বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ওয়াসিকা নুযহাত
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ওয়াসিকা নুযহাত
প্রকাশক – সৈয়দ রবিউজ্জামান
বইবাজার প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি- ২০২৪
প্রচ্ছদ – মাহামুদুল হাসান আসিফ
উৎসর্গ
আফসানা কাওসার
আমার বড়বোন, আমার আপু, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড!
আমার পরম নির্ভরতার নাম।
শৈশব থেকে আজ অবধি জীবনের প্রতিটি ধাপে
যাকে পাশে পেয়েছি।
ভূমিকা
কলোরাডোতে আমাদের প্রথম দিনটির কথা খুব মনে পড়ে। ডেনভার এয়ারপোর্টের বাইরে পা রাখা মাত্র আবিষ্কার করলাম তুলোর বৃষ্টি ঝরছে। তখন সন্ধ্যে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো পৃথিবী সাদা মশারির জালে আচ্ছাদিত হয়ে গেল। ভার্জিনিয়া থেকে কলোরাডো সাড়ে চার ঘণ্টার ফ্লাইট। আমরা ক্লান্ত শ্রান্ত অবস্থায় সম্পূর্ণ নতুন এক শহরের রাস্তায় নামলাম। প্রবল তুষার ঝড়ের মধ্যে। রাস্তাঘাট পিচ্ছিল। চারিদিক ঝাপসা। কিচ্ছু দেখা যায় না। যত দূর চোখ যায় শুধু সাদা বরফের তাণ্ডব। গাড়ি চালাতে গিয়ে আমার বর হিমশিম খাচ্ছিল। এই নিদারুণ শীতের দেশে কীভাবে টিকে থাকব সেই দুশ্চিন্তায় আমার মগজ জমে যাচ্ছে। অবশেষে দুর্যোগ ঠেলে গন্তব্যে পৌঁছুলাম। এরপর কেটে গেল দুটি বছর। রকি মাউন্টেন প্রাচীরের মতো ঘিরে ছিল আমাদের শহরটাকে। ঘরের জানালায় চোখ রাখলে অহোরাত্র চোখে পড়ত আকাশ ছোঁয়া অলৌকিক সুন্দর গিরিশৃঙ্গ। পাহাড় আমার এত আপন হয়ে গেলো, এত কাছের হয়ে গেলো, তবুও পাহাড়ের অপার রহস্য যেন ভেদ হলো না। এই রহস্য ভেদ হবার নয়। অভেদ্য সম্মোহনে বুঁদ হয়ে পাহাড় এবং পাহাড়ের বুকে জেগে থাকা সেই শহরের কিছু কাল্পনিক চরিত্র নিয়ে লেখা শুরু করলাম। এই লেখার মাধ্যমে নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশের পাঠকদের মনে বরফকুচির একটুখানি ডাক পৌঁছে গেলেই আমার লেখা সার্থক। পাঠকদের প্রতি রইল অশেষ আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
Book Content👉
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ১
তুষারকন্যা
সে অনেক কাল আগের কথা। তুষারাবৃত এক রাজ্যে বাস করত রাজা আর রানি। রানির কোলে জন্ম নিয়েছিল অপূর্ব সুন্দরী কন্যা। রাজা তুষারের মতো ধবল কন্যার নাম রাখলেন তুষারকন্যা। এই রূপকথা তো জানা আছে। কিন্তু আমাদের গল্প এমন এক তুষারকন্যাকে নিয়ে যার জন্ম কোন তুষারাবৃত দেশে হয়নি। সে জন্মেছিল নাতিশীতোষ্ণ নদীমাতৃক বাংলাদেশের এক মফস্সল শহরে। তার পিতা রাজা-মহারাজা নয়। স্থানীয় সরকারি বিদ্যালয়ের অঙ্কের শিক্ষক। এই সাধারণ শিক্ষকের ঘরে জন্ম নিল ধবধবে ফরসা পরির মতো এক দেবশিশু। মেয়ের মুখ দেখামাত্র পিতা নাম রাখলেন, ‘তুষারকন্যা!’
জন্মের ঠিক চব্বিশটি বসন্ত পার হওয়ার পর, মার্কিন মুলুকের এক সদ্য ফোটা ভোরের হিমবর্ষী আকাশের নিচে, প্রাণহীন জীর্ণ ঘাসের ওপর লেপ্টে থাকা হীরের টুকরোর মতো তুষারবিন্দুর দিকে নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে থেকে, স্কুল মাস্টারের সেই তুষারকন্যা আপনমনে কী ভাবছিল কে জানে! তার পরনের বসনখানি পিঙ্গল। একটি সুতির ওড়না জড়ানো মাথায়। একটু আগে সে ফজরের নামাজ আদায় করেছে। হাতে এখনো ভাঁজ করা জায়নামাজ। জানালার পাল্লা বন্ধ। সারা ঘর হিটারের উত্তাপে উষ্ণ হয়ে আছে। বাইরে শীত মোড়ানো ভোরবেলা। বাড়ির অগ্র-পশ্চাতের রুক্ষ মাটি শুভ্র তুষারে ঢেকে গেছে। জানালার ধারঘেঁষেই সারিবাঁধা কয়েকটা ক্র্যাব অ্যাপল ট্রি। সেই গাছে এখন পাতা নেই, ফল নেই, আছে তুষারের সাদা ফুল। শ্বেত রঙের নিষ্কলুষ প্রকৃতির ওপর ধীরে ধীরে ভোরের নরম আলোর প্রলেপ পড়ছে। চারপাশ অদ্ভুত নিস্তব্ধ। পাখির কোলাহল নেই। বাতাসের চলাচল নেই। পিতা আদর করে তুষারকন্যা নামকরণ করলেও সেই নাম পরবর্তীতে টিকল না। স্কুলে ভর্তির সময় নাম পাল্টে রাখা হলো নিষাদ হায়াত। ডাক নাম নিশা। বাবা ছাড়া অন্য কেউ তুষারকন্যা বলে ডাকেনি কখনো। পদশব্দ কানে এসে লাগল। একটা চাপা কণ্ঠ ভেসে এলো দরজার ওপাশ থেকে, ‘বৌমা! উঠেছ ঘুম থেকে?’ নিশা তড়িঘড়ি করে সরে এলো জানালা থেকে। জুবিন বেবিকটে ঘুমোচ্ছে অঘোরে। কম্বল দিয়ে মোড়ানো ওর ছোট্ট শরীরটা। বছর দেড়েক বয়স হলো মেয়ের। নিশা খুব সাবধানে ছোট্ট জুবিনকে পুঁটলির মতো কোলে তুলে নিয়ে ঘরের দরজা খুলল। শাশুড়ি নাসিমা বেগম জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন দোরগোড়ায়। পুত্রবধূকে দেখা মাত্র হাত বাড়িয়ে নাতনিকে কোলে তুলে নিলেন। নিশা ব্যস্ত গলায় বলল, ‘দুপুরে কজন মানুষ খাবে মা?’
নাসিমা বেগম নাতনিকে বুকে জড়িয়ে ধরে ধীরস্থিরভাবে বললেন, ‘আমি তো ঠিক জানি না। জাহিদ বলেনি কিছু?’
একটা বুকচাপা শ্বাস পড়ল নিশার। জাহিদ, কাগজে-কলমে যে কি না তার স্বামী। সেই লোকের সঙ্গে সাংসারিক আলাপ করা নিশার জন্য এভারেস্ট জয় করার চাইতেও কঠিন! নিজের ঘরের চৌকাঠ থেকে ঠিক দশ কদম দূরের বদ্ধ দরজাটার দিকে একবার অপাঙ্গে তাকাল সে। দরজার ওপাশের ছিমছাম কক্ষে প্রায়ান্ধকারে শায়িত আছে তার স্বামী, প্রথম স্ত্রীর বাহুবেষ্টনীর মধ্যে। আজ মঙ্গলবার। দুজনেরই অফিস আছে। ঠিক সাতটায় টেবিলে নাশতা চাই ওদের। আটটার মধ্যে অফিসের উদ্দেশ্যে যাত্রা। স্বামী-স্ত্রী দুজনে একই ব্যাংকে কাজ করে। সমবয়সি এই জুটির প্রেমের বিয়েটা হয়েছিল প্রায় বাইশ বছর আগে। জাহিদের প্রথম স্ত্রী ফারা শিক্ষিতা, আধুনিক এবং অতিশয় বুদ্ধিমতী। চল্লিশে এসেও তার যৌবন ক্ষয়ে যায়নি। ছিপছিপে দেহখানায় সাদা শার্ট, কালো স্কার্ট জড়িয়ে হাই-হিল জুতোয় টুকটুক শব্দ তুলে সে যখন বাড়ি থেকে বেরোয়, নিশা তখন বিহ্বল চোখে চেয়ে থাকে শুধু। এই অসম্ভব ব্যক্তিত্বময়ী, স্মার্ট, সুন্দরী মহিলাটির সঙ্গে কথা বলতেও ভয় হয় তার। কথা অবশ্য খুব একটা বলার প্রয়োজনও পড়ে না। শুধু শ্বশুর-শাশুড়ি ছাড়া এই বাড়িতে নিশার আপনজন বলতে কেউ নেই। আরেকজন আছে। পাতালঘরে সে মানুষের বাস। ল্যাংড়া খোঁড়া মানুষ। নিশারই মতো সেই যুবকটিও উনপাঁজুরে অভাগা বলেই তার সঙ্গে কথা বলতে পেরে অল্পবিস্তর স্বস্তির উদ্রেক হয় মনে।
কালারফুল কলোরাডো
ডেনভার এয়ারপোর্ট থেকে বেরোনো মাত্র চোখ ধাঁধানো সাদায় অর্ণবের মাথা প্রায় ঘুরে গেল। গায়ে কামড় বসাল হিম জমানো শীত। আজ পহেলা এপ্রিল। অন্য রাজ্যগুলোতে এর মাঝেই বসন্ত এসে গেছে। কিন্তু কলোরাডো এখনো শীতনিদ্রায় আচ্ছন্ন। এ যেন বাস্তব পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন এক জগৎ। আকাশ নেমে গেছে অনেক নিচে। বাড়ির ছাদে উঠলেই বুঝি বরফের মতো শীতল নিথর আকাশটাকে ছোঁয়া যাবে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছ হাজার ফিট উঁচু সমতল ভূমিতে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল অর্ণবের। হাওয়া এত ঠাণ্ডা যে শিরদাঁড়া কাঁপছে ঠকঠক করে। বিমানবন্দরের প্রস্থান দ্বারের সম্মুখবর্তী রাস্তায় বেশ কিছু গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বন্ধুবান্ধব বা স্বজনদের বরণ করে নিতে এসেছে অনেকেই। অর্ণবকে কেউ নিতে আসেনি। আসার কথাও না। গাড়ি ভাড়া করেছে অনলাইনে। রেন্ট-এ কারের অফিস থেকে সেই গাড়ি পিক করার কথা সকাল সাতটায়। সকালেও বেজায় ভিড়। কলোরাডো মার্কিন মুলুকের অন্যতম টুরিস্ট অ্যাট্রাকশন গুলোর একটি। একে বলা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সুইজারল্যান্ড। সারা বছর তাই পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে। শীতকালে ভিড়টা আরো বেশি করে জমে ওঠে। দেশ-বিদেশের নানা লোক ছুটে আসে হরেকরকম উইন্টার অ্যাডভেঞ্চারে মেতে উঠতে। রাস্তা পার হয়ে ছাউনি দেয়া বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়িয়েছে অর্ণব। তার গায়ে একটা ছাই রঙের জ্যাকেট। মাথায় হুডি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শাটল আসার কথা। শাটলে করে যেতে হবে রেন্ট-এ কারের অফিসে। বিমানবন্দর এলাকার মধ্যেই বেশ কয়েকটা রেন্ট-এ কারের অফিস আছে। আছে পার্কিং লট। কিন্তু সেসব অফিস এবং পার্কিং লট এত দূরে যে পায়ে হেঁটে যাওয়া প্রচুর সময়ের ব্যাপার। তাই যাত্রীদের জন্য শাটলের ব্যবস্থা আছে। এখন স্নোফল হচ্ছে না। একটু একটু রোদ চড়েছে আকাশে। অর্ণব শুনেছে কলোরাডোতে বছরের তিনশ দিনই রোদ ওঠে লোকে বলে এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে রৌদ্রকরোজ্জ্বল রাজ্য। এবারই প্রথম আসা। আসার পেছনের কারণটি বড় অদ্ভুত। শুধু অদ্ভুত না, অস্বস্তিকরও বটে। ভাবতে গেলেই মনটা শরমে একেবারে একটুখানি হয়ে যাচ্ছে। আমেরিকা এসেছিল দু বছর আগে এফ ওয়ান ভিসা নিয়ে। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স করার সুযোগ হয়েছিল। পরিবারের আর্থিক অবস্থা শোচনীয়। ভালো ছাত্র হওয়ায় জুটে গিয়েছিল ফুলফান্ড স্কলারশিপ। মাস্টার্স ভালোয় ভালোয় শেষ হয়েছে। সপ্তাহখানেক আগে তার ওপিটির দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েছে। হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে। এর মধ্যেই হঠাৎ ভাগ্যতারকা মুখ তুলে চাইল। আকাশ থেকে ঝুপ করে নেমে এলো অবিশ্বাস্য এক প্রস্তাব। প্রস্তাবটা এলো পিতার নিকটতম বন্ধুর মারফতে। বন্ধুর দুঃসম্পর্কের এক মামাতো ভাইয়ের পরিবার প্রায় চল্লিশ বছর ধরে কলোরাডোর বাসিন্দা। একমাত্র কন্যা বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে। পরিবারটির আর্থিক টানাপোড়েন নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে একাধিক স্থায়ী সম্পত্তি আছে। পাত্রীর বাবা একজন সচ্চরিত্র, শিক্ষিত, বাংলাদেশি মুসলিম পাত্রের সন্ধান করছেন। ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড জুতসই না হলেও আপত্তি নেই। অর্ণবের পরিবার ধনী নয়। বরং দরিদ্রই বলা চলে। বাবা বেকার। এক কালে ব্যবসা করত। এখন ব্যবসা-বাণিজ্য খুইয়ে এর-ওর কাছ থেকে টাকা ধার করে চলে। একমাত্র ছোটভাই ক্লাস টেনে পড়ে। মা মারা গেছে খুব ছোটবেলায়। পিতা সুযোগ পেলেই যার-তার সঙ্গে পুত্রের সাফল্যের গল্প শোনান। সেই সাফল্যগাথা শুনে পিতার বন্ধু খুশি হয়ে প্রস্তাবটা নিয়ে এলো। অর্ণব সুশিক্ষিত এবং বাংলাদেশি মুসলিম, চেহারাটাও চলনসই। সব কিছু একবারে খাপে খাপ। এই একটা বিয়ে তার পরিবারের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারে রাতারাতি। নিজের যোগ্যতায় ইউএস সিটিজেন হতে হলে বহুদিন ধৈর্য ধরতে হবে। টাকা-পয়াসার ব্যাপারও আছে। এক বছরের মধ্যে চাকরি না পেলে আমেরিকান সরকার ধাক্কা মেরে বের করে দেবে দেশ থেকে। এমতাবস্থায় আমেরিকান সিটিজেন পাত্রীর বিয়ের প্রস্তাবটা যেন তার জীবনে আশীর্বাদ হয়ে এসেছে। বিয়েটা একবার হয়ে গেলেই কেল্লা ফতে। খুব দ্রুত বাবা আর ছোটভাইকেও নিয়ে আসবে নিজের কাছে। লজ্জা যে হচ্ছে না তা নয়। একদম কুঁকড়ে গেছে ভেতরটা। কখনো ভাবেনি শুধু সুনিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়ার উদ্দেশ্যে অজানা-অচেনা একটা মেয়ের গলায় বিয়ের মালা পরাতে হবে। কিন্তু জীবন তো ফুলশয্যা নয়। বেঁচে থাকার তাগিদে মানুষকে অনেক অপ্রিয় কাজ করতে হয়। অর্ণব জীবনে কখনো ভালোবাসার স্বপ্ন দেখেনি। শুধু একটু ভালো থাকার স্বপ্ন দেখেছে। ভালো থাকতে কে না চায়? এই চাওয়ায় কোন দোষ নেই!
তুষারকন্যা যখন সৎ মা
বাবা বলেছিল তার তুষারকন্যা রাজকন্যা হয়ে জন্মায়নি বটে, কিন্তু একদিন সে ঠিক ঠিক রাজকন্যা হয়ে উঠবে। স্বপ্নের রাজারকুমার সাত সমুদ্দুর তের নদী পেরিয়ে এসে তাকে নিয়ে যাবে দূরের কোন এক স্বর্গরাজ্যে। নিশা স্বর্গের মতো সুন্দর রাজ্যে এসেছে এ কথা সত্য। কিন্তু রাজকন্যা হয়ে নয়। বরং রাজকন্যার সত্মা হয়ে। আজ তার স্বামীর প্রথম স্ত্রীর প্রথম কন্যাকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ। কন্যার বয়স একুশ। নিশা পাত্রপক্ষের আগমনের খবরটা পেয়েছে। কিন্তু কজন আসবে, কী ধরনের খাবার খাবে-এসব কিছুই তাকে বলা হয়নি। সে তড়িঘড়ি করে নাশতা তৈরি করছিল। ডিম ভাজি, হাতে বানানো রুটি আর কফি। এই বাড়িতে মেয়ের আধিক্য আছে। ভাশুরের ঘরেও দুটি মেয়ে। মূলত পুত্রের অভাব পূরণের উদ্দেশ্যেই এ সংসারে তার আগমন হয়েছিল। কিন্তু বিধাতার লিখন খণ্ডাবে কে? নিশার কোলজুড়ে জন্ম নিল এ পরিবারের চতুর্থ কন্যা, জুবিন।
মেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার সময় হয়েছে। সবাই ডাইনিংয়ে উপস্থিত। নিশা দ্রুত খাবার-দাবার এগিয়ে দিচ্ছে টেবিলে। মেয়েরা রুটি-ডিম খায় না। সিরিয়াল আর ওটমিল খায়। জাহিদ এবং তার প্রথম স্ত্রী ফারা উপস্থিত হলো মিনিট পাঁচেকের মধ্যে। নিশা সাধারণত টেবিল সাজিয়েই নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়। এরা কেউ তাকে পরিবারের সদস্য হিসেবে গণ্য করে না। সৎমেয়ে তুরিন চোখে চোখে তাকায় না। সামনে পড়লে এমনভাবে নাক কুঁচকে ফেলে যেন নিশা ডাস্টবিন থেকে উঠে এসেছে।
আজ জাহিদকে সরাসরিই প্রশ্ন করল নিশা, ‘দুপুরে কজন অতিথি আসছে?’
উত্তরটা এলো ফারার কাছ থেকে, ‘একজন আসবে। বাঙালি ছেলে। ভাত-মাছ খাবে। বারোটার আগেই রান্না কমপ্লিট করে ফেলবে।’ ফারা এমনভাবে কথাটা বলল যেন নিশা এ বাড়ির বাঁধা চাকর। বাড়ির সদস্যদের আদেশ পালন করাই যার একমাত্র কাজ। পাত্রপক্ষ সাধারণত দলবল নিয়ে আসে। একজন মাত্র লোক কখনো বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসতে পারে এটা ছিল ভাবনার অতীত। কপালে হালকা কুঞ্চন নিয়ে নিশা একটি ট্রেতে নাশতা গুছিয়ে নিতে লাগল। পাতালঘরের ছেলেটা ঘুম থেকে ওঠে খুব ভোরে। সকালের নাশতার পর বেচারার ওষুধ খেতে হয়। নিশা রোজ আটটার মধ্যে ওর ঘরে নাশতা নিয়ে যায়। আজকেও ব্যতিক্রম হলো না। খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে বেজমেন্টের দরজার দিকে এগোচ্ছিল। হঠাৎ শুনতে পেল সৎমেয়ে তুরিন চড়া গলায় বলছে, ‘ওই ল্যাংড়া ছেলেটাকে প্রতি বেলা খাবার খাওয়ানোর দায়িত্ব কি আমাদের? সে আমাদের কে হয়? আর উনারই বা এত কীসের গরজ? যখন তখন বেজমেন্টে রওয়ানা দেয়!’ নিশার মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিজের জন্য তার মন খারাপ হয় না একটুও। কিন্তু পছন্দের মানুষগুলোকে নিয়ে কটু মন্তব্য শুনলেই বুকে কাঁটার মতো কী যেন এসে বিঁধে।
শাহজিদ নিশার জন্যই অপেক্ষা করছিল। সিঁড়ির কাছ ঘেঁষে একটা হুইলচেয়ার। সেই হুইলচেয়ারে শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছে শাহজিদ।
—’গুডমর্নিং সানশাইন!’ এক গাল হাসি হেসে উজ্জ্বল গৌরবর্ণের যুবকটি নিশাকে অভিবাদন করল। এই একজন মাত্র মানুষ, যে কি না নিশাকে সত্যিকারের মানুষ মনে করে। যদিও নিশা জানে যে শাহজিদের উপযুক্ত সঙ্গীহওয়ার কোন যোগ্যতা তার নেই। এই বেদান্তবাগীশ পণ্ডিত যুবক হুইলচেয়ারে বসে একটা ল্যাপটপে মুখ গুঁজে অনলাইনে দিনরাত এত কাজ করে যে নিশা দুটি সবল পা নিয়ে ঘুরে বেরিয়েও সেসব কাজের সিকিভাগ সম্পন্ন করার কথা চিন্তা অবধি করতে পারে না।
খাবারের ট্রে পড়ার টেবিলের ওপর রাখল নিশা। চারপাশ বড্ড অগোছালো। ঘরটা আয়তনে খুব একটা ছোট নয়। সিঙ্গেল খাট, বিশাল আকারের ফ্রিজ, পড়ার টেবিল আর একটা ক্যাবিনেট অনায়াসে এঁটে গেছে। বামপাশের দেয়ালে সাদা পর্দায় ঢাকা একটি স্লাইডিং ডোর। দরজার ওপাশে ব্যাকইয়ার্ড। নিশার শ্বশুর মুর্তজা সাহেব আজ থেকে দু বছর আগে এই পঙ্গু ছেলেটিকে বেজমেন্টের ঘরটা বলতে গেলে দান করে দিয়েছিলেন। বাড়িতে কোন লিফট নেই। হুইলচেয়ার নিয়ে সিঁড়ি ভাঙা অসম্ভব ব্যাপার। তাই নিচতলার এই কামরা শাহজিদের জন্য সবদিক দিয়েই জুতসই। শাহজিদ এই পরিবারের কে হয়, প্রশ্নটার উত্তর খুব কমপ্লিকেটেড। সবাই এর উত্তর জানে, আবার কেউই যেন জানে না। এমনকি শাহজিদ নিজেও এসব নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসে না। নিশা জানতে চেয়েছিল প্রথম সাক্ষাতে। শাহজিদ ওর হ্যাজেল কালার চোখের মণিতে অদ্ভুত এক তরঙ্গ তুলে খুব ছোট্ট করে বলেছিল, ‘ফ্যামিলি!’ নিশার মনে হয়েছে সেই প্রথম এবং শেষবারের মতো শাহজিদ তার সঙ্গে মিথ্যে বলেছিল। এতে অবশ্য কিছু মনে করেনি সে। হয়তো মিথ্যেটা বলা প্রয়োজন ছিল। জীবনে কিছু কিছু মিথ্যের গুরুত্ব ঠিক সত্যেরই মতো, সেই মিথ্যেগুলো না থাকলে সত্যর প্রকাশ সুন্দর হয় না।
হুইলচেয়ারের হাতলসংলগ্ন একটা বাটন প্রেস করতেই চেয়ারটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। হাতে বাটার নাইফ তুলে নিতে নিতে গলায় নরম সুর টেনে নিয়ে শাহজিদ বলল, ‘তুমি না থাকলে আমার কী হতো নিশা?
নিশা পিঠময় ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো মুড়িয়ে খোঁপা বাঁধছিল। কথাটা শুনে মুচকি হাসল। এই পরিবারের কেউ কোনদিন মুখ ফুটে তার প্রশংসা করেনি। শাহজিদ যে রূপ-গুণের প্রশংসা করে একেবারে আকাশে তুলে ফেলে তা নয়, তবে সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে জানে। এই ন্যূনতম কৃতজ্ঞতা বোধটুকু বাড়ির অন্য কোন সদস্যের নেই। এলোমেলো বিছানাটা ঠিক করতে করতে একটু আদিখ্যেতার গলায় নিশা বলল, ‘আমি না থাকলে কে তোমাকে ব্রেকফাস্ট করাত? কে তোমার খবর রাখত? এক আমি ছাড়া তোমার আর আছে কে?’
শাহজিদ মাখনমাখা ব্রেডটোস্টে কামড় দেয়। মুখে মচমচ শব্দ তুলে বলে, ‘সত্যি! তুমি আমার সেভিয়র। তোমার করুণায়ই বেঁচে আছি।’
—‘বাজে কথা বলো না। তোমাকে আমি করুণা করতে যাব কোন দুঃখে? তুমি তো করুণার পাত্ৰ নও।’
—‘নই?’
—‘না নও।’
—‘পঙ্গু, বিকলাঙ্গ ব্যক্তিকে সবাই করুণা করে নিশা! তুমি যে আমার খেয়াল রাখো। এই খেয়ালটুকু করুণা থেকেই আসে।’
—‘চুপ কর। তুমি পঙ্গু না হলেও আমি তোমার টেককেয়ার করতাম।’ বলল নিশা একটু কমজোর গলায়। কারণ কথাটা সত্য নয়। শাহজিদ বিকলাঙ্গ বলেই নিশার ওর জন্য দরদ হয়। তা ছাড়া ওর প্রতিও বাড়ির লোকদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটা নিশারই মতো। দুজনেই এখানে অপাঙ্ক্তেয়, অবহেলিত। নিশা যদি কন্যার স্থলে একজন পুত্র সন্তানের জন্ম দিতে পারত, তবে হয়তো বাড়ির মানুষগুলোর কাছে সে বড় দুই জায়ের চাইতেও বেশি মূল্যবান হয়ে উঠত। যদিও এসব সাংসারিক মেকি মূল্যের কোন ব্যক্তিগত মূল্য নেই তার কাছে। স্বার্থের বিনিময়ে সুখ বা সম্মানের লেনদেনটা বাইরের লোকের সঙ্গে মানায়। পরিবারের লোকের সঙ্গে নয়। নিশা জানে শুধু নিজের নাড়িছেঁড়া কন্যাটি ছাড়া এ পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই। আশপাশের মানুষেরা কেউ তাকে জানে না, বুঝে না, এমনকি চেনেও না। ওদের আর দোষ কী? মাঝেমধ্যে তো নিশা নিজেকেই নিজে চেনে না। তার ভেতরকার আমিটা, প্রিয় বাবার তুষারকন্যাটা হারিয়ে গেছে আজ থেকে চার বছর আগে। যেদিন একটা কাগজে সাইন করে, সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ভদ্রলোকের নামমাত্র স্ত্রী হয়ে তাকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল। নিশা ক্রমেই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল। শাহজিদের কথায় ঘোর ভাঙল,
—‘আমি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হলে তুমি আমার ঘরে আসার সাহসই করতে না। তোমার বর তোমাকে আমার কাছে আসতেই দিত না!’
নিশা বেড কাভার টানটান করে বিছিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘খুব দিত! আমার কাজে-কর্মে তার কিছুই এসে যায় না। তা ছাড়া আমিও ওর সেন্টিমেন্টকে কেয়ার করি না। আমার শ্বশুর-শাশুড়িও কিছু মনে করতেন না কারণ আমার ওপর তাঁদের ভরসা আছে।
—’তাই?’
—‘ঠিক তাই!’
শাহজিদ হাসল। হাসলে ওর অনেক দিনের না কামানো দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলের আড়ালে থাকা ফরসা মুখখানায় আত্মবিশ্বাসের একটা প্রবল আলোড়ন খেলে যায়। এই আত্মবিশ্বাসটুকু অন্যান্য সাধারণ মানুষ থেকে ওকে আলাদা করে দেয়।
—‘তোমার নার্স আসার কথা না আজ? এখনো এলো না কেন?’ নিশার প্রশ্ন।
শাহজিদ ঠোঁট উল্টে বলল, ‘হু নোজ! পালিয়েছে মনে হয়!’
—‘হায় আল্লাহ। পালাবে কেন? অদ্ভুত কথাবার্তা!’
—‘পালালে দোষ কী? আমারও মাঝেমধ্যে খুব পালাতে ইচ্ছে করে জানো?’ একটু বিরতি নিয়ে কফির মগে চুমুক দিল শাহজিদ। ভ্রু জোড়ায় গম্ভীর ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘ইনফ্যাক্ট আমার মনে হয় তোমারও পালিয়ে যাওয়া উচিত এই নরক থেকে।’
নিশা কয়েক পা হেঁটে এগিয়ে স্লাইডিং ডোরের পর্দা সরাতে সরাতে বলল, ‘জুবিন না থাকলে সত্যি কবেই পালিয়ে যেতাম! মেয়েটার জন্যই পারছি না।’
পর্দা সরাতেই সকালের মিঠা রোদ এসে ঝিলিক দিল নিশার অপাপবিদ্ধ সুন্দর মুখখানায়। ওর পরনে একটা হালকা হলুদ রঙের সালোয়ার-কামিজ 1 মাথার ওড়না ঘাড়ে নেমেছে। শাহজিদ একটু ফিচেল গলায় বলল, ‘লেটস মেক অ্যা প্ল্যান। তুমি আর আমি পালিয়ে যাই চলো।’
কথাটা নতুন কিছু নয়। আগেও বলেছে শাহজিদ। নিশা তাই এক বিন্দুও বিচলিত না হয়ে পাশ কাটানো গলায় বলল, ‘বাইরে সুন্দর রোদ উঠেছে। এক রাউন্ড হেঁটে আসি চলো।’
—‘ঠাণ্ডা তো খুব!’
নিশা প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। ক্লজেট থেকে একটা লেদারের মোটা জ্যাকেট বের করে শাহজিদকে পরিয়ে দিল যত্ন করে। শাহজিদের ঘাড় পর্যন্ত গড়ানো ঈষৎ লালচে সিল্কি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছিল। কালো রঙের জ্যাকেট কোমরে এসে থেমেছে। জ্যাকেটের নিচে ট্রাউজার। ডান দিকের হাঁটুর পরেই শূন্যতা। পায়ের স্থান ফাঁকা এবং ঢলঢলে। বাঁ পা অক্ষত বটে কিন্তু দুটি আঙুল অনুপস্থিত। নিশা ওর আঙুলবিহীন পায়ের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, ‘একটু অপেক্ষা কর। আমি জ্যাকেট নিয়ে আসছি।’
শাহজিদ বিকলাঙ্গ বটে, কিন্তু বেকার নয়। পৃথিবীতে এরকম অনেক কাজ আছে যেগুলো করতে পায়ের প্রয়োজন হয় না, শুধু মগজ থাকলেই চলে। বছরখানেক হলো একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করছে। অফিসে যেতে হয় কদাচিৎ। বাড়ি থেকেই অনলাইনে কাজ করে। রোজ অফিস শুরুর আগে নিশা একবার ওকে নিয়ে হাঁটতে বেরোয়। হাঁটতে যাওয়ার জন্য কারো সাহায্য শাহজিদের প্রয়োজন হয় না। বাড়ির আশপাশের সমতল চত্বরে হুইলচেয়ার নিয়ে সে অনায়াসে ঘুরে বেড়াতে পারে। তবুও কেউ একজন সঙ্গে থাকলে ভালো লাগে। একটা সময় অগণিত মানুষের প্রিয় পাত্র ছিল। আসর জমানোর জন্য বাঙালি, ভারতীয়, আমেরিকান যেকোনো কমিউনিটির মিলনমেলায় ডাক পড়ত হরহামেশা। শীত কি গ্রীষ্ম, বছরের যেকোনো সময়ে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে রকি মাউন্টেনের উঁচু-নিচু শৃঙ্গে আরোহণ করা ছিল তার অত্যন্ত প্রিয় শখগুলোর একটি। একটা মাত্র দুর্ঘটনা জীবন বদলে দিয়েছে। যে মানুষগুলো সুস্থ স্বাভাবিক টগবগে শাহজিদকে একসময় মুগ্ধ চোখে দেখত, অনুকরণ করত, মনে মনে ঈর্ষা করত, সেই মানুষগুলোর চোখে তার জন্য এখন শুধুই অনুকম্পার উপস্থিতি।
নিশা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলো। গোলাপি রঙের একটা মোটা উলের জ্যাকেট এখন তার পরনে। গলায় মাফলার। বাইরে ঝকঝকে দিন। আকাশে নিখাদ নীলের ছড়াছড়ি। রোদ উপচে পড়ছে রাস্তার ধারের জমে থাকা সাদা বরফপুঞ্জে। নীল আর সাদা রঙের অদ্ভুত সুন্দর কারুকাজে মুখর হয়ে আছে পৃথিবী। বাতাস থমকে আছে। বরফ জমা গাছের ডাল একরত্তি নড়ছে না। তবুও প্রাণের অনাবিল সঞ্চারণ চারধারে। এমন আলো ঝলমলে বিশুদ্ধ সুন্দর দিনে মন খারাপের কোন অবকাশ নেই। গত বিকেলে নিশা শোভেল দিয়ে বাড়ির অগ্র-পশ্চাতের বরফ অপসারণ করার চেষ্টা করেছে। লাভ হয়নি খুব একটা। শাহজিদের হুইলচেয়ার এগিয়ে যাচ্ছিল। নিশা ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল ‘আজকে খুব বেশিক্ষণ হাঁটব না, কেমন? দুপুরে গেস্ট আসবে।’
শাহজিদ ঘাড় বাঁকিয়ে নিশাকে একবার দেখার চেষ্টা করল, ‘কে আসবে?’ নিশার শীত করছিল। বেরোবার আগে পায়ে মোজা পরতে ভুলে গেছে। পায়ের গোড়ালিতে একটুখানি খালি জায়গা পেয়েই নচ্ছার শীতটা বিষদাঁত বসিয়ে দিচ্ছে একদম।
—‘তুরিনকে দেখতে আসবে পাত্রপক্ষ।’
বিস্ময়টা লুকোতে পারল না শাহজিদ, ‘বলছো কী?’
—’হুম ঠিকই বলছি।’
—‘সিরিয়াসলি? ওই উইয়ার্ড মেইড ইন চায়নাকে কে বিয়ে করবে?’ নিশা হাসল, ‘যে কেউ!
—‘সেই বেচারার দুর্ভাগ্যের কথা চিন্তা করে আফসোস হচ্ছে।’
কথা বলতে বলতে ওরা বাড়ির সামনের রাস্তায় উঠে এসেছিল। ব্যাকইয়ার্ডের সঙ্গে লাগোয়া একটা পার্ক আছে। কিন্তু বরফ জমে থাকায় সেই পার্কে এখন হুইলচেয়ার নিয়ে যাওয়া কষ্টকর। অগত্যা নেইবারহুডের রাস্তা দিয়েই হাঁটতে হবে। তুরিনের গাড়িটা স্ট্রিট পার্কিং করা। গাড়ির ছাদ থেকে সে বরফ পরিষ্কার করছে। পাশে আনিতা দাঁড়িয়ে আছে। ব্লু কালারের পলিস্টারের জ্যাকেট পরেছে ও। মাথায় হুডি। কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ। দুবোনই কলোরাডো বোল্ডার ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করছে। বাড়ির কাছেই ওদের ক্যাম্পাস।
দৃশ্যটা প্রথমে শাহজিদের নজরেই পড়ল। বাঁকা একটা কাষ্ঠ হাসি হেসে বলল, ‘ওয়েল…স্পিক অব দ্য উইচ (witch) অ্যান্ড শি শ্যাল অ্যাপিয়ার!’
তুরিন ওদের লক্ষ করেছে। তার পরনে একটা হালকা বেগুনি রঙের লং কোট। কালো রেশমি চুলগুলো ছড়িয়ে আছে ঘাড়ে। তুরিনের নানাবাড়ি পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান। বংশগতভাবেই ওদের চেহারায় আদিবাসী ছাপ আছে। চোখদুটো ছোট, সরু আর কিঞ্চিৎ বাঁকানো। মুখের ছাঁচ লম্বাটে। কাঁচা হলুদের মসৃণ ত্বক। ছিপছিপে শরীরের গড়নটা ভারি নজরকাড়া। আনিতা তুরিনকে একটা খোঁচা দিল, ‘দ্যাখো দ্যাখো!’
তুরিন স্নো শাভল দিয়ে উইন্ডশিল্ডের বরফ ক্লিন করছিল। বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘দেখার কী আছে?’
—‘দ্যাখো তোমার স্টেপমাদার তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছে।’ এবার আনিতার কণ্ঠে আলগা রসের সঞ্চার হলো।
তুরিন এই কথার পিঠে কিছু না বলে কড়া চোখে একবার তাকাল হুইলচেয়ারে বসা শাহজিদের দিকে। শাহজিদ ওকেই দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই তুরিনের মুখটা থমথমে গম্ভীর হয়ে উঠল। দৃষ্টি সরিয়ে নিল চকিতে। তাড়া দিয়ে আনিতাকে বলল, ‘চলো চলো।’
আনিতা হাত তুলে থামিয়ে দিল ওকে, ‘আরে থামো। পাগলটাকে একটু দেখি। অনেক সুন্দর কিন্তু! দেখলেই কেমন যেন প্রেম প্রেম ফিল হয়।’
তুরিন ঝলসে উঠল একদম— ‘বন্ধ করো তোমার ফালতু প্যাঁচাল। ভীষণ বাজে তুমি!’
তুরিনের ওই রুষ্ট, কোপিত মুখশ্রীর দিকে বক্র চোখে চেয়ে থেকে শাহজিদ বলছিল, ‘এরকম ডাইনির মতো দেখতে একটা মেয়েকে কে বিয়ে করবে? সারাক্ষণ মুখটাকে এমন বানিয়ে রাখে কেন? সমস্যা কী এর?
নিশা মুচকি হাসল, ‘সমস্যা হলাম আমরা। আমাদেরকে সে অত্যন্ত অপছন্দ করে। তাই আমাদের সামনে এলেই ওর মুখটা আপনাআপনি কঠিন হয়ে যায়।’
তুরিন সেলফোনটা ভুলে রেখে এসেছিল বাড়িতে। মনে পড়তেই বাড়ির দিকে ফিরতে হলো তার। চকচকে রোদ তখন শাহজিদের ঈষৎ লালচে চুল আর দাড়িতে সোনালি পরশ বুলাচ্ছিল। হ্যাজেল রঙের চোখজোড়ায় খেলছিল ক্ষুরধার বিদ্বেষের চাপা স্ফুলিঙ্গ। তুরিনের পায়ে হাই-হিল বুটজুতো। তার হাঁটায় একটা চমৎকার ছন্দময় ভঙ্গি আছে। জুতোর হিলে টুকটুক শব্দ হচ্ছে আর গতির দমকে রেশমি চুলগুলো এদিক-সেদিক উড়ছে। দেখতে লাগছে বেশ! একজন শ্বেতাঙ্গ তরুণ পোষা কুকুর নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। তুরিনের চোখাচোখি হতেই হাসল সে। হাসল তুরিনও।
ওদিকে শাহজিদ পিঠ টান করে বসে আছে হুইলচেয়ারে। ওর পাশে নিশা। এদের দুজনকে একত্রে দেখলেই মনের মধ্যে একটা তেতো ভাব চিড়বিড়িয়ে ওঠে। নাহ তুরিন কোনদিন নিশাকে পিতার স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেনি। কিন্তু তার দাদা-দাদি তো করেছে। এমনকি এই মেয়ের গর্ভে জন্ম নিয়েছে তার পিতার দ্বিতীয় সন্তান। মফস্সলের গরিব এক পরিবার থেকে দাদাজান তুলে এনেছিল মেয়েটাকে। না খেতে পেয়ে মরে যাচ্ছিল এদের পরিবার। দাদাজান ছিল এদের ত্রাণকর্তা, রক্ষাকর্তা। মেয়েটির অন্তরে কি তিল পরিমাণ কৃতজ্ঞতা বোধ নেই? বাড়ির কেউ আপত্তি করে না বলেই দিনদুপুরে সবার সামনে প্রেম করে বেড়াবে? তুরিন শতভাগ নিশ্চিত এই শাহজিদ সুস্থ সবল মানুষ হলে কবেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালিয়ে যেত দুজনে। এমনটা হলেই খুব ভালো হতো। শিক্ষা হতো দাদাজানের। মনের এলোমেলো কূট চিন্তার প্রভাব তুরিনের মুখের চামড়ায় প্রত্যক্ষভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। কপালে কুঞ্চন, বোঁচা আদুরে নাকটায় অহংসর্বস্ব তাচ্ছিল্যের ঢেউ। নিশা রাস্তা পার হওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছিল। শাহজিদ ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘দাঁড়াও, একটা মজা দেখাই।’ কথাটা পুরোপুরি শেষ করার আগেই সে হুইলচেয়ারের বাটন প্রেস করে সপাং করে ঘুরে গেল। তারপর তুরিনের মুখোমুখি ফুটপাত দিয়ে চলতে আরম্ভ করল। তুরিন খুব বেশি দূরে ছিল না। হঠাৎ আবিষ্কার করল হুইলচেয়ারের পাগলটা মুখে ব্রুম ব্রুম শব্দ করতে করতে তার দিকেই এগিয়ে আসছে ঝড়ের গতিতে। হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল ভয়ে। জমে গেল পা। শাহজিদ তখন একেবারে কাছাকাছি এসে গেছে। মনে হচ্ছে হুইলচেয়ারটা এখুনি তুলে দেবে তুরিনের গায়ে। কী আশ্চর্য! সমস্যা কী পাগলটার? জানে মেরে ফেলতে চায় নাকি? অতর্কিতে পা চালাতে গিয়ে হাই-হিল জুতো ভারসাম্য রাখতে পারল না। রাস্তার ওপরেই ধপাস করে পড়ে গেল তুরিন পা ফসকে। করুণ আর্তনাদ ছিটকে এলো গলা থেকে। নিশা আর আনিতা দৌড়ে ছুটে গেল।
আনিতা চেঁচিয়ে গলা ফাটাচ্ছে, ‘হোয়াট দ্য হেল ম্যান? হ্যাভ ইউ গন ম্যাড? ইউ স্টুপিড সাইকোপ্যাথ!’
শাহজিদ হুইলচেয়ারটা রাস্তার ধারঘেঁষে দাঁড় করিয়েছিল। ধীরস্থির গলায় বলল, ‘আমি তো জাস্ট একটু মজা করলাম। উনি এতটা ভয় পাবেন কে জানত!’ একটু থেমে তুরিনের যন্ত্রণা কাতর মুখখানার দিকে চেয়ে খুব ব্যথিত হওয়ার ভান করে বলল, ‘হিল পরার অভ্যাস নেই মনে হয়। আজকেই প্রথম পরেছেন?’ তুরিনের মনে হলো কথা নয়, বরং জুতো ছুড়ে দিয়েছে কেউ তার মুখ বরাবর। সাপের মতো ফোঁস করে উঠে বলল, ‘ফাজলামো করার জায়গা পান না? আমাকে মেরে ফেলতে চাইছিলেন? ওয়েইট…আমি আপনার নামে অ্যাটেম্পট টু মার্ডারের কেস করব।’
নিশা বেশ অপ্রস্তুত বোধ করছিল। রাগ হচ্ছিল শাহজিদের ওপর। এসব ছেলেমানুষীর কোন মানে হয়? মেয়েটার পা ভেঙে গিয়ে থাকলে কী হবে এখন? ভয়ে আত্মা শুকিয়ে আসছিল। বাধ্যগত ভৃত্যের মতো তুরিনের প্রায় মচকে যাওয়া পা-টা মালিশ করে যাচ্ছিল সে। তুরিন এই খেদমতটুকুকে গ্রাহ্য করছে না। কুটিল বক্র চোখে চেয়ে আছে শাহজিদের দিকে। শাহজিদের মুখে আত্মবিশ্বাসের হাসি। বিকলাঙ্গ একটা লোকের এত আত্মবিশ্বাস আর সাহস কোত্থেকে আসে তুরিন কিছুতেই ভেবে পায় না। রাগে তার নিঃশ্বাসের সঙ্গে কাঠকয়লা পোড়া আগুন বেরোচ্ছে যেন। আনিতা ওর হাত চেপে ধরে দাঁড় করাবার চেষ্টা করছে। শাহজিদ ডাকল,
—‘নিশা চলে এসো। উনি ঠিক হয়ে যাবেন। ডোন্ট ওরি।’
তুরিন আনিতার কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে তখন। একটা খ্যাক দিয়ে নিশাকে বলল, ‘যান যান! আপনার বন্ধু ডাকছে। এখানে সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে আর ঢং করতে হবে না।’
নিশা অপমানটা হজম করল। সব সময় যেমন করে আরকি। গটগটিয়ে হেঁটে এসে শাহজিদকে বলল, ‘কী দরকার ছিল এমন একটা কাণ্ড করার? কোন বিপদ হলে কী হতো?’
শাহজিদ মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে উড়িয়ে দেয় কথাটা, ‘ধুর! এত ভয় পেলে হয় নাকি? ডাইনিটাকে একটু শিক্ষা দিলাম।’
—‘তুমি আসলেই পাগল হয়ে গেছ। এতই যখন নিজে নিজে চলতে পার তো আমাকে দরকার কী? একাই যাও। আমি যাব না!’
শাহজিদ হাত বাড়িয়ে নিশার ডান কবজিটা ধরল। নরম স্বরে বলল, ‘একা তো যেতেই পারি। কিন্তু তুমি পাশে থাকলে ভালো লাগে।’
তুরিন তেরছা চোখে দেখল দৃশ্যটা। চাপা গর্জনের সঙ্গে স্বগতোক্তি করল, ‘খুব বেশি বাড় বেড়েছে দুজনের। আজকেই আমি দাদাজানের সঙ্গে কথা বলব!’
শুভদৃষ্টি
কলোরাডোর আকাশ মুগ্ধ করল অর্ণবকে। এমন বিস্তৃত, খোলামেলা অপরিসীম আকাশ সে এর আগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না। শীতের বিষদাঁত সহ্য করেও রোদরশ্মি চাঁপা ফুলের মতো ফুটে আছে চারধারে। হাইওয়েতে উঠবার পর হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিল সে বুঝি রাস্তায় চলছে না বরং আকাশে ভাসছে। পিচঢালা রুপালি রাস্তা বয়ে চলেছে পর্বতবেষ্টিত সুবিস্তৃত মালভূমির বুক চিরে। পথের দু ধারে যতদূর চোখ যায় শুধু সমতল মাঠ-ঘাট, খেতের খামার, কৃষকদের বাড়িঘর। কোথাও আবার মাইলের পর মাইল পরিত্যক্ত জমি। দূরের পাহাড় চুড়োয় পুঞ্জীভূত বরফ। সকালের ঝিকিমিকি রোদ্দুরে পাহাড়টাকে মনে হচ্ছে যেন মাথায় হীরের মুকুট পরিহিত কোন গর্বিত রাজা। এই সেই স্বপ্নের রকি মাউন্টেন! রকি মাউন্টেন দেখবার বড় সাধ ছিল অর্ণবের। আজ সেই বহুদিনের আরাধ্য স্বপ্ন এমনভাবেই পূরণ হলো যে রকি পর্বতমালা কিছুতেই আর তার পিছু ছাড়ছে না। একেক রাস্তায় একেকরকম মোহনিয়া রূপ ধরে হাজির হচ্ছে সম্মুখে। ঠিকানা মোতাবেক বোল্ডার কাউন্টির লায়ন্স এলাকায় এসে টের পেল ডেনভার থেকেও আরো উঁচুতে পৌঁছে গেছে। আকাশের খুব কাছে। নেইবারহুডের সরু রাস্তাটা ছিমছাম। দুধারে ছবির মতো সুন্দর বাড়ি। ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়ে আছে লাল পাথর আর সবুজ বৃক্ষের পাহাড়। এখন যদিও লাল সবুজ রং অতটা আলাদা করা যাচ্ছে না। সর্বত্রই তুষারপাতের শুভ্র সাদা জাল।
বেশ নার্ভাস লাগছিল। চুপচাপ লাজুক ধরনের ছেলে অর্ণব। মেয়েদের সঙ্গে তো একেবারেই সহজভাবে কথা বলতে পারে না। কী করে পারবে? নারীবিহীন সংসারেই যে বেড়ে ওঠা তার! যার সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কথা সেই মেয়েটি কেমন মানুষ কে জানে! ছবি দেখেছে। চাইনিজ ছাপ আছে চেহারায়। ওই মেয়েটি কি তার ছবি দেখে পছন্দ করেছে? নাকি বাবা-মা জোর করে বিয়ে দেবার পাঁয়তারা করছে? এমনই অগণিত প্রশ্ন এবং সম্ভাবনার দোলাচলে মন ডুবিয়ে গাড়ি থেকে নামল অর্ণব। হাতে স্যুটকেস আর কাঁধে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে প্যাটিওর সামনে এসে দাঁড়াতেই প্রশ্নটা ছুটে এলো পেছন থেকে, ‘হাই দেয়ার! হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?’
চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে অর্ণব দেখল দুজন তরুণী দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। এর মাঝে একজনকে সে চেনে। এই সেই ছবির মেয়েটা। মেয়েটি হাঁটছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। অপর মেয়েটি শক্ত করে তার হাত ধরে আছে। অর্ণব কয়েক সেকেন্ড হতভম্ভ চোখে মেয়ে দুটোর দিকে চেয়ে রইল। তারপর বাধোবাধো গলায় বলল, ‘আমি অর্ণব। মেরিল্যান্ড থেকে এসেছি। আজ আমার আসার কথা ছিল। মুর্তজা সাহেব কি বাড়িতে আছেন?’
একটু থমকাল তুরিন। এই চিড়িয়াই তাহলে দাদাজানের পছন্দের পাত্র। বায়োডাটা পাঠানো হয়েছিল তাকে কিন্তু খুলে দেখার সময় বা রুচি কোনটিই হয়নি। বিতৃষ্ণা ভরা চোখ মেলে তাকাল তুরিন সামনে দাঁড়ানো যুবকটির দিকে। ছিপছিপে দোহারা শরীরে ছাই রঙের জ্যাকেট। গায়ের রং কালোর দিকে। শীর্ণ মুখ। চোখদুটো টানাটানা। হরিণের মতো। পুরুষ মানুষের চোখ এমন টানাটানা হতে তুরিন এর আগে কখনো দেখেনি। অর্ণব তাকাল সামনে দাঁড়ানো বোঁচা নাকের সুন্দরী মেয়েটার দিকে। প্রথম সকালের প্রখর আলোর বন্যায় এভাবেই হবু স্ত্রীর সঙ্গে শুভদৃষ্টি সম্পন্ন হলো অর্ণবের। কিন্তু মেয়েটির মুখে কোন ভাবান্তর নেই। কেমন যেন খটমটো আর উগ্র তার চোখের চাউনি I অর্ণব বিব্রত হয়ে পড়ল।
—‘দাদাজান এখন বাড়িতে নেই। বিকেলে ফিরবেন।’ উত্তর দিল আনিতা। অর্ণব মাথা নিচু করে বেশ লজ্জিত গলায় বলল, ‘জি উনি আমাকে আজ আসতে বলেছিলেন।’
—‘ভেতরে গিয়ে বসেন।’ আদেশটা ছুড়ে দিয়েই পোর্চের সিঁড়িতে পা রাখল তুরিন। আগের চাইতে কিছুটা সহজভাবে হাঁটতে পারছে সে এখন। পেছন ফিরে তাকানোর তাগিদ অনুভব করল না। অর্ণবকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেই ঢুকে গেল বাড়ির ভেতর। আনিতা তাড়া দিয়ে উঠে বলল, ‘তাড়াতাড়ি সেলফোনটা নিয়ে বেরিয়ে এসো। দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
তুরিনের গলার স্বর ক্লান্ত, ‘আমি আর যাব না আজ।’
—‘কেন?’
—‘ওই পাগলটাকে দেখলেই আমার দিন খারাপ যায়। আজ দিনের শুরুতেই এমন ঝামেলা বেঁধে গেল। না জানি আরো কী না কী বিপদ হয়। ভাললাগছে না কিছুই। অসভ্যটাকে একটা উপযুক্ত শিক্ষা না দিলে শান্তি হবে না।’
আনিতা সরু চোখে বলল, ‘আসলেই? নাকি বিয়ের পাত্র দেখে মাথা ঘুরে গেছে?’
—‘ওই খ্যাতটাকে পছন্দ হবে আমার? গেঁয়ো ভূত একটা।’
—‘অ্যাগ্রি উইদ ইউ। ভীষণ কালো!’
‘গায়ের রং কোন বিষয় না। বিষয় হচ্ছে ছেলেটা আনকালচার্ড, গাইয়া। গিয়ে দ্যাখ ঠিক মতো ইংরেজিও বলতে পারে না। দাদাজান মনে হয় পণ করেছে বাংলাদেশের সমস্ত গরিব-দুঃখী-গেঁয়োদের এই বাড়িতে এনে ঠাই দেবে। অসহ্য!’
বিষাক্ত বাসর
ফিরে এসে দেখা গেল শাশুড়িমা কিচেন কাউন্টারের টুলের ওপর বসে আছেন জুবিনকে কোলে নিয়ে। জুবিন ওর ছোট্ট হাত-পা ছুড়ে কাঁদছে। নিশা পড়িমরি করে মেয়েকে কোলে তুলে নিল। মেয়ে এখনো বুকের দুধ ছাড়েনি। কান্নার ধরন দেখে মনে হচ্ছে খিদে পেয়েছে। রান্নাঘরে শাশুড়ি ছাড়া কেউ নেই। নিশা শাশুড়ির পাশের টুলে বসে মেয়েকে খাওয়ানোর উদ্যোগ নিল।
—‘এত দেরি করলে কেন বৌমা?’
প্রশ্ন শুনে ঈষৎ অপ্রতিভ হয় নিশা। অন্যদিন চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটে। আজ আধাঘণ্টার ভেতরেই ফেরত এসেছে। সুতরাং বিলম্বের অভিযোগটা একেবারেই অযৌক্তিক, তবুও মাথা উঁচু করে স্পষ্ট স্বরে প্রতিবাদ করতে পারল না। কখনো পারেনি। ওর স্বভাবে বিদ্রোহ ব্যাপারটা নেই বললেই চলে। দুর্বল গলায় বলল, ‘আধাঘণ্টার মতো হয়েছে মা।’
মিসেস মুর্তজা শক্ত হলেন, ‘তোমার কী অত দায় পড়েছে ল্যাংড়া ছেলেটাকে প্রতিদিন বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার? লোকে মন্দ কথা বলে।’
নিশা চুপ করে রইল। তাকে নিয়ে আলোচনা করার মতো লোকের সংখ্যা খুব একটা নেই সংসারে। নিশার অস্তিত্ব শুধু বাড়ির কজন লোক ছাড়া বাদবাকি পৃথিবীর কাছে অপ্রকাশ্য। খুব অদ্ভুত হলেও ব্যাপারটা সত্য। নিশাকে আত্মীয়- স্বজনের সামনে যেতে দেয়া হয় না। ইদের দিন বা অন্য যেকোনো উৎসবমুখর সময়ে নিশা ওপরতলার কামরায় বন্দি থাকে। জুবিনকে সকলে ফারার মেয়ে হিসেবেই চেনে। জাহিদের সুবিশাল বন্ধুমহলের কেউই তার দ্বিতীয় স্ত্রী সম্পর্কে অবগত নয়। এ দেশে একই সঙ্গে দুজন স্ত্রী থাকা অবৈধ। শ্বশুর মুর্তজা সাহেব চতুর কৌশলে ব্যাপারটা সামাল দিয়েছেন। কাগজে-কলমে নিশার বিয়ে হয়েছিল জাহিদের এক কাজিনের সঙ্গে। সেই লোকের কাগজের বউ হয়ে নিশা আমেরিকায় এলো। মুর্তজা সাহেব ডিভোর্স করালেন অতি সত্বর। তারপর নিজের ছোট ছেলের সঙ্গে নিশার বিয়ে দিলেন। এই বিয়ের কোন রেজিস্ট্রেশন হলো না। শুধু আল্লাহকে সাক্ষী রেখে পাত্র-পাত্রি কবুল বলল। নিশার ক্যান্সার আক্রান্ত দরিদ্র বাবা সমস্তটাই মুখ বুজে মেনে নিলেন। মুর্তজা সাহেবের বদান্যতায় তার চিকিৎসা হচ্ছে। ছোট ছেলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। এই একটা বিয়ে নিশার পুরো পরিবারের ভাগ্য পাল্টে দিয়েছে।
নিশার নিরুত্তর বিষণ্ন বদনের দিকে চেয়ে মিসেস মুর্তজা বললেন, ‘অসহায় মানুষকে সাহায্য করবে ভালো কথা। দেখভাল করছ, যত্নআত্তি করছ, এই পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু রোজ রোজ বাইরে বেড়ানোর কী দরকার? বিষয়টা দৃষ্টিকটু।’
নিশা চুপ করে রইল। সারাদিনের মধ্যে সকাল বেলার ওই একটুখানি সময় প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয় সে। একমাত্র শাহজিদের সঙ্গেই মন খুলে কথা বলা যায়। একেবারে আপন লোকের মতো। মিসেস মুর্তজা কেশে একটু গলা পরিষ্কার করলেন। গম্ভীরভাবে বললেন, ‘শুনো বৌমা, সময় নষ্ট না করে খুব তাড়াতাড়ি আরেকটা বাচ্চা নিয়ে নাও। তোমার শ্বশুরও এটাই চায়। মন বলছে এবার ছেলে হবে।’
নিশা হতভম্ভ হয়ে গেল কথাটা শুনে। মিসেস মুর্তজা বলে চললেন,
—‘তোমার শ্বশুরের পঁচাত্তরের ওপরে বয়স হয়েছে। কোন সময় পরপারের ডাক আসে বলা যায় না। বুড়া মানুষটার অনেক শখ মরার আগে নাতির মুখ দেখার। আমি জাহিদের সঙ্গেও কথা বলেছি…’
বুকচাপা এক হাহাকারে পিষে গেল পাঁজরের হাড়। এইতো মাত্র সেদিন জুবিন এলো ওর কোল আলো করে। দু বছরও কাটেনি। এখনই আবার…?
বিয়ের প্রথম রাত। প্রাসাদতুল্য বাড়ির চকচকে কামরায় নববধূ সেজে বসে আছে নিশা। শুনেছে বরের বয়স সাঁইত্রিশ। নিশার কোন পছন্দের মানুষ ছিল না। পিতার পছন্দকে নিজের পছন্দ হিসেবে মেনে নেওয়ার জন্য সদা প্রস্তুত ছিল মনে মনে। নিজেকে বুঝিয়েছে খুব করে। বয়স কোন ব্যাপার নয়। মানুষটা যদি ভালো হয়, সচ্চরিত্র হয়, নিশা তাকে সর্বস্ব দিয়ে ভালোবাসবে। তার আজন্ম লালিত মধ্যবিত্ত ধ্যান-ধারণা এই বিয়েকে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করার জন্য তৎপর হয়ে ছিল।
বুকের মধ্যে অবাধ্য এক দাপাদাপি নিয়ে বাসরঘরের ফুলশয্যায় অপেক্ষা করছে সে। একটা সময় আবছায়া ঘরের ভেতর পা রাখল লম্বা চওড়া সুঠাম দেহের এক পুরুষ। ফ্যাকাশে আলোর ল্যাম্পশেড জ্বলছিল। কম্পিত বুক নিয়ে নিশা দেখতে পেল লোকটার পা অসম্ভব টলছে। পরনে পাঞ্জাবি। টকটকে ফরসা গায়ের রং। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা। টলমলে পা নিয়ে বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ল। নিশার মুখ অবনত। শরীরে কম্পন। এই রাতটাকে ঘিরে সব মেয়েদের মনে আলাদা রকমের স্বপ্ন থাকে। নিশারও ছিল। পাড়ার লোকে বলত ওর মতো সুন্দরী লাখে একটা পাওয়া যায় না। যে পুরুষ ওকে পাবে…সে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান। ফুল ফুটলে ভ্রমর তো আসেই। নিশার প্রেমে পড়া পুরুষের সংখ্যা কম ছিল না। একবার এক ছেলে আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে চাইল। এত এত প্রেমপ্রার্থীদের মধ্যে নিশা কারুকেই মন দিল না। তার মনটা সে সযত্নে তুলে রেখেছিল, অনেক বসন্ত ধরে জমিয়ে রেখেছিল…বিয়ের পরে নিজের স্বামীর হাতে তুলে দেবে বলে।
লোকটা কিছু বলছে না। বসে বসে একটু ঢুলছে মনে হয়। রোগীর মতো ঢুলছে কেন কে জানে! দেখতে তো বেশ হৃষ্ট-পুষ্ট-বলিষ্ঠ! নিশা চোখের কিনার দিয়ে দেখল একবার। লোকটা চশমা খুলে হাতে নিল। রাখল বিছানার পাশের নাইটস্ট্যান্ডের ওপর। হঠাৎ শুয়ে পড়ল বিছানায়। গোঙানির মতো কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ করল মুখ দিয়ে। নিশা শ্বাস রোধ করে অপেক্ষা করছে। কিছু তো বলবে তার সদ্য বিবাহিত বর! হ্যাঁ…বলল অবশেষে! ভাঙা-চড়া সাঙ্ঘাতিক এক আওয়াজ গলায় তুলে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘টেক অফ ইওর ক্লোদস।’
নিশা ইংরেজি অত ভালো বোঝে না। তার ওপর লোকটার উচ্চারণ দ্রুত, জড়ানো এবং অস্পষ্ট।
—‘জি?’
লোকটা একবারও তাকাল না ওর দিকে। ঘরের দেয়ালের দিকে চোখ ঠেকিয়ে কঠোরভাবে নির্দেশ দিল, ‘কাপড় খুলে এসো।’
শিউরে উঠল নিশা। অতিকায় এক ঐরাবতের পায়ের তলায় যেন থেঁতলে গেল মন!
—‘কী বলছেন?’
জাহিদ ঘুরে তাকাল। চোখ ফেলল নিশার মুখের ওপর, ‘এটা ছাড়া আর কী বলার আছে তোমাকে আমার? কী আশা করেছিলে তুমি?’
নিশা কাঁপছিল। প্রতিবাদের যথোচিত ভাষা মুখে আসছিল না।
—‘আমার সেলফিশ বাবা তোমাকে এখানে কেন ধরে নিয়ে এসেছে জানো তো? এনেছে সন্তান উৎপাদনের জন্য। তুমি নিশ্চয়ই সব জেনেশুনেই এসেছ। তাহলে এখন আপত্তি করছ কেন? তুমি কি ভেবেছিলে আমি তোমার সঙ্গে ভালোবাসার কথা বলব? প্রেমের কথা বলব?’ একটু থেমে বড় একটা শ্বাস টেনে নিল জাহিদ। চুপ করে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর গলার স্বর নিচের মাত্রায় নামিয়ে এনে কিছুটা নরমভাবে বলল, ‘আমি আমার স্ত্রী, কন্যাকে ভালোবাসি।
—‘আপনাদের ডিভোর্স হয়নি?’
—‘না হয়নি।’
নিশা পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাচ্ছিল না। রাগে, দুঃখে, অপমানে কাঁপতে কাঁপতে কোন রকমে বলল,
—‘আমাকে বলা হয়েছিল আপনার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়েছে।’
—‘মিথ্যে বলা হয়েছে। যদি ডিভোর্স হয়েই থাকত তাহলে আমার চাচাতো ভাইয়ের নকল স্ত্রী সেজে তোমাকে দেশ ছাড়তে হতো না।’ অসহায় কান্নায় নিশার কণ্ঠরোধ হয়ে এলো। তীক্ষ্ণ ছুরির আঘাতে বিদীর্ণ হতে লাগল বক্ষ। জাহিদ তখন মদ খেয়ে পাঁড়মাতাল। চিৎকার করে বলল,
‘ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছ কেন? ডু ইওর জব! কাম অন! এসো আমার কাছে। এসে আমাকে উদ্ধার কর! গিভ মি অ্যা চাইল্ড। গিভ মি অ্যা ফাকিং চাইল্ড অ্যানড লিভ মি এলোন!’ নিশা কিছু বলতে পারল না…নড়তে পারল না…হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল শুধু। খানিক বাদে জাহিদ গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। জেগে রইল নিশা। নববধূর সাজ সেজে একলা। পাগলের মতো পায়চারি করতে লাগল ঘরের ভেতর। একটা সময় ঘুমন্ত জাহিদের শরীরে ধাক্কা দিয়ে কান্নায় ফেটে পড়ে বলল, ‘কেন আমার এই সর্বনাশ করলেন আপনি? পিতার আদেশের বিরোধিতা করেননি কেন? আপনি তো অবুঝ বালক নন। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ!’
জাহিদ ঘুম চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে নির্জীব গলায় বলল, ‘আমার বাবার বংশধর চাই। ছেলে উত্তরাধিকার।’
—‘এর মানে বাবার সিদ্ধান্তে আপনার সমৰ্থন আছে!’
—‘দ্যাখো, তুমি চলে যেতে চাইলে যেতে পারো। আর যদি থাকতে চাও…প্লিজ আমাকে একটু সময় দাও। আমার প্রথম স্ত্রীকে আমি কখনোই ছাড়ব না। সে আমার সন্তানের মা।’
—‘উনি কি এই বাড়িতেই আছে?’
—‘কে?’
—‘আপনার প্রথম স্ত্রী।’
—‘কোথায় যাবে সে আমাকে ফেলে?’
বিশ্রী একটা অনুভূতি চিড়বিড়িয়ে উঠল শরীরে। কেউ যদি এক শিশি বিষ জোগাড় করে দিত, তবে এই মুহূর্তে গলায় সবটুকু উগড়ে দিয়ে বীতশ্রদ্ধ জীবনটার ইতি টানত নিশা। বিষ পেল না বটে, কিন্তু গভীর বিষাদের এক বিষাক্ত ছোবল কোত্থেকে যেন তেড়ে এসে রক্তের প্রতিটি কণিকায় মরণ জ্বালার সঞ্চারণ করল। সদ্য স্বজনহারা মানুষের মতো ডুকরে কেঁদে উঠল সে। ঠিক করল কাল সকালেই সব ছেড়ে-ছুড়ে দেশে ফিরে যাবে। কিন্তু হলো না। শ্বশুর মুর্তজা সাহেব সুকৌশলী জাঁদরেল লোক। মানুষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে কী করে নিজের আখের গোছাতে হয় তা খুব ভালো মতোই জানা আছে তার। নিশা থেকে গেল। এই থাকার বিনিময়ে বাংলাদেশে তার পরিবার একটি সুনিশ্চিত সচ্ছল জীবন অর্জন করল। এ এক বিশাল প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তির জন্য নিজেকে জ্যান্ত কবর দিতেও দ্বিধা করবে না সে।
—‘কী হইল বৌমা? কিছু বলছো না যে?’
শাশুড়ির প্রশ্নে ঘোর ভাঙল নিশার। জুবিন ঘুমিয়ে পড়েছে। ওকে শাশুড়ির কোলে তুলে দিয়ে নির্জীব গলায় বলল, ‘জুবিনকে রাখেন মা।’
—‘তুমি আমার কথা বুঝছ? দ্বিতীয় সন্তান নেওয়ার এখনই সময়।’
নিশা উঠে পড়ল বসা থেকে।
—‘গুরুজনের কথার উত্তর না দেয়া বড় ধরনের বেয়াদবি।’
নিশা চুপচাপ প্যান্ট্রির দিকে এগিয়ে গেল। তার চোখে-মুখে পিত্তি-জ্বালানো রাগের ছাপ। ঠোঁট কাঁপছে। বুকে কান্নার ধোঁয়াশা।
ঘরের শত্রু বিভীষণ
দশটার দিকে তুরিন দৌড়ে এলো এক পাক। দৌড়ল শ্বেত শুভ্র তুষারঘেরা পাহাড়ের কোলঘেঁষা রাস্তায়…নীল ঝকঝকে আকাশের নিচে। ফিরে এসে নামল ব্যাক ইয়ার্ডের হট টাবে। জ্যাকেট, জুতো সব ছেড়ে শুধু সুইম স্যুট পরে বুদবুদ ওঠা উষ্ণ জলে নামতেই শরীর প্রসন্ন হয়ে উঠল। কানে হেডফোন গুঁজে মোবাইলে ছেড়ে দিল পছন্দের গান। খানিক দূরেই সেইন্ট ভেইন ক্রিক। ক্রিকের চারধারে আগাছা আর জঙ্গল। বরফে সাদা হয়ে আছে সব। জমে থাকা বরফ থেকে উড়ে আসছে হিম। হিম জড়ানো রৌদ্রকরোজ্জ্বল সাদা দিনের কাছে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সঁপে দিয়ে মনের ভেতরের মনে শান্তির তালাশ করছিল তুরিন। গায়ে গরম জলের ঢেউ এসে লাগছে, কানে অ্যাডিলের গান…কিন্তু মন মাছিটা উড়ে উড়ে শুধু একটা জায়গায় গিয়ে আটকা পড়ছে। নাহ…এভাবে ছেড়ে দেয়া যাবে না। সীমাহীন সাহস হয়ে গেছে ছেলেটার। কিন্তু কী করবে তুরিন? সরাসরি গালে একটা চড় বসাতে পারলে শান্তি হতো। এরপর যেদিনই ওর সঙ্গে পা মাড়িয়ে ঝগড়া করতে আসবে ওই অথর্ব, অসামাজিক, অভদ্রটা ঠিক এই কাজটাই করবে। ঠাস করে পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দেবে গালে। অশান্ত মন নিয়ে খুব বেশিক্ষণ শান্ত হয়ে জলে ডুবে থাকা সম্ভব হলো না। উঠে পড়ল। সুইম স্যুটের ওপর নীল রঙের একটা বাথরোব গায়ে জড়িয়ে হাঁটা দিল বাড়ির দিকে। ড্রয়িংরুমে এখনো গেঁয়ো ছেলেটা বসে আছে চুপচাপ। তুরিনকে দেখেই ধড়ফড় করে উঠে দাঁড়াল বসা থেকে। যেন তুরিন তার মুরব্বি। দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাতে হবে। কী বিরক্তিকর!
—‘বসেন বসেন। দাঁড়ানোর কী আছে?’
অর্ণব বাথরোব পরা ভেজা চুলের তুরিনের দিকে একবার তাকিয়েই লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিল। আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘না মানে…এমনি…!’
—‘এমনি এমনি অত সম্মান দেখানো আমার পছন্দ না। বুঝেছেন?’
অর্ণব মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। তার ওপর এমন স্মার্ট, সুন্দরী আর ধারালো মেয়ে! বাপরে বাপ কথায় কী তেজ! কী জৌলুস তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে, চোখের চাউনিতে! দেখলে বোঝা যায় পৃথিবীর কাউকে তোয়াক্কা করে না। অর্ণব বড় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে ক্ষয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাসটা একটু খানি ফিরিয়ে আনল। নত মুখে বলল, ‘ভদ্র আচরণ করা কি অন্যায়?’
তুরিন অপলক নেত্রে সামনে দাঁড়ানো জড়সড়ো আড়ষ্ট যুবকটিকে একবার আপাদমস্তক দেখে নিল। স্বভাবসুলভ খটোমটো গলায় বলল, ‘আমাকে এসব ভদ্রতা দিয়ে ইম্প্রেস করার চেষ্টা করে লাভ নেই। আপনি কী মতলবে এখানে এসেছেন তা আমি জানি। ওসব হবে না আগেই বলে দিচ্ছি।’
—‘না হলে আর কী করা। আপনার যদি আমাকে পছন্দ না হয়…আমি ফিরে যাব।’
—‘ভাবলেন কী করে আপনাকে আমার পছন্দ হবে? চেহারাটা কখনো দেখেছেন আয়নায়?’
—‘জি দেখেছি।’ অর্ধনিমীলিত চোখ তুলে অর্নব বলল।
—‘কেমন দেখেছেন?’
—‘ভালোই! দেখতে আমি অতটা খারাপ নই।’
—‘বাহ! নিজের সম্বন্ধে খুব উচ্চ ধারণা আছে দেখছি আপনার। ফালতু যত্তসব।’
কথাগুলো বারুদের মতো অর্ণবের মুখ পানে ছুড়ে দিয়ে গটগট করে হেঁটে জায়গাটা থেকে সরে এলো তুরিন। কিছুদূর গিয়ে থামল একবার। পেছন ফিরে তাকিয়ে ধমকের সুরে বলল, ‘খেয়েছেন কিছু?’
অর্ণবের আসলেই খুব খিদে পেয়েছিল। ভারি বিনীত গলায় উত্তর দিল, ‘জি না।’
তুরিন কোন কথা না বলে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। নিশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবজি কাটছিল ছুরি দিয়ে। দাদিজান জুবিনকে কোলে নিয়ে বসে আছে। তুরিন দাদিজানকে বলল,’ গেস্ট এসেছে। সকাল থেকে কিছুই খায়নি। এটা কেমন কথা দাদিজান?’
নাসিমা বেগম উঠে দাঁড়ালেন, ‘এই নে। তোর বোনকে ধর। নাশতা রেডি আছে। আমি এক দৌড়ে গিয়ে দিয়ে আসি।’
তুরিন বিরক্ত হলো, ‘আমার সারা গা ভেজা। বাচ্চা কোলে নিব কীভাবে?’ নাসিমা বেগম নাতনির প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করলেন। একরকম জোর করে জুবিনকে গুঁজে দিলেন তুরিনের কোলে। তুরিন কেমন শক্ত হয়ে গেল। এই বাচ্চার শরীরের তার পিতার রক্ত বইছে। বয়সে উনিশ বছরের ছোট। ভাবা যায়? নাহ…ভাবা যায় না…ভাবতে চায়ও না…অসহ্য একটা অনুভূতি হয় এসব মনে পড়লে। কিন্তু হাসিটা…কী মিষ্টি করে হাসে ওই একরত্তি মানুষটা! চাইলেও এর সঙ্গে রাগ করে থাকা যায় না। নিশা আড়চোখে দেখছিল। তুরিনের কুঁকড়ে যাওয়া ফ্যাকাসে মুখটা। আস্তে করে বলল, ‘নামিয়ে দাও, হাঁটবে। কোলে নিতে হবে না।’ তুরিন তৎক্ষণাৎ আদেশ পালন করল। বোনকে নামিয়ে দিল মেঝেতে। ছোট্ট জুবিন টুকটুক করে কয়েক পা হেঁটেও ফেলল। সারা দিনের মধ্যে এই একটা মাত্র ভালো ঘটনা ঘটল। তুরিন সেলফোন বের করে ছোট বোনের গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়ানোর দৃশ্যটা ভিডিও করতে লাগল।
.
মা এলো বিকেলে। আসতেই তুরিন রেগেমেগে বলল, ‘ওই ফাজিল ছেলেটা আজকে কী করেছে জানো মা?’
ফারা গায়ের কোট খুলে ক্লজেটের হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখল। কালো রঙের একটা স্কার্ট আর সাদা শার্ট তার পরনে। হাই-হিল জুতো। চুলগুলো চুড়ো করে খোঁপা বাঁধা। দারুণ ঝাঁ চকচকে। দেখলে বোঝা যায় না তুরিনের বয়সি মেয়ের মা।
—’কী করেছে?’
তুরিন মনের সব ঝাল মিটিয়ে সকালবেলার ঘটনাটা মায়ের কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বর্ণনা করল। শুনতে শুনতে ফারার প্রসাধন মাখা নিভাজ টানটান মুখের চামড়ায় আগুনের আঁচ এসে পড়ল। শ্বশুরের ওপর সে বহুদিন ধরেই অসন্তুষ্ট। ওই স্বৈরাচার, স্বার্থপর, বিষয়ী লোকটার সঙ্গে পাঁচ বছর ধরে একটা বাক্যও বিনিময় করেনি সে। বিকলাঙ্গ ছেলেটিকে বাড়িতে আশ্রয় দেয়াও ওই লোকের বহুবিধ স্বেচ্ছাচারী দুর্বিনীত কর্মকাণ্ডের একটি। কিছুক্ষণ কুঞ্চিত কপাল নিয়ে চেয়ে রইল ফারা। তারপর দ্রুত পায়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। সোজা নেমে এলো নিচে। তুরিন মাকে অনুসরণ করছিল। ফারা বেজমেন্টের দরজায় কয়েকবার ধাক্কা দিল। কোন সাড়া না পেয়ে দরজাটা এক টানে খুলে ফেলল। দরজার সামনে ছোট্ট একটা হলওয়ে। তারপর অন্ধকার সিঁড়ি। এ পর্যায়ে নিচ থেকে গলার আওয়াজ ভেসে এলো।
—‘কে?’
উত্তর না দিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল ফারা। তুরিন সিঁড়িঘরসংলগ্ন হলওয়েতে দাঁড়াল। নামল না নিচে। আরাম লাগছে এখন। মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে গলায় বিঁধে থাকা কাঁটা নেমে গেছে। আচ্ছা শিক্ষা হবে এবার ওই শয়তানটার।
শাহজিদ একটা কনফারেন্স কলে ছিল। ফারার আকস্মিক উপস্থিতির দরুন ব্রেক নিতে হলো। ক্যামেরা আর হেডফোন মিউট করে হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিল, ‘কী ব্যাপার?’
কোমরে হাত রেখে একটু বঙ্কিম ভঙ্গিতে দাঁড়াল ফারা, ‘তুমি নিজেকে ভাবো কী?’
শাহজিদ কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে কানের পেছনে আটকে দিল। নির্বিকার গলায় বলল, ‘আমি শাহজিদ আনাম। এটাই ভাবি।’
—‘তোমার সাহস কী করে হয় আমার মেয়েকে টিজ করার?’ অবাক হয় শাহজিদ, ‘টিজ করিনি তো!’
—‘তুমি আমার মেয়ের গায়ে হুইলচেয়ার তুলে দিচ্ছিলে। যদি কোন দুর্ঘটনা ঘটে যেত? তোমার এগেইন্সটে কেস করা উচিত।’
—‘ও আচ্ছা! এর মানে কমপ্লেইন গেছে আপনার কাছে।’ কথাটা বলে শাহজিদ আপন মনে কেমন যেন একটা ফিচেল এবং আমুদে হাসি হাসল। যেন কল্পনায় দেখতে পেল তুরিন কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে তার বিরুদ্ধে নালিশ করছে।
—‘আমার মেয়ে আমার কাছে কমপ্লেইন করবে না তো কার কাছে করবে? নাকি পুলিশ স্টেশনে যাওয়া উচিত ছিল ওর?’
শাহজিদ শ্রাগ করল, ‘কিন্তু আমি তো কিছুই করিনি। হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম হঠাৎ দেখি আপনার মেয়ে আমার সামনে! প্রায় পথ রোধ করে দাঁড়াল।’
তুরিন ওপরের সিঁড়িঘরে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। এই পর্যায়ে সে রাগ জবজবে কণ্ঠে স্বগতোক্তি করল, ‘মিথ্যুক!’
ফারা গরম তেলে পেঁয়াজ ছাড়ার মতো তেঁতে উঠে বলল- ‘দ্যাখো ছেলে, আমার শ্বশুরের সঙ্গে তোমার কীসের কমিটমেন্ট তা আমি জানি না। তবে জেনে রাখো, সন্তানের ভালোর জন্য আমি সব করতে পারি। কাউকে ভয় পাই না। আর কখনো যদি আমার মেয়ের দিকে নজর দিয়েছ তো সরাসরি পুলিশ কমপ্লেইন করব।’
শাহজিদ ওর দাড়ি-গোঁফ ভরা মুখে দুষ্টু হাসির স্পষ্ট একটা রেখা ফুটিয়ে তুলল। ডান গালে জিব ঠেকিয়ে কী যেন ভাবল খানিকক্ষণ। তারপর খুব মজার কোন কৌতুক শুনেছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘এই মাত্র কী বললেন আপনি? নজর দেব? আপনার মেয়ের দিকে? সিরিয়াসলি?’
সম্মুখে বসা বিকলাঙ্গ যুবকটির স্পর্ধা দেখে অবাক না হয়ে পারে না ফারা। বাবা-মা, ভাই-বোন কেউ নেই চোদ্দ গুষ্টিতে। শুনেছে আগে বেশ কিছু মেয়ে বন্ধু ছিল। ঠ্যাং হারিয়ে পঙ্গু হওয়ার পর মেয়েদের দল লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। এখন আশ্রিত হয়ে পড়ে আছে এ বাড়িতে। এত সাহস, এত আত্মবিশ্বাস, এত অহংকার কোত্থেকে আসে এর মাঝে? অপ্রতিরোধ্য রাগের হলকায় কণ্ঠ প্রায় রোধ হয়ে এলো ফারার। দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ‘ডোন্ট ট্রাই টু বি ওভারস্মার্ট।’
—‘আপনার মেয়ের দিকে নজর দেয়ার মতো নজরকাড়া সে নয়। আর আমার নজর তো এমনিতেও যত্রতত্র পড়ে না। সো এটা নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। আপনি বরং আপনার মেয়েকে একটু ডিসেন্ট হতে বলুন। সে মানুষ হচ্ছে না।’
—‘আমার মেয়েকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। তুমি আমার মেয়ের কাছ থেকে একশ হাত দূরে থাকবে। মনে থাকে যেন।’
শাহজিদ ওর আত্মবিশ্বাসময় ঝকঝকে হাসিটা একবার হেসেই হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে নিল ঝড়ের বেগে। দায়সারা কণ্ঠে বলল, ‘ইওর টাইম ইজ আপ। প্লিজ লিভ!’
তুরিন সরে পড়েছিল জায়গাটা থেকে। ক্রোধের অন্ধকারে চোখের দৃষ্টি ঢাকা পড়েছে। অপমানে জ্বলছে শরীর। গটগটিয়ে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সে। শেষ কথাটা কানের কাছে বিরক্তিকর বাদ্যযন্ত্রের মতো একটানা বেজে চলেছে, ‘আপনার মেয়ের দিকে নজর দেয়ার মতো নজরকাড়া সে নয়। আর আমার নজর তো এমনিতেও যত্রতত্র পড়ে না।’ সত্যিই কি তাই? তুরিনকে একটুও নজরকাড়া মনে হয়নি কখনো ওই অসভ্য ছেলেটার? তবে নজরকাড়া কে? তুরিনের সত্মা? বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী? একমাত্র বোনের গর্ভধারিণী?
কেউ কেউ একা
সন্ধ্যের পর শাহজিদের আর কিছুই করার থাকে না। ভিডিও গেমস খেলে কিছু সময় কাটায়, তারপর হয়তো পছন্দের বই নিয়ে বসে। ইউটিউবে সাবস্ক্রাইব করা দেশ-বিদেশের নিউজ চ্যানেলগুলো দেখে। মুভি দেখা হয় কদাচিৎ। খুব ভালো রিভিউ পেলে তারপর। আগে…যখন সে সুস্থ স্বাভাবিক আস্ত একটা মানুষ ছিল…যখন বাবা বেঁচে ছিল…তখন ডেনভারে একটা টাউন হাউসে থাকত ওরা। বাবা, বাবার গার্লফ্রেন্ড আর শাহজিদ। পাঁচ বছর বয়সে মাকে হারিয়েছিল। তারপর থেকে বাবার জীবনে আজকে এক গার্লফ্রেন্ড তো কালকে আরেক। মদ খেয়ে টাল হয়ে রোজ নতুন নতুন মেয়ে নিয়ে ঘরে ফেরা। শাহজিদ সারাদিন ডে-কেয়ারে। রাতে একলা খাটে ঘুম…বাসে করে একলা একলা স্কুলে যাওয়া-আসা…এভাবেই কেটে গেল ছয় বছর। এক গ্রীষ্মের ছুটিতে বাংলাদেশ বেড়াতে গেল বাবার সঙ্গে। নানিজান ফিরতে দিলেন না আর। বাবাও বেশ খুশি। পুত্র বিরহ তাকে কাবু করল না। বরং স্বাধীন উচ্ছন্ন জীবনে আর কোন পিছুটান রইল না ভেবে আনন্দে আটখানা হলেন। ঢাকার একটা অভিজাত ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি হলো শাহজিদ। পড়ার খরচ বাবাই বহন করেন। পিতা হিসেবে ওইটুকু দায়িত্বই তিনি পালন করেন। নানির বাসায় নানি আর ছোটমামাকে নিয়ে শাহজিদের দিনগুলো নিশ্চিন্তে কাটছিল। বাবাকে তেমন একটা মনে পড়ে না। মায়ের স্মৃতিও ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসছে। বাবা মাঝেমধ্যে নানারকম বিদেশি খেলনা কিনে পাঠায়। ষোল বছরের জন্মদিনে একটা হেলিকপ্টার কিনে পাঠাল। ব্যাটারি দিলে ওটা ফরফর করে উড়ে বেড়ায়। এই ছিল বাবার কাছ থেকে পাওয়া শেষ উপহার। কয়মাস বাদে বাবার কোলন ক্যান্সার ধরা পড়ল। যেদিন শাহজিদ ফিরে এলো কলোরাডোতে, বাবাকে এক নজর দেখবে বলে, ঠিক সেদিনই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। না, শেষ দেখা হয়নি বাপ-ব্যাটার মধ্যে। মাসদুয়েক পর নানিজানও পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন। প্রকৃতি যেন শাহজিদকে একা করে দেবার নিষ্ফল এক পরিকল্পনা এঁটে বসেছিল। তবুও জীবনতরী যে বাইতেই হবে! শাহজিদ একলা হাতেই এবার শক্ত করে বৈঠা চেপে ধরল। পারিবারিক জীবনে একের পর এক ঝড় ঝাপটা, উত্থান-পতন, প্রিয়জনের বিচ্ছেদ…এর কোনটাই তাকে টলাতে পারেনি। তার নিরিবিলি, নির্মক্ষিক, একলা জীবনে ভাবাবেগের কমতি ছিল বটে, তবে উদ্যমের অভাব ছিল না। বাকপটু, বুদ্ধিমান এবং কর্মঠ শাহজিদ তাই খুব অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নিল। পড়াশোনার পাশাপাশি পার্টটাইম জব, সন্ধ্যায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, উইকেন্ডে পর্বত আরোহণ…এই নিয়ে তার জীবনচাকা ঘুরছিল নির্বিঘ্নে। সবাই তাঁকে পছন্দ করে, যার সঙ্গে মেশে তাকেই বশ করে ফেলে তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্ব। বন্ধুদের আড্ডার মধ্যমণি সে। তাকে ছাড়া জমেই না। অ্যাঞ্জেলিনা নামের একটা রাশান মেয়ের সঙ্গে কিঞ্চিৎ ভাবের আদান-প্রদানও হয়ে গেল। রূপের প্রতি শাহজিদের তৃষ্ণা অতি ক্ষীণ। তার মন অন্য ধাতুতে গড়া। নারী দেহের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে বাহ্যজ্ঞান হারানো তার চরিত্রগত বৈশিষ্ট নয়। তার মন আরো উঁচুদরের কোন মনোহারিতার জন্য উন্মুখ। শরীরী অবয়ব সেই মনোহারিতার জোগান দিতে পারে না। তবে অ্যাঞ্জেলিনাকে একটু একটু ভালো লাগছিল। রকি মাউন্টেনে একসঙ্গে হাইকিং করত ওরা। একবার ক্যাম্পিংয়ে গিয়েছিল দল বেঁধে। তাঁবুর ভেতর অ্যাঞ্জেলিনাকে চুমু খেয়েছিল শাহজিদ। ওটাই ছিল জীবনের প্রথম চুম্বন। সখ্যতা জমে উঠেছিল। এমনকি লিভ টুগেদারের সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হয়নি দুজনে। পড়াশোনা শেষ। চাকরি খুঁজছে হন্যে হয়ে। শিগিরই একটা রেন্টেড অ্যাপার্টমেন্টে মুভ করবে ওরা। এমন সময়ে ঘটল দুর্ঘটনা। ওই একটা মুহূর্ত ফুডুত করে উল্টে দিল জীবনের পাতা। প্রথম কয়েক মাস আঞ্জেলিনা রোজ দেখতে আসত শাহজিদকে ফুলের তোড়া নিয়ে। আসত বন্ধুরাও। ধীরে ধীরে সবার আসা-যাওয়া কমতে লাগল। আগে যে যুবককে দেখলে, যার সঙ্গে কথা বললে লোকে অনুপ্রেরণা পেত, হারানো উদ্যম খুঁজে পেত, বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষা ফিরে পেত, এখন সেই যুবকের চারিপাশে শুধু ঘোর বিষণ্ণতা। এই নির্বাক নিরানন্দ উদাস পরিস্থিতি আর কত সহ্য করা যায়? সপ্তাহখানেক কেটে যাওয়ার পর অ্যাঞ্জেলিনা লাপাত্তা হলো। হঠাৎ এক বিকেলে আবার এলো সে। এবার ফুলের তোড়া সঙ্গে নেই। আছে নতুন বয়ফ্রেন্ড। শাহজিদ হাসিমুখে অভিবাদন জানাল ওর নতুন সঙ্গীকে। অ্যাঞ্জেলিনার ওপর কোন রাগ নেই তার। অভিমান হয়তো আছে। কিন্তু যে অভিমানের দাম থাকে না, সেই অভিমানের আয়ুও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
আজ সন্ধ্যের পর অরহান পামুকের একটা বই নিয়ে বসেছিল। বইয়ের নাম ‘ A strangeness in my mind’। গ্রাম্য সহজ-সরল এক যুবকের আখ্যান। গল্প বলার ধরন নিঃসন্দেহে চমৎকার। কিন্তু অতটাও মন লাগছিল না। মনে হচ্ছে ইংরেজি অনুবাদটা আরেকটু উন্নত হলে ভালো হতো। হুইলচেয়ারের হাতলে দু হাত রেখে দুই আঙুলবিহীন বাঁ পাটায় ভর দিয়ে সামান্য সময়ের জন্য উঠে দাঁড়াল সে। দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা ক্রাচদুটো বগলদাবা করল অতি দ্রুত। খুব অল্প কাজ। তবুও হাঁফ ধরে যায়। আগে এসব করতে দ্বিগুণ কষ্ট হতো। এখন আগের মতো কষ্ট হয় না। অভ্যাসের দাসত্ব কষ্টের প্রকোপ অনেকখানি কমিয়ে এনেছে। ক্রাচে ভর দিয়ে কয়েক কদম হাঁটল। বাঁ পায়ে একটা চপ্পল গলিয়ে স্লাইডিং ডোরটা খুলল এক হাত দিয়ে। উঠোনে লাল ইটের মেঝেওয়ালা চারকোনা পোর্চ আছে। বাঁ দিকের দেয়ালঘেঁষে একটা চেয়ার রাখা। ধীরেধীরে চেয়ারটার দিকে এগিয়ে গেল সে। আকাশে গোলাপি রঙের আভা। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা শুকনো গাছের ডালে সাদা বরফের প্রলেপ। পাহাড়ের চূড়োয় জমা শ্বেত বরণ তুষারের ছায়া পড়েছে রাতের আকাশে। ব্যাকইয়ার্ড ফেলে কয়েক কদম হেঁটে গেলেই ছোট একটা জাকুজি পুল। তার ঠিক পরে পাইন আর অ্যাস্পেন গাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সেইন্ট ভ্রেইন ক্রিক পর্যন্ত চলে গেছে উঁচু-নিচু মাটিযুক্ত এক সুঁড়িপথ। ব্যাকইয়ার্ডে বসলে ক্রিকের পানির শব্দ পাওয়া যায়। ক্রিকের ধারে বসে নেইবারহুডের ছেলেমেয়েরা আড্ডা দেয় প্রায়ই। গাঁজা খায়। গাঁজার গন্ধে ভরে থাকে বাতাস। কলোরাডোতে গাঁজা অবৈধ নয়। এই মাদকদ্রব্য সেবনে তাই কোন লুকোচুরির প্রয়োজন পড়ে না এখানে। শাহজিদ একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। ঠিক মাথার ওপরেই দোতলার কাঠের ডেক। পোর্চের চতুর্দিকে অবস্থিত চারটি কাঠের খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে ডেকটা। ডেকের রেলিংয়ের বাঁ পাশ ঘেঁষে একটা সিঁড়ি নেমে এসেছে পোর্চ পার্শ্বস্থ লনের মাঝ বরাবর। ওপরে কখনো যায়নি শাহজিদ। যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। নিশা মাঝেমধ্যে জুবিনকে কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। মুর্তজা সাহেবও আসেন কদাচিৎ, খোঁজখবর নিয়ে থাকেন। আজ কেউ আসবে কি না কে জানে!
তুরিন, আনিতা আর ওর ছোট বোন তানিশা প্রায়ই ডেকের ওপর দড়িলাফ খেলে। শাহজিদ পোর্চে বসে সিগারেট ধরালে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়ে যায় ওপরে। তুরিন কাশতে থাকে। এই কাশিটা মেকি বলে মনে হয় শাহজিদের। মেকি কাশি কাশতে কাশতে তুরিন খিটখিটে গলায় শাহজিদকে নিয়ে নানা কটু কথা বলে। শাহজিদ নির্বিকারে সবটা শোনে। কখনো কিছু বলে না। মাসখানেক আগের ঘটনা। ব্যাকইয়ার্ডের পোর্চে বসে ছিল। তখনো সন্ধ্যে হয়নি পুরোদমে। আকাশে গোধূলির রং ঠিক মতো ধরতে না ধরতেই তুলোর ঝরনা ঝরতে লাগল। মাথার ওপর ডেকের ছাদ থাকায় তুলোর বৃষ্টি শাহজিদকে সরাসরি ভেজাতে পারল না। তবে চোখে-মুখে বরফ কণা এসে লাগছিল। সিগারেট তখন শেষের পথে। এমন সময় তুরিন তার বান্ধবীকে নিয়ে জাকুজি পুলে নাইতে এলো। কনকনে ঠাণ্ডা বরফঝরা দিনে ছেলেমেয়েরা উষ্ণ জলের চৌবাচ্চায় নামবে, আমোদ-ফূর্তি করবে-এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু কী কারণে যেন শাহজিদ মনে মনে বিরক্ত হলো খুব। অপরিচিতা মেয়েটি সৌজন্য হাসি হাসল। আর তুরিন সব সময়ের মতো গম্ভীর, ভ্রুকুটিবক্র মুখ। রাগী চাউনি। মেয়েটি তুরিনকে প্রশ্ন করল, ‘ও কে?’
তুরিন সাবলীল ইংরেজিতে জবাব দিল, ‘একজন অসহায় মানুষ। আমার গ্র্যান্ডপা দয়া করে আশ্রয় দিয়েছে।’ কথাটা কেন যেন এত বিশ্রীভাবে কানে লেগে গেল যে অনেকক্ষণ অবধি শাহজিদ তার মস্তিষ্কের ঘেরাটোপে শুধু একটি বাক্যই প্রতিধ্বনিত হতে শুনল। কে যেন অট্টহাসি হেসে ভর্ৎসনা করতে লাগল অনবরত, ‘একজন অসহায় মানুষ…হ্যালো…তুমি একজন অসহায় মানুষ…অন্য লোকের দয়ায় বেঁচে আছ…তুমি জানো?’
মুর্তজা সাহেব এই বাড়িতে শাহজিদকে আশ্রয় না দিলেও সে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে পারত। তবুও তুরিনের বলা কথাটায় অমন খোঁচা লাগল কেন? হয়তো মেয়েটা শাহজিদের ভেতরকার অসহায়ত্বকেই ইঙ্গিত করেছে। কোনকোন নির্জন সন্ধ্যায় শাহজিদের খুব একলা লাগে। মনে হয় পাশে কেউ এসে বসুক। দু-চারটা কথা বলুক, বিকলাঙ্গ হিসেবে নয়, করুণা থেকে নয়, একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করুক। এই চাওয়া যখন অপূর্ণ থেকে যায়, তখন সত্যিই কী নিদারুণ এক অসহায়ত্ব মাতম তুলে বুকটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে একদম ছারখার করে দেয়! এই বিপুলা পৃথিবী নিষ্ঠুর এক অট্টহাসি হেসে কটাক্ষ করে বলতে থাকে, ‘তুমি একা! তুমি একা!’ তুরিন বোধহয় এই মানসিক অসহায়ত্বের কথাই ব্যক্ত করেছে তার বান্ধবীকে।
এক রত্তি বাতাস নেই। গাছপালাসহ গোটা আকাশ শীতের দাপটে জমে হিম হয়ে গেছে। হঠাৎ হঠাৎ থপ করে গাছের ডাল থেকে খসে পড়ছে বরফের গোলা। জলের কলতানের সঙ্গে মানুষের কণ্ঠস্বরও শোনা যায়। দু-একটা চাপা গলার স্বর। একটা কালো মোটা বুনো বিড়াল শাহজিদকে দেখে কোত্থেকে যেন ছুটে আসে অন্ধকার ফুঁড়ে। ওর পায়ের কাছে ঘুরঘুর করে। শাহজিদের মনে হয় তারই মতো বুনো বিড়ালটাও বুঝি একদম একা। আচমকা একটা আর্তচিৎকার আঘাত হানল কানের পর্দায়।
সতিনের সংসার
শাহজিদের ঘর থেকে ফিরে এসে ফারা তুরিনকে আর ত্রিসীমানায় খুঁজে পেল না। রাতে ডিনারের দাওয়াত আছে। তুরিনেরও যাওয়ার কথা। এদিকে শ্বশুরমশাইয়ের পছন্দের পাত্র এসে বসে আছে সকাল থেকে। ছেলেটার সঙ্গে এখন পর্যন্ত দেখা করার সুযোগ হয়নি। ঘড়ির কাঁটা সাতটার ঘর পেরিয়ে গেছে। জাহিদ ফেরেনি এখনো। দোতলার হলওয়ে ধরে অন্যমনস্কভাবে হাঁটছিল ফারা। সেলফোন হাতে নিয়ে জাহিদের নাম্বারে কল করতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে পাশের ঘর থেকে একটা পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে এলো। থমকে গেল পা। এই ঘরে নিশা থাকে তার বাচ্চাকে নিয়ে। জাহিদ এখানে কী করছে? ঘরের দরজা হাট করে খোলা। ফারা গলা বাড়িয়ে ভেতরটা দেখল একবার। নিশা কর্নারের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে। খুব সম্ভবত বাচ্চার খাবার রেডি করছে। জাহিদ বিছানার ওপর বসে আছে বাচ্চা কোলে নিয়ে। তার পরনে অফিসের শার্ট প্যান্ট, টাই। পায়ে বুট জুতো। বাচ্চাটা ছোট্ট হাত বাড়িয়ে জাহিদের পাতলা ফ্রেমের চশমা ধরার চেষ্টা করছে। হাতদুটো চশমা বরাবর এগিয়ে যেতেই জাহিদ মাথা পেছনে সরিয়ে নিচ্ছে। পুরো প্রক্রিয়াটাতে বাচ্চা খুব মজা পাচ্ছে। ফ্যাকফ্যাক করে হাসছে ফোকলা দাঁতে। হাসছে জাহিদও। দৃশ্যটা দেখে ফারার অন্তরের অন্দরমহলে অগ্নিলাভা জ্বলে উঠল ভস করে। যেদিন খবর পেয়েছিল নিশার গর্ভে পুত্রসন্তান নয়, এসেছে কন্যাসন্তান, সেই দিনটি ফারার জীবনের সবচেয়ে খুশির দিন ছিল। যেন একটা পাষাণভার নেমে গিয়েছিল বুক থেকে। কন্যাশিশুটির প্রতি শ্বশুরমশাইয়ের তেমন কোন স্নেহের প্রকাশ ছিল না প্রথমে। জাহিদ তো দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে বরাবরই উদাস। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর প্রথম দুমাস সে সন্তানকে কোলে নেয়নি। ফিরেও তাকায়নি। এই আচরণে ফারা সুখী ছিল, নিশ্চিন্ত ছিল। বাচ্চা তার দাদি এবং মায়ের কাছেই লালিত পালিত হচ্ছিল। এক ছুটির সন্ধ্যায় ভাশুর শহিদ এবং তার স্ত্রী নীলিমাসহ ডেকের ওপর বসে আড্ডা দিচ্ছিল সবাই। শ্বশুর-শাশুড়ি বাড়িতে অনুপস্থিত। জাহিদ গাড়ির ওয়ার্কশপে গিয়েছিল। ফিরেছে মাত্র। একটা চেয়ারে বসে জুতোর ফিতা খুলছে। ঠিক সেই সময় নিশা উদয় হলো দৃশ্যপটে। কোলের বাচ্চা কাঁদছে খুব। শ্বশুর-শাশুড়ি ব্যতীত পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিশার সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। ওর সঙ্গে কেউ প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না। পারতপক্ষে নিশা পারিবারিক আড্ডায় এসে বাগড়া দেয় না। সেদিন ওর আকস্মিক উপস্থিতিতে সকলে চমকে গিয়েছিল। একটা লাল রঙের ঢোলা-ঢালা নাইটি তার পরনে। চোখে-মুখে ক্লান্তি। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ডান গালে কয়েকটা চুল ঘামে লেপ্টে আছে। তবুও তাকে অপূর্ব সুন্দর লাগছে! নিশাকে দেখার আগে ফারার ধারণা ছিল শ্বশুরমশাই বাংলাদেশের অজপাড়াগাঁ থেকে গাইয়া একটা মেয়ে তুলে এনেছে। কিন্তু সেই গাইয়া মেয়েটাকে নিজ চোখে দেখার পর…বলতে নেই ভেতরে একটা দারুণ রকমের ধাক্কা এসে লেগেছিল। তার এতদিনের অহংকার, সাহস, আত্মবিশ্বাস সমস্তটাই যেন উবে গিয়েছিল হাওয়ায়। ফারা নিজে সুন্দরী বটে কিন্তু এতটাও নয়। এই মেয়ের ধারেকাছে সে দাঁড়াতে পারবে না।
নিশা কারো দিকে না তাকিয়ে ক্রন্দনরত জুবিনকে জাহিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে স্তিমিত কণ্ঠে বলল, ‘ওকে একটু রাখবেন কিছুক্ষণের জন্য? আমি বাথরুমে যাব। মা নেই বাড়িতে।’ জাহিদের চশমা পরা ভদ্র গোছের ফরসা, ধারালো মুখখানায় একটা অপ্রস্তুত ভাব খেলে গেল মুহূর্তের জন্য। সংকুচিতভাবে একবার তাকাল সে ফারার দিকে। ফারা চোখ সরিয়ে নিল। পরিস্থিতি সামাল দিতে নীলিমা বলল, ‘আমার কাছে দাও।’ জাহিদ চট করে উঠে পড়ল বসা থেকে। হাত বাড়িয়ে জুবিনকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ‘তুমি বসো ভাবি। আমি দেখছি।’ নিশা বাচ্চাকে বাপের কোলে তুলে দিয়ে প্রস্থান করল। সেই প্রথম জুবিনকে কোলে নিয়েছিল জাহিদ। ফারা দেখেছিল সেদিন ওর মুখটা। কী ঝলমলে! কী সুখী! পিতৃত্বের অহংকারে রমরম করছে ওই মুখ।
চুঁ শব্দটি না করে নিজের ঘরে ফিরে এল। শরীর কাঁপছে প্রতিবাদের জোয়ারে। বুকে আগুন। এর একটা বিহিত হওয়া দরকার। এভাবে চলতে পারে না। জাহিদকে দুই স্ত্রীর মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে। ফারা নিজেই খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নেবে। তুরিনকে নিয়েই যত চিন্তা। মেয়েটার বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। যা বদরাগী হয়েছে! ওর জন্য সহনশীল কোন সঙ্গী প্রয়োজন। যে ছেলেটি এসেছে আজ সকালে তার স্বভাবচরিত্র কেমন কে জানে! ফারা ঠিক করল এখুনি একবার ছেলেটির সঙ্গে দেখা করবে। দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলো সে।
বিনা মেঘে বজ্রপাত
সন্ধ্যা নেমে গেছে। লাল কুসুমের মতো সূর্যটা রকি মাউন্টেনের পেছনে এইমাত্র টুপ করে ডুবে গেল। সম্মুখের পাহাড়ের দিকে আনমনে চেয়ে থেকে সিগারেটে আগুন ধরিয়েছিল তুরিন। সে বসেছে ছাই রঙের একটা পাথরের ওপর। পাথরে বরফের আস্তর পড়েছিল। বসার আগে পরিষ্কার করতে হয়েছে। জল গড়ানোর শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই ধারেকাছে। তুষার ঢাকা সাদা ভূতের মতো গাছগুলো এক বিন্দুও নড়ছে না। হাওয়ার অস্তিত্ব নেই ত্রিভুবনে। তুরিনের গায়ে মোটা কাপড়ের জ্যাকেট। হাতে জ্বলন্ত সিগারেট নিয়ে স্থাণুবৎ হয়ে বসে আছে সে। হৃদয়জুড়ে একটা অহেতুক অকারণ হাহাকার বেজে চলেছে। শাহজিদের মুখ নিঃসৃত কথাগুলো কিছুতেই ভুলতে পারছে না। অপমান সহ্য করার ক্ষমতা নিয়ে সে জন্মায়নি। নিশা পারে, চুপচাপ মুখ বুজে সব কথা হজম করতে। কিন্তু তুরিনের মতো মেয়েরা অপমান সহ্য করা তো দূরে থাক তিল পরিমাণ অবহেলাও সইতে পারে না।
ক্রিকের ওপরে পারাপারের জন্য একটা ব্রিজ আছে। তুরিন দেখল ব্ৰিজ ধরে অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি এগিয়ে আসছে। ছায়ার অবয়ব দেখে চিনতে পারল। কার্লোস। এই পাড়ায়ই থাকে। হালকা-পাতলা বন্ধুত্ব আছে ওর সঙ্গে। হাই স্কুল পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছে। কার্লোস ব্রিজের মাঝ বরাবর এসে থমকে দাঁড়াল। সিগারেটের আগুনের ওঠানামা লক্ষ করল বোধহয়। চিৎকার করে ইংরেজিতে বলল, ‘কে ওখানে?’
তুরিন কোন উত্তর দিল না। চুপচাপ সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে লাগল। কার্লোস ব্রিজ থেকে নেমে পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো ক্রিকের ধারে। ওর হাতে ব্রান্ডির বোতল। হাঁটার ধরন অবিন্যস্ত। চলতে গিয়ে একবার বরফে পা পিছলে যাচ্ছিল। সামলে নিল।
—‘কী খবর?’ মাতাল গলায় প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে তুরিনের পাশে বসল কার্লোস, পাথরের ওপর। ব্র্যান্ডির বোতল এক চুমুকে শেষ করে ছুড়ে ফেলে দিল ক্রিকের স্রোতে। ঝপাং করে একটা শব্দ হলো জলে। তুরিন নিঃস্পৃহভাবে ধোঁয়া ছাড়ল সিগারেটের। ধোঁয়াটা সরাসরি কার্লোসের মুখে গিয়ে পড়তেই সে কেশে উঠল খুকখুক শব্দে। তুষারঢাকা সাদা রাত্তিরের একটা নিজস্ব আলো আছে। সেই আলোতে কার্লোস তুরিনের মুখখানা একবার ভালো মতো দেখে নিয়ে অস্পষ্ট জড়ানো গলায় বলল, ‘কী হয়েছে তোমার?’
তুরিন একটু সময় কার্লোসের ফরসা ফোলা ফোলা মুখটার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল, তারপর কেমন দ্বিধাজড়িত গলায় বলল, ‘আমাকে দেখে তোমার কী মনে হয়?’
—‘কী আবার মনে হবে?’
—‘না মানে…আমাকে কি তোমার কখনো অ্যাট্রাকটিভ মনে হয়নি? আমি কি যথেষ্ট সুন্দরী নই?’
প্রশ্ন শুনে কার্লোস একটু থমকাল। ঢোক গিলল একবার। তারপর আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। লুব্ধ গলায় বলল, ‘কে বলবে তুমি সুন্দর নও? কার এত স্পর্ধা?’
—‘বলেছে এক অহংকারী বাজে লোক!’
—‘আমি ওই লোকের মাথায় গুলি করে দেব। এসো আমার কাছে।’ কথাটা বলেই কার্লোস তুরিনকে দু হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরল। তুরিন এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল ওকে। কার্লোসের মাতাল শরীর ভারসাম্য ধরে রাখতে পারল না। পড়ে গেল পানিতে। চিৎকার করে একটা গালি ছুড়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার এত সাহস? তুমি আমাকে ফেলে দিলে?’
তুরিন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। ঘটনা এদিকে গড়াবে ভাবতে পারেনি। বেশ নার্ভাস লাগছে এখন। কম্পিত গলায় বলল, ‘তুমি কী করতে যাচ্ছিলে? এসব কী ধরনের অসভ্যতা?’
এদিকে জল তেমন গভীর নয়। অনেকদূর অবধি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পাথর। পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে ক্রিকের শীর্ণ স্রোত। কার্লোসের মাথায় বেশ লেগেছে। টনটন করছে ব্যথায়। তবে ব্যথার চাইতেও রাগের প্রাবল্য বেশি। হাঁটুজলে ডুবে আছে সে। তুরিন দাঁড়িয়ে আছে পাথরের ওপর। কার্লোস আচমকা হাত বাড়িয়ে তুরিনের একটা পা ধরে ফেলল। দিল হ্যাঁচকা টান। তুরিন মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল। পাথরে ঘষা খেয়ে, ছেঁচড়ে পড়ল জলে। কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এলো আর্তচিৎকার। ভাগ্যিস মাথাটা বেঁচে গেল। কিন্তু কোমরে এত বেশি লাগল যে মনে হচ্ছিল শিরদাঁড়া গুঁড়িয়ে যাচ্ছে ব্যথায়। রাগে অন্ধ হয়ে কার্লসের গাল বরাবর একটা চড় বসিয়ে দিল তুরিন। কার্লোসের তখন মদের নেশা চড়াও হয়েছে। লুপ্ত হয়েছে নৈতিকতা বোধ। তুরিনকে সে মনে মনে বহুদিন ধরে কামনা করে আসছিল। তুরিন কখনো গ্রাহ্য করেনি। আজকের এই অপমান সেই কামনার স্ফুলিঙ্গকে প্রতিশোধের আগুনে রূপান্তরিত করে দিল। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে তুরিনের গালে একটা চপেটাঘাত করে বসল। সাংঘাতিক চড়টা খাবার পর তুরিনের মনে হলো পৃথিবী ভোঁ-ভোঁ করে ঘুরছে। ঝাঁ-ঝাঁ করছে কান। যেন মাথাটা আরেকটু হলেই খসে পড়ে যাবে দেহ থেকে। রাগে অন্ধ হয়ে গলা টিপে ধরল কার্লোসের। কিন্তু শক্তিতে পারল না। কার্লোস তাকে এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দিল, পরমুহূর্তেই পাঁচ আঙুল বসিয়ে দিল গলায়। হাঁটুতে শীতল জলের ধাক্কা এসে লাগছে। পায়ের তলায় স্যাঁতসেঁতে পিচ্ছিল মাটি। তুরিন ভারসাম্য টিকিয়ে রাখতে পারল না। পাথরের ওপর হেলে পড়ল। মনে হলো যন্ত্রণায় শরীরটা দুই টুকরা হয়ে যাচ্ছে। গলায় কার্লোসের আঙুলের দুঃসহ চাপ। চোখ বেরিয়ে আসতে চাইছে কোটর থেকে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমেই। ছেলেটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তুরিনকে কি মেরে ফেলবে? মেরে লাশ ভাসিয়ে দেবে ক্রিকের পানিতে? অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে এই শ্বাপদ থাবা থেকে মুক্তো করতে পারল না। এবার হাল ছেড়ে দিল। গলা দিয়ে শুধু গোঁ গোঁ শব্দ বেরোতে লাগল।
—‘কী হচ্ছে ওখানে?’
হঠাৎ আসা কণ্ঠস্বরটা থমকে দিল কার্লোসকে। টর্চের হলুদ আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিল। কার্লোস তুরিনের গলা থেকে হাতের আঙুল আলগা করল। আগুন চোখে টর্চধারীর দিকে চেয়ে বলল, ‘কী চাই?’
টর্চের আলোটা তুরিনের মুখের ওপর পড়তেই শাহজিদ চমকে উঠল 1 তুরিন এখন ভয়ংকরভাবে কাশছে। কাশির দমকে যেন ফুসফুসটাই উগড়ে দেবে গলা দিয়ে। শাহজিদ অত্যন্ত কঠোর গলায় কার্লোসকে বলল, ‘কী হচ্ছিল? তুমি কী করছিলে? ওয়েইট…আমি এখুনি পুলিশ কল করছি।’ কথাটা বলতে বলতে পকেট থেকে সেলফোন বের করল। কার্লোস অনবরত আজেবাজে গালাগাল দিচ্ছিল। চকিতে লাফ দিয়ে ডাঙ্গায় উঠে এলো সে। এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে প্রবলভাবে একটা লাথি বসিয়ে দিল শাহজিদের পেটে।
কে তুমি সুন্দর কন্যা
অর্ণব এত বড় বাড়ি এর আগে কখনো দেখেনি। শনির আখড়ায় দুই-কামরার ভাড়াবাসায় থাকত। ইউএসএ আসার পর মেরিল্যান্ডে সাতজন ছাত্র মিলে ওয়ান বেডরুম অ্যাপার্টমেন্টে থেকেছে। ছারপোকার যন্ত্রণায় রাতে ঘুমোতে পারত না। সকাল বেলা বাথরুমে লাইন। কী দুর্বিষহ জীবন। কিন্তু এখানে, আজকের এই হিম জড়ানো শীতের দিনটায়, লাল রঙের দামি কার্পেট মোড়ানো ঝাঁ-চকচকে লিভিংরুমে বসে থেকে অর্ণবের মনে হচ্ছিল দুর্ভাগ্যের নাগপাশ এবার সত্যি কেটে গেছে। ভাগ্যের চাকাটা ঘুরে গেছে অবশেষে। কলোরাডোতে ঠাণ্ডা বেশি এটাই একমাত্র সমস্যা। বসন্ত কালেও ঝিরঝির বরফ পড়ে। তাজ্জব কাণ্ড।
.
লিভিংরুমে আপাতত কেউ নেই। ফায়ারপ্লেসের সামনে রাখা আরামদায়ক কাউচে গা এলিয়ে দিয়ে মহাআনন্দে পা নাচাচ্ছিল অর্ণব। মনে মনে সে বেশ কিছু পরিকল্পনা এঁটে ফেলেছে। ঠিক করেছে বিয়ের পর কটা দিন শ্বশুরবাড়িতেই থাকবে। তারপর ভালো একটা চাকরি পাবার পর বউ নিয়ে নতুন বাসায় মুভ করবে। তবে প্রথমেই শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে এই বিষয়ে কিছু বলবে না। ভাবটা এমন দেখাবে যে সে ঘরজামাই প্রথার ঘোর বিরোধী। যে করেই হোক আত্মসম্মানটা টিকিয়ে রাখতে হবে।
দুপুরের খাবারটাও হয়েছে জম্পেশ। অনেকদিন পর এত পদের খাবার খেয়ে পেট ভরার পাশাপাশি মনটাও ভরে গেছে কানায় কানায়। খাবার টেবিলে একজন বয়স্ক মহিলার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে। আপ্যায়ন করছিলেন। জানা গেল তিনি কন্যার দাদিজান। দাদিজানের ব্যবহার মাশাআল্লাহ অতি অমায়িক। অর্ণবকে তিনি এর মাঝেই বাড়ির জামাই বলে গণ্য করছেন সেটা কথার ধরন দেখেই বোঝা গেছে। সবই ঠিক আছে, শুধু পাত্রীকে নিয়েই যা একটু সমস্যা। এত বদরাগী তেজি মেয়ে অর্ণব এর আগে কখনো দেখেনি। এই মেয়ে খুব সহজে বিয়েতে রাজি হবে বলে মনে হয় না। একটু চোখ লেগে এসেছিল। হঠাৎ একটা শব্দ হলো। ছেদ পড়ল ঘুমের আবেশে। উঠে বসল ধড়মড় করে। অপ্রস্তুতভাবে কুঁচকে যাওয়া ফুলহাতা শার্টটা একটু ধাতস্ত করে নিল। একজন ভদ্রলোক ঢুকেছেন ভেতরে। পরনে কালো স্যুট। সাদা চুল, সোনালি চাপদাড়ি। বয়স বোঝা মুশকিল। অর্ণব সালাম দিল বিনীতভাবে। সহাস্যবদনে সালামের উত্তর দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ‘তুমি অর্ণব?’
—‘জি।’ অর্ণবের গলার স্বরে বিনয় ঝরে পড়ল।
ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘বেশ বেশ। কেমন আছ? আমি মুর্তজা।’
হবু দাদাশ্বশুরের উপস্থিতি অর্ণবকে মোমের মতো গলিয়ে দিল একদম। ফট করে পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলল। আসার আগে খুব লজ্জা লাগছিল, সংকোচ হচ্ছিল এই ভেবে যে সে যেচে পড়ে ঘরজামাই হতে চলে এসেছে সুদূর মেরিল্যান্ড থেকে। কিন্তু এদের ব্যবহার এত আন্তরিক! অর্ণবের এখন আর একটুও সংকোচ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন এরা কত কালের চেনা! মুর্তজা সাহেব সদ্য পরিচিত যুবকটির ভদ্রতায় মুগ্ধ হলেন। ছেলেটা বেশ লম্বা। মায়াভরা মুখ। একটু রোগা, তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীর ফিরে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা এই ছেলে মেধাবী। নাতনির জন্য একজন মেধাবী পাত্র খুঁজছিলেন তিনি। অর্ণবের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তুমি খেয়েছ?’ অর্ণব উত্তর দিতে যাচ্ছিল। হঠাৎ একজোড়া পদশব্দ মুখের কথা কেড়ে নিল। হাই- হিল জুতোয় টুকটুক আওয়াজ তুলে একজন নারী সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো নিচে। আঁটসাঁট সাদা শার্ট, কালো স্কার্ট। ছিপছিপে মেদহীন শরীর।
ফারার আগমনে মুর্তজা সাহেবের কপালে বিরক্তিমাখা কুঞ্চন সৃষ্টি হলো। ছোট ছেলের প্রথম স্ত্রীকে তিনি বিশেষ পছন্দ করেন না। বাধ্য হয়ে এই মেয়ের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলের বয়স তখন নিতান্তই অল্প। মেয়েটি সমবয়সি। একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। পড়াকালীন সময়েই ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিল বলে সামাজিক চাপে পড়ে বিয়েটা দিতে হয়েছিল। বিয়ের সময় তুরিন তার মায়ের পেটে। অর্ণব বেশ বিব্রত বোধ করছিল। মুর্তজা সাহেব হালকা কেশে নিয়ে বললেন, ‘এই হলো তুরিনের মা।’
চক্ষুদুটো এবার ছানাবড়া হওয়ার দশা। হাঁ হয়ে গেল অর্ণব। তুরিনের মা? মানে তার শাশুড়ি? এত ইয়াং! এত সুন্দর! কীভাবে সম্ভব? সালাম দিয়ে ব্যাক্কলের মতো চেয়ে থাকল শুধু। পা ছুঁয়ে কদমবুসি করা ঠিক হবে কি না এই নিয়ে একটু দোলাচলে পড়ে গেল।
‘বসো বসো। দাঁড়িয়ে কেন?’ বলতে বলতে ফারা নিজেই একটি সোফায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে পড়ল। শ্বশুরের তোয়াক্কা করল না। মুর্তজা সাহেব ঘটনাটা আড়চোখে একবার লক্ষ করলেন। তারপর প্রস্থানোদ্যত হয়ে অর্ণবকে বললেন, ‘আমি একটু ফ্রেশ হয়ে নিই। তোমার সঙ্গে ডিনারের টেবিলে আলাপ হবে, কেমন?’ ফারা শ্বশুরের দিকে বাঁকাচোরা চোখে তাকাল একবার। বুড়ার কথা বলার ধরন দেখলে মনে হয় যেন মানুষ হিসেবে সে অতি উদারচেতা এবং উন্নতমনা, অথচ সেই হলো এ সংসারের সমস্ত অশান্তির নাটের গুরু। তুরিনের বিয়ের ব্যাপারেও অন্য কারো মতামতকে প্রাধান্য দেবে না,ফারা তা খুব ভালো মতো জানে। তবে নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোন রকম কম্প্রোমাইজ করবে না বলে মনঃস্থির করেছে। ছেলে পছন্দ না হলে সরাসরি নাকচ করে দেবে।
লিভিংরুমের পাশঘেঁষে দোতলা যাওয়ার ঘুরানো সিঁড়ি। অর্ণবরা যেখানে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে মুখ তুলে তাকালেই দোতলার লফট দেখা যায়। অর্ণব সোফায় বসতে বসতে লক্ষ করল সিঁড়ি বেয়ে দুজন মানুষ নিচে নামছে। একজন সুদর্শন ভদ্রলোক। তার কোলে একটি ছোট বাচ্চা। ভদ্রলোকের ঠিক পেছনে একটি মেয়ে। গোলাপি রঙের সালোওয়ার-কামিজ তার পরনে। চুলে একটা হৃষ্টপুষ্ট বিনুনি। চোখে-মুখে কী এক আশ্চর্য রূপের মাধুর্য ছড়ানো! মেয়েটি সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে মুর্তজা সাহেবকে একবার প্রশ্ন করল, ‘বাবা আপনাকে চা-কফি কিছু দেব?’
