহায় এক নারীর দেহজীবিকার মাধ্যমে উপার্জন করা এবং সামাজিক অসহযোগিতা—অবশেষে তার নির্মম মৃত্যুর মতো ঘটনা৷ তার এই জীবনযুদ্ধ এবং পরাজয় আমাকে দেহজীবী সমাজপতিতা নারীদের প্রতি ভাবনার এক বৃহৎ ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়৷ অবশেষে বেশ্যাদের জন্য কিছু করার কল্পনাবিলাস বাস্তবের মাটি স্পর্শ করে রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. দীপককুমার রায় মহাশয়ের সান্নিধ্যে৷ তখন তিনি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন অর্থাৎ ২০১২-১৪ সাল৷ আমি সে সময় তাঁর তত্ত্ববধানে এই গণিকা নারীদেরই একটা দিক নিয়ে এম. ফিল ডিগ্রী অর্জন করি৷ গণিকা তথা গণিকা বিষয়ে আমার অনুসন্ধান অব্যাহত থাকে৷ এ বিষয়ের উপর তাত্ত্বিক ও আকর গ্রন্থগুলির অধ্যায়ের সুবাদে পরবর্তীসময়ে এক বৃহত্তর গবেষণাকর্মের দিকনির্দেশ পেয়ে যাই এবং ড. দীপককুমার রায় মহাশয়ের উৎসাহ , প্রেরণা ও তত্ত্বাবধানে ‘বাংলা উপন্যাসে গণিকা চরিত্র (১৮৬৫-১৯৪৭)’ শীর্ষক শিরোনামে পি. এইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করি৷ এ গ্রন্থ সেই গবেষণা কর্মেরই ফল৷

এই যে যুগ যুগ ধরে অবহেলিত এই নারীরা স্থান পেয়েছে সাহিত্যের বিচিত্র বেদীতে বর্তমান সময়ে তাদের অবস্থা আরও জটিল৷ নারীর স্বাধীকারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিবর্তিত হচ্ছে তাদের জীবন; তাদের অবস্থান৷ সমাজের একশ্রেণী তাদের দিকে মুখ তুলে চাইছে—তাদের জীবন যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করছে৷ বিশ শতকের নানা উপন্যাসাদিতে আলোচিত হয়েছে তারই নানা ব্যাখ্যান৷ এটি হচ্ছে প্রান্তিক মানুষের চর্চা৷ বর্তমান যুগে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে এই প্রান্তিক মানুষের চর্চা খুব জরুরী৷ এখানে সমাজের সর্বদিক দিয়ে অবহেলিত এবং ঘৃণিত নারীকুলের সামগ্রিক চিত্রকে অনুধাবন করা যায়৷ যে প্রবৃত্তির দাহকে মেটানোর জন্য পুরুষ তার নিজের প্রয়োজনে বেশ্যা তৈরি করেছে, নিজের সুরক্ষার জন্য সমাজের প্রান্তসীমায় নিক্ষেপ করেছে-সেখান থেকে তাদের মুক্ত করার দায় অস্বীকার করার প্রবণতা পুরুষের মধ্যেই প্রবল৷

 কোনো গণিকালয়ই নারীর ইচ্ছায় গড়ে উঠেনি—তারা তার সৃষ্টিকর্তাও নয়৷ পুরুষের সতর্ক প্রহরায়, সচেতন মানসিকতায় সৃষ্ট সেই যৌনখোঁয়াড়ে ধুকে ধুকে মরে দেহব্যবসায়ী নারীর দল; যদিও তারা শরীর দেয় এবং পুরুষেরা অর্থের বিনিময়ে তা গ্রহণ করে অতৃপ্ত যৌনক্ষুধা পরিতৃপ্ত করে৷ তারা বহুপুরুষভোগ্যা নারীর জন্য বেশ্যালয় তৈরি করেছে কিন্তু বহুনারীভোগ্যা পুরুষের জন্য আজ পর্যন্ত স্বতন্ত্র কোনো আলয় তৈরি হয়নি৷ সমগ্র আলোচনার মধ্যে পুরুষের অত্যাচারে, সমাজের অত্যাচারে নারীর গণিকা হওয়ার নির্মম চিত্র যেমন রয়েছে; তেমনি তা থেকে মুক্তির জন্য বুকফাটা আর্তনাদও ধ্বনিত হয়েছে৷ বিভিন্ন সাহিত্যিকের কলমে তাদের জন্য সহানুভূতি বর্ষিত হয়েছে—সমাজে মানুষ হিসেবে তাদের মর্যাদাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সদুপদেশ, সৎপ্রচেষ্টা রয়েছে কিন্তু প্রকৃতভাবে এই একবিংশ শতাব্দীতে তারা কতটা মর্যাদার অধিকারী তার প্রকৃত স্বরূপ কারও অনবগত নয়৷ যেদিন সমাজপতিতা এই নারীরা দেহজীবিকার নারকীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হতে পারবে—যেদিন নারীর যৌনতাকে পণ্য করে পুরুষ সমাজ আর যৌনপরিতৃপ্ততার উপায় খুঁজবে না সেদিনই গণিকা নারীদের প্রকৃত মুক্তি ঘটবে—বলে আমি মনে করতে পারি৷

জলপাইগুড়ি

২৫.১১.২০২০

২. ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে গণিকা

ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে গণিকা

‘গণিকা’ শব্দটি নারী সমাজের ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ৷ শব্দটির ব্যুৎপত্তি—‘‘স্ত্রী [গণ + ইক + (ঠন্) অস্ত্যর্থে + স্ত্রী-আ (টাপ্)]৷ এর অর্থ—গণ (সমূহ) যাহার ভর্ত্তৃরূপে আছে৷’’ পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই অর্থনৈতিক দুরবস্থা বা দারিদ্র্যের বলি হয় নারীরা৷ তাদের শরীরকে পণ্য করে চলতে যাকে এক ঘৃণ্য বিকিকিনির খেলা৷ ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতিতে চিরকাল অবহেলিত হয়ে আসছে এই গণিকারা৷ সমাজ এদের বেশি করে চেনে বেশ্যা নামে৷ অর্থাৎ ‘‘স্ত্রী [বেশ + য (যৎ) + স্ত্রী-আ (টাপ্)]৷’’ যুগ যুগ ধরে সমাজের ভোগতৃষ্ণা পূরণের জন্য এরা লালিত, লাঞ্ছিত এবং ব্যবহৃত৷ নারী হয়ে জন্মগ্রহণ করেও জীবনের প্রতিকূলতায় এরা ‘বারনারী’ বহু পুরুষকে যৌন-আনন্দ দানকারী৷ সমাজের ঘৃণ্য অবহেলাকে মস্তকে ধারণ করে থাকা এই পণ্যাঙ্গনারা জন্ম থেকেই বেশ্যা হয় না বা বেশ্যাবৃত্তিতে মাথা গলায় না বরং বাঁচার অভীপ্সা রাখে সকলের সঙ্গে; তবু হয়ে ওঠে গণিকা, ঘৃণিতার চেয়েও ঘৃণিতা—এক কলঙ্কিত জীবনের আকরভূমি৷ কবে, কোথায়, কীভাবে এই নির্মম বৃত্তির জন্ম হয়েছিল তার হদিস পান না সমাজতাত্ত্বিকেরা, তাই তার সূত্র খোঁজা হয় প্রাচীন সাহিত্য-উপাদানের রন্ধ্র রন্ধ্র থেকে৷ কারণ যে কোনো সভ্যতারই সামাজিক বৈশিষ্ট্যের বীজ লুকিয়ে থাকে তার নিজস্ব রচনাগুলির মধ্যে৷ প্রাচীন ভারতীয় রচনা ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় তিনহাজার বছর আগে, খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ থেকে নবম শতাধীর মধ্যে৷ তার মধ্যে কোথাও বেশ্যাবৃত্তির উল্লেখ নেই কিন্তু তার কয়েকশত বছর পর যখন বেদের পরবর্তী অংশ ‘ব্রাহ্মণ’ রচিত হয় (অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে পঞ্চম শতধীর মধ্যে) তাতে বারাঙ্গনাদের উল্লেখ রয়েছে৷ যেমন ‘গণিকা’ ‘বেশ্যা’, ‘রুদ্রগণিকা’, ‘দেববেশ্যা’ ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ৷ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ থেকে নবম শতাব্দীর ‘ঋগ্বেদ’ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে পঞ্চম শতাব্দীর ‘ব্রাহ্মণ’-এর মধ্যবর্তী সময়কার বিভিন্ন সামাজিক কার্যকলাপ সমাজের বুকে গণিকাবৃত্তিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ইন্ধন যুগিয়েছে৷ আমাদের সেই সমাজ নারীর প্রতি যত কঠোর হয়েছে, সতীত্ব বা নিয়ম-কানুন, নিষেধের পরাকাষ্ঠায় নারীর জীবনকে যত দৃঢ়ভাবে মূল্যায়নের চেষ্টা করেছে; তত দেখা গেছে নারীকে কলুষিত করার প্রচেষ্টা৷ পিঞ্জরাবদ্ধ নিষ্ঠুর জীবন-যাপনের নাগপাশ থেকে বেরোতে গিয়ে বহু নারী হয়ে উঠেছে গণিকা বা বেশ্যা৷ নারীদের গণিকা হিসেবে আত্মপ্রকাশের কয়েকটা কারণ বাসাম তাঁর ‘ওয়াণ্ডার দ্যাট ওয়াজ ইণ্ডিয়া’ গ্রন্থে যুক্তিযুক্তভাবে প্রতিপন্ন করেছেন৷ যেমন—

১) স্বজাতি পাত্রের সন্ধান না পাওয়া৷

২) নারীর প্রতি আত্মীয় ও শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের দুর্ব্যবহার৷

৩) নানারকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানে শিশুকন্যাদের উপহার হিসেবে দান করা৷

৪) অকাল বৈধব্য৷

৫) ধর্ষিতা ও অপহৃতা নারীদের সামাজিকভাবে বহিষ্কার৷

অর্থাৎ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নানাবিধ নিয়ম, কানুন, নিষেধ, নির্দেশ,অত্যাচার-অবিচার, অবহেলা ইত্যাদিই নারীর গণিকা হয়ে ওঠার প্রধান কারণ৷ এর সঙ্গে রয়েছে পারিবারিক ঔদাসিন্য, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন এবং দুমুঠো অন্ন সংস্থানের সুতীব্র প্রয়োজনীয়তা; যা শুধু কিশোরী-যুবতীদের নয় শিশুদেরকেও এই বৃত্তি গ্রহণে বাধ্য করে তুলেছে৷

গণিকা কারা :

দেহসম্ভোগ গণিকাবৃত্তির একটি প্রধানতম দিক৷ কিন্তু যদি কোনো নারী একাধিক পুরুষের সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হয় তাহলেও তাকে দেহজীবী হিসেবে নির্দিষ্ট করা যাবে না যদি না তার সঙ্গে অর্থ বা অন্য কিছু বিনিয়োগের কোনো যোগসূত্র থাকে৷ অর্থাৎ দেহ সম্ভোগের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিনিয়োগের বা অন্য কোনো দ্রব্য-বস্তুর আদান-প্রদানের একটা যোগসূত্র থাকতেই হবে যা সেই নারীর জীবন জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ সুতরাং গণিকা তাদেরই বলা যাবে, যে নারীরা দেহকে পণ্য করে জীবিকা নির্বাহ করে৷ পুঁজিবাদী সমাজে মজুরির ভিত্তিতে শ্রমবিভাজন ব্যবস্থায় এই গণিকারা সবসময় যৌনবিনোদনকারী হিসেবে চিহ্নিত এবং নিন্দিত৷ মানসিক এবং বৌদ্ধিক সবরকম অনুভূতিকে দূরে সরিয়ে রেখে এদের একমাত্র পরিচয় নারী শরীর৷

গণিকার বৈশিষ্ট্য :

সবরকম দিক বিচার করে দেহপসারিণী নারীদের কয়েকটি বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা যায়৷ যেমন—

১) এই বৃত্তিতে নারী ও পুরুষের দৈহিক সম্পর্কের অন্যতম প্রধান মাধ্যম হল অর্থ বা অন্য কোনো বস্তুর বিনিয়োগ৷ অর্থাৎ পুরুষকে পণ্যাঙ্গনার কাছ থেকে যৌন আনন্দ পেতে গেলে অবশ্যই কিছু না কিছু বিনিয়োগ করতে হবে৷

২) যৌন আনন্দ দানকারী নারীকে বহুপুরুষভোগ্যা হতে হবে৷

৩) দেহকে অবলম্বন করে উপার্জন নারীটির প্রধান বা অপ্রধান জীবিকা হতে হবে৷ অর্থাৎ নারীটির অর্থনৈতিক সঙ্গতি কোনো না কোনোভাবে দেহ-বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকবে৷

৪) শরীরী সম্পর্কে লিপ্ত নারী-পুরুষের মধ্যে কোনো মানসিক যোগ থাকবে না৷ তাদের সম্পর্ক একে অন্যের প্রতি প্রেম-ভালোবাসার নয়, শুধুমাত্র ব্যবসায়িক৷

গণিকার বিভিন্ন নাম :

দেহব্যবসায়ী এই নারীরা নানা নামে পরিচিত৷ নারীর প্রতি নির্মম-নিষ্ঠুর এ সমাজ তাদের অবজ্ঞায়-ঘৃণায় অবদমিত করে বিভিন্ন অভিজ্ঞানে অভিনন্দিত করেছে; নারী-পুরুষের মিথুনের সুখানুভূতিকে স্থূল দেহরুচিতে বেঁধে তাদের পরিণত করেছে কামনা পরিপূরণের শাণিত অস্ত্রে৷ সেখানে তারা মর্মসহচরী নয় নর্মসহচরী; উগ্রকামনা দমনের একমাত্র মাধ্যম৷ অর্থাৎ নারীর কমনীয় সৌন্দর্যকে স্থূলদেহরুচির তীব্র পেষণে পিষ্ট করে নারীদেহকে ভোগের মানসিকতা চিরকালের৷ তাই ‘‘যে মানসিকতায় হারেমে আবির্ভূত হয়েছিল উপপত্নী, রক্ষিতা, মাগ, রাখনী তারই সম্প্রসারণ দেখা দেয় দাসী, নটী, দেবদাসী, বাইজী, বারবধূ এবং শেষ পরিণামে গণিকা, বেশ্যা, বারাঙ্গনা৷’’

নারীদেহমন্থনের এই ঘৃণ্য খেলায় কিছু স্থূল রুচিবোধসম্পন্ন মানুষেরা তাদের বিভিন্ন নামে বিভূষিত করে কদর্য দেহকামনা নিরসনের উপায় খুঁজেছে৷ যেমন—‘বেশ্যা’, ‘পতিতা’, ‘বারাঙ্গনা’, ‘বারস্ত্রী’, ‘বারবধূ’, ‘বারবনিতা’, ‘পণ্যাঙ্গনা’, ‘রূপাজীবা’, ‘দেহজীবা’, ‘দেহপসারিণী’, ‘দেহব্যবসায়ী’ প্রত্যেকটি নামের সঙ্গেই মিশে আছে ভদ্র সমাজ থেকে বিচ্যুতির কথা৷ নামগুলিকে বিশ্লেষণ করলেই উঠে আসে এর প্রকৃত স্বরূপ৷ যেমন—‘বেশ্যা’ আভিধানিক অর্থ হল যে নারী অর্থের বিনিময়ে একাধিক জনকে দেহসঙ্গ দান করে৷ অর্থাৎ ‘বিশ্’ বা জনসাধারণের ভোগ্যা৷ ‘‘বৈদিক যুগে পতিতা রমণী ছিল,… পতিতারা বিশ বা আর্য্য শ্রেণীর লোক সাধারণের ভোগ্যা ছিল বলিয়া তাহাদের নাম হইয়াছিল ‘বিশ্যা’৷ শব্দটির ব্যুৎপত্তির কথা বিস্তৃত হওয়াতে সংস্কৃত ভাষায় বৈদিক শব্দের ই-কার স্থানে এ-কার হইয়া গিয়াছিল৷’’ ‘পতিতা’ শব্দটি সুনীতি ও শালীনতার নির্ধারিত মান থেকে যাদের পতন হয়েছে সেই নারীদের নির্দেশ করে৷ এর ব্যুৎপত্তি ‘‘পত্  + ত (ক্ত)-ক৷’’ ‘বার’ বা বহুপুরুষের অঙ্কশায়িনীরা হলেন বারবনিতা, বারাঙ্গনা, বারবধূ, বারস্ত্রী৷ পণ্যজ্ঞানে যারা নিজেদের উৎসর্গ করে তারা পণ্যাঙ্গনা৷ রূপ আজীব যার সে ‘রূপাজীবা’ আর দেহের পসরা সাজিয়ে যার বিকিকিনি সে দেহপসারিণী৷ দেহ ব্যবসায়ী তারা যারা দেহকেই রুজি-রোজগারের মাধ্যম করে জীবন অতিবাহিত করে৷ এছাড়াও গণিকাদের নামের সমার্থক আরও বহু নাম আছে যেগুলি তাদের বৃত্তি, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদিকে সুস্পষ্টভাবে প্রতিবিম্বিত করে৷ যেমন অগ্রু, কুচনি, ইত্বরী, কামোরবাজ, কুম্ভদাসী, কুলটা, অতিস্কদ্বরী, অজ্জুকা, খানকি, খানসেনা, এজমালি, কঁড়ে, রাঁড়ি, কসবি, ঘুষ্কি, চুতিয়া, ছেনাল, ঘইতা, ঢেমনি, কামলেখা, কামিনা, কেপ্ট, গণেরু, গশতি, খাঁউ, গস্তানি, গুদমারানি, চুতমারানি, মাংমারানি, গ্যান, ছুটকোমেয়ে, জঙ্খাল, জঙ্খী, টানখাওয়া, জনপদবধূ, ঠুমকি, খালকুঠি, খেরেলি, খানু, চাবি, দুগগি, দো-তললি, দারী, চুদখানকি, চুসকি, ছানকি, চাটাইসার, চ্যাঙলা, ছাপকি, আধিয়া, সাই, ধর্ষকারিণী, ধর্ষণী, ছিটুয়া, কামিনী, ছুটো, নগ্নিকা, পউনি, পিসকুরি, প্রেষণী, বন্ধুরা, বারোযোষিৎ, বাঁদি, মঞ্জিকা, রাণ্ডি, রামা, রূপদাসী, রুণ্ডিকা, নটী, নগরবধূ, ধুমড়ি, নটিনি, নগরনটী, নটীদারী, নষ্টচরিত্রা, নগরশোভিনী, নেহনি, নগ্না, নৈশবালা, পুংশ্চলী, পরপুষ্টা, পুংস্কামা, প্রস, প্রস্টিটিউট, পিলকুরি, পাতুরিয়া, পাকটি, পেশাকর, বাজারি মেয়ে, রক্ষিতা, ফয়ার, ফেদড়ি, বাবোন, ফ্লাইং, বর্বটি, বারকানসি, বর্ণদাসী, বারবাণী, বারোভাতারি, বিল্লি, বিষকন্যা, ভণ্ডহাসিনী, ভুঞ্জিকা, বেবুশ্যে, বেশার্হা, বেশ্যে, ভোগ্যা, ভ্যাতা, মকর, রেণ্ডি, লঞ্জিকা, শালভঞ্জি বা শালভঞ্জিকা, লাইনের মেয়ে, লম্পটি, লিঙ্গামাকড়ি, লেদার, সঞ্চারিকা, সন্ধিজীবক, সাঙার, সিটউরি, সিটিয়া বা সেঠিয়া, সোধিয়া, সাঙার, সাধারণী, স্পর্শা, স্বতন্ত্রা, স্বাধীনযৌবনা, স্বৈরী বা স্বেরিণী, হট্টবিলাসিনী, স্বরবীথিকা, হস্রা, হাফগেরস্ত, হোর, সেক্সওয়ারকার, আর.পি (Registered Prostitute), ইট ওয়াট বা ইট হোয়াট (eat = খান what = কি, হল খানকি) মাগি—সংক্ষেপে এম. জি, রতায়নী, মুহূতির্কা, রজয়িত্রী, নানাখাতাই, যৌনকর্মী ইত্যাদি৷ নামগুলি সমস্তই অপমানজনক৷ গণিকাদের এই নাম প্রাচুর্যের সুষ্ঠু প্রতিফলন দেখা যায় নিম্নোক্ত কবিতাটিতে—

‘‘নিজের ঘরে হাতের মুঠোয়:

 পত্নী, ঘরণী, শয্যাসঙ্গিনী, অঙ্গলক্ষ্মী, সতী, পতিপ্রাণা, সুভগ৷

ভিন্ন ঘরে নিয়ন্ত্রণে:

 উপপত্নী, রক্ষিতা, মাগ, উপস্ত্রী, রাখনী৷

সবার ঘরে নিন্দা করে:

 অসতী, ভ্রষ্টা, ব্যাভিচারিণী, নষ্টা, দ্বিচারিণী, স্বৈরিণী৷

প্রমোদ ঘরে সবার তরে:

 নটী, নটদারী, সঞ্চারিকা, রূপজীবী, বাইজী৷

বেশ্যা ঘরে আটক করে:

 গণিকা, বেশ্যা, বারাঙ্গনা, বারবধূ, বারনারী, মঞ্জিকা৷

বিশ্বপটে নতুন নামে:

 বারড্যান্সার, ক্যাবারে ড্যান্সার, মডেল গার্ল, বিশ্বসুন্দরী, কলগার্ল৷’’

গণিকারা শুধু নামে অপমানিত, ঘৃণিত নয় তাদের পেশাটিও শ্রুতিকটু নানা অভিধায় অভিব্যক্ত৷ সেখানে অসম্মানজনক এক নির্মম বৃত্তিকে সামনে নিয়ে আসে৷ যেমন আদিম ব্যবসা, গণিকাবৃত্তি, কামিনাপনা, কশব, খানকিপনা, খানকিগিরি, গাণিক্য, গস্তানি, বেশ্যাগিরি, বেশ্যাবাজি, মাগিগিরি, মাগিবাজি, গুদামভাড়া, মাগিপনা, ছিনালি বা ছেনালি, খেমটা খেলা, ছেনালিপনা, নাগরালি, পতিতাবৃত্তি, বাঁধাই, বেশ্যাপনা, বেসাতি, লাইনে নামা, ভুতোলবাজি, ভোতোরবাজি, পতিতাবৃত্তি এবং বর্তমানে যৌনক্রিয়া বা এসকর্ট সার্ভিস৷

সমাজবঞ্চিতা পতিতা এই নারীদের অবস্থান সমাজ থেকে বহু দূরে; অন্য আরেক জগতে৷ সর্ব পাপকে বক্ষে ধারণ করে সমাজকে সুস্থ রেখে এই ‘নারী’ পরিচয়ধারী গণিকারা সমাজে স্থান পায় না—আস্তাকুঁড়ে পশুর মত মিথুনের জতুগৃহ তৈরি করে তিলে তিলে ছাই হয়ে যায়৷ তাদের সেই বসতখানাও রুচিবিকৃত বিভিন্ন নামে চিহ্নিত৷ যেমন—বেশ্যাপাড়া, বেশ্যাপটি, বেশ্যাপল্লী, বেশ্যালয়, আনোনদবাজার, কাপাখানা, কুততো, খাঁই খাঁই, কালি বাড়ি, ক্লাব-হাউস, খানকিবাড়ি, খানকিটোলা, খানকিপাড়া, খালিকুঠি, গণিকাপল্লী, গণিকালয়, তিরথো, গ্যান-ভ্যান, দলিজ, দোখিনপাড়া, দোকানিয়া, নিষিদ্ধপল্লী, নিষিদ্ধপাড়া, মাগিবাড়ি, মাগিপাড়া, পতিতাপল্লী, পতিতালয়, বিলাখানা, ভিয়েটনাম, নকিং সপ, ব্রথেল, সাঙগারবাড়ি, রাঁড়ের বাড়ি, লালবাতি অঞ্চল আর পুলিশি কেতায় রেড-লাইট এরিয়া৷

অর্থাৎ পুরুষেরা চিরকাল ধরে নারীকে সঙ্গিনী করে তার দেহকে যেমন উপভোগ করে এসেছে তেমনি তার ভালোলাগা না-লাগার অনুভূতিগুলিকে বিভিন্ন কৌশলে পর্যুদস্ত করেছে৷ আর সমস্ত ক্ষেত্রেই কাজ করেছে তার স্থূল দেহপিপাসা৷ গণিকাদের উপর আরোপিত নানা নাম, তাদের পেশা, তাদের বাসস্থান সবকিছুকে নানাবিধ ঘৃণ্য অভিধায় অভিজ্ঞানিত করে তাদেরকে অপমানের, লাঞ্ছনার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে দিয়েছে৷ আবার বর্তমান সময়ে গণিকাদের যে আধুনিক ‘যৌনকর্মী’ অভিধা প্রয়োগের প্রয়াস দেখা যাচ্ছে সেখানেও নারীত্বের অবমাননার আরেক রূপ প্রতিফলিত৷ যদিও বেশ্যা নামটি ব্যবহারের মধ্যে যে শালীনতাবোধের দ্বন্দ্ব দেখা যায় ‘যৌনকর্মী’ শব্দটি সেক্ষেত্রে শ্রুতি সুখকর৷ আর কিছু সুযোগ সন্ধানী মানুষ ‘যৌনকর্মী’ নামটি প্রয়োগ করে তাদের শ্রমিক বানিয়ে দেহব্যবসার মতো নারীদেহভোগ ও নির্যাতনের মতো ঘৃণ্য প্রথাকে টিকিয়ে রাখার প্রয়াস চালিয়ে বৈধ স্বীকৃতির দাবিতে মেতে উঠেছে, সঙ্গে সঙ্গে নারীদেহ মন্থনের আড়াল-আবডাল উঠিয়ে দিয়ে সামাজিক পরিবেশে তাকে অবাধ ভোগের পণ্য করে গণিকাবৃত্তিকে আরও বিস্তৃততর করতে যত্নবান হচ্ছে৷

গণিকার শ্রেণীবিভাগ :

গণিকার স্বরূপকে সহজরূপে পরিস্ফূট করতে গেলে কর্মের ধরন অনুযায়ী তাদের বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভাজন করা অবশ্যই প্রয়োজন৷ কারণ বিষদভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় গণিকাদের কেউ পল্লীতে অবস্থান করে, খদ্দের তার বাড়িতে আসে৷ অনেককে আবার রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দের ধরতে হয়৷ কেউ কেউ আবার সামাজিকভাবে কারও স্ত্রী বা বোন হয়েও অর্থাৎ সুস্থ সামাজিক পরিবেশে থাকা সত্ত্বেও কখনো কখনো দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকে৷ কর্মপদ্ধতির এই পার্থক্যের নিরিখে গণিকাদের কয়েকটি শ্রেণীতে বিভাজন করা যায়৷ যেমন—(১) অপ্সরী, (২) দেবদাসী, (৩) সভানারী, (৪) সেবাদাসী, (৫) বাইজি, (৬) বেশ্যা বা গণিকা, (৭) উপপত্নী, (৮) রক্ষিতা, (৯) কলগার্ল, (১০) ভ্রাম্যমান যৌনকর্মী, (১১) বারড্যান্সার, (১২) ক্যাবারেড্যান্সার, (১৩) শিশু গণিকা বা Child Prostitute. (১৪) স্বৈরিণী, (১৫) এসকর্ট, (১৬) স্ট্রিপার, (১৭) কোর্টসান৷

১) অপ্সরা :

‘অপ’ শব্দের অর্থ জল৷ ‘রামায়ণ’ মতে সমুদ্র মন্থন থেকে অপ্সরার উৎপত্তি হয়৷ ‘মহাভারতে’ কশ্যপপত্নী প্রধার গর্ভে অলম্বুষা প্রভৃতি চতুর্দশ অপ্সরার উৎপত্তি বর্ণিত হয়েছে৷ ‘কাদম্বরী’-তে মহাশ্বেতাকৃত অপ্সরাগণের বংশ বর্ণনায় ব্রহ্মার মানসদেব অনল জল প্রভৃতি থেকে চতুর্দশ কুলের উৎপত্তি উল্লিখিত হয়েছে৷ অভিধান চিন্তামণির টীকায় ব্রহ্মা বিষ্ণু যম থেকে প্রভৃতি একোনচত্বারিংশৎ অপ্সরার উৎপত্তি বিষয়ে ব্যাড়িধৃত বচন উদ্ধৃত হয়েছে৷ অপ্সরার উৎপত্তি বিষয়ে এইরূপ নানা মত আছে৷ মহাভারতে পাণ্ডবের উৎপত্তি বর্ণনায় অনুচানা, অনবদ্যা, গুণমুখ্যা প্রভৃতি বহু অপ্সরার নামোল্লেখ আছে৷ ঊর্বশী, মেনকা, ঘৃতাচি, রম্ভা, বিশ্বাচী ইত্যাদি বহুপরিচিত অপ্সরা নাম৷

২) দেবদাসী :

দেবদাসী হল দেবপরিচারিকা৷ মন্দিরের দেবতার উদ্দেশ্যে কুমারী মেয়েদের দান করা হয়, সেই দেবতাই হয় সেই বালিকার স্বামী৷ শুধু ভারতীয় কেন বহু সভ্যতাতেই এই প্রথা লক্ষণীয়৷ ব্যাবিলনে প্রায় চারহাজার বছর আগে দেবী ইশতারের মন্দিরে মেয়ে পুরোহিত সহ বহু দেবদাসী ছিল৷ গ্রীসের করিন্থ শহরে দেবী অ্যাফ্রোদিতির মন্দিরে একহাজার দেবদাসী ছিল বলে মনে করা হয়৷ দেবদাসীরা দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হলেও মন্দির সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে দেহদান করতে বাধ্য হত৷ আবার কারও কারও সমাজে যথেষ্ট প্রতিপত্তিও ছিল৷

দেবদাসীর ধারণাও বহু প্রাচীন৷ বেদের পরবর্তীকালে যখন ইন্দ্র বৈদিক দেবতার স্থানে শিব, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতার পূজা শুরু হয় সঙ্গে সঙ্গে মন্দির স্থাপনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যায়৷ এই দেবতাদের সঙ্গীত-নৃত্যপ্রিয় হিসেবে কল্পনা করে তাদের মনোরঞ্জনের জন্য দেবদাসীদের মন্দিরে নিয়োগ করা হয়৷ ক্রমে পুরোহিত এবং সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা নিজেদের যৌনসুখ পরিতৃপ্তির জন্য দেবতার নামে উৎসর্গীকৃত এই নারীদের ব্যবহার করতে আরম্ভ করে৷ দেবদাসীরা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে বিভিন্ন উপায়ে মন্দিরে আসত৷ তাদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য দেবদাসীদের বিবিধ শ্রেণীবিন্যাসের মধ্য দিয়ে নানা উপায় বের করে শোষক পুরুষসমাজ৷ যেমন—

(ক) দত্তা : যদি কোন পুণ্যলোভী গৃহস্থ স্ব-ইচ্ছায় কন্যাকে মন্দিরে দান করে তবে সেই কন্যা দত্তা৷

(খ) হৃতা : যে মেয়েকে হরণ করে এনে মন্দিরে উপহার দেওয়া হত৷

(গ) বিক্রেতা : যাদের মন্দিরে পাঠানো হত অর্থের বিনিময়ে৷

(ঘ) ভৃত্যা : যে মেয়েরা স্বেচ্ছায় মন্দিরে আত্ম উৎসর্গ করত৷

(ঙ) ভক্তা : যে সন্ন্যাসিনী মেয়েরা নিজের ইচ্ছেতে মন্দিরবাসিনী হত৷ অনেক রাজকন্যাও এভাবে দেবদাসী হয়েছে৷

(চ) সালংকারা : নৃত্য-গীত প্রভৃতি নানা কলাবিদ্যায় পারঙ্গম হওয়ার পর যে নারীকে অলংকৃত করে মন্দিরে দেবতার নামে অর্পণ করা হত৷

(ছ) গোপিকা বা রুদ্রগণিকা : এরা মন্দিরের বেতনভোগী দেবদাসী৷ নির্দিষ্ট দিনে বা সময়ে নৃত্যগীত করার জন্য এদের আহ্বান করা হত৷

দেবদাসীদের কথা তৃতীয় খ্রিস্টাব্দের আগে স্পষ্টভাবে পাওয়া যায় না৷ তারপরে রচিত পুরাণ৷ পুরাণগুলোতে দেবদাসীদের কথা অনেক পাওয়া যায়৷ যেমন যারা স্বর্গ কামনা করে তাদের বালিকা ক্রয় করে মন্দিরে উৎসর্গ করা উচিৎ—ভবিষ্য পুরাণে এমন কথা বলা হয়েছে৷ সপ্তম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ওড়িশার মন্দিরগুলোতে দেবদাসী প্রথার এতটাই প্রসার ঘটেছিল যার সাক্ষ্য দেয় মন্দিরের গায়ে নৃত্যরত মেয়েদের ছবি৷ নানা ভ্রমণকাহিনি ও রচনারাজীও দক্ষিণভারতে এই দেবদাসী প্রথার প্রসারের সাক্ষ্য বহন করে৷ সপ্তম শতাব্দীতে মুলতানের সূর্যমন্দিরে হিউয়েন সাঙ দেবদাসীদের উপস্থিতি দেখেছিলেন৷ যে মন্দির যত ধনী ছিল সেখানকার দেবদাসীর সংখ্যা তত বেশি ছিল৷ এছাড়া তৎকালীন রাজারাও পুণ্যকামনায় মন্দিরে দেবদাসী দান করতেন৷ ভারতের নানা অঞ্চল থেকে পাওয়া শিলালিপি, তাম্রলিপি থেকে রাজা এবং অন্যান্য বিত্তবানদের মন্দিরে দেবদাসী উৎসর্গ করা, তাদের দিয়ে নৃত্যগীতের আয়োজন করা, সম্পত্তি দান ইত্যাদি বিবরণ পাওয়া যায়৷

প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’-এর বসন্তসেনা, ‘সুতনুকা প্রত্নলেখ’-তে উল্লিখিত সুতনুকা, কলহনের ‘রাজতরঙ্গিণী’-র কমলা এরা সকলেই দেবদাসী৷ সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর ‘রামচরিতমানস’-এ নৃত্যরত দেবদাসীর কথা লিখেছিলেন৷ এদের সামাজিক অবস্থান বেশ্যাদের মতো নয়৷ এরা বারভোগ্যা হলেও তাদের জীবনাচারণ সমাজের কাছে ঘৃণ্য ছিল না৷ দেবতার সেবায় নিয়োজিত হয়ে এরা যথেষ্ট সম্মানের অধিকারী হত৷

দক্ষিণ ভারতের নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে দেবদাসী প্রথার নানা ধরন রয়েছে৷ যেমন মাদ্রাজের দেবদাসীদের মধ্যে প্রধান দুটি সম্প্রদায়—ভালাঙ্গাই এবং ইদাঙ্গাই৷ ভালাঙ্গাইদের জাতের বাছবিচার রয়েছে কিন্তু ইদাঙ্গাইরা সকলকেই গ্রহণ করে৷ কোয়েম্বাটুরের কাইকোলন সম্প্রদায়ের মধ্যে নিয়ম হল পরিবারের অন্তত একটি মেয়েকে দেবমন্দিরে উৎসর্গ করতে হয়৷ কেরলাপুরম মন্দিরের দেবদাসীদেরও দুটি শ্রেণী৷ কুরাকুদ্দি ও চিরাপ্পুকুটি৷ কুরাকুদ্দিদের রোজ মন্দিরে উপস্থিত থাকতে হয় আর চিরাপ্পুকুটিদের বিশেষ বিশেষ দিনে মন্দিরে এলেই চলে৷ মহীশুর এবং ধারওয়ারের বয়া ও বেদারু সম্প্রদায়ের নিয়ম হল যে পরিবারে পুত্র না জন্মে শুধুমাত্র কন্যা জন্মেছে তাদের একজনকে দেবমন্দিরে উৎসর্গ করা হয়৷ সেই দেবদাসীর নাম ‘বাসবী’৷ পশ্চিম ভারতে দেবদাসীদের বলে ‘ভাবিন’ (রূপসী মহিলা), দেবলী (দেবতার দাসী), নাইকিন (রক্ষিতা) প্রভৃতি৷ মারওয়ারের দেবদাসীরা নিজেদেরকে বলে ‘ভগতান’ অর্থাৎ ভগবানে সমর্পিতপ্রাণ সন্ন্যাসীর পত্নী৷ তথাপি কালের গ্রাসে এদের যৌবন অতিক্রান্ত হলে দুর্দশার শেষ থাকতো না৷

দেবদাসীদের জীবনের শেষ পর্যায় মর্মান্তিক৷ মহিশুরে নিয়ম ছিল দেবদাসী বৃদ্ধ হলে অবসরের প্রতীক হিসেবে রাজসভায় সবার সামনে কানের গহনা ‘পম্পাদাম’ খুলে ফেলে পিছন দিকে না তাকিয়ে তাকে সভা ত্যাগ করতে হত৷ তিরুপতি মন্দিরের দেবদাসীকে বিদায় দেওয়ার সময় লোহা পুড়িয়ে তার উরু এবং বুকে বেঙ্কটেশ্বরের সিলমোহরের ছাপ দেওয়া হত৷ সেই দেবদাসীর নাম হত কলিযুগ লক্ষ্মী৷ অর্থাৎ তরুণী দেবদাসী বৃদ্ধ হলে, তার যৌবন অতিক্রান্ত হলে পুরুষ সমাজের তাকে আর কোনো প্রয়োজন থাকে না৷ মন্দিরের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা সকলের মনোরঞ্জনকারিণী দেবদাসী শেষ বয়সে পথের ভিখারি হয়ে বিভৎস মৃত্যুযন্ত্রণায় পচে মরে৷ দেবতার নাম করে মানুষের যৌনপিপাসাকে তৃপ্ত করার এক বৈধ ব্যবস্থা হল দেবদাসী প্রথা৷

(৩) সভানারী বা রাজনর্তকী :

সবাই যেখানে মিলিত ভাবে শোভা পায় তাই ‘সভা’৷ আর সভায় উপস্থিত ব্যক্তিদের আনন্দদানকারী নারীরা হল সভানারী৷ ভারতে বিবিধ রাজরাজড়াদের ইতিহাসে এমন চরিত্রের সন্ধান মেলে৷ এরা রাজনর্তকী নামেও পরিচিত৷ রাজসভায় নৃত্যগীত পরিবেশন করে পারিষদদের তুষ্ট করত৷ নিজের দেহকে উৎসর্গ করে দিত রাজা তথা রাজ-অমাত্যদের সেবায়৷

(৪) সেবাদাসী :

‘সেবাদাসী’ বৈষ্ণব-মহন্তদের পরিচর্যাকারিণী বৈষ্ণবী৷ বৈষ্ণব আখড়ায়, বৈষ্ণবের সেবায়, মনোরঞ্জনে, নিজের শ্রম, রূপ সবকিছুকে অকাতরে বিলিয়ে দিত৷ আর সেবার নাম করে পুরুষের দুর্বার শরীরী পিপাসাকে মিটিয়ে রাখে এই সেবাদাসীরা৷ এখানে পরপুরুষ সম্ভোগ আছে৷ কণ্ঠীবদল যদিও এই সেবাদাসী হওয়ার প্রধান শর্ত৷ এই প্রথায় ‘বৃত্তি’ বা জীবিকা তেমনভাবে প্রতিফলিত হয় না৷ সেবাদাসীরা অন্ন-বস্ত্র-আশ্রয় জীবনের এই ত্রিবিধ ভরসাতে মুখ বুজে নিজেদের উৎসর্গ করে দেয়৷ এরা পেশাদার গণিকার মতো মজুরির ভিত্তিতে প্রকাশ্যে দেহের দর হাকে না৷ সমাজ ভোগের জন্য, কামনা-বাসনার দরজাকে উন্মুক্ত রাখার জন্য ধর্মের দোহাই দিয়ে সেবাদাসীর মতো প্রথাকে জিইয়ে রেখেছে৷ এরা তাদের কদর্য দেহভোগের কালিমাকে আড়াল করে কিছুটা সামাজিক মর্যাদা পেলেও মানসিক মুক্তি পায় না, নিজের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বরং শিউরে ওঠে৷

(৫) বাইজি :

‘বাই’ শব্দটা বেশ্যার নামের সঙ্গে প্রযোজ্য; বাইজি অর্থ পেশাদার নর্তকী ও গায়িকা৷ বাইজির সমার্থ শব্দগুলি হল—নাচনি, নাচনেওয়ালি, তওয়াইফ, খঞ্জরি, খেমটাওয়ালি, কোর্টিসান, গশতি, জান, তরফাওয়ালি, নচ-গার্ল, পাতুর, বাইওয়ালি, রামজানি৷ তাদের বৃত্তিও নানা নামে ভূষিত৷ যথা—খেমটা নাচ, ঠুমকি, পাতুর-বাজি, তয়ফা, বাইনাচ, বাইজিনাচ এবং তাদের বাসস্থানকে কোঠা, বাইবাড়ি, বাইজিখানা ইত্যাদি নামে চিহ্নিত করা হয়৷ ‘বাঈ’ শব্দটির ব্যবহার সম্মানার্থেও হয় অর্থাৎ বড়বোন৷ যেমন মীরাবাঈ, লক্ষ্ণীবাঈ, রমাবাঈ ইত্যাদি৷

যে নারীরা নৃত্যগীতকে প্রধান অবলম্বন করে দেহপসারিণী হয়ে ওঠে তারা হল বাইজি৷ এরা প্রধানত মুসলিম ধর্মাবলম্বী এবং উত্তর ভারতের ধ্রুপদী সঙ্গীত ও নৃত্যে পারদর্শিনী৷ মুঘল রাজত্ব ও তার সঙ্গে দেশীয় রাজা-নবাবদের পতনের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর ভারতের বাইউলিরা কলকাতার বুকে এসে আশ্রয় নেয়৷ কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী, জমিদার শ্রেণীর লোকেরা সর্বোপরি উনিশ শতকে কলকাতায় গড়ে ওঠা ‘হঠাৎ বাবু’ সম্প্রদায় এদের সানন্দে গ্রহণ করে৷ কলকাতায় বাইনাচ প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে৷ দুর্গাপূজার সময় বাবুদের বাড়ির জৌলুসের প্রধান আকর্ষণ ছিল বাইনাচ৷ ১৮২৫ সালের ‘ক্যালকাটা গেজেট’ পত্রিকায় পুজোর সংবাদের এক বিবরণ থেকে জানা যায় যে, উৎসবের তিনদিন রাজা কিষেণ চাঁদ রায়ের বাড়িতে নাচবে নিবি-দি বিলিংটন অব দি ইস্ট৷ নীলমণি মল্লিকের জলসা ঘরে নাচবে ঊষারানী, জয় কিষাণ রায়ের বাড়িতে নাচবে মিসরী৷ দিল্লী, বেনারস, লক্ষ্ণৌ এমনকি কাশ্মীর থেকেও বাইজিরা নাচার জন্য আসতো৷ সেই সময়কার প্রসিদ্ধ লোকরঞ্জনকারী বাইজিরা হল—নিকি, আশরুন, নুরবক্স, বন্নু প্রভৃতিরা৷ বাইজি তথা বাইনাচ বাংলার আনাচে-কানাচে প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে৷

(৬) বেশ্যা বা গণিকা :

বেশ্যা শব্দটির ব্যুৎপত্তি হল—‘‘স্ত্রী [বেশ + য (যৎ) + স্ত্রী-আ (টাপ্)]৷’’ আর ‘গণ’ বা ‘সমূহ’ যার ভর্ত্তৃরূপে অবস্থান করে সে গণিকা৷ শব্দটির ব্যুৎপত্তি—‘‘স্ত্রী [গণ + ইক (ঠন্) অস্ত্যর্থে + স্ত্রী-আ (টাপ্)]৷’’ বেশ্যা বা গণিকারা কোনো নিষিদ্ধপল্লীতে অবস্থান করে দেহকে পণ্য করে তোলে; শরীরী সক্ষমতায় ‘খদ্দের’-কে সন্তুষ্ট করে উপার্জন করে৷ নানা পর্যায়ে এই শ্রেণীর গণিকারা বিভক্ত৷ যেমন—যারা সবচেয়ে নিম্নশ্রেণীর তারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘খদ্দের’ সংগ্রহ করে৷ কুলি, মজুর শ্রেণীর মানুষেরা এই শ্রেণীর গণিকার সঙ্গে সংসর্গ করে৷ অর্থ সংস্থান কম হওয়ায় নোংরা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে অসহ্য কষ্ট সহ্য করে এরা জীবন নির্বাহ করে৷ ‘মাঠকোঠা’ অর্থাৎ মাটির বাড়িতে থাকে মধ্যম শ্রেণীর রূপাজীবারা৷ এদের অবস্থা ‘মন্দের ভালো’৷ দোকানদার, ব্যবসায়ী প্রভৃতিরা এই শ্রেণীর বারাঙ্গনাদের খরিদ্দার৷ বেশ্যাদের মধ্যে যারা উচ্চ পর্যায়ের তারা অনেকটাই সুখী৷ রাস্তায় গিয়ে এদেরকে লোক ধরতে হয় না৷ পাকা বাড়িতে বাস করে এরা৷ কায়দা কানুন, শরীরী সৌন্দর্য সব উন্নতমানের৷ আর্থিক কৌলিন্যে অনেকটা সচ্ছল শ্রেণীর৷ কেরানিস্তরের কর্মচারীরা এই ধরনের বারবনিতার দেহ সম্ভোগ করে৷

(৭) উপপত্নী :

উপপত্নীরা অবৈধ প্রণয়াসক্ত নারী৷ এরা ঢেমনি বা গৌণপত্নী নামেও পরিচিত৷ যদি কোনো নারীকে কোনো পুরুষ বিয়ে না করেও তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক থেকে শুরু করে সম্পূর্ণ ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন সেই নারী পুরুষটির উপপত্নী হিসেবে পরিচিত হয়৷ উপপত্নী নারীরা পোষক পুরুষের কাছে স্ত্রীর সম্পূর্ণ অধিকার লাভ করে শুধুমাত্র সামাজিক মর্যাদা ছাড়া৷ বিয়ে না করে পরপুরুষের সঙ্গে জীবনাচরণে অভ্যস্ত উপপত্নীর কোনো সামাজিক মূল্য নেই৷ পোষক বাবুর মোহ কেটে গেলে চরম লাঞ্ছনায় বাকি জীবন অতিবাহিত করতে হয়৷ সমাজ নির্মম পদাঘাতে তাকে ক্ষত বিক্ষত করে৷

(৮) রক্ষিতা :

‘রক্ষিতা’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি করলে দাঁড়ায় [রক্ষ + তৃ (তৃচ্)-ক ১ব; স্ত্রী-ত্রী]-এর অর্থ ‘পালিত’ বা নিজের উপভোগের জন্য পালিত৷ অর্থাৎ রক্ষিতা কোনো পুরুষের বাঁধা নারী৷ কোনো গণিকা যখন নির্দিষ্ট একজন পুরুষের অধীনে থেকে তার সবরকমের ইচ্ছে অনিচ্ছে পূরণ করে তখন সেই গণিকা হয় সেই পুরুষের রক্ষিতা৷ পুরুষটি বা রক্ষিতার বাঁধা বাবু তাকে মোটা অঙ্কের টাকা দেয় জীবন যাপনের জন্য৷ রক্ষিতা সেই টাকা মাসোহারা হিসেবে পায়৷ রক্ষিতারা গণিকাদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের৷ এদের রোজগার অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি৷ গণিকা সমাজে এরা সম্মানীয়া৷ বাঁধাবাবুরা শুধু এদের অর্থপ্রদানই নয় স্বর্ণালঙ্কার থেকে শুরু করে আস্ত বাড়িই কখনো কখনো তাদের হাতে তুলে দিত৷ ধন-সম্পদে ভরিয়ে দিত৷ রক্ষিতাদের মধ্যে নিয়ম হল তারা তাদের পোষক বাবু ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না৷ বা অন্য কোনো খরিদ্দারকে গ্রহণও করতে পারবে না যতদিন রক্ষিতা সেই বাবুর অধীনে থাকবে৷ তবুও যদি কেউ পোষক পুরুষের বাইরে অপর কোনো ব্যক্তির সঙ্গে শরীরী সংসর্গ করে তাহলে গণিকা সমাজে তার পরিচয় হয় ‘ছুটু’ নামে৷

(৯) কলগার্ল :

গণিকাদের শ্রেণী বিভাজনে ‘কলগার্ল’ অনেকটাই নবীন৷ আমাদের দেশে কলগার্ল সম্পর্কে প্রথম গবেষণা করেন ড. প্রমীলা কপূর৷ তিনি বলেছেন ১৯২০ সাল নাগাদ শব্দটির উৎপত্তি হয় ব্রিটেনে৷ প্রাক-দূরভাষ যুগে ব্রিটেনে কিছু কল হাউস গড়ে উঠেছিল যেগুলিকে নিয়মিত গণিকালয় বলা হত না৷ যখন খদ্দের আসতো তখন মালিকের কাছ থেকে বার্তাবাহক পাঠানো হত মেয়েদের কাছে৷ আর সেই মত মেয়েরা এসে মিলিত হত৷ এরপর ১৯৪০ এর দশকে যখন টেলিফোনের প্রসার ঘটে তখন বার্তাবাহকের কাজ করে ফোন কল৷ আর সেই থেকে ‘কলগার্ল’ ধারণা তৈরি হয় এই হিসেবে যে, কলগার্ল একজন অদৃশ্য যৌনকর্মী যার সঙ্গে ‘ক্লায়েন্ট-কে টেলিফোনে ‘অ্যাপোয়েন্টমেন্ট’ নিতে হয়৷ অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস ইউনিভার্সিটি এবং ন্যাশনাল হেলথ এণ্ড মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল এর সহযোগিতায় ২০০৭ সালে সমাজতত্ববিদ রবার্ট পারকিন্স ও ফ্রান্সের লাভজয় অস্ট্রেলীয় কলগার্লদের নিয়ে যে সমীক্ষা করেছেন তাতে ‘কলগার্ল’-এর কার্যপদ্ধতিতে টেলিফোনের যে প্রধান ভূমিকা আছে তা স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন৷ এদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা যায় যে ‘‘কলগার্ল একজন সাধারণ দৃষ্টিতে অদৃশ্য যৌনকর্মী যার সঙ্গে খদ্দেরের সংযোগ ঘটে টেলিফোনের মাধ্যমে৷’’১০ শুধুমাত্র যোগাযোগের পন্থায় নয় তার সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থানের মধ্যেও কলগার্লদের বিশেষত্ব নিহিত আছে৷ ১৯২০ সালের ব্রিটেনের কলগার্লদের সঙ্গে যৌনপল্লীতে থেকে দেহব্যবসা করে যে বারাঙ্গনারা তাদের তেমন কোনো পার্থক্য ছিল না কিন্তু আজকের সময়ে কোনও কলগার্লই নিতান্ত ব্যতিক্রম ছাড়া যৌনপল্লীর বাসিন্দা নয়৷ শ্রেণীগত ভাবে নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত পরিবারের মধ্যে তাদের অবস্থান৷ যৌনপেশার পাশাপাশি তাদের স্বতন্ত্র পেশাও থাকে, থাকে সামাজিক পরিচয়৷ ‘Prostitution And beyond’ বইতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে—‘‘She may be the seemingly self-confident executive, a company asset. Or she may be the typical middle-class housewife walking past you, leading a child by the hand. Or she may be just a college girl who usually ‘hangs out’ with her friends is discos. Yet, all it takes is a phone call. A ‘contact’ for a ‘programme’, and these housewife, executives, actresses, college students shift to there identity as call girls.’’১১ অর্থাৎ সামাজিক গোপনীয়তার আড়ালে থেকে যে যৌনকর্মী পেশায় লিপ্ত থাকে এক কথায় সেই কলগার্ল৷ এদের মধ্যস্থতা করে অন্য কোনো ব্যক্তি কারণ কলগার্লরা কখনোই সরাসরি ‘ক্লায়েন্ট’দের সঙ্গে মিলিত হয় না৷ এ সম্পর্কে ‘Prostitution And Beyond’ বইতে আরও বলা হয়েছে—‘‘In call girl terminology, a network is known as a line. Here, the agent plays a pivotal role in all transactions. They know not only the client’s requirements and his willingness to spend but also the profile of ‘his’ call girls or their ‘demand’. Demand in agent terminology is the valuation of a call girls beauty, physique, connection with the glamour world and so forth whereas ‘programme’ is the word used when referring to the actual encounter with the clent. It is always the agent’s responsibility to fix the ‘programme’ that is to negotiate the rate of the callgirls, the services required by the client, the venue and the time convenient to both the parties. often these ‘Programme’ are held in hotels or guesthouses. Sometimes residential units, like the agents house, are rented for the purpose.’’১২

বর্তমান মোবাইল-ইন্টারনেটের দুনিয়ায় কলগার্লদের পেশা আরও বহু বিস্তৃত৷ নিজেকে আড়াল করে সামাজিক পরিচয়ের আবেষ্টনীর মধ্যে থেকে অল্প সময়ে অধিক আয়ের এই বৃত্তিটি কমবয়সি উচ্চাকাঙ্খী নারীসমাজের কাছে সহজেই গ্রহণীয় হয়েছে৷ মনোজ দাশ তাঁর ‘ কলকাতার কলগার্ল’ বইতে এদের বলেছেন ‘হাফগেরস্ত’৷ দেবরাণী কর তাঁর ‘কলকাতার নগরনটী’ বইতে ‘Clandestine Prostitute’ বা ‘গোপন পতিতা’ বলে চিহ্নিত করেছেন৷

(১০) ভ্রাম্যমান যৌনকর্মী :

ভ্রাম্যমান যৌনকর্মীরা অনেকটা কলগার্লের মতো তবে কলগার্ল নয়৷ কলগার্লদের মধ্যস্থতাকারী ব্যক্তি থাকে যাদের মাধ্যমে তারা ‘ক্লায়েন্ট’ পায়৷ ভ্রাম্যমান যৌনকর্মীরা নিজেরাই নিজেদের ‘খদ্দের’ ঠিক করে৷ এরা কোনো যৌনপল্লীর বাসিন্দা নয়৷ কোন শহর বা শহরতলীর দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা সকালবেলায় বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে বা সিনেমাহলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে; সরাসরি খদ্দের ঠিক করে এবং কোনো পরিচিত বাড়ি বা হোটেলে গিয়ে মিলিত হয়৷ নিজের এলাকায় এরা অফিস বা কলকারখানার কর্মী হিসেবে পরিচিত৷ সারাদিন তারা যেভাবেই কাটাক না কেন দিন শেষে যে যার মতো ঘরে ফিরে যায়৷

(১১) বারড্যন্সার :

বারড্যন্সার বেশ্যাবৃত্তির আধুনিক এক পর্যায়৷ অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা এই বৃত্তির প্রধান কারণ৷ বহু সংখ্যক নৃত্যগীত পারদর্শী নারী ড্যান্সার হয়ে ‘বার’ বা পানশালাগুলিতে মদ্যপ, লম্পট ব্যক্তিদের যৌনবিনোদন দিতে গিয়ে নিজেকে পণ্য করে৷ পানশালার নর্তকীর ভূমিকা পালন তাদের বাহ্যিক আড়ম্বর, বেশিরভাগ বারড্যান্সারাই নৃত্য-গীত পরিবেশনের নাম করে দেহব্যবসা করে থাকে৷

(১২) ক্যাবারে ড্যান্সার :

‘ক্যাবারে’ শব্দটির ফরাসী অর্থ ‘সরাইখানা’৷ সমগ্র ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের বহুস্থানে এর অনুরূপ প্রতিষ্ঠান দৃষ্টিগোচর হয়৷ এই সরাইখানাগুলিতে বহু কমবয়সি পারদর্শিনী নারীরা পথিকদের মনোরঞ্জন করার জন্য নৃত্যগীত সর্বোপরি দেহব্যবসার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ভাবে সচ্ছল হতে চেষ্টা করে৷ এরা ক্যাবারে ড্যান্সার হিসেবে পরিচিত৷ এদের পেশার সঙ্গে বেশ্যাবৃত্তি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত৷

(১৩) শিশু গণিকা :

নারীদেহ পুরুষের লোলুপ জৈবরসনায় সর্বদাই আস্বাদের সামগ্রী৷ তাই তাদের যৌনপিপাসা মেটাতে শিশুরাও বাদ পড়ে না৷ এই শ্রেণীর শিশু গণিকাদের বেশিরভাগই পথশিশু এবং অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের অন্তর্ভূক্ত বালিকা৷ যারা সামান্য কিছু খাদ্য বা অর্থের লোভে শরীর বিক্রয় করে৷ এছাড়া পরিচারিকার কাজ করতে যাওয়া শিশুরা বাড়ির মালিক বা অন্য কারও দ্বারা শরীরী খেলায় অভ্যস্ত হয়ে গণিকা হয়ে যায় অথবা পাচার হয়ে যাওয়া শিশুরা যৌনপল্লীতে বিক্রয় হয়ে দেহজীবী হতে বাধ্য হয়৷

(১৪) স্বৈরিণী :

‘স্বৈরিণী’-এর ব্যুৎপত্তি ‘‘স্ত্রী [ স্বৈরণ + স্ত্রী-ঈ (ঙীপ)]৷’’১৩ স্বেচ্ছাচারিণী, পাংশুলা, কুলটা প্রভৃতি এর সমার্থক৷ এই নারীরা পতি ত্যাগ করে স্বেচ্ছানুসারে অন্যপুরুষকে গ্রহণ করে৷ সমাজে স্বৈরিণীরা ঘৃণার পাত্রী৷ নানা কারণে স্বামীর প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে নারীরা স্বৈরিণী হয় বা পরপুরুষে লিপ্ত হয়৷ এদের সঙ্গে পরপুরুষের দৈহিক যোগের সাথে মানসিক যোগও বর্তমান থাকে৷ বাৎস্যায়ন তাঁর ‘কামসূত্র’-এর চতুর্থ প্রকরণের ষষ্ঠ অধ্যায়ে ৫৪ নং সূত্রে নয় ধরনের গণিকার মধ্যে স্বৈরিণীদেরও উল্লেখ করেছেন৷

(১৫) এসকর্ট :

এসকর্ট গণিকাদের আরেকটা শ্রেণী৷ এদের কর্মকে এসকর্ট সার্ভিস বলা হয়৷ আর ক্লায়েন্ট এবং এসকর্টের মধ্যে মধ্যস্থতা করে এসকর্ট এজেন্সি৷ এসকর্টরা শিক্ষিত, সুন্দরী, শরীরীভাবে সক্ষম, মিশুকে এবং পরিবেশ উপযোগী৷ ক্লায়েন্টরা এসকর্ট এজেন্সির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে এসকর্টদের সঙ্গে সময় কাটায়৷ এরা এজেন্সির বেতনভূক্ত কর্মচারী৷ ঘন্টা, দিন, এমনকি সপ্তাহ হিসেবে এদের দর নির্দিষ্ট হয়৷ নারী পুরুষ নির্বিশেষে এসকর্ট হতে পারে৷

(১৬) স্ট্রিপার :

এরা এমন এক ধরনের যৌনকর্মী যারা অর্থের বিনিময়ে ক্লায়েন্টদের শরীর দেখায়৷ সাধারণত কোনো ‘পানশালা’ বা ‘কর্পোরেট’-এর অধীনে কাজ করে তাদের পেশাকে সচল রাখে৷

(১৭) কোর্টসান :

এই শ্রেণীর বারবনিতাদের রক্ষিতার আধুনিক রূপান্তর বললে অত্যুক্তি হয় না৷ এরা অর্থ, মান, যশসম্পন্ন কোনো উচ্চবিত্ত পুরুষের অর্থপ্রদত্ত যৌনসঙ্গী৷ ‘কোর্টসান’রা একজন বা দুজনের বেশি ক্লায়েন্ট রাখে না৷

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে এসকর্ট, স্ট্রিপার, ‘কোর্টসান’রা পণ্যাঙ্গনার আধুনিক রূপান্তর৷

প্রাচীন যুগের সমাজ ও সাহিত্যে গণিকার পর্যায়বাচক প্রায় পঞ্চাশটি নাম পাওয়া যায় যা দিয়ে তাদের পরিচয়, সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে অনেকটাই ধারণা করা যেতে পারে৷ সেই ‘ঋক’ বেদের যুগ থেকেই গণিকা শব্দের সমার্থক নানা শব্দ ওঠে এসেছে, যা থেকে বৃত্তিটির প্রাচীনতা সম্পর্কে আভাস পাওয়া যায়৷ ‘ঋক’ বেদে রয়েছে হস্রা, অগ্রু৷ (৪:১৬:১৯:৩০; ৪:১৯:৯); সাধারণী (১:১৬৭:৪; ২:১৩:১২, ১৫, ১৭) এর কিছু পরে ‘অথর্ব’ বেদে পাওয়া যায় পুংশ্চলী৷ (১৫:১:৩৬; ২০:১৩:৬;৫) ‘শুক্ল যজুর্বেদ’-এর ‘বাজসনেয়ী সংহিতা’য় এবং ‘কৃষ্ণ যজুর্বেদ’-এর ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’তে সাধারণী ও সামান্যা শব্দ দুটির (৩:১২) ও (৩:৪৭) উল্লেখ আছে৷ আরও কিছুকাল পরে ‘তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ’-এ অতিস্কদ্বরী ও অপস্কদ্বরী শব্দদুটি পাওয়া যায় (৩:৪:১১:১) অর্থাৎ যে নিয়ম উলঙ্ঘন করে এবং ব্রজয়িত্রী, যে আনন্দ দেয়৷ (‘বাজসনেয়ী সংহিতা’ (৩০:১), তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, (৩:৪:৭:১)৷ যে ক্ষণকালের সঙ্গিনী অর্থাৎ মুহূত্তিয়া শব্দটির উল্লেখ রয়েছে ‘বিনয়পিটক’-এ৷ জাতকে রয়েছে বন্নদাসী, নারিষের, রূপদাসী, বেশ্যা, গামনী, নগরশোভিনী, ইত্থি এবং জনপদ কল্যাণী৷ জাতকের এই গণিকাদের মধ্যে রূপদাসী ও বন্নদাসীরা প্রধানা গণিকার অধীনে থেকে অথবা স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থীকে আপ্যায়ন করতে পারতো৷ আরও পরবর্তীকালে সময় যত এগিয়ে যায় নারীর সামাজিক অবস্থান যত সংকুচিত হয়ে পড়ে ততই সমাজের বুকে গণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে৷ মহাকাব্যে, পুরাণগুলিতে এবং অন্যান্য সাহিত্যিক উপাদানে অসংখ্য গণিকা নাম উঠে আসে৷ যেমন স্বৈরিণী, বারস্ত্রী, কুলটা, বারাঙ্গনা, বারবনিতা, স্বতন্ত্রা, স্বাধীন যৌবনা, নটী, শিল্পকারিকা, কুম্ভদাসী, পরিচারিকা ইত্যাদি৷ রূপাজীবা ও গণিকা নামদুটির উল্লেখ রয়েছে বাৎস্যায়নের ‘কামসূত্র’-এ৷ জটাধরের ‘শব্দরত্নাবলী’-তে শালভঞ্জিকা, বাররাণী, বর্বটি, বারবিলাসিনী, শূলা, ভণ্ডহাসিনী, কামরেখা ইত্যাদি নামের উল্লেখ রয়েছে ‘শব্দমালা’ অভিধানে গণিকার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে লঞ্ছিকা৷ বৃষলী, পাংশুলা, লঞ্ছিকা, বন্ধুরা, কুন্তা, শূলা, কামরেখা, বর্বটি, রণ্ডা ইত্যাদি কিছু নাম ‘বৈশিকতন্ত্রে’-ও পাওয়া যায়৷ হেমচন্দ্রের ‘অভিধান চিন্তামণি’-তে সাধারণ স্ত্রী, পণ্যাঙ্গনা, ক্ষুদ্রা, ভুঞ্জিকা ও বারবধূ এই নামগুলির উল্লেখ আছে৷ এছাড়া ‘রাজনির্ঘন্ট’ অভিধানে ভোগ্যা ও স্মরবীথিকা, ‘অমরকোষ’-এ বেশ্যা, বারস্ত্রী গণিকা ও রূপজীবা এবং ‘ব্রহ্মবৈবর্ত’ পুরাণে কুলটা, বৃষলী বা পুংশ্চলী, বেশ্যা, যুঙ্গী, মহাবেশ্যা ইত্যাদি বহু গণিকার প্রতিশব্দ উঠে এসেছে৷ গণিকা শব্দের এই প্রতিশব্দের উদ্ভব এক সময়ে হয়নি৷ যুগ যুগ ধরে নারীদেহ সম্ভোগের যতরকম কৌশল তৈরি করেছে পুরুষসমাজ, যতভাবে নারীকে লাঞ্ছিত করার পথ খুঁজেছে, তারই ধারাবেয়ে নামগুলি উঠে এসেছে৷ সুতরাং বেশ্যাবৃত্তি অতিপ্রাচীন এক পেশা, ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে গণিকারা অনেকযুগ আগে থেকেই বিচরণ করছে৷ শুধু ভারতীয় কেন বিশ্ব ইতিহাসেও গণিকাবৃত্তি পুরোনো এক পেশা৷ কবে, কোথায়, কখন, কীভাবে নারীদেহ মন্থনের এমন এক বৃত্তি সমাজের বুকে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল তার সন্ধান সমাজতাত্ত্বিকেরা খুঁজে পাননি তবে সকলেই একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে ‘‘জীবনধারণের যতগুলি উপায় প্রাচীনতম, তার মধ্যে বেশ্যাবৃত্তি যে একটা, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই৷’’১৪

যে কোনো দেশের সামাজিক ইতিহাসের বীজ লুকিয়ে থাকে তার সাহিত্য উপকরণগুলির মধ্যে৷ কারণ যাঁদের হাত ধরে সাহিত্য তার পূর্ণাঙ্গ রূপ নিয়ে আবির্ভূত হয় সেই সব কথাকারেরা সামাজিক মানুষ৷ সমাজের বুকে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনারাজীর মধ্য থেকেই তাঁরা সাহিত্যের রসদ আহরণ করেন৷ তাই ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যে গণিকাবৃত্তির আবির্ভাব, সমাজে তাদের অবস্থান কেমন ছিল, সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে সেই দিকগুলি ভারতীয় সাহিত্য উপকরণগুলির মধ্য থেকে আহরণ করার চেষ্টা করা হবে৷

বৈদিক যুগে গণিকা :

বৈদিক যুগের সাহিত্য উপকরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায় ঋক, সাম, যজুঃ অথর্ব ইত্যাদি বেদগুলিকে৷ প্রত্যেকটি বেদের আবার চারটি করে অংশ সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ৷ চারটি বেদের প্রথম ঋকবেদ রচিত হয় প্রায় তিনহাজার বছর আগে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দী থেকে খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে৷ ঋকবৈদিক যুগে নারীর সামাজিক অবস্থান তুলনামূলক ভালো ছিল বলে মনে করা হয়৷ পারিবারিক বন্ধনও ছিল দৃঢ়৷ এই যুগেই গণিকার বহু প্রতিশব্দ পাওয়া যায়—যেমন ঋগ্বেদে গণিকাবাচক যে সব শব্দ পাওয়া যায় সেগুলি হল—‘হস্রা’, ‘অগ্রূ’, ‘সাধারণী’, অথর্ববেদে রয়েছে ‘পুংশ্চলী’, ‘সাধারণী’ ও ‘সামান্যা’ ‘শুক্ল যজুর্বেদ’-এর ‘বাজসেনীয় সংহিতা’-য়৷ এই শব্দ দুটি ‘কৃষ্ণ যজুর্বেদ’-এর ‘তৈত্তিরীয় সংহিতা’-তেও পাওয়া যায়৷ আরও পরবর্তীকালে তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণে উল্লেখ রয়েছে ‘অতিস্কদ্বরী’ ও ‘অপস্কদ্বরী’ অর্থাৎ যে নিয়ম উলঙ্ঘন করে এবং ‘ব্রজয়িত্রী’—যে আনন্দ দেয়৷

সমাজে অবৈধ প্রণয়ের সম্পর্কও সে যুগে ব্যতিক্রমী ছিল না৷ বিবাহের ব্যাপারে বা সম্পর্কের ব্যাপারে সমাজ কঠোর না হলেও ভাই-বোন ও বাপ-মেয়ের মধ্যে যৌনসম্পর্কে সেই সমাজ ছিল খড়্গহস্ত৷ ঋগ্বেদ-এ—‘‘জারো ন’ অর্থাৎ ‘অবৈধ প্রেমিকের মতো’এ উপমা বারে বারে ব্যবহার করা হয়েছে৷ তা ছাড়া ঋগ্বেদে-এই গণিকার বহু প্রতিশব্দ পাওয়া যায়৷ কাজেই সমাজে গণিকাবৃত্তি তখনই বেশ পরিচিত ছিল৷ সব দেশে সব কালে যে সব অপরাধ চলে এসেছে তার অনেকগুলিরই ঋগ্বেদ-এ উল্লেখ করা হয়েছে৷’’১৫ পুরুষের বহুবিবাহ, বহুগামিতা, নারীদের অপহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি নারী শরীরকে ভোগ করার বহু উদাহরণ বৈদিক সাহিত্যের নানা অংশগুলিতে ছড়িয়ে রয়েছে৷ তবে এই যুগে মেয়েরা নিজের স্বাধীনতায় স্বামী নির্বাচন করতে পারতো অথবা বিবাহ না করে আজীবন কুমারী হয়েও জীবন কাটাতে পারতো৷ ‘‘বুদ্ধিমতী নারী হয়েও যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমন কথা শুনি৷’’১৬

বৈদিক যুগে বেশ্যাবৃত্তি নিন্দার ছিল না৷ কিন্তু বেদের পরবর্তী অংশগুলোর মধ্যে সমাজে নারীর অবস্থান পাল্টাতে থাকে৷ যজুর্বেদ-এ বিভিন্ন যজ্ঞবিধিতে নারীর প্রতি অবমাননাকর দিকগুলি উদ্ঘাটিত হয়েছে৷ নারীকে লাঠি দিয়ে মেরে বশীভূত করার কথা বলা হয়েছে এই যুগে কারণ নিজের দেহ বা সম্পত্তিতে নারীর কোনো অধিকার নেই৷ ‘‘স্ত্রীলাভের আগে সন্তান আসে না, তাই স্ত্রী দরকার৷’’১৭ এই সমাজে শুধু স্ত্রীতে নয় পুরুষের কামনা পূরণের জন্য দাসী রাখার বা বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে দাসী উপহার দেওয়ার কথা উল্লেখ আছে৷ এই দাসীরা গণিকার বিকল্প হিসেবে থাকতো৷ আসলে এ যুগে সাধারণ নারীর সাথে গণিকার তেমন কোনো ফারাক ছিল না৷ কারণ ঘরের স্ত্রীও শুধুমাত্র স্বামীর যৌনপিপাসা নিবারণ ও সন্তান উৎপাদনের সামগ্রী, গণিকার দ্বারাও সেই যৌনস্বাদ পূরণ হয়৷ আবার একজন পুরুষের এত স্ত্রী ও দাসী থাকতো যে আলাদা করে বেশ্যা সম্ভোগের দরকারই হত না৷

এই ব্রাহ্মণ সাহিত্যের যুগে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ থেকে খ্রিস্টপূর্ব নবম শতাব্দী) অশ্বমেধ যজ্ঞে পুরোহিতের জন্য দক্ষিণা থাকতো ‘‘চারশো গাভী, চার হাজার সোনার টুকরো (মুদ্রা), চারটি বিবাহিতা নারী, একটি কুমারী, চারশো দাসী ও প্রচুর খাবার জিনিস’’১৮ ‘কৌষীতকি ব্রাহ্মণ’-এ আছে;… ‘বহু স্ত্রীর পক্ষে এক স্বামীই যথেষ্ট’, হরিশ্চন্দ্রের একশোটি স্ত্রী ছিল৷ শতপথ ব্রাহ্মণ বলে ‘সমৃদ্ধ লোকের চারটি স্ত্রী থাকবে৷’ রাজারও তাই থাকত মহিষী, বাবাতা, পরিবৃত্তি ও পালাগলী—এ ছাড়াও একটি কুমারী ও চারশোটি দাসীও থাকবে৷ ঐতরেয় ব্রাহ্মণ-এ পড়ি অঙ্গরাজ তাঁর পুরোহিত আত্রেয়কে দশ হাজার দাসী দিয়েছিলেন৷’’১৯ তাহলে দেখা যায় বৈদিক যুগে গণিকা নারীরা যেমন রয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গে উচ্চবিত্ত সম্ভ্রান্ত পুরুষেরা, পুরোহিত এবং রাজা-ব্রাহ্মণরা একযোগে গণিকার পরিপূরক বহু দাসী রেখে কাম চরিতার্থ করতো৷ বৈদিক সমাজ ও সাহিত্য এই দেহবিনোদিনীদের নিয়ে বিশেষ এক স্থান দখল করে আছে৷ সমাজে দেহজীবাদের উদ্ভবের কারণ হিসেবে তাই বলা যায়—কীভাবে কবে গণিকাবৃত্তি প্রথম মাথা তুলে দাঁড়ালো তার হিসেব পাওয়া মুশকিল৷ তবে সভ্যতার সেই আদিপর্বের সাহিত্যগুলোকে বিশ্লেষণ করলে এর উদ্ভবের কারণ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে৷ সম্ভবত বলা যেতে পারে সমাজের মধ্যে যখন বিবাহ বা পরিবার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পিতা, স্বামী, সন্তানের রক্ষণীয় হয়ে তাকে জীবন কাটাতে হয় অর্থাৎ নারী যখন সমাজের চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি হয়ে বিধি নিষেধের বেড়াজালে তার স্বতন্ত্রতা হারায় তখন পারিবারিক আবেষ্টনীর বাইরে যে নারীকে পাওয়া যায় সে-ই গণিকারূপে প্রতিভাত হয়৷ সমাজ যখন নারীর উপর পুরুষের স্বত্বাধিকার মেনে নিতে শুরু করেছে তখন থেকেই গণিকাবৃত্তি বিকাশ লাভ করেছে৷ এর আরেকটি বিষয় গণিকাবৃত্তির প্রসারের সাহায্য করেছে তা হল মানুষের হাতে উদ্বৃত্ত বিত্তের সঞ্চয় যা জীবন ধারণের প্রয়োজন মেটানোর পর বিলাস-সম্ভোগে ব্যয় করার পথ তৈরি করেছে৷

পুরাণে গণিকা প্রসঙ্গ :

গণিকাদের পূর্বসূরী অপ্সরারা৷ তারা দেববেশ্যা, দেবগণকে আনন্দ দান করে৷ এরা দৈবপরিমণ্ডলেই বিচরণশীল৷ কিন্তু অনেক অপ্সরাই দেবতার নির্দেশে দৈবইচ্ছের পরিপূরক রূপে অথবা নিজেরাই প্রেমার্ত হয়ে পৃথিবীর ধূলিমলিন মৃত্তিকায় বিচরণ করেছে৷ পুরাণে অপ্সরাদের পরিচয় তারা ইন্দ্রের অনুচর; দেবসভার নর্তকী৷ পুরাণে যেভাবেই এদের বর্ণনা করা হোকনা কেন বৈদিক অপ্সরারা কিন্তু শরীরী জীব নয়, তাদের নামের গুঢ় অর্থ রয়েছে৷ অপ্সরা অর্থাৎ জলচারিণী—অপসারিণী৷ পণ্ডিতদের মতে সূর্যকিরণে সৃষ্ট জলীয় বাস্পই অপ্সরা৷ দেব-দেবীর রূপ বর্ণনায় লক্ষ করা যায় সেখানে মূল উৎস কিন্তু সূর্য৷ সূর্যই সকল প্রাণের সকল শক্তির উৎস৷ সূর্য পূজারই বিভিন্ন রূপ বিভিন্ন দেবতার জন্মদান করেছে৷ তাই অপ্সরা বা ঊর্বশী ভাবনাও সেখানে দেবী ভাবনার রূপক রূপে ব্যবহৃত হয়েছে৷ তাই পুরাণে ঊর্বশীকে নর্তকী হিসেবে দেখা হলেও বৈদিক সাহিত্যে সে সূর্যরশ্মি রূপে বন্দিত৷ সেখানে বলা হয়েছে উষাকালের সূর্যরশ্মি অর্থাৎ ঊর্বশী বা ঊষা নর্তকীর মতো নিজের রূপ প্রকাশ করছে৷

স্কন্দপুরাণ, কালিকাপুরাণ, পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, বামনপুরাণ ইত্যাদি পুরাণগুলিতে গণিকাদের বিভিন্ন অনুসঙ্গ প্রতিভাত হয়েছে৷ স্কন্দপুরাণ ও বামনপুরাণে ঊর্বশী সৃষ্টির এক কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে৷ যেমন বদরিকা আশ্রমে তপস্যায় রত নারায়ণের তপস্যাভঙ্গের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র কয়েকজন অপ্সরাকে প্রেরণ করেন৷ তারা নারায়ণকে প্রলুব্ধ করতে বহুবিধ চেষ্টা করতে লাগলে তাদের আচরণে বিরক্ত হয়ে নারায়ণ নিজের উরু থেকে মঞ্জরীর সাহায্যে অপ্সরাদের থেকে বহুগুণ সুন্দরী এক রমণীর সৃষ্টি করলেন৷ সেই উরুজাত রমণীই পরিচিত ঊর্বশী নামে৷

পদ্মপুরাণে ঊর্বশী সৃষ্টির ভিন্ন কাহিনি বর্ণিত হয়েছে৷ পুরাকালে বিষ্ণু গন্ধমাদন পর্বতে গভীর তপস্যায় মগ্ন হলে ইন্দ্র বিষ্ণুর তপস্যায় ভীত হয়ে মধু (বসন্ত) ও মদন (কাম) কে আহ্বান করেন৷ মধু ও মদন এবং তাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন অপ্সরা যুক্ত হয়েও বিষ্ণুকে তপস্যা থেকে টলাতে পারে না৷ তাদের ব্যর্থতার বিষন্নতা থেকে জন্ম হল ঊর্বশীর৷ এখানেও ঊর্বশীকে উরুজাত বলা হয়েছে৷ পরে দেবগণের সামনে বিষ্ণু ঊর্বশীর নামকরণ করেন৷

শুধু অপ্সরা বা দেবযোষিতরাই নয় পুরাণগুলিতে মনুষ্যযোনিজাত সাধারণ বারনারীদের সম্পর্কে নানাবিধ বিধি-নিষেধের কথা বলা হয়েছে৷ স্কন্দপুরাণে দেহজীবিনীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে—বেশ্যা এক স্বতন্ত্র জাতি, তার যদি সবর্ণ বা উচ্চতর বর্ণের কোনো পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক ঘটে এবং সে যদি কারও রক্ষিতা না হয় তাহলে পুরুষটির কোনো দণ্ড হবে না৷ আর যদি গণিকাটি কারও রক্ষিতাও হয় তাহলেও তার সঙ্গে সম্পর্ককারী পুরুষটির প্রতি কোনো শাস্তি বা প্রায়শ্চিত্তের কথা বলেননি পুরাণকার৷ মৎস্যপুরাণের ৭০তম অধ্যায়ে রয়েছে ঋষি দালভ্যচৈকিতায়ণ ও অষ্টবক্র মদ্র অধ্যুষিত কুরু পাঞ্চাল ও সিন্ধসৌরীর অঞ্চলে কামশাস্ত্র শিক্ষা দিতেন৷ সেখানে গণিকা বিষয়ক পাঠও ছিল৷ ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে পুরুষের সাথে সম্পর্কের নিরিখে নারীর নানা শ্রেণীর কথা বলা হয়েছে৷ সেখানে সামান্যতম ত্রুটিতেই নারীর চারিত্রিক মানের স্খলন ঘটিয়েছেন পুরাণকারেরা৷ যেমন—

ক) একপত্নী : নারী পতিব্রতা হলে৷

খ) কুলটা : স্বামী ছাড়া যদি দ্বিতীয় পুরুষের প্রতি আসক্ত হয়৷

গ) বৃষলী বা পুংশ্চলী : তিনজন পুরুষের সঙ্গে সম্ভোগকারী নারী৷

ঘ) বেশ্যা : চার থেকে ছয়জন পুরুষের অঙ্কশায়িনী হলে৷

ঙ) যুঙ্গী : সাত-আটজন পুরুষের সঙ্গে সংশ্রবকারী৷

চ) মহাবেশ্যা : যদি এগুলির চেয়েও বেশি পুরুষের সঙ্গে যৌনসংসর্গ করে৷

অর্থাৎ একাধিক পুরুষের সংসর্গ করলেই গণিকা হয়ে যায় নারীরা কিন্তু একাধিক নারীর সঙ্গে সম্ভোগকারী পুরুষের জন্য আলাদা কোনো নাম তৈরি হয়নি৷ বিষ্ণুপুরাণের ৩৭ সংখ্যক অধ্যায়ে জায়াজীবী ও জায়াপোজীবীর (যে পুরুষ স্ত্রীর উপার্জনে দিনাতিপাত করে) প্রসঙ্গে আলোচিত হয়েছে৷ সেক্ষেত্রে স্ত্রীর উপার্জনের মাধ্যম ছিল শরীর৷ কিন্তু পুরাণকার বলেছেন যে—‘‘জায়াজীবীর পাপটা গুরুতর নয়, উপপাতক মাত্র৷ সামান্য চন্দ্রোয়ণ ব্রতেই তার প্রায়শ্চিত্ত হত৷’’২০ গণিকা সংসর্গের জন্যও এই পুরাণে প্রজাপত্য প্রায়শ্চিত্ত বিধানের কথা রয়েছে৷ এছাড়া এই পুরাণের ৭০ অধ্যায়ে গণিকাদের জন্য আলাদা একটি ব্রতেরও উল্লেখ রয়েছে যার নাম ‘অনঙ্গব্রত’৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে পুরাণগুলিতে গণিকাদের ঘৃণ্য এক রূপে পর্যবসিত করা হলেও তাদের দেহকে উপভোগ করা থেকে সমাজ কেউকে বিরত করেনি বরং অনঙ্গব্রতের মতো আচার চালু করে তারা গণিকাদের রূপবতী-যৌবনবতী-কামবতী হওয়ার ব্যবস্থা করেছেন যাতে পুরুষ মানুষের উপভোগের বাসনা চিরজাগ্রত থাকে৷

‘সংহিতা’ সাহিত্যেও গণিকা নামের পরিপূরক শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ যেমন ‘ব্রজয়িত্রী’ অর্থাৎ যে আনন্দ দেয়৷ বাজসনেয়ী সংহিতায় এর উল্লেখ রয়েছে৷ সংহিতার যুগে বেশ্যাবৃত্তিকে অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখা হয়৷ এই বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত ‘দালাল’ বা নারীদের জন্য ছিল সমাজের কঠোরতম আইন৷ ‘বিষ্ণু সংহিতা’য় ক্ষমাহীন অপরাধ হিসেবে দালালদের অপরাধকে ধার্য করা হয়েছে৷ এদের হত্যাকারীর কোনো প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন হয় না৷ ‘মনুসংহিতা’য় নারীর সমস্ত ধ্যান, জ্ঞান, স্বপ্ন, শিক্ষা-দীক্ষা সব কিছুই স্বামীসেবার মহত্বের উপর বর্ণিত হয়েছে৷ এখানে গণিকাদের শিক্ষা প্রণালী বা শিক্ষণীয় বিষয়ের উপরও আলোকপাত করা হয়েছে৷ মনুর ভাবনায় এই গণিকা নারীরা চোরের সমধর্মী৷ তিনিই আবার এই নারীদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা সকল মানুষকেই শাস্তিযোগ্য হিসেবে নির্ধারিত করেছেন৷ ‘যাজ্ঞবল্ক সংহিতা’য় গণিকার সংসর্গকারী পুরুষের জন্য নানা ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে৷

যেমন—

(ক) কোনো বারাঙ্গনা তার খদ্দেরের কাছ থেকে দেহবিক্রির দক্ষিণা স্বরূপ অর্থ গ্রহণ করার পরও যদি সে বিষয়ে অস্বীকার করে তাহলে তাকে সেই দর্শনিমূল্য তো ফেরত দিতেই হবে সঙ্গে সঙ্গে সেই পরিমান টাকা ক্ষতিপূরণও দিতে হবে৷

(খ) কোনো পুরুষ যদি দর্শনি প্রদান করার পর স্বেচ্ছায় মিলিত না হয় তাহলে গণিকাকে সেই টাকা ফেরত দিতে হবে না৷

(গ) যদি দেহসঙ্গলোভী পুরুষটি অর্থের বিনিময়ে গণিকা দেহকে একাধিক কৌশলে সম্ভোগ করতে চায় তাহলে তার দণ্ড হবে ২৪ পণা জরিমানা৷

প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে গণিকা :

ভারতীয় সভ্যতা মূলত গ্রাম নির্ভর হলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল রূপে যেখানে যেখানে নগর গড়ে ওঠে গণিকা তোষণের পরিধি সেখানে আরও বহুগুণ বিস্তৃত হয়৷ কারণ প্রাচীনকালে নগরকেন্দ্রিক সভ্যতার বিকাশ ঘটলে নগরবাসীর মধ্যে ঐশ্বর্য, বিলাস ও আড়ম্বরের ঘটা বহুগুণে বেড়ে যায়৷ নগরগুলি ব্যবসা-বাণিজ্যলব্ধ ধনের প্রধান সঞ্চয়কেন্দ্র হওয়ায় নগরবাসীই সেই ধন ভোগের সুযোগ ও অধিকার লাভ করতো৷ আর এগুলিই হল নাগরিক ঐশ্বর্য বিলাস আড়ম্বরের মূলে৷ এই নগর বিলাসিতার অন্যতম প্রধান উপকরণ ছিল দেহজীবা নারীরা৷ সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী, রাজা, রাজ অমাত্য, ভৃত্য সকলেরই গণিকাগমনের ছিল অবাধ স্বাধীনতা৷ সেই সময়কার নানা সাহিত্য উপকরণ, প্রত্নলিপি ইত্যাদিতে গণিকাগমনের বাড়বাড়ন্ত ছবি সুন্দর ভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে৷

রাজতরঙ্গিণী :

কলহন তাঁর ‘রাজতরঙ্গিণী’-তে অষ্টম শতকের পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর নর্তকী বিলাসের সুস্পষ্ট বর্ণনা দিয়েছেন৷ এর ১১৪৯ সালে রচনারম্ভ এবং পরের বছরই তার পরিসমাপ্তি৷ গ্রন্থটি মূলত রাজরাজড়াদের কাহিনি হলেও এর নানা অংশে ছড়িয়ে রয়েছে দেহজীবী নারীর ঐশ্বর্য, বিলাস, বঞ্চনা এবং বাধ্যবাধকতার নানাবিধ চিত্র৷ এই সময় গণিকারা যেমন দেহব্যবসায়ী নারী হয়ে দেহের দর কষাকষি করতে পারতো তেমনি কোনো মন্দিরের দেবদাসী হয়ে অথবা নৃত্যগীত পারদর্শী সুন্দরী নারীদের দেবদাসী বানিয়ে সমাজ তাকে উপভোগ করতো৷ এরা বহুভোগ্যা হয়েও তাদের নিজস্ব স্বকীয়তায় আবার সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসতে পারতো৷ ‘রাজতরঙ্গিণী’-র চতুর্থ তরঙ্গে রয়েছে কমলা নাম্নি এক নর্তকীর কথা৷ পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর কার্তিক মন্দিরের দেবদাসী কমলা তার রূপ ও নৃত্যগীতের পারদর্শিতায় প্রভূত সম্পদের অধিকারিণী হয়েছিল৷ ললিতাদিত্যের পৌত্র বাপ্পিয়কের কনিষ্ঠ পুত্র জয়াপীর কাশ্মীর রাজ্যে অভিষিক্ত হওয়ার পর দিগ্বিজয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলে শ্যালক গুজ্জের বিশ্বাসঘাতকতায় রাজ্যচ্যুত হয়৷ নিজেকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার উপযুক্ত স্থান ও সময় খুঁজতে খুঁজতে সে উপস্থিত হয় পুণ্ড্রবর্ধন নগরীতে৷ সেখানে কার্তিক মন্দিরে দেবদাসীদের নৃত্যগীত দেখতে গিয়ে কমলার অপরূপ নৃত্যপটুতা ও সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে যায়৷ বুদ্ধিমতী, কামার্ত, মুগ্ধ পুরুষদের নিয়ে সহবাসে অভ্যস্ত কমলার জয়াপীড়ের মুগ্ধবিস্ময়কে বুঝতে কালবিলম্ব হয় না৷ তাই দাসীর দ্বারা মোহিত করে তাকে নিজের ঘরে উপস্থিত করে৷ এখানে উল্লেখ রয়েছে ছলাকলা পটিয়সী কমলার গণিকাসুলভ আচরণভঙ্গির৷ সে মদ্য পানে মত্ত হয়ে নিজের কাম উত্তেজনাকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করে৷ জয়াপীড়কে পরিপূর্ণ রতিসুখ দেওযার জন্য বার বার অনুরোধ করে তার পরিধানের বস্ত্র পরিত্যাগ করতে৷ রাজা তাতে সম্মত না হলে কামনার উগ্রমূর্তিতে আবিষ্ট হয়ে বলপ্রয়োগের চেষ্টা করে৷ পরে লজ্জিত কমলা আত্মগ্লানিতে অনুতপ্ত হলে তাকে দীর্ঘ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে জয়াপীড়ই শান্ত করে৷ পরবর্তীকালে কমলা দেবদাসী থেকে উত্তীর্ণ হয় রাজবধূরূপে অর্থাৎ জয়াপীড়ের পত্নীরূপে৷ গণিকা গৃহে রাত্রিবাস সেই সমাজে পুরুষের জন্য যেমন দোষের ছিল না তেমনি গণিকাদের স্ত্রী বা পত্নীরূপে সামাজিক সম্মান মিললেও সমাজ তার কোনো বিরোধিতা করেনি৷

কলহনের এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে গণিকাদের সামাজিক অবস্থানের এক জীবন্ত চিত্র৷ সমাজে তারা ঘৃণিত ছিল না, সম্মানের সঙ্গে বিভিন্ন মন্দিরের সেবাকার্যের জন্য তারা নির্বাচিত হত৷ আর্থিক ভাবে তারা ছিল যথেষ্ট সচ্ছল এবং ইচ্ছে করলেই সমাজের মূলস্রোতে ফিরে যেতে পারতো৷ আবার যদি সামগ্রিকভাবে বিচার করা যায় তাহলে শুধু গণিকা কেন সব নারীরাই ছিল পুরুষের কাম পরিপূরণের রক্তমাংস সম্বলিত পুত্তলিকা৷ এই গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে রাজা-বণিকদের বহুপত্নী সম্বলিত জীবন, অন্তপুরে দাসী রেখে যৌনপ্রবৃত্তিকে সচল রাখার সুব্যবস্থা এবং অভিজাত গৃহে রমণীদের বা রাজবধূদের পরপুরুষের সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার মতো বহুবিধ ঘটনা৷ প্রকাশ্য সমাজে বেশ্যাবৃত্তিকে দেবদাসী প্রথার মধ্য দিয়ে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে৷ অর্থাৎ সুন্দরী নৃত্যকলায় সক্ষম নারী দেখলেই তাদেরকে মন্দিরে দেবদাসী হিসেবে উৎসর্গ করে দিত যাতে সহজে সকলের ভোগে লাগতে পারে৷ উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে এমন একটি ঘটনা যেখানে এক গৃহবধূ সমাজনীতির অবমাননায় বহুভোগ্যা হয়ে উঠে৷ কাহিনিটি এরকম—রাজা প্রতাপাদিত্যের প্রতাপপুর রাজ্য ব্যবসা-বাণিজ্যের উৎকৃষ্ট কেন্দ্র হওয়ায় সেখানে ব্যবসায়িক কারণে রোহতক দেশের নোন নামের এক বণিক এসে বসবাস শুরু করে৷ নোনের স্ত্রী ছিল পরমরূপবতী এবং নৃত্যগীতে পারদর্শী৷ রাজা এই বণিক-পত্নীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়৷ রাজার অন্তর্কামনা বুঝতে পেরে এবং রাজ অনুগ্রহ লাভের আশায় স্বয়ং নোনই তার স্ত্রীকে রাজার হাতে তুলে দিতে যত্নবান হয়৷ স্ত্রী এই প্রস্তাবে রাজী না হলে সে সকলের সামনে রাজসমীপে ঘোষণা করে—‘‘দেব! আমি এত অনুরোধ করিলেও যদি সহজে তাহাকে গ্রহণ না করেন, তবে সে তো নৃত্য-কার্য্যে অভিজ্ঞা, সুতরাং আমার সেই পত্নীকে কোন দেবালয়ে নর্ত্তকীশ্রেণীর্ভূক্তা করিয়া দিলাম, আপনি তথা হইতে অবাধে গ্রহণ করুণ৷’’২১ হায়রে সমাজ! হায়রে নারীর জন্য তার ব্যবস্থা! নারীর জীবন কীভাবে পদে পদে পুরুষের কাছে পিষ্ট হয়েছে, কীভাবে পুরুষের পর পুরুষ বিনা দ্বিধায় শুধুমাত্র মুখের কথাতেই তাকে দেবদাসী, সেবাদাসী, বেশ্যা, রক্ষিতা সর্বোপরি দাসী বানিয়ে নিঙড়ে নিঙড়ে উপভোগ করেছে ‘রাজতরঙ্গিণী’ তার যথার্থ উদাহরণ৷

বাৎসায়ণের কামসূত্র :

‘কামসূত্র’-এর রচনাকাল তৃতীয় শতক৷ বাৎস্যায়ণ ‘কামসূত্র’ রচনা করলেও তাঁর এই বইটি মূলত আগেকার সব কামসূত্রাবলীর সংক্ষিপ্ত সংকলন এবং বাৎস্যায়ণ তা নিজেই উল্লেখ করেছেন৷ অর্থাৎ বোঝাই যাচ্ছে ভারতীয় সমাজ ঐতিহ্যে বাৎস্যায়ণের বহুপূর্বেই কাম কলা হিসেবে চিহ্নিত ছিল৷ এই গ্রন্থে গণিকারা কীভাবে, কি কৌশলে পুরুষদের খুশি করে অর্থ রোজগার করতে পারে তার যথাযথ বর্ণনা দিয়েছেন৷ নীহাররঞ্জন রায় একে ‘‘সমসাময়িক ভারতীয় নগর-সভ্যতার ইতিহাস এবং নাগর যুবক-যুবতীদের অনুশীলন গ্রন্থ’’২২ বলেছেন৷ গৌড় ও বঙ্গের রাজপ্রাসাদন্তপুরের নারীরা প্রাসাদের ব্রাহ্মণ, কর্মচারী, ভৃত্য ও দাসদের সঙ্গে কিরূপ কামতরঙ্গে লিপ্ত হত, কীভাবে অভিজাত গৃহগুলি নর্তকী বিলাসের অন্যতম ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল ইত্যাদি বিষয় বাৎস্যায়ণের দৃষ্টি এড়ায়নি৷ ‘‘নাগর অভিজাত শ্রেণীর অবসর এবং স্বল্পায়াসলব্ধ ধনপ্রাচুর্য তাহাদিগকে ঐশ্বর্য-বিলাস এবং কামলীলার চরিতার্থতার একটা বৃহৎ সুযোগ দিত;’’২৩ বাৎস্যায়ণ গণিকাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন—গণিকাদের যৌনসঙ্গমই তাদের বৃত্তির অন্যতম উপায় তাই যখন সে কোনো পুরুষের সঙ্গে মিলিত হবে তাকে অবশ্যই পুরুষটির কাছে আনন্দ প্রকাশ করতে হবে৷ একজন আদর্শ বারবনিতাকে তরুণী, সুন্দরী, সুলক্ষণা এবং মধুর স্বভাবের অধিকারিণী হতে হবে৷ ব্যবহার হবে ভদ্র, বুদ্ধিমতী এবং চরিত্রবান হিসেবে সে বিবেচিত হবে৷ কৃতজ্ঞতা, সততা অর্থাৎ তাকে কামসূত্রে পারদর্শিনী হতে হবে৷ বিষাদগ্রস্ত মন, লোভ, মুর্খামি, অত্যধিক হাসি, পরনিন্দা-পরচর্চা, গালমন্দ করা, অস্থিরতা ইত্যাদি দোষ থাকলে চলবে না৷ ‘খদ্দের’-এর ইচ্ছা পূর্ণ করে তাকে পরিতৃপ্ত করাই গণিকাদের প্রধান সক্ষমতা৷ পুরুষের সাথে সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে তাকে এমন ভাব দেখাতে হবে যে সে পুরুষটিকে যারপরনাই ভালোবাসে৷ পুরুষকে আকৃষ্ট করে বেঁধে ফেলার চেষ্টা করলেও একজন পণ্যাঙ্গনা কখনোই সেই প্রেমে নিজে বাঁধা পড়বে না৷ খদ্দেরের শত্রুকে শত্রু বলে বিবেচিত করে, তার সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনে তার সঙ্গে একাত্ম হয়ে, ইহকাল-পরকালের সঙ্গী হিসেবে নিজেকে জাহির করার অভিনয় করবে একজন দেহব্যবসায়িনী৷

নানা ছলে, নানা উপলক্ষে খদ্দেরের কাছ থেকে টাকা আদায় করে নিজেকে সমৃদ্ধ করে তুলবে একজন গণিকা৷ কখনো বলতে হবে সে বা তার কোনো উপকারী বন্ধু খুব বিপদে পড়েছে, কখনো বলবে চোর বা প্রহরী তার সমস্ত গহনা কেড়ে নিয়েছে ইত্যাদি গল্প বানাতে হবে সঙ্গলাভকারী পুরুষটিকে বলার জন্য৷ কখনো নিজের গৃহসজ্জার কোনো জিনিস বা বাসনপত্র বা গহনা পুরুষটিকে দেখিয়ে দেখিয়ে বিক্রয় করার ভান করবে যাতে সে মনে করে অভাবে পড়ে মেয়েটি তার সব বিক্রয় করে দিচ্ছে৷ অন্য গণিকারা তাদের প্রেমিকদের কাছ থেকে কি কি পায় তা কৌশল করে নিজের খদ্দেরের কানে তুলতে হবে৷

যদি কোনো গণিকা একই সঙ্গে একাধিক পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে টাকা রোজগার করতে চায় তাহলে সে একটি পুরুষের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখবে না৷ সে ক্ষেত্রে স্থান কাল বুঝে সে নিজের দর হাকবে৷ প্রতি রাত্রের জন্য লোক হিসেবে সে দেহের মূল্য নির্ধারণ করবে৷ যদি একাধিক ধনাবান পুরুষ তার কাছে একই সময়ে আসে তখন যে তার প্রত্যাশার সমস্ত দিক পূরণ করতে পারবে গণিকা তাকেই সেই সময়ের জন্য সঙ্গ দিতে রাজী হবে৷ যে সকল গণিকারা প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী বাৎস্যায়ণ তাদের সেই অর্থকে নানা সেবামূলক কাজে ব্যয় করার উপদেশ দিয়েছেন৷ যেমন—বাগান ও পুকুর তৈরি, মন্দির তৈরি, আশ্রম স্থাপন ইত্যাদি৷

বারাঙ্গনাদের প্রতি বাৎস্যায়ণের নানাবিধ উপদেশাবলীর নিরিখে তাদের পেশাদারিত্বের প্রতিই বেশি দৃষ্টিদান করেছেন বলে মনে হয়৷ গণিকাদের শুধু মাত্র যৌনপিপাসা নিবারণকারী শরীরী মাংসপিণ্ড হিসেবে নয়; তাদের দক্ষ, শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন৷ তারা সুচতুর ব্যবসায়ীর মতো নিজের পরিশ্রমের রোজগার পুরুষের কাছ থেকে আদায় করে নিতেও দক্ষ৷ যৌনবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েও গণিকারাও যে বৃহত্তর জনকল্যাণে অংশ নিতে পারে বাৎস্যায়ণ তাঁর গ্রন্থে সে ইঙ্গিতও দিয়েছেন৷

তিনি গণিকাদের কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করেছেন—

১. গণিকা : এরা সব থেকে বেশি আয়ের শিক্ষিত দেহব্যবসায়ী৷

২. রূপজীবা : যাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা তুলনামূলকভাবে কম; মূলত রূপ ও গুণের জন্য দেহজীবিকাকে বেছে নিয়েছে তারা রূপজীবা৷

৩. কুম্ভদাসী : কুম্ভদাসীরা হল প্রাক্তন দেহজীবী, যৌনসঙ্গমে, শরীরী-সক্ষমতায় অক্ষম হয়ে তারা এই শ্রেণীতে অন্তর্ভূক্ত হয়৷ দেহব্যবসায়ী নারী ও খদ্দেরের সঙ্গে মেলবন্ধনের জন্য এরা ঘটকের কাজ করে৷ শিক্ষিত ধনবান পুরুষকে নিয়ে আসা এদের প্রধান কাজ৷

৪. পরিচারিকা : স্বামীর বা বাবুর ব্যক্তিগত স্বার্থে যে নারীরা খদ্দেরের মনোরঞ্জন করে৷

৫. কুলটা : যে নারী স্বামীর ভয়ে নিজের দেহজীবিকার পরিচয় গোপন করেও বৃত্তিটির সঙ্গে যুক্ত সে কুলটা৷

৬. স্বৈরিণী : স্বামীর ভয়কে তুচ্ছ করে যে স্ত্রীরা বাড়িতে খদ্দেরদের মনোরঞ্জন করে৷

৭. নটী : নাচ, গান, অভিনয় ইত্যাদির সঙ্গে যুক্ত থেকে যে নারী দেহব্যবসাও করে থাকে সে নটী নামে খ্যাত৷

৮. শিল্পকারিকা : ধোপানি বা সমগোত্রীয় পেশায় থেকেও যারা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করে তারা শিল্পকারিকা৷

৯. প্রকাশ বিনষ্টা : যদি কোনো সধবা বা বিধবা নিজের ইচ্ছেয় দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয় তারা প্রকাশ বিনষ্টা৷

শুধু গণিকারাই নয় এই বৃত্তির সহায়তাকারী বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গও বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়েছে কামসূত্রে৷ যেমন—

১. বিট : যে ব্যক্তি নিঃসহায় হয়ে নিজের দেশেই স্ত্রী-পুত্র-কন্যা নিয়ে আছে এবং যার অন্য কোনো উপায় না থাকায় বেশ্যা ও নাগরকের মিলনকে জোরালো করে জীবন যাপন করতে চায় সে বিট নামে পরিচিত৷

২. পীঠমর্দ : যে ব্যক্তি উপনাগরিকবৃত্তে (ঐশ্বর্যহীন কিন্তু কাম-কলা বিদ্যায় রপ্ত ব্যক্তি) নিজেকে যোগ্য করে তুলেছে, সে কলা বিদ্যার উপদেশ নিয়ে নিজেকে নাগরকদলের আচার্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করবে; তখন তার পরিচয় হবে পীঠমর্দ৷

৩. বৈহাসিক : সংসারী নয় কিন্তু সঙ্গীতের সমঝদার, লোককে হাসাতে জানে—এরকম লোক বৈহাসিক নামে পরিচিত৷ এরা বেশ্যা ও নাগরকদের মৈথুন যাতে শান্তিপূর্ণ হয় সেই ব্যাপারে উপদেশ দান করে৷ দেশকাল অনুসারে সন্ধিকৌশলী বা সন্ধি-বিগ্রাহিক নামেও এরা পরিচিত৷

৪. কুট্টনী : যে সব স্ত্রীলোকেরা বেশ্যা এবং নাগরক উভয় পক্ষের মধ্যে কথার আদান প্রদান করে তারা কুট্টনী৷

এছাড়া কোনো বারাঙ্গনাগৃহে বা নাগরকের গৃহে বেশ্যাদের সাথে সমমিলন, সমস্বভাব, সম ধনসম্পন্ন ও সমবয়স্কদের সঙ্গে একত্রিত অবস্থানকে বলা হয় গোষ্ঠী সমবায়৷ গণিকা সম্ভোগে স্ত্রীজাতির মন সম্বন্ধে জানা যায় তাই গোষ্ঠী বা শ্রেণীর মধ্যে গণিকাদেরকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷

বাৎস্যায়ণের যুগে গণিকাগমন যেহেতু নাগরিক বিলাসের অঙ্গ তাই সেই সময়ে শুধুমাত্র দেহভোগের সময়ে গণিকারা যথেষ্ট মর্যাদার অধিকারী ছিল৷ নায়করা সুরা পান করার আগে গণিকাদের দিয়ে পান করাতো এতে তার সম্মান বাড়ে৷ পালাক্রমে নায়ক ও বারাঙ্গনা উভয়ের বাড়িতে মধু, মৈবের, সুরা ইত্যাদি পানকে বলা হয় আপানক৷ আর এই অনুষ্ঠিত আপানক বা পানগোষ্ঠীকে বলে সমাপান৷ এত দিক বিচার করে দেখা যায় গণিকাগমন বা গণিকা তোষণ সে যুগে নিন্দার ছিল না৷ দেহব্যবসার মতো অমানবিক একটা পেশায় সে সমাজ ছিল সাবলীল৷ সেই সামাজিক বর্ণনার বিভিন্ন দিক উঠে আসে নীহাররঞ্জন রায়ের কথায়—‘‘খ্রীষ্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতক হইতেই বাঙলাদেশ, স্বল্পাংশে হইলেও, উত্তর ভারতীয় সদাগরী ধনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছিল এবং উত্তর ভারতের নাগর-সভ্যতার স্পর্শও তাহার অঙ্গে লাগিয়াছিল; বাৎস্যায়নীয় নাগরাদর্শ বাঙলার নগর-সমাজেরও আদর্শ হইয়া উঠিয়াছিল৷ গৌড়ের যুবক-যুবতীদের কামলীলার কথা, তাহাদের বাসনা ও ব্যসনের কথা এবং গৌড়-বঙ্গের রাজান্তঃপুরের মহিলারা যে নির্লজ্জভাবে ব্রাহ্মণ, রাজকর্মচারী ও দাস-ভৃত্যদের সঙ্গে কাম-ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইতেন তাহার বিবরণ বাৎস্যায়নই রাখিয়া গিয়াছেন৷’’২৪

বাৎস্যায়ণ তাঁর এই রচনায় গণিকারা কি ধরনের প্রার্থী খুঁজবে তারও বিবরণ দিয়েছেন৷ যেমন—তরুণ, ধনী, পারিবারিক দায়িত্ব যার নেই, উচ্চ পদস্থ, সদ্বংশজাত, প্রাণবান, শিক্ষিত, কবি, গাথাকাব্য কাহিনিতে কুশল, বাগ্মী, নানা কথায় পারদর্শী, সুরাসক্ত, বন্ধুভাবাপন্ন, নারীসঙ্গমে দক্ষ কিন্তু কারও বশ নয় এ ধরনের পুরুষরাই গণিকার উপযুক্ত নাগর৷ তিনি বিভিন্ন অলংকারাদি সুগন্ধিসহ আরও নানা উপকরণে সুসজ্জিত হয়ে গণিকাদেরকে নাগরদের মনোরঞ্জন করার কথা বলেছেন কারণ তারা পণ্যাঙ্গনা৷ পণ্যকে সুসজ্জিত রাখলেই তো নাগরক বশ হবে৷ গণিকালয়ের কর্ত্রী বা গণিকামাতার প্রতিও তাঁর উপদেশ রয়েছে৷ গণিকা যাতে কোনোভাবে লাঞ্ছিত বা প্রতারিত না হয় সে দিকে গণিকামাতাকে লক্ষ্য রাখতে হবে৷ তার উচিৎ যথাসম্ভব সর্বপ্রকারে গণিকার স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করা৷ প্রার্থী পছন্দ না হলে বা প্রার্থীর থেকে অধিক পরিমানে অর্থ রোজগারের আশায় তাকে নানা কৌশলে, কন্যা অসুস্থ, পরিশ্রান্ত, বিমর্ষ, ঋণগ্রস্ত বা কেউ আরও বেশি অর্থালঙ্কার দিতে প্রস্তুত ইত্যাদি জানিয়ে তাকে বিরত করা বা অধিক অর্থ আদায়ের চেষ্টা করতে হবে৷ আর বাৎস্যায়ণের এই দীর্ঘ উপদেশাবলীর পিছনে যে সক্রিয় চেতনা ছিল তা হল—‘‘গণিকার প্রবঞ্চিত হওয়ার সম্ভবনা—তাকে যে নিজের স্বার্থ নিজেকেই দেখতে হবে সর্ব উপায়ে যথাসম্ভব বেশি অর্থাগমের চেষ্টা করতে হবে তার বর্তমানের দিনপাতের জন্যে এবং অসমর্থ বার্ধক্যের জন্যেও এই বোধ৷’’২৫

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র :

‘অর্থশাস্ত্র’-এর রচয়িতা কৌটিল্যও গণিকাদের নিয়ে বহু উপদেশাবলী নিয়ম-নীতির কথা বলেছেন৷ এই ‘অর্থশাস্ত্র’-তেই প্রথম গণিকাদের সহায়ক কিছু আইন লিখিতরূপে স্থান পায়৷ বাৎস্যায়ণের ‘কামসূত্র’-এর মতো এখানেও রাজা, বণিক, নাগরক, ধনী ব্যক্তিদের অবাধে গণিকা সম্ভোগের নির্দেশ রয়েছে৷ ‘অর্থশাস্ত্র’-তে কৌটিল্য উপদেশ দিয়েছেন গণিকাদের কোনো এক পুরুষের প্রতি দীর্ঘকাল আসক্ত না থাকতে৷ কারণ গণিকার সঙ্গে খদ্দেরের দেহমিলন ব্যবসায়িক সম্পর্কমাত্র—এ সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হলে তাতে যে মমতা ও প্রীতি জন্মাবে তা গণিকার ব্যবসায়ের পক্ষে হানিকর৷ কৌটিল্য নির্দেশিত বিধি-বিধানগুলি গণিকাদের কেন্দ্র করে রচিত হলেও তার সুবিধা গ্রহণ করতো রাষ্ট্রই৷ কারণ গণিকা পীড়নের জন্য যে সমস্ত শাস্তির উল্লেখ ছিল তা বেশিরভাগই অর্থমূল্য৷ অপরাধী আর্থিক জরিমানা দিয়ে রেহাই পেয়ে যেত৷ গণিকা সেই জরিমানার অর্থের প্রাপক হলেও তা কিন্তু রাজস্ব হিসেবে আবার রাজকোষাগারেই জমা পড়তো৷ যেমন—গণিকাকে প্রকাশ্যে অপমান করার দণ্ড ২৪ পণ, শারীরিক অত্যাচারে ৪৮ পণ ইত্যাদি৷ রাস্ট্রের বিপদ হলে গণিকার আয়ের অর্ধেকই বাজেয়াপ্ত হত, প্রয়োজনে তাকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যাওয়ারও ব্যবস্থা ছিল৷ কৌটিল্য আরও নির্দেশ করেছেন যে রক্ষিতা বা অবরুদ্ধার উপরে একজন পুরুষেরই অধিকার; যে তাকে ভরণপোষণ করছে৷ তার অন্যথা হলে দণ্ড ভোগ করতে জরিমানা হবে ৪৮ পণ অর্থমূল্য৷

মৃচ্ছকটিক :

শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে গণিকাজীবনের সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়৷ খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতক থেকে তৃতীয় শতকের মধ্যবর্তী সময়ে বেঁচেছিলেন ‘মৃচ্ছকটিক’-এর রচনাকার৷ উজ্জয়িনীর নগরলক্ষ্মী বসন্তসেনার জীবনকাহিনি বর্ণনার মধ্য দিয়ে সেই সময়কার সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় জীবনের সম্পূর্ণ ছবিকে সুন্দর ভাবে চিত্রিত করেছেন নাট্যকার৷ তখনকার রূপবতী-কলাবতী নগরবধূরা প্রচুর বিত্তবৈভবে দিন কাটাতে পারতো, প্রচুর বিত্তবৈভবের অধিকারিণীও হত এবং সমাজের কারও অনুগ্রহ পেলে সেখান থেকে বেড়িয়ে এসে সামাজিক মর্যাদায় আসীন হতে পারতো৷ তবুও বেশ্যা বেশ্যাই৷ তার যত বৈভবই থাকনা কেন৷ তাই বসন্তসেনার বীট বারবার তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে রূপে-যৌবনে-শিক্ষায়-রুচিতে-মহানুভবতায়-বৈভবে সে যতই অতুলনীয় হোকনা কেন সে শ্মশানের জুঁই গাছের ফুলের মতোই, যা কোনো শুভকাজে লাগেনা৷ কাহিনিতে রয়েছে—নর্তকী বসন্তসেনার ছিল প্রাসাদতুল্য আটমহলা বাড়ি, অগণিত স্বর্ণালংকার এবং প্রচুর দাসদাসী৷ একদিন কামদেব মন্দিরে পূজা সেরে ফেরার সময় বণিকশ্রেষ্ঠ চারুদত্তকে দর্শন করে তার মোহে মোহিত হয়ে যায় সে৷ বসন্তসেনা বহুভল্লভা৷ বহুজনকে প্রেমদানই তার কর্ম এবং সে সম্পর্কে সচেতনও সে, তথাপি নিজের মনের এহেন আচরণে নিজেই বিস্মিত হয়ে সে ভাবে—‘‘একি হ’লো আজ তার! বহুজনবল্লভা নটী সে৷ কত শত শ্রেষ্ঠ পুরুষেরা তার পায়ের নীচে গড়াগড়ি যায়!’’২৬ বসন্তসেনার নারীহৃদয় প্রেমবিকিকিনির খেলা ছেড়ে সত্যকারের প্রেমকে উপলব্ধি করতে পেরেছে তাই অন্য পুরুষ আর সহ্য হয় না তার৷ রাজশ্যালক শকার তাকে একবার ভোগের জন্য দশহাজার টাকার গহনাসমেত গাড়ি পাঠালে এত বড় অঙ্কের টাকাকেও সে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে৷ একদিন তাকে একা পেয়ে প্রেম অর্জনের প্রত্যাশায় শকার তার পিছু নিলে বসন্তসেনা তার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে অনুনয়-বিনয় করলে শকারের শিক্ষকপণ্ডিতকে বলতে শোনা যায়—‘‘বসন্তসেনা! এটা তুমি কেমন কথা বললে? নটীর গৃহ তো যুবকদেরই আশ্রয়স্থান৷ গণিকা হল গিয়ে পথের ধারে জন্মানো লতার মত৷ উপযুক্ত ধনের বিনিময়ে বিক্রেতা যেমন শত্রুমিত্র সকলকেই পণ্য বিক্রয় করতে বাধ্য, তেমনি গণিকাও প্রিয় অপ্রিয় সকলকেই সমভাবে সেবা করতে বাধ্য৷ দীঘিতে যেমন ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ, বিজ্ঞ বা মুর্খ সকলেরই স্নান করার অধিকার; নৌকাতে যেমন পারাপার হবার অধিকার ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র সকলেরই, তেমনই গণিকাও সকলের সেবা করবে অনুরাগের সঙ্গে!’’২৭ পণ্ডিতের এই উক্তি থেকে গণিকাদের জীবন-জীবিকার সুস্পষ্ট দিক প্রতিভাত হয়৷ গণিকারা যেহেতু সর্বজনভোগ্যা তাই দেহসম্ভোগের ক্ষেত্রে—প্রেম বেচা-কেনার ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনো মূল্য থাকে না; যে অর্থ দেবে তাকে সে গ্রহণ করতে বাধ্য৷ সেই পণ্ডিতের কৌশলেই বসন্তসেনা শকারের হাত থেকে পালিয়ে উপস্থিত হয় চারুদত্তের গৃহে৷ এ যেন বিনা মেঘেই বৃষ্টি৷ যার ধ্যানে চিত্ত বিবশ তার গৃহেই এই বিনোদিনী৷ দ্বিতীয় এই সাক্ষাৎ তার প্রেমবিগলিত চিত্তে আলোড়ন তোলে এবং এবারে চিরকালের জন্য চারুদত্তের কাছে সমর্পিতা হয় সে৷ পরবর্তীসময় দেখা যায় চারুদত্তের গৃহে তার স্ত্রী-পুত্রের উপস্থিতিতেই তাদের সম্ভোগমিলন৷ তৎকালীন সমাজে পুরুষের গণিকা সম্ভোগ বা বহু নারীদেহ আস্বাদন দোষের ছিল না, চারুদত্তের এহেন বিলাসিনী সংসর্গ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়নি বা তিরস্কার করেনি বরং পুত্র রোহসেনের কাছে বসন্তসেনা মাতৃপরিচয়ে পরিচিত হয়৷ এরপর দুশ্চরিত্র কামার্ত শকারের প্রবল ষড়যন্ত্রে বসন্তসেনা তার দ্বারা আক্রান্ত হয়ে চরমভাবে আহত হলে তার সমস্ত দোষ বর্তায় চারুদত্তের উপর৷ উজ্জয়িনীর নগরবধূ গণিকারত্ন বসন্তসেনার হত্যার নিষ্ঠুর চক্রান্তে দোষীসাব্যস্ত হয়ে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয় চারুদত্ত৷ তাকে উপস্থিত করা হয় বধ্যভূমিতে৷ এদিকে বসন্তসেনার অনুগৃহীত ছিল সংবাহক৷ সে চোর থেকে উত্তীর্ণ হয়েছে বৌদ্ধ শ্রমণকে৷ তার সেবাযত্নে পীড়িত বসন্তসেনা নতুন জীবন ফিরে পেয়ে সমস্ত খবর শুনে উপস্থিত হয় বধ্যভূমিতে৷ তার সাক্ষ্যে চারুদত্ত সাজামুক্ত হয়৷ তারপর মিলনের পালা৷ পরস্পর পরস্পরের আলিঙ্গনাবদ্ধ মিলনের মুহূর্তে সংবাদ আসে স্বামীর দণ্ডাদেশে কাতর ধূতাদেবীর অগ্নিআহূতির প্রচেষ্টার কথা৷ সকলে গিয়ে ধূতাকে উদ্ধার করে৷ এই চরম পরিস্থিতিতেও স্বামীর সঙ্গে বহুবল্লভা নারীকে দেখে বিস্মিত হয় না চারুদত্তের গৃহিণী৷ বরং তথাকথিত সেই পতিব্রতা নারী সাগ্রহে তার কুশলবার্তা শুনে আপন করে নেয়৷ আর এই পরিবেশেই শর্বিলকের উত্তরীয় দিয়ে স্ত্রী-পুত্র সকলের সামনে বসন্তসেনাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে চারুদত্ত৷ বারভোগ্যা এক নারী পায় গৃহবধূর পূর্ণ সম্মান; বহুপরিচর্যাকারিণী নারীর ভাগ্যে জোটে একক স্বামীর সাহচর্যে সুখী দাম্পত্য ও পারিবারিক জীবন৷ আর এর প্রধান সাক্ষী হয় পরম সতী—স্বামীর মঙ্গলকারিণী পতিব্রতা ধূতা৷ সানন্দে নিজের সম্পূর্ণ জীবনের সঙ্গী, একমাত্র অবলম্বন স্বামীরত্নটিকে অন্য আরেক নারীর হাতে তুলে দিতে তার চিত্ত এতটুকু বিচলিত হয় না৷ কিন্তু সত্যিই কি বিচলিত হয় না? নারীর এই অনুভূতিগুলি তুলে ধরার দাক্ষিণ্য নাট্যকার করেননি, অবশ্য তখনকার সমাজে তার দরকারও হত না৷ কারণ নারী মানেই মাংসপিণ্ড৷ ধূতা সেই সমাজের নারী যে সমাজে তাদের কিছু বলার থাকে না৷ সমাজের হাতের পুতুল সে৷ তাদের ইচ্ছেই ধূতার ইচ্ছে৷ আর এ দিক দিয়ে বসন্তসেনা তার চেয়ে অনেক সুখী৷ সে বহুপুরুষের ভোগ্যা হয়ে প্রবল বিত্ত-বৈভবে স্বাধীনভাবে জীবন কাটিয়েছে, উজ্জয়িনীর প্রধান গণিকা হওয়ার সুবাদে জীবনের স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে পেরেছে, নিজের আভিজাত্যের গৌরবে গর্বিত হতে পেরেছে৷ আর এত সবের মধ্যে থেকে সে যা পেয়েছে তা হল তার ব্যক্তিত্ব৷ আর এর জোরেই শেষ পর্যন্ত সে গণিকা থেকে কুলবধূ হয়ে উঠতে পেরেছে—বারবনিতা থেকে রূপান্তরিত হয়েছে প্রেয়সী-পত্নীতে৷ প্রাচীন সাহিত্যেগুলিতে বসন্তসেনার মতো পূর্ণাঙ্গ গণিকা চরিত্র সাহিত্য ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া বিরল৷

এই নাটকে বসন্তসেনার প্রেমকাহিনির সঙ্গে সঙ্গে আরেকটি ক্ষুদ্র প্রেমকাহিনি প্রতিফলিত হয়েছে তা হল বসন্তসেনার দাসী গণিকা মদনিকা ও শর্বিলকের প্রেমকাহিনি৷ সেই সমাজে গণিকারা গণিকালয় থেকে বেড়িয়ে যেতে চাইলে তাকে নিষ্ক্রয়মূল্য দিয়ে সেখান থেকে বেরোতে হতো৷ এখানে গণিকা মদনিকার প্রেমিক শর্বিলক নিষ্ক্রয়মূল্য জোগাড় করতে অক্ষম হলে চারুদত্তের গৃহে অলংকার চুরি করে নিষ্ক্রয়মূল্য সংগ্রহের চেষ্টা করেছে৷

এছাড়া গণিকার পুত্র-কন্যাদেরও জীবনেও যে লাঞ্ছনা-বঞ্চনা সবসময়ের সঙ্গী হত তার বর্ণনাও রয়েছে এই নাটকে৷ গণিকার কন্যারা গণিকাই হত৷ আর পুত্ররা পরিচিত হত বন্ধুল নামে৷ নাটকটিতে তারা তাদের আত্মপরিচয় দিয়ে বলেছে যে তারা পরের গৃহে লালিত, পরের অন্নে পুষ্ট এবং পরপুরুষের দ্বারা পরনারীতে জন্ম তাদের৷ গণিকা কন্যারও এই পরিচয়৷ লেখক মর্মস্পর্শীভাবে এই বন্ধুলদের আত্মপরিচয় দিয়েছেন৷

সুতনুকা প্রত্নলেখ :

খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে অশোক অনুশাসনের সমসাময়িক এক প্রত্নলেখ হল সুতনুকা প্রত্নলেখ৷ বর্তমান উত্তরপ্রদেশের অন্তর্ভূক্ত রামগড় পাহাড়ের যোগীমারা গুহায় তিনছত্রে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে এক দেবদাসীর কথা৷ তার নাম সুতনুকা৷ বারাণসীবাসী রূপবান যুবক দেবদিন্ন তাকে কামনা করেছিল৷ লেখটি হল—

 ‘‘শুতনুক নম দেবদশিক্যি

 তং কময়িথ বলনশেয়ে

 দেবদিনে নম লুপদখে৷

সুতনুকা নামে দেবদাসী৷ তাহাকে কামনা করিয়াছিল বারাণসীবাসী দেবদিন্ন নামে রূপদক্ষ৷’’২৮

‘কথাসরিৎসাগর’-এর মদনমালা সর্বজনবিদিত বারবনিতা৷ বৎসরাজ উদয়ন পুত্র নরবাহনদত্তকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করার সময় নানা বন্ধুবর্গকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন৷ প্রধান বয়স্য গোমুখের স্ত্রীচরিত্র বিষয়ক কথকতার প্রসঙ্গে মন্ত্রীপদে নিয়োজিত মরুভূতি শোনায় এক বারবধূর কাহিনি৷ গণিকা হলেও ত্রিগুণের শ্রেষ্ঠগুণ সত্ত্বগুণ যার মধ্যে অতিশয় প্রবল ছিল৷ বারাঙ্গনা হয়েও এরকম শুদ্ধসত্ত্ব পরম পতিব্রতাদের মধ্যেও পাওয়া যায় না৷ তার পবিত্র অন্তকরণের পরিচয় সকলকে বিমোহিত করে৷ এই পরমপবিত্র গণিকা হল মদনমালা৷ নগরবনিতা সে৷ রাজা বিক্রমাদিত্য তার পরম শত্রু নরসিংহের সঙ্গে প্রকাশ্য সমরে না পেরে অন্তর্ঘাতের মতলবে দীনহীন বেশে চাকরিপ্রার্থী হয়ে প্রবেশ করেন নরসিংহের রাজ্য প্রতিষ্ঠান নগরীতে৷ আশ্রয় নিলেন মদনমালার গৃহে৷ রণকৌশল ও রমণকৌশলে দক্ষ দুই নরনারীর মিলন-সম্ভোগে মত্ত হয়ে উঠলো মদনমালার বিলাসপুরী৷ বিক্রমাদিত্য লক্ষচ্যুত হলেন, ভুলে গেলেন শত্রু নরসিংহের কথা৷ আর মদনমালা ভুলে গেল সে একজন দেহবিকিকিনির পসরামাত্র৷ যথাসময়ে মন্ত্রীর মাধ্যমে বিক্রমাদিত্যের চৈতন্যোদয় হলে তিনি ভিখারী ছদ্মবেশী প্রপজ্ঞবুদ্ধিকে হত্যা করে কুবেরের কাছ থেকে প্রাপ্ত অক্ষয় পঞ্চকাঞ্চন মূর্তি মদনমালার জন্য মন্দিরে রেখে প্রতিষ্ঠান নগর থেকে নিজরাজ্যে ফিরে আসেন৷ মদনমালা বিক্রমাদিত্যের প্রকৃত পরিচয় জানতো না, তবু ভালোবেসে ফেলেছে তাকে৷ সেই প্রেমাস্পদবিনা তার জীবন অন্ধকার, বেঁচে থাকা দুষ্কর৷ তাই প্রতিজ্ঞা করে ছয়মাসের মধ্যে যদি তার প্রেমিকপুরুষ ফিরে না আসে সে তার জীবন অগ্নিআহুতি করবে এবং মৃত্যুপূর্ব ছয়মাস সে তার অর্জিত সকল ধনরাশি মানুষের মধ্যে বিতরণ করতে থাকবে৷ মদনমালার ধনসম্পদও কম নয়৷ দুহাতে দান করার ফলে সেই সুবিপুল ধনরাশিও একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়৷ তখন পঞ্চকাঞ্চন মূর্তি থেকে হাত কেটে নিয়ে মানুষকে দান করে দেয়৷ পরদিন এসে দেখে যেমন মূর্তি তেমনি রয়ে গেছে৷ একেবারে অক্ষত৷ তার বুঝতে বাকি থাকে না যে সেই মূর্তিগুলি অক্ষয় স্বর্ণমূর্তি৷ প্রতিদিন সে সেই অক্ষয়মূর্তির অঙ্গ কেটে দান করতে থাকে৷ তার সেই প্রাণনাশী প্রতিজ্ঞার কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ বিক্রমাদিত্যের পাটলিপুত্র নগরের বেদজ্ঞ পণ্ডিত সংগ্রামদত্ত মদনমালার দানের খবর শুনে সেখান থেকে চারটি ভারী ভারী সোনার হাত হাতির পিঠে চাপিয়ে নিয়ে আসে এবং বিক্রমাদিত্যের কাছে মদনমালার সেই অদ্ভুৎ প্রতিজ্ঞা ও দানের কথা ব্যক্ত করে৷ বিক্রমাদিত্য জীবনে বহুনারী সম্ভোগ করেছেন কিন্তু একজন বেশ্যানারীর প্রেম যে এমন নিকষিত হেম হতে পারে তা ছিল তাঁর অভিজ্ঞতার বাইরে৷ তিনি ফিরে আসেন মদনমালার কাছে৷ তার কাছে নরসিংহকে পরাজিত করার জন্য সাহায্য ভিক্ষা করেন৷ অবশেষে এক বারবনিতার সহায়তায় পৃথিবীবিজয়ী মহাবীর বিক্রমাদিত্য নরসিংহকে আয়ত্তে আনেন৷ মদনমালা তার নিষ্পাপ প্রেম দিয়ে বিক্রমাদিত্যের স্ত্রী হয়ে শেষ পর্যন্ত পাটলিপুত্রের রানি হয়ে বাকি জীবন অতিবাহিত করে৷

এই ‘কথাসরিৎসাগর’-এই আছে আরেকজন বারাঙ্গনার কথা৷ সে অপ্সরা অলম্বুষের মেয়ে কলাবতী৷ ইন্দ্রকর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে মর্ত্যমানবের সম্ভোগের অধিকারী হয়েছিল৷ সারারাত প্রেমিক ঢিণ্ডারকরালকে তুষ্ট করতো বিচিত্র সম্ভোগ কৌশলে আর দিন হলে স্বর্গে ফিরে গিয়ে দেবসভায় দেবলোকের মনোরঞ্জন করত সে৷

কলাবিলাস :

‘কলাবিলাস’-এ রয়েছে গণিকা বিলাসবতীর কথা৷ বিলাসবতী বিত্তশালিনী এবং রূপবতী৷ রাজা বিক্রম রাজ্যচ্যুত হয়ে নিরাশ্রয় অবস্থায় ঠাঁই নেয় বিলাসবতীর আশ্রয়ে৷ বিলাসবতীর নারীসত্তা রাজা বিক্রমের প্রেমে উন্মত্ত হয়ে ওঠে৷ সে তার নিঃস্বার্থ প্রেম দিয়ে রাজাকে যেমন আগলে রাখে তেমনি তার সকল ধন-সম্পদের বিনিময়ে সাহায্য করে বিক্রমের লুপ্ত রাজ্য পুনরুদ্ধার করতে৷ কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সে পায় রাজমহিষীর মর্যাদা৷ একদিন তাকে বিমর্ষ দেখে রাজা তার কারণ জানতে চাইলে বিলাসবতী জানায় তার পূর্ব-প্রণয়ীর কথা, যার স্মৃতিতে সে ম্লান হয়ে আছে৷ রাজা নিজে অগ্রণী হয়ে সেই প্রণয়ীর সঙ্গে মিলন ঘটায় সেই নতুন রানির৷ যখন সে গণিকা ছিল তখন তার বহুপরিচর্যায় কোনো বাধা ছিল না৷ কিন্তু রাজমহিষী হওয়ার পরেও স্বামী তাকে আকাঙ্খিত পুরুষ এনে দেয়৷ এর থেকে বোঝা যায় যে গণিকা নারীকে গৃহবধূর সাম্মানিক জীবন দিলেও অনেক ক্ষেত্রে সে যে পূর্বে গণিকা ছিল তা তার স্বামী বিস্মৃত হয় না৷ তাই বিলাসবতীর অন্যপুরুষের সম্ভোগের ব্যবস্থা স্বামী বিক্রম নিজেই করে দিয়েছে৷ রাজমন্ত্রীও বহুভোগ্যার পাণিগ্রহণ করা নিয়ে রাজা বিক্রমকে সতর্ক করে দিয়েছিল যে গণিকাদের কখনো বিশ্বাস করা যায় না৷ এ কথা মনে পরার মধ্যে রাজা বিক্রমের দ্বন্দ্ব-মুখর চিত্তের ছবি ফুটে উঠেছে৷ এখানে রাজা, রাজমন্ত্রীর গণিকা নিয়ে নেতিবাচক ধারণাগুলির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত থাকলেও কাহিনির কোথাও যৌনসম্ভোগকারী পুরুষ যাদের কিনা গণিকাদের জীবনে পথের পথিকের মতো সতত আশা-যাওয়া, তার জন্য একজন গণিকা নারীর সর্বস্ব ত্যাগ করার মহানুভবতার কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত হয়নি৷ এমনই জীবন ছিল গণিকাদের৷

বৌদ্ধ যুগে গণিকা :

ভারতীয় সমাজ ইতিহাসে বৌদ্ধযুগ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ৷ খ্রিস্টপূর্ব ৬৪০ থেকে ৫৬০ পর্যন্ত সময়কালকে বৌদ্ধযুগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সমাজতাত্ত্বিকেরা৷ বুদ্ধের আবির্ভাবের প্রায় এক শতাব্দী পরে বৌদ্ধ সাহিত্যগুলি রচিত হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়৷ এই যুগের সাহিত্যকীর্তির মধ্যে উল্লেখযোগ্য জাতক অর্থাৎ বুদ্ধের বিভিন্ন জন্মের কাহিনি; অবদান শতক অর্থাৎ প্রশস্তিমূলক রচনা ও গাথা সাহিত্য৷ সে যুগের ভারতের নগর সভ্যতার পরিচয়, বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ, তাদের বৃত্তি ইত্যাদি সুস্পষ্টরূপে লিপিবদ্ধ হয়েছে৷ আর এই প্রসঙ্গে এসেছে বহু গণিকাচরিত্র৷ রাজকীয় এবং সামাজিক জীবনে তাদের অস্তিত্ব ছিল সর্বব্যাপী৷ গণিকারা অনেকেই সমাদৃত ছিল৷ তাদের পরিচয় ছিল ‘নগর শোভা’ হিসেবে৷ আবার সবক্ষেত্রেই যে তারা নগর শোভা ছিল তা নয় তাদেরকে অনেকেই ঘৃণার চোখে দেখতো৷

মহাবস্তুর বিভিন্ন কাহিনিতে, কান্তিবাদী জাতক, গমনীচন্দ জাতক, ইন্দিয় জাতক, আত্থন জাতক, কানবের জাতক, অবদান শতক ইত্যাদিতে গণিকাশ্রেণীর জীবনচর্যার সবিস্তার বর্ণনা পাওয়া যায়৷ এই জাতক মালার গল্পগুলি আয়তনে ক্ষুদ্র কিন্তু দোষে-গুণে নিজেদের বৃত্তিপোযুক্ত কার্যকলাপে এর অনেক গণিকাই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে৷ এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—আম্রপালি, শ্যামা, বাসবদত্তা, শলানতি বা শলাবতী, সুলসা, কালি, কাশিসুন্দরী, অদ্ধকাশী প্রমুখরা৷

আম্রপালী বা অম্বপালীর সঙ্গে ইতিহাসের দুই প্রবাদপ্রতিম পুরুষ জড়িত—একজন রাজা বিম্বিসার অপরজন স্বয়ং বুদ্ধদেব৷ কাহিনিটি ঐতিহাসিক৷ বিনয়বস্তুতে সবিস্তারে এবং মহাব>তে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণিত আছে এই কাহিনি৷ বৈশালী নগরের সর্বশ্রেষ্ঠ নারীরত্ন হল আম্রপালী৷ আম্রবৃক্ষের তলায় তাকে পাওয়া গেছে বলে নাম হয় আম্রপালী৷ বাগানের এক মালী তাকে সযত্নে লালন-পালন করে উপযুক্ত বয়সে নগরে নিয়ে আসে৷ তার অপরূপ সৌন্দর্য, নৃত্যগীতের পারদর্শিতায় মুগ্ধ হয়ে বৈশালী নগরের প্রতিজন যুবক পাণিগ্রহণের জন্য উন্মত্ত হয়ে ওঠে৷ এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে নগরের ‘গণপরিষদ’ নির্ণয় করে যে কোনো যুবকই একে এককভাবে লাভ করতে পারবে না, তাকে সকলের ভোগ্যা হয়ে থাকতে হবে৷ আম্রপালীর প্রতি রাত্রে পুরুষকে সঙ্গদানের মূল্য ছিল ৫০ কার্যাপণ৷ তার আয়ের উপর ধার্য করে বৈশালীর অর্থভাণ্ডার স্ফীত হয়ে উঠতে থাকে৷ একদিন সে খবর পায় যে বুদ্ধদেব আসবেন ধর্ম উপদেশ দিতে৷ নগরবধূ সে৷ বিলাসিনী নারী৷ এক সুদৃশ্য যানে চেপে যাত্রা করে বুদ্ধ-দর্শনে৷ কিন্তু পথ দুর্গম৷ মনের মধ্যে দেবদর্শনের প্রবল পিপাসা—পদব্রজেই বাকি পথ অতিক্রম করে উপনীত হয় বুদ্ধ সমীপে৷ বুদ্ধদেবের খুব কাছে বসে সে শুনতে থাকে তাঁর অমৃতময় উপদেশবাণী৷ চরম মুগ্ধ সে৷ হৃদয়ের পরম শুদ্ধতায় দেবতাকেই তার ঘরে আহারের নিমন্ত্রণ জানায় এবং দেবতা বুদ্ধও তা সানন্দে স্বীকার করেন৷

বিনয় বস্তুতে এই কাহিনি একটু অন্যরকম৷ বৈশালী নগরে লিচ্ছবি মহানামের এক আম্রকুঞ্জ ছিল৷ সেই কুঞ্জের মাঝখানে হঠাৎ একটি কলাগাছ গজিয়ে ওঠে৷ একজন ভবিষ্যৎ বক্তা গণনা করে মহানামকে বলেন যে, ঐ কলাগাছ থেকে সপ্তম দিনে একটি কন্যার আবির্ভাব হবে৷ নির্দিষ্ট সপ্তমদিনে মহানাম তার স্ত্রীদের নিয়ে সেই কলাগাছের তলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ যথাসময়ে কলার মোচা ফেটে এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান বেড়িয়ে এলে সন্তানহীনা মহানাম তাকে সানন্দে গ্রহণ করে লালন-পালনের দায়িত্ব নেয়৷ আমবাগানের মধ্যে তার জন্ম হয়েছে বলে নাম হয় আম্রপালী৷ ধীরে ধীরে নানা বিদ্যায় বিশেষ করে কলাবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে সে৷ তার চোখ ঝলসানো রূপ-লাবণ্যে চারিদিক মোহিত হয়ে যায়৷ দেশ-বিদেশ থেকে রাজপুত্র, শ্রেষ্ঠী, ধনী বণিকারা তার পাণি গ্রহণের আকাঙ্খায় উন্মত্ত হয়ে ছুটে আসতে থাকে৷ মহানাম ভীত হয়ে নগরের ‘গণ’-এর শরণাপন্ন হয়৷ বহু আলোচনার পর ‘গণ’-রা সিদ্ধান্ত জানায় যে ‘অনির্বহ স্ত্রীরত্নম’ অর্থাৎ স্বাধীনা নারী সম্পূর্ণ ‘গণ’-এর ভোগ্যা৷ আর সেইজন্য আম্রপালী কারও সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না৷ ‘গণ’-এর এহেন রায়ে মহানাম নিরাশ হলেও আম্রপালী পাঁচটি শর্তের বিনিময়ে সেই দুর্বহ জীবন বরণ করতে রাজি হয়৷ শর্তগুলি হল—

১) শহরের শ্রেষ্ঠ অংশে তাকে বাসস্থান দিতে হবে৷

২) তার নিজের প্রেমিক নির্বাচনের অধিকার থাকবে৷ আর যত বড় লোকই আসুক না কেন একজন প্রেমিক এলে আরেকজনের প্রবেশ নিষিদ্ধ৷

৩) তার সঙ্গে সম্ভোগকারী ব্যক্তিকে পাঁচশত কার্যাপণ দিতে হবে৷

৪) গণ যদি কোনো উদ্দেশ্যে তার গৃহ তল্লাশী করার আদেশ দেয় তবে আদেশ জারি হওয়ার সাতদিন পরে তা কার্যকর হবে৷

৫) তার গৃহে কে আসছে বা যাচ্ছে তার উপর কোনও নজরদারি চলবে না৷

আম্রপালীর সমস্ত শর্তই ‘গণ’ মেনে নেয়৷ সে হয়ে ওঠে বৈশালী নগরের প্রধান গণিকা৷

আম্রপালী বুদ্ধিমতী সুচতুর এবং রুচিশীল৷ বেছে বেছে ধনী পুরুষদের আহ্বান করে সে দেখলো যে তাদের মধ্যে অনেকেই কুৎসিতদর্শন এবং সঙ্গমে অক্ষম৷ তারপর সে অন্যপন্থা অবলম্বন করে৷ নানা দেশ থেকে অঙ্কনশিল্পীদের এনে বিভিন্ন রাজা, রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, মন্ত্রী, শ্রেষ্ঠ বণিক ইত্যাদিদের চিত্র অঙ্কন করিয়ে যাদের গ্রহণীয় বলে মনে হয় তাদেরই আহ্বান করে৷ এভাবে চলতে চলতে একদিন মগধের রাজা বিম্বিসারের চিত্র দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং তাঁর প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়৷ এদিকে বিম্বিসারও অমাত্যদের কাছ থেকে চৌষট্টিকলায় পারদর্শিনী পরম রূপবতী আম্রপালীর নাম শুনে কৌতুহলী হয়ে লিচ্ছবিদের শত্রুতা উপেক্ষা করে আম্রপালীর গৃহে প্রবেশ করেন৷ শত্রুরা তা বুঝতে পেরেও কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে না; বাধা হয় আম্রপালীর শর্ত৷ কিছুদিন পরে আম্রপালীর এক পুত্র জন্মায়৷ নাম অভয়৷ সে বড় হয়ে অজ্ঞাত পিতৃপরিচয়হীনতায় বিব্রত হয়ে পড়লে মায়ের কাছ থেকে মগধরাজ বিম্বিসারের কথা জানতে পারে৷ বিম্বিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সে রাজকুমার আখ্যায় ভূষিত হয় এবং আরও পরে ভগবান বুদ্ধের শরণ নিয়ে তাঁর শিষ্যত্ব লাভ করে৷

বারবধূ শ্যামার উল্লেখ আছে কানবের জাতক এবং মহাবস্তু অবদানে৷ রাজনটী শ্যামা বারাণসীর শ্রেষ্ঠ গণিকা৷ রূপ ও নৃত্যগীতে অসামান্যা৷ তক্ষশীলার অশ্বব্যবসায়ী বজ্রসেন বারাণসীতে অশ্ববিক্রয়ের উদ্দেশ্যে এসে সর্বস্ব খুইয়ে আহত অবস্থায় এক ভগ্নবাড়িতে আশ্রয় নেয়৷ সেখান থেকে নগরক্ষকেরা তাকে চোর সন্দেহ করে ধরে নিয়ে গেলে বিচারে প্রাণদণ্ড হয় তার৷ বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়ার কালে বারাঙ্গনা শ্যামা তার রূপে আকৃষ্ট হয়ে যে কোনো মূল্যের বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনার জন্য সখিকে রক্ষীদের কাছে প্রেরণ করে৷ রক্ষীরা প্রাণের বদলে প্রাণ চায়৷ তখন শ্যামা তার অনুগত এক প্রণয়ীকে পাঠায় বজ্রসেনের বিকল্প হিসেবে৷ তার প্রাণের বিনিময়ে বজ্রসেন রক্ষা পেয়ে শ্যামার কাছে চিরকৃতজ্ঞতায় নিজেকে ধরা দেয়৷ তাদের প্রণয়লীলায় উন্মত্ত পরস্পরের হৃদয়৷ বজ্রসেন শ্যামার কাছে তার মুক্তির রহস্য জানতে চাইলেও কোনো উত্তর পায় না৷ তারপর একদিন শ্যামার সকল ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে, সমস্ত অলঙ্কার আত্মসাৎ করে তাকে মদ্যপানে বিহ্বল ও আহত করে বারাণসী ঘাটে ফেলে পালিয়ে যায় বজ্রসেন৷ মায়ের ঐকান্তিক শুশ্রূষায় সে যাত্রা শ্যামা রক্ষা পেলেও তার নিকষিতহেমতুল্য হৃদয়নিঃসারিত প্রেমকে কিছুতেই ভুলতে পারে না৷ এক পরিব্রাজিকা ভিক্ষুণীকে তক্ষশীলায় পাঠায় বজ্রসেনকে ফিরে আসার অনুরোধ জানিয়ে কিন্তু এক বারবধূর প্রেমের কি মূল্য আছে এক সম্ভ্রান্ত অশ্বব্যবসায়ীর কাছে৷ শ্যামার একক নিঃসঙ্গতায় কাহিনির পরিসমাপ্তি৷

অবদান সাহিত্যের ‘দিব্যবদান’-এ রয়েছে মথুরার নগরনটী বাসবদত্তার কথা৷ সে গন্ধবণিক উপগুপ্তের প্রতি আকৃষ্ট হয় তার ভৃত্যের মুখের কথা শুনে৷ ভৃত্যের মাধ্যমে উপগুপ্তের কাছ থেকে নানা রকম সুগন্ধীদ্রব্য ক্রয় করত বাসবদত্তা কিন্তু ভৃত্য যখন সেই দ্রব্য নিয়ে ফিরে আসত তখন অর্থ অনুযায়ী জিনিস কম দিয়েছে বলে ভৃত্যের কাছে উপগুপ্তের নামে প্রতারণার অভিযোগ তুলত৷ ভৃত্য তা তীব্রভাবে অস্বীকার করে উপগুপ্তের সততা, অমলিন দিব্যকান্তি রূপের প্রশংসা করতো৷ এই ভাবে ক্রমাগত চরিত্র ও রূপের প্রশংসা শুনে বাসবদত্তা তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ভৃত্যকে দিয়ে তাকে গৃহে আমন্ত্রণ জানায়৷ উপগুপ্ত তা অস্বীকার করে জানান যে বাসবদত্তার কাছে তাঁর যাওয়ার সময় হয়নি, যখন সময় হবে তখন তিনি নিজের থেকেই উপস্থিত হবেন৷ এমতাবস্থায় মথুরায় আসে এক অশ্বব্যবসায়ী৷ বারনারী বাসবদত্তার খ্যাতি তার অগোচর থাকে না৷ পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা অগ্রিম পাঠিয়ে সে তার সঙ্গ কামনা করে৷ টাকার লোভ পেয়ে বসে বাসবদত্তাকে৷ সে বণিকের সবকিছু আত্মসাৎ করার অভিপ্রায়ে সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডেকে পাঠায় এবং সে এসে পৌঁছলে তাকে হত্যা করে শৌচাগারে লুকিয়ে রাখে৷ এই ঘৃণ্য কাজের জন্য রাজা তার হাত পা নাক ছেদন করে নগর পরিখার বাইরে শ্মশানে ফেলে রাখবার আদেশ দেন৷ এই সংবাদ উপগুপ্তর কাছে পৌঁছলে সে ভাবে যে, এই বার তার বাসবদত্তার কাছে যাওয়ার সময় হয়েছে৷ শ্মশানে হতচেতন বাসবদত্তার কাছে এসে জানায় এতদিন তার রূপগর্বিত আহ্বানকে সে অস্বীকার করলেও তার দুঃখময় পরিণতিতে কাছে আসার সময় উপস্থিত হয়েছে তার৷ এখানে বাসবদত্তার চারিত্রিক কোনো মহত্ত্ব নয় তার স্বভাবজ লোভ এবং অর্থলোলুপতার একটি দিক সুন্দরভাবে উন্মোচিত হয়েছে৷

শলানতীর কাহিনিটি রয়েছে ‘মহাবগ্গ’-তে৷ রাজগৃহের প্রধান গণিকা শলানতী বা শলাবতীর প্রতি রাত্রের মূল্য ছিল পাঁচশত কার্যাপণ৷ যৌনসঙ্গমে পারদর্শী হয়েও একবার সে গর্ভবতী হয়ে পড়ে৷ সকলের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করে অসুস্থতার ভান করে থাকে৷ যথাসময়ে এক পুত্রসন্তান প্রসব করলে ক্রুর হিংসায় দাসীর দ্বারা তাকে ফেলে আসে আবর্জনার স্তূপে৷ গণিকা নারীর বিকৃত যৌনপিপাসার কাছে কলুষিত হয়ে যায় পবিত্র মাতৃত্ব৷ গণিকা আম্রপালীর পুত্রের দ্বারা উদ্ধার ও লালিত-পালিত হয়ে পরবর্তীকালে সেই নিষ্পাপ শিশুসন্তানটি হয়ে ওঠে বিখ্যাত চিকিৎসক জীবক কুমারভৃত্য৷

বারাঙ্গনা সুলসাও বারাণসীর আরেক প্রসিদ্ধ দেহব্যবসায়ী৷ প্রভূত সম্পদের অধিকারিণী সুলসার এক রাত্রের শরীর মূল্য ছিল এক হাজার মুদ্রা৷ পাঁচশত দাসী সর্বদা এর সেবায় নিযুক্ত থাকতো৷ তার প্রণয়ী ছিল এক দস্যু৷ কয়েকমাস তার সঙ্গে মধুমাস অতিক্রান্ত করার পর সুলসার নির্মল প্রেমসত্যকে উপেক্ষা করে তার সকল অলঙ্কারাদি আত্মসাৎ করার ফন্দি আঁটে৷ পাহাড়ে উপর বৃক্ষদেবতাকে পূজা উৎসর্গ করার অছিলায় সর্বঅলঙ্কারে সুসজ্জিত করে সুলসাকে নিয়ে যায় পাহাড় চূড়ায়৷ সেখানে গিয়ে তার অভিপ্রায়ের কথা ব্যক্ত করলে ভয়ে ভীত হয়ে উঠে সুলসা৷ কিন্তু তার উপস্থিত বুদ্ধি ছিল ক্ষুরধার৷ নিজেকে সংযত করে দস্যুকে তাদের ভালোবাসার সত্যতা বোঝানোর চেষ্টা করে, দস্যু ভোলে না৷ তারপর তার সমস্ত অলঙ্কারাদি নির্বিঘ্নে তার হাতে দিয়ে প্রাণটুকু ভিক্ষা চায়, তাতেও মন গলে না পাষণ্ড দস্যুর৷ তখন সুলসা মৃত্যুর আগে শেষবারের মতো প্রিয়তমকে আলিঙ্গন করার অনুমতি চায়৷ এবারে দস্যু রাজি হয়৷ তারপর আলিঙ্গনের অছিলায় সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মেরে দস্যুকে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে ফেলে দিয়ে নিজগৃহে ফিরে আসে৷ এক সামান্য দেহজীবী পতিতাকে তার সামর্থ্য ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে অসামান্য করে তুলেছেন জাতকের কথাকার৷

তক্করীয় জাতকে বারাণসীর আরেক প্রসিদ্ধ গণিকা কালির কথা জানা যায়৷ কালির প্রণয়ী কালির অপদার্থ ভাই তুণ্ডিল্লকে মাঝে মাঝে অর্থ সাহায্য করতো৷ কালির সেটা পছন্দ ছিল না তাই সে স্পষ্ট করে ভাইকে জানিয়ে দেয় যে প্রেমিক ইচ্ছে করলে তাকে সাহায্য করতে পারে কিন্তু সে তার নিজের দেহবিক্রির রোজগার থেকে সামান্য অর্থও দেবে না৷ সেই সময় গণিকাগৃহের গণিকাদের জন্য অদ্ভূত নিয়ম ছিল যে দেহবিক্রয়কারী নারী তার দেহবিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন করবে তার অর্ধেক সে পাবে এবং বাকি অর্ধেক প্রেমিকের পোশাক, পুষ্পমালা, গন্ধদ্রব্য ইত্যাদিতে খরচ করবে৷ প্রেমিক যেদিন গণিকাগৃহে আসবে সেদিন তার নিজের পোশাক খুলে গণিকার দেওয়া বহুমূল্য বস্ত্রাদি পরিধান করবে আর চলে যাওয়ার সময় সেই বস্ত্রাদি খুলে রেখে নিজের পড়ে আসা বস্ত্রটি পরিধান করে ফিরে যাবে৷ কালির প্রেমিক তুণ্ডিল্যের দুঃখে কাতর হয়ে তার সেই মহার্ঘ্য বস্ত্র দিয়ে দিয়েছিল তাকে৷ তাতে অপমানিত হয় কালি৷ পরের দিন যখন নিজের বস্ত্র খুলে রেখে আরেক প্রস্থ বস্ত্র দাবি করে তখন ক্রুদ্ধ বারবধূ ভৃত্যদের দিয়ে বিবস্ত্র অবস্থাতেই তাকে ঘর থেকে বের করে দেয়৷ এই কাহিনিকে কেন্দ্র করে সেই সময় গণিকা সমাজের অনেক তথ্যাদিও উঠে আসে৷ শরীর নিঙড়ে নিঙড়ে উপার্জন করা অর্থের সম্পূর্ণ অংশ যে গণিকা নারীরা পেত না তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত যেমন রয়েছে তেমনি বাররামার প্রেমিকপুরুষেরা যে প্রেম-ভালোবাসা-সেবায় পরিপূর্ণ হয়ে গণিকার কাছ থেকে যৌনপরিসেবা লাভ করতো তাও অস্পষ্ট নয়৷

‘ব্রতবদানমালা’-য় রয়েছে গণিকা কাশিসুন্দরীর পেশার জন্য গভীরতম আত্মগ্লানি৷ কাশিসুন্দরী দেহজীবী হলেও তার ভেতরের নারীসত্তা বরণ করতে চায় সুবর্ণবর্ণকে৷ আর এর জন্য সে প্রত্যাখ্যান করে মগধের রাজা অজাতশত্রুর মন্ত্রী প্রচণ্ডকে৷ কিন্তু সুবর্ণও তাকে উপেক্ষা করে দেহপসারিণী বলে৷ পঞ্চস্বরে কাতর কাশিসুন্দরী সুবর্ণকে জয় করার উদ্দেশ্য নিয়ে তার বাগানবাড়িতে প্রবেশ করে৷ তাকে পেছন থেকে অনুসরণ করে মন্ত্রী প্রচণ্ড৷ সে কাশিসুন্দরীর অভিপ্রায় বুঝতে পেরে তাকে প্রবল প্রহার করে মুমূর্ষ অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়৷ আঘাতে জর্জরিত কাশিসুন্দরী একটি সাপের উপর পড়ে গেলে সাপ তাকে দংশন করে৷ প্রচণ্ড উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বুঝে কাশিসুন্দরীর মনের মানুষ সুবর্ণবর্ণের উপর হত্যার দায় চাপিয়ে দেয়৷ তার বাড়িতে কাশিসুন্দরীর মৃতদেহ পাওয়া যায়৷ বিচারে প্রাণদণ্ড হয় সুবর্ণবর্ণের৷ পরে ভিক্ষুশ্রেষ্ঠ আনন্দ অগ্রণী হয়ে তাকে রক্ষা করে এবং কাশিসুন্দরীর প্রাণ ফিরিয়ে দেয়৷ পুনরুজ্জীবন লাভ করে সে তার অপরূপ সৌন্দর্য, গণিকা জীবনের কলুষতা এবং নারী মাংসের প্রতি পুরুষের প্রবল লালসা থেকে মুক্তি চায়৷ আনন্দের কাছে প্রার্থনা করে পুরুষ শরীর৷ আনন্দের তত্ত্বাবধানে তার নারীত্ব লোপ পায়৷ সে সর্বস্ব ত্যাগ করে বুদ্ধের শরণ নেয়৷ দেহলোভী পুরুষ সমাজের নারীত্বের অবমাননার চূড়ান্ত পরিণতিতে এক রূপ-যৌবন সম্পন্না নারী কীভাবে আত্মধিক্কারে তার নারীত্বকে বিলুপ্ত করতে পারে কাশিসুন্দরী তার জীবন্ত প্রমাণ৷ তার শরীর বদল শুধু মাত্র নারী শরীর ধারণকারী এক অবলার আপোষ পরিণতি নয় নারী দেহভোগকারী সমাজের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদও৷

কাশীর বারবনিতা অদ্ধকাশি সর্বগুণে গুণান্বিতা স্বনামধন্য গণিকা৷ তার দর্শনী অর্ধেক কাশীর নগর করের সমান৷ তার প্রতি আকৃষ্ট পুরুষেরা সেই বিরাট অঙ্কের অর্থ দর্শনী দিতে পারত না বলে ধীরে ধীরে গ্রাহকসংখ্যা কমতে থাকে৷ শেষে বাজার ঠিক রাখতে সে তার দর্শনী অর্ধেক করে দেয়৷ এভাবে বহুদিন অতিক্রান্ত হলে দেহজীবিকার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে বুদ্ধের শরণ নিয়ে সংঘে চলে যায়৷

‘দিব্যবদান’ এবং ‘বাত্তাক জাতক’-এ দুজন নামহীনা গণিকার উল্লেখ রয়েছে৷ প্রথমটির নায়িকা কামার্ত৷ ছলে-বলে কৌশলে সে প্রেমাস্পদকে কাছে পেতে চায়৷ কাহিনিটি এই রকম বৌদ্ধভিক্ষু পদ্মক একদিন সেই গণিকার আলয়ে ভিক্ষার জন্য এলে তার প্রশান্ত রূপ-মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে নারীটি তার সঙ্গ কামনা করে৷ পদ্মক বিরক্ত হয়ে সেই স্থান ত্যাগ করে চলে গেলে সেই কামার্ত বারবনিতা তাকে বশে আনার জন্য এক চণ্ডালিনির দ্বারস্থ হয়, যে কিনা উচাটন, বশীকরণ ইত্যাদি তন্ত্রবিদ্যার দ্বারা অনিচ্ছুক মানুষকে কাছে টেনে আনতে পারে৷ মন্ত্রের প্রভাবে বিহ্বল নতমস্তক পদ্মক তার সামনে উপস্থিত হলেও ঘটনাক্রমে সম্বিৎ ফিরে এলে সে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করতে উদ্যত হয়৷ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে সেই গণিকা তার চরণে পতিত হয়ে নিজের আত্মগ্লানিকে স্বীকার করে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলে পদ্মকের আশীর্বাদে সে পরিণত হয় বৌদ্ধ ভিক্ষুণীতে৷

দ্বিতীয়টিতে এক কোষাধ্যক্ষের পুত্রকে সাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক জীবন থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য কার্তিক উৎসবের সময় তার ঘরে এক সুন্দরী বারাঙ্গনাকে পাঠিয়ে দেয়৷ গণিকার সবরকম কলাকৌশল তাকে প্রলোভিত করতে ব্যর্থ হলে নিরাশ হয়ে আরেক ধনবান পুরুষের সঙ্গে সে চলে যায়৷ গণিকার মা নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলেও মেয়েকে ফিরতে না দেখে কোষাধ্যক্ষের ছেলের নামে নগরপালকের কাছে নালিশ জানায়৷ নগরপালক বিচারের জন্য রাজার সম্মুখে উপস্থিত করলে সে নির্বিকারভাবে দাঁড়িয়ে থাকে৷ রাজা তার মুখ খোলাতে না পেরে প্রাণদণ্ডের আদেশ দেয়৷ বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়ার কালে বাইরের শোরগোলে সেই গণিকা বেড়িয়ে এসে সব কথা শুনে তাকে বাঁচানোর জন্য দ্রুত গিয়ে সত্যিকারে কি ঘটেছিল তা বিবৃত করলে যুবকটি রক্ষা পায়৷ একজন গণিকা, দেহবিক্রির মতো দুঃসহ পেশায় লিপ্ত অতিসাধারণ ঘৃণিত নারীও যে সত্যের প্রতি দায়বদ্ধ হতে পারে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ এই কাহিনি৷ এছাড়া যে পুরুষটি তার সমস্ত ছলাকলাকে ব্যর্থ করে তার রূপ-যৌবনের অবমাননা করেছে তার প্রতি ক্ষুব্ধ না হয়ে তাকে রক্ষা করে নিজের মহত্ত্বে নিজেই উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে৷

এই বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে এরকম অনেক গণিকার সন্ধান মেলে যাদের কেউ কেউ গণিকাবৃত্তির ক্লেদের মধ্যে থেকেও নিজের মহত্ত্বে, বুদ্ধিমত্তায়, সাত্বিকতায় উচ্চতর শিখরে অবস্থান করেছে যেমন—আম্রপালী, সুলসা, বাত্তাক জাতকের সেই নামহীনা বারবনিতা৷ আবার অনেক আছে যারা শঠতায়, নিষ্ঠুরতায় অমানবিক, তীব্রকামের দহনে জর্জরিত প্রাণ৷ যেমন বাসবদত্তা, শ্যামা, কালী৷ তারা যেমন কদর্যজীবন যাপনে হিংস্র মানসিকতায় প্রাণঘাতকরূপে প্রকাশিত হয়েছে তেমনি আবার বৌদ্ধ ধর্মের উদার ছত্রছায়ায় প্রশান্ত জীবন আস্বাদন করে সকল পাপ ধুয়ে মুছে নির্মল জীবনে উত্তীর্ণও হয়েছে৷ দেহজীবিকার গ্লানি বহন করে জীবনের শেষ প্রান্তে গিয়ে ধুকে ধুকে মরতে হয়নি তাদের৷ এই কাহিনিগুলির মধ্যে মগধের বারবনিতা কাশিসুন্দরীর কাহিনিটি অনবদ্য এক সম্পদ৷ কীভাবে একজন নারীর নিজ জীবনের প্রতি বীতরাগ এসে তার মননকে আমূল পাল্টে দেয়, কীভাবে নারীত্বকে বিলুপ্ত করে শরীর পাল্টে অন্য আরেক জীবনে প্রবেশ করে, নারী জন্মের সমস্ত বঞ্চনা থেকে রক্ষা পেতে এবং পুরুষের লালায়িত রসনা থেকে বাঁচতে সমাজের জন্য তীব্র এক প্রতিবাদ রেখে যায় তার মহামূল্য দৃষ্টান্ত এই কাশিসুন্দরী৷

বৌদ্ধ সাহিত্যগুলিতে তৎকালীন সময় ও সমাজের প্রেক্ষিতে এই চরিত্রগুলি নিজেদের পৃথকভাবে দাঁড় করাতে পেরেছে৷ বৌদ্ধধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে মূলত চরিত্রগুলির উপস্থাপনা৷ এই ধরনের রচনায় সমাজপতিতা, দেহপসারিণী নারীদের দেখানো হয়েছে নীচতার চরম পর্যায়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত তাদের পরম মুক্তিকে৷ তাদের আত্মসচেতন অস্তিত্ব, চিন্তা-ভাবনা, আবেগ-অনুভূতি, বিভিন্ন কার্যকলাপ এযুগের মানুষকে বিস্মিত করে৷ সেই সময়কার সমাজে গণিকা নারীরা অনেকেই সম্মানের শীর্ষ শিখরে আরোহন করতে পারতো তাদের কৃতকর্ম অনুযায়ী৷

জৈন সাহিত্যে গণিকা :

বৌদ্ধ সাহিত্যের মতো জৈন সাহিত্যেও লক্ষ্য করা যায় শিক্ষিতা ও সর্বাঙ্গসুন্দরী দেহবিনোদিনীদের সহস্রাধিক সম্ভোগ মূল্যের কথা৷ পুন্যবিজয়থি ভাবনগর রচিত (১৯৩৩-৩৮) জৈনগ্রন্থ ‘বৃহৎকল্প’-এ উল্লেখ রয়েছে গণিকাদের শিক্ষা-দীক্ষার কথা৷ এদের শিখতে হত সঙ্গীত, বাদ্যযন্ত্র, গণিত, নানারকম শিল্প, দ্যুতক্রীড়া, অক্ষক্রীড়া, সুলক্ষণ ও দুর্লক্ষণযুক্ত পুরুষ নারীর বিচার, অলংকরণ, অলংকার নির্মাণ, সজ্জা, অশ্ববিদ্যা, হস্তীবিদ্যা, রন্ধনবিদ্যা, রত্নপরীক্ষা, বিষনির্ণয় ও প্রতিবিধান, স্থাপত্য, সেনা-সন্নিবেশ, শিবির নির্মাণ, যুদ্ধবিদ্যা, ধনুর্বিদ্যা এমন বাহাত্তরটি বিষয়৷ বৌদ্ধসাহিত্যের গণিকাদের মতো ধর্মের ছত্রছায়ায় গিয়ে এদেরও মুক্তিলাভ ঘটতো ঘৃণ্যজীবনের গ্লানি থেকে৷ অনেকে তার অবশিষ্ট ধন-রত্নাদি অর্থসমূহও দান করে দিত ধর্মের নামে৷ জৈনগ্রন্থ ‘বৃহৎকল্পভাত’-এ লক্ষিত হয়েছে এক গণিকা চিত্রশালা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন৷ অনেকে আবার দরিদ্রদের মধ্যেও তাদের ধনরত্ন বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি৷ জৈনগ্রন্থ ‘বসুদেবহিণ্ডি’-তে রয়েছে পুরুষের জন্য স্ত্রীর বিকল্পের কাহিনি৷ সেখানে কৌমপতি ভরতের প্রাসাদে স্ত্রী ছাড়া একটি ভোগ্যা নারী থাকতো৷ একবার কৌমের অধীনের সকলেই তাদের নিজের নিজের মেয়েকে ভরতের প্রাসাদে ভোগের জন্য পাঠায়৷ কিন্তু অত নারীর অন্তঃপুরে স্থান সংকুলান হবে৷ তাই ঠিক হয়, এরা অন্তঃপুরের বাইরে রাজার পরিচর্যা করবে এবং এদের নিয়ে রাজার ভোগতৃষ্ণা মিটে গেলে এরা ঠাঁই পাবে ‘গণ’ বা গোষ্ঠীর কাছে; তখন এরা হয়ে উঠবে প্রকৃত গণিকা৷

মহাকাব্যে গণিকা :

হিন্দুদের অন্যতম ধর্মগ্রন্থ রামায়ণ ও মহাভারত৷ ধর্মীয় এই মহাকাব্যদ্বয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে উঠে এসেছে বহুলগণিকা প্রসঙ্গ৷

রামায়ণ :

রামায়ণের সাতটি কাণ্ডকে বিশদ পর্যবেক্ষণ করলে কাণ্ডগুলির কাহিনির সূত্র ধরে উঠে আসে ঊর্বশী, ঘৃতাচী, রম্ভা, মেনকা, হেমা ইত্যাদি বহুবিধ গণিকার নাম৷ এরা দেববেশ্যা৷ এদের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে নগরবিলাসিনী বারবধূদের প্রসঙ্গও৷

দেবযোষিৎ-অপ্সরারা দেবতাদের আনন্দ দান করে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজের জীবন দিয়ে দেবতাদের রক্ষা করে৷ কিন্তু পরিণতিতে তাদের শুধু অপমান ও লাঞ্ছনাই ভোগ করতে হয়৷

আদিকাণ্ডে অযোধ্যারাজ দশরথ পুত্রকামনায় অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলে অমাত্য সুমন্ত্রর মাধ্যমে অবগত হন ঋষ্যশৃঙ্গের কাহিনি৷ বিভাণ্ডক ঋষির পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে যজ্ঞের ঋত্বিক পদে বরণ করে যজ্ঞসমাপন করলে দ্রুত উদ্দীষ্ট ফল পাওয়া যাবে শুনে তিনি অতি শীঘ্র লোমপাদের রাজ্য থেকে তাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন৷ রাজা লোমপাদের রাজ্যে অনাবৃষ্টিজনিত বিপর্যয় দেখা দিলে তিনি—‘‘মুনি বেশধর বারাঙ্গনাগণ দ্বারা তপোবন হইতে ঋষ্যশৃঙ্গকে ভুলাইয়া আনিয়া, রাজা তাহাকে শান্তানাম্নী কন্যা সম্প্রদান পূর্বক গৃহে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং তখন হইতে তাহার রাজ্যে সুবৃষ্টি হইতে থাকে৷’’২৯ এখানে বারাঙ্গনা রক্ষাকারিণীর ভূমিকায় অবতীর্ণ৷ সে যদি ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রলুব্ধ না করতো তাহলে লোমপাদের রাজ্য অনাবৃষ্টিতে ছারখার হয়ে যেত৷ অর্থাৎ অঙ্গদেশ গণিকার হাত ধরে রক্ষা পায়৷ রাম ও তার অন্যান্য ভাইদের জন্মকে কেন্দ্র করে আনন্দ উৎসব মুখরিত অযোধ্যার বর্ণনাতেও অপ্সরা-গণিকাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়৷ বানরদের জন্মকে কেন্দ্র করেও অপ্সরা প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে৷ যেমন—‘‘প্রধান প্রধান কিন্নরী, অপ্সরা, বিদ্যাধরী ও নাগ কন্যাগণের গর্ভে যে সকল পুত্র জন্মিল, তারা সকলেই কামরূপী, কামাচারী ও সিংহতুল্য পরাক্রমশালী৷’’৩০ বিশ্বামিত্র রামচন্দ্রকে কান্যকুব্জ নামের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অপ্সরা ঘৃতাচীর কথা বলেন৷ ঘৃতাচী অপ্সরার গর্ভে রাজর্ষি কুশনাভের একশত কন্যা জন্মগ্রহণ করেছিল৷ তারা অভিশপ্ত হয়ে কুব্জীকৃত হয় বলে কান্যকুব্জ হয় সেই স্থানটির নাম৷ এই কাণ্ডেরই একটি অংশে পরমাসুন্দরী ষাটকোটি স্ত্রীর উত্থানের কথা সমুদ্রমন্থন প্রসঙ্গে বিশ্বামিত্র রামের কাছে উল্লেখ করেছেন৷ বিশ্বামিত্র-মেনকার কাহিনিতে দেখা যায় ব্রাহ্মণত্ব লাভের আশায় বিশ্বামিত্রের কঠিন তপস্যা শুরু হলে—দেবগণ ভীত হয়ে তপোভঙ্গের উদ্দেশ্যে তপস্যাস্থলে মেনকা নামের পরম রূপবতী অপ্সরাকে প্রেরণ করেন৷ ধ্যান ভেঙ্গে মেনকাকে দর্শন করে মোহিত হয়ে যান বিশ্বামিত্র এবং সেই মুগ্ধতার পরিণতি স্বরূপ দশ বছর তার সঙ্গে সহবাস করার পর বুঝতে পারেন সমস্তটার দেবতাদের চক্রান্ত৷ তাই মেনকাকে পরিত্যাগ করে উত্তর পর্বতে গিয়ে পুনরায় তপস্যায় রত হন৷ সেই তপস্যা সহস্র বছর অতিক্রম করে৷ এবার ইন্দ্র হাতিয়ার করেন রম্ভাকে৷ বিশ্বামিত্রের তপস্যা ভঙ্গের জন্য নির্বাচিত হয়ে ভীতা রম্ভা ইন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে—‘‘শচীপতে! বিশ্বামিত্র অতিশয় ক্রোধপরায়ণ৷ তিনি ক্রোধাগ্নি দ্বারা আমাকে ভস্মীভূত করিবেন৷ সুতরাং আমি এই কার্য সাধন করিতে পারিব না৷’’৩১ গণিকার বারণ কে কবে শুনেছে! তা স্বর্গ মর্ত্য যাই হোক না কেন৷ ইন্দ্র কন্দর্পের সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে ভুলিয়ে-ভালিয়ে তাকে যেতে রাজি করান৷ অবশেষে কন্দর্প মধুমাস তৈরি করে তাদের প্রেমশরে জর্জরিত করে সমস্ত পরিবেশ কামোপযোগী করে তুললে কন্দর্পবাণে মুগ্ধ বিশ্বামিত্র রম্ভার নিকটবর্তী হলেন কিন্তু পরক্ষণেই সমস্ত বুঝতে পেরে তাকে অভিশাপ দেন—‘‘তুমি এই তপোবনে দশ সহস্র বৎসর যাবৎ পাষাণমূর্তি হইয়া অবস্থান কর৷’’৩২ পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি স্বরূপ দেবতাদের মঙ্গল করতে গিয়ে নিজের জীবনে চরম অমঙ্গল ডেকে আনে রম্ভা৷ আর এই রম্ভা যে দেবতাদের অভীষ্টসিদ্ধ করতে গিয়েই দশ সহস্র বছর পাষাণ হয়ে পড়ে থাকলো তার খোঁজ নেওয়া কারও দরকার মনে হয় না৷

অযোধ্যাকাণ্ডে রামচন্দ্রের রাজ্যাভিষেকের সময়ে নর্তকী ও বিলাসিনী রমণীদের উল্লেখ আছে৷ বনে গমনের সময় শারীরিক অসুবিধাবোধে রামচন্দ্র যাতে কাতর না হয় সেই দিকে লক্ষ রেখে স্বয়ং রামচন্দ্রের পিতা সুমন্ত্রকে বলেন—‘‘রামের অনুরক্ত বন্ধুগণ ও বিলাসিনী রমণীরা প্রভূত ধন লইয়া অনুগমন করুক৷’’৩৩ অরণ্যকাণ্ডে বনগমনের সময় রামচন্দ্র সীতাকে নিয়ে তপোবনের ভিতর দিয়ে চলতে গিয়ে একটি ‘তরাগ বা দীর্ঘিকা’ দেখতে পান৷ মানুষজনহীন সেই স্থানে মধুর বাদ্য ধ্বনি শ্রবণ করে আশ্চর্যাম্বিত হয়ে রাম ধর্ম্মভৃৎ নামক মুনিকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে সেই মুনি রামকে এক কাহিনি শোনান৷ তিনি বলেন ‘‘এই তরাগ মাণ্ডকর্ণী মুনির নির্মিত৷ এই জলাশয় মধ্যে তিনি কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন ছিলেন৷ পরে দেবগণ তাঁহার তপোভঙ্গের জন্য পাঁচজন অপ্সরাকে পাঠাইয়া দেন৷ মুনি সেই অপ্সরাগণের রূপে মুগ্ধ হইয়া জলাশয়ের মধ্যে গৃহনির্মাণ পূর্বক তাহাদের সহিত বিহার করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছেন৷ এইজন্য এই জলাশয়ের নাম পঞ্চাপ্সর৷ জলমধ্যস্থ সেই অপ্সরাগণের মধুর সঙ্গীত ও বাদ্যধ্বনি শুনা যাইতেছে৷’’৩৪

কিস্কিন্ধাকাণ্ডে মহাপরাক্রমশালী বানররাজ বালী, তার মৃত্যুর পর সুগ্রীব রাজা হলে সুগ্রীবের ভোগ-বিলাসময় রমণী সম্ভোগের দৃষ্টান্ত রামায়ণে লক্ষ করা যায়৷ এই অধ্যায়েই অপহৃতা সীতার অনুসন্ধান করতে গিয়ে হনুমান অঙ্গদ ইত্যাদি পরাক্রমী বানরবীরেরা ঋক্ষবিলে উপস্থিত হলে সেখানে উঠে আসে হেমা নামক এক অপ্সরার প্রসঙ্গ৷ সেই স্থানের রক্ষিয়ত্রী হেমার সখী স্বয়ম্প্রভা৷ নর্তকী স্বয়ম্প্রভা বানরগণকে জানায় দীর্ঘদিন আগে তপস্যায় ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে তার বরে ময়দানব দানবদের বিশ্বকর্মা হয়েছিল৷ সেই ঋক্ষবিল সংলগ্ন স্থানে কাঞ্চনবর্ণের বন, গৃহ এবং প্রাসাদ নির্মাণ করে৷ পরে অপ্সরী হেমার প্রতি আসক্তির কারণে ইন্দ্রের হাতে তার প্রাণ গেলে ব্রহ্মার মধ্যস্থতায় ময়দানবের সবকিছু হেমার অধিকারে আসে৷ আর হেমাই সে কাঞ্চনপুরীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেয় স্বয়ম্প্রভার হাতে৷

সুন্দরকাণ্ডে হনুমান সীতার খোঁজে লঙ্কায় হাজির হলে সেখানে রাবণের প্রাসাদে, কক্ষে, ভোজনগৃহে সর্বত্রই নারী-সম্ভোগের এক বিচিত্র লীলা লক্ষ করে৷ লঙ্কাকাণ্ডে রাবণের স্ত্রীসঙ্গমে অক্ষমতা প্রসঙ্গে উপস্থাপিত হয় রম্ভার অভিশাপের কথা৷ ঘটনাটির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় উত্তরকাণ্ডে৷ বরলাভে বলীয়ান হয়ে অহঙ্কারী রাবণের ঔদ্ধত্য যে কি পরিমাণে বেড়ে গিয়েছিল তা বোঝাতে গিয়ে অগস্ত্যমুনি রামকে শোনান রম্ভার সেই কাহিনি৷ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জয়গর্বী রাবণ মধুদৈত্যের পুরী থেকে আতিথ্য সেরে ফেরার পথে কৈলাস পর্বতে সেনা সন্নিবেশ করে সামান্য ক্লান্তি অপনোদনের জন্য৷ সৈন্যদের বিশ্রামের অবসরে গিরিশিখরে একাকী বসে স্নিগ্ধ চন্দ্রমার সুমধুর আমোদে কামাতুর হয়ে পড়ে বলীয়ান রাবণ৷ আর ঠিক ঐ সময়েই অভিসারিকা রম্ভা ওই পথে প্রিয়সঙ্গমের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল৷ রাবণ তার পথ রোধ করে তাকে আহ্বান করে কাম তৃপ্তির জন্য৷ রম্ভা তা প্রত্যাখ্যান করে রাবণকে আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বলে যে, সে তার ভাই কুবেরের পুত্র নলকুবেরের প্রেমিকা এবং তার পুত্রবধূ৷ কিন্তু কামোন্মত্ত রাবণ ভ্রাতুষ্পুত্রের প্রেমিকাকেও তার দুর্বার কামনা থেকে রেহাই দেয়নি৷ আর দেবেই বা কেন! রম্ভা বহুপুরুষ পরিচর্যাকারী৷ পুরুষকে যৌন আনন্দ দেওয়াই তার কাজ৷ তাই রাবণ তাকে বলে—‘‘তুমি যদি এক ব্যক্তিতেই নিষ্ঠাবতী হইতে, তবে তোমাকে পুত্রবধূ মনে করিতে পারিতাম৷ বিশেষতঃ অপ্সরাগণের নির্দিষ্ট পতি নাই৷’’৩৫ এ কথা বলেই কামার্ত রাবণ শিলাতলে স্থাপন করে বলপূর্বক রম্ভাকে ধর্ষণ করে৷ বহুপুরুষ পরিচর্যাকারী রমণীর ভালোলাগা-না লাগার, ইচ্ছে-অনিচ্ছে ও সম্পর্কের মূল্য সমাজরক্ষক পুরুষ মানুষের নেই৷ তাই রম্ভা তার খুল্লতাত শ্বশুরের কামনা থেকে রেহাই পায় না৷ উত্তরকাণ্ডেই অশোকবনে রাম-সীতার প্রমোদ উদ্যানে সুন্দরী রমণী, কিন্নরী, অপ্সরীদের নৃত্যগীত পরিবেশনের কথা আছে৷ আর এইভাবে রামায়ণের বিভিন্ন কাণ্ডের বিভিন্ন অংশে দেবযোষিৎ নারীদের সঙ্গে সাধারণ গণিকাশ্রেণীর নারীদের কথা বর্ণিত হয়েছে৷

রামায়ণের নায়ক রাম আদর্শ পুরুষচরিত্র৷ সেখানে সৎ, ধার্মিক, চরিত্রবান রাজা দশরথ, রামচন্দ্র ইত্যাদি চরিত্রগুলি গণিকাসম্ভোগের বাধাহীন অধিকার এবং বিধি-নিষেধহীন নিরঙ্কুশ কালযাপন প্রসঙ্গে ‘প্রাচীন ভারতে গণিকা’ প্রবন্ধে কঙ্কর সিংহ বলেছেন—‘‘রামের সাথে ধর্মপত্নী সীতা ছিলেন৷ তারপরেও পুত্রের গণিকার প্রয়োজন হতে পারে মনে করার মধ্যে আদি কবি বাল্মীকি কোনও অধর্ম খুঁজে পাননি৷ কারণ এটাই ছিল তখন রাজা এবং রাজপুত্রদের জীবন ধারণের প্রথা৷’’৩৬

মহাভারত :

রামায়ণের মতো মহাভারতেও নর্তকী অপ্সরা থেকে শুরু করে প্রচুর বারবনিতা, দাসী গণিকার উল্লেখ রয়েছে৷ অর্জুনের জন্মকে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে নর্তকী, গায়িকা এবং দেবতাদের মনোরঞ্জনকারী ঊনচল্লিশজন অপ্সরার নাম৷ তাদের মধ্যে সদ্যজাত অর্জুনকে ঘিরে নৃত্য পরিবেশন করেছিল অনুচানা, অনবদ্যা, গুণমুখ্যা, গুণাবরা, অদ্রিকা, সোমা, মিশ্রকেশী, অলম্বুষা, মারীচি, শুচিকা, বিদ্যুৎপর্ণা, তিলোত্তমা, অম্বিকা, রম্ভা প্রমুখরা৷ গায়িকা হিসেবে সঙ্গীত পরিবেশন করেছে মেনকা, ঊর্বশী, পুঞ্জিকস্থলা, ঋতস্থলা, কর্ণিকা, ঘৃতাচী, বিশ্বাচী, পূর্বচিত্তি, উম্লোচা, প্রম্লোচা প্রমুখরা৷ এরা সকলেই দেবসভার বিনোদিনী৷ কখনো কোনো অসুর অশুভ ইচ্ছায় ক্রমশক্তিশালী হয়ে দেবতাদের পরাজিত করার অভিপ্রায়ে যদি কঠিন তপস্যায় মগ্ন হয়, তাদের অভিলাষকে ব্যর্থ করে দিতে দেবতাদের দ্বারা প্রেরিত হয় এরা৷ ঊর্বশী, রম্ভা, মেনকা, তিলোত্তমা এদের ক্ষেত্রে বহুবার এমন ঘটনা ঘটেছে৷ দেবতাদের মনোরঞ্জনকারিণী এই দেবযোষিৎরা নিজেদের সামান্যতম ভুল হলেই দৈবকোপে মর্ত্যে নিক্ষিপ্ত হয়৷ আবার কখনো কখনো দেখা যায় দেবতারা উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তাদেরই গুপ্ত ষড়যন্ত্রে পদস্খলন ঘটিয়ে অপ্সরীদের মর্ত্যে অবতীর্ণ হতে বাধ্য করেছে৷ ঊর্বশী, মেনকা, অদ্রিকার সঙ্গে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছিল৷

নিজস্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে দেবকুল কীভাবে এই নারীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারে এমন দৃশ্য দেখা যায় মেনকা-বিশ্বামিত্রের কাহিনিতে৷ পুরাকালে ব্রাহ্মণত্ব অর্জনের জন্য মহর্ষি বিশ্বামিত্র তপস্যা আরম্ভ করলে ইন্দ্র শঙ্কিত হয়ে উঠে৷ মেনকাকে তাঁর তপস্যা ভঙ্গ করে প্রদেয় ফল থেকে বঞ্চিত করতে আদেশ করে৷ মহাতেজস্বী ও কোপনস্বভাব ঋষি বিশ্বামিত্র রুষ্ট হলে চরম থেকে চরমতম দণ্ড দিতে পারেন৷ এই চিন্তায় বিচলিত হয়ে উঠে দেববেশ্যা এই নারী৷ তাই সে কাতরভাবে ইন্দ্রকে জানায় ‘‘যিনি আপন তেজে ত্রিজগৎ দগ্ধ করতে পারেন, পদাঘাতে পৃথিবীকে বিচলিত করতে পারেন, মহামেরু পর্বতকে ক্ষুদ্র পর্বত করে দিতে পারেন এবং দিক সকলকেও হঠাৎ পরিবর্তিত করে দিতে পারেন৷… সেই বিশ্বামিত্রকে আমার মতো রমণীই বা কীভাবে স্পর্শ করবে?… আমার মতো তুচ্ছ নারী তাঁকে ভয় পাবে না কেন?’’৩৭ মেনকার কাতর সংশয় ইন্দ্রকে বিচলিত করে না৷ সে তার সংকল্পে স্থির থাকে৷ তখন নিজের সুরক্ষার জন্য মেনকা নিবেদন করে—‘‘দেবরাজ আপনি আদেশ করলে আমাকে বিশ্বামিত্রের কাছে যেতেই হবে৷ অতএব আপনি আমার রক্ষার বিষয় স্থির করুন৷ যাতে আমি রক্ষিত অবস্থায় আপনার কার্যসম্পাদন করতে সমর্থ হই৷ আমি যখন বিশ্বামিত্রের কাছে গিয়ে নৃত্যরত অবস্থায় খেলা করব, তখন যেন বায়ু আমার অঙ্গ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে বস্ত্র সরিয়ে দেন এবং আপনার আদেশে কামদেব আমাকে যথেষ্ট সহায়তা করেন৷ আর, আমি যখন মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে প্রলুব্ধ করতে থাকব, তখন বন থেকে যেন যথেষ্ট পরিমাণে সুগন্ধ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকে৷’’৩৮

অপ্সরা তিলোত্তমার কথা জানা যায় সুন্দ-উপসুন্দের কাহিনিতে৷ সুন্দ-উপসুন্দ ব্রহ্মার আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে দেবগণের ত্রাস হয়ে উঠে৷ অত্যন্ত সৌহার্দ্যপরায়ণ এবং পরস্পরের প্রতি অনুগত দুইভাই নিজেদের আত্মকলহে হত না হলে কেউ তাদের বধ করতে পারবে না এই ছিল তাদের প্রতি ব্রহ্মার আশীর্বচন৷ পরস্পরের প্রতি বিদ্বেষহীন অভিন্ন হৃদয়ের দুই ভাই-এর কলহের কোনো কারণও ছিল না৷ ধরতে গেলে তারা অমরই৷ আর এই সুবিধা নিয়ে মহানন্দে দেবকুলকে বিধ্বস্ত করে তারা জীবন কাটাতে থাকে৷ অসহায় স্বর্গবঞ্চিত দেবতারা উপায়ন্তর না দেখে ব্রহ্মার স্মরণাপন্ন হলে তাঁরই নির্দেশে—‘‘ত্রিলোকী মধ্যে দর্শনীয় পরম রমণীয় যে সমস্ত স্থাবর-জঙ্গম পদার্থ আছে; বিশ্বকর্মা তৎসমুদয় আহরণপূর্বক দেবরূপিণী এক কামিনী সৃজন করিয়া তাহার অঙ্গপ্রতঙ্গ সমুদয় গাত্রে কোটি কোটি রত্নে অলঙ্কৃত করত তাহাকে রত্ন সংঘাতময়ী নির্মাণ করিলেন৷… মূর্তিমতী লক্ষ্ণীর ন্যায় কামরূপিণী সেই সীমন্তনী প্রাণী মাত্রেরই নয়ন মনের অপহারিণী হইল৷’’৩৯ বিশ্বকর্মা জগতের সকল রত্ন সংগ্রহ করে তিল তিল করে তার কায়ানির্মাণ করেছিলেন বলে তার নাম হয় তিলোত্তমা৷ নামকরণ করার পর ব্রহ্মা তাকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বলেন—‘‘তিলোত্তমা! তুমি সুন্দ ও উপসুন্দ, দুই অসুরের নিকট গমন কর; তথায় যাইয়া তোমার কমনীয় রূপ দ্বারা তাহাদিগকে প্রলভ জন্মাইতে যত্নবতী হও৷’’৪০ ব্রহ্মার আদেশমত তিলোত্তমা তার অসামান্য রূপের বাহার নিয়ে সুরাগ্রস্ত দুই ভাই-এর সম্মুখে উপস্থিত হলে তাকে স্ত্রীরূপে পাওয়ার জন্য দুই ভাই আত্মকলহে লিপ্ত হয়৷ শেষপর্যন্ত দুজন দুজনকে হত্যা করে খান্ত হয়৷ তিলোত্তমার কৃতকর্মের কৃতজ্ঞতাস্বরূপ দেবগণ শ্রেষ্ঠ অপ্সরার সম্মান দিয়ে তাকে সূর্যলোকে পাঠিয়ে দেয়৷ দেবতাদের রক্ষাকারিণী রূপান্তরিত হয় তাদের মনোরঞ্জনকারিণীতে৷ এখানে কামরূপিণী দুই দৈত্যের মধ্যে প্রবল কামতৃষ্ণা জাগ্রত করেছে তিলোত্তমা তার অপরূপ সৌন্দর্য দিয়ে৷ আর কামান্ধতা অর্থাৎ সৌন্দর্যময়ী নারীর দেহ সুধা পানের তীব্র বাসনাই হিতাহিত জ্ঞান লোপ করে তাদের মৃত্যু ডেকে এনেছে৷ মহাভারতে পঞ্চপাণ্ডবের সাথে দ্রৌপদীর বিয়ে হলে পাঁচ ভাই-এর এক স্ত্রীকে সুষ্ঠুভাবে বন্টনের পরামর্শ দিয়ে নারদ যুধিষ্ঠিরকে এই কাহিনি শুনিয়েছিলেন৷

‘মহাভারত’-এ অপ্সরাদের স্থূলদেহকামনার সঙ্গে বাছবিচারহীন যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চিত্র ফুটে উঠেছে ঊর্বশী-অর্জুনের সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে৷ স্বর্গরাজ্যে ত্রাস সৃষ্টিকারী অসুর কলিকেয় ও নিবাতকবচকে বধ করার জন্য অর্জুন ইন্দ্রের সন্তুষ্টি লাভ করে ইন্দ্রপুরীতে আতিথ্য নিলে তার মনোরঞ্জনের জন্য ইন্দ্রদেব আয়োজন করে নৃত্য-গীতের৷ নৃত্যসভার নৃত্য-বর্ণনায় উঠে এসেছে বহু অপ্সরার নাম৷ সেখানে নৃত্য পরিবেশনকালে অর্জুন ঊর্বশীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলে ইন্দ্র রূপমুগ্ধতার আভাস পেয়ে গন্ধর্বরাজ চিত্রসেনের দ্বারা ঊর্বশীকে অর্জুনের সেবার জন্য অর্জুনের কক্ষে প্রেরণ করে৷ ঊর্বশী দেহসুখের বাঞ্ছা নিয়ে অর্জুনকে বলে—‘‘আমি তোমার শুশ্রুষা করিবার নিমিত্ত সমাগত হইয়াছি, তোমার গুণসমূহে আমার চিত্ত আকৃষ্ট হইয়াছে; অতএব তোমাকে শুশ্রুষা করা আমার চিরাভিলাষিত মনোরথ৷’’৪১ ঊর্বশী তার কামনারাজি নিয়ে হাজির হলেও অর্জুন তাকে পৌরববংশীয় আদি জননী জ্ঞানে প্রত্যাখ্যান করলে কামতাপিত ললনা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে—‘‘হে বীর দেবরাজ নন্দন! আমরা সকলে কাহারও আবৃতা নহি, অতএব আমাকে গুরুস্থানে নিযুক্ত করা তোমার উচিৎ হয় না৷ পুরুরাজার বংশে যে সকল পুত্র বা নপ্তা তপস্যা দ্বারা এখানে আগমন করিয়াছেন, তাহারা সকলেই আমাদিগের সহিত ক্রীড়া করিয়া থাকেন, আমাদিগের প্রতি তাহাদিগের ব্যতিক্রমা ভাব নাই৷ অতএব তুমি আমার প্রতি প্রসন্ন হও৷ হে মানপ্রদ! আমি মন্মথানলে সন্তপতা ও পীড়িতা হইয়াছি, আমাকে পরিত্যাগ করা তোমার উচিৎ হয় না৷’’৪২ এর পরেও অর্জুন যখন তার সিদ্ধান্তে অটল থেকে সীমাহীন শ্রদ্ধা দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে রাখে তখন কামজর্জর নারীর স্থূল দেহকামনা হিংস্ররূপে প্রতিভাত হয়ে অর্জুনকে অভিশাপ দেয়—‘‘হে পার্থ আমি তোমার পিতার অনুজ্ঞাহেতু স্বয়ং তোমার গৃহে আসিয়াছি, বিশেষত আমি কন্দর্পের বশবর্তিনী হইয়াছি; এমতস্থলে তুমি আমার প্রতি অভিনন্দন করিলে না, অতএব তুমি পুরুষত্বহীন রূপে বিখ্যাত, মানহীন ও নর্তক হইয়া স্ত্রীগণ মধ্যে ক্লীবের ন্যায় বিচরণ করিবে৷’’৪৩

এছাড়াও মহাভারতের আদিপর্বে দ্রৌপদীর বিবাহের যৌতুকের সঙ্গে একশত সুন্দরী তরুণী দেওয়া হয়েছিল, সুভদ্রার বিবাহে অতিথিদের স্নান, সুরাপান, সেবাযত্নের জন্য এক হাজার সুন্দরী তরুণী নির্দিষ্ট ছিল৷ গান্ধারী গর্ভবতী হয়ে স্বামী ধৃতরাষ্ট্রের শুশ্রূষা থেকে বিরত হলে বিকল্প হিসেবে রাজা ধৃতরাষ্ট্র গণিকা পরিবেষ্টিত হয়৷ উদ্যোগপর্বে যুদ্ধের আগে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির গণিকাদের অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন৷ যুধিষ্ঠির যখন অশ্বমেধপর্বে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন সেই যজ্ঞে তিনি নিজে দানে, দক্ষিণায় বহু নারীকে রাজ অতিথি ও পুরোহিতের সেবার জন্য উৎসর্গ করেছিলেন৷ দ্রোণপর্বে ভগীরথের হাজারে হাজারে নারীদান কথা যেমন আছে তেমনি রাজা শশবিন্দু তাঁর অশ্বমেধ যজ্ঞেও বহু সহস্র নারী দান করেছিল৷ এই পর্বেই যুদ্ধক্ষেত্রে কর্ণ ঘোষণা করেছিল যে কেউ যদি অর্জুনকে চিনিয়ে দেয় তাহলে তাকে একশত সুন্দরী দান করবে৷ বনে যাওয়ার সময় পাণ্ডবদের সাহচর্যের জন্য, সৈন্যদের বিনোদনের জন্য অনেক গণিকা সঙ্গে গিয়েছিল, বনপর্বে এর উল্লেখ আছে৷ বীরের মতো যুদ্ধ করে প্রাণ ত্যাগ করলে স্বর্গে গিয়ে বহুসংখ্যক সুন্দরী নারী ভোগ করা যায় তার কথাও এই পর্বে ব্যক্ত হয়েছে৷ আর অনুশাসন পর্বেও প্রায় এ ধরনের কথাই আছে, যথা ব্রাহ্মণকে সুন্দরী তরুণীদান করলে স্বর্গে বহু সংখ্যক অপ্সরার দ্বারা সে পরিতৃপ্ত হবে৷ বনপর্বে অর্জুন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পরাজিত পক্ষের স্ত্রীদের জয়লব্ধ অন্যান্য সম্পদের মতোই সঙ্গে করে নিয়ে আসে৷ অর্জুনের জয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বিরাট পর্বে রাজা বিরাট তাকে পারিতোষিক দিয়েছিল বহুসংখ্যক নারী৷ মহাভারতের শান্তি পর্বে রয়েছে নারী দান না করা রাজাদের নিন্দার কথা৷ ‘‘যে রাজা সুন্দরী নারী দান করেন না তাঁর নিন্দাসূচক নাম ‘রাজকলি’, অর্থাৎ রাজাদের মধ্যে কলিস্বরূপ৷’’৪৪

এভাবে রামায়ণ মহাভারতের বিভিন্ন অংশে লক্ষিত হয় যে উৎসবে, যুদ্ধ জয়ে, যজ্ঞে নারীকে বস্তুর মতোই দান করা হত৷ আর যাদের দান করা হত তারা স্বাভাবিকভাবেই গণিকানারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতো৷ আর এদের দেহের বিনিময়ে, জীবনের মান-সম্মানের বিনিময়ে পুণ্য অর্জন করতো তৎকালীন রাজা-মহারাজা তথা সমাজপতিরা৷ এই অসহায়া নারীদের শেষপর্যন্ত কি পরিণতি হত তা ভেবে দেখার অবকাশ তাদের ছিল না৷ পুণ্যবান পুরুষেরা ইহলোকে নারীভোগ করে, নারী দান করে পরলোকে অপ্সরারূপী নারীদের লাভ করতো তাদের ভোগবাসনাকে সচল রাখার জন্য৷ আর এ থেকে সহজেই বোঝা যায় পৃথিবীর গণিকাদের কাল্পনিক রূপায়ণ স্বর্গের অপ্সরাদের মধ্যেই৷ আর এই দান হয়ে যাওয়া নারীদের মর্মান্তিক পরিণতির কি হত তা কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ ‘‘বোঝা যায় ঋত্বিক-পুরোহিতদের সাধ্য ছিল না এতগুলি নারীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার৷ অতিশয়োক্তি বাদ দিলেও তো এদের সংখ্যা শঙ্কাবহরূপে বেশি, কাজেই কিছুদিন পরেই এরা ক্রীতদাসী বা গণিকায় পরিণত হত৷ এবং ব্যাপারটা ঘটত ধর্মযাজকদের মাধ্যমেই, কারণ, এ সব দক্ষিণার গ্রহীতা তাঁরাই৷ অন্য যাঁরা, অতিথি বন্ধু প্রিয়জন, উৎসবে বা কোনও উপলক্ষে দানস্বরূপে অনেক নারী লাভ করতেন তাঁরাও নিশ্চয়ই এদের অনেককেই বিক্রি করতেন দাসীত্বে বা গণিকাত্বে৷ এ ছাড়াও অন্য বহু সূত্র ধরে নারী আসত গণিকালয়ে৷’’৪৫

মঙ্গলকাব্যে গণিকা প্রসঙ্গ :

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অনেকটা জায়গা জুড়ে রয়েছে মঙ্গলকাব্যগুলি৷ এই সাহিত্য ধারাতেও গণিকা চরিত্রের উপস্থিতি কম নয়৷

মনসামঙ্গলকাব্যে উল্লেখ রয়েছে দেবাপ্সরা ঊষার প্রসঙ্গ৷ মনসার প্রভাব-প্রতিপত্তি তথা পূজাকে মর্ত্যলোকে প্রচার করার জন্য ঊষাকে দৈব ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নিজের প্রেমাস্পদ অনিরূদ্ধকে ছেড়ে মর্ত্যে জন্ম নিতে হয়৷ এখানে দেবতা কর্তৃক বিতাড়িত নির্দোষ ঊষাকে সীমাহীন লাঞ্ছনা-যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে৷

চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে নারীর সতীত্ব সম্পর্কিত উপদেশ দিতে গিয়ে ফুল্লরা ছদ্মবেশিনী চণ্ডীকে শুনিয়েছে বেদবতী-লক্ষহীরার কাহিনি৷ এটি এক পৌরাণিক কাহিনি৷ বেদবতী পতিব্রতা সাধ্বী স্ত্রী৷ তার গলিতদেহ স্বামীর মনস্কামনা সিদ্ধ করতে স্বামীর রোগজর্জর দেহ কাঁধে করে গণিকা লক্ষহীরার অঙ্গনে নিয়ে গিয়েছিলেন৷ বারবধূ লক্ষহীরাকে বহুপরিচর্যাকারিণী হওয়ার সুবাদে গ্রহণ করতে হয়েছিল রোগজর্জ্জরিত সেই গলিত পুরুষদেহটিকেও৷

‘‘বেদবতী নামে দারা পতি যার শতশিরা অবিরাম শরীর গলিত৷

পতিব্রতা হয় যেবা তেন মতি করে সেবা স্বামীর পালন করে নিত৷৷

একদিন বেদবতী কান্দে করি নিজপতি গঙ্গাস্নান করিবারে যায়৷

গঙ্গার ওকুল ধারে অঙ্গ মার্জন করে বারবধূ দেখিবারে পায়৷৷

দৈবযোগে এক দিনে দেখাদেখি দুইজনে হাস্যরসে দুজনে কথনে৷

বেদবতী বলে বাণী হর্ষ বারনিতম্বিনি ভাগ্য করি সে মানিল মনে৷৷

মুনি বলে শুন সতী যদি বা ভুঞ্জাহ রতি বারবধূ লক্ষহীরা সনে৷

সতী নিতি দাবীঘরে অঙ্গ মার্জন করে বেশ্যা বিস্ময় ভাবে মনে৷৷

মানিল মানসম্পূর্ণ নিজাগারে যায় তূর্ণ কান্দে করি স্বামী লয়্যা যায়৷

পতির পূরিতে আশ বারবনিতার পাশ পতিব্রতা লয়্যা যায়স্বামী৷৷’’৪৬  

মধ্যযুগীয় সমাজ পরিবেশে সতী রমণীদেরও যেমন সতীত্বের পরীক্ষা দিতে দিতে দুর্দশার অন্ত থাকতো না তেমনি গণিকা নারীরাও সমাজে সর্বস্তরের সর্বশ্রেণীর মানুষের সঙ্গে সঙ্গমে বাধ্য হত৷

যৌন চাহিদা পূরণের জন্য তখনও যে গণিকার প্রয়োজন হত বা গণিকারা নির্দিষ্ট পল্লীতে অবস্থান করে পুরুষের প্রবৃত্তির দাহকে শান্ত করতো অর্থের বিনিময়ে তার উল্লেখ রয়েছে কবিকঙ্কনের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ৷ যেমন—

 ‘‘লম্পট পুরুষ আশে বারবধূগণ বৈসে

 একভিতে তার অধিষ্ঠান’’৪৭

বাংলা মঙ্গল কাব্যধারায় ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের মধ্যেও লক্ষ করা যায় গণিকা চরিত্রের অবাধ বিচরণ৷ ষোড়শ-সপ্তদশ শতাধীতে মূলতঃ এই কাব্যধারার সূচনা৷ পরবর্তীসময়ে বহু কবির হাত ধরে এ কাব্য বিকাশ লাভ করে৷ এর আদি কবি হিসেবে ময়ুরভট্টের নাম পাওয়া গেলেও রূপরাম চক্রবর্তী এবং ঘনরাম চক্রবর্তী এঁরা ‘ধর্মমঙ্গল’-এর আদর্শ কবি৷ সমগ্র ধর্মমঙ্গল কাব্য পর্যালোচনা করলে গণিকা চরিত্র ও তাঁদের জীবনাচরণ এবং সামাজিক অবস্থানের যে রূপ ফুটে ওঠে তা স্বাভাবিক ও বাস্তবসম্মত৷ আলোচ্য কাব্যে ধর্মঠাকুরের পূজা প্রচারের উদ্দেশ্যে ঘটনা ও চরিত্রের সাজুয্য বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন চরিত্ররা এসে ভিড় করেছে৷ কাহিনির শুরুতেই দেখা যায় ইন্দ্রপুরের অপ্সরী অম্বুবতীকে৷ স্বর্গের দেবতাদের মনোরঞ্জন করে যার জীবন অতিবাহিত এবং দেবইচ্ছা পূরণের জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও মর্ত্ত্যে জন্ম নিতে হয়৷ কীভাবে ছল করে দেবতারা তাঁকে মর্ত্ত্যে পাঠানোর ষড়যন্ত্র করে তার উল্লেখ রয়েছে এইভাবে—

 ‘‘অম্ববতী নামে আছে ইন্দ্রের নাচনী৷৷

 তারে যদি অভিশাপ দেহ কোন ছলে৷

 তবে সে প্রকাশ পূজা অবনীমন্ডলে৷৷

 ধরণীমন্ডলে নাম হব রঞ্জাবতী৷

 রূপে আল দশদিগ প্রকাশিব ক্ষিতি৷৷’’৪৮

এখানে দেবতাদের কার্যকলাপে বাধ্য হয়ে মনুষ্য জীবনে প্রবেশ করা অপ্সরী অম্বুবতী প্রতিনিধিত্ব করছে সমাজের বিভিন্ন পরিস্থিতির শিকার অসহায় নারীকুলের আর দেবতারা শোষক-পীড়ক৷ তবুও অম্বুবতীকে রঞ্জাবতী বানানোর জন্য দেবতাদের দরকার কোনো না কোনো অছিলার নতুবা তাদের দেবত্ব কলুষিত হতে পারে৷ তাই তাঁরা যত্নবান হয় অপ্সরীর দোষ খুঁজতে৷ আর এক্ষেত্রে জগতজননী দেবী পার্বতী জরাতী ব্রাহ্মণীর বেশে তাকে ছলনা করতে যায়৷ স্বর্গ সভায় নৃত্যের জন্য লাসবেশ ধারণের পূর্বে নর্মদার ঘাটে স্নান করতে গিয়ে নটী অম্বুবতী ঘাট আগলে বসে থাকতে দেখে সেই জরাতী ব্রাহ্মণীকে৷ সে নৃত্যের দেরি হয়ে যাবে বলে তাকে ঘাট ছাড়তে বললে তখন ব্রাহ্মণী তা অস্বীকার করে৷ বাধ্য হয়ে তাঁকে উপেক্ষা করে যৌবনের গর্বে হাসতে হাসতে ঘাট অতিক্রম করে জলে ঝাঁপ দিলে অপ্সরীর পায়ের জল বৃদ্ধার শরীরে এসে লাগে আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বৃদ্ধাবেশী গণেশের মা বলে উঠে—

 ‘‘অভিশাপ দিলুঁ আমি চল বসুমতী৷

 বুড়া দেখি হাসিলে পাইবে বুড়া পতি৷৷

 মানবের ঘরে জন্ম পাবে বড় দুখ৷

 সাত জন্ম মরিলে দেখিবে পুত্র মুখ৷৷’’৪৯

এরপর অদৃশ্য হয়ে যায় ছদ্মবেশী বৃদ্ধা৷ সামান্য এক ভুলে গুরুদণ্ড পেয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অম্বুবতী নৈরাশ্য ও শঙ্কায় চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দেয়৷ তবু বসে থাকলে তার চলবে না৷ তাই মনে যন্ত্রণার পাহাড় চাপিয়েও তাকে ধারণ করতে হয় নয়ন মনোহর বেশ, মুখে ফুটাতে হয় হাসি, পায়ে ছন্দের নূপুরনিক্কণ৷ কারণ তাদের ব্যক্তিত্বের কোনো মূল্য নেই, দুঃখ কষ্টের কোনো পরোয়া নেই৷ একমাত্র মূল্য তাদের রূপ, কামনা উদ্রেককারী লাস্যভঙ্গির৷ ভগ্নমনোরথ হয়ে লাসবেশে কৃত্রিম কটাক্ষ নিয়ে যখন সে দেবসভার উদ্দেশ্যে বের হয়, অনুভব করে চারিদিকের অমঙ্গল জনক সংকেত, যেমন ঘরের চাল মাথায় ঠেকে যাওয়া, পায়ে কাপড়ের জট লাগা, ডান চোখ নাচা, সে অনুভব করে ভয়ানক এক পরিণতির৷ এভাবে সমস্ত বাধা বিঘ্নকে দূরে সরিয়ে তাকে সুরের মূর্ছনায় অঙ্গচালনা করতে হয়৷ কিন্তু কতক্ষণ! যেখানে তার মন অস্থির হয়ে আছে পূর্বের সেই অভিশাপবাণীতে, বিভিন্ন অশুভ ইশারায়, সেখানে কতক্ষণ ধরে রাখতে পারা যায় নিজের মনোসংযোগকে! তাই শত চেষ্টা সত্ত্বেও একসময়—

 ‘‘তালভঙ্গ হৈল তার দেখিতে দেখিতে৷

 আপনা হারাল্য নটী নাচিতে নাচিতে৷৷’’৫০

দেবরাজ্যে এহেন ভুলের কোনো ক্ষমা হয় না তাই অম্বুবতী তার তালের সঙ্গে সঙ্গে চ্যুত হয় স্বভূমি৷ নেমে আসে মর্ত্যের সমস্যাদীর্ণ ধুলোমাটির মধ্যে৷

এরপর অভিশপ্ত অম্বুবতীর রঞ্জাবতী রূপে জন্মগ্রহণ, বৃদ্ধ স্বামী কর্নসেনের সঙ্গে বিবাহ, ‘শালেভর’ দিয়ে সন্তান লাভ ইত্যাদি নানা ঘটনা৷ রঞ্জার সেই সন্তানই হল ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের নায়ক চরিত্র লাউসেন, যে কিনা ধর্মঠাকুরের আশীর্বাদপুষ্ট এবং সদা ধর্মব্রতধারী৷ আলোচ্য কাব্যের ‘আখড়া পালা’-য় বর্ণিত হয়েছে দেবী পার্বতীর লাউসেনকে ছলনা করার জন্য বেশ্যা রূপ ধারণ প্রসঙ্গ৷ আশ্বিন মাসে শারদোৎসবে যখন ত্রিভুবন মেতে উঠে তখন দেবী দূর্গা পদ্মাকে সঙ্গী করে নিজের পূজা দেখতে বের হয়৷ বিভিন্ন স্থানে সন্তুষ্ট চিত্তে পূজা পর্যবেক্ষণ করে লক্ষ্য করে ময়না নগরের সুসজ্জিত রূপকে৷ কিন্তু এই নগরের কোথাও দেবীর আরাধনার লেশমাত্র চিহ্ন দেখতে পায় না এবং পদ্মার কাছে জানতে পারে ময়না নগর সম্পূর্ণভাবে ধর্ম ঠাকুরের উপাসক৷ সেখানকার কুমার লাউসেন ধর্ম ঠাকুরের আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ায় সে ধর্মঠাকুর ছাড়া আর কারো আরাধনা করে না৷ ঈশ্বরী পদ্মার মুখে এহেন কথা শুনে সিদ্ধান্ত নেয় লাউসেনকে ছলনা করার৷ তাই পদ্মাকে বলে—

 ‘‘বেউশ্যার বেশ ধরি করিব গমন৷

 অবশ্য ছলিব আজি লাউসেনের মন৷৷’’৫১

সমাজে গণিকাদের ভালবাসার যথার্থ মূল্য নেই৷ দেহ জীবিকার জন্য তাদের সর্বদা আশ্রয় নিতে হয় ছলনার৷ কপট ভালবাসা দেখিয়ে বশ করতে হয় পুরুষকে৷ আর একাজে তাদের সহায়তা করে দৈহিক সৌন্দর্য্য, বিভিন্ন অলংকার-প্রসাধনী ও কাম উদ্রেক করার মত পোশাক পরিচ্ছেদ ও অঙ্গচালনা৷ দেবীও তাই যথার্থ গণিকারূপ ধারণ করার উদ্দেশ্যে সুসজ্জিতা হয়েছেন লাউসেনের চোখে নিজেকে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য৷ যেমন—

 ‘‘শঙ্খের উপর বাজুবন্ধ ছড়া ছড়া৷

 নাপান করিতে চান দিয়া হাথ নাড়া৷৷

 কৌতুকে পরিল অপূর্ব কাঁচলি৷৷’’

অথবা

 বাছিয়া বসন পরে নাম গুয়াঠুটি৷

 বাইশ গজ বসন বাঁ হাথে হয় মুঠি৷৷

 লাসের উপরে বেশ তায় দিল চুয়া৷

 নাপান করিয়া খান গোটা দশ গুয়া৷৷

 চরনে নূপুর দিল অঙ্গে সুধাকর৷

 লাউসেন ছলিতে যান আখড়ার ঘর৷৷’’৫২

দেবী আখড়ার ঘরে ঘুমন্ত লাউসেন এর সন্নিধানে গিয়ে রূপের ছটায় মোহিত করে তার কাছে নিজের পরিচয় দান করে বলেন—

 ‘‘মন দিয়া শুন অহে ময়নার ঠাকুর৷৷

 সনকা বৈউশ্যা আমি গোলাহাটে ঘর৷

 বড় বনি আমার সুরীক্ষা বানেশ্বর৷৷

 তার ছোট বনি আমি কহিল তোমারে৷

 নাগর খুঁজিয়া আমি বুলি ঘরে ঘরে৷৷’’৫৩

এইভাবে নিজের পরিচয় দান করে তিনি লাউসেনকে প্রলোভিত করতে থাকেন বিভিন্ন কথার স্বপ্নজাল রচনা করে৷ কিন্তু তাতেও যখন লাউসেন তাকে উপেক্ষা করতে থাকে, অপমানিত করে সূর্পণখার মতো নাক কান কেটে ফেলার কথা বলে, তখন দেবী উপস্থাপন করেন বিভিন্ন পুরাণ প্রসঙ্গ৷ যেমন অহল্যা, কামতাড়িত ঊর্বশীকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য অর্জুনের অভিশপ্ত হওয়ার কাহিনি, মন্দোদরী, অহল্যা, চিন্তামণি, অঞ্জনা, তারা, দ্রৌপদী প্রমুখ নারীদের প্রসঙ্গ৷ এরা প্রত্যেকেই পরপুরুষ বন্দনা করেও ঘৃণিত হননি তবে তার প্রতি লাউসেনের বিরূপতা কেন! এখানে এক সাধারণ বেশ্যার প্রসঙ্গে দেবী শুনিয়েছেন জীবনের বৃহৎ বাস্তবসম্মত এক রূপকে৷ মানুষের সমাজে পাপ পুণ্যের বিচার ব্যবস্থা অর্থনীতির উপরও কোনো না কোনোভাবে প্রতিষ্ঠিত৷ কুন্তি, দ্রৌপদী, চিন্তামণি, মন্দোদরী, তারা এরা সকলেই উচ্চকুলের নারী৷ তাদের কষ্ট যন্ত্রণা যদিও সাধারণ নারীর মতোই সজীব তথাপি সমাজে অবস্থানগত দিক থেকে তাদের অবস্থান শোষক শ্রেণীর অন্দরমহলে৷ এরা বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্র হয়েও প্রতিনিধিত্ব করছেন উচ্চবিত্ত সমাজের৷ তাই পুরুষ নির্দেশিত শাস্ত্রে কুন্তি, অহল্যা, তারা, মন্দোদরীর যে মর্যাদা সনকা বেশ্যার মতো সাধারণ নারীদের তা নয়৷ সনকার মতো নারীরা বেশ্যাবৃত্তিতে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করেছে কিন্তু দ্রৌপদীরা শাস্ত্রকারের নির্দেশে জীবনের এই সাময়িক জটিলতাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন৷ তাই তাদের জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনার পেছনে কাজ করেছে দৈব ইচ্ছা অথবা কোনো মঙ্গলময় দিক৷ অপরদিকে সনকা বেশ্যার যে জীবন তা সমাজের কলুষতা বহনেরই দৃষ্টান্ত৷ এখানে গণিকার সমস্ত গুণাবলী প্রকাশ পেলেও সনকা রূপধারী পার্বতী শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় লাউসেনকে ছলনা করতে৷ তার স্বরূপ প্রকাশ হয়ে যায়৷

স্বৈরিণী, ব্যভিচারিণী, বেশ্যাসুলভ মানসিকতায় পরিপূর্ণ নারী চরিত্ররা ভিড় করেছেন ‘জামতি পালা’ অংশে৷ কুমির বধ করার পর লাউসেন কর্পূর সহযোগে গৌড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলে সম্মুখে দেখতে পায় সুন্দর সুসজ্জিত এক পুরী৷ কর্পূরের কাছে জানতে পারে নগরটির নাম জামতি, অগস্ত্য মুনির আশীর্বাদে যেখানে সারা বছর বসন্তকাল বিরাজ করে৷ কর্পূর লাউসেনকে অনুরোধ করে গৌড়ে যাওয়ার জন্য অন্য পথ নির্বাচিত করতে৷ কারণ সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে সুসজ্জিত হলেও জামতির প্রায় সকল নারীই অসতী৷ পরপুরুষ বশ ও সম্ভোগে তারা সিদ্ধহস্তা৷ তাই তারা দুই ভাই সেই ছলনাময়ী নারীদের কিছুতেই অতিক্রম করে যেতে পারবে না৷ কারণ মুনি-ঋষিদেরও তা অসাধ্য৷—

 ‘‘স্বর্গ বিদ্যাধরী কিবা সিংহল পদ্মিনী৷

 দরশনে ধৈরজ ধরিতে নারে মুনি৷৷

 বচনে পীযুষ মাখা মুনি মোহ যায়৷

 তোমারে দেখিলে পাছে কড়চে লুকায়৷৷

 চাঁপাফুল বলিয়া শ্রবণে পাছে পরে৷

 এ দেশ ছাড়িল যতী অসতীর ডরে৷৷’’৫৪

কিন্তু লাউসেন কর্পূরের অনুরোধ উপেক্ষা করে৷ নিজের চরিত্র ও সংযমের অসীম বাহাদুরিতে সে ঠিক করে জামতি নগর দিয়েই গৌড়ে যাবে এবং কর্পূরকে নিয়ে জামতি প্রবেশ করে৷ নগরের দক্ষিণ প্রান্তে রম্য-সরোবরের কাছে এসে তার ধারের কদমগাছ এবং পদ্মপুষ্প শোভিত সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়৷ সেখানে বসে বিশ্রামের সংকল্প করে৷ সেই সরণীতেই পূর্বে বহু মুনি তাদের পৌরুষ বিসর্জন দিয়েছে৷ সেই ঘাটই জামতি সুন্দরীদের জল নেওয়া, গাত্র মার্জনা, স্নান সমাপণ করার প্রিয় স্থান৷ কিছুক্ষণ পরে দুই ভাই লক্ষ্য করে দলবেধে নারীকুলের ঘাটে আগমন৷ এরাই সেই ব্যভিচারিণীর দল৷ সোনার কলসিতে জল ভরতে ভরতে তারা মুগ্ধ হয়ে যায় লাউসেন ও কর্পূরের রূপে৷ তাদের স্বামীদের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খাদগুলিও প্রকট হয়ে ওঠে লাউসেনের নিষ্কলুষ দেহসৌষ্ঠবে৷ তারা লাউসেনকে প্রত্যাশা করে বলতে থাকে—এমন পুরুষ পেলে নিজের রূপ যৌবনকে অকপটে বিলিয়ে দিতে পারে৷ অনেকে আবার স্বামীর অকাল মৃত্যু কামনা করেও লাউসেনকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়৷ কানা, খোঁড়া, বোবা, গোদা, কালা, বৃদ্ধ, নপুংসক, ছানিপড়া, কুঁজো ইত্যাদি বহু বিশেষণে নিজেদের স্বামীদের চিহ্নিত করে তৎক্ষণাৎ তাদের পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় তার সঙ্গে যৌবন তরঙ্গে ভেসে গিয়ে কাম চরিতার্থ করার জন্য৷ এদের মধ্যে চতুরা হল নয়নী৷ যে সম্ভ্রান্ত শিবা বারুই-এর স্ত্রী এবং হরিপালের কন্যা৷ লাউসেনকে দেখে সে ভাবে—

 ‘‘বৈদেশী কুমার বিনে না রয় পরাণ৷

 বিলক্ষণ বেশে যাব তার বিদ্যমান৷৷

 বিরলে বলব হিত উপদেশ বাণী৷

 ভুলাইয়া বৈদেশীরে আনিব আপনি৷৷’’৫৫

অন্যান্য নারীদের তার ধারে কাছে ঘেষতে না দেওয়ার জন্য বুদ্ধি করে বিভিন্ন কথার জালে তাদের ঘরে পাঠিয়ে দেয় নয়নী৷ একা বিরলে সঙ্গসুখ উপভোগ করার জন্য ঘরে গিয়ে মোহিনী বেশ ধারণে যত্নবান হয়৷ সুবর্ণের চিরুনি দিয়ে কেশ পরিচর্যা করে তৈরি করে মনোহর কবরী এবং ফুলে ফুলে সুসজ্জিত করেন তা৷ চোখে মোহন কাজল, কপালে সিঁদুর, বিভিন্ন ধরনের অলংকার—টাড়, বালা, পাসুলি বউলি, বাজুবন্ধ, অঙ্গুরী, বুক পর্যন্ত ঝোলানো সোনার হার, কামনা উদ্রেককারী অঙ্গ আচ্ছাদনের মোহন বেশ, তার সৌন্দর্য—

‘পূর্ণিমার চাঁদে পড়ে টসটস মৌ৷’৫৬—এর সঙ্গে উপমিত৷ কামে জর্জরিত হয়ে, চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য নিয়ে সে যখন লাউসেনের কাছে গিয়ে বলে—

 ‘‘আজি কর বিলম্ব ময়নার গুণমণি৷৷

 ঘরে নিব টাকাকড়ি প্রবাল কাঞ্চন৷

 নিরবধি খায়াইব শুন প্রাণধন৷৷

 কড়চে রাখিব তোমা চাঁপাফুল বলি৷

 আমি হব পদ্মফুল তুমি হবে অলি৷৷

 বড় সুখে রজনী বঞ্চিব বাসঘর৷’’৫৭

কিন্তু লাউসেনের এই গণিকা মনষ্ক নারীর প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই তাই সে যখন ঘৃণাভরে তাকে প্রত্যাখ্যান করে তখন লক্ষিত হয় পতিতা নারীর ভয়ানক মূর্তি৷ সন্তানের জননী এই নয়নী৷ তথাপি তার মাতৃত্ব কলুষিত৷ নিজের বাসনা পূরণের জন্য সে স্নেহশীলা মাতৃমূর্তির বদলে হয়ে উঠে ভয়ঙ্করী ডাকিনীতে৷ লাউসেনকে জধ করে নিজের হাতের মুঠোয় পাবার জন্য সহস্তে নিজের গর্ভজাত শিশুসন্তানকে কূপের মধ্যে ফেলে দিয়ে চিৎকার করতে থাকে এই বলে যে লাউসেন তার সন্তানকে হত্যা করেছে তাকে ভোগ করার জন্য৷ নয়নীর এই ঘৃণ্য কাজে হতভম্ব দুই ভাই গ্রামবাসীদের আক্রমনে বন্দি হয়৷ নয়নী সবার অলক্ষ্যে তাদের অভয় দেয় এই বলে—

 ‘‘একবার দেহ যদি আলিঙ্গনদান৷

 রাজাকে বলিয়া তোমার করিব ছোড়ান৷৷’’৫৮

এখানে বর্ণিত হয়েছে গণিকা চরিত্রের আরেক ভয়াবহ রূপ৷ যেখানে পতিতারা তাদের পেশাকে টিকিয়ে রাখার জন্য, উপার্জনকে নিষ্কন্টক করার জন্য অবহেলা করে নিজেদের মাতৃত্বকে৷ কারণ সন্তানের উপস্থিতি ভাটা এনে দেয় তাদের ব্যবসায়৷ পুরুষ খদ্দের অসন্তুষ্ট হয়ে তাদের গৃহ মাড়াতে চায় না৷ নয়নীর ক্ষেত্রেও তার প্রেমের পথে বাঁধা হয়েছিল তার সন্তান৷ যদিও সে পেশাদারী বেশ্যা নয়, দেহজীবীর মতো অর্থ উপার্জনই তার পরপুরুষ সম্ভোগের উদ্দেশ্য নয় তবুও নিজের আকাঙ্খা পূরণে সন্তানের উপস্থিতিকেও মানতে পারেনি৷ এখানে সে হিংস্র এবং আসক্তি জর্জরিত৷ তার এই কুৎসিত আচরণকে মেনে নেওয়া যায় না৷ সে জন্য লেখক চরম শাস্তি নির্দেশ করেছেন; সর্বসমক্ষে সভার মধ্যে কেটে নেওয়া হয় তার নাক, কান, মাথার চুল৷ এরপর জামতি নগর ত্যাগ করে দুই ভাই এসে পৌঁছায় গোলাহাট নগরে৷ কর্পূর লাউসেনের কাছে এর বিস্তৃত বিবরণ দিয়ে বলে গোলাহাট জামতি নগরের মতো বেশ্যাদের চারণভূমি৷ সেখানকার অধীশ্বরী সুরিক্ষা সুন্দরী যে সর্বদা ছকুড়ি নাগর বেষ্টিত হয়ে থাকে৷ ভিনদেশের কোনো পুরুষ সে নগর অতিক্রম করে যেতে পারে না৷ পান, সুপুরি, রূপ, যৌবন দিয়ে বশ করে সুরিক্ষার সহচরীরা তাকে তার দাস করে রাখে যাতে প্রয়োজন মতো তারা সুরীক্ষা সুন্দরীর প্রবৃত্তি দমন করতে পারে৷—

‘‘পথে বস্যা থাকে সখী বৈদেশী নন্দনে দেখি ভুলাইয়া রাখে দেশাচার৷৷

ষোলো শত ঘর নটী গোলাহাটে পরিপাটি বিস্তর দিবস ইথে আছে৷

সঙ্গে খোল করতাল বিনোদ জরপ জাল মদনে মাতাল হয়্যা নাচে৷৷

পুরুষের কাছে কাছে উলঙ্গ হইয়া নাচে চঞ্চল বসন কেশপাশ৷

বৈদেশী রাজার বেটা পথে পাইলে দেই নেটা কোনজনে নাহিক তরাস৷৷

লতা গুল্ম থরে থরে শোভা করে ঘরে ঘরে সদাই ওষধ কারখানা৷

চন্দন কস্তুরী চুয়া উপহার পানগুয়া এ সব এদেশে খাত্যে মানা৷৷’’৫৯

কর্পূরের মুখে বশীকরণের পান, সুপুরি ও বিভিন্ন উপহার গ্রহণের বিধি-নিষেধ শুনে সচেতন হয়ে যায় কুমার লাউসেন৷ নগরের প্রান্ত ভাগে এই প্রান্তবাসিনীদের অবস্থান৷ এখানে—

‘রাজা নাঞি লয় কর নটী সব করে ঘর লুট কর‍্যা খায় রূপগুনে৷’৬০

আর এহেন গণিকা রাজ্যে এসে দুই ভাই সম্মুখিন হয় ভাজন বুড়ির৷ ভাজন বুড়ি বয়স্কা গণিকা৷ বয়সের কারণে পুরুষের মন ভোলাতে না পারলেও চিরায়ত স্বভাবকে একেবারে পরিত্যাগ করতে পারেনি, তাই লাউসেনকে দেখে তার মনে হয়—

 ‘‘ইহার সহিত যদি বসি একাসন৷

 এখনি ফিরাত্যে পারি নহলী যৌবন৷৷

 যৌবন বালির বাঁধ গেল কোন দেশে৷

 অল্পদিনে বঞ্চিত হইনু পঞ্চরসে৷৷’’৬১

যৌবনের প্রখর রূপরাশি হারিয়েও ভাজনবুড়ি আবার মত্ত হয়ে ওঠে পুরুষ ভোলানো খেলায়, নিজের যৎসামান্য সম্পদ বিক্রি ও বন্ধক রেখে অর্জন করে দশপন কড়ি৷ তাই নিয়ে মালীর ঘরে উপস্থিত হয় শোলার অষ্ট আভরণের জন্য৷ শোলা নির্মিত বিভিন্ন অলংকারাদিতে সুসজ্জিত হয়ে বুড়ি নিজের ঘরে এসে ‘তিন কড়ার তেল’ মাখে নিজের সিঁথিতে৷ চোখে লাগায় কালো হাঁড়ির কাজল৷ এভাবে বিভিন্ন প্রসাধনী ও বসনে সাজ সম্পন্ন করে লাসবেশের নামে ধারণ করে উদ্ভট এক সজ্জা৷ তার এহেন রূপকে স্বয়ং রচনাকার তুলনা করেছে ‘পিশাচির’ সঙ্গে৷ কিন্তু ভাজন বুড়ির সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই৷ সে নিজের রূপের গরবে গরবিনী হয়ে লাউসেন-কর্পূরের সম্মুখে প্রেম নিবেদন করে—

 ‘‘কর্ণসেনের পুত্র যদি আমার হয় নাতি৷

 তোমা আমা বিলাস করিব সারারাতি৷৷

 সভে জানে মোর নাম বটে চন্দ্রকলা৷

 শর্বরী সময়ে এই রূপ হয় আলা৷৷

 ষোলো বৎসরের হয়্যা রব তোমার কাছে৷

 সকল রজনী রম মনে সাধ আছে৷৷’’৬২

বৃদ্ধার এহেন প্রণয় সম্ভাষণে অসন্তুষ্ট কর্পূর চড় বসিয়ে দেয় ভাজনবুড়িকে৷ বুড়ি প্রত্যাখ্যাতা হয়ে পলায়ন করে, অপমানের জ্বালায় উপস্থিত হয় সুরীক্ষার সম্মুখে এবং তাদের রূপও ঔদ্ধতকে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে উত্তেজিত করে তোলে গোলাঘাট অধীশ্বরীকে৷ সুরীক্ষরানি বশীকরণের পান ও সুপুরি দিয়ে দাসী সনকা ও গুরীক্ষাকে প্রেরণ করে দুই ভাইকে মোহোজালে বিদ্ধ করার জন্য৷ কিন্তু লাউসেন ও কর্পূরের পরামর্শে নগরের বালকেরা সেই পান লুঠ করে নিয়ে গেলে—

 ‘‘সনকা গুরীক্ষা চলে পায় কর‍্যা ভর৷

 লাউসেনে আগুলিল পথের উপর৷৷

 চন্দ্রে যেন বেষ্টিত করিল আস্যা রাহু৷

 আলিঙ্গন মাগে নটী পসারিয়া বাহু৷৷’’৬৩

এই দুই নারী তাদের লুঠ হয়ে যাওয়া পানের বিনিময়ে উপযুক্ত কড়ি অথবা আলিঙ্গন প্রার্থনা করে৷ এমন পরিস্থিতিতে ধর্ম ঠাকুরের সহায়তায় কপর্দক হীন দুই ভাই মানিক রত্ন দিয়ে তাদের বিদায় করে৷ এই অলৌকিক ক্ষমতায় গুরীক্ষা ও সনকা দাসী ক্ষিপ্রগতিতে উপস্থিত হয় সুরীক্ষা সন্নিধানে, আদ্যপান্ত ব্যক্ত করে সমস্ত ঘটনা৷ রানি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না৷ তাই—

 ‘‘না করে বিলম্ব নটী করে লাসবেশ৷

 সুবর্ণ চিরনি দিয়া আঁচড়িল কেশ৷৷’’৬৪

নানাভাবে সুরীক্ষা তার লাসবেশ সম্পন্ন করে ‘গুয়াপানে বশ’ করা ছ-কুড়ি নাগরদের নিয়ে উপনীত হয় লাউসেন সন্নিধানে৷ তার আলিঙ্গন প্রার্থনা করে দেহ-মনের কামনার বহ্নিকে নির্বাপিত করতে চায় বেশ্যাসুন্দরী৷ লাউসেন তাতে রাজী না হলে কথার মোহজালে তাকে বন্দি করতে বলে—

 ‘‘শুন রাজা লাউসেন কর্পূর পাতর৷

 আজি বাসা নিতে চল মোর বাসঘর৷৷

 একবার আমা প্রতি দিবে আলিঙ্গন৷

 নিরবধি অঙ্গে দিব কস্তুরী চন্দন৷

 নিরবধি বুকে থুব করিয়া মাদুলি৷

 আমি হব পদ্মফুল তুমি হবে অলি৷৷

 চামর বিয়নী বায়ে সুখে নিদ্রা যাবে৷

 নানা পুষ্প পারিজাতে শয়ন বঞ্চিবে৷৷

 ঘৃত অন্ন বিলাস করিবে সুধা ক্ষীর৷

 রতিরসে বিলাস করিবে মহাবীর৷৷’’৬৫

সুরীক্ষার এমন কথায় মর্মাহত হয়ে যায় দুই ভাই কারণ শাস্ত্রমতে—

 ‘বেউশ্যা পরশে পাপ না যায় খণ্ডন৷’৬৬

যে সমাজের সক্রিয় উদাসীনতায় সৃষ্টি হয় গণিকার মতো নারীরা সেই সমাজের দ্বারাই আবার ঘৃণিতা হয় তারা৷ তাদের স্পর্শ হয়ে ওঠে প্রায়শ্চিত্তহীন অপরাধ৷ সুরীক্ষা সম্পর্কে লাউসেনের এই উক্তির মধ্য দিয়ে প্রান্তবাসিনী পতিতা নারীদের জীবনের এমনই এক বাস্তবসম্মত চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যে৷ এখানে বেশ্যার প্রতি কোনো সহানুভূতি নয় উঠে এসেছে স্বৈরিণী এই নারীদের পাপময় ঘৃণ্য জীবনালেখ্য৷ তাই সুরীক্ষা সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে ছলনা করতে চেষ্টা করলেও সমাজ প্রতিভূ লাউসেন অনড়, শাস্তি পায় সুরীক্ষাই৷ নয়নী, গুরীক্ষা, বেশ্যাবেশী পার্বতী সকলের প্রতি লাউসেনরূপী সমাজপতিরা পরামর্শ দিয়েছে একপতি অর্থাৎ নিজ স্বামী সেবা করার অথচ পরবর্তী সময়ে দেখা যায় লাইসেনকে তিনটি বিবাহ করতে৷ চরিত্রবান লাউসেনের বহু পত্নী গমনে পাপ নেই—গণিকা গমন সাত জন্মের পাপ! আলোচ্য কাব্যে বর্ণিত হয়েছে গণিকা নারীদের কামপ্রবণতা, তীব্র লাস্যরূপ, পরপুরুষ সম্ভোগের নিষ্ঠুর প্রসন্নতা৷ রচনাকার এদের প্রতি সহানুভূতির এতটুকু উপকরণ দেননি যা দিয়ে তাদের নারীত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া যায়, সম্মান করা যায়৷ তাদের সব অনুভূতিকে ছাপিয়ে ব্যভিচারিণী ও কামার্ত মানসিকতার দিকেই দৃষ্টি আরোপ করেছেন রচয়িতা৷ আর লেখকের এরূপ চিন্তা থেকে সহজেই অনুমান করা যায় তৎকালীন সময়ে গণিকাদের সামাজিক অবস্থান৷

প্রাচীন যুগের সমাজে গণিকার স্তরবিভাগ :

প্রাচীন যুগে এই বহুবল্লভাদের সামগ্রিকভাবে বিচার করলে নানা স্তরবিভাগ রয়েছে তাদের সামাজিক অবস্থানের নিরিখে রাষ্ট্রের সবচেয়ে নিচু স্তরের কর্মচারী যে দারোয়ান গণিকারা তার থেকেও নিম্নস্তরের৷ আবার এই দেহব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত সর্বনিম্নস্তরের এই নারীদের মধ্যে সর্বোচ্চস্থানে রয়েছে ‘গণিকা’৷ তাদের আরেক নাম ছিল নগরশোভিনী বা জনপদকল্যাণী৷ একটা সম্পূর্ণ জনপদের মানুষেরা যাকে স্বাধীনভাবে ভোগ করতে পারে তাকে বলে জনপদকল্যাণী৷ রূপে-যৌবনে-শিক্ষায়-কলায় এরা সর্বশ্রেষ্ঠ৷ এদের পরবর্তী স্তরে থাকে রূপাজীবা৷ রূপাজীবারা শিক্ষা-দীক্ষা-বিদ্যা-বুদ্ধিতে গণিকাদের চেয়ে নিচে৷ এদেরও নিচে বেশ্যা৷ এদের প্রধান মূলধন বস্ত্রালঙ্কার ও সাজগোজ৷ এই বেশ্যাদের থেকে নিম্নস্তরে ছিল সৈরিন্ধ্রী, শিল্পকারিকা বা শিল্পদারিকা, কুম্ভদাসী, রূপদাসী, বন্নদাসী, কৌশিকাস্ত্রী, নটী, ক্ষুদ্রা, ভূঞ্চিকা৷ এরা রাজ-প্রাসাদে বা সম্ভ্রান্ত কোন ব্যক্তির আলয়ে নিজের ক্ষমতানুসারে কায়িক শ্রম করে জীবিকা নির্বাহ করতো, গৃহস্বামীদের যৌনআনন্দও এরা দিত৷ এদের বাইরে ছিল অশিক্ষিতা, অর্ধশিক্ষিতা, দরিদ্র, রূপহীনা, বিগতযৌবনা দেহজীবীর দল৷ সংখ্যায় তারাই বেশি৷ এদের জীবন-যাপন অত্যন্ত কষ্টকর৷ এদের পরিচয় কুলটা, স্বৈরিণী, পুংশ্চলী, বারবনিতা ইত্যাদি নামে৷

রাষ্ট্র ও গণিকা :

প্রাচীন কালের নগর নটীরা প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হত৷ রাষ্ট্রের সঙ্গে গণিকাদের সম্পর্ক ছিল অবিচ্ছেদ্য কিন্তু রাষ্ট্রের তাদের প্রতি কোনো কৃতজ্ঞতা ছিল না৷ সেই নগরশোভিনী-জনপদবধূরা রাষ্ট্রের ব্যয়ে তাদের শিক্ষা সম্পন্ন করত অর্থাৎ রূপ-গুণ-ছলা-কলায় পারদর্শিনী করে একজন আদর্শ যৌনআনন্দ দানকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার তালিম রাষ্ট্রই দিত৷ কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ করেছেন যে গণিকা রাজকোষ থেকে মাসোহারা পেত৷ শুধু গণিকাই নয় তার প্রতিনিধি প্রতিগণিকা, গণিকার প্রাসাদ, দাস-দাসী, সংসার সবই ছিল রাষ্ট্রের সম্পত্তি৷ রাজকোষ থেকে গণিকাদের ৫০০ থেকে ২০০০ পণ বার্ষিক বেতন দেওয়া হত৷ এছাড়া গণিকাদের নিজেদের রোজগারও কম ছিল না যেমন—গণিকা সলাবতীর একরাত্রের দর্শনী ছিল ১০০০ কাহাপন (কার্যাপণ সমান স্বর্ণমুদ্রা), কাশীর গণিকা সামার ৫০০ জন অনুচারিণীই ছিল৷ রোজগার না থাকলে এত দাসী রাখার সামর্থ কয়জনের হয়! আম্রপালীর দর্শনী ছিল ৫০ কার্যাপণ৷ তা নিয়ে তো রাজগৃহ ও বৈশালীর মধ্যে বিবাদই বেঁধে গিয়েছিল৷ তার আয়ে বৈশালীর অর্থ ভাণ্ডার স্ফীত হয়ে উঠেছিল৷ কাশীর আরেক গণিকা অর্ধকাশীর দর্শনী মূল্য শুরু হয়েছিল সমগ্র কাশীর আয়করের অর্ধেক দিয়ে৷ এছাড়া কোনো নগরবধূ যদি স্বেচ্ছায় তার বৃত্তি থেকে সরে যেতে চাইতো তাহলে তার কাছ থেকে রাষ্ট্র ২৪০০০ পণ নিষ্ক্রয় মূল্য নিত৷ গণিকাকে ধর্ষণ করলে ৫৪ পণ এবং তার মায়ের আয়ের ১৬ গুণ অর্থদণ্ড জরিমানা স্বরূপ দিতে হত৷ গণিকার বিদেশী ‘খদ্দের’-কে তার নির্দিষ্ট মূল্য ছাড়া পাঁচ পণ অর্থমূল্য বেশি দিতে হত৷ অভিনেতা, মাংসবিক্রেতা বা বৈশ্যের সঙ্গে সম্পর্ককারী রূপাজীবাদের বার্ষিক বৃত্তি ছিল ৪৮ পণ৷ কোনো গণিকা বা রূপজীবা যদি টাকা নেওয়ার পরে সম্পর্কে আপত্তি প্রকাশ করে তাহলে তাকে তার প্রাপ্যের দ্বিগুণ অর্থ দণ্ড দিতে হত আর যদি সেই অস্বীকৃতি টাকা নেওয়ার আগে হয় তখন সে সমগ্র প্রাপ্য থেকেই বঞ্চিত হত৷ ‘যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতি’ অনুসারে গণিকার শারীরিক নিরাপত্তার জন্য নানা দণ্ড ব্যবস্থা চালু ছিল৷ তাদের প্রতি অত্যাচারকারীকে ১০০০ থেকে ৪৮০০০ পণ পর্যন্ত অর্থদণ্ড ভোগ করতে হত৷ গণিকাকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে সম্ভোগ করলে ৫০ পণ এবং বহুজন দ্বারা গণধর্ষিত করলে ধর্ষণকারীর প্রত্যেকের ২৪ পণ দণ্ড ছিল৷ কৌটিল্য তাঁর রচনায় (অর্থশাস্ত্রে) উল্লেখ করেছেন গণিকা পীড়নের নানা দণ্ডাদেশ৷ যেমন গণিকাকে প্রকাশ্যে অপমান করার শাস্তি ২৪ পণ, শারীরিক অত্যাচার করলে ৪৮ পণ, কান কেটে নিলে পৌনে ৫২ পণ ও কারাবাস৷

গণিকা কন্যারা গণিকাই হত আর পুত্রের পরিচয় ‘বন্ধুল’৷ কোথাও গণিকার মাতা গণিকালয়ের কর্তৃ হত৷ তার বোন হত প্রতিগণিকা৷ গণিকার ভাইকে গীতবাদ্যে কুশল হয়ে আটবছর রাষ্ট্রের অধীনে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত মঞ্চে কাজ করতে হত, যদি বিবাহিতা গণিকা হত তাহলে তার স্বামীকেও অনুরূপ কাজ করতে হত৷ তাদের নৃত্যগীত-শিক্ষার ব্যবস্থা রাষ্ট্রের ব্যয়েই হত৷ আট বছর সম্পন্ন না হলে সেখান থেকে মুক্ত হতে গণিকার ভাইকে প্রচুর মুক্তিপণ দিতে হত, যা রাষ্ট্রের কোষাগারে জমা হত৷ যুদ্ধের সময় গণিকার সম্পত্তি রাষ্ট্র-কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হত৷

রাষ্ট্রের অধীনে, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে গণিকারা প্রচুর সম্পত্তির অধিকারিণী হলেও সেই সম্পত্তিতে তার কোনো স্বত্ব ছিল না৷ অর্থাৎ গণিকার নিজের শরীর খাটিয়ে আহরিত সম্পত্তি—‘‘বেচবার, বাঁধা দেওয়ার বা দান করারও তার অধিকার ছিল না৷’’৬৭ গণিকালয়ে বাসকারী বারবনিতাদের জন্য এই নিয়ম কার্যকর ছিল৷ আবার যারা কিছু সময়ের জন্য পুরুষের রক্ষিতা হয়ে দেহসুখ দান করতো তাদের যা উপার্জন রাজকোষে কর দিয়ে তার থেকে যা বাকি থাকতো তা সে স্বাধীনভাবে ভোগ করতে পারতো৷ দ্বাদশ শতকের রচনা ‘মৃন্ময়সুন্দরী কথা’ তে উল্লেখ আছে গণিকার আয়ের শতকরা ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ছিল রাষ্ট্রের প্রাপ্য৷

গণিকাশ্রেণীকে নিয়ে রাষ্ট্র নানা ভাবে সুবিধা আদায় করে নিয়েছে৷ গণিকার শিক্ষাতালিকা যেমন প্রকাণ্ড ছিল—(শিল্পকলা, রন্ধন, গীত, বাদ্য, গণিত ইত্যাদি নানা বিষয়ে) রাষ্ট্রের তত্ত্বাবধানে ব্যয়বহুল সেই শিক্ষার মানও ছিল অনেক উন্নত৷ রাষ্ট্র গণিকার কাছ থেকে উচ্চহারে রাজস্ব যেমন পেত তেমনি চরের কাজও তাদের রাষ্ট্রীয় কর্তব্যের মধ্যে ছিল৷ তারা তাদের শিক্ষা-রুচি-রূপ-যৌবনকে হাতিয়ার করে রাষ্ট্রের শত্রুপক্ষের অনেক গুপ্ত সংবাদ সংগ্রহ করে রাষ্ট্রকে জানিয়ে দিত এবং সেই অনুযায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিত৷

কোনো কোনো স্থানে আবার গণিকার মাতাই গণিকালয়ের কর্ত্রী হিসেবে অবস্থান করতো আর তার বোন হত প্রতিগণিকা৷ অর্থাৎ সুবিধা-অসুবিধায় সে গণিকার বিকল্প হিসেবে যৌন আনন্দ দিত৷ গণিকার ভাইকেউ গীতবাদ্যে বা অভিনয়ে দক্ষ হয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত মঞ্চে আট বছর অভিনয় বা গীতবাদ্য পরিবেশন করতে হত৷ তারও শিক্ষার ব্যবস্থা এবং আর্থিক সবরকম দায়িত্ব রাষ্ট্র বহন করতো৷ গণিকার ভাইয়ের নিষ্ক্রয়মূল্য ছিল গণিকার চেয়েও বেশি৷ বাৎস্যায়ণের ‘কামসূত্র’-এর কোথাও কোথাও আবার গণিকার বিবাহের কথাও আছে৷ সেক্ষেত্রে বিবাহিত গণিকার স্বামীকে রাষ্ট্রের ব্যয় ও পরিচালনায় চালিত মঞ্চে শ্রম দিতে হত৷ কখনো কখনো সে বিবাহ প্রতীকী অনুষ্ঠান মাত্র ছিল৷ বাৎস্যায়ণে গণিকার প্রেমের সম্ভাবনাকেও তাত্ত্বিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷ ‘শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক’-এ গণিকার প্রেমের উল্লেখ আছে৷

রাষ্ট্রের জন্য গণিকারা দায়বদ্ধ থেকে অনেক কিছু করতো অথচ তাদের প্রতি রাষ্ট্রের তেমন কোনো দায় ছিল না৷ যতদিন শরীরীভাবে সে সক্ষম ততদিনই তার কদর৷ আর ঐ সময়ের মধ্যে যদি সে কারও বধূ বা কোনো মঠ বা সংঘে স্বেচ্ছায় চলে না যেত তাহলে যৌবনের মদমত্ত বিলাসবহুল জীবনযাপনে অভ্যস্ত সেই নারী বিগতযৌবনে পথের ভিখারিনি হয়ে নিঃশেষ হয়ে যেত৷

তথ্যসূত্র :

 ১. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ১ম খণ্ড, পৃ-৭৬১৷

 ২. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ২য় খণ্ড, পৃ-১২৬১৷

 ৩. সমীরণ মজুমদার (সম্পাদিত) গণিকা মুক্তি ও মর্যাদা, পৃ-১১৷

 ৪. বিজয়চন্দ্র মজুমদার, বৈদিক যুগের জাতিভেদ, কার্তিক ১৩২০, পৃ-৫৷

 ৫. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ২য় খণ্ড, পৃ-১২৬১৷

 ৬. সমীরণ মজুমদার (সম্পাদিত) গণিকা মুক্তি ও মর্যাদা, পৃ-১৩৷

 ৭. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ১ম খণ্ড, পৃ-৭৬১৷

 ৮. তদেব, পৃ-৭৬১৷

 ৯. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ২য় খণ্ড, পৃ-১৮৮১৷

 ১০. কাজল ভট্টাচার্য, কলগার্লের দুনিয়া, পৃ-১০৷

 ১১. Ishita Majumder and Sudipta Panja, The invisible A study Kolkata’s call girls, Rohini Sahni, V. Kalyan Shankar etc. Prostitution and beyond, page-156.

 ১২. Ishita Majumder and Sudipta Panja, The invisible A study Kolkata’s call girls, Rohini Sahni, V. Kalyan Shankar etc. Prostitution and beyond, page-157.