মুর্তজা সাহেব প্রসন্ন কণ্ঠে বললেন, ‘না মা। একটু আরলি ডিনার করব আজকে। খানা লাগাও টেবিলে।’
মেয়েটি নিঃসন্দেহে অন্যরকম। এবাড়ির বাকি সদস্যদের সঙ্গে এর কোথায় যেন একটা বিষদ পার্থক্য আছে। কিন্তু তার চোখে মুখে ভাবাবেগের চিহ্ন মাত্র নেই। কেমন যেন যান্ত্রিক। নিচে নেমেই রোবটের মতো রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল। অর্ণবের চোখে আচমকা কেমন যেন এক ঘোর লেগেছে। মেয়েটা এলো আর গেল…কিন্তু যাওয়ার আগে খসখস করে বুঝি একটা বইয়ের পাতা উল্টে দিয়ে গেল। অর্ণবের একটু আগের বৈষয়িক, সজাগ মনটা হঠাৎ কেমন আনমনা হয়ে উঠল।
সুদর্শন ভদ্রলোক কাছাকাছি এসে বললেন, ‘তোমার নাম অর্ণব?’ অর্ণব অন্যমনস্কভাবে উত্তর দিল, ‘জি।’
—‘আমি জাহিদ। তুরিনের বাবা।’
আরেকবার খাবি খাওয়ার দশা হলো অর্ণবের। এমন যুবক দেখতে একটা লোকের তুরিনের বয়সি মেয়ে আছে ভাবাই যায় না। ইনাকে বরং কোলের ন্যাদা বাচ্চাটার বাবা হিসেবেই মানায়। এই বাড়ির সবকিছুই কেমন যেন অদ্ভুত! সামনে দাঁড়ানো অল্পবয়সি দেখতে জুটিটিকে কিছুতেই শ্বশুর-শাশুড়ি হিসেবে মেনে নিতে ইচ্ছে করছিল না অর্ণবের। সে অতিশয় কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে সালাম দিল জাহিদকে।
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ২
একটা আর্তচিৎকার ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল শাহজিদের মুখ থেকে। স্থানচ্যুত হয়ে পড়ল হাতের ক্রাচ। খসে পড়ল সেলফোন। মুহূর্তের মধ্যে তার পাঁচ ফিট দশ ইঞ্চির দিঘল শরীরটা নুড়ি পাথর আর ছোট-বড় আগাছাযুক্ত রুক্ষ মাটিতে চিত হয়ে পড়ে গেল কাটা গাছের মতো। মাথাটা ঠাশ করে লাগল কোথাও। পাথর-টাথর কিছু হবে হয়তো। যন্ত্রণায় চোখ বুজে ফেলল শাহজিদ। আর ঠিক সেই মুহূর্তে অনেক অনেক দিন বাদে ডান পায়ের জায়গাটায় একটা দুঃসহ শূন্যতা অনুভব করল। দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারলে একটা সামান্য লাথি আজকে তাকে এভাবে কাবু করতে পারত না! কার্লোস তখন হাতের আঙুল উঁচিয়ে গলায় বিষ ঢেলে বলছে, ‘পঙ্গু হয়ে তুমি আমার সঙ্গে লড়তে এলে। সাহস তো কম না! ক্রিপলড কোথাকার!’ তুরিনের কাশি থেমে গেছে। হতভম্ব চোখে একবার কার্লোসের রুদ্রমূর্তির দিকে আরেকবার আহত শাহজিদের দিকে তাকাল সে। মিনিট অতিক্রম হওয়ার আগেই আচমকা ফুঁসে উঠল আগ্নেয়গিরির মতো। যন্ত্রণাবিদ্ধ দুর্বল শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে ছেঁচড়ে তুলে আনল পানির ওপরে। ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো কার্লোসের দিকে ছুটে গিয়ে জ্যাকেটের কলার খামচে ধরে চিৎকার করে বলল, ‘মারলে কেন ওকে? এত সাহস তোমার! ও ক্রিপলড? আর তুমি? তুমি তো মেন্টালি ক্রিপলড!
কার্লোসের হিংস্রতা চরম পর্যায়ে পৌঁছুতে সময় লাগল না। এক ধাক্কায় তুরিনকে কয়েক পা পিছিয়ে দিল। তারপর জানোয়ারের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর গায়ের ওপর। টেনেহিঁচড়ে খুলে ফেলল মোটা জ্যাকেট। শাহজিদ ক্লেশ জর্জরিত মাথা সামান্য তুলতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল। ছেলেটা তুরিনের গায়ের ওপর চেপে বসে হাতের পাঁচ আঙুল দিয়ে ওর মুখ ঢেকে রেখেছে। তুরিন চিৎকার করতে পারছে না। অস্ফুট একটা গোঙানির শব্দ বেরোচ্ছে ওর মুখ থেকে। অন্ধকারে কার্লোসকে মানুষ নয়, হিংস্র শ্বাপদ জন্তুর মতো দেখাচ্ছে। ক্রাচ দুটো কোথায় ছিটকে পড়েছে কে জানে। শরীর এমনভাবে সেঁটে গেছে মাটির সঙ্গে যে নড়াচড়া করা মুশকিল। মাথাটা লোহার মতো ভারী। ঠিক কয়েক গজ দূরেই ঘটনাটা ঘটছে। শাহজিদ যেন এক গহন অন্ধকার গুহা থেকে প্রাণপণে উঠে আসতে চাইছে। পারছে না। দাঁড়াবার চেষ্টা না করে এবার মাটির ওপর ঘষটাতে ঘষটাতে রুদ্ধশ্বাসে এগিয়ে যেতে লাগল সামনে। সরীসৃপের মতো। পথের আগাছা আর পাথরে কেটে ছিঁড়ে যাচ্ছিল শরীরের বিভিন্ন জায়গা। এক হাতে কার্লোসের জ্যাকেটের পেছনটা খামছে ধরল শাহজিদ। টান দিয়ে ওই হৃষ্টপুষ্ট স্থুল দেহটাকে তুরিনের গায়ের ওপর থেকে তুলে আনতে বেশ বেগ পেতে হলো। আকস্মিক আক্রমণে কার্লোস কিঞ্চিৎ দূরে ছিটকে পড়ল। শাহজিদ ওর দুই পা টেনে ধরে কাছাকাছি নিয়ে এলো। এলোপাতাড়ি ঘুষি মারল কয়েকটা। তুরিন উঠে দাঁড়িয়েছে তখন। অন্ধকারে হাতড়ে শাহজিদের বাঁশের ক্রাচ তুলে নিয়েছে। এমন ভঙ্গিতে হাতে নিয়েছে মনে হচ্ছে যেন এখুনি কারো মাথা ফাটাবে। শত্রুপক্ষের শক্তি দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা টের পেয়ে কার্লোস দু-তিনটা লাথি মেরে শাহজিদকে একটু দূরে ঠেলে দিয়েই পড়িমরি করে ছুটে পালাল। জঙ্গলের অন্ধকারে ওর বিশাল বপুটা অদৃশ্য হতে খুব বেশি সময় লাগল না।
তুরিনের হাতে তখনো বাঁশের ক্রাচ। মারার জন্য উদ্যত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আলুথালু চুল আর ছেঁড়া-ফাঁড়া টি-শার্ট পরিহিতা তুরিনকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনগহিন অরণ্যের আদিবাসী জংলি। শাহজিদ শরীর ছেড়ে দিয়েছিল কঠিন মাটির ওপর। মাথা টনটন করছে। শরীর ব্যথা। চোখ বুজল একবার। কয়েকটা শ্বাস নিল বড় বড়। তারপর নিশ্ছিদ্র অচেতনতার গভীর খাদ থেকে যেন তুলে আনল নিজের কণ্ঠশক্তি। চোখ বুজেই প্রশ্ন করল, ‘আপনি ঠিক আছেন?
একটা উৎকট ঝড়ের পরে তুরিন তখন লণ্ডভণ্ড, বিধ্বস্ত। হাত-পা অস্বাভাবিক কাঁপছে। মেরুদণ্ডে শীতল স্রোত। পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এখুনি পড়ে যাবে বেহুঁশ হয়ে। ভয়ের রেশ কাটেনি। গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না। নড়ছে না পা। কয়েক সেকেন্ড থম ধরে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর কষ্টে…অনেক কষ্টে দু পায়ে ভর দিয়ে শাহজিদের লুটিয়ে থাকা শরীরটার দিকে এগিয়ে যেতে পারল। হাঁটু গেঁড়ে বসে একটু ঝুঁকে ফ্যাসফ্যাসে কাঁপা গলায় বলল, ‘আপনার কি বেশি লেগেছে? অ্যাম্বুলেন্স কল করব?’
—‘অ্যাম্বুলেন্স লাগবে না। পুলিশে রিপোর্ট করা দরকার।’
পুলিশের কথায় বিচলিত হয় তুরিন। পুলিশ রিপোর্ট মানেই বাবা-মা-দাদা দাদিসহ পুরো পরিবারের কানে ঘটনাটা তুলে দেয়া। সে নার্ভাসভাবে বলল, ‘রিপোর্ট করা যাবে পরে। আপনি উঠুন আগে।’
তুরিনের কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল শাহজিদ, এক পায়ে। একটা ক্রাচ ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে অপর ক্রাচটা খুঁজতে লাগল তুরিন। ধারে-কাছে কোথাও নেই। জলে পড়ে গেছে কিংবা কোন পাথরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে আছে।
—‘অন্ধকারে পাওয়া যাচ্ছে না। কাল দিনের আলোয় খুঁজতে হবে। আপনি একটা ক্রাচ দিয়ে হাঁটতে পারবেন?’ তুরিনের প্রশ্ন।
—‘পারব আশা করি।’ কথাটা বলে শাহজিদ পা এগিয়ে দিয়েছিল। ওকে একটু টলতে দেখেই তুরিন ঝড়ের গতিতে এগিয়ে এসে ডান কনুইটা ধরে ফেলল। শুকনো গাছের ডাল, বরফ আর আগাছা মাড়িয়ে দুজনে আস্তে আস্তে চলতে লাগল বাড়ির দিকে। সারা পথে কেউ কোন কথা বলল না। একটা অস্বস্তিজনক বাকরুদ্ধতা ঘিরে থাকল দুজনকে। নিঃশ্বাস ফেলতেও যেন অস্বস্তি হচ্ছিল। ভাগ্যিস ব্যাকইয়ার্ডের আলো জ্বলছে না। কিন্তু ডেকের ওপর কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকারে ছায়ামূর্তিটা দেখেই মনে মনে শিউরে উঠল তুরিন। কে ওটা? দাদাজান নয়তো?
স্লাইডিং ডোর খুলে ঘরে ঢুকল ওরা। শাহজিদকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে কানার মতো হাতড়ে হাতড়ে বাতির সুইচ খুঁজে পেল তুরিন। হঠাৎ পাওয়া আলোটা দুজনেরই চোখে ছুড়ির মতো বিঁধল। কয়েকটা সেকেন্ড কাটার পর আলো সয়ে এলো চোখে। শাহজিদ ধুলো আর মাটি লাগা জ্যাকেটটা গা থেকে খুলতে খুলতে চোখা চোখে তুরিনকে দেখছিল। মেয়েটার চুলের অবস্থা এলোমেলো। ঠোঁটের পাশে রক্তের দাগ। পরনের হলুদ টি-শার্ট ছিঁড়ে গেছে অনেকখানি। ফরসা গলায় কার্লোসের পাঁচ আঙুলের ছাপ। ছোট ছোট বঙ্কিম চোখে এখনো লেপ্টে আছে ভয়।
—‘ক্লজেটটা খুলুন। ওপরের তাকে ফার্স্ট এইড বক্স আছে। নিয়ে আসুন প্লিজ।’
তুরিন খুব আড়ষ্টভাবে শাহজিদের দিকে তাকাল একবার। কালো টি-শার্ট পরা দাড়ি-গোঁফওয়ালা ছেলেটা ওর দিকেই তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ছিল। দুই জোড়া দৃষ্টি একটি গন্তব্যে মিলিত হতেই কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল। হঠাৎ মনে হলো এর সঙ্গে একলা ঘরে মুখোমুখি হওয়ার চাইতে কার্লোসের অত্যাচার সহ্য করাও ঢের সহজ ছিল। তুরিন বেসামাল গলায় বলল, ‘আপনার কোথায় লেগেছে?’
শাহজিদ দুই হাতের তালু প্রদর্শন করল। দুই হাতেই একাধিক কাঁটাছেঁড়া। ওর ভ্রু কুঞ্চিত। চোয়াল শক্ত। চোখে রাজ্যের বিরক্তি। হঠাৎ কী যেন মনে পড়তেই প্যান্টের পকেট হাতড়াতে হাতড়াতে বলল,
—‘শিট…আমার মোবাইল কোথায়?’
তুরিন ক্লজেট থেকে ফার্স্টএইড বক্স নামাচ্ছিল। ধীর স্বরে বলল, ‘আমার কাছে আছে। আমি খুঁজে পেয়েছিলাম।’
হাঁফ ছাড়ল শাহজিদ, ‘থ্যাংক গড!’
শব্দদুটো উচ্চারণ করে তুরিনের মুখের ওপর একবার চোখ ফেলল। কিছুটা কুণ্ঠার সঙ্গে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইউ।’
তুরিন পকেট থেকে শাহজিদের ফোনটা বের করে রাখল পড়ার টেবিলের ওপর। তারপর হাতে বাক্সটা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে রইল।
—‘দাঁড়িয়েই থাকবেন?’ শাহজিদ ওর হ্যাজেল রঙের বিমোহন চোখজোড়ায় একটু ভর্ৎসনার ঢেউ তুলল।
অন্যসময় হলে তুরিন রেগে যেত। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ব্যতিক্রম। অনেক বড় বিপদের হাত থেকে আল্লাহর রহমতে বেঁচে ফিরে আসতে পেরেছে। অতএব তার দম্ভ এখন স্তিমিত। ভেতর থেকে ভয়ের রেশ কাটেনি। মেজাজ-মর্জি অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনুকূলে রাখতে হচ্ছে। তার ওপর এমন বিব্রতকর পরিস্থিতি। হম্বিতম্বি দেখানোর সময় যে এটা না অন্তত এতটুকু বোঝার মতো কমনসেন্স তার আছে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো সামনে। বসল বিছানার ওপর। শাহজিদের একটা পা ঝুলছিল বিছানার বাইরে। অপর পায়ের জায়গাটা শূন্য। প্যান্টের কাপড় দুলছে একটু একটু। তুরিনের হাত কাঁপছিল। একটা অবাধ্য কান্নার ঢেউ ঝাঁপ মেরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। প্রাণপণে কান্না চাপাচ্ছে সে। শাহজিদ দেখছিল ওর শঙ্কিত চোখ, থরথর করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট। তুলতুলে গাল। কী ইনোসেন্ট! কিন্তু ভেতরটা? ভেতরটা যে কী বীভৎস কুৎসিত তা শাহজিদের চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না!
তুরিন অনভিজ্ঞ হাতে ফার্স্টএইড বক্সের জিনিসগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। শাহজিদ ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ চোখে ওর কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছে। কাঁপা হাতে তুরিন এক টুকরো তুলোতে এন্টিসেপটিক লাগাল। তারপর কী করবে খুঁজে না পেয়ে তুলোর দলা একপাশে রেখে ছোট একটা গজ তুলে নিল ক্লিনিংয়ের জন্য। শাহজিদের কপালে চোট লেগেছিল হালকা। তুরিন গজটা ওর কপালের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই শাহজিদ খপ করে হাতটা ধরে ফেলল। ধক করে উঠল তুরিনের বুক। শাহজিদ গম্ভীরভাবে ওর হাতের মুঠো থেকে গজটা তুলে নিল। তারপর একটিও বাক্য ব্যয় না করে নির্দ্বিধায় ওর ঠোঁটের বাঁ পাশ দিয়ে গড়িয়ে পরা জমাটবাঁধা রক্ত মুছে নিল। তুরিন ঘটনার আকস্মিকতায় দম নিতে ভুলে গিয়েছিল। এতক্ষণ ব্যথা-যন্ত্রণার অস্তিত্ব ছিল না। হঠাৎ আকাশছোঁয়া যন্ত্রণা যেন বিদ্যুতের মতো চিলিক দিয়ে ফিরে এলো শরীর আর মনের সমস্ত আনাচ কানাচে। আটকে রাখা কান্নাটা এবার বাধ ভাঙল। থমকে গেল শাহজিদের হাত। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চোখ বন্ধ করে কান্না চাপানোর চেষ্টা করছে তুরিন। বদ্ধ চোখের দুয়ার উপচে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। রক্তাভ গালের চামড়ায় রুপোর মতো চিকচিক করছে জলবিন্দু। হঠাৎ একটা আশ্চর্যজনক অস্বস্তি শাহজিদকে ঘিরে ধরল। নিশা ছাড়া অন্য কোন মেয়ের সঙ্গে ইদানীংকালে মেলামেশা হয় না। কিন্তু নিশার উপস্থিতি কখনো তার জন্য অস্বস্তির উদ্রেক করে না। আজকের এই অদ্ভুত অস্বস্তির কারণ কী? সে হাত নামিয়ে নিয়ে একটু বিব্রতভাবে বলল, ‘আমার মনে হয় আপনার এখুনি পুলিশ কমপ্লেইন করা উচিত।’
কান্না চাপানোর চেষ্টা করল তুরিন, ‘না!’
—‘কেন নয়?’ শাহজিদ অবাক।
—‘পুলিশ কমপ্লেইন করলে বাড়ির মানুষ জেনে যাবে।’
—‘জানলে সমস্যা কী? বাড়ির লোকে জানবে বলে একটা ক্রিমিনালের শাস্তি হবে না?’
—‘ওকে শাস্তি দিতে গিয়ে তো আমি ফেঁসে যাব। যখন জানতে চাইবে এত রাতে ক্রিকের ধারে কেন গিয়েছিলাম তখন কী জবাব দেব?’
—‘সঠিক জবাবটাই দেবেন। বাই দ্যা ওয়ে…কেন গিয়েছিলেন?’ প্রশ্নটা করে একটু থামল শাহজিদ। চোখা চোখে তাকাল তুরিনের দিকে, ‘ওই স্টুপিড বাস্টার্ডটা আপনার বয়ফ্রেন্ড নাকি?’
—‘মাথা খারাপ!’
—‘তাহলে?’
তুরিন দুর্বল চোখে তাকাল শাহজিদের দিকে। কী করে বলবে যে প্রশ্নকর্তার করা অপমান সইতে না পেরেই মনের দুঃখে একলা একলা বসে ছিল ক্রিকের ধারে। খুব মন খারাপের সময় তার স্মোক করতে মন চায়। আজকেও মন খুব বেশি খারাপ ছিল। অন্ধকারে একলা বসে স্মোক করছিল। অকস্মাৎ বজ্রপাতের মতো দৃশ্যপটে পতিত হলো কার্লোস। সব দোষ শাহজিদের। বলতে ইচ্ছে হলো অনেক কিছু। জমে থাকা অপমান, রাগ, প্রতিশোধপরায়ণতা… যা এতকাল বুকের মধ্যে মাথা কুটে কুটে মরছিল…সমস্তটা উগড়ে দিয়ে…উজাড় করে দিয়ে…এই সদম্ভে ডগমগ করা আশ্চর্য ছেলেটার কাছে নিজেকে সমর্পণ করার নির্লজ্জ বাসনা চেপে বসল মাথায়। কিন্তু একটা বাক্যও উচ্চারণ করতে পারল না। শুধু কান্না চাপা ঝাপসা দুটি চোখ মেলে চেয়ে রইল। আজকে…অনেকদিন বাদে একে সে এত কাছ থেকে দেখছে। লালচে দাড়ি গোঁফের পেছনে এখনো আগের সেই রক্ত ঝিম ধরা সুন্দর মুখটা রয়ে গেছে। পাল্টায়নি একটুও। শাহজিদ কী বলবে খুঁজে পাচ্ছিল না। মাথার ভেতর একটা ব্ল্যাংকনেস কাজ করছে। আকস্মিক…খুব আকস্মিকভাবে শাহজিদের চোখজোড়া চুম্বকের মতো তুরিনের ছেঁড়া টি-শার্টের ওপর নিবদ্ধ হলো। সে দেখল বিদীর্ণ হওয়া হলুদ টি-শার্টের ফোঁকর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সাদা লঞ্জারি, তার ঠিক মাঝবরাবর ধবল দুটি পায়রার মসৃণ ভাঁজ…আর ঠিক তখনই হঠাৎ দৃষ্টির বাণ গড়িয়ে পড়ল ছিপছিপে বঙ্কিম কোমরটায়…শাহজিদের অবাধ্য চোখ দেখল কমলা রঙের ফরসা কোমরে কালো কালি দিয়ে একটা উল্কি আঁকা। কী লেখা ওখানে? এক ঝলক দেখতেই বিদ্যুৎ চমক খেলে গেল বুকে। কিন্তু…মানে আসলেই? নাহ নিশ্চয়ই সে ভুল দেখছে। এমন জায়গায় যে ভালো মতো তাকানোও যায় না। একবার দেখার পর দ্বিতীয়বার দেখতে সংকোচ হচ্ছে। তুরিন নড়ে উঠেছে। বিব্রতভাবে কাপড় টেনে ঠিক করছে। চোখেমুখে হতবুদ্ধি ভাব। উল্কি আঁকা জায়গাটা আড়াল করতে চাইল সে। বাড়ির কেউ জানে না যে সে কোমরে ট্যাটু করেছে। জানলে তুলকালাম কাণ্ড করবে। দাদাজান তো মেরেই ফেলবে। ইশ…আরেকটু হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে। পুরুষের দৃষ্টি তাকে সংকুচিত করে না কখনো, আজকে করল। লজ্জায় লাল-টাল হয়ে বেসামাল গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার? কী দেখছেন?’
শাহজিদ চোখ সরিয়ে নিয়েছে। কান ঝাঁঝাঁ করছে। কোন শব্দ বেরোচ্ছে না মুখ দিয়ে। একটা হতভম্ব ভাব সমস্ত চেতনাকে নিঃসাড় করে দিচ্ছে। কী দেখল মাত্র? এটাও কি হতে পারে? অসম্ভব!
প্রথম প্রেম
শাহজিদ চোখের কিনার দিয়ে দেখল একবার। কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে আছে তুরিন। ওর দিকে সরাসরি তাকানো যাচ্ছে না। কেন যাচ্ছে না সে কারণ স্পষ্ট নয়। এমন আড়ষ্টতা শাহজিদের চিরাচরিত স্বভাব চরিত্রের বিপরীত। ধাক্কাটা এখনো সামলে উঠতে পারেনি সে। মনে হচ্ছে একটা বিভ্রমের ভেতরে আছে। কিয়ৎক্ষণ আগে চর্মচক্ষুতে যা দেখল, তা কোনভাবেই বাস্তব হতে পারে না…আর হলেও…না…ভাবাই যায় না!
—‘একটা কোট দেবেন? আমার জ্যাকেট ভুলে ফেলে এসেছি জঙ্গলে।
—‘নিশ্চয়ই।’
বিছানা থেকে নামতে গিয়ে স্মরণে এলো ক্রাচ বা হুইলচেয়ার ছাড়া এক পায়ে ক্লজেটের কাছে যাওয়ার সামর্থ্য তার নেই। দমে গেল মনে মনে।
—‘ক্লজেটে আছে। একটু নিয়ে নেবেন কষ্ট করে?’
তুরিন আদেশ পালন করল। বাছাবাছি করল না। ক্লজেটের ডোর খুলে সামনের সারিতে ঝুলিয়ে রাখা একটা নেভি-ব্লু রঙের জ্যাকেট তুলে নিল হাতে। এই ঘরের সব কিছুই অনেক গোছানো। ব্যাচেলরদের ঘর সাধারণত এত পরিপাটি হয় না। এসবের দেখভাল কে করে? নিজেকে প্রশ্ন করে নিজের মনেই উত্তরটা পেয়ে যায়। কে আবার? সে…যে তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী, তার মায়ের সতিন, আর তার সত্মা। মনে পড়তেই বিশেষভাবে সচেতন হয়ে ওঠে ভেতরটা। এখানে তো রোজ আসে ওই অসহ্য মেয়ে। যে মেয়ে তুরিনের ব্যক্তিগত পারিবারিক সুখ-শান্তি কেড়ে নিয়েছে, ছারখার করেছে বাবা-মায়ের দাম্পত্য জীবন, আর যে মেয়ের খুব কাছের বন্ধু(প্রেমিকও হতে পারে) সেই মানুষটা…যে মানুষটা তুরিনকে জীবনের সব থেকে ভয়ংকর কষ্টটা উপহার দিয়েছে। অদৃষ্টের কী সকরুণ প্রহসন! যাকে কোন দিন ক্ষমা করবে না বলে মনে মনে শপথ নিয়েছিল একদিন। আজ সকালেও যার সঙ্গে কোমর বেঁধে ঝগড়া করেছে, মনে মনে অভিসম্পাত করেছে, ঘৃণা করেছে প্রাণ ভরে। এই মুহূর্তে সেই বিশেষ বিদ্বিষ্ট ব্যক্তিটিরই সম্মুখে, করুণার পাত্র হয়ে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। সাহায্য প্রার্থনা করতে হচ্ছে। ইশ! অপমানের দুষিত বায়ুতে তার শ্বাসনালি বিষাক্ত হয়ে উঠল হঠাৎ। এত অপমান নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে কী করে! তার উচিত পানিতে ডুবে মরা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো তার এখন একটুও মরতে ইচ্ছে করছে না। অপমানের বিষ বায়ুটাও কোন এক আজব কারণে সহনীয় লাগছে। হাতে ধরা পলিস্টারের নরম জ্যাকেটটা থেকে একটা সুন্দর ঘ্রাণ উড়ে এসে লাগছে নাকে। উপবাসী মনের জানালার বদ্ধ কাচে সেই ঘ্রাণটা বিন্দু বিন্দু বাষ্পকণার মতো জমতে শুরু করেছে। যেন বৃষ্টি নামার আগে জমাট বাঁধছে মেঘ। তুরিন লাজুকভাবে জ্যাকেটটা গায়ে জড়িয়ে নিল। অনেক বড়। এই অবস্থায় যে কেউ তাকে দেখলে বুঝবে অন্যের কাছ থেকে ধার করা কাপড় গায়ে চড়িয়েছে সে। বুঝলেও বা কী করার আছে! ছেঁড়া টি-শার্ট আর আহত শরীর আড়াল করার এর চেয়ে উত্তম উপায় এখন আর নেই।
শাহজিদ বিছানা ছেড়ে উঠতে গিয়েও শেষমেশ আর ওঠেনি। তার ওঠা তো আর সাধারণ মানুষের মতো সহজ নয়। কেন যেন মেয়েটির সামনে নিজের পঙ্গু জীবনের দুর্বিষহ বৃত্তান্ত জাহির করতে এখন ইচ্ছে করছে না।
—‘আমি যাই।’ তুরিন বলল। ইয়া বড় লম্বা ঢলঢলে জ্যাকেটটা পরার পর ওকে পেটমোটা কিউট পেঙ্গুইনের মতো দেখাচ্ছিল। লালচে গাল, পাতলা ফিনফিনে গোলাপি ঠোঁট, পুতুপুতু ছোট চোখ…সব মিলিয়ে দারুণ মিষ্টি একটা প্যাকেজ। শাহজিদের ঠোঁটে আলতো একটা বঙ্কিম রেখা ফুটে উঠছিল ধীরেধীরে। কী যেন বলতে গিয়েও বলল না আবার। চোখে ঝিকিমিকি হাসির আভাস নিয়ে তাকিয়ে রইল শুধু।
তুরিন ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে। ভয় করছিল ওর। এই বাড়িটা কখনোই নিরিবিলি পাওয়া যায় না। একগাদা মানুষ গিজগিজ করে সর্বত্র। কী করে সবার নজর বাঁচিয়ে নিজের শোবার ঘর অবধি পৌঁছুবে সেই দুশ্চিন্তায় কাঁটা হয়ে আছে ভেতরটা। ভাগ্য ভালো ছিল শুধু দাদিজান আর আনিতা ছাড়া অন্য কারো মুখোমুখি হতে হলো না। আনিতা ওর পেছন পেছন আসছিল
—‘কী ব্যাপার? এটা কার জ্যাকেট পরেছ তুমি?’
তুরিন উত্তর না দিয়ে ঝড়ের বেগে হাঁটছিল। নিজের ঘরে এসে আনিতার মুখের ওপর দরজাটা সটান বন্ধ করে দিল। বাতি জ্বালাল না। দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। হৃৎপিণ্ড খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ডানা ঝাপটে যাচ্ছে। মাথাটা শূন্য। কতক্ষণ যে কাটল তা সঠিকভাবে ঠাওর করা গেল না। একটা সময় গায়ের জ্যাকেটটা খুলে নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে বুকের ভেতর চেপে ধরল সে আদুরে বিড়াল ছানার মতো। পায়ে পায়ে হেঁটে বিছানার কাছে এগিয়ে এলো। শুয়ে পড়ল জ্যাকেটটা কোলবালিশের মতো জড়িয়ে ধরে। ঘরের ভেতর ঝুপসি অন্ধকার। জানালার কাচের বাইরে সাদা রাত। তুরিনের নরম শরীরটার নানা জায়গায় কাটাছেঁড়া। একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনার মুখ থেকে অলৌকিকভাবে ফিরে এসেছে সে। কিন্তু সেই দুর্ঘটনার বিন্দু মাত্র আঁচড় এখন তার মনের মাঝে নেই। বুকে ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ ভাঙছে আবেগ। জ্যাকেটের স্পর্শ এক আশ্চর্য শিহরণ জাগাচ্ছে রক্তে। প্রথমবার দেখা হয়েছিল রকি মাউন্টেনে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে বারো হাজার ফিট উঁচুতে। তখন বসন্তকাল। কিন্তু পাহাড়ের ওপর ঋতুবৈচিত্র্য বলতে কিছুই নেই। ওখানে সারাবছর বরফকুচি শীতল হাওয়া। পাহাড়ের গায়ে সরু রুপালি সিমেন্টের সিঁড়ি। স্টাডি ট্যুরের ছেলেমেয়েরা সব হইহই করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছে। বিরতিহীন সিঁড়িটার দিকে তাকালে মনে হয় যেন এতে চড়ে আকাশে পৌঁছে যাওয়া যাবে। মাঝসিঁড়িতে এসে থমকে গিয়েছে তুরিন। হঠাৎ করেই তার শ্বাসক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দিয়েছে। কষ্ট হচ্ছে নিশ্বাস নিতে। বন্ধুদের দেখাদেখি একটানা উঠে আসা ভুল হয়েছে। থেমে থেমে ওঠা উচিত ছিল। চারিদিকে বালুর মতো চিকচিক করছে রোদ্দুর। তুরিনের পরনে একটা গোলাপি রঙের উইন্ডব্রেকার। সিল্কি চুলগুলো বাঁধা ছিল উঁচু করে। বাতাসের ধাক্কায় এইমাত্র খুলে গেছে। চোখেমুখে চুলের ঝাপটা এসে লাগছে। এত বাতাস! মনে হচ্ছে যেন বাতাসের সমুদ্রে ডুবে আছে। বন্ধুদের কেউ কেউ অনেক আগেই উঠে গেছে চূড়োয়। কেউ কেউ আবার পিছিয়ে পড়েছে। এখানে টেম্পারেচার মাইনাস থার্টিন। হাড়কাঁপানো শীত। তুরিনের মনে হচ্ছিল দম আটকে মরে যাবে। নাক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছে। কাউকে গলা ছেড়ে ডাকবে সেই শক্তিও নেই। সমগ্র বিশ্বরঙ্গভূমি ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। প্রেতাত্মার দীর্ঘশ্বাসের মতো কাঁদছে বাতাস। রোদের তেজি করাঘাতে ঝলসে যাচ্ছে চোখ। হঠাৎ একটা কণ্ঠস্বর কানে এসে লাগে, ‘আর ইউ ওকে?’ তুরিন দেখল নেভি-ব্লু রঙের জ্যাকেট পরা একটা লম্বা ছেলে চোখে রোদচশমা নিয়ে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছেলেটা ওর দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিল, ‘ড্রিংক সাম ওয়াটার। ইউ উইল ফিল বেটার।’ তুরিন পানির বোতলটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিল। ঢালল গলায় ঢকঢক করে। পানিটুকু পান করার পর যেন শ্বাসক্রিয়া আগের চাইতে একটু স্বাভাবিক হলো। ছেলেটা বলল, ‘মনে হচ্ছে তুমি চোখ খুলতে পারছ না। সানগ্লাস পরোনি কেন?’ কথাটা বলতে বলতে সে নিজের চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে তুরিনের চোখে পরিয়ে দিল। পোলারাইজড সানগ্লাসটা চোখের সামনে আসা মাত্র চারপাশ ভারি কোমল হয়ে উঠল। অনেক ক্ষণ বাদে তুরিন চোখ মেলে তাকাতে পারল। আজকে কোন আক্কেলে সানগ্লাসটা বাড়িতে রেখে এসেছিল কে জানে! এই সানলাইট অধিষ্ঠিত রাজ্যে দিনের বেলা খুব কম লোকেই সানগ্লাস ছাড়া বাড়ি থেকে বেরোয়। সামনে দাঁড়ানো ছেলেটির সম্পূর্ণ মূর্তি এতক্ষণে ভালো মতো দৃষ্টিগোচর হলো তার। সেদিন রোদচশমার কাচের ভেতর দিয়ে সে তার জীবনে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষটিকে প্রথমবারের মতো দেখেছিল। ওই চোখের রং সোনালি, বাদামি নাকি সবুজ…তা ঠিকঠাক বোঝা গেল না। কেমন যেন অন্যরকম। পুরু ভ্রুযুগল, সরু এবং শানিত নাসিকা, মিলিটারি সোলজারদের মতো হাই চিকবোন, মেদহীন চোয়াল আর আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক ওঠা ঝলমলে হাসি। তুরিন একটা দুর্মোচ্য সম্মোহনে ডুবে গেল যেন!
—‘নিচে নামবে? নাকি ওপরে যাওয়ার সাহস আছে এখনো?’ ছেলেটা প্ৰশ্ন করল। তুরিনের কথা জড়িয়ে যাচ্ছে জিবে। সে কোন উত্তর দিতে পারল না।
—‘নিঃশ্বাস নিতে পারছ এখন?’
তুরিন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল।
—‘গ্রেট। তাহলে এখন নিচে নেমে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া। চল ওপরে।’
তুরিন একটা বড় দম নেওয়ার পর অস্ফুটে বলতে পারল, ‘চল!’
ছেলেটা পাশাপাশি হাঁটছিল। তুরিন বলল, ‘তোমার সানগ্লাস ছাড়া অসুবিধা হচ্ছে না?’
—‘না। আমার অভ্যাস আছে।’ আরো কয়েকটা সিঁড়ি ভাঙার পর বোঝা গেল পাহাড়ের চূড়োয় বৃষ্টি নেমেছে। এখানে আবহাওয়ার কোন ঠিক নেই। এই বৃষ্টি তো এই রোদ!বৃষ্টির ঠাণ্ডা ছাঁট এসে মুখে লাগছিল। তুরিন একটা একটা করে সিঁড়ি ভাঙছে। ছেলেটা একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘তুমি এখন ঠিক আছ? আমি কি এগিয়ে যেতে পারি?’
‘নিশ্চয়ই!’ তুরিন বলল ভদ্রতার গলায়।
অনুমতি পাওয়া মাত্র ছেলেটা স্নিকারস পরা দুর্দান্ত পায়ে টগবগে ঘোড়ার মতো ছুটতে লাগল। তুরিন মুগ্ধতা নিয়ে চেয়েছিল। এক পাও এগোয়নি। ছেলেটি মাঝপথে থামল। ফিরে তাকাল পেছনে। মুহূর্ত না গড়াতেই ধুপধাপ নেমে এলো আবার নিচে। তুরিনের কাছে ফিরে এসে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এসো।’ যেন দেবদূত নেমে এসেছে স্বর্গ থেকে। তুরিন মোহাবিষ্ট হয়ে সেই আশ্চর্য সুন্দর দেখতে দেবদূতের সঙ্গে স্বর্গের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠতে লাগল। মেঘ আর বৃষ্টিতে ওরা ভিজে যাচ্ছিল। চূড়োয় ওঠার পর বাতাসের তোড় এত বেড়ে গেল যে কথা বলা প্রায় অসম্ভব। চারধারে শুধু আকাশ আর আকাশ…রোদ আর রোদ…মেঘ আর মেঘ…বাতাসের হুংকার আর আস্ফালন! এর মাঝে একটি দৃশ্য সবার নজর কেড়ে ফেলেছে। একজোড়া শ্বেতাঙ্গ যুবক- যুবতী সবচেয়ে উঁচু শিলাখণ্ডটির ওপর আরোহণ করেছে। প্রথমে বোঝা যাচ্ছিল না ঘটনা কী ঘটতে যাচ্ছে। যুবকটি যখন যুবতীর সামনে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল তখনই সকলের নজর চুম্বকের মতো আটকে গেল ওদের ওপর। তুরিনের আঠার বছরের কোমল হৃদয় বশীভূত হয়ে গিয়েছিল। এক প্রাণবন্ত স্বতশ্চাঞ্চল্য মুগ্ধতা চিকচিক করছে ওর মুখে। কেটে গেছে খানিক আগের ভয়-ভীতি, অসুস্থতা। সে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিকে আপ্লুত গলায় বলল, ‘কী কিউট না?’
ছেলেটির মুখে হাসি লেগেই থাকে। এই বুঝি তার একটা বড় গুণ। হাসতে হাসতেই বলল, ‘আমার কাছে এসব ইমোশনাল ড্রামা খুব ওভাররেটেড মনে হয়।’
—‘বলো কী? আমার তো ভীষণ ভালো লাগছে। ইশ আমাকে যদি কেউ এভাবে প্রপোজ করত! মাটি থেকে বারো হাজার ফিট উঁচুতে! পাহাড়ের ওপর! আকাশের বুকে!’
ছেলেটি তুরিনের ছেলেমানুষি কথা শুনে প্রাণ ভরে হাসল, তারপর সান্ত্বনার গলায় বলল, ‘চিন্তা কোর না। তোমার স্বপ্ন নিশ্চয়ই পূরণ হবে একদিন।’ একটু থেমে ছেলেটা প্রশ্ন করল, ‘বাই দ্য ওয়ে…তোমার নাম কী?’
—‘তুরিন মুর্তজা।’
ছেলেটির চোখে একটা বিস্ময় খেলে গেল মুহূর্তের মাঝে, ‘তুমি বাঙালি?’
—‘হ্যাঁ। কী করে বুঝলে?’
—‘নাম শুনে।আমিও বাঙালি। আমার নাম শাহজিদ আনাম। তুমি বাংলায় কথা বলতে পার?’
—‘কেন নয়? আপনি পারেন তো?’ উত্তরটা বাংলায়ই দিল তুরিন।
—‘খুব পারি! মুর্তজা নামের একজনকে আমি চিনি। আমার বাবার পরিচিত ছিলেন। আপনি সামহাউ উনার সঙ্গে কানেক্টেড নন তো?’
—‘আমার দাদাজানের নাম বশির মুর্তজা। উনাকে সবাই মুর্তজা নামেই চেনে।’
এভাবেই শুরু। আর কী আশ্চর্য! সেদিন শাহজিদের পরনে নীল জ্যাকেটটাই ছিল। যে জ্যাকেটটা এই মুহূর্তে বুকে জড়িয়ে ধরে নিজের বিছানায় জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে তুরিন। সেদিনের পর থেকে কী আবোলতাবোল কাণ্ড! সারাক্ষণ ওই একটা মুখ মনে পড়ে। হৃদয়ের ভেতরে, হৃদয়ের বাইরে, আকাশে বাতাসে, রাস্তা-ঘাটে সর্বত্র শুধু একটাই নাম। কলেজের বান্ধবীর সঙ্গে ট্যাটু পার্লারে গেল একদিন। ট্যাটু করানোর কোন উদ্দেশ্যই ছিল না তুরিনের। কিন্তু হঠাৎ কী এক মতিভ্রম ঘটে গেল! বান্ধবীর দেখাদেখি সে নিজেও একটা উল্কি আঁকিয়ে ফেলল শরীরে। প্রথম প্রেমের নেশায় বোকা মেয়েটার মগজে তখন শুধুই ধোঁয়াশা। আগপিছ কিছু চিন্তা না করেই নিজের সুন্দর মসৃণ কোমরের ডান পাশে ধারালো মেশিন দিয়ে একটা নাম খোদাই করাল সে। টানা হরফে গোটা গোটা অক্ষরে, ‘Shahzid’
এমন বোকামিও মানুষ করে? করে…কেউ কেউ করে! চোখের জলে ভিজে যাচ্ছিল বালিশ। ভিজে যাচ্ছিল বুকে চেপে ধরা জ্যাকেট। যে মানুষটার নাম খোদাই করেছিল মনের ভিতরে আর শরীরে…সেই মানুষটা তুরিনকে কখনো ভালোবাসেনি। সে ভালোবাসত অ্যাঞ্জেলিনা নামের এক রাশান মেয়েকে। তুরিন ওকে রোজ ফোন করত ছ্যাচড়ার মতো। শাহজিদ দারুণ কথা বলতে পারত। তার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা অগণিত। কথোপকথনে তার কোন কার্পণ্য নেই। সবার সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলে ঝলমলে ব্যক্তিত্বের দুর্দান্ত এই যুবক। সবাই তাকে ভালোবাসে, সবাই তার বন্ধু হতে চায়। তুরিনও সেইসব গরপড়তা মুগ্ধ ভক্তদের দলেই মিশে গেল!
দরজায় ধাক্কা পড়ছে। আনিতার কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে। তুরিন নড়ল না। মটকা মেরে পড়ে রইল বিছানায়।
কে তুমি সুন্দর কন্যা
জুবিনকে নিয়ে একটু অস্বস্তিতে ভুগছিল জাহিদ। চল্লিশ বছর বয়সে নবজাতিকার বাবা হওয়া অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়, তবে পঁচিশ বছর বয়সি হবু জামাতাকে এই সংবাদ দেয়াটা বেশ বিব্রতকরই বলা চলে। তা ছাড়া সম্পর্ক হতে হলে নিশার কথাও পাত্রপক্ষকে জানাতে হবে। মুর্তজা সাহেব এর মাঝেই পাত্রের বাবার সঙ্গে এসব নিয়ে আলোচনা করেছেন কি না জানে না জাহিদ। জুবিন ঘুমিয়ে পড়েছে। ফারা ইন্টারভিউ বোর্ডের প্রশ্নকর্তার মতো একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছিল অর্ণবকে। অর্ণব মাথা নত করে অতি আদবের সঙ্গে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে ফারার প্রশ্ন ভদ্রতার চৌকাঠ ডিঙিয়ে যাচ্ছে। এই যেমন খানিক আগে সে জানতে চেয়েছে ‘তোমার বাবার বার্ষিক আয় কত?’ অর্ণব কাঁচুমাচু হয়ে বলেছে, ‘ঠিক জানি না ম্যাডাম!’
জাহিদ একটু পর পর ঘড়ি দেখছিল। বন্ধুর বাসায় ডিনারের দাওয়াত আছে। ধৈর্যের বিচ্যুতি ঘটল একটা সময়। ঈষৎ বিরক্তিমাখা গলায় স্ত্রীকে বলল, ‘তোমার প্রশ্নপর্ব শেষ হলে আমি একটু কথা বলতে পারি?’
ফারার সাংসারিক জ্ঞান জাহিদের চেয়ে উন্নত পর্যায়ের। পাছে সদ্য পরিচিত ছেলেটি তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের তিক্ততা আঁচ করে ফেলে, সেই ভয়ে সে অত্যন্ত বিগলিত হাসি ঝুলিয়ে নিল ঠোঁটে, ‘নিশ্চয়ই!’
জাহিদ প্রসন্ন কণ্ঠে বলল, ‘শোন অর্ণব, তোমার বায়োডাটা আমি দেখেছি। অনেস্টলি স্পিকিং তোমার এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমার বাবাও বেশ পছন্দ করেছেন তোমাকে। বাবার সিদ্ধান্তের ওপর সাধারণত আমরা কেউ কখনো কথা বলি না। তবে সত্যি বলতে কি আমার মেয়েটা এখনো ছেলেমানুষ। বিয়ের জন্য প্রস্তুত নয়। তোমাকে জানিয়ে রাখছি দুই পক্ষ সম্মত হলেও আমার মেয়ে কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে বেঁকে বসতে পারে। তোমাকে একটু পেশেন্ট হতে হবে। কেমন?’
অর্ণবের খুব ভালো লাগল এই সোজাসাপটা কথা বলার ধরন। ঘাড় নেড়ে বাধ্য ছেলের মতো বলল, ‘জি নিশ্চয়ই।
জুবিন এতক্ষণ ঠিকঠাক ছিল। হঠাৎ কী কারণে যেন তারস্বরে কেঁদে উঠল। কান্নার সর্বগ্রাসী দাপটে কানে তালা লাগার জোগাড়। নিশা রান্নাঘরে কাজ করছিল। মেয়ের আকস্মিক আর্তনাদ শুনে ছটফট করে উঠল। জাহিদ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে, বাচ্চার পিঠে হাত বুলিয়ে, নড়েচড়ে, নানা ভঙ্গিমায় কান্না থামানোর চেষ্টা করছিল। সেই অবস্থায়ই অর্ণবকে বলল, ‘সম্পর্ক হোক বা না হোক…সেটা বড় কথা নয়। তুমি আমাদের গেস্ট। তোমার আপ্যায়নের সর্বোচ্চ চেষ্টা আমরা করব।’
হাতের কাজ ফেলে রেখে নিশা ছুটে এসেছে। চোখমুখ উদ্বিগ্ন। বাচ্চা কাঁদলে তার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। বাস্তব জ্ঞান লোপ পায়। সে জাহিদের কোল থেকে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিল জুবিনকে। জুবিনের পুতুল পুতুল মুখ চোখের পানি আর নাকের পানিতে মাখামাখি। গালদুটো টমেটোর মতো লাল। কী আদর লাগে দেখতে! নিশা মেয়েকে কোলে নিয়ে টসটস করে দুটো চুমু খেলো গালে। মুখে বলল, ‘কী হয়েছে বাবুটার? কাঁদছে কেন?’
অর্ণব অপরিচিতা মেয়েটির সহজ-সরল সুকুমার লালিত্য চোখ দিয়ে পান করছিল যেন। একটা অকাট্য মুগ্ধতার রেশ তার হৃৎপিণ্ডকে চেপে ধরেছে চারপাশ থেকে। জাহিদ অপ্রস্তুত বোধ করছিল। ফারার মুখে ক্রোধের স্ফুরণ খেলছে। হঠাৎ সংবিৎ ফিরল নিশার। অপরাধী চোখে একবার জাহিদের দিকে তাকাল সে। চোখ পড়ল সামনে বসা ছিপছিপে, লম্বা, শ্যামবরণ ছেলেটার দিকে। কয়েকটা থতমত খাওয়া অস্বস্তিজনক মুহূর্ত কাটল। তারপর কোন মতে সংকোচের আক্রমণ কাটিয়ে নিশা এক দৌড়ে জুবিনকে নিয়ে পালিয়ে এলো জায়গাটা থেকে। জাহিদ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে অর্ণবকে বলল, ‘এসো তোমার ঘর দেখিয়ে দিই।’
ফারা এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। তাকে ডিনারপার্টিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হবে। অর্ণবকে নিচতলার একটা গেস্টরুমে থাকতে দেয়া হলো। পায়ের তলায় নরম ঘাসের মতো কার্পেট, পরিপাটি বিছানা, চকচকে বাথটাব ওয়ালা আধুনিক সজ্জায় সজ্জিত বাথরুম…সমস্তটাই দারুণ ভালো লেগে গেল অর্ণবের। হবু শ্বশুর তাকে একলা ঘরে রেখে বিদায় নেবার পর বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল সে। চোখ বন্ধ করতেই শরৎ-মধ্যাহ্নের আলোর মতো স্নিগ্ধ একটা মুখ মানসপটের হিজিবিজি জলের ভেতর থেকে ছলাৎ করে ভেসে উঠল যেন। চমকে উঠল অর্ণব। ধড়ফড় করে উঠে বসল শোয়া থেকে। তীক্ষ্ণমুখ সুঁইয়ের মতো মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল একটি মাত্র প্রশ্ন, মেয়েটা কে? এই বাড়ির সঙ্গে তার কীসের সম্পর্ক?
জুবিন কেন এত কাঁদছে কে জানে! শাশুড়িমা নিজের ঘরে এশার নামাজ আদায় করছেন। চুলায় রান্না। নিশা উদ্বেগ উত্তেজনায় একদম অস্থির হয়ে উঠল। জাহিদ অর্ণবকে ওর ঘরে ছেড়ে লিভিংরুমে ফিরে এসেছে। আনিতা কোত্থেকে যেন ঝড়ের বেগে ছুটে এলো, ‘চাচ্চু, তুরিনের কী হয়েছে জানো?’
—‘কী হয়েছে?’
আনিতা হড়বড় করে বলল, ‘জানি না তো! সেই কখন থেকে দরজা আটকে বসে আছে। ডাকলাম কত! কোন রেসপন্স করছে না!’
জাহিদের মুখে দুশ্চিন্তার কুয়াশা জমল, ‘কেন? হঠাৎ কী হলো?’
আনিতা ঠোঁট উল্টে বলে, ‘জানি না তো চাচ্চু! যাও তুমি গিয়ে খোঁজ নাও।’
জুবিনের কিন্নরকণ্ঠী কান্না তখনো আকাশ-বাতাস কাঁপাচ্ছে। জাহিদ তুরিনের ঘরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে গিয়ে থমকে গেল একবার। আনিতাকে বলল, ‘জুবিন কাঁদছে কেন একবার দ্যাখো তো মা!’
আনিতার সেলফোন বাজছিল। সে এমনিতেও নিশাকে সচেতনভাবে এড়িয়ে চলে। ফোনের বাহানায় চাচার উপরোধটাও এড়িয়ে যেতে পারল।
—‘সরি চাচ্চু, ফোন এসেছে। ফোনটা রিসিভ করি প্লিজ?’
জাহিদ একটু দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। সম্ভবত নিশা এখন বাড়ির লোকের জন্য ডিনার রেডি করছে। একই সঙ্গে রান্নাঘরের কাজ করা আর বাচ্চা সামলানো নিশ্চয়ই সহজ ব্যাপার নয়। মা এই সময়টায় নামাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। বাড়িতে বাসিন্দার অভাব নেই কিন্তু কেউ কয়টা মুহূর্তের জন্য বাচ্চাটার দেখভাল করতে নারাজ। জাহিদ তুরিনের কাছে যাওয়ার আগে রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল একবার। নিশা এক হাতে কোলের বাচ্চা সামলে অন্য হাতে চুলোয় বসানো তরকারি নাড়ছে। চুলার উত্তাপ জুবিনকে আরো বেশি অস্থির করে তুলছে। জাহিদ একটু সংকুচিতভাবে পুরো দৃশ্যটা নিরীক্ষণ করছিল। নিশাকে সাহায্য করাটা তার জন্য সহজ কাজ নয়। এ কথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে নিশা জগতের একটা পিঁপড়ার কাছ থেকেও সাহায্য গ্রহণ করতে রাজি আছে, কিন্তু জাহিদের করা কোন উপকার তার কাছে লাল মরিচের ঝাঁঝের চেয়েও বেশি অসহনীয়। ভাব দেখে মনে হয় যেন জুবিন তার একারই মেয়ে। জাহিদ ইতস্ততা দূরে ঠেলে কয়েক পা এগিয়ে গেল। জুবিনের দিকে দুহাত বাড়িয়ে বলল, ‘এসো আমার কাছে।’
জুবিন ঝাঁপ দিয়ে বাবার কোলে উঠল। কিন্তু কান্নাটা থামছিল না। নিশা চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়ে বাচ্চার কাছে এগিয়ে এলো।
—‘খিদে পায়নি তো ওর?’ জাহিদের প্রশ্ন।
—‘একটু আগেই তো ফরমুলা দিলাম। থমথমে মুখে উত্তর দিল নিশা। জাহিদের দিকে না তাকিয়েই। জাহিদ লক্ষ করেছে নিশা কখনোই তার চোখে চোখে তাকায় না। হাসেও না। সব সময় চোখ-মুখ পাথরের মতো কঠিন
—‘এত কাঁদছে কেন?’ জাহিদ উদ্বিগ্ন।
নিশা মেয়ের গালে একটা হাত রেখে চিন্তাডুবি গলায় বলল, ‘র্যাশ উঠল নাকি? এত লাল কেন মুখ?’
বাবা-মাকে কাছাকাছি পেয়ে জুবিনের কান্নার তোড় একটু দমে এসেছিল। জাহিদ বলল, ‘ডাক্তারকে ফোন করা দরকার।’ হঠাৎ নিশার চোখ আটকে গেল রান্নাঘরের চৌকাঠে। ফারা দাঁড়িয়ে আছে কুটিলবক্র চোখ নিয়ে। তার পরনে একটা সবুজ রঙের সিল্ক শাড়ি। খোলা চুল। কড়া পারফিউমের গন্ধে ভুরভুর করছে বাতাস। ওদিকে চোখ পড়তেই নিশা একটু থমকাল। জাহিদের কোল থেকে প্রায় জোর করে জুবিনকে ছিনিয়ে নিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘ডাক্তার লাগবে না। আপনার স্ত্রী অপেক্ষা করছে আপনার জন্য। প্লিজ আপনি যান!’
দেখেছিলাম আলোর নিচে; অপূর্ব সে আলো!
স্বীকার করি, দুজনকেই মানিয়েছিল ভালো
— জয় গোস্বামী
তুরিনের মনটা যেন অস্থিরমতি স্পন্দমান এক প্রজাপতি! বিন্দুমাত্র স্থিতিশীলতা নেই। সারাদিনে অসংখ্যবার শাহজিদকে ফোন করে। শাহজিদ কখনোই বিরক্ত হয় না। ব্যস্ততার সময় বিনীতভাবে ক্ষমা চেয়ে নেয়। ফুরসতে ঠিক ঠিক কল ব্যাক করে। কখনো ভুলে যায় না। এত কথা হয়। তবুও আসল কথাটিই কেন যেন কেউ মুখে আনে না। অধৈর্য তুরিন ঠিক করল এবার সবটা খুলে বলবে। তখনো ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়নি। এক বন্ধুর সঙ্গে ডেনভার গেল, শাহজিদের অ্যাপার্টমেন্টে। ওটা ছিল গ্রীষ্মের দীর্ঘতর দিনগুলোর একটা। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে আটটার ঘরে। সন্ধ্যা হয়নি তখনো। অ্যাপার্টমেন্টের নিচে আসতেই একটা ভোক্সওয়াগন গাড়ি থেকে নামতে দেখল শাহজিদকে। মনে মনে খুশি হলো তুরিন। অল্প-বিস্তর আগে পৌঁছুলে ওকে না পেয়ে ফিরে যেতে হতো। গাড়ি থেকে নামতে যাচ্ছিল,হঠাৎ করেই থমকে গেল, হারিয়ে গেল চলৎশক্তি। ভোক্সওয়াগন থেকে কোঁকড়া চুলের একটি মেয়ে নেমে এলো। দিনের শেষ সূর্যের আলোক রোশনাই তখন পৃথিবী ঝলসে দিচ্ছে। ঝলসানো সেই সোনালি আলোর নিচে, তুরিন দেখল মেয়েটি শাহজিদের গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রেখেছে। কী রকম উল্টেপাল্টে গেল দুনিয়াটা মুহূর্তের মধ্যে! শরবিদ্ধ হৃৎপিণ্ড থেকে ফিনকি দিয়ে যেন রক্ত ছুটল। তার আঠারো বছরের প্রজাপতির মতো সুন্দর, নরম হৃদয়টা কাচের টুকরোর মতো ভেঙেচুরে খানখান হয়ে গেল। ভেতরের কষ্টটা ক্রমেই দুর্দমনীয় এক ক্রোধে রূপান্তরিত হলো। সহজ-সরল হাসিখুশি মেয়েটি সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করল। নিজের শরীরটাও যেন দিবা-রাত্রি তাকে উপহাস করে চলেছে। এমন মানুষের নাম সে চিরদিনের জন্য চামড়ায় খোদাই করেছে-যে কি না কখনোই তার আপন ছিল না। এই নির্বুদ্ধিতার পরিণাম ভুগতে হবে আজীবন! আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল কয়েকবার। সফল হয়নি। ট্যাটু রিমুভ করার জন্য যে অর্থের প্রয়োজন সেটা জোগাড় করার সামর্থ্য নেই। শরীরে লেখা নাম হয়তো কোন উপায়ে অপসরণ করা যাবে। কিন্তু হৃদয়ে মুদ্রিত নামটা কী করে মুছে ফেলা যায় তুরিন তা জানে না! মরে যেতে পারলেই সবচেয়ে ভালো হতো! কিন্তু মরাটাও তো অত সহজ না। কিছুই পারে না সে, না পারে বাঁচার মতো করে বাঁচতে, না পারে মরতে! বাড়িতে থাকতেও ইচ্ছে করে না। বাবা-মায়ের যেকোনো মুহূর্তে বিচ্ছেদ হতে পারে। বিচ্ছেদের আগে তুরিনের বিয়েটা নাকি আবশ্যক। তুরিনকে বিয়ে দিয়েই মা এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। যে বাবা তার কাছে অতিমানবের চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না, সেই বাবার চোখে চোখে তাকাতে আজকাল তার সংকোচ হয়। এমনকি ঘৃণাও হয় মাঝেমধ্যে! দাদাজানকে ভালোবাসত। কিন্তু যেদিন বাবার দ্বিতীয় বিয়ে হলো, সেদিন থেকে দাদাজানকে তার একজন খুনির চেয়েও জঘন্য অপরাধী বলে মনে হয়। বিয়ের দিন তুরিন খুব কেঁদেছিল। দাদাজান তার মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, ‘কান্না কোর না দাদাভাই। আমি অকারণে কোন কাজ করি না। এই কাজের পেছনে একটি বিশেষ কারণ আছে। তোমাকে সবটা বলা যাচ্ছে না। একদিন হয়তো তুমি বুঝবে।
চারটে দেয়াল মানেই নয় তো ঘর
নিজের ঘরেও অনেক মানুষ পর :
— অঞ্জন দত্ত
—‘এভাবে কী দেখছ? হোয়াটস রং?’ গাড়ির সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে প্রশ্ন করল জাহিদ। ফারা ড্রাইভিং সিটে বসেছে। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে কড়া চোখে তাকাল একবার জাহিদের দিকে। তীর্যক গলায় বলল,
—‘আমার তো কোন সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার মধ্যে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে মনে হচ্ছে।’
—‘যা বলার সরাসরি বলো। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলা আমি পছন্দ করি না!’
নেইবারহুডের ছিমছাম রাস্তাটা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল গাড়ি। ফারা তর্জনস্বরে বলল, ‘আজকাল অফিস থেকে ফিরে ডিরেক্ট তোমার ছোট বউয়ের ঘরে যাও দেখছি! সারাক্ষণ বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। দুদিন পর তোমার বড় মেয়ের বিয়ে। এই সময়ে, এই বয়সে আঠারো মাসের একটা শিশুর বাবা সাজতে খুব আনন্দ হচ্ছে তাই না?’
জাহিদ একটা বড় শ্বাস ফেলল। চশমাটা চোখ থেকে সরিয়ে ক্লান্তভাবে মাথাটা হেলিয়ে দিল পেছনে। চোখ বুজে বলল, ‘বাবা সাজতে হবে কেন? আমিই তো ওর বাবা! এটা অস্বীকার করার তো কোন অবকাশ নেই!
ঘেন্নায় ফারার মুখ বেঁকে যায়। কর্কশ হয়ে ওঠে কণ্ঠস্বর, ‘ভালোই উন্নতি হয়েছে তোমার। ওই গ্রাম্য মেয়েটা দেখছি এর মাঝেই বশ করে নিয়েছে তোমাকে। দুদিন পর নিশ্চয়ই ওকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করতেও কোন আপত্তি থাকবে না। রুচির অধঃপতন দেখে অবাক না হয়ে পারছি না।
জাহিদ দুর্বল গলায় বলল, ‘তোমাকে আগেও বলেছি। ওই মেয়েটির জন্য আমার মনে তিল পরিমাণ জায়গা নেই। আমার স্ত্রী শুধু একজন। সে তুমি।’
—‘আর ওই ডাইনিটা তোমার কী হয় শুনি? সারাক্ষণ তো ওর আগেপিছে ঘুরঘুর করতে থাকো।’
—‘কিছুই না!’ একটু থেমে জাহিদ আবার যোগ করল, ‘কিছু না বলাটা ভুল। সে আমার মেয়ের মা। আর এ কারণেই…এ কারণেই ফারা, আমি চাই তুমি যেন তাকে ন্যূনতম সম্মান দিয়ে কথা বল।’
রাগের চোটে ফারা গাড়ির গতি বৃদ্ধি করে। চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তোমার এত লাগছে কেন? ডাইনির প্রেমে পড়লে নাকি?’
—‘বাজে বকো না। বাচ্চা একটা মেয়ে! তুরিনের চেয়ে মাত্র কয়েক বছরের বড় হবে।
—‘ও! বাচ্চা একটা মেয়ে!’ মুখ বাঁকিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে, কপট স্বরে জাহিদকে নকল করল ফারা। তারপর রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমার তো বয়স হয়ে গেছে তাই না? এখন নিশ্চয়ই বাচ্চা মেয়েদেরকেই খুব ভালো লাগছে!’
—‘তোমার মাথাটা গেছে। পাগল হয়ে গেছ।’
ফারা বিষঢালা গলায় বলল, ‘বাচ্চা মেয়েটার সঙ্গে বিছানায় শুতে তো তোমার লজ্জা করল না। এখন যে খুব বড় বড় কথা বলা হচ্ছে!’
জাহিদ মহা বিরক্ত হলো, ‘রোজ রোজ একই ঘ্যানর ঘ্যানর ভালো লাগে না। আই প্টে উইদ হার ফর ওয়ান্স! ওই একদিনই। আর তখন আমার মনের মধ্যে নিশা ছিল না। তুমিই ছিলে!’
ফারা ভর্ৎসনার বিকট হাসিতে ফেটে পড়ে, ‘ফাইজলামির জায়গা পাও না! লাইফটাকে সিনামা পেয়েছ? বিশ্বাস করতে বলো আমাকে এসব ভুজুং ভাজুং?’
—‘বিশ্বাস করো, কারণ এটাই সত্য!’
ফারা সজোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, ‘তুমি এবং তোমার বাবা, দুজনেই হিপোক্রেট। এতদিন কেন মুখ বুজে তোমাদের ওই জাহান্নামে পড়ে আছি জানো? শুধু আমার মেয়েটার জন্য। মেয়েটার একটা বিয়ে দিয়েই তোমাদের এই বিশ্রী দুর্গন্ধযুক্ত ব্যাক ডেটেড বাড়ি থেকে চিরতরে বিদায় নেব।’
—‘বিদায় নিয়ে যাবে কোথায়? কার কাছে যাবে? প্রেম-ট্রেম করছ নাকি?’
—‘করে থাকলেও সেটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তোমার এখন আর কোন অধিকার নেই এসব জানতে চাইবার। আমি ওই শাকচুন্নির সঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকব না এটাই মেইন কথা। ক্লিয়ার?’
জাহিদ চুপ করে গেল। গোপন করল একটা দীর্ঘশ্বাস। ছিঁড়ে যাওয়া নাটাইয়ের সুতা কী করে জোড়া লাগাতে হয় সে জানে না! বিক্ষুব্ধ এক অসহায়বোধে ক্রমেই তার সমস্ত হৃদয় মথিত হয়ে উঠল নিশা ডিশওয়াশারে এঁটো বাটি আর প্লেট তুলে রাখছিল। ভাশুরের বৌ নীলিমা তাকে সাহায্য করছে। নীলিমা স্বল্পভাষী, শান্তশিষ্ট রমণী। নিশার সঙ্গে নিজ উদ্যোগে কখনো কথা বলে না। নিজের মেয়েদেরকেও প্রথম থেকেই নির্দেশনা দিয়েছে নিশার সঙ্গে যেন নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। নীলিমার মতে নিশার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো না। যারা সামান্য অর্থের বিনিময়ে একজন দোজবর ব্যক্তির কাছে নির্দ্বিধায় মেয়ে গছিয়ে দেয় তারা কোন মতেই ভদ্র বা উচ্চসমাজভুক্ত লোক নয়। নিশা স্বল্পশিক্ষিতা গ্রাম্য মেয়ে। নিজের আত্মসম্মান বিকিয়ে দিয়ে এ বাড়িতে আশ্রিতা হয়ে পড়ে আছে। তার কাছ থেকে নতুন প্রজন্ম কী শিখবে? না, নীলিমা নিজ কন্যাদের দুর্ব্যবহার করার অনুমতি দেয়নি। বরং চোখাচোখি হলে সালাম বিনিময়ের শিক্ষা দেয়া হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে একটি সৌজন্য কথাও বলা বারণ। জাহিদের সঙ্গে নিশার এই বিয়ে সামাজিকভাবে স্বীকৃত নয়। সভ্য সমাজে একজন পুরুষের দুজন স্ত্রী থাকতে পারে না। নীলিমা চায় তার কন্যারা যেন এই সম্পর্ককে সুস্পষ্টভাবে অগ্রাহ্য করার সাহস রাখে। এমন অসুস্থ সংস্কারের বিরুদ্ধে মেয়েদের সোচ্চার হতে হবে, প্রতিবাদী হতে হবে অতি অল্প বয়স থেকেই।
নিশা চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছিল। নীলিমার চোখে চোখ পড়লেই সে একটু মুচকি হেসে ভদ্রতা রক্ষা করছে। অনতিদূরে, কিচেন কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছুরি দিয়ে ফল কাটছে আনিতা। কাটতে কাটতে বলল, ‘দাদাজান বলেছে গেস্টের ঘরে ফল দিয়ে আসতে। কিন্তু আমার ওই ঘরে যেতে ইচ্ছে করছে না।’
নীলিমা মেয়ের কথার প্রত্যুত্তর করল না। করার প্রয়োজন নেই। কারণ বাড়ির যে কাজগুলো অন্য কেউ করে না, অন্য কারো করতে ইচ্ছে করে না, সেই কাজগুলো দিনশেষে নিশাই করে। এমনিতেও নীলিমা চায় না ব্যাচেলর ছেলের ঘরে রাত-বিরেতে অবিবাহিতা তরুণী মেয়ে ফলের বাটি নিয়ে যাক।
আনিতা কাটা ফলের প্লেটটা এনে নিশার সামনে রাখল। বলল না কিছুই। আকার ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল, তার যা করার করেছে, বাকিটা নিশার দায়িত্ব। কাজ শেষে দোতলায় যাওয়ার আগে নিশা একবার অর্ণবের ঘরে ঢুঁ মারল। অর্ণব বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল। বড্ড ক্লান্ত। নতুন জায়গায় ঘুমও আসছিল না। এপাশ-ওপাশ করছিল। দরজার কড়া নড়তেই শোয়া থেকে উঠে বাতি জ্বালাল। তার পরনে সাদা-কালো চেকের লুঙ্গি। হাতাকাটা গেঞ্জি। এমন অবস্থায় দরজা খোলা ঠিক হবে না ভেবে গেঞ্জির ওপর একটি টি-শার্ট চড়িয়ে নিল চট করে। লুঙ্গি না পরলে রাতে ঘুমই হয় না। বিদেশবিভূঁইয়ে এসেও এই স্বভাবে পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। ডাল-ভাত আর লুঙ্গি এই তিন জিনিস জীবনে কখনো ছাড়তে পারবে বলে মনে হয় না। দরজা খুলে দেখল সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। অর্ণব হতভম্বভাবে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। নিশা হাতে ধরা প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা রাখুন।
অর্ণব নড়ল না, কিছু বললও না, বিকারগ্রস্তের মতো চেয়ে রইল শুধু। নিশা ছেলেটির অসংগত, অসংলগ্ন আচরণে কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। তার বয়স চোদ্দ নয়, চব্বিশ। তা ছাড়া মানুষের বয়স সময়ে নয়, বরং অভিজ্ঞতায় বাড়ে। সাংসারিক নানা অভিজ্ঞতা নিশার ভেতরের বালিকাসুলভ মনটাকে অনেক আগেই পিষে থেঁতলে একাকার করে দিয়েছে। পুরুষের দৃষ্টি এখন আর তাকে উতলা করে না। সে অর্ণবের হাভাতের মতো তাকিয়ে থাকা চোখের দিকে চেয়ে বলল, ‘কী হলো? দাঁড়িয়ে রইলেন কেন?
অর্ণব ঘোর ভাঙা শ্লথ হাত দুটো বাড়িয়ে দিল সামনে। আস্তে করে বলল, ‘আপনাকে ঠিক চিনলাম না।’
নিশা বুঝল জাহিদ তার হবু জামাতাকে দ্বিতীয় স্ত্রী সম্পর্কে কিছুই বলেনি। আগ বাড়িয়ে পরিচয় দেয়া ঠিক হবে কি না এই নিয়ে একটু দ্বিধায় ভুগল সে। কুটুমবাড়ির লোকদের চট করে ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে বলতে নেই। ভেবেচিন্তে বলা উচিত। পাশকাটানো গলায় বলল, ‘পরে কথা হবে। গুডনাইট।’
সব কাজ গুছিয়ে বেডরুমে ফিরল রাত দশটায়। জুবিন ঘুমিয়ে পড়েছিল দাদির কোলে। ওকে বেবিকটে শুইয়ে দিয়ে ভেবেছিল গোসল খানায় যাবে। তোয়ালেটা হাতে নিতে না নিতেই ভ্যাভ্যাঁ করে কেঁদে উঠল মেয়ে। বেজায় বিরক্ত হলো নিশা। এই দুষ্টু বাচ্চাটা নিতান্তই অকারণে কান্নাকাটি করে তার জীবন বিপর্যস্ত করে তোলে। কত দিন যে রাতে একটু শান্তি মতো ঘুমাতে পারে না! কবে এই বাচ্চা বড় হবে আর নিশাকে উদ্ধার করবে খোদা জানে। নিশা তোয়ালেটা বিছানায় ফেলে রেখে জুবিনের কাছে এলো, থমথমে গলায় বলল, ‘কী মহারানি? তোমার মা কি একটু গোসলও করতে পারবে না? কী চাও তুমি?
জুবিন কান্না থামিয়ে বড় বড় চোখ মেলে মাকে দেখতে লাগল। যেন মায়ের কথাগুলো সে বুঝতে পারছে। কুই কুই শব্দ করে কী যেন বলারও চেষ্টা করছে। ওই অঙ্গভঙ্গি দেখে নিশার মনে সারাদিন বাদে একটা বিশুদ্ধ আনন্দের ধারা প্রবাহিত হলো। মশারি তুলে মেয়ের ছোট্ট পেটের মধ্যে সুড়সুড়ি দিতে দিতে সে বলতে লাগল, ‘কী বলতে চান আপনি? হ্যাঁ? গল্প করবেন? আসেন আমরা গল্প করি!’
জুবিন ফোকলা দাঁতে খিলখিল করে হাসতে লাগল। হাসতে লাগল নিশাও। একটা গাড়ি এসে থেমেছে বাড়ির সামনে। নিশা মেয়েকে বলল, ‘তোমার বাবা এসেছে!’ জুবিন যেন বুঝে ফেলল কথাটা। শোয়া থেকে উঠে বসল ঝুপ করে। নিশা মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘরের বাতি নিভিয়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল। ফারা গাড়ি পার্ক করছে। জাহিদ নেমে গেছে বোধহয় আগেই। খানিক বাদে ঘরের বাইরে থেকে পদশব্দ ভেসে এলো। করিডরের বাতিটা জ্বালাল কেউ একজন। ইদানীং ঘুমোতে যাওয়ার আগে জাহিদ একবার আসে এই ঘরে, মেয়েকে দেখতে। আজও হয়তো আসবে। তার আসা না আসায় যদিও নিশার কিছুই এসে-যায় না। তবুও নিজের অজান্তেই সে একটু উৎকর্ণ হয়ে থাকে। ওই লোকের যখন-তখন ঘরে প্রবেশ করাটা তার পছন্দ নয়। শাশুড়িমা ছেলের কাছে ঘরের একটা চাবি দিয়ে রেখেছেন। যেন ইচ্ছে হলেই জাহিদ জুবিনকে দেখতে আসতে পারে। নিশার এই ব্যাপারে প্রথম থেকেই সম্মতি ছিল না। লোকটা জুবিনের বাবা হতে পারে কিন্তু নিশার তো কেউ না! মন প্রতিবাদী হয়ে উঠলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি। কখনোই বলতে পারে না। বলতে না পারার এক অসাধারণ দক্ষতা নিয়ে জন্মেছিল সে। তাই তো এত লোকের মধ্যে থেকেও সারাক্ষণ নিজস্ব পৃথিবীটাতে শুধু নিজেকেই নিজে বেষ্টন করে বসে থাকে। অন্ধকারে আঁকড়ে ধরার মতো কাউকেই পায় না। পায়ের শব্দ দূরে সরে গেছে। লোকটা আজকে আর আসবে না। যাক বাঁচা গেল!
নিশা জানালার পর্দা টেনে দিয়ে জুবিনকে ব্রেস্টফিড করানোর প্রস্তুতি নিল। ল্যাম্পশেডটা জ্বলছিল টিমটিম করে। হঠাৎ করেই নিচতলার গেস্টরুমের ছেলেটার কথা মনে পড়ল তার। এমন সহজ-সরল অকপট মুখশ্রী অনেকদিন দেখেনি। একদম সহজ-সরল ছেলেটা। শুনেছে ছাত্র হিসেবে খুব ব্রাইট। আমেরিকান সরকার নাকি ভালো ছাত্রদের ছাড়ে না, রেখে দেয়। এই ছেলের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। কিন্তু এত ভালো ছাত্র ঘরজামাই হতে চায় কেন? আত্মসম্মান বোধ নেই নাকি? দরজার নবটা আকস্মিক ঘুরে গেল। ভাবনায় ছেদ পড়ল নিশার। জুবিনকে বুকে নিয়ে বিছানায় আধশোয়া হয়ে ছিল। জাহিদ ঘরে ঢুকে দরজাটা ঠেলে দিল আগের জায়গায়। ওর পরনে একটা গাঢ় জলপাই রঙের পাতলা টি-শার্ট, কালো ট্রাউজার। লোকটার গায়ের রং উজ্জ্বল ফরসা। গাঢ় রঙের জামা গায়ে দিলেও বেশ মানিয়ে যায়।
নিশাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলার কোন অভিপ্রায় জাহিদের ছিল না। কিন্তু কোন এক আশ্চর্য কারণে নিশা তার উপস্থিতিতে সর্বদাই বিব্রত হয়। আজকেও হলো। জাহিদকে দেখামাত্র গায়ে ওড়না টেনে নিয়ে নিজেকে প্রায় প্যাকেট করে ফেলল। এমনই প্যাকেট করল যে জুবিনকেও আর দেখা যাচ্ছে না। এই আচরণে জাহিদ ভেতরে ভেতরে অস্বস্তি বোধ করে। নিশার দিকে সরাসরি তাকায় না, জানালায় চোখ রেখে বলে, ‘ঘুমিয়েছে?’
—‘খাচ্ছে।’
জাহিদ কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েকে এক নজর দেখার চেষ্টা করল। পারল না। নিশা সুতির ওড়না দিয়ে নিজের সারাটা শরীর আড়াল করে রেখেছে। ওড়নার নিচে জুবিনের নড়াচড়া কিছুটা টের পাওয়া যাচ্ছে। জাহিদের উঁকিঝুঁকি নিশাকে ক্রমেই আরো বেশি কুণ্ঠিত করে তুলছে। সে পাথরের মতো মুখ বানিয়ে থমথমে গলায় বলল, ‘একটু অপেক্ষা করুন। এখুনি হয়ে যাবে।’
জাহিদ বসল বিছানার ওপর, নিশার পায়ের কাছে।
খাওয়া শেষ হলে জুবিনকে জাহিদের কাছে হস্তান্তর করল নিশা। জুবিন তখনো ঘুমোয়নি। আজকাল তার রাতের বেলা বাবার কোলে ঘুমোনোর অভ্যাস হয়েছে। জাহিদ ওকে কোলে নিয়ে এদিক-সেদিক হাঁটাহাঁটি করে খানিকক্ষণ। বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়লে বেবিকট কিংবা বিছানায় আস্তে করে শুইয়ে দিয়ে প্রস্থান করে। জুবিনের ছোট্ট বলের মতো গোলাকার মাথাটা জাহিদের বুকের ওপর রাখা এখন। জাহিদ হাঁটছে ধীরে ধীরে, ঘরের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে। চোরা চোখে দৃশ্যটা একবার দেখল নিশা। বলতে কী, জুবিন তার বাবার কাছে থাকলেই নিশা সবচেয়ে বেশি নিশ্চিন্ত বোধ করে। প্রথমদিকে একটু দুশ্চিন্তায় ছিল এই ভেবে যে মেয়েটা হয়তো বাবার ভালোবাসা পাবে না। কিন্তু দিন যত কেটেছে, নিশা বুঝেছে যে এই লোকটা পারিবারিক দায়দায়িত্ব বেশ ভালোভাবেই পালন করতে জানে। নিশাকে অবশ্য সে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। আজ পর্যন্ত কোন দিন নিশার সঙ্গে হেসে কথা বলেনি। এমনকি একটা বার জানতেও চায়নি সে কেমন আছে। কষ্ট লাগলেও কষ্টটাকে আমলে নিতে চায় না নিশা। জন্ম থেকেই তার মধ্যে মানুষকে ভক্তি করার একটা অনর্থক ব্যগ্রতা আছে। সহ্য করার আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। সহজে কাউকে ঘৃণা করতে পারে না। এমনকি ফারা, তুরিন যে অহোরাত্র সাপের মতো ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে বেড়ায় চারপাশে, সুযোগ পেলেই বিষাক্ত ফণা তোলে, এদেরও সে শতভাগ ঘৃণা করতে পারে না। মাঝেমধ্যে মনে হয় ঘৃণা করার সামর্থ্যই তার নেই।
—‘আমি একটু গোসলে যেতে চাইছিলাম। যাব?’ নিচু স্বরে প্রশ্ন করল নিশা। যেন জুবিনের ঘুম না ভাঙে।
জাহিদ ছোট করে উত্তর দিল, ‘নিশ্চয়ই। যেতে পার।’
একটু তাড়াহুড়া করেই গোসল সারল। মনের মধ্যে খচখচ করছিল। কয়েক দিন আগে ঠিক আজকের মতোই জুবিনকে তার বাবার কাছে রেখে শাওয়ার নিতে গিয়েছিল। বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখে বাপ-বেটির কেউই ঘরে নেই। রাত তখন সাড়ে বারোটা। বাড়ির সব সদস্যই ঘুমে কাদা হয়ে আছে। জাহিদ এত রাতে কোথায় গেল মেয়েকে নিয়ে? কলিজাটা যেন কেউ টেনেহিঁচড়ে বুক থেকে ছিনিয়ে নিতে চাইছিল। হতবিহ্বল নিশা পাগলের মতো সমস্ত বাড়ি চষে ফেলল। লিভিংরুম, কিচেন, বারান্দা, কোন জায়গা বাদ রাখল না। মেয়েকে কোথাও না পেয়ে নিঃস্ব ভিখারিনীর মতো জাহিদের বেডরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল। ব্যখ্যাতীত রাগে তার হাত-পা কাঁপছিল। এই রুমে সে আগে কখনো আসেনি। প্রয়োজন পড়েনি। রুচিও হয়নি। সেদিন আগ পিছ কিছু চিন্তা করার সামর্থ্য ছিল না। ক্ষ্যাপা পাগলের মতো দরজায় আঘাত করতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যেই জাহিদ দরজা খুলল। নিশা বারুদের মতো ঝলসে উঠে বলল, ‘আমার মেয়ে কোথায়?’
জাহিদ নির্বাক চোখে চাইল ওর দিকে। চেয়েই রইল খানিকক্ষণ। তারপর কোন কথা বলেই সরে পড়ল দরজা থেকে। ফাঁকা দরজা দিয়ে নিশা দেখল জুবিন খাটের ওপর হামাগুড়ি দিচ্ছে। ফারা শুয়ে আছে জুবিনের ছোট্ট শরীরটার ডানপাশে। শোয়া অবস্থায়ই নিশার বারুদময় মুখটার দিকে একবার পাশ কাটানো দৃষ্টি দিল সে। হাসল বোধহয় একটু। তাচ্ছিল্যের হাসি। জাহিদ জুবিনকে কোলে নিয়ে দরজার কাছে আসতে না আসতেই নিশা ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিল মেয়েকে। রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘ওকে এই ঘরে আর কোন দিন আনবেন না। মনে থাকে যেন!’
জাহিদ প্রত্যুত্তরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল শুধু, সশব্দে। মুখ ফুটে কিছু বলেনি। মাথায় টাওয়েল পেঁচিয়ে কোন মতে একটা ম্যাক্সি পরে নিশা তড়িঘড়ি বেরিয়ে এলো বাথরুম থেকে। মনটা আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে আছে। এই বুঝি লোকটা জুবিনকে নিয়ে পাশের ঘরে পালিয়ে গেল! বেরিয়ে দেখল জুবিন ঘুমাচ্ছে বিছানায়। জাহিদ শুয়ে আছে ওর পাশে চিত হয়ে। লম্বা পা জোড়া ঝুলছে খাটের বাইরে। নিশ্চিন্তের মৃদু শ্বাস পড়ল নিশার। ল্যাম্পশেডের কমলা আলোয় দেখল জুবিনের ছোট্ট লাল টুকটুক ঠোঁটে একটা মুচকি হাসির রেখা লেগে আছে। জাহিদের হাতে কাচের চশমা আলগা করে ধরা। চোখে ঘুম।
নিশা কী করবে বুঝে পেল না। ঘুমন্ত পিতা-কন্যার দিকে কিছুক্ষণ একমনে চেয়ে রইল। মনে হলো জুবিনের মুখটা তার বাবারই মতো। ঠোঁটজোড়াও অবিকল মিলে যায়। সেলফোনটা হাতে নিয়ে আস্তে করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ভেজা তোয়ালে চুলে জড়িয়েই বাংলাদেশে ফোন করল। প্রায় আধাঘণ্টা ফোনালাপের পর যখন ঘরে ফিরল তখনো বাপ-বেটি ঘুমাচ্ছে অঘোরে। তার নিজেরও খুব ক্লান্ত লাগছে। লোকটার সঙ্গে একই বিছানায় শোবার কথা ভাবতে গিয়ে সংকোচ, বিরক্তি এমনকি অভক্তির মতো একটা বিশ্রী অনুভূতি চিড়বিড়িয়ে উঠছে মনে। তবুও ক্লান্ত শ্রান্ত মানুষটাকে ঘুম থেকে ডাকতে ইচ্ছে হলো না। জাহিদের হাতে ধরা চশমাটা আলগোছে নিজের হাতে তুলে নিল নিশা। রাখল খাটের পাশের নাইট স্ট্যান্ডের ওপর। বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল গুটিশুটি হয়ে জুবিনের পাশে। মাঝে মাঝে জুবিনকে বেবিকটে না রেখে নিজের পাশে নিয়ে শোয় নিশা। তখন অন্যপাশে কোলবালিশ দিয়ে ব্যারিকেড দিতে হয়। আজকে ব্যারিকেড হয়ে তার বাবা শুয়ে আছে। বিষয়টা সুন্দর। ভাবতেই নিশার বদ্ধ ঠোঁটে সামান্য হাসি ঝিলিক দিয়ে উঠল ভোরের প্রথম সূর্যরশ্মি রকি মাউন্টেনের আকাশস্পর্শী শৈলশিখর অতিক্রম করে, কলোরাডোর বিস্তৃত বিরান মালভূমি পার হয়ে, হরেক পাখির কিচিরমিচির সঙ্গে নিয়ে, নিশার শোবার ঘরের জানালায় যখন ঠকঠক কড়া নাড়ল, ঘুমের রাজ্যের সঙ্গে জাহিদের চেতনার সংযোগটাও ঠিক সেই মুহূর্তেই ছিন্ন হলো। চোখ খুলে ঘোলা চোখে সে নিজেকে আবিষ্কার করল নিশার বিছানায়। ডান হাতটা জুবিনের মাথার ওপর রাখা। নিশার হাতের আঙুল ছুঁয়ে আছে ওর আঙুল। চশমাবিহীন আবছা চোখে নিশার শুভ্র সুন্দর মুখখানির দিকে কয়েক সেকেন্ড অপলক চেয়ে রইল। জুবিন ঘুমাচ্ছে। মা-মেয়ের চোখের পাপড়ির ঝালরে নিখাদ মিল! ফুলের পাপড়ির মতো বঙ্কিম। কৃষ্ণ কালো! জাহিদ ইচ্ছে করেই নড়ছিল না। পাছে ওদের ঘুম ভেঙে যায় সেই ভয়ে। কিন্তু লাভ কিছুই হলো না। খানিক বাদে আপনা আপনিই নিশার ঘুমে ছেদ পড়ল। চোখ খুলে জাহিদকে দেখামাত্র পিলে চমকে উঠল সে। জাহিদের আঙুল ছুঁয়ে থাকা ডান হাতটা চট করে টেনে নিল নিজের কাছে। দুর্মোচ্য সংকোচের অনর্থক অত্যাচারে বুকের ভেতরটা দুরদুর করে কাঁপতে লাগল। জাহিদ আবছা চোখে মেয়েটার অকারণ ছটফটানি দেখতে লাগল। একটা সময় না পারতে বলল, ‘আমার চশমাটা কোথায়?’
নিশা উঠে এলো বিছানা থেকে। চশমাটা এগিয়ে দিল জাহিদের দিকে জাহিদ চোখে চশমা পরে নিয়ে নিশার দিশাহারা বিপন্ন মুখটার দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল।
—‘কী হয়েছে তোমার?’
—‘কী হবে?’ নিশা চোখ সরিয়ে নেয়।
—‘দুঃস্বপ্ন দেখেছ?’
নিশা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে তেরছা গলায় বলে, ‘দেখেছি বোধহয়। তবে ঘুমিয়ে নয়, ঘুম থেকে জাগার পর!’
জাহিদ হেসে ফেলল। নিশা আড় চোখে দেখল হাসিটা। হাসিটা হুল- বেঁধানো, জ্বালাময়…তবুও কেমন যেন টানটান সুশ্রী! নিশার হাঁসফাঁশ লাগতে থাকে। জুবিন এখনো ক্যাবলাকান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে কেন কে জানে! অন্যদিন তো ভোরের আলো ফোটার আগেই ট্যা ট্যা করে দুনিয়া মাথায় তোলে। আজকে সময় মতো উঠে গেলে তো ওকে নিয়ে ব্যস্ত হওয়া যেত। লোকটার সামনে অযথা ভাঁড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হতো না।
বেডরুমের দরজায় হঠাৎ যেন ডাকাত পড়ল। সেই শব্দে ছুটে গেল জুবিনের ঘুম। তারস্বরে কেঁদে উঠল সে। জাহিদ এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। ফারা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে জগিং স্যুট। চোখে প্রলয়ের চাপা আভাস। জাহিদ অপ্রস্তুত হলো, ‘কিছু বলবে?’
—‘বলবে তো তুমি!এখানে কী করছ শুনি?’ রূঢ় শোনাল ফারার কণ্ঠস্বর। জাহিদ পেছন ফিরে একবার বিপর্যস্ত চোখে নিশাকে দেখল,
—‘চলো ওদিকে গিয়ে কথা বলি।’
—‘ওদিকে যেতে হবে কেন? এখানে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে কি তোমার লজ্জা হচ্ছে?’
জাহিদ জোর করে ফারাকে দরজার বাইরে নিয়ে এলো। নিশা জুবিনকে বুকে চেপে ধরে থম করে বসে রইল বিছানায়। ফারার কণ্ঠস্বর উচ্চাঙ্গে উঠছে ক্রমেই। ছাপিয়ে যাচ্ছে জুবিনের কান্নার শব্দকে।
—‘এখন তুমি ওই ঘরে রাত কাটানো শুরু করেছ? আর কী কী দেখতে হবে আমার এই সংসারে জাহিদ? কবে এসব অরাজকতার দি এন্ড হবে শুনি?’
নিশার কানে কথাগুলো বোমার বিস্ফোরণের মতো শোনায়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে অশ্রু রোধ করার চেষ্টা করে সে। ব্যর্থ হয়। চোখের কার্নিশ উপচে টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে থাকে জল।
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ৩.১
নিদ্রাহীনতার রোগ নেই শাহজিদের। নিয়মমাফিক জীবন। সাড়ে সাতটার মধ্যে ডিনারের পাট চুকে যায়। দশটা পর্যন্ত ওই একটু বই টই পড়া…তারপর বিছানায় শোয়া মাত্র ঘুম। বাজারসদাইয়ের প্রয়োজন হলে ডিজেবিলিটি সারভিস সেন্টারে ফোন দেয়, ওরা গাড়ি করে এসে নিয়ে যায়। কাজ শেষ হলে আবার নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেয়। হাসপাতাল থেকে সপ্তাহে একদিন নার্স আসে। খোঁজখবর নেয়। থেরাপিস্ট আসে রোজ। পঙ্গু হওয়ার কারণে সরকারের কাছ থেকে একটা আলাদা মাসিক ভাতাও পায় সে। সংসারের দায়িত্ব নেই, নিজস্ব মানুষ নেই, নেই কোন দায়বদ্ধতা। দুশ্চিন্তামুক্ত নির্বিঘ্ন সময় কাটানোর অফুরন্ত ফুরসৎ! অ্যাক্সিডেন্টের পর, প্রথম কিছুদিন খুব করে চেয়েছিল আগের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে। কিন্তু দেখা গেল কাছের বন্ধুরাই তাকে একঘরে করে তুলছে। না করেও উপায় নেই। তাদের দলটা মূলত নানা রকম অ্যাডভেঞ্চারের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। দেখা গেল সেসব দুঃসাহসিক অ্যাডভেঞ্চার গুলো থেকে শাহজিদ সংগত কারণেই বাদ পড়ে যাচ্ছে। ভাঙা পা নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করা সম্ভব না। নকল পা, হুইলচেয়ার বা ক্রাচ নিয়েও হাইকিং সম্ভব, কিন্তু এতে যেন নিজের অক্ষমতাকেই আরো বেশি করে বরণ করে নেওয়া হয়। ঝরঝরে, টগবগে, বেগবান তরুণ দলের মধ্যে একজন উনপাঁজুরে, খুঁড়িয়ে চলা মানুষের উপস্থিতি বড্ড বেমানান। কেউ মুখ ফুটে কখনো কিছু বলেনি, কিন্তু আচার-আচরণই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল যে শাহজিদ এখন অন্য দলের মানুষ। শুনেছে অথর্ব, বিকলাঙ্গ সন্তানের প্রতি এক সময় বাবা-মার ভালোবাসাও ফিকে হয়ে ওঠে। রক্তর সম্পর্কও দুর্দিনে রং বদলায়। তাই বন্ধুদের বদলে যাওয়া চেহারা খুব সাধারণভাবেই মেনে নিয়েছিল। রাগ হয়নি, কিন্তু অভিমান হয়েছিল। সেই নিরর্থক অভিমান বুকের তলায় জমতে জমতে যখন পাহাড় হলো, তখন বুঝতে পারল প্রকৃতি তার মতো ঠুনকো মানুষের ঠুনকো অভিমানের কোন কদর করবে না বলেই পণ করেছে। ধীরেধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শিখল সে। পাহাড় ভালোবেসেছিল একদিন। কিন্তু সেই পাহাড়ই এখন তাকে নিয়ে দিবারাত্রি উপহাস করে। মুর্তজা সাহেব স্নেহের জোরে এ বাড়িতে ধরে না রাখলে, পাহাড় ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যেত নিশ্চয়ই, হয়তো সমুদ্রে!
নিজেকে নিয়ে ভাবে না বহুদিন। ভাবতে ভালো লাগে না। কাজের মধ্যে, বইয়ের মধ্যে, সংবাদপত্রের খবরের মধ্যে ডুবে থাকতে ইচ্ছে করে দিনরাত ভাবমন্দিরের দুয়ার খুলে দিলেই মোমের মতো পুড়তে থাকে মন। তখন এক ভয়ংকর অসহায়ত্ব বুকের ভেতরটাকে কুরে কুরে খায়। তাই ভাবমন্দিরের দরজা খানি সযতনে বন্ধ রাখে সে। তবুও মাঝেমধ্যে…মাঝেমধ্যে কোত্থেকে যেন দুরন্ত অবশীভূত ঝড়ের দাপট এসে হানা দেয়, খুলে দেয় রুদ্ধ কপাট। তারপর তছনছ হওয়া, বিষাদগ্রস্ত, বিরান মনাঞ্চলে শাহজিদ নিঃস্ব হয়ে বসে থাকে!
অ্যাঞ্জেলিনা দারুণ স্মার্ট মেয়ে ছিল। বাস্তববুদ্ধি সম্পন্ন, ধীমান, মেধাবী I যেকোনো আলোচনায় তার মতামত দৃঢ় এবং যৌক্তিক। জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। আকাশচুম্বী সাহস! মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা তার জীবনের ধ্রুব স্বপ্ন। শাহজিদেরও অনেকদিনের শখ একদিন পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বত শিখরে আরোহণ করবে। মানুষ আজীবন স্বপ্ন ভাগ করে নিতে ভালোবাসে। শাহজিদও নিজের স্বপ্ন বণ্টন করতে পেরে আনন্দিত ছিল। আঞ্জেলিনার সঙ্গে সময় কাটানোর মাঝে সে তৃপ্তি খুঁজে পায়। অনেকটা ভালো সিনেমা দেখার পর যেরকম স্যাটিসফ্যাকশন কাজ করে, সেরকম। একদিন আঞ্জেলিনা বলল, দ্যাখো শাহজিদ আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারিনি এটা সত্য। বাট আই এঞ্জয় ইওর কোম্পানি। মে বি উই শ্যুড গো আউট সামটাইম। আঞ্জেলিনা এমনই ছিল। প্রেমে পড়েনি, তবুও একজন পুরুষকে বন্ধুর চেয়ে বেশি করে পেতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় ওর কোন কুণ্ঠা নেই। ওর কাছে প্রয়োজনটাই বড়। শাহজিদেরও এই বাস্তববাদী প্রস্তাবে আপত্তি ছিল না। আধুনিক বিশ্ব প্ৰয়োজনে চলে, ভাবাবেগে নয়। সেই দিনগুলোতে, যখন অ্যাঞ্জেলিনার প্রভাব মনের ওপর না হলেও জীবনের ওপর শতভাগ জাজ্বল্যমান…সেই সময়, এক গ্রীষ্মের চনমনে দুপুরে তুরিনের সঙ্গে দেখা হলো অ্যালপাইন সেন্টারে,দূর পাহাড়ের বুকে। শাহজিদ দেখেছিল স্বর্নাভ তেজি রোদের নিচে খরগোশের বাচ্চার মতো আদুরে একটা মেয়েকে। একটা সময় ছিল, যখন প্রায় সব মেয়েরাই কেন যেন তার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের পর দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের জন্য আকুলিবিকুলি করত। যে কারো হৃদয়ে চটজলদি নিজের আসন গড়ে নেবার অভিনব দক্ষতা জানা ছিল শাহজিদের। তুরিনও দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সুযোগ হারাতে চাইল না। তবে ওর গায়েপড়া ভাবটাকে কখনো ভাঁড়ামি বা ছ্যাবলামি মনে হয়নি, মনে হয়েছে ছেলেমানুষি। সে একটু অন্যরকম। যেন শুধু মেয়েই নয়, বরং একটা কোমল, সুন্দর ফুল। যে ফুলের সংস্পর্শে এলে মন স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে, পবিত্র হয়ে ওঠে! ওই মুখের মধ্যে এমন একটা দৈব উপাদান মিশে আছে যে, তাকালে বোঝা যায় ওখানে শুধু সরলতার ছড়াছড়ি, কোন রকম বক্রতার স্থান নেই। আরো একটি অলংকারের উপস্থিতি ছিল মুখখানিতে। সেই অলংকারের নাম ‘লজ্জা’। লজ্জা পেলে যে মেয়েদের অপরূপ সুন্দর লাগে শাহজিদ তা তুরিনকে দেখার আগে জানত না। অ্যাঞ্জেলিনার মতো যুক্তি-তর্ক দিয়ে কথা বলতে পারত না তুরিন। যা বলত তার শতকরা আশিভাগই বালিকাসুলভ হেঁয়ালি কথাবার্তা। মাঝেমধ্যে বলত তুমি ফোন ধরে রাখো শাহজিদ, লাইন কেটো না। আমি এখন ঘুমাব। ঘুম থেকে উঠে যেন দেখি তুমি লাইনে আছ। তুরিনের মতে স্নো-ফলের মধ্যে আইসক্রিম খাওয়ার মজাই আলাদা, মনে হয় শুধু হাতে ধরা আইসক্রিম বার না, আশেপাশের বরফ জমা পৃথিবীটাকেই খেয়ে ফেলা হচ্ছে। ঝুম তুষারপাতের মধ্যে, হাতে হাত রেখে, পিচ্ছিল সাদা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আইসক্রিম খেত ওরা। আকাশ থেকে ঝরে পড়া বিশুদ্ধ তুষারকণা আইসক্রিমের সঙ্গে জিভের ডগায় মিশে যেত।
তুরিনের স্বপ্ন ছিল রকি মাউন্টেনের চূড়ায় ওর স্বপ্নের পুরুষ প্রেম নিবেদন করবে। আর নায়াগ্রা জলপ্রপাতে হবে এনগেজমেন্ট। খুবই সাধারণ এবং স্থূল এক রোমান্টিক স্বপ্ন। অ্যাঞ্জেলিনার মতো ধারালো চিন্তাধারার মেয়ে কখনোই ছিল না তুরিন। কিন্তু এই অতি সাধারণ মেয়েটিই অদৃষ্টক্রমে কী করে যেন দিনকে দিন অসাধারণ হয়ে উঠছিল শাহজিদের চোখে। পৃথিবীতে মাঝেমধ্যে এমন কিছু মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, যে মানুষকে প্রথম দেখায়ই মনে হয় জনম জনমের চেনা! মনে হয় যেন এর সঙ্গে কোথায় একটা গভীরতর যোগাযোগ আছে। বাকি আছে আর জন্মের হিসেব-নিকেশ। শাহজিদের আগে কখনো এমন হয়নি। তবে সেদিন ওই বাচ্চা খরগোশটাকে দেখামাত্র বুকের কোথায় যেন টিকটিক করে একটা সংকেত বেজে উঠেছিল, জল স্থল অন্তরীক্ষ মাতিয়ে কে যেন উদ্দাম স্বরে বলে উঠেছিল ‘তোমায় কোথায় দেখেছি? যেন কোন স্বপনের পাড়া?’
সেই মেয়েটা…সেই ফুলের মতো নরম, পবিত্র, খরগোশের বাচ্চার মতো আদুরে মেয়েটা…শাহজিদ যার চোখের ভেতর পৃথিবীর শুভ্রতম রূপ দেখেছিল প্রথম! সেই মেয়েটা হঠাৎ গিরগিটির মতো রং পাল্টে ফেলল। একদিন বলল জরুরিভিত্তিতে দেখা করতে চায়। গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। শাহজিদ অপেক্ষা করেছিল। কিন্তু তুরিন আসেনি। ফোন-টোন বন্ধ করে রীতিমতো উধাও। অ্যাক্সিডেন্টের পর মুর্তজা সাহেবের অনুরোধে এই বাড়িতে আসা হলো। দুর্ঘটনার ব্যাপারে কিছুই জানত না তুরিন। মুর্তজা সাহেবের সঙ্গে প্রথম যেদিন এলো এখানে, সেদিন অ্যাঞ্জেলিনাও সঙ্গে ছিল। তুরিন দাঁড়িয়ে আছে প্যাটিওতে। গাড়ি থেকে হুইলচেয়ার নামানো হলো। সেই হুইলচেয়ারে ধরে ধরে বসানো হলো আহত এবং ভগ্নহৃদয় শাহজিদকে। তার এমন কোন আপন জন নেই যার বুকে মাথা রেখে কদিন আগে ঘটে যাওয়া বীভৎস দুর্ঘটনার ভয়াবহতা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলতে পারে। দুর্ঘটনার পর থেকে সে বাবা- মাকে মিস করছে। আর আশ্চর্যজনকভাবে তুরিনকেও মনে পড়ছে। আঞ্জেলিনা হুইলচেয়ার ঠেলেঠুলে ব্যাকইয়ার্ডের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। তুরিন স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শাহজিদ ওর মুখে চোখ রেখেছে। কিন্তু তুরিনের চোখজোড়া থমকে গেছে হুইলচেয়ারে। শাহজিদের একটি পা নেই। অপরটি আছে। সেই থাকাও আবার কেমনতর! দুটো আঙুল অনুপস্থিত। তুরিনের মুখ দেখে মনে হলো এমন বীভৎস দৃশ্য সে জীবনে কখনো দেখেনি। শাহজিদ তবুও আশা করেছিল তুরিন একসময় ছুটে আসবে। আপন জনের বিপদে সাধারণত লোকে যেভাবে আসে। কিন্তু তুরিন আসেনি। কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে ভীত হরিণীর মতো ছুটে পালিয়ে গেছে বাড়ির ভেতর। কাকে ভয় পেয়েছিল সে? দুর্ঘটনাকবলিত, উৎসন্ন, লুণ্ঠিত শাহজিদকে? নাকি ওর অসহায় পঙ্গুত্বকে? তুরিনের কাছ থেকে পাওয়া কষ্টটা কেন যেন দুর্ঘটনার ভয়াবহতাকেও ছাপিয়ে গেল। বিশ্বাস উঠে গেল মনুষ্যত্বের ওপর থেকে। বাবা মারা যাওয়ার পর জীবনে আর কোনদিন কষ্ট পাবে না বলে শপথ নিয়েছিল মনে মনে। ধারণা ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কষ্টের ঝড়টা তার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে এরই মধ্যে। অন্য কোন ঝড়ের সাধ্য নেই এর চেয়ে বেশি শোধ নেবার। কিন্তু শাহজিদ তখনো জানত না মানুষের জীবনে আসা ঝড়গুলো একেকটা একেকরকম ভয়ংকর হয়ে থাকে। দুর্ঘটনার ঝড়, প্রত্যাখ্যানের ঝড়, সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে একঘরে হওয়ার ঝড়…হরেক রকম ঝড়ের মোকাবেলা করেছে সে মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সি ছোট্ট জীবনটায়। টলেছে, ভীত নড়ে গেছে, কিন্তু ভেঙে পড়েনি কখনো। তুরিন কখনোই আগের মতো স্বাভাবিক হয়নি। মুখোমুখি হলে ভাবটা এমন করে যেন শাহজিদকে সে চেনে না। মুখের ভাঁজে ভাঁজে তাচ্ছিল্য গিজগিজ করে। নিশার সঙ্গে শাহজিদের প্রথম থেকেই খুব ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। একদিন নিশাকে কী ভয়ংকর অপদস্থ করল বাড়ির লোকজনের সামনে! হতভম্ব শাহজিদের চোখে তুরিনের সুন্দর রূপটা যেন মুহূর্তের মধ্যে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেল! খরগোশের মতো নরম মেয়েটা কেমন বিষাক্ত কীটের মতো কদর্য হয়ে উঠল রাতারাতি।
অথচ আজ…এই এখন…তুরিন চলে যাওয়ার ঘণ্টাখানেক পরেও সারাটা ঘর যেন বুনো ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণে ছেয়ে আছে। শাহজিদ সেই মিষ্টি সুবাস বুকে নিয়ে চুপচাপ বসে আছে অন্ধকারে। আচ্ছা! সেই অ্যাক্সিডেন্টে যদি শাহজিদের পা-টা না গিয়ে জানটাই চলে যেত, তুরিন কি ভুল করে হলেও দু ফোটা চোখের জল ফেলত তার জন্য? ওর মরতে একদম ইচ্ছে করে না এইজন্য যে, মরে গেলে কেউ তার জন্য কাঁদবে না, স্মৃতি ধরে রাখবে না। হঠাৎ তুরিনের কোমরের সেই উল্কির কথা মনে পড়ল। কারো নাম শরীরে খোদাই করার মতো বোকা মানুষের অস্তিত্ব কি আজও পৃথিবীতে আছে? নিশ্চয়ই ওটা শাহজিদের ভ্রম ছিল। কিন্তু এমন অদ্ভুত ভ্রম হওয়ার কারণ কী? তার লজিক তো কখনো গোলমাল করে না!
সেই রাতটা তন্দ্রাচ্ছন্নতায় কেটে গেল। ঘুম এলো ভীষণ ফিকে ভাবে, আবার চলেও গেল। মাথার ভেতর টুকরো মেঘের মতো ভাসতে লাগল ভাবনারা। সকালে নিশা যখন নাশতা নিয়ে এলো, তখন ভুল করে একবার মনে হলো বুঝি তুরিন এসেছে। হয়তো ধার করা জ্যাকেটটা ফেরত দিতে চায়, কিংবা একটা ধন্যবাদ…হ্যাঁ একটা ধন্যবাদ তো শাহজিদের পাওনাই আছে, তাই না? গতরাতে ওই ভয়ংকর দুর্ঘটনার হাত থেকে শাহজিদই তো ওকে বাঁচিয়েছিল।
ছুটির দিনে
এপ্রিল মাসে শীতের দাপট পাকাপোক্ত বিষয় নয়। বসন্ত জানে প্রকৃতিতে এ সময় শুধু তারই একচ্ছত্র আধিপত্য গ্রহণযোগ্য। তাই অসময়ের দুর্বল শীতকে হটিয়ে দিয়ে নিজের মালিকানা স্থাপনে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না তার। দুটি ঋতু একই সঙ্গে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার যুদ্ধ করে কিছুদিন। গাছের ডালে ডালে নতুন পাতা গজায়, পাশাপাশি বরফের আবরণও পড়ে। সন্ধের দিকে বাসন্তী হাওয়া ছোটে, আবার পরদিনই হিমেল তুষারপাত! শীত এবং বসন্তর এই বিস্ময়কর সহাবস্থান কলোরাডোকে অন্যান্য অঞ্চল থেকে নিঃসন্দেহে আলাদা করে তোলে। এ বছর প্রথম এপ্রিলের জমানো তুষারটা দুদিনেই কেটে গেল। নির্মল রোদ বসন্তের ঘ্রাণ নিয়ে নেমে এলো পাহাড়ের শুষ্ক বুকে। গাছের ডালের সবুজ পাতায় নতুন প্রাণের সঞ্চারণ হলো।
সেদিন শনিবার। ছুটির দিন। সকাল থেকেই পাখিরা জানান দিচ্ছে নিজ অস্তিত্ব। উৎসবের আমেজ লেগেছে চারিদিকে। তুরিনদের নেইবারহুডে পুল পার্টি হচ্ছে। বাদ্যবাজনা, হই-হুল্লোড়ে পুরো পাড়া সরগরম। শীতে সুইমিংপুল বন্ধ থাকে। গতকাল এলাকাবাসীর জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। তুরিন গত দুটা দিন বাড়ির কারো সঙ্গেই ঠিকমতো কথা বলেনি। সকালে বেরিয়েছে ভার্সিটির উদ্দেশে। ফিরেছে সন্ধ্যায়। ডিনারও করেছে বাইরে। সন্ধে সাতটার মধ্যে তার ডিনার করার অভ্যাস। ফারা এবং জাহিদ মেয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য উদগ্রীব হয়ে ছিল। এমনকি মুর্তজা সাহেবও নাতনিকে জরুরিভিত্তিতে তলব করেছেন। তুরিন সাড়া দেয়নি। সে বলেছে উইকেন্ডের আগে সময় হবে না। অবশেষে উইকেন্ড এলো। আজ বাবা-মা, দাদা-দাদি সবাই একত্রে বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছে। তাদের নাকি বিশেষ জরুরি কথা আছে। তুরিন সেই জরুরি কথাটি সম্পর্কে খুব ভালোভাবেই অবগত। কিন্তু মরে গেলেও এখন সে বিয়ে করবে না। কিছুতেই না। মাঝের দুটি দিন কী রকম ঘোরের মধ্যে যে কাটল! শাহজিদের ওই নীল জ্যাকেটটা যেন শুধু জ্যাকেট না, শাহজিদ নিজেই। একলা ঘরে বসে বসে ওই জ্যাকেটের সঙ্গেই কথা বলেছে তুরিন।
আজ সকাল থেকে কী করে বাবা-মা আর দাদাদাদির সঙ্গে ফিক্স হওয়া মিটিংটা ক্যানসেল করা যায় তাইই ভেবে যাচ্ছিল। কোন উপায় পাচ্ছিল না। বাঁচিয়ে দিল আনিতা। তখন ঘড়িতে সকাল নটা। তুরিন বিছানা ছাড়েনি। এর মাঝেই ঘরে ডাকাত পড়ল যেন।
‘তুমি এখনো রেডি হওনি?’ ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আনিতার প্রশ্ন।
তুরিন মাথা চুলকে বলল, ‘রেডি হব কেন? কোন প্ল্যান আছে নাকি?
—‘তোমার হয়েছে কী তুরিন? সব ভুলে যাও আজকাল। আমাদের টিকটকের ভিডিও শ্যুট করার কথা আজ!’
তুরিনের মুখটা অতর্কিতে ঝলমল করে উঠল, ‘আরে তাই তো! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম!’
—‘হ্যাঁ ইদানীং সব কিছুই ভুলে যাচ্ছ। এর কারণ কী?’
তুরিন চাপা উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত হয়ে বলল, ‘এক কাজ কর আনিতা। নিচে গিয়ে দাদাজানকে বল আমরা হাফ অ্যান আওয়ারের মধ্যেই বেরোচ্ছি। আজকে কোন মিটিং হবে না।
গত দুদিন অর্ণব তুরিনের দেখা পায়নি। মেয়েটা বাড়িতে থাকেই না বলতে গেলে। ডিনারের টেবিলেও রোজ অনুপস্থিত। অবশ্য অর্ণব নিজেও প্রতিবেলা বাড়িতে খায়নি। কিছু বন্ধুবান্ধব আছে ডেনভারে। ওদের সঙ্গে দেখা- সাক্ষাৎ করেছে। রেস্টুরেন্টে খেয়েছে। বিভিন্ন জায়গা এক্সপ্লোর করেছে। আজ সকালে নাশতার পর একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল। বাড়ির সামনের উঠোন পেরিয়ে নেইবারহুডের সরু রাস্তায় উঠতেই সকালের ঝলমলে রোদ্দুরে সেই সুন্দর মেয়েটিকে দেখতে পেল সে। কামিজের ওপর একটা বেগুনি রঙের পাতলা সোয়েটার পরনে। গলায় স্কার্ফ। ঘাড়ের ওপর হৃষ্টপুষ্ট খোঁপা। ফুটপাত ধরে হাঁটছিল। একা নয়। হুইলচেয়ারে বসা একজন মানুষ আছে সঙ্গে। জগিং করতে করতে ওদের কাছাকাছি এগিয়ে এলো। ডাক দিল হেঁড়ে গলায়, ‘হ্যালো ম্যাডাম! গুড মর্নিং! কেমন আছেন?’
নিশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। মুখে ঝুলতে থাকা হাসিটা চট করে লুকিয়ে নিয়ে একটু গম্ভীরভাবে উত্তর দিল, ‘গুডমর্নিং! ভালোই আছি।’
অর্ণব দেখল হুইলচেয়ারে একজন ভারী সৌম্যদর্শন যুবক বসে আছে। মাথার লম্বা এলোমেলো চুল আর দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল তার সৌন্দর্যকে কিছুমাত্র ম্লান করতে পারেনি। কী কারণে যেন একে প্রথম দেখায় ঠিক বাঙালি বলে মনে হয় না। অর্ণব ইংরেজিতে বলল, ‘হ্যালো ব্রাদার! গুড মর্নিং! হাও আর ইউ?’
শাহজিদ হাসল, ‘গুডমর্নিং! আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
—‘আপনি বাঙালি?’
—‘বাংলাদেশি।’
অর্ণব ভারি আন্তরিক হাসি হাসল, ‘বলেন কী ভাই, আপনাকে দেখে তো বোঝাই যায় না আপনি আমাদের মতো গরিব দেশের লোক। ইউরোপের রাজকুমার মনে হয়।’
—‘আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না!’
নিশা মনে মনে বিরক্ত বোধ করছিল। হাঁটা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে এখন। তাকে মিনিট দশেকের মধ্যেই বাড়ি ফিরতে হবে। আজ ছুটির দিন। বাড়ির সব লোক উপস্থিত। আজকের ব্যস্ততা অন্যরকম। আজাইরা আলাপ করার সময় এটা নয়।
—‘আমার নাম অর্ণব। মেরিল্যান্ড থেকে এসেছি।’
নিশা যোগ করল, ‘উনি এ বাড়ির হবু জামাই। ওই যে বলেছিলাম না, তুরিনের ব্যাপারে?’
কথাটা শুনে শাহজিদ বিস্ময়ে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। ডান গালে জিব ঠেকিয়ে বঙ্কিম মুখে কী যেন ভাবনা ভাবে। ভালোমতো দেখে নেয় একবার অর্ণবকে। বেশ লম্বা। চেহারা-ছবি ভালোই। তুরিনকে মানাবে ওর পাশে। গলায় নকল সন্তুষ্টির সুর টেনে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে, সাবলীলভাবে বলার চেষ্টা করে শাহজিদ, ‘নাইস টু মিট ইউ ম্যান!’ অর্ণব লজ্জিত ভঙ্গিতে বলে, ‘লাইকওয়াইজ।’
—‘কী করা হয়?’
—‘মাস্টার্স কমপ্লিট করলাম। কম্পিউটার সায়েন্স।’
—‘কোন স্কুল?’
—‘মেরিল্যান্ড।’
—‘এখন কী করছেন?’
—‘চাকরি খুঁজছি। পি-এইচডি’র অফার আছে ইউনিভার্সিটি থেকে। মানে আমার এক প্রফেসর খুব করে চাইছেন উনার সঙ্গে যেন কাজ করি।’
নিশা ফোঁড়ন কাটল, ‘সময় ফুরিয়ে আসছে। চল বাড়ির দিকে ফেরা যাক।’ কথাটা বলতে বলতে সে এগিয়ে গেল কয়েক পা। অর্ণব ওদের পিছু ছাড়ল না। পাশাপাশি হাঁটতে লাগল। একটু নিচু স্বরে শাহজিদকে প্রশ্ন করল,, ‘আপনি কি মুর্তজা সাহেবের বাড়িতেই থাকেন?
—‘জি।’
অর্ণব বোঝার চেষ্টা করল দুজন যুবক-যুবতীর মধ্যকার সম্পর্কটা। ভাই- বোন? বন্ধু? নাকি প্রেমিক-প্রেমিকা? মেয়েটিকে যত দেখছে ততই মুগ্ধ হচ্ছে। কী শান্ত, সুনিবিড়, স্নিগ্ধ একটা আবেশ জড়িয়ে থাকে ওর চারপাশে সর্বক্ষণ। এরকম মেয়ে অর্ণব কখনো দেখেনি, শুধু কবিতায় পড়েছে আর অনুভব করেছে। কবিতা চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠলে কী চমৎকার অনুভূতি হয় তা নিশাকে যে মানুষ দেখবে না, সে বোধহয় কোন দিন জানতে পারবে না!
মুর্তজা সাহেব প্যাটিওতে দাঁড়িয়ে আছেন। কোলে জুবিন। জাহিদ আর ফারাও উপস্থিত। অর্ণবকে দেখা মাত্র মুর্তজা বললেন, ‘এই যে তুমি। তোমাকেই খুঁজছিলাম! ছিলে কোথায় এতক্ষণ?’
অর্নব একটু অপ্রতিভ হলো –’কাছাকাছিই ছিলাম। কোন দরকার?’
—‘এই যে দ্যাখো, আমার নাতনিরা কোথায় যেন যাচ্ছে পিকনিক করতে। তুমি এদের নিয়ে যাও। তোমার ওপর দায়িত্ব দিলাম।’ আদেশ করলেন মুর্তজা। আনিতা তৈরি হয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে ছিল। তানিশার সামনে পরীক্ষা। সে যাচ্ছে না। তুরিন তখনো নামেনি। মুর্তজা সাহেবের মাত্র বলা কথাটা আনিতাকে চমকে দিল, সে আশ্চর্য হয়ে বলল, ‘সিরিয়াসলি দাদাজান? উনি আমাদের সঙ্গে যাবে? আমরা একা যেতে পারব না? আমাদের দুজনেরই আঠারোর ওপর বয়স।’
জাহিদ বলল, ‘অর্ণবকে তোমরা সঙ্গে নিয়ে যাও। ওর একটু এক্সপ্লোর করা হবে। নতুন জায়গা দেখা হবে।’
শাহজিদ হুইলচেয়ার নিয়ে ব্যাকইয়ার্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। নিশা ওর পিছু ধরল। দরজার সামনে জাহিদ আর ফারা দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মুখোমুখি হওয়ার চাইতে শাহজিদের সঙ্গে বেজমেন্টে যাওয়াই উত্তম। মুর্তজা সাহেব বলে উঠলেন,
—‘তোমরা পালাচ্ছ কেন? এক কাজ করো, তোমরাও যাও আনিতা আর তুরিনের সঙ্গে। একটা দিন সবাই মিলে ঘুরে এসো। ভালো লাগবে।’
নিশা অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘না বাবা। আমি কী করে যাই জুবিনকে ফেলে?’
আনিতার মুখে আগ্নেয়োগিরির লাভা চকচক করে উঠল যেন। দাদাজান পারলে বাড়ির সব সদস্যকে তাদের সঙ্গে পাঠিয়ে দেবে। এত শয়তানি বুদ্ধি এই বুড়োর মাথায় কী করে আসে? একটা দিন তাদের স্বাধীনভাবে কাটাতে দেবে না। কী বিরক্তিকর! এখন পারলে বলবে, এক কাজ করি আমি আর তোমার দাদিজানও সঙ্গে যাই। ফুল ফ্যামিলির পিকনিক হয়ে যাবে।
মুর্তজা সাহেব নিশাকে বললেন, ‘একটা দিন জুবিন আমাদের সঙ্গে থাকবে। কোন সমস্যা নেই। তুমি যাও। একটু ঘুরে এসো মা। তোমার তো বাইরে যাওয়াই হয় না!’
নিশা অতর্কিতে একবার জাহিদের দিকে তাকাল। ফারা দাঁড়িয়ে আছে জাহিদের গা ঘেঁষে। নিশার চাউনি লক্ষ করে জাহিদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ফারার চোখে চোখ পড়তেই সে ঢোক গিলে চুপ করে গেল। কিন্তু বেশিক্ষণ চুপ করে রইল না। কী যেন ভেবে নিয়ে পরমুহূর্তেই বলল, ‘তুমি যাও নিশা। জুবিন আমার সঙ্গে থাকবে। নো ওরিজ।’
সেই সময় হাই-হিল জুতোয় টুকটুক শব্দ তুলে তুরিন প্রবেশ করল দৃশ্যপটে। উঠোনের শেষ প্রান্তে শাহজিদের হুইলচেয়ারটা দেখামাত্র তার মুখে রক্তের যে ঝলক এসে লাগল, তা বোধকরি একটু মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করলে উপস্থিত সব সদস্যই টের পেত। শাহজিদের হুইলচেয়ারের পেছনেই নিশা দাঁড়িয়ে আছে। তুরিন ওর অস্থির দুটি চোখ কোথায় রাখবে তা ঠিক মতো ঠাওর করে উঠতে না পেরে অনেকটা দৃষ্টি প্রতিবন্ধীর মতো শূন্যে তাকিয়ে অস্থির গলায় বলল, ‘এখানে কী হচ্ছে? সিনেমা চলছে নাকি?’
মুর্তজা সাহেব বললেন, ‘তোমরা একা যেও না দাদুভাই। এদেরও নিয়ে যাও।’
তুরিন আঁতকে উঠল, ‘কাদেরকে?’
শাহজিদের চোখ গেঁথে গিয়েছিল তুরিনের মুখের ওপর। একটা চেরি পিংক রঙের কোট পরেছে ও। ব্লু জিন্স। মুখে কড়া প্রসাধন। মেয়েটার কথার ধরন এত উদ্ধত আর তেজি যে ওই তেজ রূপের স্নিগ্ধতা ম্লান করে দেয়। তবুও আশ্চর্য মানুষের মন! রাগী, ডাইনির মতো ক্যাটক্যাট করা তুরিনের দিকে চোখ পড়া মাত্রই শাহজিদের হৃদয়তরিতে যেন উল্টো একটা হাওয়া লাগল। গত দুদিন এই মেয়েটির কথা ভেবেছে অসংখ্যবার। আজকে যখন সেই ভাব জগতে থাকা মানুষটা সরাসরি বাস্তবের মাটিতে নেমে এলো, তখন মনের ওপর দিয়ে মনেরই অজান্তে একটা অন্যরকম, অন্য জাতের, অন্য স্বাদের শিহরণ বয়ে গেল নিঃশব্দে!
মুর্তজা সাহেব একটু ভারী গলায় নাতনিদের বললেন, ‘তোমরা অর্নবের গাড়িতে উঠে যাও।’
তুরিন ঝাঁজ ওঠা বিষাক্ত কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ইম্পসিবল!’