 ১৩. হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গীয় শব্দকোষ, ২য় খণ্ড, পৃ-২৩১৬৷

 ১৪. দেবদাসী থেকে যৌনকর্মী, মণি নাগ, পৃ-১৷

 ১৫. সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রবন্ধ সংগ্রহ (১), পৃ-১৮৷

 ১৬. তদেব, পৃ-২১৷

 ১৭. তদেব, পৃ-২৯৷

 ১৮. তদেব, পৃ-২৭৷

 ১৯. তদেব, পৃ-২৯৷

 ২০. তদেব, পৃ-২৮০৷

 ২১. মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজতরঙ্গিণী, পৃ-২৫৭

 ২২. নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব), পৃ-৩১০৷

 ২৩. তদেব, পৃ-৩১০৷

 ২৪. তদেব, পৃ-৪৬৫৷

 ২৫. সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রবন্ধ সংগ্রহ (১), পৃ-২৮৪৷

 ২৬. উৎপল ভট্টাচার্য, মৃচ্ছকটিক (কাহিনি রূপান্তর) পৃ-১৷

 ২৭. তদেব, পৃ-৬৷

 ২৮. সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত, পৃ-১০১৷

 ২৯. শ্রীতারাপ্রসন্ন দেবশর্ম্মা কর্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত বাল্মীকি রামায়ণ (সরল বাংলা অনুবাদ), পৃ-৪৬৷

 ৩০. তদেব, পৃ-৪৭৷

 ৩১. তদেব, পৃ-১৭০৷

 ৩২. তদেব, পৃ-২৮০৷

 ৩৩. তদেব, পৃ-৪০০৷

 ৩৪. তদেব, পৃ-৪০০৷

 ৩৫. তদেব, পৃ-৪০১৷

 ৩৬. কঙ্কর সিংহ, ধর্ম ও নারী : প্রাচীন ভারত, পৃ-৮২৷

 ৩৭. ধীরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, মহাভারতে নারী, পৃ-৩০৷

 ৩৮. তদেব, পৃ-৩০৷

 ৩৯. মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস বিরচিত মহাভারত (আদিপর্ব), প্রথম খণ্ড, বর্ধমান রাজবাটী বঙ্গানুবাদ, পৃ-৪১৩৷

 ৪০. তদেব, পৃ-৪১৩৷

 ৪১. তদেব, পৃ-৭১৭-৭১৮৷

 ৪২. তদেব, পৃ-৭১৮৷

 ৪৩. তদেব, পৃ-৭১৮৷

 ৪৪. সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রবন্ধ সংগ্রহ (১), পৃ-২৮১৷

 ৪৫. তদেব, পৃ-২৮১৷

 ৪৬. সুকুমার সেন (সম্পাদিত) চণ্ডীমঙ্গল, পৃ-৭৮৷

 ৪৭. তদেব, পৃ-৮৩৷

 ৪৮. রূপরাম চক্রবর্তী বিরচিত ধর্মমঙ্গল, পৃ-৫৪৷

 ৪৯. তদেব, পৃ-৫৫৷

 ৫০. তদেব, পৃ-৫৭৷

 ৫১. তদেব, পৃ-১৪৪৷

 ৫২. তদেব, পৃ-১৪৫৷

 ৫৩. তদেব, পৃ-১৪৬৷

 ৫৪. তদেব, পৃ-২০০৷

 ৫৫. তদেব, পৃ-২০২৷

 ৫৬. তদেব, পৃ-২০৪৷

 ৫৭. তদেব, পৃ-২০৪৷

 ৫৮. তদেব, পৃ-২০৬৷

 ৫৯. তদেব, পৃ-২১১৷

 ৬০. তদেব, পৃ-২১১৷

 ৬১. তদেব, পৃ-২১৪৷

 ৬২. তদেব, পৃ-২১৬৷

 ৬৩. তদেব, পৃ-২১৯৷

 ৬৪. তদেব, পৃ-২২০৷

 ৬৫. তদেব, পৃ-২২৩৷

 ৬৬. তদেব, পৃ-২২৩৷

 ৬৭. সুকুমারী ভট্টাচার্য, প্রবন্ধ সংগ্রহ (১), পৃ-১৩০৷

৩. বাংলা উপন্যাসের পটভূমি

বাংলা উপন্যাসের পটভূমি

বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের আবির্ভাব একেবারেই নতুন সাধারণত ইংরাজি সাহিত্যের হাত ধরে৷ উনিশ শতকে নবজাগরণের ছোঁয়ায় মানুষের চিন্তা-চেতনায়, বিশ্বাসে-সংস্কারে যে আমূল পরিবর্তনের জোয়ার আসে তার পললরূপে স্থিতিলাভ করে বাংলা উপন্যাস৷ এই সাহিত্য উপকরণটি পশ্চিমি নবোদিত সূর্যের আলোকবিক্ষেপে অভিষিক্ত৷ এর প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য সমাজবাস্তবতা৷

উপন্যাস নামাঙ্কিত বা উপন্যাসের অন্যরূপ কোনো সাহিত্যকৃতি প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যরূপগুলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া না গেলেও, ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাবজাত হিসেবে একে অনুরঞ্জিত করলেও, বাংলা উপন্যাসের নানাবিধ বৈশিষ্ট্যের ছাপ আমাদের ভারতীয় সাহিত্যের তথা প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের পরতে পরতে লুকিয়ে ছিল৷ যদিও সমকালীন যুগ-পরিবেশের, সমাজ-ধর্মের গণ্ডি কাটিয়ে উপন্যাস হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করতে পারেনি; পারা সম্ভবও ছিল না৷ যা সম্ভব হয়েছে নবজাগরণের ছোঁয়ায়, পাশ্চাত্য জ্ঞান-তৃষ্ণায় পরিতৃপ্ত মানুষের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বা ব্যক্তিক মর্যাদা প্রকাশের মধ্য দিয়ে৷ দৈব প্রভাব বা দৈবানুগ্রহ কাটিয়ে মানুষের আত্মশক্তির পুনরুজ্জীবনই উপন্যাসের স্থায়ী ভিত্তিপ্রস্তর রচনা করেছে৷ অর্থাৎ সময়ের প্রবহমান ধারায় উপন্যাসের সলতে পাকানো শুরু হয়েছিল সেই প্রাচীন যুগ থেকেই; সেখানে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাব অগ্নি সংযোগ করেছে মাত্র৷ তাই বাংলা উপন্যাসের উৎস ও পটভূমিকে সঠিকভাবে জানতে গেলে প্রয়োজন উপন্যাসের বিশিষ্ট লক্ষণগুণ সম্পর্কে নুন্যতম উপলব্ধি৷ যার দ্বারা বাংলা উপন্যাসের প্রকৃত ইতিহাসকে জানতে সঠিক পথ নির্ণিত হবে বলে মনে হয়৷ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসের গুণাবলী সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন যে—

ক) উপন্যাস হবে সর্বাপেক্ষা গণতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত অর্থাৎ সেখানে মানুষ হবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বিশিষ্ট এবং মধ্যযুগের সামাজিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত৷

খ) উপন্যাসে থাকবে তীব্র জীবনমুখিতা ও বাস্তব ঘনিষ্ঠতা৷ এর সঙ্গে উপলব্ধ হবে সামাজিক মানুষের আত্মাধিকারবোধ, আত্মমর্যাদাবোধ এবং সামগ্রিক জীবনবোধ৷

গ) চরিত্রচিত্রণের সুদক্ষ ক্ষমতায় এবং কাহিনি-উপকাহিনির যথার্থ প্রয়োগ সেই আখ্যানটিকে করে তুলবে উপন্যাসের নতুন কলেবর রূপে৷

ঘ) চরিত্র, ঘটনা, কাহিনি-উপকাহিনির জাদুস্পর্শে বাস্তব রসসিক্ত জীবনালেখ্যে যথার্থ নিপুণতার আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে রচিত হবে উপন্যাস৷

কোনো দেশের সাহিত্য সেখানকার বাস্তব জীবন এবং ঐতিহাসিক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে তার পরিপূর্ণরূপ লাভ করে৷ বাংলার প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন থেকে শুরু করে প্রাচীন সংস্কৃত ও বৌদ্ধ সাহিত্য এবং উপন্যাস সৃষ্টির পূর্বপর্যায় পর্যন্ত সাহিত্যের উপকরণাদির মধ্যে যেখানে কাহিনি, চরিত্র ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবতার উপস্থাপনা ঘটেছে সেখানেই শোনা গেছে বাংলা উপন্যাসের আগমনী ধ্বনি৷ যদিও কখনো তা স্পষ্ট কখনো বা অস্পষ্ট৷ কিন্তু ধরে নিতে অসুবিধা হয় না যে বাংলা উপন্যাস তার আবির্ভাবের প্রস্তুতির দিনগোনা শুরু করে দিয়েছিল৷

প্রাচীন সংস্কৃত কাব্য ও আখ্যায়িকার মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে উপন্যাসের পদধ্বনি শোনা যায়৷ সংস্কৃত গদ্যসাহিত্য পঞ্চতন্ত্র, কথাসরিৎসাগর, হিতোপদেশ, দশকুমারচরিত, কাদম্বরী, বেতালপঞ্চবিংশতি এগুলি তাদের নিজস্ব আঙ্গিকের বাইরেও উপন্যাসের আদি লক্ষণগুলিকেও চিনিয়ে দেয়৷ এগুলির প্রায় সবই খ্রিঃ পঞ্চম শতক থেকে দশম-একাদশ শতকের মধ্যে রচিত হয়েছিল৷

পঞ্চতন্ত্র নীতিকথামূলক গল্প৷ নীতিকথা প্রচারের জন্যই যেন এর জন্ম৷ লেখক যেন নীতি-উপদেশগুলিকে খাপে ফেলার জন্যই জীবনের দিকে চোখ তুলে চেয়েছেন৷ গল্পগুলি অধ্যয়ন করলে অবাধ্য দুর্দান্ত রাজপুত্রদের নীতিশিক্ষা দেওয়ার জন্যই যে এর সৃষ্টি তা কিছুতেই বিস্মৃত হওয়া যায় না৷ এর প্রয়োজনীয়তা নীতি-উপদেশ পরিবেষ্টিত; এর বাস্তবতা উপন্যাস সৃষ্টির ভিত্তিভূমিতে তেমন কোনো রসদ জোগান দেয়না৷

হিতোপদেশের গল্পগুলোও নীতি প্রতিপাদক নানা শ্লোকের দ্বারা গতিরুদ্ধ৷ গল্পগুলিও মৌলিক নয়৷ পঞ্চতন্ত্র ও অন্যান্য কোষগ্রন্থ থেকে সংগৃহিত৷ উপন্যাস সাহিত্যের আলোচনায় এর প্রয়োজন নেতিবাচক৷

কথাসরিৎসাগরে ইন্দ্রজালঘটিত ব্যাপারই নৈতিক শৈথিল্যের প্রমাণ৷ অন্যদিকে দশকুমারচরিত দিগ্বিজয় অভিযানে নির্গত দশজন রাজকুমারের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের কাহিনি, তাদের শৌর্য-বীর্য, ছলনা, শঠতা, প্রণয়, সমাজের অভ্যন্তরস্থিত ব্যভিচার, ঘৃণ্য দাম্পত্যজীবন এখানে উপস্থাপিত হয়েছে৷ প্রকৃতপক্ষে দশকুমারচরিত রাজ-ধর্ম-বিশ্বাসের ছলনাময় দৃষ্টান্তে রাজনৈতিক আদর্শের অপমৃত্যুর ছবি৷ এখানে রাজনৈতিক পরিস্থিতির নানাবিধ চিত্র বাস্তবতার সুস্পষ্ট সাক্ষীকে বহন করে৷

বৌদ্ধসাহিত্যও বাস্তবজীবনাশ্রয়ী বিভিন্ন কাহিনিসম্ভারে পরিপূর্ণ৷ এগুলি সাধারণতঃ সংস্কৃত ও পালিতে লেখা৷ সংস্কৃত সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করলে বৌদ্ধ সাহিত্যে বাস্তবতার সুরটি অধিক প্রকটিত৷ এর কারণ হয়তো বৌদ্ধধর্ম মানবতাধর্মী বলে৷ হিন্দু ধর্মের রক্ষণশীলতা ও সনাতন শ্রেণীবিভাগগুলিকে ভেঙ্গে মানুষকে এক নতুন ঐক্য ও সাম্যের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছে এই সাহিত্যগুলি৷ রাজরাজড়া, অভিজাতদের সংযোগ-সংকর্ষ ত্যাগ করে সাধারণ মানুষের মননভূমিতে বিচরণ করার চেষ্টা করেছে এবং সেগুলিকেই সাহিত্যের উপকরণ হিসেবে গ্রহণ করেছে৷ বৌদ্ধ সাহিত্যের মধ্যে বাস্তব জীবনের সজীবতায়, বাস্তব সমস্যার নানা জটিলতায় জাতকের গল্পগুলিই শ্রেষ্ঠ৷ প্রকৃতপক্ষে বৌদ্ধধর্ম আবির্ভাবগত দিক থেকে অনেকটা অর্বাচীন আর সেকারণেই আধুনিক জীবন বৈশিষ্ট্যের ছাপ তার মধ্যে যতটা স্পষ্ট অনুভব করা যায় আর কোথাও ততটা নয়৷ এর রীতি-নীতি, অনুশাসন, প্রাত্যহিকতা, কার্যপ্রণালী ও ধর্ম বিস্তারের চেষ্টা, গার্হস্থ্য জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সবকিছু সুপরিচিত দৃশ্য৷ হিন্দু ধর্মের সুবিশাল ঔদাসীন্য, প্রবল অনাসক্তি, দেব-ঋষিদের জীবনের কঠোর কৃচ্ছসাধন, ও ত্যাগ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে; তার প্রতি শ্রদ্ধা জাগ্রত হয়, ভক্তি জন্মে কিন্তু তাকে নিজের জীবনরসে সম্পৃক্ত করে তোলা সাধ্যাতীত হয়ে পড়ে৷ আর সেদিক দিয়ে বৌদ্ধজাতক অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি৷ বৌদ্ধভীক্ষুদের জীবনের নানাবিধ সমস্যা, তাদের লোভ, ঈর্ষা, আদিম ও স্বাভাবিক প্রবৃত্তির ঘাত-প্রতিঘাত, নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে গিয়ে নানারূপ শঠতার আশ্রয় নেওয়া এবং গার্হস্থ্য জীবনে বণিকশ্রেণীর লোভ, হতাশা, সাধারণ গৃহস্থের মদ্যপান, বিত্তহীন ও বিত্তবান, উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণের প্রণয় দৃশ্য কিছুই বাদ পড়েনি৷ লেখক গল্পগুলিকে নীতি-প্রচারের মোড়কে না বেঁধে মনোহর ও চিত্তাকর্ষক করে তোলার চেষ্টা করেছেন৷ আর তাতেই গল্পগুলি হয়ে উঠেছে প্রাঞ্জল ও স্বাভাবিক৷

অন্যদিকে ঈষপের গল্প নীতিগল্প৷ সংক্ষিপ্ত নীতিকথনভঙ্গিতে লেখক তাঁর কথাকে উপস্থাপন করেছেন৷ এর ভাষা সরল, অলংকার বাহুল্যে ভারাক্রান্ত নয়৷ গল্পের মধ্যে বাস্তবতার ক্ষীণ একটা আভাস পাওয়া গেলেও দু-একটি গল্প ছাড়া সেই বাস্তবতার সঙ্গে জীবনের নিবিড় কোনো সম্পর্ক নেই৷

প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপাদান চর্যাপদ৷ চর্যাপদে বৌদ্ধ সহজিয়া সাধকেরা বাস্তব সমাজের নিদর্শন দিয়ে রূপকের মোড়কে তাঁদের গুহ্য সাধনার কথা বলেছেন৷ এগুলি মূলত ধর্মীয় সাধনসঙ্গীত৷ একেবারে ধর্মীয় নানা বিধিনিষেধ বা তত্ত্বের প্রথাগত অভিব্যক্তি বলেই এই পদগুলির মধ্যে সাহিত্যলভ্য জীবনরসের সন্ধান অনেকখানি ব্যর্থ৷ এঁদের রচনার পেছনে কাজ করেছিল প্রত্যক্ষ জীবনবোধের পরিবর্তে প্রথাসিদ্ধ সাম্প্রদায়িক দায়-দায়িত্ব৷ তাঁদের আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে যে সমস্ত গুহ্য সাধনপ্রণালী প্রচলিত ছিল তা অদীক্ষিত ব্যক্তিদের কাছ থেকে আড়াল করার জন্য রূপকচিত্র ও সাংকেতিক ভাষার মাধ্যমে গীতিরূপ দিয়েছিলেন৷ সাহিত্যে মানবজীবনের যে লৌকিক স্তরকে অবলম্বন করে জীবনসত্য অন্বেষণ করা হয় বাস্তব সংসারের সেই স্তরটিকে উপেক্ষা করাই ছিল চর্যাকারদের অন্যতম ধর্মীয় লক্ষ্য—যার জন্য যে জীবন সাহিত্যের প্রধান অবলম্বন তাই তাঁদের কাছে অস্তিত্বহীন বলে প্রতিপন্ন হয়েছে৷ তারপরেও কিন্তু উপকরণ সংগ্রহের জন্য তাঁদের হাত দিতে হয়েছে লৌকিক জীবনের নানা অভিজ্ঞতা থেকে৷ অর্থাৎ তত্ত্বের দিক থেকে তাঁরা জীবনকে অস্বীকার করলেও তার রূপাভিব্যক্তির দিক থেকে বাস্তবজীবনকে অবহেলা করতে পারেননি—যা পদগুলিকে জীবনরসে সিক্ত করে অনন্যমাত্রা দান করেছে৷ যদিও এই জীবনরসাভিব্যক্তি এর সব পদের মধ্যে উপস্থিত নয়; যেখানেই মানবজীবনের অসঙ্গতিবোধ এবং সুখদুঃখ প্রেমমিলনের বিচিত্র অনুভূতিকে তত্ত্বকথার উপমান হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে সেখানেই জীবনরসের তীর্যক অনুভূতি সজীব ও সরস হয়ে উঠেছে৷ পদকর্তাদের বাস্তব সমাজ অভিজ্ঞতার সুস্পষ্ট দলিল হয়ে উঠেছে৷

জীবনের দিক থেকে দেখলে জীবনের দুটি ভাবকে চর্যাপদে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়৷ তা হল—বিষাদ ও শৃঙ্গার৷ পদকর্তারা তাদের জীবনের সীমাহীন বিষাদকে সামাজিক অত্যাচার, সাংসারিক অশান্তি বা পারিপার্শ্বিক চাপ ইত্যাদির দ্বারা উৎসারিত করেছেন৷ ভুসুকপাদ একটি পদে নির্দয় জলদস্যুর দ্বারা লুন্ঠিত ও সর্বস্বান্ত হওয়া মানুষের রিক্ততার অনুভূতিকে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন৷—

 ‘‘বাজণাব পাড়ী পঁউআ খালেঁ বাহিউ৷

 অদঅ দঙ্গালে দেশ লুড়িউ৷৷ ধ্রু৷৷

 আজি ভুসুকু বঙ্গালী ভইলী৷

 ণিঅ ঘরিণী চণ্ডালে লেলী৷৷ ধ্রু৷৷

 … … …

 সোণ রুঅ মোর কিম্পি ণ থাকিউ৷

 নিঅ পরিবারে মহানেহে থাকিউ৷৷ ধ্রু৷৷

 চউকোড়ি ভণ্ডার মোর লইআ সেস৷

 জীবন্তে মইলেঁ নাহি বিশেষ৷৷ ধ্রু৷৷ ’’ (৪৯ নং পদ)

এর অর্থ বজ্র নৌবহর পদ্মাখালে বাওয়া হল৷ নির্দয় দঙ্গালে (বাঙ্গালে) দেশ লুঠ করল৷ ভুসুকু, চণ্ডালে-নেওয়া নিজের ঘরনি আজ বাঙালি৷… সোনা-রূপা, আমার কিছুই থাকল না৷ নিজ পরিবারে মহাপ্রেমে থাকলাম৷ চতুষ্কোটি ভাণ্ডার আমার নিঃশেষে লুন্ঠিত৷ বাঁচা-মরায় কোনো প্রভেদ নেই৷

এখানে সমাজের ভয়ঙ্কর অরাজকতার ছবি চিত্রিত৷ জলদস্যুর দ্বারা নির্মম লুন্ঠনে ভুসুকুর চারকোটির বিষয় যেমন নিঃশেষ তেমনি জলদস্যুরা তার স্ত্রীকেও ছেড়ে দেয়নি৷ তার গৃহিণীকে চণ্ডালে হরণ করায় সে ভ্রষ্টা হয়েছে৷ দেহনির্ভর সতীত্ব নষ্ট হওয়ায় সেই অপহৃতা রমণীকে সমাজ গ্রহণ করেনি—বরং তার সঙ্গে সঙ্গে স্বামী ভুসুকুকেউ জাতিচ্যুত করেছে৷ ধনসম্পদ, জাতিগৌরব হারিয়ে ভুসুকু তাই জীবন্মৃতের মত অবস্থান করছে৷ এখানে জলদস্যুর আক্রমনে সমাজের বিপর্যয়ের ছবি যেমন স্পষ্ট তেমনি অপহৃতা নারীকেও যে এ যুগের মতো সে যুগেও সমাজ গ্রহণ করতো না, নারীর সেই অবস্থানগত দিকটিও ফুটে উঠেছে৷ ভুসুকুর সেই রিক্ততা, তার স্ত্রীর সেই অবমাননা—সর্বজনীনতা লাভ করেছে৷ শুধুমাত্র সামাজিক নিরাপত্তার অভাবই নয়, তার সঙ্গে নানা সাংসারিক অসঙ্গতিজনিত বিপর্যয়ও বিস্ময়বিমূঢ় করে তুলেছে কোনো কোনো পদকর্তাকে৷ ৩৩ নং পদে ঢেন্ঢনপাদ সেই অসংগতির চিত্রকেই তুলে ধরেছেন—

 ‘‘টালত মোর ঘর নাহি পড়বেষী৷

 হাড়ীত ভাত নাঁহি নিতি আবেশী৷৷ ধ্রু৷৷

 বেঙ্গসঁ সাপ বডহিল জাঅ৷

 দুহিল দুধু কি বেন্টে ষামাঅ৷৷ ধ্রু৷৷

 বলদ বিআএল গবিআ বাঝেঁ৷

 পিটা দুহিএ এ তিনা সাঁঝে৷৷ ধ্রু৷৷

 জো সো বুধী সৌ নিবুধী৷

 জো যো চৌর সৌ দুষাধী৷৷ ধ্রু৷৷

 নিতে নিতে ষিআলা ষিহে যম জুঝঅ৷

 টেন্ঢণ পাএর গীত বিরলেঁ বুঝঅ৷৷ ধ্রু৷৷’’ (৩৩ নং পদ)

অর্থাৎ লোকালয়ে আমার ঘর প্রতিবেশী নেই৷ হাঁড়ীতে ভাত নেই নিত্যই প্রতিবেশীর আগমন৷ ব্যাঙের দ্বারা সাপ কাটা পড়ে৷ দোহন করা দুধ বাঁটে ঢুকে যায়৷ বলদ প্রসূতি গাই বন্ধ্যা, তিন সন্ধা দোহন করা হয়৷ যা সেই বুদ্ধি তা-ই নিঃকৃষ্ট বুদ্ধি৷ যে চোর সে-ই কোটাল৷ নিত্য নিত্য শিয়াল সিংহের সঙ্গে যুদ্ধ করে৷ ঢেন্ঢন পার গীত কদাচিৎ বোঝা যায়৷ এই যে মূল বক্তব্য তা শুধু তত্ত্বের আধার নয় সমাজ বৈষম্যের দ্বারা বিচলিত ব্যক্তিত্বের মূল্যবোধের চিরকালীন অবক্ষয়ের চিত্র৷ সমাজে বিপর্যয় দেখা দিলে সব বিপরীত কার্য দেখা যায়—যারা বুদ্ধিমান তারা বোকা হয়ে যায় আর বোকারা বুদ্ধিমান হয়৷ ন্যায়বোধের বিচারে যে সাধু সে-ই অসাধু হয় আর অসাধুরা সাধু বলে ঘোষণা করে নিজেদেরকে৷ বহুযুগ পরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘দুই বিঘা জমি’-তে এই বক্তব্যই প্রতিফলিত হতে দেখা যায়—যখন উপেনের সমস্ত সম্পত্তি ডিক্রি জারি করে নিজের কুক্ষিগত করার পর জমিদার উপেনকেই চোর সাব্যস্ত করে৷ তাই উপেন ব্যঙ্গ করে বলে—

 ‘‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে৷’’

অর্থাৎ ঢেন্ঢন পাদের এই পদ জীবনরস পরিবেশনে, বাস্তবতার পরাকাষ্ঠায় সর্বজনীনতা লাভ করেছে৷

অকর্মণ্য বা অসাধু স্বামী তার রতিসুখ চরিতার্থ করে গর্ভিণী স্ত্রীকেও পরিত্যাগ করে চলে যায়—তার পর সেই অসহায় নারীর যে দুঃসহ জীবন যন্ত্রণা তা কুক্করীপাদ ২০ নং পদে তুলে ধরেছেন৷

 ‘‘হাঁউ নিরাসী খমণ ভতারি৷

 মোহর বিগোআ কহণ ন জাই৷৷ ধ্রু৷৷

 ফেটলিউ গো মাএ অন্তউড়ি চাহি৷

 জা এথু বাহাম সো এথু নাহি৷৷ ধ্রু৷৷

 পহিল বিআণ মোর বাসনয়ূড়া৷

 নাড়ি বিআরন্তে সেব বায়ূড়া৷৷ ধ্রু৷৷

 জা ণ জৌবণ মোর ভইলেসি পূরা৷

 মূল ম খলি বাপ সংঘারা৷৷ ধ্রু৷৷’’

অর্থাৎ স্বামী আমার বিবাগী, আমি তাই নিরাশ—আমার দুঃখ অবর্ণনীয়৷ মাগো আমি প্রসব করলাম, তাই আঁতুর খুঁজি, কিন্তু যা খুঁজি তা পাই না৷ প্রথম প্রসব আমার বহু বাসনার ধন কিন্তু নাড়ী কাটার সঙ্গে সঙ্গে সে মিলিয়ে গেল৷ যখন আমার নবযৌবন পূর্ণ হল, আমার দ্বারা মূল স্খলিত হল, বপন ক্ষেত্র নষ্ট হল৷

যৌনতা, যৌনব্যভিচার, নারীর বহুগামিতা, পুরুষের নারী সম্ভোগ ইত্যাদি প্রত্যেক সমাজ বা যুগের সবচেয়ে বেশি বাস্তব দিক৷ চর্যাপদের পদকারেরা সেদিককেউ উপেক্ষা করতে পারেননি বা করা সম্ভব হয়নি৷ তাছাড়া সহজপন্থী পদকর্তাদের ধর্মানুষ্ঠানে যৌনাচারের বিশেষ স্থান ছিল৷ তাঁরা মহাসুখের প্রতি সাধকচিত্তের আসক্তি ও সাধকচিত্তের সঙ্গে মহাসুখের মিলনকে নরনারীর পারস্পারিক আসক্তি যৌনমিলনমূলক শৃঙ্গার চেষ্টার রূপকে বর্ণনা করেছেন৷

কাহ্নপাদের ১৮ সংখ্যক পদে দেখা যায় কবির প্রেমিকা নিম্ন শ্রেণীর এক ডোমরমণী৷ অস্পৃশ্যতার কারণে নগরের বাইরে সে বাস করে৷ উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণরা তার যৌবনচাঞ্চল্যে বিভ্রান্ত হলেও অস্পৃশ্য বলে তাকে স্পর্শ করতে পারে না৷ সে নগরের বাইরে চাঙাড়ী তৈরি, তাঁত বোনা ইত্যাদি ক্ষুদ্র বৃত্তির মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করে৷

 ‘‘কইসণি হালো ডোম্বী তোহোরি ভাভরিআলী৷

 অন্তে কুলিণজন মাঝেঁ কাবালী৷৷ ধ্রু৷৷

 তঁই লো ডোম্বী সঅল বি টলিউ৷

 কাজ ণ কারণ সসহর টলিউ৷৷ ধ্রু৷৷

 কেহো কেহো তোহোরে বিরুআ বোলই৷

 বিদুজণলোঅ তোরেঁ কন্ঠ ণ মেলঈ৷৷ ধ্রু৷৷

 কাহ্নে গাইতু কামচণ্ডালী৷

 ডোংবিত আগলি ণাহি চ্ছিণালী৷৷ ধ্রু৷৷’’

এর বাংলা অর্থ ওলো ডোমনী, কিরকম তোর চতুরালি৷ একপাশে কুলীনজন মাঝখানে কাপালিক৷ ডোমনী লো তোর দ্বারা সব কিছুই নষ্ট হল৷ কাজ নেই, কারণও নেই শশধর টলানো হল৷ কেউ কেউ তোকে মন্দ বলে৷ বিদ্বজ্জনেরা তোকে কন্ঠ থেকে ছাড়ে না৷ কাহ্নের দ্বারা-ই কামচাঁড়ালী গাওয়া হল৷ ডোমনীর বাড়া ছিনাল নেই৷

ডোমনীকে পদকর্তা ছিনাল বলে প্রতিপন্ন করেছেন৷ ‘ছিনাল’ শব্দটি বহুপুরুষভোগ্যা গণিকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য৷ নিম্নশ্রেণীর এই কুলনারী তার স্ব-বৃত্তির সাথে সাথে দেহব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত৷ আর তার জন্যই কুলীনজন, কাপালিক এমনকি পদকর্তা স্বয়ং তার প্রেমপ্রার্থী হয়ে তার সঙ্গে মিলিত হতে পারে৷ সে বহুভোগ্যা বলে কারও কারও কাছে মন্দ নারী হিসেবে প্রতিপন্ন হলেও তার শরীরী মোহে বিদ্বজ্জনেরা তাকে কন্ঠলগ্ন করে রাখে৷ অর্থাৎ এই পদে নিম্ন শ্রেণীর ডোম রমণীদের বাস্তব জীবনছবি ফুটে উঠেছে৷ শুধু তাই নয় এই স্বৈরিণী নারীর প্রেম প্রত্যাশায় কাহ্নপাদের মতো বহু পুরুষ নিজের জাত-ধর্ম পরিত্যাগ করে তার অনুসারী হয়; নিজের সর্বস্ব পণ করে বসে৷ কিন্তু তারপরেও নিজের স্বভাবজ বৈশিষ্ট্যে ডোমনী তাকে নিজের একক প্রেমের পরাকাষ্ঠায় বাঁধতে পারে না৷ ডোমনীর সেই ব্যবহার তাই কবিকে ব্যথিত করে৷ সে অনুযোগ করে বলে—

 ‘‘নগর বাহিরেঁ ডোম্বি তোহোরি কুড়িআ৷

 ছোই ছোই জাহ সো ব্রাহ্মনাড়িআ৷৷ ধ্রু৷৷

 আলো ডোম্বী তোএ সম করিব ম সাঙ্গ৷

 নিঘিণ কাহ্ন কাপালি জোই লাগ৷৷ ধ্রু৷৷

 … … …

 হা লো ডোম্বী তো পুছমি সদভাবে৷

 আইসসি জাসি ডোম্বি কাহরি নাবেঁ৷৷ ধ্রু৷৷

 তান্তি বিকণঅ ডোম্বি অবর না চঙ্গেড়া৷

 তোহর অন্তরে ছাড়ি নড়এড়া৷৷ ধ্রু৷৷

 তু লো ডোম্বী হাঁউ কপালী৷

 তোহোর অন্তরে মোএ ঘলিলি হাড়েরি মালী৷৷ ধ্রু৷৷’’

অর্থাৎ নগরে বাইরে ডোমনী, তোর কুঁড়েঘর৷ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাস সেই ব্রাহ্মণ বালককে৷ ওলো ডোমনী, তোর সঙ্গে আমি সাঙ্গা করব৷ আমি কাহ্ন ঘৃণাহীন, নগ্ন কাপালিক যোগী৷ ওলো ডোমনী তোকে সদভাবে জিজ্ঞাসা করি, তুই আসিস যাস কার নায়ে৷ ডোমনী তুই না তাঁত আর চাঙাড়ী বিক্রয় করিস৷ তোর তরে নটের ঝাঁপি ত্যাগ করলাম৷ ওলো তুই ডোমনী আমি কাপালিক৷ তোর তরে আমি হাড়ের মালা গলায় পড়লাম৷

ডোমনীর তার প্রেমকে উপেক্ষা করে পরপুরুষের প্রতি অব্যাহত সেই আসক্তি দেখে প্রবল ঈর্ষা কুটিল কন্ঠে তাকে হত্যা করার কথাও ঘোষণা করে৷—

‘মারমি ডোম্বী লেমি পরাণ৷’’

অর্থাৎ ডোমনী তোকে মারব, প্রাণ নেব৷ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম রূপের মধ্যে প্রেমের এমন ঈর্ষামিশ্রিত অভিব্যক্তি প্রাচীন বাংলার আর কোনো সাহিত্যে আছে কিনা বলা যায় না৷

সামাজিক ভ্রষ্টাচারের আরও চিত্র খুঁজে পাওয়া যায় কুক্করীপাদের পদে৷ সেখানে বর্ণিত হয়েছে এক গৃহবধূর চিত্র৷ যে তার সরল অভিব্যক্তি দিয়ে দিবসে সর্বসমক্ষে নিজেকে প্রকাশ করলেও অন্ধকার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে জেগে উঠে ঘুমন্ত জৈবপ্রবৃত্তি৷ আর তার বশবর্তী হয়েই দিবসে যে কাকের ডাক শুনে ভীত হয়ে পড়ে; রাত্রে তাকেই দেখা যায় কামপূরণের জন্য অভিসারে যেতে৷—

 ‘‘দিবসই বহুড়ী কাউই ডরে ভাঅ৷

 রাতি ভইলেঁ কামরু জাঅ৷৷ ধ্রু৷৷’’ (২ নং পদ)

যে সময় পদকর্তারা চর্যাপদ রচনা করেন তখন বাংলার শাসনকর্তা ছিল পরধর্ম অসহিষ্ণু সেন রাজারা৷ তাদের সময়ই অস্পৃশ্যতা মারাত্মক রূপ নেয়৷ অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষেরা শবর, ডোম, চণ্ডাল প্রমুখরা স্থান নেয় নগরের প্রান্ত সীমায় বা জনপদ থেকে দূরে—ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে৷

বিভিন্ন ধরনের পেশাধারী মানুষের বাস সে সময়কার অনুন্নত অর্থনৈতিক অবস্থাকে চিনিয়ে দেয়৷ ডোম, ব্যাধ, শুঁড়ি, সূত্রধর, পাটনি ইত্যাদি নিম্নবৃত্তির মানুষেরা অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা ভোগ করত৷ কিন্তু উচ্চবিত্তের পেশাগত কোনো দিক প্রকাশিত না হলেও তাদের জীবনধারণ প্রণালী যতটুকু আভাষিত করেছেন রচনাকারেরা তাতে মনে হয় আর্থিক অসাচ্ছল্য তাদের তেমন ছিল না৷ এছাড়া বিবাহ উৎসব, আমোদ-প্রমোদ, সমাজের নানা নিয়মকানুন, ব্যভিচার, বিশৃঙ্খলা, নরনারীর দাম্পত্যজীবন চিরন্তনী সুরধারাকে অবলম্বন করেই প্রতিফলিত হয়েছে৷ সে সময়ও বিবাহে বাজনা-বাদ্য নিয়ে যে আড়ম্বর ছিল—বর্তমানেও তার ব্যতিক্রম নয়৷ যেমন—কাহ্ন পাদের একটি পদে—

 ‘‘ভবনির্ব্বাণে পড়হমাদলা৷

 মণপবণ বেণি করন্ড কসালা৷৷

 জঅ জঅ দুংদুহি সাদ উছলিআঁ৷

 কাহ্ন ডোম্বি বিবাহে চলিআ৷৷

 ডোম্বি বিবাহিআ আহারিউ জাম৷

 জউতুকে কিঅ আণুতু ধাম৷৷

 অহিণিসি সুরাঅ পসংগে জাঅ৷’’ (১৯ নং পদ)

অর্থাৎ ভবনির্বাণ যেন ঢাক ও মাদল৷ মন ও পবন দুটি কাড়া (ঢোল) ও কাঁসি৷ দুন্দুভিতে জয় জয় সাড়া ছড়িয়ে পড়ল৷ কাহ্ন ডোমনীকে বিয়ে করতে চলল৷ ডোমনীকে বিয়ে করে খাওয়া হল৷ অনুত্তর ধর্মকে যৌতুক করা হল৷ দিনরাত্রি সুরত প্রসঙ্গে কাটে৷ এই যে ঢাক, ঢোল, মাদল, কাসি, দুন্দুভি বাজিয়ে—ভোজের আয়োজন করে বিবাহ নির্বাহ তা আজকের যুগেও প্রাসঙ্গিক৷ এভাবে নানাভাবে জীবনরস তথা সমাজ বাস্তবতাকে ছুঁয়ে গেছে চর্যাপদের পদকারেরা৷ আর এই যে সমাজের নানাবিধ উপকরণ তাঁরা নিয়েছেন তা একেবারে প্রত্যক্ষ বাস্তব সমাজের অভিজ্ঞতা৷ সেখানে শবর, ডোম, চুরি-ডাকাতি, পরকীয়া, চরিত্রস্খলন, নৌকাচালনা, নাট্যাভিনয়, দারিদ্র্যতা, আনন্দ-বিনোদন, বর্ণবৈষম্য কোনোকিছুই বাদ পড়েনি৷ এর গুহ্য অর্থ যাই হোক না কেন সহজ সরলভাবে বিচার করতে গেলে একেবারে বাস্তব সমাজ ঘেষা৷ সমাজের মানুষজন ও তার পারিপার্শ্বিক উপাদান এত সুনিপুণভাবে চর্যাপদের মধ্যে উঠে এসেছে যে তাকে একেবারে জীবন্ত মনে হয়৷ তবুও চর্যাপদ উপন্যাস নয়৷ বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির প্রথম পর্যায়ের এক সুনিপুণ সাহিত্য উপকরণ—বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের প্রথমতম ফসল৷

অনুবাদ সাহিত্যের ধারায় অন্যতম নিদর্শন রামায়ণ ও মহাভারত৷ এর মধ্যে তৎকালীন বাঙালি জীবনের ছাপ সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত হলেও সেগুলি ছিল রাজরাজড়াদের কাহিনি৷ সাধারণ মানুষ সেখানে ব্রাত্য৷

চৈতন্য জীবনী বা বৈষ্ণবমোহান্তদের জীবনী নিয়ে রচিত জীবনী কাব্যের মধ্যেও মনীষীদের জীবনবর্ণনাকে স্বাভাবিক করতে যতটুকু বাস্তব জীবনের উপাদান দরকার জীবনীকারেরা ততটুকুই গ্রহণ করেছেন৷ তাই সেগুলি জীবনীই; উপন্যাস লক্ষণাক্রান্ত হয়ে উঠেনি৷

নাথপন্থীদের সাহিত্য ময়নামতি গোপীচন্দ্রের গান এবং গোরক্ষ বিজয়ে সমাজ-বাস্তবতার স্পষ্ট ছবি উঠে এলেও অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতক পর্যন্ত এর কোনো লিখিত অবয়বই খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ ফলে বাংলা উপন্যাসের ভিত প্রস্তুতিতে এর কোনো দাবিকে মেনে নেওয়া যায় না৷ আবার মৈয়মনসিংহ গীতিকা কিন্তু অনেক বেশি বাস্তবধর্মী৷ বাস্তবতার রসসমৃদ্ধ এই উপকরণে উপন্যাসে কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য দৃষ্টিগোচর হয়৷ মৈমনসিংহ গীতিকার রচনাকাল ষোড়শ-সপ্তদশ শতক বলে অনুমিত৷ উপন্যাস সাহিত্যের পথপ্রদর্শকরূপে এর কিছুটা স্থান রয়েছে৷ এর মধ্যে যেমন জেলে-মাঝি, চাষি-রাইয়ৎ, বণিক, সদাগর ইত্যাদির বিচিত্র শ্রেণীসংঘবদ্ধ বাংলার আর্থ-সামাজিক রূপকে প্রতিফলিত করেছে তেমনি বাংলার পল্লীপ্রকৃতির নিসর্গরূপে তার সমগ্র সৌন্দর্য নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে৷ এখানে যেমন কাহিনিকারেরা সমাজের সমস্যা-সংঘাত মানবজীবনের বিকাশ ও পরিব্যাপ্তিকে গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনি মানুষের শত সমস্যার মধ্যেও তাদের স্বাধীন মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করেননি৷ এর মধ্যে মানবজীবনের বলিষ্ঠ নিরঙ্কুশ মহিমা স্বীকৃতি পেয়েছে—দৈবী পরিমণ্ডল সৃষ্টি করে মানবজীবনের সমাজশাসিত বেপরোয়া লীলারূপকে আধ্যাত্মদৃষ্টিতে সমাচ্ছন্ন করা হয়নি৷ নদীকেন্দ্রিক দেশের বাস্তব প্রাণ-প্রকৃতিকে মনুষ্যপ্রকৃতির সহজাত স্বাভাবিক রসবৈশিষ্ট্যে বাস্তবানুগ করে তোলা হয়েছে৷

উপন্যাসের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল ঘনসংবদ্ধ ঘটনাজাল; মানবিক বৃত্তির দ্বন্দ্ব, জীবনরূপের নানা সূক্ষ্ম সংঘর্ষ এগুলি মৈমনসিংহ-গীতিকার মধ্যেও বীজাকারে বর্তমান৷ এর চরিত্রগুলি দেব-দেবীর নিষ্ঠুর পীড়নে ধর্মের কাছে মাথা নোয়ায়নি বরং দুর্বল মানুষ সবলের অত্যাচারে আমরণ লড়াই করে চরম ট্র্যাজিক পরিণতি লাভ করেছে৷ এই সবল কখনো কন্যার পিতা, নানা ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষ, স্বামী, কাজী প্রমুখরা৷ যেমন ‘মহুয়া’ পালায় মহুয়া বেদে দলপতি হুমরার চুরি করে আনা পালিতা কন্যা৷ কালক্রমে সে বেদের দলেই খেলা দেখিয়ে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে৷ খেলা দেখানোর উদ্দেশ্যেই বামনকান্দা গ্রামে উপস্থিত হলে সেখানকার ব্রাহ্মণ তালুকদারের পুত্র নদের চাঁদ তার রূপে বিমোহিত হলে তারা পরস্পরের প্রণয়ভাগিনী হয়৷ কিন্তু তার পালকপিতা হুমরা নদের চাঁদকে মারার দায়িত্ব দেয় মহুয়ার হাতেই৷ সে প্রেমাস্পদের বুকে বিষছুরি না মেরে তাকে সব অবগত করায়; তারপর তেজী ঘোড়ায় চড়ে দুজনে পালিয়ে যায়৷ কিন্তু ঘটনাক্রমে পুনরায় তারা মুখোমুখি হয় হুমরার৷ সেই অসহায় দম্পত্তি সামনে প্রত্যক্ষ মৃত্যুকে দেখতে পায়৷ কবির বর্ণনায়—

 ‘‘চৌদিকেতে চাইয়া দেখে শিকারী কুকুর৷

 সন্ধান করিয়া বাদ্যা আইল এত দূর৷৷

 সামনেতে হুমরা বাদ্যা যম যেন খারা৷

 হাতে লইয়া দাঁড়াইয়াছে বিষলক্ষের ছুরা৷৷

 আক্ষিতে জ্বালিছে তার জ্বলন্ত আগুনি৷

 নাকে নিশ্বাস তার দেওয়ার ডাকি শুনি৷৷

 প্রাণে যদি বাঁচ কন্যা আমার কথা ধর৷

 বিষলক্ষের ছুরি দিয়া দুশমনেরে মার৷৷’’১০

কিন্তু এতদিন লড়াই করে টিকে থাকা মহুয়া দেখতে পায় তার দুই পাশে দুই জন৷ একদিকে পালক পিতা অন্যদিকে স্বামী নদের চাঁদ৷ মাঝখানে তার হাতে মৃত্যুরূপী ছোরা৷ তার দ্বন্দ্ব মুখর মন কাউকেই মারতে পারে না৷ তাই শেষ পর্যন্ত নিজের বুকেই বসিয়ে দেয় সেই বিষাক্ত ছোরা৷ আর মৃত্যুর আগে তার বলে যাওয়া কথাগুলি বড়ই মর্মস্পর্শী৷—

 ‘‘শুন শুন প্রাণপতি বলি যে তোমারে৷

 জন্মের মতন বিদ্যায় দেও এই মহুয়ারে৷৷

 শুন শুন পালং সই শুন বলি কথা৷

 কিঞ্চিৎ বুঝিবে তুমি আমার মনের বেথা৷৷

 শুন শুন মাও বাপ বলি যে তোমায়৷

 কার বুকে ধন তোমরা আইনাছিলা হায়৷৷

 ছুট মা-বাপের কুল শূন্য করি৷

 কার কুলের ধন তোমরা কইরে ছিলে চুরি৷৷

 জন্মিয়া না দেখলাম কভুবাপ আর মায়৷

 কর্ম্মদোষে এত দিনে প্রাণ মোর যায়৷৷’’১১

কাহিনিটি যদি এখানেই শেষ হত তাহলে একরকম হত৷ কাহিনিকারেরা পাষণ্ড হুমরার মনে অনুশোচনার আগুন জ্বেলে তার প্রায়শ্চিত্ত করিয়েছেন৷ আর হুমরা তার স্নেহ-কদর্যতায়, ভালো-মন্দে মিশ্রিত মানুষ হয়ে চূড়ান্ত মানবীয় গুণের পরিচায়ক হয়েছে৷—

 ‘‘ছয় মাসের শিশু কন্যা পাইল্যা করলাম বড়৷

 কি লইয়া ফিরবাম দেশে আর না যাইবাম ঘর৷৷

 শুন শুন কন্যা আরে একবার আঁখি মেইলা চাও৷

 একটি বার কহিয়া কথা পরাণ জুড়াও৷৷

 আর না ফিরিব আমি আপনার ভবনে৷

 তোমরা সবে ঘরে যাও আমি যাইবাম বনে৷৷’’

 … … …

 হুমরা বাদ্যা ডাক দিয়া কয় ‘মাইনক্যা ওরে ভাই৷

 দেশেতে ফিরিয়া মোর আর কার্য্য নাই৷৷

 কয়বর কাটীয়া দেও মহুয়ারে মাটী৷

 বাড়ীঘর ছাইড়া ঠাকুর আইল কন্যার লাগি৷

 দুইয়েই পাগল ছিল এই দুইয়ের লাগি৷৷’’১২

‘মলুয়া’ পালাটিতেও দুর্বৃত্ত কাজীর ষড়যন্ত্রে মলুয়ার জীবন বিপর্যস্ত হয়েছে৷ চান্দ বিনোদের সঙ্গে তার মধুর দাম্পত্য ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে৷ কাজী মলুয়াকে দেখে মুগ্ধ লালসায় তাকে পাওয়ার জন্য দূতী প্রেরণ করেছিল মলুয়ার কাছে৷ মলুয়া তাকে অপমান করে তাড়ালে প্রতিশোধ নিতে মলুয়ার স্বামীর উপর পরওয়ানা জারি করে—

 ‘‘বিনোদের উপরে কাজী পরণা জারি করে৷

 হুকুম লিখিয়া দিল পরণা উপরে৷৷

 সাদি কইরাছ তুমি গেছে ছয়মাস৷

 নজর মরেচা রইছে তোমার অপরকাশ৷৷

 আজি হইতে হপ্তা মধ্যে আমার বিচারে৷

 নজর মরেচা তুমি দিবা দেওয়ানেরে৷৷

 নজর মরেচা যদি নাহি দেও তুমি৷

 বাজেপ্ত হইব তোমার যত বাড়ী জমি৷৷’’১৩

একবার নয় একাধিকবার কাজীর দেওয়া পরওয়ানা এবং লালসাপূর্ণ প্রতিশোধস্পৃহা মলুয়াকে নির্মম পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছে৷

মানবিক জীবনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য যেমন দুর্ধর্ষ হুমরাকে মানুষ করে তুলেছে তেমনি মহুয়া, চন্দ্রবতী, মলুয়া, লীলা, মদিনা—র জীবনের ট্র্যাজিক পরিচয়ই বাস্তবতার অভিনব ছায়া সম্পাদে শিল্পরূপ লাভ করেছে৷ সমস্ত কিছুকে অদৃষ্ট বা দৈব বলে মাথা নত না করে তাদের ব্যক্তিত্বকে ঢাল করে শেষ পর্যন্ত যুঝতে সক্ষম হয়েছে৷ ব্যক্তিত্বের পূর্ণতম বিকাশ দেখা যায় মলুয়ার মধ্যে৷ তা যেন একে বারে শুরু থেকেই৷ ঘাটের পারে বিনোদকে অঘোরে নিদ্রা যেতে দেখে তার মনে প্রণয়ের সঞ্চার হয় ঘাটে জল আনতে গিয়ে—

 ‘‘একবার লামে কন্যা আরবার চায়৷

 সুন্দর পুরুষ এক অঘুরে ঘুমায়৷৷’’১৪

সেই সুপুরুষ বিনোদ চান্দ-ই যখন তার তৎপরতায় জাগরিত হয়ে তার অপ্সরীতুল্য রূপে মুগ্ধ হয় প্রণয় নিবেদন করে তখন নারীসুলভ লজ্জায়—

 ‘‘ভিন দেশী পুরুষ দেখি চান্দের মতন৷

 লাজ-রক্ত হইল কন্যার পরথম যৌবন৷৷’’১৫

তার রূপমুগ্ধ চাঁদ কাজী দূতী হিসেবে নেতাই কুটুনিকে দিয়ে প্রেম প্রস্তাব পাঠালে পরম সাহসিকতায় দুর্বৃত্ত ক্ষমতাবান সেই পুরুষের লালসার জবাব দিয়ে পাঠায়—

 ‘‘আমার সোয়ামী যেমন আসমানের চান৷

 না হয় দুষমন কাজী নউখের সমান৷৷

 অপমান্যা বুড়ি তুমি যাও নিজের বাড়ী৷

 কাজীরে কহিও কথা সব সবিস্তারি৷৷

 দুষমন কুকুর কাজী পাপে ছিল মন৷

 ঝাটার বাড়ী দিয়া তারে করতাম বিরম্বন৷৷

 বাচ্যা থাকুন সোয়ামী আমার লক্ষ পরমাঈ পাইয়া৷

 থানের মোহর ভাঙি কাজীর পায়ের লাথি দিয়া৷৷’’১৬

কাজীর ষড়যন্ত্রে মলুয়া নায়েবের গৃহে বন্দি হলে নিজের নিষ্ঠা ও সততার জোরে পুনরায় স্বামীর সংসারে ফিরে আসে৷ কিন্তু প্রবল বাধার সৃষ্টি করে সমাজ৷ তাকে অসতী, কলঙ্কিনী বলে বিনোদকে একঘরে করার চেষ্টা করে৷ পতিপরায়ণা মলুয়া সমাজ দ্বারা স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে বহির্বাড়িতে নিজের জায়গা করে নেয়৷ স্বামীকে আবার বিয়ে করিয়ে দাসীর মতো সকলের সেবা করতে থাকে৷ তারপর বিনোদ সর্পদংশিত হলে নিজের জীবন বাজি রেখে মুখ দিয়ে বিষ তুলে স্বামীর জীবন বাঁচায়৷ তবুও তাদের জ্ঞাতিগুষ্টির দল তাকে স্বীকার করে না৷ সমাজকে শিক্ষা দিতে, স্বামীর কলঙ্ক ঘোচাতে সে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়৷ ভরা নদীতে ভাঙা নৌকায় চেপে পাল ছেড়ে দেয়৷ স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে—

 ‘‘গত হইয়া গেছে দিন আরত নাই বাকী৷

 কিসের লাইগ্যা সংসারে কাজ আর বা কেন থাকি৷৷

 আমি নারী থাকতে তোমার কলঙ্ক না যাবে৷

 জ্ঞাতি বন্ধু জনে তোমায় সদাই ঘাটিবে৷৷’’১৭

সমাজকে সে ভালো করেই চিনে গেছে৷ সমাজ যদি একবার নারীর দোষ খুঁজে পায় তাহলে তার চেয়ে উপাদেয় আর কিছুই নেই তার কাছে৷ মলুয়া নৌকাডুবি হয়ে তাই পাতালপুরে চলে যেতে চায় সীতার মতো৷ তাই শেষবারের মতো তার কন্ঠে ধ্বনিত হয়—

 ‘‘ডুবুক ডুবুক নাও আর যা কত দূর৷

 ডুইব্যা দেখি কতদূরে আছে পাতালপুর৷৷’’১৮

মলুয়া জলে ডুবে তার ব্যক্তিসত্তাকে জাহির করে গেছে—শুধু তাই নয় তার সেই মৃত্যু যেন তীব্র প্রতিবাদের সুস্পষ্ট গর্জন৷

বাঙালি সমাজের নানা রীতি-নীতি, নারীর প্রতি পুরুষের লালসা, নানা অন্যায় অত্যাচার, দেহনির্ভর সতীত্ব, প্রেম-ভালোবাসা-প্রতিবাদ কোনো কিছুই বাদ পড়েনি এহ গীতিকায়৷ মহুয়া নদের চান্দকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে অতিথি সৎকারের যে বিবরণ দিয়েছে তার আচার-নিয়মগুলি যেমন চমৎকার তেমনি স্থায়ীত্বের দিক দিয়েও চিরন্তন৷—

 ‘‘আমার বাড়ীত যাইও রে বন্ধু বসতে দিয়াম পিরা৷

 জল পান করিতে দিয়াম সালি ধানের চিরা৷৷

 সালি ধানের চিরা দিয়াম আরও সবরী কলা৷

 ঘরে আছে মইষের দইরে বন্ধু খাইবা তিনো বেলা৷৷’’১৯

বাংলা উপন্যাসের পটভূমি নির্মাণে এই পালাগুলির গুরুত্ব অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য৷ প্রকৃতি পরিবেশ-প্রতিবেশ যা কিছু উঠে এসেছে এই গীতিকায় সবই বাস্তব সমাজ ঘেষা৷ ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও সেই সহজ স্বাভাবিকতা অতিক্রম করেননি কাহিনিকারেরা৷ এখানেও গণিকা চরিত্র বা গণিকা জাতীয় চরিত্র বাদ পড়েনি৷ বারবিলাসিনী নারীরা জীবনের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়ে কুট্টনীবৃত্তির দ্বারা যে জীবন অতিবাহিত করতো তার প্রমাণ রয়েছে মলুয়া পালায়৷ মলুয়াকে প্রলোভিত করার জন্য লম্পট কাজী যে দূতীকে প্রেরণ করেছিল সে আসলে বিগত-যৌবনা এক ভ্রষ্টা রমণী৷ কাহিনিকার তার সম্পর্কে স্পষ্টই বলেছেন—

 ‘‘বয়সেতে বেশ্যামতি কত পতি ধরে৷

 বয়স হারাইয়া অখন বসিয়াছে ঘরে৷৷

 বয়স হারাইয়া তবু স্বভাব না যায়৷

 কুমন্ত্রণা দিয়া কত কামিনী মজায়৷৷

 চুল পাকিয়াছে তার পড়িয়াছে দাঁত৷

 এতেক করিয়া অখন জুটায় পেটের ভাত৷৷’’২০

‘কমলা’ পালায় উপস্থাপিত হয়েছে চিকন গোয়ালিনীর কথা৷ নিম্নশ্রণীর এই নারীও দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত এবং কুট্টনী বৃত্তির দ্বারা অর্থ উপার্জনে পারঙ্গম৷ দুষ্ট নিদান কারকুন কমলাকে পাওয়ার জন্য এই গোয়ালিনীকে পত্রসমেত দূতী হিসেবে প্রেরণ করে৷ তার স্বভাব চরিত্রেও সেই বহুপুরুষগামী দিক তুলে ধরেছেন কাহিনির রচয়িতা৷—

 ‘‘গেরামে আছয়ে এক চিকন গোয়ালিনী৷

 যৌবনে আছিল যেন সবরি-কলা-চিনি৷৷

 বড় রসিক আছিল এক চিকন গোয়ালিনী৷

 এক সের দৈয়েতে দিত তিন সের পানি৷৷

 সদাই আনন্দ মন করে হাসিখুশী৷

 দই-দুধ হইতে সে যে কথা বেচে বেশী৷৷

 যখন আছিল তার নবীন বয়স৷

 নাগর ধরিয়া কত করত রঙ্গরস৷৷

 রসেতে রসিক নারী কামের কামিনী৷

 দেশের লোকেতে ডাকে চিকন গোয়ালিনী৷৷

 যদিও যৌবন গেছে তবু আছে বেশ৷

 বয়সের দোষে মাথার পাকিয়াছে কেশ৷৷

 কোন দন্ত পড়িয়াছে কোন দন্তে পোকা৷

 সোয়ামী মরিয়া গেছে তবু হাতে শাখা৷৷

 চলিতে ঢলিয়া পড়ে রসে থলথল৷

 শুখাইয়া গেছে তার যৌবন-কমল৷৷

 তবু মনে ভাবে যে সে চিকন গোয়ালিনী৷

 বৃদ্ধ বয়সে যেম ভাবের ভামিনী৷৷

 সংসারেতে আছে কত লুচ্চা লোকন্দরা৷

 গোয়ালিনীর বাড়িত গিয়া করে ঘুরাফেরা৷৷’’২১

অন্দর মহলে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ নিয়ে এই শ্রেণীর নিম্নবৃত্তির নারীরা বহু নারীকে গণিকা বৃত্তির পথ নির্দেশ করত৷

‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ লিখিত সাহিত্য হিসেবে বহুদিন সার্বজনীন স্বীকৃতিলাভে বঞ্চিত ছিল৷ পরবর্তী কালে গ্রন্থমধ্যে কাহিনিগুলি সম্পৃক্ত হলে সংস্কার বহির্ভূত বাস্তব অনুসারী দৃষ্টিভঙ্গী সহজেই মানুষের মনোলোক অধিকার করে৷ যে শাস্ত্রীয় অনুশাসন বা দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার চরিত্রগুলির উপর ট্রাজিক পরিণতি ডেকে এনেছে তা সমাজকেন্দ্রিক চিরন্তনতার প্রতীক৷ এর প্রাসঙ্গিক আলোচনা প্রসঙ্গে রত্নদ্যুতি গিরি বলেছেন—‘‘হয়তো গীতিকাগুলির সমাজচিত্রের মধ্যে আংশিকতার অতিপ্রাধান্য সামগ্রিকতাকে তুলে ধরতে পারেনি৷ কিন্তু প্রকৃতি বর্ণনা, রূপবর্ণনা কিংবা চরিত্র চিত্রণে গীতিকাগুলির সর্বাঙ্গে বাস্তব উপদেশ কিংবা তথ্যবিন্যাসের যে প্রাচুর্য আছে আধুনিক উপন্যাসের উপাদান তার মধ্যে প্রচুর পরিমাণেই সংসক্ত হয়ে আছে৷’’২২ আর দীনেশচন্দ্র সেন এর ভূমিকা লিখতে গিয়ে বলেছেন—‘‘এই ভাষার ঐশ্বর্য্যের কথা ছাড়িয়া দিলে, জাতীয় আদর্শ সংস্থাপনে কবিত্বে ও কারুণ্যে, মর্মকথার অভিব্যক্তিতে ও চরিত্রমর্যাদা-রক্ষণে—ঐতিহাসিকতায় ও কল্পনার শোভায়, এই গাথাগুলি বঙ্গসাহিত্যকে এক নব জয়শ্রী পরাইবে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাই৷’’২৩ এই গীতিকবিতার ধারা আধুনিক উপন্যাসের প্রস্তুতি পর্বে অপ্রত্যক্ষভাবে যে ভূমিকা নেয়নি তা নয়; বাংলা উপন্যাসের কর্ষণক্ষেত্রকে বহুপরিমানে উর্বর করে তুলেছিল৷ বাংলা উপন্যাসের জগতে এই মৈমনসিংহ গীতিকার গুরুত্ব তাই কোনো অংশেই কম নয়৷

আবার মুসলিম রোমান্টিক প্রণয় আখ্যানগুলি এর ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট নিয়ে সাহিত্যজগতে অন্য এক ধারার প্রবর্তন করে৷ দৈবানুগ্রহহীন স্বাধীন আঙ্গিকে এটি বাংলা সাহিত্যে নবদিগন্ত খুলে দেয়৷

উপন্যাস সৃষ্টির পূর্বে উপন্যাসের আদি ভূমিটিকে সর্বাধিক স্পর্শ করেছিল মঙ্গলকাব্যগুলি৷ মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, অন্নদামঙ্গল ইত্যাদির কাহিনি, ঘটনা, নানাশ্রেণীর চরিত্র, চরিত্রগুলির ঘাত-প্রতিঘাত, দুঃখ-যন্ত্রণা, প্রতিকূলতা সমস্ত সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে প্রতিফলিত হয়েছে মঙ্গল কাব্যগুলির মধ্যে৷ দৈবানুগ্রাহী হলেও পৌরাণিক দেবতারা সকলেই যেন মাটির মানুষের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে৷ মানুষের ঈর্ষা, শঙ্কা, কলহপরায়ণতা, আত্মসংকট প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যগুলি সেখানে দেবতাদের স্বভাবে প্রবেশ করে মর্ত্যলোক ও স্বর্গলোককে অভিন্ন করে দিয়েছে৷ মঙ্গলকাব্যধারার কবিদের মধ্যে এই বাস্তবতাকে সর্বাপেক্ষা বেশি করে যিনি তুলে ধরতে পেরেছেন তিনি হলেন; কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী, চণ্ডীমঙ্গলের রচয়িতা৷ জন্মসূত্রে মধ্যযুগের হলেও মুকুন্দ চক্রবর্তী মননধর্মীতায় ছিলেন আধুনিক মানুষ৷ তাঁর সৃষ্টিশীল আধুনিক মনস্কতার গুণে তিনি বৈচিত্র্য আনতে সক্ষম হয়েছিলেন মঙ্গলকাব্যের গতানুগতিক কাহিনির মধ্যেও৷ তিনি তাঁর কাব্যে যেখানে যখনই সুযোগ পেয়েছেন জীবনরসের সঞ্চার করেছেন ফলে, চরিত্রগুলি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে৷ সমাজবাস্তবতা, চরিত্রসৃষ্টির নিপুণতা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশীলতা, সুগভীর জীবনপ্রত্যয় ও জীবন রস পরিবেশনের অসামান্য ক্ষমতা মুকুন্দের কাব্যে ও তাঁর লেখনী প্রতিভায় বর্তমান ছিল যা তাকে ঔপন্যাসিকের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে৷

আখ্যানধর্মী রচনায় শিল্পগুণ নির্ভর করে কবির চরিত্রসৃষ্টির দক্ষতায়৷ এক্ষেত্রে তিনি গতানুগতিকতা থেকে বাইরে বেড়িয়ে এসে নতুন ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আরোপ করে চরিত্রগুলিকে শিল্পগুণসম্পন্ন করে তুলেছেন৷ প্রচুর চরিত্রের উপস্থাপন রয়েছে তাঁর ‘নৌতন মঙ্গলে’৷ বৈশিষ্ট্যের নিরিখে চরিত্রগুলিকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে৷ যথা—দেব-দেবীর চরিত্র, মানব-মানবী চরিত্র৷ মানব চরিত্রের মধ্যে স্বভাবজ বৈশিষ্ট্যে সাধারণ মানবগুণ সম্পন্ন চরিত্র এবং ধূর্ত বা খল চরিত্র এই দুইটি শ্রেণী বর্তমান৷ অর্থাৎ সার্বিকভাবে তিন শ্রেণীর চরিত্র দাঁড়াচ্ছে—দেব-দেবী চরিত্র, সাধারণ মানবগুণসম্পন্ন চরিত্র এবং ধূর্ত বা খল চরিত্র৷

দৈবী চরিত্রের মধ্যে প্রধান শিব ও পার্বতী৷ রচনাকারের শৈল্পিক দক্ষতায় তারা তাদের দৈব গুণাবলী ছাপিয়ে সাধারণ মানব-মানবীতে রূপায়িত হয়েছে৷ এছাড়া মেনকা, নারদ ইত্যাদি চরিত্রগুলিও সাধারণতায় মনুষ্যগুণ প্রাপ্ত হয়েছে৷ দেবাদিদেব মহাদেব শিব একদিকে যেমন ত্রিকালদর্শী অন্যদিকে আবার অলস, খাদ্যরসিক, পত্নীপরায়ণ এবং ভিক্ষুক গোত্রীয়৷ শ্বশুরবাড়িতে ঘরজামাই হয়ে থাকা অকর্মণ্য শিব শাশুড়ীর খোটা শুনে গৌরীর সঙ্গে যুক্তি করে শ্বশুরের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে নানা চিন্তা করে ভিক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়—

 ‘‘ভবনে সম্বল নাহি চিন্তিলেন গোসাঞি

 ভিক্ষার উপদেশ কৈল মতি৷

 ত্রিদশের ঈশ্বর ভিক্ষা মাগেন হর

 আরোহণ করি বৃষবরে

 বাজন ডম্বুর শৃঙ্গ শুনিয়া বাড়য়ে রঙ্গ

 নগরিয়া জোগান ধরে৷’’২৪

মহাদেব কোঁচপাড়ায় ভিক্ষা কার্য করে প্রচুর ভিক্ষান্ন প্রাপ্ত হয়ে সোৎসাহে তা গৃহিণীর নিকট অর্পণ করে৷ কিন্তু অলস প্রকৃতির শিব দ্বিতীয় দিন আর ভিক্ষায় বের হতে চায় না৷ শিব এখানে সেই শ্রেণীর মানুষের মতো যারা কোনোভাবেই পরিশ্রম করতে চায় না এবং একদিন যদি একটু পরিশ্রম করে দ্বিতীয়দিন আর কাজমুখো হয় না৷ তাই গৃহিণীকে বলে—

 ‘‘কালি দুঃখ পাইআ ফিরিলাঙ নানা ধাম

 আজি সকালে ভোজন করিয়া থাকিব বিশ্রাম৷’’২৫

ভোজন করার জন্য মহাদেব স্ত্রীকে যে সমস্ত ব্যঞ্জনাদি রন্ধনের উপদেশ দিয়েছে তাতে খাদ্যরসিক ব্যক্তি হিসেবে তার পরিচয় মেলে৷—

 ‘‘আজি গণেশের মা রান্ধিবে মোর মত

 নিমে শিমে বাগ্যনে রান্ধিআ দিবে তিত৷

 সুকুতা শীতের কালে বড়ই মধুর

 কুমুড়া বাগ্যন দিআ রান্ধিবে প্রচুর৷

 নটিআ কাঁঠাল বিচি সারি গোটা দশ

 ফুলবড়ি দিহ তায় আর আদারস৷’’২৬

সংসারের অভাব-অনটন, উপার্জনের জন্য স্ত্রী গৌরীর পীড়াদায়ক কথা অকর্মণ্য শিবের মনে বৈরাগ্য নিয়ে আসে৷ সেই বারোভূতের সংসারে সে আর থাকতে চায় না৷ তাই গনেশের মাকে বলে—

 ‘আমি ছাড়িব ঘর জাইব দেশান্তর

 কি মোর ঘরকরণে

 হইয়া সতন্তর তুমি করহ ঘর

 লইআ গুহ গজাননে৷

 কতেক ঘরে আনি লেখা নাঞি জানি

 ডেড়ি অন্ন নাহি থাকে

 কতেক ইন্দুর করয়ে দুবদুর

 গনারি মূষার পাকে৷’

পার্বতী একদিকে দেবী অন্যদিকে পিতৃ-মাতৃ স্নেহ কাঙাল কন্যা৷ দীর্ঘদিন স্বামীর সংসারে থেকে মর্ত্য মানবীর মতো মায়ের হাতের রান্না অন্ন-ব্যঞ্জন খাবার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে৷ তাই দেবী সাধারণ গৃহবধূর মতো স্বামীর পায়ে ধরে পিতৃগৃহে যাওয়ার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করছে—

 ‘‘চরণে ধরিয়া সাধি কৃপা কর কৃপানিধি

 জাব পঞ্চ দিবসের তরে

 চিরদিন আছে আশ জাইব বাপার পাশ

 নিবেদন নাঞি করি ডরে৷

 সুমঙ্গল-সূত্র করে আইলাঙ তোমার ঘরে

 পূর্ণ হইল বৎসর সাত

 দূর কর বিবাদ পুরহ আমার সাধ

 মাএর রন্ধনে খাব ভাত৷’’২৭

ত্রিকালদর্শী মহাদেব ভবিষ্যৎ অমঙ্গলের কথা অনুমান করে স্ত্রীকে যেতে বাধা দিলে স্বামীর উপর ক্ষোভে ফেটে পড়ে সে৷ রাগ করে নিজেই পিতৃগৃহের পথ ধরে—

 ‘‘জাইবারে অনুমতি নাহি দিলা পশুপতি

 দাক্ষায়ণী হইলা কোপমতি

 সভারে হইআ বামা চলিলা ভ্রূকুটী ভীমা

 একাকিনী বাপের বসতি৷’’২৮

বাপের বাড়িতে পিতার আয়োজিত মহাযজ্ঞে স্বামীকে নিমন্ত্রণ না করার জন্য পিতাকে অনুযোগ করলে পিতৃমুখে উচ্চারিত হয় তার স্বামীর উদ্দেশে প্রবল নিন্দা৷ মর্ত্যপৃথিবীর বিবাহিতা কন্যার মতো সে অপমান সহ্য করতে পারে না পতিব্রতা সতী৷ তাই পিতাকে বলে যে তার মুখে অমন নির্মম অপবাদ ধ্বনিত হয়েছে আর তার ঔরসজাত বলে নিজের দেহকেই আর জীবিত রাখবে না৷—

 ‘‘শিবনিন্দা শ্রবণে করিব প্রতিকার

 তোমার অঙ্গজ তনু না রাখিব আর৷’’২৯

তাই পিতার সামনে আত্মহত্যা করে স্বামী নিন্দার শোধ নেয়৷

এরপর উমার সংসারে দেখা যায় উমার সাংসারিক জীবনের আরেক রূপ৷ অলস, অকর্মণ্য, নেশাখোর, দরিদ্র স্বামীর গৃহিণী সে৷ দারিদ্র্যের সঙ্গে যুঝতে না পেরে বহুদিন স্বামী-সন্তানসহ পিত্রালয়ে অবস্থান করে৷ সেখানে মায়ের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় মুখরা মেয়ের মত ঝগড়া করে স্বামীর সঙ্গে বাপের বাড়ি ত্যাগ করে আবার দুরন্ত অভাব অনলে ঝাঁপ দেয়৷ তার মা মেনকা বাপের ঘারে বসে বসে খাওয়ার খোটা দিলে সে বলে—

 ‘‘রাঁধ্যা বাড়িয়া মাতা কত দেহ খোঁটা

 আজি হইতে তোমার দ্বারে দিল কাঁটা৷

 মৈনাক তনয় লইয়া সুখে কর ঘর

 কত না সহিব খোঁটা জাই অন্যত্তর৷’’৩০

সংসার প্রতিপালনের জন্য শিব ভিক্ষা করতে বাধ্য হলে হাসিমুখে সেই ভিক্ষান্ন গ্রহণ করে রেঁধে-বেড়ে স্বামী পুত্রকে খাওয়ায়, কার্তিক গনেশ খাবার নিয়ে ঝগড়া করলে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে বুঝিয়ে শান্ত করে দুই ভাইকে খাবার ভাগ করে দেয়৷ স্বামী একদিন কাজ করে দ্বিতীয় দিন যখন আর কাজে না গিয়ে ভালোমন্দ খেয়ে বিশ্রাম নিতে চায় তখন কৃতাঞ্জলী পুটে গৌরী তাকে হাড়ির হাল জানিয়ে বলে পুরোনো ধার-দেনা শোধ করতেই তার অতিরিক্ত অন্ন শেষ হয়ে গেছে৷ তাই—

 ‘‘আজিকার মত যদি বান্ধা দেহ শূল

 তবে সে আনিতে নাথ পারি হে তন্ডুল৷’’৩১

অর্থাৎ শূল বাঁধা দিয়ে তাকে চাল আনতে বলে৷ নিজের ভাগ্য নিয়ে আক্ষেপ করতেও দেখা যায় সাধারণ ভাগ্যবিড়ম্বিত গৃহবধূদের মতো—

 ‘‘কি জানি তপের ফলে হর মেল্যাছে বর

 সই সাঙ্গাতিন নাঞি আইসে দেখিআ দিগম্বর৷

 বাপের সাপ পোএর মউর সদাই করে কলি

 গনার মূষা ঝুলি কাটে আমি খাই গালি৷

 বাগ বলদে সদাই দ্বন্দ্ব নিবারিব কত

 অভাগি গৌরীর কপালে দারুণ দৈবে হত৷’’৩২

মেনকাচরিত্রটি সামান্য একঝলক উপস্থিতিতেই অসামান্য হয়ে উঠেছে৷ সেও দৈবী বাতাবরণ কাটিয়ে সাধারণ মানবী৷ মেয়ে, স্বামী, দুই পুত্র, তাদের নিজেদের বাহনগুলিকে নিয়ে বাপের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্ত মনে প্রতিবেশী সখিদের সঙ্গে পাশা খেলে দিন গুজরান করে৷ ফলে বিশাল সংসারের সমস্ত দৈনন্দিন কর্মভার মেনকাকে একাই করতে হয়৷ হাতে হাতে সাহায্য না করে, সমস্ত সংসারের দায়কে উদাসীন উপেক্ষায় অবহেলা করে চললে মায়ের তা সহ্য হয় না৷ পরিণামে মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে সে৷—

 ‘‘তোমায় ঝি হইতে মোর মজিল গার‍্যাল

 ঘরে জাওঙাঞি রাখিআ পুষিব কতকাল৷

 প্রভাতে ভাতেরে কান্দে কার্তিক গণাই

 চারি কড়ার সম্ভাবনা তোমার ঘরে নাঞি৷

 মিথ্যা কাজে ফিরে পতি নাঞি চাষবাস

 ভাত কাপড় কত না জোগাব বার মাস৷’’৩৩

আবার পার্বতীর আরেক রূপ দেবী চণ্ডীও ছলনায়, কপটতায়, ভক্তবাৎসল্যে, অলৌকিকতায় পরিপূর্ণা৷ স্বার্থসিদ্ধির জন্য ছলনার আশ্রয় নিয়ে শিবকে দিয়ে নীলাম্বরকে অভিশাপ দেওয়াতে বাধ্য করেছে, লঘুদোষে গুরুদণ্ড দিয়েছে রত্নমালা ও মালাধরকে, কালকেতুকে রাজা করার জন্য কলিঙ্গ রাজ্য প্লাবিত করে অসহায় প্রজাদের শাস্তি দিয়েছে, ভক্তের জন্য যুদ্ধও করেছে৷

অর্থাৎ পার্বতীর তিনটি স্তরে প্রথমটিতে গিরিরাজের কন্যা রূপে শিবকে পাওয়ার অদম্য জেদ, দ্বিতীয় স্তরে শিবের গৃহিণী পার্বতী রূপে মধ্যবিত্ত বাঙালি চরিত্রের মতো প্রেমে-কলহে-ঘরকন্নায় সাধারণত্ব অর্জন করেছে৷ তৃতীয় স্তরে চণ্ডীরূপে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ছলনায়-স্বার্থপরতায় নানা শঠ চক্রান্তে সর্বোপরি ভক্তজনের মঙ্গলাকাঙ্খায় দেবীধর্ম ও মনুষ্যধর্ম একাকার হয়ে গেছে৷

মানব চরিত্র নির্মাণে মুকুন্দ যেন মনের সবটুকুকে উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন৷ তাঁর বেশিরভাগ চরিত্রগুলি দ্বন্দ্ব-মুখর হয়ে উঠেছে পারিপার্শ্বিকতার কারণে৷ কালকেতু চরিত্রটি আদিম শিকারজীবী৷ তার শারীরিক আকৃতি, বন্যপ্রকৃতি, শক্তি ও সাহসিকতা, শয়ন, ভোজন ইত্যাদি বর্ণনায় আদিম রূপটিকেই তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন৷ কালকেতুর ভোজন-শয়ন সম্পর্কে তাই রচনাকার তুলে ধরেছেন—

 ‘‘মুচুড়িয়া গোফ দুটা বাঁন্ধে নিঞা ঘাড়ে

 এক শ্বাসে তিন হাণ্ডি আমানী উজাড়ে৷

 চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ-জাউ

 সুপ ছয় হাঁড়ি তায় মিসাইয়া লাউ৷

 … … …

 শয়ন কুচ্ছিত বীরের ভোজন বিটকাল

 ছোট গ্রাস তোলে বীর জেন হাড়িয়া তাল৷

 ভোজনসময়ে গলা করে ঘড়ঘড়

 কাপড় ঊষাষ করে জেন মরাই-বড়৷’’৩৪

কালকেতু যেমন বীর বিক্রমে বনের পশুদের সঙ্গে লড়াই করে, তাদের হত্যা করে বন উজাড় করে দিতে পারে তেমনি তার চরিত্রের মধ্যে বিবেচনা বোধটিকেও একেবারে বাদ দেননি রচনাকার৷ সেই বিবেচনাবোধে ফুল্লরার বাক্যবাণে পীড়িত হয়ে গৃহে এসে ষোড়শী কন্যাকে দেখে তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি ফেরাতে চেষ্টা করে৷ ঈষৎ কোপিত হয়েও করজোড়ে তাকে অনুরোধ করে—

‘‘মাতা ছাড় এই স্থান মাতা ছাড় এই স্থান

আগুনি সে রক্ষা করি আপনার মান৷

একাকিনী যুবতি ছাড়িলে নিজ ঘর

উচিত বলিতে কেনি না দেহ উত্তর৷

বড়ার বহুআরী তুমি বড় লোকের ঝি

তোমার মোহন রূপে মোর লাভ কি৷’’৩৫

দেবী চণ্ডীর কৃপায় কালকেতু দেবীর হাতের আংটি সহ সাত ঘড়া ধন পায়৷ দুই দুই চার ঘড়া দুবারে গৃহে রেখে এসে বাকি তিন ঘড়ার দুঘড়া কাধের দুদিকে নিলেও এক ঘড়া অবশিষ্ট থেকে যায়৷ তখন দেবীকে অনুরোধ করে এক ঘড়া তার কাখে করে ঘরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য৷ পরে আবার এসে একঘড়া নেওয়ার মতো ধৈর্য তার নেই৷ দরিদ্রের চেয়েও দরিদ্র সে৷ পশুশিকার করে সেই মাংস বিক্রি করে স্বামী-স্ত্রীর দুজনের পরিশ্রমের দ্বারা কোনোমতে সংসার চলে৷ সেই গরিব মানুষ হঠাৎ করে বিপুল ধন পেয়েছে৷ কার ভরসাতে একঘড়া ধন রেখে যাবে মাঝ-বনের মধ্যে! আবার দেবী তাকে ধন দিলেও দেবীকে ভরসা পায় না সে৷ কলসি কাখে সেই ধন নিয়ে দেবী তার পিছু পিছু পথ চললেও কালকেতুর মনে হয় দেবী যদি সেই ধন নিয়ে পিছন থেকে পালিয়ে যায়—

 ‘‘আগে আগে মহারীর করিল গমন

 পশ্চাত পার্বতী জান লইআ তার ধন৷

 মনে মনে মহাবীর করেন জুগতি

 ধন-ঘড়া লইআ পাছে পালায় পার্বতী৷’’৩৬

এই যে ধনদাতাকে ধন চুরি করতে পারে বলে সন্দেহ করা—তার মধ্যে কিছুটা হলেও কালুর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন৷ উপন্যাসে চরিত্র নির্মাণের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব৷ যা অল্প হলেও কালকেতুর চরিত্রে ফুটে উঠেছে৷

ফুল্লরা চরিত্রটিও সাধারণ পতিব্রতা রমণীর মতো নানা গুণপনায় উজ্জ্বল৷ সে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ির পরিচর্যা করে হাটে গিয়ে মাংস বিক্রি করে আবার সমস্ত গৃহকর্মও একাহাতে নিয়ন্ত্রণ করে৷ বেশ সুখেই কাল কাটছিল তার৷ কিন্তু হঠাৎই তার গৃহে ছদ্মবেশী ষোড়শী পার্বতীকে দেখে তাকে সতিন ভেবে সংসারে নিজের স্থানটি হারাবার ভয়ে আকুল হয়ে উঠে৷ প্রগলভা নারীর মতো সংসারের বারোমাসের দৈন্যকে তুলে ধরে, পুরাণের নানা কথা বলে, নানা নীতি উপদেশ দিয়ে বিদায় করার চেষ্টা করে৷ ছদ্মবেশিনী সেই নারীর মুখে স্বামীর অবহেলা সতিনের জ্বালা ইত্যাদি নানাবিধ কথা শুনে ফুল্লরা তাকে বোঝায়—

 ‘‘স্বামী বনিতার পতি স্বামী বনিতার গতি

 স্বামী বনিতার বিধাতা

 স্বামী পরম ধন বিনে স্বামী অন্যজন

 কেহ নহে সুখ মোক্ষ দাতা৷’’৩৭

সতিন সম্পর্কে বলে—

 ‘‘সতিনি কন্দল করে দুগুণ বলিবে তারে

 অভিমানে ঘর ছাড় কেনি

 কোপে কইলে বিষ পান আপনি তেজিবে প্রাণ

 সতিনির কি হইবে হানি৷’’৩৮

আর কোনো চেষ্টাতেই যখন সেই রূপবতী কন্যাকে গৃহ থেকে বিদায় করতে পারে না তখন সমস্ত ক্ষোভ উগড়ে দেয় গোলাহাটে মাংস বিক্রয়রত স্বামীর কাছে গিয়ে—

 ‘‘পিপিড়ায় পাক উঠে মরিবার তরে

 কাহার সোলস্যা কন্যা আনিআছ ঘরে৷

 এতদিনে মহাবীর পাপে গেল মন

 আজি হইতে হইলে তুমি লঙ্কর রাবণ৷’’৩৯

অর্থাৎ নারী সংসারে যতই মঙ্গলময়ী রূপে অবস্থান করুক না কেন নিজের সেই একমাত্র অবস্থানস্থল স্বামী এবং তার কাছে নিজের মর্যাদা টলে উঠলে তারা যে কতটা অস্থির হয়ে উঠে তা ফুল্লরার স্বভাবজ বৈশিষ্টর মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে৷ ফুল্লরার নারীজনোচিত স্বাভাবিক কোমল মনের চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে দেবীর মহিষমর্দিনী রূপ দর্শন করে মূর্ছা প্রাপ্ত হওয়ার মধ্যে৷ গৃহে এবং বাইরের পরিবেশে বিচরণশীল নারীরা তুলনামুলকভাবে বেশি সাহসী হয়৷ ফুল্লরা শেষ পর্যন্ত সাহস ধরে রাখতে পারেনি৷ মূর্ছিত হয়ে সে মাটিতে পড়ে যায়৷ তার পর দেবী তাদের মূর্ছাভঙ্গ করিয়ে দুঃখ বিমোচনের জন্য অঙ্গুরীয় প্রদান করলে অতিসাধারণ সংসার অভিজ্ঞ রমণীর মতো তা স্বামীকে নিতে নিষেধ করে৷ কারণ সামান্য একটা অঙ্গুরী প্রদান করে দেবী তাদের ধন দানের গর্ব জাহির করে যাবে তা সে মানতে পারে না৷ এ যেন ‘ছুঁচো মেরে হাত গন্ধ করা’ প্রবাদ বাক্যের সামিল সেই ব্যাধ রমণীর কাছে৷—

 ‘‘বীর হস্তে দেন চণ্ডী মানিক-অঙ্গুরি

 লইতে নিষেধ করে ফুল্লরা সুন্দরী৷

 একটী অঙ্গুরি হইতে হব কোন কাম

 সারিতে নারিবে প্রভু ধনের দুর্নাম৷’’৪০

দেবী সেই মানিক-অঙ্গুরীয়ের প্রকৃত মূল্য যে সাতকোটি টাকা তা যখন বলে তখন—

 ‘ফুল্লরা শুনিঞা মূল্য মুখ কৈল বাঁকা৷’৪১

অর্থাৎ দেবীর সেই বাক্য ফুল্লরার মনঃপূত হয় না৷ নারী চরিত্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যে মুখ বাঁকা করে সেই নেতিবাচক উপলব্ধিকে ব্যক্ত করে৷

কলিঙ্গরাজের সঙ্গে দ্বিতীয়বার যুদ্ধে অত্যন্ত সাধারণ রমণীর মতো সে কালুকে ঘরে ধানের ঘড়ার পিছনে লুকোতে বলে৷ ভাড়ুদত্ত প্রহরীদের সঙ্গে মিলে কথার প্যাঁচে কালুকে রক্ষা করার মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে ধানের ঘড়ার পিছনে লুকিয়ে থাকা কালুর সন্ধান জানতে চায় তখন সরল চিত্তে সেই স্বামীচিন্তায় অধীর রমণী—

 ‘‘ঠকের মধুর বাণী একচিত্তে রামা শুনি

 ধানঘরা কৈল বিলোকন’’৪২

আর তক্ষুণি কোটাল কালকেতুর বাড়ি ঘিরে ফেলে খণ্ডযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে তাকে বন্দি করে৷ স্বামীকে কোটালের হাতে বন্দি হতে দেখে তার আশঙ্কিত নারীমন কিছুতেই স্থির থাকতে পারে না৷ কোটালকে আর্ত হাহাকারে অনুরোধ করে—

 ‘‘না মার না মার বীরে নিদআ কোটাল

 গলার ছিঁড়িআ দিমু সতেশ্বরি হার৷

 চুরি নাহি করি কোটাল ডাকা নাহি দি

 ধন দিআ গেলা দূর্গা হেমন্তের ঝি৷’’৪৩

ফুল্লরার কাছে স্বামী মুক্তির জন্য ধনসম্পদ কিছুই নয়৷ তাই নিরাপদ দারিদ্র্য যন্ত্রণাক্লিষ্ট ব্যাধজীবনই বেশি ভালো মনে হয়৷ সে কোটালকে সবকিছু নিয়ে শুধু মাত্র তীর-ধনুক সঙ্গে দিয়ে ছেড়ে দিতে বলে—

 ‘‘গো-মহিষ লহ মোর অমূল্য ভাণ্ডার

 নফর করিআ রাখ স্বামী আমার৷

 দিআ কুলিতার ধনূ তিন গোটা বাণ

 ধন লৈয়া তুমি মোর কর পরিত্রাণ৷’’৪৪

প্রসঙ্গত বলা যায় যে কালকেতুরও ধনপ্রাপ্তির পর নগর বসাতে গিয়ে বীতরাগ চলে এসেছিল৷ তারও মনে হয়েছিল বর্তমান দায়-দায়িত্ব থেকে পূর্বেকার ব্যাধ জীবন অনেক সহজ এবং নিরাপদ৷ কলিঙ্গ রাজের কারাগারে বন্দি অবস্থায় সে তাই আক্ষেপ করে—

 ‘‘তোর বাক্য নাঞি ধরি চণ্ডিকার অঙ্গুরি

 আমি লইনু আপন মাথা খায়্যা

… … …

 মাঁস বেচ্যা ছিনু ভাল এবে সে পরাণ গেল

 বিবাদ সাধিল কাত্যায়নী৷

 কুলিতার ধনুখান তিন গোটা ছিল বাণ

 আছিলাম আপনার দম্ভে

 কেবা চাহে সম্পদ ধন দিআ কৈলে বধ

 ভগবতী আমারে বিড়ম্বে৷’’৪৫

অর্থাৎ জীবনভর শিকার জীবনে অভ্যস্ত দুই নর-নারী দৈব বলে হঠাৎ করে প্রচুর ধন-সম্পদের ফলে রাজা হয়ে নাগরিক জীবনে নিজেদের মেলাতে পারে না৷ তাদের দুটি ভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে চলার যে সংকট ও মানসিক দ্বন্দ্ব তা রচনাকার এই খেদ-আক্ষেপের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন৷

বণিক খণ্ডের লহনা ও খুল্লনা সাধারণ নারী জীবনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থাপিত৷ এই অংশের নায়িকা খুল্লনা হলেও মানসিক যন্ত্রণায় দ্বন্দ্বমুখর হয়েছে লহনা৷ চোখের সামনে বন্ধ্যাত্বের ধুয়া তুলে স্বামী সতিন করে এনেছে নিজের খুড়তুতো বোনকে৷ নিজের বিগতযৌবন অন্যদিকে সপত্নীর ঢলঢলে তরতাজা রূপ তাকে পীড়িত করেছে৷ তার মনে স্বামী প্রেম হারানোর আশঙ্কা দানা বেধেছে৷ তার সেই আশঙ্কার মূলে দিনের পর দিন জল সিঞ্চন করে গেছে দাসী দুবলা৷ সে তার মনের যন্ত্রণা প্রকাশ করে বশীকরণ বিদ্যায় পারদর্শী লীলাবতীকে ডেকে বলেছে—

 ‘‘জিজ্ঞাস কি আর কুশল বিচার

 কহিতে বিদরে বুক

 ঘরে নাহী পতি সতার উন্নতি

 দুখের উপরে দুখ৷’’৪৬

তারপর লীলাবতীর দ্বারা সাধু ধনপতির নাম করে জাল পত্র লিখে সমস্ত গৃহসুখ বঞ্চিত করে সতিনকে বনে ছাগল চরিয়ে উদরপূরণের শর্তে নিক্ষেপ করে৷ তার এই হিংস্র রূপটি দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক৷ আবার দৈব কৃপায় যখন খুল্লনা সমস্ত অবগত হয়ে গৃহে ফিরে সাধুকে সমস্ত জানাতে সংকল্প করে তখন দেখা যায় অত্যন্ত তোষামোদে তার পরিচর্যা করছে লহনা৷ কারণ সে জানে তার সেই অন্যায় ধনপতির কর্ণগোচর হলে তার আর রক্ষা থাকবে না৷ আর এর মধ্য দিয়েই চরিত্রটি অনন্যতা লাভ করেছে৷

ঔপন্যাসিক তাঁর উপন্যাসে জীবনের সংগতি-অসংগতির নানা দিক তুলে ধরে বা কৌতুকরসের অভিসিঞ্চনে সাহিত্য রূপটিকে জীবন্ত করে তোলেন৷ চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে মুকুন্দ মুরারি শীল, ভাড়ুদত্ত, দুবলা ইত্যাদি খল চরিত্রগুলির মধ্য দিয়ে সেই দিকটিকে সুস্পষ্ট করেছেন৷ তাদের মতো কপট, সুবিধাবাদী, প্রবঞ্চক, পরশ্রীকাতর, ছিদ্রান্বেষী চরিত্রগুলি না থাকলে কাব্যখানির সার্থকতা অনেকাংশে ব্যহত হত৷ তাঁর কাব্যের সবচেয়ে জীবন্ত চরিত্র ভাড়ুদত্ত৷ এর মতো ধূর্ত পাষণ্ড চরিত্র মুকুন্দের আগে একজনও রচনা করতে পারেননি বোধ হয়৷ ভাড়ুদত্ত হরিদত্তের পুত্র এবং জয়দত্তের নাতি৷ লোক ঠকানোর জন্যই যেন তার জন্ম৷ তার ধূর্ততা তুলনারহিত৷ কালকেতুর দরবারে হাজির হয়েই বাক্যজাল তৈরি করে খুড়া সম্পর্ক পাতিয়ে নিজেকে স্বতন্ত্রভাবে পরিচায়িত করে৷ কপালে চন্দনের ফোটা, ছেঁড়া ধূতির লম্বা কোঁচা, কানে কলম গোঁজা ভাড়ু বলে—

 ‘‘খুড়া আইলাঙ প্রতিআসে বসিতে তোমার দেশে

 আগেতে ডাকিবে ভাঁড়ুদত্তে

 জতেক কায়েস্ত দেখ ভাঁড়ুর পশ্চাতে লিখ

 কুলে শীলে বিচারে মহত্ত্বে৷’’৪৭

তার গোছানোর মিথ্যা কথাকে সত্য মনে করে কালকেতু তাকে মান্যগণ্য ব্যক্তি ভেবে আদর-সমাদর করে৷ সে কালকেতুর রাজ্যে স্বঘোষিত মহামণ্ডল সেজে হাটে গিয়ে কালকেতুর নাম করে দোকানিদের কাছ থেকে তোলা আদায় করতে থাকে৷—

 ‘‘পসার লুটিআ ভাঁড়ু ভরয়ে চুপড়ি

 জত দ্রব্য লয় ভাঁড়ু নাঞি দেয় কড়ি৷

 লণ্ডে ভণ্ডে দেয় গালি বলে শালামালা

 আমি মহামণ্ডল আমার আগে তোলা৷’’৪৮

তার অত্যাচারে অতিষ্ট হাটুয়ারা কালকেতুর কাছে নালিশ করলে সে যখন ভাঁড়ুকে কৃতকর্মের জন্য অপমান করে তখন ভাঁড়ুর প্রতিহিংসাপরায়ণ রূপটি স্পষ্টভাবে পাঠকের দৃষ্টিগোচর হয়৷ সে প্রতিজ্ঞা করে—

 ‘‘হরি দত্তের বেটা হঙ জয় দত্তের নাতি

 হাটে বদি বেচাঙ বীরের ঘোড়া হাথি৷

 তবে সুবাসিত করঙ গুজরাট ধরা

 পুনুর্বার হাটে মাস বেচাঙ ফুল্লরা৷’’৪৯

আর সেই প্রতিজ্ঞাপূরণ করতে কাঁচকলা, পুইশাক, কলার মোচা ভেট নিয়ে উপস্থিত হয় কলিঙ্গরাজের দরবারে৷ রাজাকে খোঁচা দিয়ে তার ব্যক্তিত্বকে আলোড়িত করতে বলে—

 ‘‘দিন গোঙায় মিছা কার্যে মন নাহি দেহ রাজ্যে

 চোর খণ্ড না কর বিচার৷’’৫০

তার এই বাক্যে রাজা সচকিত হলে সে ধীরে ধীরে রসিয়ে রসিয়ে ব্যাধ থেকে কালকেতুর রাজ্যস্থাপনের কথা বলে—আর তার ধনপ্রাপ্তিকে অসৎপন্থার ফল হিসেবে ইঙ্গিত দান করে৷ তার কথায় ক্রুদ্ধ রাজা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কালকেতুকে আক্রমন করে চরমভাবে পরাজিত হয়৷ ভাঁড়ুর কোনো লাভ হয় না তাতে৷ রাজাকে খোঁচা দিয়ে যেভাবে দিক ভ্রান্ত করে দিয়েছিল একইভাবে কোটালের পৌরুষকে বিদ্ধ করে পুনরায় যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করার চেষ্টা করে৷ কারণ ভাঁড়ুর মতো খলচরিত্র ভালো করেই জানে যে কোনোভাবে মানুষের যদি আঁতে ঘা দেওয়া যায় তাহলে তার ফল সম্পূর্ণভাবে ইতিবাচক হবে৷ তাই কোটালের আঁতে ঘা দিয়ে বলে—

 ‘‘গায়ের গরবে ডাক বিক্রমে সমসর

 বড়াঞি করিলি তুঞি রাজার গোচর৷

 সেনাপতি সামন্ত সভার বিদ্যমান

 বীর ধরিবারে বেটা আগে নিলি পান৷’’৫১

আর ভাঁড়ুর সেই কথায়—

 ‘‘কোটালে ভাঁড়ুর বোলে লাগিল ভেলকী৷

 তরাসে কোটাল পুনু গুজরাট বেড়ি

 রহ রহ বলিআ দামায় পড়ে বাড়ি৷’’৫২

দ্বিতীয়বার কোটালকে আক্রমন করতে দেখে ফুল্লরার নারী হৃদয় বড় এক বিপর্যয়ের কল্পনা করে স্বামীকে ধানের ঘরে লুকিয়ে রাখে৷ ভাঁড়ু দত্ত কালুর সন্ধান না পেয়ে কপট সহানুভূতি দেখিয়ে কালুকে রক্ষা করার নাম নিয়ে তার সন্ধান আদায় করে নেয়৷ পরিণামে বন্দি হয় কালকেতু বীর৷ দেবীর সহায়তায় দোষমুক্ত কালকেতু মহাসম্মানে পুনরায় যখন রাজ্যে ফিরে আসে ভাঁড়ু সঙ্গে সঙ্গেই একশআশি ডিগ্রি ঘুরে যায়৷ তার শঠতা দিয়ে কালুকে বোঝায় যে সে ধানের গোলা থেকে তাকে ধরিয়ে দিয়েছিল বলেই কালকেতু অত সম্মান পেয়েছে৷ কালুর সেই সম্মানের সম্পূর্ণ কৃতিত্ব নিজ স্কন্ধে গ্রহণ করে সে বলে—

 ‘‘আছিলে গোপত বেশে প্রকাশ করাইলা দেশে

 সম্ভাষ করাইল নৃপমণি

 নিজ হস্তে নরপতি ধরিল ধবল ছাতি

 ভুঞা রাজার মধ্যে তোমা গণি৷

 কোথা বীর পাইলা ধন ঘুসিত সকল জন

 পরিবাদ ছিল লোক মাঝে

 প্রকাশ করাইল আমি বড় সুখ পাইবে তুমি

 খ্যাত হইব কলিঙ্গ-সমাজে৷

 জখন দুপর নিশা করি রাজা সম্ভাষা

 আনেক বুঝাইনু নরপতি

 ধরিআ রাজার পায় খণ্ডিল সকল দায়

 খুড়ি জানেন আমার প্রকৃতি৷’’৫৩

কিন্তু এবার ভাঁড়ু বীরের মন গলাতে পারে না৷ তাকে মাথা মুড়িয়ে, গালে চুনকালি মাখিয়ে, ঘোল ঢেলে গ্রাম থেকে বিদায় করে দেয়৷ শেষপর্যন্ত অবশ্য এই শঠতার শাঠ্যের জন্য চরম অপমান ভোগ করেও কালকেতুর দয়ায় পুনর্বার গুজরাট নগরে ঠাঁই পায়৷

মুরারি শীলও ঠক চরিত্র৷ কবি তার সম্পর্কে ‘দুঃশীল’ বিশেষণ প্রয়োগ করেছেন—

 ‘‘বান্যা বড় দুঃশীল নাম মুরারি শীল

 লেখা-জোখা করে টাকা-কড়ি’’৫৪

দেবীর দেওয়া আংটি বিক্রির জন্য কালকেতু তার বাড়িতে উপস্থিত হয়ে হাক দিতেই সে লুকিয়ে পড়ে৷ কারণ কালকেতুর কাছে ‘ডেড় বুড়ি’ কড়ি বাকি আছে তার৷ সে ভেবেছে কালকেতু মাংসের সেই ‘ডেড় বুড়ি’ কড়ি আদায়ের জন্য এসেছে৷ মুরারি সেই ধরনের চরিত্র যে কৃপণতার জন্য কালকেতুর মতো দরিদ্র ব্যাধেরও বকেয়া পরিশোধ করে না৷ বরং অর্থপ্রাপককে দেখলে গা ঢাকা দেয়৷ মনুষ্য জীবনে এ ধরনের চরিত্র কোনো যুগেই অপ্রাপ্ত নয়৷ মুরারি নিজে আত্মগোপন করে স্ত্রীর দ্বারা কালকেতুকে জানায় যে সে বাড়িতে উপস্থিত নেই৷ কিছুক্ষণ পরেই যখন আংটি বিক্রির প্রসঙ্গ ঘর থেকে শোনে এবং তার উপযুক্ত সহধর্মিনী যখন বুঝতে পারে সে আংটি মূল্যবান তখন—

 ‘‘ধনের পাইআ আশ জাইতে বীরের পাশ

 ধায় বান্যা খড়কির পথে’’৫৫

 দ্রুত ভিন্ন পথে কালুর সামনে উপস্থিত হয়ে আংটি হাতে নেয় এবং তা যে আসল রত্ন তা বুঝেও সরল ব্যাধকে ঠকিয়ে লাভবান হওয়ার জন্য মাংসের বকেয়া সমেত অষ্টপণ কড়ি মূল্য হাকে৷ সেই অর্থও নগদে দিতে মন সরে না তার৷ তাই ব্যাধনন্দনকে বলে—

 ‘‘একুনে হইল অষ্ট পণ আড়াই বুড়ি

 চালু ডালি কিছু লহ কিছু লহ কড়ি৷’’৫৬

কালকেতু পূর্বেই দেবীর কাছে শুনে নিয়েছে সেই আংটির সাতকোটি মূল্যের কথা৷ তাই ন্যায্য মূল্য না পেয়ে সে অন্য বণিকের কাছে যেতে চাইলে মুরারি মূল্যবান আংটিটিকে হারাতে চায় না৷ তাকে তার পিতার সঙ্গে অতীত সম্পর্কের কথা বলে ধরে রাখতে চায়—

 ‘‘বান্যা বলে দরে বাড়া হইল পঞ্চবট

 মোর সনে সদা করি না পাবে কপট৷

 ধর্মকেতু ভায়্যা সনে কইনু লেনা দেনা

 তাহা হইতে ভাইপো হইআছ অধিক সেয়ানা৷’’৫৭

যদিও শেষ পর্যন্ত দৈববাণী শুনে সাতকোটি মূল্য দিতেই বাধ্য হয় সে৷ আবার তার সেই কম মূল্য বলাকে পরিহাস বলে চালিয়ে দিয়ে নিজের ‘ইমেজ’টিকেও ধরে রাখে৷

মুরারি শীল যেমন সেয়ানা ব্যবসায়ী ,তার স্ত্রীও তেমনি যথার্থ সহধর্মিনী৷ কালকেতুর বকেয়া শোধ না দেওয়ার জন্য সেও অনায়াসে স্বামীর অনুসরণ করে মিথ্যে কথা বলে—

 ‘‘সকালে তোমার খুড়া গেছেন খাতকপাড়া

 কালি দিব মাংসের ধার৷’’৫৮

শুধু তাই নয় অত্যন্ত মিষ্টভাষে পরদিন কালকেতুকে একভার কাঠ, মিষ্টি ইত্যাদি দ্রব্যও নিয়ে আসতে বলতে ভোলে না৷ অর্থাৎ মানুষের কাছ থেকে ‘মুফতে’ কোনোকিছু আদায় করে নেওয়ায় দক্ষ এই বনিক ও বনিকগিন্নি৷ তারপর কালু যখন জানায় যে সে বকেয়া নিতে নয় আংটি বিক্রি করার জন্য এসেছে তখন মুহূর্তে তার কথার ধরন পাল্টে যায়৷ বণিকগৃহিণী বলে—

 দন্ড চারি করহ বিলম্বন

 সহাস করিআ বাণী আসি বলে বান্যানী

 দেখি বাপা অঙ্গুরী কেমন৷’’৫৯

বণিক খণ্ডের দুবলা দাসী নামে দুবলা হলেও চরিত্র হিসেবে অত্যন্ত সবলা৷ তীক্ষ্ণ বুদ্ধিসম্পন্ন এই নারী ধনপতির দুই পত্নী লহনা-খুল্লনার দাসী হিসেবে কাজ করে৷ বাস্তব অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দুবলা দুই সতিনের সৌহার্দ্য দেখে বিচলিত হয়ে যায়৷ সে দেখে এসেছে দুই সতিনের মধ্যে কলহ না থাকলে দাসীদের সুখ থাকে না৷ তাদের কাজও যেমন বেশি করতে হয়, তেমনি দুজনের মুখনাড়াও সমান তালে সহ্য করতে হয়৷ আর অমিল হলে একের নিন্দা অন্যের কাছে করে কাজ থেকে আরাম, স্নেহ এমনকি নানা উপহারও অর্জন করা যায়৷ তার এই মানসিক ভাবনাকে কবি প্রকাশ করেছেন এইভাবে—

 ‘‘প্রেমবন্ধ দু-সতিনে দেখিআ দুবলা

 হৃদে কালকুট বিষ মুখে জেন তুলা৷

 লহনা খুল্লনা জদি থাকে এক মেলি

 পাটী করি মরিব দুজনে দিব গালি৷

 জেই ঘরে দু-সতিনে না বাজে কন্দল

 সেই ঘরে রহে দাসী সে বড় পাগল৷

 একে কহিতে নিন্দা যাব অন্যস্থান

 সে ধনি বাসিব জেন পরান সমান৷’’৬০

অর্থাৎ দুজনের কাছে দুজনের নিন্দা করে দুইয়ের কাছেই ভালো হয়ে আরামে দিন কাটানোর সংকল্প করে৷ তৎপর হয় লহনা-খুল্লনার কানে বিষ ঢেলে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে৷ তাদের সুন্দর সম্পর্ক নষ্ট করতে সে সিদ্ধান্ত নেয় লহনার যৌবনহীন দেহ এবং খুল্লনার ঢলঢলে কাঁচা অঙ্গের লাবণ্যকে ‘ইস্যু’ করার৷ কারণ বয়সের উপরে কারও হাত নেই৷ আর পুরুষরা সুন্দরের পূজারী৷ হাতের কাছে সুন্দর নারী পেলে অসুন্দরের দিকে ফিরে তাকানোর অবকাশ পায় না৷ ভবিষ্যতে লহনাও স্বামীর সেই অবমাননার শিকার হতে পারে৷ লহনার মধ্যে স্বামীপ্রেম বঞ্চিত হওয়ার আগাম সচেতনতা তৈরি করতে খুল্লনা সম্পর্কে বলে—

 ‘‘শুন গো শুন গো হের শুন গো লহনা

 আপনি করিলে নাশ ইবে সে আপনা৷

 শিশুমতি ঠাকুরাণী নাঞি জান পাপ

 কি কারণে দুগ্ধ দিআ পোষ কালসাপ

 নানা উপভোগ দিআ পোষহ সতিনী

 আপনার কার্য নাশ করিলে আপনি৷

 সাপিনী বাঘিনী সতা পোষ নাহি মানে

 অবশেষে অই তোমা বধিব পরানে৷

 কলাপির কলা জিনি খুল্লনার কেশ

 অর্ধ্বপাকা চুলে তুমি কি করিবে বেশ৷

 খুল্লনার মুখশশী করে ঢলঢল

 মাছাত্যায় মলিন তোমার গণ্ডস্থল৷

 কদম্বকোরক জিনী খুল্লনার স্তন

 গলিত তোমার কুচ হেলএ পবন৷

 খিন মাঝা খুল্লনার জেন মধুকরি

 যৌবন বিহনে তুমি হবে ঘটোদরী৷

 সাধু আসিবেন গৌড়ে থাক্যা কথো দিন

 খুল্লনার রূপে হব কামের অধীন৷

 অধিকারী হবে তুমি রন্ধনের ধামে

 মোর কথা তুমি গো জানিবে পরিণামে৷

 নেউটিয়া আইসে ধন সুত বন্ধুজন

 পুনুরপি নাহী আইসে জীবন যৌবন৷’’৬১

লহনাকে বলা এই উপদেশবাণীর ফল দুবলা হাতে হাতেই পায়৷ তার উপর খুশি হয়ে সে জানায়—

 ‘‘কানে সোনা দিআ তোর সাধিব সম্মান৷’’৬২

তার বুদ্ধিতে লহনা খুল্লনাকে নিদারুণ যন্ত্রণা দিয়ে ছাগল চরাতে পাঠালে সে একদিকে যেমন ইন্ধন দেয় লহনাকে অন্যদিকে খুল্লনার দুঃখেও সহমর্মিতা জ্ঞাপন করে৷ বহু দিন পর সাধু ফিরে এলে খুল্লনার যৌবনের মোহ থেকে সাধুকে মুক্ত করে লহনার করতলে স্থাপন করার জন্য সে যেমন লহনাকে স্বামী বশের ঔষধ এনে দেয় আবার খুল্লনাকেও একেবারে নিকট আত্মীয়ের মত সংবেদনশীলতা দিয়ে প্রলোভিত করে৷

 ‘‘আর শুন্যাছ ছোট মা সাধু আইল ঘরে

 বারি হইআ শুন তুমি বাজনা নগরে৷

 আজি তোর পোহাইল দারুণ দুঃখনিশা

 আজি তোর ভবানী সফল কৈল আশা৷

 আপন বল্যা দুবলারে রাখিহ চরণে

 দুবলা আনের দাসী নহে তোমা বিনে৷

 তোমার প্রাণের বৈরি পাপমতি বাঁজি

 সাধুর সাক্ষাতে তার বারি কর্য পাঁজি৷’’৬৩

তার মিথ্যে সহানুভূতিতে গলে গিয়ে খুল্লনা—

 ‘‘প্রসাদ করিল তারে মানিক অঙ্গুরি৷’’৬৪

 দুবলা চরিত্রটি এতটাই সজীব যে সে নিজ কৌশলে একের কথা অপরের কাছে বলে যেমন দু’জনের কাছেই প্রিয় হয়ে উঠেছে তেমনি গর্বিত মননে বাড়ির বহু দায়িত্ব প্রধানা দাসীর মতো নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে৷ সাধুর জন্য বাজার করতে গিয়ে সে বহু কেনাকাটা করে৷ প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ হলে সাধুর জেরায় তার কৌশলী বক্তব্য দ্বারা সেই খরচের চুলচেরা হিসাবও সে বুঝিয়ে দেয়৷ তার সেই বাজারের হিসেব আধুনিক পাঠককেও বিস্মিত করে৷—

 হাটের কড়ির লেখা একে একে দিব বাপা

 চোর নহে দুবলার প্রাণ

 লেখা পড়া নাহি জানি কহিব হৃদএ গনি

 এক দণ্ড কর অবধান৷

 হাটমাঝে পরবেশি আসি হরি মহাঁজসি

 ডাকে মীন-রাশ্যের কল্যাণ

 আসিআ আমারে গঞ্জি শ্রবণ করাল্য পঞ্জি

 তারে দিল কাহনেক দান৷

 কান্ধেতে কুশের বোঝা আসিআ কুসাই ওঝা

 বেদ পড়ি করিল আশীষ

 ইছিআ তোমার যশ তারে দীল পণ দশ

 দক্ষিণা ধারিল বহু দিস৷

 বাজারে কর্পূর নাহী চাঞ্যা বুলি ঠাঞি ঠাঞি

 জতনে পাইল পাঁচ তোলা

 পাঁচ কাহনের দর পাঁচশ কাহন ধর

 চারি কাহনের নিল কলা৷

 আলু কচু সাক পাত আদি নানা বস্তুজাত

 নিল চারি কাহন আষ্ট পণে

 তৈল ঘি লবন ছেনা পাঁচ কাহনের কিন্যা

 খাসী নিল আষ্ট কাহনে৷

 প্রবেশ করিতে হাট আমি তথা রাজভাট

 কায়বার পড়ে উভহাথ

 ইছিআ তোমার যশ তারে দিল পণ-দশ

 কানা পড়িল পণ সাত৷

 হাটে ফিরে অনুদিন সেক ফকীর উদাসীন

 ব্যয় তথি সপ্তদশ বুড়ি

 সঙ্গে ভারি দশ জন তারে দিল দশ পণ

 আমি খাইনু চারি পণ কড়ি৷

 প্রাণভয় দুয়া কয় সাধু বলে নাঞি হয়

 দুবলা করিল প্রাণপণ

 জদি মিথ্যা হয় ভাষা কাটিহ দুয়ার নাসা

 বিরচিল শ্রীকবিকঙ্কণ৷’’৬৫

সমাজ-সংসারের প্রতি সচেতন না হলে, মানব চরিত্রাভিজ্ঞতা পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা না থাকলে এ ধরনের বিচিত্র চরিত্র সৃষ্টির শক্তি কবিকঙ্কনের হত না৷ তাঁর ভাড়ু দত্ত, মুরারি শীল, দুবলা চরিত্রের মানুষ শুধু সে যুগে নয়—যুগ যুগ ধরে বর্তমান থাকে৷

উপন্যাসে রচয়িতা তাঁর সচেতন দৃষ্টির দ্বারা সমাজের বাস্তব অভিজ্ঞতাকে আত্মসাৎ করে সাহিত্যরূপ দান করেন৷ ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এ মুকুন্দ চক্রবর্তীও সেরূপ করেছেন৷ তিনি তাঁর কাব্যে ষোড়শ শতাধীর বাঙালি সমাজের যে ছবি একেছেন, বাংলার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থার যে চিত্র উপস্থাপিত করেছেন তা ইতিহাসসম্মত৷ এই বাস্তবতা তাঁর পরিবেশন নৈপুণ্যে যেমন প্রকট তেমনি চরিত্রচিত্রনের অভিনবত্বেও অতুলনীয়৷ তাঁর সৃষ্ট দেব চরিত্রগুলোও সমকালীন বাঙালিজীবনের রসে পরিপুষ্ট; দেবতারা তাদের দেবত্ব পরিত্যাগ করে ধূলিধূসরিত গ্রাম-বাংলার জীবন্ত মানবমূর্তি লাভ করেছে৷

কবিকঙ্কনের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর দেবখণ্ডে দেবতাদের বিভিন্ন কার্যকলাপ, কবির আত্মজীবনী অংশ, কালকেতুর জন্ম, বিবাহ, ভোজনবিলাস, ফুল্লরার বারমাসের দুঃখ-যন্ত্রণার কাহিনি, কালকেতুর নগর পত্তন, প্রজা স্থাপন, ধনপতির কাহিনি, তার দুই স্ত্রী লহনা-খুল্লনার জীবন সর্বত্রই ষোড়শ শতকের বাংলাদেশের বাস্তব জীবন নাট্যের প্রতিধ্বনি৷ যে সময়পর্বে তিনি কাব্য রচনা করেন তখন দেশে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বর্তমান৷ পাঠানশক্তি তখনও দেশ থেকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যায়নি আবার মোঘলরাও পুরোপুরি তাদের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি৷ জায়গিরদারেরা সেই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে নিজেদের অধিকার নিয়ে কাড়াকাড়ি শুরু করে দেয়; প্রজাদের উপর চলতে থাকে নির্মম অত্যাচার৷ তা থেকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র কারও নিস্তার ছিল না৷ অত্যাচারে অতিষ্ঠ প্রজারা যে দেশ ছেড়ে পালাবে তারও উপায় নেই কারণ তাদের উপর সর্বদাই পেয়াদাদের কড়া দৃষ্টি৷ এছাড়া নতুন জরিপ ব্যবস্থা চালু হয়—জমির দৈর্ঘ মাপা হয় কোণাকুণি হিসেবে৷ উর্বর জমির হিসেবে পতিত জমির উপরও খাজনা ধার্য হয়৷ টাকা ভাঙাতে গেলে পোদ্দারকে পয়সা দিতে হয়, ধার করলে প্রতিদিন টাকাপিছু এক পাই করে সুদ লাগে, মজুরি দিলেও কাজ করার লোক পাওয়া যায় না, অস্থাবর সম্পত্তি যথা ধান, গরু, কেউ ক্রয় করে না, বিক্রয়জাত দ্রব্যের মূল্য তলানিতে—এই পরিস্থিতিতে কলম ধরেন মুকুন্দ চক্রবর্তী৷ তাঁর আত্মজীবনীতে এর স্পষ্ট আভাস মেলে৷

 ‘‘অধর্মী রাজার কালে প্রজার পাপের ফলে

 খিলাত পাইল মামুদ সরিপ৷

 উজির হইল রায়জাদা বেপারি বৈশ্যের খদা

 ব্রাহ্মণ বৈষ্ণবের হইল ঐরি

 মাপে কোণে দিয়া দড়া পনর কাঠায় কুড়া

 নাঞি মানে প্রজার গোহারি৷

 সরকার হইল কাল খিল ভূমি লিখে নাল

 বিনি উবগারে খায় ধুতি

 পোতদার হইল যম টাকা আড়াই আনি কম

 পাই লভ্য খায় দিন প্রতি৷

 ডিহিদার আবুদ খোজ টাকা দিলে নাঞি রোজ

 ধান্য গোরু কেহ নাঞি কেনে

 প্রভু গোপীনাথ নন্দী বিপাকে হইলা বন্দি

 হেতু কিছু নাহি পরিত্রাণে৷

 জানদার সভার আছে প্রজাগণ পালায় পাছে

 দুয়ার চাপিয়া দিল থানা

 প্রজা হইল বিকলিত বেচে ধান্য গোরু নিত্য

 টাকা দ্রব্য দশ দশ আনা৷’’৬৬

সমাজে উচ্চ-নীচের বৈষম্য প্রবল ছিল৷ তথাকথিত উচ্চশ্রেণীর লোকেরা যেমন প্রবল আয়েস-বিলাসে জীবন কাটাতো তেমনি নিম্নশ্রণীর মানুষের দুর্দশার শেষ ছিল না৷ শিব-পার্বতীর দাম্পত্য জীবনে দারিদ্র্যক্লিষ্ট নিম্ন-মধ্যবিত্ত সমাজের ছবি ফুটে উঠেছে৷ অলস-অকর্মণ্য শিব সংসার চালাতে না পারলে সপরিবারে ঘরজামাই হিসেবে উপস্থিত হয়েছে ধনী শ্বশুরবাড়িতে৷ কিন্তু দরিদ্র জামাই ঘরজামাই হিসেবে শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করলে তার যে শ্বশুরবাড়িতে দাম থাকে না তা শাশুড়ি মেনকার কথার মধ্য দিয়ে বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন কবি৷—

 ‘‘দরিদ্র তোমার পতি পরে বাঘছাল

 সবে ধন বুড়া বৃষ গলে হাড়মাল৷

 প্রেত ভুত পিশাচ মেলিআ তার সঙ্গ

 অনুদিন কত না কিনিঞা দিব ভাঙ্গ৷

 লোক-লাজে স্বামী মোর কিছু নাঞি কয়

 জামাতার পাকে হইল ঘরে সাপের ভয়৷

 দুই পুত্র তিন দাসী স্বামী শূলপাণি

 প্রেত ভূত পিশাচের নাঞি জানি৷

 অনুদিন কতেক সহিব উৎপাত

 রাঁধিয়া বাড়িয়া মোর কাঁকালে হৈল বাত৷’’৬৭

কালকেতু-ফুল্লরার ব্যাধজীবনে দারিদ্র্যের নির্মম ছবি প্রতিভাত হয়৷ কালকেতু পশু শিকার করে আনে ফুল্লরা সেই পশুর মাংস, নানা দেহাংশ হাটে বিক্রি করে যা পায় তাতেই কোনোমতে সংসার চলে যায়৷ আর যদি শিকার না পায় তাহলে খুদকুড়ো যা ধার পেলে পেল নতুবা নিশ্চিত উপবাস৷ এমনি ঘটনা ঘটে দেবীর ছলনায় বীরের শিকার না মিললে৷ রাগ করে দেবীর ছদ্মরূপী স্বর্ণগোধিকাকেই সে বেঁধে নিয়ে আসে৷ তাকে খালি হাতে ফিরতে দেখে ফুল্লরা সভয়ে বলে যে ঘরে রাখা বাসি মাংস বাজারে বিক্রি হয় না তাহলে—

 ‘‘আজি মহাবীর বল সম্বল উপায়৷’’৬৮

অগত্যা প্রতিবেশী সই-এর কাছ থেকে খুদ ধার করতে পরামর্শ দিয়ে সেই বাসি মাংস নিয়েই হাটে চলে যায় কালকেতু৷ সই একদিনের জন্য ফুল্লরাকে যেমন চাল ধার দিতে সম্মত হয় তেমনি দরিদ্র এই রমণীকে কাছে পেয়ে মাথার উকুন বাছিয়ে রাখতেও দ্বিধাবোধ করে না৷—

 ‘‘ফুল্লরা দুকাঠা চালু মাগিল উধার

 কালি দিহ বল্যা সই কৈল অঙ্গিকার৷

 আইসহ প্রাণের সই বৈস গো বহিনি

 মোর মাথে গোটা কথো দেখহ উকিনি৷’’৬৯

এখানে ফুল্লরার দারিদ্র্য জ্বালা যেমন প্রকট তেমনি নিম্নশ্রেণীর নারীকুলের একটি অতি সাধারণ ঘটনা মাথার উকুন বাছতে বাছতে নারীমনের নানা সুখ-দুঃখের কথায় মগ্ন হয়ে যাওয়ার মতো চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন রচনাকার৷

ফুল্লরার বারমাসের দুঃখ-কষ্টের বর্ণনাতে দরিদ্রজীবনের একটা সুস্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়৷ দরিদ্র রমণীরা ক্ষুদ্র দৈর্ঘের ‘খুঞার বসন’ পড়ে লজ্জা নিবারণ করলেও সেই খাটো কাপড়ে শীত-গ্রীষ্ম কিছুই নিবারিত হত না৷ কখনো কখনো ভাগ্যক্রমে শীতের হাত থেকে বাঁচতে ‘পুরান খোসলা’ জুটে যেত৷ খাদ্য হিসেবে বেশিরভাগই জুটতো খুদ—তাও আবার চেয়েচিন্তে ধারদেনা করে৷ খুদের জন্য কোনো কোনো সময় অন্নপাত্র বন্ধক রাখা হত৷ দরিদ্রদের প্রধান খাদ্য তালিকায় ছিল ‘আমানি’৷ জলযুক্ত আমানি পাত্রের অভাবে মাটিতে গর্ত করে সেখানে ঢেলে তারপর খাওয়া হত৷ ফুল্লরার কথায় তা উঠে এসেছে৷—

 ‘‘খুদ সেরে বান্ধা দিল মাটিয়া পাথরা৷

 ফুল্লরার আছে কত কর্মের ফল

 মাটিয়া পাথরা বিনে নাহি অন্য স্থল৷

 দুঃখে কর অবধান দুঃখে কর অবধান

 আমানি খাবার গর্ত দেখ বিদ্যমান৷’’৭০

মোট কথা শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা-বসন্ত সমস্ত ঋতুতেই দরিদ্রদের উদরের চিন্তা করতে হত৷

এই কালকেতুই যখন গুজরাটের রাজা হয় তখন তার জীবনধারা পাল্টে যায়৷ ভাঁড়ুদত্তের কলিঙ্গরাজের কাছে দেওয়া বর্ণনায় তা উঠে এসেছে৷—

 ‘‘কাননে বধিআ পশু উপায় করিত বসু

 ফুল্লরা বেচিত মাংস হাটে

 কোটাল ভ্রমিআ দেশ না দেখহ সবিশেষ

 কালকেতু রাজা গুজরাটে৷

 পূর্বে পিত ভাণ্ডে বারি এবে তার হেমঝারি

 ঘটি বাটী সব হেমময়

 চড়ে পর্বতিআ ঘোড়া পরিধান খাসা জোড়া

 ঘর তার কুবের-নিলয়৷

 … … …

 রঙ্ক দুঃখী নাহি চিনি হেমঘটে পিয়ে পানি

 নাটগীত সভাকার ঘরে

 ঘর ঘর জত আছে চলিব বীরের কাছে

 না থাকিব কলিঙ্গ-নগরে৷

 বীর কত ভাগ্যবান তথা লক্ষ্মী অধিষ্টান

 চারিদিগে পাথরের গড়

 দুআরেতে মাতা হাথি আছে তার দিবারাতি

 কেবা তার হইব নিয়ড়৷’’৭১

অর্থাৎ ধনী শ্রেণীর প্রতিভূ হিসেবে কালকেতু ‘সোনায় সোহাগা’৷ ফুল্লরা প্রাসাদতুল্য গৃহে দাসদাসী নিয়ে মহাসুখে সময় অতিবাহিত করে৷

হরগৌরীর দাম্পত্য জীবন নিম্নমধ্যবিত্ত দাম্পত্যের সহজ সুরকে আত্মস্থ করে অলৌকিক থেকে লৌকিক হয়ে উঠেছে৷ দুর্গা মায়ের কথা সহ্য করতে না পেরে ঝগড়া করে স্বামীর সঙ্গে বাপের বাড়ি ত্যাগ করে চলে এসেছে৷ শিবের ভিক্ষালব্ধ অন্ন সাদরে গ্রহণ করে রান্না করে স্বামী পুত্রকে খাইয়েছে৷ আবার শিব যখন ভিক্ষা করে গৃহে ফিরেছে তখন শিশুর সারল্য নিয়ে দৌরে গিয়ে পিতা তাদের জন্য কি ‘সত্তগাত’ এনেছে তা জানতে চেয়েছে৷ পিতার ঝুলি থেকে মুড়কি খই বেরোতে দেখে তা গ্রহণ করার জন্য দুই ভাই কাড়াকাড়ি শুরু করে দিয়েছে; পরে মায়ের মধ্যস্থতায় শান্ত হয়েছে দুজনে—এ চিত্র প্রত্যেক বাঙালি ঘরের৷ সংসারে অভাব অনটনের কথা শুনে উদাসীন বাঙালি পিতা বা স্বামীর মতো শিব যে গৃহত্যাগ করার সংকল্প নিয়েছে তাও সমাজে বিরল নয়৷

শিবের ভোজন তালিকায় বর্ণিত ব্যঞ্জনাদি, ধনপতির জন্য খুল্লনার রান্না করা তরকারি অথবা খুল্লনার জন্য লহনার রন্ধন করা ব্যঞ্জনের যে তালিকা কবি দিয়েছেন তা নিতান্ত বাঙালি সমাজের খাদ্য-সংস্কৃতির পরিপূরক৷ যেমন কাজে ছুটি নিয়ে শিব পার্বতীকে রান্না করতে বলে—নিম-শিম-বেগুন দিয়ে তিতা, কুমড়া, বেগুন কাঠালবিচি, ডালবড়ি, আদারস দিয়ে শুকুতা, সরষে শাক, বথুয়া শাক, মুসুরি ডাল, ছোলার ডাল, পালং ইত্যাদি নানা ব্যঞ্জন৷ লহনা খুল্লনার জন্য রান্না করে—ঘিয়ে ভাজা নালিতার শাক, তেলে ভাজা বথুয়া শাক, মুগের ডাল, চিতলের কোল, ছোলার ডাল, মাছ ভাজা, চিংড়ির বড়া, কুমড়া ভাজা, ডালের বড়ি দিয়ে কুমড়ার তরকারি এছাড়াও রয়েছে—

 ‘‘কটু তৈলে কই মৎস্য ভাজে গণ্ডা দশ

 মুঠ্যে নিঙ্গড়িআ তথি দিল আদারস৷

 বদরি শকুল মীন রসাল মুসরি

 পণ চারি ভাজে রামা সরল-শফরী৷’’৭২

আর খুল্লনা বহুদিন পর স্বামী বিদেশ থেকে ফিরে এলে তাকে ভোজন থালায় প্রথমেই দেয় সুক্তা, ঝোল, ঘন্ট, সাক, সুপ, তারপরে মাছ-মাংস৷ সেখানেই শেষ নয়—

 ‘‘ঘৃতে জব জব খায় মীন মাংস বড়ি

 বাদ কর‍্যা ভাজা কই খায় তিন কুড়ি৷

 অম্বল খাইআ পিলা জল ঘটী ঘটী

 দধি খায় ফেনি তার করে মটমটী৷’’৭৩

দেশে ন্যায়পরায়ণতা বা ধর্মবুদ্ধির বিশেষ অভাব দেখা দিয়েছিল৷ ধূর্ত শ্রেণীর লোকেরা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য লোক ঠকিয়ে জীবন নির্বাহ করতো—মুরারি শীল, ভাঁড়ুদত্ত এই শ্রেণীর৷ সমাজে বলপূর্বক তোলা আদায়ের ব্যাপারটিও ভাঁড়ুর তোলা আদায়ের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়৷ এছাড়া কালকেতুর দরবারে এসে ভাঁড়ু যেভাবে লোক ঠকিয়ে বিত্ত বৈভবকে বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে তাকে, তাতেও সমাজে শোষণের একটা দিক স্পষ্ট হয়—

 ‘‘তাড়বালা দিবে মান দিবে হে বলদ ধান

 উচিত কহিতে কিবা ভয়

 জিনিতে প্রজার মায়া পত্র নিবে এক ছিয়া

 বন্দে বন্দে জেন প্রজা রয়৷

 জখন পাকিবে খন্দ পাতিবে বিষম ফন্দ

 দরিদ্রের ধানে নিবে নাগা

 খাইআ তোমার ধন না পালায় কোন জন

 অবশেষে নাহী পাও দাগা৷’’৭৪

সেই সময় সমাজে জাতিভেদপ্রথা বিশেষভাবে বর্তমান ছিল৷ কালকেতুর গুজরাট নগর প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষজন বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের বসত অঞ্চল গড়ে তোলে যা জাতিবৈষম্যের বা শ্রেণী বৈষম্যকেও স্পষ্ট করে৷ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, গোপ, ধীবর, মুসলমান, এমন কি গণিকারা পর্যন্ত সে নগরের অধিবাসী হয়৷ যেমন—

 ‘‘বীরের পাইআ পান বৈসে যত মুসলমান

 পশ্চিম দিগ বীর দিল তারে৷’’৭৫

অথবা

 ‘‘পাইআ বীরের পান বৈসে জত কুলস্থান

 বীরের নগরে বিপ্রগণ

 শাস্ত্র বিচার করে আশিষ করিআ বীরে

 নিত্য পায় ভুষণ চন্দন৷’’৭৬

অথবা

 ‘‘গুজুরাট এক পাশে গ্রহবিপ্রগণ বৈসে

 বর্ণদ্বিজগণ মঠপতি’’৭৭

এছাড়া তেলি, চাষি, কামার, কুঠারি, তাম্বুলি, কুম্ভকার, তন্তুবায়, মালী, বারুই, নাপিত, আঘরি, গন্ধবণিক, শঙ্খবণিক, সুবর্ণবণিক, কাসারি, সাপুড়া ইত্যাদি বিবিধ কর্ম বা পেশা ভিত্তিক শ্রেণীর মানুষ তার নগরে বসতি স্থাপন করে সুখে কাল কাটায়৷

সে সময়ে পুরুষের দৈহিক প্রবৃত্তিকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার জন্য বারবনিতার প্রয়োজনও যে অবশ্যম্ভাবী ছিল তার বর্ণনা দিতেও কবি ভোলেননি৷ কারণ নগর মাত্রই নানা শ্রেণীর, নানা পেশার মানুষের বাস এবং তাদের যৌনতৃপ্তি গণিকা ছাড়া যে সম্ভব নয় সমাজসচেতক কবি তা ভালো করে বুঝতে পেরেছিলেন৷ তাই গুজরাট নগরের এক পাশে বারাঙ্গনারাও জায়গা করে নেয়৷—

 ‘‘লম্পট পুরুষ আশে বারবধূগণ বৈসে

 একভিতে তার অধিষ্ঠান

 নাটুআ কলন্ত সঙ্গে বসিল পরমরঙ্গে

 শ্রীকবিকঙ্কণ রস গান৷’’৭৮

ধনপতির উপাখ্যানে বণিক সমাজের শ্রেণীগত পরিচয় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়৷ বানিজ্যের বর্ণনাতেও আমদানি ও রপ্তানিজাত দ্রব্যের যে বিবরণ লেখক ধনপতির সিংহল রাজের সম্মুখে বলা বক্তব্যের মধ্যে পরিস্ফুট করেছেন তা বাংলার নিজস্ব বানিজ্যিক রূপ৷

সমগ্র চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে নারীর সামাজিক অবস্থানের যে চিত্রটি ফুল্লরা, খুল্লনা, লহনা ইত্যাদি চরিত্রের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তা বাস্তবসম্মত৷ সেই সময় সমাজে পুরুষের বহুবিবাহের ফলে নারীজীবনে সতিন সমস্যা প্রবল ছিল৷ স্বামী, শাশুড়ি, এমনকি সতিনের দ্বারা নারীদের নির্যাতিত হতে হত৷ ফুল্লরার গৃহে ছদ্মবেশিনী দেবী দ্ব্যর্থক ভাষায় তার ঘর ছাড়ার যে কারণ উপস্থাপন করেছিল ফুল্লরার কাছে, তাতে সে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে৷ যেমন—

 ‘‘দারুণ দৈবের গতি হইলাঙ অবলা জাতি

 অহি সঙ্গে হইয়া গেল মেলা

 বিষকন্ঠ মোর স্বামী সহিতে না পারি আমি

 তাহে হেন সতিন প্রবলা৷

 দারুণ দৈবের গতি উগ্র আমার পতি

 পঞ্চ মুখে মোরে দেন গালী

 তাহে সতীনের জালা কত সহে অবলা

 পরিতাপে হইয়া গেলাঙ কালী৷’’৭৯

ধনপতি কার্যপোলক্ষে বিদেশে গেলে লহনাও তার সতিন খুল্লনাকে তীব্র যন্ত্রণা দিয়ে বনে ছাগল চরাতে পাঠিয়ে দেয়৷ ফুল্লরা ঘরে রূপসী কন্যাকে দেখে সতীন ভেবে কাঁদতে কাঁদতে স্বামীর সম্মুখে উপস্থিত হলে তার মুখ দেখে কালকেতু যে মন্তব্য করে তাতেও শাশুড়ি-ননদ-সতিনের সঙ্গে নারীর কোন্দলের রূপটি পরিস্ফুট৷—

 ‘‘সাসুড়ি ননদি নাঞি নাঞি তোর সতা

 কা সনে কন্দল করি চক্ষু কৈলে রাতা৷’’৮০

সমাজে বিবাহিতা নারীদের জীবনের একমাত্র অবলম্বনই ছিল স্বামী৷ স্বামীর জন্য, স্বামীর প্রণয়ের জন্য বধূদের উৎকন্ঠা চরিত্রগুলির পরতে পরতে স্থান পেয়েছে৷

বস্তুত জীবনের প্রতি সুগভীর আস্থা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণশীলতা, সৃজনশীলতা, সংবেদনশীল হৃদয়ের অপার সহমর্মিতা, বস্তুরূপের প্রতিফলনের অলৌকিক ক্ষমতা মুকুন্দের কবি প্রকৃতিতে ঔপন্যাসিকের গুণাবলীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে৷ আর এর দ্বারা সঞ্জীবিত হয়েই চিরন্তন বাঙালির সহজ জীবনধর্ম তাঁর সৃষ্টিতে শ্বাশত কাব্যরূপ লাভ করেছে৷ তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি কালের গণ্ডি পেরিয়ে সার্বজনীনতা লাভ করেছে মানুষের বিশ্বাসে, প্রত্যয়ে এবং জীবন অভিজ্ঞতার বাস্তবিক স্পর্শে৷ তাঁর গুণাবলী ও কাব্য সম্পর্কে তাই শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন—‘‘দেবতা মানুষের অধীন হইয়াছেন—দেবকীর্তিবর্ণনা উজ্জ্বল বাস্তবচিত্রের নিকট নিষ্প্রভ হইয়া পড়িয়াছে৷ এই শ্রেণীর প্রধানকাব্য মুকুন্দরামের ‘কবিকঙ্কণ—চণ্ডী’তে স্ফুটোজ্জ্বল বাস্তবচিত্রে, দক্ষচরিত্রাঙ্কনে, কুশল ঘটনাসন্নিবেশে, ও সর্বোপরি, আখ্যায়িকা ও চরিত্রের মধ্যে একটি সূক্ষ্ণ ও জীবন্ত সম্বন্ধ স্থাপনে, আমরা ভবিষ্যৎকালের উপন্যাসের বেশ সুস্পষ্ট পূর্বাভাষ পাইয়া থাকি৷ মুকুন্দরাম কেবল সময়ের প্রভাব অতিক্রম করিতে, অতীত প্রথার সহিত আপনাকে বিচ্ছিন্ন করিতে, অলৌকিকতার হাত হইতে সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ করিতে পারেন নাই বলিয়াই একজন খাঁটি ঔপন্যাসিক হইতে পারেন নাই৷ দক্ষ ঔপন্যাসিকের অধিকাংশ গুণই তাঁহার মধ্যে বর্তমান ছিল৷ এ যুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন ঔপন্যাসিক হইতেন, তাহাতে সংশয়মাত্র নাই৷’’৮১ অন্নদামঙ্গলের কবি ভারতচন্দ্রকেও এই বৈশিষ্ট্য থেকে বাদ দেওয়া যায় না৷ বাংলা উপন্যাসের জীবনাবির্ভাবের সলতে পাকানোর কাজ প্রায় সমাপ্ত হয়ে এসেছিল মঙ্গলকাব্যের মধ্যেই৷ ইতিমধ্যে দেশের অভ্যন্তরে নানা পরিবর্তন ঘটে গেছে৷ হিন্দু ও মুসলিম ধর্মের গোঁড়ামির কঠিন বন্ধনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল মানুষের ব্যক্তিগত চিন্তা-চেতনা, বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা৷ ভারতের বিপুল ঐশ্বর্যকে কুক্ষিগত করার অভিলাষে ভারতীয় ব্যবসা-বাণিজ্যে ইংরেজ, ফরাসীদের পদসঞ্চারণ শুরু হয়ে যায়৷ ক্রমে ক্রমে বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ড হয়ে মাথা তোলে ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্যে দিয়ে; অবসান হয় মুসলিম শাসনের৷ ইংরেজদের ভারত শাসনে এদেশের জনগণ বহু কলঙ্কিত অধ্যায়ের সাক্ষী থাকলেও একটি বিষয়ে তারা প্রভূত উপকার করেছিল তা হল ভারতীয়দের সুপ্ত চেতনায় করাঘাত৷ তাদের আগমন শাপে বর হয়ে উঠেছিল৷ নানাধরনের ভূমি বন্দোবস্তে, শোষণে-নিপীড়নে ভারতীয় অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিলেও ভারতবাসীর হৃদয় মন্দিরে জোগাচ্ছিল অমিত শক্তির রসদ৷ আর সে শক্তি প্রতিরোধের শক্তি, যুক্তি-বিচার-বিশ্লেষণের শক্তি৷ বাইরে থেকে এত বড় আঘাত না পেলে হয় তো ভিতর থেকে সেই ঘুমন্ত ধুর্জটির আবির্ভাব সম্ভব হত না৷

ইংরেজরা নিজেদের শাসনকার্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য এবং সিভিলিয়ানদের দেশীয় ভাষা বাংলা শেখানোর জন্য যেদিন (১৮০০ খ্রিঃ ৪ঠা জানুয়ারি) ভারতবর্ষের মাটিতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ নামে এক শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেন ( এর কিছুদিন আগে খ্রিস্ট্রধর্মপ্রচার ও ধর্ম সংক্রান্ত বই ছাপানোর জন্য গঠিত হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশন ও তার প্রেস বা ছাপাখানা৷ এটি মিশনারিরা স্থাপন করেন৷ পাশ্চাত্য জ্ঞান অর্জন এবং বাংলায় শিক্ষার প্রসারে এর অবদানও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সঙ্গে সমানগুরুত্বপূর্ণ৷) সেদিন থেকে ভারতীয় সভ্যতায় নতুন এক যুগের সূচনা হয়৷ সে যুগ আলোকের যুগ—মুক্তির যুগ৷ বাঙালির বুদ্ধি ও চেতনায় জ্ঞানদীপ্ত রাজটীকা অঙ্কনের শুভলগ্ন ঘোষিত হয়ে যায়৷ এই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হাত ধরেই বাংলা গদ্য তার পূর্ণ অবয়ব নিয়ে মাথা তুলতে থাকে৷ এর পরে আসেন রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর৷ তাঁদের হাতে বাংলা সাহিত্য হাজার বছরের আঙ্গিক (পদ্য আঙ্গিক) ত্যাগ করে নবরূপে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে৷ বাঙালি মনন ও চেতনায় নবচেতনার ঢেউ আছড়ে পড়ে৷ মধ্যযুগের দৈবী মহিমা, প্রাচীনের সেই অন্ধ-বদ্ধ সংস্কার তার অসারতা দিয়ে চিন্তাভাবনার পথকে আর গতিরুদ্ধ করে রাখতে পারে না৷ তা যেন মুক্তির উচ্ছ্বাসে মেতে উঠে৷ এই সময় সমাজে দুটি শ্রেণী তৈরি হয়৷ একদল যাঁরা নতুন আলোর অপার সম্ভাবনাকে সাদরে গ্রহণ করে আরেক দল পুরোনো অন্ধসংস্কারকেই আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে৷ একদল মুক্তির উচ্ছ্বাসে ভেসে যায় আরেক দল অন্ধ আবেগে স্থবির হয়ে রয়৷ একদল নবীন আরেক দল প্রবীণ৷ এই নবীন-প্রবীণের দ্বন্দ্বে বাংলা সাহিত্য বিকাশে নানা শ্রেণীর পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে৷ যেমন সম্বাদ প্রভাকর, সমাচার দর্পণ, সমাচার পত্রিকা, সম্বাদ কৌমুদী, সম্বাদ রসরাজ ইত্যাদি৷ এগুলিতে নানা ধরনের, নানা রসের

ইংরেজদের উদ্যোগে কলকাতা, সুতানুটি, গোবিন্দপুর এই তিনটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হয় কলকাতা নগরী৷ প্রশাসনিক নানা সুবিধা কর্মসংস্থানের বিপুল সম্ভারে সমৃদ্ধ হতে থাকে এই স্থান৷ গ্রামীণ জীবনে অভ্যস্ত সাধারণ মানুষ, জমিদার-মহাজনদের শোষণ-পীড়নে, দুর্ভিক্ষ-মন্বন্তরের মতো ঘটনায় দিশেহারা হয়ে জীবনধারণের আশায় ভিড় জমাতে থাকে কলকাতায়৷ নানা শ্রেণীর, নানা পেশার মানুষে ভরে যায় নতুন শহর৷ এই সময় কলকাতায় তৈরি হয় এক উঠতি ধনিক শ্রেণী৷ জাতিগত দিক থেকে তারা কুলিন না হলেও প্রবল ধনপ্রাচুর্যে সমৃদ্ধ হয়ে তারাই সমাজের মাথা হিসেবে পরিগণিত হয়৷ নানা ধরনের ব্যবসায় হঠাৎ অর্থাগমের প্রবল প্লাবনে তারা নিজেদের টাল রাখতে পারে না—বিলাসিতার প্রবল জোয়ারে ভাসিয়ে দেয় নিজেদেরকে৷ এদিকে নানা শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে সঙ্গে শহর কলকাতা গণিকাদেরও অন্যতম বিচরণ ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায়৷ রাজা রামমোহনের উদার ও উন্মুক্ত চিন্তা-ভাবনায় সতীদাহ প্রথা রদ হলে অগণিত নারীজীবন রক্ষা পায় সতীদাহের নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে৷ কিন্তু এর পরবর্তী পর্যায়ে দেখা যায় এই পতিহারা নারীরা সতীদাহ থেকে মুক্তি পেল ঠিকই কিন্তু জীবনে স্বাভাবিক পরিণতি পেল না৷ অল্প বয়সে বৈধব্যের তীব্র জ্বালায়—একাদশীর পীড়নে, পরিবারের গলগ্রহতায়, যৌবনের স্বপ্নভঙ্গের নিদারুণ দীর্ঘশ্বাসে কমবয়সি বিধবারা জীবনে বেঁচে থাকার সীমাহীন যন্ত্রণা উপভোগ করেছে তিলে তিলে৷ আর এই যন্ত্রণা নিবৃত্তির উপায় খুঁজতে গিয়ে অথবা সামান্যতম পদস্খলনে বহু নারী গণিকা হয়ে উঠেছে৷ এছাড়া স্বামীর অনাদরে এবং নিম্নশ্রেণীর ফুলওয়ালী, নাপিতিনি গোয়ালিনি ইত্যাদির নারীদের পরামর্শেও বহু গৃহবধূ গণিকাজীবনের অন্ধকারে নিজেকে আহুতি দিয়েছে৷ গ্রামবাংলা থেকে আগত নিপীড়িতা নারীরাও কলকাতায় এসে রুজি-রোজগারের পথ না পেয়ে শরীর বিক্রি করে পেট ভরাতে বাধ্য হয়েছে৷ ধনবান নব্য ধনিক শ্রেণীর ‘বাবু’-দের বিলাসিতার অন্যতম উপকরণ এই গণিকারা৷ এসময় গণিকাদের নিয়ে প্রকাশ্য সমাজে অকপটে মেলামেশা কোনোরকম দোষের ছিল না৷ বরং তা ছিল চরম বাহাদুরির কাজ৷ গণিকাগমনে বিরত পুরুষেরা পুরুষ বলেই বিবেচিত হত না৷ সমাজে বাবু হিসেবে পরিচিত এই ধণিক শ্রেণীর লাগামহীন বিলাসী জীবন, গণিকা শ্রেণীর কঠোর জীবনসংগ্রাম, সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর (কেরানি) মানুষের পোরখাওয়া জীবনাচারণের সঙ্গে যুক্ত হয় নিম্নশ্রেণীর অতি সাধারণ (মুটে, মজুর) মানুষের মরে বেঁচে থাকার জঙ্গমতা৷ পরস্পর ভিন্ন রুচি ও মানসিকতায় সমাজের অভ্যন্তরে চরম দুরবস্থা তৈরি করে৷ অপরাধ প্রবণতাও বেড়ে যায় বহুগুণে৷ বিভিন্ন পত্রিকার পাতায় পাতায় মানুষের নীচতার, নৈতিক অধঃপতনের মুখোরোচক খবর প্রকাশিত হতে থাকে৷ এর সঙ্গে আত্মপ্রকাশ করে বাবুশ্রেণীর জীবনাচারণ নিয়ে নানা ধরনের লেখা৷ যেমন ‘সমাচার দর্পণ’-এর সম্পাদক ১৮২১ খ্রিঃ ২৪ শে ফেব্রুয়ারি এবং ৯ই জুন দুটি সংখ্যায় প্রকাশ করেন ‘বাবুর উপাখ্যান’ নামে বাবু চরিত্রের দুটি আলোচনা৷ রচনাটি ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেনামে প্রকাশ করেন৷ কাহিনিটিতে চরিত্র চিত্রণ বা আদি-মধ্য-অন্ত্য যুক্ত কোনো সুসংবদ্ধ কাহিনি অপেক্ষা বেশি গুরুত্ব পেয়েছে স্থূল বাস্তবতা৷ বড়লোকের আদুরে ছেলে তিলকচন্দ্রবাবু পিতার অত্যধিক স্নেহ ও প্রশ্রয়ে বিগড়ে গিয়ে প্রকৃত আয়েশিবাবু হয়ে ওঠে৷—‘‘বাবু ঘুড়ী বুলবুলি প্রভৃতি খেলাতে সদা মগ্ন থাকেন লেখা পড়ার দোকান আছে কিন্তু করেন না৷ অর্থী ও স্বার্থপর খোশামুদে মিষ্টমুখো কতক গুলিন দেওয়ানজীর পারিষদ লোক বাবুর নানাবিধ গুণ ও বিদ্যাসূচক প্রশংসা করে৷’’৮২ বাবু তিলকচন্দ্র পিতার মৃত্যুর পর প্রভুত ধনসম্পদের প্রভূত্ব পেয়ে স্থূল জীবন পিপাসায় নিজেকে ভাসিয়ে দেয়—চাটুকার খোশামোদকারীরা তার ইন্ধন জোগায়৷ ‘বাবুর উপাখ্যান দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ’-এ দেখানো হয়েছে দুর্দমনীয় বিলাসবহুল জীবনাচারণের সঙ্গে সঙ্গে বাবু শ্রেণী কীভাবে ইংরেজদের ব্যর্থ অনুকরণে নিজের ব্যক্তিত্ব-অস্তিত্ব সব বিসর্জন দিয়ে বসে—‘‘সাহেব লোক রবিবার’’ গ্রিজায় গিয়া থাকেন অন্যবারে বিষয়কর্ম্ম করেন৷ বাবু এই বিবেচনা করিয়া সন্ধ্যা আহ্নিক পূজা দান তাবৎ পরিত্যাগ করিয়া রবিবারে বাগানে গিয়া কখন নেড়ীর গান কখন শকের যাত্রা খেঁউড় গীত শুনিয়া থাকেন৷’’৮৩ এই রচনাটিতে সামাজিক বিশৃঙ্খলতাকে মূল উপজীব্য করে রচনাকার কাহিনির অসংবদ্ধতা, অসামঞ্জস্যতাকে দূরে সরিয়ে খণ্ডচিত্রগুলিকে নায়ক তিলকচন্দ্রের ঐক্যসূত্রে গ্রন্থিত করেছেন৷ এই বাবু তিলকচন্দ্র শুধু উনিশ শতকের প্রথম পর্বের বিলাসী ধনবান বাবু সমাজের প্রতিনিধিই নয় যে কিনা ইংরেজি শিক্ষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ; সে কাহিনিকেন্দ্রিক বাংলা গদ্যরচনা এবং বাংলা উপন্যাস সাহিত্য সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ের আদি নায়কও৷

‘বাবুর উপাখ্যান’ রচনার পরপরই ‘সমাচার দর্পণ’-এর পাতায় প্রকাশিত হতে থাকে—‘শৌকীন বাবু’ ১৮২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে জুন, ৩০শে জুন ‘বৃদ্ধের বিবাহ’, ‘ব্রাহ্মণ পণ্ডিত’ ৭ই জুলাই, ‘বৈদ্য সংবাদ’ ১লা সেপ্টেম্বর এবং ‘বৈষ্ণব সংবাদ’ ২রা মার্চ৷

‘শৌকীন বাবু’-তে স্থান পেয়েছে এমন এক বাবুর গল্প যে কিনা প্রতিবছর পারমার্থিক স্নানযাত্রায় নানা স্থানের বাবুদের মনোরঞ্জনের নানাবিধ উপকরণ নিয়ে যায় যথা, গায়ক-গুণী নিয়ে যাওয়া, বেশ্যা বা ভাঁড় নিয়ে যাওয়া ইত্যাদি৷ বাই-বারাঙ্গনার সঙ্গে স্নানযাত্রা দেখে উৎসাহিত হয়ে নিজের স্ত্রীকে সঙ্গে করে ‘হাপ বজরা’ ভাড়া করে নিজেও স্নানযাত্রায় বের হন বিলাসীবাবু৷ কিন্তু ঘটনাক্রমে বাবুর সেই ‘বিবিঠাকুরাণী’ স্নানের নিমিত্ত বজরা থেকে বের হয়ে গঙ্গায় নামলে গঙ্গাবক্ষে জোয়ার দেখা যায় এবং ভ্রান্তিবসত সে নিজেদের বজরা চিনতে না পেরে অন্যবাবুর বজরায় গিয়ে ওঠে চিরতরে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়৷ আর ‘‘বাবু সেই ঘাটেই মঙ্গল গাইয়া বেড়াইলেন এবং ঐ নগরের মধ্যে দ্বারে২ অন্বেষণ করিলেন সাক্ষাৎ হইল না৷’’৮৪

দক্ষিণদেশের ফরকাবাজ নামে এক গ্রামের অবুঝচন্দ্র নামে এক বৃদ্ধের বিবাহাকাঙ্খা উপজীব্য হয়েছে ‘বৃদ্ধের বিবাহ’ রচনায়৷ বৃদ্ধ তার বিবাহ ইচ্ছাকে চরিতার্থ করার জন্য বার্ধক্যকে আড়াল করতে ঘটকের কাছে বলেছে৷ ‘‘ছেহত্তরের মন্বন্তরের সময়ে আমার বয়স বৎসর পঁচিশ ছাব্বিশ হইবেক আর এই যে দেখিতেছে দন্তগুলা পড়িয়াছে সে শুদ্ধ জল দোষের কারণ আর বেয়ে ধাতু-প্রযুক্ত চুল পাকিয়াছে কিন্তু শক্তি এমত অদ্যাপি ত্রিশ পঁচিশ দণ্ড রোজ২ করি৷’’৮৫ বাবু অবুঝচন্দ্র ঘটকদের রাজী করিয়ে পাঁচশত টাকা পণ ও পর্যাপ্ত স্বর্ণলঙ্কারের দাবিসহ পাত্রী নির্বাচন করে এবং বিবাহও সম্পন্ন হয়৷ অবশেষে সেই নববধূ সমস্ত টাকা ও গহনা নিয়ে পালিয়ে গেলে হৃতসর্বস্ব অবুঝচন্দ্র হাহাকার করতে থাকে৷

‘ব্রাহ্মণ পণ্ডিত’ রচনায় ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের অন্তঃসারশূন্য পাণ্ডিত্য এবং অযৌক্তিক যুক্তিবিলাস বর্ণিত হয়েছে—‘‘কখন বাবু জিজ্ঞাসা করেন ভট্টাচার্য্য মহাশয় সুরাপানে কি পাপ হয়৷ উত্তর৷ ইহাতে পাপ হয় যে বলে তাহারিই পাপ হয় ইহার প্রমাণ আগম ও তন্ত্রের দুইটা বচন অভ্যাস ছিল পাঠ করিলেন এবং কহিলেন মদ্য ব্যতিরেকে উপাসনাই হয় না৷’’৮৬

‘বৈদ্য সংবাদ’-এ বৈদ্যদের অর্থলোলুপতা এবং ‘বৈষ্ণব সংবাদে’ বৈষ্ণবদের ভোগাকাঙ্খা বর্ণিত হয়েছে৷

এভাবে ‘সমাচারদর্পণ’-এ প্রকাশিত উক্ত রচনাগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় উনিশ শতকের দোরগোড়ায় বাংলা সাহিত্যে বাস্তবতার যে প্রস্রবন বইতে শুরু করেছিল তা পরবর্তী সময়ে উপন্যাসের ভিত্তিভূমিকে সুদৃঢ় করেছিল৷ তিলকচন্দ্র, বিবাহ পাগল অবুঝচন্দ্র, বৈষ্ণব, বৈদ্য শ্রেণীর লোকেরা সকলেই বাস্তব সমাজের প্রতিনিধি৷

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আরেক অন্যতম রচনা ‘কলিকাতা কমলালয়’৷ ১৮২৩ খ্রিঃ এর প্রকাশকাল৷ এখানে বর্ণিত হয়েছে সদ্য প্রতিষ্ঠিত কলকাতা নগরীর প্রধানতম বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পরিণত হওয়া এবং তার সূত্র ধরে ইংরেজ প্রভুদের অসৎ উপায়ে বল্গাহীন লুণ্ঠনের অবাধ তাণ্ডবের সুযোগ নিয়ে হঠাৎ ধনী হওয়া বাঙালির নৈতিকতার অধঃপতনে সমাজ ব্যবস্থার সুশৃঙ্খল বন্ধন ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ার কাহিনি৷ বিভিন্ন জাতি সম্প্রদায়ের ন্যায়-অন্যায় বা সৎ-অসৎ পথে সংগৃহিত অর্থবল শ্রেণী বিভাগের মানদণ্ড হয়ে পড়ে৷ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত ধনীর দল শিক্ষা-সংস্কৃতির ভিত্তিভূমিকে পাদাঘাত করে সমাজের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ায়৷ অর্থের ‘হরির লুঠে’ কলকাতা কমলালয়ের রূপ লাভ করে; যদিও কমলা অর্থাৎ লক্ষ্মীপুরের অপার ধনসম্পদের বাহার থাকলেও সেই শ্রী আর থাকে না৷ মধ্যযুগের বাঙালিসমাজ আধুনিক যুগের সূচনাপর্বে এসে ধনপ্রাচুর্য্যে সংযম হারিয়ে ফেলে এক বিপর্যস্ত ইতিহাস তৈরি করে যার বিস্তারিত বর্ণনা এই রচনায় প্রস্ফুটিত হয়েছে৷ একজন বিদেশী এবং একজন নগরবাসীর কলকাতা, তার মানুষজন, ভাষা, রীতি-নীতি, আচার নিয়ম সম্পর্কে প্রশ্ন-উত্তরের ভঙ্গিতে এটি হয়েছে৷ যেমন কলকাতা নগরে জাতিগত উৎকর্ষতাকে ছাপিয়ে অর্থনীতির মানদণ্ডে শূদ্র ব্রাহ্মণের দলপতিরূপে অবস্থান করে, এমন একটি প্রশ্ন পাওয়া যায় বিদেশীর মুখের কথায়—‘‘আপনকার অনুগ্রহেতে দলাদলের বিষয় তাবৎ অবগত হইলাম কিন্তু শূদ্রে ব্রাহ্মণের দলপতি হইয়া থাকেন ইহা শুনিয়া বিস্ময়াপন্ন হইয়াছি তাহাতে ব্রাহ্মণঠাকুর মহাশয়রা কি আপন স্বেচ্ছাপূর্ব্বক তাঁহারদিগের দলভুক্ত থাকেন কি তাঁহারা ভয় কিম্বা লোভ দর্শাইয়া আপন দলভুক্ত করেন৷’’৮৭ উপন্যাসের নানাবিধ লক্ষণের মধ্যে বাস্তবতা একটা প্রধান লক্ষণ৷ ‘কলিকাতা কমলালয়’ বাস্তবরস সমৃদ্ধ রচনা হলেও এখানে চরিত্র বা ঘটনা কোনটাই পরিণতি লাভ করতে পারেনি৷ তাই বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের আবির্ভাবের কালগত সীমাটাকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায় না৷

১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে ‘বাবুর উপাখ্যান’-এর পরিবর্ধিত রূপ ‘নববাবু বিলাস’ রচনা করেন প্রমথনাথ শর্মা ছদ্মনামে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বাংলা সাহিত্য জগতে অন্য মাত্রা সংযোজন করেন তিনি৷ গদ্য-পদ্যের মিশ্রণে ‘নববাবু বিলাস’-এ বর্ণিত হয়েছে পারিবারিক স্নেহ-প্রশ্রয়ে, খোশামুদে স্তাবকজাতীয় অমাত্যগণের বাক্যের নিষ্পেষণে এবং বেশ্যাসম্ভোগের অমিতাচারিতায় বাবু দুর্ল্লভচন্দ্রের প্রকৃত বাবু হয়ে ওঠার কাহিনি৷ যেখানে বাবুদের স্বভাব বৈশিষ্ট্য বলতে গিয়ে ব্যক্ত করেছেন—

 ‘‘মনিয়া বুলবুল আখড়াই গান,

 খোষ পোষাকী যশমী দান,

 আড়িঘুড়ি কানন ভোজন

 এই নবধা বাবুর লক্ষণ৷’’৮৮

খলিফা বাবু শ্রেণীর গণিকা বিলাস সম্পর্কে বলেছে—‘‘যত প্রধানা নবীনা গলিতা যবনী বারাঙ্গনা আছে ইহাদিগের বাটীতে মধ্যে মধ্যে যাতায়াত করিবা ঐ বারাঙ্গনাদিগের সর্ব্বদা ধনাদি দ্বারা তুষ্ট রাখিবা কিন্তু যবনী বারাঙ্গনাদিগকে বাই বলিয়া থাকে তাহা সম্ভোগ করিবা কারণ পলাও অর্থাৎ পেঁয়াজ ও রশুন যাহারা আহার করিয়া থাকে তাহারদিগের সহিত সম্ভোগে যত মজা পাইবা এমন কোন রাঁড়েই পাইবা না৷’’৮৯

নববাবু ভোগে কামনায় লাম্পট্যে-বিলাসিতায় শেষপর্যন্ত সর্বস্ব হারিয়ে অত্যন্ত দীনহীনভাবে কায়ক্লেশে দিনাতিপাত করতে থাকে৷ তার উশৃঙ্খলতার অত্যধিক প্লাবনে ঐশ্বর্য-সম্পদ-সম্মান সমস্ত তলিয়ে যায়৷

এখানে অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বাবু দুর্লভচন্দ্রের জীবনের ভয়াবহ পরিণতিকে৷ কাহিনি ঘটনার সূত্র ধরে নির্দিষ্ট গতিতে এগিয়ে গেলেও তার একমুখী সরলরৈখিক গতিতে অন্য সব চরিত্রেরা নিষ্প্রভ হয়ে গেছে৷ নববাবু ছাড়া খলিপা, সুরবাবু এবং নববাবুর পিতা কিছুটা ব্যক্তিত্বমণ্ডিত হলেও চরিত্রগুলির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, ঘাত-প্রতিঘাত তেমন সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত না হওয়াতে এই রচনাটিও প্রথম বাংলা উপন্যাসের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা অর্জন করতে পারেনি৷

১৮২৫ খ্রিস্টাব্দে ভবানীচরণের আরেকটি লেখা প্রকাশিত হয় নাম ‘দূতী বিলাস’৷ সমাজ মধ্যস্থিত দুর্দমনীয় ব্যভিচার ও বিলাসকেলিকে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে তিনি ‘দূতী বিলাস’ রচনা করেন৷ মালিনী, নাপতিনি, উড়েনি, দাসী ইত্যাদি নিম্নবিত্ত নারীদের প্ররোচনা ও সহায়তায় ভদ্র-গৃহস্থ ঘরের কুলবধূ, বিধবা কন্যারা নির্দ্বিধায় পরকীয়ায় মত্ত হয়ে জীবনের জটিলতাকে কণ্ঠে ধারণ করতো৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে সেই নিম্নবৃত্তির মালিনী, নাপতেনি শ্রেণীর দূতীরা অন্দরমহল ও বহির্মহলে অবাধ যাতায়াতের সুযোগ নিয়ে সমাজে ব্যভিচার, উশৃঙ্খলতাকে ভয়াবহ করে তুলেছিল৷ উনিশ শতকের সামাজিক ইতিহাসকে পর্যালোচনা করলে এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী মেলে যেখানে নাপতিনি, মেছুনি, ফুলওয়ালী, গোয়ালিনি ইত্যাদি নারীদের পরামর্শে বহু-কুলবধূ ও বিধবাকন্যারা গণিকা হয়ে অন্ধকার জীবনে পা বাড়িয়েছে৷

নাপতিনির কুপরামর্শে পতিপ্রেমবঞ্চিতা কুলবধূর গণিকা হয়ে ওঠার করুণ কাহিনি ও ভয়ঙ্কর পরিণতি উপস্থাপিত হয়েছে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববিবি বিলাস’-এ৷ ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে রচিত এই রচনায় লেখক কোনো নাম ব্যবহার করেননি৷ পরে তৃতীয় সংস্করণে ভোলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছদ্মনাম ব্যবহার করেছিলেন৷

‘নববিবি বিলাস’ ‘নববাবু বিলাস’-এর সমগোত্রীয়৷ এখানে গৃহত্যাগী কুলবধূর দেহব্যবসায় যোগদান এবং গণিকা মাতার পরামর্শে নববিবি হয়ে নিজের প্রকৃত পরিচয়কে হারিয়ে ফেলা মূল উপজীব্য৷ জীবনে জটিল পথে নানা চড়াই-উতরাই পেড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ভিক্ষার থালা হাতে নিয়ে প্রাণ ধরে রাখতে হয় তাকে৷ নববিবি বা নববিবির মতো নারীদের জীবনের গতিপথ বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক শুরু ও শেষে একটি কথা ব্যবহার করেছেন যা যথার্থভাবে প্রযোজ্য হয়েছে নববিবির জীবনে—

 ‘‘অগ্রে বেশ্যা পরে দাসী মধ্যে ভবতি কুট্টনী৷

 সর্ব্বশেষে সর্ব্বনাশে সারম্ভবতি টুককনী৷৷’’৯০

নববিবি গৃহত্যাগ করে প্রথমে বেশ্যা হয়ে দেহবিক্রয় করেছে, তারপর গণিকাগৃহে দাসীবৃত্তি করে অর্থ উপার্জনের অপর্যাপ্ততায় ‘কুট্টনী’ হয়েছে৷ ‘কুট্টনী’কে সোজা কথায় বলে ‘দালাল’৷ দীর্ঘদিন গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত থাকায় তার পরিচিত বাবুদের কমবয়সি সুন্দরী পারদর্শী গণিকার সন্ধান দিয়ে উপার্জন করা হল ‘কুট্টনী’ বৃত্তি৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কার্যেও সফলতা না পেয়ে নিজের সবকিছু হারিয়ে ভিক্ষারপাত্র হাতে পথে নেমেছে৷

‘নববাবু বিলাস’-এর মতো এখানেও কাহিনি ও ঘটনার একমুখী গতিতে উপন্যাসের অন্য সব বৈশিষ্ট্য ম্লান হয়ে গেছে৷

এই রচনাগুলিতে অতিমাত্রায় ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সরস চটকভাব বাংলা ভাষার নবনির্দেশিত শিল্পশ্রীকে স্পর্শ করতে পারেনি যা কিনা উইলিয়াম কেরি, বিদ্যাসাগর, রামমোহন প্রমুখদের হাত দিয়ে শৈশব থেকে যৌবনে পথ চলা শুরু করেছিল৷ ব্যঙ্গ-বিদ্রুপকে ফুটিয়ে তোলার জন্য তিনি যে কথ্যভাষার সাহায্য নিয়েছিলেন তা সামাজিক উপন্যাসের অন্যতম গুণ৷ তথাপি সমাজ বাস্তবতার সুস্পষ্ট ছাপ থাকলেও কাহিনি, চরিত্র, ঘটনা তথা উপন্যাসের অন্যান্য লক্ষণগুলিকে স্পর্শ করতে পারেনি৷

তবে এত কিছুর পরেও মধ্যযুগীয় মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিকগত কৌশলকে অতিক্রম না করে আধুনিক উপন্যাসের ভিত্তিভূমিকে এড়িয়ে গেছে ‘নববাবু বিলাস’-এর মতো রচনা৷ যেমন গঠনশৈলীতে দেখা যায়—

 শ্রী শ্রীদূর্গা

 শরণং

 অথ বন্দনা—গণপতি বন্দনা—সরস্বতী বন্দনা—ভূমিকা৷

 অঙ্কুর খণ্ড—শিরোনামসহ সাতটি পরিচ্ছেদ

 পল্লবখণ্ড—শিরোনামসহ তিনটি পরিচ্ছেদ

 কুসুম খণ্ড—শিরোনামসহ তিনটি পরিচ্ছেদ

 ফল খণ্ড—শিরোনামসহ তিনটি পরিচ্ছেদ

 চতুর্থ খণ্ড শেষে লেখকের স্বনাম প্রকাশ৷

যতি বা বিরাম চিহ্নের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে মধ্যযুগীয় এক দাড়ি (৷ ) ও দুই দাড়ি (৷৷ ) ব্যবস্থা৷

‘নববিবি বিলাস’-এ সরস্বতী বন্দনা, গণপতি বন্দনা ইত্যাদি না থাকলেও পয়ার, দ্বিপদী, ত্রিপদীর প্রাচুর্য দৃষ্টি এড়ায় না৷

তবে একথা অবশ্যই বলা যায় ভবানীচরণ সাহিত্যের সূত্র মেনে কোনো শিল্প তৈরি করতে চাননি অর্থাৎ শৈল্পিকগুণমণ্ডিত সাহিত্য উপকরণ তৈরি করা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না, তিনি চেয়েছিলেন তৎকালীন সমাজের মানুষের নৈতিক বিপর্যয়কে, ব্যভিচার-ভোগবিলাসকে উপস্থাপন করতে৷ আর রঙ্গ-ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের আকারে সেই ছবিকেই ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি—যার সাহিত্যিক তকমা ‘নকশা’ নামে৷ নকশা রচনা করতে গিয়েই তিনি বাংলা উপন্যাসের জন্মলগ্নকে একেবারে চূড়ান্ত মুহূর্তে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর নিজেরই অগোচরে৷

হান্না ক্যাথেরিন ম্যলেন্স এর ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’-এর রচনাকাল ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দ৷ অনেক সাহিত্য সমালোচকের মতে এটি ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর পূর্ববর্তী প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাংলা উপন্যাস৷ কেরীর ‘কথোপকথন’ ও বাইবেলের অনুবাদের যুগ্ম আদর্শে পরিকল্পিত করে কয়েকটি খ্রিস্টান বাঙালি পরিবারের জীবনাচারণের কাহিনি বিবৃত করেছেন লেখিকা এই রচনায়৷

লেখিকা বাংলাদেশের মফসসলে নদীতীরবর্তী এক অঞ্চলে কিছুকাল অবস্থান করে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে রচনা করেছেন ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’-এর কাহিনি৷ প্রধান কাহিনি ও উপকাহিনির মোড়কে আবৃত এটি৷ যেমন প্রধান কাহিনি হল ফুলমণি ও করুণা নাম্নি দুজন চরিত্রের দুটি পরিবারের কাহিনি৷ উপকাহিনির মধ্যে সুন্দরীর কলকাতা যাত্রার কাহিনি, প্যারীর জীবন কাহিনি, মধু ও রাণীর কাহিনি এবং মুসলমান আয়ার কাহিনি৷

ফুলমণির পরিবার খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত৷ যীশুর প্রতি ঐকান্তিক বিশ্বাসে-শ্রদ্ধায় তারা জীবন অতিবাহিত করে এবং যীশুর কৃপায় সুখ-স্বাচ্ছন্দে ভরপুর তারা৷ অন্যদিকে করুণার পরিবার খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হলেও আন্তরিকভাবে প্রভু যীশুর প্রতি আস্থা রাখতে পারে না৷ তাদের সেই দৈন্যতায় যীশু তাদের প্রতি করুণা প্রদর্শনে কার্পণ্য করেন৷ তাদের সাংসারিক জীবন অশান্তির কালোছায়ায় ম্লান৷ লেখিকা এখানে দেখাতে চেয়েছেন খ্রিস্টধর্মের প্রতি আন্তরিক আত্মসমর্পণই সংসারে সুখের উচ্চ চূড়ায় পৌঁছানোর মূল সিঁড়ি৷ অন্য ধর্ম যা পারে না খ্রিস্টধর্ম তা অনায়াসে পারে৷

কাহিনি, ঘটনা, চরিত্রের ঘাত-প্রতিঘাত, সমাজবাস্তবতা উপন্যাসের প্রায় সকল গুণাবলীই এর মধ্যে থাকা সত্ত্বেও ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ প্রথম বাংলা উপন্যাস হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি৷ কারণ লেখিকা খ্রিস্টধর্ম প্রচারকে মূল উদ্দেশ্য করে তাঁর লেখনিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন ফলে চরিত্রগুলি তাদের জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা, ঘাত-প্রতিঘাতগুলোকে জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে সমাধান না করে ধর্মগ্রন্থের বাণী আওড়ে তাকে এড়িয়ে গিয়েছে৷ তারা হয়ে পড়েছে নিষ্প্রভ ও নির্জীব৷ যেমন করুণা একদিন ফুলমণির মেয়ে সুন্দরীর হাতের একমাত্র স্মৃতিচিহ্ন একটি চিনা গোলাপের চারাগাছকে নষ্ট করে ফেললে ফুলমণি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে৷ কিন্তু পরক্ষণেই খ্রিস্টধর্মগ্রন্থের একটি সান্ত্বনাদায়ক পদ তার স্মরণ হওয়ায় তার অন্তর্যন্ত্রণা লাঘব হয়ে যায়৷ যেমন—‘‘তৃণ শুষ্ক হয়, ও পুষ্প ম্লান হয়, কিন্তু আমাদের ঈশ্বরের বাক্য নিত্যস্থায়ী৷’’৯১ করুণার দ্বারা গাছটির ক্ষতি হওয়াতে অনুতপ্ত করুণাকে ফুলমণি বলে—‘‘ক্ষতি নাই৷ ইহাতে ধর্ম্মপুস্তকের একটি অতি সান্ত্বনাদায়ক পদ আমার স্মরণ হইতেছে৷ হায় করুণা! তুমি যদি আপন মনে ঐ কথার বহুমূল্যতা জ্ঞাত হইতা, তবে তোমার দুঃখ অনেক ন্যূন হইত৷’’৯২ করুণার স্বামী অত্যাচারী৷ মদ্যপান, বেশ্যাগমন ইত্যাদি তার প্রাত্যহিক কর্ম৷ নানা কারণে সে করুণার উপর মানসিক, শারীরিক নির্যাতন চালায়৷ লেখিকা করুণার সংসারের শান্তির জন্য বলেন—‘‘হায় করুণা! তুমি যদি সত্য খ্রীষ্টীয়ান হইতা, তবে আমার মনে কিঞ্চিত ভরসা জন্মিত, যে তোমার স্বামী দুষ্টতা ত্যাগ করিয়া ক্রমে২ ভালো হইবে;৷’’৯৩ কারণ ‘‘ধার্ম্মিক ব্যক্তির একান্ত প্রার্থনা অতি সফল হয়’’৯৪, যাকুবের পত্র ৫৷১৬৷

হান্না ক্যাথেরিন ম্যলেন্স শুধুমাত্র ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্য নিয়েই রচনাটা সম্পন্ন করেছিলেন৷ ফলে সমগ্র রচনাটি নীতিবাক্যে ভারাক্রান্ত এবং শুধু ধর্মপ্রচারই নয় নিজের ধর্ম অর্থাৎ খ্রিস্টধর্মকে শ্রেষ্ঠ প্রতিপন্ন করতে গিয়ে অন্য ধর্মের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করতেও দ্বিধাবোধ করেননি৷ যেমন—ফুলমণির সন্তান সাধুর মুখে তাদের সুষ্ঠু ধর্মাচারণার বিবরণ শুনে লেখিকা মনে মনে ভাবে যে ফুলমণির পরিবারের মতো ধার্মিক বাঙালি খ্রিস্টান লোক থাকলে তাদের ধর্ম আরও বেশি প্রশস্ত হতো৷ ‘‘কিন্তু দুঃখের বিষয় এই, যে অনেক ভক্ত খ্রীষ্টিয়ান লোকেরা হিন্দু ও মুসলমানদের ন্যায় মন্দ আচার ব্যবহার করিয়া খ্রীষ্টের নামে কলঙ্ক দেয়৷’’৯৫ তিনি নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব এবং পরধর্মের হীনতা প্রকাশ করতে গিয়ে আরও বলেন—‘‘হিন্দুদের সহিত আমাদের প্রতিদিন সাক্ষাৎ হয়, অতএব তাহাদিগকে কিছু শিক্ষা দেওয়া খ্রীষ্টিয়ান স্ত্রীলোকদের উচিত৷ তাহারা যদি এমত করিত, তবে বোধ হয় হিন্দুরা ইংরাজদের কথা স্বদেশীয় লোকদের কথা উত্তমরূপে শুনিত; সুতরাং তাহারা মনে করিবে, পূর্ব্বে ইহারা আমাদের ন্যায় হিন্দু ছিল, এখন বুদ্ধি পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছে যে নূতন ধর্ম্ম পুরাতন ধর্ম্ম হইতে উত্তম৷’’৯৬ আর এই অতিরিক্ত ধর্মীয় ভাবাবেগের মোড়কে বাঁধতে গিয়ে রচনাটির উপন্যাসগুণ তথা শিল্পগুণকেউ খণ্ডিত করেছেন এবং বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হওয়ার পথে অন্তরায় হয়েছে৷ এছাড়াও গ্রন্থটি যে তাঁর মৌলিক গ্রন্থ নয় সে বিষয়ে অনেক সমালোচকই সহমত পোষণ করেছেন৷

তবুও ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ উপন্যাস না হলেও সেখানে প্রায় চরিত্রপোযোগী সংলাপ সৃষ্টি, সামাজিক নানা কুসংস্কারের স্বরূপ উদ্ঘাটন, স্ত্রী শিক্ষা, নারীস্বাধীনতা, বিধবা বিবাহ এবং স্বামী নির্বাচনে নারীর স্বাধীনতা ইত্যাদি নানা শুভ ভাবনার প্রয়োগকুশলতা উনিশ শতকের সামাজিক পটভূমিকে যেমন চিনিয়ে দেয় তেমনি আধুনিক পাঠক-সমালোচকদের মননকেউ আলোড়িত করে৷

বাংলা সাহিত্য জগতে বাবুশ্রেণীকে কেন্দ্র করে তিনটি রচনা বিশেষ তাৎপর্যবাহী৷ ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবু বিলাস’ (১৮২৩), প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮) এবং কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ (১৮৬২) তিনটি রচনাতেই বাবুচরিত্র এবং বাবুকেন্দ্রিক সমাজজীবন আলোচিত হয়েছে৷ ‘নববাবু বিলাস’-এর কথা পূর্বেই বলা হয়েছে৷ ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’ও ঠিক উপন্যাস নয়৷ এটি নবপ্রতিষ্ঠিত কলকাতা নগরীর বাবুশ্রেণীর উশৃঙ্খল গণিকাসক্ত জীবনের বাস্তব চিত্র৷ তৎকালীন সমাজজীবনকে খণ্ড চিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন লেখক৷ ঐশ্বর্য বিলাসের জোয়ারে গা ভাসিয়ে দেওয়া বাবুদের রুচিবিকারে ও সামাজিক নানা অসঙ্গতিতে লেখক তীব্র শ্লেষপূর্ণ কষাঘাত হেনেছেন ঠিকই কিন্তু কোনো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন চরিত্র সৃষ্টি করতে পারেননি৷ ফলে বাস্তবতার সুষ্ঠু প্রয়োগ থাকলেও চরিত্র-চিত্রণের মতো প্রধানগুণই সেখানে অনুপস্থিত থেকেছে৷

এক্ষেত্রে ‘আলালের ঘরের দুলাল’-কেই সর্বশ্রেষ্ঠ ও সমধিক উপন্যাসগুণবিশিষ্ট বলা যায়৷ এর পরিবেশ বর্ণনা, পূর্ণাঙ্গ ও তথ্যবহ জীবনের নানাচিত্র, চরিত্র, চরিত্রপোযোগী সংলাপ সকলই উপন্যাসের সাহিত্যাঙ্গনে গ্রন্থটিকে প্রতিষ্ঠালাভ করাতে স্থায়ী ভূমিকা নেয়৷ কলকাতার রাস্তাঘাটের কর্মব্যস্ত জীবনপ্রবাহের বাস্তবচিত্র, পারিবারিক জীবন, নব প্রতিষ্ঠিত ইংরেজ শাসনের নানা ব্যবস্থা কীভাবে ব্যক্তিজীবনের নিয়ামক হয়ে ওঠে, আদালতের নানা কৌতুহলপূর্ণ কার্যপ্রণালী সমস্ত কিছুই নবরসোন্মাদনার পরিচায়ক৷ যেমন অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে লেখক বৈদ্যবাটির বাজারের বর্ণনা দিয়েছেন—‘‘রাস্তার দোধারি দোকান—কোনখানে বন্দিপুর ও গোপালপুরের আলু স্তূপাকার রহিয়াছে—কোনখানে মুড়ি মুড়কি ও চাল ডাল বিক্রয় হইতেছে—কোনখানে কলুভায়া ঘানিগাছের কাছে বসিয়া ভাষা রামায়ণ পড়িতেছেন—গরু ঘুরিয়া যায় অমনি টিটকারি দেন, আবার আল ফিরিয়া আইলে চীৎকার করিয়া উঠেন ‘‘ও রাম আমরা বানর রাম আমরা বানর’’—কোন খানে জেলের মেয়ে মাছের ভাগা দিয়া নিকটে প্রদীপ রাখিয়া ‘‘মাছ নেবেগো’’ বলিতেছে—কোনখানে কাপুড়ে মহাজন বিরাট পর্ব্ব লইয়া বেদব্যাসের শ্রাদ্ধ করিতেছে৷’’৯৭ শুধু ঘটনা, পরিবেশ ও প্রতিবেশই নয় চরিত্র অঙ্কনেও এর শ্রেষ্ঠত্ব অনস্বীকার্য৷ যেমন নায়ক মতিলাল, তার বাবা বাবুরাম বাবু, দুই সহোদরা এবং দুষ্কর্মে সহযোগী বন্ধুবর্গ সকলেই জীবন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ৷ সবথেকে জীবন্ত ও উৎকর্ষ চরিত্র ঠকচাচা৷ তার সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—‘‘ঠকচাচা উপন্যাসের মধ্যে সর্বাপেক্ষা জীবন্ত সৃষ্টি; উহার মধ্যে কূটকৌশল ও স্তোকবাক্যে মিথ্যা আশ্বাস দেওয়ার অসামান্য ক্ষমতার এমন চমৎকার সমন্বয় হইয়াছে যে, পরবর্তী উন্নত শ্রেণীর উপন্যাসেও ঠিক এই রূপ সজীব চরিত্র মিলে না৷’’৯৮ এছাড়া রয়েছে বেচারাম, বেণী, বাঞ্ছারাম, বক্রেশ্বর ইত্যাদি চরিত্রগুলি৷ প্রতিটি চরিত্রই তাদের নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল৷ নায়ক মতিলালের জীবনেরও একটা পূর্ণাঙ্গ পরিণতি দেখানো হয়েছে৷

 অতীতের নানা রচনার সোপান বেয়ে প্যারীচাঁদ মিত্রের হাত দিয়ে বাংলা উপন্যাস প্রথম ১৮৫৮ সালে ‘আলালের ঘরের দুলাল’-এর মধ্য দিয়ে মুক্তির আলো গ্রহণ করে৷ রচনাকার এক্ষেত্রে উপন্যাস রচনা করতেই চেয়েছিলেন যা ইতিপূর্বে কোনো বাঙালি লেখক করেননি৷ এ প্রসঙ্গে এর ইংরেজি ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন—The above original Novel in Bengali being the first work of the kind, is now submitted to the public with considerable diffidence. It chiefly treats of the pernicious effects of allowing children to be inproperly brought up, with remarks on the existing system of education, on self-formation and religious culture and is illustrative of the condition of hindu society, manners, customs &c. and partly of the state of things in the moffussil… ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে কৈশোর-যৌবনের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে নতুন জোয়ার নিয়ে আসে৷ সম্পূর্ণ সার্থকরূপে প্রথম শ্রেণীর উপন্যাস না হতে পারলেও এটিই প্রথম বাংলা উপন্যাস৷ এর সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য—‘‘আলালের ঘরের দুলাল’-এ প্রথম সম্পূর্ণাবয়ব উপন্যাসের বিবর্তন বহুদিনের প্রত্যাশিত সম্ভাবনাকে সার্থক রূপ দিয়াছে৷’’৯৯ পরবর্তীকালে বাংলা উপন্যাসের কলেবরে যৌবনের প্রাণশক্তিকে দুর্বার রূপে সঞ্চারিত করেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দুর্গেশনন্দিনী’-এর (১৮৬৫) মধ্যে দিয়ে৷ বাংলা উপন্যাস সাহিত্য জগতে নিজস্বগুণাবলীতে চিরস্থায়ী এবং সর্বজনস্বীকৃতি লাভ করে ভবিষ্যতের গতিমুখী হয়৷

তথ্যসূত্র :

 ১. নির্মল দাশ, চর্যাগীতি পরিক্রমা, পৃ-২২১৷

 ২. তদেব, পৃ-১৯০৷

 ৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সঞ্চয়িতা, পৃ-১৬৬৷

 ৪. নির্মল দাশ, চর্যাগীতি পরিক্রমা, পৃ-২২১৷

 ৫. তদেব, পৃ-১৬২৷

 ৬. তদেব, পৃ-১৩৭৷

 ৭. তদেব, পৃ-১৩৮৷

 ৮. তদেব, পৃ-১১৫৷

 ৯. তদেব, পৃ-১৬৪৷

১০. মৈমনসিংহ গীতিকা, পৃ-৬০৷

১১. তদেব, পৃ-৬১৷

১২. তদেব, পৃ-৬১৷

১৩. তদেব, পৃ-৯০৷

১৪. তদেব, পৃ-৬৮৷

১৫. তদেব, পৃ-৭০৷

১৬. তদেব, পৃ-৮৯৷

১৭. তদেব, পৃ-১০৯৷

১৮. তদেব, পৃ-১১০৷

১৯. তদেব, পৃ-৪০৷

২০. তদেব, পৃ-৮৬৷

২১. তদেব, পৃ-১৯৫৷

২২. তদেব, পৃ-৩৪-৩৫৷

২৩. তদেব, পৃ-২৮৷

২৪. সুকুমার সেন (সম্পাদিত), চণ্ডীমঙ্গল, পৃ-২৫৷

২৫. তদেব, পৃ-২৬৷

২৬. তদেব, পৃ-২৬৷

২৭. তদেব, পৃ-১১৷

২৮. তদেব, পৃ-১১৷

২৯. তদেব, পৃ-১২৷

৩০. তদেব, পৃ-২৫৷

৩১. তদেব, পৃ-২৬৷

৩২. তদেব, পৃ-২৭৷

৩৩. তদেব, পৃ-২৫৷

৩৪. তদেব, পৃ-৪৫-৪৬৷

৩৫. তদেব, পৃ-৬৩৷

৩৬. তদেব, পৃ-৩৬৷

৩৭. তদেব, পৃ-৬০৷

৩৮. তদেব, পৃ-৬০৷

৩৯. তদেব, পৃ-৬২৷

৪০. তদেব, পৃ-৬৪৷

৪১. তদেব, পৃ-৬৪৷

৪২. তদেব, পৃ-৯৫৷

৪৩. তদেব, পৃ-৯৬৷

৪৪. তদেব, পৃ-৪০৷

৪৫. তদেব, পৃ-৯৮৷

৪৬. তদেব, পৃ-১৩৩৷

৪৭. তদেব, পৃ-৭৭৷

৪৮. তদেব, পৃ-৮৪৷

৪৯. তদেব, পৃ-৮৫৷

৫০. তদেব, পৃ-৮৬৷

৫১. তদেব, পৃ-৪৭৷

৫২. তদেব, পৃ-৯৩৷

৫৩. তদেব, পৃ-১০৫৷

৫৪. তদেব, পৃ-৬৬৷

৫৫. তদেব, পৃ-৬৬৷

৫৬. তদেব, পৃ-৬৭৷

৫৭. তদেব, পৃ-৬৭৷

৫৮. তদেব, পৃ-৬৬৷

৫৯. তদেব, পৃ-৬৬৷

৬০. তদেব, পৃ-১৩১-১৩২৷

৬১. তদেব, পৃ-১৩২৷

৬২. তদেব, পৃ-১৩২৷

৬৩. তদেব, পৃ-১৫৩৷

৬৪. তদেব, পৃ-১৫৪৷

৬৫. তদেব, পৃ-১৫৮-১৫৯৷

৬৬. তদেব, পৃ-৩৷

৬৭. তদেব, পৃ-২৫৷

৬৮. তদেব, পৃ-৫৫৷

৬৯. তদেব, পৃ-৫৫৷

৭০. তদেব, পৃ-৬২৷

৭১. তদেব, পৃ-৮৬৷

৭২. তদেব, পৃ-১৫০৷

৭৩. তদেব, পৃ-১৬১৷

৭৪. তদেব, পৃ-৭৭৷

৭৫. তদেব, পৃ-৭৮৷

৭৬. তদেব, পৃ-৭৯৷

৭৭. তদেব, পৃ-৮০৷

৭৮. তদেব, পৃ-৮৩৷

৭৯. তদেব, পৃ-৫৯৷

৮০. তদেব, পৃ-৬২৷

৮১. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-৮৷

৮২. সৌমেন্দ্রনাথ সরকার, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাংলা সাহিত্য, পৃ-৬৷

৮৩. তদেব, পৃ-১০৷

৮৪. তদেব, পৃ-১১৷

৮৫. তদেব, পৃ-১২৷

৮৬. তদেব, পৃ-১৫৷

৮৭. তদেব, পৃ-৪৫৷

৮৮. তদেব, পৃ-৬৬৷

৮৯. তদেব, পৃ-৬৮৷

৯০. তদেব, পৃ-১৯৯৷

৯১. বকুল রোজারিও, ম্যলেন্স হান্না ক্যাথেরিন, ফুলমণি ও করুণার বিবরণ, পৃ-১৪৷

৯২. তদেব, পৃ-১৪৷

৯৩. তদেব, পৃ-৫৫৷

৯৪. তদেব, পৃ-৫৫৷

৯৫. তদেব, পৃ-২৭৷

৯৬. তদেব, পৃ-৭১৷

৯৭. মিত্র, প্যারীচাঁদ, আলালের ঘরের দুলাল, পৃ-৬০৷

৯৮. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-১৭৷

৯৯. তদেব, পৃ-১৯-২০৷

৪. উনিশ শতকের বাংলা উপন্যাসে গণিকা

উনিশ শতকের বাংলা উপন্যাসে গণিকা

উনিশ শতক বাংলা উপন্যাসের প্রতিষ্ঠাপর্ব৷ ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ‘দুর্গেশনন্দিনী’-র মধ্য দিয়ে সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাংলা উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের জগতে যথার্থ স্বরূপে আবির্ভূত হয়৷ শুধু বঙ্কিমচন্দ্রই নন এই সময়কার আরও বহু ঔপন্যাসিকের কলমে বিভিন্ন আঙ্গিকে বাংলা উপন্যাস তার বিচরণক্ষেত্রকে বিস্তৃত করে৷ সময়ের বিবর্তনের ধারায় নবজাগরণের কালপর্ব হিসেবে উনিশ শতক এক গুরুত্বপূর্ণ সময়পর্ব৷ গণিকা জীবনের বহু উত্থান-পতনের ইতিহাস এর পর্বে পর্বে৷ সাহিত্যিকের দৃষ্টিভঙ্গি তাদের করুণাঘন জীবনের যন্ত্রণাকে এড়িয়ে যেতে পারেনি৷ তাই উনিশ শতকের বহু উপন্যাসে গণিকা-স্বৈরিণী চরিত্রের অনুপ্রবেশ এক উল্লেখযোগ্য বিষয়৷ এই সময়পর্বের গণিকাচরিত্র সম্বলিত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ (১৮৫৭), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮), ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২), ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘এই এক নূতন’ বা ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ (১৮৭০-৭৩), বিবি মেরী ই লেসলির ‘এলোকেশী বেশ্যা’ (১৮৭৬), গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘চন্দ্রা’, নবকুমার দত্ত সম্পাদিত অজ্ঞাতনামা লেখকের ‘স্বর্ণবাই’ (১৮৮৮), সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’ (১৮৭৭), দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ (১৮৮০), শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘নয়নতারা’ (১৮৯৯) ইত্যাদি৷ গণিকাচরিত্র তথা গণিকা প্রসঙ্গ উপস্থাপনায় উক্ত উপন্যাসগুলির গুরুত্ব অপরিসীম৷

অঙ্গুরীয় বিনিময় :

ইতিহাস ও কল্পনার মেলবন্ধনে রচিত ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের এই ঐতিহাসিক উপন্যাসের রচনাকাল ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ৷ শিবাজী, আরংজেব, শাহজাহান, রোসিনারা, জয়সিংহ, রামদাস স্বামী ইত্যাদি ঐতিহাসিক চরিত্রগুলির নানা কাহিনির সঙ্গে এমনভাবে কিছু কাল্পনিক বিষয়ের অবতাড়না করেছেন রচয়িতা যেখানে ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠা ও কল্পনারসের সিদ্ধি যুগপৎ সার্থক হয়েছে৷ এই উপন্যাসে রয়েছে এক নামহীনা গণিকার কথা৷ উপন্যাসের নাম ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’৷ এখানে শিবাজী-রোসিনারার প্রণয়ে অঙ্গুরীয় বিনিময়ের মহৎ কর্তব্যটি সাধিত হয়েছে এক গণিকা নারীর দ্বারা৷ শিবাজী আরংজেব কর্তৃক বন্দি হয় দেওয়ান-ই-আম এ৷ সেই সময় আবার মোঘল সম্রাটের জন্মদিনের আমোদপূর্ণ সমারোহ৷ অনুষ্ঠান পার হলেই শিবাজীকে দেওয়া হবে চরমতম দণ্ড৷ সেই আমোদের সমারোহের মাঝেই শিবাজী পলায়নের ফন্দি আঁটে৷ সংবাদ জানাতে হবে রোসিনারাকে কারণ সে আরংজেব বা ঔরঙ্গজেবের কন্যা, শিবাজীর প্রণয়িনী; সেও শিবাজীর সঙ্গে যেতে চায় কিনা৷ সংবাদদাতার ভূমিকা নেয় এক গণিকা৷ সে দেহপসারিণী নারী৷ সর্বত্র অবাধ যাতায়াত তার৷ জন্মদিনের উৎসবমুখর সময়ে শিবাজী-রোসিনারার মিলন ঘটাতে দেহের বদলে শিবাজীর উষ্ণীষ ও অঙ্গুরীয়ের পসরা সাজায়৷ বিরহী রোসিনারা পিতামহ শাহজাহানের সঙ্গে উৎসবের সমারোহ দেখতে দেখতে উপস্থিত হয় সেই বারবনিতার সাজানো দোকানে৷ বারবনিতা তার মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য—‘‘একটি অঙ্গুরীয় এবং উষ্ণীষ প্রদর্শনান্তর সহাস্যবদনে কহিল, ‘‘বাদসাহনন্দিনী! এই সকল দ্রব্যের মধ্যে কিছু ক্রয় করিতে ইচ্ছা হয়?—ইহা অনেক দূর হইতে আসিয়াছে, তুমি গ্রহণ করিলেই সার্থক হয়৷’’ বারনারীর সেই ইঙ্গিতবাক্য বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না রোসিনারার৷ কারণ একবার দেখেই সে চিনতে পেরেছে শিবাজীর অঙ্গুরীয় এবং উষ্ণীষ৷ সেগুলির মূল্য নির্ধারণের জন্য তাকে নিভৃতে ডেকে নিয়ে সব কথা জানতে পারে রোসিনারা৷ গণিকা রোসিনারাকে বলে—‘‘যাহার এই সকল সামগ্রী তিনিই আমাকে এই স্থলে প্রেরণ করিয়াছেন এবং কহিয়া দিয়াছেন যে, যদি আপনি এতদিনেও তাহাকে বিস্মৃত না হইয়া থাকেন, তবে তাহার সহিত প্রস্থানের উপায় করুন৷ এইক্ষণে সকলই আপনার হাত, তাহার হাত কিছুই নাই৷’’ সমাজে যে সমস্ত নারীরা সকলের ঘৃণার পাত্রী, পদে পদে যাদের মিথ্যার বেসাতি করে জীবন ধারণের রসদ জোগাতে হয় সেই রকম এক দুশ্চারিণী নারীকে এমন গোপনীয় বিষয়েও যে ভরসা করা যায় তা দেখে রোসিনারা বিস্ময়াভূত হয়ে যায়৷ কারণ শিবাজী মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামি, সে আবার পালিয়ে যাচ্ছে, যাওয়ার সময় প্রণয়িনীকেও সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়৷ তাই কোনো এক নিভৃত স্থানে সে অপেক্ষা করছে এবং সেই অপেক্ষারত স্থানের হদিস জানে সেই পতিতা৷ সমাজ পরিত্যক্ত এহেন নারীদের এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দিয়ে স্বয়ং রচনাকার গণিকা নারীদের প্রয়োজনীয়তার কথা ব্যক্ত করেছেন৷ যদিও শেষ পর্যন্ত পিতামহের অনুমতি পেয়েও রোসিনারা সেই বারবনিতার সঙ্গে শিবাজী নির্ধারিত স্থানে যায়নি কারণ আরংজেব এবং শিবাজীর হিন্দু জাতি-ভাইরা তাহলে শিবাজীকে তিষ্ঠতে দেবে না এবং দুই দিকে শত্রুতা দমন করাও তার পক্ষে সম্ভব নয়৷ বারযোষিৎ রোসিনারার মনের অভিব্যক্তি ঠিকঠাক না বুঝলেও সে তার কথা মত অপেক্ষা করে৷ কিছুক্ষণ পর একটি চিঠি এবং অঙ্গুরীয় এনে বারবনিতার হাতে দিয়ে তার হাত থেকে শিবাজীর অঙ্গুরীয়টি নিয়ে নেয় রোসিনারা৷ তারপর সেই চিঠি ও আংটি শিবাজীর হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য যে সংকেত স্থানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে তা যেমন দুর্গম তেমনি ভয়ানক৷ লেখকের বর্ণনায়—‘‘সেই দিন নিশীথ সময়ে পূর্বোক্ত বারাঙ্গনা একাকিনী সেতু দ্বারা যমুনা উত্তীর্ণ হইয়া দক্ষিণাভিমুখে গমন করিতে লাগিল৷ সে দিক প্রাচীন দিল্লী, তথায় অনেকানেক ভগ্ন প্রাসাদ এবং বৃহৎ বৃহৎ দেবালয় সকল অদ্যপি দৃষ্ট হইয়া থাকে৷ তৎকালে এক্ষণকার অপেক্ষা আরও অধিক ছিল৷ ঐ স্থানে একটি মনুষ্যেরও গমনাগমন নাই৷ কেবল স্থানে স্থানে শৃগালদি হিংস্রজন্তুরই উপদ্রব আছে৷’’ সেই অন্ধকার রাত্রে জনমানবহীন ধ্বংসাবশেষের মধ্যে অত্যন্ত দুঃসাহসে সংবাদ নিয়ে যেতে হয়েছে সেই বারবনিতাকেই৷ তাকে একা দেখে অপেক্ষারত শিবাজী যখন বিফলতার খবর শোনার জন্য ব্যাকুল হয়েছে তখন অত্যন্ত সংযমী ভাষণে সে জানিয়েছে—‘‘হাঁ মহারাজ! আপনার চেষ্টা বিফল হইয়াছে বটে, কিন্তু যাহা দেখিয়াছি এবং শুনিয়াছি তাহা মুখে বর্ণন করিয়া আর কি জানাইব, এই পত্র এবং অঙ্গুরীয় গ্রহণ করিয়া সমুদায় অবগত হউন৷’’

শিবাজী কিছুটা লিপি পাঠ করে কিছুটা গণিকার মুখে শুনে রোসিনারার মহত্ত্বে এবং তারও বেশি আকর্ষণে যন্ত্রণাদগ্ধ হয়েছে তখন সেই রূপজীবা তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়েছে—‘‘মহারাজ! যাহা বলুন কিন্তু বাদসাহ-পুত্রী উচিৎ কর্ম্মই করিয়াছেন এবং তিনি উচিৎ করিয়াছেন বলিয়াই তাহার সমুদায় গুণ আপনার অনুভূত হইতেছে৷’’ একজন দেহপোজীবিনী নারীও এখানে সমাজের সম্মানশীল বাদশাহপুত্রী মহানুভবতায় অভিভূত হয়ে মহারাজা শিবাজীকে সেই গুণাবলীর কথা বলতে পারছে৷ শুধু শিবাজী নয় সেই বারযোষিৎ-এর মুখে সব কথা শুনে শিবাজীর গুরুদেব রামদাস স্বামীও রোসিনারার প্রতি সমস্ত ক্ষোভকে শান্ত করেছেন এবং অনুমতি দান করে বলেছেন—‘‘মহারাজ আমি অনুমতি করিতেছি আপনি ঐ অঙ্গুরীয় গ্রহণ করুন—এবং যদি শাস্ত্র সত্য হয়, তবে পরজন্মে এই বাদসাহ-কন্যাই আপনার সহধর্ম্মিনী হইবেন ইহার সন্দেহ নাই৷’’ একজন গণিকার সহায়তায় শিবাজী তার যথার্থ জীবনসঙ্গীকে খুঁজে পেয়েছে৷

গণিকা সমাজবিবর্জিতা৷ তারা সকলের ঘৃণার পাত্রী হলেও ঔপন্যাসিক ভূদেব মুখোপাধ্যায় অঙ্গুরীয় বিনিময়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের ভার এবং নায়ক-নায়িকার মিলনের মধ্যস্থতাকারিণী হিসেবে এক বারবনিতাকে বেছে নেওয়া যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন৷ তারা স্বাধীনযৌবনা, কুলস্ত্রীর মতো সংকোচের বালাই, নিষেধের বেড়াজাল নেই তাদের মধ্যে এবং যত্রতত্র বিচরণের অপার দক্ষতা বারবনিতার পক্ষেই সম্ভব৷ শিবাজী রোসিনারার দূতী হিসেবে বারবনিতাকে নির্দিষ্ট করায় গণিকা সমাজের প্রতি তাঁর কিছুটা হলেও সহানুভূতি ফুটে উঠেছে৷ কিন্তু গণিকারা জীবনধারণের জন্য দেহ বিক্রয় করে, অর্থের জন্য নির্মম যৌনখেলায় নিজেকে মত্ত করে কিন্তু এই উপন্যাসের সেই নামহীনা গণিকা যাকে লেখক প্রণয়ী-প্রণয়িনীর মিলন ঘটানোর জন্য জীবনের ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব দিতেও দ্বিধাবোধ করেননি৷ নিশ্চয় অর্থ রোজগার তার জীবনের উপরে নয়৷ কোনো মহৎ আদর্শ বা গুণরাজী না থাকলে কোনো মানুষই তার জীবনকে এভাবে বাজি রাখতে পারে না৷ যে কোনো সময় নিশ্চিত মৃত্যু ঘটতে পারে তার৷ তার পরেও সে পিছপা হয়নি৷ লেখক তাকে দিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করেছে৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় তার দ্বারা উপন্যাসের এতবড় কর্মটি সাধিত করলেও রচনাকার তার নামটুকু দেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেননি৷ উপন্যাসে সে নামহীনাই থেকে গেছে৷

দুর্গেশনন্দিনী :

‘দুর্গেশনন্দিনী’ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস৷ ১৮৬৫ সালে এটি লেখা হয়৷ এখানে মোঘল-পাঠান যুদ্ধ বৃত্তান্ত বর্ণিত হলেও মূলত তিলোত্তমা-জগৎসিংহের প্রেমকাহিনিই মুখ্য৷ ইতিহাস-কল্পনার যুগল সহাবস্থানে নানা প্রসঙ্গে গণিকা জীবনের প্রতিও আলোকপাত ঘটেছে এই উপন্যাসে যদিও তার পরিমাণ খুব কম; স্বতন্ত্র কোনো চরিত্র হিসেবে তো নয়ই৷

উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র হিসেবে অবস্থান করছে বিমলা চরিত্রটি৷ সে বীরেন্দ্রসিংহের কন্যা তিলোত্তমাকে লালনপালন ও রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত৷ কিন্তু তার মধ্যে দাসী বা পরিচারিকার কোনো লক্ষণ ছিল না৷ সে সধবা না বিধবা তাও কারও জানা নেই৷ তার স্বামীর হদিস নেই অথচ সধবাদের মত অলঙ্কার পড়তো, একাদশী করতো না৷ সকলে অনুমান করতো যে বিমলা বহুকাল মোঘল সম্রাটের পুরবাসিনী ছিল৷ বিমলা কোনো দিন তার সম্পর্কে কেউকে কিছু জানতে দেয়নি৷ কিন্তু কতলু খাঁর অন্তঃপুরে বন্দি বিমলা তার সমস্ত কথা যুবরাজকে (জগতসিংহকে) জানিয়ে পত্র লিখেছে৷ যে পত্র পাঠ করে কতলু খাঁর সেনাপতি ওসমান৷ বিমলার জীবনটা ছিল বীরেন্দ্রসিংহের রক্ষিতার মতো৷ তার পত্র থেকে জানা যায় বিমলা আসলে বীরেন্দ্রসিংহের পত্নী৷ শূদ্রীমাতার গর্ভজাত বলে সে বীরেন্দ্রসিংহের গৃহে রক্ষিতার মতো কাটিয়েছে৷ সকলের ঘৃণা সহ্য করে এসেছে কারণ সে স্বামীর কাছে প্রতিশ্রুত ছিল যে স্বামীর মৃত্যুর পূর্বে নিজের পরিচয় কারও কাছে প্রকাশ করবে না৷ কতলু খাঁর হাতে বন্দি বীরেন্দ্রসিংহের মৃত্যুদণ্ডের পর সে তার সকল কথা ব্যক্ত করেছে যুবরাজ জগৎসিংহের কাছে যাতে তাকে কলঙ্কিনী হয়ে মৃত্যুবরণ না করতে হয়৷ তাই সে বলেছে—‘‘যখন লোকে বলিবে বিমলা কুলটা ছিল, দাসী বেশে গণিকা ছিল, তখন কহিবেন, বিমলানীচ-জাতি সম্ভবা, বিমলা মন্দভাগিনী, বিমলা দুঃশাসিত রসনা-দোষে শত অপরাধে অপরাধিনী; কিন্তু বিমলা গণিকা নহে৷’’ কি করুণ জীবন বিমলার৷ বিবাহিত স্বামীর সংসারে তাকে গণিকার মত থাকতে হয়েছে কিন্তু গণিকার ঘৃণ্য পরিচয় সে মরতে চায় না৷ বিমলার মধ্য দিয়ে সমাজে গণিকা নারীদের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়৷

পাঠান বীর কতলু খাঁর ভোগ-বিলাসের চিত্র বর্ণনায় উঠে এসেছে গণিকা জীবনের কথা৷ কতলু খাঁ দুর্বৃত্ত এবং ইন্দ্রিয়পরবশ৷ তার নিয়ম ছিল কোন দুর্গ বা গ্রাম জয় করলেই সেখানকার উৎকৃষ্ট সুন্দরী নারীদের সে তার নিজের ভোগতৃষ্ণা নিবারণ করার জন্য বাছাই করে নিত৷ সেই ভাবেই গড় মান্দারণ জয় করার পরদিনই বন্দিদের সম্মুখে গিয়ে তার বিধিব্যবস্থা করে এবং ‘‘বন্দীদিগের মধ্যে বিমলা ও তিলোত্তমাকে দেখিবামাত্র নিজ বিলাসগৃহ সাজাইবার জন্য তাহাদিগকে পাঠাইলেন৷’’

কতলু খাঁ তার জন্মদিনে বিলাসগৃহে বিলাসগৃহবাসিনীদের সঙ্গে নৃত্যগীত-কৌতুকে মত্ত৷ ‘খোজা’ ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই৷ রমণীদের কেউ নাচছে, কেউ গাইছে, কেউ বাদ্য বাজাচ্ছে কেউ বা তাকে বেষ্টন করে জীবনসুধা পান করছে৷ কতলু খাঁর বিলাস গৃহেরও সুন্দর বর্ণনা করেছেন লেখক৷ যথা—‘‘ইন্দ্রিয়মুগ্ধকর সামগ্রী সকলই তথায় প্রচুর পরিমানে বর্ত্তমান৷ কক্ষমধ্যে প্রবেশ কর; প্রবেশ করিবামাত্র অবিরত সিঞ্চিত গন্ধবারির স্নিগ্ধ ঘ্রাণে আপাদমস্তক শীতল হয়৷ অগণিত রজত দ্বিরদরদ স্ফটিক শামাদানের তীব্রোজ্জ্বল জ্বালায় নয়ন ঝলসিতেছিল; অপরিমিত পুষ্পরাশি, কোথাও মালাকারে, কোথাও স্তূপাকারে, কোথাও স্তবকাকারে, কোথাও রমণী-কেশপাশে, কোথাও রমণীকন্ঠে, স্নিগ্ধতর প্রভা প্রকাশিত করিতেছে৷ কাহার পুষ্পব্যজন, কাহার পুষ্প আভরণ কেহ বা অন্যের প্রতি পুষ্পক্ষেপণী প্রেরণ করিতেছে; পুষ্পের সৌরভ; সুরভি বারির সৌরভ; সুগন্ধ দীপের সৌরভ; গন্ধদ্রব্যমার্জ্জিত বিলাসিনীগণের অঙ্গের সৌরভ; পুরীমধ্যে সর্ব্বত্র সৌরভে ব্যাপ্ত৷ প্রদীপের দীপ্তি, পুষ্পের দীপ্তি, রমণীগণের রত্নালঙ্কারের দীপ্তি, সর্ব্বোপরি ঘন ঘন কটাক্ষ-বর্ষিণী কামিনীমণ্ডলীর উজ্জ্বল নয়নদীপ্তি৷ সপ্তসুরসম্মিলিত মধুর বীণাদি বাদ্যের ধ্বনি আকাশ ব্যাপিয়া উঠিতেছে, তদধিক পরিষ্কার মধুরনিনাদিনী রমণীকন্ঠগীতি তাহার সহিত মিশিয়া উঠিতেছে; সঙ্গে সঙ্গে তাললয়মিলিত পাদবিক্ষেপে নর্ত্তকীর অলঙ্কারশিঞ্জিত শধ মনোমুগ্ধ করিতেছে৷’’ নারীদেহ ভোগের কত না উপাচার৷ গন্ধে-বাদ্যে-পুষ্পে নারীদেহ মথিত করার সুস্পষ্ট বর্ণনা কতলু খাঁর বিলাস গৃহে বর্ণিত হয়েছে৷

জগতসিংহের পিতা মানসিংহ৷ বিমলা তার পত্রের মধ্য দিয়ে মানসিংহ সম্পর্কে যা জানিয়েছে৷ সেখানেও উল্লেখ করা হয়েছে মানসিংহের বহুনারী সম্ভোগের চিত্রকে৷ সে লিখেছে—‘‘আমি তোমার পিতৃভবনে অনেক দিন পৌরস্ত্রী হইয়া ছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে চেন না৷… কুসুমের মালার তুল্য মহারাজ মানসিংহের কন্ঠে অগণিতসংখ্যা রমণীরাজি গ্রথিত থাকিত;’’১০

নারীর জীবন ঠুনকো কাচের মতো৷ সেই জীবনের ভিত নির্ভর তার সতীত্বের উপর৷ সেই সতীত্ব যদি বলপূর্বকও কেউ অপহরণ করে সঙ্গে সঙ্গেই সে অসতী৷ শুধু তাই নয় নারী অন্য পুরুষের হাতে বন্দি হলেও সে সমাজের চোখে অসতী; সে ধর্ষিত হোক চাই না হোক৷ এমন দৃশ্যেরও অবতাড়না রয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে৷ পাঠানদের কাছে পরাজিত হয়ে কতলু খাঁর হাতে বন্দি হয় বিমলা ও তিলোত্তমা৷ প্রশাসনিক ব্যস্ততার কারণে তাদের রূপে লালায়িত হলেও ভোগ করার সময় পেয়ে ওঠেনি৷ কিন্তু যেহেতু তিলোত্তমা, বিমলা বন্দিনী হয়েছে তাই তিলোত্তমার পিতা বীরেন্দ্র সিংহ ও প্রেমিক জগৎসিংহ তাদের কতলু খাঁর উপপত্নী ভেবে নিয়েছে৷ তাদের স্নেহ-ভালবাসা মুহূর্তেই তীব্র ঘৃণায় পর্যবসিত হয়েছে৷ বীরেন্দ্রসিংহ তার স্নেহের ধন তিলোত্তমার সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে চায়নি৷ বিমলার পত্রকে বিরক্তির সঙ্গে দূরে ছুড়ে দিলে কেউ যখন বলেছিল যে সেটা বোধ হয় তার কন্যার পত্র তখন সে সুস্পষ্ট করে জনান্তিকে বলেছে—‘‘কে বলে আমার কন্যা? আমার কন্যা নাই৷’’১১ তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তার কন্যা কতলু খাঁর উপপত্নী হয়েছে৷ আবার জগৎসিংহও যে কিনা তিলোত্তমাকে পাওয়ার জন্য জীবন পণ করেছিল সেই আবার অন্য প্রতিজ্ঞা করে প্রেমিকা অপহৃতা হওয়ার পর—‘‘বিধর্ম্মীর উপপত্নীকে এ চিত্ত হইতে দূর করিব;’’১২ আর মনে মনে বার বার গুরুদেবকে স্মরণ করে বলেছে—‘‘দেখ গুরুদেব! তুমি অন্তর্যামী, অন্তস্থল পর্য্যন্ত দৃষ্টি করিয়া দেখ, আর আমি তিলোত্তমার প্রণয়াপ্রার্থী নহি, আর আমি তাহার দর্শনাভিলাষী নহি৷’’১৩ অর্থাৎ উক্ত উপন্যাসে অভিজাত সমাজের গণিকা-বিলাস, বহুপত্নীগ্রহণ, উপপত্নী প্রথা কোনো কিছুই বাদ পড়েনি৷ এই সমস্ত নারীরা সামাজিক ভাবে কতটা ঘৃণ্য ছিল তা বিমলার পত্র, বীরেন্দ্রসিংহের কন্যাকে অস্বীকার করা, জগৎসিংহের তিলোত্তমাকে পরিত্যাগ করার সংকল্প থেকেই বোঝা যায়৷

কপালকুণ্ডলা :

‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬) উপন্যাসের স্বৈরিণী চরিত্র লুৎফউন্নীসা৷ মতিবিবি নামটি সে ছদ্মবেশকালে গ্রহণ করত৷ তার আসল নাম পদ্মাবতী৷ নবকুমারের পূর্বপত্নী সে৷ প্রথমাবধিই সে স্বাধীন প্রবৃত্তির৷ স্বামীর প্রতি বিরূপ হয়ে বাল্য বয়সেই সে স্বামীকে পরিত্যাগ করেছিল৷ তার পিতা যখন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তখন পদ্মাবতীর নাম হয়ে যায় লুৎফউন্নীসা৷ পরে যখন তার পিতা উচ্চপদস্থ হয়ে আগ্রার প্রধান ওমরাহ হিসেবে গণ্য হয় তখন সে পদার্পণ করেছে যৌবনে৷ পারসিক, সংস্কৃত, নৃত্য, গীত ইত্যাদিতে পারদর্শী হয়ে রাজধানীর অসংখ্য রূপবতী গুণবতীদের মধ্যে অগ্রগণ্য হয়ে ওঠে৷ লেখক তার সম্পর্কে বলেছেন—‘‘দুর্ভাগ্যবশতঃ বিদ্যাসম্বন্ধে তাঁহার যাদৃশ শিক্ষা হইয়াছিল, ধর্মসম্বন্ধে তাঁহার কিছুই হয় নাই৷ লুৎফ-উন্নীসার বয়স পূর্ণ হইলে প্রকাশ পাইতে লাগিল যে, তাঁহার মনোবৃত্তি সকল দুর্দ্দমবেগবতী৷ ইন্দ্রিয়দমনে কিছুমাত্র ক্ষমতাও নাই৷ ইচ্ছাও নাই৷ সদসতে সমান প্রবৃত্তি৷’’১৪ স্বৈরিণী লুৎফ-উন্নীসার নিজেকে সংযত করার কোনোরকম ইচ্ছা বা প্রবৃত্তি ছিল না৷ যৌবনকালে দুর্দমনীয় মনোবৃত্তির জন্য যা যা দোষ জন্মায় লুৎফ-উন্নিসা সবগুলোর অধিকারিণী হয়েছিল৷ তার পূর্ব স্বামী বর্তমান থাকায় কোনো আমির ওমরাহরা তাকে বিবাহ করতেও স্বীকৃত হয়নি৷ যদিও তা নিয়ে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না কারণ—‘‘তিনিও বড় বিবাহের অনুরাগিণী হইলেন না৷ মনে মনে ভাবিলেন, কুসুমে কুসুমে বিহারিণী ভ্রমরীর পক্ষচ্ছেদ কেন করাইব?’’১৫ ভ্রমরীর মতো ফুলে ফুলে বিচরণ করে যুবরাজ সেলিম সহ বহুপুরুষের কন্ঠলগ্না হয়ে জীবনের মৌতাত রচনা করে গেছে৷ কিন্তু বর্ধমান যাওয়ার পথে আকস্মিকভাবে দেখা হয় নবকুমারের সঙ্গে৷ নবকুমার তখন কপালকুণ্ডলার সাথে সদ্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে বাড়ি (সপ্তগ্রামে) ফিরছিল৷ মতিবিবি বা লুৎফ-উন্নীসা ও কপালকুণ্ডলা উভয়ে দস্যুদ্বারা পীড়িত৷ বহুদিন পর স্বামী সন্দর্শনে (তাও আবার সুন্দরী স্ত্রী সমেত) বিহ্বল হয়ে পড়ে সে৷ অন্তঃকরণে পূর্ব প্রেমের জোয়ার এসে তাকে প্রতিস্পর্ধী করে তোলে৷ বহু অনুনয়-বিনয় করে নবকুমারকে অনুরোধ করে তার পায়ে তাকে স্থান দেওয়ার জন্য৷ নবকুমার তা প্রত্যাখ্যান করলে উপস্থিত হয় সপত্নী কপালকুণ্ডলার সমীপে৷ বিনা শর্তে কপালকুণ্ডলা তার প্রস্তাবে রাজী হয়৷ তারপরেও চুপ থাকেনি লুৎফ-উন্নীসা কাপালিকের সঙ্গে পরামর্শ করে তাকে মারার সংকল্প করেছে কিন্তু তার ভেতরকার নারীসত্তা হত্যাকে মেনে নিতে পারেনি তাই নিজেই কাপালিকের সেই চক্রান্তের কথা কপালকুণ্ডলাকে জানিয়ে দিয়েছে৷ এভাবে স্বেচ্ছাচারিতায়, কামনায়, ভালোবাসায় লুৎফ-উন্নীসা বা মতিবিবি চরিত্রটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে৷

বিষবৃক্ষ :

‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩) বঙ্কিমচন্দ্রের প্রকৃত পূর্ণাবয়ব সামাজিক উপন্যাস৷ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র হীরা৷ হীরা প্রচলিত অর্থে দেহব্যবসায়ী নয়; তার পরিচয় দিতে গিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তার চারিত্রিক শুদ্ধতা সম্পর্কে সুস্পষ্ট মন্তব্য রেখেছিলেন৷ কিন্তু সেই চারিত্রিক শুদ্ধতাকে শেষপর্যন্ত রক্ষা করতে পারেনি এই যুবতী৷ লম্পট দেবেন্দ্রর দ্বারা প্রলোভিত হয়ে তার মধ্যে ব্যভিচার দোষ প্রবেশ করেছে৷

বিশ বছরের যুবতী হীরা নগেন্দ্র সূর্যমুখীর গৃহের প্রধানা দাসী৷ জাতিতে কায়স্থ সে৷ বয়সে অন্য সব দাসীদের চেয়ে কনিষ্ঠা হলেও ‘‘তাহার বুদ্ধির প্রভাবে এবং চরিত্রগুণে সে দাসীমধ্যে শ্রেষ্ঠা বলিয়া গণিত হইয়াছিল৷’’১৬ জমিদার নগেন্দ্রনাথের পিতা তার মাতামহীকে অন্য গ্রাম থেকে গৃহপরিচর্যার জন্য নিয়ে এসেছিলেন৷ হীরা তখন বালিকা৷ পরে হীরা উপযুক্ত হয়ে মাতামহীকে ছুটি করিয়ে নিজে দাসীবৃত্তি গ্রহণ করে৷ তার দিদিমা বৃদ্ধা বয়সের সামান্য সঞ্চয় দিয়ে গোবিন্দপুরে গৃহনির্মাণ করে বসবাস করতে থাকে—যা কিনা হীরারও বাড়ি৷ সে বালবিধবা হিসেবে পরিচিত হলেও কেউ কখনো তার স্বামী প্রসঙ্গে কিছু শোনেনি৷ হীরা নিজেও অকলঙ্ক৷ তবে অত্যন্ত মুখরা সে৷ রূপচর্চা সম্পর্কেও তার বিশেষ একটা আগ্রহ ছিল৷ যে কারণে আতর, গোলাপ দেখলেই সে চুরি করতো৷ বিংশতি বৎসরের হীরার রূপ বর্ণনা দিয়েছেন লেখক এইভাবে—‘‘হীরা আবার সুন্দরী—উজ্জ্বল শ্যামাঙ্গী, পদ্মপলাশলোচনা৷ দেখিতে খবর্বাকৃতা; মুখখানি যেন মেঘঢাকা চাঁদ; চুলগুলি যেন সাপ ফণা ধরিয়া ঝুলিয়া রহিয়াছে৷’’১৭ তার স্বভাব সম্পর্কে লেখক বলেছেন—‘‘হীরা আড়ালে ব’সে গান করে; দাসীতে দাসীতে ঝগড়া বাধাইয়া তামাসা দেখে; পাচিকাকে অন্ধকারে ভয় দেখায়; ছেলেদের বিবাহের আবদার করিতে শিখাইয়া দেয়; কাহাকে নিদ্রিত দেখিলে চুণ কালি দিয়া সং সাজায়৷ কিন্তু হীরার অনেক দোষ৷’’১৮

হীরার মধ্যে প্রেম-ভালোবাসার কোনো জায়গা ছিল না বরং এসব থেকে সে দূরেই থাকতো কিন্তু দত্ত বাড়িতে ভিক্ষায় আসা হরিদাসী বৈষ্ণবীর প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার করতে গিয়ে হরিদাসী ছদ্মবেশী দেবেন্দ্রকে দেখে নিজেই প্রণয়ফাঁদে পতিত হয়৷ তার মনপ্রাণ সমর্পণ করে ফিরে আসে সে৷ হীরা দাসী হলেও নিজেকে কখনো হীন মনে করতে পারতো না৷ সূর্যমুখী মনিব বলে তার প্রতি ছিল জাত ক্রোধ৷ আর সেজন্য সূর্যমুখী তাকে ভালো বাসলেও সূর্যমুখীর ক্ষতি করতে উদ্যত হয় সে৷ সূর্যমুখীকে শত্রু হিসেবে প্রতিপন্ন করতে যে কারণগুলি দেখিয়েছে সে তা হল—‘‘সূর্য্যমুখী সুখী, আমি দুঃখী, এই জন্য আমার রাগ৷ সে বড়, আমি ছোট,—সে মুনিব, আমি বাঁদী৷ সুতরাং তার উপরে আমার বড় রাগ৷’’১৯ আবার দরিদ্র, অসহায়, ভাগ্যপীড়িত কুন্দনন্দিনীর প্রতি অপার মমতা অনুভব করতো হীরা৷ কিন্তু যেদিন দেখল তার প্রেমাস্পদ নগেন্দ্রনাথ সেই বিধবা কুন্দনন্দিনীতেই অনুরক্ত এবং তাকে দূতী করেই সে প্রণয়িনী লাভ করতে চায় তখন সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে কুন্দর উপর৷ তার অপ্সরাতুল্য রূপের খুঁত বের করে নিজের সম্পর্কে বলে—‘‘আমরা গতর খাটিয়ে খাই; আমরা যদি ভাল খাই, ভাল পরি, পটের বিবির মত ঘরে তোলা থাকি, তা হলে আমরাও অমন হতে পারি৷ আর এটা মিনমিনে ঘ্যানঘেনে, প্যানপেনে, সে দেবেন্দ্রবাবুর মর্ম্ম বুঝিবে কি?’’২০ আর এইভাবে দুই নারীর ক্ষতিসাধন করতে গিয়ে নগেন্দ্র-সূর্যমুখীর সুখের সংসার ভেঙ্গে তছনছ করে দেয়৷

জীবনের জ্বালা থেকে সে একদিকে যেমন উপন্যাসের অন্যান্য চরিত্রগুলির মধ্যে সমস্যা ডেকে আনে তেমনি দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গেও তার সম্পর্ক জটিলতর হয়ে উঠে৷ দেবেন্দ্র বুঝেছিল হীরার মানস অভিলাষ৷ বুঝে ছিল কোন মন্ত্র প্রয়োগ করলে প্রণয়মুগ্ধা হীরা তার পদতলে পতিত হবে, তাকে মুঠোর মধ্যে পুরে পুতুলের মতো নাচানো যাবে৷ কিন্তু তারপরেও সে হয়তো পুরোপুরি হীরার আক্রোশকে জানতে পারেনি তাই কুন্দনন্দিনীর সাক্ষাৎ করতে গিয়ে হীরার প্ররোচনায় দ্বারোয়ান দ্বারা প্রহৃত হয়ে পলায়ন করে; ক্রোধে অন্ধ হয়ে হীরার ক্ষতি করার সংকল্প নেয়৷ যে প্রেম হীরার সবচেয়ে দুর্বলতম স্থান সেই প্রেমের গান গেয়ে তাকে বশীভূত করে ধর্ষণ করে৷ তারপর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হতেই ধর্মভ্রষ্ট হীরা প্রত্যাখ্যাতা ও পদাঘাত পুরস্কার পেয়ে তার গৃহ থেকে বিতাড়িত হয়৷ হীরা চুপ করে থাকে না৷ যে সতীত্ব হারিয়ে সে আত্মহত্যার সংকল্প নিতে বাধ্য হয়েছিল ক্রমে সেই মৃত্যু চিন্তাই কুন্দ ও দেবেন্দ্রকে বিষ প্রয়োগে হত্যার সংকল্পে ঠেলে দেয়৷ তার মানসিক রূপান্তরকে, ভেতরে অদম্য জ্বালাকে লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন৷ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন—‘‘অপমানিত হীরা পদাহতা সর্পিণীর ন্যায়ই ফণা ধরিয়া উঠিল; তাহার আত্মহত্যার ইচ্ছা দেবেন্দ্র বা কুন্দকে বিষ প্রয়োগের দ্বারা হত্যার সংকল্পে পরিণত হইল৷ একদিকে প্রবল নৈরাশ্যের আঘাত তাহাকে উন্মাদগ্রস্ত করিয়া তুলিল; অপর দিকে প্রকৃত শয়তানোচিত দুষ্টবুদ্ধি তাহাকে কুন্দের চরম দুঃখের মুহূর্তে তাহাকে আত্মহত্যার মন্ত্রণা দিতে, তাহার হাতের নিকট আত্মহত্যার অস্ত্র প্রস্তুত রাখিতে প্রণোদিত করিল৷ হীরার হৃদয়-মন্থনজাত, ঈর্ষা-ফেনিল বিদ্বেষ-হলাহলই সে কুন্দের মুখের নিকট আনিয়া ধরিল, এবং কুন্দ সেই বিষপান করিয়াই মরিল৷’’২১ শেষ পর্যন্ত ভ্রষ্টা হওয়ার যন্ত্রণা, প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা হীরাকে উন্মাদ করে দেয়৷ মৃত্যু পথযাত্রী দেবেন্দ্রর সামনে তার উন্মত্ত অট্টহাসি—মিলন মুহূর্তের সেই গান

 ‘‘স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং

 দেহি পদপল্লবমুদারং’’২২

বিভৎসরূপে তার নগ্নপাপরূপকে সামনে নিয়ে আসে৷ উপন্যাসে হীরা কোথাও বেশ্যাবৃত্তি করেনি, দেবেন্দ্র ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের অঙ্কশায়িনীও হয়নি৷ তার পরেও অনেক সমালোচক তাকে গণিকার তুল্য করে দেখিয়েছেন৷ আসলে বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন পাপের প্রতি সর্বোতভাবে বিতৃষ্ণ৷ আর হীরার পাপ হল সে কুমারীই হোক—বিধবাই হোক আর সধবা—দেবেন্দ্রর প্রতি তার প্রেম জাগ্রত হওয়া মানেই অবৈধ এক প্রণয়ের দিকে যাওয়া৷ শেষ পর্যন্ত তার প্রেম মানসিক স্তরে বদ্ধ হয়ে থাকেনি—শরীরীভাবে যৌনাচারে পর্যবসিত হয়েছে৷ দেবেন্দ্রর কাছে নিজেকে বিকানোর মূলেই ছিল দেবেন্দ্রর প্রতি তার লুব্ধ প্রণয় পিপাসা৷ আর এ জন্যই তার কপট প্রণয়ে নিজের এতকালের রক্ষিত নারীত্বকে বিলিয়ে দিয়ে সে ব্যভিচার দোষে দুষ্ট হয়েছে৷

কৃষ্ণকান্তের উইল :

বঙ্কিমচন্দ্রের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উপন্যাস কৃষ্ণকান্তের উইল৷ রচনাকাল ১৮৭৮৷ রোহিণী, গোবিন্দলাল, ভ্রমর; কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে এই তিনটি প্রধান চরিত্র৷ এই উপন্যাসে স্বৈরিণী চরিত্র হিসেবে অবস্থান করছে রোহিণী৷ বালবিধবা রোহিণী সম্পর্কে লেখক বর্ণনা করেছেন—‘‘রোহিণীর যৌবন পরিপূর্ণ—রূপ উছলিয়া পড়িতেছিল—শরতের চন্দ্র ষোল কলায় পরিপূর্ণ৷ সে অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছিল, কিন্তু বৈধব্যের অনুপযোগী অনেকগুলি দোষ তাহার ছিল৷ দোষ, সে কালা পেড়ে ধুতি পড়িত, হাতে চুড়ি পড়িত, পানও খাইত৷ এদিকে রন্ধনে সে দৌপদীবিশেষ বলিলে হয়; ঝোল, অম্ল, চড়চড়ি, সড়সড়ি, ঘন্ট, দালনা ইত্যাদিতে সিদ্ধহস্ত; আবার আলেপনা, খয়েরের গহনা, ফুলের খেলনা, সূচের কাজে তুলনারহিত৷ চুল বাঁধিতে, কন্যা সাজাইতে, পাড়ার একমাত্র অবলম্বন৷’’২৩

স্বৈরিণী রোহিণী তার রূপ সম্পর্কে সচেতন, গুণ সম্পর্কেও কিন্তু ভাগ্যের বঞ্চনায় বিশুষ্ক সে৷ তাই ঘাটে বসে এই ভেবে সে ক্রন্দন করতে থাকে যে—‘‘কি অপরাধে এ বালবৈধব্য আমার অদৃষ্টে ঘটিল? আমি অন্যের অপেক্ষা এমন কি গুরুতর অপরাধ করিয়াছি যে, আমি এ পৃথিবীর কোনো সুখভোগ করিতে পাইলাম না৷ কোন দোষে আমাকে এ রূপ যৌবন থাকিতে কেবল শুষ্ক কাষ্ঠের মত ইহজীবন কাটাইতে হইল? যাহারা এ জীবনের সকল সুখে সুখী—মনে কর, ঐ গোবিন্দলাল বাবুর স্ত্রী—তাহারা আমার অপেক্ষা কোন গুণে গুণবতী—কোন পুণ্যফলে তাহাদের কপালে এ সুখ—আমার কপালে শূন্য?’’২৪ রোহিণী তাপিত; রোহিণী এক পরিপূর্ণ জীবনের প্রতি লালায়িত৷ ভাগ্যের বঞ্চনায় তার বিক্ষুব্ধচিত্ত ঈষৎ প্রগলভ আচরণে, বৈধব্যের নীতি-নিয়মের কাছে আত্মসমর্পণের অনিচ্ছায় কিছুটা প্রকাশিত৷ তার যন্ত্রণার সিংহভাগই তার অন্তরের অন্তস্থলে জমা৷ তার জীবনযন্ত্রণা দেখে লেখক তার চরিত্রের প্রতি প্রথমে সহানুভূতিশীল হতে বলেও শেষ পর্যন্ত নিজেই বিরূপ হয়েছেন৷

রোহিণীর জীবনের তিনটি পর্যায়ে তিনজন পুরুষ তার মনের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছে৷ প্রথমে হরলাল৷ কৃষ্ণকান্ত রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র৷ রোহিণীর প্রতি তার বিধবা বিবাহের ইঙ্গিত নিমেষেই রোহিণীর মনের ভেতরকার বারুদস্তূপে আগুন ধরিয়ে দেয়৷ হরলালের অসৎ উদ্দেশ্য সে ভালো করেই জানে৷ তাকে বিশ্বাসও করে না৷ কিন্তু তার মনে যে সীমাহীন তৃষ্ণা৷ যে কোনো পানীয় দিয়েই সেই তৃষ্ণা সে নিবারণ করতে চায়৷ ভোগ ও বাসনায় পূর্ণ পৃথিবীর অধিকার পেতে যে কোনো মূল্য দিতে সে প্রস্তুত, কোনোরকম দুঃসাহসী কর্মতৎপরতায় তার ভয় নেই৷ তাই কৃষ্ণকান্তের সিন্দুক হতে উইল চুরি করতে সম্মত হতেও তার বাধে না৷ হরলালকে উদ্দেশ্য করে বলে—‘‘কাগজখানা না হয় রাখিয়া যান, দেখি, কি করিতে পারি৷’’২৫ রোহিণীর অবরুদ্ধ কামনাকে হুতাসনে প্রজ্জ্বলিত করে হরলাল৷ দ্বিতীয় পুরুষ গোবিন্দলালের মধ্য দিয়ে সেই অগ্নিশিখা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে তার শতসহস্র লেলিহান শিখাকে বিস্তৃত করে দেয়৷ গোবিন্দলালের মোহ তার দুর্বার বাসনাকে প্রেমে রূপান্তরিত করে৷ তার ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের কথা ভেবে বারুণীর পুকুরঘাটে বসে সে যখন ক্রন্দনরত গোবিন্দলাল যায় তার দুঃখের কারণ জানতে—‘‘যে রোহিণী হরলালের সম্মুখে মুখরার ন্যায় কথোপকথন করিয়াছিল—গোবিন্দলালের সম্মুখে সে রোহিণী একটি কথাও কহিতে পারিল না৷ কিছু বলিল না—গঠিত পুত্তলীর মত সেই সরোবরসোপানের শোভা বর্দ্ধিত করিতে লাগিল৷’’২৬ রোহিণীর অন্তকরণ গোবিন্দলালের প্রতি কামনায়-ভালোবাসায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে৷ সেই থেকে প্রত্যহ বারুণী পুকুরে সে জল আনতে যায়, প্রতিদিনই কোকিলের কুহুরব ও পুষ্পকাননের মধ্যে গোবিন্দলালের দর্শনে তার প্রেমাকাঙ্খা নব নব পল্লবে পল্লবিত হয়ে ওঠে৷ রোহিণী চরিত্রবান গোবিন্দলালকে জানে৷ সে যদি ঘুণাক্ষরেও তার প্রণায়াসক্ত মনের কথা জানতে পারে তবে তার ছায়া তো মাড়াবেই না উল্টো তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেবে৷ তাই অতি যত্নে সে তার মনের কথা মনের মধ্যেই লুকিয়ে রাখে৷ এ সম্পর্কে রোহিণীর অবস্থা বর্ণনা করে লেখক জানিয়েছেন—‘‘যেমন লুক্কায়িত অগ্নি ভিতর হইতে দগ্ধ করিয়া আইসে, রোহিণীর চিত্তে তাহাই হইতে লাগিল৷ জীবনভার বহন করা, রোহিণীর পক্ষে কষ্টদায়ক হইল৷ রোহিণী মনে মনে রাত্রিদিন মৃত্যুকামনা করিতে লাগিল৷’’২৭ সে তার ভেতরের অবস্থা না পারে কেউকে বলতে না পারে চাপিয়ে রাখতে৷ মৃত্যু ছাড়া তার গতি নাই৷ ঈশ্বর তাকে দুর্ভাগ্য দিয়েছেন, ঈশ্বরই তার অবসান করুক৷ সে মৃত্যুকামনা করলেও মৃত্যুর কোনো পথ অবলম্বন করতে পারে না৷ এ দিকে কৃষ্ণকান্তের সিন্দুকে জাল উইল পড়ে আছে৷ আসল উইল তার হাতে৷ জায়গা মত আসল উইল রেখে আসতে হবে৷ নইলে গোবিন্দলালের সর্বনাশ হবে৷ পুনরায় উইল বদলাতে গিয়ে ধরা পরে সে৷ কিন্তু কাজ হাসিল করতে পেরেছে৷ কৃষ্ণকান্তের করায়ত্ত হওয়ার আগেই আসল উইল সস্থানে রেখে জাল উইল পুড়িয়ে ফেলে রোহিণী৷ বিচারে শত ভয় দেখালেও সত্যকার ঘটনা সে উন্মোচিত করে না৷ কৃষ্ণকান্ত মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গ্রাম থেকে বহিষ্কার করার সিদ্ধান্ত জানালেও না৷ গোবিন্দলালের হস্তক্ষেপে সে মুক্ত হয়৷ কলঙ্কের মধ্যদিয়ে গোবিন্দলালকে তার মনের কথা জানাতে সক্ষম হয়৷ যদিও তা সরাসরি নয়৷ গোবিন্দলালের উইল চুরি সংক্রান্ত জেরায় রোহিণীর মনের কথা উঠে এসেছে এই ভাবে—

‘‘রোহিণী বলিল, ‘‘কি জানিতে চাহেন, জিজ্ঞাসা করুন৷’’

গো৷ তুমি যাহা পোড়াইয়াছ, তাহা কি?

রো৷ জাল উইল৷

গো৷ কোথায় পাইয়াছিলে?

রো৷ কর্ত্তার ঘরে, দেরাজে৷

গো৷ জাল উইল সেখানে কি প্রকারে আসিল?

রো৷ আমিই রাখিয়া গিয়াছিলাম৷ যে দিন আসল উইল লেখাপড়া হয়, সেই দিন রাত্রে আসিয়া, আসল উইল চুরি করিয়া, জাল উইল রাখিয়া গিয়াছিলাম৷

গো৷ কেন তোমার কি প্রয়োজন?

রো৷ হরলাল বাবুর অনুরোধে৷

গোবিন্দলাল বলিলেন, ‘‘তবে কাল রাত্রে আবার কি করিতে আসিয়াছিলে?’’

রো৷ আসল উইল রাখিয়া, জাল উইল চুরি করিবার জন্য৷

গো৷ কেন? জাল উইলে কি ছিল?

রো৷ বড় বাবুর বার আনা—আপনার এক পাই৷

গো৷ কেন আবার উইল বদলাইতে আসিয়াছিলে, আমি ত কোনো অনুরোধ করি নাই৷

রোহিণী কাঁদিতে লাগিল৷ বহু কষ্টে রোদন সংবরণ করিয়া বলিল, ‘‘না—অনুরোধ করেন নাই—কিন্তু যাহা আমি ইহজন্মে কখনও পাই নাই-যাহা ইহজন্মে আর কখনও পাইব না—আপনি আমাকে তাহা দিয়াছিলেন৷’’

গো৷ কি সে রোহিণি?

রো৷ সেই বারুণী পুকুরের তীরে, মনে করুন৷

গো৷ কি রোহিণি?

রো৷ কি? ইহজন্মে বলিতে পারিব না—কি৷ আর কিছু বলিবেন না৷ এ রোগের চিকিৎসা নাই—আমার মুক্তি নাই৷ আমি বিষ পাইলে খাইতাম৷ কিন্তু সে আপনার বাড়ীতে নহে৷ আপনি আমার অন্য উপকার করিতে পারেন না—কিন্তু এক উপকার করিতে পারেন,—একবার ছাড়িয়া দিন, কাঁদিয়া আসি৷ তার পর যদি আমি বাঁচিয়া থাকি, তবে না হয়, আমার মাথা মুড়াইয়া ঘোল ঢালিয়া দেশছাড়া করিয়া দিবেন৷

গোবিন্দলাল বুঝিলেন৷ দর্পণস্থ প্রতিবিম্বের ন্যায় রোহিণীর হৃদয় দেখিতে পাইলেন৷ বুঝিলেন, যে মন্ত্রে ভ্রমর মুগ্ধ, এ ভুজঙ্গীও সেই মন্ত্রে মুগ্ধ হইয়াছে৷ তাঁহার আহ্লাদ হইল না—রাগও হইল না—সমুদ্রবৎ সে হৃদয়, তাহা উদ্বেলিত করিয়া দয়ার উচ্ছ্বাস উঠিল৷ বলিলেন, ‘‘রোহিণি মৃত্যুই বোধ হয় তোমার ভাল, কিন্তু মরণে কাজ নাই৷ সকলেই কাজ করিতে এ সংসারে আসিয়াছি৷ আপনার আপনার কাজ না করিয়া মরিব কেন?’’

গোবিন্দলাল ইতস্ততঃ করিতে লাগিলেন৷ রোহিণী বলিল, ‘‘বলুন না?’’

গো৷ তোমাকে এ দেশ ত্যাগ করিয়া যাইতে হইবে৷

রো৷ কেন?

গো৷ তুমি আপনিই তো বলিয়াছিলে, তুমি এ দেশ ত্যাগ করিতে চাও৷

রো৷ আমি বলিতেছিলাম লজ্জায়, আপনি বলেন কেন?

গো৷ তোমায় আমায় আর দেখা শুনা না হয়৷

রোহিণী দেখিল, গোবিন্দলাল সব বুঝিয়াছেন৷ মনে মনে বড় অপ্রতিভ হইল—বড় সুখী হইল৷ তাহার সমস্ত যন্ত্রণা ভুলিয়া গেল৷ আবার তাহার বাঁচিতে সাধ হইল৷ আবার তাহার দেশে থাকিতে বাসনা জন্মিল৷ মনুষ্য বড়ই পরাধীন৷’’২৮ তার মনের কথা অবশেষে গোবিন্দলালকে বোঝাতে পেরে রোহিণী হাল্কা হয়েছে৷ নতুন করে বাঁচার প্রেরণা লাভ করেছে৷ প্রেমাস্পদকে নয়নের আড়াল করতে পারবে না জন্য সে গোবিন্দলালকে কথা দিয়েও গ্রাম ত্যাগ করতে পারেনি৷ অন্যদিকে গোবিন্দলালের কাছে তার স্ত্রী ভ্রমর রোহিণীকে ভালোবাসার, রোহিণীর ভালোবাসার কথা শুনে তার কাছে ক্ষীরি চাকরানিকে দিয়ে বারুণীর পুকুরে ভুবে মরার আদেশ পাঠিয়েছে এবং রোহিণী সেই সিধান্তই নিয়েছে৷ অপূর্ব রূপবতী রোহিণী জলে ডুবে কাচতুল্য স্বচ্ছ জলের তলে ‘স্বচ্ছস্ফটিক মণ্ডিত হৈম প্রতিমার ন্যায়’২৯ অন্ধকার জলতল আলো করে শুয়ে থাকলে গোবিন্দলাল তাকে উদ্ধার করে ‘ফুল্লরক্তকুসুমকান্তি অধরযুগলে ফুল্লরক্তকুসুমকান্তি অধরযুগল স্থাপিত করিয়া’৩০ রোহিণীর মুখে ফুৎকার দিয়ে বাঁচিয়ে তোলে৷ কিন্তু রোহিণী তিলে তিলে জ্বলে পুড়ে মৃত্যুর চেয়ে একবারে মরা শ্রেয়ষ্কর মনে করে প্রেমাস্পদকে জানায়—‘‘রাত্রিদিন দারুণ তৃষ্ণা, হৃদয় পুরিতেছে—সম্মুখেই শীতল জল, কিন্তু ইহজন্মে সে জল স্পর্শ করিতে পারিব না৷ আশাও নাই৷’’৩১ শেষপর্যন্ত ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে রোহিণী গোবিন্দলালকে লাভ করেছে৷ কিন্তু সে লাভের মধ্যে সম্মান নেই, ভালোবাসা নেই; আছে শুধু দুর্বার প্রবৃত্তির খেলা৷ স্বৈরিণী রোহিণী তার অপরিতৃপ্ত কামনা চরিতার্থ করতে গিয়ে গোবিন্দলালের সঙ্গে রক্ষিতার মতো জীবন কাটিয়েছে৷ গোবিন্দলাল তাকে বিয়ে করেনি, কোনো সামাজিক স্বীকৃতিও দেয়নি শুধুমাত্র রূপমুগ্ধতার জোয়ারে ভেসে গিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে তাকে নিয়ে ভোগের মন্দির সাজিয়েছে৷ রোহিণীর স্বৈরিণী নারীসত্তা তাকে পেয়েও তৃপ্ত হয়নি, গোবিন্দলালকে সম্পূর্ণরূপে পেয়েও তার মধ্যে সর্বদা ক্রিয়া করেছে না পাওয়ার যন্ত্রণা, এক অসুরক্ষিত ভবিষ্যৎ৷ আর এই চোরাপথেই রোহিণীর জীবনে তৃতীয় পুরুষ হিসেবে জায়গা নিয়েছে নিশাকর দাস৷ গোবিন্দলালের স্ত্রী ভ্রমরের পিতা মাধবীনাথ সরকারের আত্মীয় নিশাকর দাস৷ মাধবীনাথ তার সঙ্গে যুক্তি করে রোহিণীকে ফাঁদে ফেলতে যত্নবান হয় যাতে গোবিন্দলাল ও ভ্রমর তাদের সুখী দাম্পত্য জীবন পুনরায় শুরু করতে পারে, ভ্রমরের দুর্দশার অবসান হয়৷ নিশাকর দাসের সঙ্গে জানালার ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি বিনিময় হলে রোহিণী ভাবে—‘‘এ কে? দেখিয়াই বোধ হইতেছে যে, এ দেশের লোক নয়৷ বেশভূষা রকম সকম দেখিয়া বোঝা যাইতেছে যে, বড় মানুষ বটে৷ দেখিতেও সুপুরুষ—গোবিন্দলালের চেয়ে? না তা নয়৷ গোবিন্দলালের রঙ ফরশা—কিন্তু এর মুখ চোখ ভাল৷ বিশেষ চোখ—আ মরি৷ কি চোখ! এ কোথা থেকে এলো?’’৩২ নিশাকর দাসকে দেখে রোহিণীর এ মনোভাব তার বহুপুরুষ লালসার দ্যোতক৷ পরে নিশাকর দাস রাসবিহারী দে ছদ্মনামে গোবিন্দলালের সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে ভ্রমরের বিষয়ের ভাবী পত্তনিদার হয়ে, সেখানে গোবিন্দলালের সম্মতি আবশ্যক বলে সে মনে করে৷ এবং সেই অনুমতির জন্যই সে সেখানে এসেছে৷ রোহিণী আড়াল থেকে সব শোনে এবং নিশাকর দাস ওরফে রাসবিহারী দে’কে পর্যবেক্ষণ করে তার অতৃপ্ত হৃদয় তার সঙ্গে মিলনের জন্য ব্যাকুল হয়ে যায়৷ রূপো নামক চাকরকে পাঁচটাকা বকশিশের লোভ দেখিয়ে গোবিন্দলালের অজ্ঞাতে সাক্ষাতের বার্তা দিয়ে নিশাকর দাসের কাছে পাঠায়৷ চাকরকে বলে—‘‘তুই গিয়ে তাকে বসা৷ এমন জায়গায় বসা, যেন বাবু নীচে গেলে না দেখতে পান৷ আর কেহ না দেখিতে পায়৷ আমি একটু নিরিবিলি পেলেই যাব৷ যদি বসতে না চায়, তবে কাকুতি মিনতি করিস৷’’৩৩ রোহিণীর চরিত্র বোঝাতে, তার ভেতরকার কামনা-বাসনাময় প্রবৃত্তির অন্ধকার দিকটিকে তুলে ধরতে লেখক তার সম্পর্কে আরও বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন—‘‘রোহিণী যে ব্রহ্মানন্দকে এত ভালবাসিত যে, তাহার সংবাদ লইবার জন্য দিগ্বিদিগজ্ঞানশূন্য হইবে, এমন খবর আমরা রাখিনা৷ বুঝি আরও কিছু ছিল৷ একটু তাকাতাকি, আঁচাআঁচি হইয়াছিল৷ রোহিণী দেখিয়াছিল যে, নিশাকর রূপবান—পটোলচেরা চোখ৷ রোহিণী দেখিয়াছিল যে, মনুষ্যমধ্যে নিশাকর একজন মনুষ্যত্বে প্রধান৷ রোহিণীর মনে মনে সঙ্কল্প ছিল যে, আমি গোবিন্দলালের কাছে বিশ্বাসহন্ত্রী হইব না৷ কিন্তু বিশ্বাসহানি এক কথা—আর এ আর এক কথা৷ বুঝি সেই মহাপাপিষ্ঠা মনে করিয়াছিল, ‘‘অনবধান মৃগ পাইলে কোন ব্যাধ ব্যাধব্যবসায়ী হইয়া তাহাকে না শরবিদ্ধ করিবে?’’ ভাবিয়াছিল নারী হইয়া জেয় পুরুষ দেখিলে কোন নারী না তাহাকে জয় করিতে কামনা করিবে?’’৩৪ লেখক বালবিধবা যৌবনমদে মদমত্তা রোহিণীর প্রতি যে বক্তব্য পেশ করেছেন তাতে তার গণিকাসুলভ মানসিকতাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে৷ রোহিণী রূপোর মধ্য দিয়ে সংবাদ নিয়ে সবদিক সচকিত দৃষ্টি রেখে সংকেত স্থানে কিছু বিলম্বে পৌঁছলে এবং তা নিয়ে নিশাকর ছদ্ম অভিমান দেখালে তার প্রতি রোহিণী যে বক্তব্য পেশ করে তাতেও তার বহুপুরুষগামী মনোভাবটি সুস্পষ্ট হয়৷ যেমন—‘‘আমি যদি ভুলিবার লোক হইতাম, তা হলে, আমার দশা এমন হইবে কেন? একজনকে ভুলিতে না পারিয়া এদেশে আসিয়াছি; আর আজ তোমাকে না ভুলিতে পারিয়া এখানে আসিয়াছি৷’’৩৫ তাদের সংকেত স্থানে গোবিন্দলাল এসে আক্রমন করে রোহিণীকে৷ পিস্তল তাক করে সে বলে একদিন যে তার জন্য মরতে চেয়েছিল আজ সে মরতে রাজী আছে কিনা৷ কিন্তু রোহিণী মরতে চাইবে কেন৷ নিশাকর দাসকে দেখে সে আবার নতুন করে বাঁচার প্রেরণা পেয়েছে৷ যে দুঃখে একদিন বারুণীর জলে ডুব দিয়েছিল সেই দুঃখ আজ তার নেই৷ জীবনের সুখের সময়গুলিকে মনে করে হলেও সে বাঁচতে চায়৷ তাই গোবিন্দলালের পিস্তলের সম্মুখে দাঁড়িয়ে সে কেঁদে ওঠে—‘‘মারিও না! মারিও না! আমার নবীন বয়স, নূতন সুখ৷ আমি আর তোমায় দেখা দিব না, আর তোমার পথে আসিব না৷ এখনই যাইতেছি৷ আমায় মারিও না৷’’৩৬

কিন্তু মৃত্যু যে তার ভবিতব্য৷ ভোগে-বিলাসে-কামনা-বাসনায় পরিপূর্ণ স্বৈরিণী রোহিণী জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ পাওয়ার আগেই সমাজ থেকে নিশ্চহ্ন হয়ে যায়৷ সমাজ এই বঞ্চিত বালবিধবাদের মনের যন্ত্রণা বোঝার কোনো চেষ্টা করে না উল্টো নানা বিধি নিষেধ চাপিয়ে তাকে অবদমিত করে রাখার চেষ্টায় সর্বদা রত থাকে৷ রোহিণীর মত নারীকে তাই স্বেচ্ছাচারিণী হতে হয়৷ স্বেচ্ছাচারিণীদের বাস তো সমাজ মেনে নেবে না বা নেয় না তাই তাদের রোহিণীর মতো গুলিবিদ্ধ করে জীবন ও যন্ত্রণার অবসান ঘটানো হয়৷

রাজসিংহ :

বঙ্কিম উপন্যাসে অভিজাত গৃহের পদস্থ নন্দিনীদের বহুপুরুষের প্রতি আসক্তি একটা বহুচর্চিত বিষয়৷ তাঁর অন্যতম ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২)-তে রৌশনারা, জাহানারা, জেব-উন্নীসা, উদিপুরী বেগম প্রমুখরা স্বেচ্ছাচারিতায় নিজেদের ডুবিয়ে রাখে৷ জাহানারা ও রৌশনারা ঔরঙ্গজেবের দুই বোন৷ জাহানারা শাহজাঁদার বাদশাহীর প্রধান সহায় ছিল৷ তার পরামর্শ ব্যতীত কোনো রাজকার্য সম্পন্ন হত না৷ সে পিতার বিশেষ হিতৈষিণী ছিল৷ কিন্তু সে যে পরিমানে রাজনীতি বিশারদ তার থেকে বেশি ইন্দ্রিয়পরবশ৷ ইন্দ্রিয় পরিতৃপ্তির জন্য অসংখ্য লোক তার অনুগৃহীত পাত্র ছিল৷ অন্যদিকে রৌশনারা পিতৃবিদ্বেষিণী এবং ঔরঙ্গজেবের পক্ষপাতি৷ সেও রাজনীতিতে সুদক্ষ এবং জাহানারার মত বিচারশূন্য, তৃপ্তিশূন্য এবং বাধাশূন্য ইন্দ্রিয়পরায়ণ ছিল৷ ঔরঙ্গজেবকে সহায়তা করে পিতাকে পর্যন্ত পদচ্যুত ও অবরুদ্ধ করে রাজ্য অপহরণ করেছিল সে৷ ঔরঙ্গজেবের বাদশাহীতে রৌশনারা দ্বিতীয় বাদশাহ৷

জেব-উন্নীসা ঔরঙ্গজেবের জ্যেষ্ঠা কন্যা৷ অবিবাহিত থেকে ইন্দ্রিয় পরায়ণতায় এবং প্রশাসনিক কাজে সে রৌশানারার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয় এবং ক্রমে তার প্রচেষ্টা ও পরামর্শে রৌশনারা পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যায়৷ তার সম্পর্কে লেখক বলেছেন—‘‘পিতৃস্বসাদিগের ন্যায় বসন্তের ভ্রমরের মত পুষ্পে পুষ্পে মধুপান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন৷’’৩০ এই জেব-উন্নীসা কালে কালে রঙমহলের (বাদশাহের অন্তঃপুর) সর্বকর্ত্রী হয়৷ বাদশাহের অন্তঃপুরে খোজা ভিন্ন অন্য কোনো পুরুষ প্রবেশ করতে পারতো না কিন্তু জেব-উন্নীসা যাকে ইচ্ছা তাকে মহালের মধ্যে আসতে দিত৷ তার প্রণয়ভাজনেরা নির্বিবাদে তার কক্ষে প্রবেশ করতে পারতো৷ এই স্বেচ্ছাচারিণী স্বৈরিণী নারীদের বিলাসগৃহ একেকটা জীবন্ত পাপাগার৷ রাজপ্রাসাদমালার প্রাণকেন্দ্র যে রঙমহল তাও আসলে কুবের ও মদনের যৌথ রাজত্ব৷ চন্দ্র, সূর্য্য সেখানে প্রবেশ করতে পারে না, বায়ুর গতিও রুদ্ধ৷ যমরাজ তার কার্য করেন অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে৷—‘‘তথায় গৃহসকল বিচিত্র; গৃহসজ্জা বিচিত্র; অন্তঃপুরবাসিনী সকল বিচিত্র৷ এমন রত্নখচিত, ধবলপ্রস্তরনির্ম্মিত কক্ষরাজি কোথাও নাই; এমন নন্দনকানননন্দিনী উদ্যানমালা আর কোথাও নাই—এমন উর্ব্বশী মেনকা রম্ভার গর্ব্বখর্ব্বকারিণী সুন্দরীর সারি আর কোথাও নাই, এত ভোগবিলাস জগতে আর কোথাও নাই৷ এত মহাপাপ আর কোথাও নাই৷’’৩৮ পৃথিবীর সমস্ত ভোগ, সমস্ত কামনা, সমস্ত বিলাসিতার উপকরণ এই স্বৈরিণীদের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল৷ নিজেদের সুকুমার নারীত্বকে লালসার বহ্নিতে নিজেই দগ্ধ করে মেরেছিল৷

‘রাজসিংহ’ উপান্যাসের আরেকজন স্বেচ্ছাচারিণী হল উদিপুরী বেগম৷ তার নাম উদিপুরী হলেও উদয়পুরের সঙ্গে কোনো যোগ নেই৷ সে আসলে পাশ্চাত্যদেশের জর্জিয়া যা রুশিয়া রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত সেখানকার মানুষ৷ বাল্যকালে একজন দাস ব্যবসায়ী তাকে ভারতবর্ষে নিয়ে আসে বিক্রয় করার জন্য৷ ঔরঙ্গজেবের অগ্রজ দারা তাকে কিনে নেয়৷ বয়ঃকালে সেই বালিকা অসামান্য রূপবতী হলে দারা তার বশীভূত হয়ে পড়ে তার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হয়৷ উদিপুরী মুসলমান ছিল না, ছিল খ্রিস্টান৷ দারাকে যুদ্ধে পরাজিত করে ঔরঙ্গজেব শুধু সিংহাসনই লাভ করে না সঙ্গে সঙ্গে উদিপুরীকেও বেগম হিসেবে গ্রহণ করে৷ দারা অপর আরেক স্ত্রী ঔরঙ্গজেবের অঙ্কশায়িনী না হতে বিষ পান করে জীবন রাখে৷ উদিপুরী সানন্দে দেবরকে বরমাল্য প্রদান করে৷ এ প্রসঙ্গে লেখকের আক্ষেপ—‘‘খ্রিষ্টিয়ানীটা সানন্দে ঔরঙ্গজেবের কন্ঠলগ্না হইল৷ ইতিহাস এই গণিকার নাম কীর্ত্তিত করিয়া জন্ম সার্থক করিয়াছেন, আর যে ধর্ম্মরক্ষার জন্য বিষ পান করিল, তাহার নাম লিখিতে ঘৃণা বোধ করিয়াছেন৷ ইতিহাসের মূল্য এই৷’’৩৯ কথক উদিপুরীর মত নারীদের যারা সরাসরি দেহের দর হাকেনি কিন্তু দেহকে ভোগের চূড়ান্ত সীমায় নিয়ে যেতেও দ্বিধা করেনি—তাদের গণিকা হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন৷ উদিপুরীর যেমন অতুল্য রূপ, তেমনি ছিল তার মদ্যাসক্তি৷ দিল্লীর বাদশাহদের মত মদ্য এবং পুরুষ তার প্রধান সঙ্গী৷ তার রূপসায়রে সদা অনুগৃহীত পুরুষের আনাগোনা৷

বঙ্কিমচন্দ্রের এই উপন্যাসগুলিতে দেহজীবা, বহুভোগ্যা, স্বৈরিণী নারীদের যে চিত্র উঠে এসেছে তাতে এটুকু বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে উনিশ শতকীয় রক্ষণশীল ধ্যানধারণায় নারীর সতীত্বকে যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছিল তাতে বহুগামী নারীর প্রতি সমাজ খড়গহস্ত হবেই৷ অভিজাত গৃহের নারীরা বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যতই প্রশাসনিক দক্ষতা দেখাক না কেন তাদের চারিত্রিক কলুষতা তাদের আর সব গুণাবলীকে ছাপিয়ে দিয়েছে, সমাজে তাদের অপযশই বিধৃত হয়েছে৷ তাদের স্বেচ্ছাচারিণী ও স্বৈরিণীর কলঙ্কমুকুটই জুটেছে৷

হরিদাসের গুপ্তকথা :

উনিশ শতকের এক অন্যতম উপন্যাস ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’৷ ১৮৭০ থেকে ১৮৭৩ সালে যখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় তখন এর নাম ছিল ‘এই এক নূতন’৷ পরবর্তীসময়ে ১৯৮০-র দশকে এর পৃথক বটতলা সংস্করণ বের হয়৷ বিভিন্ন সংস্করণের মধ্য দিয়ে নাম পরিবর্তিত হতে হতে লেখকের জীবৎকালের শেষ সংস্করণ ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ নামে প্রকাশিত হয়৷ ‘এই এক নূতন’ নাম পাল্টে ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ নামেই পরিচিত লাভ করে৷ উপন্যাসটির রচনাকার হিসেবে ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম থাকলেও লেখাটি কুমার উপেন্দ্রকৃষ্ণ দেব বাহাদুরের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ যেহেতু বইটি ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নাম দিয়েই প্রকাশিত তাই তাঁকেই রচনাকার ধরে নিয়ে উপন্যাসটির গভীরে প্রবেশ করা যেতে পারে৷

রচনাটিতে বর্ণিত হয়েছে এক আত্মপরিচয়হীন জমিদারপুত্রের বাল্য, শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের কাহিনি, উত্থান-পতনের কাহিনি৷ কাহিনির নায়কের নাম হরিদাস৷ জীবনে বহুবিচিত্র অভিজ্ঞতায় সাতঘাটের জল খাওয়া এই বালক প্রত্যক্ষ করেছে সমগ্র ভারতবর্ষের এক বৃহত্তর জটিল রূপকে৷ যেখানে চোর-ডাকাত-বোম্বটে-জলদস্যু, ঠক-জোচ্চর, বদমাশ, মোসাহেব, জমিদার, স্বৈরিণী, বেশ্যা, সৎ-অসৎসহ জীবনের বহুবিচিত্র ধারাকে৷ শিবের ত্রিশূলের ডগায় অবস্থিত কাশী হল সর্বপাপ মুক্তির কেন্দ্র৷ হরিদাস সেই কাশীতে গিয়ে লক্ষ করেছে যে সেই কাশী হয়ে উঠেছে সর্ব পাপচক্রের মূল পীঠস্থান৷ সেখানে প্রতারক, স্বৈরিণী গণিকাদের জমজমাট নিরাপদ বিচরণ৷

এই রচনায় লেখক সমাজের নানা অন্যায়, কুরুচিপূর্ণ অনৈতিক নীতিবোধ প্রকাশ করতে গিয়ে অজস্র পতিতা নারীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন৷ পঞ্চদশ কল্পে ‘এ আবার কি কাণ্ড?’ অংশে হরিদাস কলকাতায় অবস্থানকালীন সময়ে কোনো এক কোজাগরী পূর্ণিমার বিকেলে চিৎপুর রোড ধরে বেড়াতে বেড়াতে গরাণহাটা থেকে কলুটোলা রাস্তা পর্যন্ত লক্ষ করে দুধারি বারান্দায় বারান্দায় রকমারি মেয়েমানুষে ভর্তি৷ নানা বর্ণের কাপড় পড়া, নানা ধরনের ধাতুর গহনা পড়া, রকমারি ধরনের খোঁপাবাঁধা তাদের৷ কেউ কেউ টুলের উপর বসে আছে, কেউ কেউ আবার চেয়ারে, কেউ কেউ রেলিঙের উপর বুক রেখে ভানুমতী ধরনের মুখ বাড়িয়ে রাস্তার দিকে ঝুলছে; ‘‘কারো বুকে রংদার কাঁচুলী, কারো কারো মুখে রংমাখা, কারো খোঁপা নাই, পৃষ্ঠদেশে দীর্ঘবেণী, কেহ কেহ এলোকেশী৷’’৪০ বালক হরিদাস এদের দেখে বিস্ময়াপন্ন হয়৷ কারণ পূর্বে সে শুনেছিল কলকাতা শহরের বেশ্যাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা৷ সে মনে মনে ভাবে—‘‘লোকমুখে শুনেছিলেম, কলিকাতা সহরে বেশ্যা অনেক; যে সকল পণ্ডিত সাধুভাষায় কথা কন, তাঁরা বলেন, বেশ্যা মানে নগরবিলাসিনী বারাঙ্গনা; সুখবিলাসী মতিচ্ছন্ন যুবাদলের চিত্তমোহিনী-বিলাসিনী; এরা সব জঘন্য বিলাস-রসিক যুবাপুরুষের ইহকাল পরকাল ভক্ষণ করে৷’’৪১ এখানে গণিকাপল্লীর জলজ্যান্ত চিত্র হরিদাসের দৃষ্টি দিয়ে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন লেখক৷ যেখানে পতিতা নারীরা দেহের পসরা সাজিয়ে তাদের শরীরী ভালোবাসা বিক্রয়ের জন্য পথের দুপাশে বসে আছে৷ তাদের আকার-অবয়ব, দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা অর্থাৎ শরীরী ভঙ্গিমা, পোশাক-পরিচ্ছদ, সাজসজ্জা, কটাক্ষ-চাহনি কোনো কিছুই রচয়িতার নজর এড়ায়নি৷ তারা তাদের চাকচিক্যময় অতুলনীয় রূপ-বৈভব দিয়ে যুবাদলের মনকে পতঙ্গবৎ আকর্ষণ করে৷ লেখক এদের প্রতি অনুকম্পাহীন৷ তাই এই পণ্যাঙ্গনাদের ইহকাল পরকালের কোনো সুস্পষ্ট শুভ ইঙ্গিত না দিয়ে এদের প্রতি আরোপ করেছেন ঘৃণার প্রলেপ; মন্তব্য করেছেন তারা যুবাদলের ইহকাল পরকালের খাদক৷ শুধু এটুকুই নয় রচয়িতার চোখে তার পিশাচী; মানবীর রূপ ধারণ করে সমাজ-সংসারকে রসাতলে নিয়ে যাচ্ছে৷ প্রকাশ্য জনপদে গণিকাদের অবস্থান দেখে চমকে ওঠে হরিদাস৷ ঘৃণ্য এক অনুভূতি তার সমস্ত শরীরে কাঁটা দেয়৷ সে তার এই অনুভবকে ব্যক্ত করে এইভাবে—‘‘নগরের বিলাসিনীর স্ত্রী-জাতিসুলভ লজ্জাসম্ভ্রমের মস্তকে পদার্পণ কোরে, হেসে হেসে সদররাস্তার ধারে বাহার দিচ্ছে! আকার-অবয়বে ঠিক মানবী, কিন্তু ব্যবহারে এরা জানবা—পিশাচী! কলিকাতা সহর কলুষে পরিপূর্ণ! সিঁতিকাটা, গন্ধমাখা, সাজপরা ফুলবাবুরা রাস্তা দিয়ে চোলে যাচ্ছেন, চক্ষু আছে উর্দ্ধ দিকে! বারান্দার চক্ষুরা তাঁদের দিকে ঘুরে ঘুরে ঘন ঘন কটাক্ষবাণ সন্ধান কোচ্ছে৷’’৪২ শহরের একজন পক্ষীকবি গণিকাদের ‘খদ্দের’ ধরার কৌশলের অন্তর্গত কটাক্ষচাহনিকে ব্যক্ত করে বলেছিলেন যে বারান্দার সেই চোখগুলো পাখিধরা ফাঁদ এবং পুরুষের মন মাতানোর মোহন মন্ত্রের বাঁশী৷

হরিদাস কলকাতা শহরের অভ্যন্তরে সকলের সঙ্গে বেশ্যালয়গুলির অবস্থান সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট মতবাদ ব্যক্ত করেছে৷ যেমন—‘‘কলিকাতার বেশ্যানিবাসের প্রণালীটী অতি জঘন্য৷ গৃহস্থের বাড়ীর কাছে বেশ্যা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে বেশ্যা, ডাক্তার-কবিরাজের আবাসের পাশে বেশ্যা, কোথাও বা ভালোমানুষের মাথার উপর বেশ্যা; অধিক কথা কি, ব্রাহ্ম-সমাজ-মন্দিরের আষ্টে-পৃষ্ঠে বেশ্যা৷’’৪৩ হরিদাসের এই বিরূপ মন্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় যে, পূর্বে অর্থাৎ যে সময়ে ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ উপন্যাসটি লেখেন সে সময় পতিতা নারীদের সকলেই স্বতন্ত্র কোনো পল্লীতে অবস্থান করতো না৷ সমাজ মানসিকতায় তারা যতই ঘৃণিত হোক না কেন নিষিদ্ধ পল্লীর বাসিন্দারূপে তখনো একেবারে সমাজচ্যুত হয়নি৷ সমাজে সকলের সঙ্গেই বাস করতো৷ কিন্তু সমাজে সকলের সঙ্গে তাদের অবস্থান নিয়ে বিরূপ মানসিকতার সূত্রপাত হয়েছিল, সমালোচনার কালোমেঘ তাদের আস্তাকুঁড়ের দিকে ঠেলে দেওয়ার জল্পনা শুরু করে দিয়েছিল৷ অর্থাৎ সমাজে তাদের অবস্থান যে কতটা সর্বনাশের পরিচায়ক হয়েছিল তা হরিদাসের জবানিতেই সুস্পষ্ট৷—‘‘যে সহরের এমন দৃশ্য, সে সহরের পরিণাম কি হবে, সহরবাসী ভদ্রলোকেরা সেটা কি একবারও চিন্তা করেন না?’’৪৪ গণিকাদের সমাজমধ্যে অবস্থান নিয়ে হরিদাস সকলকে সচেতন করে দিতে চাইছে, যাতে পতিতা নারীদের ব্যভিচারের কালো ছায়ায় সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়৷

কলকাতা বিলাস-বৈভবের কেন্দ্রস্থল৷ এর প্রাচুর্য ও বিকাশে মানুষেরা মহিমান্বিত৷ শিক্ষা-দীক্ষা, শিল্প-সংস্কৃতি এবং রুজি-রোজগারের মধ্যমণি কলকাতায় তাই নানা শ্রেণীর মানুষের বাস৷ বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষজনের সুবিধা নিয়ে গণিকারাও আস্তানা নিয়েছে এই নগরীর বুকে৷ যেখানে মানুষজন বেশি, যেখানে মানুষজনের রুজি-রোজগারের উপায় বেশি, সেখানে গণিকাদের পসার ও প্রয়োজন বেশি৷ জীবিকা নির্বাহের সুলভ ব্যবস্থার জন্য বারাঙ্গনাদের গ্রামের চেয়ে শহরের প্রতি আকর্ষণ তীব্র৷ ইংরেজি শিক্ষিত পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাই সগৌরবে বলেন—‘‘যেখানে সহর, সেইখানেই পাপ৷ সহরমাত্রেই বেশ্যা বেশী, মদ বেশী, বদমাস বেশী রাজধানীতে আরো বেশী৷ রাজধানীতেই পাপের রাজত্ব৷’’৪৫ ভাগ্যের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে হরিদাস কাশীতে আশ্রয় পেয়ে সেখানে প্রত্যক্ষ করে গণিকাজীবনের আরেকচিত্র৷ সারাটা দিন নানাভাবে কাটালেও সন্ধ্যার পর লাস্যময়ী হয়ে উঠে সেখানকার বারবনিতারা৷ গ্রাহক সংগ্রহ করার এটাই তাদের উপযুক্ত সময়৷ এই সময় তাদের শোভা আরও অধিক পরিমাণে বেড়ে যায়৷ তাদের বারান্দাগুলিতে মনোমুগ্ধকর সেতার-বেহালার সঙ্গীতময় সুরলহরী অন্য এক জগতের বাতাবরণ তৈরি করে৷ এই পণ্যাঙ্গনারা অর্থবান বাবুদের অবসর বিনোদনের সামগ্রী৷ মাসের পর মাস এদের সহবাসে অভিসার করে, কপট বধূ সেজে বাবুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে হয় তাদের৷ এখানে উল্লেখ রয়েছে বাবু মোহনলাল ঘোষ নামে একটি চরিত্রের৷ বহুনারী সংসর্গকারী এই ধনবান বাবুর কপট বধূর পরিচয়ধারী সমরকুমারীর কাশীতে মৃত্যু হলে শোক-দুঃখকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মনের আনন্দে কাশীর বাইজিমহলের আরেক সুন্দরী নারীকে সঙ্গিনী করে কাশীধাম পরিত্যাগ করে৷ কাশীধাম থেকে মোহনলাল বাবুর সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া এই বারবনিতাই তার অন্তঃপুরে স্ত্রী পরিচয়ে স্থান পায়৷ হরিদাস তার নিজের পরিচয় জানতে পারে এবং এও অবগত হয় যে রাজাবাহাদুর মোহনলাল ঘোষ তার কাকা৷ মোহনলালের মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার বলে সমস্ত সম্পত্তি এবং রাজাবাহাদুর উপাধি প্রাপ্ত হয়ে যখন কাশীর সেই বারনারীকে অন্তঃপুরে প্রত্যক্ষ করে, দেওয়ানজীকে জানায়—‘‘কুমারীর মৃত্যুর পর কাশীর একটি বাঈজীকে নিয়ে তিনি পাটনায় আসেন, সেই বাঈজীকেই নূতন রাণী বোলে জেনেছিলেন; রাজাই সেই পরিচয় জানিয়েছিলেন৷ বাস্তবিক পূর্ব্বোক্তা কুমারী যেমন নূতন পরিবার, কাশীর সেই বাঈজীটি ও সেইরূপ নূতন রাণী৷’’৪৬

উনিশ শতকে বাবুয়ানার এক উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হল বাইনাচের মজলিশ করা৷ বাবুদের ইয়ার-বন্ধুরা তাতে যোগদান করত৷ কাশীতে হরিদাস নীরেন্দ্রবাবুর আয়োজিত বাইনাচের মজলিশে অংশ নিয়েছিল৷ সেখানে সে প্রত্যক্ষ করেছে টাকা থাকলে বাইমহলে যেমন প্রতিপত্তি বেশি হয় তেমনি ইয়ার-বন্ধুদেরও সংখ্যাহানি ঘটে না৷ নীরেন্দ্রবাবু সম্পর্কে সে বলে—‘‘বাবুটীর বাড়ী কলিকাতায়৷ সাত আট মাস পূর্ব্বে তিনি কাশীতে এসেছেন, পরিবার সঙ্গে নাই, টাকা আছে, বাইমহলে কিছু বেশী প্রতিপত্তি৷ একঘন্টা মাত্র নাচ৷’’৪৭ বাইনাচের মজলিশে বাইজিরা চুক্তিভিত্তিক লেনদেন করত৷ নীরেন্দ্রবাবুর মজলিশে নাচনেওয়ালী বাইজির সময় চুক্তি ছিল এক ঘন্টা৷

পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা কুলটা হয়, পুরুষরা তা বানায়৷ যে হয় তার যত দোষ কিন্তু বানায় যে তার সাত খুন মাপ৷ কলকাতায় বাসকালে হরিদাস জেনেছিল কুলটা সৌদামিনীর কথা৷ যে স্বামী-সংসারের আবেষ্টনীর মধ্যে থেকেও প্রতিবেশী যুবক জয়হরি বড়ালের সঙ্গে পালিয়ে কাশীতে বসবাস করতে শুরু করে৷ বহু নারীদেহ আস্বাদনে অভ্যস্ত জয়হরি সৌদামিনীকে গৃহত্যাগী করিয়েও তার সঙ্গে সহবাসের সাথে সাথে কাশীর গণিকামহলের মধ্যেও আনাগোনায় সাবলীল থাকে৷ প্রেমাস্পদের সঙ্গে যে আশা-স্বপ্ন নিয়ে সে স্বামী সংসার ছেড়ে এসেছিল তা ধূলিসাৎ হয়ে তার দ্বারা ধীরে ধীরে অত্যাচারিত হতে থাকে সৌদামিনী৷ তাই হরিদাসকে একটি চিঠির মধ্য দিয়ে জানায়—‘‘এখানে না কি অনেক রকম বাইজী থাকে; তাহাদের পাঁচজনের সঙ্গে জয়হরি মিলিয়া গেল; সকল দিন তাহারে আমি দেখিতে পাইতাম না; এক এক রাত্রে মদ খাইয়া আসিয়া আমাকে প্রহার করিত’’৪৮ নিজের কৃতকর্মে অনুতপ্ত হয়েছিল সৌদামিনী তাই হরিদাসের কাছে অঙ্গীকার করেছিল তার সেই স্বেচ্ছাচারিণীর জীবন থেকে সরে গিয়ে সুখী স্বাভাবিক জীবনে অভ্যস্ত হবে৷ সমাজ তাকে মুলস্রোতে ফিরিয়ে নেয়নি৷ কুলটা নারীদের কুলে ফেরাতে সমাজ কোনোদিনই দাক্ষিণ্য দেখায় না৷ কিন্তু হরিদাস যখন রাজা হয় তখন নিজের জীবনের একটা সৎগতি চেয়ে সে হরিদাসকে নিবেদন করে—‘‘ভগবান তোমারে রাজা কোরেছেন, এখন তুমি আমার একটা কিনারা কোরে যাও৷ চিঠি লিখে তোমাকে আমি জানিয়েছিলেম, ইহজন্মে আর আমার পাপকর্ম্মে মতি হবে না৷ সেই অবধি চিঠির সেই কথাই আমি পালন কোরে আসছি, যতদিন বাঁচবো, চিরদিন পালন কোরবো৷’’৪৯ সে আরও জানায় যে শত চেষ্টা করেও সে তার কলঙ্ক ঘোচাতে পারেনি৷ সকলেই তাকে বলে ‘কলঙ্কিনী সৌদামিনী’৷ সে তাই কলকাতায় থাকতে চায় না৷ হরিদাসকে সে অনুরোধ করেছে সে যেন তাকে কাশীতে থাকার ব্যবস্থা করে দেয়৷ ইহকালে তাকে পাপ পথ থেকে সরিয়ে এনেছে; পরকালের জন্যও যেন বিশ্বেশ্বরের পায়ের কাছে একটু স্থান করে দেয়৷ হরিদাস সৌদামিনীর প্রতি মুখ ফিরিয়ে থাকেনি৷ তথাকথিত ভদ্র সমাজে কুলটার কালিমা ঘুচিয়ে রাখতে না পারলেও কাশীতেই তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করে দেয়৷ এক কুলত্যাগী নারী ঘরে ফেরার পথ না পেলেও ঈশ্বরের পদমূলে মুক্তির দিশা খুঁজে পেতে চেষ্টা করে৷ সৌদামিনীর মুখেই উঠে আসে বারবনিতা চন্দ্রকলার নাম যার মোহনমায়ায় জয়হরি তাকে অবজ্ঞা ও অত্যাচার করতে শুরু করেছিল৷ সৌদামিনীই জয়হরি খুনের সাক্ষী দিতে কলকাতায় এসে উপস্থিত হয় সুদূর কাশীধাম থেকে৷ কিন্তু পুনরায় সে কাশীতেই চলে যায়৷ জন্মস্থানে তাকে ধরে রাখার মতো মনোবৃত্তি কারুরই ছিল না সে কুলটা হয়েছিল বলে৷ এখানে এই ঘটনা থেকে বিভিন্ন অঘটন ঘটানোয় পারদর্শী বাবুদের কুকার্যের সাক্ষী হিসেবে বারাঙ্গনাদের জবানবন্দির গুরুত্বকেও স্বীকার করা হয়েছে৷

হরিদাস কামরূপ দর্শনে গিয়ে তার আশ্রয়দাতার কাছে শুনেছে ডাকিনীদের কথা৷ বক্তার উদ্ধৃত ডাকিনী আসলে গণিকারাই৷ কমবয়সি পুরুষেরা কামাখ্যায় গিয়ে এই ডাকিনীদের পাল্লায় পড়ে আর ঘরে ফিরে যেতে পারে না৷ সে প্রসঙ্গে তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি—‘‘তিনি রহস্যচ্ছলে গণিকাদলকেই ডাকিনী বোল্লেন, সেটা আমি বেশ বুঝতে পাল্লেম৷ ডাইনী, ডাকিনী, রাক্ষসী, পেত্নী ইত্যাদি যে সকল কুৎসিত কুৎসিত উপাধি আছে, চক্ষে না দেখলেও সে সকল উপাধিধারিণীকে ভয়ঙ্করী মনে হয়৷’’৫০ এই উদ্ধৃতির মধ্য দিয়ে গণিকাদের অশুভ শক্তির দ্যোতক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে৷ এখানে ভেল্কি দেখাতে আসা দুজন নারী অদ্ভূত নৃত্যকৌশলকে হরিদাস তুলনা করেছে ‘খোট্টা খেমটাওয়ালী’-র নাচের সঙ্গে কিন্তু পরক্ষণেই তার সেই ভ্রম ভেঙে যায়৷ গণিকাদের মতো খেমটাওয়ালিরাও নর্ত্তকী গায়িকা৷

নাচঘরের উল্লেখ আছে বাবু দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায়ের জমিদারি পর্যবেক্ষণ প্রসঙ্গে৷ নাচঘরে বাইনাচের আসর বসত৷ নাচঘরটি প্রায় ষাট হাত দীর্ঘ এবং ত্রিশ হাত প্রশস্ত৷ মেঝে কার্পেটমোড়া, দেওয়ালে বড় বড় সব ছবি, ছবির মাথায় দেওয়ালগিরি৷ কড়িকাঠে বড় বড় বেলোয়ারি, সারি সারি তাকিয়া বালিশ৷ রক্ত বর্ণ ঝাড়বুটোকাটা আবরণে বালিশগুলি আচ্ছাদিত৷ তবে পূর্বে সেই ঘরে বাইনাচের মজলিশ বসলেও চরিত্রদূষণের আশঙ্কায় দীনবন্ধুবাবু বেশ্যানর্ত্তন বন্ধ করে দিয়েছেন৷ পতিতা রমণীদের গৃহে অনুপ্রবেশ ঘটালে তা যে খাল কেটে কুমীর আনার সামিল হবে তা বিচক্ষণ দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায় অনুভব করতে পেরে বাইনাচ তুলে দিয়েছেন এবং সেই কারণে সেখানে হরিদাস বাইনাচের মজলিশ দেখতে পায়নি৷

বেশ্যাতোষণকারী পুরুষেরা প্রকাশ্যে বেশ্যাগমন করলেও সমাজ বিচ্যুত হয় না কিন্তু বেশ্যাবৃত্তিকারিণী নারীটিকে সমাজ পরিত্যাগ করে৷ এক সম্ভ্রান্ত গৃহের কন্যা পিসতুতো দাদার প্ররোচনায় ব্যভিচারিণী হয়ে ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে ধর্ষিতা হয় ডাকাতদলের সর্দার দ্বারা৷ অবশেষে ডাকাতদলেই সে জায়গা করে নেয়৷ নাম হয় রঙ্গিণী, কিন্তু হরিদাসের চোখে তার ছদ্মরূপ ধরে রাখতে পারে না৷ ঘটনাক্রমে সেখান থেকে বেড়িয়ে রঙ্গিণী দাক্ষিণ্য লাভ করে বর্ধমানের যুবরাজ রণেন্দ্ররাও-এর৷ ছদ্মবেশী ডাকাত ভূষণ তথা রণেন্দ্ররাও হরিদাসের কাছে রঙ্গিণীর সব কথা জানতে চাইলে হরিদাস জানায়—‘‘রঙ্গিণী স্বেচ্ছা পূর্ব্বক ব্যভিচার-পাপে লিপ্ত হয় না, প্রকাশ্যে বেশ্যাবৃত্তিও অবলম্বন করে নাই, রঙ্গিণীর সে পাপের ক্ষমা আছে,—এখানেও আছে, উপরেও আছে৷’’৫১ তবুও রঙ্গিণী অসহায়৷ যুবরাজ যদি তাকে আশ্রয় বা সাহায্য না করে তাহলে তাকে বেঁচে থাকতে হলে বাধ্য হয়ে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করতে হবে৷ রঙ্গিণীকে বেঁচে থাকার জন্য বাধ্য হয়ে যাতে গণিকাজীবনে প্রবেশ করতে না হয় এজন্য রাজপুত্র রণেন্দ্ররাও এক বিপত্নীক প্রজার সঙ্গে তার বিবাহ দিয়ে সংসারের মূলস্রোতে ফিরিয়ে দিয়েছে৷ পরিণামে রঙ্গিণীকে তার নিজের পরিচয়, অতীত সব কিছুকে ভুলে যেতে হয়েছে৷ তবুও মন্দের ভালো রঙ্গিণী একটা স্থায়ী সম্মানিত জীবন ফিরে পেয়েছে৷

গণিকাদের আশ্রয় করে সমাজের ইতর সন্তানেরা সুখ-শান্তি খোঁজার চেষ্টা করে৷ লক্ষণীয় যে চোর, জোচ্চোর, মাতাল, বাটপার, গুণ্ডা, বদমাশ থেকে শুরু করে অনেক ধনী বাবুরা বারবনিতার অঞ্চলতলে নিজেদের জীবনের সার্থকতা খুঁজে বেড়ায়৷ হরিদাস সৎ পন্থার পথিক৷ খুন সংক্রান্ত মামলায় হরিদাসের বুদ্ধিতে যখন সব অপরাধীরাই আইনের চোখে চিহ্নিত হয়ে যায় তখন তাদের বেশিরভাগই আত্মগোপনের জন্য আশ্রয় নেয় কোনো না কোনো পতিতালয়ে৷ যেমন কৃষ্ণনগরের এক বেশ্যালয় থেকে ধরা পড়ে ঘনশ্যাম বিশ্বাস৷ অন্য আর এক বারাঙ্গনার আস্তানা থেকে শৃঙ্খলিত হয় জয়হরি৷ এই অপরাধী মানুষগুলো গণিকালয়ে আশ্রয়গ্রহণ করার ফলে তাদেরও নানা অসুবিধা, বিপদের সম্মুখীন হতে হতো৷ খুন, দাঙ্গা, প্রতারণা সংক্রান্ত মামলায় যেমন বিপর্যস্ত হত তারা, আবার কখনো কখনো প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটত৷ এছাড়া আরও বহু স্বৈরিণী নারীর ভিড়ে ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ উপন্যাসটি পরিপূর্ণ ছিল৷ যেমন—নবীনশশী, রাঙামামি, রূপসী এদের মধ্যে অন্যতম৷ এদের কেউ বালবিধবা, কেউ পরিচারিকা, কেউ বা কুলকামিনী কিন্তু ঘটনাচক্রে ব্যভিচারিণী হয়ে ঘৃণ্য অমর্যাদার শিকার৷

হরিদাসের গুপ্তকথা উপন্যাসে উনিশ শতকীয় ধ্যানধারণায় নারীচরিত্রের মূল্যায়ন করেছেন লেখক৷ নারীর সতীত্ব, নিষ্ঠা, আত্মত্যাগ ইত্যাদিই তাদের চরিত্রে উৎসারক; ব্যভিচার, ভ্রষ্টাচার বা অসংযমী যৌন পিপাসা নয়৷ আর এ কারণেই গণিকারা মূল্যহীন, পাপীয়সী, সমাজ থেকে বিচ্যুত৷ গণিকাদের সামাজিক অবস্থান নির্ণয়ে উপন্যাসটির বড় ভূমিকা রয়েছে৷

এলোকেশী বেশ্যা :

গণিকা জীবনের সুস্পষ্ট ও সামগ্রিক চিত্রকে খুঁজে পাওয়া যায় এই উপন্যাসে ৷ এর রচয়িতা মিশ মেরী ই লেসলি বা বিবি মিশ লেসলি৷ রচনাকাল ১৮৭৬৷ বই-এর প্রচ্ছদে রয়েছে—‘‘বিবি মিশ লেসলি কর্ত্তৃক প্রকাশিত৷’’৫২ ‘এলোকেশী বেশ্যা’ উপন্যাসটি এক বাল বিধবা বালিকার জীবনের ক্রমিক পরিণতি৷ এর মূল উপজীব্য এক পতিতা নারীর গ্লানিময় নিষ্ঠুর জীবন এবং পরিণতিতে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সুস্থ সমাজের মূল স্রোতে ফিরে এসে নিষ্কলুষ জীবনযাপন৷ খ্রিস্টধর্মের উদার ছায়ায় এক রূপাজীবা নারীর পুনরায় স্বাভাবিক জীবনের ফিরে এসে মানুষের মতো বাঁচা এই শতকের এক ব্যতিক্রমী বিষয়৷ উপন্যাসটির শুরুতেই দেখা যায় আটবছর বয়সি এলোকেশী নামে এক বালিকাবধূর চরম বিপর্যয়ের কথা—‘‘ওগো তোমরা একটি সর্ব্বনাশের কথা শুনেছ? গত রাতে ওলা ওঠায় এলোকেশীর স্বামী মারা পড়েছে!’’৫৩ কিন্তু আটবছরের বালিকাবধূ এলোকেশী স্বামীবিরহ বা স্বামীসুখ কি তা বোঝে না৷ বোঝার কথাও নয়৷ তাই স্বামী মারা গেলে তার ক্ষতি হল তার কিছুই জানে না সে৷ শুধু—‘‘তার মা তার বালা দুগাছী খুলে নিলে বলে, সে অমনি গহনার শোকে কেঁদে উঠলো৷ ছেলেমানুষ বৈ ত নয়, স্বামী কাকে বলে তাই জানে নি, তা আবার তার জন্য কাঁদতে জানবে৷’’৫৪ পুতুল খেলারত এলোকেশীর এত বড় সর্বনাশে সকল আত্মীয়পরিজনেরা যখন হায় হায় করে ওঠে, তার হাতের বালা খুলে নিয়ে সিঁথির সিঁদুর তুলে এয়োস্ত্রীর চিহ্নসকল মুছে দেয় তখন সে শুধু ভয় পেয়ে কেঁদে উঠে শিশুসুলভভঙ্গিতে৷ এলোকেশী এই আচরণকে লেখিকা বিবৃত করেছেন এইভাবে—‘‘এই সব দেখে শুনে, ছেলেমানুষ বৈ ত নয়, তার মনে একটু ভয় হল এবং কাঁদতে লাগলো৷ কিন্তু তার যে কি সর্ব্বনাশ হয়েছে, তার যে কপাল ভেঙ্গেছে, আহা সে তার কিছুই বুঝতে পারলে না৷’’৫৫ স্বামীর বিরহ যন্ত্রণা এলোকেশীকে অনুভব করতে হয়নি, বুঝতে পারেনি স্বামী বিচ্ছেদ যাতনা৷ কিন্তু ধীরে ধীরে যতই তার বয়স বেড়েছে, তার বালিকা বয়সের কলি প্রস্ফুটিত হয়ে সৌরভ ছড়িয়েছে ততই অপূর্ব রূপবতী এলোকেশীর চাওয়া-পাওয়া, ভালোলাগা-না লাগার সীমাগুলি অনেকদূর বিস্তৃত হয়ে পড়েছে৷ তার যৌবনদশায় উদয় হওয়া নানাবিধ সুখের ইচ্ছার মধ্যে অন্যতম হল লেখাপড়া শেখা৷ ভাইদের সঙ্গে মিষ্টি ব্যবহার ভাইদের দ্বারা লেখাপড়া শেখার পথকে সুগম করেছিল৷ তারপরে প্রতিবেশীদের কাছে শেখে শিল্পকর্ম৷ তাদের বাড়ির খিড়কির দিকে একটি বাগান ও তার মধ্যে একটি পুকুর ছিল৷ নানাবিধ ফুলে, ভ্রমরের গুঞ্জনে অপূর্ব শোভা সেই বাগানের৷ এলোকেশীর ফুল খুব প্রিয় ছিল৷ এই বাগানের মনোরম পরিবেশ তার মনের গোপনস্তরে বাসনার জন্ম দিতে শুরু করেছিল৷ সে প্রায় সর্বদাই বাগানে থাকত৷ গ্রীষ্মকালের এক বিকেলে সে কতগুলি ফুল তুলে ঘাটের উপর একটি বকুলগাছের তলায় বসে এক মনে মালা গাঁথছিল সেই সময় প্রেমপূর্ণবাক্যে ভায়ের বন্ধুর পরিচয় দিয়ে এক যুবক তাকে প্রণয় সম্ভাষণ করে৷ লেখাপড়া শেখা সভ্য সমাজে বড় হওয়া শিক্ষিতা, রূপবতী, যৌবনমদে পরিপূর্ণ এলোকেশী সেই অপরিচিত যুবকের প্রণয়সম্ভাষণে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে৷ ভাইয়ের বন্ধুর সামান্য স্তুতিবাদেই মন বিগলিত হয়ে যায়৷—‘‘কারণ একে যুবতী, তাহাতে আবার প্রেমপূর্ণ বাক্য, তাহাতে কাহার মন না চঞ্চল হয়?’’৫৬ সে যৌবন যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে প্রবৃত্তির তাড়নায় সহজেই সেই যুবকের কাছে ধরা দেয় এবং পুনরায় তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার বাসনা জানিয়ে বলে—‘‘আপনি কল্য অবশ্য অবশ্য আসিবেন৷’’৫৭ এভাবে এলোকেশী সকলের অগোচরে সেই যুবকের সঙ্গে মিলিত হতে থাকে৷ সেই সময় সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল কিন্তু তার বাবা মা বালবিধবা কন্যার পুনরায় বিবাহে মত দেয়নি৷ কিছুদিন পর যৌবনযন্ত্রণায় দগ্ধ এলোকেশী হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়৷ বহু অনুসন্ধানের পর জানা যায় পুর্বোক্ত যুবক তাকে লোভ দেখিয়ে নিয়ে চলে গেছে৷ সেই যুবক এক ধনী পরিবারের সন্তান৷ নাম ক্ষেত্রবাবু৷ ছোট বালিকার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল বলে স্ত্রীর প্রতি তার কোনো অনুরাগ ছিল না৷ এলোকেশীকে ভুলিয়ে এনে তাকে উপপত্নী হিসেবে স্থান দেয়৷ শুধুমাত্র প্রবৃত্তির তাড়নায় পরিবার পরিজনের স্নেহ-ভালোবাসার নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে সে হয়ে ওঠে রক্ষিতা৷ বিবাহিত ক্ষেত্রবাবু তাকে পুনরায় বিয়ে করে ঘরে তুলতে পারে না৷ ধনী বাবা-মায়ের সন্তান হওয়ার জন্য এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পুরুষের বহুগামীতার কোনো অপরাধ না থাকায় অনায়াসে সে তাকে উপপত্নী হিসেবে রাখতে সক্ষম হয়৷ সে—‘‘এলোকেশীকে লইয়া গিয়া একটি উত্তম বাটীতে রাখিয়াছিলেন৷ মণিমুক্তাযুক্ত অনেক অনেক দামী গহনা, উত্তম উত্তম কাপড়, প্রভৃতি নানাবিধ জিনিসপত্র দিয়াছিলেন, এবং সেবার জন্য দাসদাসী নিযুক্ত করিয়া দিয়াছিলেন, এবং আপনিও প্রায় সর্ব্বদাই তার কাছে থাকিতেন৷’’৫৮ বাড়ি, বিত্ত-বৈভব, গহনা-অলঙ্কার, দাস-দাসী, কাপড়-চোপর সবই পেয়েছিল শুধু নারীত্বের সম্মানটুকু ছাড়া৷ ক্ষেত্রবাবু তাকে ভোগ করার দাম দিয়েছে মাত্র আর কিছু নয়৷ এখানে উঠে এসেছে তখনকার সমাজে ধনী বাবুদের রক্ষিতাপোষণের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি৷ বিলাসী বাবুরা প্রচুর অর্থ ব্যয় করতো এই রক্ষিতাদের পেছনে৷ সেই পুরুষের প্রতি সমাজের কোনো বিরূপতা ছিল না কিন্তু সেই রক্ষিতা নারীর শেষ পর্যন্ত কি পরিণতি তা উপন্যাসে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনারাজীর মাধ্যমে সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এলোকেশীর জীবন পরিণতির মধ্য দিয়ে৷ তার জীবনে স্ত্রীর বৈধ অধিকার ছাড়া কিছুরই অভাব ছিল না৷ ক্ষেত্রবাবুর সঙ্গে আমোদ-প্রমোদে কোথাও কোনো খাদ ছিল না তার তবুও ভেতরের নারীসত্তাটি বোধ হয় গুমরে গুমরে মরতো নইলে এত ভোগবিলাসের মধ্যেও, সুখ-ঐশ্বর্যের মধ্যেও এক খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারিকার ধর্মীয় বাণী তার মনে পাপবোধ জাগ্রত করবে কেন! সেই ধর্ম প্রচারিকা তাকে বাইবেলের অন্ত্যভাগ দিয়ে বলেন যে সেখানে তার মতো এক স্ত্রীলোকের কথা আছে যে যীশুর কৃপায় পাপ পথ থেকে সরে আসতে সক্ষম হয়েছিল৷ ধর্ম্মসংক্রান্ত কথাবার্তা এলোকেশীর মনে ঈশ্বরের কৃপার আলোকস্পর্শ দিতে আরম্ভ করেছিল৷ কিন্তু ঐ পর্যন্তই৷ গণিকা জীবনের ক্লেদ মুক্ত হওয়ার আগেই ক্ষেত্রবাবু তার রাশ টেনে ধরে৷ সেই ধর্মপ্রচারিকা ও এলোকেশীর যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়৷ ধর্মের আলো প্রবেশের সমস্ত পথ বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় তাকে পাপের পথে ঘুরিয়ে নেয়৷ ‘‘বাইবেল এবং অন্যান্য পুস্তক সকল তফাতে রাখা হইল৷ পুনরায় আবার পূর্ব্বের ন্যায় আমোদ প্রমোদ চলিতে লাগিল৷’’৫৯

এলোকেশীকে ক্ষেত্রবাবু রক্ষিতা হিসেবে গ্রহণ করলেও এলোকেশীর কাছে সে স্বামীতুল্য৷ শুধু স্বামীতুল্য নয় স্বামীই৷ বাল্যকালে যে স্বামী মারা গিয়েছিল তার প্রতি কোনোরকম বোধ জাগ্রত হয়নি তার৷ পুরুষ হিসেবে প্রথম সে পেয়েছিল তাকেই৷ নিজের জীবন-যৌবন সমর্পণ করেছিল তার কাছেই৷ তাই কায়মনোবাক্যে সে তার স্বামী৷ সেই ক্ষেত্রবাবু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লে এলোকেশী পাগলিনি হয়ে যায়৷ তাকে অসুস্থতার সময়ে সে দেখতে পর্যন্ত পায় না কারণ ক্ষেত্রবাবু তখন নিজগৃহে৷ একজন রক্ষিতার সেখানে প্রবেশাধিকার নেই৷ তাই তাকে দেখতে না পেয়ে, তার শুশ্রূষা করতে না পেরে, দিনরাত্রি মহাদুর্ভাবনায় আহার নিদ্রা ত্যাগ করে মৃতবৎ বাস করতে থাকে৷ কিছুদিন এভাবে কাটানোর পর হঠাৎ শুনতে পায় যে ক্ষেত্রবাবুর মৃত্যু হয়েছে৷ আর সে সংবাদ পাওয়ামাত্রই—‘‘ছিন্ন কদলীগাছের ন্যায় ভূমিতে আছাড় খেয়ে পড়ে গেলেন, উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করিতে লাগিলেন, বুক চাপড়াতে লাগলেন, চুল ছিঁড়তে লাগলেন, গায়ের গহনা সব দূর ফেলিয়া দিলেন এবং শোকে অধীর হইয়া বলিতে লাগিলেন, ‘‘আমি আর এ প্রাণ রাখব না, আমি আর কি সুখে প্রাণ-ধারণ করিব, আমার আর এ ছার জীবনে কাজ কি! হে মৃত্যু, আমি তোমায় মিনতি করিয়া বলিতেছি, তুমি এখনই আমাকে আমার নামের সঙ্গিনী কর!’’৬০ এলোকেশী বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হয়েছিল বহুদিন আগে, তার আটবছর বয়সে; তখন তার সে বোধ হয়নি কিন্তু ক্ষেত্রবাবুর মৃত্যু হওয়ার পর সে নিজেকে সত্যসত্যই বিধবা ভাবতে থাকে৷ ক্ষেত্রবাবুর দুঃখে বিলাপ করে করে কিছুদিন কাটলে তারপর মাথায় ভর করে ভরণ-পোষণের চিন্তা৷ বাবা-মা তাকে আর ঘরে তুলবে না, ক্ষেত্রবাবুর পরিবারেও তার কোনো জায়গা নেই, কি করে বাকি জীবনটা চলবে তার৷ কিছুদিন ক্ষেত্রবাবুর দেওয়া গয়নাগুলি বিক্রয় করে তার দিন গুজরান হয়৷ পরে আর কোনো উপায় নেই৷ এদিকে রূপ উথলে পড়ছে তার শরীরে, চারিদিক থেকে দেহলোভী শ্বাপদেরা নানাভাবে তাকে প্রলোভিত করতে আরম্ভ করছে; জীবনে আর কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে তার মনে হয়—‘‘আর কী, আমারও দুর্নাম হয়েছে, আমার ত স্বভাব একবারে নষ্ট হয়ে গেছে, আর সকলেই আমাকে বেশ্যা বলিয়া জানে, তবে কেন এরূপ গোপনে থেকে মিছে কষ্ট পাই৷’’৬১ শোকে মুহ্যমান হয়ে জীবন কাটানোর অধিকার একজন বিধবার থাকলেও রক্ষিতার নেই; কারণ সমাজে কলঙ্কিনী নারীদের কোনো স্থান হয় না৷ এলোকেশীরও হল না৷ কঠোর বাস্তবকে খুব ভালোভাবে চিনে গিয়েছে সে৷ বুঝে গিয়েছে কোথায় তার অবস্থান৷ আর—‘‘এই ভেবে এলোকেশী পেটের ভাতের জন্যে সাধারণ-সমক্ষে বেশ্যাবৃত্তি করিতে লাগিলেন৷’’৬২

এলোকেশী অত্যন্ত সুন্দরী৷ আর এই রূপের ছটায় অল্পদিনেই দেহজীবিকার পসার বেড়ে যায়৷ রূপবহ্নিতে মোহিত হয়ে সর্বদাই তার বাড়িতে লোক যাতায়াত করতে আরম্ভ করে৷ আবার—‘‘খুব আমোদ প্রমোদ চলতে লাগল, টাকাকড়ির কিছুমাত্র অভাব রহিল না৷’’৬৩ আমোদে-আহ্লাদে, টাকাপয়সায় তার ভাণ্ডার ভরে উঠলেও নারীত্বের চিরন্তন আহ্বান, সুন্দর জীবনের হাতছানিকে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না সে৷ স্বাভাবিক জীবনের অদম্য পিপাসা হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে৷ তার অন্তরে কিছুমাত্র সুখের অবকাশ থাকে না৷ এলোকেশী—‘‘সর্ব্বদাই মনাগুনে দগ্ধ হতেন; তিনি আপনাকে ঘোর পাতকিনী বলিয়া জানিতেন তজ্জন্য সর্ব্বদাই আপনাকে আপনি ঘৃণা করিতেন এবং আপনার মৃত্যু কামনা করিতেন৷’’৬৪ তার সব সময় মনে হত যে, তার কৃতকর্মের জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়ানক বিচার; বিচারকের প্রজ্জ্বলিত ক্রোধাগ্নি৷ মনের পাপবোধের গভীর ভাবনা থেকেই একসময় বেড়িয়ে আসে মুক্তির পথ, তার মনে পড়ে যায় পূর্বেকার সেই খ্রিস্টধর্ম প্রচারিকার কথা, তার দেওয়া বাইবেলের অংশখানির কথা৷ তারপর অনেক খুঁজে বের করে ক্ষেত্রবাবুর লুকিয়ে রাখা বাইবেলখানি৷ তার পাতা ভাঁজ করা অংশগুলো মুক্তির স্বর্গকে সামনে এনে দেয়৷ বইটির বিভিন্ন অংশের মধ্যে যোহন লিখিত সুসমাচারের অষ্টম অধ্যায়ের ছয় নম্বর পদ থেকে এগারো সংখ্যক পদ পর্যন্ত পড়তে শুরু করে, যেখানে রয়েছে এক ব্যভিচারিণী নারীর কথা৷ সেই নারী ‘ব্যভিচার কর্ম্ম’ করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছে৷ শাস্ত্রাধ্যাপক ও ফরীশিগণ মোশির উপদেশ মতো তাকে ব্যভিচারকর্ম করার অপরাধে প্রস্তরাঘাত করে মৃত্যু দান ঠিক করে যীশুর কাছে তা জানাতে এসেছে৷ যীশু অনেক ভাবনাচিন্তার পর বলেছিলেন যে তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি নিষ্পাপ সে তাকে প্রথম প্রস্তরাঘাত করুক৷ বলেই আবার মাথা নত করে তিনি ভূমিতে লিখতে লাগলেন৷ কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে দেখেন সেখানে সেই স্ত্রীলোকটি ব্যতীত কোনো জন-মানব নেই৷ যীশু তাকে কোনোরকম শাস্তি না দিয়ে শুধু বলেন—‘‘যাও আর পাপ করিও না৷’’৬৫ বাইবেলের অংশদ্ধৃত যীশুর এই বাণী এলোকেশীর কাছে মহামন্ত্র হয়ে যায়৷ বারাঙ্গনা এই নারী বহুভোগ্যার গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে এই একটি মাত্র বাক্যকেই জপের মালা করে কায়মনোবাক্যে ভগবান যীশুর প্রতি আত্মনিবেদন করে৷ বাইবেল পাঠ করে তার মনে উপস্থিত হয় ধর্মীয় দ্বন্দ্ব৷ হিন্দু-ধর্মের কঠোর অনুশাসনে কোন কুলটা নারীর বা দেহজীবিনীর ঘরে ফেরার অধিকার নেই, নেই কোনো প্রায়শ্চিত্ত কিন্তু খ্রিস্টধর্মে রয়েছে তাদের প্রতি ক্ষমা৷ অসৎ পথ থেকে সরে এলে পুনরায় সে সমাজে আশ্রয়লাভ করতে পারে৷ তাই খ্রিস্টধর্মের উদারতায় মোহিত হয়ে সে ভাবে—‘‘কি আশ্চর্য্য আমি অনেক অনেক হিন্দুশাস্ত্র পড়িয়াছি বটে কিন্তু কিছুতেই কখন আমার মন এত ব্যাকুল হয় নাই; কিন্তু এই বইখানি (বাইবেলখানি) পড়িয়াই আজ আমার মন এমন হল কেন, এবং আমি আপনাকেই বা এত অপবিত্র জ্ঞান করিতেছি কেন?’’৬৬ তার মনে বিষম উদ্বেগ উপস্থিত হয়৷ মনে মনে স্থির করে যে আর বইখানি পড়বে না কিন্তু কি একটা দুর্নিবার আকর্ষণে নিজের অজান্তেই বই-এর পাতা খুলে বসে৷ আবার পড়তে শুরু করে লুক লিখিত সুসমাচারের পঁচাত্তর অধ্যায়ের ছত্রিশ সংখ্যক পদ থেকে পঞ্চাশ সংখ্যক পদ পর্যন্ত৷ সেখানে ফরীশিদের মধ্যে একজন যীশুকে ভোজনে নিমন্ত্রণ করলে তিনি যখন ভোজনে বসেন তখন দেখেন সেই নগরের একজন পাপিষ্ঠা স্ত্রী তাঁর ভোজনে বসা লক্ষ করে নানা উপাচারে পদসেবা করার জন্য প্রতীক্ষা করে আছে৷ তার চোখের জলে যীশুর পা ভিজিয়ে, মাথার চুল দিয়ে ভেজা পা মুছে সুগন্ধি তৈলে চরণ মর্দ্দন করে৷ তার নিষ্পাপ ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে তিনি তাকে সর্ব পাপ থেকে মুক্তি প্রদান করেন৷ এই অংশটুকু পড়ার পর এলোকেশী মনোবেদনায় অস্থির হয়ে কাঁদতে থাকেন৷ আত্মপীড়নে আহত এই বারবনিতার স্বগোতক্তি—‘‘হায় কোথায় গেলে আমি, সেই দয়াময় প্রভুর দর্শন পাইব? যদি এখন একবার তাঁহার দেখা পাই তবে তাঁহার কাছে গিয়ে চরণে ধরে আমিও কাঁদি তাহা হইলে সেই দয়াল প্রভু আমাকেও ক্ষমা করিবেন; এই যে স্ত্রীটির কথা আমি এইমাত্র পড়লাম, ইনিও আমার মত হতভাগিনী পাপীষ্ঠা ছিলেন, এবং প্রভু তাঁহাকে ক্ষমা করিয়াছেন৷ আমি সেই স্ত্রীলোকটীর (সেই খ্রিষ্টধর্মপ্রচারিকা যাঁহার সহিত ক্ষেত্র বাবুর বাটীতে এলোকেশীর প্রথম দেখা হয়) মুখে শুনেছি যে যীশু সর্ব্বদাই জীবিত আছেন, এবং সর্ব্বদাই পাপীজনের পাপ মার্জ্জনা করেন৷ হায় কোথায় গেলে আমি তাঁহার দেখা পাইব?’’৬৭ ধর্মীয় চেতনায়, মুক্তির বাসনায় উদ্বুদ্ধ এলোকেশীর দেহবিক্রয় করে জীবনধারণ ক্রমেই অসহ্য হয়ে উঠে কিন্তু কি করবে! তাছাড়া তার যে অন্য কোনো উপায় নেই৷ দেহব্যবসা না করলে কি করে তার খাওয়া পড়া চলবে, ভরণ-পোষণ চলবে৷ কোনো ভদ্রবাড়িতে তার মত পণ্যাঙ্গনার চাকরিও জুটবে না আবার অসৎ সংসর্গীয় লোকের বাড়িতে থাকাও পাপ৷ সে বিষম সংকটের মধ্যে পড়ে৷ কি করবে কোথায় যাবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না৷ অবশেষে পতিতপাবন যীশুর উদ্দেশ্যে ক্রন্দন করে বলে—‘‘হে দয়াময়, তুমি যেমন সেই আমার ন্যায় হতভাগিনীকে কহিয়াছিলে ‘যাও আর পাপ করিও না’ এবং তার প্রতি কৃপা করিয়া তাহাকে পরিত্রাণ করিয়াছিলে, তেমনি নাথ আমিও আর পাপ করিব না, তুমি দয়া করে আমাকে পথ দেখাইয়া দাও; দয়াময়, অনাথিনীর প্রতি একবার কৃপাদৃষ্টি কর, একবার সদয় হও৷’’৬৮ গণিকাবৃত্তি থেকে মুক্তির চিন্তায় যীশুর কাছে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন করে নিজের প্রতি উদাসীন হয়ে মনের গহনে তলিয়ে যায় সে৷ থাকে না শরীরের প্রতি কোনো নজর৷ ফল স্বরূপ প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে সেখানে তার অসুখ আরও বেশি পরিমাণে বেড়ে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়৷ ক্রমে ঈশ্বরের কৃপায় আরোগ্যলাভ করলে হাসপাতালে থাকতে থাকতে সাক্ষাৎ হয় এক ধার্মিকা স্ত্রীর সঙ্গে৷ তার বিনম্র ব্যবহার এলোকেশীর কাছে স্বর্গীয় দূতের মতো মনে হয়৷ নিজের সমস্ত কথা অকপটে তার কাছে ব্যক্ত করে এলোকেশী তাকে জানায় তার হৃদয়ের সত্য কথাটি—‘‘যদি তিনি কোন উপায় পান তবে এ পাপকার্য্য একেবারে পরিত্যাগ করিবেন এই তাহার একান্ত ইচ্ছা৷’’৬৯ খ্রিস্টকে হৃদয়ে ধারণ করে সৎ সংসর্গে এবং সৎ চিন্তায় তার মনের সমস্ত পাপ দূর হয়ে যায়৷ শান্তির সুখানুভূতিতে হৃদয় আচ্ছাদিত হয়ে যায়৷ হাসপাতালে সাহচর্যদানকারী সেই স্ত্রীলোকটির সঙ্গে নতুন জীবনে প্রবেশ করে অতীতের সকল ক্লেদাক্ত কালিমাকে ধুয়ে৷ সেই স্ত্রীলোকটির সহায়তায় স্বহস্তে পরিশ্রম করে নিজের খাওয়াপরার ব্যবস্থা নিজেই করে নেয়৷ আর নিজের পরিশ্রমলব্ধ উপার্জন দেখে প্রবল আত্মতৃপ্তি অনুভব করে সে৷ সে সম্পর্কে তার নিজেরই স্বীকারোক্তি—‘‘আমি এতদিন বেশ্যাবৃত্তি দ্বারা যে এত টাকা উপার্জ্জন করিয়াছিলাম তাহাতে একদিনের জন্যও আমার এমন সুখ ও এমন আনন্দ কখন হয় নাই৷ এতদিন যত কিছু উপার্জ্জন করিয়াছিলাম, সকলই কুকার্য্যের বেতন স্বরূপ৷ আজ এই আমার প্রথম দিন যে আমি আনন্দের সহিত পয়সা উপার্জ্জন করিলাম৷ আর আমি আজ কত সুখী হইলাম! আঃ আজ কি আনন্দ!’’৭০ শরীর বিক্রয়ের অপমানজনক জীবিকা থেকে বেড়িয়ে এসে সুস্থ পরিবেশে সম্মানজনক কাজের মধ্য দিয়ে উপার্জন করে এলোকেশী যে আত্মসুখ লাভ করেছে তা বারবধূদের জীবনের প্রতি এক স্বর্ণোজ্জ্বল দিকনির্দেশ; তাদের মুক্তির মহামন্ত্র৷

এভাবে উপন্যাসটিতে দেখানো হয়েছে একজন রূপাজীবার সত্যকার আত্মদাহকে৷ নিজের জীবনধারণের নিরুপায় প্রক্রিয়ায় যে তার নিজের কাছে সর্বদা অসম্মানিত৷ নিষ্ঠুর সমাজব্যবস্থা তাকে আটবছরে বিধবা করেছে, ক্রমে সেই বালবিধবা যৌবনের পরশমণির স্পর্শে উজ্জীবিত হয়ে চারিদিকের আকর্ষণীয় পরিবেশের হাতছানিতে বৈধব্যজীবনের শুচিস্মিত আস্বাদন থেকে দূরে গিয়ে পাপপঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে রক্ষিতার ঘৃণ্য জীবন উপহার পেয়েছে৷ যার সঙ্গে ঘর ছেড়ে রক্ষিতা হয়েছিল সেই ক্ষেত্রবাবুর মৃত্যুর পর সরাসরি দেহের দর হেকেছে নিজের রূপ-যৌবনকে কাজে লাগিয়ে অর্থাৎ প্রকাশ্যে বেশ্যাবৃত্তি করেছে কোনো উপায় না দেখে৷ অবশেষে খ্রিস্টধর্মের ছত্রছায়ায় মুক্তি পেয়েছে বহুভোগ্যার গ্লানি থেকে৷ ‘এলোকেশী বেশ্যা’ উপন্যাসে একদিকে যেমন বর্ণিত হয়েছে হিন্দুত্বের সমাজ অনুশাসনে আবদ্ধ হয়ে এক নারীর গণিকা হয়ে যাওয়ার চিত্র তেমনি অন্যদিকে খ্রিস্টধর্মে উদার ছায়ায় ঘটেছে তার আত্মজাগরণ৷

চন্দ্রা :

গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘চন্দ্রা’ উপন্যাসটি ‘কুসুমমালা’ নামক এক স্বল্পজীবী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ১২৯১ সালে বা ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে৷ এর গ্রন্থরূপে আত্মপ্রকাশ ১২৯৪ সাল বা ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে, প্রকাশক ‘বন্দ্যো ও মুখার্জি’৷ রচনাকার একে ঐতিহাসিক উপন্যাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন৷ কারণ এর পটভূমিকায় তিনি ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের কথা, মঙ্গল পাঁড়ে, নানা সাহেব, লর্ড ও লেডি ক্যানিং, পাদ্রী আলেকজান্ডার ডাফ ইত্যাদি ঐতিহাসিক চরিত্রগুলিরও উপস্থাপন করেছেন৷

‘চন্দ্রা’-য় আলাদা করে কোনো গণিকা চরিত্রের উল্লেখ নেই কিন্তু উপন্যাসের নায়িকা চন্দ্রা ও তার সতী সাধ্বী মা তারা সমাজের নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে গণিকা না হয়েও সমাজের চোখে গণিকা হিসেবে প্রতিবিম্বিত হয়৷ চন্দ্রার পিতা জনার্দ্দন যুবা বয়সেই সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিল৷ পারস্যরাজ্যের পাৎসাহের সাথে সাক্ষাৎ করতে যাওয়ার সময় পাঞ্জাবে এক বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করে৷ সেখানে দর্শন পায় তারার৷ অসামান্য রূপবতী এই রমণী সেই পাঞ্জাবি গৃহকর্তার কন্যা৷ তারার মনেও প্রণয় সঞ্চার হয়৷ সেই যুবক সন্ন্যাসীর প্রেমে নিজেকে উৎসর্গ করে তার সঙ্গে গৃহত্যাগ করে৷ সন্ন্যাসীও সন্ন্যাসধর্ম ভুলে গৃহী জীবনে পদার্পণ করে৷ তারার জীবন সুখে ভরে যায়৷ সমাজ তারাকে সহজ চোখে দেখেনি৷ সে মহারাষ্ট্রীয় পরিচয়ে স্বামীর সংসারে বসবাস করলেও পরে তার পাঞ্জাবি পরিচয় সকলের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ে৷ তাকে সমাজের চোখে জনার্দ্দনের স্ত্রী হয়েও রক্ষিতা পরিচয়ে থাকতে হয়৷ জনার্দ্দনের কথায় এর প্রতিধ্বনি—‘‘প্রথমে মহারাষ্ট্রীয় বলিয়া পরিচয় দিই৷ পাঞ্জাবী প্রকাশ হওয়ায় সকলে ভাবিল, বিবাহ করি নাই৷’’৭১ যাইহোক সমাজের অসহায়তা এবং স্বামীর সহায়তায় দিন কেটে যাচ্ছিল তারার৷ তার সেই সুখের সংসারে আগুন লাগে স্বামীর মিথ্যা সন্দেহে৷ এক অত্যাচারী ইংরেজ কর্মাধ্যক্ষকে বধ করে আত্মগোপন করে থাকার সময় স্ত্রীর সঙ্গে রাত্রি দুই প্রহরে দেখা করতে এসে স্ত্রীকে তার বসার ঘরে এক ইংরেজের সঙ্গে কথা বলতে দেখে মিথ্যে সন্দেহ প্রজ্জ্বলিত হয় জনার্দ্দনের মনে৷ প্রবল ঘৃণায় বেশ্যাজ্ঞানে তাকে পরিত্যাগ করে চলে যায় জনার্দ্দন৷ ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতা আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন তারা স্বামীর সেই অপমান মেনে নিতে পারে না৷ তাই স্বামীর ঔরসজাত তার গর্ভস্থ সন্তান চন্দ্রার বয়স দশ বৎসর হলে নিজেকে সকলের চোখে মৃত প্রতিপন্ন করে ভিখারিনিবেশে প্রতিশোধ স্পৃহায় ঘুরতে থাকে৷ অবশেষে ইংরেজবিদ্বেষী স্বামী গোঁসাইজীর জীবনে চরম পরাজয় সাধিত করে পুনরায় সকলের সামনে নিজের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করে স্বামীর সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে৷

চন্দ্রাও তার মায়ের মতো সমাজের চোখে হীন৷ সেও শিক্ষিতা, সুন্দরী এবং সর্বকর্মে সুনিপুণা৷ মিশনারিদের যত্নে মানুষ হলেও, ইংরেজদের সঙ্গে ওঠা-বসা করলেও কোনোভাবেই সে তার ধর্ম ও নারীত্বকে বিসর্জন দিতে পারেনি৷ সমাজের কোনো কোনো মানুষের তার প্রতি হীন আচরণ ও মনোভাব তাকে ব্যথিত করত—‘‘পিতামাতা কেহই নাই, কুলবধূর ন্যায় লজ্জা সরম ছিল না৷ কেহ কেহ তাঁহাকে বেশ্যা মনে করিত; অনেকে পত্র লিখিত৷ ইহাতে তিনি আপনাকে অতিশয় হতভাগিনী বিবেচনা করিতেন৷’’৭২ তারপর একদিন জলমগ্ন হয়ে এক নবীন সন্ন্যাসীর সেবা-যত্নে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরে এসে—‘‘নূতন আশা, নূতন ভরসা মনে স্থান পায়, জীবন সম্পূর্ণ রসশূন্য নয়, জ্ঞান হয়৷’’৭৩ তার কোমল নারী হৃদয়ে অচিরেই অধীশ্বর হয়ে বসে সে৷ ইংরেজদের সঙ্গে মেলামেশা করে চন্দ্রা বুঝতে পারে তার প্রেমাস্পদের জীবন কতটা ঝুঁকিপূর্ণ৷ সে তার সমস্ত সাধ্য প্রয়োগ করে তাকে সেই পথ থেকে ফেরানোর জন্য৷ প্রথমে অনুনয় বিনয় করে বলে—‘‘সন্ন্যাসী, কেন প্রাণ দিবে? ইংরাজ-বিরোধী কি নিমিত্ত হইতেছ? আমায় কৃপা কর, আমায় রক্ষা কর, দুরভিসন্ধি পরিত্যাগ কর, এপথে আর চলিও না৷… দেখ, আমার চক্ষে ধারা বহিতেছে—দেখ, আমি কাতর হইয়াছি৷ আমায় কাতর দেখিলে ত তুমি কথা কও! সন্ন্যাসি, কথা কও, যে পথে চলিতেছ সে পথে আর চলিও না৷ আমায় হতভাগিনী শুনিয়া দুঃখিত হইয়াছিলে, কেন আরও হতভাগিনী কর? আমায় রক্ষা কর, আমায় প্রাণদান দাও—সন্ন্যাসী, আমার জীবনদাতার প্রাণদান মাগিতেছি, নির্দ্দয় হইও না, অবলা অনাথিনীকে কৃপা কর৷’’৭৪ এভাবে আরও বহু কথা বলে চন্দ্রা যখন প্রেমাস্পদকে নিরস্ত করার চেষ্টা করতে থাকে এবং তার উত্তরে সন্ন্যাসী যখন বলে যে, বেশি অনুনয় করলে সে সেই স্থান পরিত্যাগ করে চলে যাবে তখন চন্দ্রাকে বাধ্য হয়েই চুপ করতে হয়৷ পরে সন্ন্যাসী চন্দ্রার থেকে বিদায় নিয়ে তার গৃহ পরিত্যাগ করলে সেই সুযোগে চন্দ্রাকে আক্রমন করে লম্পট রমানাথ৷ চন্দ্রার আর্তনাদ সন্ন্যাসীর কর্ণে পৌঁছাতে দেরি হয় না৷ তাকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রবলভাবে আহত হয় সেই সন্ন্যাসী৷ আহত অবস্থাতেই পাহারাওয়ালা কর্তৃক ধৃত হয়ে বিচারাধীন আসামি হিসেবে হাসপাতালে স্থান পায়৷ আর রমানাথও ধরা পরে টাকার জোরে সাজাপ্রাপ্ত আসামি হয়েও হাসপাতালে রোগী সেজে দিন গুজরান করে৷ সন্ন্যাসীকে দেখতে চন্দ্রা হাসপাতালে উপস্থিত হলে তাকে অনুসরণ করে প্রণয়বাক্য বলে রমানাথ৷ সন্ন্যাসী লম্পট, নারীলোলুপ রমানাথকে চন্দ্রার সঙ্গে দেখে চন্দ্রার চরিত্র সম্পর্কে নিঃসন্দিগ্ধ হয়ে ভাবে যে—‘‘এ স্ত্রীলোকটা ভ্রষ্টা৷’’৭৫ তার গুরুদেব যথার্থই বলেছিলেন যে সে একজন পিশাচিনী৷ আর সে কথা মনে হতেই চন্দ্রাকে অপমান করে সেখান থেকে দূর করে দেয়৷ চন্দ্রার মধ্যেও ছিল তার মায়ের মতো আত্মমর্যাদাবোধ সে তার সমস্ত ভালোবাসা নিজ হৃদয়ে পুঞ্জিভূত করে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যতদিন না সন্ন্যাসীর সেই ভুল ভাঙিয়ে দেবে ততদিন তার মুক্তি নেই৷ আর তাই সব দিক দিয়ে সে রক্ষয়িত্রীর ভূমিকা নেয় সন্ন্যাসীর৷ যেখানেই বিপদের সম্ভাবনা দেখে সেখানেই ছুটে যায় তাকে রক্ষা করতে৷ সন্ন্যাসী অহিতকারী দুর্বৃত্ত রামচাঁদকে অনুসরণ করতে গিয়ে তার দ্বারা ধৃত হয়ে নিক্ষিপ্ত হয় মুসলমান বদমায়েশদের যৌনখোরাক হিসেবে৷ সেখান থেকে রমানাথের কৌশলে উদ্ধার পেয়ে সৎপথে ফিরে আসা রমানাথের প্রণয়বাক্যের উত্তরে তার সন্ন্যাসীর প্রেমে উৎসর্গীকৃত অবস্থার কথা ব্যক্ত করে করজোড়ে জানুপেতে নিবেদন করে—‘‘মহাত্মন! নিজগুণে মার্জ্জনা করুন৷ আমি আমার নহি, আপনার হইব কি?’’৭৬ চন্দ্রার সেই বিনম্র প্রত্যাখ্যান রমানাথকে বিহ্বল করে দেয়৷ সে সন্ন্যাসীর অনুসারী হয়ে যুদ্ধ করে নিজেকে উৎসর্গ করতে চায়৷ সন্ন্যাসীর সম্মুখে উপস্থিত হয়ে সে ইচ্ছা ব্যক্ত করলে সন্ন্যাসীর মনের মধ্যে তাকে দেখা মাত্রই ঘৃণ্য এক অনুভূতির অনুরণন হয়৷ রচনাকার সন্ন্যাসীর সেই মনোবিকারকে ব্যক্ত করেছেন এইভাবে—‘‘দেখিবামাত্র সোমনাথ চিনিলেন; চন্দ্রার কথা মনে পড়িল, মনে বিষ উদয় হইল৷’’৭৭ তারপর এক্কাওয়ালার চন্দ্রার নামাঙ্কিত সোনার ফুল রমানাথকে ফেরত দেওয়া দেখে প্রবল শ্লেষে সন্ন্যাসী বা সোমনাথকে বলতে শোনা যায়—‘‘চন্দ্রাকে রাখিয়া যুদ্ধ করিতে আসিয়াছ? …যাহার মাথার এই ফুলটী, যাহার সহিত এক্কা চড়িয়া মাঠে বেড়াইতে গিয়াছিলে, তিনি কি তোমার সঙ্গে আছেন?’’৭৮ সন্ন্যাসীর মনের বিকার রমানাথের বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ সে আদ্যপান্ত চন্দ্রার সমস্ত ঘটনা তার সকাশে ব্যক্ত করে মনের ভ্রম ভাঙাতে চেষ্টা করে কিন্তু পুরুষের পৌরুষের গর্বে গর্বিত সোমনাথের সে সকল কথায় প্রত্যয় জন্মে না৷ চন্দ্রা তো কুলটা নয়, ব্যভিচার দোষেও দুষ্ট নয়; তার হৃদয়ের অধীশ্বর সন্ন্যাসীর জীবন রক্ষার্থে এবং মিথ্যা সন্দেহ ভঞ্জন করতে বদ্ধপরিকর সে৷ তাই ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ বাঁধলে সন্ন্যাসীর তত্ত্ব নিতে সমস্ত বিপদ মাথায় নিয়ে পথে বের হয়, রামচাঁদ ও নানা সাহেবের গোপন শলা শুনে নানাসাহেবকে প্রকৃত সত্য অবগত করায়, তারপর সন্ন্যাসীর দেখা পেয়ে তাকে আসন্ন ভয়ঙ্কর বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে প্রবলভাবে তিরস্কৃত হয় তার দ্বারা৷ তার কর্কশবাক্যে আহত হয়ে চন্দ্রা সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়েও গোরার দলকে তার দিকে আসতে দেখে পুনরায় সে সন্নাসীর সমীপে উপস্থিত হয়ে অনুনয় করতে থাকে—‘‘সন্ন্যাসি পলাও! গোরায় তোমার প্রাণ বধ করিবে৷ পলাও!’’৭৯ সন্ন্যাসী তার কথা শোনে না৷ গোরার গুলিতে বিদ্ধ হয়ে চন্দ্রা মূর্ছিত হয়ে ভূলুন্ঠিত হয়৷ এক ইংরেজ রমণীর অনুরোধে সে মৃত্যু মুখ থেকে রক্ষা পেয়ে বিচারাধীন আসামি হিসেবে কলকাতায় চালান হয়৷

আহত চন্দ্রা তিন দিন পর চৈতন্যপ্রাপ্ত হয় সেই রক্ষয়িত্রী বিবির যত্নে৷ জ্ঞান ফিরতেই সে ব্যাকুলভাবে সেই বিবিকে বলে—‘‘যদি বন্ধু হন, আমার প্রাণরক্ষা করুন—সন্ন্যাসীর কি হইল বলুন?’’৮০ বার বার তিরস্কৃত অপমানিত হয়েও চন্দ্রা তার তত্ত্ব নিতে ভোলে না৷ বিবির কাছে তার কলকাতায় চালান হওয়ার খবর শুনে সেও কলকাতায় যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে৷ উঠে বসতে গিয়ে পুনরায় মূর্ছিত হয়ে পড়ে৷ তারপর টানা দুই পক্ষকাল জ্বরে অচৈতন্য হয়ে থেকে কিছুটা সুস্থ হলে ডাক্তারকে অনুরোধ করে কলকাতায় যাওয়ার অনুমতি দিতে কারণ সন্ন্যাসীকে না দেখলে, তার কুশল না শুনলে সে বাঁচবে না৷ ডাক্তার বুঝতে পারেন চন্দ্রার যা মনের অবস্থা তাকে যাওয়ার অনুমতি দিলে যতটা আশঙ্কা না যেতে দিলে তার চেয়ে বেশি আশঙ্কা৷ সুতরাং তিনি অনুমতি দিতে বাধ্য হন৷ চন্দ্রা কলকাতায় উপস্থিত হয়ে লর্ড ক্যানিং-এর সামনে উপস্থিত হয়ে ইংরেজদের কাছে কঠিন অপরাধে অপরাধী সন্ন্যাসীর জন্য নাছোড়ের মতো প্রাণ প্রার্থনা করে বলতে থাকে—‘‘একজনের অপরাধে দুইজনের প্রাণবধ কি নিমিত্ত করিবেন? সেই বিদ্রোহী, আমি আপনার প্রজা-কন্যা, আমার প্রাণবধ কি নিমিত্ত করিবেন? পিতঃ, আপনি দয়াগুণে শ্রেষ্ঠ, কেবল কি অভাগিনীর প্রতি প্রসন্ন হইবেন না? জগৎ আপনাকে দয়াবান বলিবে—সুমেরু হইতে কুমেরু পর্য্যন্ত আপনার গুণ-গানে প্রতিধ্বনিত হইবে, কেবল কি এই অবলা জানিবে, আপনার হৃদয়ে দয়া নাই? কেবল কি আমার প্রতি কঠিন হইবেন? পিতঃ, অভাগিনী পিতার মুখ দেখে নাই, বাল্যকালে মা মমতা-ত্যাগ করিয়া গিয়াছেন, সমাজে স্থান দেয় নাই, কখনও কোন সাধ পূর্ণ হয় নাই, অভাগিনী কেবল দুঃখ পাইয়া আসিতেছে৷ পিতঃ, তুমিই এই দুঃখময় জীবন সুখময় করিতে পার৷ রাজ্যেশ্বর, ঈশ্বরের প্রতিনিধি, আমার প্রতি দয়া কর!’’৮১ লর্ড ক্যানিং এবং লেডি ক্যানিং-এর সহৃদয়তায় এবং তার কাতরোক্তিতে সন্ন্যাসী মুক্ত হয়৷ লেডি ক্যানিং চন্দ্রাকে অনুরোধ করে সে যেন নিজে গিয়ে সন্ন্যাসী ও তার মাকে মুক্ত করে আনে৷ তার সেই প্রস্তাবে চন্দ্রা অস্বীকৃত হলে বিস্মিত হয়ে যায় লেডি ক্যানিং৷ কারণ যে তার ভালোবাসাকে রক্ষার জন্য জীবন পণ করে বসে আছে সে-ই আবার তার সম্মুখে যেতে চাইছে না! সে লেডি ক্যানিংকে জানিয়েছে—‘‘মাগো! স্ত্রীলোকের প্রাণে কত সয়? আমার যা বলিবার ছিল, কার্য্যে বলিয়াছি—আর দেখা করিব না৷’’৮২

সন্ন্যাসী এবারে তার ভুল বুঝতে পারে৷ সে যথার্থই অনুধাবন করতে পারে চন্দ্রা সতী এবং তার যথার্থই অনুরাগিনী৷ এবারে সে তাকে গ্রহণ করতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত৷ ভিখারিনীবেশী চন্দ্রার মায়ের তার হাতে দেওয়া চন্দ্রার উদ্দেশ্যে পত্রখানি নিয়ে সে তাই উপস্থিত হয়েছে চন্দ্রার বাড়িতে৷ উদ্দেশ্য স্বহস্তে সেই পত্রখানি চন্দ্রার কাছে দিয়ে নিজের সমস্ত দৈন্যতাকে স্বীকার করে নেবে৷ সেখানে দ্বারোয়ানের হাতে স্বনামাঙ্কিত পত্র প্রেরণ করে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ভেবেছে যে, চন্দ্রা তার আগমনের সংবাদ পেয়ে আহ্লাদিত হয়ে সাগ্রহে তাকে আপ্যায়ন করবে৷ কিন্তু চন্দ্রা আসে না৷ আসে দ্বারোয়ানের হাত দিয়ে তার লেখা একখানি পত্র৷ সেখানে সে তাকে উদ্দেশ্য করে লিখেছে—‘‘সন্ন্যাসী, আমার প্রয়োজন সিদ্ধ হইয়াছে৷ তোমার সহিত আর আমার কার্য্য নাই৷ জেলে তোমার নিকট শুনিয়াছিলাম, তোমারও আমার সহিত কার্য্য নাই৷ পত্রের দ্বারা এই শেষ কথা৷—চন্দ্রা৷’’৮৩ এখানেই অনন্য গিরিশচন্দ্র৷ তিনি নারীর আত্মমর্যাদাবোধকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন, যে চন্দ্রাকে বেশ্যা জ্ঞানে সর্বদা বিষনজরে প্রত্যক্ষ করেছে সন্ন্যাসী, যে তারাকে ব্যভিচারিণী ভেবে মুহূর্তে পরিত্যাগ করেছিল জনার্দ্দন তারা কেউই পুনরায় তাদের নারীত্বকে সেই গর্বিত পুরুষের কন্ঠলগ্না করেনি বরং নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণিত করে সেই পুরুষদের থেকে বহুদূরে সরে গিয়েছে৷

রামেশ্বরের অদৃষ্ট :

সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ছোট্ট উপন্যাস ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৭ সালে৷ গ্রন্থাকারে প্রকাশের পূর্বে এটি প্রথম ভ্রমর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল৷ এর নায়ক রামেশ্বর শর্মা ভাগ্যবিড়ম্বিত যুবক৷ পিতৃবিয়োগের পর পিতৃকর্তব্য পালনার্থে পিতার সমস্ত সঞ্চয় ব্যয় করে পিতার শ্রাদ্ধে৷ শুরু হয়ে যায় কপর্দকহীন মর্মান্তিক জীবন যুদ্ধ৷ স্ত্রী-পুত্র নিয়ে অনাহারে দিন কাটে তার৷ ক্ষুধার্ত পুত্রের মুখে অন্ন তুলে দিতে গিয়ে আট আনা চুরি করে সাময়িক খুন্নিবৃত্তি নিবারণের জন্য৷ অবশেষে চলে যায় ভিন গায়ে, সেখানেও একই অবস্থা৷ জমিদারের নায়েব জমিদারিতে অন্যের চুরির দায় তাকে গ্রহণ করার জন্য পঞ্চাশটাকা অগ্রিম দেয়৷ চুক্তিমত চুরির দায়ে আবদ্ধ হলে শোকে উন্মাদিনী স্ত্রীকে দেখার জন্য রক্ষকের কাছ থেকে পালিয়ে এসে সাক্ষাৎ করে নায়েববাবুর সঙ্গে স্ত্রীর একত্রে ঘরে অবস্থান৷ অবরুদ্ধদ্বার ঘর স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে তার মনে সন্দেহ বদ্ধমূল করে৷ আসলে নায়েববাবু এসেছিল রামেশ্বরের চুরির প্রমাণস্বরূপ চুরির মাল তার স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে ঘরে রাখার জন্য৷ যাতে রামেশ্বর কোনো অবস্থাতেই সেই মিথ্যা চুরির দায়কে অস্বীকার করতে পারে না৷ রামেশ্বর শুধু নায়েববাবুকে দরজা বন্ধ করতেই দেখেছিল কিন্তু কোনো কথা শুনতে পায়নি৷ রামেশ্বরের দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে স্ত্রীর পরপুরুষ সম্ভোগের ধারণায়৷ এইভাবে সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রামেশ্বরের সন্দেহের মধ্য দিয়ে গণিকা প্রসঙ্গের অবতাড়না করেন৷ চরম ক্রোধে বন্ধ দ্বারে পদাঘাত করে রামেশ্বর বলে—‘‘আমি আসিয়াছি, তুমি যাহার জন্য কাঁদিতেছিলে, সেই আমি আসিয়াছি—তোমার উপপতি তোমার ঘরে আছে, এখন আমি চলিলাম৷’’৮৪ স্বৈরিণীজ্ঞানে স্ত্রীকে ফেলে, পুত্রকে ফেলে চুরি, স্ত্রীহত্যাসহ জমিদারির যত অপরাধ আছে সবকিছুর দায় শিরোধার্য করে বিশবছরের সাজা নিয়ে দ্বীপান্তরে চলে যায়৷

উপন্যাসের দ্বিতীয়পর্বের ঘটনা বিশ বছর পরের৷ এখানে উল্লেখ আছে এক নামহীনা গণিকার প্রসঙ্গ৷ স্ত্রীকে গণিকা জ্ঞানে ত্যাগ করে গিয়েছিল রামেশ্বর৷ তার প্রতি সেই ধারণাই বদ্ধমূল রয়েছে৷ কিন্তু সন্তানকে তো অস্বীকার করতে পারে না পিতার স্নেহ৷ তাই বিশ বছর সাজা কাটানোর পর আবার উপস্থিত হয় তার স্বদেশ ভাতিপুরে৷ সেখানে এসে দেখতে পায় এক গণিকাকে৷ তার আকার অবয়ব দেখে নিশ্চিত যে সে বেশ্যা৷ কিন্তু তার বয়স তাকে চমকে দেয়৷ গণিকার বয়স চল্লিশ হবে৷ বিশবছর পূর্বে যখন সে দ্বীপান্তরে গিয়েছিল তখন তার স্ত্রী পার্বতীর বয়সও বিশ বছর ছিল৷ সুতরাং সেই গণিকাকে পার্বতী ভেবে তার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়৷ দেহব্যবসায়ী নারীরা কি ধরনের পোশাক পরিধান করে, পরপুরুষ ভোলানোর জন্য কি ধরনের সাজগোজ করে সে সম্পর্কে লেখকের স্বচ্ছ ধারণা ছিল৷ সেই চল্লিশ বছর বয়স্কা বিগত যৌবনা গণিকা—‘‘রক্তবর্ণ বস্ত্র পড়িয়া, শুষ্ক বনফুলের মালা গলায় দিয়া তামাক খাইতে খাইতে একজন মুসলমানের সহিত কথা কহিতেছে৷’’৮৫ এই বারবনিতার রূপ বিরূপ হয়েছে, যৌবন গত হয়েছে, শরীরের সব রস-লাবণ্য শুকিয়ে গেছে তাই তার গলার বেলফুলের মালাটিও শুষ্ক; বিগত যৌবনের সাক্ষী হয়ে গলার মধ্যে ঝুলে রয়েছে৷ সেই গণিকা রূপ-রস-রঙ হারিয়েও মুসলমান পুরুষের সঙ্গে কথা বলছে বা খদ্দেরের সঙ্গে কথা বলে দেহের বিকিকিনির জন্য, জীবনধারণের জন্য৷ শুষ্ক মালাটি সেই বিগতযৌবনা গণিকার জীবনের প্রতীক৷ রামেশ্বর তাকে পার্বতী ভেবে তার কাছে গিয়ে উপস্থিত হয়, গম্ভীরভাবে সন্ধান চায় ছেলে আনন্দদুলালের৷ কিন্তু গণিকা তো গণিকাই৷ সে কত পুরুষকে শয্যা দিয়েছে, কত পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়েছে৷ তাই রামেশ্বরের মুখে ছেলের কথা শুনে স্বাভাবিক লাস্যভঙ্গিতে—‘‘বেশ্যা আকাশমুখী হইয়া হাসিয়া উত্তর করিল, ‘‘কে তোর ছেলে?’’৮৬ রামেশ্বর পার্বতী ভেবে অটল বিশ্বাসে আনন্দদুলালের নাম করলে নটী তার স্বাভাবিক ভঙ্গিতে জবাব দেয়—‘‘মরণ আর কি! তোমার দড়ি কলসী জোটে না?’’৮৭ তারপরেও বিরত হয় না রামেশ্বর৷ বরং বেশ্যার তাচ্ছিল্যপূর্ণ উত্তরে তার ক্রোধ আরও বেড়ে যায়৷ সে যখন ক্রোধান্বিত হয়ে পুনরায় সেই গণিকার কাছে ছেলের সন্ধান চায় তখন গণিকার দেওয়া উত্তর ঠিক বেশ্যাসুলভ ভাবেই প্রকাশিত হয়—‘‘চুলায় পাঠাইয়াছি—নদীর ধারে তারে পুঁতিয়া আসিয়াছি—তাহার ওলাওঠা হইয়াছিল সে গিয়াছে, এক্ষণে তুমি যাও৷’’৮৮ রামেশ্বর আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না৷ সরাসরি তাকে আক্রমণ করে৷ বিনাদোষে তার পদাঘাতে বিপর্যস্ত হয় বছর চল্লিশের সেই নারী৷

আসলে গণিকাদের জীবনই অমন৷ তাদের ভালোবাসা বিক্রয়ের খেলায় সত্যিকারের ভালোবাসার কোনো স্থান থাকে না৷ যখন যেভাবে খুশি যে কেউ তাদের আঘাত করতে পারে৷ তার প্রতিকার হয় না৷

দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন :

দুর্গাচরণ রায়ের লেখা ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ উপন্যাসটি ১৮৮০ খ্রিস্টব্দে (১২৮৭ বঙ্গাব্দে) প্রথম ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ‘কল্পদ্রুম’ পত্রিকায়৷ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে৷ তখনও পর্যন্ত রচনাকার অজ্ঞাত৷ পরবর্তী সময়ে ১৮৮১ সালে ঐ ‘কল্পদ্রুম’ পত্রিকাতেই দুটি লেখার সন্ধান পাওয়া যায় যা দুর্গাচরণ রায়ের স্বাক্ষরিত৷ সেই রচনাদুটির রচনাশৈলী এবং বিবরণের সঙ্গে ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এর সাদৃশ্য লক্ষ করে এর রচয়িতা যে দুর্গাচরণ রায়ই সে বিষয়ে নিঃসন্ধিগ্ধ হয়েছেন সমালোচকেরা৷ উপন্যাসটিতে তৎকালীন সময়ের ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক পরিবেশের এক জীবন্ত ছবি ব্রহ্মা, নারায়ণ, ইন্দ্র এবং বরুণের মর্ত্য ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় চিত্রিত হয়েছে৷ দেবতারা স্বর্গের অলসপ্রিয় বিস্তৃর্ণ অবসরের ক্লান্তিকর একঘেয়েমি থেকে মুক্তির জন্য সংকল্প নেন কলকাতা ভ্রমণের৷ কলকাতা বিলাসপ্রিয়তা, আরামপ্রিয়তা, আনন্দ-বিনোদনের বিস্তির্ণ সুযোগ-সুবিধার জন্য চিরকালই তাঁদের আকর্ষণীয় এক স্থান৷ ইংরাজ, বাবু শ্রেণীর আগমনের ফলে তার আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে৷ জলধিপতি বরুণ তাই কলকাতা সম্পর্কে ইন্দ্রকে জানান—‘‘যদি একবার ইংরাজ-রাজধানী কলিকাতা দেখ, অমরাবতীতে আর আসিতেও চাহিবে না৷ এখানে তুমি সামান্য সুন্দরী শচীকে পাইয়া ভুলিয়া আছ; কিন্তু কলিকাতায় যাইয়া যদি আরমানি বিবি দেখ, হয়তো আর শচীর প্রতি ফিরেও তাকাইবে না৷ এখানে তুমি সামান্য বন নন্দন-কাননে যাইয়া অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত বসিয়া থাক, কিন্তু কলিকাতায় যাইয়া যদি একদিন ইডেন গার্ডেনে প্রবেশ কর, তাহলে হয়তো আর ফিরে আসতে চাইবে না৷ তুমি স্বর্গীয় ধেনো মদকে সুধা বল, কিন্তু ইংরাজ রাজ্যে যাইয়া যদ্যপি সেরি, স্যাম্পেন, ব্রাণ্ডি পান কর, হয়তো আর এ সুধা মুখেও করবে না৷ ইংরেজরা তৈল-শলিতা-বিহীন লন্ঠনে আলো জ্বালে৷ লৌহ-তারে খবর আনে৷ জলে কলের তরী চালায়৷ কুইনাইন নামক ঔষধে সদ্যঃ জ্বর আরাম করে৷ ইংরাজকৃত কুইনাইনের শিশি সম্বল করিয়া কত শত গণ্ডমূর্খ ধন্বন্তরি হইয়া পথে পথে ডিসপেন্সরি খুলে বিরাজ করিতেছে৷’’৮৯ অমরাবতী থেকে কলকাতা আসার পথে ভ্রমণ করেন ভারতবর্ষের আরও বহু বিখ্যাত স্থান৷ আর এই অনুসঙ্গেই বিস্তারলাভ করেছে সমগ্র উপন্যাসের কাহিনি৷

যদিও সমগ্র উপন্যাসটিই ভ্রমণবৃত্তান্তে পরিপূর্ণ তথাপি একে ঠিক ভ্রমণ উপন্যাস বলতে চাননি এর প্রকাশক৷ এ সম্পর্কে তার স্পষ্ট বক্তব্য—‘‘এই গ্রন্থ ভ্রমণ উপন্যাস নয়, ক্ষমতার হস্তান্তরের (কোম্পানি পর্ব থেকে ইংরাজ সরকার) আরও এক আখ্যান৷ আপাত হালকা, মজলিসি চালে লেখা হলেও এই আখ্যানের অন্তর্লীনতা আমাদের আজকের এই সংকট ও সম্ভাবনাময় দিনে জিজ্ঞাসার নানান উৎসমুখের সঞ্চার করে : ঐতিহাসিকদের হাত ছাড়িয়ে ভাবনা চালিত হয় ইতিহাস নির্মাণের আখ্যানে৷’’৯০ উপন্যাসটির সম্পূর্ণ অবয়বের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গণিকা জীবনের কথা৷ ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে একটা গুরুতর দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে এই গণিকা সমাজের উপর৷ রচয়িতার কলমে এরা অঙ্কিত হয়েছে চরিত্রস্খলনের প্রধান হাতিয়াররূপে৷ রচনাটি বিষদ বিশ্লেষণ করলে উনিশ শতকের সমাজজীবনে গণিকাদের অবস্থানগত ধারণাটি সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়৷

ব্রহ্মা, ইন্দ্র, নারায়ণ, বরুণ প্রমুখ দেবগণ কলকাতার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে হরিদ্বার হয়ে দিল্লীতে পৌঁছান তখন নবাব-বাদশাদের বেগমদের পর্দাসীন হয়ে থাকা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বরুণদেব তাদের বোঝান যে দিল্লীতে কোথাও কোথাও বিবিদের পর্দাসীন হয়ে থাকার দৃশ্য দেখা গেলেও কলকাতার নিয়ম স্বতন্ত্র৷ সেখানকার বাবুরা তাদের স্ত্রীদের শুধু একাধিক জানালাযুক্ত দোতলা-ত্রিতলা ঘরে রেখেই তৃপ্ত হয় না কখনো কখনো খোলা গাড়িতে তাদের বিবি সাজিয়ে লোকচক্ষুর সম্মুখ দিয়ে হাওয়া খাইয়ে আনে৷ বরুণের মুখে নারীস্বাধীনতার এহেন বাড়াবাড়ির কথা শুনে পিতামহ ব্রহ্মা ঘোর কলিযুগ যে আগত প্রায় তার আভাস দেন৷ কারণ বিধাতার লিখন অনুযায়ী কলির অন্তিম দশায় স্বেচ্ছাচারিণী হয়ে স্ত্রীলোকেরা তাদের অন্দরমহলের আবেষ্টনী ত্যাগ করে যেখানে সেখানে ভ্রমণ করবে৷ এখানে নারীস্বাধীনতার—নারীমুক্তির বিরোধিতা করেছেন পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষতন্ত্রের প্রতিভূ পিতামহ ব্রহ্মা৷ দেবতাদের দিল্লী ভ্রমণ প্রসঙ্গে উঠে আসে সেখানকার বাইদের কথা৷ তাদের নৃত্যগীত-পারদর্শিতার কথা আগেই বরুণদেবের জানা ছিল এবং তিনি এজন্য তাদের অনুরক্ত হয়েছিলেন৷ কিন্তু প্রকাশ্যে তাদের তামাক সেবনের দৃশ্য দেখে জলধিপতির অশ্রদ্ধা বেড়ে যায়৷ তাই বিরক্তসহকারে তিনি বলেন—‘‘দিল্লীর বাঈ ভাল শোনা ছিল; কিন্তু মাগীরা বারাণ্ডায় ব’সে যে গুড়ুক তামাকে খাচ্চে, দেখে অশ্রদ্ধা হয়ে গেল৷’’৯১

উপন্যাসটিতে উল্লেখ রয়েছে সেবাদাসী প্রথার৷ এই নির্মম প্রথার মধ্য দিয়ে নারীদেহকে ভোগ করার উত্তম সুযোগ বের করেছে মহাত্মাগণ৷ সেবাদাসী সম্ভোগদৃশ্য দেবতাদের নজরে আসে বৃন্দাবন ভ্রমণ করতে এসে৷ সেখানকার চৈতন্যদাস বাবাজী সত্তর-পঁচাত্তর বছর যার বয়স তার অধীনে রয়েছে ষাট-সত্তর জন সেবাদাসী৷ এদের সহবাসে এবং তাদের ভিক্ষালব্ধ অন্ন ও সেবাযত্নে বয়সের ভারে নুয়ে পরা অশীতিপর বৃদ্ধ চৈতন্যদাস মহারঙ্গে দিনাতিপাত করে৷ শুধু চৈতন্যদাস বাবাজীই নয় তার মতো অনেক বাবাজীই সেবাদাসীদের সেবা নিয়ে ভোগে-কামনায়-বাসনায়-সুখে-আহ্লাদে দিন কাটায়৷ সমস্ত দেখে শুনে রাতে শয্যাগ্রহণ করার সময় সুরগণ লক্ষ করেন বৃন্দাবনে সেবাদাসী জীবনের আরেক অভিনব নিয়ম৷ সেখানকার বিধি অনুযায়ী নারীসঙ্গ ব্যতীত রাত্রিবাস মহাপাপের৷ সেবাদাসীদের আহ্বানে তাদের সঙ্গে শয্যাগ্রহণে অসম্মত হলে এক সেবাদাসীর কথায় ফুটে উঠে গণিকাসুলভ বাক্যভঙ্গি—‘‘মিন্সেরা বলে কি—বৃন্দাবনে কি যুগলরূপ না হয়ে রাত্রি বাস ক’রতে আছে! ওতে যে পাপ হয়৷’’৯২ বৃন্দাবনের সেবাদাসীদের এইরূপ বাক্যবন্ধ থেকে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয় তাদের বহুপুরুষে অভ্যস্ত জীবনের নারকীয় এক যাপনের৷ ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যে থেকে ধর্মের দোহাই দিয়ে এই নারীরা নিজের অজান্তেই যুগিয়ে যায় পুরুষদের ভোগ-পিপাসার রসদ৷

উত্তরভারতের লক্ষ্ণৌ বাইজিদের মূল আবাসভূমি৷ নৃত্যগীতপটিয়সী গণিকারা সেখানকার আকর্ষণীয় বিষয়৷ সেখানে গিয়ে বরুণদেব তাঁর সঙ্গী দেবতাদের কাছে সেখানাকার প্রসিদ্ধ বাইনাচ দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেন কারণ লক্ষ্ণৌ গিয়ে যদি বাইনাচ না দেখা হয় সে স্থান ভ্রমণই বৃথা৷ সেখানকার বাইজিদের সৌন্দর্য স্বর্গের মেনকা, ঊর্বশী, তিলোত্তমার সৌন্দর্যকেও হার মানায়৷ তাদের নৃত্যগীত দক্ষতা অপ্সরাদের দক্ষতাকেও ছাপিয়ে যায়৷ তাদের দেখে দেবগণ বিহ্বল হয়ে পড়েন৷ দেবরাজ ইন্দ্র রূপমুগ্ধ হয়ে তাদের দেবপুরীতে নিয়ে যেতে চাইলে স্বর্গের অভিভাবক ব্রহ্মা তরুণ দেবতাদের সতর্ক করে বলেন যে, যে দেশে বাইনাচ, যাত্রা, থিয়েটারের যত বেশি প্রভাব সে দেশ তত বেশি নিম্নগামী৷ স্বর্গরাজ্যে গণিকাদের নিয়ে গিয়ে স্বর্গের পরিবেশকে কলুষিত করতে চান না পিতামহ৷ এরপর দেবতারা উপস্থিত হন কাশীধামে৷ শিবের ত্রিশূলের ডগায় অবস্থিত পবিত্র কাশী৷ সেখানে তাঁদের নজরে আসে এক বাঙালি স্ত্রীলোকের খেমটা নাচ৷ সেই খেমটাওয়ালির জীবন-ইতিহাস দেবতাদের শোনান বরুণ; অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিল সেই খেমটাওয়ালি৷ ভাশুরের দুর্বার কামনায় আহুতি হয় তার৷ কলঙ্কিত জীবনে অন্য কোনো উপায়অন্তর না দেখে তার সঙ্গেই ঘর ছাড়ে সে৷ তখনো হয় তো ঘর বাঁধার স্বপ্ন লেগেছিল তার চোখেমুখে৷ কিন্তু ভোগই যার উদ্দেশ্য, যে তার ভ্রাতৃবধূর প্রতি লালায়িত হতে পারে সে ঘর বাঁধতে যাবে কোন স্বার্থে! তাই জীবনধারণের জন্য সেই নারীকে খেমটা নাচের সাথে সাথে দেহের পসরা সাজাতে হয়েছে৷ নারীত্বের সমস্ত লজ্জাসম্ভ্রমকে বিসর্জন দিয়ে তাকে হতে হয়েছে কুলবধূ থেকে বারবধূ৷ এভাবে বহু কামনার, বহু পাপের কেন্দ্রস্থল হিসেবে কাশী রমরমা হয়ে উঠেছে৷ দেবাদিদেব মহেশ্বরের বহু যত্ন ও সাধনায় প্রতিষ্ঠিত কাশী বেশ্যা-লম্পটের আশ্রয়ে অবাধ যৌনাচারের চারণক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে৷

গণিকা মানেই ভিন্ন এক পরিচিতি; গণিকা জীবন মানেই কদর্য এক জীবনের যাপন৷ সেখানে না আছে সম্মান না আছে শান্তি৷ অথচ তাদের সঙ্গে ভোগ-বিলাসে রপ্ত হয়ে কখনো যশক্ষুন্ন হয় না চরিত্রবান পুরুষসমাজ৷ পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি ব্রহ্মার ভাষায় তাই পতিতারা ‘খারাপ স্ত্রীলোক’৷ দেবতাদের পথ প্রদর্শক বর্ষণের অধিরাজ তাই ব্রহ্মদেবকে বোঝান—‘‘আপনি খারাপ স্ত্রীলোক ব’লে ভয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হ’লেন! আজকাল পৃথিবীর সর্ব্বত্রই খারাপ স্ত্রীলোক দেখিতে পাওয়া যায়৷ অতএব বেশ্যার নিকট দিয়া যাইলে পাপ হয়, যে নগরে বেশ্যা থাকে তথায় বাস করিলে পাপ হয়, এত বিচার ক’রে চ’লতে হ’লে আর মর্ত্ত্যে আগমন হয় না৷’’৯৩ গয়ায় গয়ালীগুরু কর্ত্তৃক সুফল প্রদানের দৃশ্য প্রতিবিম্বিত হয়েছে মিরজাপুরে৷ সেখানে উপস্থিত হয়ে দেবতারা লক্ষ করেন সেখানে গয়ালীগুরুদের দারুণ প্রভাব৷ গয়ালীগুরুদের সন্তুষ্ট করতে না পারলে গয়ায় গিয়ে পিণ্ডদান অসম্ভব৷ দেবতারা দেখেন গোলাপী নামের এক বেশ্যা গয়ালীগুরুর কাছে সুফল প্রার্থনা করে৷ সেই গুরু তাকে পাঁচশত টাকার সুফল কিনতে বলে৷ সে গণিকা; অত টাকার সুফল কিনতে যাবে কেন, যদি তা তার গণিকাবুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে কম পয়সায় করতে পারে! সে তার লম্পট প্রেমিকত্রয়ের সাহায্য নিয়ে সেই গুরুকে জব্ধ করে পাঁচশত টাকার স্থানে দু’টাকায় সুফল লাভ করে৷ অন্যদিকে আর এক সহায়-সম্বলহীনা গৃহবধূ অনেক সাধ্য-সাধনা করেও গয়ালীগুরুর মন গলাতে পারে না৷ এখানে বর্ণিত হয়েছে ধর্মের নামে সমাজপ্রভুদের চরম শোষণের দৃষ্টান্ত৷ সেখানে সাধারণ গৃহবধূ থেকে পতিতা কেউই বাদ পড়ে না৷ আর তা দেখে ব্রহ্মা উগরে দেন তার ক্ষোভ৷ তিনি তার সহযাত্রী দেবগণকে জানান যে, যেখানে বেশ্যার দান গ্রহণ করে সুফল প্রদান করা হয় সেখানে তিনি এক মুহূর্তও থাকবেন না৷ গণিকারা সমাজে এতটাই অপাংক্তেয় যে তাদের অর্থজাত সুফলও পিতৃপুরুষের নামে উৎসর্গীকৃত হয় না৷

জামালপুরে বর্ণিত হয়েছে বিবাহিত বাবুদের ঘরে স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও উপপত্নী রেখে ভোগ-বিলাসে মত্ত হয়ে জীবন কাটানোর ছবি৷ সেখানে মেজবাবু নামের এক চরিত্রের ঘরে দুজন পত্নী থাকতেও নিজের কামনাকে চরিতার্থ করার জন্য উপপত্নী রেখেছে আলাদা করে৷ রাতের পর রাত বিবাহিত স্ত্রীদের উপেক্ষা করে সময় কাটায় সেই রক্ষিতার সাথে৷ কিন্তু রক্ষিতারা তো বহুগামী৷ নিয়ম অনুযায়ী যতদিন ভরণপোষণ জোগাবে ততদিন তাদের রক্ষকবাবুর অধীনে থাকতে হয়, একমাত্র সেই বাবুরই অঙ্কশায়িনী হতে পারে৷ যখন বাবু অক্ষম হবে তখন আর তার নিয়ন্ত্রণে থাকে না৷ যদিও থাকাটা তাদের স্বভাব নয়৷ তাই বেশিরভাগ সময়ই বাবুকে ফাঁকি দিয়ে তার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে মধুচক্রের মোহন বাসর গড়ে তোলে৷ এখানে মেজবাবুর অধীনস্ত রক্ষিতার অন্য গুপ্ত পুরুষ হল বাবুর দুই কেরানি৷ কেরানিদের জীবনও অদ্ভুত ছাঁচে ফেলা৷ সে প্রসঙ্গেও উঠে এসেছে গণিকাদের জীবনালেখ্য৷ সামান্য বেতনের বিনিময়ে হাড়ভাঙ্গা খাটুনির চাকরি করে তারা৷ ঘরভাড়া বাঁচানোর জন্য অনেকে মিলে মেসভাড়া নিয়ে থাকে৷ জীবনের দৈন্যতা ভুলতে গুলি, গাঁজা, চরস, চণ্ডু, তাস, পাশার সঙ্গে বেশ্যা নিয়ে জীবন কাটায়৷ স্ত্রী-পরিজন কাছে না থাকায় তাদের দুর্দান্ত যৌনপিপাসাকে পরিতৃপ্ত করে বারবিলাসিনীরা৷ জীবনের চরম অবসাদে গণিকাগৃহে গিয়ে বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে৷ কেরানিদের মধ্যে যারা সরকারি অফিসের কেরানি তাদের তো কোনো কথাই নেই৷ তারা ভবিষ্যতে পেনশনভোগী হয় বলে অর্থসঞ্চয়ে তাদের তেমন তাগিদ দেখা যায় না৷ বেতনের বেশিরভাগ অর্থ (ভবিষ্যতে পেনশনের ব্যবস্থা থাকায়) বিনা দ্বিধায় খরচ করে ফেলে গণিকাদের পেছনে৷ সেই অর্থ নিয়েই পণ্যাঙ্গনারা বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করে৷

মর্ত্যভূমিতে মানুষজনের নাস্তিক জীবনযাত্রা দেবগণকে ব্যথিত করে৷ তাঁরা প্রত্যক্ষ করেন সেখানকার মানুষজনের পুণ্যের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই৷ তারা শুভ কাজে অর্থ ব্যয় না করে তার সৎব্যবহার করে ভোগ-বিলাসের আনন্দ-মেলায়৷ যার জন্য ভাগলপুরের বুড়াশিবের মন্দির ভগ্নদশা প্রাপ্ত হয়েছে, তা মেরামত করার পয়সা জোটে না৷ তাই নারায়ণ ব্যঙ্গ করে বলেছেন—‘‘যখন মুসলমান বাইওয়ালি সুমধুর সুরে গান ধরে এবং বেশ্যারা অঙ্গভঙ্গীর সহিত নৃত্য করিতে করিতে হাত নাড়ে, সেই আসনে বসিয়া পান চিবাইতে চিবাইতে তামাক টানার যে সুখ, তাহা শত শত বুড়ানাথের মন্দির প্রস্তুত করিয়া দিলেও হয় কি না সন্দেহ৷’’৯৪ বরুণ ভাগলপুরের বারাঙ্গনাদের আমোদ প্রদান বা ‘খদ্দের’ সংগ্রহের কৌশল বলতে গিয়ে তুলে আনেন দিল্লীর প্রসঙ্গ৷ কারণ দিল্লীর মতো রূপে আলো করে অনেক বাইউলি সেখানেও আছে যারা সন্ধ্যাকালে সৌন্দর্যের ডালি সাজিয়ে যৌবনমন্দিরে উপবেশন করে, নৃত্য শিক্ষা করে, বিভিন্ন অঙ্গচালনা করে মনের গুপ্ত ইঙ্গিতে মনের গোপন বাসনাকে প্রকাশের কৌশল প্রয়োগ করে৷ বাবুশ্রেণীর বাহাদুরি প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম এই বাররামারা৷ সমাজে সেই ব্যক্তির গৌরবই সবচেয়ে বেশি যে ব্যক্তি তার রক্ষিতার পেছনে যত বেশি খরচ করতে পারে৷ ভাগলপুরের এক বাবুর তার দুই-তিনজন মোসাহেবের কাছে সেজো খুড়ো সম্পর্কে যে কথাগুলি বলেছে তাতে এই দিকটি পরিষ্কার হয়ে যায়৷ যেমন বাবু বলে—‘‘সেজো খুড়ো যে অহঙ্কার করেন—আমার চাইতে তিনি বড়—কিসে? বিষয় উভয়েরই সমান, পরিবারকে গহনা—বরং তাঁহার অপেক্ষা আমি বেশী দিইছি৷ কোম্পানীর কাগজও আমার চাইতে তাঁর বেশী হবে না৷ কিন্তু তা বলি, তাঁর মত কৃপণ হ’লে আমি আরো এক লক্ষ টাকা সঞ্চয় ক’রতে পারতাম৷ যে মদ খায় না, বেশ্যা রাখে না, সে আবার কিসের অহঙ্কার করে? রাখুন দেখি, আমার মত বেতন দিয়ে বেশ্যা রাখুন দেখি, তবে বাহাদুরী বুঝবো৷’’৯৫

কোনো নারী জন্মমাত্রই গণিকা হয় না৷ সমাজ, পরিবেশ, পরিস্থিতি তাকে গণিকা তৈরি করে৷ ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে বাধ্য হয়ে প্রবেশ করে গণিকাজীবনে৷ এখানে সম্ভ্রান্ত জমিদারবাড়ির এক কুলবধূর গণিকা হয়ে ওঠার করুণ কাহিনি বর্ণিত হয়েছে৷ স্বামী কর্তৃক অত্যাচারিত হতে হতে তার জীবন বিষিয়ে যায়৷ সেখানেই থেমে থাকে না; তার চোখের সামনে স্বামী অন্য নারী গ্রহণ করে৷ নারীজীবনের শেষ সম্মানিত আশ্রয় আত্মহত্যার দিকে না গিয়ে সংকল্প নেয় শ্বশুর কুলে কালি দেওয়ার, যাতে লোকে তার শ্বশুর-স্বামীর দিকে আঙ্গুল তুলে বলতে পারে অমুক বাবুর স্ত্রী বা পুত্রবধূ পরপুরুষের সঙ্গে বাড়ি ভাড়া করে থাকে৷ তার মতো বহু কুলস্ত্রী স্বামীকর্তৃক লাঞ্ছিতা হয়ে চরম ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণায় নিমজ্জিত হয় কলঙ্কিত জীবনের গভীর পঙ্কে৷ এরপরে দেবতারা আসেন বর্ধমানে৷ সেখানে প্রত্যক্ষ করেন এক বেশ্যাসক্ত ব্যক্তির জীবনের শোচনীয় পরাজয়৷ ব্রহ্মা বরুণের কাছে জানতে পারেন যে বাবুটি বেশ্যা খুব ভালোবাসে৷ বেশ্যাকে রক্ষিতা করার অভিপ্রায়ে সে তার সর্বস্ব খুইয়ে বসে; তার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি নিলামে ওঠে৷ বরুণ সমগ্র ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করে বলেন সেই বাবুটি গণিকাপ্রেমের বাড়াবাড়িতে একজন বেশ্যাকে নিজের রক্ষিতা করেন৷ সেই বারাঙ্গনা ভালোবাসার মন্ত্র জপে জপে তার সমস্ত পুঁজি, সম্পত্তি গ্রাস করে৷ সব শেষে যখন বুঝতে পারে যে বাবুটি অর্থ প্রদানে সম্পূর্ণ অপারগ তখন প্রত্যেক রাত্রে দেহবিক্রির পারিশ্রমিক স্বরূপ বাবুটির কাছ থেকে একটি করে ‘খত’ লিখে নিত, সেখানে তার ঋণের পরিমাণ লেখা থাকত৷ যখন খতের সংখ্যা অনেক হয়ে যায় তখন বাবুর থেকে সমস্ত পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয় সেই রক্ষিতা৷ এই অংশে দেবতারা গণিকার বিচার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন৷ শুধু যে ঠকিয়ে, মিথ্যা বচনে, খত লিখিয়ে গণিকারা বাবুদের বিপর্যস্ত করত তাই নয়, অনেক ক্ষেত্রে গণিকারাও শোষিত, প্রতারিত হত বাবুদের দ্বারা৷ এমন প্রতারিত হওয়ায় অভিযোগের হদিসও উনিশ শতকে কম পাওয়া যায় না৷ গণিকামহলে আভিজাত্যের মিথ্যা গৌরবকে জাহির করে নিজের প্রভাব-প্রতিপত্তিকে অক্ষুন্ন রাখতে বর্ণিত হয়েছে আরেক বাবুর মিথ্যা আস্ফালন৷ উপপত্নীকে খুশি রাখার জন্য সেই বাবু তার মোসাহেবের দ্বারা পাঠিয়েছিল পাঁচশত টাকার একজোড়া শাল৷ উপপত্নী তা ফেরত পাঠায়৷ ফলে উপস্ত্রীর মন রাখতে ব্যর্থ বাবু সংকল্প করে—‘‘যা হউক, হাজার টাকা কর্জ্জ ক’রে আমাকে অদ্যই এক জোড়া শাল খরিদ ক’রে দিতে হবে; নচেৎ বেশ্যা-মহলে আমার মান-সম্ভ্রম থাকবে না৷’’৯৬ বরুণদেব প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটন করে তাঁর সহযাত্রীদের উদ্দেশে বলেন যে,—সেই বাবুর একজন রক্ষিতা আছে যে কিনা তার কাছে দামি একজোড়া শাল আবদার করেছিল৷ বাবুর অর্থসামর্থ কম থাকায় তুলনামূলক কম দামে একজোড়া শাল কিনে মোসাহেবের দ্বারা তার কাছে পাঠিয়েছিল৷ আশাহত সেই বাররামা অসন্তুষ্ট হয়ে তা খণ্ড খণ্ড করে মোসাহেবের দ্বারাই ফেরত পাঠিয়েছে৷ একজন গণিকা নারীর এ হেন আচরণ থেকে সেই সময়ে তাদের চাহিদা ও আধিপত্যের দিকটিও সুস্পষ্ট হয়ে যায়৷

রূপাজীবাদের পাপের ভার এত বেশি যে কোনোভাবেই সেই বোঝা তাদের মস্তকচ্যুত হয় না৷ বলা হয় হরিনাম সর্বপাপ মুক্তির উপায় কিন্তু এই নাম শত জপ করেও তারা দেহজীবিকার কলুষতা থেকে কোনোভাবেই পাপমুক্ত হয় না৷ এদের ফেরার পথ একেবারে রুদ্ধ; কোনোরকম ফাঁক-ফোকর নেই৷ ব্রহ্মার মুখে ধ্বনিত হয় এমন কথারই প্রতিধ্বনি—‘‘বেশ্যারা নিজের উপজীবিকার জন্যই হরিনাম করে; অতএব তাহাদের মুক্তি হইবে না৷’’৯৭ আর এত কঠিন জীবন বলেই তারাও সমাজ-কুল-চূড়ামণি পুরুষদের কাছ থেকে দেহ বিক্রির রসদ নিংড়ে নিতে ছাড়ে না৷ সেজন্যই যে বাবু তথা পুরুষেরা তাদের মোহনমায়ায় আবদ্ধ হয় তারা সর্বস্বান্ত না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি পায় না৷ পূর্বোক্ত যে বাবুটি তার রক্ষিতাকে সর্বস্ব দান করেছে, বিষয়-সম্পত্তি নিলামে গিয়ে কপর্দকহীন অবস্থার মধ্যে পতিত হয়েছে সেই বাবুর আর গণিকামহলে স্থান হয় না অথচ কর্জ্জ করে শাল এনে যে গণিকার পদতলে অর্পণ করতে পারে তার জন্য থাকে সাদর অভ্যর্থনা৷ এমন দৃশ্যের অবতরণ ঘটে দুজন পাগড়িপরা উকিলের বেশধারী বাবু বেশ্যালয়ে উপস্থিত হলে৷ দুজনের মধ্যে একজনের হাতে শাল থাকায় তাকে হাত ধরে ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় আর অপরজন বহু সাধ্যসাধনা করেও, অনেক চোখের জল ফেলেও শুধুমাত্র হাত খালি বলে সেখানে প্রবেশের অধিকার পায় না৷ বারবধূ তাকে অপমান করে বলে—‘‘তোর আর আছে কি? নীলামে যথাসর্ব্বস্ব বিক্রী ক’রে নিয়েছি৷ তুই দূর হ৷’’৯৮ এই বিলাসী বাঙালি সম্প্রদায় যেমন স্ত্রী অপেক্ষা উপস্ত্রী ভালোবাসে তেমন সৎকার্য অপেক্ষা পোষ্যপুত্র গ্রহণকরাকে মহৎ কাজ বলে মনে করে৷ তাদের ধারণা পরবর্তীসময়ে সেই পোষ্যপুত্ররা তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে৷ কিন্তু আসল ঘটনায় দেখা যায় যতদিন পোষ্যপুত্র গ্রহণকারী ব্যক্তি জীবিত থাকে ততদিন তার মরণ কামনা করে সেই পুত্র আর একটু বড় হলেই মদ, গাঁজা ও বেশ্যার প্রিয় পাত্র হয়ে স্ফূর্তির জোয়ারে জীবনকে ভাসিয়ে দেয়৷

বৈধব্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরেও নারীরা যে ভুল পথে চালিত হয়ে স্বৈরিণী বা দেহজীবিকার পথে অগ্রসর হয় এমন ঘটনাও ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ বিরল নয়৷ কোনো সম্ভ্রান্ত পিতা মৃত্যুকালে তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি দিয়ে যান দুই বিধবা কন্যার হাতে৷ যুবতি বিধবা কন্যাদের বৈধব্যের যন্ত্রণা এবং প্রচুর সম্পদের প্রভাবে অভিভাবকহীন হওয়ায় তাদের জীবন স্বেচ্ছাচারে ভরে যায়৷ তারা আকন্ঠ পাপপঙ্কে নিমজ্জিত হয়৷ বড়জন গৃহে থেকেই উপপতি জুটিয়ে অবাধ কামতরঙ্গে ভেসে যায় আর ছোটোজন বাড়ির খানসামার সঙ্গে গৃহত্যাগী হয়৷ সেই খানসামার ভোগ-পিপাসা মিটে গেলে সে তাকে সর্বস্বান্ত করে অকূলে ভাসিয়ে পালিয়ে যায়৷ জীবনধারণের জন্য ‘ঘেসুরে উপপতি’ গ্রহণ করে ছোটজন৷ বাবুরা যেমন রক্ষিতা পোষণ করে তেমনি সম্পদশালী নারীরাও যে কাম চরিতার্থ করার জন্য উপপতি রাখে তার দৃষ্টান্ত এই ঘটনা৷ এখানে প্রথমোক্ত বিধবা নারীটি সরাসরি অর্থ উপার্জনের জন্য দেহের দর হাকেনি বরং গৃহে থেকে নিজের অর্থ দিয়েই উপপতি ধারণ করেছে৷ কিন্তু এই পুরুষ উপপতিরা উপপত্নীর মত সমাজবিচ্যুত হয় না৷ সমাজের নিয়মকানুন তাদের জন্য শিথিল৷ আরেক স্থানে উল্লিখিত হয়েছে স্বৈরিণী স্ত্রীর দ্বারা স্বামী লাঞ্ছনার ঘটনা৷ ভাইদের ফাঁকি দেওয়ার অভিপ্রায়ে কোনো বাবু তার সমস্ত বিষয় স্ত্রীর নামে গচ্ছিত রাখে৷ স্বামীর সেই বোকামির সুযোগ নেয় স্ত্রী৷ বহুল সম্পত্তির অধিকারিণী হয়ে পরপুরুষগামী হয়ে উঠে এবং সেই উপপতির পরামর্শে স্বামীকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে অবৈধ প্রেমাকাঙ্খাকে জোরদার করে তোলে৷ ধনসম্পদের আভিজাত্যে এবং অধিক স্বাধীন মনোবৃত্তির ফলে পুরুষের মতো নারীরাও যে অধঃপাতে যেতে পারে তার সুনিপুণ অভিব্যক্তি উপরোক্ত দৃষ্টান্তগুলির মধ্যে৷ এর আরও একটি নমুনা হল—এক সম্ভ্রান্ত বাবু স্ত্রীকে নিয়ে পশ্চিমে বেড়াতে যায়৷ ইতিমধ্যে বিলাসবহুল জীবন ও বেশ্যাসম্ভোগে সে তার সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে৷ ট্রেনে উঠে সেই বাবুর অকাতর নিদ্রার সুযোগ নিয়ে তার স্ত্রী সেই ট্রেনেরই আরেক যুবকের সঙ্গে হৃদয় বিনিময় করে ফেলে৷ তারা পলায়নের উদ্যোগ করতেই বাবুটির নিদ্রা ভেঙ্গে যায়৷ স্ত্রী স্বামী দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়৷ শোরগোলের মধ্যে উপস্থিত হয় পুলিশ৷ তখন সেই স্ত্রী তার সদ্যপ্রণয়কে অক্ষুন্ন রাখতে স্বামীকে অস্বীকার করে সেই যুবকটির হাত ধরে তাকে স্বামী পরিচয় দেয়৷ লেখক এই ঘটনাবলীর মধ্যদিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে নারী যদি সম্পদশালিনী হয় বা তাদের যদি স্বাধীনতা প্রয়োগ করে ঘরের চারদেওয়াল থেকে বের করা হয় তাহলে সেই নারী হয়ে উঠবে অঘটনপটিয়সী৷ কোনো অসৎকাজ তার পক্ষে অসম্ভব হবে না৷ সমাজবাদী লেখক পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় নারীর বিচার করেছেন৷ নারীকে বন্দিনী করে, সম্পদহীন করে নিজেদের মর্যাদাকে অক্ষুন্ন রাখার কথা বলেছেন৷

বৈদ্যবাটীতে এসে দেবতারা দেখেন প্রকাশ্য রাস্তায় সগর্বে পতিতাদের দলবেঁধে চলা৷ সেই চলনের ভঙ্গিতে কামনার আগুন ছিটকে ছিটকে পড়ছে৷ তাদের চলার মুখে কোনো পুরুষ কিংবা যুবক পড়লে তো কোনো কথাই নেই৷ লাস্যভঙ্গিমায়, ইয়ার্কি-ঠাট্টায় তাকে নাজেহাল না করে ছাড়ে না৷ বেশ্যাগণের নিমাই তীর্থের ঘাটে স্নান করতে যাওয়ার সময় পথে এক যুবক তাদের দ্বারা চরম নাজেহাল হয়৷ যুবকটি কলকাতা থেকে বাবুরা আসবেন বলে এক মস্তকহীন পাঁঠা নিয়ে দাঁড়িয়েছিল বাবুদের আপ্যায়নের জন্য৷ রূপোপজীবিনীর দল তার সম্মুখে গিয়ে সেই পাঁঠাখানা দাবি করে৷ ভায়ার্ত যুবক তার দাদার শাসনের কথা বলে তাদের বিরত করতে চায়৷ গণিকারা তখন মজা দেখার জন্য সেই মাথাহীন পাঁঠাটা নিয়ে কপট টানা-হিঁচরা শুরু করে৷ যুবকটিকে যারপরনাই হেনস্তা করে অশ্লীল বাক্যবাণে বিদ্ধ করে বলতে থাকে—‘‘দূর গুয়োটা, একটা পাঁটা দিতে পারলিনি?’’৯৯ গণিকাদের অশালীন বাচনভঙ্গির বাস্তব রূপকে উপস্থাপন করেছেন দুর্গাচরণ রায়৷ দেহবিক্রি করে চোর, বদমাশ, গুণ্ডা, লুচ্চাদের সঙ্গে সহবাসের দ্বারা জীবন অতিবাহিত হয় বলে বারবনিতারা যেমন দৈহিক শুচিতাকে ধরে রাখতে পারে না তেমনি মার্জিত ভদ্রসমাজের উপযোগী বচন প্রয়োগও তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না৷ প্রকৃত শিক্ষার অভাব, অসামাজিক পরিবেশ এবং উত্তেজক কথা বলে ব্যবসায়িক প্রয়োজন সিদ্ধ করতে হয়৷ আর এর জন্যই পুরুষরা ফাঁদে পড়ে তাদের৷ সেই কারণে গণিকাদের কাছে ভব্যতা-সভ্যতা আশা করা যায় না; তাদের কথা লাগামছাড়া, কামোদ্দীপক এবং অশ্লীল৷ তারকেশ্বরে উপস্থিত হয়ে দেবগণ লক্ষ করেন এক অসহায় নারীর জীবনের ভয়াবহ পরিণতি৷ সে অঞ্চলে মহন্তরাই সর্বেসর্বা৷ গয়ার গয়ালীগুরুদের মত তারকেশ্বর পীঠস্থানে গিয়ে মহন্তদের সন্তুষ্ট করতে না পারলে পুণ্য অর্জন অসম্ভব৷ এই মহন্তরা ভণ্ডামির চূড়ান্ত শিখরে অবস্থান করে৷ ধর্মীয় বাতাবরণের মধ্যে আবদ্ধ থেকে নারীলোলুপতায় এরা বিপথগামী৷ মহন্তের চরম নারীলোলুপতার চিত্র দেখা যায় মহন্ত-এলোকেশী ঘটনায়৷ তারকেশ্বর কাছাকাছি কুমরুল নামক গ্রামের দরিদ্রকন্যা এলোকেশীর বিয়ে হয় নবীন নামে এক যুবকের সাথে৷ নবীনের পিতৃকুলে কেউ না থাকায় উপযুক্ত ভরণ-পোষণ দিয়ে স্ত্রীকে বাপের বাড়িতেই রেখে দেয়৷ এলোকেশীর সৎমা একজন স্বৈরিণী৷ তার প্রণয়ী মহন্ত এলোকেশীকে দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়৷ বিমাতার সঙ্গে পরামর্শ করে সেই মহন্ত মাদক দ্রব্য খাইয়ে তাকে অজ্ঞান করে অচৈতন্য অবস্থায় ধর্ষণ করে৷ ছেলে হওয়ার নাম করে সেই মাদকদ্রব্য বিমাতা যখন তার হাতে দিয়েছিল অত্যন্ত সরলমনে এলোকেশী তা ভক্ষণ করেছিল কিন্তু তার পরিণতিতে যে সে ধর্ষিত হতে পারে তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি৷ যে রূপের তৃষ্ণা মহন্তের চোখে তা তো একদিন ভোগ করে মিটবার নয় তাই পরবর্তী সময়ে অজস্র স্বর্ণালঙ্কার দ্বারা সে বশ করে নেয় এলোকেশীকে৷ ঘটনাক্রমে সেখানে উপস্থিত হয় তার স্বামী৷ স্ত্রীর স্বীকারোক্তিতে সব জানতে পেরে স্ত্রীকে মহন্তের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তাকে নিয়ে সেখান থেকে সরে পড়ার পরিকল্পনা করে৷ মহন্ত তা বুঝতে পেরে নিজ-ক্ষমতাবলে সে পথ বন্ধ করে দিলে স্বামী কোনো উপায়ন্তর না দেখতে পেয়ে স্ত্রীকে খুন করে পুলিশে আত্মসমর্পণ করে সমস্ত ঘটনা জানিয়ে দেয়৷ মহন্তের কুকীর্তি প্রকাশ হয়ে পড়ায় সে শাস্তি ভোগ করে৷ কিন্তু তার কামাগ্নিতে দগ্ধ হয়ে যে গৃহবধূটি নির্মমভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয় তার ক্ষতিপূরণ সমাজ দিতে পারে না৷

এরপর দেবতারা উপস্থিত হন শ্রীরামপুরে৷ পিতামহ ব্রহ্মা সেখানে এক ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্ব বা শুচিতা রক্ষার অদ্ভূত প্রয়াস দেখে মুগ্ধ হয়ে যান৷ সেই ব্রাহ্মণ অস্পৃশ্য দ্রব্যের স্পর্শ বাঁচিয়ে চলার জন্য লাফিয়ে লাফিয়ে চলছিল৷ কিন্তু রাতের অন্ধকারে তাকেই দেখা যায় গণিকাগৃহে গালাগাল খেতে৷ সেই ব্রাহ্মণ তার রক্ষিতার দরজায় করাঘাত করলে সেই বারনারীর মুখের কদর্য বাক্যভঙ্গি ব্রাহ্মণের ব্রাহ্মণত্বকে যেমন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করায় তেমনি রূপাজীবাদের স্বাভাবিক বাচনভঙ্গিটিও সহজভাবে প্রতিফলিত করায়৷ যেমন সেই বারবধূ বলে—‘‘পোড়ারমুখো! কাল রাত্রে ছিলি কোথায়? আমি তোর জন্যে রুটি আর বেগুনভাজা ভেজে এক বোতল মদ এনে সমস্ত রাত্রি ব’সে ব’সে কাটিয়েছি৷’’১০০ এখানে শুধু গণিকাদের ভাষা ব্যবহার নয়, নারী শরীরের সাথে সাথে মদ-মাংস, ভাজা-ভুজিও যে পরম উপাদেয় তাই নির্দেশিত হয়েছে৷ সেই ব্রাহ্মণ অতঃপর সেই রক্ষিতার হাত ধরে গৃহাভ্যন্তরে চলে গেলে জলধিপতি ব্যঙ্গ করে ব্রহ্মদেবকে বোঝান তার কপট শুচিমনস্কতাকে—‘‘ঠাকুরদা! এই বামুনকে দেখিয়া এক সময় আপনার বড় ভক্তি হইয়াছিল; এক্ষণে ইহার কার্য্য দেখুন৷ এটি বেশ্যাবাড়ী৷ ঐ বামুনের বামী নামে একটি রক্ষিতা বেশ্যা এই বাড়ীতে বাস করে৷ ঠাকুর রজনীতে সেই বামীর নিকট এসেছেন৷’’১০১ এই শ্রীরামপুরের কাছেই বিখ্যাত মহেশের রথ ও স্নানযাত্রা৷ কলকাতার অনেক বিলাসীবাবু এখানে বোট ভাড়া করে রক্ষিতা-গণিকা সমভিব্যাহারে সময় কাটায়৷ মদ খেয়ে বিভোর হয়ে বেশ্যার হাত ধরে জগন্নাথের সামনে উদোম নৃত্য করা তাদের অন্যতম ‘ফ্যাশন’৷ অর্থাৎ অর্থবান বাবুদের হাত ধরে সমাজপতিত এই নারীরা সর্বত্র বিচরণ করতে পারে৷ যতক্ষণ বাবু সাথে থাকে কেউ তাদের কোথাও প্রবেশে বাধা দিতে পারে না৷

বহুস্থানে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার পর সুরগণ অবশেষে পৌঁছতে সক্ষম হন তাঁদের চিরাকাঙ্খিত-চিরাভিলাষিত কলকাতা নগরীতে৷ পূর্বাভিজ্ঞতায় তিতিবিরক্ত সমভিব্যাহারী দেবতাদের কলকাতার জন-জীবন সম্পর্কে তাই আগে থাকতেই সতর্ক করে দিয়ে বলেন—‘‘চুরি, জুচ্চুরি, মিথ্যা কথা—এই তিন নিয়ে কলিকাতা৷’’১০২ এখানে প্রবেশ করেই সুরগণ প্রত্যক্ষ করেন এক গৃহবধূর ব্যভিচারময় কাণ্ডকীর্তি৷ তাঁরা দেখেন তিনতলা থেকে সুতোবাঁধা হয়ে নেমে আসছে প্রেমপত্রসহ মিষ্টান্ন পরিপূর্ণ ঠোঙা৷ দুর্ভাগ্যবশতঃ তা ঐ স্বৈরিণী গৃহবধূর গুপ্তপ্রণয়ীর হাতে না গিয়ে পৌঁছয় দেবতাদের হাতে৷ পত্রটি খুলে দেবতারা দেখেন সেখানে সেই নারী তার প্রেমাস্পদকে লিখেছে যে তাদের বাড়ির সকলে রাত্রিবেলায় বাগানে যাবে এবং সে যদি আসে তাহলে নিরাশ না হয়ে অনায়াসে রাত্রিযাপন করতে পারবে তার সঙ্গে৷ তৎকালীন সমাজে নারীর অবমূল্যায়ন, বিধবাদের সংখ্যাধিক্য, পুরুষের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, ফুলে-ফেঁপে ওঠা ধনবৃদ্ধির কারণে উনিশ শতকের কলকাতা শহর স্বৈরিণী, ব্যভিচারিণী, বারবিলাসিনী নারীতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়৷ সেই সমাজে ধনবান পুরুষদের গণিকা তোষণ ছাড়া পুরুষত্ব মূল্যহীন৷ বারাঙ্গনারাও তাদের পৌরুষত্ব জাহিরের গৌরবময় আড়ম্বরের সদব্যবহার করতে ছাড়তো না৷ অধিক রোজগারের আশায় কখনো কখনো তাদের পৌরুষকে বিঁধে নিক্ষেপ করতো তাদের তীব্র বাক্যবাণ৷ বেশ্যা কর্তৃক কেরানিদের তিরস্কারের ঘটনায় গণিকাদের পুরুষ ধরার এমনই এক দিক তুলে ধরেছেন দুর্গাচরণ রায়৷ জীবনধারণের জন্য স্বল্পতম বেতনের বিনিময়ে হারভাঙা খাটুনির পর চূড়ান্ত অপমান সহ্য করে চিৎপুর রোড ধরে সন্ধ্যার সময় ঝিমোতে ঝিমোতে কেরানিরা যখন বাসার দিকে ফেরে তখন তাদের দেখে দোতলা-তিনতলা বাড়ির বারান্দা থেকে ঝংকৃত হয় বেশ্যাদের নির্মম হাস্য ধ্বনি এবং গায়ে কাঁটা দেওয়ার মতো কথাবার্তা৷ তারা কেরানিদের পরিশ্রান্ত দেহমনকে শূলের মতো বিদ্ধ করতে থাকে৷ কেউ যদি গণিকাদের সেরূপ ব্যবহারের প্রতিবাদ করতে যায় তাহলে খিলখিল হাস্যধ্বনিতে জবাব আসে—‘‘আ মর মিন্সে৷ যাচ্ছেন কেরাণীগিরি ক’রে, আবার রাগটুকু আছে৷ আজিও বাবুদের সখ মেটেনি—গোঁপ রাখা হয়েছে৷ আমরা বেশ্যা, বেশ্যাবৃত্তি করি বটে, কিন্তু তোদের মত সাতটা কেরাণীকে পুষতে পারি৷ এই তো সমস্ত দিন কলম পিষে এলি—কি আনলি? আমরা ঘরে ব’সে ঘন্টায় আট দশ টাকা উপায় করি৷ তোর তিন পুরুষে চাকরী ক’রে যা না ক’রতে পারবে, আমরা এক পুরুষে তা ক’রেছি৷ কলিকাতায় ঈশ্বর ইচ্ছায় দুই তিন খানা বাড়ীও আছে, আর গায়েও এই দেখ, দুই তিন হাজার টাকার গহনা রয়েছে৷ তোরা আমাদের চাকর হবি? অফিসে যে মাইনে পাস—দেব৷’’১০৩ এই ধরনের কথা থেকে বোঝা যায় যে দেহ জীবিকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যখন ক্রমে ক্রমে পেশাটি সম্পর্কে অভ্যস্ত হয়ে যায় তখন অনেক গণিকাই গর্বের সঙ্গে দিনাতিপাত করে৷ অনেক সময় প্রচুর উপার্জন তাদের পেশাটির সম্পর্কে বিশ্বস্ত করে তোলে, তাদের মনের মধ্যে পাপবোধের লেশমাত্র চিহ্ন থাকে না৷ তারা আত্মগরবে গরবিনি হয়ে ওঠে৷ যে সমাজ তাদের কলঙ্কিত করে দেহজীবিকার নির্মম পেশাটির মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে সেই সমাজ প্রতিভূ পুরুষদের তাই তারা নিজেদের আবেষ্টনীর মধ্যে জড়িয়ে রাখতে এতটুকু কুন্ঠাবোধ করে না৷ তারা তাদেরকে ঘরছাড়া, পরিবার-পরিজনের সঙ্গছাড়া করে তাদের কাছ থেকে অর্থ সম্পদ নিংড়ে নিংড়ে বের করে নেয়৷

এই রচনায় উল্লেখ রয়েছে লক হাসপাতালের নাম৷ গণিকা নারীদের দৈহিক সুস্থতার পরীক্ষাকেন্দ্র এই হাসপাতাল৷ ইংরেজ সিবিলিয়ানরা এদেশের বারাঙ্গনাদের সঙ্গে যৌনসংসর্গ করে সিফিলিস, গনেরিয়া সহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হলে ইংরেজ সরকার তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এক আইন পেশ করে৷ সেই আইন ‘চৌদ্দ আইন’ নামে পরিচিত৷ চৌদ্দ আইন অনুযায়ী গণিকারা সুস্থতার শংসাপত্র ছাড়া দেহব্যবসা করতে পারবে না৷ লক হাসপাতালে সেই পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়৷ জলধিপতি দেবরাজ ইন্দ্রকে তাই বলেন—‘‘ঐ স্থানে চৌদ্দ আইনের পরীক্ষা লওয়া হইত৷ যে বেশ্যার রোগ থাকিত, এই স্থানে রাখিয়া আরোগ্য না হওয়া পর্যন্ত্য তাহাকে চিকিৎসা করা হইত৷’’১০৪ কিন্তু পরীক্ষার নাম করে গণিকাদের উপর চলতে থাকে অকথ্য অত্যাচার৷ ফলে বহু গণিকা দেশছাড়া হয় আইনের এবং পরীক্ষার হাত থেকে বাঁচার জন্য৷ কলকাতা ঘুরতে ঘুরতে বহুস্থানে দৃষ্টিগোচর হয় গণিকাদের নানা অভিযোগ অনুযোগের বিচার পর্বের৷ যারা সীমাহীন কষ্ট সহ্য করে বেঁচে থাকার সম্বল জোগাড় করে, সেই কষ্টার্জিত সম্পদের ছল-জোচ্চুরির মধ্য দিয়ে আত্মসাতের ঘটনা, সম্ভোগ করে চুক্তিবদ্ধ অর্থ প্রদান না করা, পুলিশের অপরাধ দমনের নাম করে তদের প্রতি অত্যাচার, ভয় দেখিয়ে বলপূর্বক সম্ভোগ ইত্যাদি নানাবিধ পীড়নের শিকার হয় তারা৷ অনেক সময় বিচার পাবার আশায় মামলা করতেও বাধ্য হয়৷ এই নানাবিধ বিচারের দৃশ্য দেবতাদের নজরে আসে৷ গণিকাদের আসামিদের বেশিরভাগই ভদ্র ঘরের সন্তান৷ তাদের অভিযোগ কোথাও খোরাকির দাবি জানিয়ে, কোথাও দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাঁধানোর জন্য নালিশ৷ কোথাও চুরি, কোথাওবা জোচ্চুরি৷ জুয়াচোরেরা অনেক সময় পুলিশের পোশাক পড়ে পুলিশ সেজে তাদের সবকিছু নিয়ে নেয়৷ এক বিচারকেন্দ্রের বিচার্য বিষয় গণিকার উপপতি সংক্রান্ত নালিশ৷ কোনো এক বারাঙ্গনা নাকি ‘খত’ লিখিয়ে নিয়ে উপপতিকে সঙ্গসুখ প্রদান করতো৷ দুই তিন মাস খত লিখে লিখে সম্ভোগ করার পর সে আর তার কাছে আসে না৷ গণিকাটি বাবুকে ফিরিয়ে আনার কোনো উপায় না দেখে এবং দুই-তিনমাসের রোজগার আদায়ের আশায় আইনের দ্বারস্থ হয়েছে৷ তাহলে বোঝাই যায় সর্ব দিক থেকে বঞ্চিতা এই পুণ্যাঙ্গনারা জীবনভর শুধু প্রবঞ্চিতাই হয়ে যায়, প্রতিকারের আশায় বিচার-ব্যবস্থার কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে হয় তাদের৷

গণিকারা তাদের রোজগার, বিলাসী জীবন ইত্যাদির দ্বারা অনেক মানুষের ঈর্ষার কারণও হয়ে ওঠে৷ আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার উন্নতির ফলে মাঝি, তাঁতি, কোচম্যান, ভিস্তি, মুটে, মেথর প্রভৃতি নিম্নবর্গের মানুষগুলো যখন কর্মহীন হয়ে জীবন-যন্ত্রণায় ব্যতিব্যস্ত তখন তারা দেখে গণিকাদের মনোসুখে হাতে টিয়াপাখি নিয়ে গঙ্গাস্নানে যাওয়ার দৃশ্য৷ গণিকাদের সেই আপাতসুখী জীবন দেখে ঈর্ষাকাতর কন্ঠে নিম্নশ্রেণীর সেই মানুষগুলির আক্ষেপ—‘‘সুখী এরা; কোম্পানী বাহাদুর কলে কতকগুলো মাগী বানাতে পারেন, তাহ’লে এরা জব্ধ হয়৷’’১০৫ অর্থাৎ যন্ত্রচালিত বাররামা আবিষ্কৃত হলে গণিকারা তাদের মত কর্মহীন হয়ে পড়বে এবং তাদের দুঃখের দিনে এভাবে টিয়াপাখি হাতে নিয়ে মনোসুখে গঙ্গাস্নানে যেতে পারবে না৷

কলকাতার অলিতে-গলিতে এমন অনেক নিম্নবর্গের নারীদের সন্ধান পাওয়া যায় যারা তাদের নিজস্ব কিছু বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত থেকেও গোপনভাবে দেহব্যবসাও চালিয়ে যায়৷ যেমন মেছুনি, নাপতিনি, গোয়ালিনি, ফুলওয়ালী ইত্যাদি৷ মেছুনিরা স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিতা হয়ে বাজারে মাছ বিক্রি করে৷ দেবতা নারায়ণ দরিদ্র মেছুনিদের গহনা প্রাপ্তির কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বরুণদেবের মুখে উচ্চারিত হয়—‘‘অনেক বাবু উহাদের সঙ্গে…’’১০৬ জলধিপতির এই অসম্পূর্ণ বাক্যবন্ধে উহ্য থেকে যায় দেহবিক্রির প্রসঙ্গটি৷ তিনি যতটুকু উচ্চারিত করেছেন তাতে সম্পূর্ণ বাক্যটির সারমর্ম কি হবে তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না কারও৷ তাদের মাছ বিক্রির পাশাপাশি গোপন বৃত্তিটি কি তা জলের মতো পরিস্কার হয়ে যায়৷ এর পরে তাঁরা উপস্থিত হন কলকাতার বিখ্যাত চুনাগলিতে৷ স্থানটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছে ফিরিঙ্গিদের বসবাসের জন্য৷ কিন্তু বরুণদেবতার মতে শুধু ফিরিঙ্গি নয় খালাসিদের মদ খেয়ে বেশ্যাদের সঙ্গে স্ফূর্তি করার প্রসিদ্ধ স্থানও সেই চুনাগলি৷ তার পর তাঁরা পৌঁছান কলকাতার বিখ্যাত বেশ্যাবাজার হাড়কাটা গলিতে৷ বৃষ্টির দেবতা হাড়কাটা গলিকে বিশেষভাবে ব্যাখ্যা করে বলেন যে স্থানটি বদমায়েশির জন্য বিখ্যাত এবং তাদের সৌভাগ্য যে সেখানকার বারবধূরা সেই সময় ঘুমিয়ে আছে নইলে তাদের অত্যাচারে সেখানে দাঁড়ানো মুস্কিল হত৷ তিনি গণিকাদের রোজনামচা সম্পর্কে তাঁর সহযাত্রী দেবতাদের বোঝান—‘‘আমাদের সৌভাগ্য যে বেশ্যামাগীরা এক্ষণে ঘুমাইতেছে৷ সমস্ত রাত্রি জাগিয়া এই সময়ে মাগীগুলো ঘুমায়; আবার সন্ধ্যাকালে উঠিবে এবং যাহারা যেমন সম্বল সাজ গোজ করিয়া এই রাস্তাগুলোয় ছুটাছুটি করিয়া তোলপাড় করিবে৷ ঐ সময়ে ইহারা কি ভদ্র কি ইতর যাহাকে পায় হাত ধরিয়া টানাটানি করে৷’’১০৭ বরুণদেবতার এই উক্তি রূপাজীবাদের জীবনাচারণের বিশেষ দিকগুলিকে সুবিশেষ বিশেষায়িত করে৷ যেমন বাররামাদের নিকষ অন্ধকার জীবনে উপার্জনের অন্যতম সময় সূর্য ডোবার পরে৷ রাত্রি যত এগিয়ে যাবে তাদের শরীরী সৌরভে মধুমক্ষিকার মত খদ্দেররা তাদের ঘিরে ধরবে৷ আর দেহই যেহেতু উপার্জনের প্রধান এবং একমাত্র সহায় তাই তাকে সজীব ও পুষ্ট রাখার জন্য দিনভর দেওয়া হয় বিশ্রামের অবসর৷ রূপ-যৌবনকে সহায় করে যৌবনসূর্য মধ্য গগণে থাকাকালীনই করে নিতে হয় যথাসাধ্য সঞ্চয় নতুবা শেষ জীবনে পথের কুকুরের মত অবধারিত নির্মম মৃত্যু৷ এদের কোনো ভবিষ্যৎ থাকে না, থাকে না কোনো যোগ্য উত্তরসূরী; যারা শ্রদ্ধা ভক্তিতে সুখময় করে তুলবে জীবনের শেষ ধাপকে; বার্ধক্য হয়ে উঠবে বারাণসী৷ তাই দৈহিক সামর্থ রূপ-যৌবন থাকতে থাকতেই যথার্থ সঞ্চয় করার মানসে তাদের বাছ-বিচারের অবকাশ থাকে না৷ ইতর ভদ্র যেই হোক না কেন হাত ধরে টানাটানি করে ঘরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ কারণ ঘরে গেলেই উপার্জন; উপার্জন হলেই জমবে ভবিষ্যতের সঞ্চয়৷ তাই কোনো রাত যেন বৃথা না যায়৷

গণিকারাও তো মানুষ৷ অস্থি-মজ্জা-রক্ত-মাংস-বিবেক-বুদ্ধি-মন-আর যা সব থাকে মানুষের মধ্যে সবই তাদের আছে৷ তাই তারাও সকলের সঙ্গে সমাদরে মানুষের মতো বাঁচতে চায়৷ শুধু দেহ-সম্ভোগের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে নয়; পূজা-পার্বণ নানা সামাজিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিজেকে মেলে ধরতে চায়৷ কিন্তু সমাজ তো তাদের মেনে নেয় না৷ তাই নিজেদের মতো করে কালীপূজা করে, দোল-দুর্গোৎসবে মেতে ওঠে৷ হাড়কাটা গলিতে দেবতারা দেখে এক শিখাধারী ব্রাহ্মণকে নানা দানসামগ্রীসহ পুত্রের হাত ধরে বেড়িয়ে আসতে৷ সেই পুরোহিত একশত গৃহে যজমানি করে যা না পায় এক গণিকাগৃহেই লাভ করে তার চেয়ে অনেক বেশি৷ এখানে এর থেকে বোঝা যায় যে পূজা-পার্বণে গণিকারা উদার হস্তে দান করতো অথবা তাদের অশুচি গৃহে কোনো ব্রাহ্মণ পদ স্পর্শ করতো না বলে অধিক দানের বিনিময়ে তাদের পুরোহিত সংগ্রহ করতে হত৷ যাইহোক অর্থপ্রতিপত্তি না থাকলে সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানোর ক্ষমতা কারও থাকে না৷ ধনী বাবুরা গণিকার সঙ্গে গণিকাগৃহে গিয়ে যা করতে পারে দরিদ্র ব্রাহ্মণের পক্ষে তা তো সম্ভবই না উপরন্তু গণিকা গৃহে যজমানি করাটাও সমাজের চোখের অসম্মানজনক৷ তাই সেই দরিদ্র যজমান ছেলেকে সাবধান করে দেয়, যাতে পাড়াগাঁয়ে প্রচার না করে সেও সেই উপায়ে অধিক অর্থ রোজগার করতে শেখে৷

বাবুরা রক্ষিতা রাখবে, বেশ্যাগমন করবে তা চিরাচরিত প্রথা কিন্তু এই উপন্যাসে আলোকপাত হয়েছে গণিকাজীবনে এক অভিনব দিকের প্রতি, তা হল বেশ্যা কর্তৃক বাবু পোষা৷ কয়েকজন গৃহবধূর বিলাপের মধ্য দিয়ে অর্থ-খোরাকি, ভরণ-পোষণ দিয়ে বেশ্যাদের বাবু রাখার বিষয়টিকে লেখক উপস্থাপিত করেছেন৷ সেই কুলনারীদের তাদের বাবা-মায়েরা কুলীন দেখে বিয়ে দিয়েছিল কিন্তু তাদের স্বামীরা বেশ্যার অঞ্চলবন্দি হওয়ায় তারা স্বামীসঙ্গ লাভে বঞ্চিত৷ স্বামী বিরহে তালাবন্দি অবস্থায় তাদের দিনগুজরান হয়৷ রাতভর বেশ্যাসহবাসে থেকে ভোরের দিকে সেই স্বামীরা ফিরতে শুরু করে৷ কোঁচা ভরা থাকে চালে, হাতে মাছ ও তরকারি এবং বগলে শালপাতা৷ এই নারী তিনজন তিনভাই-এর স্ত্রী৷ তাদের স্বামীরা তিনজন বেশ্যার সখের উপপতি৷ বরুণদেব সেই তিন উপপতি সম্পর্কে দেবতাদের বুঝিয়ে বলেন যে—‘‘উহাদের বেশ্যাকে কিছু দিতে হয় না; বরং বেশ্যারা প্রত্যহ একটি করে সিদে কাপড় দেয়৷ আর মাস মাস ২০৷২৫ টাকা করিয়া মাসহারা দেয়৷ তদ্ভিন্ন বেটাদের জুতা যখন যাহা আবশ্যক, ঐ মাগীরা কিনে দেয়৷ বড়টাকে ৫০০ টাকা দিয়া তার বেশ্যা কাপড়ের দোকান ক’রে দিয়াছে৷’’১০৮ বারবনিতার অর্থগৌরবে এই তিন যুবকের বাবুয়ানার শেষ নেই৷ তাদের মাথার চুল সদৃশ্য আচড়ানো; গায়ের জামার উপরে চেন, হাতে ঘড়ি ব্যতীত তারা কখনো ঘরের বাইরে যায় না৷ তিন বেশ্যার খিদমদগারি তিন উপপতি নিজের নিজের গণিকাপ্রভুর কাছে প্রত্যহ ছুটি পেয়ে বড় জন রাত দুটোয় বাড়ি ফেরে, মেজো জন তিনটায় এবং ছোটো জন ভোরবেলায়৷ তাদের ফিরে আসার সময় থেকে দরজায় ঘন ঘন ঘা মারার শধে, ডাকাডাকি, চিৎকারে পাড়ায় লোকের আর ঘুমোবার উপায় থাকে না৷ উপপত্নীরা যেমন যে বাবুর নিয়ন্ত্রণে থাকে তার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল, এই উপপতিত্রয়ও সর্বাংশে নির্ভর করে থাকে তাদের পোষক বেশ্যাগণের কাছে৷

বেশ্যা, মদ ও বাগানবাড়ি উনিশ শতকের বাবুয়ানার প্রধান লক্ষণ৷ এই বাবুদের সর্বদা শনির বলয়ের মতো ঘিরে থাকে মোসাহেবরা৷ বাবুয়ানা প্রয়োগের চাবিকাঠি হল অর্থ; বয়সের কোনো বালাই থাকে না৷ ইন্দ্রদেব এই বাবুদের সম্পর্কে বলেন যে—‘‘বাবুরা মোসাহেব ও বেশ্যা লইয়া গিয়া আমোদ করেন৷ কলিকাতার ধনীবাবুদের মধ্যে যাঁহার বাগান নাই বা যিনি বাগানে যান না, তিনি বাবুই নন৷ ঐ বাগানে বাবু যান, বাবুর রক্ষিতা বেশ্যা যান ও মোসাহেবরা যান৷ মোসাহেবদের সেবার জন্য মাছ মাংস ও খাদ্য দ্রব্যের সহিত ২৷ ৪টে ভাড়াটে বেশ্যাও লইয়া যাওয়া হয় এবং সমস্ত রাত্রি মদ, মাংস, বেশ্যা, তামাক, তাস ও পাশা খেলার শ্রাদ্ধ হয়৷’’১০৯ বাবুরা অর্থবান, ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধি৷ মোসাহেবরা তাদের চাটুকার, অনুগামীও প্রায় বিত্তহীন৷ তাই বাবুদের সম্ভোগার্থে নিয়ে যাওয়া বেশ্যারা মোসাহেবদের সঙ্গ দিতে পারে না৷ সেইজন্য বাবুরা তাদের জন্য নিজ নিজ রক্ষিতা বেশ্যা যেমন নিয়ে যায়, সঙ্গে দু-চারজন ভাড়াটে বেশ্যা নিয়ে যাওয়া হয় মোসাহেবদের জন্য৷

কলকাতার চিৎপুর রোডের শাখাগলি সিন্দুরেপটির গণিকাদের কার্যকলাপে তাদের পুরুষ ধরার বা খদ্দের ধরার কৌশল উঠে এসেছে৷ জলধিপতির ব্যাখ্যা অনুসারে—‘‘এখানে ২৷৪ পয়সা মূল্যের সস্তা বেশ্যারা বাস করে৷ সন্ধ্যার সময় এই পাপিষ্ঠারা দলবদ্ধ হইয়া রাস্তায় দাঁড়াইয়া থাকে এবং কোন ব্যক্তি রাস্তা দিয়া যাইলে ‘ও মানুষ’ ‘ও মানুষ’ শব্দে চীৎকার করিয়া ডাকে৷ ভদ্রলোকেরা মান সম্ভ্রমের ভয়ে পালায়, নষ্ট লোকেরা হাস্য করিয়া নিকটে যায় এবং যখন দেখে, মাগীগুলো ছুটিয়া আসিয়া ‘আমার বাড়ী চল’ ‘আমার বাড়ী চল’ বলিয়া টানাটানি আরম্ভ করে৷’’১১০ এখানে লেখকের কথায় গণিকাদের শ্রেণীবৈষম্যের দিকটি উঠে এসেছে৷ তাঁর বর্ণনায় সিন্দুরেপটির গণিকারা সস্তা৷ তারা অত্যন্ত কম দামে তাদের শরীর বিক্রয় করে৷ ইতর-ভদ্রের কোনো বাছ-বিচার নেই৷ সন্ধ্যাকালে দলবদ্ধ হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পুরুষমানুষ দেখামাত্রই চিৎকার করে ডাকতে থাকে৷ ভদ্রলোকে এড়িয়ে গেলেও নষ্টলোকেরা তাদের কাছে আসে৷ আসামাত্র তাকে নিয়ে তারা টানাটানি শুরু করে তাদের যার যার ঘরে নিয়ে যাওয়ার জন্য৷ জোর করে টেনে হিঁচরে পুরুষ সংগ্রহ করতে হয় বলে এদের শরীরের দামও অনেক কমে যায়৷ গণিকাদের মধ্যেও নানা কুসংস্কার বদ্ধমূল৷ সিন্দুরেপটির বেশ্যারা রামভদ্র খুড়োর নাম উচ্চারণ করে না, শ্রবণও করে না৷ কেউ সে নাম উচ্চারণ করলে তারা গালাগালি দিতে শুরু করে৷ তাদের কাছে রামভদ্র খুড়ো নামটি অমঙ্গলসূচক৷ কারণ কোনো একদিন সেখানকার কোনো এক বারাঙ্গনা তার কাজের সময় রামভদ্রখুড়োর নাম করেছিল, সেদিন তার পসার জমেনি৷ আর সেই দিন থেকে তাদের কাছে রামভদ্রখুড়ো নামটি অশুভ হিসেবে স্থির হয়ে আছে৷ এরপর বর্ণিত হয়েছে মেছুয়াবাজারের গণিকাদৃশ্য৷ সেখানে রাস্তার দুধারে সারি সারি বেশ্যালয়৷ বারবধূরা সুসজ্জিত হয়ে লাসবেশে বারান্দায় বসে তামাকু সেবন করতে করতে লোক দেখলেই ডাকাডাকি শুরু করে৷ আহ্বানে সারা না দিলে থুথু ছিটিয়ে গালিগালাজ করে পাড়া মাথায় করে৷ ছোট ছোট ফেরারি ছেলেরা কম বয়সেই গণিকাদের প্রতি অপার কৌতুহলে তাদের সম্ভোগের তালিম নেওয়ার জন্য এখানে-সেখানে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে থাকে৷ কাছে যাওয়ার সাহস হয় না তাদের কারণ বয়স এবং অর্থ কোনো কিছুতেই তারা গণিকাদের উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি৷ এই বারযোষিৎদের গৃহে প্রতি সন্ধ্যায় শ্রুতিগোচর হয় তবলার চাটি৷ ক্রমে জমে উঠে সঙ্গীতের আসর৷ শোনা যায় কোনো বেশ্যার উত্তেজক সঙ্গীত ধ্বনি—

‘‘আবার কি বসন্ত এল! অসময়ে ফুটলো কুসুম, সৌরভে প্রাণ, (যাদু আমার) সৌরভে প্রাণ আকুল হ’ল৷৷’’১১১

এই বারাঙ্গনাদের গৃহে আট টাকা বেতনের কেরানিরা পোশাক ভাড়া করে বাবু সেজে খরিদ্দার হিসেবে যায় সঙ্গসুখ লাভের আশায়৷ গণিকাগৃহে চাকচিক্য বাড়িয়ে বেশি সমাদর লাভের আসায় পোশাক ভাড়া পাওয়ার দৃষ্টান্ত দেখে ধারণা করা যায় যে গণিকাগমন পুরুষদের কাছে কতটা অবশ্যম্ভাবী ছিল৷

‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ খোট্টা গণিকাদের উপপতি বরণের অদ্ভূত নিয়মের উল্লেখ আছে৷ খোট্টা গণিকাদের বিধি অনুযায়ী কোনো রক্ষিতা বা বেশ্যাকে যদি তার উপপতি ছেড়ে দিয়ে চলে যায় তখন সেই শূন্যস্থান পূরণের জন্য বহু বাবু সেই বারবনিতার উমেদারি শুরু করে৷ সেই ‘বহু’-র মধ্য থেকে একজন হবে সেই গণিকার বাঁধা বাবু৷ সেই ‘বাবু’ নির্বাচনের জন্য বৃহদাকার এক ফর্দ তৈরি করা হয়৷ সেই ফর্দে উল্লিখিত হয় তার পেছনে খরচের দীর্ঘ তালিকা৷ সেই তালিকা অনুযায়ী অর্থ ব্যয়ের সামর্থ যে বাবুর থাকে সে-ই উপপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়৷ খোট্টা গণিকাদের এরূপ নিয়মের কারণ ব্যাখ্যা করে বরুণদেব বলেন যে, তারা ফর্দপূরণ উপলক্ষ করে পরীক্ষা করে নেয় তাদের পোষক বাবু দাতা হবে না কৃপণ হবে৷ নির্বাচিত বাবুরা উপপতি হয়ে রক্ষিতার পেছনে খরচ করতে করতে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়৷ গণিকারা সমাজ থেকে যেমন একঘরে বা পৃথক তেমনি তাদের আরাধ্য দেবতারাও আলাদা হন৷ কলকাতার নানা জায়গায় লম্পটেরা বেশ্যাদের আরাধনার জন্য কালীমন্দির প্রতিষ্ঠা করে দেয়৷ বিস্তর পাঁঠা বলি দেওয়া হয় সে পূজায়৷ গণিকা ও তাদের সহায়ক লম্পটেরা মহাসমারোহে পূজা সম্পন্ন করে মহানন্দে প্রসাদ ভক্ষণ করে৷ কলকাতায় এমনি বেশ্যা ও লম্পটদের প্রতিষ্ঠিত কালী হলেন ‘কসাই কালী’৷ কলকাতা নগরীতে বাবু ‘কালচার’ এবং গণিকাবৃত্তিকে সতেজ রেখেছে মোসাহেবরা৷ বাবুর যত স্ত্রীলোক প্রয়োজন এরা বিভিন্ন কৌশলে তা জোগাড় করে দেয়৷

ব্রহ্মা, নারায়ণ, ইন্দ্র, বরুণ ঘোষপাড়ায় উপনীত হয়ে দেখেন কর্তাভজা সম্প্রদায়ের সাধনপ্রণালী৷ আউলচাঁদ নামে এক উদাসীন ব্যক্তি এই ধর্ম সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা৷ ঘোষপাড়ার রামশরণ পাল সেই ধর্মের প্রচারক৷ এই ধর্মানুগামীদের মধ্যে ধর্মীয় কোনো বাছবিচার নেই৷ সেখানে বহু নারী সেবাদাসী হিসেবে আত্মনিয়োগ করে দিনাতিপাত করে৷ এই ধর্মসম্প্রদায় সম্পর্কে প্রচলিত কথায় বলা হয়—‘‘মেয়ে হিজড়ে, পুরুষ খোজা, তবে হয় কর্ত্তাভজা৷’’১১২

দুর্গাচরণ রায়ের এই উপন্যাসটিতে সমগ্র ভারতবর্ষের গণিকাজীবনের নানা চিত্র চিত্রিত হয়েছে৷ দেবতারা অমরাবতী থেকে কলকাতা পর্যন্ত যাত্রা পথে বরুণদেবকে ‘গাইড’ করে যেখানে যেখানে অবতরণ করেছেন সেখানে সেখানেই গণিকা নারীদের একটি করে অবয়ব তুলে ধরেছেন৷ দিল্লীর অপ্সরাতুল্য বাইজিরা, বৃন্দাবনের সেবাদাসী, লক্ষ্ণৌর নৃত্যগীতপটিয়সী বাইজি, কাশীর স্বৈরিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা; মির্জাপুরের বেশ্যারা, জামালপুরের উপপত্নী, বেশ্যা, ভাগলপুরের বেশ্যাসক্ত জীবন, রক্ষিতা পোষণের বাহাদুরিতা, কুলবধূর অত্যাচারী স্বামীর অপযশ আনতে গণিকাবৃত্তি গ্রহণ, বর্ধমানের গণিকাবিলাস, শ্রীরামপুরের গণিকা সমাজ এবং কলকাতার অলিতে গলিতে গণিকাপল্লীর বাড়বাড়ন্ত চিত্র, খোট্টা গণিকা, ফিরিঙ্গি গণিকা, যবনী গণিকা, গণিকাদের উপপতি পোষা ইত্যাদি নানা দিক বর্ণিত হয়েছে৷ শুধু গণিকা নয় তাদের সাজসজ্জা, খদ্দের ধরার কৌশল, খাদ্য প্রণালী, ভাষাব্যবহার, সমাজের নানা স্তরের মানুষের দ্বারা অত্যাচারিত হওয়া, বিচারের আশায় অভাব-অভিযোগ-নালিশ জ্ঞাপন, প্রতারিত হওয়া, গণিকাদের বিভিন্ন স্তরবিভাগ কোনো কিছুই বাদ পড়েনি৷ এই চরিত্রগুলির মধ্যে স্নেহ,প্রেম, মমতার বিকাশ না ঘটিয়ে লেখক শুধুমাত্র যৌনবিনোদনের যন্ত্রমানবী হিসেবে উপস্থাপন করেছেন৷ এরা সকলেই অর্থ এবং সম্পদ সংগ্রহের মহাযুদ্ধে খল নায়িকা৷ ছলে-বলে-কৌশলে জীবনধারণের রসদ সংগ্রহই এদের একমাত্র অবলম্বন৷

স্বর্ণবাই :

‘স্বর্ণবাই’ উপন্যাসটির রচনাকাল ১৮৮৮৷ এর রচয়িতা অজ্ঞাত৷ প্রকাশিত হয়েছে নবকুমার দত্ত মহাশয়ের সম্পাদনায়৷ ব্রিটিশ সৈন্যদের ভারতীয় গণিকাদের সঙ্গে অবাধ যৌনাচারে লিপ্ত হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে সিফিলিস, গনোরিয়া ইত্যাদি জটিল যৌনরোগগুলি ক্রমবিস্তার লাভ করে এবং কালক্রমে এত ব্যাপকহারে বিস্তৃত হয় যে তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়৷ তাই সেনাদের রোগের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ১৮৬৮ সালে ব্রিটিশ সরকার ‘Indian Contagious Diseases Act’ বা ‘চৌদ্দ আইন’ জারি করে৷ সেই আইনে ‘ফিট সার্টিফিকেট’ ছাড়া রূপাজীবাদের দেহব্যবসাকে অবৈধ এবং অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ শারীরিকভাবে সুস্থতার বা নীরোগের শংসাপত্র প্রদানের পরীক্ষার নাম করে শুরু হয় তাদের প্রতি অকথ্য অত্যাচার ও অসম্মান৷ শংসাপত্র না হলে ব্যবসা চলবে না আবার পরীক্ষা দিতে গেলে যে পাশবিক সব ‘টেষ্ট’-এর যন্ত্রণা সহ্য করতে হয় তাতে কলকাতার সব গণিকা আতঙ্কে একশেষ হয়ে যায়৷ হাসপাতালের কর্মী, ডাক্তাররা গণিকাদের প্রতি অবমাননা এবং বিকারগ্রস্ত মানসিকতায় যৌনরোগের পরীক্ষা করতে গিয়ে যৌনাঙ্গ কেঁটে, ছিঁড়ে, বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ যৌনাঙ্গে প্রবেশ করিয়ে গণিকাদের নরকযন্ত্রণা প্রদান করতে থাকে৷ স্বেচ্ছায় লক হাসপাতালে পরীক্ষা না করাতে এলে বলপূর্বক ধরে আনা হত তাদের৷ ফলে বহু গণিকা আত্মহত্যা করে৷ অনেকে পালিয়ে যায় যেখানে চৌদ্দ আইনের ভয়াবহতা নেই৷ (গণিকারা পালিয়ে উপস্থিত হয় চন্দন নগরে৷ কারণ চন্দননগর ইংরেজ শাসনের বাইরে ফরাসী শাসনের অধীনে ছিল৷) উনিশ শতকের ভয়াবহ ‘চৌদ্দ আইন’-র প্রেক্ষাপটে লেখা ‘স্বর্ণবাই’ উপন্যাসটি৷

উপন্যাসে স্বর্ণর আসল নাম কাত্যায়নী৷ দশ বছর বয়সে বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হয় উপন্যাসের নায়িকা কাত্যায়নীর৷ তখন সে বালিকামাত্র৷ কালক্রমে বাল্যাবস্থা কাটিয়ে প্রবেশ করে যৌবনের কুঞ্জবনে৷ অসামান্য রূপবতী কাত্যায়নী বাবা-মায়ের সঙ্গে তীর্থ যাত্রা করে সঙ্গীভ্রষ্ট হলে হস্তগত হয় প্রমোদ নামক এক যুবকের৷ কাত্যায়নী মুগ্ধ হয় তার প্রতি কিন্তু বিবাহিত চরিত্রবান প্রমোদ অনুসন্ধান চালিয়ে তার বাবা-মায়ের সন্ধান করে মেয়েকে তাদের হাতে তুলে দেয়৷ প্রমোদের প্রতি অনুরাগ হৃদয়ের মধ্যে স্থায়ী বাসা বাঁধে৷ এই অনুরাগ এবং কুসুম নাম্নী প্রতিবেশিনীর মুখে শোনা দাম্পত্য প্রণয়ের গল্প তাকে ধীরে ধীরে অগ্রসর করে যৌনলালসার দিকে৷ নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে সতেরো বছরের এক কিশোরকে প্রলুব্ধ করে সে এবং তাকে নিয়েই গৃহত্যাগী হয়৷ সেই কিশোর রমেশ কিছুদিন পর তাকে একা ফেলে গৃহে প্রত্যাগমন করে৷ কাত্যায়নী দমবার পাত্রী নয়৷ তাই ভাড়াটে গৃহের গৃহকর্ত্রীর প্ররোচনায় এক বৃদ্ধের সঙ্গে সহবাসে লিপ্ত হয়৷ বৃদ্ধ তার উদ্দাম যৌবনকে তাতিয়ে তুললেও মাতিয়ে তুলতে পারে না৷ আর এই অপরিতৃপ্ত কামনার যন্ত্রণায় বৃদ্ধের দেওয়া দামি পোশাক, অলঙ্কার সর্বোপরি সমস্ত সুযোগ সুবিধা ত্যাগ করে এক যুবক ভৃত্যকে সঙ্গী করে পালিয়ে যায়৷ সেই ভৃত্য তার যথাসর্বস্ব হরণ করে পালিয়ে গেলে সহায়-সম্বলহীন কাত্যায়নী উপায়ান্তর না দেখে দেহব্যবসা করে দিনাতিপাত করতে থাকে৷ তারপর আক্রান্ত হয় যৌনরোগে৷ চিকিৎসার জন্য ভর্তি হতে হয় লক হাসপাতালে৷ হাসপাতালে কাত্যায়নীর চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে ‘চৌদ্দ আইনে’র ভয়াবহ দিক সুস্পষ্টভাবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে৷ কাত্যায়নীর চিকিৎসা প্রণালীতে দেখা যায় সেখানে তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে বিভিন্ন যন্ত্রাদির দ্বারা অকথ্য অত্যাচারে এবং কটু ঔষধ সেবন করিয়ে চিকিৎসা চলতে থাকে৷ অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে হাসপাতাল থেকে পালানোর ফন্দি আঁটে সে৷ তার কাছে অর্থ অলংকার কিছু নেই যা দিয়ে কেউকে প্রলুব্ধ করতে পারবে৷ থাকার মধ্যে আছে শরীর এবং সেই শরীরের রূপ৷ হাসপাতালের কর্মীদের শরীর ও রূপ দিয়েই প্রলুব্ধ করতে হয়৷ সেখানকার কোনো এক কর্মী তার সঙ্গে বিনা পয়সায় শরীরী সংসর্গ করে পালানোর উপায় বের করে৷ অবশেষে এক জমাদারকে টাকা ঘুষ দিয়ে বেড়িয়ে আসে সেই অত্যাচারের কারাগার থেকে৷

কাত্যায়নীর নতুন জীবন শুরু হয়৷ গণিকাসমাজে নৃত্যগীতের একটা বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে৷ হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে নৃত্যগীত শিক্ষা করে নিজেকে আমূল বদলে ফেলে সে৷ নিজের নাম পাল্টে রাখে স্বর্ণবাঈ৷ স্বর্ণবাঈ এর পসার দিগদিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে৷ জীবনে এত পুরুষের সংসর্গ করেছে কাত্যায়নী তবুও প্রমোদকে ভুলতে পারে না কিছুতেই৷ প্রমোদই স্বর্ণর কামনার প্রথম ইন্ধনকাঠি৷ একদিন এক জমিদারের বাগানবাড়িতে মুজরা করতে গিয়ে মুখোমুখি হয় প্রমোদের৷ তার ছলা কলা এবং নিজের জানা সমস্ত কৌশল প্রয়োগ করে বশ করে তাকে৷ সচ্চরিত্রের প্রমোদ হয়ে উঠে এক দেহবিনোদিনীর হাতের পুতুল৷ কিন্তু প্রমোদ যখন স্বর্ণবাঈ-এর সত্যকার পরিচয় জানতে পারে তখন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে তাকে৷ প্রবল অপমানবোধে জর্জরিত হয় স্বর্ণবাঈ৷ তার প্রতি প্রবল প্রতিশোধস্পৃহায় সর্বনাশ করে তার বন্ধুর৷ একদিন যেমন করে বালবিধবা কাত্যায়নী যৌবনের দীপ্তিতে জ্বলে উঠেছিল তেমনি করেই সময়ের প্রবহমান ধারায় সেই যৌবনে ভাটা পড়তে থাকে৷ দেহব্যবসার পসার স্তিমিত হয়ে আসে৷ বেঁচে থাকার জন্য এবার তার সঙ্গী হয় যুবক চাকর-বাকররা৷ বহুবার তাদের দ্বারা লাঞ্ছিতাও হয় সে৷ তার ব্যবসা আর চলে না৷ শরীরের দিকে কেউ তাকিয়েও দেখে না৷ কিন্তু বেঁচে থাকতে গেলে তো অর্থ চাই৷ অর্থের বিনিময়ে খাদ্যের সংস্থান হবে৷ তাই অর্থ রোজগারের আশায় পথে-ঘাটে ঘটক সেজে অল্পবয়সি মেয়েদের গণিকা বৃত্তির দিকে প্রলোভিত করতে থাকে৷ তার উদ্দেশ্য সফল হয়৷ এক অল্পবয়সি বালবিধবাকে গণিকা বানিয়ে তার রোজগারেই স্বর্ণর জীবন চলতে থাকে৷ কিন্তু স্বর্ণ ক্রমশ অত্যাচারী হয়ে উঠলে মেয়েটি পালিয়ে যায়৷ হতাশায়—ভয়ে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর স্বপ্ন তার অবচেতন স্তর থেকে বেড়িয়ে আসতে থাকে৷ সে উন্মাদ হয়ে যায়৷ তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলে এক স্নেহশীলা মহিলার সেবা যত্নে সে সুস্থ হয়ে ওঠে৷ সেই মিশনারি নারী হয়ে যায় তার ‘নতুন মা’৷ সেবায়, যত্নে, সৎসংসর্গ স্বর্ণবাইকে তার দেহজীবিকার কালিমা থেকে মুক্ত করে৷ মিশনারিদের সাহায্যেই এক ধনী ব্যক্তির বাড়িতে নার্সের কাজ জোটে তার৷ সেবিকার ব্রতধারিণী স্বর্ণবাই ক্রমে জানতে পারে সেই ধনী ব্যক্তি আর কেউ নয় তার চিরবাঞ্ছিত, চিরকাঙ্খিত প্রমোদ৷ প্রমোদ তাকে চিনতে পারে কিন্তু কিছু করার আগেই স্বর্ণ তার সতীলক্ষ্মী স্ত্রীর দয়ায় সেখানে স্থায়ী আশ্রয় অর্জন করে নিয়েছে৷ প্রমোদের স্ত্রী-সন্তানদের নিষ্পাপ জীবনের ছায়ায় স্বর্ণবাঈ-এর জীবনে আরেক অধ্যায়ের সূচনা হয়৷ তাদের উদ্যোগেই সে শেষজীবনে কাশীতে আশ্রয়লাভ করতে পারে৷ তীর্থের সেই মুক্ত পবিত্র পরিবেশে বিশ্বেশ্বরের চরণতলে পরম শান্তিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে৷ একজন দেহজীবী নারী তার জীবনের সকল পঙ্কিলতা থেকে মুক্তি পেয়ে সাধারণ জীবনের সীমাকে স্পর্শ করে চিরমুক্তি লাভ করে৷

গণিকাদের প্রতি ঘৃণা ও অবমাননার জন্য তারা চিরটাকাল অস্পৃশ্য ও পতিতা থেকে যায়৷ কিন্তু প্রকৃত সহানুভূতি পেলে তারাও যে সাধারণ মানুষের মতো সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে স্বর্ণর জীবন পরিণতি তারই ইঙ্গিত দেয়৷

নয়নতারা :

শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘নয়নতারা’ (১৮৯৯) উপন্যাসের মূল উপজীব্য উনিশ শতকের সামাজিক নানা অসঙ্গতির মধ্যে চরিত্রবতী, সাধ্বী নয়নতারার জীবনাদর্শ৷ সৎ, নিষ্ঠাবতী, তেজস্বিনী, ধর্মপ্রাণা এই নারীচরিত্রের চারিত্রিক শুচিতাকে আরও বেশি দৃঢ় করার অভিপ্রায়ে আরেক শ্রেণীর নারীচরিত্রের উপস্থাপন করা হয়েছে; তারা গণিকা চরিত্র৷ উপন্যাসের এক অন্যতম চরিত্র গোবিন রঙ্গালয়ের মধ্যমণি এবং বিলাসবহুল জীবনাচারণে অভ্যস্ত৷ হিন্দুধর্মের নিষ্ঠাবতী নারীদের সংস্পর্শে সে সৎপথে ফিরে আসে স্বেচ্ছাচারী জীবন-পরিবেশ থেকে৷ পতিতা নারীদের নৈকট্য পরিত্যাগ করে৷ এমতাবস্থায় রঙ্গালয়ের ম্যানেজার হরিশ্চন্দ্র ঘোষ তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করলে তার মুখে উচ্চারিত হয়—‘‘কতকগুলো বাজারের মেয়ের সঙ্গে বৈ ত নয়, এই উঁচুদরের মেয়েরা যে কি জিনিস তা ত জান না, সে মেয়ে যদি দেখতে তা হলে পায়ে পড়ে পুজো করতে৷’’১১৩ গোবিনের এই উক্তির মধ্য দিয়ে নিম্নবিত্তের পতিতা নারীদের সঙ্গে তথাকথিত উচ্চঘরের চরিত্রবান নারীদের বৈপরীত্য বোঝাতে গিয়ে গণিকাদের প্রতি অবমাননাকর মানসিকতা তুলেছেন লেখক৷ এই উপন্যাসে পতিতা নারীরা ‘বাজারের মেয়ে’ হিসেবে বিশেষিত৷ তাদের মান, ইজ্জত, জীবন-যাপন সবকিছুকে রচনাকার সংকীর্ণ মানসিকতায় ব্যক্ত করেছেন৷ এরা প্রকাশ্য রাস্তায়, থিয়েটার মহলে নির্দ্বিধায় পরপুরুষের সান্নিধ্য গ্রহণ করে, ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে৷ তাদের সাহচর্যে পুরুষেরা বিপথগামী হয়ে উশৃঙ্খলায় পর্যবসিত হয়৷ রচনাকারের কলমে তারা ঘৃণিত৷

নয়নতারার ছোট দাদা যোগেশ যখন পতিতা নারীদের সাহচর্যে মদ-মাতাল হয়ে তার পিতার বন্ধুস্থানীয় পরিবারের সঙ্গে অভব্য আচরণ করে তখন নয়নতারার মুখে ব্যক্ত হয়—‘‘বাজারের কতকগুলো মেয়ে কি তোমার ইয়ারকি দেবার লোক, তুমি কি করে তাদের সঙ্গে মাখামাখি করতে গেলে?’’১১৪ স্নেহশীলা, মমতাময়ী, পরদুঃখে কাতর নয়নতারাও সামান্যতম সহানুভূতি দিয়ে সমাজপতিতা এই নারীদের যন্ত্রণাকে বোঝার প্রয়োজন মনে করেনি৷ যোগেশের এই ধরনের নারীদের সঙ্গে মেলামেশাকে বিষদৃষ্টিতে দেখেছে সে৷ তাই তাকে বলে—‘‘ভদ্রলোকের ছেলেরা যেখানে বাজারের মেয়েদের সঙ্গে কোমর দুলিয়ে নাচে ভদ্রলোকের সেখানে যাওয়াই উচিৎ নয়৷… কেবল গিয়েছ তা নয়, সেই সব মেয়ে মানুষের সঙ্গে মাখামাখি করেছ, আমি ভেবে উঠতে পারছি না কিরূপে তোমার এত অধোগতি হলো৷’’১১৫

উপন্যাসটিতে গণিকারা কোন স্বতন্ত্র চরিত্র হিসেবে স্থান না পেলেও প্রধান চরিত্র নয়নতারার চারিত্রিক শুদ্ধতাকে গাঢ়তর করতে এই ধরনের প্রসঙ্গ উপস্থাপন করেছেন রচনাকার শিবনাথ শাস্ত্রী৷ ‘বাজারের মেয়ে’ বিশেষিত পতিতারা ঘৃণ্য, সমাজ দূষক হিসেবে চিহ্নিত এবং নিন্দিত হয়েছে৷ তাদের সংসর্গ, সংস্পর্শ সবই আদর্শ সমাজের কাছে পরিত্যাজ্য৷

তথ্যসূত্র :

 ১. প্রমথনাথ বিশী সম্পাদিত ভূদেব রচনাসম্ভার, পৃ-৩২৯৷

 ২. তদেব, পৃ-৩২৯৷

 ৩. তদেব, পৃ-৩৩৭৷

 ৪. তদেব, পৃ-৩৩৭৷

 ৫. তদেব, পৃ-৩৩৭৷

 ৬. তদেব, পৃ-৩৩৯৷

 ৭. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, উপন্যাস সমগ্র, পৃ-৬৪৷

 ৮. তদেব, পৃ-৬২৷

 ৯. তদেব, পৃ-৯৩৷

 ১০. তদেব, পৃ-৬৮৷

 ১১. তদেব, পৃ-৬০৷

১২. তদেব, পৃ-৭৭৷

১৩. তদেব, পৃ-৭৭৷

১৪. তদেব, পৃ-১৩৫৷

১৫. তদেব, পৃ-১৩৫৷

১৬. তদেব, পৃ-২৭৭৷

১৭. তদেব, পৃ-২৭৭৷

১৮. তদেব, পৃ-২৭৭৷

১৯. তদেব, পৃ-২৮৮-২৮৯৷

২০. তদেব, পৃ-২৮৮৷

২১. তদেব, পৃ-৬৭৷

২২. তদেব, পৃ-৩৪২৷

২৩. তদেব, পৃ-৭৫৯৷

২৪. তদেব, পৃ-৭৬৬৷

২৫. তদেব, পৃ-৭৬১৷

২৬. তদেব, পৃ-৭৬৭৷

২৭. তদেব, পৃ-৭৬৯৷

২৮. তদেব, পৃ-৭৭৮-৭৭৯৷

২৯. তদেব, পৃ-৭৮৪৷

৩০.  তদেব, পৃ-৭৮৬৷

৩১. তদেব, পৃ-৭৮৬৷

৩২. তদেব, পৃ-৮১৪৷

৩৩. তদেব, পৃ-৮১৬৷

৩৪. তদেব, পৃ-৮১৭-৮১৮৷

৩৫. তদেব, পৃ-৮১৯৷

৩৬. তদেব, পৃ-৮২১৷

৩৭. তদেব, পৃ-৮৪৫৷

৩৮. তদেব, পৃ-৮৪৬৷

৩৯. তদেব, পৃ-৮৫২৷

৪০. ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হরিদাসের গুপ্তকথা, পৃ-৮১৷

৪১. তদেব, পৃ-৮১৷

৪২. তদেব, পৃ-৮১৷

৪৩. তদেব, পৃ-৮১-৮২৷

৪৪. তদেব, পৃ-৮২৷

৪৫. তদেব, পৃ-৮২৷

৪৬. তদেব, পৃ-৪২৬৷

৪৭. তদেব, পৃ-১৩২৷

৪৮. তদেব, পৃ-১৩৯৷

৪৯. তদেব, পৃ-৪৪৯৷

৫০. তদেব, পৃ-১৪৮৷

৫১. তদেব, পৃ-২২৭৷

৫২. মৌ ভট্টাচার্য, বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ, পৃ-১২৫৷

৫৩. তদেব, পৃ-১২৭৷

৫৪. তদেব, পৃ-১২৭৷

৫৫. তদেব, পৃ-১২৭৷

৫৬. তদেব, পৃ-১২৯৷

৫৭. তদেব, পৃ-১২৯৷

৫৮. তদেব, পৃ-১২৯৷

৫৯. তদেব, পৃ-১৩২৷

৬০. তদেব, পৃ-১৩৩৷

৬১. তদেব, পৃ-১৩৩৷

৬২. তদেব, পৃ-১৩৩৷

৬৩. তদেব, পৃ-১৩৩৷

৬৪. তদেব, পৃ-১৩৩৷

৬৫. তদেব, পৃ-১৩৪৷

৬৬. তদেব, পৃ-১৩৫৷

৬৭. তদেব, পৃ-১৩৬৷

৬৮. তদেব, পৃ-১৩৬৷

৬৯. তদেব, পৃ-১৩৭৷

৭০. তদেব, পৃ-১৩৭-১৩৮৷

৭১. গিরিশ রচনাবলী, পঞ্চমখণ্ড, পৃ-১৬১৷

৭২. তদেব, পৃ-১৫৫৷

৭৩. তদেব, পৃ-১৫৫৷

৭৪. তদেব, পৃ-১৩৪৷

৭৫. তদেব, পৃ-১৩৭৷

৭৬. তদেব, পৃ-১৫৮৷

৭৭. তদেব, পৃ-১৬২৷

৭৮. তদেব, পৃ-১৬২৷

৭৯. তদেব, পৃ-১৬৯৷

৮০. তদেব, পৃ-১৭০৷

৮১. তদেব, পৃ-১৭১৷

৮২. তদেব, পৃ-১৭২৷

৮৩. তদেব, পৃ-১৭৩৷

৮৪. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদক) সঞ্জীব রচনাবলী (সম্পূর্ণ), পৃ-৯৷

৮৫. তদেব, পৃ-১২৷

 ৮৬. তদেব, পৃ-১২৷

 ৮৭. তদেব, পৃ-১২৷

 ৮৮. তদেব, পৃ-১২৷

 ৮৯. দুর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, পৃ-১০৷

 ৯০. তদেব, পৃ-৬৷

 ৯১. তদেব, পৃ-২৯৷

 ৯২. তদেব, পৃ-৩৯৷

 ৯৩. তদেব, পৃ-৯৯৷

 ৯৪. তদেব, পৃ-১৫৮৷

 ৯৫. তদেব, পৃ-১৬৩৷

 ৯৬. তদেব, পৃ-১৮৮৷

 ৯৭. তদেব, পৃ-১৯৭৷

 ৯৮. তদেব, পৃ-১৯৭৷

 ৯৯. তদেব, পৃ-২৪২৷

 ১০০. তদেব, পৃ-২৫৭৷

 ১০১. তদেব, পৃ-২৫৭৷

 ১০২. তদেব, পৃ-২৬৯৷

 ১০৩. তদেব, পৃ-২৯৫৷

 ১০৪. তদেব, পৃ-৩১০৷

 ১০৫. তদেব, পৃ-৩২৫৷

 ১০৬. তদেব, পৃ-৩৪৯৷

 ১০৭. তদেব, পৃ-৩৫২৷

 ১০৮. তদেব, পৃ-৩৫৪৷

 ১০৯. তদেব, পৃ-৩৫৫৷

 ১১০. তদেব, পৃ-৩৬৫৷

 ১১১. তদেব, পৃ-৩৬৬৷

 ১১২. তদেব, পৃ-৪২৮৷

 ১১৩. শ্রীগোপাল হালদার (প্রধান সম্পাদক), শ্রীবারিদবরণ ঘোষ (সম্পাদক), শিবনাথ রচনাসংগ্রহ, পৃ-১৫৯৷

 ১১৪. তদেব, পৃ-১৭৬৷

 ১১৫. তদেব, পৃ-১৭৬৷

৫. বিশ শতকের বাংলা উপন্যাসে গণিকা

বিশ শতকের বাংলা উপন্যাসে গণিকা

গণিকা চরিত্র পর্যালোচনায় বিশ শতক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে৷ উনিশ শতকের উপন্যাসগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গণিকারা ঘৃণ্য ও নিন্দিত৷ সমাজের এতটুকু সহানুভূতি নেই তাদের প্রতি৷ তারা প্রচলিত অর্থে ডাইনি, পিশাচিনী, ডাকিনী স্বরূপ; সর্বোপরি সমাজদূষক৷ কিন্তু পরবর্তী শতাব্দীর আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে গণিকাদের অবস্থানগত তারতম্য ঘটে৷ ঘৃণ্য সমাজদূষক থেকে তাদের প্রতি আরোপিত হয় সহানুভূতির পেলব স্পর্শ৷ মমতায়-ভালোবাসায়-ত্যাগে-মহত্ত্বে তারা মহীয়ান হয়ে ওঠে৷ যন্ত্রণাকর পেশার সঙ্গে সংযুক্ত থাকলেও সমাজ তাদের আর ঘৃণা করতে পারে না—রক্তমাংশের মানবী হয়ে ছিটকে পড়া প্রান্তসীমা থেকে পুনরায় আমাদের ঘরের মেয়ে হয়ে উঠে ৷ প্রথম পর্বের বাংলা উপন্যাসে তাদের না ছিল কোনো নাম, না ছিল কোনো সম্মান বা সহানুভূতি কিন্তু বিশ শতকে তারা স্বনামে, স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে লেখকের মরমি দৃষ্টিভঙ্গির গুণে৷ কোনো কোনো উপন্যাসে আবার মুখ্য চরিত্র হিসেবেও দেখা যায় তাদের৷ দেহজীবিকার গ্লানি নারীত্বের উজ্জ্বল বিভায় ম্লান হয়ে যায়; স্নেহে-প্রেমে-মহত্বে উচ্চতম শিখর স্পর্শ করে তারা৷ বাংলা উপন্যাসের আঙিনায় এই বারযোষিৎদের প্রথম পঙ্ক থেকে উদ্ধার করে সম্মান ও সহানুভূতিতে সুমহান মর্যাদা দান করেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ তাঁর ‘চরিত্রহীন’-এর সাবিত্রী, কিরণময়ী, ‘শ্রীকান্ত’-এর পিয়ারীবাই, ‘দেবদাস’-এর চন্দ্রমুখী, ‘শুভদা’-এর কাত্যায়নী, ললনা বা মালতী সমাজ পরিত্যক্ত বারবনিতা হলেও তাদের ভেতরকার চিরপবিত্র স্নেহরসধারার প্রস্রবনে কোথাও যেন এতটুকু খামতি নেই৷ তাদের প্রতি কোনোভাবেই পাঠকের ঘৃণা জন্মে না বহুপুরুষভোগ্যা বলে বরং পরম সহানুভূতিতে চিত্ত আবিষ্ট হয়ে উঠে৷ তারপরে কল্লোল-কালিকলম-প্রগতির হাত ধরে বহু সাহিত্যিক গণিকা চরিত্র চিত্রিত করেছেন, সেখানেও তারা স্বাধীকারবোধসমন্নিত স্নেহ মমতার পরিপূর্ণ প্রতিমূর্তি৷ যেমন জগদীশ গুপ্তের উত্তম, টুকী (লঘুগুরু), নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের শুভা (শুভা), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কুন্তা (আরণ্যক), পান্না (অথৈ জল), তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বসন্ত (কবি), দুর্গা (গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম), রমা (প্রেম ও প্রয়োজন), বনফুলের মুক্তো (জঙ্গম), আসমানী (বৈতরণীর তীরে), মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের দুর্গা, চাঁপা (শহরবাসের ইতিকথা), সঞ্জয় ভট্টাচার্যের বনানী (বৃত্ত) ইত্যাদি চরিত্রগুলি৷

পাঁচকড়ি দে :

বাংলা সাহিত্যে ডিটেকটিভ উপন্যাস যাঁর হাত ধরে স্থায়ীরূপ লাভ করেছিল তিনি পাঁচকড়ি দে (১৮৭৩-১৯৪৫)৷ তাঁর রহস্য উপন্যাসগুলিতে নানাভাবে গণিকা চরিত্রের রেখাঙ্কন করেছেন তিনি যার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সময়ে গণিকাদের সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করা যেতে পারে৷

ক. নীলবসনা সুন্দরী :

পাঁচকড়ি দে-এর সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘নীলবসনা সুন্দরী’ প্রকাশিত হয় ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে৷ উপন্যাসটির বিষয়বস্তু ডিটেকটিভ দেবেন্দ্রবিজয়ের গোয়েন্দাগিরিতে মেহেদীবাগানের অত্যাশ্চর্য নারী হত্যা রহস্যের উদ্ভেদ৷ আর সেই অনুসঙ্গেই উঠে এসেছে নর্তকী গুলজার-মহল, লতিমন বাইজি, দিলজান প্রমুখ গণিকার নাম৷ এছাড়া স্বৈরিণী সৃজানও তার লোভ ও ঈর্ষায় বহুগামী হয়ে জীবন কাটাতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে৷

গুলজার-মহল :

উপন্যাসটির শুরু হয়েছে এক ধনীগৃহে বাইনাচের মজলিশ দিয়ে—‘‘রাত দুইটা বাজিয়া গিয়াছে৷ এখনও প্রসিদ্ধ ধনী রাজাব-আলির বহিবর্বাটীর বিস্তৃত প্রাঙ্গণ সহস্র দীপালোকে উজ্জ্বল৷ সেই আলোকোজ্জ্বল সুসজ্জিত প্রাঙ্গণে নানালঙ্কারে সুসজ্জিতা, সুবেশা, সুস্বরা নর্ত্তকী গায়িতেছে—নাচিতেছে—ঘুরিতেছে—ফিরিতেছে—উঠিতেছে—বসিতেছে, উপস্থিত সহস্র ব্যক্তির মন মোহিতেছে৷’’ তাদের উন্নত গ্রীবার ভঙ্গি, নয়নের নানারকম ভঙ্গি, মুখের, হাত নাড়ার, পা ফেলার ভঙ্গিতে তন্ময় হৃদয়ে সকলে তাদের দিকে চেয়ে আছে৷ কারও উঠার ক্ষমতা নেই৷ মোহিনী মায়ায় আবিষ্ট হয়ে রাত বহুদূর গড়িয়ে গেলেও নিজেদের আবেশবিহ্বল মনকে কিছুতেই গণিকার মায়াডোর থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছে না৷ এখানে গণিকার বীণা নিক্বণের সুমধুর শব্দরাজী নানা তানে দর্শকের চেতনাকে আবিষ্ট করে৷ নানা মধুর তানের উল্লেখ করেছেন লেখক যথা—কখনো তা বেহাগের সুমিষ্ট আলাপ, কখনো মীড়ে, গমকে, মূর্ছণায়, গিটকারীতে, উদারা মুদারা তারা তিনগ্রামে, প্রক্ষেপে ও বিক্ষেপে ষড়জ রেখার, গান্ধার পঞ্চম, ধৈবত প্রভৃতি সপ্তস্বরে অনাস্বাদিতপূর্ব সুরধারা বর্ষণ করছে৷ নয়নমনোহর ঝলমলে বাইজির পোশাক-আশাক, নৃত্যপ্রাঙ্গণ ও সুসজ্জিত বসন্তের মধুরবায় চিরযৌবনের সুর বহন করে আনে৷ ধনাঢ্য গৃহের বাইজিবিলাসের পারিপাট্যে লেখক মজলিশগৃহের বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘ঊর্ধ্বে বহু শাখাবিশিষ্ট ঝাড় ঝুলিতেছে তাহাতে অগণ্য দীপমালা৷ লাল, নীল, পীত, শ্বেত—বর্ণবিচিত্র পতাকাশ্রেণী৷ নিম্নে বহুমূল্য গলিচা বিস্তৃত, রজত-নির্ম্মিত আতরদান গোলাপপাশ, আলবোলা, শটকা এবং তাম্বুল-এলাইচপূর্ণ রজতপাত্রের ছড়াছড়ি৷ চারিপার্শ্বে গৃহ-প্রাচীরে দেয়ালগিরি, তাহাতে অসংখ্য দীপ জ্বলিতেছে৷ অলিন্দে অলিন্দে—লাল, নীল, সবুজ, জরদ বিবিধ বর্ণের স্ফটিক-গোলকমালা দুলিতেছে, তন্মধ্যস্থিত দীপশিখা বিবিধ বর্ণে আলোক বিকীর্ণ করিতেছে৷ স্তম্ভে স্তম্ভে দেবদারুপত্র, চিত্র, পতাকা ও পুষ্পমাল্য শোভা পাইতেছে৷ আলোকে-পুলকে সকলই উজ্জ্বলতর দেখাইতেছে৷ উর্দ্ধে নিম্নে, মধ্যে, পার্শ্বে সহস্র দীপ জ্বলিতেছে…৷’’ এত বিলাস এত বৈভব এত সমারোহের মাঝখানে যে বাইজিকে কেন্দ্র করে সহস্র লোক সবকিছু ভুলে গিয়ে আবেশবিহ্বল হয়ে বসে আছে তার নাম গুলজার-মহল৷ সে কলকাতার প্রসিদ্ধ বাইজি৷ শ্রোতৃগণের পুষ্প, পুষ্পমাল্য, পুষ্পস্তবকে গুলজার-মহলের আসর ভরে গিয়েছে৷ রাত দুটা বেজে গেলেও শ্রোতারা ওঠার নাম করছে না৷ গুলজার-মহলও তার গান থামাতে পারছে না কারণ পাঁচশত টাকা চুক্তির বিনিময়ে সে মুজরা করতে এসেছে৷ থামলে তো তার চলবে না৷ তাছাড়া মুন্সী জোহিরুদ্দীন মল্লিকের স্ত্রী এবং নাজিব-উদ্দিন চৌধুরীর কন্যা জোহেরা বাইজিকে দুটি হীরার আংটি বকশিশ দিয়েছে৷ তার মূল্য স্বরূপও তাকে অন্তত দুটো গান বেশি গাইতে হবে৷ মোটা অঙ্কের টাকা এবং দামি বকশিশে গুলজার-মহলের মধ্যেও উৎসাহের সঞ্চার করেছে৷ গুলজার তার প্রসিদ্ধ নৃত্যগীতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছে৷ মোবারকের কথায় সেই রকমই দিক নির্দেশ হয়৷ সে সুজাত-এর সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে তাই বলে—‘‘এমন লোক দেখিনা গুলজার-মহল বাইজীর গান যাহার ভাল না লাগে৷’’ অর্থাৎ সৌন্দর্য, নৃত্যগীত পারদর্শিতায় গণিকারা সমাজে সম্মান না পেলেও অর্থপ্রতিপত্তি লাভ করতো৷ ধনী গৃহে গণিকাবিলাসের চিত্রও ফুটে উঠেছে রাজাব-আলির বাড়িতে মুজরার আয়োজন দৃশ্যের মধ্য দিয়ে৷ বাইজির গান শুনতে অভিজাত গৃহের নারীরাও যে উপস্থিত হতো মুন্সী জোহিরুদ্দিন মল্লিকের স্ত্রী এবং নাজিব-উদ্দীন চৌধুরীর কন্যার উপস্থিতির মধ্য দিয়ে তার প্রমাণ পাওয়া যায়৷

লতিমন বাইজী :

গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় অজ্ঞাত পরিচয় সেই নীলবসনা সুন্দরীর মৃতদেহের পরিচয় উদ্ধার এবং রহস্য উদ্ঘাটন করার অভিপ্রায়ে মৃতের গলায় জড়ানো রেশমের সূচি-কার্যের সুদৃশ্য ওড়না নিয়ে সূচিশিল্পী করিমের মায়ের কাছে উপস্থিত হলে তার মেয়ের কাছ থেকে জানতে পারে লতিমন বাইজির নাম৷ লতিমন বাইজি বামুনবস্তিতে থাকে৷ সেই করিমের বোনের কাছ থেকে সেই সুদৃশ্য ওড়না তৈরি করিয়ে নিয়েছে৷ লতিমনবাইজিও প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারিণী৷ সে এবং তার প্রকাণ্ড দ্বিতল বাড়ি বামুনবস্তির আবালবৃদ্ধবনিতার পরিচিত৷ পাড়াপড়শীদের কাছ থেকে গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় লতিমন সম্পর্কে আরও তথ্য সংগ্রহ করে৷ তা থেকে জানা যায় যে লতিমন বাইজি সবসময় বাড়ির বাইরে আসে না৷ প্রভূত খ্যাতি থাকায় দেশে-বিদেশে তাকে মুজরা করতে যেতে হয়৷ তার বাড়িতে দিলজান নামের এক ষোড়শী সুন্দরী কন্যা বাস করে৷ তার সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যেই মনিরুদ্দীনের সেখানে যাতায়াত আছে৷ লতিমনের গৃহে বিত্ত-বৈভবের চিহ্ন সুপ্রকটিত৷ লেখক দেবেন্দ্রবিজয়ের দৃষ্টিতে সেই গৃহের প্রাচুর্যের দিকটি তুলে ধরেছেন এইভাবে—‘‘গৃহটী মূল্যবান আসবাবে পূর্ণ৷ গৃহতলে গালিচা বিস্তৃত৷ গৃহ-প্রাচীরে উৎকৃষ্ট তৈল-চিত্র ও দেয়ালগিরি৷ একপার্শ্বে একখানি প্রকাণ্ড দর্পণ—সম্মুখে গিয়া কেহ দাঁড়াইলে তাহার মাথা হইতে পা পর্য্যন্ত তাহাতে প্রতিবিম্বপাত হয়৷ অপরপার্শ্বে গবাক্ষের নিকটে একটি হারমোনিয়ম রহিয়াছে, নিকটে একখানি মখমলমণ্ডিত চেয়ার ও একখানি কৌচ৷’’

দেবেন্দ্রবিজয়ের স্পষ্ট ধারণা হয়েছিল সেই নীলওড়না-নীলবসন পরিহিত বেওয়ারিশ মৃতদেহ লতিমন বাইজিরই হবে৷ সে তদন্ত করতে লতিমনের গৃহে উপস্থিত হলে তার সম্মুখে একজন স্ত্রীলোক বেড়িয়ে আসে৷ লেখকের বর্ণনায় সেই স্ত্রীলোকটি দেখতে তেমন সুন্দরী নয়, শ্যামবর্ণা, মুখে বসন্তের ক্ষতচিহ্ন এবং বয়সও ত্রিশের কাছাকাছি৷ জড়ির চটিজুতা পায়ে দিয়ে সর্বালঙ্কারে ভূষিতা হয়ে সেই স্ত্রীলোক গোয়েন্দার সঙ্গে কথপোকথন চালাতে থাকে৷ গোয়েন্দা নিজের পরিচয় দিয়ে তাকে লতিমন খুনের প্রসঙ্গ বললে সেই ভ্রম ভেঙ্গে দেয় সেই স্ত্রীলোকটিই৷ সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে সে-ই লতিমন৷ গোয়েন্দা বিস্মিত হয়ে তাকে নীলওড়না দেখালে একটা ভাবী দুশ্চিন্তায় মুখাবয়ব উদ্বেগপূর্ণ হয়ে ওঠে লতিমনের এবং যখন শোনে নীলরঙের সিল্কের তৈরি সাঁচ্চার কাজ করা কাপড় পরিহিতা সেই মৃতদেহের কথা তখন গভীর আশঙ্কায় কেঁদেই ফেলে৷ ‘‘আমাদের দিলজানই খুন হয়েছে৷’’ বলে সে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলে৷ লতিমন স্নেহপরায়ণ এক নারী৷ দিলজানকে মনিরুদ্দীন তার কাছে নিয়ে এলে সে তাকে সহোদরা ভগ্নীর মতই ভালোবাসে৷

লতিমন বাইজির মধ্যে ছল-চাতুরীর বালাই নেই৷ সাধারণ একজন নারীর মতো করেই লেখক চরিত্রটিকে উপস্থাপন করেছেন৷ খুনের রহস্য উদ্ঘাটনে শেষ পর্যন্ত দেবেন্দ্রবিজয় যেভাবে চেয়েছে সেভাবে সাহায্য করেছে সে৷ তার মনের মধ্যে সর্বদাই একটাই আদর্শ কাজ করেছে অপরাধী যাতে শাস্তি পায়৷ গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় তথ্য সংগ্রহের জন্য দিলজানের ব্যক্তিগত বাক্স-দেরাজ খুলে তল্লাশি করতে চাইলে লতিমন ইতস্তত করলেও শেষ পর্যন্ত তাকে অনুমতি দেয়৷ শুধু তাই নয় তালাবন্ধ বাক্স-দেরাজের চাবি না থাকায় লোহার তার, ছাতা ভাঙ্গা লোহার শিক সংগ্রহ করে দেয় যাতে সেগুলির সাহায্যে বাক্সগুলি খোলা যায়৷ মুন্সী জোহিরুদ্দীন মল্লিকের বাড়ির অন্দরমহলের খবর নেওয়ার জন্য সাখিয়াকে ডেকে পাঠায়৷ সাখিয়া মুন্সী পত্নী সৃজানবিবির প্রধান দাসী৷ লতিমন তাকে মনিবের সুরে প্রথমেই সচেতন করে দিয়ে বলে—‘‘সাখিয়া, ইনি তোকে গোটাকতক কথা জিজ্ঞাসা করতে চান৷ যা, জানিস সত্য বলবি৷’’ সাখিয়া গোয়েন্দার মুখে খুনের কথা শুনে তার বিবি সাহেবা খুন হয়েছে ভেবে আর্তনাদ করে ওঠে কিন্তু যখন শোনে তার বিবি সাহেবা সৃজান নয় দিলজান খুন হয়েছে তখন হাল্কা তাচ্ছিল্য করে বিষয়টাকে উড়িয়ে দেয়৷ একজন ‘বেশ্যামাগী’ খুন হয়েছে শুনে সে নিশ্চিন্ত হয় এবং তাচ্ছিল্যপূর্ণ মন্তব্য করে৷ একজন দাসীর মুখে এ হেন তাচ্ছিল্যসূচক মন্তব্য শুনে রেগে যায় লতিমন বাইজি৷ প্রতিবাদ করে তার কথার৷ লতিমন বাইজির সহৃদয়তায়ই দিলজান বা মৃজান এর পরিচয় উদ্ধার করে সমস্যার সমাধানে এগিয়ে যেতে সক্ষম হয় উপন্যাসের গোয়েন্দা৷

দিলজান :

উপন্যাসের প্রথম পর্যায়ে লেখক দিলজানকে উপস্থিত করেছেন মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা রূপে৷ গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় মেহেদী-বাগানের মৃত্যুর রহস্যমোচন করার জন্য লতিমন বাইজির বাসস্থান বামুনবস্তিতে উপস্থিত হলে সেখানে পড়শীদের মুখে উঠে আসে দিলজানের নাম৷ সে শোনে—‘‘লতিমনের বাড়ীতে দিলজান নামে আর একটি ষোড়শী সুন্দরী বাস করে; মনিরুদ্দীন কোথা হইতে তাহাকে এখানে আনিয়া রাখিয়াছে৷’’ লতিমনের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে দিলজান মনিরুদ্দীনের সঙ্গে ভিনদেশে বেড়াতে গেছে৷ সেই নীল ওড়নার মালিক লতিমন জীবিত প্রমাণিত হলে সকলে স্থির সংকল্প হয় সেই নীলবসনা সুন্দরী নারীর মৃতদেহ দিলজানেরই৷ কারণ দিলজান নীলবসন ও লতিমনের নীল ওড়না পড়ে মনিরুদ্দীনের সন্ধানে শেষবারের মতো বের হয়েছিল৷ তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে লতিমন গোয়েন্দাকে জানায় যে দিলজান কারও সঙ্গে মিশত না; কারও সঙ্গে তার বাদ-বিসংবাদও ছিল না৷ মনিরুদ্দীনকেই সে একমাত্র ভালোবাসতো৷ মনিরুদ্দীন তাকে বিবাহ করবে আশা দিয়ে নিয়ে এসেছিল৷ ক্রমে তার সে সম্ভাবনা স্তিমিত হয়ে আসে৷ দিলজানের পীড়াপীড়িতেও সে মুখ ফিরিয়ে থাকে৷ দিলজান মনিরুদ্দীনের উপেক্ষা বুঝতে পারে৷ অনুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে যে তার প্রেমাস্পদ অন্য আরেক সুন্দরীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে ভুলতে বসেছে এবং তার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার সংকল্প করেছে৷ দিলজান এমনি শান্ত স্বভাবের হলেও রেগে গেলে ভয়ঙ্করী হয়ে যায়৷ তখন তার মত উগ্র স্বভাবের কেউ নয়৷ সে রেগে গিয়ে প্রতিজ্ঞা করে মনিরুদ্দীন যদি তাকে প্রত্যাখ্যান করে তাহলে সে খুন করে তার অপমানের প্রতিশোধ নেবে৷ দিলজানকে সকলে গণিকা হিসেবেই দেখে৷ মল্লিকবাড়ির দাসী সাখিয়া দিলজানের মৃত্যু সম্পর্কে তাচ্ছিল্য প্রকাশ করলে তার প্রতি গভীর সহানুভূতিতে লতিমন বাইজি তার সম্পর্কে সাখিয়া দাসীকে যে কথা বলে তাতে দিলজান চরিত্রের আরেকটি দিক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে—‘‘রেখে দে তোর বিবি সাহেবা—সে আবার বেশ্যার অধম; নৈলে সে এমন কাজ করে?’’ তার আবার মান! ‘‘আমাদের দিলজানের সঙ্গে তার তুলনা? যদিও মনিরুদ্দীনের সঙ্গে দিলজানের বিবাহ হয় নাই; তা’ না হ’লেও, সে মনিরুদ্দীন ভিন্ন আর কিছু জানিত না৷ তোর বিবি সাহেবা কি নামটাই কিনলে বল দেখি? তোর বিবি সাহেবা যদি মনিরুদ্দীনের মাথাটা একেবারে না খেয়ে দিত, তা’ হ’লে আমাদের দিলজানই বা খুন হবে কেন?’’ অর্থাৎ গণিকার গৃহে বসবাস করে, প্রেমাস্পদের হাত ধরে বেড়িয়ে এসে তাকে দেহমন সমর্পন করার কারণে দিলজান সমাজের চোখে গণিকা হলেও সে আদতে গণিকা নয়—প্রেম ভালোবাসায় পরিপূর্ণ নারী৷ পরবর্তী সময়ে দেবেন্দ্রবিজয় রহস্যের গিঁট খুলতে খুলতে তার প্রকৃত পরিচয় উদ্ধার করে৷ সে আসলে মৃজান, মুন্সী মোজাম হোসেনের কন্যা৷ মুন্সী জোহেরুদ্দীন মল্লিকের স্ত্রী সৃজান যে কিনা মনিরুদ্দীনের সঙ্গে পরকীয়ায় আবদ্ধ আসলে দিলজান বা মৃজানের যমজ বোন এবং আরও পরে জানা যায় যে সেই নীলবসনা সুন্দরী দিলজান ছিল না, ছিল সৃজান৷ মৃজান বা দিলজান তার একরোখা ভালোবাসা দিয়ে মনিরুদ্দীনকে জয় করে নেয়৷ সে যখন খুনের দায়ে অভিযুক্ত মনিরুদ্দীনের সকল দোষ নিজ স্কন্ধে নিয়ে সৃজানকে নিজে খুন করেছে বলে স্বীকার করে তখন মনিরুদ্দীন বুঝতে পারে প্রকৃত প্রেম কি৷ সে তার লাম্পট্য-মদ্যপান পরিত্যাগ করে শেষপর্বে উন্মাদ হয়ে যাওয়া মৃজানের শূশ্রূষায় আত্মনিয়োগ করে৷ বারবনিতা পরিচয়ধারী এক নারী তার সমস্ত কলঙ্ক মুছে সুখী দাম্পত্যের সন্ধান পায়৷

সৃজান :

সৃজান স্বৈরিণী চরিত্র হিসেবে আলোচ্য উপন্যাসে প্রতিবিম্বিত হয়েছে৷ সৃজান চরিত্রটিকেও প্রথম থেকেই স্বৈরিণী হিসেবে প্রতিবিম্বিত করেছেন লেখক৷ উপন্যাসের শুরুতেই সেই ইঙ্গিত পাওয়া যায় সুজাত আলির কথায়৷ সে মোবারককে জানায়—‘‘সৃজান বিবির স্বভাবে কিছু দোষ আছে৷ ইহারই মধ্যে তাহার একটা নিন্দাপবাদও বাহির হইতে আরম্ভ হইয়াছে৷ শুনিয়াছি, স্বভাবটা ভালো নহে—মনিরুদ্দীনের উপরেই না কি তাহার নজরটা পড়িয়াছে৷’’১০ সৃজান বিবাহের পূর্বে খিদিরপুরে তার পিত্রালয়ে অবস্থান কালে মোবারক আলির সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ কিন্তু সৃজান ছিল উচ্চাভিলাষী৷ তার কাম্য প্রেম নয় সম্পদ৷ তাই একই সঙ্গে মোবারকের সাথে সম্পর্ক জীবিত রেখেও অনুসন্ধান চালাতে থাকে কোনো ধনবান যুবকের৷ উদ্দেশ্য তাকে হাতে রাখা৷ শেষ পর্যন্ত যদি কোনো ধনবান জমিদার-আমীর-ওমরাও না জোটে তাহলে মোবারককেই বরমাল্য প্রদান করবে৷ মোবারক অর্থোপার্জনের চেষ্টায় নেপালে গেলে সেই অবসরে ধনী মুন্সী সাহেবের সঙ্গে বয়সের বিশাল ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও তার বিয়ে হয়৷ মুন্সী জোহিরুদ্দীন মল্লিকের গৃহিণী হয়েও তার মনোবৃত্তি পূর্ববৎ লোভী ও ঈর্ষাপরায়ণ থাকে৷ সে তার প্রলোভন দিয়ে মনিরুদ্দীনকে বশ করে তার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে৷ অবশেষে মোবারক প্রতিহিংসায় পালাতে গিয়ে খুন হয় সে৷

এছাড়া এই উপন্যাসে মোবারকের স্বীকারোক্তির মধ্যে কাওয়াল জাতির স্ত্রীলোকদের স্বেচ্ছাচারের কথা উঠে এসেছে৷ তার কথায়—‘‘কাওয়াল জাতির স্ত্রীলোকেরা অত্যন্ত সুন্দরী; কিন্তু তাহাদিগের স্বভাব অত্যন্ত কলুষিত—সকলেই স্বেচ্ছাচারিণী—সতীত্ব বলিয়া যে কিছু আছে, তাহা তাহারা জানে না৷’’১১ এই কাওয়াল জনজাতির বাস নেপালের দক্ষিণপ্রান্তস্থ পর্বতমালায়৷ মোবারক অবসর পেলেই তাদের সঙ্গে মিশতো৷ তাদের মধ্যে মানিয়া নামের এক রমণীর ঘনিষ্ঠতা বেশি হয়েছিল৷ মানিয়াই ভালোবাসার প্রতীক স্বরূপ তাদের নিজেদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য বিষাক্ত তীরের ফলা মোবারককে উপহার দিয়েছিল৷

খ. মায়াবিনী :

‘মায়াবিনী’ উপন্যাসটি ‘গোয়েন্দার গ্রেপ্তার’ সাময়িকপত্রে ‘জুমেলিয়া’ নামে প্রকাশিত হতে থাকে৷ তিন ফর্মা ছাপা হওয়ার পর পাঁচকড়ি দে একেবারে বই আকারে প্রকাশ করে নাম বদল করে রাখেন ‘মায়াবিনী’৷ এ সম্পর্কে প্রথমবার বিজ্ঞাপনে গ্রন্থকার লিখেন—‘‘গতবর্ষে ‘গোয়েন্দার গ্রেপ্তার’ নামক সাময়িক পত্রিকায় ‘জুমেলিয়া’ নামে এই পুস্তকের ৩ ফর্ম্মা বাহির হইয়াছে৷ এক্ষণে অবশিষ্ট ফর্ম্মাগুলি মুদ্রাঙ্কিত করিয়া পুস্তক সম্পূর্ণ করা গেল৷ ‘জুমেলিয়া’ নামের পরিবর্ত্তে ‘মায়াবিনী’ নামে সম্পূর্ণ পুস্তক স্বতন্ত্র আকারে বাহির হইল৷’’১২

এই উপন্যাসে মায়াবিনী বলা হয়েছে জুমেলিয়াকে৷ সে তার পৈশাচিক অভিব্যক্তি দিয়ে বহুমানুষ হত্যা করেছে, গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয়কে বার বার বিপদের মধ্যে ফেলেছে৷ পুরুষদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে নিজের কাজ হাসিল করেছে৷ জুমেলিয়ার অঘটন ঘটিয়ে আত্মগোপন প্রসঙ্গে উঠে এসেছে থিরোজা বাইজির নাম৷ থিরোজার বাড়ি খিদিরপুর মেটেবুরুজ-এ৷ ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়সি থিরোজাবাই অসামান্য সুন্দরী৷ তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গঠন প্রণালী পরিপাটি ও সুন্দর৷ তার বেশবাশের বর্ণনায় লেখক সেই সৌন্দর্যকে আরও বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন—‘‘কৃষ্ণতার নয়নের নিম্নপ্রান্তে অতি সূক্ষ্ণ কজ্জলরেখা তাহার প্রচুরায়ত নয়ন যুগলের সমধিক শোভাবর্দ্ধন করিতেছে৷ পরিধানে প্রশস্ত সাঁচ্চাজরীর কাজ করা, সাঁচ্চা সল্মা-চুমকী বসান, ঘন নীলরঙ্গের পেশোয়াজ৷ উন্নত ও সুঠাম বক্ষোদেশে সবুজ রং-এর সাটিনের কাঞ্চলী৷ তাহার উপরে হরিদ্বর্ণের সূক্ষ্ণ ওড়না৷ টিকল নাসিকায় একটি ক্ষুদ্র নথ, একগাছি সরু রেশম দিয়া নথ হইতে কর্ণেও টানা-বাঁধা৷’’১৩ থিরোজাবাই-এর গাত্রবর্ণ চম্পক বর্ণ সদৃশ৷ নীল বর্ণের বসন পড়ে তার সৌন্দর্যরাশি অনন্ত শোভায় শোভামান৷ গণিকালয়ে যে অপরাধীরা অপরাধ করে আস্তানা নেয় তার গৃহে জুমেলিয়ার সাময়িক অবস্থান সে বিষয়ে দিক নির্দেশ করে৷

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) :

বাংলা উপন্যাসের জগতে আবেগ-ভাবালুতাকে আঁকরে ধরে আবির্ভূত হয়েছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ তিনি তার নিজস্ব ভালোলাগার-মন্দলাগার অনুভূতি দিয়ে সমাজ-সংসারকে দেখেছিলেন৷ সেই সেন্টিমেন্টলি আবেদন ও রোমান্টিক পরিমণ্ডলেই তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসের বিভিন্ন দেহজীবী নারীরা ঘৃণ্য দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থেকেও সহানুভূতির পেলব স্পর্শে অসামান্য হয়ে উঠেছে৷ বস্তুত নারীকে শরৎচন্দ্র চিরকালই শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেছেন তা থেকে দেহব্যবসায়ী, স্বৈরিণী, কলঙ্কিনী নারীরাও বাদ যায়নি৷ তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন কি ভয়ানক পরিস্থিতিতে নারীরা যৌনপেশার শিকার হয়—সমাজ পরিত্যক্ত হয়৷ তাঁর সেই উপলব্ধির রসে জারিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন উপন্যাসের কিরণময়ী, চন্দ্রমুখী, পিয়ারীবাই, কাত্যায়নীর মতো নারীরা৷

ক. চরিত্রহীন :

‘চরিত্রহীন’ শরৎচন্দ্রের ঝড় তোলা উপন্যাস৷ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে৷ এখানে তিনি কামনা-অধীর চরিত্রের জীবনচিত্র অঙ্কন করেছেন৷ কামনার তীব্রদাহ কীভাবে মানুষের নৈতিক ভারসাম্য নষ্ট করে, মূল্যবোধের অপসারণ ঘটায়, আদর্শবাদের সব মহিমাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে হৃদয়কে কীভাবে পাপের আবর্তে আকন্ঠ নিমজ্জিত করে তারই কাহিনি ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাস৷

উপন্যাসে প্রধান দুই চরিত্র সাবিত্রী এবং কিরণময়ী৷ তারা তাদের চারিত্রিক স্খলনের মধ্য দিয়ে সমাজে পতিতা৷ সরাসরি তারা দেহের দর না হাকলেও, ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে, লোভে-কামনায় চরিত্রভ্রষ্ট হয়েছে৷ দুজনের জীবনেই মর্মান্তিক এক দাহ, ভয়ঙ্কর এক শূন্যতা তাদের ভুলপথে নিয়ে গেছে৷ লেখকের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তারা সেই গ্লানি থেকে সরে আসতে পারলেও সমাজের চোখে তারা পতিতাই৷

সাবিত্রী :

সাবিত্রী বালবিধবা৷ নয় বছর বয়সে নিজের জ্ঞান হওয়ার আগেই তাকে বরণ করে নিতে হয়েছিল চরম বৈধব্য যন্ত্রণা৷ যৌবনের মদনানিলে রঙ লাগে তার মনে৷ স্বপ্ন দেখে সুখী জীবনের৷ ফলে বড় ভগ্নিপতি ভুবন মুখোপাধ্যায়ের প্ররোচনায় ঘর বাঁধার আশায় কুলত্যাগ করতে দ্বিধা করে না কুলীনকন্যা সাবিত্রী৷ কিন্তু ভুবনের উদ্দেশ্য ছিল অন্য৷ সে শুধু তাকে ভোগই করতে চায়৷ বিবাহ না করেই সম্পন্ন করতে চেষ্টা করে তার ভোগ পিপাসা৷ নিজের ভুল বুঝতে পারে সাবিত্রী৷ বিবাহের পূর্বে দেহ দিতে অস্বীকার করায় তার শরীরলোভী ভুবন মুখুজ্জে তাকে পরিত্যাগ করে৷ সে আশ্রয় নেয় এক ভাড়াবাড়িতে—ঝি মোক্ষদার সহায়তায়৷ তার বসবাস করা বাড়িটি আসলে এক বেশ্যালয়েরই নামান্তর৷ বিপিনের মতো লম্পট মদ্যপ যুবকেরা যেখানে অহরহ যাতায়াত করে, সেখানকার ভাড়াটিয়াদের মদ খাইয়ে বশ করে অকাতরে নিদ্রা যেতে পারে সাবিত্রীর ঘরে তার অবর্তমানে৷ মদ্যপ মোক্ষদার কথায় সেই প্রচ্ছন্ন দেহব্যবসার দিক উঠে এসেছে—‘‘আমারো একদিন ছিল লো, আমারো একদিন ছিল৷ আমিও একদিন চব্বিশ ঘন্টা মদে ডুবে থাকতুম! তুই তার জানবি কি—কালকের মেয়ে!’’১৪ ভুবন মুখুজ্জের সংস্পর্শ থেকে বাঁচতে গণিকা গৃহে ভাড়া থেকেও অন্যের বাড়িতে ‘ঝি গিরি’ করে তার দিনাতিপাত হতে থাকে৷ সেখানে পরিচয় হয় সতীশের সঙ্গে৷ সতীশের সাথে তার ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা, তার প্রতি সেবাপরায়ণতা সমস্ত কিছুই আসলে ‘‘এক মদ্যাসক্ত লম্পটের সঙ্গে এক কুলটা-বারবনিতা জাতীয় নারীর পারস্পরিক আসক্তির চেয়ে বেশি কিছু নয়৷’’১৫ কারণ সতীশের দৃষ্টিতে সে তার বাসাবাড়ির ঝি, সতীশ তার লম্পট চরিত্রের গুণে সহজেই তার প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে৷ মেসের রাখালবাবু থেকে উপেন্দ্র পর্যন্ত সেই হিসেবেই তাদের সম্পর্ককে দেখে৷

উপন্যাসে সাবিত্রীর আখ্যান শুরু করেছেন লেখক তার বর্ণনা দিয়ে—‘‘সাবিত্রী বাসার ঝি এবং গৃহিণী৷ চুরি করিত না বলিয়া খরচের টাকাকড়ি সমস্তই তাহার হাতে৷ একহারা অতি সুশ্রী গঠন৷ বয়স বোধ হয় একুশ-বাইশের কাছাকাছি, কিন্তু মুখ দেখিয়া যেন আরও কম বলিয়া মনে হয়৷ সাবিত্রী ফরসা কাপড় পরিত এবং ঠোঁট-দুটি পান ও দোক্তার রসে দিবারাত্রি রাঙা করিয়া রাখিত৷’’১৬ তার সঙ্গে সে যে সবার সাথে হেসে কথা বলতো এবং সতীশ নামক আরেক যুবক ভাড়াটের প্রতি একটু বেশি সহানুভূতি প্রকাশ করতো সেই বিবরণটিও লেখক দিতে ভোলেননি, যার মধ্য দিয়ে সতীশের সঙ্গে একটা আলাদা সম্পর্কের সূত্রপাত এবং তার রাঙা ঠোঁটের মধ্যে কামনা-বাসনার রঙিন ভাবনাকে পূর্বেই উৎসারিত করে দিয়েছেন রচনাকার৷ বিধবা কুলত্যাগিনী সাবিত্রীর প্রশ্রয়ে সতীশের মধ্যেও ধীরে ধীরে ভালোবাসার বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে৷ কিন্তু সাবিত্রী যে কিনা পুরুষের দ্বারা চরম প্রতারণার শিকার এবং পুরুষের প্রবৃত্তির সংযমহীনতাকে খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছিল; তার পুরুষের কোনো বাক্যেই আর তেমন কোনো বিশ্বাস থাকে না বা নিজের অধঃপতনে নিজেকেও তেমনি করে হীন প্রতিপন্ন করে সকলের খেলো করে ভাবতেও দ্বিধা নেই তার৷ তাই সাবিত্রীর সঙ্গে কথপোকথন কালে সাময়িক আবেগে সতীশ তার আঁচল টেনে ধরলে এবং পরবর্তী কালে তাতে নিজেকে সংকুচিত করে রাখলে সে সতীশকে বলে—‘‘আমার মত নীচ স্ত্রীলোকের আঁচল ধরে এই কি নূতন টেনেছেন যে, লজ্জায় একেবারে মরে যাচ্ছেন৷’’১৭ সাবিত্রীর মধ্যে পূর্ণ নারীসত্তা ছিল—তার প্রতিটি কোষ অযাচিত মমতায় পরিপূর্ণ৷ ত্যাগে-ভালোবাসায়-সেবায়-মমতায় সে অনন্যা৷ লেখক নানা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন যে সাবিত্রী দৈহিক ভাবে নষ্টা হয়নি, তার সেই পুণ্যফলেই সতীশের জীবনের মহৎ সাধনে ব্রতী হয়েছে৷ উপীনবাবুর দশহাজার টাকার বিনিময়ে রক্ষিতা হতে সে পারেনি৷ বিত্ত-বৈভবের মধ্যে নিজেকে সঁপে দেওয়ার চেয়ে সতীশের প্রতি উৎসর্গীকৃত প্রেমকে মহৎ জ্ঞান করে অন্যের বাড়িতে ‘ঝিগিরি’ করে জীবনধারণ করাকে শ্রেয় মনে করেছে৷ তার ভালোবাসা হৃদয়ের পবিত্রতম প্রস্রবন হয়ে সর্বদা তার মনকে সতেজ রেখেছে কিন্তু কখনোই তা আত্মহারা হয়ে আছড়ে পড়েনি প্রেমিকের সামনে বরং সতীশের দুর্বার আহ্বানকে উপেক্ষা করে গেছে শুধুমাত্র সামাজিক অপমান থেকে তাকে বাঁচাতে৷ পরিণামে দুজনেই কষ্ট পেয়েছে৷ সে কখনোই সতীশের সামনে ধরা দেয় নি—বার বার ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়ে তাকে বশে আনতে পারেনি সতীশ৷ তার সেবা সংযম দেখে মুগ্ধ হয়েছে কিন্তু মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ শব্দটাকে বের করতে পারেনি৷ তাই সতীশের একসময় মনে হয়েছে সাবিত্রী তাকে বড়শিতে গেঁথে খেলিয়ে চলছে৷ এবং এ নিয়ে তাকে কঠিন বাক্যবাণে বিদ্ধ করলে সাবিত্রী বলেছে—‘‘অসচ্চরিত্র! আমার মত একটা স্ত্রীলোককে ভালবেসে ভালবাসার বড়াই করতে তোমার লজ্জা করে না? যাও তুমি—আমার ঘরে দাঁড়িয়ে আমাকে মিথ্যে অপমান করো না৷’’১৮ প্রেমাস্পদকে অপমান করে দূরে ঠেলে দিয়ে লজ্জায় দুঃখে শেষ পর্যন্ত মূর্ছিত হয়ে গেছে সাবিত্রী নিজেই৷ সতীশ তাকে জলসেচন করে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলে সে বিনম্রভাবে তাকে অনুরোধ করে বলেছে—‘‘তোমার দেহটাকে ত তুমি পূর্বেই নষ্ট করেছ, কিন্তু সে না হয় একদিন পুড়েও ছাই হতে পারবে, কিন্তু একটা অস্পৃশ্য কুলটাকে ভালবেসে ভগবানের দেওয়া এই মনটার গালে আর কালি মাখিয়ো না৷’’১৯

সাবিত্রী সারাজীবন নিজের সঙ্গে লড়াই করে সতীশের প্রেমকে লাঞ্ছিত করে গেছে৷ নিজেকে দুশ্চরিত্র বিপিনবাবুর রক্ষিতা হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে সতীশের কাছে৷ যাতে সতীশ মনে-প্রাণে কলঙ্কিত না হয় তার সংস্পর্শে৷ আবার সতীশের মদ খাওয়া, বাগানবাড়ি গিয়ে গণিকাসঙ্গমে মত্ত হওয়া, নিজের প্রতি চরম অবহেলা সব কিছুকে নিজ হাতে নিয়ন্ত্রণ করে আর অদম্য ব্যক্তিত্ব দিয়ে তাকে বশ করে রেখেছে৷ সতীশের কাছে অপমানিত হয়ে কাশী চলে গেলে চাকর বিহারীকে বলে গিয়েছে সে সেখানে গিয়ে নিজের ঠিকানা অবশ্যই জানাবে যাতে সতীশের কোনো বিপদের সম্ভাবনা হলে সময় মতো তার কাছে চলে আসতে পারে৷ কিরণময়ী যখন সতীশের মুখে তার সমস্ত বৃত্তান্ত শুনেছিল তার নারীমন নিমেষেই বুঝে নিয়েছিল সত্যিকারের সাবিত্রীকে৷ তাই অভিমানহত হয়ে তার সঙ্গে ইহজন্মে সাক্ষাৎ করতে না চাইলেও দুঃখের দিনে অথবা বিপদের দিনে তার সাক্ষাৎ যে সে পাবেই সে কথা জোর দিয়ে বলতে পেরেছিল সতীশকে৷ সতীশকে সচেতন করতে বলেছে—‘‘তোমার নিজের চেয়েও সে তোমার অধিক মঙ্গলাকাঙ্ক্ষিণী, এ কথা যেন কোনদিন ভুলো না৷’’২০ সতীশের প্রতি তার গোপন ভালোবাসার সত্যস্বরূপটি যাতে সতীশের সামনে প্রকাশ হয়ে না পড়ে সে বিষয়ে সে চাকর বিহারীকেও শপথ করিয়ে নিয়েছে৷ অবশেষে সতীশ প্রবল অসুস্থতায় মৃত্যু মুখে পতিত হলে বিহারীর আহ্বানে কাশী থেকে ফিরে এসে সেবা শূশ্রূষায় তাকে ভরিয়ে দিয়েছে কিন্তু তার বিয়ের প্রস্তাবকে সে কোনোভাবে মেনে নেয়নি কারণ সে মনে করে তার দেহের শুচিতা নষ্ট না হলেও মনের দিক থেকে সে পবিত্র নয়—‘‘এই দেহটা আমার আজ্য নষ্ট হয়নি বটে, কিন্তু তোমার পায়ে দেবার যোগ্যতাও এর নেই৷ এই দেহ নিয়ে যে আমি ইচ্ছে করে অনেকের মন ভুলিয়েচি, এ ত আমি কোনমতেই ভুলতে পারব না! এ দিয়ে আর যারই সেবা চলুক, তোমার পূজা হবে না৷’’২১ শেষ পর্যায়ে যক্ষ্মারোগী উপেনের সেবার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সতীশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছে৷ মৃত্যুর পূর্বে উপন্যাসের চরিত্রবান যুবক উপেন্দ্র সাবিত্রীর চিরপূজ্য সতীশকে সরোজিনীর জন্য নির্বাচিত করে তাকে উপদেশ দিয়ে গেছে, যে দুর্ভাগ্য তাকে কুলত্যাগী করে কুলের বাইরে এনে ফেলেছে সে যেন আসক্তির বন্ধনে জড়িয়ে তার ভেতরে না যায়; চির দিন বাইরে থেকেই তাকে যেন বুকে আগলে রাখে৷ উপেনের কথায় সতীশের সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্য সাবিত্রীকে তার জীবনের সর্বোত্তম বস্তুটি পরিত্যাগ করতে হয়৷ প্রেমের আদর্শে কুলত্যাগিনী, পুরুষ ভোলানো এক নারী তার জীবনে চরম উৎকর্ষতা লাভ করে৷ সমাজ পতিতা হওয়ার কারণে সমাজ তাকে গ্রহণ না করলেও উপন্যাসের শেষে লেখকের কলমে তার কলুষমুক্তির স্বচ্ছ পথ আবিষ্কার হয়৷

কিরণময়ী :

কিরণময়ী উপন্যাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল চরিত্র৷ সে প্রথাসিদ্ধ গণিকা নয় তবে তার অভীষ্ট সিদ্ধি করতে গিয়ে সে হয়ে উঠেছে অঘটনপটিয়সী সমাজদূষক৷ উপন্যাসে কিরণময়ী অতৃপ্ত কামনা-বাসনাময় নারী৷ সে তার স্বামী মৃত্যুশয্যায় জেনেও পরিপাটী করে চুল বাঁধে, কপালে কাঁচপোকার টিপ পড়ে এবং তার ওষ্ঠাধরে হাসির রেখা কখনোই ম্লান হয় না৷ উপন্যাসের নীতিবান যুবক উপেন্দ্র অযত্নলাঞ্ছিত হারাণের রোগসজ্জা এবং তার স্ত্রীর সেইরূপ রূপের বাহার ফোটানোতে বিরক্ত হয়ে ওঠে৷ কিরণময়ী বুদ্ধিমতি, সকলের সঙ্গেই তার যুক্তিতর্কের সুন্দর ভাষণ শোনা যায়৷ দার্শনিকতা, নাস্তিক্য, নৈয়ায়িক বুদ্ধি, প্রথানুগ সতীত্ব এবং ত্যাগের বিরোধিতা তাকে অনন্য করে তুলেছে৷ স্বাভাবিক মানুষের মতো সে কামনা বাসনাকেও অস্বীকার করে না, তত্ত্বভাবের সঙ্গেও বিরোধিতা নেই আবার তাকে তত্ত্বসর্বস্বও বলা চলে না৷ স্বামী হারাণ তার তত্ত্বভারাক্রান্ত বিদ্যাচর্চা দিয়ে অবদমিত করে রেখেছিল কিরণময়ীর প্রথম যৌবনের দুরন্ত বাসনাকে৷ পরে সে অসুস্থ হয়ে শয্যা নিলে কিরণের সেই অবরুদ্ধ প্রবৃত্তির গর্জন তাকে দিশেহারা করে তোলে৷ তার স্বামীর ডাক্তার অনঙ্গের সঙ্গে অবৈধ প্রণয়পাশে আবদ্ধ হয়ে বাসনা চরিতার্থ করার উপায় খোঁজে৷ তাদের সাংসারিক অসচ্ছলতায় ছেলের প্রাণ ফিরে পেতে শাশুড়ি অঘোরময়ীও তাকে সেই দিকে অগ্রসর হতে মদত দিয়ে চলে; জীবনের সেই কামনার অবরুদ্ধ প্রাচীরে প্রথম আঘাত হানে উপেন্দ্র ও সতীশ৷ উপেন্দ্রর সুখী জীবনে তার স্ত্রী সুরবালার কর্তৃত্ব অথবা বলতে গেলে উপেন্দ্র-সুরবালার মধুর দাম্পত্য সম্পর্ক তার মধ্যে নুতন ভাবনার বীজ বপন করে৷ সে স্বামীকে অবহেলার মধ্য দিয়ে যেভাবে উপেন্দ্রর বিরক্তি আদায় করেছিল ঠিক সেই ভাবে পতিব্রতা সাধ্বীর মতো নিজেকে উজাড় করে দেয় তার সেবায়৷ তার অক্লান্ত স্বামীসেবা দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় উপেন্দ্র৷ স্বামীর আসন্ন মৃত্যু সামনে জেনেও ধীর স্থির ভাবে যেমন সেই বিপদের মোকাবিলা করতে পারে তেমনি শ্রান্ত ক্লান্ত উপেন্দ্রকেও বিশ্রামের অবসর করে দেয়৷ যে কিরণময়ীকে প্রথম সাক্ষাতে উগ্রস্বভাব কঠিনমূর্তির নারী হিসেবে দেখেছিল সেই কিরণময়ীর শান্ত স্নিগ্ধ মূর্তি উপেন্দ্রর মনে আলোড়ন তোলে৷ তাই সে মনে মনে স্বীকার করে ‘‘স্ত্রীলোক সম্বন্ধে তাহার জ্ঞানের মধ্যে মস্ত ভুল ছিল৷ এমন নারীও আছে, যাহার সম্মুখে পুরুষের অভ্রভেদী শির আপনি ঝুঁকিয়া পড়ে৷ জোর খাটে না, মাথা অবনত করিতে হয়৷ এমনি নারী কিরণময়ী৷’’২২ উপেনকে দেখে কিরণময়ী নারীহৃদয়ের অন্তস্থলের সত্যিকারের প্রেমকে উপলব্ধি করতে পেরেছিল৷ সেই প্রেমে গদ গদ হয়ে অদৃশ্য ঈর্ষায় কাতর হয়ে পড়ে তার প্রতি৷ অসামান্য রূপবতী কিরণময়ী তাই নিজের প্রণয় প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে নিজের অজ্ঞাতেই নিজেকে টেনে এনে হাজির করে৷ উপেন্দ্র-সুরবালার দুষ্টুমিপূর্ণ দাম্পত্য এবং সতীশের মুখে তাদের দাম্পত্যের সুগভীর রসাস্বাদ তাকে উপেন্দ্রর দিকে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়৷ সে পরম যত্নে স্বামীকে হারিয়েও সেই সদ্য বৈধব্যের ম্লানিমাকে উজ্জ্বলরূপ দান করে নব প্রেমের বিভায়৷

কিরণময়ীর মধ্যে বরাবরই কাজ করেছে সুবৃহৎ তর্কপ্রবণতা৷ সে তার নিজের যুক্তি-বিচার-বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সর্বদাই তার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে প্রস্তুত৷ তার ভেতরে অদম্য সাহসিকতা সেই শক্তির জোগানদার৷ সেই সাহসিকতার জোরেই সে প্রণয় নিবেদন করে উপেন্দ্রকে৷ তাকে তার নিজের জীবন যন্ত্রণা শোনাতে গিয়ে জানায় অনঙ্গ ডাক্তারের প্রতি দুর্বলতা৷ সে দুর্বলতা মনের নয় শরীরের অপরিতৃপ্ততার৷ সে তার সেই কলঙ্কের কথা অকপটে স্বীকার করে উপেন্দ্রকে বলে—‘‘তবু ত সেই অনঙ্গ ডাক্তারকে তুমি চেন না৷ চিনলে বুঝতে পারতে, কত বৎসরের দুর্দান্ত অনাবৃষ্টির জ্বালা আমার এই বুকের মাঝখানে জমাট বেঁধে ছিল বলেই এমন অসম্ভব সম্ভব হতে পেরেছিল৷ কি জানো ঠাকুরপো, যে তৃষ্ণায় মানুষ নর্দমার গাঢ় কালো জলও অঞ্জলি ভরে মুখে তুলে দেয়, আমারও ছিল সেই পিপাসা৷’’২৩ বহু দিনের উপোসী কামনা তাকে অনঙ্গ ডাক্তারের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল৷ তার সেই বিষাক্ত প্রেমানুভূতিতে কিরণময়ীকে আজও শিউরে উঠতে হয়৷ সংসারে অর্ধেক ভার বহন করতে রাজী হয়েছিল সেই ডাক্তার শুধুমাত্র তার অনুগ্রহ পাবে বলে৷ ক্রমে তার প্রতি বিরক্তি জন্মালেও শাশুড়ির তৎপরতায় সে তার থেকে মুক্তি পায়নি৷ নিজের স্বার্থের জন্য শাশুড়ি পুত্রবধূকে কীভাবে পরপুরুষের লালসায় সমর্পণ করতে পারে তারই নির্দেশক কিরণের এই বক্তব্য৷ কিরণময়ী সেই পথ থেকে সরে যাওয়ার অনেক পথ খুঁজেছে কিন্তু পায়নি৷ শেষে উপেন্দ্রকে দেখে তার জীবনের সমস্ত লোভ অপসারিত হয়েছে৷ তার প্রাণতুল্য গহনা যত ছিল তা অনঙ্গের পায়ে ছুড়ে দিয়ে সে তার স্বামীর চিকিৎসার দেনা মিটিয়েছে, নিজের শরীরকে রক্ষা করেছে৷ কিরণময়ী তার উদ্ধারকারী হিসেবে বার বার উপেন্দ্রকে অভিনন্দিত করে৷ সে অকপটে তার মনের সেই গোপন সত্যটিকে তার সামনে প্রকাশ করে দিলে উপেন্দ্রর মুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে যায়৷ কিরণময়ী এ বিষয়ে তাকে মৃদু তিরস্কার করে জানায় ছেলে মানুষকে লজ্জা পেতে নেই৷ এবং তার মনের কথা তাকে জানিয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বলে—‘‘যাক, তোমাকে যে ভালবাসি তা জানিয়ে দিয়ে আমি বাঁচলুম৷’’২৪ কিরণময়ী তার ঔদার্য, তার চিন্তাভাবনা দিয়ে জয় করতে পেরেছিল উপেন্দ্রকে৷ নারীর প্রণয়ই যে পুরুষের পরম সম্পদ! উপেন্দ্রও সেই সুন্দরী বিদুষী নারীর মুখে স্পষ্ট প্রণয়সম্ভাষণ শুনে গলে গিয়েছিল বললে অতুক্তি হবে না৷ কারণ সে সময় তার মুখে কোনোভাবেই কিরণের প্রতি তিরস্কার বা কোনো কঠিন বাণী উচ্চারিত হয়নি৷ বরং পরম ভরসায় তাকে বিশ্বাস করে তার অত্যন্ত আদরের পোষ্য ভাতৃতুল্য দিবাকরকে তার হাতে তুলে দিয়েছে দেখাশোনা করার জন্য৷ কিন্তু কিরণ তো উপেনের কাছে এমন অনুগ্রহ চায়নি৷ সে চেয়েছিল তার বিদ্যা বুদ্ধি রূপ দিয়ে তাকে সুরবালার প্রভাব মুক্ত করতে৷ আর সেই সময়ই ঘটে দুর্ঘটনা৷ উপেন্দ্র দিবাকরকে তার তত্ত্বাবধানে রেখে কলকাতায় গেলে সে তার চটুল যুক্তি-বাক্য-ব্যবহারে ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে দিবাকরকে৷ অবশেষে দিবাকরকে নষ্ট করবার অভিযোগে তাকে অপমানিত করে উপেন্দ্র৷ কিরণ তার চরিত্র বলে দিবাকরকে মুগ্ধ করেছিল ঠিকই কিন্তু প্রণয়জালে আবদ্ধ করেনি—করার সংকল্পও করেনি৷ শাশুড়ি, বাড়ির ঝি এবং উপেনের তিরস্কারে আহত সর্পিণীর মতো সে গর্জে উঠে৷ চরম তিক্ততায় উপেনকে বলে—‘‘তোমার রাগ বল, ঘৃণা বল ঠাকুরপো, সমস্ত দিবাকরকে নিয়ে ত? কিন্তু বিধবার কাছে সেও যা, তুমিও ত তাই৷ তার সঙ্গে আমার সম্বন্ধটা কতদূর গিয়ে দাঁড়িয়েচে, সেটা শুধু তোমাদের অনুমান মাত্র৷ কিন্তু সেদিন যখন নিজের মুখে তোমাকে ভালবাসা জানিয়েছিলুম, তখন ত আমার দেওয়া খাবারের থালাটা এমনি করে ঘৃণায় সরিয়ে রাখোনি! নিজের বেলা বুঝি কুলটার হাতের মিষ্টান্নে ভালবাসার মধু বেশী মিঠে লাগে ঠাকুরপো?’’২৫ উপেন্দ্রর জন্য কিরণময়ী খাবার নিয়ে এলে দিবাকরের সঙ্গে সম্পর্ক অনুমান করে তার ছোঁয়া খাবারে ঘৃণায় অবহেলা করলে চরম অপমানে উপেন্দ্রর পৌরুষকে চরমভাবে বিদ্ধ করতে থাকে সে৷ আর সেই আসন্ন অপমানের প্রতিশোধ নিতে ঝি কে হাত করে দিবাকরকে সঙ্গে নিয়ে সকলের মুখে কালি ছিটিয়ে আরাকানে যাত্রা করে৷ সেখানে যাত্রাকালে জাহাজে পরিচিত হয় আরাকানের বাসিন্দা এক বাড়িউলির৷ সে তাদের কাছে প্রতিশ্রুত হয় কম দামে ঘর ভাড়া দেওয়ার এবং দিবাকরকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার৷ জাহাজের কেবিনে বসে কিরণময়ী তার উষ্ণ চুম্বন দান করলে বৌঠানের সঙ্গে দেশ ত্যাগের কালিমায় দিবাকরের তা বিষাক্ত মনে হয়৷

তারপরে ধীরে ধীরে লক্ষ্য করা যায় দিবাকরের প্রতি তার তীব্র অনিহা৷ সে তার সংযম দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে রাখে৷ ধীরে ধীরে দিবাকর তাকে ভালোবাসতে আরম্ভ করলেও সে প্রণয়ে সংকুচিত হয়ে পড়ে; তাদের সম্পর্ক চরম তিক্ততায় পর্যবসিত হয়৷ পারিপার্শ্বিক পরিবেশের চাপে তাদের জীবনধারাও পাল্টে যায়৷ তারা আরাকানে গিয়ে যে বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল তা যে আসলে একটা গণিকাগৃহ তার মালকিনের বর্ণনা এবং সেখানকার পরিবেশ সে চিত্রকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত করে৷ এবং শেষে দেখা যায় কিরণময়ী গণিকা হতে হতে বেঁচে যায়৷ তখনো তার দেহলোভীবাবু তার বিছানায় বসে প্রণয় প্রতিক্ষা করছে আর চরম অপমানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় কিরণের মূর্ছা প্রাপ্তি হয়েছে৷ সেই মুহূর্তে সতীশ তাদের আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার করে৷ উপেনের অসুস্থতার বার্তা দিতে সে উপস্থিত হয়েছে তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য৷ কিরণময়ী সেই সংবাদ শুনে পুনরায় মূর্ছা গেলে দিবাকরের বুঝতে অসুবিধা হয় না কেন তাকে কিরণ এতদিন ধরে উপেক্ষা করে এসেছে৷ সে তাই কিরণময়ীর সংজ্ঞাহীন দেহটার কাছে গিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরে বলে—‘‘আমি সমস্ত বুঝেচি বৌদি, তুমি আমার পূজনীয়া গুরুজন, তবে, কেন এতকাল গোপন করে আমাকে নরকে ডোবালে৷’’২৬ কিরণময়ী তার প্রেমের অপমান সহ্য করতে পারেনি তার বাঞ্ছিতের কাছ থেকে, তাই তার প্রতিশোধ নিতে তার প্রিয়জনের সর্বনাশ করেছে৷ উপন্যাসের শেষে তার জন্য অপার দয়া বর্ষিত হয়েছে৷ প্রেমিকের আসন্ন মৃত্যুর ভাবনা তাকে উন্মাদ করে ফেলেছে৷ সে তার লোভে কামনায় ঈর্ষায় যথার্থ স্বৈরিণী নারী হয়ে উঠেছে৷ যদিও লেখক বার বার প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন সাবিত্রীর মতো কিরণময়ীরও দৈহিক শুচিতার কথা৷ কিন্তু বহুদিনের অপার পিপাসা যাকে অনঙ্গের প্রতি ধাবিত করেছিল, সুরবালার সতীত্বকে পরাজিত করতে প্রণয় সম্ভাষণ করেছিল উপেন্দ্রকে এবং পরিশেষে জাহাজের কেবিনে যে নারী তার উষ্ণ চুম্বন নিবেদন করতে পিছপা হয়নি সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত যুবক দিবাকরকে; যে দিবাকর কিনা কিছু না জেনেবুঝেই তার সঙ্গে তার কথামত আরাকানে পাড়ি দিয়ে সমস্ত কলঙ্ককে মস্তকে ধারণ করেছিল৷ সেই কিরণময়ী সুদীর্ঘকাল একই ঘরে তার সঙ্গে পারস্পারিক সহবাসের মধ্যে কতটা শুচিতা রাখতে পারে তা সন্দেহের বিষয়৷ যাই হোক কিরণময়ীকে স্বৈরিণী নারী হিসেবে বিবেচিত করা যেতে পারে৷

কামিনী বাড়িউলি :

লেখক বেশ ফলাও করে আরাকানের কামিনী বাড়িউলির ব্যবসাকে বর্ণনা করেছেন৷ সে নিজে একজন গণিকা এবং বেশ্যালয়ের কর্তৃ৷ তার বাড়িটি আসলে একটা বেশ্যালয়৷ সে জানায় আরাকানে সে বিশ বছর ধরে আছে৷ উপন্যাসে বাড়িউলির বিবরণ দেওয়া হয়েছে এইভাবে—তার কথা বাঁকা বাঁকা, কপালে উলকি, সীমন্তে মস্ত সিঁদুরের দাগ, দুই কানে বিশ-ত্রিশটা মাকড়ি, নাকে নথ৷ বাড়িউলি দিবাকরকে কিরণের স্বামী ভেবে জাহাজে বসেই তার সঙ্গে বাড়ির দাম-দর করে নিয়ে তবে তাদের রেহাই দেয়৷

কিরণময়ী রূপবতী৷ প্রথম থেকে তাকে কাজে লাগানোর জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ে সেই বাড়িউলি৷ সে এক মাড়োয়ারি বাবুর কাছ থেকে টাকা খেয়ে তাকে প্রলোভিত করার চেষ্টায় থাকে৷ দিবাকরের সামনে সেই মাড়োয়ারি বাবুর আসক্তির কথা প্রকাশ করলে তা নিয়ে যখন সে নিজের সংযম হারিয়ে কিরণকে কঠিন বাক্য দ্বারা পীড়িত করে তার জবাব দিয়ে বাড়িউলি বলে—‘‘আমরা হলুম সুখের পায়রা—বেবুশ্যে! যেখানে যার কাছে সুখ পাব, সোনা-দানা পাব, তার কাছেই যাব৷ এতে লজ্জাই বা কি, আর ঢাকাঢাকিই বা কিসের জন্য!’’২৭ বাড়িউলি কামিনী পাকা ব্যবসায়ী৷ সে তার যৌনপেশাকে কারও কাছে রাখঢাক করে রাখতে চায় না৷ তাছাড়া অর্থ ও সম্পদে অসাধারণ কর্তৃত্ব তার৷ দিবাকর তার কথায় সম্বিত হারিয়ে সেই অন্ত্যজ গণিকার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া শুরু করে দেয় এবং কিরণ তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভেবে তাকেও আঘাত করে৷ কিরণময়ী তার জন্য দিবাকরকে কামনায় পীড়িত বুঝে তাকে অনুরোধ করে সম্মুখস্থ কালীবাড়ীতে পাঠিয়ে দেয় আপাত রাত্রিবাসের জন্য৷ পরদিন দিবাকরের অনুপস্থিতির অবসরে আবার তার সামনে চুপি চুপি এসে উপস্থিত হয় সেই কামিনী বাড়িউলি৷ সে নানাভাবে প্রলোভিত করতে থাকে তাকে৷ সে তাকে উপদেশ দিয়ে বলে—তার মতো নারীদের জীবনের মূল কথাই হল—‘‘খাও, পরো, মাখো, সোনা-দানা গায়ে তোলো, সঙ্গে সঙ্গে পীরিতও কর৷’’২৮ অর্থাৎ তাদের ভালোবাসায় মনোবৃত্তির কোনো স্থান নেই সেখানে শুধু প্রযোজ্য অর্থ আর অলঙ্কার এবং দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য৷ সে তাকে আরও বোঝায় যে তার সেই বয়সটাই হল পীরিত করবার বয়স৷ সে তার ‘সোমত্ত’ বয়সটাকে শুধু দুহাতে লুটেপুটে উপভোগ করবে, করবে ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়৷ তবেই রানি হয়ে সেই সম্পদ নির্বিঘ্নে উপভোগ করতে পারবে সুদূর ভবিষ্যতে৷

বাড়িউলি তার কৌশল খাটিয়ে কিরণের জন্য খদ্দেরও জোগাড় করে ফেলে৷ কিরণকে সে কথা জানিয়ে সে বলে—‘‘খোট্টা মিনসেকে ত সকালেই খবর পাঠিয়েছিলুম৷ ব্যাটার আর তর সয় না, বলে, লোকজন কাজে বেরিয়ে গেলে দুপুরবেলাতেই আসব৷’’২৯ সে তার ঘরে কোনো পরপুরুষ তার দেহের লোভে খদ্দের হয়ে আসবে ভেবে সন্ত্রস্ত হয়ে গেলে তার সেই ভাব দেখে হেসে গড়িয়ে পড়ে বাড়িউলি৷ সে কিরণকে তার সমগোত্রীয় করে পরম আত্মীয়তায় ‘তুই’ সম্বোধন করে বসে৷ তার সেই কথার স্পষ্ট ইঙ্গিত কিরণময়ীকে তীরের মতো বিদ্ধ করতে থাকে কিন্তু ভদ্রতার বশে চুপ করে থাকলে বাড়িউলি আপন ঝোকেই তাকে বলে—‘‘তুই দেখিস দিকিন বৌ, ছ’মাসের মধ্যে যদি না তোর বরাত ফিরিয়ে দিতে পারি ত, আমার কামিনী বাড়িউলী নাম নয়৷ তুই শুধু আমার কথামত চলিস—আর আমি কিছুই চাইনে৷’’৩০ বাড়িউলি তার সুদক্ষ বাক্যজালে কিরণের জন্য ঠিক করা খদ্দেরের অর্থ, যশ, প্রতিপত্তি জাহির করে—তার রূপের প্রশংসা করে তাকে তৈরি করার চেষ্টা করে—কিন্তু তাতে আপত্তি করে কিরণ জানায়, তার ঘরে যেন না আসে কেউ৷ সে কথায় অবাক হয়ে সেই বাড়িউলি বলে—‘‘তুই ত আর কারো কুলের বৌ ন’স! মানুষ-জন তোর ঘরে আসবে, বসবে, তাতে ভয়টা কাকে শুনি? তুই হলি বেবুশ্যে৷’’৩১ বাড়িউলির মুখে বেবুশ্যে বা বেশ্যা সম্বোধন শুনে কিরণের আত্মজ্ঞান বিলুপ্ত হয়ে যায় আর সেই অবসরে সেই মাড়োয়ারি খদ্দের তার গৃহে উপস্থিত হলে সমস্ত সহিষ্ণুতা হারিয়ে মূর্ছিত হয়ে যায় সে৷ বাড়িউলির চিৎকারে তাকে সুস্থ করার জন্য সকলে ছোটাছুটি শুরু করে দেয়৷

এই বাড়িউলি চরিত্রকে একবারে বাস্তবসম্মতভাবে উপস্থাপিত করেছেন লেখক৷ শিক্ষা সংস্কার বর্জিত এই অন্ত্যজ গণিকা তার যথার্থ দোসর বানাতে নানা রকম প্ররোচনামূলক বাক্য প্রয়োগ করে কিরণের উদ্দেশ্যে তা যথার্থই তার চরিত্রপোযোগী৷ একজন নারীকে গণিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে আখেরে যে তারই লাভ সেই দিকটিকেও লেখক তার লোলুপ মনোবৃত্তির মধ্যে প্রকাশ করেছেন৷ বাড়িউলি সেই মারোয়ারি খদ্দেরকে কিরণময়ীর ঘরে প্রবেশ করাতে করাতে আবদার রাখে তার বাড়িটি মেরামত করে দেওয়ার জন্য৷ অর্থাৎ নিজে হাতে গণিকা তৈরি করে তাকে কাজে লাগিয়ে দু-পয়সা উপার্জন করার প্রচেষ্টা যে বাড়িউলিদের মধ্যে সদা জাগ্রত থাকে তাও লেখকের দৃষ্টি এড়ায়নি৷

খ. দেবদাস :

‘দেবদাস’ (১৯১৭) উপন্যাসের অন্যতম গণিকা চরিত্র চন্দ্রমুখী৷ সে উপন্যাসের আসল নায়িকা নয়—সহনায়িকা৷ তথাপি লেখক এই বারবিলাসিনী নারীটিকে তাঁর অপার সহানুভূতি দিয়ে গড়ে চরিত্রমহিমায় নায়িকার সমকক্ষ করে দিয়েছেন৷ এই চরিত্র চিত্রণে শরৎচন্দ্রের আধুনিক বাস্তববাদী অথচ রোমান্টিক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে৷ এখানে চন্দ্রমুখীর দেহব্যবসায়ী হওয়ার কোনো ইতিহাস ব্যক্ত করেননি, চেষ্টাও করেননি তার দৈহিক শুচিতা প্রমাণের৷ শুধু দেবদাসের সঙ্গে তার কথার ছলে নিজের পূর্বজীবন সম্পর্কে একটুখানি কথা তার মুখে তুলে ধরেছেন—‘‘সে আজ দশ বছরের কথা—যখন আমি ভালবেসে ঘর ছেড়ে চলে আসি৷ তখন মনে হতো কত না ভালবাসি, বুঝি প্রাণটাও দিতে পারি৷ তারপর একদিন তুচ্ছ একটা গয়না নিয়ে দু’জনের এমনি ঝগড়া হয়ে গেল যে, আর কখনো কেউ কারো মুখ দেখলাম না৷’’৩২ তার পরের কথা স্পষ্টতই বোঝা যায় তার বর্তমান অবস্থা দেখে৷ চন্দ্রমুখী গণিকা হয়ে তার পরবর্তী জীবন অতিবাহিত করেছে৷ সে তার সেই গণিকাজীবনের মাঝখানে দেবদাসকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবেসেছে কিন্তু সেই ভালোবাসা একপাক্ষিক৷ দেবদাসের প্রবল ঘৃণার মধ্য দিয়ে তার সত্যিকারের প্রেমে অভিষেক ঘটেছে৷ তাই সে তাকে বলতে পেরেছে যে যেদিন কৈশোরের কাঁচা প্রেমকে সামান্য গয়নার কারণে অনায়াসে পরিত্যাগ করে চলে এসেছিল সেদিন তার জানা ছিল না সীতা-দময়ন্তীর ব্যথা, বিশ্বাস করতো না জগাই-মাধাই-এর কথা এবং সেদিন তার ধারণার মধ্যেও ছিল না প্রেমাস্পদের সামান্য একটু মাথাধরা সারাতে গিয়েও অকাতরে নিজের প্রাণটা পর্যন্ত বিসর্জন দেওয়া যায়৷

উপন্যাসের আরেক চরিত্র চুনিলাল মদ্যাসক্ত এবং বেশ্যাভক্ত৷ তার সঙ্গেই প্রথম পার্বতী বিরহের বেদনাভুলতে দেবদাস উপস্থিত হয়েছিল চন্দ্রমুখীর দরজায়৷ এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞতাহীন দেবদাস তার গৃহে উপস্থিত হলে গণিকা নারীর সংস্পর্শজনিত প্রবল ঘৃণায় সর্বাঙ্গ জ্বলে উঠে তার৷ সেই নিবিড় ঘৃণা গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের মতো চোখের ভ্রূকুটির মধ্যে দিয়ে বেড়িয়ে আসে তার মুখে—‘‘চুনিবাবু, এ কোন হতভাগা জায়গায় আনলে?’’৩৩ সেই বাক্যবাণে হতভম্ব হয়ে যায় চুনি ও চন্দ্রমুখী৷ নিজেকে সামলে চুনি তাকে চন্দ্রমুখীর ঘরে নিয়ে বসায়৷ সেখানে সেই বাক্যহীন পরিবেশে কারও মুখে কোনো কথা জোগায় না৷ দেবদাসের প্রচণ্ড ঘৃণা যেন সবকিছুকে চেপে ধরে থাকে৷ আর চন্দ্রমুখী যাকে ইতিপূর্বে কেউ কখনো কথায় ঠকাতে পারেনি, কখনো নিজের কৌশলীবুদ্ধি দিয়ে কারও কাছে অপ্রতিভ হয়নি, তার অন্তরের মধ্যে দেবদাসের আন্তরিক ঘৃণা এবং কঠোর উক্তি প্রবল আঘাত হানে৷ সেও জীবনে প্রথম হতবুদ্ধি হয়ে বসে থেকে গড়গড়ায় তামাকু সেবন করতে থাকে৷ চুনিলাল সেই অস্বস্তিকর পরিবেশ থেকে কাজের অছিলায় বেড়িয়ে গেলে অনেকক্ষণ পর দেবদাস চন্দ্রমুখীকে জিজ্ঞেস করে, সে টাকা নেয় কি না৷ হঠাৎ তার সেই কথায় কোনো উত্তর জোগাড় হয় না চন্দ্রমুখীর মুখে৷ তার চব্বিশ বছর বয়স হয়েছে, গণিকা জীবনের নয়-দশ বছর সময়ের মধ্যে বিভিন্ন প্রকৃতির লোকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছে কিন্তু দেবদাসের মত অমন আশ্চর্য মানুষ সে একটিও দেখেনি, তাই একটু ইতস্তত করে সে যখন বলে—‘‘আপনার যখন পায়ের ধূলো পড়েচে—’’৩৪ তার মুখের কথা শেষ করতে না দিয়েই দেবদাস পুনরায় সেই টাকার কথা জিজ্ঞেস করলে সে স্পষ্টভাবে স্বীকার করে৷ কারণ টাকা না হলে তাদের চলবে কি করে৷ সঙ্গে সঙ্গে সে একটা নোট দিয়ে তার ঘর থেকে বেড়িয়ে যায়৷ চন্দ্রমুখীর ইচ্ছে হচ্ছিল সেই টাকা তখনি ফিরিয়ে দেয় কিন্তু সংকোচের বশে তা আর পারে না৷ নিস্পন্দের মতো চৌকাঠ ধরে শুধু দাঁড়িয়ে থাকে৷ পরে চুনি ফিরে এলে তাকে অনুরোধ করে দেবদাসের টাকা তার হাতে ফিরিয়ে দিতে কিন্তু চুনিও রাজী হয় না৷ সে চুনির মুখে আভাস পায় দেবদাসের ভিতরের অব্যক্ত যন্ত্রণার৷ তাই চুনিকে সে মাথার দিব্যি দিয়ে রাজী করায় আরেকবার দেবদাসকে তার ঘরে আনার জন্য৷

চুনি চন্দ্রমুখীর রোজকার অতিথি৷ তার হাত ধরে দেবদাস পুনরায় উপস্থিত হয় চন্দ্রমুখীর ঘরে৷ আকন্ঠ মদে নিমজ্জিত হয়ে যতক্ষণ পর্যন্ত তার জ্ঞান লোপ না পায় ততক্ষণ চন্দ্রমুখীর প্রতি ঘৃণা বর্ষণ করতে থাকে৷ তারপর যখন নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে শান্ত হয়ে যায় তার প্রলাপ তখন পরম মমতায় সেই বহুপুরুষবিনোদিনী চন্দ্রমুখী তার কাছে গিয়ে বসে, আঁচল ভিজিয়ে মুখ মুছিয়ে দেয়, মাথার ভেজা বালিশ পাল্টে দেয়৷ শেষে পাখা নিয়ে বাতাস করতে করতে অবরুদ্ধ এক যন্ত্রণায় গুমরে মরতে থাকে৷ দেবদাসকে দেখে সে দুঃখ পেয়েছে, করুণা অনুভব করেছে এবং সেই ছিদ্রপথ বেয়েই দানা বেঁধেছে তার প্রতি নিষ্কলুষ ভালোবাসা৷ আর ভালোবাসার জোরেই নিজের বহুদিনের পুরোনো পেশা ছেড়ে বরণ করে নিয়েছে দুঃখ কষ্টময় সাধারণ জীবন৷ দেবদাস পিতৃশ্রাদ্ধ সমাপন করে পুনরায় চন্দ্রমুখীর গৃহে উপস্থিত হয়ে দেখেছে তার গৃহের সেই জৌলুস লুপ্ত৷ অনেকক্ষণ ধরে ডাকাডাকির পর ভেতর থেকে উত্তর আসে ‘এখানে নয়’৷ চন্দ্রমুখী তার কোনো দেহলোভী ভ্রমর ভেবে ‘এখানে নয়’ বলে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে পুরুষ গ্রাহকদের৷ অর্থাৎ সে যে আর গণিকা হিসেবে নিজেকে হেয় করতে চায় না৷ কিন্তু পরক্ষণে যখন জানতে পারে সে-ই দেবদাস তখন সাগ্রহে দরজা খুলে দেয়৷ দেবদাসের তার কন্ঠস্বর পরিচিত মনে হলেও সেই দ্বার খুলে দেওয়া নারীটিকে চিনতে পারে না৷ তারপর উপরে গিয়ে বিস্মিত হয়ে যায় চন্দ্রমুখীর বেশভূষা দেখে৷ তার পরণে কালোপেড়ে ধুতি, দুহাতে দুগাছি বালা, মাথার চুল এলোমেলো, শরীর পূর্বের তুলনায় কৃশ৷ ঘরের ভিতরে একটিও আসবাব অবশিষ্ট নেই৷ দেবদাস এসবের কিছুই বুঝতে পারে না৷ সে নানা কথা জিজ্ঞেস করে আসল ঘটনা জানার জন্য৷ চুনিবাবুর সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে তার সঙ্গে দুমাস ধরে চন্দ্রমুখীর কোনো যোগাযোগ নেই৷ চুনিবাবু চন্দ্রমুখীর উপপতি করার জন্য একজন বাবু ধরে এনেছিল, সে তাকে মাসে দু’শ করে টাকা একরাশ অলঙ্কার এবং সুরক্ষার জন্য একজন সিপাই দিতে রাজী ছিল৷ চন্দ্রমুখী চুনিবাবুর আনা সেই বাবু এবং তাকে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে৷ অতবড় সুযোগ সে শুধু হেলায় অবহেলা করেছে দেবদাসকে ভালোবেসে৷ সব কিছু বিক্রয় করে নয়শত টাকা সম্বল ছিল তার৷ এক দোকানির কাছে তা জমা দিয়ে মাসে মাসে কুরি টাকা করে সে পায়৷ তা দিয়েই জীবনধারণের চেষ্টা করে গেছে চন্দ্রমুখী৷ যে দীর্ঘ দিন আরাম-আয়েস বিলাসিতায় রানির মতো জীবন কাটাতে অভ্যস্ত তার কুড়ি টাকায় জীবন চালানোর কথা শুনে অবাক হয়ে গেছে দেবদাস এবং তার সেই বিস্ময় আরও বেড়ে যায় যখন সে শোনে চন্দ্রমুখী শুধু তাকে দেখার জন্য সেই শ্রীহীন বাড়িতে শ্রীহীন হয়ে উন্মুখ অপেক্ষায় বসে আছে৷ সে দেবদাসের প্রতি নিঃস্বার্থ প্রেমকে একবার দেখাতে চায় দেবদাসকে৷ হয় তো তার গণিকা জীবনে অভ্যস্ত যে নারীসত্তা বহুদিন ভালোবাসা বেচা-কেনার মধ্যে দিয়ে সময় অতিবাহিত করে এসেছে আর যখন সত্যিকারের ভালোবাসার স্বাদ পেয়েছে তা প্রেমাস্পদকে না জানিয়ে থাকতে পারেনি৷ সে তার সেই প্রেমানুভূতিকে প্রেমাস্পদের কাছে ব্যক্ত করার সুযোগটিকেও হারাতে চায় না কারণ এর পূর্বে দেবদাসকে কখনো সজ্ঞানে পায়নি৷ যতক্ষণ তার জ্ঞান থাকতো ততক্ষণ তাকে ঘৃণা করে দূরে ঠেলে রাখত আর যখন জ্ঞান হারাত তখন নিজের কথা বলার মতো অবকাশ থাকতো না৷ আর আজ দেবদাস তাকে ঘৃণা না করে কাছে বসে দুটো কথা শুনছে সে কি করে তার ভেতরের দুর্বার প্রেমাবেগকে দমন করবে! সে দেবদাসকে জানিয়েছে দেবদাসকে একবার দেখার জন্য প্রতীক্ষায় থাকা তার একটা খেয়াল৷ সে প্রথম যখন একরাশ ঘৃণা নিয়ে তার সামনে উপস্থিত হয়েছিল তখন থেকেই চন্দ্রমুখী তার দিকে দৃষ্টি দিয়েছিল৷ সে ধনের আশায় তার দিকে আকৃষ্ট হয়নি৷ সে আকৃষ্ট হয়েছে তার তেজ দেখে৷ সে এসে তাকে প্রথম আঘাত করে তার অযাচিত রুঢ় ব্যবহার দিয়ে, ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে থেকে শেষে তামাশার মতো একটা নোট দিয়ে কোনো কথা না বলে চলে যায় তখন চন্দ্রমুখীর মনে হয়েছিল দেবদাস সকলের চেয়ে আলাদা—‘‘সেই অবধি তোমার প্রতি দৃষ্টি রাখলাম৷ ভালবেসে নয়, ঘৃণা করেও নয়৷ একটা নূতন জিনিস দেখলে যেমন খুব মনে থাকে, তোমাকেও তাই কিছুতেই ভুলতে পারিনি—তুমি এলে বড় ভয়ে ভয়ে সতর্ক হয়ে থাকতাম, কিন্তু না এলে কিছুই ভাল লাগত না৷ তারপর আবার কি যে মতিভ্রম ঘটল—এই দুটো চোখে অনেক জিনিসই আর একরকম দেখতে লাগলাম৷ পূর্ব্বের ‘আমি’ র সঙ্গে এমন করে বদলে গেলাম—যেন সে ‘আমি’ আর নয়৷ তার পরে তুমি মদ ধরলে৷ মদে আমার বড় ঘৃণা৷ কেউ মাতাল হলে তার উপর বড় রাগ হত৷ কিন্তু তুমি মাতাল হলে রাগ হত না, কিন্তু বড্ড দুঃখ পেতাম৷’’৩৫ তারপর মাতাল দেবদাসের মুখে যেদিন গণিকার অপার যন্ত্রণার কথা উঠে আসে সেদিন থেকে সব ছেড়ে দেয় চন্দ্রমুখী৷ আর সে সম্পর্কে তার স্পষ্ট সিদ্ধান্ত—‘‘এ জীবনে ভালবাসার ব্যবসা অনেকদিন করেচি কিন্তু একটিবারমাত্র ভালবেসেচি৷ সে ভালবাসার অনেক মূল্য৷’’৩৬ দেবদাসকে ভালোবেসে সে শুধু তার সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়ে আড়ম্বরহীন জীবনযাপনকে বরণ করেই নেয়নি—নিজের কলঙ্কিত দেহের জন্য নিজেকেই ঘৃণা করতে শুরু করে দিয়েছে৷ নিজের সমস্ত কথা দেবদাসকে বলে নিজেকে হাল্কা করে শেষে তার পদধূলি নিয়ে নিজের তাগিদে সম্বলহীন হয়ে নিঃসঙ্গ চন্দ্রমুখী অশ্বত্থঝুরি গ্রামে ঘর বেঁধেছে৷ সে বিদায় কালে দেবদাসকে অনুরোধ করেছিল কোনোদিন যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তার মতো দাসীকে যেন মনে করে সে৷ সেখানে বহুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর দেবদাসের কোনো খোঁজ না পেয়ে উদ্বিগ্ন মনে সে উপস্থিত হয় তালসোনাপুর গ্রামে দেবদাসের বাড়িতে৷ কথার ফাঁদ পেতে বড়বৌ-এর কাছ থেকে সব খবর নিয়ে স্বেচ্ছাচারী অসুস্থ দেবদাসের খবর পাওয়ার জন্য কলকাতায় উপস্থিত হয়ে নকল গহনা-বস্ত্রাদিতে পুনরায় দেহের পসরা সাজায়৷ উদ্দেশ্য যদি ভ্রমক্রমেও সেখানে দেবদাস এসে উপস্থিত হয়৷ অচেনা লোকদের দুয়ার থেকে তাড়িয়ে দিয়ে চেনা লোকদের ডেকে ডেকে ঘরে বসায়৷ দেবদাসের কথা জিজ্ঞেস করে৷ অবশেষে দেড়মাস পর সন্ধান পায় দেবদাসের ৷ মদ্যপ, অসংলগ্ন কথাবার্তায়রত দেবদাসকে রাস্তা থেকে কুড়িয়ে ঘরে নিয়ে যায়৷ মাসাধিককাল শয্যাশায়ী দেবদাসকে সেবায় যত্নে চিকিৎসায় সুস্থ করে তোলে৷ সে যেভাবে তাকে বেশ্যা সেজে পথ থেকে কুড়িয়ে নিয়ে গেছে, যেভাবে অক্লান্ত সেবা করে সুস্থ করে তুলেছে মৃত্যুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে—তাতে তার ব্যক্তিত্ব ও বুদ্ধিমত্তাও প্রকাশিত হয়েছে৷ চন্দ্রমুখী বুঝেছিল যে যতই সে দেবদাসের দিকে দৃষ্টি রাখার চেষ্টা করুক কিছুতেই তাকে ধরে রাখতে পারবে না, সে অধিকার তার নেই৷ সে উশৃঙ্খল অনাচারী জীবন থেকে তাকে সরিয়েও আনতে পারবে না৷ নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে তার মন জয় করেছিল; ভালোবেসে বুকে টেনে না নিলেও বারবধূ চন্দ্রমুখী, দেবদাস তাকে আর ঘৃণা করতে পারেনি অন্তত৷ গণিকার নিঃছিদ্র ভালোবাসাকে স্বীকৃতি দিয়ে ‘বৌ’ ডেকে ধন্য করেছিল, যা চন্দ্রমুখীর প্রেমবুভুক্ষ অন্তরের সবচেয়ে বড় পাওয়া৷ চন্দ্রমুখী তার একপাক্ষিক ভালোবাসায় দেবদাসকে নিজের করে পাওয়ার মতো দুঃসাহস পর্যন্ত দেখায়নি কোনোদিন৷ দেবদাস যখন তাকে বলে যে মৃত্যুর পরে যদি কোনো মিলন থাকে তবে সেখানে সে চন্দ্রমুখীর থেকে দূরে থাকবে না৷ তার এইটুকু স্বীকারোক্তিতে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেয় নিম্নপেশাত্তীর্ণ চন্দ্রমুখী৷ ভগবানের কাছে শুধু প্রার্থনা করে—‘‘ভগবান, কোনকালে, কোন জন্মে যদি এই পাপিষ্ঠার প্রায়শ্চিত্ত হয়, আমাকে যেন এই পুরস্কার দিয়ো!’’৩৭ দেবদাস তার সদ্য আরোগ্যপ্রাপ্ত দেহটি নিয়ে বায়ুপরিবর্তনের জন্য শুধুমাত্র চাকর ধর্ম্মদাস সহ এলাহাবাদে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলে চন্দ্রমুখী তার সেবার জন্য যেতে চায়৷ কিন্তু সে যখন সমাজের সম্ভ্রমের কথা বলে তার সামনে সমাজে গণিকার অবস্থানগত এক জীবন্ত ছবি ফুটে উঠে৷ চন্দ্রমুখী জানে ‘‘এ জগতে তাহার সম্মান নাই৷ তাহার সংস্পর্শে দেবদাস সুখ পাইবে, সেবা পাইবে, কিন্তু কখনো সম্মান পাইবে না৷’’৩৮

চন্দ্রমুখী সেবায় মমতায় ভালোবাসায় তৈরি এমন একজন নারী যে দেবদাসের মতো মানুষের সহানুভূতি অর্জন করেছে৷ যে দেবদাস কোনোদিন গণিকাদের ঘৃণ্য জীব ছাড়া আর কিছু মনে করতো না তার কাছে নিজের ব্যক্তিত্ব দিয়ে ‘বৌ’ এর অভিধা অর্জন করেছে৷ জীবনের শেষ লগ্নে দেবদাসের মানসপটে তার মায়ের মুখচ্ছবির সঙ্গে চন্দ্রমুখীর মুখের ছবিও ফুটে উঠেছে৷ একজন বেশ্যা হয়ে সে তার শ্রদ্ধা-ভালোবাসার রসে দ্রবিভূত করেছিল প্রেমাস্পদের প্রস্তরকঠিন মনকে৷ পার্বতীও চন্দ্রমুখীর সংস্পর্শ থেকে দেবদাসকে মুক্তির জন্য তার কাছে গিয়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল৷ নিজের জীবনের প্রিয় মানুষটিকে একজন বারাঙ্গনার তত্ত্বাবধানে রাখতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল৷ চন্দ্রমুখী তার হীন জীবনে কোনোদিন কোনোকিছু প্রত্যাশা করেনি তার কাছে৷ তবু যতটুকু পেয়েছে ততটুকুই নিঙড়ে গ্রহণ করেছে, নিজেকে ধন্য মনে করেছে তাতেই৷ দেবদাসকে তার স্বভাব অনুযায়ী মেনে নিয়ে তার ভালো করার সাধনায় তিলে তিলে নিজেকে ক্ষয় করেছে; ভেঙ্গে নতুন করে গড়েছে৷

এছাড়া আরেকজন গৌন গণিকার সন্ধান পাওয়া যায় সে ক্ষেত্রমণি৷ সে চন্দ্রমুখীর প্রতিবেশী পণ্যাঙ্গনা৷ চন্দ্রমুখী তার বৈরাগ্যের সূচনায় বিক্রির অতিরিক্ত জিনিস ক্ষেত্রমণিকে দিয়ে এসেছিল৷ তার পরে দীর্ঘ আড়াই বছর পর যখন পুনরায় বেশ্যা সেজে দেবদাসকে ধরার পরিকল্পনা করে তখনও ক্ষেত্রমণির উল্লেখ রয়েছে৷ উপন্যাসে আলাদা করে ভূমিকা নেই তার৷ চন্দ্রমুখীর মধ্য দিয়েই তাকে একটু-আধটু করে তুলে ধরেছেন লেখক৷

গ. শ্রীকান্ত :

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি চারটি পর্বে সমাপ্ত৷ ১৩২২ সালের মাঘ মাস থেকে ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় এটি যখন ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকে তখন এর নাম ছিল ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী’ এবং প্রথম দিকে লেখকের নামের জায়গায় নাম ছিল শ্রী শ্রীকান্ত শর্মা৷ পরবর্তীকালে ‘শ্রীকান্ত’র চারটি পর্ব আলাদা আলাদা সময়ে প্রকাশিত হয়৷ যথা ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্ব-১৯১৭, দ্বিতীয় পর্ব ১৯১৮, তৃতীয় পর্ব ১৯২৭, চতুর্থ পর্ব ১৯৩৩৷

বাংলা সাহিত্যের জগতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতেই গণিকারা প্রথম মনুষত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হয়৷ স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসায়, ত্যাগে, মহত্ত্বে উচ্চতম শিখর স্পর্শ করে তাদের মহিমা৷ অন্তরের সংবেদনশীলতা ও স্বচ্ছ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে লেখক স্বয়ং প্রকৃত সমাজতাত্ত্বিকের মতো নারীর পদস্খলন ও পতিতাবৃত্তি গ্রহণের কারণ অনুসন্ধান করতে তৎপর হয়েছিলেন এবং তার ভিত্তিতেই পরম সহানুভূতি ও শ্রদ্ধায় অঙ্কিত করেছিলেন পতিতা নারীদের জীবন৷

পিয়ারীবাই :

‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসটি শ্রীকান্তের কলমে লেখা৷ শ্রীকান্ত তার সুদীর্ঘ জীবন অভিজ্ঞতার পরতে পরতে যে সকল মানুষের সংস্পর্শ লাভ করেছিলেন এবং যা যা দেখেছিলেন তারই নথিবদ্ধ বিবরণ৷ শ্রীকান্তের কথায় এখানে আলোচিত হয়েছে পিয়ারীবাঈ-এর প্রসঙ্গ৷ শ্রীকান্ত যদি উপন্যাসের নায়ক হয় তাহলে উপন্যাসটির নায়িকা রাজলক্ষ্মী বা পিয়ারীবাই৷ চরিত্রটির মধ্য দিয়ে লেখকের আধুনিক বাস্তববাদী অথচ রোমান্টিক মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে৷

পিয়ারীর কাহিনি শুরু হয়েছে উপন্যাসের প্রথম পর্বের মাঝামাঝি আসার পর৷ শ্রীকান্ত তার কেন্দ্রহীন ভবঘুরে জীবনে জমিদার বন্ধুর আমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত হয় বিহারের জঙ্গলে শিকারের উদ্দেশ্যে বন্ধুর তাবুতে৷ পাটনার স্বনামধন্য বাইজি পিয়ারীবাই বহু অর্থের বিনিময়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছে তাদের মনোরঞ্জন করার জন্য৷ সে সম্পর্কে শ্রীকান্ত জানিয়েছে—‘‘এই বাইজীটি পাটনা হইতে অনেক টাকার শর্তে দুই সপ্তাহের জন্য আসিয়াছেন৷ এইখানে রাজকুমার যে বিবেচনা এবং যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়াছেন, সে কথা স্বীকার করিতেই হইবে৷ বাইজী সুশ্রী, অতিশয় সুকন্ঠ এবং গান গাহিতে জানে৷’’৩৯ রূপ যৌবন সম্পন্না নৃত্যগীতে পারদর্শিনী বারবধূরাই যে তাদের উপপতি, বাবুদের পছন্দের প্রধান সামগ্রী তা শ্রীকান্তের উক্তি থেকে স্পষ্টতই প্রমাণিত হয়৷ পিয়ারী রাজকুমারের আদেশে এবং শ্রীকান্তের অনুরোধে তার সুরেলা কন্ঠের জাদুকরি মহিমায় সকলকে আপ্লুত করে এবং শ্রীকান্তের মনে হয় এতক্ষণ টাকার লোভে সে তার গান পরিবেশনে বাধ্য থাকলেও তার মত সমজদার শ্রোতা পাওয়ার ফলে বাইজি তার গানের রাজ্যে সুরের তরীটিকে ভাসিয়ে দিতে পেরেছে নিজের খেয়ালে৷ গান শেষে অভিভূত শ্রীকান্ত তার ‘তারিফ’ করলে বাইজি তাকে সেলাম না ঠুকে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে প্রণাম জানায়৷ তারা দুজনেই দু-সপ্তাহের জন্য রাজকুমারের তাবুতে এসেছে৷ সেই দু-সপ্তাহ শ্রীকান্ত তার গান শুনতে পাবে বাইজির সামনে তা নিজের সৌভাগ্য বলে জাহির করলে সে তার কাছে সরে এসে পরিষ্কার বাংলায় জানায়—‘‘টাকা নিয়েছি, আমাকে ত গাইতেই হবে, কিন্তু আপনি এই পনর-ষোল দিন ধ’রে এঁর মোসাহেবি করবেন? যান, কালকেই বাড়ি চ’লে যান৷’’৪০ বাইজির মুখে এধরনের খোঁচা খেয়ে মনটা বিকল হয়ে যায় তার৷ বন্ধুর সঙ্গে শিকারে গিয়েও সেখান থেকে ফিরে এসে বাইজির খানসামা রতনের মধ্য দিয়ে বাইজির আমন্ত্রণ পেয়ে তার তাবুতে উপস্থিত হয়৷ সেখানে গিয়ে দেখে বাইজি তার প্রতীক্ষা করে বসে আছে৷ তার আকৃতি প্রকৃতি বাঙালি নারীর মতোই৷ একটা মূল্যবান কার্পেটের উপর গরদের একটা শাড়ি পড়ে বসে আছে৷ ভিজে এলোচুল পিঠের উপর ছড়ানো; হাতের কাছে পানের সাজ-সরঞ্জাম, সামনে গুড়গুড়িতে তামাক সাজা, বাইজি তামাক খাচ্ছিল৷ শ্রীকান্তকে দেখে সৌজন্যবশত তার তামাক খাওয়া বন্ধ করে একেবারে নিকট আত্মীয়ের মতো তার সকল খোঁজ-খবর করতে থাকে৷ বাইজির সেই অতি পরিচিত জনের মতো কাথায় তাকে চিনতে না পেরে শ্রীকান্ত বিরক্ত হয়ে গেলে সেই বাইজি—‘‘হাসিল; কহিল, লাভ-ক্ষতিই কি সংসারে সব? মায়া, মমতা, ভালবাসাটা কি কিছু নয়? আমার নাম পিয়ারী, কিন্তু, আমার মুখ দেখেও যখন চিনতে পারলে না, তখন ছেলেবেলার ডাকনাম শুনেই কি আমাকে চিনতে পারবে? তা ছাড়া আমি তোমাদের—ও গ্রামের মেয়েও নই৷’’৪১ কথক শ্রীকান্ত কোনোভাবেই তার জীবনের সমস্ত অতীত পাতাগুলি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পিয়ারীর সন্ধান পায় না৷ তিন-চারদিন উভয়ের উভয়কে এড়িয়ে চলার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়ে যায়৷ হঠাৎ কথক রাজকুমার ও তার অপর বয়স্যদের সঙ্গে বাজি ধরে শনিবারে অমাবস্যার নিশুতিরাতে একাকী সাহসিকতার পরিচয় দিতে শ্মশানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আবার তার পথ আগলায় পিয়ারী৷ অদৃশ্য একটা অধিকারের বন্ধন দিয়ে সে কথকের সঙ্গে অত্যন্ত আপনজনের মতো নিষেধ জ্ঞাপন করতে থাকে৷ কথক তার বারণ না শুনলে সে নিজেও তার সঙ্গে যেতে চায়৷ তার পরে কথক যখন তাকে সঙ্গে যেতে বলে তখন তার সামাজিক অবস্থানের কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপে জ্বলে উঠে সে বলে—যে দেশ-বিদেশে তা হলে তার সুখ্যাতির আর সীমা-পরিসীমা থাকবে না! সকলে বলবে বাবু শিকারে এসে একটা বাইউলি সঙ্গে করে দুপুর রাত্রে ভূত দেখতে গিয়েছিলেন৷ পিয়ারীর জেদ, তার জোর করার ভঙ্গি এবং আপনজনের মতো ব্যবহার কথকের স্মৃতির পথের অনুসন্ধানের কার্যটিকে ক্রমাগতই এগিয়ে নিয়ে আসছিল; হঠাৎই তা যেন সফলতা স্পর্শ করে৷ তা হল পিয়ারীর একটা অভ্যেস৷ সে রাগলেই তার দাঁত দিয়ে অধর চেপে ধরতো৷ সেই অভ্যেস সে ছোটবেলায় আরেকজনের কাছে দেখেছে সে হল রাজলক্ষ্মী৷ তাই কথক সেই রাজলক্ষ্মী এই হয়ে গেছে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যায়৷ এখানে কথকের অভিভূত হয়ে যাওয়া শুধুমাত্র একজন গ্রাম্য মেয়ের বারবধূ হয়ে উঠার মধ্যে নয় তার বিস্ময়ের আর এক কারণ হল তার শারীরিক পরিবর্তন৷ কারণ রাজলক্ষ্মীর ছোটবেলায় গায়ের রঙ ফরসা হলেও ম্যালেরিয়া ও প্লীহার কারণে তার পেটটা ছিল ধামার মতো, হাত-পা কাঠির মতো, মাথার চুলগুলো তামার শলার মতো—কতগুলো তা গুণে বলা যেতে পারতো৷ সেই রূপহীন শ্রীহীন ছোট্ট মেয়েটি রূপবতী নৃত্যগীত পারদর্শী ছলাকলাপটিয়সী একজন বিত্তবান বারবনিতা!