আনিতা ওর কনুইয়ে একটা চিমটি কেটে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘প্রটেস্ট করার দরকার নাই। বেশি কথা বললে দাদাজান নিজেই আমাদের সঙ্গে যেতে চাইবে।’ কথাটা শেষ করে সে ছদ্ম হাসি হাসল, ‘মিস্টার অর্ণব! আপনার গাড়ি কোনদিকে?
শাহজিদ এতক্ষণে কথা বলল, ‘নিশা, তুমিও যাও ওদের সঙ্গে। ভালো লাগবে।’
—‘তুমিও চলো।’ অকপট আবদার করল নিশা
—‘আমি যাব না।’
—‘তাহলে আমিও যাব না।’
—‘মানে কী?’
—‘মানে হচ্ছে তুমি না গেলে আমিও যাব না!’
ওদের কথোপকথন শুনছিল সবাই। শুনছিল তুরিনও। শুনতে শুনতে তার শরীরের প্রতিটি অণু-পরমাণুতে লাল মরিচের ঝাঁঝ ধরে যাচ্ছিল। নিশা গলায় দুনিয়ার মায়া ঢেলে বলল, ‘চলো শাহজিদ! তুমি না গেলে আমার ভালো লাগবে না!’
ফারা ঠোঁটে একটা তেরছা হাসি নিয়ে জাহিদের দিকে তাকাল। জাহিদ চাউনিটা উপেক্ষা করে পা বাড়াল ভেতর বাড়ির দিকে। ফারা ওর পেছন পেছন আসতে আসতে ভর্ৎসনার গলায় বলল, ‘তোমার বউয়ের কী দরদ দেখলে তো ওই খোঁড়া ছেলেটার জন্য? ওদের মধ্যে কিছু চলছে নাকি?’
জাহিদ স্ত্রীর কথার প্রত্যুত্তর করল না।
— ‘চুপ করে আছ কেন? আমার তো মনে হয় দুজনে তলে তলে প্রেম করছে।’
জাহিদ প্রসঙ্গ পাল্টে নিল, ‘আজকে কোন প্ল্যান আছে?’
—‘নেই আবার! দু-দুটো দাওয়াত। দুপুরে অনিমেষ খাওয়াচ্ছে। ওর প্রমোশন উপলক্ষে। রাতে আনিস ভাইয়ের মেয়ের গ্র্যাজুয়েশন পার্টি।’
—‘অনিমেষ আমাকে কিছু বলেনি তো!’
—‘জনে জনে বলতে হবে নাকি? আমাকে তো বলেছেই।’
—‘তুমি যাও। আমি বাবা-মাকে নিয়ে একটু বেরোব।’
—‘কোথায় যাবে?’
—দেখি। ভাইয়া-ভাবি তো বাড়িতে নেই। আমরাও বেরিয়ে পড়লে বাবা- মা একদম একা হয়ে যাবে।’
—‘মানে তোমার ভাই-ভাবি নিজেদের মতো উইকেন্ড এঞ্জয় করবে আর বাবা-মায়ের দায়িত্বটা সব সময় তোমার ঘাড়েই পড়বে। অসাম!’
—‘তুমিও চলো আমাদের সঙ্গে। অনিমেষকে না করে দাও।’
—‘মাথা খারাপ? ভীষণ কষ্ট পাবে অনি। বাবা-মাকে বুঝিয়ে বল আজ বন্ধুর পার্টি আছে।’
—‘বন্ধু তো তোমার। আমার নয়।’
ফারা একটা বড় শ্বাস গোপন করল। কয়েক পা এগিয়ে এসে জাহিদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বলল, ‘বাবা-মাকে নিয়ে লাঞ্চের পর বের হই আমরা, কেমন? আজকে অনির খুব স্পেশাল একটা ডে। আমরা উপস্থিত না থাকলে মন খারাপ করবে। বেচারাকে এভাবে হার্ট করা কি ঠিক হবে বলো?’
.
নিশা একটা চাঁপা ফুল রঙের সুতির শাড়ি পরেছে। বাড়ির বাইরে বেরোনো হয় কদাচিৎ। এসব আউটিংয়ে কী ধরনের পোশাক পরা উচিত-সে সম্পর্কে তার ধারণা ক্ষীণ। তুরিন,ফারার মতো খোলামেলা পোশাক গায়ে চড়ানোর কথা ভাবতে গেলে মনে মনে শিউরে ওঠে সে। পশ্চিমা চালচলন রপ্ত করার মতো স্মার্টনেস তার মধ্যে নেই। ইংরেজিটাও ঠিকঠাক বলতে পারে না এখনো। এই আধুনিক উন্নত দেশে তার মতো গেঁয়ো প্রডাক্ট বুঝি একেবারেই বেমানান। সাজগোজ বলতে ওই একটু কাজল আর কপালের মাঝ বরাবর একটা টিপ। শাশুড়িকে জুবিনের খাওয়া-দাওয়া বুঝিয়ে দিয়ে নিচে নামতেই দেখল জাহিদ লিভিংরুমে বসে আছে খবরের কাগজ হাতে নিয়ে। পাশে মুর্তজা সাহেব। টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা চলছে। নিশার হাতভর্তি চুরির ঝিনিঝিনি মিষ্টি শব্দে জাহিদের মনোযোগ বিঘ্ন হলো। মুখ তুলে চাইল সে। চশমার আড়ালের প্রশান্ত দুটি চোখের তারা নিশার লালিত্য ঠাঁসা মুখটায় পড়তে না পড়তেই একটা মন কেমনের ঝড় উঠল নিশার চারপাশে। অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সে, কী কারণে যেন লজ্জিতও হলো…কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়ে টের পেল…গলার স্বর বুজে এসেছে। বুক কাঁপছে ধুকপুক করে। লোকটা এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? সে কি একটু বেশি সেজে ফেলেছে?
—’তুমি রেডি?’
প্রশ্ন করলেন মুর্তজা সাহেব। নিশা কোন রকমে উত্তর দিল, ‘জি বাবা।’ জাহিদ খবরের কাগজে চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। নিশা একটু স্বস্তি ফিরে পেয়ে শ্বশুরকে বলল, জুবিন থাকল বাবা। কিছু দরকার হলে আমাকে ফোন করবেন।
—তুমি নিশ্চিত থাকো। চিন্তা কোর না।
বেরোনোর আগে নিশা একবার তাকাল জাহিদের দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে জাহিদও চোখ তুলল। চার চোখেতে মিলন হতেই নিশা লক্ষ করল চশমা পরা ছিপছিপে গড়নের সুন্দর দেখতে ভদ্রলোকটার ফরসা মুখে লালচে রঙের মৃদু আভা চিকচিক করছে। বুকের কোন একটা ঘরের জানালার কপাট যেন বাড়ি খেল দড়াম শব্দে! নিশা চট করে চোখ নামিয়ে নিল নিচে।
বেরোনোর সময় মনটা হঠাৎ করেই খুব খারাপ হয়ে গেল। জুবিনকে রেখে কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। একা একা বেড়াতে কার ভালো লাগে? নিজের পরিবার ফেলে? পরিবার শব্দটা মাথায় আসতেই তার চোখের সামনে আরো একটি মুখ ভেসে উঠল অতর্কিতে। মন খারাপের পাল্লাটার ঝুপ করে ওজন বেড়ে গেল। অনেকখানি!
ম্যাজিক মিরর
দেখতে কোমল হলেও নিশার ব্যক্তিত্ব কিন্তু ভীষণ কড়া। চাইলেই কেউ ওর কাছে ঘেঁষতে পারে না। একটু আগে অর্ণব বেজায় অনুগত ভঙ্গিতে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছে। নিশা এত সম্মান পেয়ে অভ্যস্ত নয়। সে বিব্রতভাবে বলেছে, ‘অর্ণব সাহেব, আপনি বসুন প্লিজ। ব্যস্ত হবেন না।’ অর্ণব নড়ল না। দরজা ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। গাড়িতে ওঠার পর শাড়ির আঁচলটা সামান্য ঝুলে পড়েছিল বাইরে। অর্ণব আঁচলখানি তুলে নিয়ে নিশার হাতে গছিয়ে দিল 1 বিনিময়ে একটা ছোট্ট ‘ধন্যবাদ’ আশা করেছিল সে। কিন্তু নিশা ধন্যবাদ তো দিলই না, উপরন্তু মুখটাকে এমন গম্ভীর বানিয়ে ফেলল যেন অর্ণবের মাত্র করা কাজটা কোন উপকার নয়, বরং অনধিকার চর্চা।
মধ্যিখানে আনিতা। জানালার পাশে তুরিন। নিশা আনিতার গা বাঁচিয়ে বসল। যেন ছোঁয়া না লেগে যায়। আনিতার আচরণে এমন একটা ভাব আছে যে মাঝে মাঝে মনে হয় নিশা অদ্ভুত। ড্রাইভিং সিটের পাশে শাহজিদ বসেছে। ওর পরনে একটা সাদা রঙের লং স্লিভ টি-শার্ট। ছাই রঙের জিন্স। কানের লতি পর্যন্ত নেমে আসা এলোমেলো ঈষৎ লালচে চুলগুলো আজকে জেল দিয়ে পরিপাটি করে আঁচড়ানো। চোখে কালো রঙের পোলারাইজড সানগ্লাস। মুখে চুইংগাম। নিশা গাড়িতে উঠে বসেই প্রশ্ন করল, “শাহজিদ, তোমার হুইলচেয়ার নিয়েছ?’
—‘না লাগবে না। ক্রাচেস শ্যুড বি এনাফ।’
নিশা একটু গম্ভীরভাবে, অনেকটা স্বগতোক্তির মতো বলল, ‘হুইলচেয়ারটা নিয়ে নিলেই পারতে!’
গাড়ির ভেতর একটা অসহ্য রকমের নৈঃশব্দ্য খাবি খাচ্ছিল। অর্ণবই কথা বলল প্রথম।
—‘কোথায় যাব?’
আনিতা একটু সামনে এগিয়ে এসে অর্ণবের কাঁধের কাছাকাছি মুখ নামিয়ে বলল, ‘আপনার সেলফোনটা দিন। ডেস্টিনেশন সেট করে দিচ্ছি।’
আনিতা কাছে আসতেই পারফিউমের কড়া ঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা খেল। একটু ভড়কে গিয়েছিল অর্ণব। তড়িঘড়ি করে সেলফোন এগিয়ে দিল সে। শাহজিদ জানালার কাচ নামিয়ে দিয়েছে। গাড়ির সিটটা এত বেশি হেলিয়ে দিয়েছে পেছনে যে আরেকটু হলেই ওটা তুরিনের গায়ের ওপর ধসে পড়বে। হাঁসফাঁস লাগছিল তুরিনের। না পারছে কিছু বলতে, না পারছে সইতে। শাহজিদের কোন বিকার নেই। গদিতে প্রায় অর্ধশয়নে শায়িত হয়ে, মনের তৃপ্তি নিয়ে রোদের উত্তাপ খাচ্ছে সে। এপ্রিলের এই শীত কাটানো নরম নরম গরম রোদটা ওর দারুণ লাগে।
গাড়ি চলতে শুরু করতেই ঝাপটা বাতাস ছুঁয়ে দিল সবাইকে। বাতাসটা ভারি মসৃণ। নাতিশীতোষ্ণ ভাব আছে এর মধ্যে। খুব বেশিক্ষণ গায়ে লাগলে অবশ্য শীত শীত করে। তবে ওই শীতটা সহনীয় এবং আরামদায়ক। নিশা আর তুরিন দুজনে দুদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে মূর্তির মতো বসে আছে। যেন পরস্পরের দিকে তাকানো বারণ।
—‘কেমন লাগছে আপনার? আমাদের কলোরাডো?’ শাহজিদের প্রশ্ন।
অর্ণবের ভাড়া করা কালো রঙের টয়টা এসইউভি তখন রোদ তাতানো চকচকে রাস্তা দিয়ে মসৃণভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে সামনের দিকে মুখ তাক করেই সে উত্তর দিল, ‘এখনো বুঝতে পারছি না ভাই। অনেক ড্রাই। আমার চামড়া ফেটে যাচ্ছে। মেয়েদের মতো লোশন মাখতে হচ্ছে দিন রাত।’
শাহজিদ একটু হেসে বলল, ‘লোশন জিনিসটা কি শুধু মেয়েদের জন্যই বরাদ্দ নাকি? পুরুষদেরও শরীরে চামড়া আছে। পুরুষরাও মানুষ! ‘
—‘আমার যে ত্বক বা চামড়া বলে কিছু আছে তা কলোরাডো এসে টের পেলাম। চামড়া ফেটে ফেটে জানান দিচ্ছে, আমি আছি! আমি আছি!
এই কথায় সবাই হেসে উঠল। হাসল না শুধু তুরিন। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে চেয়ে রইল জানালার বাইরে।
—‘আপনার ঘরে হিউমিডিফায়ার আছে?’
—‘খেয়াল করিনি।’
নিশা ফোড়ন কাটল পেছন থেকে, ‘না নেই। এটিকে একটা এক্সট্রা রাখা আছে। দেখি বাড়ি ফিরে নামিয়ে দেব।’
—‘মনে করে একটু নামিয়ে নিও নিশা। বেচারা কষ্ট পাচ্ছে।’ নিশাকে কথাগুলো বলে নিয়ে একটু থামল শাহজিদ। তারপর অর্ণবের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘এখানে সারা বছর ওই একটা যন্ত্র অপরিহার্য, বুঝলেন? নইলে গায়ের চামড়া কেটে ছিঁড়ে একাকার হয়ে যায়।’
—‘হুম…আর আমার তো ব্রিদিং প্রব্লেমও হচ্ছে। হাই এলেভেশনের কারণেই হচ্ছে বুঝতে পারছি। তবে এর প্রতিকার কী? মানে আপনাদেরও কি হয় এরকম?’
—‘প্রথম প্রথম একটু ব্রিদিং প্রব্লেম, মোশন সিকনেস কাজ করা স্বাভাবিক। ধীরেধীরে ঠিক হয়ে যাবে। আপনার ড্রাইভ করতে কোন সমস্যা হচ্ছে না তো?’
অর্ণব দুদিকে মাথা নেড়ে বলল, ‘একেবারেই না।’
—‘আপনি কোস্টাল এরিয়ার মানুষ। সমুদ্র দেখে অভ্যস্ত। বিরান পাহাড়ে মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে।’ কথা বলতে বলতে, চশমার তলা দিয়ে ব্যাক মিররের ওপর চোখ রেখেছিল শাহজিদ। তুরিনের চোখে রোদ চশমা নেই। মিষ্টি, মিহি মুখখানায় রোদের সোনালি ছোপ এসে পড়েছে। বাতাসে উড়ছে চুল। ছোট ছোট বঙ্কিম চোখদুটি আলোর তেজে যেন আরো বেশি ছোট হয়ে গেছে। খরগোশের বাচ্চা চোখ ভালো মতো ফোটার আগে যেমন কুঁইকুঁই করে চারিদিকে চায়, ঠিক তেমন ভঙ্গিতেই খোলা জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছে তুরিন। ওই ভঙ্গিটা চকলেটের মতো একটা তুলতুলে স্বাদের উদ্রেক করছিল শাহজিদের মনের মধ্যে। ফুরফুরে বাতাসে রোদের ঝাপটা মেশানো উত্তাপ আর মনের মধ্যে চকলেটের মিষ্টি স্বাদ…সবটা মিলিয়ে দারুণ উপভোগ করছিল সে!
—‘এখানে ডাইভার্সিটি একেবারে নেই বলা চলে।’ অর্ণব বলল।
—‘কথা সত্য।’ সায় দিল শাহজিদ।
—‘ইস্ট-কোস্টে ভাই রাস্তায় নামলে মাঝেমধ্যে মনে হয় না বিদেশ। এত ভারতীয় চারিদিকে। এখানে তো সব সাদা। এরা মনে হয় বাদামি মানুষ দেখে অভ্যস্ত না। কেমনে কেমনে জানি চেয়ে থাকে। মনে হয় আমি মঙ্গলগ্রহ থেকে আসছি।’
অর্ণবের বলার ধরনে এবার তুরিনের ফিনফিনে পাতলা দুটি ঠোঁটেও হালকা হাসির রেশ যুক্ত হলো। এখন তার ভালো লাগছে। এত ভালো লাগছে যে মনে হচ্ছে আজকের দিনটা বাস্তব নয়, স্বপ্নলব্ধ কোন দিন। সামনে যে ছোট্ট এক টুকরো আয়না গাড়ির জানালার ধার ঘেঁষে ঝুলে আছে, সেই আয়নাটাকে এখন ম্যাজিক মিরর বলে ভ্রম হচ্ছে। ওদিকে চোখ মেলে চাইলেই জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মুখটা ভেসে উঠছে। রোদের ঝিকিমিকিতে উদ্ভাসিত সেই মুখ কী রকম যেন মাদক মাদক সুন্দর! দেখতে গিয়ে তুরিনের চোখের তারা ঝিমঝিম করে, সেই ঝিমঝিমানি শিরশির করে নেমে আসে নাকে, ঠোঁটে, বুকে, তারপর হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় শরীরের প্রতিটি রক্ত কণিকায়। মাতাল মাতাল লাগে!
—‘এখানকার বাঙালি কমিউনিটি একেবারেই ছোট। আগে তো বাঙালি ছিলই না বলতে গেলে। আমাদের ছোটবেলার কথা বলছি। এমনকি ডেনভারে একটা ইন্ডিয়ান রেস্তোরাঁ পর্যন্ত ছিল না।’ শাহজিদ বলল।
আনিতা যোগ করল পেছন থেকে, ‘এ বছর বেশ কিছু স্টুডেন্ট এসেছে বাংলাদেশ থেকে। বোল্ডার সিইউ-তে।’
—‘আপনি কী পড়ছেন?’ অর্ণবের প্রশ্ন, আনিতার উদ্দেশে।
—‘বিবিএ।’
—‘আমি বিজনেসের কিছুই বুঝি না। তবুও আউট অব কিওরিসিটি জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। আপনার মেজর কী?’
আনিতা ড্রাইভিং সিটে বসা, ছাই রঙের ফতুয়া পরা, ছিপছিপে ছেলেটার দিকে ত্যাড়া চোখে তাকাল একবার। ব্যাটা অনেকটা রামছাগলের মতো দেখতে হলেও কথা কিন্তু ভালোই বলে! রামছাগলের কথা মনে হতেই আনিতা নিজের অজান্তে ফিক করে হেসে দিল। পরমুহূর্তে হাসিটা চট করে লুকিয়ে ফেলে বলল, ‘মার্কেটিং।’
নিশার বাইরে খুব একটা বেরোনো হয় না। জুবিনকে নিয়ে ডাক্তারখানায় যাওয়ার সময় একটা অন্যরকম ব্যস্ততা থাকে। এ দেশে গাড়িতে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসা যায় না। গদির ওপর আলাদা কার-সিট রেখে তাতেই বাচ্চাকে বসাতে হয়। বেঁধে দিতে হয় বেল্ট দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে। জুবিন কার সিটে থাকতেই চায় না। কাঁদতে কাঁদতে পৃথিবী মাথায় তোলে। সঙ্গে সর্বদাই শ্বশুর- শাশুড়ি থাকেন। আজ শ্বশুর-শাশুড়ি নেই, জুবিনও নেই। নিশার যেন অফুরন্ত অবসর। বাইরের রোদ ধোয়া সতেজ প্রকৃতি সে মন ভরে পান করছিল। পাহাড়ি এলাকায় আবহাওয়ার কোন স্থিরতা নেই। একটু আগে তেজালো রোদ ছিল। এখন গাঢ় নীল পাতলা মেঘের আস্তর আকাশি রঙের মসৃণ আকাশটাকে অনেকখানি ঢেকে দিয়েছে। কয়েকটা দলছুট সাদা মেঘ নেমে এসেছে অনেক নিচে। যেন এখুনি টুপ করে ঝাঁপ দেবে গাছের মাথায়। চার লেনের সুবিশাল রাস্তাটার দুপাশে বিস্তৃত সমভূমি। রোদে জীর্ণ হওয়া সোনালি ঘাসের গায়ে একটু একটু সবুজের আঁচড় লেগেছে। দিগন্ত প্রসারিত সবুজ আভার সোনালি মাঠে স্রোতের মতো বয়ে চলেছে হাওয়া। কোথাও ছায়া, কোথাও রোদ্দুর…আর মাঠের শেষে…ওই দূরে…অনেক দূরে…রক্ষীবাহিনীর সামরিক সিপাহির মতো গর্বিত, দাপুটে ভঙ্গিতে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে রকি পর্বতমালা। পর্বতের চুড়োয় যেন অন্য একটা দুনিয়া। আকাশ থেকে আশ্চর্য আলো ঠিকরে পড়ছে সাদা বরফের মুকুট পরা পর্বতের মাথায়। বরফের মুকুট হীরের মতো ঝিকোচ্ছে। মেঘে মেঘে ছড়িয়ে পড়ছে হীরের টুকরোর রোশনাই। কত রং, কত বিভা! কত যে নিগুঢ় সৌন্দর্যের জাল ছড়ানো আলপনা! দেখলেও পুরোপুরি দেখা হয় না, বুঝলেও বোঝা যায় না, দুর্বোধ্য এক ভয়ংকর মুগ্ধতা বুকে চেপে ধরে প্রকৃতির সেই বিরাট মহাজ্যোতির্ময় লীলাখেলার দিকে নির্বাক চেয়ে থাকতে হয়। শিরা উপশিরার কুহরে কুহরে বাজতে থাকে অলৌকিক শঙ্খধ্বনি! নিশা বুঁদ হয়ে চেয়েছিল…ওইদিকে…আকাশ আর পাহাড় মিলেছে যেখানে। তার মনে পড়ছিল দেশের কথা, বাবার কথা, মায়ের কথা, মফস্সলের তিন কামরার বাসার কথা, গ্রামের বাড়ির টিনের চালের ঝমঝম বৃষ্টির শব্দের কথা, শীতকালের পিঠার কথা…! মনে পড়ছিল জুবিনের কথা…এমনকি…জুবিনের বাবার কথাও!
—‘নিশা, পানি হবে তোমার কাছে?’ ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেছিল শাহজিদ। নিশার ওপর চোখ পড়তেই ভারি চমৎকার হাসল সে, ‘বাহ! তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে তো!’
ওটা ছিল সাধারণ একটা স্তুতি বাক্য কিন্তু তুরিন শুনতে পেল কোথায় একটা কাচের শিশি ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল এই মাত্র। যন্ত্রণায় চিনচিন করে উঠল বুক। নিশা ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করতে করতে শান্ত গলায় ছোট করে উত্তর দিল শাহজিদকে, ‘থ্যাংক ইউ।’
শাহজিদ পানি খাওয়ার আগে চোখের সানগ্লাসটা খুলে নিয়েছিল। আয়নার ভেতর দিয়ে দেখল তুরিন বিষণ্ণ দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে দূর পাহাড়ের দিকে ওর চোখে কাচের মতো ভাসছে একটু একটু জল। ঠোঁট কাঁপছে হালকা। চুলের ঝাপটা এসে পড়ছে মুখে। ওই মুখখানা এখন রোদ ছায়ার লুকোচুরি খেলার মতো রহস্যময় সুন্দর!
টেবল মেসা
গাড়িটা উঁচুতে উঠছিল। আকাশটা যেন নিচে থেকে নিচে নেমে আসছে ক্রমশ। আরেকটু হলেই হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যাবে ভাসমান সাদা পালের মেঘ। গুগল ম্যাপ অর্ণবকে যে রাস্তার ওপর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তার নাম টেবল মেসা ড্রাইভ। বসতি ছেড়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা পার হয়ে গাড়িটা ক্রমেই পাহাড়ের শিখরের দিকে ছুটছে। সোনালি আর সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছানো চড়াই- উতরাই ভূমি রাস্তার দুধারে বহুদূর অবধি বিস্তৃত। শীতকালে তীব্র রোদে পুড়ে গিয়ে ঘাসগুলোর রং জ্বলে যায়। সোনালি পাটের মতো দেখায়। বসন্তের শুরুতে রুক্ষ ঘাসগুলোতে একটু একটু করে প্রাণের অস্তিত্ব ফিরে আসে। রাস্তার দুদিকে ঢেউয়ের মতো ছড়িয়ে থাকা উঁচু-নিচু মাঠের শেষে সারি বাঁধা পাইনগাছ। এই পাইনগাছগুলো খুব বেশি লম্বা নয়, আকারে মাঝারি। দূর থেকে দেখলে মনে হয় অগণিত প্রহরী পাহাড়ের ঢালে দলবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। যেন প্রাচীনকালের কোন যুদ্ধের ময়দান। চড়াই-উতরাইয়ের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে আঁকাবাঁকা একাধিক ট্রেইল। পর্যটকরা সেই ট্রেইল ধরে হেঁটে হেঁটে পুরো পাহাড় চষে বেড়াতে পারে।
গন্তব্যস্থলে পৌঁছনোর পর দেখা গেল ভিড় নিছক কম নয়। পার্কিং লটে অনেক গাড়ি। দীর্ঘদিন পর আবহাওয়া ভালো। তার ওপর ছুটির দিন। ভিড় হওয়াটাই স্বাভাবিক। এত ভিড়ে পার্কিংয়ের জায়গা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হতো। কিন্তু শাহজিদ সঙ্গে থাকায় সেই ঝামেলা মিটে গেল। এ দেশে ডিজেবলদের জন্য আলাদা পার্কিং স্পট থাকে। সেসব জায়গা সুস্থ স্বাভাবিক লোকেরা ব্যবহার করলে দণ্ড হয়। আজকে হ্যান্ডিক্যাপড পার্কিংয়ে সোজা গাড়ি পার্ক করে ফেলল অর্ণব। সামনে ঝুলিয়ে দিল হ্যান্ডিক্যাপড স্টিকার। ভাগ্যিস শাহজিদ পকেটে করে নিয়ে এসেছিল ওটা।
গাড়ি থেকে নামতেই বেগবান হাওয়ার দমক ধাক্কা দিল গায়ে। কানে এসে লাগল নানা জাতের পাখির ডাক। নিশা তড়িঘড়ি করে শাহজিদের ক্রাচ দুটো নামাল গাড়ির ট্রাঙ্ক থেকে। সে এখানে আগে কখনো আসেনি। এত আলো, এত আকাশ, এত হাওয়া, এত মেঘের আনাগোনা…একসঙ্গে আগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ে না। তার মনটা অন্যরকম হয়ে গেছে এ জায়গায় এসে। বদ্ধ হৃদয়ের সবকটা দরজা-জানালা যেন খুলে গেছে।
উঁচু-নিচু অসম মাটির ওপরের ঘাস আর আগাছা মাড়িয়ে কিছুদূর যেতেই পাহাড়ের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেল ওরা। চোখের সামনে একটা জীবন্ত লোকালয়ের ছবি ভেসে উঠল। ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে ছোট ছোট বাড়ি, ছিমছাম রাস্তা-ঘাট, খেলনার মতো চলন্ত গাড়ি, পাহাড়ের ঢেউ ভাঙা নকশা কাটা ঢাল আর অগণিত সারি বাঁধা পাইনগাছ। পাহাড়টা একেবারে খাদের মতো নেমে যায়নি নিচে। বরং একটু একটু করে নেমেছে। সামনে তাকালে মনে হয় যেন সুবিস্তৃত কোন মালভূমি। যেন পৃথিবীর ছাদ। যেন এখানে, এই পাহাড়ের শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে পুরো পৃথিবীটাকে এক লহমায় দেখে নেওয়া যাবে।
নিশা ঘাসের ওপর একটা চাদর বিছিয়ে দিল। চাদরটা নিয়ে এসেছিল সঙ্গে করে। মাটি বেশ শক্ত। ঘাসগুলোও কেমন সুচালো আর ধারালো। তবুও শাহজিদকে নিয়ে বসার একটা জায়গা চাই। পাহাড়ের কিনারে বেশ কিছু পাথর ছড়ানো আছে। সেসব পাথরের ওপর অবশ্য চাইলেই বসা যায়। শাহজিদ সঙ্গে একটা বই নিয়ে এসেছিল। এক সময় এই জায়গা তার প্রিয় ছিল। পুরো পাহাড় চষে বেরিয়েছে বন্ধুদের সঙ্গে। কোথায় কোন ট্রেইল, কোথায় হরিণ আছে, কোথায় মাউন্টেন লায়ন বা গ্রিজলি বিয়ার, কোন শৈলখণ্ডের উচ্চতা কতখানি, কোন দিকে ক্যাম্পিং করলে বন্য জন্তুর আক্রমণের ঝুঁকি কম, সমস্ত খুঁটিনাটি এখনো তার মুখস্ত। আগে পাহাড়কে জয় করার অদম্য নেশা ছিল। এখন আর সেই নেশা নেই। পাহাড়কে সে আর কোন দিন জয় করতে পারবে না। পাহাড়ের কাছে…পাহাড়ের উচ্চতার কাছে…শাহজিদ হেরে গেছে চিরতরে!
চাদরের ওপর পা ছড়িয়ে বসেছিল। কোলে বই। মনে হচ্ছে হেলান দেয়ার কিছু থাকলে ভালো হতো। শিরদাঁড়ায় একটু লাগছে। একটা মাত্র পায়ের যে কী দাম, তা টের পাওয়া গেল পা-টা চলে যাওয়ার পর। সাধারণ মানুষের মতো বসাটাও সম্ভব হচ্ছে না। এক পাশে ক্রাচ দুটো রাখা। অন্য পাশে নিশা। অর্ণব এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তুরিন এখন অবধি তার সঙ্গে একটি কথাও বলেনি। এই অহংকারী, উদ্ধত মেয়েটির সঙ্গে ভাব জমানোর কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছে না সে। ভাব করার খুব একটা তাগিদ যে অনুভব করছে তাও নয়। ওর বরং নিশাকেই ভালো লাগছে। নিশার আশেপাশে চুপ করে বসে থাকার মধ্যেও যেন একটা অন্যরকম ভালো লাগার ব্যাপার আছে।
তুরিনদের দলটায় ছেলেমেয়ে মিলিয়ে ছয়জন সদস্য। নিশারা যেখানে বসেছে তার ঠিক ডান পাশে কয়েক গজ দূরেই জড়ো হয়েছে ওরা। ওদের পেছনে পাহাড় ঢালু হয়ে নেমে গেছে দূরের পাইনগাছ ঘেরা শহরের কাছে। আকাশে মেঘ আছে, আছে রোদ্দুরও। এ যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক সুষম বণ্টন। শাহজিদ কোলের ওপর রাখা বইটার পাতা ওল্টাচ্ছিল অন্যমনস্কভাবে। তুরিনের বন্ধুরা ব্লুটুথ স্পিকার নিয়ে এসেছে। মিউজিক বাজিয়ে পাহাড়ের শান্ত সুনিবিড় পরিবেশ বিনষ্ট করছে। শাহজিদ মনে মনে বিরক্ত বোধ করছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটা যেন শ্যুটিং স্পটে রূপান্তরিত হলো। বোঝা গেল নাচ-গান কিছু একটা শ্যুট করা হবে। নিশার মজাই লাগছিল। মুখে একটা আমুদে হাসি নিয়ে ছেলেমেয়েদের কাজ-কারবার দেখছিল সে।
আনিতা রিপড জিন্সের ওপর কালো একটা জ্যাকেট পরে ছিল এতক্ষণ। জ্যাকেট খুলে ফেলার পর তার গায়ে রইল স্লিভলেস লো কাট নীল রঙের ব্লাউজ। ওর চুলগুলো বেশ লম্বা, মজবুত এবং কালো। কোমর পর্যন্ত ছাপিয়ে আছে একদম। তুরিন দল থেকে একটু দূরে বিচ্ছিন্নভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ আটকে গেছে চাদরের ওপরে বসে থাকা যুবক-যুবতীর ওপর। নিশা শাহজিদের এত কাছে বসেছে যে একটু নড়লেই পিঠের সঙ্গে পিঠ ঠেকে যাবে। দৃশ্যটা তুরিনের চোখে খেজুরকাঁটার মতো বিঁধছে। সে দৃষ্টি ফেরাতে পারছে না, তাকাতেও পারছে না। অস্থির লাগছে…এত অস্থির লাগছে যে মনে হচ্ছে পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মরে গেলেই সবচেয়ে ভালো হয়! একদিন বলবে…একদিন নিশার চোখে চোখ রেখে দৃপ্ত কণ্ঠে শব্দগুলো উচ্চারণ করবে তুরিন,
‘আমি তোমাকে ঘৃণা করি! খুব বেশি ঘৃণা করি!’
নাচ শুরু হয়ে গেছে। ছেলে মেয়েরা পর্যায়ক্রমে নেচে যাচ্ছিল। অর্থাৎ একজনের নাচ শেষ হলে অন্যজন শুরু করছিল। ছেলেদের পরনে টি-শার্ট আর হাফ প্যান্ট। মাথায় ক্যাপ। দুজন ক্যামেরাম্যান আছে। এদিকে অর্ণবও মোবাইলে ভিডিও করা শুরু করেছে। তার মুখে ফকফকে হাসি। এমন মজার ঘটনা যেন সে এর আগে কখনো দেখেনি। শাহজিদ চোখা চোখে দেখছিল। কুঞ্চিত ভ্রু। ঠোঁটে উপচেপড়া বিরক্তি। তুরিনের পালা এলো তিনজনের পর। পিংক কোটটা খুলে রেখেছে। এখন ওর গায়ে সাদা রঙের সিল্ক কাপড়ের স্লিভলেস ব্লাউজ। ব্লু জিন্স। ফরসা পেটের অনেকখানি অনাবৃত। ঝকঝকে সোনালি আলোর নিচে খোলা চুলে ও যখন ক্যামেরার সামনে এসে নাচ শুরু করল, ঠিক সেই সময় ওর দিকে তাকানো মাত্র শাহজিদ একটা হার্টবিট মিস করল। চাপা আগুনের নিবিড় আঁচ যেন ছড়িয়ে পড়ল চামড়ার তলায়। বিব্রত শাহজিদ কম্পিত বক্ষ নিয়ে দেখল, তুরিনের কণ্ঠার হাড়ের খাঁজে এক টুকরো বেহায়া রোদ লুকোচুরি খেলছে। ‘কলারবোন’ জিনিসটা এত কাব্যিক হতে পারে তা আজকে এই ক্ষণে তুরিনকে না দেখলে তার হয়তো কখনো জানা হতো না!
ভিড়ের মাঝে একটা পুরুষকণ্ঠ বলল, ‘হার পশ্চার ইজ ভেরি গুড।’ আরেক জন বলল, ‘অ্যাবসোলিউটলি। আই জাস্ট লাভ টু ওয়াচ হার মুভ!’
মানুষ আজব প্রাণী। কথা গুলো শোনামাত্র, কেন কে জানে শাহজিদের মেজাজটা অতর্কিতে খিঁচড়ে গেল। বুকের নাড়িগুলো টনটন করে উঠল বিদ্রোহের হুংকারে। শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে উঁচু গলায় বলল, ‘টেরিবল পারফরমেন্স!’ কর্কশ শব্দ দুটো বাতাসে ডিগবাজি খেয়ে পারফরমারের কানে বিস্ফোরণ ঘটাতে সময় নিল না বেশি। তুরিন থমকে গেল। দুর্ধর্ষ চোখে তাকাল শাহজিদের দিকে। শাহজিদ আকাশে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে যেন পুরো বিশ্বের উদ্দেশে বলছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘নেভার সিন সাচ বুলশিট বিফোর! হরিফিক!
একটি ছেলে প্রতিবাদ করল, ‘হোয়াটস রং ম্যান? শি ইজ হট!’
—‘শাট ইওর মাউথ। বেল্ট আপ!’ ধমকে উঠল শাহজিদ।
তুরিন স্তব্ধীভূত। তার মুখে রক্ত নেই। হাত-পা কাঁপছে এপিলেপ্সির রোগীর মতো। চোখে ভয়ংকর প্রলয়ের আভাস। কয়েক সেকেন্ড থম ধরে দাঁড়িয়ে থেকে একছুটে পালিয়ে গেল জায়গাটা ছেড়ে। শাহজিদ ভ্রুক্ষেপ করল না। নির্বিকারভাবে বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগল।
—‘এটা কী করলে তুমি? কী সুন্দর নাচ হচ্ছিল। কেন এরকম করলে?’ তীর্যক গলায় বলল নিশা।
শাহজিদ প্রত্যুত্তর করল না। নিশা বসা থেকে অস্থিরভাবে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘ইশ তুরিন নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পেয়েছে। এভাবে অপমান করে কেউ কাউকে? তুমি মানুষ না!’
কথাটা শেষ করে সে পাশে দাঁড়ানো অর্ণবকে বলল, ‘অর্ণব সাহেব, যন্ত্রের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে, তুরিন কোথায় গেল একটু দেখুন। বেচারি মেয়েটা!’
একটি অন্যরকম দিন
অপ্রকৃতস্থের মতো ছুটছিল তুরিন। কোথায়, কোনদিকে যাচ্ছে জানে না। এত তাণ্ডব সইতে পারছে না তার দুর্বল হৃদয়। দম আটকে আসছে। রক্তের শিরায়- উপশিরায় আসুরিক এক তেজের স্ফুরণ। এই মুহূর্তে মানুষ খুন করাও যেন অসম্ভব কিছু নয়। পার্কিং লটের কাছে এসে অর্ণবের গাড়িটা চিনতে পারছিল না। একটা অপরিচিত গাড়ির গায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল। তারপর মুখের ওপর দুহাত চেপে দীনহীন রিক্ত নিঃস্বের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক পাশের গাড়ি থেকে নামামাত্র দৃশ্যটা দেখল। সান্ত্বনার গলায় বলল, ‘টেক ইট ইজি হানি! থিংগস ওনট অলওয়েজ বি ব্যাড।’ কথাটা বলতে বলতে ভদ্রলোক একটু এগিয়ে এলো, নরম স্বরে বলল ‘ইউ ওকে?’
তুরিন এত জোরে চোখের পানি মুছতে লাগল যেন আরেকটু হলে চোখ সহ উপড়ে ফেলবে। ওপর-নিচে মাথা নেড়ে বলল, ‘আই অ্যাম অলরাইট। থ্যাংক ইউ।’
আনিতাকে দেখা গেল। তুরিনের মুখের ওপর বিস্মিত চোখজোড়া স্থাপন করে ভারি অবাক গলায় বলল, ‘এত কান্নাকাটির কী হলো?’
তুরিন ঝংকার দিয়ে উঠে বলল, ‘কী হলো তুমি দেখোনি? কীভাবে অপমান করল আমাকে?’
—‘কী এসে যায়? আমরা আবার শ্যুট করব তোমার অংশটা। কামঅন তুরিন! ওভার-রিঅ্যাক্ট কোর না!’
—‘আমি ওভার-রিঅ্যাক্ট করছি?’
—‘হ্যাঁ করছ।’
খানিক দূরে অর্ণব এসে দাঁড়িয়েছে। তার কাঁচুমাচু মুখে খেলছে দ্বিধার ঢেউ। কী করা উচিত বুঝতে পারছে না। বলতে কী, তুরিনকে মনে মনে একটু ভয়ই পায় সে। এমন আগুনের মতো রাগ মেয়েটার। বাবারে, চোখ দিয়ে যেন ঝলসে দেবে একদম। নিশা ওর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। চাপা স্বরে বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? যান গিয়ে কথা বলুন।’
অর্ণব চমকে উঠল, ‘জি? আমি?…মানে আমি?’
খুব বিরক্ত হলো নিশা, ‘হ্যাঁ আপনি!’
—‘ইয়ে…মনে হচ্ছে উনি খুব রেগে আছেন। এখন কথা বলাটা একেবারেই উচিত কাজ হবে না।’
এদিকে আনিতার কথা শুনে তুরিনের আরো বেশি রকমের কান্না পাচ্ছিল। ‘ওভার-রিঅ্যাক্ট’ বলতে ও কী বোঝাতে চাইছে? এত বড় অপমানের পর তুরিন চুপ করে বসে থাকবে? প্রতিবাদ করবে না? এমনকি প্রতিক্রিয়াও ব্যক্ত করতে পারবে না? এত সোজা?…মানে একজন মানুষকে জনসম্মুখে নির্বিকারে লাঞ্ছিত করা এতই সোজা? তা ছাড়া নাচের দলের মধ্যে সবাই তুরিনের শুভাকাঙ্ক্ষী নয়। এই অবমাননার ঘটনায় কেউ কেউ খুশি হয়েছে। আড়ালে হাততালি দিয়ে উল্লাস জ্ঞাপন করছে। আনিতা তো ছোট বালিকা নয় যে এসব বোঝে না। তুরিন ব্যথিত স্বরে বলল,
—‘তুমি আমার বোন হয়ে এরকম কথা বলতে পারছ? আমার মান-সম্মান ম্যাটার করে না তোমার কাছে?’
—‘সম্মান হানি হওয়ার মতো কিছু হয়েছে বলে তো আমার মনে হচ্ছে না। সবার তো সব সময় সবকিছু ভালো লাগতে হবে এমন কোন কথা নেই। মানে তোমার পারফরমেন্স কারো কাছে যদি খারাপ লাগে সে তো সেটা বলতেই পারে, তাই না? মানছি, এভাবে সবার সামনে বলাটা উচিত হয়নি। সে তো একটু পাগল আছে আমরা সবাই জানি। পাগলের কথা পাত্তা দিয়ে কী লাভ বলো?’
আনিতার বলা কথাগুলো শুনতে শুনতে যেন বিষম খেলো তুরিন। চোখে ঘনিয়ে এলো সন্দেহের মেঘ। কষ্টের একটা লৌহবেড়ি খামচে ধরল হৃৎপিণ্ড। ঝকঝকে দিনের আলোয় হঠাৎ এত কালের চেনা আনিতাকে কেমন অচেনা লাগতে লাগল তার। মনে হলো শাহজিদের করা অপমানটার কোথাও না কোথাও আনিতা বুঝি একটা গোপন আনন্দের স্বাদ খুঁজে পেয়েছে। ওর চোখের উজ্জ্বল তারার মাঝে চাপা বিজয়ের জেল্লা চিকচিক করছে। কী কাণ্ড! পৃথিবীর সব মানুষ কেন তুরিনকেই অপছন্দ করে? কেন তার হেরে যাওয়ার মাঝেই সুখ খুঁজে পায়? আশ্চর্য! নাহ…কষ্ট হচ্ছে না। বরং রাগ হচ্ছে। দুনিয়া কাঁপানো রাগ হচ্ছে। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘনঘন। যুক্তিবোধ ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে। চোখের সামনে নেমে আসছে বিদঘুটে অন্ধকার! এরকম সময়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ার মতোই ঘটনা ঘটল একটা। নাচের দলের একজন মেয়ে সদস্য, স্টেলা ওর নাম, হঠাৎ আনিতার পাশে এসে দাঁড়িয়ে চঞ্চল কণ্ঠে বলল, ‘আমার মনে হয় ওই ছেলেটাকে আমি চিনতে পেরেছি। আমাদের স্কুলের সিনিয়ার ছিল।’
—‘কোন ছেলে?’
—‘হোয়াইট টি-শার্ট। অভিওসলি দ্য মোস্ট হ্যান্ডসাম ওয়ান।’ কথাটা বলে একটু ফিচেল হাসল মেয়েটি। তারপর আবার বলল, ‘স্কুলে ওর ওপর আমার ক্রাশ ছিল। ও কি তোমাদের পরিচিত? আমার সঙ্গে একটু আলাপ করিয়ে দাও না!’
তুরিন শ্বাপদ জন্তুর মতো বিভীষণ চোখে চেয়ে ছিল স্টেলার দিকে শুনছিল কথাগুলো। কর্কশ, নির্দয় পৃথিবীটাতে আর এক মুহূর্তও বাঁচতে ইচ্ছে করছে না তার। এমন কেউ কি নেই যে তাকে একটু বুঝবে? একটু বন্ধুর মতো আচরণ করবে? মনের কোনায় আশ্রয় দেবে? শরীরে কোন সাড় পাচ্ছিল না তুরিন। অদ্ভুত ভয়ংকর এক কষ্ট ভেতরের সমস্ত স্পন্দন থামিয়ে দিয়েছিল। ঝাপসা চোখে দেখল আনিতা স্টেলাকে নিয়ে হাঁটা দিয়েছে। একটু দূরে নিশা দাঁড়িয়ে আছে অর্ণবের পাশে। নিশাও নিশ্চয়ই মনে মনে তিরস্কারপূর্ণ হাসি হাসছে, আনিতার মতো, স্টেলার মতো…শুধু এরাই নয়, তুরিনের মনে হলো গোটা পৃথিবীটাই তাকে নিয়ে কৌতুকে মেতে উঠেছে। সমগ্র আকাশ-বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠছে উপহাসের আমোদ রসে। তুরিন চোখ কান বুজে বুনো ষাঁড়ের মতো ছুটতে লাগল আনিতার পেছন পেছন। শাহজিদ তখনো চাদরের ওপর বসে ছিল। কোলে রাখা খোলা বই। তুরিন দেখল আনিতা স্টেলাকে সঙ্গে নিয়ে শাহজিদের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শাহজিদ হেসে কী যেন বলল ওদের। হেসেই উত্তর দিল আনিতা। হনহন করে হেঁটে এগিয়ে এলো তুরিন। ওর চোখ লাল। গালে তেজের আগুন। যেন এক অপশক্তি ভর করেছে ওর ওপর।
—‘কী ব্যাপার?’ ফুটন্ত গরম পানির মতো টগবগিয়ে ফুটতে ফুটতে প্রশ্নটা করল তুরিন আনিতাকে।
আনিতা ভড়কে গেল, ‘মানে?’
—‘কেন এসেছ এখানে?’
—‘এরকম করছ কেন? পাগল হয়ে গেলে?’
শাহজিদ স্তব্ধ চোখে দেখছিল তুরিনকে। বুঝতে পেরেছিল যে মেয়েটা কষ্ট পেয়েছে। সত্যি বলতে বাচ্চা খরগোশটাকে কষ্ট দিয়ে একটুও স্বস্তি পাচ্ছিল না মনে মনে। নিজ উদ্যোগে ক্ষমা চাইতেও আত্মসম্মানে বাধছিল। তুরিন আগুন জ্বলা চোখে তাকাল একবার শাহজিদের দিকে। ঝড়ের বেগে এগিয়ে এলো। রাগে কাঁপতে কাঁপতে ওর কোলের ওপর রাখা বইটা তুলে নিয়ে সজোরে ছুড়ে মারল দূরে। সাঁইসাঁই বাতাস কেটে ভারি মোটা বইটা কোথায় গিয়ে যে ভূপতিত হলো সেই খবর আর কেউ জানল না। ঘটনার আকস্মিকতায় শাহজিদ থ বনে গেছে। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না একটা আস্ত জীবন্ত বই কোন মানুষ এমন ময়লা আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলতে পারে। ঠোঁট দুটো একটু ফাঁকা হয়ে গেছে। হ্যাজেল রঙের বিমোহন চোখে জন্মের বিস্ময়! তুরিন ঝগড়াটে ভঙ্গিতে কোমরে হাত রেখে গা শিউরে ওঠা শীতল কণ্ঠে বলল, ‘কেন এভাবে অপমান করলে আমাকে?’
শাহজিদ উত্তর দিতে পারল না। শুধু চেয়েই রইল।
—‘কেন করলে?’ চিৎকারটা আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে দিল একদম। শাহজিদের ভেতরকার ঘুমটা ভাঙতে বাধ্য হলো সেই চিৎকারে। নড়েচড়ে বসে বলল, ‘কী বলছেন আবোলতাবোল?’
—‘কেন বললে আমার নাচ ভালো হয়নি? কোন সাহসে বললে? এখন সবার সামনে সরি বলো, ক্ষমা চাও।’
—‘হ্যাঁ?’ বেকুব বনে যাওয়া গলায় কোনমতে শব্দটা উচ্চারণ করল শাহজিদ। আশপাশে নাচের দলের সদস্যরা ভিড় করেছে। বাংলা বুঝতে পারছে না কিন্তু কিছু একটা গুরুতর ঘটনা যে ঘটছে তা টের পাচ্ছে সবাই। তুরিন দাঁতে দাঁত চিবিয়ে গমগমে গলায় বলল, ‘তুমি এখন সবার সামনে সরি বলবে। ক্ষমা চাইবে আমার কাছে।’
—‘তাই?’ শাহজিদের কণ্ঠ থেকে বিস্ময়ের ঘোর কাটছেই না।
—হ্যাঁ তাই!
কিছুক্ষণ তব্দা মেরে চেয়ে থেকে, যেন খুব মজার কোন কৌতুক শুনেছে এমন ভঙ্গিতে হাসল শাহজিদ। চোখ সরু করে তুরিনের রাগে লাল হওয়া মুখখানার দিকে চেয়ে ভারি কায়দা করে বলল, ‘আচ্ছা! ক্ষমা চাইতে হবে! আর কী কী করতে হবে ম্যাডাম?’
—‘যা কিছু তখন বলেছ সবটা ফিরিয়ে নেবে। সবার সামনে বলবে যে তুমি মিথ্যে বলেছ…আর সত্যিটা বলবে।’
—‘সত্যিটা কী?’
—‘সত্যিটা হলো আমি খুব ভালো নাচি, সবচেয়ে ভালো নাচি এবং আমি খুবই ভালো, আমি খুবই সুন্দর…আমি…মানে আমার প্রশংসা করবে!’ পাগলের মতো চোখ-কান বুজে কথাগুলো বলে যেতে লাগল তুরিন। শাহজিদ দেখল মেয়েটা ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো ছটফট করছে। যেন আরেকটু হলেই শ্বাসক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে। মেয়েটার আসলে বয়স বাড়েনি একটুও। মানসিক পরিপক্কতা আসেনি। এখনো বয়ঃসন্ধির বালিকার মতো নড়বড়ে আর নাজুক ওর ইমোশন। শাহজিদ আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করল না। গলাটাকে উচ্চগ্রামে নিয়ে উপস্থিত সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে তুরিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘আই অ্যাম সরি ফর হোয়াট আই সেইড বিফোর। আই ডিডন’ট মিন ইট। ট্রুথ ইজ, ইওর ড্যান্স পারফরম্যান্স ওয়াজ ট্রিমেন্ডাস। মাই পুওর হার্ট কুডন’ট হ্যাণ্ডেল ইট। সো…আই ক্রুড আপ!’
দুনিয়াটা বড়ই আজব জায়গা। আজ এই প্রত্যুষে, তুরিনের ভাগ্যতারকার গতিবিধি দেখে মনে হচ্ছিল শাহজিদকে দিয়ে জোর করে ক্ষমা চাওয়ানোর পরে আপাতদৃষ্টিতে সবার সামনে সে নিজেই ক্লাউন হবে। সবাই বুঝবে চিৎকার- চ্যাঁচামেচি করে বদমেজাজি আত্মম্ভরী মেয়েটি শাহজিদকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছে। কিন্তু শাহজিদের অকপট, আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর ঘটনার গতি পাল্টে দিল মুহূর্তের মধ্যে। ওর চোখের দিকে চাওয়া মাত্র সবাই বুঝে গেল, এই ছেলে একটা শব্দও মিথ্যে বলছে না। যা বলছে তার শত ভাগ সত্য!
তুরিনের ঠোঁটজোড়া কাঁপছিল। চোখের কার্নিশে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল জলের আভাস। বুকে নিঃশ্বাসের উথাল-পাতাল। খোলা চুল উড়ছে দুর্ধর্ষ হাওয়ায়। এক টুকরো ঝকঝকে পলকা রোদ গলন্ত রুপা দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে ওর মুখ। কী সুন্দর! যেন সাদা রঙের একটা ডানাকাটা পরি। শাহজিদ ওর চোখের ওপর অনিমেষ দৃষ্টি রেখে কথা শুরু করল, ‘অ্যান্ড…’
আজব ব্যাপার! বলতে গিয়ে শাহজিদ নিজের হৃৎপিণ্ডের ধুকপুক নিজের কানে শুনতে পাচ্ছে। এতটা নার্ভাস অনেকদিন লাগেনি। সে কণ্ঠস্বরের কম্পন আত্মবিশ্বাস দিয়ে ঢাকা দেয়ার চেষ্টা করে খুব বোল্ডভাবে বলল, ‘অ্যান্ড আই হ্যাভ নেভার সিন এনিওয়ান, অ্যাজ বিউটিফুল অ্যাজ ইউ…ইউ আর ডিভাইনলি বিউটিফুল!’
ভেতর থেকে কেউ একজন জিব টেনে ধরতে চাইছিল। চিৎকার করে বলছিল, আরে থামো থামো! বলছো কী বোকার মতো? চুপ করো! ভেতরের ডাকটা ঠিকঠাক মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছানোর আগেই শাহজিদ কথাগুলো বলে ফেলেছিল। বলার পর ওর সুন্দর চোখ দুটির তলায়, উঁচু চিকবোনের আনাচে- কানাচে লজ্জার একটা আরক্ত আভা এসে ভিড় করেছিল।
এদিকে তুরিনের বুকে জ্বলতে থাকা দাউদাউ করা অগ্নিকুণ্ডতে ঠাণ্ডা পানির ছিটা পড়ছিল ধীরেধীরে। রাগ-অভিমানের জড়ত্ব কেটে গিয়ে মনের দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ছিল আবেগের আলতা রং। সংকোচ মিশ্রিত অদ্ভুত এক আলোড়নে তোলপাড় হয়ে, একটু অপ্রতিভ গলায় সে আনিতাকে বলল, ‘শুনলে তো? এবার যাও!’
আনিতার মুখটা অপমানে কালো হলো, ‘যাব মানে? কোথায় যাব?’
—‘তোমার বান্ধবীকে নিয়ে কেটে পড়।’
কথাটা বলতে বলতে তুরিন মাটিতে বিছানো চাদরের ওপর হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল। তার ধারণা, সে এখান থেকে সরে পড়লেই আনিতা আর স্টেলা শাহজিদকে ছেঁকে ধরবে। আজকে এসব হবে না। হতে দেয়া যাবে না। অনেক হয়েছে। আর কত! তুরিন এই এখানটায় বসে থেকে পাহারা দেবে। কেউ যেন মানুষটার ধারে-কাছে আসতে না পারে।
নিশা আর অর্ণব অনতিদূরে দাঁড়িয়ে ছিল। নিশার ঠোঁটে একটা ফিচেল হাসি। চোখে রহস্য। অর্ণব ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। ঘটনার আগামাথা কিছুই যেন বুঝতে পারছে না। নিশা বলল, ‘ইয়ে…অর্ণব সাহেব, চলুন আমরা অন্যদিকে যাই। একটু হাঁটাহাঁটি করি।’
আনিতা অপমানিত বোধ করলেও আচরণে তা প্রকাশ করল না। কপট হাসি দিয়ে চাপা দিল ক্ষোভ। সে তুরিনের মতো বোকা নয়। পরিস্থিতি কী করে হ্যান্ডেল করতে হয় জানা আছে তার। স্টেলাকে খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘তোমার কাছে পানির বোতল হবে? খুব তেষ্টা পেয়েছে!’
নিশার ব্যাগটা রাখা ছিল চাদরের ওপর। শাহজিদের ঠিক পাশে। হাঁটতে যাওয়ার আগে ব্যাগ নিতে আসতে হলো ওর। একটু ঝুঁকে শাহজিদের পাশ থেকে ব্যাগটা তুলে নিতে গেল। শাহজিদ অন্যদিকে চোখ দিয়ে ঝুম হয়ে বসেছিল। নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগছে। নিশা আস্তে করে বলল, ‘ভালো ছিল শাহজিদ! কিন্তু কাহিনি কী? প্রেমে পড়লে নাকি?
শাহজিদ রাগতে গিয়েও হেসে ফেলল। লাল হয়ে উঠল কান। নিশা ব্যাগ নিয়ে কেটে পড়ার পর তুরিন উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘উনি কী বললেন?’
শাহজিদ ঘাড় নেড়ে উড়িয়ে দিল প্রশ্নটা, ‘কিছু না!’ প্রশ্নের যথোচিত জবাব না পেয়ে তুরিন কিছুক্ষণ উত্তেজিত চোখে চেয়ে রইল নিশার চলে যাওয়া পথের দিকে। খানিক বাদে নিশার অবয়ব অদৃশ্য হলো। তুরিন ক্ষিপ্তবৎ দুটি চোখ ফিরিয়ে আনল কয়েক হাত দূরে বসে থাকা শাহজিদের ওপর। চোখে চোখ পড়া মাত্র দুজনেই কেমন একটু থমকে গেল, বিভ্রান্তির মায়াজালে বন্দি হলো, তারপর সংকোচ মিশ্রিত অপ্রস্তুত হাসি হাসল। শাহজিদ এমন তব্দা খায়নি জীবনে কখনো। যেন পাগলামির এক অথৈ খাদ পার হয়ে এলো মাত্র। মাথাটা পুরাই ফাঁকা লাগছে। কী দরকার ছিল এতগুলো কথা বলার। শুধু সরি বলে চুপ করে গেলেই তো হতো। আর এই মেয়েটা কেন দুনিয়াদারি ফেলে তার পাশে বসে আছে এখন? কী কারণে? এর সমস্যা কী? চাপা রাগে ফুঁসছিল আনিতা। শাহজিদকে ওর ভালো লাগে, এ কথা হাজার বার বলেছে তুরিনকে। তুরিনই সেই ব্যক্তি যে কি না সব সময় ভেটো দিয়ে এসেছে। ‘খোঁড়া লোকের সঙ্গে প্রেম করবা? শেষ পর্যন্ত এই তোমার রুচি? কিছুতেই এই ভুল করো না, ব্লা ব্লা ব্লা।’ এমনই সব ঋণাত্মক ভাবনা আনিতার সহজ-সরল নিষ্পাপ মনটার ওপর একটা দ্বিধার বলয় সৃষ্টি করে এসেছে সর্বক্ষণ। বয়ফ্রেন্ড তার আছে নাম কা ওয়াস্তে। কিন্তু শাহজিদের দ্বিতীয় পিস এই দুনিয়ায় আর নেই তো! মনটা সব সময় মাছির মতো ভনভন করে নিচতলার ওই কামরায় গিয়েই আটকা পড়ে। সব সময়ই একটা সন্দেহ ছিল, হয়তো তুরিন মুখে যা বলছে মনে তার ঠিক উল্টো। কারণ শাহজিদের জন্য তুরিনের চোখে অন্যরকম একটা আভা দেখতে পায় আনিতা। আজকে মনে হলো বিষয়টা এক তরফা নয়। দুদিকেই রহস্য আছে। তুরিন কি কিছু লুকোচ্ছে তার কাছ থেকে? মেয়েটা আসলে এক নম্বরের স্বার্থপর! তার বিয়ে হওয়ার কথা অর্ণবের সঙ্গে। কিন্তু এখন ভাব জমাচ্ছে শাহজিদের সঙ্গে। দুমুখো সাপ একটা!
অর্ণব আর নিশা হাঁটছিল ঢালু পথটার ওপর দিয়ে। ওদের পেছনে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে আনিতা। নিশা অর্ণবকে নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় আছে। বেচারা শাহজিদ-তুরিনের নাটক সিনেমা দেখার পর না জানি কী ভাবছে! নিশা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ‘অর্ণব সাহেব, ঢাকায় আপনাদের বাসা কোথায়?’
—‘শনির আখরায় থাকতাম আগে। এখন টিকাটুলিতে। আপনার পরিবার কোথায় থাকে?’
—‘জি আমার বাবা-মা ঢাকায় থাকেন না। কুমিল্লায় থাকেন।’
–-‘আপনি কি এখানে পড়ালেখা করছেন?
নিশা একটু নিভল, ‘না, আমি পড়াশোনা করছি না।’
অর্ণবের মনটা নিশার ব্যাপারে আরো অনেক কিছু জানার জন্য আঁকুপাঁকু করছিল। প্রশ্নগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিল মনে মনে। হঠাৎ সেলফোনটা বেজে উঠল। নম্বর অচেনা। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে একটা ভরাট কণ্ঠ বলল, ‘অর্ণব বলছো? আমি জাহিদ। তুরিনের বাবা।’
অর্ণব একটু ভড়কে গেল, ‘ও আচ্ছা! আসসালামু আলাইকুম আংকেল! কেমন আছেন?’
—‘আমি ভালো। তোমাদের কী খবর?
ফোনটা আসায় অর্ণবের হাঁটা থেমে গিয়েছিল। থেমেছে নিশাও। উৎসুক চোখে চেয়ে আছে অর্ণবের দিকে। তার মন বলছে ফোন এসেছে বাড়ি থেকে।
—‘আমরা ভালো আছি।’
—‘কোথায় এখন?’
—‘কাছাকাছিই। সাউথ বোল্ডারে। টেবল মেসা।’
—‘তুরিনের সঙ্গে কথা হয়েছে তোমার?’
অর্ণব দমল, ‘এখনো হয়নি…মানে হচ্ছে আরকি…’
—‘আমার মেয়েটা একটু বদরাগী আছে। বাট শি ইজ ভেরি গুড অ্যাট হার্ট।’
অর্ণব কী উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে হাসতে লাগল নিঃশব্দে। আনিতা হেঁটে হেঁটে ওদের কাছাকাছি এসেছে। হাতে ধরা সেলফোনের স্ক্রিনে ঠেসে রেখেছে চোখ। কপালজোড়া বিরক্তির কুঞ্চন।
—‘আর সবার কী খবর?’
—‘জি…সবাই ভালো আছে।’
—‘সব ঠিকঠাক?’
—‘জি।’
—‘তুরিনের ফোনে রিচ হচ্ছিল না। সে কি তোমার সঙ্গে আছে?’
অর্ণব ইতস্ততভাবে বলল,
—‘জি না। উনি একটু অন্যদিকে আছেন।’
—‘বাকিরা কোথায়?’
—‘আমার সঙ্গে মিস আনিতা আছেন, মিস নিশা আছেন।’
জাহিদ একটু চুপ করে রইল।
—‘কে ফোন করেছে?’ নিশা পরের বাড়ির জানালায় বিনা অনুমতিতে উঁকি
দেবার মতো একটা অপরাধবোধ গলায় নিয়ে প্রশ্নটা করল।
—‘আংকেল।’
—‘আংকেল?’
—‘জাহিদ আংকেল।’
নিশা রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘জুবিন কেমন আছে? কী করছে?’
অর্ণব বলল, ‘মিস নিশা কিছু জানতে চাইছেন। উনাকে ফোন দেব?’
নিশা একটু অপ্রস্তুত হলো অর্ণবের কথায়। ফোন হস্তান্তর করার কী আছে? অর্ণব নিজে প্রশ্নটা করলেই তো পারে!
—‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই।’ জাহিদ বলল। কিঞ্চিৎ বিরতির পর।
ফোন হাতে নিয়ে নিশা একটু দূরে সরে এলো। তার বুক কেন যে ধড়ফড় করছে জানে না।
—‘হ্যালো।’
—‘হ্যালো নিশা।’
—‘জুবিন কেমন আছে?’
—‘জুবিন ভালো আছে। আমার সঙ্গেই আছে।’
নিশা চুপ করে গেল। কথা খুঁজে পেল না। জাহিদের সঙ্গে এই প্রথম ফোনে কথোপকথন হচ্ছে। এর আগে কোনদিন লোকটার কণ্ঠ টেলিফোনে শোনেনি সে। কেমন অচেনা লাগছে গলাটা! অনেক কষ্টে বলল,
—‘জুবিন কান্না করছে না তো?’
—‘মাঝেমধ্যে কেঁদে উঠছে।’
—‘কাঁদছে কেন?’
—‘মাকে মিস করছে মনে হয়।’
খুশির একটা ঢেউ উঠল নিশার মনে।
—‘জুবিনকে বলবেন, আমিও ওকে মিস করছি।’
অর্ণব আর আনিতা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে নিশার দিকেই তাকাচ্ছে আড়চোখে। অস্বস্তি লাগছে নিশার। ফোনের ওপার থেকে জুবিনের মিহি গলার লুতুপুতু আওয়াজ ভেসে আসছিল। ফোন রাখতে ইচ্ছে করছিল না। নিশা ইতস্ততভাবে বলল,
—‘বাবা-মা কেমন আছেন?’
—‘ভালো।’
—কী করছেন?’
—‘মা রান্নাঘরে কাজ করছেন। বাবা টিভিতে নিউজ দেখছেন।’
—‘আপনার স্ত্রী?’
—‘বাইরে গেছে।’
—‘কখন ফিরবে?’
—‘ঘণ্টা দেড়েকের মাঝেই।’
—‘বেশ।’
জাহিদ কিয়ৎক্ষণ নীরব থেকে বলল,
—‘জুবিনের মা কখন বাড়ি ফিরবে?’
একটা খোঁচা লাগল নিশার বুকে। ধীরস্বরে বলল,
—‘তাতে জুবিনের বাবার কী?
জাহিদ হাসল, ‘জুবিন জানতে চাইছে।’
—‘তাই নাকি?’
—‘হুম তাই!’
—‘বিকেলের আগেই ফিরে আসবে।’
—‘আচ্ছা।’
—‘জুবিন আর কিছু জানতে চায়?’
—‘ও জানতে চাইছে মায়ের দিন কেমন কাটছে?’
—‘মা জুবিনকে মিস করছে।’
—‘জুবিনও মাকে মিস করছে।’
কথাটা নিশার ভালো লাগল। এত বেশি ভালো লাগল যে ভালো লাগার আচমকা জোয়ারে কাঁপন ধরল কণ্ঠস্বরে। হালকাভাবে বলল, ‘রাখছি।’
অর্ণব ওর ছলছল চোখের দিকে সন্দেহের চোখে চেয়েছিল। নিশা ফোনটা ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘আমার শরীর ভালো লাগছে না। গাড়িতে গিয়ে একটু বসি?’
.
একটু আগে নিশার বলে যাওয়া কথাটা শাহজিদের মস্তিষ্কে বাড়ি খাচ্ছিল থেকে থেকে। জীবনটা তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। একা বেঁচে থাকার, একা সংগ্রাম করার, একা একাই হেসে উড়িয়ে দেয়ার বা কেঁদে ভাসাবার দুর্গম চ্যালেঞ্জ। মানবীর প্রেমে পড়ার মতো শৌখিনতা এই প্রতিকূল জীবনে বড্ড বেমানান। প্রেম তো দূরের কথা, মেয়েমানুষের শরীর কামনা করার মধ্যেও একটা অশুচি বোধ কাজ করে ভেতরে। পরাজয়ের ঘ্রাণ পায়। তবে আজ একটু আগে বুঝি অদ্ভুত একটা পরাজয় খুব নিভৃতে ঘটে গেছে। এই পরাজয় বুকের ভেতর গ্লানি সৃষ্টি করছে না। বরং একটা নাম না জানা ভেজা ভেজা অনুভূতিতে ছেয়ে আছে সমস্ত সত্তা। তুরিন যখন গত তিন বছরের বাধা, সংকোচ, অবহেলা আর দূরত্ব ডিঙিয়ে ঝপ করে পাশে এসে বসল, ঠিক সেই মুহূর্তে পাহাড়ের কাছে হেরে যাওয়া বিধ্বংসী মনটার মাঝেও যেন একটা জয়ভেরির ডমরু বেজে উঠল। যে পাহাড়ের বিশালতা অষ্টপ্রহর কটাক্ষ করে আসছিল, তপ্ত শেলের মতো বিঁধছিল বুকে, সেই প্রকাণ্ড পাহাড়ের নির্মম পরিহাসও সহনশীল হয়ে উঠল। আশ্চর্য বটে!
তুরিনের কপাল থেকে কুঞ্চন মুছে গেছে। সরে গেছে ঠোঁটের কোণের ঝাঁজালো ভাঁজ। কী রকম যেন নরম একটা আদুরে আবরণে ভরে গেছে ওর সারা শরীর। হতাশায়, অবহেলায় তার মনটা বদ্ধ পচা পুকুরে সাঁতরে বেড়ানো মাছের মতো হয়ে গিয়েছিল। আজকে যেন সেই মাছ পরিষ্কার টলটলে পানি পেল। মজা পুকুর থেকে ঝাঁপ দিল সমুদ্দুরে! শুধু কাছাকাছি চুপ করে বসে থাকাতেই যে এমন বিপুল মুক্তি মিলবে তা কে জানত!
এখন রোদ কমে গেছে। বাতাস আগের চেয়ে ঠাণ্ডা। সামনের সুবিশাল নরম আকাশে এই মাত্র কোন শিল্পী যেন গাঢ় নীল রঙের কয়েকটা মেঘ এঁকে দিয়ে গেছে।
তুরিনই কথা বলল প্রথম,
—‘শেভ করেন না কেন?’
শাহজিদ গালের আধ ইঞ্চি লম্বা দাড়ি হাতড়ে উদাসভাবে বলল, ‘ইচ্ছে করে না।’
—‘ইচ্ছে না করলেও করবেন।’
শাহজিদের চোখে একটা দুষ্টু অথচ মিষ্টি হাসির প্রলেপ পড়েছে। ঠোঁটের কোণে ফিরে এসেছে আত্মবিশ্বাসের ঝিলিক। তুরিনের আরক্ত মুখের দিকে চেয়ে সে সকৌতুকে বলল, ‘এটা কি অনুরোধ? নাকি আদেশ?’
একটা নীল পাখনার ম্যাগপাই পাখি রুক্ষ সোনালি ঘাসের ওপর তিড়িং- বিড়িং করে লাফাচ্ছিল। ডাকছিল কাকে যেন আনচান গলায়। অস্থিরমতি পাখিটার ওপর অস্থির দুটি চোখ রেখে তুরিন কেটে কেটে বলল, ‘হবে কিছু একটা। শেভ করবেন, চুল কাটবেন। এরকম পাগলের মতো হয়ে থাকবেন না।’
শাহজিদের চোখে এখনো দুষ্টু হাসির ঝিকিমিকি। ডান দিকের গালে জিব ঠেকিয়ে, মুখ বাঁকিয়ে কী যেন ভাবল একটু। তারপর ঠোঁট উল্টে বলল, ‘নিশ্চয়ই! আপনার কথা তো শুনতেই হবে। নইলে কখন আবার বইয়ের মতো আমাকেও ছুড়ে ফেলে দেন পাহাড় থেকে…বলা যায় না!’
তুরিন কিছু বলল না। চোখে-মুখে লজ্জার আবির রং ছড়িয়ে চুপ করে রইল।
—‘বাই দ্য ওয়ে, আমার পছন্দের বই ছিল। ফেলে দিলেন কেন?’
তুরিন চুপ।
—‘মানুষের ওপর অত্যাচার তাও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু বইয়ের ওপর এমন জুলুম মেনে নেওয়া যায় না। আপনার পানিশমেন্ট হওয়া উচিত।’
—‘পানিশমেন্ট তো হওয়া উচিত আপনার!’
—‘আমি কী করলাম?’
—’মিথ্যে বলেছিলেন কেন?’
—’কখন মিথ্যে বললাম?
—‘ওই যে বললেন আমার নাকি টেরিবল পারফরমেন্স, ব্লা ব্লা… শাহজিদ রহস্য নিয়ে বলল, ‘সত্য-মিথ্যা যাচাই করা কঠিন ব্যাপার। তুরিন ঘুরে তাকাল, ‘আচ্ছা? তা এই মাত্র যে বললেন আমার চেয়ে সুন্দর মানুষ আর দেখেননি ওটা মিথ্যে ছিল?’
—‘আপনি বিশ্বাস করেছেন? সিরিয়াসলি? আপনার মতো মেইড ইন চায়না হবে পৃথিবীর সেরা সুন্দরী? অ্যাবসার্ড!’ হাসতে হাসতে বলছিল শাহজিদ কথাগুলো। দারুণ কিন্তু ওর বলার ভঙ্গিটা। তুরিন মুগ্ধ দুটি চোখ পেতে রইল খানিকক্ষণ ওই এলোমেলো চুল দাড়িওয়ালা সুন্দর মুখের ওপর। লঘু সব কথার ভিড়ে গুরুত্বপূর্ণ কথারা কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ। শাহজিদের জানার ছিল গত তিনটি বছর তুরিন কেন তাকে অবহেলা করেছে? কেন বদলে গিয়েছিল হঠাৎ? তুরিনেরও জানার ছিল,… সেই সন্ধ্যায় শাহজিদের অ্যাপার্টমেন্টের নিচে যে দৃশ্যটি সে দেখেছিল সেই দৃশ্যটা কতভাগ সত্য? নিশার সঙ্গে শাহজিদের সম্পর্ক কী? নিশা এবং তুরিন, এই দুজনের মধ্যে কাউকে বেছে নিতে হলে শাহজিদ কাকে বেছে নেবে? মনের ভেতরের কূট চিন্তাসংলগ্ন সন্দেহের গ্যাজলা ওঠা কথাগুলো কেন যেন এই সুন্দর সময়টায় বলতে ইচ্ছে করছিল না একদম।
সেই সময় হঠাৎ স্টেলাকে দেখা গেল আবার। হাসি হাসি মুখে এদিকেই এগিয়ে আসছে মেয়েটা।
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ৩.২
এ ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর
নিশার মুখ তখনো আরক্ত। চোখজোড়া বাষ্পে ঢাকা। গাড়িতে উঠে বসবার সঙ্গে সঙ্গে রোদচশমার আড়ালে চোখ লুকাল সে। অর্ণব মাথাটা একটু ঝুঁকিয়ে বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন? কিছু লাগবে?’
—‘আমি ঠিক আছি।’ নিশা বলল পাশ কাটানো গলায়। অর্ণব আরো কয়েক সেকেন্ড এমনি এমনিই দাঁড়িয়ে রইল। তারপর একটু অমায়িক হাসল,
—‘আমি কাছাকাছি আছি। প্রয়োজন হলে ডাকবেন।’
—‘নিশ্চয়ই।’
ছেলেটির ভদ্রতায় মুগ্ধ হচ্ছে নিশা। এত ভদ্র, এত নরম…আহা তুরিনের সঙ্গে মানাবে কি? একদম পাত্তা দেবে না তো দাম্ভিক মেয়েটা! উঠতে-বসতে কথা শোনাবে। শেষকালে ছেলেটাকে না অপমানিত হয়ে ফিরে যেতে হয়!মনটা খারাপ হয়ে যায় নিশার। অর্ণবের জন্য মায়া হয়…আচ্ছা…! লোকটা কেন বলল জুবিন ওকে মিস করছে? কেন জানতে চাইল নিশা কখন বাড়ি ফিরবে? জুবিনের নাম করে নিজেই যে জানতে চাইল নিশা কি তা বোঝেনি? কিন্তু এই প্রহসনের মানে কী? বলেছিল তো কখনো ভালোবাসবে না, কখনো স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করবে না…তাহলে কেন এই মিথ্যে কেয়ার করার অভিনয়? বড় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে নিশা চিন্তাগুলোকে বুকের একপাশ থেকে অন্যপাশে সরিয়ে দিল ঠেলে। মনকে কেন্দ্রীভূত করতে চাইল অন্য কোন জায়গায়। চোখ মেলে চাইল অনেক খানি নিচে নেমে আসা আকাশে। এদিকে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। কিন্তু রোদ কাটেনি। মেঘের সিলভার লাইনিংয়ে কড়া ঝিলিক দিয়ে রুপালি রোদ উপচে পড়ছে পৃথিবীতে। বৃষ্টিটা প্রথমে এই উঁচু পাহাড়েই নামবে। তারপর যাবে লোকালয়ে। ভেজা ধূলোর গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। নিশা চোখ বুজে খোলা জানালা দিয়ে উড়ে আসা ভেজা ভেজা হাওয়াটা অনুভব করতে চাইল। চোখ বুজতেই মন দৌড়ে ছুটে গেল পেছনে ফেলে আসা দিনগুলোর পুরনো ক্যালেন্ডারে। অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা চলছে। এর মাঝেই বিয়ের কথাবার্তা পাকা হলো। মা বলেছে পড়াশোনা করার আর প্রয়োজন নেই। বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এবার সংসার ধর্মে মন বসাও। ছাত্র হিসেবে খুব একটা উন্নত গোছের কখনোই ছিল না নিশা। টেনেটুনে পাশ করত। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে অগামগা সন্তান জন্ম নিলে বাবা-মায়ের দুশ্চিন্তার পাল্লা দ্বিগুণ হয়ে যায়। নিশার পরিবারেও ব্যতিক্রম কিছু হলো না। তার ওপর মেয়ে সুন্দরী। পাড়ার ছেলেরা উত্ত্যক্ত করে দিবানিশি। যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে একটা গতি করতে পারলেই দায়িত্ব চুকে যায়।
গান ভালোবাসত। গাইতও দারুণ। জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় পুরস্কার জিতেছিল দুবার। কিন্তু পরিবারের কেউ এই প্রতিভার কদর করতে জানল না। মা বলল,ভদ্র ঘরের মেয়েরা গান করে না। অতএব ষোলতে পা রাখতে না রাখতেই নিজের সবচাইতে প্রিয় শখটা চিরদিনের জন্য বিসর্জন দিতে হলো। নিশার আরো একটি মেয়েলি গুণ ছিল। তার মনটা অসম্ভব ঘরোয়া ধাঁচে গড়া। বাইরের পৃথিবী তাকে কখনোই সেভাবে হাতছানি দিয়ে ডাকেনি। সংসারের কাজেই যেন আত্মিক মুক্তি মেলে। লোকে বলত, মেয়েটি ভীষণ লক্ষ্মী। যে ঘরে যাবে ভাগ্যলক্ষ্মী ফিরিয়ে আনবে! এমন মেয়ে বাড়ির শ্রী বর্ধন করে।
আঠারো হতে না হতেই বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয়েছিল। বাবা বলতেন আমার স্নো-হোয়াইটকে আমি রাজার ঘরে বিয়ে দেব। এই সিদ্ধান্তে অটল হয়েই বুঝি পর পর অনেক প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলেন। অবশেষে একদিন সত্যি সত্যি দূরের রাজ্য থেকে ডাক এলো। এত ভালো প্রস্তাব, এত ধনী এবং এত শিক্ষিত পাত্র! শুনে-টুনে আত্মীয়-স্বজনরা গুম হয়ে গেল একদম। কেউ কেউ বিশ্বাস করল না, কেউ হিংসা করল, কেউ আবার বলল, বিদেশে বেড়ে ওঠা ছেলেরা ভালো হয় না, ক্যারেক্টারে সমস্যা থাকে।
নিশার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেনি বাবা-মা। শুধু জানানো হলো কাগজে-কলমে একজনের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আপাতত। মূল বিয়েটা হবে আমেরিকায় যাওয়ার পর। বালিশের তলায় একটা ছবি রেখে গিয়েছিল মা। নিশা ছবিটা দেখেনি। আসলে দেখা না দেখায় কিছু এসে যায় না। যে লোকটার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সে আর যাই হোক না কেন স্বপ্নের নায়ক হবে না। স্বপ্নে দেখা পুরুষ, স্বপ্নেই থাকে! নিশার মতো হেঁজিপেঁজি মেয়ের জীবনে ওরা কল্পলোকের পর্দা সরিয়ে বাস্তবে প্রবেশ করে না। ভবিতব্য যেরকমই হোক না কেন নিশা মনটাকে বেঁধে-ছেঁদে নিয়েছিল মানিয়ে নেবে বলে। অতি অল্প বয়সেই সে জেনে গেছে, এই দুনিয়ায় অল্পবিস্তর মানুষই শুধু বেঁচে থাকে, বাকিরা মানিয়ে নেয়, মানিয়ে চলে। বিয়েটা ঠিক হওয়ার পর থেকে বাবা-মায়ের পোড় খাওয়া চোখে আলাদা রকমের দ্যুতি দেখতে পেয়েছে সে। এই দম্পতির জীবনে যেন ইদ লেগেছে। বহুদিন পর তাদের একঘেয়ে অভাবি সংসারে আনন্দের হাওয়া বইছে। শ্বশুরমশাই মহৎ হৃদয়ের মানুষ। নিশার পরিবারকে ভদ্রলোক যে সম্মান দিচ্ছেন তা অতুলনীয়। নিশা তাই বিয়েটা মন থেকেই গ্রহণ করল। পরিবারের ভালোর জন্য নিজেকে কেটেকুটে পদ্মার জলে ভাসিয়ে দিতেও আপত্তি ছিল না তার।
বিয়ের আগের রাতে বান্ধবীরাই জোর করে ছবিটা দেখাল। পাত্র নাকি রাজপুত্রের মতো সুন্দর। নিশা রাজপুত্র কখনো স্বচক্ষে দেখেনি, কিন্তু একবার তুষারকন্যার গল্প নিয়ে চিত্রিত একটি চলচ্চিত্র দেখেছিল। অবাক হয়ে আবিষ্কার করল শুধু চশমা বাদ দিলে, ছবির মানুষটা দেখতে অনেকটাই সেই সিনেমার প্রিন্সের মতো! ধবধবে ফরসা, নাকটা যেন তুলি দিয়ে আঁকা, মাজা মাজা নিখুঁত চোয়াল…আশ্চর্য! পৃথিবীতে এরকম মানুষও আছে? ভাবতে গিয়ে নিশার মন থেকে বাস্তবতার মেঘ কেটে গেল। স্বপ্ন স্বপ্ন একটা ঘোলা চাঁদোয়া নেমে এলো ওখানে। ঝুম হয়ে বসে রইল। • ঘুম এলো না…কখনো নিজের মনে হাসল…কখনো কাঁদল…কখনো মনে মনে ছবির মানুষটার সঙ্গে কথা বলল…!
স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণা কী ভয়াবহ নিশা তা আগে কখনো জানত না। যখন জানল, তখন সেই মানুষটাকেই সব চেয়ে বেশি ঘৃণা করতে শুরু করল, যাকে একদিন ভালোবাসবে বলে মনে মনে পণ করেছিল। নিজেকেই নিজে গঞ্জনা দিতে লাগল অষ্টপ্রহর। কী লজ্জা! কী লজ্জা! এসেছিল রাজকন্যা হওয়ার বাসনা নিয়ে, কিন্তু হতে হলো দাসী-বাঁদি কিংবা তার চেয়েও অধম। প্রথম কটা দিন উম্মাদের মতো কাটল। চোখে-মুখে পাগলামির চিহ্ন, শরীর নিঃসাড়, খাওয়া দাওয়ায় অরুচি। বুকটা সারাক্ষণ খাঁখাঁ করে। বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি সবাই তাকে ঠকিয়েছে। পৃথিবীতে কিছু মানুষের জন্মই হয় প্রতারিত হওয়ার আশ্চর্য ক্ষমতা সঙ্গে নিয়ে। এসব লোক জীবনের প্রতি পদে পদে ধোঁকা খায়, ঠকে, তবুও এদের জ্ঞান চক্ষু উন্মীলিত হয় না। শিক্ষা হয় না। দিন শেষে এরা আয়নায় নিজের ভাঙাচোরা, প্রতারিত হওয়া প্রবঞ্চিত মুখের দিকে চেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলার চেষ্টা করে, থাক…আমি নাহয় খারাপই রইলাম…ওরা তো ভালো আছে। ওরা ভালো থাকুক!
বিয়ের কদিন পর একদিন খুব ভোরে মানুষটা ওর ঘরে এলো।
—‘নিশা! ওঠো!’
কাঁচা ঘুম চোখে নিয়ে আধো আলো অন্ধকারে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল নিশা।
— ‘কী হয়েছে?’
—‘দশ মিনিট সময় দিচ্ছি। তোমার ব্যাগ গুছিয়ে নাও।’
—‘কেন?’ উথাল-পাতাল বুক নিয়ে প্রশ্ন করে নিশা।
জাহিদ চাপা গলায় বলল, ‘তোমাকে নিউইয়র্ক রেখে আসব। ওখানে আমার বন্ধুর বাসায় কদিন থাকবে। ওরা আগামী সপ্তাহে দেশে যাচ্ছে। তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে।’
এসব কথার মাথামুণ্ডু বুঝে উঠতে সময় লাগল। নিশা কিয়ৎক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল মানুষটার মুখের দিকে। মানুষটার পরনে কালো জ্যাকেট, মাথায় হুডি, জিন্সের প্যান্টের পকেটে দু হাত রেখে দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে। তাড়া দিয়ে উঠে বলল, ‘দ্রুত তৈরি হয়ে নাও। সময় নেই। বাড়ির লোকে জেগে যাবে।’
নিশা আজ্ঞাধীন ভৃত্যের মতো উঠে দাঁড়াল। স্যুটকেস থেকে খুব বেশি কাপড়চোপর বের করা হয়নি। কিছু টুকটাক জিনিস বাইরে ছিল। যন্ত্রচালিতের মতো সেগুলো স্যুটকেসের ভেতরে পুরল। হাত-মুখ ধুয়ে নিল। মুখ দিয়ে একটা বাক্যও অপচয় করল না। একদিন তার আপন পরিবার মতের মূল্য না দিয়ে স্রেফ একটা কাগজের বৌ বানিয়ে নিজ জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করেছিল। আজকে কলেমা পড়ে খোদার ওয়াস্তে কবুল করা স্বামী ঠিক একইভাবে তার মতামতের তোয়াক্কা না করে শ্বশুরবাড়ির ভিটা থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু কোথায় যাবে নিশা? সেই বাবার কাছে? যে বাবা কয়টা পয়সার জন্য নিজ কন্যার সঙ্গে মিথ্যাচার করেছে? বিক্রি করে দিয়েছে? মুখ দেখাবে কী করে আত্মীয়-স্বজনকে?
আধো আলো অন্ধকারের শীত জমানো ভোরে একটা মোটা শাল গায়ে দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো সে জাহিদের সঙ্গে। বেরোবার সময় শ্বশুরমশাইয়ের মুখটা বারবার মনে পড়ছিল। এই বৃদ্ধ হাতজোর করে ক্ষমা চেয়েছেন তার কাছে। অনুনয়-বিনয় করে বলেছেন, তোমার ওপর আমার অনেক ভরসা মা! লোকে সৎপাত্রে কন্যা দান করে, আমি সৎপাত্রীতে পুত্র দান করেছি। আমার ছেলের তোমাকে প্রয়োজন। তোমাকে দেখামাত্র বুঝেছি, তুমিই পারবে। মুর্তজা সাহেব কেন বলেছিলেন কথাগুলো তা আজও জানে না নিশা। জাহিদকে তার সব সময় একজন জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন স্বাবলম্বী পুরুষ বলে মনে হয়েছে। এমন পুরুষের কখনোই নিশার মতো অবলা অকর্মণ্য নারীর প্রয়োজন হবে না, এ কথা হলফ করে বলতে পারে সে।
গাড়িতে ওঠার পর জাহিদ ওর থমথমে মুখটা একবার দেখে নিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছ নিশা?’
নিশা মুখে কোন শব্দ করল না। সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।
—‘ভয় করছে?’
নিশা নিরুত্তর। বাইরের তুষার ধোয়া আবছা সকালের দিকে চেয়ে আছে ওর নিথর দুটি চোখ। টপটপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল। বাঁকা হয়ে নাকের পাশ কাটিয়ে মিশে যাচ্ছে ঠোঁটের ভাঁজে। জাহিদ অস্থিরভাবে বলল, ‘তুমি কাঁদছ কেন? দেশে ফিরে যেতে চাও না?’
নিশা চুপ করে রইল।
—‘আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি। তুমি এরকম লাইফ ডিজার্ভ কর না। ইউ ডিজার্ভ মাচ বেটার দ্যান দিস।’
নিশা এতক্ষণে কথা বলল, ‘আমি চলে গেলে আপনার খুব সুবিধা হয় তাই না?’
—‘আমার সুবিধার কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি তোমার কথা ভাবছি।’
নিশা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, ডাগর দুটি চোখ ওই চশমা ঘেরা চোখের ওপর রেখে বলল, ‘কেন ভাবছেন আমার কথা?’
জাহিদ পরিষ্কার কণ্ঠে জানিয়ে দিল, ‘আমি চাই না আমার জন্য তোমার জীবনটা নষ্ট হোক। তোমার বয়স এখনো অনেক কম। সামনে পুরো জীবন পড়ে আছে। আচ্ছা, দেশে ফিরতে না চাইলে সমস্যা নেই। এক কাজ করো। তুমি নিউইয়র্কে থাকো কিছুদিন। টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। আমি দেখছি ব্যাপারটা। তোমার গ্রিনকার্ডের প্রসেসিং চলছে। হয়ে গেলে চাকরি করবে, পড়াশোনা করবে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে।’ অনেক কথা একসঙ্গে বলে একটু থামল জাহিদ। তারপর গলায় জোর দিয়ে বলল, ‘আর আমাদের ডিভোর্সের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ডোন্ট ওরি।’
নিশা অনেকক্ষণ কোন কথা বলল না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। লোকটা হয়তো ঠিক কথাই বলছে। তার চলে যাওয়াই উচিত। মনে হলো জীবনে এই প্রথম কেউ একজন সত্যিকার অর্থে তার মঙ্গল কামনা করছে। এভাবে কেউ কখনো মুক্তি দেয়নি তো! এমনকি সে নিজেও নিজের জন্য এভাবে ভাবেনি কখনো। আজ এক সোনালি ভবিষ্যৎ হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে। সামনে দুর্লভ স্বাধীনতা, পেছনে কারাবন্দি জীবন। কোনটা বেছে নেবে নিশা? কোনটা? কোনটা বেছে নেওয়া উচিত?…দায়িত্ব! দায়িত্ববোধ কড়া নাড়ল ভেতরে। সব দায়বদ্ধতা ছুড়ে ফেলে দিয়ে শুধু নিজের চলার পথটা আগাছামুক্ত করে এগিয়ে যাওয়া কি স্বার্থপরের কাজ নয়? তার সংস্কারবদ্ধ মন যে কিছুতেই এত স্বার্থপর হওয়ার কথা ভাবতে পারে না! এতদিন মনের মধ্যে শূন্যতা ছিল, এখন ভয় এসে যুক্ত হলো। সেই ভয়ের আদ্যপান্ত নিশা জানে না। না জেনে, না বুঝেই বিশাল কিছু একটা হারিয়ে ফেলার বিপৎসংকেত বাজতে লাগল বুকে। আকুল হয়ে বলল, ‘আমি কোথাও যাব না!’
জাহিদের চশমার আড়ালের চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইল।
—‘কী বলছো তুমি?’
নিশা গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘শুনেছেন তো যা বললাম।’
জাহিদ তড়িঘড়ি করে নেমে এলো গাড়ি থেকে। বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছিল নিশা। জাহিদ ওর হাত খামচে ধরল। হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এলো রাস্তার ধারে, একটা বিশাল আকৃতির পাইনগাছের আড়ালে। গাছের নিচে তখনোঝুপসি অন্ধকার। সেই অন্ধকারে নিশার ভেজা ভেজা ডাগর দুটি চোখের দিকে চেয়ে জাহিদ কড়া গলায় প্রশ্ন করল, ‘সমস্যা কী তোমার?’
—‘হাত ছাড়ুন!’
—‘না ছাড়ব না। আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। কেন যেতে চাও না?’
—‘জানি না।’
—‘কী জানো না?’
—‘উফ হাত ছাড়ুন। লাগছে খুব।’
—‘লাগুক। তোমার মতো বোকা মাথামোটা মেয়েদের লাগাই উচিত। তুমি কি বুঝতে পারছ কী অসম্ভব একটা সম্পর্ক আমাদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে? আমাদের বয়সের কত তফাত, সেটা চিন্তা করে দেখেছ?’
নিশা বলল…কেন যে বোকার মতো কথাটা বলে ফেলল কে জানে, ‘বয়স কোন ব্যাপার নয়। আমার দাদাভাই, দাদিমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। উনারা এখনো একে অপরকে ভালোবাসে।’
জাহিদ বিহর্ষ বিস্ময়ে থ বনে গেল। পরমুহূর্তেই রাগের একটা তীব্র ঝংকার উঠল ওর মুখে। নিশা সংকুচিতভাবে চোখ নামিয়ে নিল। কথাটা বলার পর বুঝতে পেরেছে, বলা উচিত হয়নি।
—‘শোন মেয়ে! আমি কখনোই তোমাকে ভালোবাসব না…নেভার, এভার!’
অপমানের ঝাপটা এসে লাগল মুখে। নিশা অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে শক্ত গলায় বলল, ‘আমি যেন আপনাকে ভালোবাসার জন্য বসে আছি!’
—‘একজ্যাক্টলি…এটাই আমি বলতে চাইছি…’ হঠাৎ জাহিদের গলার স্বর আটকে গেল। বদলে গেল চোখের দৃষ্টি। বাবা-মা হাঁটতে বেরিয়েছেন। বেরোনো মাত্র দৃশ্যটা তাঁদের নজরে এসেছে। এই সুযোগে নিশা ছুটে পালাল বাড়ির ভেতর। জাহিদ ভীষণ রেগে গিয়েছিল। পরের কয়েকটা মাস নিশার চোখে চোখে তাকাল না পর্যন্ত। এদিকে বাড়ির অন্য সদস্যরাও নিশাকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না। অপমানের জ্বালায় বুক পুড়ে যায়। মুখ বুজে সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। শ্বশুর-শাশুড়ি স্নেহ করেন। সেই স্নেহ আর সম্মানটুকুই নিশাকে অক্সিজেনের জোগান দেয়। একেকদিন মনে হয় জাহিদের প্রস্তাব মেনে নেওয়াই সমীচীন কাজ হবে। চলে যাওয়া উচিত এই বন্দি কারাগার ছেড়ে। সাহস আসে, আবার ঝিমিয়ে যায় মন। কোথায় যেন কী একটা পেছন থেকে টেনে ধরে। যেন এখনোযাওয়ার সময় আসেনি, যেন কী একটা করার আছে, কিছু একটা হওয়ার আছে! এ সংসারে তার কোন জায়গা নেই, তবুও কোন এক অলীক উপায়ে সমস্ত সংসারটা তার চোখের মধ্যে, মনের মধ্যে, শরীরের মধ্যে বিঁধে গেছে! নিশা পারেনি…হতে পারেনি নির্ভীক, হতে পারেনি নারীবাদী, হতে পারেনি যুক্তিবাদী মনন ও চিন্তায় বিশ্বাসী। হেরে গেছে সে। নিজের কাছে, জীবনের কাছে, সমাজের কাছে বিষমভাবে হেরে গেছে!
কিন্তু পৃথিবীতে সমস্ত হারের মধ্যেই মনে হয় একটি করে প্রচ্ছন্ন গোপন বিজয় থাকে। সেই বিজয়টা নিশা টের পেত শ্বশুর-শাশুড়ির স্নেহাশিস প্রীতিপূর্ণ ব্যবহারে। নিজের বাবা-মায়ের তৃপ্তি বিজড়িত, গর্বিত কণ্ঠস্বরে। এসব ছোটখাটো প্রাপ্তি দিনশেষে নিজের বিবেকের চোখের ওপর চোখ রাখার সাহস জোগাতো। স্বস্তি দিত!
এর মাঝে শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের প্রত্যাশার ব্যাপারে জানিয়ে দিলেন। তাঁরা চান খুব দ্রুত যেন পরিবারে নতুন সদস্য আসে। এদিকে জাহিদ নিশার দিকে চোখ তুলেও চায় না। যেন নিশা অদৃশ্য, অশরীরী। ফারাকে পতিগর্বে গর্বিত ভাগ্যবতী এক নারী বলে মনে হয় নিশার। যদিও এই রমণী কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক। জাহিদ তখন ব্যাংকের চাকরির পাশাপাশি শ্বশুরমশাইয়ের হোটেলের বিজনেস দেখাশোনা করে। প্রায় রাতে ফিরতে ফিরতে দেরি হয়। ফারাকে একদিনও স্বামীর জন্য জেগে থাকতে দেখেনি নিশা। অবশ্য সে নিজেও চাকরিজীবী। নিয়ম মেনে চলতে হয়। স্বামীর পথ চেয়ে রোজ রোজ রাত জেগে অপেক্ষা করা তার শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফারাকে কোন এক বিশেষ কারণে শ্বশুর-শাশুড়ি খুব একটা পছন্দ করেন না। বড় জা নীলিমা সবার মন জুগিয়ে চললেও চাকরির সুবাদে বাড়িতে থাকা হয় কম। বাড়ির মেয়েদের মধ্যে একমাত্র নিশাই ঘরোয়া। তাই শ্বশুর-শাশুড়ির মনে বিশেষ জায়গা দখল করে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি ওর।
জাহিদের ডিনার ডাইনিং টেবিলে ঢেকে রাখা হয়। মাইক্রো ওয়েভে গরম করে একা বসে খাবার খায় সে। নিশা জেগে থাকে। নিঝুম ঘুমন্ত বাড়িতে নিজের ঘরে বসে ঠিক ঠিক টের পায় নিচে ডাইনিংয়ে ওভেন চালানো হচ্ছে, চেয়ার টানা হচ্ছে, পানির কল ছাড়ার শব্দ হচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ বাদে পায়ের শব্দ সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে কাছে এগিয়ে আসে। দরজার ওপারের করিডর পার হয়ে খানিক দূরে ফারার ঘরের সঙ্গে গিয়ে মিলিয়ে যায়। একরাতে নিশা টের পেল দুটি পা তার দরজার সামনে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। নিশা বদ্ধ দরজার দিকে চেয়ে দম আটকে বসে রইল। কয়েক সেকেন্ড কাটার পর দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল জাহিদ। গায়ে অফিসের ফর্মাল শার্ট-প্যান্ট। চিন্তিত, শীর্ণ মুখ। ধবধবে ফরসা গালে কৃষ্ণ রঙের দাড়ির একটা পাতলা আস্তর। ক্লান্তিকর ম্লান ভাবটা যেন তার মুখে আলাদা রকমের শ্রী যুক্ত করেছে। চশমার আড়ালের চোখদুটো ঋষির মতো শান্ত!। নিশা এমনিই একটু লাজুক প্রকৃতির মেয়ে। পুরুষ বন্ধু ছিল না, প্রেমিক ছিল না। তার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে সদ্য বয়ঃসন্ধি পেরোনো বালিকার মতো অদম্য জড়তা। জাহিদ সামনে এলে সে আরো বেশি জড়সড়ো আর কুণ্ঠিত হয়ে যায়। শব্দের ঘরে তালা পড়ে। নিজেকে জড়বৎ পদার্থ বলে মনে হয়। আত্মবিশ্বাসের পারদ নেমে যায় অনেক নিচে।
জাহিদ ধপ করে বিছানার ওপর বসে পড়ে অধীর হয়ে বলল, ‘বাবা-মা কী শুরু করেছে বলো তো? দুদিন পর আমি মেয়ের বিয়ে দেব। এই সময়ে নতুন বাবা হওয়া আমাকে মানায়?’
প্রসঙ্গটা বুঝতে পেরে নিশা আরো বেশি কাদা হয়ে গেল সংকোচে। জানালার সামনে দাঁড়িয়েছিল। এত লজ্জা লাগছিল যে মন চাইছিল জানালা টপকে অদৃশ্য হয়ে যায়। ঘরের ভেতর একটা হলুদ রঙের ম্লান আলো জ্বলছে। সেই আলোতে জাহিদ নিশার রাঙা হওয়া মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলল, ‘দ্যাখো, তুমি নিঃসন্দেহে সুন্দরী। কিন্তু শুধু দৈহিক সৌন্দৰ্য যথেষ্ট নয়। মেন্টাল অ্যাটাচমেন্ট প্রয়োজন। তুমি কি বুঝতে পারছ?’
নিশা কোন উত্তর দিল না। কাঁচুমাচু হয়ে দাঁত দিয়ে হাতের আঙুলের নখ কাটতে লাগল।
জাহিদ বলল, ‘তোমার শ্বশুর-শাশুড়িকে বোঝাও। প্রতিদিন একই ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগে না। আমি এত প্রেশার নিতে পারছি না। প্লিজ! হেল্প মি আউট!’ একটু থেমে বলল, ‘তা ছাড়া…তুমি তো জানো আমি ফারাকে ভালোবাসি!’
নিশা ছ্যাঁত করে জ্বলে উঠে বলল, ‘জানি…আগেও বলেছেন। বারবার বলতে হবে না। নাকি বলতে খুব ভালো লাগে?’
জাহিদ হেসে ফেলল। কিছুক্ষণ নিশার জ্বলুনিধরা মুখটার দিকে হাসি হাসি চোখে চেয়ে থেকে ধীর গলায় বলল, ‘তুমি কখনো কাউকে ভালবেসেছ নিশা?’
—‘না!’ সোজাসাপ্টা উত্তর দিয়ে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল নিশা।
— ‘যেদিন বাসবে সেদিন নিশ্চয়ই বুঝবে ভালোবাসার কথা লোকে বারবার কেন বলে।
বুকের জ্বালাটা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। খানিক বাদেই বুঝতে পারল নিশা, যে এই জ্বালারই অপর নাম ঈর্ষা। ফারাকে তার এই মুহূর্তে ঈর্ষা হচ্ছে। ভয়ংকর ঈর্ষা!
—‘আপনি যান এখান থেকে।’ বলল নিশা মুখ ঝামটা মেরে।
—‘যাচ্ছি। তুমি কিন্তু তোমার শ্বশুর-শাশুড়িকে বোঝাবে। ভরসা করলাম তোমার ওপর।’
—‘বুঝিয়ে বলব উনাদের। চিন্তা করবেন না।’
দু মাস কেটে গেল। ফারা টেক্সাস গেছে বাবার বাড়িতে। থাকবে কিছুদিন। বাবা অসুস্থ। বাধ্য হয়েই থাকতে হচ্ছে। শাশুড়ি নিশাকে বললেন, বৌমা এটাই সময়। বরকে নিজের দিকে টানো। ওই ডাকিনীর কালো জাদু থেকে মুক্ত করো আমার ছেলেকে। নিশা গ্রাহ্য করল না বিষয়টা। ফারার নামে যতই বদনাম করুক ইনারা, তার ছেলে তো ফারা বলতে অজ্ঞান। তা ছাড়া জাহিদকে সে এই একটা কারণে মন থেকে সম্মান করে। কারণ লোকটা আর যাই হোক না কেন, দুশ্চরিত্র অথবা প্রতারক নয়। শাশুড়ির কথায় বিশেষ আমল না করলেও নিশা একটা কাজ করল। নিজে না খেয়ে, খাবার নিয়ে অপেক্ষা করা শুরু করল জাহিদের জন্য। প্রথম দুদিন বিরক্ত হয়েছে জাহিদ। খাবার ছুঁয়ে দেখেনি। কাঠকাঠ গলায় বলেছে, ‘খেয়ে এসেছি। খাবো না।’
তৃতীয় দিন অধৈর্য হয়ে বলল, ‘কেন করছ এসব?’
নিশা ধীরস্বরে উত্তর দিয়েছিল, ‘আপনি রোজ একলা একলা ডিনার করেন। আমার দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগে না।’ জাহিদ স্তম্ভিত চোখে তাকিয়ে ছিল নিশার দিকে। কিছু বলেনি। খানিক বাদে হাত-মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসল। কিন্তু জানতে চাইল না ঘুণাক্ষরেও, নিশা খেয়েছে কি না। যন্ত্রের মতো গপাগপ খাবার খেয়ে হাত ধুয়ে শুতে চলে গেল। নিশা বসে ছিল ওর সামনেই। অভুক্ত পেটে। খেতে ইচ্ছে করেনি। কেউ খেতে বলেনি তাই!
পরদিন রাতে একটু তাড়াতাড়িই ফিরে এলো জাহিদ। সেদিন সন্ধ্যে থেকে ঝুম বৃষ্টি। জানালাটা হাট করে খোলা। সারা ঘরে পাগল হাওয়ার মাতামাতি। নিশা জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। বৃষ্টির ছাঁট ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। বুনো ফুলের উগ্র ঘ্রাণে ভরে আছে বাতাস। এমন সময় দড়াম শব্দ করে ঘরের দরজাটা খুলে গেল। জাহিদ হনহন করে ভেতরে ঢুকে বলল, ‘নিশা, এ তোমার ভীষণ অন্যায়। মা বলল, তুমি নাকি নিজে না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা কর? এসবের মানে কী?’
নিশা উত্তর খুঁজে পেল না। মেঘাচ্ছন্ন চোখে চেয়ে রইল শুধু। এসবের মানে কী? সত্যিই তো এসবের মানে কী? বুকের ভেতর প্রশ্নটা দুলে দুলে, ফুলে ফুলে বিশালাকৃতির ঢেউ হয়ে উঠল। আকাশচুম্বী সেই ঢেউ নিশার চেতনরাজ্যে ছড়িয়ে দিল ধোঁয়াশা। আবছা, অলীক আর অস্পষ্ট হয়ে উঠল চারধার। ঘরে কোন আলো জ্বলছে না। ফাঁকা দরজা দিয়ে হলওয়ে থেকে একটা চৌক আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। সেই একটুখানি আশ্চর্য আলোয় ওরা দুজনে পরস্পরের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইল নির্বাক। বাইরে বৃষ্টির একটানা ঝমঝম শব্দ। দুর্দান্ত হাওয়ায় নিশার খোলা চুল উড়ছে। জানালায় ঝুলে থাকা পর্দায় শাড়ির আঁচলের মতো ঢেউ ভাঙছে হাওয়া। চশমার পেছনের শান্ত দৃষ্টিটা নিশার নরম সুন্দর মুখে টর্চলাইটের মতো বিঁধে বিধে বুকের একদম তলানিতে গিয়ে ধাক্কা দিল। সে স্বপ্নোত্থিতের মতো ঘুরে দাঁড়াল জানালার দিকে। তার মনে হচ্ছে এটা কোন সাধারণ ক্ষণ নয়। এই ক্ষণ সর্বনাশা! খানিক বাদে টের পেল মানুষটা পায়ে পায়ে এগিয়ে আসছে। ঘাড়ের ওপর উষ্ণ, মসৃণ শ্বাস পড়ল। পারফিউমের সুন্দর একটা ঘ্রাণ এসে লাগল নাকে। পেছন থেকে কোমরের ওপর নেমে এলো দুটি সবল হাত। নিশা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করল। কিন্তু পায়ের নিচ থেকে ক্রমই মাটি সরে যাচ্ছিল। কয়েকটা কঠিন শব্দ জোগাড় করে ওঠার আগেই মানুষটা ভীষণ কাব্যিকভাবে ওর ঘাড়ের চুলগুলো সরিয়ে দিল একপাশে। তারপর চুমু খেলো গ্রীবায়, কানে। অন্যায্য, অযাচিত ভালোলাগার অত্যাচারে বুজে এলো নিশার কণ্ঠস্বর।
এই মিথ্যে ঘোর অবশ্য ভাঙতে বেশি সময় লাগল না। বিছানায় যাওয়ার পর ফারার নামটা কয়েকবার কানে এসে লাগল স্পষ্টভাবে। অপমানের বিষ দাঁত আঁচড় কেটে কেটে রক্তাক্ত করে তুলল হৃদয়। অদ্ভুত অভিমান বুকের পাঁজর পিষে দিল। কষ্ট! অনেক কষ্ট পেয়েছে নিশা তার এই ছোট্ট জীবনে। কিন্তু এমন তীব্রভাবে এর আগে কোন কষ্টই যেন ঘায়েল করেনি তাকে। সকালে নিশা জাহিদকে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘আপনি আর কোনদিন আমাকে ছোঁবেন না!
জাহিদ অপ্রস্তুত হলো, ‘সরি…আসলে…ভুলটা আমারই। ক্ষমা চাই!’ একটু থেমে আবার বলল, ‘কিন্তু তুমি তো আপত্তি করোনি নিশা!’
—‘করিনি। এখন করছি। আপনি আমার ঘরে আসবেন না আর কখনো! মনে থাকে যেন।
জাহিদ কোন উচ্যবাচ্য না করে আদেশটা মেনে নিয়েছিল। জুবিন ওদের জীবনে আসার আগ পর্যন্ত আর একটিবারের জন্যও নিশার ঘরে পা রাখেনি সে।
—‘মিস নিশা! আপনি ঠিক আছেন?’ অর্ণব কখন ড্রাইভিং সিটে এসে বসেছে খেয়াল করেনি নিশা। একটু চমকে উঠে বলল, ‘জি আমি ঠিক আছি!’
—‘একা একা বসে আছেন…ভাবলাম আপনাকে একটু কোম্পানি দিই।’ নিশা ভদ্রতার হাসি হাসল, ‘ধন্যবাদ আপনাকে।’
—‘গান শুনবেন?’
—‘আপনি গান করেন নাকি?’
অর্ণব লজ্জিত গলায় বলল, ‘না না! আমি গান করি না। শুনতে চাইলে অডিও চালাতে পারি।’
—‘ও আচ্ছা। তাই বলুন। হ্যাঁ গান ছাড়ুন। শুনি।’
—‘আপনি কি কোন কারণে আপসেট?’
নিশা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল, ‘না আপসেট নই।’
—‘আপনি চাইলে সামনে এসে বসতে পারেন। আশপাশটা ঘুরে দেখি। বাকিরা তো খুব ব্যস্ত! ‘
নিশা আপত্তি করল না। ড্রাইভারের পাশের সিটে এসে বসল। আনিতা অনতিদূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিল। অর্ণব, নিশার প্রস্থানটা সে আড়চোখে দেখল। হাসল একটা অদ্ভুত হাসি। গাড়ি চলতে শুরু করতেই ঠাণ্ডা বাতাসটা অন্তর শান্ত করে দিল। কিন্তু আনিতার হাসিটা একটু কাঁটা হয়ে লাগল নিশার বুকে। অর্ণব বলল আর সেও অমনি রাজি হয়ে গেল। কী দরকার ছিল ছেলেটার পাশে এসে বসার? আচ্ছা বসলেই বা কী এমন ক্ষতি হলো? জাহিদ তো কখনো আপত্তি করবে না। ওই লোকের তো কিছু এসে যায় না! শাহজিদকে নিয়ে বাড়ির লোকে ফিসফিস করে, লোকটা সবই শুনে চুপচাপ। কখনো তো মুখ ফুটে অসন্তোষ জানায় না!
—‘জায়গাটা আসলেই খুব সুন্দর।’ অর্ণব বলল।
—‘জি…খুব সুন্দর! আমরা বেশিদূর না যাই, কেমন?’
—‘দূরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। পুরো পার্কটায় একবার চক্কর দিই।’ অর্ণব বলল।
গাড়ির স্পিকারে পুরনো দিনের একটা গান বাজছিল। পুরনো গান, নতুন করে গাওয়া।
ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর
ভরা বাদর…
ভরা বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর
—বিদ্যাপতি
ঢালু রাস্তার দুধারে উঁচুনিচু উপত্যকার নয়নাভিরাম পটভূমি। সারা পাহাড়ে এখন অলৌকিক এক স্বর্ণালি রোদের ছটা। বাতাসে গুঁড়ি গুঁড়ি মেঘ উড়ে এসে লাগছে মুখে। বৃষ্টিটা বুঝি নামবে এবার। নিশা ঝুম চোখে চেয়ে ছিল বাইরে। হঠাৎ কেমন অন্যরকম গলায় বলল, ‘আপনি এই পঙ্ক্তিগুলোর অর্থ জানেন অর্ণব সাহেব?’
অর্ণব মাথা নেড়ে বলল, ‘একটু একটু। আমি অতটা সংস্কৃতিমনা নই। গানটান ভালো বুঝি না।’
নিশা ঘোর-লাগা গলায় বলল, ‘ভরা বর্ষাকাল। বর্ষার অথৈ পানিতে পথ- ঘাট, নদী-নালা, খাল-বিল সর্বত্রই ভরে গেছে। পুকুরগুলো পানিতে টইটুম্বুর। ব্যাঙ ডাকে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ। এ সময় একলা ঘরে বসে আছে নববধূ। বসে বসে ভাবছে স্বামীর কথা। স্বামীহীন এক নারীর বিরহগাঁথা অঙ্কন করেছেন কবি এ কবিতায়। চারিদিকে উথালপাতাল বর্ষা, কিন্তু সেই মেয়েটির মনমন্দির শূন্যতায় খাঁখাঁ করছে। এমন বর্ষা কেন আসে মানুষের জীবনে?’
বলতে বলতে নিশার চোখে বাষ্পরাশি জমে উঠছিল। কণ্ঠস্বর কাঁপছিল হালকা।
মুগ্ধতার ঝাপটা এসে ভিজিয়ে দিল অর্ণবকে। তার মনে হলো এ কোন সাধারণ মানবী নয়। এই মানবী স্বর্গীয়! এক ফোঁটা রুপালি চোখের জল নিশার মোমে মাজা গালের ওপর এসে পড়তেই অর্ণবের মন কেমন করে উঠল। এই মেয়েটির কী কষ্ট সে জানে না! কিন্তু কেন যেন তার খুব ইচ্ছে হলো কোন এক জাদুমন্ত্র দিয়ে মেয়েটির সমস্ত দুঃখ-কষ্ট মুছে দিতে। পারবে কি অর্ণব? ইশ! যদি পারত!
মন কেমনের দিনগুলো
স্টেলাকেই দেখছিল ওরা। মেয়েটির সাদা শরীরে গাঢ় লাল ব্লাউজটা মোমবাতির কাঁপতে থাকা তিরিতিরে আগুনের মতো চমকাচ্ছে। চোয়াল ভাঙাচোরা হলেও অদ্ভুত চাঁছাছোলা এক শ্রী আছে ওই মুখে। তুরিনকে পাশ কাটিয়ে শাহজিদের সামনে এসে দাঁড়াল স্টেলা।
—‘ক্যান আই বরো ইওর লাইটার ফর আ সেকেন্ড?’
শাহজিদের মনে পড়ল ওর কোলের ওপর সিগারেটের বাক্স এবং লাইটার রাখা আছে। ওগুলোর দিকে একবার চোখ নামিয়েই সে ভদ্র গলায় ছোট করে বলল, ‘শিওর।’ মাটিতে লেপ্টে বসে থাকা অবস্থা থেকে ক্রাচের সাহায্য নিয়ে উঠে দাঁড়ানো তার জন্য কম কসরতের বিষয় নয়। সময় সাপেক্ষও বটে। তাই উঠে দাঁড়াবার বৃথা চেষ্টা না করে হাতে ধরা লাইটারটা সামনে এগিয়ে দিল। স্টেলা লাল লিপস্টিক মাখা পিচ্ছিল ঠোঁটে আলতোভাবে একটা সিগারেট চেপে ধরল। মাথাটা ঝুঁকিয়ে আনল নিচে। ধবল বুকের সন্ধিরেখা মরীচিকার মতো চোখ-ধাঁধানো ঝিলিক দিল। শাহজিদের মুখে উত্তাপের একটা অনভিপ্রেত হলকা এসে লাগল লাইটারের আগুন জ্বলার আগেই। আর ঠিক সেই মুহূর্তে স্টেলার পেছনে ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা তুরিনের ওপর নজর পড়ল। সিগারেটে আগুন তখনো ধরেনি। ঘটনা ঘটল খুব দ্রুত। তুরিন স্টেলার কনুই খামচে ধরেছে। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে দূরে। চিৎকার করে গালমন্দ করছে। দৃশ্যটা শাহজিদ বিবশ বিধ্বস্ত চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগল। কিছু বলার মতো, করার মতো শক্তি বা উদ্যম খুঁজে পেল না। আশপাশের মানুষজন ছুটে এসেছে বিরোধ নিষ্পত্তির উদ্দেশ্যে। বিবাদ মিটে যাওয়ার পর তুরিন আগুন মুখে ফিরে এসেছে।
শাহজিদ বিস্ময়ের ঢোকটা তখনো পুরোপুরি গিলতে পারেনি। অনেক কষ্টে কয়েকটা শব্দ পরপর বসিয়ে একটা বাক্য সাজাতে পারল,
—‘আপনার কী হয়েছে?’
তুরিন হুংকার ছেড়ে বলল, ‘আমার আবার কী হবে?’
শাহজিদ তীব্র চোখে তুরিনের রাগ-ঝলসানো মুখের দিকে চেয়ে কিছু একটা পড়ার চেষ্টা করে বলল, ‘যার-তার সঙ্গে ঝগড়া করছেন, যাকে পাচ্ছেন গালি দিচ্ছেন, সমস্যা কী?’
—‘আমি ঝগড়া করছি?’ ফুঁসে উঠল তুরিন।
—‘তা নয়তো কী?’
—‘বেশ! আমি ঝগড়া করছি কারণ আমি ঝগড়াটে। উত্তর পেয়েছেন? খুশি এখন?’
শাহজিদ একটু নিচু গলায় বলল, ‘আগে তো এমন ছিলেন না আপনি। এত পাল্টালেন কী করে?’
তুরিন কয়েক পা এগিয়ে এলো, ‘আচ্ছা? কেমন ছিলাম আগে? শুনি?’
শাহজিদ এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘অনেক কিউট, বাচ্চা খরগোশের মতো কিউট!’
তুরিন একটু থমকায়। গলার তেজ কমে আসে। আস্তে করে বলে,
—‘আর এখন? এখন কী রকম মনে হয় তোমার আমাকে?’ নিজের অজান্তেই আপনি থেকে তুমিতে সরে আসে তুরিন।
—‘এখন মনে হয় যেন তোমাকে আমি চিনি না!’
এলোমেলো বাতাসে শাহজিদের কান পর্যন্ত গড়ানো ঈষৎ লালচে চুলগুলো উড়ছিল। মেঘ ছুঁইছুঁই রোদ খেলছিল মুখে। সেদিকে আবছাভাবে চেয়ে তুরিন আবছা গলায় বলল, ‘কেউ কখনো এমনি এমনি পাল্টে যায় না। পাল্টানোর পেছনে কারণ থাকে।’
—‘কারণটা জানতে চাই।’ দৃঢ় শোনাল শাহজিদের গলা। তুরিন কয়েক পা এগিয়ে এসে শাহজিদের পাশে বসল। ক্ষুরধার গলায় বলল, ‘অ্যাঞ্জেলিনার সঙ্গে তোমার প্রেম ছিল। এ কথাটা আগে কখনো বলোনি কেন?’
—‘বলার মতো কোন ঘটনা নাকি?’ শাহজিদ অবাক।
—‘নয়?’
কাঁধ ঝাঁকায় শাহজিদ, ‘তেমন সিরিয়াস কিছু ছিল না। ঘটা করে বলার মতো ব্যাপার না। কম্লিকেটেড ছিল।’
—‘তাই?’
—‘হ্যাঁ তাই।’
—‘তাহলে ওকে কিস করেছিলে কেন?’ বোকা বোকা প্রশ্ন করে তুরিন। বিস্ময় ঝিলিক মারে শাহজিদের চোখে। হেসে ফেলে,
—‘তাতে কী এসে যায়?’
—‘কিছু এসে যায় না?’
—‘না…মানে…ও আমার গার্লফ্রেন্ড ছিল…’
—‘এইমাত্র বললে তুমি শিওর ছিলে না।’
—‘ঠিকই বলেছি…কোনটাই মিথ্যে নয়…কিন্তু এসব কেন জানতে চাইছ? এতদিন পর?’
তুরিন একটা বড় শ্বাস ছেড়ে দূরের আকাশে চোখ সরিয়ে নেয়। কী যেনভাবে বিষণ্ন মুখে। দুটি হাত পিছমোড়া করে দুষ্টু বাতাসে উড়তে থাকা অবাধ্য চুলগুলো পেঁচিয়ে খোঁপা বাঁধতে থাকে। শিরদাঁড়া টানটান হয়,
পিঠটা যেন ছড়িয়ে যায় আরো অনেকখানি, কোমরের বাঁক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মসৃণ, ঝকঝকে, অনাবৃত কাঁধে আর কণ্ঠাহাড়ে লাফিয়ে পড়ে সূর্যের আলো। সুন্দর দেখায়!
—‘আমি তো কখনো তোমার গার্লফ্রেন্ড ছিলাম না। তাই না?’
শাহজিদের অবাধ্য স্বেচ্ছাচারী চোখজোড়া বন্দি হয়েছিল তুরিনের কণ্ঠাহাড়ের খাঁজের ভেতর। সে কথাটা যেন শুনেও ঠিকমতো শুনল না। বিবশ গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী?’
তুরিন তাকাল, ‘আমি কি তোমার গার্লফ্রেন্ড ছিলাম?’ আবারও একটা বোকা প্রশ্ন।
শুনে শাহজিদ এমন অভিনব ভঙ্গি করল মুখের, যেন এর চেয়ে মজার কৌতুক আর হয় না।
—‘মাথা খারাপ!’
তুরিন চোখ সরিয়ে নিল, ‘তাহলে আমি তোমার কে ছিলাম?’
শাহজিদ সহজ গলায় বলল, ‘বন্ধু ছিলে। এমন একজন বন্ধু যাকে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃসময়ে খুব বেশি রকমের প্রয়োজন ছিল।’
—‘আমাকে তোমার প্রয়োজন ছিল?’ যাচাই করার ঢঙে প্রশ্ন করে তুরিন।
—‘ভীষণ প্রয়োজন ছিল।’
—‘কিন্তু কেন শাহজিদ? অ্যাঞ্জেলিনা তো তোমার পাশে ছিল।’
—‘ছিল একরকম। অস্বীকার করব না।’
তুরিনের কণ্ঠে বিষাদ বেজে ওঠে ঝনঝন করে, ‘যখন তুমি অ্যাঞ্জেলিনায় মত্ত হয়ে ছিলে, সেই সময়…সেই সময় আমার জীবনে কী ঘটেছিল জানো শাহজিদ? আমার বাবা…যে বাবা আমার সবাচাইতে প্রিয়…সবচাইতে বেশি ভরসার…সেই বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করে বাড়িতে একটা অচেনা মেয়ে নিয়ে এসেছিল। আর তুমি…তুমি তখন আমার পাশে না দাঁড়িয়ে আমার বাবার সেই দ্বিতীয় স্ত্রীর দিকেই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলে। সন্ধি করলে আমার শত্রুর সঙ্গে। চমৎকার!’
ভীষণ জটিল একটা সমীকরণ যেন সমাধান করতে দেয়া হয়েছে শাহজিদকে। যে সমীকরণের আগামাথা কিছুই বোঝা যায় না। ধাঁধা লাগা চোখে তব্দা মেরে চেয়ে রইল সে তুরিনের দিকে। অগাধ বিস্ময়ে হাবুডুবু খেতে খেতে বলল, ‘কী বলছো এসব? নিশা তোমার শত্রু হবে কেন? ও ভীষণ ভালো একটা মেয়ে। এত ভালো মেয়ে কারো শত্রু হতে পারে না।’
তুরিনের চোখে রক্ত চড়ে যায় অতর্কিতে।
—‘তাই? খুব ভালো মেয়ে?’
শাহজিদ তুরিনের রাগটা প্রত্যক্ষ করল। গম্ভীরভাবে বলল, ‘কথায় কথায় রেগে যাও কেন?’
—‘রাগব না তো কী করব শাহজিদ? যে মহিলা আমার পরিবারটাকে নষ্ট করে দিয়েছে, আমার বন্ধু হয়ে, আমারই সামনে বসে তুমি সেই মহিলার গুণগান গাইছ। বিশ্বাস হচ্ছে না!’
—‘তুরিন শোন, আমি জানি তোমার বাবার সেকেন্ড ম্যারেজ তোমার জন্য একটা বিশাল শক। কিন্তু নিশার এতে কোন দোষ নেই!’
—‘তাই?’
—‘হ্যাঁ তাই তো! তুমি চিন্তা করে দ্যাখো পুরো ঘটনাটায় একমাত্র ভিক্টিম কিন্তু সে। তোমরা নও।’
—‘আমি ভিক্টিম নই? দিনকে দিন আমার বাবা-মায়ের মধ্যে কীভাবে ডিস্টেন্স ক্রিয়েট হচ্ছে তুমি জানো? আমার ওপর দিয়ে কী যায় সেটা কখনো ভেবে দেখেছ? আমার বাবা…যে কি না আমাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। আমাকে সব চাইতে বেশি ভালোবাসত, সে এখন সারাক্ষণ ওই মহিলার বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।’
—‘বাচ্চাটা উনারও। নিশার একার না। এটা ভুলে যাচ্ছ কেন?’
—‘ওই বাচ্চা আর ওই বাচ্চার মা আমাদের কেউ না। তোমার বন্ধু হতে পারে। তোমার প্রেমিকা হতে পারে…’
—‘কী যা তা বলছো!’ শাহজিদের গলা উঁচুতে উঠল। লোহার মতো শক্ত হয়ে বলল, ‘বাজে বোক না।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘নিশা আমার বোনের মতো। তা ছাড়া ও তোমার বাবার স্ত্রী। কথা বলার আগে একটু ভেবে দেখো কী বলছো।’
—‘ও আমার বাবার কিছুই না। বাজে মেয়ে একটা!’
—‘এভাবে বোলো না তুরিন। এতটা নিষ্ঠুরতা তোমাকে মানায় না।’
—‘খুব দরদ তোমার ওর জন্য তাই না? দুনিয়ার সবার জন্যই দরদ উথলে ওঠে তোমার। শুধু আমার জন্যই কিছু নাই! ‘
শাহজিদ হতাশভাবে বলল, ‘গত তিনটা বছর তুমি আমাকে কম জ্বালাওনি। এখনো জ্বালাচ্ছ। এমন কর কেন সব সময়?’
—‘গত তিন বছর আমি তোমার ধারে-কাছেই যাইনি। জ্বালালাম কীভাবে?’ শাহজিদ ঘোলা চোখে চেয়ে থাকে, ঘোলা গলায় বলে, ‘তুমি আমাকে কীভাবে জ্বালাও সেটা একটা রহস্য!’
হঠাৎ আনিতাকে দেখা যায়। কাছাকাছি এসে তুরিনের দিকে সেলফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘চাচিমার ফোন। কথা বলতে চায়।’
ফোনটা লাউড স্পিকারে ছিল। তুরিন হ্যালো বলতেই ফারা ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ স্বরে বলে উঠল, ‘কী করছ?’
তুরিন একটু অপ্রস্তুত বোধ করে, ‘আমি…কিছু করছি না…তেমন কিছু করছি না।’
—‘অর্ণব কোথায়?’
অর্ণবের কথা ভুলেই গিয়েছিল তুরিন। আমতা আমতা করে বলল, ‘আছে।’
ফারা গলায় বিষ উগড়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি ওই ল্যাংড়া খোঁড়া ছেলেটার সঙ্গে বসে বসে কী করছ শুনি?’
তুরিন চট করে লাউডস্পিকারটা অফ করে দিল। উঠে দাঁড়াল বসা থেকে। ফোন কানে নিয়ে সরে গেল একটু দূরে। ফারার মন্তব্যটা শুনতে পেয়েছে শাহজিদ। তেমন গায়ে মাখেনি। এসব সয়ে গেছে এখন। অনেকটা সময় একটানা বসে থাকায় পায়ে ঝিঁঝি ধরে গিয়েছিল। পাশে রাখা ক্রাচদুটো কাছে টেনে নিল এবার। উঠে দাঁড়াবার জন্য উদ্যত হতেই আনিতা এগিয়ে এসে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল। শাহজিদ আনিতার হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। সৌজন্যসূচক হাসি হাসল, ‘থ্যাংকস ফর ইওর হেল্প।’
—‘কাল সন্ধ্যায় কী করছ তুমি?’ আনিতার আচমকা নির্ভীক প্রশ্ন।
একটু অবাক গলায় শাহজিদ বলল, ‘কাল সন্ধ্যায়? কোন প্ল্যান নেই তো!’ আনিতা চোরা চোখে দেখল একবার তুরিনকে। তুরিন ফোনে কথা বলতে বলতে এদিকেই চেয়ে আছে।
—‘আমার সঙ্গে ডিনার করবে?’ দ্বিধাহীন প্রস্তাব রাখল আনিতা।
শাহজিদের চোখে একটু কৌতুক খেলে গেল। ডান মাড়িতে জিব ঠেকিয়ে কী যেন ভাবল সে কয়েক সেকেন্ড। সরু হয়ে এলো চোখের দৃষ্টি। দুরন্ত হেসে বলল, ‘আর ইউ আস্কিং মি আউট অন অ্যা ডেট?’
আনিতা স্মার্ট হাসে, স্মার্ট গলায় বলে, ‘কাইন্ড অফ!’
—‘ওয়াও!’ স্বগতোক্তির মতো শব্দটা উচ্চারণ করে শাহজিদ। তারপর একটু আমতা আমতা করে বলে,
—‘সাউন্ডস ফান!’
তুরিন ফোনে কথা বলা শেষ করে ফিরে এসেছে। ওর চোখে প্রশ্ন। তাকানোর ভঙ্গি দেখে বোঝা যাচ্ছে শাহজিদ আর আনিতার মধ্যকার কথোপকথনের সারমর্ম জানতে চায় সে। আনিতা নিজের সেলফোনটা তুরিনের হাত থেকে তুলে নিয়ে শাহজিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওকে দেন…সি ইউ টুমরো।’ কথাটা বলেই আর দাঁড়াল না সে। তুরিন হতবাক হয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী হবে টুমরো?’
শাহজিদ ফিচেল হাসল, ‘শি অ্যাস্কড মি আউট!’
—‘কী?’ তুরিনের চোখে রক্ত চলকে উঠল আবারও।
—‘হুম।’ আনিতার চলে যাওয়া পথটার দিকে তাকিয়ে থেকে অন্যমনস্ক শাহজিদ বলল।
—‘তুমি কী উত্তর দিয়েছ?’ ঝাঁঝ বেরোচ্ছিল তুরিনের গলা থেকে।
—‘রাজি না হওয়ার তো কোন কারণ নেই!’
—‘ও আচ্ছা! নাচতে নাচতে রাজি হয়ে গেলা?’
—‘সুন্দর একটা মেয়ে ডেটে যেতে চায়। কোন গাধার বাচ্চা রাজি হবে না শুনি?’
রাগে কান গরম হয়ে উঠল তুরিনের। মাথার ভেতর যেন হাজার হাজার ঝিঁঝি পোকা ডেকে চলেছে। একটু দূরে অর্ণব আর নিশা দাঁড়িয়ে আছে। শাহজিদ ক্রাচে ভর দিয়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল। তুরিন ওর পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে উত্তেজিতভাবে বলল, ‘ওই যে ছেলেটাকে দেখছ? ওকে তোমার কেমন লাগে?’
একটু থমকাল শাহজিদ। ফতুয়া পরা ছিপছিপে গড়নের অর্ণবের দিকে তীব্র চোখে চেয়ে তীব্র গলায় প্রশ্ন করল, ‘কেন জানতে চাইছ?’
—‘দাদাজান ওর সঙ্গে আমার বিয়ে দিতে চায়।’
—‘ভালো তো!’ গলায় উদাসীনতা ফুটিয়ে তোলার বৃথা চেষ্টা করে শাহজিদ।
—‘ভালো?’
—‘হ্যাঁ, ছেলেটা বেশ ভালো। তোমার কেমন লেগেছে?’
তুরিন অর্ণবের দিকে তাকায়। চোখে চোখ পড়ে। একটু হাসার চেষ্টা করে অর্ণব। তুরিনও হাসে। তারপর গলায় আলাদা একটা সুর নিয়ে বলে, “আই থিংক…হি ইজ অ্যাট্রাক্টিভ!’
কথাটা শুনতে ভালো লাগল না শাহজিদের। বুকে কী যেন একটা খচখচ করে উঠল। চুপ করে গেল বিরক্তিতে। তুরিন শাহজিদের মেঘাচ্ছন্ন মুখটা লক্ষ্য করে রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘বিয়ে করে নিয়ে যাবে আমাকে।’
—‘কোথায় নিয়ে যাবে?’ ত্যাড়া গলায় প্রশ্ন করে শাহজিদ।
—‘দূরে।’
শাহজিদ এবার আর কিছু বলে না। ক্রাচে ভর দিয়ে আগাছাওয়ালা উঁচু- নিচু এবড়োখেবড়ো পথটা অনেক কষ্টে পার হওয়ার চেষ্টা করে। বাতাস এখন রুক্ষ। ঘনঘন বজ্রপাত হচ্ছে। বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা সুচের মতো এসে বিঁধছে গায়ে। ভেজা বালির গন্ধে ভরে যাচ্ছে নিঃশ্বাস। একটু আগে তুরিনের বলা ‘দূরে’ শব্দটা মাথার ভেতর বিরক্তিকর মাছির মতো ভনভন করে যাচ্ছে। গত তিন বছর তুরিনের সঙ্গে কথা না হলেও কখনোই সে দূরে ছিল না। মাথার ওপরের ছাদে পায়ের শব্দ হলেই মনে হতো তুরিন বুঝি হাঁটছে। সন্ধ্যায় ডেকের ওপর চুপচাপ বসে বসে তুরিন মোবাইলে গেম খেলে। শাহজিদ টের পায়। ওর সিগারেটের ধোঁয়া উড়ে যায় ওপরে। চাপা রাগের তর্জন-গর্জন ভেসে আসে। প্রায় রাতে হটটাবের উষ্ণ জলে তুরিন গা ডুবিয়ে বসে থাকে। শাহজিদও বসে থাকে ব্যাকইয়ার্ডে। সিগারেট টানে। দুজনে চুপচাপ একে অপরের অস্তিত্ব অনুভব করে। এটাকে কি দূরে থাকা বলে? বলে না! কিন্তু এখন তুরিন বলছে অর্ণব নাকি ওকে বিয়ে করে দূরে নিয়ে যাবে। খুবই সহজ একটা কথা। কিন্তু কেন যেন এই সহজ কথাটাই শাহজিদের বুকের ওপর পাথরের মতো ভার হয়ে চেপে বসেছে। মন খারাপের বাতাসে গুমোট হয়ে উঠেছে ভেতরটা। সবাই চলে যায়…দূরে…বহুদূরে…মা, বাবা, নানিজান…সবাই চলে গেল!
তুরিন জহুরি চোখে তাকায় শাহজিদের দিকে, চোখাভাবে বলে, ‘বিয়েটা করে ফেলব নাকি? কী বলো?’
শাহজিদ একটা বড় শ্বাস গোপন করল, ‘নিশ্চয়ই করবে। আমার মনে হয় অর্ণব ছেলেটা ভালো। তুমি যেন আবার মিসবিহেভ করো না বেচারার সঙ্গে। শেষমেশ ভয়ে পালাবে।’
—‘আমার সম্পর্কে তোমার এই ধারণা?’
—‘কী ধারণা?’
—‘মানে আমাকে ছেলেরা পছন্দ করে না। ভয় পায়?’
—‘নিশ্চয়ই পায়। নইলে তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই কেন?’
তুরিন উত্তেজিত হয়ে বলে, ‘বয়ফ্রেন্ড নেই কারণ আমি কাউকে পাত্তা দেই না। নইলে একশ ছেলে আমাকে ভালোবাসে!’
শাহজিদ হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে হঠাৎ একটা জটিল অংক যেন ফট করে সমাধান হয়ে গেল। তুরিন সবার চেয়ে অন্যরকম কারণ একটা বয়সে এসে কোন মানুষই ওর মতো ইনোসেন্ট থাকে না। মেয়েটা তাই বলে যা ওর মনে আসে। মনের কথাকে রং চং মেখে সভ্য আর সামাজিক করে তুলতে জানে না সে। এই সাদামাটা দিকটাই ওকে অন্য সবার চেয়ে আলাদা করে। লোকে মনে করে ঠোঁটকাটা, বদরাগী। কিন্তু ঠোঁটকাটা স্বভাবের পেছনের ঝকঝকে পরিষ্কার মনটা কেউ দেখার চেষ্টা করে না।
—‘একশ ছেলে?’
—হ্যাঁ।
—‘তাহলে এই অর্ণব বেচারার কী হবে?’
—কী আবার হবে? তুমিই তো বললে বিয়ে করে ফেলতে।’
—‘হুম…করে ফেলো…কিন্তু তাড়াহুড়া কেন? তুমি তো এখনো বাচ্চা খরগোশই আছ। বড় হওনি তো!’
—‘মায়ের খুব তাড়া।’
—‘কেন?’
তুরিন একটা হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়ল –’পরে বলব।’
—‘তুমি ঠিক আছ শাহজিদ?’
নিশা এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল। শাহজিদ চমৎকার হেসে বলল, ‘ঠিক আছি। একদম পার্ফেক্ট।
নিশার চোখে চোখ পড়ল তুরিনের। দুজনেই চোখ সরিয়ে নিল। হালকা একটু অনুতাপের হাওয়া এসে লাগল তুরিনের বুকে। নিশাকে নিয়ে সে হয়তো একটু বেশিই ভেবে ফেলেছিল। এখন লজ্জা করছে। তার মনটা এমন নষ্ট হলো কেন কে জানে! কিন্তু এই আনিতার কী হয়েছে হঠাৎ? এত সাহস হয় কী করে ওর? আচ্ছা, আনিতাকে তো সে দেখে নেবে দশ হাত। কিন্তু মূল সমস্যা অন্য জায়গায়। সমস্যা হলো শাহজিদ তাকে বন্ধুর চেয়ে বেশি কিছু কখনোই ভাবেনি। আজকে সেই সত্যটা আরো একবার খোলামেলাভাবে উঠে এলো। আর এটা ভাবতে গিয়ে তুরিনের আর কিছুই ভালো লাগছে না। ভয়ংকর এক বিষাদ ডোবা বাতাস তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে। ফিরে যাওয়ার সময় গাড়িতে সবাই কেন যেন একটু বিষণ্ণ হয়ে গেল। বদ্ধ গাড়িতে তুরিনের হাঁসফাঁস লাগছিল। এয়ারকন্ডিশন না চালিয়ে জানালার কাচ নামিয়ে দিতে বলল সে। বৃষ্টির ছাঁটে ভরে গেল গাড়ির ভেতরটা।
—‘দ্রুত চালান মিস্টার অর্ণব। আমার স্পিড ভালো লাগে।’ রুদ্ধশ্বাসে বলল তুরিন।
অর্ণব হাসে, ‘টিকিট খাবো তো।’
—‘কিছু হবে না। আশপাশে কপস নেই।’ অভয় দেয় তুরিন। অর্ণব স্পিড বাড়ায়। পাহাড়ি রাস্তায় টাল খেয়ে ছুটতে থাকে গাড়িটা। জানালার বাইরে মাথা বের করে আনে তুরিন। চোখ বুজে বাতাসটা বুক পর্যন্ত শুষে নেয়। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে মুখে। শনশন হাওয়া ওর চুলের খোঁপা খুলে দেয়। উপত্যকার পাইনগাছের সারিতে যত হাওয়াই লাগুক না কেন ওরা এক বিন্দুও নড়ে না। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে বন্দুকধারী সৈনিকের মতো। মেঘ-ছোঁয়া রোদের উদ্দাম নাচন চলে ওদের ঘিরে। যতদূর চোখ যায় শুধু আকাশ আর আকাশ। তুরিনের হঠাৎ হঠাৎ মনে হয় সে বুঝি আকাশেই ভাসছে। কলোরাডোতে আকাশ এত কাছে! ওরা একরকম আকাশের বুকেই তো থাকে! তুরিন একসময় ম্যাজিক মিররের ভেতর দিয়ে শাহজিদের দিকে তাকায়। হাই চিকবোনে বিদ্যুতের মতো কাঠিন্য চমকাচ্ছে। বিমোহন চোখজোড়ায় থকথক করছে বৈরাগ্য। তুরিনের মনে পড়ে শাহজিদের এক সময় আর্মিতে যোগ দেবার শখ ছিল। আর্মিতে গেলে…ওকে মানাত খুব!
অর্ণব বলছিল, ‘তেলের দাম যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা গরিব লোকেরা দুদিন পর গাড়ি চালাতে পারব কি না সন্দেহ।’
আনিতার চোখ ছিল ফোনের স্ক্রিনে নিবদ্ধ। সে একবার ডান দিকে তাকাল নিশার দিকে। আরেকবার বাঁ দিকে তুরিনের দিকে। দুজনেই নিশ্চুপ, নিথর নিজস্ব চিন্তায় মগ্ন। সামনে বসা শাহজিদও যেন কাষ্ঠপুতুল। অগত্যা আনিতাকেই কথা বলতে হলো, ভদ্রতা রক্ষার্থে।
—‘শুধু তেল কেন? সবকিছুর তো দাম বাড়তি।’
—‘ঠিক বলেছেন। আপনাদের কলোরডো কিন্তু খুব এক্সপেন্সিভ।’
—‘তা তো বটেই। যুদ্ধের কারণে ইনফ্লেশনও হচ্ছে।’
—‘হুম…কিন্তু পুতিন তো বলছে বিশ্বে মূল্যস্ফীতির জন্য ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান দায়ী নয়। পশ্চিমা দেশগুলো নিজেদের ভুল ঢাকতেই এই দায় মস্কোর ঘাড়ে চাপাচ্ছে।’
—‘হ্যাঁ তার ভাষ্যমতে যুদ্ধের আগে থেকেই জ্বালানির দাম বেড়েছে।’
—‘কোভিডের কারণেও অর্থনীতিতে একটা বড়সড়ো ধস নেমেছে। সামনে আরো খারাপ দিন আসছে, বুঝলেন?’
নিশার মাথা ধরেছিল খুব। পিঠ এলিয়ে দিয়েছিল সিটের গায়ে। বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছুতেই রাস্তার ধারের ওয়াক ওয়েতে মানুষটাকে দেখল। গায়ে অফ হোয়াইট স্পোর্টস টি-শার্ট। হাঁটু-ছোঁয়া কালো রঙের শর্টস। পায়ে স্নিকার। টিপটিপ বৃষ্টিটা মাথায় নিয়ে দৌড়চ্ছে। অ্যাথলেটের মতো ঝরঝরে মেদহীন শরীরটা বৃষ্টির ফোঁড় কেটে কেটে ছুটে চলেছে তীরের বেগে। নিশা সোজা হয়ে বসল। গাড়ির গতি এত বেশি যে ক্রমেই মানুষটা পেছনে পড়ে যাচ্ছে। নিশা বাচ্চা মেয়ের মতো জানালার ধার চেপে ধরল দু হাতে। ঘাড় বাঁকিয়ে দেখতে থাকল ফেলে আসা দৃশ্যপট।
আনিতা হঠাৎ বলে উঠল, ‘আরে চাচ্চু না?…হ্যাঁ চাচ্চুই তো।’
অর্ণব মুখ ঘুরিয়ে দেখে একবার। হালকাভাবে বলে, ‘আঙ্কেল কিন্তু এখনো ফিট। অনেক হ্যান্ডসাম।’
আনিতা হাসে, ‘এখনো শব্দটা দ্বারা কী বুঝাতে চাইছেন? হি ইজ স্টিল ইয়াং!’
—‘তা ঠিক। আপনার বয়সি মহিলার চাচা বললে কেউ বিশ্বাস করবে না।’
—‘আমি মহিলা?’
অর্ণব বাঁকা চোখে পেছন দিকে চায় একবার, ‘মহিলা নন? পুরুষ বলা উচিত ছিল?’
আনিতা ভাবলেশহীন গলায় বলল—‘আপনার কৌতুকটা ঠিক কৌতুকের মতো শোনাচ্ছে না। তাই হাসতে পারলাম না। সরি।’
—‘কী বললেন? কৌতুকটা যৌতুকের মতো লাগছে?’ আনিতা রাগতে গিয়ে হেসে ফেলল।
বাড়ি ফিরে দেখা গেল শ্বশুরমশাই বাজার করে এনেছেন। লিভিং রুমে বাজারের ব্যাগগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। নিশা ফিরে এসে জুবিনের খোঁজ নিল প্রথমে। দাদির কোলে বহাল তবিয়তে ঘুমাচ্ছে জুবিন রাণী। মেয়েকে দেখে এসে নিশ্চিন্ত মনে কোমরে আঁচল বেঁধে কাজে লেগে গেল নিশা। কার্পেটের ওপর অবিন্যস্তভাবে পড়ে থাকা বাজার-সদাই বয়ে নিয়ে যেতে লাগল কিচেনে। অগোছালো থাকতে তার মোটেই ভালো লাগে না। ঘরের জিনিস টুকটুক করে গুছিয়ে ফেলার মধ্যে নিজের অশান্ত মনকে শান্ত করার আনন্দ পায়। মনে হয় সংসার নয়, নিজের আত্মাটাকেই সাজাচ্ছে। জাহিদ ফিরল কাকভেজা হয়ে। মাথার ছোট ছোট চুলে, চশমার ফ্রেমে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি নিয়ে। নিশা দু হাত ভর্তি প্যাকেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল। জাহিদকে দেখতে পেয়ে একটু থামল ক্ষণিকের জন্য। তারপর দ্রুত সরে গেল জায়গাটা থেকে।
জাহিদ টুলে বসে জুতোর ফিতে খুলছিল। অবনত চোখের সামনে একটি ছায়া প্রত্যক্ষ করল। নিশা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে তোয়ালে। চোখাচোখি হয়। নিশার কপালে টিপ, চোখের কার্নিশে কাজল, গালে একটু একটু লজ্জার লাল…একবার তাকালে শুধু তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। জাহিদ ইচ্ছের বিরুদ্ধাচার করে চোখ সরিয়ে নেয়। মনোযোগ দিয়ে জুতোর ফিতে খুলে। নিশা তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে থাকে অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে। দূর থেকে ট্রেন আসার আগে স্টেশনের মাটি যেমন করে কাঁপে, ঠিক তেমন করেই কাঁপতে থাকে বুকের ভেতরটা। জুতো ছাড়া হলে জাহিদ নিশার মুখোমুখি দাঁড়ায় নিঃশব্দে। তোয়ালেটা হাতে তুলে নেয়। নিশার দিকে চেয়ে থাকে খানিকক্ষণ, চোখে চাপা হাসির রেশ নিয়ে। নিশা দূরের ট্রেনের শব্দ পায়…মনের স্টেশনের মাটি কাঁপে! জাহিদ মাথার জবজবে ভেজা চুল তোয়ালে দিয়ে ঝাড়ন দেয়। একগুচ্ছ পানির ছিটা এসে পড়ে নিশার চোখেমুখে। চোখ বন্ধ করে হেসে ফেলে সে। হাসে জাহিদও। রান্নাঘর থেকে হঠাৎ ফারার কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
—‘কতবার বলা হয়েছে বাইরে থেকে জিনিস এলে প্ৰথমে ডিসইনফেকটেন্ট স্প্রে ইউজ করতে হবে। এই মেয়ে কথা পাত্তাই দেয় না!’
নিশা চমকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে এলো। তড়িঘড়ি করে দৌড়ে গেল কিচেনে। ফারা কোমরে হাত দিয়ে রণরঙ্গিণী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। তুরিন আর আনিতা জুসের বোতল নিয়ে বসেছে কিচেন কাউন্টারের টুলে। তানিশাও যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে। নিশার উপস্থিতি টের পেয়ে ফারার গলার স্বর আরো উঁচুতে উঠে গেল।
—‘প্রতিটা জিনিস আলাদা আলাদাভাবে স্প্রে করতে হয়। করোনা কি নতুন এসেছে পৃথিবীতে? এত দিনেও অভ্যাস হয়নি?’
বাচ্চাদের সামনে বেশ অপদস্ত বোধ করল নিশা। অপমানে মুখ ছোট হয়ে গেল। ভুল যে হয়েছে, তা অস্বীকার করে কী করে? সত্যিই তো জিনিসগুলো রান্নাঘরে আনার আগেই জীবাণু মুক্ত করা বাঞ্ছনীয় ছিল। নিশা পড়িমরি করে স্প্রের বোতল নিয়ে এলো ক্যাবিনেট থেকে। ফারা ওর হাত থেকে বোতলটা ছোঁ মেরে তুলে নিল নিজের হাতে। তারপর ডিমের বাক্স, দুধের কনটেইনার, সবজির প্যাকেট, সমস্ত জিনিস আলাদা আলাদাভাবে স্প্রে করতে লাগল। সেই সঙ্গে গজগজ করে বলতে লাগল, ‘অশিক্ষিত গেঁয়ো মানুষজন ঘরে থাকলে এই অবস্থাই হবে। সবাইকে মারবে! কমনসেন্স নেই কোন।’
মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কথা থামিয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। নিশা মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল। অপদস্ত মেঘাচ্ছন্ন মুখে। জাহিদ কাউন্টারে এসে মেয়েদের পাশে একটা টুল টেনে নিয়ে বসল। গ্লাসে জ্যুস ঢালতে ঢালতে শান্ত গলায় বলল, ‘ব্যাগগুলো আমি এনেছিলাম কিচেনে। স্প্রে করতে ভুলে গিয়েছিলাম।’ ফারা থমকাল। থমকাল নিশাও। জাহিদ গম্ভীরভাবে বলল, ‘না জেনে-শুনে কাউকে অ্যাকিউজ করা ঠিক না।’
ফারার তেজি মুখটা ভস করে নিভে গেল। অপমানে কাদা হয়ে বলল, তোমার আক্কেলটা কেমন হ্যাঁ? অশিক্ষিত মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে তুমিও দিন দিন অশিক্ষিত হয়ে যাচ্ছ?’
তুরিন একটা খ্যাক দিয়ে উঠে বলল, ‘উফ মা! চুপ করো তো। সব সময় এসব ভ্যাজর ভ্যাজর ভালো লাগে না!’
নিশা উদ্বেলিত চোখে তাকাল একবার জাহিদের দিকে। জুসের গ্লাসে ঠোঁট ডুবিয়ে জাহিদও শান্ত চোখে দেখল নিশাকে। নিঃশব্দে কী যেন একটা কথা হয়ে গেল চার চোখেতে। কয়েকটা ইতস্তত সেকেন্ড বিনা বাক্য ব্যয়ে পার করার পর নিশা দ্রুত প্রস্থান করল রান্নাঘর থেকে।
তবুও জীবন যাচ্ছে চলে
—‘কী ব্যাপার? তোমরা বাবা-মেয়ে জোট বেঁধে আমাকে অপমান করলে কেন?’
ফারার ঠোঁটজোড়া ছুরির মতো ধারালো হয়ে ওঠে। চোখ থেকে ঠিকরে বেরোয় আগুন।
জাহিদ গলার স্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘কেউ তোমাকে অপমান করেনি। আমি জাস্ট ফ্যাক্ট বলেছি। এখানে মান-অপমানের প্রশ্ন আসছে না।’
আনিতা আর তানিশা এই পারিবারিক কলহ থেকে রেহাই পেতে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। ওরা চলে যাওয়ার পর তুরিন ফারার চোখে চেয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘মাঝেমধ্যে তুমি একটু বেশি বলে ফেলো মা! চুপ থাকলেই কিন্তু এত ঝামেলা হয় না!’
—‘চুপ থাকতে হবে আমার?’
—‘থাকতে পারো। মাঝেমধ্যে।’ জুসের গ্লাসে চুমুক দেয় তুরিন।
ফারা অসহায় রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘তোমার জন্য…শুধু তোমার জন্য আমি সব কিছু সহ্য করে এই বাড়িতে পড়ে আছি। আর তুমি আমাকে লেকচার শোনাচ্ছ? উপদেশ দিচ্ছ?’
তুরিন বন্দুক তাক করার মতো স্পর্ধিত ভঙ্গিতে অগ্নিবৎ দুটি চোখ তাক করল ফারার মুখের ওপর, ‘কেন আমার জন্য এত কিছু সহ্য করছ তুমি? কেন কেয়ার করার অভিনয় করছ? সত্যটা হচ্ছে তোমরা শুধু নিজেদের নিয়েই ভাবো। আমাকে নিয়ে কখনোই ভাবোনি তোমরা।’
জাহিদ মেয়ের পেছনে এসে দাঁড়াল। একটা হাত ওর কাঁধে রেখে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘মায়ের সঙ্গে তর্ক কোর না।’
তুরিন এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দিল, ‘তুমি আমাদের মাঝে এসো না! যাও এখান থেকে।’
কথাটা শেলের মতো বিঁধল জাহিদের বুকে। মনে পড়ল তুরিন ওর সঙ্গে অনেক দিন ধরে স্বাভাবিক স্বরে কথা বলে না। কাছে আসে না। জুবিনের জন্মের পর থেকেই মেয়েটা পাল্টে গেছে।
ফারা মেয়ের কথার সুরে তাল মিলিয়ে যোগ করল, “ঠিকই বলছে ও। আমাদের মা-মেয়ের মাঝে তোমাকে আসতে হবে না। তুমি বরং তোমার নতুন বউ আর নতুন বাচ্চাকে নিয়ে লুতুপুতু করো গিয়ে। সেটাই তোমাকে মানাবে।’
জাহিদ কথাটা গ্রাহ্য না করে তুরিনকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল মা! সময় হবে?’
তুরিন বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। টুলটা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল অনেক দূরে। চড়া গলায় বলল, ‘সরি। আমার সময় নেই…ইচ্ছাও নেই।
বিষাদ আর অপমানের বিভীষণ বাতাস বুকফাটা এক ঝাপটা দিয়ে গেল জাহিদের মনে। শ্রাবণের মেঘ ঘনিয়ে এলো গৌরবর্ণ মুখখানায়। ফারার কথা আজকাল তার আর গায়ে লাগে না। কিন্তু তুরিনের উপেক্ষা আর অবহেলা সহ্য করার শক্তি ফুরিয়ে আসছে দিনকে দিন। ফারা মেয়ের পেছন পেছন ছুটতে লাগল।
—‘অর্ণবের সঙ্গে কথা হয়েছে?
—‘চুপ করো তো!’
—‘চুপ করব কেন? আমার তো ছেলেটাকে ভালোই মনে হচ্ছে।’
সিঁড়ির গোড়ায় পৌঁছে তুরিন ব্রেক কষার মতো ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে পড়ল হঠাৎ। ঘুরে দাঁড়িয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘আমার বিয়ে দিয়ে নিজের রাস্তা ক্লিয়ার করতে চাইছ?’
ফারার মুখে একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভাব ফুটে উঠল। চমকে আশপাশটা দেখে নিল একবার। গলার স্বর কয়েক স্কেল নিচে নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘কী বলছো এসব?’
ঘেন্নায় মুখ বাঁকায় তুরিন, ‘ঠিকই বলছি। সবই বুঝি আমি। বাই দ্য ওয়ে, তোমরা কি এখন পর্যন্ত ওই ছেলেটার সঙ্গে বাবার সেকেন্ড ম্যারেজ নিয়ে কথা বলেছ?’
ফারার গাল চুপসে যায়, ‘বলিনি। বলব…’
—‘দেরি না করে বলে ফেল। আগে এটা জেনে নাও যে ওই ছেলে তোমাদের মতো স্ক্যান্ডালাস ফ্যামিলির সঙ্গে আদৌ কোন রিলেশন করতে চায় কি না।’
কথাটা ছুড়ে দিয়ে আর দাঁড়াল না তুরিন। গটগটিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে লাগল। দোতলার সিঁড়িসংলগ্ন হলওয়েতে মুর্তজা সাহেব দাঁড়িয়ে ছিলেন। ছাই রঙের পাঞ্জাবি-পাজামা তাঁর পরনে। শান্ত মুখ। আতরের খুশবু ম-ম করছে বাতাসে। তিনি নাতনির পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘দাদুভাই তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে। একবার এসো আমার ঘরে।’
—‘তোমাদের কারো সঙ্গেই আমি কোন কথা বলতে চাই না। প্লিজ আমাকে বিরক্ত করো না।’
মুর্তজা সাহেব ব্যথিত স্বরে বললেন, ‘দাদুভাই তোমার বয়স এখনো অল্প। জীবনে কিছু ভুল শোধরাবার জন্য মানুষকে মাঝেমধ্যে উল্টো পথ বেছে নিতে হয়। ধরে নাও আমি সেরকম কিছুই করেছি।’
তুরিন ফুঁসে উঠল, ‘কোনটা ভুল ছিল? আমার বাবা-মায়ের রিলেশন? এটাই বলতে চাও তুমি?’
মুর্তজা সাহেব নাতনির মুখের ওপর অনুকম্পার দৃষ্টি রেখে বললেন, ‘তোমাকে আরেকটু শক্ত হতে হবে দাদুভাই। আরেকটু ম্যাচিওর হতে হবে।’
তুরিন ঘৃণার একটা তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হাঁটা শুরু করল নিজের ঘরের দিকে। মুর্তজা সাহেব সেলফোন হাতে নিয়ে অর্ণবের নম্বরে ডায়াল করলেন। ছেলেটার সঙ্গে কিছু জরুরি আলাপ সেরে নিতে হবে। তুরিনের পাশে এমন কাউকে দরকার যে শক্ত হাতে ওকে সামলাতে পারবে। ওকে বুঝবে, ভালোবাসবে, কেয়ার করবে। ঝড়ের দিনে মাথার ওপর ছাদ হবে।
.
হনহনিয়ে বেডরুমে ঢুকল ফারা। জানালা খোলা হয়নি। এয়ারকন্ডিশন চলছে না। ভেতরটা ভ্যাপসা। ঘরের কোণে রাখা হিউমিডিফায়ারের জলীয় বাষ্প এঁকেবেঁকে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে সিলিং। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলএকজন অন্ধকার মানুষ ঝিম ধরে শুয়ে আছে সোফায়। বহুদিন হলো ওদের শয্যা আলাদা। জাহিদ সোফায় ঘুমোয়।
—‘তুমি যাবে না? তৈরি হওনি যে?’
জাহিদ অলস চোখে তাকাল একবার ফারার দিকে,
—‘কোথায় যাব?’
—‘কোথায় আবার? অনিমেষের ওখানে।’ বিরক্তিতে কাদা হয়ে বলে ফারা।
—‘আমার শরীর ভালো লাগছে না।’
—‘কী হয়েছে?’
—‘মাথা ব্যথা।’
—‘কোভিড-টোভিড বাঁধালে নাকি আবার?’
—‘কী জানি!’ দায়সারা গলায় বলে জাহিদ। আড়চোখে দেখে ফারাকে। টাওয়েল নিয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছে। ওর মুখে ক্ষণিক আগের পারিবারিক কলহর লেশমাত্র নেই এখন। কেমন একটু সুখী সুখী ভাব। ও নিজের সুখ নিজের মতো করে খুঁজে নিতে জানে। সেই খুঁজে নেওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে যেন ওর কোন দোষ নেই, বরং যে এর মাঝে দোষ খুঁজে বেড়াবে, আদতে দোষটা তারই।
দীর্ঘ শরীর, মেদহীন মজবুত গঠন, আর দুঃসাহসিক এক চটকদার স্মার্টনেস দেখেই একসময় ওর প্রেমে পড়েছিল জাহিদ। দিনে দিনে এই দুঃসাহসিক ব্যক্তিত্বের গাঁথুনি অনেকটা হিংস্র ইমারতের মতো বেড়ে উঠেছে ফারার চতুর্দিকে। জাহিদ এখন শুধু ওই শক্ত ইমারতই দেখতে পায়। ভেতরের মানুষটা হারিয়ে গেছে। এই মুহূর্তে ফারা নিশ্চয়ই শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবছে। না শুধু নিজেকে নিয়ে নয়। হয়তো ওর ভাবনায় অনিমেষও আছে। ছিল সব সময়। সেই কলেজ জীবন থেকে…আজ অবধি! এই থাকাটা যে হঠাৎ ঝড়ে উড়ে আসা অস্থায়ী ধূলোর মতো নয়, বরং মাটির অনেক গভীরে ছড়িয়ে থাকা শক্ত শিকড়ের মতো, সেই বাস্তবতাটুকু বুঝে নিতে জাহিদের বড়ই বিলম্ব হয়ে গেল! একটা বড় শ্বাস ফেলে সে চিন্তাগুলোকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল। ক্যাবিনেট খুলে অ্যানটিজেন র্যাপিড টেস্ট কিট বের করল। বেশ কয়েকটা টেস্টিং কিট অনলাইনে অর্ডার করে আনিয়ে রেখেছিল। কী একটা সময় এলো, হালকা জ্বর-জারি হলেই করোনা বলে সন্দেহ হয়। মিনিট পনের সময় লাগল নিরীক্ষণ প্রক্রিয়া শেষ হতে। ফলাফল নেগেটিভ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে একটা আইবুপ্রফেন গিলে নিল পানির সঙ্গে। ততক্ষণে ফারা বেরিয়ে এসেছে গোসল সেরে। পরনে সাদা বাথরোব, মাথায় তোয়ালে। মুখে হালকা হালকা সুখের ছিটা। ও এখন যত্ন করে সাজবে। কার জন্য সাজবে ফারা? অনিমেষের জন্য? নাহ…ও আসলে নিজের জন্যই সাজবে…ভালো…নিজেকে ভালোবাসা নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। যারা এই কঠিন কাজটা করতে পারে, তারা নিঃসন্দেহে ভাগ্যবান।
জাহিদ চোখ বুজে শুয়ে রইল। মাথায় যন্ত্রণা। জ্বর-জ্বর ভাব। মুখ তেতো। বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক হয়নি। চোখ বন্ধ করতেই জুবিনের মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে উঠল চোখের সামনে। কিন্তু জ্বর ভাব নিয়ে ওর কাছে যাওয়া ঠিক হবে না আপাতত। জুবিনের পাশাপাশি আরো একজনের কথা মনে পড়ল। মনে করতে চায় না। তবুও মনে পড়ে। একটা প্রশ্ন জাহিদের গলায় অনেকদিন ধরে মাছের কাঁটার মতো লেগে আছে। নিশা কেন সেদিন চলে যায়নি? এই বন্দি জীবন, অতি অল্প বয়সে সন্তানের মা হওয়া, দিনরাত এমন এক সংসারের জন্য খেটে যাওয়া যেখানে তাকে মানুষ হিসেবে ন্যূনতম সম্মানটুকুও কেউ দিতে চায় না। এমন একটা জীবন কেন বেছে নিয়েছিল মেয়েটা? জাহিদ তো ওকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। এখনো দিতে চায়। বেজমেন্টে যে ছেলেটা থাকে…বাবার পরিচিত…নামটা ঠিক মনে পড়ছে না এই মুহূর্তে। কেউ কেউ বলে ওর সঙ্গে নাকি নিশার অন্যরকম একটা সম্পর্ক আছে। সত্য-মিথ্যা জানে না জাহিদ। তার আত্মসম্মানবোধ সদা জাগ্রত। নিশার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খোলামেলা আলাপ করতে আজও কুণ্ঠা হয়। সত্যি বলতে ছেলেটির সঙ্গে নিশার কোন বিশেষ রকমের বোঝাপড়া থেকে থাকলে জাহিদ একরকম বেঁচে যায়। সে মনে-প্রাণে চায় নিশা ভালো থাকুক, সেসব সুখ খুঁজে পাক, যেসব সুখ তাকে এই পরিবার কখনো দিতে পারেনি, পারবেও না।
জীবনের শুরুতে ফারাকে কথা দিয়েছিল, আজীবন ভালোবাসবে, আজীবন পাশে থাকবে। মানুষ একবার বাঁচে, একবার ভালোবাসে। মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে সে কথাগুলো। ফারাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে নিজের কাছেই নিজে ভীষণভাবে হেরে যাবে! এই হেরে যাওয়ার ভয়েই নিশাকে সজ্ঞানে এড়িয়ে যেতে হয়। কিন্তু জীবনটা সব সময় হিসাব নিকাশ আর পরিকল্পনার ছক মেনে চলে না। বাড়িভর্তি লোকের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ জাহিদ যখন ভীষণ একা হয়ে ওঠে আজকাল, যখন তার শূন্য হৃদয় একটা আশ্রয় খোঁজে ভিখিরির মতো, সেই অসহায় মুহূর্তে নিশার মুখটাই ভেসে ওঠে চোখের সামনে। মাঝেমধ্যে মনে হয় ভালোবাসা জিনিসটা বোধহয় অত প্রস্তুতি নিয়ে হয় না। ফারাকে আজীবন ভালোবাসার শপথ নিয়েছিল যখন…বয়স কতই বা তখন? মাত্র বিশ! অত কাঁচা বয়সে বাবা-মা হওয়ার কথা ভাববারও সাহস পায় না কেউ। কিন্তু ওই বয়সেই জাহিদ পুরো জীবনের পরিকল্পনা এঁটে ফেলেছিল। আজকে এত বছর পর এসে বুঝতে পারে পরিকল্পনা মোতাবেক আর যাই হোক না কেন, মনের বোঝাপড়াটা কখনো হয়ে ওঠে না।
মাথায় এলোমেলো ভাবনা নিয়ে বেরিয়ে এলো বেডরুম থেকে। তুরিনের ঘরের দরজাটা আলতো করে লাগানো ছিল। একবার টোকা দিয়ে বলল, ‘কী করছ মা? আসব ভেতরে?’
—‘প্লিজ! লিভ মি এলোন। ডোন্ট ওয়ানা টক।’
প্রত্যাখ্যাত মন নিয়ে সরে এলো জাহিদ। বহুদিন হয়ে গেল, তুরিন তাকে বাবা বলে ডাকে না। তুরিনের মুখ থেকে একবার বাবা ডাক শোনার জন্য আত্মাটা খাঁচাবন্দি পাখির মতো ডানা ঝাপটে যাচ্ছে অনবরত। ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিশার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল জাহিদ। ভেতর থেকে জুবিনের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। একবার খুব ইচ্ছে হলো ওকে দেখতে। বলতে নেই, নিশাকেও এই মুহূর্তে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। প্ৰথম প্ৰথম মেয়েটির দিকে ফিরেও তাকাত না। দুর্দান্ত রূপবতী মেয়ে। ওই মুখের দিকে তাকাতে রীতিমতো ভয় হতো। কিন্তু ক্রমেই বুঝতে পারল শুধু রূপ নয়, মেয়েটির মধ্যে আরো কিছু আছে। এমন কিছু যা অন্য অনেকের মধ্যেই নেই। রূপমুগ্ধতা বেশিদিন টেকে না। টিকে যায় মনের নির্যাসটুকু। নিশাকে…..নিশার মতো ভালো মনের একটা মেয়েকে ভালো না লাগানোর জন্য যত রকম কৌশলের প্রয়োজন ছিল তার সবটাই প্রয়োগ করেছিল নিজের ওপর। তুরিনের ঘরটা হলওয়ের শেষ মাথায়। হঠাৎ দরজা খুলে বেরিয়ে বাবাকে নিশার ঘরে দেখতে পেলে হয়তো মেয়েটা কষ্ট পাবে। কথাটা মনে হতেই জাহিদ নিঃশব্দে সরে এলো। নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়ল সোফায়।
.
বাইরে এখন বৃষ্টির রেশ কাটানো রুপালি রোদ। ঝিরঝির হাওয়া দিচ্ছে চকচকে মেঘমেদুর আকাশ। ফারা বেগুনি সিল্ক শাড়ির আঁচল সামলে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে নামিয়ে দিল জানালার কাচ। চাকা ঘুরতে না ঘুরতেই রুপো রঙের রূপবান দুপুরটা ওকে আলিঙ্গন করল দূর পরবাসী প্রেমিকের মতো। গাড়ির অডিওতে চালু করে দিল ব্লুজ মিউজিক। গাড়ি চালানোর সময়টাই ওর ‘মি টাইম’। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে সাপের মতো মসৃণ আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলতে চলতে নিজেকে নিজের সময় দিতে ওর দারুণ লাগে। জীবনে অনেক ঠেকে শিখেছে ফারা, সুখ জিনিসটা এমনই দুর্লভ যে, কেড়ে নিতে না জানলে ওই হতচ্ছাড়া কারো কাছে আত্মসমর্পণ করে না, ধরা দেয় না। চাওয়া-পাওয়ায় কোন সংকোচ নেই ফারার, ভয়ও নেই। জাহিদের মতো কর্তব্যবোধে চালিত, বিবেকের চোখ রাঙানিতে হরহামেশা গুটিয়ে থাকা মানুষেরা জানে না জীবনটাকে কী করে উপভোগ করতে হয় বিবেকের শাসনকে পাশ কাটিয়ে।
নিতান্তই অল্প বয়সে প্রেমটা হয়ে গিয়েছিল। জাহিদ চুপচাপ, ভালো ছাত্র গোছের ছেলে। কাউকে খুব একটা পাত্তা-টাত্তা দেয় না। তেমন বাকপটু নয়। নিজের মতো থাকে। বান্ধবীর সঙ্গে বাজি ধরে ওকে পটাতে গিয়েছিল ফারা। প্রথম কয়েকদিন গ্রাহ্য করল না জাহিদ। খোঁজ নিয়ে জানা গেল জাহিদের ফুটবলে প্রবল আগ্রহ। নিয়মিত খেলাধুলা করে। ফারা প্রতিটা ম্যাচে সশরীরে উপস্থিত থাকতে লাগল। খেলাধুলার আলাপ দিয়েই শুরু হলো বন্ধুত্ব। প্রেমটাও জমে গেল একসময়। জাহিদের মাধ্যমেই অনিমেষের সঙ্গে পরিচয়। অনিমেষ সাহা…গাঢ় গাত্রবর্ণের পোষ-না-মানা ধাঁচের দুর্ধর্ষ পুরুষ। সংকোচহীন, প্রত্যুৎপন্নমতি, সপ্রতিভ এবং রসিক। জাহিদকে পড়ে ফেলা যতটা সহজ, অনিমেষের দুর্বোধ্য ব্যক্তিত্ব ঠাওরে ওঠা তার চাইতে অনেক অনেক কঠিন। গৃহপালিত আস্থাবান নিরীহ প্রাণীর চেয়ে গহিন অরণ্যের বুনো, বর্বর, হিংস্র সিংহই ফারাকে বেশি টানল। তাই সহজলভ্য জাহিদ নয়, বরং দুর্ধর্ষ চরিত্রের অনিমেষের দিকেই দ্রুত ঝুঁকতে লাগল সে। কিন্তু বাড়ির লোকজনের জাহিদকে পছন্দ ছিল। সুদর্শন, ভালো ছাত্র এবং মুসলিম পরিবারের ছেলে। কলেজ শেষ হওয়ার আগেই মা একদিন জানিয়ে দিল, জাহিদ ছেলেটার সঙ্গে তোর যদি প্রেম থাকে বলতে পারিস। কিন্তু সাদা চামড়ার কারো দিকে ভুলেও তাকাবি না। মনে থাকে যেন। অনিমেষ সাদা চামড়ার না হয়েও বিয়ের যোগ্যতার মাপকাঠিতে পিছিয়ে আছে। ধর্মের ফারাকটাই এখানে মুখ্য বাধা।
একদিন জাহিদের অনুপস্থিতিতে দেখা করল ওরা। খোলামেলা কথা বলে জানা গেল আকর্ষণ এক তরফা নয়। দুদিক থেকেই প্রবল। অতএব মেলামেশা থেমে থাকল না। দুর্ঘটনাবশত তুরিন পেটে চলে এলো…নাহ ফারার জীবনে তুরিন ছাড়া আপাতত অন্য কোন দুশ্চিন্তা নেই। এমনকি নিশাকেও বিন্দুমাত্র পাত্তা দেয় না সে। তবে নিশা অসহ্য একটা মেয়ে। ফারার পায়ের নখের সমান যোগ্যতাও তার নেই। জাহিদকে চাইলেই টেনেহিঁচড়ে বাড়ি থেকে বের করে আনতে পারবে ফারা। নিশার মতো লো ক্লাস মেয়ে জাহিদকে বেঁধে রাখতে পারবে না কিছুতেই। এখনো জাহিদ ফারা’র রূপগুণ মুগ্ধ একনিষ্ঠ ভক্ত। এত বছর হয়ে গেল। কই নিশা তো পারল না জাহিদকে কব্জা করতে। পারবেও না। শ্বশুরমশাই ভেবেছে গ্রাম্য একটা অশিক্ষিত মেয়ে ধরে এনে পুত্রের গলায় বেঁধে দিলেই হলো…সব সমস্যার সমাধান! বোকা, মাথামোটা, বৃদ্ধ লোকটা জানে না ফারার ইন্দ্রজাল তার পুত্রের জীবনে গাছের শিকড়ের চাইতেও মজবুতভাবে বিস্তৃত হয়ে আছে। ফারা দড়ি ছেড়ে দিয়েছে দূরে, কিন্তু রাশ টেনে ধরে আছে শক্ত করে। জাহিদ কিংবা অনিমেষ এদের কারো পক্ষেই এই রাশ ছেঁড়া সম্ভব নয়। কিন্তু মেয়েটা হয়েছে বোকার হদ্দ। জীবনকে গুছিয়ে নেওয়ার মতো, নিজের সুখটুকু ছিনিয়ে নেওয়ার মতো ক্ষমতা, সাহস বা বুদ্ধি কোনটাই ওর নেই। ও পারবে না ফারার মতো করে ঠেকে ঠেকে কৌশলে বেঁচে থাকতে। ওকে সবকিছু গড়ে দিতে হবে। সাজিয়ে-গুছিয়ে বানিয়ে দিতে হবে। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। অর্ণব ছেলেটা নিতান্তই ভদ্র গোছের। শ্বশুরের পছন্দ মেনে নিতে ইচ্ছে করছে না তবে এটুকু ফারা মানে যে লোকটা তুরিনের ভালোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।
.
আনিতা ডেকের ওপর বসে যোগব্যায়াম করছিল। পরনে সবুজ স্পোর্টস ব্রা। কালো টাইটস। ভারী চুলের গোছা উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। লম্বাটে কাটা কাটা শ্যামবরণ মুখে দুটি পটোলচেরা আয়ত চক্ষু। এই চোখ দুটোই ওকে অন্যমাত্রার সুন্দরী করে তোলে। তুরিন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
—‘তুমি শাহজিদকে ডিনারে ইনভাইট করেছ?’
আনিতা পদ্মাসনে বসে আছে। চোখ বোজা। সেই অবস্থায়ই বলল, ‘হ্যাঁ।’
— ‘কেন?’
—‘ইচ্ছে হয়েছে তাই।’
—‘হঠাৎ এমন ইচ্ছে হলো কেন?’
—‘অনেকদিন ধরেই ভাবছিলাম মনে মনে।
—‘ক্যান্সেল করো।’
এক চোখ খুলে তাকাল আনিতা তুরিনের মুখের দিকে। প্রচ্ছন্ন হুমকিটা টের পেয়ে বলল, ‘ক্যান্সেল করব কেন?’
—‘আমি বলেছি তাই।’
—‘কেন বলছো? ইউ আর নট মাই মম। আদেশ মানতে বাধ্য নই। তা ছাড়া তোমার তো বিয়ে হচ্ছে ওই দেশি বাবুর সঙ্গে। শাহজিদের সঙ্গে আমি মার্সে যাই কিংবা মুনে তাতে তোমার কী?’
তুরিন উত্তেজিতভাবে বলল, ‘চাচি-মা জানতে পারলে কী হবে?’
‘কিছুই হবে না। আমার মা আমাকে বুঝবে। আমার মা আমার বন্ধুর মতো।’
অপমানের একটা হলকা এসে লাগল তুরিনের মুখে। চাপা ইঙ্গিতটা ধরতে খুব বেশি সমস্যা হলো না। সত্যিই তো তুরিনের কোন বন্ধু নেই। বাবা মা থেকেও নেই। এতদিন জানত আনিতা আছে বোনের মতো। এখন দেখা যাচ্ছে সেই জানায়ও কমতি ছিল। থমথমে গলায় বলল, ‘শাহজিদ তোমাকে পছন্দ করে না।’
হাসল আনিতা, ‘আচ্ছা? তো কাকে পছন্দ করে? তোমাকে?’
তুরিন অসহায় গলায় বলল, ‘প্লিজ আনিতা! ক্যানসেল করো প্রোগ্রামটা।’
—‘ইম্পসিবল!’
তুরিন কিছুক্ষণ স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভাবল কী যেন। বলল, ‘ঠিক আছে। আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে।’
—‘আজিব! তুমি কেন যাবা?’
—‘লেটস গো অন আ ডাবল ডেট।’
—‘ডাবল ডেট?’
—‘ইয়াপ।’
—‘কার সঙ্গে যাবে তুমি?’
তুরিন আগপিছ কিছু চিন্তা না করেই বলল, ‘অর্ণব…অর্ণব তো আছেই!’
আনিতা হাসতে লাগল খুব। হাসির ছিটেগুলো উপহাসের ধারালো দাঁত হয়ে বসতে লাগল তুরিনের বুকে। উদ্বেলিত গলায় সে বলল, ‘ঠিক আছে তাহলে? আমরা একসঙ্গে যাচ্ছি।’
আনিতা বাঁকা ঠোঁটে বাঁকা হাসি নিয়ে চুপ করে রইল। বলল না কিছু।
অর্ণব দুপুরে খেয়ে-দেয়ে একটু ভাতঘুম দিচ্ছিল। চোখে দোজাহানের আরামের ঘুম চেতনার দেয়াল বেয়ে অলস বিড়ালের মতো নেমে আসছিল চুপিচুপি। এমন সময় দরজায় পড়ল ধাক্কা। তড়িঘড়ি করে উঠে দরজা খুলতেই দেখল তুরিন দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে গোলাপি টি-শার্ট, সাদা-কালো চেকের কিউট পাজামা। দেখতে কিন্তু বেশ মেয়েটা!
—‘আপনি?’
—‘হ্যাঁ আমি।’ চোখা চোখে লুঙ্গি পরা অর্ণবকে দেখল একবার তুরিন। আলুথালু পাগলের মতো চুল। গাঢ় বাদামি রঙের গায়ে হাতাকাটা সাদা গেঞ্জি গেঞ্জির গলা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে কোঁকড়া রোমশ বুক। ঈষৎ টানা চোখজোড়া ঘুমে লাল। আস্ত একটা চিড়িয়া ধরে এনেছে দাদাজান। কী বিরক্তিকর!
—‘ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন কেন?’
—‘না মানে…আপনাকে এক্সপেক্ট করিনি এই সময়।’ কাঁচুমাচু হয়ে বলল অর্ণব।
—‘শুনুন, কাল সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে ডিনারে যাচ্ছেন আপনি। –’হ্যা?’ ভারী চমকায় অর্ণব
—‘অবাক হচ্ছেন কেন?’
—‘না অবাক না…আসলে একটু অবাক লাগছে আরকি।’
—‘সুন্দর পোশাক পরবেন। শ্যাবি ড্রেসআপ করবেন না দয়া করে।
—‘সুন্দর পোশাকটা ঠিক কী রকম?’
—‘এখন পরে আছেন অদ্ভুত এক পোশাক। এসব আমার বাবা-দাদারাও পরে না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে টাইম ট্র্যাভেল করে এসেছেন উনিশশ আশি সাল থেকে।’
অর্ণব নিজের দিকে চোখ পিটপিট করে তাকাল। ভারি লজ্জা হলো নিজের এই মলিন সাজসজ্জা দেখে।
—‘সাতটার মধ্যে রেডি থাকবেন।’ হুকুম করল তুরিন।
—‘আচ্ছা।’
—‘আমাদের সঙ্গে শাহজিদ আর আনিতাও যাবে।’ শাহজিদের নাম শুনে একটু স্বস্তি পেল অর্ণব।
—‘বেশ ভালো।’
অনেকক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তুরিন। অর্ণব দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আসুন না। ভেতরে আসুন প্লিজ।’
—‘না। ভেতরে আসব না। আপনার কিছু বলার আছে?’
—‘বলার আছে বলতে…জানতে ইচ্ছে করছিল হঠাৎ আবার ডিনার কেন?’
—‘কেন আপনি চান না?’
—‘চাইব না কেন?’
—‘তাহলে এত প্রশ্ন করছেন কেন?’
অনেক ‘কেন’ তালগোল পাকিয়ে দিল অর্ণবের মাথায়। বিপন্ন গলায় বলল,
—‘আপনি কি সব সময় সবার সঙ্গে এমন উইকেড কুইনের মতো আচরণ করেন?’ সাহস করে কথাটা বলে ফেলল অর্ণব। ঝপ করে রাগের ছায়া পড়ল তুরিনের মুখে।
—‘কীভাবে কথা বলতে হবে আপনার সঙ্গে? একটু শিখিয়ে দিন প্লিজ।’
—‘না না আমি শেখাব কেন? কুইন তো আপনি। শেখানো-টেখানো আপনার কাজ।
তুরিন অপমানের একটা ঢোঁক গিলে বলল,
—‘উইকেড কুইনের সঙ্গে ডেটে যেতে আপনার আপত্তি আছে? নাকি স্নো হোয়াইট লাগবে?’
‘ডেট’ শব্দটা উচ্চারণ করায় অর্ণব বেশ লজ্জা পেল। জীবনে কোনদিন কারো সঙ্গে ডেট-টেট করেনি সে। চোখ নামিয়ে, একটু লাল হয়ে নার্ভাস গলায় বলল, ‘ছি ছি আপত্তি কীসের? স্নো-হোয়াইট কি সবার কপালে জোটে? তা ছাড়া…আপনাকে যদি বিয়ে করতেই হয়…’ফট করে কথাটা বলে ফেলে একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল অর্ণব। বিয়ের প্রসঙ্গ উঠে আসায় তুরিনও কিঞ্চিৎ অপ্রতিভ হলো। অর্ণব তুরিনের কুণ্ঠিত মুখপানে একবার চেয়ে নিয়ে ভেঙে যাওয়া কথাটাকে জোড়া লাগাল, ‘না মানে বলছিলাম যে বিয়েটা যদি করতেই হয় তো একটু চেনা-জানা হয়ে নিলেই ভালো।’
তুরিন চোখ সরিয়ে নিল। হালকা অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘কাল দেখা হচ্ছে। এখন আসি।’
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ৩.৩
তোমাকে যখন দেখি, তার চেয়ে
বেশি দেখি যখন দেখি না
— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
জুবিনের ছোট্ট, নরম শরীরের চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে আলতোভাবে হাতের আঙুল চালিয়ে লোশন মাখছিল নিশা। জুবিন বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে হাত-পা ছুঁড়ছে শূন্যে। একরত্তি গোলাপি জিবটা নেড়ে নেড়ে অদ্ভুত সব শব্দ করছে। ঝপ করে লাফ দিয়ে উঠে বসতে চাইছে। উল্টে গিয়ে ডিগবাজি খেতে চাইছে। হঠাৎ হঠাৎ হেসে উঠছে খিলখিলিয়ে। এইসব দস্যিপনা নিশার রোজকার সাংসারিক কাজে বিলম্ব ঘটাচ্ছে। বাইরের শাড়ি এখনো পাল্টায়নি। মেয়েকে গোসল করিয়ে, খাইয়ে-দাইয়ে শ্বশুরের কাছে গছিয়ে দিয়ে তবেই ছুটবে রান্নাঘরে। আজ রান্না শাশুড়িই করেছেন। বাকি কাজটুকু নিশাকেই সামলে নিতে হবে। ঘরের দরজাটা আধভেজানো অবস্থায় হালকা হালকা নড়ছে। নিশার মন বারেবারে সরে যাচ্ছে ওদিকে। দরজার পাল্লা একটু নড়ে উঠলেই মনে হচ্ছে এই বুঝি কেউ এলো। ভেতরটা টানটান হয়ে আছে। শান্তি নেই, ক্লান্তিও নেই…কেমন একটা শিরা দপদপ করা উত্তেজনা! মানুষটা একবার এলে সরাসরি জানতে চাইবে মিথ্যে বলার কারণ কী ছিল? এমনিতে তো বেজায় ভদ্রলোক। শান্তশিষ্ট, স্থিরবুদ্ধি, সচ্চরিত্র। বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্বশীল। এমন মানুষ বিনা কারণে মিথ্যে বলবে কেন? নিশাকে নিজ স্ত্রীর কূট মন্তব্য থেকে বাঁচানোর জন্য? কিন্তু কেন? নিশা তার কে?
জুবিনের গায়ে লোশন মাখিয়ে, ডায়াপার আর সবুজ রঙের একটা সুতির জামা পরিয়ে শ্বশুরের ঘরে গেল নিশা। ছুটির দিনে এই সময়টায় জাহিদ বাবা- মায়ের ঘরে থাকে। আজ এখানেও নেই। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে রান্নাঘরে এলো। টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিল। অর্ণবের লাঞ্চ আগেই দেয়া হয়েছে। শাশুড়িমা যত্ন করে পাশে বসিয়ে খাইয়েছেন হবু নাতজামাইকে। নিশা এবার শাহজিদের খাবারটা গুছিয়ে নিল ট্রেতে। ভাত-তরকারি অত খেতে চায় না ছেলেটা। নিশা তবুও রোজ নিয়ম করে বাড়িতে যা রান্না হয় তার থেকে অল্পবিস্তর বাঁচিয়ে গুছিয়ে রেখে আসে ওর ঘরে। বেচারাকে যত্নআত্তি করার কেউ নেই। বাংলাদেশে নিশার নিজের ভাইটিকে মা তিন বেলা যত্ন করে ভাত খাওয়ান। পাশে বসে থাকেন। পাতে সবচেয়ে বড় মাছের টুকরাটা তুলে দেন। শাহজিদকে অমন একলা একলা অবহেলায় পড়ে থাকতে দেখে নিশার মন খারাপ হয়। যদিও এই দেশে সবাই স্বাবলম্বী, সবাই আত্মনির্ভরশীল। কেউ কারো জন্য ঠেকে থাকে না। নিশার এত শুষ্কং কাষ্ঠং আধুনিক নিয়ম-কানুন ভালো লাগে না। তার জন্ম হয়েছে মায়ার দেশ, বাংলাদেশে। মানুষের জন্য এক বুক মায়া তার মনের মধ্যে টলমল করে সর্বদা।
সপ্তাহে দুদিন নার্স আসে শাহজিদকে দেখতে। কৃষ্ণাঙ্গ সুঠামদেহি এক যুবক। প্রায় তিরিশ মিনিট সময় ধরে ব্যায়াম করায়। হাত, কাঁধ এবং পা- বিহীন থাইয়ের ব্যায়াম। গোসলে সাহায্য করে। অন্য দিনগুলোতে ওয়াটার রেজিস্ট্যান্ট চেয়ারে বসে নিজেই শাওয়ার নেয় শাহজিদ। নার্স এলে কাজগুলো সহজ হয়। লেগ অ্যাম্পুটেশনের পর ফিজিক্যাল থেরাপির পাশাপাশি মেন্টাল থেরাপির পরামর্শ দিয়েছে ডাক্তার। শাহজিদ প্রথম এক বছর মেন্টাল থেরাপি নিয়েছিল। এখন আর প্রয়োজন পড়ে না। নিশা খাবার নিয়ে ওর ঘরে পৌঁছুনোর আরো তিন-চার মিনিট পর নার্স ছেলেটি প্রস্থান করল। শাহজিদের গায়ে পরিষ্কার জামা কাপড়, ভেজা আঁচড়ানো চুল, পরিপাটি সুবিন্যস্ত দাড়ি। নিশা একটু হেসে বলল, ‘তোমাকে খুশি খুশি লাগছে। কারণটা কী?’
ঘরের মাঝখানে ফোল্ডিং টেবিল পেতে তাতেই খাবার সার্ভ করে নিশা। খাওয়া হয়ে গেলে টেবিলটা মুড়িয়ে ব্যাক ইয়ার্ডে রেখে আসে। শাহজিদ হুইলচেয়ার টেবিলের কাছে এগিয়ে নেয়। হালকা হেসে বলে,
‘ওয়েল…আই হ্যাড আ ডিসেন্ট শাওয়ার…মে বি দ্যাটস দ্য রিজন…’ নিশা ওর প্লেটে ভাত, মাছ তুলে দেয়, মুচকি হাসতে হাসতে বলে, ‘নাকি অন্য কোন কারণ আছে?’
শাহজিদ কাটাচামচ আর ছুরি টেনে নেয়, ‘তুমি খেয়েছ?’
— ‘এখনো না।’
—‘তোমার খিদে-টিদে পায় না? তুমি কি অতিমানবী?’
—‘আমি অনেক খাই। ভাত খাই এতগুলা। তোমাদের মতো সাহেবি কায়দায় চামচ দিয়ে খাই না। হাত দিয়ে চেটেপুটে খাই। যাক গে। তুমি বলো, তুরিনের সঙ্গে তোমার ঝগড়া মিটে গেছে?’
হালকা একটু রং ধরল শাহজিদের মুখে। আলতো স্বরে বলল, ‘ওই পাগলের কথা আর কী বলব?’
নিশা ভালোমতো একবার দেখে নেয় শাহজিদকে, তারিয়ে তারিয়ে বলে, ‘তুমি মনে হয় কিছু একটা বলছো না আমাকে। লুকোচ্ছ নাকি?’
শাহজিদ মাথা নাড়ে, ‘হাইড করার কিছু নেই। ওই পাগল মনে করে তোমার সঙ্গে আমার প্রেম চলছে।’
নিশা নিভে গেল দপ করে, ‘ছিঃ…এসব কী কথা!’
—‘হুম আমার রি-অ্যাকশনও অনেকটা এরকমই ছিল।’
নিশার মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করে ওঠে। তুরিন তাহলে মনে মনে তাকে নিয়ে এমন বিরূপ ধারণা পোষণ করে আসছে? এত ভয়ংকর ধারণা? থমথমে মুখে মেঘলা গলায় বলল, ‘এ কারণেই তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছিল?’
—‘জানি না! ওর বাবা-মায়ের আন্সটেবল রিলেশনশিপ নিয়ে চিন্তিত সে।’
—‘তোমাকে সব কিছু খুলে বলল?’ নিশা চেয়ার টেনে নিয়ে বসে।
— ‘হ্যাঁ বলল তো…অ্যাকচুয়েলি উই হ্যাড আ হিস্ট্রি। তোমাকে বলা হয়নি কখনো।’
—‘কীসের হিস্ট্রি? প্রেম ছিল?’
—‘আরে না! ওই পাগলের সঙ্গে কে প্রেম করবে? ফ্রেন্ড ছিল।’
নিশা নড়েচড়ে পাকাপোক্ত আসন গেঁড়ে বসল, জমানো গলায় বলল, ‘শুনতে চাই তোমাদের কাহিনি। বলতে থাকো।’
শাহজিদ সবটাই বলল। তুরিনের সঙ্গে প্রথম দেখার দিনটি। এক সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো। তারপর হঠাৎ একদিন ওর পাল্টে যাওয়া। শুনছিল নিশা একাগ্র চিত্তে। সব কথা ওর কর্ণকুহর ছুঁয়ে গেলেও মনটা যেন ঠিকঠাক ছুঁতে পারছিল না। একাগ্রতার ফাঁকফোকর গেলে হঠাৎ হঠাৎ ওর চোখ গিয়ে ঠেকছে একটা আবছা মুখের ওপর। রিমলেস পাতলা কাচের চশমা, শান্ত দুটি চোখ, খাঁড়া নাক, বাদামি ঠোঁটের কোণে গাম্ভীর্যের উঁকিঝুঁকি…! নিশা শুনছে…আবার শুনছেও না। দেখছে…আবার দেখছেও না। দূর থেকে যেন একটা ট্রেন তারস্বরে হুইসেল বাজিয়ে ছুটে আসছে। প্ল্যাটফর্ম কাঁপছে। কানে চিঁচিঁ শব্দে তালা পড়ছে। হঠাৎ একটা অন্যরকম গলার স্বরে চমকে উঠল নিশা। শাশুড়ি ডাকছেন ওপর থেকে, ‘বৌমা! ও বৌমা!’
নিশা তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল। শাহজিদকে কিছু না বলেই ছুটে গেল সিঁড়ির দিকে। ভারি চঞ্চল তার হাঁটার ভঙ্গি। মুখে অকারণ ব্যগ্রতা। বেজমেন্টের দরজার চৌকাঠে মিসেস মুর্তজা দাঁড়িয়ে আছেন। কোলে জুবিন। কাঁদছে খুব। মিসেস মুর্তজা কড়া গলায় বললেন, ‘মেয়েটা কাঁদছে কেন দ্যাখো। আমার খেতে হবে তো। নিচে গিয়ে বসে থাকলে হবে?’
কটাক্ষসমেত মন্তব্যটা হজম করে মেয়েকে কোলে তুলে নিল নিশা। গলা বাড়িয়ে দেখল টেবিলে শ্বশুরমশাই, তুরিন, আনিতা আর তানিশা উপস্থিত আছে। জাহিদ আর ফারা অনুপস্থিত। নিশ্চয়ই দাওয়াত-টাওয়াতে গেছে। চমৎকার! এদিকে নিশার জন্য বউয়ের সঙ্গে মিথ্যে বলছে, আবার সেই বউকে নিয়েই আদর্শ স্বামী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হিপোক্রেট মানুষ একটা! ধুর ছাই! কেন ভাবছে এসব? ভাবনার বিষয়বস্তুর কি আকাল পড়েছে? এইতো কোলের ওপর আস্ত একটা ভাবনার বিষয়। কাঁদছে তো কাঁদছেই অবিরাম। অন্য কিছুতে মন লাগানোর সময় আছে নাকি?
শ্বশুরমশাই ডাকলেন একবার, ‘বৌমা, খেতে এসো।’
নিশা কখনোই বাড়ির লোকদের সঙ্গে একত্রে বসে খাবার খায় না। ফারা আর নীলিমার উপস্থিতির কারণেই এটা হয়ে ওঠে না। আজকে ওরা নেই বলেই বোধহয় শ্বশুরমশাই ডাকছেন। নিশা করুণ গলায় বলল, ‘কী করে আসি বাবা? দেখছেন না আপনার নাতনি কী পরিমাণ জ্বালাচ্ছে?’
কান্নারত জুবিনকে কোলের মধ্যে এপাশ-ওপাশ করে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করতে লাগল নিশা। হেঁটে হেঁটে, পিঠ চাপড়ে ঘুম পাড়ানি গান গুণগুণ করতে লাগল। সব তো তার একাই করতে হয়। এই বেচারি বাচ্চার তো বাবা থেকেও নেই। তেতো একটা রাগের আঁচে মন চিড়বিড় করে উঠল। বেশ খানিকক্ষণ কাটল এভাবেই। সদর দরজায় ধাক্কা পড়ল কয়েকবার। নিশা দরজা খুলে দেখল ডেলিভারি ম্যান এসেছে। হাতে খাবারের বাক্স ধরিয়ে দিল। এক হাতে বাচ্চা আর অন্য হাতে বাক্স নিয়ে ডাইনিংয়ে আসতেই মুর্তজা সাহেব বললেন, ‘খাবার দিয়ে গেছে? আমি জাহিদের জন্য স্যুপ অর্ডার করেছিলাম। ওর নাকি খাবারে রুচি নেই।’
নিশার মুখে একটা ব্ল্যাংকনেস খেলে গেল। অস্ফুটে বলল, ‘ও!’
শাশুড়ি বললেন, ‘তুমি দোতলায় গিয়ে দিয়ে আসো খাবারটা। তার জ্বর। নিচে নামবে না।’
নিশা মনে মনে একটু থমকে গেল। থমকানো ভাবটা নিয়েই জুবিনকে স্ট্রলারে শুইয়ে দিয়ে বেল্ট বেঁধে দিল। ডাইনিংয়ে খাবার টেবিলের পাশে স্ট্রলারটা এনে রাখল। যেন খেতে খেতেই সকলে নজর রাখতে পারে ওর ওপর। তারপর গরম স্যুপটা বাটিতে ঢেলে কিছুক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে রইল। কেন দাঁড়িয়ে রইল জানে না। খুব সূক্ষ্মভাবে টের পেল তার বুকের প্ল্যাটফর্মে হতচ্ছাড়া এক ট্রেন হুইসেল বাজাচ্ছে তো বাজাচ্ছেই! থামাথামির লক্ষণ নেই। মানুষটা অসুস্থঅবস্থায় ঘরবন্দি হয়ে আছে। আর সে কী সব উলটাপালটা ভাবছিল! এখন আবার তাঁর সামনে যাও…তারপর? কী যেন একটা প্রশ্ন করার ছিল? ধুরছাই…দূরে থাকাই ঢের ভালো। কাছে গেলেই তো সব কুয়াশার মতো ঝাপসা!
.
নিশার প্রস্থানের মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই খাওয়ার পাট চুকে গেছে শাহজিদের। নিশা এখনো ফিরে আসেনি। নিশ্চয়ই কোন কাজে আটকে গেছে। হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে ব্যাকইয়ার্ড-সংলগ্ন পোর্চে এলো। বেশ সুন্দর আজকের দুপুরটা। বৃষ্টির পর রুক্ষ ঘাসের ডগায় আর গাছের মাথায় প্রাণবন্ত ভাব এসেছে। সবুজের সতেজ আস্তরণটা মন ভালো করা চমক ছড়াচ্ছে চারিদিকে। নিশা বলছিল ওকে নাকি দেখে সুখী সুখী লাগছে, সুখ নাকি অন্যকিছু জানে না শাহজিদ। তবে তুরিনের সঙ্গে এতদিনের ভুল বোঝাবুঝির প্রাথমিক নিষ্পত্তি বুকে শান্তির উদ্রেক করছে এই সত্যটুকু অস্বীকার করার উপায় নেই। দুর্ঘটনা-পরবর্তী পঙ্গু জীবনে এই প্রথম যেন ভালো কিছু ঘটল। মনটা ভীষণ ঝরঝরে লাগছে। অনেক…অনেকদিন পর! একটা সিগারেট ধরিয়েছিল শাহজিদ। গোল হটটাবটার কাছে অর্ণবকে দেখা গেল এই সময়।
—‘হেই ব্রো! হোয়াসসাপ?’
চোখের দৃষ্টি অর্ণবের দিকে তাক করে অনেক উঁচুতে কথাটা ছুড়ে দিল শাহজিদ। অর্ণব শুনতে পেয়েই তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো। ওর পরনে কালো ট্রাউজার। হালকা আকাশি রঙের টি-শার্ট। তুরিনের ধমক খেয়ে লুঙ্গি পাল্টে ট্রাউজার পরেছে সে। আর মনে মনে ঠিক করেছে এ বাড়িতে থাকা অবস্থায় আর লুঙ্গি-টুঙ্গি পরবে না। অর্ণব চেয়ারের ধার না ধরে মাটিতেই বসে পড়ল ধপ করে। শাহজিদ ভারি বিনয়ী গলায় বলল,
—‘আরে…করছেন কী? আমার ঘরে চেয়ার আছে। দাঁড়ান আমি নিয়ে আসছি। হাঁটতে পারি না তবে আমার হাত এখনো অ্যাকটিভ আছে।’
—‘চেয়ার-টেয়ার লাগবে না! এই জায়গা তো পরিষ্কার। দ্যান একটা বিড়ি দ্যান।’
শাহজিদ হালকা হেসে সিগারেটের বাক্সটা এগিয়ে দিল। অর্ণব সিগারেটে আগুন ধরিয়ে বলল,
—‘কী হচ্ছে ভাই আপনাদের আমেরিকায় বলেন তো? যত্রতত্র গুলি করে মানুষ মেরে ফেলছে। এখন তো রাস্তায় নামতেই ভয় লাগে।’
—‘হুম। সিচুয়েশন দিনকে দিন খারাপ হচ্ছে। যার-তার কাছে বন্দুক থাকলে এসব তো হবেই তাই না?’
—‘আপনার আছে নাকি?’
—‘আছে…ইউজ করিনি কখনো!’ বাঁকা হেসে বলল শাহজিদ।
—‘গানকন্ট্রোল ল কঠোর করে না কেন? এত বিক্ষোভ-মিছিল হচ্ছে। সরকারের দেখি কোন খবরই নাই। এই সুযোগেই তো আপনাদের মতো ধনী লোকরা বাড়িতে বন্দুক লুকিয়ে রাখে। আমাদের মতো কালো হতদরিদ্র দেখলে বিনা কারণে গুলি করে মাথা উড়িয়ে দেয়।
—‘আমি ধনী নই।
ধনী নই। আসলে অ্যাক্সিডেন্টের পর কিছুদিন বেশ ইনসিকিউরিটিতে ভুগছিলাম। তাই আত্মরক্ষার খাতিরে ওটা কিনতে হয়েছিল।’
অর্ণব আসন গেঁড়ে বসেছে লাল ইটের উঠোনে। দুপুরের আকাশ হাওয়া দিচ্ছে ঝিরিঝিরি। পাখি ডাকছে। রোদ ছায়া লুকোচুরি খেলছে গাছের মাথায়। কাঠবিড়ালি দৌড়চ্ছে এদিক-সেদিক।
—‘আপনার অ্যাক্সিডেন্টটা কীভাবে হয়েছিল?’
শাহজিদ একটু দমল কেন যেন প্রশ্নটা শুনে। হালকা গম্ভীর গলায় বলল, ‘পরে কোন এক সময় বলব। ওই দুর্ঘটনাটা নিয়ে কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। এখনো মনে পড়লে শিউরে উঠি। আপনি বরং আপনার কথা বলুন। কেমন লাগছে সব?’
—‘ভালোই। কালকে শুনলাম আপনি ডেটে যাচ্ছেন…’
শাহজিদ অপ্রস্তুত হাসল, ‘আপনাকে কে বলল?’
—‘মিস তুরিন।’
—‘আচ্ছা? কী বলল সে?’
—‘বলল আপনি আর আনিতা কোথাও যাচ্ছেন, সেখানে আমাদেরও যেতে হবে।’
—‘ও…ভালোই তো…আপনাদের যেহেতু বিয়ের কথা চলছে…ইউ গাইজ শ্যুড স্পেন্ড মোর কোয়ালিটি টাইম টুগেদার!’ কথাটা বলে শাহজিদ আড়চোখে দেখল অর্ণবকে। বুকে কী যেন একটা খচখচ করে উঠল। অস্বস্তি হতে লাগল।
অর্ণব একটু লজ্জা পেয়ে নরম স্বরে বলে, ‘জি আমিও সেটাই ভাবছিলাম ভালো হলো আপনিও যাচ্ছেন। আসলে আমি একটু নার্ভাস ফিল করছি।’
—‘নার্ভাস কেন? ওই বাচ্চা খরগোশকে ভয় পাওয়ার কিছু নাই। এমনিই তিড়িং বিড়িং করে। ভেতরে ভেতরে একদম ইনোসেন্ট।’
—‘আপনি তো উনাকে চেনেন অনেকদিন ধরে। একই বাড়িতে আছেন। আমাকে একটু হেল্প করতে পারবেন?
—‘কী বিষয়ে?’
—‘না মানে উনার পছন্দ-অপছন্দ, প্যাশন, হবি-এসব জানা থাকলে ভালো হতো।’
—‘অর্ণব শুনুন, সবচেয়ে ভালো হয় আপনি যদি সরাসরি এসব নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেন।
অর্ণব এ কথার পিঠে কিছু বলে না। চুপ করে সিগারেটে টান দেয়। শাহজিদ বলল,
—‘আইসক্রিম খেতে খুব ভালোবাসে। নাচতে ভালোবাসে। আপনি ওর নাচের প্রশংসা করবেন কয়েকবার। মোমবাতির মতো গলে যাবে।’ কথাগুলো বলতে বলতে শাহজিদের চোখের পর্দায় খরগোশের মতো কিউট মুখটা ভেসে উঠল অতর্কিতে। বাঁকা চোখ, তুলতুলে গাল আর কণ্ঠাহাড়ের আশ্চর্য সুন্দর খাঁজ! হঠাৎ খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে পড়ার ঢঙে বলল, ‘আর হ্যাঁ, ওকে প্রপোজ করার আগে আমাকে অবশ্যই বলবেন। আমি জানি এক্সাক্টলি কোথায় প্রপোজ করলে ও সবচেয়ে বেশি খুশি হবে।’
—‘তাই? ঠিক আছে…আপনাকে সঙ্গে নিয়েই যাব নাহয়।’
শাহজিদের সুখ জ্বলজ্বলে হ্যাজেল রঙের চোখের তারায় হঠাৎ একটা ম্লান ছায়া পড়ে। কপট হাসি হাসার চেষ্টা করে স্তিমিত স্বরে বলে, ‘আমাকে সঙ্গে নেওয়ার চিন্তা বাদ দিন।’
—‘কেন?’
—‘আপনি ওকে প্রপোজ করবেন পাহাড়ের চূড়োয়। মাটি থেকে বারো হাজার ফিট উঁচুতে। সেখানে আমার পক্ষে যাওয়া পসিবল না।’
অর্ণব চুপ হয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। তারপর আবার ঝলমলিয়ে হেসে উঠে বলল, ‘সমস্যা নাই। আপনাকে যেকোনো উপায়ে পাহাড়ে তুলে ফেলব। প্রয়োজনে হেলিকপ্টার নিয়ে আসব ভাই। নো চিন্তা! জাস্ট চিল!’
অর্ণবের সহজ সরল কৌতুক মুখর কথা শুনে হেসে ফেলল শাহজিদ।
.
শ্লথ পায়ে হেঁটে দোতলার করিডরটা পার হলো নিশা। বুকভর্তি অস্বস্তি নিয়ে বদ্ধ দরজার সামনে কয়েক সেকেন্ড এমনি এমনিই দাঁড়িয়ে রইল। এই ঘরে আগে কখনো পা রাখা হয়নি। শুধু একবার এসেছিল জুবিনের খোঁজ করতে। এখন তার সঙ্গে জুবিন নেই। নিছক একটা স্যুপের বাটি নিয়ে লোকটার শোবার ঘরের দ্বারস্থ হয়েছে, ভাবতে গিয়েই কেমন অপমানের টক টক গন্ধ পাচ্ছে ভেতরে। উনার জ্বর হোক, মহামারি হোক…নিশার কী? উনার বউ তো ঘুরে বেড়াচ্ছে মহা আনন্দে। বর অসুস্থ হয়ে বাড়িতে পড়ে আছে, এমতাবস্থায় বউয়ের মনে এত ভ্রমণের আনন্দ আসে কোত্থেকে? একবার ভাবল ট্রেটা দরজার বাইরে রেখে চলে যায়। ভাবনার দোলাচলে দুলতে দুলতেই দরজায় আলতো করে ধাক্কা দিল সে পা দিয়ে। মসৃণ গতিতে খুলে গেল দরজাটা। ভেতরে আবছা অন্ধকার। জানালার পর্দা টানা। কোন শব্দ নেই। সুবিশাল ঘর। পরিচ্ছন্ন, পরিপাটি। পায়ের চপ্পল খুলে নরম কার্পেটের ওপর পা রাখল নিশা। চারিদিক গুমোট নিস্তব্ধতায় ঠাঁসা। ঘরের মাঝামাঝি অবস্থানে রাখা কিং সাইজের বিস্তৃত বিছানাটা ফাঁকা পড়ে আছে। সেই মানুষ কোথায়? নেই তো বাড়িতে! যাক, বাঁচা গেল! স্বস্তির শ্বাস টানার আগে একটা প্রচ্ছন্ন মন খারাপের ম্লান ছায়া পড়ল মনে। নিশা সেই ছায়াটা দেখেও না দেখার ভান করল। ঘুরে দাঁড়াবে ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা অন্ধকার মূর্তি নড়ে উঠল ঘরের একদম পূর্ব কোণে। নিশা পিলে চমকাতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে সামলে নিল নিজেকে।
জাহিদ শোয়া থেকে উঠে বসেছে। সোফাসংলগ্ন সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে চশমা তুলে নিয়ে পরে নিয়েছে চোখে। চশমা ছাড়া আজকাল সে প্রায় অন্ধই বলা চলে। পরিস্থিতি দিনকে দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। কোনদিন লিগ্যালি ব্লাইন্ড হয়ে যায় কে জানে! ফিকে আলোয় নিশাকে ট্রে হাতে স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল সে। স্কুলের শাস্তি পাওয়া শিক্ষার্থীর মতো। যেন একটু নড়লেই মার খাবার সম্ভাবনা আছে। ভয়ের চোটে মেয়েটা নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে বোধহয়। কিন্তু এত ভয়ের কী আছে? আশ্চর্য! জাহিদ অবাক গলায় একবার নাম ধরে ডাকল, ‘নিশা!’
একটু নড়ে উঠে, আড়ষ্ট গলায় নিশা উচ্চারণ করল শব্দটা, ‘জি।’
—‘কিছু বলবে?’
পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো সোফাসংলগ্ন সেন্টার টেবিলের দিকে। ট্রেটা নামিয়ে রেখে নতমুখে বলল, ‘বাবা আপনার জন্য স্যুপ অর্ডার করেছিলেন।’
—‘ও…আচ্ছা…।’ কেমন স্তিমিতভাবে বলে জাহিদ। একটু বিরতি নিয়ে সৌজন্যমূলক স্বরে যোগ করে দুটো সংক্ষিপ্ত শব্দ, ‘থ্যাংক ইউ।’
নিশা স্যুপের বাটিটা সামনে এগিয়ে দিল। দিতে গিয়েই টের পেল হাতের আঙুল কাঁপছে। জাহিদ ধোঁয়া ওঠা বাটিটা একবার হাতে নিয়েই আবার টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল, ‘অনেক গরম!’
নিশা ঝুঁকে থাকা অবস্থা থেকে সোজা হলো। সামনে তাকাল একবার। অন্ধকারে শুধু একটা ছায়ামূর্তি ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না। তাহলে এখন কী করা উচিত? কাজ তো শেষ। খাবার সার্ভ করেছে। এবার চলে যাওয়াই সমীচীন। কয়েকটা দম আটকানো সেকেন্ড গড়িয়ে যাওয়ার পর সে বলল, ‘আপনি খেয়ে নিয়েন। আমি আসি।’
জাহিদ কিছু বলল না। নিশা আরেকবার দেখার চেষ্টা করল ওকে। কোমর পর্যন্ত টানা পাতলা চাদর। হেলান দিয়ে বসে আছে সোফায়। চোখ খোলা নাকি বন্ধ বোঝা গেল না। নিশা আবার বলল,
‘আসি।’
জাহিদ নিশ্চুপ। এই নীরবতা নিশ্চয়ই প্রমাণ করে নিশার থাকা না থাকায় তার কিছু এসে যায় না। জুবিনের অনুপস্থিতিতে দুজনের দেখা হয় কদাচিৎ। ক্ষীণ সুতোর মতো একটা নড়বড়ে সম্পর্ক তাদের মধ্যে আছে বৈকি, কিন্তু সেটা শুধু জুবিনেরই জন্য। এখন জুবিন সঙ্গে নেই অতএব কথা বলার প্রয়োজনও নেই। একটা সৌজন্যমূলক ‘থ্যাংক ইউ’ দিয়েই লোকটা তার কর্তব্য পালন করেছে। অপমানের টক টক গন্ধটা ফিরে এলো বুকে। আত্মসম্মানে ঘা লাগল। একটা মুহূর্তও অপচয় না করে দরজার দিকে পা বাড়াল নিশা। যেতে যেতে হঠাৎ মনে হলো…এত বড় বিছানা থাকতে মানুষটা সোফায় কেন? বাড়িভর্তি লোক গমগম করছে। বৌ গেছে আনন্দবিহারে, তা উনি একা একা কোন দুঃখে বসে আছেন এই বদ্ধ ঘরে?
কথাগুলো মনে হতেই নিশা পদচালনা বন্ধ করল। দম আটকানো অস্বস্তিটাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘আপনার কি বেশি শরীর খারাপ লাগছে?’
জাহিদ অন্ধকারে মুখ ঘুরিয়ে দেখল নিশাকে। এই প্রথম…প্রথমবারের মতো নিশা তার সম্পর্কে কিছু জানতে চাইল! ‘কেমন আছেন’ এই অতি সাধারণ আটপৌরে প্রশ্নটিও নিশার কাছ থেকে সে পায়নি কখনো। তবে ব্যাপারটা একতরফা নয়। নিশা কেমন আছে, তা জানার ফুরসত্ত কখনো হয় না জাহিদের। সে হালকাভাবে বলল, ‘আমি ঠিক আছি।’ একটু থেমে আবার বলল, ‘জুবিন কোথায়?’
—‘নিচে। সবার সঙ্গেই আছে।’
—‘ভালো।’
—‘জ্বর মেপেছেন?’
—‘না, প্রয়োজন নেই।’
নিশা ফিরে এলো আবার ঘরের ভেতর, ‘অন্ধকারে বসে আছেন কেন? জানালা খুলে দিই?’
বলতে বলতে নিজেকে নিজের কেমন অচেনা লাগতে লাগল নিশার। জুবিন সঙ্গে নেই। পুরো ঘরে শুধু সে আর ওই মানুষ। ব্যাপারটা ভাবতেই গা রিরি করা অস্বস্তি চেপে ধরছে চারপাশ থেকে। চলেই তো যাচ্ছিল। চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। আবার ফিরে এলো কেন? এ যেন অফিসের বসের সঙ্গে অফিশিয়াল কাজের বাইরের কোন নীতিবিরুদ্ধ অসংগতিপূর্ণ মিটিং। নিশার মনটা অযাচিত অপরাধের ভারে কেমন মিইয়ে যেতে লাগল। তবুও কী কারণে যেন ভেতরকার সমস্ত সংকোচ সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে ফ্লোর লেনথ উইন্ডোর পর্দা আর কাচ সরিয়ে দিল। হইহই করে হাওয়া ঢুকল ঘরে। মুখ ঝলসে দিল মিঠা দুপুরের মিঠা রোদ্দুর। ওপাশে ছোট্ট একটা বারান্দা। সদ্য সবুজ পাতা আসা গাছগুলো মাথা বাড়িয়ে নীল আকাশ ছুঁয়ে দিয়েছে। গাছের ডালের ফাঁকে ফাঁকে চোখে পড়ছে লাল মাটির পাহাড়। নিশা ওই তপ্ত, নীল দুপুরটার দিকে চেয়ে একটা বড় শ্বাস টেনে নিল। তার মনে হলো এই ঘরটা খুবই প্রশস্ত এবং আরামদায়ক। অন্তত নিশাকে যে ছোট্ট এক টুকরো গেস্টরুমে থাকতে দেয়া হয়েছে, তার চাইতে তো হাজার গুণে ভালো। জাহিদের শীত শীত করছিল। মাথাটা ভার। তবুও রোদের আঁচমাখা ফুরফুরে বাতাসটা ঘরে এসে ঢুকতেই প্রাণের একটা স্ফুরণ টের পেল সে। বসন্ত এসে গেছে। বাতাসে নানা জাতের ফুলের ঘ্রাণ উড়ে বেড়াচ্ছে। নিশা রোদ আর আলোর বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ির আঁচল উড়ছে বাতাসে। হঠাৎ ঘুরে তাকাল ও। চোখাচোখি হলো। জাহিদ জ্বরের ঘোর লাগা চোখে নিশার শাড়ির রংটা ঠিক ধরতে পারল না, এই শাড়ি পরা অবস্থায় যে আজ সকালেও ওকে দেখেছে সেটাও মনে পড়ল না। মনে হলো শাড়ির রং আর দুপুরের রং এক। এমনকি নিশার গায়ের রংটাও এই নীলে ডোবা ঝকঝকে দুপুরের মতোই সুন্দর। সে দেখল নিশার দুপুর রঙের গায়ে একটা দুপুর রঙের শাড়ি…দেখল বড় দুটি ডাগর চোখ…সুন্দর গোলাপি ঠোঁট…দেখল কপালের টিপ…মোমে মাজা মসৃণ গলায় তিরতির করে কাঁপতে থাকা নীল রগ…আগেও দেখেছে…দেখতে ভালো লেগেছে…প্রতিবারই নিজেকে নিজে ধমকে উঠে চোখ সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আজকের অপ্রত্যাশিত অসুস্থতা যেন সেই আত্মশাসনের শক্তিটুকুও কেড়ে নিয়েছে। সোফার পিঠে হেলান দিয়ে বসে সে স্থবির হয়ে চেয়ে আছে সামনে দাঁড়ানো কবিতার মতো স্নিগ্ধ মেয়েটির দিকে। দৃষ্টি ফেরানোর তাগিদ অনুভব করছে না।
নিশা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। দৃষ্টি অবনত। টের পাচ্ছে মানুষটা তাকে দেখছে। নির্নিমেষ…নির্লজ্জ চোখে দেখছে! ওই চোখের উষ্ণতা আলপিনের সুচালো অগ্রভাগের মতো নরম, গরম হুল ফোটাচ্ছে বুকের ভেতর। পা থেকে শিরশির করে মেরুদণ্ড পর্যন্ত বেয়ে উঠছে অদ্ভুত বিপজ্জনক এক অস্বস্তি। তবুও জায়গাটা থেকে সরল না সে। সরতে পারল না। একবার চোখ তুলে দেখল সামনে। অবিন্যস্ত চুল, অবহেলার দাড়ি, চোখের কোণে রক্তের ছোপ…ঈষৎ খোলা ঠোঁট আর ঈষৎ লালচে ফোলা নাক…দেখতে দেখতেই নিশার মনে হলো ফরসা চামড়ার ওপর কালোর আস্তরণ পড়লে কী সুন্দরই না দেখতে লাগে! আর সেই সময় হঠাৎ করে ওই গম্ভীর স্বল্পভাষী মানুষটার জন্য জীবনে প্রথমবারের মতো তার মায়া হলো…বড় বেশি মায়া হলো!
—‘আপনার স্যুপ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।’
কথাটা বলতে বলতে এগিয়ে এলো নিশা। স্যুপের বাটিটা তুলে ধরল সামনে। জাহিদ স্যুপের বাটির দিকে তাকাল না। নিশার মুখের ওপর চোখ রেখেই বলল, ‘এখন খাবো না।’
—‘কেন? বাবা কষ্ট করে অর্ডার করলেন…!’
—‘রেখে দাও। পরে খেয়ে নেব।’
নিশা বাটিটা নামিয়ে রেখে আরো কয়েক পা এগিয়ে এলো। ও কাছে আসতেই জাহিদ সুন্দর ঘ্রাণ পেল বাতাসে। ভালো লাগার একটা ধোঁয়াটে রং ছায়া ফেলল অন্তরে। নিশা অস্বস্তি নিয়ে হাত রাখল জাহিদের কপালে। বেশ জ্বর। করুণ গলায় বলল, ‘আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে? কোভিড টেস্ট করেছেন?’
—‘করেছি। নেগেটিভ। ভয়ের কিছু নেই। তুমি সেফ আছ।’
—‘আমার ভয় কীসের? আমি তো আপনার কথা ভাবছি।’
জাহিদ হাসল নীরবে। কপালে নেমে আসা নিশার নরম হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে কেমন অন্যরকম সুন্দর গলায় বলল, ‘আমার কথা ভাবছ? আমার কথাও তুমি ভাবো নিশা? ভাববার সময় হয়?’
প্রশ্নটা শুনে নিশা থমকাল…চমকাল আর নিজের হাতটা ওই বলিষ্ঠ, শক্ত, জ্বরে পোড়া হাতের অধীনে চলে যেতেই ভেতরে ভেতরে ভীষণ রকম কুঁকড়ে গেল! কিন্তু হাতটা সে ছাড়িয়ে নিল না। বরং আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল, ‘আপনি ওষুধ খেয়েছেন?’
জাহিদ সোফায় বসে আছে। ওর মাথাটা নিশার গলার কাছাকাছি এসে থেমেছে। উষ্ণ শ্বাস এসে লাগছে মুখে।
—‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না নিশা? আমার কথা তুমি কখনো ভাবো?
নিশার বুকে অনেক দিন ধরে আটকে থাকা অভিমান আর ক্ষোভ ডানা ঝাপটে বেরিয়ে আসার পথ পেল যেন। সে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,
—‘কেন ভাবব আপনার কথা? আপনি আমার কে?’
জাহিদ জানে না এই প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দেয়া যায়। অনেক কুড়িয়ে পাওয়া অবসরে সে চুপ করে বসে ভেবেছে নিশা তার কে? কিন্তু উত্তরটা মনের অন্ধকার ঘুপচি অলিগলির রহস্যঘন কুঠুরিতে লুকিয়ে থাকে কেবলই, তাকে পাওয়া যায় না…ধরা যায় না…ভীষণ সূক্ষ্মভাবে শুধু অনুভব করা যায় মাঝেমধ্যে। জাহিদ কিছু বলল না। ঠোঁটে দুর্বোধ্য হাসি নিয়ে বেহেড চোখে চেয়ে রইল শুধু নিশার দিকে।
—‘আপনি সোফায় শুয়ে আছেন কেন?’ একটু আগের ভীতু ভীতু, বাধো বাধো ভাবটা ছুটে গেছে নিশার গলা থেকে। এখন সেখানে অন্য মাত্রার এক উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা।
—‘আমি এখানেই থাকি।’
—‘কেন?’
জাহিদ নিশার হাতটার দিকে তাকায়। ও এত কাজ করে তবুও ওর হাত এত নরম কী করে থাকে? নিশার হাতের আঙুলে বিয়ের আংটি। জাহিদ আংটিতে একটা আঙুল ছুঁইয়ে বলে, ‘ফারা বিছানায় শোয়।’
—‘কবে থেকে?’
—‘তুমি…তুমি আমার জীবনে আসার পর থেকে!
—‘আপনি বড়সড়ো লম্বা চওড়া মানুষ। সোফায় শুতে কষ্ট হয় না?
জাহিদ মুখ তুলল ওপরে। ঘোর লাগা হাসি হেসে বলল, ‘তুমি দেখি সত্যিই একটু একটু ভাবছ আজকাল আমাকে নিয়ে!’ ছিপছিপে শীর্ণ মুখে ওই বিভ্রম ছড়ানো হাসিটা গা শিউরে ওঠা এক সম্মোহনের উদ্রেক করে। সুন্দর দেখায়! নিশা দূরের ট্রেনের শব্দ পায়। প্ল্যাটফর্ম কাঁপতে থাকে। অশ্রুজলের মিহি ছিটা এসে পড়ে চোখের বারান্দায়। মানুষটার অবিন্যস্ত উশকোখুশকো চুলে কম্পনশীল হাত রাখে সে। চিরুনির মতো আঙুল চালায় আস্তে আস্তে। মুখে কিছু বলে না। হৃৎপিণ্ডের গতি বাড়ে। নীরব নিস্তব্ধ ঘুম-ঘুম ঝুম দুপুরটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অদ্ভুত এক কুহকী মায়াজাল ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
সকাল থেকে যে গম্ভীর তমসাচ্ছন্ন একাকীত্ব বোধ জাহিদকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল, সেই একলা বিষণ্ণ বোবা বোধটা এখন অদৃশ্য। বর্তমান মুহূর্তটাকে সে কোন শব্দ দিয়ে সংজ্ঞায়িত করতে পারছে না। সুখ- দুঃখ, রাগ…সমস্ত ইন্দ্রিয়জাত স্কুল অনুভূতির ঊর্ধে এই ক্ষণ। এই মেয়েটির কথা সে পারতপক্ষে ভাবে না, ভাবতে চায় না, সজ্ঞানে এড়িয়ে চলে এর সঙ্গ, তবুও আজকে যখন ও এত কাছে এসে দাঁড়িয়েছে…মনে হচ্ছে খুব গভীরে, খুব গোপনে, চেতন-অবচেতনের আবছায়া প্রান্তরে, তার তৃষিত বক্ষ এই মুহূর্তটিরই অপেক্ষায় ছিল অনন্তকাল ধরে! ও হাত বাড়িয়ে নিশাকে আরেকটু কাছে টেনে নেয়। মাথাটা নামিয়ে আনে নিশার উষ্ণ নরম সুগন্ধি বুকের ওপর। নিশা ভেতরকার সমস্ত আত্মসম্মান আর মেয়েলি অহংকার স্টিমরোলার দিয়ে দলিতপিষ্ট করে মানুষটার উশকোখুশকো ছোট ছাটের চুলওয়ালা, জ্বরো উত্তাপে পোড়া মাথাটা নিজের বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে। তারপর আচমকা…ভীষণ আচমকাভাবে নিজের কাছেই নিজে ধরা পড়ে যায়। যেন পুলিশের হাতে পাকড়াও হলো বহুদিনের ফেরারি অপরাধী বুঝতে পারল…জানতে পারল যে তিন বছর আগে সেই শীতের ভোর বেলায় কেন সে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারেনি। বুঝতে পারল…আজকের এই বুক- কাঁপানো, হাপর-ওঠানো, শিরশিরে গা-ছমছমে অনুভূতির প্রথম আবির্ভাব ঘটেছিল সেই কবে…ওদের তিন রুমের মফস্সল শহরের বাসায়…যেদিন প্রথম দেখেছিল ছবির ভেতরের শান্ত স্থির দুটি চোখ! সে জানল এতদিন ধরে এই বাড়িতে দুঃসহ অপমান, উপেক্ষা আর তাচ্ছিল্য সহ্য করে দাঁত মুখ খিঁচে পড়ে থাকার পেছনের গূঢ় কারণটা! সে জানল এখন নতুন করে…কিংবা সব সময়ই জানত। আজকে শুধু সেই জানাটাকে প্রথমবারের মতো স্বীকৃতি দিল মন!
বাইরে রোদের তেজ বাড়ছে। সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হাওয়ার তোড়। গাছের ডালে শনশন শব্দ। দূরে কোথায় যেন ঘুঘু ডাকছে মন কেমনের সুরে। জাহিদের দুটি হাত নিশার কোমর বেষ্টন করে ছিল। মাথাটা রাখা ছিল বুকের ওপর। নিশার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন ছড়িয়ে পড়ছিল ওর চামড়ার নিচের কোষে কোষে, শিরা-উপশিরায়। বুকের নরম উত্তাপ এসে লাগছিল চোখে, মুখে, গালে। আশ্চর্য আবেশে ভেসে যাচ্ছিল ভেতর-বাহির, চেতন-অবচেতন!
আচমকা একটা কাণ্ড ঘটল। ঘরের বাইরে ফিসফিস কথা আর পায়ের খসখস শব্দ…হঠাৎ নড়ে উঠল দরজাটা। বুজে রাখা কান্না ভেজা চোখ দুটো খোলামাত্র ফারার ক্রুদ্ধ, কুপিত অগ্নিমূর্তি দেখতে পেল নিশা। হৃৎপিণ্ডটা এমনভাবে লাফিয়ে উঠল যে আরেকটু হলেই প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে যেত। ফারার পাশে তুরিনও দাঁড়িয়ে আছে। মুখ ফ্যাকাসে। ঠোঁট কাঁপছে দুৰ্যোচ্য ক্রোধে। চক্ষুদ্বয়ে বিস্ফোরণের চাপা আভাস!
I’VE BEEN LOCKED AND LOST A KEY,
NOW THAT DARKNESS THAT CREEPS
IN AT NIGHT,
IS MY ONLY COMPANY
— Erin Hanson
বিস্ফোরণটা ঘটার আগে দম আটকানো থমথমে একটা হাওয়া গুমরে গুমরে কয়েকবার ঘুরপাক খেল চার দেয়ালঘেরা প্রশস্ত কামরায়। নিশা কিয়ৎ সময় বজ্রাহতর মতো চেয়ে রইল ফারার তীব্র তেজসর্বস্ব, দুঃসহ দর্পিত মুখের দিকে। তারপর চট করে পিছিয়ে নিল ভীতিবিহ্বল দুটি পা। জাহিদ তখনো কিছু টের পায়নি। নিশার ভূজবন্ধন আলগা হওয়ার পর সোজা হয়ে বসল সে।
—‘গেট লস্ট! গেট দ্য হেল আউট অফ মাই রুম!’
ফারার মুখনিঃসৃত বাক্যে এমন হৃদয় বিদীর্ণকরণ অগ্নিময় বারুদের উপস্থিতি ছিল যে শোনামাত্র নিশার বুকের পাঁজর পিষে গেল অসহ্য যন্ত্রণা এবং অপমানে। কাঠগড়ায় দাঁড়ানো অপরাধীর মতো নত হয়ে এলো মুখ। কান্নার একটা ঢেউ বুক থেকে তড়াক করে লাফিয়ে এসে ধাক্কা দিল গলায়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে কান্না সংবরণ করে জাহিদের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিল সে।
ফারা ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে এসে নিশার কনুই খামচে ধরল। হিড়হিড় করে দরজার দিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগল, ‘তোমার সাহস কী করে হয় আমার ঘরে আসার? অসভ্য, বেয়াদব! বের হও এখান থেকে!’
নিশা ছোটবেলা থেকেই একটু নিভৃতচারী, অন্তর্মুখী এবং তর্ক-বিমুখ স্বভাবের মেয়ে। ঝগড়া করার অভ্যাস নেই। বাবা-মা মুখে বকাঝকা করলেও গায়ে হাত তোলেনি কখনো। আজকে ফারার এই মারদাঙ্গা ভঙ্গির সামনে পড়ে তার অন্তরাত্মা থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল। অপমানের গলিত সিসা যেন ঢেলে দেয়া হলো কানে। বধির হওয়ার উপক্রম। দরজার কাছাকাছি আসতেই জাহিদ ওদের পথ আটকাল। অদ্ভুত ঠাণ্ডা স্বরে বলল, ‘ফারা! লিভ হার! ব্যাক অফ! এখান থেকে যাও এখন।’
বিধ্বস্ত বিস্ময়ের ঠ্যালায় ফারার চোখের ডিম খুলে পড়ার দশা হলো। মুখে তৈরি হলো গোলাকার একটা ‘হাঁ’। কয়েক সেকেন্ড স্থিরচিত্র হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। কথা বলতে পারল না। নিশা চমকে তাকাল জাহিদের দিকে। এক পলকের মধ্যেই তার বুকে শত সহস্র আশা, আশ্বাস এবং সাহসের বীণ বেজে উঠল ঝনঝনিয়ে। একটু আগের অপমান বোধটা কেউ একজন ঝাড়ন দিয়ে তাড়িয়ে দিল মনের ওপর থেকে ধূলোর মতো।
—‘তোমার মাথা ঠিক আছে? আমাকে আমার ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলছো?’ ফারার কণ্ঠে অবিশ্বাস, ক্রোধ এবং আগুনের অস্বাভাবিক স্ফুরণ!
জাহিদ নিজ উদ্যোগে নিশার কনুই থেকে ফারার সাঁড়াশির মতো আটকে থাকা আঙুলগুলো ছাড়িয়ে নিল। ওর মুখে ছমছমে এক অকাট কাঠিন্য। জ্বরে পোড়া লাল চোখের মানুষটাকে মোটেও স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। ফারাকে দরজার বাইরে ঠেলে দিয়ে শীতল গলায় বলল, ‘এখন যাও। পরে এসো।’
কথাটা বলে কোন দিকে না তাকিয়েই দরজাটা দড়াম করে আটকে দিল। কেউ লক্ষ করেনি তুরিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খিঁচুনি ওঠা রোগীর মতো কাঁপছিল। এবার আর্তনাদে ফেটে পড়ে বলল, ‘কী হচ্ছে এসব?’
জাহিদ মেয়েকে এতক্ষণ সেভাবে খেয়াল করেনি। আচমকা মেয়ের কণ্ঠটা শুনতে পেয়ে তার মুখে অপ্রস্তুত ভাব দেখা দিল তারপর ঝপ করে এক ফালি অনুতাপের ছায়া পড়ল। তুরিনের দিকে তাকাল একবার চোখ তুলে। কিছু বলল না। ক্লান্ত পায়ে সোফার কাছে এগিয়ে গেল। নিশা স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চমকানো, থমকানো বিবশ এক অনুভূতি তাকে প্রস্তরীভূত করে তুলেছে। নড়াচড়ার শক্তি নেই।
তুরিন ফণিনীর মতো হিংস্র ছোবল তুলে বলল, ‘হোয়াট ডিড ইউ জাস্ট ডু? তুমি আমার মাকে…আমার চোখের সামনে ঘর থেকে বের করে দিলে?’
জাহিদ সোফায় বসে পড়ল। দুটি হাত কপালে জড়ো করে একটা বুকচেরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত গলায় বলল, ‘তুমি দেখোনি তোমার মা কী করছিল? মেয়েটাকে অপমান করছিল।’
তুরিন ফেটে পড়ল দুঃসহ, দুর্মোচ্য, অসম্ভব এক রাগে,
—‘তোমার কাছে ওই মেয়ের মান-সম্মান বড় হয়ে গেল? ওর সামনে আমার মাকে অপমান করতে তোমার বাধল না? হু ইজ শি? হু দ্য হেল ইজ শি? হাউকুড ইউ ডু দ্যাট? ইউ জাস্ট ক্যান্ট ডু সামথিং লাইক দ্যাট বাবা! ইউ ক্যান্ট ডাম্প আস লাইক দ্যাট!’
জাহিদ শিহরিত চোখে তাকাল মেয়ের দিকে। তুরিন বিকৃতমস্তিষ্ক উন্মাদিনীর মতো কাঁপছে। তার চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক। রাগের প্রকোপে মুখ দিয়ে সাদা ফেনা বের হচ্ছে। মেয়ের এই উৎসন্ন দুর্দশা দেখে বুক কেঁপে উঠল। উঠে দাঁড়িয়ে কাছে টেনে নিল। ভীষণ নরম হয়ে উঠল কণ্ঠস্বর।
—‘ইটস ওকে মাই বেবিগার্ল! আই উইল নেভার ডাম্প ইউ। নেভার এভার! ইউ কাম ফার্স্ট! ওকে? ইউ আর ইম্পরট্যান্ট টু মি…অ্যান্ড ইউ ম্যাটার টু মি ইন এভ্রি ওয়ে!’
নিশা থম ধরা চোখে রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে দেখছিল দৃশ্যটা। মেয়েটা কি পাগল হয়ে গেছে? এমন অদ্ভুত আচরণ করছে কেন? তুরিন হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পাগলের প্রলাপ বকার মতো বলতে লাগল, ‘বাবা আই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক। আই ওয়ান্ট আস ব্যাক। প্লিজ বাবা! প্লিজ! ডোন্ট লেট মি ডাউন দিস টাইম! কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেলল তুরিন।
জাহিদ কিছুতেই মেয়েকে শান্ত করতে পারছে না। দেখতে পেল নিশা দাঁড়িয়ে আছে ক্ষণিক দূরে রক্তহীন, ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে। চোখে নিদারুণ অসহায় ভাব। এদিকে তুরিন ডুকরে ডুকরে কাঁদছে তার বুকে মাথা রেখে। টি- শার্টের গলা ভিজে যাচ্ছে আদরের কন্যার লোনা অশ্রুর জলে। দম আটকে আসছে জাহিদের। এত কষ্ট বহুদিন হয়নি! মেয়ের কপালে একটা চুমু খেয়ে সে সান্ত্বনা দেবার গলায় বলল, ‘সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে মা! কেঁদো না প্লিজ!’
—‘বাবা আমি চাই সবকিছু আগের মতো হয়ে যাক। শুধু তুমি-আমি আর মা। আমি অন্য কাউকে চাই না আমাদের মধ্যে।’ তুরিনের কান্নাজড়ানো কাঁপা কণ্ঠের কথাগুলো শুনতে পেয়ে ভেতরে ভেতরে একটু শিউরে উঠল জাহিদ। চকিতে তাকাল একবার নিশার দিকে। আতঙ্কগ্রস্ত অসহায় মেয়েটির চোখের চাউনি আর নিজ কন্যার নিরন্তর করুণ আকুতি যেন তাকে গভীর মরণখাদ বেষ্টিত কোন উঁচু গিরিশৃঙ্গে দাঁড় করিয়ে দিল। এই শৃঙ্গ থেকে যেদিকেই ঝাঁপ দিক না কেন মরণ তাকে ছেঁকে ধরবে। নিস্তার নেই! মেয়ের মাথায় হাত রেখে যথাসাধ্য স্থির কণ্ঠে বলার চেষ্টা করল, ‘কাম ডাউন মা, কাম ডাউন! টেক ইট ইজি। সব ঠিক থাকবে! আই প্রমিজ!’
তুরিন দুহাত দিয়ে শক্ত করে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। অদ্ভুত শীতল গলায় বলল, ‘বাবা আমাকে কথা দাও তুমি আমাদের মাঝে আবার ফিরে আসবে। প্রমিজ করো ওকে তুমি ছেড়ে দেবে। বাবা ‘ইউ হ্যাভ টু লেট হার গো! ইউ হ্যাভ টু!’
মেয়ের কথাগুলো তপ্ত শেলের মতো বিঁধল জাহিদের বুকে। ছুরি দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যেন কেউ রক্তাক্ত করে তুলছে হৃদয়। নিশা চেয়ে আছে ওর দিকে, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে। অবিশ্বাস, সন্দেহ আর দ্বিধা ঠিকরে বেরোচ্ছে ওই চোখ থেকে। তুরিন পাগলের প্রলাপ বকার মতো বকে চলেছে, ‘প্রমিজ করো বাবা। প্রমিজ করো তুমি ওকে ডিভোর্স দেবে। আমি আবার সেই পুরনো তোমাকে ফেরত চাই।’
অনেক অনেক দিন পর তুরিন বাবা ডেকে কিছু চাইল। আবদার করল। কী করে নাকচ করবে জাহিদ? পৃথিবীতে সন্তানের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই কিছু নেই। চোখ বুজে নিশার নিষ্পাপ মুখশ্রী থেকে মনটাকে সরিয়ে নিল সে। ধীর স্বরে বলল, ‘তুমি যা চাইবে তাই হবে মা! চিন্তা কোর না।’
তুরিনের অতৃপ্ত মন এতেও তৃপ্ত হলো না, জাহিদের একটা হাত নিজের মাথায় চেপে ধরে ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘তুমি প্রমিজ করো ওকে ডিভোর্স দেবে। আমার মাথা ছুঁয়ে প্রমিজ করো বাবা!’ কষ্টের একটা ঢোক গিলল জাহিদ। ঢোকটা সরাসরি হৃৎপিণ্ডে গিয়ে হাতুড়ির বাড়ি দিল সজোরে। তীব্র যন্ত্রণায় ঝিনঝিন করে উঠল মেরুদণ্ড। সেই যন্ত্রণা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে জাহিদ প্রস্তরীভূত গলায় বলল, ‘ঠিক আছে।’
—‘কথা দাও বাবা!’
জাহিদ তাকাল নিশার দিকে। নিশার ঠোঁট কাঁপছে, চোখে অবিশ্বাস, সংশয় এবং ব্যগ্রতার অসহ্য দাপাদাপি। জাহিদের মুখখানা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো আসামির মতো মেঘাচ্ছন্ন। চোখে কুয়াশা। তুরিন বিলম্ব সহ্য করতে না পেরে বাবার টি-শার্ট খামচে ধরল। ফেটে পড়ল চিৎকারে।
—‘বাবা চুপ করে আছ কেন? কথা দাও আমাকে!’
—‘কথা দিলাম।’ যন্ত্রণাকাতর আর্তনাদের মতো শব্দ দুটো ছিটকে বেরিয়ে এলো জাহিদের মুখ থেকে। নিশা নিশ্চল কাষ্ঠপুত্তলিকা হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুসময়। চোখ থেকে খসে পড়ল এক বিন্দু জল। নিঃশব্দে সরে এলো জায়গাটা থেকে। বুকে দুঃসহ এক পাষাণভার নিয়ে প্রথমে স্থবিরের মতো দু পা এগোলো। তারপর ছুটল নিজের ঘরের দিকে। এমনভাবে ছুটল যেন এই এক ছুটেই জীবনের শেষ সীমানাটা পেরিয়ে যেতে চায়।
.
ফারা গাড়ির দরজাটা হ্যাঁচকা টানে খুলে ধপ করে বসে পড়ল গদিতে। অনিমেষ ওর উত্তেজিত রাগান্বিত মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?’
—‘কী হয়নি তাই বলো। এই বাড়িতে থাকতে হলে আমাকে আরো কত কী সহ্য করতে হবে খোদাই জানে!’
অনিমেষ ফারাদের বাড়ি থেকে নিরাপদ দূরত্বে পার্ক করেছিল গাড়িটা। বাড়ির লোকজনের চোখে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়েই এই সতর্কতা অবলম্বন করা। জাহিদ-ফারার বন্ধু হিসেবে এ বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত বহাল আছে। কিন্তু জাহিদের অনুপস্থিতিতে, ফারার সঙ্গে মেলামেশাটা পরিবারের সদস্যগণ নিশ্চয়ই সহজভাবে নেবে না। অনিমেষ গাড়িটা ক্ষিপ্র গতিতে চালিয়ে নিল। নেইবারহুডের ভেতরে বিশ কিলোমিটারের ওপর গতি বৃদ্ধির নিয়ম নেই। অনিমেষ নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করল না। দু-তিন মিনিটের মধ্যে মূল রাস্তায় উঠে এলো।
—‘তোমার ফোন পেয়েছ?’ প্রশ্ন করল অনিমেষ। ফারা সেলফোন ভুলে রেখে গিয়েছিল বাড়িতে। লাঞ্চের পর দূরে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল। ভেবেছিল যাওয়ার আগে বাড়ি এসে ফোনটা নিয়ে নেবে, নিজের গাড়িটাও রেখে যাবে। কিন্তু বাড়ি আসার পর যে এমন লঙ্কাকাণ্ড বাঁধবে তা কে জানত!
—‘না। সুযোগ পাইনি।
—‘কেন?’
—‘তুমি বিশ্বাস করবে না অনি! ওই মেয়েটা…ওই আনকালচারড, স্টুপিড মেয়েটা আমার বেডরুমে ঢুকে আমারই হাজবেন্ডের সঙ্গে…ছিঃ…বলতে ঘেন্না হচ্ছে।’
অনিমেষ স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখেই প্রখর চোখে একবার তাকাল ফারার দিকে।
—‘তাতে তোমার কী? হিংসে হচ্ছে?’
ফারা ধারালো গলায় বলল, ‘হিংসে করব আমি ওই দুই টাকার মেয়েকে? –’তোমার রি-অ্যাকশন তো সেরকম কিছুই বলছে।’
—‘শোন, জাহিদের সঙ্গে ওই মেয়েটার রিলেশন যাই হোক না কেন আই ডোন্ট গিভ আ ড্যাম টু দিস, বাট আমার বেডরুমে কেন? বাড়িতে আর জায়গা নেই?’
—‘কী এসে যায়?’
ফারা জোরালো গলায় বলল, ‘এসে যায় অনি! এখনো অনেক কিছু এসে যায়। ওই বাড়িতে আমাদের মেয়ে আছে। আজ মেয়ের সামনে আমাকে চরমভাবে অপমান করা হয়েছে। মেয়েটার ওপর দিয়ে কী যাচ্ছে তুমি একবার চিন্তা করে দেখেছ?’
অনিমেষ কপালে ভাঁজ ফেলে কিছু একটা ভাবে। চিন্তার রেশ পড়ে গাঢ় গাত্রবর্ণের শানিত মুখে।
—‘তুরিন কিছু বলেছে তোমাকে?’
—‘কিছু বলেনি। কিন্তু আমি জানি ও খুব ইমোশোনাল। জাহিদের পাশে ওই মেয়েটাকে সহ্য করতে পারে না।’
—‘তোমাকে তো কতবার বললাম ওকে নিয়ে চলে এসো আমার কাছে। মেয়েটাকে একটা সুস্থ স্বাভাবিক লাইফ দাও। কিন্তু তুমি তো ওই বাড়ি ছাড়তেই চাও না। ব্যাপার কী? এখনো ভালো-টালো বাসো নাকি জাহিদকে?’
বিরক্তিতে ফারার মুখ কুঁকড়ে যায়, ‘শোনো অনিমেষ, এত বড় বড় কথা না তোমাকে একদম মানায় না! আজকে আমি আর আমার মেয়ে এই যে জ্বলন্ত নরকের মধ্যে দিনাতিপাত করছি, এর জন্য দায়ী একমাত্র তুমি!’
অনিমেষ বাঁকা হাসে, ‘আচ্ছা? তাহলে সব দোষ এখন আমার!’