পিয়ারীর সেই স্নিগ্ধ অতীত সর্বদাই তার মনকে মাধুর্য দান করেছে৷ তার ও শ্রীকান্তর অতীত ছিল প্রায় একই ডোরে গাঁথা৷ শ্রীকান্তর মারের ভয়ে সে প্রতিদিন বঁইচির বনে ঢুকে একছড়া পাকা বঁইচিফলের মালা গেঁথে তাকে এনে দিত৷ কোনোদিন ছোটো হলে পুরোনো পড়া জিজ্ঞেস করে প্রাণভরে শ্রীকান্ত তাকে চপেটাঘাত করতো৷ রাজলক্ষ্মী মার খেয়ে ঠোঁট কামড়ে গোঁজ হয়ে বসে থাকতো কিন্তু কোনো দিন তা আনার কথা অস্বীকার করতো না৷ পিয়ারীর কথায় সেদিন সেই বঁইচির মালা দিয়েই রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে স্বামীত্বে বরণ করে নিয়েছিল৷ তার সেই স্থান, সেই সম্মান সে চিরদিন শত প্রতিকূলতার মধ্যেও অক্ষয় করে রেখেছে৷

পিয়ারীবাই-এর এই অতীত নারীজীবনের কঠিন অনুশাসনে বাঁধা৷ ধীরে ধীরে উপন্যাসটির সমগ্র পর্ব জুড়ে নানা ঘটনার অভিঘাতে সে তার রাজলক্ষ্মী থেকে পিয়ারীবাই হয়ে ওঠার কাহিনি উন্মোচন করেছে৷ একজন সরল-সাদা গ্রাম্য মেয়ে কীভাবে সমাজের কঠোর নিষ্পেষণ ও উদাসীনতায় বহুবল্লভা হয়ে সমাজের প্রান্তদেশে পতিত হয় রাজলক্ষ্মীর পিয়ারী হয়ে ওঠার কাহিনির মধ্যে তা পরিস্ফুট৷ রাজলক্ষ্মীর দুই পুরুষে কুলীন বাবা যখন আরেকটি বিয়ে করে সে ও তার বোন সুরলক্ষ্মীসহ তার মাকে তাড়িয়ে দেয়, তখন স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় মাতা কোনো উপায়ন্তর না দেখে উপস্থিত হয় বাপের বাড়িতে৷ সে মামার বাড়িতে শ্রীকান্তের নানা পীড়ন সহ্য করে কিছুকাল কাটানোর পর পুনরায় সমস্যার সম্মুখীন হয় বিয়ে নিয়ে৷ ভাগ্নীরা বিয়ের উপযুক্ত হচ্ছে মামার দুশ্চিন্তার শেষ নেই৷ অথচ কুলীন পাত্রই বা পাবে কোথায়৷ এই মহাসংকটে তার মামা ধরনা দেয় বিরিঞ্চি দত্তের বাড়িতে৷ তার পাচক ব্রাহ্মণ যাকে সে বাঁকুড়া থেকে বদলি হয়ে আসার সময় সঙ্গে নিয়ে এসেছিল তাকে দায় উদ্ধারের জন্য৷ যথা সময় হাবাগোবা সেই পাচক ঠাকুর বেশি পণের জন্য বেঁকে বসে জানায়—‘‘অত সস্তায় হবে না মশায়—বাজারে যাচিয়ে দেখুন পঞ্চাশ-এক টাকায় একজোড়া ভাল রামছাগল পাওয়া যায় না—তা জামাই খুঁজচেন৷ একশ-একটি টাকা দিন—একবার এ পিঁড়িতে ব’সে আর একবার ও পিঁড়িতে ব’সে দুটো ফুল ফেলে দিচ্চি৷’’৪২ অনেক দর কষাকষির পর সত্তর টাকায় রফা করে একসঙ্গে সুরলক্ষ্মী ও রাজলক্ষ্মীকে বিয়ে করে সত্তর টাকা আদায় করে দুজনকে ফেলে স্বস্থানে গমন করে৷ সমাজে নারীর অবমূল্যায়নের নারকীয় দৃশ্য শরৎচন্দ্রের মতো বিচক্ষণ সাহিত্যিকের পক্ষেই এমন প্রাঞ্জল ভাষায় তুলে ধরা সম্ভব৷ ঘটনার দেড়বছর পরে সুরলক্ষ্মী প্লীহার জ্বরে প্রাণ ত্যাগ করে জীবনযন্ত্রণা থেকে চিরমুক্তি লাভ করে আর জীবনভর অসম্মান আর অপযশ বহন করার জন্য বেঁচে থাকে রাজলক্ষ্মী৷ যদিও তার ক্রমিক পরিণতি তার আরেক মৃত্যুই—অর্থাৎ রাজলক্ষ্মী মরে গিয়ে সেখানে নবজন্ম লাভ করে পাটনার নগরনটী পিয়ারীবাই৷ সুরলক্ষ্মীর মৃত্যুর পর তার মা তাকে কাশীতে নিয়ে গিয়ে সেখানে এক মৈথিলি রাজপুত্রের হাতে বিক্রি করে দেয় একহাজার টাকার বিনিময়ে৷ কিন্তু রাজলক্ষ্মী তা মেনে নেয়নি৷ মাকে আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে সেখান থেকে বিদায় করে দেয় এবং কথা দেয় তার মায়ের নেওয়া অগ্রিম হাজার টাকা সে যেমন করে পারবে শোধ করবে৷ তার মা সেই টাকা নিয়ে দেশে ফিরে এসে প্রচার করে যে কাশীতে রাজলক্ষ্মীর মৃত্যু হয়েছে৷ একজন বৃদ্ধ বাঙালি ওস্তাদ রাজলক্ষ্মীকে গানবাজনা শেখাত এবং সেই ওস্তাদের মুসলমানী স্ত্রী শেখাত নাচ৷ রাজলক্ষ্মী তাদের দাদামশাই দিদিমা ডাকতো৷ তাদের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজপুত্রকে ফাঁকি দিয়ে সে তাদের সঙ্গে পালিয়ে যায়৷ এলাহাবাদ, লক্ষ্ণৌ, দিল্লী, আগ্রা, জয়পুর, মথুরা ইত্যাদি বহুদেশ ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে উপস্থিত হয় পাটনায়৷ সেখানে তার জমানো অর্ধেক টাকা জমা রাখে এক মহাজনের গদিতে আর বাকি অর্ধেক দিয়ে খোলে এক মনোহারী ও এক কাপড়ের দোকান৷ তারপর বাড়ি কিনে স্বামীর বাড়ি খোঁজ করে লোভী পাচকঠাকুরের পুত্র অর্থাৎ তার সতীনপুত্র বঙ্কুকে নিজের কাছে এনে পড়াশুনা চালাতে থাকে আর জীবিকার জন্য পিয়ারীবাই হয়ে মজলিশে যায় মুজরা করতে৷

রাজলক্ষ্মী তার জীবনের জটিল আবর্তে একাধিক পুরুষের হস্তগত হয়েছে, বেঁচে থাকার জন্য গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করেছে তবুও তার ছেলেবেলার ভালোবাসাকে কোনোভাবেই ভুলতে পারেনি ৷ মনের রাজসিংহাসনে বঁইচির মালা দিয়ে বরণ করে নেওয়া মানুষটিকে জীবনভর শ্রদ্ধা করে এসেছে৷ তাই তো অকপটে তাকে বলতে পেরেছে—‘‘কি বিশ্রী এই মেয়েমানুষ জাতটা, একবার যদি ভালোবেসেচে ত মরেচে৷’’৪৩ রাজলক্ষ্মীর কাছে তার ভালোবাসা ঈশ্বরদত্ত ধন৷ তাই শ্রীকান্তের শত অপমান, সহস্র খোঁচা এবং ততধিক ‘বাইজি’ সম্বোধনেও সে বিব্রত বোধ করে না৷ সে স্বেচ্ছায় তাকে ভালোবেসেছে৷ স্বেচ্ছায় বরমাল্য পরিয়েছে এবং সেই সাধ ও ভালোবাসাকে স্ব-ইচ্ছেতেই নিজের মধ্যে লালন পালন করেছে৷ সেখানে সেই ভিতকে নড়িয়ে দেওয়ার সাধ্য কারও নেই; তার সেই ভালোবাসার মানুষটিরও নয়৷ পিয়ারীর এই সুস্পষ্ট স্বীকারোক্তি শ্রীকান্তর মনের চিন্তাস্রোতকে বাধাহীনভাবে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে৷ তাই শ্মশানের পথে চলতে চলতে ভেবেছে—‘‘এ কি বিরাট অচিন্তনীয় ব্যাপার এই নারীর মনটা৷ কবে যে এই পিলেরোগা মেয়েটা তাহার ধামার মত পেট এবং কাঠির মত হাত-পা লইয়া আমাকে প্রথম ভালবাসিয়াছিল, এবং বঁইচি ফলের মালা দিয়া তাহার দরিদ্র পূজা নীরবে সম্পন্ন করিয়া আসিতেছিল, আমি টেরও পাই নাই৷ যখন টের পাইলাম তখন বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না৷ বিস্ময় সেজন্যেও নয়৷ নভেল নাটকেও বাল্যপ্রণয়ের কথা অনেক পড়িয়াছি৷ কিন্তু এই বস্তুটি, যাহাকে সে তাহার ঈশ্বরদত্ত ধন বলিয়া সগর্বে প্রচার করিতেও কুন্ঠিত হইল না, তাহাকে সে এতদিন তাহার এই ঘৃণিত জীবনের শতকোটী মিথ্যা প্রণয়-অভিনয়ের মধ্যে কোনখানে জীবিত রাখিয়াছিল? কোথা হইতে ইহাদের খাদ্য সংগ্রহ করিত? কোন পথে প্রবেশ করিয়া তাহাকে লালন-পালন করিত?’’৪৪ শ্মশানের সেই ভয়ঙ্কর পরিবেশে নিজের আসন্ন বিপদের সম্ভাবনার মধ্যে আশার আলো নিয়ে উপনীত হয় রতন—রাজলক্ষ্মীর নির্দেশে৷ রাজলক্ষ্মীর নির্মল ভালোবাসা তাকে বিপদের মুখে যেতে দিয়ে চুপ করে থাকেনি৷ তাই খানসামা রতন ও দারোয়ানকে একমাসের বেতন বকশিশ দিয়ে পাঠিয়েছে তাকে সাহায্য করতে৷ পরের দিনও কথক একাকী শ্মশানে উপস্থিত হয়েছে নিজের অজ্ঞাতসারেই৷ সারারাত কীভাবে সেখানে অতিবাহিত হয়েছে তা কথকের নিজেরও জানার বাইরে৷ সেখানে আবার দেখা হয় পিয়ারীর৷ সে তার দলবল নিয়ে ফিরে যাচ্ছিল৷ পিয়ারী তার পথ রোধ করে হাত ধরে প্রায় জোর করেই গাড়িতে ওঠায়৷ তাকে তার সঙ্গে ফিরে যেতে অনুরোধ করে৷ কিন্তু শ্রীকান্তের পক্ষে তা সম্ভব নয়৷ পিয়ারী একজন গণিকা; পরপুরুষের মনরঞ্জনকারিণী৷ তার সঙ্গে হঠাৎ করে কাউকে না বলে চলে গেলে সে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না৷ গণিকার সঙ্গে অর্থের বিনিময়ে সহবাস চলে; ভালোবাসা চলে না, তা সমাজবিরুদ্ধ৷ সেই নৈতিক পতনের কুৎসাভার শ্রীকান্ত নিতে অপারগ৷ রাজলক্ষ্মী তার প্রেমাস্পদের আসন্ন বিপদটাকে দেখে মুহূর্তের জন্য নিজের অবস্থানকে ভুলে গিয়েছিল কিন্তু শ্রীকান্তের কুৎসা রটনার কথা শুনে তার সম্বিত ফিরে আসে; নিমেষেই সে ম্লান হয়ে যায়৷ তার পরে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলে—‘‘কি জানো কান্তদা, যে কলম দিয়ে সারা-জীবন শুধু জালখত তৈরি করেচি, সেই কলমটা দিয়েই আজ আর দানপত্র লিখতে হাত সরচে না৷ যাবে? আচ্ছা যাও! কিন্তু কথা দাও—আজ বেলা বারোটার আগেই বেরিয়ে পড়বে?’’৪৫ রাজলক্ষ্মীর সুখ-দুঃখের একমাত্র সম্পদ তার অন্তরের নিগুঢ় ভালোবাসা৷ যে কিনা এক অদৃশ্য হাতছানিতে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে নিজের অজান্তে শ্মশানে উপস্থিত হয়েছে৷ আর তার মুখে সেই বিবরণ শুনে আশঙ্কায় নীল হয়ে গেছে তার নারীমন৷ সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে সে ভয়ে তাকে আর তাবুতে ফিরতে দিতে চাইছিল না৷ অনুরোধ করেছিল সে দেশে যাক, অথবা যেখানে খুশি সেখানে যাক তথাপি তাবুতে নয়৷ কিন্তু রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ করে তাবু থেকে তারও অন্তর্ধান তার চরিত্রে কালি লেপন হবে সেই সম্ভাবনা শ্রীকান্তর মুখে শুনে আর কঠোর হতে পারে না সে৷ তাই নিজের হাতে বহুপুরুষ সম্ভাষণকারী নারীটি আশঙ্কায় দুরুদুরু বক্ষে তাকে সেই বিপদের মধ্যেই ফেলে যেতে বাধ্য হয়৷ তার মিথ্যে প্রণয়ের জালখত লেখার কলম দিয়ে সত্যিকারের ভালোবাসার জালখত লেখা শুরু হয়ে যায়৷

পিয়ারীবাই স্নেহ-প্রেম-ভালোবাসা-মায়া-মমতার জীবন্ত বিগ্রহ৷ রাজকুমারের তাবু থেকে বিদায় নেওয়ার পর পুনরায় সে শ্রীকান্তের সংবাদ পায় যে প্রবল জ্বরাক্রান্ত হয়ে শ্রীকান্ত আরা স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে পড়ে আছে৷ মুহূর্তে অভয়দাত্রীর ভূমিকা নিয়ে উপস্থিত হয় সেখানে৷ সন্ন্যাসীর দলে মিশে সন্ন্যাসী সেজে থাকা অসুস্থ শ্রীকান্তকে সেখানকার একটা ঘর ভাড়া নিয়ে ভালো ভালো ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করাতে থাকে৷ বসন্ত আক্রান্ত স্থানে ওভাবে জ্বরে বেহুঁশ শ্রীকান্তর সেবা করতে তার একটুও বাধে না৷ তার পর তাকে নিয়ে আসে পাটনার বাড়িতে৷ পিয়ারীর পাটনার বাড়িঘরের সাজ-সজ্জা দেখে বিস্মিত হয়ে যায় শ্রীকান্ত৷ সে তার জীবন অভিজ্ঞতায় বহু বাইজিবাড়ি দেখেছে—যার সর্বত্র বিলাস-ভোগের উপকরণে ঠাসা৷ সেখানে কামনা আর বাসনা হাত ধরাধরি করে সর্বদা যেন যৌবনের গান গায়—মদিরারক্ত দৃষ্টিতে প্রিয়সম্ভাষণ করে৷ তার কল্পনায় পিয়ারীর গৃহসজ্জাও সেরূপ কল্পিত ছিল৷ পিয়ারীর ঘর সম্পূর্ণ আভরণহীন৷ মেঝেটি সাদাপাথরের, দুধের মতো সাদা ঝকমকে দেওয়াল৷ ঘরের একধারে একটি তক্তপোষের উপর একটি ছোটো আলমারি৷ এই বিলাসিনী নারীর সকল কিছুই যেন কথককে বিস্ময়ে হতবাক করে দেয়৷ এই পাটনাতেই কয়েকদিনের বিশ্রামের অবসরে সে আবিষ্কার করে তার মাতৃত্বের আর এক সুবিস্তৃত তটভূমি৷ যার সম্পূর্ণ জায়গা জুড়ে রয়েছে বঙ্কু—তার সতীনের ছেলে৷ পিয়ারী তার মাতৃত্বকে নিষ্ফলা হতে দেয়নি৷ সতীনের ছেলেকে দিয়ে নিজের স্নেহতৃষ্ণাকে মিটিয়ে নিয়েছে৷ আর মা হয়ে সে যেন আরও বেশি কর্তব্যপরায়ণ৷ তাই সে নির্দ্বিধায় শ্রীকান্তকে বলতে পেরেছে যে সে তো সুস্থ হয়ে গেছে, কবে বাড়ি ফিরবে৷ বঙ্কুর সামনে সে নিজেকে খেলো করে দিতে চায় না৷ শ্রীকান্ত তার কথায় যেতে অস্বীকার করলে সে সুস্পষ্টভাবে নিজের ভাবনাকে প্রকাশ করে—‘‘কিন্তু আমার ছেলে প্রায়ই আজকাল বাঁকিপুর থেকে আসচে৷ বেশিদিন থাকলে সে হয়ত কিছু ভাবতে পারে৷’’৪৬ পিয়ারীর তার সন্তানকে ভালোবাসা যতটা জীবন্ত তার চেয়েও জীবন্ত তার প্রতি বঙ্কুর ভালোবাসা৷ মায়ের প্রতি নিষ্পাপ ভক্তি তার৷ বঙ্কুর সে ছাড়া আরও চারটি বোন রয়েছে৷ তার মায়ের প্রতি উচ্ছ্বসিত প্রশংসায় কথক জানতে পারে যে রাজলক্ষ্মী নিজে সেই চার বোনের বিয়ে দিয়েছে৷ শুধুমাত্র রাজলক্ষ্মীর অন্নে প্রতিপালিত বলে বঙ্কুদের ‘একঘরে’ করে রেখেছে গ্রামের লোকজন৷ তাদের চোখে পিয়ারী পতিতা৷ অথচ সেই গায়ের ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ, শীতকালে কাপড়-কম্বল দিয়ে কত উপকার করে পিয়ারীবাই৷ বঙ্কুর ভাবনায় তার মায়ের গানবাজনা করাতে কোনো দোষ নেই তথাপি গ্রামের লোকেরা তার মাকে দোষী করে রেখেছে৷ শুধু তাই নয় পিয়ারীবাই গ্রামের জলকষ্ট দেখে নিজেই উদ্যোগী হয়ে তিন-চার হাজার টাকা খরচ করে একটি পুকুর খোদাই করিয়ে তা বাঁধিয়ে দেয়৷ কিন্তু গ্রামের লোকেরা বারাঙ্গনা পিয়ারীকে সেই পুকুর প্রতিষ্ঠা করতে দেয় না৷ তারা অনায়াসে লুকিয়ে লুকিয়ে সুদৃশ্য পুকুরের জল ব্যবহার করতে পারে কিন্তু প্রকাশ্যে পতিতার শরীরের মতো পতিতার হাতের কোনো জিনিস তাদের কাছে দূষণীয়ই৷ রাজলক্ষ্মীর সে জন্য দুঃখের শেষ নেই৷ বঙ্কু তার সরল স্নেহবুভুক্ষায় রাজলক্ষ্মীকে আপন করে নিয়েছেন তার ভালোমন্দও বুঝতে তার অসুবিধা হয় না৷ তাই বঙ্কু সলজ্জভঙ্গিতে শ্রীকান্তকে জানায় যে সে যেন আরও কিছুদিন থেকে যায় কারণ সে থাকলে তার মা খুব আনন্দে থাকে৷ বঙ্কুর কথায় পিয়ারী সম্পর্কে আরেক দিগন্ত খুলে যায় শ্রীকান্তর৷ সে স্পষ্টত অনুধাবন করতে পারে কেন পিয়ারী ছেলে সম্পর্কে সচেতন হয়ে তাকে চলে যেতে বলছে৷ আর তাই—‘‘মাতৃত্বের এই একটা ছবি আজ চোখে পড়ায় যেন একটা নূতন জ্ঞান লাভ করিলাম৷ পিয়ারী হৃদয়ের একাগ্র বাসনা অনুমান করা আমার পক্ষে কঠিন নয়; এবং সে যে সংসারে সব দিক দিয়া সর্বপ্রকারেই স্বাধীন, তাহাও কল্পনা করা বোধ করি পাপ নয়৷ তবুও সে যে-মুহূর্তে এই একটা দরিদ্র বালকের মাতৃপদ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করিয়াছে, অমনি সে নিজের দুটি পায়ে শত পাকে বেড়িয়া লোহার শিকল বাঁধিয়া ফেলিয়াছে৷ আপনি সে যাই হোক, কিন্তু সেই আপনাকে মায়ের সম্মান তাহাকে ত এখন দিতেই হইবে! তাহার অসংযত কামনা, উশৃঙ্খল প্রবৃত্তি যত অধঃপথেই তাহাকে ঠেলিতে চাউক, কিন্তু এ কথাও সে ভুলিতে পারে না—সে একজনের মা! এবং সেই সন্তানের ভক্তিনত দৃষ্টির সম্মুখে তাহার মাকে ত সে কোনমতেই অপমানিত করিতে পারে না!’’৪৭ কথকের ভাবনায় উঠে অসে তার পিয়ারী নামটি৷ যে রসিকবাবু কোনো যৌবনের লালসামত্ত বসন্তদিনে তার নামটিকে রাজলক্ষ্মী থেকে পিয়ারীবাইতে প্রতিস্থাপিত করেছিল সেই নামটিও ছেলের সামনে সে গোপন করতে চায়৷ তার সেই সারল্যে পরিপূর্ণ স্নেহকাতর মাতৃহৃদয়কে শ্রীকান্তের আর বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না৷ যে বাসনার জালে বন্দি হয়ে সে ও রাজলক্ষ্মী পরস্পরের অভিমুখে অগ্রসর হতে শুরু করেছিল ঠিক তার মাঝখানটিতে বঙ্কুর মাকে দেখে শ্রদ্ধায় অভিভূত হয়ে যায় সে৷ তাই রাজলক্ষ্মীকে কামনার ধন ভেবে আর ছোটো করতে পারে না৷ তার চোখে রাজলক্ষ্মী এক পরিপূর্ণ মাতৃমূর্তি৷

আবার শ্রীকান্তের প্রতি তার দুর্নিবার আকর্ষণ, সেবা, প্রেমাবেগ কোনোকিছুকেই যেন অতিক্রম করা যায় না৷ শ্রীকান্ত জানে সে চলে গেলে মাতৃত্বের গৌরব রক্ষায় জয়ী হলেও প্রেমিকের অদর্শনে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাবে রাজলক্ষ্মীই তার পরেও তাকে তার বন্ধনপাশ উপেক্ষা করে চলে যেতে হবে৷ তাই তো কথক বলেছে রাজলক্ষ্মীর জন্যই রাজলক্ষ্মীকে ছেড়ে যেতে হবে; সেখানে দ্বিধা করলে চলবে না৷ আর এখানেই ফুটে উঠেছে লেখকের গভীর জীবন দর্শন—‘‘বড় প্রেম শুধু কাছেই টানে না—ইহা দূরেও ঠেলিয়া ফেলে৷’’৪৮

উপন্যাসের কথক শ্রীকান্ত ভেবেছিল হয় তো আর কোনোদিন তাদের দেখা হবে না৷ যে সম্পর্কের গ্রন্থি তৈরি হয়েছিল নিজেদের সামায়িক দুর্বলতায় তীব্র সংযম দিয়ে তা ছিন্ন করে চলে আসতে পেরেছে, কিন্তু তা নয়৷ পিয়ারীর ভালোবাসার শিকর বহুদূর প্রোথিত৷ তা ছিঁড়লেও ছিঁড়ে না৷ তাই তো নিজের মাতৃ প্রতিশ্রুতি রক্ষার দ্বিধা থেকে রক্ষা করতে সে নিজেই উপস্থিত হয় পিয়ারীর পাটনার বাড়িতে৷ এবারেও বিস্ময়াপন্ন হতে হয় কথককে৷ সে যখন পিয়ারীর সঙ্গে প্রথমবার পাটনায় আসে তখন তার কল্পিত বাইজিবাড়ি আকাশকুসুম হয়ে সাধারণ আড়ম্বরহীন গৃহসজ্জার রূপ নিয়ে প্রতিভাত হয়েছিল দ্বিতীয়বার তার পাটনার গৃহসজ্জার কল্পনা উল্টোরূপ পরিগ্রহণ করে৷ সেই সাদামাঠা গৃহসজ্জা পুনরায় গণিকার নূপুরনিক্বণে বিলাসমন্দির হয়ে উঠেছে৷ তাকে হঠাৎ গৃহে উপস্থিত দেখে মুজরারত পিয়ারীবাই-এর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়৷ সে নিজেকে সংযত করে মুখে জোর করে হাসি আনার চেষ্টা করে৷ শ্রীকান্তও ততক্ষণে সামলে নিয়েছে নিজেকে৷ মজলিশের আয়োজক পূর্ণিয়া জেলার বাবুটির অনুরোধে শ্রীকান্ত সেখানে আসন গ্রহণ করে গান বাজনার ‘ফরমাশ’ করলে হতবুদ্ধি পিয়ারী রাগে-দুঃখে-অভিমানে হারমোনিয়াম দূরে ঠেলে দিয়ে সেখান থেকে চলে যায়৷ সেই বাবুটির কাছ থেকে জানা যায় তার নাম রামচন্দ্র সিংহ, দ্বারভাঙ্গা জেলার একজন জমিদার, পিয়ারীবাইকে সে সাত-আট বছর থেকে চেনে৷ সে তার পূর্ণিয়ার বাড়িতে তিন-চারবার মুজরা করতে গিয়েছিল৷ সে নিজেও অনেকবার তার এখানে গান শুনতে এসেছে, কখনো কখনো দশ-বারোদিন থেকেও গেছে; মাস তিনেক পূর্বে এসেও এক সপ্তাহ থেকে গেছে৷ পিয়ারী গণিকা হলেও তার সুখ-দুঃখ সমস্তই শ্রীকান্তকে নিয়ে৷ তাই শ্রীকান্তের সামনে অন্যপুরুষের জন্য গান পরিবেশন করতে তার অন্তরাত্মার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাগের রূপ নিয়ে৷ সে নানা কথা বলে শ্রীকান্তকে অপদস্ত করার চেষ্টা করতে থাকে—শ্রীকান্তও সবকিছু বুঝতে পেরে তাকে জব্দ করতে সচেষ্ট হয়৷ শ্রীকান্ত বোঝে তার অচিন্ত্যপূর্ব আগমনে রাজলক্ষ্মী হতবুদ্ধি হয়ে যে ব্যবহারই করুক না কেন তার নির্বিকার ঔদাসীন্যে শঙ্কিত হয়েই গিয়েছিল৷ তারপরে তার মধ্যে ঈর্ষা জাগ্রত করতে নানাভাবে আঘাত হানতে থাকলে শ্রীকান্ত তার কৌশলী জবাব দিয়ে সে আঘাত তাকেই ফিরিয়ে দেয়৷ প্রেমিকের জন্য অতি যত্নে বিছানা পেতে পরম যত্নে তাকে আপ্যায়ন করলে কথকের আবেগবিহ্বল মন সংযম হারিয়ে নিজের হৃদয় উন্মোচন করে ফেলে৷ বর্মা যাত্রী শ্রীকান্ত জানায় সে বর্মা থেকে যদি কোনোদিন ফিরে আসে তাহলে তার জন্যই আসবে৷ পিয়ারী তার দেবদুর্লভজনের এ হেন কথায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে নিজের অপরাধী মন ধরা দেয় প্রেমাস্পদের কাছে৷ তাই সে জিজ্ঞাসা করে—‘‘আগে বল ও লোকটা এখানে থাকাতে তুমি আমাকে কোন মন্দ মনে করনি?’’৪৯ তার পরে বর্ষিত হয় কঠিন মর্মদাহী এক প্রশ্ন যা শুধু কথকের উদ্দেশ্যে নয় সমস্ত সমাজের জন্য৷ রাজলক্ষ্মীর ভেতরকার নারীসত্তার বিদ্রোহ ধ্বনিত হয় এই বাক্যবন্ধের দ্বারা—‘‘আচ্ছা, জিজ্ঞেস করি তোমাকে, পুরুষমানুষ যত মন্দই হয়ে যাক, ভাল হ’তে চাইলে তাকে ত কেউ মানা করে না; কিন্তু আমাদের বেলায়ই সব পথ বন্ধ কেন? অজ্ঞানে, অভাবে প’ড়ে একদিন যা করেচি, চিরকাল আমাকে তাই করতে হবে কেন? কেন আমাদের তোমরা ভাল হতে দেবে না?’’৫০ এরপর রাজলক্ষ্মী শোনে শ্রীকান্তের বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা৷ তার সঙ্গে পরামর্শ না করে তাকে না দেখিয়ে তার প্রেমাস্পদ যে নিজের বিয়ে ঠিক করতে পারে তা বুঝে তার প্রদীপ্ত মুখ ম্লান হয়ে যায়৷ কিন্তু পরক্ষণেই যখন শোনে শ্রীকান্তের মায়ের প্রতিশ্রুতির কথা তখনই বুদ্ধিমতী রাজলক্ষ্মী শ-পাঁচেক টাকা পাঠিয়ে দিয়ে মেয়েটির অন্যত্র বিবাহের ব্যবস্থা করে দেয়৷ শ্রীকান্ত-রাজলক্ষ্মীর প্রণয় গাঢ় থেকে গাঢ়তর হলেও তা পরিণতির সীমা স্পর্শ করতে পারে না৷ তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সুখী দাম্পত্য অতিবাহিত করতে পারে না৷ প্রথমত রাজলক্ষ্মী পরস্ত্রী-বিধবা তার উপর সে গণিকা৷ কোনো দিক থেকেই সে শ্রীকান্তের সঙ্গে থাকার উপযোগী নয়৷ তাই বর্মা যাওয়ার পূর্বে তাকে সে দুর্বলতা প্রকাশ করলে, শুধু পিয়ারীকে নয় পিয়ারীর বিত্ত-বৈভব সমস্ত অস্বীকার করলে তার পায়ের উপর ক্রন্দনরতা রাজলক্ষ্মীর হাত ধরে শ্রীকান্ত ভাবতে থাকে যে—একদিন এই পিয়ারীই মাতৃত্বের দোহাই দিয়ে তাকে প্রায় জোর করে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলেছিল, সেদিন তার ধৈর্য ও মনের জোর দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল সে আর আজ তার সকরুণ কণ্ঠের এতবড় দুর্বলতায় তার বুক ফাটতে থাকে৷ কিন্তু কিছুতেই তার কোনোকিছুকে গ্রহণ করার স্বীকৃতি দিতে পারে না৷ তাই নিজেকে সংযত করে তাকে কথা দেয়—‘‘তোমাকে সঙ্গে নিতে পারিনা বটে, কিন্তু যখনি ডাকবে, তখনি ফিরে আসব৷ যেখানেই থাকি, চিরদিন আমি তোমারই থাকব রাজলক্ষ্মী!’’৫১

বহুদিন পর পিয়ারী কলকাতার জাহাজঘাটে তার প্রেমিকের দর্শন পায়৷ বর্মা থেকে ফিরে এলে সে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে৷ সে সকল চক্ষুলজ্জাকে উপেক্ষা করে বহুদিন পর নিজের মানুষটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কাটাবে বলে তার সঙ্গে একাই গরুর গাড়িতে করে বৌবাজারের বাসাবাড়ির সামনে উপস্থিত হয়৷ সমস্ত রাস্তা উভয়ের দীর্ঘ অদর্শনের শূন্যতাকে উপভোগ করতে থাকে৷ শ্রীকান্ত তার জন্য নির্ধারিত ঘরে প্রবেশ করে দেখে সেখানকার সমস্তই তার জন্যই পরিপাটী করে সাজিয়েছে রাজলক্ষ্মী৷ তার প্রত্যেক পছন্দের জিনিসপত্রে সুসজ্জিত সেই ঘর৷ রাজলক্ষ্মীর সেবায় যত্নে মুগ্ধ শ্রীকান্ত তার সেই নির্লোভ প্রেমকে কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারে না৷ কথক যত দেখে রাজলক্ষ্মীকে তত বিভোর হয়ে যায়৷ নানা রূপে নানা আঙ্গিকে সে ধরা দেয় তার সম্মুখে৷ এই কলকাতার বাসায় সে নতুনভাবে দেখছে তাকে৷ অসুখ ছাড়া সে কোনোদিনও তার বিছানার অত কাছে গিয়ে বসেনি, অত কাছে বসে বাতাস পর্যন্ত করেনি৷ কিন্তু এবার সে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করল না৷ চাকর-বাকর এমনকি বঙ্কুর সামনেই দর্পভরে নিজেকে প্রকাশ করে দিল৷ যে কি না একদিন বঙ্কুর জন্যই পাটনার বাড়ি থেকে তাকে বিদায় করে দিয়েছিল সে ভিন্ন আরেক মানুষ হয়ে, ভিন্ন ভাবনা নিয়ে তার সামনে উপস্থিত হতে চায়৷ অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে রাজলক্ষ্মী ধীরে ধীরে তার নিজের গণিকাসত্তা ভুলে আত্মপ্রত্যয়ী হতে আরম্ভ করেছে৷ যার ফল স্বরূপ সে তার সত্যকারের ভালোবাসাকে আর কারও সামনেই আড়াল করতে চায় না৷

রাজলক্ষ্মীর মন অত্যন্ত অনুভূতিশীল৷ শ্রীকান্তকে নিয়ে কাশীতে যাওয়ার পথে কেরানিদের জীবন আলোচনা প্রসঙ্গে তার অনুভূতিপরায়ণ, পরদুঃখে কাতর হওয়া মন নিমেষেই অপার সহানুভূতিতে সিক্ত হয়ে গেছে৷ কেরানিদের পশুবৎ জীবনযাপনের বর্ণনা শুনে তার চোখ জলে ভেসে গেছে৷ তার সেই করুণ মুখচ্ছবি শ্রীকান্তকে ব্যথিত করেছে ফলে সে কেরানিদের একশো-দেড়শো টাকা বেতন, উপরি পাওনা ইত্যাদি বিষয় কল্পনা করতে বাধা দেয়নি রাজলক্ষ্মীকে৷ এবং এই কথা প্রসঙ্গে উপরি রোজগার হিসেবে শ্রীকান্ত ‘প্যালা’-র কথা বলে ব্যঙ্গ করলে বাইজি পিয়ারী আহত হয়েছে এবং মুখ ভার করে জানালার দিকে চেয়ে অনুযোগ করে বলেছে—‘‘তোমাকে যতই দেখচি, ততই তোমার ওপর থেকে আমার মন চলে যাচ্চে৷ তুমি ছাড়া আর আমার গতি নেই জানো ব’লেই আমাকে তুমি এমন ক’রে বেঁধো৷’’৫২ রাজলক্ষ্মীর অনুভূতিপ্রবণ হৃদয়ের সংবাদ পাওয়া যায় পাঁড়েজীর প্রসঙ্গে৷ হতদরিদ্র পাঁড়েজী তার অসুস্থ মেয়ের জন্য একটা মাটির পুতুল কিনে নিয়ে যাচ্ছিল৷ প্লাটফর্মে আড়াইটের লোকাল ট্রেন ছাড়ে ছাড়ে অবস্থায় দৌঁড়ে গিয়ে ট্রেন ধরার চেষ্টা করলে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার কারণে রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে ধাক্কা লেগে তার হাতের সেই পুতুল ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়৷ সে ট্রেন ছেড়ে দেবে জেনেও পুতুলের টুকরোগুলো কুড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে৷ ফলস্বরূপ ট্রেন ছেড়ে দেয়৷ সে ফিরে এসে পুনরায় মাটির পুতুলের দেহাংশগুলি সংগ্রহ করতে থাকলে শ্রীকান্ত তার কারণ জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, তার অসুস্থ মেয়ের বায়না রাখতে অনেক কষ্ট করে দু-আনা দিয়ে মাটির পুতুলটা কিনেছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তা ভেঙ্গে যাওয়ায় মেয়ের বিশ্বাস অর্জনের জন্য সেই ভাঙ্গা টুকরোগুলি দেখিয়ে বলবে যে সে তার ইচ্ছে পূরণ করার জন্য কিনেছিল কিন্তু তা ভেঙ্গে গেছে এবং পরের মাসে তাকে আরেকটা কিনে দেবে৷ লোকটি জানায় তার পুতুলও গেল, ট্রেনও পেল না৷ ঐ ট্রেনে গেলে দুঘন্টা আগে পৌঁছত এবং দুঘন্টা আগেই মেয়েকে দেখতে পেত৷ পাঁড়েজীর এই কাহিনি রাজলক্ষ্মীর দু’চোখে শ্রাবণের ধারা নামায়৷ সে অত্যন্ত মমতায় পাঁড়েজীকে তাদের গাড়িতে তুলে নেয়, তার অসুস্থ মেয়ের জন্য উপহার পাঠায় দামি একটি শাড়ি৷ শ্রীকান্ত লক্ষ্য করছে একটু একটু করে রাজলক্ষ্মীর জীবনের পরিবর্তনের চোরা স্রোতকে৷ তার ভেতরকার পিয়ারীবাই যতই মরে যাচ্ছিল ততই যেন সে নারীত্বের মহিমায় পূর্ণমানবীতে রূপান্তরিত হচ্ছিল৷ এ প্রসঙ্গে কথকের অভিব্যক্তি—‘‘রাজলক্ষ্মীকে আমি চিনিয়াছিলাম৷ তাহার পিয়ারী বাইজী যে তাহার অপরিণত যৌবনের সমস্ত দুর্দাম আক্ষেপ লইয়া প্রতি মুহূর্তেই মরিতেছিল, সে আমি লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছিলাম৷ আজ সে নামটা উচ্চারণ করিলেও সে যেন লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশিয়া যাইতে থাকে৷’’৫৩ রাজলক্ষ্মী শান্ত ও স্থির৷ তার ভেতরের কামনা-বাসনাগুলোও কোথায় যেন ডুব দিয়েছে তার তল পাওয়া যায় না আর সেখান থেকে জাগ্রত হয়েছে তার মাতৃত্ব৷ তার সেই সর্বগ্রাসী মাতৃত্ব প্রকাশের পথ না পেয়ে যেন কুম্ভকর্ণের মতো বিরাট ক্ষুধায় ক্ষুধার্ত৷ আর সে বিশাল মাতৃত্বের ক্ষুধাই শ্রীকান্তের মধ্যে আশঙ্কায় বীজ বপন করেছে৷ সে পাটনা শহরে একদিন বঙ্কুর প্রতি স্নেহ দেখে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু ‘‘আজ তাহার সেই মূর্তি স্মরণ করিয়া আমার অত্যন্ত ব্যথার সহিত কেবলি মনে হইতে লাগিল, তত বড় আগুনকে ফুঁ দিয়া নিভানো যায় না বলিয়াই আজ পরের ছেলেকে ছেলে কল্পনা করার ছেলেখেলা দিয়া রাজলক্ষ্মীর বুকের তৃষ্ণা কিছুতেই মিটিতেছে না৷ তাই আজ একমাত্র বঙ্কুই তাহার কাছে পর্যাপ্ত নয়, আজ দুনিয়ার যেখানে যত ছেলে আছে, সকলের সুখদুঃখই তাহার হৃদয়কে আলোড়িত করিতেছে৷’’৫৪

রাজলক্ষ্মী তার নিজের জীবনের সব অনিষ্টের মূলে যে টাকার লোভ দায়ী তা তার জীবন অভিজ্ঞতা দিয়ে অনুধাবন করেছে৷ পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করেছে গণিকা হতে, তার সঙ্গে কাজ করেছে তার মায়ের টাকার লোভ৷ সে তার জীবনের সেই পরিণতি মেনে নিতে পারেনি৷ নিজেকে শোধরানোর শত চেষ্টা করেও সমাজের স্বাভাবিক স্রোতে নিজেকে ফেরাতে পারে না৷ সমাজ তাকে গ্রহণ করে না৷ তাই সে প্রবল আত্মগ্লানিতে বলতে পারে—‘‘আজ ত আমার টাকার অভাব নেই, কিন্তু আমার মত দুঃখী কি কেউ আছে? পথের ভিক্ষুক যে সেও বোধ হয় আজ আমার চেয়ে ঢের ঢের বেশি সুখী৷’’৫৫ রাজলক্ষ্মী নিজের যন্ত্রণা ভুলে সমস্ত টাকা-পয়সা-ধন-সম্পত্তিকে অবহেলা করে শুধুমাত্র সুখে ঘর বাঁধতে চায়৷ যেমন করে বর্মাতে অভয়া-রোহিণী ঘর বেঁধেছে৷ তার কথার সেই প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না শ্রীকান্তর৷ সে তাই বলে—‘‘তোমার জন্য আমি সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু সম্ভ্রম ত্যাগ করি কি ক’রে?’’৫৬ তার এ কথার জবাবে রাজলক্ষ্মী তার হাত দুখানি নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলতে থাকে—‘‘তোমাকে কিছুই বিসর্জন দিতে হবে না৷ কিন্তু, তুমি কি মনে কর শুধু তোমাদেরই সম্ভ্রম আছে, আমাদের নেই? আমাদের পক্ষে সেটা ত্যাগ করা এতই সহজ? তবু তোমাদের জন্যেই কত শত-সহস্র মেয়েমানুষ যে এটাকে ধুলোর মত ফেলে দিয়েচে, সে কথা তুমি জানো না বটে, কিন্তু আমি জানি৷’’৫৭ রাজলক্ষ্মীর এই কথার মধ্য দিয়ে ধ্বনিত হয়েছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতি তীব্র খোঁচা৷

তারা কাশীতে উপস্থিত হয়ে আশ্রয় নেয় রাজলক্ষ্মীর নিজের বাড়িতে৷ উপরের দুটো ঘর ছাড়া পুরো বাড়িটাই নানা বয়সের বিধবায় পরিপূর্ণ৷ সকলেই রাজলক্ষ্মীর আশ্রিতা এবং পালিতা৷ অপার স্নেহ-মমতায় একবাড়ি সহায়-সম্বলহীনা বিধবা নারীদের প্রতিপালন করে যাচ্ছে রাজলক্ষ্মী যাতে অবস্থার বিপাকে পড়ে তাদের পিয়ারীবাই না হতে হয়৷ সেখানে থাকাকালীন সময়ে সে শ্রীকান্তকে প্রয়াগে স্নান করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে শ্রীকান্ত মুশকিলে পড়ে৷ সেখানে কর্মোপলক্ষে তার এক জ্ঞাতিখুড়ো বসবাস করে৷ একজন গণিকার সমভিব্যাহারে তাকে দেখলে তার যে আর দুর্নামের শেষ থাকবে না তা তৎক্ষণাৎ তাকে আশঙ্কিত করে ফেলে৷ শ্রীকান্তের সেই ভাবনা বুঝে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না রাজলক্ষ্মীর৷ তাই প্রবল অভিমানে তীব্র শ্লেষে সে প্রশ্ন করে—‘‘আমি সঙ্গে থাকলে হয়ত কেউ দেখে ফেলতেও পারে, না?’’৫৮ সে শ্রীকান্তের বিপদে বার বার রক্ষা করেছে, সেবায় যত্নে তাকে বার বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে—তার সঙ্গস্পর্শকে স্বীকার করেও তবু শ্রীকান্তের সংকোচের শেষ নেই৷ সে মেয়েদের শ্রদ্ধা করে নারীদের খুব সহজে খারাপ ভাবতে পারে না তথাপি এক গণিকা নারীকে তার ভালোবাসার গভীরতা বুঝেও সামাজিক স্বীকৃতি দিতে তার কুন্ঠার অন্ত্য নেই৷ শ্রীকান্তের সেই মনোবৃত্তি রাজলক্ষ্মীর আত্মাভিমানে আঘাত হানে ফলে সে বহুদিন পর তাকে উপেক্ষা করে বেড়িয়ে যায় মুজরা করতে৷ তার পোশাক-পরিচ্ছদ সমস্তই নগরবিনোদিনীসুলভ৷ তাকে শাস্তি দিতে শ্রীকান্ত নিজেই তার পথ থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়৷ শ্রীকান্ত বোঝে পিয়ারীর দুর্বলতা কোথায়৷ শত রাগ অভিমান সত্ত্বেও পিয়ারী কিছুতেই তার অনুপস্থিতি মেনে নিতে পারে না৷ তার জীবন উৎসর্গ করা ভালোবাসা দিয়েও সে নিজেকে শ্রীকান্তের উপযোগী করে তুলতে পারেনি, নিজের গণিকার খোলস ত্যাগ করেও সেই গ্লানি থেকে কেউ তাকে মুক্তি দেয়নি তাই আহত অভিমানে সে বের হয় পুনরায় মুজরা করতে৷ তার এই মুজরাকে শ্রীকান্ত অভিজ্ঞানিত করে লোভ নাম দিয়ে৷ সে রাজলক্ষ্মীকে জানায় যে সে কিছুতেই তার সেই লোভ ত্যাগ করতে পারবে না৷ তার অনেক টাকা, অনেক রূপগুণ, অনেক প্রভূত্ব৷ সংসারে এগুলোই সব থেকে লোভের জিনিস৷ সে তাকে ভালোবাসতে পারে, শ্রদ্ধা করতে পারে, তার জন্য অনেক দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারে কিন্তু সেই মোহ কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারবে না৷ রাজলক্ষ্মী তাকে অনুরোধ করে তাকে সেই নীচ প্রবৃত্তি থেকে উদ্ধার হতে সহায়তা করার জন্য৷ শ্রীকান্ত তাকে তার সমাজ সম্পর্কে সচেতন করে৷ কারণ সমাজ মনসা পণ্ডিতের পাঠশালার রাজলক্ষ্মীকে ভুলে গেছে, সে শুধু চেনে পাটনার প্রসিদ্ধ বাই পিয়ারীবাইজিকে৷ ফলে শ্রীকান্ত যে রাজলক্ষ্মীর প্রতি অনুরক্ত পিয়ারীর প্রতি নয়, সমাজ সেটা বুঝবে না—শুধু শ্রীকান্তকে ছোটো করেই যাবে৷ সংসার সমাজের কথা বলে রাজলক্ষ্মীকে থামিয়ে দিয়ে শ্রীকান্ত বিদায় নেয় সেখান থেকে৷ বহুদিন পর উপস্থিত হয় তার ফেলে যাওয়া গ্রামে৷ সেখানে প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হলে স্বয়ং রাজলক্ষ্মী উপস্থিত হয়ে তার পরিচর্যা শুরু করে দিলে তাকে সশরীরে গ্রামে উপস্থিত দেখে শ্রীকান্তের আর সংকোচের পরিসীমা থাকে না৷ তার মান-সম্মান-সম্ভ্রম হারানোর মহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত জেনেও রাজলক্ষ্মী তাতে এতটুকু বিচলিত হয় না৷ কারণ সে স্থির চিত্তে জবাব দেয় তার লজ্জা-শরম, মান-সম্মান সমস্ত শ্রীকান্ত এবং পৃথিবীতে তার বাড়া কিছু নাই৷ শ্রীকান্ত তার কথা শুনে মৃতবৎ পড়ে থাকে প্রতিবেশীগণের ভাবী প্রতিক্রিয়া স্মরণ করে৷ সেখানে কিছুক্ষণ পড়ে ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে প্রসন্ন ঠাকুরদা উপস্থিত হলে রাজলক্ষ্মীর সমস্ত দর্প, জেদ, মনের জোর নিমেষেই কর্পূরের মতো উবে যায়; তার মুখ মরার মতো ফ্যাকাশে হয়ে যায়৷ তার সেই মুখচ্ছবি মুহূর্তেই শ্রীকান্তের বিবেকশক্তিকে জাগ্রত করে৷ তার জন্য সমস্ত দুঃখ কষ্ট স্বেচ্ছায় বরণ করা মেয়েটিকে চূড়ান্ত ক্ষণে স্বীকৃতি জানিয়ে বলে—‘‘তুমি স্বামীর সেবা করতে এসেচ, তোমার লজ্জা কি রাজলক্ষ্মী! ঠাকুরদা, ডাক্তারবাবু এঁদের প্রণাম কর৷’’৫৯ গ্রামের মানুষজন পিয়ারীবাইকে চেনে না, চেনে পাচকঠাকুরের সঙ্গে বিয়ে হওয়া রাজলক্ষ্মীকে৷ সে পাচকঠাকুরের মৃত্যুতে তাদের চোখে বিধবা৷ আর গ্রামীণ সমাজে পুনর্বিবাহিত বিধবারা বারাঙ্গনা অপেক্ষা বেশি সম্মান পায় না৷ শ্রীকান্তের দেওয়া সেই মিথ্যে পরিচয় রাজলক্ষ্মীকেও নতুন কোনো সম্মান দিতে পারেনি, তেমনি নিজেও তেমন কোনো উচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়নি৷ আর সেই আত্মপীড়া থেকেই সমাজ প্রতিবেশীদের থেকে মুখ লুকোতে অসুস্থ শ্রীকান্তকে নিয়ে সে রাতের গাড়িতেই কলকাতা রওনা হয়৷ শ্রীকান্ত নিঃশেষে নিজেকে রাজলক্ষ্মীর হাতে সঁপে দেয়৷ রাজলক্ষ্মীর শুচিতায়, ত্যাগে, সংযমে, করুণায় সে যেন অন্য আরেক সত্তা আবিষ্কার করতে পেরেছে তার মধ্যে৷ তাই তার মনে হয়—‘‘যে রাজলক্ষ্মীর অন্তর-বাহির আমার কাছে আজ আলোর ন্যায় স্বচ্ছ হইয়া গেছে, সে কেমন করিয়া এতদিন বৎসরের পর বৎসর ব্যাপিয়া পিয়ারীর জীবন যাপন করিতে পারিল!’’৬০ শ্রীকান্ত বরাবরই লক্ষ্য করেছে যে সমস্ত বিষয়ে রাজলক্ষ্মীর অপরিসীম কর্তৃত্ব ক্ষমতা৷ সে কর্তৃত্বে শাসন নেই; তা ভালোবাসার অদৃশ্য গ্রন্থিতে বাঁধা৷ তার আদেশ তার উপদেশের মধ্যে এমন একটা জোর থাকে যে তা উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারও নেই৷ চাকর-বাকর থেকে শুরু করে শ্রীকান্ত পর্যন্ত সে আদেশ মানতে বাধ্য৷ রতনের কথায় তেমনই অভিব্যক্তি৷ রাজলক্ষ্মীর বীরভূমের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গঙ্গামাটি গ্রামে নতুন ক্রয় করা জমিদারিতে যেতে ইচ্ছে নেই রতনের৷ তার পরেও তাকে যেতে হবে৷ সে বিষয়ে শ্রীকান্ত তার নিজের ইচ্ছের প্রাধান্য দিতে বললে সে বলে যে মা পারেন৷ কি জানি কি জাদুমন্ত্র সে জানে, যদি বলে যমের বাড়ি যেতে হবে তাহলেও অতগুলো লোকের মধ্যে কারও সাহস হবে না তাতে আপত্তি করার৷ রাজলক্ষ্মী তার গণিকা জীবনের মধ্যে রক্ষা করে গেছে তার শুচিবায়ুগ্রস্ততাকে; বিশেষ করে তার খাবার নিয়ে৷ যে নারী পরপুরুষের সামনে মুজরা করে, গুড়গুড়ি টেনে তামাক খেতে পারে, সাত ঘাটের জল খাওয়া সেই নারীর সেই আচার-নিয়ম ইত্যাদির বৈসাদৃশ্য শ্রীকান্তের মনকে যেন নতুন করে আঘাত করে৷ তার সেই শুচিবায়ুগ্রস্ততা অনেক সময় কথককে পীড়া দিয়েছে, নিরর্থক জ্ঞান হয়েছে, এমন কি অত্যাচার বলেও মনে হয়েছে কিন্তু মুহূর্তে সমস্ত কিছু যেন ধুয়ে মুছে গিয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে৷ একদিন তার মনে হয়েছিল শৈশবে রাজলক্ষ্মী যাকে ভালোবেসেছিল, তাকে পিয়ারী তার উন্মত্ত যৌবনে কোন অতৃপ্ত লালসার পঙ্ক থেকে এমন করে সহস্রদল বিকশিত পদ্মের মতো বের করে দিতে পারল? তাই তার মনে হয় সে তো পিয়ারী নয়; সে যে রাজলক্ষ্মীই৷ রাজলক্ষ্মী ও পিয়ারী নামের মধ্যে যে তার জীবনের কতবড় ইঙ্গিত গোপন ছিল তা কথকের চোখে এতদিন ধরা পড়েনি৷ গঙ্গামাটি যাওয়ার প্রাক্কালে রাজলক্ষ্মীর নানা কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শ্রীকান্ত তার সত্যকার রূপটিকে চিনে নিয়েছে৷ তাই দৈহিক কলুষতাকে ছাপিয়ে নারীর মনকে বিচার করতে পেরেছে সে৷ সে মনে মনে বলেছে—‘‘মানুষ ত কেবল তাহার দেহটাই নয়! পিয়ারী নাই, সে মরিয়াছে৷ কিন্তু একদিন যদি সে তার ওই দেহটার গায়ে কিছু কালি দিয়াই থাকে ত সেইটুকুই কি কেবল বড় করিয়া দেখিব, আর রাজলক্ষ্মী যে তাহার সহস্র-কোটি দুঃখের অগ্নিপরীক্ষা পার হইয়া আজ তাহার অকলঙ্ক শুভ্রতায় সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহাকে মুখ ফিরাইয়া বিদায় দিব৷’’৬১ কথক তাকে, তার শুদ্ধতাকে ফিরিয়ে দিতে পারেনি৷ আর শ্রীকান্তের সেই কথার মধ্য দিয়ে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নারীর চিরন্তন পবিত্রতাকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পেরেছেন৷ তার চিন্তায় নারীর সতীত্ববোধ তার দেহে নয়; মনে৷ মন যদি দেহের কলুষতাকে ছাপিয়ে শুদ্ধ হতে পারে তাহলে সেই মসীলিপ্ত দেহও চির পবিত্রতা অর্জন করে৷ শ্রীকান্ত নারীর সেই রূপটাকে যথার্থ উপলব্ধি করতে পেরেছে৷

শ্রীকান্তকে নিজের করে পেয়ে রাজলক্ষ্মীর দায়িত্ব যেন আরও বহুগুণে বেড়ে যায়৷ সে তার নিজের মানুষটিকে একান্ত করে পাওয়ার অভিলাষে এবং গঙ্গামাটিতে কেনা নতুন জমিদারির কার্যপোলক্ষে তাকে নিয়ে উপস্থিত হয় বীরভূমের সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে৷ সেখানে ধীরে ধীরে তার মধ্যে নানা পরিবর্তন লক্ষ্য করে শ্রীকান্ত৷ তার সাজ-পোশাকের যেমন সাধারণত্ব চলে আসে তেমনি নায়েব কুশারী মহাশয়ের ভ্রাতৃবধূ সুনন্দার সংস্পর্শে ধর্মপরায়ণ হয়ে ব্রতধর্মে নিজেকে উৎসর্গ করে দেয়৷ তার সেই নতুন ধর্মবোধের জোয়ারে উপেক্ষিত হতে থাকে শ্রীকান্ত৷ যে ভালোবাসার সীমাহীন আপ্যায়নে শ্রীকান্তের মত একজন পথিক মনোবৃত্তির মানুষকে নিজের করায়ত্ব করতে সক্ষম হয়েছিল সেই রাজলক্ষ্মীর নিরব ঔদাসীন্যে নিজেকে তার জীবনে বড় খাপছাড়া মনে হয়৷ সে বর্মা চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে রাজলক্ষ্মী সেখানেও জোরালো কোনো আপত্তি তোলে না৷ শুধু তার বিদায় মুহূর্তে প্রতিশ্রুতি আদায় করতে ভোলে না যে সে যেন বর্মা যাওয়ার আগে তার সঙ্গে একবার দেখা করে যায়৷ শ্রীকান্ত প্রায় উদাসীন হয়েই সেখান থেকে চলে আসে৷ চিঠির মধ্য দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে রাজলক্ষ্মী৷ তার পর বর্মা যাওয়ার প্রাক মুহূর্তে সোজা কাশী গিয়ে উপস্থিত হয় তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে৷ যাত্রাপথে তাকে নিয়ে নানা রোমান্টিক কল্পনা তার চিত্তকে উদবেল করে রাখে৷ কিন্তু কাশীর বাড়িতে রাজলক্ষ্মীর নতুন রূপ দেখে স্তব্ধ হয়ে যায় সে৷ সে দেখে—‘‘সে যে শুধু থানকাপড় পরিয়া দেহের সমস্ত অলঙ্কার খুলিয়া ফেলিয়াছে তাই নয়, তাহার সেই মেঘের মত পিঠজোড়া সুদীর্ঘ চুলের রাশিও আর নাই৷ মাথার পরে ললাটের প্রান্ত পর্যন্ত আঁচলটানা, তথাপি তাহারই ফাঁক দিয়া কাটা-চুলের দুই-চারিগোছা অলক কন্ঠের উভয় পার্শ্বে ছড়াইয়া পড়িয়াছে৷ উপবাস ও কঠোর আত্মনিগ্রহের এমনি একটা রুক্ষ শীর্ণতা মুখের ’পরে ফুটিয়াছে যে হঠাৎ মনে হইল, এই একটা মাসেই বয়সেও সে যেন আমাকে দশ বৎসর অতিক্রম করিয়া গিয়াছে৷’’৬২ রাজলক্ষ্মীর সেই বৈধব্যবেশ শ্রীকান্তের হৃদয়ে স্থান পাওয়া সমস্ত রঙীন কল্পনাসৌধকে নিমেষে ধূলিসাৎ করে দেয়৷ সে মনে মনে শুধু জোর সঞ্চয় করার চেষ্টা করে যে সে যেন চিরদিনের মতো তাকে পরিত্যাগ করে যেতে পারে৷ সে যেন আর কোনোদিন রাজলক্ষ্মীর কোনো বন্ধনে আবদ্ধ না হয়৷ পিয়ারীবাই নিজের খোলস ত্যাগ করে সত্যসত্যই রাজলক্ষ্মী হয়ে উঠেছে৷ সেখানে শুধুই বিধবার নিষ্ঠা আর সংযম; প্রণয়ের কোনো স্থান নেই৷ কিন্তু সেই ধর্মীয় নিষ্ঠা, বৈধব্যের সংযম বেশিদিন রাজলক্ষ্মীকে বেঁধে রাখতে পারেনি৷ শ্রীকান্তের প্রতি তার নিবেদিত প্রাণ মন বিদ্রোহ করে উঠেছে এবং সেখানে জয় হয়েছে তার নিষ্পাপ ভালোবাসার৷ সব কিছু ছেড়ে দিয়ে তার প্রেমাস্পদের সন্ধান নিতে উপস্থিত হয়েছে শ্রীকান্তের কলকাতার বাসা বাড়িতে৷ কিন্তু সেখানে উপস্থিত নেই তার কাঙ্খিতধন৷ তাই ফিরে আসার অনির্দেশ্য অপেক্ষায় বাসার নিকটবর্তী আরেকটা বাসা নিয়ে অহরহ তার প্রতীক্ষার প্রহর গুণেছে৷ ঈশ্বর তাকে নিরাশ করেনি, চারদিন অপেক্ষার পর সে দেখতে পেয়েছে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে৷ শ্রীকান্ত যত দিন তাকে দেখছে তার মধ্যে দেখেছে এক অভাবনীয় জোর করার ক্ষমতা৷ তার সেই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে তার ভাবনায়৷ সে দেখেছে বন্ধুর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়ে সাহাসিকতার পরিচয় দিতে শ্মশানঘাটে রওনা দিলে রাজলক্ষ্মী তার পথরোধ করেছিল৷ তখনো শ্রীকান্ত তাকে চেনে নি সে যে রাজলক্ষ্মী তবু বলেছিল—‘‘যাবে বললেই তোমাকে যেতে দেব নাকি? কৈ যাও ত দেখি! এই বিদেশে বিপদ ঘটলে দেখবে কে? ওরা, না আমি? এবার তাহাকে চিনিলাম৷ এই জোরই তাহার চিরদিনের সত্য পরিচয়৷ জীবনে এ আর তাহার ঘুচিল না—এ হইতে কখনো কেহ তাহার কাছে অব্যাহতি পাইল না৷ আরায় পথের প্রান্তে মরিতে বসিয়াছিলাম, ঘুম ভাঙ্গিয়া চোখ মেলিয়া দেখিলাম শিয়রে বসিয়া সে৷ তখন সকল চিন্তা সঁপিয়া দিয়া চোখ বুজিয়া শুইলাম৷ সে ভার তাহার, আমার নয়৷ দেশের বাড়িতে আসিয়া জ্বরে পড়িলাম৷ এখানে সে আসিতে পারে না—এখানে সে মৃত—এর বাড়া লজ্জা তাহার নাই, তথাপি যাহাকে কাছে পাইলাম—সে ওই রাজলক্ষ্মী৷’’৬৩ শুধু সেখানে নয় নানা পারিপার্শ্বিক চাপে যখন সে প্রায় বাধ্য হতে যাচ্ছিল পুটুকে বিয়ে করতে তখনো তার সামনে প্রবল সাবধানবাণী উচ্চারণ করে তাকে সচেতন করে দিয়ে সে বলেছে—‘‘যদি কখনো অসুখে পড়ো দেখবে কে—পুঁটু? আর আমি ফিরে আসব তোমার বাড়ির বাইরে থেকে চাকরের মুখে খবর নিয়ে? তার পরেও বেঁচে থাকতে বলো নাকি?’’৬৪ তার সেই রাজলক্ষ্মী প্রতীক্ষার প্রহর গুণে তার জন্য চার দিন থেকে অপেক্ষা করে রয়েছে৷ সেখানে রাজলক্ষ্মীকে যেন নতুন চোখে আবিষ্কার করলো সে৷ তার দেহে রূপ আর ধরে না৷ পিয়ারীকে মনে পড়ে গেল কথকের৷ সে যেন নবকলেবর ধরে পুনরায় তার সামনে ফিরে এসেছে৷ রাজলক্ষ্মী যেন নিজেকে নতুন করে ভেঙ্গে আবার গড়েছে৷ আগে সে অনেক গয়না পড়তো, মাঝখানে সব খুলে ফেলেছে, যেন সে সন্ন্যাসিনী৷ তারপর পুনরায় সেই সকল পরিধান করতে আরম্ভ করেছে সে৷ সাধারণ আটপৌরে শাড়ি পড়েও তাকে অসাধারণ সুন্দরী ভাবতে কথকের সামান্যতম দ্বিধাবোধও হয় না৷ রাজলক্ষ্মী নিজেকে একটু একটু করে মেলে ধরছে তার সামনে আর সেখানে উঠে আসছে তার কৃচ্ছসাধন ব্রত-উপবাসের কথা, অবশেষে চরম অপ্রাপ্তির জ্বালা৷ সে নিজে থেকে একদিন অসম্মান করেছিল শ্রীকান্তকে সেই যন্ত্রণাই বিদ্ধ করছে তাকে৷ তাই সে বলে—‘‘এত পাপ করেও সংসারে এত ভাগ্য আমার মত কারো কখনো দেখেচো? কিন্তু আমার তাতেও আশা মিটলো না, কোথা থেকে এসে জুটল ধর্মের বাতিক, আমার হাতের লক্ষ্মীকে আমি পা দিয়ে ঠেলে দিলুম৷ গঙ্গামাটি থেকে চলে এসেও চৈতন্য হ’লো না, কাশী থেকে তোমাকে অনাদরে বিদায় দিলুম৷… বিষের গাছ নিজের হাতে পুঁতে এইবার তাতে ফল ধরল৷ খেতে পারিনে, শুতে পারিনে, চোখের ঘুম গেল শুকিয়ে, এলোমেলো কত কি ভয় হয় তার মাথামুণ্ডু নেই—গুরুদেব তখনো বাড়িতে ছিলেন, তিনি কি একটা কবজ হাতে বেঁধে দিলেন, বললেন, মা, সকাল থেকে এক আসনে তোমাকে দশ হাজার ইষ্টনাম জপ করতে হবে৷ কিন্তু, পারলুম কৈ? মনের মধ্যে হু-হু করে, পুজোয় বসলেই দু’চোখ বেয়ে জল গড়াতে থাকে—এমনি সময়ে এলো তোমার চিঠি৷ এতদিনে রোগ ধরা পড়ল৷’’৬৫ এ থেকে বোঝা যায় শ্রীকান্তকে তার সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে কম চেষ্টা করেনি৷ তার কলঙ্কিত জীবনে যুক্ত হয়ে সে যে চরম সামাজিক বয়কটের মধ্যে পড়বে তাও তার অজানা নয় তবু তার সমস্ত সাধ্যসাধনা ব্যর্থ হয়ে যায়৷ তার খাওয়া-পড়া, শোওয়া-বসা, ব্রত-উপবাস সমস্তই বৃথা মনে হয়৷ অবশেষে তার চিঠি পেয়ে বুঝতে পারে তার প্রকৃত শান্তি কোথায়—মুহূর্তেই তার উদ্দেশ্যে বাকি সব কিছুকে হেলায় অবহেলা করে চলে আসে সে৷

রাজলক্ষ্মীর মুখে বার বার ধ্বনিত হয়েছে সমাজের প্রতি, সমাজ ব্যবস্থার প্রতি প্রতিবাদ৷ সে যেমন তার জীবনের চরম দুর্গতির জন্য তার মায়ের অর্থলিপ্সাকে দায়ী করেছে তেমনি সে প্রসঙ্গে সমাজের নিষ্ঠুর নিয়ম-কানুনকেও ছেড়ে কথা বলেনি৷ তার মতে তার জীবনের সেই চরম পরিণতি তার একার নয়, তাদের দুইবোনের মতো বহু নারীর জীবনে ঘটে এবং তার মনে হয় কুকুর-বেড়ালের প্রতিও এমন দুর্গতি করতে মানুষের বাধে কিন্তু নারীর জন্য তাদের কোনো ক্ষমা নেই৷ সেই প্রসঙ্গে তার আশ্রিতা বিধবাদের কথাও সে বলতে ভোলে না যাদেরকে তাদের বাবা-মা আত্মীয় স্বজনেরা তারই মত হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিয়েছিল৷ তাই সে প্রবল যন্ত্রণার সঙ্গে বলতে পারে—‘‘যে-দেশে মেয়ের বিয়ে না হলে ধর্ম যায়, জাত যায়, লজ্জায় সমাজে মুখ দেখাতে পারে না—হাবা-বোবা-অন্ধ-আতুর কারও রেহাই নেই—সেখানে একটাকে ফাঁকি দিয়ে লোকে অন্যটাকেই রাখে, এ ছাড়া সে-দেশে মানুষের আর কি উপায় আছে বলো ত? সেদিন সবাই মিলে আমাদের বোন দুটিকে যদি বলি না দিত, দিদি হয়ত মরত না, আর আমি—এজন্মে এমন করে তোমাকে হয়ত পেতুম না, কিন্তু মনের মধ্যে তুমিই চিরদিন এমনি প্রভু হয়েই থাকতে৷’’৬৬ রাজলক্ষ্মীর কন্ঠে যেমন প্রতিবাদ তার কলঙ্কিত জীবনের প্রতি আক্ষেপ তেমনি সে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে সেই গ্লানি থেকে নিজেকে মুক্ত করতে৷ তার পেশার কারণেই হোক আর নারীসুলভ স্বভাবধর্মেই হোক পরকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা অপরিসীম৷ সে খানসামা রতনকে বাড়ির কাজের লোক হওয়া সত্ত্বেও পরম মমতায় যেমন আগলে রাখতে পারে তেমনি মানবসেবায় আত্মনিয়োগকারী আনন্দকে ভ্রাতৃস্নেহে তার অকৃত্রিম স্নেহভালোবাসা দিয়ে বুকে টেনে নেয়, নিজের হাতে পরম মমতায় রান্না করে খাওয়ায়৷ আনন্দ যে কোনো মায়ের বুক খালি করে দেশমাতার সেবায় সন্ন্যাস জীবন যাপন করছে রাজলক্ষ্মীর কোমল হৃদয় সেই মায়ের কথা, ঘরের কথা ভেবেও আদ্র হয়ে ওঠে এবং শ্রীকান্তকে জানায় কোনোদিন যদি সে আনন্দকে নিজের আয়ত্তের মধ্যে পায় তাহলে তাকে অবশ্যই সংসারে ফিরিয়ে দেবে৷ আর তার অনুরোধ, আহ্বান সংসার বন্ধনহীন সন্ন্যাসীকেও মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ করে দিতে পারে৷ এ প্রসঙ্গে আনন্দ শ্রীকান্তকে জানায়—‘‘ওঁর অনুরোধ ত অনুরোধ নয়, যেন মায়ের ডাক৷ পা আপনি চলতে শুরু করে৷ কত ঘরেই তো আশ্রয় নিই, কিন্তু ঠিক এমনটি আর দেখিনে৷’’৬৭ আর কমললতা যে তার প্রথম জীবনে ‘শ্রীকান্ত’ নামটিকে জীবনের জপমন্ত্র করেছিল, পরবর্তীকালে বৈষ্ণব জীবনে প্রবেশ করে সেই নামধারী শ্রীকান্তকে সশরীরে পেয়ে নিজের প্রেম নিবেদন করতে দ্বিধা করে না—সেই বৈষ্ণবী কমললতাও রাজলক্ষ্মীর মমতাপূর্ণ হৃদয়ে দিদির আসনে অধিষ্ঠিত হয়৷ আর তার মানুষ বশ করার এরূপ স্বভাব ধর্মের কথা শ্রীকান্ত বার বার নানা কথার ছলে ব্যক্ত করেছে তার সামনে৷

রাজলক্ষ্মী তার তপস্যা দিয়ে শেষ পর্যন্ত লাভ করেছে তার প্রেমাস্পদকে৷ সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতায় সে তার সঙ্গে কোনো বৈবাহিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারেনি—কারণ শ্রীকান্তকে বিবাহ করে সমাজের চোখে তাকে ছোটো করে দিতে তার হৃদয় সায় দেয়নি তথাপি ভালোবাসার বিনিসুতোর বন্ধনে বাঁধা পড়ে তার সমস্ত দায়ভার সে গ্রহণ করেছে, পুনরায় গঙ্গামাটিতে গিয়ে চেনা-জানা জগৎ থেকে অনেক দূরে তারা দুই নর-নারী সুখের ঘরকন্না শুরু করতে পেরেছে৷ যেখানে আর কোনো বিচ্ছেদের ব্যথা বাজেনি, কোনো হারানোর ভয় থাকেনি৷ শ্রীকান্তও তার চিরন্তনী মূর্তির কাছে নিরবে মাথা নত করেছে৷ তার চিন্তায় তার রাজলক্ষ্মী নামটি তার চরিত্রপোযোগী করে তৈরি করেছিলেন বিশ্বপিতা৷ তাই সব শেষে রাজলক্ষ্মীর চরিত্রের ঐশ্বর্য রূপটি শ্রীকান্তর মুখ দিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে এইভাবে—‘‘সকলের সকল শুভ-চিন্তায় অবিশ্রাম কর্মে নিযুক্ত—কল্যাণ যেন তাহার দুই হাতের দশ অঙ্গুলি দিয়া অজস্র ধারা ঝরিয়া পড়িতেছে৷ সুপ্রসন্ন মুখে শান্তি ও পরিতৃপ্তির স্নিগ্ধ ছায়া; করুণায় মমতায় হৃদয়-যমুনা কূলে কূলে পূর্ণ—নিরবচ্ছিন্ন প্রেমের সর্বব্যাপী মহিমায় আমার চিত্তলোকে সে যে-আসনে অধিষ্ঠিত, তাহার তুলনা করিতে পারি এমন কিছুই জানি না৷’’৬৮

এভাবে সমগ্র উপন্যাসটিতে একজন রূপাজীবা ত্যাগে, ভালোবাসায়, প্রেমে, নিষ্ঠায়, কর্তব্যে অসাধারণ নারীমূর্তি হিসেবে চিত্রিত হয়েছে৷ রাজলক্ষ্মী শুধু উপন্যাসে মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র নয়—সে উপন্যাসটির নায়িকাও৷ লেখক অসীম শ্রদ্ধার সঙ্গে তার জীবনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা-বিশ্লেষণ করে একজন গণিকা থেকে নারীত্বের শ্রেষ্ঠ সম্মানে অধিষ্ঠিত করেছেন তাকে৷

কমললতা :

‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের আরেকজন পদস্খলিতা নারী কমললতা৷ তার আসল নাম ঊষাঙ্গিনী৷ সিলেটে ছিল তার আদি বাসস্থান৷ কারবারি বাবা কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকতেন বলে তার পরম আদরের একমাত্র কন্যা ঊষাঙ্গিনীকেও সেখানে এনে মানুষ করতে থাকে৷ কলকাতাই তার প্রিয় স্থান৷ তাই কোনো কারণে দেশে গিয়ে থাকতে হলে বেশিদিন থাকা তার মনের পক্ষে সম্ভব হত না৷ সেই কলকাতাতেই সতেরো বছর বয়সে তার বিয়ে হয় এবং কলকাতাতেই সেই জীবনের প্রথম সঙ্গীটিকে হারায়৷ তার নামও ছিল শ্রীকান্ত৷ তারপর কমললতা যখন গহরগোঁসাই-এর কাছে প্রথম শ্রীকান্ত নাম শোনে, সে চমকে ওঠে এবং মনের নিভৃতে তাকে একটিবার দেখার জন্য প্রবল বাসনার জন্ম নেয়৷ মুরারিপুরের সেই আখড়ার বৈষ্ণবী কমললতা তার জীবনের কথা শোনাতে গিয়ে শ্রীকান্তকে আরও বলে যে কলকাতায় বিবাহের অব্যবহিত পরেই সে তার স্বামীকে হারিয়ে তাদের সরকার মন্মথর সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্কে আবদ্ধ হয়৷ যার ফলস্বরূপ একুশ বছর বয়সে তার গর্ভসঞ্চার হলে সেই দায় নিতে অস্বীকার করে প্রণয়ী মন্মথ৷ সে তার পিতৃহীন ভাইপো যতীনের উপর সেই দোষ আরোপ করে৷ ফলে যতীন আত্মহত্যা করে৷ অবশেষে তার লজ্জায় কাতর বাবা স্থির করে নবদ্বীপে গিয়ে বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা দিয়ে মন্মথ ও ঊষাঙ্গিনীর বিয়ে দেবে যাতে মেয়ের জীবনের সমস্ত যন্ত্রণা মুছে যায়, তার গর্ভের সন্তানের সুন্দর এবং নিরাপদ ভবিষ্যৎ পায়৷ বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষা নেওয়ার পর তার নতুন নামকরণ হয় কমললতা৷ কিন্তু সময় উত্তীর্ণ হতে চললেও মন্মথ সেখানে আসে না৷ অবশেষে তাদের বিয়ে দিনকতক পিছিয়ে যায় মন্মথর নিজের কোনো ব্যক্তিগত কারণের জন্য৷ নবদ্বীপের বাসায় কমললতার অসীম প্রতীক্ষায় দিনগুজরান হয়৷ অবশেষে শুভদিন উপস্থিত হলে বিবাহের প্রাক্কালে সে বাড়ির পুরোনো দাসীর কাছে জানতে পারে মন্মথর প্রকৃত রূপ৷ মন্মথ নিজের দোষ ভাইপো যতীনের স্কন্ধে আরোপ করে যতীনকে তো মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেই তৎসঙ্গে নিজের দায় নিতে অস্বীকার করে কুরি হাজার টাকার বিনিময়ে তাকে বিবাহ করতে সম্মত হয়েছে৷ কারণ সেই দুর্বৃত্ত সকলের কাছে বলেছে যতীনের দোষে সে পরের পাপ নিজ স্কন্ধে ধারণ করতে চলেছে, সেই জন্য বিশ হাজার টাকার বিনিময়ে সে তা করতে পারবে৷ সেই দাসীর মুখেই জানতে পারে সেই অপবাদে যতীনের গলায় দড়ি দেওয়ার কথা৷ কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় কমললতা৷ সে বলে—‘‘সেদিন ঠাকুরের প্রসাদী মালা ঠাকুরের পাদপদ্মে ফিরিয়ে দিয়ে এলুম৷ মন্মথর অশৌচ গেল কিন্তু পাপিষ্ঠা ঊষার অশৌচ ইহজীবনে আর ঘুচল না নতুনগোঁসাই৷’’৬৯ ঊষাঙ্গিনী অবশেষে মরা ছেলের জন্ম দিয়েছিল৷ পিতাকে পুনরায় গৃহে পাঠিয়ে তার মাকে জানাতে বলেছিল তার নিজের মৃত্যু সংবাদ কারণ মেয়ে মরে গেলে যতটা দুঃখ, মেয়ে কুলটা হয়ে বেঁচে থাকলে তার চেয়ে অধিক দুঃখ৷ সে তাই তার মায়ের কাছে মৃত হয়েই থাকতে চায়৷ অবশেষে কলকাতার পাট মিটিয়ে সে গৃহত্যাগী হয়৷ সঙ্গী পেয়ে যায় শ্রীবৃন্দাবন ধাম দর্শনের৷ তারপর বহু তীর্থ, গাছতলায় দিন কাটিয়ে সে উপস্থিত হয় মুরারিপুরের আখড়াতে৷ শ্রীকান্ত তার সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছে বৈষ্ণবদের সেবাদাসী প্রসঙ্গ, বাবাজীদের পরকীয়া সাধনাতত্ত্ব সম্পর্কে৷ সবকিছুর পেছনেই ছিল তার চাপা ব্যঙ্গ৷ কমললতাও বিচক্ষণ, সেও তার ঠাট্টা তামাশা দিয়ে সেই জিজ্ঞাসা প্রসঙ্গকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে৷

কমললতা জীবনের বহুঘাট পেরিয়ে বৈষ্ণব জীবন বরণ করেছে৷ যৌবনের সামান্য একটু পদস্খলন তাকে নির্বাসন দিয়েছে সংসার সীমানা থেকে৷ তার পরেও তার মধ্যেকার সেই চিরন্তনী নারীসত্তাটিকে উপেক্ষা করেননি রচনাকার৷ নারীর পরম ধর্ম সেবা, নিষ্ঠা দিয়ে সে অধিষ্ঠিত হয়েছে অনেক উচ্চ আসনে৷ সেবায়-যত্নে আখড়ায় ঘুরতে আসা শ্রীকান্তকে ভরিয়ে রেখেছে৷ আশ্রমের রীতিবিরুদ্ধ হলেও তার সখের দিকে লক্ষ্য রেখে ‘চা’ এর ব্যবস্থা করেছে৷ তার আশ্রমে আগত সকল অতিথিদেরই সে সেবা যত্নে মোহিত করে রাখে৷ কথকের বাল্যবন্ধু গহর তার উদাসী কবিমন দিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আত্মসমর্পণ করে তার কাছে৷ তার সম্পর্কেও লেখক মানুষ বশ করার অপার ক্ষমতার কথা ব্যক্ত করেছেন৷ আসলে নারীরা তাদের স্বাভাবিক গুণাবলী দিয়ে সকল কিছু জয় করার ক্ষমতা রাখে৷ গহরের মৃত্যুশয্যায় তার নিরবচ্ছিন্ন সেবার দ্বারা নিজের নারীত্বকে ধন্য করেছে সে৷ যার জন্য আখড়ার বৈষ্ণবেরা তাকে মন্দিরে প্রবেশ করতে দেয় না, পূজার উপকরণে হাত দিতে দেয় না৷ সমস্ত কিছু ঈশ্বরের ইচ্ছা ভেবে নিজেকে ঈশ্বরের নামে সমর্পণ করে দিয়েছে বৈষ্ণবী কমললতা৷

কমললতার মধ্যে ছিল গভীর এক মননশীলতা৷ জীবনের সবকিছুকে সে গভীরভাবেই যাচাই করতে চায়৷ নারী পুরুষের প্রেম নিয়েও তার ভাবনা স্বতন্ত্রতা পেয়েছে৷ সে প্রেমের সেই সুগভীর বৈপরীত্য প্রকাশ করে শ্রীকান্তকে বলেছে—‘‘প্রেমের বাস্তবতা নিয়ে তোমরা পুরুষের দল যখন বড়াই করতে থাকো তখন ভাবি আমাদের জাত যে আলাদা৷ তোমাদের ও আমাদের ভালোবাসার প্রকৃতিই যে বিভিন্ন৷ তোমরা চাও বিস্তার, আমরা চাই গভীরতা; তোমরা চাও উল্লাস, আমরা চাই শান্তি৷’’৭০

চারপাশের নানা জটিল অভিজ্ঞতা শেষ পর্যন্ত কমললতার জীবনে বৈরাগ্য এনেছে৷ আশ্রমে তার পালাই পালাই মন বৈষ্ণবদের অসন্তোষে সত্যসত্যই পালাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ কিন্তু সেখানকার আরেক অসহায় বৈষ্ণবী পদ্মার অশ্রুপূর্ণ স্নেহ সম্ভাষণ সে সূত্রটাকে এতদিন পর্যন্ত অখণ্ড রেখেছিল অবশেষে গহরের মৃত্যুর পর তার জন্য রেখে যাওয়া অনেক পরিমাণ টাকা, যা দিয়ে জীবনের সুখ বৈভব অনায়াসে খরিদ করতে পারতো সে, সবকিছুকে হেলায় অবহেলা করে সকলের অগোচরে সে স্থান থেকে এক কাপড়ে বিদায় নিয়েছে৷ শুধুমাত্র বিদায় বেলায় স্টেশনে শ্রীকান্ত তাকে দেখলে সে তাকে অনুরোধ করে বৃন্দাবনে যাওয়ার টিকিট কিনে নিয়েছে৷ কমললতা সংসারের সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তি চায়—বিদায় বেলায় সে শ্রীকান্তের সঙ্গে সম্পর্কসূত্রকেও আর ধরে রাখতে চায় না৷ জীবনের সব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিঃস্ব রিক্ত হয়ে ঈশ্বরের চরণে তার সব কিছু সঁপে দিতে চায়৷ তাই সে শেষ প্রার্থনা করে শ্রীকান্তর কাছে কিছু পাওয়ার দাবি করে৷ তার সে চাওয়া বড় মর্মান্তিক৷ সে শ্রীকান্তকে বলে—‘‘আমি জানি, আমি তোমার কত আদরের৷ আজ বিশ্বাস করে আমাকে তুমি তাঁর পাদপদ্মে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হও—নির্ভয় হও৷ আমার জন্যে ভেবে ভেবে আর তুমি মন খারাপ ক’রো না গোঁসাই, এই তোমার কাছে আমার প্রার্থনা৷’’৭১

সমাজের চোখে পতিতা কমললতা শেষ পর্যন্ত সমাজের সব বন্ধন উপেক্ষা করে ‘তাঁর’ পাদপদ্মে নিজেকে সমর্পণ করেছে৷ পরম সহানুভূতিতে কমললতা চরিত্রটি চিত্রিত করেছেন রচনাকার৷

ঘ. শুভদা :

‘শুভদা’ উপন্যাসটির প্রকাশকাল ১৯৩৮ কিন্তু এর রচনাকাল অনেক পূর্ববর্তী সময়ে৷ এম. সি সরকার প্রকাশিত রচনা সমগ্রের অষ্টম সম্ভারে গ্রন্থপরিচয় অংশে বলা হয়েছে বইটি নাকি ১৮৯৮ সালে লেখা৷ শরৎচন্দ্র জীবদ্দশায় বইটিকে ছাপতে চাননি ফলে তা প্রকাশিত হয়েছে মৃত্যুর পরে৷ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে একটি দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের এক কুলবধূর করুণ জীবন যন্ত্রণার ছবি৷ এখানে নানা ঘটনার অভিঘাতে কয়েকজন পতিতা নারীর জীবন উঠে এসেছে৷ একজন কাত্যায়নী, সে পুরোদস্তুর নিম্নশ্রেণীর দেহব্যবসায়ী, অপরজন মালতী ও জয়াবতী৷ দুজনেই জমিদার সুরেন্দ্রনাথ রায়ের রক্ষিতা৷

মালতী :

মালতীর পূর্বনাম ললনা৷ সে বালবিধবা৷ চরিত্রহীন পিতার চরম প্রতিকূলতায় তাদের সংসারে চরম অর্থকষ্ট দেখা দিলে সেই জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করে আশ্রয় পায় সুরেন্দ্রনাথ রায়ের নৌকায়৷ তার রূপ-যৌবনে মুগ্ধ হয়ে সেই জমিদারতনয় তাকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলে সে তাতে রাজী হয় না৷ তার ইচ্ছে কলকাতা যাওয়ার৷ সেখানে রূপের পসরা সাজিয়ে উপার্জন করতে চায় প্রচুর অর্থ৷ তাই বলা হয়েছে—‘‘মালতী রূপবতী; শরীরে তাহার রূপ ধরে না একথা সে টের পাইয়াছে; কলিকাতা বড় শহর৷ সেখানে এ রূপ লইয়া গেলে বিক্রয় করিবার জন্য ভাবিতে হইবে না, হয়ত আশাতীত মূল্যেও বিক্রয় হইতে পারে, তাই কলিকাতা যাইতে এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হইয়াছে৷ সেখানে তাহার আদর হইবে, দরিদ্র ছিল ধনবতী হইবে, ক্লেশে জীবন কাটিতেছিল এইবার সুখে কাটিবে৷’’৭২ ললনা অর্থের জন্য মালতী হয়েছে; অর্থ উপার্জনের পথও আবিষ্কার করেছে তথাপি তার মনে শান্তি নেই, যন্ত্রণার শেষ নেই৷ তার মনের কথা, তার অর্থের প্রয়োজনের কথা মুখে না বললেও বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না বিচক্ষণ সুরেন্দ্রর৷ সে তাই তাকে বলে—‘‘যেজন্য তুমি কলিকাতায় যাইতে চাহিতেছ তাহা তুমি পারিবে না৷ এ বৃত্তি বোধ হয় তুমি পূর্বে কখন কর নাই, এখনও পারিবে না৷’’৭৩

সাধারণ সরল গ্রাম্য মেয়েটিকে ঠিকই বুঝেছিল সুরেন্দ্রনাথ রায়৷ সে প্রায় জোর করেই তার ভালোবাসা ও টাকার অভাব মেটানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে মালতীকে তার কাছে রেখে দেয়৷ মালতীও তার সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়৷ অবশেষে মালতী তার কোমলতা দিয়ে মন জয় করে সুরেন্দ্রর৷ বাগানবাড়িতে সে রক্ষিতার পরিচয়ে থাকলেও সুরেন্দ্র তাকে জাত-কুল-মান বিসর্জন দিয়ে বিবাহ করতেও রাজী হয়৷ কিন্তু প্রবল আত্মগ্লানিতে তাকে বাধা দিয়ে মালতী বলে—‘‘বিধবাকে বিবাহ করিতে আছে, কিন্তু বেশ্যাকে নাই৷’’৭৪ মালতী তাকে জানিয়েছে সে ছাড়া তার দেহ কখনো কেউ স্পর্শ করেনি কিন্তু তার পূর্বেই সে আরেকজনকে মনপ্রাণ সমস্ত সমর্পণ করেছিল৷ সেই অশুচি মনপ্রাণ সে কিছুতেই অন্য জনকে দান করতে পারবে না৷ তাই সে সেই কথার সূত্রধরে বলে—‘‘আমি বেশ্যা—বেশ্যায় সব পারে৷’’৭৫ অর্থাৎ যে ভাবে একদিন অপর আরেকজনকে ভালোবেসে প্রাণমন সমর্পন করেছিল, সেই সে আবার পুনরায় সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে ভালোবাসার বাসর সাজিয়েছে৷

ললনার প্রবল ইচ্ছে সে তার দুঃখী মাকে সহায়তা করে৷ যতদিন গৃহে ছিল ততদিন করেও ছিল৷ তারপর মালতী হয়ে সুরেন্দ্রর হৃদয়রাজ্যের একচ্ছত্র অধীশ্বরী হয়ে বসেছে৷ তাকে বিয়ে না করে তার সঙ্গে লিপ্ত হয়েছে অবৈধ শরীরী সংসর্গে৷ কিন্তু একমুহূর্তের জন্য সে তার ভেতরকার ললনা নারীটিকে ভুলে যেতে পারেনি৷ ভেতরে ভেতরে সর্বদাই চলেছে তার অশ্রুক্ষরণ৷ সুরেন্দ্রও মালতীর ভেতরকার সেই সাধারণ রূপকে ভয় করেছে৷ আভরণহীন সাধারণ বেশবাসে মালতীকে তার মনে হয়েছে কোনো পবিত্র জ্যোতির্ময়ী রূপ; তাকে স্পর্শ করতেও ভয় হয় তখন৷ এরকমই কথার প্রতিধ্বনি—‘‘তোমার এ নিরাভরণা মূর্তি বড় জ্যোতির্ময়ী—স্পর্শ করিতেও সময়ে সময়ে কি যেন একটা সঙ্কোচ আসিয়া পড়ে—দেখিলেই মনে হয় যেন আমার পাপগুলা ঠিক তোমারি মত উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে৷ তোমাকে বলতে কি—তোমার কাছে বসিয়া থাকি, কিন্তু কি একটা অজ্ঞাত ভয় আমাকে কিছুতেই ছাড়িয়া যাইতেছে না বলিয়া মনে হয়৷ আমি তেমন সুখ পাই না—তেমন মিশিতে পারি না; তাই তোমাকে অলঙ্কার পরাইয়া একটু ম্লান করিয়া লইব৷’’৭৬ সুরেন্দ্র তাকে রক্ষিতা করে সুসজ্জিত বাগানবাড়িতে স্থান দিয়েছে, তাকে রক্ষিতার মতোই উপভোগ করতে চায়৷

অবস্থার বিপাকে পড়ে ললনাকে মালতী হতে হয়েছে৷ তার সংবেদনশীল হৃদয় তাই দুঃখী মানুষের দুঃখ দেখে আঁতকে ওঠে৷ সুরেন্দ্রনাথের আরেক রক্ষিতা জয়াবতীর মৃত্যুর পর তার মাকে সে আপন করে নেয়, দশটাকা অর্থ সাহায্য দিয়ে তার দারিদ্র্যতা নিবারণ করার চেষ্টা করে৷ আবার সেই সংবেদনশীল মনের জোরেই সুরেন্দ্র মালাচন্দনে ভূষিত হয়ে বাগানবাড়িতে এসে বিলাসচ্ছলে তার গলায় মালা পড়িয়ে তাকে সেই স্থান থেকে স্বগৃহে নিয়ে যেতে চাইলে মালতী তা অস্বীকার করে৷ সে তার রক্ষিতা হিসেবে প্রথম স্থান পেয়েছিল, রক্ষিতা হিসেবেই জীবন পাড়ি দিতে চায়৷

এই চরিত্রটির মধ্য দিয়ে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে পিতার উদাসীনতা, মায়ের জীবনযন্ত্রণা, পারিবারিক অনটন, ভাই-এর অসুস্থতা একজন সরল বিধবাকে কুপথে যেতে প্ররোচিত করে৷ ললনা তার পরিবারকে আর্থিক অনটনের হাত থেকে বাঁচাতেই গণিকাবৃত্তির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তা ছাড়া একজন বিধবা নারীর কিই বা পথ থাকতে পারে৷

জয়াবতী :

জয়াবতী আরেকজন রক্ষিতা, যাকে প্রথম দেখা যায় সুরেন্দ্রনাথের নৌকায়৷ অসুস্থ শরীরকে সুস্থ করার জন্য ডাক্তার বায়ু পরিবর্তনের নিদান দিলে সুরেন্দ্র জয়াবতী সমভিব্যাহারে জলপথে দিন যাপনের সিদ্ধান্ত নেয়৷ জয়াবতী সুরেন্দ্রর যথেষ্ট অনুগ্রহ অর্জনে সক্ষম হয়েছিল৷ মালতীকে উদ্ধার করার পর এবং বজরায় সে অসুস্থ হয়ে পড়লে জয়াবতী গৃহিণীর মতো পরিচর্যা করে তাকে সুস্থ করে তোলে৷ শেষে জয়াবতী নৌকাডুবি হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়৷ জয়াবতী উপন্যাসের নিতান্তই এক গৌণ চরিত্র৷ হয়তো সুরেন্দ্রর মনে মালতীর অবস্থান পাকা করতে জয়াবতীকে তার রক্ষিতা হিসেবে দেখানো হয়েছে৷

কাত্যায়নী :

কাত্যায়নী নিম্নশ্রেণী দেহজীবি নারী৷ বামুনপাড়ার একটা গলিপথ ধরে দরমাঘেরা এক ঘরে বাস করে সে৷ ললনার পিতা হারাণচন্দ্রের সে প্রণয়িনী৷ লম্পট, গাঁজাখোর, প্রতারক হারাণ স্ত্রীর শেষ সম্বলটুকুও বিনা দ্বিধায় আত্মসাৎ করে তার বিলাস-ব্যসনে ব্যয় করে৷ কাত্যায়নীর বয়স পঁচিশ বছর, ‘‘কালোকোলো মোটাসোটা সর্বাঙ্গে উলকিপরা মানানসই যুবতী’’৭৭ সে৷ জীবনে সে অনেক অর্থই সংগ্রহ করেছে হারাণচন্দ্রের কাছ থেকে৷ ইদানিং জুয়াড়ি হারাণ তার দিকে অতটা দেখে না৷ অনেকদিন পর এসে উপস্থিত হলে সে বিরক্ত হয়ে জানায়—‘‘আসতে হয় একটু সকাল সকাল এসো৷ রাত্তির নেই, দুপুর নেই, যখন-তখন যে অমনি করে চেঁচাবে—তা হবে না, অত গোলমাল আমার ভাল লাগে না৷’’৭৮ হারাণচন্দ্র তাকে শান্ত করে তার কাছে দুটাকা ধার চাইলে সে সঙ্গে সঙ্গে তার সেই প্রার্থনা প্রত্যাখ্যান করে৷ সে চাবি খুলে সিন্দুকে টাকা আছে কি না তা দেখতে চাইলে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে কাত্যায়নী৷ হারাণচন্দ্রের মুখে ভালোবাসার নাম শুনে তার আর হিতাহিত জ্ঞান থাকে না৷ সে গণিকা৷ গণিকাকে ভালোবাসার মূল্য দিতে নেই তা সে অক্ষরে অক্ষরে মানে৷ তাই হারাণের ভালোবাসার কৈফিয়তে বারনারীর মতো ঝংকৃত হয় তার কথা৷ আর তার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয় গণিকা নারীদের জীবনের পূর্ণ প্রতিচ্ছবি—‘‘আমাদের যেখানে পেট ভরে সেইখানে ভালবাসা৷ এ কি তোমার ঘরের স্ত্রী যে গলায় ছুরি দিলেও ভালবাসতে হবে? তোমা ছাড়া কি আমার গতি নেই? যেখানে টাকা সেইখানে আমার যত্ন, সেইখানে আমার ভালোবাসা৷ যাও, বাড়ি যাও—এত রাত্তিরে বিরক্ত ক’রো না৷’’৮৯

কাত্যায়নী তার তীব্র বাক্যবাণে আহত করার চেষ্টা করেছে প্রণয়ী হারাণচন্দ্রকে৷ আপাত দৃষ্টিতে তাকে যতটা হিংস্র অর্থলোভী মনে হয় আদতে সে তা নয়৷ আসলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নারীর কঠিন-পাশবিক রূপে কখনোই বিশ্বাস করতেন না, তার কাছে নারীরা বরাবরই শ্রদ্ধেয়৷ তাই অর্থলোভী নিম্নশ্রেণীর বারবনিতা কাত্যায়নীর মধ্যেও তিনি মাধুর্যরস সিঞ্চন করতে ভোলেননি৷ কাত্যায়নী হারাণচন্দ্রের স্বভাব সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল৷ সে সকলের অলক্ষ্যে গিয়ে তার পরিবারের দুরবস্থা চোখে দেখে এসেছে৷ হারাণের উদাসীনতায় তার বাড়ির সদস্যদের দুঃখজনক জীবনযাপন দেখে সে চুপ থাকতে পারেনি৷ তার ভেতরকার সেই কোমল নারীসত্তাটি জেগে ওঠে তাদের দুঃখে অশ্রুপাত করেছে৷ তাই সে তার গচ্ছিত ধনের থেকে দশটি টাকা নির্দ্বিধায় তুলে দিয়েছে তার প্রণয়ীর হাতে৷ পরিতৃপ্তির হাসি হেসে সে তাকে বলেছে—‘‘এই টাকাগুলো তোমার স্ত্রীর হাতে দিও—তবুও দুদিন স্বচ্ছন্দে চলবে৷ নিজের কাছে কিছুতেই রেখো না৷ শুনচ?’’৮০ কাত্যায়নী জানে হারাণের স্বভাব৷ তার পরিবার যে উপোস করে দিন কাটাচ্ছে সেটাও তার অজানা নয়৷ কিন্তু হারাণ টাকা পেলেই জুয়ায়-গাঁজায় মেতে ওঠে, তার বাহ্যজ্ঞান-বিবেকবোধ লোপ পায় তাই সে সেই টাকা তার স্ত্রী শুভদার হাতে দিতে বলেছে, যাতে দু-একদিন তাদের মুখে অন্নের জোগান হয়৷

সমাজ কাত্যায়নীকে ‘খারাপ মেয়েমানুষ’ বলে জানে৷ সকলে তার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করে হারাণের মতো মানুষদের কুপথে চালিত করার জন্য৷ কিন্তু যারা কুপথগামী তাদের কাত্যায়নীর মতো নারীরাও কখনোই সৎপথে ফিরিয়ে দিতে পারে না৷ তাই কাত্যায়নী তার সংস্পর্শ থেকে মুক্তি দিয়ে হারাণকে বলতে পেরেছিল—‘‘ঠাকুর করুন তোমার যেন চোখ ফোটে৷ আমরা ছোটলোকের মেয়ে, ছোটলোক—কিন্তু এটা বুঝি যে, আগে স্ত্রী-পুত্র বাড়িঘর, তারপর আমরা; আগে পেটের ভাত, পরবার কাপড়, তারপর শখ, নেশা-ভাঙ৷ তোমার আমি অহিত চাইনে, ভালর জন্যই বলি—এখানে আর এস না, গুলির দোকানে আর ঢুকো না—বাড়ি যাও, ঘরবাড়ি স্ত্রী-পুত্র দেখ গে, একটা চাকরি-বাকরি কর, ছেলেমেয়ের মুখে দুটো অন্ন দাও, তারপর প্রবৃত্তি হয় এখানে এসো৷’’৮১ কাত্যায়নীর সেই কথা তার মহত্ত্বকে প্রকাশিত করে৷ সে আরেকটি পরিবারের আসন্ন দুর্যোগ রক্ষা করতে নিজের প্রতিদিনের খরিদ্দারকেও হাতছাড়া করতে দ্বিধাবোধ করে না৷ তবুও সমাজের সমস্ত অভিশাপ বর্তায় তার উপরই৷

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৮৫-১৯৩০) :

ইতিহাসবিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাসের জগতেও বিশেষ কৃতিত্ব রেখে গিয়েছেন৷ তিনি ভারতীয় ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বে গভীর গবেষণা করেছিলেন এবং তাঁর অন্বীক্ষায় এবং কল্পনায় আমাদের দেশের পুরোনো ইতিহাসকে প্রত্যক্ষবৎ উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন৷ সেই উপলব্ধির উষ্ণতা সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে৷ গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংসের সূত্রপাতে লিখিত ‘করুণা’ (১৯১৭) এবং বাদশা ফররুখসিয়রের আমলে বাংলা দেশের অবস্থা চিত্রণের উদ্দেশ্যে ‘অসীম’ (১৯২৪) উপন্যাসদুটি লিখিত হলেও এগুলির মধ্যে গণিকা জীবনের এক সুস্পষ্ট আলেখ্য উঠে এসেছে৷ ত্যাগে-মহানতায়, ঈর্ষা-স্বার্থপরতায় তাঁর সৃষ্ট গণিকাচরিত্রগুলি অন্যান্যমাত্রা লাভ করেছে৷

ক. করুণা :

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘করুণা’ (১৯১৭) উপন্যাসে পাটালিপুত্রের নর্তকী ইন্দ্রলেখা, ইন্দ্রলেখা-কন্যা অনন্তা, সখি মদনিকাসহ রাজসভার উৎসব অনুষ্ঠানে নৃত্যগীত পারদর্শী বহু নামহীনা গণিকার উল্লেখ রয়েছে৷ গুপ্তসাম্রাজ্যের ধ্বংস এবং বৌদ্ধশক্তির উত্থানে এই গণিকাত্রয়ের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা লক্ষণীয়৷

ইন্দ্রলেখা :

অঘটনপটিয়সী বিগতযৌবনা ইন্দ্রলেখা এককালে পাটলীপুত্রের প্রধান নর্তকী ছিল৷ গণিকাবৃত্তিতে তার পসার তাকে পাটলিপুত্রের প্রধান ধনবান হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে৷ তার চক্রান্তেই গুপ্তবংশের সর্বনাশ সাধিত হয়৷ লোভে, হিংসায়, বিদ্বেষে, ছলনায়, সর্বোপরি উপস্থিত কুবুদ্ধির প্রাবল্যে ইন্দ্রলেখা চরিত্রটি অনবদ্য৷ উপন্যাসে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে অনন্তার মা হিসেবে৷ উত্তরপথের রাজধানী পাটলিপুত্রের মহারাজাধিরাজ শ্রীমৎ কুমারগুপ্তকে তার কন্যার বশে এনে বৃহৎ গুপ্তসাম্রাজ্যকে নিজের করায়ত্ব করাই ইন্দ্রলেখার প্রধান উদ্দেশ্য৷ এই উদ্দেশ্যপূরণে তাকে সহায়তা করেছে তার অনুগৃহিত বীট চন্দ্রসেন, মহাবিহারস্বামী হরিবল৷ কিন্তু ইন্দ্রলেখার উদ্দেশ্যপূরণে প্রথম বাধা হয় দ্বিতীয়চন্দ্রগুপ্তের পুত্র গোবিন্দগুপ্ত৷ ইন্দ্রলেখার নবীন যৌবনে গোবিন্দগুপ্ত ‘মন্দমলয়ানিল’ হয়ে তার সর্বস্ব পাটলিপুত্রের সেই প্রধান রূপসীর হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল৷ রাজসিংহাসন ত্যাগ করে তার প্রেমে মত্ত গোবিন্দগুপ্ত বিশবছর পূর্বে পর্ণকুটিরে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল; কিন্তু গণিকার প্রেম তো এক পুরুষে সীমাবদ্ধ নয়! তাই নির্দ্বিধায় তাকে ত্যাগ করে নট ফল্গুযশের সঙ্গে প্রেমডোর বেঁধেছিল ইন্দ্রলেখা৷ সেই গোবিন্দগুপ্ত এসেছে তার উদ্দেশ্যপূরণে বাধা দিতে৷ ইন্দ্রলেখার গোবিন্দগুপ্তর স্বভাব-চরিত্র-বুদ্ধিমত্তা, যুদ্ধক্ষমতা সকল নখদর্পণে৷ নর্তকীগৃহে বিবাহসভা থেকে বৃদ্ধ মহারাজা কুমারগুপ্তকে সে যখন কৌশল করে প্রাসাদে ফিরিয়ে আনতে যায় তখন ইন্দ্রলেখা তাকে উদ্দেশ্য করে ইতরভাষায় বাক্য প্রয়োগ করে—‘‘তুই কে? কোন সাহসে, বিনা অনুমতিতে আমার গৃহে প্রবেশ করিয়াছিস? জানিস, এখনই তোকে কুকুর দিয়া খাওয়াইতে পারি?’’৮২ গোবিন্দগুপ্ত তার হবু জামাতা পাটালিপুত্রের অধীশ্বর কুমারগুপ্তকে কৌশল করে তার গৃহ থেকে নিয়ে যাওয়ার পর তার এক চর যখন পুনরায় অজ্ঞতাবশত গোবিন্দগুপ্তের আগমনের সংবাদ জ্ঞাপন করে তখন সম্মার্জনী হাতে গণিকাসুলভ স্বভাব ভঙ্গিতে সে সেই সংবাদদাতাকে পীড়ন করে বলতে থাকে—‘‘বড় সংবাদ লইয়া আসিয়াছিস, গোবিন্দগুপ্ত আসিয়াছে, গোবিন্দগুপ্ত আসিয়া যে আমার সর্বনাশ করিয়া গেল, এতক্ষণ কোথায় ছিলি—?’’৮৩

ইন্দ্রলেখার ভাবী জামাতাকে কৌশলে তার থেকে সরিয়ে নিয়েছে গোবিন্দগুপ্ত, তার সসাগরা আর্যপট্টের অধীশ্বরী হওয়ার স্বপ্ন কিছুতেই ভাঙতে দেবে না সে তাই পুনরায় প্রেমের ফাঁদ রচনা করে, উদ্দেশ্য ছলনা করে গোবিন্দগুপ্তকে হত্যা করা৷ তাই তারই একজন দাসীর হাতে পঁচিশ বছর পূর্বে গোবিন্দগুপ্তের দেওয়া প্রেমের চিহ্নস্বরূপ রাজনামাঙ্কিত অঙ্গুরী দিয়ে দাসীকে পাঠায় তাকে আমন্ত্রণ জানাতে৷ সেই সাক্ষাতে রাজী হয় গোবিন্দগুপ্ত৷ বিশবছর পূর্বেকার সেই সংকেতস্থানে উভয়ে মিলিত হয়৷ তাকে দেখামাত্রই কপট অনুশোচনায় নয়নবারিতে ভেসে গিয়ে ইন্দ্রলেখা বলতে থাকে—‘‘মহারাজপুত্র মার্জনা কর৷… সত্যই,—সত্যই—দেখিব বলিয়া—আসিতে অনুরোধ করিয়াছিলাম; মহারাজ-পুত্র—তুমি—এত নিষ্ঠুর,—যদি অপরাধ করিয়া—থাকি—মার্জনা করিও৷—’’৮৪ তার চোখের জল দেখেও মন গলে না গোবিন্দগুপ্তর৷ বরং তার গণিকাসুলভ অভিনয় দক্ষতা, বারবনিতাসুলভ অভীষ্ট পুরুষকে ছেড়ে পরপুরুষের হস্ত ধরে পলায়ন করা, প্রেমিককে হত্যার প্রচেষ্টা ইত্যাদি স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাকে তিরস্কার করলে তাতে ইন্দ্রলেখার মন সামান্যতম বিচলিতও হয় না৷ বরং অবলীলাক্রমে সে চালিয়ে যায় তার প্রেমাভিনয়৷ গোবিন্দগুপ্তের সব কথা অবনত মস্তকে শুনতে শুনতে চোখের জলে গাল ভাসিয়ে দেয়৷ তারপর বলে—‘‘মহারাজপুত্র, যৌবনে যে অপরাধ করিয়াছি—আজীবন তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিতেছি, ইচ্ছা করিয়া রাজ্যসম্পদ জলাঞ্জলি দিয়াছি৷ আমার বহু অনুরোধ রক্ষা করিয়াছ একটি অনুরোধ রক্ষা কর৷ এই শেষ অনুরোধ, আর একবার তেমন করিয়া তোমার মুখখানি দেখিব৷’’৮৫ ইন্দ্রলেখার সুনিপুণ অভিনয় দক্ষতা মুহূর্তের মধ্যে বিচলিত করে গোবিন্দগুপ্তকে৷ সুযোগ বুঝেই ইন্দ্রলেখা তার হস্তধারণ করে কাছে দাঁড়াতেই গোবিন্দগুপ্ত বিচলিত হয়ে যায়৷ কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়ে তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে তিরস্কার করলে ইন্দ্রলেখা শেষবারের জন্য একবার তার আলিঙ্গন প্রার্থনা করে৷ অঙ্গুরীয় ফিরিয়ে দিলে আলিঙ্গন পাবে শর্ত রাখে গোবিন্দগুপ্ত৷ ইন্দ্রলেখার উদ্দেশ্য আলিঙ্গন মুহূর্তে ছুরিকাঘাতে তাকে হত্যা করা৷ শর্তে রাজী হয়ে আংটি ফিরিয়ে দিয়ে সে আলিঙ্গনাবস্থায় কন্ঠে ছুরিকাঘাত করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে বন্দিনী হয়৷ সঙ্গে বন্দি হয় তার সঙ্গে সহায়তাকারী মহাবিহারস্বামী হরিবল৷

ইন্দ্রলেখা ছলনাময়ী৷ সে তার বুদ্ধির জোরে ছলনা করে সহস্র সুবর্ণ দীনার-এর বিনিময়ে রক্ষীদের বশ করে হরিবলকে নিয়ে গবাক্ষপথে পলায়ন করে৷ রক্ষীদের সম্মতিতে বুদ্ধি করেই তাদের হাত পা বেঁধে রেখে যায় যাতে রক্ষীদ্বয়ের উপর তাদের পলায়নের দায় না পড়ে৷ অসাধারণ বুদ্ধিমত্তায় গবাক্ষ দিয়ে জল পথে উপপতি চন্দ্রসেনের নৌকায় বসে তারা পরামর্শ করে সন্ন্যাসীবেশে দিন কাটানোর জন্য৷ হরিবল তাকে ভিক্ষুসাজার পরামর্শ দিলে অত্যন্ত বিচক্ষণতায় সে জানায়—‘‘মহাবীরস্বামী হরিবল পলায়ন করিয়াছে শুনিলে কৃষ্ণগুপ্ত নগরের সমস্ত ভীক্ষু বন্দী করিবে৷ তাহা হইবে না, ভাগবত সন্ন্যাসী সাজিতে হইবে৷’’৮৬ চন্দ্রসেন তাদের জন্য সন্ন্যাসীবেশ আনতে গেলে ইন্দ্রলেখা হরিবল আবার বিপদের সম্মুখীন হয়৷ ততক্ষণে তাদের পলায়নের খবর চারিদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেছে৷ মহাপ্রতিহারের সেনারা তাদের অন্বেষণে তাদের দিকেই উল্কার উজ্জ্বল আলো নিয়ে এগিয়ে আসছে৷ মহাবিহারস্বামী হরিবল নিশ্চিত মৃত্যুর সম্ভাবনায় কাঁপতে থাকলে গণিকার উপস্থিত বুদ্ধিতেই সে যাত্রায় তারা রক্ষা পায়৷ সৈনিকদের আসতে দেখেই ইন্দ্রলেখা হরিবলের হাত ধরে সমুখের প্রাচীন পুষ্করিণীর হিমশীতল জলে নেমে শ্যাওলা সংগ্রহ করে উভয়ের মাথা আচ্ছাদিত করে জলের মধ্যভাগে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷ সেনারা সম্মুখে এসেও তাদের উপস্থিতি টের পায় না৷ তারা অধরাই থেকে যায়৷ অবশেষে সন্ন্যাসীবেশে সকলের চোখের সামনেই বসবাস করতে থাকে৷ কেউ চিনতে পারে না৷

কুমারগুপ্তকে কিছুতেই নাগালের মধ্যে না পেয়ে ইন্দ্রলেখা মরিয়া হয়ে ওঠে৷ এবারে সে সহায়তা নেয় মন্ত্রতন্ত্রের৷ বশীকরণের মন্ত্র দিয়ে তার মেয়ের প্রতি মহারাজকে অনুরক্ত করতে বদ্ধপরিকর হয়৷ ইন্দ্রলেখা, হরিবল ও চন্দ্রসেন তিনজনে উপস্থিত হয় মহারানি পট্টমহাদেবীর সম্মুখে৷ তার সামনে গিয়ে বলে যে তারা বিষয়-বাসনাত্যাগী সন্ন্যাসী, ধন-সম্পদের প্রয়োজন রাখে না৷ গণনা করে জানতে পেরেছে যে সম্প্রতি সমুদ্রগুপ্তের বংশের মহাদুঃসময় উপস্থিত৷ আর তা নিবারণের জন্য মহারানির মাথার একটি কেশ দিয়ে যজ্ঞ করতে হবে৷ বংশের মঙ্গল কামনায় মহারানি তৎক্ষনাৎ তার একটি কেশ তাদের হাতে দিয়ে দিলে তারা অভিষ্ট সিদ্ধ হতেই দ্রুতপদে প্রস্থান করে৷ পরে জানা যায় তারা সেই কেশ দিয়ে মারণ যজ্ঞ করবে; তাতে মহারানির মৃত্যু হবে, ইন্দ্রলেখার কন্যা পট্টমহাদেবী হবে এবং গুপ্তবংশ নির্মূল হবে৷

ইন্দ্রলেখা তার মেয়ের প্রতি মহারাজকে বশীভূত করতে দ্বারস্থ হয় কাপালিকের৷ অমাবশ্যার ঘোর অন্ধকারে অশোক গাছের তলে যজ্ঞ সমাপন করে কাচের পাত্রে গাছের লতাবিশেষের রস পান করায় মেয়েকে৷ তারপর কাপালিক তাকে বলে—‘‘যা, তোর কন্যার অভীষ্ট সিদ্ধ হইবে৷ এখন হইতে উহার নয়ন বন্ধন করিয়া রাখ, যাহাকে তোর কন্যা কামনা করিয়াছে, তাহাকে দেখিতে পাইলে দূর হইতে নয়নের বন্ধন মোচন করিয়া দিস৷’’৮৭ তারপর পুনর্বার মন্ত্রপাঠ ও যজ্ঞানুষ্ঠান করে মন্ত্রপুত অর্ধদগ্ধ জবাফুল ইন্দ্রলেখার কন্যার হাতে দেয় বশীকরণের জন্য৷ ইন্দ্রলেখার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়৷ কুমারগুপ্ত তার কন্যাকে বিবাহ করে৷ ইন্দ্রলেখা তার দুষ্টবুদ্ধি খাটিয়ে গোবিন্দগুপ্তের বাধা কাটিয়ে চরম আত্মপ্রসাদে যখন উপপতি চন্দ্রসেনকে জানায় যে তার বুদ্ধি বেশি না সেই বুড়োশেয়ালের বুদ্ধি বেশি তখন তার সম্পর্কে চন্দ্রসেনের অভিমত তার চরিত্রকে আরও বেশি করে ফুটিয়ে তোলে৷ যেমন—‘‘ইন্দ্রলেখা, আমি ত চিরদিন বলিতেছি যে, তুমি যদি পুরুষ হইতে তাহা হইলে কুমারগুপ্তের কান ধরিয়া আর্যপট্ট হইতে নামাইয়া দিয়া সসাগরা ধরণীর অধীশ্বর হইতে?’’৮৮

কন্যাকে মহারানি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিলেও তার মনে শান্তি নেই৷ কারণ চারিদিকে শত্রু৷ মহামন্ত্রী, মহাপ্রতিহার, যুবরাজভট্টারক, মহাবলাধিকৃত কেউই তার কন্যাকে পট্টমহাদেবীরূপে মানতে পারেনি৷ মেয়ের জীবনকে নিষ্কন্টক করতে তাই সে আবার কাপালিকের দ্বারস্থ হয়৷ তাকে জানায় যে তার কন্যা এক রমণীর কারণে স্বামীসঙ্গলাভ করতে পারছে না৷ সেই কাপালিকের সামনে অগ্নি শপথ করে প্রতিজ্ঞা করতে হয়৷ আর যদি কেউ মিথ্যা বলে শপথ করে তাহলে জীবিতাবস্থায় শেয়াল কুকুর তাকে খণ্ড খণ্ড করবে৷ ইন্দ্রলেখা দেহব্যবসায়িনী নারী৷ সারাজীবন তার মিথ্যার সঙ্গে কারবার৷ তাই সন্ন্যাসীর কথায় তার হৃদয় কম্পিত হলেও সে তার বাম হাত দিয়ে অগ্নিকুণ্ড স্পর্শ করে, শপথ করে—‘‘অগ্নিদেবতা স্পর্শ করিয়া কহিতেছি, অনন্তার বাঞ্ছিতের ধর্মপত্নী কলহপ্রিয়া ও ক্রুরস্বভাবা, সে অনন্তাকে হত্যা করিতে চাহে৷’’৮৯ কিন্তু পরক্ষণেই ইন্দ্রলেখা ভয়ে অস্থির সেখান থেকে পলায়ন করে তার মনুষ্যসুলভ স্বাভাবিকতায়, কারণ সে মিথ্যা শপথ করেছে৷ গণিকার পেশার মিথ্যা বলা একটা অঙ্গ৷ সেই প্রবণতায় উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অগ্নিকুণ্ডে হাত রেখে মিথ্যা বলতেও তার বাধে না৷ কিন্তু তার মনুষ্যপ্রকৃতি তাকে ভীত করে তোলে৷

ইন্দ্রলেখা প্রথম জীবনে নর্তকী ছিল৷ পরে দেহব্যবসা তার সঙ্গে যুক্ত হয়৷ আজীবন সে রাজ্যের উৎসব অনুষ্ঠানে নৃত্য পরিবেশন করে রাজপুরুষদের মনোরঞ্জন করে এসেছে৷ সেই ইন্দ্রলেখাই যখন মেয়েকে সামনে রেখে দণ্ডমুণ্ডের কর্তৃ হয়ে পূর্বোক্ত রাজঅমাত্যদের অপমান করতে থাকে তখন মহামন্ত্রী দামোদর শর্মা তাকে কঠোর ব্যঙ্গোক্তিতে বিদ্ধ করে বলে—‘‘ইন্দ্রলেখে, অগ্রসর হও, তোমার জয় আমার পরাজয়৷ সম্রাট তোমার, সাম্রাজ্য তোমার, তুমি সম্রাটের শিরে আসিয়া উপবেশন কর৷ তোরণে দাঁড়াইয়া আছ কেন?’’৯০ ইন্দ্রলেখা খল হোক, কুমতলবি হোক; বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের তীব্র দৃষ্টি সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়৷ সে নিমেষেই সেখান থেকে পলায়ন করে৷

অনন্তাকে পুত্তলিবৎ বৃদ্ধ রাজার পাশে পট্টমহাদেবী করে বসিয়েছে ইন্দ্রলেখা, সঙ্গে সহায়তা করেছে হরিবল৷ অনন্তার রাজকার্য চালানোর ক্ষমতা নেই, সে মিথ্যা আক্রোশের প্রতিশোধ নিয়ে রাজ্যের সর্বনাশে বদ্ধপরিকর৷ ইন্দ্রলেখা সে ভাবনায় ভাবিত৷ হরিবলের সাথে পরামর্শ করে সে শুনতে পায় হরিবল গুপ্ত সাম্রাজ্যের ধ্বংস সাধনে দৃঢ়সংকল্প তখন তার মতো ছলনাময়ী নারীও তার আশৈশব কাটানো সেই রাজ্য ধ্বংস করতে সহমত পোষণ করতে পারে না৷ সে আক্ষেপ করে বলে—‘‘প্রাচীন বিশ্ববিখ্যাত গুপ্তসাম্রাজ্য এমন করিয়া নষ্ট করিব?’’৯১ সে গুপ্তসাম্রাজ্যের অধীশ্বরী হতে চায় কিন্তু তা সাম্রাজ্যের বিনাশ সাধন করে নয় আর হরিবল হিন্দুধর্মের সম্পূর্ণ বিনাশ করে প্রতিষ্ঠা দিতে চায় বৌদ্ধ ধর্মের৷ তাই সে বলে যে বৈষ্ণব-অভিজাত সম্প্রদায়ের সর্বনাশ না করে সে ক্ষান্ত হবে না এবং যদি গুপ্তসাম্রাজ্য শেষ হয়ে যায় তাহলে যেমন করে গোবিন্দগুপ্তের বদলে ফল্গুযশ, ফল্গুযশের বদলে চন্দ্রসেন জুটেছে ইন্দ্রলেখার তেমন করে অনন্তার নতুন নতুন স্বামী জুটিয়ে দেবে৷ তখন ইন্দ্রলেখার কথায় ফুটে উঠে মাতৃহৃদয়ের সহজসরল আক্ষেপবাণী—‘‘আমি যাহা করিয়াছি তাহা করিয়াছি, অনন্তাকে যেন আর তাহা করিতে না হয়৷’’৯২ ইন্দ্রলেখা নিজে গণিকা৷ দেহব্যবসার মধ্যে দিয়ে জীবনকে চালিত করেছে৷ অনন্তা তার গর্ভের সন্তান৷ তার মাতৃহৃদয় কোনোভাবেই চায় না যে তার মেয়ে পুরুষের পর পুরুষের অঙ্কশায়িনী হোক৷ সে চায় তার মেয়ে পতিব্রতা হয়ে জীবন অতিবাহিত করুক৷ তার এই বাসনাই সমস্ত খলতাকে দূরে সরিয়ে তাকে মহানতায় পর্যবসিত করে৷ এই আক্ষেপ বাণী থেকেই বেড়িয়ে আসে হরিবলের প্রতি প্রবল ঘৃণা৷—‘‘দেখ হরিবল, আমি সামান্য গণিকা, বহু পাপ করিয়াছি, বহু মহাপাতকী দেখিয়াছ কিন্তু তোমার ন্যায় দেশদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী, মহাপাতকী কখনও দেখি নাই৷ ত্রিকালে ত্রিভুবন তোমার যশোগান করিবে না, তোমার নামে নিষ্ঠীবন পরিত্যাগ করিবে৷ তুমি অনায়াসে স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বিশাল আর্যাবর্ত, বিস্তৃত গুপ্তসাম্রাজ্য, পবিত্র পিতৃভূমি বর্বর, হূণের হস্তে তুলিয়া দিতে চাও, নরকেও তোমার স্থান হইবে না৷’’৯৩

ইন্দ্রলেখার সহায়তায় অনন্তার পুত্রসন্তান জন্ম নিয়েছে৷ সে চায় তার কন্যা, দৌহিত্র নিষ্কন্টক জীবন অতিবাহিত করুক৷ তাই সখি মদনিকার কাছে প্রতিজ্ঞা করে—‘‘হয় অনন্তার কন্টক দূর করিব, না হয় মরিব৷’’৯৪ হরিবলের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে কুমারগুপ্তের জ্যেষ্ঠপুত্র স্কন্দগুপ্তকে হত্যা করার জন্য৷ কন্যা, বৃদ্ধজামাতা রাজ্য পরিচালনায় অপারগ হলে দেখা যায় রাজা-রানির দুটি সিংহাসনের স্থানে চারটি সিংহাসন স্থাপন করে রাজা-রানি-ইন্দ্রলেখা-মদনিকা রাজ্য পরিচালনা করতে শুরু করে৷ কিন্তু ক্রমে দেবধর-অমিয়া অপমানিত হয়ে মৃত্যুবরণ করলে রাজ-অমাত্যদের সকলের প্ররোচনায় সম্বিত ফিরে আসে বৃদ্ধরাজা কুমার গুপ্তের৷ দামোদর শর্মা তাকে সবিস্তারে জানায় যে মহারাজাধিরাজ মহানায়ক চন্দ্রধরের পুত্র, মহানায়ক গুল্মাধিকৃত দেবধর পাটলীপুত্রের প্রকাশ্য রাজপথে মদনিকার অশিষ্ট আচরণের জন্য তাকে অপমান করায় গণিকার কন্যা অনন্তা পট্টমহাদেবীর অধিকার বলে নিদ্রিত সম্রাটের অনুমতির অপেক্ষা না করে মহামুদ্রানামাঙ্কিত আদেশপত্র প্রেরণ করে দেবধরকে বন্দি করে বিচার করার জন্য৷ সেই অপমানেই দেবধর প্রাণত্যাগ করে৷ মহারাজ কুমারগুপ্ত সব শুনে বিচার করতে না পেরে লজ্জিত হয়ে সিংহাসন ছেড়ে পালিয়ে যায়৷ তখন বারোজন উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা বিচার করে মূল অপরাধীদের প্রাণদণ্ডের আদেশ দেন৷ অবশেষে অমিয়া-দেবধরের শব সৎকার করতে গিয়ে দেখা হয় সেই কাপালিকের৷ তার মুখ থেকে সকলে জানতে পারে গুপ্তকুলধ্বংসের প্রধান তিনজন কথা৷ যথা—ইন্দ্রলেখা, হরিবল ও চন্দ্রসেন৷ নির্মম শাস্তি পায় ইন্দ্রলেখা৷ ‘‘কাপালিকরচিত চিতার উপরে শৃঙ্খলাবদ্ধ ইন্দ্রলেখা ও চন্দ্রসেনকে স্থাপিত করিয়া, তাহাদিগের মস্তকে নরকপালের মুকুট ও গলদেশে নর-অস্থির মাল্য দিয়া, বৃদ্ধ কাপালিক স্বয়ং তাহাতে অগ্নিসংযোগ করিল, শতশত কলস ঘৃত সংযোগে চিতা জ্বলিয়া উঠিল৷ বিট ও প্রৌঢ়া গণিকার আর্তনাদে গগন বিদীর্ণ হইল৷’’৯৫ এভাবে ইন্দ্রলেখা তার কৃতকর্মের জন্য চরম শাস্তি ভোগ করে৷

অনন্তা :

অনন্তা ইন্দ্রলেখার কন্যা৷ উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়ে জানা যায় যে বৃদ্ধ মহারাজা কুমারগুপ্ত কোনো গণিকা কন্যার পাণিগ্রহণ করতে চলেছে৷ বৃদ্ধ মন্ত্রী তাই বলেন—‘‘কল্য নর্তকী ইন্দ্রলেখার কন্যার সহিত চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সমুদ্রগুপ্তের পৌত্র পরমেশ্বর পরমবৈষ্ণব পরমমাহেশ্বর পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ শ্রীমৎ কুমারগুপ্তের বিবাহ হইবে৷’’৯৬ কিন্তু গণিকাদের সমাজে সম্মান কোথায়৷ মহারাজ অন্য কোনো নারীকে বিবাহ করতে চাইলে কোনো অসুবিধা হত না কিন্তু যেহেতু সে গণিকা কন্যা তাই সেখানে সকলের বিরোধিতা৷ তাই বৃদ্ধ মন্ত্রী বিকট হাস্যে ব্যঙ্গ করে রামগুপ্তকে বলে যে—‘‘রাম, উৎসবের জন্য প্রস্তুত হইয়াছ ত? কল্য যুবরাজ-ভট্টারক স্কন্দগুপ্তের মাতা সিংহাসনচ্যুতা হইবেন, নর্তকী ইন্দ্রলেখা—ফল্গুযশ নটের কন্যা তাহাতে উপবেশন করিবে৷ কল্য গুপ্তসাম্রাজ্যের অভিজাতসম্প্রদায় তাহার সম্মুখে নতজানু হইবে৷ তুমি না কুমারগুপ্তের জ্ঞাতি, প্রথম চন্দ্রগুপ্তের বংশজাত?’’৯৭

অনন্তা হরিবলের প্ররোচনায় তার অসামান্য রূপ-যৌবনের দ্যুতি নিয়ে মায়ের নৃত্যপোলক্ষে তার সঙ্গে যখন বিলাসগৃহে উপস্থিত হয়েছিল সেদিন থেকেই তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল কুমারগুপ্ত৷ যেভাবেই হোক অনন্তাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে গিয়েছিল স্বয়ং পাটলিপুত্রের বৃদ্ধ রাজাধিরাজ৷ রাজার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মায়ের প্ররোচনায় অনন্তা প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিল সে যদি রাজ্যের পাটরানি হয় এবং তার পুত্র যদি রাজ্যের সিংহাসনের অধিকারী হয় তাহলেই মহারাজাকে অনুগৃহীত করবে৷ নারীর নবযৌবনের মোহে পড়ে সমস্ত মেনে নিয়েছিল মহারাজ৷ কিন্তু গোবিন্দগুপ্তের কৌশলে কুমারগুপ্ত কিছুটা স্থির হয়ে গেলে ইন্দ্রলেখা বশীকরণের ফুল দিয়ে ভুবনমোহিনী বেশে মেয়েকে সাজিয়ে উদ্যান-তোরণে রথে উপবিষ্ট বৃদ্ধ রাজার সম্মুখে প্রেরণ করে৷ আবেশ বিহ্বল অনন্তা ছুটে গিয়ে লম্ফ দিয়ে রথাহোরণ করে তার কন্ঠলগ্ন হয়ে নিজেকে প্রকাশ করে৷ তার চূর্ণ কুন্তলের স্পর্শ, অঙ্গরাগ-গন্ধলেপ ও কেশতৈলের সুগন্ধ এবং সুকোমল স্পর্শ পুনরায় মহারাজকে বিহ্বল করে তোলে৷ অনন্তার কপট অশ্রুপাত, চুম্বনে সংযম হারিয়ে মহারাজ প্রতিজ্ঞা করে তাকে কোনোদিনও ত্যাগ করবে না, পট্টমহাদেবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেবে৷ শূন্য সভামন্ডপে অনন্তা কুমারগুপ্তের হাত ধরে অবশেষে পট্টমহাদেবীপদে অভিষিক্ত হয়৷ সিংহাসনে বসেই সে তার পিতার অপমানের কথা শ্রবণ করে গুপ্তবংশের রীতি-নীতির তোয়াক্কা না করে মহাদণ্ডনায়ক রামগুপ্ত এবং মহাপ্রতীহার কৃষ্ণগুপ্তের প্রতি দণ্ড জারি করে৷ দণ্ড পূর্ণ করতে কিছু বাধ্যবাধকতার কথা কুমারগুপ্ত তাকে জানালে স্বার্থপর কাণ্ডজ্ঞানহীনের মতো সে রাজাকে জানায়—‘‘প্রজা অসন্তুষ্ট হইবে তাহাতে কি আসে যায়? তোমার যাহা ইচ্ছা হইবে তাহা যদি করিতে না পার, তবে তুমি কিসের সম্রাট?’’৯৮ এখানে এই উক্তির মধ্যে দিয়ে অনন্তার বালিকাসুলভ চপল মনোভঙ্গিটিও দৃষ্টিগোচর হয়৷

অনন্তা পট্টমহাদেবী হয়ে প্রবল দম্ভে নিজেকে হারিয়ে ফেলে৷ বৃদ্ধ মন্ত্রী দামোদর শর্মাকে প্রকাশ্য সভায় নিজের পদমর্যাদা বুঝিয়ে অভিবাদন না করার জন্য চরম অপমান করে৷ পরিণামে দামোদর শর্মা তাকে বেশ্যাকন্যা বলে পট্টমহাদেবীর অভিধা অমান্য করলে সে শিবনন্দীকে আদেশ দেয় তাকে বন্দি করার জন্য এবং মহারাজাকে বলে যে সে যদি মন্ত্রীকে বন্দির আদেশ না দেয় তাহলে সে আত্মহত্যা করবে৷ কুমার গুপ্ত তরুণী ভার্যার বিরহের চেয়ে মন্ত্রীর অপমানই শ্রেয়ষ্কর মনে করে৷ অনন্তার ক্ষমতার বড়াই সেখানেই সীমাবদ্ধ থাকে না৷ তার কুটচালে অর্থাৎ মদনিকাকে অপমান করার শাস্তি স্বরূপ রাজার অজান্তে রাজার নামাঙ্কিত আদেশনামা পেশ করে দেবধরকে অপমান করায় দেবধর তার ভাবী স্ত্রী অমিয়াকে নিয়ে আত্মহত্যা করলে অসন্তোষ আরও তীব্র হয়ে ওঠে৷ এই ধৃষ্টতার সীমা আরও চূড়ান্ত রূপ নেয় যখন পাটলিপুত্রের রাজসভায় একযোগে চারটি সিংহাসন স্থাপন করা হয় রাজাকে বসিয়ে তিনজন গণিকা দ্বারা রাজ্য পরিচালনার জন্য৷ সকলের বিদ্রোহে কুমারগুপ্ত সিংহসন ছেড়ে পলায়ন করলে বারোজন উচ্চপদস্থ রাজঅমাত্যরা মিলে অপরাধের বিচার করে৷ গুপ্তকুল ধংসকারিণী বারবনিতাকন্যা অনন্তা ভয়ে মূর্ছিত হয়ে পড়ে৷ চারিদিকের গভীর ষড়যন্ত্রে ভীত অনন্তা তাই চেতনা প্রাপ্ত হয়েই যুবরাজের দিকে অঙ্গুলি সঞ্চালন করে বলে—‘‘উহাকে দূর কর, দূর কর৷ মাতাকে হত্যা করিয়াছে, এখন আমাকে হত্যা করিবে৷’’৯৯ ভীতসন্ত্রস্তা এই গণিকাকন্যা নিজের ভয়াবহ পরিণতি আসন্ন বুঝে বার বার অনুরোধ করে মহারাজের মনোযোগ আশ্রয় করে নিজের আসনটি পুনরায় মজবুত করে নেয়৷ পরে কুমারগুপ্ত স্বেচ্ছায় বিচারক্ষম হয়ে সিংহাসন থেকে পালিয়ে গেলে এবং তার সহায়কারী মাতা, মাতৃসহচরী মদনিকা, পিতা চন্দ্রসেন, সকলে চরম শাস্তি লাভ করলে তাকে বন্দি করা হয়৷ অনন্তা তার শিশুপুত্র পুরগুপ্ত সহ বন্দিনী হয়ে থাকে৷ পরবর্তীকালে তার পুত্র পুরগুপ্তই মগধের সিংহাসনে আসীন হয়৷

মদনিকা :

মদনিকা ইন্দ্রলেখার সখি৷ ইন্দ্রলেখার কন্যা অনন্তা পাটলিপুত্রের পট্টমহাদেবীরূপে অধিষ্ঠিত হলে মদনিকা পাটলিপুত্রের মহানায়িকার মর্যাদা পায়৷ মদনিকার পরিচয় প্রকাশ করতে গিয়ে স্বয়ং রচনাকার বলেছেন—‘‘বারবনিতা মদনিকা যে কাহার কন্যা তাহা তাহার গর্ভধারিণী পর্যন্ত অবগত ছিল না৷’’১০০ পাটলিপুত্রে অনন্তা ও ইন্দ্রলেখার রাজত্বে গণিকাদের মহাসম্মান৷ মদনিকা প্রাসাদের শিবিকায় চলাফেরা করে৷ মদনিকা রাজপথের সন্ধিস্থলে শিবিকা দাঁড় করিয়ে তার পূর্ব পরিচিত পানওয়ালীর সঙ্গে রহস্যলাপে মগ্ন হলে পথচলতি মানুষেরা প্রবল সমস্যার সম্মুখীন হয়৷ এমন স্থানে সেই শিবিকা দাঁড়ানো যাকে অতিক্রম করা কোনো কিছুর পক্ষেই সম্ভব না৷ তাই মহানায়ক গুল্মাধিকৃত দেবধর দেখে যে বহু রথ, অশ্ব, গজ, উষ্ট্র ও শিবিকা গতিরোধ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে৷ মদনিকাকে সেখান থেকে শিবিকা সরাতে বললে মদিরাবিহ্বলা সেই বারবনিতা অশিষ্ট বাক্য প্রয়োগ করে দেবধরকে উদ্দেশ্য করে—‘‘তুই কি মনে ভাবিয়াছিস? তোর কি প্রাণের ভয় নাই? জানিস তোকে কুক্কুর দিয়া খাওয়াইতে পারি৷’’১০১ দেবধরের কোন শিষ্ট বাক্যই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে না৷ অবশেষে গণিকা সম্বোধন করে তাকে সাবধান হতে বললে মহাকলরবে সে তাকে আক্রমন করে—‘‘তোর মাতা বেশ্যা, পিতামহী বেশ্যা, প্রপিতামহী বেশ্যা৷ আমি গণিকা৷’’১০২ মদনিকা তার উগ্রস্বভাবের কারণে আক্রান্ত হয় দেবধর দ্বারা৷ কুমার হর্ষগুপ্ত তাকে শিবিকায় বন্ধন করে কশাঘাতে জর্জরিত করে তার অন্যায়ের শাস্তি দেয়৷ সেখানে শেষ নয়; তার কোপানলে দগ্ধ হয়ে যায় দেবধর-অমিয়ার নিষ্পাপ জীবন৷ মদনিকা তার সহচরীর সহায়তায় সিংহাসনেও উপবিষ্ট হয়৷

মদনিকার পরিণাম ভয়াবহ৷ তার শাস্তি কুকুরের ভক্ষ হয়ে৷ উগ্রস্বভাব, দেহব্যবসায়ী মদনিকাকে লেখক স্নেহমায়া বিবর্জিত দানবীরূপে উপন্যাসে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন৷

এই তিনজন গণিকা চরিত্রের বাইরেও রাজবাড়ির নানা উৎসব অনুষ্ঠানে নৃত্য-গীত, মদ্য পরিবেশনের জন্য অনেক নামহীনা গণিকার উল্লেখ আছে৷ যেমন কুমারগুপ্তের ভাই ও ছেলে হুণ আক্রমণ প্রতিরোধ করে জয়ী হয়ে ফিরে এলে বিজয়োৎসবে রয়েছে গণিকা বিলাসের চিত্র৷—‘‘সন্ধ্যা হইল; মহোদয়-নগরে অসংখ্য দীপমালা জ্বলিয়া উঠিল, তরুণী পাটলিপুত্রিকা গণিকাগণ পথে পথে নৃত্য আরম্ভ করিয়া দিল৷’’১০৩

সম্রাটের উদ্যান-বিলাসেও থাকে গণিকার সমাবেশ৷ জনৈক সেনার কথায়—‘‘সম্রাট উদ্যান-বিলাসে আসিলে তরুণী নর্তকী আসে, সুন্দরী গায়িকা আসে…৷’’১০৪

গণিকারা সমাজে বিলাস-বৈভবের প্রধান মাধ্যম ছিল৷ নগরের শ্রেষ্ঠ নর্তকীরা প্রচুর ধনসম্পদের অধীশ্বরী হতো৷ নগরের শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী এমন কি পট্টমহাদেবীর চেয়েও বেশি ধনরত্ন তাদের থাকতো৷ তবে গণিকাদের সম্মান ছিল না৷ তারা আনন্দ দিতে পারতো বিনোদন করতে পারতো কিন্তু কারও বধূ হয়ে সংসার জীবনে প্রবেশ করতে পারতো না৷

খ. অসীম :

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অসীম’ (১৯২৪ প্রথম প্রকাশ ভারতবর্ষ পত্রিকায়) ঐতিহাসিক উপন্যাস৷ এখানে বর্ণিত হয়েছে হতভাগ্য ফররুখসিয়রের শোচনীয় পরিণামের মর্মান্তিক চিত্র৷ এটি ঐতিহাসিক হলেও এর বেশিরভাগ আখ্যানই কল্পনা এবং উৎকল্পনার উপর প্রতিষ্ঠিত৷ উপন্যাসে গণিকাচরিত্র হিসেবে মনিয়াবাই, সরস্বতী বৈষ্ণবী, মনিয়ার মাতা মতিয়া বিশেষভাবে উল্লেখ্য৷

মতিয়া :

মতিয়া দেহজীবী কসবি৷ উপন্যাসের বিংশ পরিচ্ছেদের ‘নর্তকী’ অধ্যায়ে তার আবির্ভাব৷ অধ্যায়ের সূচনাতেই লেখক সুন্দরভাবে তার পরিচয়কে ব্যক্ত করেছেন৷ যথা—‘‘পাটনা সহরের এক প্রান্তে ভদ্র-পল্লীর মধ্যে এক বৃদ্ধা গণিকা বাস করিত৷ তাহার নাম মতিয়া৷ সে গণিকা হইলেও, পল্লীর সকলেই তাহার উপর সন্তুষ্ট ছিল৷ কারণ তাহার গৃহে অসদাচারণ দেখিতে পাওয়া যাইত না৷ যৌবনান্ত হইবার পূর্বেই মতিয়া গণিকা-বৃত্তি পরিত্যাগ করিয়াছিল’’১০৫ তাহলে দেখা যাচ্ছে গণিকাবৃত্তি ছেড়ে দেওয়ার ফলে ভদ্রসমাজে তাকে নিয়ে কোনো আশঙ্কা না থাকায় সে সকলের সঙ্গে ভদ্র পল্লীতেই বাস করতে পারতো৷ বিগতযৌবনা এই বারাঙ্গনার জীবনধারণের প্রধান মাধ্যম ছিল মুজরা কিন্তু সবসময় মুজরা জুটতো না ফলে সেই অবসর সময়ে নিজের জীবন নির্বাহের জন্য নতুন গণিকাদের নৃত্যগীত শিক্ষা দিত৷ এভাবে চলতে চলতে পাটনার অধিবাসীগণ দেহপসারিণী মতিয়াকে ভুলে ওস্তাদনী মতিয়াতে অভ্যস্ত হয়ে যায়৷ মতিয়ার যৌবন অস্তমিত হওয়ার আগেই তার একজন প্রণয়ী তার প্রেমে মজে তারই গৃহে আশ্রয় নেয়৷ সে সকলের কাছে সেই আহদী পাঠান প্রেমিককে তার নেকা করা স্বামী বলে পরিচয় দিলেও সেই পুরুষটি কখনো তার সেই দাবিকে সমর্থন করতো না কিন্তু কখনো তাকে ছেড়েও যায়নি৷ তার সঙ্গে থাকাকালীন মতিয়ার এক কন্যা সন্তান জন্ম নেয়৷ যার নাম রাখা হয় মনিয়া৷ তার সেই কন্যা অপূর্বসুন্দরী৷ তাকে নিয়ে অনেক আশা-স্বপ্ন মায়ের৷ সে নিজে একসময় গণিকাবৃত্তি অবলম্বন করে জীবন অতিবাহিত করেছে, পরে যৌবন গত হলে পুরুষসমাজের কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়ায় তার সেই পসার আর নেই৷ তাই সে তার উত্তরসূরী করে তুলতে চায় আত্মজাকে৷ বহু যত্নে বহু পরিচর্যায় তাকে মানুষ করতে থাকে যাতে তার দ্বারা বিগতযৌবনের সমস্ত খামতিগুলোকে অনায়াসে ভরিয়ে নিতে পারে৷ সঙ্গীতশাস্ত্রে পারদর্শিনী মতিয়া স্বহস্তে কন্যাকে নৃত্যগীত শিক্ষা দিয়ে সুর ও ছন্দের অপরিমিত উৎসমুখ অর্জনের গৌরব নিজকন্যার মস্তকে আরোপ করেছে৷ আঠারোবছর বয়সি মনিয়া মায়ের পরিচর্যায় এবং ঈশ্বরপ্রদত্ত অশেষ রূপরাশি ও গুণাবলীর দ্বারা পাটনা নগরীর হৃদয়েশ্বরী হয়ে উঠেছে৷ তার যখন মুজরার বায়না আসে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে মা তা বিচার-বিবেচনা করে তবেই সে বায়না গ্রহণ করে মেয়েকে পাঠায়৷ মেয়েকে নিয়ে সর্বদা একটা সুখী ও সচ্ছল জীবনের স্বপ্ন দেখে৷ মেয়েকে নিয়ে গড়া তার স্বপ্নসৌধে প্রবল আঘাত হানে সেই মেয়েই৷ মেয়ে গণিকাবৃত্তি ছেড়ে অসীম নামের এক যুবকের প্রেমে আত্মহারা হয়ে যায়৷ শাহাজাদার দরবারে মুজরা করতে গিয়ে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া কন্যার শোকে মুহ্যমান হয়ে মতিয়া নাওয়া-খাওয়া ভুলে যায়৷ পরে যখন তার সন্ধান মেলে তার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ককে অস্বীকার করে মেয়ে৷ মতিয়া চরম নৈরাশ্যে নিমজ্জিত হয়৷ আবার হঠাৎই যখন মেয়ে গৃহে ফিরে আসে তখন তার আর আনন্দ ধরে না৷ মেয়ের মধ্যে অনেক পরিবর্তন লক্ষ করেছে মতিয়া৷ তার মেয়ে পায়জামা ছেড়ে শাড়ি পড়েছে, সমস্ত অলংকার ত্যাগ করেছে৷ তবুও সে কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহস পায় না৷ মেয়ে ফিরে এসেছে এটাই তার শান্তি৷ মনিয়া আমিষ আহার পরিত্যাগ করে সহস্তে নিরামিষ রন্ধন করে নিরামিষ আহার করে৷ মা শুধু বিস্মিত হয়ে সেই দৃশ্য পর্যবেক্ষণই করে যায়৷ তারপর সন্ধ্যাবেলায় ফরীদ খাঁ মুজরার জন্য তাকে নিতে এলে সে যথাযোগ্য বেশভূষা করে চলে যায়৷ এ দৃশ্য দেখে চিন্তিতা মা হাফ ছেড়ে বাঁচে এবং পাড়ার দরগায় গিয়ে পীড়ের পূজা দিয়ে আসে ও কতকটা নিশ্চিন্ত হয়৷ এখানে মতিয়ার সহজসরল মাতৃরূপটি চিত্রিত হয়েছে৷ মতিয়া অসহায়৷ তার শেষ পারানির একমাত্র সম্বল মেয়ে মনিয়া৷ আর সেই মেয়ে তাদেরকে যখন অস্বীকার করেছিল তখন তার অন্ধকার জীবনের নিদারুণ ভবিষ্যতের চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল৷ সেই মেয়ে যখন পুনরায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করে নিয়মিত মুজরা করতে থাকে তখন তার সাবধানী মানবাত্মা তাকে আর ঘাটাতে সাহস পায় না৷ নির্বিবাদে সব কিছু মেনে নিয়ে পীড়ের পূজা দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে৷ এখানে মাতৃহৃদয়ের আবেগ, মায়া, মমতা উৎকন্ঠা থেকে এক অসহায় সাবধানী মায়ের ভবিষ্যৎ চিন্তাই বেশি প্রকটিত হয়েছে৷ যা সব দিক থেকে বাস্তবসম্মত৷

মেয়ে ঘরে ফিরে এলেও ক্রমে ক্রমে তার আচরণ মতিয়াকে আবার চিন্তিত করে৷ অবশেষে মেয়ের খেয়ালিপনা চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেলে দিশেহারা মা কবিরাজ, হাকিম, রোজা, জ্যোতিষী, গণক, মুসলমান বুজরুক কারুরই দ্বারস্থ হওয়া বাকি রাখে না৷ হাকিম নাড়ী টিপে রোগ নির্ণয়ের কথা বলে, জ্যোতিষী গণকেরা বলে যে তার মেয়ের কোনো বিপদ নেই; অথচ মেয়ের ব্যবহার তা বলে না৷ জ্যোতিষীর মুখে শোনে সেও যেমন উপপতির সহবাসে জীবন কাটাচ্ছে বিবাহ না করেও তেমনি তার মেয়েরও কোনোদিন বিয়ে হবে না৷—‘‘যবনী তুমি কসবী৷ তোমার কন্যা সুগায়িকা হইবে; কিন্তু বেশ্যাবৃত্তি করিবে না৷’’১০৬ এই কথা শুনে মতিয়া অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে গিয়ে তাকে তিরস্কার করতে থাকে৷ কিন্তু তাকে তো মেয়ের বিষয়ে সমস্তটা জানতে হবে৷ তাই পুনরায় হাতখানা মেলে দেয় তার দিকে৷ বলে—‘‘আমার কন্যা রূপসী, সে সুগায়িকা; কিন্তু সম্প্রতি তাহাকে দানো পাইয়াছে; না হয় সে পাগল হইয়াছে৷ কিন্তু কি হইয়াছে বুঝিতে না পারিয়াই আমি তোমার নিকট আসিয়াছি৷’’১০৭ তারপরেও সকল বিষয়ে মেয়ের সুস্থতার বিষয়ে জ্যোতিষী অটল থাকলে মতিয়া আর নিজেকে সংযত রাখতে পারে না৷ চরম বিরক্তিসহকারে সে বলে—‘‘আরে পাগল, ঘরেই যদি ফিরিয়া যাইব, তবে তোর নিকট মরিতে আসিয়াছি কেন? মেয়ে আমার আপন মনে হাসে, আপন মনেই কাঁদে; বিড় বিড় করিয়া কি বলিতে থাকে, তাহার কিছুই বুঝিতে পারি না৷ জিজ্ঞাসা করিলে বলে, কৈ, কিছুই না৷ লোকে বলে উপদেবতা যাহাদিগকে আশ্রয় করে, তাহারা নাকি এইরকম আচরণ করিয়া থাকে৷’’১০৮ সেই জ্যোতিষীর মুখ থেকে যখন জানতে পারে যে তার মেয়ে একজন হিন্দু যুবকের প্রেমে পড়েছে, এবং সেই জন্য সে তার সকল উপদেশ অগ্রাহ্য করবে, কথামত বেশ্যাবৃত্তি করবে না তখন মতিয়ার মনে কন্যার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রশ্নচিহ্ন উঁকি দেয়৷ সে তাকে বলে—‘‘সর্বনাশ! তবে আমার কি হইবে কাফের?’’১০৯ তাবিজ মাদুলি দিয়ে সে মেয়েকে বশে আনার চেষ্টা করে৷ একজন গণিকামাতার তার উপার্জনক্ষম মেয়ের পাগলামির দুশ্চিন্তা এবং ভবিষ্যতের খুন্নিবৃত্তির ভাবনা এই অংশে তার কথামত প্রতিভাত হয়েছে৷

পাটনার বিগতযৌবনা বাইজি মতিয়াকে এর পর দেখা যায় এক হাকিমের চিকিৎসালয়ে৷ হাকিম শহীদ উল্লাহ সেখানকার নানা অবৈধ চিকিৎসার শিরোমণি৷ তার চিকিৎসালয়ে তাই রোগীর ভিড় রাতের অন্ধকারে৷ মতিয়াও সেইমত রাতের আধাঁরে সেখানে উপস্থিত হয় মেয়ের চিকিৎসার জন্য৷ তার রূপগুণসম্পন্ন কন্যা স্ববৃত্তিতে আত্মনিয়োগ না করে নিজের খেয়ালে দিন কাটাচ্ছে৷ মেয়ের খামখেয়ালির চিকিৎসা করাতে সে মনিয়ার সকল লক্ষণ হাকিমকে ব্যক্ত করে—‘‘আমার বেটী তয়ফাওয়ালী; দেখিতে খুব সুন্দরী৷ তাহার এই প্রথম বয়স সুতরাং খোদার মর্জিতে বিলক্ষণ দু’পয়সা রোজগার হইত৷ বুড়া বয়সে আমার নসীব ফিরিয়া গিয়াছিল৷ হঠাৎ কোথা হইতে কি হইল, বেটী আমার এক কাফেরকে দেখিয়া পাগল হইয়া গেল৷ তাহাকে দেখিবা অবধি মুজরা করা ছাড়িয়া দিল; পাগলের মত পথে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতে আরম্ভ করিল; অনুনয় বিনয় কিছুই শুনিল না৷ লোকে বলিল দানো পাইয়াছে৷ রোজা আসিয়া কত মন্ত্র বলিল; ওস্তাদ আসিয়া ঝাড়িল, তাবিজ পরাইল; কিন্তু কিছুতেই কিছু হইল না৷ আপনি ছাড়া পাটনা সহরের যত নামজাদা হাকিম, সকলকেই ডাকিয়া দেখাইয়াছি; কিন্তু কেহই বলিতে পারে নাই বেমারটা কি? এই একমাস হইল কোথায় চলিয়া গিয়াছিল, আজি সকালে ফিরিয়া আসিয়াছে৷ আমি সেইজন্য এখন আপনার নিকটে আসিয়াছি৷’’১১০ হাকিম সমস্ত শুনে দীর্ঘ্যসময়ব্যাপী সেবনের জন্য ঔষধ দিলে মতিয়া তার মূল্য শুনে ঘাবড়ে যায়৷ মেয়ের চিকিৎসার জন্য দিনের পর দিন অর্থ ব্যয় করতে করতে প্রায় নিঃশেষ সে৷ নিজের অস্তমিত যৌবনের স্তিমিত রশ্মির প্রভাবে তার রোজগারও তলানিতে৷ কিন্তু হাকিম সে কথা বুঝবে কেন! অগ্রিম কিছু অর্থের বিনিময়ে সে ঔষধ ক্রয় করে কিন্তু তার পরেও সমস্যামুক্ত হয় না সে কারণ তার কন্যা কিছুতেই ঔষধ সেবন করতে চায় না৷ তখন হাকিম একটা সুস্বাদু ঔষধ সরবতের সঙ্গে মিশিয়ে পান করানোর জন্য দিলে তা সেবন সংক্রান্ত নির্দেশ বুঝে নিয়ে মতিয়া প্রত্যাবর্তন করে৷ উপন্যাসটিতে যেখানে যেখানে মতিয়ার উপস্থিতি রয়েছে সেখানে সেখানেই তার মেয়ের জন্য, পেশাটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য এবং ভবিষ্যতে সুষ্ঠু অর্থনৈতিক সচ্ছলতা অবলম্বনের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকার সম্বল সঞ্চয়ের জন্য দুশ্চিন্তা ফুটে উঠেছে৷ মতিয়া চরিত্রটি চরম অর্থলোভী এক চরিত্র যে মেয়ের আবেগ-অনুভূতির তত্ত্ব-তালাশ না করে তাকে দিয়ে বেশ্যাবৃত্তি করিয়ে উপার্জন করতে চায়৷ শঠতাও তার মধ্যে কম নেই৷ সে জিনের কথা বলে সুদর্শনকে গ্রেফতার করায়, হাকিম, জ্যোতিষীদের হাত দেখিয়ে পয়সা দিতে চায় না যেখানে যেখানে সে তার মেয়ের জন্য উৎকন্ঠিত-চিন্তিত সেখানেই সেখানেই তার ভবিষ্যৎ রোজগারের চিন্তা কাজ করেছে৷ অর্থাৎ ভবিষ্যতের অর্থের জোগানদার হিসেবে মেয়েকে সুস্থ রাখার, স্বপথে ফিরিয়ে আনার জন্যই সে যত্নবান হয়েছে৷ তার মায়া-মমতার কোনো গভীর বন্ধন সেখানে নেই৷ রূপবতী মেয়েকে পরম যত্নে গান নাচ শিখিয়েছে বিত্তবান সমাজে বেশ্যাবৃত্তির উপযুক্ত করে তোলার জন্য আর কিছু নয়৷ এদিক থেকে মতিয়া চরিত্রটি একটি সুবিধাবাদী চরিত্র হিসেবে পরিগণিত হয়েছে৷

মনিয়াবাই :

মনিয়াবাই উপন্যাসের অন্যতম প্রধান চরিত্র৷ তাকে কেন্দ্র করে সমগ্র উপন্যাসের কাহিনি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে৷ মনিয়ার মায়ের কথা অনুসারে জানা যায় তার বয়স আঠারো বছর৷ সে তার সঙ্গীতমূর্ছনা, রূপ-যৌবন দিয়ে সবেমাত্র গণিকা জীবনে প্রবেশ করেছে৷ শাহাজাদার দরবারে মুজরা করতে গিয়ে ঘটনার বিক্ষেপে সংস্পর্শ লাভ করে উপন্যাসের নায়ক আদর্শবান যুবা অসীমের; সেই থেকে তার ভাবান্তর; সেই থেকে তার রূপান্তর৷ সে গণিকা মায়ের কন্যা৷ উপন্যাসে কোথাও তাকে সরাসরি দেহের দর হাকতে দেখা যায়নি কিন্তু বিভিন্ন সময়ে তার নিজের স্বীকারোক্তি, মায়ের উক্তির মধ্য দিয়ে তার পণ্যাঙ্গনা রূপটি প্রকটিত হয়েছে৷ আর গণিকা গর্ভজাত বলে সমগ্র উপন্যাসে তার যন্ত্রণার শেষ নেই৷ আবার এই বারবধূর কলুষিত পরিচয় দিয়েই সে অসাধ্য সাধনে সক্ষম হয়েছে৷ লেখক মনিয়ার পরিচয় উদ্ঘাটন করেছেন এইভাবে—‘‘মতিয়ার কন্যার নাম মনিয়া৷ মনিয়াকে দেখিলে কেহই বিশ্বাস করিতে পারিত না যে, সে গণিকার কন্যা; সকলেই কহিত, ‘‘গোময়ে পঙ্কজিনীর আবির্ভাব সম্ভব নহে৷’’ মতিয়া সঙ্গীত-শাস্ত্রে পারদর্শিনী ছিল; এবং সে অতি যত্নে কন্যাকে নৃত্য-গীত শিক্ষা দিয়াছিল৷ প্রথম যৌবনে রূপসী কলাবতী মনিয়া পাটনা নগরের সকলেরই প্রিয়পাত্রী হইয়া উঠিয়াছিল৷ যে সময়ের কথা বলিতেছি, সে সময়ে মনিয়া অষ্টাদশ বর্ষে পদার্পণ করিয়াছে; এবং মাত্র এক বৎসর মুজরা করিতে আরম্ভ করিয়াছে৷’’১১১

মায়ের যথার্থ উত্তরসূরী হওয়ার বা তার চেয়ে বহুগুণ বেশি পারদর্শী হওয়ার কথা অনিন্দ্যসুন্দর মনিয়ার ছিল৷ তার কমনীয় সৌন্দর্যে, বিকশিত যৌবনশ্রীতে আর নিষ্কলুষ মনোবৃত্তিতে হঠাৎ নির্মল প্রেমের ছটা এসে লাগে৷ শাহাজাদার দরবারে মুজরা সেরে ফেরার সময় এক দুর্বৃত্তের কামোন্মত্ত আহ্বানে ভীতচকিতা হয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকে৷ কিন্তু মনিয়া যদি যৌনতার নিয়ত পীড়নে সুঅভ্যস্ত গণিকা হত তাহলে সেই কামাসক্ত পুরুষটির নির্লজ্জ আহ্বানে সে হেসে ফেলতো কিন্তু গণিকাপুত্রী হলেও তার সুন্দর দেহ তখনও কলুষিত হয়নি তাই সে না হেসে ভয়ে শিউড়ে ওঠে৷ ভয়ে ঘৃণায় আসন্ন বিপদের ভয়ঙ্করতাকে উপলব্ধি করতে পেরে যখন তার দুচোখ জলে প্লাবিত, তখন সেই দুরাত্মা তার রূপরাশির মোহে উন্মত্ত হয়ে তাকে বলপূর্বক হস্ত ধারণ করে অপহরণের চেষ্টা করলে মনিয়ার মুখে উচ্চারিত হয় কাতর অনুনয়—‘‘আমাকে ছাড়িয়া দাও, তুমি মেহেরবান, আল্লা তোমার মঙ্গল করিবেন৷ আমি কসবী নহি, আমাকে ছাড়িয়া দাও৷’’১১২ এক বারবনিতার কন্যার, এক পেশাদার বাইজির অনুনয় কর্ণে তোলার মতো মহানুভব কামান্ধ আফরাসিয়র খাঁ-এর নেই, তাই সে সুরাবিজরিত অবস্থায় মনিয়ার দুহাত চেপে ধরলে উপায়ন্তর না দেখে মনিয়া চিৎকার করে৷ সেই দুর্বৃত্তের হাত থেকে উদ্ধার পায় অসীমের কৃপায়৷ মনিয়া সসম্মানে তার তাবুতে স্থান পায়৷ অসীম অচিরেই তার অপাপবিদ্ধা নিষ্পাপ নারীহৃদয়ের রাজ-রাজেশ্বর হয়ে বসে৷ মনিয়ার নির্মল জীবনের প্রসঙ্গ তার অনুপস্থিতিতে পিতা গুলশের খাঁ ও তার বন্ধু রুস্তম দিল খাঁ এর কথপোকথনে উঠে এসেছে৷ গুলশের খাঁ মনিয়াকে চেনে তাই যখন শাহাজাদার দরবার থেকে মেয়ে ফিরে আসছে না দেখে আশঙ্কিত হয় তখন রুস্তম দিল খাঁ বলে—‘‘কসবীর কন্যা কসবী,—আশনাই করা যাহার পেশা, তাহার জন্য চোখের জল ফেলিলে কি হইবে? তাহার হয় ত মাশুক জুটিয়াছে; সে দুই দিন ফুর্তি করিতে সরিয়া পড়িয়াছে৷’’১১৩ গুলশের খাঁ বন্ধুর এ হেন কথার প্রতিবাদ করে যখন জানায় যে তার মেয়ে বেশ্যার মত চারিত্রিক গুণাবলীর নয় তখন গুলশের খাঁ তার কথাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বলে—‘‘রাখ তোমার কথা, কসবীর কন্যা, সতী, তোমার পূর্বে তোমার ন্যায় অনেক আহম্মক দেখিয়াছি,—তুমি প্রথম নহ৷’’১১৪ মনিয়ার পালক পিতা গুলশের খাঁ জন্মাবধি মনিয়াকে জানে তাই তার অন্তঃকরণ তাকে গণিকার মতো শরীরী উত্তেজনায় মত্ত হয়ে পুরুষ বিহারে রত বলে মেনে নিতে পারে না কিন্তু রুস্তম দিল খাঁ তা নয়৷ তার চোখে মনিয়া শুধুমাত্র গণিকাকন্যা এবং দেহবিক্রয় করাই তার অনিবাহ্যতা৷ তার কথায় গণিকাজীবনের বিভিন্ন দিকগুলোও প্রতিভাত৷ যেমন তাদের আশনাই অর্থাৎ প্রেম করা পেশা৷ ফূর্তি করতে পরপুরুষের সঙ্গে চলে যেতেও দ্বিধাবোধ হয় না বা তাদের জন্য তা দোষের নয়৷ অবশেষে গুলশের খাঁ যখন মেয়ের সন্ধান পেয়ে অসীমের তাম্বুর সামনে উপস্থিত হয় তখন তাকে দেখে মনিয়া শিহরিত হয়ে উঠে; মুখে-চোখে ভীতির চিহ্ন স্পষ্ট হয়ে দেখা দেয়৷ তার অন্তরাত্মা অসীমকে ছেড়ে কোথাও যেতে চায় না৷ অসীমের সঙ্গে থাকার অভিলাষে সে তার পিতাকে বলে—‘‘আব্বা, আমি কসবীর বেটী কসবী, কসব আমার পেশা৷ বাল্যকাল হইতে পিতা-মাতা যাহা শিখাইয়াছে, তাহাই করিতে এখানে আসিয়াছি৷’’১১৫ মেয়ের মুখে এহেন কথা শুনে স্তম্ভিত গুলশের খাঁ তাকে বলে—‘‘মনিয়া, তুমি কসবী, এ কথা ত প্রথম শুনিলাম মা! লোকে জানুক, বা না জানুক আমি তোমার পিতা৷ আমি কি কখনও তোমাকে কসব করিতে শিখাইয়াছিলাম? তুমি কসবীর কন্যা বটে, কিন্তু আমি আজীবন তোমাকে ভদ্র গৃহস্থকন্যার মত রাখিতে চেষ্টা করিয়াছি৷ তওয়াইফ হইলেই কি কসবী হইতে হয় মা!’’১১৬ গুলশের খাঁর এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে মনিয়া চরিত্রের মধ্যে যে স্বচ্ছতা-নির্মলতা-পবিত্রতার দৃঢ় অবস্থান তার ভিতটিকে খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না৷ পিতার গৃহে ফিরিয়ে নেওয়ার অনুরোধ-উপরোধ তাকে এমন কঠিন করে তোলে যে শেষ পর্যন্ত সে সকলের সামনে পিতাকেই অস্বীকার করে যাতে অসীম তাকে পুনরায় গৃহে না পাঠাতে পারে৷ তবু মনিয়া বারাঙ্গনা কন্যা৷ সে মুজরা করে নিজের যশ-খ্যাতিকে বহুদূর বিস্তির্ণ করেছে৷ তার জাত নেই৷ মা হিন্দু বাবা মুসলমান৷ তাকে কোনো উচ্চবংশীয় হিন্দু যুবা পত্নী হিসেবে মেনে নিতে পারে না; সমাজে তার প্রচলনও নেই৷ সে উচ্চবংশের পুরুষদের শরীরী ক্ষুধা মেটাতে পারে কিন্তু সামাজিকভাবে কোনো গৃহের গৃহিণীরূপে তার স্থান নেই৷ তাই অসীম তার প্রণয়সম্ভাষণকে দৃঢ়ভাবে উপেক্ষা করলে সে প্রবল আত্মাভিমানে সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে দেহব্যবসার আবর্তে আবর্তিত হওয়ার জন্য তার মায়ের কাছে ফিরে যেতে চেয়ে অসীমকে জানায়—‘‘বাবুসাহেব, আপনি নিশ্চিন্ত মনে চলিয়া যান,—আমার মুহূর্তের জন্য চিত্তবিভ্রম হইয়াছিল, এখন তাহা কাটিয়া গিয়াছে৷ আমি মনিয়া,—পাটনা সহরের কসবী, মুজরা করিয়া খাই,—এখন আমার কসবী মায়ের ঘরে আবার কসব করিতে ফিরিয়া যাইতেছি৷ ভয় করিও না বাবুসাহেব, আমি মরিব না৷ আমার জাতির কি মরণ আছে?’’১১৭ অসীম দুর্বৃত্ত নয়, সে এক হৃদয়বান যুবক৷ দুষ্টের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই সে মনিয়াকে উদ্ধার করেছে, নিজের তাম্বুতে আশ্রয় দিয়েছে৷ মনিয়ার পিতা মেয়ের ঘরে না ফেরার দায় সমস্ত তার উপর ন্যস্ত করলে বাধ্য হয়েই সে মনিয়াকে ঘরে ফেরার জন্য অনুরোধ করেছিল৷ কিন্তু তার দৃঢ় এবং স্পষ্ট প্রেম সম্ভাষণের মধ্যে সে যখন নারী হৃদয়ের গভীর বেদনাকে অনুভব করতে পারে তখন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তার দুহাত নিজ হস্তে ধারণ করলে মনিয়া আতকে ওঠে—‘‘স্পর্শ করিলে কেন? আমার বেশ্যা জননী জীবনে যে পথ আমার জন্য নির্দেশ করিয়াছিল, সেই পথ অবলম্বন করিতে যাইতেছিলাম দিলের৷ তুমি আমাকে স্পর্শ করিলে কেন? তোমার পবিত্র করস্পর্শে হীনা, যবনী, বেশ্যাকন্যা যে পবিত্রা হইয়া উঠিল! কেন তুমি আমার উদ্দেশ্য বিফল করিলে? যে দেহ তোমার পবিত্র স্পর্শে পুত হইয়াছে দিলের, তাহা আর কামুকের পাপ-করস্পর্শে কলুষিত হইবে না—তাহা উৎসর্গকৃত শুভ্র-পুষ্পের ন্যায় চির-নির্মল থাকিবে৷’’১১৮ সে অসীমের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ফিরে যেতে চেয়েছিল তার মায়ের নির্দেশিত কসবি জীবনে কিন্তু অসীমের করস্পর্শে সে পবিত্র হয়ে উঠে৷ এই পবিত্রতাই তাকে শক্তি জোগায় দেহজীবিকার গ্লানিময় জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে৷ অসীমের সংস্পর্শ থেকে পূর্ণ পবিত্রতার উপলব্ধি নিয়ে সে ঘরে ফিরে যেতে চাইলে হৃদয়বান সচ্চরিত্রের যুবক অসীমও তাকে বিপদসংকুল পথে একা ছাড়তে চায় না৷ সে তাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য যত্নবান হলে মনিয়া তার পাপসংস্পর্শ থেকে অসীমকে মুক্ত রাখতে হাত জোড় করে হলে—‘‘ঐটি মাফ করিও৷ আমার বিশেষ প্রয়োজন আছে, একাই যাইতে হইবে৷ দোহাই তোমার দিলের,—’’১১৯ মনিয়ার ছিল অসীমের প্রতি নিষ্পাপ ভালোবাসা৷ সে প্রেমাস্পদকে সম্বোধন করতো ‘জানি’, ‘দিলের’ ইত্যাদি দ্বারা৷ তার জীবন থেকে সে বহু দূরে চলে যেতে চায় যাতে, তার বেশ্যা পরিচয়ে অসীম বিব্রত না হয়৷ কিন্তু হৃদয় তো তা চায় না৷ তাই বিদায় মুহূর্তেও তার মুখ থেকে যখন ‘দিলের’ সম্বোধন বেড়িয়ে আসে তখন নিজেকে সংযত করতে সে বলে—‘‘মাঝে-মাঝে ঐ সম্বোধনটা এখনও আসিতেছে; কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানের একমাত্র ঈশ্বরের নাম লইয়া শপথ করিতেছি, কাল হইতে আর আসিবে না৷’’১২০

মনিয়া বেশ্যা-কন্যা৷ হিন্দু মা ও মুসলিম পিতার ঔরসে তার জন্ম৷ চোখধাঁধানো প্রখর তার সৌন্দর্য৷ বেশ্যা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যথার্থ তালিম দিয়ে তার যৌবনাবেগকে আরও খানিকটা উস্কে দিয়েছে তার মা৷ কিন্তু অসীমকে ভালোবেসে ওসবের কিছুই চায় না সে৷ মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় হিন্দু হয়ে সে অসীমের যোগ্য হিসেবে নিজেকে তৈরি করবে৷ এই উদ্দেশ্য নিয়ে সে উপস্থিত হয় মহেন্দ্রূতে এক পুষ্করিণীর তীরে; যেখানে একদিকে ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীরা অপরদিকে ফকিরেরা সংসার থেকে বৈরাগ্য নিয়ে বসবাস করে৷ মনিয়ার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল ঈশ্বরের সেবাব্রত ধারণকারী ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীরা তার অভীষ্ট সিদ্ধ করতে পারবে৷ এই অংশে লেখক নারীলোলুপ ভণ্ড তপস্বীদের কামগন্ধময় জীবনচিত্রের সুষ্ঠু বর্ণনা দিয়েছেন৷ সেখানকার প্রত্যেকেই মনিয়ার অপ্সরীতুল্য রূপ দেখে প্রবৃত্তির তাড়নায় তাকে উপভোগ করতে চেয়েছে৷ মনিয়া প্রথমেই তিন্তিড়ীবৃক্ষমূলে বৃহজ্জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসীকে ধুনি জেলে বসে থাকতে দেখে তার সামনে গিয়ে প্রণাম জানিয়ে কিছু বলতে চাইতেই সন্ন্যাসী তার রূপ দেখে বুঝতে পারে যে সে একজন তওয়াইফ৷ তাই প্রথমেই তার উপর শর্ত আরোপ করে ‘দো-চার রোজ’ ভজন গাওয়ার৷ বিরক্তচিত্তে সে স্থান ছেড়ে এক ব্রহ্মচারীর সামনে দাঁড়াতেই সেই ব্রহ্মচারী লালসাসিক্ত নয়নে ক্ষুধিত ব্যাঘ্রের ন্যায় তাকে গিলে ফেলতে চায়৷ সকলের ভাবগতিক বুঝতে পেরে অবশেষে পুকুরের এক কোণে বসে থাকা এক বৃদ্ধ ব্রহ্মচারীর সম্মুখে গিয়ে নিজের মনোবাঞ্ছা জ্ঞাপন করতে পারে৷ তাকে অকপটে নিজের পরিচয় দান করে বলে—‘‘আমি বেশ্যাকন্যা,—কিন্তু আমার পিতা মুসলমান৷… বাবা, আমি কি হিন্দু হইতে পারি?’’১২১ সন্ন্যাসী তাকে উপদেশ দেয় মুসলমানের আচার-ব্যবহার পরিত্যাগ করে কায়-মনো-বাক্যে হিন্দুর অনুকরণ করতে৷ সেই অনুসারে সে পায়জামা ত্যাগ করে শাড়ি পরিধান করে, বিলাস-ব্যসনের চিহ্নস্বরূপ সব আভরণ ত্যাগ করে নিরাভরণ হয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় মুজরা ঠিকই করবে কিন্তু কখনো পরপুরুষের কন্ঠলগ্ন হবে না; ঈশ্বরের দেওয়া নিজের সুরেলা কন্ঠে ঈশ্বরের ভজন গাইবে৷

মনিয়ার প্রেমাকাঙ্খী ফরীদ খাঁ৷ সে মনিয়াকে তার উদ্যানে মুজরা গাওয়ার প্রস্তাব রাখে৷ সেই মতো সে যখন ‘রূপার তাঞ্জামে’ চড়ে মুজরা করার জন্য উদ্যানের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে তখন পথে দেখা হয় অসীমের সঙ্গে৷ অসীম লক্ষ করে তার পোশাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার সমস্তই বারনারীসুলভ৷ তওয়াইফ-এর কায়দাতেই সে অসীমকে কুর্নিশ জানায়৷ তারা দুজনে যে পূর্বপরিচিত তা তাদের ব্যবহারে কারও বোধগম্য হয় না৷ তাই মনিয়াবাইকে দেখে কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় অসীম হঠাৎ হাসতে শুরু করলে তার সেই হাসির কারণও কারও বোধগম্য হয় না৷ এক পথচারী তাকে মনিয়াবাইয়ের পরিচয় জানিয়ে বলে যে পাটনার মনিয়াবাইকে যে না চেনে সে পাটনাশহরে নবাগত৷ মনিয়া তার রূপ যৌবন ও সুরেলা কন্ঠ দিয়ে পাটনা শহরের সর্বশ্রেষ্ঠ গণিকার স্থান দখল করে নিয়েছিল৷ যেখানে যেখানে তার মুজরা হত সেখানকার প্রত্যেক ব্যক্তিই তার রূপের বহ্নিতে পতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মসুখ চরিতার্থ করতে চাইত৷ পাটনার প্রত্যেক পুরুষের হৃদয়েশ্বরী তাই মনিয়াবাই৷ ফরিদ খাঁ তাকে ‘পাটনা সহরের বুলবুল’ বলে অভিজ্ঞানিত করেছে৷ মনিয়ার মুজরা কক্ষে কৌতুহল্লোদ্দীপক হয়ে অসীম উপস্থিত হলে তার প্রতি নিক্ষিপ্ত মনিয়ার নয়ন কটাক্ষে অসীম লজ্জায় রক্তবর্ণ হলে তাকে উদ্দেশ্য করে এক বৃদ্ধ রসিক বলে—‘‘জনাব, আপনার মত নসীব কয়জনের হয়? মনিয়া ইচ্ছা করিয়া যাহার দিকে অমন করিয়া চাহে, সে খোদার বড়ই প্রিয়পাত্র৷ কত আমীর-ওমরাহ ঐ গোলাপী চরণে আশ্রয় পাইবার জন্য বাদশাহের দৌলৎ লুটাইয়া দিয়া গিয়াছে, তাহার ইয়ত্তা নাই৷ আজ যে চাহনি মনিয়াজান বিনামূল্যে তোমার উপর বর্ষণ করিল তাহার লক্ষ অংশের জন্য কত রাজার রাজ্য গিয়াছে৷ দোস্ত, তুমি আমার তুলনায় এখনও বালক, এমন মওকা হেলায় হারাইও না৷’’১২২ সেই মজলিশে অসীম মনিয়াবাইয়ের গান শুনে চলে গেলে প্রেমে গরিয়সি সেই বাইজি অনায়াসে সকলের সামনে নিজেকে অসীমের প্রেমপ্রার্থিনী হিসেবে স্বীকার করে৷ আর বৃদ্ধ রসিকের কথার মধ্য দিয়ে উচ্চবিত্ত আমীর ওমরাহদের গণিকা তোষণের চিত্রটিও সকলের সম্মুখে সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হয়৷

মনিয়া চায় অসীম তার সংস্পর্শরহিত হয়ে ভালো থাকুক৷ সে অসীমের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি৷ তাই সংকল্প নিয়েছিল অভিসারিকা বেশে তার প্রবলরূপবহ্নির কাছে অসীমকে পরাস্ত করতে, তার সম্মুখে পরপুরুষের সামনে মুজরায় গিয়ে তার ঈর্ষা জাগ্রত করতে৷ কিন্তু অসীম নিরুত্তাপ৷ তার ভুবনমোহিনী রূপেও অসীমের সংযম এতটুকু টলে না৷ সে বার বার মনিয়ার ভালো করতে চাইলেও প্রেমালিঙ্গনে কখনো কাছে টেনে নেয় না৷ তাই সংকল্প নেয় সন্ন্যাসী হওয়ার৷ বিলাসের সব বেশ পরিত্যাগ করে গৈরিক বসন ধারণ করে সে৷ তার নবসন্ন্যাসীবেশকে লেখক বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘সন্ন্যাসিনী যুবতী, রূপসী৷ গৈরিক বসনে তাহাকে ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নির ন্যায় দেখাইতেছিল৷ কেহ যদি সে সময় লক্ষ্য করিয়া দেখিত, তাহা হইলে বুঝিতে পারিত যে, সন্ন্যাসিনী অতি অল্প দিন বিলাস-বাসনা পরিত্যাগ করিয়াছে৷ কারণ, তাহার আকর্ণ-বিশ্রান্ত নয়নযুগ্মের কোণ হইতে কজ্জলের রেখা বহু চেষ্টা সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে মুছিয়া যায় নাই; এবং হস্তের ও পদের নখে মেহেদীর বর্ণ তখনও স্পষ্ট ছিল৷ এমন কি, হস্তের দশ অঙ্গুলিতে গুরুভার অঙ্গুরীয়কগুলির দাগ তখনও মিলাইয়া যায় নাই৷’’১২৩ অসীম মনিয়ার কখনো বারবধূ কখনো সন্ন্যাসিনীর বেশ এই প্রহেলিকাময় আচরণে বিস্মিত৷ তাই সে মনিয়ার সম্মুখে নারীচরিত্রের রহস্যময়তা সম্পর্কে কিছু কথা বললে উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠে মনিয়া৷ অসীম তার সেই হঠাৎ কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে মনের অবরুদ্ধ আবেগে জানায়—‘‘কাঁদি কেন? তাহা পুরুষে বুঝিবে না৷ যদি রমণী হইতে, তাহা হইলে জিজ্ঞাসা করিতে না৷’’১২৪ মনিয়া ভেবেছিল তার রূপের মোহে তার চোখের সম্মুখে অন্যপুরুষের যখন আকৃষ্ট হবে তখন ঈর্ষান্বিত হয়ে সে হয় তো তাকে ভালোবাসবে, তার প্রেমকে স্বীকৃতি দেবে৷ কিন্তু তার সে ভুল অসীম ভেঙে দিয়েছে; সে হিন্দু সন্ন্যাসিনী হয়ে হিন্দুধর্ম অনুশীলন করতে শুরু করে দিয়েছে৷ কারণ সে শুনেছে হিন্দুরা পুনর্জন্ম লাভ করে৷ হিন্দুকন্যারা এক জন্মে যার উপাসনা করে পরজন্মে তাকে লাভ করে৷ তাই সে অসীমকে বলে—‘‘এ জন্মে যাহা আমার অসাধ্য, পরজন্মে তাহা পাইবার ভরসায় হিন্দু হইয়াছি৷ আমার এ সাধে বাধা দিও না দিলদার৷’’১২৫

মনিয়া প্রেমের অনলে পুড়ে যোগিনী হয়ে প্রেমিকের আরাধনায় আত্মবিস্মৃত হয়েছে৷ প্রবল রৌদ্রকে মস্তকে ধারণ করেও প্রেমিকের ভাবনায় বিভোর মনিয়ার কোনো হুশ থাকে না৷ নগরোপকন্ঠে প্রেমের যোগিনীভাবে বিহ্বল তপস্বিনীকে পুড়তে দেখে সরস্বতী বৈষ্ণবী এগিয়ে এসে তাকে মুখে-চোখে জল সেচন করে সুস্থির করে তোলে৷ ছায়ায় নিয়ে গিয়ে তার প্রলাপবাক্যে সান্ত্বনা সুধা বর্ষণ করে৷ মনিয়া যে কারও প্রেমে যোগিনী হয়ে এভাবে তপস্বিনী হয়েছে তা বিচক্ষণ সরস্বতীর বুঝতে বাকি থাকে না৷ মনিয়া তার কাছে ‘আশনাই’ জহর না অমৃত এরূপ প্রশ্ন করলে সরস্বতী তাকে জানায় যে যেহেতু মনিয়ার বয়স কম এবং রূপবতী তাই তার কাছে ‘আশনাই’ মিঠা৷ কিন্তু যখন সেই রূপ ও যৌবন সূর্যের মতো পশ্চিমে ঢলে পড়বে তখন মধুর স্বল্পতার কারণে ভ্রমর আর কাছে ঘেষবে না, তখন বোঝা যাবে প্রেম বিষ এবং সেই বিষ যাকে গ্রাস করে তার আর উদ্ধার নেই৷ তাই সে তাকে উপদেশ দিয়ে বলে যে বোন এমন দিন চিরকাল থাকবে না৷ তার চম্পকবর্ণ গায়ের রঙ জ্বলে কালো হয়ে যাবে৷ চোখের কোলে সেই তীব্র বিষের জ্বালা কালির দাগ টেনে দেবে৷ তার ঐ কোকিল কুজনের মতো কন্ঠস্বর হয় তো দাঁড়কাকের আওয়াজ ধরবে৷ সে মনিয়াকে তার কম বয়সে জ্বলে পুড়ে মরতে দেখে অনুরোধ করে বলে—‘‘বহিন, ফিরিয়া যা; গেরুয়া ধরিবার অনেক সময় আছে,—এই ত তোর প্রথম যৌবন, সারাটা জীবন দীর্ঘ পথের মত সম্মুখে পড়িয়া আছে৷ ফিরিয়া যা৷ যতদিন যৌবন আছে, ততদিন উপার্জন করিয়া নে; তাহা হইলে বুড়া বয়সে আর সরস্বতীর মত খঞ্জনী বাজাইয়া মুরশিদাবাদ ও পাটনার পথে-পথে ভিক্ষা করিয়া উদর পূরণ করিতে হইবে না৷’’১২৬ কিন্তু মনিয়া তো প্রেমের কাছে জীবনকে, জীবনের সুখ-দুঃখকে সমর্পণ করে বসে আছে৷ সে বুঝতে পেরেছে তার প্রেমাস্পদ তার কাছে দুষ্প্রাপ্য নয়—অপ্রাপ্য৷ সরস্বতী তাকে প্রেমিকের কঠোরতায় কঠিন হতে উপদেশ দিলে সে উত্তর দেয়—‘‘শোন বহিন, আমি বেশ্যাকন্যা, বেশ্যবৃত্তি আমার পেশা৷ আমার পিতামাতা ইচ্ছা করিয়া আমাকে এই বৃত্তি অবলম্বন করাইয়াছে, সুতরাং স্বভাবতঃ আমার মন সচরাচর পুরুষ অপেক্ষা সহস্রগুণ কঠিন৷ কিন্তু আমি ত কঠিন হইতে পারি নাই৷’’১২৭ অর্থাৎ মনিয়া বেশ্যা জীবন-পরিবেশে লালিত৷ পুরুষের প্রতি কপট ভালোবাসা, ছলা-কলা-কৌশল কিছুই তার অজানা নয়৷ তার পরেও সে তার বেশ্যাবৃত্তির কৌশলকে প্রয়োগ করতে পারে না অসীমের প্রতি৷ সে তার কাছে দেবদুর্লভ৷ সদবংশজাত, উচ্চপদস্থ কর্মী অসীমকে স্পর্শ তো দূর দর্শন করাই তার কাছে দুরাকাঙ্খা৷ কারণ সে নিজে নীচ৷ তার প্রেমিক অনেক উচ্চে এবং সে পরম পবিত্র৷ সে তার জীবনের কালিমা দিয়ে অসীমকে মসীলিপ্ত করতে চায় না৷

মনিয়ার জীবনে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করে হরিনারায়ণ বিদ্যালঙ্কার৷ সে অসীম রায়ের পিতৃবন্ধু এবং তার পিতার অন্নে প্রতিপালিত৷ সে বুঝতে পারে মনিয়ার প্রেমের সত্যকার রূপকে৷ তার চারিত্রিক দৃঢ়তা, কষ্ট সহ্যের ক্ষমতা এবং সীমাহীন সংযম বিদ্যালঙ্কারকে অভিভূত করে৷ সেও মনিয়াকে পরামর্শ দেয় কঠোর সংযমের৷ কারণ হিন্দু সমাজে বেশ্যার গর্ভে এবং যবনের ঔরসে জন্ম নেওয়া নারী অস্পৃশ্য৷ সে তাকে বলে যে অসীমকে তার লৌকিক জীবনে লাভ করা সম্ভব না হলেও তাকে উপাস্য করে আকাঙ্খা বর্জনের মধ্য দিয়ে সত্যকার প্রেমকে লাভ করা তার পক্ষে অসম্ভব নয়৷ তাই এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য—‘‘মা, যদি মানুষিক প্রেম পবিত্র করিয়া, কামনা পরিত্যাগ করিয়া ঈপ্সিতকে ভজনা করিতে পার, তাহা হইলে জগতের পথে তোমার ও তাহার পদে কুশাঙ্কুরও বিঁধিবে না৷’’১২৮ মনিয়া তার কথা শুনে প্রতিজ্ঞা করে সে তার সমস্ত কামনা বাসনা পরিত্যাগ করে ঐশ্বরিক সাধনায় অসীমের আরাধনা করবে৷ বিদ্যালঙ্কার তার ত্যাগ-মহানতায় এই গণিকা কন্যাকেও নিজের কন্যার সমতুল করে কন্যা হিসেবে গ্রহণ করে৷ মনিয়া যেন মুহূর্তেই সমস্ত আত্মগ্লানি ভুলে পবিত্র হয়ে যায়৷ সে তার কাছে প্রতিশ্রুত হয় অসীমের হিতসাধনে তার অনিষ্টকারী সরস্বতী বৈষ্ণবীর অনুসরণ করবে এবং বিদ্যালঙ্কারের অনুমতি ব্যতীত কখনোই অসীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে না৷

বারবনিতা মনিয়া অসীমের হিতকল্পে তার সকল হিতকারীর বন্ধু হয় এবং অহিতকারীর শত্রু হয়৷ সরস্বতীকে অনুসরণ করে সে নাপিত নবীনের ষড়যন্ত্র থেকে তার পিতৃতুল্য বিদ্যালঙ্কারের প্রাণ রক্ষা করে৷ কাফ্রী বালকের রূপ ধরে নবীনের সম্মুখে গিয়ে নিজেকে মনিয়াবাইয়ের দূত হিসেবে পরিচয় দেয় এবং তার সকল খবর সংগ্রহ করে৷ নবীন ও সরস্বতী ষড়যন্ত্র করে যখন বিদ্যালঙ্কারের কন্যা ও পুত্রবধূকে অপহরণ করে নিয়ে বন্দি করে রাখে তখন মনিয়া তার উপস্থিত বুদ্ধির সাহায্যে তাদের উদ্ধার করতে সচেষ্ট হয়৷ নবীনের সঙ্গে মেলামেশা করে এবং তাদের অনুসরণ করে সমস্ত ঘটনা সে আগেই বুঝতে পেরেছিল৷ তাই ব্রাহ্মণ কন্যার ছদ্মবেশে দুর্গা ও তার ভ্রাতৃজায়ার বন্দি কক্ষের সম্মুখস্থ এক দীর্ঘিকায় বসে নবীনকে ভোলাবার জন্য তার সুরেলা কন্ঠে ভজন শুরু করে—

 ‘‘মাহ কি জ্যোছনা হোয়ে আঁধিয়ার৷

 যব তুঁহু ছোড়ি গয়ে হমারে পিয়ার৷৷’’১২৯

মনিয়া তার হাবভাব, কটাক্ষ, অনুগ্রহ দেখিয়ে নবীনকে প্রথম থেকেই নিজের হস্তগত করে রেখেছিল৷ তাই মনিয়ার সেই সুরেলাকন্ঠ নবীনের বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ সে মুগ্ধ বিস্ময়ে তার কন্ঠের অনুসরণ করে আর সম্মুখে উপস্থিত হলে মনিয়ার ছলনায় বন্দি হয় এক কবরের মধ্যে৷ তাকে বন্দি করে সরস্বতীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে উদ্ধার করে অসীমের দুই হিতৈষিণীকে৷ সসম্ভ্রমে তাদের পৌঁছে দেয় আপনজনদের হাতে৷ সেই সময় ত্রিবিক্রমের মুখে অসীমের বিবাহের কথা শুনে নিজের আবেগকে দমন করে নিরবে প্রেমাস্পদকে নতুন জীবনের অভিমুখে ছেড়ে দিয়ে বাল্যবন্ধু, সুহৃদ ফরিদ খাঁর সঙ্গে পাটনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়৷ ফরীদ প্রথমাবধিই মনিয়ার প্রণয়প্রার্থী৷ তার সহবাসেই সে তার যৌবনের প্রথম পর্যায় বিলাস-বাসনায় অতিবাহিত করেছে৷ সে মদ্যপ, উশৃঙ্খল, লম্পট৷ তার প্রথম প্রণয়ী মনিয়াকে জীবনভর নিজের করে নিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরতে চায় সে৷ মনিয়াকে নিয়ে গৃহকন্নায় শান্তি পেতে চায় শ্রান্ত-ক্লান্ত ফরীদ৷ তার সেই প্রস্তাব দৃঢ়স্বরে প্রত্যাখ্যান করে মনিয়া বলে—‘‘তোমার পিতা হিন্দুস্থানের একজন বিখ্যাত বীর,—আলমগীর বাদশাহের একজন বিখ্যাত কর্মচারী;—আর আমি হিন্দু বেশ্যার মুসলমান উপপতির কন্যা,—উদরের জন্য পাটনার পথে-পথে দেহ বিক্রয় করিয়া বেড়াই! ফরীদ, আমি কি তোমার যোগ্যা জীবনসঙ্গিনী?’’১৩০ ফরীদ মনিয়াকে পেয়ে জীবনের মুক্তির পথ খুঁজেছিল কিন্তু মনিয়া তো অপারগ৷ তার জীবনের শতদল সে উৎসর্গ করে দিয়েছে অসীমের পদতলে; অন্য কারও জীবনসঙ্গিনী সে হতে পারে না তাই ফরীদকে ভাই বলে সম্বোধন করে, সহোদরা ভগিনীর মতো বিপদে-আপদে সে ফরীদের সঙ্গে থাকতে চায়৷ ভালোবাসার মানুষের মুখে ভাই সম্বোধন মেনে নিতে পারে না ফরীদ খাঁ৷ তাই রাত্রির অন্ধকারেই মনিয়ার অজ্ঞাতে সে রথ থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়৷ মনিয়া যখন বুঝতে পারে রথে ফরীদ নেই সে পাগলের মতো ছুটতে থাকে ফরীদকে খোঁজার জন্য৷ সে আশৈশব ফরীদকে দেখে এসেছে৷ সে ধনীর পুত্র, আরাম আয়াসে ভোগে-সুখে তার জীবন৷ তাকে মুহূর্তে দেখতে না পেলে তার পিতামাতা অন্ধ হয়ে যায়৷ আশঙ্কিত হৃদয়ে তার সন্ধান করতে করতে সে উপনীত হয় এক জনশূন্য মন্দিরে৷ তার শ্রান্ত দেহ মন্দিরের দুয়ারে এলিয়ে দিয়ে অচিরেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়৷ হঠাৎ নিদ্রাভঙ্গ হলে সে দেখতে পায় এক স্থূলকায় খর্বাকৃতি বৃদ্ধ তার দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে৷ মনিয়া ভয় পেয়ে গেলে বৃদ্ধ তাকে আশ্বস্ত করে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে সে সেই মন্দিরের পূজারী; তাকে কোনো ভয় নেই৷ বৃদ্ধের কোমল ব্যবহারে মনিয়া ধীরে ধীরে ধাতস্থ হয়৷ বৃদ্ধের মুখে গোপাল, শ্রীচন্দ, গোবিন্দ ইত্যাদি নাম শুনে সন্ন্যাসিনীবেশী মনিয়া তার অর্থ বুঝতে না পারলে বৃদ্ধের বিস্ময়ে সে জানায়—‘‘বাবা, আমি মুসলমানী, নর্তকীর কন্যা নর্তকী৷ বেশ্যাবৃত্তি পরিত্যাগ করিব বলিয়াই সন্ন্যাসিনী সাজিয়াছি৷’’১৩১ সেই বৃদ্ধ বৈষ্ণবের সাহায্যেই মনিয়া পরিচিত হয় হিন্দু দেবতা গোপালের সঙ্গে৷ অবগত হয় পৃথিবীতে যত কার্য সম্পন্ন হয় তার চক্রী স্বয়ং গোপালই৷ তারই নির্দেশে মনিয়া তার সঙ্গে পূর্বদেশে যাত্রা করে উপস্থিত হয় অসীমের বিবাহ মণ্ডপে৷ বিবাহের নান্দীমুখ শ্রাদ্ধের সময়ে অবগুন্ঠনবতী এক নারীকে দেখে নিজের অজ্ঞাতেই অসীমের মুখে উচ্চারিত হয় ‘মনিয়া’ নামটি৷ মনিয়ার প্রেমের স্পর্শ অসীমের হৃদয়কেও রোমাঞ্চিত করেছিল তা অস্বীকার করা যায় না৷ মনিয়ার জন্য বার বার তার হৃদয় কেঁদে উঠেছে কিন্তু জাতি ও সমাজের অদৃশ্য বন্ধনে সে মনিয়াকে গ্রহণ করতে পারেনি৷ মনিয়াও সমস্ত প্রবৃত্তিকে সুদৃঢ় করে বাঁধতে পেরেছিল৷ লেখক মনিয়ার সেই কঠিন কাজকে সহজ করে উপস্থাপন করে দিয়েছেন৷ বাস্তবে হয়তো তা সম্ভব হত না৷ কারণ যে মনিয়া অসীমের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করেছে, অসীমের ভালোর জন্য অসাধ্য সাধনের সংকল্প নিয়েছে; অসীমের প্রেমে পাগলিনী হয়ে যোগিনী হয়েছে; অসীমের বিবাহ সভায় প্রেমাস্পদকে অপর এক নারীর হস্তগত হতে দেখে তার সামান্যতম বিচলিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল৷ কিন্তু তার নির্বিকার ঔদাসীন্য, প্রতিক্রিয়াহীনতা চরিত্রটির সজীবতা কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ণ করেছে বলে মনে হয়৷ বিবাহের পর সে অসীমকে সম্বোধন করেছে হুজুর, জনাব ইত্যাদি শব্দ দ্বারা৷ মনিয়ার এহেন সম্বোধনে বিরক্ত হয়েছে অসীম, কারণ মনিয়াকে সে বহুদিন দেখেছে এবং জানে৷ তার সঙ্গে মনিয়ার সেই নতুন সম্বোধনে সে অভ্যস্ত নয়৷ অসীমের প্রতি তার অনুরাগের কথা জানতে পেরে নববধূ যখন মনিয়াকে তার সঙ্গ ছাড়ার হুকুম দিয়েছে তখন মনিয়া বিনাবাক্যব্যয়ে তা শিরোধার্য করেছে৷ তার সেই প্রখর রূপ নিয়ে একাকী অনির্দেশের পথে যাত্রার সঙ্কল্প দেখে অসীম শঙ্কিত হয়েছে, ব্যথিত হয়েছে৷ এর প্রেক্ষিতে মনিয়া তাকে বলেছে—‘‘হুজুর, অলঙ্কার, পোষাক খুলিয়া ফেলা যায়, কিন্তু রূপ ত মুখোসের মত খুলিয়া ফেলা যায় না৷ দুনিয়ার হাওয়ার সঙ্গে মনের হাওয়াও বদলাইয়া যায়; কিন্তু চেহারা যিনি দিয়াছেন, তিনি না বদলাইলে আর কেহ পরিবর্তন করিতে পারে না৷’’১৩২ অসীম মনিয়াকে অনুরোধ করে পাটনায় তার পিতা-মাতার কাছে ফিরে যেতে৷ মনিয়ার ইচ্ছে না থাকলেও অসীমের আদেশ হিসেবে তা মেনে নেয়৷ সহসা মনিয়ার জীবনযন্ত্রণায় কাতর হয়ে অসীমের চোখ থেকে জল গড়িয়ে আসে কারণ সে জানে ভুবনমোহিনী রূপ, সুরেলা কন্ঠের জাদুকারীতায় পাটনার হৃদয়েশ্বরী মনিয়াবাই আজ তারই জন্য ভিখারিনি হয়েছে অথচ সে কিছুই করতে পারেনি তার জন্য৷ তার চোখের অশ্রুবিন্দু মনিয়াকে বিহ্বল করে দেয়৷ মুহূর্তে সমস্ত সংযম ভুলে তার পদদ্বয় আলিঙ্গন করে সে বলে ওঠে—‘‘তুমি কাঁদিতেছ! আমার দুনিয়ার দৌলৎ, তুমি কাঁদিতেছ কেন! তোমার কিসের দুঃখ বল? তুমি যাহা বলিবে, আমি তাহাই করিব৷’’১৩৩ অসীমের দুঃখের কারণ শুনে মনিয়া তাকে সান্ত্বনা দিয়ে তার জীবনের সমস্ত প্রাপ্তির কথা শোনায়৷ তাকে বোঝায়—‘‘মনে করিও না যে, তোমার জন্য আমার অবস্থা হীন হইয়াছে, আমি আজ তোমার জন্য কত উচ্চ, তা কি তুমি জান? দিলের তুমি ভাবিতেছ আমি কি ছিলাম কি হইয়াছি—শাটিন-মখমলের পেশোয়াজ না পরিয়া, হীরা-মুক্তার অলঙ্কার না পরিয়া, এই গেরুয়া কাপড় পরিয়া বেড়াইতেছি বলিয়া মনে করিও না যে, মনিয়া ছোট হইয়াছে৷ লোকের চোখে এ বেশ হীন দেখাইতে পারে; কিন্তু তুমি জান না দিলের, এ বেশে আমি আমার কাছে কত উচ্চ৷ এখন আমি আমার৷ এখন পথের কুকুরের মত ডাকিলেই আমাকে লোকের কাছে যাইতে হয় না৷ যাহাকে মনে মনে ঘৃণা করি, অর্থের জন্য তাহার সঙ্গে হাসিমুখে কথা কহিতে হয় না;—সে যে কত বড় সুখ, কত উচ্চতা, তাহা বেশ্যা ভিন্ন কেহ বুঝিতে পারে না৷’’১৩৪ মনিয়া অসীমের কাছে তার জীবনের সত্যটিকেই তুলে ধরেছে৷ তার কাছে তাই সুখ, ঐশ্বর্য, সম্পদ না থাকলেও সে আত্মতৃপ্ত৷ পরের গৃহে গৃহে মুজরা করে, দেহ-মন দান করে পরপুরুষকে আনন্দ দেওয়ার মধ্যে নারীর কোনো গৌরব নেই; সেখানে শুধুই অপমান৷ মনিয়া অসীমকে ভালোবেসে সে অপমান থেকে মুক্ত হয়েছে৷ নিজের কাছে নিজের মুখ লুকিয়ে আর তাকে থাকতে হয় না৷ অসীমের প্রতি মনিয়ার সেই অসংযত হৃদয়-উন্মোচন দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে হরিনারায়ণ তাকে তার সংযমব্রত নিয়ে তিরস্কার করলে মনিয়া তাকে জানায়—‘‘বাপজান, আমি আপনার উপদেশ ভুলি নাই,—সংযম-ব্রত পরিত্যাগ করি নাই৷ এক মুহূর্ত দেবতার চোখে জল দেখিয়া আত্মহারা হইয়া গিয়াছিলাম৷ খোদার কসম বলিতেছি বাপজান, আমি ইচ্ছা করিয়া এদেশে আসি নাই৷’’১৩৫ মনিয়া তো অসীমকে পরিত্যাগ করেই গিয়েছিল কিন্তু বিধাতার নির্বন্ধ পুনরায় তাকে তার প্রেমাস্পদের সম্মুখবর্তী করেছে৷ এবারে বিদ্যালঙ্কার আরও কঠিন উপদেশ দান করে বলে যে এমন কঠোর সংযমী হতে হবে তাকে যে অসীমের চোখের জল কেন অসীমকে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখেও তার বিচলিত হওয়া যাবে না৷ শুধু তাই নয় ইচ্ছে করে অসীমকে দেখা যাবে না, তার কথা কানে তোলা যাবে না এবং তার রূপ মনে আনা যাবে না৷ মনিয়া সব শর্ত মেনে নেয় শুধুমাত্র শেষেরটি ছাড়া৷ কারণ অসীম তার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা; তার আরাধ্য দেবতা৷ সেই দেবতাকে হৃদয়মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করে অহরহ তাকে দর্শন করে সে৷ সেই দেবতার রূপ মনে না আনলে সে তো মরে যাবে৷ তথাপি সে চেষ্টা করবে তার প্রিয়তমকে সর্বোতভাবে উপেক্ষা করার কৌশল অর্জন করতে৷

সত্যকারের ভালোবাসা মানুষের মনে স্বর্গীয় সুখানুভূতি এনে দেয়৷ সংসারের কোনো কিছুর প্রতি তখন তার আর কোনো আকর্ষণ থাকে না৷ ধনসম্পদ, বৈভবের প্রতি তো নয়ই; এমন কি নিজের রূপ, যৌবন, দেহের প্রতিও নয়৷ মনিয়ারও সেই একই অবস্থা৷ সে অসীমকে ভালোবেসে পাটনা নগরে অভিজাত সমাজের হৃদয়ের বুলবুল থেকে পথের ভিখারিনি হয়েছে; নিজের পক্ষে যতখানি ত্যাগ করা সম্ভব সব করেছে৷ কিন্তু ঈশ্বরপ্রদত্ত রূপরাশি তো ত্যাগ করতে পারে না৷ সেই রূপের জন্য সে বার বার বিপদের মধ্যে পড়েছে, রূপের ভয়েই অসীমের স্ত্রী শৈল অসীমের সংস্পর্শ থেকে তাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে৷ তাই সে সংকল্প নিয়েছে সেই রূপ পরিত্যাগ করার; হাকিমের সাহায্য নিয়ে চোখঝলসানো অপরূপ রূপরাশিকে জ্বালিয়ে দেওয়ার৷ তাই নিশুতি রাতে সকলের অগোচরে হাকিম শহীদুল্লাহের কাছে উপস্থিত হয়ে বলে—‘‘জনাব, আমার বেমার রূপ৷ রূপ কেমন করিয়া জ্বলিয়া যায় বলিতে পারেন?’’১৩৬ তার বেণুনন্দিত কন্ঠে সেই অভাবনীয় প্রস্তাব শুনে আশ্চর্য হয়ে যায় হাকিম৷ মনিয়া তার রূপের প্রতি সম্পূর্ণ বিতৃষ্ণ৷ রূপের জ্বালায় মানুষের লালসা থেকে, মায়ের লোভ থেকে, অসীমের দুশ্চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আসতে চায় সে চিরতরে৷ তাই হাকিমকে অবাক হতে দেখে পুনরায় তাকে উদ্দেশ্য করে বলে যে; সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিকে নিজের ইচ্ছেতে সে রূপ পরিত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ তার কারণ দর্শিয়ে জানায়—‘‘এই রূপ আমার কাল; এই রূপের জন্য আমার সমস্ত সুখ-সম্পদ দূর হইয়াছে৷ আমার এই রূপ আমার সুখের ঘরেও দুঃখের আগুন জ্বালাইয়া দিয়াছে৷’’১৩৭ হাকিম তার অর্ধশতাব্দীব্যাপী জীবনে বহুধরনের ভালো-মন্দ চিকিৎসা করেছে কিন্তু স্বেচ্ছায় নিজের রূপ জ্বালিয়ে দেওয়ার অদ্ভূত প্রস্তাব সে কখনো শোনেনি৷ সে মনিয়াকে বোঝায় যে রূপ হল ঈশ্বরের দান, তা মানুষের সাধ্যায়ত্ত নয়৷ হয় তো তার প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে এবং সেই অভিমানে মর্মাহত হয়ে সে তার রূপ পরিত্যাগ করতে চাইছে৷ কিন্তু প্রথম যৌবনের সামান্য বিরাগে স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে নিজের রূপ জ্বালিয়ে দেওয়া কখনোই যুক্তিযুক্ত নয়৷ আর মানুষ যদি নিজের আত্মাভিমানে বিভোর হয়ে ঈশ্বরের দেওয়া পরমরূপরাশিকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয় তাহলে শত চেষ্টা করলেও সেই রূপ পুনরায় ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়৷ হাকিমের এই কথা শুনে মনিয়ার মুখে প্রতিফলিত হয় সমগ্র বারাঙ্গনাদের জীবনালেখ্য এবং গণিকা হিসেবে তার নিজের জীবনদর্শন৷—‘‘জনাব, আমি কসবী; শুধু কসবী নহি; কসবীর বেটী কসবী৷ আজি দশ বৎসর ধরিয়া এই পাটনা সহরের আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার মুখে শুনিয়া আসিতেছি যে, আলমগীর বাদশাহের মত আমার রূপ জগজ্জয়ী৷ রূপের গুণ-ব্যাখ্যান শুনিয়া কর্ণ বধির হইয়াছে৷ জনাব, বেশ্যার কি মাশুক থাকে? বেশ্যার মাশুক আশরাফি৷ শুনিয়াছি দুই একজন বেশ্যার মাশুক থাকে; কিন্তু তাহারা তখন আর বেশ্যা থাকে না, তাহারা তখন রমণী হইয়া যায়৷ এই রূপে জগৎ জয় করিয়াছি, পুরুষ জাতিকে অবহেলায় পদে দলন করিয়াছি; কিন্তু সেই রূপই এখন আমার কাল হইয়া দাঁড়াইয়াছে; রূপ আমার সদ্গতির অন্তরায়, রূপ আমার কুপথ প্রদর্শক আর কেবল আমার সর্বনাশের কারণ নহে, অনেক গৃহস্থের গৃহদাহের কারণ৷ জনাব, বেশ্যার রূপ জ্বালাইয়া দিলে দুনিয়ার মঙ্গল হইবে—আল্লাহ প্রসন্ন হইবেন৷ কত সতী দুই হাত তুলিয়া আপনাকে দোয়া করিবেন৷’’১৩৮ এরপর মনিয়া লোভ দেখিয়ে, অনুনয় করে বলে—‘‘আমি আমার পাপের ধন দিয়া আপনার দুই হাত আশরফিতে ভরিয়া দিব৷ জনাব, আপনি আমার বাপের বয়সী; মনে মনে বিচার করিয়া দেখুন, যে বেশ্যা স্বেচ্ছায় নিজ রূপ ধ্বংস করিতে চাহে, সে কি কখনও সে রূপ আর ফিরিয়া পাইবার চেষ্টা করে?’’১৩৯

মনিয়া নিজে রূপাজীবা৷ গণিকাজীবনের পঙ্কিল পরিবেশে তার বেড়ে ওঠা৷ তাই সে ভালো করেই জানে একজন কসবির কাছে রূপের মূল্য কি; অর্থের মূলই বা কি৷ তারপরেও সে তার পরমসুন্দর রূপকে পরিত্যাগ করতে চায়৷ অর্থের বিনিময়ে দেহ-বিক্রয় করা নারীদের সর্বদা মিথ্যা প্রেমের গান গাইতে হয়, তাদের সেই কপট ভালোবাসায় সত্যিকারের প্রেম থাকে না, থাকে না হৃদয়বাঞ্ছিত প্রেমাস্পদ৷ কিন্তু যদি কখনো কারও মনে প্রেম জাগ্রত হয় তখন সে আর পণ্যাঙ্গনা থাকে না; সে তখন রমণী হয়ে যায়৷ তার দেহজীবিকার সমস্ত কলুষতা প্রেমের পরশমণির ছোঁয়া পেয়ে পবিত্র হয়ে ওঠে৷ মনিয়ারও তাই হয়েছে৷ তাই সে নিজেকে আর গণিকা করে রাখতে চায় না, পুরুষের প্রবৃত্তিকে উস্কে দেওয়ার মতো রূপেও তার আর প্রয়োজন নেই৷ আবার বারাঙ্গনাদের জন্য যে সমাজ কুপথগামী হয়, পুরুষেরা পত্নীর একনিষ্ঠ সেবাকে উপেক্ষা করে নিষিদ্ধপল্লীতে গণিকাঙ্গনে জীবন কাটায় সেই দিক থেকে সমাজে তাদের অমঙ্গলের দ্যোতক, অঘটন-ঘটনপটিয়সী হিসেবেও দেখিয়েছেন লেখক৷ তাই তো মনিয়া হাকিমকে বলতে পারে যে তার রূপ জ্বালিয়ে দিলে দুনিয়ার মঙ্গল হবে, আল্লাহ প্রসন্ন হবেন এবং সতী-সাধ্বীরা দুহাত তুলে তার জন্য দোওয়া প্রার্থনা করবে৷ দেহজীবীরা দেহজীবিকার গ্লানিমুক্ত হলে গণিকার মুক্তির পথ আছে নতুবা তারা সমাজের কাছে পাপীয়সীই; লেখকের এই ভাবনারই প্রতিধ্বনি মনিয়ার সেই উক্তির মধ্যে৷ হাকিম বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেছে মনিয়ার মতো পরমাসুন্দরী নারীর কথা শুনে৷ তার চাপা পড়ে থাকা বিবেকবোধ জাগ্রত হয়ে বার বার মনিয়াকে নিষেধ করছে তার সংকল্প রক্ষায়৷ কিন্তু মনিয়ার ছুড়ে দেওয়া পাঁচটি সুবর্ণমুদ্রা তার ভেতরের বিবেককে পুনরায় দাবিয়ে দিয়ে চিরকালীন লোভকে চাঙ্গা করে তোলে৷ সে তাকে রূপ জ্বালিয়ে দেওয়ার ঔষধ দিতে রাজী হয় এবং সঙ্গে এও বলে যে সেই ঔষধের অসহ্য জ্বালা মানুষে সহ্য করতে পারে না৷ কারণ ঔষধ প্রয়োগ করার পর সমস্ত শরীরে গভীর ক্ষত তৈরি হবে, পরে ক্ষত শুকিয়ে গেলে সেই স্থান কুৎসিত হয়ে সমস্ত রূপকে গলিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেবে৷ তারপরেও মনিয়া তার সংকল্পে অটুট থাকে৷ সে বলে—‘‘হজরৎ, আমি অসহ্য নরক যন্ত্রণা সহ্য করিতেছি৷ ইহা হইতে অসহ্য যন্ত্রণা আর কিছুই হইতে পারে না!’’১৪০ মনিয়াকে অনুসরণ করে আড়াল থেকে সমস্ত কথা অবগত হয় বৃদ্ধ বৈষ্ণব৷ পরে তারই হস্তক্ষেপে সে তার রূপজ্বালানোর সংকল্প পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়৷ রূপ জ্বালানোর পরিবর্তে সমস্ত অঙ্গে মসীলেপন করে নিজেকে আড়াল করে সে বৃন্দাবনের পথে বের হয়৷

এর দুই তিনমাস পরে মনিয়াকে দেখা যায় ঘোর কৃষ্ণবর্ণা এক নারীরূপে বৃদ্ধ বৈষ্ণবের সঙ্গে রোজবাহানী গ্রামে এক পানের দোকানের সম্মুখে৷ গ্রামটি আগ্রা থেকে মথুরা ও দিল্লী যাওয়ার পথে অবস্থিত৷ পানের দোকানি তার ব্যবসার আসন্ন ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে স্মরণাপন্ন হয়েছিল বৈষ্ণব ও মনিয়ার যাতে মনিয়া কোনো গান গেয়ে তার দোকানে খদ্দের নিয়ে আসতে পারে৷ দোকানির বিনীত অনুরোধে মনিয়া তার সুরেলা কন্ঠের গান শুরু করলে মুহূর্তেই দোকানের সম্মুখভাগ নানা শ্রেণীর শ্রোতায় ভরে যায়৷ এক শ্রোতার মুখে তার গানের ব্যাখ্যান এইরূপ—‘‘মাগীটা যেন কোকিল রে!’’১৪১ এই শ্রোতার উক্তিকে বিশ্লেষণ করে লেখক বলেছেন—‘‘সত্যই গায়িকা সুশ্রী হইলেও মসীকৃষ্ণবর্ণা৷’’১৪২ অর্থাৎ এতদিন যে প্রখর রূপৈশ্বর্যের বর্ণনা লেখক মনিয়া সম্পর্কে দিয়ে এসেছেন রোজবাহানী গ্রামে সেই কনকবর্ণ রঙ কালিমালিপ্ত৷ যার জন্য তার কন্ঠ চিনতে পেরে উপস্থিত ফরীদ খাঁ ভিড় ঠেলে ব্যাকুল হয়ে ছুটে এসে তার সন্ধান পায় না—পরিণামে অবগুন্ঠনবতী কৃষ্ণবর্ণের রমণীকে দেখে পিছু হটে যায়৷ তাকে দেখে তার কন্ঠ শুনে ফরীদের মনে হয়—‘‘গায়িকা মনিয়ার মত বটে কিন্তু তাহার দৃষ্টি চাঞ্চল্যবিহীন, স্থির, তাহাতে বারবণিতাসুলভ নৃত্য নাই, অঙ্গ-ভঙ্গিতে লালিত্য আছে কিন্তু লজ্জাহীনতা নাই৷’’১৪৩ মনিয়া শুধু তার পূর্বের জীবনধারণ প্রণালী পোশাক-পরিচ্ছদকে পরিত্যাগ করেনি, সুদীর্ঘ সংযম অভ্যাসে তার যে সহজাত আচরণগত বারবনিতাসুলভ ভঙ্গিমা তাও দূরে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে৷ তার দৃষ্টির চাঞ্চল্য, লজ্জাহীন অঙ্গভঙ্গিমা সমস্তই সেখানে অবলুপ্ত৷ বৃষ্টি এবং ঘন কুয়াশার কারণে অন্ধকার হয়ে এলে তারা আর মথুরার পথে অগ্রসর হতে পারে না৷ বাধ্য হয়েই আশ্রয় নেয় রোজবাহানীর অনতিদূরে এক ভাঙা কবরের মধ্যে৷ সেখানে আশ্রয় নেওয়া তিনজন সিপাহির মুখে শুনতে পায় যে কিছুক্ষণের মধ্যে ফররুখসিয়র ও বাদশাহ জাহান্দর শাহর মধ্যে প্রাণঘাতী যুদ্ধ শুরু হবে৷ ফলে বৃষ্টি কমে যাওয়ার পরও তারা সেখান থেকে বের হতে পারে না৷ যোদ্ধাদের কোলাহল ও আহতদের আর্তচিৎকারে রাত শেষ হয়ে এলে যুদ্ধফলের কলরবের মধ্য দিয়ে মনিয়া ও হরিদাস বৈষ্ণব মথুরার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে৷ মনিয়ার কোমল মন মুহূর্তপূর্বে ঘটে যাওয়া যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণতিস্বরূপ চারিদিকে চাপচাপ রক্ত ও রাশি রাশি মৃতদেহের স্তূপ দেখে আঁতকে ওঠে৷ মুমূর্ষ সেনানীদের আর্তচিৎকারে ও করুণ গোঙানিতে সে তাদের অসহায় মৃত্যুর মুখে ঠেলে বেড়িয়ে যেতে পারে না৷ কোথাও না থেমে যদি তারা ক্রমাগত হাটতে থাকে তাহলে সন্ধ্যার আগেই অভীষ্টস্থানে পৌঁছতে পারবে জেনেও সে না থেমে থাকতে পারে না৷ সে সঙ্গী বৈষ্ণবের পরামর্শ উপেক্ষা করে তার হাতের কমণ্ডলু কেড়ে নিয়ে এক আহত মোগল সেনার মুখে জলসিঞ্চন করতে থাকে এবং বৈষ্ণবকে উদ্দেশ্য করে বলে—‘‘লোকটা এখনো বাঁচিয়া আছে বাবা, যতক্ষণ আছে ততক্ষণ ছাড়িয়া যাইতে পারিব না৷’’১৪৪ পরক্ষণেই সেই আহত ব্যক্তি যে ফরীদ খাঁ সে চিনতে পেরে ‘‘ফরীদ, ফরীদ ভাই!’’১৪৫ বলে আর্তনাদ করে ওঠে৷ ফরীদের কানে কানে নিজের পরিচয় প্রদান করলে সে তাকে চোখ মেলে দেখে তার কালোকুৎসিত রূপ সম্পর্কে বলে—‘‘তুমি দোজখের বাঁদী, আর আমার মনিয়াজান বেহেস্তের চামেলী ফুলের মত সফেদী৷’’১৪৬ মনিয়ার সেই কালো রূপ তখনো ফরীদ চিনতে পারে না৷ তখন সমস্ত বিষয় বুঝিয়ে দিতে সে বলে—‘‘ফরীদ, ভাই! আমি যে আত্মগোপন করিবার জন্য রং মাখিয়া আসিয়াছি, আমি সত্যসত্যই মনিয়া, বাঁদীই বল আর পরীজাদীই বল—আমিই সেই মনিয়া৷’’১৪৭ মনিয়া সমাজের হিংস্র শ্বাপদদের হাত থেকে নিজেকে রেহাই দিতে তার মোহিনীরূপকে কালি দিয়ে ঢেকে আত্মরক্ষায় ব্রতী হয়েছে৷ তার অভীষ্ট গোপাল লাভ৷ গোপাল সেবার মধ্য দিয়েই সে অসীমের প্রতি দুর্বার প্রেমপিপাসাকে অবদমিত করতে চায়৷ সেই গোপালের পথে যাওয়ার সময়ই সে ফরীদের দেখা পেয়েছে৷ ফরীদ তাকে তার মৃত্যুর খবর পাটনায় তার বাবা-মায়ের কাছে পৌঁছানোর ভার দিলে মনিয়া প্রবলক্রন্দনে মাথা নেড়ে তা অস্বীকার করে বলে—‘‘ফরীদ, তুই যে বাপ-মায়ের নয়নের মণি, আমি তোকে মরিতে দিব না৷’’১৪৮ আর ঠিক এই সময় মনিয়ার সঙ্গী তার কাছে আর একটু জল চাইলে মনিয়া মুখ তুলে দেখে রাশি রাশি মৃতদেহের মধ্যে আরেক পরিচিত মুখ৷ সেই মুখ আর কারও নয় স্বয়ং অসীমের৷ মনিয়া আবার আর্তনাদ করে ওঠে৷ মনিয়া ফরীদকে ছেড়ে ছুটে এসে তাকে আলিঙ্গন করে৷ আহত দুই আত্মার আত্মীয়কে তার অক্লান্ত সেবা দিয়ে ধীরে ধীরে সুস্থ করে তোলে৷ হাকিম ফরীদের নিদ্রা আবশ্যক জানালে সে এস্রাজ বাজিয়ে তার সুমধুর কন্ঠের জাদুকরি স্পর্শে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেয়৷ অসীম সুস্থ হয়ে ফরীদকে হরিদাস বৈষ্ণবের তত্ত্বাবধানে রেখে মনিয়াকে দেশে তার বাবা-মায়ের কাছে নিয়ে যেতে চাইলে মনিয়ার মুখে উচ্চারিত হয় বিনম্র অস্বীকার—‘‘তসলিমৎ হুজুর, এখন ফরীদভাইকে ফেলিয়া স্বর্গে যাইতেও পারিব না৷’’১৪৯ এখানেই মনিয়া অনন্যা৷ সে তার কর্তব্য সম্পর্কে দৃঢ়৷ আর এই কর্তব্যের বশেই বন্ধুর প্রতি দায়িত্বজ্ঞানে অটল থেকে প্রেমিকের সঙ্গে গিয়ে তার সান্নিধ্যলাভের সুখটাকেও অনায়াসে পরিত্যাগ করতে পারে৷ মনিয়ার প্রেম আর সেই রূপজ মোহে আবদ্ধ নেই৷ সে মনের অন্তরস্থলে অসীমের মূর্তি কল্পনা না করেও অসীমকে ভালোবাসতে পারে৷ সে দেহাতীত প্রেমস্বরূপকে আত্মস্থ করতে পেরেছে৷ অসীম সামনে না থাকলেও তার হৃদয় সিংহাসন কখনো আর খালি থাকে না৷ সেই রত্নসিংসনে অসীমের দিব্যমূর্তি চিরস্থায়ীত্ব লাভ করেছে৷ তাই অসীম মনিয়াকে ফরীদের কাছে রেখেই চলে যেতে বাধ্য হয়৷

এরপর ছয় বৎসর গত হয়েছে৷ এবার মনিয়ার উপস্থিতি দিল্লীতে৷ অসীম রাজকার্য সম্পাদন করতে এসে আলাউদ্দীন খলজীর নির্মিত বিরাট মসজিদ প্রাঙ্গণে শুভ্র-মর্মরের ক্ষুদ্র সমাধি-মন্দিরে শুনতে পায় সুমধুর সঙ্গীতধ্বনি৷ সে আশ্চর্য হয়ে এগিয়ে যায়, কারণ সেই কন্ঠ, সেই সুরমূর্ছনা মনিয়ার না হয়ে পারে না৷ সেখানে এগিয়ে এসে এক সুশ্রী বালকের সঙ্গে সত্যসত্যই মনিয়াকে দেখতে পায়৷ মনিয়ার কাছে বৃন্দাবন ছেড়ে তার দিল্লীতে থাকার কারণ জানতে চাইলে মনিয়া জানায়—‘‘বৃন্দাবন গিয়া বিবেচনা করিয়া দেখিলাম যে, আমি পরিত্যাগ করিলে ফরীদ ভাই সংসারে স্থির হইয়া থাকিবে না, সেই জন্য বাবাকে বলিয়া, চারি পাঁচ বৎসর পূর্বে দিল্লী চলিয়া আসিয়াছি৷’’১৫০ শুধু বন্ধুর হিতৈষী নয়, তার জীবন বাঁচিয়েও ক্ষান্ত হয়নি সে৷ তাকে রীতিমত সংসারী করে উচ্চ পদমর্যাদায় অভিষিক্ত করে তবেই নিশ্চিন্ত হয়েছে৷ তার সঙ্গে থাকা সেই সুশ্রী বালক ফরীদ খাঁর সন্তান৷ মনিয়ার অনুরোধে অসীম তাদের সঙ্গে আতিথ্য নিতে সম্মত হয়৷ সেখানে উপস্থিত হয়ে ফরীদ খাঁর মুখে জানতে পারে বাদশাহ ফররুখসিয়রের শত্রুবেষ্টিত হওয়ার কথা৷ ফররুখসিয়র তার বন্ধু৷ সে বন্দি বন্ধুর উদ্ধারের জন্য বদ্ধপরিকর হয়৷ এখানেও মনিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছে৷ সে গুপ্তচর হয়ে ভিখারির ছদ্মবেশে অসীমকে সাহায্য করে৷ অসীম আজমীর শহরের ফটকের কাছে এসে দেখে যে ফটকের ভিতর আপাদমস্তক বোরখামণ্ডিত এক ভিখারিনি গান গেয়ে ভিক্ষা করছে৷ অসীম সুর শুনে বুঝতে পারে তা মনিয়ার৷ তাকে আহ্বান করলে মনিয়া না চেনার ভান করে দীর্ঘ সেলাম ঠুকে বলে যে সে গত দিন থেকে কোনো ভিক্ষা পায়নি, আটপ্রহর ধরে না খেয়ে আছে৷ আল্লার দিব্যি দিয়ে বলে যে অসীম যেন তাকে একখানা রুটি কিনে দেয়৷ মনিয়ার এহেন আচরণে বিস্মিত হয়ে যায় আমীর অসীম রায় কিন্তু তার বোঝার বাকি থাকে না যে মনিয়ার ভিক্ষায় বার হওয়ার পিছনে নিশ্চয় কিছু উদ্দেশ্য রয়েছে৷ সে ফটকের কাছে এসে এক রুটির দোকান থেকে তাকে চারখানি বড় রুটি কিনে দিলে সেখানকার একটা রুটি মুখে দিয়ে কিছুক্ষণ পর তা বের করে অসীমের শরীরের মধ্যে ছুড়ে মারে এবং বাকি তিনখানা পথের কুকুরের দিকে ছুড়ে দেয়৷ কিন্তু যেটা অসীমের দিকে ছুড়ে দিয়েছিল সেটা অসীম তুলে না নিলে তার উদ্দেশ্যে কটুক্তি বর্ষণ করতে থাকে৷ অসীম বুঝতে পারে নিশ্চয় রুটির মধ্যে কিছু রয়েছে৷ সে ঘোড়া থেকে নেমে তার দিকে দেওয়া রুটিটা তুলে নিলে সেখানে শক্তমত কোনো পদার্থের উপস্থিতি অনুধাবন করে সেটাকে লুকিয়ে এক পুরাতন কবরের কাছে এসে তা খুলে দেখে সেখানে তামার তাবিজের মধ্যে একটি চিঠি৷ পত্রটি বন্দি ফররুখসিয়রের লেখা৷ সে বন্দি অবস্থায় নিদারুণ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তাকে উদ্দেশ্য করে উদ্ধারের অনুরোধ জানিয়েছে৷ ইতিমধ্যে মনিয়া সেখানে উপস্থিত হলে অসীম পত্রসম্পর্কে তাকে জিজ্ঞাসা করলে সে জানায়—‘‘কিল্লার লাহোর ফটকে ভিক্ষা করিতে গিয়া পাইয়াছি৷ তুমি এখন চলিয়া যাও; দ্বিপ্রহর রাত্রিতে ফরীদের সহিত দুইটা ঘোড়া লইয়া লাহোর-ফটকের বাহিরে থাকিও৷ আজমীর ফটকের পাহারা ঘুষ দিয়া বশ করিয়াছি৷’’১৫১ এই গোপন বার্তা জানিয়ে পুনরায় অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করতে করতে মনিয়া সেই স্থান ত্যাগ করলে অসীমের তাকে দেখে বিস্ময়ের সীমা থাকে না৷ শত্রুবেষ্টিত স্থানে বন্দি বাদশাহকে উদ্ধার করার জন্য চরের কাজের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ দুঃসাহস না হলে হয় না৷ সে বন্দি গৃহের কঠিন বুহ্য ভেদ করে ভেতরকার সবরকম খবর সংগ্রহ করে, তা অসীমের কাছে জ্ঞাপন করে; পাহারাদারদের ঘুষ খাইয়ে বশ করে অসীমের কর্মে সহায়তা করে যাতে অসীম নির্বিঘ্নে তার সমস্ত কর্তব্যকর্ম সুষ্ঠুভাবে সমাধান করতে পারে৷ অসীম যখন সমস্তদিন অপেক্ষায় থেকে সন্ধ্যাকালে বেশ-ভূষা পরিধান করে সংকেতস্থানে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে সেই সময় ভিখারিনিবেশী মনিয়া তার সাক্ষাৎপ্রার্থী হয়ে জানায়—‘‘হুজুর, আপনি এখন বাহির হইবেন না৷ ফরীদ ও আমি সমস্ত ঠিক করিয়া আপনাকে ডাকিতে আসিব৷… অনেক কষ্টে পাঠান আব্দুল্লা খাঁকে বশ করিয়াছি কিন্তু রতনচাঁদের কসবী গোলাপ বাঈ খবর দিয়াছে যে বাদশাহকে কাল হত্যা করা হইবে সুতরাং আজ রাত্রিতে যদি কিছু না করিতে পারা যায় তাহা হইলে এত যত্ন, আয়োজন ও চেষ্টা সমস্তই বৃথা হইবে৷’’১৫২

মনিয়া তার মতো আরেক গণিকা গোলাপবাঈ এর সাহায্য নিয়ে ভেতরের সব খবর সংগ্রহ করে, বাদশাহকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করে, নির্দিষ্ট সময়ে অসীমকে বেরোনোর সংকেত দিয়ে বংশীধ্বনি করেও শেষ রক্ষা করতে পারে না অসীমের সাময়িক দুর্বলতার জন্য৷ তার স্ত্রী বিষ পান করার মিথ্যা অভিনয় দিয়ে বেরোনোর মুখে অসীমকে নিজের পীড়িত বাহুর দ্বারা আবদ্ধ করে রাখে৷ মৃতপ্রায় স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য করতে গিয়ে সে নিজের স্থলে প্রেরণ করে অন্ধ ভাই ভূপেন্দ্রকে৷ নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হলে সে তার স্ত্রীর হৃদয়বিদারক হাস্যধ্বনিতে বুঝতে পেরেছে যে তার সকল অসুস্থতা শুধুমাত্র ঈর্ষাপ্রযুক্ত অভিনয়৷ সে স্ত্রীকে ফেলে ছুটে গিয়ে আবিষ্কার করে তার ভাই ও ফররুখসিয়রের মৃতদেহ৷

বাদশাহের অন্তিম সংস্কারের পর মোগল সম্রাটবংশের প্রাচীন রীতি অনুযায়ী সৈয়দগণের আদেশে সহস্র রুটি, তাম্র ও রৌপ্য মুদ্রা যখন ভিক্ষুককুলের উদ্দেশ্যে নিক্ষিপ্ত হতে থাকে এবং তা সংগ্রহের জন্য বিশহাজার ভিক্ষুকদের মধ্যে কোলাহল শুরু হয়ে যায় তখন সেখান থেকে একখানা তুলে নিয়ে মনিয়া চিৎকার করতে থাকে—‘‘ভাই সব, নিমকহারামের রুটী নিমকহালালের হারাম৷’’১৫৩ তা দেখে বিশহাজার ভিক্ষুকও মনিয়ার অনুরূপ কার্য করতে থাকলে সেই সম্মিলিত প্রতিবাদে সৈয়দগণ ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়৷ এখানে মনিয়ার মধ্যে স্বাধীনবৃত্তির জনকল্যাণকামী এক প্রতিবাদী নারীরূপ প্রতিবিম্বিত হয়েছে৷

অসীমের শেষ সময়ের বন্ধুও মনিয়া৷ প্রথম জীবনে যার হাত ধরে সে একদিন ঘর ছেড়েছিল, যার বদান্যতায় দিল্লী দরবারে একজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী হয়ে তার বড়ভাই-এর দ্বারা প্রতারিত হয়ে সহায়-সম্বলহীন হওয়ার পরেও প্রচুর বিত্ত-বৈভব সম্পদ লাভ করেছিল এবং যে তাকে তার শত বিপদে-আপদে এক মুহূর্তের জন্যও ছেড়ে দিয়ে কোথাও যায়নি, সেই অন্ধ ভাই ভূপেন্দ্রকে নিশ্চিত মৃত্যুমুখে পতিত করে তার চিতার আগুনের সামনে জীবনের সবকিছুর মানে হারিয়ে ফেলে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়ে থাকে৷ মনিয়া তাকে গৃহে ফিরে যাবার অনুরোধ জানালে সে তার শূন্য জীবনে ঘর-সংসারের কোনো ভিত্তি খুঁজে পায় না৷ বিচক্ষণ মনিয়া বুঝতে পারে তার আরাধ্য দেবতার জীবনেও তার মতো বৈরাগ্য এসে গেছে৷ তাই সে তাকে সস্নেহ আলিঙ্গন দিয়ে বলে—‘‘বুঝিয়াছি ভাই, বুঝিয়াছি, গোপাল তোমাকেও ডাকিয়াছে৷ চল গোপালের ঘরে যাই৷’’১৫৪ মনিয়ার সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসীম তার সঙ্গেই গোপাল লাভে অর্থাৎ জীবনের অতৃপ্তি থেকে তৃপ্তি লাভে যাত্রা করে৷

উপন্যাসটিতে দেখা যায় মনিয়া শেষ পর্যন্ত তার প্রেমাস্পদ অসীমকে নিজের কাছে পায়৷ কিন্তু যখন সে অসীমকে লাভ করে তখন সে আর পাটনা শহরে বুলবুলও নয়, অসীমের পদপ্রান্তে দেহ-মন উৎসর্গ করে দেওয়া মনিয়াও নয়৷ তখন সে গোপালের কাছে তার সমস্ত কামনা-বাসনা, চাওয়া-পাওয়া সঁপে দেওয়া এক আকাঙ্খাবর্জিতা বৈরাগী৷ তার সম্পূর্ণ বৈরাগ্য প্রাপ্তি হয়েছে৷ অসীমের প্রতি নিবেদিত প্রেম তার নিষ্কলুষ সাধনার দ্বারা ঐশ্বরিক প্রেমে উত্তীর্ণ হয়েছে৷ তখন আর তার প্রেমিক হিসেবে অসীমের কোনো অস্তিত্ব নেই; তখন তার প্রেমিক গোপাল৷ বিদ্যালঙ্কার যে সংযমের কথা বলেছিল, ফরীদ যে চাঞ্চল্যহীন নিরুত্তাপভাব লক্ষ্য করেছিল, তার মধ্যেই ছিল তার কামনাবাসনাহীন গোপাল সেবার ভূমি কর্ষণের চিত্র৷ তাই উপন্যাসের শেষে ‘দিলের’ নয়, ‘হুজুর’ নয়, ‘জানি’ নয় , ‘ভাই’ সম্বোধন করে তার সস্নেহ আলিঙ্গন দিয়ে তার চিরবাঞ্ছিত প্রেমাস্পদকে চিরবৈরাগ্যের দোসর করে নেয়৷ লেখক সমগ্র উপন্যাসটিতে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে একটু একটু করে নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে মনিয়াকে এই পরিণতির দিকে নিয়ে গিয়েছেন৷ তার শ্রদ্ধা ভক্তি ও সাধনার মধ্য দিয়ে গণিকাবৃত্তি থেকে উচ্চতর সম্মানীয় স্থানে অভিষিক্ত করেছেন৷

সরস্বতী বৈষ্ণবী :

সরস্বতী বৈষ্ণবী জাতিবৈষ্ণবের কন্যা৷ তার যৌবন অতীত হয়ে গেলে ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে৷ যৌবন ও যৌবনের সঙ্গে বৈষ্ণবের প্রেম তার সঙ্গ পরিত্যাগ করলেও তখন পর্যন্ত তার সুকন্ঠ তাকে পরিত্যাগ করেনি, যার জন্য অন্নের অভাবও কোনোদিন হয়নি তার৷ তার সংসারের সেই সুখ স্বাচ্ছল্য দেখে শেষ বসন্তের কোকিলের মতো বিগতযৌবন কোনো প্রেমিক প্রেমের ফাঁদ পাতার চেষ্টা করলে সে তার অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাদের জানিয়ে দিত যে, সে পুরুষজাতির দ্বারা যৌবনে যে শিক্ষা লাভ করেছে স্নিগ্ধ প্রৌঢ়ে এসেও তা ভুলতে পারেনি৷ সরস্বতী বেশ্যা না হলেও বহুগামী৷ বৈষ্ণবীয় ধর্মের সাধনা করতে গিয়ে বহুপুরুষের কন্ঠলগ্না হতে হয়েছে তাকে৷ উপন্যাসের খলনায়ক অসীমের দাদা হরনারায়ণের দ্বারা প্রেরিত হয়ে নরসুন্দর নবীন অসীমের ক্ষতিকরার মতলব নিয়ে তার গৃহে এসে তাকে বশ করতে কথার জাল রচনা করে বলে—‘‘ইচ্ছা করিয়া কেন এত কষ্ট পাও দিদি,—একটা মালাচন্দন করিলেই পার৷ তোমার কি বৈষ্ণবের অভাব হয়! তোমার বয়সটা কি! তার উপর তুমি গুণী লোক৷’’১৫৫ নবীনের এই কথার মধ্য দিয়ে বৈষ্ণব সমাজে মালাচন্দন অর্থাৎ কন্ঠী বদলের প্রসঙ্গ উঠে এসেছে, যার মধ্য দিয়ে দুটি নরনারীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়৷ কিন্তু বৈষ্ণবীয় সমাজের এই শুদ্ধ ধর্মাচার কারও কারও কাছে স্বেচ্ছাচারের নামান্তর হয়ে পরোক্ষভাবে দেহব্যবসায় রূপান্তরিত হয়৷ সরস্বতী বুদ্ধিমতী ও বিচক্ষণ৷ তার চিরশত্রু নবীনের কথায় সে যে তার শরণ নিতে এসেছে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না তার৷ তাই নিজের পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের ধুয়া তুলে সে নবীনকে বলে—‘‘তোমরা পুরুষ মানুষ, ভোমরার জাতি৷ যতক্ষণ মধু থাকে, ততক্ষণ তোমরা থাক৷ আমার যৌবনের মধু ফুরাইয়াছে; সুতরাং এখন আর তোমরা আসিবে কেন?’’১৫৬ বৈষ্ণবী সরস্বতীর যৌবনের মধু শুকিয়ে গিয়েছে৷ পীতাম্বরের মতো মানুষদের প্রতারণায় সংসারী জীবনের মায়া পরিত্যাগ করে তাকে একাকিত্বময় একটা জীবন মেনে নিতে হয়েছে৷ পরে অসীমের অনিষ্ট করতে নবীনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সে পাড়ি দেয় মুর্শিদাবাদের ডাহাপারা গ্রাম থেকে সুদূর পাটনা শহরে৷ উপস্থিত হয় বিনা দোষে গ্রাম থেকে বিতাড়িত হওয়া বিদ্যালঙ্কারের আবাসভূমিতে৷ টাকার বিনিময়ে সে বরাত নিয়েছে বিদ্যালঙ্কারের বিধবা কন্যা শুদ্ধাচারী দুর্গার চারিত্রিক ত্রুটি বের করতে এবং সমাজের চোখে তাকে পতিত করতে৷ সেই উদ্দেশ্যে সে যখন দীর্ঘ রসকলি কেটে, খঞ্জনী হস্তে, নামাবলী অঙ্গে দিয়ে উপনীত হয় দুর্গাদের নতুন ঘরকন্নার মধ্যে তখন তার সেই অসৎ উদ্দেশ্য সেই গ্রাম বিতাড়িত সহজ সরল মানুষগুলো কিছুতেই অনুধাবন করতে পারে না বরং বহুদিন পর প্রতিবেশী চেনা মানুষটার দর্শন পেয়ে সাদর অভ্যর্থনায় তাকে আপন করে নেয়৷ সে তাদের বোঝায় শেষ জীবনে বৃন্দাবনে কাটানোর উদ্দেশ্যেই সে বৃন্দাবনের উদ্দেশে বের হয়ে পাটনায় উপস্থিত হয়েছে৷ সেখানে এসে সুযোগ্য ‘স্পাই’ এর মতো সে অসীম-দুর্গা-বিদ্যালঙ্কারকে অনুসরণ করতে থাকে৷

মনিয়া-সরস্বতীর কথোপকথনেও সরস্বতীর প্রেমবঞ্চিত জীবনের অনুসঙ্গ উঠে এসেছে৷ সংসারের নানা অভিজ্ঞতা সামান্য একজন নারীকেও চরম দার্শনিক জ্ঞান দান করতে পারে, সরস্বতীর নানা কথার মধ্যে সেই ইঙ্গিত প্রতিভাত৷ অসীমের প্রেমে উদভ্রান্ত মনিয়া প্রখর রৌদ্রের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ ভাবলেশহীন হয়ে বসে থাকলে সরস্বতীর মুখে শোনা যায় সহানুভূতির তরল সুর৷—‘‘আহা, বহিন, তোমার দেহটা যে জ্বলিয়া গেল, এমন সোনার অঙ্গ মলিন হইয়া গেল?’’১৫৭ সে মনিয়াকে যত্ন করে সেখান থেকে ছায়ায় নিয়ে গিয়ে তার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বলে যে প্রেম বিষ যাকে জরজর করে ফেলে তার বাহ্যজ্ঞান থাকার কথা নয়৷ মনিয়ারও ছিল না তাই প্রখর রৌদ্রে মূর্ছা যাওয়ার উপক্রম হলেও কিছুই বুঝতে পারেনি৷ সরস্বতী জীবনের নানা অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক৷ সে বোঝে মানুষের জীবনে প্রেম এলে কি হয়৷ কিন্তু যখন নবীন যৌবন থাকে তখন কখনো প্রেম বিষ হয় না তখন তা আশনাই বা আনন্দ৷ মনিয়া প্রেমের বিষাক্ত রূপ সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করলে তার মুখ দৃঢ় হয়ে ওঠে৷ সে উত্তেজিত হয়ে প্রেমের সেই মারণ পরিণতি বোঝাতে চেষ্টা করে মনিয়াকে৷ তার অভিজ্ঞতায় প্রেম মানুষের সুন্দর জীবনকে ধ্বংস করে দেয়৷ মনিয়ার মতো নবীন বয়সে প্রেম আশনাই হয়ে আবির্ভূত হলেও সে আশনাই দীর্ঘস্থায়ী হয় না; বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রেমের উত্তাপ কমে আসে এবং ক্রমে তা বিলুপ্ত হয়ে জীবনকে তছনছ করে দেয়৷ তাই সে মনিয়াকে বলে—‘‘দেখ বহিন, এই সরস্বতী বৈষ্ণবী এমন চেহারা লইয়া দুনিয়ায় আসে নাই৷ এমন দিন ছিল, যে দিন কত-কত রাজা-রাজড়া তাহাকে দেখিবার আকাঙ্খায় দরিদ্র বৈষ্ণবের কুটিরের আশে-পাশে ঘুরিয়া বেড়াইয়াছে৷ সে দিন গিয়াছে; এখন আর সরস্বতী মাটিতে পা দিলে তাহার পায়ের তলে পদ্মবর্ণ ফুটিয়া উঠে না, হাসিলে গণ্ডস্থলে গোলাপের আভা দেখা দেয় না; সেইজন্য সরস্বতীও এই ফুলের বাস ছাড়িয়া গৈরিক ধরিয়াছে, কারণ তাহার চারিদিকে তাহার যৌবনের রূপমাধুর্যের আকর্ষণে যে শত-শত ভ্রমর গুঞ্জন করিয়া বেড়াইত, কালধর্মে তাহারা ছাড়িয়া দূরে চলিয়া গিয়াছে৷ বহিন, এমন দিন চিরদিন থাকিবে না৷ এই চাঁপার বরণ জ্বলিয়া কাল হইয়া যাইবে; ঐ চোখের কোলে বিষের জ্বালা কালির দাগ টানিয়া দিবে; ঐ কোকিল-কুজনের মত কন্ঠস্বর হয় ত দাঁড়কাকের আওয়াজ ধরিবে৷—তখন বুঝিবে এ বাঙ্গালী সরস্বতী বৈষ্ণবী কেন এ কথা বলিয়াছিল৷’’১৫৮ সে বার বার বিকশিত চাঁপাকলির মতো মনিয়াকে ফিরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে—‘‘বহিন, ফিরিযা যা; গেরুয়া ধরিবার অনেক সময় আছে,—এই তো তোর প্রথম যৌবন, সারাটা জীবন দীর্ঘ পথের মত সমুখে পড়িয়া আছে৷ ফিরিয়া যা৷ যতদিন যৌবন আছে ততদিন উপার্জন করিয়া নে; তাহা হইলে বুড়া বয়সে আর সরস্বতীর মত খঞ্জনী বাজাইয়া মুরশিদাবাদ আর পাটনার পথে-পথে ভিক্ষা করিয়া উদর পূরণ করিতে হইবে না৷’’১৫৯ সে জীবনে যা ভুল করেছে কেউ তার মতো সেই ভুল করুক তা সে চায় না৷ যৌবনে প্রণয়ীর কপট প্রেমসম্ভাষণে আত্মনিবেদিত হয়ে সে নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছিল যৌবন ফুরানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রেমকে আত্মঘাতী করে প্রেমিক তাকে ছেড়ে চলে গেছে৷ তাই সরস্বতীর বেঁচে থাকার সম্বল ভিক্ষাবৃত্তি৷ সে তার জীবনে মিথ্যা প্রেমের ফাঁদে পড়ে বেঁচে থাকার সম্পদ সঞ্চয় করতে পারেনি, গৈরিক বসন পড়ে ভিক্ষাবৃত্তিই সার হয়েছে, তাই মনিয়াকে বুঝিয়েছে যে সেও গেরুয়া পরার অনেক সময় পাবে, সেটা তো তার হাতেই রইলই কিন্তু তার আগে সে যেন ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার মতো রসদ সংগ্রহ করে নেয়৷ কারণ মানুষের রূপ-যৌবন চিরস্থায়ী নয়৷ সে তার অতীত কথা বলতে গিয়ে নিজের অজান্তেই আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে৷ তার দুচোখ বেয়ে দু-বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়লে মনিয়া তা মুছিয়ে দিয়ে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলে—‘‘কাঁদি কেন? বহিন, তাহা এখন বুঝতে পারিবে না, যতদিন উপায় থাকে মানুষ ততদিন বুঝিতে পারে না৷’’১৬০ সরস্বতীর মধ্য দিয়ে শুধু গণিকা নয় সমগ্র মানব সমাজের, জীবনের গভীর সত্য উদ্ভাসিত হয়েছে৷ মানুষ যতদিন উপায় থাকে ততদিন ভাববার সময় থাকে না কিন্তু যখন ভাবনার সময় আসে তখন তার কাছে আর কোনো উপায় থাকে না৷

সতী নারীর ধর্ম এক পুরুষের অনুগামী হয়ে জীবনকে অতিবাহিত করা৷ মনিয়াও অসীমকে পেয়ে সেই আদর্শ গ্রহণ করেছিল৷ আর যার মধ্যে সেই লক্ষণ থাকে সে জীবনে কোনোদিন শান্তি পায় না৷ নারীরা একজন পুরুষকে ভালোবেসে জীবনের সার্থকতা খোঁজে এবং তা না হলে তাদের জীবন যন্ত্রণাময়; পুরুষরা নারীদের সেই দুর্বলতা জানে বলেই পদে পদে তাদের অবদমিত করে রাখতে পারে, নির্দ্বিধায় অপমান করতে পারে৷ এই কথা বোঝাতে গিয়ে সে মনিয়াকে বলে—‘‘পুরুষ তোমাকে যে চোখে দেখে, তুমি আমি ত তাহাকে সে চোখে দেখিতে পারি না; পুরুষ জানে যে আমরা তাহা পারি না এবং এই সন্ধিস্থল জানে বলিয়াই কঠিন পুরুষ চিরদিন অবলা নারীজাতিকে হেলায় পদদলিত করিয়া থাকে৷’’১৬১ মনিয়ার প্রতি সরস্বতীর এই উক্তির মধ্যে আধুনিক নারীমনস্তত্বের এক গভীর দ্যোতনা ফুটে উঠেছে৷

সরস্বতী যে আখড়ায় আশ্রয় নিয়েছে সেখানকার মহন্তের সেবাদাসী, চেলা-চেলি পরিবৃত্ত জীবনের পরিচয় দিয়েছেন ঔপন্যাসিক৷ সেবাদাসীর মধ্য দিয়ে বৈষ্ণব-মহন্তদের নারীদেহমন্থনের বৃত্তান্ত কারও অজানা নয়৷

সরস্বতী উপন্যাসে খলনারী৷ অর্থের লোভে সে দু-দুবার দুর্গা ও তার আত্মীয়দের অপহরণ করায়, শ্রীমতি ছদ্মনামে অসীমের স্ত্রী শৈলর মনে দুর্গা ও মনিয়াকে উদ্দেশ্য করে বিষবৃক্ষের বীজ রোপণ করে তাতে নিয়মিত জলসেচন করে, তারপর সময় বুঝে সেখান থেকে সরে পড়ে৷ অসীমের সংসারজীবনে অশান্তির ঝড় তুলে উপন্যাসটিকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় সে৷ স্বৈরিণী এই নারী উপন্যাসের গতিপথ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে৷

নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত :

উপন্যাস সাহিত্যে যাঁরা নতুন পরিকল্পনা ও উদ্দেশ্য প্রবর্তনের জন্য চেষ্টা করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত৷ তাঁর প্রথম দিককার উপন্যাসে যৌন ও অপরাধতত্ত্ব বিশ্লেষণকেই মুখ্য উদ্দেশ্য করেছেন তিনি৷ আর এর ধারা বেয়েই গণিকা, স্বৈরিণী, স্বেচ্ছাচারিণী নারীরা ভিড় করেছে তাঁর উপন্যাসে৷ তাঁর যে সমস্ত উপন্যাসে গণিকা চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—‘শুভা’ (১৯২০), ‘পাপের ছাপ’ (১৯২২), ‘রক্তের ঋণ’ (১৯২৩), ‘লুপ্তশিখা’ (১৯৩০)৷

ক. শুভা :

নরেশচন্দ্রের সাহিত্যিক জীবনের প্রথমদিকে লেখা উপন্যাস ‘শুভা’ (১৯২০)৷ এটি শুভা নাম্নী এক নারীর আখ্যান৷ ছোটোবেলায় লেখাপড়া শেখা শুভা বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবীচৌধুরাণী’ পড়ে যখন জানে জীবন ভোগের জন্য নয়, কেবল অন্যের জন্য আত্মসমর্পণই কর্তব্য তখন শুভার মনে হয় যে সাহিত্যিকরা সব কথা বেচে খায়, সত্যিকারের জীবনের খোঁজ রাখে না৷ সমগ্র উপন্যাস জুড়ে তার একটাই প্রশ্ন জীবন কিসের জন্য৷

চৌদ্দো বছর বয়সের কিশোরী শুভার বিয়ে হয় অপদার্থ অত্যাচারী নিবারণের সঙ্গে৷ সাত বছর সংসার করে অত্যাচার ও গ্লানিবোধ ছাড়া সে আর কিছুই পায়নি৷ তার আত্মস্বতন্ত্রতাবোধ তাকে স্বামী সংসার থেকে বাইরে টেনে এনেছে৷ বাইরের জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞা শুভা একটা কথাকে মাথায় নিয়ে বাইরে পা দিয়েছে তা হল ঘরে থাকলেও শরীর বেচে থাকতে হবে বাইরেও না হয় তাই করব৷ দেহ-বেচার মধ্য দিয়ে জীবনধারণকে তার ঘৃণ্য মনে হয় না৷ অন্য জীবিকা যদি না জোটে তাহলে শরীর বেচে জীবনধারণ কখনো অন্যায় নয় তার কাছে কিন্তু তার স্বাধীনতা চাই, মুক্তি চাই, জীবনটাকে উপভোগ করা চাই৷ সংসারের বৃত্ত থেকে বাইরে এসে সে কখনো হয়েছে থিয়েটারের অভিনেত্রী, পতিতা চাঁপার গৃহসঙ্গিনী, কখনো থিয়েটারের পরিচালক সুরেশবাবুর আশ্রিতা৷ প্রাক্তন প্রেমপ্রার্থী নগেনের গৃহসঙ্গিনী হয়েও তাকে থাকতে দেখা গেছে৷ আবার আত্মসম্মানের জেরে সেই আশ্রয় পরিত্যাগ করে পুনরায় থিয়েটারে আত্মনিয়োগ করেছে সে৷

তার জীবন নিয়ন্ত্রণে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে বারবনিতা চাঁপার৷ জীবনে নানাঘাটের জল খেয়ে সে বার বার আশ্রয় নিয়েছে গণিকা চাঁপার কাছে৷ অবশেষে মাদার ক্রিশ্চিয়ানার প্রভাবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে সেবিকার ব্রত নিয়ে হাসপাতালে আশ্রয় নেয়৷ এভাবে দেখা যায় স্বৈরিণী শুভা জীবনের বিচিত্র আবর্তনে নিজেকে বহন করে নিয়ে গেছে একূল থেকে ওকূলে৷

খ. লুপ্তশিখা :

এই উপন্যাস (১৯৩০)-র কথক বটুক৷ তার আত্মকথন রীতিতে অতীতচারণার মধ্যে উঠে এসেছে সমাজের তমসাবৃত ‘অবহেলিত’ চিরবঞ্চিত বারবনিতাদের কথা৷ সমাজের সভ্য বাবুরা এদের পরিচায়িত করেছেন ‘বেশ্যা’ হিসেবে৷ এদের জীবনে আলোর চেয়ে আঁধার বেশি, সেই আঁধারেই তাদের জীবন আরও বেশি কলঙ্কিত হয়, ক্লেদাক্ত হয়৷

কলকাতাবাসী বটুকের মামার অজপল্লীতে খুব সমাদর৷ স্ত্রীকে পল্লীগ্রামে রেখে সে কর্মসূত্রে বাসা নিয়ে থাকে কলকাতায়৷ মায়ের পীড়াপীড়িতে মামার সঙ্গে কলকাতায় পড়তে এসে বটুক দেখে তার মামার আশ্রিত বিমলাকে৷ পরে বুঝতে পারে বিমলা দেহব্যবসায়িনী, তার মামার রক্ষিতা; কামনাপূরণের মাধ্যম৷ বিমলা বা তার শ্রেণীর নারীদের মোহেই বটুকের মামা তার লক্ষ্মীস্বরূপা স্ত্রীকে পল্লীগ্রামে অবাধে ফেলে রাখে৷

উপন্যাসের আরেক অন্যতম বারবনিতা মালতী৷ সে শিক্ষিতা৷ দেহব্যবসায়ী হলেও তার মধ্যে থেকে শুভবোধ সম্পূর্ণরূপে বিলীন হয়ে যায়নি৷ কলকাতার এক বেশ্যাপল্লীতে তার বাস৷ মামার সঙ্গে মতানৈক্যে ঘটনাক্রমে তথাকথিত সেই ‘বাজেপাড়াতেই’ তার সঙ্গে দেখা হয় বটুকের৷ মালতী উপবিষ্টা হয় তার দিদির আসনে৷ মালতীর শিক্ষা, সংস্কার রুচিবোধ ইত্যাদি দেখে বটুকের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সে ভদ্রবংশের কন্যা৷

মালতীর মা এককালে তাকে কোলে নিয়েই স্বামী ত্যাগ করে কুলত্যাগিনী হয়েছিল৷ মায়ের পাপের বোঝা উত্তরসূরীরূপে আরোপিত হয় মালতীর মধ্যে৷ সে পাপবোধ তাকে দেহব্যবসায়িনী হিসেবে গড়ে তুললেও তার শুভবোধকে সম্পূর্ণ শেষ করতে পারেনি যার ফলে সে নিরাশ্রয় বটুককে আশ্রয় দেয়, লেখাপড়া করায়৷ তার স্নেহাশ্রয়ে বটুক নতুন জীবন খুঁজে পায় ঠিকই কিন্তু তার ত্রাণকর্তৃ এক ঘাট থেকে আরেক ঘাটে আরও পঙ্কিলতায় ডুবে যেতে থাকে৷ অবশেষে একদিন বটুক হারিয়ে ফেলে তার মালতীদিদিকে৷ সুদূর ভবিষ্যতে সে স্বনামধন্য উকিল হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলে তার হাতে এক ‘কেস’ আসে এবং সেই সূত্র ধরে পুনরায় খুঁজে পায় তার হারানো দিদিকে কিন্তু অত্যন্ত বিকৃত রূপে৷ পাপের আবেষ্টনে তখন সম্পূর্ণ বাঁধা মালতী৷ শত চেষ্টা করেও সে ও তার পিতৃপরিচয়হীন কন্যাকে বাঁচাতে পারে না বটুক৷ একজন বারবনিতার স্নেহধন্য সেই উকিল চির ঋণী থেকে যায় তার আশ্রয়দাত্রীর কাছে৷

এভাবে দেখা যায় একজন নারী তার সর্বস্ব দিয়ে পুরুষের আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে কিন্তু পুরুষের নীতি শাসনের শৃঙ্খলে তাকে হতে হয় কখনো কুলটা, কখনো পাপিষ্ঠা, কখনো কলঙ্কিনী৷ আদালতের চোখে মালতী আসামি হলেও তার ভিতরে বটুক খুঁজে পেয়েছিল এক মহামানবীকে৷ মালতী নিজে মন্দ হয়েও বটুকের কাছে মাতৃরূপী কারণ ঔপন্যাসিক নারীর বাইরে সামাজিক খোলসটুকু খুলে দিয়ে সেই নারীর মনের গহনে ডুব দিয়ে ছিলেন৷ আবিষ্কার করেছিলেন পঙ্কের ভেতরকার সেই পঙ্কজিনীকে৷

ভাইয়ের কাছে তার জীবনের অন্ধকার দিকটিকে বহুদিন আড়াল করে রেখেছিল মালতী৷ কিন্তু নিজের অবশ্যম্ভাবী পতনে সে আড়াল একদিন উঠে গেছে৷ সে নিজের কাছে হেরে গেলেও সার্থকতা পেয়েছে অজানা-অচেনা সহায়হীন এক কিশোরের মধ্যে৷ উপন্যাসের শেষে তাই সমাজের ভদ্রলোক হয়ে ওঠা বটুক আক্ষেপ করেছে তার সে ঋণের এক কণাও সে শোধ করতে পারল না বলে৷

উপন্যাসটিতে এক দেহপসারিণী নারীকে মনুষত্বের মহিমায় উজ্জ্বল করে তুলেছেন রচনাকার৷

গ. পাপের ছাপ :

‘পাপের ছাপ’ (১৯২২) উপন্যাসটিতে নানা ঘটনাবাহুল্য শ্বাসরুদ্ধকর জটিলতা সৃষ্টি করেছে৷ নানা বিশৃঙ্খল ঘটনার সুযোগে লেখক যৌনবাসনার অসংযত বিক্ষোভ এবং ফ্রয়েডাদি কথিত লিবিডোর বিচিত্র গতির পরিচয় দেওয়ার জন্য নানা প্রসঙ্গ উপস্থাপিত করেছেন৷ উপন্যাসে নায়ক মেঘনাদের অতৃপ্ত শরীরীক্ষুধা এবং মনের দুর্মর গ্লানির যে সংঘাত ও সমন্বয়ের রূপ তিনি অঙ্কন করেছেন তাতে দেহের আধারে বাঁধা মানুষের অদ্ভুত জীবনরহস্যই ধরা পড়েছে৷

উপন্যাসের অন্যতম নারীচরিত্র মনোরমা উগ্র ও দুর্দমনীয় লালসার অধিকারী৷ তার সঙ্গে মিশেছে স্বভাব অপরাধীর রক্ত৷ মেঘনাদ সব বোঝে কিন্তু তার দুর্বার আকর্ষণ থেকে সরে থাকতে পারে না৷ নানাভাবে মনোরমা থেকে নিবৃত্ত হতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়৷ আত্মগ্লানিতে জর্জর হয়েও তার দেহের কাছে, তার দুর্বার কামনার কাছে নিজেকে আহুতি না দিয়ে পারে না৷

উপন্যাসে মনোরমা যৌন ও অযৌন অনেক অপরাধ করেছে৷ লক্ষ্য পূরণের জন্য খুনের মতো অপরাধ করতেও তার সামান্যতম হাত কাঁপেনি৷ সে জন্য পাপবোধ বা অনুশোচনার সামান্য অনুভূতিটুকুও তার নেই৷ লেখকের হাতে সৃষ্ট মনোরমার মত লালসাসিক্ত, উগ্রমস্তিষ্ক মায়ামমতাহীন নারীচরিত্র অনন্য মাত্রা লাভ করেছে৷ মনোরমা সম্পূর্ণ নারীস্বভাব বর্জিত৷

ঘ. রক্তের ঋণ :

বহুবল্লভা সিদ্ধেশ্বরী ‘রক্তের ঋণ’ (১৯২৩) উপন্যাসের এক অন্যতম চরিত্র৷ জমিদার কালিদাস চৌধুরীর রক্ষিতা সে এবং জমিদারবাড়ির দাপটশালিনী রাঁধুনিও৷ জমিদারগৃহে যথেষ্ট প্রতিপত্তি তার৷ শুধু জমিদার নয় অন্যপুরুষের সঙ্গেও যৌন সম্পর্কে লিপ্ত সে৷ লেখক তাকে দেহের ক্ষুধায় বন্দিনী নারী হিসেবেই কল্পনা করেছেন৷ তার ব্যভিচারের ফলস্বরূপ কালিদাস চৌধুরীর ঔরসে তার গর্ভে জন্ম নেয় নাগানন্দ৷ সত্য পরিচয় জানতে পেরে মাকে পাপ থেকে মুক্ত করতে সে জমিদারবাড়ির ছায়া থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় কিন্তু ফল হয় বিপরীত৷ মায়ের কামলীলার ক্ষেত্র আরও প্রসারিত হয়৷ স্বেচ্ছাচারিতার মুক্তাঙ্গন পেয়ে সে সম্পূর্ণ পাপপঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে যায়৷ গণিকার সন্তান নাগানন্দ হয় চরিত্রবান এবং লেখাপড়ায় ভালো৷ কিন্তু মাতা-পিতার অসংযত যৌনতার পাপ তার মধ্যেও নিহিত রয়েছে সে আশঙ্কা তার প্রবল৷ আর সেই পূর্বসূরীর যৌনপাপকে অবলম্বন করেই এক যৌবনবতী সন্তানের মা বিবাহিত সাঁওতাল রমণীকে ভোগ করে সে৷ মাতা পিতার দুষিত রক্তের বাহক হয়ে সেও যৌন পাপে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়৷

কীভাবে ব্যভিচারিণী সিদ্ধেশ্বরীর যৌনতার কামার্ত রক্তধারা তার অবৈধ সন্তানের মধ্যে প্রবাহিত হয় এ উপন্যাস তারই আলেখ্য৷

জগদীশ গুপ্ত :

জগদীশ গুপ্ত বাংলা সাহিত্যে একজন মুখ্য ফ্রয়েড প্রভাবিত লেখক৷ তিনি উপন্যাসে যে জগৎ তৈরি করেছেন তাতে বিকার ও বিভীষিকার প্রাধান্য; পাপ, কাম, হিংসা, অকল্যাণ আর অসুন্দরের রাজত্ব৷ চারিদিকের ঘনায়মান অন্ধকারের পীড়নে চরিত্রগুলি পিষ্ট—বিকারগ্রস্ত৷ আর এর সঙ্গে নানাভাবে উঠে এসেছে গণিকাজীবনের কথা; তাদের বাধ্যবাধকতা, আত্মশোধনের নানা দিক৷

ক. লঘুগুরু :

‘লঘুগুরু’ (১৯৩১) উপন্যাসে উত্তম, সুন্দরী এবং টুকী তিনজন চরিত্রের তিনটি জীবনালেখ্য আলোচিত হয়েছে৷ উত্তম গৃহস্থ, সংসার বিমুখ হয়ে একদিন গণিকা হয়েছিল৷ পুনরায় সেই পুরোনো গৃহাকাঙ্খা প্রবলাকার হলে নিজেকে শুধরে বিশ্বম্ভরের স্ত্রী ও টুকীর মা হয়ে উঠেছে৷ তার জীবনের মধ্যকালীন সময়ের সমস্ত পাপ ভুলে লক্ষিত হয়েছে আলোর পথন্বেষা৷ সমাজ তাকে গ্রহণ করেনি৷ টুকী গণিকা মাতার স্নেহধন্যা বলে সংসারের ষড়যন্ত্রে নৈতিকতা থেকে ভ্রষ্টা হতে পা বাড়িয়েছে অন্ধকার পথে৷ সুন্দরী জন্ম সূত্রেই দেহব্যবসায়ী৷ সে তার লোভ, ঈর্ষা, হিংস্রতা নিয়ে বেশ্যা হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত রেখেছে নিজেকে—টুকীকেও অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে৷

উত্তম :

‘লঘুগুরু’ উপন্যাসের মূল কেন্দ্রীয় চরিত্র উত্তম৷ লেখক তার নিপুণ সৃজনীক্ষমতায় সৃষ্টি করেছেন এই চরিত্রটিকে৷ তাকে উপন্যাসে মা-মরা টুকীর স্নেহময়ী সৎমা হিসেবে তুলে ধরেছেন৷ সে পূর্বে দেহব্যবসায়ী ছিল৷ গণিকা জীবনের একঘেয়েমি তিক্ততা থেকে মুক্তির জন্য তার ছিল দুর্দান্ত বাসনা৷ সেই বাসনাকে লেখক ব্যক্ত করেছেন এইভাবে—‘‘মানুষকে হাতে পাইয়া তাহাকে বশীভূত করিয়া খেলাইয়া খেলাইয়া পিশাচ করিয়া তুলিবার বিদ্যাটা সে চেষ্টা করিয়া, ভিতরকার বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া শিক্ষা করিয়াছিল—তখন তার নাম ছিল বনমালা—তারও আগের নাম তার যূথী৷ মানুষ সেই যূথীর শত্রু৷ কিন্তু যেদিন ঐ কাজে দুরন্ত ঘৃণা ধরিয়া গেল, আর যেদিন তার বিশ্বম্ভরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল, ঐ দু’দিনের ব্যবধান খুব অল্প—তার হিংস্র পুরুষ-বুভুক্ষা লুপ্ত হইয়া তখন পুরাতন গৃহ-বুভুক্ষা জাগরিত হইয়াছে৷ মনে মনে সে কল্পনা করিত, বিপরীত পথে চলিয়া শয়তানকে শাসন করিয়া মানুষ করিয়া তুলিতেও না জানি কত আনন্দ—ভালবাসা দিয়া সুখী করাও বুঝি সুখের৷’’১৬২ উপন্যাসে আবির্ভূত হওয়ার পর কখনো উত্তমকে দেহের দর হাকতে দেখা যায়নি বরং তখন তার একমাত্র ব্রত ছিল নিজেকে শোধন করা৷ লেখকের ভাষণ এবং চরিত্রগুলির নানা কথার প্রেক্ষিতে উঠে এসেছে তার গণিকা বৃত্তির কথা৷ উত্তম দীর্ঘকাল শরীর বিক্রির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছিল৷ কবে কেন কীভাবে সে দেহব্যবসার মতো একটা পেশায় নিজেকে অঙ্গীভূত করেছে তার কোনো হদিস লেখক দেননি৷ তবে একসময় যে সুকোমল নারীত্ব তার মধ্যে অধিষ্ঠিত ছিল, সেই বৃত্তিতে প্রবেশের পূর্বে ছিল কোনো গৃহস্থের গৃহিণীপনা তার ইঙ্গিত লেখক দিতে ভুল করেন নি৷ তাই তিনি বলেছেন যে যৌনতার মধ্য দিয়ে মানুষকে বশীভূত করে প্রবৃত্তির দাসানুদাস হিসেবে প্রতিপন্ন করার পৈশাচিক বিদ্যেটা তাকে কষ্ট করেই আয়ত্ত করতে হয়েছে৷ তার ভিতরকার বিরুদ্ধ শক্তির প্রতিবাদে মানুষকে নিয়ে খেলার কৌশল অর্জন করতে পরীক্ষা দিতে হয়েছিল অনেক ধৈর্যের৷ তারপরে দেহব্যবসায় সফলতার স্বাদ পেয়েছে সে৷ যুথী, বনমালা ইত্যাদি নামের আড়ালে থেকে বহুদিন নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছে বারবধূ করে৷ তার পরে একদিন তার সেই বৃত্তিতে ধরে গেছে তীব্র ঘৃণার ঘুণ৷ সেই ঘৃণা আরও ভয়ানক হয়ে গেছে নদীর ঘাটে বিশ্বম্ভরকে প্রথম দেখে৷ তার প্রবল পুরুষ বুভুক্ষ মন কাতর হয়েছে নিরিবিলি গৃহসুখ অর্জনের আশায়৷ তার মনে হয়েছে গৃহের চারদেওয়ালে আবদ্ধ হয়ে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে প্রবৃত্তি তাড়িত পুরুষ সমাজকে বশীভূত করে সংসারের মঙ্গলময় মূর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা না জানি কত না সুখের! দুর্দান্ত পুরুষকে স্নেহ-মাধুরী দিয়ে সংসার অভিমুখী করে তোলার মধ্যে নারীজীবনের চিরন্তন সার্থকতাকে ধরতে চেয়েছে সে৷ তাই নিজের প্রচুর ‘পসার’-কে অবহেলায় পদদলিত করে বিশ্বম্ভরের গৃহের গৃহিণী হতে দ্বিধা করেনি৷ বিপত্নীক বিশ্বম্ভরের প্রথম পক্ষের সন্তান টুকীকে আপন করে নিয়েছে নিজের অপরিতৃপ্ত মাতৃত্বকে আস্বাদন করতে৷ সে নতুন স্বামীর সংসারে অধিষ্ঠিত হলে প্রতিবেশিনীদের প্রশ্নবাণে নিজেকে আড়াল করেনি—আড়াল করবার মতো সংকোচ বা সংকীর্ণতা কোনোটাই ছিল না তার৷ তাই প্রতিবেশীরা যখন তার সম্পর্কে কৌতুহলী হয়ে নানা কথা উপস্থাপন করে তার পরিচয় এবং পূর্ব জীবন সম্পর্কে তখন সে উত্তর দেয় অস্পষ্ট অথচ সুনির্দিষ্ট এক বাক্যবন্ধে—‘‘ধরন দেখে, বা না দেখেই যা ভেবেছ তা-ই ঠিক৷’’১৬৩

উত্তমকে চোখে দেখে মোহিত হয়ে গিয়েছিল বিশ্বম্ভর৷ তার প্রতি আন্তরিক আকর্ষণ অনুভব করে তাকে পাবার আশায় মনের সকল শান্তি-স্বস্তি লোপ পেয়েছিল৷ অবশেষে তার অন্যমনস্কতার সমস্ত কারণ ধরা পরে ভগিনীপতি লালমোহনের কাছে৷ সে উত্তমের চেহারার বর্ণনা করে বলে—‘‘রং ফর্সাও নয়, কালও নয়; শরীর মোটাও নয়, রোগাও নয়, তার স্বাস্থ্য ভাল, গড়ন লম্বাটে—সেইজন্যেই দোহারা দেখায়—পরণে ‘গঙ্গা-যমুনা’ পাড় শাড়ী, সাদা সেমিজ; নাকের অগ্রভাগ একটু চাপা, টানা টানা ভুরু, বড় বড় চোখ ইত্যাদি৷’’১৬৪ লালমোহনের সহায়তায় বিশ্বম্ভর গৃহসুখ বুভুক্ষ উত্তমকে লাভ করেছিল৷ কিন্তু একজন গণিকা গৃহবধূ হলে সমাজ তাকে মেনে নেবে কেন! উত্তম টুকীর প্রতি আন্তরিক বাৎসল্যে নিজের পূর্বজীবনের সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করতে থাকে৷ শুধু অবশিষ্ট রাখে নিজের সৎ সংকল্প এবং অসীম ধৈর্য৷ বিশ্বম্ভর তাকে ঘরে তুলেছিল নিজের মুঠোর মধ্যে পুরে তাকে সম্পূর্ণরূপে করায়ত্ব করতে, তার প্রথম স্ত্রী হিরণ যেমন করে তার মুঠোর মধ্যে আবদ্ধ থাকত৷ কিন্তু দু-একদিনেই তার সে ভ্রম ভেঙ্গে যায়৷ উত্তম স্বাধীন৷ লাজ-লজ্জা-সংকীর্ণতার বালাই নেই তার৷ বহুপুরুষ পরিচর্যাকারিণী এই নারীর জীবন সংসারের নানাবিধ অভিজ্ঞতায় পূর্ণ৷ তাই তাকে দেখে বিশ্বম্ভরের মনে হয়—স্ত্রীর নবতর এবং উৎকৃষ্টতার রূপ সে৷ স্ত্রীকে গণ্ডির মধ্যে ফেলে ইচ্ছামত নিষ্পেষণ করা যায়—স্ত্রী সেই পেষণের প্রতিবাদ করে কখনোই ছেড়ে যেতে পারবে না কিন্তু এই স্বাধীন বিহঙ্গ জীবনের অবাধ স্বাধীনতাসুখ উপভোগ করে স্বেচ্ছায় ডানাগুটিয়ে পিঞ্জরে ঢুকেছে৷ এর বন্দিত্ব চিরকালের নয়৷

উত্তম স্বেচ্ছায় নতুন করে ঘর বাঁধার বাসনায় বিশ্বম্ভরের ঘরে স্থান নিয়েছে৷ কিন্তু তার মনের যে দুর্দান্ত কামনায় বন্যপশুকে পোষ মানিয়ে সংসারী করার বাসনা প্রকট ছিল তা তার আর পূর্ণ হয়নি৷ বিশ্বম্ভরের তাণ্ডবে প্রাণ হারাতে বাধ্য হয়েছিল ভীতা-সন্ত্রস্ত হিরণ৷ স্ত্রীর সেই নির্মম মৃত্যুতে মদ্যপান ছেড়ে দিয়ে, চেষ্টা করেছিল সংসারী হওয়ার৷ আগে থেকেই এই হারমানা মানুষটির আচরণ উত্তমকে দুর্বৃত্তদমনের আস্বাদ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত করেছে, হতাশ করেছে৷ হিরণের নির্মম মৃত্যু তার নারীহৃদয়কে আদ্র করে অশ্রুপাত করালে তা নিয়ে স্বামী তাকে ঠাট্টা করে৷ একজন গণিকার একজন সাধারণ নারীর জীবন-দুর্দশায় কাতর হওয়া বিশ্বম্ভরের মত মানুষের কাছে হাস্যকরও বটে৷ কারণ সে গৃহিণী হলেও বহুপুরুষ ভোগ্যা৷ স্বামীর সেই ব্যঙ্গোক্তিকে উত্তম নিজের প্রায়শ্চিত্ত হিসেবেই গ্রহণ করেছে৷ কারণ তার জীবনে এমন বহুদিন বিগত হয়েছে যখন সে মানুষের শোকে কাঁদেনি; মানুষকে শুধু কাঁদিয়েই গেছে৷ সে বহুপুরুষ ভোগ্যা বারবিলাসিনীরূপে জীবনের বহু সময় অতিবাহিত করেছে৷ সেখানে প্রায় প্রতিনিয়তই শুনে এসেছে পুরুষের পৌরুষের মিথ্যে বড়াই৷ আর সেই পৌরুষহীন পুরুষত্বের অধিকারীরা নিজের স্ত্রীকে কৃপাভিক্ষু করে পদদলিত করে আত্মসুখ চরিতার্থ করে বারাঙ্গনাগৃহে গিয়ে৷ তার মতে বিশ্বম্ভরও সেই দলের৷ উত্তম গণিকা হলেও তার মধ্যেকার সংস্কার সংযম নীতিবোধ কোনো কিছু উবে যায়নি৷ সে তার নতুন ঘরকন্নার আশ্রয়ে নিজেকে সর্বদা ভুলিয়ে রাখতে চায়৷ স্বামীর সেবা করে, মেয়েকে শিক্ষা-সংস্কার দান করে আদর্শ জননীর স্নেহধন্য শিষ্টাচারসম্পন্ন করে তুলতে চায়; কিন্তু তার সেই সংসার গোছানোকে ব্যঙ্গ করে প্রতিবেশীগণ, স্বামীর ইয়ারবক্সীর দল এমন কি স্বামী নিজেও৷ স্বামীর ইয়ার বন্ধুর দল তাদের বাড়িতে মদ-মাংসের আসর বসাতে চাইলে এবং সেখানে উত্তমকে মধ্যমণি হিসেবে উপস্থাপিত করতে চাইলে উত্তম স্বামীর কাছে জানতে চায় তার পূর্বস্ত্রী সেরূপ করতো কি না৷ উত্তমের সেই কথায় স্বামী জিব কেটে জবাব দেয়—‘‘না, না; সে ছিল বউমানুষ—’’১৬৫ মদের আসরে বসতে অস্বীকার করে উত্তমের সেই ব্যবহারে তার স্বামীর বন্ধুরা তাকে ‘নিষ্ঠাবতী খাণ্ডরী’ অপভাষণে অভিষিক্ত করলেও তার স্বামীর সেখানে কিছু বক্তব্য থাকে না৷ তার বন্ধুরা তারপরে সময়ে অসময়ে উত্তমকে দেখার অছিলায় তার সঙ্গে কথা বলার অছিলায় তাদের বাড়ি উপস্থিত হলেও মেরুদণ্ডহীন বিশ্বম্ভর কিছু বলতে পারে না৷ সে উত্তমকে বিয়ে করে স্ত্রীর অধিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত করলেও তাকে উপভোগ করেছে গণিকা হিসেবে৷ বন্ধুদের সামনে মদের আসর বসিয়ে বেশ্যার সঙ্গদান কামনা করেছে দ্বিতীয় পক্ষের এই স্ত্রীর কাছে৷ তারপরে সে যখন মেয়ে টুকীকে অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে হিন্দু ঘরের নানা আচার-নিয়ম পালনে কর্তব্যরত তখন তার সেই কর্তব্য কর্মকে অবহেলা করেও বর্ষিত হয় বিশ্বম্ভরের অপমানকর বাক্যবাণ—‘‘তোমার শুচিবাই দিন দিন বাড়ছে দেখছি৷ গেরস্তের ঘরে ওটা কিছু কিছু থাকা ভাল; কিন্তু তুমি অনেক গেরস্তের বৌকেও হার মানিয়ে দিতে পার৷’’১৬৬ প্রতিবেশীদের মুখে টুকীর অকল্যাণকর মন্তব্যও বিশ্বম্ভরের চিত্তকে চঞ্চল করে তোলে৷ তারা যখন বলে বেশ্যার হাতে লালিত বলে কেউ টুকীকে বিয়ে করবে না অথবা উত্তম তার ভবিষ্যতের রাস্তা পরিষ্কার রাখার জন্য তাকে পুরদস্তুর গণিকা বানিয়ে ছাড়বে, বা তাকে নিয়ে পালিয়েও যেতে পারে তখন তাদের মুখের সেই কথা উত্তমের প্রতি বিশ্বম্ভরকেও অবিশ্বাসী করে তোলে৷ কিন্তু দুর্বলচিত্তের বিশ্বম্ভরের কোনো এক দুর্বলতা তাকে বিশ্বাসঘাতিনী, টুকীর অনিষ্টকারিণী ভাবতে সায় দেয় না বরং ভরসাদাত্রীই মনে হয়৷ সে তার মনের সেই দোলাচলতা গোপন রাখেনা স্ত্রীর কাছে৷ উত্তম তার স্বার্থহীন ভালোবাসার নজির দিয়ে তার বহুদিন ধরে জমানো তাড়া তাড়া নোট এবং রাশি রাশি অলংকার দেখায় স্বামীকে৷ সে যে টাকা রোজগারের জন্য আসেনি এবং তার নিজেরও যে টাকার অভাব নেই তা বুঝতে অসুবিধা হয় না বিশ্বম্ভরের৷ উত্তমের সেই বিপুল সম্পদ তার মনের সমস্ত সংশয়কে দূরে ঠেলে দেয়৷ উত্তম তার বেশ্যাজীবনে প্রচুর অর্থ কামিয়েছে যা দিয়ে তার বাকি জীবন অনায়াসে অতিবাহিত করতে পারতো; প্রতিবেশীদের সন্দেহপ্রবণতা, অপমানকর কথাবার্তা, বিশ্বম্ভরের ভালোবাসার সঙ্গে দেহভোগের কামনা কিছুই তাকে ভোগ করতে হত না৷ দেহব্যবসা না করলেও তার নিজের একটা জীবন নিয়ে কোনো অসুবিধা ছিল না৷ তারপরেও সে যে কেন পুনরায় সংসারে আবদ্ধ হওয়ার জন্য সতৃষ্ণ হয়ে উঠলো সে খবর সে নিজেও জানে না৷ তার ভেতরে বাইরে কোথাও বিশ্বম্ভরের স্থান তেমন উচ্চ নয় তথাপি তাকে প্রথম যেদিন চাক্ষুষ দর্শন করে সেদিন থেকেই—‘‘গৃহবাসিনী হইয়া লালিত হইবার, লালন করিবার ইচ্ছার উত্তেজনা তাহাকে বোধ হয় অসহিষ্ণু চক্ষুহীন করিয়া দিয়াছিল৷ সে আকাঙ্খা আর ইচ্ছা আজও তেমনই অখণ্ড ও অটুট আছে, গঞ্জনার প্রহারে তাহার গায়ে দাগ পড়ে নাই; কিন্তু তার সেই ইচ্ছাকে বিশ্বম্ভর যেন দুস্তর অগ্নিপরীক্ষায় ফেলিয়া যাচাই করিয়া লইতেছে৷’’১৬৭ স্বামী যখন বার বার মনে করিয়ে দেয় তার পূর্বের জীবনের কথা তখন বিরক্ত হয়ে উত্তমকে বলতে শোনা যায় সে যে কি ছিল তা সে কখনো ভুলে যায় না এবং তাকে বার বার মনে করিয়ে দেওয়াও অনাবশ্যক, তারপরেও বিশ্বম্ভর তার অভ্যাস ভোলে না৷ প্রতিবেশীরাও গণিকা জীবন নিয়ে খোঁটা দেওয়া নিজেদের কর্তব্য মনে করে, আর সেই কর্তব্যের বশেই মাতৃস্নেহে অন্ধ কিশোরী টুকীর মনে বিষ ঢেলে দিতে জিজ্ঞেস করে তার মায়ের গহনা প্রাপ্তির ইতিহাস৷ টুকী সেই গহনা তার বাবা দিয়েছে বললে অশ্লীল ঠাট্টা-বিদ্রুপে তাকে বিদ্ধ করতে বলে—‘‘এক দুই তিন চার পাঁচ ছয় সাত আট নয় দশ—বিশ—ত্রিশ—শ—দুশো—অঙ্গদ রায়বারের রাবণ রাজা—যেদিকেই চাই সেদিকেই তোর—হা হা হা ৷’’১৬৮ সংসারজীবনে অনভিজ্ঞ টুকী মোক্ষদার মায়ের সেই অশ্লীল ইঙ্গিত বুঝতে না পারলে বোঝানোই যার উদ্দেশ্য সে ছাড়বে কেন! তাই সেই রমণী আড়ালে নিয়ে গিয়ে তাকে বোঝায় যে তার মা বেশ্যা ছিল৷ শুধু সেটুকুই নয় বেশ্যার প্রকৃত স্বরূপ কি তা ভালোভাবে অবগত হতে টুকীকে প্রায় জোর করে পাঠায় তার মায়ের কাছে৷ উত্তম তার অতীত জীবন নিয়ে কোনো রাখ-ঢাক রাখতে চায়নি৷ বিশ্বম্ভর তো আরও নয়৷ কিন্তু বাড়ন্ত মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে পারেনি এতদিন৷ প্রতিবেশীদের দ্বারা ব্যঙ্গবাণে বিদ্ধ মেয়ের মুখ দেখে শিউরে ওঠে সে৷ সে তার ক্লেদাক্ত জীবনের কোনো কথাই টুকীর সামনে উপস্থাপন করার সাহস পায় না৷ তাকে সদা সন্ত্রস্ত থাকতে হয় পাছে তার আচরণে গণিকাসুলভ কিছু প্রকটিত হয়ে টুকীকে সংশয়ী করে তোলে৷ সে তার সম্পূর্ণ জীবনে একমাত্র সম্পদ হিসেবে পেয়েছে টুকীকে৷ কোনো সুদূর অতীতে কেন গৃহস্থের সুখী পরিবেষ্টনী থেকে বেড়িয়ে গিয়ে তাকে গণিকা হতে হয়েছিল সে ইতিহাস অব্যক্ত৷ বিশ্বম্ভর তাকে ঘরে তুলেছে যে খেয়ালে সেখানে ভালোবাসা ও স্বার্থ পরিব্যাপ্ত৷ প্রথম দিকের স্বার্থ ছিল যৌনক্ষুধা, বিপত্নীক জীবনের শূন্যতা, শেষের দিকে বিপুল অর্থ৷ কিন্তু টুকীর সঙ্গে মা-মেয়ের সখ্যতায় কোনোরকম স্বার্থ আরোপিত নয়৷ সেখানে সীমাহীন বাৎসল্য ও শ্রদ্ধায় পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত৷ সেই বন্ধনই তার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি৷ তাই প্রথম থেকেই তার সেই অপার মমতা সীমাহীন ধৈর্যের সঙ্গে বর্ষিত হয়েছে টুকীর প্রতি৷ তার জীবন টুকীময়৷ সে কোনোভাবে হারাতে চায় না তার জীবনের সেই বড় প্রাপ্তিকে৷ কোনোভাবে আঘাত করতে চায় না টুকীর সুকুমার হৃদয়বৃত্তিকে৷ তাই টুকী এসে যখন মোক্ষদার মায়ের সমস্ত কথা মায়ের সামনে ব্যক্ত করে ‘বেশ্যে’ শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করে তখন সেই শব্দটা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সীমাহীন আশঙ্কায় তার কান রুদ্ধ হয়ে যায়৷—‘‘যে অতীত সে প্রাণপণে মুছিয়া দিয়াছিল, তাহাই যেন নবারুণের স্নিগ্ধ আলোক গায়ে মাখিয়া সুসজ্জিত হইয়া তাহার সম্মুখে দাঁড়াইল৷ জীবনের প্রবাহ তখন অবিচ্ছিন্ন স্বচ্ছ গৃহগোমুখীতে তার উৎস৷ কিন্তু যেদিন সেই প্রবাহ পঙ্কিল হইয়া উঠিল, সেইদিন আকাশের আলোক প্রবাহবক্ষে একবার জ্বলিয়া উঠিয়াই অদৃশ্য হইয়া গিয়াছিল৷ সে ভুল যেমন চিরসঙ্গী তেমনই অমার্জনীয়—তারপরের কথাগুলি সে ভাবিতে পারিল না—বুকে যেন কাঁটা বিঁধিতে লাগিল৷’’১৬৯ সে বহুদিন গৃহকন্নার মধ্যে নিজেকে আটকে রেখেছিল৷ তারপরে আসে সেই চরম মুহূর্ত যখন পঙ্কিল জীবনের আষ্টেপৃষ্ঠে সম্পূর্ণ বদ্ধ সে ৷ আর যে কর্দম গায়ে মেখে জীবনের স্বচ্ছ প্রবাহকে জটিল করে তুলেছিল সে কর্দম কোনোদিনই তার জীবন থেকে মুছবার নয় তা ভালো করে বুঝে গেছে উত্তম ৷ তার শেষ জীবনে একমাত্র সুখের আশ্রয় মেয়ে টুকী মায়ের সেই মানসিক পরিস্থিতির কথা ভেবে আতঙ্কে কন্টকাকীর্ণ হয়েছে৷ বিশ্বম্ভর মেয়ের কাছে সেই কথা শুনে লঘু হাস্য-পরিহাসে তা উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে শোনা যায় উত্তমের মুখে কঠিন তিরস্কার—‘‘আমার নাম সবাই জানে, মোক্ষর মা যা বলেছে তাই বলে৷ কিন্তু টুকীর কাছে ও কথাটি গোপন রাখতে চেয়েছিলাম, তুমি তা রাখতে দিলে না৷’’১৭০

টুকীকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই উত্তমের৷ সে জানে তার শরীরের কালিমা কোনোদিনও সমাজ অপসারিত হতে দেবে না—সাধারণ গৃহবধূর মতো কোনোদিনও তার ঠাঁই হবে না কিন্তু তার মেয়ে টুকী? তার হাতে তার স্নেহে লালিত বলে টুকীর প্রতিও যদি আরোপিত হয় কলঙ্কের কর্দম তা হলে সে নিজেকে মুখ দেখাবে কি করে৷ টুকী সুশ্রী, সুস্থির, সুলক্ষণা, শিক্ষিত, গৃহকন্নায় সুনিপুণা৷ এমন কন্যার ভবিষৎ ভেবে আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখতে থাকে মা৷ যে মেয়েটি তার পেটের মেয়ে নয়—একেবারে পর—তার দিকে তাকিয়ে একটা অজানা ভয়ে তার সমস্ত শরীর ঠান্ডা হয়ে আসে৷ তার দেওয়া অর্থকে পুঁজি করে দোকান করে বিশ্বম্ভর অর্থবান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়৷ প্রতিবেশীরা টাকাওয়ালা বলে তাদেরকে আর বেশি ঘাটাতে সাহস পায় না৷ সকলেই কম-বেশি মুখাপেক্ষি তাদের৷ উত্তম আদর করে তাদের আপ্যায়ন করে, ধার দেয়, বিনিময়ে কোনোদিন স্বতোপ্রণোদিত হয়ে সেই ধারের কথা মুখেও উচ্চারণ করে না—কিন্তু সেই সুখী নির্বিবাদ ঘরকন্নার মধ্যেও টুকীর ভবিষ্যৎ ভাবনা থেকে কখনোই মুক্তি পায় না সে৷ অবশেষে তার সেই দুর্ভাবনা বাস্তবরূপ নিয়ে আঘাত হানতে শুরু করে৷ গোপন শত্রুর চরম শত্রুতায় টুকীর পরপর বিয়ে ভেঙে যেতে থাকে৷ চার-পাঁচবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে উত্তম ও বিশ্বম্ভর দিশেহারা হয়ে পড়ে৷ চরিত্রবতী উপযুক্ত শিক্ষাপ্রাপ্ত সুন্দরী কিশোরী কন্যার শুধুমাত্র গণিকার স্নেহধন্যা বলে কোনো গৃহস্থ বধূ করে নিতে দাক্ষিণ্য করে না৷ তাকে সংসারে প্রতিষ্ঠা করার মতো হৃদয়বত্তার সন্ধান মেলেনা৷ মেয়ের অন্ধকারময় জীবনের ভাবনা ভয়ে বিহ্বল করে দেয় উত্তমকে৷ সে জানে সংসারের পীড়ন কাকে বলে৷ সে জানে একজন বারবনিতার সমাজে কোথায় স্থান৷ টুকী দেহব্যবসায়িনী নয়, গণিকা নারীর স্নেহে লালিত হলেও গণিকা হওয়ার শিক্ষাও সে পায়নি কোনোদিন৷ শুধুমাত্র মা-মরা মেয়েটি বারাঙ্গনার বাৎসল্যে বড় হয়েছে বলে সমাজের চোখে সে গণিকাতুল্য৷ কোনো গৃহস্থ গৃহবধূরূপে তাকে বরণ করতে রাজী নয়৷ সমস্ত ঘটনার জন্য দায়ী করা হয় উত্তমকেই৷ বিশ্বম্ভর যারপরনাই তিরস্কার করতেও দ্বিধা করে না—সবটা জেনে বুঝেও৷ নিজের প্রতি নিজের আত্মগ্লানিতে বিপর্যস্ত উত্তম সমগ্র স্নেহবাৎসল্য দিয়ে গড়া তার সোনার প্রতিমার সেই ভয়াবহ দুর্ভোগের জন্য নিজেকেই দায়ী করে৷ সে তার চির আদরের ধন টুকীকে নিজের বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে যখন বলে—‘‘টুকী, আমায় তুই ক্ষমা কর—আমি তোকে সুখ দেব ব’লে আসিনি, কিন্তু তোর সুখ ইচ্ছে করেছি, ভগবান তা জানেন৷ কিন্তু অন্তরায় হয়ে দাঁড়ালাম আমিই৷’’১৭১ তখন উত্তমের সেই নিদারুণ আত্মপীড়া তার হৃদয়ের পবিত্র মাতৃধারাকে উদ্ভাসিত করে তোলে৷ শেষ পর্যন্ত এক চরিত্রহীন, বয়স্ক, মদ্যপ পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে বাধ্য হয় উত্তম-বিশ্বম্ভর৷ সেই অপাত্রে সোনার পুত্তলিকে সমর্পণ করে নিদারুণ বিষজ্বালা বহন করে গণিকা থেকে গৃহিণী—উত্তম৷ টুকীকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে জীবনের উদ্দেশ্যশূন্য হয়ে যায় উত্তমের৷ তার মায়ের মন উপলব্ধি করতে পারে তার মর্মযন্ত্রণা৷ বিশ্বম্ভর তাকে কোনোদিনও বোঝেনি তার স্থূলবোধে নারীত্বের মান-অপমানের কোন ভিত্তিভূমি নেই৷ টুকীর বিয়ের পর উত্তম আর সরাসরি হাজির হয়নি উপন্যাসটিতে৷ বিশ্বম্ভরের শ্লেষ উক্তির মধ্য দিয়ে তার কন্যাবিহনে অসুস্থতার কথা, অশ্রুবিসর্জনের কথা উঠে এসেছে মাত্র৷ এর মধ্য দিয়েও এক স্নেহাতুরা মাতার স্নেহবুভুক্ষ হৃদয়ের বার্তা প্রতিফলিতই হয়েছে যা উত্তমকে অনবদ্য করে তুলেছে৷

টুকী :

‘লঘুগুরু’ উপন্যাসে যেমন উত্তম গণিকাবৃত্তিকে সমূলে উৎপাটন করে গৃহিণী হয়ে উঠার চেষ্টা করেছে তার বিপরীত চরিত্র টুকী৷ সীতা-সাবিত্রীর আদর্শে আদর্শায়িত সুলক্ষণা, গৃহকর্মে সুনিপুণা এবং নম্র-মার্জিত চরিত্রের টুকী জীবনের জটিল আবর্তে পা বাড়িয়েছে গণিকা জীবনে৷ উত্তম আগে বেশ্যা ছিল—সমগ্র উপন্যাস জুড়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করেছে আর টুকী সারাজীবন সতীর সাধনা করেও সমাজের নিষ্পেষণে অনির্দেশ্য অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে৷

টুকী জন্মলগ্নে তার মাকে হারিয়ে প্রতিপালিত হয়েছে উত্তমের দ্বারা৷ উত্তমকে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী করে ঘরে তুলেছে টুকীর বাবা বিশ্বম্ভর৷ উত্তম বেশ্যা থেকে গৃহিণী হয়ে—তার শিক্ষা-সংস্কার রুচিশীলতা দিয়ে বড় করেছে টুকীকে৷ সেই রুচি গণিকার নয় তা অবশ্যই সুস্থ সুন্দর মাতৃত্বের৷ কিন্তু গণিকার দ্বারা প্রতিপালিত বলে তার স্থান হয়নি কোনো আদর্শবান ভদ্র পরিবারের গৃহিণীরূপে৷ পাঁচবার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর তার বাবা-মা বাধ্য হয়ে তাকে বিয়ে দেয় বাহান্ন বছরের পরিতোষের সঙ্গে৷ তার পরেও আপত্তি ছিল না টুকীর৷ মায়ের আদেশ ও সীতা-সাবিত্রীর আদর্শেই সে মেনে নেয় বয়স্ক স্বামীসঙ্গকে৷ অনেক পণসামগ্রী সহযোগে সে যখন স্বামীগৃহে পদার্পণ করে তাকে আপ্যায়ন করে ঘরে নিয়ে যায় আরেক যুবতী—নাম সুন্দরী৷ টুকী প্রথমে তাকে স্বামীর আত্মীয়ই ভেবেছিল, পরে বুঝতে পারে তার সঙ্গে স্বামীর সম্পর্কের অন্য কোনো যোগসূত্রের কথা৷ তাই যখন স্বামীকে জিজ্ঞেস করে ‘দিদি তোমার কে?’’১৭২ স্বামী নিরুদ্বিগ্ন মনে জবাব দেয়—‘‘তোমার মা তোমার বাবার যা হয়৷’’১৭৩ টুকী চিরকাল মায়ের মুখে স্বামী পরম দেবতা কথাটি শুনে এসেছে, সতীনারীদের আদর্শ বহন করে এসেছে কিন্তু স্বামীর সেই ঘৃণ্যরূপ সে কোনো দিন কল্পনা করতে পারেনি৷ পরিতোষ তার সম্মুখেই তার রক্ষিতার সঙ্গে ঠাট্টা-তামাশায় মেতে ওঠে, তাকে অবহেলা করে—এমনকি সুন্দরীর দ্বারাও পীড়িত হতে হয় তাকে৷ সে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেছে তার বাবা তার মাকে অতীত জীবন নিয়ে খোঁটা দিয়েছে, আর তার মায়ের সেটাই ছিল সবচেয়ে যন্ত্রণার জায়গা৷ তাই তার উপলব্ধি হয় যে তার মা সকল ধৈর্যশক্তি ও স্নেহ দিয়ে ঢেকে রেখেছিল তার বাবার কুৎসিত রূপটাকে যার জন্য টুকী তা ধরতে পারেনি৷ নইলে সে কোনোদিনই তার বাবাকে অতটা ভক্তি করতে পারতো না৷ তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে সীতা-সাবিত্রী যে স্বামীর জন্য জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেনি সেই স্বামীরা পরিতোষ বিশ্বম্ভরের মতো কখনো ছিল না৷ তার পরেও সে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে সতীর আদর্শেই স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়৷ স্বামীর নির্দেশ মতো বাড়ি থেকে টাকা আনিয়ে স্বামীকে তুষ্ট রাখে৷ তার বাবা তাকে দেখার জন্য তাদের বাড়ি উপস্থিত হলে সে সুন্দরীকে দিদি বলে পরিচয় দেয় কিন্তু স্বামী পরিতোষ সুন্দরীর সঙ্গে সত্যিকারের সম্পর্ক অকপটে প্রকাশ করে দেয়৷ সেই অপমানের মর্মজ্বালায় স্বামীকে রেহাই দেয় না টুকী৷ চরম অপমানে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সে সুন্দরীর নীচতা ও উত্তমের মহানুভবতাকে সদর্পে ঘোষণা করে বলে তার মা ও সুন্দরীর সঙ্গে বিস্তর তফাত সে যেন তার তুলনা করতে না যায়৷ যত সময় গেছে ততই টুকীর সামনে উপস্থিত হয়েছে পরিতোষ, সুন্দরীর কুৎসিত জীবন-যাপন, তাদের শিক্ষাহীন, রুচিহীন ইতর মন-মানসিকতা৷ মার্জিত রুচির টুকী সহজে তা মেনে নিতে পারেনি৷ অশ্রুবিসর্জন করে সব কিছুর সঙ্গে আপোষ করতে না পেরে অহরহ নিজের মৃত্যু কামনা করেছে৷ তারপর একসময় তার দেহের প্রতি তীব্র ঈর্ষা ও লোভকে প্রকটিত হতে দেখেছে সুন্দরীর চোখে৷ সে সেই দেহকে কাজে লাগিয়ে উপার্জন করার অস্ফুট ইঙ্গিত জ্ঞাপন করতে ভোলেনি৷ সরলমনের টুকীর সেই ইঙ্গিতের তাৎপর্য বোধগম্য হয়নি৷

টুকীর জীবনে জটিলতা যত বেড়েছে সে তত তার মায়ের মুখ মনে করার চেষ্টা করেছে—পালন করার চেষ্টা করেছে তার আদেশ৷ সুন্দরী তার কাছ থেকে তার কোমল মনের সুযোগ নিয়ে গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছে অর্থ উপার্জনের জন্য সে যা বলবে টুকী তা করবে৷ সেই ঘটনার সূত্র ধরেই সুন্দরী তার ঘরে অতিথি করে এনেছে অচিন্ত্য বাবুকে৷ উপন্যাসের চূড়ান্তভূমি স্পর্শক স্থান এই অংশটিই৷ সুন্দরী অচিন্ত্যবাবুর কাছে অগ্রিম টাকা নিয়ে টুকীর জন্য বেশ্যাবৃত্তির দালালি করতে এসেছে৷ যখন সে বুঝতে পারে—লজ্জায় ঘৃণায় পাথর হয়ে যায় সে৷ শেষবারের মতো চেষ্টা করে মায়ের নাম উচ্চারণ করে শক্তি সঞ্চয় করার৷ কিন্তু তা আর হয়ে উঠে না৷ মা বলতে গিয়ে মুখ দিয়ে নিরর্থক একটু শব্দহীন বাতাস বেড়িয়ে যায়৷ অবশেষে নিজের সমস্ত শক্তিকে একত্রিত করে প্রতিস্পর্ধী হয়ে সে অচিন্ত্যবাবুকে বলে—‘‘আসুন৷… আমার সঙ্গে৷… একাজ যদি করতে হয়, তবে আমি আপনাকে দেব দেহ, আপনি আমাকে দেবেন টাকা৷ মাঝখানে ওরা কে?’’১৭৪ অচিন্ত্যবাবু হতভম্ভ হয়ে যায়৷ এক সরলা গ্রাম্যবধূর মুখে এহেন তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে সে শোনেনি বোধহয় কোনোদিন৷ আর সুন্দরী! সেও অত বিস্মিত কোনোদিন হয়নি৷ অবশেষে দুজনকে চরম অপমান করে নিজে বেড়িয়ে যেতে চেয়েও সুন্দরীর নিয়ে আসা সেই খদ্দেরকে বের হতে বললে তাকে আক্রমণ করে সুন্দরী কিন্তু ততক্ষণে টুকী বাড়ির চৌকাঠ পার হয়ে ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী অন্ধকারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে৷

টুকী তার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে এসেছে তার মায়ের চরম অপমানকর জীবন-যাপন৷ তার বাবা ভালোবেসে ঘরে তুলেও তাকে সেই অপমান জ্বালা থেকে মুক্তি দেয়নি৷ কীভাবে পুরুষের কাছে নারীর জীবন খেলো হয়ে যায় বিমাতার কাছে সাংসারিক জ্ঞান নিতে নিতে সেই পাঠটিও সে পরিবেশ থেকে নিপুণভাবে অধ্যয়ন করতে পেরেছে৷ শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর লাম্পট্য, গণিকার কর্তৃত্ব তার সুকুমারবৃত্তিকে আঘাত করে নারীত্বের চিরন্তন অস্তিত্বকে নষ্ট করে দিয়েছে৷ সে বার বার ভয়ে ভেঙে যাওয়ার মুহূর্তেই ধরে নিয়েছিল জীবন কোথায় যেতে পারে৷ মাকে বলে বিয়ের চেষ্টা থেকে বিরত হয়ে সেই অবশ্যম্ভাবী ভবিষ্যৎ থেকে নিজেকে সরাতে চেয়েছিল৷ যদিও জানে গণিকা প্রতিপালিত বলে বিয়ে হলেও তার মুক্তি নেই, না হলেও নয়৷ তারপরেও চরিত্রহীন, লম্পট স্বামীর সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করেছে প্রাণপণে কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার মানতে হয়েছে৷ যে গ্লানিময় জীবন থেকে বেড়িয়ে এসে উত্তম টুকীর জন্য সুস্থ ঘরকন্নার স্বাদ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিল সেই অপযশেই টুকীকে পা বাড়াতে হয়েছে উত্তমের পূর্বজীবনে৷ লেখক টুকীকে দিয়ে সরাসরি দেহের দর হাকাতেই বাধ্য করেননি তাকে ঠেলে দিয়েছেন সীমাহীন অনির্দেশ্য অন্ধকারে৷ বাড়ির চৌকাঠ অর্থাৎ নিরাপত্তার আবেষ্টনী এবং গৃহ-সংসারের বন্ধনী থেকে অন্ধকার বিশ্বের প্রতি ইঙ্গিত দিয়ে দেহব্যবসার অসংশোধনযোগ্য পাপপঙ্কে নিমজ্জিত করেছেন তাকে৷ যে জীবনে কোনোদিন আলোর সূর্য উঠেনা—সমাজ যেখান থেকে চাইলেও বেড়িয়ে আসতে দেয়না; লেখক টুকীর জন্য নির্দিষ্ট করেছেন সেই পথ৷

সুন্দরী :

সুন্দরী টুকীর স্বামী পরিতোষের রক্ষিতা৷ নিম্নশ্রেণীর দেহজীবী সে৷ তার সঙ্গে পরামর্শ করেই পরিতোষ বিপুল অর্থ প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছিল গণিকা বিমাতার দ্বারা প্রতিপালিত টুকীকে৷ কিন্তু টুকীর বিমাতা উত্তমের ছিল আলোর সাধনা, পঙ্ক থেকে মুক্ত হয়ে পঙ্কজ হয়ে ওঠার সাধনা৷ সুন্দরীর তা নয়৷ সে লোভী৷ মা-ঠাকুমার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সুত্রে সে অর্জন করেছে দেহব্যবসায়ের পেশা৷ তার কামনা শুধু অর্থ এবং কায়িক সুখ৷ টুকী যখন নববধূবেশে আঠারোশত টাকা নিয়ে সুন্দরীর ডোমপাড়ার বাসভবনে প্রবেশ করে তখন লণ্ঠন হাতে তাকে ঘরে নিয়ে যায় সুন্দরী৷ বধূর সুন্দর মুখশ্রী তার মনে অপার সম্ভাবনার দিগন্ত খুলে দেয়৷ টুকীকে ঘরে বসিয়েই সে পরিতোষের কাছ থেকে পণের হিসেব বুঝে নিতে ভুল করে না৷ পরিতোষকে হাত মুখ ধোওয়ার অবকাশ না দিয়েই সে হস্তগত করে পণের পনেরো’শ এবং গহনার জন্য দেওয়া তিনশত টাকা৷ কিন্তু সেই বিশাল অঙ্কের টাকা ভোগ করার ভাগ্য হয় না সুন্দরীর৷ তার শত সচেতনতার মধ্যেও সাময়িক নিদ্রার সুযোগে সিঁদ কেটে টাকার বাক্স চোরের হস্তগত হয়ে গেলে ভয়ানক চিৎকারে সে পাড়া মাথায় করে তোলে৷ সুন্দরীর জীবনে অর্থই সব৷ তাই অর্থের শোকে নাওয়া-খাওয়া ভুলে শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়ে থাকে সে৷ লেখক তাঁর শোকসন্তপ্ত চেহারার বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে—‘‘সুন্দরীর চোখের পাতা ফুলিয়া আমড়ার মত দেখাইতেছে৷ যেন দুনিয়ার শোক একত্র হইয়া বটিকাকারে সুন্দরীর চোখের পাতায় আসিয়া বসিয়াছে৷’’১৭৫

সুন্দরী লক্ষ্য করে টুকীর সংসারের জন্য গভীর নিষ্ঠাকে৷ তুলসীমঞ্চ, লক্ষ্মীপ্রতিমা প্রতিস্থাপন এবং নানা দেব-দেবীর আরাধনার মধ্য দিয়ে সে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে চায়৷ তার সেই মাঙ্গলিক ধর্মানুষ্ঠান নিয়ে ব্যঙ্গ করতে গিয়ে তার নারীসত্তা শিউরে ওঠে৷ সে লক্ষ করে তার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছে৷ তারপর যখন সে টুকীর মুখে শোনে যে টুকী তার জীবনের সমস্ত আদর্শ তার মায়ের কাছ থেকে আয়ত্ত করেছে তখন তার বহুপুরুষ আসক্ত জীবন এক বারবনিতার আদর্শ বহন করা এক নারীর নিষ্ঠা দেখে খিল খিল করে হেসে ওঠে৷ তার সেই হাসি কঠিন ও বিভৎস৷ সে টুকীকে দেহব্যবসার ইঙ্গিত দিয়ে বলে—‘‘টাকা কিছু জমিয়ে নিয়ে ধর্ম্মনিষ্ঠে করলে দু’কালেরই উপায় হয়৷’’১৭৬ সুন্দরীর এই উক্তি দ্ব্যর্থক৷ একদিকে যেমন টুকীকে বেশ্যাবৃত্তিতে ইন্ধন জোগানো অন্যদিকে উত্তমের বেশ্যাবৃত্তি ছেড়ে প্রচুর অর্থ নিয়ে পুনরায় গৃহিণী হওয়ার জন্য তীব্র খোঁচা৷ তার সেই বাক্যভঙ্গি তার বিভৎস ভয়ানক মুখচ্ছবি দেখে টুকীর মনে হয় সুন্দরী তার মায়ের সঙ্গে নিজের তুলনা করে পরাভবের জ্বালায় দমফেটে মরছে৷

নতুন সংসারে টুকীকে সে দিদি বলে পরিচয় দিয়েছিল৷ কিন্তু সময়ের সঙ্গে তার আসল অবস্থান বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না টুকীর৷ সে বরাবরই লক্ষ্য করেছে সুন্দরী তার কর্তৃত্ব দিয়ে বশ করে রেখেছে স্বামীকে, এমনকি তাকেও মুঠোর মধ্যে নেওয়ার জন্য তার আমরণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে৷ অবশেষে স্বামীর কাছে তার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তিতে সে জানতে পারে সুন্দরী তার স্বামীর রক্ষিতা৷ সুন্দরীও তার অবস্থা সম্পর্কে সচেতন কম নয়৷ তাই টুকী ও পরিতোষকে একা কথা বলতে দেখলে সে যেমন তার স্বাভাবিক ঈর্ষায় প্রজ্জ্বলিত হয়৷ তেমনি সুন্দরী ষোড়শীর অনিন্দ্যসুন্দর রূপে পরিতোষকে বিমোহিত হয়ে উঠতে দেখলে আশঙ্কায় আঁতকে উঠে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে৷ লম্পট পরিতোষের কাছে যথেষ্ট আস্কারাও পেয়ে থাকে সে৷

সুন্দরী ব্যভিচারিণী হলেও তার মধ্যেও রয়েছে একটি সুন্দর মন৷ যে মন দিয়ে সে মানুষের বিচার করতে পারে৷ তবে লেখক উপন্যাসে সুন্দরীর সেই সুকুমার মনোবৃত্তিকে কখনোই স্থায়িত্ব দিতে চাননি৷ তাই মাত্র দুবার তা উত্থিত হয়ে পুনরায় তার চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেছে তারপরে আর একবারও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি৷ একবার টুকীর ঘরের দেওয়াল জুড়ে ঠাকুরের ছবি লাগানো নিয়ে ব্যঙ্গ করলে তার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ সেই কন্টককীর্ণ হওয়া হিংস্র অর্থলোভী দেহব্যবসায়ী সুন্দরীর মনের নয় তা সেই গোপন সুকুমারী মানবীসত্তার দ্বারাই ঘটেছে৷ আরেকবার তার সুমনোবৃত্তি জাগ্রত হয় বিশ্বম্ভর তার বাড়িতে মেয়েকে দেখতে এলে৷ বিশ্বম্ভর মেয়ের কাছে জানতে পেরেছে যে সুন্দরী পরিতোষের বোন এবং মালক্ষ্মী সম্বোধনে বিশ্বম্ভর তাকে আহ্বান করলে সে পুত্রের বয়সি কিন্তু পিতৃস্থানীয়ের আত্মীয় সম্ভাষণের জন্য প্রস্তুত হলেও বিশ্বম্ভরের মুখে যখন শোনে উত্তমের প্রতি ভয়ঙ্কর শ্লেষ বাক্য তখন তার আর পা চলে না৷ ‘‘উত্তমকে সে দেখে নাই—টুকী এবং বঙ্কু কেবল দু’একবার তাহার নামোচ্চারণ করিয়াছে মাত্র—সুন্দরীর সম্মুখে সে ছায়া নিক্ষেপ করে নাই; কিন্তু এখন তাহার মনে হইয়াছে, উত্তম স্বাভাবিক নয়, অনুকুল নয়, অপরিচিত নয়, সুদূর নয়৷ সুন্দরী আরো অনুভব করিল, এই লোকটি প্রণয়িনীর মর্মবাণী কিছুমাত্র হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে নাই৷’’১৭৭ কিন্তু তার এই উপলব্ধি ক্ষণিকের৷ তারপরে টুকী যখন জানায় তার বাবা তার যথার্থ অবস্থান অনুধাবন করতে পারবে না এবং পরিতোষ যখন শ্বশুরের সম্পর্কে নির্দ্বিধায় তার রক্ষিতা পরিচয়কে জাহির করে তখন সমস্ত ভয়-সংকোচ ভুলে অম্লানবদনে তাকে প্রণাম করে আশীর্বাদ প্রাপ্ত হয়৷ টুকী লজ্জায় অপমানে যাওয়ার সময় বাবার দেওয়া দশটি টাকা মাটিতে ছুড়ে দিয়ে কাঁদতে থাকলে অর্থলোভী সুন্দরীর সেই দুঃখ উপলব্ধি করায় ক্ষমতা থাকে না৷ সে টুকীর ছুড়ে দেওয়া পয়সাগুলি কুড়িয়ে আঁচলে বেঁধে নেয়৷ পরিতোষকে তার বাবার সামনে নিজের রক্ষিতা পরিব্যাপ্ত জীবনকে প্রকাশ করা নিয়ে অপমানে জর্জরিত টুকী সেই অপমানের কারণ জানতে চাইলে পরিতোষও সহাস্যে ইঙ্গিত করে শ্বশুরের বেশ্যাদ্বার হওয়ার কথা৷ উত্তম ও সুন্দরীর তুলনায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য টুকী সুন্দরীর নোংরামোকে কটাক্ষ করলে সুন্দরী ধীর মস্তিষ্কে তাকে উদ্দেশ্য করে শোনায় এক প্রবাদবাক্য—‘‘আছে বোন, তফাৎ মানুষে মানুষে, তার উপায় নেই—হাতের পাঁচটা আঙুল সমান করে’ ত’ ভগবান গড়েননি৷’’১৭৮ সুন্দরী বিগত যৌবনা, সম্পদহীন আর টুকী বহু সম্পদের অধিকারী বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান; তার সঙ্গে রূপবতীও৷ সে জানে ‘‘যে গরু দুধ দেয় তার চাঁট খাওয়া যায়৷’’১৭৯ তাই টুকীর শত অপমানেও কোনো কিছুর প্রতিবাদ করে না সে৷ টুকী তার ভবিষ্যতের পেট ভরানোর প্রধান মাধ্যম৷ কিন্তু তাকে ‘নোংরা’ বলার অপমান সে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না৷ প্রকাশ্যে তাকে না বোঝালেও টুকীর প্রতি তার আক্রোশের সীমা পরিসীমা থাকে না৷ জীবনে অনেক কটুক্তি তাকে সহ্য করতে হয়েছে, তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে সে কটুক্তিকারীকে দংশন করেছে কিন্তু টুকীর সেই কথার মতো তীক্ষ্ণ হয়ে আর কোনো কটুক্তি তাকে বিদ্ধ করেনি উপরন্তু সে প্রতিবাদটুকুও করতে পারেনি৷ জীবনে তার প্রবল অভাব৷ দু-বেলা দু-মুঠো অন্নও ঠিকঠাক জোটে না তাদের৷ যে উদ্দেশ্যে প্রচুর টাকা সমেত টুকীকে ঘরে এনেছিল—চোর এসে সব মাটি করে দিয়েছে৷ সে তার মনের প্রবল ঘৃণায় আসক্তি প্রকাশ করে টুকীর দেহটার প্রতি৷ তাই টুকীকে দেখে—‘‘কেমন একটা লালসা সুন্দরীর মনে দুর্দমনীয় হইয়া উঠিল, যেন ইহাকে খণ্ড খণ্ড করিয়া সহস্র লম্পটের রিরংসা-দাহ তৃপ্ত করিতে দু’হাতে বিলাইয়া দেয়—সুন্দরীর যৌবনোল্লাসের সুপ্ত প্রেতমূর্তি একবার দাঁড়াইয়া উঠিল—যেন অতৃপ্তির ঢেউ এখনো বহিতেছে—প্লাবনের আকাঙ্খা বুকে বহিতেছে৷’’১৮০ যে তীব্র ঘৃণায় গণিকাবৃত্তির জন্য টুকী তাকে অবজ্ঞা করে—তার মায়ের সঙ্গে তুলনা করে তাকে নোংরা বলে অভিজ্ঞানিত করে সেই ঘৃণার পরিবর্তে টুকীর দেহকে সহস্র লম্পটের ভোগে উৎসর্গ করতে চেয়ে আত্মতৃপ্তি বোধ করে সে৷ আর তার মতোই দেহজীবিকার পেশায় ধীরে ধীরে ঠেলতে থাকে টুকীকে৷ সুন্দরীর মতে শরীরের সুখই সুখ—মনের সুখও আসে সেই শরীরের সুখের মধ্য দিয়ে৷ সে তাই টুকীকে ইঙ্গিতপূর্ণ বাক্যে বলে তার মতো নবযৌবনবতীর ষাটবছরের বৃদ্ধ স্বামীতে প্রকৃত দেহসুখ উপলব্ধি করার ক্ষমতা নেই৷ তার জন্য প্রয়োজন অন্য কোনো সক্ষম মানুষ৷ টুকীকে দেখে তার ক্লেশের সীমা থাকে না৷—‘‘টুকীর রূপ আর যৌবন তার চোখের সম্মুখেই অনুপভুক্ত হইয়া অস্পৃশ্য আবর্জনার মত অপচয়িত হইতেছে দেখিয়া সুন্দরীর গণিকাচিত্ত যেন নিজেই সর্বস্ব লুন্ঠনের যন্ত্রণা অহরহ সহ্য করে—তার বিরাম নাই৷’’১৮১ টুকীর যৌবন সমৃদ্ধ দেহ দেহব্যবসায় লাগছে না বলে তার কাছে তা চরম অপচয় বলে মনে হয়৷ আর সে পরিতোষের রক্ষিতা হয়ে জীবন কাটাবে, টুকী তাকে বেশ্যা বলে ঘৃণা করে সমাজের কাছে সতী হয়ে থাকবে এটাও তার সহ্যের বাইরে৷ তার এই তীব্র ঘৃণার প্রতিশোধ নিতে সে সংকল্প করে টুকীকে দিয়ে দেহব্যবসা করানোর৷ স্বামীর মনে সুখ ফিরিয়ে দিয়ে সংসারে শান্তি প্রতিস্থাপনের জন্য যা করার টুকীকেই করতে হবে এবং সে যেভাবে বলবে সেভাবে করলেই সবকিছু ঠিক করা সম্ভব বলে অসীম মমতার অভিনয় করে টুকীকে রাজী করায়৷ যেমন—

‘‘—আমাদের দিন আর চলে না, টুকী৷

— দেখছি ত, দিদি; কিন্তু উপায় কি৷ বাবার কাছে টাকা চাইতে লজ্জা করে৷

— তা ত’ করবেই; বাবা যে এখন পর৷—তুই কিন্তু পারিস কিছু টাকা আনতে৷

— কোত্থেকে, দিদি?

— যা বলি তাই যদি করিস তবে হয়৷

— করবো৷

— করবি?

— হ্যাঁ৷

সুন্দরীর উত্তেজনা ক্রমশ বাড়িতেছিল৷

টুকীর গায়ের উপর দুই হাতের সম্পূর্ণ থাবা তুলিয়া দিয়া সে বলিল,—আমার গা ছুঁয়ে বল—

যেন স্পৃষ্ট স্থান যত বৃহৎ হয় শপথ তত শক্ত হয়৷

… কিন্তু টুকীকে এই অনতিক্রম্য শপথে বাঁধিয়াও সুন্দরীর চিত্ত নিঃসন্দেহ সুস্থির হইল না৷ সুন্দরীর মাতামহী মরিয়াছিল পালঙ্কে শুইয়া, তার মা মরিয়াছিল পালঙ্কে শুইয়া, কিন্তু তার মত হতভাগীর সে অদৃষ্ট নয়৷’’১৮২

সুন্দরী কীভাবে একটু একটু করে সংসারের অভাব অনটন দেখিয়ে গ্রাস করার চেষ্টা করছে টুকীকে তার সুস্পষ্ট বর্ণনা উপরোক্ত উদ্ধৃতির মধ্যে উপস্থিত৷ এছাড়া তার মা-মাতামহীরা দেহব্যবসায়ের মধ্য দিয়ে সমৃদ্ধ জীবন যাপন করেছে—মৃত্যুকালেও তাদের সেই সমৃদ্ধির এতটুকু হ্রাস হয়নি৷ তাদের পালঙ্কে শুয়ে মৃত্যুবরণ সেই সমৃদ্ধিকে প্রকাশ করে৷ কিন্তু সুন্দরীর জীবনে ঠিকমত অন্নসংস্থানও হয় না৷ টুকীকে দেহব্যবসায়ে লিপ্ত করলে তার সেই মাতা-মাতামহীর জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য কতটা তার জীবনে ফিরে আসবে তা নিয়েও সংশয়াকীর্ণ সে৷ সুন্দরী ধীরে ধীরে যেমন টুকীকে সংসারের দায় মনে করিয়ে দেহব্যবসার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তেমনি তার মন থেকে স্বামীভক্তির আদর্শটাকেও ছিন্ন করতে তার কৌশলের অন্ত্য নেই৷ সে পরিতোষ সম্পর্কে তাকে বলে—‘‘পেট ভরাবার সোয়ামী নয়; পিঠ পাতাবার কত্তা! অমন সোয়ামীর মুখে আগুন—দুশোবার দুশোবার৷’’১৮৩

পরিতোষের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে সে বাড়িতে টুকীর দেহের বিকিকিনি করতে ডেকে আনে অচিন্ত্যবাবুকে৷ চা দেওয়ার নাম করে টুকীকে তার সামনে ডেকে এনে অচিন্ত্যবাবুর সামনে তার নানা গুণের পরিচয় দিতে থাকে৷ সেখানে সে দেহব্যবসায়ী থেকে পর্যবসিত হয়েছে দেহবিক্রির দালালে৷ দালালের মতোই টুকীর শরীর, তার গুণাবলীর বর্ণনা করতে থাকে আগত খদ্দেরের কাছে৷ তার হাতে দালালির বকশিশ বাবদ অগ্রিম পয়সা৷ তারপর টুকী যখন সুন্দরীর সমস্ত উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে দেহব্যবসায় স্বেচ্ছায় নিজেকে বিকিয়ে দিতে চায় মাঝখানে তার মতো কোনো দালালকে না রেখে তখন বংশপরম্পরায় দেহব্যবসা করে আসা সুন্দরী এতটাই বিস্ময়াপন্ন হয় যতটা সে তার সারাজীবনে হয়নি৷ তারপর সুন্দরীকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বললে হিংস্র উন্মদনায় জ্ঞানশূন্য হয়ে তীব্র বাক্যবর্ষণে বিধ্বস্ত করতে থাকে টুকীকে৷ কিন্তু ততক্ষণে তার আশার মূলে বিষ ঢেলে গৃহ ছেড়ে অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে টুকী৷ তার সেই অন্ধকার জীবনের ছিটে এসে সুন্দরীরও ভবিষ্যতের রুজি-রোজগারের পথটিকে তমসাচ্ছন্ন করে দেয়৷

খ. অসাধু সিদ্ধার্থ :

‘অসাধু সিদ্ধার্থ’-তে (১৯২৯) নটবর এক ভণ্ড দেশ সেবক৷ সিদ্ধার্থ বসুর ছদ্মবেশে নিজেকে আত্মগোপন করে রেখেছে৷ সে চোর, জারজ৷ তার নৈতিক স্খলনকে আরও সুদৃঢ় করতে তাকে দেখানো হয়েছে বেশ্যার দাসত্মকারী হিসেবে৷ এক বৃদ্ধা বারাঙ্গনা—যার কাছে নটবর বহুদিন নিজেকে সঁপে রেখেছিল৷ শেষে সেই বারাঙ্গনাকে হত্যা করে তার সঞ্চিত অর্থ নিয়ে নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করে৷ উপন্যাসে স্বতন্ত্র কোনো চরিত্র হিসেবে গণিকার উপস্থিতি নেই৷ তার পরেও যতটুকু উপস্থিতি তার মধ্য থেকেও পণ্যাঙ্গনার জীবনের কিছু ধারণা পাওয়া যায়৷ গণিকারা যে পুরুষের অধঃপাতের কারণ তা নটবরের অসৎ জীবন বোঝাতে তাদের সঙ্গে সহবাসকে ব্যক্ত করে৷ এছাড়া পুরুষেরা যে গ্রাহক সেজে, শুভাকাঙ্খী হয়ে গণিকাদের চরম ক্ষতি করতো তা নটবরের সেই বৃদ্ধা বারাঙ্গনাকে খুন করে টাকা-পয়সা আত্মসাতের ঘটনা প্রমাণ করে৷

গ. গতিহারা জাহ্নবী :

‘গতিহারা জাহ্নবী’-র কেন্দ্রীয় বিষয় অসার্থক ও ব্যর্থ দাম্পত্য৷ বাবা-মায়ের আদরে বখে যাওয়া বিকৃত রুচির আকিঞ্চন এবং তার স্ত্রী কিশোরীর নষ্ট হয়ে যাওয়া দাম্পত্য জীবনই এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু৷ হাতের বাইরে বেড়িয়ে যাওয়া জোয়ান লম্পট ছেলেকে বিয়ে দিয়ে মতিগতি ফেরাতে চেয়েছিল বাবা-মা৷ কিন্তু তার সে দোষ কাটেনি৷ স্ত্রীকে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করে অন্য নারীর সঙ্গে নিজের পৌরুষকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেছে সে৷ বহু নারীদেহের স্বাদ আস্বাদন করতে তাকে যেতে হয়েছে বাগ্দী পাড়ায়৷ সেখানকার নারীদের বেশিরভাগই দেহবিনোদিনী৷ আকিঞ্চনের অধঃপাতের সুত্র ধরে উঠে এসেছে কিছু রূপাজীবাদের কথা৷ যেমন বিন্দু, চম্পা, পাঁচী, ভামিনী৷ এরা সকলেই নিম্ন শ্রেণীর দেহজীবী৷ সামাজিক নীতিবোধের বালাই নেই এদের৷ সামান্য কিছু অর্থের বিনিময়ে স্বামী-সংসার সকলের মধ্যে থেকেও দেহব্যবসা চালিয়ে যায়৷ স্বামী বা পরিবারের কারুরই বাধা দেওয়ার প্রয়োজন নেই, নিয়মও নেই৷ দেহপসারিণীদের দেহের সেই হাট আকিঞ্চনের মতো মানুষদের প্রিয় স্থান৷ সেই স্থান আছে বলেই তার রক্ষা৷ নতুবা তার তীব্র পশুপ্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার কোনো উপায় খুঁজে পেত না৷ এ প্রসঙ্গে তার নিজের অভিমত—আনন্দের ক্ষেত্রটা তার বড় সীমাবদ্ধ৷ সেই পাড়াটা ছিল বলেই রক্ষা, নইলে মরুভূমিতে পড়ে বালি চেটে তাকে মরতে হত৷ এই দেহজীবী বাগ্দীবধূদের দেহসুধা পান করতে গিয়ে আকিঞ্চনের মাসে ত্রিশ-বত্রিশ টাকা ব্যয় হয়ে যায়৷

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) :

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাবুক ও অন্তর্মুখ৷ তাঁর সাহিত্যমনস্তত্ত্ব সম্পর্কে সুকুমার সেন বলেছেন—‘‘বিভূতিভূষণের বস্তু অভিজ্ঞতালব্ধ হইলেও বাস্তব নয়, তাঁহার দৃষ্টি স্বচ্ছ নয় বলিয়া তাহা রোমান্টিক৷ সে দৃষ্টিতে প্রকৃতি মানবজীবনের খেলাঘর অথবা পটভূমিকা নয়, মানবজীবনই প্রকৃতির খেলাঘর অথবা পটভূমিকা হইয়া প্রতিভাত৷’’ (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, ৫ম খণ্ড, পৃ-৩৪৬) নিসর্গের গহন সৌন্দর্যে ডুব দিয়ে অথবা পল্লীর সাধারণ দারিদ্র্য-জর্জরিত জীবনে অবগাহন করে তাঁর চরিত্রগুলি অসামান্য হয়ে উঠেছে৷ মানুষের অত্যন্ত সরল রূপগুলিকেই তিনি তাঁর রোমান্টিক উপলব্ধি দিয়ে আকর্ষণীয় করে তুলেছেন৷ যেমন ‘আরণ্যক’-এর কুন্তা, ‘বিপিনের সংসার’-এর কামিনী, ‘অথৈ জল’-এর খেমটাওয়ালি পান্না সকলেই তাদের সারল্যে, অকুন্ঠ আত্মপ্রকাশে পাঠকের মনকে মুগ্ধ করে ৷

ক. আরণ্যক :

বিভূতিভূষণ ‘আরণ্যক’-এ (১৯৩৯) বাঙালির দৈনন্দিন বাস্তবতায় ক্লিষ্ট নন, নিসর্গ বন্দনার নতুন মন্ত্র পেয়ে উল্লসিত৷ এখানে প্রকৃতি একটি বিশাল গহন অরণ্য৷ উপন্যাসের একটি বড় অংশ অরণ্যের বিভিন্ন অঞ্চলের রূপবৈচিত্র্য, ঋতুবৈচিত্র্যে প্রকৃতির রূপের বদল, এর শান্ত কোমলতা আবার রুক্ষ-শুষ্ক বিরূপতা৷

এই উপন্যাসের অন্যতম এক চরিত্র কুন্তা৷ উপন্যাসে চরিত্র হিসেবে এর উপস্থিতি কম কিন্তু গুরুত্ব অপরিসীম৷ কুন্তা কাশীর বিখ্যাত বাইজির মেয়ে৷ সে নিজে কখনো গণিকাবৃত্তি করেনি—একাধিক পুরুষের কন্ঠলগ্নও হয়নি কোনোদিন তারপরেও অসহ্য নরক যন্ত্রণা ভোগ করে তাকে জীবন কাটাতে হয়েছে শুধুমাত্র বাইজির মেয়ে বলে৷ সমাজে গণিকাদের অবস্থান সুস্পষ্টভাবে অবগত হবে কুন্তা চরিত্রটি অধ্যয়ন করলে৷ প্রবল প্রতাপশালী দেবী সিং রূপে মুগ্ধ হয়ে তার বাইজি মায়ের কাছ থেকে তাকে ভুলিয়ে নিয়ে এসেছিল—ঘর বেঁধেছিল৷ কিন্তু বাইজির মেয়ে হওয়ার দরুণ তাদের একঘরে হতে হয় এবং দেবী সিং-এর মৃত্যুর পর তার জীবনে চরম দারিদ্র্য নেমে আসে৷

খ. বিপিনের সংসার :

‘বিপিনের সংসার’-এ (১৯৪১) বর্ণিত বিষয় দাম্পত্য বহির্ভূত প্রেম৷ বিপিনের প্রতি মানী বা শান্তির প্রেম শুচিস্মিত প্রদীপ শিখার মতো৷ ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণের হাতে প্রেমের উগ্ররূপ যৌনতার রসে সিক্ত হতে খুবই কম দেখা যায়৷ উপন্যাসে দুজন স্বৈরিণী নারীর কথা আছে৷ একজন কামিনী গোয়ালিনি৷ অপরজন মতিবাগ্দী৷

কামিনী :

কামিনী উপন্যাসের নায়ক বিপিনের পিতা দুর্ধর্ষ নায়েব বিনোদ চাটুজ্জের প্রণয়িনী৷ সে গোয়ালা ঘরের মেয়ে—বালবিধবা, সুন্দরী৷ নিজের জীবন, যৌবন, প্রেম সব কিছু নির্দ্বিধায় সঁপে দিয়েছিল বিনোদ চাটুজ্জের পায়ে৷ বিনোদের সমস্ত প্রয়োজন-অপ্রয়োজন সবই সিদ্ধ করেছে সতী-সাধ্বীর মতো৷ সমাজে তাকে নিয়ে কানাঘুষো ছিল কিন্তু দুর্দান্ত চরিত্রের বিনোদের বিরুদ্ধে কারও মুখ খোলার সেদিন সাহস ছিল না৷ বিনোদের ভালোবাসার পাত্রী হয়ে সে কালোপেড়ে কাপড় পরতো, পান খেয়ে ঠোঁট রাঙা করে রাখতো, হাতে সোনার বালা ও অনন্ত পরতো এবং কালোচুলে খোঁপা বেঁধে সুসজ্জিত হয়ে থাকতো৷ অবৈধ হলেও, স্ত্রীর মর্যাদা না পেলেও সত্যিকারের ভালোবাসায় উদ্বেল ছিল তার হৃদয় তাই—‘‘বিনোদ চাটুজ্জে মহাশয় পরলোকগমন করিলে পর আর সে ভাল করিয়া হাসে নাই, ভাল করিয়া আনন্দ পায় নাই জীবনে৷’’১৮৪

বিনোদের সঙ্গে সম্পর্কের সুবাদে সে তার ছেলে বিপিনকেও পুত্রবৎ স্নেহ করত৷ বিপিন পিতৃপদে উপবিষ্ট হয়ে কর্মস্থলে এলে কামিনী তার খাবার তত্ত্বাবধান করেছে, বিপদে অর্থ সাহায্য করেছে এবং বিনা বাধায় পুত্রের সম্মুখে প্রণয়ীর যশোগান করে নিজের চিত্ত ব্যাকুলতাকে প্রকাশ করেছে৷ সে সমাজে সুস্থ কোনো সম্পর্কের মর্যাদা না পেলেও প্রেমে, ভালোবাসায় দায়িত্বে-কর্তব্যে মহীয়ান হয়ে উঠেছে৷

মতি :

মতি বাগ্দিনীও অল্প বয়সে বিধবা হয়েছিল৷ তার বাবা ভাসানপোতার বাগ্দী পাড়ার মধ্যে সচ্ছল লোক৷ বিধবা হয়ে বাপের বাড়িতে থাকলেও তার সচ্ছলতার অভাব হত না৷ সেখানকার মাইনর স্কুলের মাস্টার বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তীর সঙ্গে হৃদয় বিনিময় হয় তার বাবার জমা নেওয়া স্কুলের কাঁঠাল গাছ থেকে কাঁঠাল পারতে গিয়ে৷ আর সেই ভালোবাসার জোরেই সমস্ত সুখ-সচ্ছলতাকে দূরে ফেলে এককাপড়ে তার সঙ্গে ঘর ছাড়ে সে৷ যে বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তী একদিন নারীর ভালোবাসা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ ও উদাসীন ছিল, তার ভালোবাসায় নিজেকে সম্পূর্ণ নিমগ্ন করে সে অকপটে বিপিনকে বলে—‘‘আপনি তো জানেন আপনাকে বলেছিলাম মেয়েমানুষের ভালোবাসা কি জীবনে কখনও জানিনি৷ কিন্তু এখন আর সে কথা বলতে পারি নে ডাক্তারবাবু৷ ও বাগদী হোক, দুলে হোক ওই আমায় সে জিনিস দিয়েছে—যা আমি কারু কাছে পাইনি কোনো দিন৷’’১৮৫

মতি তার নিরাপদ আশ্রয় ত্যাগ করে শাক তুলে, মাছ ধরে তা বাজারে বিক্রি করে তাদের ভালোবাসায় গড়া ছোট্ট সংসারটিকে সচল রাখতে চায়৷ অন্ত্যজ শ্রেণীর হলেও তার হাতের রান্না বিশ্বেশ্বরের খেতে অরুচি হয় না৷ আর সে সম্পর্কে বলে—‘‘যে আমায় অত ভালবাসে, তার হাতে খেতে আমার আপত্তি কি?’’১৮৬ বিশ্বেশ্বর তার জন্য সব করেছে৷ নিজের অক্ষমতার মধ্যেও মতির অসুস্থতায় ডাক্তার দেখিয়েছে, নিজে আপ্রাণ সেবা করেছে৷ কিন্তু তার পরেও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি তাকে৷ এত গভীর যে সম্পর্ক দুই নরনারীর মধ্যে তার পরেও মতি তার রক্ষিতা৷ বিশ্বেশ্বর তাকে ভালোবাসার সর্বোচ্চ আসনে বসিয়েছিল কিন্তু সম্মানের সর্বোচ্চ আসনে বসাতে পারেনি—বিয়ে করে তাকে স্ত্রীর মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে পারেনি৷

এছাড়া পিতৃসম্পত্তি হাতে পেয়ে কুসঙ্গে পড়ে বিপিনের গণিকা বিলাসের কথাও তুলে ধরেছেন৷ বিপিন মানীর কাছে তার অতীত জীবনের স্বেচ্ছাচারকে তুলে ধরতে গিয়ে বলেছে যে সে তার স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে গণিকা নারীর টাকার ব্যবস্থা করেছে, তাদের আহ্লাদ পূরণ করতে গিয়ে চুরি করারও পরিকল্পনা করেছে৷

গ. দম্পতি :

‘দম্পতি’ উপন্যাসটির রচনাকাল ১৯৪৩৷ পরস্ত্রীর মোহে ছকে বাঁধা দাম্পত্যজীবনের ধ্বংসের এক চিত্র৷ সহজ সরল গ্রাম্য জীবনে পাটের আরতদার গদাধর বসু ও তার স্ত্রী অনঙ্গর মধ্যে সম্পর্কের কোনো খাদ ছিল না৷ বারবধূদের প্রতি বা চরিত্রহীনদের প্রতি ছিল তাদের তীব্র অশ্রদ্ধা৷ অনঙ্গের দাদা টাকা ধার নেওয়ার জন্য তাদের বাড়িতে একজন নারীকে নিয়ে উপস্থিত হলে অনঙ্গের মনে হয় সেই মেয়েটি নষ্ট চরিত্রের৷ চরম অশ্রদ্ধায় সেই মেয়েটির সম্পর্কে সে স্বামীকে বলে—‘‘আমি তাকে ঘরে দোরে ঢুকতে দিই নি৷ অমন ধরনের মেয়েমানুষ দেখলে আমার গা ঘিন ঘিন করে৷’’১৮৭ মেয়েটিকে তাই অনঙ্গ বাইরেই বসিয়ে রাখে৷ ভদ্রতার খাতিরে চা জলখাবার বাইরেই পাঠিয়ে দেয়৷

সেই অনঙ্গই স্বামীর ব্যবসার সুবাদে স্বামী সন্তানসহ যখন কলকাতায় বাস নেয় তখন নিজের চোখে ধীরে ধীরে স্বামীর অধঃপতনের চিত্র দেখতে থাকে৷ এখানে আছে সিনেমা অভিনেত্রীদের কথা৷ যেমন শোভারাণী মিত্র, সুষমা, রেখা ইত্যাদি নারীরা৷ লেখক এদের গণিকা হিসেবে দেখাননি গণিকার কোনো বৈশিষ্ট্যও এদের মধ্যে নেই৷ এই নারীসঙ্গ লাভের প্রত্যাশাতেই নিজের ব্যবসা জলাঞ্জলি দিয়ে সিনেমার কোম্পানি খুলে তার ও অনঙ্গের পরিপাটী করে গোছানো দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে তছনছ করে দেয় স্বামী গদাধর৷ এবং শেষে দেখা যায় শোভারাণীর ঘনিষ্টতা অর্জন করে জি. বোস নামে প্রতিষ্ঠিত হয়ে মোটর গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়—এবং তার স্ত্রী সন্তান গ্রামে অনাহারে অর্ধাহারে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝতে থাকে৷

ক্ষেত্রগুপ্ত বিভূতিভূষণ সম্পর্কে বলেছেন ‘‘লাম্পট্য ও বেপরোয়া স্ফূর্তিতে ধনসম্পদ নাশের চিত্রাঙ্কনও বিভূতির জন্য নয়’’১৮৮ অর্থাৎ গদাধরের লাম্পট্যের চরমতম দিক তুলে ধরা বিভূতিভূষণের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য নয় কিন্তু তার মধ্য দিয়েও তিনি যতটা তুলে ধরেছেন তাতে এতটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না যে শোভারাণী মিত্র শেষ পর্যন্ত গদাধরের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারিতায় লিপ্ত হয়ে তার সঙ্গে সিনেমা জগতে ভেসে গিয়েছে—সেখানে অনঙ্গের প্রবেশাধিকার নেই৷

ঘ. অথৈ জল :

পান্না :

‘অথৈ জল’-এর (১৯৪৭) নায়িকা পান্না খেমটাওয়ালি৷ লেখক তাঁর কল্পনাবিলাসের সোনার কাঠির স্পর্শে তাকে ত্যাগে, মহত্ত্বে, ভালোবাসায়, অকপট সরলতায় অনন্যমাত্রা দান করেছেন৷ তার যতটুকু পরিচয় লেখক তুলে ধরেছেন তাতে দেখা যায় পান্না মুজরাওয়ালি মায়ের সন্তান৷ তার প্রকৃত নাম সুধীরাবালা৷৷ বয়স ষোলো-সতেরো, অপূর্ব মুখশ্রী, টানা টানা ডাগর চোখদুটি স্বপ্নমাখা৷ সে খেমটা দলে মুজরা করে বেড়ায়৷ থাকে দমদমা, সিঁথি, এক বাড়িউলির বাগানবাড়িতে৷ বাড়িউলি মাসির নিয়ন্ত্রণে থেকে রুজি-রোজগার করে৷

উপন্যাসের নায়ক শশাঙ্ক ডাক্তার৷ বয়স চল্লিশের কাছাকাছি৷ ডাক্তারি করে প্রচুর রোজগার এবং পসার৷ চরিত্রবান সেই ডাক্তার সমাজে ভ্রষ্টাচারকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেয় না৷ স্ত্রী, দুই সন্তান নিয়ে সুখের জীবন তার৷ মঙ্গলগঞ্জে খেমটার আসরে পান্নাকে দেখে পরম মুগ্ধতায় তার নীতিবোধ সংস্কার সবকিছু মুহূর্তেই ওলোটপালট হয়ে যায়৷ মেয়েটির শরীরের গঠন, তার লীলায়িত অঙ্গভঙ্গি, চোখেমুখে বুদ্ধির দীপ্তি, সর্বোপরি সমবেত সকল দর্শকাদির মধ্যে থেকেও শুধু তার প্রতি পান্নার বিশেষ অনুরাগের চাহনি কথক শশাঙ্ককে আত্মহারা করে তোলে৷ অদ্ভুত এক আকর্ষণ ও মোহে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, পান্নাকে দেখবার জন্য উতলা হয়ে ওঠে তার মন৷ সেই আকর্ষণ আরও দৃঢ় হয় যখন আসরে প্যালা নিতে গিয়ে পান্না স্বেচ্ছায় তার অঙ্গুলিস্পর্শ করায় তার লীলায়িত ভঙ্গিতে৷ কথক সেই অনুভূতিকে ব্যক্ত করে বলে—‘‘ওর অঙ্গুলীর স্পর্শে আমার অতি সাধারণ একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন জীবন ভূমার আনন্দ আস্বাদ করল৷ অতি সাধারণ আমি অতি অসাধারণ হয়ে উঠলাম৷ আরও কি কি হোল, সে সব বুঝিয়ে বলবার সাধ্য নেই আমার৷… আমি হঠাৎ একি পেয়ে গেলাম? কোন অমৃতের সন্ধান পেলাম আজ এই খেমটা নাচের আসরে এসে? আমার মাথা সত্যিই ঘুরচে৷ উগ্র মদের নেশার মতো নেশা লেগেচে যেন হঠাৎ৷ কি সে নেশার ঘোর, জীবনভোর এর মধ্যে ডুবে থাকলেও কখনো অনুশোচনা আসবে না আমার৷’’১৮৯ পান্না একটু একটু করে তার মোহিনী মায়ায় ধীরে ধীরে গ্রাস করতে থাকে মধ্যবয়সি শশাঙ্ক ডাক্তারকে৷ এরপর পান্না তার স্বভাবতভঙ্গিতে ডাক্তারের ডিসপেনসারিতে অভিসারে আসে৷ আসরে নাচের সময় ডাক্তারের দুচোখের মুগ্ধ দৃষ্টি বুঝে নিয়েছিল এই কিশোরী পণ্যাঙ্গনা৷ ডাক্তারের প্রতি তারও আকর্ষণ কম ছিল না৷ জীবনে পুরুষ নিয়েই তার কারবার৷ উগ্রকামনায় পুরুষের তার শরীরকে ভোগের জন্য আত্মনিবেদন করা সে বহু দেখেছে কিন্তু ডাক্তারের মতো অমন মুগ্ধ বিস্ময় তার চোখে পড়েনি হয় তো৷ তাই খেমটার আসরে তার মন-প্রাণ-সত্তা সমর্পণ করে দিয়েছে ডাক্তারেরই পাদপদ্মে৷ নির্জন-নিভৃত-গভীর রাতে উদোম শরীরী বাসনা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে তার ডিসপেনসারিতে৷ সলজ্জভঙ্গিতে, অসম্পূর্ণ বাক্য দ্বারা প্রকাশ করেছে নিজেকে সমর্পণের কথা৷ পান্নাকে গ্রহণ করেনি ডাক্তার কিন্তু পান্না যখন যাওয়ার সময় বার বার তাকে বলে গেছে—‘‘সন্দের পর কাল আরম্ভ হবে তো? আপনি আসবেন, কেমন তো? তার পরেই মাথা দুলিয়ে বললে—ঠিক, ঠিক, ঠিক৷ যাই—’’১৯০ তখন তার সঙ্গে নিজের মনটাকেও বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে৷ গল্পের কথক ডাক্তার তার সেই লাগামছেঁড়া মনের অবস্থাকে সুন্দরভাবে বর্ণনা করে বলেছে—‘‘নৌকো ছাড়লো, আমি শুয়ে রইলাম চোখ বুজে কিন্তু কেবলই পান্নার মুখ মনে পড়ে,—তার সেই অদ্ভুত হাসি, সকুন্ঠ চাউনি৷ লাবণ্যময়ী কথাটা বইয়ে পড়ে এসেছি এতদিন, ওকে দেখে এতদিন পড়ে বুঝলাম নারীর লাবণ্য কাকে বলে, কি যেন একটা ফেলে যাচ্ছি মঙ্গলগঞ্জের বারোয়ারি-তলায়, যা ফেলে আমি কোথাও গিয়ে শান্তি পাবো না৷’’১৯১ মঙ্গলগঞ্জের বারোয়ারি তলার শেষ খেমটার আসরে পান্নার সত্যিকারের মানসিক অবস্থাটা জানার জন্য নিজেকে একটু আড়াল করে রাখে ডাক্তার৷ পান্না আসরে উঠে চারিদিকে দৃষ্টি বুলিয়ে খুঁজতে থাকে তাকে৷ নাচ ও গান করার সময়ও পান্না তাকেই খুঁজতে থাকে অবশেষে দেখতে না পেয়ে তার চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রভ হয়ে যায়—সব কিছুর যেন মানে হারিয়ে যায় তার কাছে৷ কথক নিজেকে আড়াল করেই সরে আসে তার ডিসপেনসারিতে৷ হঠাৎ দরজায় করাঘাত শুনে দরজা খুলে দেখে আসরের সেই ঝলমলে চোখভোলানো সাজেই সে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে৷ তার আত্মনিবেদনের আকুতিতে, সস্তা সেন্টের তীব্র গন্ধ ঘরটাকে ভরিয়ে দিয়েছে৷ এভাবে পান্না সময়ে-অসময়ে তার ঘরে উপস্থিত হয়ে তার কিশোরীর সলজ্জভঙ্গিতে ডাক্তারকে মুগ্ধ করে শেষপর্যন্ত তাকে অনুরোধ করে তার সঙ্গে কলকাতায় যাওয়ার জন্য৷ ডাক্তার অপার মুগ্ধতায় কোনো দ্বিরুক্তি না করেই বেড়িয়ে যায় তার সঙ্গে৷

পান্নার কলকাতার মাসির বাড়িতে আসার পর তার আরেক রূপ স্পষ্ট হয় মাসির কথার মধ্য দিয়ে৷ সে তার রূপ-জৌলুসে পতঙ্গের মতো পুরুষকে আকর্ষণ করে৷ কত ধনী-যুবা, প্রৌঢ় তার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত৷ সে যেমন মুজরা করে অর্থ উপার্জন করে তেমনি মাসির বাড়িতে থাকাকালীন সময়ে দেহের পসরা সাজিয়ে নিজের ঘরে খদ্দের ডেকে আনে৷ অর্থাৎ খেমটার দলের নর্তকী গায়িকার বাইরে সে পাকা দেহব্যবসায়ী৷ মাসির ডাক্তারকে বলা কথার মধ্য দিয়ে সে দিক স্পষ্ট—‘‘এ ঘরে তুমি থাকতে পারবে না৷ ওকে রোজগার করতে হবে, ব্যবসা চালাতে হবে৷ ওর এখানে লোক যায় আসে, তারা পয়সা দেয়৷ তুমি ঘরে থাকলে তারা আসবে না৷’’১৯২ শুধু তাই নয় পান্না তার সুন্দর রূপবান দেহটিকে নিয়ে যেখানেই গিয়েছে খেমটাওয়ালি হিসেবে সেখানেই তার পিছনে মাছির মত ভনভন করেছে শরীরলোভী স্তাবক দল৷ ডাক্তারকে নিয়ে জীবন শুরু করার পর সে যখন খেমটা নেচে উপার্জন অব্যাহত রেখেছে বেঁচে থাকার জন্য তখন বেথুয়াডহরি গ্রামের বারোয়ারি যাত্রায় খেমটাওয়ালি হিসেবে দল নিয়ে উপস্থিত হলে সেখানকার নায়েব জোয়ারদার মশাই তাকে দেখে প্রৌঢ়ত্বের মধ্যেও লালসায় অধীর হয়ে উঠেছে৷ দলের রসুই বামুন পরিচয়ধারী ডাক্তারকে উপঢৌকন দিয়ে বলেছে—যে ভাবেই হোক সে যেন পান্নাকে রাজী করিয়ে তার সঙ্গলাভের ব্যবস্থা করে দেয়৷ একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় কেশবডাঙা নামে এক গঞ্জের বারোয়ারির আসরে৷ সেখানে পল্লীকবি হিসেবে খ্যাত ঝড়ু মল্লিক পান্নাকে দেখে তাকে ভোগের জন্য লালসায় অধীর হয়ে ডাক্তারকে ডেকে পাঠায় দালালি করার জন্য৷ মেয়েটিকে ভোগের জন্য পঁচিশ টাকা পর্যন্ত দর হাকে৷ পান্না নিজেও যে সতী নয়, অর্থের জন্য দেহবিক্রয় করেছে সে কথা অকপটে স্বীকার করে নিজের জীবনের এক কাহিনি শোনায় ডাক্তারকে৷ সেখানেও তার প্রতি এক জমিদারকুমারের লোলুপতার ছবি৷ ভবনহাটি তালকোলার জমিদার-বাড়িতে জমিদারের ভাইপোর বিয়েতে মুজরা করতে গেলে বিয়ের বরই তাকে পাওয়ার জন্য ক্ষেপে ওঠে৷ সে তার হাতে নিজেকে সমর্পণ করে, সারারাত তার সঙ্গে নৌকাবিহারে কাটায়৷ ছেলেটি তাকে তার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার জন্য বহু অনুনয়-বিনয় করে৷ সদ্য বিবাহিত যুবক, তখনো বোধ হয় তার ফুলশয্যা হয়নি তার সঙ্গে পালিয়ে যেতে মন সরে না পান্নার৷ তাই সে হাজার টাকা খোরপোষ চায় মাসে৷ অর্থাৎ হাজার টাকার বিনিময়ে তার রক্ষিতা হয়ে থাকতে রাজী সে৷ বাবা-কাকার জমিদারিতে সে টাকা দিতে অপারগ সেই যুবক৷ শেষে নববধূর গায়ের থেকে তিনহাজার টাকার গহনা চুরি করে এনে তাকে দিতে চায়৷ নব পরিণীতার শরীর থেকে গয়না চুরি করে এক বারবনিতাকে খুশি করার মানসিক প্রবণতায় তার উপর গা ঘিনঘিন করে পান্নার৷ নির্দ্বিধায় তাকে ছেড়ে চলে আসে সে৷ তারপর মাসির মুখে শুনেছে পরেশ বাবুর প্রসঙ্গ৷ পান্নার মোহে আকৃষ্ট হয়ে সে তার পিছু পিছু চলে এসেছিল পান্নার বাসায়৷ পনেরোদিন পার হয়ে গেলেও তার সেখান থেকে নড়ার নাম নেই৷ পান্নাকে বিয়েও করতে চায় সে৷ শেষ পর্যন্ত পান্না আমল না দেওয়ায় তাকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় সে৷ মাসি পান্নার সেই পুরুষ আকর্ষণের মোহময়ী ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নিজে উপার্জন করে৷ তার প্রতি পুরুষদের আকৃষ্ট হওয়া সম্পর্কে মাসি বলে—‘‘ও ছুঁড়ি যখনই বাইরে যায়, তখনই ওর পেছনে কেউ না কেউ… তা অমন কত এল, কত গেল৷’’১৯৩

এই রূপবতী খেমটাওয়ালি তার শরীরের হিল্লোলে যেমন সহজেই পুরুষের মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে তেমনি তার নিজের উপার্জনও কম নয়৷ পান্নার জন্যই তাদের খেমটা দলের অত পসার, অনেক বেশি টাকা বায়না দিয়ে তাদের দলকে বড় বড় জায়গা থেকে আমন্ত্রণ করে৷ তার মতো একজন সরলমনের উপার্জনকারিণী মেয়েকে আকৃষ্ট করার ক্ষমতা দেখে নীলিমা ডাক্তারকে বলে—‘‘পান্নাকে গেঁথেচেন ভাল মাছ৷… তবে আপনার ক্ষমতা আছে৷ অনেকে ওর পিছনে ছিল, গাঁথতে পারে নি কেউ৷ আমি তো সব জানি৷ হরিহরপুরে একবার মুজরো করতে গিয়েছিলাম, সেখানকার জমিদারের ছেলে ওর পেছনে অনেক টাকা খরচ করেছিল৷ তাকে ও দূর করে দিয়েছিল এক কথায়৷ তাই তো বলি, আপনার ক্ষমতা আছে৷’’১৯৪ অর্থাৎ একজন উঠতি বয়সি সুন্দরী বারাঙ্গনার ভালোবাসা অর্জন করাও সবার পক্ষে সম্ভব হয় না; টাকা থাকলেও নয়৷ পান্না দলের জন্য অপরিহার্য আসরে নৃত্যগীত পরিবেশনের সময়ও প্রচুর প্যালা লাভ করে ৷ বেথুডহরির নায়েব মশাই তো রুমালে বেঁধে দশ টাকা প্যালাই দেয়৷ দলের সবচেয়ে বেশি প্যালা সে পায়৷ তার প্যালার অংশ তার নিজেরই, সেখানে কেউ ভাগ বসাতে পারে না৷ সে তার শরীরী ক্ষমতায় নিজে ঠিকঠাক পরিশ্রম করলে নব্বই টাকা থেকে একশত টাকা রোজগার করতে পারে৷ এবং সেই গরবে অনায়াসে ডাক্তারকে নিজের করে পেতে, ডাক্তারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব সব নিজের কাঁধে নেয় এবং ডাক্তারকে সে প্রসঙ্গে বলে—‘‘যদি ঠিক-মত বায়না হয়, খাটি, তবে মাসে নব্বই টাকা থেকে একশো টাকা৷ তোমার ভাবনা কি?’’১৯৫

পান্নার মধ্যে লেখক সবচেয়ে বেশি করে দেখিয়েছেন তার অকপট সরলতা৷ যে শ্রেণীতের মানুষ, যে পরিবেশে বড় হয়েছে, তা সবই স্বার্থ ও প্রবৃত্তির ঘেরাটোপে আবদ্ধ৷ বারবনিতা হওয়ার সুবাদে সেই বুদ্ধিটুকুও অজ্ঞাত নয় যে যতক্ষণ তার রূপ থাকবে ততদিনই কদর—শরীর ভেঙ্গে গেলে, যৌবন অতিক্রান্ত হলে তার শরীরকে, তাকে কেউ ফিরেও দেখবে না৷ তারপরেও ভবিষ্যতের জন্য যেন তার কোনো ভাবনা নেই৷ সে এক মুজরার আসরে ডাক্তারকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসে তার কলকাতার বাসায়৷ মাসির সাথে বিরোধ করতেও তার বাধে না৷ ডাক্তার যতবার তাকে বাস্তবজীবন সম্পর্কে সচেতন করে দিতে চেয়েছে—ততবারই সে আপন স্বপ্নবলয়ের মধ্যে আরও বেশি করে ডাক্তারকে জড়িয়ে ফেলেছে৷ কোথায় থাকবে, কি খাবে, কি করে চলবে তা নিয়ে যেন তার কোনো ভাবনা নেই—চিন্তা নেই৷ ডাক্তারের সঙ্গে উদ্দেশ্যহীনভাবে ভেসে বেরানোতেই যেন তার আনন্দ৷ সে এক ব্যতিক্রমী৷ তার ব্যতিক্রমী সত্তাকে তুলে ধরতে কথক বলেন—‘‘আমাকে অবাক করে দিয়েচে পান্না৷ ওর শ্রেণীর মেয়েরা শুনেচি কেবলই চায়, পুরুষের কাছ থেকে শুধুই আদায় করে নিতে চায়৷ কিন্তু ও তার অদ্ভুত ব্যতিক্রম৷ নিজের কথা কিছুই কি ও ভাবে না৷ আমার মত একজন বড় ডাক্তারকে গেঁথে নিয়ে এল, এসে কিছুই দাবি করলে না তার কাছে, বরং তাকে আরও নিজেই উপার্জন করে খাওয়াতে চলেচে৷’’১৯৬

ডাক্তারের কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পণ করেছে সে৷ অকূলে ভাসার জন্য তৈরি হয়ে ডাক্তার যখন বলে তাকে না খাইয়ে গাছতলায় রাখার কথা তাতেও আপত্তি নেই তার৷ শুধু সেটুকুই নয় প্রেমের আবেশে অকপটে বলে ওঠে সে যদি নিজের হাতে তাকে মেরেও ফেলে তারপরেও সে টু’শব্দটি করবে না৷ পান্নার বাড়িতে এসে গণিকাপল্লীর সংকীর্ণ পরিবেশে এবং মাসির বাক্যবাণে ডাক্তার যখন সেখান থেকে চলে যেতে চায় পান্নাকে নিয়ে তাতেও সে যেমন বারণ করে না তেমনি মুজরা, দেহব্যবসা বন্ধ করতে বললেও সে জিজ্ঞেস করে না ‘খাবো কি’ বা ‘চলবে কিসে’৷ সে যেভাবে পান্নাকে চলতে বলে পান্না সেভাবেই চলতে রাজী, উল্টো কোনো প্রশ্ন করে না—প্রশ্ন করে বিরক্ত করে না৷

মাসির বাক্যবাণ থেকে রেহাই পেতে পান্না ডাক্তারের সঙ্গে বেড়িয়ে যায় লেবুতলার এক ক্ষুদ্র গলির বাসায়৷ সেখানে অগোছালো ঘরকন্নায় সে নিজের হাতে তার বহুকষ্টের উপার্জিত অর্থ নিঃশেষে দান করতে থাকে৷ সেই ‘নেই’ এর সংসারেও তার আনন্দের শেষ থাকে না৷ সবতাতেই তার যেন আনন্দ৷ জল খাওয়ার জন্য গ্লাস নেই তাতেও তার ভারি মজা৷ আবার কথক তার দূরদর্শিতা দিয়ে যখন তাকে বোঝায় তখন সে পাকা গিন্নির মতোই সচেতন হয়ে ওঠে৷ বলে—‘‘তাইতো কি করা যায় তাই ভাবচি৷’’১৯৭ মাদুরে ঘুমিয়ে, শালপাতায় খাবার খেয়ে তাদের নতুন ঘরকন্না অভাব-অনটনের মধ্যেও জমে ওঠে৷ সব শূন্যতা পূরণ করে দেয় তাদের পরস্পরের নির্ভরযোগ্য ভালোবাসা৷ সেই ভালোবাসায় সচ্ছল গৃহস্থের ছেলে, ডাক্তার হিসেবে প্রভূত অর্থের উপার্জনকারী হয়েও পান্নার সঙ্গে মাদুরের উপর বসে শালপাতার ঠোঙায় কচুরি খেয়ে যে আনন্দ পেয়েছিল সে আনন্দও তৃপ্তি সে তার সারা গৃহস্থ জীবনে কখনো কোথাও পায়নি৷ পান্না খেমটাদলে নাচ-গান করে, মুজরা করে তার প্রণয়ীকে চালাবার সাহস রাখে৷ তার দলের অপর নারী নীলিমা যখন তাদের সাংসারিক দুরবস্থা দেখে ডাক্তারকে তিরস্কার করে পান্নাকে দলছাড়া করে এনে কষ্ট দেওয়ার জন্য তখন পান্না নিজের সারল্য দিয়ে ডাক্তারের সে দোষ ঢেকে ফেলে৷ নীলিমাকে অনুযোগ করে বলে—‘‘ওর ওপর কোনো কথা বলবার তোমার দরকার কি নীলি? ধরো ও পুরুষ মানুষকে আমি নড়তে দেবো না৷ আমাকে মুজরো করে চালাতে হবে৷ এখন কি দরকার তাই বলো৷’’১৯৮ সে নীলিমা যা বলে করেও তাই৷ নীলির সঙ্গে গিয়ে মুজরা করে অর্থ রোজগার করে, সেই অর্থ দিয়ে তাদের দুজনের নতুন পাতা সংসার দিব্যি চালিয়ে নেয়; পূরণ করে ডাক্তারের নানা শখ আহ্লাদ৷

প্রণয়ী সঙ্গে থাকলে পান্না নিজেকে তার নৃত্যকলায় উজাড় করে দিতে পারে৷ তার নাচের জন্য ডাক্তারের প্রশংসা করে বলে—‘‘নীলি কি বলচে জানো? বলচে তোমার জন্যেই নাকি আমার নাচ ভাল হচ্চে৷’’১৯৯ রসুইঠাকুর হিসেবে সে তাদের দলের সঙ্গী হয়ে গেলেও তার কষ্ট হবে জন্য রান্না করতে দেয় না পান্না৷ দর্শকের মনোরঞ্জন করে আসর শেষ করার পর ক্লান্ত শরীরে রান্না করতে রাজী তবু প্রেমাস্পদকে সামান্য কষ্ট দেবে না৷ শুধু তাই নয় বাসাবাড়িতেও সে কি খাবে কি পড়বে নিজের পয়সায় নিজে তাগিদ নিয়ে তত্ত্বাবধান করে৷ কোনো কিছুর জন্য পয়সার দরকার হলেই সে নির্দ্বিধায় দেখিয়ে দেয় তার ক্যাশবাক্স অর্থাৎ একটা পাউডারের খালি কৌটো৷ অচেনা অজানা একজন মানুষ তার ক্ষতি করে সমস্ত পুঁজি-উপার্জন নিয়ে চলে যেতে পারে বলেও তার কোনো ভয় নেই—নিলেও যেন কোনো আক্ষেপ নেই৷ এ প্রসঙ্গে ডাক্তার তাকে সাবধান করে দিলে সে সাবলীলভাবে জবাব দেয়—‘‘তোমার মত পুরুষ মানুষে পারে না৷’’২০০ কতখানি ভরসা একজন আরেকজনকে করলে এরকম কথা বলতে পারে—তা পান্নার নিজের অভিজ্ঞতার একটা গল্পতে আরও স্পষ্ট হয়৷ পান্নার বয়স কম হলেও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা কম নয়৷ নিজে বারবনিতা; হীনরুচির মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ৷ ফলে একজন অচেনা-অজানা মানুষকে বিশ্বাস করার ফল কি হতে পারে তাও জানে৷ তবুও বিশ্বাসই সে করে৷ নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করেছে যার কাছে তাকে যদি সে ভরসা-বিশ্বাস না করে তো কাকে করবে! সে শোনায় তাদের পাড়ার শশীমুখী পিসির গল্প৷ রামবাবু বলে একজন লোক ছিল তার প্রণয়ী৷ অনেকদিন থেকেই সে শশীমুখীর সঙ্গে থাকতে শুরু করেছে৷ সে মদ খেত, পিসির জন্য বাজার থেকে হিংয়ের কচুরি আনতো৷ সেই রামবাবুই এক কালীপুজার রাতে তাকে খুন করে তার সর্বস্ব নিয়ে পালিয়ে যায়৷ তাদের জীবনের সেই অস্তিত্বহীনতায় পান্নারও যে বুক কাঁপে না তা নয়, তার পরেও তার অন্তরাত্মা সর্বদা বলতে থাকে ডাক্তার যতক্ষণ তার সঙ্গে আছে তার কোনো ভয় নেই৷

পান্না জানে সে তার সাতপাঁকের বৌ নয় তাই স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যের মতো সে তার নিজের দায়িত্ব কিছুতেই দিতে চায় না ডাক্তারকে৷ ডাক্তারের রোজগারহীনতার হীনমন্যতায় তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে—‘‘আমি কি তোমাকে কষ্টে রেখেছি? সুখে রাখতে পারচি নে? হ্যাঁ গা, সত্যি করে বলো৷ আমি আরও পয়সা রোজগারের চেষ্টা করবো৷’’২০১ সে আরও বলে সে তার সাতপাঁকের বৌ নয়—যেখানে তার দায়িত্ব ডাক্তারকে নিতেই হবে৷ বিনম্র বচনে তাকে বলে—‘‘তুমি ও সব নিয়ে মাথা ঘামিও না লক্ষ্মীটি৷ বোলো যখন যা দরকার, আমি চেষ্টা করবো যুগিয়ে দিতে৷ আমার মাসিক আয় কত বলো দিকি? আশি নব্বুই কি একশো টাকা৷ দু’টো প্রাণীর রাজার হালে চলে যাবে৷’’২০২ সে দায়িত্বশীল অভিভাবকের মতো প্রণয়ীকে সুখে রাখতে সর্বদা বদ্ধপরিকর৷ শুধু এটুকুই নয়, পান্নার যেন অগাধ বিশ্বাস সে পুরুষদের খুব ভালো করে চেনে—ওদের শখ, আহ্লাদ ভালো করে বোঝে; তাই জুতো, জামা, নানারকম খাবার দিয়ে ডাক্তারের অভাব মোচনের চেষ্টা করে এবং সব সময় বলে—‘‘তোমরা কি চাও, আমি সব জানি—’’২০৩

কিন্তু পান্নার ভালোবাসার ভিত্তির উপর সাজানো ঘরকন্না বেশিদিন স্থায়ী হয় না৷ হঠাৎ পুলিশের অঘোষিত আগমনে তছনছ হয়ে যায় সেই সুখের ঘর৷ ডাক্তারের উপর চূড়ান্ত অভিযোগ তার মায়ের৷ সে নাকি তার নাবালিকা মেয়েকে আটকে রেখেছে তার নিজের কাছে৷ পান্না সমস্তটা শোনে ডাক্তারের কাছে৷ যখন বোঝে সে স্বেচ্ছায় চলে গেলে পুলিশ প্রণয়ীর কোনো ক্ষতি করবে না তখন অনায়াসে রাজী হয়ে যায় ফিরে যেতে৷ সে যথার্থ ভালোবাসে; ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে৷ প্রণয়ীকে কোনো অসম্মান সে করতে দিতে পারে না৷ তাই যাওয়ার সময় তার সমস্ত টাকা পয়সা রেখে যায় প্রণয়ীর জন্য৷ যে মুগ্ধ আকর্ষণে পান্নার সঙ্গে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল ডাক্তার সেই মুগ্ধতার মধ্যে নারীমনকে, নারীমনের ভালোবাসাকে বোঝার ক্ষমতা হয় তো ডাক্তারের ছিল না৷ তাই পান্নার সেই আত্মত্যাগ অনুভব করতে পারে না সে৷ পান্না চলে গেলে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে থেকে সে ভাবে—‘‘যাকগে৷ প্রলয় মন্থন করে আমি জয়লাভ করবো৷ ঘর ভাঙুক, দীপ নিবুক, ঘট গড়াগড়ি যাক৷ ও সব মেয়ের ওই চরিত্র৷ কি বোকামি করেছি আমি এতদিন৷’’২০৪

নীলিমা :

নীলিমা বা নীলি পান্নার খেমটাদলের সহগায়িকা৷ তার বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের কম নয় বরং বেশিই হতে পারে৷ গায়ের রং এর জৌলুস অনেকটা কমে এসেছে৷ মঙ্গলগঞ্জের বারোয়ারি অনুষ্ঠানে সে পান্নার সহগায়িকা হয়ে গিয়েছিল৷ নীলিও দরিদ্র৷ পান্নার সঙ্গে তুলনা করলে তার চেয়ে গরিবই সে৷ নীলির বড়দিদি সুশীলা; মুখে বসন্তের দাগ কটা বাদ দিলে তাকেও সুশ্রী বলা চলে৷ এছাড়া বিধবা মা রয়েছে নীলির সংসারে৷ নীলি খেমটা নাচের পাশাপাশি দেহব্যবসাও চালায়৷ বেথুয়াডহরির নায়েববাবু কামনা পরিতৃপ্তির জন্য পান্নাকে চাইলে পান্না নীলির কথাই বলে৷ অর্থাৎ আসর শেষ হয়ে পুরুষের লালসা মিটিয়ে কিছু উপরি উপার্জনও নীলি করে থাকে৷ দলে নীলির কদর কম৷ নীলিও স্বীকার করে যে পান্নার জন্যই ওদের দলের বায়না আসে—পান্নাকে সকলেই চায়৷ নিজের স্বল্পতম উপার্জন দিয়ে তার পরিবারটিকে সে প্রতিপালন করে৷ আসরে তার নামে প্যালা পড়ে না বললেই চলে৷ বায়নার অর্ধেক টাকা সে পেলেও প্যালা না পাওয়ায় তার উপার্জনও কম হয়৷

নীলিমা পান্নার যথার্থই হিতকারিণী৷ পান্নার সমস্ত খবর শুনে মুজরার বায়নার মিথ্যে অজুহাত বলে সে ডাক্তারের সঙ্গে তার নতুন বাসায় উপস্থিত হয়—সংসারের দৈন্য দুর্দশা দেখে ডাক্তারকে তিরস্কার করতে তার বাধে না৷ সে বলে—‘‘এই অবস্থায় ওকে নিয়ে এসে রেখে দিয়েচেন?’’২০৫ পান্নাকে সে ভালো করেই চেনে৷ তার সরলতা সম্পর্কেও যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে তার৷ তাই ডাক্তারকে ব্যঙ্গ করে বলে—‘‘পান্নাকে গেঁথেচেন ভাল মাছ৷ আমি ওকে জানি৷ ভারি সাদা মন৷ নিজের জিনিসপত্তর পরকে বিলিয়ে দেয়৷’’২০৬ পান্নার চেয়ে নীলির জীবন অভিজ্ঞতা অনেক বেশি৷ তার চেয়ে বয়স বেশি ও রূপ কম হওয়ার দরুণ তার জীবনের লড়াইটা আরও বেশি কঠিন৷ তাই পান্নার ছেলেমানুষিকে সে প্রশ্রয় দিতে চায় না৷ তাকে সাবধান করে দিয়ে বলে—‘‘এ সব কি আবার ঢং৷ ও বাবু কি তোকে চিরকাল এমনি চোখে দেখবে? তুই নিজের পসার নিজে নষ্ট করতে বসেচিস—’’২০৭ পান্নার চেয়ে নীলি বাস্তবধর্মী৷ গণিকা জীবন অভিজ্ঞতার বাস্তব রূপটি তার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে৷

সুশীলা :

সুশীলাও নীলির মতো হিসেবি৷ বোনের রোজগারে জীবন চালাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই৷ নীলির মুজরার বায়না এলে সে খুশি হয়৷ তাই যখন ডাক্তার তাকে মিথ্যে করে বলে যে সে মুজরার বায়না নিয়ে এসেছে তখন ডাক্তারকে সে খাতির করে এবং নীলিকে তার সঙ্গে পাঠানোর সময় পাকা ব্যবসায়ীর মতো দুটি টাকাও চেয়ে রেখে দেয় সে৷

মাসি :

এই উপন্যাসের আরেক অন্যতম চরিত্র বাড়িউলি মাসি৷ প্রচণ্ড হিসেবি ও ব্যবসায়ী মন তার৷ ব্যবসার কোনো ক্ষতি সে সহ্য করতে পারে না৷ পান্না তার বাড়িতে থাকে৷ তাদের ভাড়া খাটিয়ে মাসির উপার্জন৷ পান্নার মতো নারীদের এই স্বার্থেই খোরপোষ দিয়ে আটকে রাখে সে৷ মঙ্গলগঞ্জ থেকে মুজরা করে ফেরার সময় পান্নার সঙ্গে শশাঙ্ক ডাক্তার এসে উপস্থিত হলে মাসির বিরক্তির শেষ থাকে না৷ সে পান্নার অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে তার সমস্ত অভিপ্রায় জানার চেষ্টা করে৷ পান্নার ব্যবসার কথা ভেবে এবং সে থাকলে তার রোজগারের ক্ষতি হবে জেনে ডাক্তারকে সাবধান করে দিয়ে বলে—‘‘একটা কথা বলি৷ স্পষ্ট কথার কষ্ট নেই৷ এ ঘরে তুমি থাকতে পারবে না৷’’২০৮ সে তাকে আরও জানায় যে পাড়াগাঁয়ের মানুষ শহরে এসেছে—দু-চারদিন শহর ঘুরে যেন চলে যায়৷ পান্না তার কথায় বিরক্ত প্রকাশ করে প্রতিবাদ করলে বুড়ি হাত-পা নেড়ে তাকে জানায়—‘‘এখন অল্প বয়েস, বয়েস দোষ যে ভয়ানক জিনিস? হিত কথা শুনবি তো এই মাসীর মুখেই শুনবি—বেচাল দেখলে রাশ কে আর টানতে যাবে, কার দায় পড়েচে?’’২০৯ পান্নাকে নিয়ে গঙ্গায় নাইতে যাওয়ার কথা শুনে বুড়ি খিঁচিয়ে ওঠে৷ ব্যঙ্গ বিদ্রুপে তাকে জর্জরিত করে ফেলে৷ অবশেষে তাকে জানায়—‘‘অত দরদ যদি থাকে পান্নার ওপর, তবে মাসে ষাট টাকা করে দিয়ে ওকে বাঁধা রাখো৷ ওর গহনা দেও, সব ভার নাও—তবে ত তোমার সঙ্গে যেখানে খুশি যাবে৷ ফেলো কড়ি মাখো তেল, তুমি কি আমার পর?’’২১০

মাসি আপ্রাণ চেষ্টা করেছে পান্নার কাছ থেকে ডাক্তারকে সরাতে৷ সে চলে যাওয়ার পর যখন আবার ফিরে আসে পান্নার কাছে৷ তাকে বাড়িতে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে যায় মাসি৷ সে রেগে গিয়ে বলে—‘‘তোমরা সবাই মিলে ও ছুঁড়ীর পেছনে পেছনে অমন ঘুরচো কেন বলো তো? তোমাদের পাড়াগাঁ অঞ্চলে মেয়েকে পাঠালেই এই কাণ্ড গা? জ্বলে পুরে মনু বাপু তোমাদের জ্বালায়৷ আবার তুমি এসে জুটলে কি আক্কেলে?’’২১১ তার পর বুড়ি তাকে বলে যে তাকে এর আগে ভালো করে বোঝানোর পরেও সে কেন বার বার আসছে৷ এসব জায়গায় এলে বিস্তর টাকা-পয়সার দরকার৷ সে যথেষ্ট পরিণত মানুষ হয়েও কেনই বা একজন বহুবল্লভার জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাইছে৷ তাছাড়া পাড়াগেঁয়ে মানুষ শহুরে বাবুদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে৷ সে যেন ভালোয় ভালোয় বাড়ি চলে যায়৷ কিন্তু সে মুহূর্তে পান্না উপস্থিত হয়ে তাকে তিরস্কার করলে বৃদ্ধা পান্নার দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে—‘‘দ্যাখ পানু বাড়াবাড়ি কোন বিষয়ে ভাল না৷ দু’জনকেই হিত কথা শোনাচ্চি বাপু,—কষ্ট পেলে আমার কি, তোরা দুজনেই পাবি—’’২১২

পান্না মাসির সোনার ডিম পারা হাঁস৷ কিছুতেই সে তাকে হারাতে চায় না বা রাগাতে চায় না৷ তাই যতবারই সে ডাক্তারকে সাবধান করতে গিয়েছে, তিরস্কার করেছে সবই তার অনুপস্থিতিতে৷ অপরদিকে ডাক্তারকে না তাড়ালেও তার নয় নইলে পান্নার দ্বারা উপার্জন করা তার আর সম্ভব হবে না৷ রচনাকার দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কন করেছেন মাসি চরিত্রটিকে৷ স্বার্থ রক্ষার চেষ্টায়, বাস্তববোধে চরিত্রটি বাস্তব রসসিক্ত হয়ে উঠেছে৷

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১) :

বাংলা উপন্যাসের আঙিনায় তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রবাদপ্রতিম ঔপন্যাসিক৷ বীরভূমের সাধারণ জনজীবন, অনতিপ্রাচীন স্থানীয় ঐতিহ্য, গল্পকাহিনি ও কিংবদন্তি ইত্যাদিকে অবলম্বন করে সাহিত্য জগতে তাঁর পদসঞ্চারণ৷ এই ধারাপথেই তিনি বিভিন্ন উপন্যাসাদির মধ্যে অঙ্কন করেছেন গণিকাজীবনের বিচিত্র চিত্র৷

ক. নীলকন্ঠ :

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকন্ঠ’ (১৯৩৩) উপন্যাস পারিবারিক জীবনের আলেখ্য৷ এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে এক গৃহবধূর গণিকা হয়ে উঠার নির্মম কথা৷ উপন্যাসের নায়ক শ্রীমন্ত বাল্যকাল থেকেই যেমন চাতুর্যহীন তেমনি বোকাটে৷ নিজের সুবিধা-অসুবিধা ভালোমন্দ বোধটুকুও যেন তার নেই৷ তার মধ্যে ভাবালুতা ও আবেগের বাড়াবাড়ি৷ তার স্ত্রী গিরিবালা বা গিরি৷ বাস্তব বুদ্ধি ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন এই নারী কীভাবে জীবনের নিষ্ঠুর পরিহাসে দেহব্যবসায় লিপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বনে নির্মম পরিণতি প্রাপ্ত হয় তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করেছেন রচনাকার৷

বাপ-মা মরা এবং খুড়ো-খুড়ির ঝাঁটা-লাথি খেয়ে মানুষ হওয়া গিরিবালা শ্রীমন্তের ঘরে লক্ষ্মী হয়ে এসেছিল বারো-তেরো বছর বয়সে৷ শ্বশুর-শাশুড়ি, মা-মরা—বাবার উপেক্ষিত ননদের চারবছরের মেয়ে গৌরীকে নিয়ে সুখী জীবন তার৷ স্বামীর প্রেম-সোহাগে পরিপূর্ণ তার দাম্পত্য জীবন৷ তার জীবনের একটাই অতৃপ্তি সে বাঁজা৷ মৃত্যুর আগে তা নিয়ে শাশুড়িরও আক্ষেপের শেষ ছিল না৷ তার সেই শূন্য নারীজীবনের বাৎসল্য রস পিপাসা কানায় কানায় পূর্ণতা পেতে শুরু করেছিল গৌরীকে ঘিরে৷ গৌরীই তাদের জীবনের সমস্ত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছিল৷ কিন্তু সেই সুখের জীবন তার বেশিদিন স্থায়ী হয়নি৷ গৌরীর বাবার এক অন্ধ পাত্রের হাতে মেয়েকে সমর্পণ করাকে কেন্দ্র করে তার জীবনের সব কিছু রঙহীন হয়ে যায়৷ সমস্ত বিষয় সম্পদ বন্ধক রেখে শ্রীমন্তের গৌরীর জন্য নির্বাচিত সুপাত্রের খরচ বাবদ আড়াইশত টাকা নিয়ে সে যখন বাড়িতে ফেরে তখন শুনতে পায় গিরির মুখে গৌরীকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা৷ চরম ক্রোধে সে বিয়ে পণ্ড করতে এগিয়ে গিয়ে গৌরীর পিতা হরিলালের চক্রান্তে এবং নিজের নির্বুদ্ধিতায় মেয়েটির অন্ধপাত্রের সঙ্গে বিবাহও আটকাতে পারে না আবার নিজের জমি বন্ধক দেওয়ার টাকাও খোয়াতে হয়৷ যার খেসারত সবচেয়ে বেশি দিতে হয় গিরিবালাকে৷ পরাজিত শ্রীমন্ত যখন হরিলালের সমস্ত কারসাজি বুঝতে পারে তখন চরম ক্রোধে তার মাথায় আঘাত করে চলে আসে৷ হরিলালের ও বরপক্ষের সাক্ষ্যে শ্রীমন্তের পাঁচ বছরের জেল হলে সহায়-সম্বলহীন নিঃসঙ্গ গিরি অকূল সংসারে পতিত হয়৷ নারীর জীবনের সবচেয়ে বিপজ্জনক তার শরীর, যদি সেই শরীরে রূপ থাকে তাহলে সেই বিপদের গতি আরও দ্রুত৷ গিরিবালা সুশ্রী৷ সন্তানহীন হওয়ার জন্য তার আঁটসাট শরীর গ্রন্থির কোথাও কোনো শিথিলতা আসেনি৷ তার স্বামী যখন বিচারের আসামি হয়ে উকিলের খরচ জোগাতে অপারগ তখন তার শরীরী সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যেচে তাদের উপকার করতে এসেছিল বিপিন নামের এক যুবক৷ সে গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধনবান৷ শ্রীমন্তের বাল্য বন্ধু৷ বিপিনের ইতর মনোভাব গিরিবালার অজ্ঞাত নয়৷ স্বামী জেলবন্দি হলে সেই ভয়ই তাকে গ্রাস করে৷ স্বামী তার কিছুই রেখে যায়নি৷ গৌরীর জন্য বা পরের মেয়ের ভালো করতে গিয়ে সংসারের সব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য হারিয়ে তাদের দাম্পত্য সম্পর্কেও প্রবেশ করেছিল দারিদ্র্যের কঠিন থাবা৷ সংসারে সম্বল তার কিছুই নেই৷ গ্রামের নিম্ন শ্রেণীর নারী পাঁচুর মায়ের কাছে সে বেঁচে থাকার উপায় খোঁজে৷ পাঁচুর মায়ের মুখেই শোনে তার মতো সহায় সম্বলহীন নারীদের জীবনযাপনের দুটি পন্থার কথা৷ প্রথম পথ দারিদ্র্যের চরম পীড়ন সয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে জীবন কাটানো৷ আর দ্বিতীয় পথ দেহ ব্যবসা৷ এ সম্পর্কে পাঁচুর মা তাকে জানায়—‘‘ইজ্জত বিক্রি করে মা, তারা বলে খেয়ে-পড়ে তো বাঁচি—তার পর ধম্ম৷ ধম্ম আমায় সগগে দেবে—তা সগগে আমার কাজ নাই৷’’২১৩ বাগ্দি রমণী পাঁচুর মায়ের কাছে জীবনধারণের সেই ঘৃণ্য উপায় শুনে শিউরে উঠেছে গিরি৷ সে তিরস্কার করেছে তাকে৷ কিন্তু পথ তো তার সব বন্ধ৷ দেহলোভী বিপিনের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই তার কাছে৷ তাই সে সংকল্প করে মৃত্যুবরণ করবে৷ কারণ—‘‘এমন করিয়া আপনাকে বিক্রয় করিয়া বাঁচার অপেক্ষা মরাই সহস্র গুণে কাম্য৷’’২১৪ সে এমন ভাবে মরার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে সমাজকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাতে পারে নারী জীবনের চরম অসহায়তাকে৷ তার মৃত্যুর দীর্ঘশ্বাস অর্থলোভী, নারীদেহলোভী পশুদের কাছে অভিশাপ হয়ে ঘুরতে থাকবে৷ আর সেই মৃত্যুর পন্থা হল অনাহার৷ পাঁচদিন সে খাবার না খেয়ে কাটিয়ে দেয়৷ তার দুরবস্থার শরীক হয়ে এগিয়ে আসা পাঁচুর মায়ের দেওয়া চাল, আনাজও চরম অবজ্ঞায় দূরে সরিয়ে দেয়৷ কিন্তু কত দিন? শেষ মুহূর্তে তাকে ক্ষুধার কাছে পরাজয় মানতেই হয়৷ মৃত্যুর নিঃশধ আক্রমন প্রতিহত করার শক্তি থাকে না তার৷ তাই শেষ পর্যন্ত মনে হয়—‘‘তার চেয়ে যে আপনাকে বিক্রি করাও ভাল আমার৷’’২১৫ ক্ষুধার জ্বালায় লেবু গাছ থেকে লেবু তুলে তা দাঁত দিয়ে কেটেই লেহন করতে থাকে সে৷ তারপর পাঁচুর মায়ের ফেলে যাওয়া কিছু চালের কণা জলে ভিজিয়ে খায়৷ কাঁচা মূলা খেতেও ভুল করে না৷ জঠরাগ্নির ভয়ঙ্কর দাহে মরিয়া হয়ে উঠেছে সে৷ আর মরা সম্ভব নয়৷ মরণ অতি ভয়ঙ্কর এবং বিভৎস৷ বাঁচার অভিলাষেই নিজের বক্ষ অনাবৃত করে অফলা যৌবন দেখিয়ে আমন্ত্রণ জানায় কামতাপিত লম্পট বিপিন বা মোটা মোড়লকে৷ তাকে বলে—‘‘আমি চাই টাকা—ভাল খাবার, গহনা, কাপড়—৷’’২১৬ লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন গিরির জীবনের এই পতনের চিত্রকে৷ এখানে সমাজ নিয়তির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে সব দিক থেকে চেপে ধরেছে তাকে৷ গিরি বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল৷ তার দ্বিতীয় চেষ্টা ছিল মরে গিয়ে নিজেকে বাঁচানো৷ কিন্তু মৃত্যু যন্ত্রণার কাছে হার মেনে পুনরায় তাকে আরেক মৃত্যু যন্ত্রণায় পতিত হতে হয়৷ গিরি তাই প্রবল সামাজিক পীড়নে বাধ্য হয়ে বিপিনের কাছে শরীর বিক্রির অঙ্গীকার করে মূর্ছিত হয়ে যায়৷ মূর্ছাভঙ্গ তার জীবনে নতুন স্বপ্ন সম্ভাবনার বার্তা নিয়ে আসে৷ পাঁচুর মা তার জন্য ধানভানার কাজ জোগাড় করে দিয়েছে৷ বিপিনের হাত থেকে বাঁচার এই পথ তাকে নবজীবন দান করে৷ পরম কৃতজ্ঞতায় সে তাই পাঁচুর মাকে বলে—‘‘ইচ্ছে করছে তোমার গলাটা জড়িয়ে ধরে প্রাণ খুলে আজ কাঁদি; পাঁচুর মা, তুমি আমার আর-জন্মে মা ছিলে!’’২১৭ কিন্তু গিরির মতো সহায় সম্বলহীনা নারীরা বেঁচে থাকতে চাইলেই সমাজ তা দেবে কেন! তার নতুন করে সম্মান বাঁচিয়ে বাঁচার চেষ্টার মূলে কুঠারাঘাত করে বিপিন৷ সে গিরির দেওয়া কোনো এক অসংযত মুহূর্তের অঙ্গীকার মনে রেখে তাকে ভোগ করার জন্য উপস্থিত হয় শাড়ি, খাবার, তেল, সাবানসহ নানা প্রসাধনী নিয়ে৷ তার গিরিকে অগ্রিম টাকা দেওয়ার জন্য এগিয়ে যাওয়ার মুহূর্তেই সেখানে উপস্থিত হয় পাঁচু ও তার মা৷ পরে রামকেষ্টর মধ্য দিয়ে সমস্ত পাড়ায় রাষ্ট্র হয়ে যায় তার কলঙ্কের কথা৷ সমাজপতিরা বিপিনের পরস্ত্রীগমনকে রসে কৌতুকে আমোদিত করলেও গিরির জন্য সঞ্চিত থাকে অপমান ও লাঞ্ছনা৷ গিরি যে তখন পর্যন্তও বিপিনের অস্পৃশ্য ছিল হরিলালের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তা চাপা দিয়ে দেয় বিপিন৷ প্রকাশ্য পঞ্চায়েত সভায় সে সকলের সামনে স্বীকার করে গিরিবালার সঙ্গে অবৈধ যৌন সংসর্গের কথা৷ একজন নারীর জীবনে মিথ্যে কলঙ্কের কালিমা লেপন করে ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে প্রীতিভোজ সারে বিপিন৷ তার পর তার অসহায় নারীত্বের সুযোগ নিয়ে বলপূর্বক ধর্ষণ করে গিরিকে৷ সমাজ তার জন্য কোনো বিচার রাখেনি৷ বরং লম্পট বিপিনের মিথ্যা স্বীকারোক্তির উপর ভিত্তি করে পতিত হওয়ার আগেই পতিত করেছে তাকে৷ লেখক অল্প কয়েকটি কথায় এক নারীর চরম লাঞ্ছনার চিত্রকে তুলে ধরেছেন৷—‘‘সহসা বাড়ির গণ্ডিটুকুর ভিতরে রজনীর সুপ্তি বিচলিত করিয়া একটা অস্ফুট আর্ত চিৎকার ধ্বনিত হইয়া উঠিল—তারপর একটা চাপা ক্রন্দনের ধ্বনি৷’’২১৮ আর তারপর থেকে ‘‘অহল্যার মত গিরি পাথর হইয়া গেল৷ এমনি করিয়াই নারী পাষাণী হয়৷’’২১৯ লেখক গিরিকে পাথর করে তুলেছেন—সে পাথরে নারীত্বের লালিমা নেই আছে শুধু কঠিন জমাট নিস্পৃহ উদাসীনতা৷ তার লজ্জার বাঁধ সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দিয়েছে বিপিন৷ সে তার চক্ষুলজ্জা পাপ-পুণ্য সমস্ত ভাসিয়ে দিয়েছে৷ জীবনে যা প্রত্যাশা করেছিল দারিদ্র্যের চরম পীড়নে ব্যতিব্যস্ত হয়ে সব পেয়েছে বিপিনের কাছ থেকে৷ পরিপূর্ণ আহারে তার ক্ষুধাদীর্ণ শরীর কানায় কানায় ভরে উঠেছে৷ আর সেই পরিপূর্ণ শরীরকে ভোগ করতে তাকে গহনা, শাড়ির উপকরণে সুসজ্জিত করে নিয়েছে বিপিন৷ গিরি বসে বসে পান চিবিয়ে চিবিয়ে উঁচুতলার মানুষ বিপিনের পরিচর্যা করে৷ সমাজ প্রভুরা স্ত্রী-পরিবার থাকা সত্ত্বেও বিপিনকে পরস্ত্রী সম্ভোগের অবাধ ছাড়পত্র দিয়েছে৷

গিরি অন্ন-বস্ত্র-অলঙ্কার-প্রসাধনী এবং অর্থের বিনিময়ে রক্ষিতা হয়েছে বিপিনের কিন্তু তার মাতৃত্ব—যা তার অন্তরের চিরকালীন ক্ষুধার মতো বহমান তাকে শেষ করতে পারেনি৷ তাই ডোমপাড়ায় এক সদ্য সন্তান হারানো নারীর মর্মভেদী করুণ বিলাপে ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকতে হয় তাকে৷ কিন্তু তার কাছে বিপিন সম্পূর্ণ পেশাদার৷ সে বিপিনকে শরীর দেয় বিনিময়ে বিপিন তাকে দেয় অন্ন, বস্ত্র, অর্থ, গহনা৷ তার এবারের পাওনা গলার হার৷ সে তার কাছে আসতেই গিরি দাবি করে সেই হারের৷ বিপিন তাকে সংসারের টানাটানির কথা জানিয়ে হার দেওয়ার বিলম্বের কারণ বললে দক্ষ ব্যবসায়ীর মতো সে বলে—‘‘সে কি আমার দেখবার কথা? মনে আছে তোমার, আমি চেয়েছিলাম—টাকা, গয়না, কাপড়!’’২২০ গিরির বিপিনের প্রতি মায়া নেই৷ যে জটিল পরিস্থিতিতে তাকে দেহব্যবসায়িনী হতে হয়েছে, নারীত্বের শেষ সম্মানটুকু বিসর্জন করতে বাধ্য হয়েছে সেই বিপিনকে সে ক্ষমা করতে পারে না৷ তাই বিপিন যখন তাকে জানায় যে সে তার জন্য জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিচ্ছে তখন তার কথার উত্তরে গিরি বলে—‘‘তোমার আজ জমি গিয়েছে আবার কিনবে, যা ছিল তার চেয়েও বেশি হতে পারবে; কিন্তু আমার যা গিয়েছে তা কি ফিরবে, ফিরিয়ে দিতে পারবে?’’২২১ গিরির মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয়েছে উপন্যাসটির সবচেয়ে সত্যকার কথাটি৷ গিরি তার সতীত্ব ধর্ম সব কিছু হারিয়েছে, তা লুন্ঠন করেছে বিপিন৷ বিপিনের গিরির জন্য বিক্রয় করা জমি পুনরায় ফিরে পেতে পারে কিন্তু কোনো অবস্থার বিনিময়ে গিরির বিপিনের দ্বারা লুন্ঠিত সতীত্ব-সম্ভ্রম ফেরাতে পারবে না৷

তারপরে আরেক বাঁক আসে গিরির জীবনে৷ তার অতৃপ্ত মাতৃত্ব পরিতৃপ্তির পথে অগ্রসর হয় বিপিনের ঔরসে সন্তান গর্ভে ধারণের মধ্য দিয়ে৷ সন্তানই তার জীবনের সবচেয়ে বড় চাওয়া৷ কি না করেছে সে একটি সন্তান প্রত্যাশায়৷ তার অফলবতী জীবনই তো তার ও শ্রীমন্তের সুখী দাম্পত্যকে ধ্বংস করে দিয়েছে৷ নিজের সন্তান ছিল না বলেই তো পরের সন্তানের জন্য সর্বস্ব হারিয়েছে তারা—সেই সন্তান তার গর্ভে এসেছে৷ তার আর আনন্দের সীমা পরিসীমা থাকে না৷ রতনের মুখে সে যখন সেই সন্তানের কন্টকাকীর্ণ ভবিষ্যতের কথা শোনে তখন—‘‘বুক চাপড়াইয়া তাহার কাঁদিতে ইচ্ছা করিতেছিল৷ ভবিষ্যতের বাস্তবতা তাহার চক্ষের উপর ভয়াবহ রূপ লইয়া ফুটিয়া উঠিল৷’’২২২ সে রতনকে দিয়ে বিপিনকে ডেকে আনিয়ে তার পায়ে আছাড় খেয়ে পড়ে ভবিষ্যতের কথা ভেবে৷ বিপিন সমাধানসূত্র বের করে পদা দাইকে দিয়ে গর্ভপাত করানোর মাধ্যমে৷ তার এই সমাধান মেনে নিতে পারে না গিরি৷ সন্তান তার সারাজীবনের কাঙ্খিত ধন৷ সেই সন্তানকে সে গর্ভে পেয়েছে৷ বিপিনকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজের পথ নিজেই খোঁজে৷ তারপর গভীররাত্রে নিজের ঘরে আগুন দিয়ে অলক্ষে গ্রাম থেকে বের হয়ে যায় সে৷ ‘‘ঘরের বন্ধন, সমাজের নাগপাশ নিজের হাতে আগুন ধরাইয়া নিঃশেষে ভস্ম করিয়া পৃথিবীর বুকে দাঁড়াইয়া আপনাকে সে মুক্ত অনুভব করিল৷’’২২৩

সে স্বামী হারিয়ে, সতীত্ব হারিয়ে, গ্রাম ছেড়ে সন্তানের নির্বিঘ্ন ভবিষ্যৎ ভেবে পথে নামলেও পদে পদে সেই প্রতিকূলতা জব্দ করেছে তাকে৷ পথের কুকুরের মতো রাস্তায় গাছতলায় পড়ে থেকেছে৷ এক ছোট শহরের প্রান্তদেশে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা এক পুরোনো বয়লারের মধ্যে আশ্রয় নেওয়া গিরি প্রবল প্রসব যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মূর্ছিত হয়ে গেলে সে জ্ঞান ফিরে পেয়েছে হাসপাতালে—সেখানে ছোট্ট ফুটফুটে সন্তান জন্ম দিয়েছে সে৷ তার নিজের গর্ভজাত সন্তান৷ তার জীবনের সব আশা-আকাঙ্খা সাধ-আহ্লাদ৷ সন্তান কোলে পেয়ে সে ভুলে গিয়েছে তার সব যন্ত্রণা৷ কোলে শিশুকে নিয়ে ভিক্ষা করতে করতে পেয়ে গেছে এক ধনী বাড়ির ঠাকুরদালানের এঁটোকাঁটা ঘোচানোর কাজ৷ কিন্তু সেখানেও বিধি বাম৷ তার ছোট্ট সন্তান নীলকন্ঠের অসুস্থতার কারণে একবেলা কাজ না করার অপরাধে গৃহকর্ত্রীর দ্বারা বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নেয় পথের পরে৷ সেখানে চলে নানা মানুষের তার শরীরের প্রতি শ্বাপদ দৃষ্টি বিনিময়৷ মন্দিরের পুরোহিত পর্যন্ত তার শরীরকে উপভোগ না করে ছাড়ে না৷ সন্তান এবং ক্ষুধা তাকে ভিখারিনি দেহব্যবসায়ী করে তুলেছে৷ লেখক তার বেশ্যাজীবনের ইতিহাসও বর্ণনা করেছেন দু-চারটি কথায় কিন্তু তার অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনার ব্যাপ্তি বহুদূর প্রশস্ত৷ ‘‘তারপর কত মানুষকেই সে দেখিল৷ অধিকাংশ পাষণ্ড নৃশংস৷’’২২৪ কামাতুর মানুষদের পশুবৎ যৌনপীড়নকেও লেখক তুলে ধরতে ভোলেননি৷ নারীর শরীরকে অর্থের বিনিময়ে ভোগ করার সুযোগ নিয়ে সে অর্থের মূল্য সুদ-আসলসহ পুষিয়ে নিতে ভোলেনা পশুবৎ মানুষেরা৷ গিরির গণিকা জীবনের অভিজ্ঞতায় বর্ণিত হয়েছে এক ড্রাইভারের প্রসঙ্গ৷ ধুলিধূসর, কালোরঙ এবং জবাফুলের মতো লাল চোখের অধিকারী সেই ড্রাইভার এতটা পাশবিক পীড়ন করেছিল তাকে যে গিরির তাকে হত্যা করতে ইচ্ছে করেছিল৷

জীবনে চারটি বছর গ্রামছাড়া গিরি৷ আবার গ্রামমুখো হয়েছে—ছোট্ট নীলকে হাতে ধরে৷ বৃষ্টির প্রবল বর্ষণে গ্রামের নদীর ঘাটে এসে নীলকন্ঠকে এবং নিজেকে জলের ছাঁট থেকে বাঁচাতে সে আশ্রয় নেয় ঘাটের মাথায় বটগাছ তলে৷ সম্পূর্ণ অতীতচারিতায় মগ্ন হয়ে জীবনের খেই হারিয়ে ফেলে সে৷ সে জন্য সেই ঘাটপাড়ে বসে মৃত্যুর প্রত্যক্ষ আহ্বান শুনতে পায়৷ সেই বিমূঢ় অবস্থা থেকে যখন সম্বিত ফিরে আসে তখন নদীতে বান এসেছে—ঝুপ ঝুপ করে পাড় ভেঙ্গে পড়ছে৷ নীলের কথা মনে হতেই সে ছুটে যেতে চায়—কিন্তু বিধাতা এবার সদয় তার প্রতি৷ পা পিছলে ভরা নদীতে তলিয়ে যায় সে৷ তার স্নেহের প্রিয় ধন নীলকন্ঠ আশ্রয় নেয় তারই গ্রামে তাদের সেই পরিত্যক্ত ভিটায়৷ পরবর্তী সময়ে শ্রীমন্ত যার প্রতি স্নেহের হাত বাড়িয়ে দেয়৷

লেখক গিরিবালার নিদারুণ জীবনযন্ত্রণার পরিসমাপ্তি করলেন তার মৃত্যুকে নিশ্চিত করে৷ গিরিবালার মতো মানষদের মৃত্যু ছাড়া কোনো গতিও নেই৷ তাই দেখালেন রচনাকার৷

খ. রাইকমল :

উপন্যাসটির প্রকাশকাল ১৯৩৪ হলেও লেখক পূর্বের লেখা দুটি গল্পকে প্রায় অবিকৃত রেখে সামান্য কলেবর বৃদ্ধি করেই উপন্যাসটিকে গঠন করেছেন৷ গল্পদুটি যথাক্রমে ‘রাইকমল’ (১৯২৯) এবং ‘মালাচন্দন’ (১৯৩১)৷ বৈষ্ণব ভাবপরিমণ্ডল, সামাজিক বিশিষ্ট রীতি-নীতি, ধর্মীয় আচার ও বিশ্বাস এই উপন্যাসের মূল কেন্দ্রভূমি৷

উপন্যাসটিতে আলোচিত হয়েছে ‘সেবাদাসী’ প্রথা৷ বৈষ্ণবীয় এই প্রথা তৈরির পেছনে পূর্বসূরীদের সাধনার কোনো গোপন তত্ত্ব ইতিবাচক দিক থাকলেও তা ক্রমে স্থূল দেহভোগের ইঙ্গিতকেই গ্রহণ করে৷ এখানে বর্ণিত হয়েছে ‘মালাচন্দন’-এর মাধ্যমে বৈষ্ণবদের বোষ্টম, বোষ্টমী গ্রহণ৷ নায়িকা কমলিনী মালাচন্দনের মাধ্যমে যেমন রসিকদাসকে গ্রহণ করেছিল তেমনি রসিকদাসের সেই মালা ফিরিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে সেই বন্ধনও ছিন্ন হয়ে যায়৷ পুনরায় সে মালাচন্দন দিয়ে গ্রহণ করে রঞ্জনকে৷

উপন্যাসে রঞ্জনের গল্পে সেই সেবাদাসী প্রথার অপরিহার্যতা উঠে এসেছে৷ রঞ্জন কমলিনীর মানসপুরুষ৷ শৈশব থেকে ‘বর-বউ’ খেলতে খেলতে সেই খেলার সম্পর্কই কৈশোরে তাদের মনে প্রণয়ের সঞ্চার করে৷ কিন্তু তাদের সেই সম্পর্ককে মান্যতা দিতে চায় না রঞ্জনের বাবা-মা৷ কারণ বৈষ্ণবদের মধ্যে কোনো জাত-বিচার নেই, বহুগামীতা তাদের ধর্মীয় উপসর্গ৷ তাই কমলের মুখের এঁটো কুল খাওয়াকে কেন্দ্র করে রঞ্জনের মায়ের ক্রোধান্বিত কথা—‘‘রাক্ষুসী, রাক্ষুসী, মায়াবিনী গো, ওরা ছত্রিশ জেতে বোষ্টম—ওদের কাজই এই৷’’২২৫ বৈষ্ণবীরা পরপুরুষের সঙ্গকে কৃষ্ণসঙ্গ মনে করে এবং নিজেদের ভাবে রাধারাণী৷ সাধারণ মানুষজনের এদের প্রতি শ্রদ্ধা নেই৷ তাদের ধর্মের নামে ব্যভিচার সকল মানুষেরই জানা৷ কমলিনী বা রাইকমল রঞ্জনকে মুক্তি দিতে গ্রাম ছেড়েছিল৷ তার বহুদিন পরে রসিকদাসকে পতিত্বে বরণ করে সে যখন পুনরায় নিজগ্রামে উপস্থিত হয়ে পাড়ার যুবাদের নিয়ে এক মশগুল আখড়া গড়ে তোলে তখন তাকে কেন্দ্র করে পাড়ার নারী মহলের আক্রোশের সীমা থাকে না৷ কেউ শুনিয়ে শুনিয়ে কেউ বা আড়ালে তার ধর্মাচার নিয়ে কটু কথা বলতে থাকে৷

রাইকমলকে রঞ্জন বৈষ্ণব হয়ে বিবাহ করতে চেয়েছিল৷ তার আগেই সে চলে যায় গ্রাম ছেড়ে৷ গ্রামে এসে সে জানতে পারে রঞ্জন বৈষ্ণব হয়ে তাদের খেলাঘরের সঙ্গিনী বিধবা পরীকে নিয়ে দেশান্তরী হয়েছে৷ সেই রঞ্জনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় জয়দেবের শ্যামচাঁদের দরবারে যাত্রাকালে৷ সেখানে মালাচন্দনের মাধ্যমে পরস্পর একাত্ম হয়ে আখড়ায় ফিরে এসে দেখতে পায় পরীকে৷ কঙ্কালের উপর চামড়ার আচ্ছাদন দিলে যেমন হয় তেমনি রোগশীর্ণ পরী৷ পরীকে ভোগের জন্য তার সেবাদাসী করেছিল৷ কিন্তু সে যখন তার শরীরী ক্ষুধা মেটাতে অক্ষম হয় তখন মালাচন্দন করে সেবাদাসী বানায় কমলকে৷ মৃত্যুকালে পরীর মুখ দিয়ে উচ্চারিত হয় এই সব ভোগ্যা নারীদের জীবনের এক গুঢ় সত্য৷ সে কমলকে বলে—‘‘রূপ একদিন আমারও ছিল৷’’২২৬ তার রূপ শেষ হতেই এঁটো পাতার মতো তাকে ত্যাগ করেছে রঞ্জন৷ পরীর মৃত্যুর পর মিলনে উচ্ছ্বাসে তিনটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায় কমলের৷ তারপর থেকেই সে বুঝতে পারে তার প্রতি রঞ্জনের নিরাসক্তি৷ সেই উদাসীন অবহেলা আরও গভীর হয় রঞ্জনের সঙ্গে ঝুলনের স্বপ্নে মগ্ন হলে৷ তার সেই প্রেমস্বপ্নের মূলে কুঠারাঘাত করে রঞ্জন যখন বলে—‘‘বলি বয়স বাড়ছে, না কমছে?… নইলে এখনো তোমার ঝুলনে সাধ হয়! আয়নাতে কি মুখ দেখা যায় না, না নিজের রূপ খুব ভালই লাগে?’’২২৭ পরীর সেই বেদনার বিলাপ স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় তার চেতনায়৷ সে যেন বাস্তব থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছিল৷ রঞ্জন তার ব্যথিত চিত্তে এতটুকু সান্ত্বনা না দিয়ে তার কাজের কথা বলে দিনতিনেকের জন্য বেড়িয়ে যায়৷ সে আহত হয়ে আয়না ধরে তার মুখের উপর৷ চমকে উঠতে হয় তাকে—‘‘সত্যিই তো, কোথায় সেই প্রাণ-মাতানো রূপ তাহার? সেই চাঁপার কলির মতো রং এখনো আছে, কিন্তু সে চিক্কণতা তো আর নাই৷ চাঁদের ফালির মত সেই কপালখানি আকারে চাঁদের ফালির মত আছে, কিন্তু তাহাতে যেন গ্রহণ লাগিয়াছে, সে মসৃণ স্বচ্ছতা আর তাহাতে নাই৷ গালে সে টোলটি এখনো পড়ে, কিন্তু তাহার আশেপাশে সূক্ষ্ণ হইলেও সারি দিয়া রেখা পড়িতে শুরু করিয়াছে—এক দুই তিন৷ নাকের ডগায় কালো মেচেতার রেশ দেখা দিয়াছে৷’’২২৮ কমল বুঝতে পারে তার বিগতযৌবনের প্রতি রঞ্জনের অবহেলাকে৷ সে যে তাকে না জানিয়ে গোপনে গোপনে কোনো কার্য করে যাচ্ছে সেটাও বাকি থাকে না বুঝতে কিন্তু জিজ্ঞাসা করার ঔৎসুক্য যেন হারিয়ে ফেলেছে সে৷ তার দিন কয়েক পরে রঞ্জন উপস্থিত হয় আখড়ায়৷ তার পেছনে মালাচন্দনে চর্চিত এক তরুণী৷ সে নিজেই নিজের পরিচয় দিয়ে বলে—‘‘আমি নতুন সেবাদাসী গো৷’’২২৯ তার মুখেও প্রতিধ্বনিত হয় রাইকমলের বিগত যৌবনের জন্য ব্যঙ্গরসিকতা—‘‘তবে যে শুনেছিলাম গাইয়ে-বাজিয়ে বলিয়ে-কইয়ে—রূপে মরি মরি! ও হরি তুমি এই!’’২৩০

রঞ্জন স্থূল দেহভোগী৷ তার মধ্যে ফুটে উঠেছে প্রবল রূপতৃষ্ণা এবং নতুন নতুন নারীকে ভোগ করার তীব্র আকাঙ্খা৷ শুধু তাই নয় পুরোনোকে পরিত্যাগ করার মধ্যেও তার কোনো কুন্ঠা নেই বরং তীব্র নির্মমতা৷ পরীকে ত্যাগ করে একদিন সে গ্রহণ করেছিল কমলকে আবার কমলের যৌবনে ভাটা পড়তে শুরু করলে নিয়ে আসে আরেক সেবাদাসী৷ পুরুষের ভোগের শিকার হয়ে এক নিষ্ঠুর ধর্মীয় বাতাবরণে আবদ্ধ এই নারীদের জীবনভর পিষ্টই হতে হয়৷ রূপ থাকলে তারা নতুন বৈষ্ণব পায় আর যদি না থাকে তাহলে ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া কোনো উপায় থাকে না৷

গ. কালিন্দী :

‘কালিন্দী’ (১৯৩৪) উপন্যাসের পটভূমিতে আছে পড়ন্ত জমিদারি ব্যবস্থা, আভিজাত্যের লড়াই, যুথবদ্ধ কৌমসমাজ, ধনতান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ ও পুঁজিবাদের আক্রমণ এবং বিপ্লবী রাজনীতি৷ উপন্যাসের এই দ্বন্দ্বমুখর পরিবেশের প্রাণচঞ্চল নারী সারী৷ সে সাঁওতাল কন্যা-সাঁওতালি নারীদের দলনেত্রী৷ সাহসে, ক্ষিপ্রতায় চমৎকারিত্বে ভরপুর সেই প্রাণবন্ত কিশোরী সামাজিক নিষ্পেষণে দেহব্যবসায়ী হতে বাধ্য হয়৷ চিনিকল মালিক বিমলবাবুর লোলুপ দৃষ্টিতে ছাই হয়ে যায় সে৷ তাদের নিজস্ব ব্রতনিয়মের মাঝে মেয়েদের দলের মধ্যমণি দলপতি কমল মাঝির নাতনি দীর্ঘাঙ্গী লতার মত সরস মেয়েটিকে প্রথম দেখেই বিমলবাবুর মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এসেছিল তাকে ভোগ করার প্রচ্ছন্ন বাসনা—‘‘বাঃ, মেয়েটির দেহখানি চমৎকার, tall, graceful,-youth personified.’’২৩১ তার কামনার তীব্র দহনেই সতেজ সবল বন্যলতাটি শুকিয়ে খড় হয়ে যায়৷ সে কালিন্দীর চর বরাত নিয়ে চিনিকল স্থাপন করে আস্তে আস্তে পুরো চরখানাই দখল করে৷ সাঁওতালদের কলের মজুরে পরিণত করে৷ তদের যূথবদ্ধতাকে ভেঙ্গে দিয়ে কৌশলী ষড়যন্ত্রে একঘরে করে কমলমাঝির পরিবারটিকে৷ তারপর রাতারাতি নিরুদ্দেশ হয়ে যায় সাঁওতাল দলপতি৷ সারী তার গৃহে স্থান পায় তার রক্ষিতা হিসেবে৷ উদ্যত ছুরি দেখিয়ে সে সারীর সঙ্গে তার স্বামীর বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে তার শরীরটিকে নিজের ভোগের জন্য করায়ত্ত করে৷ তার দলের মেয়েরা তাকে তাই আজ ঘৃণা করে৷ বিমলবাবুর সঙ্গে তার বসবাস নিয়ে অহীন্দ্রকে জানায়—‘‘হেঁ, পাপ করলে; আপোন বরকে—মরদকে ছেড়ে উ ওই সায়েবটোর ঘরে থাকছে৷’’২৩২ অপর একটি মেয়ে বলে—‘‘উ এখুন ভালো কাপড় পরছে, গোন্দ মাখছে, উই সায়েব দিচ্ছে উকে৷’’২৩৩ কিন্তু বিমলবাবুর মতো নারীমাংসলোভী মানুষদের সারীর মতো সামান্য একজন সাঁওতাল মেয়েকে ভোগ করে তৃপ্ত থাকার কথা নয়—থাকেও না৷ তার কামনা পূরণ হয়ে গেলে সে নির্মমভাবে তার ঘর থেকে বের করে দেয় সারীকে৷ সেই কথা লেখক ব্যক্ত করেছেন এইভাবে—‘‘মুখার্জি সাহেব কাল হইতে সারীকে বাংলোর আউটহাউস হইতে তাড়াইয়া দিয়াছেন; তাঁহার শখ মিটিয়া গিয়াছে৷’’২৩৪ মুখার্জীসাহেব বা বিমল বাবুর শখ মিটে গেলেও রক্ত-মাংসের দেহধারী সারী তো মরে যায় না৷ সে বেঁচে থাকে৷ আর তার জন্য তাকে রসদ জোগাড় করতেই হয়৷ দেহ খাবার না হলে চলে না৷ দেহকে খাবার দিয়ে সচল রাখতে পুনরায় তাকে উপায় খুঁজতে হয়৷ তার সমাজ তাকে পরিত্যাগ করেছে, বিমলবাবুর তাকে প্রয়োজন শেষ হয়ে গেছে তারপরেও তার উচ্ছিষ্ট দেহটার জন্য মুখিয়ে আছে সরকারবাবু, শূলপাণি রায় প্রভৃতিরা৷ এতগুলো পুরুষের যৌনখোরাক জোগাতে গিয়ে সে হয়ে যায় রক্ষিতা থেকে বেশ্যা৷ কুলি ব্যারাকের মধ্যে বসতি স্থাপন করে দেহ ব্যবসা চালিয়ে যায়৷

পূর্বের সেই চপল চঞ্চল নারী বহু পুরুষের পীড়নে তার সরলতা হারিয়ে ফেলে৷ তার সেই সর্বস্বহারা মলিন রূপ পাঠকের মনে শুধু দাগ রেখে যায় না একটা প্রতীকের মতো হয়ে ওঠে৷—‘‘আদিম মাটির ঘাসের সজল সবুজ যেন নীরস শুকনো তৃণে পরিণত হল৷ চরের আদিবাসী চটুল প্রগলভ তরুণী কলে নিষ্পেষিত হয়ে ছিবড়ে হয়ে গেল, শোষণ-রিক্ত মজুরের মতো৷’’২৩৫ সাঁওতাল মেয়েগুলো ছিল যেন কলরব মুখর একঝাঁক রঙিন পাখি৷ তাদের নেত্রী সারীর জীবনের নিষ্ঠুর রূপান্তর সমাজের এক নগ্নরূপকে সামনে নিয়ে আসে৷

ঘ. প্রেম ও প্রয়োজন :

নলিনী :

তারাশঙ্করের ‘প্রেম ও প্রয়োজন’-এর (১৯৩৫) কেন্দ্রীয় চরিত্র নলিনী৷ সে লেডি ডাক্তার এবং ধাত্রীবিদ্যায় পারদর্শী৷ সেই সুবাদে জমিদার মহেন্দ্রবাবুর মাতৃহীন পুত্রকে লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করে৷ তা ছাড়া জমিদারের দাতব্যচিকিৎসালয়ে চুক্তিভিত্তিক ডাক্তার হিসেবেও তার নাম রয়েছে৷ ধর্মে সে খ্রিস্টান৷ অনেকে আবার তাকে মহেন্দ্রবাবুর রক্ষিতা হিসেবেও প্রতিপন্ন করতে চায়৷ অনেকে তাকে বলে বেশ্যাকন্যা৷ নলিনীর নিজের কথার মধ্যেও তার পরিচয় উঠে এসেছে৷ শহুরে, শিক্ষিত, স্বাধীনজীবী নলিনীর মধ্যে ছিল দুর্দান্ত সাহস ও প্রতিবাদ মনস্কতা৷ গ্রামের অসহায় বিধবা রমাকে মহেন্দ্রবাবুর লালসা থেকে বাঁচাতে মহেন্দ্রর হত্যার হুমকির প্রতিবাদে সাহসিকতার সঙ্গে বলে—‘‘আপনি তো আমার পরিচয় জানেন৷ বেশ্যার মেয়ে আমি৷ আপনাদের এই ধনী জাতদের সর্বনাশ করা আমার না হোক—আমার জাতের পেশা৷’’২৩৬ নলিনী নিজে উপন্যাসে কখনো শরীর বিক্রয় করেনি কিন্তু গণিকার সন্তান হয়েও সমাজে ডাক্তার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পেছনে চরিত্রটির গুরুত্ব রয়েছে৷

রমা :

রমা রমণদাসের বিধবা কন্যা৷ নিম্নশ্রেণীতে সৌন্দর্যের বাহার নিয়ে জন্মেছিল সে৷ তাকে দেখে মানুষের আশ মিটত না৷ সেই অপরূপা সুন্দরী নারী বিধবা হয়ে ভাই-ভাজের কাছে ফিরে এসে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ তাঁর বাবা-মাও তাকে গিলতে বা ফেলতে কিছুই করতে পারছিল না৷ এমতাবস্থায় তাঁর দিকে দৃষ্টি পরে জমিদারের৷ দালাল কড়ি গাঙ্গুলীর মধ্যস্থতায় পাঁচশত টাকার বিনিময়ে জমিদার তাকে কিনে নেয়৷ সে জমিদার বাড়ির অন্দরমহলে স্থান পায় জমিদারের রক্ষিতা হিসেবে৷ মাটি ও গরুর জন্য এবং নিজেকে জমিদারের সুনজরে রাখার জন্য একজন পিতা তার আত্মজাকে নির্দ্বিধায় বিক্রয় করে দিতে পারে এমন দৃশ্যের অবতাড়না করা হয়েছে আলোচ্য উপন্যাসে৷ রমার মধ্যেও ধনসম্পদের একটা সুপ্ত মোহ ছিল৷ সেই লোভে সেও নিজেকে জমিদারের লালসার কাছে বিকিয়ে দেয়৷ নলিনীর বুঝতে অসুবিধা হয় না জমিদারের প্রবৃত্তি বাসনাকে৷ রমা নলিনীর সহায়তায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ঘটনার আবর্তে পুনরায় নিজেকে সমর্পণ করে মহেন্দ্রবাবুর কাছে৷ সুদীর্ঘ অতৃপ্ত জীবনে পুরুষের সঙ্গ কামনা, মহেন্দ্রবাবুর ধনরাশিতে কর্তৃত্ব করার বাসনা এবং শিশুকে পালন করার বুভুক্ষ প্রত্যাশায় তার মায়ের মুখে মহেন্দ্রবাবুর কাছে পাঠানোর ইতিবাচক ইঙ্গিতে—‘‘বুকের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন ঘন আবেগ গর্জনমান উতলা মেঘের মত মুখর হইয়া উঠিল৷ সে অনুভব করিল, বাহির পর্যন্ত তাহার সে গর্জনের প্রতিধ্বনিতে থরথর করিয়া কাঁপিতেছে৷’’২৩৭ যে আয়না ঘরে মহেন্দ্রবাবুর দুর্বার কামনা থেকে তাকে একদিন নলিনী রক্ষা করেছিল সেই ঘরেই পুনরায় সে মহেন্দ্র বাবুর বাহুবন্ধনে নিজেকে সমর্পণ করে৷

রমার তার পরের জীবন ব্যভিচারের এক সুদীর্ঘ কাহিনি৷ তার উন্মত্তভাবে বাবুর কাছে আত্মসমর্পণের পেছনে ছিল যৌবনের আকস্মিক জাগরণে পুরুষের শক্ত বাহুবেষ্টনী, সংসার, সন্তান—জীবজগতে কৈশোর-অতিক্রান্ত নারীর কল্পনার বস্তু যা তার সব৷ প্রেম সে বোঝেনি সেখানে ছিল শুধু প্রবৃত্তি আর কামনা৷ কিন্তু মহেন্দ্রবাবুর প্রয়োজনের হিসেবে একদিন রমার মূল্য কমে যায়৷ তাই তিনবছর ক্রমাগত ভোগ করার পর পুনরায় দালাল কড়ি গাঙ্গুলীকে ডেকে জানায় যে তার জবাব হয়ে গেছে—একটা বাড়ি এবং কিছু টাকা তাকে ভোগ করার দক্ষিণা স্বরূপ বুঝিয়ে দেয় কড়ি গাঙ্গুলীকে৷ রমার যে পুনরায় সমাজে স্থান হবে না সে কথা বোঝার মন জমিদারের নয়৷ কড়ি গাঙ্গুলী সে কথা জানালে জমিদার বলে যে সে তার প্রতাপ দিয়ে সমাজের মুখ বন্ধ করে দেবে৷ কড়ি তার কাছে প্রার্থনা করে অন্তত দাসী হিসেবে যদি মহেন্দ্র তাকে স্থান দেয় তাহলেও মেয়েটা সমাজের পীড়ন থেকে রক্ষা পাবে৷ তার উত্তরে জমিদার জানায়—‘‘না, তা হয় না এককড়ি৷ পুরাতন কাপড় বাক্সে তুলে রেখে পরিত্যাগ করা আমি পছন্দ করি নে৷’’২৩৮ কি ভয়ানক অবজ্ঞা নারীর প্রতি৷ একজন জলজ্যান্ত রক্তমাংসের মানুষ দিনের পর দিন যাকে দিয়ে দেহের উন্মত্ত পিপাসাকে পূরণ করেছে—তাকে পুরোনো কাপড়ের মতো পরিত্যাগ করতে কোনো দ্বিধা হয় না তার৷

সময় ধীরে ধীরে পাল্টে দেয় মানুষের জীবন৷ দুর্বৃত্ত লম্পট মহেন্দ্রবাবু কঠিন পীড়ায় পীড়িত হলে তার সেই রোগের ছোঁয়াচ থেকে বাঁচতে নিকট আত্মীয়ের কেউই সেবার দায়িত্ব নেয় না৷ পুনরায় প্রয়োজন পড়ে পরিত্যাগ করা সেই পুরোনো কাপড়ের প্রতীক রমাকে৷ কর্মচারীকে জানায় রমা নামের তার সেই পুরোনো ঝিটিকে নিয়ে আসতে৷ রমা আসে তাকে পরিচর্যা করতে—রোগের ছোঁয়াচের ভয়কে উপেক্ষা করেই আসে৷ মহেন্দ্রবাবু তার পরেও রমার মূল্য যাচাই করে টাকার হিসেবে৷ পাঁচহাজার টাকা সে উইল করে দিতে চায় তাকে৷ কিন্তু রমা তো আর সেই প্রবৃত্তি তাড়িত নয়—তার মধ্যে জীবনের সত্য স্বরূপকে—নিজের অবস্থানকে বোঝার বোধ জন্ম নিয়েছে৷ সে তাই টাকা নিয়ে সেবার দরকষাকষি করতে চায় না৷ মহেন্দ্র বাবুর ঈশ্বরের দিব্যিতেও তার মুখে ফুটে উঠে বিচিত্র তিক্ত হাসি৷

ঙ. আগুন :

‘আগুন’(১৯৩৭) উপন্যাসের গল্পে তিনটি পৃথক পূর্ণাবর্ত কাহিনি চন্দ্রনাথ, হীরু এবং নিশানাথের৷ চতুর্থ চরিত্র নরু বা নরেশ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় গল্পের কথক৷ হীরুর গল্প প্রসঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে যাযাবরী মুক্তোকেশীর নাম৷ যাযাবরদের জীবনযাত্রা বিচিত্র৷ কবে কেমন করে কথকদের গ্রামে তারা বাসা বেঁধেছে তা তার জানা নেই৷ অদ্ভুত মিষ্টভাষী সেই যাযাবর জাতিটি৷ বর্ষের প্রথমেই জাতিটা পথে বের হয় ফেরে একেবারে দুর্গাপূজার সময়৷ তারপর আবার পথে বেড়িয়ে গাজনের সময় গ্রামে ফিরে আসে৷ তাদের রহস্যময় জীবন ধারার সবচেয়ে বড় রহস্য হল নারীদের স্বাধীন জীবন৷ নারীরা স্বেচ্ছায় তাদের শরীরকে বিলিয়ে দেয় পুরুষের হাতে তারপর নারী পুরুষ উভয়ের প্রয়োজন ফুরালে যূথে ফিরে আসতেও কোনো বাধা নেই তাদের৷ কথক এ প্রসঙ্গে বলেছেন—‘‘সে আপনাকে স্বেচ্ছায় বিলাইয়া দেয়, বাপ দাবি করে শুধু টাকা৷’’২৩৯ অর্থাৎ কৌমের মেয়েদের শরীরের বিনিময়ে মেয়ের পিতার টাকা গ্রহণ করার মধ্যে এদের সমাজে অনৈতিকতার কোনো বাড়াবাড়ি নেই৷ সেই বাজিকর দলের কন্যা মুক্তোকেশীও স্বাধীন বৃত্তির৷ সেও তাদের জাতটার মতো রহসময়ী৷ পিঙ্গলবর্ণা তরুণী যাযাবরী, সুগঠিত দীঘল দেহে পশ্চিমা মেয়েদের মতো করে ছিটের কাপড় পরিধান করে একহাত কাঁচের চুড়ি এবং গলায় বেলের খোলের মালা পড়ে ঈষৎ বঙ্কিম ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে যখন গান শোনাতে এবং নাচ দেখাতে প্রার্থনা জানায় তখন সেই বর্বরা মোহময়ীর মোহমায়ায় নরু এবং হীরু উভয়কেই মুগ্ধ হতে হয়৷ নরু গল্পের কথক লেখক মানুষ সে নিজের প্রবৃত্তির সংযম জানে কিন্তু হীরু বিলেত ফেরত পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত এবং প্রচুর ধন সম্পদের অধিকারী৷ তার মধ্যে সংযমের কোনো বালাই নেই৷ অপার মুগ্ধতায় সে পান করে যাযাবরীর রূপ সৌন্দর্য৷ যাযাবরীও অভিভূত হয়ে যায় রূপবান হীরুকে দেখে৷ তার আদিম কামনার শিখা লেলিহান হয়ে উঠে৷ সে তার চোখের দৃষ্টি দিয়ে আকন্ঠ পান করতে চায় হীরুর রূপ সৌন্দর্য৷ অদ্ভুত নাচ পরিবেশন করার পরেও ক্লান্তির মধ্যেও সে বলে ওঠে—‘‘টুকচা বসি বাবু, তুমাকে দেখি৷ চোখের সার্থক ক’রে লিই গো চাঁদপারা বাবু৷’’২৪০ শুধু তাই নরু তার ঔদ্ধত্তের কথা তাদের মোড়লকে বলে দিতে চাইলে সেই যাযাবরী অকপটে বলতে পারে—‘‘কি বলবা বাবু? ওই বাবুটি যদি আমার বাবাকে টাকা দিয়ে কিনে লেয় তো দিয়ে দিবে বাবা৷’’২৪১

এরপর যাযাবরী আবার উপস্থিত হয় শঙ্খপতির বিলের ধারে হীরু নরুর শিকারের সময়৷ সেখানেও হীরুর প্রতি তার আসক্তির কথা অকপটে ব্যক্ত করেছে সে৷ হীরু যদি বলে তাহলে বিলের জলে পড়া গুলিবিদ্ধ পাখিগুলিকে সে অনায়াসে এনে দিতে পারবে বলে জানায় এবং তা করেও৷ সে তাদের সাপের খেলা দেখায়৷ বন্দুক দিয়ে শিকারের অভিলাষ ব্যক্ত করে৷ হীরু তার নাম দেয় চিত্রাঙ্গদা এবং অতিসংক্ষেপে চিত্রাঙ্গদার কাহিনি তাকে জানালে সে খিল করে হেসে জবাব দেয়—‘‘বড় মিঠ্যা নাম গো বাবু৷’’২৪২ হীরুর সঙ্গে ঘনিষ্ট হয়ে তার সাহায্য নিয়ে পাখি শিকারও করে সে৷

যাযাবরী তার মোহের মায়ায় সত্য সত্যই বিদ্ধ করে হীরুকে৷ সেই আদিম বর্বর মেয়ে হীরুকে প্রলুব্ধ করে ঘর বাঁধে তারই জমিদারির এক নির্জন জঙ্গলমহলে৷ সে ঘর বাঁধা স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সংসার নয় তা আদিম আসক্তি ও কামনা দিয়ে ঘেরা৷ কথক বহুদিন পর হীরু সন্ধানে গিয়ে তাকে আবিষ্কার করে গভীর শালবনে বাঘ শিকারের উদ্দেশ্যে তার পাতা মাচায়৷ সেখানে আশ্চর্য হয়ে যায় তার সঙ্গিনী যাযাবরীকে দেখে৷ সেখানে লালসাময়ী যাযাবরীর জীবনের অদ্ভুত রূপান্তর৷ হীরুর সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে তার মধ্যে সঞ্চিত হয়েছে অমৃত মাতৃত্ব ধারার৷ তাই শিকারে আর তার প্রবৃত্তি নেই৷ হীরু তিনটি ছানা সহ বাঘিনীকে হত্যা করতে চাইলে সে তার আসন্ন মাতৃত্বের মমতায় চিৎকার করে ওঠে ‘না, না, মেরো না৷’২৪৩ তার চিৎকারে সচকিত বাঘিনী সন্তানসহ পালিয়ে যায়৷ কিন্তু হীরুর তো তা নয়৷ সে সন্তান চায় না, সংসার চায় না, বন্ধন চায় না—সে চায় কামনা-বাসনার কুঞ্জসজ্জিত অমৃতলোক৷ তাই সে নরুকে জানায়—‘‘যাযাবরীতে আমার অবসাদ এসেছে৷… আমার বিতৃষ্ণা এসেছে৷ আমি ওকে আর সহ্য করতে পারছি না৷ জানিস নরু, যেদিন প্রথম শুনলাম, চিত্রাঙ্গদা হবে জায়া, আমার সন্তানের জননী, সেদিন আমি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলাম, হত্যার সংকল্পও মনে মনে জেগে উঠেছিল৷’’২৪৪ যাযাবরী হীরুর রূপে মুগ্ধ হয়েছিল, তাকে কামনাও করেছিল৷ তার স্বপ্ন সার্থক হয়েছে, সে তার প্রেমের পুরস্কার স্বরূপ পেয়েছে তার গর্ভে হীরুর সন্তান৷ বুক দিয়ে আগলে রাখতে চায় সে সন্তানকে৷ রাঙা খোকার মা হওয়া তার জীবনে আরেক স্বপ্ন৷ কিন্তু সে যখন আড়াল থেকে হীরু-নরুর সমস্ত কথা শুনতে পায় তখন তার ভেতরকার মাতৃত্ব শিউরে ওঠে৷ সে যাযাবরী তার জীবনে প্রেমাস্পদের কাছ থেকে গভীর কোনো প্রত্যাশা নেই৷ তাই কোনো প্রতিবাদ করে না বরং হীরুর বুকে আছড়ে পড়ে উচ্ছ্বসিত ক্রন্দনে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়৷ তারপর কেউকে না জানিয়ে চুপচাপ চলে যায়৷ তার সেই নিরবে চলে যাওয়া হীরু নরুর কাছে ব্যক্ত করেছে এইভাবে—‘‘বর্বরা আপন সংস্কার অনুযায়ী কাজই করেছে নরু৷ কাল বোধ হয় আড়াল থেকে সব শুনেছে৷ শুনে সন্তানের মমতায় আদিম যুগের মায়ের মতই সন্তানের পিতাকে পরিত্যাগ ক’রে চ’লে গেছে;’’২৪৫

নিশানাথের কঠোর উপাসনায় তার মৃত্যুর প্রাক মুহূর্তে তাকে কেন্দ্র করে শ্মশানে মেলা বসে যায়৷ সেখানে বিভিন্ন দোকানের সমাবেশ যেমন অপরিহার্য, তেমনি মেলার আরেক অপরিহার্য অঙ্গ হল বেশ্যাপল্লী৷ বারবনিতারা দেহের পসরা সাজিয়ে মেলার এক প্রান্তে বসে গিয়েছে৷ তারাশঙ্করের বহু রচনায় মেলাতে বেশ্যাপল্লী বসার বিবরণ রয়েছে৷

চ. মন্বন্তর :

‘মন্বন্তর’ উপন্যাসে (১৯৪৪) ‘মন্বন্তর’ বলতে শুধু দুর্ভীক্ষকে বোঝাননি কথাকার—বুঝিয়েছেন মহাকালের পদধ্বনিকে৷ এর প্রেক্ষাপটে যতই অন্নাভাবে বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ঘটুক এর কাল মহাকালের প্রলয় নৃত্যের একপদপাত মাত্র৷ এ সময়ে দেশে ও সমাজে যুগ বিপ্লবের দামামা বেজেছিল৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন ভারতবর্ষের পূর্ব সীমান্তের কাছাকাছি৷ যুদ্ধকালীন জীবনের বিচিত্র ও বহুমুখী সমস্যা, সংশ্লিষ্ট রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি৷ এর পটভূমিতে আছে বিবরণে, বর্ণনায়, সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে, আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রনায়কদের ঘোষণায় ও বক্তৃতায়৷ এছাড়া জমিদারি ব্যবস্থার ভাঙ্গন, বিলাস-ব্যসনের কদাকার রূপ, নানা যৌনব্যাধি উপন্যাসের অবয়বকে সমৃদ্ধ করেছে৷ আর এই সব ঘটনারাজীর পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে গণিকা জীবনের করুণ ইতিহাস৷

উপন্যাসের নায়ক কানাই চক্রবর্তী বংশের সন্তান৷ তাদের তৃতীয় প্রজন্মের প্রতিনিধি সে৷ সে বাদ দিয়ে সকলেই পূর্ব-পুরুষদের যৌনবিলাসের কদাচার রোগে জীর্ণ৷ তাদের অতীত ইতিহাস ব্যক্ত করতে গিয়ে উল্লিখিত হয়েছে তারা বাহির বাড়িতে নিয়মিত বাইজি এনে রূপসুধা পান করতো৷ দ্বিতীয়পুরুষ মেজকর্তার মুখে বর্ণিত হয়েছে চক্রবর্তী পরিবারের চরম ব্যভিচারময় জীবনের কথা৷ কানাই ছাত্রকে ভালো ‘রেজাল্ট’ করানোর গৌরবে একশত টাকা প্রণামী পেলে তা নিয়ে বাড়িতে যখন প্রায় একটা শোরগোল পড়ে যায় তখন মেজকর্তা জানায় কালীঘাটের বস্তি বিক্রি করে প্রাপ্ত দেড়লক্ষ টাকার সৎব্যবহারের কথা৷ ‘‘রতন-বাঈয়ের বাড়িতে সন্ধ্যে থেকে বারোটার মধ্যে দেড় হাজার টাকা পায়রার পালকের মত ফুঁয়ে উড়ে গেল৷’’২৪৬ অর্থাৎ নিজের পিতৃপুরুষের জমানো বিষয় বিক্রি করে তা দিয়ে বারবিলাসিনী নারীদের তোষামোদকারী হয়ে সমাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রবণতা লক্ষণীয়৷ রতন বাঈ নাম্নী কোনো এক বারাঙ্গনার সান্নিধ্যে সে দেড়হাজার টাকা উড়িয়েও সেই পাপাচার নাতির সম্মুখে সগর্বে ঘোষণা করে৷ শুধু সেখানেই থেমে থাকেনি মেজকর্তা চিৎপুর রোড দিয়ে জুড়িগাড়িতে করে ফেরার সময় গ্যাসপোষ্টের আলোর নীচে দাঁড়িয়ে থাকা শীতে কাতর বেশ্যাদলের খদ্দের সংগ্রহের প্রচেষ্টা দেখে তার মনে দয়া জেগে উঠে এবং ‘‘পরের দিন রাত বারোটায় জুড়ী নিয়ে বেরুলাম—সঙ্গে একশোখানা আলোয়ান—সে আমলে একখানার দাম আট টাকা৷’’২৪৭ পরেরদিন নাকি কলকাতায় গুজব রটে দিল্লীর বাদশাহের কোন এক বংশধর কলকাতায় ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ মেজকর্তার এই কথা শুনে তৎকালীন সময়ে গণিকাদের একটা রূপ কল্পনা করে নিতে অসুবিধা হয় না৷ সমাজে উচ্চশ্রেণীর গণিকা রতন বাঈদের জীবনে আরাম-আয়েশ যতটা পরিমাণে ছিল নিম্নশ্রেণীর দেহজীবী যারা রাস্তায় বেড়িয়ে গ্যাসপোষ্টের আলোর নীচে দাঁড়িয়ে খদ্দের সংগ্রহ করে তাদের দুর্দশার অন্ত্য ছিল না৷ হয়তো শীতের কাপড় কেনার মতো সামর্থ্যও তাদের থাকতো না৷ মেজকর্তার মতো কিছু মানুষ যারা ভোগের উপকরণের মধ্যেও গণিকাদের প্রতি কিছুটা হলেও সহানুভূতিশীল তাদের দ্বারা গণিকারা কদাপি কশ্চিৎ উপকৃত হতো বলে মনে হয়৷

এছাড়া যুদ্ধের বাজারে দারিদ্র্যের ভয়াবহ পীড়নে বাবা-মায়েরা নিজেদের সন্তানকে বেচে দিতে দ্বিধা করে না এমন ঘটনাও বিরল নয়৷ গীতার জীবন এর প্রমাণ৷ গীতা দরিদ্র পিতার এবং ভদ্র বংশের কন্যা৷ সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনার পর বাবার চাকরি চলে যাওয়ায় তার আর পড়া হয়নি৷ পিতার পূর্বজীবনের তীব্র অনাচার-বিলাসিতায় শরীরে ভয়ানক মারণ রোগ বাসা নিয়েছে৷ সেই রোগের তাড়নায় এবং প্রবল আর্থিক অনটনে তার বাবা-মা ঘটকী প্রৌঢ়ের প্রলোভনে তাকে বিক্রি করে দেয়৷ সেই ঘটকী রমণী দেহব্যবসায়ের দালাল গোত্রীয়৷ বাবা-মায়ের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে সে গীতাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়৷ সেই ঘটকীর বাড়ি সম্পর্কে লেখক বলেছেন—‘‘তার সে বাড়ীতে চলে গোপন দেহ-ব্যবসায়৷ ঘটকী তাকে সেই ব্যবসায়ের পণ্য হিসেবে বিক্রী করেছে৷’’২৪৮ শুধু ঘটকী নয় সেখানে মেয়েকে এক ঘৃণ্য পেশায় নিয়োজিত করে আর্থিক সঙ্গতি ফিরিয়ে আনার চেষ্টায় গীতার বাবা-মায়ের যে ভূমিকা রয়েছে তা গীতার কথাতেই স্পষ্ট৷—‘‘মা জানে কানুদা, মা জানে৷… নিশ্চয় জানে৷ নইলে যাবার সময় আমায় কেন সে বললে—বামুনদিদি যা বলবে, তাই শুনিস মা৷ তোর দৌলতে যদি দুটো খেতে পরতে পাই; নইলে না খেয়ে শুকিয়ে মরতে হবে৷’’২৪৯ গীতা সেদিন কানাই-এর তৎপরতায় তার দৈহিক শুচিতা হারিয়েও রক্ষা পেয়েছিল গণিকা হয়ে ক্রমাগত যৌন পীড়নের হাত থেকে কিন্তু যারা কানাই-এর মতো উদার ছত্রছায়া পায়নি তারা জীবনভর সেই নরকেই পচে মরেছে৷ যে সীমাহীন পাশবতায় বাবা-মা তাদের পেটের সন্তানকে বিক্রয় করে দিতে পারে সে পাশবতা যে ক্ষুধার চেয়ে বড় নয়৷ এই সহজ সত্যটির মধ্য দিয়ে রচনাকার তৎকালীন সময়ের নারীদের গণিকা হয়ে যাওয়ার নানা চিত্র উৎঘাটিত করেছেন৷ উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র বিজয়বাবুর কথার ঔদাসীন্যের মধ্যে দিয়ে সে চিত্রকে অনুধাবন করা যায়—‘‘মেয়েরা বাল্যে বাপের সম্পত্তি—যৌবনে স্বামীর, তার পরে পুত্রের৷ দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে বাপ-স্বামী কন্যা পত্নী বিক্রী করে আসছে৷…আর পৃথিবীতে রাষ্ট্রবিপ্লব কদাচিৎ হলেও দুর্ভিক্ষ তো চিরস্থায়ী অবস্থা৷ ধনী আর দরিদ্র নিয়ে পৃথিবী—দরিদ্রের মধ্যে দুর্ভিক্ষ চিরকাল৷ সুতরাং কেনা বেচা চিরকাল চলছে৷ এই কলকাতা শহরে ওটা একটা চিরকেলে ব্যবসা৷ শুধু কলকাতা কেন, যে কোন দেশের পুলিস রিপোর্ট দেখ তুই, দেখবি ব্যবসাটা প্রাচীন৷’’২৫০

মেয়েদের গণিকা তৈরি করে, বিভিন্ন অলিগলির ভিতরে কোথায় কোন শ্রেণীর গণিকা বসবাস করে তার বিস্তারিত খোঁজ দিয়ে বহু পুরুষ ও দালাল কলকাতা শহরে জীবন-জীবিকা চালিয়ে যায় তার কথাও উঠে এসেছে ‘মন্বন্তর’ উপন্যাসে৷

ছ. কবি :

বসন্ত :

‘কবি’ (১৯৪২) উপন্যাসের বসন স্বৈরিণী, স্বেচ্ছাচারিণী৷ সে মাসি পরিচালিত ঝুমুরদলের নর্তকী গায়িকা৷ সে ঝুমুর গানের পাশাপাশি দেহ ব্যবসা করে৷ তার কাছে প্রেম দেহজ এবং পণ্য৷ ঝুমুর দলের সঙ্গে বসন্তের প্রথম আবির্ভাব উপন্যাসের অষ্টম পরিচ্ছেদে৷ ঝুমুরদলের সবচেয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে ছিল সে৷ পথশ্রমের ক্লান্তিতে সে যখন চা প্রার্থনা করে সামনে এগিয়ে আসে তখন নিতাই দেখে—‘‘একটি দীর্ঘ কৃশতনু গৌরাঙ্গী মেয়ে৷ অদ্ভুত দুইটি চোখ৷ বড় বড় চোখ দুইটার সাদা ক্ষেতে যেন ছুরির ধার,—সেই শাণিত-দীপ্তির মধ্যে কালো তারা দুইটা কৌতুকে অহরহ চঞ্চল৷’’২৫১ তার সেই চঞ্চল চোখের দৃষ্টি বৈশাখের মধ্যাহ্নে নেচে বেড়ানো মধুপ্রমত্ত মরণজয়ী দুটো কালো ভ্রমরের সঙ্গে উপমিত হয়েছে৷ বসন্তের কথার মধ্যে যেন একটা অনির্দেশ্য শ্লেষ, ব্যঙ্গ সদা প্রচ্ছন্ন থাকে৷ তার হাসির ধারে তার ভেতরকার অভিব্যক্তি ফুটে উঠে এবং মানুষের মনকে যেন কেটে টুকরো টুকরো করে ধুলোর মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দেয়৷

তারা নিতাই এর বাসস্থান রেলওয়ে কুলি-ব্যারাকের বারান্দায় আশ্রয় নেয়৷ সেখানে নিজের রূপের গরবে গরবিনী বসন্তের সঙ্গে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ-পরিহাসে নিতাই-এর গৃহপ্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে উঠে৷ নিতাই-এর কালো গাত্রবর্ণ ঘৃণার উদ্রেক করে সেই নিম্নশ্রেণীর পণ্যাঙ্গনার মনে৷ তার শাণিত ব্যঙ্গে ছিন্নভিন্ন করে দিতে চায় নিতাইকে৷ লেখক ঝুমুর সম্পর্কে তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন—‘‘বহু পূর্বকালে ঝুমুর অন্য জিনিস ছিল, কিন্তু এখন নিম্নশ্রেণীর বেশ্যা গায়িকা এবং কয়েকজন যন্ত্রী লইয়াই ঝুমুরের দল৷ আজ এখানে, কাল সেখানে করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়, গাছতলায় আস্তানা পাতে৷ কেহ বায়না না করিলেও সন্ধ্যার পর পথের ধারে নিজেরাই আসর পাড়িয়া গান-বাজনা আরম্ভ করিয়া দেয়৷ মেয়েরা নাচে, গায়—অশ্লীল গান৷ ভনভনে মাছির মত এ রসের রসিকরা আসিয়া জমিয়া যায়৷’’২৫২ ঝুমুর দলের মেয়েরাও নিম্নশ্রেণীজাত৷ আক্ষরিক কোনো শিক্ষাই এদের নেই; কিন্তু সঙ্গীত ব্যবসায়িনী হিসেবে একটা অদ্ভুত সংস্কৃতি এদের আছে৷ পালাগানের মধ্য দিয়ে এরা পুরাণ জানে, পৌরাণিক কাহিনির উপমা দিয়ে প্রশংসা বা ব্যঙ্গ করলে সেটাও বুঝতে পারে৷ তাই বসন্তকে নিয়ে যখন নিতাই গান বাঁধে—

 ‘‘প্রেমডুরি দিয়ে বাঁধতে নারলেম হায়,

 চন্দ্রাবলীর সিঁদুর শ্যামের মুখচাঁদে!

 আর কি উপায় বৃন্দে—এইবার দে এনে দে—

 বশিকরণ লতা—বাঁধব ছাঁদে ছাঁদে৷’’২৫৩

নিতাই এর গানের গুঢ় অর্থ শুধু বসন্ত নয় দলের সকল মেয়েরাই বুঝতে পারে যা সকলের কাছে পীড়াদায়ক হয়ে উঠলে বসন্ত তার সহজাত ক্ষমতায় সকলের হয়ে জবাব দেয়—

‘‘উনোন-ঝাড়া কালো কয়লা—আগুন তাতে দিপি-দিপি! ছেঁকা লাগে!’’২৫৪

এভাবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে, শাণিত বাক্যবাণে উপন্যাসে আবির্ভাবেই বসন্ত তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে পাঠকের সামনে তুলে ধরে৷

বসন্ত নিম্নশ্রেণীর দেহজীবী হলেও তার রুচিবোধ দলের অন্যান্য মেয়েদের থেকে স্বতন্ত্র৷ সে নিজে পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে—সময়ে অসময়ে স্নান করে তার প্রমাণ দেয়৷ দলের প্রত্যেক মেয়ের নিজ নিজ প্রেমাস্পদজন থাকলেও তার রুচিবোধ দলের পুরুষগুলির মধ্য থেকে কেউকে কাছের মানুষ হিসেবে ভাবতে পারে না৷ সে সম্পর্কে লেখক জানিয়েছেন—‘‘সে কাহাকেও সহ্য করিতে পারে না৷ কেহ পতঙ্গের মত তার শাণিত দীপ্তিতে আকৃষ্ট হইয়া কাছে আসিলে মেয়েটার ক্ষুরধারে তাহার কেবল পক্ষচ্ছেদই নয়, মর্মচ্ছেদও হইয়া যায়৷’’২৫৫

বসন্ত নিতাই-এর নাম দিয়েছে কয়লামানিক৷ সে তার মৎসাসক্তির কথা জানিয়ে নিতাইকে চার পয়সার মাছ আনতে অনুরোধ করলে নিতাই যখন তার হাত ঈষৎ সরিয়ে তার স্পর্শ বাঁচিয়ে আলগোছে পয়সা গ্রহণ করে তখন বসন্তের ঠোঁটের দুই কোন তীব্র অপমানে গুণছেঁড়া ধনুকের মতো বেঁকে ওঠে৷ সে অস্পৃশ্যতার প্রসঙ্গ টেনে নিতাইয়ের কাছে জানতে চায় তার মতো দেহজীবিনীর হাতের ছোঁয়া পেলে তার স্নান করতে হবে কি না৷ তার সেই শাণিত ব্যঙ্গের জবাব নিতাই দেয় হাসিমুখে৷ সে কয়লার ময়লা বসন্তের রাঙা হাতে লাগাতে চায় না৷ তার সেই কথায় বসন্তের যে প্রতিক্রিয়া তাতে বসন্তর অদ্ভুত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন লেখক৷ বসন্তের হাতের পয়সা আপনিই খসে নিতাই-এর হাতে পড়ে যায়৷ মুহূর্তে ধনুকের গুণ যেন ছিঁড়ে যায়৷ তার অপর প্রান্ত থেকে থর থর করে কেঁপে উঠে৷ পর মুহূর্তে সে কম্পন তার বাঁকা হাসিতে রূপান্তর গ্রহণ করে৷ তার সেই রূপান্তর দেখে নিতাই-এর বিস্ময়ের সীমা থাকে না৷ তার মনে হয় বসন্ত যেন গল্পের মায়াবিনী; প্রতিদ্বন্দ্বী সাপ হলে সে বেজি হয়৷ আর প্রতিদ্বন্দ্বী যদি বিড়াল হয়ে সেই বেজিকে আক্রমণ করে তাহলে সে বেজি থেকে হয়ে যায় বাঘিনী৷ কান্না মুহূর্তে তার বাঁকা হাসিতে রূপান্তর গ্রহণ করে ৷ হেসে জানায় সেই জন্যই সে আলগোছে দিল৷ এই স্বৈরিণী নারী দেহের পসরা সাজায়—ভালোবাসার বিকিকিনি করে পুরুষের প্রবৃত্তির দাহ শান্ত করে—আর সেই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যেন তার সহজাত কৌশল হয়ে উঠে৷

তারপর সন্ধ্যাকালে শুরু হয় বসন্তর ঝুমুরের আসর৷ নিতাই তার নাম দিয়েছে শিমুল ফুল—যার শুধু রঙটাই সার৷ নিতাই সেই আসরে নিজের বানানো গান গেয়ে দর্শকদের মাত করে দিলে তার খোঁচা এসে লাগে বসন্তের গায়ে৷ সে চুক্তিবদ্ধ হয়েও প্রচণ্ড রাগে আসর ছেড়ে বেড়িয়ে যেতে চাইলে তার কাছে নতি স্বীকার করে নিতাই তাকে ফিরিয়ে আনে৷ বসন্ত মদ খেয়ে শুরু করে তার ছুরির ধারের মতো কন্ঠ দিয়ে অদ্ভুত সুরবিতান৷ সেই তালে তার সুন্দর কমনীয় দেহখানিও নৃত্যচাপল্যে উদ্বেল হয়ে ওঠে৷ চারিদিক থেকে প্যালা পড়ে আসর ভরে যায়৷ শরীরে প্রচণ্ড জ্বর নিয়েও নির্জলা মদ খেয়ে সে পুনরায় তার নৃত্য-গীত শুরু করে৷ তারপর কারও অনুমতি না নিয়েই নিজের খেয়ালে আসর থেকে বেড়িয়ে এসে নিতাই-এর বিছানায় শুয়ে পড়ে৷ নিতাই লক্ষ্য করে বসন্তদের আগমন দেখেই হিংস্র শাপদের মতো তাদের শরীরের লোভে চলে এসেছে পাড়ার কয়েকজন যুবক৷ তার মধ্যে কাসেদ শেখের ছেলে নয়ান প্রধান৷ বসন্ত জানে তাদের রাত্রির ভয়ানক অভিজ্ঞতা৷ তারা বাধা মানবে না—হয় তো পাঁচিল টপকে এসেই তার শরীরকে নির্মমভাবে উপভোগ করে যাবে৷ জ্বর এবং শরীরের ক্লান্তিতে সে তাদের হাত থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য নিতাইকে বলে দরজা বন্ধ করে দিতে৷ তার সঙ্গে কথোপকথনের সময় হঠাৎ সে বুঝতে পারে জানালা দিয়ে কোনো নারীমূর্তি তাদের অনুসরণ করছে৷ তার বুঝতে অসুবিধা হয় না সেই নারীর হৃদয়ের অভিব্যক্তি৷ নিমেষেই সে নিতাই-এর ঘর থেকে বেড়িয়ে গিয়ে কাসেদ শেখের ছেলের সঙ্গে দেহের দরাদরি করতে চলে যায় এবং তার সঙ্গেই পূর্বদিকের গভীরতম অন্ধকারের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়৷ তার পর তারা বসন্তকে দেখে একজন পশুর জান্তব লালসার শিকার হয়ে ‘‘হতচেতনের মত অসম্বৃত দেহে পড়িয়াছিল৷… কেশের রাশ বিস্রস্ত অসম্বৃত, সর্বাঙ্গ ধুলায় ধূসর, মুখের কাছে কতকগুলো মাছি ভনভন করিয়া উড়িতেছে; পাশেই পড়িয়া আছে একটা খালি বোতল, একটা উচ্ছিষ্ট পাতা৷’’২৫৬ নিতাই-এর তৎপরতায় তার সম্বিত ফিরে আসে৷ নিতাই-এর মনের মানুষের কথা সবার কাছে ব্যক্ত করে প্রবল হাসির জোয়ারে সে তাদের দলের সঙ্গে সে স্থান ত্যাগ করে৷

তারপর আবার বসন্তের দূত হয়ে নিতাইয়ের কাছে যায় বেহালাদার৷ রাসপূর্ণিমায় আলেপুরে বিখ্যাত মেলা৷ সেখানে ঝুমুর দলের মুখপাত্র হিসেবে তাকে গান গাইতে হবে কারণ তাদের দলের গায়ক বসন্তর সঙ্গে ঝগড়া করে তার পদাঘাতে অপমানিত হয়ে দল ছেড়ে অন্য দলে চলে গেছে৷ নিতাই তাদের একমাত্র ভরসাস্থল৷ সে মেলায় প্রবেশ করেই দেখে মেলার বৈচিত্র্যময় রূপ৷ মেলার বিভিন্ন পটি অতিক্রম করে তারা একেবারে বিপরীত প্রান্তে চলে আসে৷ ‘‘এখানে আলোকের সমারোহটা কম, কিন্তু লোকের ভিড় বেশি৷ মেলার এই প্রান্তে একটা গাছের তলায় খড়ের ছোট ছোট খানকয় ঘর বাঁধিয়া ঝুমুরের দলটি আস্তানা গাড়িয়াছে৷ আশেপাশে এমনি আরও গোটাকয়েক ঝুমুরের দলের আস্তানা৷ একপাশে খানিকটা দূরে জুয়ার আসর৷ তাহারই পর চতুষ্কোণ আকারের একটা খোলা জায়গায় সারি সারি খড়ের ঘর বাঁধিয়া বেশ্যাপল্লী বসিয়া গিয়াছে৷ সে যেন একটা বিরাট মধুচক্রে অবিরাম গুঞ্জন উঠিতেছে৷’’২৫৭ অর্থাৎ আলেপুরের মেলার অন্ধকারময় সর্পিল পরিবেশে দেহকামনার পান্থশালা নারীদেহ ভোগের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে৷

ঝুমুর দলে নিতাই সাদর আমন্ত্রণে আপ্যায়িত হয়৷ দলের অন্য মেয়েরা সহোদরার মতো তাকে আপন করে নেয়৷ বসন্ত মদ খেয়ে মদ্যপ হয়ে দেহব্যবসার আসর পাতে৷ তার ঘরেই খদ্দেরের ভিড় বেশি৷ সে লক্ষ্য করে বসন্তর ঘর থেকে দুজন আগন্তুক ইতিমধ্যেই চলে গেছে৷ আবার নতুন আগন্তুক এসে উপস্থিত হয়েছে৷ পরদিন বসন্ত আরেক নারী৷ নিকানো মুছানো উঠানে লালপাড় শাড়ি পড়ে ভেজাচুল পিঠে এলিয়ে পুণ্যবতী নারী হিসেবে প্রতিভাত হয়৷ সেখানে তার প্রবল মদ্যাশক্তি, নিষ্ঠুর বাক্যবাণ কিছুই কূল পায় না৷ শুদ্ধ ব্রতচারিণীর ন্যায় লক্ষ্মীপূজা করে সে পরিপাটী করে ঠাঁই করে একটা পাতায় ফলমূল, সন্দেশ সাজিয়ে দেয়৷ নিতাই তার সেই রূপে মুগ্ধ হয়ে যায়৷ তার মনে হয়—‘‘সেই বসন এমন হইতে পারে৷’’২৫৮ শুধু এখানেই নয় ঝুমুরের আসরেও বসন্ত আরেক বসন্ত৷ সাধারণ সাজপোশাকে, চোখের সুস্থ সাদা দৃষ্টিতে তার অন্য আরেক রূপ৷ নিতাই তার সেই চোখ দেখে ভাবে—‘‘অদ্ভুত দৃষ্টি বসন্তের! চোখে মদের নেশায় আমেজ ধরিলে তাহার দৃষ্টি যেন রক্তমাখা ছুরির মতো রাঙা এবং ধারালো হইয়া ওঠে৷ আবার সুস্থ বসন্তের চোখ দেখিয়া মনে হইতেছে—এ চোখ যেন রূপার কাজললতা৷’’২৫৯ নিতাই-এর তত্ত্বগানে তাদের আসর ফিকে হয়ে মর্মান্তিক পরাজয় ঘটে৷ বসন তা মেনে নিতে পারে না৷ কারণ—‘‘নিম্নশ্রেণীর দেহব্যবসায়িনী রূপ-পসারিণী তাহারা, দেহ ও রূপ লইয়া তাহাদের অহংকার আছে, কিন্তু সে শুধু অহঙ্কারই—জীবনের মর্যাদা নয়৷ কারণ তাহাদের দেহ ও রূপের অহঙ্কারকে পুরুষেরা আসিয়া অর্থের বিনিময়ে পায়ে দলিয়া যায়৷ পুরুষের পর পুরুষ আসে৷ দেহ ও রূপকে এতটুকু সম্ভ্রম করে না, রাক্ষসের মত ভোগই করে, চলিয়া যাইবার সময় উচ্ছিষ্ট পাতার মত ফেলিয়া দিয়া যায়৷’’২৬০ তাই তাদের জীবনের সকল মর্যাদা পুঞ্জীভূত হয়ে আশ্রয় নিয়েছে নৃত্য-গীতের অহংকারটুকুর মধ্যে৷ নৃত্য এবং গীতই তাদের জীবনের একমাত্র সত্য; তারা বোঝে ভাল নাচ গানের যে কদর তা মেকি নয়৷

ঝুমুরের আসরে শোচনীয় পরাজয়ে বসন্ত আকণ্ঠ মদে নিমজ্জিত হয়৷ নিতাই তাকে ডাকতে এসে তার সেই আগুনের ছটায় বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে বসন সক্রোধে চর বসিয়ে দেয় নিতাইয়ের গালে৷ আহত নিতাই তাদের দলের আগলদার লোকটির কাছ থেকে মদ্য পান করে মদের নেশায় অন্য আরেক মানুষ হয়ে উপস্থিত হয় আসরে৷ বিবেক বর্জিত বীরবংশী রক্তের বর্বরত্বের মৃতপ্রায় বীজানুগুলি মদের স্পর্শে জেগে উঠলে তার অশ্লীল গানে আসর মাতোয়ারা হয়ে যায়৷ আর নতুন উত্তেজনায় তখন বসন্তও পুনরায় আসরে এসে নাচতে শুরু করে৷

বসন্তের মনে ধীরে ধীরে অনুরাগের জন্ম হতে থাকে৷ যে বসন্ত একদিন মনে করেছিল প্রেম শুধুই দেহ, প্রেম শুধুই পণ্য, নিতাই-এর স্পর্শে সেই প্রেমানুভূতি অন্য মাত্রা লাভ করে৷ তার কাছ থেকে বিলাতি মদ খেতে খেতে নিতাই যখন মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার মুখটাকে ভালো করে দেখার অভিলাষ জানায় তখন সেই লজ্জাহীনা বসন্তর মুখও নবপ্রেমানুরাগে রাঙা হয়ে ওঠে৷ পরক্ষণে নিতাইয়ের থেকে এক পা পিছিয়ে গিয়ে তার গোপন রোগের কথা জানিয়ে তাকে সাবধান করতে চায়, যে তার কাশ রোগ আছে এবং মধ্যে মধ্যে কাশির সঙ্গে রক্ত ওঠে৷ পরম আবেগে তার চোখ থেকে ফোটা ফোটা জলও ঝরতে থাকে৷ কিন্তু নিতাই-এর যে বর্বর বিজানুগুলি অন্তরে ক্রিয়াশীল৷ কোনো বাধাই তার আর বাধা নয়৷ তাই পরম আবেগে সে যখন তাকে আবদ্ধ করেছে নিজের বাহুর বন্ধনে তখন তার কাছে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে পিষ্ট হতে হতে সে গেয়েছে—

 ‘‘বঁধু তোমার গরবে গরবিনী হাম গরব টুটাবে কে৷

 ত্যেজি’ জাতি-কুল বরণ কৈলাম তোমারে সঁপিয়া দে!…

 পরাণ-বঁধুয়া তুমি,

 তোমার আগেতে মরণ হউক এই বর মাগি আমি৷’’২৬১

নিতাইকে দেহ-মন সমর্পণ করে অন্য মানুষ হয়ে উঠেছে বসন্ত৷ নবপ্রেমের জোয়ারে তার মধ্যে জাগরিত হয়েছে সুন্দর এক সুখ স্বপ্ন৷ নানা রকম ছবি দিয়ে কয়েকদিনের জন্য নির্মিত ঘরটিকে সুসজ্জিত করে তুলেছে, নিজের হাতে নিতাই-এর বমি করে নোংড়া করা সমস্ত কাপড়-চোপড় কেচে দিয়েছে৷ নিতাইকে মদের আবেশ থেকে মুক্ত করতে কাঁচা চা করে দিয়েছে, নিজের বহু যত্নের ‘ফুলেল তেল’, সাবান বের করে দিয়েছে৷ কিন্তু সেই আপ্যায়ন, মদ্যপান, নাচ গান সমস্তই নিতাই-এর স্বভাব বিরুদ্ধ৷ সে সব কিছু ফেলে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়৷ বাজার ঘুরে আসার নাম করে বেড়িয়ে পড়তে চাইলে সমস্তটা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না বিচক্ষণ বসন্তর৷ নিতাই-এর মনে হয় বসন্তর চোখের দৃষ্টি ছুরি নয় সূচ—যেন বুকের ভিতের বিঁধে ভিতরটাকে তন্ন তন্ন করে দেখতে পায়৷ নিতাই-এর যাওয়া হয় না—বসন্ত তার সঙ্গে যায়৷ সাধারণ গৃহস্থ নারীর মতোই সে নানা জিনিস কিনে পুরা একটা টাকাই খরচ করে ফেলে৷ তারপর মন্দিরের প্রাঙ্গণে কানা-খোঁড়াদের পয়সা দেওয়ার জন্য চারটি আধুলি তুলে রাখে৷ কানা-খোঁড়াদের প্রতি বসন্তর ভয়ঙ্কর সমবেদনা৷ সুস্থ মস্তিষ্কে একাকী নিতাইকে পেয়ে তার সমস্ত বেদনা—হৃদয়ের সমস্ত অভিব্যক্তি সুন্দর ভাবে ফুটে উঠে৷ একজন পতিতা নারীর জীবনের প্রকৃত পরিণতি যেন তার মুখ দিয়ে স্পষ্ট হয়ে বেড়িয়ে আসে৷ সে নিতাইকে জানায় তার জীবনেও কষ্টের শেষ হবে না৷ কারণ তার কাশির সঙ্গে রক্ত উঠে৷ সেই রক্তের ভয় কাটানোর জন্য সে বেশি করে পান-দোক্তা খেয়ে মুখ লাল করে রাখে৷ তার সেই অসুখের খবর জানে শুধু মাসি৷ অন্য কেউ জানে না৷ জানলে হয় তো তাদের দল ভেঙে যাবে৷ সে বলে—‘‘কিন্তু এখনও নাচতে গাইতে পারি, চটক আছে, পাঁচটা লোক দেখে বলেই দলে রেখেছে৷ যেদিন পাড়ু হয়ে পড়ব, সেদিন আর রাখবে না, নেহাৎ ভাল মানুষের কাজ করে তো নোক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে৷ নইলে যেখানে রোগ বেশি হবে, সেইখানেই ফেলে চলে যাবে, গাছতলায় মরতে হবে৷ জ্যান্ততেই হয়তো শ্যাল-কুকুর ছিঁড়ে খাবে৷’’২৬২ সে রোগটিকে দমিয়ে রাখার জন্য রোজ সকালে নিয়ম করে দুর্বা পাতার রস থেতো করে খায়৷ কখনো কখনো আবার ভুলেও যায়, উশৃঙ্খল জীবন যাপনে সে নিয়মের ব্যতিক্রম প্রায়ই হয় তখন মাসি তাকে মনে করিয়ে সচেতন করে৷ তার সৃজিত বিষন্নতার পরিবেশকে মুহূর্তেই আবার ঠাট্টা তামাশায় ভরিয়ে তোলে সে নিজেই৷ নিতাইকে ঠাট্টা করে বলে—‘‘গাঁটছড়া বাঁধবে নাকি? গাঁটছড়া?’’২৬৩ এবং সেই ঠাট্টাতে সত্যসত্যই নিতাই যখন তার শাড়ির আঁচলখানি টেনে নিজের চাদরের খুঁটের সঙ্গে বাঁধতে আরম্ভ করে তখন বসন্ত আর্তনাদ করে উঠে৷ নিতাই যখন তাকে জানায় যে ‘‘গিঁট আগেই পড়ে গিয়েছে বসন৷ টেনো না৷ আমি যদি আগে মরি, তবে তুমি সেদিন খুলে নিও এ গিঁট; আর তুমি যদি আগে মর, তবে সেই দিন আমি খুলে নোব গিঁট৷’’২৬৪ নিতাই-এর এই উক্তিতে বসন্ত থরথর করে কাঁপতে থাকে৷ তার রক্তাভ সুগৌর মুখটা যেন সঙ্গে সঙ্গে সাদা হয়ে যায়৷ দর্পিতা, গরবিনী বসন্ত যেন একমুহূর্তে কাঙালিনি হয়ে যায়৷ ঠাকুরের সামনে গাঁটছড়া বেঁধে নতুন জীবনের স্বাদ নিতে তারা আবার উপস্থিত হয় তাদের দলের কুটিরে৷

শুরু হয়ে যায় বসন্ত-নিতাই-এর নতুন অধ্যায়৷ নিতাইকে সম্বল করে তাদের দল নানা স্থানে ঘুরতে থাকে৷ তার সংস্পর্শে বসন্তের জীবনেও অনেক পরিবর্তন আসে—সে মদ খাওয়া কমিয়ে দেয়, দূর্বার রস নিয়মিত খায়, কথার ধার আছে কিন্তু জ্বালা কমে গিয়েছে, তেমন তীক্ষ্ণ কন্ঠে আর খিল খিল করে হাসে না—মুচকে মৃদু মৃদু হাসে৷ স্বাস্থ্যও তার আগের চেয়ে ভালো হয়েছে—শীর্ণ রুক্ষ মুখটা নিটোল হয়ে ভরে এসেছে, দীপ্ত গৌর বর্ণে শ্যাম আভাস দেখা দিয়েছে৷ শুধু তার পূর্ব রূপ ফিরে পাওয়া যায় সন্ধ্যার পর—‘‘সন্ধ্যার পর হইতেই সে উগ্র হইয়া উঠে৷ এটা তাহাদের দেহের বেসাতির সময়৷ সন্ধ্যার অন্ধকার হইলেই ক্রেতাদের আনাগোনা শুরু হয়৷ মেয়েরা গা ধুইয়া প্রসাধন করিয়া সাজিয়াগুজিয়া বসিয়া থাকে৷ তিনজনে তখন তাহারা বসে একটি জায়গায়৷ অথবা আপন আপন ঘরের সম্মুখে পিঁড়ি পাতিয়া বসে—মোট কথা, এই সময়ের আলাপ-রঙ্গরহস্য সবই মেয়েদের পরস্পরের মধ্যে আবদ্ধ৷’’২৬৫ এই কাজ থেকে তাদের নিষ্কৃতি নেই—মাসি মুক্তি দেয় না৷ আবার তারা নিজেরাও দেহব্যবসাটাকে ছাড়তে পারে না৷ সেই সন্ধ্যারাত্রিটুকু বাদ দিয়ে নিতাই-বসন্তর জীবন মাধুর্যে ভরা৷ নতুন নতুন গান বেঁধে ঝুমুরের আসর মাতিয়ে দিয়ে বসন্তর মনে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে নিতাই৷ নিতাই যেদিন আকন্ঠ মদ পান করে সেই দিনটি হয় বসন্তের সবচেয়ে প্রিয় দিন৷ কারণ ঐরকম এক দিনেই নিতাইকে সে দেহ-মনে লাভ করেছিল, সে আত্মসমর্পণ করেছিল তার কাছে৷ তারপর নিতাই-এর নতুন বাঁধা এক গানে বিহ্বল হয়ে যায় বসন৷ সে যখন তাকে শোনায়—

 ‘‘এই খেদ আমার মনে মনে৷

 ভালোবেসে মিটল না আশ—কুলাল না এ জীবনে৷

 হায়, জীবন এত ছোট কেনে?

 এ ভুবনে?’’২৬৬

মুহূর্তে যেন একটা কাণ্ড ঘটে যায়৷ গানটা শুনে মনে হয় সে যেন পাথর হয়ে গেছে৷ সে গভীর আশঙ্কায় তাকে বলে—‘‘এ গান তুমি কেনে লিখলে কবিয়াল?… আমি তো এখন ভাল আছি কবিয়াল—তবে তুমি কেনে লিখলে, কেনে তোমার মনে হ’ল জীবন এত ছোট কেনে?’’২৬৭

বসন্ত মদ খেয়ে তার পূর্ব নেশা পূর্ব প্রবৃত্তির বশে বিষহীন সর্পের মতো বিনা প্রতিবাদের নিজের ঘরে ‘খদ্দের’ ঢোকায়৷ নেশার বশে কামনার সলিলে সিক্ত করে তোলে সেই পুরুষটিকে কিন্তু নেশা কেটে গেলেই সে আত্মগ্লানিতে ডুবে যায়৷ তারপর নেশার ভান করে পড়ে থাকে, কান্না করে৷ মনে মনে কল্পনা করে পরদিনই সে নিতাইকে নিয়ে আর কোথাও চলে যাবে৷ কিন্তু বহুদিনের সহাবস্থানের ফলে ললিতা নির্মলা মাসির সঙ্গে যে আত্মার যোগসূত্র তৈরি হয়েছে তা ছিন্ন করে সে কিছুতেই যেতে পারে না৷ বসন্তর মনের এটা শুভ দিক৷ সে স্বৈরিণী ব্যভিচারিণী কিন্তু সম্পর্কে মূল্য দেওয়ার বোধটুকু তার কোনো সময়ই ক্ষয়ে যায়নি৷

তারপর বসন্ত আক্রান্ত হয় বসন্ত রোগে৷ নিজেই রোগের ছোঁয়াচে শিহরিত হয়ে ওঠে৷ নিতাই-এর পরিচর্যায় একমাস রোগশয্যায় কাটানোর পর কোনোমতে উঠে বসে৷ সেই রোগের তাণ্ডবে তার অনুপম সৌন্দর্য নিঃশেষ হয়ে যায়, রুক্ষ কেশভার, শরীরে উৎকট গন্ধ এবং কঙ্কালসার৷ তার গর্বিত রূপরাশির মধ্যে শুধু অবশিষ্ট থাকে তার চোখ দুটি৷ ভস্মরাশির মধ্যে জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলজ্বল করে শুধু তার ডাগর দুই চোখ৷ নিতাই-এর সেবা শুশ্রুষায় সে বিহ্বল হয়ে যায়—অনর্গল চোখের জল ফেলতে থাকে৷ কিন্তু তারপর নিতাই যখন তার সুস্থ রূপটাকে দেখানোর জন্য আয়না এগিয়ে দেয় তখন প্রবল আত্মধিক্কারে সে আর ঠিক থাকতে পারে না৷ সেই আয়নাই নিতাইকে উদ্দেশ্য করে ছুড়ে মারে৷ নিতাই পাশ কাটিয়ে রক্ষা পেলে মাসির কঠিন শাসন তার দিকে এগিয়ে এলে নিতাই তার বিনয়বচন দিয়ে তাকে রক্ষা করে৷ পরম মমতায় তাকে আঁকরে ধরে৷ তার পর পুনরায় শুরু হয় তার ক্রন্দনধ্বনি৷ নিতাই তার কারণ জিজ্ঞেস করলে বসন্ত ভেঙ্গে পড়ে তাকে জানায়—‘‘কেনে তুমি দলে এসেছিলে তাই আমি ভাবছি৷ মরতে তো আমার ভয় ছিল না৷ কিন্তু আর যে মরতে মন চাইছে না৷’’২৬৮ বসন্ত দুর্দান্ত স্বেচ্ছাচারিণী কবিয়ালকে পেয়ে বাঁচার স্বপ্নে বিভোর কিন্তু তার মাথার উপর মারণ রোগ থাবা পেতে আছে৷ আর যেদিন নিতাই সেই মৃত্যুর গানটি বেঁধেছে সেদিন থেকেই তার সেই মৃত্যুভাবনা যেন প্রকট হয়ে উঠেছে৷ সে যেন চারিদিকে শুধু বিচ্ছেদেরই ধ্বনি শুনতে পায়, বেহালাদারের ধ্বনির মধ্যেও সেই একই মৃত্যুর সুর৷ সেই মৃত্যুই যেন সশরীরে এসে হাজির হয় তার দরবারে৷ তখন কাটোয়া শহরের একপ্রান্তে একটি জীর্ণ মাটির বাড়ি ভাড়া করে তাদের দলটি আশ্রয় নিয়েছে৷ সেখানে প্রবল জ্বরের উপসর্গ ধরে মৃত্যু এসে হাজির হয়৷ বসন্তের বারণের জন্য নিতাই ডাক্তার ডাকতেও যেতে পারে না৷ শেষ রাত্রে মরণ বিকার উপস্থিত হয় তার৷ সে যেন শুনতে পায় বিনিয়ে বিনিয়ে কান্নার মতো বেহালার বাজনা৷ নিতাই নাড়ী টিপে বুঝতে পারে তার সময় আসন্ন৷ সে যখন সকরুণ দৃষ্টিতে তাকে বলে গোবিন্দ নাম করতে, জীবনভর দুঃখ ভোগ করে সুখের মুখে ভগবানের এত বড় বঞ্চনা সে মেনে নিতে পারে না৷ তাই—‘‘ছিলা-ছেঁড়া ধনুকের মত বিছানার উপর লুটাইয়া পড়িয়া বসন্ত বলিল—না৷ কি দিয়েছে ভগবান আমাকে? স্বামীপুত্র ঘরসংসার কি দিয়েছে? না৷’’২৬৯ জীবনের পাওয়া না পাওয়ার সমস্ত ক্ষোভ আসন্ন মৃত্যুর মুখে উগড়ে শেষ মুহূর্তে সে নিবেদন করেছে—‘‘গোবিন্দ, রাধানাথ, দয়া করো৷ আসছে জন্মে দয়া করো৷’’২৭০ গোবিন্দের নাম নিতে নিতে সে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে৷ জীবনভর বঞ্চিত বসন্তর মৃত্যুর পরেও তার সামান্য কিছু অলঙ্কার তাও খুলে নেয় মাসি৷

‘কবি’-উপন্যাসের ভূমিকা লিখতে গিয়ে মোহিতলাল মজুমদার বসন্ত চরিত্রটির বাস্তব রূপের স্বরূপ উদ্ঘাটন করেছেন৷ তিনি বলেছেন—‘মেয়েটির নাম—বসন না বসন্ত৷ প্রথম হইতেই তাহার দেহে ও মনে একটা জ্বরতাপ, এবং তাহারই কারণে তাহার রূপেও একটা রক্তিমতা ফুটিয়া উঠিয়াছে, দেখা যায়৷ সে প্রেমকে—নরনারীর সহজ ধর্ম্মকে—হত্যা করিয়াছে, করিতে বাধ্য হইয়াছে; তার পর সে আর কিছুকে, কাহাকে বিশ্বাস করে না, শ্রদ্ধা করে না৷ তাহার নারীজীবন সর্ব্বস্বান্ত হইয়াছে—সে কথা সে কিছুতেই ভুলিবে না; সে নিজের প্রতিও যেমন নিষ্ঠুর, মনুষ্যজীবনের প্রতিও তেমনই উদাসীন৷… আত্মবিস্মৃতির জন্য সে দেহের লালসাকেও জীয়াইয়া রাখে৷… ঐ নারী যে-প্রেমকে হৃদয় হইতে চিরতরে নিবর্বাসিত করিয়াছিল, যে অমৃতের স্বাদ সে জীবনে কখনো পায় নাই, তাহাই যখন ধরা দিয়া তাহার প্রাণকে পিপাসার্ত করিয়াছে, তখনই,—যে-মৃত্যুকে সে এতদিন নির্ভয়ে তাহার দেহে বাসা বাঁধিতে দিয়াছিল, সেই মৃত্যু আর তর সহিল না, করাল মূর্ত্তিতে আসিয়া দাঁড়াইল৷ সেই অন্তিমকালে, এক দিকে প্রেম, অপর দিকে মৃত্যু—এই দুইয়ের মধ্যে পড়িয়া হতভাগিনীর সেই আর্ত্ত-চীৎকার—এবং মৃত্যু অপেক্ষা প্রেমই অসহ্য হইয়া উঠার যে অনিবার্য্য চেতনা—তাহাতে জীবনের বাস্তবই চিরন্তন কাব্য হইয়া উঠিয়াছে;’

দেহব্যবসার ক্লেদাক্ত পরিসরে থেকেও তার ভেতরের নারীসত্তা স্বাভাবিক জীবনের আস্বাদ নিতে চেয়েছে; নিতাই কবিয়ালের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তাকে আঁকড়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছে৷ ভালোবাসার পবিত্র স্পর্শে ধুয়ে মুছে গেছে তার সব পাপ৷ সে লোহা থেকে নিতাই কবিয়ালের স্পর্শে সোনা হয়ে উঠেছে৷

মাসি :

মাসি চরিত্রটি তারাশঙ্করের বাস্তবসম্মত এক চরিত্র৷ তার মধ্য দিয়ে লেখক গণিকালয়ের কর্তৃর এক পূর্ণরূপ ফুটিয়ে তুলেছেন৷ ঝুমুর দলের কর্তৃ সে৷ তার স্নেহ-শাসনের অটুট বন্ধনে সে তার দলটিকে বাঁচিয়ে রেখেছে—দলের সকলকে নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে৷ তার বচন অত্যন্ত বিনয়ী ধৈর্যও অপরিসীম৷ পরম ধৈর্য ও সুদৃঢ় শাসনের সঙ্গে মাসি শুধু ঝুমুর দলটিকেই নিয়ন্ত্রণ করে তা নয় তাদের নাচ-গানের বাইরে দেহব্যবসাটাকেও নিয়ন্ত্রণ করে৷ দুটো ক্ষেত্রেই দলের কর্তৃ হওয়ার সুবাদে সে উপার্জন গ্রহণ করে সে৷ আসরে প্যালার মধ্য দিয়ে যা উপার্জন হয় তা দলের প্রত্যেক সদস্যের কার্য অনুযায়ী ভাগ করে৷ তাদের দলে আটজন সদস্য৷ তিনজন মেয়ে বসন্ত, নির্মলা ও ললিতার জন্য তিন ভাগ, কবিয়ালের দুই ভাগ, মাসির এক ভাগ, বেহালাদারদের একভাগ এবং দোহার ও বাজনাদার পায় আধভাগ করে একভাগ৷ আর মেয়েদের শরীর বিক্রয়ের টাকাও তিনভাগ হয়৷ দুইভাগ পায় উপার্জনকারিণী আর একভাগ মাসি৷

মাসি বুদ্ধিমতী ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের মানুষ৷ দেহ ব্যবসায়িনী থেকেই সে আজ ঝুমুর দলে কর্তৃরূপে স্থান পেয়েছে৷ সে জানে দলের সদস্যদের মধুর বচনে ভুলিয়ে না রাখলে তার দল চলবে না—দল ভেঙে লোক বেড়িয়ে যাবে, তাই সর্বদা হাসি মুখে মধুর বচনে সকলকে তুষ্ট রাখে৷ নিতাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার পর তার গান গাওয়ার ক্ষমতা জেনে তাকে দলে টানার জন্য মাসি তার সঙ্গে ছেলে সম্পর্ক পাতিয়ে বলে—‘‘ছেলেই বলবো তোমাকে৷ অন্য লোক বলে—ওস্তাদ! রাগ করবে না তো বাবা?’’২৭১ নিতাই তার দলের গায়ক কবিয়াল তাই সে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে ‘বাবা’ ‘বাবা’ বলে তোষামোদ করে গেছে৷ বসন্ত বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ শ্রীহীন হয়ে আরোগ্য লাভ করলে সে নিজে উদ্যোগী হয়ে তেল-হলুদ মাখিয়ে স্নান করিয়ে দিয়েছে৷ এমনকি তার ছোঁয়াচে-মারণ রোগ যক্ষার কথা জেনেও সে আর সকলের কাছে গোপন করেছে৷

শুধু যে বিনয়বচন, তোষামোদ করা তা নয়৷ তার মধ্যে লক্ষিত হয়েছে একজন দক্ষ কর্তৃত্বকারিণী৷ মেয়েরা যখন নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাঁধায় তখন সে ধমকে-বুঝিয়ে তাদের বিচার করে সেই কোন্দল থামায়৷ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সেই বিচার৷ তার মধ্যে রয়েছে অসীম শাসন দক্ষতা, দলের প্রতিটি সদস্য তার শাসনকে ভয় পায়৷ তার আদেশ আহ্বান অগ্রাহ্য করার মতো ক্ষমতা কারুরই নেই৷ দীর্ঘ এক মাস রোগশয্যা থেকে মুক্ত হয়ে মানসিক অবসাদ ও আসন্ন মৃত্যু ভয়ে কাতর বসন্ত মানসিক বিপর্যয়ে নিতাইকে আয়না ছুড়ে মারলে মাসি কঠোরতর স্বরে শাসনের ভঙ্গিতে ডাক দেয় তাকে৷ মাসির সেই রূপকে, শাসন পরায়ণতাকে লেখক বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘এ মাসী আলাদা মাসী৷ নিষ্ঠুর কঠোর শাসনপরায়ণা দলনেত্রী৷ মেয়েরা হইতে পুরুষ—এমন কি তাহার নিজের ভালবাসার জন—ওই মহিষের মত বিশালকায় ভীষণদর্শন লোকটা পর্যন্ত প্রৌঢ়ার এই মূর্তির সম্মুখে দাঁড়াইতে ভয় পায়৷ নিতাইও এ স্বর, এ মূর্তির সম্মুখে স্তব্ধ হইয়া গেল৷… এ মূর্তি সে আজ প্রথম দেখিতেছে৷’’২৭২

মাসির ধর্মজ্ঞান থাক বা না থাক ব্যবসায়ীক জ্ঞান প্রবল৷ কঠোর হাতে সে সেই ব্যবসার হাল পরিচালনা করে৷ মেয়েদের প্রত্যেকের কাছের মানুষ থাকা সত্ত্বেও, বসন্তের নিতাই-এর সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার পরেও মাসির ইচ্ছানুসারে দেহের পসরা সাজাতে হয়৷ মাসির রাজত্বে তাদের না বলার উপায় নেই৷ সন্ধ্যা হলেই সে তার সম্পূর্ণ দলটা বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রাখার জন্য বাইরে এসে বসে সুপুরি কাটতে থাকে৷ লোকজন এলে মেয়েদের ডেকে এনে দেখায়, দর-দস্তুর করে, টাকা আদায় করে, গোপনে মদ বিক্রি করে৷ সেই সময় তার মূর্তি আরেক৷ গম্ভীর, কথা খুব কম, চোখের ভ্রূ দুটি কুঞ্চিত হয়ে ভ্রূকুটি উদ্যত করেই রাখে৷ দলের প্রত্যেকটি লোক তখন সন্ত্রস্ত হয়৷ বসন্ত খরিদ্দারের সঙ্গে মদ খাওয়া নিয়ে ঝগড়া বাঁধালে মৃদু তিরস্কার সে বসন্তকেই করে ৷ সে বলে একটু আধটু মদ না খেলে ঘরে লোক আসবে না৷ বসন তার প্রত্যুত্তরে ঘরে লোক নিতে অস্বীকার করলে মাসি বলে—‘‘বেশ, কাল সকালে তুমি ঘর চলে যেয়ো৷ আমার এখানে ঠাঁই হবে না৷’’২৭৩ শুধু বসন্তই নয় নির্মলা ও ললিতাও মাঝে মাঝে হাপিয়ে উঠে ঘরে খদ্দের নিতে অস্বীকার করলে মাসির সেই একই উত্তর—‘‘তাহলে বাছা তোমাদের নিয়ে আমার দল চলবে না৷ তোমরা পথ দেখ৷ ঝুমুর দলের লক্ষ্মী ওইখানে৷ ও পথ ছাড়লে চলবে না৷’’২৭৪ আবার যদি বাজার খুব মন্দা হয় মাসি তখন নতুন পথ ধরে৷ তখন সে মেয়েদের সকলকে সাজগোজ করতে বলে৷ তাদের নিয়ে গাঁয়ের বাজারে বেড়াতে যায়৷ মেয়েরা তার কথা শুনে উৎসাহিত হয়ে পুকুরঘাটে যায় সাবান হাতে নিয়ে৷ তারপর স্নো, সিঁদুর, পাউডার নিয়ে সাজতে বসে৷ ধোওয়া ধবধবে কাপড় পড়ে মুখে একগাল পান নিয়ে মাসি মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে বের হয়৷

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে উপার্জনের পথের দিকে তাকিয়ে থাকে৷ কোনো দিক থেকে ক্ষীণতম সাড়া পেলেই সে মিষ্টিমুখে সরস বাক্যে সাদর আহ্বান জানিয়ে বলে—‘‘কে গো বাবা? এস, এগিয়ে এস৷ নজ্জা কি ধন? ভয় কি? এস এস৷’’২৭৫ তারপর আগন্তুক এগিয়ে এলে সে মোড়া পেতে বসতে দেয়, পান দিয়ে সম্মান করে বলে—‘‘পানের জন্য দু আনা পয়সা দাও বাবা! দিতে হয়৷’’২৭৬ পয়সা আঁচলে বেঁধেই সে আহ্বান করে মেয়েদের৷ সঙ্গে সঙ্গে তাদের গহনা , সজ্জাবিলাস ইত্যাদিও গ্রাহকের সম্মুখে তুলে ধরে তার বিনয়ী কথার মাধ্যমে৷ মাসির কার্যবিবরণীর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন রচনাকার৷ যেদিন একজন লোক এসে বসনকে সঙ্গী হিসেবে পেতে চায়৷ বসন্ত শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে তাতে অস্বীকৃত হলে মাসি কঠোর অথচ মোলায়েম আহ্বান করে তাকে বাইরে ডাকে৷ মাসির সে আদেশ অতিক্রম করার সাধ্য বসন্তর নেই৷ সে বাইরে এসে দেখে মাসির সম্মুখে একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ মাসি স্নেহ সম্ভাষণে তাকে বলে—‘‘দেখি, তোর গা দেখি!… ওমা, গা যে দিব্যি—আমার গা তোর চেয়ে গরম৷ ওগো বাবা, মেয়ের আমার শরীর খারাপ, একটু মদ খাওয়াতে হবে৷ সহসা কন্ঠস্বর মৃদু করিয়া হাসিয়া বলিল—আমার কাছেই আছে৷’’২৭৭ মদ খেয়ে মাসির ইচ্ছে পূরণ করতে সানন্দে তার হাত ধরে বসন্ত ঘরে চলে যায়৷

তাদের দলের কারও ব্যাধি হলে মাসিই তার ডাক্তার; তার বিধানদাতা৷ গণিকা দেহজীবাদের এক ভয়ঙ্কর যৌনরোগের আভাস দিয়েছেন লেখক কিন্তু তার নাম উল্লেখ করেননি৷ হয় তো তা সিফিলিস হতে পারে৷ রোগে তারা ডাক্তার কবিরাজ দেখায় না নিজেরাই চিকিৎসা করে—সে রোগ বাহ্যিকভাবে অন্তর্নিহিত হলেও রক্তস্রোতের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে ফেরে৷ এরপর বসন্তর বসন্ত হলে মাসি তাকে পরামর্শ দেয় মাছ না খেয়ে ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলার৷ সে ছোঁয়াচ গামছা-কাপড়-সাবান এবং স্পর্শের ছোঁয়াচ৷

মাসির আরেকটি রূপ প্রকাশিত হয় বসন্তর মৃত্যুর পর৷ শোকের মধ্যেও সে চিতায় ওঠানোর আগে তার মৃতদেহ থেকে সামান্য আভরণটুকু খুলে নিতে ভোলে না৷ নিতাই তা নিয়ে সামান্য প্রতিবাদ করলে সে তাকে তার যথাযথ বিনয় বচনে বোঝায়—‘‘বুকের নিধি চলে যায় বাবা, মনে হয় দুনিয়া অন্ধকার, খাদ্য বিষ আর কিছু ছোঁব না—কখনও কিছু খাব না৷ আবার এক বেলা যেতে না যেতে চোখ মেলে চাইতে হয়, উঠতে হয়, পোড়া পেটে দুটো দিতেও হয়, লোকের সঙ্গে চোখ জুড়তে হয়৷ বাঁচতেও হবে, খেতে-পরতেও হবে—ওগুলো চিতেয় দিয়ে কি ফল হবে বল৷’’২৭৮ মাসির বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন মন সংসারের বহু অভিজ্ঞতায় দীর্ণ হয়ে জীবনের এই দায়টুকু বুঝতে পেরেছে৷ জীবনে বেঁচে থাকার জন্য আবেগ-ভালোবাসার দরকার কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার প্রাত্যহিক নানা প্রয়োজনীয় জিনিস৷ অর্থ তার অন্যতম৷ মাসির বিচার সেই প্রয়োজনানুসারী৷ তাছাড়া সে যেহেতু ঝুমুর দলের কর্তৃ তাই সেখানকার কোনো সদস্যের কিছু হলে সেইই হয় ওয়ারিশান এবং তার সব কিছুর মালিক৷

বসন্তের মৃত্যুর সন্ধ্যাতেও তাদের দলের আসর বসে৷ মাসি বসন্তের সমস্ত জিনিস নিজের ঘরে নিয়ে রেখে খাবার-দাবারের ব্যবস্থায় ব্যস্ত৷ তারা সকলে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে বসন্তের স্থানে আর কেউকে বসানোর জন্য৷ তারা সে স্থানে প্রভাতী নাম্নী এক ঝুমুর গায়িকাকেও মনোনীত করে ফেলে৷ বসন্তের সমস্ত কাপড়-চোপড় মাসি দরদাম করে এক পুরোনো কাপড় ব্যবসায়ীর কাছে বেঁচে দেয়৷ মদ, মাংস, সেদ্দ ডিম ইত্যাদি দিয়ে বশে রাখতে চায় নিতাইকে৷ সে নানাভাবে এমন কি বসনের গয়নাগাটি, কাপড়-চোপড় বেঁচে প্রাপ্ত অর্থের অর্ধাংশ দিতে চেয়েও তাকে যখন প্রলোভিত করতে পারে না তখন ভবিষ্যতে তাকে পুনরায় পাওয়ার আশায় সে বলে—‘‘চিরকাল তো মানুষের মন বিবাগী হয়ে থাকে না বাবা৷ মন একদিন ফিরবে, আবার চোখে রঙ ধরবে৷ ফিরেও আসবে৷ তখন যেন মাসীকে ভুলো না৷ আমার দলেই এসো৷’’২৭৯

এভাবে শাসনে-নিয়ন্ত্রণে-ভালোবাসায়-লোভে-স্বার্থপরতায় মাসি চরিত্রটিকে অনবদ্য করে তুলেছেন লেখক৷

নির্মলা ও ললিতা :

নির্মলা ও ললিতা উপন্যাসের আর দুই পণ্যাঙ্গনা৷ তারাও ঝুমুর দলের নর্তকী৷ দলে বসন্তর পরেই তাদের স্থান৷ নির্মলা নিতাই কবিয়ালের সঙ্গে দাদা-বোনের সম্পর্ক পাতে আর ললিতা বলে ঠাকুরঝি৷ দলে নাচ ছাড়াও তারা যেমন ঘরকন্নার কাজগুলি করে তেমনি সঙ্গে সঙ্গে দেহব্যবসার দ্বারাও অর্থাগম ঘটায়৷ নির্মলার মনের মানুষ বেহালাদার৷ মনের মানুষ থাকা সত্ত্বেও তাদের দেহব্যবসা করতে হয়—প্রেমাস্পদের সম্মুখ দিয়ে অন্যপুরুষের হাত ধরে ঘরের দরজা বন্ধ করতে হয়৷ মাঝে মাঝে তাদের জীবনে ক্লান্তি চলে আসে৷ তারা বেড়িয়ে যেতে চায় কিন্তু পারে না৷ নিজেদের যেমন দীর্ঘদিনের অভ্যাস তেমনি মাসিও তাদের ছাড়তে দেয় না৷ তারা দলের সকলের সঙ্গে একটা পরিবারের মতো বাস করে৷ বসন্তর মৃত্যুর পর যখন তার মৃতদেহটা চিতার আগুনে জ্বলতে থাকে তখন তার জন্য অকৃত্রিম শোকে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেও সেই সঙ্গে তারা ভাবে নিজেদের কথা৷ নিজের জীবনের সেই পরিণতির কথা৷ তাদেরও হয়তো এমনি করে একদিন চলে যেতে হবে, এমনি করেই মাসি তাদের গা থেকে গয়না খুলে নেবে৷ আর বহুভাগ্যে যদি বৃদ্ধা হওয়া পর্যন্ত বাঁচে, তবে তারা হয়তো মাসির মতো কোনো দলের কর্তৃ হবে৷ কিন্তু কল্পনা তাদের অতদূর যেতে পারে না৷ কারণ—‘‘আশার চেয়ে নিরাশাই তাহাদের জীবনে বড়৷’’২৮০ বসন্তের মৃত্যুর শোককে চাপা দিতে সন্ধ্যা রাত্রেই তারা মদ খেয়ে বিভোর হয়ে থাকে, নিতাইকে আদর যত্নের মধ্য দিয়ে ভোলাতে চেষ্টা করে প্রিয় বিরহের যন্ত্রণা৷ তারপর নিতাই যখন তাদের দল ছেড়ে চলে যায় তখন ললিতা, নির্মলা ব্যথাভারাক্রান্ত হৃদয়ে চোখের জল ফেলে৷ যাওয়ার সময় নিতাই অনুধাবন করে মাসির তার প্রতি ভালোবাসা যেমন অকৃত্রিম তেমনি নির্মলার ভালোবাসা মায়ের পেটের বোনের মতো, আর রহস্যে-ঠাট্টায় ললিতা যেন তার শ্যালিকাই ছিল৷

নির্মলা ও ললিতার আলাদা কোনো ভূমিকা নেই উপন্যাসে কিন্তু উপন্যাসের তারা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে৷ ঝুমুরদলের চিত্র, দেহব্যবসার নির্মম নিষ্ঠুর দিক তাদের কেন্দ্র করে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে৷

জ. গণদেবতা ও পঞ্চগ্রাম :

‘গণদেবতা’ ও ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসদুটি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৯৪২ এবং ১৯৪৪ সালে৷ দুটিকে একটি উপন্যাস হিসেবেই ভাবা যায়৷ লেখকেরও তেমনি অভিপ্রায় ছিল৷ তিনি প্রথমটির নাম ‘চণ্ডীমণ্ডপ’ এবং দ্বিতীয়টির নাম ‘পঞ্চগ্রাম’ রাখার পরিকল্পনা করেছিলেন ,আর দুটিকে মিলে নাম দিতে চেয়েছিলেন ‘গণদেবতা’৷ দুটি উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরাও যেমন অভিন্ন তেমন দুটির মধ্যে ভাবগত রূপগতও কোনো প্রভেদ নেই৷ ব্যবধান শুধু ভৌগোলিক সীমায়৷ ‘গণদেবতা’-য় একটি গ্রাম শিবকালীপুরের কথা রয়েছে আর ‘পঞ্চগ্রাম’-এ কঙ্কণা, কুসুমপুর, মহাগ্রাম, শিবকালীপুর ও দেখুরিয়া এই পাঁচটি গ্রামের উপস্থিতি৷ উপন্যাসে গণিকা চরিত্র হিসেবে উপস্থিত হয়েছে দুর্গা মুচিনি, পাতুর বৌ, দুর্গার মা ইত্যাদিরা৷

দুর্গা :

প্রচলিত অর্থে ‘গণদেবতা’ এবং ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসে কোনো নায়িকা নেই কিন্তু দুর্গা উপন্যাসের প্রধান রমণী৷ তার বসবাস গ্রামের প্রান্তসীমায় অবস্থিত হরিজনপল্লীতে৷ সেখানকার অন্ত্যজ শ্রেণীর নরনারীর মধ্যে সতীত্বের কোনো বাছবিচার নেই৷ চরিত্র স্খলনের জন্য কোনো কঠোর শাস্তি বা নিজেদের শোধরানোর জন্য কোনো আদর্শ-সংস্কার নেই৷ অল্প-স্বল্প উশৃঙ্খলতা স্বামী পর্যন্ত দেখেও না দেখার ভান করে থাকে৷ আর সেই উশৃঙ্খলতার সঙ্গে যদি উচ্চবর্ণের কোনো সচ্ছল পুরুষ যুক্ত থাকে তখন সেখানকার পুরুষেরা বোবা ও কালা হয়ে যায়৷ স্ত্রীর অতিরিক্ত রোজগারের এই পন্থা তারা গর্বের সাথে মেনে নেয় ও স্বীকার করে৷ এই নীতি-নৈতিকতার বাছ-বিচারহীন পরিবারে জন্ম দুর্গার৷ তার মধ্যে কোনো সংস্কারের বালাই নেই৷ হরিজনপল্লীর অন্যান্য নারীদের চেয়ে তার স্বভাব আরও বেশি দুর্দমনীয়৷ তার দেহ বেঁচে রোজগারের পেছনে একটা অতীত ইতিহাস তুলে ধরেছেন লেখক৷ তার মা-শাশুড়িদের ইন্ধনে সে প্রথম শরীরের বিনিময়ে আঁচলে অর্থ বাঁধতে সক্ষম হয়েছিল৷ দুর্গার বিয়ে হয়েছিল কঙ্কণায়৷ তার শাশুড়ি সেখানকার এক ধনী বাবুর বাড়িতে ঝাড়ুদারনীর কাজ করত৷ একদিন শাশুড়ির অসুখ করাতে দুর্গা যায় তার পরিবর্তে কাজ করতে৷ সব কাজ শেষ হয়ে গেলে সেই বাবুর বাড়ির চাকর তাকে ধমকে পাঠায় তার বাগানবাড়ি সংলগ্ন একটা নির্জন ঘরে ঝাঁট দেওয়ার জন্য৷ কিন্তু ঘরটা নির্জন ছিল না৷ স্বয়ং বাবু বসেছিল সেই ঘরের ভিতরে৷ দুর্গা ঘোমটা টেনে সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করে দেখে ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ৷ ঘন্টাখানেকপরে কাপড়ের খুঁটে পাঁচটাকার একখানি নোট বেঁধে সে সোজা বাপের বাড়ি চলে আসে৷ সেই বাবুর কাছেই সে জানতে পারে তার দেহকে বাবুর ভোগ্য করার যোগসাজেশ তার শাশুড়িই করে গিয়েছে৷ সেই বাবুর দ্বারা ধর্ষিত হয়ে কোনো নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জাগেনি দুর্গার মনে বরং আতঙ্কমিশ্রিত একপ্রকার আনন্দ অনুভব করেছিল সে৷ তাই—‘‘আতঙ্কে, অশান্তিতে ও গ্লানিতে এবং সেই সঙ্গে বাবুর দুর্লভ অনুগ্রহ ও এই অর্থপ্রাপ্তির আনন্দে—পথ ভুল করিয়া, সেই পথে পথেই সে পলাইয়া আসিয়াছিল আপন মায়ের কাছে৷’’২৮১ মেয়ের মুখে সব কথা শুনে জীবনে রুজি-রোজগারের সম্ভাবনাময় পথ আবিষ্কার করেছিল স্বৈরিণী দুর্গার স্বৈরিণী মা৷

দুর্গা সুশ্রী৷ সুগঠিত তার দেহ৷ নিম্ন শ্রেণীর মানুষ হয়েও তার দেহবর্ণ গৌর৷ তার রূপের মধ্যে একটা মাদকতা আছে যা দিয়ে মানুষের মনকে মোহাবিষ্ট করে তোলে—আর মুগ্ধ মত্ততায় তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে পতঙ্গের মতো তার রূপ-বহ্নির দিকে৷ তার মায়ের স্বৈরিণী জীবনের ফল দুর্গা৷ দুর্দান্ত তার স্বভাবও৷ কাউকে সে পরোয়া করে না৷ শাশুড়ির চক্রান্তে কঙ্কণার বাবুদের দ্বারা ধর্ষিত হয়ে পাঁচটাকার নোট আঁচলে বেঁধে সেই যে দেহ ব্যবসার সূচনা হয়েছিল তারপর থেকে তাকে আর থেমে থাকতে হয়নি৷ ফরসা কাপড় পরে, হাসি-ঠাট্টা-মস্করা দিয়ে পুরুষের চিত্তকে বিগলিত করতে তার জুড়ি নেই৷ লেখক তার সম্পর্কে বলেছেন—‘‘সে দুরন্ত স্বেচ্ছাচারিণী; ঊর্ধ্বে বা অধঃলোকের কোন সীমাকেই অতিক্রম করিতে তাহার দ্বিধা নাই৷ নিশীথ রাত্রে সে কঙ্কণার জমিদারের প্রমোদভবনে যায়, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টকে সে জানে; লোকে বলে দারোগা, হাকিম পর্যন্ত তাহার অপরিচিত নয়৷ সেদিন ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের ভাইস-চেয়ারম্যান মুখার্জী সাহেবের সহিত সে গভীর রাত্রে পরিচয় করিয়া আসিয়াছে, দফাদার শরীর-রক্ষীর মত সঙ্গে সঙ্গে গিয়াছিল৷ দুর্গা ইহাতে অহঙ্কার বোধ করে, নিজেকে স্বজাতীয়দের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনে করে;’’২৮২ অর্থাৎ দুর্গার নিজের দেহবিক্রয় নিয়ে কোনোরকম গ্লানি নেই; বরং গর্বিতই সে৷ তার চটুল প্রণয়পাশে উচ্চ থেকে নিম্নস্তরের অনেক মানুষই আবদ্ধ৷

মুচির মেয়ে দুর্গা ছলাকলাপটিয়সী, রূপবতী এবং সামাজিক-নৈতিক নীতিবোধগুলির প্রতি সম্পূর্ণ আস্থাহীন৷ সে তার বেঁচে থাকার প্রধান অবলম্বন করেছে নিজের শরীরকে৷ তার দেহব্যবসা নিয়ে কেউ বিরূপ মন্তব্য করলে সে তা মেনে নিতে পারে না, গর্বভরে প্রতিপক্ষকে হেলায় অবনত করে৷ গ্রামের উঠতি ধনী ছিরুপাল তার লাম্পট্য এবং ক্রুর বুদ্ধিতে দুর্গার দাদা পাতুকে অপদস্ত করে, সেই ছিরুপালের দুর্গার ঘরে যাওয়া-আসা নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করলে তা নিয়ে দুর্গার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় প্রতিস্পর্ধী বাক্যজাল৷—‘‘ঘর আমার, আমি নিজের রোজগারে করেছি, আমার খুশী যার ওপর হবে—সে-ই আমার বাড়ি আসবে৷ তোর কি? তাতে তোর কি?’’২৮৩ আবার শ্রীহরির চক্রান্তে যখন তাদের গোটা মুচি পাড়াটা পুড়ে ছাই হয়ে যায় তখন হরিজনপল্লীর সকল সদস্যরা সরকারি সাহায্য পাওয়ার আশায় ব্যস্ত সে সময় দুর্গাকে দেখা যায় সে সেই সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন৷ জগন ডাক্তার তাকে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার আশায় টিপসই দিতে বললে সে তার নিজের পেশার গর্বে তা হেলায় অবহেলা করে বলে—‘‘আমি টিপ-সই দিতে আসি নাই গো৷… গতর থাকতে ভিখ মাঙব ক্যানে? গলায় দড়ি!’’২৮৪ শ্রীহরির সঙ্গে কথা বলে তার হঠাৎ আঁতকে ওঠা মুখচ্ছবি দেখে বিচক্ষণ এই স্বৈরিণী নারীর মনে মুহূর্তে দৃঢ় প্রত্যয়ের জন্ম নেয় যে তাদের পল্লীটিকে ছিরুপালই জ্বালিয়ে ছাই করে দিয়েছে৷ সে সেকথা ছিরুপালকে জ্ঞাত করে ভয় দেখিয়ে মোটা টাকা প্রাপ্তির অঙ্গীকার করিয়ে নেয়৷ দুর্বৃত্ত ছিরুপালের সঙ্গে দুর্গার অনেক দিনের সম্পর্ক৷ কিন্তু সেটা সম্পূর্ণভাবে দেওয়া-নেওয়ার৷ তার প্রতি কোমলতা কোনোদিনও দুর্গার ছিল না৷ গ্রামের ভালো মানুষগুলোর সঙ্গে তার শত্রুতাপূর্ণ আচরণ ধীরে ধীরে দুর্গার মনে আক্রোশ ও ঘৃণার জন্ম দেয়৷ যে নির্দয় প্রতিহিংসায় শ্রীহরি তাদের সমগ্র পাড়াটিকে ছাই করে দিয়েছে সেখানকার মানুষজনের প্রতি বিশেষ করে তার দাদা পাতুর প্রতি হঠাৎ দুর্গা অপরিসীম মমতা অনুভব করে৷ সে সংকল্প নেয় ছিরুপালকে জব্দ করার—তার ক্ষতি করার৷ মদের সঙ্গে গরু মারার বিষ মিশিয়ে তাকে চরম শাস্তি দেওয়ার ভাবনাটিও তার মানসলোকে উঁকি দিয়ে যায়৷

দুর্গার অবরুদ্ধ মনে দেবুর প্রতি ভালোবাসাও প্রবল৷ উপন্যাসের নায়ক পাঠশালার পণ্ডিত সচ্চরিত্রের দেবু৷ বিলুদিদি, যাকে কোলে পিঠে করে এককালে দুর্গার মা মানুষ করেছিল দেবু দুর্গার সেই বিলুদিদির বর৷ কিন্তু দেবু দুর্গাকে দুই চোখে দেখতে পারে না৷ সে স্বৈরিণী, সে ভ্রষ্টা, সে পাপিনী—তার সঙ্গে আবার ছিরু পালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট৷ কিন্তু দেবুর প্রতি দুর্গার মানসিক দুর্বলতা স্পষ্ট৷ দেবুর প্রতি তার ভালোলাগাকে লেখক বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘পণ্ডিতকে তাহার ভাল লাগে—খুব ভাল লাগে৷… কিন্তু ছিরুর সহিত যখন তাহার ঘনিষ্ঠতা ছিল—তখনও তাহার পণ্ডিতকে ভাল লাগিত; ছিরু অপেক্ষা অনেক বেশী ভাল লাগিত৷ কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই যে, এই দুই ভাল লাগার মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব ছিল না৷ আজ পণ্ডিতকে পূর্বাপেক্ষা যেন আরও বেশী ভাল লাগিল৷’’২৮৫ সে দেবুর বাড়িতে উপস্থিত হয় তার স্ত্রীর মুখে অগ্রহায়ণ সংক্রান্তির ‘ইতুলক্ষ্মী’র ব্রতকথা শুনতে৷ দেবুর প্রতি, বিলুর প্রতি, কামার অনিরুদ্ধ এবং তার স্ত্রী পদ্মর প্রতি মিষ্ট মনকাড়া আত্মীয়তার সুর শুনে স্বৈরিণী বৃত্তির জন্য ঘৃণা করলেও কিছুতেই যেন তার প্রতি রাগ করা যায় না৷ দেবুও তার সঙ্গে কথা বলতে বাধ্য হয়, আস্কারা দিতে বাধ্য হয়৷

‘ইতুলক্ষ্মী’ ব্রতকথার শেষ প্রার্থনা স্বামীর কোলে মাথা রেখে মৃত্যু কামনা৷ বিলু কামার বউ ব্রতকথা সাঙ্গ করে উলুধ্বনি দিয়ে প্রণাম করে ব্রত শেষ করে৷ দুর্গাও উলুধ্বনি দিতে পারদর্শী৷ তার গলার স্বর যেমন তীক্ষ্ণ তার জিহ্বাও তেমনি লঘু চাপল্যে চঞ্চল৷ সমস্ত বাড়িটা মুখরিত হয়ে যায় তার উলুধ্বনির আওয়াজে৷ সে ব্রতকথার সুপুরিটি দেবুর স্ত্রীর সামনে রেখে সহাস্যে লঘুচপলতায় বলে উঠে—‘‘বিলু দিদি, ভাই কামার-বউ, মরণকালে তোমারা কেউ আমাকে স্বামী ধার দিয়ো ভাই কিন্তুক৷’’২৮৬ দুর্গার এই পরিহাস শুধুমাত্র পরিহাস হলেও স্বৈরিণী নারীর মুখে এহেন পরিহাস কিন্তু সকলে মেনে নিতে পারে না৷ বিলু তার স্বামীর চরিত্র অবগত তাই সে হেসে ওঠে৷ পদ্মও রাগ না করে পারে না৷ রূপবতী এই গণিকা তার ছলা কলা হাস্য-পরিহাস দিয়ে পাড়ার সমস্ত পুরুষদের নাচিয়ে চলে৷ তার মান-অপমান বোধ কিছু নেই৷ লজ্জা নেই, ভয়ও নেই৷ পুরুষ দেখলেই সে দুই-চারটা রসিকতা করে সর্বাঙ্গ দুলিয়ে চলে যায়৷ তাই সে যখন তার মুখের মৃদু বাঁকা হাসিটি নিয়ে পথে বের হয় তখন পাড়ার প্রতিটি বধূই সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে৷ তার পরিহাস-রঙ্গ রসিকতা থেকে দেবু, অনিরুদ্ধ কামার কেউই বাদ যায় না৷ দেবু তার চারিত্রিক দৃঢ়তায় দুর্গাকে প্রতিরোধ করলেও সে দৃঢ়তা কামারের নেই৷ একটা দা গড়ানোর সূত্র ধরে সে নিয়মিত তার বাড়ি যায়, তার সঙ্গে রঙ্গ রহস্য করে হেসে ঢলে পড়ে৷ পদ্মর তা সহ্য না হলেও কিছু বলার থাকে না৷ ইদানিং একটা চরম ঔদাসীন্য তাকে ছেয়ে রেখেছে ফলে অনিরুদ্ধ-দুর্গার রহস্যলীলা সে চোখে দেখেও কিছু বলে না৷ তাই দুর্গা তাদের কাছে স্বামী ধার চাইলে সেও না হেসে পারে না৷ দুর্গা তার রূপের ফাঁদে পুরুষদের আবদ্ধ করে, অভিসম্পাতের শিকার হয় তাদের অন্তপুরীকাদের দ্বারা৷ দুর্গার কাছে ওটাই প্রায়শ্চিত্ত৷ কিন্তু দুশ্চরিত্র ছিরু পাল বা শ্রীহরি পালের স্ত্রী তার সঙ্গে প্রকাশ্য সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও কোনো দিন কোনোরকম কটু কথা শোনায়নি৷ তার সেই প্রতিবাদহীন মৌনতায় দুর্গা তার সঙ্গে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে লজ্জা বোধ করে৷

নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ দুর্গার দেহপসারিণী জীবন৷ সে-ই প্রথম পদ্মকে শোনায় শুধুমাত্র নারীরা নয় পুরুষরাও ‘বাঁজা’ হয়৷ সে প্রসঙ্গে বহু দৃষ্টান্ত তুলে ধরে৷ তার কচিকাঁচাদের প্রতি কোনোরকম বাৎসল্যবোধ নেই৷ সে পদ্মকে স্পষ্ট ভাষায় জানায় ছোট বাচ্চা দেখলেই তার নাকি গা ঘিন ঘিন করে৷ তার জীবনে তার শরীরই সব৷ সে শরীরের দেমাকে উপার্জন করে—শরীর বেচেই আত্মসুখ লাভ করে৷ কিন্তু সে যাকে ভালোবাসে বা যাকে তার ভালোলাগে তার জন্য অকাতরে নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে৷ অনিরুদ্ধের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেকদূর বিস্তৃত হয়েছে৷ সে যেমন অনিরুদ্ধর বিপদে তাকে টাকা ধার দিয়ে সহায়তা করে তেমনি পদ্ম ফিট হলে তার পরিচর্যা করে, বাড়িতে লক্ষ্মীপূজার জন্য নিজের পয়সা খরচ করে নানা উপকরণ কিনে নিয়ে এসে রাঙাদিদিকে জানায় যে পদ্ম তাকে পয়সা দিয়েছে জংশন থেকে কিনে আনার জন্য৷ তার দান গ্রহণ করে গৃহস্থবাড়িতে লক্ষ্মীপূজা হচ্ছে তা যদি পাড়াময় রাষ্ট্র হয়ে যায় তাহলে অনিরুদ্ধর প্রতি সমাজ বিরূপ হয়ে যাবে—তার সম্ভ্রমে ঘা লাগবে৷ পদ্ম তাকে দেখে নানা ভাবে অপমান করলেও সে লজ্জাহীনার মতো সব কথার হেসে উত্তর দেয়৷ তার পরিহাসপটুতায় পদ্মর নিদারুণ কথার শরকে ভেঙ্গে খান খান করে দিয়ে নিজেকে তাদের আপনজন হিসেবে দাবি করে৷ তার আপনজন হওয়ার প্রস্তাবে সে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেও দুর্গার হাস্য-পরিহাস কমে না৷ বরং সে অনিরুদ্ধর সঙ্গে তার সম্পর্ক তার সামনে ব্যক্ত করে হাসতে হাসতে বলে—‘‘আমি তোমার সতীন! তোমার কর্তা তো আমাকে ভালবাসে হে!’’২৮৭ নির্লজ্জের মতো পদ্মর সামনে সে কথা বলতে পারলেও রাঙাদিদির সামনে তা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়৷ রাঙাদিদিকে যখন বলে যে পদ্ম তাকে জংশন থেকে লক্ষ্মীপূজার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে পয়সা দিয়েছিল তখন তার সেই ছোট্ট মিথ্যা কথাটিতে পদ্মর কঠিন মন যেমন গলে নরম হয়ে যায় তেমনি রাঙাদিদিও হাস্য-পরিহাস ছলে বিষয়টিকে হালকা করে নেয়৷

দুর্গা দেহব্যবসায়ী হলেও তার মধ্যে ধীরে ধীরে প্রেমপরায়ণা পবিত্র এক নারীসত্তা প্রকাশ পায়৷ যে দুর্গাকে শুরুতেই লেখক বর্ণনা করেছেন দুরন্ত স্বেচ্ছাচারিণী হিসেবে, যে তার রূপকে নিয়ে, তার পেশাকে নিয়ে গর্ববোধ করে সেই দুর্গার মানসলোকে দেবুকে ঘিরে ঘটতে থাকে নানা পরিবর্তন৷ একটু একটু করে প্রকটিত হতে থাকে তার ভেতরকার সেই নির্মল নারীমহিমা৷ কানুনগোর সাথে বচসার জেরে দেবু পণ্ডিতকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেলে বিলুর সান্ত্বনাস্থল হয় সে-ই৷ তারপর দেবুর যখন পনেরো মাসের কারাদণ্ডের শাস্তি হয় তখন সকলে সেই আসন্ন দুর্যোগের খবর চেপে গেলে দুর্গা বিলাসিনী বেশে সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে যায় সেখানকার কর্মচারীদের মনোরঞ্জন করার জন্য, উদ্দেশ্য তাদের অনুরোধ করে দেবুর শাস্তি মুকুব করা৷ সেখানেই সে জানতে পারে তার দীর্ঘ দিনের কারাদণ্ডের কথা৷ অস্থির পদবিক্ষেপে সেখান থেকে সেই অভিসারিকাবেশেই এসে উপস্থিত হয় বিলুর দুয়ারে৷ তাকে জানায় সেই মর্মান্তিক সংবাদ৷ দেবুর দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে বিলু ও খোকাকে সেই আগলে রাখে৷ জেলে বসে বিলুর চিঠির মধ্য দিয়ে দুর্গার সব খবর পায় দেবু৷ দীর্ঘ কারাবাসের পর গৃহে প্রত্যাবর্তনের পথে দুর্গার কোঠা-ঘর দেখে দুর্গার প্রতি দেবুর ভাবান্তর স্পষ্ট হয়—‘‘দুর্গা! আহা, দুর্গা বড় ভাল মেয়ে৷ পূর্বে সে মেয়েটাকে ঘৃণা করিত, মেয়েটার গায়েপড়া ভাব দেখিয়া বিরক্ত ভাব প্রকাশ করিত৷ অনেকবার রূঢ় কথাও বলিয়াছে সে দুর্গাকে৷ কিন্তু তাহার অসময়ে, বিপদের দিনে দুর্গা দেখা দিল এক নূতন রূপে৷ জেলে আসিবার দিন সে তাহার আভাস মাত্র পাইয়াছিল৷ তারপর বিলুর পত্রে জানিয়াছে অনেক কথা৷ অহরহ—উদয়াস্ত দুর্গা বিলুর কাছে থাকে, দাসীর মত সেবা করে, সাধ্যমত সে বিলুকে কাজ করিতে দেয় না, ছেলেটাকে বুকে করিয়া রাখে৷ স্বৈরিণী বিলাসিনীর মধ্যে এ রূপ কোথায় ছিল—কেমন করিয়া লুকাইয়া ছিল?’’২৮৮ শুধু দেবুর সংসারেই নয় ছিরু পালের চক্রান্তে এবং নিজের একগুয়েমিতে অনিরুদ্ধ কামারের সংসার তছনছ হয়ে যায়৷ সে বদ্ধ মাতাল হয়ে দিনরাত পড়ে থাকে হরিজনপল্লীতে দুর্গার বাসায় আর তার স্ত্রী প্রায় উন্মাদ হয়ে নিজের ঘরে৷ দুর্গা দুজনকেই বাঁচানোর চেষ্টা করেছে তার ক্ষুদ্র সামর্থ্য দিয়ে৷ সে বিলুর মধ্য দিয়ে টাকা পাঠিয়েছে পদ্মর কাছে৷ তাকে পদ্ম ঘৃণা করে জেনেও সে পদ্মর উপকারে বিরত হয়নি৷ অনিরুদ্ধ তার উন্মত্ত দেহকামনা পূরণের আধাররূপে গ্রহণ করেছিল দুর্গাকে৷ পদ্মর মানসিক বিকারের সুযোগে দুর্গার প্রতি সে আরও বেশি নির্ভর করেছিল৷ দুর্গা তাকে দেহ দিয়েছিল, প্রেম দিয়েছিল, অর্থ দিয়েছিল—তার সমস্ত জ্বালাকে মিটিয়েছিল৷ কিন্তু একদিন দুর্গাই তাকে পরিত্যাগ করে৷ তার মদ-মাতাল ঔদ্ধত্য, পরিবারের প্রতি অনীহা ইত্যাদিতে বিরক্ত দুর্গা তাকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়৷ কিন্তু দুর্গা তাদের অনেক উপকার করেছে সে কথাও কামার একেবারে ভোলে না৷ দারোগাবাবুর সঙ্গে তার জানাশোনা আছে বলেই তাকে বলে কয়ে মাসিক দশটাকা ভাড়ায় নজরবন্দি যতীনকে তাদের বাড়িতে থাকার জায়গা করে দেয়৷ শুধু কি দেবু-অনিরুদ্ধের পরিবার! নিজের পরিবারও প্রতিপালন করে দুর্গা৷ দুর্গার মা ও দাদা তার ও তার ভ্রাতৃবধূর দেহবিক্রয়ের অন্নে প্রতিপালিত৷

দুর্গা সর্বতোভাবে সমস্ত ভালো মানুষগুলোর মঙ্গলাকাঙ্খিনী৷ তার উপস্থিত বুদ্ধিও প্রকট৷ যদিও পুরুষ ভোলানো তার রক্তের নেশা৷ বংশপরম্পরায় তার পরিবারের নারীরা দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত৷ তাই দেহব্যবসা তার অস্থি-মজ্জায়৷ সে অনিরুদ্ধকে ভালোবাসে, দেবুকে ভালোবাসে, এমনকি নজরবন্দি যতীনকে বশ করার জন্য উন্মুখ তার চিত্ত৷ মহুয়ার ফুলের মধ্য দিয়ে সে যতীনকে পেতে চায়, তার রক্তে নেশা ধরিয়ে দেয়৷ আর তার এই ভালোবাসার মানুষগুলিকে বাঁচাতে উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করে প্রাণের ঝুঁকি নিতেও দ্বিধাবোধ করে না৷ দুর্গা তার সন্ধ্যাকালীন অবসরে ভাবছিল দেবু পণ্ডিতের সুখ্যাতির কথা—নজরবন্দির মহুয়াফুলের নেশায় মদিরাসক্ত আবেশের কথা৷ সেই সময় সে তার কোঠাঘরের জানালা দিয়ে লক্ষ্য করে তাদের বায়েনপাড়ার প্রান্ত দিয়ে প্রবেশ করছে তিনজন মানুষ—ভূপাল থানাদার, জমাদারবাবু এবং হিন্দুস্থানী সিপাহি৷ সকলেই তাদের পদানুযায়ী পোশাকে সুসজ্জিত৷ ছিরু পালের নিমন্ত্রণে জমাদারের আসা বিচিত্র নয় কিন্তু তাদের মজলিশ কখনো প্রথমরাত্রে বসে না, তা মধ্য রাত্রির পর৷ দুর্গা চকিত হয়ে যায়৷ হঠাৎই তার মনের অজান্তেই দুটো নাম তার মানসপটে ভেসে উঠে একজন জামাই পণ্ডিত অর্থাৎ দেবু ঘোষ অপরজন নজরবন্দিবাবু অর্থাৎ যতীন৷ সে তাদের উদ্দেশ্য জানার জন্য তাদের পিছু নিয়ে জানতে পারে ছিরু পাল খবর পাঠিয়েছিল নজরবন্দির বাড়িতে প্রজা সমিতির কমিটি বসেছে৷ জমাদার সাহেবের কাছে সেলাম পাঠানো হয়েছিল, সেলামির ইঙ্গিতও ছিল৷ জমাদারের নিজেরও প্রত্যাশা আছে পদন্নোতি অথবা পুরস্কার কারণ নজরবন্দি যতীনকে আইন অমান্য বা গোপন ষড়যন্ত্র করার দায়ে হাতে নাতে ধরলে তার উপরমহল থেকে বাহবা প্রাপ্তির অশেষ সম্ভাবনা৷ তাদের সেই গোপন মতলবে দুর্গা শিউরে উঠে৷ মুহূর্তে বুদ্ধি বের করে দেবু যতীনের মতো সমাজের মঙ্গলাকাঙ্খীদের রক্ষা করার জন্য৷ সে নিজেকে সামলে নিয়ে পুনরায় চুড়ির রিনিঝিনি শব্দ তুলে তাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে৷ তাদের আহ্বানে সেখানে উপস্থিত হলে জমাদারবাবু দুর্গার শ্রীহরিকে ত্যাগ করা নিয়ে খোঁচা দিলে সেই সুযোগে দুর্গা আলগোছে ব্যক্ত করে ছিরু পালের হরিজনপল্লী জ্বালানোর প্রসঙ্গ৷ দুর্গার বিশ্বাস ছিল জমাদারবাবু শ্রীহরির কোনো খুঁত পেলে সেখান থেকে অবশ্যই জরিমানা গ্রহণ করবে এবং এ নিয়ে শ্রীহরি ও জমাদারবাবুর বাগবিতণ্ডাও কম হবে না৷ সেই সময়টুকু কাজে লাগানোর জন্য ঘাট থেকে আসার নাম করে সেখান থেকে বেড়িয়ে যায়৷ পণ্ডিতজামাইকে সে খবর দিতে হবে৷ তাদের আসন্ন ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে রক্ষা করতে হবে৷ দুর্গার হাতে সময় কম৷ ঘাটের দিকে খিড়কির পুকুরের পাড় দিয়ে কম সময়ে পৌঁছানো যাবে তাদের প্রজাসমিতির মিটিংস্থলে৷ তাছাড়া শ্রীহরিদের আড়াল করারও ব্যাপার আছে৷ সে সেই পুকুর পাড় দিয়েই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভয়ানক বিপদের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও৷ লেখক শ্রীহরির পুকুরপাড়ের সেই দুরতিগম্য স্থানকে বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘শ্রীহরির খিড়কীর পুকুরের পাড় ঘন জঙ্গলে ভরা৷ বাঁশের ঝাড়, তেঁতুল, শিরীষ প্রভৃতি গাছ এমনভাবে জন্মিয়াছে যে দিনেও কখনো রৌদ্র প্রবেশ করে না৷ নিচেটায় জন্মিয়াছে ঘন কাঁটাবন৷ চারিদিকে উই-ঢিবি৷ এই উইগুলির ভিতর নাকি বড় বড় সাপ বাসা বাঁধিয়াছে৷ শ্রীহরির খিড়কির পুকুর সাপের জন্য বিখ্যাত৷ বিশেষ চন্দ্রবোড়া সাপের জন্য৷ সন্ধ্যার পর হইতেই চন্দ্রবোড়ার শিস শোনা যায়৷’’২৮৯ সেই দুর্গম স্থান নির্ভয়ে নিশাচরীর মতো অতিক্রম করে উপস্থিত হয় অনিরুদ্ধর বাড়ি৷ সেখানে তার সংবাদ পেশ করেই আবার সেই জঙ্গল পথেই উপস্থিত হয় শ্রীহরির বৈঠকখানায়৷ জমাদারের তীব্র যৌনপীড়নের হাত থেকে বাঁচতে পায়ে বেলকুড়ির কাঁটা দিয়ে সর্পদংশনের মত ক্ষতস্থান তৈরি করে তাদের গিয়ে জানায় তাকে সর্পদংশন করেছে৷ তার সুদক্ষ অভিনয় দিয়ে সকলকে তটস্থ করে তোলে৷ সকলে এসে দেখে যায় কৃত্রিম সর্পবিষে জরাজীর্ণ দুর্গাকে৷ কিন্তু দুর্গার সতৃষ্ণ চোখে দেবু ও যতীনের প্রতীক্ষা৷ যতীন না হয় নজরবন্দি কিন্তু দেবু তো নয়৷ অভিমানে তার চোখ ফেটে জল আসে৷ প্রবল অভিমানে বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থেকে একসময় শুনতে পায় জামাইপণ্ডিতের কন্ঠস্বর৷ তাকে দেখে অভিমানাহত দুর্গা বলে—‘‘যদি এতক্ষণে মরে যেতাম জামাই-পণ্ডিত!’’২৯০ দুর্গার সাপেকাটার কৃত্রিম অভিনয় দেবুর জানা ছিল না কিন্তু যে বিপদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে সে তাদের সকলকে ভয়ঙ্কর আইনিপীড়নের হাত থেকে বাঁচিয়েছে তাতে দুর্গার প্রতি তাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই৷ যতীন সেখান থেকে ফিরে দুর্গার কথাই ভাবতে থাকে৷ তার মনে হয় দুর্গা বিচিত্র, দুর্গা অতুলনীয় এবং দুর্গা অদ্ভুত৷ বিলু সব কথা শুনে তার সম্পর্কে মন্তব্য করে বলে—‘‘গল্পের সেই নক্ষহীরে বেশ্যার মত—দেখো তুমি, আসছে জন্মে ওর ভাল ঘরে জন্ম হবে, যাকে কামনা করে মরবে সে-ই ওর স্বামী হবে৷’’২৯১ ঠিক সেই সময় পণ্ডিত মহমহোপাধ্যায় শিবশেখর ন্যায়রত্ন পদার্পণ করে তার বাড়িতে৷ সে উচ্চস্বরের ধার্মিক মানুষটিকে আপ্যায়ন করতে গিয়ে সে দুর্গার বিপদের কথা শুনেও তাকে দেখতে যেতে পারেনি৷ অনেক পরে জনসমাগম কমে গেলে সে উপস্থিত হয়েছিল দুর্গার বাড়ি৷

দুর্গার সমস্ত চালাকি পরে বুঝতে পারে ধুরন্ধর ছিরু পাল৷ সে তার প্রতিশোধ নিতে দেবু, অনিরুদ্ধ প্রমুখের গাছ কেটে নেয়৷ প্রতিবাদ করতে গেলে আহত হয় দ্বারিক চৌধুরী এবং দেবু৷ ছিরু পালের উপর প্রতিশোধ নিতে অনিরুদ্ধ তার শখের বাগান তছনছ করে দেয়৷ কিন্তু সেই অপরাধে দেবু গ্রেপ্তার হলে সকল দোষ স্বীকার করে অনিরুদ্ধ এবং দেবুর বদলে নিজে গ্রেপ্তার হয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করে৷ দুর্গাও পুলিশের রিপোর্টের ভিত্তিতে তলব পেয়ে থানায় উপস্থিত হয়৷ ইন্সপেক্টার তাকে দাগি বদমায়েশদের সঙ্গে সংশ্রবের কারণে সাবধান করে দিলে সে পুনরায় তার বিচক্ষণতা দিয়ে শ্রীহরির মতো শয়তানদের কথাই তুলে ধরে, তার সঙ্গে জমাদারবাবু, ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ইত্যাদির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথাও ব্যক্ত করে৷ যেমন—‘‘আজ্ঞে হুজুর, আমি নষ্ট-দুষ্ট—এ কথা সত্যি৷ তবে মশায়, আমাদের গাঁয়ের ছিরু পাল—৷ জিভ কাটিয়া সে বলিল—না, মানে ঘোষ মহাশয়, শ্রীহরি ঘোষ, থানার জমাদারবাবু, ইউনান বোর্ডের পেসিডেনবাবু—এঁরা সব যে দাগী বদমাস নোক—এ কি করে জানব বলুন৷ মেলামেশা আলাপ তো আমার এঁদের সঙ্গে৷’’২৯২ তার কথাশুনে ইন্সপেক্টর তাকে ধমকে দিলে অকুতোভয় দুর্গা তার কথাকে শেষ না করে থামে না৷ সে বলে—‘‘আপনি ডাকুন সবাইকে—আমি মুখে মুখে বলছি৷ এই সেদিন রেতে জমাদার ঘোষ মশায়ের বৈঠকখানায় এসে আমোদ করতে আমাকে ডেকেছিলেন—আমি গেছলাম৷ সেদিন ঘোষ মশায়ের খিড়কীর পুকুরে আমাকে সাপে কামড়েছিল—পেরমাইছিল তাই বেঁচেছি৷ রামকিষণ সিপাইজি ছিল, ভূপাল থানাদার ছিল৷ শুধান সকলকে৷ আমার কথা তো কারু কাছে ছাপি নাই৷’’২৯৩ দুর্গা তার কথার মধ্য দিয়ে জমাদার-শ্রীহরির গোপন সখ্যতাকে অত্যন্ত সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছে৷

গ্রামে দেখা দেয় মহামারী৷ প্রথম কলেরা হয় উপেনের৷ দুর্গা মৃত্যুভয়কে তোয়াক্কা না করে সেখানে উপস্থিত হয় তার সেবা করতে৷ পরে সেখানে যোগ দেয় দেবু৷ ধীরে ধীরে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে৷ দেবু তাদের সেবায় উদয়স্ত আত্মনিয়োগ করে৷ দুর্গা নিজের টাকা ধার দিয়ে নিজেই দেবুর ঋণ জংশনের দোকানে গিয়ে পরিশোধ করে আসে৷ দেবুর আর দুর্গার প্রতি কোনো রাগ নেই, ঘৃণা নেই, বিরক্তি নেই৷ সে দেহব্যবসায়ী হয়েও তার কর্মনিষ্ঠা, পরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়া, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ইত্যাদির দ্বারা মন জয় করে নিয়েছে দেবুর৷ বিচক্ষণ দুর্গা তার অত্যন্ত পছন্দের মানুষ দেবুর অকাতরে কলেরা রোগীর সেবায় নিয়োজিত দেখে আঁতকে উঠে৷ কি জানি কখন বা সেই মারণ ব্যাধির আক্রমণে তার জীবনে সংকট নেমে আসে৷ সে স্থির থাকতে না পেরে বিলুকে সাবধান করে দিয়ে বলে—‘‘একটুকুন শক্ত হও বিলু-দিদি, জামাই-এর একটু রাশ টেনে ধর৷ নইলে এই রোগের পিছুতে ও আহারনিদ্রে ভুলবে, হয়তো তোমাদের সর্বনাশ—নিজের সর্বনাশ করে ফেলবে!’’২৯৪ নিজের সর্বনাশই করে দেবু৷ সেই মারণব্যাধির ছোঁয়াচে প্রাণ হারায় খোকা ও বিলু৷ দেবু সংসারে একা হয়ে গেলে তার শোকনিমজ্জিত সান্ত্বনাহীন চিত্তদাহ দুর্গার অন্তকরণকেউ স্পর্শ করে৷ দুর্গার ভেতরকার চপল পুরুষভোলানো স্বৈরিণী নারীচিত্তটি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয়ে যায়৷ যে দুর্গা তার এত লোভ কামনা নিয়ে একে একে সকলকে বশ করার অভিলাষে আত্মমগ্ন সেই দুর্গা যেন দেবুর আসন্ন বিপর্যয়ে বিলুদিদি ও খোকার অকালমৃত্যুতে নিজেও মরে গেছে৷ তার বদলে জন্ম নিয়েছে আশ্চর্য রকমের শান্ত এক নারী৷ যে উদ্ধতভঙ্গিতে সে সমাজের কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করতো না, কারও ধার ধারতো না সেই দুর্গাই সংস্কারের চাপে বাঁধা পড়ে বিলু ও খোকার মৃত্যুর পর খুব বেশি আর দেবুর বাড়িতে যেতে পারে না৷ দেবু সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে জানায়—‘‘গাঁয়ের লোককে তো জান জামাই! এখন আমি বেশী গেলে-এলেই—তোমাকে জড়িয়ে নানান কুকথা রটাবে৷’’২৯৫ সে নিজে না গেলেও দেবুর ঘরে নিয়মিত দুধ পৌঁছে দিতে তার মাকে পাঠায়৷ তারই বন্দোবস্তে নিঃসঙ্গ দেবুর বাড়িতে তার দাদা পাতু গিয়ে রাত কাটায়৷

এভাবে ‘গণদেবতা’ উপন্যাসে দেখা যায় দুর্গা ধীরে ধীরে নিজের স্বৈরিণীসত্তাকে ভুলে নারী হিসেবে আত্ম প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হয়৷

‘পঞ্চগ্রাম’-এ দুর্গার মধ্যে ভাঙা-গড়ার খেলা৷ বিলুর মৃত্যুতে পরিহাসপ্রিয় চপল স্বভাবের দুর্গা হঠাৎ শান্ত হয়ে গিয়েছিল ‘পঞ্চগ্রাম’-এ আবার সে ছন্দে ফিরতে থাকে৷ দেবুর বিপর্যস্ত সংসার, পদ্মর উন্মাদ নিঃসঙ্গ জীবনে সে-ই হয় প্রধান সহায়ক৷ এককালে অনিরুদ্ধের সঙ্গে মিতার সম্পর্ক পাতিয়ে শ্লেষ এবং ব্যঙ্গে বিদ্ধ করার জন্য পদ্মকে মিতেনি বলে সম্বোধন করেছিল তখন প্রচণ্ড ঘৃণায় তাকে অপমানে জর্জরিত করতো পদ্ম৷ কিন্তু অনিরুদ্ধ চলে যাওয়ার পর সেই সম্বন্ধটাই হয়েছে পরম সত্য৷ দুর্গা তার প্রতি প্রবল মমতায় দেবু ঘোষের কাছে তার হয়ে দরবার করেছে৷ কীভাবে অভিভাবকহীন সংসারে ছিরু পালের কামুক দৃষ্টি থেকে পদ্ম রক্ষা পাবে সেটাই ছিল দুর্গার প্রধান চিন্তা৷ দেবু তার খাওয়া-পরার ভার নিতে রাজী হলেও তার দেখাশোনার দায়িত্ব নিতে অপারগ৷ কারণ তার সদস্যহীন সংসারে একা পদ্মবৌকে রাখবে সে কোন অধিকারে৷ একা পুরুষ মানুষ সে৷ তার খাওয়াপরার দায়িত্বের কথা শুনেই দুর্গা নিশ্চিন্ত হয়েছে৷ সে জানে মেয়েরা কেন ভুল পথে চালিত হয়৷ কোন নিদারুণ পরিস্থিতিতে তারা যৌনব্যবসায় মেতে উঠে৷ দুর্গার দেবুকে বলা কথার মধ্যে সেই জীবনসত্যের প্রতিধ্বনি—‘‘—জান জামাই! মেয়েলোক নষ্ট হয় পেটের জ্বালায় আর লোভে৷ ভালবেসে নষ্ট হয় না—তা নয়, ভালবেসেও হয়৷ কিন্তু সে আর ক’টা? একশোটার মধ্যে একটা৷ লোভে পড়ে—টাকার লোভে, গয়না-কাপড়ের লোভে মেয়েরা নষ্ট হয় বটে৷ কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, পণ্ডিত৷ তুমি তাকে পেটের জ্বালা থেকে বাঁচাও৷’’২৯৬ সে দেবুকে বলে শুধু তার অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা করেই খান্ত হয়নি সে চেষ্টা করেছে তার কর্ম সংস্থানের৷ কারণ পদ্মকে সাহায্য করতে গিয়ে দেবু ও পদ্ম দুজনকেই সামাজিক কুৎসা ভোগ করতে হবে জেনে সে পুনরায় তাকে অনুরোধ করে বলেছে—‘‘কামার-বউকে কিছু ধান ভানা-কোটার কাজ দেখে দাও, জামাই৷ একটা পেট তো, ওতেই চলে যাবে৷ তারপর যদি কিছু লাগে তা বরং তুমি দিও৷’’২৯৭ শুধু পদ্ম, দেবুই নয় গ্রামের বৃদ্ধা রাঙাদিদির শেষ সময়ে অস্পৃশ্য হয়েও সে সামনে থেকেছে, মাকে দিয়ে দুধ পাঠিয়ে দিয়েছে৷ তারপর রাঙাদিদির মৃত্যু হলে সেই মৃত্যুকে শ্রীহরি পাল (পরে যে নিজের পদবি পাল্টে ঘোষ করেছিল) ও জমাদারবাবুরা খুন বলে প্রতিপন্ন করে যখন দেবু, দুর্গা, পদ্মকে যারপরনাই হেনস্তা করতে থাকে তখন সে গ্রামের প্রধান ধনী শ্রীহরি ঘোষকে পাল বলে তাচ্ছিল্য করে৷ তা নিয়ে জমাদারবাবু তাকে ধমকে দিলে দুর্গা তার স্বভাবসুলভ সপ্রতিভতায় তৎক্ষণাৎ জবাব দেয়—‘‘লোকটি যে এককালে আমার ভালবাসার লোক ছিল, তখন পাল বলেছি, তুমি বলেছি, মাল খেয়ে তুইও বলেছি৷ অনেক দিনের অভ্যেস কি ছাড়তে পারি জমাদারবাবু? এতে যদি তোমাদের সাজা দেবার আইন থাকে দাও৷’’২৯৮ দুর্গা এমন একটা চরিত্র যে তার স্বৈরিণীবৃত্তিকে ধরে রেখেও নানা খল ইতর মানুষের সঙ্গে মিশেও তা সুমনোবৃত্তিকে কখনো দমিত করেনি৷ বরং ভালো মানুষগুলিকে বুক দিয়ে আগলে রেখে খারাপ মানুষগুলির প্রতিস্পর্ধী হয়েছে৷

দেবুর চোখে দুর্গা ধীরে ধীরে তার দেহব্যবসার কলুষতা ছাপিয়ে অন্যমাত্রা নিয়ে উপস্থিত হয়৷ তাকে নিয়ে ছিরুপালের চক্রান্তে কর্দম লিপ্ত হয়েছে দেবুর নামে৷ দুর্গা সেই কুৎসাকে ভয় পায় না বরং আনন্দিতই হয়৷ দেবু ছিরুকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য দুর্গাকে অনুরোধ করে তার বাড়িতে থাকতে৷ অন্তত পঞ্চায়েত যতদিন না বসে ততদিন পর্যন্ত৷ সে যখন দুর্গাকে তার বাড়িতে থাকতে বলে ঘরদোর ঝাঁট দেওয়া, নিকোনো, দেখাশোনা করা ইত্যাদি কাজের কথা বলে এবং বিনিময়ে পয়সাও দিতে চায় তার সে কথায় চাবুক খাওয়া ঘোড়ার মত সচকিত হয়ে ওঠে দুর্গা৷ সে স্বাধীনবৃত্তির শৌখিন নারী৷ রূপের গরবে বহু পুরুষ তার পদানত৷ দাসীর কাজ বা ভিক্ষাবৃত্তিতে তীব্র ঘৃণা তার৷ গ্রামে ঝড় হলে সকলে যখন গাছের ডাল, পাতা কুড়োতে মত্ত হয়ে যায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দুর্গা আলস্য চোখে তা শুধু দেখে৷ ওসব কাজ তার দ্বারা হয় না৷ আজীবন সে লাকড়ি কিনে জ্বালানি করে৷ নিজের ঘর ঝাঁট দেওয়ার কাজও সে করায় তার ভ্রাতৃবধূকে দিয়ে৷ বিনিময়ে প্রত্যহ সে পায় একসের করে চাল৷ তাই দেবুর সে কথায় সঙ্গে সঙ্গে সে প্রতিবাদ করে বলে ঝিয়ের কাজ সে করতে পারে না৷ পরক্ষণেই দেবু সামলে নেয় নিজেকে৷ সে যে আর দুর্গাকে ঘৃণা করে না, আর জাতপাত মানে না৷ দুর্গা তার মা বোনের চেয়ে কম নয়৷ সমস্ত সময়-অসময়ে গ্রামের অন্যলোকেরা যখন ছিরুপালের ভয়ে তার প্রতি অন্যায় হলে মুখ বুঝে থাকে তখন দুর্গা একক প্রতিবাদে তাকে আগলে রাখে৷ কোনোভাবেই সে দেবুর সঙ্গ ছাড়েনি৷ তাই দেবু তার হাতে জল খেতে চায় কিন্তু দুর্গা তাকে তা দিতে পারে না৷ দেবু তো আর সব মানুষের মতো তার শরীরলোভী নয়, দেবু পাথরের মত দিনের পর দিন তার ভালোবাসা উপেক্ষা করেছে, কোনো দিন কোন কামনাপূর্ণ অভিব্যক্তিও সে তার চোখে দেখেনি৷ সেই দেবু তার মতো স্বেচ্ছাচারিণী মুচিকন্যার হাতে জল খেতে চাইলে দুর্গা আঁতকে উঠে—‘‘—না৷ সে আমি পারব না জামাই-পণ্ডিত৷ আমার হাতের জল কঙ্কণার বামুন-কায়েত বাবুরা নুকিয়ে খায়, মদের সঙ্গে জল মিশিয়ে দিই, মুখে গ্লাস তুলে ধরি—তারা দিব্যি খায়৷ সে আমি দিই—কিন্তু তোমাকে দিতে পারব না৷’’২৯৯