ফারা দাঁতে দাঁত চেপে রুষ্ট স্বরে বলল,
—‘একজ্যাক্টলি, সব দোষ তোমার। তুমি যদি সেইসময় আমার পাশে এসে দাঁড়াতে তাহলে জাহিদকে আমার বিয়ে করতে হতো না। আমার মেয়ের সঙ্গেও মিথ্যাচার করতে হতো না।’
অনিমেষ গাড়িটা রাস্তার ধারের গ্যাস স্টেশনে দাঁড় করাল। পরিস্থিতি যতই ঘোলাটে হোক না কেন, উদ্বেগ-উত্তেজনা প্রকাশ করা ওর ধাতে নেই। ফারার দিকে ঘুরে তাকিয়ে স্থির গলায় সে বলল, ‘তুমি মনে হয় ভুলে গেছো যে তোমাকে আমি সেই সময় আমার অ্যাপার্টমেন্টে মুভ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম।’
— ‘হ্যাঁ প্রস্তাব দিয়েছিলে, বাট উইদাউট ম্যারেজ, উইদাউট কমিটমেন্ট!’
—‘আমার ভালোবাসা কি যথেষ্ট ছিল না ফারা? কাগজ-কলমের কমিটমেন্ট প্রয়োজন ছিল তোমার?’
—‘আমার ফ্যামিলি এটা কখনোই সাপোর্ট করত না।’
—‘তোমার ফ্যামিলি তো আমার সঙ্গে তোমাকে বিয়েও দিতে চায়নি। তুমি ভুলে গেছো? আমি তোমার বাবার সঙ্গে কথা বলেছিলাম!’
—‘হ্যাঁ বলেছিলে এবং তাঁর মুখের ওপর বলে দিয়েছিলে তুমি ধর্মান্তরিত হবে না।’
—‘হ্যাঁ বলেছিলাম।’
—‘আমার জন্য, আমাদের সন্তানের জন্য অ্যাটলিস্ট বাবার কথা মেনে নিতে পারতে। মেনে নাওনি কারণ তোমার স্বাধীন জীবনে তুমি কোন দায়বদ্ধতা চাওনি। হস্তক্ষেপ চাওনি।’
—‘জাহিদের সঙ্গে তোমার তখনো রিলেশন ছিল। তুমি তো কখনোই সবকিছু ছেড়েছুড়ে আমার কাছে আসোনি ফারা! এখনো আসতে চাইছ না!’
ফারা অনিমেষের প্রখর চোখজোড়ায় স্থির দৃষ্টি স্থাপন করল, ‘কিন্তু আমি তোমাকেই সব সময় ভালোবেসেছি অনি! ‘
ফারার একটা হাত নিজের কাছে টেনে নিল অনিমেষ, চুমু খেয়ে বলল, ‘আমি জানি। এবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে তুমি দেখো!’
ফারা একটা কষ্টমিশ্রিত বড় নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বলল, ‘কিছুই ঠিক হবে না। তুরিন তোমাকে আমার পাশে মেনে নেবে না কখনোই। মেয়েটাকে নিয়ে আজকাল আমার খুবই চিন্তা হয়। তাড়াতাড়ি ওর একটা বিয়ে দিতে পারলে বাঁচি।’
অনিমেষ গলায় ঠাট্টার সুর যোগ করল, ‘তোমার চিন্তাধারা এত ব্যাকওয়ার্ড কেন? ভীষণ ক্লিশে শোনাল কিন্তু কথাটা। বিয়ে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? আশ্চর্য!’
—‘এখন ওই একটা পথই আমার সামনে খোলা আছে। আমার মেয়েটার খুব ভালো একজন লাইফ পার্টনার প্রয়োজন।
—‘এসব চিন্তা বাদ দাও। শোন, আমি বলি কি তুরিনকে তুমি সবটা খুলে বলো।’
—‘অসম্ভব!’
—‘কেন? অসম্ভব কেন?’
ফারা বিপন্নভাবে বলে, ‘ও সহ্য করতে পারবে না। জাহিদের একনিষ্ঠ ভক্ত মেয়েটা। বাবাকে খুব ভালোবাসে।’
—‘এটা তো তোমার কারণেই হয়েছে। আরো আগেই সত্যটা খুলে বলা উচিত ছিল।’
—‘যেহেতু বলা হয়নি…এখন আর বলা যাবে না। আমার মেয়েকে আমার পাস্ট সম্পর্কে কখনো কিছুই বলবে না তুমি! মনে থাকে যেন!’
—‘মেয়েটা শুধু তোমার একার নয়। আমারও ইচ্ছে করে ওকে নিজের করে পেতে।’
—’এই কথাটা যদি জীবনের শুরুতেই বুঝতে…তাহলে আজকের এই দিন দেখতে হতো না!’
—‘যাক গে। ড্রপ ইট! কোথায় যাবে?’
ফারা অবশ কণ্ঠে বলল, ‘দূরে কোথাও চলো। অনেক দূরে! আমি সবকিছু ভুলে যেতে চাই!’
জ্বরটা ছাড়ল না খুব সহজে। সারাটা দিন শুয়ে শুয়েই কাটল। ঘুম এলো না আবার ঝিমুনি ভাবটাও কাটল না। সিলিংয়ের দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টে। মাথার ভেতর টুকরো মেঘের মতো চিন্তার ভেলা আসল, উবেও গেল। সাধারণ একটা জীবন চেয়েছিল। দশটা-পাঁচটা অফিস। সন্ধ্যায় ফিরে এসে প্রিয় মুখ দর্শন। রাতে স্ত্রীর সান্নিধ্য। আর উইকেন্ডে প্রিয় খেলার মাঠ। এতটুকু ভারসাম্য টিকে থাকলেই জীবনে সুখী হতে পারত সে। অথচ জীবন বিচিত্র! অল্পে সন্তুষ্ট থাকা মানুষগুলোকে নিয়েই বুঝি প্রকৃতি জগতের সবচেয়ে কঠিন খেলাগুলো খেলতে ভালোবাসে। নিজের কাছে নিজেকে কখনোই আলোচ্য বিষয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি জাহিদ। জীবন তরীতে ঝড়ের দাপট লাগা গুরুতর সময়গুলোতেও কর্ম অন্তপ্রাণ মানুষটা কাজের মধ্যে বিলীন হতে চেয়েছে। আকণ্ঠ ডুবে থেকেছে ব্যস্ততায়। সেই ব্যস্ততা নিরেট এবং পরিপূর্ণ। সাংসারিক নাটকীয়তা মনোযোগে বিঘ্ন ঘটাতে পারেনি। ব্যাংকের চাকরি, বাবার মোটেলের বিজনেস দেখাশোনা, বাড়ি ফিরে ছোট্ট পুতুলের মতো মেয়েটাকে কাছে পাওয়া আর উইকেন্ডে খেলাধুলা। আহা জীবন পরিপূর্ণ!
ফারার পরিবর্তনটা বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই চোখে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল কোথায় যেন কী একটা ধোঁয়াশা আছে। কিন্তু সেই ধোঁয়াশা জাহিদের মনকে কখনো বিষাক্ত করে তুলতে পারেনি। কারণ তার কাছে তুরিন ছিল। তুরিন যে তার নিজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ও যখন এলো পৃথিবীতে, জাহিদের মাত্র বিশ বছর বয়স। ভার্সিটি শেষ হয়নি। অল্প বয়সে বাবা হওয়ার লজ্জা কম না। লোক সম্মুখে মুখ দেখানোর জো নেই। এত সংকোচ নিয়ে বেঁচে থাকাই দায়! কিন্তু তুরিন তার মন খারাপের ওষুধ। ওই ছোট্ট নিষ্পাপ প্রাণটাকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচতে শুরু করল সে। তার বিবেকবোধ জাগ্রত। ফারার প্রতি কর্তব্য পালনে কখনো পিছপা হয়নি। মনে মনে শপথ করেছিল জীবন প্রারম্ভে করা প্রতিশ্রুতি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ভঙ্গ করবে না। আজ নতুন এক প্রতিশ্রুতির বোঝা এসে পড়ল মাথায়। তুরিন তার প্রাণভোমরা। ওর আবদার পায়ে ঠেলে দেয়ার সাধ্য নেই। কিন্তু জুবিনও যে জীবনের অকাট্য সত্য! ওকে নিজের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দিলে জাহিদের আত্মা কি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে না? জীবনটাকে যতই খোলামেলা বইয়ের পাতার মতো সহজ করে পড়ার চেষ্টা করছে ততই যেন এর অক্ষর গুলো দুর্ভেদ্যরহস্যঘন এক গোলকধাঁধায় রূপান্তরিত হয়ে উঠছে। একটা অনতিক্রম্য দুর্গম ফাঁদ যেন চারপাশ থেকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরছে তাকে। বেঁচে থাকাটাকে নিছক একটা ফাঁদ ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না আজকাল। এই ফাঁদ থেকে মুক্তি পাবার উপায় কী? অদ্ভুত হাসফাঁস লাগে বুকের ভেতরটায়। ফাঁকা…ভীষণ ফাঁকা আর খালি খালি লাগতে থাকে। অসহ্য ছটফটানি নিয়ে সিলিংয়ের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে সে। বিড়বিড় করে একটা কবিতা আওড়ায়।
I pass my day in solitude,
Watch the world move on outside!
I’m trapped inside a tower,
I’ve been locked and lost a key,
Now that darkness that creeps in at night,
Is my only company!
মা এসে অনেকক্ষণ শিয়রের কাছে বসে রইলেন। তসবিহ জপলেন। সুরা পড়ে ফুঁ দিলেন মাথায়। সন্ধ্যায় শহীদ আর নীলিমা ফিরে এলো। ফারাও ফিরল সাড়ে সাতটার দিকে। সান্ধ্য চা খাবার ডাক পড়ল নিচে। জাহিদ উঠল না। রাত আটটার দিকে তুরিন এসে বলল, ‘বাবা! চলো খেতে যাবে।’
জাহিদ মেয়ের ডাক অগ্রাহ্য করতে পারল না। অনেকদিন পর তুরিন তার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করছে। এর চেয়ে সুখের সংবাদ আর কী হতে পারে? নিচে নেমে দেখল জুবিন দাদির কোলে ঘুমাচ্ছে। নিশাকে দেখা গেল না আশেপাশে। খেতে বসার আগে জুবিনকে কিছুক্ষণ নিজের কাছে রাখল জাহিদ। ছুটির দিনে এই সময় বাড়িটা বেশ সরগরম হয়ে থাকে। সবাই একত্রে বসে খাবার খায়। রাত জাগে। আজকেও বাড়ির সব সদস্যের কোলাহলমুখর উপস্থিতি আনন্দের বান ডেকে এনেছে যেন। মুর্তজা সাহেব লিভিংরুমে নাতনিদের সঙ্গে বসে দাবা খেলছেন। টিভিতে খেলা চলছে। শহিদ, নীলিমা, মিসেস মুর্তজা এবং ফারা টেবিলে খাবার সাজাতে সাজাতে মেতে উঠেছে সাংসারিক নানা গল্পে। জুবিন ঘুমোচ্ছে শান্ত হয়ে বাবার কোলে। চারিদিকে জীবনের হইহই উল্লাস। সংসারের সমস্ত মায়া উপচে পড়ছে বাড়ির প্রতিটি ইট, কাঠ, পাথরে। শুধু একটা মেয়ে দোতলার স্বল্প পরিসর ছোট্ট ঘরে একলা বসে আছে। ও কেমন আছে সেই খবর কেউ জানার প্রয়োজন বোধ করছে না। কেউ ওর কথা ভাবছে না। হাজার চেষ্টা করেও সংসারের স্বার্থপর এই আনন্দযজ্ঞে যোগ দিতে পারছে না জাহিদ। বিশীর্ণ শরীরে ম্লান বদনে বসে আছে ঝুম হয়ে। আত্মগ্লানিতে দগ্ধ হচ্ছে হৃদয়। মন খারাপের পোড়া পোড়া ছাইগন্ধি বাতাসে ছেয়ে যাচ্ছে পৃথিবী! একটাবার খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে নিশা এই মুহূর্তে দোতলার ওই একলা ঘরে বসে কী করছে? কার কথা ভাবছে?
IF THIS IS THE END
PLEASE DON’T TRY AND
MAKE ME LOVE YOU AGAIN
— Dokken
,
আকাশে কৃষ্ণপক্ষের তৃতীয়া চাঁদ। জানালাঘেঁষা গাছের মাথা বরাবর বাঁকাচোরা চাঁদটা আটকে আছে। যেন গাছের ডাল ধরে সজোরে ঝাঁকুনি দিলেই মাটিতে খসে পড়বে ঝনঝন করে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তবেই টের পাওয়া যায় চাঁদটা আসলে গাছে নয়, বরং আকাশেই চড়ে আছে। নিশা আগে কখনো চাঁদ এত নিচে নেমে আসতে দেখেনি, যেমনটা কলোরাডোতে দেখে। প্রথম প্রথম খুব অবাক লাগত। আজকাল সয়ে গেছে। ধীরেধীরে সব কিছুই সয়ে যায়! বিস্ময়, পুলক, অপমান বা গ্লানি…কোনটাই চিরস্থায়ী হয় না। প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিতে পারলেই পরবর্তীতে সব কিছু ডাল-ভাত হয়ে যায়। ঝড় আসে, শিকড় শুদ্ধ উপড়ে দেয়, মানুষের জান-মাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। সময়ের সঞ্চার সেই ঝড়কেও প্রশমিত করে তোলে। কিছু মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়। কিন্তু পৃথিবী রূপ পাল্টায় না। সে চিরায়ত নিয়মে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায়। এই যে নিশার হৃদয়জুড়ে হুহু করে রক্তের প্লাবন বইছে। আত্মমর্যাদাহীন, পরমুখাপেক্ষী, কলুষিত এক জীবনের তীব্র অভিঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে শরীরের প্রতিটি অস্থিমজ্জা। এতে দায়শূন্য, নৃশংস পৃথিবীর টিকিটাও নড়বে না। কাল ভোরে যথারীতি সূর্য উঠবে, নাগরিক ব্যস্ততায় গমগম করবে চারিদিক। সংসারের চাকা ঘুরবে। নিশার দিকে কেউ ফিরে তাকাবে না!
আসলে কষ্ট সেখানে নয়। কষ্ট অন্য জায়গায়। লোকটা যখন অকপটে তুরিনকে কথা দিল জুবিনের মাকে ডিভোর্স দেবে, তখন কি একটা বারের জন্যও জুবিনের ভবিষ্যৎ ভাবনা তাকে নাড়া দেয়নি? সে স্বীকার করেছে তুরিনই গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে জুবিন কে? তুরিনের তো জীবনের জটিলতা বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে। আর কিছু না থাকলেও তার ঝুলিতে আজীবন মনে রাখার মতো সুন্দর একটি শৈশব আছে। এদিকে জুবিন জ্ঞান বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই জানবে বাবার সঙ্গে মায়ের সম্পর্ক নেই। নিশা তো বাবার রাজকন্যা ছিল। রাজপ্রাসাদের রাজকন্যা নয়, বাবার মনের রাজকন্যা। জুবিনের তো বাবার ভালোবাসায়ও ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। ভাবতে ভাবতে অশান্তিতে দম আটকে আসে। মাথাটা অদ্ভুত ফাঁকা লাগে। সবচেয়ে বেশি রাগ হয় নিজের ওপর। মরে যেতে ইচ্ছে করে। পাগলের মতো দুহাত দিয়ে নিজের গলা চেপে ধরে। ব্লেড দিয়ে আঁচড় কাটে হাতে। রক্ত বেরোয়। মাঝ সমুদ্রে ডুবতে থাকা আনাড়ি সাঁতারুর মতো হাঁসফাঁস করতে থাকে ভেতরটা। কূল নাই, কিনারা নাই…অথৈ এক সাগর! কী করবে নিশা? কোথায় যাবে? কার কাছে গেলে ঘুচবে এই অসম্ভব, অসহ্য, বিকৃত চিত্ত পীড়ন?
চট করে উঠে দাঁড়িয়ে স্যুটকেস বের করে নিল। আর থাকবে না… লোকটা যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে ডিভোর্স দেবে তাহলে আর এখানে পড়ে থেকে লাভ কী? ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার আগেই মানে মানে কেটে পড়া উত্তম। নিশা উদ্ভ্রান্তের মতো স্যুটকেস গুছাতে লাগল। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক নয়। চোখের কাজল লেপটে সারা মুখে ছড়িয়ে গেছে। শাড়ির আঁচল অবিন্যস্ত, চুল আউল-বাউল। তবে বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলার পর কিছুটা শান্ত লাগছে। শুধু একটা বিষয় কলিজার ওপর দগদগে কাটা ঘায়ের মতো লেগে আছে। কিছুতেই সেই ঘা শুকাচ্ছে না। লোকটা তাকে কখনো চায়নি! মানুষের তো বাড়ির পোষা বিড়ালের ওপরেও মায়া হয়। নিশার প্রতি কি উনার অল্পবিস্তর মায়াও হয়নি কখনো? হয়নি নিশ্চয়ই…হলে কি আর এত সহজে ছেড়ে দিতে পারত? যেদিন খুব আদর করল, সেদিনও তার মনন চেতন সমস্তটা জুড়ে ছিল অন্য কেউ। ভীষণ অন্তরঙ্গ মুহূর্তেও ফারাকেই মনে পড়েছে মানুষটার। এতকিছুর পরেও একে ঘৃণা করতে পারে না কেন? যে লোকটা তার জন্য কিছুই করেনি, মানুষ হিসেবে ন্যূনতম সম্মান দেয়নি, স্ত্রীর স্বীকৃতি দেয়নি, তাকেই কেন আজও জীবনের সবচাইতে দুর্লভতম অভীষ্ট অমৃত গন্তব্য বলে মনে হয়? এই অভিশপ্ত মোহচক্র থেকে মুক্তি পাবার উপায় কী?
.
ভোর পাঁচটার দিকে নিশার ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল জাহিদ। একটু টোকা দিতেই খুলে গেল দরজা।
ঘরটা প্রথম প্রত্যুষের নিবিড় নরম আলোয় ভরে আছে। বাইরে হরেক পাখির কিচিরমিচির। দূরে রকি মাউন্টেনের বরফচূড়ায় সূর্যের রক্তলাল আভা বিকিরিত হচ্ছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে হালকা উড়ছে পর্দা। নিশা দাঁড়িয়ে আছে জানালার ধার ঘেঁষে। বাস্তববর্জিত চোখের দৃষ্টি, অন্যমনস্ক। মাথায় ওড়না পেঁচানো। হাতে ধরা জায়নামাজ। ওর দিকে তাকানো মাত্র স্নিগ্ধতার একটা ঝাপটা এসে লাগল জাহিদের চোখে-মুখে। উবে গেল রাত জাগার ক্লান্তি। নিশা একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল সামনে। মনটাকে সে বেড়ি দিয়ে বেঁধেছে এবার। ওই মুখের দিকে চাইলে বেড়ির বাঁধন পুনরায় আলগা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। জাহিদ দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকল। জুবিন বেবিকটে ঘুমাচ্ছে। মেঝের ওপর একটা স্যুটকেস রাখা। নিশাই কথা বলল প্রথমে।
—‘আমি তৈরি।’
—‘হ্যাঁ?’
নিশা জানালার বাইরে চোখ রেখে যান্ত্রিক গলায় বলল, ‘আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য তৈরি।’
—‘তাই?’ ভরাটভাবে শব্দটা উচ্চারণ করল জাহিদ। একটু যেন অবিশ্বাস ঝিলিক দিল গলায়।
—‘জি। শাহজিদের সঙ্গে কথা হয়েছে। ও আমাকে নিউইয়র্ক রেখে আসবে।’
জাহিদ নিজের হৃৎকম্প টের পাচ্ছিল। বুকটা ভীষণ খালি খালি! ঘুম না হওয়া, জ্বরকবলিত দুর্বল মস্তিষ্ক নিয়ে বুঝতে একটু সময় লাগল যে শাহজিদ বেজমেন্টে থাকা সেই ছেলেটার নাম। বিছানার ওপর বসে হাতে ধরা সেলফোন নামিয়ে রাখল পাশে। নিশার আবছায়া মূর্তির দিকে কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে চেয়ে থেকে একটু থেমে থেমে বলল,
—‘সব প্ল্যান-প্রোগ্রাম করে ফেলেছ দেখছি!’
—‘জি। করতেই হলো।’
—‘নিউইয়র্কে কোথায় থাকবে?’
—‘শাহজিদ বলেছে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
একটু বিরতি নিয়ে নিশা আবার বলল, ‘আমি দুঃখিত। তিন বছর আগে আপনি যেদিন আমাকে চলে যেতে বলেছিলেন, সেদিনই আসলে আমার চলে যাওয়া উচিত ছিল। সেদিন চলে গেলে আজকের এই দিন দেখতে হতো না।’
জাহিদ কেন যেন একটু স্তব্ধ হয়ে গেল কথাটা শুনে। অচেনা বিষাদে ভারী হয়ে উঠল নিঃশ্বাস। হঠাৎ নিজেকে এই সুবৃহৎ বিশ্ব রঙ্গমঞ্চের পটভূমিকায় বড়ই ক্ষুদ্র এবং নগন্য এক জীব বলে মনে হতে লাগল। প্রকৃতির লীলাখেলা বোঝার সামর্থ্য তার নেই। এই মেয়েটিকে কয়েক বছর আগে নিজের জীবন থেকে জোরপূর্বক দূরে সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। অথচ আজ…বুকের ভীষণ আবছা কোণে টের পাচ্ছে নিশা সেদিন চলে গেলে জীবনটা ঠিক জীবনের মতো হতো না! নিশা চলে গেলে আজকের এই রক্তাভ আলো মাখা সাদা খোলসের নরম ভোরে একটা ভীষণ নিভৃত নিঃসীম ভালোলাগা আচানক শিহর তুলে হুহু করে ডেকে উঠত না মনের গভীরে…নিশা চলে গেলে নিঃশ্বাসে থাকত না উষ্ণতা…থাকত না প্রাণের আবেদন…নিশা চলে গেলে…!
জাহিদ অস্থিরভাবে উঠে পড়ল বসা থেকে। ক্লান্ত পায়ে হেঁটে এসে দাঁড়াল জানালার সামনে। নিশার চক্ষুদ্বয় সম্মুখে তাক করা। স্থির নির্বিকার দৃষ্টি।
—‘আজ যেও না।’
—‘যাব না?’ চমকলাগা গলায় প্রশ্ন করে নিশা।
—‘না মানে…আমাকে একটু সময় দাও।’
—‘সময় কেন?’
—‘আমি এভাবে আমার সন্তানকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিতে পারি না।’
—‘অনিশ্চয়তা কেন? আমি আমার মেয়েকে টেক কেয়ার করতে পারব।’
—‘হয়তো পারবে। কিন্তু বাবা হিসেবে আমার একটা দায়িত্ব আছে।’
—‘সেটা আপনার ব্যাপার। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আজই যাব।’
জাহিদের মুখ কঠোর হয়ে উঠল, ‘আজ তোমার যাওয়া হবে না।’
—‘আপনি কে এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার?’
নিশাকে এর আগে কখনো মুখে মুখে তর্ক করতে দেখেনি জাহিদ। অবাক হলো বেশ। রাগ নিয়ন্ত্রণ করে ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘আমি জুবিনের বাবা। মেয়ের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার আছে।’
নিশা ক্রোধ প্রজ্বলিত কণ্ঠে বলল, ‘আমি ওর মা। আপনার যতটা অধিকার আছে ঠিক ততটা অধিকার আমারও আছে।’
—‘হ্যাঁ আছে। এ কথা অস্বীকার করছি না। কিন্তু আজকেই যাওয়ার প্রয়োজন নেই। কয়েকটা দিন সময় দাও। আমি দেখি তোমাদের কোথায় সেট করা যায়। ভাবতে দাও।’
—‘আপনার ভাবতে হবে না। আমি আজকেই চলে যাব।’
—‘তুমি কোথাও যাবে না আজ। এটাই আমার শেষ কথা।’
—‘দেরি করে লাভ কী? আপনি তো তুরিনকে কথা দিয়েছেন আমাকে ডিভোর্স দেবেন।’
—‘হ্যাঁ কথা দিয়েছি। আমিও ভাবছিলাম একটা সিদ্ধান্তে এবার আসা দরকার। এভাবে আর কতদিন?’
কথাটা তপ্তশেলের মতো বিঁধল নিশার বুকে। রুদ্ধশ্বাসে বলল,
—তাহলে আর দেরি না করাই উচিত।’
—‘সময়টা আমাকে নির্ধারণ করতে দাও। আজ যেও না। এভাবে না বলে কয়ে চলে গেলে বাবা-মা কষ্ট পাবেন।
—‘ঠিক আছে। কাল যাব।’
—‘না…কালকেও না।’ ভীষণ গম্ভীর শোনাল জাহিদের কণ্ঠস্বর
—‘তাহলে কখন যাব?’
—‘যখন আমি বলব…তখন।’
নিশা ঘুরে তাকাল। দিনের প্রথম সূর্যের সিঁদুর রঙা লাল আলো এসে পড়েছে মানুষটার গৌরবরণ মুখে। একটা ঘরোয়া টিশার্ট আর ট্রাউজার পরনে। এত অপ্রসন্নতার ভেতরেও ওই মুখখানি বড় সুন্দর। দুশ্চিন্তা, অসুস্থতা, নিদ্রাহীনতা…কোন প্রতিকূলতাই এই মানুষকে ছুঁতে পারে না। এমন কি বয়সও প্রভাব ফেলে না। নিশা কয়েক সেকেন্ড এমনি এমনিই তাকিয়ে থাকে। মায়া এবং মুগ্ধতায় অবশ হয়ে আসে মন। লোকটা কি জানে নিশা তার কত বড় মুগ্ধ ভক্ত? জানে কি তার জন্য নিশার বুকের মাঝে এক আকাশ ভালোবাসা অবাধ্য পায়রার মতো বাকবাকুম করে ডাকতে থাকে সকাল-দুপুর-রাত্তিরে? জানে না…না জানাই উত্তম। সে তো ভালোবাসে তার স্ত্রীকে। জানিয়ে দিয়েছিল প্রথম সাক্ষাতেই! নিশার মনে আছে। কখনো ভুলবে না। চোখ সরিয়ে নিয়ে নিশা বলে, ‘আপনি আমাকে জোর করে আটকে রাখতে চাইছেন এই বাড়িতে।’
—‘ঠিক বলেছ।’
—‘কেন জোর করছেন? কীসের অধিকার আপনার আমার ওপর?
জাহিদ আকস্মিকভাবে নিশার একটা বাহু খামচে ধরল। টেনে নিয়ে এলো অনেক কাছে। ব্যাকুল হয়ে বলল, ‘তুমি জানো না?’
নিশার মাথার কাপড় খসে গেছে। সূর্যের লাল রশ্মি লেপটে আছে চুলে আর কুসুমপেলব মুখে। বড় বড় চোখের অবিন্যস্ত পাপড়ি তিরতির করে কাঁপছে। বিশুদ্ধ সুন্দর সেই মুখখানার দিকে চেয়ে থেকে জাহিদ অবসন্ন গলায় আরেকবার উচ্চারণ করল বাক্যটা, ‘তুমি জানো না নিশা?
জুবিন কান্না করে উঠল তারস্বরে। নিশা অপ্রস্তুতভাবে জাহিদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। বেসামাল গলায় বলল, ‘আপনাকে বলেছিলাম আমাকে ছোঁবেন না। ভুলে গেছেন?’
জাহিদ একটু নিভল। ঘা লাগল আত্মসম্মানে
—‘ভুলিনি। বারবার মনে করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। তোমাকে ছোঁবার জন্য মরে যাচ্ছি, এটা ভাবলে ভুল করবে।’
নিশা জুবিনকে বেবিকট থেকে তুলে নিতে নিতে তেরছা গলায় বলল, ‘তাহলে যখন-তখন হাত ধরছেন কেন? দুপুরে নাহয় জ্বরের ঘোরে ছিলেন। এখন কী হলো?’
জাহিদ কপাল কুঁচকে কী যেন ভাবল খানিকক্ষণ। চোখ নাচিয়ে বলল, ‘আমি তো জ্বরের ঘোরে ছিলাম। কিন্তু তুমি? তোমার কী হয়েছিল?’
নিশার মুখে লজ্জার পর্দা পড়ল, ‘আমার কী হবে?
—‘দ্যাখো নিশা, তুমি আমাকে আর যাই ভাবো না কেন দুশ্চরিত্র ভেবো না কখনো কেমন? আর সেদিনের ব্যাপারটা…মানে দ্য নাইট উই সেপ্ট টুগেদার…ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল।’
অ্যাক্সিডেন্ট শব্দটা খট করে লাগল বুকে। বড় একটা পাথর যেন আটকে গেল শ্বাসনালিতে। নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হলো পরের কয়েকটা সেকেন্ড। তাহলে অ্যাক্সিডেন্ট ছিল? হ্যাঁ তাই তো…তাই তো! নিশা দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণাটা হজম করল। কান্নারত জুবিনকে বিছানার ওপর চিত করে শুইয়ে দিল।
—‘আপনি যান এখন।’
—‘কেন?’
—‘বাচ্চাকে খাওয়াব। ডায়াপার চেঞ্জ করব। অনেক কাজ।’
জাহিদ নির্বিকার গলায় বলল, ‘তো?’
—‘তো আপনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করবেনটা কী?’
জাহিদ হেঁটে এসে বিছানায় বসল, ‘দাঁড়িয়ে থাকায় আপত্তি থাকলে নাহয় বসেই থাকি।’
—‘না বসতে হবে না।’
—‘তুমি কিন্তু ভীষণ মিসবিহেভ করছ!’
—‘হ্যাঁ করছি।’
—‘কেন করছ?’
—‘কারণ আমি চাইছি না আপনি এখানে থাকেন।’
অপমানের একটা ধক এসে লাগল জাহিদের বুকে। দুর্বল গলায় বলল,
—‘কেন? রেগে আছ আমার ওপর?’
এমন আবেগতাড়িত প্রশ্ন লোকটা এর আগে কোনদিন করেনি। নিশার চোখদুটো হঠাৎ জল চুপচুপ করে উঠল। কান্নার একটা ঢোক গিলে সে বলতে চাইল, আপনার ওপর রাগ করতে পারলেই হয়তো বেঁচে যেতাম। কিন্তু রাগ তো হয় না, ঘৃণাও হয় না! এখন এখানে মূর্তির মতো বসে থাকলে আরো বিপদ হবে। আমার আরো বেশি করে ভালোবাসতে ইচ্ছে করবে আপনাকে। আপনি যান। এই অত্যাচার থেকে আমি মুক্তি চাই। নিশা বলতে চাইল অনেক কিছুই কিন্তু মুখে উঠে এলো শুধু দুটো শব্দ, ‘চলে যান।’
জুবিন খুব কাঁদছিল। কান্নার তোড়ে লাল হয়ে গেছে ফোলা ফোলা গাল। লালায় ভিজে টসটস করছে কমলার কোয়ার মতো ছোট্ট দুটি ঠোঁট। জাহিদ বসে থাকা অবস্থায় মেয়ের ওপর ঝুঁকে ওই একটুখানি মুখে অনেকগুলো চুমু খেলো। মুখে বলল, ‘কাঁদছে কেন জুবিন রাণী? এই তো বাবা আদর করে দিয়েছে। এখন আর কাঁদবে না। কেমন?’ সত্যিই বাবার আদর খেয়ে জুবিন কান্নায় একটু বিরতি দিল। পুতুপুতু চোখ মেলে চাইল বাবার দিকে।
নিশা জুবিনের পাশে বসেছে। ওর চোখের চুপচুপ করা জল গড়িয়ে এসেছে নাকের ডগায়। জাহিদ আড়চোখে ওকে একবার দেখে নিয়ে জুবিনকে বলল,
—‘মা কাঁদছে কেন? মাকেও কি আদর করতে হবে?’
নিশার মুখটা লজ্জায় একটুখানি হয়ে গেল। চট করে চোখের জল মুছে নিয়ে ঘুরে তাকাল অন্যদিকে। জাহিদ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিশার দিকে এক পা এগিয়ে যেতেই নিশা ধড়ফড়িয়ে ছিটকে সরে গেল কয়েক হাত দূরে। জাহিদের মুখে একটি বিচিত্র বঙ্কিম হাসি ফুটে উঠল। কপট গলায় বলল, ‘ভয় পেও না। সেলফোনটা নিচ্ছি। তোমাকে নয়।’
নিশা ভূমিকম্পিত বক্ষ নিয়ে আবিষ্কার করল সত্যিই সেলফোনটা ওর পাশেই বিছানার ওপর রাখা ছিল। ইশ! কী ধোঁকাটাই না খেলো!
জাহিদ সেলফোন পকেটে পুরে নিয়ে বলল,
—‘চললাম। কিন্তু তুমি কোথাও যাচ্ছ না আজ, কেমন? আমি জানাব কখন যেতে হবে।’
নিশা হাঁপড় ওঠা বুক কোন রকমে ধাতস্থ করে বলল,
—‘টিকিট কেটে ফেলেছে।’
—‘ঠিক আছে। ওই ছেলেটার সঙ্গে আমি কথা বলে দেখি।’
—‘কোন ছেলে?’
—‘ওই যে…তোমার শাহজাদা।’
—‘ওর নাম শাহজিদ।’
—‘হবে কিছু একটা।’
ওর সঙ্গে আপনি আবার কী কথা বলবেন?’
জাহিদ দরজা খুলে ঘরের বাইরে পা বাড়ানোর আগে ক্ষীণ কণ্ঠে স্বগতোক্তির মতো আওড়াল বাক্যটা, ‘কী আবার বলব? আমার বৌকে নিয়ে যাচ্ছে কোথায় সেই বিষয়ে খোঁজখবর নেব!’
নিশা চমকে উঠল। লোকটা এইমাত্র কী বলল? আমার বৌ? কী আশ্চর্য! কে ওর বৌ? অনেকক্ষণ বাদে এক টুকরো মুচকি হাসি সকাল বেলার মিঠা রোদ্দুরের মতো ঠিকরে পড়ল নিশার ঠোঁটে। লাল হয়ে উঠল কান।
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ৩.৪
ওইখানেতে যেওনাকো তুমি
বলো নাকো কথা ওই যুবকের সঙ্গে
—জীবনানন্দ দাশ
.
বিকেল ছয়টায় আনিতা টোকা দিল শাহজিদের দরজায়।
—‘আসব?’
শাহজিদের একটা অনকল অফিশিয়াল মিটিং চলছিল। মিনিট দুয়েক সময় লাগল মিটিং শেষ হতে। আনিতা সিঁড়ির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল। শাহজিদ একটু অন্যমনস্ক গলায় বলল,
—‘এসো।’
আনিতা নিচে নামতেই বাতাস ভরে গেল দামি পারফিউমের গন্ধে।
—‘তুমি এখনো রেডি হওনি?’
শাহজিদ একবার দেখল আনিতাকে। সাদা গাউন, সাদা নেকলেস, সাদা কানের দুল। একটু বিস্ময় ভাসা গলায় বলল,
—‘তোমার সাজগোজ দেখে মনে হচ্ছে আজকের ডেট তুমি সিরিয়াসলি নিয়েছ।’
আনিতা একটুও বিচলিত না হয়ে সোজাসাপটা বলে দিল, ‘সাজগোজ আমার নিজের জন্য। তোমার জন্য নয়।’
শাহজিদ ঠোঁট উল্টায়, ‘স্মার্ট!’
—‘দ্রুত তৈরি হয়ে নাও।’
—‘আই ক্যান্ট ডু দিস।’
—‘মানে কী?’
—‘মানে আমার দ্বারা এসব হবে না। সাজগোজ করে সুন্দর একটা মেয়ে পাশে নিয়ে দামি রেস্টুরেন্টে যাওয়া। রোমান্টিক আলাপ করা। এসব আমার ধাতে নেই।’
—‘এতটাই বোরিং তুমি?’
—‘হুম এতটাই বোরিং।’
—‘তাহলে রাজি হলে হলে কেন আমার প্রস্তাবে?’
—‘অন্যকিছু করা যায়।’
—‘অন্য কিছু বলতে?’
শাহজিদ মাড়িতে জিব ঠেকায়। চিন্তামগ্ন হয় ক্ষণিকের জন্য। তারপর সহজভাবে বলে,
—‘আই ওয়ানা বাই মাই ফেভারিট শ্যাম্পেইন। ওয়ানা গো টু মাই ফেভারিট প্লেস।’
—‘সাউন্ডস লাইক আ ডেট টু মি!’
—‘নোপ…নট অ্যা ডেট। জাস্ট অ্য র্যান্ডম হ্যাং আউট।’
আনিকা হালকা অসন্তোষ নিয়ে বলল, ‘ঠিক আছে। তুমি যেখানে যেতে চাও সেখানেই যাব। আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।’
মিনিট দশেকের মধ্যে ক্রাচে ভর দিয়ে ব্যাক ইয়ার্ডে এলো শাহজিদ। তুরিন লাল রঙের একটা হাঁটু-ছোঁয়া শর্ট গাউন পরেছে। শাহজিদের মনে হলো গাউনের কাপড়টা একটু বেশিই পাতলা। নেট নাকি? কে জানে! ফেব্রিক সম্পর্কে তার ধারণা ভালো নয়। কিন্তু এত সংকীর্ণ, ফাঁকা ফাঁকা, মিহি কাপড় পরার কারণ কী? এসব ওয়ানা-বি ফ্যাশন তুরিনকে একেবারেই মানায় না। ওকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায় তখন, যখন ও সাজে না। শাহজিদ ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকাতে পারল না। কেমন যেন সংকোচ হলো। সেই সঙ্গে মনে পড়ল নিশার সঙ্গে করা অসদাচরণের কথা। নিশাকে শেষমেশ ঘর ছাড়তে বাধ্য করছে তুরিন। ঘটনাটা স্মরণে আসতেই তুরিনের প্রতি প্রবল বেগে বিরূপ হয়ে উঠল মন। আনিতা ওর পাশাপাশিই হাঁটছিল। একটু সামনে অর্ণব আর তুরিন। তুরিন কয়েকবার শাহজিদের চোখে চোখ রেখেছে। কথা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু শাহজিদ পাত্তা দেয়নি। এই অবজ্ঞা আর অসমাদরে তুরিনের মনটা কুঁকড়ে গেছে। মুখ হয়ে উঠেছে রক্তিম। সে অর্ণবের এক খানা বাহু শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। অর্ণব বেচারা অস্বস্তিতে কাঁচুমাচু একদম! মেয়েদের সামনে এমনিই সে লজ্জা-টজ্জা পায়। তার ওপর তুরিন কথা নেই বার্তা নেই হুট করে হাতে হাত রেখে, গায়ে গা ঘেঁষে হাঁটা শুরু করেছে।
—‘কোন রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি আমরা?’ তুরিনের প্রশ্ন।
—‘কোন রেস্টুরেন্টে নয়।’ আনিতার কাঠখোট্টা উত্তর।
— ‘তাহলে কোথায়?’
আনিতা শাহজিদের দিকে তাকাল। শাহজিদ নিরুত্তর। বাড়ির সম্মুখ ভাগের প্যাটিওতে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা। কয়েক গজ দূরেই রাস্তার ওপর অর্ণবের গাড়িটা পার্ক করা। অর্ণব তুরিনের হাত থেকে সন্তর্পণে ছাড়িয়ে নিল নিজের কনুইটা। গাড়ি আনলক করল। তুরিন ডাকল পেছন থেকে, “মিস্টার অর্ণব, আমার গাড়ি নিচ্ছি। আপনারটা থাক।’
কথাটা শুনে অর্ণবের পায়ের গতি শ্লথ হলো। পেছন ফিরে তুরিনকে একবার দেখে নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে শ্রাগ করল সে, ‘আপনার ইচ্ছা!’
তুরিনের গাড়িটা গ্যারেজে রাখা ছিল। গ্যারেজের গেট খুলে গাড়ি বের করে আনতে মিনিটপাঁচেক সময় লেগে গেল। এই গাড়িটা দাদাজানের পক্ষ থেকে উপহার পেয়েছিল তুরিন। আনিতার ড্রাইভিং লাইসেন্স হয়েছে তুরিনের আগে। বাবার কাছে নতুন গাড়ি কেনার অনুমতি চেয়েছিল। বলেছিল পার্ট টাইম জব করে গাড়ির লোন শোধ করে দেবে। কিন্তু বাবা রাজি হয়নি। বলেছে পুরনো গাড়ি চালিয়ে আগে হাত পাকাও। তারপর নতুন গাড়ি কেনার চিন্তা করবে। আনিতা তাই বাবার দুই দশ সালের পুরনো মডেলের নিশান আল্টিমা চালায়। তুরিন তার চেয়ে বয়সে মাত্র নয় মাসের বড়। ডিএমভি রাইটিং টেস্টে একবারে পাস করেনি। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। গাড়ি চালানো শিখলও আনিতার অনেক পরে। অথচ দাদাজান ওর জন্মদিনে পুরোদস্তুর নতুন একটা গাড়ি গিফট করে বসল। মুখে বলল, তুরিন বাড়ির বড় মেয়ে। তাই ওর জন্মদিনে একটু বড় উপহার থাকল। এই পক্ষপাতিত্ব কষ্ট দিয়েছিল আনিতাকে! আজকে প্যাটিও সংলগ্ন মসৃণ ড্রাইভ ওয়েতে তুরিনের নতুন মডেলের মার্সিডিজ বেঞ্চ এসে দাঁড়াতেই আনিতার মনে ঈর্ষার একটা গোপন সুড়সুড়ি এসে লাগল। তুরিন গাড়ি থেকে নেমে অর্ণবের দিকে চাবিটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
—‘আপনি ড্রাইভ করুন।’
অর্ণব মাথা নেড়ে বিনীতভাবে বলল, ‘না না…আপনিই চালান।’
শাহজিদ একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। হাতের সেলফোনে চোখ নিবদ্ধ। তুরিন ওকে বলল, ‘অ্যাই যে, তুমি ড্রাইভ করবে?’
শাহজিদ একটা ভ্রু উঁচিয়ে তাকাল তুরিনের দিকে, ‘না।’
—‘কেন নয়? নতুন গাড়ি। অটো গিয়ার। তোমার চালাতে সমস্যা হবে না।’
শাহজিদ ফোনটা পকেটে পুরে নিয়ে কেমন চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘আই ডোন্ট ড্রাইভ এনিমোর।
তুরিন কথাটা পাত্তা না দিয়ে চাবি ছুড়ে দিল ওর দিকে। শাহজিদ ক্যাচটা মিস করল না। হাত বাড়িয়ে লুফে নিল। তার ভ্রুজোড়ায় চিন্তামিশ্ৰিত কুঞ্চন। মুখে বেজায় বিরক্তির ছাপ। অ্যাক্সিডেন্টের পর গাড়ি বিক্রি করে দিয়েছিল। বিগত কয়েকবছর ড্রাইভ করার ইচ্ছা বা প্রয়োজন কোনটিই তাড়া করেনি তাকে। জীবনে আর কখনো গাড়ি-টাড়ি চালাবে না বলে ঠিক করেছিল। তার ইচ্ছেগুলো অন্য কারো নিয়ন্ত্রণাধীন নয়। মানুষ পরিবারের জন্য, প্রেমিকা বা বন্ধুর জন্য মাঝেমধ্যে নিজের ইচ্ছের বলি দেয়, স্যাক্রিফাইস করে। প্রিয়জনের সন্তুষ্টির মাঝে আত্মতৃপ্তি খুঁজে পায়। শাহজিদের এই জাতীয় দায়বদ্ধতা কারো প্রতি নেই। সে স্বাধীন এবং একা মানুষ। একটা সময় জীবনকে জয় করার নেশা ছিল। এখন সেই নেশা কেটে গেছে। অবশিষ্ট আছে শুধু টিকে থাকার তাগিদ। টিকে থাকা আর বেঁচে থাকার মধ্যে তফাত আছে। জীবনকে প্রতিটি পদে পদে অগ্রাহ্য করে, অবজ্ঞা করে, মাছি তাড়াবার মতো হাত নেড়ে উড়িয়ে দেবার মধ্যেই যেন প্রচ্ছন্ন এক গোপন বিজয়ের স্বাদ পায় সে আজকাল।
—‘তুমিই ড্রাইভ কর শাহজিদ।’ আদেশ দেয়ার ভঙ্গিতে কথাটা বলে আনিতা হাইহিল জুতোয় সুন্দর একটা ছন্দ তুলে ড্রাইভিং সিটের পাশে গিয়ে বসে পড়ল। তুরিন আড়চোখে দেখল ঘটনা। এখন খুব ভালো হবে আনিতার পাশে যদি অর্ণবকে বসিয়ে দেয়া হয় ড্রাইভ করার জন্য। সিদ্ধান্তের এই রদবদলে আনিতার মুখখানা কেমনতর হবে সেটা ভাবতে গিয়েই একটা বিভীষণ আনন্দ কিলবিল করে উঠল তুরিনের মনে। কিন্তু এই কল্পিত আনন্দকে সে কল্পনাতেই বেঁধে রাখল। বাস্তবে নামাল না। কারণ সে ভীষণভাবে চাইছিল শাহজিদ যেন গাড়িটা চালায়। আজকের আধুনিক বিজ্ঞানময় পৃথিবীতে একটিমাত্র পায়ের অভাব কারো জীবনকে থমকে দিতে পারে না। এই আত্মবিশ্বাসটুকু শাহজিদের মনে গেঁথে যাওয়াটা খুব জরুরি। তুরিন তাই এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে পেছনের সিটের দরজা খুলে বসে পড়ল। শাহজিদ কুঞ্চিত কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল দৃশ্যটা কয়েক সেকেন্ড। তিনজন স্বাভাবিক পরিপূর্ণ মানব-মানবীর গাড়ির চালক হবে তার মতো বিকলাঙ্গ একজন মানুষ। এটা কোন ধরনের রসিকতা? একবার ভাবল চাবিটা রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যায়। পরমুহূর্তেই ভাবনায় উল্টো বাতাস লাগল। এভাবে পিছিয়ে যাওয়া মানে কি কাপুরুষতা নয়? অর্ণবের সামনে, আনিতার সামনে…বিশেষ করে ওই ঝগড়াটে, কুটিল, লাগামছাড়া পাগলিটার সামনে নিজের কাপুরুষতা জাহির করতে কেন যেন ইচ্ছে হলো না!
ভ্রুকুটিবক্র মুখ নিয়ে ক্রাচসমেত এগিয়ে এলো শাহজিদ গাড়ির কাছে। কিন্তু লাইসেন্স তো সঙ্গে নেই! কথাটা মনে পড়তেই আবার ঘুরে দাঁড়াল সে। ঠিক সেই সময় বিকেলের কমলা রোদ গায়ে মেখে একটা নেভিব্লু রঙের বিএম ডাব্লিউ গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল প্যাটিওর সামনে। শাহজিদকে দেখেই বোধহয় গাড়ির ড্রাইভার জানালার কাচ নামাল। চোখাচোখি হতেই একটু অপ্রস্তুত হাসল শাহজিদ। জাহিদ হাসিটা ফিরিয়ে দিয়ে ভদ্র গলায় বলল, ‘তুমি কি ব্যস্ত? সময় হবে একটু?’
তুরিনের গাড়িটা লক্ষ করেছে জাহিদ। কালো কাচে সুরক্ষিত বাহনের আভ্যন্তরীন দৃশ্য দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু এই ছেলে তুরিনের গাড়ির কাছে কী করছে? শাহজিদ একটু থমকানো গলায় বলল, ‘জি বলুন। শুনছি।’
জাহিদ গাড়িটা পার্ক করল রাস্তার ধারে। দরজা খুলে নেমে এসে আড়চোখে লাল মার্সিডিজ বেঞ্চের দিকে চেয়ে বলল, ‘কোথাও যাচ্ছ নাকি?’
—‘হ্যা…একটু বাইরে যাচ্ছিলাম।’
—‘কোথায়?’
শাহজিদ ঘাড় নাচিয়ে বলল, ‘এখনো জানি না।’
জাহিদ তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করল সামনে দাঁড়ানো যুবকটিকে। সাদা কালো চেকের ম্যান্ডারিন কলার শার্ট পরেছে। ব্লু জিন্স। কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ। মুখে অবিন্যস্ত দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। তবুও জাহিদের মনে হলো এর চেহারায় আলাদা একটা চার্ম আছে। আছে ব্যক্তিত্বের গভীরতা।
—‘কেমন চলছে সব?’ জাহিদের প্রশ্ন শুনে একটু অবাক হলো শাহজিদ। এই লোকটা কখনো তার সঙ্গে যেচে পড়ে কথা বলেনি আগে। হঠাৎ কী হলো?
—‘সো ফার…সো গুড।’ সংক্ষেপে উত্তর দিল শাহজিদ 1
বাড়ির সদর দরজাটা খুলল কেউ একজন। ওরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক কয়েক কদম দূরেই চওড়া একটি সিঁড়ি ঘাসযুক্ত মাটি থেকে দুই ধাপে বিভক্ত হয়ে উঠে গেছে ওপরে। ছয়শ স্কয়ারফিটের চতুষ্কোণ প্যাটিওর দুদিকে স্নো-ড্রপ ফুলের ছড়াছড়ি। আর আছে লাল টুকটুকে গোলাপ। দরজা খুলে যে ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এলো তার পরনে বাদামি রঙের সালোয়ার-কামিজ। চুলে খোঁপা। বেরোনো মাত্র সম্মুখে দাঁড়ানো দুজন পুরুষকে দেখে সে একটু থমকে গেল। দ্বিধাজড়িত মুখ নিয়ে কয়েকটা সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকেই ঘুরে গেল উল্টো পথে।
—‘নিশা!’ পেছন থেকে শাহজিদের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। নিশা তাকিয়ে দেখল শাহজিদ ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে আসছে সিঁড়ির কাছে। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা ওর পক্ষে সম্ভব না। নিশাকেই এগিয়ে যেতে হলো।
জাহিদ লক্ষ করল শাহজিদের ডাক শোনামাত্র নিশা কেমন চঞ্চল হরিণীর মতো ছুটে আসছে। মুখে সুস্পষ্ট ব্যগ্রতা। এহেন ব্যগ্রতা ওর মাঝে সচরাচর দেখা যায় না। কথা বলছে উদগ্রীব হয়ে। শাহজিদ যেন তার খুব কাছের কেউ, গুরুত্বপূর্ণ কেউ! জাহিদ হঠাৎ বুকের ভেতর হাঁসফাঁস টের পায়। একটা ধোঁয়াশা তৈরি হয় চারপাশে। স্নায়ু টানটান হয়। ভেতর থেকে ব্যাকুল কণ্ঠে কে যেন বলে ওঠে, কী কথা তাহার সঙ্গে? তার সঙ্গে?
শাহজিদ বলছিল,
—‘একটা ফেভার করবে?’
—‘নিশ্চয়ই। বলো কী করতে পারি?’
—‘আমার ঘরে গিয়ে দেখবে টেবিলের ওপর ড্রাইভিং লাইসেন্স রাখা আছে। একটু কষ্ট করে নিয়ে আসবে প্লিজ?’
—‘এখুনি আনছি।’
শাহজিদ ফিরে এসেছে। কিন্তু জাহিদের চোখের সামনের ধোঁয়াশা এখনো ফিকে হয়নি। বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীর মতো শাহজিদের আবছা অবয়বের দিকে চোখ রেখে তার হঠাৎ মনে পড়ল ফারাকেও অন্য পুরুষের জন্য আকুল উৎকণ্ঠিত হতে দেখেছে এ জীবনে বহুবার। সেই পুরুষ অনিমেষ। ফারা স্বীকার করে না কখনো। কিন্তু জাহিদ বোঝে…বোঝার সামর্থ্য তার আছে। আর নিশা…নিশাও নিশ্চয়ই স্বীকার করবে না…কিংবা করবে। আজ ভোরেই তো খুব জোর গলায় জানিয়ে দিয়েছিল নিউইয়র্ক যাবে শাহজিদের সঙ্গে। নিশাকে সে নিজের করে কখনোই তো পেতে চায়নি! তবুও কেন এই মুহূর্তে ভীষণভাবে মনে হচ্ছে বহুদিনের পুরনো বন্ধু অনিমেষেরই মতো সামনে দাঁড়ানো এই যুবকটির কাছেও সে হেরে গেছে? শাহজিদের চোখের দিকে তাকাতে কেন সংকোচ হচ্ছে তার? কেন হীনম্মন্যতায় ডুবছে মন? আচ্ছা সব মেয়েরাই কি এমন হয়? পরশ্রীকাতর, ছদ্মবেশী এবং প্রবঞ্চক? ভাবতে ভাবতে জাহিদের মনটা বড় ফাঁকা হয়ে যায়। ধু-ধু করা হাহাকারে আটকে আসে দম।
—‘বলুন।’ আদেশ করল শাহজিদ।
জাহিদ জং ধরা গলায় ধীরগতিতে বলল, ‘শুনলাম তুমি নিশাকে নিয়ে নিউইয়র্ক যাওয়ার প্ল্যান করছ। টিকিট কি হয়ে গেছে?’
বিব্রত বোধ করল শাহজিদ, ‘নাহ…নিশা বলছিল সে যেতে চায়। কিন্তু আমি ওকে নিয়ে যাব এ ব্যাপারে কথা দিইনি।’ একটু থেমে শাহজিদ আবার বলল, ‘আপনাদের পারমিশন না নিয়ে টিকিট করাটা অন্যায় হতো। তাই করিনি।’ জাহিদকে একটু দ্বিধায় পেল। ছেলেটাকে বুঝতে পারছে না সে। চালাকি করছে নাতো? শাহজিদ জাহিদের দ্বিধাজড়িত মুখের দিকে চেয়ে স্পষ্টভাবে বলল, ‘তা ছাড়া আমি জানি নিশা এ বাড়ি ছেড়ে যেতে চায় না। তুরিনের কারণে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে।’
জাহিদ খুব সন্তর্পণে দীর্ঘশ্বাস মোচন করল। একটা বিষধর প্রশ্ন ছোবল দিয়ে গেল বুকে। কেন যেতে চায় না নিশা? শাহজিদের জন্য? জাহিদের তো ওর হাত ধরার পর্যন্ত অনুমতি নেই। তবে এই বাড়ির প্রতি নিশার কীসের এত টান?
—‘আপাতত এই ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন নেই কেমন? আমি জানাব তোমাকে।’
শাহজিদ বুঝল না ওকে জানানোটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল হঠাৎ, তবুও বাধ্য ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়ল।
—‘জি ঠিক আছে।’
জাহিদ বাড়ির দিকে পা বাড়াল। ভেতরটা থম ধরে আছে। কিছু মানুষকে দিয়ে আজীবন অন্য মানুষেরা এটা-সেটা করিয়ে নেয়। এইসব মানুষ কখনোই নিজের জন্য বাঁচে না। বাঁচে অন্যের ফাই-ফরমাশ খাটার জন্য। কারণে অকারণে অন্যকে খুশি রাখার চেষ্টা করে। যেন জগতের সব মানুষকে খুশি রাখার দায়টা খোদা একমাত্র তার ওপরেই চাপিয়েছেন। নিশাকে বিয়ে করেছিল বাবার উপরোধে। বাবার মন এবং স্বাস্থ্য রক্ষার্থেই বিয়েটা করতে হলো। ফারার সঙ্গে অনিমেষের হৃদয়ঘটিত সম্পর্কের ব্যাপারটা বাবা টের পেয়েছিলেন। তাই মফস্সলের অতিরিক্ত সহজ-সরল একটি মেয়ে নিয়ে এসেছিলেন, যে মেয়ে বাধ্যগত স্ত্রী হয়ে ছেলের পাশে থাকবে সারাজীবন। কিন্তু অপরিণামদর্শী বাবা এখনো জানেন না যে ফারার মতোই, নিশাও জাহিদের একান্ত নারী নয়। তার মনের ভেতরেও অন্য পুরুষের ছায়া আছে। ফারা শিগগিরই অনিমেষের কাছে চলে যাবে। এদিকে নিশার জন্য শাহজিদ আছে। ওদের কারো জীবনেই জাহিদের একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। ফারার সঙ্গে ভীষণ ক্ষয়া একটা সম্পর্কের সূতো আলগাভাবে বিগত কয়েক বছর ধরে টিকে ছিল। আজ সকালের ঘটনাটার পর জাহিদ মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেছে সেই ক্ষীণ সুতোর অস্তিত্বটুকুও এখন বিলীয়মান। নিশার ঘর থেকে ফিরে এসে দেখেছিল ফারা জেগে উঠেছে। বসে আছে ড্রেসিং টেবিলসংলগ্ন টুলে। চুলগুলো বুকের একপাশে ছড়ানো। হালকাভাবে চিরুনি চালাচ্ছে চুলে। জাহিদকে দেখে কী মনে করে যেন উঠে দাঁড়াল। হেঁটে এগিয়ে এলো কাছে। তারপর কোন ভূমিকা ছাড়াই ঠোঁটে একটা রসকষহীন শুকনো চুমু খেয়ে ফেলল। জাহিদ চমকে উঠল ঘটনার আকস্মিকতায়। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে বলল, ‘কী ব্যাপার?’
ফারা হাত বাড়িয়ে দিল, ‘এসো। অনেকদিন তো এসব হয় না!’
অদ্ভুতভাবে গা গুলিয়ে উঠল। ফারা আরো কাছে এগিয়ে এসে ওর গলা জড়িয়ে ধরল আলতোভাবে। জাহিদ হাতটা ছাড়িয়ে নিল। তারপর একটা চকিত ধাক্কায় ওর শরীরটা ছুড়ে ফেলে দিল দূরে, বিছানার ওপর। গা শিউরে ওঠা ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘আর কোনদিন হবে না। মনে রেখো।’
নারীজাতির ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গেছে। নিশার তো বয়স কত কম! অল্প বয়সে বেচারি মা হলো। সংসারের দায় এসে পড়ল মাথায়। শাহজিদ হয়তো ওর ভীষণ একঘেয়ে বন্দি জীবনের একটা মাত্র খোলা জানালা। ওকে নিশ্চয়ই এই অপরাধের জন্য ক্ষমা করা যায়। হ্যাঁ…জাহিদ ওকে ক্ষমা করে দেবে। যদি শাহজিদকে ও চায়…তবে সেই চাওয়ার পথে কোন বাধাকেই টিকতে দেবে না সে।
নিজের সঙ্গে এতরকম বোঝাপড়ার পরেও মনের ভেতর এক বিষণ্ণ বাতাস হুহু মাতম করতে থাকে। ভয়ংকর একা লাগে। মনে হয় কেউ নেই…কোথাও কেউ নেই…চারিদিকে শুধু শূন্যতা, অন্ধকার আর বুক কাঁপানো দুরূহ হতাশা!
নিশা শাহজিদের লাইসেন্স নিয়ে ফিরে এসেছে। গাড়ির বদ্ধ জানালার ভেতর দিয়ে দৃশ্যটা দেখছে অর্ণব। নিশাকে দেখলেই তার মনটায় ভালোলাগার একটা অনর্থক আলোড়ন ঘটে যায়। সেই আলোড়ন ছায়া ফেলে মুখে। তুরিন পাশে বসে অর্ণবের এই বাক্যহীন বিভোর চেয়ে থাকাটা লক্ষ্য করছিল। শাহজিদের চোখে অবশ্য মুগ্ধতার চেয়ে প্রশ্রয় বেশি। ওই প্রশ্রয়টুকুও তুরিনের ভালো লাগে না। গা জ্বালা করে। তবে এই মুহূর্তে অর্ণবকে বেশি রকমের অসহ্য লাগছে। মন চাইছে লাথি মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দেয় রাস্তায়। সে বিয়ে করতে এসেছে তুরিনকে কিন্তু হাভাতের মতো চেয়ে আছে নিশার দিকে। বাজে লোক একটা!
শাহজিদ গাড়িতে উঠে বসার পর অর্ণবকে একবার নামতে হলো। ক্রাচদুটো ব্যাক ডালায় রাখতে হবে। গাড়ির সামনে ডিজেবল সাইন সংলগ্ন স্টিকার ঝুলিয়ে দিল শাহজিদ। এই স্টিকার থাকলে পার্কিংসহ যেকোনো জায়গায় বিকলাঙ্গ হিসেবে বাড়তি সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। ইঞ্জিন স্টার্ট দেবার পর খুব সূক্ষ্ম একটা তরঙ্গ টের পেল মনের ভেতর। টের পেল শিরায় শিরায় আর অস্থিমজ্জায় প্রতিবাদের এক সুতীব্র ঝংকার। জীবনকে সে যে করেই হোক পোষ মানাবে। একটা বদ্ধ দরজা যেন বহুদিন বাদে খুলে গেছে দমকা বাতাসে। দূরে কোথাও একটা শিকল ভাঙছে ঝনঝন। ডাকছে কেউ হাতছানি দিয়ে…কে ডাকছে? পাহাড় নয়তো?
—‘কোথায় যাচ্ছি?’ আনিতা প্রশ্ন করল।
শাহজিদ একটু রহস্যময় হেসে বলল, ‘আমাকে ফোর্সফুলি গাড়ি ড্রাইভ করানোর মাশুল তো তোমাদের দিতেই হবে।’
—‘মানে কী?’
—‘মানে হলো আজ আমি যেদিকে দু চোখ যায় সেদিকে যাব। তোমরা গাইড করতে পারবে না।’
তুরিন মাথাটা সামনের দুটো সিটের মাঝ বরাবর এগিয়ে দিয়েছিল। উদ্বেলিত কণ্ঠে বলল, ‘দূরে কোথাও যাচ্ছি?’
শাহজিদ ওর প্রশ্নটা পাত্তা দিল না। তাতে তুরিন কিছুমাত্র মাইন্ড করল না। বেশ খুশি খুশি গলায় বলল,
—‘দূরে গেলেই মজা হবে!’
—‘কিন্তু আমার ক্লাস আছে তো আগামীকাল।’ আনিতা ভেটো দিল।
—‘এখনো সময় আছে। চাইলে প্ল্যান ক্যান্সেল করতে পারো। ভেবে দ্যাখো।’ শাহজিদ বলল।
—‘ক্যানসেল করব কেন? যাবো…দূরেই যাব!’ তুরিন রায় ঘোষণা করল প্রসন্ন চিত্তে।
অর্ণব বলল, ‘কাল আপনার অফিস নেই শাহজিদ ভাই?’
—‘ল্যাপটপ আর ইন্টারনেট থাকলেই আমি অফিস করতে পারব। অবশ্য নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেলে সেটা হবে না। বাট আই উইল ম্যানেজ সামহাও। নো ওরিজ।’
তুরিন আনন্দে বাকবাকুম হয়ে বলল, ‘ইয়েস! আমি চাই অনেক দূরে যেতে…অনেক অনেক দূরে যেতে…হেই গাইজ! ক্যাম্পিং করলে কেমন হয়?’
এবারেও ওর কথাটার জুতসই উত্তর দিল না কেউ। আনিতা কয়েক সেকেন্ড পর দায়সারা গলায় বলল, ‘করা যায়!’
গাড়িটা নেউবারহুডের রাস্তা পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠেছে সবে। শাহজিদ ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকিয়ে ছিল। এক পায়ে গাড়ি চালানো এইই প্ৰথম। অনেক দ্বিধা, অনেক সংকোচ আর অনেক অহেতুক ভয়ের অবসান হলো আজ। একসময় পথের সঙ্গে তার উত্তাল প্রেম ছিল। দিনরাত গাড়ি নিয়ে ছুটে বেরিয়েছে এই রাজ্য থেকে সেই রাজ্যে। বাইক চালানোরও শখ ছিল। বোল্ডার সাইক্লিং ক্লাবের মেম্বার ছিল। কতবার পাহাড়ি রাস্তায় বাইক নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে দুর্দান্ত প্রতিযোগিতায় নেমেছে!
শাহজিদ জিপিএস অন করল না। ওকে দেখে মনে হচ্ছে পথঘাট সব মুখস্থ। আনিতা ওর মোবাইলের প্লেলিস্ট চালু করল গাড়ির স্পিকারে। প্রশ্ন করল,
—‘মিউজিক প্রেফারেন্স আছে কারো?’
তুরিন হড়বড় করে বলল, ‘মিউজিকের ক্ষেত্রে আমি সর্বভুক প্রাণী। যেকোনো কিছুই চলবে।’
তুরিনের চোখে আনন্দের ঝিকিমিকিটা দেখছিল অর্ণব। মেয়েটাকে এখন শিশুর মতো সরল লাগছে। এই মেয়ে যে অমন রাগী স্বরে উইকেড কুইনের মতো খ্যাক খ্যাক করতে পারে তা এই মুহূর্তে ওকে দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না।
সত্যিই খুব ভালো লাগছিল তুরিনের। এত আনন্দ বহুদিন হয়নি! এমন একটা ট্রিপ, যেখানে সারাদিন শাহজিদ ওর কাছে থাকবে, পাশে থাকবে…এমন ট্রিপের স্বপ্ন মনের কোণে লালন করে এসেছে যেন জনম জনম ধরে! আজ সেই স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে। এত সুখ সে রাখে কোথায়? সুখের অত্যাচারে পাগল টাগল হয়ে যাবে নাতো? অর্ণবকে বিস্ময় ডোবা চোখে চেয়ে থাকতে দেখে তুরিন বলল, ‘আমার কিন্তু খুব ভালো লাগছে মিস্টার অর্ণব। আপনার কেমন লাগছে?’
অর্ণব একটু থতমত খেয়ে গেল প্রশ্ন শুনে। হালকা বিভ্রম এবং হালকা সম্ভ্রম নিয়ে বলল, ‘ভালো।’
গাড়িটা লালপাহাড় ঘেরা ছোট্ট শহর লায়ন্স ছেড়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই হাইওয়েতে উঠে পড়ল। জানালার কাচ নামানো। বিকেলের রোদ্দুর ভাসা দুর্দান্ত হাওয়া মেয়েদের খোলা চুল নিয়ে খেলায় মেতেছে। গান বাজছে উঁচু ভলিউমে।
Can you blow my whistle baby,
whistle baby Let me know
Girl I’m gonna show you how to do it
And we start real slow
You just put your lips together
And you come real close
গানের তালে তালে তুরিন আর আনিতা নেচে যাচ্ছিল। শিস দিচ্ছিল, গলা মিলাচ্ছিল। শাহজিদ গম্ভীর মুখে একনিষ্ঠভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। অর্ণব একটু জড়সড়ো, লজ্জিত। তুরিনের থেকে নিরাপদ দূরত্বে, জানালার কাচঘেঁষে বসেছে সে। জানে না কেন, একটু বাদে বাদেই নিশার ওই সলজ্জ, লালিত্যে ঘেরা কুসুমের মতো মসৃণ পেলব মুখ-চোখের সামনে ফ্ল্যাশ বাতির মতো জ্বলে উঠছে। এই মনে পড়াটা তার দীর্ঘশ্বাসের কারণ হচ্ছে। গাড়ির অভ্যন্তরের দুজন ফূর্তিবাজ সুন্দরী তরুণীর প্রাণোচ্ছ্বাস তাকে স্পর্শ করছে না। সে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে খাঁখাঁ করা এক বিষণ্ণ একাকীত্বে। গাড়ি ধীরেধীরে উঁচুতে উঠছিল। চার লেনের চওড়া রাস্তা। মাঝে একটা ডিভাইডার। রাস্তার দু পাশে খোলা মাঠ। গরু-ছাগল আর ঘোড়ার চারণক্ষেত্র। দূরে মালভূমির শেষ সীমানায় নীল আকাশে মাথা ঠুকে দিয়েছে সুউচ্চ রকি মাউন্টেন। পর্বতের চূড়ায় এখন বৃষ্টি নেমেছে। রোদ আর বৃষ্টিতে মিলেমিশে গলন্ত রুপোর মতো অলীক এক আলোতে ছেয়ে আছে জায়গাটা। শাহজিদের জলদ-গম্ভীর মুখে এক টুকরো বিকেল-মোড়ানো রোদ এসে পড়েছিল। চারিদিকে হাওয়ার ঝরোখা। সেই হাওয়ায় বাসন্তী ফুলের পরাগায়নের তীক্ষ্ণ সুবাস। তুরিন দেখছিল গাড়ির চালককে। চোখের মণির রংটা আশ্চর্য সুন্দর! আর আশ্চর্য সুন্দর ওই হাই- চিকবোন, সুচালো নাক, চেয়ে থাকার নিরাসক্ত, উদাস, একাগ্র ভঙ্গি! অর্ণব হঠাৎ লক্ষ করল সামনে বসা আনিতা এবং পাশে বসা তুরিন… দুজনেই একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে চালকের দিকে। হিংসে হলো না, কিন্তু ক্ষীণ একটা অপ্রসন্ন অসহায় ভাব আশ্রয় নিল মনে। নিজেকে অবাঞ্ছিত এবং অনাহূত মনে হলো। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলল, এই জায়গাটা তার জন্য ঠিক মানানসই নয়। তুরিন কখনোই তাকে বিয়ে করবে না। ভুল করেও না!
মধ্য পথে গাড়ি থামিয়ে ওরা কিছু খাবার-দাবার কিনে নিল। শ্যাম্পেইন আর বিয়ার কিনল। গ্রীষ্মকাল সমাসন্ন। এ সময় রাত আটটা পর্যন্ত আলো ধরে রাখে আকাশ। ভর গ্রীস্মে তো রাত নটায় সন্ধ্যা নামে। আই সেভেন্টি রাউটে উঠতেই পাহাড়গুলো আরো কাছে চলে এলো। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দশহাজার ফিট উঁচুতে! কানে তালা লাগছে একটু পর পর। রাস্তাটা এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে বহুদূরে। সামনে তাকালে মনে হয় আকাশ থেকে বুঝি একটা চকচকে রুপালি ফিতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। পাথুরে পাহাড়গুলো যেন বিশ্বস্রষ্টার নিজ হাতে তৈরি করা একেকটি ভাস্কর্য! রাস্তার মোড়ে মোড়ে সেই ভাস্কর্য পথিকদের অভিবাদন জানাচ্ছে। কোনকোন পাহাড় সবুজ পাইনগাছে ঢাকা। কোনটা লাল, কোনটা ছাই রঙের, আবার কোনটা এত চকচকে সাদা যে দেখলে মনে হয় বালুর ঢিবি। কোথাও একপাশে গভীর খাদ, অন্য পাশে রাস্তার একদম গা- ঘেঁষে ঊর্ধ্বলোক হয়ে আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে বাদামি রঙের পাথুরে পাহাড়। কিছু রাস্তা আবার পাহাড়ের পেট চিরে বয়ে গেছে। মনে হয় যেন প্রাচীন গুহার ভেতর দিয়ে চলছে গাড়ি।
কোন কোন রাস্তার মুখ বরাবর পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। দেখলে মনে হয় ওখানেই পথ শেষ। আর যাওয়া যাবে না। কিন্তু কাছাকাছি গেলেই পাহাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা রাস্তা ম্যাজিকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ওরা কেউ কোন কথা বলছিল না। তুরিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ একটা পাহাড়ি বাঁক ঘুরতেই গাড়ি তীব্রভাবে ঝাঁকুনি খেলো। তুরিনের ভারসাম্যহীন শরীরটা ঝপ করে এসে পড়ল অর্ণবের গায়ে। বেশ ঘাবড়ে গেল অর্ণব। নিজের অজান্তেই হাত-পা শক্ত হয়ে উঠল। তুরিনের মাথাটা ওর কাঁধের ওপর। গাড়ির ঝাঁকুনিতে নিয়ন্ত্রণহীন শরীরটা দুলছে একটু একটু। মনে হচ্ছে এখুনি পড়ে যাবে সিট থেকে। সেরকম কিছু হলে মেয়েটা নিশ্চয়ই আহত হবে। অর্ণব আড়ষ্ট হাতে তুরিনের মাথার পজিশনটা একটু ঠিক করে দিল। যাতে বেসামাল হয়ে পড়ে না যায়। তুরিন ঘুমের ঘোরে ওকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। তার শর্ট গাউন হাঁটুর অনেকখানি ওপরে পৌঁছে গেছে। ফরসা, চন্দন রঙের মসৃণ দুটি পা অর্ণবের হাঁটুর সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে বারেবারে। বীতশ্রদ্ধ লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে অর্ণব। জীবনে সে কোন মেয়ের হাত পর্যন্ত ধরেনি। সংকোচ হওয়াটা স্বাভাবিক। তুরিনের মতো সুন্দরী মেয়েরা কাছে এলে নাকি কত রকম ভাবের উদয় হয় পুরুষের মনে। কিন্তু অর্ণব এই মুহূর্তে শুধু একটি অনুভূতিই টের পাচ্ছে। সেই অনুভূতির নাম ভয়। হঠাৎ আনিতার চোখ পড়ল দৃশ্যটায়। বাঁকা হাসিতে ভরে উঠল ঠোঁট। মোবাইল বের করে দৃশ্যটা বন্দি করল সে ক্যামেরায়।
—‘কী হয়েছে?’ শাহজিদের প্রশ্ন।
আনিতা হাসতে হাসতে বলল, ‘এই দ্যাখো। লাভবার্ডস!’
শাহজিদ চোখের কিনার দিয়ে দেখল ছবিটা। অবাক দৃষ্টি আটকে গেল মোবাইলের ছোট্ট স্ক্রিনে। একটা তীর ছুটে আসল বুকে, চলকে উঠল রক্ত। চোখে জ্বালা! তুরিনের ওপর দ্রবীভূত হওয়া রাগের পারদ যেন হঠাৎ করেই আরো কয়েক মাত্রা উঁচুতে উঠে গেল। সামনের পাহাড়ি বাঁকে উল্টো পাশ থেকে একটা ট্রাক আসছিল। আরেকটু হলেই ট্রাকটার গায়ে ধাক্কা লেগে যেত। আনিতার চিৎকারে সম্বিৎ ফিরল শাহজিদের। বেঁচে গেল অল্পের জন্য। অর্ণব কথা বলল এতক্ষণে, ‘ভাই অনেক ড্রাইভ করলেন। এবার আমাকে দিন। নেক্সট একজিটে থামেন একটু।’
শাহজিদ উত্তর দিল না। মৃত চোখে চেয়ে রইল সামনে। হঠাৎ করেই তার ভেতরের সমস্ত উদ্যম যেন মরে গেছে। বাইরের রোদ ধোয়া ঝকঝকে বিকেল, মায়াবী আলো, নীল নির্জন আকাশ…এর সমস্তটাই এখন মিথ্যে এবং বানোয়াট!
সকলেরই একটু ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। তুরিনের ঘুম তো কুম্ভকর্ণের ঘুমের চেয়েও মারাত্মক শক্তিধর। গাড়ি রাইফেলসিটি পৌঁছুলো রাত ন’টায়। এবার রাত কাটাবার জন্য হোটেল চাই। অর্ণব গুগুলে দেখতে লাগল আশপাশে কোন হোটেলে খালি রুম পাওয়া যায় কি না। আনিতার একটু ভয় ভয় করছিল। বাড়িতে বাবা-মাকে কিছু জানানো হয়নি। ফোন করে বলতে হবে কোন বান্ধবীর বাসায় থাকছে। সত্য বলা যাবে না কিছুতেই। হোটেল খুঁজে পেতে পেতে রাত দশটা বেজে গেল। খিদেয় পেট চনমন করছে সবার। তুরিনকে জাগানো হলো শেষমেশ। অর্ণবের খুব কাছে নিজেকে আবিষ্কার করে প্রথমটায় থতমত খেয়ে গেল সে। থতমত চোখে থতমত গলায় বলল, ‘হোয়্যার অ্যাম আই?’
ওকে তখন এত কিউট দেখাচ্ছিল যে আনিতা গাল-টাল টেনে দিয়ে গুলুমুলু গলায় বলল, ‘অঅঅ…ইউ আর ইন প্যারাডাইস বেবি। ওয়েক আপ!’
ওরা হোটেলে চেকইন করেই রেস্টুরেন্ট খুঁজতে বেরিয়ে পড়ল। রাত নটার মধ্যে সব খাবার দোকান বন্ধ হয়ে যায়। দেখা গেল আশেপাশের তিরিশ মাইলের মধ্যে কোন রেস্তোরাঁ খোলা নেই। চল্লিশ মাইল দূরে ‘ডেনিজ’ আছে। এই ডাইনার চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। অগত্যা সেখানেই যেতে হলো। চিজ বার্গার, স্টেক আর পেট পুরে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ খেলো ওরা। সঙ্গে তুরিনের প্রিয় ডেজার্ট আইস্ক্রিম উইদ ব্রাউনি। কিন্তু খাবার পেটে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সব সমস্যার সমাধান হলো না। আরো একটি মৌলিক চাহিদা পূরণ হওয়া জরুরি। কেউ তো এক্সট্রা জামা-কাপড় আনেনি। রাতে পরবে কী? মেয়েরা গাউন আর হাই হিল জুতো পরে এসেছে। এসব পরে পার্টিতে যাওয়া যায় কিন্তু ট্র্যাভেল তো করা যায় না। ভাগ্য ভালো কাছাকাছি একটা ‘ওয়ালমার্ট’ পাওয়া গেল। জামা-কাপড় কেনার জন্য ওয়ালমার্ট উত্তম জায়গা নয়। তবে এই রাতের বেলা কোন শপিং মল খোলা নেই। তাই ওয়ালমার্ট ছাড়া গতিও নেই। ছেলেরা মেয়েদের পয়সা খরচ করার অনুমতি দিতে চাইছিল না। কিন্তু আনিতার আত্মসম্মান বোধ এবং নারীবাদী চেতনা টনটনে। জামা-কাপড় কেনার খরচ সে বহন করল। মেয়েরা খুব হইহই মুডে ছিল। অর্ণবও এখন অনেকটাই সপ্রতিভ। শুধু শাহজিদের গাম্ভীর্য কাটেনি। আনিতা অর্ণবের সঙ্গে সহজভাবে কথা বললেও তুরিনকে সে কেন যেন স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছিল না। কিন্তু তুরিনের এতে কিছুই এসে যায় না। তার পিঠে প্রজাপতির পাখনা লেগেছে। মনের আনন্দে ডানা ঝাপটে নেচে বেড়াচ্ছে।
দূর থেকে ঝরনার শব্দ ভেসে আসছিল। স্বাস্থ্যকর চনমনে সূর্যটা নির্মেঘ নীল আকাশে এক মসৃণ সাদা আলোর জাল ছড়িয়ে দিয়েছে। রোদ চড়েনি তখনো। মৃদু এবং মনোরম বাতাস মালভূমির খোলা চত্বরে প্রাণের উচ্ছ্বাস নিয়ে ফুরফুর করে বয়ে যাচ্ছিল। ঘড়িতে সকাল সাতটা। এই সকালেও ভিড় নিছক কম নয়। আজ সোমবার। অফিস-আদালত খোলা। হাইকিংয়ে ইচ্ছুক ব্যক্তিবর্গ ভোররাতেই বেরিয়ে পড়েছে। সূর্যোদয় দেখেছে। এখন অনেকেই ফিরে যাচ্ছে। গাড়ি পার্ক করে ওরা নেমে পড়ল। উঁচু-নিচু এবড়ো-খেবড়ো পথ। বেশ কিছু কটনউড গাছ ঘিরে আছে রাস্তাটাকে। শাহজিদ ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। ওর কারণে অন্যরাও গতি কমাতে বাধ্য হলো। হালকা অসন্তোষ নিয়ে সে সঙ্গীদের বলল, ‘প্লিজ ডোন্ট ওয়েইট ফর মি। গো অ্যাহেড গাইজ!’ আনিতা বলল, ‘তুমি প্রস্থেটিক লেগ ইউজ করো না কেন শাহজিদ?’ একটা গুমোট দীর্ঘশ্বাস চেপে শাহজিদ পাশ কাটানো গলায় বলল, ‘ইচ্ছা করে না।’
এই কারণেই…শুধু এই কারণেই সে লোকজনের সঙ্গে মেলামেশা কমিয়ে দিয়েছে। কিছুক্ষণ আলাপ চালিয়ে যাওয়ার পরেই যেকোনো মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে তার হারানো পা। বাঙালিদের মধ্যে এই নাক গলানোর স্বভাবটা অতিমাত্রায় উপস্থিত। স্থানীয় লোকজনও কম যায় না। হয়তো সরাসরি কিছু বলবে না, কিন্তু আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দেবে ক্রাচ ধারী মানুষ সব পরিস্থিতিতে সব স্থানে গ্রহণযোগ্য নয়।
কিছুদুর এগোতেই ঝরনার লহর বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেটে রঙের পাহাড় দৃশ্যমান হয়ে উঠল। যেন মাটি ফুঁড়ে হঠাৎ মাথা তুলে দাঁড়াল এক নয়নাভিরাম স্বর্গোদ্যান। পার্কিং লট থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে জলপ্রপাতটি অবস্থিত। রাইফেল ক্রিক নামের একটি বাঁধ এই তিন শাখাবিশিষ্ট জলপ্রপাতের উৎপত্তিস্থল। সিমেন্ট বাঁধানো সমতল পথটা পাহাড়ের পাদদেশের ক্ষুদ্র জলাশয়ের সঙ্গে মিশে বিলীন হয়েছে। পথের চারিধার সতেজ সাদা ঘাসফুলে ছেয়ে আছে। ডান পাশে একটা বাদামি রঙের পায়ে হাঁটার ব্রিজ। তার নিচে বয়ে চলেছে ক্রিকের স্বচ্ছ পানি। ব্রিজটি ক্রিকের দুধারের গাছগাছালি সন্নিবিষ্ট ট্রেইল সংযুক্ত করেছে। তিনটি শ্বেতশুভ্র জলপ্রপাতের ধারা পাহাড়ের বুক চিরে চঞ্চল হরিণীর ন্যায় নেমে এসে আছড়ে পড়ছে জলাশয়ে। মেটে রঙের পাহাড়ের গায়ে সবুজ এবং সোনালি আগাছার আস্তর। মাঝখানের ঝরনাটির সর্বাগ্রভাগ বরাবর ফুটে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ হলদে বুনোফুল। ফুলের প্রাচীরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে দুধের মতো সাদা জল। অর্ণবরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার ঠিক সামনেই জলাশয়। জলপ্রপাতের গুড়ি গুড়ি ছিটা এসে লাগছে ওদের চোখেমুখে। ডানদিকে একটা শাখা-পথ ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে ক্রিকের পার ঘেঁষে এঁকেবেঁকে এগিয়ে গেছে পাহাড়ের কাছাকাছি। জায়গাটা দেখলে মনে হয় প্রাচীন কোন গুহার প্রবেশপথ। কিছু পর্যটক ভিড় করে আছে ওখানে। শাহজিদ আর আনিতাকে ওই পথেই যেতে দেখা গেল। তুরিন অর্ণবকে তাড়া দিয়ে উঠল, ‘চলুন ওদিকে যাই।’
একটা টেবিলসংবলিত বেঞ্চ রাখা আছে পাহাড়ের সামনে। শাহজিদ ক্লান্ত বোধ করছিল। অনেকদিন এতটা পথ হাঁটেনি একটানা। বেঞ্চ পেয়েই বসে পড়ল ও। সাহায্য করল অর্ণব। ক্রাচ দুটো নামিয়ে রাখল টেবিলের ওপর। বাকিরা বসল বেঞ্চের উপরিভাগের টেবিলে। এদিক থেকে তৃতীয় ঝরনাটি সবচেয়ে কাছে। একটু এগোলেই ঝরনার জল স্পর্শ করা যাবে।
—‘ওই খানে যেতে চাই। ওই জংলি ফুলের কাছে।’ আনিতা বলল।
ওর হাতের ইশারা অনুসরণ করে অন্যরা তাকাল ওপরে। পাহাড়ের মাথায়, ঠিক যেখান থেকে মধ্যবর্তী ঝরনার শুরু, সেখানেই ধরে আছে থোকা থোকা হলদে ফুল।
—‘আমি বেশ কয়েকবার গিয়েছি।’ একটা বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিয়ে শাহজিদ বলল।
—‘তাই? ক্লাইম্ব করে?’
—‘নাহ…উড়ে উড়ে!’ মুখ বাঁকায় শাহজিদ।
আনিতা হাসতে হাসতে বলে, ‘আমাকেও একটু নিয়ে যাও উড়ে উড়ে।’
—‘এই পাহাড়ের ভেতর অনেক কেইভ আছে। সামনের ট্রেইলটা ধরে এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবে। এক কাজ করো, তোমরা সময় নষ্ট না করে পুরো জায়গাটা এক্সপ্লোর করো। আমি ওয়েইট করি এখানে।’
—‘না থাক। এখানেই বসে থাকি।’ অর্ণব আপত্তি করল।
—‘বসে থাকার জন্য এসেছেন নাকি? কাল বাদে পরশু আমার মতো ঠ্যাং হারিয়ে ফেললে আফসোস করবেন। কেপেবল আছেন। ঘুরে আসেন।’
আনিতা দ্বিধা নিয়ে শাহজিদকে বলল, ‘তুমি কি পারবে না যেতে?’
—‘আমি এক পা নিয়ে পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠব? রসিকতা করছ?’ রুষ্ট শোনাল শাহজিদের গলার স্বর।
—‘না না! পাহাড় ক্লাইম্ব করার কথা বলছি না। ট্রেইলটা ঘুরে দেখতে পারো।’
শাহজিদ চুপ করে গেল। আনিতা তুরিনকে বলল, ‘তুমি যাবে?’
তুরিন হাত-পা নেড়ে বলল, ‘আমি পাহাড় টাহার বাইতে পারব না।
আনিতা অর্ণবের দিকে তাকাল এবার। অর্ণব বলল, ‘আপনি যেখানে যেতে চাইছেন সেখানে আমার পক্ষে পৌঁছানো সম্ভব হবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে ওখানে যেতে পারি।’ কথাটা বলতে বলতে আঙুল তুলে দেখাল অর্ণব। প্রথম ঝরনার মাঝামাঝি জায়গায় পাহাড়ের একটা খাঁজ আছে। যেন পাহাড়ি প্রাসাদের বারান্দা। ওই পর্যন্ত উঠতে তেমন কষ্ট হওয়ার কথা না। অনেকেই উঠে পড়ছে অনায়াসে। আনিতা বলল, ‘তাহলে সেখানেই যাই আগে। শাহজিদ চলো! ধীরেধীরে উঠবে। আমরা হেল্প করব।’
একটু রেগে গেল শাহজিদ, ‘দ্যাখো আনিতা, যে পাহাড়ে একটা সময় কয়েক লাফে উঠে গেছি সেই পাহাড়ে ধুঁকে ধুঁকে মুমূর্ষু রোগীর মতো উঠবার কথা ভাবতে গিয়েই আমার খুব খারাপ লাগছে। আই ফিল ডাউন। রিয়েলি ডাউন।’
অর্ণব বলল, ‘থাক উনাকে আর প্যারা দিয়ে লাভ নাই। চলেন আমরা যাই। উনি এখানে থাকুক।’
কথাটা বলতে বলতে লাফ দিয়ে টেবিল থেকে নেমে পড়ল অর্ণব। নামল আনিতাও। তুরিনকে নড়তে চড়তে দেখা গেল না।
—‘বসে আছ কেন?’ আনিতার কড়া প্রশ্ন।
—‘তোমরা যাও। আমি যাব না।’ তুরিনের উত্তরটা সোজাসাপটা। শাহজিদ ধমকে উঠে বলল, ‘যাবে না কেন? হোয়াটস রং?’
—‘ইচ্ছে করছে না!’
শাহজিদ এবার অর্ণবের দিকে চেয়ে মিনতির সুরে বলল, ‘একে নিয়ে যান অর্ণব ভাই। প্লিজ নিয়ে যান।’
অর্ণব হাসতে হাসতে বলল, ‘উনি মনে হয় এখানেই থাকতে চাইছেন।’
—‘হ্যাঁ আমি এখানেই থাকতে চাইছি। আপনারা যান।’ বলল তুরিন, রসকষহীন গলায়।
অতএব তুরিনকে রেখেই অর্ণব আর আনিতা যাত্রা শুরু করল। আনিতার কাঁধে একটা ব্যাকপ্যাক। লাল টিশার্ট আর কালো থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। পায়ে কালো কেডস। অর্ণবের কাঁধে ব্যাগ নেই। হাতও খালি। একটা কালো হাফ প্যান্ট আর ছাই রঙের পোলো শার্ট পরনে। পায়ে ঢাকাশহরের মৌচাক থেকে কেনা দুই ফিতার চামড়ার স্যান্ডেল।
তুরিন একটু অভিমানী গলায় শাহজিদকে বলল, ‘তুমি আমার সঙ্গে এরকম করছ কেন? সমস্যা কী?’
শাহজিদ বিয়ারের ক্যানে চুমুক দিচ্ছে আর নিরাসক্ত চোখে চেয়ে আছে ঝরনার স্রোতের দিকে। চোখে দূরের দৃষ্টি রেখেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘সমস্যা হচ্ছ তুমি।’
—‘আমি সমস্যা?’
—‘হ্যাঁ।’
—‘কী দোষ করেছি আমি?’
—‘তোমাকে আমার ভীষণ বিরক্ত লাগছে!’
অপমান, অভিমান আর রাগে তুরিনের ফরসা মুখ আগুনের মতো কমলা হয়ে উঠল, ‘বিরক্ত লাগছে কেন?’
—‘এই যে অযথাই ভ্যাজর ভ্যাজর করে আমার মাথা ধরিয়ে দিচ্ছ। ওদের সঙ্গে গেলেই তো পারতে। ভেবেছিলাম একটু একা থাকব।’
—‘আমার কথা তোমার ভ্যাজর ভ্যাজর মনে হচ্ছে?’
—‘হচ্ছে।’
—‘তুমি চাও আমি চলে যাই এখান থেকে?’
—‘প্লিজ যাও। তোমার ফিয়ান্সের সঙ্গে বেশি বেশি টাইম স্পেন্ড কর। শুধু কাঁধে মাথা রেখে ব্যাক্কলের মতো ঘুমালে তো হবে না!’
তুরিন রাগে গমগম করে উঠল—
—‘টাইম স্পেন্ড তো করছিই…আর কী করব? জড়িয়ে ধরে চুমা খাবো?’ শাহজিদ তাকাল ওর দিকে তেরছা চোখে, তেরছা গলায় বলল, ‘ইচ্ছে হলে তাই করো। মানা করেছে কে?’
ফণা তোলা সাপের মতো ক্রুর দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল তুরিন শাহজিদের দিকে। তারপর ঝপ করে নেমে পড়ে বলল, ‘ঠিক আছে। সেটাই করছি তাহলে।’ অর্ণব আনিতা তখনো বেশিদূর যায়নি। তুরিন হনহনিয়ে হাঁটতে লাগল ওদের পিছুপিছু। আকাশি আর সাদা চেকের স্লিভলেস ওভারঅল পরেছে ও। পায়ে সাদা জুতা। পিঠে ঝুলছে মাইকেলকোর্সের সোনালি চেইনওয়ালা ছোট্ট সাদা ব্যাকপ্যাক।
তুরিন অর্ণবের একটা হাত পেছন থেকে খামচে ধরল। শাহজিদ বিধ্বস্ত চোখে দেখছে দৃশ্যটা। সে ভুলে গেছে নিঃশ্বাস নিতে। মুখ থেকে সরে গেছে রক্ত। কী করতে যাচ্ছে পাগলিটা? মানে পাগলামোর একটা সীমা থাকা চাই তো নাকি? তুরিন কিয়ৎক্ষণ বোকা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তারপর আস্তে করে ছেড়ে দিল অর্ণবের হাত। কিছু একটা বলল মুখে। পার হলো কয়েকটা থমকানো সেকেন্ড। টার্ন করল। তারপর অনেকটা দৌড়ে অতিক্রম করল ফিরে আসার পথটুকু। শ্বাসনালিতে আটকে থাকা দমটা অনেকক্ষণ পর ছেড়ে দিতে পারল শাহজিদ। আবিষ্কার করল তার বুক ধড়ফড় করছে অজানা এক আশঙ্কায়। এত ভয় পেয়ে গিয়েছিল কেন? কী আশ্চর্য! তুরিন ফিরে এসেছে। ওর মুখে উদ্বেগের বিন্দু বিন্দু দাগ। শাহজিদ শূন্য চোখে চেয়ে আছে সামনে। তুরিনকে কিছু বলার আগে নিজেকে ধাতস্থ করাটা বেশি জরুরি। সে মনোজগতের হালচাল ঠিক বুঝতে পারছে না। এই মুহূর্তে তার চোখের দৃষ্টি একটু বোকা বোকা। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা। একটা হতভম্ব ভাব ভ্যাগাবন্ডের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে মুখের চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে। অর্ণবের সঙ্গে তুরিনের ঘনিষ্টতা তাকে পীড়া দিচ্ছে কেন? এর কারণ কী? এতটা সংকীর্ণমনা সে কবে থেকে হলো? ভূতগ্রস্তের মতো বসে থেকে নিজের মনের এই বিচিত্র যুক্তিবিরুদ্ধ আচরণের পেছনে একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাইল সে। কিন্তু কোন লজিকই খাটল না মাথায়। কণ্ঠস্বরে একটু নিঃস্পৃহ ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে বলল,
—‘ফিরে এলে কেন?’
—‘এটা প্রপার টাইম না।’
— তাই?’
—‘ইয়াপ! ফার্স্ট কিস স্পেশাল হওয়া উচিত।’
—‘রিয়েলি?’
—‘হুম…এ বিষয়ে তোমার কী মতামত?’
—‘আমার কোন মতামত নেই। এসব নিয়ে ভাবি না।’ কঠিন হয়ে উঠল শাহজিদের গলা।
ঝরনার জলের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ছিটা এসে লাগছে ওদের চোখে-মুখে। দুধসাদা জলপ্রপাত পাহাড়ের চূড়া থেকে উপচে পড়ছে অবিরাম। সকালবেলার নরম আলো সারা গায়ে রোদের স্বর্ণকুচি মেখে রাজকীয় আঙ্গিকে হেলে পড়েছে ঝরনাধারার ওপর। পিচ্ছিল পাথরের খাঁজে খাঁজে ঝরঝর করে জলের প্রস্রবণ হুমড়ি খাচ্ছে, জান্নাতের সুধা যেন উপচে পড়ছে ধরিত্রীতে। সাদা সাদা জলের কণা স্বপ্নের মতো উড়ছে বাতাসে। প্রকৃতি কী নিখুঁত এক কারিগর! কোথাও কোন ছন্দপতন নেই! সূর্য এখন তেজহীন, তাই চোখ মেলে সবটাই দেখা যায়, অনুভব করা যায়, প্রাণ ভরে নিঃশ্বাসের সঙ্গে একদম বুক পর্যন্ত টেনে নেওয়া যায় বিশ্ববিধাতার গড়া এই আশ্চর্য রূপমাধুরী।
—‘ভাবোনি কেন কখনো?’ তুরিনের প্রশ্ন।
—‘ভাববার বিষয়ের অভাব পড়েনি, তাই।’
—‘তুমি কী রকম যেন হয়ে গেছ শাহজিদ!’
শাহজিদ ঘুরে তাকায়, ‘কী রকম?’
—‘কেমন যেন ইল-টেম্পার্ড, গ্রাম্পি!’
—‘আর তুমি?’
—‘আমি কী?’
—‘তোমার কী হয়েছে? তুমি তো আগে এত নিষ্ঠুর ছিলে না।’
—‘আমি নিষ্ঠুর?’
—‘নিশাকে চলে যেতে বলেছ কেন?’
তুরিনের মুখে হঠাৎ দিয়াশলাই কাঠির ঘষা লাগে। বারুদের ধোঁয়া ওঠে হালকা।
—‘ও…এই জন্যেই আমার সঙ্গে এতক্ষণ মিসবিহেভ করছিলে?’
—‘ঠিক ধরেছ।’
—‘তুমি সারাক্ষণ নিশা নিশা করো কেন?’
—‘নিশা একটা নিরীহ মেয়ে। ও নিরীহ বলেই তোমরা ওর সঙ্গে অন্যায় করছ। পৃথিবীতে নির্দোষ মানুষের সঙ্গেই অন্যায়টা বেশি হয়ে থাকে।
—‘নিশাকে নিয়ে এত ভাবছ কেন? ওর প্রেমে পড়েছ নাকি?’
শাহজিদ তুরিনের মুখের ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থাপন করল। এই মেয়েটার মাথা কি নিরেট? এর কথাবার্তায় কখনো বুদ্ধির ছাপ থাকে না কেন? গভীরতা থাকে না কেন? নিশা ধারণা করেছিল শাহজিদ নাকি তুরিনের প্রেমে পড়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে তুরিনের মতো এম্পটি-হেডেড, নির্বোধ মেয়ের প্রেমে পড়া শাহজিদের পক্ষে কখনোই সম্ভব না। বাহ্যিক রূপ ছাড়াও মানুষের অন্য কিছু থাকতে হয়। একটা এক্স ফ্যাক্টর লাগে। তুরিনের মধ্যে যা আছে সমস্তটাই মেয়েলি হীনম্মন্যতায় ভরা। অ্যাঞ্জেলিনার প্রেমে কখনো পড়েছিল কি না জানে না শাহজিদ, তবে সেই মেয়েটির মধ্যে ভাববুদ্ধির গভীরতা ছিল। জ্ঞানের আদিগন্ত পিপাসা ছিল। যুক্তির দেদীপ্যমান উপস্থিতি ছিল। সেসব গুণের সিকি ভাগও নেই তুরিনের মধ্যে। এরকম অবোধ, স্থূলবুদ্ধি, গভীরতাহীন মেয়েকে কেন ভালো লাগবে শাহজিদের মতো একজন বিবেচক, বিচক্ষণ, গভীর চিন্তাধারাসম্পন্ন যুবকের? কথাগুলো ভাবতে পেরে শাহজিদ মনে মনে কিঞ্চিৎ স্বস্তি বোধ করল। মস্তিষ্কের ধোঁয়াশা কেটে গেল। সে নিশ্চিত হলো তুরিনের প্রতি অনুভূতিটা আর যাই-ই হোক না কেন প্রেম নয়!
অনেকক্ষণ পর সে স্বাভাবিক হতে পারল। স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘দ্যাখো তুরিন, কাজটা তুমি ঠিক করোনি। তোমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত তুমি কিছুতেই তোমার বাবা-মায়ের ওপর চাপিয়ে দিতে পারো না। তোমার বাবা নিশাকে ডিভোর্স দেবে কি দেবে না সেটা নিয়ে তুমি কথা বলার কে? তুমি খুব বেশি হলে মতামত দিতে পারো কিন্তু আদেশ নয়।’
—‘আমার বাবাকে আমি কী বলব সেটা তুমি শিখিয়ে দেবে?’
—‘আমি তোমাকে কিছুই শেখাতে চাই না। বন্ধু হিসেবে শুধু মতামত দিতে পারি। আমার মনে হয় তোমার এতটুকু বোঝার মতো বয়স হয়েছে যে প্যারেন্টসদেরও ব্যক্তিগত একটা জীবন থাকে। আর তুমি নিশার কথা একবারও ভেবে দেখেছ? মেয়েটা ছোট একটা বাচ্চা নিয়ে কোথায় যাবে? ওর তো একা একা সার্ভাইভ করার অভ্যাস নেই। এতটা অবিবেচক কেন হলে? তুমি তোমার বাবা-মায়ের সম্পর্কটা যেভাবে দেখছ হয়তো বাস্তবতা তার ঠিক উল্টো। আমরা চোখ দিয়ে যা দেখি তার সবটাই সত্য নয় তুরিন! পৃথিবীতে অনেক অনেক ভুল দৃশ্য আছে। এই যে সূর্যটা দেখছ এটাও কিন্তু আট মিনিট আগের। পৃথিবী থেকে আমরা অতীতের সূর্যটাই দেখি সবসময়। আমার মনে হয় তুমিও তোমার বাবা-মায়ের অতীতেই আটকে আছ।’
তুরিনের কান্না পাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে নিঃসঙ্গ একাকী মানুষটি হলো সে নিজে। তার পাশে কেউ নেই। কেউ তাকে ভালোবাসে না। পৃথিবীটা ভীষণ নিষ্ঠুর! একটু আগের স্বর্গসুখ বাতাসে উড়ে গেছে সুদূরে ভেসে যাওয়া শুকনো পাতার মতো। শাহজিদের চোখজোড়া ঝরনার জলের ওপর নিবদ্ধ। সে নিস্তরঙ্গ গলায় বলে চলেছে,
—‘তুমি কি তোমার বাবাকে ভালোবাসো? যদি বেসে থাকো তবে তোমার জানা উচিত সে কী চাইছে। সে কি আদৌ নিশাকে ডিভোর্স দিতে চায়? আজ সকালে আমি যখন তার সঙ্গে কথা বলছিলাম আমার মনে হয়নি সে এখনো নিশাকে যেতে দেবার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত। তোমার এই অযাচিত আবদার তোমার বাবার মনে কী রকম প্রভাব ফেলতে পারে এটা তো একবার ভাবতে পারতে। আর তোমার মা…আই নো শি ইজ নট ইজি টু ডিল উইদ…’
—‘ডোন্ট সে অ্য ওয়ার্ড এগেইন্সট মাই মম!’ হঠাৎ ঝলসে উঠল তুরিন।
— ‘ঠিক আছে। তার ব্যাপারে আমি কিছু বলতে চাই না। বাট তুমি একটু চোখ খুলে তাকাও চারপাশে। বোঝার চেষ্টা করো।’
—‘বাবা তোমাকে কী বলেছে?’ কান্নাচাপা, উদ্বেলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল তুরিন।
—‘লেটস কিপ ইট বিটউইন হিম অ্যান্ড আই।’
—‘সো তুমি বলতে চাইছ আমার উচিত ওই মেয়েকে আমার বাবার স্ত্রী হিসেবে মেনে নেওয়া?’
—‘লিসেন তুরিন। সবার প্রথমে এটা বোঝার চেষ্টা করো তুমি কোন অথরিটি নও। তোমার মেনে নেওয়া না নেওয়ায় কিছু এসে যায় না। লাইফটা তোমার বাবা-মায়ের এবং নিশার। তাদের পারসোনাল ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করো না।’
—‘তাহলে ওরা কেন আমার পারসোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার করছে? কেন জোর করে ওই ছেলেটার সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইছে?’ তুরিনের কণ্ঠস্বর কাঁপছিল, এলোমেলো নিশ্বাসে মথিত হচ্ছিল বুক।
শাহজিদ অবিচল দৃঢ় গলায় বলল, ‘কারণ তারা ভাবছে তুমি এখনো ইম্যাচিওর। নিজের ভালো-মন্দ বুঝতে শেখোনি। কিছু বলার থাকলে এই বিষয়েই বলো। নিজের বিয়ে নিয়ে কথা বলো। বাবার বিয়ে নিয়ে নয়!’
তুরিনকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখাল। অসহায় গলায় বলল,
— ‘তাহলে আমার কী করা উচিত?’
—‘ইউ শ্যুড স্টে অ্যাওয়ে। ক্যান ইউ ডু দ্যাট?’
কথাটা বলে শাহজিদ ঘুরে তাকাল। তুরিন ওর এক হাত দূরে হাঁটু ভাঁজ করে বসেছে টেবিলের ওপর। বাতাসে সিল্কের মতো রেশমি নরম চুলগুলো উড়ছে। সকাল বেলার তেজহীন স্নিগ্ধ রোদ তিরতির করে কেঁপে কেঁপে একটা সোনালি রঙের নকশা আঁকছে ওর ফরসা মুখে। চোখের কোলভর্তি জলের আভাস। শাহজিদ কী কারণে যেন চোখ সরিয়ে নিল। পরমুহূর্তেই আরেকটিবার দেখতে ইচ্ছে করল তুরিনের বসে থাকার ওই বিষণ্ণ শৈল্পিক ভঙ্গিটা। একটু আগেই সে ভাবছিল এই ক্ষীণবুদ্ধি, নির্বোধ মেয়েটির মধ্যে কোন আকর্ষণ নেই। এক্স ফ্যাক্টর নেই। তাহলে এই মুহূর্তে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে কেন? নায়াগ্রা ফলস যখন প্রথমবার দেখেছিল, মনে হয়েছিল এই অতি সাধারণ একটি জলপ্রপাত নিয়ে পৃথিবীর মানুষের এত মাতামাতির অর্থ হয় না। এই স্থানের কোন বিশেষত্ব নেই। কিন্তু ফিরে আসার পর মনে হয়েছে জীবনে অন্তত আর একটিবার এই জলপ্রপাতটি তার দেখা চাই। নায়াগ্রার আশ্চর্য দিকটা সে বুঝেছিল নায়াগ্রাকে ছেড়ে আসার পর। জলের সেই ছন্দময় পতন, সুবিশাল বিস্তার, অলৌকিক শৈল্পিক গঠন অনেকদিন অবধি তার মনে একটা রহস্যময় আবেদনের সঞ্চার করেছে। তুরিনও কি নায়াগ্রার মতো বিধাতার আশ্চর্য কোন সৃষ্টি? ন্যাচারাল ওয়ান্ডার?
—‘আমাকে তুমি পছন্দ করো না, তাই না শাহজিদ?’
শাহজিদ একটা থম ধরা জটিল নিঃশ্বাস ফেলল, সময় নিয়ে। এই সোজাসাপটা দিকটাই অনেক মেয়ের মধ্যে নেই। মেয়েরা ভাবে এক, বলে আরেক। তুরিন সেটা পারে না বলেই হয়তো বোকা। এই বোকামির জন্য নিশ্চয়ই ওকে ক্ষমা করে দেয়া যায়। ও তো আসলে বাচ্চা মানুষ না, বাচ্চা খরগোশ। মানুষের ওপর রাগ করা যায়, খরগোশের ওপর রাগ করা যায় না।
—‘আমি কি কখনো এমন কিছু বলেছি?’ তুরিনের নরম মুখের ওপর নরম দৃষ্টি রেখে নরম স্বরে বলল কথাটা শাহজিদ।
—‘পছন্দ করো এমনটাও তো বলোনি কখনো!
—‘ইমোশনাল কথাবার্তা অতটা বলতে পারি না। অভ্যাস নেই।’
—‘আমি জানি তুমি নিশা কিংবা অ্যাঞ্জেলিনাকে যতটা পছন্দ কর আমাকে ততটা করো না।’
শাহজিদ কাষ্ঠ হেসে বলল, ‘নিশাকে দেখছি তুমি ভুলতেই পারো না।’
—‘বলো না শাহজিদ,আমার মধ্যে কি ভালো লাগার মতো কিছুই নেই?’
—‘তুমি বড্ড বোকা।’
—‘এই কারণেই কি আমাকে ঘৃণা করো?’
শাহজিদের মুখটা বিরক্তিতে একটু কঠোর হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে সাদা ঝরনার জলের দিকে চেয়ে থেকে উত্তর দিল, ‘আমি তোমাকে ঘৃণা করি না, তুরিন!’
—‘কেন? বোকা মানুষ কি ঘৃণার যোগ্যও হয় না?’
শাহজিদ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল তুরিনকে, ‘বাজে বোক না।’
তুরিন প্রত্যুত্তর করল না। বিষণ্ণ দুটি জলভাসা চোখ মেলে চেয়ে রইল শুধু। সূর্যের সোনালি আলোটা এখন ওর কণ্ঠার হাড় দখল করে নিয়েছে। স্পর্ধিত গ্রীবার খাঁজ কাটা কণ্ঠাস্থিতে খেলতে থাকা ওই আশ্চর্য রহস্য নায়াগ্রা ফলসের রহস্যকেও হার মানায়। ঝরনার কিরিকিরি মিহি ছাঁটে ভিজতে ভিজতে শাহজিদ বিবশ চোখে সেদিকে চেয়ে থেকে ভাবছিল হৃদয়ের আকর্ষণ-বিকর্ষণ হয়তোকোন যুক্তি মেনে চলে না। তুরিন হঠাৎ বলল, ‘আচ্ছা শাহজিদ, তুমি আমার দিকে যেভাবে তাকাও, অন্য মেয়েদের দিকেও কি ঠিক এভাবেই তাকাও?’
শাহজিদ অপ্রতিভ হলো কথাটা শুনে। শক্তপোক্ত শাণিত মুখখানায় লজ্জার একটু রেশ পড়তেই ভারী অন্যরকম সুন্দর দেখাল ওকে। নিস্তেজ গলায় বলল, ‘কেন? আমার তাকানোতে কি কোন সমস্যা আছে?’
তুরিন একটু কাছে এগিয়ে এলো। পাশাপাশি বসে টেবিলের বাইরে পা ঝুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘তাকানোতে কিছু একটা আছে। কিন্তু ওটা কোন সমস্যা নয়। বরং অন্য কিছু।
শাহজিদ জানে না কেন, ভেতরে ভেতরে তার মনটা একটু টাল খেয়ে গেল। শুধু এইই নয়। বোকা মেয়েটাকে হঠাৎ করেই তার একটু ভয় করতে লাগল। ভয় এই কারণে যে মেয়েটির মুখে লাগাম নেই। রাখঢাক করে কথা বলার নিয়ম-নীতি এ জানে না। এমন মানুষের সঙ্গে ভদ্রোচিত কথোপকথন চালিয়ে যাওয়া একটু কঠিন ব্যাপার। শাহজিদ সামনের দিকে চেয়ে ছিল। ডান মাড়িতে জিব ঠেকিয়ে কী যেন ভাবছিল গভীরভাবে। তুরিন হাসতে হাসতে বলল, ‘কী হলো?’
—‘কী হবে?’ একটু রাগ ঝরে পড়ে শাহজিদের গলায়।
—‘ওইদিকে তাকিয়ে আছ কেন?’
—‘তো কোনদিকে তাকাব? তোমার দিকে তাকালেও তো দোষ হচ্ছে!’ তুরিনের হাসির তোড় বেড়ে যায়,
—‘দোষের কথা কে বলল? তুমি আমাকে দেখতে পারো। পানিশমেন্ট হবে না।’
—‘তোমাকে দেখার জন্য মরে যাচ্ছি না!’
তুরিন শাহজিদের গাল টেনে দিয়ে বলে, ‘অঅঅ…রাগ করে না! এত কিউট কেন তুমি?’
শাহজিদ তুরিনের চিকন নরম আঙুলগুলোর কবল থেকে নিজের মুখটা চট করে সরিয়ে নেয়। ঝাঁঝ ধরা গলায় বলে, ‘ফালতু কথা বলো নাতো!’
—‘আচ্ছা তুমি কিউট নও। তাহলে কী? হট?’
—‘চুপ করো। চুপ করে বসে থাকো।’
তুরিন পা নাচাতে নাচাতে বলল, ‘কিন্তু এখন তো আমার চুপ থাকতে ইচ্ছে করছে না। বরং অনেক বেশি বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে।’
শাহজিদ আড়চোখে দেখল পাশে বসা অস্থিরমতি মেয়েটাকে। একটু আগের বিষণ্ণতা গায়েব। চোখে কষ্টের রেশ নেই। তার বদলে ছেলেমানুষি দুষ্টুমির অবাধ উপস্থিতি। পাগল আর কাকে বলে!
তুরিন ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সেলফি তোলার জন্য উদ্যত হতেই শাহজিদ ধমকে উঠল, ‘কী হচ্ছে?’
তুরিন দাঁত বের করা হাসি দিল, ‘চেকইন।’
—‘কীসের চেকইন?’
—‘ইন্সটায়।’
শাহজিদ জোর করে তুরিনের হাতে ধরা অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা ছিনিয়ে নিল, ‘সোশ্যাল মিডিয়াতে আমার কোন ছবি যাবে না।’
—‘সোশ্যাল মিডিয়া হেইট কর?’
—‘হ্যাঁ করি।’
—‘কেন?’
—‘সোশ্যাল মিডিয়া সাকস। ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া এরা কীভাবে তোমার পারসোনাল লাইফ ট্র্যাক করছে। ইউ আর অলঅয়েজ বিইং মনিটরড। প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই।’
তুরিন বোকা গলায় বলল, ‘তাতে সমস্যা কী? আমি তো চুরি-ডাকাতি করে পালাচ্ছি না!’
শাহজিদ একটা বড় শ্বাস ফেলল, ‘বুঝবে না। বাদ দাও।’
—‘আচ্ছা বাদ দিলাম। এখন বলো, তোমার কেমন লাগছে?’
—‘কেমন লাগবে আবার?’ শাহজিদ পানসে গলায় প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করে। -’ভালো লাগছে না?’
শাহজিদ উত্তর দেয় না। মাড়িতে জিব ঠেকিয়ে ভাবতে থাকে। ভাবতে ভাবতে আবিষ্কার করে আজকে অনেকদিন বাদে সে একটা জলজ্যান্ত পাহাড়ের মুখোমুখি বসে আছে কিন্তু তার মনের মাঝে পরাজয়ের গ্লানি নেই। এমনকি ওই পাহাড়ের চূড়ায় কয়েক লাফে উঠে যাওয়ার ইচ্ছেও হয়নি। বরং মনে হচ্ছে এখানেই বসে থাকে, যেভাবে আছে…এই পাগলিটার পাশে! এটাকে কি ভালো লাগা বলে? জানে না শাহজিদ!
—‘তুমি সোলমেটের কন্সেপ্ট বিশ্বাস করো?’ হঠাৎ প্রশ্ন করে তুরিন।
—‘না।’
—‘কেন? কখনো কাউকে ভালোবাসোনি?
—‘লাভ ইজ উইকনেস। আমার জীবনে কোন উইকনেসের জায়গা নাই।’
—‘ও!’ একবার মন খারাপের গলায় শব্দটা উচ্চারণ করে চুপ হয়ে যায় তুরিন। ঘাড় ঘুরিয়ে নিবিড় চোখে দেখে শাহজিদকে। একটা হালকা সবুজ টি- শার্ট, কালো ট্রাউজার পরনে। ঝরনার জল আর আলোর ছায়া পড়ছে হ্যাজেল রঙের অক্ষিতারকায়। তুরিন একটা ঘন শ্বাস ফেলে আস্তে করে বলে,
—‘আমি যদি দূরে কোথাও চলে যাই কখনো। তোমার কি আমাকে মনে পড়বে শাহজিদ?’
—‘কোথায় যাবে তুমি?’
—‘জানি না। ধরো অর্ণবের সঙ্গে বিয়ে হলো। তারপর আমরা অন্য কোথাও চলে গেলাম।’
শাহজিদ তুরিনের দিকে ঘুরে তাকাল। মোমের মতো মসৃণ গালের ওপর কয়েকটা এলোমেলো চুল পড়েছিল। চুল এসে পড়েছিল রক্তাভ পাতলা ফিনফিনে ঠোঁটে। শাহজিদ ওদিকে চেয়ে থেকে স্থির গলায় বলল, ‘তুমি তখন কী বলছিলে? আমার তাকানোর ব্যাপারে?’
তুরিন হাত দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে নেয় নিজের মুখের ওপর থেকে, ‘বলেছি তো একবার।’
—‘আমার তাকানোটা খারাপ? কেউ তো বলেনি কখনো আগে!’
—‘খারাপ কেন হবে? অন্যরকম!’
—‘অন্যরকমটা আবার কীরকম?’
—‘সেটা এমন যে তোমার চোখ দেখে আমি মনের কথা পড়তে পারি।’
—‘ও বাবা! তাই নাকি?’
—‘হ্যাঁ তাই তো!’
শাহজিদ হাসতে হাসতে বলল, ‘আচ্ছা? বলো তো দেখি আমি এখন কী ভাবছি?’
তুরিন গালে হাত রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পেতে দিল শাহজিদের মুখ বরাবর। ওদিকে ঝরনার জল নিরন্তরভাবে ঝরে পড়ছে ঝরঝরিয়ে। জলের ছিটা ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। কাছাকাছি একটা কটনউডগাছের গুঁড়ি ফেটে বেরিয়ে এসেছে সাদা তুলো। উড়ছে বাতাসে, আলোর গায়ে ভেসে ভেসে। তুলোর সাদা আঁশ এসে ভিড়েছে তুরিনের ফিনফিনে গোলাপি রঙের পাতলা সুন্দর ঠোঁটে। শাহজিদের চোখ আটকে গেছে ওখানে স্থবির হয়ে। একটা অনীর্বচনীয় ভালোলাগার ফিসফিসানি অবেলার টিপটিপ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়তে চাইছে ওর মনের শার্সিতে!
—‘আমি জানি তুমি এখন কী ভাবছ, বলব?’
—‘বলে ফেলো।’
তুরিন চোখ ঘুরিয়ে, মুখ বাঁকিয়ে বেশ কায়দা করে বলল, ‘ইউ ওয়ান্ট টু কিস মি!’
শাহজিদ হাঁ হয়ে গেল। বিস্ময়ের জোর ধাক্কায় কয়েক সেকন্ড থ মারা চোখে চেয়ে থেকে সজোরে বলে উঠল, ‘হেল নো!’
—‘হেল ইয়াহ! ইউ ওয়ান্ট টু কিস মি সো ব্যাড!’
শাহজিদ পাশে রাখা ক্রাচ দুটো তুলে নিতে নিতে বলল, ‘দিস ইজ ইনসেইন! ইউ হ্যাভ গন ক্রেজি!’
—‘কোথায় যাচ্ছ?’
—‘নিরাপদ দূরত্বে।’
তুরিন শাহজিদের লাল হওয়া মুখের দিকে চেয়ে হাসতে হাসতে বলল, ‘ভয় পাচ্ছ?’
—‘হ্যাঁ পাচ্ছি। তুমি কি আসলেই মানুষ নাকি ডাইনি?’
তুরিনের হাসির জোয়ারে ভাটা পড়ার লক্ষণ নেই। তার জীবনে এমন মুহূর্ত খুব কমই এসেছে যখন সে বাবা-মায়ের ভঙ্গুর সম্পর্কের কথা ভাবেনি, নিশাকে নিয়ে অনিরাপত্তায় ভোগেনি। আজ যেন তার কোন দুঃখ নেই, দুশ্চিন্তা নেই। যে কেউ ওর মুখের দিকে তাকালে বলে দিতে পারবে এই সুন্দর পরির মতো দেখতে মেয়েটা নিশ্চয়ই পৃথিবীর সবচাইতে সুখী মানুষদের একজন। শাহজিদ ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। তুরিন ওর আড়ষ্ট, সংকোচে ভরা আরক্ত মুখের দিয়ে চেয়ে অবলীলায় বলল, ‘তুমি চাইলে তোমার ইচ্ছে পূরণ করতে পারো শাহজিদ। আই ডোন্ট মাইন্ড।’
শাহজিদ কথাটার কোন উত্তর দিল না। সে দৌড় দেয়নি, ওয়ার্ক আউট করেনি, তবুও তার হার্টবিটের গতি এত বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে যে হাঁসফাঁস লাগছে। তুরিন লাফ দিয়ে নেমে বলল, ‘এই যে লাজুক ছেলে! চলো ওইদিকে যাই।’
—‘তুমি যাও।’
—‘আমার সঙ্গে তুমিও যাবে।’
—‘সিঁড়ি বেয়ে উঠব কীভাবে?’
—‘খুব বেশি বড় না সিঁড়িটা। তোমাকে পারতে হবে। আগে থেকেই হার মানলে হবে না।’
শাহজিদ সামনের পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া সিঁড়িটার দিকে একবার তাকাল। ক্রাচ নিয়ে হাঁটাহাঁটিটাই একটা বিশাল ঝামেলার ব্যাপার। তার ওপর সিঁড়ি বাওয়া…! তুরিন ওর কনুইয়ে একটা হাত রেখে বলল, ‘এসো আমার সঙ্গে। আনিতা ঠিকই বলছিল, তুমি নকল পা লাগাও না কেন?
—‘ইচ্ছা করে না। নকল জিনিসের ওপর ভরসা নাই। তা ছাড়া আমার নি জয়েন্ট ইন্ট্যাক্ট নেই।’
—‘তাতে কী?’
—‘নি জয়েন্টে প্রব্লেম থাকলে প্রস্থেটিক লেগের মুভমেন্টে সমস্যা হয়।’
সিঁড়ি ভাঙতে বেশ সময় লাগল ওদের। একটা সিঁড়ি পার হওয়া যেন পাহাড় বেয়ে ওঠার মতো সময় সাপেক্ষ এবং কষ্টকর। অ্যাক্সিডেন্টের পরপর ট্রেনিং নিয়েছিল বলেই পারল শাহজিদ। পারার পর তার ভালো লাগছিল। হারিয়ে যাওয়া, ছিটিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস একটু একটু করে জোড়া লাগছিল যেন। একপাশে মেটে রঙের পাহাড়ের পাথুরে গা অন্য পাশে জঙ্গল। একটা ক্ষীণ নালা বয়ে গেছে জংলা ঝোপের ওপর দিয়ে। এদিকটায় কেউ নেই। ছুটির দিন নয় বলে টুরিস্টের সংখ্যা এমনিতেই নগণ্য। এবড়োখেবড়ো সুঁড়িপথ দিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিল ওরা। জঙ্গলের গাছে গাছে বুটিকাটা আলো ছায়ার খেলা চলছে। চিরুণির মতো বয়ে যাচ্ছে মৃদু হাওয়া। সেই হাওয়ায় বাসন্তী ফুল আর পাহাড়ি পাথরের ঝরনাভেজা গায়ের ঘ্রাণ মিলেমিশে একাকার। বনের আনাচে-কানাচে হলদে, বেগুনি আর সাদা ফুলের ছড়াছড়ি! বনের খুব গভীরে একটা প্যাঁচা ডেকে ওঠে হঠাৎ হঠাৎ। তুরতুর করে দৌড়ে যায় সোনালি চামড়ার দুরন্ত কাঠবিড়ালি।
কিছুদুর আসার পর একটি সুড়ঙ্গ চোখে পড়ল। এসব সুড়ঙ্গ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। ভেতরে ঢুকে তুরিন মুগ্ধ হয়ে গেল। কী শান্তি শান্তি ঠাণ্ডা একটা স্পর্শ! এই শীতলতা অন্য রকম। একেবারে পাহাড়ের প্রাচীন হিমেল গা থেকে ভেসে আসা। মাথার ওপরে শিলা প্রস্তরের ছাদ, চারিদিকে পাথুরে দেয়াল। এই স্থান একসময় হয়তো আদিবাসীদের বাসস্থান ছিল। কত শত শতাব্দীর সাক্ষী হয়ে আজও জীবিত আছে! আজও কত দুর্গম রহস্য এই পাহাড়ের পেটের মধ্যে লুকিয়ে আছে কে জানে! গুহার ভেতরে একটা পাথরের তৈরি বেদি আছে। শাহজিদ বসে পড়ল। তুরিন বলল, ‘জায়গাটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। এখানে কেউ আমাকে সংসার করতে বললে রাজি হয়ে যাব। বুঝলে শাহজিদ?’ বদ্ধ গুহায় তুরিনের কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হলো। শাহজিদ মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘খুব ভালো! এখানে একটা জিন বাস করে। তার বয়স ছয়শর কাছাকাছি। তাকে প্রপোজ করে দেখতে পার। সে বিয়েতে রাজি হলে তোমাকে আজকেই তার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিই। তারপর ঘর-সংসার শুরু করো। কী বলো?’
তুরিন একটু ভয় পাওয়া গলায় বলল, ‘আসলেই? যা!’
শাহজিদ হাসতে লাগল, ‘তোমার ভয় কীসের? তুমি তো ডাইনি। জিনকে বশ করতে পারবে না?’
—‘মানুষকেই বশ করতে পারলাম না আজ পর্যন্ত। আর জিন!’
তুরিন পুরোটা জায়গাজুড়ে ফরিংঙের মতো তিড়িংবিড়িং করে উড়ে বেড়াচ্ছিল, ঘুরে বেরাচ্ছিল। বাচ্চাদের মতো আমোদে আটখানা হয়ে বলছিল, দ্যাখো আমাদের কথা ইকো হচ্ছে! কী মজা!
শাহজিদ একা বোকা হয়ে বসে থেকে গালে হাত রেখে মেয়েটার নাচানাচি দেখছিল। ভালো লাগার মতো অসাধারণ কোন দৃশ্য না। কিন্তু আজগুবি বিষয় হলো শাহজিদের ভালো লাগছে! ভালো লাগার এক অদৃশ্য ঝাড়লণ্ঠন গুহার প্রস্তরীভূত ছাদ থেকে নিঃশব্দে নেমে এসে নীল জোছনার মতো নরম আলোর বিকিরণ করছে চারিপাশে। কী কারণে যেন এমন বোকা, নির্বোধ, আর ইংরেজিতে যাকে বলে ‘মিন গার্ল’ ঠিক সেরকম একটা মেয়েকেই তার এই মুহূর্তে স্বর্গের অপ্সরা বলে ভ্রম হচ্ছে। মেয়েদের সঙ্গে কম মেশেনি জীবনে। অনেক গুণবতী, বুদ্ধিমতি, সাহসী মেয়ে দেখেছে। কিন্তু হৃদয়ের গভীর গোপন বদ্ধ কুঠুরিতে কেউ কখনো এমন আচানক ঝড় তোলেনি যেভাবে…যাঃ কী ভাবছে এসব? নিজেকে একটু শাসন করা প্রয়োজন। শাহজিদ ক্রাচ দুটো হাতে নিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, ‘চলো! এখানে আর বসে থেকে কাজ নেই।
তুরিনের দৃষ্টি তখন আটকে গেছে ডিম্বাকৃতির সুড়ঙ্গ দরজার বাইরে। সেকেন্ড না গড়াতেই ভয়ানক আর্তচিৎকারে ফেটে পড়ে দুই লাফে শাহজিদের কাছে চলে এলো। শাহজিদ অবাক, ‘কী হয়েছে?’
তুরিনের চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। গলা দিয়ে গোঙানির মতো অদ্ভুত শব্দ বের হচ্ছে। আতঙ্কে সাদা হয়ে গেছে মুখ। কোন মতে হাতের আঙুল তুলে ইশারা করল সে। শাহজিদ ওর ইশারা অনুযায়ী বাইরে তাকিয়ে দেখল একটা চিকন দেহের সবুজ চকচকে সাপ গুহার ঠিক দরজার বাইরে ফণা তুলে বসে আছে। শাহজিদ তুরিনের একটা হাত ধরল, ‘এত ভয়ের কিছু নেই। এই সাপ বিষাক্ত নয়।
তুরিনের সারা শরীর কাঁপছে থরথর করে। মুখে এক বিন্দু রক্ত নেই। গোঁগোঁ করে বলে উঠল, ‘আমার ফোবিয়া আছে। সাপ সহ্য করতে পারি না। আল্লাহ! এখন আমি কী করব? কী করব?’
শাহজিদ তুরিনকে টেনে নিয়ে পাশে বসাল। ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘এই সাপকে ভয়ের কিছু নেই। এটার নাম আমি ভুলে গেছি বাট আই অ্যাম মোর দ্যান শিওর যে এই ব্যাটা তোমার-আমার চাইতে বেশি নিরীহ। নেটওয়ার্ক থাকলে আমি এখনই তোমাকে গুগল করে দেখাতাম।’
এ কথায় তুরিনের ভয় প্রশমিত হলো না, বরং আরো বৃদ্ধি পেল, ‘নেটওয়ার্ক নাই! এখান থেকে এই সাপ না সরলে আমরা বের হতে পারব না। কাউকে ডাকতেও পারব না ফোন করে!
—‘ভয় পেও না। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকো। ও চলে যাবে।’
তুরিন আড়চোখে দেখতে লাগল সাপটাকে। ওর কপাল ঘামছে। সারা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে।
—‘তুমি ওর দিকে তাকাচ্ছ কেন বারবার? চোখ বন্ধ করে থাকো। ভয় কেটে যাবে।’ শাহজিদ আদেশ করল।
ঠিক সেই মুহূর্তে ফণাধারী সাপটা তার ছিপছিপে শরীরে আঁকাবাঁকা ছন্দ তুলে কিলবিলিয়ে গুহার ভেতরে প্রবেশ করল। তুরিন চমকে উঠে শাহজিদকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। পাগলের প্রলাপ বকার মতো বলতে লাগল, ‘আল্লাহ এখন কী হবে? বাঁচাও…বাঁচাও আমাকে!
শাহজিদ ভারি বিরক্ত গলায় বলল, ‘আচ্ছা আমি দেখছি কী করা যায়। তুমি সরো। আমাকে উঠতে দাও।’
তুরিন চিৎকার করে উঠল, ‘না…তুমি কোথাও যাবে না আমাকে ছেড়ে। প্লিজ কোথাও যাবে না!’ সাপটা গুহার মুখের দরজা বরাবর শুয়ে আছে এখন। শাহজিদ একা হলে একে ডিঙ্গিয়ে চলে যেত কখন! কিন্তু তুরিনকে নিয়ে সেটা সম্ভব নয়। একটা পর্যায়ে তুরিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।
—‘আমার বিশ্বাস হচ্ছে না একটা সাপের সঙ্গে আমি একই ঘরে আছি। ও গড! হেল্প মি! প্লিজ হেল্প মি!’ আর্তনাদটা বদ্ধ গুহার দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে, প্রতিধ্বনিত হয়ে, ভীষণ প্রকটভাবে কানের পর্দায় আঘাত হানতে লাগল। শাহজিদের বুকের ওপর তুরিনের মাথাটা রাখা ছিল। খাঁচাবন্দি পাখির মতো ছটফট করছে মেয়েটা। ওর ফোবিয়া মারাত্মক। শাহজিদ একটু নার্ভাস বোধ করছিল। এদিকে তুরিনের কান্নার তোড় বেড়েই যাচ্ছে। সাপটারও নড়াচড়ার লক্ষণ নেই। পা ঠিক থাকলে তুরিনকে তুলে নিয়ে কখন পেরিয়ে যেত জায়গাটা! আরো একটিবার জীবন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল তার অসহায় পঙ্গুত্বকে। শাহজিদ একটা বড় শ্বাস ফেলে তুরিনের কান্নারত মুখটার দিকে তাকাল। আবছা আলোয় দেখল ওর কান্নায় মাখামাখি গাল, ফোলা চোখ, কাঁপতে থাকা ঠোঁট। নচ্ছাড় সাপটা ঠিক সেই সময়েই হিসহিস করে নড়ে উঠল আবার। তুরিন বিদ্যুৎচমকের মতো কেঁপে উঠে চিৎকার করে বলল, ‘এটাকে মারো। বিদায় করো। প্লিজ প্লিজ!’
—‘চিৎকার করো না। চুপ করে থাকো। এরকম লাফালাফি দাপাদাপি করলে ও যাবে না এখান থেকে।’
তুরিনের চিৎকার থামল না। উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। অদ্ভুত স্বরে গুঙিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে লাগল সে। মেজাজটা চড়ে যাচ্ছিল শাহজিদের। একটা চটকানা দিয়ে মেয়েটাকে থামিয়ে দিতে মন চাইছে। বাবা-মা ছোটবেলায় শাসন করলে ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে এমন অবাধ্য হয় না। ছোটবেলায় একে শাসন করা হয়নি। সে ক্রুদ্ধ চোখে তুরিনের ফোলা ফোলা লাল মুখটা দেখতে লাগল। দেখতে দেখতে হঠাৎ মায়া হলো। সে এক অদ্ভুত বাঁধভাঙ্গা মায়া! এরকম মায়া সচরাচর হয় না তার। নরম স্বরে বলল, ‘চিৎকার চ্যাঁচামেচি বন্ধ কর।’
তুরিন থামল না।
—‘চুপ করো! নইলে আমি দেখছি কীভাবে তোমার মুখ বন্ধ করা যায়।’
কে শোনে কার কথা! তুরিন আতঙ্কিত বিধ্বস্ত চোখে সাপটার দিকে চেয়ে চেয়ে ফোঁপাতে লাগল। শাহজিদ হঠাৎ দুহাত দিয়ে ওর মুখটা তুলে ধরল। তারপর কোন ভূমিকা ছাড়াই পাতলা ফিনফিনে ঠোঁটজোড়ায় একটা কবোষ্ণ চুম্বনের টেকসই সিল মেরে দিল! তুরিনের গোঙানি থেমে গেছে। সেই সঙ্গে থেমে গেছে শ্বাস-প্রশ্বাস। ঠোঁটদুটো ঈষৎ ফাঁকা। চোখে ভয়াবহ বিস্ময়! শাহজিদ ওর গোলাপি অধরে বৃদ্ধাঙ্গুলি চেপে জলদগম্ভীর সুরে বলল,
‘শোনো, তখন তোমার মাইন্ড রিডিং ঠিক ছিল।’ গুহার মধ্যে কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হয়। বুকের মধ্যে শব্দরা বাজতে থাকে ঝনঝন করে। দুটি তরুণ হৃদয়ের অস্বাভাবিক হৃৎস্পন্দনে কাঁপতে থাকে প্রাচীন পাহাড়। তুরিন কিছু বলতে পারে না। চেয়ে থাকে শুধু ফ্যালফ্যাল করে। স্থান, কাল পরিবেশ কোন কিছুর আর হুঁশ থাকে না।
—‘আই রিয়েলি ওয়ান্টেড টু কিস ইউ!’
কথাটা বলে শেষ করেই শাহজিদ তুরিনের ঠোঁটে আরো একটি চুমু খেলো, দীর্ঘ…দীর্ঘক্ষণ ধরে! তুরিনও নিরুত্তর রইল না। উষ্ণ, প্রখর, দুরন্ত চুম্বনের উদ্দীপ্ত আস্ফালনে সুরঙ্গর বদ্ধ, থমকানো বাতাস থেকে থেকে আন্দোলিত হতে লাগল। শত শত নিষ্কলঙ্ক ভালোলাগার পায়রা যেন ওদের কানের একদম পাশঘেঁষে তির্যক গতিতে ডানা ঝাপটে উড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিতে লাগল অগ্নিলাভার লকলকে সূর্যটার ঠিক বুক বরাবর। তুরিনের তন্বী, কৃশ ঢেউ খেলানো কটিদেশের যেখানটায় শাহজিদের ডান হাতের পাঁচ আঙুল গলিত মোমের মতো দেবে যাচ্ছিল ক্রমশ, শাহজিদ জানে না ঠিক সেখানটায়ই তার নামটি বড় যতন করে খোদাই করা আছে, লেখা আছে, সংরক্ষিত আছে অনেক অনেক দিন ধরে!
—‘কী করছ শাহজিদ? কেন করছ?’ অনেকক্ষণ পর একটা পরিপূর্ণ বাক্য উচ্চারণ করল তুরিন। ভাঙা ভাঙা এলোমেলো কণ্ঠে।
শাহজিদ থামল। উত্তপ্ত আর এলোমেলো নিঃশ্বাসে লাগাম দেয়ার চেষ্টা করে একবার তাকাল চারপাশে। চট করে তুরিনকে ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘সাপটা নেই। চলো এখান থেকে!’
তুরিন স্থবির হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। ফাঁকা…ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা একটা শূন্য অনুভূতিতে ছেয়ে গেল মন। অনেক কষ্টে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।
তোমারি বিরহে রহিব বিলীন,
তোমাতে করিব বাস
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস!
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.
—‘ডেকেছিলেন বাবা?’
শ্বশুরমশাইয়ের ঘরের দরজার ফাঁকে মাথা বাড়িয়ে দিয়ে বিনীত স্বরে প্রশ্ন করল নিশা।
—‘হ্যাঁ ডেকেছিলাম। এসো, ভেতরে এসো।’
একটা ক্ষীণ বাতি জ্বলছে। সোফার ওপর মুর্তজা সাহেব বসেছেন। তাঁর ঠিক পাশেই বসেছে জাহিদ। মেঝের কার্পেটে জুবিন হামাগুড়ি দিচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ উঠে দাঁড়াচ্ছে। মিসেস মুর্তজা নাতনির হাত ধরে হাঁটানোর চেষ্টা করছেন। নিশা একটু জড়সড়ো ভঙ্গিতে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়াল।
—‘দাঁড়িয়ে কেন? বসো বৌমা।’
—‘আমি ঠিক আছি বাবা।’ আড়ষ্টভাবে কথাটা বলে নিশা একবার চোরা চোখে জাহিদকে দেখল। গম্ভীর মুখে বসে আছে। ঘণ্টাখানেক আগে উঠোনে দাঁড়িয়ে শাহজিদের সঙ্গে কথা বলছিল। এখন কী চলছে ওই লোকের মনের মধ্যে খোদা জানে! হঠাৎ কেন এই জরুরি তলব? ডিভোর্সের বিষয়টা উত্থাপন করেছে নাকি মা-বাবার কাছে? নিশার বুকটা উদ্বেগে ভারী হয়ে ওঠে। দুশ্চিন্তায় দপদপ করে মাথার রগ।
মুর্তজা সাহেব শান্ত গলায় বললেন, ‘বৌমা তোমার মনে আছে কি না জানি না, আসছে শনিবার আমাদের জুবিনের বার্থডে। আমি ভাবছি এবার ঘটা করে ওর জন্মদিন পালন করব। তোমার কী মতামত?’
নিশা কী বলবে বুঝে পেল না। জন্মদিন পালন করার অর্থ হলো আত্মীয়স্বজন ডেকে এনে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করা, কেক কাটা, ছবি তোলা। তা উনার নাতনিকে নিয়ে উনি এসব করতেই পারেন। কিন্তু এতে নিশার কী অবদান থাকতে পারে? নিশাকে তো খুব কাছের আত্মীয়-স্বজনরাও দেখেনি কখনো। বন্ধু-বান্ধব তো দূরের কথা। জুবিনকে সবাই ফারার মেয়ে হিসেবেই চেনে। তাহলে জুবিনের জন্মদিনে নিশার কী করার আছে? রান্নাবান্না? সেতো রোজকার কাজ। জন্মদিনের অতিথিদের জন্যও নাহয় করবে। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে বসে থাকবে।
দ্বিধাগ্রস্ত গলায় নিশা বলল, ‘আপনি যা ভালো বোঝেন করেন বাবা। আমার কোন মতামত নেই।’
মুর্তজা সাহেব জাহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি কী বলো?’
জাহিদ শ্রাগ করল, ‘জন্মদিন তো করাই যায়। নো বিগ ডিল। কিন্তু আমরা তো থাকছি না। এক সপ্তাহের জন্য ফ্লোরিডা যাচ্ছি। ভ্যাকেশনে।
—‘তাই নাকি? বলোনি তো আমাকে। কে কে যাচ্ছ?’
—‘এইতো আমি, ফারা আর আমাদের কিছু বন্ধু-বান্ধব।’
মুর্তজা সাহেব থমথমে মুখে বললেন, ‘এটা কোন কথা হলো? জুবিনের জন্মদিনে তুমি থাকবে না? ফারা যাক। তুমি থাকো।
জাহিদ একটা বড় শ্বাস ফেলে বলল, ‘আসলে বাবা, আমার বেশ কিছু ছুটি জমা হয়ে গিয়েছিল। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না…তাই ভাবলাম…’
—‘ঠিক আছে…তোমার যেখানে ইচ্ছা যাও। আমার নাতনির জন্মদিন আমিই সেলিব্রেট করব। ধুমধাম করে করব!’ অসন্তোষ নিয়ে রায় ঘোষণা করলেন মুর্তজা সাহেব।
জাহিদ হঠাৎ নিশাকে বলল, ‘তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো।’
নিশা বুঝল জরুরি কথার পালা শেষ হয়নি। আদতে আসল কথাটি এখনো আলোচনায় উঠেই আসেনি। জাহিদ নিশ্চয়ই তুরিনকে করা ওয়াদা নিয়ে কথা বলবে বাবা-মায়ের সঙ্গে। একটা ফয়সালা হয়তো আজকেই হয়ে যাবে, এখুনি এই মুহূর্তে। ভালো তো…ভালো না? চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত যত তাড়াতাড়ি নেওয়া সম্ভব হবে ততই আগামীর পথ সুগম হবে। বুঝতে পারছে নিশা। পরিপূর্ণ সচেতনভাবে এবং সজ্ঞানে সবকিছু বুঝে শুনেও একটা গায়ে কাঁটা দেওয়া, দাঁতে দাঁত লাগা উৎকণ্ঠা এবং ব্যাকুলতা তাকে জাপটে ধরেছে চারপাশ থেকে। জাহিদের আদেশ অমান্য করল না সে। বিছানার ওপর বসল। জুবিন গুটিগুটি পায়ে হেঁটে এগিয়ে এলো ওর দিকে। মুখ দিয়ে শব্দ করল ‘মাম্মাম্মামমাম’। মিসেস মুর্তজা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, ‘মাকে ডাকল। মা শা আল্লাহ। মা শা আল্লাহ।’
এই ছোট্ট ঘটনাটি উপস্থিত সদস্যদের মনে একটি নিষ্কলুষ আনন্দের সঞ্চার করল। নিশা আনন্দে আটখানা হয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিতে যাচ্ছিল। মুর্তজা সাহেব একটু ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘কোলে নিও না। ছোটাছুটি করুক। তোমরা সারাক্ষণ বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে রাখো কেন?’
নিশা শ্বশুরের হুমকি শুনে নিরস্ত হলো। দাদির কাছে ফিরে গেল জুবিন টলমলে নাজুক পায়ে থপথপ করে।
—‘আপনাদের সঙ্গে একটু কথা ছিল।’ জাহিদ বলল।
—‘শুরু করো।’ চেয়ারের পিঠে হেলান দিলেন মুর্তজা সাহেব।
জাহিদ নিশার দিকে একবার তাকাল। চোখ নামিয়ে নিল নিশা। তার বুক কাঁপছে। পরীক্ষার ফলাফল আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে যেরকম ভয়মিশ্রিত দুশ্চিন্তায় কাবু হয় ছাত্রছাত্রীর দুর্বল মন ঠিক সেরকম একটা ভয়ে দাপাদাপি করছে ভেতরটা। লোকটা কি সত্যিই ডিভোর্সের কথা ভাবছে? পারবে কাজটা করতে? একটুও বুক কাঁপবে না?
—‘বাবা আমি আপনার সঙ্গে তুরিনের বিষয়ে কথা বলতে চাইছিলাম। আপনার উচিত অর্ণবকে নিশা আর জুবিনের ব্যাপারে খুলে বলা।’
মুর্তজা সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, ‘আজ সন্ধ্যায় ছেলেটির সঙ্গে আমি এই ব্যাপারে কথা বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাকে তো পাওয়া গেল না। তুরিন আনিতাকেও তো দেখছি না অনেকক্ষণ ধরে। এরা কোথায়?’
—‘তুরিন আর আনিতা এক সঙ্গেই আছে। বলল ফ্রেন্ডের বাসায় আজ রাতে থাকবে।’
—‘কোন ফ্রেন্ড? খোঁজখবর নিয়েছ তো ঠিকমতো?’
জাহিদ বিরক্ত বোধ করল। ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার পর একটু প্রাইভেসি দিতে হয় এই বিষয়টা বাবা-মাকে কিছুতেই বোঝানো যায় না। সে পাশ কাটানো গলায় বলল, ‘নিয়েছি। ওরা ঠিক আছে। চিন্তা করবেন না।
—‘অর্ণবের সঙ্গে আমি সব কিছু খোলামেলাভাবেই আলাপ করব। আমার মনে হয় ছেলেটি বিবেচক এবং বুদ্ধিমান।’
—‘আপনি ওকে আরো সপ্তাহখানেক থাকতে বলবেন। আমি ফ্লোরিডা থেকে ঘুরে আসি। তারপর ওর পরিবারের সঙ্গে কথা বলব। ফাইনাল ডিসিশন নেওয়ার আগে ভালো মতো ভেবে দেখবেন বাবা। আমার মনে হয় তাড়াহুড়া করা ঠিক হবে না।’ কথাগুলো বলে জাহিদ একটু থামল। তারপর আবার বলল, ‘আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলার ছিল।’
মুর্তজা সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। কনিষ্ঠ পুত্রকে কোন এক অজ্ঞাত কারণে তিনি মাত্রাতিরিক্ত স্নেহ করেন। তাঁর নিজের নেওয়া সিদ্ধান্তের কারণে ছেলের জীবনে এখন দুঃসময়ের ঘনঘটা চলছে এ কথা ঠিক, তবে তিনি শতভাগ নিশ্চিত এই সিদ্ধান্তের বরাতেই একদিন পুত্রের জীবনে সুসময় ফিরে আসবে। জাহিদের বিষণ্ণ, শীর্ণ মুখের দিকে চেয়ে তিনি দরাজ গলায় বললেন, ‘কী বলতে চাও বলে ফেলো।’
—‘বাবা, আমার মনে হয়…’ বলতে গিয়ে একটু হোঁচট খায় জাহিদ। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে মনে মনে কথা গুছিয়ে নেয়। তারপর আবার পূর্ণ উদ্যমে বলা শুরু করে, ‘আমার মনে হয় নিশা আর জুবিন কিছুদিন এ বাড়ি থেকে দূরে থাকলে ভালো হয়।’
ঘরের ভেতর আচমকা একটা বিমূর্ত গুমোট ভাব তৈরি হলো। বিস্ময়ের আকুলি বিকুলি রেখা কুঞ্চন সৃষ্টি করল বয়োজ্যেষ্ঠ দুজন সদস্যের মুখে। নিশা দম বন্ধ করে কান পেতে ছিল। মাত্র বলা কথাটায় ডিভোর্সের উল্লেখ ছিল না বিধায় একটা স্বস্তির শ্বাস গড়িয়ে পড়ল তার বুক চিরে।
—‘কেন? হঠাৎ তোমার এরকম মনে হচ্ছে কেন?’
জাহিদ আনত নয়নে বলল, ‘তুরিন মেন্টালভাবে ভীষণ আপসেট। মেয়েটার বড়সড়োকোন ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আগেই আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার।’
—‘কী ধরনের সিদ্ধান্ত?’
জাহিদ রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘তুরিন চাইছে নিশার সঙ্গে আমার সেপারেশন হয়ে যাক।’
—‘তুমি কী চাইছ?’
পিতার অকপট অবিচল প্রশ্ন শুনে একটু থমকায় জাহিদ। ফ্যালফ্যাল করে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে থেকে শ্লথভাবে বলে, ‘আমি…আমি আমার মেয়ের ভালো চাই।’
মুর্তজা সাহেব নিশার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমার কী মতামত?’
নিশা কোন উত্তর দিতে পারল না। তার গলায় কান্নার সুড়সুড়ি। কথা বলতে গেলেই এখন বিপদ হবে। এটা আবেগের কান্না নয়। বরং বুকজুড়ে ঝলসে উঠছে ক্রোধ। রাগের বিষধর সাপ কলিজায় ছোবল দিয়ে বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে সর্বাঙ্গে। লোকটা বলেছে সে তার মেয়ের ভালো চায়। তার কাছে মেয়ে এবং স্ত্রীই সব। নিশা আর জুবিন কেউ না। এর পর আর কোন কথা বাকি থাকে না। যাচ্ছে আবার ভ্যাকেশনে! আনন্দের সীমা নাই! দম চেপে, ঠোঁট চেপে, দাঁতে দাঁত চেপে কান্নাটাকে সে কোন রকমে রুখে দিল। তারপর একটা নির্বিকারত্বের খোলস জোর করে মুখের ওপর টেনে এনে বলল, ‘আপনারা যা ভালো বোঝেন তাই করেন।’ কথাটা শেষ করেই ঝপ করে উঠে দাঁড়িয়ে ঘর ছেড়ে পালিয়ে বাঁচল সে। দরজা খুলতেই একটা দীর্ঘ ছিপছিপে ছায়ামূর্তি লাফ দিয়ে সরে গেল কিছুটা দূরে। হলওয়ের আলো-আঁধারির মাঝে নিজেকে লুকাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। নিশা বিস্ফারিত দুটো চোখ নিক্ষেপ করতেই জিভে চুকচুক শব্দ তুলে ছায়ামূর্তিটি আফসোসের গলায় বলল, ‘ইশ… শেষ পর্যন্ত ডিভোর্সটা হয়েই যাচ্ছে বুঝি?’
নিশা কিছু বলল না। বুকে পাষাণ ভার নিয়ে ফারার আবছা শরীরটার দিকে চেয়ে রইল শুধু। ফারা গলায় সুর তুলে বলল, ‘দ্যাখো আমি প্রথম থেকেই জানতাম তোমার মতো পান্তাভাত দিয়ে জাহিদের হবে না। বিয়ের পরদিনই বলেছিলাম, মনে আছে? ইশ মিছিমিছি স্বপ্ন দেখলে এতদিন।’
হলওয়েসংলগ্ন একটি কক্ষের দরজা খুলে গেল হঠাৎ। নীলিমা বেরিয়ে এলো। তার পরনে ঘরোয়া ম্যাক্সি। মুখে অরেঞ্জ পিল অফ মাস্ক। হনহন করে কয়েক কদম হেঁটে এসে জরুরি গলায় বলল, ‘নিচে মেকানিক এসেছে। আজ সকাল থেকে স্মোক ডিটেকটর কাজ করছে না। একটু পরপর চিঁচিঁ করে বেজে উঠছে। ওয়াশিং মেশিনের ড্রায়ারটাও ডিস্টার্ব দিচ্ছে। নিশা, তুমি একটু সমস্যাগুলো বুঝিয়ে বলবে মেকানিককে? আমি দশ মিনিট পর আসছি।’
নিশা প্রত্যুত্তর করার আগেই ফারা মেকি গলায় বলে উঠল, ‘ভাবী কী যে বলো তুমি! ইংরেজি না জানা গণ্ডমূর্খ দিয়ে কোন কাজ হয় এই দেশে? আমিই যাচ্ছি।’
নীলিমা বুদ্ধিমতী মহিলা। সংসারের কাদা-মাটি ধুলো থেকে গা বাঁচিয়ে চলাই তার নীতি। সে ফারার কথার উত্তরে শুধু একটি ভদ্রতাসূচক ‘থ্যাংক ইউ’ বলেই নিষ্ক্রান্ত হলো জায়গাটা থেকে। নিশা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ক্ষিপ্রগতিতে নিজের ঘরের দিকে ধাবিত হওয়ার সময় শুনতে পেল ফারা বলছে, ‘আমরা কাল ভ্যাকেশনে যাচ্ছি। তুমি এর মাঝেই বিদেয় হবে আশা করি। ভ্যাকেশন থেকে ফিরে তোমার চেহারা যেন আর দেখতে না হয়।’
কথাগুলো তারিয়ে তারিয়ে বলে শেষ করে ফারা সিঁড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল। মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। মজার ব্যাপার হলো এই ট্যুরে অনিমেষ এবং জাহিদ দুজনকেই অনেক অনেক দিন পর এক সঙ্গে কাছাকাছি পাবে সে। জাহিদ অবশ্য এখনো অনিমেষের ট্যুরে উপস্থিত থাকার ব্যাপারে কিছু জানে না। জানলেও খুব একটা আপত্তি করার সুযোগ পাবে না একদল বন্ধু-বান্ধবের সামনে। আজকাল ফারার মনে হয় তার জীবনে এই দুজন মানুষের গুরুত্ব প্রায় সমান। অনিমেষ প্রেমিকপুরুষ, ওর সঙ্গে কাটানো সময়গুলো রোমাঞ্চে ভরা। জীবনে একটু থ্রিল না থাকলে হয় নাকি? আর জাহিদ তো নিরাপদ আশ্রয়স্থল। অনিমেষের ঝোড়ো, বুনো, আরণ্যক ভালোবাসার পর জাহিদই তো এতকাল ফারার শান্তিটুকু, স্বস্তিটুকু আগলে রেখেছে যতন করে। অনিমেষকে ছেড়ে বেঁচে থাকার কথা সে ভাবতে পারে না এ কথা সত্য। আবার ওকে বিয়ে করে অন্যত্র বাস করার প্রসঙ্গ উঠলেও বড্ড দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তায় পেয়ে বসে। তার শ্বশুর বাড়ির আলাদা একটা কদর আছে বাঙালি সমাজে। বাবার বাড়ির আত্মীয়স্বজনও এমন সম্ভ্রান্ত শ্বশুরবাড়ির সুবাদে তাকে আলাদা সম্মান দেয়। তা ছাড়া এ বাড়ির সঙ্গে তুরিনের সম্পর্কটা আজন্মের। মেয়েটা জাহিদকেই বাবা হিসেবে জানে এবং মানে। এর ব্যতিক্রম কিছু সে সইতে পারবে না। মানসিকভাবে পুরোদমে ভেঙে পড়বে। তার চেয়ে যেমন চলছে, তেমনই চলুক। নিশা বিদায় হলেই আপাতত সব সমস্যা মিটে যাবে। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না। ফারার জীবন সেভাবেই কাটবে, যেভাবে এতকাল কেটেছে। উইকেন্ডে অনিমেষের সঙ্গে একটা সন্ধ্যা কাটাতে পারলেই হলো। অনিমেষটা যে ওকে কী ভালোবাসে! জীবনভর বিয়েই করল না! কেন করল না? ফারার জন্যই তো! আর জাহিদ? অল্প বয়সি সুন্দরী কন্যা তার গলায় ঝুলিয়ে দেবার পরেও ফারার মোহ কাটাতে পারল কি? পারল না! এমনই সব টক-ঝাল-মিষ্টি উপাদেয় ভাবনা ফারার মনে বসন্তের কোকিলেরই মতো শিস দিয়ে যাচ্ছিল থেকে থেকে। অনেকদিন পর তার ভাগ্যাকাশে যেন মেঘবিহীন সূর্যের দেখা মিলেছে। আহ শান্তি!
নিশা ঘরের দোর আটকে দিয়ে বিছানায় গাঁট হয়ে বসে আছে। বুকের ভেতর থকথকে অপমান আর গ্যাজলা ওঠা রাগ। রক্তে বিষের জ্বালা। মাথায় পাগলামির একটা আঁচ টের পাচ্ছে সে। লোকটা সকালে তাকে যেতে দিল না কেন? নিশাকে ঘরবন্দি করে রেখে এখন নিজেই যাচ্ছে ভ্যাকেশনে! কী আজগুবি মানুষ রে বাবা!
দরজায় আঘাত পড়ছে। নিশা নড়ল না। পাথরের মতো স্থির হয়ে বসে রইল। উত্তর না পেয়ে দরজা ঠেলে ঘরের ভেতর ঢুকল জাহিদ। ল্যাম্পশেডের পিঙ্গল আলোয় নিশার ক্লিষ্ট মাখা, রাগ গনগনে মুখের দিকে এক ঝলক চেয়ে নিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছ?’
নিশা উত্তর দিল না। গায়ের ওড়নাটা ঠিকঠাক করে জড়িয়ে নিয়ে নিঃসাড় হয়ে বসে রইল। যেন বিষাদের প্রতিমূর্তি। তার চুলের খোঁপার ভাঁজ খুলে গেছে। কয়েকটা এলোমেলো চুলের গাছি অবিন্যস্তভাবে পড়ে আছে কপালে। জাহিদ ওর পাশে এসে বসতেই তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল, ‘কী চাই আপনার?’
—‘তুমি কথা শেষ না করে চলে এলে কেন?
—‘আমার বলার মতো কিছু নেই।’
—‘কিছুই নেই?’
—‘না নেই।’
—‘আমার তোমাকে কিছু বলার ছিল।’
—‘আমার কিছু শোনার নেই আপনার কাছ থেকে।’
নিশা কথাটা ছুড়ে দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। জাহিদ বসে রইল একলা। নিশা ফিরল না খুব সহজে। মিনিট দশেক বাদে জাহিদ নিচে নেমে এলো ধীর পায়ে। লিভিংরুমে তানিশা টিভি দেখছে। লন্ড্রিরুমেও কেউ একজন আছে। খুব সম্ভবত মেকানিক। ফারা উচ্চস্বরে কথা বলছে মেকানিকের সঙ্গে। জাহিদ রান্নাঘরে এসে দেখল নিশা একগাদা সবজি সাজিয়ে নিয়ে কাটাকুটিতে ব্যস্ত হয়ে গেছে। জাহিদ বলল,
—‘নিশা, কথা ছিল তোমার সঙ্গে।’
নিশা প্রত্যুত্তর করল না। যেন শুনতেই পায়নি! কানকাটা হয়ে নিজের কাজ করতে লাগল। মনে মনে মুখ ঝামরে উঠে বলল, যাও তুমি ভ্যাকেশনে! হানিমুনে যাও। মঙ্গলগ্রহে যাও! বৌয়ের সঙ্গে প্রেম করো আর নেচে বেড়াও। নিশার সঙ্গে কীসের কথা তোমার? তুমি বরং বৌয়ের আঁচলের তলায় গিয়ে বসে থাকো। সেটাই তোমাকে মানাবে। নিশা অত সস্তা নয়!
তানিশা কিচেন কাউন্টারে উঁকি দিয়ে বলল, ‘চাচ্চু সুইম করতে যাচ্ছি। তুমি যাবে? চলো না আমার সঙ্গে!’
আনিতা আর তানিশা তাদের ছোট চাচার খুব ন্যাওটা বাল্যকাল থেকেই। জাহিদও ভাতিজি দুজনকে অত্যধিক স্নেহ করে। আজকে তার সাঁতার কাটার মানসিকতা নেই। তবুও ভাতিজির মন রক্ষার্থে সে প্রস্তাবটা মেনে নিল। তা ছাড়া নিশা তাকে গ্রাহ্যমাত্র করছে না। এখানে ভাঁড়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে লাভটা কী হবে? সে বুঝতে পারছে না তার দোষটা কোথায় হয়েছে? আজকে ওকে বাড়ি ছেড়ে যেতে না দেয়ার কারণেই কি এই আক্রোশ? কে জানে!
নিশা দুই পদের সবজি রান্না করল। ঘড়িতে এখন বাজে সাতটা। সন্ধ্যা হয় সাড়ে আটটায়। মাগরিবের নামাজের পর পর শ্বশুরমশাই ডিনার করেন। নিশা চলে গেলে শ্বশুর-শাশুড়ি নিশ্চয়ই একটু কষ্টে পড়ে যাবেন। শ্বশুরমশাই পুরনো দিনের মানুষ। নিজের কাজ নিজে করার অভ্যাস নেই। তাঁর দেখভালের সমস্ত দায়িত্ব শাশুড়ির ওপর গিয়েই বর্তাবে। এই দুজন মানুষ ছাড়া তৃতীয় কোন ব্যক্তি নিশার অনুপস্থিতি টের পাবে না। বাগানের গাছগুলো হয়তো একটু একটু মিস করলেও করতে পারে। কিংবা এই রান্নাঘর। যে রান্নাঘরের প্রতিটি খুঁটিনাটি জিনিস সে নিজের সংসার ভেবে বড় যত্নে আগলে রেখেছিল গত তিন বছর ধরে। অন্যমনস্ক গরহাজির মনটা নিয়েই নিশা রান্নার পাট চুকাল। কোন পদই বিশেষ উপাদেয় হলো না। চেখে দেখার পর বোঝা গেল একটায় অতিরিক্ত ঝাল, অন্যটায় অতিরিক্ত লবণ। এই সৃষ্টিছাড়া রান্না করতে চল্লিশ মিনিট লেগে গেল। রাগের জ্বলুনিটা তখনো ছেড়ে যায়নি শরীর। খানিক বাদে বাদে বুকের গহন থেকে যন্ত্রণার মতো আর্তস্বরে বেরিয়ে আসছে একটি ব্যভিচারী বিস্ফোরক শব্দ, ‘ভ্যাকেশন!
হায় দুনিয়া! কিছু মানুষ জীবনের মর্মান্তিক সংকটের ঘাত-অভিঘাতে চূর্ণ হতে হতে ঠিকঠাক শ্বাসটুকু পর্যন্ত নিতে পারে না। আরেক দল মানুষ সেইসব বক্ষচেরা কষ্টের ভারে জর্জরিত মানুষের চোখের ওপর দিয়ে আনন্দ করে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়, নেচে বেড়ায়, জীবনের সব রং শুষে নেয়, লুটে নেয়, সর্বাঙ্গে মেখে নেয়! যাক…ভালো থাকুক। দিন শেষে মানুষটা ভালো থাকলেই হয়তো…নিশাও ভালো থাকবে!
ভালোবাসার মানুষের ভালোর জন্য কিছুটা কষ্ট তো সয়ে নেওয়াই যায়। তাই না? নিজের সঙ্গে এমনি করেই বোঝাপড়াটুকু আপাতত শেষ করল। তারপর উঠোনের ফুলগাছগুলোতে পানি দেয়ার জন্য বেরিয়ে এলো। সারা দিনের সব কাজের মধ্যে এই কাজটিই তার সব চাইতে প্রিয়। গোধূলির গেরুয়া রঙে আকাশটা চমৎকার সেজেছে। বাড়ির সামনের ক্র্যাব অ্যাপল গাছগুলোতে চলছে ফুল ধরার মৌসুম। সাদা মুকুলে ছেয়ে গেছে গাছের ডাল। হাওয়া ছুটলে মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসে নাকে। পথের ওপর ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ে। সেই পাপড়ি বিছানো রাজকীয় পথে একলা একলা হেঁটে বেড়াতে দারুণ লাগে নিশার। গাছের গোঁড়ায় স্প্রিংকলারের ফোয়ারার জল পড়তেই সন্ধ্যার এলোমেলো বাতাসে ভেজা মাটির ঘ্রাণ উথলে উঠল। ফুলগুলো যেন ঝলমলিয়ে হেসে ফেলল, কথা বলে উঠল। হঠাৎ টের পেল নিশা, কেউ উঠে আসছে পোর্চের সিঁড়ি বেয়ে। তাকিয়ে দেখল। দেখেই আবার চট করে সরিয়ে নিল দৃষ্টি। চোখের কিনার দিয়ে আবছাভাবে টের পেল মানুষটা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
—‘তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল।’
জবাব দেয়া উচিত নিশা বুঝতে পারছে। কিন্তু লোকটা খালি গায়ে, ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে কেন? লজ্জা-শরমের বালাই নেই। এই দেশে অবশ্য মেয়েমানুষরাই চরম বেহায়া, পুরুষমানুষদের আর শরম আসবে কোত্থেকে? নিশা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল একবার। গৌর-বরণ চওড়া কাঁধ, সুশ্ৰী সুঠাম পেশি এবং মেদবর্জিত কোমর ছাড়া অন্য কিছুই চোখে পড়ল না তার। ঝিনঝিন করে উঠল মেরুদণ্ড। অস্বস্তি কাঁটা দিল গায়ে। স্প্রিংকলারের সুইচ অফ করে পানির ফোয়ারা থামাল সে। সংকুচিতভাবে বলল, ‘জি বলুন।’
জাহিদের এতক্ষণ মনে হচ্ছিল নিশাকে ভীষণ জরুরি একটা কথা তার বলবার আছে। সুইমিং পুলের নীল জলে সাঁতার কাটতে কাটতেও এই একটি কথাই ভেবেছে বারবার। মনে হচ্ছিল কথাটা এখুনি বলতে না পারলে কোথায় যেন কী একটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। বড়সড়ো গোলমাল! কিন্তু এখন, এই মুহূর্তে নিশার ওই আয়ত দুটি নিষ্পাপ বিশুদ্ধ সুন্দর চোখের ওপর চোখ রেখে জাহিদ সেই অতীব গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বেমালুম ভুলে গেল। মস্তিষ্কের আনাচে কানাচে তন্নতন্ন করে খুঁজে একটিও জুতসই শব্দ জোগাড় করতে পারল না। হঠাৎ সদর দরজা খুলে ফারা বেরিয়ে এলো। দৃশ্যটা এক ঝলক দেখে নিয়েই, ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এসে জাহিদকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল সে। ভেজা পিঠে নাক ঘষে, কণ্ঠে আহ্লাদের ঝংকার তুলে বলল, ‘তুমি সুইম করতে গিয়েছিলে হানি? আমাকে ডাকোনি কেন?’
নিশার গায়ে যেন ফুটন্ত তেলের ছিটে এসে লাগল ছ্যাঁত করে। হ্যান্ড স্প্রিংকলার নামিয়ে রেখে দৌড় দিয়ে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল সে। খোদা বোধহয় তার কপালে সুখ লেখেননি। কোন পাপ করেছিল কি সে? ঠিক কোন অপরাধের সাজা মিলছে তা যদি একবার জানতে পারত!
—‘সমস্যা কী তোমার?’ জাহিদ ফারার বাহুযুগল থেকে মুক্ত করল নিজেকে।
ফারা তবুও নিরস্ত হলো না। জাহিদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘দ্যাখো বেবি, এখন তো সবকিছু ঠিক হয়েই যাচ্ছে। নিশাকে তুমি ডিভোর্স দিচ্ছ আমাদের মধ্যে কোন থার্ড পারসন রইল না। ফাইনালি আমাদের বিয়েটা টিকেই গেল!’
—‘আমাদের মধ্যে একজন আগেও ছিল, এখনো আছে ফারা। তুমি নিজে সেটা আমার চাইতে ভালো জানো।
ফারা একটু বোকা সাজার ভান করে বলল, ‘নিশাকে তুমি ছাড়বে না?’
—‘আমি নিশার কথা বলছি না। অনিমেষের কথা বলছি।’
জাহিদ আর দাঁড়াল না। ভ্যাকেশনে যাওয়ার বিশেষ কোন ইচ্ছে ছিল না তার। ফারাকে না করে দিয়েছিল আগেই। কিন্তু তুরিন এমন জোরজার শুরু করল যে জাহিদের আপত্তিটা আর টিকল না। আজ দুপুরে অফিসে ফোন করে অনুনয়-বিনয় করেছে তুরিন। বলেছে সে খুব করে চাইছে ফারার সঙ্গে জাহিদ যেন ছুটি কাটাতে যায়। অনেকদিন ধরে তার বাবা-মা একসঙ্গে কোথাও ঘুরতে যায় না। তুরিনের মনে হয়েছে একটা ভ্যাকেশন বাবা-মায়ের জীবনে এই মুহূর্তে অপরিহার্য। সত্যি বলতে, জাহিদেরও মনে হচ্ছিল বাড়ি থেকে কিছুদিন দূরে থাকা প্রয়োজন। দিনকে দিন এই বাড়িটা যেন কারাগারে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর ভেতরে থাকলে দম আটকে আসে। আজকাল নিশার প্রত্যাখ্যানটুকুও সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছে। দমচাপা এক বিষণ্ণতা বুকের ওপর যেন স্থায়ী আসন গেঁড়ে বসেছে। হাওয়া বদল আবশ্যক। নিশার তো আছে…শাহজিদ! আর আছে বলেই এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে ওর বুক কাঁপেনি। বাবা বলেছে নিশা আর জুবিনকে নিয়ে খুব দ্রুতই অন্য কোথাও মুভ করবে। নিশাকে একা থাকতে হবে না। বাবা-মা ওর সঙ্গে থাকবে। এই সিদ্ধান্ত স্বস্তি দিয়েছে জাহিদকে। ওহো…হারিয়ে যাওয়া জরুরি কথাটা পোষা কুকুরের মতো পথ চিনে বাড়ি ফিরল এবার। এই ব্যাপারেই আলাপ করতে চাইছিল সে। কিন্তু নিশা তো ধরা-ছোঁওয়ার মধ্যে নেই। ডিনারের টেবিলেও পাওয়া গেল না তাকে।
অনেকদিন ধরে জাহিদের গভীর ঘুম হয় না। আজকেও হলো না। মানসিক বিকলতার দরুণ মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগে। চিন্তাগুলো স্থির হয়ে বসে না কোথাও। মস্তিষ্কের শিরায় শিরায় ছারপোকার মতো কিলবিল করে। রক্ত চুষে খায়। একটু তন্দ্রার মতো আসে, আবার কেটে যায়। মনে হয় কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিচ্ছে। তন্দ্রার ঘোরে চোখের সামনে একটা মুখ ভেসে ওঠে হঠাৎ। ভ্রমরকৃষ্ণ কেশভার লুটিয়ে পড়েছে পিঠে। মুখখানা তুষারবিন্দুর ন্যায় শুভ্র। ভারী চোখের পাতার নিচে নিটোল দুটি ডাগর চোখ। মেয়েটা একলা একলা কোন পথে যেন হেঁটে বেড়াচ্ছে। চারিদিক থেকে নানা রঙের ফুল ছেঁকে ধরেছে তাকে। মেয়েটির সৌন্দর্যের কাছে ফুলের সৌন্দর্য হার মেনেছে। কিন্তু মেয়ের নামটা কিছুতেই মনে পড়ছে না জাহিদের। নাম না জানা মেয়েটির দিকে স্বপ্নাবিষ্ট চোখে চেয়ে আছে সে। এত চেনা! তবুও নাম মনে পড়ছে না কেন? হঠাৎ দূর থেকে কে যেন ডেকে ওঠে, তুষারকন্যা! বিদ্যুৎ চমকানোর মতো চিলিক দিয়ে কেটে যায় তন্দ্রার ভাব। জাহিদের মনে পড়ে নিশার বাবা ওকে তুষারকন্যা বলে ডাকে। কন্যার নামটা নিশ্চয়ই ভদ্রলোক বড় আদর করে ভালোবেসে রেখেছিলেন। এমন রূপবতী গুণবতী রাজকন্যার কপালে কি না জুটল তার মতো দোজবরে মধ্যবয়সি পুরুষ। এটা অন্যায়। ঘোরতর অন্যায়!
শাহজিদের সঙ্গে একবার খোলামেলা কথা বলা দরকার। ছেলেটি কর্তব্য- পরায়ণ এবং সৎ হয়ে থাকলে জাহিদ নিজ উদ্যোগে নিশাকে ওর হাতে তুলে দেবে। শেষ রাতের দিকে শোয়া থেকে উঠে পড়ল। বারান্দায় পায়চারি করল। সিগারেট পুড়াল। ছটার সময় টিকটিক করে বেজে উঠল অ্যালার্ম। ওদের ফ্লাইট সাড়ে নটায়। বাড়ি থেকে এয়ারপোর্ট প্রায় ঘণ্টা খানেকের পথ। জাহিদ তুরিনের ফোন নম্বরে কয়েকবার ট্রাই করল। নেটওয়ার্ক রিচ করল না। আনিতার নম্বরে রিং পড়ল টানা অনেকক্ষণ। কিন্তু মিলল না উত্তর। ঘুমোচ্ছে নিশ্চয়ই। মাথা থেকে সব চিন্তা ধূলোর মতো ঝাড়ন দিয়ে ঝেড়ে ফেলে জাহিদ চটপট তৈরি হয়ে নিল। এই বাড়ি থেকে কটা দিন দূরে থাকতে পারলে হাঁফ ছেঁড়ে বাঁচবে সে। আরো ভালো হতো যদি একদম একলা কোথাও গা-ঢাকা দিতে পারত। আসন্ন মুক্তির আশায় মনটা ধীরে ধীরে প্রসন্ন হতে থাকে। ভেতরকার ক্ষত বুঝি শুকিয়ে আসে একটু। কিন্তু পরমুহূর্তেই একটা বিপন্ন হাওয়া চোখের সামনে মন খারাপের পৃষ্ঠাটা খসখস শব্দে মেলে ধরে আবার। বুক চিনচিন করে যন্ত্রণায়। জুবিনকে ছেড়ে দূরে কোথাও যেতে ইচ্ছে করে না। জুবিন তার জীবনের একটি মাত্র আনন্দ। ওকে না দেখে কী করে কাটাবে টানা এতগুলো দিন? হঠাৎ মনে পড়ল জুবিনের জন্মদিনে থাকা হচ্ছে না। অবশ্য না থাকাই ভালো। অনর্থক নাটকীয়তার অংশ হতে তার ইচ্ছে করে না। ফারাকে জুবিনের মা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার মতো বিব্রতকর ব্যাপার আর দ্বিতীয়টি নেই। অসম্ভব রকমের অপরাধবোধ জন্ম নেয় মনে। নাশতার টেবিলে মায়ের কোলে জুবিনকে পাওয়া গেল। জাহিদ ওকে বুকে চেপে ধরে বসে থাকল অনেকক্ষণ। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিল একরত্তি মুখখানা। আর একটা মানুষকে এক ঝলক দেখার জন্য ভেতরটা আকুলি-বিকুলি করতে থাকে। নিশা চায়ের ট্রে নিয়ে ডাইনিংয়ে আসে। নামিয়ে রাখে টেবিলের ওপর। চোখাচোখি হয় ঘরভর্তি মানুষের মাঝে। নিশা চোখ নামিয়ে পালিয়ে যায়। মানুষটা এমনভাবে চেয়ে ছিল কেন সবার সামনে? নিশার বুঝি লজ্জা করে না? উপস্থিত সদস্যরা নিজেদের আলোচনায় বুঁদ হয়ে থাকে। জাহিদ জুবিনকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দিয়ে চুপচাপ খাবার খেয়ে নেয়। জাগতিক কোন কথা তাকে স্পর্শ করে না। বুকটা খাঁখাঁ করে।
ফ্লাইট মিস করতে না চাইলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়তে হবে। লাগেজগুলো পোর্চের সামনে এনে রাখল ওরা। বাবা-মা, বড় ভাই, ভাবি, ফারা প্রত্যেকে ঘিরে আছে জাহিদকে। শুধু একজন অনুপস্থিত। সেই একজনের অনুপস্থিতি যেন মৃত্যুর চাইতেও বেশি যন্ত্রণাদায়ক। ওকে একটা বার না দেখে, কিছু না বলে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই দম আটকে আসছে। এমন মৃত মন নিয়ে ভ্যাকেশনে যাওয়ার অভিজ্ঞতা এই-ই প্রথম। নিশা তাকে কীসের শাস্তি দিচ্ছে? কেন দিচ্ছে? আর জাহিদই বা কেন ওর কথা ভেবে ভেবে কষ্ট পাচ্ছে? শেষমেশ আক্রোশটা নিজের ওপরেই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। নিজেকে ভীষণ কাপুরুষ বলে মনে হয়।
নিশা ঘুমোতে পারেনি রাতে। নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতায় ছটফট করেছে। চোখ বন্ধ করলেই ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইটের মতো জ্বলে উঠেছে দৃশ্যটা। ফারার দরজা খুলে বেরিয়ে আসা, হুট করে মানুষটাকে জড়িয়ে ধরা…অথচ নিশা জানে ওরা স্বামী-স্ত্রী। এই ঘনিষ্টতায় অপরাধ কিছু নেই। তবুও ঘটনাটা মনে পড়লেই আগুনের ফুলকি উঠছে সারা শরীরে। চোখে জল ছিল না। শুধুই জুলুনি। মরুভূমির উত্তপ্ত প্রান্তরের মতো ধু-ধু শূন্যতা। সারা রাত এভাবেই কাটল…কিন্তু এখন…এখন বুক ফাটা কান্নার জোয়ার উথলে উঠছে মনে। নিশাকে যেতে না দিয়ে মানুষটা নিজেই চলে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে? না গেলে অন্তত আর কটা দিন এক ছাদের নিচে থাকা যেত! ফিরে এসেই তো নিশাকে বিদায় করার জন্য হন্যে হয়ে যাবে। এত নিষ্ঠুর মানুষ হয়?
জানালা দিয়ে দেখল ফারা গাড়ির সামনে দাঁড়িয়েছে। জাহিদকে দেখা যাচ্ছে না। কী মনে করে বেরিয়ে এলো নিশা ঘর থেকে। ক্ষিপ্রগতিতে ভাঙল সিঁড়ি। জাহিদ ডানকাঁধে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ ধুপধাপ পায়ের আওয়াজ পেয়ে থমকে দাঁড়াল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল নিশাকে। দেখা মাত্রই দূরে কোথায় যেন বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। ফ্যাকাসে সাদা মুখে রক্তের আভা পড়ল। দরজার সামনে পরিবারের সদস্যরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে ছিল। নিশা শ্লথ পায়ে ওদের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তার মুখে একটা চাপা প্রলয়ের আভাস। বড় বড় চোখদুটি স্বচ্ছ কাচের মতো চকচকে। শ্বাস পড়ছে এলোমেলো। জাহিদ রুদ্ধশ্বাসে ওর দিকে চেয়ে আছে। চেয়ে আছে নিশাও। বাড়ির সদস্যরা এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে। কেউ কথা খুঁজে পাচ্ছে না। নিশা কয়েক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে থাকার পর পায়ে পায়ে শাশুড়ির কাছে এগিয়ে এলো। কোল থেকে জুবিনকে তুলে নিল এমন ভঙ্গিতে যেন ওকে নিতেই এসেছিল। জাহিদ দমচাপা গলায় বলল, ‘আমি যাচ্ছি নিশা!
নিশা ওর দিকে তাকাল না। জুবিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আস্তে করে বলল, ‘কবে ফিরবেন?’
—‘সাতদিন পর।’
নিশা মনে মনে প্রমাদ গুণল, সাতদিন? নাকি সাত শতাব্দী? সে মুখ তুলে ছদ্মবেশী হাসি হাসার চেষ্টা করল। ক্ষীণ গলায় বলল, ‘ভালো থাকবেন।’
কথাটা বলে প্রস্থান করল দ্রুত। কলিজায় মোচড় দিয়ে রক্তপাত হচ্ছে। চোখে আছড়ে পড়ছে সাগরের উত্তাল স্রোত। জাহিদ গাড়িতে উঠে বসল ভূতগ্রস্তের ন্যায়। মন চাইল নেমে পড়ে। ট্যুর ক্যানসেল করে দেয়। কিন্তু তুরিনকে কী বলবে? বাড়ির লোকেও বা কী ভাববে? নিশার চোখের সেই দৃষ্টি পিছু ছাড়ল না। তাড়া করতে লাগল সারাটা পথজুড়ে। যেন একটা শক্তিশালী চুম্বক টানছে পেছন থেকে। তার মনে হচ্ছে রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড নিশার কাছে ভুলে ফেলে রেখে এসেছে। ছিদ্রিত এবং শূন্য বক্ষ নিয়ে জীবিত লাশ হয়ে ছুটে চলেছে পথে। খালি…ভীষণ খালি খালি একটা ভাব শ্বাসনালির প্রবেশপথ বরাবর ঠেসে আছে। নিঃশ্বাস নেওয়া যাচ্ছে না। এহেন অতলস্পর্শী বিষাদ জীবনে এই প্রথম অনুভব করল! এর নামই কি বিরহ?
অন্য পৃথিবী
জুবিনকে নিয়ে হয়েছে মস্ত জ্বালা। এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে আর ধুপধাপ পড়ে গিয়ে অঘটন ঘটাচ্ছে। একটু আগে কুঁইকুঁই করে মায়ের কোল থেকে নেমে এসে দিল এক ভোঁ দৌড়। কিছুদূর গিয়েই আপন মনে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। গলা ফাটানো কান্নায় সারা বাড়ি মাথায় তুলল। শ্বশুর-শাশুড়ি ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছুটে এলেন। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মিনিট দশেক বাদে মহারানির কান্না থামানো হলো। শাশুড়ি বললেন, ‘ও আমাদের কাছে থাকুক। তুমি একটু রেস্ট নাও বৌমা। তোমার চেহারাটা খুব খারাপ হয়ে আছে। রাতে ঘুমোওনি নাকি?’
নিশা নিরুচ্চারে হাসল। বলল না কিছু। বাড়িটা বড্ড ফাঁকা এখন। সবাই যার যার কাজে বেরিয়ে গেছে। শাহজিদও নেই। কোথায় আছে কে জানে! আজ রান্নার পাট বন্ধ। শহীদের এক বন্ধুর বৌ ক্যাটারিং সার্ভিস চালু করেছেন। সেই ক্যাটারিং থেকে দুপুর দুটার মধ্যে খাবার আসবে। হঠাৎ করিডরে রাখা ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল ঝনঝন করে। নিশা সাধারণত ফোন- টোন ধরে না। ইংরেজি বুঝলেও বলাটা এখনো আয়ত্তে আসেনি। আজকে কর্ডলেসের ছোট্ট স্ক্রিনে বাঙালি নাম দেখে ফোন রিসিভ করার সাহস করল। ওপাশ থেকে একটা কিন্নর নারীকণ্ঠ বলল, ‘ফারা আছে?’
—‘উনি তো বাড়িতে নেই।
—‘আপনি কে বলছিলেন?’
নিশা নিজের নাম উচ্চারণ করল। ফোনের ওপাশের মহিলা একতাল উৎসাহ নিয়ে বলল, ‘ও আচ্ছা চিনেছি! তুমি জুবিনের ন্যানি! কেমন আছ?’ ঘটাং করে একটা হাতুড়ির বাড়ি এসে পড়ল বুকে। চিনচিনে যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল শরীরের শিরায় শিরায়। ফোনটা নামিয়ে রাখল নিঃশব্দে। কিছুক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকার পর বড় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করল। ফারার বন্ধুবান্ধবরা তাহলে নিশাকে জুবিনের ন্যানি, আয়া, বুয়া অথবা নার্স হিসেবেই চেনে! চমৎকার! জাহিদও নিশ্চয়ই এই প্রচারণায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। এখন উনারা ভ্যাকেশনে গেছেন। বন্ধুবান্ধবরা বাচ্চা সম্পর্কে জানতে চাইলে দুজনে সগর্বে ডগমগ করে বলবেন, বাচ্চার দাদা-দাদি আছে, আয়া আছে! আমাদের চিন্তা কীসের? অদ্ভুত এক বিষণ্নতায় তমসাচ্ছন্ন হয়ে রইল ভেতরটা। একা একা নীরব নিঝুম বাড়িতে ভূতের মতো ঘুরে বেড়াতে লাগল নিশা। বুকের মধ্যে যন্ত্রণার ভারী মেঘ গুড়গুড় শব্দে ডেকে উঠতে লাগল থেকে থেকে। সিঁড়িঘরের দেয়ালে অনেক পারিবারিক ছবি লাগানো আছে। এর মধ্যে একটি ছবিতে জাহিদ আর ফারা পাশাপাশি দাঁড়ানো। ওদের বিয়ের দিনের ছবি। তার ঠিক পাশেই আরেকটি ছবিতে তুরিন দাঁড়িয়ে আছে ফ্রেমবন্দি হয়ে বাবা-মায়ের মাঝখানে। একপাশে জুবিনের ছবিও আছে। বাবার কোলে দুই মাস বয়সি ছোট্ট জুবিন ঘুমাচ্ছে নিশ্চিন্তে। নিশার বিয়ের কোন ছবি নেই। জাহিদের পাশে দাঁড়িয়ে আজ পর্যন্ত কোন ছবি তোলা হয়নি তার। এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর এখানে নিশার কোন স্মৃতি থাকবে না। পারিবারিক ছবির ভিড়ে নিশার ছবি কেউ কখনো যত্ন করে আগলে রাখবে না। নিশা চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!
ঘাড় বেঁকিয়ে, তেরছা চোখে দেয়ালে টাঙানো ছবির দিকে অনেকক্ষণ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীর মতো চেয়ে থাকে নিশা। প্রায় একুশ বছর আগের ছবি। এই ছবিতে জাহিদকে দেখাচ্ছে অনভিজ্ঞ, অপরিপক্ব এবং লাজুক। চোখে চশমা। মুখে কৈশোরের লাবণ্য। যেন ছোট একটা ছেলেকে নিজ মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দেয়া হচ্ছে। ওর তুলনায় ফারাকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী, সুপরিণত এবং পরিশীলিত দেখাচ্ছে। জীবন আশ্চর্য! বালিকা বয়সে নিশা কখনো কারো প্রেমে পড়েনি। ভালোও বাসেনি। কে জানত সেও একদিন ভালোবাসবে! ভালোবাসবে এমন এক ব্যক্তিকে যে কি না নিশার জীবনে প্রবেশ করার বহু বছর আগে অন্য এক নারীর হাতে তুলে দিয়েছিল প্রথম প্রেমের সব কটা গোলাপ! এমন একজনকে তো নিশার ঘৃণা করার কথা ছিল। সত্যি বলতে এঁকে ঘৃণা করতে পারলেই বেঁচে যেত। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও ঘৃণা করা যাচ্ছে না কেন? ছবিতে দাঁড়ানো হাস্যোজ্জ্বল মুখের মানুষটা তো ফারার স্বামী। তুরিন আর জুবিনের বাবা। নিশার কেউ না! তবুও কেন ওকে দেখলেই সর্বগ্রাসী বেহায়া ভালোবাসা সর্বাঙ্গে অমন দুর্মোচ্য কাঁপন তোলে? কেন বুকের মধ্যে তোলপাড় হয়? কেন ওকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথা ভাবতে গিয়ে দুর্বিষহ মর্মযাতনাময় বিষাক্ত ফলার আঘাতে চির ধরে পাঁজরের ঠিক মাঝ বরাবর?
নিশা ধীরপায়ে সরে এলো ছবির সামনে থেকে। তার চুলগুলো কোমরে লুটাচ্ছে। সাদা রঙের সালোওয়ার-কামিজের ওড়নাটা একপাশে ঝুলানো। হাঁটার ভঙ্গি দেখে মনে হয় যেন অপ্রকৃতস্থ এক নারী সদ্য মানসিক হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসেছে। সিঁড়ির মাঝামাঝি ধাপে বসল সে। হাঁটুতে কনুইয়ের ভর রেখে ডান গালে একটা হাত ঠেকাল। কোন বাতি জ্বলছে না। নিচতলার লিভিংরুমের খোলা জানালা দিয়ে আসা সাদাটে আলোর একটা আভা ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। প্যাটিওর উইন্ডচ্যাম হাওয়ায় দোল খাচ্ছে আর টুংটাং সুর তুলছে। আবছায়া আলো-আঁধারিতে বসে থাকা নিশার অবয়বটা দেখে মনে হচ্ছে যেন বিষণ্ণ কোন অতৃপ্ত প্রেতাত্মা। এখান থেকে সদর দরজাটা দেখা যায়। একদিন এই কারুকাজখচিত কাঠের দরজা পার হয়ে বধূবেশে প্রবেশ করেছিল সংসারে। কত অনিশ্চয়তা, কত দুশ্চিন্তা, কত দ্বিধা! বিয়ের রাতে প্রথম যখন ফারার ব্যাপারে জানতে পারল, মন চেয়েছিল গলায় দড়ি দিয়ে মরে যায়। পরদিন সত্যি ছুরি দিয়ে হাতের রগ কাটতে যাচ্ছিল। কী মনে করে যেন কাটল না। কী মনে করে সমস্ত অপমান সহ্য করে এখানে মুখ বুজে পড়ে থাকল। এত বোকা মানুষ হয়? এত বোকা? হঠাৎ পাগলের মতো নিজের মনে হেসে ওঠে নিশা। ভেতর থেকে কে যেন বিদ্রুপের সুরে বলে ওঠে,
হাসো হাসো। জীবনটাকে হেসে উড়িয়ে দিতে পারলেই এখন তুমি বেঁচে যাবে। তোমার নিজের ওপর ঘেন্না হয় নিশা? হওয়াই উচিত। তুমি কি ভেবেছিলে এই বাড়িতে ছ্যাঁচড়ার মতো রয়ে গেলেই লোকটাকে দখল করতে পারবে? কীসের মতলবে সেদিন থেকে গিয়েছিলে? লোকটা গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল এক সকালে। তবুও তুমি গেলে না। তুমি কি ভেবেছিলে সে তোমার জন্য নিজের স্ত্রী-সন্তানকে ত্যাগ করবে? হাস্যকর! ধিক তোমাকে ধিক! নিশা ফিসফিস করে বলে, এসব কিছুই চাইনি আমি বিশ্বাস কর। আমি শুধু ওর সঙ্গে এক ছাদের নিচে থাকতে চেয়েছিলাম। প্রতিদিন ওকে দেখতে পাই। এটাই যথেষ্ট!
ভেতরের কণ্ঠটা বলে, তুমি ভীষণ হ্যাংলা। আত্মসম্মান বলতে কিছুই নেই। কেন এমন একটা মানুষকে ভালোবাসতে গেলে?
নিশা দুর্বোধ্য হাসে, ‘ওকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়? সে মানুষ অন্যরকম! আমি আমার জীবনে এমন খাঁটি মানুষ দ্বিতীয়টি আর দেখিনি। বাবা বলেছিল, আমার জন্য রাজপুত্র খুঁজে এনে দেবে। বাবা সত্যিকারের রাজপুত্র খুঁজে পায়নি কিন্তু ভাগ্যগুণে একজন সত্যিকারের মানুষ খুঁজে পেয়েছিল। আমি জানি রাজপুত্রের চেয়ে খাঁটি মানুষের দাম অনেক বেশি! তা ছাড়া সে তো আমাকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। আমি নিজের সিদ্ধান্তে এখানে থেকেছি। কিন্তু দ্যাখো…এখন তো তাড়িয়ে দিচ্ছে! তাড়িয়ে দিচ্ছে এই সংসার থেকে, নিজের জীবন থেকে!
নিশার কণ্ঠ বুজে এলো কান্নায়। চোখ দিয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে লাগল জল।
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ৪
৪
আনিতা তরতর করে পাহাড় বেয়ে উঠছিল। মেয়েটা বেশ সাহসী। তুরিনের মতো নরম সরম নয়। লম্বা চওড়া শরীরে কমনীয়তার অভাব থাকলেও বেশ টান টান একটা দুরন্ত সৌন্দর্য আছে। পাহাড়ের মাঝামাঝি খাঁজে এসে দাঁড়াল ওরা। এখান থেকে ঝরনার পেছন দিকটা দেখা যায়। এত কাছে যে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায়। আনিতা ঝরনার ধারাটার একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল। অর্ণব একটু দূরে একটা বেঞ্চির ওপর বসেছে। পাশেই একটা সরু সুড়ঙ্গ মুখ আছে। ভেতরটা অন্ধকারে ঢাকা। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় যেন কত শত অমীমাংসিত রহস্য ঘিরে আছে এই সুড়ঙ্গকে। বাতাসে গুঁড়ি গুঁড়ি জলের ছিটা ভেসে বেড়াচ্ছে। ঝরনার জলের মিহিন নেশাড়ু শব্দে থইথই করছে চারিদিক। আনিতা হঠাৎ বলল, ‘আমার একটা ছবি তুলে দিতে পারবেন?’
অর্ণব তটস্থ হলো, ‘জি নিশ্চয়ই।’
আনিতা ওর সেলফোনটা এগিয়ে দিল। তারপর সাদা ফেনীল ঝরনার সামনে, ঝলমলে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে নানা ভঙ্গিমায় ছবি তুলল বেশ কিছু। তোলা হয়ে গেলে অর্ণবকে ভদ্র গলায় প্রশ্ন করল, ‘আপনাকে তুলে দেব?’
অর্ণব সজোরে মাথা নাড়ল, ‘না না!আমি ছবি তুলি না।’
—‘কেন?’
—‘এমনিই!’
—‘লজ্জা লাগে?’
আনিতা কথা বলতে বলতে অর্ণবের পাশে এসে বসল। একটু তফাতে। অর্ণব জন্ম থেকেই বেশ লাজুক। মেয়েদের সামনে একটু বেশিই লজ্জায় পড়ে যায়। তবে ছবি তোলায় অনীহার কারণ লজ্জা নয়, বরং আগ্রহের কমতি। সে সবিনয়ে বলল,
—লজ্জা নয়। আসলে ইচ্ছা করে না।
—হুম .. সেই ভালো…মেয়েদের মতো দিন-রাত সেলফি তোলা ছেলেদের আমার বিরক্ত লাগে।’
অর্ণব এই কথার উত্তরে কী বলবে খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইল। আনিতাই কথা বলল আবার,
—দেশে আপনার কে কে আছে?
—বাবা আর ছোট ভাই।
—কী করেন আপনার বাবা?
অর্ণব একটু অপ্রতিভ গলায় বলল, আগে ব্যবসা করতেন এখন কিছু
করেন না।
আনিতা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল একবার অর্ণবকে। শ্যামবরণ লম্বাটে মুখে খচিত ঈষৎ টানা চোখের ওপর অনড়ভাবে নিজের চোখ রেখে বলল,
—একটা কথা বলি কিছু মনে করবেন না। আপনি ভালো ছাত্র। দেখতেও খারাপ নন। তুরিনকে বিয়ে করার জন্য এখানে পড়ে আছেন কেন? আপনার কি ধারণা আমার দাদাজান আপনাকে বিয়ের সময় অনেক যৌতুক দেবেন?
অর্ণব জীবনে শক্ত কথা কম শোনেনি। তার নিজের বাবাই রেগে গেলে গালাগালি দিয়ে আস্ত রাখে না। দেশে বাবার পাওনাদারদের সঙ্গেও দফায় দফায় ঝগড়া হয়েছে। এক পাওনাদার অর্ণবের মাথা পর্যন্ত ফাটিয়ে দিয়েছিল একবার। বাড়িওয়ালার বৌটাও ভাড়া দিতে কদিন দেরি হলেই সোজা বাড়ি
এসে যা তা বলত। অতএব অপমানজনক বাক্যবাণের আঘাত সয়ে নেবার অভ্যাস আছে অর্ণবের। তবুও আনিতার মতো স্মার্ট, সুন্দরী, আধুনিক মেয়ের মুখে এমন অমর্যাদাপূর্ণ কর্কশ সত্য শুনে ভেতরে ভেতরে ভীষণ অপদস্থ বোধ করল সে। মেয়েটা কি তাকে লোভী মনে করছে? তার পিতার মধ্যে লোভের আধিক্য আছে বটে। ভালো থাকা খাওয়ার লোভে মান সম্মান পর্যন্ত বিকিয়ে দিতে রাজি সেই বান্দা। কিন্তু অর্ণবের চক্ষুলজ্জা এখনো পুরোদমে তামাদি হয়ে যায়নি। মুখে একটা ভ্যাবাচ্যাকা ভাব নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সে আনিতার দিকে। তারপর হালকা কেশে নিয়ে বলল, ‘না আসলে…মানে যৌতুক দেবে কেন?’
—‘তাহলে কীসের আশায় তুরিনকে বিয়ে করতে চাইছেন? আপনাকে হিউম্যানিটি গ্রাউন্ডে একটা উপদেশ দিই কেমন? তুরিনের আশা ছেড়ে দিন। ও হচ্ছে আমাদের পরিবারের বখে যাওয়া বড় সন্তান। সব পরিবারেই এমন একজন থাকে যে ছোটবেলা থেকে প্রতিটি জিনিসকে টেকেন ফর গ্র্যান্টেড হিসেবে নেয়। এসব ছেলেমেয়েরা বাস্তবতা কখনো বোঝে না। যা পায় তার দাম দিতে জানে না।’
—‘উনি কি খুব অহংকারী?’
—‘ও বোকা। ওর বোকামিটা এত মারাত্মক হয়ে উঠছে দিনকে দিন যে মনুষ্যত্ব লোপ পাচ্ছে।’
—‘আমি মনে মনে প্রস্তুত হয়ে ছিলাম যে তুরিন আমাকে পছন্দ করবেন না। আমি আসলে কোন দিক দিয়েই উনার যোগ্য নই।’
আনিতা সরু চোখে বলল, ‘আপনি কোন দিক দিয়ে ওর যোগ্য নন? কী বলছেন এসব?’
অর্ণব বিভ্রান্তি নিয়ে বলল, ‘দেশে আমার পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়। সত্যি বলতে বিয়েটা আমি করতে চাইছিলাম দ্রুত সিটিজেনশিপ পাবার আশায়। পি-এইচডি করে গ্রিনকার্ডের অ্যাপ্লাই করতে হলে চার-পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে হবে। আমার বাবার লিভারে সমস্যা আছে। তিনি আর কতদিন বাঁচবেন জানি না। আমার দ্রুত নিজের পায়ে দাঁড়ানোটা খুব জরুরি। বাবা-ভাইকে এই দেশে নিয়ে আসতে চাই।’
—‘তা সিটিজেন পাত্রীর কি অভাব আছে নাকি? অন্যদিকে চেষ্টা করুন মিস্টার অর্ণব। তুরিন আপনার কপালে নেই।’
অর্ণব একটু সময় কী যেন ভেবে নিয়ে সামান্য লজ্জা মিশ্রিত গলায় বলল, ‘আচ্ছা…আপনাদের বাড়িতে একজন মেয়ে আছেন। উনার নাম নিশা। উনি আপনাদের কী হন?’
আনিতা হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, ‘কেন উনাকে আপনার পছন্দ হয়েছে?’
অর্ণব চোখ নামিয়ে নিল নিচে। আনিতা বলল,
—‘উনার আশাও ছেড়ে দিন। উনি বিবাহিতা।’
অর্ণবের চোখ কপালে উঠে যায়, ‘তাই নাকি?’
—‘জি।’
—‘উনার হাজবেন্ড কোথায় থাকেন?’
আনিতা কণ্ঠে রহস্যের ফোয়ারা তুলে বলে, ‘তা আর আপনার জেনে কাজ নেই।’
৫
এয়ারপোর্টের পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করল। আগামী সাতদিন গাড়িটা এখানেই থাকবে। একটা নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা প্রদান করতে হবে বিনিময়ে। গাড়ি রেখে শাটলে চড়ে টার্মিনালে এলো ওরা। সেলফ চেকইন করে বোর্ডিং পাস আর সিট নাম্বার সংগ্রহ করল। সব কাজ হয়ে যাওয়ার পরেও দেখা গেল প্লেন ছাড়তে আরো এক ঘণ্টা বাকি। খুব বেশিক্ষণ মাস্ক পরে থাকলে জাহিদের শ্বাসকষ্ট হয়। কিন্তু বিমানবন্দরের অভ্যন্তরে মাস্ক খোলার নিয়ম নেই। সে ফারাকে বলল, ‘তুমি বসো। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।’
ফারা আকুলি বিকুলি গলায় বলল, ‘কোথায় যাবে এখন আবার? প্লিজ যেও না। সিকিউরিটি পার হয়ে গেটের সামনে গিয়ে বসি চলো।’
জাহিদ তাকাল ফারার দিকে। সাদা টি-শার্ট আর মালটিকালারের একটা সুতি কাপড়ের ট্রাউজার পরনে। গলায় রঙিন মালা। চুলগুলো বাঁধা চূড়ো করে। ওর মুখে বয়সের কোন ভাঁজ পড়েনি। বেশ কিছুদিন হলো পাক্কা ভেজিটেরিয়ান হয়ে গেছে। মাছ-মাংস কিছুই খায় না। এই ত্যাগের প্রতিদান দেয়া শুরু করেছে ওর শরীর। যৌবনের দ্যুতি এখনো নিভে যায়নি। বরং নিভে যাওয়ার আগে দুর্দান্ত স্ফুরণে প্রজ্বলিত হয়েছে আরো একবার। জাহিদের পাশে ওকে ভীষণ মানায়। বন্ধু-জগৎ এবং আত্মীয়মহলে এই জুটির বেশ খ্যাতি আছে। অনেকে মনে মনে এদের হিংসে করে, অনুকরণ করে। এই ভ্রমাত্মক ধারণার পেছনে ফারার ছলা-কলাময়ী আচরণই মূল ভূমিকা পালন করে এসেছে। লোকে ভ্রান্তিময় দৃশ্যের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো ফারার চালচলনের এই তঞ্চকতা আজকাল যেন আরো বিশদ এবং প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে জাহিদের কাছে। ওর মনের ফাঁকে ফাঁকে জমে থাকা ময়লাগুলো, কালো দাগগুলো যেন সর্বক্ষণ অনায়াসে ভেসে উঠছে চোখের তারায়। অথচ প্রথম যৌবনে এর প্রণয় তাকে অন্ধ করে তুলেছিল। একাধিকবার ওর পায়ের কাছে ভালোবাসার ফুল নিবেদন করেছে। সেই ফুলের পাই-পয়সা পরিমাণ মূল্য দেয়নি ফারা। তবে এই নারীই তার প্রথম সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখাতে সক্ষম হয়েছিল! জাহিদ আটপৌরে সাধারণ বাঙালি পুরুষের মতোই ভেবেছিল নিজের প্রথম সন্তানের জন্মদাত্রীকে আজীবন ভালোবাসবে, পাশে থাকবে। অথচ আজ এতগুলো বছর পরে এসে বুঝতে পারছে ভালোবাসা কোন দায়িত্ব কর্তব্যবোধের কাতারে পড়ে না। মানুষ শত চেষ্টা করেও এই অনুভূতিকে বশে আনতে পারে না। বরং এই স্বৈরাচার অনুভূতিই মানুষকে বশ করে, শাসন করে! এমনই সব বিক্ষিপ্ত ভাবনার দোলাচালে দুলতে দুলতে জাহিদ বড় ব্যথিত চোখে চেয়ে ছিল ফারার দিকে। দুনিয়া এক আজব কারখানা। প্রথম প্রেমের সামনে দাঁড়িয়ে আজ বিভ্রান্ত জাহিদের শুধুই মনে হচ্ছে ফারা তার জীবনের প্রথম প্রেম নয় বরং প্রথম ভুল! আরো কত কত ভুল এই জীবনে করার বাকি আছে কে জানে! একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে জাহিদ নিঃশব্দে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসল। মাথা হেঁট। বসার ভঙ্গিটি বড় ক্লান্ত। সে জানে ফারা তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। সেই প্রতারণা দাঁতমুখ খিঁচে সহ্য করেছে প্রথম সন্তানের মুখ চেয়ে। তুরিনের জন্যই এই ট্যুরে যেতে হচ্ছে। তুরিনের জন্যই নিশাকে তালাক দিতে হবে। তুরিনের জন্যই মিথ্যে একটা সম্পর্ক জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বয়ে যেতে হবে! দিনশেষে তুরিন আর জুবিনই তার একমাত্র ভালোবাসা। কিন্তু জুবিন যখন বড় হয়ে চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করবে, আমার মায়ের কী দোষ ছিল? কেন তাকে ত্যাগ করা হয়েছিল? বাবা হয়ে জাহিদ তখন সন্তানকে কী জবাব দেবে?
চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করল সে। বদ্ধ চোখের দর্পনে সবার প্রথমে নিশার মুখটাই ভেসে উঠল। কী করছে এখন নিশা? জুবিনের দেখাশোনা? ঘরের কাজ? নাকি অন্যকিছু? কর্মব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে একলা নিশা কার কথা ভাবে বিষণ্ণ অলস দুপুরগুলোয়? ভুল করেও জাহিদকে কখনো মনে পড়ে কি? নাকি ওর সমস্তটাই শাহজিদের দখলে? শাহজিদের নামটা মনে পড়তেই একটা আগুনের হলকা এসে লাগল মনে। অবাক হয়ে আবিষ্কার করল অনিমেষকে সে কখনো ঈর্ষা করেনি, কিন্তু শাহজিদের প্রতি যে প্রলয়ংকরী মনোভাব তার বিচক্ষণ, বিবেচক মস্তিষ্কের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেও অনায়াসে দাউদাউ করে জ্বলছে বুকের প্রতিটি ইট-কাঠ-পাথরে…সে মনোভাব ঈর্ষা বই অন্যকিছুই নয়। তার হঠাৎ ইচ্ছে হলো ভারি কিছুর আঘাতে মাথাটা চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলে। এক নিমেষে মিটে যাক সব যন্ত্রণা। কিংবা অনেক ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে নিশ্চিন্তে। কতদিন ঘুমায় না শান্তির ঘুম!
ফারা পাশে এসে বসেছে। বলছে কিছু একটা। জাহিদ ওর কথা শুনতে পাচ্ছে না। আচ্ছা নিশাকে তো সে ভালোবাসে না, তাহলে নিশা শাহজিদকে ভালোবাসলে ক্ষতিটা কোথায়? জানে না…! ক্ষতির স্বরূপ অজ্ঞাত। তবে ক্ষতি কিছু একটা হয়ে গেছে। বিশাল ক্ষতি! কেন যেন মনে হচ্ছে জীবনের অন্য সব ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হলেও এই ক্ষতিটুকু কখনোই পূরণ হওয়ার নয়! ফারাকে সে কখনো মিস করেনি। কিন্তু নিশাকে সে মিস করছে। এমনকি একই বাড়িতে থেকেও নিশাকে সে সর্বক্ষণ মিস করে!
হঠাৎ একটা ছায়ামূর্তি ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। জাহিদ চোখ তুলে দেখতে পেল অনিমেষকে।
—‘হোয়াসসাপ বাড়ি?’ অনিমেষ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ওর পাশে বন্ধুজগতের আরো কিছু পরিচিত মুখ দেখা গেল। এই ট্যুরে অনিমেষ যাচ্ছে সেকথা ঘুণাক্ষরেও উল্লেখ করেনি ফারা। জাহিদ কিছুক্ষণ স্থির চোখে অনিমেষের ধারওয়ালা গাঢ় গাত্রবর্ণের মুখের দিকে চেয়ে থেকে নির্জীব গলায় বলল, ‘তুই যাচ্ছিস নাকি?’
—‘হ্যাঁ যাচ্ছি তো!’ কথাটা বলে শেষ করে সে বাড়িয়ে দেয়া হাতটা গুটিয়ে নিল। জাহিদের প্রত্যাখ্যান বুঝতে সময় লাগল না তার। জাহিদ ফারার দিকে তাকাল, ‘তুমি তো বলোনি আমাকে।’
ফারা বিচলিত কণ্ঠে বলল, ‘কী বলব?’
—‘অনিমেষ যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে একথা আগে বলোনি কেন?’ অদ্ভুত শীতল শোনাল জাহিদের গলা। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল ফারার। তবুও মুখ- চোখ স্বাভাবিক রেখে সে বলল, ‘আমিও কি জানতাম নাকি?’
মিথ্যাটা খুব সুনিপুণ সত্যের মতো উপস্থাপন করা হলেও জাহিদ বুঝল ওটা সত্য নয়, ডাহা মিথ্যা কথা। অনিমেষ একটু অপ্রস্তুত গলায় বলল, ‘আগে থেকে জানানোটা ম্যান্ডেটরি ছিল নাকি? ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে তো আমিও আছি। তোদের কোন সমস্যা আছে আমার প্রেজেন্সে? থাকলে বল, আমি কুইট করছি।’ জাহিদ কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল কাঠ হয়ে। তার মনোজগৎমুহূর্তের জন্য সংকটপূর্ণ এক রণক্ষেত্রে পরিণত হলো। তুরিনের উপরোধ আর আত্মসম্মান বোধের মধ্যে একটা নিঃশব্দ লড়াই চলতে লাগল ওখানে। কী করবে জাহিদ? তুরিনের অনুরোধের ঢেঁকি গিলে নিয়ে ফারা, অনিমেষের সঙ্গে নিছক একটা দলগত ভেড়া হয়ে সাতদিনের উদ্দেশ্যে উড়াল দেবে? নাকি নিজের আত্মসম্মান রক্ষা করবে? নাকি বাড়ি ফিরে যাবে, নিশার কাছে? শেষের ভাবনাটা তার বুকে একটা নাড়া দিয়ে গেল। বাড়ি ফিরে যাওয়া মানেই কি নিশার কাছে ফিরে যাওয়া? হ্যাঁ তাই তো! বাড়ি ফিরলেই তো নিশাকে দেখতে পাবে! এমন একটা বাড়ি, যে বাড়িতে মমতাময়ী মা আছে, সেই সঙ্গে ভালোলাগার মানুষ আছে! এমন বাড়িতে ফিরে যাওয়ার চাইতে স্বস্তির আর কী হতে পারে?
—‘তুইই বরং যা। আমার যেতে ইচ্ছা করছে না। আই কুইট।’ পাথরের মতো শক্ত চোয়াল জোড়া নেড়ে হিমায়িত কণ্ঠে বলল জাহিদ।
ফারা আঁতকে উঠল, ‘কী বলছো তুমি এসব?’
জাহিদ বোর্ডিং পাসটা দু হাত দিয়ে ছিঁড়ে বলল, ‘তোমরা যাও। হ্যাভ আ ওয়ান্ডারফুল ভ্যাকেশন গাইজ!’
কথাটা বলেই জাহিদ আর দাঁড়াল না। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হনহনিয়ে হাঁটতে লাগল একজিট বরাবর। নিশাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। মনে হচ্ছে এখুনি ওকে একবার দেখতে না পেলে নির্ঘাত মরে যাবে! ফারা জাহিদের পেছন পেছন পা বাড়াতেই অনিমেষ খপ করে ওর হাত ধরে ফেলল, ‘কোথায় যাচ্ছ?’
—‘কোথায় আবার? জাহিদকে ফিরিয়ে আনতে।’
—‘ফিরিয়ে আনার কী দরকার? ওকে যেতে দাও। আমরা আমরাই ঠিক আছি।’
ফারা চাপা গলায় বলল, ‘অনি তুমি বুঝতে পারছ না এ সময় ওকে আমি একলা ছাড়তে পারব না।’
—‘কেন হঠাৎ কী এমন হলো?’ সন্দেহ উঁকি দেয় অনিমেষের গলায়।
—‘নিশা বিদায় হওয়ার আগের কটা দিন আমাকে জাহিদের সঙ্গে থাকতে হবে। ওই ডাইনিকে আমি বিশ্বাস করি না। তা ছাড়া তুরিন কী ভাববে ওর বাবাকে ফেলে একা একা ভ্যাকেশনে গেলে?’
অনিমেষ তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি জাহিদের জন্য তোমার দরদ বেড়ে গেছে। ব্যাপারটা কী?’
—‘অনিমেষ! লক্ষ্মীটি, প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো। কয়েকটা দিন সময় দাও আমাকে। নিশাকে বিদায় করতে পারলেই সব আগের মতো হয়ে যাবে। ট্রাস্ট মি!’
পাশে একজন বন্ধু এসে দাঁড়িয়েছে। বন্ধুটি জাহিদের ব্যাপারে জানতে চাইলেই ফারা হড়বড় করে মিথ্যে কথার ডালি সাজিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে ফেলল, ‘আমার শ্বশুর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেছেন তো তাই আমাদের আর ট্যুরে যাওয়া হলো না।’
অনিমেষ কড়া গলায় বলল, ‘জাহিদ তো গেছেই ওর বাবার কাছে। তাছাড়া তোমাদের বাড়িভর্তি মানুষ। দেখাশোনা করার ঢের লোক আছে। তুমি চলো আমাদের সঙ্গে।’ এই কথা বলে অনিমেষ ফারার হাত চেপে ধরে টানতে টানতে নিয়ে যেতে লাগল সিকিউরিটি চেকপয়েন্টের দিকে।
বাইরে বেরোনোর পর জাহিদের মনে হলো আজকের পৃথিবীটা অন্যরকম! রক্তে বারুদের স্ফুরণ ঝলসাচ্ছে। বুদ্ধিভ্রংশের মতো গাড়ির স্টিয়ারিং চেপে ধরে আছে সে। এই মুহূর্তে সাংসারিক বা বৈষয়িক কোন ভাবনা মস্তিষ্কের বিন্দু মাত্র জমিন দখল করতে পারছে না। তুরিনের কথা মনে থাকছে না। এমনকি ট্যুর ক্যান্সেল করে ফিরে যাওয়ার পর বাড়ির লোকে কী ভাববে সেই চিন্তাও নাড়া দিচ্ছে না। একটা অদৃশ্য শক্তি তাকে চুম্বকের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিশার কাছে। আকর্ষণের তীব্রতায় চাপা পড়ে যাচ্ছে নৈতিকতা এবং বাস্তববোধ! গাড়িটা গন্তব্যে এসে থামল প্রকট শব্দে ব্রেক কষে। ঝোপঝাড়ে আর গাছের ডালে লুকিয়ে থাকা পাখিরা শব্দ শুনে সচকিত হয়ে উঠল, ডানা ঝাপটে উড়াল দিল আকাশে। একটা ঘুঘু ডেকে উঠল মন কেমনের সুরে ক্র্যাব অ্যাপল ট্রির কচি সবুজ পাতার ঝালরের ভেতর থেকে। জাহিদের চোখজোড়া রক্তাভ। মুখে একটা প্রচ্ছন্ন উন্মাদনা। কালো দাড়িগোঁফের আঁচড়ওয়ালা ফরসা গালে লালচে আভার বিস্তার। শ্বাস-প্রশ্বাস অস্বাভাবিক। বশীভূতের মতো গাড়ি থেকে নামল। অবিন্যস্ত এলোমেলো পায়ে এগিয়ে গেল প্যাটিওর দিকে। তার বুক অসম্ভব রকমের কাঁপছে!
নিশা সিঁড়ির ওপর বসে ছিল থম ধরে। গাড়ির চাকার প্রকট শব্দটা কানে এসে লেগেছে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সম্পূর্ণ বিনা কারণে একটা ডঙ্কা বাজিয়ে গেছে বুকের গভীরে। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সে মর্মভেদী দৃষ্টি মেলে অপ্রকৃতস্থের মতো চেয়ে আছে সদর দরজার দিকে। দরজার ওপাশে পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে…দেয়াল ঘড়ির কাঁটা বয়ে চলেছে টিকটিক টিকটিক করে…নিশার স্নায়ু টান টান…শ্বাস আটকানো…সর্বাঙ্গে কম্পন! হঠাৎ দরজাটা খুলে গেল সশব্দে। আলোর ঠিক বিপরীতে একটা দীর্ঘ ছায়ামূর্তি ভেসে উঠল। নিশা সিঁড়ির মাঝবরাবর রেলিং আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল নিঃশব্দে। জাহিদ মুখ উঁচু করে তাকাতেই দুইজোড়া তৃষিত চক্ষু যেন মিলিত হলো শত শতাব্দী পর! বেহেশতি হাওয়া ছুটল দিগ্বদিক মথিত করে। আবছা অন্ধকারে ছাওয়া বদ্ধ বাড়িটা মুহূর্তের মধ্যে নন্দন কাননে রূপান্তরিত হলো। ওরা কেউ নড়ল না, কিছু বললও না। শুধু মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইল পরস্পরের দিকে!
কতক্ষণ কাটল কে জানে! নিশা দুরুদুরু বুক নিয়ে এক পা-দুপা করে সিঁড়ি ভাঙল। দূর থেকে হুইসেল বাজিয়ে একটা ট্রেন ধেয়ে আসছে। হৃদয়ের প্ল্যাটফর্ম কাঁপছে প্রবলভাবে!
—‘ফিরে এলেন যে?’ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে নিশা।
—‘এলাম…মানে আসতেই হলো!’ রুদ্ধশ্বাসে উত্তর দেয় জাহিদ। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রাখে সোফায়। নার্ভাসভাবে বলে, ‘নিশা তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল।’
—‘বলুন।’
জাহিদ দেয়ালের দিকে চোখ সরিয়ে নিল,
—‘এভাবে…এখানে নয়। বাইরে চলো।’
নিশা উথাল… পাতাল মনটা কোন রকমে সামলে নিয়ে বলল, ‘বাইরে?’
—‘হ্যাঁ বাইরে।’
—‘বাইরে কোথায়?’ নিশার চোখ কার্পেটের ওপর ঠাঁসা। সংকোচের অত্যাচারে বুজে আসছে কণ্ঠস্বর।
জাহিদের চোখজোড়াও দেয়াল থেকে সরল না। যেন নিশার সঙ্গে নয়, ওই দেয়ালের সঙ্গেই কথা বলছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি যেখানে যেতে চাও!’
—‘জুবিনকে সঙ্গে নেব?
—‘না…জুবিন থাক বাসায়। তুমি রেডি হয়ে নাও।’
নিশা বাধ্য মেয়ের মতো ঘাড় নাড়ল, ‘আচ্ছা।’
আড়ষ্ট দুটো পা অনেক কষ্টে চালিত করে ঘুরে দাঁড়াল। তার হৃৎপিণ্ড কি একটু বেশিই জোরে স্পন্দিত হচ্ছে? নিজেই তো শব্দ শুনতে পাচ্ছে! কী মুশকিল! বাড়ির সব লোকের কানে পৌঁছে যাচ্ছে নাকি হৃদয়ের উত্তেজনা?
—‘নিশা!’ হঠাৎ ডাকটা ছুটে এলো পেছন থেকে।
—‘জি?’ নিশা ঘুরে তাকাল।
জাহিদ হাতে ধরা সেলফোনে কিছু একটা টাইপ করতে করতে গম্ভীর মুখে বলল, ‘তোমার নীল রঙের শাড়ি আছে?’
—‘জি আছে।’
জাহিদ তাৎক্ষণিকভাবে কোন প্রত্যুত্তর করল না। কয়েক সেকেন্ড পর ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকেই অস্ফুটে বলল, ‘খুব ভালো!’
নিশা ঠোঁটে মুচকি হাসির একটা রেখা নিয়ে প্রস্থান করল। সিঁড়ি ভেঙে হলওয়েতে এসে দেখল শাশুড়ি দাঁড়িয়ে আছেন। নিশা মাথা নিচু করে নিজের ঘরে দৌড়ে গেল। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছিল। সুখের কান্না সুড়সুড়ি দিচ্ছে বুকে। মাথাটা পাগল পাগল! উনার সঙ্গে এর আগে কখনো কোথাও যায়নি নিশা। আজকেই প্রথম! ভাবতে গিয়ে ওর গায়ে জ্বর চলে আসার উপক্রম হলো। নীল শাড়ি আছে বেশ কয়েকটা। কিন্তু এখন চিত্ত চাঞ্চল্যের প্রবল দাপাদাপিতে মাথা ব্ল্যাংক হয়ে গেছে। কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না! অন্ধের মতো জামা-কাপড়ে ঠাঁসা ক্লজেটটা হাতিয়ে বেড়াচ্ছে। ওর মুখে চিলতে চাঁদের বাঁকা হাসি লেগে আছে। চোখে উপচে পড়ছে খুশি। মন পাখিটা আনন্দে বাকবাকুম করছে! ঘরের দরজা খুলে শাশুড়ি ঢুকলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, ‘বৌমা, নীল শাড়ি পরো। নীল রং জাহিদের পছন্দ।’
নিশা চোখ তুলে তাকাতে পারল না শাশুড়ির দিকে। তার খুব লজ্জা করছে…আবার ভীষণ ভালোও লাগছে!
জাহিদ মনে মনে বোকা বনে গিয়ে সেলফোন হাতে নিয়ে বসে আছে। কী করল সে? কেন করল? কী দরকার ছিল বাইরে যাওয়ার প্রস্তাব দেবার? শাড়ির প্রসঙ্গই বা কেন টেনে আনল? মেয়েটা তাকে হ্যাংলা ভাবল নাতো? একটা বড় শ্বাস টেনে নিতে নিতে বুঝতে পারল পাগলামিটা করে ফেলার পর বেশ হালকা লাগছে। বিশাল বড় ভারী পাথর যেন নেমে গেছে বুকের ওপর থেকে। রক্তক্ষরণের মতো যন্ত্রণাটা ব্রেক কষে থেমে গেছে। ফুসফুসে অক্সিজেন ফিরে এসেছে। স্বাস্থ্যকর হাওয়া ছুটোছুটি করছে ঘরময়!
দোতলায় উঠে এসে শাওয়ার নিল সময় নিয়ে। শিস দিয়ে প্রিয় গানের সুর তুলল গলায়। শেভ করল। পছন্দের আফটার শেভ মাখল গালে। স্নানের উষ্ণ জলের স্রোতের সঙ্গে যেন ধুয়ে-মুছে ভেসে গেল সমস্ত রাতজাগা ক্লান্তি আর দুশ্চিন্তা। একটা সাদা রঙের অ্যাথলেটিক ফিট টি-শার্ট আর ব্লু জিন্স পরে নিচে নেমে এলো। একটু পর পর ঘড়ি দেখছিল সে। দুশ্চিন্তা কেটে গেছে, তবে অস্বস্তিটা যায়নি ভেতর থেকে। মন ছটফট করছে। নিশা কখন আসবে? এত দেরি করছে কেন?
জাহিদ বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরাল। আকাশে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। দুপুরে বৃষ্টি হওয়ার কথা। হাওয়ায় আসন্ন বৃষ্টির ভেজা স্পর্শ ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঘ ডাকছে হঠাৎ হঠাৎ। ভেজা মাটির গন্ধের সঙ্গে বসন্তের কাঁচা ফুলের পরাগায়নের সুখী ঘ্রাণ মিশে গেছে। ক্র্যাব অ্যাপল গাছের থোকা থোকা সাদা ফুলের পাপড়ি উড়ছে হাওয়ায়। জাহিদের চোখ বারবার দরজার দিকে ছুটে যাচ্ছে। মন বড় উচাটন!
নিশা এলো অবশেষে। জাহিদ সরাসরি ওর দিকে তাকাতে পারল না। সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে চোখের কিনার দিয়ে দেখল প্যাটিওর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সন্তর্পণে। পরনে নীল শাড়ি! জাহিদ শিরায় শিরায় একটা নিষ্কলুষ স্নিগ্ধতার আশ্চর্য পরশ টের পাচ্ছিল। রক্তে ছলাৎছলাৎ ঢেউ ভাঙছে মাতাল মাতাল সুখ! এরকম অনুভূতি আগে কখনো হয়েছিল কি না মনে পড়ে না! সে কোন কথা বলল না। কথা বলল না নিশাও। কেউ কারো দিকে তাকাল না পর্যন্ত! দুজনে চুপচাপ নীরবতা পালন করে পরস্পরের অস্তিত্ব অনুভব করল শুধু! জাহিদ আধখাওয়া সিগারেটটা মাটিতে ছুড়ে ফেলে জুতো দিয়ে মাড়িয়ে দিল। তারপর এগিয়ে গেল গাড়ির কাছে। নিশা নতমস্তকে ওকে অনুসরণ করল। এই প্রথম জাহিদের গাড়িতে উঠবে। এর আগে সবসময় শ্বশুরের গাড়ি চড়েই বাইরে গেছে। উঠোনের শেষ প্রান্তে রাস্তার ধারে গাড়িটা রাখা ছিল। জাহিদ ড্রাইভিং সিটের পাশের দরজা খুলে দিল, নিশার জন্য। নিশা ভেবেছিল অন্তত ‘থ্যাংক ইউ’ শব্দ দুটো উচ্চারণ করে ভদ্রতা বজায় রাখবে। কিন্তু ওর গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোচ্ছে না। সংকোচ, আনন্দ আর উৎকণ্ঠায় ভেতর বাহিরের সমস্তটা বোবা হয়ে গেছে।
ঠিক সেই সময় আচমকা একটা গাড়ি এসে থামল। মিনিট না গড়াতেই ফারা তড়িঘড়ি করে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। দৌড়ে ছুটে এসে জাহিদকে জাপটে ধরল। হাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘তুমি ভাবলে কী করে আমি তোমাকে ছাড়া ভ্যাকেশনে যাব হানি? এই দ্যাখো আমি চলে এসেছি!’
নিশার মুখ থেকে রক্ত সরে গেল। ভয়ংকর এক স্থবিরতা গ্রাস করল তাকে মুহূর্তের মাঝে। জাহিদ কিংকর্তব্যবিমূঢ়!
JUST GONNA STAND THERE AND
HEAR ME CRY, BUT THAT’S
ALL RIGHT, BECAUSE
I LOVE THE WAY YOU LIE!
— SKYLAR GREY
.
শাহজিদ একটা সিগারেট ধরিয়েছিল। তুরিন হাত পেতে দিয়েছে, ‘আমাকেও দাও।’
শাহজিদ ওর চোখের দিকে না চেয়েই বরফশীতল কণ্ঠে বলেছে, ‘জাস্ট ব্যাক অফ অ্যান্ড লিভ মি এলোন!’
তুরিন বুঝতে পারছে না তার দোষটা কোথায়। সে তো যেচে পড়ে কিছু করেনি। এখন ভাবটা এমন দেখাচ্ছে যেন তুরিনকে চেনেই না! অথচ ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার পর তুরিনের কিন্তু মোটেও খারাপ লাগছে না। একটা ফুরফুরে খুশি খুশি ভাব মনটাকে অবশ করে তুলেছে। সে এখন জানে শাহজিদও তাকে চায়। সেই চাওয়ার তীব্রতা কতখানি তা অজ্ঞাত, তবে আকর্ষণ শুধু একতরফা নয় এটুকুমাত্র জ্ঞান আপাতত তাকে স্বর্গসুখে ভাসিয়ে দিয়েছে। কিন্তু শাহজিদ ভুলেও ওর চোখে চোখে তাকাচ্ছে না। যেন ভয়ংকর কোন অপরাধে অভিযুক্ত আসামিসে। মুখে ঘন ঘোর শ্রাবণের কৃষ্ণবরণ মেঘ। চোখের দৃষ্টি অপরাধবোধের প্রাবল্যে ন্যুব্জ হয়ে এসেছে।
অর্ণব আনিতা পার্কিং লটে ফিরে আসার পর শাহজিদ শশব্যস্ত হয়ে বলল, ‘আমাদের এবার ফিরে যাওয়া উচিত।’
—‘এত তাড়াতাড়ি?’ আনিতার প্রশ্ন।
—‘আমার কাজ আছে। ফিরতে হবে।’ শাহজিদ বলল। অর্ণব একটু নিরাসক্ত গলায় মতামত পেশ করল, ‘আমার কিছু বলার নেই। আপনাদের ইচ্ছা।’
শাহজিদ ড্রাইভিং সিটের পাশে উঠে বসতে যাচ্ছিল। তুরিন ওকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে এলো পেছনে।
—‘তুমি আমার পাশে বসো। আনিতা, প্লিজ সামনে যাও।’
আনিতা ত্যাড়া চোখে একবার দেখল তুরিনকে। এই মেয়ের পাগলামি উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। কোনদিন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায় কে জানে! বিরক্তিতে চিড়বিড় করে উঠল ওর মন। কিন্তু মুখে কিছু বলল না। শাহজিদ অর্ণব আনিতার সামনে কোন উচ্চবাচ্য না করে তুরিনের পাশে এসে বসল। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে। সারা মুখে গাঢ় বিষণ্নতার ছাপ নিয়ে স্থিরচিত্র হয়ে বসে আছে। তুরিনের বালিকাসুলভ অপরিপক্ব মন এই অগ্রাহ্যতা পাত্তাই দিচ্ছে না। ওর চোখে-মুখে একটি দুষ্টু হাসি পাজি ডাকাতের মতো দর্পিত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা মনে পড়লেই সারা গায়ে শিহরণ খেলে যাচ্ছে। মনের ভেতরকার মন ক্ষণে ক্ষণে পুলকিত হচ্ছে দুর্দান্ত হর্ষে। সে দুরন্ত চোখে শাহজিদের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে ওর হাত আলতো করে ছুঁয়ে দিল। শাহজিদ তাৎক্ষণিকভাবে হাতটা গুটিয়ে নিল। তুরিন এই প্রত্যাখ্যানে মোটেও ব্যথিত হলো না। বরং শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বময় শাহজিদের কাঁচুমাচু মুখটা দেখে মনে একটা গোপন আনন্দ হলো। সে এবার ডান পায়ের আঙুল রাখল শাহজিদের বাঁ পায়ের গোড়ালিতে। হালকা সুড়সুড়ি টের পেল শাহজিদ। আগুন চোখে তাকাল তুরিনের দিকে। তারপর আগুন গলায় অর্ণবকে বলল, ‘অর্ণব ভাই। নেক্সট একজিটে গাড়ি থামাবেন প্লিজ।’
বিরতিহীন হাইওয়ে ধরে আরো ছয় মাইল যাওয়ার পর রাস্তার ডান দিকে একজিট সাইন চোখে পড়ল।
একটা গ্যাস স্টেশনে গাড়ি থামাল অর্ণব। ট্রাংক থেকে শাহজিদের ক্রাচ বের করে দিল। শাহজিদ বাইরে বেরিয়ে এসে তুরিনকে বলল, ‘তোমার সঙ্গে কথা আছে। এদিকে এসো।’
তুরিন ফড়িংয়ের মতো তিড়িংবিড়িং করে উড়ে উড়ে ওকে অনুসরণ করল। অর্ণব আনিতা বসে রইল গাড়িতে। আনিতার একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। অর্ণবের সঙ্গে টানা এতটা সময় থাকতে হবে জানলে সে এই ট্যুরে কখনোই আসত না। পাশাপাশি একটা মানুষ বসে থাকলে টুকটাক কথা তো বলতেই হয়। কিন্তু কতই বা আর বলা যায় কথা? অপরিচিত একজন মানুষের সঙ্গে? অর্ণব ভাবছিল এ বাড়িতে আসবার পর থেকে আনিতার সঙ্গে ওর যতটা কথা হয়েছে, অন্য কারো সঙ্গেই বোধহয় ততটা হয়নি। এখানে সবাই একটু কেমন যেন। আনমনা, কিঞ্চিৎ ছিটিয়াল এবং আত্মকেন্দ্রিক। একমাত্র আনিতাই সাধারণ।
গ্যাসস্টেশনের পেছন দিকের নিরিবিলি জায়গায় এসে দাঁড়াল শাহজিদ। এদিকে ঝোপ-জঙ্গল আছে আর কিছুটা দূরে আছে লাল রঙের পাহাড়। রোদ এখন খুব কড়া। রোদ চশমা ছাড়া চোখ মেলে রাখা দায়। শাহজিদের সঙ্গে এখন সানগ্লাস নেই। সে অর্ধনিমীলিত সরু চোখে তুরিনের খুশি মাখামাখি মুখের দিকে তাকাল।
—‘কী হয়েছে তোমার?’
তুরিন হাসতে হাসতে বলল, ‘আমার আবার কী হবে! হয়েছে তো তোমার!’
—‘আমার কী হয়েছে?’ শাহজিদ বুকের ভেতরকার নরম মাটিটাকে জোর করে শক্ত করার চেষ্টা করে। তার আত্মবিশ্বাসের ভিত নড়ে গেছে। নিজেকেই নিজের ভয় হচ্ছে এখন। তবে সবচেয়ে বেশি ভয় হচ্ছে এই মাথামোটা বেকুব, পাগল মেয়েটাকে।
তুরিন খুশিতে জুলজুল হয়ে বলল, ‘আই থিংক ইউ আর ফলিং ফর মি।’ শাহজিদ ধমকে উঠল, ‘শাট আপ! সব সময় লেইম কথাবার্তা বলো কেন?’
একটু নিভল তুরিন, ‘লেইম কিছু তো বলিনি।’
শাহজিদ চোখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে, ‘তুরিন শোনো, আজকের ঘটনাটা ভুলে যাও।’
—‘ভুলে যাব?’
—‘হ্যাঁ ভুলে যাও।’
—‘তুমি ভুলতে পারবে?’
—‘আমার জন্য এটা বিশেষ কিছু নয়।’ যান্ত্রিক কণ্ঠে বলল শাহজিদ।
তুরিনের বুকে একটা তপ্ত শেল এসে বিঁধল। ব্যথিত চোখে তাকাল একবার শাহজিদের হাইচিকবোন সংবলিত বিচক্ষণ, সবল এবং সদম্ভ মুখখানার দিকে।
—‘তোমার জন্য বিশেষ কিছু নয়?’
—‘নাহ! তুমি জানো অ্যাঞ্জেলিনার সঙ্গেও এসব হয়েছিল।’ অবহেলার গলায় বলে শাহজিদ। অবহেলা নিয়ে তাকায় তুরিনের দিকে। অবহেলার সুরে বলে, ‘জানো তো, তাই না?’
তুরিনের বুকে মোচড় দিল তীব্র ব্যথা। বাধোবাধো গলায় বলল, ‘আমাকে যেভাবে আদর করেছ…অ্যাঞ্জেলিনাকেও ঠিক এভাবেই…’
—‘নিজেকে এত স্পেশাল ভাবছ কেন?’ শাহজিদ থামিয়ে দিল তুরিনকে। তুরিন ছোট ছোট বঙ্কিম দুটো চোখ ভারি নিষ্পাপ ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ মেলে রাখল শাহজিদের ওই বিমোহন চক্ষুদ্বয়ের ওপর। তারপর ফাঁপা বাঁশির মতো বেসুরো কণ্ঠে বলল, ‘তুমি মিথ্যে বলছো।’
হাসার চেষ্টা করল শাহজিদ, ‘এক বিন্দুও মিথ্যে বলছি না। শোন, আমি একজন সাধারণ পুরুষ। মেয়েদের আমার ভালো লাগে! ওখানে অন্য কেউ ছিল না। তুমি খুব কাছে ছিলে। সো আই টুক অ্যাডভ্যান্টেজ অফ ইউ।’
—‘এতটাই খারাপ তুমি?’
—‘আমি এর চাইতেও অনেক বেশি খারাপ! ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া-আমি কতটা খারাপ হতে পারি। তাছাড়া আমি কখনোই কাউকে ভালোবাসিনি। বাসবও না। আমার জীবনে এসবের কোন জায়গা নেই। ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? আর তোমার মনে যদি আমার জন্য কিছু থেকে থাকে, খুব দ্রুত সেই ফিলিংস ওয়াইপ আউট করে দাও। এটাই তোমার জন্য ভালো হবে।’
তুরিনের ঠোঁট দুটো কাঁপছিল। চোখে-মুখে মর্মান্তিক যন্ত্রণার ছাপ। কেউ যেন বুলডোজার দিয়ে ওর হৃৎপিণ্ড পিষে দিচ্ছে। শাহজিদ ওর দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিল। তার ভেতরে মর্মযাতনা হচ্ছে। কথাগুলো তুরিনকে বলার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু বলে ফেলার পর মনে হচ্ছে এতটা শক্ত ভাবে না বললেও চলত।
—‘তোমার মনে আমার জন্য কোন ফিলিংস নেই?’
শাহজিদ কপট হাসি হেসে অবহেলার স্বরে বলল, -”ফিলিংস? নো ওয়ে!
—‘আমি অর্ণবকে বিয়ে করলে তোমার কষ্ট হবে না শাহজিদ?’ ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করে তুরিন।
—‘কষ্ট হবে কেন? স্ট্রেঞ্জ!’
তুরিন আহত এবং পীড়িত চোখে চেয়ে রইল। তার বুকের ভেতর ওলটপালট হচ্ছে…ভাঙচুর হচ্ছে…সর্বনাশা এক প্রলয় ঘটছে!
—‘আমি শেষবারের মতো প্রশ্ন করছি। তুমি আমাকে চাও না?’
শাহজিদ তুরিনের চোখে চোখ রাখল। দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল, ‘আমি কাউকে চাই না! কিচ্ছু চাই না!’
তুরিনের চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়ল জলের একটা ধারা। রুদ্ধ স্বরে বলল, ‘তুমি মিথ্যেবাদী।’
শাহজিদ কাঠ কাঠ হাসল, ‘তোমার কনফিডেন্স লেভেল আমাকে মুগ্ধ করেছে। হ্যাটস অফ! ‘
—‘তাহলে আজকের পর থেকে তোমার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।’ শাহজিদ চুপ করে রইল। তার চোখদুটো শূন্যে নিবদ্ধ। মুখে বিষণ্নতার গহন ছায়া।
তুরিন জায়গাটা থেকে চলে যাওয়ার আগে একবার শুধু উচ্চারণ করল, ‘ভালো থেকো শাহজিদ!’
গাড়িতে ফিরে এসে কান্নারত কণ্ঠে আনিতাকে বলল, ‘তুমি পেছনে যাও। আমি সামনে বসব।’
৬
ফারা খুব সহজে মুক্তি দিল না জাহিদকে। এমন শক্তিশালী ভুজবন্ধনে আটকে ফেলল যে ওই শীর্ণ, কোমল হাত দুখানি নিজের গলা থেকে ছাড়িয়ে নিতে জাহিদের বেশ বেগ পেতে হলো। ফারা আড়চোখে নিশাকে লক্ষ্য করছিল। এই মেয়ে সেজেগুজে সং সেজে জাহিদের গাড়ির কাছে কী করছে? তার বাড়ি ফিরতে অতিরিক্ত বিলম্ব হয়েছে এমন তো নয়, এর মাঝেই এতকাহিনি! অনিমেষটাকে বোঝাতে বোঝাতেই পাক্কা বিশ মিনিট চলে গেল। নইলে আরো আগেই উপস্থিত হওয়া যেত। ভাগ্যিস এসেছিল! তার মন বলছিল ডাইনিটা কোন গুপ্ত চক্রান্ত করে জাহিদকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। হলোও তাই। একটু দেরি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত। এসব ভাবতে ভাবতে মনে মনে সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্যবার ধন্যবাদ জানাল সে যথাসময়ে তাকে ঘটনাস্থলে পৌঁছে দেবার জন্য।
নিশা বিবর্ণ মুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। সে ভুলে গিয়েছিল যে তার জীবনে এক টুকরো হাসির ঋণ শোধ করতে হয় সহস্র অশ্রুজল দিয়ে। ক্ষণিকের আনন্দের হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে দিতে হয় অগণিত লাঞ্ছনা আর অপমানের ধূসর আশ্লেষকে বরণ করার মাধ্যমে। সে জানে জাহিদ ফারাকে…শুধু ফারাকেই ভালোবাসে। একথা নিজ মুখে স্বীকার করেছে বহুবার। অতএব ভালোবাসার রমণীর আবির্ভাব নিশার উপস্থিতিকে নিশ্চয়ই ফিকে করে দিয়েছে মুহূর্তের মধ্যেই। জাহিদের কিছু জরুরি কথা আছে বলেছিল, হয়তোফারার উপস্থিতি এখন ওর সমস্ত জরুরি কথা ভুলিয়ে দেবে। নিশা বুঝতে পারে ফারার মধ্যে মানুষকে বশ করার একটা অভূতপূর্ব শক্তি আছে। আর সেই মানুষ যদি পুরুষমানুষ হয়, তবে তো ওর বশীকরণ থেকে নিস্তার লাভ করা সেই পুরুষের জন্য প্রায় অসম্ভব। একটু আগে নিশার চোখে ছিল ঘোর, ছিল সর্বাঙ্গে শিহরণ। এখন সেই স্বপ্নঘোর কেটে গেছে। মনটা ডানা ভাঙা আহত রক্তাক্ত কবুতরের মতো দ্যুলোক থেকে আছড়ে পড়েছে ভূলোকের বাস্তব প্রেক্ষাপটে। কষ্ট হচ্ছে খুব। এত বেশি কষ্ট হচ্ছে যে জীবনে প্রথমবারের মতো একটা বিভীষণ ইচ্ছা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। মন চাইছে জাহিদকে ফারার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়, তারপর ওর হৃদয়টাকে ছিঁড়েখুঁড়ে দোফালা করে ফারাকে টেনে বের করে আনে চিরকালের জন্য।
—‘তুমি বাইরে কী করছ? চলো ভেতরে চলো!’
জাহিদের মুখে এতক্ষণ একটা বিভ্রম খেলা করছিল। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ছিল চোখের চাউনি। ফারার মাত্র বলা কথাটা শোনার পর কয়েক সেকেন্ড সে বিপন্ন চোখে চেয়ে থাকল ওর দিকে। তারপর অবিচল কণ্ঠে বলল, ‘তুমি ভেতরে যাও। আমার একটু কাজ আছে।’
—‘কী কাজ?’ ফারা উৎসুক হয়ে প্রশ্ন করে। প্রশ্নের মধ্যে একটা আধিপত্যশীল ভাবগাম্ভীর্যের উপস্থিতি ছিল, যেটা জাহিদের একেবারেই মনঃপূত হলো না।
— ‘ভেতরে যাও। রেস্ট নাও। তুরিনকে ফোন করে খোঁজখবর নাও।’
কথাটা বলতে বলতে জাহিদ ড্রাইভিং সিটের দরজার দিকে এগিয়ে এলো। নিশাকে কিছু বলতে হলো না। যন্ত্রচালিতের মতো গাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল সে, রুদ্ধশ্বাসে! ফারার চোখের দৃষ্টি হিংস্র হয়ে উঠল। দ্রুত পায়ে জাহিদের কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘কী এমন জরুরি কাজ পড়ল তোমার? আগে বলোনি তো!’
জাহিদ ড্রাইভিং সিটে উঠে সিটবেল্ট বেঁধে নিল, শুষ্কং কাষ্ঠং একটা হাসি হেসে বলল, ‘বলার প্রয়োজন বোধ করিনি।’ দড়াম শব্দে গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ক্রোধ এবং অপমানের ভয়ংকর শিখা জ্বলে উঠল ফারার মুখে। আগুন ধরা চোখে দেখতে পেল গাড়িটা মসৃণ পিচঢালা পথের ওপর দিয়ে ধীরেধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। অনিমেষ ফোন করে যাচ্ছিল বিরতিহীনভাবে। ফোন ধরে বিষাক্ত কণ্ঠে ফারা বলল, ‘কী চাই?’
অনিমেষ হাসে, ‘তোমাকে চাই বেবি!’
—‘ঢং করার সময় না এটা। তুমি জানো আমার কত বড় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে?’
—‘কীসের ক্ষতি?’
—‘উফ! তুমি বুঝবে না। ছাড়ছি এখন!’
—‘আমি আসছি তোমার ওখানে।’
—‘আজকে হবে না অনি!’
—‘কেন?’
ফারা বিরক্তিতে কাদা কাদা হয়ে গেল, ‘আমার মুড নেই।’ হঠাৎ করেই অত্যুগ্র হয়ে ওঠে অনিমেষের কণ্ঠস্বর, ‘ফারা শোন, অনেক হয়েছে। এবার তোমাকে আমার সম্পূর্ণভাবে চাই।’
—‘আগে আমার সংসারটা বাঁচাই, কেমন?’
—‘সংসার হবে…নতুন সংসার। তোমার আর আমার। সঙ্গে থাকবে আমাদের মেয়ে।’
—‘তোমার মাথাটা গেছে।’
—‘তুমি জাহিদকে ছাড়তে চাইছ না?’
ফারা বিভ্রান্ত গলায় বলে, ‘জাহিদকে ছাড়ার কথা আসছে কেন?’
—‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো ফারা?’
—‘এটা কেমন প্রশ্ন হলো? আমি তোমাকেই…শুধু তোমাকেই ভালোবাসি অনি!’