গ্রামে বন্যার সময় বাঁধ রক্ষা করতে গিয়ে দেবু জলের তোড়ে ভেসে গিয়ে চরমভাবে আহত হলে উৎকন্ঠিত দুর্গা বন্যার জল উপেক্ষা করে এগিয়ে যায় দেবুর খোঁজ নিতে৷ দেবুর সংবাদের জন্য তার অন্তরের হাহাকার সাধ্বী প্রণয়িনীকেও হার মানায়৷ গ্রামের মানুষেরা জলের হাত থেকে বাঁচতে চণ্ডীমণ্ডপে ও ছিরুপালের বাড়িতে উপস্থিত হলে তাদের শুধু নিজেদের জন্য ভাবনা দুর্গাকে পীড়া দেয়৷ দেবুর অতবড় বিপদেও গ্রামের মানুষজন যে একবারও তার কথা জিজ্ঞেস করছে না সেই স্বার্থরূপ দেখে তার অন্তকরণ দুঃখে ভেঙে যায়৷ সে এককভাবে শুধু প্রার্থনা করতে থাকে সে যেন ভাল থাকে৷ তারপর বাঁধরক্ষা করতে যাওয়া ইরসাদের দল ফিরে এলে হঠাৎই যেন মৌচাকে ঢেলা নিক্ষেপ হয়৷ গ্রামবাসী সকলেই যেন হঠাৎ করে দেবুর জন্য সচকিত হয়ে ওঠে৷ সকলের মুখে শুধু একটাই প্রার্থনা—‘‘বাঁচিয়ে দাও মা, তুমি বাঁচিয়ে দাও৷’’৩০০ দুর্গাও তাদের সঙ্গে অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে প্রার্থনা করতে থাকে৷ মা কালীকে জোড়া পাঁঠা মানত করে শুধুমাত্র দেবুর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে৷ এখানেও মানত-বিশ্বাসের মধ্যে দুর্গার স্বৈরিণীসত্তা চাপা পড়ে নারীসত্তা বেরিয়ে এসেছে৷ দেবু আহত অবস্থায় দেখুরিয়া গ্রামে তিনকড়ির বাড়িতে চিকিৎসাধীন থাকলে দুর্গা তাকে প্রত্যহ গিয়ে দেখে এসেছে৷ তিনকড়ির মেয়ে স্বর্ণ দেবুর সেবাযত্নের ভার নিলে দুর্গা তার বাড়িঘর তদবির করেছে৷ এছাড়া ন্যায়রত্ন ঠাকুরের নাতি বিশ্বনাথ পৈতে ছিঁড়ে তার ব্রাহ্মণত্বকে অস্বীকার করলে ন্যায়রত্ন ঠাকুরের জন্য তার যেমন দুঃখে হৃদয় আদ্র হয়েছে—তেমনি বিশ্বনাথের চিরতরে গ্রাম ত্যাগ করে যাওয়া, দ্বারিক চৌধুরীর বাস্তুদেবতা বিক্রি করা এবং এই মানুষগুলির পরিবেশ পরিস্থিতি, বাধ্যবাধকতা দুর্গার হৃদয়কে ব্যথিত করেছে৷ সমাজের সকলের দুঃখ কষ্ট ভালোমন্দ সে যেন দরদ দিয়ে অনুভব করতে পারে৷

দুর্গা হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে অনেকবার দেবুকে তার হৃদয়ের অভিব্যক্তি জানিয়েছে৷ সে শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে দেবু পাথর দিয়ে গড়া৷ পদ্মবৌকেও সে কথা বলেছে অনেকবার৷ দেবুকে কাছ থেকে, দেখে ও তাকে সেবা করার মধ্য দিয়ে দেবুর সবটুকু বুঝেছিল সে৷ দেবুই তার জীবনের আদর্শ হয়ে উঠেছিল৷ সত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা দুর্গার দুর্দান্ত৷ দেবুও সেই সত্যেরই সেবক৷ দেবুর কাজে আত্মনিয়োগ এবং তাকে ইহজন্মে পাওয়ার প্রত্যাশা না করে শুধু ভালোবাসাই দুর্গার হৃদয়ের নিকষিত-হেম প্রেম৷ দেবু তার প্রেমকে উপেক্ষা করে তার প্রতি নিবেদিত দেহকে উপেক্ষা করে তাকে সত্যকার জীবনের সন্ধান দিয়েছে৷ দীর্ঘ প্রবাস যাপন করে ফিরে এসে সে যখন দুর্গাকে দেখেছে সে দুর্গা আর দুর্গা নেই৷ দেবু অবাক বিস্ময়ে দেখে গ্রামের ভিতর থেকে দুর্গা ছুটে আসছে—‘‘ক্ষারে-ধোওয়া একখানি সাদা থান কাপড় পরিয়া, নিরাভরণা, শীর্ণ দেহ, মুখের সে কোমল লাবণ্য নাই, চুলের সে পারিপাট্য নাই—সেই দুর্গা এ কি হইয়া গিয়াছে!’’৩০১ দুর্গার এই রূপ যেন শিবের তপসায় কঠিন ব্রতযাপনে অভ্যস্ত গৌরীর রূপ৷ কিন্তু শেষপর্যন্ত শিব গৌরীর তপস্যায় তুষ্ট হয়ে তাকে গ্রহণ করেছিল দুর্গার ভাগ্যে তা হয়নি৷ দান-ধ্যান পাড়ার অসুখে-বিসুখে-সেবায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে দুর্গা শেষ পর্যন্ত কিছুই পায়নি৷ দেবু তাকে কোনোদিন স্পর্শ পর্যন্ত করেনি—শুধু বিলু ভ্রমে নিজের অজ্ঞাতেই একদিন চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিয়েছিল তাকে৷ সেটা তো তাকে নয়—বিলুকে৷ গ্রামে ফিরে এসে দেবু নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছে স্বর্ণর হাত ধরে৷ সেখানেও দুর্গার প্রবেশাধিকার নেই৷ দেবু সেই ধনী-গরিবের জাত-পাতের ভেদাভেদহীন সমাজ ভাবনার স্বপ্নবিহ্বল মুহূর্তে সে শুধু ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিল—যদি কোনো দিন ছুত-অচ্ছুতের অচ্ছুত লুপ্ত হয়, ভালো-মন্দের মন্দ উঠে যায়—‘‘সে দিন যেন জামাই তোমাকে আমি পাই৷ বিলু দিদি মুক্তি পেয়েছে আমি জানি৷ স্বর্ণও যেন সেদিন মুক্তি পায়—নারায়ণের দাসী হয়৷ আমি আসব এই মর্ত্যে—তোমার জন্যে আসব, তুমি যেন এস৷ আমার জন্যে একটি জন্মের জন্যে এস৷ তোমার কথা আমি বিশ্বাস করলাম৷ করছি এই জন্যে৷ তোমাকে পাবার জন্যে৷’’৩০২ ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’-এ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নারী চরিত্র দুর্গা আর সবচেয়ে অবহেলিত হয়েছে দুর্গাই৷

দুর্গার মা :

দুর্গার মা-ও দুর্গার মতো দেহব্যবসায়ের মধ্য দিয়ে তার জীবন অতিবাহিত করেছে৷ দুর্গার মায়ের চরিত্র স্খলনের জীবন্ত প্রমাণ দুর্গা৷ মুচির ঘরে দুর্গার অমন রূপের আমদানি হয়েছে দুর্গার মায়ের বাবুদের সঙ্গে ব্যভিচারের ফলে৷ দুর্গার দাদা পাতু নিজেই তার মা সম্পর্কে দ্বারকা চৌধুরীকে বলেছে—‘‘আমার মা-হারামজাদীকে তো জানেন? হারামজাদীর স্বভাব আর গেল না!’’৩০৩ দুর্গার স্বেচ্ছাচারের জন্য অনেকে দায়ী করে তার মাকেই৷ সে-ই নাকি মেয়েকে স্বামী পরিত্যাগ করিয়ে দেহবৃত্তির পথে টেনে এনেছে৷ কিন্তু আসল কারণ অন্য৷ শাশুড়ির চক্রান্তে পাঁচটাকার বিনিময়ে সতীত্ব খুইয়ে দুর্গা যখন সোজা মায়ের কাছে উপস্থিত হয় তখন সব শুনে তার মায়ের চোখের সামনে সহসা এক উজ্জ্বল আলোকিত পথ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে৷

দুর্গার দেহব্যবসায়ের রোজগারে তার মায়ের জীবন চলে৷ মেয়ের সেই পেশা নিয়ে তারও কোনো রাখঢাক নেই৷ শ্রীহরির চক্রান্তে তাদের ঘর পুড়ে গেলে নতুন ঘর করার জন্য টাকার প্রয়োজন৷ গোরুর পাইকার হামদু স্যাখের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা ঘুষ নিয়ে মেয়েকে গোরু বেচার জন্য প্ররোচিত করলে তাকে আক্রমণ করে তার মেয়ে৷ তাদের মা মেয়ের ঝগড়ার মধ্যেও নিম্নশ্রেণীর অমার্জিত জীবনের ছাপ স্পষ্ট৷ দুর্গার দেহব্যবসার পসার নিয়ে তার মায়ের আহ্লাদের শেষ নেই৷ ছেলে পাতু যখন অকর্মণ্য হয়ে ঘরে থাকে তখন তার মা-ই তাকে উৎসাহ দেয় দুর্গার দেহপসারের সহায়ক হয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে যাওয়ার জন্য৷ সেখানে দুর্গা তার উপার্জিত অর্থের ভাগ তো দেয়-ই বকশিশও আদায় করে দেয় বাবুদের কাছ থেকে৷ কিন্তু দেবুর প্রতি অনুরক্ত হয়ে যখন সে অর্থ উপার্জনে ঢিলেমি দেয় তখন দুর্গার মায়ের আক্ষেপের শেষ থাকে না৷ এই অনুরাগের জন্যই যে তার হতভাগী মেয়ে হাতের লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলে তার রূপের অপব্যবহার করছে তাতে তার দুঃখের আর শেষ নেই৷ কঙ্কণার বাবুদের মালীরা অনেকদিন যাতায়াত করে অবশেষে বন্ধ করে দিয়েছে৷ তারা আর খোঁজ নেয় না৷ কন্যার উপার্জনে তার কোনো স্বার্থ নেই৷ দু-মুঠো ভাত হলেই চলে যায় তার তবু আক্ষেপ; মেয়ের রাজ-রাজেশ্বরী সম্পদ দেখে যেতে পারলো না সে৷

পাতুর বৌ :

উপন্যাসের কাহিনি প্রসঙ্গে হরিজনপল্লীর দুর্গার পরিবারকে বিশেষভাবে সামনে আনা হয়েছে৷ অন্ত্যজ হরিজনদের জীবনধারায় সতীত্বের কোনো বাছ-বিচার নেই৷ পাতুর বৌও স্বৈরিণী৷ তাকে নানা স্থানে ‘বেড়ালের মতো’ চলনভঙ্গির উপমায় উপমিত করেছেন রচনাকার৷ পাতু যখন দুর্গার সাগরেদ হয়ে নানা স্থানে রাত কাটাতে থাকে সেই অবসরে সে দক্ষতা অর্জন করে তার পতিতাবৃত্তিতে৷ অক্লান্ত পরিশ্রমী সে৷ একসময় দুর্গা এবং পাতুর বৌ-এর রোজগারেই তাদের পরিবার প্রতিপালিত হতে থাকে৷ হরেন ঘোষালের অবৈধ সন্তান গর্ভে ধারণ করেও সেই সন্তানের প্রতি তাদের সমাজের কারও অবহেলা থাকে না৷

এছাড়া উপন্যাসে বন্যার জন্য সাহায্য গ্রহণ কে কেন্দ্র করে উঠে এসেছে গোঁসাইবাবার প্রসঙ্গ৷ যার বৃহৎকর্ম যজ্ঞকে এক খেমটাওয়ালির দ্বারা পণ্ড করে দিয়েছিল সেখানকার ধনীবাবুমশাইরা৷ ঘটনাটা অনেকটা তপস্বীদের অপ্সরা দ্বারা তপস্যাভঙ্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত৷

গৃহত্যাগী অনিরুদ্ধ বহুদিন পর গ্রামে ফিরে এলে তার কথা প্রসঙ্গে উঠে আসে আরেক বারবনিতা চরিত্র৷ সেই পণ্যাঙ্গনা ছিল অনিরুদ্ধর কর্মস্থলের (কারখানার) বৃদ্ধ খাজাঞ্চির অনুগৃহীতা৷ বৃদ্ধের টাকা পয়সার প্রতি তার আসক্তি ছিল প্রবল কিন্তু বৃদ্ধের প্রতি নয়৷ অনিরুদ্ধর সঙ্গে তার আগে থেকেই জানাশোনা ছিল৷ বৃদ্ধের সঙ্গে ঝগড়া করে মেয়েটি শহরে এসে দেহব্যবসা শুরু করলে পুনরায় তার নজরে পড়ে অনিরুদ্ধ কামার৷ সে তাকে তার বাড়িতে নিয়ে যায়৷ একদিন বুড়ো খাজাঞ্চি তাকে নিতে এলে তাকে ঘৃণা করে অনিরুদ্ধকে নিয়ে পালিয়ে যায়৷ জেলের সাজা কাটিয়ে এই বারবনিতার কুহকী মায়ায় তার আর ঘরে ফেরা হয় না৷ সাবি নামের সেই বারাঙ্গনা অবশেষে অনিরুদ্ধকেও ধরে রাখেনি৷ সেটা বারবনিতার স্বভাবও নয়৷ অন্য আরেক পুরুষের হাত ধরে নির্দ্বিধায় চলে গিয়েছিল আরেক স্থানে৷ এই দেহজীবা নারী শুধুই রূপজীবা—তার অন্য কোনো উত্তরণ নেই৷

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বা বনফুল (১৮৯৯-১৯৭৯) :

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম ‘বনফুল’-এও সমধিক পরিচিত৷ তিনি বহু উপন্যাস রচনা করেছেন এবং সবক্ষেত্রেই তা একই ছাঁচে না ঢেলে টেকনিকগত পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছেন৷ এছাড়া তাঁর অন্য বিশেষত্ব হল—বিষয়-অবিচলতা, অপ্রগলভতা ও প্রযত্ন৷ লেখায় যেমন তিনি শৈথিল্যের প্রশ্রয় দেননি তেমনি চরিত্রচিত্রণের ক্ষেত্রেও রাখেননি ভাবাবেগের প্রাধান্য৷ পরিচিত স্থান-কাল-পাত্রের মধ্য থেকেই তিনি তাঁর রচনার বিষয়কে নির্বাচন করেছেন৷ ফলে সংসারের অভিজ্ঞতা ও জীবনের স্বচ্ছ অনুধাবনে তাঁর অঙ্কিত বারযোষিৎরা অনেক বেশি বাস্তবানুসারী হয়ে উঠেছে৷

বাংলা উপন্যাসের জগতে নবমাত্রা যোগ করেছেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় বা বনফুল৷ তাঁর রচনায় পরিকল্পনার মৌলিকতা, আখ্যানবস্তু সমাবেশে বিচিত্র উদ্ভাবনী শক্তি, নানারূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে মানবচরিত্রের যাচাই, তীক্ষ্ণ মননশীলতা পাঠকের বিস্ময় উৎপন্ন করে৷ তিনি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস রচনা করতে যতটা আগ্রহশীল, তার অপেক্ষা স্বল্পতম উপাদানে ও ক্ষীণতম ভাবসূত্রের অবলম্বনে উপন্যাস জাতীয় সৃষ্টি সম্ভব কিনা তা প্রমাণ করতে অনেক বেশি বদ্ধপরিকর৷ তাঁর উপন্যাস সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন—‘‘উপন্যাসের কঙ্কালের উপর রক্ত-মাংসের একটি সূক্ষ্ণ আবরণ দিয়া, নিজের মনোধর্মী প্রাচুর্যের ফুৎকার-বায়ু উহার নাসারন্ধ্রে সঞ্চার করিয়া, যবনিকার অন্তরাল হইতে পুতুলবাজির নিয়ন্ত্রণ-সূত্র আকর্ষণ করিয়া, উহাকে জীবন্ত ও প্রাণশক্তিসমৃদ্ধ করা যায় কি না এই পরীক্ষাই তাঁহার উপন্যাস-রচনার মুখ্য প্রেরণা বলিয়া মনে হয়৷’’৩০৪

তাঁর চরিত্র চিত্রণে গণিকারা এক বিশেষ মাত্রা লাভ করেছে৷ জীবনের প্রতিকূলতায়, সমাজ পরিবেশের চাপে বা কখনো নিজের সাময়িক পদস্খলনকে কেন্দ্র করে সীমাহীন দুঃখ যন্ত্রণার পঙ্কে নিমজ্জিত হয়ে কি নিদারুণ বেদনা ভোগ করে তারা তা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন৷

ক. তৃণখণ্ড :

‘তৃণখণ্ড’ (১৯৩৫) উপন্যাসের কথক ডাক্তার৷ ডাক্তারি জীবন অভিজ্ঞতার নানা পথ বেয়ে নানা ধরনের মানুষ সে দেখে চলেছে৷ মানুষের মতো বিচিত্র তাদের রোগ৷

উপন্যাসের রূপোপজীবিনী আসমানী৷ জীবনের বসন্ত দিনে ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে এক যুবকের সঙ্গে গৃহত্যাগ করেছিল৷ ‘ঝাঁকড়া-ভুরু’, মিথ্যে সার্টিফিকেট চাওয়া লোকটি উপন্যাসের শেষ অংশে আসমানীর পরিচয় দান করেছে৷ সে আসমানীর বাবা৷ আসমানী ঘর ছাড়ার পর কীভাবে দেহব্যবসায়ের সাথে যুক্ত হল, ছেলেটিই বা তাকে ছেড়ে গেল কেন তার কোনো ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি উপন্যাসটিতে৷ আসমানীর প্রথম আবির্ভাব সিফিলিসের রোগী হিসেবে৷ যদিও তার সেই রোগ সম্পর্কে সে নিজে সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং ডাক্তার সম্পূর্ণ অন্যমনস্ক হয়ে প্রায় আন্দাজেই তাকে ঔষধের প্রেসক্রিপসনসহ একটি টাকা দিয়ে ঔষধ কিনতে বলেছিল৷ কারণ তার সর্বাঙ্গে বড় বড় চাকা চাকা ঘা, ফোলা নাক, ঠোঁটের কোণে সাদা ঘা, দুইটি লাল চোখ নিয়ে সে যখন ডাক্তারের কাছে আসে চিকিৎসা করানোর জন্য তখন সে সম্পূর্ণ কপর্দকহীন৷ ঔষধ কিনে খাওয়ার ক্ষমতাও সেদিন তার ছিল না৷

তারপর সে যখন আবার ডাক্তারের মুখোমুখি হয় তখন সে সম্পূর্ণ সুস্থ৷ ডাক্তারকে নিজের ঠিকানা দিয়ে জানায় যে সে রংবাজারে থাকে৷ আসমানী রূপবতী৷ সে যখন পূর্বে ডাক্তারের কাছে এসেছিল তখন তার সেই রূপ কদর্য সিফিলিস রোগে চাপা পড়ে ছিল৷ তার অবহেলায় দেওয়া ঔষধ খেয়ে সুস্থ আসমানীকে দেখে বিস্ময় মানে ডাক্তার৷ সে যখন ডাক্তারকে জানায় যে সে ঔষধ কিনে খেতে সক্ষম তখন ডাক্তারের মনে হয়—‘‘বুঝিলাম রূপোপজীবিনী সে৷ স্বাস্থ্য ও রূপ যখন সে ফিরিয়া পাইয়াছে, তখন তাহার পয়সার অভাব কি?’’৩০৫ আসমানী যখন চলে যায় তখন সৎ ডাক্তারের মনে জাগ্রত হয় বিবেকবোধ৷ সে ভাবে ‘‘এমন একটা মোহিনী অগ্নি-শিখাকে সমাজে ছাড়িয়া দিয়া কি সৎকার্য করিলে! এ তো নিভিয়া গিয়াছিল প্রায়৷ আমি তো আবার তাহাকে জ্বালাইয়া তুলিলাম! উচিত হইল কি?’’৩০৬ ডাক্তারের বিবেক দংশন সমাজে একজন বারবনিতার অবস্থানগত দিকটিকে নির্দিষ্ট করে৷

তারপর আবার কিছুদিন পর আসামানীকে পুনরায় ডাক্তারের চেম্বারে দেখা যায়৷ সে ভয়ানক অসুস্থ৷ খুক খুক করে কাশতে কাশতে সে জানায় মাসখানেক থেকে জ্বরে ভুগছে সে—তার কাছের লোক তেমন কেউ নেই যাকে দিয়ে তাকে একটা খবর দেওয়াতে পারে৷ তাছাড়া ডাক্তার দেখানোর মতো আর্থিক সঙ্গতিও তার নেই৷ চরম অসুস্থতা নিয়েও তাই নিজেকেই উপস্থিত হতে হয়েছে৷ ডাক্তার তার সমস্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর বুঝতে পারে তার যক্ষা হয়েছে এবং পৃথিবীতে আর বেশিদিন তার পক্ষে থাকা সম্ভবও নয়৷ ঔষধ নিয়ে যখন সে পুনরায় কবে আসতে হবে তা জানতে চায় তখন ডাক্তার তাকে বারণ করে নিজে যেতে প্রতিশ্রুত হয়৷ সে ঠিকানা দিয়ে বলে ‘‘রং বাজারে সেই যে শিবমন্দিরটা আছে—তারই সামনের গলিতে আমার বাসা৷’’৩০৭

আসমানীর শরীর দিনকেদিন খারাপ হতে থাকে৷ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আবার তাকে আসতে হয় ডাক্তারের কাছে৷ ব্যাকুলতার সঙ্গে সুস্থ হওয়ার আর্জি জানায়৷ সে সঙ্গে নিয়ে আসে তার সমস্ত গয়নাপত্র৷ সেগুলি ডাক্তারকে দিয়ে বলে—‘‘কতদিন আর বিনা-পয়সায় আপনাকে কষ্ট দেব! সেবার এক শিশি ওষধ খেয়েই আমার সেরে গেল—এবারে সারছে না কিছুতে! আপনি বরং ভাল করে দেখে একটা ওষধের ব্যবস্থা করুন৷’’৩০৮ আসমানী পাঁচির মা বলে একজনের কাছে শুনেছে ‘বদ্যির কড়ি না দিলে ব্যামো সারে না!’’৩০৯ সে সুস্থ হতে চায়৷ নিজের মতো করে সুস্থ দেহ নিয়ে আবার বাঁচতে চায়৷ তার মারণ রোগ সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ৷ ডাক্তারও তার চাল-চুলোহীন একক জীবনে সেই নির্মম কথাটা তাকে বলার সাহস পায়নি যার জন্য তার মনে হয়েছে ডাক্তারবাবু হয় তো বিনাপয়সায় চিকিৎসা করছে জন্য তার চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে না৷

তারপর আসমানীর জীবনের অন্তিম লগ্নে আসমানীর বদলে ডাক্তারের সামনে আসে আসমানীর বাবা৷ দীর্ঘদিন খুঁজতে খঁজতে অবশেষে সে সন্ধান পেয়েছে মেয়ের৷ মেয়ের জীবনের সেই শোচনীয় পরিণতিতে ঝরঝর করে কেঁদে উঠে তার বাবা৷ খেয়ালের বসে যৌবনের মদমত্ততায় নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে আসমানী দেহপোজীবিনীর নির্মম পেশায় আত্মনিয়োগ করার পর নিষ্ঠুর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে৷

এই উপন্যাসে আসমানী চারবার ডাক্তারের সামনে উপস্থিত হয়েছে৷ তার মধ্যে তিনবারই সে রোগী৷ মাঝের একবার সিফিলিস সারার পর পরামর্শ নিতে এসেছিল৷ এই ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যেও আসমানীর জীবনের এক বৃহৎ ক্যানভাস তৈরি করে ফেলেছেন৷ একজন দরিদ্র গৃহস্থ কন্যা ভালোবাসার মোহ ফাঁদে পড়ে কীভাবে দেহবিনোদনের কারখানা হয়ে কদর্য জীবন ও কদর্য রোগের শিকার হয়ে সংসার থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয় এ তারই গল্প৷

খ. বৈতরণী তীরে :

‘বৈতরণী তীরে’ (১৯৩৬) গ্রন্থে ডাক্তারি অভিজ্ঞতার এক ভয়াবহ দিক উদ্ঘাটিত হয়েছে৷ যারা একদিন আত্মহত্যার নানা জ্বালাময় পথে নিজের জীবনকে শেষ করে দিয়েছিল, শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে ডাক্তারি ছুরির শাণিত আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছিল, সেই মৃত আত্মারাই এক দুর্যোগময় রাত্রে ডাক্তারের স্মৃতি-সমুদ্র আলোড়িত করে তার চারিদিকে ভিড় জমিয়েছে৷ এদের মধ্যে প্রেতলোকের রহস্যবোধের পরিবর্তে মানবিক অন্তর্জ্বালা ও কৌতুহলই বেশি পরিমাণে ফুটে উঠেছে৷ এই মৃত প্রাণগুলির মধ্যে একজন দেহপসারিণী নারী৷ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল সে৷ ‘‘খুলে দাও, বাঁধনটা খুলে দাও আমার—’’৩১০ বলতে বলতে সে হাজির হয় উপন্যাসের কথক ডাক্তারের সামনে৷ বিভৎস তার চিত্র৷ রক্তাক্ত চোখ দুটি যেন ঠিকরে বের হয়ে আসছে—গলার দড়িটা শক্ত করে বাঁধা৷ তার পর সে শুরু করেছে তার জীবনের বিচিত্র পুরুষ সম্ভোগের অভিজ্ঞতা৷ তাহার রূপপূর্ণ শরীরটিকে হিন্দু, মুসলমান, জৈন, খ্রিস্টান, বালক, বৃদ্ধ, যুবা সকলেই খাবলে খেয়েছে৷ ধনী টাকা দেখিয়েছে৷ কবি কবিতা লিখেছে, বলী বল প্রকাশ করেছে তার উপর৷ আর যার কিছু নেই সে অসহায় মিনতি করে পান করেছে তার তীব্র রূপসুধা৷ তারপর পরম কৌতুহলে সত্যিকারের প্রেম কি ও কেমন সে সম্পর্কে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছে—‘‘ছাপা কেতাবে যে সব প্রেমের গল্প লেখা থাকে সে সব কি সত্যি? ওরকম কি হয়! আমার জীবনে আমি তো দেখেছি পুরুষগুলো আমাকে নিয়ে লোফালুফি করেছে! আমি যেন একটা ফুটবল—আমায় ঘিরে সুদক্ষ একদল খেলোয়াড়; সবারই লোলুপ দৃষ্টি আমার ওপর—কিন্তু আমাকে কাছে পাওয়া মাত্র লাথি মেরে তারা দূর করে দিয়েছে! দূর করে দিয়ে আবার ছুটেছে আমার পেছনে আমাকে ধরবে বলে! একি আশ্চর্য ব্যাপার বলুন তো!’’৩১১ তার এই কথার মধ্য দিয়ে নারীদেহ লোলুপতার চূড়ান্ত একটি ছবি ফুটে উঠেছে—যেখানে প্রেম নেই ভালোবাসা নেই—আছে শুধু শরীর আর সেই শরীরকে ভোগ করার উদগ্র কামনা৷

সেই গলায় দড়ি দেওয়া রূপোপজীবিনীর প্রেত তারপরে শুরু করেছে নিজের জীবনের গল্প৷ এক সুকুমারী সত্তা থেকে বিভৎস হয়ে উঠার কাহিনি৷ নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণবংশের কন্যা সে৷ দরিদ্র হলেও তার মায়ের নিষ্ঠার কারণে যথেষ্ট খাতিরও ছিল তাদের৷ নয় বছর বয়সে এক ধনী যুবকের ঘরে তাকে গৌরীদান করে অসীম পুণ্য অর্জন করেছিল তার মা৷ গৌরীর মতো রূপবতী সেই সুকুমারী বালিকার স্বেচ্ছাচারী বিলাসী যুবকস্বামীর হাতে পড়ে দুর্দশার অন্ত্য থাকে না৷ তার স্বামীর কাছে তার রূপের কোনো দাম ছিল না—সে মদ্যপ ও গণিকাসক্ত৷ সে শুধু স্বামীর উপস্থিতি তখনই টের পেত যখন তার দুর্গন্ধযুক্ত বমি পরিষ্কার করতে হতো তাকে৷ তাই সে আক্ষেপ করে ডাক্তারকে বলেছে—‘‘কোনও গরিবের হাতে পড়লে বোধ হয় আমার এ দুর্দশা হত না!’’৩১২ যাইহোক সমস্ত বিষয় সম্পদ মদ ও বেশ্যাবাজিতে উড়িয়ে তার স্বামী যখন পচা লিভারটা নিয়ে স্বর্গে চলে যায় তখন আরেক যন্ত্রণা তাকে সবলে গ্রাস করে তা হল অর্থযন্ত্রণা৷ বৈধব্য জীবনের চরম যন্ত্রণা বোঝাতে সে তাই সতীদাহের সমর্থন করে বলে—‘‘আমাদের দেশে সতীদাহ প্রথাই ঠিক ছিল—স্বামীর সঙ্গে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলত—বাস নিশ্চিন্ত! এ রকম দগ্ধে দগ্ধে মরতে হত না! এই দেশে কখনও সতীদাহ প্রথা লোপ পেতে পারে? আজও এ দেশের ঘরে ঘরে বিধবা সতীরা পুড়ে মরছে৷ আগুনের চেহারাটা শুধু বদলেছে৷ আগে ছিল চিতানল—এখন হয়েছে তুষানল৷’’৩১৩ কি সুকঠিন বাক্য এই বারবনিতার৷ তার মধ্য দিয়ে লেখক সমাজকে যেন নগ্ন কুৎসিতরূপে তুলে ধরতে চাইছেন সকলের সামনে৷ বিধবা, নিঃসম্বল তাতে রূপবতী৷ জীবনে তার কোনো উপায়ই নেই৷ একদিকে চরম মৃত্যু আরেকদিকে হিংস্র স্বাপদদের লোলুপ দৃষ্টি৷ কিন্তু মৃত্যুকে বরণ করতে পারে কজন! সেও পারেনি৷ বৈধব্যের তৃষিত দাহকে সে শান্ত করেছে তার স্বামীর মামাতো ভাইকে দিয়ে৷ সে-ই প্রথম দেহের বিনিময়ে চেষ্টা করেছিল প্রেম দিতে৷ তার পর তার জীবনে এসেছে তুষানল অর্থাৎ অতৃপ্ত ভালোবাসাকে ভরাতে চেয়েছিল জল বা প্রেম দিয়ে কিন্তু সে প্রেম সে কারও কাছে পায়নি৷ তাই মর্ত্যলোকই তার কাছে নরক হয়ে উঠেছিল৷ তার কথায়—‘‘সে নরক আমি গুলজার করেও তুলেছিলাম!’’৩১৪ সেই বারবনিতা ভেবে পায় না কি করে তার সামান্য দেহটা দিয়ে অতলোককে মুগ্ধ করতে পেরেছিল—অত শত শত লোকের প্রবৃত্তির জ্বালা মিটিয়েছিল৷ বিনোদিনী থেকে সে হয়ে উঠেছিল সকলের বিন্দিবাইজি৷

গণিকা নারীদের টাকার বিনিময়ে প্রেম দেওয়া-নেওয়া চলে৷ বিনোদিনী তার সম্পূর্ণ জীবনে সামান্য ভালোবাসাও পায়নি—ভালোবাসার মতো কোনো মানুষও খুঁজে পায়নি কিন্তু টাকার লোভে তাকে যে কত ভালোবাসার ভান করতে হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই৷ তাই সে বলে—‘‘জীবনে আমার সব চেয়ে বেশি দুঃখ কি জানেন? কাউকে ভালোবাসি নি৷ ভালবাসবার মতো কেউ আমার কাছে আসে নি৷ অথচ টাকার লোভে অহরহ ভালবাসার ভান করতে হয়েছে!’’৩১৫ পুরুষের প্রবৃত্তি বর্ণনা করে সে বলেছে যে তারা ঘরে সতী স্ত্রী ফেলে চলে আসে তাদের মতো বারাঙ্গনার কাছে—নিজেদের স্ত্রীর একনিষ্ঠতা সেবা কোনোকিছুরই দাম নেই তাদের অথচ সেই একনিষ্ঠতা, সেই ভালোবাসা তারা দাবি করে বারবনিতার কাছ থেকে যদিও তাদের অজ্ঞাত নয় যে তারা অসতী—বহুপরিচর্যাকারিণী৷ তার স্বামীও একদিন তার সেবা নিষ্ঠাকে উপেক্ষা করে দেহপসারিণীর ভালোবাসায় উন্মুখ হয়ে থাকতো আর আজ সে যখন গণিকা তখন তার স্বামীর মতো বহু মানুষ তার কাছে সেই একনিষ্ঠতা সেবা দাবি করতে আসে৷ তাই সে বলে—‘‘পুরুষদের ষোল-আনা লোভ এই অসতী মেয়েগুলোর প্রতি!—অসতী জেনেই তারা আমাদের কাছে আসে অথচ এসেই একনিষ্ঠতা দাবি করে বসে৷ আর আমারও টাকার লোভে একনিষ্ঠতার অভিনয় করতে থাকি৷’’৩১৬

বিন্দির মধ্যে ছিল পরিশুদ্ধ প্রেমের প্রত্যাশা৷ যে প্রেম অন্তরের ধারায় উদ্বেল হয়ে উঠবে৷ সে প্রেমকে সে খুঁজে পায়নি৷ কদর্য দেহকামনায় তার পুষ্পিত প্রেমের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল৷ গলায় দড়ি দিয়ে প্রেমহীন জীবনের নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছিল৷ মৃত্যুর পরেও চলে তার সেই প্রেম অন্বেষণ৷ সে বার বার ডাক্তারের সামনে জল প্রত্যাশা করেছে৷ সেই জল তার প্রেমের প্রতীকীরূপ৷ সেখানেই প্রেত রূপে অবস্থানকারী বোমার দলের ছেলেটিকে দেখে অবশেষে প্রেমকে খুঁজে পেয়েছে৷ সে তার নব প্রেমের অভিব্যক্তি জানিয়ে ডাক্তারকে বলেছে—‘‘জীবনে প্রেমের আবির্ভাব হলে ক্ষুদ্র জলাশয় সমুদ্র হয়ে ওঠে৷ লোহা সোনা হয়ে যায়৷ সেদিন সেই যে ছেলেটি দেখলাম আপনার কাছে—কোথায় সে!—আহা ঠিক যেন ঝরণা!’’৩১৭ লোকায়ত যে প্রেমপিপাসা তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে মৃত্যুর পর সেই তৃষ্ণা নিবারণের জন্য স্বচ্ছ জলের সন্ধান পেয়েছে সে৷ তার জীবনে সে একটাও নদী দেখতে পায়নি—শুধু দেখেছে নর্দমা৷ সেই নর্দমার জলই পিপাসায় আকন্ঠ পান করে করে শেষে গলায় দড়ি দেওয়ার পর ঝরণাধারার খোঁজ পেয়েছে৷ মৃত্যুর পরপারে এসে পুনরায় অভিসারিকা সেজেছে বোমার দলের ছেলেটিকে পাওয়ার জন্য৷ ডাক্তার অবাক বিস্ময়ে দেখে বিন্দির সে চেহারা নেই৷ সুন্দর খোঁপা বেঁধেছে—খোঁপায় বেলফুল গোঁজা৷ গালে রঙ, ঠোঁটে রঙ—সুন্দর টানা টানা চোখে কাজল রেখা টেনে আরও অপরূপা হয়ে উঠেছে৷ পরনে মখমলে ফিনফিনে শাড়ি৷ তার সেই মোহিনী বেশে পুরুষের মন মুগ্ধ না হয়ে পারে না৷ অপরূপ লাস্যভঙ্গিতে সে আহ্বান করছে সেই অ্যানার্কিষ্ট ছেলেটিকে যে ব্যর্থ প্রণয়ের যন্ত্রণায় সায়ানাইট খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল৷ কথক-ডাক্তার তাই তার সম্পর্কে বলে—‘‘যে হতভাগিনী বাঁচিয়া থাকিতে পুরুষের মনোযোগের জ্বালায় অস্থির হইয়া গলায় দড়ি দিয়াছিল, মৃত্যুর পর সে-ও দেখিতেছি অভিসারিকা সাজিয়াছে এবং ভুলাইতেছে সেই ব্যর্থ প্রণয়ীকে যে নারীর উপর অভিমান করিয়া সায়ানাইড গিলিয়াছিল শান্তির আশায়৷’’৩১৮

বিন্দিবাইজি মৃত্যুর পর যে শুধু প্রেমিকের সন্ধান পেয়েছে তা নয়, সে দেখে তার দেহভোগকারী এক পুরুষও মৃত্যুর পরে সেখানে উপস্থিত হয়েছে৷ বিন্দির গলার স্বর শুনে তার অশরীরী দেহ পুনরায় নারীসঙ্গ প্রাপ্তির আশায় লালায়িত হয়ে উঠেছে৷ সেও ডাক্তারের কাছে বার বার জিজ্ঞেস করেছে বিন্দির কথা৷ বিন্দিও সেই মাংসলোভী পাষণ্ডকে দেখে ভয় পেয়ে মুহূর্তেই অন্তর্হিত হয়ে গেছে ডাক্তারের সম্মুখ থেকে৷

উপন্যাসের শেষে দেখা যায় সেই কালো-কুৎসিত গলাকাটা লোকটা যখন বোমার দলের ছেলেটিকে আক্রমণ করে তখন ঝড়ের মতো বিন্দি ছুটে এসে লোকটার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকানি দিয়ে তাকে ছেড়ে দিতে বলে৷ তারপর সে নতজানু হয়ে প্রাণ ভিক্ষা চায় সেই অ্যানার্কিষ্ট ছেলেটির৷ অবশেষে তার জীবনের ‘ঝরণা’কে শত্রুর হাত থেকে উদ্ধার করে ছেলেটির মাথা কোলে নিয়ে বসে কাঁদতে থাকে—তার কাপড় রক্তে রাঙানো৷

বিনোদিনী জীবনের যে বিপুল তৃষ্ণা নিয়ে বিন্দিবাই হয়েছিল এবং শেষপর্যন্ত গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল সেই তৃষ্ণার জলের সন্ধান পেয়েছিল সে মৃত্যুর পরে৷ তাও সে পাওয়া তার সম্পূর্ণ নয়৷ পেয়েও সে আবার তাকে হারায় এক দুর্বৃত্তের নিষ্ঠুর পীড়নে৷ বিন্দির মধ্য দিয়ে সমাজের ভয়ঙ্কর কুৎসিত বাস্তব রূপটাকে তুলে ধরেছেন লেখক তার ‘বৈতরণী তীরে’ উপন্যাসে৷

গ. জঙ্গম :

মুক্তো :

বনফুলের জঙ্গম (১৯৪৩) উপন্যাসের অন্যতম গণিকা চরিত্র মুক্তো৷ মমতায় ভালোবাসায় ত্যাগে মহীয়ান সে৷ চরিত্রটিকে প্রথম দেখা যায় হাওড়া স্টেশনে মূর্ছিত অবস্থায়৷ নায়ক শঙ্কর তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনার জন্য সংজ্ঞাহীন দেহটাকে পাঁজাকোলা করে কলের কাছে নিয়ে গিয়ে মুখে-চোখে জলসেচন করে৷ মুক্তোর সঙ্গিনী মাসি৷ তারা দুজনেই দেহজীবিনী৷ তাদের পরিচয় শঙ্করের সম্পূর্ণ অজ্ঞাত৷ সে তাদের কোলকাতায় ফেরার জন্য ঘোড়ার গাড়ি ঠিক করে দিলে তার নিঃস্বার্থ সহযোগিতায় মুগ্ধ হয়ে যায় প্রৌঢ়া মাসি৷ সে আতিথ্যের জন্য আমন্ত্রণ জানায় তাকে৷ মুক্তো কেরানি বাগানের উনিশ নং বস্তির আঠার নং ঘরের বারবধূ৷ তার বয়স সতেরো-আঠারো৷ তারপর নানা ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে শঙ্কর ভুলে যায় তাদের নিমন্ত্রণ৷ মুক্তোর সংজ্ঞাহীন দেহের মধুর স্পর্শে সেদিন নড়ে চড়ে উঠেছিল তার ভেতরের নিভৃত কন্দরবাসী পুরুষটা; সেই যুবতী নারীর কথা তার অনেক দিন মনে পড়ে না৷ কিন্তু বহুদিন পড়ে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত শংকর নিজের কাছ থেকে নিজেকে লুকোতে প্রায় মনের অজ্ঞাতেই হাজির হয় কেরানিবাগানের বস্তিটিতে ৷ সেখানে উপস্থিত হয়ে সে দেখে—‘‘একটা ল্যাম্প-পোষ্টের ধারে একফালি সরু বারান্দার উপর রঙিন-কাপড়-পরা কয়েকটি মেয়ে হাসাহাসি করিতেছে৷ তাহাদের মধ্যে একজন কোমরে হাত দিয়া সিগারেট খাইতেছে৷’’৩১৯ লেখক সুস্পষ্টভাবে বেশ্যাদের ‘খদ্দের’ ধরার জন্য অপেক্ষার চিত্রটি বর্ণনা করেছেন৷ যে মেয়েটি সিগারেট খাচ্ছিল সে শঙ্করকে দেখে আরও একটু কায়দা করে ধোঁয়া ছাড়তে থাকে৷ অন্য আরেকটি মেয়ে বঙ্কিম ভঙ্গিতে আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়েছিল, সে রাস্তায় নেমে এসে শঙ্করের দিকে চকিতে একবার চেয়ে সঙ্গিনীদের মুখপানে তাকিয়ে হেসে উঠে একজন সঙ্গিনীকে ডেকে লাস্যভঙ্গিতে বলে উঠে—‘‘আমার খোঁপাটা একটু ঠিক করে দে তো, বার বার এলিয়ে যাচ্ছে৷’’৩২০ সঙ্গিনী কথা মতো শঙ্করকে দেখিয়ে দেখিয়ে তার খোঁপা ঠিক করে দেয়৷ গণিকাদের উল্লিখিত হাবভাব, কটাক্ষ, পুরুষ ধরার কৌশল লেখক একেবারে বাস্তবসম্মত করে তুলে ধরেছেন৷ সমাজের এই সব পতিত নারীরা কখনো কারও সহানুভূতি পায় না৷ জীবন ধারণের জন্য তাদের পরিবেশ উপযোগী খিস্তি-খেউড় দিয়ে কর্ম-প্রয়োজন সম্পাদন করে৷ সেই চিত্রটিও লেখকের উপস্থাপনা থেকে বাদ পড়েনি৷ তাই তো শঙ্কর যখন সেই এলোখোঁপার মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে—‘‘আপনি কি ১৮ নম্বর কেরানিবাগানে থাকেন?’’৩২১ খদ্দেরের মুখে ‘আপনি’ সম্বোধন শুনে মেয়েটি গম্ভীর হয়ে যায়৷ কিন্তু গম্ভীর হয়ে থাকলে তো চলবে না৷ তাদের রোজগার করতে হবে৷ তাই মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে আবার চোখ মিটিমিটি করে হেসে সম্মতি জ্ঞাপন করলে শঙ্কর সেই হাওড়া স্টেশনের যুবতী নারীর সত্যকার পরিচয় পেয়ে দিশেহারা হয়ে যায়৷ তার তালু শুকিয়ে যায়, নিদারুণ তৃষ্ণায় বুক ফেটে যায়৷ সেই ষোড়শী নারী যে একজন বেশ্যা হতে পারে শঙ্কর তা কল্পনায়ও আনতে পারেনি৷ মেয়েটি শঙ্করের ভাব অনুধাবন করতে পেরে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে৷ হঠাৎ শঙ্কর তার কাছে জল পান করতে চাইলে মুক্তো তাকে জল দেওয়ার জন্য ভেতরে ডেকে নিয়ে যায়৷ একজন গণিকার খদ্দের জোটার সম্ভাবনায় অপর বারবধূদের কন্ঠে অক্ষমতার আক্ষেপ ধ্বনিত হয়—‘‘মুক্তোটার কপাল ভাল৷ আমাদের আর কতক্ষণ ভোগান্তি আছে, কে জানে বাপু!’’৩২২ আর একজন বারনারী লঘু হাস্য পরিহাসে তাকে জানায়—‘‘ওলো, মুক্তো, শুধু জল দিসনি, একটু মিষ্টিমুখ করিয়ে দিস বাবুকে৷’’৩২৩ শঙ্কর মুক্তোর ঘরে এসে তাদের পূর্ব পরিচয়ের সব বিবরণ দিলে সে সম্পূর্ণরূপে দক্ষ অভিনেত্রীর মতো ভুলে যাওয়ার ভান করে৷ কাঁচের গ্লাসে করে জল এনে শঙ্করের হাতে এনে দিলে সে ঢকঢক করে তা পান করে ফেললে মুক্তো তার স্বরূপে ফিরে আসে৷ বারবধূ সে৷ তার কাছে সময়ের অনেক দাম৷ তাই শঙ্করকে সচেতন করতে জিজ্ঞেস করে সে আর কতক্ষণ বসবে৷ শঙ্করের উত্তরে যখন বুঝতে পারে সে তখনই উঠতে চায় না তখন অত্যন্ত সাবলীলভাবে সময় হিসেবে তার দেহের দর হাকে—‘‘ঘন্টা পিছু দু-টাকা করে লাগবে, এই আমার রেট৷’’৩২৪ মুক্তোর প্রকাশ্যে দর হাকায় বিব্রত হয়ে তখনি নিজের মানিব্যাগ থেকে দশ টাকার নোট বের করে দিলে সেই বহুভোগ্যা অভিনয়দক্ষ নারী তার স্বভাবসুলভ খিল খিল হাসিতে লুটিয়ে পড়ে বলতে থাকে—‘‘বাবা! রাগ তো আপনার কম নয় দেখছি!’’৩২৫ তারপর গম্ভীর হয়ে আবার বলে—‘‘না, ছি, আপনি অতিথি মানুষ, আমাদের নেমন্তন্ন পেয়ে এসেছেন বলছেন, আপনার কাছে কি টাকা নিতে পারি? সব জায়গায় কি আর ব্যবসাদারি চলে? দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? বিছানায় বসুন না, আমি আসছি এক্ষুনি৷’’৩২৬ এরপর মুক্তোর মনের অর্গলটাকে যেন একটু একটু করে উন্মুক্ত করছেন লেখক৷ গণিকার বহুপুরুষপিষ্ট জীবনের মাঝেও সহসা কোনো এক পুরুষ স্থায়ী আসন লাভ করে তাকে তার দুঃসহ জীবন যন্ত্রণার মধ্যেও মহিমান্বিত করে তোলে; এ যেন তারই চিত্র৷ তাই বাইরে কিছু সময় অতিবাহিত করে আসার পর ক্লান্ত শঙ্করকে তা বিছানায় অকাতরে নিদ্রা যেতে দেখে পরম মমতায় সে নির্নিমেষ নয়নে তার মুখের পানে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে৷

দেহব্যবসায়ী নারীদের প্রায় সকলেরই একজন বাঁধা বাবু থাকে৷ মুক্তোরও ব্যতিক্রম নয়৷ নির্জন দ্বিপ্রহরে শঙ্কর মুক্তোর পরিপাটী করে গোছানো ঘরে শুয়ে শুয়ে ঘরের সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতে করতে লক্ষ করে আলনায় রাখা মুক্তোর বাঁধা বাবুর লুঙ্গি ও গেঞ্জি৷ মুক্তোর সেই বাবু প্রত্যহ রাত্রি দশটায় আসে, সমস্ত রাত্রি থাকে৷ তার সঙ্গে মুক্তোর পাকাপাকি বন্দোবস্ত—‘‘রাত্রি দশটা পর্যন্ত মুক্তো ইচ্ছা করিলে অপর লোক বসাইতে পারে, কিন্তু দশটার পরে মুক্তোর কক্ষে অপর কাহারও প্রবেশ নিষেধ৷ তবে যদি কোনো দিন কোনো কারণে আসিতে না পারেন, সেদিন মুক্তোর ছুটি এবং সে ছুটি মুক্তোর নিজের ইচ্ছামত ব্যয় করিতে পারে৷’’৩২৭ মুক্তোর সেই বাঁধা বাবুর নাম দশরথ৷ শঙ্করের বন্ধু ভন্টুর ভাষায় অরিজিন্যাল৷ সে ব্যবসায়ী লোক তাই প্রকৃত ব্যবসাদারের মতোই তার বন্দোবস্ত৷ মুক্তোর সঙ্গে প্রৌঢ় দশরথ বাবুর হৃদয়ঘটিত কোনো সম্পর্ক নেই৷ লেখকের ভাষায়—‘‘সম্পর্কটা নিতান্তই আধিভৌতিক৷’’৩২৮ সোজাসাপটা গোছের দশরথ বাবু সমাজের সামনে তার গণিকাপল্লীতে আসা-যাওয়াটাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে পছন্দ করে না৷ সে অকপটে তার এই গণিকাগমন প্রসঙ্গে ভন্টুর কাছে বলতে পারে—‘‘আপনাদের মত মর‍্যাল সেজে ভদ্দরলোকের বাড়ির জানালার পানে হাঁ করে চেয়ে থাকি না, সোজা বেশ্যাবাড়ি যাই৷ আমি ক্ষিদের সময় চাই খাবার, চা নয়৷ চটলে লাথি মারি, ভালবাসলে জড়িয়ে ধরি৷ ঢাক-ঢাক গুড়-গুড় পছন্দ করি না৷’’৩২৯ দশরথ বাবুর ছেলে লক্ষণ পিতার এই গণিকাপল্লীতে যাওয়াটাকে মেনে নিতে পারেনি৷ নানা কারণে সে আত্মহত্যা করলে তার মুখ থেকে এমন হৃদয় বিদারি কথা বেড়িয়ে আসে৷ দশরথ বাবুর প্রকাশ্যে গণিকা গমন এবং ভদ্দরলোকের বাড়ির জানালায় উঁকিঝুকি মারার কথা প্রসঙ্গে লেখক এই দিকটার প্রতি ইঙ্গিত দিয়েছেন বলে মনে হয় যে সমাজের স্ত্রী জাতির প্রতি পুরুষদের কামনার ভারসাম্য ঠিক রেখেছে গণিকারা৷ যদি গণিকাপল্লী না থাকতো তাহলে পুরুষেরা তাদের দুর্বার কামনায় ভদ্রবাড়ির মেয়েদের আক্রমণ করতো৷ সমস্যা আরও বেড়ে যেতো৷ দশরথ বাবু জানালা দিয়ে পরস্ত্রীকে দর্শন করে বাসনা পূরণ করার কৌশলকে ব্যঙ্গ করে প্রকাশ্যে গণিকালয়ে যাওয়াটাকেই শ্রেয় বলে মনে করেছে৷ পরের বাড়ির জানালার দিকে তাকিয়ে থেকে প্রবৃত্তির জ্বালা মেটানো তার কাছে ক্ষুধার সময় চা খাওয়ারই সামিল৷

মুক্তো নামের এই দেহজীবিনী নারীটিকে শঙ্কর যত দেখে তত অবাক হয়ে যায়৷ সে আপন মনেই ভাবে—‘‘অদ্ভুত মেয়ে এই মুক্তো! এতদিন ধরিয়া শঙ্কর এখানে যাতায়াত করিতেছে, কিন্তু মেয়েটির স্বরূপটি যে কি, তাহা আজও সে বুঝিতে পারে নাই৷ কিছুতেই যেন ধরা-ছোঁয়া দেয় না৷ হাসে, নাচে, গান গায়, মদ খায়, বৈকালে গা ধুইয়া চুল বাঁধিয়া চোখে কাজল দিয়া রঙিন শাড়িটি কায়দা করিয়া পরিয়া গালে ঠোঁটে রঙ মাখিয়া খোঁপায় ফুলের মালা পরিয়া রাস্তার ধারে গিয়া দাঁড়ায়, ভঙ্গিভরে সিগারেট টানে, কথায় কথায় খিলখিল করিয়া হাসিয়া লুটাইয়া পড়ে, চটিয়া গেলে অশ্লীল ভাষায় গালাগালি করে, অন্ধ-আতুর দেখিলে পয়সা দেয়, গঙ্গাস্নান করিতে যায়, মেনি বেড়ালকে আদর করে, দশরথের জন্য প্রত্যহ হাঁসের ডিমের ডালনা ও পরোটা বানায়, সামনের চপ-কাটলেটওয়ালার সঙ্গে দুই-এক পয়সার জন্য ইতরের মত কলহ করে, ঘরে লুকাইয়া মদের বোতল রাখে এবং তাহা সুযোগ মত শাঁসালো কাপ্তেনের নিকট দুর্মূল্যে বিক্রয় করে৷ কিন্তু শঙ্করের মনে হয়, আসল ব্যক্তিটি অন্তরালে আছে, সে কখনও ভুলিয়াও পাদ-প্রদীপের সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করে না৷ তাহাকে একটু যেন চেনা যায়, যখন সে দুপুরে ফালি বারান্দাটুকুতে বসিয়া রোদে পিঠ দিয়া চুল শুকায়৷ মনে হয়, উহাই যেন তাহার জীবনের সত্য আকাঙ্ক্ষা, ও যেন আর কিছু চায় না, নিশ্চিন্ত চিত্তে নিজের ঘরের দাওয়াটিতে বসিয়া রোদে পিঠ দিয়া চুল শুকাইতে শুকাইতে প্রতিবেশিনীর সঙ্গে সুখদুঃখের আলোচনা করিতে চায়৷’’৩৩০ উদ্ধৃত কথাগুলির মধ্য দিয়ে গণিকা নারীর প্রাত্যহিক জীবনের সমস্ত খুঁটিনাটির বিষদ বিবরণ দিয়েছেন বনফুল৷ অবশেষে সবকিছু ভুলে রোদে পিঠ দিয়ে বসে চুল শুকোতে শুকোতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলার মধ্য দিয়ে বারবনিতাদের দেহবিক্রির যন্ত্রণাময় চক্রবুহ্য থেকে বেড়িয়ে আসার আকাঙ্খাকে প্রকাশ করেছেন৷ সেখানে খদ্দের ধরার চিন্তা নেই, রসদ সংগ্রহের ভাবনা নেই শুধু নিশ্চিন্তমনে দিন যাপন করতে চায় তারা৷ শঙ্কর পঙ্কিলতার সেই ঘোর পঙ্ক থেকে মুক্তোকে উদ্ধার করে সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে দিতে চায়৷ প্রথম যখন সে মুক্তোর সংস্পর্শ লাভ করেছিল, সে গণিকা সংস্পর্শের কলুষিত হয়ে নিজের প্রতি নিজেই ধিক্কার জানিয়েছিল; নিজের অধঃপতনের দরুণ ঘৃণা করেছিল নিজেকে৷ এর মধ্য দিয়ে গণিকার প্রতি লেখকের বা সমাজের ঘৃণিত মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে৷ কিন্তু ধীরে ধীরে সব দ্বন্দ্ব ঘুচে যায়, মুক্তোর মতো পণ্যাঙ্গনাদের তাদের সুখ, দুঃখ, বেদনা, ভালোবাসা, অপমান-লাঞ্ছনার অলিগলি ঘুরে, তাদের জীবন যন্ত্রণাকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করে শঙ্কর৷ তার মনে হয়—‘‘মুক্তো গণিকা—এই কথাই বড় নয়, মুক্তো নারী—এই কথাই বড়৷ শুধু নারী নয়, লাঞ্ছিতা অবনমিতা নারী৷ সমাজের অত্যাচারে, পারিপার্শ্বিক ঘটনার চাপে নিতান্ত নিরুপায় হইয়া উদরান্নের জন্য দেহ-বিক্রয় করিতেছে৷’’৩৩১ অর্থাৎ লেখক শঙ্করের মধ্য দিয়ে স্বীকার করেছেন একজন নারীর দেহ-বিক্রয়ের পেছনে কতটা প্রতিকূল পরিস্থিতি কাজ করে, সমাজ কতটা ইন্ধন জোগায়৷ মুক্তোর মতো নারীরা সমাজেরই তৈরি, সমাজই তাদের গণিকা বানায়, আবার সমাজই তাকে ঘৃণ্য অবমাননায় দূরে ঠেলে দেয়৷ শঙ্কর তাই প্রতিজ্ঞা করে—‘‘উহাকে উদ্ধার করিতে হইবে৷ পঙ্ক হইতে পঙ্কজিনীকে আহরণ করিয়া প্রেমের মন্দিরে নির্মাল্য রচনা করিতে হইবে৷’’৩৩২ শঙ্করের তাই মুক্তোকে প্রয়োজন৷ তার সমস্ত মলিনতা সত্ত্বেও সে একান্তভাবে মুক্তোকে চায়৷ সে আর কোনো পুরুষকে মুক্তোর কাছে আসতে দেবে না, যেমন করে হোক দশরথকে তাড়িয়ে দেবে৷ মুক্তোও সমস্ত কলুষতার মধ্যেও, দেহজীবিনীর আবর্তে চালিত হলেও, তার নারীত্বকে ত্যাগ করতে পারেনি৷ শঙ্কর সেই অক্ষুন্ন নারীত্বের সন্ধান পেয়েছে৷ সেই নারীত্বের সম্মান যদি সে না করে তবে তার শিক্ষা-দীক্ষা সমস্তই ব্যর্থ৷ সে আরও অনুভব করে সমাজে এমন অনেক নারীরা আছে যারা প্রকাশ্যে দেহের দর হাকে না কিন্তু নিজের দেহকে পুরুষের পর পুরুষের অঙ্কশায়িনী করতেও দ্বিধাবোধ করে না৷ এমনই এক চরিত্র মিষ্টি দিদি৷ তাই সে মুক্তো সম্পর্কে ভাবে—‘‘মুক্তো গণিকা বটে, কিন্তু মুক্তোকে দেখিয়া তো ঘৃণা করিতে প্রবৃত্তি হয় না! সে রূপোপজীবিনী, ওই তাহার পেশা৷ মিষ্টিদিদির মত ছদ্মবেশী ঘৃণ্য জীব সে নয়৷… নিরপেক্ষ বিচারে মুক্তো ও মিষ্টিদিদির কোনো তফাত নাই৷’’৩৩৩ ঔপন্যাসিক বনফুল মুক্তো ও উচ্চবিত্ত ভদ্রসমাজের প্রতিনিধি মিষ্টিদিদির প্রবৃত্তির খেলাকে দেহব্যবসা ছাড়া কিছুই ভাবেননি৷ শুধুমাত্র দুজনের প্রেক্ষাপট আলাদা৷

মুক্তো রূপাজীবা হয়েও শঙ্করকে ভালোবাসে৷ সেই ভালোবাসা গণিকাদের কপট ভালোবাসা নয়; তা অন্তরের নির্মোহ স্তর থেকে উৎসারিত৷ তাই সে শঙ্করকে তার ঘৃণ্য জীবনের পঙ্কে নামিয়ে আনতে চায় না৷ নিজের একান্ত বাঞ্ছিতকে বার বার প্রত্যাখ্যান করে তাকে তার জীবনবৃত্তের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরিয়ে দিতে চায়৷ তবুও হৃদয়ের দুর্দমনীয় প্রেমোচ্ছ্বাসকে বেশিক্ষণ দাবিয়ে রাখতে পারে না৷ তাই একদিকে সে যেমন তার প্রেমাস্পদকে উপেক্ষা করে, অপর দিকে তার সামান্য অনুপস্থিতেই তার মন হাহাকার করে ওঠে৷ সে যতক্ষণ তার ঘরে থাকে ততক্ষণ সে নানা অছিলায় তার থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে কিন্তু থাকতে পারে না তাই পাশের ঘরের জানালা দিয়ে নির্নিমেষ নয়নে তার দিকে চেয়ে থাকে৷ আর তার সেই ভাব দেখে তার সহকর্মী টিয়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে—‘‘ঢঙ দেখে আর বাঁচি না৷ ঘরে গিয়ে নয়ন ভরে দেখ না! উঁকি দেওয়া কেন?’’৩৩৪

মুক্তো শঙ্করকে ডাকে অতিথি বলে৷ কারণ শঙ্কর তার কাছে ‘খদ্দের’ নয়৷ এ বিষয়ে শঙ্কর তাকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়—‘‘অতিথি বলব না তো কি বলব, আপনি তো খদ্দের নন ঠিক৷’’৩৩৫ শঙ্কর তাকে ‘খদ্দের’ কথার মানে জিজ্ঞেস করলে মুক্তো গা দুলিয়ে হাত নাড়িয়ে বলে—‘‘ফেল কড়ি মাখ তেল, তুমি কি আমার পর—এই কথা যাকে বলতে পারা যায়, সেই হল খদ্দের৷’’৩৩৬ তার কথা শুনে শঙ্কর তার খদ্দের হতে চাইলে মুক্তো জানায় আজ সে তাকে খদ্দের ভাবতে পারছে না কিন্তু একদিন না একদিন তাকে খদ্দের ভাবতেই হবে৷ তার ভবিষ্যৎ আছে সে রোজগারের পথে নেমেছে; দানছত্র খুলে বসেনি৷ মুক্তো বোঝে তার মত গণিকার জীবনে ভালোবাসার কোনো জায়গা নেই, সমস্তই আপেক্ষিক, শুধুমাত্র রোজগারের জন্য৷ তার মত কলঙ্কিনী নারীর জীবনে সে আর শঙ্করকে জড়াতে চায় না৷ তাই তাকে উপেক্ষা করার জন্য তার পেছনে ঘুরঘুর করা কাঁচা পাকা দাড়িওয়ালা লোকটিকে দেখিয়ে শঙ্করকে চলে যেতে বলে, যাতে সে দু-পয়সা রোজগার করতে পারে৷ শঙ্কর চলে যেতেই সেই লোকটিকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিতেই চোখে পড়ে শঙ্কর আবার ফিরে আসছে৷ আবার তার আচরণ বিপরীত হয়৷ তার সামনেই সেই লোকটিকে সমাদর করে ডেকে নিয়ে ঘরে খিল এঁটে দেয়৷ শঙ্কর তার ফেলে যাওয়া বইটি ফেরত নিতে এসেছে জানালে সে ভেতর থেকে কোনো সাড়া দেয় না৷ অবশেষে শঙ্কর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর চলে গেলে সে নিজের মনেই ভাবে—‘‘ভালই হইয়াছে, বইখানার জন্যও অন্তত আর একবার আসিবে৷’’৩৩৭

কেরানিবাগানের সেই গণিকাপল্লীতে শুধু মুক্তো নয় কালোজাম, টিয়া, আঙ্গুরসহ আরও বহু গণিকা৷ তাদের সবারই জীবন মুক্তোর মতো৷ শঙ্কর একদিন রাত্রি আটটার সময় মুক্তোর ঘরে গিয়ে দেখে মুক্তো সেখানে নেই৷ কালোজামের কাছে জানতে পারে আঙ্গুরের ঘরে একজন বড়লোক বাবু ইয়ার বন্ধু সমভিব্যাহারে স্ফূর্তি করতে আসায় দশবারোজন নর্তকীর প্রয়োজন হওয়াতে মুক্তো সেখানে গেছে৷ কালোজামের প্রচেষ্টায় শঙ্কর জানালা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে মুক্তোর মোহময়ী নৃত্য৷ সেখানে আরেক ভয়াবহ দৃশ্যে তার শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে৷ সে দেখে এক আসন্নপ্রসবা নারী দেহভারে ক্লান্ত হয়েও পুরুষের মতো মাথায় পাগড়ি বেঁধে, জুতা পড়ে প্রবল মদ্যপ অবস্থায় নেচে চলেছে৷ তার গালের হাড় উচু হয়ে আছে, চোখদুটো ঠিকরে বাইরে বেড়িয়ে আসতে চাইছে৷ সামান্য কয়টা টাকার জন্য আসন্নপ্রসবা এক নারীর এহেন কার্যে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে সে সমস্ত তছনছ করার জন্য আঙ্গুরের ঘরের দিকে পা বাড়ালে মুক্তোর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়৷ নিমেষে শান্ত হয়ে সে লক্ষ করে মদ খেয়ে চোখে অপূর্ব মদিরা প্রাখর্যে সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখাচ্ছে মুক্তোকে৷ মুক্তো তাকে আঁচলের তল থেকে বের করে এক ডিশ মেটেচচ্চরি খেতে দিলে শঙ্কর তা প্রত্যাখ্যান করে৷ সে মুক্তোকে জানায় তাকে গণিকাপল্লীর কদর্য নরক থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে৷ ‘নরক’ শব্দ শুনে মুক্তো উত্তেজিত হয়ে পড়ে৷ সে শঙ্করকে জানায় সে সমাজের সেই অপমানের স্বর্গে কখনোই ফিরে যেতে চায় না৷ কিন্তু মুক্তোর সেই উষ্মা দীর্ঘস্থায়ী হয় না৷ নিমেষেই সে শান্ত হয়ে স্নেহময়ী জননীর মত গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে প্রেমিককে খাবার খাওয়ায়৷ শেষে পুনরায় আঙ্গুরের ঘরে যেতে চাইলে শঙ্কর তাকে বাধা দেয়৷ কিন্তু মুক্তোকে তো যেতেই হবে! কারণ সে অগ্রিম টাকা নিয়ে এসেছে৷ শঙ্কর সেই টাকা ফিরিয়ে দিতে বলে তার হাতে কিছু টাকা দিলে মুক্তো সুদক্ষ হিসেবির মতো সেই টাকা গুণে গুণে শেষে তাকে উদ্দেশ্য করে বলে—‘‘এ কটা টাকায় আমার কি হবে? ওদের সাতদিন মাইফেল চলবে, একশো টাকা অগ্রিম দিয়েছে, বকশিশটা-আশটাও মিটবে৷ নিন আপনার টাকা, আপনি বাড়ি যান৷ গরিবের ছেলের এসব ঘোড়ারোগ কেন বাপু? সোন্দর দেখে বিয়ে করলেই পারেন একটা৷’’৩৩৮ মুক্তো এভাবে তার কঠিন বাক্য দ্বারা প্রকাশ্যে শঙ্করকে যতই উপেক্ষা দেখাক, অপমান করুক, ভেতরে ভেতরে সেই আঘাতটা নিজের মধ্যেই অনুভব করে৷ শঙ্করকে অপমান করে, কুকথা শুনিয়ে জানালার ফুটো দিয়ে তাকেই দেখতে থাকে অপলক নয়নে৷ প্রবল অভিমান নিয়ে তার চোখের সামনে দিয়ে যখন সে চলে যায় তখন তার বার বার ইচ্ছে করে তাকে অনুরোধ করে ফিরিয়ে আনে কিন্তু প্রতিবারই সে নিজেকে সংযত করে প্রেমিকের শুভকামনায়৷ কিছুতেই তার সঙ্গ সে ছাড়াতে পারে না৷ যতই অপমানই করুক সে বার বার তীর্থের কাকের মতো তার দুয়ারে এসে তারই অপেক্ষায় বসে থাকে৷ অবশেষে আরও কঠিন হয় সে৷ মুক্তো মনে প্রাণে ভালোবাসে তাকে৷ সে নিজে আকন্ঠ পাপে নিমগ্ন৷ কিছুতেই সেখানে তার প্রিয়তমকে নামাতে পারবে না৷ তাই বাঘা নামের এক গুণ্ডাগোছের লোক দিয়ে তাকে চরম অপমান করায়; বাঘাকে আপনার লোক বলে দাবি করে৷ অপমানে বজ্রাহত শঙ্কর তাকে ছেড়ে চলে গেলে পরম শূন্যতায় ‘‘যতক্ষণ দেখা গেল, মুক্তো শঙ্করের পানে চাহিয়া রহিল; কিন্তু বেশিক্ষণ দেখা গেল না৷ কতটুকুই বা গলি, শঙ্কর দেখিতে দেখিতে পার হইয়া গেল! মুক্তো তবু সেই দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল৷ তাহার পুণ্যলেশহীন অন্ধকার পতিতা-জীবনে একটিমাত্র পুণ্য-প্রেরণার শিখা জ্বলিয়াছিল৷ সেই শিখার ইন্ধন যোগাইতে গিয়াই সে নিঃস্ব হইয়া গেল৷ শঙ্করের মত ছেলেকে সে নষ্ট করিতে চাহে নাই৷ যেদিন তাহাকে প্রথম দেখিয়াছিল, সেই দিনই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিয়াছিল—যেমন করিয়া হউক, পঙ্কিলতা হইতে ইহাকে সে রক্ষা করিবে৷ অন্তর্দ্বন্দ্বে সে ক্ষত-বিক্ষত হইয়াছে, কিন্তু হার মানে নাই৷ শঙ্করকে পঙ্ককুণ্ড হইতে সত্যই রক্ষা করিয়াছে৷’’৩৩৯ তার ভেতরকার কোমল ভালোবাসায় বার বার তাকে ধিক্কার জানিয়ে বলতে থাকে যে সে কি করলো সে যে চলে গেলো৷ মুক্তো মনে মনে বুঝেছিল শঙ্কর আর কোনোদিন তার গৃহে আসবে না৷ প্রেমের জন্য—প্রেমিকের জন্য সেই বৃহৎ ত্যাগের স্বীকার শঙ্কর কিছুই বুঝতে পারে না৷ বরং দুর্বার এক বাসনা তার দেহমনকে উথাল-পাথাল করে দেয়৷ তবুও স্বস্তি প্রকাশ করে সে ভাবে—‘‘তাহার পঙ্কিল স্পর্শ হইতে সে যে মানে মানে দূরে চলিয়া আসিতে পারিয়াছে, এজন্য সে আনন্দিত৷ পঙ্কিল স্পর্শ! এখন মুক্তোর স্পর্শকে পঙ্কিল স্পর্শ মনে হইতেছে৷’’৩৪০ শঙ্কর মুক্তোর জীবন থেকে চিরতরে চলে যায়৷ প্রেমময়ী করুণাময়ী মুক্তো তার নির্মোহ প্রেমের অস্ত্রে তাকে সরিয়ে দেয় কামনার জতুগৃহ থেকে৷

প্রায় প্রত্যেক বারবনিতারই একটা অতীত ইতিহাস থাকে৷ সেখানে তার পরিচয় গণিকা হিসেবে নয় কারও মাতা, কারও বোন অথবা কারও পত্নী হিসেবে৷ কিন্তু পরিবেশ ও পরিস্থিতি তাদের দেহজীবিকার ঘৃণ্য পঙ্কে নিমজ্জিত করে; তারা বলি হয়ে যায় সমাজের নির্দয় যূপকাষ্ঠে৷ মুক্তোর জীবনেরও এক অতীতকে তুলে ধরেছেন লেখক৷ উনিশ নং কেরানিবাগানের গণিকা হওয়ার আগে তার নিজের আরেকটা পরিচয় ছিল৷ সে ছিল যতীন হাজরার স্ত্রী৷ স্বামীর প্রতারণার শিকার হয়ে শেষ পর্যন্ত তার আশ্রয় হয় কেরানিবাগানের সেই নিষিদ্ধপল্লীতে৷ যক্ষাক্রান্ত যতীন হাজরা তার উপস্থিত মৃত্যুর প্রাক্কালে মৃত্যুকালীন জবানবন্দিতে সেই সব কথা ব্যক্ত করে গেছে শঙ্করকে—‘‘আমি তাকে ফেলে পালিয়ে এসেছিলাম৷ সে নিরপরাধ জেনেও তার মাথায় কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে ত্যাগ করে এসেছিলাম৷ সে এখনও বেঁচে আছে৷ আপনি একবার দয়া করে যাবেন তার কাছে?… বলবেন আমার পাপের পুরো প্রায়শ্চিত্ত করে জ্বলে পুড়ে অনুতাপ করতে করতে আমি মরেছি৷… জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারই কথা ভেবেছি, মনে মনে তার পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছি—৷’’৩৪১ যতীন হাজরা মুক্তোকে ত্যাগ করে চুনচুনকে বিয়ে করেছিল৷ তার নিজের পাপে নিজেই শেষ হয়ে গেছে৷ কিন্তু মুক্তোর তো পাপ ছিল না৷ মিথ্যা কলঙ্ক নিয়ে সে বেশ্যাবৃত্তি করতে বাধ্য হয়েছে৷ সমাজের চির উপেক্ষিত স্থানে পতিত হয়েছে৷ নিরপরাধী মুক্তোর অন্যায় শাস্তি লাভের ফল কেউ ভোগ করেনি৷ সমস্তটাই মুক্তোকেই বহন করতে হয়েছে৷ যতীন হাজরা তার প্রথমা স্ত্রীর সম্পর্কে অত কথা বললেও শেষ পর্যন্ত তার ঠিকানা দিয়ে যেতে পারেনি শঙ্করকে৷ মৃত্যু সেই অবসর তাকে দেয়নি৷ কিন্তু মুক্তো খুন হয়ে যাওয়ার পর স্বজন হারানো দশরথ বাবুর ঘরে তার তোরঙ্গটি চালান হলে সেই তোরঙ্গ থেকে শঙ্কর আবিষ্কার করে তার দেওয়া নীল রঙের চাদরখানি৷ সেখানেই সে দেখতে পায় যতীন হাজরার একটি ছবি৷ ছবির মুখটিকে আঁচড়ে কে যেন ক্ষত বিক্ষত করে দিয়েছে৷ আঁকাবাঁকা অক্ষরে নীচে লেখা ‘‘স্বামী নয়—শয়তান৷’’৩৪২ এই কথাটি থেকেই মুক্তোর স্বামীর প্রতি প্রবল ঘৃণার চিত্রটি ফুটে উঠেছে৷ সে যতদিন বেঁচেছিল তার স্বামী নামক নরপশুটিকে ঘৃণা করে গেছে৷ তাকে হাতের কাছে না পেয়ে তার ছবিটিকে প্রবল আক্রোশে নখের আঁচড় দিয়ে আহত করতে চেয়েছে৷ নিজের স্ত্রীকে বেশ্যাবৃত্তির নির্মম জীবনে ঠেলে দেওয়া যতীন হাজরার মতো মানুষদের প্রতি অন্তরের অন্তস্থল থেকে বিদ্রোহ করে গেছে৷

এই উপন্যাসে আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হল রূপাজীবাদের অসুরক্ষিত জীবন-যাপন৷ মুক্তোর খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে৷ দেহজীবিনী নারীকে বেঁচে থাকার জন্য অপমান-লাঞ্ছনা তো সারাজীবন ভোগ করতেই হয় তার পরও সর্বদাই তাদের পিছনে তাড়া করে প্রবল মৃত্যু ভয়৷ চোর-ডাকাত-গুণ্ডা-বদমাশ নিয়ে তাদের কারবার৷ বেশিরভাগ খদ্দেরই তাদের সেই শ্রেণীর৷ তাদের দেহের সঙ্গে তাদের প্রাণেরও কোনো মূল্য নেই সমাজের কাছে৷ তাই নিজের দেহের শেষ অনুভূতিটুকু নিংড়ে নিংড়ে দান করেও সামান্য কিছু অর্থ বা অলঙ্কারের বিনিময়ে তাদের মূল্যহীন প্রাণটিকেও আহুতি দিতে হয়; মুক্তোর মতো মেয়েগুলোকে খুন হতে হয় নির্মমভাবে৷ লেখকের এ চিত্র উত্থাপন শুধু মর্মস্পর্শী নয় বাস্তবসম্মত৷ বাস্তব সমাজেও যেমন বহু বারবনিতার খুনের ঘটনা অহরহ ঘটে যায় তদনুরূপ ঘটনাই উপস্থাপিত হয়েছে মুক্তো খুনের মধ্য দিয়ে৷ সমাজের পাপ নিজ দেহে ধারণ করে, প্রান্তবাসিনী এই নারীরা এভাবেই শেষ হয়ে যায়৷ তার কোনো বিচার হয় না৷

মাসি :

মাসি চরিত্রটির আবির্ভাবও মুক্তোর সঙ্গে সঙ্গেই৷ উপন্যাসের নায়ক শঙ্কর তার বিলেতগামী বন্ধু উৎপলকে হাওড়া স্টেশনে ‘সি অফ’ করে স্টেশন থেকে বাইরে বেরোনোর সঙ্গে লক্ষ করে বাইরে কি একটা বস্তুকে ঘিরে কতগুলি লোকের কোলাহল করা৷ সেখানে এগিয়ে গিয়ে দেখে ‘‘একটি রমণী মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে, এবং সেই মূর্ছিতা রমণীর মাথা কোলে করিয়া লইয়া আর এক নারী বিলাপ করিতেছে৷’’৩৪৩ এই বিলাপকারী নারী হল মাসি৷ মাসি যুবতী নয় বিগতযৌবনা৷ শঙ্কর মূর্ছিত মেয়েটিকে পাঁজাকোলা করে কলের কাছে নিয়ে গিয়ে জলসেচনের মধ্য দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলে বিপদগ্রস্ত এই নারী তার স্বাভাবিক নারীসুলভ ভঙ্গিমায় তাকে আশীর্বাদ করে বলে—‘‘বেঁচে থাক তুমি বাবা৷ মেয়েটির ফিটের ব্যায়রাম আছে৷ তুমি না থাকলে কি যে বিপদ হত আজ আমার!’’৩৪৪ অবশেষে তাদের বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে নিজেদের ঠিকানাটাও বলে দেয় মাসি৷ বহুদিনপর শঙ্কর মাসির দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী উপস্থিত হয়ে বুঝতে পারে তা একটি বেশ্যাপল্লী৷ পরে মুক্তোর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বাড়লে মাসি চরিত্রটির সম্পর্কে আরও বিশদ জানা যায়৷ মাসি সেই বেশ্যালয়ের কর্ত্রী৷ মুক্তোর মতো রূপাজীবাদের ভাড়া খাটিয়ে সে তাদের রোজগার করা অর্থের অংশভাগিনী হয়৷ মাসি চরিত্রের মতো নারীরা শুধু গণিকাপল্লীর অধীশ্বরীই নয় তারাও পূর্বে গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল৷ পরবর্তী সময়ে যৌবন অস্তমিত হলে উপার্জিত অর্থের জোরে তারা নিজেরাই কোনো নিষিদ্ধপল্লীর মালকিন হয়ে ওঠে৷ তাদের নিয়ন্ত্রণের থেকে বহু নারী তাদের দেহব্যাবসা চালিয়ে যায়৷ গণিকাপল্লীর এই মাসিরা তাদের নিয়ন্ত্রিতা পণ্যাঙ্গনাদের আয়-ব্যয়ের সম্পূর্ণ হিসেব রাখে৷ কোনোভাবেই তাদের বিপথে চালিত হতে দেয় না তাদের বৃত্তির আবর্তভূমি থেকে৷ মুক্তো ও শঙ্করের মধ্যে বেশ্যা-খদ্দের-এর সম্পর্কের বাইরে এক মধুর সম্পর্ক তৈরি হলে, মুক্তোর রোজগার ব্যহত হয়, সঙ্গে সঙ্গে দেহব্যবসায়িনীর খোলস ছিঁড়ে তার ভেতরকার প্রেমময়ী নারীসত্তাটিও বেড়িয়ে আসতে থাকে; মাসির বিচক্ষণ দৃষ্টিতে তা সহজেই ধরা পড়ে যায়৷ সে মুক্তোকে শঙ্করের কবল থেকে মুক্ত করার জন্য তাকে সাবধান করতেও ভোলে না৷ মুক্তোর কথার মধ্য দিয়ে এমনই ভাবনার প্রতিধ্বনি—‘‘মাসিটিকে তো চেনে না! সেদিন তো মাসি তাহাকে বলিয়াই দিয়াছে, ওসব কাব্যি-মার্কা ছোঁড়াকে যেন আমল না দেয় সে৷ অথচ মাসি নিজের মুখেই তাহাকে আসিবার জন্য নিমন্ত্রণ করিয়াছিল, এখন বলিতেছে বিদায় করিয়া দিতে! কোনো দিন হয়তো মুখের ওপর কি বলিয়া বসিবে?’’৩৪৫ মাসি চরিত্রের মধ্যে সেটাই বাস্তব৷ মুক্তোর মতো নারীদের উপার্জিত অর্থাংশ হতে তার জীবন নির্বাহ হয়৷ তাই তাদের অর্থ রোজগারে ভাটা পড়লে মাসির মতো নারীরা মেনে নিতে পারে না৷

পানওয়ালী :

পানওয়ালী ঝামাপুকুরের সংকীর্ণ গলির মুখে পান বিক্রয় করে৷ সে বিগতযৌবনা কুৎসিতদর্শন৷ উপন্যাসের আরেক অন্যতম চরিত্র করালীচরণ বকসীর ভাবনায় তার রূপ বর্ণিত হয়েছে এইভাবে—‘‘সেই কাজল-পরা, মাথায়-ফুল-গোঁজা, দাঁতে-মিশি-লাগানো নীলাম্বরী-কাপড়-পরা বুড়িটা—ছুঁড়ি সাজিয়া লোক ভুলাইতে চায়!’’৩৪৬ লেখকের কথায় এই কুৎসিতদর্শনা পানওয়ালীই একমাত্র নারী যে করালীচরণকে ভালোবাসে৷ কিন্তু তার প্রেম নিতান্তই একপাক্ষিক৷ যতটা করালীর প্রতি তার ভালোবাসা ততটাই তার প্রতি ঘৃণা করালীর৷ যে ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মস্তকে দীর্ঘ অবিন্যস্ত কেশ, শীর্ণ লম্বা দেহ, এক চোখ কানা, দপদপ করে জ্বলা প্রদীপ্ত আরেক চোখ, সম্মুখের দিকে বক্রভাবে এগিয়ে আসা সূচালো চিবুক, শ্মশ্রু, গুল্ফ এমন কি ভ্রূ হীন, বসন্তের দাগবিশিষ্টমুখমণ্ডল এবং অত্যাধিক সুরাপানে হেজে যাওয়া ঠোটের করালীকে সকলের সঙ্গে বেশ্যারাও ভয় পায়; বেশি অর্থ দিলেও আপ্যায়ন করতে পারে না, সেই বিকটদর্শন করালীর প্রতি সীমাহীন ভালোবাসায় আত্মনিবেদিত প্রাণ সেই পানওয়ালীর৷ তাই তার শত ঘৃণা, অবমাননার মাঝেও মনের নিভৃত কন্দর থেকে কখনো কখনো উঁকি দেয় পানওয়ালীর মুখ৷ যার কথা ভাবলেও তার গায়ে জ্বর আসে তার পরেও করালীচরণ না ভেবে থাকতে পারে না যে—‘‘ওই বোধ হয় একমাত্র নারী যে করালীচরণকে একটু মমতার চক্ষে দেখে৷ বাকী সবাই তো তাহাকে ত্যাগ করিয়াছে, কেহই তো তাহাকে আমল দিতে চায় না, টাকা দিতে চাহিলেও প্রত্যাখ্যান করে—এমনকি বেশ্যারাও৷’’৩৪৭ তবুও পানওয়ালীকে দেখলেই তার আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে৷ নাম-পরিচয়হীনা বিগতযৌবনা পানওয়ালী তার কুৎসিত রূপের মধ্যেও হৃদয়ে নির্মল স্তরে তার প্রতি সর্বদা প্রজ্জ্বলিত রাখে তার প্রেমের দীপশিখাটিকে৷ পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সি—এই নারীর প্রতি কোনো সহানুভূতি নেই করালীর৷ বরং তীব্র ঘৃণায় তাকে উদ্দেশ্য করে সে বলে—‘‘বেশ্যারা আবার মানুষ!’’৩৪৮ অবিবাহিত নারীসঙ্গ বঞ্চিত করালী বিগতযৌবনা এই গণিকার প্রেমকে উপেক্ষা করে খদ্দের ধরার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা দেহব্যবসায়িনীদের সঙ্গ কামনা করলে তারাও তাকে সভয়ে অস্বীকার করে৷ লেখকের কথায় এমনই কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায়—‘‘রাস্তার ধারে দাঁড়াইয়া যাহারা দেহ বিক্রয় করে, তাহারাও তাঁহাকে চাহে না৷ অর্থই যাহাদের পরমার্থ, করালীচরণের অর্থও তাহাদের নিকট নিরর্থক৷’’৩৪৯

পানওয়ালীর ভালোবাসায় কোনো ত্রুটি নেই৷ সে বিপদনাশিনী হয়ে নানা ছোটখাট বিপদের হাত থেকে তার প্রেমাস্পদকে রক্ষা করে; দূর থেকে সর্বদা ছন্নছাড়া, স্বজন-বান্ধবহারা করালীচরণের প্রতি নজর রাখে৷ এমনকি তার সমস্ত বিরক্তি ও বিতৃষ্ণাকে উপেক্ষা করেও করালীর কোনো কাজে লাগবার জন্য সে উন্মুখ হয়ে বসে থাকে৷ প্রচণ্ড ক্ষুধায় তার মনের মানুষটি যখন রাস্তার ধারের হোটেলের অখাদ্য খাবারগুলি গলাধকরণ করতে না পেরে ক্ষুধা সত্ত্বেও খাবার ফেলে উঠে আসে তখন পরম মমতায় নিম্নশ্রণীর এই বারাঙ্গনা হাঁসের ডিমের ডালনা ও কয়েকটা পরোটা তার অলক্ষ্যে ঘরের টেবিলের উপর ঢাকা দিয়ে রেখে যায়৷ করালী তার সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের খাবার কেউ ঘৃণা করে৷ তাই প্রচণ্ড আক্রোশে তা ছুড়ে ফেলে দিয়ে মদ পান করতে করতে তার স্বগোতক্তি ‘‘হারামজাদি!… মাগীর তাড়কা রাক্ষসীর মত চেহারা, সোহাগ জানাইতে আসিয়াছে! একটুও যদি রূপ থাকিত, দেমাকে মাটিতে পা পড়িত না, আমাকে দেখিয়া তখন হয়তো মুখ ঘুরাইয়া চলিয়া যাইত৷ এখন বোধ হয় কেউ পৌঁছে না, তাই আমার কাছে ভিড়িয়াছে৷ এবার আসিলে চাবকাইয়া পিঠের চামড়া তুলিয়া ফেলিব৷’’৩৫০

করালী কোষ্ঠী বিচার করে জ্যোতিষ গণনা করতে সক্ষম৷ কোষ্ঠী ছাড়া শুধুমাত্র হাতের রেখা দেখে জ্যোতিষ গণনার পারদর্শিতা অর্জনের জন্য সে দ্রাবিড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে পানওয়ালী বুঝতে পারে সে কোথাও যাবে৷ সে তার আকাঙ্খিতের কাছে গন্তব্যস্থান জানতে চাইলে করালীচরণের দ্বারা চরম অপমানিত হয়৷ অবশেষে সে সাহসে ভর করে তার প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণার কারণ শুনতে চাইলে করালী প্রবল ঘৃণায় তাকে জবাব দেয়—‘‘হারামজাদী ছোটলোক বেশ্যা, তোর মুখদর্শন করলে যে পাপ হয়, তা তুই জানিস না?’’৩৫১ এত বড় নিষ্ঠুর অপভাষণে সে নিষ্প্রভ হয়ে গেলেও নিমেষে নিজেকে সংযত করে প্রায় তোষামোদের ভঙ্গিতে তার প্রতি ছুড়ে দেয় নির্মম প্রশ্নবাণ—‘‘ওমা, এইজন্যেই এত রাগ! আমি ভেবেছিলাম, বুঝি বা আর কিছু! মুখ দেখলে পাপ হয়, আর আমার কাছ থেকে সিগারেট পান নিলে বুঝি কিছু হয় না? ধন্যি শাস্তর তোমাদের!’’৩৫২

সত্যিই তো! রাতের অন্ধকারে লোকচক্ষুর আড়ালে যে সকল বিধাতাপুরুষেরা গণিকাদের দেহকে নিংড়ে নিংড়ে উপভোগ করে সামান্য ক’টি পয়সার বিনিময়ে তারাই আবার প্রকাশ্য দিবালোকে সেই উপভোক্তা রমণীকে পতিতা বলে ঘৃণা করে, অবজ্ঞায়-লাঞ্ছণায় ছুড়ে দেয় সমাজের প্রান্তসীমায়৷

করালীচরণ তার পোষ্য দাঁড়কাক এবং আহত বন্ধু মোস্তাকের দায়িত্বসহ সমস্ত বাড়িটার দেখাশোনার ভার ভন্টুকে দিয়ে গেলে ভন্টুর অনুপস্থিতিতে নির্দ্বিধায় সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয় পানওয়ালী৷ ভন্টুকে শুধু অনুরোধ করে করালী যেন তার এ কথা জানতে না পারে৷ কারণ সে যে করালীর দুচক্ষের বিষ এটা তার নিজেরও অজ্ঞাত নয়৷ সে পরম নিষ্ঠার সঙ্গে করালীচরণের ঘর ও বন্ধুদের পরিচর্যা করতে থাকে৷ মোস্তাকের দুর্গন্ধময় পায়ের ক্ষতের জন্য ঔষধ ও ব্যাণ্ডেজ এনে দেয়৷ ভন্টু তাকে হাসপাতালে পাঠাতে চাইলে আঁতকে উঠে সে বলে—‘‘না তা আমি পারব না, হাসপাতালে শুনেছি বড় কষ্ট দেয় গরিবদের৷’’৩৫৩ কাকটিকে খাইয়ে-দাইয়ে পরিষ্কার করে স্নান করিয়ে তার অজস্র ঠোকর-আঁচর সহ্য করে দিব্যি হাসতে হাসতে বলে—‘‘কি দস্যি কাক! পরশু হলুদজল করে নাওয়াতে গেছি, এমন ঠুকরে দিয়েছে হাতে যে, জ্বলে মরি!’’৩৫৪ সে তার মানসপুরুষের অনুপস্থিতিতে তার সব কিছুর নিখুঁত তত্ত্বাবধান করে৷ তার বই-এর উই ঝেড়ে রোদে শুকোতে দেওয়া, পাগল মোস্তাকের সেবা করা, দাঁড়কাকের পরিচর্যা করা সবকিছুই বেশ্যার দৈহিক কলুষতা থেকে মুক্তি দিয়ে তার নারীত্বকে উদ্ভাসিত করেছে৷ তার অন্তরে বাইরে যে একটা সুন্দর ঘরকন্নার স্বপ্ন সদা বিরাজমান সেই দিকেও দিগনির্দেশ করেছেন লেখক৷ করালীর প্রতি ভালোবাসায় তার ঘরবাড়ি, দুর্গন্ধময় ক্ষতযুক্ত পাগল মোস্তাক, পোষ্য দাঁড়কাক সব কিছু আপন হয়ে উঠেছে৷ পানওয়ালীর সচেতন নারীআত্মা প্রেমাস্পদের সন্তুষ্টির জন্য ভন্টুকে একথা জানাতেও ভোলে না যে তার আসার খবর পেলে তা যেন তাকে আগে থাকতেই জানানো হয়৷ করালী এসে তাকে ফের দেখলে একেবারে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে৷

পানওয়ালীর এই নিখাদ প্রেমকে লেখক ব্যর্থ হতে দেননি৷ যে পরম যত্ন ও মমতায় সে এতকাল চরম উপেক্ষা সহ্য করেও করালীর সেবা করে গেছে অবশেষে তার নিজেরই শেষ মুহূর্তে সে লাভ করতে সক্ষম হয়েছে প্রেমিকের অনুগ্রহ৷ করালী নিজে এসেছে তাকে সেবার হাত বাড়িয়ে দিতে৷ ইতিমধ্যে করালীর ভাবনারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ যে বারাঙ্গনাদের সে এতকাল শুধুমাত্র বেশ্যা বলে ঘৃণা করে এসেছে সে দ্রাবিড়ে গিয়ে জানতে পেরেছে সেও তেমনি এক বেশ্যামাতার সন্তান৷ মুহূর্তেই চোখের সম্মুখ থেকে পণ্যাঙ্গনাদের প্রতি ঘৃণার পর্দা উড়ে গেছে৷ আর গৃহে ফিরে এসে যখন মুমূর্ষু পানওয়ালীকে আবিষ্কার করেছে তখন তার সমস্ত যন্ত্রণা ক্ষোভ উপচে পড়েছে৷ জীবনের শেষবেলায় পানওয়ালী প্রেমিকের হাতের জল পেয়েছে৷ অবশেষে মৃত্যুর পর তার কাঁধে চড়েই অন্তিমযাত্রা করেছে৷ শুধু এটুকুই নয় এই উপেক্ষিতা কুল-মান আত্মীয়-স্বজনহীন বারনারীর শ্রাদ্ধক্রিয়াও করালী ধুমধাম করে সম্পন্ন করেছে৷ ভন্টুকে বলা করালীর সমস্ত কথার মধ্য দিয়ে এক সমাজ পরিত্যক্ত বারবধূর জন্য কারুণ্য ফুটে উঠেছে; তার হৃদয় উন্মোচিত হয়েছে—‘‘পারেন? কল্পনা করতে পারেন, একটা কঙ্কালসার কদাকার বুড়ি বেশ্যা অনাহারে বিনা চিকিৎসায় মরছে, তার মৃত্যুর সময়ে মুখে এক ফোঁটা জল দেওয়ার লোককেউ কাছে নেই৷ কদাকার মুখ ভাল করে দেখেছেন কখনও? গালের হাড় উঁচু, কপালের শির বার করা, বড় বড় দাঁত, তাতে আবার মিশি লাগানো—… দেখেছেন কখনও কদাকার মুখ? শুধু কদাকার নয়, তৃষিত, মুমূর্ষু, যে তার কুৎসিত হাসি ও কদর্য কটাক্ষ দিয়ে আজীবন লোকও ভোলাবার চেষ্টা করেছিল কিন্তু একজনকেও ভোলাতে পারেনি, একটা লোকও তার আপন হয়নি, তার মৃত্যুকালে কেউ কাছে আসেনি—দেখেছেন এরকম কখনও?… পৃথিবীতে কেউ ভাল চোক্ষে দেখত না মাগীকে৷’’৩৫৫ করালীর এই কথার মধ্য দিয়ে একজন বিগত যৌবনা রূপহীন বারনারীর জীবন-যন্ত্রণার সুনিপুণ জীবনছবি বুঝে নিতে কারও অসুবিধা হয় না৷

পানওয়ালীর দোকানে ছোকরা গোছের একটি ছেলেকে পান বেচতে দেখে, তার কাছেই ভন্টু পানওয়ালী সম্পর্কে আরও বিশদ জানতে পারে৷ সে শোনে দোকানটি পানওয়ালীর নিজের ছিল না৷ অপরের দোকানে সে চাকরি করত৷ অসুখের অজুহাতে মালিক তাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিলে সে করালীচরণের বাড়িতেই আশ্রয় নেয়৷ করালী যেদিন দ্রাবিড় থেকে ফিরে আসে সে দিনই তার হাতের জল পেয়ে পানওয়ালী সকল লৌকিক মায়া পরিত্যাগ করে৷ তার সারাজীবনের সকল যন্ত্রণা, রূপহীনতার যন্ত্রণা, প্রেমিকের প্রত্যাখ্যানের যন্ত্রণা, দেহজীবিকার যন্ত্রণা, দারিদ্র্যের যন্ত্রণা নিমেষেই চরম সার্থকতা লাভ করে৷

এই উপন্যাসে শুধু মুক্তো, মাসি, টিয়া, কালোজাম, আঙ্গুর পানওয়ালীর মত দেহব্যবসায়ী পতিতা নারীরাই নয় রয়েছে পতিতা নারী তৈরি করার নানারকম সক্রিয় চক্রের প্রসঙ্গ৷ এই চক্রটি নারীহরণ এবং নারী পাচারের সঙ্গে যুক্ত৷ অচিনবাবু, খগেশ্বর বাবু এই অপহরণ চক্রের হাতিয়ার; মূল পাণ্ডা বৃদ্ধ ম্যানেজারবাবু৷ অশীতিপর বৃদ্ধ ম্যানেজারবাবু নিজের বিকৃত কাম-লালসাকে চরিতার্থ করার জন্য মুখোশের আড়ালে আত্মগোপন করে থাকে৷ অনির্দেশ্য এক মালিকের নাম করে অচিনবাবু খগেশ্বর বাবুকে দিয়ে নারী অপহরণ করায় মোটা টাকার বিনিময়ে৷ তারা মেয়েদের কাজ দেওয়ার নাম করে বুদ্ধি ও বলের সাহায্যে (যেখানে যেটা দরকার) অপহরণ করে৷ যেমন শিক্ষয়িত্রীর বিজ্ঞাপন৷ এই বিজ্ঞাপন দেখেই মৃন্ময়ের স্ত্রী স্বর্ণলতা দুষ্কৃতিদের খপ্পরে পড়ে৷ বহুকাল পড়ে অচিনবাবু ধরা পড়লে খবরের কাগজে অপহৃত নারীর নামের তালিকা দেখে স্বর্ণলতা নামটি খুঁজে পাওয়া যায়৷ সেই অপহৃতা নারীদের সবার অলক্ষ্যে সর্বপ্রথম বলপূর্বক ধর্ষণ করে ম্যানেজারবাবু৷ অবশেষে ধর্ষিতা সেই নারীকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় কোনো বেশ্যাপল্লীতে৷ সামাজিক পশুদের লালসার শিকার হওয়া সেই নারীরা যদি আত্মহত্যা নাও করে তথাপি পরবর্তী সময়ে দেহজীবিকাই তাদের প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়ায়৷ যেমন সৌদামিনি৷ সৌদামিনি খগেশ্বরের স্ত্রী৷ টাকার লোভে সে তার স্ত্রী ও কন্যাকে অনায়াসে ম্যানেজারের হাতে তুলে দেয়৷ তার স্পষ্ট স্বীকারোক্তি—‘‘আপনার কাছে এনে দিলাম, আপনি বললেন, কর্তার দুজনকেই পছন্দ হয়েছে৷ নিজের চোখে দেখলাম৷ এখন বেশ সোনাদানা পরে দিব্যি জাঁকিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে মশাই,’’৩৫৬ অচিনবাবুর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে খগেশ্বর অচিনবাবুর মেয়েকেই ম্যানেজারের হাতে তুলে দিলে অচিনবাবু ক্রোধে অন্ধ হয়ে ম্যানেজারকে খুন করে এবং তার জেল হয়৷ পাপীর হাতেই পাপের শাস্তি হয়৷

ফুলশরিয়া :

‘জঙ্গম’ উপন্যাসে আরেকজন পতিতা নারী হল ফুলশরিয়া৷ তার শরীরের বিষাক্ত ঘা এর সংক্রমণে হরিয়া অসুস্থ হলে তাকে অক্লান্ত সেবা-শুশ্রুষা করে চলে৷ হাসপাতালে ঠিকঠাক ঔষধ দেয় না বলে হাসপাতালেও পাঠায় না৷ দারিদ্র্যের সঙ্গ লড়াই করে অকৃত্রিম সেবা-ভালোবাসায় শেষ পর্যন্ত তাকে সুস্থ করে তোলে ফুলশরিয়া৷ তার সঙ্গে হরিয়ার সম্পর্ক প্রেমের নয়—দেহের; তথাপি ফুলশরিয়া তার প্রতি কর্তব্যপরায়ণ৷ সে তার কর্তব্যের খাতিরেই শঙ্করকে বলতে পারে—‘‘ও যদি সুস্থ হইত, উহাকে অনায়াসেই ত্যাগ করিতে পারিতাম৷ এখন কিন্তু পারি না৷’’৩৫৭ ফুলশরিয়া বহুভোগ্যা৷ হরিয়া, রামু, জমাদার, গদাইসাহেব এরা তার গণিকা জীবনে পাথেয় সংগ্রহের মাধ্যম৷ সে তার ক্ষুদ্র জীবনে বহু পুরুষকে দেখেছে যারা তার দেহের প্রতি লালায়িত হতে দ্বিধা করেনি কিন্তু শঙ্করবাবুর মধ্যে নিষ্কাম সহায়তার মনোভাব তাকে তার কাছে শ্রদ্ধেয় করে তোলে কিন্তু নিজের আত্মসচেতন মনে নিমেষে তা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে গ্রামে আগুন দেওয়ার ব্যাপারটিতে তার মনে বিরক্তি এসে বাসা বাঁধে৷ তার মনে হয় শঙ্কর বাবুর ঐ ভালোমানুষী লোক দেখানো ঢঙ৷ ফুলশরিয়ার মধ্যে প্রতিবাদিনী ও সেবাপরায়ণতার ভিন্ন দুটি সত্তা সদা বিরাজমান৷ শঙ্কর পলাশপুর থেকে হেঁটে ফেরার সময় রাস্তায় হোলির দলের মুখোমুখি হয়৷ আবিরে-রঙে-ধূলায়-নেশায় বুদ হয়ে তারা ফাগুয়া খেলতে খেলতে যাচ্ছে৷ সেখানেই মুখোমুখি হয় ফুলশরিয়ার৷ শঙ্কর তাকে দেখে বিব্রত হলে নিম্নশ্রেণীর দেহব্যবসায়ী এই পতিতা নারী তাকে প্রশ্ন করে বসে—‘‘তু হাম সেনিসে ঘিন করইছ, নেই বাবু?’’৩৫৮ ফুলশরিয়ার এই হৃদয়বিদ্ধ প্রশ্নে শঙ্কর স্থির থাকতে পারে না৷ সে তাকে এড়িয়ে দ্রুতপদে পা বাড়িয়ে হঠাৎ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখে ফুলশরিয়া তার দিকে নিনির্মেষে তাকিয়ে আছে৷ তার চোখ জ্বলছে, যেন বাঘিনীর চোখ! কিন্তু তার এই ঘৃণা দীর্ঘস্থায়ী হয় না৷ সমস্ত ক্ষোভ মুহূর্তে শান্ত হয়ে যায় শঙ্করের কাছে কলেরার সেবায় সহযোগিতার প্রার্থনা শুনে৷ সে কলেরার মৃতদেহ সৎকারের জন্য লোক সংগ্রহ করতে না পারলেও শঙ্করকে সাহায্য করতে খাটিয়া সংগ্রহ করে আনে কিন্তু শঙ্কর যখন মৃতদেহ ধরাধরি করে নেওয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করে তখন স্বাভাবিক নারীসুলভ ভীতিতে সে তা অস্বীকার করে৷ পরে একার হাতে তার সকল কাজ করা দেখে ফুলশরিয়া মুগ্ধ বিস্ময়ে শ্রদ্ধায় ভক্তিতে তার প্রতি নতমস্তক হয়৷ সে সত্যিকারের দেবতা হয়ে তার সামনে ধরা দেয়৷ তাই তো সামান্য এক পতিতা নারী গভীর রাত্রে তার পদধূলি নেওয়ার জন্য তার বাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকে৷ এ প্রসঙ্গে তার সশ্রদ্ধ উক্তি—‘‘মেথরের মড়া বাবু নিজে কাঁধে করিয়া বহিয়া লইয়া গেলেন! এ কি মানুষে পারে? এ লোককে প্রণাম না করিয়া থাকা যায়?’’৩৫৯ তার এই আত্মপোলব্ধি তার পতিতা চরিত্রের গ্লানিকে ছাপিয়ে তাকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে৷

দুলকি :

এই উপন্যাসে আরেকজন বহুবল্লভা দুলকি৷ সে জাতে মুসহর৷ মাঝে মাঝে মধু বিক্রয় করতে আসে৷ দুলকি পেশায় মধুবিক্রেতা হলেও প্রয়োজন হলে দেহবিক্রয় করতেও তার বাধে না৷ উপন্যাসের এক চরিত্র নিপুর কথায় তারই প্রতিধ্বনি৷—‘‘দেহের শুচিতা ইহাদের কাছে তত বড় নয়, মনের শুচিতা যতটা৷ প্রাণ ধারণ করিবার জন্য যেমন মধু বিক্রয় করিতে হয়, তেমনই দরকার পড়িলে দেহ বিক্রয়ও করিতে হয়৷ নারী-মাংসলোলুপ কুত্তার অভাব নাই পৃথিবীতে৷ তাহাদের লোভের খোরাক যোগাইয়া অর্থ উপার্জন করিতে হয় বই কি মাঝে মাঝে৷’’৩৬০

নিপু তার কামনার আগুনে দুলকিকে দগ্ধ করেছে৷ যতদিন থেকে সে দুলকির সংস্পর্শ লাভ করেছে সে কোনোদিনও তার মধ্যে কোনোরকম উচ্ছলতা লক্ষ করেনি৷ নির্ঝরের চাপল্য, অগ্নির প্রদাহ, মান, অভিমান, সোহাগ, আবদার কোনো কিছুই যেন তার মধ্যে নেই৷ তাই তার অহরহ মনে হয়েছে—‘‘দুলকি শুধুই যেন দেহ, কেবল মাংস খানিকটা, আর কিছু নয়৷ কিন্তু অপরূপ সে দেহের গঠন৷ ক্ষীণকটি কুচভর নমিতাঙ্গী নিবিড়নিতম্বিনী দুলকি যেন জীবন্ত অজন্তা-চিত্র৷’’৩৬১ দুলকির খদ্দের হয়ে সে সবসময় বুঝতে পেরেছে যে তার দৃষ্টিতে শঙ্কা নেই, লজ্জা নেই, আগ্রহ নেই, প্রেম নেই এমনকি দীপ্তিও নেই৷ সে যেন দেহ দান করে আর দেহের বিনিময়ে শুধু তার পাওনাটুকু বুঝে নেয়৷ একদিন নিপু তার কামনা পূরণের অবলম্বন করেছিল ফুলশরিয়াকে৷ পরবর্তী সময়ে ফুলশরিয়াকে অসুস্থ হরিয়ার সেবায় নিমজ্জিত দেখে সে সরে আসে দুলকির দিকে৷ কারণ—‘‘সে বায়োলজিকালি বাঁচিতে চায়, দুলকি ফুলশরিয়া যে কেহ একটা জুটিলেই হইল৷’’৩৬২ পুরুষের দুর্বার কামনায় নারী কীভাবে শুধুমাত্র শরীর হিসেবে উপস্থাপিত হয় নিপুর চিন্তায় তারই প্রতিধ্বনি৷

দুলকির একজন স্বামী আছে৷ স্বামী-স্ত্রীর প্রচলিত সম্পর্ক যা বোঝায় দুলকির সঙ্গে তার স্বামীর তেমন সম্পর্ক কি না জানা কঠিন৷ কিন্তু সেই দুলকির মালিক৷ দুলকি তারই পদানত৷ দুলকির সকল নৈশ-অভিযান সে-ই নিয়ন্ত্রিত করে, উপার্জনের সমস্ত টাকা তার হাতেই চলে যায়৷ এভাবে দুলকির মতো মেয়েদের পুরুষের পর পুরুষের পীড়ন সহ্য করে জীবন অতিবাহিত করতে হয়৷ নিপু সমাজসেবীর আদর্শ সামনে রেখে তার প্রবৃত্তিকে শান্ত করে ফুলশরিয়া, দুলকির মতো নারীদের দিয়ে৷ তার স্বামী নির্দ্বিধায় স্ত্রীকে নৈশঅভিসারে পরপুরুষের অঙ্কশায়িনী করতে পাঠায় নিজের অর্থলিপ্সা পূরণের জন্য৷

এইভাবে সম্পূর্ণ ‘জঙ্গম’ উপন্যাসটিতে দেখা যায় জীবনের এক চলমান রূপ৷ শঙ্করের জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে জীবনের সেই রূপ প্রতিফলিত হয়েছে৷ আর সেই গতিময় পথেই পথিকরূপে এসেছে মুক্তো, মাসি, পানওয়ালী, সৌদামিনি, ফুলশরিয়া দুলকির মতো বারাঙ্গানারা৷ লেখকের অপার সহানুভূতিতে মাসি, সৌদামিনি ও দুলকি ছাড়া প্রায় সব চরিত্ররাই তাদের ত্যাগে ভালোবাসায় মহানতায় উজ্জ্বল৷ মুক্তো বেশ্যা হয়েও প্রেমিকের শুভকামনায় নিজের দুর্দমনীয় বাসনাকে সংযত করে তাকে সঙ্গচ্যুত করেছে, নির্দ্বিধায় শঙ্করের দেওয়া ঘর বাঁধার স্বপ্ন, সুস্থ জীবনে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন উপেক্ষা করে শঙ্করকে সম্মানিত জীবন উপহার দিয়েছে৷ কারণ সে জানে শঙ্কর তাকে ত্যাগ না করলেও তাকে বিবাহ করলে শঙ্কর সমাজচ্যুত হবে৷ পানওয়ালীর কুৎসিতদর্শন রূপের মধ্যেও অবস্থান করছে একটি নির্মল হৃদয়৷ আর সেই হৃদয়বৃত্তির বশবর্তী হয়ে সে ভালোবেসেছে বিকটদর্শন করালীকে৷ করালীর সমস্ত অপমান অবজ্ঞা অপবাক্য উপেক্ষা করে নিখুঁতভাবে তার ভালো-মন্দের খোঁজ রেখেছে৷ মুখ বুজে সমস্ত সহ্য করে দক্ষ গৃহিণীর মতো করালীচরণের অনুপস্থিতিতে তার গৃহের দেখভাল করেছে৷ তার দুই পোষ্য অসুস্থ মোস্তাক ও দাঁড়কাকটিকেও আপন করে নিয়েছে শুধু করালীকে ভালোবাসে জন্য৷ ফুলশরিয়া তার ঘৃণ্য দেহজীবিকার মধ্যেও তার শেষ উপার্জনটুকুও হরিয়ার জন্য ব্যয় করতে সংকোচ করেনি৷

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬) :

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসল নাম প্রবোধকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়৷ মানিক তাঁর ডাকনাম৷ তিনি তাঁর রচনায় ব্যক্তি ও ব্যষ্টিকে যে দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন তা অভিনব ও নিজস্ব৷ ফ্রয়েডীয় ভাবনার অনুসারী হয়ে তিনি ‘ক্ষুধা’ ও ‘রিরংসা’ মানুষের এই দুই আদিমতম প্রবৃত্তির মধ্য থেকে রিবংসাকেই প্রগাঢ়তর রূপে দেখিয়েছেন৷ মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনের নানা অভিব্যক্তি এই যৌনপ্রবৃত্তির গৌণবৃত্তির পথেই সাধিত হয়৷ ব্যক্তিমানুষের এই অনবরুদ্ধ প্রবণতার উপরই তার সুস্থতা-অসুস্থতা, সফলতা-বিফলতা নির্ভর করে৷ এই দিক দিয়েই জীবনের তাৎপর্যের ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করেছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ দারিদ্র্যের ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য-অ-দারিদ্র্যের অবচেতন যৌনবিকার তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির নিয়তি৷ মানুষের যৌনকামনাপূরণের আধাররূপে তাঁর উপন্যাসে উপস্থাপিত হয়েছে গণিকা চরিত্র৷

ক. শহরবাসের ইতিকথা :

বাংলা উপন্যাসের জগতে একজন বলিষ্ঠ লেখক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়৷ ফ্রয়েডীয় ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে মানুষের যৌনতার নগ্ন রূপকে তিনি টেনে বের করেছেন তার শৈল্পিক ক্ষমতায়৷ সেই প্রসঙ্গেই গণিকা চরিত্রের উপস্থাপন৷

‘শহরবাসের ইতিকথা’-য় (১৯৪০) দুজন দেহব্যবসায়ী নারীর পরিচয় উঠে এসেছে৷ একজন চাঁপা অপরজন দুর্গা৷

চাঁপা :

চাঁপা চরিত্রটি উঠে এসেছে মোহনের বাড়ির সতেরো টাকা মাইনের চাকর জ্যোতি এবং গ্রাম থেকে রোজগারের আশায় শহরে চলে আসা কামার শ্রীপতির অনুসঙ্গে৷ মোহনের ভাড়াবাড়ির পিছন দিকে এক অস্বাস্থ্যকর বস্তিতে চাঁপার ঘর৷ সেই বস্তিতে গেলেই—‘‘চেনা-অচেনা অতিথি অভ্যর্থনা করার জন্য দুয়ারে দুয়ারে সাজগোজ করিয়া খোঁপায় মালা জড়ানো মেয়েদের দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখা যায়৷’’৩৬৩ লেখকের বর্ণনাতেই স্পষ্ট স্থানটা পতিতাপল্লী৷ আর সেই মেয়েরা পণ্যাঙ্গনা—পুরুষ ধরার জন্য ওভাবে সাজগোজ করে ওদের সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা৷

চাঁপার ঘর সুসজ্জিত৷ সে উচ্চদরের সম্ভ্রান্ত গণিকা নয়৷ তার সামর্থ্য অনুযায়ী লন্ঠনের আলোকে সম্বল করে সে তার ঘরকে সাজিয়ে রেখেছে তার পারিপাট্যের দ্বারা৷ যে প্রবৃত্তির তাড়নায় কামদগ্ধ পুরুষ তার মতো নারীর দ্বারে উপস্থিত হয় তাদের যথাযথ আপ্যায়নের ব্যবস্থা না রাখলে তার চলবে কি করে৷ চাঁপা চপল চরিত্রের৷ গ্রামে স্ত্রীর সঙ্গে দুদিন কাটিয়ে এসে শ্রীপতি যখন যৌনকামনায় অস্থির তখন তাকে কাম নিবৃত্তির জন্য উপস্থিত হতে হয় চাঁপার ঘরে৷ চাঁপার ঘরের সন্ধান সে পেয়েছিল জ্যোতির কাছ থেকে৷ তারপর জ্যোতিকে ছেড়ে একা একদিন তার কাছে উপস্থিত হলে চাঁপা তাকে অপমান করে তার ঘর থেকে বের করে দেয়৷ শ্রীপতি বুঝতে পারে না ‘‘দেহ বেচা যার ব্যবসা তার এটা কোনদেশি নীতিজ্ঞান? কী মানে চাঁপার এই অদ্ভুত ব্যবহারের?’’৩৬৪ কিন্তু পরে যখন পুনরায় জ্যোতির সঙ্গে তার ঘরে আসে চাঁপা তাকে সাগ্রহে আপ্যায়ন করে—সেদিনের সেই অপমানের কথা বলে ঠাট্টা তামাশা করতেও ভোলে না৷

চাঁপা উচ্ছল প্রকৃতির৷ তার লাস্যভঙ্গিতে সে পুরুষকে বশ করতে সক্ষম৷ সঙ্গিনীকে চূড়ান্ত আনন্দ দিতে তার সঙ্গে বসে মদ খায়, ঠাট্টা তামাশা করে৷ তার সমস্ত আচার-আচরণ থেকে তার পেশাদারিত্বকে বোঝা যায়৷ কারণ ‘‘চাঁপা অনেকদিন এ লাইনে আছে,’’৩৬৫

দুর্গা :

গণিকা হওয়ার আগে দুর্গা ছিল একজন নিষ্ঠাবতী গৃহবধূ৷ স্বামীর নিষিদ্ধ কাজ তাকে অস্বস্তি দিত৷ তিনমাস পূর্বেও সে স্বামীর সঙ্গে ঘরকন্নায় রত ছিল৷ বছর দুই আগে সে কলকাতায় আসে স্বামীর সঙ্গে৷ দেশে থাকাকালীন স্বামী তাকে খুব ভালোবাসত—আদরযত্ন করতো কিন্তু শহরে আসার পর দিন দিন পাল্টাতে থাকে৷ মদ খেয়ে, জুয়া খেলে অশ্রাব্য গালিগালাজ সহযোগে স্ত্রীকে মারধোরও করতে থাকে৷ ঠিক মতো ঘরভাড়া দেয়না—শেষে তাদের খাওয়াও জোটে না৷ না খেয়ে স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়েও মুখ বুজে সংসার করতে থাকে৷ কিন্তু শেষে দুর্গার সমস্ত গয়না গাটি নিয়ে তাকে অকূলে ভাসিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় স্বামী৷ সহায়-সম্বলহীন দুর্গা অনুগ্রহ পায় স্বামীর বন্ধু অঘোরের৷ প্রায় দুইমাস দুর্গার সঙ্গে থেকে তাকে সাহায্য করার নামে তার শরীরকে ভোগ করে শখ মিটিয়ে বেপাত্তা হয়ে যায় অঘোর৷ বাধ্য হয়ে বাঁচার জন্য সে আশ্রয় নেয় দেহব্যবসার৷

দুর্গা মোটাসোটা, শান্ত ভালোমানুষের মতো চেহারা৷ চাঁপার মতো চপল নয়৷ বেশভূষা গৃহস্থ বৌদের মতো, মাথায় সিঁদুর পর্যন্ত রয়েছে৷ তার চেহারায়-সাজে-কথায়-কাজে একটা তেজ আর আত্মমর্যাদা ধরা পরে৷ সে চাঁপার প্রতিবেশিনী৷ জ্যোতিই তার পরিচয় করিয়ে দেয় শ্রীপতির সঙ্গে৷ দুর্গা তার সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই তার সব কিছু খুটিয়ে খুটিয়ে জেনে নেয়—রোজগার পর্যন্তও৷ সে তার মোটা চেহারার জন্য দুঃখ করে শ্রীপতিকে জানায় যে—ছেলেপিলে না হওয়াতে সে মুটিয়ে গিয়েছে—যার জন্য স্বামী তাকে ছেড়ে পালিয়েছে৷ স্বামীর বন্ধুও তার তন্বীর বদলে ভারী চেহারার জন্য সরে পড়েছে৷

দুর্গার শান্ত ঘরোয়া ব্যবহারে শ্রীপতি তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল৷ এখন তাকে কেমন যেন ভোঁতা মনে হয় তার৷ ‘‘দুর্গার সরল সহজ কথা আন্তরিক সহানুভূতি আর তেমন মিঠা লাগে না৷’’৩৬৬ কারখানার টাকা পেয়ে শ্রীপতির স্ফূর্তি এসে যায়৷ সে ভাবে দুর্গার ঘরে চাঁপাকে নিমন্ত্রণ করে এনে হইচই করবে সারারাত৷ কিন্তু দুর্গার ঘরে যথার্থ স্ফূর্তি যে খুঁজে পাবে না তাও জানে কারণ—‘‘দুর্গা চাঁপার মতো নয়, গেলাসে চুমুক দেওয়ার বদলে সে শুধু ঠোঁটে ঠেকায়৷ অনর্গল হাসি, তামাসা ছলনা চাতুরীর উল্লাসে বিশ্বসংসার ভুলাইয়া দেওয়ার বদলে জড়োসড়ো হইয়া বসিয়া থাকে, উত্তেজনা ঠান্ডা করিয়া দেয়৷৷’’৩৬৭

গৃহবধূর সুনীতি-শালীনতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে গণিকা বৃত্তিতে প্রবেশ করার বেশিদিন হয়নি তার৷ তাই গণিকাসুলভ চটকও আয়ত্ত করতে পারেনি৷ দেহপসারিণী হয়েও চাল-চলন,আচার-ব্যবহার সবই গৃহবধূ স্বরূপ৷ বেশ্যার হাবভাব আয়ত্ত করতে না পারলেও অর্থের প্রয়োজন সে বোঝে৷ অর্থের জন্যই তার শরীর বিক্রয়৷ জ্যোতি যখন শ্রীপতিকে জানায় দুর্গা তাকে যেতে বলেছে তখন দুর্গার সেই টাকা চেনার প্রসঙ্গ উত্থাপন করে করে বলে—‘‘তা বলিবে বইকী, দুর্গা কি আর খবর রাখে না কবে সে মজুরি পাইয়াছে, আট দশ দিন খোঁজও নেয় নাই, এখন একেবারে তার জন্য ব্যাকুল হইয়া পড়িয়াছে৷ মন ভুলাইতে না জানুক দুর্গা পয়সা চেনে৷’’৩৬৮ শ্রীপতি তার বাড়িতে উপস্থিত হলে তার গায়ে পিঠে হাতবুলিয়ে হাতুড়ি পেটা স্প্রিং-এর মতো মাংসপেশীগুলিকে টিপে টিপে আমোদ পায় দুর্গা৷ সেই অবস্থাতেই তার কুশল জিজ্ঞেস করে, না আসার কারণ জানতে চায়৷ তাদের দুজনের আলাপ প্রসঙ্গে উঠে আসে গণিকার দায়বদ্ধ পয়সা আদায়ের বিবরণ৷—

‘‘আসো না কেন বলো দিকি? কী হয়েছে তোমার?…

পয়সাকড়ি নেই, আসব!

তোমার সঙ্গে আমার বুঝি শুধু পয়সার সম্পর্ক? তেমন মানুষ নই গো, নই!

নিতে তো ছাড় না৷

দিয়েছ, নিয়েছি৷ কেড়ে নিয়েছি তোমার ঠেঁয়ে?

কেড়ে নেবে কেন, তক্কে তক্কে থাকো কবে মজুরি পাই ওমনি ডাক পড়ে৷ কেড়ে নেওয়ার চেয়ে ভালো নিতে জানো তুমি৷

… না নিলে খাব কি? খেয়ে পরে বাঁচতে হবে না আমার?’’৩৬৯

পণ্যনারী দুর্গা শ্রীপতির কাছে পয়সা নেয়৷ না নিলে তাদের উপায় নেই৷ সে অকপটে সে কথা স্বীকারও করে যে না নিলে সে খেয়ে পড়ে বাঁচবে কি করে৷ পয়সার বিনিময়ে সে শ্রীপতিকে সঙ্গ দান করে৷ শ্রীপতি তাকে ভোগ করলেও পয়সার মায়া ছাড়তে পারে না৷ তাই মনে মনে তৈরি হয়েই থাকে যে সে দুর্গার সঙ্গে চিরতরে সম্পর্ক ছেদ করে দেবে৷ সে জানে যে স্বল্প পয়সায় সে দুর্গাকে ভোগ করে এসেছে তাতে দুর্গার লোকসানই হয়েছে—সুসম্পর্কের জন্যই দুর্গা তাকে প্রশ্রয় দিয়েছে তারপরেও তার আক্ষেপের শেষ নেই৷ কিন্তু দুর্গা যখন বলে—‘‘রাগ কোরো না বাবু৷ ঝগড়াঝাঁটি আমার সয় না৷ সাধ না গেলে একটি পয়সা তুমি আমায় দিয়ো না৷ আজ পর্যন্ত চাইনি, কখনও চাইব না৷’’৩৭০ তখন সে আরাম বোধ করে৷ জানতে চায় পয়সা না নিলে তার চলবে কিসে৷ দুর্গা অকপটে বলে যায় শ্রীপতির প্রতি তার সরল বিশ্বাসের কথা৷ সে জানে শ্রীপতি তার কষ্ট দেখে থাকতে পারবে না৷ সে একদিন যেচেই তাকে শাড়ি, গয়না দেবে, না নিতে চাইলে জোর করে দেবে৷ সেই দিনের প্রত্যাশায় সে বসে আছে৷ কারণ শ্রীপতির সঙ্গে মিশে সে বুঝতে পেরেছে সে নিষ্ঠুর নয়, অন্যান্য পুরুষদের মতো পাষণ্ড নয়৷ দুর্গার সেই কথা শ্রীপতিকে মনে করায় গল্পের রহস্যময় নারীদেরকে যারা পুরুষ পেলে নিজেদের বশীভূত করে রাখে, ঘরে ফিরতে দেয় না৷ দুর্গাও তেমনি করে ধীরে ধীরে তাকে বশ করতে চায়—তার পর নিজের খাওয়া পরার সব দায়িত্ব অর্পণ করতে চায় তার স্কন্ধে৷ সাবধানি শ্রীপতি সেদিনই সংকল্প করে সে আর দুর্গার কাছে আসবে না—তার স্তিমিত হয়ে আসা কামনার দাহ সে সংকল্প রক্ষায় তাতে সাহায্য করলেও দুর্গাকে সে ভুলতে পারে না৷ দুর্গাই একমাত্র নারী যে সিংপুরের হাতুড়িপেটা গেয়ো কামারকে, কারখানার সামান্য কর্মী শ্রীপতিকে সম্ভ্রম করেছে—সম্মান করেছে যা সে কারও কাছে পায়নি এমনকি নিজের স্ত্রী কদমের কাছেও নয়৷

চাঁপার কোনো অতীত কাহিনি তুলে ধরেননি রচনাকার৷ সে বহুদিনের পেশায় অভ্যস্ত বারবনিতা৷ কিন্তু দুর্গা তা নয়৷ সদ্য গণিকা হওয়া এক নারীর ভেতরকার দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন দুর্গার মধ্য দিয়ে৷ সে যেমন তার গৃহবধূর খোলসটিকেও সম্পূর্ণ ত্যাগ করতে পারেনি তেমনি বেশ্যাজীবনের নিষ্ঠুরতাকেও সম্পূর্ণ আয়ত্ত করতে পারেনি৷ দুর্গা চরিত্রটি এ দিক থেকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনব সৃষ্টি৷

খ. ধরাবাঁধা জীবন :

‘ধরাবাঁধা জীবন’ (১৯৪২) উপন্যাসে গণিকা প্রসঙ্গ এসেছে উপন্যাসের নায়ক ভূপেনের স্ত্রীর মৃত্যুর পর৷ মৃত্যুশোক বা তার জীবনের শূন্যতাকে ভোলার জন্য বন্ধুদের সাহায্যে তাদেরই সঙ্গে গণিকালয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে৷ তারা ভূপেনকে আহ্বান জানিয়ে বলে ‘‘এখন তো বাইরে রাত কাটাতে বাধা নেই, এসো না?’’৩৭১ সংসারী মধ্যবয়সি ভূপেন দুই বন্ধুর সঙ্গে মদ ও মেয়েমানুষের সঙ্গ লাভের জন্য উপস্থিত হয় দেহপসারিণীর দোকানের মতো সাজানো ঘরে৷ ভূপেন তার প্রথম যৌবনেও কয়েকটি স্ফূর্তির রাত্রি যাপন করেছিল নিষিদ্ধপল্লীতে কিন্তু বন্ধুদের মতো অভ্যস্ত হতে পারেনি৷ তারা তাদের মধ্য বয়সেও স্ত্রীর একঘেয়ে সাহচর্য থেকে মুক্তির জন্য পতিতা নারীর দেহসুখ অন্বেষণ করে৷ কিন্তু গণিকালয়ে মদের নেশায় বিভোর ভূপেন যখন শশীতারা নাম্নি বারাঙ্গনাকে একরাত্রের জন্য ভাড়া করেও তার সঙ্গীত ও শরীর আস্বাদন করতে পারে না তখন তার বন্ধুদের মনে হয়—‘‘বড়ো একঘেয়ে জীবন, ফুর্তি কোনোদিন জমে না, ভূপেন সঙ্গে থাকায় আশা করিয়াছিল হয়তো আজ জমিবে৷ রাত্রির পর রাত্রি বৃথা গিয়াছে, আরেকটা রাত্রি আজ ব্যর্থ হইয়া গেল৷ এখন আবার অন্য একটি রাত্রির ভরসায় বুক বাঁধিতে হইবে৷’’৩৭২

গণিকাদের পয়সার বিনিময়ে ভাড়া করে তারপর তাকে উদোম ভোগের ইঙ্গিত রয়েছে উপন্যাসটিতে৷

সঞ্জয় ভট্টাচার্য (১৯০৯-১৯৬৯) :

সঞ্জয় ভট্টাচার্য উপন্যাস জগতে বিচরণ করলেও তাঁর মুখ্য পরিচয় একজন কবি এবং পূর্বাশা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে৷ তিনি তাঁর উপন্যাসের বিষয় হিসেবে গ্রহণ করেছেন বুদ্ধিজীবীর অস্তিত্বকে এবং সেকারণেই উপন্যাসগুলি গতানুগতিক না হয়ে পরীক্ষামূলক হয়ে উঠেছে৷ তিনি একদিকে যেমন অনুসরণ করেছেন চেতনাপ্রবাহ বা মনস্তত্ত্বমূলকরীতিকে তেমনি অন্যদিকে জেমস্ জয়েস, প্রুস্ত বা অস্তিবাদী দর্শনের ধারা৷ সেই সঙ্গে পালন করেছেন কালমাকর্স এর মার্কসীয় চিন্তাচেতনাকে৷ ‘পূর্বাশা’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে (দ্বিতীয় বর্ষ, ১৩৭২, আশ্বিন) উপন্যাসের বিষয় সম্পর্কে বলেছেন যে—ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে সমাজ জীবনের যে অবশ্যম্ভাবী সংঘাত এবং তার ফলে সমাজজীবনে বা ব্যক্তিজীবনে যে রূপান্তর তা যেমন কথা সাহিত্যের উপজীব্য হতে পারে তেমনি ইতিহাসেরও৷ তাঁর মতে সব উপন্যাসই ইতিহাস তা অতীত অথবা বর্তমানের৷ তাঁর এই মননচর্চা ও ইতিহাসবোধের যে বিশিষ্টতা তার প্রতিফলন যেন ‘বৃত্ত’ উপন্যাসটির পরতে পরতে৷

ক. বৃত্ত :

সঞ্জয় ভট্টাচার্য যুগ যন্ত্রণার এক খণ্ড রূপের রূপকার হিসেবেই ‘বৃত্ত’ (১৯৪২) উপন্যাসটি রচনা করেছেন৷ এর কেন্দ্রীয় আকর্ষণ যৌনমনস্তাত্ত্বিকতা ভিত্তিক৷ এখানে বর্ণিত হয়েছে এক মধ্যবয়স্ক অধ্যাপক সত্যবানের পনেরো বছর আগে পিতা-মাতার মতের বিরূদ্ধে যাওয়া দুঃসাহসিক নারী সতীকে বিয়ে করা৷ কিন্তু বিয়ের পর সতী দুঃসাহসী থেকে স্বামীর অনুবর্তনকারিণী নারীরূপে নিজেকে প্রতিভাত করে যা সত্যবানের উত্তপ্ত হৃদয় কামনাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না৷ তার কামনা পূরণের আধার হয় সুরমা ও তার মেয়ে বনানী৷ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত সুরমা এবং যুদ্ধোত্তর যুগের সন্তান পিতার স্নেহ বঞ্চিত বনানী পেশাগত গণিকা নয়, দুরন্ত স্বেচ্ছারিণী৷ আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির ধারায় এরা সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত৷

সুরমা :

উপন্যাসের এক অন্যতম চরিত্র সুরমা৷ মতের অমিল হওয়ায় সে স্বামী থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে৷ শুধু নিজেকে নয় মেয়ে বনানীকেও পিতৃসান্নিধ্য থেকে দূরে সরিয়ে তার মতো করে মানুষ করতে শুরু করেছে৷ তার মধ্যে স্বাধীনতাবোধ প্রবল৷ প্রভূত সম্পদশালিনী এই নারী স্বাধীনতার জন্যই স্বামীকে অনায়াসে বলতে পারে—‘‘আপনার টাকাপয়সার জোর থাকলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন—কিন্তু আমি জানি আমাকে কেন, খুকিকেও আপনি নিতে পারবেন না৷’’৩৭৩

বৈবাহিক সম্পর্কের আদর্শ তার কাছে ভিত্তিহীন৷ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আত্মার মিল না থাকলে সে বিয়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া এবং তা একটা শৃঙ্খলা৷ সে সত্যবানকে বলে—‘‘কেন জানি নে বিয়েতেই আমি বিশ্বাস হারিয়েছি৷’’৩৭৪ শুধু বিয়ে নয় যৌনতা সম্পর্কেও তার মনোভাব স্বাধীন৷ সে স্বামীকে ত্যাগ করেছে কিন্তু যৌনতাকে নয়৷ তাই বহুপুরুষের সঙ্গে রচনা করেছে অবৈধ যৌন সম্পর্ক কিন্তু তৃপ্তি পায়নি কোথাও৷ তার অন্তর্নিহিত বিশ্বাস ও বিচ্ছিন্নতাকে ভোলার জন্য কামনার প্রাসাদ রচনা করেছে; রজত, সত্যবান নির্দ্বিধায় সেই প্রাসাদের অতিথি হয়েছে৷ তার জীবনের কোনো দিকই অন্ধকার রাখেনি মেয়ের কাছে৷ তার ধারণা মেয়ে তার স্বাধীন হয়ে উঠুক, জীবনের সবটা নিজে দেখে, নিজের কানে শুনে জানুক৷

জীবনের শেষের দিকে উপস্থিত হয়ে সুরমা যখন বুঝতে পেরেছে তার মেয়েও সত্যবানের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত তখন মেয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবে না জন্যই অসুস্থ শরীরে বায়ু পরিবর্তনের জন্য পুরীতে গিয়ে সেখানে থেকে মেয়ের উদ্দেশ্যে একটা চিঠি রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে৷ সুরমার অন্তর্ধানের কারণ সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন রচনাকার—‘‘বনানী যে ধীরে ধীরে সত্যবানের কাছে এগিয়ে গেছে তা কি সুরমা লক্ষ করে নি? একদিন নিজেও সুরমা তাই করেছিল—একদিন যা সে করেছিল, মনে হয়েছিল যা জীবনের একটা নিগূঢ় সত্য বলে—তা কি সে নিশ্চিহ্ন করে মুছে ফেলেছে আজ? কে বলবে যে আজও সুরমা সত্যবানকে ভালোবাসে না? কিন্তু তা-ই বলে সে বনানীর সঙ্গে গিয়ে দাঁড়াতে পারে না, পারে শুধু সরে যেতে৷’’৩৭৫

বনানী :

বনানী যুদ্ধোত্তর যুগের সন্তান৷ তার চরিত্র আরও অদ্ভুত৷ সেও মায়ের মতোই স্বেচ্ছাচারে দুর্বার৷ উপন্যাসে যখন তাকে প্রথম দেখা যায় তখন তার বয়স বারো৷ সে সমাজতন্ত্রবাদের সমর্থক হয় তার ভরা যৌবনে৷ কর্মসহচর শিশির কিন্তু যৌনপরিতৃপ্তিকারী তার চেয়ে ষোলো বছরের বড় মধ্যবয়সি সত্যবান৷ তার সহপাঠী ও সম্ভাব্য প্রণয়ী সমাজনৈতিক মতবাদের অত্যুৎসাহে যখন প্রেম ভালোবাসা ইত্যাদি সুকোমল মনোবৃত্তিগুলিকে ঠেলে সরিয়ে রেখেছে এবং সমাজ পুনর্গঠন না হওয়া পর্যন্ত সেগুলিকে আপ্যায়ন করারও পক্ষপাতী নয় তখন হৃদয়াবেগের মোহ পরিতৃপ্তির জন্য সে আশ্রয় নিয়েছে সত্যবানের৷ অকপটে তার প্রতি অনুরাগের কথা যেমন প্রকাশ করতে পেরেছে তেমনি ক্ষুদ্র চিঠি লিখে নিবেদন করেছে তার প্রেমাকাঙ্খাকে৷ মানুষের যৌনবৃত্তির যে রূপান্তর হয় তা সে নির্দ্বিধায় সত্যবানকে জানায় এবং বলে—‘‘ওকে প্রাধান্য দেওয়াতেও ক্ষতি চেপে যাওয়াতেও ক্ষতি৷ পুরুষ-নারীর মধ্যে শুধু এ সম্বন্ধই আছে এ যেমন আমি ভাবতে পারি নে তেমনি পুরুষ-নারীর মেলামেশার ভেতর এ-বৃত্তিটাকে সতর্ক পাহারা দিয়ে রাখতে হবে তা-ও আমি মানতে রাজি নই৷’’৩৭৬ অর্থাৎ মানুষের যৌনপ্রবৃত্তি সম্পর্কে নিজস্ব একটা মত নিজস্ব একটা দর্শন তার মধ্যে বর্তমান৷ কিন্তু এই দ্বিধাবিভক্ত মন নিয়ে জীবনে কি চরিতার্থতা প্রত্যাশা করে তা বোঝা কঠিন৷ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন—‘‘যৌনবোধের পরিমিত অসংকোচ উপভোগ ও ইহাকে মানস-বিলাসের সহিত জড়িত না করার যৌক্তিকতা সম্বন্ধে তাহার মত তাহার মাতার মতের প্রতিধ্বনি; তাহার মাতারই জীবনাভিজ্ঞতা মতবাদরূপে তাহার অনভিজ্ঞ মনে সংক্রামিত হইয়াছে৷ তাহার স্বতঃস্ফূর্ত লীলা চঞ্চলতা ও নিশ্চিন্ত উপভোগস্পৃহা তাহার নব উন্মেষিত যৌবনের দুঃসাহসিকতারই বিচ্ছুরণ; ইহার মূল কোনো সুপ্রতিষ্ঠিত মানস সাম্যে নিহিত নাই৷ মনে যৌবনের জোয়ারে ভাটা পড়িলে তাহার এই সরসতাও শুকাইয়া যাইবে; বয়োবৃদ্ধির সহিত সেও সুরমার দ্বিতীয় সংস্করণে রূপান্তরিত হইবে৷’’৩৭৭

তথ্যসূত্র :

১. পাঁচকড়ি দে রচনাবলী (১), পৃ-১৫৷

 ২. তদেব, পৃ-১৫৷

 ৩. তদেব, পৃ-১৬৷

 ৪. তদেব, পৃ-২৪৷

 ৫. তদেব, পৃ-২৬৷

 ৬. তদেব, পৃ-৬৫৷

 ৭. তদেব, পৃ-৬৬৷

 ৮. তদেব, পৃ-২৪৷

 ৯. তদেব, পৃ-৬৬৷

 ১০. তদেব, পৃ-১৬৷

 ১১. তদেব, পৃ-১২৮৷

 ১২. তদেব, পৃ-১৩৫৷

 ১৩. তদেব, পৃ-১৪৩৷

 ১৪. শরৎ রচনাসমগ্র (৩), পৃ-৩০০৷

 ১৫. ক্ষেত্র গুপ্ত, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস (৩), পৃ-১৪০৷

 ১৬. শরৎ রচনাসমগ্র (৩), পৃ-২৭০৷

 ১৭. তদেব, পৃ-২৭৬৷

 ১৮. তদেব, পৃ-২৯৬৷

 ১৯. তদেব, পৃ-২৯৬৷

 ২০. তদেব, পৃ-৩৩১৷

 ২১. তদেব, পৃ-৪২৫৷

 ২২. তদেব, পৃ-৩৪২৷

 ২৩. তদেব, পৃ-৩৫৯৷

 ২৪. তদেব, পৃ-৩৬০৷

 ২৫. তদেব, পৃ-৩৮০৷

 ২৬. তদেব, পৃ-৪৩৩৷

 ২৭. তদেব, পৃ-৪২৬৷

 ২৮. তদেব, পৃ-৪২৯৷

 ২৯. তদেব, পৃ-৪২৯-৪৩০৷

 ৩০. তদেব, পৃ-৪৩০৷

 ৩১. তদেব, পৃ-৪৩০৷

 ৩২. সম্পাদক সুকুমার সেন, শরৎসাহিত্য সমগ্র, পৃ-৫৫৬৷

 ৩৩. তদেব, পৃ-৫৪৩৷

 ৩৪. তদেব, পৃ-৫৪৪৷

 ৩৫. তদেব, পৃ-৫৪৪৷

৩৬. তদেব, পৃ-৫৫৫৷

৩৭. তদেব, পৃ-৫৬৪৷

৩৮. তদেব, পৃ-৫৬৪

৩৯. শরৎ রচনাসমগ্র (৩), পৃ-৩১৷

৪০. তদেব, পৃ-৩২৷

৪১. তদেব, পৃ-৩৩৷

৪২. তদেব, পৃ-৩৮৷

৪৩. তদেব, পৃ-৩৯৷

৪৪. তদেব, পৃ-৩৯৷

৪৫. তদেব, পৃ-৪৭৷

৪৬. তদেব, পৃ-৫৬৷

৪৭. তদেব, পৃ-৫৭৷

৪৮. তদেব, পৃ-৫৯৷

৪৯. তদেব, পৃ-৬৪৷

৫০. তদেব, পৃ-৬৫৷

৫১. তদেব, পৃ-৬৬৷

৫২. তদেব, পৃ-১১০৷

৫৩. তদেব, পৃ-১১১৷

৫৪. তদেব, পৃ-১১২৷

৫৫. তদেব, পৃ-১১৫৷

৫৬. তদেব, পৃ-১১৫৷

৫৭. তদেব, পৃ-১১৫৷

৫৮. তদেব, পৃ-১১৬৷

৫৯. তদেব, পৃ-১২১৷

৬০. তদেব, পৃ-১২৫৷

৬১. তদেব, পৃ-১২৭৷

৬২.  তদেব, পৃ-১৮৭

৬৩.  তদেব, পৃ-২২৮৷

৬৪. তদেব, পৃ-১৯৭৷

৬৫. তদেব, পৃ-২৩১৷

৬৬. তদেব, পৃ-২৫৫৷

৬৭. তদেব, পৃ-২৫৬৷

৬৮. তদেব, পৃ-২৫৯৷

৬৯. তদেব, পৃ-২১৬৷

৭০. তদেব, পৃ-২১৮৷

৭১. তদেব, পৃ-২৬৪৷

৭২. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুভদা, পৃ-৫৮৷

 ৭৩. তদেব, পৃ-৬৬৷

 ৭৪. তদেব, পৃ-৮৯৷

 ৭৫. তদেব, পৃ-৯০৷

 ৭৬. তদেব, পৃ-১০১৷

 ৭৭. তদেব, পৃ-২১৷

 ৭৮. তদেব, পৃ-২১৷

 ৭৯. তদেব, পৃ-২২৷

 ৮০. তদেব, পৃ-২৩৷

 ৮১. তদেব, পৃ-২৩৷

 ৮২. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী, (উপন্যাস), ২য় খণ্ড, পৃ-৩২৩৷

 ৮৩. তদেব, পৃ-৩২৪৷

 ৮৪. তদেব, পৃ-৩৭৭৷

 ৮৫. তদেব, পৃ-৩৭৭৷

 ৮৬. তদেব, পৃ-৪০৫৷

 ৮৭. তদেব, পৃ-৪২৬৷

 ৮৮. তদেব, পৃ-৪২৯৷

 ৮৯. তদেব, পৃ-৪৩৭৷

 ৯০. তদেব, পৃ-৪৬৯৷

 ৯১. তদেব, পৃ-৪৮২৷

 ৯২. তদেব, পৃ-৪৮২৷

 ৯৩. তদেব, পৃ-৪৮৩৷

 ৯৪. তদেব, পৃ-৫১৫৷

 ৯৫. তদেব, পৃ-৪৫৮৷

 ৯৬. তদেব, পৃ-৩১২৷

 ৯৭. তদেব, পৃ-৩১২৷

 ৯৮. তদেব, পৃ-৪৪৬৷

 ৯৯. তদেব, পৃ-৫৭১৷

 ১০০. তদেব, পৃ-৫৩৪৷

 ১০১. তদেব, পৃ-৫৩৫৷

 ১০২. তদেব, পৃ-৫৩৫৷

 ১০৩. তদেব, পৃ-৫৬৯৷

 ১০৪. তদেব, পৃ-৩৮৩৷

 ১০৫. তদেব, পৃ-৭৬৷

 ১০৬. তদেব, পৃ-১৪৩৷

 ১০৭. তদেব, পৃ-১৪৩৷

১০৮. তদেব, পৃ-১৪৩৷

১০৯. তদেব, পৃ-১৪৪৷

১১০. তদেব, পৃ-২৫৫৷

১১১. তদেব, পৃ-৭৬৷

১১২. তদেব, পৃ-৭৯৷

১১৩. তদেব, পৃ-৮৫৷

১১৪. তদেব, পৃ-৮৫-৮৬৷

১১৫. তদেব, পৃ-৮৮৷

১১৬. তদেব, পৃ-৮৮৷

১১৭. তদেব, পৃ-১০৯৷

১১৮. তদেব, পৃ-১০০৷

১১৯. তদেব, পৃ-১১২৷

১২০. তদেব, পৃ-১১২৷

১২১. তদেব, পৃ-১১৪৷

১২২. তদেব, পৃ-১৩৯৷

১২৩. তদেব, পৃ-১৪৬৷

১২৪. তদেব, পৃ-১৪৭৷

১২৫. তদেব, পৃ-১৪৮৷

১২৬. তদেব, পৃ-১৫৪৷

১২৭. তদেব, পৃ-১৫৫-১৫৬৷

১২৮. তদেব, পৃ-১৬৩৷

১২৯. তদেব, পৃ-২০৯৷

১৩০. তদেব, পৃ-২২০৷

১৩১. তদেব, পৃ-২২৮৷

১৩২. তদেব, পৃ-২৪৪৷

১৩৩. তদেব, পৃ-২৪৫৷

১৩৪. তদেব, পৃ-২৪৫৷

১৩৫. তদেব, পৃ-২৫১৷

১৩৬. তদেব, পৃ-২৫৬৷

১৩৭. তদেব, পৃ-২৫৬৷

১৩৮. তদেব, পৃ-২৫৭৷

১৩৯. তদেব, পৃ-২৫৭৷

১৪০. তদেব, পৃ-২৫৮৷

১৪১. তদেব, পৃ-২৬০৷

১৪২. তদেব, পৃ-২৬০৷

১৪৩. তদেব, পৃ-২৬২৷

১৪৪. তদেব, পৃ-২৬৪৷

১৪৫. তদেব, পৃ-২৬৪৷

১৪৬. তদেব, পৃ-২৬৫৷

১৪৭. তদেব, পৃ-২৬৫৷

১৪৮. তদেব, পৃ-২৬০৷

১৪৯. তদেব, পৃ-২৭৯৷

১৫০. তদেব, পৃ-২৮৯৷

১৫১. তদেব, পৃ-২৯৪৷

১৫২. তদেব, পৃ-২৯৬৷

১৫৩. তদেব, পৃ-৩০১৷

১৫৪. তদেব, পৃ-৩০১৷

১৫৫. তদেব, পৃ-১০৪৷

১৫৬. তদেব, পৃ-১০৪৷

১৫৭. তদেব, পৃ-১৫৩৷

১৫৮. তদেব, পৃ-১৫৪৷

১৫৯. তদেব, পৃ-১৫৪৷

১৬০. তদেব, পৃ-১৫৫৷

১৬১. তদেব, পৃ-১৫৫৷

১৬২. জগদীশ গুপ্ত, লঘুগুরু ও অসাধু সিদ্ধার্থ, পৃ-১৭৷

১৬৩. তদেব, পৃ-১৪৷

১৬৪. তদেব, পৃ-১০৷

১৬৫. তদেব, পৃ-২০৷

১৬৬. তদেব, পৃ-২৯৷

১৬৭. তদেব, পৃ-২৮৷

১৬৮. তদেব, পৃ-৩০৷

১৬৯. তদেব, পৃ-৩১৷

১৭০. তদেব, পৃ-৩৩৷

১৭১. তদেব, পৃ-৩৯৷

১৭২. তদেব, পৃ-৫১৷

১৭৩. তদেব, পৃ-৫১৷

১৭৪.  তদেব, পৃ-৬৯৷

১৭৫. তদেব, পৃ-৪৯৷

১৭৬. তদেব, পৃ-৫৯৷

১৭৭. তদেব, পৃ-৫৭৷

১৭৮. তদেব, পৃ-৫৭৷

১৭৯. তদেব, পৃ-৫৭৷

১৮০. তদেব, পৃ-৫৯৷

১৮১. তদেব, পৃ-৬০৷

১৮২. তদেব, পৃ-৬৩-৬৪৷

১৮৩. তদেব, পৃ-৬৭৷

১৮৪. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (দ্বিতীয় খণ্ড), পৃ-৩১৫৷

১৮৫. তদেব, পৃ-৩৬৪৷

১৮৬. তদেব, পৃ-৩৬৫৷

১৮৭. তদেব, পৃ-৮৪৭৷

১৮৮. ক্ষেত্রগুপ্ত, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস (৩), পৃ-

১৮৯. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র, (দ্বিতীয় খণ্ড), পৃ-৪১৬৷

১৯০. তদেব, পৃ-৪২২৷

১৯১. তদেব, পৃ-৪২২৷

১৯২. তদেব, পৃ-৪৩৭৷

১৯৩. তদেব, পৃ-৪৩৮৷

১৯৪. তদেব, পৃ-৪৫৭-৪৫৮৷

১৯৫. তদেব, পৃ-৪৭৬৷

১৯৬. তদেব, পৃ-৪৫৮৷

১৯৭. তদেব, পৃ-৪৫৩৷

১৯৮. তদেব, পৃ-৪৫৭৷

১৯৯. তদেব, পৃ-৪৫৯৷

২০০. তদেব, পৃ-৪৭১৷

২০১. তদেব, পৃ-৪৭৮৷

২০২. তদেব, পৃ-৪৭৮৷

২০৩. তদেব, পৃ-৪৮০৷

২০৪. তদেব, পৃ-৪৮১৷

২০৫. তদেব, পৃ-৪৫৭৷

২০৬. তদেব, পৃ-৪৫৭৷

২০৭. তদেব, পৃ-৪৫৮৷

২০৮. তদেব, পৃ-৪৩৭৷

২০৯. তদেব, পৃ-৪৩৮৷

২১০. তদেব, পৃ-৪৩৯৷

২১১. তদেব, পৃ-৪৪৪৷

২১২. তদেব, পৃ-৪৪৫৷

২১৩.  তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রচনাবলী তৃতীয় খণ্ড, পৃ-২৩০৷

২১৪.  তদেব, পৃ-২৩১৷

২১৫.  তদেব, পৃ-২৩২৷

২১৬. তদেব, পৃ-২৩৪৷

২১৭. তদেব, পৃ-২৩৫৷

২১৮. তদেব, পৃ-২৪৩৷

২১৯. তদেব, পৃ-২৪৭৷

২২০. তদেব, পৃ-২৪৮৷

২২১. তদেব, পৃ-২৪৮৷

২২২. তদেব, পৃ-২৫২৷

২২৩. তদেব, পৃ-২৫২৷

২২৪. তদেব, পৃ-২৫৫৷

২২৫. তদেব, পৃ-২৬৯৷

২২৬. তদেব, পৃ-৩০৩৷

২২৭. তদেব, পৃ-৩০৬৷

২২৮. তদেব, পৃ-৩০৭৷

২২৯. তদেব, পৃ-৩০৭৷

২৩০. তদেব, পৃ-৩০৮৷

২৩১. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃ-১৩৩৷

২৩২. তদেব, পৃ-১৭০৷

২৩৩. তদেব, পৃ-১৭০৷

২৩৪. তদেব, পৃ-১৮৭৷

২৩৫. ক্ষেত্রগুপ্ত, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস, (৪), পৃ-৫৮৷

২৩৬. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, পৃ-২৬৬৷

২৩৭. তদেব, পৃ-৩২৬৷

২৩৮. তদেব, পৃ-৩৩৩৷

২৩৯. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রচনাবলী, পঞ্চম খণ্ড, পৃ-৫৩৷

২৪০. তদেব, পৃ-৫৫৷

২৪১. তদেব, পৃ-৫৪৷

২৪২. তদেব, পৃ-৫৯৷

২৪৩. তদেব, পৃ-৯০৷

২৪৪. তদেব, পৃ-৯০৷

২৪৫. তদেব, পৃ-৯১৷

২৪৬. তদেব, পৃ-১৩৬৷

২৪৭. তদেব, পৃ-১৩৬৷

২৪৮. তদেব, পৃ-১৪১৷

২৪৯. তদেব, পৃ-১৪১৷

২৫০. তদেব, পৃ-১৪৪-১৪৫৷

২৫১. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি, পৃ-৬৫৷

২৫২. তদেব, পৃ-৬৬৷

২৫৩. তদেব, পৃ-৬৭৷

২৫৪. তদেব, পৃ-৬৭৷

২৫৫. তদেব, পৃ-৭০৷

২৫৬. তদেব, পৃ-৮১৷

২৫৭. তদেব, পৃ-৯৪৷

২৫৮. তদেব, পৃ-১০১৷

২৫৯. তদেব, পৃ-১০২৷

২৬০. তদেব, পৃ-১০৪৷

২৬১. তদেব, পৃ-১১১৷

২৬২. তদেব, পৃ-১১৭৷

২৬৩. তদেব, পৃ-১১৮৷

২৬৪. তদেব, পৃ-১১৮৷

২৬৫. তদেব, পৃ-১৩২৷

২৬৬. তদেব, পৃ-১৩১৷

২৬৭. তদেব, পৃ-১৩১৷

২৬৮. তদেব, পৃ-১৪৩৷

২৬৯. তদেব, পৃ-১৪৫৷

২৭০. তদেব, পৃ-১৪৬৷

২৭১. তদেব, পৃ-৭০৷

২৭২. তদেব, পৃ-১৪১৷

২৭৩. তদেব, পৃ-১৩৪৷

২৭৪. তদেব, পৃ-১৩৪৷

২৭৫. তদেব, পৃ-১৩৫৷

২৭৬. তদেব, পৃ-১৩৫৷

২৭৭. তদেব, পৃ-১৩৬৷

২৭৮. তদেব, পৃ-১৪৭৷

২৭৯. তদেব, পৃ-১৫৫৷

২৮০. তদেব, পৃ-১৪৭৷

২৮১. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৪১৷

২৮২. তদেব, পৃ-৪০৷

২৮৩. তদেব, পৃ-৩৬৷

২৮৪. তদেব, পৃ-৩৯৷

২৮৫. তদেব, পৃ-৬৬৷

২৮৬. তদেব, পৃ-৭৩৷

২৮৭. তদেব, পৃ-১০৪৷

২৮৮. তদেব, পৃ-১২১৷

২৮৯. তদেব, পৃ-১৮৩৷

২৯০. তদেব, পৃ-১৮৪৷

২৯১. তদেব, পৃ-১৮৭৷

২৯২. তদেব, পৃ-২১০৷

২৯৩. তদেব, পৃ-২১০-২১১৷

২৯৪. তদেব, পৃ-২২১৷

২৯৫. তদেব, পৃ-২৩৫৷

২৯৬. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী, চতুর্থ খণ্ড, পৃ-৩২৷

২৯৭. তদেব, পৃ-৩৩৷

২৯৮. তদেব, পৃ-৭৬৷

২৯৯. তদেব, পৃ-১৩৪৷

৩০০. তদেব, পৃ-১৫০৷

৩০১. তদেব, পৃ-২৪৫৷

৩০২. তদেব, পৃ-২৫৩৷

৩০৩. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৪০৷

৩০৪. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-৩৭১৷

৩০৫. বনফুলের রচনাসমগ্র (প্রথম খণ্ড), পৃ-১১৯৷

৩০৬. তদেব, পৃ-১১৯৷

৩০৭. তদেব, পৃ-১৩২৷

৩০৮. তদেব, পৃ-১৩৬৷

৩০৯. তদেব, পৃ-১৩৭৷

৩১০. তদেব, পৃ-২৮৩৷

৩১১. তদেব, পৃ-২৮৩৷

৩১২. তদেব, পৃ-২৮৫৷

৩১৩. তদেব, পৃ-২৮৫৷

৩১৪. তদেব, পৃ-২৮৫৷

৩১৫. তদেব, পৃ-২৮৫৷

৩১৬. তদেব, পৃ-২৮৫৷

৩১৭. তদেব, পৃ-১০২৷

৩১৮. তদেব, পৃ-৩১৫৷

৩১৯. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৭৮৷

৩২০. তদেব, পৃ-১৭৮৷

৩২১. তদেব, পৃ-১৭৮৷

৩২২. তদেব, পৃ-১৭৮৷

৩২৩. তদেব, পৃ-১৭৮৷

৩২৪. তদেব, পৃ-১৭৯৷

৩২৫. তদেব, পৃ-১৭৯৷

৩২৬. তদেব, পৃ-১৭৯৷

৩২৭. তদেব, পৃ-১৯৩৷

৩২৮. তদেব, পৃ-১৯৩৷

৩২৯. তদেব, পৃ-১৭৬৷

৩৩০. তদেব, পৃ-১৯৩৷

৩৩১. তদেব, পৃ-১৯৪৷

৩৩২. তদেব, পৃ-১৯৪৷

৩৩৩. তদেব, পৃ-১৯৪-১৯৫৷

৩৩৪. তদেব, পৃ-১৯৫৷

৩৩৫. তদেব, পৃ-১৯৫৷

৩৩৬. তদেব, পৃ-১৯৫৷

৩৩৭. তদেব, পৃ-১৯৬৷

৩৩৮. তদেব, পৃ-২১২-২১৩৷

৩৩৯. তদেব, পৃ-২৩৫৷

৩৪০. তদেব, পৃ-২৩৬৷

৩৪১. তদেব, পৃ-২৫৮৷

৩৪২. তদেব, পৃ-৩২৯৷

৩৪৩. তদেব, পৃ-২৪৷

৩৪৪. তদেব, পৃ-২৪৷

৩৪৫. তদেব, পৃ-১৯৫৷

৩৪৬. তদেব, পৃ-১১৪৷

৩৪৭. তদেব, পৃ-১১৪৷

৩৪৮. তদেব, পৃ-২০৩৷

৩৪৯. তদেব, পৃ-২০১৷

৩৫০. তদেব, পৃ-২০৩৷

৩৫১. তদেব, পৃ-২৭৩৷

৩৫২. তদেব, পৃ-২৭০৷

৩৫৩. তদেব, পৃ-৩৩৩৷

৩৫৪. তদেব, পৃ-৩৩৩৷

৩৫৫. তদেব, পৃ-৪০০-৪০১৷

৩৫৬. তদেব, পৃ-২২৬৷

৩৫৭. তদেব, পৃ-৪৭৮৷

৩৫৮. তদেব, পৃ-৫৭৭৷

৩৫৯. তদেব, পৃ-৫৯৮৷

৩৬০. তদেব, পৃ-৫২০৷

৩৬১. তদেব, পৃ-৫১৮৷

৩৬২. তদেব, পৃ-৫১৯৷

৩৬৩. মানিক উপন্যাস সমগ্র (১ম খণ্ড), পৃ-৭৩০৷

৩৬৪. তদেব, পৃ-৭৫৯৷

৩৬৫. তদেব, পৃ-৭৭৩৷

৩৬৬. তদেব, পৃ-৭৭২৷

৩৬৭. তদেব, পৃ-৭৭৩৷

৩৬৮. তদেব, পৃ-৭৭৩৷

৩৬৯. তদেব, পৃ-৭৭৩৷

৩৭০. তদেব, পৃ-৭৭৩৷

৩৭১. তদেব, পৃ-৪২৮৷

৩৭২. তদেব, পৃ-৪২৯৷

৩৭৩. শাশ্বতী গাঙ্গুলী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য : একটি পরিক্রমা, পৃ-১৫১৷

৩৭৪. তদেব, পৃ-১৫২৷

৩৭৫. তদেব, পৃ-১৯৬৷

৩৭৬. তদেব, পৃ-১৭৯৷

৩৭৭. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-৩৬৬৷

৬. বাংলা উপন্যাসে গণিকা চরিত্রের বিবর্তন

বাংলা উপন্যাসে গণিকা চরিত্রের বিবর্তন

গণিকাচরিত্র সম্বলিত যে সমস্ত বাংলা উপন্যাসের আবির্ভাব ঘটেছে তার সিংহভাগেরই প্রচ্ছদপট হল কলকাতা ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলি৷ এর পিছনে রয়েছে গভীর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণ৷ ১৬৯০ সালে জব চার্ণক যখন কলকাতা নগরীর পত্তন করেন সাবর্ণ চৌধুরীদের কাছ থেকে সুতানুটি, গোবিন্দপুর এবং কলকাতা এই তিনটি গ্রাম পত্তনি নিয়ে তখন তা ছিল জেলে, মালো, কলু, ধাঙর প্রভৃতিদের দ্বারা অধ্যুষিত গণ্ডগ্রামমাত্র৷ ব্রাহ্মণদের বাস ছিল না বললেই চলে৷ তারপর ইংরেজরা একে রাজধানী করে প্রশাসনিক সকল কাজকর্ম চালানোর আয়োজন করলে ধীরে ধীরে কলকাতার অবস্থা পাল্টাতে থাকে৷ রাজকর্মচারীদের বাসস্থান, অফিস-কাছারি নির্মাণ, কলকারখানা স্থাপন, বন্দর তৈরি এবং ব্যবসা-বানিজ্যের বিস্তার ইত্যাদির ব্যাপক আয়োজনে কলকাতা নগরীতে মানুষের ভিড় উপচে পড়তে থাকে৷ পলাশীযুদ্ধে সহায়তা করে ইংরেজদের আস্থা অর্জনকারী মানুষজন নানা খেতাব, অর্থসম্পত্তি, প্রতিপত্তি প্রাপ্ত হয়ে যেমন কলকাতায় বসবাস শুরু করে দেয় তেমনি জমিদার শ্রেণীর মানুষজনও গ্রামের জমিদারির ভার নায়েব-গোমস্তার হাতে সমর্পণ করে আয়াস-বিলাসে জীবন কাটানোর জন্য কলকাতায় আস্তানা গারে৷ এছাড়াও একটু চালাক-চতুর ধরনের মানুষেরা বুদ্ধি খাটিয়ে ব্যবসা করে প্রচুর ধনসম্পদের অধিকারী হয়ে উঠে৷ নব্যশহরের কাঁচা পয়সায় তাদের ভাণ্ডার উছলে উঠে৷ তাদের না ছিল শিক্ষা, না ছিল রুচি—কিন্তু পয়সার দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান করে চরম উশৃঙ্খলতায় গা ভাসিয়ে দেয়৷ এইসব প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধনসম্পদের অধিকারী মানুষজনের বিকৃত বিচারশূন্য চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজন দেখা দেয় মনোরঞ্জিকার৷ দেহজীবী নারীরা তাদের কামনা পূরণের হাতিয়ার হয়৷

আবার দেশের শাসনভার ইংরেজদের হস্তগত হওয়ায় দেশীয় শাসন-ব্যবস্থায় ভাঙ্গন দেখা দেয়৷ নবাবি শাসনের পতন হওয়ায় নবাব, আমীর, ওমরাহদের মনোরঞ্জনকারী উচ্চশ্রেণীর বাইজিরা কলকাতার অর্থশালী ধনী মানুষদের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে অথবা পৃষ্ঠপোষকতার আশায় দলে দলে কলকাতায় পাড়ি জমাতে থাকে৷ এদের বেশিরভাগই বনেদি, নৃত্যগীত পারদর্শিনী এবং আদব-কায়দা সম্পন্ন উচ্চপর্যায়ের গণিকা৷ সম্ভবত এদের দ্বারাই কলকাতায় বাইজি সমাজের সৃষ্টি হয়৷ এছাড়া কলকারখানা, সওদাগরি অফিস, বন্দর ইত্যাদিতে কাজ করা বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী, চাকুরিজীবী মানুষজন যারা দেশে স্ত্রী-পরিবারকে ফেলে মেসে ভাড়া থেকে রুজি-রোজগারের উপায় খুঁজছিল তাদের সুবিপুল শরীরী ক্ষুধার চাহিদা মেটাতেও প্রয়োজন হয় দেহপসারিণী নারীর৷ কলকাতায় পর্যাপ্ত খদ্দের পাওয়ার সম্ভাবনায় পণ্যাঙ্গনাদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে৷ এদের বেশিরভাগই ছিল বালবিধবা, কুলত্যাগিনী অত্যাচারিত নারী৷ পুরুষদের বহুবিবাহ, কৌলিন্যপ্রথা, বিলাস-বহুল অসংযমী জীবন এবং সতীদাহ প্রথা রদ, তার সঙ্গে বিধবাদের প্রতি নানা কঠিন-কঠোর বিধিনিষেধ নারীকুলকে দেহব্যবসার জন্য ইন্ধন দান করে৷ এদের কেন্দ্র করে গড়ে উঠে দালালদের সিণ্ডিকেট, নারীপাচারচক্র৷ ‘সুলভ দৈনিক’-এ ১৪.০২.১৮৯৬ এবং ‘রিপোর্ট অন নেটিভ পেপারস’-এ ২২.০২.১৮৯৬-তে নারীপাচার নিয়ে একটি রিপোর্ট বের হয়৷ রিপোর্টটি এইরূপ ‘‘The Sulabh Dainik of the 14th February complains that a brisk traffic in immorality is going on in Calcutta and its neighbourhood. Young girls, married and unmarried, are being bought and sold by the prostitutes. Recently a young married girl, enmeshed by a prostitute, was going to be sold when she was rescued by a kind-hearted gentleman…’’ সমাজের নানা জটিল আবর্তে পাক খেতে খেতে কলকাতায় গণিকার সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে৷ শুধু কলকাতা নয় ঠুনকো সতীত্বের ফাঁসকে অনায়াসে ছিঁড়ে ফেলে সমাজের নানাদিক থেকে বঞ্চিত অত্যাচারিত নারীরা কলকাতার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলোতে ঘাঁটি গারতে থাকে৷ কলকারখানা, নানারকম ক্ষুদ্র শিল্প ইত্যাদি স্থাপিত হয়ে হাওড়া, চব্বিশ পরগণা, বর্ধমান, হুগলি প্রভৃতি জায়গাও গণিকাপল্লীর ভিত রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়৷

শ্রেণীভেদে কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে গণিকাদের অবস্থানক্ষেত্র হয়ে উঠে৷ যেমন মুঘল নবাব-বাদশাহের পোষকতা হারানো বাইজিরা লক্ষ্ণৌ, আগ্রা, বেনারসের পাট উঠিয়ে কলকাতার বউবাজার অঞ্চলে বাসা বাঁধে৷ দেশ-বিদেশের নাবিকদের মনোরঞ্জন করার জন্য বন্দর এলাকায় আস্তানা নেয় অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান সহ নানাদেশের গণিকারা৷ উচ্চবিত্ত ধনকুবেরদের জন্য বেশ্যালয় গড়ে উঠে শেঠবাগান, সোনাগাছি, রামবাগান, গরাণহাটা ইত্যাদি অঞ্চলে৷ হাড়কাটাগলি, মেছুয়াবাজার, চিৎপুর, আহিরীটোলা, কেরমবাগান, দরমাহাটা এই সমস্ত অঞ্চলে কুলিমজুর, শ্রমজীবী শ্রেণীর মানুষজনদের যৌনআনন্দ দেওয়ার জন্য সাধারনতঃ কম মূল্যের বারবিলাসিনীরা বাস করতে থাকে৷

কলকাতার যে সম্প্রদায় গণিকাদের নিয়ে বিলাস-ব্যসনে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল তারা বাবু অভিধায় ভূষিত হয়৷ বাবু চরিত্রের পূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে৷ তিনি তাদের পরিচায়িত করে বলেছেন—‘‘যাঁহার বুদ্ধি বাল্যে পুস্তকমধ্যে, যৌবনে বোতলমধ্যে, বার্দ্ধক্যে গৃহিণীর অঞ্চলে, তিনিই বাবু৷ যাঁহার ইষ্টদেবতা ইংরাজ, গুরু ব্রাহ্মধর্ম্মবেত্তা, বেদ দেশী সম্বাদপত্র এবং তীর্থ ‘ন্যাশানেল থিয়েটার’ তিনিই বাবু৷ যিনি মিসনরির নিকট খ্রীষ্টিয়ান, কেশবচন্দ্রের নিকট ব্রাহ্ম, পিতার নিকট হিন্দু এবং ভিক্ষুক ব্রাহ্মণের নিকট নাস্তিক, তিনিই বাবু৷ যিনি নিজগৃহে জল খান, বন্ধুগৃহে মদ খান, বেশ্যাগৃহে গালি খান, এবং মুনিব সাহেবের গৃহে গলাধাক্কা খান, তিনিই বাবু৷ যাঁহার স্নানকালে তৈলে ঘৃণা, আহারকালে আপন অঙ্গুলিকে ঘৃণা এবং কথোকপথনকালে মাতৃভাষাকে ঘৃণা, তিনিই বাবু৷ যাঁহার যত্ন কেবল পরিচ্ছদে, তৎপরতা কেবল উমেদারিতে, ভক্তি কেবল গৃহিণী বা উপগৃহিণীতে, এবং রাগ কেবল সদগ্রন্থের উপর, নিঃসন্দেহে তিনিই বাবু৷’’ অর্থাৎ আরামে, আয়াসে, বিলাসিতায়, নৈতিকপতনে এবং নারীদেহ ভোগের চূড়ান্ত উৎসাহে মুখরিত হয়ে ছিল উনিশ শতকের কলকাতা নগরী৷ কলকাতার এই সমাজচিত্রই এই সময়কার লেখকদের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠে৷ বিভিন্ন নাটক, নকশা জাতীয় রচনায় বাবু ও গণিকাসক্তি বিশেষভাবে প্রাধান্য পায়৷ যেমন প্রসন্ন কুমার পালের ‘বেশ্যানুরক্তি নিবারণ নাটক’ (১৮৬০) প্যারীমোহন সেনের ‘রাঁড় ভাড় মিচেকতা, এই নিয়ে কলকেতা’ (১৮৬৩), শ্রীগিরীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘বেশ্যা গাইড’ (১৮৬৮), রাধামাধব হালদারের ‘বেশ্যানুরক্তি বিষমবিপত্তি’ (১৮৬৩), শ্রীঅঘোরচন্দ্র ঘোষের ‘পাঁচালী কমলকলি’ (১৮৭২), চণ্ডীচরণ ঘোষ লিখেছেন ‘বেশ্যাই সর্ব্বনাশের মূল’ (১৮৭৩) ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবু বিলাস’, ‘নববিবি বিলাস’ কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’, প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘মদ খাওয়া বড় দায়/জাত থাকার কি উপায়’ ইত্যাদি৷

উনিশ শতকের বাংলা উপন্যাসে গণিকাদের সামাজিক মর্যাদা একেবারে তলানিতে৷ তারা সে সময়কার সমাজমনস্কতায় সম্পূর্ণভাবে দূষিত মানবী৷ মানবী বললে তবু মানুষের মর্যাদার মধ্যে পড়ে যায় ; তাই সে যুগের প্রেক্ষিতে তাদের পিশাচী বললে অত্যুক্তি হবে না৷ প্রাচীন যুগের সমাজব্যবস্থার পর্যালোচনায় দেহজীবিকার ঘৃণ্য পঙ্কে অবস্থান করলেও যে সামান্যতম মূল্যটুকু অবশিষ্ট ছিল উনিশ শতকে তা যেন একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়৷ উনিশ শতকে উপন্যাসগুলি পর্যালোচনা করলে সে জায়গাটা সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হবে বলে আশা করা যায়৷

গণিকাচরিত্র উপস্থাপন করতে গিয়ে উনিশ শতকের যে সমস্ত উপন্যাস আলোচিত হয়েছে সেগুলি হল—ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রাজসিংহ’, ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘এই এক নূতন’ বা ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’, বিবি মেরী ই লেসলির ‘এলোকেশী বেশ্যা’, গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘চন্দ্রা’, নবকুমার দত্তের সম্পাদনায় অজ্ঞাতনামা লেখকের ‘স্বর্ণবাই’, সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’, দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’, শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘নয়নতারা’ ইত্যাদি৷

‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ উপন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র একজন পণ্যাঙ্গনা৷ লেখক তাকে দিয়ে অসাধ্য সাধন করেছেন কিন্তু উপন্যাসে কোথাও তার নামোল্লেখমাত্র নেই৷ মোঘল-মারাঠা দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাস৷ মারাঠাবীর শিবাজী প্রণয়প্রার্থী ঔরঙ্গজেবের কন্যা রোসনারার৷ রোসনারারও সেই বিধর্মীর প্রতি মন-প্রাণ সমর্পিত৷ মোঘল সম্রাটের চক্রান্তে দেওয়ান-ই-আম এ বন্দি শিবাজী পলায়নের বুদ্ধি এঁটে রোসনারাকেও সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে৷ কিন্তু রোসনারাকে তার মনের গোপন কথাটি জানাবে কে৷ সে নিজেই বন্দিত্ব থেকে পালিয়ে যাচ্ছে! যার মধ্য দিয়ে প্রণয়িনীর কাছে সংবাদ পাঠানো যাবে তাকে হতে হবে বিশ্বাসী, সাহসী, বুদ্ধিমান সর্বোপরি কর্মের প্রতি দৃঢ় মনস্বতাসম্পন্ন৷ কারণ সে-ই একমাত্র জানবে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়ে থাকা শিবাজীর গোপন ঠিকানা৷ সেই ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে গিয়ে ধরা পড়লে কোনো অবস্থাতেই যেন সে আসল সত্য প্রকাশ না করে ফেলে৷ অতএব অনেক বুদ্ধি খরচ করে সেই মারাঠাবীর তার দূতী রূপে নির্বাচন করে এক বারাঙ্গনাকে৷ যে শিবাজীর অভিজ্ঞানস্বরূপ অঙ্গুরীয় নিয়ে রোসনারার বিশ্বাস অর্জন করবে এবং সমস্ত খবর জানার পর যদি রোসনারাও শিবাজীর অনুসরণে যেতে চায় তাহলে তাকে পৌঁছে দেবে শিবাজীর ঠিকানায় আর না এলে নিজেই ফিরে এসে সে সংবাদ জানাবে তাকে৷

এই বহুপুরুষভোগ্যা রমণী শিবাজীর দূতী হয়ে ঔরঙ্গজেবের জন্মদিনের উৎসবমুখর সমারোহের মধ্যে দেহের পসরার বদলে অন্য নানাবিধ বস্তুরাজী দিয়ে সঙ্গে শিবাজীর উষ্ণীষ ও অঙ্গুরীয়সহ দোকান সাজিয়ে বসে থাকে; উদ্দেশ্য রোসনারার দৃষ্টি আকর্ষণ করা৷ তা সম্ভবও হয়৷ পিতামহ সাহজাহানের সঙ্গে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সেই দোকানের সামনে উপস্থিত হয়ে এবং দোকানের বিক্রেতার সঙ্গে আড়ালে কথা বলার পর সব বুঝতে পারে সে৷ শিবাজীর অঙ্গুরীয় উষ্ণীষ গ্রহণ করে নিজের হাতের অঙ্গুরীয় তুলে দেয় বারাঙ্গনার হস্তে৷ সঙ্গে লিখে দেয় একখানি পত্র৷

আশ্চর্যের বিষয় হল একজন পালিয়ে যাওয়া বন্দি যার ধরা পড়লে নির্মম মৃত্যুদণ্ড ছাড়া অন্য কোনো শাস্তি হতে পারে না সে কি করে একজন সামান্য বারবনিতাকে বিশ্বাস করতে পারে৷ যে বারবনিতাদের অর্থ হয় পরমার্থ এবং শঠতা, কপটতা, মিথ্যাচার, অভিনয়ই হল জীবন-জীবিকার প্রধান মূলধন! রোসনারাও শিবাজীর এই ব্যবহারে বিস্মিত না হয়ে পারেনি৷ যাই হোক শেষ পর্যন্ত সে শিবাজীর প্রণয়বার্তার যথাযথ উত্তর পাঠিয়েছিল সেই গণিকার দ্বারাই৷

শিবাজী সেই বারবনিতাকে যে কর্মের দায়িত্ব দিয়েছে তা সেই রমণীর পক্ষে যেমন ভয়ঙ্কর ঝুঁকির কাজ তেমনি যে পথে সেই মহানায়ক অবস্থান করছে সেই গন্তব্যস্থানও ভয়ানক দুর্গম; পদে পদে বিপদের সম্ভবনা৷ লেখক সেই পথের বর্ণনা করে বলেছেন—‘‘সেই দিন নিশীথসময়ে পূর্ব্বোক্ত বারাঙ্গনা একাকিনী সেতুদ্বারা যমুনা উত্তীর্ণ হইয়া দক্ষিণাভিমুখে গমন করিতে লাগিল৷ সে দিক প্রাচীন দিল্লী, তথায় অনেকানেক ভগ্ন প্রাসাদ এবং বৃহৎ বৃহৎ দেবালয় সকল অদ্যপি দৃষ্ট হইয়া থাকে৷ তৎকালে এক্ষণকার অপেক্ষা আরও অধিক ছিল৷ ঐ স্থানে একটি মনুষ্যেরও গমনাগমন নাই৷ কেবল স্থানে স্থানে শৃগালাদি হিংস্র জন্তুরই উপদ্রব আছে৷ যাহা হউক ঐ স্ত্রী একাকিনী নিঃশঙ্কহৃদয়ে ঐ স্থান দিয়া গমন করত কিয়ৎ দূর অন্তরে এক ভগ্ন দেবালয়ে প্রবেশ করিল৷’’ এই পণ্যরমণী দেহবিকিকিনি করে জীবন কাটালেও তার যে একটা কোমল হৃদয় আছে এবং যে হৃদয়ে মানুষের প্রতি বিশ্বাস, কর্তব্য এবং কৃতজ্ঞতা বোধ আছে তা শিবাজীর দূতীরূপে তাকে নির্বাচন করার মধ্যে দিয়ে যেমন প্রমাণিত হয় তেমনি রোসনারার সমস্ত আচরণ, কথা শিবাজীর সম্মুখে ব্যক্ত করার মধ্য দিয়েও ধরা পড়ে৷ যার মনে অনুভবশক্তি আছে সে সহজেই অন্যের মন বুঝতে পারে সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকতে পারে না৷ সে শিবাজীকে বলে—‘‘মহারাজ! সেই বাদসাহ-পুত্রীর ন্যায় উদার-চরিত্রা কামিনী কখনো দেখি নাই শুনি নাই—যাহা ঘটিয়াছে তাহা আনুপূবর্বীক্রমে বর্ণনা করিতেছি শ্রবণ করুন৷’’ বাদশাহকন্যা শিবাজীর প্রতি প্রণয়পাশে আবদ্ধ হলেও, তার উদ্দেশে তার দেহ-মন সমর্পণ করলেও ঔরঙ্গজেবের বিরোধিতায় তার জন্য ক্ষুদ্র মারাঠাবীরের ভয়ানক সর্বনাশ করে প্রেমিকের পদমূলে নিজেকে সশরীরে সঁপে দিতে পারেনি৷ কিন্তু পত্রে তার উদ্দেশে লিখেছে—‘‘তুমিই আমার স্বামী, তাহার চিহ্নস্বরূপ আমার হস্তাঙ্গুরীয় তোমার অঙ্গুরীয়ের সহিত বিনিময় করিলাম—অতএব অদ্যাবধি আমাদিগের বিবাহ সম্পন্ন হইল৷’’ শিবাজীর গুরু রামদাস স্বামী তাকে আদেশ করে বলেন—‘‘মহারাজ! আমি অনুমতি করিতেছি আপনি ঐ অঙ্গুরীয় গ্রহণ করুন—এবং যদি শাস্ত্র সত্য হয়, তবে পরজন্মে বাদসাহ-কন্যাই আপনকার সহধর্মিণী হইবেন ইহার সন্দেহ নাই৷’’

পরজন্মে রোসনারা শিবাজীর যথার্থ সহধর্মিণী হয়েছিল কিনা জানা নেই কিন্তু ইহজন্মে অঙ্গুরীয় বিনিময় করে যে বিবাহকার্য সম্পন্ন হল তাদের তাতে পৌরহিত্য করল একজন রূপাজীবা৷ সমাজে যারা ঘৃণিতা এবং বেশ্যা বলে সমাজপ্রতিনিধিরা লোকসংযোগ থেকে যাদের সহস্রযোজন দূরে সরিয়ে রাখে লেখক তেমনি এক পণ্যরমণীকে বোধ-বুদ্ধি-বিচারক্ষমতা দিতে কার্পণ্য করেন নি; কোথাও কোথাও সে যে স্ত্রীলোক সেই কথাটিও ব্যক্ত করেছেন কিন্তু মানুষ কতটা ভেবেছেন তা ভাববার বিষয়৷ একজন মেয়ে মানুষকে দিয়ে এতটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করাতে পেরেছেন শুধুমাত্র সে একজন অঘটনপটিয়সী বারবনিতা বলে! উপন্যাসের নাম অঙ্গুরীয় বিনিময়৷ কাহিনি ও ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুও এই অঙ্গুরীয় বিনিময়৷ অথচ যে নিজের প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করে দুজন মহান নর-নারীর মধ্যে এই মহৎ কার্যটি সম্পন্ন করল রচনাকার তার নামটুকু নির্দিষ্ট করারও প্রয়োজন মনে করেননি৷ কারণ মানুষের একটা নাম থাকে আর তা যদি উপন্যাসের কোনো গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের একজন হয় তাহলে তো একটা নাম থাকা অবশ্যই বাঞ্ছনীয়৷ সেই পণ্যরমণীকে কোনোভাবেই উপন্যাসের গৌণ চরিত্র বলা যায় না৷ অথচ তার কোনো নাম নেই৷ নাম মানুষের থাকে; গণিকারা আবার মানুষ নাকি! এই বোধটাই যেন আলোচ্য উপন্যাসে গণিকাদের সামাজিক অবস্থানকে চিনিয়ে দেয়৷

বাংলা উপন্যাসের জগতে বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব নতুন এক দিকনির্দেশনা৷ তিনি বৈশিষ্টগুণসম্পন্ন আদর্শ উপন্যাসে প্রতিষ্ঠাতাও৷ মানুষের জীবনের নানা ঘটনারাজীকে তিনি বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন৷ সাধারণ মানবজীবনের ছোটো-বড় আশা-আকাঙ্খাকে ফ্রয়েড-ইয়ুং-এর তত্ত্ব ছাড়াই নিপুণভাবে রূপায়িত করেছিলেন ঠিকই কিন্তু তার মধ্যে পাপ-পুণ্যের একটা সূক্ষ্ণ পর্দা, নীতির অদৃশ্য আচ্ছাদন চরিত্রগুলিকে আবৃত করে রেখেছিল৷ তাই তাঁর উপন্যাসে পতিতা নারীরা এসেছিল ঠিক গণিকা হিসেবে নয়; তারা প্রবঞ্চিতা-স্বৈরিণী-ব্যভিচারিণী হিসেবে নিজেদের প্রকাশ করেছে৷ ‘কপালকুণ্ডলা’-র মতিবিবি, ‘বিষবৃক্ষ’-র হীরা, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এর রোহিণীরা নানা কারণে সমাজ থেকে পতিত হতে বাধ্য হয়েছে৷

এছাড়া ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে গণিকাচরিত্র বা তথাকথিত স্বৈরিণী চরিত্র না থাকলেও সেখানেও পতিতা নারীদের প্রতি সমাজের কেমন মনোভাব তা বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না৷

‘দুর্গেশনন্দিনী’-তে ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষাপটে প্রাধান্য পেয়েছে তিলোত্তমা জগৎ সিংহের প্রেম কাহিনি৷ এছাড়া বীরেন্দ্র সিংহের গৃহে দাসী বা রক্ষিতার বেশে বসবাসকারী বিমলাও আসলে বীরেন্দ্রর সতী-সাধ্বী সহধর্মিণী৷ বিমলার প্রসঙ্গে আর কেউ কিছু না জানলেও বীরেন্দ্র সিংহের কিছু অজানা ছিল না৷ তার মৃত্যুর পর এ বিষয়ে নিঃসন্দিগ্ধ হয়েছে সকলে৷ যাই হোক এই সম্পর্কগুলির মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে ব্যভিচারের কোনো প্রশ্ন নেই৷ কিন্তু ঘটনা জট পাকে বীরেন্দ্র সিংহের কন্যা তিলোত্তমা এবং পত্নী বিমলা কতলু খাঁর অন্তপুরে বন্দি হলে৷ পাঠান বীর কতলু খাঁ দুর্বৃত্ত লম্পট৷ যুদ্ধে জয়লাভ করে সবচেয়ে সুন্দরী রমণীদের সে নিজের হারেমে বন্দি করে নির্দ্বিধায় তার ভোগ-লালসা প্রশমিত করে৷ সেই দৃষ্টিতে তিলোত্তমা ও তার বিমাতা বিমলাও অনিন্দ্যসুন্দরী বঙ্গরমণী৷ তারা হারেমে বন্দি হলে তিলোত্তমার প্রেমিক জগৎ সিংহ এবং পিতা বীরেন্দ্র সিংহ ধরেই নেয় যে কতলু খাঁ তাদের সতীত্ব হরণ করেছে এবং তারা তার উপপত্নীত্ব স্বীকার করে নিয়েছে৷ সেই ধরে নেওয়াকে কেন্দ্র করে একজনের দুর্বার প্রেম পিপাসা এবং আরেকজনের সীমাহীন বাৎসল্য মুহূর্তেই কর্পূরের মতো উবে যায়৷ বন্দি অসহায় দুজন কুলনারীর পরিস্থিতি বিচার না করেই তাদের হীন প্রতিপন্ন করতে দুই বীরপুরুষের সামান্যতম অনুকম্পাও হয় না৷ বীরেন্দ্র সিংহ মৃত্যুদণ্ড গ্রহণের পূর্বে তার একমাত্র স্নেহ পুত্তলিকা তিলোত্তমার সঙ্গে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতে চায় না৷ সে সম্পর্কে কতলু খাঁকে বলে—‘‘যদি আমার কন্যা তোমার গৃহে জীবিতা থাকে, তবে সাক্ষাৎ করিবনা৷ যদি মরিয়া থাকে, লইয়া আইস, কোলে করিয়া মরিব৷’’ এবং সে সময় একজন তার হাতে বিমলার পত্র তুলে দিলে জনতার মধ্য থেকে কেউ যখন বলে উঠে যে সেটা মনে হয় তার কন্যার পত্র ছিল তখন প্রবল ঘৃণায় সুস্পষ্টভাবে জনান্তিকে জানায়—‘‘কে বলে আমার কন্যা? আমার কন্যা নাই৷’’ মেয়েকে শত্রুর হাত থেকে উদ্ধার করার ক্ষমতা রাখেনা যে পিতা তার শত্রু হাতে বন্দি কন্যাকে অসতী ভেবে ঘৃণা করাতে সামান্য লজ্জাবোধও হয় না৷ এই হল সমাজ! তিলোত্তমা স্বেচ্ছায় বিধর্মীর গৃহে উপস্থিত হয়নি, তাকে বলপূর্বক অপহরণ করা হয়েছে এবং সে কথা তার পিতার অজানাও নয়৷ তার পরেও তাকে ঘৃণা করার মধ্য দিয়ে সমাজের নগ্ন কুৎসিত দিকটাই প্রকটিত হয়ে উঠে৷ সেখানে বীরেন্দ্র সিংহ পিতা নয়, যে সমাজ নষ্টসতীত্বের নারীদের ঘৃণা করে তাদের একজন প্রতিনিধিমাত্র৷ জগৎ সিংহের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য৷ তিলোত্তমার পিতার বিরোধ জেনেও সে পিছপা হতে পারে না প্রণয়িনীর দুর্বার প্রেমাকর্ষণ থেকে৷ মৃত্যুর মুখের কাছে পৌঁছেও তার একই ধ্যান সে তিলোত্তমা৷ তার সম্মুখেই বন্দি হয় তার হৃদয়েশ্বরী৷ নিজের বীরত্ব দিয়ে তাকে যেমন রক্ষা করতে পারে না তেমনি নিজেকেও নয়৷ সেও চূড়ান্ত আহতাবস্থায় কতলু খাঁর হাতে বন্দি৷ তার পরিচর্যায় রাতকে দিন করে চলেছে কতলু খাঁর কন্যা আয়েষা৷ সেখানে থাকাকালীন সময়ে সে যখন জানতে পারে কতলু খাঁর অন্তপুরে বন্দি রয়েছে প্রেমিকা, তারও দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে সে নিশ্চয় সেই পাঠান দুর্বৃত্তের উপপত্নী হয়ে অবস্থান করছে৷ মুহূর্তে সেই সীমাহীন ভালোবাসা রূপান্তরিত হয় তীব্র ঘৃণায়৷ যাকে পাওয়ার জন্য একদিন সে জীবনপণ করতে দ্বিধা করেনি সেই আবার অন্য প্রতিজ্ঞা করে প্রেমিকা বন্দিনী হওয়ার খবর পেয়ে—‘‘বিধর্ম্মীর উপপত্নীকে এ চিত্ত হইতে দূর করিব;’’ মনে মনে গুরুদেবকে স্মরণ করে বার বার বলেছে—‘‘দেখ গুরুদেব! তুমি অন্তর্যামী, অন্তস্থল পর্য্যন্ত দৃষ্টি করিয়া দেখ, আর আমি তিলোত্তমার প্রণয়প্রার্থী নহি, আর আমি তাহার দর্শনাভিলাষী নহি৷’’১০ হায়রে নারীর সতীত্ব! ইচ্ছে-অনিচ্ছে কোনোভাবেই তা নাশ হলেই, শুধু নাশ নয় নাশ হওয়ার কল্পনা করেই সমাজ তাকে পতিত করে৷ অথচ কতলু খাঁর গৃহে বন্দি রয়েছে জগৎ সিংহ নিজেও এবং রাত-দিন কতলু খাঁর কুমারী কন্যা আয়েষার সেবা গ্রহণ করেও নিজেকে পতিত ভাবে না৷ এই উপন্যাসে বীরেন্দ্র সিংহ, জগৎ সিংহ প্রমুখের ভাবনার মধ্য দিয়ে সমাজে অসতী বা গণিকা নারীরা যে কতটা ঘৃণ্য ছিল তা অনুমান করা যায়৷ এখানে নারীর দৈহিক শুদ্ধতার প্রতি নজর দিয়ে কোন পরিস্থিতিতে তাদের সতীত্বের হানি হচ্ছে সে দিকে দৃষ্টিপাত পর্যন্ত করে না৷

এছাড়া কতলু খাঁর অন্তঃপুরে ভোগ বিলাসচিত্র, তার লাম্পট্য, নারীলোলুপতা ইত্যাদি থেকেও স্পষ্ট হয় অভিজাত সমাজের গণিকা তোষণের চিত্র৷ সেখানেও পুরুষের প্রবৃত্তির জ্বালা মেটানোর জন্য তাদের যন্ত্রবৎ ব্যবহার করা হয়েছে৷ তাদের প্রতি কোনো মানবিক আবেদনের অবকাশ রাখেননি রচনাকার৷

মতিবিবি বা লুৎফউন্নীসা ‘কপালকুণ্ডলা’ উপন্যাসের স্বৈরিণী৷ তার পূর্বনাম পদ্মাবতী৷ বাল্য থেকেই সে স্বাধীন প্রবৃত্তির এবং উচ্চাকাঙ্খী যার জন্য স্বামীর অনুগামিনী হয়ে স্বামী সেবার দ্বারা জীবন অতিবাহিত করা তার পক্ষে দুষ্কর হয়েছিল৷ ফলস্বরূপ বাল্য বয়সেই স্বামী পরিত্যাগ করেছিল সে৷ পদ্মাবতীর বাবা রামগোবিন্দ ঘোষালের মধ্যেও ছিল দুর্দমনীয় উচ্চাকাঙ্খা৷ এই উচ্চাকাঙ্খা তাকেও স্বাধীন প্রবৃত্তির করে তুলেছিল যা রক্তবাহিত হয়ে আত্মজার মধ্যে বহমান হয়েছিল বোধ হয়৷ এবার যদি প্রশ্ন আসে যে রামগোবিন্দ ঘোষাল তো পুরুষ মানুষ তার আবার পরাধীনতা কোথায়? তার উত্তরে বলা যায় যে প্রত্যেকটি মানুষই কোনো না কোনো শক্তির বশীভূত থাকে যা তাকে, তার ইচ্ছেকে নিয়ন্ত্রণ করে৷ সেগুলো ধর্ম, বিবেক ইত্যাদিও হতে পারে৷ পদ্মাবতীর পিতা এই সকল দিক থেকেও স্বাধীন৷ তাই উচ্চ পদ অর্থ প্রতিপত্তির আশায় বিবেক-বুদ্ধি-ধর্ম বিসর্জন দিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে৷ সেখানেই থেমে না থেকে আরও বেশি কিছু পাওয়ার আশায় স্বদেশ ত্যাগ করে আগ্রা চলে যায়৷ পিতা ধর্মান্তরিত হলে তার সঙ্গে ধর্মান্তরিত হয়ে যায় কন্যাও৷ তার নাম হয় লুৎফউন্নীসা৷ ক্রমে পিতা আগ্রার প্রধান ওমরাহদের একজন হয়ে উঠলে যৌবনবতী লুৎফউন্নীসা পারসিক, নৃত্য, গীত ইত্যাদিতে পারদর্শী হয়ে রাজধানীর অসংখ্য গুণবতী ও রূপবতীদের একজন হয়ে উঠে৷ নানা শিক্ষায় সে শিক্ষিত হয় ঠিকই কিন্তু ধর্মশিক্ষা, বা নীতিশিক্ষা যা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করবে সে শিক্ষা অর্জন করার সৌভাগ্য সে পায়নি৷ ফলে ইন্দ্রিয় দমন করার ক্ষমতা হারিয়ে প্রবৃত্তির দাস হয়ে কুৎসিত যৌনাচারে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়৷ তার উশৃঙ্খলতা এতটাই দুর্দমনীয় হয়ে উঠে যে লুৎফউন্নীসার বিবেকবোধ বর্জিত পিতাও তাকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়৷ তার বিবাহ এবং পূর্বস্বামী যে জীবিত একথা কারও অজানা নয়, তাই শরীরকে ভোগ করতে পারলেও বা রক্ষিতা হিসেবে তার সঙ্গে জীবন অতিবাহিত করতে পারলেও কেউ তাকে বিয়ে করতে চায় না৷ তারও প্রবৃত্তি দমন করে কারও স্ত্রী হয়ে জীবন কাটানোর ইচ্ছা বিন্দুমাত্র ছিল না৷ তাই আমীর-ওমরাহরা তাকে বিবাহ করতে অস্বীকৃত হলে সে মনে মনে ভাবে ‘‘কুসুমে কুসমে বিহারিণী ভ্রমরীর পক্ষচ্ছেদ কেন করাইব?’’১১ সে যা ভেবেছে তাই করেছে৷ নিজের জীবন-যৌবনকে বহুপুরুষের পায়ে দলিত করে আত্মসুখ লাভ করেছে৷ এখানেই যদি শেষ হয়ে যেত মতিবিবির উপাখ্যান তাহলে তার জন্য উদ্বেগের কোনো কারণ ছিল না৷ লেখক আরও এগিয়ে নিয়ে গেছেন তার কাহিনিকে৷ যেখানে সে আত্মদহনে পীড়িত হয়েছে; সমাজ তাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েছে৷ এই উশৃঙ্খল ইন্দ্রিয়পরায়ণ স্বৈরিণীর মনে প্রেমের সঞ্চার ঘটেছে বর্ধমানে যাওয়ার পথে সস্ত্রীক তার পূর্ব স্বামীকে দেখে৷ স্বামীর পায়ে স্থান পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে সে৷ কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়! সমাজ তাকে সবই দিয়েছিল৷ সে-ই তো তার মর্যাদা রাখতে পারেনি৷ স্বামী সংসারের মুখে পদাঘাত করে নাম লিখিয়েছে অসতীদের খাতায়৷ অসতীর স্থান সমাজে কোথায়! তাই স্বামী নবকুমার সতীর অনুসরণ করলে সমাজপতিত পদ্মাবতী পতিতই থেকে যায়৷

রচনাকার মতিবিবি বা লুৎফউন্নীসা বা পদ্মাবতীর যতটুকু পরিচয় উদ্ঘাটন করেছেন ততটুকুই তার চরিত্র বিশ্লেষণের পক্ষে যথেষ্ট৷ তার পিতা, পরিবেশ, শিক্ষা, রুচি সব এক যোগে তাকে অধঃপতিত করেছিল৷ স্নেহে রসসিক্ত করে শাসনের ডোরে কেউ কোনোদিন বাঁধেনি বা জীবনে ভালো সংস্পর্শ পেয়েছে বলেও উপন্যাসের কোথাও দেখা যায় না৷ পিতার স্বভাব বৈশিষ্ট্য জন্মসূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিল পদ্মাবতী যা তাকে পরবর্তী জীবনে ইন্দ্রিয় পরবশ ও উশৃঙ্খল হতে সাহায্য করে৷ এছাড়া লেখক স্পষ্ট করেই বলেছেন যে দুর্ভাগ্যবশতঃ বিদ্যাসম্বন্ধে যতটা শিক্ষা হয়েছিল—‘‘ধর্ম্ম সম্বন্ধে তাঁহার কিছুই হয় নাই৷’’১২ অর্থাৎ ধর্মশিক্ষা বা নীতি শিক্ষা কিছুই পায়নি সে৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে তার পরিবার, পরিবেশ, ইত্যাদি কোনো না কোনোভাবে তাকে বহুগামীতায় পর্যবসিত করেছে৷ এই পরিবার-পরিজন পরিবেশও যে মানুষের চরিত্র গঠনে, জীবন নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা অর্জনে কতটা সহায়ক তা ‘শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত’-এ কুমারী শ্রীমতি মানদা দেবী সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন—‘‘আমি সুশিক্ষা ও সৎসঙ্গ কিছুই পাই নাই৷ স্কুলে শিক্ষার ফলে কাব্য-কবিতা-গল্প উপন্যাস প্রভৃতি তরল সাহিত্যই পড়িতে শিখিয়াছি৷ তাহাতে আমার হৃদয়ে কল্পনার উত্তেজনায় দুষ্প্রবৃত্তিই সকলের আগে মাথা তুলিয়া উঠিয়াছে৷ সদগ্রন্থ কখনও পড়ি নাই—যাহাতে সংযম শিক্ষা হয়, যাহাতে ধর্মভাবের উদয় হয় এমন কোন পুস্তক কেহ আমার হাতে দেয় নাই৷ আমোদ-প্রমোদ যাহা ভোগ করিয়াছি, তাহা সমস্তই অতি নিম্ন স্তরের৷’’১৩ মানদা সম্ভ্রান্ত ঘরে রাজকীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বড় হয়েও প্রবৃত্তির তাড়নায় বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করেছে৷ তার ইন্দ্রিয়পরায়ণতা শতমুখে প্রবৃত্তির অগ্নি উদ্গার করে সেই পাপ পথে টেনে নিয়ে গেছে৷ এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য—‘‘আমাকে টানিয়া রাখিবার জন্য শাসন, মাতৃস্নেহ, আদর যত্ন ছিল না৷ আজ মনে হয়, আমার মা বাঁচিয়া থাকিলে হয়ত এ-পথে আসিতাম না৷ আমার বাবা যদি একদিনও একটু আদর করিয়া আমার দিকে মুখ তুলিয়া চাহিতেন, অথবা শাসন করিতেন তবে বোধ হয় এ জীবনের গতি ফিরিয়া যাইত৷’’১৪ তাহলে দেখা যাচ্ছে যে কারণে মানদা দেহবৃত্তির আকণ্ঠ পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছিল পদ্মাবতীর স্বেচ্ছাচারের পিছনেও প্রায় সেই একই কারণ৷ কায়িক সুখ, অর্থ খাবার ইত্যাদির জন্যেই যে মেয়েরা পতিতা হয় তা নয়, পরিবারের অসচেতন ঔদাসীন্যেও বহু নারী দেহজীবিকার পথে পা বাড়ায়৷ সমাজ পরোক্ষভাবে সে পথে যাবার জন্য ইন্ধন জোগালেও পরে তার কোনো দায় গ্রহণ করে না৷ তাই পদ্মাবতী সমাজের চোখে পতিতা ও ঘৃণিতা৷

হীরাকে দেবেন্দ্রনাথ কুন্দকে প্ররোচিত করার জন্য না লাগালে বা তার সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করে যৌনাচারে লিপ্ত না করালে হীরা পতিত হত না৷ হীরা ‘বিষবৃক্ষ’-এর সবচেয়ে জটিল চরিত্র৷ ঈর্ষায়-প্রতিহিংসায়-বুদ্ধিচাতুর্যে-আত্মগর্বে-প্রেম-প্রণয়-ব্যর্থতায় উজ্জ্বল করে রচনা করেছেন তাকে তার রচয়িতা৷ হীরার মধ্যে লক্ষণীয় কিছু দিক হল ধনীর বিরুদ্ধে দারিদ্র্যের এক গুঢ় অভিমান এবং অকারণ বিদ্বেষ৷ সেই কারণে সে সূর্যমুখীর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে৷ দেবেন্দ্রর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে এই আত্মাভিমান ও কঠোর সংযম তাকে প্রেমের পথেও অগ্রসর হতে দেয়নি৷ দেবেন্দ্রকে দেখার পর তার যৌবনের ঝরণাধারা প্রেমের আবেগে উছলে উঠে৷ আর যখনই তার মনে প্রেম জাগ্রত হয়েছে সেই মুহূর্তেই মদ্যপ-লম্পট দেবেন্দ্র তাকে দাসী ভেবে কুন্দের প্রতি তার অনুরাগ ব্যক্ত করেছে এবং তাকে পাওয়ার বিষয়ে হীরারই সাহায্যপ্রার্থী হয়েছে৷ তার ধনী বিদ্বেষের মধ্যে এতদিন কুন্দ অনুপস্থিত ছিল কিন্তু দেবেন্দ্রর অভিসন্ধি জানার পর কুন্দের প্রতিও এক বিজাতীয় হিংসায় ভেতরে ভেতরে গর্জাতে থাকে৷ ধীরে ধীরে দেবেন্দ্রর সঙ্গে তার সম্পর্ক জটিলরূপ ধারণ করে৷ হীরার কোন এক আবেশ-বিহ্বল মুহূর্তে দেবেন্দ্রর প্রতি গোপন ভালোবাসা মুখের ভাষায় প্রকাশিত হওয়ার পর তার যখন চৈতন্য হয় তখন যেন তার মাথা ঘুরে যায়৷ প্রাণপণে দেবেন্দ্রকে ঘর থেকে চলে যেতে বলে কারণ সে জানে দেবেন্দ্র লম্পট; কোনো যুবতী নারীর শরীর উপভোগ করার সুযোগ পেলে সে সুযোগের সৎব্যবহার না করে ছাড়ে না এবং মদের আসরে ইয়ারবন্ধুদের সকাশে তা রসিয়ে রসিয়ে প্রকাশ করতেও তার বাঁধে না৷ ‘‘আপনি যুবতী স্ত্রী হাতে পাইলে কখন ছাড়েন না, এজন্য আমার পূজা গ্রহণ করিলেও করিতে পারেন, কিন্তু কালে আমাকে হয়ত ভুলিয়া যাইবেন, নয়ত যদি মনে রাখেন, তবে আমার কথা লইয়া দলবলের কাছে উপহাস করিবেন—এমন স্থানে কেন আমি আপনার বাঁদী হইব?’’১৫ সে স্পষ্টভাবেই স্বীকার করেছে যে দেবেন্দ্রনাথের দেবকান্তি রূপ দেখে সে তাকে ভালোবেসেছে৷ সে ভালোবাসা তার একান্ত নিজের৷ সে তার জন্য দেবেন্দ্রকে শরীর দিতে পারবে না৷ তারপরেও সে আরও ভালো করে জানে যে সে তাকে ভালোবাসেনা—মুগ্ধ কুন্দর প্রতি এবং যদি তাকে গ্রহণ করে তাহলে শরীরী ক্ষুধা মেটানোর জন্যই করবে তাই শুধুমাত্র কাম পূরণের জন্য ভালোবাসা থাকা সত্ত্বেও তার অঙ্কশায়িনী হয়ে কুলটা হতে পারবে না৷ হীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করলেও ভাবী মিলনের সম্ভাবনার আশা দিয়ে দেবেন্দ্রর কামপ্রবৃত্তি বিমোচনের একটা পথ খোলা রাখে৷ সে বলে—‘‘কিন্তু যে দিন আপনি আমাকে ভালবাসিবেন, সেই দিন আপনার দাসী হইয়া চরণসেবা করিব৷’’১৬ হীরার সমস্ত কথা আচার-আচরণ অনুধাবন করে লম্পট দেবেন্দ্র মনে মনে ভাবে—‘‘আমি তোমাকে চিনিলাম, এখন কলে নাচাইতে পারিব৷ যেদিন মনে করিব, সেই দিন তোমার দ্বারা কার্য্যোদ্ধার করিব৷’’১৭

দেবেন্দ্র হীরাকে পুত্তলিবৎ পরিচালিত করতে চেয়েছিল কিন্তু হীরার জটিল মনস্তত্ত্বকে অনুধাবন করতে পারেনি৷ তাই হীরার দ্বারা কুন্দনন্দিনীর সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য নগেন্দ্রনাথের বাড়িতে উপস্থিত হলে হীরার প্ররোচনায় দ্বারোয়ান দ্বারা চরম অপমানিত হয়ে প্রতিজ্ঞা করে হীরাকে তার প্রতিফল অবশ্যই ভোগ করাবে৷ গুরুতর প্রতিফলই প্রদান করেছিল দেবেন্দ্র৷ বলা হয় নারীজাতির সতীত্বের বড় রত্ন নেই; দেবেন্দ্র সেই সতীত্বই লুন্ঠন করেছিল৷ তবে বলপূর্বক নয়; বুদ্ধি খাটিয়ে৷ সে জানতো হীরা তাকে ভালোবাসে, সে জানতো তার প্রণয় আহ্বান হীরা কিছুতেই উপেক্ষা করতে পারবে না৷ তাই প্রেমেরই ফাঁদ পাতে তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য৷ মালতী নামের এক স্ত্রী দ্বারা হীরাকে আহ্বান করলে দুই-একদিন ইতস্তত করার পর সে ধরা দেয়৷ দেবেন্দ্রর সেই প্রণয়ফাঁদ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়ে রচনাকার বলেছেন—‘‘দেবেন্দ্র কিছুমাত্র রোষ প্রকাশ করিলেন না—ভূতপূর্ব্ব ঘটনার কোন উল্লেখ করিতে দিলেন না৷ সে সকল কথা ত্যাগ করিয়া তাহার সহিত মিষ্টালাপে প্রবৃত্ত হইলেন৷ যেমন ঊর্ণনাভ মক্ষিকার জন্য জাল পাতে, হীরার জন্য তেমনি দেবেন্দ্র জাল পাতিতে লাগিলেন৷ লুদ্ধাশয়া হীরা-মক্ষিকা সহজেই সেই জালে পড়িল৷ সে দেবেন্দ্রর মধুরালাপে মুগ্ধ এবং তাহার কৈতববাদে প্রতারিত হইল৷ মনে করিল, ইহাই প্রণয়; দেবেন্দ্র তাঁহার প্রণয়ী৷’’১৮ সে দেবেন্দ্রর বাহুমূলে নিজেকে সম্পূর্ণ সঁপে দিল৷ এক লম্পটের পায়ে নিজের মহামূল্যবান সতীত্ব বিসর্জন দিয়ে পদাঘাতে তার প্রমোদ উদ্যান থেকে বিতাড়িত হয় হীরা৷ বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন—‘‘হীরা পাপিষ্ঠা—দেবেন্দ্র পাপিষ্ঠ এবং পশু৷ এইরূপ উভয়ের চিরপ্রেমের প্রতিশ্রুতি সফল হইয়া পরিণত হইল৷’’১৯ হীরাও এই অপমানের শোধ নিয়েছে দেবেন্দ্রর মানসী কুন্দনন্দিনীকে বিষ খাইয়ে মেরে৷ শেষে উন্মাদিনী বেশে শতচ্ছিন্ন মলিন বসন পড়ে রুক্ষ কেশে এবং অযত্ন লাঞ্ছিত খড়ি উঠা দেহ নিয়ে দেবেন্দ্রর মৃত্যুর পূর্বে তার সামনে গিয়ে সকল কথা ব্যক্ত করে দেবেন্দ্রনাথের তার পা ধরে গাওয়া সেই প্রণয়সম্ভাষণ উচ্চস্বরে কীর্তন করেছে—

 ‘‘স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং

 দেহি পদপল্লবমুদারং৷’’২০

সমগ্র উপন্যাসটি অধ্যয়ন করলে সহজেই বোঝা যায় কীভাবে হীরার মতো দাসীবৃত্তি করা এক নারী শেষ পর্যন্ত প্রলোভিত হয়ে পতিত হয়৷ বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং তাকে ‘পাপিষ্ঠা’ বলে উল্লেখ করেছেন৷ তার সতীত্ব হারানোর পাপের শাস্তি দিয়ে লেখক তাকে উন্মাদিনী করে পথে ছেড়ে দিয়েছেন৷ হীরার সেই সাময়িক দুর্বলতাকেও ক্ষমা করতে পারেননি নীতিবাদী লেখক৷

‘কৃষ্ণকান্তের উইল’-এ পতিত হয়েছে রোহিণী৷ বালবিধবা সে৷ রূপবতী এই বিধবার গুণের অন্ত্য নেই৷ গৃহকন্নার সবরকম কাজ, নানাধরনের হাতের কাজ, সেলাইকাজ, রন্ধনবিদ্যা, চুলবাঁধা কি জানে না সে৷ রচনাকার তাকে সর্বগুণবতী বলে তুলে ধরতে চেয়েছেন৷ আবার রোহিণীর দোষও অনেক৷ সে কালোপেড়ে ধুতি পরতো সাদা থানের বদলে, নিরাভরণ না থেকে হাতে চুড়ি পড়তো, পান খেয়ে ঠোঁট রাঙা করে রাখতো৷ এই কালোপেড়ে শাড়ি পরা, হাতে চুড়ি পরা এবং পান খাওয়ার মধ্য দিয়ে তার মধ্যে সমাজ বিধিকে অমান্য করার প্রবণতা শুরু থেকেই যেন ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন রচয়িতা৷ তার বৈধব্য এবং অপ্রয়োজনীয় রূপ (যা কি না পুরুষের সেবায় লাগতে পারবে না কোনোদিন) নিয়ে সর্বদাই অনুতপ্ত সে৷ তাই ভাগ্যের বঞ্চনায় ক্রন্দন করতে করতে সে বলে—‘‘কি অপরাধে এ বালবৈধব্য আমার অদৃষ্টে ঘটিল? আমি অন্যের অপেক্ষা এমন কি গুরুতর অপরাধ করিয়াছি যে, আমি এ পৃথিবীর কোন সুখভোগ করিতে পাইলাম না৷ কোন দোষে আমাকে এ রূপ যৌবন থাকিতে কেবল শুষ্ক কাষ্ঠের মত ইহাজীবন কাটাইতে হইল? যাহারা এ জীবনের সকল সুখে সুখী—মনে কর, ঐ গোবিন্দলালবাবুর স্ত্রী—তাহারা আমার অপেক্ষা কোন গুণে গুণবতী—কোন পুণ্যফলে তাহাদের কপালে এ সুখ—আমার কপালে শূন্য?’’২১

রোহিণী জীবনরসিক৷ জীবনকে সে সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করতে চায় কিন্তু পথ নেই৷ তার মনের সেই সুপ্ত আশার মূলে বিধবা বিবাহের কথা বলে জলসিঞ্চন করে হরলাল৷—

‘‘রো৷ আপনার স্ত্রীর নামে সেই বিধবাবিবাহের কথা মনে পড়িল৷ আপনি না কি বিধবাবিবাহ করিবেন?

হর৷ ইচ্ছা ত আছে—কিন্তু মনের মত বিধবা পাই কই?…

হর৷ দেখ রোহিণী, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত৷

রো৷ তা ত এখন লোকে বলিতেছে৷

হর৷ দেখ, তুমিও একটা বিবাহ করিতে পার—কেন করিবে না?…

দেখ, তোমাদের সঙ্গে আমাদের গ্রাম সুবাদ মাত্র—সম্পর্ক বাধে না৷’’২২

হরলাল কৃষ্ণকান্তের জেষ্ঠ্যপুত্র৷ তার সেই কথা রোহিণী বিশুষ্ক অন্তরে শ্রাবণের মেঘ নিয়ে আসে৷ যদিও সে জানে হরলাল অসৎ৷ তাকে দিয়ে উইল পরিবর্তিত করিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ হলে সে কথা নাও রাখতে পারে৷ কিন্তু তারপরেও তৃষ্ণা যে অসীম! যে কোনোভাবেই সেই তৃষ্ণার পরিতৃপ্তি চায় সে৷ হরলালের কথামত কাজও করে সে কিন্তু তার সঙ্গে ঝগড়া করে সেই আসল উইল হরলালের হাতে তুলে দেয় না৷ তারপর রোহিণীর জীবনে আসে দ্বিতীয় পুরুষ গোবিন্দলাল৷ গোবিন্দলালের প্রতি হৃদয়ের টান প্রথম অনুভব করেছিল রোহিণীই৷ তার ভেতরকার সেই অবরুদ্ধ কামনা—যেখানে হরলাল ঢিল ছুড়ে দুলিয়ে দিয়ে গেছে; গোবিন্দলালকে দেখে তা সহস্র গুণে আলোড়িত হতে থাকে৷ বারুণীর পুকুরঘাটে জল আনতে গিয়ে গোবিন্দলালের মিষ্ট ব্যবহারে সে প্রণয়পিপাসায় অস্থির হয়ে উঠে৷ সে জানে চরিত্রবান গোবিন্দলাল ঘুণাক্ষরেও তার মনের কথা জানতে পারলে গ্রামছাড়া করে ছাড়বে—তারপরেও মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না৷ প্রেমাস্পদকে দেখার জন্য মনে অস্থির পদবিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়৷ অবশেষে হৃদয়ের দায়ভার বহন করতে না পেরে নিজের মৃত্যুকামনা করতে থাকে৷ মৃত্যু তো সহজ নয়৷ আর যার জীবনের আশা প্রবল সে মরতে চাইলেও সহজে মরতে পারে না৷ এই দুশ্চিন্তার মাঝে আরেক বড় দুশ্চিন্তা—উইল৷ সে নিজের হাতে আসল উইল সরিয়ে হরলালের দেওয়া জাল উইল রেখে এসেছে—যেখানে গোবিন্দলালের প্রাপ্য শূন্য৷ সে উইল সরাতে না পারলে গোবিন্দলাল যে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে তা বিচিত্র কি৷ কৃষ্ণকান্তের মৃত্যু হলে সেই জাল উইলই আসল উইল বলে চালিত হবে আর সেই আসল উইল যা সে হরলালকে না দিয়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছে তা জাল বলে প্রমাণিত হবে৷ উপরন্তু তার কাকা ব্রহ্মানন্দ ঘোষও নিস্তার পাবে না৷ এতসব চিন্তা করে পুনরায় সে উইল পাল্টাতে যায়৷ কার্য সিদ্ধি হয় বটে কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না৷ ধরা পড়ে যায়৷ বিচারে যখন চরম অপদস্ত হতে থাকে তখন গোবিন্দলালের তৎপরতায় রক্ষা পায় এবং নির্জনে গোবিন্দলালের জিজ্ঞাসাবাদে নিজের হৃদয়ের কথা ব্যক্ত করে—‘‘কি? ইহজন্মে বলিতে পারিব না—কি৷ আর কিছু বলিবেন না৷ এ রোগের চিকিৎসা নাই—আমার মুক্তি নাই৷ আমি বিষ পাইলে খাইতাম৷ কিন্তু সে আপনার বাড়ীতে নহে৷’’২৩ গোবিন্দলালকে তার মনের ভাব বোঝাতে পেরে নিজেকে হাল্কা মনে করেছে সে৷ গোবিন্দলাল কথাচ্ছলে স্ত্রী ভ্রমরকে রোহিণীর তাকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দিলে বালিকা স্বভাবা ভ্রমর ক্ষীরি দাসীকে দিয়ে রোহিণীকে মৃত্যুর বার্তা পাঠায়৷ রোহিণী নিজেও বোঝে তার নিজের জীবন কতটা যন্ত্রণাময় হয়ে উঠেছে৷ তার নিজের পক্ষেও সেই গুরুভার বহন করা অসম্ভব হলে সে বারুণীর পুকুরে ডুবে মরার চেষ্টা করে৷ পুকুরের স্বচ্ছ জলতল থেকে দীব্যকান্তি রোহিণীকে উদ্ধার করে তার ‘ফুল্লরক্তকুসুমকান্তি অধরযুগলে ফুল্লরক্তকুসুমকান্তি অধরযুগল স্থাপিত করিয়া’২৪ মুখে ফুৎকার দিয়ে গোবিন্দলাল তার জীবন বাঁচালে যৌবনের অসহ্য যন্ত্রণাকে ব্যক্ত করতে সে বলে—‘‘রাত্রিদিন দারুণ তৃষ্ণা, হৃদয় পুরিতেছে, সম্মুখেই শীতল জল, কিন্তু ইহজন্মে সে জল স্পর্শ করিতে পারিব না৷ আশাও নাই৷’’২৫ নানা কুৎসা, অপভাষণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে তার ও গোবিন্দলালের প্রেম যেন আরও বেশি ইঙ্গিতময় হয়ে উঠেছে৷ শেষ পর্যন্ত নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে গোবিন্দলালকে পেয়েছে সে৷ নিজ এলাকা থেকে বহুদূরে প্রসাদপুরে দুজনে ভালোবাসার নীড় রচনা করেছে৷ কিন্তু সত্যিই কি সেখানে ভালোবাসা ছিল! সে গোবিন্দলালকে চেয়েছিল, পেয়েছে৷ কিন্তু তার মর্যাদা সেখানে কি৷ রক্ষিতা ছাড়া তো অন্য কিছু মনে হয় না৷ যে দুর্বার প্রেম পিপাসা তাকে দুঃসাহসী করে নারীমনের সংস্কার পরিত্যাগ করে প্রেমিকের সামনে হৃদয় উন্মোচন করতে বাধ্য করেছিল; যে দুর্দমনীয় প্রেমভার বহন করতে না পেরে বারুণীর জলে আত্মহত্যার শয্যা পেতেছিল, সেই প্রেম কেনই বা তা হলে এক বছরের মধ্যে বিরক্তির স্তরে নেমে আসে! রোহিণীর জীবনে নতুন পুরুষের প্রয়োজনই বা কেন দেখা দেয়!

গোবিন্দলালের শ্বশুর জামাতাকে সৎপথে ফিরিয়ে এনে মেয়ের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তার রূপবান বন্ধু রাসবিহারী দে কে পাঠায় রোহিণী-গোবিন্দলালের সংসারে৷ সে নিশাকর দাস ছদ্মনামে ভ্রমরের বিষয়ের ভাবী পত্তনিদার হয়ে প্রায় জোর করে গোবিন্দলালের সম্মুখে উপস্থিত হয়৷ আড়াল থেকে নিশাকর দাস নামের সেই যুবককে দেখে পুনরায় রোহিণীর মনে মোহের সঞ্চার হয়৷ চাকরকে বশ করে তার সঙ্গে গোপন সাক্ষাতের ব্যবস্থাও করে ফেলে৷ নিশাকর দাসকে দেখে রোহিণীর যে মনোভাব লেখক প্রকাশ করেছেন তা নিঃসন্দেহে একজন বহুভোগ্যার আচরণকে ইঙ্গিত করে—‘‘রোহিণী যে ব্রহ্মানন্দকে এত ভালবাসিত যে, তাহার সংবাদ লইবার জন্য দিগ্বিদিগজ্ঞানশূন্য হইবে, এমন খবর আমরা রাখি না৷ বুঝি আরও কিছু ছিল৷ একটু তাকাতাকি, আঁচাআঁচি হইয়াছিল৷ রোহিণী দেখিয়াছিল যে, নিশাকর রূপবান—পটোলচেরা চোখ৷ রোহিণী দেখিয়াছিল যে, মনুষ্যমধ্যে নিশাকর একজন মনুষ্যত্বে প্রধান৷’’২৬ রোহিণীর মনে মনে সংকল্প ছিল ‘‘আমি গোবিন্দলালের কাছে বিশ্বাসহন্ত্রী হইব না৷ কিন্তু বিশ্বাসহানী এক কথা—অর এ আর এক কথা৷ বুঝি সেই মহাপাপিষ্ঠা মনে করিয়াছিল, ‘‘অনবধান মৃগ পাইলে কোন ব্যাধ ব্যাধব্যবসায়ী হইয়া তাহাকে না শরবিদ্ধ করিবে?’’ ভাবিয়াছিল নারী হইয়া জেয় পুরুষ দেখিলে কোন নারী না তাহাকে জয় করিতে কামনা করিবে?’’২৭ তারপরে নির্দিষ্ট সময়ের কিছু বিলম্বে সংকেত স্থানে পৌঁছলে নিশাকরের ছদ্ম অভিমানের কৈফিয়ত দিয়ে যে বক্তব্য পেশ করে তাতেও তার বহুচারিণী মানসিকতাটি সুস্পষ্ট হয়ে উঠে—‘‘আমি যদি ভুলিবার লোক হইতাম, তা হলে, আমার দশা এমন হইবে কেন? একজনকে ভুলিতে না পারিয়া এ দেশে আসিয়াছি; আর আজ তোমাকে না ভুলিতে পারিয়া এখানে আসিয়াছি৷’’২৮ ঘটনাক্রমে গোবিন্দলাল অকুস্থলে উপস্থিত হয়ে রোহিণীর কাহিনিতে চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে আসে৷ পিস্তল উঠিয়ে তাকে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে বললে তার মুখে উচ্চারিত হয় বেঁচে থাকার চিরকালীন আর্তি—‘‘মারিও না! মারিও না! আমার নবীন বয়স, নূতন সুখ৷ আমি আর তোমায় দেখা দিব না, আর তোমার পথে আসিব না৷’’২৯ তার এই কাতর অনুনয় ছাপিয়ে গোবিন্দলালের পিস্তল গর্জে উঠে৷ নবীন বয়স, নতুন আশার একবুক স্বপ্ন নিয়ে রোহিণী চিরতরে লুপ্ত হয়ে যায়৷

বঙ্কিমচন্দ্র যে মানবিকতা দিয়ে, যে সহানুভূতি দিয়ে রোহিণীকে উপন্যাসের প্রারম্ভে অঙ্কন করেছিলেন উপন্যাসের শেষে সেই সহানুভূতি সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হয়ে চরম ঘৃণায় পর্যবসিত হয়েছে৷ সেই ঘৃণা এতটাই প্রবল যে তাকে পৃথিবীর আলো-বাতাসের মধ্যে জীবন্ত রাখাও নিরাপদ মনে করেননি৷ একজন বালবিধবা রমণী যে যৌবনের মধুমাসে শরীরী উন্মাদনায় দিশেহারা হয়ে উঠবে তা মানব-শরীরের স্বাভাবিক ধর্ম৷ অথচ পুরুষ সঙ্গ সে পায়নি—পাবার সম্ভাবনাও সমাজ তার জন্য রাখেনি৷ কিন্তু উপচে পড়া রূপ, অতুলনীয় গুণরাশি কোনো কিছুরই অভাব নেই তার৷ হরলাল তার অতৃপ্ত বাসনায় বারুদ নিক্ষেপ করে যায়; গোবিন্দলালের সংস্পর্শে সেই বারুদে অগ্নিসংযোগ ঘটে৷ সেই বিস্ফোরণে প্রণয়ীর হাত ধরে ঘরের বার হতেও তার বাধে না৷ প্রসাদপুরে প্রায় একবছর সময় অতিবাহিত করে তার সঙ্গে৷ সেখানে কতটা আত্মতৃপ্তি লাভ করেছিল গোবিন্দলালের সঙ্গে সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে৷ নইলে গোবিন্দলালের সঙ্গে থেকেও নিশাকরের প্রতি মুগ্ধ হতে যাবে কেন? নাকি গোবিন্দলালের রক্ষিতা হয়ে জীবন কাটাতে গিয়ে সে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল? রোহিণী কেন শেষ পর্যায়ে গিয়ে অমন আচরণ করল তা নিয়ে নানাজনে নানান ব্যাখ্যা দিয়েছেন৷ নীতিবাগীশ বঙ্কিমের বিধবার নিজের ব্রতধর্ম ভুলে পরপুরুষের অনুরক্তি ও শেষে কুলটা হওয়া মেনে নেওয়া হয়তো সম্ভব হয়নি৷ তাই যতদূর সম্ভব নীচে নামিয়ে তাকে বেশ্যার সমগোত্রীয় করে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়ে আাত্মতৃপ্ত হয়েছেন৷ তাঁর মতে রোহিণী পাপিষ্ঠা৷ আর সমাজে পাপিষ্ঠার কোন স্থান হয় না৷ বঙ্কিমের এই বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—‘‘পাপ-সম্বন্ধে বঙ্কিমের একটা সহজ সংকোচ, একটা স্বাভাবিক বিমুখতা ছিল; সুতরাং কোথাও তিনি ইহার সবিস্তার বর্ণনা করেন নাই, আধুনিক বাস্তব লেখকদের ন্যায় প্রতিদিনকার গ্লানি ও কলঙ্কচিহ্ন পুঞ্জীভূত করিয়া চিত্রকে মসীময় করিয়া তোলেন নাই, সর্ববিধ তথ্যবিস্তার সযত্নে বর্জন করিয়াছেন৷ কেবল পাপস্খলনের পূর্ববর্তী অবস্থাগুলিকে, আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও প্রাণপণ প্রলোভন-দমনের চেষ্টাটিকে সুরুচি ও রসজ্ঞানের নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ফুটাইয়া তুলিতে চাহিয়াছেন; পাপের পঙ্কিল প্রবাহের প্রত্যেক ক্ষুদ্র বীচিবিক্ষেপ, প্রত্যেক ক্ষণস্থায়ী আবর্তসৃজন অনুসরণ করেন নাই৷ কেবল স্বল্পকালব্যাপী চেষ্টার পর এই পঙ্কিল প্রবাহকে সূর্যালোকে তুলিয়া, তাহার পর এক অবিশ্রান্ত দ্রুতগতিতে তাহাকে মরণের উপকূলে লইয়া গিয়া, প্রায়শ্চিত্তপর্বতের শিখরদেশ হইতে মৃত্যুর অতল শূন্যতার মধ্যে ফেলিয়া দিয়াছেন৷’’৩০

অভিজাতগৃহের স্বেচ্ছাচারিণী রমণীদের তীব্র ইন্দ্রিয়পরায়ণতা বর্ণিত হয়েছে ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে৷ রৌশনারা, জাহানারা, জেব-উন্নীসা, উদিপুরী বেগম প্রভৃত নারী স্বেচ্ছাচারিতায় নিজেদের ডুবিয়ে রাখত৷ বঙ্কিম উপন্যাসে অভিজাতগৃহের উচ্চপদস্থ নন্দিনীদের বহুপুরুষগামিতা একটি চর্চিত বিষয়৷ তাদের বিলাস গৃহ বঙ্কিমের মতে জীবন্ত পাপাগার৷ এদের সম্পর্কে লেখক বলেছেন—‘‘এমন উর্ববশী মেনকা রম্ভার গর্ব্বখর্ব্বকারিণী সুন্দরীর সারি আর কোথাও নাই, এত ভোগবিলাস জগতে আর কোথাও নাই৷ এত মহাপাপ আর কোথাও নাই৷’’৩১ অভিজাত গৃহের এই রমণীরা রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যত বড় কৃতিত্বই দেখাক না কেন সমাজ তাদের অপযশই কীর্তন করেছে তাদের ইন্দ্রিয়াসক্তির জন্য এবং মস্তকে রাজমুকুটের তুলনায় কলঙ্কমুকুটই বেশি প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে৷

‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ হরিদাসের জবানিতে লেখা৷ এই রচনায় লেখক হরিদাসের মুখ দিয়ে সমাজের অন্যায়, অত্যাচার, কুরুচিকর আচরণ, অনৈতিক নীতিবোধ ইত্যাদি প্রকাশ করতে গিয়ে উত্থাপন করেছেন অজস্র স্বৈরিণী পতিতা দেহব্যবসায়ীর প্রসঙ্গ৷ এই উপন্যাসে ভদ্রপল্লীতে বেশ্যানিবাস নিয়ে যেমন সমালোচনা রয়েছে তেমনি রয়েছে নানা স্থানের দেহজীবী নারী তার সঙ্গে অপরাধজগতের যোগসূত্রের প্রসঙ্গ৷ সম্পূর্ণ নেতিবাচক দৃষ্টিতে গণিকাদের দেখানো হয়েছে যদিও চরিত্র হিসেবে স্বতন্ত্রভাবে কোনো বারযোষিৎ-এর কথা নেই এই রচনায়৷

হরিদাস কলকাতায় বসবাসের সময়ে চিৎপুর রোড ধরে বেড়াতে বেড়াতে গরাণহাটা থেকে কলুটোলা পর্যন্ত রাস্তায় লক্ষ করে রকমারি সজ্জা ও ভঙ্গিতে রকমারি মেয়েমানুষদের৷ বলাবহুল্য এরা দেহব্যবসায়ী নারীদল৷ তাদের দেখে বিস্ময়াপন্ন হয়ে যায় হরিদাস৷ কারণ সে পূর্বে কলকাতা শহরে গণিকাদের সংখ্যাধিক্যের কথা শুনেছিল৷ তারা যে পুরুষদের পক্ষে কতটা ক্ষতিকারক তা হরিদাসের জবানীতেই স্পষ্ট হয়—‘‘লোকমুখে শুনেছিলেম, কলিকাতা সহরে বেশ্যা অনেক; যে সকল পণ্ডিত সাধুভাষায় কথা কন, তাঁরা বলেন, বেশ্যা মানে নগরবিলাসিনী বারাঙ্গনা; সুখবিলাসী মতিচ্ছন্ন যুবাদলের চিত্তমোহিনী-বিলাসিনী; এরা সব জঘন্য বিলাস-রসিক যুবাপুরুষের ইহকাল পরকাল ভক্ষণ করে৷’’৩২ রচনাকার অনুকম্পাহীন দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করেছেন এই বারবিলাসিনীদের জীবনকে৷ তাদের প্রতি কোনো রকম মর্যাদা না রেখে যুবক-পুরুষদের ইহকাল-পরকাল ভক্ষণকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন৷ শুধু এখানেই নয় রচনাকার আরও বলেছেন—‘‘আকার-অবয়বে ঠিক মানবী, কিন্তু ব্যবহারে এরা জানবা—পিশাচী! কলিকাতা সহর কলুষে পরিপূর্ণ!’’৩৩ এই নারীশ্রেণীর প্রতিনিধিরা যে মানুষ, তাদেরও যে হৃদয় বলে পদার্থ থাকে এবং পরিস্থিতির পরিণতিতে এদের বেশিরভাগ অংশই যে বাধ্য হয়ে এই পেশাকে আঁকরে ধরে আছে সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করার প্রয়োজন মনে করেন না সমাজপ্রতিভূরা৷ শুধু তাই নয় এই পণ্য রমণীদের মানবিক অস্তিত্বটুকুকেও স্বীকার করতে চাননা ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’-র কথাকার তাই চূড়ান্ত অবজ্ঞায় বলতে পারে যে তারা আকার অবয়বে মানবী হলেও ব্যবহারে সম্পূর্ণ পিশাচী৷

এই সময় সমাজে গণিকারা সর্বোতভাবে ঘৃণিত হলেও, মানুষ হিসেবে মর্যাদা না পেলেও তাদের অবস্থান যে ভদ্রপল্লীর মধ্যেই ছিল তা হরিদাসের জবানিতেই স্পষ্ট৷ ‘‘কলিকাতার বেশ্যানিবাসের প্রণালীটী অতি জঘন্য৷ গৃহস্থের বাড়ীর কাছে বেশ্যা, ছেলেদের পাঠশালার পাশে বেশ্যা, ডাক্তার-কবিরাজের আবাসের পাশে বেশ্যা, কোথাও বা ভালমানুষের মাথার উপর বেশ্যা; অধিক কথা কি, ব্রাহ্ম-সমাজ-মন্দিরের আষ্টে-পৃষ্ঠে বেশ্যা৷’’৩৪ কিন্তু দেহ-পসারিণীদের তথাকথিত ভদ্রপল্লীতে সকলের সঙ্গে বসবাস নিয়ে যে সমাজ মধ্যে আলোড়ন শুরু হয়ে গেছে তা হরিদাসের ‘কলিকাতায় বেশ্যানিবাসের প্রণালীটী অতি জঘন্য’ কথাটুকুর মধ্য দিয়েই প্রমাণিত হয়৷ সমাজের প্রায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যেই গণিকাগমন প্রচলিত থাকলেও তাদের সকলের সঙ্গে বাস করার অধিকার নেই৷ তাদের প্রান্তিক মানুষে পরিণত করার চক্রান্ত এর বহুদিন আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল৷ ১৩.১১.১৮৫৬ সংবাদ প্রভাকরের একটি রিপোর্টে ভদ্রপল্লীতে এই শ্রেণীর নারীদের বসবাসের নিষেধাজ্ঞা সম্পর্কে বলা হয়—‘‘অভিনব পুলিস নিয়মের মধ্যে আমারদিগের ব্যবস্থাপক মহাশয়েরা নির্দ্ধারণ করিয়াছেন যে নগরের সকল পল্লীতে বেশ্যারা বাস করিতে পারিবেক না এবং এক পল্লী মধ্যে সকলের বাস হইবারও সম্ভাবনা নাই, এবং তাহারদিগের নিমিত্ত ভিন্ন ভিন্ন কয়েক পল্লী নিরূপিত হইবেক, সেই স্থানেই তাঁহারা অবস্থান করিবেক, দুর্জ্জন, দুরাত্মা, চোর, লম্পটেরা বেশ্যালয়েই অবস্থান করে, এবং সেই স্থানেই নানাপ্রকার অসদ্বৃত্তির আতিশয্য হয়, অতএব পুলিস প্রহরিরা বিশেষ সতর্কভাবে বেশ্যাপল্লীর তত্ত্বাবধারণ করিবেক, প্রধান শান্তিরক্ষকগণ সময়ে সময়ে ঐ সকল পল্লীর নিমিত্ত কঠিনতর নিয়মাদি নির্দ্ধারণ করিতে পারিবেন৷’’৩৫ ১৯.১১.১৮৫৬-তে সংবাদ প্রভাকরে বিদ্যোৎসাহিনী সভার সম্পাদক কালীপ্রসন্ন সিংহ নগরপ্রান্তে বেশ্যাদের বসতি স্থানান্তরের জন্য স্মারকলিপি জমা দেন৷ এছাড়াও এই সংবাদ প্রভাকরেই ১১.০৩.১৮৫৭, ০২.০৪.১৮৫৭, ১৪.০১.১৮৭৯, ২৫.০৪.১৮৬৯-এ ঢাকাপ্রকাশে, ১৫.০৯.১৮৭৪ তারিখে রাজসাহী সংবাদে, ১৮.০৯.১৮৮৫ এডুকেশন গেজেটে এবং এপ্রিল, ১৮৯৫ সেবক পত্রিকায় গণিকাদের স্বতন্ত্র পল্লিতে সরানোর দাবিতে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ পায়৷ তথাকথিত ভদ্রসমাজ থেকে তাদের সরানোর জন্য সমাজপ্রভূদের যে দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টা ছিল তা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলি থেকেই স্পষ্ট৷ নীতিবোধ পরায়ণ হরিদাস কলকাতায় সকলের সঙ্গে বেশ্যাবাসের কুফল সম্পর্কে যা বলে—‘‘যে সহরের এমন দৃশ্য সে সহরের পরিণাম কি হবে, সহরবাসী ভদ্রলোকেরা সেটা কি একবারও চিন্তা করেন না?’’৩৬ তাতে যেন সুবিধাভোগী নীতিবাগীশ পুরুষসমাজের কথার প্রতিধ্বনিই শোনা যায়৷

কলকাতা শহর বিলাস-ব্যসনের কেন্দ্রভূমি৷ এর প্রাচুর্য ও বাহারে এবং কর্মসংস্থানের সুজোগ থাকায় নানা শ্রেণীর মানুষের আস্তানা হয়ে উঠেছে৷ তাদের শরীরী ক্ষুধা মেটানোর জন্য দেহের পসরা সাজিয়ে বসেছে পণ্যাঙ্গনারা৷ যেখানে রুজি-রোজগারের উপায় বেশি, সেখানে মানুষ বেশি;যেখানে মানুষ বেশি সেখানে বেশ্যা বেশি; আর যেখানেই বেশ্যা বেশি সেখানেই পাপ বেশি—এমনি ইঙ্গিত ধ্বনিত হয় শিক্ষিত পণ্ডিতগণের মুখে৷—‘‘যেখানে সহর, সেখানেই পাপ৷ সহরমাত্রেই বেশ্যা বেশী, মদ বেশী, বদমাস বেশী৷ রাজধানীতে আরো বেশী৷’’৩৭ ভাগ্যের চাকায় ঘুরতে ঘুরতে হরিদাস কাশীতে উপস্থিত হয়ে দেখে সেখানেও দেহব্যবসার রমরমা কারবার৷ শিবের ত্রশূলের ডগায় অবস্থিত মনোরম কাশী পণ্যাঙ্গনাদের প্রধান বিচরণ ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে৷ গণিকা-ব্যভিচারীদের পদচারণায় সেখানকার পরিবেশ কলুষিত৷

উনিশ শতকের বাবুয়ানার প্রধান লক্ষণ হল বাইনাচের মজলিশে টাকা ওড়ানো অথবা বাইজি সমভিব্যাহারে দিন গুজরান করা৷ বাইজিরা চুক্তিভিত্তিক লেনদেন করতো৷ হরিদাস কাশীতে নীরেন্দ্রবাবুর সঙ্গে বাইনাচের মজলিশে গিয়ে এসব ব্যাপার জানতে পারে৷ হরিদাসের কাকা বাবু মোহোনলাল ঘোষ বাইজি সমভিব্যাহারে দীর্ঘকাল অতিবাহিত করেছে৷ সেই বাইজিকে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে অন্তঃপুরেও স্থান দিয়েছিল৷ হরিদাস নিজের পরিচয় জানার পর তার কাকার সকল কথা প্রকাশ করে৷

এছাড়া এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে এক কুলকামিনীর কথা৷ যে স্বামী-সংসারের নিরাপদ আবেষ্টনী থেকে কুলটা হয়েছিল প্রতিবেশী এক যুবকের হাত ধরে৷ কিন্তু ভোগের পিপাসা মানুষের কতদিন থাকে! যেখানে প্রেম শুধু লালসা৷ সেই যুবক জয়হরি শেষ পর্যন্ত সৌদামিনীর উপর শারীরিক-মানসিক পীড়ন করতে শুরু করে; অন্য বারনারীর আশ্রয় নিয়ে তাকে অবজ্ঞা করতে থাকে৷ নিজের ভুল বুঝতে পারে সৌদামিনী৷ কিন্তু সমাজের কি এসে যায় তাতে! পরপুরুষের হাত ধরে বেড়িয়ে যাওয়া কুলনারীর কুলে ফেরার তো কোনো পথই সমাজ রাখেনি৷ তাই হরিদাসের মধ্যস্থতায় বিশ্বেশ্বরের পায়ে নিজেকে সমর্পণ করে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে থাকে৷

হরিদাস কামরূপ দর্শন করতে গিয়ে যে ডাকিনীদের কথা শোনে তা যে গণিকারই প্রতিশধ তা তার ব্যাখ্যায় সুন্দরভাবে প্রতিভাত হয়৷ সে শুনেছে কামরূপে ডাকিনীদের পাল্লায় পড়ে কমবয়সি পুরুষেরা আর ঘরমুখো হতে পারে না৷ এ প্রসঙ্গে হরিদাস স্পষ্ট করেই বলে—‘‘তিনি রহস্যচ্ছলে গণিকাদলকেই ডাকিনী বল্লেন, সেটা আমি বেশ বুঝতে পাল্লেম৷ ডাইনী, ডাকিনী, রাক্ষসী, পেত্নী ইত্যাদি যে সকল কুৎসিত কুৎসিত উপাধি আছে, চক্ষে না দেখলেও সে সকল উপাধিধারিণীকে ভয়ঙ্করী মনে হয়৷’’৩৮ রাক্ষসী পেত্নী কি রকম, এখনকার দিনে সে দুই মূর্তি দেখা যায় না; ডাইনী ডাকিনীর আকৃতি বিভিন্ন নয়; সাধারণ স্ত্রীলোকেরা যেমন, তাদের আকৃতিও সেই প্রকার; কেবল কার্য্য দ্বারা তাদের পরিচয় হয় মাত্র; কার্য্যশ্রবণে ভয়ের সঞ্চার হয়ে থাকে৷ এই বিশেষণাদির দ্বারা গণিকাদের যে কি পরিমাণ হেয় করা হয়েছে তা জলের মতোই স্বচ্ছ৷

পূর্বে জমিদারবাড়িতে বাইজিদের জন্য নির্বাচিত নাচঘরে বাইনাচের জমজমাট মজলিশ বসানোর প্রচলন থাকলেও বাবু দীনবন্ধু চট্টোপাধ্যায় ছেলেদের চরিত্র খারাপ হবে বলে বাইজিদের সংস্পর্শ কাটানোর জন্য জমিদারির উৎসব অনুষ্ঠান থেকে বাইনাচকেই তুলে দিয়েছেন৷ এমন কথাও হরিদাসের জবানিতে উঠে এসেছে৷ এর মধ্য দিয়েও প্রতিভাত হয়েছে বাইজিদের অপকারি দিক৷

এই রচনায় বর্ণিত হয়েছে আরেকজন সমাজপতিতা রঙ্গিণীর কথা৷ রঙ্গিণী পিসতুতো দাদার প্ররোচনায় ব্যভিচারী হয়েছিল৷ পরে ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে ডাকাত দলের সর্দার কর্তৃক ধর্ষিত হয়ে সেই ডাকাত দলেই ঠাঁই করে নেয়৷ সেখান থেকে সান্নিধ্য লাভ করে বর্ধমানের যুবরাজ রণেন্দ্ররাওয়ের৷ ছদ্মবেশী ডাকাত ভূষণ তথা রণেন্দ্ররাও হরিদাসের কাছে রঙ্গিণীর বিষয়ে সমস্ত কথা জানতে পারে৷ সেই লাঞ্ছিতা রমণীর অসহায়তা এক নৈতিক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করায় বর্ধমানের যুবরাজকে৷ কারণ তার সাহায্য না পেলে বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া বেঁচে থাকার দ্বিতীয় কোনো উপায় থাকবে না সেই সহায়-সম্বলহীন নারীর৷ নিজের অতীত জীবনের সবকিছুকে ভুলে যাওয়ার শর্ত রেখে রণেন্দ্ররাও রঙ্গিণীকে এক বিপত্নীক প্রজার সঙ্গে বিবাহ দিয়ে সংসার আবর্তে নিক্ষেপ করেছে৷ তবুও মন্দের ভালো রঙ্গিণী স্থায়ী সংসারী একটা জীবন তো পেয়েছে৷ সমাজে পতিতা নারীর এর চেয়ে বেশি কি-ই বা প্রাপ্তি হতে পারে৷

গণিকাদের আশ্রয়ে ও সাহচর্যে অপরাধপ্রবণ মানুষের মনোশুদ্ধি ঘটানোর চেষ্টা করে এবং পুনরায় পরের অপরাধের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে এমন দৃষ্টান্তও ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’-য় উল্লিখিত৷ আসলে চোর, ডাকাত, গুণ্ডা, বদমাশ শ্রেণীর লোকেরা কোনো অপরাধ করার পর তার মানসিক ক্লান্তি দূর করতে বেশ্যালয়ে উপস্থিত হয়৷ নারীসঙ্গ এবং নানারকম আনন্দজনক কর্মকাণ্ডে তাদের মানসিক গ্লানি দূর হয়৷ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এ বিষয়ে দৃষ্টিপাত করানোর চেষ্টা করেছেন তৎকালীন সমাজপ্রভুরা৷ আলোচ্য রচনায় দেখা যায় এক খুন সংক্রান্ত মামলায় হরিদাসের বুদ্ধিতে প্রায় সব অপরাধীই ধরা পড়ে এবং বেশির ভাগই গ্রেপ্তার হয় বারাঙ্গনাগৃহ থেকে৷ যেমন কৃষ্ণনগরের এক বেশ্যালয় থেকে ধরা পড়ে ঘনশ্যাম বিশ্বাস৷ বহরমপুর আদালতের উকীল রজনীবাবু হরিদাসকে এ সম্পর্কে জানায়—‘‘খোসখবর৷ দুই নামে দুখানা ওয়ারীণ ছিল—জটাধর আর ঘনশ্যাম৷ সম্প্রতি একটা লোক ধরা পড়েছে; হুলিয়া মিলিয়ে পুলিশের লোকেরা কৃষ্ণনগরকে এক বেশ্যালয়ে সেই লোকটাকে গ্রেপ্তার কোরেছে৷’’৩৯ অন্য আর এক গণিকার আস্তানা থেকে আবদ্ধ হয় জয়হরি বড়াল৷

উপন্যাসটিতে আরও কিছু কিছু চরিত্রের উল্লেখ আছে যারা পেশাদার গণিকা না হলেও ব্যভিচারদোষে দুষ্ট গৃহললনা৷ যেমন নবীনশশী, রাঙামামি, রূপসী এদের মধ্যে অন্যতম৷

দেখা যাচ্ছে উনিশ শতকীয় ধ্যান-ধারণায় রচিত হয়েছে ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’ উপন্যাসটি৷ সতীত্বের নিক্তিতে ওজন করা হয়েছে নারীদের নানাবিধ আচার-আচরণকে৷ এর একটু এদিক ওদিক হলেই তারা হয়ে যায় কুলটা, স্বৈরিণী ব্যভিচারিণী অবশেষে বেশ্যা৷ আর যে সমস্ত ইতর শব্দের দ্বারা গণিকাদের বিশেষিত করা হয়েছে যেমন পিশাচী, রাক্ষসী, ডাইনি, পেত্নি সবতাতেই তাদের প্রতি অবমাননাকর মানসিকতা স্পষ্ট৷ রচনাকার অত্যন্ত রক্ষণশীল মানসিকতায় গণিকা চরিত্র সম্বলিত বিধি-নিষেধের কথাগুলি ব্যক্ত করেছেন৷ সমাজের চোখে তাদের অবস্থান মনুষ্যত্বের পরাকাষ্ঠায় নয় অশুভশক্তির দ্যোতক হিসেবে৷

‘এলোকেশী বেশ্যা’ উপন্যাসে গণিকাদের সামাজিক অবস্থানগত দিক পর্যালোচনা করতে গেলে প্রথমেই মনে রাখতে হবে এর রচয়িতা একজন ইংরেজ মহিলা, নাম বিবি মেরী ই লেসলি এবং ধর্মে খ্রিস্টান৷ তার সংস্কার, জীবনদর্শন বাংলার রচনাকারদের চেয়ে স্বতন্ত্র এবং ধর্মবোধও স্বতন্ত্র৷ উপন্যাসটি তাই উনিশ শতকের গতানুগতিক গণিকা ভাবনা থেকে সরে এসেছে৷

এর নায়িকা এলোকেশী৷ যে বয়সে সে বিধবা হয় সে সময় তার স্বামী, সংসার, পুরুষ সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না৷ তাই পুতুল খেলারত আটবছর বয়সি বালিকা বধূর শরীর থেকে এয়োস্ত্রীর লক্ষণস্বরূপ বালা দুগাছি খুলে নিলে ‘‘সে অমনি গহনার শোকে কেঁদে উঠলো৷’’৪০ মা, পাড়া-পড়শীরা তার জীবনের ভয়াবহ দুর্বিপাকে হায় হায় করতে থাকে তখন শিশুসুলভ ভয়ে বড়দের মধ্যে ভীতি এবং আশঙ্কার ক্রন্দন শুনে সেও কেঁদে উঠে৷ লেখিকা তার আচরণকে বিবৃত করে বলেন—‘‘এই সব দেখে শুনে, ছেলেমানুষ বৈ ত নয়, তার মনে একটু ভয় হল এবং কাঁদতে লাগলো৷ কিন্তু তার যে কি সর্ব্বনাশ হয়েছে, তার যে কপাল ভেঙ্গেছে, আহা সে তার কিছুই বুঝতে পারলে না৷’’৪১ স্বামীর বিরহ যাতনা সহ্য করতে হয়নি এলোকেশীকে; তখন তার সে বয়স হয়নি কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বয়োবৃদ্ধি ঘটতে থাকে, জীবনের নিকুঞ্জবনে ভ্রমরের গুঞ্জন শুরু হয়ে যায় তখন সর্বোতভাবে উপলব্ধি করতে থাকে সত্যকারের মন্মথ জ্বালা৷ তাই তার বালিকা বয়সের কলি প্রস্ফুটিত হয়ে যত সৌরভ ছড়িয়েছে ততই সে মধুপের গুঞ্জন শোনার জন্য ব্যাকুলিত হয়ে পড়েছে৷

এলোকেশী সুন্দরী এবং ভাইদের তত্ত্বাবধানে লেখাপড়াও শিখে নিয়েছিল৷ তার জীবনে ফুল ছিল অত্যন্ত প্রিয়৷ তাই তাদের বাড়ির খিড়কি সংলগ্ন বাগান ওপুকুরের চারধারে অজস্র ফুলের সমারোহে নিজেকে ভরিয়ে রাখত৷ এই ফুল ভালোলাগাটাও তার উচ্ছল যৌবনের সংকেতবাহী৷ এরপর এলোকেশীর চঞ্চল যৌবনদীপ্ত মন সন্ধান পায় ক্ষেত্রবাবুর৷ সে তার ভাই-এর বন্ধু৷ তার প্রণয়পূর্ণ বাক্যে আত্মহারা হয়ে যায় সে৷ সে সময় বিধবা বিবাহের প্রচলনও শুরু হয়েছিল৷ তার বাবা-মা যদি ইচ্ছে করতো তাহলে পুনরায় মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঘরবসাতে পারতো৷ কিন্তু সেদিকে তার বাবা-মায়ের মত নেই৷ সে মদনের নিষ্ঠুর পীড়নে তাই নিজের পথ নিজেই বেছে নেয়৷ ক্ষেত্রবাবুর হাত ধরে সংসারের নিরাপদ আবেষ্টনী থেকে বেড়িয়ে পড়ে৷ হঠাৎ একদিন মেয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার পর যখন জানাজানি হয়ে যায় যে সেই যুবকের প্রলোভনে পড়ে ঘর ছেড়েছে বাড়ির মেয়ে তা তার বাড়ির সদস্যদের মনে তেমন গুরুতর আঁচড় বসায় না৷ লেখিকা বলেছেন—‘‘এই প্রকার ঘটনা নাকি প্রায়ই ঘটিয়া থাকে, এইজন্য তার মা বাপ বড় একটা মনোযোগ করিলেন না৷’’৪২ ঘরের বিধবা মেয়ে পরপুরুষের প্রলোভনে ঘরের বাইরে চলে গেল বাবা-মা ইচ্ছে করলেই তাকে ঘরে ফিরিয়ে আনতে পারতো কিন্তু তা তারা পারলো না৷ মেয়ের পরবর্তী জীবন কোন দিকে বাঁক নেবে তা বুঝেও শুধুমাত্র মান অপমানের ভয়ে মেয়ের খোঁজটুকুও নিতে পারেনি তারা৷ সমাজ তার বাবা-মাকে হাত ধরে টেনে রেখেছে—কুলটা নারীর প্রতি অনমনীয় সে৷

ক্ষেত্রবাবু এলোকেশীকে নিয়ে গেছে ঠিকই ধন-রত্ন, কাপড়-চোপড়, দাস-দাসী, উত্তম বাড়ি সর্বোপরি তার সীমাহীন প্রেম দিয়ে তাকে ভরিয়ে রাখলেও বিয়ে করে সত্যকার যে সম্মান দান করা তা কিন্তু করেনি৷ একজন বিধবা রমণীকে সর্বোতভাবে ভোগ করা যায় কিন্তু তাকে বিয়ে করে গৃহিণীর মর্যাদা দেওয়ার উদারতা কজন দেখাতে পারে৷ যদিও ধনী ক্ষেত্রবাবু ইচ্ছে করলেই তাকে বিয়ে করতে পারতো৷ ক্ষেত্রবাবুর ঘরে বৌ ছিল ঠিকই, কিন্তু সে নিতান্ত বালিকা৷ কোনো যুবকের দুর্দমনীয় প্রবৃত্তি বালিকাতে তৃপ্ত হতে পারে না তাই তার প্রয়োজন হয়েছিল এলোকেশীর৷ ঘরে স্ত্রী বাইরে রক্ষিতা—আর সমাজ তো দুহাত তুলে এগিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র দিয়েই রেখেছে; কত সুবিধা!