—‘তাহলে জাহিদকে ডিভোর্স দাও।’
ফারা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল, ‘আমি ছাড়ছি ফোন। মাথাটা খুব ধরেছে।’
—‘এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না। প্রয়োজনে আমি জাহিদের সঙ্গে কথা বলব।’
‘কী কথা বলবে?’ আঁতকে ওঠে ফারা।
—‘সত্যটা ওর জানা দরকার।’
ফারা আশপাশটা একবার সতর্ক চোখে দেখে নেয়। গলা খাদে নামিয়ে বলে, ‘খবরদার! জাহিদের কানে যেন একটা কথাও না যায়।’
—‘সরি বেবি! তোমার কথা মতো চুপ করে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব না। জাহিদকে জানতে হবে ওর স্ত্রী কিংবা সন্তান কোনটাই ওর নিজের নয়। সবটাই আমার।’
এ কথা শুনে ফারার হাত-পা শিউরে উঠল। একটা বিপদ সংকেত ঢংঢং শব্দে বেজে উঠল বুকে। ভয়-টয় সাধারণত সে পায় না। কিন্তু আজকে তার কণ্ঠে ভয়ের উপস্থিতি পরিপূর্ণরূপে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠল।
—‘অনি প্লিজ! একটু ভাবার সময় দাও আমাকে। কোথায় আছ তুমি? আমি আসছি।’
—‘বাসায় আছি। চলে এসো।’
—‘ঠিক আছে।’ ফোনের লাইন কেটে ফারা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। এই মুহূর্তে অনিমেষের সঙ্গে দেখা করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না। কী করে ডাইনিটার জাল থেকে জাহিদকে ছাড়িয়ে আনা যায় সেই প্ল্যানটাই ঠাণ্ডা মাথায় গুছিয়ে নেবে বলে ভেবেছিল। কিন্তু অনিমেষ এমন গোঁয়ার্তুমি শুরু করল…উফ…! ওকে বোঝাতে হবে। ভালোবাসা দিয়ে, আদর দিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় পই পই করে বোঝাতে হবে যে কোন মতেই জাহিদকে তুরিনের জন্মবৃত্তান্ত জানানো যাবে না। বড় বড় দম নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল ফারা। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করতে করতে ভাবল, তুরিনই এখন তার একমাত্র হাতিয়ার। নিশার সঙ্গে মোকাবেলার জন্য মেয়েটাকে খুব ভালো মতো প্রস্তুত করতে হবে। এমনিতেই মেয়ে যথেষ্ট জেদি আছে। বাবাকে যে করেই হোক ফিরিয়ে আনবে। মা-মেয়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়লে নিশা-মুক্ত জীবন লাভে নিশ্চয়ই সফল হবে ওরা। এদিকে শাহজিদের সঙ্গেও একবার কথা বলাটা জরুরি। খুব দ্রুত ওই ল্যাংড়া ছেলেটার সঙ্গে যদি নিশা ডাইনিটাকে জুড়ে দেয়া যায় তাহলেই সব ঝামেলা মিটে যাবে। প্রয়োজনে জুবিনকে নিশার কাছে সঁপে দেয়া হবে। জাহিদের তুরিন আছে, জুবিন না হলেও চলবে! ড্রাইভ করতে করতে নিজের মনে পরিকল্পনাগুলো গুছিয়ে নেয় ফারা। কিন্তু এই অনিমেষ হঠাৎ এত ক্ষেপল কেন? অনিমেষের দেয়া হুমকিটা মনে পড়তেই দুশ্চিন্তায় মাথা ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। গাড়িতে উঁচু ভলিউমে গান বাজিয়ে দিল। পথে কিংসুপারে থামল। অনিমেষের জন্য কিনে নিল এক থোকা গোলাপ ফুল। ফুল উপহার দিয়ে, নানারকম ছলাকলা করে, ওই উদ্ধত, একগুঁয়ে লোকটাকে আপাতত ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখতে হবে।
এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘন ঘোর বরষায়
এমন মেঘস্বরে, বাদল ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.
বিস্ময়, বিভ্রান্তি এবং মানসিক বৈকল্যতার দরুন বুক ধড়ফড় করছিল নিশার। ঘটনাটা কি সত্যিই বাস্তবে ঘটেছে? যে মানুষ বাসর রাতে নির্ভেজালভাবে স্বীকার করেছিল, শুধু প্রথম স্ত্রীকেই সে মনে-প্রাণে ভালোবাসে এবং বাসবে…সেই সত্যনিষ্ঠ, দায়িত্ববান মানুষ আজ প্রিয়তমা স্ত্রীকে অগ্রাহ্য করে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সেই মেয়েটিরই পাশে এসে বসেছে, যে মেয়েটিকে কখনো নিজের জীবনে স্বীকৃতি দেবে না বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিল এক সময়। নিশার সঙ্গে কী এমন জরুরি কথা আছে তার? যা ফারার চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ? তাদের বিয়ে হয়েছে আজ থেকে তিন বছর আগে। এর মাঝে একজন সন্তানও এসেছে। কিন্তু কখনোই একসঙ্গে কোথাও যাওয়া হয়নি। এভাবে পাশাপাশি বসা হয়নি। আজকের দিনটি নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম। জাহিদের গাড়ির ড্রাইভিং সিটের পাশের জায়গাটা ফারার জন্যই বরাদ্দ ছিল সবসময়। নিজের স্বামীর পাশে একদিন স্ত্রীর অধিকার নিয়ে দাঁড়াবে এমন কিছু কল্পনা করারও সাহস পায়নি কখনো নিশা। তার মনটা অনেক ছোটবেলা থেকেই অভাবে-অনটনে, সাংসারিক টানপোড়েনে সর্বদা সংকীর্ণ হয়ে থাকত। বিয়ের পরেও প্রতি পদে পদে বুঝেছে ভাগ্যক্রমে এই পরিবারের সঙ্গে গাঁটছড়ায় বাঁধা পড়লেও আদতে এমন অভিজাত পরিবারের যোগ্য সে নয়। এভাবেই স্বপ্ন দেখার শৌখিন সাহসটা দিনকে দিন হারিয়ে গেছে কঠোর বাস্তবতার অতল গহ্বরে। তবে আজকের এই ব্যতিক্রম মুহূর্তটিকে তার স্বপ্ন বলে ভ্রম হচ্ছে। হয়তো একটু পরেই জেগে উঠবে ঘুম থেকে জুবিনের কান্নার শব্দে কিংবা শাশুড়ির ডাকে।
জাহিদ একাগ্রচিত্তে গাড়ি চালাচ্ছিল। ভেতরটা এলোমেলো। নিশাকে নিয়ে এই বেরিয়ে আসাটা যেন রণক্ষেত্রে যুদ্ধাহত সৈনিকের লড়ে যাওয়ার মতো কষ্টকর এবং শ্রমসাধ্য ছিল! নিজের অভ্যন্তরীণ সত্তার সঙ্গে যুদ্ধ। ফারার সঙ্গে যুদ্ধ। প্রাণাধিক প্রিয় কন্যার উপরোধ গলা টিপে হত্যা করে নিজ স্বার্থপরতাকে জিতিয়ে দেয়ার দুঃসহ নির্মম যুদ্ধ। কিন্তু কেন? কেন এই মেয়েটিকে একটুখানি পাশে পাবার জন্য এত ব্যাকুলতা? কেন এত দ্বন্দ্ব, সংঘর্ষ এবং লড়াই? জাহিদ একবার তাকাল নিশার দিকে। ভদ্রতার খাতিরে প্রশ্ন করল,
—‘তুমি ঠিক আছ?’
—‘জি।’ নিশার অনেক কষ্টে দেয়া ছোট্ট উত্তর।
—‘কিছু খাবে?’
নিশা চমকালো। উনার সামনে জীবনে কিছু খেয়েছে কি না মনেই পড়ছে না। এখন তো উত্তেজনায় খিদে মরে ভূত হয়ে গেছে। খানা-খাদ্য গলা দিয়ে নামার প্রশ্নই আসে না। সে মিনমিন করে বলল,
—‘আমার খিদে নেই।’
—‘কোথায় যেতে চাও?’ জাহিদের কথার ধরনে মনে হচ্ছে ভাইভা বোর্ডের প্রশ্নকর্তা। নিশা অমন গুমোট প্রশ্নের ধরনে আরো বেশি মিইয়ে যায়। আস্তে করে বলে, ‘কী জানি!’
তারপর কী মনে করে আবার বলে, ‘সেদিন শাহজিদদের সঙ্গে গিয়েছিলাম একটা জায়গায়। ওই জায়গাটা সুন্দর।’
জাহিদ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। শাহজিদকে নিশা ভুলতেই পারে না!
—‘তোমরা সেদিন টেবল মেসা গিয়েছিলে মনে হয়। ওখানেই যাবে?’
—‘জি যাওয়া যায়।’
কথাটা বলে নিশা ডান দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে আকাশ দেখতে লাগল। যেন আকাশে খুব জরুরি কিছু ঘটে যাচ্ছে। তার নিশ্চয়ই আরেকটু স্মার্ট হওয়া উচিত ছিল। জাহিদের পাশে ওর মতো গেঁয়ো মেয়ে বোধহয় একদমই মানায় না। ফারাকে দেখো না কত্ত স্মার্ট! চোখে-মুখে বুদ্ধির ঝিলিক খেলে বেড়ায় সারাক্ষণ। অমন বৌ রেখে জাহিদ কেনই বা নিশার মতো সাধারণ চাকচিক্যবিহীন হাবাগোবা টাইপ মেয়েকে পছন্দ করবে? এসব ভাবতে গিয়ে একটু দুঃখ দুঃখ ভাব হয়। হৃদয় তবুও উদ্বেল। এমন হাঁসফাঁস অনুভূতি আরো কিছুক্ষণ বুকের ওপর চেপে বসে থাকলে নির্ঘাত হৃদরোগে আক্রান্ত হবে। কী মুশকিল! জাহিদ দেখল নিশা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে। মেয়েটাকে সে বোঝে না। আর বোঝে না বলেই ওকে বুঝবার জন্য, জানবার জন্য হয়তো মনটা এমন আনচান করে আজকাল।
বসন্তের আবির্ভাবে গাছপালার রং আগের চাইতে সতেজ হয়েছে। আদিগন্ত আকাশে এখন ঘন তামসিক ফেরারি মেঘের বিচরণ। কিছু ছাই রঙের মেঘ পঙ্খিরাজের মতো নেমে এসেছে মাটির খুব কাছাকাছি। দেখে মনে হয় হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। দুই লেনের রাস্তার মাঝখানে প্রশস্ত ঘাসযুক্ত ডিভাইডার। রাস্তার দুধারে মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে আছে সমতল বিরানভূমি। বৃষ্টিপাত কম হয় বিধায় এসব জমির আগাছা আর ঘাস শুকিয়ে গেছে। সবুজ নয়, এই ঘাসের রং রুক্ষ বাদামি। লোকালয়ের ঘাসে কৃত্রিম জলসেচনের ব্যবস্থা করা হয় বলে সবুজ হয়ে ওঠে। বিরানভূমিতে মানুষের বিচরণ নেই। এই ঘাস রোদের তেজে ঝলসে থাকে সারা বছর। দূরের পাহাড় প্রাচীরের মতো পুরো শহরটাকে ঘিরে রেখেছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু পাহাড় আর পাহাড়। আশ্চর্য এই পাহাড়ের রহস্য! দেখে দেখে কখনো একঘেয়েমিতে পায় না। আবহাওয়া পাল্টে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর রূপ পাল্টায়। আজকে পাহাড়ের ওপর এমনভাবে ধোঁয়াটে মেঘ এসে ভিড়েছে যে হঠাৎ তাকালে মনে হয় পুরো আকাশটা নেমে এসে মিশে গেছে পর্বতের চুড়োয়। একটু ভালো মতো লক্ষ করলে আবার মনে হয় কোন আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত ধোঁয়া বুঝি ঊর্ধ্বগতিতে ধাবিত হচ্ছে আকাশে।
—‘গান শুনবে?’ জাহিদের প্রশ্ন।
—‘আপনি গান গাইতে পারেন?’ নিশা অবাক।
জাহিদ হাসল নিঃশব্দে, ‘আমি গান গাইতে পারি না। তুমি শুনতে চাইলে অডিও প্লে করতে পারি। তোমার কী ধরনের গান পছন্দ?’
নিশার কেন যে এমন অস্বস্তি হচ্ছে! জিব জড়িয়ে যাচ্ছে। শব্দ হারিয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছেতাই অবস্থা! জানালার বাইরে চোখ রেখে নিম্ন স্বরে বলল, ‘রবীন্দ্রসংগীত।’
—‘তাই?’ প্রশ্নটা করে জাহিদ একটু থামল। তারপর মৃদু আফসোস নিয়ে বলল, ‘আমার কাছে তো রবীন্দ্রসংগীতের কালেকশন নেই। দুঃখিত।’
—‘আপনার কী ধরনের গান পছন্দ?’ নিশার আড়ষ্ট প্রশ্ন।
—‘আমার পছন্দ বোধহয় তোমার পছন্দ হবে না। শুনে দেখবে?’
—‘শোনা যায়।’
আয়রন মেইডেনের একটা হেভি মেটাল গান এয়ারকন্ডিশন্ড বদ্ধ গাড়িতে বেজে উঠতেই নিশার দম আটকে আসার উপক্রম হলো। দাঁত-মুখ খিঁচে বসে রইল সে। মন ভালো থাকলে জাহিদ পছন্দের গান শোনে। আজকে এই মুহূর্তে কী কারণে যেন তার মনটা অত্যধিক ভালো। কিন্তু ক্ষণিক বাদে নিশার বিরক্তিমাখা মুখটা আড়চোখে লক্ষ করে তাৎক্ষণিকভাবে বাজনা বন্ধ করতে বাধ্য হলো সে।
টেবল মেসা ড্রাইভে গাড়ি উঠতেই টিয়া রঙের ঘাসের কার্পেট মোড়ানো ঝকঝকে এক উপত্যকা ভেলকি দিয়ে ভেসে উঠল চোখের সামনে। ঢালু পাহাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাইনগাছের সারি অভিবাদন জানাল। ছবির মতো সুন্দর বাড়িঘর পেরিয়ে ধীরে ধীরে আরো উঁচুতে উঠতে লাগল ওরা। পাহাড়ের ওপর হাওয়া বড় বেশি দুরন্ত। মেঘের দাপটও তীক্ষ্ণ। ওয়ার্কিং ডে বলে লোকজনের ভিড় নিতান্তই কম। পার্কিং লটের পিচঢালা রাস্তার ওপারেই সোনালি ঘাসের বহর। আগাছাও আছে। আর আছে রঙিন বুনো ফুলের সমাহার এবং কিছু কাঁটাযুক্ত ক্যাকটাস। জাহিদ এগিয়ে যাচ্ছিল সামনে। নিশা ওকে অনুসরণ করল। ঘাস আর আগাছাযুক্ত সরু এবড়োখেবড়ো মাটির পথ পেরিয়ে ওরা পাহাড়ের কিনারে এসে দাঁড়াল। সামনে বিস্তৃত খোলা আকাশ। নিচে পাহাড়ি উপত্যকার বুকে দাঁড়িয়ে আছে সুসজ্জিত পরিপাটি শহর বোল্ডার। এই শহরকে অষ্টপ্রহর পাহারা দিচ্ছে কোন-আইসক্রিম আকৃতির অগণিত পাইন গাছ।
জাহিদ চোখ রেখেছে দূরের মেঘাচ্ছন্ন আকাশে। নিশা ওর পাশে দাঁড়ানো। কিন্তু নিশার উপস্থিতি যেন সে টের পায়নি। কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাব খেলছে চোখে-মুখে। অদ্ভুত আছে কিন্তু লোকটা! নিশার ঠোঁটে অজান্তেই একটা মুচকি হাসির ঢেউ লাগল। এমন অদ্ভুত বলেই হয়তো ও অন্য সবার চাইতে আলাদা। নিশা জানে ওর জায়গায় অন্য কোন পুরুষ হলে এমন রোমান্টিক নির্জন জায়গায় অল্পবয়সি তরুণীর সান্নিধ্য পেয়ে হরেক রকম সস্তা রংঢং করত। প্রেম নিবেদনের সুযোগ হাতছাড়া করত না। কিন্তু এই মানুষটার মধ্যে হ্যাংলামো নেই, উপরন্তু ওর হৃদয়ের রংটা অনেক বেশি শুভ্র! নিশা যখনই মানুষটার আশেপাশে থাকে, ওই শুভ্র হৃদয়ের মনাকাড়া সুগন্ধি পায়।
তবে আজকে জাহিদের যে আচরণকে নিশা অন্যমনস্কতা ভাবছে সেই আচরণটুকু আদতে অন্যমনস্কতা নয়, বরং নার্ভাসনেস। কৃষ্ণাভ মেঘে ঢাকা রহস্যময় আকাশের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে জাহিদ ভাবছিল নিতান্তই অল্পবয়সি একটি মেয়ের সামনে তার এত নার্ভাস কেন লাগছে? স্পষ্ট বুঝতে পারছে নিশার উপস্থিতি রক্তে একটা তরঙ্গের সৃষ্টি করেছে। বুকে তিরতিরে কাঁপন ধরাচ্ছে। স্নায়ু বড় দুর্বল! কথা গুছিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে বিপজ্জনক ব্যাপার হলো জরুরি কথাটা সে বারবার অপ্রয়োজনীয় এলোমেলো ভাবনার ভিড়ে হারিয়ে ফেলছে। তার মনে পড়ছে না নিশাকে আসলে ঠিক কী কথা বলার ছিল। হঠাৎ একটা বক্ষচেরা দীর্ঘনিঃশ্বাস তার হৃদয় মথিত করে তুলল। মেয়েটাকে কেন এত বেশি ভালো লাগছে? ও তো চলে যাবে। শাহজিদের মতো কোন টগবগে হিম্মৎদার যুবক ওকে নিশ্চয়ই একদিন নিয়ে যাবে দূরে। ঘাড় ঘুরিয়ে নিশাকে দেখে একবার। নিশা ওকেই দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই অন্যদিকে ঘুরে তাকাল। মেয়েটা অসম্ভব লাজুক। হয়তো এই লাজুক ভাবটাই ওকে আরো বেশি সুন্দর করে তোলে। স্নিগ্ধ করে তোলে। মাতাল বাতাসে নিশার খোলা চুলগুলো উড়ছিল এলোমেলো। মেঘলা আকাশের ছায়া পড়েছে মেঘলা দুটি ডাগর চোখে। নীল শাড়ি পরা নিশার দিকে বিভোর হয়ে চেয়ে থেকে জাহিদের মনে হলো এই মেয়েটি বাড়াবাড়ি রকমের রূপবতী। সে জীবনে কখনোই এত সুন্দরী মেয়ে দেখেনি। এই রূপ যতখানি বাহ্যিক তার চাইতে অনেক বেশি আত্মিক। মানুষের মনের সৌন্দর্য যখন বাইরের আবরণে প্রভাব ফেলে, ছায়া ফেলে, শুধু তখনই সে এমন অতুলনীয় সুন্দর হয়ে উঠতে পারে।
—‘তুমি কেমন আছ নিশা?’ প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়ে জাহিদ একটা গোলগাল ছাই রঙের পাথরের ওপর বসল। এই পাথরের চারিধারে গুচ্ছ গুচ্ছ হলুদ রঙের বুনো ফুল ধরে আছে।
—‘ভালো আছি।’ নিশা উত্তর দিল। দূরের মেঘের দিকে চোখ রেখে।
—‘এই জায়গাটা তোমার পছন্দ?’
—‘হুম পছন্দ।’
—‘পছন্দ হওয়ার পেছনে কোন বিশেষ কারণ আছে কি?’ প্রশ্নটা করে জাহিদ একটু তটস্থ হয়ে গেল মনে মনে। নিশা হয়তো সত্যটা বলবে না। কিন্তু জাহিদ জানে শাহজিদের সঙ্গে এসেছিল বলেই নিশার এই জায়গাটি প্রিয়। প্ৰিয় মানুষ পাশে থাকলে যেকোনো স্থান প্রিয় হয়ে ওঠে অনায়াসে। নিশা কাছাকাছি একটি পাথরের ওপর বসতে বসতে বলল, ‘এখানে দাঁড়ালে মনে হয় আমি বুঝি পৃথিবীর ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। দারুণ লাগে।’ জাহিদ একটু চমকলাগা চোখে তাকাল নিশার দিকে। পৃথিবীর ছাদ! ব্যাপারটা মজার তো!
—‘আপনার কেমন লাগছে?’ কথাটা বলে শেষ করে নিশা ওর ডাগর চোখের পাপড়ি মেলে ধরল জাহিদের মুখের ওপর। ছিপছিপে অথচ মজবুত গড়নের দীর্ঘদেহী মানুষটা ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। মুখে ক্লান্তির রেশ নেই। আছে গভীর বিষণ্নতার ছাপ। ফরসা, শীর্ণ মুখের ভালোমানুষি দুটি চোখে রিমলেস চশমাটা দারুণ মানায়! বাদামি ঠোঁটের কোণের একটুখানি কুঞ্চন যেন চেহারার সুশোভন অবয়বে একটা রহস্যময় তেজের স্ফুরণ ছড়িয়ে দেয়। নিশাকে বোধহয় ওই তেজটুকুই বেশি করে টানে। চুম্বক আকৃষ্টের মতো চেয়ে থাকে সে। জাহিদ একটু হেসে বলে, ‘আমার ভালো লাগছে। জায়গাটা সুন্দর। আমি অবশ্য আগেও এসেছি এখানে।
নিশার একটা কাঁপা কাঁপা শ্বাস পড়ে। অস্ফুটে বলে, হ্যাঁ জায়গাটা সুন্দর, কিন্তু জুবিনের বাবা আরো বেশি সুন্দর! জাহিদ কথাটা স্পষ্ট শুনতে পায় না। কান খাঁড়া করে প্রশ্ন করে,
—‘কিছু বললে?’
—‘না।’
একথার পর কেন যেন দুজনেই চুপ হয়ে যায়। হুহু করে হাওয়া বইতে থাকে। কিন্তু পাইনগাছের শরীর একটুও দোলে না। এসব গাছ প্রলয় মোকাবেলা করার মতো শক্তিশালী। ওরা যেখানে বসেছে তার এক হাত দূরেই মাটি ঢালু হয়ে নেমে গেছে বহু দূর। মিশে গেছে নিম্নভূমির শহরের সঙ্গে। শাহরের পথঘাট যেন পেন্সিলে আঁকা ছবি। রাস্তায় চলতে থাকা গাড়িগুলো খেলনার মতো ঠুনকো। যেন মানবসভ্যতার কোন অংশ নয়, ওটা আসলে পুতুলের সংসার। মেঘের পাতলা প্রাচীরের ওপর সূর্যের রুপালি আলো ঝিকোচ্ছিল। বাতাসে ভেজা মাটির সুন্দর গন্ধ। ওরা কেন চুপ করে আছে কে জানে! দুজনেই মুগ্ধ হয়ে প্রকৃতি দেখছে, কী যেন ভাবছে আর হঠাৎ হঠাৎ তাকাচ্ছে একে অপরের দিকে। এক বৃদ্ধ দম্পতি কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে অনেকক্ষণ হলো। হঠাৎ ওদের উদ্দেশে বলল, ‘হাই দেয়ার, উড ইউ মাইন্ড টেকিং অ্যা পিকচার অফ আস?’
জাহিদ সবিনয়ে রাজি হলো। সাদা চুলো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে পেছনে উপত্যকার জাগ্রত শহর সঙ্গে নিয়ে ফ্রেমবন্দি হলো আইফোনের ক্যামেরায়। ছবি তোলা হলে জাহিদ ওদেরকে ফোন ফিরিয়ে দিল। বৃদ্ধ লোকটি সহাস্যে বলল, ‘তুমি চাইলে আমি তোমার এবং তোমার ওয়াইফের ছবি তুলে দিতে পারি।’
নিশা কথাটা শোনামাত্র একরাশ লজ্জায় ঝুপ করে ভিজে গেল। মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। জাহিদও একটু লাল হলো। সুন্দর হেসে বলল, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আমাদের ছবি তুলে দিলে খুশি হব।’
আড়ষ্ট নিশা বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। এই প্রথমবারের মতো ওরা দুজন ক্যামেরাবন্দি হতে যাচ্ছে। নিশার চোখে-মুখে উদ্বেগের বিন্দু বিন্দু প্রলেপ পড়ছিল। বুক কাঁপছে খুব! জাহিদের মুখে হাসির উপস্থিতি আছে। কিন্তু সে দাঁড়িয়েছে নিশার কয়েক হাত দূরে। বৃদ্ধ লোকটি হাতের ইশারায় ওদেরকে ক্লোজ হতে বলল। জাহিদ একটু জড়তা নিয়ে নিশার কাছে এগিয়ে গেল। নিশা শক্ত হয়ে আছে। জাহিদ কী মনে করে যেন ওর কাঁধে একটা হাত রাখল। পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধা মহিলাটি ছোট্ট মন্তব্য ছুড়ে দিল, কিপ স্মাইলিং। ইউ বোথ লুক সো গ্রেট টুগেদার।
নিশা হাসল বুকের উত্তেজনার দাপাদাপি কাটিয়ে। সুন্দর দেখাল ওর সলজ্জ হাসিমাখা মুখ। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা চলে যাওয়ার পরের কয়েকটা ক্ষণ অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে রইল দুজন। জাহিদ নিজের দিকে চোখ মেলে তাকাতে পারছিল না। একসময় সে পণ করেছিল এই মেয়েটিকে কখনোই স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে না। অথচ আজ বৃদ্ধ লোকটি যখন ওদের স্বামী-স্ত্রী বলল, তখন এক মুহূর্তের জন্যও প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করেনি। বরং এই স্বীকৃতি পেয়ে মনের মধ্যে একটা গোপন তৃপ্তির সঞ্চার ঘটে গেছে।
—‘আপনি বলেছিলেন জরুরি কথা আছে।’ নিশা বলল পাহাড়ের কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। জাহিদ ওর কয়েক হাত দূরে দাঁড়ানো। নিশার কথার প্রত্যুত্তরে সে ভদ্র গলায় বলল, ‘আমি কি স্মোক করতে পারি? তুমি মাইন্ড করবে না তো?’
—‘মাইন্ড করব না। কিন্তু এটা তো ভালো অভ্যাস নয়।’
জাহিদ নীরবে হাসল শুধু। কিছু বলল না। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে আগুন জ্বালাল। শান্ত স্থির গলায় বলল, ‘বাবা বলেছেন তোমাকে আর জুবিনকে একলা ছাড়বেন না। প্রয়োজনে তাঁরাও তোমাদের সঙ্গে থাকবেন।’
—‘তাই?’
—‘হুম। তাই তো বলল।’
—‘আর ডিভোর্সের ব্যাপারে উনাদের কী মতামত?’
জাহিদ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সরু চোখে কী যেন চিন্তা করে নিয়ে বলল, ‘আমাদের তো বিয়ের কোন কাগজপত্র নেই। তাই ডিভোর্সটা আসলে তেমন বিগ ইস্যু নয়। যেকোনো মুহূর্তেই হতে পারে।’
একটু থেমে জাহিদ আবার বলল,
—‘তোমার প্ল্যান কী নিশা?’
নিশা একটু দ্বিধা নিয়ে বলে, ‘আমার প্ল্যান?’
—‘হ্যাঁ…মানে ফিউচার নিয়ে কী ভাবছ?’
নিশা শূন্য চোখে চেয়ে থাকে। কী বলবে ভেবে পায় না।
—‘তোমার পড়াশোনা শুরু করা উচিত। তুমি বাংলাদেশে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেছিলে?’
নিশা ঘাড় নাড়ে, ‘জি না।’
—‘আনডার গ্র্যাডের সাবজেক্ট কী ছিল?’
—‘বিবিএ শুরু করেছিলাম। শেষ হয়নি।’
—‘এখানেও বিবিএ করতে পারো চাইলে।’
—‘জি।’
—‘কোর্স শুরু করার জন্য খুব সম্ভবত একটা ল্যাংগুয়েজ টেস্টের প্রয়োজন হতে পারে। তোমাকে আমি লিংক পাঠিয়ে দেব। নিজেই দেখবে, এক্সপ্লোর করবে। আর ড্রাইভিংটা শিখে ফেলো। একটা হ্যান্ডনোট পাঠাচ্ছি। ওটা পড়লেই রিটেন টেস্ট পাস করে যাবে। কঠিন কিছু নয়।’ কথা শেষ করে জাহিদ হাত বাড়িয়ে বলল, ‘তোমার মোবাইলটা দাও তো!’
নিশা নির্বাক ম্লান মুখে মোবাইল এগিয়ে দিল। সেপারেশনের কথাটা ওঠার পর থেকেই তার কিছু ভালো লাগছে না। এসব ছাইপাশ শিখে সে করবে কী? যদি লোকটা পাশেই না থাকে?
নিশার সেলফোনের স্ক্রিনে আঙুল চালাতে চালাতে জাহিদ বলল, ‘একটা অ্যাপ ডাউনলোড করে দিচ্ছি। এখানে তুমি প্র্যাক্টিস টেস্ট দিতে পারবে। লার্নার্স হয়ে গেলে ড্রাইভিং স্কুলে ভর্তি করে দেব তোমাকে।’
নিশা গাল ফুলিয়ে তেতো গলায় বলল, ‘ছবিগুলো আমার নাম্বারে পাঠিয়ে দিন।
—‘হ্যাঁ?’ জাহিদ ভ্রু তুলে তাকাতেই নিশা অপ্রতিভ হয়ে নামিয়ে নিল চোখ। কী কাণ্ড! লোকটা বলছে কীসব পড়াশোনার কথা আর নিশার মাথায় কি না অগামগা ছাত্রীর মতো ঘুরছে ঠুনকো কয়েকটা ছবির চিন্তা! সে লাজ-শরমের মাথা খেয়ে নতমুখে বলল, ‘না বলছিলাম যে, আপনার মোবাইলে তোলা ছবিগুলো আমার নাম্বারে পাঠিয়ে দিন।’
কথাটা শুনে জাহিদ একটু হাসল। প্রশ্রয় মিশ্রিত গলায় বলল, ‘হ্যাঁ দিচ্ছি।’ এসময় ওদের চোখাচোখি হলো একবার। সেই একটুখানি চোখাচোখিতে গুচ্ছ গুচ্ছ ভালোলাগার অনুভূতি সদ্য ডানা গজানো প্রজাপতির মতো তিরতির করে পাখা মেলে উড়াল দিল হাওয়ায়। পায়ের তলা শিরশির করে উঠল। জাহিদ কিছুক্ষণ নিশার লাজুক মুখখানার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে বলল,
—‘আমার ওপর তোমার কোন রাগ নেই তো?’
নিশার বুকটা হঠাৎ অদম্য আবেগে টলমল করে ওঠে। কী যেন বলতে গিয়েও আবার থেমে যায়। শুধু চেয়ে থাকে ফ্যালফ্যাল করে। জাহিদ স্পষ্ট গলায় বলল, ‘তুমি আমার পরিবারের জন্য, আমার বাবা-মায়ের জন্য অনেক করেছ। নিজের সন্তানও এতটা করে না। তবে আমার সব সময় মনে হয় এমন জীবন তুমি ডিজার্ভ কর না। এবার নিজেকে নিয়ে, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে তোমার ভাবা উচিত।’
নিশা চুপ করে থাকে।
—‘আমি চাই তুমি নিজের পছন্দ মতো জীবনটাকে সাজিয়ে নাও। এমনকি জুবিনকে নিয়েও তোমার ভাবনার কারণ নেই। ওর পাশে আমি আছি।’
নিশার চিবুকটা গলার সঙ্গে লেগে গেছে। সংকোচের প্রাবল্যে প্রায় বুজে এসেছে চোখের পাতা। জাহিদ একটা বড় শ্বাস টেনে নিয়ে বলল, ‘ফারা এবং তুরিনের আচার-আচরণ হয়তো তোমাকে নানা সময় কষ্ট দিয়েছে। আমি ওদের হয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি।’
কান্না কান্না একটা গুমোট হাওয়া নিশার বুকে চেপে বসল। সেতো সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছে। পৃথিবীর কারো প্রতিই তার কোন অভিযোগ নেই। তবুও এতকাল একটা চাপা কষ্ট ছিল। কারণ যে মানুষের জন্য সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে, সেই বিশেষ মানুষটিই এই ত্যাগ এবং সংগ্রাম সম্পর্কে নির্বিকার। কিন্তু আজকের এই ক্ষমা চাওয়ার অমায়িক সুন্দর ভঙ্গিটি এতকালের বুকচাপা কষ্টকে ম্যাজিকের মতো উধাও করে দিল। নিশা ধরা গলায় বলল, ‘তুরিনের ওপর আমার কোন রাগ নেই। ওকে আমি নিজের মেয়ের মতোই দেখি।
জাহিদ স্তম্ভিত চোখে নিশার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। শেষের কথাটা শুনেছে ঠিকই, কিন্তু বোধগম্য হয়নি। অবাক গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী বললে?’
নিশা চোখ তুলে তাকাল। দেখতে পেল উত্তাল বাতাসে মানুষটার ছোটছাঁটের কালো চুল উড়ছে। চোখে উপচে পড়ছে দুনিয়াজোড়া বিস্ময়। আকাশে বিদ্যুৎ ঝলসাচ্ছে অবিরত। ভর দুপুরবেলায় পাহাড়ে নেমে এসেছে সন্ধ্যার অন্ধকার। এমন বর্ষণমুখর আশ্চর্য দিনে যেন কোন কথাই গোপন রাখতে নেই। এমন দিনে সব বলা যায়। এমনই ঘন ঘোর বরষায়। এমন মেঘস্বরে, বাদল ঝরঝরে, তপনহীন ঘন তমসায়! নিশা মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলল, ‘তুরিন তো আমারও মেয়ে। তাই না? আপনার মতো আমিও তার ভালো চাই। ওর ওপর আমার কোন রাগ নেই।’
জাহিদ স্তব্ধ, সম্মোহিত এবং নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল নিশার দিকে অনির্বাচ্য থকথকে তরল অনুভূতিতে ছেয়ে উঠল মন। পুলকস্বর্বস্ব দুর্দমনীয় হর্ষ কেড়ে নিল বাকশক্তি। একটা সময় ভারি আশ্চর্য হয়ে আবিষ্কার করল নিশা কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে বুক থেকে একটা পাষাণ ভার নেমে গেছে! এমন কিছু শুনবে বলে স্বপ্নেও আশা করেনি। কিন্তু শোনার পর মনে হচ্ছে যেন এই একটা কথার মধ্যেই তার জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান নিহিত আছে! স্বার্থপর পৃথিবীতে নিশার মতো স্বার্থহীন মানুষ খুব কমই আছে। মেয়েটা কখনো নিজের কথা না ভেবে অন্যের ভালো-মন্দ নিয়ে উদগ্রীব থাকে বলেই হয়তো ওর সান্নিধ্যে এলে এত ভালো লাগে। জাহিদ কয়েকটা সেকেন্ড আবেগরুদ্ধ হয়ে বসে রইল। তারপর খুব ধীরেধীরে বলল, ‘তুমি আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে তোমাকে কিছু দিতে চাই। কিন্তু বুঝতে পারছি না কী দেয়া যায়। নিশা দুর্বোধ্য হাসল। পায়ে পায়ে এগিয়ে এলো জাহিদের কাছে। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
—‘হঠাৎ এই ইচ্ছে হলো কেন?’
—‘তোমাকে কখনো কিছু দেয়া হয়নি…তাই ভাবছিলাম…’
—‘দিয়েছেন।’
—‘দিয়েছি?’
—‘হ্যাঁ। জুবিনকে দিয়েছেন। আমার জীবনের সবচাইতে সুন্দর উপহার!
জাহিদের চোখে মুগ্ধতা ঝিলিক দিল। কত ছোট্ট একটা বাক্য! অথচ কত সুন্দর আর প্রভাবশালী! মন ভরে গেল কানায় কানায়! মেয়েটা এত চমৎকার কথা বলতে পারে জানা ছিল না।
—‘জুবিনের বিষয়টা আলাদা। আমি তোমাকে কিছু কিনে দিতে চাই নিশা। তোমার পছন্দের কোন জিনিস।’
—‘সত্যি?’
জাহিদ হাসল, ‘সত্যি।’
নিশার মুখটা এখন জাহিদের বুক বরাবর। দৃষ্টি উঁচু করে তাক করা। অবাধ্য হাওয়ায় কপালে এসে পড়ছে চূর্ণকুন্তল। চোখে জনম জনমের ঘোর। সে একটা কম্পিত হাত জাহিদের বুকের বাঁপাশে আলতোভাবে রেখে ব্যাকুল স্বরে বলল, ‘এখানে একটু জায়গা দেবেন?’
জাহিদের নিশ্বাস আটকে গেল ক্ষণিকের জন্য। গলার কাছে ভারী কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠল। হঠাৎ মনে হলো বুকের ভেতরের ওই স্থান যেন যুগ যুগ ধরে ফাঁকা পড়ে ছিল শুধু নিশারই অপেক্ষায়। নিশা একদিন আসবে, স্থানটির মালিকানা দাবি করবে, এই বুঝি ছিল জন্ম-জন্মান্তরের মন্ত্রণা!
—‘জায়গা দিয়ে কী হবে?’
নিশার চোখের কার্নিশে চিকচিক করে উঠল অশ্রুবিন্দু। চাপা গলায় বলল,—’একটা বাড়ি বানাব।’
—‘সেই বাড়ি যে ঝড় এসে গুঁড়িয়ে দিয়ে যাবে না তার নিশ্চয়তা আছে কি?’
—‘আপনি শুধু জায়গাটা লিখে দিন আমার নামে। বাদবাকি দায়িত্ব আমার।’
সেই সময় আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঝলসে উঠল বিদ্যুৎ। তারপর বৃষ্টির একটা বড় ফোঁটা এসে পড়ল নিশার মোমে মাজা মসৃণ গালে। যেন সদ্য প্রস্ফুটিত কোন কুসুম পল্লবকে ছুঁয়ে দিল ভোরের নিষ্পাপ শিশির। জাহিদের ঠোঁটে কী কারণে যেন একটা নিগূঢ় হাসির রেখা ফুটে উঠল। সে নিশার গালে এসে পড়া রুপো রঙের জলবিন্দুতে আঙুল রাখল। তারপর ওর সারা মুখে ওই জলটুকু দিয়ে এমনভাবে আঁকিবুকি করতে লাগল যেন পোট্রেট আঁকছে। নিশা চোখ বুজে ফেলল। শিরশিরে এক কাঁপন ধরল সর্বাঙ্গে। নিশার রক্তাভ দুটি ঠোঁট একনিষ্ঠভাবে বৃষ্টির জল দিয়ে আঁকতে আঁকতে জাহিদ বিষাদ ডোবা নেশাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘ভালোবাসায় আমার আর বিশ্বাস নেই,জানো নিশা?’
নিশা আঙুলটা খপ করে ধরে ফেলে ডাগর চোখ মেলে গভীরভাবে তাকাতেই রক্তে একটা প্রলয়ের আভাস টের পেল জাহিদ। হৃৎপিণ্ড কেঁপে উঠল। হাত বাড়িয়ে নিশার লতার মতো নরম শরীরটা কাছে টেনে নিল সে। জড়িয়ে ধরল বুকের সঙ্গে শক্ত করে। নিভে এলো সমস্ত যন্ত্রণা আর অতৃপ্তির আর্তনাদ।
বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। মেঘ ডাকছে ঘন ঘন। উতলা বাতাসে বুনো ফুলের পাপড়ি উড়ছে এলোমেলো। পাহাড়ের নিচের শহর ক্রমেই আবছা হয়ে আসছে। আবছা হয়ে আসছে সমগ্র বিশ্বচরাচর!
নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ
তুরিনের রক্তবর্ণ চোখ দেখে অর্ণব রীতিমতো ভয় খেয়ে যাচ্ছে। গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে আড়ে আড়ে দেখছিল সে মেয়েটির পাণ্ডুবর্ণ মুখখানা। ওই মুখে এখন কোন রক্তের সঞ্চার নেই। শূন্যগর্ভ দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে সামনে। হঠাৎ তাকালে মনে হয় মরা মানুষ। এদিকে পেছনের সিটে চুপচাপ বসে থেকে শাহজিদের হৃদয় এই ভেবে ভেতরে ভেতরে পীড়িত হচ্ছিল যে আজকের পর থেকে সে অর্ণবের চোখে চোখে তাকাবে কোন সাহসে? তুরিন তো বরাবরই ছেলেমানুষ, অদূরদর্শী এবং কিছুটা ছিটিয়াল। কিন্তু শাহজিদ একজন চিন্তাশীল, বিবেচক মানুষ হয়ে এতবড় ভুল কী করে করল? অর্ণব ছেলেটা সাদামাটা মনের অধিকারী। প্রথম দর্শনেই ভালো মানুষ বলে মনে হয়েছিল। সহজ-সরল ছেলেটার সঙ্গে না চাইতেও এক অমার্জনীয় প্রতারণা করা হয়ে গেল। এই সকণ্টক, পীড়াদায়ক অপরাধ বোধ শাহজিদকে এখন স্বস্তিতে শ্বাস ফেলতে দিচ্ছে না।
বেশ অনেকক্ষণ ধরে ওরা কেউ কোন কথা বলছে না। ঝিমোচ্ছে বসে বসে। আনিতার সেলফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। ধরতেই ওপাশ থেকে ফারা বলল,
—‘তোমরা কোথায়?’
—‘অন দ্য ওয়ে হোম চাচি…তোমার গলা এমন শোনাচ্ছে কেন? ইজ এভরিথিং অলরাইট?’
—‘তুরিন কোথায়? ওকে কল করছি সেই তখন থেকে। ফোন ধরছে না কেন?’
আনিতা একটু দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘ফোন ধরছে না কেন তা তো ঠিক বলতে পারলাম না। তুমি ওর সঙ্গে কথা বলবে?’
—‘হ্যাঁ প্লিজ। ফোনটা দাও ওকে।’
আনিতা সামনের দুই সিটের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থানে হাত গলিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুরিন, ফোনটা ধর। চাচি ওয়ান্টস টু টক।’
তুরিন ঝড়ের আঘাতে মটকে যাওয়া গাছের ডালের মতো জীর্ণ ভঙ্গিতে হাতটা বাড়িয়ে দিল। ফোন কানে নিয়ে নিষ্প্রভ গলায় বলল, ‘হ্যালো!’
ফারা ধমকে উঠল ‘কোথায় তুমি? কতবার কল করলাম? ফোন ধরো না কেন?’
—‘নোটিস করিনি। তুমি কোথায়? তোমার তো এখন ফ্লাইটে থাকার কথা!’
ফারা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হোয়াট আই অ্যাম গোইং ধ্ৰু!’
তুরিন উৎসুক হয়ে উঠল, ‘হোয়াট হ্যাপেন্ড? তোমরা ট্রিপে যাওনি?’
—‘তোমার বাবা যায়নি।’
এ কথা শুনে তুরিনের কণ্ঠস্বর আচমকা ফেটে পড়ল বজ্রপাতের মতো, ‘কেন?’
ফারা বিষাক্ত গলায় বলল, ‘আমাকে এয়ারপোর্টে ফেলে রেখে তোমার বাবা ছুটে এসেছে বাসায়। আমি ওর পিছু পিছু দৌড়ে এসে কী দেখেছি জানো? দেখেছি তোমার বাবা ওই গেঁয়ো আনকালচারড স্লাটটাকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে।’
ভয়ংকর এক ছন্নছাড়া ক্রোধ যেন মুহূর্তের মধ্যে তুরিনের সারা গায়ে আগুন ধরিয়ে দিল। চিৎকার করে বলল, ‘বেরিয়ে যাচ্ছে মানে?’
ফারা একটু কান্নাকান্না ভাব সৃষ্টির চেষ্টা করল গলায়, ‘বেরিয়ে গেছে…তোমার বাবা…আমার চোখের সামনে ওই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেছে। এবার তুমিই কিছু কর!
তুরিনের হাত-পা কাঁপতে লাগল রাগে। অদম্য রোষানলের আদিগন্ত উত্তাপে পুড়তে পুড়তে তার মনে হলো নাক-কান সব বধির হয়ে আসছে। হৃদযন্ত্রটা বোধহয় আরেকটু হলেই বিকল হয়ে যাবে। কেন তার সঙ্গেই প্রকৃতি সবসময় এমন নিষ্ঠুর পরিহাস করে? কেন তার ভালোবাসার মানুষটা কাছে এসেও ধরা দিতে চায় না? কেন তাকে ভালোবাসে না? কেন তার বাবা তার মাকে অন্য মেয়ের সামনে অপমান করে বারবার? জীবনের সমস্ত অপ্রাপ্তি, সমস্ত অপমান যেন হিংস্র দানবের মতো প্রকট আস্ফালনে একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর বুকে। কাঁপতে কাঁপতে বাবার নম্বরে ডায়াল করল সে।
.
সাদা বৃষ্টির ঘেরাটোপের মধ্যে ওরা দুজন দাঁড়িয়ে ছিল। গোটা আকাশটা বুঝি ধসে পড়ছে জনশূন্য সুনসান পাহাড়ের ওপর। বৃষ্টির ছাঁটে চোখের কিনারা ঝাপসা হয়ে এসেছে। সেই ঝাপসা বৃষ্টির পর্দার ভেতর দিয়ে জাহিদ দেখল তুষারকন্যার মতো গোলাপি গালের আশ্চর্য সুন্দর মেয়েটা তার দিকে নেশারু চোখে চেয়ে আছে। উদ্দাম বাতাস তার চুল নিয়ে খেলছে। ঠোঁটে ঝিকমিক করছে রহস্যময় মিষ্টি আহ্বান। জাহিদ এই পাহাড়ি বৃষ্টির কনকনে শীতেও নিজের নিঃশ্বাসে উত্তাপ টের পেল। শরীরের যেসব রক্তকণিকারা বহুদিন ধরে বরফ বিন্দুর মতো থমকে ছিল…জমে ছিল অথর্ব বৃদ্ধের মতো… সেই সব জমাট বাঁধা বরফকুচিতে বসন্তের পেলব রোদের আঁচ এসে লাগল যেন। রোদ- রাঙ্গা আকাশের মতো মস্ত এক উষ্ণ হৃদয় বুকে নিয়ে জাহিদ নিজের ভেতরকার দুর্বলতাটাকে সমগ্র সত্তা দিয়ে অনুভব করতে করতে কেঁপে উঠল অজ্ঞাত, অচেনা এক গা শিউরে ওঠা বিস্ময়ে। তার মনে হলো এত প্রবলভাবে জীবনে কোন মানুষ তাকে টানেনি। যেভাবে এই মেয়েটি টানছে এখন…টানে সব সময়…! নিশা অপেক্ষা করছে…জাহিদের কাটাকাটা মুখশ্রীর দিকে কাঙালের মতো চেয়ে থেকে নিজের সমস্ত স্নিগ্ধতা আর সিক্ততাকে প্রাণপণে উজাড় করে দেবার জন্য মনে মনে ভীষণভাবে অপেক্ষা করছে! অপেক্ষা করেছে রাতের পর রাত…
…দিনের পর দিন…যেভাবে বৃষ্টির আশায় চাতক তৃষিত নয়নে চেয়ে থাকে আকাশ পানে! আতঙ্ক-মেশা তীব্র আনন্দের আভাসে কেমন জ্বর জ্বর লাগছে তার। জাহিদের মুখটা ওর মুখের ওপরে ঝুঁকে আসছিল, ঠিক সেই সময় সেলফোন ঝনঝন করে বেজে উঠল। জাহিদ অপ্রস্তুতভাবে থমকে গেল। প্যান্টের পকেটে বাজতে থাকা ফোন হাতে নিয়ে এক নজর দেখল তুরিনের নম্বরটা। নিশাকে আস্তে করে বলল, ‘তুরিন কল করছে।’ কথাটা শুনে নিশা একটু সরে এলো জাহিদের কাছ থেকে। মনের মধ্যে কাঁটার মতো খচখচ করে বিঁধে রইল একটা অসমাপ্ত, ব্যর্থ এবং পিপাসার্ত চুম্বন।
জাহিদ ফোন ধরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তুরিনের কান্নায় ছটফট করা অস্থির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
—‘বাবা! তুমি কোথায়?’
জাহিদ খুব বিচলিত হয়ে পড়ল, ‘এইতো আছি…তুমি কোথায়?’
—‘আছি মানে কী? তুমি মায়ের সঙ্গে ট্যুরে যাওনি?’
জাহিদ অপরাধবোধে ন্যুব্জ হয়ে বলল, ‘না…যাওয়া হয়নি!’
—‘কেন বাবা?…কেন?’ তুরিনের গগনবিদারী চিৎকার জাহিদকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। মেয়েটা এরকম অপ্রকৃতস্থের মতো চ্যাচাচ্ছে কেন? জাহিদ ত্রস্ত কণ্ঠে বলল, ‘কাম ডাউন মা…শান্ত হও..’
তুরিন কাঁদতে লাগল মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীর মতো, ‘হোয়াই আর ইউ ডুইং দিস বাবা? তুমি আমাকে প্রমিজ করছিলে ওই মেয়েটাকে ছেড়ে দেবে। এরপরেও আমার মাকে কষ্ট দিয়ে তুমি ওর হাত ধরে বেরিয়ে গেছ। হাও কুড ইউ ডু দিস টু মাই মম? হাও কুড ইউ বাবা?’
মেয়ের কান্না শুনে জাহিদের বুক মুচড়ে উঠল কষ্টে। দিশাহারা হয়ে বলল, ‘মা শোন, আই নো ইউ আর আপসেট, আই নো আই রংড ইউ বাট আই অ্যাম গননা ফিক্স ইট…ওকে?’
হঠাৎ আনিতার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘চাচ্চু! তুমি এখন কোথায়?’
—‘আমি বাড়ির ধারে-কাছেই আছি। তোমরা কোথায়?’
—‘আমরাও কাছকাছি চলে এসেছি। তুরিন খুব কান্নাকাটি করছে।’
—‘তুমি ওকে একটু সামলাও। আমি বাড়ি ফিরছি। বাড়ি ফিরে কথা হবে।’
ফোনের লাইন কেটে দিয়ে জাহিদ নিশার দিকে না তাকিয়েই ব্যস্ত গলায় বলল, ‘চলো!’
—‘কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?’ জাহিদ প্রশ্নটা বোধহয় শুনেও শুনল না। দ্রুতপদে এগিয়ে যেতে লাগল পার্কিং লটের দিকে। নিশা দ্বিতীয়বার কোন প্রশ্ন করার সাহস পেল না। সে জানত স্বপ্নটা ভাঙবে। তার মতো দুর্ভাগা মানুষদের এই পৃথিবীতে স্বপ্নে বসবাস করার অনুমতি নেই। কষ্ট হচ্ছে না, কান্না পাচ্ছে না…শুধু মনে হচ্ছে একটু আগের অদম্য ভালোলাগার অনুভূতিতে ঝপ করে কেউ আলকাতরা ঢেলে দিয়েছে। নিজেকেই নিজের কাছে আলকাতরা মাখা সং সাজা ভূতের মতো হাস্যকর লাগছে। জাহিদ নিঃশব্দে গাড়ি ড্রাইভ করতে লাগল। তার মুখে দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের ভয়াবহ দৌরাত্ম্য! নিশা জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে বিষণ্ন চোখে দেখছে বৃষ্টিভেজা পাহাড়ি উপত্যকা। বুকটা হুহু করছে হতাশায়।
তুরিনের কথা শুনে টাস্কি খেয়ে গেছে অর্ণব। তার মুখে খেলছে ভয়ংকর বিভ্রম এবং কৌতূহল। হবু শ্বশুরের কি তাহলে এক্সট্রা ম্যারিট্যাল অ্যাফেয়ার আছে? তুরিনের কথা শুনে তো সেরকমই মনে হলো। অথচ জাহিদকে সে নিতান্তই ভদ্র মানুষ ভেবেছিল। দেখলে তো মনে হয় লোকটা আগাগোড়া ভালোয় মোড়ানো। এই ভালোত্বের মুখোশের আড়ালে যে এমন কদর্য ব্যক্তিসত্তা লুকিয়ে আছে তা কে জানত! ছিঃ ছিঃ ঘেন্নায় গা গুলিয়ে উঠছে অর্ণবের। তুরিনের জন্য কষ্ট হচ্ছে। বেচারী মেয়েটা কী ভয়ংকর মনঃকষ্টের ভেতর নিয়েই না দিনাতিপাত করছে!
শাহজিদ পেছনের সিটে বসে থেকে তুরিনের কান্নাভেজা অগ্নিশর্মা মুখটা লক্ষ করছিল। রক্তবর্ণ চোখে হিংস্রতা ঝলসে উঠছে। মনে হচ্ছে মেয়েটা এখন মানুষও খুন করতে পারবে। ওই অপ্রকৃতস্থ মুখের দিকে চেয়ে থেকে শাহজিদের ভেতরটা দুশ্চিন্তায় দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। বাড়ি ফিরে পাগলটা নিশার সঙ্গে কী আচরণ করবে আল্লাহ জানে! কোন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসবে না তো?
বাড়ির সামনের ড্রাইভওয়েতে জাহিদের গাড়ি দেখতে পেল ওরা। অর্ণবকে গাড়ি পার্ক করার সময় দিল না তুরিন। তাড়া দিয়ে বলে উঠল, ‘থামো, আমি এখানেই নামব!’
অর্ণব এই কঠোর আদেশ শুনে তড়িঘড়ি করে গাড়ি থামাল। ঝড়ের বেগে নেমে পড়ল তুরিন। শাহজিদ জানাল সেও এখানে এই মুহূর্তে নেমে যেতে চায়। অর্ণব গাড়ির ট্রাংক থেকে ক্রাচ বের করল। শাহজিদকে গাড়ি থেকে নামতে সাহায্য করল। তুরিন তখন বাড়ির ভেতর ঢুকে গেছে হনহনিয়ে। শাহজিদ ক্রাচে ভর দিয়ে প্যাটিওর সামনে এসে দাঁড়াল। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল অর্ণব-আনিতা গাড়ির ভেতরে বসে আছে। অর্ণব গাড়ি পার্ক করছে ধীরেসুস্থে। ওদের সাহায্য ছাড়া ভেতরে যাওয়া সম্ভব হবে না। ভেতরে যাওয়া উচিত হবে কি না সেটাও বুঝতে পারছে না। একরাশ দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে অসহায় শাহজিদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল প্যাটিওর সামনে। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে তীব্র ভাঙচুরের আওয়াজ ভেসে এলো। শিউরে উঠল শাহজিদ
বক্ষ হইতে বাহির হইয়া
আপন বাসনা মম
ফিরে মরীচিকা সম!
— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.
বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে আসা ভাঙচুরের শব্দ শুনতে শুনতে শাহজিদ ক্রমেই নিজের অপারগ, ক্ষমতাশূন্য, বলহীন সত্তার কণ্টকিত উপস্থিতি সমূলে অনুভব করছিল। প্যাটিওর চারধাপ সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে ভেতরবাড়িতে তুরিনের কাছে পৌছুনোটাই তার জন্য এক অসম্ভব ব্যাপার! কী ভয়ংকর রকমের অসহায় সে! হঠাৎ আনিতার কণ্ঠস্বর কানে এসে লাগল, ‘ওয়ানা গেট ইনসাইড?’
শাহজিদ একটু অপ্রস্তুত হলো প্রশ্নটা শুনে। ভেতরে যাবে? কী হবে গিয়ে? সেই সময় একটা কালো লম্বা ছিপছিপে দেহের লোক বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। আনিতা হাসল তাকে দেখে, ‘হাই আংকেল! হাউ ইজ গোইং?’
অনিমেষ আনিতাকে আলগাভাবে একটু আলিঙ্গন করে ওর গালের সঙ্গে গাল লাগিয়ে শূন্যে চুমু খেয়ে বলল, ‘আই অ্যাম গ্র্যান্ড। তুমি কেমন আছ?’
—‘গুড সো ফার।’
অনিমেষকে দেখে মনে হলো বেশ তাড়াহুড়ায় আছে। আনিতাকে ছেড়ে দিয়ে তড়িৎপদে বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ল সে।
—‘তুমি কি ভেতরে যেতে চাও?’ আনিতার প্রশ্ন, শাহজিদের উদ্দেশে। শাহজিদ দ্বিধা নিয়ে বলল, ‘না…থাক। সিঁড়িতে বসব। একটু হেল্প করবে?’
—‘শিওর!’
শাহজিদ বসল সিঁড়ির প্রথম ধাপে। ক্রাচ দুটো শুইয়ে রাখল মাটিতে। আনিতা বসল এক ধাপ ওপরের সিঁড়িতে। ক্ষণিক বাদে অর্ণবও ওদের সঙ্গে এসে যুক্ত হলো।
ভাঙচুর করার অভ্যাসটা তুরিনের আগে ছিল না। এটা নতুন। জাহিদ স্তম্ভিত চোখে মেয়ের বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড দেখছে। শ্বাস পড়ছে না তার। হৃৎপিণ্ড জমে গেছে রোমহর্ষক বিস্ময়ে। নিশা জাহিদের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ে কাঁপছে। মুখ সাদা। লিভিং রুমের শোকেজে রাখা সমস্ত কাচের জিনিস একটা একটা করে ডাকিনীর মতো হিংস্র ভঙ্গিতে ছিনিয়ে নিচ্ছে তুরিন। শরীরের সমস্ত বল প্রয়োগ করে ছুড়ে ফেলছে দূরে। ভাঙা কাচের টুকরোতে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ঘরের মেঝে। ছোট ছোট দুটি চোখে রক্তের দাপাদাপি। ঘাতকের মতো ক্রুর দৃষ্টি। ফ্যাকাসে গালের চামড়ায় নীল শিরা কাঁপছে কপকপ করে। চিৎকার করে কাঁদছে তুরিন। এমনভাবে কাঁদছে যে দেখে মনে হচ্ছে এই মেয়েটির কোন নিকটজন বুঝি কিয়ৎক্ষণ আগে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। অনতিদূরে কিচেন কাউন্টারের টুলে বসে ফারা ভাবলেশহীন চোখে মেয়ের ধ্বংসাত্মক উচ্ছন্ন ক্রিয়াকাণ্ড দেখছে। অরেঞ্জ জ্যুসের গ্লাসে ধীরস্থিরভাবে চুমুক দিচ্ছে। অনিমেষ এসে দাঁড়িয়েছে ওর পাশে। বিস্ময় নিয়ে বলছে, ‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে?’
ফারা নিরুত্তাপ গলায় বলল, ‘দেখতেই তো পাচ্ছ!’
—‘তুরিন এরকম করছে কেন?’
ফারা একটা আলগা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ওদের বাবা-মেয়ের সমস্যার মধ্যে আমরা ইন্টারফেয়ার না করি। কেমন?’
অনিমেষ জ্বলন্ত চোখে তাকাল ফারার দিকে, ‘এভাবে বড় করছ তুমি আমার মেয়েকে? দিন দিন একটা বদ্ধ উন্মাদে পরিণত হচ্ছে এই বাড়িতে থাকতে থাকতে!’
ফারা ঝপ করে উঠে দাঁড়িয়ে অনিমেষের কনুই চেপে ধরে বলল, ‘শশশ…আস্তে…কেউ শুনবে! তুরিন ঠিকই আছে। ওকে নিয়ে তোমার দুশ্চিন্তা করতে হবে না।’
জাহিদ ওই ভাঙচুরের ধ্বংসলীলার মধ্যেই শ্বাসরুদ্ধকর পদক্ষেপ ফেলে এগিয়ে গেল মেয়ের কাছে। পায়ে জুতো আছে বিধায় কাচ বিঁধল না। কিন্তু তুরিনের পা অনাবৃত। এর মাঝেই কাচের টুকরো তার চন্দন রঙের ফুটফুটে সুন্দর পায়ের পাতায় গেঁথে গেছে। মনে হচ্ছে যেন রক্ত দিয়ে আলতা পরেছে মেয়েটা। তুরিন একটা মার্বেল পাথরের বড়সড়ো মোমদানি দেয়ালের দিকে ছুড়ে মারার জন্য উদ্যত হয়েছিল। জাহিদ মেয়ের হাত খপ করে ধরে ফেলে নিরস্ত করার চেষ্টা করল। তুরিনের ছিপছিপে শরীরে রাগের ঝংকার থাকলেও বল তেমন একটা নেই। জাহিদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে পারল না সে। আত্মসমর্পণ করতে হলো। জাহিদ মোমদানিটা ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিল। রাখল পাশের সোফার ওপর। কাঁপতে থাকা, ফুঁসতে থাকা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘তুমি এমন করছ কেন মা? শান্ত হও। প্লিজ শান্ত হও।’
তুরিনের মুখের ফাঁকে সাদা ফ্যানা ভেসে উঠেছে। শুষ্ক ঠোঁটে অস্বাভাবিক কাঁপন। কান্নার হিক্কা তুলতে তুলতে সে অস্পষ্ট গলায় বলতে লাগল,
—‘ইউ ডোন্ট লাভ মি এনিমোর বাবা! ইউ ডোন্ট লাভ মি…’ এটুকু বলে অনতি দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নিশার দিকে শ্বাপদ চোখে চেয়ে তুরিন উন্মাদের মতো চিৎকার করে উঠল, ‘ইউ লাভ হার…ইউ লাভ দ্যাট ব্লাডি বিচ…’ বুকের মধ্যে একরাশ রক্তের তোলপাড় নিয়ে নিশা দেখল জাহিদ দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে দৃঢ় গলায় বলছে, ‘না না তুমি ভুল বুঝেছ মা…তুমি ভুল বুঝেছ…’
ভুল বুঝেছ! এই দুটি শব্দ মুহূর্তের মধ্যে ছুরির মতো খুরধার হয়ে উঠে নিশার হৃৎপিণ্ডের জমিনটাকে তীব্র রোষের সঙ্গে ফালাফালা করে দিতে লাগল। সমগ্র পৃথিবী যেন ডাকাতিয়া অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে চারধার থেকে তীব্র বিদ্রুপের সঙ্গে একযোগে বলতে লাগল…’ভুল বুঝেছ…ভুল বুঝেছ!’
খণ্ডিত, চূর্ণ-বিচূর্ণ মন নিয়ে নিশা কয়েক পা পিছিয়ে এলো। তারপর এক ছুটে দৌড়ে গেল সিঁড়ির দিকে। দোতলার সিঁড়ির মুখের হলওয়েতে শাশুড়ি দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘুমন্ত জুবিনকে কোলে নিয়ে। শাশুড়ির মুখে আতঙ্কের চিহ্ন। নিশাকে দেখামাত্র তিনি উৎসুক গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে বৌমা?’
নিশা থমকে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ ঝাপসা, ফাটা দৃষ্টিতে শাশুড়ির দিকে চেয়ে থেকে অবরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আমি এখানে আর থাকব না মা! আমি আজকে এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যাব।’ কথাটা বলে সে পাগলের মতো দপদপ করে নিজের ঘরের দিকে হেঁটে গেল। শাশুড়ি পিছু নিলেন, ‘কী বলছো আবোল তাবোল? তোমার শ্বশুর বাড়িতে নেই এখন। উনি আসুক…তারপর একটা ফয়সালা হবে।’
নিশা শাশুড়ির কথা শুনেও শুনল না। বিষদগ্ধ অগ্নিবাণে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। ছাই হয়ে যাচ্ছে দেহ-মন-আত্মা। নিজের সমস্ত মান-সম্মান, আত্মমর্যাদা সাঙ্গ করে আজ ওই লোকটার কাছে সমস্ত হৃদয় সমর্পণ করেছিল। এমন স্বার্থশূন্য নিষ্কলুষ সমৰ্পণকে সেই মানুষটা একটু আগে হাস্যকর উপহাসে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। দৃঢ় কণ্ঠে মেয়ের কাছে স্বীকার করেছে সে নিশাকে চায় না…ভালোবাসে না। এমন পাষণ্ড জগতে কি আর দ্বিতীয়টি আছে? থাকবে না নিশা এমন কাপুরুষ পাষণ্ড লোকের সংসারে!
জাহিদ তুরিনের মাথাটা বুকের সঙ্গে চেপে রেখেছে। ধীরে ধীরে…থেমে থেমে…বাধো বাধো ভাবে বলছে, ‘তোমাকে ভালোবাসি না এটা ভাবলে কী করে? বোকা মেয়ে!’
—‘আমি জানি তুমি এখন আর আমাকে আগের মতো ভালোবাসো না। তুমি ভালোবাসো জুবিনকে আর জুবিনের মাকে।
জাহিদ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে খুব সাবধানে বলল, ‘জুবিন তো তোমার সিস্টার…তোমারও কি ওকে ভালোবাসা উচিত না?’
এই কথায় তুরিন আবারও ঝলসে ওঠে। বাবার বুক থেকে মাথাটা ঝট করে তুলে নিয়ে নির্মম গলায় বলে, ‘শী ইজ নট মাই সিস্টার…শী ক্যান্ট বি…!’ এরপর হঠাৎ সে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আকুল স্বরে বলতে লাগল, ‘বাবা আমি তোমার মেয়ে…আমিই তোমার প্রিন্সেস। তুমি আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসতে পারো না কাউকে….!’
অনিমেষ এগিয়ে এসেছে তখন। তুরিনের রক্তাক্ত পায়ের দিকে চেয়ে আহত স্বরে বলছে, ‘লুক অ্যাট হার…শি ইজ ব্লিডিং!’
জাহিদ সেই সময় লক্ষ করল তুরিনের ডান পায়ের পাতা রক্তে ভিজে আছে। অনিমেষ তুরিনকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে সোফার ওপর বসিয়ে দিল। তুরিন তখনো কাঁপছে। চোখমুখ পাংশুটে। কান্নার দাপটে চোখের কোল ফুলে ঢোল। অনিমেষ ওর পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসেছে। রক্তাক্ত পা হাতে তুলে নিয়ে কাচের টুকরো বের করার চেষ্টা করছে। ফারা ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে এগিয়ে এসেছে ওদের কাছে। যদিও অনিমেষের বাড়াবাড়িটা ওর মোটেও ভালো লাগছে না। প্রথমেই বলেছিল এসব পারিবারিক কলহ থেকে দূরে থাকতে। এই একরোখা লোকটাকে নিয়ে আর পারা গেল না। জীবনটা নরক বানিয়ে ছাড়ল একদম।
জাহিদ কেমন এলোমেলো চোখে দৃশ্যটা দেখছিল। অনিমেষ কাছে এসে দাঁড়াতেই তুরিনের মুখে একটা নির্ভরতার ছায়া ভর করেছে। ছোটবেলা থেকেই তুরিন অনিমেষের বেশ ন্যাওটা। নিজের আপন চাচার চাইতেও অনিমেষকেই সে বেশি ভালোবাসে। আর ফারার মনের ভেতরে যে অনিমেষের জন্য একটি পাকাপোক্ত স্থান আছে, সে সম্পর্কে জাহিদ সম্যক রূপেই অবগত। ফারাকে নিয়ে সে আর ভাবে না। কিন্তু তুরিনের প্রতি অনিমেষের এই অনাবশ্যক আগ্রহ জাহিদের ইদানীং সহ্য হয় না। আজকের এই ঘটনা তাকে আপাদমস্তক দগ্ধ করে চলেছে। শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে দিচ্ছে ক্রোধের বিদ্যুৎ। কয়েক পা এগিয়ে এসে পাথরসম কঠিন গলায় সে প্রশ্ন করল, ‘অনি…তুই এখানে এসেছিস কেন?’
অনিমেষ ঘাড় উঁচিয়ে দেখল একবার জাহিদকে, ‘কেন? নিষেধ আছে নাকি?’
জাহিদ বাহ্যজ্ঞানরহিত হয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘হ্যাঁ নিষেধ আছে!’
এই আকস্মিক হুংকারে উপস্থিত সবাই চমকে উঠল। তুরিন বিস্ফারিত চোখে তাকাল বাবার দিকে। ফারার মুখে রক্তের লেশমাত্র নেই। আতঙ্ক ফেটে পড়ছে চোখ দিয়ে। অনিমেষ প্রথমে চমকে গেলেও পরমুহূর্তেই সামলে নিল নিজেকে। ধারালো মুখে একটি চতুর হাসি ফুটিয়ে বলল, ‘এত রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি তো বন্ধু হিসেবে তোদের খোঁজখবর নিতে এলাম।’
জাহিদ এগিয়ে এসে অনিমেষের শার্টের পিঠ খামচে ধরল, ‘বের হ তুই…গেট লস্ট।’
তুরিনের পাগলাটে মুখে ভীষণ রকমের বিভ্রম খেলছে। অনিমেষকে সে বাবার কাছের বন্ধু বলেই জানত। শুধু বাবারই নয় মায়েরও অনেক পুরনো বন্ধু। তুরিনকেও তো কত্ত আদর করে! কত্ত ভালোবাসে! বাবা হঠাৎ এই অসম্ভব ভালো মানুষটার সঙ্গে এমন দুর্ব্যবহার করছে কেন?
অনিমেষ তুরিনের পা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঠাণ্ডা চোখে জাহিদের দিকে চেয়ে বলল, ‘হোয়াটস রং মেইট? কী হয়ে গেল হঠাৎ?’
পাগল পাগল এক উচ্ছৃঙ্খল রাগের দাপটে জাহিদের চেতনা বিলুপ্তির পথে। কণ্ঠে বজ্রের ঝংকার তুলে সে বলল, ‘স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মাই ডটার…ইউ জ্যাকঅ্যাস…’
অনিমেষ হঠাৎ অদ্ভুত গা শিউরানো হাসি হাসল, ‘ইয়োর ডটার?’
জাহিদের মাথায় আগুন ধরে যায়। হনহনিয়ে এগিয়ে এসে অনিমেষের বুকে একটা জোর ধাক্কা বসিয়ে দেয় সে। রাগ চাপা বিষাক্ত গলায় বলে, ‘আমার বৌকে দিয়ে হয় না তোর? এখন আমার মেয়েকেও চাই?’
তুরিন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। বাবার বলা এই অদ্ভুত কথার তাৎপর্য কী হতে পারে তা সে বুঝে উঠতে পারছে না। তার মস্তিষ্ক এখন বড়ই দুর্বল। ফারা চট করে ওর কাছে এসে বলল, ‘চলো তোমাকে আর্জেন্ট কেয়ারে নিয়ে যাই। এখনো ব্লিডিং হচ্ছে পা থেকে। লেটস গো। হারিয়াপ।’ ফারার মুখটা ভয়ে নীল হয়ে গেছে। ভীষণ বুক কাঁপছে তার। অনিমেষ এমন পাগলামো কেন শুরু করেছে হঠাৎ? কেন আগ বাড়িয়ে ঝামেলা বাধাতে চাইছে? আতঙ্কে জমে যাওয়া মন নিয়ে কোনরকমে তুরিনকে ধরে ধরে বাইরে বেরিয়ে এলো ফারা। আনিতা আর অর্ণবের মাখখানে বিমর্ষ মুখে বসে ছিল শাহজিদ। আহত তুরিনকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে আসতে দেখে আঁতকে উঠল সে। উত্তেজনার বশে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। আরো একবার নিজের অপারগতা শেলের মতো ধারালো হয়ে বিধল তার সর্বাঙ্গে। তুরিন ওর দিকেই চেয়ে আছে। চোখভর্তি টলমল করছে রুপালি জল। খরগোশের মতো নরম নিষ্পাপ মুখটায় ভয়, দুশ্চিন্তা আর ক্লেশের দাপাদাপি ছিল এতক্ষণ। শাহজিদের দিকে তাকানো মাত্র সেই ক্লেশের চিহ্ন ফিকে হয়ে এসেছে। বুকে এসে মিশে গেছে একগুচ্ছ শান্তির সুবাতাস। তুরিনের মনে হচ্ছিল এই মুহূর্তে শাহজিদকে তার ভীষণ ভীষণ ভীষণ প্রয়োজন ছিল! শাহজিদ নিশ্চয়ই ওর জন্যই অপেক্ষা করছিল। অদ্ভুত একটা ছেলে…মুখে বলবে ভালোবাসে না…কিন্তু দ্যাখো…ভালো যে বাসে তা ওই হ্যাজেল চোখের ঘোর-লাগা চাউনি দেখেই তো দিব্যি টের পায় তুরিন!
ভেতরে তখনো দুই বন্ধু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের চোখেই ক্রোধ, হিংসা এবং বিদ্বেষের চাপা গর্জন। সেই সময় নিশাকে দেখা গেল হনহনিয়ে সদর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে। ওর এক হাতে ট্র্যাভেল ব্যাগ, অন্য হাত দিয়ে কোমরের সঙ্গে লটকে রেখেছে জুবিনকে। জুবিন খুব কাঁদছে। গলা ছেড়ে বুক ফাটা কান্না কাঁদছে ছোট্ট মানুষটা। লাল টুকটুকে টমেটোর মতো ফুলে গেছে গাল। একরত্তি গোলাপি ফিনফিনে ঠোঁটে জমে আছে অভিমানের পাহাড়। ওই কান্না শুনে জাহিদের মন কেমন করে উঠল। অনিমেষকে ফেলে সবেগে অগ্রসর হলো সে নিশার দিকে। মা পেছন পেছন ছুটে আসছিলেন। জাহিদকে দেখে বললেন, ‘বৌ তো চলে যাচ্ছে! তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ওকে থামা!’
কথাটা শুনে জাহিদের হাত-পা কেমন অসাড় হয়ে উঠল। বুকের পাঁজরে যন্ত্রণার স্ফীতি টের পেল সে। নিশা চলে যাচ্ছে…তার জীবনে যেটুকু সুখ…যেটুকু উত্তাপ…যেটুকু শান্তি উদ্বৃত্ত ছিল…সেটুকু ছিনিয়ে নিয়ে নিশা চলে যাচ্ছে…নিশাকে হয়তো যেতেই হবে…আজ নয়তো কাল…কিন্তু এত তাড়া কেন? আর কিছুদিন পরে গেলে কী ক্ষতি হয় নিশা? জাহিদ সাড়হীন, অবশ শরীরটাকে কোন রকমে ধাবিত করল নিশার পেছন পেছন। মন থেকে একটা সকরুণ প্রার্থনা ঊর্ধ্বমুখী হয়ে বেরিয়ে আসছে, নিশা যেও না। আরেকটু সময় দাও আমাকে। আর কয়েকটা দিন!
দরজার বাইরে এসে নিশাকে একবার ডাকল অস্ফুটে। নিশা সেই ডাক শুনল কি শুনল না কে জানে, কয়েক সেকেন্ড দিশাহারা চোখে চারপাশটা দেখল। ফারা আর তুরিন তখনো প্যাটিওতে দাঁড়িয়ে আছে। শাহজিদ বসা থেকে উঠে ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে সবে। নিশা হঠাৎ ওর দিকে চেয়ে অসহায়ভাবে বলল, ‘শাহজিদ! আমি যাচ্ছি…তুমি…তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’
নিশার মুখনিঃসৃত প্রস্তাবটা জাহিদের অন্তরাত্মায় একটা ধাক্কা দিয়ে গেল। যে সকরুণ প্রার্থনা এতক্ষণ ধরে বুক থেকে উথলে উঠে নিশার পায়ের কাছে ভিখিরির মতো লুটিয়ে পড়তে চাইছিল, সেই প্রার্থনাটিই যেন এক মর্মান্তিক প্রহসন হয়ে আচমকা তার বুকের মধ্যে ছুরিকাঘাত করে বসল। একটা শোচনীয়, দুঃস্থ দীর্ঘশ্বাস চাপা দিতে দিতে জাহিদের মনে হলো, এই ঘটনার সাক্ষী হওয়ার আগে সে মাটির সঙ্গে মিশে কেন গেল না?
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ৭
৭
নিশার প্রশ্নটা শাহজিদকে অপ্রস্তুত করে তুলেছে। হাই-চিকবোন সমৃদ্ধ সবল কাটাকাটা মুখখানায় হঠাৎ একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব ফুটে উঠেছে। বিস্ময়- ডুবি চোখ নিয়ে সে নিশার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। কিছু বলতে পারছে না। নিশা ওই নিরুচ্চার নির্বাক দৃষ্টি থেকেই নিজের প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজে নিল। রুদ্ধস্বরে বলল, ‘থাক…তোমার যেতে হবে না। আমি একাই যাচ্ছি।’
কথাটা বলেই বিশাল ব্যাগটা এক হাতে টানতে টানতে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামতে লাগল। জুবিনের কান্না থামেনি। ঘাড় ঘুরিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা জাহিদকে আকুল নয়নে দেখছে সে। ছোট্ট দুটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে এখুনি ঝাঁপ দিয়ে বাবার কোলে উঠে যাবে। শাহজিদের বিস্ময়ের ধাক্কাটা তখনো কাটেনি। তবুও কোনরকমে সামলে নিয়ে সে বলল, ‘নিশা…একটু দাঁড়াও…আমি নিশ্চয়ই তোমার সঙ্গে যাব…বাট…এখন হুট করে তুমি কোথায় যাবে?’
মিসেস মুর্তজা হেঁটে এগিয়ে এলেন নিশার কাছে। কোল থেকে কেড়ে নিলেন জুবিনকে ছোঁ মেরে। তারপর শাহজিদের দিকে তাকিয়ে ক্যাটক্যাট করে বললেন, ‘তোমাকে কোথাও যেতে হবে না বৌমার সঙ্গে। তুমি আমাদের পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাবে না। বিষয়টা আমার একেবারেই পছন্দ না!’ শাহজিদের মুখটা অপমানে জমে গেল। লাঞ্ছনার তীরবিদ্ধ আহত চোখজোড়া কোন কারণ ছাড়াই তুরিনের ওপর গিয়ে পড়ল অতর্কিতে। তুরিনও ওর দিকেই চেয়ে ছিল। উপস্থিত লোকজনের কেউই লক্ষ করেনি ওদের এই নির্নিমেষ চেয়ে থাকা। নিশা অধৈর্য গলায় বলল, ‘মা আপনি ওকে কেন অযথা এসব বলছেন? তার তো কোন দোষ নেই…আমিই তাকে…’
—‘চুপ করো বৌমা। তোমার শ্বশুর ফিরে আসার আগ পর্যন্ত কোথাও যাবে না। অপেক্ষা কর। তুমি তো জানো ওই লোকটা জুবিনের জন্মদিন পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবকিছু জেনেশুনেও বাচ্চা কোলে নিয়ে ঢ্যাংচ্যাং করে হাঁটা দিলে। বিবেক বলতে কিছু নেই তোমার?’
নিশার সত্যিই জন্মদিনের বিষয়টা স্মরণে ছিল না। মনে পড়ার পর সামান্য গ্লানি বোধ হলো। শাশুড়ি জুবিনকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। নিশা অপদস্থ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর মাথা হেঁট করে ব্যাগটা টানতে টানতে পরাজিত সৈনিকের মতো বাড়ি ফিরে এলো। সদর দরজার চৌকাঠে তখনো জাহিদ দাঁড়িয়ে ছিল। নিশা ওর দিকে তাকাল না। ভেতরে ঢোকার সময় অনিমেষের মুখোমুখি পড়ে গেল। লোকটাকে সে আগেও দেখেছে। জাহিদের বন্ধু। এই একজন মাত্র বন্ধু, যে কি না নিশার আসল পরিচয় সম্পর্কে সম্যকরূপে জ্ঞাত। একে দেখলে কেন যেন নিশার গা শিউরে ওঠা অস্বস্তি হয়। মনে হয় লোকটা ঠিক সাধারণ নয়। একটু অন্যরকম। লম্বাটে কৃষ্ণাভ ধারালো চেহারার মধ্যে ব্যতিক্রমী সাহসের উদ্ধত ছাপ আছে, যে ছাপটা নিশার সহ্য হয় না। অনিমেষকে পাশ কাটিয়ে নিশা ত্বরিত পদে দোতলার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। অনিমেষ জাহিদের দিকে চেয়ে কৌতুকের সুরে বলল, ‘শি ইজ সো প্রিটি! হাও ডু ইউ ফিল মেইট? দুইটা সুন্দরী বৌ…একই ছাদের নিচে…সাম পিপল হ্যাভ অল দ্য লাক আই এনভি ইউ ম্যান!’
জাহিদ শীতল একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করল অনিমেষের চতুর হাসিমাখা মুখের ওপর। কোন কথা না বলে সরে এলো জায়গাটা থেকে। অনিমেষ সদর দরজার পার্শ্ববর্তী ক্লজেটের র্যাকে ঝুলিয়ে রাখা কোটখানা প্রসন্নচিত্তে শিস দিতে দিতে গায়ে পরে নিল। হঠাৎ চোখ পড়ল…জাহিদের মা দাঁড়িয়ে আছেন কয়েক হাত দূরে। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অনিমেষ নির্বিকার গলায় বলল, ‘কিছু বলবেন আন্টি?’
মিসেস মুর্তজা আদেশের সুরে বললেন, ‘এদিকে এসো। কথা আছে তোমার সঙ্গে।’
৮
পা ফেলতে কষ্ট হচ্ছিল তুরিনের। এই অবস্থায় প্যাটিওর কয়েকধাপ সিঁড়ি ভেঙে নামা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। শাহজিদ সিঁড়ির নিচ বরাবর ক্রাচ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তুরিনকে সাহায্য করার সামর্থ্য তার নেই। তাই চুপচাপ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই এখন একমাত্র কাজ। আনিতা এগিয়ে গেল সাহায্যের জন্য। ফারা আর আনিতার হাতের ওপর শরীরের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে সিঁড়িটা পার হওয়ার চেষ্টা করল তুরিন। পারল না। পায়ের তলায় কয়েকটা কাচের টুকরো নিয়েই সে হাঁটতে পারছে না, শাহজিদ কী করে একটা পা ছাড়াই কাটিয়ে দিচ্ছে গোটা জীবন? কথাটা চিন্তা করে তুরিনের মনটা ভয়ংকর খারাপ হয়ে উঠল 1
নিজের আহত পায়ের বেদনা আর পীড়া দিল না তাকে। মনে হলো জীবনে সুস্থভাবে আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকাটাও এক ধরনের সৌভাগ্য। এই সৌভাগ্যটুকু কেন শাহজিদের কপালে জুটল না? যে ছেলেটার পাহাড় জয় করার কথা ছিল, যুদ্ধের ময়দানে বীরদর্পে দেশের জন্য লড়বার কথা ছিল সে কেন আজ অথর্ব বিকলাঙ্গ হয়ে ঘরের কোণে আবর্জনার মতো পড়ে আছে? প্রকৃতির এই নিষ্ঠুর পরিহাসের ব্যাখা কী? ভাবতে ভাবতে তুরিনের বুকটা প্রচণ্ড হতাশায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছিল। অন্যমনস্কভাবে ডান পাটা সিঁড়ির ওপর নামিয়ে দিয়েছিল সে। নামাতেই তীব্র ব্যথায় কনকন করে উঠল পায়ের পাতা। কণ্ঠনালি থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো একটা অনভিপ্রেত আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ শাহজিদের অন্তরাত্মায় কঠিন ঝংকার হয়ে বেজে উঠল… বাজতে লাগল অবিরত। নিজের অসহায়, ক্ষমতাহীন অস্তিত্বের ওপর এতটা ঘৃণা এর আগে কখনো হয়নি ওর। অর্ণব এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল। এবার দৌড়ে ছুটে এলো। তুরিনের মুখটা যন্ত্রণায় নীল হয়ে গেছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ব্যথা সহ্য করছে সে। অর্ণব ফারার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি সরে দাঁড়ান। আমি দেখছি।’
ফারা উচ্চবাচ্য না করে আদেশ পালন করল। অর্ণব চট করে তুরিনকে কোলে তুলে নিল। সংকোচ হচ্ছিল না যে তা নয়। কিন্তু বিপদের দিনে লজ্জা- শরমের তোয়াক্কা করতে নেই। ঘটনাটা ঘটা মাত্র শাহজিদের মুখ থেকে সবকটা রঙের চিহ্ন উবে গেল। সাদা…ভীষণ সাদা আর বিবর্ণ দেখাতে লাগল ওকে। অর্ণবের হৃষ্টপুষ্ট তাম্রাভ বাহুদ্বয়ের মধ্যে তুরিনের পাখির পালকের মতো নরম পাতলা শরীরটা নেতিয়ে আছে। ধবধবে ফরসা পায়ের পাতা থেকে টপটপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় গড়িয়ে পড়ছে লাল টুকটুকে রক্ত। সেই রক্তের দিকে শাহজিদের চোখ আটকায়নি, তার চোখ আটকে গেছে অর্ণবের হাতজোড়ার ওপর। যে হাত এখন তুরিনের সুন্দর শরীরের ওপর গেঁথে আছে। ভয়ংকর এক অগ্নিশিখা শাহজিদের পায়ের তলা থেকে ব্রহ্মরন্ধ্র পর্যন্ত জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ভস্ম করে দিল যেন। কষ্টের অসহনীয় ভারী বোঝা নেমে এলো বুকের ওপর। এই অনাকাঙ্ক্ষিত কষ্টের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সে কখনো জানত না, এমন অকিঞ্চিৎকর, অর্থহীন ঘটনাও ভেতরটা এভাবে নাড়িয়ে দিতে পারে। তুরিন হঠাৎ ডেকে উঠল ওর নাম ধরে, ‘শাহজিদ!’
সর্বস্বান্ত, নিষ্প্রাণ হৃদয় নিয়ে শাহজিদ এগিয়ে এলো কয়েক পা। নিষ্প্রাণ চোখে দেখল তুরিনকে। তুরিন ব্যাকুল স্বরে বলল, ‘তুমি চলো আমার সঙ্গে।’
কথাটা পুরোপুরি শেষ হওয়ার আগেই সাপের মতো ছোবল দিয়ে উঠল ফারা, ‘ও এসে কী করবে? হ্যাভ ইউ গন ইনসেইন? সে নিজেই হাঁটতে পারে না, ক্রিপন্ড একটা ছেলে। এই ছেলে আমাদের সঙ্গে গেলে লাভটা কী হবে?’ কথাটা বলতে বলতেই ফারা ড্রাইভিং সিটে এসে বসল। নিষ্ঠুর উক্তিটা তুরিনকে ছিড়েখুঁড়ে ঝুরাঝুরা করে দিল। মনের ভেতরের ভাঙচুরের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে ছাপ ফেলল ওর নির্মল শুভ্র মুখশ্রীতে।
গাড়িটা এগিয়ে যাচ্ছিল দুপুরবেলার দুকূল ছাপানো চনমনে রোদের ভেতর দিয়ে। তুরিন গাড়ির জানালার বাইরে মুখ বাড়িয়ে দিল। ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অসহায়, পঙ্গু…অথচ দুর্দান্ত সুদর্শন যুবকটির দিকে অবোধ কিশোরীর মতো অশ্রুসিক্ত করুণ চোখে চেয়ে রইল। একসময় ওর ঝাপসা চোখের তারা থেকে সেই অসহায় ছেলেটার যন্ত্রণাবিদ্ধ বিবর্ণ মুখটা মুছে গেল। ওই মুখে এমন অনির্দেশ্য, অপরিমেয় কষ্টের নকশা তুরিন এর আগে কোনদিন দেখেনি। তার বুকটা মন খারাপের কালো মেঘে মেঘে ছেয়ে গেল একদম!
—‘ওই ছেলেটা গার্লফ্রেন্ডকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেই তো পারত! তোমার দাদিটাও না…একটা ডিজগাস্টিং মহিলা! কী দরকার ছিল ওদেরকে আটকানোর?
তুরিন খুব অবাক হলো, ‘কার গার্লফ্রেন্ড? কীসের কথা বলছো?’
—‘কার গার্লফ্রেন্ড আবার? ওই ল্যাঙড়াটার সঙ্গে নিশার প্রেম চলছে তুমি জানো না?
কথাটা শুনে তুরিনের কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। চাপা একটা ধমক দিয়ে উঠল সে, ‘স্টপ টকিং ননসেন্স মা। তোমার মাথাটা গেছে।’
ফারা ড্রাইভ করতে করতে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের সিটে বসা মেয়ের সঙ্গে আই কন্ট্যাক্ট করল। ওর ছিপছিপে ফরসা মুখে একযোগে সাঁতার কাটছে বিস্ময়, রাগ এবং উত্তেজনা। মেয়ের চোখে চোখ রেখে সে কড়া গলায় বলল, ‘তুমি আমার কথা বিশ্বাস করছ না?’
তুরিন জানালার বাইরে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘না বিশ্বাস করছি না…তুমি ভুল বুঝেছ। আর প্লিজ…সামনে তাকাও। ড্রাইভ কেয়ারফুলি। অ্যাকসিডেন্ট করবে।
—তুমি কি দেখোনি দুজনে পুরো ফ্যামিলির নাকের ডগার ওপর দিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল? হ্যাঁ? তুমি দেখোনি?’
রোদটা খুব চোখে লাগছিল। সানগ্লাস সঙ্গে নেই। কলোরাডোতে দিনের বেলায় সানগ্লাস ছাড়া ঘুরে বেড়ানো অতি বিপজ্জনক ব্যাপার। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ছয় হাজার ফিট উঁচুতে অবস্থিত এই মালভূমিতে সূর্য তার সমস্ত উত্তাপ অকুণ্ঠচিত্তে উজাড় করে দেয় সারাদিন। আলোর বন্যায় ভাসতে থাকে গোটা রাজ্য। তুরিন মাথাটা গাড়ির সিটে হেলিয়ে দিয়ে করতল দিয়ে চোখ ঢেকে বলল, ‘পালিয়ে যাচ্ছিল না। শাহজিদ জাস্ট হেল্প করতে চেয়েছে। এর চেয়ে বেশি কিছু না।’
ফারার কণ্ঠস্বরে বিস্ময় ফেটে পড়ে, ‘হাও কুড ইউ বি সো শিওর?’
—‘শাহজিদ আমাকে বলেছে।’
—‘কী বলেছে?’
—‘নিশাকে ও বোনের মতো দেখে।’
ফারা অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ল, ‘ও বলল আর তুমি বিশ্বাস করলে?’
তুরিন চোখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ বিশ্বাস করেছি… বিশ্বাস করেছি কারণ শাহজিদ মিথ্যা কথা বলে না…চেষ্টা করলেও বলতে পারে না।’ কথাটা বলতে বলতে তুরিনের আজ ভোরবেলার কথা মনে পড়ল। শাহজিদ সত্যিই মিথ্যা বলতে পারে না। মিথ্যা বলতে পারে না বলেই ভালোবাসার কথা অস্বীকার করতে ওর কষ্ট হচ্ছিল। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে তুরিনের। পায়ের ব্যথাটা টনটন করে অস্তিত্বের জানান দেয়। হঠাৎ সেই প্রায়ান্ধকার গিরি- খাঁজের ভেতরকার এক টুকরো স্মৃতি মনের উঠোনে জলোচ্ছ্বাসের মতো আছড়ে পড়ে। একটা উন্মাদ আনন্দ শরীরের কোষে কোষে ছড়িয়ে যায়। সেই উন্মাদ চোরা আনন্দ নিমেষে সমস্ত ব্যথা-বেদনা আর অবসাদকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। নিঃশ্বাসের ওজন বাড়ে। ভালো না বাসলে কেউ কখনো কাউকে অমন পাগলের মতো আদর করতে পারে? শাহজিদ অন্তত পারে না… তুরিন জানে…খুব ভালো মতোই জানে!
ফারার কর্কশ কণ্ঠস্বরে ঘোর ভাঙল ওর, ‘তোমাকে কেন এসব কথা বলেছে সে?’
তুরিন অধৈর্য গলায় বলল, ‘তুমি ভুলে গেছ ও আমার ফ্রেন্ড ছিল।’
—‘ছিল…এখন তো আর নেই। ল্যাংড়া-খোঁড়া অথর্ব একটা ছেলের সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ রাখার কোন মানেই হয় না।’
তুরিন চিৎকার করে ওঠে হঠাৎ, ‘ফর গড সেক ওয়াচ ইয়োর টাং মা! সেই তখন থেকে ল্যাংড়া, ক্রিপন্ড এসব অফেন্সিভ কথাবার্তা বলে যাচ্ছ। সমস্যা কী?’
ফারা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বলল, ‘শোন তুরিন, আমার মনে হয় তুমি কিছু একটা ভুল করছ। আই অ্যাম মোর দ্যান শিওর দে আর হ্যাভিং অ্যান অ্যাফেয়ার। আর এটা হলেই আমাদের জন্য ভালো হয়। তুমি বুঝতে পারছ?’
তুরিন মুখ ঝামড়ে উঠে বলল, ‘না বুঝতে পারিনি। ইউ আর টকিং রাবিশ।’
—‘আমি প্রমাণ করে ছাড়ব তোমার কাছে আর তোমার বাবার কাছে। আর এটা প্রমাণ করতে পারলেই আমার রাস্তা ক্লিয়ার হয়ে যাবে।’
—‘ইউ ডোন্ট নিড টু প্রুভ এনিথিং। আমিই আমার বাবাকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনব। তোমার কোন ডার্টি গেম প্লে করতে হবে না।’
—‘তুমি কিছুই পারবে না। যা করার আমাকেই করতে হবে।’
তুরিন কঠোর গলায় বলল, ‘শাহজিদকে এসব নোংরামিতে ইনভল্ভ করবে না মা! যদি করো…’
ফারা সাপের মতো বিষ-ফণা তুলে বলে, ‘কী হবে করলে?’
—‘খারাপ হবে…খুব খারাপ!’
.
অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পর জুবিন এখন একটু শান্ত হয়েছে। কেন ওভাবে গলা ছেড়ে কাঁদছিল? ওর নিষ্পাপ মন কি বাবার সঙ্গে বিচ্ছেদের কোন পূর্বাভাস টের পেয়েছিল? কে জানে! হয়তো শিশুরাও কিছু জিনিস বুঝে যায়, টের পেয়ে যায়, শুধু মুখ ফুটে বলতে পারে না। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ড্রইংরুমের ফ্লোর টু সিলিং উইনডোর সামনে এসে দাঁড়াল জাহিদ। গোটা বাড়ির মধ্যে এই জায়গাটাই জুবিনের সবচাইতে প্রিয়। সাদা কাচের ভেতর দিয়ে উন্মুক্ত লন দেখা যায়। লনের ওপাশে নেইবারহুডের ছিমছাম রাস্তা। একটা খালি উদ্যান। তার ঠিক পরেই লাল পাথরের রকি মাউন্টেন। পাহাড়ের গায়ে গায়ে ছোট ছোট বাড়িঘর। সাপের মতো একটা আঁকাবাঁকা রাস্তা লাল পাহাড়ের গা বেয়ে বহুদূর পর্যন্ত উঠে গেছে। সেই রাস্তায় চলতে থাকা গাড়িগুলোকে দূর থেকে খেলনার মতো মনে হয়। জুবিন খুব মজা পায় এসব দৃশ্য দেখে। জানালার কাচে হাত রেখে নিজস্ব ভাষায় অনেক কথা বলে, হেসে কুটিকুটি হয়। জাহিদ মেয়েকে অনেক আদর করল। মনে হলো জুবিনের চুলেও নিশার চুলের মতো একটা সুঘ্রাণ লেগে আছে। আজ সকালে পাহাড়ের ওপর নিশাকে যখন জড়িয়ে ধরেছিল, ঠিক এমনই একটা সুঘ্রাণ ওর নাকে এসে লেগেছিল। কী নিষ্পাপ…কী সুন্দর…কী কোমল একটা ঘ্রাণ!
অদৃষ্টের খেলা বড়ই বিচিত্র। ভাবতে গেলে অবাক হতে হয়। দুটা বছর আগেও জাহিদ জানত না তার জীবনে জুবিন আসবে। যে অল্পবয়সি, সাধারণ ঘরোয়া মেয়েটির দিকে এক সময় চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত, যাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার কোন নিগূঢ় অভিলাষ তার মনে ঘুনাক্ষরেও ছিল না, যে ছিল জীবনের নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর, অস্বস্তিকর, অপ্রয়োজনীয় এক অধ্যায়… আজ সেই অধ্যায়ের সমাপ্তির কথা ভাবতে গিয়ে জাহিদের বক্ষ-ভূমিতে চিরচির করে ফাটল ধরছে। অথচ সেই মেয়েটি ফারার চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু তো নয়! সব মেয়েরাই কি এমন হয়? তার নিজেরও দুটি কন্যাসন্তান আছে। এদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে তো? নাকি ফারার মতো, নিশার মতো পুরুষের মন নিয়ে, জীবন নিয়ে, অনুভূতি নিয়ে খেলা করা এদের অভ্যাসে পরিণত হবে?
শাহজিদের উদ্দেশ্যে বলা নিশার কথাটা, আকুতি ভরা অনুরোধটা কানে বাজতে থাকে জাহিদের। একটু আগে যে মেয়েটা তার মনের ঘরে আশ্রয় চাইছিল সেই মেয়েটিই ঘণ্টার ব্যাবধানে অন্য একজন পুরুষের সঙ্গ চেয়ে বসল একগাদা লোকের সামনে। কী কাণ্ড! অপমান আর অভিমানের ধোঁয়ায় জাহিদের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। মেয়েটার প্রতি যে সম্মানটুকু এতকাল ধরে তিলতিল করে জমে উঠেছিল, সেই সমাদর এবং মর্যাদার স্তরে যেন ধূলোর আবরণ এসে পড়েছে। জাহিদ বুঝতে পারছে না নিশা আসলে কাকে ব্যাক-আপ হিসেবে ব্যবহার করছে? তাকে নাকি শাহজিদকে? ব্যাপারটা হয়তো এমন…এ বাড়িতে টিকতে পারলে তো টিকেই গেল…নইলে শাহজিদ তো আছেই! যেকোনো মুহূর্তে ওর হাত ধরে বেরিয়ে যাবে…বাহ! কিন্তু মেয়েটার সাহস কত…সে জুবিনকে নিয়ে ওই ছেলের সঙ্গে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কী সাংঘাতিক! এসব বিরূপ বিক্ষিপ্ত ভাবনা জাহিদের মনের মধ্যে ক্রমেই ক্রোধের আগুন ছড়িয়ে দিতে লাগল। রক্তে একটা জ্বালা টের পাচ্ছিল সে। জুবিনকে কোলে নিয়ে দ্রুতপায়ে দোতলায় উঠে এলো। নিশার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা সেরে নেওয়া দরকার। ওর জানা উচিত শাহজিদ কিংবা অন্য যাকে নিয়েই সে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা গড়ুক না কেন, সেই পরিকল্পনা থেকে জুবিনকে ছাটাই করতে হবে। জাহিদের কাছ থেকে কেউ তার সন্তান ছিনিয়ে নিতে পারবে না। নিশার ঘরের দরজাটা আধখোলা অবস্থায় ছিল। জাহিদ টোকা দিয়ে বলল, ‘আসব?’
ক্ষণিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে
হারাই-হারাই সদা হয় ভয়,
হারাইয়া ফেলি চকিতে
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
.
কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে জাহিদ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ঘরটা ফাঁকা। সতেজ সূর্যকিরণে চারিদিক থইথই করছে। জানালার ধারের ক্র্যাব অ্যাপল-ট্রি ছেয়ে আছে সাদা আর লাল ফুলে। ডালে ডালে লার্ক বান্টিং পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। ডাকছে গলা ছেড়ে। কালো আর সাদার মিশেলের এই ছোট্ট লার্ক বান্টিং কলোরাডোর জাতীয় পাখি। বসন্তের আগে আগে দূর দেশ থেকে উড়ে আসে ওরা। একটা মেটে রঙের আদুরে কাঠবিড়ালি গাছের ডাল বেয়ে বেয়ে জানালার কার্নিশের ধারে উঠে এসেছে। গোল্লা গোল্লা চোখ মেলে পিটপিট করে দেখছে ঘরের ভেতরটা। ক্র্যাব অ্যাপল গাছ দুটোর ঠিক পেছনেই ফিরোজা রঙের মসৃণ আকাশ। দেখলে মনে হয় যেন আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছগুলো। রোদমাখা ফিরোজা আকাশে ভেসে থাকা সাদা ফুলের নিখুঁত আলপনা বসন্তের আমেজের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু এই রাজ্যে বসন্তের একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। শীতের দাপটে ম্লান হয়ে যায় বসন্তের মাধুর্য। জুবিন সোনা ঘুমিয়ে পড়েছিল বাবার কোলে। জাহিদ মেয়েকে বিছানার ওপর শুইয়ে দিল। খুট করে একটা শব্দ হলো হঠাৎ। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই বাথরুমের দরজায় নিশাকে দেখতে পেল। ওর গায়ে একটা সাদা তোয়ালে জড়ানো। মাথার ভেজা চুল ছড়িয়ে আছে পিঠে। একটু অস্বস্তি কাঁটা দিয়ে উঠল জাহিদের মনে। সরিয়ে নিল চোখ। নিশা তাড়াহুড়া করে ঘরের দরজাটা বন্ধ করল প্রথমে। গোসলে যাওয়ার আগে কেন কাজটা করার আক্কেল হলো না, কী করে এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ভুলে গেল, সেই কথা ভেবে নিজেকেই নিজে ধমকে উঠল হালকা। দরজা লক করে ঘুরে দাঁড়াতেই চোখ পড়ল ঘরের মধ্যিখানে স্থিরচিত্র হয়ে থাকা মূর্তিমানের ওপর। ভূত দেখার মতো চমকে উঠল নিশা। একটা আচমকা আর্তনাদ ছুটে বেরিয়ে এলো মুখ থেকে। সেই আকস্মিক চিৎকারে জুবিনের ঘুম গেল ছুটে। ট্যাট্যা করে কান্না শুরু করল।
জাহিদ বিরক্তিতে কাদা কাদা হয়ে বলল, ‘বাচ্চাটাকে কত কষ্টে ঘুম পাড়ালাম। দিলে তো ঘুমটা ভেঙে!’
নিশার তখনো বুক কাঁপছে ভয় আর লজ্জার দুঃসহ দাপাদাপিতে। শরীরের প্রতিটি রক্তকণা বরফের মতো জমে হিম হয়ে গেছে। নিজেকে কোথায় একটু লুকোনো যায় সেই চিন্তায় পাগল হওয়ার দশা। জাহিদের ধমক শুনে সে আরো বেশি নার্ভাস হয়ে পড়ল। দরজার সঙ্গে ঠেসে দাঁড়িয়ে রইল স্থাণুবৎ হয়ে। কান্নারত বাচ্চা সামলাতে সামলাতে জাহিদ আড়চোখে দেখল একবার ওকে।
— জুবিনকে লাস্ট কখন খাইয়েছ? ইট সিমস লাইক শি ইজ স্টার্ভিং। নিশা কিছু বলতে পারল না। অবাধ্য সংকোচের উৎপীড়ন তার কণ্ঠস্বর রোধ করে দিয়েছে। জাহিদ আলতোভাবে বাচ্চার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ঘুরে দাঁড়াল, তাকাল নিশার দিকে। নিশা অতর্কিতে দুই বাহু বুকের ওপর তুলে এনে মুখ ঝামড়ে উঠে বলল, ‘আমার দিকে তাকাচ্ছেন কেন? অন্যদিকে তাকান!’
জাহিদ ধমক শুনে আজ্ঞাবহ ভৃত্যের মতো দৃষ্টি সরিয়ে নিল। জুবিনের দুনিয়া কাঁপানো কান্নাটা মাথা ধরিয়ে দিচ্ছে। বিগত বেশ কয়েকটা রাত কেটেছে নিদ্রাবিহীন। সকাল থেকে নানাবিধ দুশ্চিন্তা, স্নায়বিক চাপ এবং পারিবারিক কলহের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে জাহিদের স্বাভাবিক বোধবুদ্ধি এখন লুপ্তপ্রায়। নিশার ওপর একটা নচ্ছার পাগল পাগল রাগ ক্রমেই জমতে জমতে মহীরুহর আকার ধারণ করছে। শাহজিদকে বাড়িভর্তি লোকের সামনে ওই প্রস্তাবটা দেবার আগে একবার কি ওর ভাবা উচিত ছিল না? এই অদূরদর্শী, হঠকারী কাজে বাড়ির লোকের যে ওর প্রতি বিরূপ ধারণা জন্মাতে পারে এটা বুঝতে না পারার মতো অবুঝ তো সে নয়। নাকি এখন আর কোন রাখঢাক চলবে না। সবাইকে জানিয়ে বুঝিয়েই সব সীমা অতিক্রম করে এই পরিবারের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার সময় এসে গেছে! এখন তো মনে হচ্ছে ফারার চেয়েও সাহসী এবং সাংঘাতিক এই মেয়ে! অথচ একটু আগে পাহাড়ের ওপর মেয়েটা কত আবেগসর্বস্ব কথা বলছিল। একই মানুষের এত রূপ হয় কী করে? ভাবতে অবাক লাগে!
নিশার দিকে না তাকিয়েই জাহিদ কঠোরভাবে বলল, ‘তুমি সঙের মতো দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ নিশার মেজাজ এমনিতেই খুব চড়ে আছে। এই অপ্রীতিকর, অপ্রস্তুত পরিস্থিতি তাকে আরো বেশি বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। কণ্ঠস্বর উচ্চাঙ্গে তুলে চাঁছাছোলা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল সে, ‘কী করতে হবে তাহলে?’
— ‘বাচ্চার কান্না থামাও…নইলে জামা-কাপড় পর…কিছু একটা তো কর!’
— ‘সব আমিই করব তো, আপনি কী করবেন?’
জুবিনের কান্নার তোড় বেড়ে চলেছে। জাহিদের বিনিদ্র, বিক্ষিপ্ত, ক্লান্ত মস্তিষ্ক ক্রমেই ভারসাম্য হারাচ্ছে। নিশা আগে কখনো মুখে মুখে তর্ক করত না। এখন সেই জড়োসড়ো, অপ্রতিভ, স্বল্পবাক মেয়ের মুখে কথার খই ফুটছে। এই অবস্থা চললে সংসারে জাহিদের টিকে থাকাই দুষ্কর হয়ে উঠবে। ফারা, তুরিন, নিশা…কেউ তাকে মান্য করছে না। সবাই যাচ্ছেতাই ব্যবহার করছে। মন চাইছে সবকিছু ছেড়েছুড়ে কোথাও চলে যায়। সংসার নামক বিভীষণ দায়িত্বের বোঝা সে আর বইতে পারছে না।
— ফর গড সেক নিশা, ডোন্ট আরগু। আই কুডন’ট স্লিপ অল নাইট! ট্ৰাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড।’
— ‘আর আমি তো খুব ভসভস করে ঘুমিয়েছি। এই বেয়াদব মেয়েটা আমাকে সারারাত ঘুমাতে দেয়নি আপনি জানেন?
— ‘রাতে কান্না করেছে?’
— ‘হ্যাঁ।’
— ‘কেন কী সমস্যা?’
— আমি কী জানি! একটা থাপ্পড় মারলে সব কান্নাটান্না লেজ তুলে পালাবে। ঠাস করে একটা চটকানা লাগান।
―শাট আপ। ইউ সাউন্ড টু হার্শ নিশা! তুমি ওর মা। মেয়ে কেন কান্না করছে সেটা তুমি না জানলে কে জানবে? আর মারামারির কথা বলছ কেন? খবরদার আমার মেয়ের গায়ে কখনো হাত তুলবে না।’
— ‘আপনিও তো ওর বাবা…আপনি কিছু জানেন না কেন?’
রাগে নিশার ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছিল। লোকটা একটু আগে তুরিনের সামনে তাকে মানুষ বলে গণ্য করেনি। কখনোই করে না। তুরিনের উদ্ধত, দুর্বিনীত আচরণ মাথা পেতে মেনে নেয় প্রতিবার। মেয়েকে একটা কড়া কথা শোনাতে পারে না। সেই একরত্তি মেয়ে আজ সবার সামনে নিশাকে গালাগাল করেছে। কই তখন এত বড় বড় কথা কোথায় ছিল? নিজের সন্তানকে ন্যূনতম ভদ্রতা- জ্ঞান শিক্ষা দেবার মুরোদ নেই। এখন এসেছে খুব হম্বিতম্বি দেখাতে। ফালতু যত্তসব!
জাহিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ওর দিকে, তীক্ষ্ণ গলায় বলল, ‘এভাবে কথা
বলছ কেন?’
— ‘আপনি বারবার এদিকে তাকাচ্ছেন কেন? কী আজব!’
অপমানের গরম-জল যেন ছিটকে এসে পুড়িয়ে দিল জাহিদের মুখ, ‘তাকাচ্ছি প্রয়োজনে। তোমাকে দেখার কোন শখ নেই আমার। তোমার কি ধারণা তোমাকে দেখার জন্য মরে যাচ্ছি?’
— ‘যাচ্ছেন নিশ্চয়ই। নইলে বারবার তাকাচ্ছেন কেন?’
জাহিদের চোয়ালজোড়া নিমেষে কঠোর হয়ে ওঠে, ‘তাকালে সমস্যা কী? তাকানো যাবে না?’
— ‘না যাবে না!’ বজ্রনিনাদ কণ্ঠে ঘোষণা দেয় নিশা।
— ‘আশ্চর্য!’ স্বগতোক্তির মতো শব্দটা উচ্চারণ করে জাহিদ।
— ‘আপনার কোন ঠিক আছে নাকি? সেদিনের মতো হুট করে কিছু করে ফেলবেন।’
জাহিদ আকাশ থেকে পড়ল, ‘দ্যাট ওয়াজ অ্যান আক্সিডেন্ট! ইউ ডিডন’ট ইভেন একজিস্ট টু মি। ইউ শুডন’ট হ্যাভ এনি ডাউট অ্যাবাউট ইট।’
নিশা গমগম করে বলল, ‘এত ইংরেজিতে কথা বলবেন না আমার সঙ্গে। বাংলায় বলেন। আমি আপনাদের মতো ফটফট করে ইংরেজি বলতে পারি না।’
জাহিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমি আগেও বলেছি ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। সব সময় আমাকে ব্লেম কর। এটা ঠিক না।’
নিশার মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। শরীর অত্যধিক দুর্বল। এতক্ষণ রাগে গা জ্বলছিল, এখন সেই রাগের সঙ্গে এসে জুটল অপমান আর লাঞ্ছনা। কেউ যেন অবমাননার ভারী পাথর দিয়ে তার হৃদয়টা মসলা ছেঁচার মতো করে ছেঁচতে লাগল অবারিত। নিশা জানে লোকটা তাকে সেই রাতে ঠিক মতো লক্ষই করেনি। এই অবজ্ঞাটুকুই তার মনের মধ্যে এতকাল ধরে জমে জমে অভিমানের ফেনিল সমুদ্রে রূপান্তরিত হয়েছে। এই অবজ্ঞা তাকে স্বস্তিতে শ্বাস ফেলতে দেয় না, ঘুমাতে দেয় না, বাঁচতে দেয় না…ভয় হয় এই অবজ্ঞা, উপহাস আর অশ্রদ্ধা একদিন তাকে গলা টিপে মেরে না ফেলে!
জুবিনের কান্না তখন থেমেছে। ঘুমিয়ে পড়েছে আবার। জাহিদ মেয়েকে শুইয়ে দিয়েছে বিছানায়। নিশা এলোমেলো কণ্ঠে বলল, ‘আমি জানি অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। আপনি অনেকবার বলেছেন। সেই রাতেও আপনি আপনার স্ত্রীর নাম নিচ্ছিলেন বারবার। আমার কোন অস্তিত্বই আপনার কাছে ছিল না। আপনি আমাকে জাস্ট ইউজ করেছেন।’
শেষের কথাটা জাহিদের সমস্ত চেতনাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল। চকিতে ঘুরে তাকাল সে নিশার দিকে। পরমুহূর্তেই আবার সরিয়ে নিল চোখ। খুব খারাপ লাগল কথাটা…এত বেশি খারাপ লাগল যে, সেই খারাপ লাগাটা জাহিদের বোধশক্তি এবং যুক্তির পাল্লাকে বড় গোলমেলে এবং বক্র করে তুলল। নিজেকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট, ঘৃণ্য এবং জঘন্য বলে মনে হতে লাগল তার। নিশা বারবার কেন এই প্রসঙ্গটা তুলে আনে? ওর কি অনুশোচনা হয়? ওই ঘটনার জন্য…জুবিনকে পৃথিবীতে আনার জন্য ওর কি আফসোস হয়? এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কি ওর জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ ধ্বংস করে দিয়েছে? হঠাৎ করেই জাহিদের চৈতন্যের আবর্তে যেন একটি নতুন বোধের সঞ্চার হলো। একটি অতীব সহজ-সরল অকাট্য সত্য, যা কিনা এতকাল কোন এক বিচিত্র কারণ বশত জ্ঞানচক্ষুর আড়ালে ছিল, নিদ্রিত ছিল। সেই সত্যটিই যেন আচমকা ধড়ফড় করে জেগে উঠে চোখে চোখ রেখে অকপটে তাকাল ড্যাবড্যাব করে। জাহিদ স্পষ্টভাবে বুঝল…জুবিন না এলে…নিশাকে এই বাড়িতে অষ্টপ্রহর বন্দিনী হয়ে দিন কাটাতে হতো না। জুবিন না আসলে নিশা হয়তো আরো আগেই নিজের জীবন সম্পর্কে কোন সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারত। নিশার জীবনের এই ভরাডুবি এবং অধঃপতনের জন্য পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ ভাবে জাহিদই দায়ী। এ কারণেই মেয়েটা বারংবার এই প্রসঙ্গ টেনে এনে জাহিদকে দোষারোপ করে। জাহিদ একটা দীর্ঘ নিশ্বাস আড়াল করে ক্লান্ত…ভীষণ ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আমার কখনোই মনে হয়নি আমি তোমাকে ইউজ করেছি। তোমারও কনসেন্ট ছিল…তুমি অস্বীকার করতে পারো না। আমি তোমাকে ফোর্স করিনি। এর পরেও…আমি জানি…ভুলটা আমারই। পারহ্যাপস, আই ওয়াজ হ্যাভিং অ্যান আনহ্যাপি সেক্স লাইফ। সো… আই…মেসড ইট আপ। ইউ হ্যাভ নো আইডিয়া হাও সরি আই অ্যাম অ্যাবাউট দ্যাট…’ একটু থেমে যোগ করল জাহিদ, ‘ইংলিশ বলার জন্য দুঃখিত।’
এই কয়েক বছরে নিশা একটু একটু জেনেছে যে উত্তেজিত হলে জাহিদ বাংলা বলতে ভুলে যায়। ব্যাপারটা অনিচ্ছাকৃত। সে অস্বস্তি নিয়ে চুপ করে রইল। তার মনের মধ্যে একটা অপ্রীতিকর সন্দেহ হঠাৎ করেই বিষফোঁড়ার মতো গজিয়ে উঠেছে। খচখচ করছে ভেতরে। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, ‘আপনি সেদিন বলেছিলেন আপনার স্ত্রীর সঙ্গে থাকেন না।
জাহিদ ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘বুঝলাম না।’
নিশা এবার ক্যাটক্যাট করে বলল, ‘আপনার বউয়ের সঙ্গে তো এক বিছানায় থাকেন না, তাহলে আপনার আনহ্যাপি সেক্স লাইফ হ্যাপি হওয়ার তো কোন চান্স নেই…’ একটু চুপ করে থাকে নিশা। তারপর খুব ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে ছুড়ে দেয় প্রশ্নটা, ‘নাকি অন্য কেউ আছে?’
জাহিদ স্তম্ভিত হয়ে গেল প্রশ্নটা শুনে। ওর চশমা পরা ফরসা মুখে বিস্ময়, সংকোচ, অপমানের একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া ঘটে গেল মুহূর্তের জন্য। ওর সম্পর্কে নিশার ধারণা এতটা নিচ, এতটা হীন, এতটাই কদর্য? ঝাঁজাল গলায় বলল ‘আই কুড আস্ক ইউ দ্য সেইম কোয়েশ্চন।’
—‘আমি তো মেয়েমানুষ।’
—‘সো হোয়াট? মেয়েদের কি ফিজিক্যাল নিড থাকতে নেই?’
জাহিদ কথাটা বলতে বলতে কয়েক পা এগিয়ে এসেছে। নিশা দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনো। চুল থেকে গড়িয়ে পড়া পানিতে ভিজে গেছে বুকে জড়ানো তোয়ালে। মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ফোঁটা ফোঁটা জল। জানালা দিয়ে আসা কুড়মুড়ে রোদের দুনিয়া কাঁপানো আলোয় জাহিদের কন্দৰ্পকান্তি ছিপছিপে মুখখানা এতক্ষণে একবার দেখল নিশা। আর দেখামাত্রই বুঝল এই মানুষটাও আসলে ভালো নেই। স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথাই ভাবছে সে। এর ওপর দিয়েও তো কম ঝড়-ঝাপটা যাচ্ছে না। নিশা কিছুক্ষণ চুপ করে ওর দিকে চেয়ে রইল। চেয়ে থাকতে থাকতে ভেতরের রাগ, ক্রোধ, অভিমানের সমস্তটাই কেমন ঝাপসা আর ফিকে হয়ে এলো। এতক্ষণের তর্কবিতর্ক, বাদানুবাদ আর কলহকে অকিঞ্চিৎকর, তুচ্ছ বলে হলো। এসবের সত্যিই কোন অর্থ হয় না। এই মানুষটার দিকে শুধু নির্বাক চেয়ে থেকেই সে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। জাহিদ মেঝের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে বলল, ‘নিশা সরে দাঁড়াও। বের হব।’
হঠাৎ হেসে ফেলল নিশা, ‘আল্লাহ! আপনি কী ভীষণ লজ্জা পাচ্ছেন! লজ্জায় লাল হয়ে গেছে মুখ!’
জাহিদ খুব বিরক্ত হলো। কয়েক পা পিছিয়ে এসে অসহায় গলায় বলল, ‘দিস ইজ রিডিকিউলাস। তোমার দিকে তাকানো যাবে না। ঘর থেকে বেরোনো যাবে না…কী করতে হবে তুমিই তাহলে বলে দাও!’
নিশা কয়েক পা এগিয়ে আসে। জাহিদ না তাকিয়েও নিশার অস্তিত্বের আলোড়ন টের পায়। চেরিফুলের মতো হালকা গোলাপি আভাযুক্ত দীর্ঘ কোমল দুটি বাহু…অনাবৃত গ্রীবা…উন্নত বুক…কোমরের নিখুঁত নান্দনিক খাঁজ…..হাতের চুরির রিনিঝিনি…চুল থেকে গড়িয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু জলে রোদের বিকিরণ…এই সমস্ত খুঁটিনাটি জাহিদের মেরুদণ্ডে শিরশিরে এক অদম্য শিহরণের সঞ্চার করে। তালাবদ্ধ অনুভূতির ঘরে ডাকাত পড়ে অপ্রত্যাশিত ভাবে। দুয়ারের তালা ঝনঝন শব্দে ভাঙতে থাকে ডাকাতদল। নিশা ওর চোখ থেকে চশমাটা খুলে নেয় আলগোছে। মুহূর্তে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে।
— ‘কী হলো?’
— ‘আপনার রাতে ঘুম হয়নি। আপনি বরং মেয়ের পাশে শুয়ে ঘুমান। আমি চলে যাচ্ছি ঘর ছেড়ে।’
কথাটা বলতে বলতে নিশা ওর হাত ধরে বিছানার কাছে নিয়ে এলো। জাহিদ বসল বিছানায়। চোখের সামনেটা গাঢ় কুয়াশার মতো সাদা হয়ে আছে। নিশার অবয়ব ঝাপসা। ওর খোলা চুলের উড়াল ঘ্রাণ বসন্ত বনের মৌমাছির মতো জাহিদের বুকের ওপর উড়ে আসছে ঝাঁক বেঁধে।
— ‘আপনি ঘুমান। আমি জুবিনকে নিয়ে যাচ্ছি। নইলে একটু পরেই কান্না করে আপনার ঘুম ভাঙিয়ে দেবে।’
— জুবিন থাকুক। তুমিও চাইলে থাকতে পার।
— ‘না আমি যাচ্ছি… আপনার ঘুমানো দরকার।’
জাহিদ ঠোঁটের দূর কোণে একটা মিটমিটে হাসি টেনে এনে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘ঘরের বাইরে গেলে এভাবে যেও না নিশা। গেট ড্রেসড।’
নিশা কথাটা শুনে একটু লাজুক হাসল। বলল না কিছু। ক্লজেট খুলে কাপড় বের করল। জাহিদ শুয়ে পড়েছিল। কী মনে করে আবার উঠে বসল, ‘তুরিনের একটা খবর নেয়া দরকার। এখন ঘুম আসবে না। মেয়েটার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে।’
— ‘দুশ্চিন্তা করবেন না। ওর সঙ্গে ওর মা আছে তো! শাহজিদও আছে নিশ্চয়ই। শাহজিদ ওকে একলা ছাড়বে না বলেই আমার বিশ্বাস।’
নিশার মুখে শাহজিদের নামটা শুনে আবারও রক্তে একটা জ্বালার ভাব টের পায় জাহিদ। মস্তিষ্কের তিতকুটে ভাবটা ঝপ করে ফিরে আসে। চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। মনে পড়ে নিশার সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলার ছিল।
— ‘আমার চশমা কোথায়?’
নিশা এগিয়ে আসে। চশমা খোলার পর জাহিদের চোখজোড়ায় একটু ট্যাড়া ভাব এসে গেছে। দৃষ্টি কোনদিকে স্থির নয়। চোখের কোল ফোলা। চশমার গাঢ় দাগ বসে গেছে সরু, তীক্ষ্ণ নাকের ওপর।
— ‘চশমা লাগবে না। আপনি ঘুমান।’
জাহিদের কণ্ঠস্বর আগের চাইতে কঠোর শোনাল, ‘চশমাটা তুমি কেন নিয়ে নিলে নিশা? যেন আমি তোমাকে দেখতে না পাই? তোমার ধারণা তোমাকে দেখামাত্র আমি তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব? এতটাই খারাপ মনে হয় তোমার আমাকে?’
নিশার বুক চিরে একটা ঘন শ্বাস পড়ে। অস্ফুটে বলে, ‘এত ভালো হওয়ার কী দরকার ছিল? মাঝেমাঝে একটু খারাপ হলেও তো পারেন!’
জাহিদ কান খাড়া করে— ‘কী বললে?’
— ‘না কিছু না।’
— ‘তখন কী বলেছিলে নিশা? পাহাড়ের ওপর? কীসব জায়গা জমির কথা বলছিলে যেন?’
সংকোচের দরুন নিশার মুখটা একটুখানি হয়ে যায়। চুপ করে থাকে। –’কথা বলছ না কেন?’
নিশার পায়ের তলার মাটি ক্রমেই বড় পিচ্ছিল হয়ে আসে। বুকের ভেতরের ভেঙে যাওয়া, গুঁড়িয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস খুঁজে খুঁজে জড়ো করার চেষ্টা করে সে। অপমানের শিলাবৃষ্টি হয় হৃৎপিণ্ডে। মনে পড়ে লোকটা অবিচল কণ্ঠে তুরিনের চোখে চোখ রেখে বলেছিল…ভালোবাসে না নিশাকে।
― ‘তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলিনি…কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কথাটা এখন বলছি, শুনে রাখুন…আমি এই বাড়িতে আর থাকতে পারব না। জুবিন আর আমাকে অন্য কোথাও পাঠাবার ব্যবস্থা করুন দ্রুত।’
জাহিদ খুব উত্তেজিতভাবে বলল, ‘তুমি যেখানে ইচ্ছা যেতে পারো। কিন্তু জুবিনকে সঙ্গে নিতে পারবে না।’
নিশার বুকে একটা জোর ধাক্কা এসে লাগে। উচ্চাঙ্গে উঠে যায় কণ্ঠস্বর, ‘আপনি আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চান? ওই মেয়ে ছাড়া আমার আর আছে কে?’