কিন্তু এলোকেশী? তার জ্ঞান-বোধ-বুদ্ধিতে ক্ষেত্রবাবুই তো তার জীবনের একমাত্র সত্য৷ যে স্বামী দেবতা তাকে বৈধব্যের ধু-ধু শূন্যতা উপহার দিয়ে স্বামীর মহান কর্তব্য পালন করে গেছে—তাই স্বামী হোক আর প্রথম পুরুষ—সব সেই ক্ষেত্রবাবুই৷ এলোকেশী তাকে স্বামী বলেই জ্ঞান করতো৷ কিন্তু স্বামী ভাবা আর স্বামী হওয়া এক জিনিস নয়৷ অচিরেই সে তা বুঝতে পারে৷ তার কিছুদিনের রঙিন মধুর স্বপ্ন বাস্তবের ঘা খেয়ে হঠাৎ যেন জেগে উঠে তার প্রাণপ্রিয় স্বামীতুল্য ক্ষেত্রবাবু অসুস্থ হলে৷ এতদিন দিন রাত তার সঙ্গে সময় কাটালেও অসুস্থতার কারণে সে নিজগৃহে আটকে পড়ে৷ একজন সমাজপতিত রক্ষিতার সাধ্য থাকে না তার গৃহে গিয়ে প্রেমাস্পদকে সেবা করার বা একবার দুচোখ ভরে দেখার৷ তাই ক্ষেত্রবাবুর অসুস্থতায় সে পাগলিনীর ন্যায় হয়ে উঠে৷ লেখিকা বলেছেন—‘‘তিনি তাঁহাকে দেখিতে যেতেও পেতেন না, এবং সেবা শুশ্রূষা করিতেও পাইতেন না৷ দিবা নিশি মহা দুর্ভাবনায় মগ্ন ছিলেন, সময়ে আহার ও রাত্রে নিদ্রা ছিল না, সর্ব্বদাই মৃতবৎ বাস করিতেন৷’’৪৩ কয়েকটি কথার মধ্য দিয়ে লেখিকা তার অবস্থা বর্ণনা করলেও শাঁখের করাতের মতো এলোকেশীর সেই দুরবস্থা কল্পনা করে নিতে কোনো অসুবিধা হয় না৷ তারপর যখন সেই প্রিয় মানুষটির মৃত্যু সংবাদ শোনে তখন নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না৷ চূড়ান্ত অসহায়তায় কাটা কলাগাছের মতো মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে, চুল ছিঁড়ে, বুক চাপড়ে, গায়ের গয়নাগাটি সমস্ত দূরে ফেলে দিয়ে বিলাপ করতে থাকে—‘‘আমি আর এ প্রাণ রাখব না, আমি আর কি সুখে প্রাণ-ধারণ করিব, আমার আর এ ছাড় জীবনে কাজ কি! হে মৃত্যু, আমি তোমায় মিনতি করিয়া বলিতেছি, তুমি এখনই আমাকে আমার নামের সঙ্গিনী কর!’’৪৪ এলোকেশীর সেই বিলাপ হৃদয় বিদারক৷ বাল্যের সেই বৈধব্যকে অনুধাবন করতে না পারলেও যৌবনের উচ্ছল সময়ে ক্ষেত্রবাবুর মৃত্যুতে বাস্তবিকই নিজেকে বিধবা জ্ঞান করতে থাকে৷

তবু দুঃখ চিরস্থায়ী নয়৷ সময়ের সাথে সাথে দুঃখের ভার হালকা হয়ে আসে তখন নিজের দিকে তাকাতে হয়, নিজের কথা ভাবতে হয়৷ ইচ্ছে না থাকলেও বাধ্য হয়েই করতে হয়৷ এলোকেশীরও তাই হল৷ মৃত্যুকে ডাকলেই তো মৃত্যু ধরা দেয় না৷ তাই প্রেমাস্পদের শোকে কিছুদিন মুহ্যমান হয়ে মৃত্যুকে ডেকে ডেকে অবশেষে নিজের দিকে তাকাতে হল তাকে৷ এবারে জীবনের চরম সত্যকে বুঝে গেছে সে৷ মদনের দাহ সহ্য করতে না পেরে ক্ষণিক সুখের আশায় কোন নরকের পথে পা দিয়েছে তাও বোঝার বাকি নেই৷ কিন্তু বেঁচে তো থাকতে হবে৷ ক্ষুধার মুখে অন্নও তুলে দিতে হবে৷ মা-বাবাও আর বাড়িতে স্থান দেবে না আর ক্ষেত্রবাবুর বাড়ির লোকজনের তো কথাই নেই৷ কিছুদিন গয়নাগাটি বিক্রয় করে জীবন-ধারণের চেষ্টা করলেও অবশেষে তাও শেষ হয়ে আসে৷ নিরুপায় অবস্থায় নানা পাপ ইঙ্গিত সর্বদা হাতছানি দিতে থাকে৷ পাপের হাতছানিতে পাপকে গ্রহণ করেই মনে মনে ভাবে—‘‘আর কী, আমারও দুর্নাম হয়েছে, আমারত স্বভাব একবারে নষ্ট হয়ে গেছে, আর সকলেই আমাকে বেশ্যা বলিয়া জানে, তবে কেন এরূপ গোপনে থেকে মিছে কষ্ট পাই৷’’৪৫ এলোকেশী পেটের ভাতের জন্য সাধারণ সমক্ষে বেশ্যাবৃত্তি করতে শুরু করে দেয়৷

কোনো নারী একবার কুলটা হলে কোনো অবস্থাতেই যে তারা সৎপথে ফিরে যাওয়ার পথ পায় না৷ পতিতা মানদা দেবীও তাঁর আত্মচরিতে একথা বলেছেন৷ তিনি যেমন কুলটা হয়ে কোনো রকম সৎসংসর্গ বা সৎ সাহায্য পাননি সংসারের মূলস্রোতে ফিরে আসার জন্য তেমনি এলোকেশীও পায়নি৷ ক্ষেত্রবাবুর মৃত্যুর পর কেউ যদি একটু দয়াপরবশ হয়ে তাকে সম্মানিত জীবনের জন্য আহ্বান করতো তাহলে হয় তো প্রকাশ্যে দেহের দর হাকতে হতো না৷ মানদা দেবীর মতো তাকেও পাপই আশ্রয় দিয়েছে৷ পাপের ইন্ধনে মানদা তার সহচরী কালিদাসী ও রাজবালাকে বলেছিল—‘‘যদি রূপ-যৌবন বেচতে হয়, তবে লুকিয়ে চোরের মত কেন—একেবারে বাজারে নেমে দর যাচাই করে উপযুক্ত মূল্যে বিক্রয় করব৷’’৪৬ তেমনি এলোকেশীও বেশ্যা হওয়ার জন্য নিজের জীবনের কলঙ্ক, অসহায়তা এবং পেটের দায়কে কারণ দর্শিয়ে পূর্ণ নিমজ্জিত হয়েছে৷ এছাড়া শোকে বিহ্বল হয়ে জীবন অতিবাহিত করা একজন বিধবার নৈতিক কর্তব্য হলেও রক্ষিতার সে অধিকারই নেই৷ অভিভাবকহীন জীবনে হিংস্র শ্বাপদদের লুব্ধ রসনাকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তার ছিল না৷ বাধ্য হয়েই সে দেহব্যবসার পথ অবলম্বন করে৷ শরীরে রূপ-যৌবন থাকলে পণ্যাঙ্গনার খদ্দেরের অভাব হয় না; তারও হয়নি৷ তার রূপবহ্নিতে পুরুষেরা পতঙ্গের মত ঝাঁপিয়ে পড়তে থাকে৷ এলোকেশীর শূন্য ভাণ্ডার টাকা পয়সায় ভরে যায়৷ কিন্তু তার পরেও কোনো শান্তি নেই মনে৷ দেহজীবিকার গ্লানি সর্বদাই বিদ্ধ করতে থাকে তার অন্তকরণকে৷ ক্ষেত্রবাবুর সঙ্গে থাকার সময় তার মধ্যে খ্রিস্টধর্মের উদার দোলা দিয়ে গিয়েছিল একজন খ্রিস্টান মহিলা৷ তার উপহার দেওয়া ‘বাইবেল’ গ্রন্থটি সেই সময় বিহ্বল করে তুলেছিল তাকে, যদিও ক্ষেত্রবাবুর তৎপরতায় সেই ধর্মের বীজ পুনরায় প্রবৃত্তির মাটির তলে চাপা পড়ে গিয়েছিল৷ বহুদিন পর হঠাৎ করে সেই ‘বাইবেল’-খানার কথা মনে পড়ে যায় তার৷ গ্রন্থের পাতা ভাঁজ করা অংশগুলি পড়ে পাপের পরিত্রাণের পথনির্দেশ পায়৷ নিজের কৃতকর্মের জন্য আত্মগ্লানির অনুশোচনায় বিভোর হয়ে ধীরে ধীরে কঠিন পীড়ায় পতিত হয়৷ বিতৃষ্ণা এসে যায় বেশ্যাবৃত্তিতে৷ অসুস্থ এলোকেশী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে এক ধর্মপ্রাণা নারীর সংস্পর্শে আরোগ্যলাভ করে৷ দূর হয়ে যায় তার মনের ক্ষতও৷ সৎপথে রোজগার করে আত্মসুখ লাভ করে৷ লেখিকার বর্ণনায় এলোকেশীর সেই উপলব্ধি—‘‘স্বহস্তে পরিশ্রম করিয়া আপনার খাওয়া পরা চালাইতে লাগিলেন৷ নিজের পরিশ্রমের প্রথম বেতন পাইয়া তাহার কত আনন্দ, কত সুখ বোধ হইল৷ তিনি বলিলেন যে আমি এতদিন বেশ্যাবৃত্তি দ্বারা যে এত টাকা উপার্জ্জন করিয়াছিলাম তাহাতে এক দিনের জন্যও আমার এমন সুখ ও এমন আনন্দ কখন হয় নাই৷ এতদিন যত কিছু উপার্জন করিয়াছিলাম, সকলই কুকার্য্যের বেতন স্বরূপ৷ আজ এই আমার প্রথম দিন যে আমি আনন্দের সহিত পয়সা উপার্জ্জন করিলাম৷ আর আমি আজ কত সুখী হইলাম! আঃ আজ কি আনন্দ!’’৪৭ সেই কলঙ্কিত পেশা থেকে সেই প্রতিদিন মরা থেকে মুক্তি পেয়েছিল এলোকেশী এবং যৌনতার বদলে শরীরীশ্রম দিয়ে যে উপার্জন করেছিল তাতে কোনো প্রবঞ্চনা নেই কোনো পাপ নেই৷

কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে উনিশ শতকীয় পরিবেশ যেখানে মেয়েদের জন্য সমাজপ্রভুরা সতী-অসতীর মাঝখানে কোনো শব্দ রাখেনি সেখানে এলোকেশীর পেশা থেকে মুক্তি, আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি এক শুভ সংকেত৷ আসলে এলোকেশীর রচয়িতা পাশ্চাত্যের নারী বলে এটা সম্ভব করেছেন এবং সেখানে অবশ্যই ধর্ম প্রচারের একটা উদ্দেশ্য রয়েছে৷ হিন্দুধর্ম আচার নিয়মকানুনে পতিতার মুক্তির বিধান নেই কিন্তু খ্রিস্টধর্মে আছে৷ যে সমস্ত ব্যভিচারী নারীর প্রসঙ্গ পড়ে এবং ‘যাও আর পাপ করিও না’৪৮ এই বাণী শুনে এই পতিতা নারীর যে ভাবান্তর তা অবশ্যই খ্রিস্টধর্মকে মহান করে দেখানোর প্রচেষ্টা৷ যেমন—‘‘কি আশ্চর্য আমি অনেক অনেক হিন্দুশাস্ত্র পরিছি বটে কিন্তু কিছুতেই কখন আমার মন এত ব্যাকুল হয় নাই; কিন্তু এই বইখানি (বাইবেলখানি) পড়িয়াই আজ আমার মন এমন হল কেন?’’৪৯ তথাকথিত হিন্দু সমাজের নিষ্ঠুর রক্ষণশীলতা এবং খ্রিস্টধর্মের উদারতা দেখিয়ে সেই ধর্মের প্রতি মানুষকে অনুরক্ত করার জন্যই যে এলোকেশীর কাহিনি রচিত হয়েছে তাতে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু উদ্দেশ্য যাই থাক না কেন একজন পণ্যাঙ্গনাও যে কলুষিত দেহব্যবসার পথ থেকে সরে এসে সৎ পথে জীবিকা উপার্জন করে সমাজের সকলের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে তার পথনির্দেশ করেছেন রচনাকার৷ এদিক থেকে আলোচ্য উপন্যাসটি গণিকাদের সামাজিক মূল্য ফিরিয়ে দেওয়ার একটি শুভ প্রচেষ্টা৷

‘চন্দ্রা’-য় গণিকাদের প্রতি ঘৃণ্য মনোভাব পোষিত হয়েছে৷ সেখানে সম্ভ্রান্ত পুরুষদের গণিকাগমনের ইঙ্গিত থাকলেও আলাদা করে কোনো বারবধূ উপস্থাপিত হয়নি৷ রামচাঁদের স্ত্রী শান্তমণি, চন্দ্রার মা তারা, চন্দ্রা প্রমুখ সাধ্বী চরিত্রগুলি মিথ্যা সন্দেহের বশে কখনো সমাজের কাছে, কখনো নিজের পরিজনের কাছে গণিকা হিসেবে প্রতিবিম্বিত হয়েছে৷ গোঁসাইজীর ধারণায় তো চন্দ্রা পিশাচিনীর সমান৷ যুবক সন্ন্যাসী তাকে জল থেকে উদ্ধার করে শূশ্রূষা করতে গিয়ে গুরুদেবের আহ্বানে তার সামনে উপস্থিত হতে না পারলে গুরুদেব তাকে তিরস্কার করে বলেছে—‘‘যে পিশাচীকে জল হইতে উদ্ধার করিয়াছ, যাহাকে কুটীরে স্থান দিয়াছ, যাহাকে অনিমেষ নেত্রে সমস্ত রাত্রি দেখিয়াছ; যাহাকে দেখিবার জন্য আমার তত্ত্ব লও নাই, বুঝিলে, পিশাচী কে?’’৫০ সন্ন্যাসী যেমন বার বার বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে চন্দ্রাকে চন্দ্রাও তেমনি সন্ন্যাসীর একটু ক্ষতির সম্ভাবনা যেখানেই দেখেছে সেখানেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে তা প্রতিরোধ করতে৷ অথচ রমানাথকে চন্দ্রার অনুবর্তী হয়ে কথা বলতে দেখে সে তার গুরুদেবের মতোই তাকে ভ্রষ্টা ভেবেছে৷ তাই কোনো দুর্বল মুহূর্তে চন্দ্রার কথা মনে হতেই ‘‘অমনি ঘৃণা ও দ্বেষের উদয় হইল৷’’৫১ চন্দ্রা তাই তার মিথ্যা ভ্রম ভাঙানোর জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে যে, যতদিন প্রকৃত সত্য সন্ন্যাসীর হৃদয় গোচর না হবে ততদিন তার মুক্তি নেই৷ অবশেষে তার উদ্যোগে ভয়ানক শাস্তি থেকে মুক্ত হয়ে চন্দ্রার সত্য স্বরূপের সন্ধান পেয়ে চন্দ্রার কাছে ছুটে গিয়েছে, চন্দ্রা কিন্তু তার সামনে আসেনি৷ যে প্রেমাস্পদকে একবার দেখার জন্য চন্দ্রা জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারতো সে দরজায় এসে দাঁড়িয়ে আছে জেনেও চন্দ্রা দেখা দেয়নি—তার আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব সে কাজ করতে দেয়নি৷ একটা চিঠির মধ্য দিয়ে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছে৷ যে পুরুষসমাজ কথায় কথায় মেয়েদের কুলটা-কলঙ্কিনী-বেশ্যা বানিয়ে চরম ঘৃণায় অপদস্ত করতে পারে প্রেমিকের কাছে ফিরে না গিয়ে সেই সমাজের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ পোষণ করেছে চন্দ্রা৷ উনিশ শতকীয় ধ্যান-ধারণায় গিরিশচন্দ্রের সৃষ্ট চন্দ্রার সেই প্রতিবাদ নারীর ব্যক্তিত্বরক্ষার লড়াইকে বহুবিস্তৃত করে তুলেছে৷

চন্দ্রা তার সমস্ত ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদাবোধ অর্জন করেছিল তার মায়ের কাছ থেকে৷ তার মা তারা যুবক জনার্দ্দনে প্রেমে পাগলিনী হয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বি হয়েও ঘর ছেড়েছিল প্রেমিকের সঙ্গে৷ এ সমাজ তাকে মেনে নেয়নি৷ সে জনার্দ্দনের বিবাহিতা স্ত্রী হয়েও সমাজের কাছ থেকে পেয়েছিল রক্ষিতার অপমান৷ তবুও সহ্য করেছিল সব কারণ স্বামী বিরূপ নয়; তার কাছে নিজের সম্মান ঠিক ছিল৷ কিন্তু সেই স্বামীই যখন পিতৃতুল্য ইংরাজ সাহেবের সঙ্গে রাত্রি বেলায় তাকে কথা বলতে দেখে মিথ্যা সন্দেহে অপমান করে পরিত্যাগ করে চলে যায় তখন তা সহ্য করতে পারেনি৷ স্বামীর ঔরসজাত কন্যা চন্দ্রার দশবছর বয়ঃক্রমে সে সমাজের চোখে নিজেকে মৃত প্রমাণিত করে স্বামীর পেছনে ছুটতে থাকে ভিখারিণী বেশে৷ উদ্দেশ্য প্রকৃত সত্য অবগত করানো৷ কিন্তু স্বামীর খোঁজ পায় না৷ স্বামীর এক প্রতিকৃতিকে অবলম্বন করে নিজের মনের সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিয়ে মানসিক জ্বালা অপনোদন করে৷ সে ছবিকে লক্ষ করে বলে—‘‘আরে আরে, তোর জিহ্বা পুড়িয়া গেল না? আমাকে অসতী বলিলি? তুই কে, সন্ন্যাসী বই নয়, আমি তোর নিমিত্ত পিতা মাতা ভ্রাতা সকল পরিত্যাগ করিয়াছি; তবু তোর মন উঠে না? আরে নির্দয়! আমি তোকে দেশে দেশে খুঁজিতেছি, তুই তবু আমাকে দেখা দিস না? আমি তোর জন্য পাগল, তোর জন্য ভিখারিণী৷ দেখ—চেয়ে দেখ৷ আমায় কি দেখিয়াছিলি—এখন দেখ!’’৫২ শেষ পর্যন্ত সে ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ পরিকল্পনায় ব্যস্ত স্বামীকে খুঁজে পেলে ভয়ঙ্কর ক্ষোভে যুদ্ধের সমস্ত পরিকল্পনা ইংরেজদের জানিয়ে স্বামীর চরম পরাজয় সাধন করে৷ তারপর ভীষণভাবে আহত স্বামীর মাথা নিজের কোলে নিয়ে উন্মাদিনীর ন্যায় নিজের বক্ষে ছুরি মেরে স্বামীর সঙ্গে একসাথে পরলোকে চলে যায়৷ চন্দ্রার মতো শিক্ষিতা সুন্দরী তারাও স্বামীর মিথ্যা অপমান ও অপবাদকে ক্ষমা করেনি চরম দণ্ড দিয়ে তবে ক্ষান্ত হয়েছে৷ গিরিশচন্দ্র ঘোষ কলঙ্কিত নারীদের প্রতিবাদীরূপকে সর্বসমক্ষে তুলে ধরেছেন৷

‘স্বর্ণবাই’ উপন্যাসের বিষয়বস্তুও প্রায় একই রকম৷ এর রচয়িতা অজ্ঞাত৷ প্রকাশ করেছেন নবকুমার দত্ত মহাশয় সম্পাদনা করে৷ সমগ্র উপন্যাসের কাহিনি পর্যালোচনা করলে এই প্রতীতি জন্মে যে ‘এলোকেশী বেশ্যা’-র মতো ‘স্বর্ণবাই’-এর রচয়িতাও কোনো খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারক৷ উপন্যাসে স্বর্ণর আসল নাম কাত্যায়নী৷ তার বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হয় দশ বছর বয়সে৷ যৌবনের মদপ্লাবী সময়ে অসামান্য রূপবতী কাত্যায়নী বাবা-মায়ের সঙ্গে তীর্থ যাত্রা করে সঙ্গীভ্রষ্ট হয়ে হস্তগত হয় প্রমোদ নামের এক চরিত্রবান যুবকের৷ সৎচরিত্রের প্রমোদ খোঁজখবর করে তাকে তার বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিলেও ততক্ষণে কাত্যায়নীর হৃদয়ে উপ্ত হয়ে গেছে পাপের বীজ৷ কিছুতেই ভুলতে পারে না তাকে৷ একদিকে প্রমোদের জন্য তীব্র অনুরাগ অন্য দিকে কুসুম নামের এক বিবাহিতা প্রতিবেশিনীর মুখে শোনা দাম্পত্য প্রণয়ের গল্প তার হৃদয়াকাঙ্খাকে দুর্বার করে তোলে৷ কন্দর্পবাণের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সতেরো বছরের এক কিশোরকে প্রলুব্ধ করে ঘর ছাড়ে সে৷ তার দ্বারা পরিত্যক্ত হতে সময় লাগে না কাত্যায়নীর৷ তখন কামনার পীড়নে অন্ধ সে৷ তাই ভাড়াটেগৃহের কর্ত্রীর প্ররোচনায় এক ধনবান বৃদ্ধের উপপত্নী হয়ে পুনরায় কামতরঙ্গে লিপ্ত হয়৷ কিন্তু বৃদ্ধ তার কামনা পরিপূরণে যথার্থ নয়৷ সেই অতৃপ্তিবোধে বৃদ্ধের সমস্ত বিত্তবৈভবকে হেলায় অবহেলা করে এক যুবক ভৃত্যকে সঙ্গী করে পালিয়ে যায়৷ সেই ভৃত্য তার যথাসর্বস্ব হরণ করে নিয়ে গেলে উপায়ন্তর না দেখে প্রকাশ্যে দেহের দর হাকে অর্থাৎ বেশ্যা হয়ে যায়৷ এতক্ষণ পর্যন্ত কাত্যায়নীর জীবনের যে বর্ণনা পাওয়া গেল তাতে বোঝা যায় দুর্দমনীয় প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়েই সে গণিকা জীবনে পা বাড়িয়েছে৷ কিন্তু তার সেই গণিকাবৃত্তি অবলম্বন করার পিছনে সমাজের কি কোনো ভূমিকা নেই? মোটামুটিভাবে এর কারণ নির্দেশ করা যায় বাল্যবিবাহ এবং বিধবাবিবাহের অপ্রতুলতা৷ এলোকেশীও মদনজ্বালায় দেহব্যবসায়ী হয়েছিল৷ সেও ছিল বালবিধবা৷ এলোকেশী মুক্তি পেয়েছে, দেখা যাক কাত্যায়নীর মুক্তি কতদূরে৷

বহুপুরুষের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করার ফলে গণিকাদের যৌনরোগের সম্ভাবনা একশত শতাংশ৷ কাত্যায়নীও সেই রোগের শিকার হয়৷ চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয় লক হাসপাতালে৷ এ প্রসঙ্গে উঠে এসেছে চৌদ্দ আইনের প্রসঙ্গ৷ ১৮৬৮ সালে ইংরেজ সরকার ব্রিটিশ সেনাদের বেশ্যাসম্ভোগজনিত কারণে যৌনরোগের পীড়ন থেকে বাঁচাতে এই আইন প্রণয়ন করে৷ যেখানে প্রত্যেক গণিকাকে হাসপাতালে পরীক্ষা ও চিকিৎসা করিয়ে নীরোগের সার্টিফিকেট নিয়ে দেহব্যবসা বাধ্যতামূলক করা হয়৷ পরীক্ষা করার নাম করে দেহপসারিণীদের উপর চালানো হয় নির্মম অত্যাচার৷ যৌনাঙ্গ কেটে-ছিঁড়ে, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি যৌনাঙ্গে প্রবেশ করিয়ে এবং কটু ঔষধ প্রদানের নামে হাসপাতালের কর্মী, ডাক্তার, নার্সরা পৈশাচিক আনন্দে মেতে উঠে৷ লক হাসপাতালে যৌনরোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে কাত্যায়নীও প্রায় সেই বিকৃত চিকিৎসাপ্রণালীর শিকার হয়৷ সে বলে যে সেখানে তাকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে বিভিন্ন যন্ত্রাদির দ্বারা অকথ্য অত্যাচারে এবং কটু ঔষধ সেবন করিয়ে চিকিৎসা চালানো হয়৷ ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর ১৫.০৪.১৮৬৯ তারিখের একটি প্রতিবেদনেও সেই বিকৃত চিকিৎসার বিবরণ পাওয়া যায়—‘‘বেশ্যাদিগের রেজিষ্টরি ও ব্যাধি পরীক্ষা সম্বন্ধে রাজধানী মধ্যে যে কত প্রকার ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর কথা শুনা যাইতেছে, তাহা প্রকাশ করিতে হইলে বিদ্রোহীর মধ্যে গণনীয় হওয়া অসম্ভাবিত হয় না৷ অধিকন্তু অশ্লীলতা ও জগপ্রিয়তার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাওয়াও দুর্ঘট হয়৷ কেহ বলিতেছে পুলিসের লোকেরা স্ত্রীলোকদিগের প্রতি নির্দ্দয় হইয়া রেজিষ্টরির জন্য গ্রেপ্তার করিতেছে৷ তাহাদিগের ক্রন্দনে ও আর্ত্তনাদে পুলিসের আহ্লাদ বর্ধিত হইতেছে৷ কেহ বলিতেছে, পরীক্ষার সময় লৌহ শলাকা ও পিচকারি ব্যবহৃত হইতেছে৷ কোন কোন ডাক্তার অসম্ভব বল প্রকাশ করিয়া এ কাজ করিতেছেন৷ যাহাদিগের ব্যাধি নাই তাহারাও পরীক্ষার পর গৃহে আসিয়া উদর বেদনায় ৩/৪ দিন শয্যাগত থাকিতেছে৷ সেই কষ্টে ও সেই যন্ত্রণায় ২/৩ জন বেশ্যা গলায় দড়ী দিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছে৷ সেই ভয়ে শত শত বেশ্যা কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করাতে বেশ্যাপল্লী সকল অন্ধকারময় হইয়াছে৷’’৫৩

এই যে আইনের নাম করে গণিকাদের উপর অত্যাচার তা এই বারযোষিতদের প্রতি ঘৃণ্য এবং বিকৃত মানসিকতা থেকেই উৎসারিত৷ তাদের অবজ্ঞা না করলে মানুষের প্রতি মানুষ এতটা পৈশাচিক হতে পারে না৷ ‘স্বর্ণবাই’-এর কাত্যায়নী হাসপাতালের কর্মীদের যৌন পরিষেবা ঘুস দিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে৷ তারপর নাচ-গান শিখে ‘স্বর্ণবাই’ নাম নিয়ে শুরু করে তার নতুন জীবন৷ দিগদিগন্তে তার পসার ছড়িয়ে পড়ে৷ জীবনে বহুপুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়েও তার ভেতরের পশুটির ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া প্রমোদকে কোনোভাবেই ভুলতে পারে না৷ অবশেষে এক জমিদারবাড়িতে মুজরা করতে গিয়ে দেখা পায় তার৷ সমস্ত ছলা-কলা প্রয়োগ করে সেই চরিত্রবান পুরুষটিকে বেশ্যানুগামী করে তুললেও প্রমোদ যখন তার পূর্ব পরিচয় জানতে পারে তখন ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে ত্যাগ করে তাকে৷ অপমানিত স্বর্ণ হিংস্র হয়ে তার প্রতিশোধ নিতে সর্বনাশ করে তার বন্ধুর৷ সময়ের প্রবহমান ধারায় তার জ্বলে উঠা যৌবনদীপ্তি ম্লান হতে থাকে, কমতে থাকে দেহলোভী মধুপের সংখ্যা৷ এবারে চাকর শ্রেণীর যুবকেরা খদ্দের হয় তার৷ তাদের দ্বারা লাঞ্ছিতও হয় বহুবার ৷ তারপরে তারাও আর আসে না তখন ঘটক সেজে অল্পবয়সি মেয়েদের প্রলোভিত করে উপার্জন করতে থাকে৷ এক তরুণী বিধবাকে গণিকা তৈরি করে তার উপার্জনেই চলতে থাকে সে৷ নিজের অগাধ ক্ষমতা হারিয়ে পরজীবী হয়ে বেঁচে থাকার জন্য যে ধৈর্যের প্রয়োজন তা স্বর্ণবাই-এর ছিল না৷ তাই ক্রমশ অত্যাচারী হয়ে উঠলে মেয়েটি পালিয়ে যায়৷ জীবনে ব্যর্থতার গ্লানিতে, অন্নসংস্থানের অক্ষমতায় এবং হতাশায় ভয়ে ধীরে ধীরে উন্মাদ হয়ে যায়৷ তাকে ভর্তি করা হয় এক মিশনারি হাসপাতালে৷ সেখানকার এক মিশনারি মহিলা তার সেবা যত্ন ধৈর্য দিয়ে সুস্থ করে তোলে তাকে৷ স্বর্ণ তাকে সম্বোধন করে ‘নতুন মা’ বলে৷ তারই সাহায্যে বেশ্যাবৃত্তি থেকে মুক্তি পেয়ে ধনীর বাড়িতে নার্স হিসেবে যোগদান করে৷ কালক্রমে জানতে পারে সেই বাড়ি আর কারও নয়, প্রমোদের৷ কিন্তু প্রমোদের কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তার সেবা ও ভালোবাসা দিয়ে বাড়ির সকলের মনজয় করে ফেলেছে সে৷ বিধবা কাত্যায়নী, বারবনিতা স্বর্ণবাই দেহজীবিকার ঘৃণ্য পঙ্ক থেকে মুক্তি পেয়ে সীমাহীন আত্মপ্রসাদ লাভ করে৷ ‘এলোকেশী বেশ্যা’-র মতো এই উপন্যাস সম্পর্কেও বলা যায় যে এখানে পতিতা স্বর্ণবাই যতটুকু সম্মান পেয়েছে পুরোটাই খ্রিষ্টধর্মের উদারতার ফল৷ সেই মিশনারি নারীই তার ভেতরকার পাপ প্রবৃত্তির বীজানুকে মেরে ধর্মের বীজ পুতে দিয়েছিল—তা থেকে অঙ্কুরিত হয়েছে গ্লানিমুক্ত এক নারীবৃক্ষ৷

গণিকাদের সর্বপাপের মূল কেন্দ্র হিসেবে অভিজ্ঞানিত করা হয়েছে দুর্গাচরণ রায়ের ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ৷ ব্রহ্মা, ইন্দ্র, বরুণ, নারায়ণ এই চারজন দেবতার মর্ত্য ভ্রমণের উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার ফল এই উপন্যাস৷ স্বর্গ থেকে হরিদ্বার এবং হরিদ্বার থেকে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেবগণ উপনীত হয়েছেন কলকাতায়৷ প্রায় সমগ্র ভ্রমণ পথেই বাইজি, গণিকা, বেশ্যা, খেমটাওয়ালি, স্বৈরিণী নারীদের উপস্থিতি দেখেছেন এবং সর্বক্ষেত্রেই বর্ষণ করেছেন নেতিবাচক মনোভাব৷

দিল্লীতে বেপর্দা হয়ে খোলাগাড়িতে স্বামীদের সঙ্গে বিহার করে বলে তাদের স্বেচ্ছাচারী তকমা দান করেছেন পিতামহ ব্রহ্মা৷ তাঁর ধারণায় নারী অন্তঃপুরে বন্দি হয়ে শিক্ষা মর্যাদাচ্যুত হয়ে স্বামীর অনুবর্তনকারিণী হয়ে জীবন কাটাবে৷ তাই স্ত্রীলোকের স্বামীসমভিব্যাহারে যত্রতত্র ভ্রমণ করা প্রসঙ্গে বেদের একটি লাইন উচ্চারণ করেন৷—‘‘বেদে লেখা আছে—কলির শেষ দশায় স্ত্রীলোকেরা স্বেচ্ছাচারিণী হয়ে যথা তথা ভ্রমণ ক’রবে, তাহারই সূত্রপাত৷’’৫৪ ব্রহ্মাদেব রক্ষণশীল মানসিকতায় নারীর স্বাধীন এই দিকটির সমালোচনা করেছেন৷ দিল্লীর বাই সম্পর্কে ভাল ধারণা ছিল নারায়ণের৷ কিন্তু তাদের তামাক খাওয়া দেখে বরুণের কানে কানে বলেন—‘‘দিল্লীর বাঈ ভাল শোনা ছিল; কিন্তু মাগীরা বারাণ্ডায় ব’সে যে গুড়ুক তামাক খাচ্চে, দেখে অশ্রদ্ধা হয়ে গেল!’’৫৫ বলা বাহুল্য নানারকম ইতর লম্পট মাতাল মানুষের সংস্পর্শেই গণিকাদের ব্যবসা৷ খদ্দেরের মনোরঞ্জনের জন্য বা শিক্ষা, রুচিহীন অবহেলিত জীবনযাপনের দরুণ শুধু তামাক কেন মদ থেকে শুরু করে সমস্ত নেশাই তাদের করতে হয়৷ পুরুষের ক্ষেত্রে যা স্বাভাবিক হয় নারীর ক্ষেত্রে তা সেভাবে নয় তথাপি বারযোষিতদের নীতিবোধবর্জিত জীবনে তা অশোভনও নয়৷ এখানে নারায়ণ ইতর শব্দ প্রয়োগ করে তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন৷

বৃন্দাবনে সেবাদাসীর রমরমা কারবার৷ মহান্তরা অসংখ্য সেবাদাসী নিয়ে তাদের সঙ্গে আরাম আয়াসে দিন কাটায়৷ সেবাদাসীদের রাখার পেছনে যৌনচাহিদা পূরণেরও ইঙ্গিতও রয়েছে৷ সেবাদাসীরাও পুরুষসঙ্গ করতে অভ্যস্ত৷ দেবতাদের যুগলরূপে তাদের সঙ্গে রাত্রিযাপনের আহ্বানের মধ্যে সে দিকটি সুস্পষ্ট৷ তাদের সেই ধর্মীয় আচরণের পেছনে যৌনচারিতাকে ধিক্কার জানিয়েছেন ইন্দ্র—‘‘তোমরা চ’লে যাও, আমাদের না হয় পাপ হবে৷ কি সর্ব্বনাশ! বরুণ, এই কি তীর্থস্থান?—এই কি তীর্থস্থানের ব্যবহার? ধিক! ইহারা কি এই মন্দ অভিপ্রায়ের জন্যই বৈষ্ণবী হয়েছে! ধর্ম্মের জন্য নহে?’’৫৬ ইন্দ্রদেবের মুখে তাদের প্রতি যে ধিক্কার ধ্বনিত হয়েছে তা পুরুষতন্ত্রের মিথ্যা অস্ফালনের জন্য৷ বৃন্দাবনের সেই সেবাদাসীরা হয়তো সংসারে লাঞ্ছিত হয়ে ঈশ্বরের পদমূলে নিজেদের সমর্পণ করতে চেয়েছিল কিন্তু ঈশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে বসে থাকা বাবাজী মহন্তদের তুষ্ট না করলে বৃন্দাবনেও তাদের ঠাঁই হবে না৷ মন্দের ভালো নিষিদ্ধপল্লীতে পরিত্যক্ত না হয়ে ধর্মের আড়ালে শরীরের বিনিময়ে অন্নভোগ করে বেঁচে থাকে তারা৷

লক্ষ্ণৌর বাইনাচ জগৎবিখ্যাত৷ দেবগণ সেখানে এসে অপ্সরাতুল্য বাইজিদের নৃত্য দেখে কৃতার্থ হয়ে যান৷ দেবরাজের একান্ত ইচ্ছে বাইজিদের স্বর্গে নিয়ে গিয়ে প্রত্যহ বাইনাচ দেখেন৷ বরুণকে সে ইচ্ছে প্রকাশ করতেই চটে যান ব্রহ্মা৷ তিনি মন্তব্য করেন—‘‘যে দেশে যাত্রা, থিয়েটার, বাইনাচের বেশী প্রাদুর্ভাব, সে দেশ ত উৎসন্ন যেতে ব’সেছে৷’’৫৭ অর্থাৎ যাত্রা থিয়েটারের মতো বাইজিদেরও দেশকে উচ্ছন্নে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন৷ দেবতাদের এক বেনারসি পানের দোকানে দরকষাকষির সময় একদল বেশ্যা এসে গান শোনার জন্য টানাটানি শুরু করলে পিতামহ ব্রহ্মা ভীষণভাবে রেগে যান৷ তিনি বিরক্ত চিত্তে ঘোষণা করেন—‘‘যেখানে বেশ্যাতে এলে হাত ধরে, সে স্থানে ক্ষণকাল থাকা মহাপাপ৷’’৫৮ কি চরম অপমান! গণিকারা সমাজে এতটাই ঘৃণ্য যে তাদের স্পর্শ এবং আবাসস্থল শুধু পাপাগার নয় তা মহাপাপের কেন্দ্রস্থল৷

কাশীতে এক বঙ্গযুবতীর খেমটানাচে এবং নীলাম্বরী বসনে দিগম্বরী রূপে মোহিত হয়ে কয়েকজন যুবক তাকে হাঁ করে পর্যবেক্ষণ করছে এবং গ্লাসে গ্লাসে মদ্যপান করছে৷ পিতামহ বাঙালি রমণীর এরূপ লজ্জহীনতা দেখে বিরূপ মন্তব্য করলে বরুণ তাঁকে বলেন—‘‘আজ্ঞে, ঐ স্ত্রীলোক বাঙ্গালী বটে, কিন্তু এক্ষণে বেশ্যাস্বভাব প্রাপ্ত হওয়ায় লজ্জা সরম সকলেরই মাথা খেয়েছে৷ নচেৎ একদিন উহার লজ্জা সরম ধর্ম্মভয় সকলই ছিল৷ উহার ভাশুরই উহার এ দশা ক’রেছে৷’’৫৯ সে বৈধব্য দশায় ভাশুরের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে অবশেষে সমাজের ভয়ে উভয়ে কাশীতে আশ্রয় নিয়েছে৷ ভাশুর-ভাদ্রবৌ-এর এই অবৈধ পাপাচার শ্রবণ করে নীতিবাগীশ ব্রহ্মদেব নাক-সিটকে বলেছে—‘‘ছি! ছি! ভাশুর ভাদ্রবৌ!! কাশী! তুমি ধ্বংস হও৷—পৃথিবী! তুমি রসাতলে প্রস্থান কর, আর কেন?’’৬০ এক অসহায় অবস্থায় বিধবা হয়েও ভাশুরের অনুগ্রহে শ্বশুরবাড়িতে স্থান পেয়েছিল আরেক অসহায় পরিস্থিতিতে খেমটাওয়ালি হয়ে যুবক মদ্যপ পুরুষের মনোরঞ্জন করে জীবন-জীবিকা চালাতে হয়৷ ভাশুরের কি পরিণতি হল তার উল্লেখ নেই কিন্তু নারীটিকে গণিকার স্তরে পর্যবসিত হতে হয়৷ দেবাদিদেব মহাদেবের অতি যত্নে গড়া কাশী বেশ্যা, লম্পট, স্বৈরিণী-ব্যভিচারিণীদের লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছে বলে শিবের আক্ষেপের শেষ নেই৷ দেবতাদের সঙ্গে গল্পের প্রসঙ্গে শিবের মুখে উচ্চারিত হয়েছে সেই খেদোক্তি—‘‘আমার সোণার কাশীতে আর আছে কি?—যে কাশীতে বোসে কপিল সাংখ্যদর্শন লেখেন, যে কাশীতে বোসে গৌতম ন্যায়শাস্ত্র লেখেন, যে কাশী পাণিনি-ব্যাকরণ জন্য চিরপ্রসিদ্ধ, সেই কাশীতে এখন কি না কতকগুলো দুপাতা উল্টানো, নয় ত বর্ণজ্ঞানহীন ন্যায়রত্ন, বিদ্যারত্ন, শিরোরত্ন প্রভৃতি চৈতনধারী মহাত্মারা টোল খুলে দোকান পেতে বসে আছেন৷… এখন সেই কাশীতে আছে কি না কতকগুলো বেশ্যা এবং লম্পট৷’’৬১

মিরজাপুরে কোনো ঘর থেকে বামাকন্ঠ নিঃসৃত সঙ্গীত শুনে পিতামহ বরুণকে উদ্দেশ্য করে বলেন—

‘‘বরুণ! এখানেও আছে?

বরুণ৷ কি আছে?

ব্রহ্মা৷ খারাপ স্ত্রীলোক৷

বরুণ৷ আপনি খারাপ স্ত্রীলোক ব’লে ভয়ে ভয়ে আড়ষ্ট হ’লেন! আজকাল পৃথিবীর সর্ব্বত্রই খারাপ স্ত্রীলোক দেখিতে পাওয়া যায়৷ অতএব বেশ্যার নিকট দিয়া যাইলে পাপ হয়, যে নগরে বেশ্যা থাকে তথায় বাস করিলে পাপ হয়, এত বিচার ক’রে চ’লতে হ’লে আর মর্ত্ত্যে আগমন হয় না৷’’৬২ দেবতাদের রক্ষণশীল মানসিকতায় গণিকারা ‘খারাপ স্ত্রীলোক’ হিসেবে চিহ্নিত এবং ঘৃণিত৷ সেই পাপী নারীদের দেখে ব্রহ্মা ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যান পাপ অর্জন হবে ভয়ে৷

গয়াতে পিণ্ড দান করলে মৃত আত্মার সদগতি প্রাপ্ত হয়৷ সেখানকার দালাল গয়ালীগুরুরা৷ তাদের সাহায্য ব্যতীত পিণ্ডদান সম্ভব নয়৷ দেবগণ সেখানে দেখেন এক বেশ্যা তার লম্পট প্রেমিকদ্বয়ের সাহায্যে গয়ালীগুরুকে জব্দ করে কম টাকা সুফল আদায় করছে৷ বেশ্যার স্পর্শদোষে দুষ্ট পিণ্ড গ্রহণ করার সহৃদয়তা নীতিনিষ্ঠ দেবতাদের নেই৷ তাই পতিতা নারীকে অর্থের বিনিময়ে সুফল দান করতে দেখে ক্ষুব্ধ হয়ে যান পিতামহ৷ তিনি বলেন—‘‘যেখানে বেশ্যার দান গ্রহণ করিয়া সুফল দেয়, সেখানে এক মুহূর্তও থাকতে নাই৷ আমি এই দন্ডে গয়া পরিত্যাগ করিলাম, তোমাদের ইচ্ছা হয় থাক৷’’৬৩ একজন ঘৃণ্য বারবনিতাকে সুফল প্রদান করা দেখে ব্রহ্মাদেব এতটাই ক্রুদ্ধ হয়ে যান যে তাঁর সহযাত্রীদের পরিত্যাগ করে একাই সেই স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হন৷

মুঙ্গেরে খেমটা, বাইনাচ ইত্যাদির পিছনে খরচ করে সরকারি কর্মচারীরা যে সর্বস্বান্ত হয়ে যায় সে বর্ণনা রয়েছে৷ গণিকাদের কুহকী মায়া ঐ শ্রেণীর মানুষের অধঃপাতের মূল৷ ভাগলপুরে মানুষেরা ধর্মবোধ বিসর্জন দিয়ে, ধর্মকাজে ব্যয় না করে অপব্যয় করে গণিকাদের পিছনে৷ এখানেও গণিকাদের কুহকীমায়ায় বশীভূত তারা৷ বেশ্যারা বাবুদের সর্বনাশ করে শুধু যে অর্থ সম্মান অপহরণ করে তা নয় তারা বাবুদের ইহকাল-পরকাল ভক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে বিষয়সম্পত্তিসকলও গ্রাস করে নেয়, বর্ধমানে উল্লেখ রয়েছে এমন ঘটনার৷ এই বর্ধমানেই বেশ্যার মুখে কীর্তন শ্রবণ করে বরুণ তার স্বর্গ প্রাপ্তির বিষয়ে কথা বললে ব্রহ্মা তা অস্বীকার করে জানান—‘‘ভাই! বেশ্যারা নিজের উপজীবিকার জন্যই হরিনাম করে; অতএব তাহাদের মুক্তি হইবে না৷’’৬৪ কোনো মানুষ যে কোনো পাপ করে হরিনাম উচ্চারণ করলে পাপমুক্ত হয় কারণ ধর্মবেত্তাদের মতে হরিনাম সর্বোপাপ মুক্তির আকর কিন্তু গণিকাদের পাপ পুরুষের কোনো পাপেরই সমতুল নয়৷ সেই পাপের ব্যাপ্তি এতটাই সুগভীর যে হরিনাম সর্বোপাপ মুক্তি ঘটালেও সেই পাপমুক্ত করার ক্ষমতা তার নেই৷ এই নির্মম বাক্য পুরুষশাসিত সমাজে গণিকাদের অবস্থানকে সেই স্তরে নিয়ে যায় যে স্তরের কল্পনা এখন পর্যন্ত করে উঠতে পারেনি সমাজপ্রতিভুরা৷

উপন্যাসের আলোচনার সূচনাতে যেমন নারীস্বাধীনতার বিপক্ষ মতবাদ পোষণ করেছেন ব্রহ্মা তেমনি চন্দননগরেও বর্ণিত হয়েছে একই দিক৷ পিতার বিষয়-সম্পত্তির গর্বে দুইবোনের গণিকা হওয়ার প্রসঙ্গ যেমন বর্ণিত হয়েছে তেমনি স্ত্রী স্বাধীনতার ফলে স্ত্রীর অন্যপুরুষের প্রতি আসক্তির চিত্রও অঙ্কিত হয়েছে৷

বালিতে এক আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণের আচার-পরায়ণতা দেখে পিতামহ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও সেই ব্রাহ্মণকে পরবর্তী সময়ে বেশ্যাগৃহে দেখে সমস্ত ভক্তি উবে যায়৷ বরুণ তাঁকে ব্যঙ্গ করে বলেন—‘‘ঠাকুরদা! এই বামুনকে দেখিয়া এক সময় আপনার বড় ভক্তি হইয়াছিল; এক্ষণে ইহার কার্য্য দেখুন৷ এটি বেশ্যাবাড়ী৷ ঐ বামুনের বামী নামে একটি রক্ষিতা বেশ্যা এই বাড়ীতে বাস করে৷ ঠাকুর রজনীতে সেই বামীর নিকট এসেছেন৷’’৬৫ তাঁর এই মন্তব্যে হতাশ ব্রহ্মা তাঁকে শোনায়—‘‘কলিকালে লোক চেনা ভার৷ এত সাজ গোজ, আচার ব্যবহার, আর এদিকে বেশ্যার বাড়ীতে রুটি বেগুনভাজা মদ খায়!’’৬৬ সেই আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণ বেশ্যাগৃহে না গিয়ে যদি অন্য কোনো গুরুতর পাপকার্য সম্পন্ন করতো তাহলেও হয় তো পিতামহ এত বেশি হতাশ হতেন না৷

কলকাতায় উপস্থিত হয়ে প্রথমেই দর্শন করেন এক ভ্রষ্টা গৃহবধূর নষ্ট জীবনযাপনের আলেখ্য৷ আরেক স্থানে পরীর মত সুন্দরী রমণীদের মানুষের গাড়ি, পাল্কি ধরে টানাটানি করতে দেখে দৌঁড়ে সরে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে ব্রহ্মা তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন—‘‘অমন সর্ব্বনেশে স্থানে নিয়ে যায় ও মাগীগুলো কে৷’’৬৭ বরুণ বুঝিয়ে দেন যে তারা জার্মানি, ইটালী, রুসিয়া প্রভৃতি স্থান থেকে আগত বারাঙ্গনা৷ ভদ্রলোকে গাড়ি, পাল্কি ধরে টানাটানি করে তারা আনন্দলাভ করে৷ এখানেও উপস্থিত হয়েছে লক হাসপাতালের প্রসঙ্গ৷ বরুণ ইন্দ্রকে সে বিষয়ে এবং চৌদ্দ আইন সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান দান করেন৷ স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত মেছুনি রমণীদের বিলোল কটাক্ষে ভীত হয়ে নারায়ণ বলেন—‘‘বরুণ, অপর রাস্তা দিয়া চল৷ মেছুনী মাগীরা বড় দুষ্ট, ওদিক দিয়ে যাইবার আবশ্যকতা নাই৷’’৬৮

চুনাগলিতে ফিরিঙ্গি গণিকাদের বাস৷ এই পণ্যাঙ্গনাদের দেবতারা কখনো ‘মাগী’ কখনো ‘পেত্নী’ কখনো বা ‘মিন্সে ধরা’ ইত্যাদি অভিধায় অভিনন্দিত করে হৃদয়ের ঘৃণ্য মনোভাবকে প্রকাশ করেছেন৷ তার পর হাড়কাটা গলিতে৷ সেখানে পরিবেশ তুলনামূলক শান্ত৷ বরুণদেব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বোঝান যে—‘‘এই স্থানে যত বাঙ্গালী বেশ্যারা বাস করে৷ স্থানটি বদমায়েসীর প্রধান আড্ডা৷ আমাদের সৌভাগ্য যে বেশ্যামাগীরা এক্ষণে ঘুমাইতেছে৷ সমস্ত রাত্রি জাগিয়া এই সময়ে মাগীগুলো ঘুমায়, আবার সন্ধ্যাকালে উঠিবে এবং যাহারা যেমন সম্ভব সাজ গোজ করিয়া এই রাস্তাগুলোয় ছুটাছুটি করিয়া তোলপাড় করিবে৷ ঐ সময়ে ইহারা কি ভদ্র কি ইতর যাহাকে পায় হাত ধরিয়া টানাটানি করে৷ ঐ সময়ে আবার এই ব্যবসায়ের দালালেরাও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়ায়৷’’৬৯ এখানেও বরুণদেব তাদের জীবনাচারের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা অবমাননামূলক৷ সেখানেই এক পুরোহিতকে বেশ্যাগৃহে পৌরহিত্য করে বেড়িয়ে আসতে দেখেন এবং সে বিষয়ে নিজপুত্রকে দেওয়া উপদেশের কথা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেন প্রজাপতি৷ অত্যন্ত বিরক্তির সঙ্গে ব্যক্ত করেন তাঁর মনের ভাব—‘‘বুড়ো বামুন মরিবার বয়েস, এখনও শমনের ভয় নাই! মাথায় ত শিখাটিখা বেশ রেখেছে৷’’৭০ পিতামহকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে ইন্দ্র ও বরুণ মেছুয়াবাজারে উপস্থিত হয়ে নানারকম চিত্র দেখে৷ গণিকাদের নিয়ে মত্ত হয়ে পুরুষেরা যেভাবে পাপাচারে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয় সে সম্পর্কে রচনাকারও ঘৃণা প্রকাশ করেন৷ মেছুয়া বাজার সম্পর্কে তাই উঠে আসে—‘‘এই সময় সন্ধ্যা হওয়ায় স্থানটির শ্রী ফিরিয়া গেল৷ এখানকার লোকগুলো আর যেন নিরানন্দ কাহাকে বলে জানে না৷ স্বর্গ ও নরক আছে কি না, তাহাও তাহাদের স্মরণ নাই৷ পাপ পুণ্য কাহাকে বলে সে বোধ দূরে পলাইল৷ সকলেই বেশ্যা ও মদে মজিল৷’’৭১ অর্থাৎ বেশ্যা সংস্পর্শে গিয়ে পাপ-পুণ্য, ভালো-মন্দ, স্বর্গ-নরকের ব্যবধানও মুছে যায় তাই আলোচ্য উপন্যাসে সর্বোতভাবে গণিকারা পরিত্যাজ্য৷

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ সুস্পষ্টভাবে গণিকাদের উপর বর্ষিত হয়েছে অপবাক্য৷ তাদের শোষণ-বঞ্চনা-নিপীড়ন কোনো কিছুর প্রতিই দৃষ্টি নেই রচনাকারের৷ তারা তাঁর চোখে শুধু মাত্র পুরুষের জীবন ধ্বংসকারী এবং এক একজন যেন একএকটা জীবন্ত পাপাগার৷ তাদের মুক্তি নেই৷

‘চন্দ্রা’, ‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’, ‘নয়নতারা’ ইত্যাদি উপন্যাসগুলিতেও গণিকাদের প্রতি ঘৃণ্যমনস্কতা ফুটে উঠেছে৷ ‘চন্দ্রা’ উপন্যাসে চন্দ্রার বাবা শুধুমাত্র মিথ্যা সন্দেহবশে স্ত্রীকে ব্যভিচারিণী জ্ঞানে পরিত্যাগ করে গোঁসাই হয়ে যায়৷ স্বামীর দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে চন্দ্রার মা তারা হয় ভিখারিনি৷ আর চন্দ্রা পিতা-মাতা জীবিত থাকতেও তাদের সঙ্গচ্যুত হয়ে অনাথিনীর মত জীবন কাটায়৷ নারীর সতীত্ব সমাজের বুকে এতটাই ঠুনকো যে মিথ্যা সন্দেহ করেও সেই সতীত্বকে অনায়াসে পদদলিত করতে পারে পুরুষসমাজ৷ চন্দ্রার পিতার ভাবনায় শুধু তার স্ত্রীর নয় তার মেয়েও সমান পাতকী৷ স্ত্রীর ব্যভিচারের ফল জেনে মেয়ের প্রতিও তার বিজাতীয় ঘৃণা৷ সোমনাথ তাই জল থেকে চন্দ্রার অচৈতন্য দেহ উদ্ধার করে পরিচর্যা শুরু করলে তাকে পাপীয়সী, পিশাচী বলে সম্বোধন করে৷

‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’-তেও প্রায় একই ঘটনা৷ তার স্ত্রীর ঘরে নায়েবকে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে দেখে মিথ্যা সন্দেহে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে রামেশ্বর স্ত্রীকে, পুত্রকে পরিত্যাগ করে৷ দীর্ঘ বিশ বছর দ্বীপান্তরে থেকে স্ত্রীকে ব্যভিচারিণী কল্পনা করতে করতে শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে এসে এক বারাঙ্গনাকেই স্ত্রী ভেবে বসে এবং বিশ বছর আগে ফেলে যাওয়া পুত্রকে দাবি করে৷ এখানেও পুরুষের মিথ্যা সন্দেহে এক নারীর জীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়; একটি সুখী পরিবার ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়৷ ব্যভিচারিণীদের প্রতি—গণিকাদের প্রতি সমাজ ঘৃণ্য মানসিকতা আরোপ না করলে মিথ্যা সন্দেহে দুটি পরিবার এভাবে নিঃশেষ হয়ে যেত না৷ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে একটু ধৈর্য রাখলেই চন্দ্রার পিতা এবং রামেশ্বরের ভুল ভেঙে প্রকৃত সত্য সামনে আসতে পারতো৷ কিন্তু নারীর সতীত্বে ভ্রষ্টাচারের ছায়ামাত্র দেখলেই সমাজপ্রভুরা দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানে মত্ত হয়ে উঠে৷ সেখানে সত্য-মিথ্যা বিচারের কোনো অবকাশ থাকে না৷

সতী সাধ্বী শিক্ষিতা এবং চরিত্রবতী নয়নতারা ‘নয়নতারা’ উপন্যাসে একজন উদারমনস্ক নারী হয়েও পণ্য নারীদের প্রতি উপেক্ষা প্রকাশে দ্বিধা করেনি৷ তার দৃষ্টিতে সেই রমণীরা ‘বাজারের মেয়ে’ অভিধায় পরিচায়িত৷ এ নিয়ে একাধিকবার তিরস্কারও করেছে তার ভাইকে৷ রচনাকারের উদ্দেশ্য ছিল এই ধরনের বারবনিতার প্রসঙ্গ এনে নয়নতারার চরিত্রকে আরও বেশি ঔজ্জ্বল্য প্রদান করা৷ তাই এখানেও নেতিবাচক দৃষ্টিতে তাদের মূল্যায়ন করা হয়েছে৷

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে উনিশ শতকের প্রায় সব রচনাতেই গণিকারা ক্ষতিকারক এবং সমাজ দূষক৷ কোথাও তাদের মানবিক আবেদনকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি৷ নানা ইতর বিশেষণ প্রয়োগ করে তাদের হীনতাকে আরও ব্যঞ্জনাময় ভাষায় প্রকাশ করেছেন রচনাকারেরা৷ সমাজে সকলের সঙ্গে বসবাস নিয়ে যেমন সমালোচনা করেছেন কেউ, কেউ আবার খারাপ লোকদের সঙ্গদানকারী এবং অপরাধের আকরভূমি হিসেবে বর্ণনা করেছেন তাদের নিবাসস্থলকে৷ তারা সেখানে সর্বোতভাবে পাপী৷ আর সমাজের বিচারে তারাই পুরুষদের পাপপথে নিমজ্জিত করে তাদের ইহকাল পরকাল ভক্ষণ করে৷ এবং বলা হয় তাদের গণিকা হওয়ার পেছনে পুরুষদের কোনো দায় থাকে না৷ অর্থাৎ উনিশ শতকীয় সমাজমনস্কতায় গণিকারা সর্বোতভাবে ঘৃণ্য ও উপেক্ষিত৷ মানুষ হিসেবে অস্তিত্বটুকুকেও কেউ মূল্য দিতে চায়নি৷

বিশ শতকের উপন্যাসগুলিতে গণিকাদের অবস্থানগত পার্থক্য দেখা গেলেও একেবারে প্রথম দিকের সাহিত্যগুলোতে কিন্তু গণিকাদের প্রতি সেই ঘৃণ্য মনস্কতাই প্রকাশ পেয়েছে৷ যেমন পাঁচকড়ি দে এর ‘নীলবসনা সুন্দরী’৷ সেখানে গণিকাদের প্রতি কোনোরকম সহানুভূতির অনুরণন খুঁজে পাওয়া যায় না৷ এটি ডিটেকটিভ উপন্যাস৷ নীলবসন পরিহিতা অজ্ঞাতপরিচয় এক সুন্দরীর মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনই এর উপজীব্য৷ এই প্রসঙ্গে অবতাড়না একাধিক গণিকা চরিত্রের৷ আর এই খুন সম্পর্কে তদারক করতে গিয়ে মনিরুদ্দীনের রক্ষিতা দিলজান খুন হয়েছে বলে গোয়েন্দা দেবেন্দ্রবিজয় যখন মুন্সী সাহেবের বাঁদী সাখিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে তখন একজন গণিকার অপমৃত্যুর খবর শুনে একজন অতিসাধারণ দাসী চরিত্রও ঘৃণায় নাক-সিটকে বলে—‘‘তাই ভাল—একটা বেশ্যা মাগী খুন হয়েছে, তার আবার কথা!’’৭২ এই সামান্যা স্ত্রীর বিচারেও বেশ্যারা মানুষের তুল্যই নয়৷ তাই মৃত্যুর মতো একটা মর্মান্তিক বিষয়ও এভাবে হেলায় উড়িয়ে দিতে পেরেছে৷

সম্ভ্রান্ত গৃহস্থের অন্তঃপুরে গণিকাদের প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ৷ খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে গিয়ে এই ভাবনাই উঠে এসেছে দেবেন্দ্রবিজয়ের চিন্তা থেকে—‘‘দিলজান কেন তাহার সহিত দেখা করিতে যাইবে? দিলজানের কি সহসা এতখানি সাহস হইতে পারে? সে বারাঙ্গনা—মুন্সী জোহিরুদ্দিনের অন্তঃপুরে প্রবেশ করা তাহার পক্ষে সম্ভবপর নহে৷’’৭৩ দিলজানকে সকলে রক্ষিতা পরিচয়ে জানে অর্থাৎ সে সমাজপতিতা৷ উচ্চবংশের পুরুষেরা রক্ষিতা নিয়ে স্ফূর্তি করতে পারলেও তাদের অন্তঃপুরে এই শ্রেণীর পণ্য রমণীর প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ৷ পতিতাদের এইভাবে অবজ্ঞা-অবহেলা এবং অপমানিত জীবন দেখে এবং তাদের সঙ্গে সংসর্গকারীপুরুষ সমাজের অপাপবিদ্ধ সম্মান অনুভব করে সমাজের প্রতি এক সুগভীর প্রশ্ন রেখে গেছেন পণ্যাঙ্গনা মানদা দেবী৷ এক আশ্রমের আচারনিষ্ঠ মোহন্ত যিনি মুমূর্ষ মানদার প্রাণ রক্ষা করে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দেওয়ার বহু চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নি তার, সেই মোহান্তজীর সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ করে তিনি বলেছিলেন—‘‘বাবাজী, আমি মহাপাপী, সমাজে আমার স্থান নাই—পিতা আমায় পরিত্যাগ করিয়াছিলেন৷ কিন্তু আমার মত পাপরতা, পতিতা নারীর পদতলে যে সকল পুরুষ তাহাদের মান, মর্যাদা, অর্থসম্পত্তি, দেহমন বিক্রয় করেছে, ঐ দেখুন, তাদের সমাজ মাথায় তুলে রেখেছে—তারা কবি ও সাহিত্যিক বলিয়া প্রশংসিত, রাজনীতিক ও দেশসেবক বলিয়া বিখ্যাত—ধনী ও প্রতিপত্তিশালী বলিয়া সম্মানিত৷ এমনকি অনেক ঋষি-মোহান্তও গুরুগিরি ফলাইয়া সমাজের শীর্ষস্থানে অধিষ্ঠিত আছেন, তাহা সমাজ জানিয়া-শুনিয়াও নিরব৷ কোর্টে, কাউন্সিলে, করপোরেশনে গুরুগিরিতে কোথাও তাদের কোনো বাধা নাই৷ আর আমরা কবে বালিকা-বয়সের নিবুর্দ্ধিতার জন্য এক ভুল করেছিলাম, তার ফলে এই বারো বৎসর ধরে জ্বলেপুড়ে মরছি৷ এই ত আপনাদের সমাজের বিচার৷’’৭৪ সমাজের প্রতি মানদার এই নিদারুণ বাক্য নিক্ষেপ শুধু মানদার নয় সমস্ত উপেক্ষিত পণ্যাঙ্গনাদের৷

ঊনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগ পর্যন্ত গণিকাশ্রেণীকে যে ঘৃণা, রঙ্গতামাশা, অবজ্ঞার পীড়নে পর্যুদস্ত করে হীন প্রতিপন্ন করার প্রবণতা বর্ধিত হয়েছিল তা থেকে বাঙালি মনস্কতা যেন একটু একটু করে নড়ে উঠছিল৷ অবশ্য এই চিন্তাচেতনা আবর্তিত হয়েছিল পাশ্চত্যের নানারকম সামাজিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে৷ সংবেদনশীল আবেগপ্রবণ বাঙালিসমাজ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নতুন অনুপ্রেরণা লাভ করেছিল যা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করার জায়গা প্রস্তুত করেছিল বারাঙ্গনাদের প্রতি৷ এর মধ্য দিয়ে বাংলা উপন্যাসে গণিকাচরিত্রের বিবর্তনের ভেদরেখাটি স্পষ্ট হয়ে উঠে৷

গণিকারাও যে মানুষ, তাদের মধ্যেও যে প্রেম, প্রীতি, স্নেহ, ভালোবাসা, ত্যাগ, মহত্ত্ব ইত্যাদি মানবিক গুণগুলি বর্তমান এবং সমাজ পরিত্যক্ত হওয়ার দরুণ তারাও যে ভীষণভাবে অনুভব করে মানসিক যন্ত্রণা; বাংলা উপন্যাসে এই গভীর চিন্তা উদ্দীপকপূর্ণ বোধটাকে প্রথম প্রকাশ করলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর দরদি দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে৷ সেখানে তাঁর মূল সুর ছিল নারীর অপ্রকাশিত আত্মিকরূপের, আত্মিকশক্তির ও অলঙ্ঘনীয় ব্যক্তিত্বের আবিষ্কার৷ বস্তুত নারীকে শরৎচন্দ্র চিরকালই শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখেছেন—সেখানে সেই মরমি দৃষ্টি থেকে পতিতা নারীরাও বাদ যায়নি৷ ‘নারীর মূল্য’ প্রবন্ধে নারীর প্রতি তাঁর সুগভীর চিন্তার কথা প্রকাশ পেয়েছে যা সমাজতত্ত্ববিদদের ভাবনা থেকে কোনো অংশেই কম নয়৷ তিনি নিজের হৃদয়ের তাড়নাতেই নারীর দুর্দশার কারণ অনুসন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন৷ আর সে বিষয়ে তাঁকে সাহায্য করেছিল সুগভীর সংবেদনশীলতা এবং অন্তরের স্বচ্ছ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি৷ তিনি তাঁর নিজের তাগিদেই অনুসন্ধান করতে পেরেছিলেন যে নারীরা স্বেচ্ছায় গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করে না, সমাজ ও সংসার তাকে ধীরে ধীরে সে যন্ত্রণাকর জীবনে পা বাড়াতে বাধ্য করে৷ সমাজ এইজন্য দায়ী যে সে অল্পবয়সি বিধবাদের বিয়ে দিতে চায় না, পুরুষেরা বহুবিবাহ করে এবং কুলকামিনীর প্রতি সীমাহীন অত্যাচার করে তাকে গৃহত্যাগ করতে বাধ্য করায়৷ সতীদাহ বন্ধ এবং বিধবা বিবাহের প্রচলন না থাকায় সমাজে এই পাপের বাড়-বাড়ন্ত দেখে সমাজতাত্ত্বিকেরা যখন বিধবাদের সংখ্যাধিক্যকেই দায়ী করেন তখন শরৎচন্দ্র নিজের তাগিদে সমীক্ষা চালিয়ে মন্তব্য করেন—‘‘আমি হিসাব করিয়া দেখিয়া বিস্মিত হইয়া গিয়াছিলাম যে, এই হতভাগিনীদের শতকরা সত্তর জন সধবা৷ বাকী ত্রিশটি মাত্র বিধবা৷ ইহাদের প্রায় সকলেরই হেতু লেখা ছিল, অত্যধিক দারিদ্র্য ও স্বামী প্রভৃতির অসহনীয় অত্যাচার-উৎপীড়ন৷ সধবাদিগের প্রায় সবগুলিই নীচজাতীয়া এবং বিধবাদিগের প্রায় সবগুলিই উচ্চজাতীয়া৷ নীচজাতীয়া সধবারা এই বলিয়া জবাবদিহি করিয়াছিল যে, খাইতে-পরিতে তাহারা পাইত না,—দিনে উপবাস করিত, রাত্রে স্বামীর মারধর খাইত৷ সৎ-কুলের বিধবারাও কৈফিয়ত দিয়াছিল—কেহ বা ভাই ও ভ্রাতৃজায়ার, কেহ-বা শ্বশুর-ভাসুরের অত্যাচার আর সহ্য করিতে না পারিয়া এই কাজ করিয়াছে৷’’৭৫ সমাজের নারীর সেই শোচনীয় অবস্থা এবং পুরুষের সর্বপাপ মার্জনার বিষয়টিও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি৷ সেই বৈপরীত্যের কথাও ‘নারীর মূল্য’-তে স্পষ্ট—‘‘এদিকে পুরুষ যেমন দরিদ্র ও কহনাতীত উৎপীড়নে নারীর স্বাভাবিক শুভবুদ্ধিকে বিকৃত করিয়া দিয়া ঘরের মধ্যে তাহাকে অতিষ্ট করিয়া তোলে, অন্যদিকে তেমনি তাহাকেই আপাতমধুর সুখের প্রলোভনে প্রতারিত করিয়া ঘরের বাহির করিয়া আনে৷ পুরুষের ভয় নাই, সে যদিচ্ছা সুখ ভোগ করিয়া ফিরিয়া যাইতে পারে৷… আত্মীয়স্বজন তাহার পুনরাগমনে খুশী হইয়া সাহস দিয়া বলিতে থাকে, ‘‘তার আর কি? ও অমন হইয়া থাকে,—পুরুষের দোষ নেই৷ এস বাহিরে এস৷’’ সেও তখন হাসিমুখে বাহির হয় এবং গলা বড় করিয়া প্রচার করিতে থাকে, নারীর পদস্খলন কিছুতেই মার্জনা করা যাইতে পারে না৷… যে কারণেই হউক, যে নারী একটিবার মাত্রও ভুল করিয়াছে, হিন্দু তাহার সহিত কোন সংশ্রব রাখে না৷ ক্রমশঃ ভুল যখন তাহার জীবনে পাপে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, দিন দিন করিয়া যখন তাহার সমস্ত নারীত্ব নিঙরাইয়া বাহির হইয়া যায়—যখন বেশ্যা—তখন, আবার তাহার অভাবে হিন্দুর স্বর্গও সবার্ঙ্গসুন্দর হয় না৷’’৭৬ পতিতা নারীর জীবনের দুঃখ যন্ত্রণাকে উপলব্ধি করে সমাজের চোখে তার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে তাঁর উপন্যাসগুলি আকর হিসেবে কাজ করেছে৷ তিনি সাহিত্যে নতুন ‘স্টাইল’ আনয়নের জন্য নয় অন্তরের তাগিদেই নতুন ভাবনায়, নতুন রূপে এই জাতীয় চরিত্রের উপস্থাপন ঘটিয়েছিলেন৷

সতী-অসতীর ভাবনাকে নতুন দিকে মোড় ঘুরিয়ে সমাজে ঝড় তুলে দিয়েছিলেন ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসের মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক ও সমাজতাত্ত্বিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ নারীর নারীত্ব, সতীত্ব ইত্যাদি প্রচলিত রক্ষণশীল বিশ্বাসগুলিকে আঘাত করে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন রচনাকার৷ তাই এই উপন্যাসটি যত বিরূপ সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিল তাঁর আর কোনো রচনা (শেষ প্রশ্ন ছাড়া) এত তীব্র মুখনাড়া সহ্য করেনি৷ হয়তো লেখকের বক্তব্য উপন্যাসটিতে যুগের চেয়ে একটু বেশিই ‘আধুনিক’ হয়ে পড়েছিল৷ সাবিত্রী, কিরণময়ী ইত্যাদি গৃহস্থ কুলীন কন্যাদের কুলটা-ব্যভিচারিণী করেও শেষপর্যন্ত কলঙ্কের ক্লেদ মুছিয়ে পাঠকের সহানুভূতি প্রদান করেছিলেন৷ দুজনের কেউই দেহব্যবসায়ী নয়, অবৈধ যৌনচারে লিপ্ত হয়ে দেহিক শুচিতাকেও যে তারা ক্ষুন্ন করেনি লেখক একথা স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করেছেন কিন্তু সেই স্বৈরিণীতুল্য নারীচরিত্রগুলিকে ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে যে সকল স্থানে নিক্ষিপ্ত করেছেন সেই পরিবেশে দৈহিক সতীত্ব অক্ষুন্ন রাখাও সম্ভব বলে মনে হয় না৷

উপন্যাসের নায়িকা কিরণময়ী৷ যেভাবে চরিত্রটিকে অঙ্কন করেছিলেন তিনি তাতে সে যুগের প্রেক্ষিতে সে সতী নয়৷ অভিষ্ট সিদ্ধ করতে গিয়ে, নিজের জেদ পূরণ করতে গিয়ে সমাজের চোখে অঘটনপটিয়সী সমাজদূষক৷ সে কামনা-বাসনাময় একজন নারী৷ স্বামী মৃত্যু শয্যায় জেনেও যত্ন করে চুল বাঁধে, কপালে কাচপোকার টিপ পড়ে৷ নীতিবান যুবক উপেন্দ্র তার স্বামী হারাণের রুগ্ন শয্যার পাশে কিরণময়ীর সেই অতুলনীয় রূপচর্চা দেখে ঘৃণায় শিউরে উঠে৷ তাই প্রথম দর্শন করে যাকে ভুবনমোহিনী মনে হয়েছিল পরক্ষণেই তার প্রতি বিরূপ ধারণা জন্মে৷ তার প্রতি উপেন্দ্রর যে মনোভাব তা আসলে সমাজপ্রভুদের নারীর প্রতি রক্ষণশীল মনোভাব—‘‘কোথায় গেল ঐ অতুল রূপ! কোথায় গেল ঐ হাসি; তাহার দৃষ্টির সম্মুখে যেন কোন এক প্রেতলোকের পিশাচ উঠিয়া আসিল৷ সে ভাবিতে লাগিল, স্বামী যার এই, সে আবার হাসে, পরিহাসে যোগ দেয়, খোঁপা বাঁধে, টিপ পরে! এক মুহূর্তের জন্য তাহার সমস্ত নারীজাতির উপরেই ঘৃণা জন্মিয়া গেল৷’’৭৭ শুধু উপেন্দ্র কেন মৃত্যু পথযাত্রী স্বামীর দুর্দশার মধ্যে স্ত্রীর সাজ গোজ করে হাসি-ঠাট্টায় যোগ দেওয়া উপেন্দ্রর বন্ধু সতীশের কাছেও তীর্যক হয়ে দেখা দিয়েছে৷ তাই তার চোখে কিরণ ভাল লোক নয়৷ উপেন্দ্রকে সাবধান করে বলেছে—‘‘খাল খুঁড়ে কুমীর এনো না উপীনদা৷’’৭৮ সতীশ সেই পুরুষ শ্রেণীর প্রতিনিধি যে উপন্যাসের আর এক কুলটা নারী সাবিত্রীর প্রতি প্রণয় নিবেদনে দ্বিধা করে না, ইয়ারবন্ধুদের সঙ্গে ‘অস্থানে-কুস্থানে’ গিয়ে মদ্যপ হয়ে বাসায় ফিরে আসে৷ সেই সতীশের মুখে নারীর প্রতি অমন তাচ্ছিল্যসূচক বাক্য শুনে বিস্ময় উৎপন্ন হলেও অবিশ্বাস করা যায় না৷ তখনকার সামাজিক পরিস্থিতিই তাই৷ যাদের দ্বারা যত বেশি নারী অসতী হবে তাদের দ্বারা ততবেশি নারীর সতীত্বে বড়াই ঘোষিত হবে৷

কিরণময়ী বুদ্ধিমতী, শিক্ষিতা, তার্কিকতায় সিদ্ধহস্ত৷ রূপবতী এই নারী তার জীবনের সমস্ত সুখ দুঃখ, শখ-আহ্লাদ স্বামীর সারস্বত সাধনার মধ্যে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল৷ স্বামী হারাণ তার অগাধ পাণ্ডিত্য দিয়ে স্ত্রীকে পারদর্শী করে তুললেও পুরুষ হয়ে নারীর অবরুদ্ধ কামনাকে পরিতুষ্টি দান করতে পারেনি৷ তাই তত্ত্বভার দিয়ে অবদমিত করে রাখা দুরন্ত কামনা-বাসনা স্বামী রোগশয্যা নিলে মুক্ত হওয়ার জন্য গর্জন করতে থাকে; দিশেহারা হয়ে যায় সে প্রবৃত্তির নির্মম পীড়নে৷ এদিকে সংসারেও অভাবের ছায়া—স্বামীর বিপুল চিকিৎসার ভার, সর্বোপরি অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থাপনায় শাশুড়ি অঘোরময়ীও বধূর রূপরাশিকে অবলম্বন করতে তৎপর হয়ে উঠে৷ তার রূপবহ্নিতে এবং শাশুড়িমাতার প্রচ্ছন্ন ইন্ধনে কামার্ত অনঙ্গডাক্তার সহজেই ঝাঁপ দেয় সেখানে৷ কিরণকে ভোগ করার লোভেই বিনা পারিশ্রমিকে, বিনা খরচে মুমূর্ষু হারাণের চিকিৎসাভার গ্রহণ করে৷ তার কামনার সেই প্রজ্জ্বলিত হুতাশনে ঘৃতাহুতি দেয় উপেন্দ্র ও সতীশ৷ স্বামীর তাকে বঞ্চিত করে উইল করার প্রস্তাব এবং উপেন্দ্র ও সতীশের তীব্র অপমান তাকে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য করে তোলে৷ তার সেই মানসিক অভিব্যক্তি লেখকের বর্ণনায় সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে—‘‘উপেন্দ্র ও সতীশ চলিয়া গেলে কবাট রুদ্ধ করিয়া সেইখানেই কিরণময়ী দাঁড়াইয়া রহিল৷ অন্ধকারে তাহার চোখ দুটো হিংস্র জন্তুর মতই জ্বলিতে লাগিল৷ তার মনে হইতে লাগিল, ছুটিয়া গিয়া কাহারো বক্ষঃস্থলে দংশন করিতে পারিলে সে বাঁচে৷ হাতে দীপটা উঁচু করিয়া ধরিয়া উন্মাদ ভঙ্গী করিয়া বলিল, আগুন ধরিয়ে দেবার উপায় থাকলে দিতুম৷ দিয়ে যেখানে হোক চলে যেতুম৷ ডাকাডাকি চেঁচামেচি করে একটু একটু করে পুড়ে মরত, শত্রুতা করবার সময় পেত না৷’’৭৯ কিরণময়ীর প্রতি শাশুড়িমাতা অঘোরময়ীর ভালোবাসা ছিল না৷ পুত্র অথর্ব হয়ে গেলে বধূর রূপ এবং যৌবনই তার হাতিয়ার হয়ে উঠে৷ তাঁর সম্পর্কে লেখক বলেছেন—‘‘তাঁহার রূপসী বধূ যে ইদানিং সতীধর্মেরও সম্পূর্ণ মর্যাদা বহন করিয়া চলে না, ইহাও তিনি বুঝিতেন৷ কিন্তু, পুত্র তাঁহার মৃতকল্প, দুঃসহ দুঃখের দিন সমাগতপ্রায়৷ এই মনে করিয়াই বোধ করি, বধূর বিসদৃশ আচার-ব্যবহারও উপেক্ষা করিয়া চলিতেন৷ যে ডাক্তার হারানের চিকিৎসা করিতেছিল, সে যে কি আশায় বিনা ব্যয়ে ঔষধপথ্য যোগাইতেছে, কেন সংসারের অর্ধেক ব্যয়ভারও বহন করিতেছে, ইহা তাঁহার অগোচর ছিল না৷’’৮০ শুধু ডাক্তারের ক্ষেত্রেই প্রচ্ছন্ন ইন্ধন দান নয় উপেন্দ্র এসে যখন ছেলে এবং সংসারের দেখভালের দায়িত্ব গ্রহণ করে তখন তাকে প্রলুব্ধ করতে বধূকে তার দিকে ঠেলে দিতে দেখা যায়৷ সে উপীনের আসার প্রহর গুণে বধূকে বলে—‘‘তা হোক—নীচে যে অন্ধকার, একটু বেলা থাকতেই সিঁড়ির আলোটা জ্বেলে দেওয়া ভাল৷ এখনি হয়ত উপীন এসে পড়বে, কাল থেকে সে আসেনি—কৈ বৌমা, এখনো তোমার ত গা-ধোয়া, চুল-বাঁধা হয়নি দেখচি—কি কচ্ছিলে গা এতক্ষণ?’’৮১ শাশুড়িমাতা নিজের স্বার্থের খাতিরে বাসনার যে চোরাপথে বধূকে পতিত হওয়ার ইন্ধন জোগান দিয়েছে সেখানে আঘাত হেনেছিল উপীন তার আদর্শ চরিত্রের দোহাই দিয়ে৷ উপেন্দ্রর সেই ঘৃণার জবাব দিতে অথবা উপেন্দ্রকে বশীভূত করতে হঠাৎ করে তাই সে পাতিব্রত্যের উপাসক হয়ে উঠে৷ পতিব্রতার পরাকাষ্ঠায় নিজেকে উজাড় করে দিয়ে মনোযোগ আকর্ষণ করে উপেন্দ্রর৷ চরিত্রবানযুবক উপেন্দ্রকে বশীভূত করে তাকেও তার চরণের দাস হিসেবে প্রতিপন্ন করার পেছনে হয়তো তার লুন্ঠিত নারীত্বের প্রতিশোধস্পৃহা অনেকাংশে কাজ করেছিল৷ যে উপেন্দ্র সাধ্বী স্ত্রী সুরবালার সঙ্গে দাম্পত্য প্রণয়ে বিহ্বল হয়ে কিরণের মতো অসতী নারীদের প্রতি তীব্র ঘৃণাভাব পোষণ করতে দ্বিধা করেনি কিরণের নতুন আচরণে আবার সে মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়৷ কিরণময়ীকে দেখে তার মনে হয়—‘‘স্ত্রীলোক সম্বন্ধে তাহার জ্ঞানের মধ্যে মস্ত ভুল ছিল৷ এমন নারীও আছে, যাহার সম্মুখে পুরুষের অভ্রভেদী শির আপনি ঝুঁকিয়া পড়ে৷ জোর খাটে না, মাথা অবনত করিতে হয়৷ এমনি নারী কিরণময়ী৷’’৮২ কিরণময়ীর মধ্যে রয়েছে দার্শনিকতা, নাস্তিক্য নৈয়ায়িক বুদ্ধি সর্বোপরি এক বিচক্ষণ নারীমনন৷ স্বামীর আসন্ন মৃত্যু সামনে জেনেও ধীর-স্থির ভাবে সেই বিপদটাকে সামলানোর ক্ষমতা সে রাখে আবার তার স্বামীর সেবা করতে করতে শ্রান্ত-অবসন্ন হয়ে যাওয়া উপেন্দ্রকেও বিশ্রামের অবসর করে দিতে পারে৷ তার ভেতরকার অবরুদ্ধ বাসনা প্রেমের মূর্তি ধরে নবরূপ লাভ করে উপীনকে দেখার পর থেকে৷ তার এই প্রেমই আবার ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে উপেনের সঙ্গে সুরবালার দুষ্টু মিষ্টি দাম্পত্য সম্পর্ক সচক্ষে প্রত্যক্ষ করার পর৷ তারপর বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হয়েও সে প্রেমের বিভা এতটুকু ম্লান হয় না৷

কিরণময়ী তার স্বামীর কাছ থেকে আর কিছু পাক না পাক, পেয়েছিল সুবিশাল তাত্ত্বিক জ্ঞানের ভাণ্ডার৷ তা তাকে তার্কিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে৷ আর সর্বদাই তার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে নিজের মধ্যে একটা নিঃসংকোচের বাতাবরণ তৈরি করে নেয়৷ সেই সাহসেই তার ভেতরের অব্যক্ত প্রণয়বাসনার কথা নিঃসংকোচে উপেন্দ্রর কাছে প্রকাশ করে বলতে পারে—‘‘যাক, তোমাকে যে ভালবাসি তা জানিয়ে দিয়ে আমি বাঁচলুম৷ এখন তোমার যা খুশি করো, আমার কিছুই বলবার নেই৷’’৮৩ কিরণময়ী স্বামীর সান্নিধ্যে বাসনাকে জয় করার শিক্ষা না পেলেও নিজের মনোবৃত্তিগুলিকে সহজে প্রকাশ করার শিক্ষা লাভ করেছিল৷ চরিত্রবান উপীন একজন বিধবা নারীর প্রণয় স্বীকৃতি পেয়ে হয়তো বর্তে গিয়েছিল৷ কৃতজ্ঞতা স্বরূপ ভাই সম্পর্কিত এক অল্পবয়সি যুবক দিবাকরকে তার কাছে রেখে দিয়েছিল লেখাপড়া ও তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব দিয়ে৷ কিন্তু ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয় বাড়ির ঝি-এর তাৎক্ষণিক বিরক্তির সূত্র ধরে৷ কিরণময়ীর কর্তৃসুলভ উষ্মার জবাব দিতে গিয়ে উপেন্দ্রকে নিয়ে আসা অঘোরময়ীর আহ্বানে দরজা খুলতে খুলতে বলে—‘‘কানের মাথা চোখের মাথা না খেলে কি আর তোমার বাড়িতে কেউ চাকরি করতে আসে মা? এবার চোখকানবালা কাউকে রাখো গে মা, আমাকে জবাব দাও৷’’৮৪ ঝি এর বিরুক্তিসূচক এই কয়টা কথাতেই উপেন্দ্রর মনে বিষবৃক্ষের বীজ রোপিত হয়ে যায়৷ তারপর ঝি যখন আরও বলে—‘‘দেওরকে নিয়ে সারাদিন সোহাগ হচ্চে—আর কি হবে!’’৮৫ তাতেই সে বীজ মুহূর্তে অঙ্কুরিত হয়ে উঠে৷ আর দিবাকরের প্রতি সামান্য অসন্তোষের শোধ তুলতে গিয়ে যখন অঘোরময়ী বলে—‘‘কি করে খবর জানবে উপীন? দু’জনের কি যে রাতদিন ফষ্টি-নষ্টি, হাসি-তামাশা, ফুস-ফুস গল্প-গুজব হয় তা ওরাই জানে!’’৮৬ আর এর মধ্য দিয়েই অঙ্কুরিত বিষবৃক্ষ ডালপালা বিস্তার করে ভয়ানক আকার ধারণ করে৷ শাশুড়ি যেন বধূর প্রতি ঈর্ষা প্রকাশ করতে গিয়ে একরাশ কলঙ্কের কালিমা ছিটিয়ে দেয় কিরণময়ীর উপর৷ এভাবে নিজের স্বার্থ-রাগ-বিরক্তি ইত্যাদির পরিণতি স্বরূপ নারীরাও নারীদের ব্যভিচারিণী করে তোলে সমাজের চোখে৷ কিরণময়ী পুনরায় পতিত হয় উপেন্দ্রর চোখে৷ কিন্তু সমাজের অত্যাচার-অপবাদ মুখ বুজে সহ্য করার মতো নারী কিরণ নয়৷ সে যুগের প্রেক্ষিতে অনেকটাই স্বাধীন প্রবৃত্তির৷ তাই তীব্র শ্লেষে উপেন্দ্রর ঘৃণার জবাব দিয়ে বলে—‘‘তোমার রাগ বল, ঘৃণা বল ঠাকুরপো, সমস্ত দিবাকরকে নিয়ে ত? কিন্তু বিধবার কাছে সেও যা, তুমিও ত তাই৷ তার সঙ্গে আমার সম্বন্ধটা কতদূর গিয়ে দাঁড়িয়েচে, সেটা শুধু তোমার অনুমান মাত্র৷ কিন্তু সেদিন যখন নিজের মুখে তোমাকে ভালবাসা জানিয়েছিলুম, তখন ত আমার দেওয়া খাবারের থালাটা এমনি করে ঘৃণায় সরিয়ে রাখোনি! নিজের বেলা বুঝি কুলটার হাতের মিষ্টান্নে ভালবাসার মধু বেশী মিঠে লাগে ঠাকুরপো?’’৮৭ কিরণ যথার্থই ভালোবেসেছিল উপেন্দ্রকে৷ তাই তীব্র শ্লেষে তাকে বিদ্ধ করার পরও তার লুন্ঠিত নারীত্ব উপেন্দ্রর চলে যাওয়ার সময় তার দু’পা আঁকড়ে সবকিছু যে মিথ্যে সন্দেহমাত্র তা বলার চেষ্টা করেছে৷ কিন্তু সে তো পুরুষমানুষ৷ তাকে ভালোবাসা এক বিধবা রমণীর মধ্যে ভ্রষ্টাচারিণীর প্রতিবিম্ব চিত্রিত করে ফেলেছে৷ তাই কিরণের কোনো কথা না শুনে তাকে ঠেলেফেলে দিয়ে ‘‘নাস্তিক! অপবিত্র, ‘ভাইপার’!’’৮৮ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করে ত্যাগ করে চলে গেছে৷ প্রচণ্ড আক্রোশে তার লাঞ্ছিত নারীত্ব সেই তীব্র অপমানে পুনরায় গর্জন করে উঠেছে৷ লেখক তার সেই অবস্থাকে বুঝিয়েছেন—‘‘অনেকদিন পূর্বে ঠিক এইখানে দাঁড়াইয়া তাহার দুই চোখে এমনি উন্মত্ত চাহনি, এমনি প্রজ্জ্বলিত বহ্নিশিখা দেখা দিয়াছিল, যেদিন সতীশকে সঙ্গে করিয়া উপেন্দ্র প্রথম দেখা দিয়া বাহির হইয়া গিয়াছিলেন৷ আবার আজ শেষ বিদায়ের দিনেও তাহার বিরুদ্ধে সেই দুটি চোখের মধ্যে তেমনি করিয়াই আগুন জ্বলিতে লাগিল৷’’৮৯ সেই তীব্র অপমানের প্রতিশোধ নিতে সে উপেন্দ্রর অত্যন্ত স্নেহাস্পদ দিবাকরের সর্বনাশ করতে সংকল্প নেয়৷ ঝি কে একজোড়া রূপার মোটা মল ঘুষ দিয়ে দিবাকরকে নিয়ে আরাকানে পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা করে৷ কিরণময়ী সমাজের ছুড়ে দেওয়া মিথ্যা অপবাদের কলঙ্ককর্দম পুনরায় সেই দিকেই ছুড়ে দিয়েছিল কিন্তু তার দ্বারা নিজেও কম বিভূষিত হয়নি৷ উপেন্দ্রকে শাস্তি দিতে ব্যবহার করেছিল দিবাকরকে৷ আরাকানে বাড়িউলি মাসির দেহব্যবসায়ে নিযুক্তিকরণের সক্রিয় তৎপরতা, দিবাকরের তার প্রতি তীব্র যৌন পিপাসার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে প্রাণপণ যুঝতে হয়েছে তাকে৷ শেষে সমস্ত দুর্যোগের হাত থেকে তাকে রক্ষা করে সতীশ পুনরায় উপেন্দ্রর নির্দেশেই দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে৷ উপেন্দ্রও নিজের ভুল বুঝতে পেরে মৃত্যুর পূর্বে সতীশকে বলেছে—‘‘ওঁর অন্তরের আঘাত যে কত দুঃসহ, সে উপলব্ধি করার শক্তি নেই আমাদের, কিন্তু সে যত নিদারুণ হোক, অত বড় বুদ্ধিকে চিরদিন সে আচ্ছন্ন করে রাখতে পারবে না৷’’৯০

কিরণময়ী অবস্থার বিপাকেই হোক আর প্রতিশোধ নিতেই হোক তার রূপ এবং দেহটার দ্বারা একাধিক পুরুষকে বশীভূত করেছে৷ অনঙ্গ ডাক্তার, উপেন্দ্র, দিবাকর কেউ বাদ পড়েনি৷ বিধবা হয়েও কুলটার মতো রাতের অন্ধকারে দিবাকরকে সাথে নিয়ে আরাকানে পাড়ি দিয়েছে, ছমাস একত্র একঘরে অবস্থান করেছে তার প্রতি মুগ্ধ দিবাকরের সঙ্গে৷ তাদের আশ্রয় নেওয়া বাড়িটিও একটা বেশ্যালয় যেখানে বাড়িউলি মাসি নানাভাবে প্ররোচিত করেছে বেশ্যাবৃত্তির প্রতি৷ সমাজের চোখে তার সম্পূর্ণ আচরণ ব্যভিচার দোষে দুষ্ট৷ এমন নারীর প্রতিও লেখক আরোপ করেছেন ক্ষমাসুন্দর মনোভাব৷ শেষে সতীশ যখন তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য আরাকানে উপস্থিত হয়েছে তখন সমাজে তার যে আর ঠাঁই হবে না সে সম্পর্কে নিজেই বলেছে ‘ঠাকুরপো, সমাজ আছে ত?’’৯১ সতীশ তার প্রত্যুত্তর দিয়ে বলেছে—‘‘না নেই৷ যার টাকা আছে, গায়ের জোর আছে, তার বিরুদ্ধে সমাজ নেই৷’’৯২ সতীশের এই কথায় সমাজের সত্য ও নগ্ন এক রূপচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে৷ সমাজ চিরকাল ক্ষমতাওয়ালার৷ নারী পুরুষের তুলনায় কোমল, নরম তাই পুরুষ অনায়াসে তাকে পর্যুদস্ত করে৷ কিন্তু কোনো ক্ষমতাবান মানুষের সাহায্য পেলে পতিতা নারীরাও অনেক সময় বর্তে যায়৷ কিরণময়ী সেই জোরেই সতীশের সঙ্গে কলকাতায় ফিরে আসে৷ কিন্তু উপেন্দ্রর মর্মান্তিক পীড়া শেষ পর্যন্ত তাকে অপ্রকৃতিস্থ করে তোলে৷

লেখক অত্যন্ত দরদের সঙ্গে কিরণময়ীর জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাত তার ভ্রষ্টাচারের কারণ উল্লেখ করেছেন৷ সেখানে তার সেই আচরণের দায় আরোপিত হয়েছে তার স্বামী-শাশুড়ি সর্বোপরি সামাজিক পরিবেশের উপর৷

এই উপন্যাসের আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সাবিত্রী৷ সে ব্রাহ্মণ ঘরের বালবিধবা৷ ভগ্নীপতি ভুবন মুখোপাধ্যায়ের বিয়ের প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে ঘর ছাড়ে সে৷ কিন্তু সে ভুল ভাঙতে দেরি হয় না তার৷ জামাই বাবু তাকে রেখে দেয় এক ভাড়া করা বাড়িতে৷ সাবিত্রীর সেই বাসাবাড়িও এক বেশ্যালয়ের নামান্তর৷ বিপিনের মতো মদ্যপ যুবকদের সেখানে প্রতিনিয়ত যাওয়া-আসা, বাড়ির কর্ত্রীর মদ খেয়ে নিজের যৌবনের বিলাসী জীবনের বর্ণনা কি নেই সেখানে৷ সতীশ যখন প্রথম সাবিত্রীর সেই বাসাবাড়িতে উপস্থিত হয় তখন তাকে দেখে সাবিত্রীর উদ্দেশ্যে মাসির বলা কথাগুলিও এক হিসেবে গণিকালয়ের গৃহকর্ত্রী মাসির জীবন্ত ভাষ্যরূপ—

‘‘এমন বুদ্ধি না হলে আর দাসীবৃত্তি করতে যাস! কোথায় তুই নিজে দাসী-চাকর রাখবি, না—

সাবিত্রী হাসিয়া বলিল, নিজেই দাসী হয়ে আছি, তাতেই বা দোষ কি মাসী, খেটে খেতে লজ্জা নেই৷

মোক্ষদা রাগিয়া বলিল, কে বললে নেই? আমার মত বয়সে না থাকতে পারে, কিন্তু তোর বয়সে আছে৷ তা থাক না থাক, বাবুকে যখন খেতে বলেছিস, তখন বসে থেকে খাওয়াগে যা৷ মানুষের কপাল ফিরে যেতে বেশী দেরি লাগে না!… আর একটা কথা তোকে বলে রাখি বাছা৷ ভগবান কপালের মাঝখানে যে দুটো চোখ দিয়েছেন সে দুটো একটু খুলে রাখিস৷ ঘড়ির চেন, হীরের আংটি না থাকলেই মানুষকে ছোটো মনে করিস নে৷…’’৯৩ বলা বাহুল্য মাসির এই উপদেশবাণী সাবিত্রীকে গণিকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার দিকনির্দেশমাত্র৷

সাবিত্রী ঘর বাঁধার আশায় কুলটা হয়েছিল ঠিকই কিন্তু যখন বুঝতে পারে তার জামাইবাবু তাকে বিয়ে না করেই ভোগ করতে চায় তখন থেকেই নিজেকে সাবধান করে নেয়৷ তার অনুগ্রহ থেকে বাঁচার জন্য বেশ্যাবাড়িতে ভাড়া থেকেও অন্য আর এক বাসায় ঝি-এর কাজ করে৷ একুশ-বাইশ বছর বয়সি এই সুন্দরী যুবতীবিধবা অনায়সেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে সতীশ নামের এক উশৃঙ্খল ধনীর দুলালের৷ তার আকর্ষণে-প্রত্যাখ্যানে হাবুডুবু খেতে খেতে এক সময় দুজন-দুজনের মনের সন্ধান পায়৷ সতীশ তার ভালোবাসার কথা প্রকাশ করলেও সাবিত্রী দ্ব্যর্থক ইঙ্গিতে তাকে নাচিয়ে চলতে থাকে৷ সাবিত্রী কখনোই চায়নি তার মতো এক কুলত্যাগিনীকে ভালোবেসে সতীশ সমাজের কলঙ্কের ডালা মাথায় তুলে নিক তাই তাকে অপমান করে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে নিজেই মূর্ছিত হয়ে গেছে৷ প্রেমে-ভালোবাসায়-ত্যাগে-মহত্ত্বে মহান সে৷ কুলটার শিরোপা সে আগেই গ্রহণ করেছে, মাসির বাড়িতে ভাড়া থেকে মাসির দৃষ্টিতে বা তার মতো মানুষের নজরে পতিতাই সে৷ সতীশের প্রেমে কলুষতা ছিল না৷ তাই তার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে তার সঙ্গে ঘরকন্নায় মেতে উঠলে সমাজের নতুন করে কিছুই বলার ছিল না৷ মরার উপরে খাড়ার ঘা কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা মানুষ যতটা ব্যঞ্জিত করে প্রকাশ করে মরার তা বিন্দুমাত্র উপলব্ধি হয় না৷ সাবিত্রীরও তাই৷ সে কুলটা হয়ে আগেই পতিত হয়েছে৷ নারীজীবনের সর্বোচ্চ সম্মান থেকে বিচ্যুত হয়েছে৷ পুনরায় সমাজ আর তার কি করবে৷ কিন্তু তার নিজের নতুন করে কিছু করতে না পারলেও তা যে তার প্রেমাস্পদকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরবে! আর যাকে ভালোবাসা যায় তার সামান্যতম ক্ষতিও সহ্য করা সম্ভব হয় না৷ সেও তা পারে না৷ সতীশের দুর্বার প্রেম সম্ভাষণে, তার বিয়ের প্রস্তাবকেও প্রত্যাখ্যান করে বলে—‘‘আমি বিধবা, আমি কুলত্যাগিনী, আমি সমাজে লাঞ্ছিতা, আমাকে বিয়ে করার দুঃখ যে কত বড়, সে তুমি বোঝনি বটে,… সমাজ আমাকে চায় না, আমাকে মানে না জানি, কিন্তু আমি ত সমাজ চাই, আমি ত তাকে মানি৷ আমি ত জানি শ্রদ্ধা ছাড়া ভালোবাসা দাঁড়াতে পারে না… তোমাকে এত দুঃখ দিলুম, কিন্তু কিছুতে এই দেহটা দিতে পারলুম না!… আমার এই দেহটা আজও নষ্ট হয়নি বটে, কিন্তু তোমার পায়ে দেবার যোগ্যতাও এর নেই৷ এই দেহ নিয়ে যে আমি ইচ্ছে করে অনেকের মন ভুলিয়েচি, এ ত আমি কোনমতেই ভুলতে পারব না!’’৯৪ সাবিত্রীর তার কোমলতা দিয়ে নিষ্কলুষ ভালোবাসা দিয়ে সমস্ত কলুষতাকে ছাপিয়ে পবিত্রতম হয়ে উঠেছে এই ত্যাগের মধ্য দিয়ে৷ নারীর নৈতিকতা, পবিত্রতা, সতীত্ব সম্পর্কে রক্ষণশীল মনোভাবাপন্ন উপেন্দ্রও তাকে সহোদরা জ্ঞানে স্নেহ করে তার কোলে মাথা রেখে মৃত্যু শয্যা পাততে দ্বিধাবোধ করেনি৷ লেখক তাকে মহানতার অত্যুচ্চ শিখরে প্রতিষ্ঠা দিয়ে কুলটা থেকে নারীত্বের মহিমামণ্ডিত মানবীতে রূপান্তরিত করেছেন৷

কিন্তু ‘চরিত্রহীন’-এর সেই নিম্নশ্রেণীর দেহজীবী বারাঙ্গনা আরাকানে যার গৃহে অর্ধবৎসরকালব্যাপী সময় অতিবাহিত করেছিল দিবাকর ও কিরণময়ী তার মধ্যে কিন্তু নারীর কোনো মহানুভবতার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেননি রচনাকার৷ লোভে-ঈর্ষায়-দক্ষতায় পরিপূর্ণ বেশ্যা সে৷ অর্থই তার জীবনের পরমার্থ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে৷

‘দেবদাস’ উপন্যাসের চন্দ্রমুখী রূপপসারিণী বাইজি৷ লেখক তাঁর সংবেদনশীল মন দিয়ে এই বারবিলাসিনী নারীকেও অসামান্য দক্ষতায় অঙ্কন করেছেন৷ স্নেহ ভালোবাসা-ত্যাগ-মহানতা কোনোকিছুই বাদ পড়েনি তার চরিত্রে৷ উপন্যাসটির নায়িকা পার্বতী হলেও চন্দ্রমুখী প্রায় তার মতোই গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র৷ রূপে দক্ষতায় অসামান্য সে৷ দেবদাসের ঘৃণার আঘাতে দেহপসারিণীর প্রাচীর ভেঙে তার পবিত্রতম নারীসত্তাটি বাইরে বেড়িয়ে আসে৷ ছেলেবেলায় যাকে প্রেম ভেবে ঘর থেকে প্রথম বেড়িয়ে এসেছিল, পড়ে সামান্য গহনার কারণে সেই ঠুনকে প্রেমস্তম্ভ ধূলিসাৎ হয়ে দেহজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল তাকে, দেবদাসের প্রতি নিষ্কাম প্রেমে তার প্রেমের সত্যরূপটি উদ্ভাসিত হয়ে উঠে৷ গণিকাবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে এক অচেনা গ্রামে গিয়ে সাধারণভাবে জীবন যাত্রা শুরু করে দেয়৷ সেখানে যাওয়ার আগে পার্বতীর অনুসঙ্গে নিজের মনের সমস্ত কথা প্রকাশ করে ফেলে দেবদাসের কাছে৷ পার্বতী প্রসঙ্গে যে সমস্ত কথা দেবদাসকে জানায় তাতে নারীর প্রতি নারীর অনুভবের যে আন্তরিকতা তা প্রকাশ হয়৷ সে দেবদাসকে বলে—‘‘মাঝে মাঝে নেশার ঘোরে তোমার মুখ থেকে অনেক কথাই শুনেচি৷ কিন্তু তবুও আমার বিশ্বাস হয় না যে, পার্বতী তোমাকে ঠকিয়েচে৷ বরঞ্চ মনে হয়, তুমি নিজেই নিজেকে ঠকিয়েচ৷ দেবদাস, আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়, এ সংসারে অনেক জিনিস দেখেচি৷ আমার কি মনে হয় জান? নিশ্চয় মনে হয়, তোমারই ভুল হয়েচে৷ মনে হয়, চঞ্চল এবং অস্থিরচিত্ত বলে স্ত্রীলোকের যত অখ্যাতি, ততখানি অখ্যাতির তারা যোগ্য নয়!’’৯৫ চন্দ্রমুখী নিজের হৃদয় দিয়ে পার্বতীর প্রেমকে যতটা বুঝেছিল পার্বতী নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ততটা বোঝেনি৷ বোঝার কথাও নয়৷ সে আবাল্য দেহপসারিণী নারীদের ঘৃণা করা দেখে এসেছে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে সেই মনোভাবই প্রাপ্ত হয়েছে৷ তাই ভৃত্য ধর্মদাসের কাছে যখন শোনে মদ-বেশ্যাসক্ত দেবদাস কোনো বারবনিতাকে কয়েক হাজার টাকার গহনা গড়িয়ে দিয়েছে তাতে আশঙ্কার গাঢ় মেঘ জমাট বাঁধে তার মনে৷ দেবদাসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সে বিষয়ে জানতেও চায়—‘‘আর কত হাজার টাকার গয়না গড়িয়ে দিয়েচ, না?’’৯৬ গণিকারা যে সমাজদূষিত মর্যাদাহীন; পার্বতীর সখি মনোরমার, দেবদাসের ভ্রাতৃবধূর কথার মধ্য দিয়েও সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়৷

দেবদাসের দৃষ্টিতে চন্দ্রমুখী ঘৃণ্য নয়৷ তার ভেতরকার প্রেম-বুভুক্ষ নারীটিকে চিনতে পেরেছিল সে৷ একদিন যার বাসস্থানকে ‘হতভাগা’ জায়গা এবং যাকে কোনো কথা না বলে মুখের উপর একটা নোট ছুড়ে দিয়ে চলে এসেছিল তাকে বৌ সম্বোধন করে আপনজনের স্বীকৃতি দেয়৷ তার দৃষ্টিতে ভদ্র-শালীন পরিবারের মেয়ে ও বধূ পার্বতী এবং চন্দ্রমুখী একাকার হয়ে যায়৷—‘‘তোমাদের দু’জনে কত অমিল, আবার কত মিল৷ একজন অভিমানী, উদ্ধত, আর একজন কত শান্ত, কত সংযত৷ সে কিছুই সইতে পারে না, আর তোমার কত সহ্য! তার কত যশ, কত সুনাম, আর তোমার কত কলঙ্ক! সবাই তাকে ভালবাসে, আর কেউ তোমাকে ভালবাসে না৷’’৯৭ দেবদাসের এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একজন সাধারণ বারাঙ্গনা তার মানবিক গুণাবলীর দ্বারা সমাজের স্বীকৃত চরিত্রবতী পার্বতীর থেকেও অনেক বেশি মর্যাদা লাভ করেছে৷ তাই দেবদাস তাকে মৃত্যুর পরের জীবনে সঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়ে অপ্রত্যাশিত সম্মান দান করেছে৷ দেবদাসের সেই সম্মান জানানো আসলে দরদি শরৎচন্দ্রের দরদি মনের প্রতিচ্ছবি৷

শরৎচন্দ্র তথাকথিত ব্যভিচারিণী দেহজীবী নারীদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তার মাত্রাকে ছাড়িয়ে যেতে পারেননি৷ দেবদাস চন্দ্রমুখীর প্রতি নরম হল, তাকে বৌ বলে সম্বোধনও করল আবার মৃত্যুর পরের জীবনে সঙ্গী হিসেবে প্রার্থনা করে অশেষ সম্মান প্রদর্শন করতে পারলেও চন্দ্রমুখীর সেবায়-যত্নে রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করে বায়ুপরিবর্তনের জন্য বাইরের কোনো স্থানে যাওয়ার সময় সেই বারবনিতাকে সঙ্গে নিতে পারলো না৷ সমাজের কোনো নৈতিক দাবিই তো সে মানেনি৷ বাল্যবয়স থেকেই তার মধ্যে দেখা গেছে সমাজের প্রচলিত নিয়মগুলিকে লঙ্ঘন করার প্রবণতা৷ সে মদ ধরেছে, বেশ্যাসক্ত হয়েছে—এসব কিছুতেই তো সমাজের অনুমোদন থাকে না অথচ চন্দ্রমুখীকে সাথে নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গে সমাজই তার কাছে বড় হয়ে উঠলো৷ তাই বায়ুপরিবর্তনে যাওয়া স্থির হলে দাসী হিসেবে চন্দ্রমুখী তার সঙ্গে যেতে চাইলে দেবদাস ঘৃণায় শিউরে উঠে—‘‘ছিঃ, তা হয় না! আর যাই করি, এতবড় নির্লজ্জ হতে পারব না৷’’৯৮ দেবদাসের মতো পুরুষদের রাতের পর রাত তাদের দরজায় হত্যে দিয়ে পড়ে থাকায় নির্লজ্জতা নেই নির্লজ্জতা রয়েছে প্রত্যক্ষভাবে সকলের সামনে মেলামেশা করায়৷ যাই হোক দেবদাস তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে না পারলেও যতটুকু সম্মান দিয়েছিলেন শরৎচন্দ্রের আগে পর্যন্ত কেউ তেমন সম্মান প্রদর্শন করতে পারেনি বোধ হয়৷ তারাও যে মানুষ—শুধু মানুষ নয়, স্নেহ-মায়া-মমতাপূর্ণ নারী শ্রেণীর প্রতিনিধি সেই সত্যটা অন্তত প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷

বারবনিতা পিয়ারীর এক সাধারণ গ্রাম্য মেয়ে থেকে বারভোগ্যা হয়ে উঠার মর্মান্তিক কাহিনি বর্ণনা করেছেন ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের৷ সমাজের যূপকাষ্ঠে বলি হয়ে পুরুষের কাছে তার নারীমাংস পরম আস্বাদিত হলেও লাঞ্ছিতা নারীর সেই হৃদয়বিদারি মর্মজ্বালাকে সুনিপুণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন রচনাকার৷ পিয়ারীর পূর্বনাম রাজলক্ষ্মী৷ তার দুই পুরুষে কুলীন বাবা আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ করে তারা দুই বোন রাজলক্ষ্মী ও সুরলক্ষ্মী সহ তার মাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়৷ রাজলক্ষ্মীর বয়স তখন আট এবং সুরলক্ষ্মীর বারো-তেরো৷ স্বামী বিতাড়িত মাতা কাঁধে দুই প্রায় বিবাহযোগ্যা মেয়ে নিয়ে উপান্তর না দেখে আশ্রয় নেয় বাপের বাড়িতে৷ তাদের মামা অস্থির হয়ে পড়ে ভাগ্নীদের বিয়ের চিন্তায়৷ একে কুলীন তার মধ্যে আবার দরিদ্র৷ টাকা ছাড়া কে সেই বোকামি করতে যাবে৷ অবশেষে প্রতিবেশী বিরিঞ্চি দত্তের বাঁকুরা থেকে নিয়ে আসা ভঙ্গকুলীন পাচক ঠাকুরের কাছে ধরনা দেয় তাদের উদ্ধার করার জন্য৷ পাত্র এমনিতে হাবাগোবা হলেও এ ব্যাপারে বুদ্ধির কমতি নেই৷ রাজলক্ষ্মীর মামা একান্ন টাকার বিনিময়ে ভাগ্নীকে তার হাতে সম্প্রদান করতে চাইলে—‘‘একান্ন টাকা পণের কথায় সে সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, অত সস্তায় হবে না মশায়—বাজারে যাচিয়ে দেখুন পঞ্চাশ-এক টাকায় একজোড়া ভাল রামছাগল পাওয়া যায় না—তা জামাই খুঁজচেন—একশ-একটি টাকা দিন—একবার এ-পিঁড়িতে ব’সে আর একবার ও-পিঁড়িতে ব’সে দুটো ফুল ফেলে দিচ্চি৷ দুটি ভাগ্নীই এক সঙ্গে পার হবে৷ আর একশখানি টাকা—দুটো ষাঁড় কেনার খরচটাও দেবেন না?’’৯৯ গরু-ছাগলের মতো দরকষাকষির পর সত্তর টাকায় রফা করে দুই বোনকে একসঙ্গে বিয়ে করে আঁচলে সত্তর টাকা গুজে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীদের ফেলে চলে যায় স্বামীরত্নটি৷ তার প্রায় বছর দেড় পড়ে সুরলক্ষ্মী মারা যায় এবং আরও দেড় বছরের মতো সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শোনা যায় রাজলক্ষ্মী কাশীতে তার মায়ের সঙ্গে গিয়ে শিবলোকে যাত্রা করেছে৷ তারপর আর তাদের দু-বোনের কোনো অস্তিত্ব নেই৷ কি মর্মান্তিক অবমাননা! দুটি তাজা প্রাণ সমাজের নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে অচিরেই সমাপ্তির মুখ দেখে৷ কিন্তু সেখানেই থেমে যায়নি৷ সুরলক্ষ্মী মরে বেঁচে গেলেও ঘটনার বহুদিন পর শ্রীকান্তের দৃষ্টিতে রাজলক্ষ্মী পুনরায় বেঁচে উঠে অন্য আরেক রূপে৷ তা যেন রাজলক্ষ্মীর প্রেতাত্মা—নাম পিয়ারীবাই৷ বড়লোক বন্ধুর শিকারে নিমন্ত্রণ পেয়ে তার তাবুতে উপস্থিত হয়ে দেখে সেখানে যুবকবৃন্দের পাশবিক পিপাসাকে সাফল্যমণ্ডিত করতে নিয়ে আসা হয়েছে এক রূপপসারিণীকে৷ সে-ই পিয়ারীবাই৷ সেই হতভাগা নারী প্রথম দর্শনেই চিনে ফেলে তাকে৷ যদিও ধামার মতো পেট, কাঠির মতো হাত-পা এবং তামার শলার মতো চুলের অধিকারিণী বাল্যের সেই রাজলক্ষ্মীর নবজন্মপ্রাপ্ত আরেক সত্তা পরমরূপবতী উদ্ভীন্নযৌবনা পিয়ারীবাইকে কোনোভাবেই চেনার ক্ষমতা ছিল না শ্রীকান্তের৷ একটু একটু করে সে নিজেকে তার সামনে তুলে ধরেছে৷ অকপটে জানিয়েছে ছোট বেলায় পীড়নের ভয়ে বৈঁচি ফলের মালা গেঁথে তাকে স্বামীত্বে বরণের কথা৷ অত্যন্ত আপন জনের মতো নানা বিষয়ে সেই বাল্য বয়সের প্রণয়ীকে শাসন করেছে, সাবধান করেছে, কখনো বিদ্রুপ প্রকাশ করতেও বাধেনি৷ তাম্বু থেকে বিদায়ের আগে নিজের অজান্তে শশ্মানে উপস্থিত হলে রাজলক্ষ্মীই তাকে বাস্তবের পরিবেশে ফিরিয়ে এনেছে এক অতিলৌকিক আকর্ষণের জগৎ থেকে৷ তার কোমল মন প্রেমাস্পদের ভাবী বিপদে আতঙ্কিত হয়ে তক্ষুণি তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিতে চাইলে শ্রীকান্ত বলে—‘‘এমনভাবে চলে যাবার অর্থ কি হবে জান?’’১০০ রাজলক্ষ্মী জানে একজন বাইজির সঙ্গে হঠাৎ করে গাঢাকা দিলে সমাজে শ্রীকান্তের অপযশের শেষ থাকবে না৷ তবু প্রেমাস্পদকে ভাবী বিপদের মধ্যে ফেলে যেতে পারে না সে৷ তাকে পায়ে ধরে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য মিনতি করতে থাকলে শ্রীকান্ত বলে—‘‘কিন্তু যে মিথ্যা কুৎসার রটনা হবে, তার দাম ত কম নয়!’’১০১ পিয়ারী একজন বারনারী—সমাজে প্রত্যক্ষভাবে গণিকা সংস্পর্শ পাপ হিসেবে গণ্য৷ শ্রীকান্ত একজন বারবনিতার সঙ্গে গিয়ে বা কেউকে না বলে পিয়ারীর সাথে সাথে নিজেও বেপাত্তা হয়ে গেলে তার নামে গণিকার সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ারই কুৎসা রটবে৷ অন্য কোথাও গেল কি না তা কেউ খতিয়ে দেখবে না৷ শুভাকাঙ্খিনীর শুভ অনুরোধটুকু তাই সে রাখতে পারে না৷ নিরুপায় পিয়ারী শ্রীকান্তের সেই নিষ্ঠুর অপমানে পা ছেড়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকলে তার সেই অপমানাহত মুখ দেখে শ্রীকান্তের মনে হয়—‘‘সম্মুখের ওই পূর্ব আকাশটার সঙ্গে এ পতিতার মুখের কি যেন একটা নিগূঢ় সাদৃশ্য রহিয়াছে৷ উভয়ের মধ্য দিয়াই যেন একটা বিরাট অগ্নিপিণ্ড অন্ধকার ভেদ করিয়া আসিতেছে—তাহারই আভাস দেখা দিয়াছে৷’’১০২ সমাজের কুটিল চক্ষুকে উপলব্ধি করে তখনকার মতো তার প্রিয়তমকে ছেড়ে যেতে হয় কিন্তু যাওয়ার আগে সে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নেয় যে বারোটার আগেই তার কান্তদা সবার সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করে সেই স্থান ত্যাগ করবে৷

রাজলক্ষ্মী সাতঘাটের জল খেয়ে পিয়ারীবাইয়ের রূপ ধারণ করেছে৷ অভাবের জ্বালায় তার মা কাশীতে নিয়ে গিয়ে একহাজার টাকার বিনিময়ে এক মৈথিলি রাজপুত্রের হাতে বিক্রি করে দিয়ে গ্রামে এসে প্রচার করে যে কাশীতে তার শিবপ্রাপ্তি ঘটেছে৷ সে বুদ্ধি খাটিয়ে মুক্ত হয় সেই রাজপুত্রের হাত থেকে৷ একজন বৃদ্ধ বাঙালি ওস্তাদের কাছ থেকে গান-বাজনা এবং তার স্ত্রীর কাছ থেকে নাচ শিখে পিয়ারীবাই হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে জীবন অতিবাহিত করতে থাকে৷ কিন্তু জীবনের জটিল আবর্তে একাধিক পুরুষের হস্তগত হয়েও অন্তরের রাজসিংহাসনে বসিয়ে পুজো করে গেছে শ্রীকান্তকে৷ দীর্ঘদিন সেই পাপবৃত্তিতে আত্মমগ্ন থেকেও তার ভালোবাসার নৈবেদ্যকে বাসী হতে দেয়নি৷ এ সম্পর্কে শ্রীকান্তকে বলেছে—‘‘কি বিশ্রী এই মেয়েমানুষ জাতটা, একবার যদি ভালোবেসেচে, ত মরেচে৷’’১০৩

রূপপসারিণী হলেও তার মধ্যে স্নেহ-মায়া-মমতা-প্রেম-সেবাপরায়ণতা সবকিছু যেন উপচে পড়েছে৷ সে সন্তান বাৎসল্যে স্বামীর প্রথমপক্ষের সন্তান বঙ্কুকে নিজের কাছে রেখে মাতৃত্বের সাধ মেটায়, শ্রীকান্তকে বিপদে-আপদে সেবাযত্ন করে প্রেমপূজা চালিয়ে যায়৷ তার রূপপসারিণীর প্রকৃত স্বরূপ এবং শ্রীকান্তকে ভালোবাসার কথা বঙ্কুর সামনে আড়াল করতে চায়৷ শ্রীকান্তকে বলে—‘‘অসুখ ত একরকম ভাল হ’ল, এখন যাবে কবে মনে করচ?… আমার ছেলে প্রায়ই আজকাল বাঁকিপুর থেকে আসচে৷ বেশিদিন থাকলে সে হয়ত কিছু ভাবতে পারে৷’’১০৪ এই যে ছেলের কাছ থেকে নিজেকে আড়াল করার প্রচেষ্টা তার মধ্যেও পরোক্ষভাবে নিহিত রয়েছে সামাজিক তর্জনীহেলন৷

বঙ্কুর শ্রীকান্তকে বলা কথার মধ্যেও সমাজে গণিকাদের অবস্থানগত দিক সুস্পষ্ট হয়ে উঠে৷ মায়ের সুখ্যাতি প্রকাশ করতে গিয়ে একসময় মায়ের হৃদয়ের দুঃখের এক দিক উন্মোচন করে ফেলে সে৷ পিয়ারী পুরুষের মনোরঞ্জনের উপার্জিত অর্থ দিয়ে সতীনের চার মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে, দরিদ্র গ্রামবাসীদের সুখ-দুঃখের দিকে তাকিয়ে তাদের ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যুগিয়ে যায়, শীতকালে জামা-কাপড়, কম্বল দান করে৷ কিন্তু সমাজের মানুষজন তার দানকে গ্রহণ করলেও তাকে মেনে নিতে পারে না৷ বঙ্কুদের বাড়িতে তার যাতায়াতের জন্য পুরো পরিবারটিকেই সমাজ ‘একঘরে’ করে রেখেছে৷ তাদের জন্য ধোপা, নাপিত, মুদি সমস্ত কিছু বন্ধ৷ গ্রামের জলকষ্ট দূর করার জন্য তিন-চার হাজার টাকা খরচ করে পুকুর বানিয়ে দেয়, ঘাট বাঁধিয়ে দেয় কিন্তু গ্রামের লোক শুধু ‘বাইউলি’ বলে সে পুকুর তাকে প্রতিষ্ঠা করতে দেয় না৷ লুকিয়ে-চুরিয়ে পতিতাবৃত্তির অর্থে নির্মিত পুকুরের জল পান করতে পারলেও প্রকাশ্যে বর্ষণ করে তীব্র ঘৃণা৷ পিয়ারীর সদুদ্দেশে খোদিত সেই পুকুরের জল ব্রাহ্মণ, কায়স্ত, ছোটলোক সবাই নিয়ে খেতে পারে অথচ এক বারাঙ্গনাকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না৷ রচনাকার মানুষের সেই স্থুল দিকটার প্রতিই অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন৷ কথক শ্রীকান্ত পিয়ারীর ভেতরকার সেই পবিত্র সত্তাটিকে আবিষ্কার করে বঙ্কুর কথার মধ্য দিয়ে৷ তাই পিয়ারী যে সর্বপুরুষের কামনার ধন তা আর ভাবতে পারে না৷ তার পরিপূর্ণ মাতৃরূপটির কাছে শ্রদ্ধায় আপনিই মস্তক নত হয়ে আসে শ্রীকান্তের৷

শ্রীকান্তের দৃষ্টি দিয়ে শরৎচন্দ্র একটু একটু করে পিয়ারীর গ্রন্থিমোচন করে রাজলক্ষ্মীকে মুক্ত করে চলেছেন, তার মাতৃমূর্তি যেমন অভিভূত করে রাখে তাকে; প্রেমময়ী রূপটিও তেমনি শ্রীকান্তের বন্ধনহীন জীবনে মধুর প্রণয়পাশ রচনা করে৷ পিয়ারীকে মুজরায় বেড়োতে হয়, নানা রসিক পুরুষ তার রূপছটা পান ও মধুর কণ্ঠের গান শোনার জন্য তার বাড়িতেও উপস্থিত হয়, দিনের পর দিন ও অতিবাহিত করে সেখানে৷ এমনি এক মুজরার সময় শ্রীকান্ত তার বাসায় উপস্থিত হলে হতবুদ্ধি হয়ে যায় সে৷ শ্রীকান্ত সমস্তটা বুঝতে পেরে তাকে আরও অধিক আলোড়িত করার জন্য পিয়ারী, বাইজিবিবি, বাইজি ইত্যাদি সম্বোধন করে৷ কিংকর্তব্যবিমূঢ় পিয়ারী শ্রীকান্তের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়৷ তার বিলাসী রূপ প্রণয়ীর মনে কি প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে না জানলেও তার নিরব ঔদাসীন্যে ভীত হয়ে পড়ে সে৷ পিয়ারী পতিত হয়েছে, মুজরা করে পুরুষ ভুলিয়ে অর্থ উপার্জন করেছে৷ কিন্তু সেই রূপপসারিণী নিজের ইচ্ছায় হয়নি, হতে বাধ্য হয়েছে৷ তার পরেও তার কোনো ভালো কাজ সমাজ অনুমোদন করে না৷ মুক্ত হতে চেয়েও তার যেন মুক্তি নেই৷ তাই সর্বদিক থেকে বঞ্চনার জ্বালা প্রকাশ করতে গিয়ে এক মর্মভেদী প্রশ্ন করে বসে শ্রীকান্তকে—‘‘আচ্ছা, জিজ্ঞেস করি তোমাকে, পুরুষমানুষ যত মন্দই হয়ে যাক, ভাল হ’তে চাইলে তাকে ত কেউ মানা করে না; কিন্তু আমাদের বেলায়ই সব পথ বন্ধ কেন? অজ্ঞানে, অভাবে প’ড়ে একদিন যা করেচি, চিরকাল আমাকে তাই করতে হবে কেন? কেন আমাদের তোমরা ভাল হতে দেবে না?’’১০৫ পিয়ারীর এ প্রশ্ন শুধু তার একার নয়, তা যেন তার মত সমস্ত নারীর৷ স্নেহ-বাৎসল্য ভালোবাসায় সে কারও চেয়ে কোনো অংশেই হীন নয় অথচ তার জন্য নিশ্চিন্ত কোনো আশ্রয় রাখেনি সমাজ—যেখানে স্বামী থাকবে, সন্তান থাকবে, তার প্রতি সম্মান থাকবে৷ সে যখন একবার পতিত হয়ে রূপপসারিণী হয়েছে তখন রূপ বিক্রয় করাই যেন তার ভবিতব্য৷ তাছাড়া অন্য কোন পথ নেই৷ অথচ তার কাছে বিনোদনের লোভে আসা পুরুষ সমাজের জন্য কোনো বিধি নিষেধ নেই—অপমান-অবমাননা নেই—পতিত করার প্রবণতা নেই৷

রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে নিয়ে কাশী যাওয়ার প্রস্তাব করলে শ্রীকান্ত আঁতকে উঠে সে কথা শুনে৷ একজন বারাঙ্গনা সমভিব্যাহারে ভ্রমণে গেলে তার মান-সম্মান কিছুই থাকবে না৷ তাই নিজের সম্ভ্রম রক্ষার প্রসঙ্গ টেনে পুনরায় বলে—‘‘লক্ষ্মী, তোমার জন্যে আমি সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু সম্ভ্রম ত্যাগ করি কি ক’রে?… সম্ভ্রম যাওয়ার পরে পুরুষমানুষের বেঁচে থাকা বিড়ম্বনা৷ শুধু সেই সম্ভ্রম ছাড়া তোমার জন্যে আর সমস্তই আমি বিসর্জন দিতে পারি৷’’১০৬ যাই হোক মান-সম্ভ্রমের ঝুঁকি নিয়ে শ্রীকান্তকে কাশী যেতে হয়৷ সেখান থেকে শ্রীকান্ত পশ্চিমে যাওয়ার মনস্ত করলে প্রয়াগে স্নানের উদ্দেশ্যে রাজলক্ষ্মীও সঙ্গে যাওয়ার জন্য আবদার করে৷ শ্রীকান্ত জানে যে সেখানে তার জ্ঞাতি সম্পর্কের এক খুড়ো বহুদিন থেকে কর্মোপলক্ষে বসবাস করছে৷ তাছাড়া কয়েকজন আত্মীয়-বন্ধুও সেখানে রয়েছে৷ একজন বাইজিকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে আমতা-আমতা করলে পিয়ারীর মুখে ধ্বনিত হয় তীব্র ব্যঙ্গবাণী৷ তার সঙ্গে পরিচিত কেউ শ্রীকান্তকে দেখে ফেলতে পারে তার জন্যই যে সে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে রাজী হচ্ছে না তা নিমেষেই বুঝে ফেলে সে৷ তাই বলে—‘‘তা বটে, আর বছর আরাতে ত তোমাকে একরকম কোলে নিয়েই আমার দিন-রাত কাটল৷ ভাগ্যিস সে অবস্থাটা কেউ দেখে ফেলেনি৷ সেখানে বুঝি তোমার কেউ চেনাশুনা বন্ধু-টন্ধু ছিল না৷’’১০৭ রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তকে ভালোবেসে যতই অতীতের সমস্ত জ্বালা-যন্ত্রণাকে ভুলতে চায় কিন্তু শ্রীকান্ত যেন ততই সমাজের বেত হাতে নিয়ে তার পৃষ্ঠে আঘাত হেনে তাকে মনে করিয়ে দেয় সে একজন পণ্যনারী৷ তাই তার আহত নারীমন শ্রীকান্তের সেই বিরুদ্ধ মনোভাবকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারে না৷ তার মনের গুমোট যন্ত্রণাকে শ্রীকান্তর সামনে উগরে দিয়ে শান্তনা লাভের চেষ্টা করে৷ নিজের প্রকৃত অবস্থাকে পুনরায় বিচার করে উপলব্ধি করে সেখান থেকে মুক্তিলাভ সম্ভব নয় জন্য আবার সাজগোজ করে মুজরার উদ্দেশ্যে বের হয়৷ তার সেই মুজরায় বের হওয়ার পেছনে যদিও প্রকটভাবে কাজ করেছিল শ্রীকান্তকে বিদ্ধ করার প্রবণতা৷ কিন্তু পিয়ারীর সেই কাঁটা পুনরায় তার বক্ষকেই বিদ্ধ করে শ্রীকান্তের প্রবল বক্রবাক্যে—‘‘ওরে পাষণ্ড রোহিণি! তুই গোবিন্দলালকে চিনিস না? আহা! আজ যদি আমার একটা পিস্তল থাকিত! কিংবা একখানা তলোয়ার!… রাজলক্ষ্মী শুষ্ককন্ঠে কহিল, তাহলে কি করতে?—খুন!… না ভাই পিয়ারী, আমার অতবড় নবাবী শখ নেই৷ তা ছাড়া এই বিংশ-শতাব্দীতে এমন নিষ্ঠুর নরাধম কে আছে যে, সংসারের এই এতবড় একটা আনন্দের খনি পাথর দিয়ে বন্ধ করে দেবে? বরঞ্চ আশীর্বাদ করি, হে বাইজীকুলরাণি! তুমি দীর্ঘজীবিনী হও, তোমার রূপ ত্রিলোকজয়ী হোক, তোমার কন্ঠ বীণানিন্দিত এবং ঐ দুটি চরণকমলের নৃত্য উর্বশী তিলোত্তমার গর্ব খর্ব করুক—আমি দূর হইতে তোমার জয়গান করিয়া ধন্য হই!১০৮ কোন নিষ্ঠুর আঘাতে আহত হয়ে রাজলক্ষ্মী পুনরায় পিয়ারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল তা বোঝার ক্ষমতা হয় তো সেই মুহূর্তে শ্রীকান্তর ছিল না কিন্তু তার থিয়েটারি কায়দায় বলা সেই বক্তব্যে পিয়ারী যে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায় তা বুঝতে অসুবিধা হয় না৷ শ্রীকান্ত ভাবে মুজরায় বের হওয়া আসলে পিয়ারীর টাকার নেশা এবং অনুতপ্ত রাজলক্ষ্মীকে বলেও ফেলে সে সেই নেশা সে কোনোদিন ছাড়তেও পারবে না৷ রাজলক্ষ্মী তার সঙ্গে বর্মায় যেতে চেয়ে, তার সান্নিধ্যে থাকতে চেয়ে বার বার তাকে অনুরোধ করে পিয়ারীবাই-এর আকর্ষণ থেকে নিজেকে বাঁচাতে৷ কিন্তু শ্রীকান্তর মত দরদি মানুষেরা এই পতিতা নারীদের জন্য অনেক কিছু ভাবতে পারে, অনেক জ্ঞান-উপদেশ দান করতে পারে;সবই দূর থেকে কিন্তু সমাজের শিকল ভেঙ্গে হাতে ধরে সেই পঙ্ক থেকে উদ্ধার করতে সাহস পায় না৷ শ্রীকান্তের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সেই দিকটাই স্পষ্ট হয়—‘‘লোক ত মনসা পণ্ডিতের পাঠশালার সেই রাজলক্ষ্মীটিকে চিনবে না, তারা চিনবে শুধু পাটনার প্রসিদ্ধ পিয়ারী বাইজীকে৷ তখন সংসারের চোখে যে কত ছোট হ’য়ে যাবো, সে কি তুমি দেখতে পাচ্ছো না?’’১০৯ কিন্তু রাজলক্ষ্মী তো যথার্থ প্রেমিকা৷ সে জানে তার কাছে শ্রীকান্ত কতটা কাঙ্খিত৷ তারপরেও তার সঙ্গ স্পর্শে শ্রীকান্তের ছোটো হওয়াকে মানতে পারে না৷ কারণ দশজন না জানলেও ঈশ্বর জানেন তার জন্য শ্রীকান্ত কোনোভাবে হীন হবে না৷ শ্রীকান্ত নিজেও জানে সে কথা৷ রাজলক্ষ্মীর অনুভূতিপ্রবণ অন্তকরণে যে কোনো পাপ নেই তা তার অজানা নয়৷ তবুও সমাজের অনুশাসনে বাঁধা তার সামাজিকসত্তাটি তাকে আপন করে নিতে পারে না৷ সে বলে—‘‘তাঁর চক্ষু ত সর্বদা দেখা যায় না! যে দৃষ্টি সংসারের দশজনের ভেতর দিয়ে প্রকাশ পায়, সেও ত তাঁরই চক্ষের দৃষ্টি রাজলক্ষ্মী! তাকেও ত অস্বীকার করা অন্যায়৷’’১১০ আর দশজনকে অস্বীকার করতে পারবে না জন্যই পতিত প্রণয়িনীকে কাঁদিয়ে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে উপস্থিত হয় নিজের জন্মভিটায়৷ কপর্দকহীন অবস্থায় পুনরায় জ্বরে পড়লে শরণাপন্ন হতে হয় পিয়ারীবাই-এরই৷ শ্রীকান্তের অসুস্থতার জন্য টাকা চেয়ে পাঠানো চিঠি দেখে ঠিক থাকতে পারে না বাইজি৷ সমাজের সমস্ত অপমান এবং নিজের অবস্থান ভুলে শ্রীকান্তের বাড়িতে উপস্থিত হলে আবার শ্রীকান্তকে আঁতকে উঠতে হয়৷ তাদের দুজনের কথোপকথনের মধ্যে সামাজিক অনুশাসনের সেই দিকটি স্পষ্ট হয়ে উঠে৷—

‘‘এ গ্রামে, এ পাড়ার মধ্যে তুমি ঢুকলে কোন সাহসে? তুমি কি মনে কর তোমাকে কেউ চিনতে পারবে না?

রাজলক্ষ্মী সহজেই কহিল, বেশ যা হোক! এইখানেই মানুষ হলাম, আর এখানে আমাকে চিনতে পারবে না? যে দেখবে সেই ত চিনবে৷

তবে?

কি করব বল? আমার কপাল, নইলে তুমি এসে এখানে অসুখে পড়বে কেন?

এলে কেন? টাকা চেয়েছিলাম, টাকা পাঠিয়ে দিলেই ত হ’তো৷

তা কি কখনও হয়? এত অসুখ শুনে কি শুধু টাকা পাঠিয়েই স্থির থাকতে পারি?

বলিলাম, তুমি নাহয় স্থির হলে, কিন্তু আমাকে যে ভয়ানক অস্থির করে তুললে৷ এখনি সবাই এসে পড়বে, তখন তুমিই বা মুখ দেখাবে কি করে, আর আমিই বা জবাব দেব কি!

রাজলক্ষ্মী প্রত্যুত্তরে শুধু আর-একবার ললাট স্পর্শ করিয়া কহিল, জবাব আর কি দেবে—আমার অদৃষ্ট!

তাহার উপেক্ষা এবং ঔদাসীন্যে নিতান্ত অসহিষ্ণু হইয়া বলিলাম, অদৃষ্টই বটে! কিন্তু লজ্জা-সরমের মাথা কি একেবারে খেয়ে বসে আছো? এখানে মুখ দেখাতেও তোমার বাধলো না?

রাজলক্ষ্মী তেমনি উদাসকন্ঠে উত্তর দিল, লজ্জা-সরম আমার যা-কিছু এখন সব তুমি৷’’১১১

অর্থাৎ রাজলক্ষ্মী যে প্রেমাস্পদের অসুস্থতার খবর পেয়ে শ্রীকান্তের সামাজিক অবস্থান ভুলে তাকে সুস্থ করার অভিলাষে তার শৈশবের চারণভূমিতে উপস্থিত হয়েছে তা শ্রীকান্তকে আশঙ্কিত করে তোলে! রাজলক্ষ্মী গণিকা হয়েছে না কি হয়েছে সে খবর তারা জানে না; তারা জানে কাশীতে বহুবছর পূর্বে রাজলক্ষ্মীর মৃত্যুর খবর৷ সেই মৃত রাজলক্ষ্মীকে হঠাৎ জীবিত হয়ে শ্রীকান্তের সেবা করতে দেখলে গ্রামের লোকজনের মনে যে কি ভাবনার উদয় হবে তা কল্পনা করতে কোনো অসুবিধা হয় না শ্রীকান্তের৷ তাই তার নির্বিকার ঔদাসীন্যে অসহিষ্ণু হয়ে উঠে৷ যাই হোক শেষ পর্যন্ত সেই মহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হয়; যখন শ্রীকান্তের মান-সম্ভ্রম সম্পূর্ণ ভূপতিত হওয়ার উপক্রম হবে৷ ডাক্তারবাবু, প্রসন্ন ঠাকুরদা প্রমুখ শ্রীকান্তের তদ্বির করতে কোনো স্ত্রীলোকের আসার সংবাদ পেয়ে উপস্থিত হয় সেখানে৷ তাদের দেখে মুহূর্তে সমস্ত সাহস উবে যায় রাজলক্ষ্মীর৷ তার আসন্ন অপমানের ভয়ে মড়ার মতো ফ্যাকাশে মুখ দেখে বিবেক জাগ্রত হয় শ্রীকান্তের৷ সে উপলব্ধি করতে পারে তার জন্য রাজলক্ষ্মীর চরম আত্মত্যাগ ও নির্মল প্রেমকে৷ তাই বিপদের হাত থেকে সেই অসহায় রমণীকে উদ্ধার করতে সকলের সামনে নিজের স্ত্রী পরিচয় দেয়৷ কিন্তু সেই পরিচয় যে রাজলক্ষ্মীর সম্মানকে উপরে না তুলে আরও অধঃপতিত করে তা শ্রীকান্তের জবানিতেই স্পষ্ট—‘‘বাস্তবিক এ শুধুই কেবল আপনাদের আপনি অপমান করিলাম৷ ইহার কোন প্রয়োজন ছিল না৷ বাজারের বাইজী অপেক্ষা বিধবা-বিবাহের পত্নী যে ইঁহাদের কাছে উচ্চ আসন পায় না—সুতরাং নীচেই নামিলাম,’’১১২ রাজলক্ষ্মী পরস্ত্রী, রাজলক্ষ্মী বিধবা৷ রাজলক্ষ্মী যে বাইজি সেটা তাদের অবগত নয়৷ শ্রীকান্ত রাজলক্ষ্মীকে স্ত্রী বলে পরিচয় দিয়েছিল এক সম্মানিত আসনে অধিষ্ঠিত করার জন্য৷ কিন্তু তাদের চোখে পুণর্বিবাহিত বিধবা বা বাইজির কোনো প্রভেদ নেই৷ রাজলক্ষ্মীর হীন জীবন তাদের চোখে আরও হীন হয়ে যায়৷ পুরুষেরা বিবাহের পর বিবাহ করলেও দোষের হয় না—রাজলক্ষ্মীর স্বামী তার পূর্বস্ত্রী থাকা সত্ত্বেও তাদের দুইবোনকে সত্তর টাকার বিনিময়ে বিবাহ করেছিল অর্থাৎ স্ত্রী জীবিত থাকলেও যেখানে বাধা থাকে না আর মৃত হলে তো কোনো কথাই নেই৷ সেখানে শৈশবের কোনো নাম মাত্র বিয়েকে অবলম্বন করে বৈধব্যদশা প্রাপ্ত হলেও পরবর্তী সময়ে মেয়েদের আবার বিয়ে হওয়া মানতে পারে না সমাজ৷ সেই বিধবা নারীরা পুনরায় বিবাহিত হলে তাদের চোখে তারা বেশ্যারই সমতুল্য৷

সময় যত এগিয়ে গিয়েছে শ্রীকান্ত ততই যেন রাজলক্ষ্মীর নিষ্কলুষ সত্তাকে নতুন নতুন করে উপলব্ধি করতে পেরেছে৷ ধীরে ধীরে তার সঙ্গে সহবাসের সমস্ত বাধা দূর হয়ে গেছে৷ যে সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে একদিন উপেক্ষায় নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিল তার করকমলেই নিঃশেষে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে৷ নারীর সতীত্বের ধারণা দেহের ভিতকে ছাড়িয়ে আরও উর্দ্ধমুখী হয়ে উঠেছে তার কাছে৷ তাই রাজলক্ষ্মী সম্পর্কে অকপটে বলেছে—‘‘মানুষ ত কেবল তাহার দেহটাই নয়! পিয়ারী নাই, সে মরিয়াছে৷ কিন্তু একদিন যদি সে তার ওই দেহটার গায়ে কিছু কালি দিয়াই থাকে ত সেইটুকুই কি কেবল বড় করিয়া দেখিব, আর রাজলক্ষ্মী যে তাহার সহস্র-কোটি দুঃখের অগ্নিপরীক্ষা পার হইয়া আজ তাহার অকলঙ্ক শুভ্রতায় সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহাকে মুখ ফিরাইয়া বিদায় দিব! মানুষের মধ্যে যে পশু আছে, কেবল তাহারই অন্যায়, তাহারই ভুলভ্রান্তি দিয়া মানুষের বিচার করিব; আর যে দেবতা সকল দুঃখ, সকল ব্যথা, সকল অপমান নিঃশব্দে বহন করিয়াও আজ সম্মতি মুখে তাহারই মধ্য হইতে আত্মপ্রকাশ করিলেন, তাঁহাকে বসিতে দিবার কোথাও আসন পাতিয়া দিব না?’’১১৩ শ্রীকান্তের এই ভাবান্তর শুধু শ্রীকান্তের নয় সঙ্গে লেখকেরও৷ লেখক তার অনুভূতিশীল মন দিয়ে একটু একটু করে রাজলক্ষ্মীর জন্য শ্রীকান্তের মনে অনুকম্পা-শ্রদ্ধা-সম্মান সঞ্চিত করেছেন তাতেই শ্রীকান্তের ভাবান্তর ঘটেছে; একজন পতিতা নারী মনুষত্বের উজ্জ্বল বিভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে৷ তারপর বহুদিন একসঙ্গে কাটিয়েছে তারা৷ শ্রীকান্তের উদ্দেশ্যহীন জীবনে প্রায় চালিকাশক্তি রূপে কাজ করেছে রাজলক্ষ্মী৷ তারপরেও একটা বড় প্রশ্ন রেখে গিয়েছেন লেখক৷ তা হল তাদের পারস্পারিক সম্পর্ক৷ রচনাকার পিয়ারীকে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়ে পুনরায় রাজলক্ষ্মীতে রূপান্তরিত করলেন, রাজলক্ষ্মী রাজলক্ষ্মী হয়েই লাভ করলো তার প্রেমাস্পদকে৷ অর্থাৎ সমাজে একটা সম্মানের জায়গায় নিয়ে এলেন তাকে কিন্তু তাদের বিয়ে দিলেন না কেন৷ সমাজে বেঁচে থাকতে গেলে একটা পরিচয় চাই৷ রাজলক্ষ্মীর প্রথম পরিচয় স্বামী পরিত্যক্ত মাতার কন্যা হিসেবে, তারপরে পাচক ঠাকুরের স্ত্রী হিসেবে, তারপরে হয় পিয়ারীবাই৷ পিয়ারীবাই হয়েই কাছে পায় শ্রীকান্তকে; তার রূপপসারিণীসত্তা মরে গিয়ে রাজলক্ষ্মী বেঁচে উঠে৷ শ্রীকান্তের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস করতে থাকে৷ কিন্তু আদতে শ্রীকান্ত তাকে বিয়ে করেনি কখনো৷ বিয়ে না করেও একজন নারীপুরুষের সহবাস সমাজের চোখে বৈধ নয়৷ তবে কি সে রক্ষিতা হিসেবে বাঁধা পড়ে? তাও তো নয়৷ আসলে তৎকালীন সামাজিক পরিবেশে একজন বাইজির কোনো মূল্যই ছিল না৷ সেখানে শরৎচন্দ্র যা করেছেন তা তার স্পর্ধার চূড়ান্ত পর্যায়৷ একজন পতিতাকে পুনরায় গৃহী করে গৃহিণীর মর্যাদা দেওয়ার দুঃসাহস হয়তো তাঁর ছিল না কিন্তু যতখানি করেছেন তাও পতিতাদের জন্য কম নয়৷ শুধু তাই নয় রাজলক্ষ্মীর মতো এক অতিসাধারণ বালিকা ভাগ্যচক্রে বাইজি হয়ে প্রভূত ধনসম্পদের অধিকারিণী হয়ে উঠেছিল৷ এই ধনসম্পদের প্রাধান্যই তার মধ্যে জন্ম দিয়েছিল এক স্বাধীকার বোধের৷ আর তার জন্যই সমাজের মুখ ফিরিয়ে থাকা এই বারবনিতা নিজের কর্দম ছুড়ে দিতে পেরেছে সমাজের মুখেই৷ তার পরিণতির জন্য আঙ্গুল তুলেছে সমাজের বিধি-ব্যবস্থার দিকেই৷ সে শ্রীকান্তকে বলেছে—‘‘যে-দেশে মেয়ের বিয়ে না হলে ধর্ম যায়, জাত যায়, লজ্জায় সমাজে মুখ দেখাতে পারে না—হাবা-বোবা-অন্ধ-আতুর কারও রেহাই নেই—সেখানে একটাকে ফাঁকি দিয়ে লোকে অন্যটাকেই রাখে, এ ছাড়া সে-দেশে মানুষের আর কি উপায় আছে বলো ত? সেদিন সবাই মিলে আমাদের বোন দুটিকে যদি বলি না দিত, দিদি হয়ত মরত না, আর আমি—এজন্মে এমন করে তোমাকে হয়ত পেতুম না৷’’১১৪ সমাজের বিরুদ্ধে রাজলক্ষ্মীর এই বিক্ষোভ বারবনিতাদের মনস্তাত্ত্বিক বিবর্তনের দিকনির্দেশ করে৷ সমাজের উপেক্ষার মধ্যেও একজন মনোরঞ্জিকা হিসেবে তার গুরুত্ব কম ছিল না৷ আর যে ক্ষমতা সে অর্জন করেছিল তা তার মানসিক দৃঢ়তাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল বললে অত্যুক্তি হবে না৷

এই উপন্যাসের আরেক নারী কমললতা৷ তার পিতা-মাতা প্রদত্ত নাম ঊষাঙ্গিনী৷ অল্প বয়সে বিধবা হয় বাবা-মায়ের পরম আদরের ঊষাঙ্গিনী সমাজের চোখে কুলটা হয় তার বাবারই কর্মচারী মন্মথর সঙ্গে৷ মন্মথের সঙ্গে স্বেচ্ছাচারের ফলে গর্ভবতী হয়ে পড়লে তার বাবা সেই লজ্জার হাত থেকে নিজেকে ও মেয়েকে বাঁচাতে নবদ্বীপে নিয়ে যায়৷ উদ্দেশ্য সেখানে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষা দিয়ে মেয়েকে মন্মথর সঙ্গে বিয়ে দেওয়া৷ মন্মথ সেই সন্তানের দায় অস্বীকার করে সেই দোষ আরোপ করে ভাইপো যতীনের উপর৷ যতীন লজ্জায় গলায় দড়ি দেয়৷ শেষে কুড়ি হাজার টাকার বিনিময়ে নিজের অপবাদ যতীনের নামে চালিয়ে রাজী হয় ঊষাঙ্গিনীকে বিয়ে করতে৷ বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত ঊষা দাসীর মুখে সমস্তটা জানতে পেরে মন্মথের লোভের মুখে ছাই দিয়ে সেখান থেকে শ্রীবৃন্দাবন ধামের উদ্দেশে যাত্রা করে৷ তার স্বামীর নামও ছিল শ্রীকান্ত৷ তাই ‘শ্রীকান্ত’ নামটার প্রতিই ছিল তার দুর্বলতা৷ পরবর্তী সময়ে দেখা যায় তার ভেতরকার সুকুমারী নারীত্বকে শ্রীকান্তের প্রতি নিষ্কাম ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে লেখক সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন৷

যাইহোক ঊষাঙ্গিনীও সমাজের নির্মম পীড়নের শিকার৷ সমাজের চোখে সে অপবিত্র৷ নারীর কুলটা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও শ্রেয়স্কর মনে করতো তখনকার সমাজ৷ তাই মা-বাবার পরম আদরের ধন ঊষাঙ্গিনী বাবাকে চোখের জলে ভাসিয়ে বলতে পারে—‘‘আমি মরব না বাবা, কিন্তু আমার সতী লক্ষ্মী মা, তাঁকে ব’লো ঊষা মরেছে৷ মা দুঃখ পাবেন, কিন্তু মেয়ে তাঁর বেঁচে আছে শুনলে তার চেয়েও বেশি দুঃখ পাবেন৷’’১১৫ কি নিষ্ঠুর সমাজের অনুশাসন! দুরন্ত যৌবনবতী এক বিধবার যৌবনের সামান্য পদস্খলনে একবার যে ভুল হয়ে গেছে, সেখান থেকে তার মুক্তি নেই৷ মায়ের কাছে তাই পদস্খলিত মেয়ের বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া কম যন্ত্রণাকর৷ ঊষা সমাজকে জানে; নিজের মৃত্যুর খবর তাই নিজের মুখেই বাবার মধ্য দিয়ে মায়ের কাছে প্রেরণ করে৷ আত্মীয়-স্বজন-পরিবার-পরিজন সবকিছু ভুলে নিজের অস্তিত্বটুকু মুছে কমললতা নাম নিয়ে আরেক উদ্দেশ্যহীন জীবনে নিজেকে ভাসিয়ে দেয়৷ আর মন্মথ? সে তো পুরুষ মানুষ! সমাজের কাছে সে বরাবরই নির্দোষ৷ সে নিজের পাপ অন্যের স্কন্ধে আরোপ করে; অবশেষে সবকিছু প্রকাশ পেলেও কোনো দণ্ড ভোগ করে না৷ কমললতার কন্ঠে তার জীবনের কথা বলতে গিয়ে এ প্রসঙ্গে যে কথা উঠে আসে তা এক হিসেবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি তীব্র চাবুকাঘাত৷ সে বলে—‘‘মন্মথর অশৌচ গেল কিন্তু পাপিষ্ঠা ঊষার অশৌচ ইহজীবনে আর ঘুচল না নতুনগোঁসাই৷’’১১৬ এই অশৌচ আসলে সামাজিক পীড়ন৷ যে পাপ করে মন্মথ সমাজের মধ্যে সাবলীলভাবে বিচরণ করতে পারে সেই একই পাপে সমাজচ্যুত হয় ঊষা৷ নারী-পুরুষের এই বৈষম্যসূচক বিধিনিষেধের প্রতি অল্প কথার মধ্যে দিয়ে বৃহৎ এক প্রশ্নচিহ্ন একে দিয়েছে লাঞ্ছিতা কমললতা৷

‘শুভদা’ উপন্যাসে দুজন গণিকা৷ একজন কাত্যায়নী অপরজন মালতী৷ এছাড়া গৌণচরিত্র হিসেবে আরেক নারীর উল্লেখ রয়েছে সে জয়াবতী; জমিদার সুরেন্দ্রর রক্ষিতা৷

কাত্যায়নী নিম্নশ্রেণীর দেহজীবী৷ দেহপসারিণী ছাড়া অন্য আর কোনো পরিচয় প্রকাশ করেননি রচনাকার৷ শুভদার স্বামী হারাণচন্দ্র তার বাঁধাবাবু৷ এই চরিত্রটির প্রতিও দাক্ষিণ্য প্রকাশ করেছেন রচনাকার৷ সে পরিবারের প্রতি উদাসীন হারাণচন্দ্রকে স্ত্রী-সন্তানের দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করেছে, বোঝানোর চেষ্টা করে বলেছে—‘‘আমরা ছোটলোকের মেয়ে, ছোটলোক—কিন্তু এটা বুঝি যে, আগে স্ত্রী-পুত্র বাড়িঘর, তারপর আমরা; আগে পেটের ভাত, পরবার কাপড়, তার পর শখ, নেশা-ভাঙ৷ তোমার আমি অহিত চাইনে, ভালর জন্যই বলি—এখানে আর এস না, গুলির দোকানে আর ঢুকো না—বাড়ি যাও, ঘরবাড়ি স্ত্রী-পুত্র দেখ গে, একটা চাকরি-বাকরি কর, ছেলেমেয়ের মুখে দুটো অন্ন দাও, তারপর প্রবৃত্তি হয় এখানে এসো৷’’১১৭ শুধু বোঝানোই নয় সে নিজে খোঁজ নিয়ে দেখে এসেছে তার পরিবারের দুর্দশা৷ নিজের বহু কষ্টের জমানো অর্থ থেকে দশটাকা বের করে দিয়েছে দুর্বৃত্ত হারাণের হাতে, যাতে তার পরিবারের মুখে অন্তত দু’চার দিন অন্ন সংস্থান হতে পারে৷ তাদের মতো পতিতা নারীরা যে কোনোভাবেই সমাজের দাক্ষিণ্য অর্জন করতে পারে না; ভগবানও তাদের প্রতি বিরূপ এই সত্যটিও উঠে এসেছে কাত্যায়নীর কথায়৷ সে হারাণকে বলেছে—‘‘যার কেউ নেই, তার ভগবান আছেন, আমাদের সে ভরসাও নেই৷’’১১৮ শোনা যায় ঈশ্বর মানুষের ভাগ্য লিখে দেন—কাত্যায়নীর অদৃষ্টলিপিও ঈশ্বরের তৈরি; সে যে দেহব্যবসা করে জীবনধারণ করে সেটা তাহলে ঈশ্বরেরই নির্দেশিত অথচ এই বিড়ম্বিত ভাগ্যের নারীদের জন্য ঈশ্বরও মুখ ফিরিয়ে থাকেন; যেমন করে অসহায়া নারীদের সমাজের যূপকাষ্ঠে বলি দিয়ে সমাজপ্রভুরা সেই নারীর ভবিষ্যৎ পরিণতি দেখে নাক সিটকাতে দ্বিধাবোধ করে না৷ কাত্যায়নী সংবেদনশীল মন নিয়ে হারাণের পরিবারের জন্য তার ক্ষমতানুযায়ী উপকার করতে তৎপর; যা কিছু দুর্বিপাক সমস্তর জন্য দায়ী হারাণ নিজেই৷ অথচ সকলে সে দোষ আরোপ করে কাত্যায়নীর প্রতিই৷ কৃষ্ণঠাকুরাণী দুর্বৃত্ত হারাণের চাকুরিস্থলের ক্যাশ ভেঙ্গে তিনহাজার টাকা চুরির পেছনেও তাকে অভিযুক্ত করে হারাণের স্ত্রী শুভদাকে বলে—‘‘হারামজাদা মাগী বামুনপাড়ার কাতি, সে-ই ত এই দুর্ঘটনা ঘটালে; ইচ্ছে করে মুখপুড়ীকে পাঁশ পেড়ে কাটি৷… হারাণ মুখ্যু কিনা, তাই তার ফাঁদে পা দিলে৷ তিন হাজার টাকা চুরি করলি, না হয় দু শ’ এক শ’ মাগীর হাতেই এনে দিতিস! তবু ত কিছু থাকত?… কিন্তু ভগবান কি নেই? বামুনের যেমন সর্বনাশ করেছে তোর মতন সতীলক্ষ্মীর যখন চোখের জল ফেলিয়েচে, তখন শাস্তি কি হবে না? তুই দেখিস, আমি বললাম—’’১১৯ যে মানসিকতায় সমাজ হারাণের মতো পাপীদের পাপাচারকে আড়াল করতে পারে সেই মানসিকতায়ই তীব্র কটুবাক্য বর্ষণ করে শাপে জর্জরিত করতে পারে কাত্যায়নীর মতো বহুভোগ্যা রমণীকে৷ সমাজের সেই স্থূল দিকটার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন রচনাকার৷

ললনাও পিতার কাণ্ডজ্ঞানহীনতা, পরিবারের চরম দুরবস্থা এবং চরম দারিদ্র্য মাথায় নিয়ে দেহব্যবসার উদ্দেশে পা বাড়িয়ে সুরেন্দ্রবাবুর রক্ষিতা হয়ে যায়৷ সে আচারশীলা বিধবা হয়েও রক্ষিতা হতে বাধ্য হয়েছে৷ তার সংসারের আবেষ্টনীর মধ্য থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পিছনে কোনো পাপবোধ বা প্রবৃত্তির উস্কানি ছিল না৷ সে জানে কলকাতায় নারী শরীরের মূল্য অনেক৷ সেখানে গিয়ে শরীর বেচে অনেক উপার্জন করতে পারবে এবং তা দিয়ে পরিবারের অর্থসংকটের সমাধান করবে৷ কিন্তু পরিবারের মুখে কালি দিতে পারবে না সে৷ তাই গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়ে সকলের চোখে মৃত পরিণত হয়ে ললনা মালতী হয়ে যায়৷ নারায়ণপুরের জমিদার সুরেন্দ্রনাথ চৌধুরীর রক্ষিতা হিসেবে স্থান পায় তার বাগানবাড়িতে৷ পরে দেখা যায় মালতীর নামে তার বাড়িতে টাকা পাঠানোর চেষ্টা সহৃদয় সুরেন্দ্রনাথের৷ অপরিচিতের কাছ থেকে পাওয়া সেই টাকা ফেরত দিতে এসে সদানন্দ সুরেন্দ্রবাবুর কাছে যখন জানতে পারে ললনা জীবিত এবং তার বারবনিতাসুলভ জীবন তখন মুহূর্তে বিহ্বল হয়ে সেখান থেকে উঠে যেতে যেতে চিৎকার করতে থাকে ‘সে স্বর্গে গিয়াছে—’১২০ বলে৷ গ্রামময় পাগল হিসেবে পরিচিত সদানন্দও ললনার অস্তিত্বকে আর স্বীকার করতে পারে না৷ তার মতে ললনা তাই মৃতই৷ এখানেও সমাজ ললনাকে বাঁচতে দেয়নি৷ মালতী নামের আড়ালে তাকে সম্পূর্ণভাবে শ্বাসরোধ করে মেরেছে৷

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘করুণা’ উপন্যাসে গণিকারা ছলনাময়ী, অঘটনপটিয়সী৷ ইন্দ্রলেখা, মদনিকা প্রমুখ চরিত্ররা তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে গিয়ে নানারকম অসৎ পন্থা অবলম্বন করেছে৷ তাদের উপর কথকের সামান্যতম সহানুভূতি বর্ষণ করেননি রচনাকার—বরং তীব্র ঘৃণায় নির্মম পরিণতির দিকে ঠেলে দিয়েছেন৷

ইন্দ্রলেখার কন্যা অনন্তার রূপ এবং নৃত্য সৌকর্যে মোহিত হয়ে মহারাজাধিরাজ শ্রীমৎ কুমারগুপ্ত তাকে বিবাহ করতে চাইলে পারিষদবর্গ প্রবল বিরোধিতা করে৷ বৃদ্ধ মন্ত্রী প্রবল ব্যঙ্গবাণে রাজ্যের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মীদের সচেতন করতে মহাদণ্ডনায়ক রামগুপ্তকে বলেন—‘‘রাম, উৎসবের জন্য প্রস্তুত হইয়াছ ত? কল্য যুবরাজ-ভট্টারক স্কন্দগুপ্তের মাতা সিংহাসনচ্যুত হইবেন, নর্তকী ইন্দ্রলেখা—ফল্গুযশ নটের কন্যা তাহাতে উপবেশন করিবে৷ কল্য গুপ্তসাম্রাজ্যের অভিজাতসম্প্রদায় তাহার সম্মুখে নতজানু হইবে৷ তুমি না কুমারগুপ্তের জ্ঞাতি, প্রথম চন্দ্রগুপ্তের বংশজাত?’’১২১ সেই সময়ের সমাজের প্রেক্ষিতে পুরুষের বহুবিবাহ অমান্য ছিল না৷ মহারাজা যদি একজন বেশ্যাকন্যাকে বিবাহ না করে অন্য কোনো সাধারণ রমণীকেও বিবাহ করতেন তাহলেও রাজঅমাত্যদের এতটা বিরোধিতা সহ্য করতে হত না৷ মন্ত্রী দামোদর শর্মা, দেবধর, গোবিন্দগুপ্ত, রামগুপ্ত, ভানুমিত্র, অগ্নিগুপ্ত প্রমুখ উচ্চপদস্থ রাজ অমাত্যরা সর্বস্ব পণ করেছিলেন সেই বিবাহ বন্ধ করতে এবং রাজাকে সদুপদেশ দিয়ে বিরত করতে৷ বৃদ্ধ মন্ত্রী দামোদর শর্মা রাগে গর্জন করে কাঁপতে কাঁপতে বলে—‘‘বৃদ্ধ দামোদর সপ্ততিবর্ষ বয়ঃক্রমকালে নটের দাস হইতে পারিবে না, রঙ্গমঞ্চে নৃত্য করিতে পারিবে না৷ স্কন্দ, আমি বিদ্রোহী, আমি দামোদর, সমুদ্রগুপ্তের অন্নে প্রতিপালিত৷ এককালে চন্দ্রগুপ্তের দক্ষিণহস্তস্বরূপ ছিলাম, আমিই চন্দ্রগুপ্তের পুত্রকে সিংহাসনচ্যুত করিব৷ তুমি যদি পিতৃদ্রোহী না হও, গোবিন্দ যদি ভ্রাতৃসিংহাসনে উপবেশন করিতে সম্মত না হয়, তাহা হইলে আর্যপট্ট উঠাইয়া গঙ্গাজলে নিক্ষেপ করিব৷’’১২২ এই শক্তিশালী অমাত্যদের বিরোধিতা করতে করতে ইন্দ্রলেখা নিঃশেষ হয়ে গেছে৷ যদিও শেষ পর্যন্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের শত্রুস্থানীয় বৌদ্ধ সংঘস্থবির হরিবল, প্রণয়ী চন্দ্রসেন এবং তান্ত্রিকের সহায়তায় অনন্তাকে রাজবধূ এবং পট্টমহাদেবীর আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিল৷ কিন্তু তার জন্য যে হীন পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল তাকে বা তার দ্বারা প্ররোচিত কন্যা অনন্তাকে তাতে পাঠক তাদের ঘৃণা না করে পারে না৷ সমাজও পরিণতিতে কঠিন শাস্তি বিধান করেছে তাদের প্রতি৷

আবার ‘অসীম’ উপন্যাসে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুর আরোপ করেছেন বারাঙ্গনাদের প্রতি৷ শরৎচন্দ্রের মতো তিনিও তার মনিয়া চরিত্রটিকে ত্যাগে-ভালোবাসায়-ক্ষমায়-মহত্ত্বে মহান করে তুলেছেন৷

মনিয়াবাই দেহপসারিণী বাইজি মতিয়ার সন্তান৷ যৌবন বিগত হওয়ায় এবং ‘খদ্দের’ সংখ্যা কমে যাওয়ায় মতিয়া গণিকাবৃত্তি ছেড়ে বাইজির শিক্ষিকা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যত্নবান হয়৷ অল্পদিনের মধ্যে সে বিষয়ে তার খ্যাতি প্রতিপত্তিও বেড়ে যায়৷ সমাজ দূষণের সবরকম হীন ক্রিয়া-কাণ্ড পরিত্যাগ করায় মতিয়াকে নিয়ে তার প্রতিবেশীদের কোনো অভিযোগ ছিল না৷ পাড়ার সকল ভদ্রস্থ লোকের সঙ্গে নিরুপদ্রবে জীবন চলতে থাকে তার৷ এখানে ভদ্রপল্লীতে সকলের সঙ্গে গণিকার বাস সম্পর্কে ইঙ্গিত দান করেছেন লেখক৷ যদিও তার আগে তিনি বলে নিয়েছেন—‘‘পাটনা সহরের এক প্রান্তে ভদ্র-পল্লীর মধ্যে এক বৃদ্ধা গণিকা বাস করিত৷ তাহার নাম মতিয়া৷ সে গণিকা হইলেও, পল্লীর সকলেই তাহার উপর সন্তুষ্ট ছিল৷ কারণ, তাহার গৃহে অসদাচরণ দেখিতে পাওয়া যাইত না৷ যৌবনান্ত হইবার পূর্বেই মতিয়া গণিকা-বৃত্তি পরিত্যাগ করিয়াছিল;’’১২৩ অর্থাৎ মতিয়া যদি গণিকাবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত থাকতো তাহলে সমাজ বিরোধিতা করে হয়তো প্রান্তবাসিনী করে তুলতো৷ যা হোক মতিয়ার ভাগ্যে সে দুর্ভোগ আসেনি৷ মতিয়ার কন্যাই মনিয়া৷ মতিয়া তার নিজের সমস্ত শিক্ষা উজাড় করে দিয়েছিল মেয়ের প্রতি৷ সঙ্গীতের সহজাত দক্ষতা এবং অসামান্য রূপের ছটায় কিছুদিনের মধ্যেই মায়ের সমস্ত কৃতিত্বকে ছাপিয়ে যায়৷ তার নাম এবং রূপের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে৷ পরিণত হয় পাটনা শহরের বুলবুল হিসেবে৷ কিন্তু ঘটনার বাঁক নেয় শাহজাদার দরবারে মুজরা করতে গিয়ে অবস্থার দুর্বিপাকে অসীমের দর্শন পেয়ে৷ দুর্বৃত্তের হাত থেকে মনিয়াকে রক্ষা করে অসীম তার হৃদয়ের সিংহাসনে অক্ষয় আসনে অধিষ্ঠিত হয়৷ কিন্তু সে বারবনিতা—সমাজের মনোরঞ্জিকা৷ পুরুষরা তাদের দু’দিনের জন্য উপভোগ করতে পারে, রক্ষিতা হিসেবে তারও বেশিদিন নিজের করায়ত্ত রাখতে পারে কিন্তু একজন পণ্যাঙ্গনার প্রেমের মূল্য কেন দিতে যাবে৷ মনিয়া অসীমের জন্য তার নাম, যশ, মায়ের প্রতি দায়িত্ব এমনকি নিজস্ব ধর্মীয় আচরণ পরিত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে সাধনা শুরু করলেও তাকে লাভ করতে পারে না৷ অসীম তার দরদি মন দিয়ে মনিয়ার আত্মস্বরূপকে বুঝতে পারলেও সে তার কাছে সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাজ্য৷ মনিয়ার কোনো জাত নেই, তার পিতা মুসলিম, মা হিন্দু৷ শুধু ধর্মীয় বিভেদই নয় সর্বোপরি সে বেশ্যাকন্যা৷ একজন বেশ্যাকন্যাকে গ্রহণ করে তার প্রেমের যথাযোগ্য মূল্য দেওয়ার কোনো বিধান সমাজে প্রচলিত নেই৷ অসীম তাই অপারগ৷ কিন্তু দেখা যায় শুধু অসীমকে ভালোবাসাই নয়, তার সমস্ত বিপদে-আপদে রক্ষয়িত্রী হয়ে অবতীর্ণ হয়েছে সে-ই৷ একজন অস্পৃশ্যা রমণীর ভালোবাসার দান গ্রহণ করা যায়, বিপদ উদ্ধারের জন্য সাহায্য নেওয়া যায় তার কৌশল ও বুদ্ধির অথচ তার প্রতিদানে উপেক্ষা ছাড়া কিছুই জোটে না তার৷

সম্পূর্ণ উপন্যাস জুড়ে কথক মনিয়াকে দিয়ে অসাধ্য সাধন করিয়েছেন, প্রেমের আগুনে পুড়িয়ে পুড়িয়ে ছাই করে তুলেছেন, সবশেষে সেই প্রেমকে নিষ্কামস্তরে উত্তীর্ণ করে এক আধ্যাত্মিক মাত্রা আরোপ করেছেন কিন্তু প্রেমাস্পদের বাহুবন্ধনে তার অতৃপ্ত ভালোবাসার পরিতৃপ্তি ঘটাতে পারেননি৷ ত্যাগে-ভালোবাসায়-মহানতায় মনিয়া নিজেকে বিলিয়েই গিয়েছে শুধু পরিণামে কোনো কিছু পায়নি৷ বেশ্যা কন্যা বলে সেই যন্ত্রণার পাহাড় বুকে চেপে আধ্যাত্মিক সাধনায় অগ্রসর হয়েছে৷

রচয়িতা মনিয়ার চরিত্রে যে মহৎ গুণগুলির সমাবেশ ঘটিয়েছেন তাতে তার প্রতি আর কোনো ঘৃণা থাকে না৷ একজন বেশ্যা কন্যার দুঃখে ব্যথিত হয়ে যেমন হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে যায় তেমনি তার কঠিন প্রেম-সাধনায় মস্তক নত হয়ে আসে৷ আর এর মধ্য দিয়েই সার্থক হয়ে উঠে ‘অসীম’-এর মনিয়া৷

নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত সাহিত্য সৃষ্টির দিক দিয়ে প্রায় শরৎচন্দ্রের সমকালীন৷ মানুষের জীবনের বাস্তব রূপকে প্রতিবিম্বিত করতে গিয়ে তিনি উপন্যাসে যে সমস্ত গণিকা চরিত্র গুলোকে চিত্রিত করেছেন—তারা শুধু দেহজীবীই নয়—তারা রক্তমাংসের দোষগুণসম্পন্ন মানবী৷ সুপ্ত চৈতন্য বা প্রবৃত্তির তমসাপূর্ণ দিকটিকে তুলে ধরতে গিয়ে ‘পাপ’, ‘পুণ্য’ ইত্যাদি গতানুগতিক আদর্শের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে জীবনে যা বাস্তব, যা সত্য সেটাই দেখাতে চেষ্টা করেছেন৷ সেখানে কোনো ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের জ্বালা নেই; নেই কোনো ক্রোধ বা প্রতিহিংসা৷ চরিত্রগুলি সাধারণ দোষগুণ সম্পন্ন মানুষের মতো ভুল-ভ্রান্তি,ভালো-মন্দ নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে৷

তাঁর ‘শুভা’ উপন্যাসের শুভার মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার তীব্র আকাঙ্খা৷ স্বামী নিবারণের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে ঘর ছাড়ে সে৷ তার কাছে পরপুরুষের সঙ্গে যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে উপার্জন করা যেমন দেহ ব্যবসা তেমনি বিবাহিত স্বামীর সঙ্গে ভরণপোষণের নিমিত্ত অনিচ্ছাকৃত শরীরী সংসর্গও একরকমের দেহ ব্যবসা৷ তাই তার মনে হয় যে ঘরে থাকলেও শরীর বেচে খেতে হবে; বাইরেও না হয় তাই করবে৷ কিন্তু স্বাধীনতা তো পাবে৷ শুভা নারীর প্রতি প্রচলিত নানা বিধি-বিধান এবং পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া নানা অত্যাচার, পীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ জীবনকে দেখার জন্য পথে বের হয়—জীবনের নানা স্তর অতিক্রম করে নারীজীবনের নানা প্রতিকূলতাকে মাথায় নিয়ে৷ তবু হার মানে না সে৷

শুভার মধ্য দিয়ে রচনাকার খড়গ ধরেছেন সমাজের নারীজাতির প্রতি নানা অত্যাচারের মধ্যে৷ শুভার মন-মানসিকতা আধুনিক নারীমনস্তত্বের পরিপূরক হয়ে উঠেছে৷ প্রচলিত সতীত্বের ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে আজীবন বিদ্রোহ করে গেছে সে৷

‘লুপ্তশিখা’-র মালতী একজন পণ্যাঙ্গনা হলেও মনুষত্বকে একেবারে বিসর্জন দিতে পারেনি৷ গণিকাদের প্রতি যে নেতিবাচক ধারণা একসময় নায়ক বটুকের মনে বিদ্বেষভাব বহন করতো সেই বটুকই ঘটনাচক্রে নিক্ষিপ্ত হয় এক পতিতাপল্লীতে৷ বারবনিতা মালতীর স্নেহ ও উপার্জনের পয়সায় অভিভাবকহীন বটুক একজন বড় উকিল হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে কিন্তু ততদিনে তার সেই পতিতা দিদিকে হারিয়ে ফেলেছে সে৷ পরে একটি কেস-এর ভিত্তিতে পুনরায় দিদির দেখা পেলেও শেষ রক্ষা করতে পারেনি৷

ঔপন্যাসিক সংবেদনশীল দৃষ্টিতে অঙ্কন করেছেন এই চরিত্রটিকে৷ ডুবুরির মতো তার পঙ্কিল শরীর ছেড়ে ডুব দিয়েছিলেন মনের গভীরে৷ সেখানে শুক্তির ভেতরে মুক্তোর মতো স্নেহ-ভালোবাসায় পরিপূর্ণ মনটিকে আবিষ্কার করে পাঠকের সামনে তাকে অনবদ্য করে তুলেছেন৷ যদিও ভাগ্যের চক্রে তার জীবন পরিণতি ট্র্যাজিক তথাপি বটুকদের মতো প্রতিপত্তিশালী মানুষদের সহায়তা ও অনুকম্পা গণিকাদের থেকে ঘৃণার পর্দামোচন করেছে৷

‘পাপের ছাপ’-এর মনোরমা উগ্রস্বভাবের৷ তার মধ্যে আরোপিত হয়েছে অপরাধ প্রবণতা৷ সে যৌনতায় লালসায় নিষ্ঠুর ব্যবহারে প্রায় নারীস্বভাব বর্জিত হিসেবে অঙ্কিত৷ ‘রক্তের ঋণ’-এ বর্ণিত বারবনিতাও যৌনতার ক্লেদ অঙ্গে ধারণ করে পরিণতি প্রাপ্ত হয়েছে৷ নিজের সেই পাপ সংক্রামণ প্রবাহিত করেছে পুত্র নাগানন্দের মধ্যেও৷

অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের হাতে পতিতারা নানা রূপে উদ্ভাসিত৷ তার মধ্যে শুভা ও মালতী অবশ্যই উল্লেখযোগ্য দুই চরিত্র৷ শুভার স্বাধীন প্রবৃত্তি ও মালতীর হৃদয়ের কোমলতা, নির্মম পরিণতি সমাজে পতিতাদের অবস্থানগত স্বাতন্ত্র্যকে চিনিয়ে দেয়৷ সঙ্গে এই দিকটাও স্পষ্ট হয় যে এই পণ্য রমণীরাও নিজেদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, সামাজিক মূল্য ইত্যাদি বিষয়ে একটু একটু করে সচেতন হতে শুরু করেছে—এবং পুরুষতন্ত্রকে তোয়াক্কা না করে নিজের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হচ্ছে৷

জগদীশগুপ্ত ‘লঘুগুরু’ উপন্যাসে তিনজন নারীর তিনরকমের পরিণতি দেখিয়েছেন৷ প্রথম জন উত্তম৷ সে প্রথমে ছিল কারও গৃহবধূ৷ অবস্থা বিপাকে গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করেছিল৷ পরে তাতে প্রবল বিতৃষ্ণা উপস্থিত হলে পুনরায় গৃহী হওয়ার বাসনা, লালন করবার বাসনা তাকে পেয়ে বসে৷ যার ফলশ্রুতিতে সে হয়ে উঠে বিশ্বম্ভরের স্ত্রী এবং টুকীর মা৷ দ্বিতীয় চরিত্র টুকী৷ মা-মরা এই মেয়েটি যখন মা হিসেবে উত্তমকে লাভ করে নারীত্বের সৎগুণাবলীতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে৷ গণিকা স্নেহে মানুষ হয়েছে বলে তার বিবাহ নিয়ে বিভ্রাট দেখা দেয়; পরিশেষে উপায়ন্তর না দেখে এক মাঝবয়সি লম্পট পুরুষের ঘরনি হয়ে আরেক জীবন শুরু করে৷ টুকীর স্বামী লম্পট পরিতোষ আগে থেকেই বারবনিতা সুন্দরীকে রক্ষিতা হিসেবে গ্রহণ করে জীবন অতিবাহিত করছিল, সেই সংসারে অসামান্য রূপ নিয়ে হাজির হয়ে পরিতোষ ও সুন্দরীর সুপ্ত আশাকে জাগ্রত করে টুকী৷ পরিতোষ ও সুন্দরী মিলিতভাবে গণিকাবৃত্তির দিকে ঠেলতে থাকে টুকীকে৷ সেখানে টুকী চালিয়ে যায় সতীত্বকে বাঁচিয়ে রাখার অদম্য প্রয়াস৷ শেষ পর্যন্ত নিয়তির কাছে হার মানে সে৷ দেহব্যবসার অন্ধকার জগতে পা বাড়াতে বাধ্য হয় সীতা-সাবিত্রীর আদর্শে বেড়ে উঠা সেই নারী৷ তৃতীয়জন সুন্দরী৷ জন্মসূত্রেই দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সে৷ প্রায় বিগতযৌবনা এই বারবনিতা টুকীকে সামনে পেয়ে বেঁচে থাকার নতুন পথনির্দেশ পায়, তার সাধনা চলতে থাকে তাকে অবলম্বন করে রোজগার করার৷ সে কৌশল করে দূতী হয়ে টুকীর যৌনব্যবসার সমস্ত পথ তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত টুকী তাকে ত্যাগ করে স্ব-দায়িত্বে সেই বৃত্তির দিকে চলে যায়৷ সুন্দরী একা সেই নরকেই পচতে থাকে৷ অর্থাৎ তিনজন নারীর একজন অন্ধকার থেকে আলোতে, আরেকজন আলো থেকে অন্ধকারে এবং শেষজন শিক্ষা-সংস্কার বিবর্জিতরূপে অনন্ত নরকে পচে মরার মধ্যে পরিণতি পেয়েছে৷

আসলে জগদীশগুপ্ত মানুষের মনের জট বাঁধা-খোলার ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন৷ তার কোনো কোনো রচনায় নিয়তি বিশেষ ভূমিকা নিয়েছে৷ তিনি ‘লঘুগুরু’ উপন্যাসে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন একজন বহুভোগ্যা বারবনিতা তার দেহব্যবসা ছেড়ে গৃহলক্ষ্মীরূপে প্রতিষ্ঠিত হলে তার পরিণতি কি হতে পারে৷ সেই পরীক্ষার উপকরণ উত্তম৷ উত্তম জন্মসূত্রে পতিতা ছিল না৷ গৃহের চারদেওয়ালের আবেষ্টনী থেকে বেড়িয়ে তাকে কষ্ট করেই গণিকাসুলভ মানসিকতা আয়ত্ত করতে হয়েছিল৷ লেখক তার বর্ণনা দিয়েছেন—‘‘মানুষকে হাতে পাইয়া তাহাকে বশীভূত করিয়া খেলাইয়া খেলাইয়া পিশাচ করিয়া তুলিবার বিদ্যাটা সে চেষ্টা করিয়া, ভিতরকার বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া শিখিয়াছিল—তখন তার নাম ছিল বনমালা—তারও আগের নাম তার যূথী৷ মানুষ সেই যূথীর শত্রু৷’’১২৪ অর্থাৎ সংসারের নিরাপদ আবেষ্টনী থেকে বেড়িয়ে বেশ্যা হতে তাকে কম কষ্ট ভোগ করতে হয়নি৷ লেখকের এই কথার মধ্য দিয়ে তার গণিকা হওয়ার পেছনে সমাজের যে একটা প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল তা স্পষ্ট৷ তাই উত্তমের পূর্ব জীবনের মূর্তি যূথীর শত্রু হয়েছিল মানুষেরাই৷ উত্তম বেশ্যা হয়ে মানুষকে ঘৃণা করেছে—মানুষকে কাঁদিয়ে কাঁদিয়ে চরম তৃপ্তি অনুভব করেছে৷ এক হিংস্র আক্রোশে পুরুষদের কষ্ট দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে আত্মসুখ অনুভব করেছে৷ তার পর একদিন দুরন্ত ঘৃণা জন্মে যায় সেই কাজে৷ তার সংসার বুভুক্ষ মন পুনরায় গৃহী হওয়ার জন্য দুর্নিবার আকর্ষণে টানতে থাকে৷ তারপর নদীরঘাটে যেদিন বিশ্বম্ভরকে প্রথম দেখে; তার চোখে লক্ষ করে অনুরাগের হিরণ্যদ্যুতি, নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারে না৷ দেহ ব্যবসার রমরমা কারবার ছেড়ে তার গৃহিণী হওয়ার জন্য উৎসুক হয়ে উঠে৷ লেখক সেই মনোভাবকে ব্যক্ত করে বলেছেন—‘‘কিন্তু যেদিন ঐ কাজে দুরন্ত ঘৃণা ধরিয়া গেল, আর যেদিন তার বিশ্বম্ভরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হইল, ঐ দু’দিনের ব্যবধান খুব অল্প’’১২৫—তার হিংস্র পুরুষ বুভুক্ষা লুপ্ত হয়ে পুরোনো গৃহবুভুক্ষার তন্দ্রা ভঙ্গ করে৷ এতদিন শয়তানকে বশীভূত করে সে তার দেহের খদ্দের বানিয়েছে; সে মানসিকতার পরিবর্তন ঘটিয়ে সে বিপরীত পথে চলে শয়তানকে শাসন করে মানুষ করার অভিপ্রায়ে মশগুল হয়৷ তাই তার মনে হয় বিপরীত পথে চলে শয়তানকে শাসন করে মানুষ করে তোলাও না জানি কত আনন্দের—ভালোবাসা দিয়ে সুখী করাও বুঝি অসীম সুখের৷ আর এই অভিপ্রায়েই বিশ্বম্ভরের প্রস্তাবে সে তার গৃহলক্ষ্মী হয়ে গৃহে প্রবেশ করে৷ কিন্তু উত্তমের সেই সাধ পূর্ণ হয়নি৷ তার স্বামীর পূর্বস্ত্রী হিরণ মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অনেক আগেই পিশাচ বিশ্বম্ভরকে প্রায় মানুষ করে তুলেছিল৷ হিরণের জন্যও এক নারীর স্বাভাবিক সমবেদনায় ব্যথিত হয়েছে উত্তম৷ তার করুণ মৃত্যুকে মনে করে চোখে অশ্রুবাষ্প জমা হলে তা নিয়ে স্বামী বিশ্বম্ভরের বিদ্রুপ করতে বাধেনি৷ সে বলেছে—‘‘কথায় কথায় চোখে জল আনিয়া যদি আমাকে তুমি গদগদ করিয়া তুলিতে চাও, তবে সে সুদিনের দেরি আছে বলিয়া মনে করিয়া রাখ৷’’১২৬ তারপর হঠাৎ হো হো করে হেসে উঠে একটা প্রবাদবাক্য আওড়ে বলেছে—‘‘কার শোকে কে কাঁদেরে বাবা, তার দিশে পাওয়া ভার—মাছ মরলে বিড়াল কাঁদে, গরু মরলে শকুন; আর, পদির পিসী কাঁদে পদি মারলে বলে উকুন৷’’১২৭ এখানে বিশ্বম্ভরের কথা থেকে বোঝাই যাচ্ছে যে সে উত্তমকে গৃহে গৃহিণীরূপে ঠাঁই দিয়েছে তার পাশবিক ক্ষুধা মেটানোর জন্য—সে যে একজন নারী; তার হৃদয়ের সুখ-দুঃখ তাপ কিছু বোঝার ক্ষমতা নেই বিশ্বম্ভরের বা সে চেষ্টাও সে করেনি কোনোদিন৷ সে তাকে পণ্য জ্ঞানেই ঘরে তুলেছে, পণ্য ভেবেই উপভোগ করতে চায়; আর কিছু নয়৷ তারপরেও বলা যায় এযাবৎ আলোচিত উপন্যাসগুলিতে গণিকা নারীদের বিবর্তনের নানা পথ নির্দেশ করেছিলেন রচনাকরেরা কিন্তু জগদীশ গুপ্ত উত্তমকে দিয়ে যা করালেন তা চরম দুঃসাহসের৷ তিনি উত্তমকে এক বেশ্যা থেকে গৃহবধূরূপে প্রতিষ্ঠা দিলেন৷ গণিকাদের জন্য সমাজ সর্বদাই প্রতিকূল৷ তারা গৃহবধূ হয়ে যাওয়া এই বারবনিতাকে কি চোখে দেখবে, গৃহলক্ষ্মী হয়ে গৃহে অবস্থান করলে সংসারের কতটা মঙ্গল সাধিত হবে তা পরের ভাবনা কিন্তু তাকে গৃহিণীর মর্যাদা দেওয়ার প্রাথমিক পদক্ষেপটা জগদীশ ছাড়া কেউ দেখাতে পারেননি৷ পণ্যাঙ্গনার গৃহিণী হওয়ার পরিকল্পনা এবং তাকে বাস্তবায়িত করা গণিকা চরিত্রের বিবর্তনের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷

উত্তম বিশ্বম্ভরের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী হিসেবে সংসারে প্রবেশ করেই বুকে টেনে নেয় স্বামীর প্রথমাস্ত্রী হিরণের রেখে যাওয়া সন্তান টুকীকে৷ মাতৃহারা বালিকাকে আঁকড়ে ধরে সে হয়ে উঠে টুকীর মা৷ কিন্তু এক বারবনিতাকে গৃহিণীরূপে মানবে কেন সমাজ! উত্তমকেউ মেনে নেয় না৷ তাই প্রতিবেশিনীদের নানা ইঙ্গিতপূর্ণ কথার জবাব সে দেয় স্পষ্ট করেই৷ সে তার পরিচয় বা পূর্বজীবন কোনোটাই অস্পষ্ট রাখে না তাদের প্রতি৷ কারণ উত্তম সমাজকে জানে—জানে নারীর প্রতি তার নিষ্ঠুর উপহাসকে৷ তাই সবলে নিজের ব্যক্তিত্বকে ধরে রেখেছিল সে৷ প্রতিবেশীদের পীড়ন, স্বামীর খেয়ালিপনা কোনোকিছুতেই সে মুঠো আলগা করে নি৷ বিশ্বম্ভর ভেবেছিল তাকে করায়ত্ত করে একদিকে স্ত্রীর পরিচর্যা অন্যদিকে গণিকার সাহচর্য দুটোকেই এক সাথে গ্রহণ করবে কিন্তু তার সেই ভ্রম ভাঙতে দেরি হয় না৷ তার মনে হয়—স্ত্রীর নবতর এবং উৎকৃষ্টতর রূপ সে৷ স্ত্রীকে গন্ডির মধ্যে ফেলে ইচ্ছেমত নিষ্পেষণ করা যায়—স্ত্রী সেই পেষণের প্রতিবাদ করে কখনোই ছেড়ে যেতে পারবে না কিন্তু এই স্বাধীন বিহঙ্গ জীবনের অবাধ স্বাধীনতাসুখ উপভোগ করে স্বেচ্ছায় ডানা গুটিয়ে পিঞ্জরে ঢুকেছে৷ এর বন্দিত্ব চিরকালের নয়৷ আর উত্তমও বিশ্বম্ভরের স্বরূপকে বুঝতে পেরেছে স্পষ্ট করে৷ যে দুর্বৃত্ত দমনের দুর্বার বাসনায় বিশ্বম্ভরের গৃহে স্থান নিয়েছিল সে আশা তার পূর্ণ হয় নি৷ হিরণের নির্মম মৃত্যু তাকে আগে থেকেই পরাজিত করে দিয়েছিল৷ সেই মৃত্যুঘটনা শুনে উত্তমের কোমল হৃদয় দ্রবীভূত হয়ে দু’ফোটা অশ্রু বিসর্জন করলে একজন বহুভোগ্যা নারীর সেই আচরণ বিশ্বম্ভরের ঠাট্টার রসদ জোগান দেয়৷ উত্তম প্রতিবাদ করে না৷ স্বামীর ব্যঙ্গোক্তিকেই সে নিজের বিগত জীবনে প্রায়শ্চিত্ত হিসেবে গ্রহণ করেছে৷ সীমাহীন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা দিয়ে খেয়ালি বিশ্বম্ভরের সংসারকে ধরে রাখে, টুকীকে মানুষ করার সংকল্প নেয়৷ তার সেই সংসার গোছানোতেও স্বামী বিদ্রুপ না করে ছাড়ে না৷ উত্তমকে মধ্যমণি করে ইয়ার-বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে মদ-মাংসের আসর বসিয়ে আত্মসুখ চরিতার্থ করার চেষ্টা করলে উত্তম বাধা দেয়৷ সে জানতে চায় হিরণ তেমনটা করতো কি না? সেই প্রশ্নের উত্তর বিশ্বম্ভর দেয় জিব কেটে—‘‘না, না; সে ছিল বউমানুষ—৷’’১২৮ উত্তমকে তার মনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করে এইভাবে ‘‘আমার কয়েকজন খুব বন্ধু আছে; আমার সঙ্গে খুব তাদের দহরম-মহরম—একাত্মা হরিহর বললেই চলে৷ তারা অনেকদিন এ বাড়ীতে আসে না—…তাই তারা তোমার অনুমতি চায়—…হিরণ, মানে টুকীর মা থাকতে তারা হামেশাই আসত৷’’১২৯ এ পর্যন্ত বলা কথার মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর সাধারণ সাংসারিক আলাপের সুরই বর্তমান৷ উত্তমও সাধারণ গৃহিণীর মতোই তার জবাব দেয়—‘‘এখনও আসতে চান আসুন; আমি তাতে বাধা দেব কেন! আমার অনুমতি তাঁরা নিতে পাঠিয়েছেন কেন—তুমি বা কথাটা বলতে এমন ইতস্তত করছিলে কেন?’’১৩০ এবারে বিশ্বম্ভর নিজের স্বরূপে আসে৷ উত্তমের গৃহিণী হয়ে ঘরকন্না করার মনের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে—‘‘—তারা ত’ আসবে, বসবে, আমোদ করবে; তুমিও যদি বসো সেখানে, তবেই, তাই তারা—’’১৩১ কিন্তু যে পথ সে স্বেচ্ছায় পরিত্যাগ করে এসেছে সে পথে কিছুতেই নিজেকে ফেরাবে না উত্তম৷ আর এই জেদই তাকে ঘরে-বাইরের সকল প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের শক্তি দিয়েছে৷ নিজের ধৈর্য অক্ষুন্ন রেখে স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে সে আর গণিকা নয়—সে একজন মা, একজন গৃহিণী৷—

‘‘টুকীর মা থাকতো?

দাঁতে জিব কাটিয়া বিশ্বম্ভর বলিল,—না, না; সে ছিল বউমানুষ—

বিশ্বম্ভরের দৃষ্টি অকারণেই নত হইয়াছিল—

উত্তমের মুখের দিকে চাহিলে দেখিতে পাইত, তার মুখে যেন রক্ত নাই, ঠোঁট কাঁপিতেছে৷

উত্তম একটু সময় লইয়া জবাব দিল; বলিল,—কিন্তু টুকীর সামনে ত’ তা হতে পারে না৷ আমি এসে আছি বলে’ যে পথে সে যেতে পারে’ তোমার ভয় আছে, সে পথটাই খুলে দেয়া হবে যদি তার সামনেই তোমার বন্ধুদের সঙ্গে আমি বসি৷’’১৩২ অর্থাৎ পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি বিশ্বম্ভর উত্তমকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেনি, গণিকা হিসেবেই গৃহে রেখেছিল৷ তাই সেই বিয়ে করা রক্ষিতাকে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে উপভোগ করতে চেয়েছিল৷ একজন বারবধূ যে শত চেষ্টা করলেও যে তার কলুষতা মুক্ত করতে পারে না উত্তম তার প্রমাণ৷ যাই হোক উত্তমের সংসার বুভুক্ষ মন তাতে আঘাত পেলেও বিচলিত হয়নি৷ স্বামীর অবজ্ঞা, ইয়ার বন্ধুদের অসভ্যতা শক্তহাতে মোকাবিলা করেছে৷ স্বামীর বন্ধুদের দ্বারা সে ভূষিত হয়েছে—‘নিষ্ঠাবতী খাণ্ডারী’ উপাধিতে৷ সে তার জীবনে বন্য পশুকে বশ করাতে পারেনি ঠিকই কিন্তু অবোধ মাতৃহারা শাবকটিকে নিজের হৃদয়ের সমস্ত উত্তাপ দিয়ে পরিপূর্ণ করে তুলেছিল৷ অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে লেখা-পড়া, কাজ-কর্ম, আচার-নিয়ম ইত্যাদির দ্বারা টুকীকে সমৃদ্ধ করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিল৷ তার সেই আচার-নিষ্ঠা দেখে ব্যঙ্গ করেছে বিশ্বম্ভর—‘‘শুচিবাই দিন দিন বাড়ছে দেখছি৷ গেরস্থের বৌকেও হার মানিয়ে দিতে পার৷’’১৩৩ এখানেও বিশ্বম্ভর তাকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় নি বেশ্যা হিসেবেই দেখেছে৷ আসলে বিশ্বম্ভর তার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় সারা জীবন বিচার করে এসেছে উত্তমকে৷ তাকে ভয় করেছে, তার রাশি রাশি টাকা দেখে প্রতিবেশীদের বিরূপ মন্তব্যকেও হজম করেছে, সে টাকা গ্রহণ করে ব্যবসা করে প্রভূত সম্পদের অধিকারী হয়েছে কিন্তু একজন নারী হিসেবে কোনোদিনও মর্যাদা দিতে পারেনি৷ আর উত্তম সংসারের স্থায়ী এক সম্পর্কে ঠাঁই দেওয়াটুকুতেই তার উপর চিরকৃতজ্ঞ থেকেছে৷ তার শুধু মনে হয়েছে তার গৃহবাসিনী হওয়ার দুরন্ত ইচ্ছেকে ‘‘বিশ্বম্ভর যেন দুস্তর অগ্নিপরীক্ষায় ফেলিয়া যাচাই করিয়া লইতেছে৷’’১৩৪ স্বামী তাকে এতটুকু বিশ্বাস করে না; প্রতিবেশীরা যখন বলে সেও তার মতো গণিকা বানাবে মেয়েকে তাতে সন্দিহান হয়ে সে সন্দেহর কথা ব্যক্তও করে উত্তমের কাছে; পরে উত্তমের বাক্সভর্তি তাড়া তাড়া নোট ও রাশি রাশি অলঙ্কার দেখে সমস্ত সন্দেহ দূর করে দেয়৷ বিশ্বম্ভর তার প্রতি অনুরক্ত হয়েই তাকে ঘরে তুলেছিল, আগে থেকে হেরে যাওয়া মানুষটার মধ্যে উত্তমও মাঝে মাঝে লক্ষ্য করে ভালোবাসার প্রচ্ছন্ন দ্যুতি; তার পরেও তার পূর্বজীবন নিয়ে তার দেওয়া নানা খোঁটা, বিদ্রুপ বিদ্ধ করে বলেছেন—‘‘সে যে সমাজের কতখানি গ্লানি তাহা সে জানে—তাহার অতিশয় সচেতন মনে যত তীক্ষ্ণ অপ্রত্যাশিত আঘাত লাগিতে পারে তাহা সে সহ্য করিতে প্রস্তুত; কিন্তু বিশ্বম্ভর তাহাকে ভালবাসিয়াও কেন এমন!’’১৩৫ তার হৃদয়ের তীব্র দহন বোঝার ক্ষমতা বিশ্বম্ভরের নেই—উত্তমের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সংসারে টিকে থাকার লড়াইটা সম্পূর্ণ তার একার আর সেখানে থাকতে গেলে সমস্ত অপমান-অবমাননা সহ্য করেই থাকতে হবে৷ তাই সীমাহীন ধৈর্যকে বর্ম করে সমাজের স্বামীর সমস্ত আঘাত নির্বিবাদে গ্রহণ করতে থাকে৷

প্রতিবেশীরা উত্তম বিশ্বম্ভরের সঙ্গে পেরে না উঠে টুকীর নির্মল-নিখাদ মনে বিষবৃক্ষের বীজ বপন করতে যত্নবান হয়৷ লেখক প্রতিবেশিনীদের ক্রিয়াকলাপকে বাস্তবসম্মতভাবে তুলে ধরেছেন৷—

‘‘টুকী, তোর হাতের ওই চুড়ি পেতলের না সোনার?

টুকী বলিল,—সোনার৷

—মানুষের ঘাড় ভেঙে কত টাকা এনেছেরে তোর মা?

সরল মনে টুকী উত্তর করিল,—তা জানিনে৷

শুনিয়া উল্লাসী গুঞ্জ প্রভৃতি পাঁচ সাতটি মেয়ে একসঙ্গে হাসিয়া উঠিল৷

টুকী বলিল,—আরো গয়না দেবে বলেছে মা৷

গুঞ্জ বলিল,—বিশ্বম্ভর বনেদি বনে গেল৷ ওলো টুকী, তোর মা এত সোনা পেলে কোথায় জানিস?

টুকী জানিত না; বলিল,—না৷…

শুদোস তোর মাকে, এত সোনা তাকে কে দিয়েছে৷

—বাবা দিয়েছে৷…

তোর মা বেশ্যে ছিল; গয়না দিয়েছে হাজার লোকে—তোর এ বাবা দেয়নি৷ যা শুদোকে তোর মাকে৷’’১৩৬

উত্তমের জীবনের একমাত্র দুর্বল স্থান হল টুকী৷ সে তার কাছে সমস্ত কিছু আড়াল করে এক আদর্শায়িত জীবনের পথে চালিত করতে চেয়েছে৷ প্রতিবেশীদের স্পষ্ট কথা এবং বিশ্বম্ভরের অভিব্যক্তিতে টুকী যখন সমস্তটা বুঝতে পারে তখন সে আর চুপ থাকতে পারে না৷ কঠিন বাক্য দ্বারা তিরস্কার করে বিশ্বম্ভরকে বলে—‘‘মোক্ষর মা যা বলেছে তাই বলে৷ কিন্তু টুকীর কাছে ও কথাটি গোপন রাখতে চেয়েছিলাম, তুমি তা রাখতে দিলে না৷’’১৩৭ যে জন্য উত্তম টুকীকে অপাপবিদ্ধ করে রাখতে চেয়েছিল, যে আদর্শের পথে চলে মাতৃহীনা মেয়েটিকে নিজের করে নিয়ে শিক্ষা-সংস্কারে সুশ্রী, সুস্থির, সুলক্ষণা, গৃহকর্মে নিপুণা করে তুলেছিল; সে সমস্তকে ছাপিয়ে ভবিতব্য হিসেবে দেখা দেয় তার নিজের অতীত জীবনই৷ সীতা-সাবিত্রীর আদর্শে বড় করা মেয়েটি শুধুমাত্র উত্তমের বিগত জীবনের কলুষতার জন্য সুস্থ সমাজে ঠাঁই পায় না৷ কোন সৎপাত্র তাকে বিয়ে করতে রাজী হয় না৷ বার বার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর শেষপর্যন্ত এক লম্পট মধ্যবয়সি প্রৌঢ়র সঙ্গে বাধ্য হয় মেয়ের বিয়ে দিতে৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে কয়লা ধুলে যেমন ময়লা যায় না তেমনি কোনো গণিকা তার বৃত্তি থেকে বেড়িয়ে এলেও কোনো প্রায়শ্চিত্তের বিনিময়েও সেই বৃত্তির কালিমা থেকে মুক্ত হয় না৷ লেখক দুঃসাহস দেখিয়ে তাকে পুনরায় গৃহবধূ করে গৃহী জীবনে ফিরিয়ে দিয়েছেন ঠিক তারপরে সম্পূর্ণভাবে সে হয়ে উঠেছে সমাজে ক্রীড়ণক৷ নিজের সীমাহীন ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা দিয়ে সে লড়াই করে গেছে বিরুদ্ধ শক্তির সঙ্গে কিন্তু মাথা নত করেনি৷ তার এই সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব তাকে অনন্যতা দান করেছে৷ তার সম্পর্কে ক্ষেত্রগুপ্ত বলেছেন—‘‘সে বাধ্য হয়ে বেশ্যাবৃত্তিতে লিপ্ত হয়েছে—সে পেশাদার দেহব্যবসায়ীর মনোভাব ও চরিত্রভঙ্গি আয়ত্ত করেছে, ‘পুরুষমানুষকে হাতে পাইয়া তাহাকে খেলাইয়া খেলাইয়া পিশাচ করিয়া তুলিবার বিদ্যা’ আর ‘হিংস্র পুরুষ-বুভুক্ষা’৷ এই বৈশিষ্ট্য লেখকের মনোবিশ্লেষণে পাওয়া যায় কিন্তু গল্পে অনুপস্থিত৷ এই নারীর মনে সম্পূর্ণ বিপরীত হাওয়া বইল—সে গৃহস্থ বধূর জীবনে সার্থক হয়ে উঠবার বাজি ধরল৷ তবে আসলে এটা জয়ের বাজি ছিল না, ছিল আলোর সাধনা৷’’১৩৮ যে আলোর পথে অগ্রসর হয়ে জীবনে সমস্ত কালিমাকে ঝেড়ে ফেলেছিল; কোনো কিছুর বিনিময়েই সেই আলোর পথ থেকে সে সরে আসেনি৷

অন্যদিকে পরিতোষের রক্ষিতা সুন্দরী প্রবল অর্থকষ্ট সহ্য করেও তার সঙ্গ ছাড়েনি৷ তার যৌবন গত হয়েছে৷ অনিয়মিত আহারে স্বাস্থ্যও ভগ্ন৷ একসঙ্গে অনেকগুলি টাকা ও গহনার লোভে পরিতোষকে স্ত্রী গ্রহণে ইন্ধন জুগিয়েছিল৷ তারপর নববধূ হয়ে টুকী যখন তার সম্মুখে উপস্থিত হয় তার অসামান্য রূপছটা নতুন আশার সঞ্চার করে সুন্দরীর মনে৷ টুকীকে ঘরে বসিয়েই সে পরিতোষের কাছ থেকে পণের পনেরশত এবং গহনার জন্য আরও তিনশত টাকা নিজের হস্তগত করে৷ সেই টাকা তার পরম সাধনার টাকা, সচ্ছলভাবে জীবনধারণ করার একমাত্র রসদ৷ প্রবল সাবধানতায় তাকে আগলে রাখলেও সাময়িক তন্দ্রার সুযোগে তা চোরের হস্তগত হলে নাওয়া-খাওয়া ভুলে শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে সুন্দরী৷ তারপর ধীরে ধীরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই শোক থিতিয়ে এলে তার বেঁচে থাকার, ভবিষ্যতের অন্নসংস্থানের একমাত্র অবলম্বন হয় টুকীর যৌবনদীপ্ত সুগঠিত শরীর৷ টুকীর তার মায়ের শেখানো আদর্শে ধর্মনিষ্ঠা দেখে তাই সে বিদ্রুপ করে৷ সে উত্তমের প্রথমে দেহ ব্যবসা করে অর্থ জমানো ও পরে ধার্মিক সাধ্বী স্ত্রীর মতো সংসার আগলানোর উপমার দ্বারা টুকীকেও সেইভাবে জীবনের গতিপথ নির্ধারণের ইঙ্গিত দেয়৷ তাকে টাকা কিছু জমিয়ে নিয়ে ধর্মনিষ্ঠা করতে বলে৷ তার সেই দ্ব্যর্থক উক্তি যে উত্তমকে খোঁচা দিয়ে বলা এবং একই শ্রেণীর হয়েও মনোগত ভাবে টুকীর কাছে দুজনের দুরকম অবস্থানের প্রতিবাদে ব্যক্ত তা টুকী ঠিকই বুঝতে পারে৷

সুন্দরীর মানসিকতায় বেশিরভাগক্ষেত্রেই নগ্ন-কুৎসিত রূপকে উপস্থাপন করেছেন লেখক৷ সে অর্থ ছাড়া কিছুই বোঝে না৷ তার স্থূল রুচিহীন জীবনে অভাব-অনটনের মধ্যে মনে-প্রাণে শুধু প্রার্থনা করে অর্থের সমৃদ্ধি৷ অর্থের জন্যই পরিতোষকে বিয়ে করতে প্রলোভিত করেছে; অর্থের জন্যই টুকীর দেহটার প্রতি তার দুরন্ত লোভ৷ টুকী তার নিষ্ঠা, ধর্মজ্ঞান নিয়ে সর্বদা মুখ বুঝে থাকলেও সুন্দরীর ঘৃণ্য চরিত্রবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তার মাকে মেলাতে পারেনি৷ চরম প্রতিবাদ করেছে তার৷ তার উপযুক্ত জবাব দিতে না পেরে চতুর্দিক থেকে অবদমিতা সুন্দরী ভেতরে ভেতরে ক্রদ্ধ হয়েছে৷ তার সমস্ত রাগ গিয়ে উপচে পড়েছে টুকীর সুললিত দেহটার প্রতি৷ তার মনে হয়েছে টুকীর দেহটাকে খণ্ড খণ্ড করে সহস্র লম্পটের রিরংসা-দাহ তৃপ্ত করতে দু’হাতে বিলিয়ে দেয়৷ আর তাকে দেহব্যবসার কাছে লাগিয়ে উপার্জন করিয়ে নিজের সুখ চরিতার্থ করতে ষাটবছরের বৃদ্ধ পরিতোষের অক্ষমতা তুলে ধরে, তার অপরিতৃপ্ত যৌনজীবন সম্পর্কে আক্ষেপ প্রকাশ করে৷ তার রূপ-যৌবন পূর্ণ দেহটা কোনো কাজে না লেগে যেভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে তাতে তার ক্লেশের সীমা থাকে না৷ সে টুকীকে ‘ইমোশনালি’ জব্দ করতে থাকে৷ সে বোঝায় তাদের সেই চরম অভাবের দিনে স্বামীর মনে সুখ ফিরিয়ে সংসারে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে একমাত্র টুকীই৷ আর সে যদি তার কথামত চলে তাহলে সবকিছু পুনরায় স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব৷ অসীম মমতায় আপনজনের মতো কথা বলে সংসারের চূড়ান্ত অভাবকে তুলে ধরে; সে টুকীকে তার কথা শুনে চলার জন্য গা ছুঁইয়ে শপথ করিয়েও নেয় ৷ তবু শান্তি পায় না৷ লেখক তার অবস্থার বর্ণনা করে বলেছেন—‘‘টুকীকে এই অনতিক্রম্য শপথে বাঁধিয়াও সুন্দরীর চিত্ত নিঃসন্দেহ সুস্থির হইল না৷ সুন্দরীর মাতামহী মরিয়াছিল পালঙ্কে শুইয়া, তার মা মরিয়াছিল পালঙ্কে শুইয়া, কিন্তু তার মত হতভাগীর সে অদৃষ্ট নয়৷’’১৩৯ তার মা-মাতামহীরা দেহব্যবসার মধ্য দিয়ে যে সুখ ও সমৃদ্ধি ভোগ করেছে তার সে সম্ভাবনা কোনোদিনই ছিল না৷ টুকীকে দেখে সেই সুপ্ত আশার মূলে জলসিঞ্চন ঘটেছে—কিন্তু তার বিরূপতা পুনরায় তাকে হতাশ করে৷ শপথ করিয়েও তার প্রতি নিঃসন্দিগ্ধ হতে পারে না৷ সে যেমন একদিকে গণিকাবৃত্তির দিকে আহ্বান করতে থাকে তেমনি আরেক দিকে দেখা যায় স্বামীভক্তির সূত্রটিকে ছিন্ন করার প্রচেষ্টা৷ পরিতোষের নির্যাতনের সময় তাই টুকীর পক্ষ নিয়েই তাকে বিদ্ধ করে নানা কটুক্তিতে৷ ‘‘বেহায়া মিনসে—কোন কাজটা তোর আটকেছিল শুনি? খেয়ে পরে’ বেশ থাকত—তুই কেন ওকে নিয়ে এলি না খাইয়ে মারতে?’’১৪০ তারপর সুযোগ বুঝে খদ্দের ডেকে আনে সেই বাড়িতে৷ আদর্শ দূতীর মতো খদ্দের হয়ে আসা অচিন্ত্যবাবুর কাছে তার গুণপনা ব্যাখ্যা করে৷ কিন্তু হঠাৎই দালালির অগ্রিম নেওয়া পয়সা যখন তার হাত থেকে মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে যায় তখন সমস্তটা বুঝতে পারে টুকী৷ তাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বললে হিংস্র উন্মাদনায় নির্মম বাক্য পীড়নে টুকীকে বিধ্বস্ত করতে থাকে সুন্দরী৷ ততক্ষণে তার সামনে থেকে বাইরের নিঃসীম অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেছে তার শেষ আশা-ভরসার স্থল৷

লেখক যে উগ্রমনস্কতায় সুন্দরী চরিত্রকে বাস্তবায়িত করেছেন তার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করেছে সুন্দরীর ভবিষ্যতের অন্নসংস্থানের চিন্তা৷ অন্নসংস্থানের একটা সুনির্দিষ্ট পথ যদি থাকতো তাহলে হয়তো এতটা বিবেকশূন্য হত না এই বারনারী৷ যত সবলভাবেই তার ভেতরকার নারীত্বটুকুকে চাপা দিয়ে নগ্ন স্বার্থকে দেখানোর চেষ্টা হোক না কেন তার ভেতর থেকেও স্বচ্ছ নারীমনটি দু-একবার উঁকি দিয়েছে৷ টুকীর ঘরের দেওয়াল জুড়ে ঠাকুরের ছবি লাগানো নিয়ে ব্যঙ্গ করলে নিজের অজান্তেই তার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠে৷ আর যখন বিশ্বম্ভর টুকীকে দেখতে এসে টুকীর মুখে পরিতোষের বোনের পরিচয় পায় এবং টুকীর বাবা যখন মালক্ষ্মী সম্বোধন করে স্নেহবিগলিত কন্ঠে সম্বোধন করে তখন অজানা এক উপলব্ধিতে তার পা অবশ হয়ে যায়৷ কিন্তু তার দুর্বার বাস্তব ভাবনা, মা-দিদিমার সমৃদ্ধ জীবন এবং নিজের সহায়-সম্বলহীন উদ্দেশ্যশূন্য বিভৎস ভবিষ্যৎ তাকে ভালোকিছু ভাবতে দেয়নি৷ সমাজ-প্রতিবেশ পরিস্থিতিই তাকে অমন নিষ্ঠুর করে গড়ে তুলেছে৷

আর একদিকে আদর্শায়িত চরিত্র উত্তম অন্য দিকে আদর্শশূন্য সুন্দরী—এই দুই-এর মাঝখানে পড়ে বিপর্যস্ত হয়ে গেছে টুকীর জীবন৷ টুকী তার বিবাহ পূর্ববর্তী জীবনে মায়ের কাছে যে শিক্ষা অর্জন করেছিল তা ছিল সতীত্বের পরাকাষ্ঠায় সুশৃঙ্খলিত৷ বিয়ের পরে সে হস্তগত হয় স্বামীর রক্ষিতা হয়ে থাকা সুন্দরীর৷ সে যতই তাকে দেহব্যবসার দিকে টানতে থাকে ততই মায়ের আদর্শে কঠোর হয়ে সতীত্বকে আঁকড়ে ধরে রাখে৷ কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারে না৷ তার ভক্তি নিষ্ঠা স্বামী পরিতোষের কাছে ভিত্তিহীন রূপে প্রতিপন্ন হয়৷ স্বামীর নির্যাতন ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ, মায়ের প্রতি অপমান বাক্য, সুন্দরীর মতো একজন বারাঙ্গনার কটূক্তি, প্রলোভন তাকে আদর্শ ধরে রাখতে দেয় না৷ তাই সুন্দরী যখন দালাল হয়ে অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করে তার শরীরের জন্য খদ্দের ডেকে আনে সেই চূড়ান্ত মুহূর্তে সমস্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় টুকীর৷ সে প্রতিবাদ করে বলে—‘‘…একাজ যদি করতে হয়, তবে আমি আপনাকে দেব দেহ, আপনি আমাকে দেবেন টাকা৷ মাঝখানে ওরা কে?’’১৪১ হতভম্ভ অচিন্ত্যবাবু সরল গ্রাম্যবধূর অমন তীব্র প্রতিবাদ বোধ হয় কোনোদিন শোনেনি; সুন্দরীও অত বিস্মিত কোনোদিন হয়নি৷ শেষে অচিন্ত্যবাবু ও সুন্দরীকে বাড়ি থেকে বের হতে বলে নিজেই চৌকাঠের বাইরে অন্ধকারের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়৷ লেখক তার অনির্দেশ্য অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাওয়াকে বর্ণনা করেছেন এইভাবে—‘‘সুন্দরীর বাড়ীর চৌকাঠ পার হইয়া সে বাহিরে ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী অন্ধকারের মধ্যে যাইয়া দাঁড়াইল৷’’১৪২

টুকী সৎ আদর্শে, সৎ মানসিকতায় বড় হয়েছে৷ কিন্তু সমাজ তাকে ভালো থাকতে দেয়নি৷ তার বিমাতার বিগত জীবনের বেশ্যাবৃত্তির জন্য, তার আশ্রয়ে বড় হওয়া টুকীর মধ্যে সমস্ত রকম মানবিকগুণাবলী থাকা সত্ত্বেও সমাজ তাকে অনুকম্পা করেনি৷ যেদিন থেকে সে শুনেছে তার মা বেশ্যা ছিল, যেদিন থেকে ‘বেশ্যা’ কথাটির প্রকৃত তাৎপর্য অনুভব করেছে এবং তার মায়ের মধ্যে বেশ্যার কোনো অভিজ্ঞানই খুঁজে পায়নি৷ তখন থেকেই ভেতরে ভেতরে লড়াই শুরু হয়ে গিয়েছিল তার৷ তারপর বার বার যখন বিয়ে ভেঙে যাচ্ছিল তখন মাকে অনুরোধ করেছিল তাকে না বিয়ে দেওয়ার জন্য৷ তবু বিয়ে করতে হয়েছে৷ সমাজে বাস করে তার নিয়ম অতিক্রম করার সাধ্য কারুই নেই৷ এতদিন যে লড়াইটা তার অন্তরের মধ্যে আবদ্ধ ছিল বিয়ের পড়ে তা প্রকাশ হয়ে পড়ে৷ কিন্তু অভিমন্যুর মতো চক্রবুহ্যে পড়ে গিয়েছে সে৷ সমাজের নানা প্রতিকূলতা সপ্তরথীর মত অস্ত্র হাতে নিয়ে প্রস্তুত৷ আর যাবে কোথায়! তবু পরাজয়কে বরণ করার আগে নিক্ষেপ করে গেছে নির্মম প্রতিবাদ৷ যে ধর্মবোধ-আদর্শ তাকে সতীত্বের চূড়ান্তমূর্তি করে রেখেছিল সেই সতীত্বকেই অজানা বিশ্বের দুর্ভেদ্য অন্ধকারে সমর্পণ করেছে৷ টুকীর মতো এত বড় প্রতিবাদ বোধ হয় কোনো গণিকা করে উঠতে পারেনি৷

গণিকারা সমাজে কি পরিমানে হেয় তা ‘আরণ্যক’-এর কুন্তার জীবন থেকে স্পষ্ট হয়৷ বিভূতিভূষণের সৃষ্ট এই নারী চরিত্র গণিকা নয়—জীবনে শত দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যেও স্বামী ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পুরুষের অঙ্কশায়িনীও হয়নি; সতীত্বের পরাকাষ্ঠায় উজ্জ্বল নারীরত্ন সে, তার পরেও কুন্তার লাঞ্ছনার শেষ নেই৷ বাইজির মেয়ে বলে সমাজের উদাসীন উপেক্ষায় পর্যুদস্ত তার জীবন৷ সাতাশ-আটাশ বছরের ধনবান দেবী সিং কাশীতে এক বাইজির বাড়ি গান শুনতে গিয়ে সেই বাইজিরই চৌদ্দ-পনেরোবছর বয়সি কিশোরী কন্যার সঙ্গে প্রণয়পাশে আবদ্ধ হয়ে তাকে নিয়ে পালিয়ে আসে৷ দেবী সিং তাকে রক্ষিতা করেনি বিয়ে করে স্ত্রীর যথোপযুক্ত মর্যাদায় অন্তঃপুরে স্থান দিয়েছিল৷ সেখানে সম্ভ্রান্ত ঘরের গৃহবধূর মতো—একসময় লবটুলিয়া থেকে কিংখাবের ঝালর-দেওয়া পালকি চেপে কুশী ও কলবলিয়ার সঙ্গমে স্নান করতে যেত, বিকানীর মিছরি খেয়ে জল খেত৷ দেবী সিং অর্থ ও প্রতিপত্তিশালী বলে তাকে নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে সাহস পায়নি৷ কিন্তু ঘটনাচক্রে সর্বস্বান্ত হয়ে দেবী সিং মারা গেলে দু-তিনজন শিশুসন্তান নিয়ে অথৈ জলে পতিত হয় কুন্তা; সেই সঙ্গে সমাজও তাকে পতিত করে রূপাজীবার কন্যা বলে৷ সমাজের মানুষের তার প্রতি হীন মনোভাব সম্পর্কে পাটোয়ারী কথক সত্যচরণকে বলে—‘‘এদেশে ওকে কেউ দেখতে পারে না, সবাই নাক সিঁটকে থাকে, নীচু চোখে দেখে, বোধ হয় বাইজীর মেয়ে বলে৷’’১৪৩ শুধু সমাজের ঘৃণ্য অবজ্ঞাই বর্ষিত হয়নি তার উপর, তার শরীরের প্রতি বন্য লালসাও কম নেই প্রবৃত্তিতাড়িত পুরুষ সমাজের৷ যদিও দারিদ্র্যের কঠিন পীড়নে তার ভুবনমোহিনীরূপ চাপা পড়ে গেছে তারপরেও বাইজির কন্যা হওয়ার দরুণ তার রূপহীন শরীরটাকে আস্বাদন করার লোভ সামলাতে পারেনি আরেক প্রতিপত্তিশালী চরিত্র রাসবিহারী সিং৷ জাতভাই-এর স্ত্রী ধুয়া তুলে, তার কষ্টের কপট দুঃখ দেখিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে যায় রাসবিহারী সিং৷ সেখানে কিছুকাল কাটানোর পর সময় মতো অন্নগ্রহণের ফলে পুনরায় কুন্তার পূর্ব স্বাস্থ্য ফিরে আসতে থাকে৷ তার সেই অপরূপ রূপে মোহিত রাসবিহারী কামোন্মত্ত হয়ে তাকে ভোগ করতে চায়৷ কুন্তা তার প্রতিবাদ করে বলে ‘‘জান দেগা—ধরম দেগা নেহিন৷’’১৪৪ কুন্তা যে যন্ত্রণার মধ্যে থেকে বেড়িয়ে দুদিন স্বাচ্ছন্দ্যের আস্বাদ পেয়েছিল তাতে ইচ্ছে করলেই রাসবিহারী সিং-এর অনুগত থেকে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতো আর গণিকার মেয়ে বলে তাতে কেউ বিস্মিতও হত না; কিন্তু তা সে করেনি৷ পুনরায় দরিদ্রতার আগুনে ঝাঁপ দিয়ে নিয়মিত উদরজ্বালাকে মাথায় তুলে নিয়েছে৷ তারপরেও কুন্তা অপবিত্র৷ তার স্বামী বেঁচে থাকতে সমাজ তার এক অবস্থান এবং দেবী সিং-এর মৃত্যুর পর আরেকরকম অবস্থান—এই প্রবাদটিকেই মনে করিয়ে দেয় যে আমাদের এই সমাজ ‘শক্তের ভক্ত; নরমের যম’ অর্থাৎ প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তির স্ত্রী হিসেবে কুন্তাকে ক্ষমা করতে পারে সমাজ কিন্তু অসহায় বিধবার প্রতি কোনো অনুকম্পা নেই তার৷ রচনাকার অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রিত করেছেন কুন্তা চরিত্রের নানা দিককে; সেই সঙ্গে উদ্ভাসিত হয়েছে গণিকা নারীদের সামাজিক মূল্য৷

‘বিপিনের সংসার’-এর কামিনী গোয়ালিনি বিপিনের পিতার রক্ষিতা হয়ে নির্বিঘ্নে জীবন কাটিয়েছে; প্রণয়ীর মৃত্যুর পরও তার জীবনে সামাজিক অসন্তোষের কোনোরকম ছায়াপাত ঘটেনি৷

মতি বাগ্দিনী স্কুল শিক্ষক বিশ্বেশ্বর চক্রবর্তীকে ভালোবেসে ঘর ছাড়ে৷ সমাজের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতে পারেনি সেই স্কুল মাস্টার—কিন্তু অসুস্থ হয়ে পতিতা এই নারী মৃত্যুশয্যায় পতিত হলেও মাস্টার তার সঙ্গ ছাড়েনি৷ সেও ইচ্ছে করলেই নির্মম মৃত্যুমুখে ফেলে সরে পড়তে পারতো৷ কিন্তু তা না করে শেষ সময়ে সেবায়-ভালোবাসায় প্রেমের প্রতিদান রক্ষা করেছে৷ এভাবে বোধ হয় পতিত নারীদের প্রতি একটু একটু করে সমাজ বা সমাজের প্রতিভূ মাস্টারের মতো মানুষেরা দায়বদ্ধ হচ্ছে; তারাও যে মানুষ এই মূল্যটা অন্তত প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে৷

‘দম্পতি’ নষ্ট দাম্পত্যের গল্প৷ এই উপন্যাসে যেমন ইঙ্গিত দান করেছেন এক চরিত্রভ্রষ্ট নারীর তেমনি ফিল্ম স্টার নায়িকাদের প্রতি সাধারণ গ্রাম্য মানুষের বিকৃত মনোভাব৷ লেখকের বর্ণনায় নেতিবাচক দৃষ্টিতে উপস্থাপিত হয়েছে তারা৷

অনঙ্গ-গদাধর তাদের সুখী ঘরকন্নায় কখনোই ভ্রষ্টাচারকে প্রশ্রয় দেয় না৷ অনঙ্গর দাদা একজন অপরিচিত মেয়েকে নিয়ে টাকা ধার করতে তাদের বাড়িতে এলে মেয়েটির ধরন দেখে অনঙ্গর মনে হয়েছিল যে সে ভালো নয়৷ তাই তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেয়নি৷ সে প্রসঙ্গে স্বামীকে বলে—‘‘আমি তাকে ঘরে-দোরে ঢুকতে দিই নি৷ অমন ধরনের মেয়েমানুষ দেখলে আমার গা ঘিন-ঘিন করে৷’’১৪৫ স্ত্রীর মুখে বিস্তারিত কথা শুনে গদাধরও মন্তব্য করে—‘‘ওসব ঢং অনেক দেখেচি! ছি-ছি আমার বাড়িতে এই সব কাণ্ড!’’১৪৬ সেই গদাধরই ব্যবসার জন্য কলকাতায় গিয়ে সিনেমার নটীদের সংস্পর্শলাভে উন্মুখ হয়ে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করতে থাকে স্ত্রী-পরিবারকে৷ অনঙ্গর সংগে কাটানো দাম্পত্যজীবন একঘেয়ে হয়ে উঠে৷ ব্যবসা, ঘর-সংসার সব কিছুকে জলঞ্জলি দিয়ে শোভারাণী মিত্রদের মতো ফিলম স্টারদের সঙ্গসুখের আস্বাদ পেতে নিজেকে উজাড় করে দেয়৷ তার জীবনের স্বেচ্ছাচার সম্পর্কে চিন্তিত ভড়মশায় ভাবে—‘‘মনিব পাটের গদির ক্যাশ ভাঙিয়া ছবি তৈরির ব্যবসায় লাগাইয়াছেন, এ ভাল লক্ষণ নয়৷ সে নাকি যত নটী লইয়া কারবার, তাহাতে মানুষের চরিত্র ভাল থাকে না, থাকিতে পারে না কখনও!’’১৪৭ ভড়মশাই-এর ভাবনায় সিনেমার অভিনেত্রীরা হীন হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে৷ এই হীন মানসিকতাতেই লেখক দেখিয়েছেন শেষ পর্যন্ত গদাধর শোভারাণীর সঙ্গেই স্থায়ী সম্পর্ক স্থাপন করে—অনঙ্গর দাম্পত্য সম্পর্ককে অস্বীকার করে৷ এক সিনেমা নটীর জন্য চুরচুর হয়ে যায় স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্যের৷

পান্না ‘অথৈ জল’-এর খেমটাওয়ালি৷ ষোলো-সতেরো বছর বয়সি সুশ্রী-তন্বী এই নারীকে সারল্যে পরিপূর্ণ করে রচনা করেছেন লেখক৷ খেয়ালি স্বভাবের এই কিশোরী নিজের আকর্ষণের মূল্য দিতে স্বনামধন্য ডাক্তার শশাঙ্ককে নিজের দিকে টেনে নেয়৷

এযাবৎ যত ধরনের গণিকাচরিত্র আলোচনা করা হয়েছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী এই পান্না৷ তার মধ্যে সর্বদাই কাজ করেছে স্বাধীন চেতনা৷ আত্মবিশ্বাসেও সে পুরুষের চেয়ে কম নয়৷ ডাক্তারকে মোহিত করে নিজের বাসাবাড়িতে নিয়ে গিয়ে নিজের রোজগারে তার ভরণ-পোষণ চালিয়ে গেছে৷ অম্লান বদনে শত অভাবের মধ্যে সিগারেট, জুতো ইত্যাদি কিনে দিয়ে তার নেশা, শখ পূরণ করেছে৷ সর্বদা তাকে সাহস দিয়ে গিয়েছে—‘‘যদি ঠিক-মত বায়না হয়, খাটি, তবে মাসে নব্বুই টাকা থেকে একশো টাকা৷ তোমার ভাবনা কি?’’১৪৮ সে আপন স্বপ্নবলয়ের মধ্যে অবস্থান করে, ডাক্তারকে নিয়ে সেখানে অনাবিলভাবে পাক খেয়ে গেছে৷ তার এই ব্যতিক্রমী সত্তাকে ডাক্তারের জবানিতে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন রচনাকার—‘‘আমাকে অবাক করে দিয়েচে পান্না৷ ওর শ্রেণীর মেয়েরা শুনেচি কেবলই চায়, পুরুষের কাছ থেকে শুধুই আদায় করে নিতে চায়৷ কিন্তু ও তার অদ্ভুত ব্যতিক্রম৷ নিজের কথা কিছুই কি ও ভাবে না৷ আমার মত একজন বড় ডাক্তারকে গেঁথে নিয়ে এল, এসে কিছুই দাবি করলে না তার কাছে, বরং তাকে আরও নিজেই উপার্জন করে খাওয়াতে চলেচে৷’’১৪৯ তার বৃত্তি নিয়ে পান্নার কোনোরকম আক্ষেপ নেই৷ সে নিজেও যেমন জানে সে বহুজন ভোগ্যা তেমনি সমাজের মানুষজনও তাকে সেই হিসেবেই চেনে৷

পান্না চরিত্রের মধ্য দিয়ে গণিকা চরিত্রের মানসিক বিবর্তনের ধারার দিক-নির্দেশ পাওয়া যায়৷ গণিকারা সর্বদাই মানুষের উপেক্ষা নিয়ে বেঁচে থাকে৷ সমাজের যত রকমের পাপের ধারণা রয়েছে সবই এইজাতীয় নারীর উপর আরোপিত হয়৷ ভূষণ দাঁ, গোবিন্দ দাঁ, আধুল হামিদ প্রমুখ ধনবান মানুষেরা তাদের শরীরকে পরম আস্বাদনীয় হিসেবে গ্রহণ করেও সমাজের ঘৃণ্য সব অভিধায় ভূষিত করতে দ্বিধাবোধ করে না৷ তারপরেও পান্নার কোনো মানসিক বিকার নেই৷ মধ্যবয়সি ডাক্তারকে ভীষণভাবে ভালো লেগেছিল তার; সেখানে ভালোবাসা ছিল কি না আলোচনার বিষয় নয়৷ সেই ভালোলাগাকেই সম্বল করে তার পায়ে মাথা কুটে, দিব্যি দিয়ে নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল৷ আর যেহেতু সে নিজের তাগিদে ডাক্তারকে ঘরের বার করেছে তাই সব খরচ-পত্র দায়-দায়িত্বও নিজেই গ্রহণ করেছে৷ এ বিষয়ে তার বক্তব্য—‘‘তুমি নির্ভাবনায় বসে খাও৷ আমি থাকতে তোমার ভাতের অভাব হতে দেবো না৷’’১৫০ পান্নারা যেন এখানে একটু একটু করে শক্তিশালী হয়ে উঠছে মনের দিক থেকে৷ চন্দ্রমুখী, পিয়ারী, মালতী, মনিয়া, এলোকেশী, কাত্যায়নীদের মতো নিজেকে পাপী মনে না করে দেহবৃত্তির মধ্য দিয়েই স্বতস্ফূর্তভাবে সংসারের দায়-দায়িত্বকে নিজস্কন্ধে তুলে নিতে এদের যেন কোনো আপত্তি নেই৷ শুধু পরিবার পরিজন নয় প্রেমাস্পদকেও যেন স্বামীর ভূমিকা নিয়ে তত্ত্বতালাশ করতে আরম্ভ করেছে তাদের সেই স্বাধীন চেতনা৷

পান্না সমাজকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যাই-ই করুক না কেন সমাজ কিন্তু তার প্রতি খড়্গহস্তই৷ কলকাতার বাসা ভাড়া নিয়ে পান্না ও ডাক্তার একত্রে বসবাস শুরু করলে পান্নার মা মেয়ের রোজগার থেকে বঞ্চিত হয়ে ডাক্তারের নামে নালিশ করেছে নাবালিকা পান্নাকে ভুলিয়ে পালিয়ে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখার জন্য৷ পান্না সমস্তটা শুনে প্রেমাস্পদকে বাঁচাতে স্বেচ্ছায় যখন মাতৃগৃহে ফিরে যায় তখন তার উদ্দেশ্যে জনৈক পুলিশের লোক ডাক্তারকে বলে—‘‘মশায়, এবার পেতনি ঘাড় থেকে নামলো; বুঝে চলুন৷ আমরা পুলিশের লোক মশায়৷ কত রকম দেখলাম, তবু যে যাবার সময় মায়াকান্না কাঁদলো না, এই বাহবা দিচ্ছি৷ কতদিন ছিল আপনার কাছে?’’১৫১ দিনের পর দিন ঘর-বাড়ি, স্ত্রী-সন্তান, ডাক্তারি ছেড়ে পান্নার সঙ্গে সহবাস করলেও পুলিশের লোকের চোখে ডাক্তার কিন্তু এতটুকুও হেয় হয়নি উল্টে পান্নাকেই পেত্নি সম্বোধন করে নীচে নামিয়ে দিয়েছে৷ আর ডাক্তার যে কিনা পান্নার সারল্যে অভিভূত হয়ে দিনের পর দিন তার পরিশ্রমলব্ধ উপার্জন দিয়ে নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে, পান্না মায়ের কাছে চলে গেলে তার মনস্তত্ত্বকে না বুঝেই তার মনে হয়েছে—‘‘যাকগে৷ প্রলয় মন্থন করে আমি জয়লাভ করবো৷ ঘর ভাঙুক, দীপ নিবুক, ঘট গড়াগড়ি যাক৷ ও সব মেয়ের ওই চরিত্র৷ কি বোকামি করেছি আমি এতদিন৷’’১৫২ যে সূক্ষ্ণ অনুভূতি নিয়ে কথক ডাক্তার পান্নার কাছে নিজেকে সঁপে দিয়েছিল শেষ পর্যন্ত অনুভূতির সেই ধার তার আর থাকেনি৷ তাই তাকে পুলিশি হেনস্তার হাত থেকে বাঁচাতেই যে পান্না স্বেচ্ছায় মায়ের কাছে চলে গেল সেটুকু উপলব্ধি করার ক্ষমতা ছিল না তার৷ তাছাড়া ডাক্তার বরাবরই নীতিবাগীশদের দলের একজন ছিল৷ মাঝের সাময়িক বিভ্রান্তি তাকে পান্নার অনুগামী করে৷ পান্না চলে গেলে তার নীতিবোধ পুনরায় জাগ্রত হয়ে পান্না সম্পর্কে সমালোচনা করতে দ্বিধা করে না যে ‘ওসব মেয়ের ওই চরিত্র’৷ মুহূর্তেই মোহময়ী প্রেমময়ী পান্না ঘৃণ্য দেহব্যবসায়ী নারীতে পরিণত হয়ে যায়৷ ডাক্তার নিজের চরিত্রের বিচার না করে পান্নার চরিত্রের বিচার করতে তৎপর হয়; এই সমাজ—আর এই বিচার!

তারাশঙ্করের উপন্যাসে আলোচিত বারনারীরা ব্যক্তিত্বে, দায়িত্ব-কর্তব্যে, প্রেম-ভালোবাসায় অনন্যা৷ তাদের কেউ সমাজকে শিক্ষা দিতে সমাজের মুখের উপর দেহব্যবসা করেছে, কেউ বা সমাজপ্রভুদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে প্রতিষ্ঠা করে গেছে৷ তারা যেমন উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়েছে; তেমনি সমাজের মুখোশটাকে টেনে ছিঁড়ে দিয়ে তার কুৎসিত রূপটাকে সকলের সম্মুখে প্রকাশ করে দিয়েছে৷ গণিকা নারীদের মানসিক ও সামাজিক বিবর্তন ধারা একযোগে পরিলক্ষিত হয়েছে তাঁর রচনায়৷

‘নীলকন্ঠ’ উপন্যাসে সতী-সাধ্বী—লক্ষ্মীমন্ত গৃহবধূ গিরিবালা বা গিরি৷ বাপ-মা মরা, খুড়ো-খুড়ির লাথি ঝাঁটা খেয়ে মানুষ হওয়া গিরি শ্রীমন্তের গৃহিণী হয়ে এসে সুদক্ষ কর্তৃত্বে অচিরেই সমৃদ্ধি-সচ্ছলতায় ভরিয়ে তোলে তার সংসারকে৷ জীবনে তাদের একটাই ‘আফসোস’ গিরি নিঃসন্তান৷ তার শূন্য হৃদয়ের দাহকে শীতল করে মা মরা কুচক্রী পিতার সন্তান শ্রীমন্তের বোনঝি গৌরী৷ পিতার টাকার লোভ থেকে গৌরীকে বাঁচাতে শ্রীমন্ত যেমন তার তিল তিল করে তৈরি করা প্রায় সমস্ত সম্পত্তি বন্ধক রাখতে বাধ্য হয় তেমনি গৌরীর বাবা হরিলালের চক্রান্তে সমস্ত টাকা খুঁইয়ে গৌরীকেও শেষ রক্ষা করতে পারে না৷ চরম ক্রোধে শ্রীমন্ত আঘাত করে বসে হরিলালের মাথায়৷ অবশেষে মিথ্যা সাক্ষ্যে পাঁচবছরের জেল হয় শ্রীমন্তের৷ সংসারে সম্পূর্ণ সহায়-সম্বলহীন হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে একা গিরি৷ গিরি সুন্দরী৷ সন্তান না হওয়ায় তার শরীরের বাঁধুনি আঁটসাট৷ তার সেই সুগঠিত কলেবর কামনার লেলিহান শিখা জ্বালিয়ে দেয় গ্রামের সম্ভ্রান্ত লম্পট যুবক বিপিনের মনে৷ গিরি তা বুঝতে পেরে সচেতন হয়৷ পাঁচুর মাকে অবলম্বন করে, বিপিনের তার শরীরের বিনিময়ে সহায়তার ইঙ্গিতকে উপেক্ষা করে বাঁচার জন্য পথ হাতড়াতে থাকে৷ কিন্তু একা অসহায় নারী কি করে জীবন কাটাবে৷ অন্ন সংস্থানের জন্য যেমন কোনো সৎ কর্মও সে খুঁজে পায় না তেমনি বিপিনের নানা চক্রান্তও তাকে কাজ করতে দেয় না৷ অবশেষে—‘‘গিরি সঙ্কল্প করিল সে মরিবে৷ এমন করিয়া আপনাকে বিক্রয় করিয়া বাঁচার অপেক্ষা মরাই সহস্র গুণে কাম্য৷ আর মরিবে সে এই অনাহারে শুকাইয়া শুকাইয়া, তিলে তিলে দগ্ধ হইয়াই সে মরিবে, যেন তাহার যাতনার প্রতি দীর্ঘনিশ্বাসটি সে রাখিয়া যাইতে পারে৷ সে দীর্ঘনিশ্বাস যেন অভিশাপ হইয়া এই বিকিকিনির সংসারে বেনিয়ার অঙ্কশায়িনী লক্ষ্মীর সোনার বর্ণটাকে মসীময় করিয়া দেয়৷’’১৫৩ যে সমাজ বিপিনের মত অর্থবানদের অঙ্গুলি নির্দেশ ছাড়া চলতে পারে না, যে সমাজ অসহায় নারীর শরীরকে পুরুষের কামনার মুখে ছুড়ে দিয়ে তাকে কদর্য বেঁচে থাকার পথমাত্র খোলা রাখে সেই সমাজকে শিক্ষা দিতে পাঁচ-পাঁচদিন ধরে মৃত্যুর আশায় না খেয়ে থাকে৷ সমাজের সেদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই৷ আর পাঁচদিন অনাহারে থাকার পরেও মৃত্যু তো আসেই না বরং চূড়ান্ত ক্ষুধায় দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে৷ পাঁচুর নিয়ে আসা সামান্য চাল ও সব্জীও ক্ষুধার ক্রোধে ছুড়ে ফেলে দেয়৷ কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হয়—‘‘ওর ভিক্ষেই বা কেন নেব আমি; তার চেয়ে যে আপনাকে বিক্রি করাও ভাল আমার৷’’১৫৪ প্রবল ক্ষুধা পুনরায় তাকে মৃত্যুর সংকল্প ভুলিয়ে দিয়ে পুনরায় বাঁচার জন্য ব্যগ্র করে তোলে৷ কারণ সে বুঝে গিয়েছে মৃত্যু অতি ভয়ঙ্কর, মরতে সে পারবে না৷ সে অনাবৃত বক্ষে আহ্বান করে বিপিনকে৷ বহুদিনের কামনা উদ্রেককারী নারীর আহ্বান পেয়ে ছুটে এসে যখন স্থূল ভালোবাসার কথা ব্যক্ত করে তখন গিরি তাকে জানায়—সে ভালোবাসা চায় না; টাকা চায়, ভালো খাবার গয়না, কাপড় চায়৷ তার বাক্য অসম্পূর্ণ রেখেই প্রবল উত্তেজনায় মূর্ছিত হয়ে গেলে বিপিন পালিয়ে যায়৷ পাঁচুর মায়ের সেবা যত্নে জ্ঞান ফিরে পেয়ে শোনে সে তার জন্য পাশের গ্রামের ভবি মোড়লের কাছ থেকে কাজের খবর নিয়ে এসেছে; যা তাকে সৎপথে থেকে উপার্জনে সহায়তা করবে৷ পরম কৃতজ্ঞতায় নিম্নশ্রেণীর সেই নারীও যেন গিরির পরম আপন হয়ে উঠে৷ যে সমাজ উপায় থাকতেও তার মতো একজন নারীর সৎভাবে বেঁচে থাকার সব পথ বন্ধ করে রেখেছে সেখানে পাঁচুর মায়ের মতো সহায়-সম্বলহীন নারীর নিঃস্বার্থ তত্ত্বাবধান তাকে বিহ্বল করে তোলে সে বলে—‘‘পাঁচুর মা, তুমি আমার আর-জন্মে মা ছিলে!’’১৫৫ কিন্তু ওদিকে বিপিন গিরির দুর্বল মুহূর্তের প্রত্যাশিত সেই গয়না কাপড় এনে তার সামনে হাজির করলে পাঁচু ও তার মায়ের নজরে পড়ে পালিয়ে যায়৷ তাকে গিরির দুয়ার থেকে পালিয়ে যেতে দেখে রামকেষ্ট সাহা৷ পরদিন তার মধ্য দিয়ে গ্রামময় রাষ্ট্র হয়ে যায় বিপিনকে জড়িয়ে গিরির কুৎসা৷ সালিশি সভায় ভোজ ও অর্থ জরিমানা দিয়ে সলজ্জ বধূর মতো বিপিন স্বীকার করে তার সঙ্গে গিরিব মিথ্যে অবৈধ সংসর্গের কথা৷ বিপিন গিরিকে কোণঠাসা করতে রামকেষ্টকে দিয়ে কুৎসা রটায়, পঞ্চায়েত বসিয়ে পাঁচুর মাকে তার থেকে আলাদা করে দেয় এবং হরিলালের সঙ্গে টাকার রফা করে নিশুতি রাতে একাকিনী অবস্থানকারী গিরিকে ধর্ষণ করে৷ একজন নারীকে যতদূর উপদ্রব করা যায়—তার সীমাটাকেও যেন অতিক্রম করেছেন লেখক৷ গিরিকে ধর্ষণ করার সমস্ত পথ সুগম করেছে সমাজ; অথচ রক্ষা করার কোন চেষ্টা করেনি৷ বিপিনের ভোগের শিকার করে গিরিকে বেশ্যাবৃত্তির পথে নিক্ষেপ করেছে৷ আর বিপিন? সে তো তার অপকর্মের জন্য রাতারাতি ‘সেলিব্রিটি’ হয়ে উঠেছে৷ রামকেষ্ট তাকে ধরে বলেছে—‘‘মিষ্টি খাওয়াতে হবে দাদা৷’’১৫৬ হরিলাল পঞ্চায়েতে যাওয়ার আগে তাকে উপদেশ দিয়েছে—‘‘একটুখানি লজ্জার হাসি হেসে দিস দাদা, সব ঠিক হো যায়েগা৷’’১৫৭ পঞ্চায়েত বিপিনের সেই ‘শুভকর্মের’ জন্য কি জরিমানা হবে তা ভাবতেই ব্যস্ত৷ লেখক বলেছেন—‘‘এদিকে তুমুল তর্কে পঞ্চায়েতের আলোচনা চলিয়াছিল৷ লুচি কি অন্নের ভোজন শাস্তিস্বরূপ নির্ধারিত হইবে সেইটাই আলোচনার বিষয়৷’’১৫৮ আর কুকর্মের গুরুঠাকুর হরিলাল তাকে সহায়তা করে পঞ্চাশ টাকা ইনাম গ্রহণ করেছে৷ বিপিন কামনা চরিতার্থ করার পথ নির্দেশ পেয়ে সেই খুশির আতিশয্যে হিন্দি ভাষায় হরিলালকে বলেছে—‘‘আজ কিন্তু রাতকো একঠো জলসা হোনা চাহি৷ মালকোষ একঠো তুমারা পাশ শুননে হোগা ওস্তাদ৷’’১৫৯ পুরুষ সমাজের এই নির্মম লজ্জাহীনতাকে ভাষারূপ দিয়েই খান্ত হননি রচনাকার কঠোর সমালোচকের মতো মানুষের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বলেছেন—‘‘এ সংসারে মানুষকে কঠোর সমালোচক বলিলে তাহার অতি প্রশংসা করা হয়—মানুষ নিন্দুক, পরনিন্দার উপর তাহার একটা সহজাত লিপ্সা আছে, সাদার গায়ে কালি ছিটাইয়া তাহার পরম তৃপ্তি৷’’১৬০ এই সাদাকে কালিমালিপ্ত করতে গিয়েই গিরিকে পতিত করেছে মানুষজন; এক হিংস্র কামার্ত পশুর মুখে তার সতীত্বকে ছুড়ে দিয়েছে৷ গিরি বিপিনের রক্ষিতা হতে বাধ্য হয়েছে৷

একবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার ফলে তার মধ্যে কাজ করেছে প্রবল মৃত্যুভীতি৷ যার দরুণ আত্মহত্যাও করতে পারেনি সে৷ রক্ষিতা হয়ে একরকম দিন কাটছিল তার৷ কিন্তু ঘটনা আবার বাঁক নেয় তার গর্ভসঞ্চার হলে৷ যে সন্তান একদিন গিরি ও শ্রীমন্তের ধ্যান-জ্ঞান ছিল, যে শূন্যতাবোধে সর্বস্ব খুইয়েছে সে—সেই সন্তান তার গর্ভে; যদিও তা বিপিনের ঔরসজাত৷ তথাপি মাতৃত্বের পুলকে তার শূন্য জীবন যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে৷ বিপিন সেই সন্তানের গর্ভপাতের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ ঠিক করলে শিউড়ে উঠে গিরি৷ তার অবুঝ মন এটা ভুলে যায় যে রক্ষিতার সন্তানেরা সর্বদাই অবাঞ্ছিত৷ বিপিনের হাত থেকে সন্তানকে বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায় সে৷ নানা স্থানে ঘুরে বেড়িয়ে, নানা জনের কাছে শরীর বেচে তার সন্তান নীলকন্ঠকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে৷ সেখানে এক খদ্দেরের দ্বারা নিষ্ঠুর যৌনপীড়নেরও উল্লেখ করেছেন রচনাকার, যে অত্যাচারের কথা কোনোদিন ভোলেনি গিরি৷ তারপর একদিন গ্রামে ফেরার মুখে মৃত্যুর হাতছানিতে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পা পিছলে নদীতে তলিয়ে যায়৷

রচনাকার কি নির্মম জীবন একেছেন এক নারীর৷ ভাগ্য ও সমাজের যুগপৎ পীড়নে নিঃশেষ হয়ে গেছে তার জীবন৷ সমাজের সেই ভয়ঙ্কর রূপ নারীর ক্ষেত্রে কতটা ক্ষতিকারক তারাশঙ্কর তাঁর রচনার গুণে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করেছেন৷

‘রাইকমল’-এ বহুপুরুষ লাঞ্ছিত সেবাদাসীদের প্রতি সমাজের ঘৃণ্য মানসিকতা প্রকাশ পেয়েছে৷ সেবাদাসী কন্যা কমলিনী রূপে যৌবনে পরিপূর্ণা হলেও তা সমাজের কাছে আশঙ্কার কারণ৷ সমাজের চোখে এই সেবাদাসীরা যে গণিকাই সেই ধরনের মনোভাবও স্পষ্ট হয়েছে এই রচনায়৷ কমলিনীর মানসপুরুষ রঞ্জন৷ রঞ্জনের মা কমলিনীকে খুব ভালোবাসত৷ তার নাম দিয়েছিল হাস্যময়ী৷ কমলিনীকে না দিয়ে রঞ্জনকে কোনো কিছু খেতে পর্যন্ত দিতে পারতো না তার মা৷ অথচ যেদিন রঞ্জন তার এঁটো কুল খেয়ে বাড়িতে ফেরে তখন রঞ্জনের মাকে প্রচণ্ড ক্রোধে বলতে শোনা যায়—‘‘রাক্ষুসী রাক্ষুসী, মায়াবিনী গো, ওরা ছত্রিশ জেতে বোষ্টম—ওদের কাজই এই৷ মুড়োঝাঁটা মারি আমি হারামজাদীর মুখে৷’’১৬১ অর্থাৎ রঞ্জনের খেলার সঙ্গী হিসেবে তাকে মানতে অসুবিধা নেই কিন্তু রঞ্জন প্রণয়ী জ্ঞানে তার এঁটো কুল খেলে একজন সেবাদাসীর কন্যাকে ভাবী পুত্রবধূ কল্পনা করে মানতে পারেনি সভ্য সমাজের প্রতিনিধি তার মা৷ তাই নানারকম ইতর শব্দ দ্বারা বিশেষায়িত করে অভ্যর্থনা করা হয়েছে কমলিনীকে৷ রঞ্জনের মায়ের সেই আক্রোশ দেখে শিউরে উঠে রঞ্জনের বাবা৷ স্ত্রীকে ধমকে বলে—‘‘চুপ চুপ, চেঁচিয়ে গাঁগোল করিস না৷ জ্ঞাতিতে শুনলে টেনে ছাড়ানো দায় হবে, পতিত করবে৷’’১৬২ একজন সেবাদাসী, যে কিনা ঈশ্বরের চরণে নিজের দেহ-মনকে সমর্পণ করে, বহুচারীতায় লিপ্ত হয়; তাদের সেই আচার-নিয়মকে সমাজ সহজভাবে মেনে নিতে পারে না৷ তাদের সংস্পর্শ যে গণিকা সংসর্গের চেয়েও হীন রঞ্জনের বাবা মহেশ্বরের কথার মধ্য দিয়েও তা স্পষ্ট হয়৷ রঞ্জনের বাবার অনুরোধে কোলের ছেলে কোলে ফিরিয়ে দিতে মায়ের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে চিরকালের জন্য নবদ্বীপ যাত্রা করে৷ তারপর ঘটনার চলমান ধারায় একদিন কমলিনী কন্ঠিবদল করে বৃদ্ধ রসিকদাসের সঙ্গে৷ তার অতৃপ্ত প্রেমিকাসত্তা পথ চলতে চলতে আবার বহুদিন পর উপস্থিত হয় নিজ গ্রামে৷ রসিকদাসের কাছ থেকে মুক্তি নিয়ে গ্রামের যুবক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কীর্তন গানে মুখরিত করে তোলে তার পুরোনো আখড়া৷ তার মোহিনীরূপে মুগ্ধ হয়ে পতঙ্গের মতো পুরুষের দল সেই রূপসুধা পান করতে ব্যগ্র হয়ে গেলে পুনরায় তাকে নিয়ে গ্রামের মধ্যে কলরব উঠে৷ সবই তার কানে যায়—‘‘গ্রামের গৃহস্থজন সকলেই কমলকে গালাগালি দেয়৷ বলে, ছি! এই কি রীতিকরণ? রঞ্জনকে দেশছাড়া করলে, মহান্তকে তাড়ালে, আবার কার মাথা খায় দেখ৷ যাকে দশে বলে ছি, তার জীবনে কাজ কি?’’১৬৩ প্রতিবেশিনীগণের এই বিদ্রোহ কোনো ধর্মীয়ভাবাপন্ন নারীর প্রতি নয় বহুপুরুষের জীবন বিপর্যয়কারিণী গণিকার প্রতি৷ এখানে কমলিনীর প্রতি সমাজের ঘৃণা যেমন উঠে এসেছে তেমনি উঠে এসেছে কমলিনীর মতো নারীদের পুরুষের দ্বারা বঞ্চনার বাস্তব চিত্র৷ শেষপর্যন্ত কমলিনী তার কাঙ্খিত রঞ্জনকে ফিরে পেয়েছিল৷ কন্ঠিবদল করে তার দেহ-মন সঁপে দিয়েছিল তার পায়ে৷ কিন্তু ভোগী পুরুষের প্রতিনিধি রঞ্জন তার প্রেমের সম্মান রাখতে পারেনি৷ তার যৌবনের দ্যুতি ম্লান বুঝেই পুনরায় নতুন সঙ্গিনী জোগাড় করে নিয়েছে প্রবৃত্তির দাহকে শীতল করতে৷ কমলিনী চুপ করে থাকেনি৷ নিজের অবস্থান বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ত্যাগ করেছে রঞ্জনকে৷ বলেছে রঞ্জনের মতো তারও নতুন শ্যামের প্রয়োজন৷ রঞ্জন যেমন বিগতযৌবনা কমলিনীকে আর রাধাভাবে সাধনসঙ্গিনী করে রাখতে পারেনি৷ বৈষ্ণবীয় রীতির ধুয়া তুলে তেমনি সেও সেই বৈষ্ণব ধর্মের অনুকারিণী হয়ে যৌবনহীন রঞ্জনকে কৃষ্ণ ভাবতে পারবে না৷ আর এইভাবেই প্রতারিত কমলিনী রঞ্জনের কামনাকে বিদ্ধ করে তার সঙ্গ ত্যাগ করেছে৷ তার এই তীর্যক বাক্যবন্ধ তার মনের দৃঢ়তাকে প্রতিপন্ন করে৷

‘কালিন্দী’-তে সরল, নিষ্পাপ বনবালা সারীর দেহব্যবসায় আত্মনিয়োগের পিছনে পুঁজিবাদী-ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন রচনাকার৷ সাঁওতাল নারীগণের মধ্যমণি সারী শেষ পর্যন্ত সকলের চোখে ঘৃণ্য বলে প্রতিপন্ন হয়েছে৷

মেয়ে কেনা-বেচার নিষ্ঠুর চিত্র উপস্থাপিত হয়েছে ‘প্রেম ও প্রয়োজন’ উপন্যাসে৷ রমণদাস তার বিধবা সুন্দরী কন্যা রমাকে পাঁচশত টাকার বিনিময়ে দালাল কড়ি গাঙ্গুলীর মধ্যস্থতায় বিক্রি করে দেয় জমিদার মহেন্দ্রবাবুর কাছে৷ স্বামী হারিয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে এবং ভাই-ভাজের গলগ্রহ হয়ে থাকা থেকে মুক্তি লাভের প্রচ্ছন্ন একটা ইচ্ছেও রমার মধ্যে বর্তমান ছিল—আর তাই প্রায় বিনা প্রতিবাদেই মহেন্দ্রবাবুর অন্তঃপুরে তার শিশুপুত্রের লালন-পালনের নামে স্থান নেয়৷ সমাজে গণিকার কন্যা বলে পরিচিত এবং জমিদারের রক্ষিতা হিসেবে কল্পিত লেডি ডাক্তার নলিনী তার প্রখর ব্যক্তিত্ব দ্বারা মহেন্দ্রবাবুর অসৎ উদ্দেশ্য বুঝতে পেরে রমাকে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যায়৷ যদিও ঘটনার আবর্তে রমা পুনরায় মহেন্দ্রবাবুর রক্ষিতা রূপে সেই অন্তঃপুরেই স্থান নেয়৷ যাইহোক এখানে দেখানো হয়েছে এক গৃহস্থ কন্যার পিতার অর্থলোলুপতার কারণে গণিকা হিসেবে প্রতিপন্ন হওয়া৷ নির্মম বৈধব্যাচার এ বিষয়ে ইন্ধন দান করেছে৷ সমাজে মেয়ের মূল্য কতটা নীচে নামলে কোনো পিতা নির্দ্বিধায় তাকে বিক্রয় করে দিতে পারে তার চিত্র এটি৷ আবার অন্য দিকে নলিনী যে কিনা নিজেকে বেশ্যাকন্যা বলে পরিচায়িত করেছে তার মুখে সমাজের প্রতি বিদ্রোহ দেখিয়েছেন রচনাকার৷ বিভূতিভূষণের ‘আরণ্যক’-এ কুন্তা বেশ্যা কন্যা বলে চূড়ান্ত লাঞ্ছনা ভোগ করেছে কিন্তু ‘প্রেম ও প্রয়োজন’-এর নলিনী নিজেকে সেই পরিচয়ে পরিচায়িত করলেও শিক্ষা সম্মান সমস্ত কিছুই অর্জন করতে সচেষ্ট হয়েছে৷ শুধু তাই নয় তার ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তাও অতুলনীয়৷ নলিনী যেন সমাজের পায়ের তলা থেকে সবলে বাইরে বেড়িয়ে এসে সদর্পে নিজেকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে৷

যাযাবরী মুক্তকেশী ‘আগুন’ উপন্যাসে তাদের গোষ্ঠীর স্বাভাবিক বহুপুরুষগামীতায় অভ্যস্ত৷ হীরুর রূপে মুগ্ধ হয়ে স্বেচ্ছায় তার কামনার বহ্নিতে ঝাঁপ দিয়েছে৷ এমনকি সে নিজেই হীরুকে অনুরোধ করেছে সে যেন তার বাবাকে পয়সা দিয়ে তাকে কিনে নেয়৷ এই যাযাবর সম্প্রদায়ের মধ্যে সতীত্বের কোনো বালাই নেই; সাপখেলা ইত্যাদি নানারকম পেশার সঙ্গে সঙ্গে দেহব্যবসাও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ৷ তারপর অনেক দিন ধরে সেই যাযাবরী হীরুর সঙ্গে বসবাস করেছে—তারপর একদিন হীরুর সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে তার হাত থেকে সন্তানকে বাঁচাতে ‘নীলকন্ঠ’-র গিরির মতো পালিয়ে গিয়েছে৷ রচনাকার এখানে সেই যাযাবর বেদে জাতির স্বেচ্ছাচারকে তুলে ধরেছেন৷ তাদের প্রতিও সমাজ বিরূপ মনোভাব পোষণ করেছে৷

‘মন্বন্তর’ উপন্যাসেও ‘প্রেম ও প্রয়োজন’-এর রমার মতো বাবা-মা তার কন্যার সতীত্বকে পুরুষের কামনা পূরণের জন্য আহুতি দিয়েছে পেটের ভাত ও স্বামীর চিকিৎসার জন্য৷ তবে রমার বাবা রমণদাসের মতো তীব্র লোভ এখানে কাজ করেনি৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ঙ্করতায় দেশব্যাপী প্রবল অন্নকষ্টে মেয়ের শরীর ছাড়া যখন অন্য আর কোনো অবলম্বন থাকে না তখন বাধ্য হয়েই দালাল ঘটকীর পরামর্শ মতো মা তাকে শিখিয়ে পড়িয়ে পুরুষের মনোরঞ্জন করতে পাঠিয়ে দেয়৷ এখানেও সামাজিক শোষণের শিকার সেই মেয়েটি অর্থাৎ গীতা৷ গীতা এক ভদ্রলোকবাবুর দ্বারা বলপূর্বক ধর্ষিত হয়ে সোজা উপস্থিত হয় উপন্যাসের নায়ক কানাই চক্রবর্তীর কাছে৷ কানাইয়ের তৎপরতায় গণিকাবৃত্তিতে নিমজ্জিত না হলেও জীবনভর সেই গ্লানি এবং ধর্ষক বাবুর সন্তান গর্ভে ধারণ করে পাপবোধে জর্জরিত থেকেছে৷ কানাই-এর মতো শিক্ষিত উদার চরিত্রের মধ্যে দিয়ে গীতার যে সুস্থ জীবনে ফেরার সংগ্রাম তা পতিতা ধর্ষিতা নারীদের জন্য বিশেষ মাত্রাবাহী৷

‘কবি’-র বসন্ত ঝুমুরদলের নর্তকী; সঙ্গে দেহব্যবসাও করে থাকে৷ শুধু বসন্ত নয় তার দলের অন্য মেয়েরাও যথা ললিতা, নির্মলা সকলেই দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত৷ দলে কর্ত্রী মাসি নিপুণ হস্তে সেই ব্যবসা পরিচালনা করে; সেই উপার্জিত অর্থের কিছু অংশও তার ঝুলিতে স্থান পায়৷ লেখক চরিত্রগুলির পূর্ব কোনো ইতিহাস ব্যক্ত করেননি৷ দেহজীবী হিসেবেই তারা পরিচিত; সেই দেহজীবী হয়েই মৃত্যুবরণ করা যেন তাদের ভবিতব্য৷

সেই নিম্নশ্রেণীর বারাঙ্গনাদের সমগ্র ধারণাকে পাল্টে দিয়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হয় নিতাই৷ বসন্তর ক্ষুরধার কথা ও হাসির মধ্যে প্রেমের সুর সংযোজন করে জীবনে নতুন আশার বীজ উপ্ত করে মানুষ হিসেবে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়৷ দিনের পর দিন যেভাবে পুরুষেরা এসে তাদের ভোগ করে উচ্ছিষ্ট পাতার মতো ফেলে রেখে চলে যায় সেখানে নিতাই বসন্তকে সম্মান দিয়ে বুকে বেঁধে রেখে আমৃত্যু তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়; ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে গাঁটছড়া বাঁধে বসন্তের সঙ্গে৷ অর্থাৎ বসন্ত যে একজন নারী; নিতাই ভালোবাসার মন্ত্র দিয়ে তার সর্ববিদ্রোহী গণিকাসত্তার ভিতর থেকে তার সেই সত্যকার রূপটিকে বের করতে সক্ষম হয়েছিল৷ সেই ভিতের উপর দাঁড়িয়েই সর্ববঞ্চিত এই নারী তার ক্ষয়ে যাওয়া জীবনের মধ্যেও নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল৷

রচনাকার অত্যন্ত বাস্তবসম্মতভাবে তার মতো দেহপসারিণী নারীদের চাওয়া-পাওয়া, স্বপ্ন সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন৷ বসন্ত তার জীবনের শেষ মুহূর্তে ঘৃণ্য জীবনের মহার্ঘ্য সুখানুভূতিকে হারাতে চায়নি৷ সমাজের সকলের মতো ঈশ্বরও যেন তার সঙ্গে বঞ্চনা করে তাকে সুখভোগে বঞ্চিত করতে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করছে৷ তাই অন্তিমলগ্নে নিতাই-এর মুখে গোবিন্দ নাম উচ্চারণ করার উপদেশ শুনে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে—‘‘কি দিয়েছে ভগবান আমাকে? স্বামীপুত্র ঘরসংসার কি দিয়েছে? না৷’’১৬৪ তার এই ক্ষোভ যেন সমস্ত গণিকা সমাজের শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদী কন্ঠস্বর৷ যদিও শেষ পর্যন্ত মিনতি করেই নিজের শেষ ইচ্ছেকে ব্যক্ত করতে বাধ্য হয়েছে; সে বুঝে গিয়েছে তাদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে থাকা নিষ্ঠুর সমাজ ও ঈশ্বর তার স্পর্ধিত বাণী কানে তুলবে না৷

মরতে কোনোদিনই ভয় ছিল না বসন্তর কারণ তার জীবনটাই ছিল মরে বেঁচে থাকার মতো অবস্থা৷ তার সেই অতৃপ্তির মহাশূন্যে একটা নক্ষত্র হয়ে জ্বলে উঠেছিল নিতাই৷ আর বসন্ত আবার নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিল সেই নক্ষত্রের উজ্জ্বল বিভায়৷ কিন্তু যেদিন নিতাই-এর মুখে বসন্ত প্রথম শ্রবণ করে—

‘‘এই খেদ মোর মনে৷

 ভালবেসে মিটল না আশ—কুলাল না এ জীবনে৷

 হায়, জীবন এত ছোট কেনে?

 এ ভুবনে?’’১৬৫

এই সুরকলি শোনামাত্র বসন্ত হাহাকার করে উঠেছিল৷ সে তখন থেকেই প্রত্যক্ষ মৃত্যুকে দেখতে পেয়েছিল৷ তাই নিতাইকে তার মৃত্যুর দিন কয়েক পূর্বে বলেছিল—‘‘বেহালাদার রাত্রে বেহালা বাজায়, আগে কত ভাল লাগত৷ এখন ভয় লাগে৷ মনে হয়, আমার আশেপাশে দাঁড়িয়ে কে যেন বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে৷ অহরহ মনে আমার মরণের ভাবনা৷ মনের কথা কি মিথ্যে হয়? তার ওপর এই গান তোমার মনে এসেছে! কি করে এল?’’১৬৬ নিতাই-এর কোলে মাথা রেখে সে মৃত্যুর মধ্যে মিশে গিয়েছিল৷ কিন্তু তার পরে? কোথায় গেল সে? নিতাই তাই ভাবতে থাকে বসন্তর যত অতৃপ্তি, যত শূন্যতা সব কি মৃত্যুর পরের জগতে গিয়ে পূর্ণ হয়েছে—জীবনে যা পায়নি মরণে কি তা পেয়েছে সে! নিতাই-এর মধ্য দিয়ে বসন্তর অপবিত্র জীবনের সমস্ত অতৃপ্তিকে তুলে ধরেছেন লেখক৷ শুধু তাই নয় তার মতো একজন ঘৃণ্য দেহপসারিণী নারীকে নিতাই-এর সঙ্গে কর্মের ভিত্তিতেও এক আসনে বসিয়েছেন তারাশঙ্কর৷ যে কর্মের জন্য দেহজীবাদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো প্রায়শ্চিত্তের ব্যবস্থা করতে পারেনি সমাজপ্রভুরা, তারাশঙ্কর সেই বারযোষিতদের প্রতিনিধি বসন্তকে নিতাই-এর সঙ্গে কর্মের ভিত্তিতেও এক আসনে বসিয়েছেন৷ পতিতা নারী ও পুরুষের মৃত্যুপরবর্তী জগৎকে একাকার করে দিয়েছেন যা এর পূর্বে কোনো সাহিত্যিকের লেখনিতে দৃষ্টিগোচর হয়নি৷ বসন্তর মৃতদেহ সৎকার করে এসে নিজের শ্রান্ত দেহটিকে ঘরের একপাশে এলিয়ে দিয়ে মৃত্যু সম্পর্কে নানা কথা ভাবতে থাকে৷ এ প্রসঙ্গে রচনাকার তার মনের ভেতরের মরণ সংক্রান্ত ভাবনাকে প্রকাশ করেছেন এইভাবে—‘‘মরণ কি? পুরাণে পড়া মরণের কথা তাহার মনে পড়িল৷ মানুষের আয়ু ফুরাইলে ধর্মরাজ যম তাঁহার অনুচরগণকে আদেশ দেন ওই মানুষের আত্মাটিকে লইয়া আসিবার জন্য৷ ধর্মরাজের অদৃশ্য অনুচরেরা আসিয়া মানুষের অঙ্গুলিপ্রমাণ আত্মাকে লইয়া যায়; ধর্মরাজের বিচারালয়ে ধর্মরাজ তাহার কর্ম বিচার করেন, তাহার পর স্বর্গ অথবা নরকে তাহার বাসস্থান নির্দিষ্ট হইয়া যায়৷ বিভিন্ন কর্মের জন্য বিভিন্ন পুরস্কার, বিভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থাও সে পড়িয়াছে৷ নিতাইকেও একদিন সেখানে যাইতে হইবে৷ বসন্তর সঙ্গে তাহার কর্মের পার্থক্যই বা কোথায়? তাহা সে খুঁজিয়া পাইল না৷ এবং তাহাতে সে একটা আশ্চর্য সান্ত্বনা পাইল৷ কারণ বসন্ত যেখানে গিয়াছে, সেইখানেই সে যাইবে৷ সে হয়তো অনন্ত নরক৷’’১৬৭ দেহব্যবসায়ী নারী হয়েও প্রেমিকের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বাংলা উপন্যাসে অন্যান্য গণিকাদের তুলনায় বসন্তই বোধ হয় সবচেয়ে বেশি মাত্রায় লাভ করেছিল৷

কিন্তু বসন্তর সেই ঝুমুর দল যেখানে সে সকলের মধ্যমণি হিসেবে অবস্থান করেছিল মৃত্যুর পরে সেই দলের আরেক রূপ প্রকাশ পায়৷ সেখানে যে একজন মানুষ হিসেবে যে বসন্ত দুপুরবেলা পর্যন্ত অবস্থিত ছিল; তার মৃতদেহ বের করার সঙ্গে সঙ্গে যেন মুহূর্তেই সমস্ত অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়৷ তার জন্য কাঁদবার, তার শোকে বিহ্বল হয়ে থাকবার কোনো প্রবণতা দলের কারও মধ্যে দেখা যায় না৷ বসন্তর জন্যই যে দল এতদিন অর্থ উপার্জনে প্রশস্ততা অর্জন করে এসেছিল, তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই স্থান পূরণ করতে দলের সকলের তৎপরতা দেখে নিতাই শিউরে উঠে৷ নিতাই ভাবে—‘‘বসন্ত আজই মরিয়াছে, দুপুরবেলা পর্যন্ত দেহটাও তাহার ছিল৷ এখন প্রায় সন্ধ্যা হইয়াছে, ইহারই মধ্যে দল হইতে বসন্ত মুছিয়া গেল! তাহার স্থান কে লইবে সেই সমস্যা এখনই পূরণ না করিলেই নয়? প্রৌঢ়া বসন্তের জিনিসপত্র লইয়া আপনার ঘরে পুরিয়া খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থায় ব্যস্ত৷ ললিতা, নির্মলা আজ নিজেরা খরচ দিয়া মদ কিনিয়া খাইতে বসিয়াছে৷ ইহাদের মধ্যে বেহালাদার, দোহার ও ঢুলীটা আলোচনা করিতেছিল কোন ঝুমুর দলে গানে-নাচে-রূপে যৌবনে সেরা মেয়ে কে আছে! সর্ববাদিসম্মতভাবে ‘প্রভাতী’ নাম্নী কে একজন তরুণীর নাম স্বীকৃতিলাভ করিয়াছে; মেয়েটা নাকি বসন্ত অপেক্ষা আরও ভাল এই কারণে যে তাহার বয়স বসন্তের চেয়ে অনেক কম৷ দোহার বলিতেছে, তাহাকেই আনা উচিৎ৷ তাহাতে বিশ তিরিশ বা পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত লাগে তাহা দিয়াও তাহাকে দলে আনা উচিৎ৷’’১৬৮ গৃহে একটা বিড়ালও দুদিন অবস্থান করলে তার প্রতি নাকি মানুষের মায়া পড়ে যায় অথচ বসন্ত একজন জলজ্যান্ত পণ্যাঙ্গনা৷ তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সে সম্পূর্ণরূপে মুছে যায় তাদের দল থেকে৷ তার জন্য দুদিন শোক-প্রকাশ করবে এমন দরদি সেখানে কেউ নেই৷ এমনকি ভাগ্য বসন্তর মত হতভাগিনী রমণীদের!

‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রাম’-এর বারযোষিৎ দুর্গাও কম হতভাগিনী নয়৷ সে একজন পণ্য রমণী হয়েও বুদ্ধির প্রাখর্যে, প্রত্যুপন্নমতিত্বে, সমাজের মঙ্গলাকাঙ্খিনীরূপে উপন্যাসের অন্য সব প্রধান পুরুষচরিত্রগুলির তুলনায়ও কোনো অংশে কম ছিল না৷ তার নারী হৃদয়ের কোমলতা কোনো কোনো স্থানে বিলুর মতো মহীয়সীকেও অতিক্রম করে গেছে৷ অথচ সমগ্র জীবন ধরে সে শুধুই উমার মতো তপস্যা করে গেছে; তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করতে পারেনি৷ যে সমাজে জন্মগ্রহণ করেছে সে সেখানে গণিকাবৃত্তি দোষের নয় বরং তাদের আত্মীয় পরিজনদের মদতেই সেই নিম্নশ্রেণীর মেয়ে-বৌরা নিজের শরীরকে পরপুরুষের যৌন খোরাক হিসেবে উপস্থাপিত করে৷ দুর্গারও তাই হয়েছিল৷ তার শাশুড়ি মনিবের সঙ্গে চক্রান্ত করে অসুস্থতার ভান করে তাকে কাজে পাঠিয়েছিল বাবুর দ্বারা ধর্ষিত হয়ে এবং শরীরের মূল্য হিসেবে পাঁচ টাকা পারিশ্রমিক লাভ করে আতঙ্কে, অশান্তিতে, গ্লানিতে; সঙ্গে সঙ্গে বাবুর দুর্লভ অনুগ্রহ ও অর্থপ্রাপ্তির আনন্দে পথ ভুল করে সে আপন মায়ের কাছে পালিয়ে এসেছিল৷ ‘‘কারণ সে বাবুর কাছে শুনিয়াছিল এই যোগসাজশটি তাহার শাশুড়ির!’’১৬৯ মায়ের কাছে সমস্ত বৃত্তান্ত প্রকাশ করলে তার মায়ের চোখেও এক বিচিত্র দৃষ্টি ফুটে উঠেছিল৷ লেখকের বর্ণনায়—‘‘একটা উজ্জ্বল আলোকিত পথ সহসা যেন তাহার চোখের সম্মুখে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল—সেই পথই সে কন্যাকে দেখাইয়া দিয়া বলিল—যাক, আর শ্বশুড়বাড়ি যেতে হবে না৷’’১৭০ তার পর থেকেই দুর্গা সেই পথ ধরেই চলেছে৷

দুর্গা স্বতন্ত্র কোনো পল্লীতে দেহের পসরা সাজায়নি৷ বাপের বাড়িতেই তার বাসস্থান৷ তাদের সেই হরিজনপল্লীর প্রায় প্রত্যেক রমণীই কম-বেশি যৌনব্যবসার সঙ্গে যুক্ত৷ দুর্গার ঘরে যেমন লোক যাতায়াত করে তেমনি প্রয়োজন হলে যৌনখোরাকের জোগানদার হিসেবে তাকে অভিসারেও যেতে হয়৷ শুধু নিজের গ্রাম নয় পার্শ্ববর্তী গ্রাম কঙ্কনাতেও তার শরীরভোগী পুরুষের সংখ্যা কম নয়৷ এই শরীর কেনা-বেচা নিয়ে তার মনে কোনো ক্ষোভ নেই, অনুতাপ নেই৷ সে স্বাধীনবৃত্তির এবং আত্মপ্রত্যয়ী৷ ভাই পাতুর সঙ্গে ঝগড়ার প্রসঙ্গে তার সেই আত্মপ্রত্যয়ের বিচ্ছুরণ লক্ষিত হয়৷ যেমন দুর্গার চরিত্র নিয়ে ভরা মজলিশে পাতু তাকে অপমানিত করলে সকলের সামনে সে সদম্ভে ঘোষণা করে—‘‘ঘর আমার, আমি নিজের রোজগারে করেছি, আমার খুশী যার ওপর হবে—সে-ই আমার বাড়ি আসবে৷ তোর কি? তাতে তোর কি? তু আমাকে খেতে দিস, না দিবি?’’১৭১ দুর্গাদের সমগ্র মুচিপাড়াটা আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেলে জগন ডাক্তারের উদ্যোগে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তির আশায় সকলে যখন ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে আবেদন করতে টিপ-ছাপ দিতে ব্যস্ত তখন নিজ কর্মে গরবিনী দুর্গা তা অস্বীকার করে৷ টিপসই না দিলে যে সে সরকারি টাকা পাবে না জগন ডাক্তার সে কথা তাকে বলতেই সে মুখ বেঁকিয়ে উত্তর দেয়—‘‘আমি টিপ-সই দিতে আসি নাই গো৷ তোমার তালগাছ বিক্রি আছে শুনে এসেছিলাম কিনতে৷ গতর থাকতে ভিখ মাঙব ক্যানে? গলায় দড়ি!’’১৭২ এই বক্তব্যেও দুর্গার পেশা সম্পর্কে আত্মপ্রত্যয়ী মনোভাব স্পষ্ট৷ সুন্দরী-রূপবতী দুর্গা নিজেকে সর্বদাই নিজের স্বজাতীয়দের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে; নিজের কলঙ্ক কোনোভাবেই কারও কাছে গোপন করে না৷ স্বেচ্ছাচারের দুরন্তপনায় ঊর্ধ্ব বা অধঃলোকের কোনো সীমাকেই অতিক্রম করতে তার বাধে না৷ পুরুষ দেখলেই লাস্যের দোলায় দু-একটা রঙ্গ-রসিকতা করা তার চিরায়ত স্বভাব৷ যার জন্য গ্রামের কুলবধূরা তার প্রতি বিরক্ত ও আশঙ্কিত৷ রচনাকার দুর্গা চরিত্রের মধ্য দিয়ে গণিকা নারীদের সামাজিক ও মানসিক বিবর্তনের ধারাটিকে স্পষ্ট করেছেন৷ সামাজিক ভাবে দেখা যায় ওপরতলার-নীচুতলার বেশিরভাগ মানুষই দুর্গার শরীরকে উপভোগ করে ফলে শরীরের সূত্রে দুর্গা সকলে দোষ-গুণের সন্ধান রাখে; তাই একটা প্রচ্ছন্ন কর্তৃত্ব যেন সহজভাবেই দুর্গার মধ্যে আরোপিত৷ আর সকলের হাড়ির খবর তার নখদর্পণে বলে তার ঔদ্ধত্তে বা তার অগোপনীয় স্বেচ্ছাচারীতাকে কেউ ঘাটাতে সাহস পায় না৷ আর মানসিকভাবে দেখা যায় যে দেহজীবিকার জন্য তার মনে কোনো অনুতাপ অনুশোচনা তো নে-ই বরং তার শরীর ও যৌনতা নিয়ে সকলের সামনে গর্বপ্রকাশ করে সে৷ পুরুষের যৌনতার খোরাক হিসেবে অবস্থান করা একজন নারীর এ ধরনের আত্মগর্বী মনোভাব দৃঢ়মননের অধিকারী না হলে সম্ভব হয় না৷ দুর্গার মধ্যে সে মনন কাজ করেছে৷ পণ্য রমণী হয়েও সাহাসে আভিজাত্যে অসামান্য হয়ে উঠেছে৷

লেখক দুর্গার মধ্যে শুধু পণ্যাঙ্গনার শরীরী গর্বকেই আরোপিত করেননি তাকে অধিষ্ঠিত করেছেন সমস্ত মানবীয় গুণাবলীর সমন্বিত রূপে৷ সেখানে নারীর কমনীয়তা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে পুরুষের প্রচণ্ড সাহসিকতা৷ পদ্মর দুঃখে, রাঙাদিদির মৃত্যু শয্যায়, দেবুর সংসার রক্ষণাবেক্ষণে, অনিরুদ্ধর যৌন ও মানসিক খোরাক জোগান দিতে গিয়ে সে যথার্থ রমণী হয়ে উঠেছে৷ আবার যখন শ্রীহরি চক্রান্ত করে ভূপাল থানাদার, জমাদারবাবু ও হিন্দুস্থানী সিপাহিকে নিয়ে পদ্মর বাড়িতে ভাড়া থাকা নজরবন্দি যতীন ও দেবুদেরকে প্রজাসমিতির মিটিং করার জন্য ধরিয়ে দেওয়ার জন্য সংকল্প করে তখন উপস্থিত বুদ্ধির জোরে দুর্গা আগাম সংবাদ দিয়ে তাদের সচেতন করে আইনি পীড়নের হাত থেকে রক্ষা করে, পুলিশ দেবুদের ঘর তল্লাশি করতে চাইলে দুর্গা দেবুকে বলে—‘‘ঘরে কিছু থাকে তো আমাকে দেবে৷ আমি ঠিক পেট-আঁচলে নিয়ে বাইরে চলে যাব৷’’১৭৩ এই বক্তব্যের মধ্যেও দুর্গার সাহসিকতার প্রত্যক্ষ দ্যুতি লক্ষিত৷ এছাড়া গ্রামে কলেরা দেখা দিলে দুর্গা দেবুর সঙ্গে সমান তালে সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের প্রাণের তোয়াক্কা না করে৷ শ্রীহরির গাছ নষ্ট করার অপরাধে দোষী বানিয়ে দেবু গ্রেপ্তার হলে সমস্ত দায় স্কন্ধে তুলে নেয় অনিরুদ্ধ৷ সত্যই সে শ্রীহরির নানা কুকর্মের শোধ নিতে গাছ কেটেছিল৷ সেই গাছ কাটা মামলায় দুর্গার নামেও রিপোর্ট হয়৷ দুর্গা কিন্তু পুলিশি জেরায় ঘাবড়ে যায় না৷ অকুতোভয়ে সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিয়ে যায়৷ সে যখন দারোগাকে বলে—‘‘আপনি ডাকুন সবাইকে—আমি মুখে মুখে বলছি৷ এই সেদিন রেতে জমাদার ঘোষ মশায়ের বৈঠকখানায় এসে আমোদ করতে আমাকে ডেকেছিলেন—আমি গেছলাম৷ সেদিন ঘোষ মশায়ের খিড়কীর পুকুরে আমাকে সাপে কামড়েছিল—পেরমাই ছিল তাই বেঁচেছি৷ রামকিষণ সিপাইজি ছিল, ভূপাল থানাদার ছিল৷ শুধান সকলকে৷ আমার কথা তো কারু কাছে ছাপি নাই৷’’১৭৪ দুর্গা এই কথার মধ্য দিয়ে শ্রীহরি, থানাদার, জমাদারবাবু, সিপাইজি সকলের পারস্পারিক সম্পর্ককেও ইন্সপেকটারের কর্ণগোচর করে দেয় নিজের উপস্থিত বুদ্ধিতে৷

‘গণদেবতা’ থেকে ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসে একটু একটু করে দেহজীবিকার খোলসমুক্ত হয়েছে বারযোষিৎ এই নারী৷ দেবুর বরাবরই ছিল দুর্গার মতো নারীদের প্রতি অবজ্ঞা৷ জেল থেকে ফেরত আসার পর তার প্রতি অন্য আর এক মানসিকতা দানা বাঁধে৷ পনেরো মাসের সাজা কাটিয়ে গৃহে ফেরার পথে দুর্গাদের মুচিপাড়াটা দেখে দেবুর মন দুর্গার কথা ভাবতে থাকে—‘‘ছোট ছোট কুঁড়েঘরগুলির মধ্যে ওই বড় ঘরখানা দুর্গার কোটা-ঘর৷ দুর্গা! আহা, দুর্গা বড় ভাল মেয়ে৷ পূর্বে সে মেয়েটাকে ঘৃণা করিত, মেয়েটার গায়েপড়া ভাব দেখিয়া বিরক্তি-ভাব প্রকাশ করিত৷ অনেকবার রূঢ় কথাও বলিয়াছে সে দুর্গাকে৷ কিন্তু তাহার অসময়ে, বিপদের দিনে দুর্গা দেখা দিল এক নূতন রূপে৷ জেলে আসিবার দিন সে তাহার আভাস মাত্র পাইয়াছিল৷ তারপর বিলুর পত্রে জানিয়াছে অনেক কথা৷ অহরহ—উদয়াস্ত দুর্গা বিলুর কাছে থাকে, দাসীর মতো সেবা করে, সাধ্যমত সে বিলুকে কাজ করিতে দেয় না, ছেলেটাকে বুকে করিয়া রাখে৷ স্বৈরিণী বিলাসিনীর মধ্যে এ রূপ কোথায় ছিল—কেমন করিয়া লুকাইয়া ছিল?’’১৭৫

দুর্গা দেবুর জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েছে৷ সে শ্রীহরির স্থূল বদবুদ্ধির পাশে দেবুর সচ্চরিত্রের দীপ্তিতে মোহিত হয়ে তাকে ভালোবেসে ফেলেছে; তাকে কাছে পেতে চেয়ে নিজের গণিকা সুলভ কৌশলের যে প্রয়োগ করেনি তাও নয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত বুঝতে পেরেছে সে পাথর দিয়ে তৈরি৷ নারীর লাস্যে সে পাথর কোনোভাবেই বিগলিত হয় না৷ পদ্মবৌ-এর কাছে তার সেই অভিব্যক্তি সম্পর্কে গল্পও করেছে৷ তার শরীরের প্রতি উদাসীন উপেক্ষা তার ভালোবাসাকে আরও মজবুত করেছে৷ দেবু যদি অনিরুদ্ধর মতো তার প্রলোভনে প্রলোভিত হয়ে পতঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তো তাহলে দেবুর প্রতি তার সেই প্রেম অত গভীর বোধ হয় হত না, অনিরুদ্ধর মতো তার বহুপুরুষ বিলাসী মন দেবুকেও একসময় পরিত্যাগ করতো৷ দুর্গা দুই উপন্যাস জুড়ে দেবুর জন্য অকাতরে উপেক্ষা করে গেছে নিজের সব কিছুকে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দুটি উপন্যাসের কোথাও লেখক দেবুর মধ্যে দুর্গার সেই প্রেমভাবনাকে জ্ঞাত করাননি৷ বিচক্ষণ দেবুর অন্তত একবার হলেও দুর্গার তার প্রতি ভালোবাসাকে বোঝা উচিৎ ছিল৷ বরং শ্যালিকা হিসেবে তার প্রতি সর্বদা স্নেহই বর্ষণ করেছে৷ শেষ পর্যন্ত দুর্গা যেভাবে দেবুর সঙ্গে থেকে তাকে সাহায্য করে এসেছে তার প্রেমের স্বরূপকে বুঝলে হয়তো দেবু দুর্গার সাহায্য সেভাবে নিতে পারতো না আর দুর্গা চরিত্রটিকেও সেইভাবে উপস্থাপিত করা হয়তো সম্ভব হত না৷ যাই হোক ভেতরে ভেতরে ক্ষয় হয়েও, নিজের দেহব্যবসা জারি রেখেও হৃদয়ের প্রেমের প্রদীপকে অনির্বাণ রেখেছিল৷ দেবু দুর্গার সমস্ত গুণপনাকে স্বীকার করলেও তার গণিকাবৃত্তিকে মেনে নিতে পারেনি৷ অনিরুদ্ধর সঙ্গে দুর্গার সম্পর্ক নিয়ে কথা প্রসঙ্গে তাই স্ত্রী বিলুকে সে বলে—‘‘ছি! ছি! ছি! দুর্গার ওই দোষটা গেল না৷ ওই এক দোষেই ওর সব গুণ নষ্ট হয়েছে৷’’১৭৬ অর্থাৎ গ্রাম জুড়ে প্রায় সকল পুরুষের সঙ্গে দুর্গার সম্পর্ক থাকলেও পুরুষগুলির কোনো দোষ হয় না দুর্গা তার এক দোষেই সমস্ত গুণাবলীকে ধ্বংস করে দেয়৷ দেবুর মুখে উচ্চারিত এই কথা রক্ষণশীল সমাজপ্রভুদের মতো শোনায়—যারা সমাজ, প্রতিবেশ, পরিবেশের বিচার না করেই সমস্ত দায় চাপিয়ে দেয় নারীর অসহায়তার উপর৷

সমাজের কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করলেও বিলুর ও খোকার মৃত্যুর পর নিঃসঙ্গ দেবুর তত্ত্বাবধানের দায় তার উপর আরোপিত হলে সমাজের ছড়িই যেন তার মাথার উপর ঘুরতে থাকে৷ সে বোঝে নিঃসহায় দেবুকে সে যদি দেখভাল করতে যায় তাহলে সমাজ তার আর দেবুর নামে কুৎসা রটাবে৷ প্রেমাস্পদের মিথ্যা কলঙ্ক সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবে না৷ তাই দেবুকে বলে—‘‘গাঁয়ের লোককে তো জান জামাই! এখন আমি বেশী গেলে-এলেই—তোমাকে জড়িয়ে নানান কুকথা রটাবে৷’’১৭৭ সে নিজে না গেলেও তার মাকে প্রত্যহ পাঠায় দুধ দিতে, পাতুকে দুবেলা পাঠায় খোঁজ-খবর নিতে৷ তার বন্দোবস্তে পাতু রাত্রে দেবুর বাড়িতেই ঘুমায়৷ চরিত্রগতভাবেও অনেক পরিবর্তন এসেছে তার—‘‘সে আর লীলাচঞ্চলা তরঙ্গময়ী নাই৷ আশ্চর্য রকমের শান্ত হইয়া গিয়াছে৷’’১৭৮

দুর্গা দেহব্যবসায়িনী হলেও একজন নারী৷ সে ভালো করে জানে একজন নারীর জীবনে বিপর্যয় কোন দিক থেকে নেমে আসে৷ তাই কামার অনিরুদ্ধ সাজামুক্তির পর নিরুদ্দেশ হয়ে গেলে পদ্মর জন্য উৎকন্ঠা বেড়ে যায়৷ সে জানে পদ্মর উপর বহুদিন থেকে দুর্বৃত্ত ছিরু পালের নজর রয়েছে৷ অসহায় পদ্ম যদি উপায়ন্তর না দেখে তার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে তাহলে সেই দ্বিপদ শ্বাপদের বাড় আরও বেড়ে যাবে৷ দেবুকে তাই অনুরোধ করে পদ্মকে ছিরুপালের থাবা থেকে বাঁচানোর জন্য৷ দেবু তার খাওয়া পরার দায়িত্ব নিতে চায় কিন্তু তার দেখাশোনা করবে কে সেই চিন্তায় যখন ব্যাকুল তখন দুর্গার কথায় ফুটে উঠে নারী জীবনের চরম দর্শন—‘‘জান জামাই! মেয়েলোক নষ্ট হয় পেটের জ্বালায় আর লোভে৷ ভালবেসে নষ্ট হয় না—তা নয়, ভালবেসেও হয়৷ কিন্তু সে আর ক’টা? একশোটার মধ্যে একটা৷ লোভে পড়ে—টাকার লোভে, গয়না-কাপড়ের লোভে মেয়েরা নষ্ট হয় বটে৷ কিন্তু পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, পণ্ডিত৷ তুমি তাকে পেটের জ্বালা থেকে বাঁচাও৷ কর্মকার পেটের ভাত রেখে যায় নাই, কিন্তু একখানা বগি-দা রেখে গিয়েছে; বলত, এ দা দিয়ে বাঘ কাটা যায়৷ সেই দাখানা পদ্ম-বউ পাশে নিয়ে শুয়ে থাকে৷ কাজ করে, কর্ম করে—দাখানা রাখে হাতের কাছাকাছি৷ তার লেগে তুমি ভেবো না৷ আর যদি দেহের জ্বালায় সে থাকতে না পারে, খারাপই হয়, তা হলে তোমার ভাত আর সে তখন খাবে না৷ চলে যাবে৷’’১৭৯ দুর্গার সেই যুক্তিপূর্ণ কথায় আস্বস্ত হয়ে দেবু সেদিন থেকেই পদ্মর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে৷

দুর্গার তার দেহব্যবসার সমস্ত বৃত্তান্ত অকপটে ব্যক্ত করে কামারবৌ-এর কাছে৷ দম্ভ করেই সে বলে—‘‘পেটের ভাত পরনের কাপড়ের জন্য দাসীবিত্তিও করতে নারব ভাই, ভিক্ষেও করতে নারব৷’’১৮০ ভিক্ষাকে বড় ঘৃণা দুর্গার৷ তার মতো নারীদের দেহব্যবসা বা ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া তৃতীয় কোনো পথ নেই৷ সে প্রথমটিকেই গ্রহণ করেছিল৷ কিছুতেই পরের মুখাপেক্ষী হয়ে চলবে না সে৷ দেবুর স্নেহ তাই তার চিত্তকে মাঝে মাঝে বিক্ষুব্ধ করে তোলে—দেবুর জন্যই যেন সে অত সহজে অভিসারে বেড়োতে পারে না৷ দুর্গা জাতিগতভাবে নিম্ন শ্রেণীর, দেহজীবী হিসেবেও অনেকে ঘৃণা করে তাকে৷ সেই অবস্থানগত বৈষম্যও কামারনির সঙ্গে কথা প্রসঙ্গে ব্যক্ত করে সে—‘‘ওলো, আমি মুচীর মেয়ে; আমাদের জাতকে পা ছুঁয়ে পেন্নাম করতে দেয় না, ঘরে ঢুকতে দেয় না; আর আমারই পায়ে গড়াগড়ি সব! পাশে বসিয়ে আদর করে—যেন স্বগগে তুলে দেয়, বলব কি ভাই!’’১৮১ দুর্গা তার বিদ্রুপের খোঁচায় চরমভাবে বিদ্ধ করেছে প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে৷ যে বৈষম্যে সমাজ কখনো তাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয় না; তার শরীরকে ভোগ করার সময় সেই অচ্ছুৎ দেহই পরম আস্বাদনীয় হয়ে উঠে৷ তাই দুর্গার সকল বিদ্রোহ শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে; যে শোষক সমাজকে শোষণ করে; যে শোষক নারীকে শোষণ করে৷ শ্রীহরি, জমাদার, থানাদার, প্রেসিডেন্টসাহেব সকলের সঙ্গে প্রকাশ্যে শত্রুতা করে দেবুর মঙ্গলাকাঙ্খায়৷ দেবুর তালে তাল মিলিয়ে অত্যাচারীদের শাস্তি দিতে চায়৷

সমাজের মঙ্গল সাধনে মানুষের উপকার করতে গিয়ে তার ভেতরকার লাস্যময়ীসত্তাটি ধীরে ধীরে জাল গোটাতে থাকে৷ পদ্ম লক্ষ করে—‘‘আজকাল দুর্গা আর বড় একটা অভিসারে যায় না৷ বলে—ওতে আমার অরুচি ধরেছে ভাই৷ তবে কি করি, পেটের দায় বড় দায়! আর আমি না বললেই কি ছাড়ে সব? কামার-বউ, বলব কি—ভদ্দনোকের ছেলে—সন্দেবেলায় বাড়ীর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে৷ জানালায় ঢেলা মেরে সাড়া জানায়৷ জানালা খুলে দেখি গাছের তলায় অন্ধকারের মধ্যে ফটফটে জামা-কাপড় পড়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ আবার রাতদুপুরে—ভাই কি বলব, কোঠার জানালায় উঠে শিক ভেঙে ডাকাতের মত ঘরে ঢোকে৷’’১৮২ অর্থাৎ দুর্গা যেমন পেটের দায়ের জন্য দেহব্যবসা ছাড়তে পারে না তেমনি তার দেহলোভী স্বাপদেরাও সেই বৃত্তি থেকে তাকে সরতে দেয় না৷ দেবুর স্নেহধন্য হয়ে সে যখন তার অভিসার যাত্রাকে কমিয়ে দেয়, ঘরে লোক ঢোকানো প্রায় বন্ধ করে দেয় তখন দেখা যায় ভদ্রলোকের ছেলেরা তার শরীর ভোগের আর্তি নিয়ে জানালায় ঢেলা মারে, কেউ কেউ মাঝরাত্রে শিক ভেঙে ঘরে ঢোকে তার তনুসুধা পান করতে৷ একজন পণ্য রমণী যে ইচ্ছে করলেই তার পসরা উঠিয়ে দিতে পারে না সমাজের চাপে, সেই দিকের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন রচনাকার৷

দুর্গা স্বাধীনতার জন্য ভিক্ষাবৃত্তির বদলে দেহব্যবসা করে; কোনোকিছুর বিনিময়ে সে তার স্বাধীনতাকে হারাতে চায় না তাই দেবু যখন তাকে তার বাড়িতে থাকতে বলে মাইনে নিয়ে কাজকর্ম করার জন্য তখন তার মানসিকতাকে ব্যক্ত করেছেন রচনাকার ‘চাবুক খাওয়া ঘোড়ার মত’১৮৩ সে প্রতিবাদ করে বলে—‘‘ঝিয়ের কাজ তো আমি করতে পারি না, জামাই-পণ্ডিত৷ আমার বাড়ীঘর ঝাঁটপাটের জন্যে দাদার বউকে দিনে এক সের করে চাল দিই৷’’১৮৪ দেবু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে শ্যালিকা হিসেবে তাকে থাকতে বললে, অন্তত পঞ্চায়েত বসার আগের কদিন থাকার জন্য অনুরোধ করলে সমস্তটা বুঝতে পারে বিচক্ষণ দুর্গা৷ গ্রামে তাকে ও দেবুকে নিয়ে যে কুৎসা ছড়িয়ে গিয়েছে তা দুর্গার অবিদিত নেই এবং দেবু তার যথাযোগ্য জবাব দিতেই যে তাকে তার বাড়িতে থাকতে বলেছে সেটা বুঝতে বাকি থাকে না তার৷ শুধু তাই নয় সমাজকে অস্বীকার করে দেবু যখন তার হাতে জল খেতে চায় তখন পরম শ্রদ্ধায় দুর্গার চোখে জল চলে আসে৷ সে বলে—‘‘—না৷ সে আমি পারব না জামাই-পণ্ডিত৷ আমার হাতের জল কঙ্কণার বামুন-কায়েত বাবুরা নুকিয়ে খায়, মদের সঙ্গে জল মিশিয়ে দিই, মুখে গ্লাস তুলে ধরি—তারা দিব্যে খায়৷ সে আমি দিই—কিন্তু তোমাকে দিতে পারব না৷’’১৮৫ দুর্গা জানে দেবু সমাজকে শিক্ষা দিতেই দুর্গার কাছে জল খেতে চেয়েছে—উচ্চবর্ণের সেই ভালো মানুষটিকে তার ছোঁয়াচযুক্ত জল দিয়ে জাত নষ্ট করতে চায় না৷

ময়ুরাক্ষীর ভয়ঙ্কর বন্যায় বাঁধ রক্ষা করতে গিয়ে জলের তোড়ে দেবু ভেসে গেলে দুর্গা দেবুর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে৷ পরে আহত অবস্থায় সে উদ্ধার হলে মাকালীর কাছে তার প্রাণের জন্য আকুলভাবে মানত করতে দেখা যায় তাকে৷ পার্শ্ববর্তী গ্রামে তিনকড়ির বাড়িতে দেবুর শ্রশ্রূষার ব্যবস্থা হলে দেবুর বাড়ি-ঘরের তাদরকের সমস্ত দায়িত্ব সে স্বেচ্ছায় নিজস্কন্ধে তুলে নেয়৷ সুস্থ হয়ে পুনরায় যখন দেশপ্রেমের জোয়ারে সে মেতে উঠে তখন তার প্রধান সহায়কারী হয় এই বারবনিতাই৷ দুর্গার কারণে শ্রীহরির নেতৃত্বে সমাজ তাকে পতিত করলেও দেবু দুর্গাকে পরিত্যাগ করেনি৷ সহোদরার মতো দুর্গা তাকে সাহায্য করে গেছে, সাহায্য পেয়ে এসেছে৷ তিনকড়ির নেতৃত্বে লোকে সমাজের রায়কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দেবুর পাশেই থেকেছে৷ অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে দুর্গার মতো দেহপসারিণী নারীদের রক্ষার জন্য একটা শ্রেণী ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে, যে শ্রেণী তাদের মানুষ হিসেবে মূল্য দিতে সক্ষম দেহের কলুষতাকে মেনে নিয়েও৷ দেবুর সহায়তাতেই দুর্গা শেষ পর্যন্ত তার পায়ের তলার মাটিকে আঁকড়ে রাখতে পেরেছে৷

ন্যায়রত্ন ঠাকুরের নাতি বিশ্বনাথ মানবতার ধর্মে দীক্ষিত হয়ে পৈতা ছিঁড়ে ফেললে তা যেমন দুর্গাকে ব্যথিত করে তেমনি চৌধুরী মহাশয়ের ঠাকুর বিক্রির খবরেও সে কষ্ট পায়৷ বিশ্বনাথ চলে যাওয়ায় দেবুকে কাঁদতে দেখে সে যখন দ্বারিকা চৌধুরীর সেই খবর জানায় তা দেবুকেও বিহ্বল করে দেয়৷ এই সুযোগে কথার সূত্র ধরে দুর্গা আক্ষেপ প্রকাশ করে দেবুকে বলে—‘‘বিলু-দিদির বুন হয়েও আমি তোমার মন পেলাম না, আর লোকে সাধ্যি-সাধনা করে আমার মন পেল না৷’’১৮৬ সত্যই দুর্গা তার শরীর দিয়েছে অগণিত পুরুষকে কিন্তু মন সমর্পণ করেছিল একমাত্র দেবুকেই৷ দেবু তার কথাকে ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে চরম বিরক্তিতে তাকে ধমকে দিলে দুর্গা সেই ঠাকুর বিক্রয়ের খবর শোনার ইতিহাস ব্যক্ত করে৷ চৌধুরীর বড় ছেলে তার দেহভোগের জন্য দিন কয়েক থেকে ঘুরঘুর করছিল৷ দুর্গা ঠাট্টা করে তাকে বলেছে শরীর বিক্রয়ের মূল্য হিসেবে সোনার হার গ্রহণের কথা৷ চৌধুরীর কামদগ্ধ পুত্র তাতে সম্মত হয়ে বলেছে যে তার পিতা শ্রীহরির কাছে পাঁচশত টাকার বিনিময়ে কুলদেবতাকে বিক্রয় করেছে, সে অর্থ হাতে এলেই সে তাকে গহনা গড়িয়ে দেবে৷ সেই ঠাকুর বিক্রয়ের কার্য অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে হলেও দুর্গার কাছে কোনো সংবাদই গোপন থাকে না৷

স্পষ্টবক্তা দুর্গা কোনোদিনই অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি৷ সে তার শত্রু বা বন্ধু যেই করুক না কেন৷ বহুদিন পর অনিরুদ্ধ ফিরে এসে তার বিগত জীবন প্রসঙ্গে সে যখন সাবিত্রী নামের এক বারবনিতার সঙ্গে কাটানো উচ্ছ্বাসে ভরপুর সময়গুলিকে ব্যক্ত করে তখন দুর্গার অন্তকরণ পদ্মর কথা ভেবে মোচড় দিয়ে উঠে৷ সেই বারবনিতা তাকে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় সে যে পুনরায় গ্রামে ফিরে এসেছে সে কথা শুনে প্রবল অবজ্ঞায় অনিরুদ্ধকে বলে উঠে—‘‘তাতেই বুঝি পরিবারকে মনে পড়ল?’’১৮৭ দুর্গা প্রত্যক্ষভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে পদ্মর স্বামী পরিত্যক্ত অসহায় জীবনকে৷ অনিরুদ্ধ তার জন্য নিরাপদ আশ্রয় তো দূরের কথা ক্ষুধার অন্ন পর্যন্ত রেখে যায়নি৷ তার অবহেলায় ভেসে গিয়েছে পদ্মর মতো সহায়সম্বলহীন এক চরিত্রবান গৃহবধূ৷ সেই ক্ষোভেই চরম শ্লেষবাক্য ধ্বনিত হয় দুর্গার মুখে৷

সারাজীবন পুরুষের তীব্র দৈহিক উত্তাপকে অঙ্গে ধারণ করে এসেছে দুর্গা৷ আর দেবু ভুল করে বিলু ভেবে তাকে চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিলে সেই ভুলের অনুশোচনায় তার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইলে দুর্গাকে অবাক হতে হয় বৈকি৷ সেও জানে দেবু স্বেচ্ছায় তাকে স্পর্শ করেনি, সেই স্পর্শে কিছু মনেও করেনি সে কিন্তু সেই ভুলের আত্মগ্লানিতে তাকে কাঁদতে দেখে সবিস্ময়ে বলতে শোনা যায়—‘‘এর জন্যে তুমি কাঁদছ জামাই-পণ্ডিত!’’১৮৮ দুর্গা কল্পনাও করতে পারে না তার মতো একজন বারযোষিতকে ভুলবশত স্পর্শ করে কেউ কাঁদতে পারে৷ আর এই ভাবনা তাকে স্বাভাবিক করেছে; রক্তমাংসের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে৷

এরপর ঘটনার নানা ঘাত-প্রতিঘাতে প্রথমে গৃহত্যাগী হয়ে, পড়ে কারাবাস করে পুনরায় দেবু যখন নতুন মানুষ হয়ে গ্রামে ফিরে আসে তখন দুর্গাও আরেক মানুষ৷ ‘গণদেবতা’-য় জেল খেটে ফেরার পর দুর্গার মধ্যে যে রূপের আভাস পেয়েছিল তা পরিপূর্ণ রূপ পায় ‘পঞ্চগ্রাম’-এ জেলফেরত দেবুর দৃষ্টিতে৷ ক্ষারে-ধোওয়া সাদা থান পড়ে৷ নিরাভরণা শীর্ণদেহের লাবণ্য ও পারিপাট্যহীন দুর্গাকে দেখে দেবু বিস্মিত হয়ে যায়৷ পরম মমতায় স্নেহধন্য এই বারবধূকে জিজ্ঞেস করে—‘‘এ কি তোর শরীরের অবস্থা, দুর্গা? তুই এমন হয়ে গিয়েছিস কেন?’’১৮৯ লেখক দুর্গার বর্ণনা দিয়ে বলেছেন—‘‘দুর্গার সব গিয়াছে—কিন্তু ডাগর চোখ দুইটি আছে, মুহূর্তে দুর্গার বড় বড় চোখ দুইটি জলে ভরিয়া উঠিল৷’’১৯০ ডাক্তার বলে—‘‘দুর্গা আর সে দুর্গা নাই৷ দান-ধ্যান—পাড়ার অসুখ-বিসুখে সেবা—’’১৯১ ডাক্তারের প্রশংসাকে মাঝপথেই থামিয়ে দেয় দুর্গা৷ অর্থাৎ উপন্যাসের শেষ পর্যায়ে দুর্বিনীত স্বেচ্ছাচারিণী থেকে কামগন্ধহীন সেবাপরায়ণা মানবীতে রূপান্তরিত করেছেন লেখক৷ তার এই রূপান্তর সম্ভব হয়েছে দেবুকে ভালোবেসে, সমাজের ভালোমানুষগুলির মঙ্গলাকাঙ্খায়৷ প্রেমাস্পদকে সে লাভ করতে পারেনি; তার বিলুদিদির বর, তার হৃদয়ের অধীশ্বর স্বর্ণর করকমলে নিজেকে সমর্পণ করেছে; সেখানে তার স্থান নেই৷ তাই ঈশ্বরের কাছে আকুল আর্তি জানিয়ে মনে মনে নিবেদন করেছে যেদিন সাম্যের জোয়ারে ছোট-বড়র ছোট থাকবে না ছুত-অচ্ছুতের অচ্ছুৎ উঠে যাবে, ভালো-মন্দের মন্দ থাকবে না—‘‘সে দিন যেন জামাই তোমাকে আমি পাই৷ বিলু-দিদি মুক্তি পেয়েছে আমি জানি৷ স্বর্ণও যেন সেদিন মুক্তি পায়—নারায়ণের দাসী হয়৷ আমি আসব এই মর্ত্যে—তোমার জন্যে আসব, তুমি যেন এস৷ আমার জন্যে একটি জন্মের জন্যে এস৷ তোমার কথা আমি বিশ্বাস করলাম৷ করছি এই জন্যে৷ তোমাকে পাবার জন্যে৷’’১৯২ ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তিল তিল করে দুর্গার মধ্যে মঙ্গলময়ী নারীশক্তির প্রতিষ্ঠা করলেও তাকে অভিষ্ট লাভে বঞ্চিত করেছেন৷ একে নিম্ন শ্রেণীর অস্পৃশ্য তার মধ্যে আবার দেহজীবী! সাম্যবাদের গান শুনিয়ে তার সমস্ত সাধ-আহ্লাদ পূরণের জন্য পরজন্মকে রেখে দিয়েছেন৷ তারপরেও যে সম্মান যে কর্মভার আরোপ করে চরিত্রটিকে বিকশিত করেছেন, পঙ্কের মধ্যে থেকে ফুটিয়ে তুলেছেন পঙ্কজিনী হিসেবে তাতে এক দেহপসারিণী নারী চরম সার্থকতা লাভ করেছে৷ মানুষ হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠা পেয়েছে সে৷ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার সম্পর্কে বলেছেন যে সমস্ত চরিত্র উপন্যাস মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অর্জন করেছে তাদের মধ্যে—‘‘তৃতীয় ব্যক্তি, দুর্গা মুচিনী৷ তাহার প্রকাশ্য স্বৈরিণীবৃত্তির মধ্য দিয়া অনেকগুলি সদগুণ ফুটিয়া উঠিয়াছে৷ তাহার সপ্রতিভতা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, হৃদয়ের উদারতা, প্রতিবেশীর দুঃখে-কষ্টে সহানুভূতি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াইবার সৎসাহস তাহাকে নীচকুল ও হেয় বৃত্তির গ্লানি হইতে অনেক ঊর্ধ্বে উন্নীত করিয়াছে৷’’১৯৩

বনফুলের ‘তৃণখণ্ড’ উপন্যাসে কথক ডাক্তারের চেম্বারে গা-ময় ঘা নিয়ে কপর্দকহীন এক রোগিনী প্রবেশ করে৷ চূড়ান্ত অবহেলায় ডাক্তার তাকে আন্দাজে সিফিলিসের প্রেসক্রিপশন ও একটা টাকা গুজে দিয়ে বিদায় করে দেয়৷ কিছুদিন পর এক সুন্দরী রমণী তার চেম্বারে উপস্থিত হলে ডাক্তার তার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে সে তার সেই পূর্বের রোগিনী৷ তার নাম আসমানী৷ রঙবাজারে বাসস্থান৷ ডাক্তারের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সে একজন রূপোপজীবিনী৷ ডাক্তারের কাছে সে শুনতে এসেছে আরও ঔষধ তাকে খেতে হবে কি না৷ ডাক্তার আরেক শিশি ঔষধ কিনে খেতে বলে তাকে বিদায় করে দেয়৷ কিন্তু আসমানী চলে গেলে বিবেকের দংশনে দংশিত হয় সে৷ তার মনে হয়—‘‘এটাও কি ঠিক কাজ হইল? এমন একটা মোহিনী অগ্নি-শিখাকে সমাজে ছাড়িয়া দিয়া কি সৎকার্য করিলে! এ তো নিভিয়া গিয়াছিল প্রায়৷ আমি তো আবার তাহাকে জ্বালাইয়া তুলিলাম! উচিৎ হইল কি?’’১৯৪ এ প্রশ্ন ডাক্তারের সচেতন মন তার বিবেককে করেছে৷ সচেতন সত্তা এখানে সেই সমাজের প্রতিনিধি যারা দেহব্যবসায়ী নারীদের মানুষ ভাবতে পারে না৷ রোগজর্জর, মৃতপ্রায় রূপোপজীবিনীকে মৃত্যুর দরজা থেকে ফিরিয়ে নিয়ে তার চিরাভ্যস্ত পরিবেশে ছেড়ে দিলে সচেতন মন যেন ভাবী এক বিপদের সম্ভাবনায় উদগ্রীব হয়ে উঠে৷ অন্যদিকে বিবেক তাকে মানুষের মর্যাদা দিয়ে আসমানীর দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণায় একাত্ম হয়ে যায়৷ এখানে বিবেক ও সচেতন মনের প্রেক্ষিতে দুই শ্রেণীর মানুষের দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়েছে৷ এক শ্রেণীর যারা গণিকাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, আরেক শ্রেণী খড়্গহস্ত হয়ে তাদের বিলুপ্তি সাধনে বদ্ধপরিকর৷ আর ডাক্তার তার চিকিৎসা করেছিল বলে চারিত্রিক দোষে দোষী হয়ে উঠে নিন্দুক সমাজের মধ্যে৷ হারাণদা লোক মুখে শুনে তাই বলে—‘‘তোমার নাকি স্বভাব-চরিত্রও আজকাল খুব খারাপ হয়ে উঠেছে৷ ভদ্রলোকের বাড়িতে না কি তোমাকে ডাকা বিপজ্জনক!’’১৯৫ কারণ হিসেবে জানায়—‘‘রং বাজারের একটা মাগি নাকি তোমার বাড়িতে সন্ধেবেলা আসে৷’’১৯৬ আসমানীর মতো রূপজীবা নারীরা সমাজে এতটাই অপাংক্তেয় যে তাদের চিকিৎসা করলে চিকিৎসককে পর্যন্ত সামাজিকভাবে দোষের ভাগীদার হতে হয়; চরিত্রদোষের অপবাদ ছড়ায়৷ যাই হোক মানসিক দ্বন্দ্ব, নিন্দুকের অপবাদ উপেক্ষা করে ডাক্তার আসমানী যক্ষা আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা করে যায় বিনা ‘ফি’ তে; যদিও জানে সে আর পৃথিবীতে বেশিদিন থাকবে না৷ তারপর হঠাৎই তার সম্মুখে হাজির হয় আসমানীর পিতা৷ যে লোকটি ডাক্তারের পূর্ব পরিচিত এবং বহুবার মিথ্যা অসুখের সার্টিফিকেট চেয়ে ডাক্তারকে বিভ্রান্ত করেছে৷ সে ডাক্তারকে জানায় যে আসমানীর অবস্থা বড়ই খারাপ৷ সে ‘‘বাড়ি থেকে এক ছোঁড়ার সঙ্গে পালিয়ে যায়৷ সেই থেকে খুঁজছি তাকে৷ সেই জন্যই অসুখের মিথ্যে সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়ে ছুটি নিচ্ছি৷ আমার অসুখ-টসুখ সব মিছে কথা৷ আমার আসল অসুখ এই৷’’১৯৭

আসমানী এক যুবকের মিথ্যা মোহে ঘর ছেড়ে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করেছে৷ সমাজের সুস্থ পরিবেশ থেকে চ্যুত হয়ে ঘৃণ্য পরিচয় গ্রহণ করেছে৷ তবু তার ঘরে ফেরার পথ রুদ্ধ করেননি রচনাকার৷ আসমানীর বাবা চাকরি থেকে অসুখের মিথ্যে সার্টিফিকেট দেখিয়ে ছুটির পর ছুটি নিয়ে মেয়ের সন্ধানে ফিরেছে৷ শেষপর্যন্ত যখন তাকে খুঁজে পেয়েছে তখন তার অন্তিম দশা৷ কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে পিতার ক্ষমাসুন্দর ব্যাকুলতা তাকে পতিতা হওয়ার গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়েছে৷ অর্থাৎ লেখক অত্যন্ত সহানুভুতির সঙ্গে আসমানীর বা তার মতো পতিতা নারীদের ঘরে ফেরার দিক নির্দেশ করেছেন৷ শুধু আসমানীই নয় এই উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে আরেক ভ্রষ্টা গৃহবধূর কথা৷ প্রৌঢ় নয়ন মল্লিকের তৃতীয় পক্ষ সে৷ কম বয়সি এই বধূটি আত্মীয় শ্যামলালের সাহায্যে ভ্রষ্টা হয়েছে৷ সাধারণত এযাবৎ যত উপন্যাস পর্যালোচনা করা হয়েছে সেখানে ভ্রষ্টা স্ত্রীদের পুনরায় সংসারে ফেরানো সম্ভব হয়নি৷ সমাজে সেই কুলত্যাগিনী রমণীদের কোনো স্থান হত না কিন্তু ‘তৃণখণ্ড’-এ বনফুল নতুন ভাবে পথনির্দেশ করেছেন৷ ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে তাদের সামায়িক ভুলকে পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে ফিরে আসার এক সম্ভাবনাকে পুনরুজ্জীবিত রেখেছেন৷ তাই তো নয়নবাবু ডাক্তারকে চিঠিতে লিখেছে—‘‘আমার নগদ দেড়লক্ষ টাকা এবং বিষয়-সম্পত্তি কোনও সৎকার্যে দান করিয়া যাইতে চাই৷ আমি একটা উইল করিতে চাই যে আমার পত্নী—যেখানেই থাকুন—আমার সম্পত্তি হইতে ভরণ-পোষণ খরচা পাইবেন৷ তাঁহাকে আমি ভালবাসিতাম৷ একটা ভুল করিয়াছেন সত্য৷ কিন্তু উদরের দায়ে যে সে ভুলটাকে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিতে বাধ্য না হন—এই আমার অভিপ্রায়৷ আমিও ভুল করিয়াছিলাম—এই বয়সে একটা কচি মেয়েকে বিবাহ করিয়া! ভুলের কিছু প্রায়শ্চিত্ত করিয়া যাইতে চাই৷’’১৯৮

নারীরা চিরকাল যা ভুল করে এসেছে তার বহুগুণ বেশি শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে তাদের৷ পুরুষ নিরব ঔদাসীন্যে তাদের কঠোর পরিণতিতে ইন্ধন যুগিয়ে এসেছে৷ আলোচ্য উপন্যাসে লেখক সে পথ থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে মুখ ঘুরিয়েছেন৷ তিনি দেখিয়েছেন অপরাধ করলে পুরুষকেও তার প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়৷ কয়েকগুণ বেশি বয়সি নয়ন মল্লিক একটা কচি মেয়েকে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে গ্রহণ করলে, সে যখন পরপুরুষের হাত ধরে চলে যায় তখন বুঝতে পেরেছিল অন্যায়টা তার দিক থেকেই হয়েছিল৷ তার প্রৌঢ় পুরুষত্বে সন্তুষ্ট হতে পারেনি সেই কিশোরী বধূ; যদিও সন্তুষ্ট হওয়া সম্ভবও ছিল না৷ পুরুষ হয়ে এই ভুলটুকু যে নয়ন মল্লিক বুঝতে পেরেছিল তাতে নারী জীবনের অগ্রগতির পথ অনেক বেশি প্রশস্ত হয়ে গিয়েছিল৷ পুরুষ চিরকাল নারীকে দমন করে এসেছে৷ নানা বিধি-নিষেধের বেড়াজাল তৈরি করে তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছে৷ নিজের ইচ্ছে-অনিচ্ছে জোর করে চাপিয়ে দিয়েছে অবলা নারী সমাজের উপর৷ নয়ন মল্লিক সে দিক থেকে ব্যতিক্রম৷ সে শুধু নিজের ভুল বুঝেই ক্ষান্ত হয়নি তার ভ্রষ্টা স্ত্রীর ভরণ-পোষণের সুষ্ঠু বিলি ব্যবস্থা করে গেছে—যাতে প্রবৃত্তির অসচেতন খেয়ালিপনায় তার বাকি জীবনটা নষ্ট না হয়ে যায়৷ গণিকা নারীদের চারিত্রিক ও সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাসে এই মানসিকতা নিঃসন্দেহে সুফলদায়ী৷

‘বৈতরণী তীরে’ উপন্যাসের বিন্দি তার গণিকা জীবনের জ্বালা যন্ত্রণার ইতিহাস বিবৃত করেছে অপঘাতে মৃত্যুর পর শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে ডাক্তারের কাছে৷ বিন্দির ব্যঙ্গ মিশ্রিত কথায়, অতৃপ্ত জীবনের জ্বালায় চরম প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে৷

বিন্দিবাইজির পূর্ব নাম বিনোদিনী৷ তাকে গণিকাবৃত্তিতে ঠেলে দিয়েছে তার লম্পট স্বামী এবং তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থা৷ আচারনিষ্ঠ দরিদ্র ব্রাহ্মণ মাতার কন্যা বিনোদিনীকে নয় বছর বয়সে এক ধনী যুবকের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে গৌরীদানের পুণ্য অর্জন করেছিল তার মা৷ অসামান্য রূপবতী এই বালিকার মদ্যপ-বিলাসী যুবকের হাতে পড়ে সমস্ত সৌকুমার্য পিষ্ট হয়ে যায়৷ তার রূপ-নিষ্ঠার কোনো দাম ছিল না সেই স্বেচ্ছাচারী গণিকাসক্ত স্বামীর৷ অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে লিভার দূষিত হয়ে যখন কপর্দকশূন্য অবস্থায় তাকে ফেলে সেই স্বামীরত্নটি স্বর্গে চলে যায় তখন বিনোদিনীকে গ্রাস করে অর্থ যন্ত্রণা৷ বিন্দি যেমন ডাক্তারের কাছে আক্ষেপ করে বলেছে যে কোনো গরীবের হাতে পড়লে তার হয়তো অমন দুর্গতি হত না তেমনি বৈধব্যে চরম সংকটে তার মনে হয়েছে বিধবা হয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে সতীদাহতেই নারীর অধিক মঙ্গল৷—‘‘আমাদের দেশে সতীদাহ প্রথাই ঠিক ছিল—স্বামীর সঙ্গে মেয়েটাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলত—বাস নিশ্চিন্ত! এ রকম দগ্ধে দগ্ধে মরতে হত না! এই দেশে কখনও সতীদাহ প্রথা লোপ পেতে পারে? আজও এ দেশের ঘরে ঘরে বিধবা সতীরা পুড়ে মরছে৷ আগুনের চেহারাটা শুধু বদলেছে৷ আগে ছিল চিতানল—এখন হয়েছে তুষানল৷’’১৯৯ এই বারযোষিৎ সমাজের প্রতি আঙ্গুল তুলে তার নিষ্ঠুর ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করেছে৷ সতীদাহ বন্ধ করে মেয়েদের প্রত্যক্ষ মৃত্যু থেকে বাঁচানো হয়েছিল ঠিকই কিন্তু তার বিনিময়ে বৈধব্যের ভয়াবহ যন্ত্রণা দিয়ে যেভাবে তিলে তিলে মারার ব্যবস্থা প্রচলিত হয়েছে তার চেয়ে সতীদাহ বোধ হয় অনেক বেশি ভালো ছিল৷ বিন্দির এই কথার মধ্যে সমাজের কতবড় এক অসঙ্গতি যে চিহ্নিত হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ যাইহোক একদিকে অনাহারে মৃত্যু আরেক দিকে অন্নের থালা হাতে নিয়ে তার দেহকে ভোগ করার জন্য পুরুষের লোলুপ আহ্বান—বিন্দি মরতে পারে না; আরও বহু কিছু দেখার হয়তো বাকি ছিল তাই পুরুষের উদোম কামনার কাছেই নিজেকে সমর্পণ করে৷ তার স্বামীর মামাতো ভাই পুলক ঠাকুরপোই হয় তার প্রথম প্রেমিক৷ তারপর বিন্দিকে আর থেমে থাকতে হয়নি৷ পুরুষের পর পুরুষ তার সেই কমনীয় দেহটাকে উপভোগ করেছে৷ নিজেকে ফুটবলের সঙ্গে তুলনা করে বলেছে—‘‘আমি যেন একটা ফুটবল—আমায় ঘিরে সুদক্ষ একদল খেলোয়াড়; সবারই লোলুপ দৃষ্টি আমার ওপর—কিন্তু আমাকে কাছে পাওয়া মাত্র লাথি মেরে তারা দূর করে দিয়েছে! দূর করে দিয়ে আবার ছুটেছে আমার পেছনে আমাকে ধরবে বলে! এ কি আশ্চর্য ব্যাপার বলুন তো!’’২০০

বিনোদিনী বিন্দিবাইজি হয়ে কামনায়-ভোগে মর্ত্যলোককেই নরক করে তুলেছিল এবং সে নরক গুলজার হয়েও উঠেছিল তার দ্বারা৷ তার সেই সামান্য দেহটা নিয়ে কি করে যে অসংখ্য পুরুষকে মুগ্ধ করেছিল তাতে নিজেই বিস্ময় না মেনে পারে না৷ পুরুষের পর পুরুষ এসেছে তার কাছে, ভালোবাসার ভান করে তাদের শরীরী ক্ষুধা নিবারণ করেছে কিন্তু তার প্রেমবুভূক্ষ হৃদয় এতটুকু শান্ত হয়নি৷ সে সত্যকারের প্রেম দিয়ে নিজের হৃদয়ের আগুনকে নেভাতে চেয়েছে কিন্তু জল পায়নি৷ তার নিজের কথাতেই তার প্রতিধ্বনি—‘‘এই তুষানল নেভাবার নানা চেষ্টা আমি করেছি—জল পেলাম না৷’’২০১ বিনোদিনী স্বচ্ছ জলের সন্ধানে পচা নর্দমা ঘেটে বেড়িয়েছে৷ আসলে গণিকাদের কেউ ভালোবাসতে পারে না৷ সকলেরই লোভ তাদের শরীরের প্রতি৷ আর সেই ভ্রষ্টা নারীদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে সত্যকার ভালোবাসার৷ বিন্দিকে কেউ ভালোবাসেনি কিন্তু সকলেই তার কাছে শরীরী উত্তাপের সঙ্গে প্রেমের পেলবতা প্রার্থনা করেছে৷ বিন্দির কথার মধ্যে এমন দিকের প্রতিও আলোক বর্ষিত হয়েছে—‘‘কি আশ্চর্য এই পুরুষ মানুষগুলোর প্রবৃত্তি! তারা ঘরে সতী স্ত্রী ফেলে আমাদের কাছে ছুটে আসে৷ আমার স্বামীও যেতেন শুনেছি৷ পুরুষদের ষোল-আনা লোভ এই অসতী মেয়েগুলোর প্রতি!—অসতী জেনেই তারা আমাদের কাছে আসে অথচ এসেই একনিষ্ঠতা দাবি করে বসে৷ আর আমরাও টাকার লোভে একনিষ্ঠতার অভিনয় করতে থাকি৷’’২০২ এখানে পুরুষের গণিকাগমনের মনস্তাত্ত্বিক দিকটিও প্রতিভাত হয়েছে৷ পুরুষেরা জানে বিন্দি বা বিন্দির মতো নারীরা বহুভোগ্যা৷ অর্থের বিনিময়ে তাদের ভালোবাসা৷ অথচ যেখানে একনিষ্ঠতা পাওয়ার কথা (ঘরের স্ত্রী) সেখানে তা না খুঁজে সেই একনিষ্ঠতার সন্ধান চায় বেশ্যাদের কাছে৷ টাকার বিনিময়ে বেশ্যার একটু বেশি অনুগ্রহ লাভ করলে সেই মুহূর্তে যেন উতরে যায় তারা৷

গণিকাদের জীবনেও অবসাদ আসে৷ বিন্দিবাইজির মতো নর্দমা ঘাটতে ঘাটতে স্বচ্ছ জলের পিপাসা যখন তাদের বুকের ছাতিকে একেবারে শুকিয়ে ফেলে তখন চরম নির্বেদ তাদের আরেক জগতে ঠেলে দেয়৷ সে জগৎ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৃত্যুর জগৎ৷ জীবনকে আর একটু দেখার তাগিদে যে বিনোদিনী একদিন মৃত্যুর বদলে যৌনবৃত্তিকে গ্রহণ করেছিল; ধীরে ধীরে সমাজ-জীবনের বিভৎস নগ্নতা তাকে জীবনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ করে ফেলে৷ তাই গলায় দড়ি দিয়ে তার ইতিরেখা টানতে হয় তাকে৷ বিন্দি সমাজের চরম নিষ্পেষণের শিকার৷ মৃত্যুর পরে লাশকাটা ঘরে ডাক্তারের কাছে সেই ইতিবৃত্ত ব্যক্ত করে পুরুষ সমাজের উপর সমস্ত দায় চাপিয়ে দিয়েছে৷ একজন গণিকা নারীর এভাবে সমাজের নগ্নতাকে প্রকাশ করার ক্ষমতা নিঃসন্দেহে তার মানসিক শক্তিকে বিধৃত করে৷ সমাজের কঠোর নিয়ম, নানা ধর্মীয় আচার, গৌরীদান, সতীদাহ ইত্যাদির সমালোচনা রচনাকার সুদক্ষভাবে একজন বারযোষিতকে দিয়ে সম্পন্ন করিয়েছেন৷ যে অতৃপ্ত তৃষ্ণা তাকে পৃথিবীর বন্ধন ছিন্ন করিয়েছে মৃত্যুর পরপারে লাশকাটা ঘরে অবশেষে সেই নিষ্কলুষ ঝরণাধারার খোঁজ পেয়েছে৷ যে পুথি-কেতাবের প্রেমের কাহিনি এতদিন তার কাছে নিরর্থক হয়েছিল তা স্বার্থকতার পথে অগ্রসর হতে পেরেছে৷ তাই ডাক্তারকে বলেছে—‘‘সেদিন সেই কবিকে ঠাট্টা করলাম বটে—কিন্তু সে ঠিকই বলছিল বোধ হয়৷ জীবনে প্রেমের আবির্ভাব হলে ক্ষুদ্র জলাশয় সমুদ্র হয়ে ওঠে৷ লোহা সোনা হয়ে যায়৷ সেদিন সেই যে ছেলেটি দেখলাম আপনার কাছে—কোথায় সে!—আহা ঠিক যেন ঝরণা!’’২০৩ পচা নর্দমার বদলে ঝরণার সন্ধান বিন্দিকে মৃত্যুর পরে আশান্বিত করেছে৷ তাকে পাওয়ার জন্য পুনরায় সুদৃশ্য খোঁপায় বেলফুল গুজে গালে-ঠোঁটে রঙ মেখে টানা টানা চোখে কাজলরেখা টেনে মখমলের ফিনফিনে শাড়ি পড়ে অভিসারিকা সেজেছে বিন্দিবাইজি৷ লেখক বিন্দির অতৃপ্ত জীবনে মৃত্যুর পরে হলেও তৃপ্তির আভাষ দিয়েছেন৷

বিন্দির মতো নারীদের শরীর যে পুরুষের কাছে কতটা উপাদেয় তা তার এক খদ্দেরের প্রেতাত্মার ভাষণে সুস্পষ্ট৷ খদ্দেরের চোখে গণিকা নারীদের অবস্থানকে তুলে ধরেছেন লেখক৷ সেই প্রেতাত্মা বিন্দির গলার আওয়াজ পেয়ে ডাক্তারকে বলে—‘‘আমাদের বিন্দির গলার আওয়াজটা যেন শুনলাম৷ আমাদের বিন্দি বাইজী৷ চেনো তাকে? ভাল নাম বোধহয় বিনোদিনী! বেড়ে নাচে বেটি! ওর কোমর ঘোরান যদি দেখ একবার৷ একখানি ‘চিজ’—মাইরি বলছি—৷’’২০৪ এই শ্রেণীর কামুক পুরুষের মাঝে বিন্দি মানুষ নয় একখানি ‘চিজ’ অর্থাৎ ব্যবহার্য বস্তুর তুল্য৷

বনফুল এই উপন্যাসে শুধু মাত্র বিন্দির অতৃপ্ত গণিকা জীবনকেই তুলে ধরেননি; গণিকার মধ্যেও যে নারী জীবনের কোমল প্রবাহ ফল্গুর মতো বহমান থাকে তার প্রতিও দৃষ্টিদান করেছেন৷ তার সেই জলের আর্তি যেমন অতৃপ্ত নারীসত্তার অস্পষ্ট হাহাকার তেমনি বিন্দির ঝরণা সেই অ্যানার্কিস্ট ছেলেটি দীর্ঘাকৃতি কালো লোকটির দ্বারা আক্রান্ত হলে তার নারীমন সুস্পষ্টভাবে আর্তনাদ করে উঠে৷ সে নতজানু হয়ে তাকে মিনতি করতে থাকে—‘‘যেই হই তুমি ওকে ছেড়ে দাও—ওগো তোমার দুটি পায়ে পড়ি!’’২০৫ এবং শেষে দেখা যায় বিন্দি সেই ছেলেটির মাথা কোলে নিয়ে বসে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে—‘‘তাহার কাপড় রক্তে রাঙা—যেন হোলি খেলিয়াছে!’’২০৬ হৃদয়ের সেই কাঙ্খিত পুরুষকে বাঁচানোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, অবশেষে অক্ষম পরাজয়ে তার মাথা কোলে নিয়ে বসে চোখের জলে বুক ভাসানো প্রিয় হারানোর ব্যথায় জর্জরিত নারীর পরিপূর্ণ মূর্তিরূপে প্রতিভাত৷

‘বৈতরণী তীরে’-র বিন্দিবাইজি মানসিকতার দিক দিয়ে বহুদূর এগিয়ে৷ সে দেহব্যবসা করেছে ঠিকই তার সঙ্গে তিল তিল করে সেই বৃত্তির বিভৎস অভিজ্ঞতাগুলোকে স্মৃতির ঘরে সুনিপুণভাবে গ্রন্থিত করেছে, আর চরম অতৃপ্তিতে গলায় দড়ি দিয়ে মরার পর লাশকাটা ঘরে ডাক্তারের কাছে এক এক করে তার গ্রন্থি মোচন করেছে৷ তার সকল অভিযোগের তীর পুরুষ শাসিত সমাজের বিরুদ্ধে; পুরুষ আশ্রিত ধর্মের বিরুদ্ধে৷ সমাজকে এইভাবে দেখার ক্ষমতা তাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে৷

‘জঙ্গম’-এর মুক্তো পুরোদস্তুর বেশ্যা৷ কেরানিবাগানের উনিশ নং বস্তির আঠারো নং ঘরে তার বাস৷ সেই পল্লীতে মুক্তোর মতো আরও অনেক বারযোষিৎ (যেমন টিয়া, আঙ্গুর প্রমুখ) বসবাস করে৷ তারা সকলে দলবদ্ধভাবে বিচিত্র সজ্জায়, বিচিত্রভঙ্গিতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দের ধরে—অর্থের বিনিময়ে সেই কামতাপিত পুরুষদের যৌনক্ষুধা নিবারণ করে৷ হাওড়া স্টেশনে ছোট্ট এক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে শঙ্কর তাদের উপকার করে আমন্ত্রিত হয়েছিল৷ সেদিন সেই ষোড়শী নারীর অঙ্গস্পর্শ অন্য এক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল নায়ক শঙ্করের দেহে৷ বহুদিন পর সেই নিমন্ত্রণের সূত্র ধরে শঙ্কর আঠারো নং কেরানি বাগানে উপস্থিত হয়ে পূর্বের দেখা সেই মেয়েটিসহ অনেকগুলি মেয়েকে সুসজ্জিত হয়ে বঙ্কিমভঙ্গিতে লাইট পোষ্টের নীচে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাদের প্রকৃত স্বরূপ সম্পূর্ণভাবে অবগত হয়৷ একজন শিক্ষিত ভদ্র যুবকের সেই কামপুরীতে হঠাৎ করে উপস্থিত হয়ে যা অবস্থা হওয়ার কথা শঙ্করেরও তাই হয় তাদের দেখে৷ শুধু মনে হতে থাকে—‘‘যেন তাহার তালু শুষ্ক হইয়া গিয়াছে, নিদারুণ তৃষ্ণায় বুক ফাটিয়া যাইতেছে৷’’২০৭ শেষ পর্যন্ত জলই চেয়ে বসে মুক্তোর কাছে৷ আর মুক্তো যে কিনা পাকা দেহব্যবসায়িনী হিসেবে বহু পুরুষ চড়িয়ে খেতে অভ্যস্ত, শঙ্করের অবস্থা উপলব্ধি করতে কোনো অসুবিধা হয় না তার৷ যদিও প্রথমে তার ‘আপনি’ সম্বোধন শুনে গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল পরে পুরো অবস্থা বুঝতে পেরে শুধু মুচকি মুচকি হাসতে থাকে৷ শঙ্করকে জল দিতে নিজের ঘরে নিয়ে গেলে অন্য সঙ্গিনীরা তার সৌভাগ্যে এবং নিজেদের দুর্ভাগ্যে হতাশা ব্যক্ত করে৷ কারণ তারা দেখে মুক্তো ভাগ্যগুণে খুব তাড়াতাড়ি খদ্দের পেয়ে গেছে কিন্তু তাদের আর কতক্ষণ ভোগান্তি আছে তা কেউ জানে না৷ একজন গণিকার কাছে তার খদ্দের লক্ষ্মী৷ তাদের কাছ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়েই বারযোষিতকুলের জীবন অতিবাহিত হয়৷ তাই লক্ষ্মী লাভের আশায় সকলে উন্মুখ হয়ে থাকে৷

শঙ্কর মুক্তোর ঘরে প্রবেশ করে তার হাওড়া স্টেশনের সমস্ত বৃত্তান্ত ব্যক্ত করে৷ মুক্তোর সমস্তটা মনে পড়ার পরেও তা অস্বীকার করে এবং তাকে জল দিয়ে ঘন্টা পিছু দু’টাকা করে রেট জানিয়ে দেয়৷ হতভম্ব শঙ্কর পকেট থেকে একটা দশটাকার নোট বের করে দিলে খলখল করে হেসে লুটিয়ে পড়ে তা নিতে অস্বীকার করে বলে—‘‘না, ছি, আপনি অতিথি মানুষ, আমাদের নেমন্তন্ন পেয়ে এসেছেন বলছেন, আপনার কাছে কি টাকা নিতে পারি? সব জায়গায় কি আর ব্যবসাদারি চলে?’’২০৮ মুক্তোর রহস্যময়ীর মতো শঙ্করকে খেলিয়ে চললেও তার সৌজন্যকে কোনোভাবেই চাপা রাখতে পারে না৷ তাই নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট হওয়ার পরেও তার কাছ থেকে কৃতঘ্ন হয়ে টাকা নিতে পারে না৷ মুক্তোর এই সৌজন্যবোধ তার মানবিক গুণাবলীর পরিচায়ক৷ আমাদের সমাজব্যবস্থা মুক্তোর মতো রূপজীবাদের যতই পিশাচিনী ভাবুক না কেন; মানুষের মর্যাদা থেকে যতই তাদের দূরে সরিয়ে রাখুক না কেন, তাদের মানবিক গুণাবলী অন্যান্য মানুষের তুলনায় কিন্তু কোনো অংশেই কম নয়৷

এই বারযোষিৎ-এর ঘরে শুয়ে শুয়ে শঙ্কর নিবিষ্ট মনে পর্যবেক্ষণ করে গৃহসজ্জার পারিপাট্যকে৷ তার ঘরের বর্ণনা দিয়ে লেখক বলেছেন—‘‘মুক্তোর ঘরখানি ছোট, কিন্তু বেশ গোছানো৷ দুইখানি তক্তপোশ রহিয়াছে, একখানি অপেক্ষাকৃত নীচু ও ছোট, অপরটি উঁচু ও বড়৷ বড় খাটটিতে পুরু গদি, ফরসা চাদর, ফরসা বালিশ৷… ছোট গ্লাসকেসটি বেশ পরিচ্ছন্ন, নানা রঙের রঙিন শাড়ি পাট করা রহিয়াছে অনেক৷ দেওয়ালে নানা রকম ছবি—শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ, মেম-সাহেব, কালীঘাটের পট, পুরীর জগন্নাথ! গত কার্তিক-পূজার কার্তিকের ময়ূরের পালকগুলি এক কোণে টাঙানো আছে৷ এক ধারে একটি আলনা৷ আলনায় মুক্তোর নিত্য-ব্যবহার্য কাপড়-জামা এবং তাহারই এক ধারে একটি লুঙ্গি ও গেঞ্জি ঝুলিতেছে৷’’২০৯ মুক্তোর এই সুসজ্জিত ঘরখানা তার সুন্দর মনের পরিচয়কে গ্রহণ করে৷ কারণ মন অগোছালো হলে অত সুন্দর পরিপাট্যে কেউ গৃহ সাজাতে পারে না৷

মুক্তোর প্রতিদিনকার জীবন-যাপনের মধ্যে শঙ্কর লক্ষ করেছে মানুষের পরিপূর্ণসত্তাটিকে৷ সে হাসে, নাচে, গান গায়, মদ খায়, বিকেলে গা ধুয়ে প্রসাধন সম্পূর্ণ করে রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়ায়, ভঙ্গিভরে সিগারেট টানে, কথায় কথায় খিল খিল করে হাসে, রেগে গেলে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে, অন্ধ-আতুর দেখলে পয়সা দেয়, গঙ্গাস্নান করতে যায়, মেনি বিড়ালকে আদর করে, তার বাঁধাবাবু দশরথের জন্য যত্ন করে হাঁসের ডিমের ডালনা রান্না করে৷ সে দুই-এক পয়সার জন্য ইতরের মতো চপ-কাটলেটওয়ালার সঙ্গে ঝগড়া করে আবার ঘরের মধ্যে মদের বোতল লুকিয়ে রেখে সুযোগ বুঝে তা দুর্মূল্যে বিক্রয় করে৷ তার এই দোষ-গুণসম্পন্ন রহস্যময় সত্তাটিকে শঙ্কর ঠিকঠাক অনুধাবন করতে পারে না৷ রহস্যের আবরণে থেকে সে যেন জানা-না জানার সীমার মধ্যে অহরহ খেলে বেড়াতে থাকে৷ কিন্তু সেই মুক্তোই যখন ফালি বারান্দাটুকুতে বসে দুপুরবেলায় রোদে পিঠ দিয়ে চুল শুকায় তখন যেন তাকে একটু একটু করে চেনা যায়৷ তার মনে হয়—‘‘উহাই যেন তাহার জীবনের সত্য আকাঙ্ক্ষা, ও যেন আর কিছু চায় না, নিশ্চিন্ত চিত্তে নিজের ঘরের দাওয়াটিতে বসিয়া রোদে পিঠ দিয়া চুল শুকাইতে শুকাইতে প্রতিবেশিনীর সঙ্গে সুখদুঃখের আলোচনা করিতে চায়৷’’২১০ অর্থাৎ মুক্তোর সঙ্গে মেলামেশা করে শঙ্কর বুঝতে পেরেছে তার যে গণিকাসত্তা সেখানে সে স্বাভাবিক নয়৷ তার চিরন্তনী নারীসত্তার আভাস পাওয়া যায় রোদে পিঠ দিয়ে চুল শুকানোর সময়৷ লেখক তার পণ্যরূপের খোলস ছিঁড়ে তার ভেতরকার নারীরূপকে বের করে আনতে সচেষ্ট হয়েছেন৷ প্রথম প্রথম শঙ্কর সেই গণিকাপল্লীতে একজন বেশ্যার গৃহে নিজেকে আবদ্ধ দেখে নিজের প্রতি ধিক্কার জানিয়েছিল, তার ভদ্র অন্তকরণ দ্বিধায় জর্জরিত হয়েছিল কিন্তু ধীরে ধীরে সে ধারণা কেটে যায়৷ প্রত্যক্ষভাবে অত্যন্ত কাছ থেকে তাদের জীবনকে পর্যবেক্ষণ করে বুঝতে পারে সেখানকার বাসিন্দারা ঘৃণ্য পেশার সঙ্গে যুক্ত থেকেও মানসিকভাবে কোনোমতেই ঘৃণার যোগ্য নয়৷ তাই শঙ্করের কাছে—‘‘মুক্তো গণিকা—এই কথাই বড় নয়, মুক্তো নারী—এই কথাই বড়৷ শুধু নারী নয়, লাঞ্ছিতা অবনমিতা নারী৷ সমাজের অত্যাচারে, পারিপার্শ্বিক ঘটনার চাপে নিতান্ত নিরুপায় হইয়া উদরান্নের জন্য দেহ-বিক্রয় করিতেছে৷ উহাকে উদ্ধার করিতে হইবে৷ পঙ্ক হইতে পঙ্কজিনীকে আহরণ করিয়া প্রেমের মন্দিরে নির্মাল্য রচনা করিতে হইবে৷’’২১১ লেখক মুক্তকন্ঠে শঙ্করের মতো শিক্ষিত চরিত্রের মধ্য দিয়ে একজন পতিতা নারীর জীবনের বাধ্যবাধকতাকে উল্লেখ করেছেন৷ এভাবে শঙ্করের মধ্যে দিয়ে যে চেতনার সঞ্চার করেছেন রচনাকার তা যদি আরও বেশি বিস্তৃত হয়ে যায় তাহলে পতিতা নারীদের জীবন যন্ত্রণার কিছুটা হলেও উপশম হয়৷ শঙ্কর যেমন কাছ থেকে মুক্তোদের জীবনকে দেখেছে তেমনি মিষ্টিদিদির মতো শিক্ষিত ভদ্র রুচির নারীদের প্রবৃত্তির নগ্নরূপকেও প্রত্যক্ষ করেছে৷ তাই তার মনে হয়—‘‘মুক্তো গণিকা বটে, কিন্তু মুক্তোকে দেখিয়া তো ঘৃণা করিতে প্রবৃত্তি হয় না! সে রূপোপজীবিনী, ওই তাহার পেশা৷ মিষ্টিদিদির মত ছদ্মবেশী ঘৃণ্য জীব সে নয়৷’’২১২

মুক্তো এককালে কুলবধূ ছিল৷ স্বামীর প্রতারণায় সে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করেছে৷ তার স্বামী যতীন হাজরা মিথ্যা কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে তাকে পরিত্যাগ করে বিয়ে করেছিল চুনচুনকে৷ পুরুষের সেই নির্মম অবমাননা মেনে নিতে পারেনি মুক্তো—যে অসতীর মিথ্যে তকমা দিয়ে তার স্বামী তাকে পরিত্যাগ করে, প্রতিশোধ নিতে সেই অসতীত্বের বৃত্তিই সে বেছে নেয়৷ কারণ সে বুঝে গিয়েছে মেয়েদের জীবনের কোনো সুরক্ষা নেই৷ স্বামী অন্য নারীর জন্য তাকে অসুরক্ষিত জীবনতরঙ্গে নিক্ষেপ করেছে সেখানে তার বড় শত্রু সতীত্ব৷ সতীত্বের বেশি একজন নারীর কি হারানোর আছে৷ সেই সতীত্বকেই সে বিলিয়ে দেয় পুরুষ সমাজের কাছে সামান্য অর্থের বিনিময়ে৷ ঠাঁই নেয় কেরানিবাগানের পতিতাপল্লীতে৷ দশরথকে বাঁধা বাবু করে তার ধরাবাঁধা সময়ের বাইরে অন্যপুরুষের সঙ্গেও নিজেকে বিলিয়ে দেয়৷ কারণ দশরথের সময় ছিল রাত্রি দশটা থেকে সারারাত৷ তার বন্দোবস্তে রাত্রি দশটা পর্যন্ত মুক্তো অন্য লোক ঘরে তুলতে পারে কিন্তু তার বাইরে নয়৷ আর যদি কোনোদিন সে না আসে সেদিনও তার ছুটি৷ মুক্তোর সেই বাসস্থানকে নরকের সঙ্গে উপমিত করে তাকে সেই নরককুণ্ড থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার কথা বললে ক্রুদ্ধ হয়ে যায় সে৷ শঙ্করকে বলে—‘‘আস্পর্ধা তো কম নয় আপনার! এ নরকে এসে আমাদের উপকার করবার জন্য কে পায়ে ধরে সেধেছিল আপনাকে, শুনি? কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল? নরক! আপনাদের সগগে আপনারাই থাকুন গিয়ে, আমরা সেখানে যেতে চাই না, সেখান থেকে পালিয়ে বেঁচেছি আমরা৷’’২১৩ মুক্তোর এই কথার মধ্যেও তথাকথিত সমাজ ব্যবস্থার প্রতি বিদ্রোহ ধ্বনিত হয়েছে৷ সে কোনো এক সময়ে ভদ্র সমাজের একজন হিসেবে অবস্থান করেছিল—কিন্তু অপমান ও অবজ্ঞা ছাড়া কোনো কিছু পায়নি৷ স্বামীর অধীন হয়ে, তার ইচ্ছে অনিচ্ছাকে অবলম্বন করে অমানুষিকভাবে বেঁচে থাকতে হয়েছিল৷ তারপর স্বামী যখন নিজের আসক্তি মেটাতে তাকে পরিত্যাগ করে তখন তার মন থেকে সতী-অসতীর ভেদরেখা মুছে যায়৷ সে বোঝে নারীর সতীত্ব সেও যেমন পুরুষের দেওয়া তার অসতীত্বও পুরুষের হাতে তৈরি৷ সেদিনই সে বিদ্রোহী হয়ে অসতী হয়ে যায়, সেখানে আর কিছু না থাক স্বাধীনতাটুকু তো আছে৷ মুক্তো তাই কোনোভাবেই সেই সভ্য সমাজে ফিরে যেতে চায় না যেখানে নারীর কোনো মূল্য নেই৷ প্রতিবাদিনী এই বারবনিতার বিদ্রোহীরূপের দ্যোতনা বহন করে তার ঘরের দেওয়ালে লেখা কবিতার একটি চরণে৷ সেখানে লাল পেন্সিল দিয়ে লেখা—‘‘সমুদ্রে পেতেছি শয্যা শিশিরে কি ভয়!’’২১৪ অর্থাৎ সমুদ্রের বুকে একফোটা শিশির কোনো অনুরণন জাগাতে পারে না৷ গৃহের চারদেওয়ালে আবদ্ধ কুলবধূদের যে কলঙ্কভয়ে সর্বদা সজাগ থাকতে হয় মুক্তো সেই আবেষ্টনী থেকে বেড়িয়ে কলঙ্ক সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছে, তাই তার আর কোনো কলঙ্কের ভয় নেই৷ বনফুলের তৈরি বারনারীরাই এমন সাহসী৷ আসলে বাস্তবসমাজের অনুসরণ করতে গিয়ে, জীবনের নিগুঢ় সত্যকে উপস্থাপন করতে গিয়ে তাঁর এই চরিত্রগুলি অনেক বেশি সাহসিকতা দেখাতে পেরেছে৷ সমাজের কোনো অনুশাসন, কোনো রক্তচক্ষু তাদের নিরস্ত করতে পারেনি৷

মুক্তো পুরুষের দ্বারা প্রতারিত হলেও তার ভেতরের নরম মাটিকে সমাজের প্রতি তীব্র ঘৃণা দিয়েও ধুয়ে ফেলতে পারেনি৷ সেখানে ছাপ পড়েছে শঙ্করের৷ সে ভালোবেসেছে তাকে৷ যে প্রবল বিরক্তিতে সে সমাজ পরিত্যাগ করে গণিকা হয়েছিল, তার মোহে আবদ্ধ করে শঙ্করকে সেই সমাজ পরিত্যাগ করাতে পারেনি৷ সে হয়তো বুঝেছিল সমাজচ্যুত হয়ে সেই ভদ্র সন্তান নিজেকে ভালো রাখতে পারবে না, তাই প্রেমাস্পদের মঙ্গলের জন্য শত যন্ত্রণা মনের মধ্যে সহ্য করেও শঙ্করকে লোক দিয়ে অপমান করিয়েছে, তার সামনে অন্য লোককে খদ্দের হিসেবে গ্রহণ করেছে৷ অপমানিত শঙ্কর তাকে বুঝতে না পেরে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে চলে গেছে৷ এবং সেখান থেকে বেরোনোর পর তার মনে হয়েছে—‘‘মুক্তোকে সে পাইবে না, পাইতে পারে না এবং পাইতে চাহেও না৷ তাহার পঙ্কিল স্পর্শ হইতে সে যে মানে মানে দূরে চলিয়া আসিতে পারিয়াছে, এজন্য সে আনন্দিত৷’’২১৫ যে মুক্তোকে উদ্ধার করা তার জীবনের ব্রত হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যে মুক্তোকে বিবাহ করতে চেয়েছিল তার সমস্ত কলুষতা সত্ত্বেও, সেই মুক্তোর স্পর্শ তার কাছে পঙ্কিল মনে হয়৷ শঙ্করের সেই দ্বিধামিশ্রিত মানসিকতা হয় তো বুঝতে পেরেছিল মুক্তো তাই ভালোবাসার বন্ধনে না বেঁধে মুক্তি দিয়েছিল তাকে৷ শঙ্কর আর মুক্তোর খোঁজ রাখেনি৷ বহুদিন গত হলে মুক্তো খুন হওয়ার পর দশরথের জিম্মায় রাখা তার ট্রাঙ্ক থেকে পাওয়া দুটি জিনিস শঙ্করকে বিস্মিত করে৷ একটা তারই দেওয়া নীল রঙের একখানি চাদর অপরটি একটি ছবি—চুনচুনের স্বামী যতীন হাজরার প্রতিকৃতি৷ ছবির মুখের উপর অজস্র নখের আঁচরের দাগ এবং আঁকাবাঁকা অক্ষরে নীচে লেখা—‘‘স্বামী নয়—শয়তান’’২১৬ শঙ্করের বুঝতে অসুবিধা হয় না মুক্তোর জীবন ইতিহাস৷ কারণ মৃত্যুর পূর্বে যতীনবাবু তার পূর্বস্ত্রীর সম্পর্কে বহু কথা বলে গিয়েছিল—সে যে নির্দোষ ছিল এবং তাকে অপমান করার জন্যই যে সে অকালে মৃত্যু পথে যেতে বসেছে সে কথাও গোপন করেনি৷ যতীন হাজরা তার সন্ধান পেয়ে শঙ্করকে বলেছিল তাকে সংবাদ দিতে; মৃত্যুর আগে পায়ে ধরে সমস্ত অন্যায়ের প্রায়শ্চিত্ত করে যাবে৷ কিন্তু তার পূর্ব স্ত্রীর নাম ও ঠিকানা বলার আগেই মৃত্যু তার কন্ঠ রোধ করে দিয়েছিল৷ মুক্তোর ট্রাঙ্কের সেই ছবি যতীনের অসমাপ্ত কথাকে সমাপ্ত করে৷ আর নখে আঁচড়ানো সেই ছবিখানা প্রমাণ করে কি ভীষণ প্রতিহিংসায় জর্জরিত ছিল মুক্তোর মন৷ সারা জীবনেও সে তার স্বামীকে ক্ষমা করে যেতে পারেনি৷

মুক্তো স্বামীর অপমানের শোধ নিতে গিয়ে যে পথ অবলম্বন করেছিল সেখানে মৃত্যুর বাড়া আর কোনো শাস্তি ছিল না৷ তার কপালে শেষ পর্যন্ত তাই জোটে৷ নির্মমভাবে খুন হতে হয় তাকে৷ তাদের সেই খুন হওয়ার কোনো প্রতিকার সমাজে নেই৷ সমাজের পাপ বক্ষে ধারণকারী প্রান্তবাসিনী এই নারীরা মুক্তোর মতো খুন হয়ে বিনা বিচারে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়৷ আর এই নির্মম হত্যাকাণ্ড গণিকা নারীদের বেশিরভাগেরই ভবিতব্য৷ শরীরের বিনিময়ে তিল তিল করে জমানো সামান্য সম্পদও তাদের প্রাণের প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়৷

রচনাকার ত্যাগে, মহত্ত্বে, সাহসে, প্রতিবাদে এবং প্রতিহিংসায় অনবদ্য করে উপস্থাপন করেছেন মুক্তো চরিত্রকে৷ গণিকা নারীদের বিবর্তন ক্ষেত্রে চরিত্র বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ৷

এই উপন্যাসেরই আরেক চরিত্র পানওয়ালী৷ বিগতযৌবনা বারনারীদের জীবনে সংকট চিত্রিত হয়েছে তার মধ্য দিয়ে৷ তার যৌবন যেমন অস্তমিত, তেমনি দেখতেও কুৎসিত সে৷ আর সেই বিরূপ রূপের বাহার ফোটাতে কাজল পড়ে, মাথায় ফুল গুঁজে, দাঁতে মিশি লাগিয়ে এবং নীল বর্ণের কাপড় পড়ে বুড়িটা ছুঁড়ি সেজে প্রণয়ী করালীকে ভোলাতে চায়৷ করালীও কুৎসিত দেখতে৷ অন্য গণিকারা যখন তার ভয়ঙ্কর রূপ দেখে অর্থের বিনিময়েও তাকে গ্রহণ করতে স্বীকৃত হয় না তখন পানওয়ালী অযাচিতভাবে তার উপকার করে যায়৷ করালী তাকে যতটাই ঘৃণা করে ততটাই অনুরক্ত সে তার প্রতি৷ তার সব অপমান নিরবে সহ্য করে অন্তরে প্রেমের নৈবেদ্যকে তার জন্যই অক্ষত রাখে৷ কদর্য রূপ, বিগত যৌবন এবং নিষ্ঠুর উপেক্ষা তার মধ্য থেকেও সত্যকার প্রেম যে নিকষিত হেম হয়ে উঠতে পারে সেই সত্যটিকেই পানওয়ালী চরিত্রের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করেছে৷

ফুলশরিয়া নিম্ন শ্রেণীর দেহজীবী৷ সেও বনফুলের হাতে তৈরি মানবিক গুণসম্পন্ন একজন নারী৷ কৃতজ্ঞতাবোধও কম নয় তার৷ তার ছোঁয়াচ লেগে প্রণয়ী হারিয়া অসুস্থ হলে তার দেখভাল, চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করে৷ শঙ্করের ভালোমানুষী তাকে যেমন তার প্রতি সশ্রদ্ধ করে তোলে তেমনি গ্রামে আগুন লাগার ঘটনায় সেই ভালোমানুষীকেই মনে হয় লোক দেখানো ঢং৷ তাদের প্রতি বিরূপ ঔদাসীন্যে শঙ্করকে তীর্যক বাক্য প্রয়োগেও দ্বিধা করে না৷ আবার কলেরার রোগীর প্রতি নির্মল সহানুভূতি; অক্লান্ত সেবা, মৃতদেহ সৎকার শঙ্করের এই কর্মগুলি তার মননে তাকে মানুষ থেকে দেবতার স্তরে উন্নীত করে৷ সে স্বতোপ্রণোদিত হয়ে শঙ্করের সঙ্গে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়৷ গভীর রাতে শঙ্করের মতো দেবতুল্য মানুষের পদধূলি গ্রহণ করার জন্য তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকে৷ তার মানসিক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিত্ব, আত্মোপলব্ধি তাকে পতিতা চরিত্রের গ্লানিকে ছাপিয়ে মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে৷ লেখক ফুলশরিয়াকেও যৌনতার পুত্তলি করে না রেখে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষীতে রূপান্তরিত করেছেন৷

এছাড়া ‘জঙ্গম’ উপন্যাসে সমাজের আরেক ভয়াবহ দিকের প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে তা হল নারীহরণ ও নারীপাচার চক্রের বর্ণনা৷ যে চক্রগুলি অসহায় দরিদ্র নারীদের কর্মের লোভ দেখিয়ে, প্রলোভিত করে গণিকাবৃত্তি গ্রহণে বাধ্য করে৷ অচিনবাবু, খগেশ্বরবাবু এই চক্রের প্রধান কর্মী৷ মূল পাণ্ডা বৃদ্ধ ম্যানেজারবাবু৷ সেই বিকৃত রুচির বৃদ্ধ অনির্দেশ্য মালিকের নাম করে কখনো মোটা টাকার বিনিময়ে, কখনো কাজ দেওয়ার নাম করে মেয়েদের অপহরণ করায়৷ অচিনবাবু, খগেশ্বরবাবুরা অপহৃতা বা প্রলোভিতা নারীদের ফুসলিয়ে তুলে দেয় ম্যানেজার বাবুর হাতে৷ বৃদ্ধ ম্যানেজার তার বিকারগ্রস্ত কামনায় ধর্ষণ করে সেই নারীদের৷ তারপর কোনো বেশ্যাপল্লীতে পাঠিয়ে দিয়ে আবার নতুন করে ফাঁদ পাতে৷ যেমন শিক্ষয়িত্রীর বিজ্ঞাপন দেখে চাকরীপ্রার্থী হয়ে মৃন্ময়ের স্ত্রী স্বর্ণলতা তার খপ্পরে পড়েছিল৷ এই অপহৃতা নারীরা কেউ আত্মহত্যা করে মুক্তির উপায় খোঁজার চেষ্টা করে নতুবা পুরোদস্তুর পণ্য হয়ে যায়৷ যেমন খগেশ্বরের স্ত্রী সৌদামিনি৷ টাকার লোভে সেই নরপিশাচ নিজের স্ত্রী-কন্যাকে ম্যানেজারবাবুর হাতে তুলে দিয়েছিল৷ ম্যানেজার তাদের দুজনকে পছন্দ হলে চরম আত্মপ্রসাদ লাভ করে বলে—‘‘কর্তার দুজনকেই পছন্দ হয়েছে৷ নিজের চোখে দেখলাম৷ এখন বেশ সোনাদানা পরে দিব্যি জাঁকিয়ে ব্যবসা ফেঁদে বসেছে মশাই,’’২১৭ আবার দেখা যায় অচিনবাবুর দুর্বলতার সুযোগে খগেশ্বর তার মেয়েকেউ ম্যানেজারের হাতে বিক্রয় করে দেয়৷ আত্মজাকে বৃদ্ধের দ্বারা ধর্ষিত হতে দেখে ক্রোধান্ধ অচিনবাবু ম্যানেজারকে খুন করে জেলে যায়৷ এই নারীপাচার চক্র লেখকের কল্পনাবিলাস নয়; সমাজের বাস্তব এক সমস্যা৷ এই অপরাধ চক্রই সমাজে গণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি করে৷ কারণ বেশিরভাগ পাচার হয়ে যাওয়া নারীই সমাজে ঠাঁই পায় না বা বেশ্যালয়ের নির্মম অন্ধকার থেকে বেরোনোর সুযোগ পায় না৷

লেখক এই উপন্যাসে অত্যন্ত সহানুভূতির সঙ্গে গণিকাদের জীবনকে দেখেছেন৷ গণিকা তৈরির পেছনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমাজই যে ইন্ধন জুগিয়ে চলে সে বিষয়েও বাস্তবসম্মতভাবে যুক্তির অবতাড়না করেছেন৷ তার সৃষ্ট পণ্যরমণীরা প্রায় সকলেই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং সমাজের বিরুদ্ধে মুক্তকন্ঠ৷

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরবাসের ইতিকথা’-য় দুজন বারনারী—তারা হল চাঁপা ও দুর্গা৷ দেহব্যবসায়ী হলেও স্বভাব বৈশিষ্ট্যে দুজনে দুই মেরুর৷ খোলার ঘরের এক বস্তিতে অন্য অনেক পণ্যাঙ্গনার সঙ্গে তারা বাস করে৷ গেঁয়ো কামার শ্রীপতি কাজের সন্ধানে শহরে এসে জ্যোতির সঙ্গে উপস্থিত হয় চাঁপার ঘরে৷ চাঁপা উচ্ছল যুবতী৷ গণিকাবৃত্তিতে পোক্ত সে৷ কোন মোহন মন্ত্রে খদ্দের বশ হয় সে বিষয়ও সম্পূর্ণরূপে অবগত তার৷ বহুদিন বেশ্যা বৃত্তির ‘লাইনে’ থাকায় পুরুষ ভোলানোর সব কৌশলই সে আয়ত্ত করেছে৷ কিন্তু বেশ্যাবৃত্তিতে নতুন প্রবেশ করা নারীরা যেভাবে আনাড়ি হয়ে জীবন কাটায় তার প্রমাণ দুর্গা৷ দুর্গার ঘরেও শ্রীপতি প্রথম পদার্পণ করেছিল জ্যোতির সঙ্গেই৷ বেশিদিন হয়নি সে গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করেছে তাই তার মধ্যে কুলবধূর ভাবটি প্রবল৷ শ্রীপতি যেদিন প্রথম দুর্গার সংস্পর্শে তার শরীরীদাহকে শীতল করে, একটা অস্বস্তি যেন তাকে কাঁটার মতো বিদ্ধ করতে থাকে৷ কারণ সে তার মুখে শুনেছে স্বামীর দ্বারা পরিত্যক্ত হয়ে দুর্গার গণিকা হওয়ার কাহিনি৷ সে চাঁপার মতো চপল নয়; মোটাসোটা শান্ত ভালোমানুষ৷ বেশভূষা গৃহস্থঘরের বৌ-এর মতো—সিঁথিতে সিঁদুর পর্যন্ত পড়ে৷ তার কথায়-বার্তায়, চাল-চলনেও যেন একটা তেজ ও আত্মমর্যাদাবোধ কাজ করে৷ তাই—‘‘দুর্গাকে দেখিয়াই শ্রীপতির ভয় আর সংকোচ জাগিয়াছিল৷ তার এই গল্প শোনার পর গা যেন তার ছমছম করিতে লাগিল৷ এখন দুর্গা অপবিত্র হইয়া গিয়াছে, তাকে স্পর্শ করিলে আর দোষ হয় না, এই অকাট্য যুক্তিটা সে অবশ্য এখনও মনে মনে আঁকাড়াইয়া ধরিয়া আছে, তবু তার কেবলই মনে হইতেছে সে যেন একটা মহাপাপ করিয়া ফেলিয়াছে৷ কেবল তার জন্যই আজ একটি পরস্ত্রী অসতী হইয়া গেল৷’’২১৮ অর্থাৎ নারীরা গণিকার মতো চটুল, লাস্যময়ী না হলে পুরুষ তাকে ভোগ করে তৃপ্তি পায় না৷ আর শ্রীপতি, এক গ্রাম্য কামার যে দুদিন স্ত্রীর সঙ্গে অপরিতৃপ্ত যৌনসম্পর্ক স্থাপন করে শহরে এসে শরীরী উত্তেজনায় বিহ্বল হয়ে বেশ্যাসঙ্গলাভে প্রায় বাধ্য হয়েই ব্রতী হয়, তার মতো মানুষের প্রায় গৃহবধূর মতো সদ্য বারযোষিৎ হওয়া এক নারীকে উপভোগ করে অস্বস্তি হওয়াটাই স্বাভাবিক৷

দুর্গা সকলের কাছে ঠকেই তার বৃত্তিটাকে সচল রাখে৷ বিয়ে করা বৌ-এর মতো খদ্দেরের কাছে আবদার করতে পারে—শরীরের যথাযথ মূল্য আদায় করে নিতে পারে না৷ শ্রীপতি পয়সা নিয়ে তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চাইলে দুর্গা পয়সা চাইবে না বলে নতি স্বীকার করে৷ শরীর বিক্রির অর্থ না পেলে তার চলবে কিসে সে প্রসঙ্গে শ্রীপতি জানতে চাইলে সে উত্তর দেয়—‘‘তুমি চালাবে৷ পাষাণ নও তো তুমি, মানুষ৷ খেতে পরতে পাই না দেখলে সইবে তোমার? আজ না দাও, একদিন যেচে তুমি আমায় কাপড় দেবে, গয়না দেবে৷ নেব না বললে বরং রাগ হবে তখন৷ সেদিন আসুক, আমি চুপ করে আছি৷’’২১৯ দুর্গার ঘরের বৌ-এর মতো উত্তাপহীন কথা শুনে শ্রীপতির তাকে রহস্যময় দেশের সেই নারীদের মতো মনে হয় যারা কি না পথিককে নিজের মায়া দিয়ে বশীভূত করে ধরে রাখে, গৃহে ফিরতে দেয় না৷ যদিও শেষ পর্যন্ত শ্রীপতি দুর্গার মায়া কাটিয়ে তার সঙ্গ পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয়৷

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যদিও শ্রীপতির মতো স্ত্রীসঙ্গরহিত পুরুষের লিবিডোর প্রভাবকে ব্যঞ্জিত করতে চাঁপা, দুর্গার মতো একই বৃত্তির ভিন্ন চরিত্রবৈশিষ্ট্যের দুই নারীর জীবনের খণ্ড চিত্রকে তুলে ধরেছেন তবুও তার মধ্যে গণিকা জীবনের নানা দিকও ফুটে উঠেছে৷

কীভাবে স্বামীর অবহেলায় ও প্রত্যাখ্যানে দুর্গা গণিকাবৃত্তি গ্রহণ করেও কুলবধূর বৈশিষ্ট্যগুলোকে ঝেড়ে ফেলতে না পেরে পদে পদে ঠকে যাচ্ছে তা যেমন চিত্রিত হয়েছে তেমনি সময়ের বিবর্তনে সেও যে একদিন চাঁপার মতো পারঙ্গম হয়ে উঠবে সে বিষয়েও দিক নির্দেশ করেছেন রচনাকার৷ দুর্গা ও চাঁপা যেন পরস্পরের অতীত ও ভবিষ্যতের দুটি ভিন্নতর রূপ৷ চাঁপা হয় তো একদিন দুর্গার মতো আনাড়ি ছিল সময় তাকে চটুল করেছে তেমনি আনাড়ি দুর্গাও সময়ের প্রবাহে চাঁপার মতো চপল-চতুর হয়ে উঠবে৷

সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘বৃত্ত’-এ যৌন ব্যবসা ও যৌনতা একাকার হয়ে গিয়েছে৷ বলা চলে যৌনতার যে ভেদরেখার জন্য সতী-অসতীর ধারণা প্রচলিত সেই রেখা মুছে যাওয়ায় তা এক সহজ সাধারণ জৈব প্রক্রিয়ারূপে স্থান পেয়েছে৷ উপন্যাসে যুদ্ধোত্তর যুগের সন্তান বনানী৷ শিক্ষিত সমাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী বনানীর কর্ম সহচর শিশির কিন্তু যৌনসঙ্গী মধ্যবয়সি অধ্যাপক সত্যবান৷ যে সমাজগঠনের আদর্শে প্রেম-ভালোবাসা-শরীরী চাওয়া-পাওয়াকে সবলে চেপে রেখে শিশির কঠিন ব্রতধারী হয়ে বসে আছে সেখানে মানুষের স্বাভাবিক চাওয়া-পাওয়াগুলোকে তার কর্মসহচরী হয়েও বনানী অতিক্রম করতে পারেনি৷ তাই নির্দ্বিধায় তার চেয়ে ষোলো বছরের বড় এবং প্রায় মায়ের বয়সি সত্যবানকে যৌনসহচর হিসেবে গ্রহণ করে৷ তাতে তার কোনো আক্ষেপ নেই—সংকোচ নেই৷ কারণ তার মতে যৌনতাকে প্রাধান্য দিলেও যেমন ক্ষতি, তেমন চেপে রাখলেও ক্ষতি৷ সে তাই সত্যবানকে বলে—‘‘পুরুষ-নারীর মধ্যে শুধু এ সম্বন্ধই আছে এ যেমন আমি ভাবতে পারি নে তেমনি পুরুষ-নারীর মেলামেশার ভেতর এ-বৃত্তিটাকে সতর্ক পাহারা দিয়ে রাখতে হবে তা-ও আমি মানতে রাজি নই৷’’২২০ মানুষের যৌনপ্রবৃত্তি নিয়ে একটা মত বা দর্শন তার মধ্যে সর্বদাই কাজ করেছে৷

বনানী তার জীবনের এই বোধগুলিকে কিছুটা হলেও অর্জন করেছে তার মা সুরমার কাছ থেকে৷ বৈবাহিক সম্পর্কের চিরায়ত আদর্শ তার কাছে ভিত্তিহীন৷ কারণ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মতের মিল না হলে, আত্মার মিল না থাকলে তা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বা শৃঙ্খলার সামিল৷ স্বামীর সঙ্গে মতের মিল না হওয়াতে স্বামীকে সে পরিত্যাগ করেছে৷ যৌনতা সম্পর্কেও সে স্বাধীন মনোভাব সম্পন্ন৷ স্বাধীন মনোবৃত্তির জন্য সে স্বামীকে ত্যাগ করেছে ঠিকই, বিবাহকে অস্বীকার করেছে যদিও কিন্তু যৌনতাকে ত্যাগ করেনি৷ তাই তার যৌনসহচর একাধিক৷ রজত, সত্যবানের মতো মানুষেরা তার কামনার উৎসারক হয়েছে৷ মেয়ের কাছে সে কোনো কিছুই গোপন রাখেনি৷ কারণ সে বিশ্বাস করে তার সবটা জানার অধিকার আছে এবং তা প্রয়োজনও৷ কিন্তু জীবনে শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়ে সে যখন বুঝতে পেরেছে তার মেয়েও সত্যবানের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারবেনা জন্যই নিরবে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে৷

‘বৃত্ত’ ঔপন্যাসিকের দুঃসাহসী পদক্ষেপ৷ তিনি সুরমা ও বনানী চরিত্রটির মধ্য দিয়ে মানুষের চিরায়ত ধারণার মূলে কুঠারাঘাত করেছেন৷ সতী, অসতী, কুলটা, স্বৈরিণী, ব্যভিচারিণী, গণিকা, বেশ্যা—যৌনতা সম্পর্কিত নারীর যত পরিচয় আছে; তার স্বাধীন যৌনমানসিকতায় সব যেন মুহূর্তে তাদের সকল অর্থ, ব্যঞ্জনা হারিয়ে ফেলেছে৷ গণিকাজীবন বিবর্তিত হয়ে এমন এক পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যেখানে তাদের যৌনব্যবসা মানুষের স্বাভাবিক যৌনাচার হয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে৷ নিতান্ত জৈব তাড়নাই সে সম্পর্কের মূল ভিত্তি৷ এখানে একাধিক পুরুষের সঙ্গে বা অবৈধ যৌনসংসর্গকারী নারীরা কুলটা নয়; গণিকা তো নয়ই তার সহজ-স্বাভাবিক মানুষ৷ গণিকা চরিত্রের বিবর্তনে সঞ্জয় ভট্টাচার্য চূড়ান্ত পরিণত ভাবনার ছাপ রেখে গেছেন৷

বাংলা উপন্যাসে গণিকা চরিত্রের নানা দিক আলোচনা করে চরিত্রগুলির সামাজিক ও মানসিক বিবর্তনের এক সুস্পষ্ট ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়৷ উনিশ শতকের যে সমস্ত বাংলা উপন্যাসে গণিকাচরিত্র বা গণিকাদের কাহিনি বিধৃত হয়েছে সবতাতেই তারা পরিচায়িত হয়েছে সমাজ দূষক রূপে৷ তারা ডাইনি, ডাকিনি, পিশাচিনী ইত্যাদি নানা অভিধায় অপমানিত৷ সেখানে তাদের যেমন কোনো বক্তব্য নেই তেমনি রচনাকার চরিত্রগুলির পরিচয় দিতে কোনো নাম পর্যন্ত প্রয়োগ করেননি৷ অর্থাৎ তারা নাম হীনা, সম্মানহীনা, নানা অঘটনপটিয়সী৷ অথচ পুরুষ সমাজ নির্দ্বিধায় তাদের উপভোগ করে গেছে৷ তারপর ধীরে ধীরে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে৷ সময় যত এগিয়ে যায়, যুক্তি, বিচারবোধ মানুষের মধ্যে যত বেশি কার্যকর হয় ততই পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিদ্যায় দক্ষ মানুষজনের মননে এই সর্বদিক দিয়ে পতিতা, বঞ্চিতা নারীরা আলাদা একটা অনুভূতির সঞ্চার করতে থাকে৷ বারবনিতারা বেশ্যা, বারাঙ্গনা ইত্যাদি নানাবিধ তকমার বাইরে নির্দিষ্ট একটা নাম পায়৷ নাম অর্জনের মধ্য দিয়েই তারা যেন মানুষ হিসেবে সমাজের দিকে একধাপ এগিয়ে আসে৷ শরৎচন্দ্রের মতো দরদি লেখকেরা সহনুভূতির বন্যায় ভাসিয়ে দিয়েছেন পণ্যাঙ্গনাদের৷ শুধুমাত্র চরিত্র নয় তারা উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র হিসেবে স্থান দখল করতে পেরেছে—আর এই শ্রেণীর নারীদের প্রতি একটা ঘৃণা, একটা খুতখুতে মনোভাবে পাঠকরা যেভাবে বিব্রত হত তা অনেকটাই দূর হয়ে গেছে৷ আমাদের ঘরের মানুষের মতো দুঃখ-সুখের বেদনা নিয়ে মনুষ্যত্বের মর্যাদায় স্বপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷ জগদীশগুপ্ত, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, বনফুল, মানিক, সঞ্জয় ভট্টাচার্য প্রমুখের রচনার মধ্য দিয়ে গণিকারা নাম, যশ, প্রভাব, প্রতিপত্তি লাভ করতে থাকে৷ তাদের কন্ঠে ধ্বনিত হয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, শোষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ৷ সঞ্জয় ভট্টাচার্য তো তার উপন্যাসে সতী-অসতীর ভেদরেখাই তুলে দিয়েছেন৷ তাঁর মতে যৌনতা শুধুমাত্র এক প্রকার জৈব চাহিদা ছাড়া আর কিছু নয়৷ তার নায়িকার তাই বহুপুরুষের সঙ্গে যৌনসংসর্গে লিপ্ত হয়েও গণিকা হয়ে যায়নি৷ আর এই যে যৌনতার প্রতি ধারণা বদল, সমাজের বিরুদ্ধে নিজেদের জীবনের নানা শোষণের বিরুদ্ধে তাদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রতিবাদ তা বাংলা উপন্যাসে গনিকাচরিত্রের বিবর্তনের রূপরেখাটিকে সুস্পষ্ট করেছে৷

তথ্যসূত্র :

১. স্বপন বসু, সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ (২য় খণ্ড), পৃ-১৪২

 ২.  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, প্রবন্ধ ও অন্যান্য রচনা, পৃ-৩৩-৩৪

 ৩. প্রমথনাথ বিশী (সম্পাদিত), ভূদেব রচনাসম্ভার, পৃ-৩৩৮

 ৪. তদেব, পৃ-৩৩৮

 ৫. তদেব, পৃ-৩৩৯

 ৬. তদেব, পৃ-৩৩৯

 ৭.  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম উপন্যাস সমগ্র, পৃ-৬০

 ৮. তদেব, পৃ. ৬০

 ৯.  তদেব, পৃ-১২

 ১০. তদেব, পৃ-৭৭

১১. তদেব, পৃ-১৩৫

১২. তদেব, পৃ-১৩৫

১৩.  কুমারী শ্রীমতি মানদা দেবী, শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত, পৃ-২৩

১৪. তদেব, পৃ-২০

১৫. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম উপন্যাস সমগ্র, পৃ-২৯৭

১৬. তদেব, পৃ-২৯৮

১৭. তদেব, পৃ-২৯৮

১৮. তদেব, পৃ-২৯৮

১৯. তদেব, পৃ-৩২৬

২০. তদেব, পৃ-৩৪২

২১. তদেব, পৃ-৭৬৬

২২.  তদেব, পৃ-৭৬০-৭৬১

২৩. তদেব, পৃ-৭৭৯

২৪. তদেব, পৃ-৭৮৬

২৫. তদেব, পৃ-৭৮৬

২৬. তদেব, পৃ-৮১৭

২৭.  তদেব, পৃ-৮১৭-৮১৮

২৮. তদেব, পৃ-৮১৯

২৯. তদেব, পৃ-৮২১

৩০.  শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-৬৬-৬৭

৩১.  বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম উপন্যাস সমগ্র, পৃ-৮৪৬

৩২. ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হরিদাসের গুপ্তকথা, পৃ-২

৩৩. তদেব, পৃ-৩

৩৪. তদেব, পৃ-৫

৩৫.  স্বপন বসু, সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ (২য় খণ্ড), পৃ-৫৯৯-৬০০

৩৬. ভুবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হরিদাসের গুপ্তকথা, পৃ-৬

৩৭. তদেব, পৃ-৭

৩৮. তদেব, পৃ-১৫

৩৯.  তদেব, পৃ. ৩৮৬

৪০. মৌ ভট্টাচার্য, বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ, পৃ-৪৭

৪১. তদেব, পৃ-১২৭

৪২. তদেব, পৃ-১২৯

৪৩. তদেব, পৃ-১৩২-১৩৩

৪৪. তদেব, পৃ-১৩৩

৪৫. তদেব, পৃ-১৩৩

৪৬. কুমারী শ্রীমতি মানদা দেবী, শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত, পৃ-৪৩

৪৭. মৌ ভট্টাচার্য, বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ, পৃ-১৩৭-১৩৮

৪৮. তদেব, পৃ-১৩৪

৪৯. তদেব, পৃ-১৩৫

৫০.  ড. দেবীপদ ভট্টাচার্য সম্পাদিত, গিরিশ রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-১৩০

৫১. তদেব, পৃ-১৪৬

৫২. তদেব, পৃ-১৪৭

৫৩.  স্বপন বসু, সংবাদ-সাময়িকপত্রে উনিশ শতকের বাঙালী সমাজ (২য় খণ্ড), পৃ-৬০৮

৫৪.  দুর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, পৃ-২৭

৫৫. তদেব, পৃ-২৯

৫৬. তদেব, পৃ-৩৯

৫৭. তদেব, পৃ-৫৫

৫৮. তদেব, পৃ-৫৭

৫৯. তদেব, পৃ-৬৯

৬০. তদেব, পৃ-৬৯

৬১. তদেব, পৃ-৭২

৬২. তদেব, পৃ-৯৯

৬৩. তদেব, পৃ-১০৪

৬৪. তদেব, পৃ-১৯৭

৬৫. তদেব, পৃ-২৫৭

৬৬. তদেব, পৃ-২৫৭-২৫৮

৬৭. তদেব, পৃ-২৯৮

৬৮. তদেব, পৃ-৩৪৯

৬৯. তদেব, পৃ-৩৫২

৭০. তদেব, পৃ-৩৫৩

৭১.  তদেব, পৃ-৩৬৬

৭২. পাঁচকড়ি দে রচনাবলী (১ম খণ্ড), পৃ-৬৬

৭৩. তদেব, পৃ-৬৬

৭৪. কুমারী শ্রীমতি মানদা দেবী, শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত, পৃ-৩৭

 ৭৫.  সুকুমার সেন (সম্পাদিত), শরৎ সাহিত্য সমগ্র, পৃ-১৯৩৮

 ৭৬. তদেব, পৃ-১৯৩৮

 ৭৭. শরৎ রচনা সমগ্র, পৃ-৩০৬

 ৭৮. তদেব, পৃ-৩০৯

 ৭৯. তদেব, পৃ-৩১২

 ৮০. তদেব, পৃ-৩১৯

 ৮১. তদেব, পৃ-৩১৯

 ৮২. তদেব, পৃ-৩৪২

 ৮৩. তদেব, পৃ-৩৬০

 ৮৪. তদেব, পৃ-৩৭৯

 ৮৫. তদেব, পৃ-৩৭৯

 ৮৬. তদেব, পৃ-৩৮০

 ৮৭. তদেব, পৃ-৩৮০

 ৮৮. তদেব, পৃ-৩৮১

 ৮৯. তদেব, পৃ-৩৮১

 ৯০. তদেব, পৃ-৪৩৮

 ৯১. তদেব, পৃ-৪৩২

 ৯২. তদেব, পৃ-৪৩২

 ৯৩. তদেব, পৃ-২৯৪

 ৯৪. তদেব, পৃ-৪২৫-৪২৬

 ৯৫. সেন, সুকুমার (সম্পাদিত), শরৎ সাহিত্য সমগ্র, পৃ. ৫৫৫

 ৯৬. তদেব, পৃ-৫৫৫

 ৯৭. তদেব, পৃ-৫৬৪

 ৯৮. তদেব, পৃ-৫৬৪

 ৯৯. তদেব, পৃ-৩৮

১০০. তদেব, পৃ-৪৭

১০১. তদেব, পৃ-৪৭

১০২. তদেব, পৃ-৪৭

১০৩. তদেব, পৃ-৩৯

১০৪. তদেব, পৃ-৫৬

১০৫. তদেব, পৃ-৬৫

১০৬. তদেব, পৃ-১১৫

১০৭. তদেব, পৃ-১১৬

১০৮. তদেব, পৃ-১১৭

১০৯. তদেব, পৃ-১১৮-১১৯

১১০. তদেব, পৃ-১১৯

১১১. তদেব, পৃ-১২০-১২১

১১২. তদেব, পৃ-১২২

১১৩. তদেব, পৃ-১২৭

১১৪. তদেব, পৃ-২৫৪

১১৫. তদেব, পৃ-২১৭

১১৬. তদেব, পৃ-২১৬

১১৭. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুভদা, পৃ-১৪৮৮

১১৮. তদেব, পৃ-১৪৮৮

১১৯. তদেব, পৃ-১৪৯৫

১২০. তদেব, পৃ-১৫৪৩

১২১.  অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় (সম্পাদিত), রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী, পৃ-৩১২

১২২. তদেব, পৃ-৩১১

১২৩. তদেব, পৃ-৭৬

১২৪. জগদীশ গুপ্ত, লঘুগুরু ও অসাধু সিদ্ধার্থ, পৃ-১৭

১২৫. তদেব, পৃ-১২২

১২৬. তদেব, পৃ-১৭

১২৭. তদেব, পৃ-১৭

১২৮. তদেব, পৃ-২০

১২৯. তদেব, পৃ-১৯

১৩০. তদেব, পৃ-২০

১৩১.  তদেব, পৃ. ২০

১৩২.  তদেব, পৃ. ২০

১৩৩. তদেব, পৃ.২৯

১৩৪. তদেব, পৃ. ২৮

১৩৫. তদেব, পৃ. ২৯

১৩৬. তদেব, পৃ. ৩০

১৩৭. তদেব, পৃ. ৩৩

১৩৮. ক্ষেত্র গুপ্ত, বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস (৪র্থ খণ্ড), পৃ-২৮২

১৩৯. তদেব, পৃ. ৬৪

১৪০.  তদেব, পৃ. ৬০

১৪১. তদেব, পৃ. ৬৯

১৪২.  তদেব, পৃ. ৬৯

১৪৩. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৫১০

১৪৪. তদেব, পৃ-৬১২

১৪৫. তদেব, পৃ-৮৪৭

১৪৬. তদেব, পৃ-৮৪৭

১৪৭. তদেব, পৃ-৮৮১

১৪৮. তদেব, পৃ-৪৭৬

১৪৯. তদেব, পৃ-৪৫৮

১৫০. তদেব, পৃ-৪৭৬

১৫১. তদেব, পৃ-৪৮২

১৫২. তদেব, পৃ-৪৮৪

১৫৩. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রচনাবলী (৩য় খণ্ড), পৃ-২৩১

১৫৪. তদেব, পৃ-২৩২

১৫৫. তদেব, পৃ-২৩৫

১৫৬. তদেব, পৃ-২৩৮

১৫৭. তদেব, পৃ-২৪২

১৫৮. তদেব, পৃ-২৪২

১৫৯. তদেব, পৃ-২৪২

১৬০. তদেব, পৃ-২৩৭

১৬১. তদেব, পৃ-২৬৯

১৬২. তদেব, পৃ-২৬৯

১৬৩. তদেব, পৃ-২৯৩

১৬৪.  তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি, পৃ-১৪৫

১৬৫. তদেব, পৃ-১৩১

১৬৬. তদেব, পৃ-১৪৩

১৬৭. তদেব, পৃ-১৪৭-১৪৮

১৬৮. তদেব, পৃ-১৪৯

১৬৯.  তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৪১

১৭০. তদেব, পৃ-৪১

১৭১. তদেব, পৃ-৩৬

১৭২. তদেব, পৃ-৩৯

১৭৩. তদেব, পৃ-২০৬

১৭৪. তদেব, পৃ-২১০-২১১

১৭৫. তদেব, পৃ-১২১

১৭৬. তদেব, পৃ-১৩৫

১৭৭. তদেব, পৃ-২৩৫

১৭৮. তদেব, পৃ-২৩৬

১৭৯. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রচনাবলী (৪র্থ খণ্ড), পৃ-৩২

১৮০. তদেব, পৃ-১২৬

১৮১. তদেব, পৃ-১২৬

১৮২. তদেব, পৃ-১২৬

১৮৩. তদেব, পৃ-১৩৪

১৮৪. তদেব, পৃ-১৩৪

১৮৫. তদেব, পৃ-১৩৭

১৮৬. তদেব, পৃ-১৯৩

১৮৭. তদেব, পৃ-২০২

১৮৮. তদেব, পৃ-২১৪

১৮৯. তদেব, পৃ-২৪৫

১৯০. তদেব, পৃ-২৪৫

১৯১. তদেব, পৃ-২৪৫

১৯২. তদেব, পৃ-২৫৩

১৯৩.  শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, পৃ-৩০৩

১৯৪.  বনফুল রচনা সমগ্র (৫ম খণ্ড), পৃ-১১৯

১৯৫. তদেব, পৃ-১২০

১৯৬. তদেব, পৃ-১২০

১৯৭. তদেব, পৃ-১৪০

১৯৮. তদেব, পৃ-১৩৮

১৯৯. তদেব, পৃ-২৮৫

২০০. তদেব, পৃ-২৮৩

২০১. তদেব, পৃ-২৮৫

২০২. তদেব, পৃ-২৮৫

২০৩. তদেব, পৃ-৩০২

২০৪. তদেব, পৃ-৩০৩

২০৫. তদেব, পৃ-৩২১

২০৬. তদেব, পৃ-৩২৬

২০৭.  বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৭৮

২০৮. তদেব, পৃ-১৭৯

২০৯. তদেব, পৃ-১৯৩

২১০. তদেব, পৃ-১৯৩

২১১. তদেব, পৃ-১৯৪

২১২.  তদেব, পৃ-১৯৪

২১৩. তদেব, পৃ-২১২

২১৪. তদেব, পৃ-১৯৩

২১৫. তদেব, পৃ-২৩৬

২১৬. তদেব, পৃ-৩২৯

২১৭. তদেব, পৃ-২২৬

২১৮.  মানিক উপন্যাস সমগ্র (১ম খণ্ড), পৃ-৭৬১

২১৯. তদেব, পৃ-৭৭৪

২২০.  শাশ্বতী গাঙ্গুলী, সঞ্জয় ভট্টাচার্য : একটি পরিক্রমা, পৃ-১৭৯

৭. বাংলা উপন্যাসে গণিকা নারীদের ভাষাবৈচিত্র্য

বাংলা উপন্যাসে গণিকা নারীদের ভাষাবৈচিত্র্য

ভাষা মানুষের জন্মসূত্রে পাওয়া৷ সাধারণত মানুষের উচ্চারিত, অর্থবহ বহুজনবোধ্য ধ্বনিসমষ্টিকে ভাষা বলে৷ এর মধ্য দিয়ে সুস্পষ্টভাবে ভাবের আদান-প্রদান ঘটে৷ আর এই ভাষার মূল কথাই হল বৈচিত্র্য৷ একভাষী ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণীর মধ্যে, বিভিন্ন ধর্মীয় মতাবলম্বী ভাষীর মধ্যে বিভিন্ন জাত বা বর্ণের মধ্যে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে ভাষার যে ভেদ পরিলক্ষিত হয় তাই ভাষা বৈচিত্র্যের সৃষ্টি করে৷ নানা কারণে ভাষায় বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়৷ যেমন—রীতির পার্থক্যের জন্য ভাষায় ভেদ দেখা দেয়, অঞ্চলভেদে ভাষা হয় ভিন্ন; সামাজিক শ্রেণীভেদে, নৃগোষ্ঠী, ধর্ম, জাত-পাত, লিঙ্গ, বয়স ইত্যাদির নানা ভেদে ভাষায় রূপভেদ হয়৷ যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন সাহিত্যরূপের মধ্যেও এই রূপভেদ সুস্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হতে দেখা যায়৷

সাহিত্যের অন্যান্য প্রকরণের মতোই বাংলা উপন্যাসও বাকপ্রতিমা—অর্থাৎ ভাষার সুষম সমন্বয়েই তার অবয়ব গঠিত৷ এর ভাষার মাধ্যম গদ্যরীতি; ঊনবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে যা ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে বিষয় ও সময়ের যথার্থ অনুসারী হয়ে উঠেছে৷ উপন্যাস জীবনের কথা বলে—যে জীবন মানুষের বিচিত্র কর্মকাণ্ডে, বিচিত্র অনুভবের ব্যঞ্জনায় ব্যঞ্জিত৷ আর সে কারণেই উপন্যাসের ভাষাও জীবনের বিচিত্র রূপের প্রয়োজনে সর্বার্থসাধক হয়ে ওঠে৷ তাই বাংলা উপন্যাসের জগতে বিশেষ তাৎপর্য বহন করেছে চরিত্রগুলির ভাষা৷ বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ঔপন্যাসিকেরা যে পরিবেশে, যে প্রেক্ষাপটে, যে ধরনের চরিত্র সৃষ্টি করেছেন তাদের মুখে আরোপ করেছেন ঠিক সেই পরিবেশ উপযোগী ভাষা৷ নানা শ্রেণীর চরিত্রের ভিড় পরিলক্ষিত হয় উপন্যাসের কায়া মধ্যে৷ উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, ধনী, গরিব, চোর, লম্পট বেশ্যা, সতী-সাধ্বী, স্বৈরিণী আরও কত শ্রেণী৷ তন্মধ্যে গণিকা চরিত্রগুলি তাদের কথায়-বার্তায়, হাব-ভাব-কটাক্ষে ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আসে উপন্যাসের ভাষার অঙ্গনে৷ সামাজিক অবস্থানগত দিক থেকে এই চরিত্ররা ঘৃণ্য-পতিত৷ শিক্ষা-সংস্কারবিবর্জিত এই শ্রেণীর নারীরা দেহ-ব্যবসার যন্ত্রণাময় পেশাকে অবলম্বন করে বসবাস করে সমাজের প্রান্তসীমায়৷ নানা শ্রেণীর ইতর-ভদ্র-লম্পট, চোর, বদমাশ, গুণ্ডাগোত্রীয় মানুষেরা হয় এদের দেহের খদ্দের৷ ফলে তাদের বাকভঙ্গিতেও এই শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে সংযোগকারী ইতর-অশ্লীল-স্ল্যাং ভাষার প্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে৷ যৌনতা, অশ্লীলতা, নানা ধরনের গালিগালাজবাচক শব্দ এবং পুরুষের কামনা উদ্রেককারী নানারকম বাকভঙ্গি গণিকা সমাজের মুখের ভাষার ক্ষেত্রে নতুন বৈচিত্র্য নিয়ে আসে৷

কিন্তু সমাজে গণিকারা যে ধরনের বাকভঙ্গিই অবলম্বন করুক না কেন সাহিত্য বিশেষ করে বিশ শতকের পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত উপন্যাসে হুবুহু সেই ধরনের চরিত্রপোযোগী ভাষার বাস্তব প্রয়োগ ঘটানো সেই সময়কার ঔপন্যাসিকদের পক্ষে সম্ভব হয়নি৷ নীতিবাগীশ পাঠকের রক্ত চক্ষুর ভয়ে সেই সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই চরিত্রমুখে মার্জিত বাকরীতিই স্থান পেত৷ আর গণিকারা যেহেতু নারী শ্রেণীর প্রতিনিধি তাদের ভাষা বৈশিষ্ট্যে মেয়েলি সুরটিকেই আরোপ করেছেন তাদের সৃষ্টি কর্তারা৷ তারপরেও গণিকাদের ভাষার স্বতন্ত্রতা কিন্তু একেবারে চাপা পড়েনি৷ সেই মার্জিত ভাষার ভিতর থেকেও তাদের নিজস্ব ভাষা বৈশিষ্ট্যকে সহজেই অনুমান করা যায়৷

উপন্যাসের এই বারবনিতারা নিজস্ব ভাষাভঙ্গিমায় তাদের নিজেদের চিনিয়ে দেওয়ার জন্য কখনো অশ্লীল ইতর শব্দের প্রয়োগ করেছে, কখনো খদ্দের ধরার জন্য প্রয়োগ করেছে তাদের নিজস্ব হাব-ভাব ও বাকরীতি৷ কখনো বা বিগত যৌবনের আক্ষেপপূর্ণ অভিমান জানিয়ে প্রেম প্রত্যাশা করেছে প্রেমিকের কাছে আবার কখনো মৃত্যুর কথা তুলে খদ্দের বা প্রেমিককে বশে রাখার চেষ্টা করেছে৷ তাদের প্রণয় সম্ভাষণও সাধারণ প্রেমের থেকে স্বতন্ত্র এবং তা অবশ্যই ব্যবসায়িক৷ কখনো তাদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে নিজেদের বৃত্তির জন্য স্পর্ধিত গর্ববাণী আবার কখনো সেই দেহ বেচা-কেনাই তাদের জীবনে গুরুভার হয়ে চরম যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট করেছে তাদের, যা চরম হতাশাব্যঞ্জক হয়ে প্রকাশ পেয়েছে৷ এছাড়া গণিকাদের বিভিন্ন কায়দা কানুন, মেয়েলি বাক্যরীতি-ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, শাপ-শাপান্ত, প্রবাদ-প্রবচন ইত্যাদির মধ্য দিয়েও তাদের ভাষা আলাদা ব্যঞ্জনা লাভ করেছে৷

গণিকাদের বাচনভঙ্গি সামাজিক ও অর্থনৈতিক মানের উপর অনেকটা নির্ভরশীল৷ একজন পতিতার বাচনভঙ্গি নির্ভর করে সমাজের কোন স্তরে সে অবস্থান করছে; এমন কি তাদের আচার-ব্যবহার এবং বাকরীতি বহুলাংশেই নির্ভর করে তাদের পুরুষ অতিথি-অভ্যাগতদের শ্রেণী সংস্কৃতির উপর৷ সামাজিক মানের ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভাষারও পরিবর্তন হয়৷ তাদের ভাষায় ধ্বনিবৈষম্য নির্ভর করে জন্মস্থানের ভাষা, শিক্ষা, সামাজিক অবস্থা ইত্যাদি বহু কিছুর উপর৷

গণিকাদের ভাষায় বহুল পরিমানে ইতর বা অশ্লীল শব্দের ব্যবহার রয়েছে৷ তাদের বহু খদ্দেরই অপরাধ জগতের সঙ্গে যুক্ত৷ যদিও গণিকারা অপরাধী নয় তথাপি অপরাধ জগতের সঙ্গে পরোক্ষ যোগাযোগ থাকাটাও বিচিত্র নয় তাদের ক্ষেত্রে৷ অনেক সময় দেখা যায় অপরাধের অকুস্থলে রয়েছে এই শ্রেণীর নারীদের কেউ৷ এছাড়া কোনো অপরাধী কোনো অপরাধ কার্য সম্পন্ন করে আশ্রয় নিতে পারে তাদের ঘরে৷ যেখানে নেশা ভাঙ করে স্ত্রীলোকের সংস্পর্শে মানসিক যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেতে চায়৷ ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’য় হরিদাসের জবানিতে এমন দৃশ্যেরই বর্ণনা রয়েছে৷ খুনি জয়হরি বড়াল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা একে একে গ্রেপ্তার হয়েছে বিভিন্ন বেশ্যালয় থেকে৷ যেমন কৃষ্ণনগরের এক বেশ্যালয় থেকে ধরা পড়ে ঘনশ্যাম বিশ্বাস৷ অন্য আরেক বেশ্যাপল্লী থেকে জয়হরি৷ সমাজের এই বাস্তবদিকগুলিই সাহিত্যে স্থায়ীরূপ পায়৷ অর্থাৎ গণিকাদের সঙ্গে অপরাধ জগত বা সেই জগতের ভাষাও বিশেষভাবে সম্পৃক্ত বলা যেতে পারে৷

বাররামারা যে ইতর বা অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করে তার পিছনে নানা সামাজিক কারণের সন্ধান করেছেন ভাষাতাত্ত্বিকেরা৷ তার আগে বুঝে নেওয়া প্রয়োজন ইতরশব্দ বা অশ্লীল শব্দ কি? ইতর বা অশ্লীল শব্দ সমাজ ভাষাবিজ্ঞানের আলোচ্য বিষয়৷ ইংরেজিতে যাকে Slang বলে তার সাধারণত দুটি অর্থ৷ প্রথমটি সমাজে বিশেষ কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত অমান্য বা অশিষ্ট ভাষা৷ যেমন ড্রাইভার, মাঝিমাল্লা, রাজমিস্ত্রী, পতিতা, রিক্সাওয়ালা ইত্যাদির গোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ শব্দ ব্যবহৃত হয় সেগুলিও একধরনের স্ল্যাং৷ এই স্ল্যাং অমান্য হলেও ততটা অশ্লীল নয়৷ এগুলিকে অশিষ্ট পেশাগত বুলি’ও বলা হয়৷ দ্বিতীয়টি পথে-ঘাটে আড্ডায় যে অশিষ্ট বা অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করা হয় তাকেও স্ল্যাং বলা হয়৷ ইংরেজি ‘Slang’ শব্দটিকে বাংলায় কি বলা হবে তা নিয়ে নানা ভাষাবিদ নানা কথা বলেছেন৷ সুকুমার সেন বলেছেন ‘ইতর শব্দ’, পবিত্র সরকার বলেছেন ‘অপভাষা’, ‘অপশব্দ’, কুমারেশ ঘোষ বলেছেন ‘জনবুলি’, সুভাষ ভট্টাচার্য বলেছেন ‘অশিষ্ট পেশাগত বুলি’ এবং ‘অশিষ্ট বুলি’৷ আবার সত্রাজিৎ গোস্বামী একে বলেছেন ‘অকথ্যভাষা’৷ ‘‘প্রকৃতপক্ষে স্ল্যাং হল কথ্যবাকরীতির (Colloquialism) অব্যবহিত নীচের বাকরীতি৷ বিভিন্ন পেশাগত বা সামাজিক গোষ্ঠীর ভাষা যখন গোষ্ঠীর সীমা অতিক্রম করে ব্যাপকতর গ্রাহ্যতা লাভ করে অথচ কথ্যভাষায় ব্যবহৃত হবার উপযুক্ত শিষ্টতা অর্জন করে না, তখন তা স্ল্যাং হিসেবে গণ্য হতে পারে৷’’ সুকুমার সেন স্ল্যাং এর বাংলা প্রতিশব্দ ‘ইতর শব্দ’-এর সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন—‘‘যে শব্দ বা পদ ভদ্রলোকের কথ্যভাষায় ও লেখ্য ভাষায় প্রয়োগ হয় না এবং যাহার উৎপত্তি কোন ব্যক্তিবিশেষের অথবা দলবিশেষের হীন ব্যবহার হইতে তাহাই ইতর শব্দ (Slang)৷’’ ইতর শব্দ কালক্রমে ভদ্রভাষায় স্থান পেতে পারে আবার বিলুপ্ত হতে পারে৷

এই ইতর শব্দের ব্যবহার মানুষ করে অনেকটা সচেতনভাবেই এবং এর পেছনে কাজ করে সামাজিক প্রথা বা সমাজ-সংস্কারের বিরুদ্ধে এক প্রকার বিরোধী মনোভাব৷ যেখানে মনের আবেগ, ক্রোধ, যন্ত্রণাকে আরও বেশি জ্বালাময় করে প্রকাশ করা যায়৷ ইতর শব্দের কিছু কিছু লক্ষণ নির্ধারণ করা যায়৷ যেমন—

১. এটি মান্যভাষা বহির্ভূত৷

২. এই শব্দ অনাচারিক (Informal) পরিবেশে ব্যবহৃত হয়৷

৩. অশ্লীল বা অশালীন না হলেও তথাকথিত ভদ্র রুচি বিরোধী৷

৪. শব্দগুলি স্থায়ী নয়৷ কখনো তা লুপ্ত হতে পারে বা কখনো মান্য ভাষার সঙ্গে মিশে যেতে পারে৷

৫. নানারকম শব্দের (বিদেশী, মুণ্ডমাল, খণ্ডিত) সমবায়ে গঠিত হতে পারে এই শব্দ৷

বিভিন্ন কারণে গণিকারা এই ইতর শব্দের ব্যবহার করে থাকে৷ যেমন—

হইহুল্লোড় বা স্ফূর্তি গণিকালয়ের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার৷ আর এক্ষেত্রে ইতর শব্দ প্রয়োগ বেশ জমকালো হয়৷

কিছু কিছু ইতর শব্দ ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বারবনিতাদের স্বতন্ত্রতা বা নিজস্বতা ফুটে উঠে৷ যেমন—‘গণদেবতা’-য় পাতুর সঙ্গে কলহ প্রসঙ্গে দুর্গাকে নালিশ করে পাতুর মা যখন বলে—‘‘শুনলি দুগগা, বচন শুনলি ‘খালভরার’?’’ বাক্যমধ্যে এই ইতর শব্দ প্রয়োগ তাকে স্বতন্ত্রতা দান করে৷ আবার এই উপন্যাসেই দেবু দুর্গার খোঁজ করতে তাদের বাড়িতে উপস্থিত হলে দুর্গার মায়ের মুখে ইতর শব্দের ব্যবহার দেখা যায়৷ যেমন—‘‘সে নচ্ছারীর কথা আর বলো না বাবা!’’

‘জঙ্গম’ উপন্যাসে শঙ্করকে মুক্তো ঘরের মধ্যে শুইয়ে রেখে পাশের ঘরের জানালার ফুটো দিয়ে নির্নিমেষ নয়নে তাকে দেখতে থাকলে টিয়া তার খোঁপায় টান মেরে খোঁপা খুলে দেয়৷ মুক্তো পুনরায় তা বেঁধে দিতে বললে টিয়া বলে—‘‘এমনিতেই গলে পড়েছে, কিছু করতে হবে না, যা৷’’ এই ‘গলে পড়া’ শব্দটি বিশেষ গভীর অনুরাগের প্রকাশক ইতর শব্দবিশেষ৷

আঙ্গুরের ঘরে বড়লোক বাবু বন্ধু সমভিব্যাহারে এলে নাচের মজলিশ বসে৷ সেই নাচের মজলিশে অন্ধকার বারান্দার কোণে বসে কালোজামের সহায়তায় শঙ্কর আড়াল থেকে দেখতে থাকে মুক্তোদের নাচ৷ বাবুদের মনোরঞ্জনের জন্য প্রয়োজন হয়েছে দশ-বারোজন নর্তকীর৷ শঙ্কর কিছুক্ষণ সেই দৃশ্য দেখার পর পুনরায় কালোজাম তার সামনে উপস্থিত হয়৷ তাকে মুক্তোর ঘরে বসতে বলে কালোজাম বলে—‘‘আমি যাই, আমার লোক এসেছে৷’’

এই ‘লোক আসা’ শব্দটি গণিকাদের একান্তই নিজস্ব৷ ‘লোক’ শব্দটি ‘খদ্দের’ অর্থে ব্যবহৃত৷

বক্তব্যকে স্পষ্ট করতে বা চাঁচাছোলা ধরনের কথা বলার জন্য গণিকাদের ভাষা ব্যবহারে ইতর শব্দ বিশেষ মাত্রা গ্রহণ করে৷ যেমন—‘অসীম’-এ সরস্বতী বৈষ্ণবীর সঙ্গে অনিন্দ্যসুন্দরী মনিয়াকে দেখে নবীন নরসুন্দর বিস্ময়বিস্ফারিত নেত্রে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে সরস্বতী তার স্বভাবজ সুস্পষ্ট বাক্যভঙ্গিতে তাকে বিদ্ধ করে—‘‘আ মর মিনসে, মেয়েটাকে যেন হাঁ করিয়া গিলিতেছে,—একটু লজ্জাও করে না?’’ এখানে ‘মিনসে’, ‘হাঁ করিয়া গিলিতেছে’ ইত্যাদি ইতর শব্দ৷

দুর্গার প্রণয়ী দুর্গার ভাই পাতুকে অপমানিত করে নারীসঙ্গ উপভোগ করতে আবার তাদের গৃহেই যখন উপস্থিত হয় তখন শ্রীহরির তাদের বাড়ি আসা-যাওয়া সম্পর্কে পাতু বিরুদ্ধাচারণ করলে ‘গণদেবতা’-র স্বৈরিণী দুর্গার মুখে উচ্চারিত হয় তার পেশা সম্পর্কিত চাঁচাছোলা বক্তব্য—‘‘ঘর আমার, আমি নিজের রোজগারে করেছি, আমার খুশি যার উপর হবে—সে-ই আমার বাড়ি আসবে৷ তোর কি? তাতে তোর কি? তু আমাকে খেতে দিস, না দিবি? আপন পরিবারকে সামলাস তু৷’’

তারপর ছিরুপালের দ্বারা তাদের মুচি পাড়াটা ধূলিসাৎ হয়ে যায়৷ ঘরপুড়ে যাওয়ার দুঃখে এবং সমস্ত রাত্রি কষ্টভোগের ফলে স্বামীর শাসনের প্রতিবাদ করে পাতুর স্ত্রীর কন্ঠে ধ্বনিত হয় প্রতিবাদী স্বর৷—‘‘ক্যানে, ক্যানে আমার হাড় ভেঙে দিবে শুনি?… নিজের ছেনাল বোনকে কিছু বলবার ক্ষমতা নাই—’’ এখানে পাতুর বৌ-এর বক্তব্যও ভাষার মান্যদিককে অনুসরণ করেনি৷

বিভূতিভূষণের ‘অথৈ জল’-এ মাসির বাক্যপীড়নে অতিষ্ট ডাক্তার শশাঙ্ক মাসি সম্পর্কে আশঙ্কিত হলে পান্না তার পৌরুষকে বিদ্ধ করে ধমক দিয়ে বলে—‘‘আপনি না পুরুষমানুষ? ভয় কিসের৷ আমি আছি৷’’১০ এই স্বচ্ছ খোঁচার মধ্যেও গণিকার আত্মপ্রত্যয়ের দিকটি পরিস্ফুট৷

বেশ্যা ও খদ্দেরদের সম্পর্ককে স্পষ্ট করে বোঝাতে নানা ধরনের ইতর শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে উপন্যাসের গণিকাচরিত্রগুলির মুখে৷ এর মধ্য দিয়ে তাদের নিজস্ব স্বরূপ খদ্দেরকে জানিয়ে দিতে পারে অত্যন্ত সহজভাবে৷ যেমন—

ডাক্তার শশাঙ্ক খেমটাওয়ালি পান্নার মোহে আবিষ্ট হয়ে তার সঙ্গে তারই বাসাবাড়িতে উপস্থিত হলে তার বাড়িউলি মাসির মুখে উচ্চারিত হয় এমন বাকভঙ্গি যা গণিকা ও খদ্দেরের সম্পর্ককে সুস্পষ্টরূপে চিহ্নিত করে৷—‘‘একটা কথা বলি৷ স্পষ্ট কথার কষ্ট নেই৷ এ ঘরে তুমি থাকতে পারবে না৷ ওকে রোজগার করতে হবে, ব্যবসা চালাতে হবে৷ ওর এখানে লোক যায় আসে, তারা পয়সা দেয়৷ তুমি ঘরে থাকলে তারা আসবে না৷’’১১

পরে আবার তাকে একা পেয়ে মাসি বলে—‘‘পান্না তোমার ঘরের বৌ নাকি যে, যা বলবে তাই করতে হবে তাকে? ওর কেউ নেই? অত দরদ যদি থাকে পান্নার ওপর, তবে মাসে ষাট টাকা করে দিয়ে ওকে বাঁধা রাখো৷ ওর গহনা দেও, সব ভার নাও—তবে ত তোমার সঙ্গে যেখানে খুশি যাবে৷ ফেলো কড়ি মাখো তেল, তুমি কি আমার পর?’’১২

গণিকার সঙ্গে খদ্দেরের সম্পর্ক যে সম্পূর্ণ অর্থনৈতিক বা ব্যবসায়িক এবং সেখানে যে কোনো রকমের প্রথাবদ্ধতা নেই তাও মাসির এই বক্তব্য দ্বারা সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হয়েছে৷ পান্নার বাড়িউলি মাসি সেখানেই থেমে যায়নি৷ প্রবল বাক্যবাণে বিদ্ধ করে পান্নার সঙ্গ ছাড়াতে ডাক্তারকে বলেছে—‘‘তুমি বাপু কি রকম ভদ্দর নোক? বয়েস দেখে মনে হয় নিতান্ত তুমি কচি খোকাটি তো নও—এখানে এলেই পয়সা খরচ করতে হয় বলি জানো সে কথা? বলি এনেচ কত টাকা সঙ্গে করে? ফতুর হয়ে যাবে বলে দিচ্চি৷’’১৩

যেখানে অর্থ, যেখানে রোজগার সেখানেই গণিকাদের প্রেম—অর্থ-প্রতিপত্তি শেষ হয়ে গেলে তাদের প্রেমেও ভাঁটা পড়ে৷ বারবনিতাদের ভাষা ব্যবহারে এমন দিকেরই উদ্ঘাটন করেছেন দুর্গাচরণ রায় তাঁর ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ৷ দেবতারা বর্ধমানে এলে সেখানে দেখে গণিকা তোষণে সর্বস্বান্ত হওয়া এক বাবুর তারই রক্ষিতার দ্বারা অপদস্ত হওয়ার চিত্র৷ রক্ষিতা তার হৃতসর্বস্ব বাবুকে ইতর ভাষায় বলে—‘‘তোর আর আছে কি? নীলামে যথাসর্ব্বস্ব বিক্রী ক’রে নিয়েছি৷ তুই দূর হ’’১৪

প্রায় একই ধরনের বাক্যভঙ্গির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘শুভদা’-র কাত্যায়নীর মুখে—‘‘আমাদের যেখানে পেট ভরে সেইখানে ভালবাসা৷ এ কি তোমার ঘরের স্ত্রী যে গলায় ছুরি দিলেও ভালবাসতে হবে? তোমা ছাড়া কি আমার গতি নেই? যেখানে টাকা সেইখানে আমার যত্ন, সেইখানে আমার ভালবাসা৷ যাও, বাড়ি যাও—এত রাত্তিরে বিরক্ত ক’রো না৷’’১৫

 ‘জঙ্গম’ উপন্যাসে পান্নার কথাতেও প্রথাবদ্ধহীন সম্পর্কের বাইরে ব্যবসায়িক সম্পর্কের একটা দিক ফুটে উঠেছে তাদের নিজস্ব ভাষাভঙ্গিমায়৷ শঙ্কর মুক্তোর পতিতাপল্লীর নির্দিষ্ট কক্ষে বসে যখন জানতে চায় যে সে তার কোনো অসুবিধা করছে কি না তখন অনায়াসে মুক্তো তাকে জানায়—‘‘কিছুমাত্র না৷ ঘন্টা পিছু দু-টাকা করে লাগবে, এই আমার রেট৷’’১৬ মুক্তোর এই রেট তার শরীর বিক্রির নির্ধারিত মূল্য৷ তবুও সে শঙ্করের কাছে পয়সা নিতে পারে না কারণ শঙ্কর তার কাছে খদ্দের নয় অতিথি৷ কিন্তু সে জানে একদিন না একদিন শঙ্করকে তার কাছে খদ্দের হতেই হবে কারণ তার মতে—‘‘রোজগার করতে বসেছি, দানছত্র তো খুলিনি৷’’১৭

অপমান, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ বা খোঁটা দিতে এমন বিশেষ শব্দ ব্যবহার দেখা যায় যা তাদের ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যকে সহজেই চিনিয়ে দেয়৷ যেমন—

বৈদ্যবাটীতে এক কালীমন্দিরের বাইরে দাঁড়িয়ে দেবগণ দেখেন একদল বেশ্যার হাতে এক যুবকের অপদস্ত হওয়ার চিত্র৷ সেখানে মস্তকহীন পাঁঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যুবককে দেখে তার কাছে পাঁঠার অর্ধেকাংশ দাবি করে দেহপসারিণীরা৷ যুবক তা দিতে অস্বীকৃত হলে তাদের মুখে উচ্চারিত অশিষ্ট ভাষা—‘‘দূর গুয়োটা, একটা পাঁটা দিতে পারলিনি?’’১৮

শ্রীরামপুরে বামী নাম্নী রক্ষিতা তার পোষক বাবুকে তিরস্কার করে বলে—‘‘পোড়ারমুখো! কাল রাত্রে ছিলি কোথায়? আমি তোর জন্যে রুটি আর বেগুনভাজা ভেজে এক বোতল মদ এনে সমস্ত রাত্রি ব’সে ব’সে কাটিয়েছি৷’’১৯ বারাঙ্গনা কথিত এই বাক্যবন্ধ শিষ্টভাষার সীমাকে লঙ্ঘন করেছে৷

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘করুণা’ উপন্যাসে গোবিন্দগুপ্ত মহারাজাধিরাজ কুমারগুপ্তের গণিকাকন্যার পাণিগ্রহণ পণ্ড করে দিতে নগরনটী ইন্দ্রলেখার বাসভবনে উপস্থিত হলে ইন্দ্রলেখা তাকে চরম অপমান করে ইতর ভাষায় বলে—‘‘তুই কে? কোন সাহসে, বিনা অনুমতিতে আমার গৃহে প্রবেশ করিয়াছিস? জানিস, এখনই তোকে কুকুর দিয়া খাওয়াইতে পারি?’’২০

ইন্দ্রলেখা তার সখি মদনিকা পরবর্তীকালে কন্যার দৌলতে আর্যপট্টের শাসনকর্ত্রী হয়ে বসে৷ সেই সুযোগের সৎব্যবহার তারা করতে থাকে নিজেদের বিচিত্র খেয়াল-খুশি চরিতার্থ করে৷ সুরাসক্ত মদনিকা রাজপথ অবরুদ্ধ করে পুরনো পানওয়ালা বন্ধুর সঙ্গে রহস্যালাপে রত হলে সেই পথরুদ্ধ করা নিয়ে মহানায়ক গুল্মাধিকৃত দেবধরের সঙ্গে বচসা বাঁধে৷ সেখানে মদনিকার ইতর বাক্য ব্যবহার তার রুচিবোধহীন মন মানসিকতাকে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে—‘‘তুই কি মনে ভাবিয়াছিস? তোর কি প্রাণের ভয় নাই? জানিস তোকে কুক্কুর দিয়া খাওয়াইতে পারি?’’২১ দেবধর তাকে গণিকা সম্বোধন করে সাবধান হতে বললে সে আরও উগ্রস্বরে জবাব দেয়—‘‘তোর মাতা বেশ্যা, পিতামহী বেশ্যা, প্রপিতামহী বেশ্যা৷’’২২ বারবনিতা ইন্দ্রলেখার সখি মদনিকাও একজন পণ্যাঙ্গনা৷ তাদের মুখের কথায় বেশ্যাসুলভ ভঙ্গিটিই প্রবল৷

সঙ্ঘস্থবির হরিবল ইন্দ্রলেখার সঙ্গে রসবাক্য জুড়ে দিলে সেই নগরনটীর কন্ঠে ধ্বনিত হয় গণিকাসুলভ প্রশ্রয় তিরস্কার—‘‘মরণ আর কি, বুড়ার রকম দেখ! বলি যম তোমায় ভুলিয়াছে কেন?’’২৩

শরৎচন্দ্রের ‘শুভদা’-য় দেহজীবী কাত্যায়নী হারাণচন্দ্রকে খোঁটা দিয়ে বলে—‘‘যখন রেখেছিলে তখন টাকা দিয়েছিলে, তা বলে তোমার দুঃসময়ে কি সে সব ফিরিয়ে দেব?’’২৪ হারাণচন্দ্র তাকে ভালোবাসার কথা শোনালে তেলেবগুনে জ্বলে উঠে সে তাকে অপমান করতে বলে—‘‘ছাই ভালবাসা৷ মুখে আগুন অমন ভালবাসার৷ আজ তিনমাস থেকে একটি পয়সা দিয়েচ কি যে ভালোবাসব?’’২৫

‘অথৈ জল’-এ পান্নার বাড়িউলি মাসি ডাক্তারকে পান্নার পিছনে টাকা না দিয়ে ঘোরার জন্য খোঁচা দিয়ে বলে—‘‘তুমি বাপু কি রকম ভদ্দর নোক?’’২৬ তারপর তাকে সাবধান করে দিতে তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বলে—‘‘শহুরে বাবুদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে টাকা খরচ করতে গিয়ে একেবারে ফতুর হয়ে যাবে, এখনো ভালয় ভালয় বাড়ি চলে যাও—৷’’২৭ ‘ভদ্দর নোক’, ‘টেক্কা’, ‘ফতুর’ শব্দগুলি এই বারনারীদের মুখে সহজেই মানিয়ে যায়৷

পান্নার সারল্য ও ভালোবাসায় এবং রোজগারে শশাঙ্ক নির্বিঘ্নে জীবন কাটাতে থাকলে তাকে ব্যঙ্গ করে পান্নার খেমটাদলের সঙ্গী নীলিমা বলেছে—‘‘পান্নাকে গেঁথেচেন ভাল মাছ’’২৮—অর্থাৎ সুন্দরী তন্বী মোহময়ী পান্না নিজের লাস্যভঙ্গি দিয়ে খেমটাদলের প্রধান অবলম্বন হয়ে উঠেছিল৷ তার উপার্জনও প্রচুর৷ সে সরল মনে ভালোবাসার স্রোতে ভেসে মধ্যবয়সি ডাক্তারের ভরণপোষণ চালিয়ে যাচ্ছে উল্টো কিছু প্রত্যাশা না করে৷ আর এই উদ্দেশ্যেই নীলিমার ব্যঙ্গোক্তি৷

পুত্রবধুর দেহবিক্রির টাকার অংশ না পেয়ে দুর্গার মা যখন তা নিয়ে মেয়ের কাছে আক্ষেপ করে তখন দুর্গা শরীর বিক্রির পয়সা তাকে ছুঁতে নিষেধ করলে তার মায়ের কন্ঠে ধ্বনিত হয় চরম ব্যঙ্গোক্তি—‘‘ওলো সীতের বেটি সাবিত্তিরি আমার৷’’২৯ মায়ের এই ব্যঙ্গের লক্ষ্য দুর্গা৷ সে নিজেও দেহজীবী এবং দেহজীবী হয়েও অন্যের দেহজীবিকার অর্থ স্পর্শ করতে কুন্ঠা প্রকাশ করলে তার মা উক্ত মন্তব্যটি করে৷

বারাঙ্গনা মুক্তোর সহবাসী টিয়া শঙ্করের প্রেম নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করলে মুক্তো মুচকি হেসে তার জবাব দেয়—‘‘সবাই তো আর তোর মালবাবু নয়৷’’৩০ এই উক্তির মধ্যে প্রচ্ছন্ন আছে ব্যঙ্গরস৷ মালবাবু অর্থাৎ যে প্রভূত সম্পদের অধিকারী এবং রক্ষিতাকেও প্রচুর অর্থ দেয়৷ মুক্তো এই ক্ষুদ্র বাক্যের মধ্য দিয়ে গণিকার ভাষাগত স্বতন্ত্রতাকে যেমন ধরে রেখেছে তেমনি শঙ্কর ও মালবাবুর তুলনার দিকটিকেও প্রতিভাত করেছে৷

বিরক্তি, ক্ষোভ, ধিক্কার বা অসন্তোষ প্রকাশের মাধ্যমরূপেও গণিকারা বহুল ইতর শব্দের ব্যবহার করে৷ ‘অসীম’ উপন্যাসে মনিয়া কসবিবৃত্তি ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাসী জীবন শুরু করলে তার মা মেয়ের সেই মানসিক পরিবর্তনে ভীত হয়ে তাকে স্ববৃত্তিতে ফেরানোর জন্য জ্যোতিষীর দ্বারস্থ হয়৷ জ্যোতিষী মেয়ের কিছু হয় নি বলে আশ্বস্ত করে তাকে ঘরে ফিরে যেতে বললে চরম বিরক্তিতে মতিয়া তাকে বলে—‘‘আরে পাগল, ঘরেই যদি ফিরিয়া যাইবে, তবে তোর নিকট মরিতে আসিয়াছি কেন?’’৩১ আর এ বিষয়ে গণক যখন তাকে বলে যে তার কন্যা একজন হিন্দুর প্রেমে পড়ে সন্ন্যাস জীবন শুরু করেছে তখন সেই না দেখা হিন্দু ব্যক্তির প্রতি তার সমস্ত ক্ষোভ উগরে দিয়ে সে বলে—‘‘তোবা, তোবা! তাহার মুখে হাজার ঝাড়ু মারি৷’’৩২

অসীম এবং তার হিতার্থী দুর্গার ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে সরস্বতী তাদের নতুন ঠিকানায় উপস্থিত হলে তার মুখে ‘নাম’ (কীর্তন) শুনতে চায় দুর্গা৷ সরস্বতীর উদ্দেশ্য কীর্তন নয় গল্পগুজব করে ভেতরের সত্য উদ্ঘাটন৷ তাই দুর্গার সেই প্রস্তাবকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য চরম বিরক্তির সঙ্গে বলে ওঠে—‘‘রাধেকৃষ্ণ, রাধেকৃষ্ণ, এমন পোড়ার দেশে মানুষ আসে! একটা ঠাকুরবাড়ি নাই, আখড়া নাই, পোড়া কপাল দেশের! খেংরা মারি, খেংরা মারি৷’’৩৩

সংঘস্থবির হরিবল ইন্দ্রলেখাকে তার মঠে রাত্রিবাস করতে বললে ইন্দ্রলেখা তাকে মৃদু তিরস্কার করে বলেছে—‘‘মরণ আর কি, যৌবন ত অনেক দিন গিয়াছে, মহাবিহার-স্বামীর পাপকার্যে মতি এখনও যায় নাই?’’৩৪ এবং এ নিয়ে বাদানুবাদ দীর্ঘ হলে সেই বিগতযৌবনা বারনারীর কন্ঠে ধ্বনিত হয় ‘‘তুমি মর, তোমার মুখে আগুন৷’’৩৫—এই প্রণয়-তিরস্কার৷

শ্রীহরির সঙ্গে ‘ফষ্টিনষ্টি’ করার জন্য পাতু ও দুর্গার মধ্যে বিরোধ হলে শ্রীহরি পাতুকে নির্মম প্রহার করে৷ ভাইয়ের ক্ষতবিক্ষত শরীর দেখে দুর্গার হৃদয় দ্রবীভূত হলে তা পাতুর স্ত্রীর আর সহ্য হয় না৷ সে জানে দুর্গার জন্যই তার স্বামীর এই অবস্থা৷ তাই তার স্বভাবজ ভঙ্গিতে স্বৈরিণী সেই নারী মনের সমস্ত ক্ষোভ ও অসন্তোষকে উগরে দেয় ইতরভাষায়—‘‘হারামজাদী আবার ঢং করে ভাইয়ের দুঃখে ঘটা করে কানতে বসেছে গো! ওগো আমি কি করব গো!’’৩৬

মুচিপাড়া আগুনে ভস্মীভূত হয়ে গেলে সেখানে গরু-ছাগল ক্রয় করার জন্য নানা ধরনের পাইকারদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়৷ কারণ বিপর্যস্ত মানুষেরা পুনরায় গৃহনির্মাণের জন্য গবাদি পশু বিক্রি করতে বাধ্য হয়৷ দুর্গার বলদী বাছুরের জন্য হামদু শেখ বহুদিন থেকেই লালায়িত৷ সেই দুর্দিনে সে গোপনে তার মাকে চার আনা বকশিশ দিয়ে দুর্গাকে বাছুর বিক্রি করানোর ভার দেয়৷ সেই অনুসারে মা মেয়েকে বাছুর বিক্রি করে গৃহ নির্মাণ করার কথা বললে দুর্গা অস্বীকার করে৷ মা টাকার সংস্থান কীভাবে হবে জানতে চাইলে দুর্গা ইতর শব্দ প্রয়োগ করে বলে—‘‘তোর বাবা টাকা দেবে, বুঝলি হারামজাদী?’’৩৭

ছেলে এবং মেয়ের সঙ্গে ঝগড়া করে দুর্গার মা কাঁদতে বসলে দুর্গা রূঢ়স্বরে বলে—‘‘বলি, রান্নাবান্না করবি, না প্যান প্যান করে কাঁদবি? পিণ্ডি গিলতে হবে না?’’৩৮

‘পঞ্চগ্রাম’-এ দুর্গার খোঁজে আসা দেবুকে মেয়ের সম্পর্কে বিরক্তি প্রকাশ করে দুর্গার মা বলে—‘‘কাল আবার কামার মাগীর ঘরে শুতে যায় নি৷ উঠেই সেই ভাবী-সাবির লোকের বাড়ীই যেয়েছে৷’’৩৯

বনফুলের ‘বৈতরণীর তীরে’ উপন্যাসের বারবনিতা বিন্দি দেহজীবীকার মর্মপীড়া সহ্য করতে না পেরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল৷ কিন্তু মৃত্যুর পরেও তার শরীরলোভী পুরুষেরা তার পিছু ছাড়েনি৷ মৃত্যুলোকে উত্তীর্ণ হয়েও সে তখন তার দেহভোগকারী পুরুষের একজনকে দেখতে পায় তখন চরম বিরক্তির সঙ্গে বলে—‘‘এখানেও মুখপোড়ারা সঙ্গ ছাড়বে না—’’৪০ বিন্দি বা বিনোদিনী তার পুরুষ খদ্দেরদের বিশেষিত করছে ‘মুখপোড়া’ বিশেষণে৷

মাসির কথার খোঁচায় আহত হয়ে ‘অথৈ জল’-এর ডাক্তার পান্নাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলে পান্না ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে—‘‘কেন? কেন? ওই বুড়ীর কথায়! তুমি—’’৪১ পান্না রেগে গিয়ে মাসির পরিবর্তে ‘বুড়ী’ শব্দ ব্যবহার করছে৷ এক্ষেত্রে শব্দটি অ-শিষ্ট৷

‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ বেশ্যা ও মাতাল লম্পটদ্বয়ের কথোপকথনে উঠে এসেছে নানা ইতর শব্দ৷ তাদের ভালোবাসায় জ্বালায় অস্থির হয়ে বেশ্যা বলে—‘‘ওরে গুয়োটা! থাম তোদের জ্বালাতেই প্রেতশিলায় যাচ্চি৷’’৪২ এখানে বারবধূ তার প্রণয়ীকে সম্বোধন করছে ‘গুয়োটা’ বলে৷

গণিকাদের মুখে উচ্চারিত হয় বিভিন্ন গালিগালাজবাচক ইতর শব্দ৷ সাধারণ নারী চরিত্রের মুখে যে সংলাপ অশোভন বা বেমানান তা অনায়াসেই গণিকার মুখে আরোপ করা যায়৷ উনিশ-বিশ শতকের বহু উপন্যাসে গণিকাদের মুখে এধরনের শব্দ ব্যবহার দেখিয়েছেন রচনাকারেরা যা তাদের বিশেষভাবে বিশেষায়িত করেছে৷ ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ তাদের প্রেমিক খদ্দেরদের গালিগালাজ করেছে ‘গুয়োটা’, ‘মিন্সে’, ‘পোড়ারমুখো ইত্যাদি নানা বিশেষণে৷

সাধারণত গালিগালাজের ক্ষেত্রে উদ্দীষ্ট ব্যক্তিকে বিশেষায়িত করেই নানা শব্দ বাণ বর্ষিত হয় এবং তার বেশিরভাগই যে শিষ্টভাষা নয় তার সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই৷

রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘করুণা’ উপন্যাসে ব্যবহৃত হয়েছে নানা ইতর শব্দ, ঝগড়ার বা অপমান করার নানা ইতর ইঙ্গিত৷ যেমন—‘‘সম্মার্জনী (ঝাড়ু) নিয়ে তেড়ে যাওয়া, নিষ্ঠীবন (থুথু) ছিটানো ইত্যাদি৷ সেখানেও মুখপোড়া, কুকুর দিয়ে খাওয়ানো, গোবিন্দগুপ্তকে ‘বুড়া শেয়াল’ নামে বিশেষায়িত করা ইত্যাদি বহুল শব্দ রয়েছে৷

‘অসীম’ উপন্যাসে ভিখারিনির ছদ্মবেশী মনিয়া অসীমের উদ্দেশ্যে গুপ্ত সংকেত দিলেও যখন সে তা বুঝতে পারে না তখন তাকে বোঝানোর জন্য সে আশ্রয় নেয় গালিগালাজের৷ সে অসীমের উদ্দেশ্যে বলে—‘‘কাফের, হারামখোর, হারামজাদ, নিমকহারাম, আমি কি শূকর যে পথের ময়লা তুলিয়া খাইব? তুই হারাম তোর রুটীও হারাম, তুই নরকে গিয়া তোর হারাম খা৷’’৪৩

‘গণদেবতা’-য় গ্রামে আগুন লাগার পরদিন পাতু যখন গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তখন পাতুর মা ছেলে সেই সিদ্ধান্তে বিহ্বল হয়ে ছেলে উদ্দেশ্যে গালিগালাজ করে শাপ-শাপান্ত করতে থাকে—‘‘মরুক, মরুক ড্যাকরা—এই অঘ্রাণের শীতে সান্নিপাতিকে মরুক!’’৪৪ দুর্গার মায়ের এই বচনে উঠে এসেছে নানা অমান্য শব্দ৷

‘পঞ্চগ্রাম’-এ শ্রীহরির লাঠিয়াল কালু যৌন আবেদন নিয়ে দেহপোজীবিনী দুর্গার হাত ধরে টানলে দুর্গা তাকে সশব্দে চড় বসিয়ে দিয়ে তীক্ষ্ণকন্ঠে বলে—‘‘আমার হাত ধরে টানিস, বদমাস—পাজী!’’৪৫

গ্রামে বানের জল ঢোকা শুরু করলে সকলে যখন আপন-আপন জিনিসপত্র সামলাতে ব্যস্ত তখন দুর্গা পরম আলস্যে বুকের নীচে বালিশ দিয়ে জানালা দিয়ে বান দেখতে থাকে এবং কন্ঠে গুনগুন গানের কলি৷ তাতে তার মা রেগে গিয়ে গালি দিতে শুরু করে৷ মেয়েকে সাবধান করে সে বলে—‘‘যা-না তু দীঘির পাড়ে৷ মরণের ভয়েই গেলি হারামজাদী!’’৪৬

‘শুভদা’-য় হারাণচন্দ্র কাত্যায়নীর কাছে টাকা চাইলে রাগে-বিরক্তিতে সে বলে উঠে—‘‘মিছে ভ্যানভ্যান করচ কেন?’’৪৭

‘রামেশ্বরের অদৃষ্ট’-তে বহুদিন সাজা কাটিয়ে ফিরে আসা রামেশ্বর তার স্ত্রীর বয়সি এক বারাঙ্গনাকে দেখে স্ত্রী ভেবে ছেলের খোঁজ চাইলে গণিকা তার স্বভাবজ ভঙ্গিতে বলে—‘‘মরণ আর কি! তোমার দড়ি কলসী জোটে না?’’৪৮ তারপরও রামেশ্বর যখন বার বার ছেলের সন্ধান চাইতে থাকে তখন রাগে বিরক্তিতে অশিষ্ট বাক্য প্রয়োগ করে সেই বারবনিতা বলে—‘‘চুলায় পাঠাইয়াছি—নদীর ধারে তারে পুতিয়া আসিয়াছি—তাহার ওলাওঠা হইয়াছিল—সে গিয়াছে, এক্ষণে তুমি যাও৷’’৪৯

‘অথৈ জল’-এ এক জমিদারপুত্রের বেশ্যাসক্তির বাড়াবাড়ি স্বরূপ নববধূর গহনা খুলে এনে তার বিনিময়ে পান্নাকে রক্ষিতা করতে চাইলে তার প্রতি ঘৃণায় পান্নার মতো এক নিম্নশ্রেণীর বারাঙ্গনাও শিউড়ে উঠে৷ পরম ঘৃণায় তাকে ও তার দেওয়া অর্থকে অবজ্ঞা করে সে বলে—‘‘অমন টাকার মাথায় মারি সাত ঝাড়ু৷ একটা নতুন বৌ, ভাল মানুষের মেয়ে, তাকে ঠকিয়ে তার গা খালি করে টাকা রোজগার?’’৫০

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘শহরবাসের ইতিকথা’-য় গণিকা চাঁপা শ্রীপতিকে তার ঘরে একা দেখে রাগে ফুলে উঠে৷ সে ঝাঁঝের সঙ্গে তাকে ঘর থেকে বের করে দেয় অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ করে—‘‘বেরিয়ে যা ঘর থেকে মুখপোড়া বজ্জাত কোথাকার৷’’৫১

এভাবে নানা অনুসঙ্গে গণিকা চরিত্রগুলির মুখে ইতর শব্দ বসিয়ে তাদের ভাষাকে সাধারণ নারীর ভাষা থেকে স্বতন্ত্রমণ্ডিত করেছেন রচনাকারেরা৷ এই ধরনের শব্দের ব্যবহার তাদের ভাষায় বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে৷

দেহব্যবসা বা যৌনতা এই শ্রেণীর নারীদের জীবনধারণের প্রধান মাধ্যম৷ দীর্ঘদিন দেহব্যবসার সঙ্গে যুক্ত থেকে বা সমাজের মানুষগুলির কাছে অপমানিত হতে হতে সেই বৃত্তি নিয়ে তাদের যেন সাহসের ক্ষেত্রটা আরও অনেক বেশি বিস্তৃত হয়ে পড়ে৷ জীবনে সবকিছু হারিয়ে এই একটা জিনিস নিয়েই গণিকারা স্পর্ধা দেখাতে পারে৷ বিভিন্ন উপন্যাসে বিভিন্ন চরিত্রের মুখে এইধরনের দেহব্যবসা নিয়ে স্পর্ধাপূর্ণ বাক্য উচ্চারিত হতে দেখা যায়৷

‘অসীম’-এর মনিয়া কসবির কন্যা হয়েও কসব ছেড়ে প্রেমিকা হয়েছিল৷ তার অতুলনীয় রূপ দেখে বার বার পুরুষেরা পতঙ্গবৎ আকৃষ্ট হয়েছে তার দিকে৷ সে পরিণত হয়েছে পাটনা শহরের বুলবুল রূপে৷ কিন্তু তার একান্ত সাধনা অসীমের প্রেম৷ অসীম হিন্দু-ব্রাহ্মণ আর সে হিন্দুবেশ্যামাতা ও যবন পিতার ঔরসে পৃথিবীর মুখ দেখেছে, তাই অসীমের অস্পৃশ্য৷ জীবনে নানা ঘাটে ঠোকর খেয়ে খেয়ে তার মুখে বার বার উচ্চারিত হয়েছে নিজের গণিকা পরিচয়৷ সমাজের সকলের সামনে স্পর্ধার সঙ্গে সেই পরিচয় সে প্রকাশ করেছে৷ যেমন রূপ নষ্ট করতে গিয়ে হাকিমকে বলেছে—‘‘জনাব, আমি কসবী; শুধু কসবী নহি; কসবীর বেটি কসবী৷’’৫২ সে মুজরা করলেও জীবনে কোনোদিন কোনো পুরুষের অঙ্কশায়িনী হয়নি তথাপি সমাজের চরম বঞ্চনায় নিজেকে গণিকা পরিচয় দিতে বাধ্য হয়েছে এবং সে পরিচয়ের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে কাজ করেছে তার স্পর্ধা৷ গণিকামাতার কন্যা বলে এই স্পর্ধা দেখানো তার সহজ হয়েছে৷

‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ নামহীনা বারবনিতাদের মধ্যেও উচ্চারিত হয় দেহজীবিকার দরুণ গৌরবময়ভাষা৷ মানুষের যৌনতার গোপনাচারকে তারা যেন তাদের ভাষা ব্যবহারে সর্বপ্রকাশ্যে নিয়ে আসে৷—‘‘আমরা বেশ্যা, বেশ্যাবৃত্তি করি বটে, কিন্তু তোদের মত সাতটা কেরাণীকে পুষতে পারি৷ এই ত সমস্ত দিন কলম পিষে এলি—কি আনলি? আমরা ঘরে ব’সে ঘন্টায় আট দশ টাকা উপায় করি৷… তোরা আমাদের চাকর হবি? অফিসে যে মাইনে পাস—দেব৷’’৫৩

বঙ্কিমচন্দ্রের রোহিণী বিধবা হলেও রূপমুগ্ধ৷ গোবিন্দলালের প্রতি আকর্ষিত হয়ে সে যেমন তার সঙ্গে বিবাগী হয়েছে তেমনি পরবর্তী সময়ে তার আকর্ষণ তীব্র হয়েছে নিশাকর দাসের প্রতি৷ সে সেই স্পর্ধাবাক্য অকপটে নবপ্রণয়ীর কাছে ব্যক্ত করেছে—‘‘একজনকে ভুলিতে না পারিয়া এদেশে আসিয়াছি; আর আজ তোমাকে না ভুলিতে পারিয়া এখানে আসিয়াছি৷’’৫৪ রোহিণীর এই বাক্য তার গণিকাসুলভ মনোভঙ্গিকে স্পষ্ট করে৷

তারাশঙ্করের ‘কবি’-তে দেহজীবি নারীরা দেহব্যবসায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় যখন ব্যবসায় মন্দা বা ভাটা পড়ে তখন নিজেরাই যেন অস্থির হয়ে যায়৷ তাদের সেই কর্মহীন জীবনের অভিব্যক্তি ফুটে উঠে ললিতা, নির্মলা বসন ইত্যাদিদের কথার মাধ্যমে৷—‘‘দূর, দূর, রোজগার নাই, পাতি নাই, লোক নাই, জন নাই—কিছু নাই৷ সব ভোঁ ভোঁ৷’’৫৫ সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বলে—‘‘ঠিক বলেছিস, ভাই, ভাল লাগছে না মাইরি৷’’৫৬ অর্থাৎ যে পরিবেশ বা পরিস্থিতিতেই দেহজীবীরা যৌনপেশার সঙ্গে যুক্ত হোক না কেন ক্রমে ক্রমে অনেকের কাছেই তা যেন অভ্যাস হয়ে যায়৷ স্পষ্টভাষার মধ্য দিয়ে তা ব্যক্ত করেছেন রচনাকার৷

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে৷ সেখানে পিয়ারীবাই রাজলক্ষ্মী হয়ে শ্রীকান্তকে নিয়ে সব ছেড়ে-ছুড়ে দিয়ে সুখী ঘর কন্নায় মেতে উঠলেও একসময় দেখা যায় সে শ্রীকান্তের উদাসীন উপেক্ষার জবাব দিতে মুজরা করতে বের হয়৷ শ্রীকান্ত তার গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চাইলে আহত ফণিনীর ন্যায় গর্জে উঠে বলে—‘‘আমি কারও কেনা বাঁদী নই যে, কোথায় যাবো, না যাবো, তারও অনুমতি নিতে হবে !’’৫৭ তার এই ব্যবহার সম্পর্কে শ্রীকান্ত তাকে জানায় সে যে টাকার লোভ এবং সেই টাকা দিয়ে কর্তৃত্ব করার লোভ পেয়েছে তা সহজ ছাড়তে পারবে না৷ অর্থাৎ এখানেও রাজলক্ষ্মী যেন পিয়ারীর খোলস থেকে বেড়িয়ে আসতে চেয়েও অভ্যাস বশে বেরোতে পারে না৷

‘গণদেবতা’-র দুর্গা অনেক বেশি সাহসী ও স্পষ্টবাদী৷ তার ভাষায়-ভঙ্গিমায় যেন সর্বদাই একটা রহস্যের চমক কাজ করে৷ পুরুষ মানুষ দেখলেই তার মন লাস্যের চমক দিয়ে যায়, কেউ তোয়াক্কা না করলেও হেসে গা দুলিয়ে রহস্যালাপ করে যায়৷ পাড়ার রমণীকুল তার প্রতি সর্বদা সন্ত্রস্ত থাকে৷ সে তার পেশা নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে যেমন ঝগড়া করে তেমনি অনিরুদ্ধ কামারের বৌ পদ্মর উপেক্ষা ও ঘৃণাকে উস্কে দিয়ে নিজে মজা উপভোগ করে৷ পদ্মকে রাগাতে বলে—‘‘যদি বলি আমি তোমার সতীন! তোমার কর্তা তো আমাকে ভালবাসে হে!’’৫৮

অনিরুদ্ধর মামলার তদন্ত সাপেক্ষে ইন্সপেক্টর দুর্গাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় তাকে দাগি আসামিদের সঙ্গে মেলামেশার অভিযোগ করলে সে অকপটে বলে—‘‘আজ্ঞে হুজুর, আমি নষ্ট-দুষ্ট—এ কথা সত্যি৷…’’৫৯ এখানেও সে তার নিজের স্বরূপকে ঢেকে রাখেনি৷

ছিরু পালকে জব্ধ করতে সে অকপটে তার জীবনের ব্যভিচারের চিত্রকে বর্ণনা করেছে ‘পঞ্চগ্রাম’ উপন্যাসে ‘‘লোকটি যে এককালে আমার ভালবাসার লোক ছিল, তখন পাল বলেছি, তুমি বলেছি, মাল খেয়ে তুইও বলেছি৷ অনেক দিনের অভ্যেস কি ছাড়তে পারি জমাদারবাবু?’’৬০ তারপর বড় গলায় বলে—‘‘ঘোষ মশায়—ছিরে পাল গো, যে এককালে মুচীর মেয়ের এঁটো মদ খেয়েছে, মুচীর মেয়ের ঘরে রাত কাটিয়েছে, মুচীর মেয়ের পায়ে ধরেছে৷’’৬১

এভাবে ‘গণদেবতা’ ‘পঞ্চগ্রাম’-এ দুর্গা স্পর্ধিত কন্ঠে নিজে যৌনাচারকে ব্যক্ত করেছে৷ সেই ভাষা, সেই বক্তব্য একজন স্বৈরিণী নারীর মুখেই সম্ভব৷

‘বৈতরণী তীরে’-তে বিন্দি তার দেহজীবিকার পসার বোঝাতে বলেছে—‘‘এই মর্ত্যলোকই আমার কাছে নরক হয়ে উঠেছিল আর সে নরক আমি গুলজার করেও তুলেছিলাম! কি করে আমার এই সামান্য দেহটা দিয়ে যে এত লোককে আমি মুগ্ধ করেছিলাম তাই ভাবি৷ সে কি এক আধটা লোক? প্রতিদিন প্রতি বেলা নূতন লোক!’’৬২ ‘শুভদা’-র কাত্যায়নী তার বাবুকে বলে—‘‘আমাদের যেখানে পেট ভরে সেইখানে ভালবাসা৷… যেখানে টাকা সেইখানে আমার যত্ন,’’৬৩ এই উপন্যাসেই মালতী যে কি না সুরেন্দ্রবাবুর রক্ষিতা হয়ে নবপরিচয় লাভ করেছে তার মুখেও উচ্চারিত হয় সেই স্পর্ধাবাণী—‘‘আমি বেশ্যা—বেশ্যায় সব পারে৷’’৬৪

‘অথৈ জল’-এ মাসি, নীলিমার দিদির মুখেও অর্থের বিনিময়ে পান্না বা নীলিকে নিয়ে যা খুশি করার অভয়বাণী শোনা যায়৷ ডাক্তার শঙ্কর পান্নার পরামর্শে নীলির ঠিকানায় উপস্থিত হয় তাকে পান্নার কাছে নিয়ে আসার জন্য৷ নীলির দিদির কাছে তাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার কথা ব্যক্ত করলে সে স্পষ্ট করেই বলে—‘‘সে আপনি নিয়ে যান না? তবে দু’টো টাকা দিয়ে যাবেন৷ খরচপত্তর আছে তো?’’৬৫

সমাজ তাদের শরীরকে উপভোগ করেও তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করতে দ্বিধাবোধ করে না৷ তাদের পরিণত করেছে প্রান্তিক মানুষে৷ তাই তারা তাদের স্পর্ধা যতটা পারে ততটাই যেন সমাজের সামনে নিঙড়ে দেয়—অন্তরে যতই দুঃখ-বেদনা থাকুক না কেন৷ সেই স্পর্ধিত ব্যবহারে পুরুষের কাছ থেকে শোষণ করতেও তাদের বাধে না৷

গণিকাদের প্রণয় সম্ভাষণের মধ্যেও বৈচিত্র্য রয়েছে৷ বাইজিরা গণিকাদের মধ্যে উচ্চশ্রেণীর হওয়ায় তারা প্রেমিককে যে ধরনের প্রণয় সম্ভাষণ করে, নিম্ন শ্রেণীর গণিকা—যারা কোনো পল্লীতে থাকে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে খদ্দের ধরে তাদের প্রণয় সম্ভাষণের ধরন আলাদা৷ রাখালদাসের মনিয়া, শরৎচন্দ্রের পিয়ারী, চন্দ্রমুখী এরা বাইজি৷ মনিয়া মুজারাওয়ালি৷ সে প্রেমিককে প্রণয় সম্ভাষণ করে ‘জানি’, ‘জান’, ‘দিলের’, ‘পিয়ার’, ‘দুনিয়ার দৌলত’, ‘কলিজা’, ‘দিলদার’ ইত্যাদি সম্বোধনের দ্বারা৷ যেমন—

‘‘দিলের, একবার বসিবে চল!’’৬৬

‘‘জানি, পাটনা সহরের প্রসিদ্ধা মনিয়াবাঈ কেমন করিয়া এক মুহূর্তে পিতা, মাতা, নাম, যশঃ, প্রথম যৌবনের রোজগার ছাড়িয়া আসিয়া, তোমার দুয়ারে কুক্কুরের মত পড়িয়া আছে, তাহা কি বুঝিতে পার নাই?’’৬৭

‘‘আমার দুনিয়ার দৌলৎ, তুমি কাঁদিতেছ কেন!’’৬৮

‘‘মেরা জান, আমার কলিজা, আমি কি তোমায় এমনি সাদা কথায় ছাড়িয়া দিতে পারি৷’’৬৯

‘‘তোমাকে ছাড়িলে মনিয়ার জানে আর কি থাকিবে পিয়ার?’’৭০

‘‘ও-হোঃ, অমন কথা বলিও না দিলদার!’’৭১

‘করুণা’-র ইন্দ্রলেখা গোবিন্দগুপ্তকে প্রণয় সম্ভাষণ করে বলে—‘‘মহারাজপুত্র,… আর একবার তেমন করিয়া তোমার মুখখানি দেখিব৷’’৭২

‘বৈতরণীর তীরে’-র দেহব্যবসায়িনী বিন্দি পুরুষের শরীরে উষ্ণতার তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি করতে বলে—‘‘আমার পিছনে এই সেফটিপিনট লাগিয়ে দাও না—এই পিঠের দিকে—’’৭৩ এও গণিকাদের একধরনের প্রণয় সম্ভাষণ৷

‘জঙ্গম’-এ পতিতাপল্লীর বারবনিতারা তাদের সম্মুখে শঙ্করকে উপস্থিত দেখে হাব-ভাব কটাক্ষে তাকে ঘরে নিতে চায়৷ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য তাদের একজন বলে—‘‘আমার খোঁপাটা একটু ঠিক করে দে তো, বার বার এলিয়ে যাচ্ছে৷’’৭৪ অথবা সরাসরিই জিজ্ঞেস করে—‘‘আপনি কাউকে খুঁজছেন?’’৭৫ এও পুরুষের সঙ্গে বাররামাদের আলাপ করার এক রকম ধরন৷

‘অথৈ জল’-এ পান্না নানাভাবে প্রণয় সম্ভাষণ করেছে রাসভারী নীতিবান প্রসিদ্ধ মধ্যবয়সি ডাক্তার শশাঙ্কর কাছে৷ সে অযাচিতভাবে তার চেম্বারে এসে তাকে খেমটার আসরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছে৷ ডাক্তার তাতে আপত্তি করলে সে বলেছে—‘‘কেন যাবেন না? আমি মাথা কুটবো আপনার সামনে এখুনি৷ আসুন৷’’৭৬ এভাবে মাথা কুটার কথা বলে পান্না তাকে আসরে নিয়ে যায়৷ পুনরায় গভীর রাত্রে ডাক্তারের চেম্বারের দরজায় ঘা পড়ে৷ অযাচিত ভাবে উপস্থিত হয়েছে পান্না৷ সে ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তরে সহজ ভাবে বলে—‘‘দেখতে এসেছি, মাইরি বলছি৷’’৭৭ সে মাথার দিব্যি দিয়ে শেষের দিনের গানের আসরে থাকতে বলে—‘‘আপনাকে থাকতে হবে৷ আমার মাথার দিব্যি৷ আমি আসবো আবার৷ কখনো যাবেন না৷’’৭৮ এভাবে দেখা যায় তার লাস্য-কথাবার্তার প্রণয়পাশে শেষ পর্যন্ত ডাক্তার সম্পূর্ণরূপে তার কাছে ধরা দেয়৷

ডাক্তারের কাছে তার নিজেকে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের মধ্যেও উঠে আসে সুগভীর প্রণয় বাক্য—‘‘মেরে ফেলো আমাকে৷ তোমার হাতে মেরো৷ টু’ শব্দটি যদি করি তবে বোলো পান্না খারাপ মেয়ে ছিল৷’’৭৯

‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’ উপন্যাসে লক্ষিত হয়েছে এক ব্যভিচারী গৃহবধূর প্রেমিকে উদ্দেশ্যে প্রণয়বাক্য—‘‘ভাই! আজি অবশ্য আসিবে৷ আজ আসিলে বিফল হইবে না৷… তুমি অনায়াসে নিশা যাপন করিতে পারিবে৷’’৮০

সিন্দুরেপটি অঞ্চলের দুই-চার পয়সা সস্তা মূল্যের পণ্যাঙ্গনারা খদ্দের ধরে ‘ও মানুষ’, ‘ও মানুষ’ ‘আমার বাড়ী চল’ ‘আমার বাড়ী চল’ বলে হাত ধরে টানাটানি করে৷ এদের প্রাথমিক খদ্দের সংগ্রহের সম্ভাষণ এই শব্দগুলিই৷

এভাবে বিভিন্ন উপন্যাসে বিভিন্ন শ্রেণীর গণিকারা বিবিধ বাক্য, শব্দ, হাব-ভাব দ্বারা খদ্দের সংগ্রহ করে, পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷

পুরুষদের কাছে শরীর বিক্রয় করে সেই উপার্জনেই তাদের সম্পূর্ণ জীবন পরিচালিত হয়৷ তাই খদ্দের না পেলে বা তাদের সঙ্গিনীদের কেউ খদ্দের পেলে অন্যদের মন হতাশায় ডুবে যায়৷ তাই দেখা যায় ‘জঙ্গম’-এ মুক্তো শঙ্করকে নিয়ে ঘরে চলে গেলে বাকি মেয়েদের মধ্যে একজন বলে—‘‘মুক্তোটার কপাল ভাল৷ আমাদের আর কতক্ষণ ভোগান্তি আছে, কে জানে বাপু!’’৮১

‘কবি’ উপন্যাসে ঝুমুর দলের নর্তকী বেশ্যাদের যৌনবৃত্তির মন্দা সময়ে বলতে শোনা যায়—‘‘রোজগার নাই, পাতি নাই, লোক নাই, জন নাই—কিছু নাই৷ সব ভোঁ ভোঁ৷… ঠিক বলেছিস, ভাই, ভাল লাগছে না মাইরি৷

—ললিতে!

—কি?

—এ কেমন জায়গা বল তো?

—কে জানে ভাই৷ পাঁচটি টাকা রেখেছিলাম নাকছাবি গড়াব বলে, চার টাকা খরচ হয়ে গেল৷’’৮২

প্রেমিককে বশে রাখার জন্য নানা ধরনের বাক্য ব্যবহার করে তারা৷ কখনো মৃত্যুর কথা বলে প্রেমিককে বশ করার চেষ্টা৷ যেমন মহামন্ত্রী দামোদরদেবকে ইন্দ্রলেখার কন্যা অনন্তা বন্দি করার আদেশ দিলে মহামন্ত্রী যখন সেই আদেশ কুমারগুপ্তের মুখে শুনতে চান তখন নতশীর সম্রাটকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে অনন্তা বলে—‘‘বল, নতুবা আমি আত্মহত্যা করিব৷’’৮৩

‘পঞ্চগ্রাম’-এ স্বৈরিণী দুর্গা ঠাকুর মশাইয়ের স্বদেশপ্রেমী পুত্র বিশ্বনাথের সঙ্গেও রহস্যালাপ ফাঁদতে ভয় করে না৷ বিশ্বনাথ চিরতরে গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে দেশ মাতৃকার সেবার জন্য৷ দুর্গা তাকে শেষবারের জন্য প্রণাম করতে চায়৷ সে তার সঙ্গে আলাপের সূত্রে তার সমবেদনা লাভের আশায় বলে—‘‘আপনি তো এখানকার বিপদ আপদ ছাড়া আসবেন না৷ তার আগে যদি মরেই যাই আমি৷’’৮৪

‘অথৈ জল’-এর পান্না ডাক্তারকে প্রণাম করে বলে—‘‘বলো যেন শিগগির করে মরে যাই৷’’৮৫

গণিকাদের এই মৃত্যু কামনা বা মৃত্যুর কথা বলার পেছনে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ করে প্রণয়ীর বেশি বেশি ভালোবাসা প্রাপ্তির প্রত্যাশা৷

যৌবন গত হয়ে গেলে ভালোবাসায় ভাটা পড়ে৷ গণিকাদের মধ্যে যেহেতু সম্পর্কের কোনো স্থায়ী ভিত্তি নেই তাই তাদের জীবনে প্রেমিকের আনাগোনা যৌবনের ফাগুনবেলাতেই৷ তারপরে শুধুই বিগত যৌবনের গ্লানি৷ তাই বহু গণিকার মধ্যে লক্ষিত হয় বিগত যৌবনের প্রতি আক্ষেপ; অভিমান প্রকাশ করে প্রেমিককে করায়ত্ত রাখার চেষ্টা৷

ইন্দ্রলেখা অভিমান করে হরিবলকে বলে—‘‘যাও তোমার মিষ্টি কথায় কাজ নাই৷ আমি কুৎসিতা, আমি বুড়া, আমার নিকট কেন? নবযৌবনভারে অবনমিতদেহা তন্বীর নিকটে যাও৷’’৮৬

আবার সখি মদনিকাকে বলে—‘‘মদনিকে, উহার সহিত বাক্যালাপ করিও না, আমি কুৎসিতা, বৃদ্ধা, আমার অনুরোধ কেন রাখিবে?’’৮৭

সরস্বতী নবীনকে বিদ্ধ করতে বলে—‘‘তোমরা পুরুষ মানুষ, ভোমরার জাতি৷ যতক্ষণ মধু থাকে, ততক্ষণ তোমরা থাক৷ আমার যৌবনের মধু ফুরাইয়াছে; সুতরাং এখন আর তোমরা আসিবে কেন?’’৮৮

গণিকাবৃত্তি এমন একটা পেশা যেখানে নারী জীবনকে সবচেয়ে বেশি নিষ্পেষণ করা হয়৷ অনেক বারবধূই চায় সে পেশা থেকে সরে আসতে বা তাদের উত্তরসূরীদের সেই পেশা থেকে দূরে রাখতে৷ বাংলা উপন্যাসে কোনো কোনো বারবনিতার মুখে এই পেশার জন্য তীব্র আক্ষেপবাণী ধ্বনিত হতে শোনা যায়৷ ‘করুণা’-য় তাই ইন্দ্রলেখা বলে—‘‘আমি যাহা করিয়াছি তাহা করিয়াছি, অনন্তাকে যেন আর তাহা করিতে না হয়৷’’৮৯ ইন্দ্রলেখা দেহপসারিণী৷ সে অনন্তার জন্মদাত্রী৷ তাই সে কোনোভাবেই চায় না তার মেয়েও দেহপসারিণী হয়ে বেঁচে থাকুক৷

‘গণদেবতা’-‘পঞ্চগ্রাম’-এর দুর্গার ভালোমানুষগুলোর সংস্পর্শে থাকতে থাকতে ঔদ্ধত স্বৈরিণীসুলভ চপলতা স্তিমিত হয়ে এসেছে৷ সে তাই অভিসারে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে৷ তার মুখে শোনা যায় সেই পেশা থেকে সরে যাওয়ার অভীপ্সা—‘‘ওতে আমার অরুচি ধরেছে ভাই৷ তবে কি করি, পেটের দায় বড় দায়!’’৯০

বৃত্তি থেকে সরে গিয়েও দেহজীবিকার গ্লানি নিয়ে উপন্যাসের শেষে সে দেবুকে প্রশ্ন করে—‘‘আমাদের মত পাপীর কি হবে জামাই? আমরা কি নরকে যাব?’’৯১ দুর্গার এই কথা তার জীবনের চূড়ান্ত আক্ষেপকে সামনে নিয়ে আসে৷

বিন্দি বাইজি ‘বৈতরণী তীরে’ উপন্যাসে দেহব্যবসার মধ্যে থেকেও প্রেমকে পেতে চেয়েছিল৷ তার সেই তৃষ্ণা পবিত্র ঝরণাধারার কিন্তু জীবনভর সে পান করেছে নর্দমার জল অর্থাৎ পুরুষের উগ্র যৌনতা৷ তাই প্রেম না পাওয়ার আক্ষেপ থেকে সে উপন্যাসের কথকের কাছে জানতে চেয়েছে—‘‘ছাপা কেতাবে যে সব প্রেমের গল্প লেখা থাকে সে সব কি সত্যি? ওরকম কি হয়! আমার জীবনে আমি তো দেখেছি পুরুষগুলো আমাকে নিয়ে লোফালুফি করেছে! আমি যেন একটা ফুটবল—আমায় ঘিরে সুদক্ষ একদল খেলোয়াড়;’’৯২ তারপর সে আবার বলেছে—‘‘দেখুন আমার আকন্ঠ পিপাসায় ভরে আছে৷ সারা জীবনটা একবিন্দু ভাল ঠাণ্ডা জল পেলাম না৷… জীবনে একটাও নদী দেখতে পাই নি—খালি নর্দমা৷ কেবল দুর্গন্ধ পচা জল৷’’৯৩ দেহবৃত্তির এই গ্লানি মুক্ত হতে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে সে৷ সত্যকার প্রেমের জন্য তার এই আক্ষেপ মর্মস্পর্শী৷

গণিকারা শুধু যে খদ্দের এনে ঘরে বসায়, তা নয়৷ অনেক সময় নিজস্ব ভাষারীতিতে খদ্দেরকে দরজা থেকে ফিরিয়েও দেয় তারা৷ সেখানেও বারাঙ্গনাদের ভাষাগত স্বতন্ত্রতা ফুটে উঠে৷ যেমন ‘দেবদাস’ উপন্যাসে চন্দ্রমুখী দেবদাসের প্রেমে শুদ্ধচারিণী হয়ে সব ছেড়ে দিয়ে গ্রামে বসবাস করতে শুরু করে৷ পরে যখন জানতে পারে যে তার প্রণয়ী কলকাতায় ছন্নছাড়া জীবন কাটাচ্ছে এবং বাড়িতে তার কোনো খোঁজ খবর নেই, চিঠি দিলে চিঠি ফেরত আসে তখন পুনরায় কলকাতা গিয়ে চন্দ্রমুখী দেহের পসরা সাজায়৷ যখন অপরিচিত পুরুষ কন্ঠ তার দরজায় এসে প্রেম প্রার্থনা করে তখন সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করে জানায় ‘‘এখানে নয়৷’’ ৯৪

‘জঙ্গম’-এর শঙ্করকে খোঁটা দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিলে মুক্তোর দরজায় দাঁড়ায় কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা এক ব্যক্তি৷ তার সতৃষ্ণ কামনাকে উপেক্ষা করতে তাকে প্রত্যাখ্যান করে তিক্ত কন্ঠে বলে—‘‘এখন এখানে হবে না৷’’৯৫

‘এখানে নয়’, ‘এখন এখানে হবে না’ এগুলি গণিকাদের প্রত্যাখ্যানের জন্য ব্যবহৃত বাক্যবন্ধ৷

কখনো কখনো এই প্রত্যাখ্যানের ভাষা জোরালো হয়ে খদ্দেরের কাছে অপমানকর হয়ে উঠে৷ ‘শহরবাসের ইতিকথা’-য় জ্যোতির বিশ্বাসঘাতক বন্ধু শ্রীপতিকে একা তার সঙ্গ উপভোগে আসতে দেখে গালিগালাজ দিয়ে তার ঘর থেকে বের করে দেয়৷ সে বলে—‘‘বেরিয়ে যা ঘর থেকে মুখপোড়া বজ্জাত কোথাকার৷’’৯৬ তার এই প্রত্যাখ্যান প্রেমিককে রুঢ় প্রত্যাখ্যান৷

গণিকারা যেহেতু নারী শ্রেণীর প্রতিনিধি তাই তাদের ভাষা বৈশিষ্ট্যে মেয়েলি সুরটিকে সহজেই চিনে নেওয়া যায়৷ সমাজভাষাবিজ্ঞানীরা শুধু যে নারীপুরুষের ভাষার মধ্যে ভিন্নতা লক্ষ করেছেন তা নয়, যথার্থ প্রামাণিকতার সঙ্গে সেই ভিন্নতার স্বরূপ ও কারণেরও অনুসন্ধান করেছেন৷ ভাষার এই লিঙ্গগত ব্যবধানকে ভাষাবিদ ট্রাডগিল সামাজিক তফাত বা Social difference বলে অভিহিত করেছেন৷

কথায় কথায় প্রবাদের ব্যবহার, সম্বোধনের ক্ষেত্রে বিশেষ শব্দ প্রয়োগ, বাগধারা, বাগার্থ, প্রত্যয়-উপসর্গ, কিছু কিছু নিজস্ব রীতির শব্দ ব্যবহার গণিকাদের ভাষার ক্ষেত্রে মেয়েলি সুরের সংযোজন ঘটিয়েছে৷ এই নারীর ভাষার বৈচিত্র্যের কারণ অবশ্যই তার শরীরবৃত্তীয় গঠন যা তার মানসিক বিকাশেরও ভিত্তি৷ সমাজে পুরুষের প্রাধান্য, পুরুষের কাছে নারীর অধীনতা, নারীর প্রকৃতি ও অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে তার ভাষাকেউ করে তোলে অনুদ্ধত, কুন্ঠাপূর্ণ ও কোমল৷ যদিও বর্তমান কালে শিক্ষার দৌলতে নারীর ভাষাগত পার্থক্য অনেক কমে গিয়েছে৷

নারীর ভাষাবৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক হল প্রবাদ-প্রবচনের বহুল ব্যবহার৷ প্রবাদ মানুষের প্রাজ্ঞমনস্কতার ফসল৷ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে সুগভীর দার্শনিক প্রত্যয়ের ফলশ্রুতি প্রবাদের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে৷ আর গ্রামীণ মানুষ সুদীর্ঘকাল ধরে নিজের সমাজ পরিবেশ ও প্রকৃতি সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করে তাই হল প্রবচন৷ মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে প্রবাহিত হতে হতে প্রবাদ লাভ করে তার সংক্ষিপ্ত নিটোল অবয়বকে৷ প্রবাদ-প্রবচনের মধ্যে থাকে যৌথ জীবনের কথা, জীবনের শত শত দুঃখ-আনন্দ বেদনার কথা, ঘর-পরিবার-কৃষি ও কর্মের কথা—সমস্ত মননক্রিয়ার নির্যাস হয়ে প্রবাদ আত্মপ্রকাশ করে৷

গণিকা নারীরা তাদের জীবনে দুঃখ, যন্ত্রণা, বঞ্চনা, ক্ষোভ-বিক্ষোভ সর্বোপরি তাদের বৃত্তির স্বরূপ প্রকাশ করতে নানা রকমের প্রবাদের আশ্রয় নিয়েছে৷

‘অসীম’ উপন্যাসে নবীন নরসুন্দরের বিদ্যালঙ্কারের কন্যা ও পুত্রবধূকে অপহরণ করাকে কেন্দ্র করে সরস্বতী তিক্ত বিরক্ত হয়ে নবীনকে উদ্দেশ্য করে বলে—‘‘বুড়ার যেন ভীমরতি ধরিয়াছে৷ দুই-দুইটা ব্রাহ্মণের মেয়ে খামকা ধরিয়া আনিল’’৯৭ এখানে ‘বুড়ার যেন ভীমরতি’ বাক্যাংশটি ‘বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরা’ প্রবাদের সমতুল৷ ভীমরতি মতিভ্রষ্ট অর্থে ব্যবহৃত৷ একটি ছোট্ট বাক্যের মধ্যে দিয়ে অনেক কিছুই যেন বলে দিয়েছে সরস্বতী বৈষ্ণবী৷

গণিকা ইন্দ্রলেখা ‘করুণা’ উপন্যাসে তার স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বৃদ্ধ অপরিণামদর্শি রাজা কুমারগুপ্তের সঙ্গে কন্যার বিবাহ দেয়৷ কিন্তু পরবর্তী সময়ে জামাতার অকর্মণ্য, ব্যক্তিত্বহীন আচরণে তার আর আক্ষেপের সীমা থাকে না৷ সে হরিবলকে ‘আফসোস’ করে বলে—‘‘কি জন্য বৃদ্ধ বানরের কন্ঠে শুভ্র মুক্তাহার পরাইয়া দিয়াছি৷’’৯৮ ইন্দ্রলেখার এই আক্ষেপবাণী প্রচলিত ‘বানরের গলায় মুক্তার মালা’ প্রবাদটিকে মনে করিয়ে দেয়৷ অর্থাৎ অসমঝদারের হস্তে মূল্যবান জিনিস অর্পণ করার সামিল৷

শরৎচন্দ্রের ‘শুভদা’-য় বারাঙ্গনা কাত্যায়নী নিজের পতিত জীবনের মর্মান্তিক পরিণতির কথা বোঝাতে তার বাবু হারাণচন্দ্রকে বলে—‘‘লোকে বলে, ‘যার কেউ নেই, তার ভগবান আছেন’, আমাদের সে ভরসাও নেই৷’’৯৯ তার এই কথার মধ্যে দিয়ে গণিকাজীবনের নিদারুণ সত্য স্বরূপ উপস্থাপিত হয়েছে৷ সমাজের মানুষজনের সঙ্গে ভগবানও যেন এই নারীদের প্রতি মুখ ফিরিয়ে থাকেন৷

‘গণদেবতা’ উপন্যাসে স্বৈরিণী দুর্গা, পাতুর স্ত্রী, দুর্গার মা ইত্যাদি চরিত্রগুলির মুখে বহু প্রবাদ উচ্চারিত হয়েছে৷

দুর্গার সঙ্গে পাতুর কলহ বাঁধলে দুর্গা তীক্ষ্ণ কন্ঠে তার অবস্থান জানিয়ে বলে—‘‘ভাত দেবার ভাতার নয়, কিল মারার গোসাঁই৷… হাজার নোক আসবে আমার ঘরে, তোর কি? তোর ভাত আমি খাই?’’১০০ অর্থাৎ দরিদ্র মুচি পরিবারে ভাই পাতুর স্বামী পরিত্যাগ করে আসা বোন দুর্গার ভরণপোষণের সামর্থ নেই৷ তাকে শরীর বেঁচে নিজের অন্নসংস্থান নিজেকেই করতে হয়৷ সেখানে সে ভাই-এর শাসন মানবে কেন! তাই দুর্গা প্রবাদের মধ্য দিয়ে নিজের প্রকৃত অবস্থান এবং ভাইয়ের সামর্থ অল্পকথার মধ্যে প্রকাশ করে৷

শ্রীহরি ঈর্ষাবশত সকলের অলক্ষ্যে মুচিপাড়ায় আগুন ধরিয়ে দিলে পরে দুর্গার সচেতন দৃষ্টিতে তা ধরা পড়ে যায়৷ তাই শ্রীহরিকে সে কথা জানিয়ে সে প্রবাদ আওড়ায়—‘‘ঠাকুর ঘরে কে রে? না, আমি তো কলা খাই নাই! সে বৃত্তান্ত৷’’১০১

হামদু স্যাখের কাছ থেকে টাকা খেয়ে দুর্গার মা বার বার তাকে গরু বেচার জন্য প্ররোচিত করলে সে তার মাকে বলে—‘‘আমি কিছু বুঝি না, মনে করেছিস! ধান-চালের ভাত আমি খাই না, লয়?’’১০২ আর এ প্রসঙ্গে হামদু স্যাখকে বলে—‘‘ও বলদের নামে তুমি হাত ধোও হামদু ভাই৷ ও আমি এখন দু’বছর বেচব না৷’’১০৩ এখানে ‘হাত ধোও’ অর্থাৎ দুর্গা তাকে বলতে চাইছে যে আশা ছেড়ে দাও৷

দুর্গা অনিরুদ্ধকে চার দিনের জন্য দুই টাকা ধার দেয়৷ সময়ের মধ্যে অনিরুদ্ধ সেই টাকা ফেরত দিলে সে তাকে বলে—‘‘সোনার চাঁদ খাতক আমার!’’১০৪

‘পঞ্চগ্রাম’-এ রাখাল বালকের মনের উল্লাসে প্রেমের গান গাইতে শুনলে দুর্গা তাকে বলে—‘‘মরণ তোমার! গলা টিপলে দুধ বেরোয়, একবার গানের ছিরি দেখ!’’১০৫ এখানে ‘গাল টিপলে দুধ বেরোয়’ অর্থাৎ কম বয়সকে চিহ্নিত করা হয়েছে; যার বাল্য দশা কাটেনি৷ সেই রকমের বালকের মুখে গভীর প্রেমের গান শুনে দুর্গার এই প্রবাদবাক্যের ব্যবহার যথোপযুক্ত হয়েছে৷

দেবুকে ভালোবেসে সে দেহব্যবসা ছাড়তে চায়৷ কিন্তু দরিদ্র পরিবারে অন্ন সংস্থানই বা হবে কি করে৷ তার ও তার ভ্রাতৃবধূর রোজগারেই মা-ভাই-এর খুন্নিবৃত্তি নিবারণ হয়৷ তাই কামার বউকে সে বলে—‘‘ওতে আমার অরুচি ধরেছে ভাই৷ তবে কি করি, পেটের দায় বড় দায়!’’১০৬

দুর্গার ভ্রাতৃবধূ অর্থাৎ পাতুর বৌও স্বৈরিণী৷ বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে তার মুখেও উচ্চারিত হয় প্রবাদ বাক্য৷ যেমন তার স্বামী মেরে তার হাড় ভেঙে দিতে চাইলে সে হিংস্র ভঙ্গিতে ফ্যাঁস করে উঠে বলে—‘‘ক্যানে, ক্যানে আমার হাড় ভেঙে দিবে শুনি? বলে ‘দরবারে হেরে, মাগকে মারে ধরে’—সেই বিত্তান্ত৷’’১০৭ পারিবারিক কলহ, মজলিশে অপমান, অগ্নিদাহে গৃহ ভস্মীভূত হওয়া ইত্যাদি নানা কারণে পাতুর অস্থির মন স্ত্রীর উপরে বিদ্বেষী হয়ে উঠে৷ দরবারে হেরে স্ত্রীকে মেরে সে যেন তার যন্ত্রণার ভার লাঘব করতে চায়৷ যা পূর্বের কোনো গল্পের অনুরূপ৷ যেখানে কোনো স্বামী ভরা দরবারে চরম অপমানিত হয়ে সেই অপমানের জ্বালা ভুলেছিল স্ত্রীকে প্রহার করে৷ পাতুর একই আচরণে পাতুর বৌ এর মুখে যথার্থ বাক্য হয়ে প্রবাদ রূপে বেড়িয়ে আসে৷

দুর্গার মা পুত্রবধূর দেহব্যবসার রোজগার থেকে কোনরকম সাহায্য না পেয়ে মেয়ের কাছে আক্ষেপ করলে মেয়ে সেই পাপের পয়সা তাকে স্পর্শ করতে নিষেধ করে৷ তাতেই দুর্গার মায়ের মুখে উচ্চারিত হয় প্রবাদ যা তাকে বিদ্ধ করতে যথেষ্ট৷—‘‘ওলো সীতের বেটি সাবিত্তিরি আমার৷’’১০৮ দুর্গা দেহজীবী৷ একজন দেহজীবিনীর পক্ষে অপর দেহজীবিনীকে পাপী ভাবা হাস্যকর৷ দুর্গা তাই করেছে৷ যার প্রেক্ষিতে দুর্গার মায়ের সেই জবাব৷ সীতা, সাবিত্রী, দুই পৌরাণিক চরিত্র৷ তারা পঞ্চসতীর দুজন৷ কেউ কারও মেয়ে নয়৷ দুর্গার মায়ের শিক্ষা-সংস্কারহীন অজ্ঞ মনস্কতায় দুজনের সম্পর্কের ভেদরেখা উল্লিখিত না হলেও তাঁরা যে সতীত্বের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন ছিলেন তা অজানা নয়৷ মা তার প্রবাদ বাক্যের মধ্য দিয়ে দুর্গার কৃত্রিম সতীত্বকে চরম ব্যঙ্গে বিদ্ধ করেছে৷ পুত্রবধূরও সেই পুরোনো সতীত্ববোধকে বিদ্ধ করে বলে—‘‘বউ হারামজাদী সাবিত্তির, তখন ফণা কত? কত বলেছিলাম, তা নাক ঘুরিয়ে তখন বলত—ছি! এখন তো সেই ‘ছি’ তপ্তভাতে ঘি হইছে৷ সেই রোজগারে প্যাট চলছে, পরন চলছে!’’১০৯ গরমভাতে ঘি যেমন উপাদেয় পাতুর বৌ এক কালে ছি ছি করলেও পরবর্তী সময়ে দেহব্যবসাই তার কাছে পরম উপাদেয় হয়েছে গরমভাতে ঘি-এর মতো৷ মায়ের কথায় সেই দিকটিই প্রতিভাত৷

মানুষের হিতকারী দেবু পণ্ডিতকে আশীর্বাদ করে দুর্গার মা বলেছে—‘‘মাথার চুলের মত পেরমাই হবে, সোনার দোতকলম হবে,’’১১০ মাথার চুলের মতো পরমায়ু হল আয়ুরেখাকে অনেকগুণ বাড়িয়ে দেওয়ার আশীর্বাদ যা প্রবাদ- বাক্যেরই সামিল৷

দেবু দুর্গার খোঁজ নিতে এলে মা তার উদ্দেশ্যে বলে—‘‘সে নচ্ছারীর কথা আর বলো না বাবা! বানের আগে কুটো৷’’১১১ এই ‘বানের আগে কুটো’ কথাটিও প্রবাদবাক্য৷ বন্যার সময় যেমন খড়-কুটো আগে ভেসে আসে দুর্গাও তেমনি কারও কোনো কিছু হলে সকলের আগে ছুটে যায়৷ এর মধ্য দিয়ে দুর্গার স্বভাবজ বৈশিষ্ট্য উঠে এসেছে৷

এছাড়া প্রবচন ব্যবহার করে নিজের মনের অস্ফুট উদ্দেশ্য কেউ ব্যক্ত করেছে দুর্গা৷ যেমন দুর্গা কামারবউ-এর সঙ্গে দেবুর বাড়িতে এসে বিলুদিদির বোন হিসেবে আপ্যায়িত হতে চাইলে সে ভার দেবু তার স্ত্রী অর্থাৎ দুর্গার বিলুদিদির উপরই ছেড়ে দেয়৷ সে ঠাট্টা করে বলে আপনার জন থাকতে পরের আদর কি কখনো ভালো লাগে৷ তখন তার উত্তরে দুর্গা ছড়া কেটে কেটে প্রবচনের মধ্য দিয়ে নিজের মনের ভাবকে প্রকাশ করে দেয়—‘‘টাকার চেয়ে সুদ মিষ্টি; দিদির চেয়ে দিদির বর ইষ্টি, আদর আরও মিষ্টি৷ আমার কপালে মেলে না!’’১১২

প্রবল বানে ময়ুরাক্ষী যখন ফুসতে থাকে তখন দেবু দুর্গাকে বলে সে বাঁধের কি অবস্থা তা দেখতে যাবে৷ তাতে দুর্গা গালে হাত দিয়ে এক প্রবচন বলে—‘‘কাঁদি-কাঁদি মন করছে, কেঁদে না আত্মি মিটছে, রাজাদের হাতী মরেছে, একবার তার গলা ধরে কেঁদে আসি’’১১৩ অর্থাৎ যখন কাঁদার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠে তখন রাজার হাতী মারা গেলেও তার গলা ধরে কাঁদা যায়৷ তেমনি দেবু গ্রামের মানুষজনের জন্য চিন্তায় এত বেশি অস্থির যে সামান্য বানেই তার বাঁধ দেখতে ছোটে৷ কারণ দুর্গা তার জীবনে কোনোদিন শোনেনি যে ময়ুরাক্ষীর বাঁধ ভেঙ্গে জল ঢোকে৷ সেই প্রবচন জেরে সে তাই বলে—‘‘আচ্ছা, বাঁধ ভেঙে বান কোন কালে ঢুকেছে শুনি?’’১১৪

‘জঙ্গম’ উপন্যাসে মুক্তো ‘খদ্দের’-এর সংজ্ঞা বোঝাতে গিয়ে শঙ্করকে একটি প্রবাদ শোনায়৷—‘‘ফেল কড়ি মাখ তেল, তুমি কি আমার পর’—এই কথা যাকে বলতে পারা যায়, সেই হল খদ্দের৷’’১১৫ অর্থাৎ গণিকাদের শরীর ভোগ করার পেছনে অর্থনৈতিক একটা যোগসূত্র বর্তমান৷ গণিকাদের যে কড়ি দেবে সে-ই তার ভালোবাসা পাবে বা আপনজন হবে৷

জগদীশগুপ্তের ‘লঘুগুরু’-তে পরিতোষের রক্ষিতা সুন্দরী টুকীকে স্বামী সম্পর্কে মন বিষিয়ে দিতে বলে—‘‘পেট ভরাবার সোয়ামী নয়; পিঠ পাতাবার কত্তা!’’১১৬ আবার অনিন্দ্যসুন্দরী টুকীকে দিয়ে দেহব্যবসা করাতে পারলে যে একসময় প্রচুর অর্থ উপার্জন ঘটবে সেই আশায় টুকীর স্পর্ধিত বাক্য সহ্য করেও সুন্দরী মনে মনে ভাবে—‘‘যে গরু দুধ দেয়, তার চাঁট খাওয়া যায়;’’১১৭

এই উপন্যাসেই টুকী স্বামী পরিতোষের ব্যবহারে মর্মাহত হলে তার ভয়কে আরও বাড়িয়ে স্বামীর প্রতি মনোভাবকে বিরূপ করতে সুন্দরী বলে—‘‘এই ত কেবল কলির সুরু’’১১৮ প্রবচনটি৷ অর্থাৎ লম্পট অত্যাচারী স্বামীর পীড়ন শুরু হয়ে গেছে তার উপর৷ টুকীর মা উত্তম সম্পর্কিত কটূক্তির জবাব দিতে টুকী যখন স্বামীকে সুন্দরীর সঙ্গে তুলনা করতে বাধা দেয় তখন রক্ষিতা দেহজীবী পতিতা আরেক দেহজীবির প্রতি সম্মান দেখে মনে রাগ রেখেও শান্ত সুরে বলে—‘‘হাতের পাঁচটা আঙুল সমান করে’ ত’ ভগবান গড়েননি৷৷’’১১৯

‘অথৈ জল’-এ পান্নার প্রণয়ী হয়ে কপর্দকহীন অবস্থায় ডাক্তার শশাঙ্ক তার বাসাবাড়িতে উপস্থিত হলে বাড়িউলি মাসি তাকে বিদেয় করার জন্য প্রবাদ আওড়ে বলে—‘‘একটা কথা বলি৷ স্পষ্ট কথার কষ্ট নেই৷ এ ঘরে তুমি থাকতে পারবে না৷’’১২০ মাসির সমস্ত আদেশ উপদেশ অনুরোধকে উপরোধকে উপেক্ষা করে সে যখন সেখানেই পড়ে থাকে, নড়তে চায় না তখন পান্নার ব্যবসায়িক দিকটাকে তুলে ধরে মাসি আরও বলে—‘‘ফেলো কড়ি মাখো তেল, তুমি কি আমার পর?’’১২১ অর্থাৎ সে যদি কড়ির বিনিময়ে পান্নার সঙ্গপ্রার্থী হয় তাতে সে-ও মাসির পরম আপন হয়ে উঠবে৷

তারাশঙ্করের ‘নীলকন্ঠ’ উপন্যাসে শ্রীমন্তর জেল হয়ে গেলে নিম্নশ্রেণীর নারী (যারা সময়ে-অসময়ে দেহব্যবসাও করে থাকে) পাঁচুর মা শ্রীমন্তের সাধ্বী স্ত্রী গিরিকে বলে—‘‘রাজাতে কাটিয়ে শির, কি করিবে কোন বীর৷’’১২২ এখানে ইংরাজ সরকারের আইনের প্রতি সাধারণ মানুষের অসহায়ত্ব প্রকাশ পেয়েছে৷

গ্রামের মোটামোড়ল নামে পরিচিত বিপিন তার লোলুপ বাসনায় আত্মীয় সেজে গিরির সাহায্য করতে এলে পাঁচুর মায়ের মুখে উচ্চারিত হয় এই ব্যঙ্গাত্মক প্রবচনটি—‘‘গাঁ সম্পক্কে মুচি মিন্সে মামা হয়৷’’১২৩

এছাড়া গণিকাচরিত্রগুলির কথার মধ্যে বাগধারার ব্যবহারও লক্ষ করা যায়৷ যেমন—ভ্রাতৃবধূর প্রতি ক্ষিপ্ত দুর্গা ভাইয়ের দ্বারা বৌকে প্রহৃত হতে দেখে ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলে—‘‘হ্যাঁ বউকে একটুকুন শাসন কর, মাথায় তুলিস না৷’’১২৪ এখানে ‘মাথায় তুলিস না’ শব্দটি ‘মাথায় তোলা’ অর্থাৎ প্রশ্রয় দেওয়া বাগ্ধারার অন্তর্ভূক্ত৷

‘পঞ্চগ্রাম’-এ ভূপাল ঈষৎ শ্লেষ ভরে দুর্গার সাহসিকতাকে বিদ্রুপ করলে দুর্গা বলে—‘‘বুকের পাটা না থাকলে থানাদার, রাত-বিরেতে প্রেসিডেনবাবুর বাংলোতে নিয়ে যাবার জন্য কাকে পেতে বল দেখি?’’১২৫ ‘বুকের পাটা’ শধটি অত্যধিক সাহস অর্থে বোঝানো হয়েছে৷

শঙ্কর বেশ্যা মুক্তোর প্রতি অনুরক্ত হয়ে বহুসময় নিষিদ্ধপল্লীতে মুক্তোর ঘরে সময় কাটাতে থাকে৷ কিন্তু মুক্তোকে দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত অর্থ তার নেই৷ মুক্তো এ বিষয়ে সতর্ক করতে তাকে বলে—‘‘গরিবের ছেলের এসব ঘোড়ারোগ কেন বাপু?’’১২৬ ‘গরিবের ঘোড়ারোগ’ কথাটি সামর্থের বাইরে বেশি ব্যয় করার প্রবণতাকে ব্যক্ত করে৷

করালীচরণের প্রণয়াকাঙ্খিনী বিগতযৌবনা কুৎসিত বারাঙ্গনা তার প্রতি করালীর বিরূপ মনোভাবকে বোঝাতে বলে—‘‘আমি ওঁর দুচক্ষের বিষ ছিলুম৷’’১২৭ দুচক্ষের বিষ অর্থাৎ যাকে সহ্য করা যায় না৷ করালীর অনুপস্থিতিতে তার ঘরবাড়ি ও পোষ্য দাঁড়কাক ও পাগলের দেখাশোনা করেও ভল্টুকে জানায় করালী আসার আগেই যেন তাকে খবর দেওয়া হয় কারণ—‘‘আমাকে এখানে দেখলে তেলে-বেগুনে জ্বলে যাবে৷’’১২৮ ‘তেলে-বেগুনে জ্বলে যাওয়া’ কথাটি অত্যধিক রাগ প্রকাশ অর্থে বোঝানো হয়েছে৷

‘অথৈ জল’-এ মাসি ডাক্তারকে ব্যঙ্গ করে বলেছে—‘‘ও! আমার ভারী নবাবের নাতি রে৷’’১২৯ নাবাবের নাতিরা আয়েশি-বিলাসী হয়৷ ডাক্তার পান্নাকে কানাকড়ি না দিয়েও মহাস্ফূর্তিতে তাকে উপভোগ করে চলেছে৷ তারই খোঁচা দিতে মাসির এ বক্তব্য৷

‘‘তোমার সঙ্গে জোড়-পায়রা হয়ে বসে থাকলে তো ওর চলবে না৷’’১৩০ এ কথাটিও ডাক্তারকে মাসি বলেছে৷ ‘জোড়-পায়রা’ অর্থাৎ সবসময় একত্রে থাকা৷ পান্না মুজরা দেহব্যবসা বাদ দিয়ে ডাক্তারকে নিয়ে মেতে উঠলে মাসি এ কথা বলে৷

‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ এক বেশ্যা বলে—‘‘অনেক ছেলের মাথা খেয়ে গহনাগুলি ক’রেছিলাম, জুয়াচোর বেটারা আমার মাথা খেলে৷’’১৩১ ‘মাথা খাওয়া’ অর্থাৎ ভুলিয়ে ভালিয়ে নেওয়া৷

গণিকাদের সম্বোধনের ক্ষেত্রে যেমন মেয়েলি বাক্যরীতির ছায়াপাত ঘটেছে তেমনি ইতর শব্দ প্রয়োগও অনুপস্থিত নয়৷ যেমন—‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ সেবাদাসীরা বলে—‘‘ওগো তোমরা এস৷’১৩২

বারবনিতার দল পাঁঠা স্কন্ধে দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবককে দেখে বলে—‘‘ও শালা! পাঁটাটা কি একলা খাবি?’’১৩৩

একজন রক্ষিতা তার বাবুকে বলে—

‘‘পোড়ারমুখো! কাল রাত্রে ছিলি কোথায়?’’১৩৪ স্বৈরিণী গৃহবধূ তার অবৈধ প্রণয়ীকে সম্বোধন করে লেখে ‘‘ভাই! আজি অবশ্য আসিবে৷’’১৩৫

এক গণিকা তার মাতাল লম্পট প্রেমিককে সম্বোধন করে—‘‘ওরে গুয়োটা! থাম…৷’’১৩৬

ম্যাজিট্রেট-এর কাছে বিচার চাইতে আসা এক বারবধূর সম্বোধন—‘‘হুজুর আমি কোন অপরাধ করি নাই,’’১৩৭

সিদুরেপটির দেহব্যবসায়িনীরা খদ্দের ধরে ‘ও মানুষ’ ‘ও মানুষ’১৩৮ সম্বোধন করে৷

বৃন্দবনের সেবাদাসীরা দেবতাদের সম্বন্ধে বলে—‘‘ও মা! মিন্সেরা বলে কি—’’১৩৯

‘অসীম’ উপন্যাসে মনিয়া উচ্চশ্রেণীর শিক্ষিত গণিকা৷ সে প্রণয়ীকে সম্বোধন করেছে জান, জানি, দিলের, পিয়ার, দিলদার, হুজুর, বাবুসাব ইত্যাদি সম্বোধনের দ্বারা৷ মনিয়ার মা মতিয়া গণককে সম্বোধন করেছে ‘কাফের’ বলে৷

‘পঞ্চগ্রাম’-এ দেবুর বানের তোরে ভেসে যাওয়ার খবর শুনে দুর্গার মা দুর্গাকে সম্বোধন করে বলেছে—‘‘ওলো, জামাই-পণ্ডিত ভেসে যেয়েছে লো!’’১৪০

‘জঙ্গম’-এ মুক্তোর সঙ্গিনীরা শঙ্করকে নিয়ে মুক্তো ঘরে গেলে বলেছে—‘‘ওলো, মুক্তো, শুধু জল দিসনি, একটু মিষ্টিমুখ করিয়ে দিস বাবুকে৷’’১৪১

মাসি ‘অথৈ জল’ উপন্যাসে ডাক্তারকে বলে—‘‘বলি ওগো ভালোমানুষের ছেলে, একটা কথা তোমায় শুধুই বাপু—’’১৪২

পান্না ডাক্তারকে বলে—‘‘নাও ওগো গুরুঠাকুর, কাল সকালে যখন খুশি তুমি কৃপা করে আমায় উদ্ধার কোরো—’’১৪৩ পান্না তার রোজগারের গল্প শোনালে তার সারল্য দেখে নির্বাক হয়ে যায় ডাক্তার৷ তাকে চুপ করতে থাকতে দেখে সে বলে—‘‘হ্যাঁগো, চুপ করে রইলে কেন?’’১৪৪

‘কবি’-তে বসন্তর ক্ষুরধার হাসিতে মাসি বিরক্ত প্রকাশ করলে বসন্ত বলে—‘‘ওলো মাসি লো—কয়লামাণিকেরও মনের মানুষ আছে লো৷’’১৪৫ মাসি তার দলের মেয়েদের আহ্বান করে—‘‘ওলো বসন, নির্মলা ইদিকে আয়৷’’১৪৬

সম্বোধনের ক্ষেত্রে এই যে শব্দ প্রয়োগ বা মেয়েলি ভাষারীতির অনুসরণ তা গণিকাদের ক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ৷

গণিকারা সাধারণ নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যে শাপ-শাপান্ত করে৷ এমন নিদর্শনও পাওয়া যায় বহু উপন্যাসে৷ মাঝি-মল্লাদের টিপ্পনীর জবাবে ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ দেহব্যবসায়িনীরা বলে—‘‘তুমি নৌকো ডুবি হয়ে মর—৷’’১৪৭ ‘গণদেবতা’-য় পাতু গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে চাইলে তার মায়ের শাপ শাপান্ত—‘‘মরুক, মরুক ড্যাকরা—এই অঘ্রাণের শীতে সান্নিপাতিকে মরুক!’’১৪৮

গ্রামে কলেরা হয়েছে শোনামাত্রই দুর্গা নিজের ভালো-মন্দ ভুলে যখন রোগী দেখতে দৌড়ে চলে যায় তখন তার উদ্দেশ্যে তার মায়ের শাপ-শাপান্ত—‘‘রাক্ষস, প্যাটে আগুন নাগুক—আগুন নাগুক—আগুন নাগুক! মরুক, মরুক, মরুক! আর হারামজাদী, নচ্ছারী, বানের আগে কুটো,—সববাগ্যে তোর যাওয়ার কি দরকার শুনি?’’১৪৯

উপমা, অব্যয়, প্রত্যয়, বিশেষণ ইত্যাদিরও প্রয়োগ রয়েছে পণ্যাঙ্গনাদের ভাষায়৷ মুক্তো শঙ্করের ভালোবাসাকে জাপানী ফানুষের সঙ্গে তুলনা করেছে ‘জঙ্গম’ উপন্যাসে৷—‘‘আপনারা জাপানি ফানুস, দুদিন একদিনই দেখতে বেশ৷’’১৫০ তার প্রতি শঙ্করের মোহ জাপানী ফানুষের সঙ্গে উপমিত৷ ‘কবি’-তে নিতাই-এর নিকষ কালো রূপ দেখে তাকে কয়লার সঙ্গে উপমিত করে বসন্ত বলেছে—‘‘ওহে কয়লা-মানিক!’’১৫১ এখানে কয়লার কালো এবং নিতাই-এর কালো একাকার হয়ে গেছে৷

নানা শ্রেণীর অব্যয়ের ব্যবহারও দেখা যায়৷ যথা—দুর্গার কথায়—‘‘ওরে বাস রে! বসে বসে কি এত ভাবছ গো?’’১৫২ ঝুমুর দলের নেত্রী নিতাইকে তার গান শুনে বলে—‘‘পদখানি তো বড় ভাল বাবা৷’’১৫৩ ‘দেবদাস’-র চন্দ্রমুখীর কথায় একাধিক অব্যয়ের ব্যবহার ‘‘যেদিন তুমি এখানে প্রথম এলে, সেইদিন থেকেই তোমার উপর আমার দৃষ্টি পড়েছিল! তুমি ধনীর সন্তান তা জানতাম; কিন্তু ধনের আশায় তোমার পানে আকৃষ্ট হইনি৷’’১৫৪ রাখাল বালকের মুখে প্রেমের গান শুনে দুর্গা বলে—‘‘মরণ আর কি ছোঁড়ার!’’১৫৫ ডাক্তার পান্নার হাত ধরে গভীর রাত্রে ঘরে আসার কারণ জানতে চাইলে সে বসে—‘‘ছুঁলেন যে বড়?’’১৫৬

বাংলা প্রত্যয়ের নিখুঁত প্রয়োগ মেলে মুক্তো, পান্না, টুকী, পিয়ারীর কথায়৷ মুক্তো শঙ্করকে বলে—‘‘আপনার মত গঙ্গাজলমার্কা ছেলে দেখলে আমার গায়ে জ্বর আসে৷’’১৫৭ বেশ্যালয়ের মাসি মুক্তোকে সাবধান করে দিতে বলে—‘‘ওসব কাব্যিমার্কা ছোঁড়াকে যেন আমল না দেয় সে৷’’১৫৮ পরিতোষের রক্ষিতা সুন্দরী টুকীর সঙ্গে ঝগড়ার সময় প্রয়োগ করে প্রত্যয়যুক্ত শব্দের—‘‘ওরে আমার সোয়ামী-উলি, বেরো বলছিস কাকে তুই?’’১৫৯ শ্রীকান্তকে তার সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন করে পিয়ারীবাই তার হিতার্থে বলে—‘‘বাবু শিকারে এসে একটি বাইউলি সঙ্গে করে দুপুর রাত্রে ভূত দেখতে গিয়েছিলেন৷’’১৬০

গণিকারা তাদের ভাষাব্যবহারের প্রসঙ্গে শ্লীল-অশ্লীল নানা ধরনের বিশেষণের প্রয়োগ করেছে যা তাদের ভাষায় বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে৷

‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ গণিকারা তাদের প্রণয়ী খদ্দের বাবুদের উদ্দেশ্যে যে সমস্ত বিশেষণ প্রয়োগ করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল—‘মিন্সে’, ‘শালা’, ‘গুয়োটা’, ‘পোড়ারমুখো’৷

‘করুণা’য়—‘বুড়া’, ‘বুড়াশেয়াল’, ‘মন্দমলয়ানিল,’ ‘বিষধর সর্প,’ ‘বৃদ্ধশৃগাল’ ইত্যাদি বিশেষণ ইন্দ্রলেখা গোবিন্দগুপ্তের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছে৷ ‘বৃদ্ধ বানর’ বলে বিশেষায়িত করেছে বৃদ্ধ কুমারগুপ্তকে৷

‘অসীম’ উপন্যাসে মনিয়া অসীমের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রেক্ষিতে প্রয়োগ করেছে যে সমস্ত বিশেষণ পদের তা হল—‘জান’, ‘জানি’, ‘দুনিয়ার দৌলত’, ‘দিলের’, ‘মেরিজান’, ‘পিয়ার’, ‘হুজুর’, ‘বাবুসাহেব’, ‘হারামখোর’, ‘কাফের’, ‘হারামজাদা’, ‘নিমকহারাম’৷

সরস্বতী বৈষ্ণবী নবীনকে বিশেষায়িত করেছে ‘মিন্সে’, ‘পোড়ারমুখো’—(তার প্রাক্তন গোঁসাই পিতাম্বরের উদ্দেশ্যে)

‘গণদেবতা’-য় দুর্গার মা ছেলে পাতুর উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছে ‘ড্যাকরা’, ‘খালভরার’ ইত্যাদি বিশেষণ৷ মেয়ের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছে—‘নচ্ছারী’, ‘হারামজাদী’, ‘দুগগাবিবি’ ইত্যাদি৷ এছাড়া ‘কামারমাগী’ বলেছে কামারবৌকে৷ পাতুর বৌ দুর্গার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছে ‘পোড়ারমুখী’, ‘ছেনাল’, ‘কলঙ্কিনী’ ইত্যাদি৷ দুর্গা রাগ করে তার মাকে বলেছে ‘হারামজাদী’, পঞ্চগ্রাম-এ শ্রীহরির অনুচর কালুর উদ্দেশ্যে বলেছে—‘বদমাস’, ‘পাজী’, রাখাল বালককে ‘মুখপোড়া’ পদ্মকে বলেছে ‘খালভরি’, ফুল্লরার বারমাস্যার গান শুনে তার উদ্দেশ্যে প্রয়োগ করেছে ‘মাগী’ বিশেষণ৷

বিন্দি তার খদ্দেরদের বিশেষিত করেছে ‘মুখপোড়া’ বলে৷ ‘অথৈ জল’-এ পান্না মাসিকে রাগ করে বলেছে ‘বুড়ি’৷

‘শহরবাসের ইতিকথা’-য় গণিকা চাঁপা জ্যোতির বিশ্বাসঘাতক বন্ধু শ্রীপতিকে গালিগালাজ করে যে সমস্ত বিশেষণ ব্যবহার করে তা শ্রুতি সুখকর নয়৷ যেমন—‘মুখপোড়া’, ‘বজ্জাত’ ইত্যাদি অপশব্দ তার মুখ থেকে বেড়িয়ে আসে৷

নারীভাষার সহজ সুরটি তো এই শ্রেণীর নারীদের প্রায় প্রতিটি কথার মধ্যে৷ ‘দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন’-এ রেলগাড়িতে বসে পরপুরুষের প্রণয়পাশে আবদ্ধ হয়ে স্বামীকে অস্বীকার করে পুরুষটিকে আপান করে নিয়ে বলে—‘‘মর মিন্সে—তুই আমার স্বামী, না ইনি আমার স্বামী?’’১৬১ এই বাক্যে ফুটে উঠেছে নারীভাষার সহজ সুরতান৷ নবীন নরসুন্দরকে ছদ্মবেশে পাটনা শহরে দেখে সহজ নারীসুলভ ভঙ্গিমায় সরস্বতী বলে উঠে—‘‘ওমা, নবীন দাদা বুঝি! এ আবার কি ঢং?’’১৬২ ইন্দ্রলেখা যখন কপট শাপ-শাপান্ত করে প্রণয় আকর্ষণের চেষ্টা করে সংঘস্থবির হরিবলের কাছ থেকে ‘‘তুমি মর, চিতায় আরোহণ কর, আমার রাত্রিবাসের সাধ অনেকদিন মিটিয়াছে,’’১৬৩ তখন তার মধ্যেও ধ্বনিত হয় নারীর নিজস্ব ভাষারীতি৷

‘গণদেবতা’য় পাতুর স্ত্রীর বিলাপ—‘‘ওগো, বাবুমশায়গো! খুন করলে গো!’’১৬৪ দুর্গার মায়ের মেয়েকে বলা কথা—‘‘মরণ! গেলি ক্যানে তবে ঢং করে?’’১৬৫ দুর্গার বিলুকে বলা—‘‘মরণকালে তোমরা কেউ আমাকে স্বামী ধার দিয়ো ভাই কিন্তুক!’’১৬৬ সবই যেন নারীভাষার সহজসুরে বাঁধা৷

‘অথৈ জল’-এ পান্না অযাচিত প্রেম প্রত্যাশায় ডাক্তারের চেম্বারে এলে ডাক্তার যখন তাকে রূঢ় কথা না বলে বসতে বলে তখন নারীসুলভ ভঙ্গিমায় সে বলে উঠে—‘‘ওমা কি ভাগ্যি! আমাকে আবার বসতে বলা! কক্ষনো তো শুনি নি৷’’১৬৭ অথবা—‘‘ভাল, ভাল৷… ওমা, কার মুখ দেখে না জানি আজ উঠেছিলুম, রোজ রোজ তার মুখই দেখবো৷’’১৬৮

‘জঙ্গম’ উপন্যাসে শঙ্করের দ্বারা বিপদমুক্ত হয়ে মাসি সরল কন্ঠে তাকে আশীর্বাদ করে বলে—‘‘বেঁচে থাক তুমি বাবা৷… তুমি না থাকলে কি যে বিপদ হত আজ আমার!’’১৬৯ মুক্তোর ঘরে একটা কবিতার লাইন দেখে সে প্রসঙ্গে শঙ্কর তাকে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়—‘‘জানি না বাবু, কত লোক আসে যায়, কে কখন লিখেছে, অত খেয়াল করিনি৷’’১৭০ এর মধ্যেও ধ্বনিত হয় নারীর ভাষার সহজ বৈশিষ্ট্য৷

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসে ঝুমুরদলের কর্ত্রী মাসি যখন বসন্তকে বলে যে তার ওস্তাদ নিতাই কবিয়ালকে পছন্দ হয় কি না তখন বসন্ত বলে—‘‘মা গো! ও যে বড্ড কালো; মা—গ৷’’১৭১ আবার ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসে শ্রীকান্তকে তিরস্কার করে পিয়ারীবাই যখন বলে—‘‘চাকর-বাকরের সামনে আর ঢলাঢলি কোরো না—তোমার পায়ে পড়ি একবার উঠে এসো—’’১৭২ তখন মেয়েলি কথার চিরন্তন সুরটিকে অনুধাবন করে নিতে অসুবিধা হয় না৷ ‘লঘুগুরু’-তে টুকীর স্বামীর রক্ষিতা সুন্দরী যখন পরিতোষকে বলে—‘‘তোমায় নিয়ে আমার চিরকালই দুঃখে গেল৷ দুঃখে ভাজা হয়ে গেছি৷’’১৭৩ তখন তার মুখে ধ্বনিত হয় চিরকালীন নারীভাষার ভাষ্যরূপ৷

রূপাজীবাদের ভাষার মধ্যে শব্দদ্বৈত বা দ্বৈত শব্দের ব্যবহারও কম নয় যেমন—‘গণদেবতা’-য়—দুর্গা তার মাকে বলে—‘‘রান্নাবান্না করবি, না প্যান প্যান করে কাঁদবি?’’১৭৪

ইন্সপেক্টরকে বলে—‘‘আজ্ঞে হুজুর, আমি নষ্ট-দুষ্ট—এ কথা সত্যি৷’’১৭৫

কামারবউকে বলে—‘‘কচি-কাঁচা দেখলে আমার তো গা ঘিন-ঘিন করে ৷ মা গো!’’১৭৬ ‘‘সেই ট্যা-ট্যা করে কাঁদবে,’’১৭৭

‘শুভদা’য় কাত্যায়নী তার বাবুকে বলে—‘‘মিছে ভ্যানভ্যান করচ কেন?’’১৭৮

এছাড়াও রূপোপজীবিনীদের ভাষায় আরও নানারকম শব্দ প্রয়োগ দেখা যায়৷ যেমন—অপভাষা, মিশ্রভাষার ব্যবহার৷ সুকুমার সেন অপভাষার সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন—‘‘এক ভাষাগোষ্ঠীর (অথবা উপভাষা সম্প্রদায়ের) ব্যক্তি যদি ভালো করিয়া না শিখিয়া অপর ভাষা (অথবা অপর উপভাষা) ব্যবহার করে তবে উচ্চারণে ও শব্দপ্রয়োগে বিকৃতি ও ভ্রমপ্রমাদ অবশ্যম্ভাবী৷ এমন অবস্থায় বিকৃত ও ভ্রমপ্রমাদপূর্ণ বাগব্যবহার অপভাষা (অথবা অপ-উপভাষা) বলা যায়৷’’১৭৯ যেমন বসন্ত মরে গেলে দলনেত্রী প্রৌঢ়া আক্ষেপ করে বলে—‘‘আমার অদেষ্ট দেখ বাবা৷ আমিই হলাম ওয়ারিশান!’’১৮০ ইংরেজি ওয়ারিশিয়ান মাসির অজ্ঞতার কারণে ওয়ারিশান অপভাষা হয়েছে৷ ‘‘যাই, শুকনো কাপড় পরে আসি৷ ‘নিমুনি’ হলে কে করবে বাবা!’’১৮১ বসন্ত এই বাক্যে ‘নিমুনি’ শব্দটি বিকৃত উচ্চারণ করেছে৷ তাই তা অপভাষা৷ মূল শব্দ হল ‘নিউমোনিয়া’৷

‘গণদেবতা’য় দুর্গা বলে—‘‘উকিল ব্যালেস্টার—সাত-সতেরো বলা ক্যানে শুনি?’’১৮২ ব্যালেস্টার শব্দটির প্রকৃত উচ্চারণ ব্যারিস্টার; দুর্গার মুখে উচ্চারিত হয়েছে বিকৃতভাবে৷

এছাড়া মিশ্র শব্দের ব্যবহার দেখা যায় নিম্নোক্ত উদাহরণে৷

‘‘বলি, বাড়িতে কি একেবারে আউট হয়ে গেছ নাকি?’’১৮৩

‘‘শেষে তামাসার মত কিছু দিয়ে গেলে৷’’১৮৪ পিয়ারীর কথায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার এবং চন্দ্রমুখী বলেছে বাংলা ও আরবির মিশ্র বাক্য৷ দুর্গার মুখে উচ্চারিত হিন্দি শব্দের মিশ্র প্রয়োগের উদাহরণ হল—‘‘গতর থাকতে ভিখ মাঙব ক্যানে?’’১৮৫

নানা সময়ের নানা শ্রেণীর গণিকাচরিত্র সম্বলিত উপন্যাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায় যে গণিকাচরিত্রগুলির নামকরণের ক্ষেত্রেও রচনাকারেরা ভিন্ন ধরনের শব্দ চয়ন করেছেন৷ প্রায় প্রত্যেকটা নামের মধ্যেই রয়েছে তাদেরকে উপভোগ করার ব্যঞ্জনা যা উপন্যাসের ভাষা আলোচনার ক্ষেত্রে তাৎপর্যবাহী৷ তাদের নামগুলির সঙ্গে সাধারণ নারীচরিত্রের নামের বিস্তর ফারাক৷ উদাহরণ দিলেই তা সুস্পষ্ট হবে৷ যেমন—

মনিয়া—(অসীম) পাখি বিশেষ৷ খাঁচায় বন্দি করে পোষা হয়৷

ইন্দ্রলেখা—(করুণা) বাইজির নাম৷

মদনিকা—(করুণা) মদন বা মন্মথর সঙ্গে সম্পৃক্ত৷

হীরা (বিষবৃক্ষ)—রত্ন বিশেষ৷ অঙ্গে ধারণ করা হয়৷ (সৌন্দর্যবৃদ্ধি)৷

স্বর্ণবাই (স্বর্ণবাই)—বাইজির নাম৷

চন্দ্রমুখী (দেবদাস)—চাঁদের সৌন্দর্যের সঙ্গে তুলনীয়৷

পিয়ারীবাই (শ্রীকান্ত)—প্রেম উদ্রেককারী৷

পান্না (অথৈ জল)—রত্ন বিশেষ৷ অঙ্গে ধারণ করা হয় (সৌন্দর্যবৃদ্ধি)৷

মুক্তো (জঙ্গম)—রত্ন বিশেষ৷ অঙ্গে ধারণ করে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়৷

কালোজাম (জঙ্গম)—ফল বিশেষ৷ খাওয়া হয়৷

আঙ্গুর (জঙ্গম)—ফল বিশেষ৷ খাওয়া হয়৷

টিয়া (জঙ্গম)—পাখি বিশেষ৷ খাঁচায় পোষা হয়৷

আসমানী (বৈতরণীর তীরে)—রঙ বিশেষ৷

সুন্দরী (লঘুগুরু)—সৌন্দর্যজ্ঞাপক৷

উত্তম (লঘুগুরু)—শ্রেষ্ঠ অর্থে৷

এই নামকরণের মধ্যেও যেন তাদের চারিত্রিক স্বতন্ত্রতা উজ্জ্বল হয়ে উঠে৷

এভাবে বিভিন্ন উপন্যাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বারবনিতারা তাদের বাচনিক স্বতন্ত্রতায় বিশেষ বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে অন্যান্য চরিত্রগুলির চেয়ে; তাদের এই ভাষা ব্যবহার তাদের নিজস্ব স্বরূপ ও অবস্থান বোঝাতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ৷

তথ্যসূত্র :

 ১. অভ্র বসু, বাংলা স্ল্যাং সমীক্ষা ও অভিধান, পৃ-২৪৷

 ২. সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত, পৃ-২৩৷

 ৩. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-১৬০৷

 ৪. তদেব, পৃ-২১৭৷

 ৫. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৯৫৷

 ৬. তদেব, পৃ-২১১৷

 ৭. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী (উপন্যাস, ২য় খণ্ড), পৃ-১৮৬৷

 ৮. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৩৬৷

 ৯. তদেব, পৃ-৩৬৷

 ১০. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪৪৭৷

 ১১. তদেব, পৃ-৪৩৭৷

 ১২. তদেব, পৃ-৪৩৯৷

 ১৩. তদেব, পৃ-৪৪৪৷

 ১৪. দুর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, পৃ-১৯৭৷

 ১৫. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুভদা, পৃ-২২৷

 ১৬. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৭৯৷

 ১৭. তদেব, পৃ-১৯৫৷

১৮. দুর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, পৃ-২৪২৷

১৯. তদেব, পৃ-২৫৭৷

২০. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী (উপন্যাস, ২য় খণ্ড), পৃ-৩২৩৷

২১. তদেব, পৃ-৫৩৫৷

২২. তদেব, পৃ-৫৩৫৷

২৩. তদেব, পৃ-৫১৭৷

২৪. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুভদা, পৃ-২২৷

২৫. তদেব, পৃ-২২৷

২৬. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪৪৪৷

২৭. তদেব, পৃ-৪৪৪৷

২৮. তদেব, পৃ-৪৫৭৷

২৯. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-১৬২৷

৩০. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৯৫৷

৩১. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী (উপন্যাস, ২য় খণ্ড), পৃ-১৪৩৷

৩২. তদেব, পৃ-১৪৪৷

৩৩. তদেব, পৃ-১৪৫৷

৩৪. তদেব, পৃ-৪৮৩৷

৩৫. তদেব, পৃ-৪৮৩৷

৩৬. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-২২৷

৩৭. তদেব, পৃ-৪২৷

৩৮. তদেব, পৃ-৪২৷

৩৯. তারাশঙ্কর রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-১৩০৷

৪০. বনফুলের রচনা সমগ্র (১ম খণ্ড), পৃ-৩০২৷

৪১. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪৩৮৷

৪২. দুর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, পৃ-১০২৷

৪৩. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী (উপন্যাস, ২য় খণ্ড), পৃ-২৯৩৷

৪৪. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৪২৷

৪৫. তারাশঙ্কর রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-৪১৷

৪৬. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-১৪৬৷

৪৭. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুভদা, পৃ-২২৷

৪৮. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, (সম্পাদিত) সঞ্জীব রচনাবলী, পৃ-১২৷

৪৯. তদেব, পৃ-১২৷

৫০. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪৬৪৷

৫১. মানিক উপন্যাস সমগ্র (১ম খণ্ড), পৃ-৭৫৯৷

৫২. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী (উপন্যাস, ২য় খণ্ড), পৃ-২৫৭৷

৫৩. দুর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগম, পৃ-২৯৪৷

৫৪. বঙ্কিম উপন্যাস সমগ্র, পৃ-৮১৯৷

৫৫. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি, পৃ-১৩৪৷

৫৬. তদেব, পৃ-১৩৪৷

৫৭. শরৎ রচনা সমগ্র, পৃ-১১৮৷

৫৮. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-১০৪৷

৫৯. তদেব, পৃ-২১০৷

৬০. তারাশঙ্কর রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-৭৬৷

৬১. তদেব, পৃ-৭৯-৮০৷

৬২. বনফুলের রচনা সমগ্র (১ম খণ্ড), পৃ-২৮৫৷

৬৩. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুভদা, পৃ-২২৷

৬৪. তদেব, পৃ-৯০৷

৬৫. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪৫৭৷

৬৬. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী (উপন্যাস, ২য় খণ্ড), পৃ-১০৮৷

৬৭. তদেব, পৃ-১০৮৷

৬৮. তদেব, পৃ-২৪৫৷

৬৯. তদেব, পৃ-৯৭৷

৭০. তদেব, পৃ-৯৭৷

৭১. তদেব, পৃ-৯৭-৯৮৷

৭২. তদেব, পৃ-৩৭৭৷

৭৩. বনফুলের রচনা সমগ্র (১ম খণ্ড), পৃ-৩১৫৷

৭৪. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৭৮৷

৭৫. তদেব, পৃ-১৭৮৷

৭৬. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪২৯৷

৭৭. তদেব, পৃ-৪৩১৷

৭৮. তদেব, পৃ-৪৩২৷

৭৯. তদেব, পৃ-৪৩৬৷

৮০. দুর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, পৃ-২৭৩৷

৮১. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৭৮৷

৮২. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি, পৃ-১৩৪-১৩৫৷

 ৮৩. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী (উপন্যাস, ২য় খণ্ড), পৃ-৪৭১৷

 ৮৪. তারাশঙ্কর রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-১৯১৷

 ৮৫. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪৫৫৷

 ৮৬. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী (উপন্যাস, ২য় খণ্ড), পৃ-৫১৬৷

 ৮৭. তদেব, পৃ-৫১৬৷

 ৮৮. তদেব, পৃ-১০৪৷

 ৮৯. তদেব, পৃ-৪৮২৷

 ৯০. তারাশঙ্কর রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-১২৬৷

 ৯১. তদেব, পৃ-২৫৩৷

 ৯২. বনফুলের রচনা সমগ্র (১ম খণ্ড), পৃ-২৮৩৷

 ৯৩. তদেব, পৃ-৩০২৷

 ৯৪. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবদাস, পৃ-৮৫৷

 ৯৫. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৯৬৷

 ৯৬. মানিক উপন্যাস সমগ্র (১ম খণ্ড), পৃ-৭৫৯৷

 ৯৭. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী (উপন্যাস, ২য় খণ্ড), পৃ-২১১৷

 ৯৮. তদেব, পৃ-৪৮২৷

 ৯৯. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুভদা, পৃ-২৩৷

১০০. জগদীশ গুপ্ত, লঘুগুরু ও অসাধু সিদ্ধার্থ, পৃ-৩২৷

১০১. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৪০৷

১০২. তদেব, পৃ-৪২৷

১০৩. তদেব, পৃ-৪৩৷

১০৪. তদেব, পৃ-৯৯৷

১০৫. তারাশঙ্কর রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-৮১৷

১০৬. তদেব, পৃ-১২৬৷

১০৭. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৩৬৷

১০৮. তদেব, পৃ-১৬২৷

১০৯. তদেব, পৃ-১৬২৷

১১০. তদেব, পৃ-১৮০৷

১১১. তদেব, পৃ-২১৭৷

১১২. তদেব, পৃ-৮৯৷

১১৩. তদেব, পৃ-১৩৬৷

১১৪. তদেব, পৃ-১৩৬৷

১১৫. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৯৫৷

১১৬. জগদীশ গুপ্ত, লঘুগুরু ও অসাধু সিদ্ধার্থ, পৃ-৬৭৷

১১৭. তদেব, পৃ-৫৭৷

১১৮. তদেব, পৃ-৬১৷

১১৯. তদেব, পৃ-৫৭৷

১২০. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪৩৭৷

১২১. তদেব, পৃ-৪৩৯৷

১২২. তারাশঙ্কর রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-২২৭৷

১২৩. তদেব, পৃ-২২৮৷

১২৪. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৩৬৷

১২৫. তারাশঙ্কর রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-৪০৷

১২৬. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-২১২৷

১২৭. তদেব, পৃ-২৭১৷

১২৮. তদেব, পৃ-২৭১৷

১২৯. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪৪৫৷

১৩০. তদেব, পৃ-৪৪৫৷

১৩১. দুর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, পৃ-৩১২৷

১৩২. তদেব, পৃ-৩৯৷

১৩৩. তদেব, পৃ-২৪১

১৩৪. তদেব, পৃ-২৫৭৷

১৩৫. তদেব, পৃ-২৭৩৷

১৩৬. তদেব, পৃ-১০২৷

১৩৭. তদেব, পৃ-৩১১৷

১৩৮. তদেব, পৃ-৩৬৫৷

১৩৯. তদেব, পৃ-৩৯৷

১৪০. তারাশঙ্কর রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-১৪৬৷

১৪১. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-১৭৮৷

১৪২. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪৩৯৷

১৪৩. তদেব, পৃ-৪৪৭৷

১৪৪. তদেব, পৃ-৪৭৮৷

১৪৫. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি, পৃ-৮২৷

১৪৬. তদেব, পৃ-১৩৫৷

১৪৭. দুর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, পৃ-৩২৫৷

১৪৮. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৪২৷

১৪৯. তদেব, পৃ-২১৬৷

১৫০. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-২১২৷

১৫১. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি, পৃ-৭০৷

১৫২. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৬৫৷

১৫৩. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি, পৃ-৬৮৷

১৫৪. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবদাস, পৃ-৬৯৷

১৫৫. তারাশঙ্কর রচনাবলী (৫ম খণ্ড), পৃ-৮১৷

১৫৬. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪৩১৷

১৫৭. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-২১২৷

১৫৮. তদেব, পৃ-১৯৫৷

১৫৯. জগদীশ গুপ্ত, লঘুগুরু ও অসাধু সিদ্ধার্থ, পৃ-৬৯৷

১৬০. শরৎ রচনাসমগ্র, পৃ-৩৭৷

১৬১. দূর্গাচরণ রায়, দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, পৃ-২৩৮৷

১৬২. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত) রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী (উপন্যাস, ২য় খণ্ড), পৃ-১৮৬৷

১৬৩. তদেব, পৃ-৪৮৩৷

১৬৪. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-২০৷

১৬৫. তদেব, পৃ-৪১৷

১৬৬. তদেব, পৃ-৭৩৷

১৬৭. বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (২য় খণ্ড), পৃ-৪৩৪৷

১৬৮. তদেব, পৃ-৪৩৪৷

১৬৯. বনফুল, জঙ্গম, পৃ-২৪৷

১৭০. তদেব, পৃ-১৯৩৷

১৭১. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি, পৃ-৭০৷

১৭২. শরৎ রচনাসমগ্র, পৃ-৪৭৷

১৭৩. জগদীশ গুপ্ত, লঘুগুরু ও অসাধু সিদ্ধার্থ, পৃ-৪১৷

১৭৪. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৪২৷

১৭৫. তদেব, পৃ-২১০৷

১৭৬. তদেব, পৃ-৭৯৷

১৭৭৷ তদেব, পৃ-৮০৷

১৭৮. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শুভদা, পৃ-২২৷

১৭৯. সুকুমার সেন, ভাষার ইতিবৃত্ত, পৃ-২২৷

১৮০. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি, পৃ-১৩৬৷

১৮১. তদেব, পৃ-৭০৷

১৮২. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৩৯৷

১৮৩. শরৎ রচনাসমগ্র, পৃ-৩৭৷

১৮৪. শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দেবদাস, পৃ-৬৯৷

১৮৫. তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গণদেবতা, পৃ-৩৯৷

.

গ্রন্থপঞ্জি

ক. আকর গ্রন্থ :

১. কয়াল, অক্ষয়কুমার (সম্পাদিত) – ধর্মমঙ্গল রূপরাম চক্রবর্তী বিরচিত,ভারবি, কলকাতা, জানুয়ারি,২০১১৷

২. দেবী, কুমারী শ্রীমতী মানদা, – শিক্ষিতা পতিতার আত্মচরিত, অরুণা প্রকাশন, কলকাতা, জুলাই,২০১৩৷

৩. গাঙ্গুলী, শাশ্বতী, – সঞ্জয় ভট্টাচার্য : একটি পরিক্রমা, পুস্তক বিপণি, জানুয়ারী, কলকাতা, ২০১৫৷

৪. ঘোষ, উত্তম (সম্পাদনা) – বাৎস্যায়ণ প্রণীত কামসূত্র, সাহিত্য তীর্থ, কলকাতা, বইমেলা, জানুয়ারি,২০০৩৷

 ৫. চট্টোপাধ্যায়, তপনকুমার – গোপীচন্দ্রের গান : পাঠকের চোখে, প্রজ্ঞাবিকাশ, কলকাতা, জুলাই ২০১৪৷

৬. চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র -উপন্যাস সমগ্র, সাহিত্যম, কলকাতা, ১৪০৯৷

 ৭. চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র -দেবদাস, গীতাঞ্জলী, কলকাতা, ১৪০৯ বঙ্গাব্দ৷

 ৮. চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র – শরৎ রচনাসমগ্র (৩), বসাক বুক স্টোর প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৯৷

 ৯. চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র – শুভদা, ইউনাইটেড পাবলিশার্স, কলকাতা, ১৪০৮৷

১০. দাশ, নির্মল, – চর্যাগীতি পরিক্রমা, দে’জ পাবলিশিং,তৃতীয় সংস্করণ, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০০৫৷

১১. দেবশর্ম্মা, শ্রী তারাপ্রসন্ন কর্ত্তৃক অনুদিত ও সম্পাদিত – বাল্মীকি রামায়ণ (সরল বাংলা সার অনুবাদ), ওরিয়েন্টাল পাবলিশিং কোং, কলকাতা, ১৪ই মার্চ, ১৯৯৬৷

১২. নাগ, অরুণ (সম্পাদিত) -সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, আশ্বিন, ১৩৯৮৷

১৩. বনফুল – জঙ্গম, বাণীশিল্প, কলকাতা, জুলাই, ২০১০৷

১৪. বনফুল – বনফুলের রচনা সমগ্র (প্রথম খণ্ড ও ষষ্ঠ খণ্ড), বাণীশিল্প, কলকাতা, আগষ্ট, ২০১২৷

১৫. বনফুল – বনফুলের রচনাসমগ্র (চতুর্থ খণ্ড), বাণীশিল্প, আগস্ট, কলকাতা, ২০১২৷

১৬. বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার ও বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় (সম্পাদিত)- রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় রচনাবলী, (উপন্যাস) দ্বিতীয় খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, সেপ্টেম্বর ১৯৯৩, কলকাতা৷

১৭. বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার, – সঞ্জীব রচনাবলী (সম্পূর্ণ), মণ্ডল বুক হাউস, ১৮ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩, কলকাতা৷

১৮. বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাদাস, – বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড) শুভম, কলকাতা, দ্বিতীয় পরিমার্জিত সংস্করণ, জানুয়ারী, ২০১২৷

১৯. বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর – কবি, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, শ্রাবণ, ১৪২০৷

২০. বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর – গণদেবতা, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, কার্তিক, ১৪২০৷

২১. বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর – রচনাবলী (চতুর্থ ও পঞ্চম খণ্ড), মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, অগ্রহায়ণ, ১৪১৭৷

২২. বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ, – বিভূতিভূষণ উপন্যাস সমগ্র, (১ম-২য় খণ্ড), শুভম, জানুয়ারী, ২০১২, কলকাতা৷

২৩. বন্দ্যোপাধ্যায়, মানবেন্দু(সম্পাদিত) – কলহণ পণ্ডিত বিরচিত রাজতরঙ্গিণী, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলকাতা, বইমেলা, ২০১৩৷

২৪. বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক – মানিক উপন্যাস সমগ্র, (১ম ও ২য় খণ্ড), কামিনী প্রকাশালয়, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০১৭৷

২৫. বন্দ্যোপাধ্যায়, রঞ্জন (সম্পাদনা) – ইন্দ্রনাথ গ্রন্থাবলী (১-২ খণ্ড), দীপ প্রকাশন, ২০০৮, কলকাতা৷

২৬. বিনোদিনী দাসী – আমার কথা ও অন্যান্য রচনা, সুবর্ণরেখা, ১৩১৯৷

২৭. বিশী, প্রমথনাথ (সম্পাদিত) – ভূদেব রচনা সম্ভার, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, তৃতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ, ভাদ্র, ১৩৭৫৷

২৮. ভট্ট, মহাকবি সোমদেব – কথাসরিৎসাগর, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০১২৷

২৯. ভট্ট, মহাকবি সোমদেব বিরচিত – কথাসরিৎসাগর, পুনঃকথন অদ্রীশ বর্ধণ,পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০১২৷

৩০. ভট্টাচার্য, ডক্টর দেবীপদ, (সম্পাদিত) – গিরিশ রচনাবলী, (পঞ্চম খণ্ড), সাহিত্য সংসদ, তৃতীয় মুদ্রণ, এপ্রিল, ২০০২, কলকাতা৷

৩১. ভট্টাচার্য, মৌ (সম্পাদিত) – বেশ্যাপাড়ার পাঁচটি দুর্লভ সংগ্রহ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, জানুয়ারি, ২০১১৷

৩২. মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস বিরচিত – মহাভারত (১ম খণ্ড), আদিপর্ব, বর্ধমান রাজবাটী বঙ্গানুবাদ ভারবি, ১৩/১ বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রীট, কলকাতা-১২

৩৩. মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণ বেদব্যাস বিরচিত – মহাভারত (২য় খণ্ড), বনপর্ব ও সভাপর্ব, বর্ধমান রাজবাটী বঙ্গানুবাদ ভারবি, ১৩/১ বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রীট, কলকাতা-১২৷

৩৪. মাইতি, ড. খগেন্দ্রনাথ (সম্পাদিত) – আলালের ঘরের দুলাল এবং মদ খাওয়া বড় দায়/জাত থাকার কি উপায়, প্যারীচাঁদ মিত্র, করুণা প্রকাশনী, কলকাতা, ১লা বৈশাখ, ১৪১৩৷

৩৫. মিস, শেফালি – সন্ধ্যারাতের শেফালি, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড কলকাতা, ডিসেম্বর, ২০১৪৷

৩৬. মুখোপাধ্যায়, শ্রীভুবনচন্দ্র – হরিদাসের গুপ্তকথা, সটীক সংস্করণ, সম্পাদনা অর্ণব সাহা, সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০১৪৷

৩৭. মুখোপাধ্যায়, সুখময় (সম্পাদিত) – চণ্ডীমঙ্গল পরিক্রমা, প্রজ্ঞাবিকাশ, কলকাতা, ২০১৬৷

৩৮. রায়, শ্রীদুর্গাচরণ – দেবগণের মর্ত্ত্যে আগমন, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০০১৷

৩৯. রোজারিও, বকুল – ম্যলেন্স হান্না ক্যাথেরিন ফুলমণি ও করুণার বিবরণ, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩৷

৪০. সরকার, সৌমেন্দ্রনাথ – ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাংলা সাহিত্য, বর্ণালী, কলকাতা, জুলাই, ২০০১৷

৪১. সেন, দীনেশ চন্দ্র – মৈমনসিংহ-গীতিকা, প্রজ্ঞাবিকাশ, কলকাতা, মে, ২০১৬৷

৪২. সেন, সুকুমার (সম্পাদক) – শরৎসাহিত্যসমগ্র, দে’জ পাবলিকেশন, অষ্টম মুদ্রণ, শ্রাবণ ১৪২৩, কলকাতা৷

৪৩. সেন, সুকুমার (সম্পাদিত) – চণ্ডীমঙ্গল, সাহিত্য অকাদেমি, কলকাতা, ষষ্ঠ মুদ্রণ, ২০১৩৷

৪৪. সেনগুপ্ত, ডঃ সুবোধচন্দ্র, দেবীপদ ভট্টাচার্য (সম্পাদিত) – শরৎরচনাবলী, জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ শরৎ সমিতি, (পঞ্চম খণ্ড); স্নানযাত্রা, ১৪ আষাঢ়, ১৩৮৭৷

৪৫. হালদার, শ্রী গোপাল (প্রধান সম্পাদক) শ্রী বারিদবরণ ঘোষ (সম্পাদক) – শিবনাথ রচনাসংগ্রহ, সাক্ষরতা প্রকাশন/পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দুরীকরণ সমিতি, কলকাতা, ৩রা নভেম্বর, ১৯৭৫৷

৪৬. হালদার, শৈলেন্দ্র (সম্পাদিত) – মন্দমেয়ের উপাখ্যান, পারুল প্রকাশনী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০১৩৷

খ. সহায়ক গ্রন্থ :

১. আচার্য, অনিল ও অর্ণব সাহা

 (সম্পাদিত) – যৌনতা ও বাঙালি, অনুষ্টুপ, কলকাতা, বইমেলা, ২০০৯৷

২. আজাদ, হুমায়ুন – নারী, আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, আগষ্ট, ২০১২৷

৩. আহমেদ, শামিম – মহাভারতে যৌনতা, গাঙচিল, কলকাতা, জুলাই, ২০১৩৷

৪. কর, অরবিন্দ – আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও জগদীশ গুপ্ত,বইওয়ালা, কলকাতা, বইমেলা, ২০০৮৷

৫. গুপ্ত, ক্ষেত্র – বাংলা উপন্যাসের ইতিহাস, (১-৬ খণ্ড) গ্রন্থনিলয়, কলকাতা, ডিসেম্বর, ২০০৫৷

৬. ঘোষ, ড. জয়তী – বাংলা থিয়েটারের অভিনেত্রী সংগ্রাম ও সৃজনশীলতা, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা বইমেলা, ২০১২৷

৭. ঘোষ, ড. মীরা – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সমকালীন বাংলা কথাসাহিত্য, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, সেপ্টেম্বর, ১৯৮৪৷

৮. ঘোষ, দেবযানী – আয়নায় সারি সারি মুখ, সোনালিয়া, কলকাতা, বইমেলা, ২০১৫৷

৯. ঘোষ, বারিদবরণ (সম্পাদিত) – শিবনাথ শাস্ত্রী, রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ২০০৯৷

১০. ঘোষ, যতীন্দ্রমোহন – বঙ্গসাহিত্যে নকশা, পঞ্চপুষ্প, কলকাতা,আশ্বিন, ১৩৩৭ সন৷

১১. ঘোষ, শ্রীঈশানচন্দ্র, (অনুদিত) – জাতক, (১-৬ খণ্ড) করুণা প্রকাশনী, চতুর্থ মুদ্রণ, বৈশাখ, ১৪১১, কলকাতা৷

১২. চক্রবর্তী, বামনদেব – উচ্চতর বাংলা ব্যাকরণ, অক্ষর মালঞ্চ, কলকাতা, মার্চ, ২০১৩৷

১৩. চক্রবর্তী, সুমিতা, উপন্যাসের বর্ণমালা, পুস্তক বিপণি আগস্ট, ২০১৬, কলকাতা৷

১৪. চট্টোপাধ্যায়, তপনকুমার – আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রজ্ঞাবিকাশ, কলকাতা, জুন, ২০১৫৷

১৫. চট্টোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ – নিষিদ্ধ কথা আর নিষিদ্ধ দেশ, নিউ এজ পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০০৯৷

১৬. চট্টোপাধ্যায়, হীরেন, – উপন্যাসের রূপরীতি, দে’জ পাবলিশিং, জুন ২০১৭, কলকাতা৷

১৭. চন্দ, বীরেন, (সম্পাদিত), – বিষয় : বাংলা উপন্যাস সময়ের দর্পণে সমাজের প্রতিবিম্ব (সংযোজন খণ্ড), উত্তরধ্বনি, জানুয়ারী, ২০০৪, কলকাতা ও শিলিগুড়ি৷

১৮. জানা, স্মরজিৎ – জীবন, যৌনতা ও যৌনকর্মী, দুর্বার প্রকাশনী, কলকাতা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৮৷

১৯. জানা, স্মরজিৎ (সম্পাদিত) – ভাঙে যেন…, দুর্বার প্রকাশনী, কলকাতা, অক্টোবর, ২০০৮৷

২০. জানা, স্মরজিৎ, মৃণালকান্তি দত্ত (সম্পাদিত) – কখনও জিত কখনও হার, দুর্বার প্রকাশনী, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০১২৷

২১. দত্ত রায়চৌধুরী, প্রজ্ঞাপারমিতা – ‘ফুলমণি’ এল কলকাতা, উনিশ এবং বিশ শতকের নারী ও গণিকা সমাজ, গাংচিল, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০১৩৷

২২. দত্তগুপ্ত, শর্মিষ্ঠা ও অহনা বিশ্বাস (সম্পাদিত) – এগারোয় পা মেয়েদের অন্তরঙ্গ কথা, গাঙচিল, কলকাতা, এপ্রিল, ২০১৪৷

২৩. দাশ, শ্রীশচন্দ্র, – সাহিত্য সন্দর্শন, প্রজ্ঞাবিকাশ, ১৩৪৭, কলকাতা৷

২৪. দাস, জয়িতা – অন্তঃপুরের স্বর আত্মকথনের স্ত্রী-পর্ব, গাংচিল, কলকাতা, আগষ্ট, ২০১৪৷

২৫. দাস, বেলা – বাংলা উপন্যাসের উন্মেষ পর্ব বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, মহালয়া, ১৪২৩, কলকাতা৷

২৬. দাস, বেলা (সম্পাদিত) – সমাজ ও সাহিত্যে নারী অবস্থান ও নির্মাণ, একুশ শতক, কলকাতা, জুন, ২০১৩৷

২৭. নন্দী, রতনকুমার, – কর্তাভজা ধর্ম ও সাহিত্য, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা বইমেলা, ২০১৮৷

২৮. নাগ, মণি, ভট্টাচার্য, স্বাতী – দেবদাসী থেকে যৌনকর্মী ভারতে বারাঙ্গনাদের জীবন, দ্বীপ প্রকাশন, কলকাতা, ডিসেম্বর, ২০০৭৷

২৯. নাথ, মৃণাল, – ভাষা ও সমাজ, নয়া উদ্যোগ, জানুয়ারি, ১৯৯৯, কলকাতা৷

৩০. পাল, ড. মোহন – সংস্কৃত সাহিত্যের কয়েকটি দিক, প্রজ্ঞবিকাশ, কলকাতা, জানুয়ারি, বইমেলা, ২০১৩৷

৩১. প্রামাণিক, প্রতিমা – বিংশ শতাব্দীর উপন্যাসে পারিবারিক জীবন, প্রজ্ঞাবিকাশ, কলকাতা, আগষ্ট, ২০১২৷

৩২. বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবজিত (সম্পাদিত) – বাই-বারাঙ্গনা গাথা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০১৬৷

৩৩. বন্দ্যোপাধ্যায়, ধীরেন্দ্রনাথ – সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাস, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, কলকাতা,সেপ্টেম্বর, ২০১৫৷

৩৪. বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকুমার – বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা, মর্ডাণ বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৩৪৫৷

৩৫. বন্দ্যোপাধ্যায়, সরোজ – বাংলা উপন্যাসের কালান্তর, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, মাঘ, ১৪১৮৷

৩৬. বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিচরণ – বঙ্গীয় শব্দকোষ, প্রথম খণ্ড৷৷ অ-ন, দ্বিতীয় খণ্ড৷৷ প-হ, সাহিত্য অকাদেমি,২০১১৷

৩৭. বড়পণ্ডা, ড. দীপক – নাচনির কথা, দুর্বার প্রকাশনী, কলকাতা, (পরিবেশক, পুস্তক বিপণি, কলকাতা) ১লা এপ্রিল,২০০৭৷

৩৮. বসু, অভ্র – বাংলা স্ল্যাং সমীক্ষা ও অভিধান, প্যাপিরাস, কলকাতা, ডিসেম্বর, ২০১২৷

৩৯. বসু, স্বপন – সংবাদ-সাময়িক পত্রে উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ, দ্বিতীয় খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, অক্টোবর, ২০০৩৷

৪০. বসু, স্বপন, হর্ষ দত্ত (সম্পাদিত) – বিশ শতকের বাঙালি জীবন ও সংস্কৃতি, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, আগষ্ট, ২০১৫৷

৪১. বাগচি, যশোধরা – নারী ও নারীর সমস্যা, অনুষ্টুপ, কলকাতা, মার্চ, ২০১২৷

৪২. বিশ্বাস, অদ্রীশ ও আচার্য, অনিল (সম্পাদিত) – বাঙালীর বটতলা (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), অনুষ্টুপ, জানুয়ারি, ২০১৩৷

৪৩. বিশ্বাস, বনানী – যৌনকর্মীর জীবন, বাংলাপ্রকাশ, ঢাকা, ফাল্গুন, ১৪১৯৷

৪৪. ভট্টাচার্য, কাজল – কলগার্লের দুনিয়া, গাংচিল, জানুয়ারি, কলকাতা, ২০১০৷

৪৫. ভট্টাচার্য, দেবীপদ – উপন্যাসের কথা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ডিসেম্বর, ২০০৩৷

৪৬. ভট্টাচার্য, ধীরেশচন্দ্র – মহাভারতের নারী, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, জানুয়ারি, ২০১০৷

৪৭. ভট্টাচার্য, শ্রী আশুতোষ – বাংলা মঙ্গল কাব্যের ইতিহাস, এ মুখার্জী অ্যান্ড কোং প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, মে, ২০১৫৷

৪৮. ভট্টাচার্য, সুভাষ, – ভাষার তত্ত্ব ও বাংলা ভাষা, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, রবীন্দ্র জয়ন্তী, ২০১২, কলকাতা৷

৪৯. মজুমদার, সমরেশ – বাংলা উপন্যাসের পঁচিশ বছর, বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, কলকাতা বইমেলা, ২০০৮৷

৫০. মজুমদার, সমীরণ – গণিকা মুক্তি ও মর্যাদা, নিউ হরাইজন বুক ট্রাস্ট, বইমেলা, ২০০৬৷

৫১. মনিরুজ্জামান – উপভাষা চর্চার ভূমিকা, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, মে, ১৯৯৪, ঢাকা৷

৫২. মল্লিক, ভক্তিপ্রসাদ – অপরাধ জগতের ভাষা ও শব্দকোষ, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, নভেম্বর, ২০১১৷

৫৩. মাইতি, ড. খগেন্দ্রনাথ – ঊনবিংশ শতাব্দীর গদ্য নকশা সমাজ সমালোচনা ও গদ্য রীতির বিশিষ্টতা, করুণা প্রকাশনী, জানুয়ারি, ১৯৯৫৷

৫৪. মাসুদুজ্জামান – নারী যৌনতা রাজনীতি, বেঙ্গল পাবলিকেশনস লিমিটেড, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৩৷

৫৫. মিত্র, রাধারমণ – কলিকাতা দর্পণ, (প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্ব), সুবর্ণরেখা, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০১৪৷

৫৬. মুখার্জী, তরুণ – যৌনকর্মীদের আইনবন্ধু, সোনাগাছি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনসটিটিউট, কলকাতা, ডিসেম্বর, ২০১৩৷

৫৭. মুখোপাধ্যায়, অরুণকুমার – কালের প্রতিমা, (বাংলা উপন্যাসের পঁচাত্তর বছর : ১৯২৩-১৯৯৭), দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, এপ্রিল, ২০১০৷

৫৮. মুখোপাধ্যায়, অরুণকুমার – বাংলা কথাসাহিত্য জিজ্ঞাসা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, জ্যৈষ্ঠ, ১৪১১৷

৫৯. মুখোপাধ্যায়, ড. প্রার্থনা – গণিকাপুরাণ, মৌসুমী প্রকাশনী, কলকাতা, বইমেলা ২০০১৷

৬০. মুরশিদ, গোলাম – নারী প্রগতির একশো বছর রাসসুন্দরী থেকে রোকেয়া, অবসর, ঢাকা, বইমেলা, ২০১৩৷

৬১. মৈত্র, অমিত – রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, জানুয়ারি, ২০০৪৷

৬২. রায়, নীহাররঞ্জন – বাঙালীর ইতিহাস (আদি পর্ব), দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৩৫৬৷

৬৩. রায়, সত্যেন্দ্রনাথ – বাংলা উপন্যাস ও তার আধুনিকতা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, আগষ্ট, ২০০৯৷

৬৪. রায়চৌধুরী, গোপিকানাথ – দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যকালীন বাংলা কথা সাহিত্য, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, আগষ্ট, ২০১০৷

৬৫. শ’ রামেশ্বর – আধুনিক বাংলা উপন্যাসের পটভূমি ও বিবিধ প্রসঙ্গ, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪১৫৷

৬৬. শ’ রামেশ্বর – সংস্কৃত ও প্রাকৃত সাহিত্য সমাজচেতনা ও মূল্যায়ন, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ৯ই ফাল্গুন, ১৪১১৷

৬৭. শ’, রামেশ্বর, – সাধারণ ভাষাবিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা, পুস্তক বিপণি, ৮ই অগ্রহায়ণ, ১৪০৩, কলকাতা৷

৬৮. শ্রীকর্ণ – বাবুদের অন্দরমহল, দুর্বার প্রকাশনী, কলকাতা, নভেম্বর, ২০০১৷

৬৯. শ্রীপান্থ – দেবদাসী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, অগ্রহায়ণ, ১৪১৪৷

৭০. শ্রীপান্থ – বটতলা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০১০৷

৭১. সিকদার, অশ্রুকুমার – আধুনিকতা ও বাংলা উপন্যাস, অরুণা প্রকাশনী, কলকাতা, নভেম্বর, ২০০৮৷

৭২. সিংহ, কঙ্কর – ধর্ম ও নারীঃ প্রাচীন ভারত র‍্যাডিক্যাল কলকাতা, জানুয়ারি, ২০০৯৷

৭৩. সুর, ড. অতুল – দেবলোকের যৌনজীবন, জ্যোৎস্নালোক, কলকাতা, আশ্বিন, ১৩৯৬৷

৭৪. সেন, অরুণ – কোনারক যৌবন-মন্দির, প্রতিক্ষণ, কলকাতা, জানুয়ারি, ২০১১৷

৭৫. সেন মজুমদার, জহর – উপন্যাস সময় সমাজ সংকট, বুকস স্পেস, কলকাতা, জুলাই, ২০১০৷

৭৬. সেন, শ্রীসুকুমার – বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস (১-৫ খণ্ড), আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, জ্যৈষ্ঠ, ১৪১৭৷

৭৭. সেন, সুকুমার – ভাষার ইতিবৃত্ত, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৩৯৷

৭৮. সেনগুপ্ত, ড. প্রদ্যোত (সম্পাদিত) – নকশা: সেকাল একাল (প্রথম পর্ব), অঞ্জনা প্রকাশনী, কলকাতা, অক্টোবর, ১৯৮২৷

৭৯. হোসেন, মিতালী, ইরাজ হায়দার -নারী সতীদাহ ও পর্দাপ্রথা, জিৎ ইন্টারন্যাশনাল, কলকাতা, ফেব্রুয়ারি, ২০১৪৷

ইংরেজী সহায়ক গ্রন্থ :

1. Basham A.L, – The Wonder that was India, Picador, 2004.

2. Das, Sisir Kumar – A History of Indian literature (1800-1910 and 1911-1956), Sahitya Akademi, 2015.

3. Durbar Mahila Samanwaya Committee – Durbar a brief profile, Durbar Prakashani, Kolkata, December, 2011.

4. Durbar Mahila Samanwaya Committee – Community, led antitrafficking and child protection program, Durbar Prakashani, Kolkata, December, 2013.

5. Durbar Mahila Samanwaya Committee – Only rights can stop the wrong, Durbar Prakashani, Kolkata, January, 2013.

6. Murthy, Laxmi, -Meena Saraswathi Seshu, The Business of Sex, ZUBAAN, First published, 2013, New Delhi.

7. Rizvi, S.A.A – The Wonder that was India II, Picador India, 2005.

8. Sahni, Rohini, V. Kalyan Shankar, Hemant Apte, – Prostitution and Beyond An analysis of sex work in India, sage, New Delhi, 2008.

গ. পত্র-পত্রিকা :

১. আনন্দবাজার পত্রিকা,

 (দৈনিক পত্রিকা) -১৭.০৯.১৪ (রাজ্য-পৃ: ৩),

 ২৬.০৯.১৪ (আনন্দ প্লাস-পৃ: ৬),

 ২৮.০৯.১৪ (পৃ: ১০),

 ১২.১০.১৪ (রাজ্য-পৃ: ৪),

২৬.১০.১৪ (পৃ: ১৩),

 ২৮.১০.১৪ (বিদেশ পৃ: ৬),

২২.১১.১৪ (উত্তরবঙ্গ-পৃ: ২),

 ২৪.১১.১৪ (পৃ: ১),

 ০৫.১২.১৪ (পৃ: ৫),

 ২৮.১২.১৪ (পৃ: ৪),

 ২৩.১১.১৪ (রবিবাসরীয়-পৃ: ১)৷

২. উত্তরবঙ্গ সংবাদ,

 (দৈনিক পত্রিকা) -০৩.০৯.১২ (পৃ: ৪),

 ২১.১২.১২ (পৃ: ৪),

 ১০.০১.১৩ (পৃ: ৪),

 ২৫.০১.১৩ (পৃ: ৪),

 ২৬.০১.১৩ (শ্রীমতী পৃ: ১৩),

 ৩১.০৮.১৩ (শ্রীমতী পৃ: ১৩),

 ২৮.০৮.১৩ (পৃ ৪),

 ০৫.০৯.১৩ (পৃ: ৭),

 ১৮.০৯.১৩ (পৃ: ৩),

 ০৭.০৮.১৪ (পৃ: ৩),

 ২৩.০৯.১৪ (পৃ: ৬),

 ০১.১১.১৪ (পৃ: ৩),

 ১০.০১.১৫ (পৃ: ৯),

 ১৯.০৮.১৪ (পৃ: ৩)৷

৩. ঘোষ, অনিল, – অশেষ দাস (সম্পাদক) স্বদেশচর্চালোক, সমাজ ও সংস্কৃতির ষান্মাসিক গবেষণাপত্র, আদিরস সেকাল-একাল, শারদ, ২০১৬৷

৪. ঘোষ, অনিল, অশেষ দাস

 (সম্পাদিত) – স্বদেশচর্চা লোক, সমাজ ও সংস্কৃতির ষান্মাসিক গবেষণাপত্র, নানারূপে নারী সেকাল-একাল, জানুয়ারী, ২০১৮, মাঘ, ১৪২৪ বইমেলা সংখ্যা৷

 ৫. জানা, স্মরজিৎ (সম্পাদিত) – দুর্বার ভাবনা, (বিভিন্ন সংখ্যা)৷

৬. ধর, প্রসূন (সম্পাদক) – সংবর্তক, জন্মদ্বিশতবর্ষে প্যারীচাঁদ মিত্র বিশেষ সংখ্যা, জানুয়ারী, ২০১৬৷

 ৭. পুরকাইত, উত্তম (সম্পাদক), – জগদীশ গুপ্ত সংখ্যা, উজাগর,সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ষান্মাসিক, চতুর্থ বর্ষ, প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যা, ১৪২৪, উজাগর প্রকাশন, হাওড়া৷

 ৮. ফুয়াদ, আফিফ, (সম্পাদক) – দিবারাত্রির কাব্য, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় সংখ্যা, দ্বাবিংশ বর্ষ, তৃতীয় ও চতুর্থ সংখ্যা, কলকাতা৷

 ৯. বসু, সত্রাজিৎ (সম্পাদক) – স্বপ্নকল্পক, বিষয়বিশেষ: উনিশ শতকের বাংলা ও বাঙালী, প্রথম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর, ২০১২৷

১০. মুখার্জী, উদয় রতন,

 রঞ্জনা ভট্টাচার্য, – বাংলা উপন্যাসের দেরশো বছর (প্রথম পর্ব), হেমন্ত, ১৪২২, ডিসেম্বর, ২০১৫৷

১১. মুখার্জী, উদয় রতন, ভট্টাচার্য,

 রঞ্জনা (সম্পাদিত) – সাহিত্য তক্কো, চতুর্থ বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, ডিসেম্বর, ২০১৫৷

১২. মুখার্জী, উদয় রতন,

 রঞ্জনা ভট্টাচার্য (সম্পাদিত) -সাহিত্য তক্কো, বাংলা উপন্যাসের দেরশো বছর (দ্বিতীয় পর্ব) গ্রীষ্ম, ১৪২৩ (মে, ২০১৬)৷

১৩. সরকার, পুলক কুমার

 (সম্পাদক ও প্রকাশক) – শুভশ্রী, অভিনব সৃষ্টি: বাংলা কথাসাহিত্য, ৪৯ বর্ষ, ১৪১৭: ২০১০-১১৷

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(60)

Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
Ok, Go it!
Do you have any doubts? chat with us on WhatsApp
Hello, How can I help you? ...
Click me to start the chat...