— ‘নিশা, আমার চশমাটা দাও। তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। জরুরি কথা চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে হয়।
নিশা উচ্চবাচ্য না করে চশমাটা ত্বরিত গতিতে গুঁজে দিল জাহিদের হাতে। চশমা চোখে দিতেই চারিদিক রোদের প্লাবনে ঝলসে উঠল। নিশার ডাগর দুটি চোখ…চেরিফুলের গোলাপি আভায় চিকচিক করা গাল আর সুডৌল বাহু, দিঘল গ্রীবায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু রুপালি জল…সাদা টাওয়েল জড়ানো মোমের মতো মসৃণ বুকের নিখুঁত ভাঁজ…সমস্তটাই দৃশ্যমান হয়ে উঠল একযোগে। জাহিদের হৃদযন্ত্র অচল হয়ে পড়ল মুহূর্তের জন্য। শ্বাস নিতে ভুলে গেল সে। চট করে চশমাটা খুলে ফেলল আবার। রুদ্ধশ্বাসে বলল, ‘থাক…চশমা ছাড়াই ভালো আছি!’
এই এক বাক্যের মধ্যে কত দুর্মোচ্য পিপাসা, অতৃপ্তি এবং হতাশা চাপা দেওয়া ছিল তা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, রোষপরবশ নিশা টের পেল না। সে অধৈর্য গলায় বলল, ‘কী জরুরি কথা বলবেন বলেছিলেন? বলে ফেলুন।’
জাহিদ বিছানার হেডবোর্ডে মাথাটা এলিয়ে দিল। চোখজোড়া বুজে নিয়ে বলল, ‘জুবিন আমার সঙ্গেই থাকবে। তুমি যদি শাহজিদের সঙ্গে কোথাও মুভ করতে চাও…করতে পারো। আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমার মেয়েকে আমি ছাড়তে পারব না।’
বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল নিশা। কয়েক সেকেন্ড হাঁ করে চেয়ে রইল শুধু। কিছু বলতে পারল না। জাহিদ বলে চলল, ‘দ্যাখো আমি তোমার চেয়ে বয়সে অনেক বড়। এত বয়সের তফাতে সংসার করা যায় না। আমি বিষয়টা বুঝি। শাহজিদকে যদি তোমার ভালো লাগে…এতে দোষের কিছু নেই। তুমি আধুনিক, শিক্ষিতা মেয়ে। সামনে তোমার অনেকটা পথ যেতে হবে। এই পরিবারের জন্য নিজের জীবনটা অযথা কেন নষ্ট করবে? জুবিনের দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে না। শাহজিদ হাই-প্রোফাইল জব করে। সে এই বাড়িতে কেন এতগুলো দিন ধরে আশ্রিত হয়ে পড়ে আছে, তা আমি এখন বুঝতে পারছি। তোমার জন্যই আছে। ওকে আর অপেক্ষায় রেখো না। যত দ্রুত সম্ভব তোমরা সম্পর্কটাকে লিগ্যাল করে নাও।’
নিঃসীম বিস্তৃত একটা আকাশ যেন টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছিল নিশার মাথার ওপরে। স্তব্ধ, বিহ্বল চোখে চেয়ে আছে সে সামনে বসা মানুষটার দিকে। অভিমানের ঘন বাষ্পে ভরে গেছে বুক। গলা কাঁপছে…এত বেশি কাঁপছে যে সে কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারছে না। তবে জীবনে এই প্রথমবারের মতো সে বুঝতে পারছে ভালোবাসার চাইতেও আত্মসম্মান, আত্মাভিমানের দাম অনেক বেশি। ভালোবাসা ছাড়া বেঁচে থাকা যায়, কিন্তু নিজের প্রতি ন্যূনতম সম্মানটুকুও যে মানুষ হারিয়ে ফেলে, জীবনযুদ্ধের এই অমোঘ পরিক্রমায় মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা তার জন্য দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। এই লোকটা নিশাকে তাড়ানোর জন্য অন্য একজনের সঙ্গে জোরপূর্বক তার নাম জুড়ে দিতে চাইছে। অপবাদ দিতে চাইছে। পৃথিবীতে এর চেয়ে বড় অবমাননা বোধহয় আর হয় না।
জাহিদের পিঠ তখনো হেডবোর্ডে হেলানো, পা টানটান করে ছড়ানো সামনে। চোখ বুজে রাখা অবস্থায়ই সে ধীরস্থির গলায় বলল, ‘আমি চাই না তুমি মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই সংসারে টিকে থাকার যুদ্ধ করে যাও। শাহজিদের বাবা-মা নেই। দুর্ঘটনায় পা হারিয়ে পঙ্গু জীবন যাপন করছে। ছেলেটাকে মিছে আশায় রেখ না। ওকে বিয়ে করলে তুমি অনেককিছুই পাবে, যা এই বাড়িতে থেকে পাবে না।’
নিশা একটা দীর্ঘ কণ্টকময় শ্বাস ফেলল, ‘আর কিছু বলার আছে আপনার?’
—‘আর বিশেষ কিছু বলার নেই। তোমাকে এই অভিশপ্ত জীবন থেকে আমি মুক্তি দিলাম নিশা! তুমি নিজের জীবন গুছিয়ে নাও। এতে তোমার মঙ্গল হবে। তুরিনও খুশি হবে। দেখেছ তো মেয়েটা কী পরিমাণ ডেস্পারেট হয়ে উঠছে দিনকে দিন। শুধু একটা অনুরোধ থাকবে…জুবিনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও না। আমার জীবনে জুবিন আর তুরিন ছাড়া কেউ নেই। একটু বোঝার চেষ্টা করো প্লিজ।’
নিশা অপ্রকৃতস্থ অট্টহাসি হেসে উঠল হঠাৎ। হাসতে হাসতেই বলল, ‘আর শাহজিদ যদি আমাকে বিয়ে করতে না চায়…তখন কী হবে বলুন তো?’
জাহিদ সোজা হয়ে বসল। গম্ভীর গলায় বলল, ‘বিয়ে করতে চাইবে না কেন? প্রয়োজনে আমি নিজে ওর সঙ্গে কথা বলব এই ব্যাপারে।
নিশা খিলখিল করে হাসতে থাকল পাগলের মতো। চোখে চিকচিক করতে লাগল অশ্রুজল। হাসির মধ্যেও যে কত বেদনা, কত যন্ত্রণা আর ক্ষোভ লুকোনো থাকতে পারে তা নিশার এই অদ্ভুতুড়ে হাসিটা নিজ চোখে না দেখলে বোধহয় কেউ কোনদিন সত্যিকার অর্থে অনুভব করতে পারবে না। সেই সময় ঘরের দরজায় যেন ডাকাত পড়ল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো তুরিনের গলা ফাটানো চিৎকার, ‘বাবা!…বাবা!’
এই চিৎকারে ছোট্ট জুবিনটা ভয়ে কেঁপে উঠল থরথরিয়ে। ঘুমের মধ্যেই ঠোঁট ফুলিয়ে, হাত-পা ছুঁড়েকাঁদতে লাগল। জাহিদ চোখে চশমা লাগিয়ে তড়িঘড়ি করে কান্নারত বাচ্চাকে কোলে তুলে নিল। দরজায় তখনো উপর্যুপরি আঘাত চলছে। জাহিদ নিশার দিকে একবার তাকাল। স্থিরচিত্র হয়ে বসে আছে। জুবিনকে কোলে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। নিশা হঠাৎ ডাকল পেছন থেকে, ‘শুনুন!’
দরজার আঘাতের শব্দ আর জুবিনের কান্নার স্বর সব কিছুকে ছাপিয়ে যাচ্ছে একদম। জাহিদ অস্থির ভাবে বলল, ‘বলো, শুনছি।’
— ‘যতদিন এই বাড়িতে আছি, আপনি আমার সঙ্গে আর একটি কথাও বলবেন না। আমি আপনাকে ঘৃণা করি!’
নিশার মুখনিঃসৃত দৃঢ় বচনখানি জাহিদের বুকের মধ্যে তীক্ষ্ণমুখ শেলের মতো এসে বিঁধল। যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠল ওর মুখ। কী যেন একটা বলতে গিয়েও বলল না আর। নতশিরে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। তুরিন, ফারা আর আনিতা দাঁড়িয়ে আছে দরজার ওপাশে। তুরিন জাহিদকে দেখামাত্র উত্তেজিত গলায় বলল, ‘বাবা হোয়াট দ্য হেল আর ইউ ডুইং হিয়ার?’
জাহিদের মুখে ভয়াবহ ভাঙচুরের ছাপ। মেয়ের দিকে ব্যথিত চোখে চেয়ে রইল শুধু। কোন প্রত্যুত্তর করতে পারল না। এদিকে জুবিন কেঁদে যাচ্ছে আনিতা এগিয়ে এসে জুবিনকে কোলে তুলে নিল। জাহিদ আপত্তি করল না। আনিতার কোলেই বাচ্চাকে গছিয়ে দিল। তুরিন ফারার হাতের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ে ব্যান্ডেজ। জাহিদ এগিয়ে এসে ওর অপর হাতটা ধরল।
তুরিন বলল, ‘বাবা আই ডোন্ট ওয়ানা সি ইউ ইন দিস রুম এনিমোর। জুবিনকে আমরা আমাদের কাছেই রাখতে পারি। আই কুড ইভেন টেক কেয়ার অব দ্যাট কিড। নো বিগডিল!’
জাহিদ এবারেও মেয়ের কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বলল না। একটা অনুচ্চার্য, ব্যাখ্যাতীত কষ্টে ওর বুকটা খণ্ড খণ্ড হয়ে যাচ্ছিল। নিশা কথাটা এভাবে না বললেও পারত। জাহিদ তো বুঝেই নিয়েছিল! মুখ ফুটে বলাটা কি খুব বেশি জরুরি ছিল?
৯
নিজেকে এতটা অচেনা এর আগে কোনদিন লাগেনি শাহজিদের। তার জীবনের একমাত্র প্রেম ছিল পাহাড়। যেদিন আকস্মিক দুর্ঘটনায় ডান পা-টা খুইয়ে ফেলল আজীবনের জন্য, ঠিক সেদিন থেকে এই পাহাড়ই হলো সবচাইতে বড় শত্রু…বড় দুঃখ…এবং দীর্ঘশ্বাস! পাহাড়ের বিচ্ছেদ তাকে পীড়ন করে অষ্টপ্রহর। জীবনে আর কোনদিন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো তরতর করে পাহাড়ে বাইতে পারবে না, এই একটিমাত্র তিতকুটে সত্য তার আত্মবিশ্বাসের খুঁটিতে আঘাত হেনে যায় অনবরত। শাহজিদের মনে অন্য কোন আক্ষেপ ছিল না, অভিযোগ বা খেদ ছিল না। শুধু এক বুকভর্তি পাহাড়ের বিচ্ছেদের শূন্যতা ছিল। বিরহ ছিল। যে মানুষ কখনো পাহাড়ের প্রেমে পড়েনি, সে মানুষ এই বিরহের যাতনা কোনদিন অনুভব করতে পারবে না। কিন্তু আজ যেন জীবনে প্রথমবারের মতো একটা অন্তর্নিহিত অনির্বচনীয় চৈতন্যর উদয় হলো দ্বিধা, দ্বন্দ্ব এবং বিভ্রমের মেঘে ঢাকা ধূসর মনের আকাশে। ঠিক যে মুহূর্তে অর্ণব তুরিনকে স্পর্শ করেছিল…শাহজিদের আবাল্য চেনাজানা পুরনো পৃথিবীর রংটা যেন ঠিক সেই মুহূর্তেই পাল্টে গেল। গাছের গা থেকে পাতা খসে যাওয়ার মতো, শাহজিদের দেহ আর আত্মা থেকে প্রাণের প্রতিটি স্পন্দন এবং উষ্ণতার অস্তিত্ব যেন একটা একটা করে ঝরে পড়তে লাগল।
বুকের সব উষ্ণ রক্তকণা একপাশে সরে গিয়ে মিশে যেতে লাগল মৃত্যুর মতো কোন এক শীতলতম নিস্তব্ধ হিমঘরে।
আজ একটা অটল সিদ্ধান্তে বদ্ধপরিকর হলো সে। সময় নষ্ট না করে মুর্তজা সাহেবের নম্বরে ডায়াল করল। দুবার রিং পড়তেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর ভরাট কণ্ঠ।
— ‘হ্যালো।’
— ‘হ্যালো আংকেল!’
— ‘কেমন আছ শাহজিদ?’
— ‘আছি ভালোই। আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল। সময় হবে?’
— ‘আমি তো বাড়ির দিকেই ফিরছি। তুমি কি সামনাসামনি কথা বলতে চাও? নাকি ফোনেই বলবে?’
— ‘যেভাবে আপনার সুবিধা।’
— ‘বলো কী বলতে চাও।’
শাহজিদ একটা বড় শ্বাস টেনে নিল। মনে মনে কথা গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘আংকেল আমি এখানে আর থাকতে চাই না। অন্য কোথাও মুভ করতে চাই। অনেকদিন তো হলো। আপনি আমার জন্য যথেষ্ট করেছেন। তা ছাড়া আপনার প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই… অভিযোগ নেই।’
মুর্তজা সাহেব একটু সময় চুপ করে ভাবলেন কিছু একটা। চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘তুমি বাচ্চা একটা ছেলে, একা একা থাকবে কী করে?’ একথা শুনে শাহজিদ মনে মনে একটু বাঁকা হাসল। মুর্তজা সাহেব নিশ্চয়ই ‘বাচ্চা একটা ছেলে’ কথাটা উল্লেখ করেছেন নেহাত ভদ্রতা রক্ষার খাতিরে। আসলে তার কথার অন্তর্নির্বিষ্ট ভাববস্তু হলো, তুমি পঙ্গু একটা ছেলে একা একা থাকবে কী করে? শাহজিদ মনের বাঁকা হাসিটুকু মনে গচ্ছিত রেখেই মুখে গাম্ভীর্য টেনে এনে বলল
— ‘আপনি তো ইচ্ছাকৃতভাবে কিছু করেননি। কেন সব সময় গিলটি ফিল করেন আংকেল?’
— ‘তুমি কি অন্য কোন স্টেটে মুভ করার কথা ভাবছ?’
— ‘আপাতত ডেনভারে একটা অ্যাপার্টমেন্ট রেন্ট করব।’
—‘তাহলে ভাড়াটা আমি দেব।’
— ‘না না…প্লিজ! আই ক্যান অ্যাফর্ড মাইসেলফ!’
— ‘আমি জানি তুমি সাবলম্বী এবং সাহসী একজন যুবক। তবুও তোমার জন্য কিছু করতে চাই শাহজিদ!’
কথাটা শোনার পর কেন যে শাহজিদের মানসপটে তুরিনের খরগোশের মতো আদুরে আর ইনোসেন্ট চেহারাটা আচমকা টর্চের আলোর মতো ঠিকরে পড়ল, কে জানে! বুকের আবছা কোণে সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা এবং আনকোরা এক আকাঙ্ক্ষার ক্ষীণ বিচ্ছুরণ টের পেল সে। সাবধানে বলল, ‘আমার কিছু প্রয়োজন হলে আমি নিজেই আপনার কাছ থেকে চেয়ে নেব। এই তিন বছর আপনার বাড়িতে বিনামূল্যে থেকেছি, খেয়েছি। আপনি যথেষ্ট করেছেন।’
— ‘আমি তোমার যে ক্ষতি করেছি…সেই ক্ষতি যে কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়!’
শাহজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস চাপা দিয়ে বলল, ‘ক্ষতিপূরণের কথা আমি ভাবিই না কখনো! তবে যদি আপনার কাছে সত্যিই কখনো কিছু চাই…আপনি দেবেন তো?’
মুর্তজা সাহেব উৎসুক গলায় বললেন, ‘কীসের কথা বলছ? কী চাও তুমি শাহজিদ?
— ‘কী চাই তা আমি নিজেও এখনো সঠিক জানি না। জানতে পারলে অবশ্যই জানাব। আপাতত এটুকু জেনে রাখুন আমি মুভ করছি। এখানে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব না।’
— ‘শাহজিদ শোন…তোমার সঙ্গে কি বাড়ির কেউ দুর্ব্যবহার করেছে? শাহজিদ চুপ করে রইল। মুর্তজা সাহেব বললেন, ‘তুমি কেন এই বাড়িতে আছ, কার অনুরোধে আছ-এসব কিছুই বাড়ির লোকে জানে না। হতে পারে এ কারণে অনেকেই তোমাকে সঠিক সম্মানটুকু দেখাতে চায় না। তোমার অ্যাক্সিডেন্টের জন্য আমিই দায়ী। আমার গাড়ির চাকার নিচেই তোমার একটা আস্ত পা পিষে গেছে। এ কারণে আমি তোমার কাছে আজীবন অপরাধী হয়ে থাকব। তোমার দেখাশোনার দায়িত্ব নেয়ার মাঝে নিজের পাপমুক্তির একটা পথ খুঁজে পাই। এটাই আমার স্বস্তি। প্লিজ এই স্বস্তিটুকু থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না। তুমি চাইলে আমি বাড়ির সবার সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলতে পারি।’
— ‘না না…আমি আমার ব্যক্তিগত ইস্যু নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে চাই না।’
শাহজিদ দেখল স্লাইডিং ডোরের ওপাশে অর্ণব এসে দাঁড়িয়েছে। কথা সংক্ষিপ্ত করে লাইন কেটে দিল। হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে এগিয়ে গেল দরজার দিকে। অর্ণব ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘সরি শাহজিদ ভাই। ডিস্টার্ব করলাম অসময়ে।’
— ‘আরে না…ডিস্টার্ব কীসের?’
অর্ণবের মুখে একটা ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া ভাব লক্ষ করল শাহজিদ। বিস্মিত গলায় বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন?’
অর্ণব ঘরের মাঝামাঝি স্থানে দাঁড়িয়ে হুইলচেয়ারে বসা শাহজিদের দিকে একটু সময় ফাঁকা চোখে চেয়ে রইল। আর ঠিক তখনই গতকাল সকালের সেই গিরিখাদের ভেতরের টুকরো ঘটনাটা মনে পড়ল শাহজিদের। অপরাধ বোধের কাঁটা খচখচ করে উঠল মনে। সেই সঙ্গে একটা অদ্ভুত গা-শিরশিরে অনুভূতি। আশ্চর্য! তুরিনের মতো নেহাত বোকা, হিংসুক, অপরিণত মস্তিষ্কের একটা মেয়েকে মনে করতে গিয়ে শাহজিদের মতো ব্যক্তিত্ববান, বিবেচক যুবকের হৃৎপিণ্ড শিহরিত হবে…এটা কোন যৌক্তিক কথা হলো? নিজের মনের যুক্তিবিরূদ্ধ, অবান্তর আচরণে সীমাহীন বিরক্ত হলো শাহজিদ। অর্ণবের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারল না। অর্ণব বলল, ‘শাহজিদ ভাই, একটা প্রশ্ন ছিল আপনার কাছে।’
— ‘জি বলুন।’ একটু থেমে শাহজিদ যোগ করল, ‘আপনি দাঁড়িয়ে কেন? বসুন না, প্লিজ বসুন।’ বলল ঠিকই। কিন্তু কোথায় বসতে দেবে? বিছানাটা বড্ড এলোমেলো, একটা মাত্র চেয়ার আছে ঘরে, সেই চেয়ারটাও কাপড়- চোপড়ে বোঝাই। নিশা রোজ ঘর গুছিয়ে দেয়, পরিষ্কার করে। কিন্তু গত দুদিন ধরে সে এদিকে আসেনি। তাই ঘরের অবস্থা যাচ্ছেতাই। শাহজিদ একটু লজ্জিত স্বরে বলল, ‘আমার ঘর একদম মেসড আপ হয়ে আছে। সরি…আপনাকে যে কোথায় বসতে দিই…’
অর্ণব এলোমেলো বিছানাটার ওপরেই ধপাস করে বসে পড়ে বলল, ‘আচ্ছা…ওই মেয়েটার সঙ্গে এই বাড়ির সম্পর্ক কী?’
—‘কোন মেয়ে?’
— ‘যে মেয়েটি বাচ্চা কোলে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল।’
শাহজিদ একটু অপ্রস্তুত হলো। নিশার ব্যাপারে অর্ণবকে এখনো কিছু জানানো হয়নি? অথচ ওর সঙ্গে তুরিনের বিয়ের কথা চলছে। পরিবারের আদ্যপান্ত পাত্রপক্ষকে না জানিয়ে ধোঁকা দিয়ে মেয়ে বিয়ে দেবার মতো অবিবেচক মানুষ মুর্তজা সাহেব নন। তাহলে এখন অবধি তিনি নিশার ব্যাপারটা অর্ণবের কাছ থেকে গোপন রেখেছেন কেন? সঠিক সময়ের অপেক্ষায়? শাহজিদ একটু দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘আপনাকে ওর বিষয়ে কিছু বলা হয়নি?’
— ‘না।’
— ‘অন্যের পারিবারিক ব্যাপারে আমার কথা বলাটা ঠিক হবে না। আপনি সরাসরি তুরিনের সঙ্গে কথা বলুন। কিংবা তুরিনের বাবার সঙ্গে।’
অর্ণব একটু ম্লান হেসে বলল, ‘উনারা নিজ থেকে কিছু না জানাতে চাইলে আমি ঘাঁটাব না।’
— ‘তুরিনের সঙ্গে আপনার সবকিছু ঠিকঠাক?’ সাবধানে প্রশ্ন করে শাহজিদ।
— ‘ঠিকঠাক বলতে?’ অর্ণবের সরল প্রশ্ন।
বুকের উৎকণ্ঠা নিবৃত্তের বৃথা চেষ্টা করে শাহজিদ। নিজের বাঁ পায়ের ভাঙা আঙুলের ওপর অস্থির দৃষ্টি রেখে অনেকটা চাপা গলায় বলে, ‘বিয়েটা হচ্ছে?’ অর্ণব হাসল, ‘মনে হয় হচ্ছে না।’
— ‘কেন?’ প্রশ্নটার সঙ্গে কেন যে একটা স্বস্তির শ্বাস অজান্তেই বেরিয়ে এলো শাহজিদের বুক চিরে! উফ…নিজেকে প্রচণ্ড বিরক্ত লাগছে এই মুহূর্তে। অসহ্য!
‘উনার খুব সম্ভবত আমাকে পছন্দ হয়নি। আমার বাবা অবশ্য চাইছেন বিয়েটা যেন হয়ে যায়। আসলে আমার পিতা দারিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে নৈতিক জ্ঞান হারিয়েছেন। তার ধারণা এই বিয়ে হয়ে গেলেই আমাদের চৌদ্দগুষ্টির অভাব-অনটন দূর হয়ে যাবে।’
— ‘মুর্তজা আংকেলও তো চাইছেন বিয়েটা হয়ে যাক, তাই না?’
— ‘জি। তিনি পাত্র হিসেবে আমাকে খুবই পছন্দ করেছেন।’ একটু লাজুক গলায় বলল অর্ণব।
১০
— ‘কেন এসেছ এ বাড়িতে?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করেন মিসেস মুর্তজা।
অনিমেষ গায়ে জ্বালা ধরানো হাসি হাসে। লঘু গলায় বলে, ‘কেন আন্টি? আসা কি নিষেধ নাকি? আমার মেয়েকে দেখতে আমি আসতে পারি না?’
— ‘আস্তে!’ দাঁতে দাঁত চেপে শব্দটা উচ্চারণ করেন মিসেস মুর্তজা। লিভিংরুমের কর্নারের একটা সোফায় বসে আছেন তিনি। অনিমেষ দাঁড়িয়ে আছে সামনে। প্যান্টের পকেটে হাত। মুখে ড্যাম কেয়ার ভাব। চোখে-মুখে ঝিলিক দিচ্ছে নির্লজ্জ হাসি। মিসেস মুর্তজার বয়সের ভারে কুঞ্চিত হয়ে আসা চেহারার ত্বকে ঘৃণা এবং তাচ্ছিল্যের দৌরাত্ম্য। একটি টাঙ্গাইলের সুতির শাড়ি আর ফুলহাত ব্লাউজ তাঁর পরনে। মাথায় আঁচল টানা। চোখে চশমা। সেই চশমার কাচ ভেদ করে এখন ঠিকরে বেরোচ্ছে ক্রোধ। বিষঝরা কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘তোমাকে এই বাড়িতে আসতে অনেকবার নিষেধ করা হয়েছে। এর পরেও বেহায়ার মতো আসো কেন? লজ্জা-শরম বলতে কি কিছুই নাই?’
— ‘আমিও অনেকবার বলেছি আমার মেয়েটাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আপনারা তো এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না।’
মিসেস মুর্তজা কঠিন গলায় বললেন, ‘তুরিন এ বাড়ির মেয়ে। তোমার মেয়ে না। খবরদার এমন কথা আর কোনদিন মুখে আনবা না।’
— ‘তুরিন আমার মেয়ে। বিষয়টা আপনি এবং আপনার হাজবেন্ড খুব ভালোমতো জানেন। এর পরেও দিনের পর দিন সত্যটা চাপা দিয়ে যাচ্ছেন। এর চেয়ে বড় অপরাধ কিন্তু আর হয় না।’
— ‘এতো দেখছি ভূতের মুখে রাম-নাম! সত্যটা যদি তোমরা সবার প্রথমেই খোলাসা করে বলতে তাহলে এই দিন দেখতে হতো না। ফারা আমার ছেলেকে বিয়ে করেছে মিথ্যে কথা বলে। এত বড় অপরাধের পর ওকে হজম করছি শুধু আমার ছেলে আর নাতনির মুখের দিকে চেয়ে। এই জঘন্য সত্য যদি তুরিনের জ্ঞান হওয়ার আগেই আমাদের সামনে আসত তাহলে…’
— ‘তাহলে?’
— ‘তাহলে ফারাকে জুতাপেটা করে এই সংসার থেকে বিদায় করতাম। তোমরা যে অপরাধ করেছ তার কোন ক্ষমা হয় না। এই ঘটনা জানতে পারলে আমার ছেলেটা ভয়ংকর কষ্ট পাবে। মরে যাবে সে। তুরিনও সহ্য করতে পারবে না। তুমি কি এই সহজ-সরল বাচ্চা- মেয়েটাকে মেরে ফেলতে চাও?’
— ‘মেরে ফেলতে চাই না, তবে সত্যটা জানাতে চাই।’
মিসেস মুর্তজা ব্যথিত গলায় বললেন, ‘তোমার মনে কি একটু মায়াদয়া নাই? মেয়েটা পাগল হয়ে যাবে এই কথা জানতে পারলে। জাহিদকে সে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে।’
অনিমেষের মুখটা শক্ত হয়ে ওঠে, ‘সত্য প্রকাশ হবে আজ নয় কাল … তুরিনকে জানতে হবে…জাহিদকেও জানতে হবে।’
মিসেস মুর্তজা ব্যাকুল স্বরে বললেন, ‘আমি হাতজোড় করে অনুরোধ করছি তোমাকে। এত বড় নিষ্ঠুরতা করো না। তুমি ফারাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাও। এখনো তোমাদের বয়স কম। চাইলেই জীবনটা নতুন করে শুরু করতে পারবে।’
— ‘আপনারা তো আপনাদের ছেলেকে আবার বিয়ে করালেন, সেখানে তার নিজের সন্তান আছে। আমাকে কেন আমার সন্তানের কাছ থেকে দূরে সরাতে চাইছেন?’
— ‘একথা বলতে তোমার লজ্জা করল না? সত্যিই যদি তোমার সন্তানের প্রতি এত মায়া থাকত তাহলে সেই সময় ফারাকে বিয়ে করোনি কেন? কেন আমার ছেলের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলে নিজের অপকর্মের বোঝা?’
— ‘কারণটা আপনাকে বলার আমার কোন প্রয়োজন নেই। তবুও বলছি, ফারার বাবা মা অন্য ধর্মের ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চাননি।’
মিসেস মুর্তজা দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে গম্ভীর ভাবে বললেন, ‘অনেক বড় পাপ করেছ তোমরা অনিমেষ…অনেক বড় পাপ! এই পাপের ক্ষমা নেই। ‘ অনিমেষ বিরক্ত হয়, ‘আর কিছু বলবেন?’
— ‘তোমাকে বারবার অনুরোধ করছি, প্লিজ সত্যটা চেপে যাও। আমার ছেলের এত বড় সর্বনাশ করো না। তুরিন ওর প্রথম সন্তান। মেয়েটাকে সে মনে প্রাণে ভালোবাসে। এত বড় প্রতারণা ও সহ্য করতে পারবে না।’
— ‘চেষ্টা করব ঘটনা চেপে যাওয়ার। তবে কথা দিতে পারছি না। আপনারা বাংলাদেশ থেকে কোন এক গেঁয়ো ছেলে ধরে এনে আমার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইছেন। এই ব্যাপারে আমার আপত্তি আছে।’
— ‘তুরিন ছেলেটাকে পছন্দ করলেই বিয়ে হবে। নইলে নয়।’
— ‘এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার কী দরকার?’
— ‘এই দেশে ছেলেমেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়াই ভালো। নইলে অঘটন ঘটার সম্ভাবনা থাকে। বিধর্মী কাউকে ধরে নিয়ে এসে যদি বলে একে বিয়ে করতে চাই। তখন কী হবে?’
— ‘ধর্মটা আপনাদের কাছে অনেক বড় ইস্যু, তাই না?’
— ‘হ্যাঁ…অনেক বড় ইস্যু।’
১১
বেডরুমে ঢুকতেই ফারা ধারাল কণ্ঠে বলল, ‘তোমার সমস্যাটা কী আমি বুঝলাম না। এত কিছুর পরেও ওই ঘরে গিয়ে বসে ছিলে কেন?’
জাহিদ ক্লান্ত চোখে তাকাল ফারার দিকে, ক্লান্ত গলায় বলল, ‘তাতে তোমার কী?
— ‘মেয়েটাকে তো দেখছ। দিন দিন ডিপ্রেসড হয়ে যাচ্ছে। ডোন্ট ইউ ফিল ব্যাড ফর হার? ওর জন্য কি তোমার কিছুই করার নেই?’
জাহিদ ওয়াক ইন ক্লজেটের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। হ্যাঙ্গারে ঝুলানো তোয়ালে কাঁধে তুলে নিয়ে ভাবলেশহীন গলায় বলল, ‘কী করতে হবে?’
— ‘ওই মেয়েটাকে আর ল্যাংড়া ছেলেটাকে একসঙ্গে কোথাও পাঠিয়ে দিলেই তো পার। আজকে তো চলেই যাচ্ছিল। তোমার মা আটকাতে গেল কেন?
জাহিদ ক্লজেট থেকে বেরিয়ে এলো। ফারার চোখে চোখ রেখে শীতল স্বরে বলল, ‘ইটস নান অব ইয়োর বিজনেস। ডোন্ট এক্সিড ইয়োর লিমিটস।’
‘আমার মেয়েটাকে চোখের সামনে এভাবে শেষ হয়ে যেতে দেখব, কিন্তু কিছুই বলতে পারব না?’
জাহিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘ফারা শোন, আমার ব্যক্তিগত ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করো না। আর নিশার বিরুদ্ধে তুরিনকে উসকে দিও না। যদি দাও…’
— ‘কী হবে দিলে?’
— ‘অনিমেষের সঙ্গে তোমার অ্যাফেয়ারের ব্যাপারে তুরিন এখনো কিছু জানে না। তুমি নিশাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে আমি কিন্তু তুরিনের কাছে মুখ খুলতে বাধ্য হব।’
ফারার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে উঠল চকিতে। ভয়ের একটা ঢেউ মুহূর্তের মধ্যে শুষে নিল মুখের সব রক্ত। হতভম্ব গলায় বলল, ‘তুমি আমাকে থ্রেট করছ?’
জাহিদ শ্রাগ করল, ‘সর্ট অফ।’
— ‘এর মানে তুমি ওই অসভ্য মেয়েটাকে ছাড়বে না?’
জাহিদের মুখে একটা অভ্রভেদী কঠোরতা নেমে আসে। চোয়াল হয়ে ওঠে লোহার মতো শক্ত। গমগমে স্বরে বলে, ‘আমি একবারই বলেছি আমার পারসোনাল ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কোন কথা বলতে চাই না। তুমি সেই অধিকার হারিয়েছ অনেক আগে। আর একটা বিষয়, সবসময় নিশাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলো কেন? সমস্যা কী?’
— ‘কেন? ওকে নিয়ে বাজে কথা বললে তোমার বুঝি খুব লাগে?’
— ‘হ্যাঁ লাগে।’
— ‘এত লাগে কেন? প্রেমে পড়ে গেছ নাকি?’
‘তুমি কেন এখনো এই সংসারে পড়ে আছ বলো তো? অনিমেষ কি তোমাকে পুরোপুরি চায় না? এখানে থেকে তোমার লাভটা কী হচ্ছে? নাকি অনিমেষ হিন্দু বলে ওকে বিয়ে করা সম্ভব হচ্ছে না?’
রাগে ফারার মুখটা বিকৃত হয়ে উঠল, ‘আমি এখানে আছি শুধু আমার মেয়ের জন্য।’
—‘তাহলে মেয়েকে নিয়েই ভাবো। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না।’
‘তুমি কি এখনো বিশ্বাস করোনি ওই ক্রিপলড ছেলেটার সঙ্গে তোমার নিশার প্রেম চলছে?’
জাহিদ চুপ করে রইল। ফারা জোরালো গলায় বলল, ‘সকাল বিকাল চব্বিশ ঘণ্টা নিশা বেজমেন্টে গিয়ে বসে থাকে। একটা ব্যাচেলার ছেলের ঘরে সে করেটা কী? বনে-জঙ্গলে দিনে দুপুরে ঘুরে বেড়ায়। আমার কাছে ছবি আছে ওদের ইনটিমেট মোমেন্টের। তুমি কি ছবি দেখতে চাও?’
কথাটা শুনে কান ঝাঁঝাঁ করে উঠল। রক্তে জ্বালা টের পেল জাহিদ। বিষের ছোবল এসে লাগল মনে। শক্ত গলায় বলল, ‘না। আমি কিছুই দেখতে চাই না।’
ফারা এগিয়ে এসে ওর একটা হাত ধরল, ‘জাহিদ লিসেন, আমি অনিমেষকে ছেড়ে দেব। আমার কাছে অনিমেষের চাইতে এই ফ্যামিলি অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট। তুমি…তুমি ফিরে এসো আমার কাছে…ফিরে এসো আমার মেয়ের কাছে…নিশাকে ভুলে যাও।’
জাহিদ হাতটা ছাড়িয়ে নিল। একটা গভীর হতাশার শ্বাস পড়ল ওর। ঝাঁক বাঁধা হতাশায় ডুবে থেকেই বিষণ্নভাবে বলল, ‘তোমার সঙ্গে আমার আর কখনোই কিছুই হবে না ফারা। কারো সঙ্গেই হবে না। বিশ্বাস জিনিসটা আমার মন থেকে পুরোদমে উঠে গেছে!’
কথাটা শুনে কেন যেন ফারার মুখে একটা প্রচ্ছন্ন স্বস্তির আভাস পড়ে। সাবধানে বলে, ‘নিশাকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। তুমি বরং ওকে ওই ছেলেটার সঙ্গেই থাকতে দাও।’
জাহিদ কঠিন চোখে তাকায়, ‘তুমিও আমাকে আমার মতো থাকতে দাও ফারা! শেষবারের মতো বলছি, আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করো না।’
কালারে কইরো গো মানা
সে যেন আমার কুঞ্জে আসে না।
—অমর পাল বাউল
.
নিশা কেন বলেছিল কথাটা? হঠাৎ…একদম হঠাৎ করে…এতকাল বাদে? জাহিদের প্রতি ওর ঘৃণাটা যদি পুরনোই হয়ে থাকে, তবে নতুন করে সেই উপলব্ধিকে আজ এমন জোরেশোরে স্বীকৃতি দেবার কারণ কী?
— ‘বাবা!’ আচমকা ছুটে আসা ডাকটা জাহিদের ভাবনার জাল ছিন্ন করল। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে তুরিন। মুখখানা শীর্ণ। চোখ লালচে। নীল সাদা চেকের পাজামা সেট ওর পরনে। সিল্কি চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পিঠে। বাবার পাশে বসে পড়ে বলল, ‘কী ভাবছ?’
জাহিদ চিন্তামগ্ন দুটি বিষণ্ণ চোখ মেলে মেয়েকে দেখল। হাসল সামান্য। মেয়েটা হঠাৎ করেই অনেক বড় হয়ে গেছে। মেয়েরা কি খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়? অবশ্য এই বয়সে জাহিদ বাবা হয়েছিল। এইটুকু বয়সে বাবা হওয়ার মতো মানসিক পরিপক্বতা ছেলেদের আসে না। কিন্তু তুরিনের জন্য জাহিদকে রাতারাতি একজন দায়িত্বশীল পিতায় পরিণত হতে হয়েছিল। ছোট্ট একটা তুলার বস্তা ছিল তুরিনটা। জীবনের সবচাইতে প্রিয় খেলনার মতো, প্রিয় অভ্যাসের মতো, সারাদিন, সারাক্ষণ ওই পেঁজা তুলোর পুতুলটাকে বুকের সবটা দিয়ে ভালোবাসত জাহিদ। বাসে এখনো। মুখে কথা ফোটার পর থেকে তুরিনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিল বাবা। প্রতিদিনের খুঁটিনাটি ঘটনার বিবরণ বাবার কাছে উজাড় করে দিত সে। অনেক বয়স পর্যন্তও বাবার মুখ থেকে গল্প না শুনে ঘুমাতে পারত না। কিন্তু বয়ঃসন্ধিতে মেয়েদের জীবনে মায়ের প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে পড়ে। শিশু থেকে নারী হয়ে ওঠার দুর্বোধ্য সময়টাতে এমন অনেক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়, যা বাবার সঙ্গে শেয়ার করা যায় না, কিন্তু মাকে অনায়াসে বলা যায়। কৈশোরের বেখাপ্পা দিনগুলোতেই বাবার সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হলো তুরিনের। তারপর নিশা এ বাড়ির বৌ হয়ে আসার পর থেকে সেই দূরত্বের ভিতটা আরো অনেকখানি মজবুত হলো। আজকে মেয়ের শুকনো, শীর্ণ মুখের দিকে তাকিয়ে জাহিদ বুকের গভীরে একটা অব্যক্ত ব্যথা অনুভব করল। জুবিনের জন্মের পর থেকে তুরিনকে আর আগের মতো সময় দেওয়া হয় না। অফিসের কাজ, মোটেল বিজনেস, সাংসারিক অশান্তি…যাপিত জীবনের নানা বাস্তবমুখী ডামাডোলে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে থাকে সর্বক্ষণ। মেয়েকে দেবার মতো সময় কোথায়?
জাহিদ হাত বাড়িয়ে তুরিনকে কাছে টেনে নিল। তুরিন বাবার বুকে মুখ লুকিয়ে আদুরে গলায় বলল, ‘কী ভাবছিলে বাবা? কার কথা ভাবছিলে?’
জাহিদ এই প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর দিল না। একটু সময় চুপ করে থেকে বলল, ‘তুমি কেমন আছ মা?’
— ‘ভালোই!’
লিভিংরুমের কাউচে বসে আছে বাবা-মেয়ে। কাল বাদে পরশু জুবিনের জন্মদিন। নীলিমা শাশুড়ির আদেশ মোতাবেক ঘর সাজাচ্ছে। তাকে সাহায্য করছে আনিতা আর তানিশা। একটু আগে শহীদ ডেকোরেশনের জিনিসপত্র কিনে এনেছে। বেশ উৎসব উৎসব একটা আমেজ এসে গেছে বাড়িতে। লিভিং রুমের দেওয়ালে রিং লাইটস লাগাচ্ছে নীলিমা। আনিতা ব্লুটুথ স্পিকারে গান ছেড়ে দিয়েছে। মা-মেয়ে গানের তালে তালে বেশ প্রফুল্ল চিত্তেই জন্মদিনের সাজসজ্জার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ফারা এসবের মধ্যে নেই। সে বলেছে অনুষ্ঠানের সময় সামাজিক দায়বদ্ধতা রক্ষার্থে না পারতে উপস্থিত থাকবে। যেহেতু আত্মীয়স্বজনরা জুবিনকে ফারার সন্তান হিসেবেই চেনে, তাই অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি একান্ত ভাবে কাম্য। লিভিংরুমের গা-ঘেঁষে সিঁড়িটা ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে দোতলায়। সিঁড়ির মুখের পার্শ্ববর্তী লফটে মিসেস মুর্তজা বসে আছেন জুবিনকে কোলে নিয়ে। রেলিংয়ের ফাঁক দিয়ে নিচতলার লিভিংরুমে বসে থাকা বাবা-মেয়েকে তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করছিলেন তিনি। জাহিদ হঠাৎ করেই প্রশ্নটা করল, ‘অর্ণবকে তোমার কেমন লাগছে?’
তুরিনের মুখে হুড়মুড় করে একগুচ্ছ অস্বস্তি এসে ভিড় করল। আস্তে করে বলল, ‘আই অ্যাম নট ইনটু হিম অ্যাট অল।’
জাহিদ মেয়ের মুখটা একবার দেখার চেষ্টা করল। এমনভাবে বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে রেখেছে যে দেখার উপায় নেই।
—‘মে আই নো হোয়াই?’ জাহিদের কণ্ঠস্বর চিন্তিত শোনাল।
তুরিন আগের চাইতেও নিচু গলায় বলল, ‘নট মাই কাপ অব টি।’
জাহিদ একটু চুপ করে থেকে কণ্ঠে কৌতুকের মৃদু ঝাপটা এনে বলল, ‘তোমার বয়ফ্রেন্ডের নামটা যেন কী?’
তুরিন লজ্জা পায়, ‘আই ডোন্ট হ্যাভ এনি বয়ফ্রেন্ড বাবা! ইউ নো দ্যাট ভেরি ওয়েল।’
জাহিদ মেয়েকে আর একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে। কপালে একটা আলতো চুমু খেয়ে বলে, ‘আই নো মাই বেবি গার্ল বেটার দ্যান এনিবডি এলস…বাট…টেল মি ওয়ান থিং…ডু ইউ কারেন্টলি হ্যাভ এনি ক্রাশ অন সামওয়ান?’
তুরিন একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। অনেকদিন ধরেই ভাবছিল বাবার সঙ্গে কথা বলবে। তার জীবনে সত্যিকারের কোন বন্ধু তো নেই! মাকে সে ভালোবাসে খুব, ভীষণ ভীষণ ভালোবাসে…কিন্তু বড় হওয়ার পর থেকেই তুরিন একটু একটু বোঝে যে, মায়ের মধ্যে ডেপথনেস বলতে কিচ্ছু নেই। ভেতরটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা, জড় পদার্থের মতো অনুভূতিহীন। একজন উঠতি বয়সি তরুণীর হৃদয়বৃত্তান্ত মায়ের মতো শুষ্ক মনের মানুষ কখনো বুঝতে পারবে না বলেই মনে হয়েছে সবসময়। তুরিন বাবার বুকের ওপর একটা হাত রেখে বাধোবাধো অস্পষ্ট স্বরে বলল, ‘একজনকে ভালো লাগে আমার!’
জাহিদ চমকে উঠল, ‘তাই?’
— হুম।’
জাহিদ পুলকিত হয় মনে মনে। সময় কোনদিক দিয়ে যে চোরাস্রোতের মতো কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে! সেদিনের পেঁজাতুলোর পোঁটলা, পুতুল পুতুল তুরিনটারও এখন পছন্দের পুরুষ আছে। ভালোবাসার মানুষ আছে। আশ্চর্য লাগে ভাবতে গেলে!
— ‘নাম কী তার?’
‘বাবা…আই নিড সাম টাইম…এখুনি কিছু বলতে চাইছি না তোমাকে। তবে অর্ণবকে বিয়ে করতে পারব না। তুমি প্লিজ দাদাজানকে বোঝাও।’
— ‘ওয়ান কুইক কোয়েশ্চন…তোমার পছন্দের ছেলেটা কি হোয়াইট?’ – ‘ব্রাউন।’
— ‘কোন ধর্ম?’
— ‘ধর্ম-কর্ম খুব একটা করে বলে তো মনে হয় না।’
— ‘স্টিল…তার ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে তোমার জানতে হবে।’
— ‘বাংলাদেশি অ্যামেরিক্যান।’
— এটা তো গুড নিউজ! তুমি আগে বলোনি কেন?
তুরিন চুপ করে থাকে। বুকের মধ্যে ভয়ের ঢেউ খেলে যায়। উৎকণ্ঠায় কণ্ঠস্বর বুজে আসে। শাহজিদের নাম শোনার পর কি বাবার এই অনুকূল মনোভাব অক্ষুণ্ণ থাকবে? নাকি এই গুড নিউজই নিমেষে ব্যাড নিউজে রূপান্তরিত হবে? জাহিদ বলল, ‘হাও ডাজ হি লুক লাইক? ইজ হি হ্যান্ডসাম?’
তুরিনের মুখটা লজ্জায় একটুখানি হয়ে আসে। আহ্লাদি গলায় বলে, ‘নট অ্যাজ হ্যান্ডসাম অ্যাজ ইউ বাবা!’
জাহিদ মেয়ের কথা শুনে প্রশ্রয় মিশ্রিত হাসি হাসল, ‘তাই?’
— ‘হুম। সে অনেক সুন্দর। কিন্তু তোমার চেয়ে সুন্দর না! ইউ আর দ্য মোস্ট হ্যান্ডসাম ম্যান ইন দ্য হোল ওয়ার্ল্ড!’
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ১২
১২
দরজায় খুট করে একটা শব্দ হতেই চমকে উঠল নিশা। শরীর ভীষণ দুর্বল। সকাল থেকে বলতে গেলে কিছুই খাওয়া হয়নি। চোখের সামনে এখন সর্ষে ফুল নেচে বেড়াচ্ছে। বোধবুদ্ধির স্থিরতা নেই। সারাদিন বালিশে মুখ গুঁজে রেখে বুকের সমস্ত কষ্ট আর কান্নাকে সমাধিস্থ করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। তন্দ্রার মতো আচ্ছন্নতায় কেটেছে প্রহর। দুর্বিষহ অপমান ধারাল দাঁত দিয়ে কামড়ে কামড়ে হৃৎপিণ্ড ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে। কেন এমন একটা অবিবেচক নিষ্ঠুর মানুষকে ভালোবাসতে গেল এই কথা ভেবে ভেবে নিজেকেই নিজে গঞ্জনা দিয়েছে, গালমন্দ করেছে। কিন্তু যতই সে মানুষটাকে ঘৃণা করার দুর্নিবার প্রয়াসে নিজেকে আকণ্ঠ নিযুক্ত করার চেষ্টা করেছে, ততই যেন পাগল পাগল তারছেঁড়া ভালোবাসার অশরীরী আত্মা আরো বেশি করে ভর করেছে মাথায়। জীবনের সমস্ত অপ্রাপ্তি, অনিশ্চয়তা এবং অবহেলাকে ছাপিয়ে শুধু একটিমাত্র অসহ্য ব্যথার তপ্তশেল তার পঁচিশ বছরের যুবতী হৃদয়কে অনবরত দগ্ধ করে চলেছে। সমস্ত কষ্ট, বেদনা, অপমান সহ্য করতে পারত হাসিমুখে, যদি ওই লোকটা একটাবার তাকে বোঝার চেষ্টা করত। বুঝল তো না, বরং চিরজীবনের জন্য নিজের কাছ থেকে বিচ্যুত করতে চাইল। আর সবেচেয়ে কুৎসিত ব্যাপার হচ্ছে, এতকিছুর পরেও নিশার শুধু একটি কথা চিন্তা করেই মরে যেতে ইচ্ছা করছে যে, এই বাড়ি থেকে চলে গেলে সে মানুষটাকে রোজ একটিবারের জন্য দেখতে পাবে না। নিজের এই হীন বেহায়া মনোভাব তাকে নিজের কাছেই অনেক বেশি রকমের তুচ্ছ এবং নগণ্য করে তুলছে। ভীষণ তিতকুটে একটা নিস্তব্ধ অনুভবে গুম হয়ে আছে অন্তঃকরণ। মরতে ইচ্ছা করছে খুব। জুবিন না থাকলে সত্যিই আজকে মরে যেত নিশা। এই বিশ্রী রকমের জীবন তার আর সহ্য হচ্ছে না।
দরজায় শব্দ হতেই ঢুলুঢুলু অস্পষ্ট মস্তিষ্কের মাথাটা নিয়ে উঠে বসেছিল সে। ঘরে কোন আলো নেই। করিডরের আবছা আলোয় দেখতে পেল চৌকাঠে শ্বশুরমশাই দাঁড়িয়ে আছেন। নিশা তড়িঘড়ি করে গায়ের ওড়নাটা ঠিকঠাক করল। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে এসে বাতি জ্বালাল ঘরের। মুর্তজা সাহেব ধীরস্থির গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘আসব?’
— ‘জি বাবা আসুন।’
— ‘কেমন আছ?’
নিশা এলোমেলো চুল হাত দিয়ে ঠিক করে ব্রিবত ভাবে বলল, ‘এইতো…আছি মোটামুটি।’
মুর্তজা সাহেব চেয়ারে বসতে বসতে পুত্রবধূকে গম্ভীর চোখে পরখ করলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘অসুস্থ নাকি?’
— ‘জি…মাথাটা একটু ধরেছে।’
— ‘তোমার শাশুড়ি বললেন, তুমি নাকি আজ সকালে জুবিনকে নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিলে?’
নিশা অপ্রস্তুত বোধ করল। ঘরের মাঝামাঝি জায়গায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মাথাটা নিচু। পরনে সুতির সালওয়ার কামিজ। ওড়নাটা বুকের ওপর চওড়াভাবে ছড়ানো। এলোমেলো চুল ফুলেফেঁপে আছে মুখের চারিধারে। মুর্তজা সাহেব এই মেয়েটিকে অত্যধিক স্নেহ করেন। মেয়েটি শুধু বাহ্যিকভাবেই রূপবতী নয়, এর আত্মার একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। এত মার্জিত, নম্র, সুললিত মেয়ে আজকাল চোখেই পড়ে না। যে অধ্যাবসায়, ধৈর্য এবং সহনশীলতা তিনি নিশার মধ্যে দেখেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়। মেয়েটিকে দেখলে তাই মনের মধ্যে একটা অপূর্ব ভক্তির সঞ্চার হয়। মুর্তজা সাহেব স্নেহসিক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো। বসে কথা বলো। হঠাৎ এমন কী হয়ে গেল যে তুমি জুবিনকে নিয়ে একলা বেরিয়ে যাচ্ছিলে?’
নিশার চোখে কান্নার ঢেউ ঝাপটা মারছিল। নতমুখে বিছানার ওপর বসল সে। কান্নার ঢোক গিলে বলল, ‘বাবা এ বাড়িতে আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব না। তুরিন খুব কষ্ট পাচ্ছে আমার জন্য। শুধু তুরিনই নয়, তুরিনের বাবা-মা কেউ শান্তিতে নেই। এই সমস্ত অশান্তির জন্য শুধু আমিই দায়ী। আপনি আমাকে দ্রুত অন্য কোথাও পাঠাবার ব্যবস্থা করুন। আমার এখানে দম আটকে আসছে।’
মুর্তজা সাহেব ব্যথিত স্বরে বললেন, ‘সে আমি খুব ভালোমতোই বুঝতে পারছি মা। তুমি না বললেও বুঝি। আমি তোমার শাশুড়ির সঙ্গে কথা বলেছি। নেক্সট উইকেন্ডেই তোমাকে নিয়ে তোমার শাশুড়ি মুভ করবে। কলোরাডো স্প্রিংসে শহীদের একটা কনডো আছে। গতমাসে টিন্যান্ট চলে গেছে। খালি পড়ে আছে। তোমরা ওখানে গিয়ে থাকো। তবে এই বিষয়ে তোমার স্বামীর মতামত কী?
নিশার মুখটা আরও বেশি করে লেগে গেল চিবুকের সঙ্গে। অবাধ্য কান্নার জল রুদ্ধ করে তুলল কণ্ঠস্বর। কম্পনরত গলায় সে অনেক কষ্টে বলল, ‘উনি আমাকে চিরতরে মুক্তি দিয়েছেন।’
— ‘দুঃখের কথা আর কী বলব মা? ছেলেটাকে আমি মানুষ করতে পারলাম না…মানুষ হলে তোমার মতো একটা মেয়েকে অগ্রাহ্য করতে পারত না।’
স্বামী সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য নিশা সহ্য করতে পারে না কখনোই। তার মনটা চকিতে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। শ্বশুরমশাইকে সে ভক্তি করে। কখনো মুখের ওপর কথা বলে না। কিন্তু আজকে চুপ করে থাকতে পারল না। রুষ্ট স্বরে বলে উঠল, ‘মানুষ হিসেবে উনি অত্যন্ত উচ্চশ্রেণির। উনাকে আমি দোষ দিই না। উনি তুরিনকে ভালোবাসেন, উনার স্ত্রীকে ভালোবাসেন, যদিও শুনেছি স্ত্রীর সঙ্গে এখন আর সম্পর্ক আগের মতো নেই। সেই বিচ্ছেদের জন্যও নিশ্চয়ই আমিই দায়ী। আসলে বাবা এই সংসারে আমার আগমনটাই সবচেয়ে বড় ভুল ছিল।’
— ‘আমি জানি জাহিদের মতো তুমিও আমাকে মনে মনে এই বিয়ের জন্য দায়ী কর, দোষী কর। কিন্তু মা, তোমাদের বিয়েটার পেছনে আমার একটা গোপন উদ্দেশ্য ছিল। তুমি হয়তো কোন একদিন জানলেও জানতে পারবে। কিন্তু আপাতত একটা বিষয়ে আমি তোমাকে নিশ্চিত করতে চাই যে আমি বেঁচে থাকতে তোমার কোন দুশ্চিন্তা নেই।’
— ‘বাবা একটা বিষয় দেখবেন, উনি যেন জুবিনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে না যায়। আমি যেখানে থাকব, জুবিনও কিন্তু সেখানেই থাকবে।
— ‘আলৎ থাকবে। জুবিনকে তোমার কাছ থেকে নিয়ে যাবে, এত সাহস ওই ব্যাটার আছে নাকি?’
১৪
‘খুব তো বসে বসে আড্ডা দিচ্ছ। বার্থডে গার্লের জামা কাপড় তো কিছুই কেনা হয়নি। সে খবর আছে?’ নীলিমার উচ্চকণ্ঠের হাঁকডাক জাহিদ আর তুরিনের কথোপকথনে বাধ সাধল। মিসেস মুর্তজা লফটের রেলিংয়ের ধারে তখনো জুবিনকে কোলে নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। নীলিমার কথা শুনে নিচতলার লিভিংরুমে বসে থাকা জাহিদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ভালো কথা মনে করিয়েছে বড় বৌমা। জাহিদ, তুই ওর সঙ্গে গিয়ে বাচ্চার জামা কিনে আন।’
নীলিমা বলল, ‘মা আমি যেতে পারব না। অফিসের একগাদা কাজ পড়ে আছে। ঘর সাজানো হয়ে গেলেই আমাকে ল্যাপটপ নিয়ে বসতে হবে।’
আনিতা বলল, ‘আমি যেতে পারি চাচ্চুর সঙ্গে।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল জাহিদ। জুবিনের জন্মদিনের জন্য ঘর সাজানো হচ্ছে। নতুন জামা কেনাকাটার পরিকল্পনা করা হচ্ছে…এই সমস্ত উৎসব যজ্ঞে যে মানুষটার সবচাইতে বেশি প্রাধান্য থাকার কথা ছিল সেই মানুষটাকেই এরা সমস্ত প্রক্রিয়া থেকে কী সচেতনভাবে বঞ্চিত করে চলেছে। কেউ একটিবার নিশার কথা ভাবছে না। ওর নামটাও উচ্চারণ করছে না। যেন নিশার অস্তিত্বই নেই এদের কাছে। কথাগুলো মনে হতেই জাহিদের বুকের ভেতর দহনজ্বালা ফিরে আসে। পাঁজরে আঘাত হানে যন্ত্রণা। নিশা কেন বলেছিল, ঘৃণা করে? ওই সুতীব্র নির্দয় বাক্যবাণটুকু জাহিদকে আর কোনদিন স্বস্তিতে শ্বাস ফেলতে দেবে কি? কথাটা কেন হাজার চেষ্টা করেও ভোলা যাচ্ছে না? আনিতা সামনে দাঁড়িয়ে কী যেন একটা বলল। জাহিদ শুনেও শুনল না। আশ্চর্য ব্যাপার হলো নিশার সঙ্গে আজ দুপুরেই কথা হয়েছে…দেখা হয়েছে…অথচ এখন এই সন্ধ্যাবেলায় মনে হচ্ছে যেন কতকাল দেখে না! নিশাকে একটুখানি দেখতে পাবার অবাধ্য তৃষ্ণার নির্মম অত্যাচারে বুকের ভেতরটায় জ্বরের মতো একটা ঘোর লেগে গেছে। দোতলার ওই ছোট্ট ঘরে একলা বসে থেকে নিশা এখন কার কথা ভাবছে কে জানে! শাহজিদের কথা? শাহজিদকে কি ও সত্যিই ভালোবাসে? শাহজিদও কি ওকে ভালোবাসে? নিশ্চয়ই বাসে…নিশার মতো মেয়েকে ভালো না বেসে কি থাকা যায়?
— ‘চাচ্চু!’ ধমকের সুরে ডাক দেয় আনিতা।
— ‘হুম?’ ঘোর ভাঙে জাহিদের।
— ‘যাবে এখন?’
জাহিদ একটু অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘কোথায় যাওয়া যায় বলো তো?’
— ‘চেরিত্রিক যাবে?’
— ‘আমি তো শপিং-টপিং ভালো বুঝি না…’
আনিতা অভয় দিল, ‘আমি আছি না? আমি অনেক ভালো বুঝি। চলো তুমি। আমি ড্রাইভ করব কিন্তু!’
নীলিমা চিৎকার করে উঠল, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রাস্তায় প্রচণ্ড ট্রাফিক। এখন তুমি ড্রাইভ করতে পারবে না।’ আনিতা মায়ের কথা পাত্তা না দিয়ে জাহিদকে বলল, ‘পাঁচ মিনিট সময় দাও। এখুনি আসছি রেডি হয়ে।’
আনিতার পেছন পেছন তুরিনও উঠে পড়ল। তার এখনো হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। নইলে বাবার সঙ্গে শপিংমলে সে নিজেও যেত। তুরিন উঠে পড়তেই নীলিমা এগিয়ে এলো কয়েক পা। অনেকটা চাপা স্বরে বলল, ‘কী ভাই? এমন দেবদাস লুক নিয়ে বসে আছ কেন? বিরহ চলছে? বিরহে থাকলে দেখছি লোকে সুন্দর হয়ে যায়। এই তথ্য জানা ছিল না!’
জাহিদ বিদ্রুপের হাসি হাসল, ‘বিরহ জিনিসটা কী? ওটা খেতে হয় নাকি মাথায় দিতে হয়?’
নীলিমা পিঠময় ছড়ানো চুলগুলো দু হাত দিয়ে খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে দেবরের পাশে এসে বসল। সকৌতুকে বলল, ‘সে তো তুমিই ভালো জানবে! জাহিদ হঠাৎ অন্য গলায় বলল, ‘ভাবি শোন!
— ‘বলো শুনছি।’
জাহিদ আমতা আমতা করল, ‘নিশাকে একবার জিজ্ঞাসা করবে সে আমাদের সঙ্গে জুবিনের বার্থডের শপিং করতে যাবে কি না?’
নীলিমার চোখে ফুটে ওঠা বিস্ময় রেখাটা জাহিদকে লজ্জা দিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে চোখ নামিয়ে সে বলল, ‘না মানে…ভাবছিলাম যে…আফটার অল সে জুবিনের মা…’
নীলিমা বুদ্ধিমতী নারী। বিস্ময়টুকু চট করে লুকিয়ে ফেলতে পারল। স্বাভাবিকভাবে বলল, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই…তুমি বসো। আমি ওর সঙ্গে কথা বলে আসি।’
নীলিমা চলে যাওয়ার পর কেন যেন ভীষণ অস্থিরতা কাজ করতে লাগল জাহিদের ভেতর। এক মুহূর্তের জন্য সুস্থির হয়ে বসতে পারল না। বড় বড় শ্বাস টেনে আভ্যন্তরীণ উত্তেজনা দমনের চেষ্টা করল। চিন্তাশক্তি অন্যদিকে ধাবিত করতে চাইল। তুরিনের জন্য একজন সাইকিয়াট্রিস্ট ঠিক করতে হবে খুব দ্রুত। বাবার সঙ্গে কথা বলতে হবে অর্ণবের ব্যাপারে। আর এক পাও যেন অগ্রসর না হয়। মেয়ের মতের বিরুদ্ধে কিছুতেই এই বিয়ে হতে দেবে না জাহিদ। আগামী মাসে ক্যালিফোর্নিয়ায় হোটেলের নতুন একটা ব্রাঞ্চ ওপেন হবে। এই ওপেনিং নিয়ে বিস্তর কাজকর্ম পড়ে আছে। প্রাত্যহিক জীবনের আরো অনেক জরুরি কথা, যা নিয়ে চিন্তা করা, দুশ্চিন্তা করা বড়ই আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই সব টুকরো টুকরো চিন্তাকে মনের মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে বের করে আনতে চাইছিল জাহিদ। কিন্তু লাভ কিছুই হলো না। সমস্ত দুর্ভাবনা, বিক্ষোভ আর অশান্তি দূরে ঠেলে দিয়ে একটা মাত্র নাম ওর মানসপটের দুর্বল মাটিতে অনেক বেশি উর্বর আর প্রকাশ্য হয়ে ভেসে উঠতে লাগল বারেবারে। অন্যমনস্ক, বিক্ষিপ্ত মনের জাহিদ…নিশার কথা…শুধু নিশার কথাই ভেবে গেল অনবরত। নিশা.. নিশা…নিশা! ভারি ছোট্ট, সুন্দর, মিষ্টি একটা নাম! ডাকতে কী ভীষণ ভালো লাগে! বার বার ডাকতে ইচ্ছে করে!
— ‘তোমার বৌয়ের মাথা ব্যথা। জ্বরও আছে হালকা। কোথাও যাবে না বলল! আমি বলেছিলাম কথাটা যেন সে সরাসরি তোমাকে এসে বলে। কিন্তু সে বলল, তোমার সঙ্গে কথা বলবে না।’
নীলিমার কথাটা হিমঘরের মৃত্যুগন্ধি শীতল বাতাসের মতো ছুঁয়ে দিল জাহিদের শরীর। বুকের কোণে জ্বলতে থাকা সবকটা বাতি নিভে গেল একে একে। খারাপ…ভীষণ খারাপ হয়ে গেল মনটা! নিশা কি সত্যিই অসুস্থ? নাকি নেহাত জাহিদের সঙ্গ এড়িয়ে যাওয়ার জন্য অসুস্থ হওয়ার ভান করছে?
নীলিমা ওর পাণ্ডুবর্ণ মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আনিতা থাকুক। চলো আমিই যাচ্ছি। কথা আছে তোমার সঙ্গে।’
সংসার মানে ব্যর্থ বাসনা, বেদনার জলাভূমি
সংসার মানে সংসার ভাঙা, সংসার মানে তুমি
—নির্মলেন্দু গুণ
.
বিরক্তি, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠায় মেজাজটা একদম খিঁচড়ে যাচ্ছিল ফারার। অনিমেষের অ্যাপার্টমেন্টে এসেছে প্রায় আধাঘণ্টা হয়ে গেল। সেই বান্দা লাপাত্তা। ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় অনিমেষ হাজির হলো। কাউচে বসে থাকা ফারার ক্রোধান্বিত মুখখানার দিকে চেয়ে একটা ভাবলেশহীন হাসি দিল সে। ফারা খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজটাকে কোনভাবেই বশে আনতে পারল না। চিৎকার করে উঠতে যাচ্ছিল। তার আগেই ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল অনিমেষ। অনেকটা জন্তুর মতো। ফারা দমবন্ধ গলায় বলল, ‘সরো অনি…এখন ভালো লাগছে না। সরে যাও প্লিজ।’ অনিমেষ বড্ড জেদি পুরুষ। কারো আদেশ মেনে চলার ধাত নেই। ফারার কথা ওর কানেই ঢুকল না। এই একগুঁয়ে, দুরন্ত, বুনো স্বভাবটাই অল্পবয়সে ফারার মন কেড়েছিল। এমন নির্ভীক, ছন্নছাড়া জীবনযাপন ওকে এক রহস্যময় দুঃসাহসিক অভিযানের আনন্দ দিত। একদিকে অনিমেষের স্পর্ধিত ডানপিটে পৌরুষ, অন্যদিকে জাহিদের শান্ত, আরামদায়ক, পরিচ্ছন্ন আশ্রয় ফারার প্রথম যৌবনের দিনগুলোকে রোমহর্ষক এক রোমাঞ্চকর সুখে কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলেছিল। এই দুজন বিপরীতমুখী পুরুষের কাউকেই সে সবটা দিয়ে ভালোবাসতে পারেনি, তবে এরা দুজনেই তার রোজকার আকাঙ্ক্ষা এবং কামনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। অনিমেষকে ছাড়া সুখ হয় না, আবার জাহিদকে ছাড়াও যে মনের ভেতর স্বস্তি আসে না! ওরা যেন একে অন্যের পরিপূরক!
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষের একগুঁয়েমি যেন সীমা ছাড়াচ্ছে। ফারা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে অনিমেষের লম্বা চওড়া সুঠাম দেহটা নিজের ওপর থেকে সরানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল। পারল না। অনিমেষ ফারার শীতলতা টের পেয়ে বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘হোয়াটস রং?’
— ‘সরো।’
— ‘কেন?’
— ‘এখন মুড নাই।’
অনিমেষ উঠে বসল। রুষ্ট স্বরে বলল, ‘মুড অফ কেন?’
ফারা পরনের জামার খুলে যাওয়া বোতাম লাগাতে লাগাতে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘বাড়িতে কী চলছে তুমি জানো? কোন আইডিয়া আছে আমি কীসের মধ্যে আছি?’
অনিমেষ তার লম্বাটে চাঁছাছোলা ধারাল মুখটা আরো বেশি রকম তীক্ষ্ণ করে তুলে বলল, ‘আছ কেন ওই বাড়িতে? আমি তো সেই কবে থেকেই বলছি তুরিনকে নিয়ে আমার এখানে চলে আসো।’
ফারার চোখ থেকে আগুন ঠিকরে বের হয়। ক্যাটক্যাট করে বলে, ‘এই কথাটা আজ থেকে বিশ বছর আগে কেন বললে না? কেন আমাকে তোমার বাচ্চা পেটে নিয়ে জাহিদকে বিয়ে করতে হলো? লজ্জা করে না তোমার?’
‘আমি তো বিয়ে করতেই চেয়েছিলাম। তোমার বাবা-মা রাজি হয়নি। তা ছাড়া তুমিও তো আমার জন্য বাবা-মাকে ছাড়তে চাওনি।’
— ‘তুমি মুসলিম হলেই তো আর ঝামেলা ছিল না।’
— আমি ধর্মে বিশ্বাস করি না। শুধু তোমাকে পাবার জন্য নামমাত্র মুসলিম হওয়ার মতো ভণ্ডামি আমার দ্বারা সম্ভব হয়নি। এটাই আমার দোষ?
ফারা রাগে গজগজ করতে করতে বলল, ‘জাহিদের মতো একটা সহজ সরল ভালো মানুষকে ঠকাতে হয়েছে শুধু তোমার জন্য!’
অনিমেষ রুক্ষ ডাকাবুকো হাসি হাসতে হাসতে বলল, ‘আমি যতই খারাপ হই না কেন ফারা, এই আমি ছাড়া তোমার আর কোন গতি নেই এখন। জাহিদ তোমাকে আর কোনদিন নিজের জীবনে ফিরিয়ে নেবে না।’
শেষের কথাটা যেন বারুদ ঘষে দিল ফারার বুকে। গর্জে উঠে বলল, ‘ফিরিয়ে নেয়ার কথা আসছে কেন? ওটা আমার বাড়ি…আমার সংসার…! জাহিদ আমার হাজবেন্ড!’
— ‘কিন্তু আমি তোমার মেয়ের বাবা। এটা ভুলে যেও না।’
— ‘বাবা হিসেবে কোন দায়িত্বটা পালন করেছ তুমি? মেয়ের গ্র্যাজুয়েশনের খরচটাও তো জাহিদকেই বহন করতে হচ্ছে!’
— ‘কোন দায়িত্বটা পালন করতে দিয়েছ তুমি শুনি? আমি তো তুরিনের স্টাডি কস্ট বেয়ার করতে চেয়েছি। তুমিই দাওনি!’
— ‘তুমি স্টুডেন্ট লোন নেয়ার কথা বলেছিলে।’
অনিমেষের গলার স্বর চড়ে যায়, ‘আর দশটা আমেরিকান ছেলেমেয়ে যা করে তাই করতে হবে তোমার মেয়েকেও। এই দেশে উইদাউট লোন হায়ারস্টাডি করা চাট্টিখানি কথা না। আমি জাহিদের মতো বাপের হোটেলে থাকি না। আমার সেভিংসের একটা লিমিট আছে।’
ফারা এই পর্যায়ে কিছু না বলে চুপ করে যায়। ক্রোধ জড়িত ফোঁস ফোঁস শ্বাস পড়তে থাকে। অনিমেষ হাজার চেষ্টা করলেও কখনো আদর্শ বাবা হতে পারত না, এই সত্যটা আর কেউ না জানলেও ফারা হাড়েহাড়ে জানে। তার মেয়েটা জাহিদের মতো একজন পরিপূর্ণ বাবা পেয়েছে বলে মনে মনে তৃপ্ত বোধ করেছে সর্বদা। জীবনে ওই একটুখানি শান্তিই তো ছিল ফারার। মেয়েটাকে একটা সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য হিসেবে বড় করতে পারছে। অনিমেষের উচ্ছন্ন, ভ্রষ্টচারী জীবন ওদের মা-মেয়েকে সেই সম্মান এবং নিরাপত্তা কখনোই দিতে পারত না, যা জাহিদের পরিবার দিয়েছে। সেই উচ্ছিষ্ট সম্মান এবং শান্তিটুকু শ্বশুর-শাশুড়ি ছিনিয়ে নিয়েছে নিশাকে ঘরের বৌ করে এনে। এই অসভ্য মেয়েটাকে হাজার চেষ্টা করেও নিজের জীবন থেকে বিতড়িত করা গেল না। কোন পরিকল্পনাই সফল হচ্ছে না। এর মাঝে অনিমেষের ওই বাড়িতে ঘন ঘন যাওয়াটা যে কতটা বিপজ্জনক তা বোঝাবে কী করে ফারা! বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তোমাকে একটা জরুরি কথা সামনাসামনি বলব বলে এসেছিলাম। খবরদার ওই বাড়িতে আর যাবে না। আমি যেন তোমার এই মুখ ওখানে আর না দেখি।’
অনিমেষ কাষ্ঠহাসি হেসে বলল, ফারা শোন, ‘তুমি তো খুব ভালো মতোই জানো আমি যা চাই তা যেকোন মূল্যে নিজের করে নিই। আমি ঠিক করেছি তোমাকে বিয়ে করব। তুমি জাহিদকে ডিভোর্স দিয়ে আমার কাছে চলে এসো। মেয়েটাকেও নিয়ে এসো সঙ্গে করে।’
ফারা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে বিয়ে করব না! যখন করতে চেয়েছিলাম তখন তুমি আমাকে আর আমার মেয়েকে দূর দূর করে অন্যের সংসারে ঠেলে দিয়েছিলে।’
অনিমেষ হঠাৎ খুব তীব্রভাবে প্রশ্ন করল, ‘তুমি আসলে কাকে ভালোবাসো ফারা? আমাকে? নাকি জাহিদকে?’
ফারা প্রশ্নটা শুনে একটু স্তম্ভিত হয়ে পড়ল সেকেন্ডের জন্য। পরমুহূর্তেই সামলে নিয়ে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা দিল, ‘আমি শুধু আমার মেয়েকেই ভালোবাসি!’ কথাটা বলে নিয়েই ত্বরিতপদে বেরিয়ে এলো ফ্ল্যাট থেকে। গাড়ি চালাতে চালাতে সারাটা পথজুড়ে সে একটি কথাই শুধু ভাবল…ভাবল এই ভাঙাচোরা জীবনটাকে আবার কীভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে জোড়াতালি দিয়ে একটু চলনসই করে তোলা যায়। ভাবতে ভাবতে অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে একটি চূড়ান্ত উপলব্ধিতে এসে স্থির হলো মন। জাহিদকে ছাড়া তার কিছুতেই চলবে না। অনিমেষ তার জন্য অন্যতম এক দুঃসাহসিক অভিযান হতে পারে কিন্তু জাহিদ হলো জীবন নামক উত্তাল ঝড়ের মধ্যে একটিমাত্র শান্ত নিবিড় আশ্রয়ের নাম। এই আশ্রয় হারানো যাবে না!
১৫
তুরিনের বেডরুমের দরজাটায় আলতোভাবে হাত রাখতেই খুলে গেল। এই দেশের বেশির ভাগ বাড়ির শোবার ঘরের দরজায় তালা-চাবির ব্যবস্থা থাকে না। ঘরের ভেতর আলো জ্বলছে। বিছানায় পাশ ফিরে শুয়ে আছে তুরিন। ঘুমাচ্ছে খুব সম্ভবত। ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ ভেসে আসছে। হঠাৎ একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল আনিতার। তুরিনের চেক চেক পাজামা সেট একটু অবিন্যস্ত হয়ে আছে। সেই অবিন্যস্ত কাপড়ের ফাঁকে ওর ফরসা কোমরের ক্ষুদ্র অংশ দৃশ্যমান হয়ে আছে স্পষ্টভাবে। ওখানে কালো অক্ষরে কিছু একটা লেখা। তুরিন কি ট্যাটু করিয়েছে? কই কখনো কিছু বলেনি তো এ ব্যাপারে! আনিতা পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। আলতো হাতে কাপড়টা আরো একটুখানি সরিয়ে নিল। চমকিত বক্ষ নিয়ে আবিষ্কার করল ওখানে ইংরেজিতে টানাটানা অক্ষরে লেখা ‘SHAHZID’।
চমকটা লুকাতে পারল না। হাতের দশটা আঙুল অনায়াসে চেপে বসল নিজের মুখের ওপর। ভেতর থেকে অতর্কিতে বেরিয়ে এলো এক বিস্ময়সূচক সুতীব্র আর্তনাদ। তুরিনের ঘুম গেল ছুটে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে ঘুমঘুম চোখদুটি ডাগর করে তুলে বলল, ‘কী ব্যাপার?’
আনিতা তখনো হাঁ হয়ে আছে। অনেক কষ্টে আমতা আমতা করে সে বলল, ‘তোমার গায়ে শাহজিদের নাম লেখা কেন?’
তুরিনের মুখটা মুহূর্তে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে উঠল। ভয় এবং অনিশ্চয়তায় কেঁপে উঠল বুক।
— ‘তুমি কী করে জানলে?
— ‘আই স ইট উইদ মাই ওন টু আইজ!’
তুরিন পরনের জামাটা টেনেটুনে ঠিকঠাক করতে করতে বিব্রত ভাবে বলল, ‘ফরগেট ইট!’
— ‘মানে কী? তুরিন ডু ইউ হ্যাভ এনি ফাকিং আইডিয়া হোয়াট ইউ হ্যাভ ডান টু ইয়োরসেলফ?’
তুরিন মুখে জোরপূর্বক একটা নির্বিকারত্ব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে, ‘নো বিগ ডিল!’
আনিতার চোখ দুটো বিস্ময়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো, ‘রিয়েলি? ইটস নো বিগ ডিল? তোমার দুদিন পর অর্ণবের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে আর তুমি তোমার গায়ে শাহজিদের নাম খোদাই করে রেখেছ ফরএভার! তুমি জানো ট্যাটু রিমুভ করা কতটা ঝামেলার কাজ?’
তুরিন শ্রাগ করে, ‘রিমুভ করব কেন?’
— ‘রিমুভ না করলে অর্ণব এটা দেখে কী ভাববে? তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?’
— ‘অর্ণবকে আমি বিয়ে করব না।’
আনিতা ঝগড়াটে গলায় বলল, ‘তাই? তাহলে কাকে বিয়ে করবে শুনি? শাহজিদকে?’
তুরিন মৃদু হেসে বলল, ‘হুম!’
আনিতার কণ্ঠে ঝংকার দিল উপহাস, ‘শাহজিদ তোমাকে বিয়ে করবে? সে বলেছে এই কথা?
তুরিন আনিতার দিকে একটু কেমন অন্যমনস্কভাবে তাকায়। যেন আশাপাশের কিছুই সে দেখছে না। তার দৃষ্টি যেন ঠেকে গেছে বহুদূরের আবছা কোন অলীক জগতে।
— ‘ইউ নো হোয়াট আনিতা? উই কিসড!’
আনিতা ভীষণ অবাক হয়, ‘মানে?’
তুরিনের ঠোঁটে মিটমিট করে সুখী সুখী একটা প্রচ্ছন্ন হাসি। তাড়িয়ে তাড়িয়ে বলে, “হি কিসড মি…সাডেনলি…আউট অফ নো হোয়্যার!’
— ‘ওয়াও! সিরিয়াসলি?’
— ‘হুম…।’
আনিতা তুরিনের পাশে বসে পড়ে। কৌতূহল ফেটে পড়ে কণ্ঠ থেকে, ‘সত্যি? তারপর?…তারপর কী হলো?’
— ‘দেন আই কিসড হিম ব্যাক!’
‘হলি মলি!’ শব্দদুটো উচ্চারণ করে বিস্ময়ে বুঁদ হয়ে থাকে আনিতা কিছুক্ষণ। তারপর হঠাৎ ব্যথিত স্বরে বলে, ‘কিন্তু অর্ণব বেচারাকে তুমি এভাবে ঠকালে। এটা ঠিক হলো না।’
— ‘এত দরদ হলে তুমিই ওকে বিয়ে করে ফ্যালো না!’ বাঁকা কণ্ঠে বলে তুরিন।
আনিতার চোখে ক্রোধ ঝিলিক দেয়, ‘স্ট্রেঞ্জ! আমি কেন বিয়ে করব? সবসময় তোমার রিজেক্ট করা জিনিসগুলো আমার ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অভ্যাসটা ছেড়ে দাও তুরিন! ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি তোমার রিজেক্ট করা অথবা ইউজ করা খেলনা আমাকে দেওয়া হচ্ছে। ওহ তুরিনের পছন্দ হয়নি? তাহলে আনিতাকে দিয়ে দাও! অ্যাজ ইফ, আমার নিজস্ব কোন পছন্দ থাকতে পারে না!’
‘আমার খেলনা তোমাকে দেওয়া হয়েছে কারণ তুমি আমার ছোট বোন। কষ্ট লাগলে সেসব জিনিস ট্র্যাশ করলেই তো পারতে। এখন শান্ত হও। এত সিরিয়াস হওয়ার কিছু নাই। অর্ণবকে তোমার বিয়ে করতে হবে না। খুশি?’
— ‘শাহজিদ জানে তোমার ট্যাটুর ব্যাপারে?’
তুরিন হাসে, ‘নাহ…বাসররাতে সারপ্রাইজ দেব। কেমন হবে বলো তো ব্যাপারটা?’
‘আই থিংক শাহজিদের সঙ্গে তোমার খোলামেলা কথা বলা দরকার।’ তুরিন একটা শ্বাস ফেলল, ‘কাল সকালেই ওর সঙ্গে কথা বলব ভাবছি।’
১৬
আই টোয়েন্টি ফাইভের রাস্তায় উঠতেই চারপাশটা দূর-দূরান্ত অবধি প্রসারিত হয়ে গেল। কোথাও কোন বাড়িঘর নেই। গাছগাছালির ঘন সন্নিবেশ নেই। দুপাশে বিস্তৃত সমতল ভূমি। দূরের দিগন্তজুড়ে জেগে আছে আলো ঝলমলে রাজধানী ডেনভার। হাইওয়ে থেকে দেখা যায় চোখধাঁধানো সেই শহুরে ঝিকিমিকি। মনে হয় যেন আকাশের তারারা সব ভূখণ্ডে অবতরণ করেছে।
— ‘নিশাকে খুব আপসেট লাগছিল। কোন ঝামেলা হয়েছে নাকি? স্টিয়ারিংয়ে এক হাত রেখে অপর হাত উঁচিয়ে স্টারবাক্সের কফির কাপে চুমুক দিল নীলিমা।
— ‘তোমাকে কিছু বলেছে ও?’
— ‘বিশেষ কিছু বলেনি তবে চেহারা দেখে মনে হলো সারাদিন কান্নাকাটি করেছে।’
কথাটা শুনে জাহিদের বুকটা কেন যে এমনভাবে মুচড়ে উঠল! চমক ঠাসা ব্যথিত স্বরে বলল, ‘তাই?’
— ‘হুম…সেরকমই তো মনে হলো।’
ভারাক্রান্ত যন্ত্রণাবিদ্ধ মনটা নিয়ে জাহিদ আর কোন কথা বলতে পারল না। চুপ করে রইল।
— ‘তুমি কি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছ?’
‘কী বিষয়ে?’
‘ফারা কিংবা নিশা এদের দুজনের মধ্যে একজনকে তো বেছে নিতে হবে!’
জাহিদ দুদিকে মাথা নাড়ে সজোরে, ‘আমি কাউকেই চাই না। আমি চাই শুধু আর মেয়ে দুটো যেন সত্যিকারের মানুষ হয়ে উঠতে পারে।’
— ‘শুধু সন্তানের কথা ভাবলে তো চলবে না ভাই! নিজের কথাও ভাবতে হবে।’
— ‘নিজের কথা আর ভাবি না।’
— ‘ভাবো…আমি তোমাকে অনুরোধ করছি অ্যাটলিস্ট ওয়ান্স ইন ইয়োর লাইফটাইম, নিজের কথা ভাবো।’
জাহিদ কিছু বলল না। অন্ধকারে জেগে থাকা দূরের ঝিকিমিকি বিস্তৃত শহরের দিকে চেয়ে রইল নির্বাক।
— ‘তুমি কি নিশাকে ভালোবাসো?’
হঠাৎ ছুটে আসা প্রশ্নটা জাহিদের শিরদাঁড়ায় বিদ্যুতের মতো মৃদু ঝংকার তুলে দিয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিল সে। কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হয়ে বলল, ‘নিশা আমার চেয়ে বয়সে কত ছোট! ভেবে দেখেছ একবার?’
— ‘তাতে কী? বয়সে ছোট মেয়ের সঙ্গে ফিজিক্যালি ইনভলভ হওয়া যাবে কিন্তু মেন্টালি নয় এটা কোন শাস্ত্রে লেখা আছে?’
— ‘ফিজিক্যাল ব্যাপারটা আনইনটেনশনাল ছিল। দিস শুডন’ট হ্যাভ হ্যাপেনড।’
— ‘যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। পাস্ট নিয়ে চিন্তা করে তো লাভ নেই। ফিউচার নিয়ে ভাবতে হবে।’
— ‘আমি চাই না আমার জন্য নিশার লাইফটা নষ্ট হয়ে যাক। ওর সামনে অনেকটা সময় পড়ে আছে। আমি চাই বাকি জীবনটা সে নিজের খেয়ালখুশি মতো কাটাক। আমার মতো মধ্যবয়স্ক লোকের সংসারে পড়ে না থেকে ওর উচিত সমবয়সি কাউকে খুঁজে নেয়া।’
নীলিমা ঠাট্টার সুরে বলল, ‘তুমি মধ্যবয়স্ক নাকি? দেখে তো পুরোদস্তুর যুবক মনে হয় এখনো!’ জাহিদ প্রত্যুত্তর করল না। নীলিমা পূর্বের ঠাট্টার সুরটা গলায় ধরে রেখেই বলল,
— ‘আমার মনে হয় তুমি নিশাকে ভালোবাসো! মুখ ফুটে শুধু বলতে পারছ না!’
জাহিদের কানদুটো ঝাঁঝাঁ করে ওঠে। অস্বস্তি চিড়বিড় করে মনে। অপ্রস্তুত গলায় বলে, ‘ভালোবাসা-টাসা…আর হবে না…প্রশ্নই আসে না! তবে হ্যাঁ…আমি ওর ভালো চাই। আমি চাই না আমার ফ্যামিলির জন্য সে বিন্দুমাত্র সাফার করুক।’
— ‘খোঁজ নিয়ে দ্যাখো নিশা নির্ঘাত তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।’
— ‘তুমি কিছুই জানো না ভাবি! ইউ আর সো নাইভ! নিশার মতো একটা মেয়ে আমাকে কেন পছন্দ করবে?’
— ‘আমার মনে হয় তোমার ধারণা ভুল।’
জাহিদ একটু ম্লান হাসল, ‘সে নিজের মুখে বলেছে।’
— ‘কী বলেছে?’
জাহিদ দীর্ঘশ্বাস গোপন করল, ‘বলেছে সে আমাকে ঘৃণা করে।’
নীলিমা ড্রাইভ করতে করতেই ঘাড় ঘুরিয়ে আশ্চর্য চোখে তাকাল জাহিদের দিকে। বলল না কিছু। চুপ মেরে গেল হঠাৎ। কয়েক মিনিট টানা নীরবতা পালন করার পর গম্ভীরভাবে বলল,
— ‘এনি ওয়ে। আজকের আলোচনার বটম লাইন হচ্ছে তোমাকে ফারা, নিশার মধ্যে যেকোনো একজনকে বেছে নিতে হবে। দুই-দুইটা বৌ নিয়ে লাইফটা মেস বানানোর কোন মানে হয় না।’
জাহিদ নিশ্চুপ। নীলিমা জানে না ফারা এবং নিশা এরা কেউই প্রকৃতভাবে জাহিদের নিজস্ব নারী নয়। ফারার যেমন অনিমেষ আছে, ঠিক তেমনি নিশারও আছে শাহজিদ। কী মর্মান্তিক অথচ হাস্যকর একটা ব্যাপার! নীলিমার মুখনিঃসৃত প্রশ্নটা তবুও ওর মনের সঙ্গে খচখচে বিরক্তিকর আংটার মতো লেগে রইল অনেকক্ষণ ধরে। বিয়ের প্রথম রাত থেকেই নিশাকে ভালো না বাসার যে প্রতিজ্ঞা শিকড়ের মতো মনের জমিনে শক্ত করে গেঁথে নিয়েছিল, সেই শিকড়টা উপড়ে ফেলার আয়োজন কি তবে শুরু হয়ে গেছে?
ভালোবাসা বলে কিছু নেই এই পৃথিবীতে। পোড় খাওয়া, ভগ্নহৃদয় জাহিদ জীবনে আর কোনদিন হয়তো ভালোবাসার ওপরে সত্যিকারের আস্থা স্থাপন করতে পারবে না, কিন্তু কিছু একটা তো বিশেষত্ব আছে নিশার মধ্যে! নইলে সারাক্ষণ কেন ওকে মনে পড়ে? ভাবতে ভাবতেই ভাবনার গাড়িতে আচমকা ব্রেক কষে জাহিদ। মেয়েটার বয়স কত্ত কম! তুরিনের চেয়ে খুব বেশি হলে পাঁচ কি ছয় বছরের বড় হবে। তার মতো কাপুরুষের কবলে পড়ে অল্পবয়সি এক যুবতী মেয়ের সম্ভাবনাময় জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
দায়িত্ববোধ, নৈতিকতা এবং আবেগের বাড়াবাড়ি রকমের বিশৃঙ্খল দৌরাত্ম্যে জাহিদের মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরাগুলো ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো। নীলিমা ঠিকই বলেছে এবার হয়তো সত্যিই নিজেকে নিয়ে একটু ভাবা উচিত অনেকদিন হয়ে গেল মাঠে নেমে খেলা হয় না, অবসরে খোলা আকাশের নিচে বসে একখানা ভালো বই পড়া হয় না। ভ্যাকেশনেও যাওয়া হয় না! অদ্ভুত এক ভালো না লাগার রোগ হয়েছে তার। কিছুই আর ভালো লাগে না ছাই!
১৭
জুবিনের গায়ে হালকা একটু লালচে র্যাশ দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা খাওয়া দাওয়াও করছে না ঠিকমতো। মুর্তজা সাহেব ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বললেন। কোন নির্দিষ্ট খাবার থেকে অ্যালার্জি হয়েছে বলে ধারণা করছেন ডাক্তার। বললেন খাবারের তালিকায় পরিবর্তন আনতে হবে। একটুখানি একটা মানুষ, খায়ই না কিছু বলতে গেলে, তার খাদ্যতালিকায় কী করে পরিবর্তন আনা যায় নিশা তার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝল না। ইংরেজিটা ঠিকঠাক বলতে পারে না বিধায় মেয়ের ডাক্তারের সঙ্গে মা হয়েও সরাসরি কোন ডিসকাশনে যেতে পারে না। এ দেশে থাকতে হলে ইংরেজি বলা শিখতে হবে। নইলে জুবিনকে নিয়ে একা একা টিকে থাকাটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে উঠবে দিনকে দিন। কিন্তু কীভাবে শুরু করবে, কী করে নিজেকে এই সমাজের উপযোগী করে তুলবে তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে না সে। খুব অসহায় লাগে। তবে মনে মনে আজকাল একটা জিদ টের পায় নিশা। কে যেন ভেতর থেকে বজ্রকণ্ঠে হুমকি দেয় ক্ষণে ক্ষণে, তোমাকে আত্মনির্ভরশীল হতেই হবে! সেই জিদ থেকেই আজ সন্ধ্যার পর টানা বেশ কিছুক্ষণ অনলাইনে ইংরেজি শেখার বিভিন্ন কোর্সগুলো এক্সপ্লোর করল। ইউটিউবে স্পোকেন ইংলিশের ভিডিওগুলো দেখল। মোবাইল হাতে নিয়েই জুবিনকে ব্রেস্টফিড করাল, ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করল। তারপর এক সময় বাচ্চা ট্যাট্যা করে কেঁদে উঠতেই লক্ষ করল ওই ছোট্ট বাহুদ্বয়ের একটু একটু কুঁচকে থাকা ফরসা চামড়া লালচে ছোপে ভরে গেছে। দেখামাত্র বুকটা কেমন কেঁপে উঠল ভয়ে। মেয়েকে কোলে নিয়ে দ্রুতপদে শ্বশুরের ঘরে এলো সে। মাথাটা ভীষণ ঘুরাচ্ছে। হাঁটুতে ঠকঠকে কাঁপন। এবার কিছু না খেলেই নয়। শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে জুবিনকে রেখে ডাইনিংয়ে এলো। একটা প্লেটে অল্প একটু ভাত আর সবজি নিয়ে কিচেন কাউন্টারের টুলে বসল। এদিকটায় কেউ নেই এখন। নিশা চুপচাপ খাবার খেয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা শব্দ হতেই পেছন ফিরে তাকাল। ফারা এসেছে বাইরে থেকে। ও আসতেই পারফিউমের ঘ্রাণে ভরে গেল চারপাশ। পরনে নীল ব্লাউজ, ব্ল্যাক জিন্স। হাঁটু পর্যন্ত উঠে এসেছে হাই হিল বুট জুতো। পিঠের ওপর সিল্কি চুল ছড়িয়ে, হাইহিল জুতোয় টিকটিক আওয়াজ তুলে, ফারা যখন কোমরে ভারী সুন্দর একটা ছন্দের ঝংকার নিয়ে সামনে দিয়ে হেঁটে যায়, তখন মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। নিশার চোখেও হালকা একটু মুগ্ধতার রেশ পড়ল। ঈর্ষা নামক ঘাতক অনুভূতিকে মনের মাঝে কখনো স্থান দেয়নি সে, কিন্তু আজকে নিজের এই জীর্ণ-শীর্ণ দৈন্য অবয়বের সামনে ফারার জাঁকজমক চোখধাঁধানো উপস্থিতি তার মনের চরাচরকে হীনম্মন্যতার ম্লান অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়ে গেল ক্ষণিকের জন্য। এই বয়সেও ফারা কত সুন্দর! কত আধুনিক! কত স্মার্ট! এমন বৌ ফেলে জাহিদ কেনই বা নিশার মতো সাধারণ, অনাধুনিক, সেকেলে একটা মেয়েকে পছন্দ করবে? ফারা পারফিউমের ঘ্রাণ উড়িয়ে কিচেন কাউন্টার পার হলো। ফ্রিজ থেকে পানির বোতল বের করতে করতে একবার রুক্ষ চোখে দেখল নিশাকে। তারপর কপট স্বগতোক্তির সুরে বেশ স্পষ্টভাবেই বলে উঠল ঝাঁজাল কথাটা, ‘বাড়ির মধ্যে এসব ময়লা- আবর্জনা টাইপ মানুষজন আর কতদিন সহ্য করতে হবে কে জানে! অসহ্য!’
কথাটা বলতে বলতে হাতে পানির বোতল নিয়ে হাইহিলে শব্দ তুলে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল। নিশার গলা দিয়ে আর খাবার ঢুকল না। একটা হাহাকার গুমরে উঠল ভেতরে। উঠে পড়ল বসা থেকে। প্লেটের উচ্ছিষ্ট খাবার ট্র্যাশ করল। ঠিক একইভাবে নিজের এই আবর্জনার মতো জীবনটাকেও ডাস্টবিনে ট্র্যাশ করে দেওয়ার এক অবাধ্য অদম্য ইচ্ছা বুনো জন্তুর ধারাল দাঁতের মতো নিশাকে আপাদমস্তক চিবিয়ে চিবিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দিতে লাগল। সদর দরজা খুলেছে কেউ একজন। পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। নিশা প্লেট ধুয়ে রেখে কিচেন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। সেই সময় দেখা হলো হঠাৎ! চলতে চলতে থমকে গেল নিশা। থমকে গেল জাহিদও!
লিভিংয়ের দোরগোড়ায় জাহিদ। নিশা কিচেন কাউন্টারের পাশে। বুকে জ্বলতে থাকা হাহাকারের আগুন নিমেষে ভিজে গেল মন কেমনের এক ফিনফিনে জলের স্রোতে। চশমার আড়ালের নিষ্প্রভ দুটি চোখ নিশার চেরিফুলের মতো গোলাপি গালের ওপর পড়তেই জাহিদের ‘কিছু ভালো না লাগা’ মনের মধ্যে হঠাৎ একটা ভালো লাগার দমকা বাতাস বয়ে গেল। খুলে গেল বদ্ধ জানালার পাল্লা। ফুরফুরে উতলা হাওয়ায় ছেয়ে গেল মন ময়দান। কয়েকটা বিভ্রমের সেকেন্ড কাটল। তৃষ্ণার্ত চারটি চোখ চুম্বকের মতো আটকে রইল। দুই হৃদয়ের মধ্যে এক বাক্যবিহীন অনাবিল শান্তি মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল ক্রমশ। ফারা সিঁড়ির গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে দৃশ্যটা দেখল। আর দেখামাত্রই দুর্ধর্ষ এক ভয়ের তীব্র আলোড়ন তার অন্তরাত্মা কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। জাহিদ এখন…এই মুহূর্তে নিশার দিকে যে সীমাহীন ব্যাকুলতা এবং মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে ঠিক এভাবে, এত ব্যাকুল হয়ে কোনদিন ফারার দিকে তাকায়নি! ভয়ে লাফিয়ে ওঠা হৃৎপিণ্ডটাকে কোন রকমে সামলে নিল সে। হাত-পা জ্বালা করছে। বুকে অদম্য ঈর্ষার আগুন! শেষমেশ নিশার মতো একটা গেঁয়ো ভূতের কাছে হেরে যেতে হবে ফারার মতো প্রগতিশীল নারীকে? হতেই পারে না!
ফারা দ্রুতপদে এগিয়ে এসে জাহিদের বাদামি ঠোঁটজোড়ায় ঝুপ করে একটা চুমু খেয়ে ফেলল। তারপর আহ্লাদী গলায় বলল, ‘হোয়্যার হ্যাভ ইউ বিন হানি?’
একটা প্রবল ধাক্কা এসে লাগল নিশার বুকে। দ্রুত সরে এলো জায়গাটা থেকে। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে লাগল রূদ্ধশ্বাসে। এত দ্রুত উঠতে লাগল যে দেখে মনে হলো বুঝি কোন জংলি ডাকাতদল পেছন থেকে তাড়া করছে।
লিপস্টিক মাখা একজোড়া আঠালো ঠোঁট নিজের ঠোঁটের ওপর জোরপূর্বক চেপে বসতেই জাহিদ বুঝল ভালোবাসা ছাড়া চুম্বনের মতো রোমান্টিক ব্যাপারটাও যে কী দুর্দান্ত রকমের বিশ্রী হতে পারে! তিতকুটে একটা স্বাদে হাতপা গুলিয়ে উঠল। ফারার কাঁধ ধরে একটু দূরে ঠেলে দিয়ে অস্ফুটে বলল,
‘সরো!’
ফারার চোখ ঝলসে উঠল হিংস্র দীপ্তিতে, ‘এত রুড কেন তুমি?’
জাহিদ উত্তর না দিয়ে হেঁটে গেল সামনে। নিশাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আশ্চর্য! এমন ঝড়ের বেগে উধাও হলো কী করে মেয়েটা! পেছন থেকে ফারার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘বিয়ে করেছিলে কেন তুমি আমাকে? এভাবে আমার জীবনটা নষ্ট করে দেওয়ার কোন অধিকার নেই তোমার!’
জাহিদ ঘুরে তাকাল। বিস্ময় এবং ঘৃণার দ্বৈত রং খেলে গেল ওর মুখে, আলো-ছায়ার মতো। কেটে কেটে বলল, ‘আমি নষ্ট করেছি তোমার জীবন? হাস্যকর কথা বলো না ফারা। তোমার লাইফ তুমি নিজে নষ্ট করেছ অনিমেষকে আমাদের মাঝে টেনে এনে।’ ফারা আচমকা এক বাহ্যজ্ঞানহীন চিৎকারে ফেটে পড়ে,
— ‘তোমার বাবা-মা বাংলাদেশের বস্তি থেকে মেয়ে তুলে এনে তোমার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেবে আর আমি চুপচাপ বসে থাকব?’
জাহিদ কয়েক পা এগিয়ে এসে ফারার মুখোমুখি দাঁড়াল, ‘তোমাকে তো বলেছিলাম আমি নিশাকে ছেড়ে দেব। একটা বছরও অপেক্ষা করতে পারলে না?’
ফারা দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘ছেড়ে দেওয়ার নাম করে কী করেছ তুমি? ইউ সেপ্ট উইদ দ্যাট বিচ অ্যান্ড গট হার প্রেগন্যান্ট!’
—‘তুমি ভুলে যাচ্ছ এই ঘটনা ঘটেছে তোমাকে আর অনিমেষকে আবিষ্কারের পর।’
— ‘তুমিই ঠেলে দিয়েছ আমাকে অন্যদিকে। কেন তোমার বাবা-মা ওই মেয়েটাকে নিয়ে এলো এখানে? কেন বিয়ে দিল তোমার সঙ্গে? আমি যদি কেস করি তোমার চোদ্দগুষ্টির মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে তুমি জানো?’
জাহিদ একটু বাঁকা হাসল। রুষ্ট স্বরে বলল, ‘আচ্ছা একটা কথা বলো তো? তুমি কেস করোনি কেন? করলেই তো পারতে!’
ফারা একটু থতমত খেয়ে গেল এই প্রশ্নে। কেস করার কথা সে ভাবেনি তা নয়। কিন্তু তার বজ্জাত শ্বশুরটা আগেভাগেই বলে দিয়েছিল কোন আইনি ব্যবস্থা নিতে চাইলে তুরিনের জন্মপরিচয় জাহিদের কাছে ফাঁস করে দেবে। এ কারণেই সমস্ত অত্যাচার দাঁতে দাঁত চেপে দিনের পর দিন সহ্য করতে হয়েছে। মিথ্যে বলতে ফারার কখনো কষ্ট হয় না। চট করে বানোয়াট যুক্তি খাঁড়া করায় তার জুড়ি মেলা ভার। দ্বিধাহীন স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আমার মেয়েটার দিকে চেয়েই কোন স্টেপ নেইনি। তা ছাড়া আমার শ্বশুর-শাশুড়িকে আমি ভক্তি করি। বুড়ো বয়সে মানুষদুটোর জীবনে একটা হ্যাসেল হোক এটা আমি চাইনি।’
জাহিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকায় ফারার দিকে। ছিপছিপে, ফরসা, চাপা চোয়ালের মুখখানায় কী যেন খুঁটেখুঁটে পরখ করে। কাজলপরা ছোট ছোট দুটি চোখের ওপর স্থির দৃষ্টি রেখে অবিচল গলায় বলে, ‘একটা বিষয় কি জানো? ইদানীং তোমার সবকিছুই আমার কেমন যেন ভেগ লাগে। মনে হয় তোমার মধ্যে এমন কিছু একটা আছে যা আমি এত বছরেও দেখতে পাইনি, বুঝতে পারিনি…মাঝেমধ্যে মনে হয় এই ভেগনেস আর কোনদিন কাটবে না।’
ফারার মেরুদণ্ডে ভয়ের একটা লু হাওয়া বয়ে যায়। অনির্ণেয় শঙ্কায় বুক কাঁপে। তবুও মনের দুর্বলতা মুখে প্রকাশ করে না সে। বাইরের খোলসটা শক্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে কঠোর গলায় বলে, ‘আমাকে তো এখন ভেগ মনেই হবে তোমার। খারাপ মনে হবে। বিশ্রী মনে হবে। এসব মনে হওয়ার কারণ হলো তুমি এখন ওই বস্তির মেয়েটার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ। ছিঃ এত বাজে টেস্ট তোমার! নিশা? রিয়্যালি? শিক্ষাদীক্ষা নাই, ম্যানার্স নাই…অশিক্ষিত একটা জাংক গারবেজ…’
— ‘ফারা!’ হঠাৎ ছুটে আসা গর্জনটা চমকে দেয় ফারাকে। ঘুরে তাকিয়ে দেখে জাহিদের চোয়ালজোড়া ইস্পাতের মতো শক্ত হয়ে উঠেছে। গমগমে গলায় বলছে,
— ‘একটা মানুষ ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতে না পারলেই অশিক্ষিত হয়ে যায় না। স্পেসিফিক কোন ভাষার দক্ষতা কারো শিক্ষার মানদণ্ড হতে পারে না। সত্যিকারের শিক্ষাটা মানুষের আচার-আচরণেই প্রকাশ পায়। আজ পর্যন্ত নিশাকে আমি তোমার বিরুদ্ধে কিছু মুখ ফুটে বলতে দেখিনি। অথচ তুমি…ইট মাইট সাউন্ড হার্শ, বাট দ্য ট্রুথ ইজ তোমার কথা শুনলে তোমাকে আমার ইদানীং মোটেও শিক্ষিত, রুচিশীল বলে মনে হয় না।’
ফারার মনে ঈর্ষার সর্বগ্রাসী আগুনটা ভস করে জ্বলে ওঠে নতুন উদ্যমে। ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, ‘যত কিছুই তুমি বলো না কেন, শি ডাজন’ট বিলং টু আওয়ার সোসাইটি। এতই যদি সে প্রেশাস জেম হয়ে থাকে তাহলে জুবিনের মা হিসেবে পুরো ফ্যামিলির সামনে তাকে প্রেজেন্ট করো না কেন তোমরা? তোমার বাবা-মা তো তাদের অপকর্ম খুব চমৎকারভাবে আড়াল করে যাচ্ছেন। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব সবাই আমাকেই জুবিনের মা হিসেবে চেনে।
— ‘আত্মীয়স্বজন কারো সঙ্গেই আমার তেমন ঘনিষ্ট সম্পর্ক নেই। বন্ধুদের মধ্যে অনিমেষ খুব কাছের ছিল। সে সবটাই জানে। অন্য বন্ধুদের বলতে তুমিই নিষেধ করেছিলে। তুমি বলেছিলে এতে আমাদের ভালোবাসার অপমান হবে। আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব কে কী ভাবল, তাতে কী এসে যায়? আই ডোন্ট গিভ আ ড্যাম টু দেম।’
ফারা মস্তিষ্কের শিরা উপশিরায় বিদ্বেষপূর্ণ ক্রোধের তীব্র হুংকার টের পাচ্ছিল। বড় বড় শ্বাস টেনে নিয়ে রাগটা দমন করার চেষ্টা করল সে। এখন কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ হারানো যাবে না। জাহিদকে মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে রাখতে হবে। সুন্দরী নারীর মুখের মিষ্টি কথার চেয়ে বড় অস্ত্র দুনিয়ায় আর দ্বিতীয়টি নেই। সেই অস্ত্রই কাজে লাগাতে হবে।
এগিয়ে এসে দু হাত বাড়িয়ে শিকলের মতো জাহিদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আচ্ছা শোন, যা হওয়ার হয়ে গেছে। চলো আমরা আবার সবকিছু নতুন করে শুরু করি। তুমি তো জানো আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি। তোমার জন্য জুবিনকেও আমার আপন করে নিতে কোন আপত্তি নেই। চলো আমরা এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাই। শুধু তুমি, আমি আর আমাদের দুই মেয়ে। অন্য কেউ না!’
জাহিদ ফারার লতানো দুটি হাত নিজের গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খুব কঠিনভাবে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই একটা অনাহুত ছায়া উপস্থিত হলো দুজনের মাঝখানে। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসছে তুরিন। কাছাকাছি এসেই বাবা-মা দুজনকে আনন্দে জাপটে ধরল সে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল, ‘সো হ্যাপি টু সি ইউ বোথ টুগেদার। ইট ব্রিংস প্লেজার টু মাই আইজ!’
জাহিদ মেয়ের খুশিতে মাখামাখি পবিত্র মুখখানার দিকে চেয়ে কিছু বলতে পারল না। একটা কষ্ট বিজড়িত আক্ষেপের নিঃশ্বাস পড়ল ওর বুক চিরে। ফারা চঞ্চল গলায় বলল, ‘তুরিন শোন…আমরা যদি তোমার ক্যাম্পাসের কাছাকাছি একটা বাসা নেই তাহলে কেমন হবে?’
তুরিন বিভ্রম নিয়ে বলল, ‘এটা কেন বলছ?’
ফারা রসিয়ে রসিয়ে বলল, ‘আমি আর তোমার বাবা ডিসাইড করেছি খুব শিগগিরই অন্য কোথাও মুভ করব। শুধু আমাদের ফ্যামিলি। তুমি আমি তোমার বাবা…’
তুরিনের ছেলেমানুষি চোখে উপচে পড়ে নিষ্কলুষ হর্ষ। আনন্দে আটখানা হয়ে বলে, ‘রিয়্যালি?’ জাহিদ চশমার ফাঁক দিয়ে আড়চোখে মেয়েকে দেখে। মেয়ের আনন্দে বিঘ্ন ঘটাতে কষ্ট হয় তার। অগত্যা চুপ করে দাঁতে দাঁত চেপে ফারার ধৃষ্টতা সহ্য করে।
ফারা মেয়ের মাথায় একটা হাত রাখে। সিল্কি সিল্কি রেশমি চুলের গাছি কপাল থেকে সরিয়ে নিয়ে খুব নরম ভাবে বলে, ‘বাট ওয়ান থিংগ হানি…জুবিন কিন্তু তোমার সিস্টার। শি ইজ ফ্যামিলি। সো ওকেও আমাদের সঙ্গে রাখতে হবে। এতে তোমার মন খারাপ করা চলবে না।’
তুরিন ফকফকে হাসি হাসে, ‘তাতে কোন সমস্যা নেই…ওয়াও…আমার খুব ভালো লাগছে কথাটা শুনে। কবে যাব আমরা?’ কথাটা বলতে বলতে সে বাবার হাতের ওপর হাত রাখে, ব্যাকুল হয়ে বলে, ‘বলো না বাবা! কবে যাব?’
জাহিদ স্তব্ধ চোখে চেয়ে রইল মেয়ের দিকে। একটা দমবন্ধ যন্ত্রণা বুকের ভেতর থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে নিঃশ্বাসের সঙ্গে উঠে আসছে। সেই যন্ত্ৰণা পাশ কাটিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল। আস্তে করে বলল, ‘এই বিষয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব পরে। কেমন?’
.
নিশা সাধারণত আটটার মধ্যেই ব্রেকফাস্ট নিয়ে আসে। সাড়ে আটটার মধ্যে নাশতা সেরে একটু হাঁটতে বের হয় ওরা। বিগত কয়েকদিন ধরে নিশা লাপাত্তা। ফ্রিজে ডিম-রুটি সবই আছে কিন্তু কেন যেন খেতে ইচ্ছে করছে না। ব্রেকফাস্ট স্কিপ করেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল শাহজিদ। ব্যাকইয়ার্ডের সামনে ঝোপ-জঙ্গল, তারপর পাথরে ছাওয়া ক্রিক। হুইলচেয়ার নিয়ে ওদিকে যাওয়া খুব কষ্টকর। শাহজিদ তাই ব্যাকইয়ার্ড পার হয়ে সামনের রাস্তায় চলে আসে এক টানে। ভোরের ধোঁয়াশা কেটে সবেমাত্র দুনিয়া কাঁপানো রোদটা চড়ে বসেছে ক্র্যাব অ্যাপল আর পাইন গাছের ডালে ডালে। বাড়ির সামনের রাস্তাটা ভরে আছে লাল, সাদা ফুলের পাপড়িতে। ক্র্যাবঅ্যাপলের ফুলগুলো পুরোপুরি লাল নয়। কিছুটা ম্যাজেন্টা ছাপ আছে। প্রথমে কিছুদিন সাদা থাকে, তারপর ধীরে ধীরে ম্যাজেন্টা হয়। এখন ওদের ম্যাজেন্টা রঙের ঝাঁকড়া মাথায় সকালের তাজা রোদের চকচকে প্রলেপ পড়েছে। বাতাসে দুলছে খুব। আজকে স্নোফল হওয়ার কথা। তুষারের রাজ্যে বসন্ত বড়ই ক্ষণস্থায়ী, ক্ষীণজীবী! তাই তো বাড়ির সামনের এই একটুকরো বসন্তকে এই মুহূর্তে শাহজিদের মনে হচ্ছিল স্বর্গ থেকে উড়ে আসা কোন মূল্যবান উপহার। রাস্তার ওপারের লালচে রকিমাউন্টেনের মাথায় নেমে এসেছে নির্জলা নীল আকাশ। রোদধোয়া ওই আকাশের দিকে তাকালেই মনটা ভালো হয়ে যায়। যদিও রোদচশমা ছাড়া ওই দুর্দান্ত সূর্যর দিকে সরাসরি তাকানো যায় না। তাকালে মাথা ব্যথা হয়। নেই বারহুডের ঘাসগুলো এখন গাঢ় সবুজ। কলোরাডোর বেশির ভাগ সমতল ভূমি স্বল্প বৃষ্টিপাতের কারণে সারা বছর রুক্ষ পিঙ্গল ঘাসে ছেয়ে থাকে। পাণ্ডুর বর্ণ মাঠ প্রান্তর বসন্ত আর গ্রীষ্মের অল্পকটা দিন একটু প্রাণ পায়। সেই ক্ষীণ প্রাণটুকু জিইয়ে রাখার জন্য বসতভূমিতে কৃত্রিম জলসেচনের ব্যবস্থা করা হয়। শাহজিদ বাড়ির সামনের লন পেরিয়ে ওয়াকওয়েতে উঠে এসেছিল। ঠিক তখনই গাঢ় সবুজ ঘাসের কার্পেটের ওপর ওয়াটার স্প্রিংকেলের ফোয়ারা চালু হয়ে গেল। একটি নির্দিষ্ট সময় পর পর এই ইরিগেশন সিস্টেম কার্যকর হয়। চলে দুই-তিন মিনিট। জলের ফোয়ারা চতুর্দিকে তারার মতো ছড়িয়ে গেল মুহূর্তের মাঝে। গায়ে ছিটা এসে পড়তেই শাহজিদ হুইলচেয়ার নিয়ে একটু দূরে সরে গেল। তারপর ওই সকালবেলার হলুদমাখা কুড়মুড়ে রোদের মাঝে, ঝরনার রুপালি জলের ফুলঝুরির ওপর চোখ দিয়ে দেখল কালো রঙের একটা জ্যাকেট গায়ে দিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে হেঁটে আসছে তুরিন। উতলা বাতাসে উড়ছে ওর সিল্কের মতো নরম চুল। ছোট ছোট চোখদুটো রোদ এসে লাগায় আরো বেশি রকম ছোট দেখাচ্ছে। অনেকটা সদ্য ঘুম থেকে ওঠা আদুরে বেড়ালের মতো।
— ‘হেই শাহজিদ! হোয়াসসাপ?’
— ‘তোমার পায়ের কী অবস্থা?’ প্রশ্নের ওপর প্রশ্ন করে শাহজিদ। তুরিন ফোয়ারার রুপালি জল পেরিয়ে, সবুজ ঘাস মাড়িয়ে রাস্তার ধারের ওয়াকওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা শাহজিদের হুইলচেয়ারের সামনে এসে থামল। হাসিমুখে বলল, ‘খুব বেশি ভালো না। তবে হাঁটতে পারছি। তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল। সময় হবে?’
শাহজিদ ডান গালে জিব ঠেকিয়ে কী যেন চিন্তা করল মগ্নভাবে। মগ্ন গলায় বলল, ‘কী কথা?’
তুরিনকে একটু নার্ভাস দেখাচ্ছিল। জ্যাকেটের পকেটে লুকিয়ে রাখা হাত দুটো বের করে এনে উড়তে থাকা মাথার চুল ঠিক করল সে। ওদের পাশঘেঁষে একজন ব্রুনেট তরুণী বাদামি চামড়ার ফ্রেঞ্চ বুলডগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। শাহজিদ আর তুরিনের দিকে চেয়ে হাত নাড়ল তরুণী। বুলডগ মাথা উঁচিয়ে শাহজিদকে দেখল। তারপর হুইলচেয়ারের চাকার কাছে এসে মুখ ঘষতে লাগল। শাহজিদ ওর পিঠে হাত রাখল। ব্রুনেট মেয়েটা হাতে ধরা দড়িতে হালকা টান দিয়ে ভারি মিষ্টি গলায় কুকুরটাকে বলল, ‘কামঅন সুইটি…..উই আর গেটিং লেইট!’
শাহজিদ কুকুরের মাথায় আর গলায় হাত বুলিয়ে অনেক আদর করল। হাসিমুখে বলল, ‘হি ইজ এডরেবল, হোয়াটস হিজ নেইম?’
— ‘ইটস অ্যা গার্ল। হার নেইম ইজ রুখি!’
— ‘নাইস নেইম!…হেই রুখি… হাও আর ইউ ডুইং?’
তুরিনের বিরক্তির মাত্রা চরমে উঠতে সময় লাগল না। কুকুর সে ভালোবাসে। কিন্তু এখন এই রুথি এবং রুথির মনিবকে একটা ফোঁটাও সহ্য হচ্ছে না। হঠাৎ চোখ পড়ল, অনতি দূরে একটা বিশাল আকৃতির কটনউড গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। হাতে সেলফোন। কানে গুঁজে রেখেছে এয়ারপড। সম্ভবত কথা বলছে কারো সঙ্গে। তুরিন একটু বিরক্তি নিয়ে শাহজিদকে বলল, ‘তোমাকে বললাম আমার জরুরি কথা আছে। এখনই কেন এদের সঙ্গে গল্প করতে হবে?’
তরুণী মেয়েটি বাংলা না বুঝলেও তুরিনের ভাব ভঙ্গি দেখে টের পেল তার উপস্থিতি তুরিন খুব একটা উপভোগ করছে না। সে দ্রুত কুকুরটিকে নিয়ে সরে পড়ল। শাহজিদ বলল, ‘কী বলতে চাও?’
তুরিন সরাসরি শাহজিদের দিকে তাকাতে পারল না। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, ‘তুমি বাবার সঙ্গে কথা বল।’
শাহজিদের কপালে কুঞ্চন পড়ল, ‘মানে? কী কথা বলব?’
তুরিন মুখ নিচু করে নিজের হাতের নখ দেখতে দেখতে সলজ্জ কণ্ঠে বলল, ‘আমাদের বিয়ের ব্যাপারে।’
চূড়ান্ত এক চমকসমৃদ্ধ বিস্ময়ে শাহজিদের মুখটা স্থবির হয়ে গেল। নির্বাক চেয়ে রইল শুধু। কিছু বলতে পারল না। তুরিন আড়চোখে তাকাল ওর দিকে। ভয় ভাসা, বিচলিত, কুণ্ঠিত স্বরে বাধোবাধোভাবে বলল, ‘ইউ হার্ড মি?’
শাহজিদ থম ধরা গলায় বলল, ‘আই হার্ড ইউ। জাস্ট প্রসেসিং… বিয়ে মানে…কার বিয়ে?’
তুরিন দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে একটা বড় নিঃশ্বাস আড়াল করল। স্খলিত কণ্ঠে বলল, ‘তোমার আর আমার…আমাদের…’
একটা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব ভীষণ প্রকটভাবে দৃশ্যমান হয়ে উঠল শাহজিদের হ্যাজেল রঙের চোখের তারায়। অপ্রস্তুতভাবে চোখ সরিয়ে নিল সে। মনের মধ্যে একটা ত্রাস উঠল এই ভেবে যে এই মেয়েটি বোধহয় অন্তর্যামী। শাহজিদের ভাবন-ঘরে বুঝি আড়ি পেতে আছে। ভাবনারও আর কোন স্বাধীনতা রইল না। হাতের আঙুল দিয়ে সুইচ চেপে হুইলচেয়ারের চাকাটা নিমেষে ঘুরিয়ে দিল সে। এগিয়ে যেতে লাগল সাঁই সাঁই করে। তুরিন ওর পাশাপাশি দৌড়তে লাগল।
— ‘কী হলো? কিছু বললে না?’
— ‘তুমি পাগল। পাগলের সঙ্গে কী কথা বলব?’
—‘কেন? আমাকে বিয়ে করতে তোমার সমস্যা আছে?’ কথাটা বলতে বলতে তুরিন হুইলচেয়ারের সামনে এসে পথ রোধ করে দাঁড়াল।
চেয়ারের হাতলের ওপর দুটি হাত রেখে একটু ঝুঁকে এলো শাহজিদের দিকে। শাহজিদ নিজের মাথাটা হেলিয়ে দিল পেছনে। অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘কী চাই?’
— ‘তুমি আমার বাবাকে ভয় পাও?’
শাহজিদের কণ্ঠে আরো বেশি রকমের অস্বস্তি চারিয়ে উঠল যেন, ‘এই কথাটা বলার জন্য তোমাকে এত কাছে আসতে হবে কেন? দূর থেকেও তো বলা যায়।’
প্রশ্নটা শুনে তুরিনের কেন যেন হাসি পেয়ে গেল। ঠোঁটে মুচকি একটা হাসির রেশ ভাসিয়ে আহ্লাদী গলায় বলল, ‘অ…লুক অ্যাট ইউ। ইউ আর ব্লাশিং!’
তুরিনের মুখখানায় থইথই করছে সোনালি রোদ। রকিমাউন্টেনের বুক থেকে উড়ে আসা, পাথুরে ঘ্রাণ মেশানো বাতাস হুহু করে উড়িয়ে দিচ্ছে ওর খোলা চুল। ক্র্যাব অ্যাপল ফুলের কয়েকটা ম্যাজেন্টা রঙের পাপড়ি আর কটনউড গাছের গুঁড়ি ফেটে বেরিয়ে আসা সাদা তুলোর আঁশ মৌমাছির মতো প্রদক্ষিণ করছে ওকে। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাসের স্নিগ্ধ ছোঁয়া শাহজিদের শীতল অন্তঃকরণের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা আবেগ, অভীপ্সা এবং প্রবৃত্তির অনুভূতিকে যেন খোঁচা দিয়ে জাগিয়ে তুলতে চাইছে। সে একটু অসহায়ভাবে বলল, ‘তুরিন প্লিজ! ব্যাক অফ!’
শাহজিদের ঈষৎ লালচে এলোমেলো চুল হাত দিয়ে সুবিন্যস্ত করে দিতে দিতে তুরিন মৃদু গলায় বলল, ‘আগে বলো তুমি বাবার সঙ্গে কথা বলবে।’
—‘এটা সম্ভব না!’
তুরিনের চোখে রাগের ঝাঁঝ এসে লাগে। রাগী গলায় বলে, ‘তুমি আমাকে চাও না?’
— ‘না চাই না।’
— ‘তাহলে সেদিন অমন অসভ্যতা করলে কেন?’
শাহজিদ তুরিনের রোেদ ভাসা ছোট চোখ, ছোট নাক, লম্বাটে মুখ আর গোলাপি ঠোঁটের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে রইল। তারপর ওর খরগোশের বাচ্চার মতো নরম গালদুটো টেনে দিয়ে নির্বিকার গলায় বলল, ‘তুমি এত সুন্দর কেন? তোমাকে দেখলেই আমার অসভ্যতা করতে ইচ্ছে করে। কী করব বলো? ক্যান্ট হেল্প!’ তুরিনের চোখেমুখে রক্তের আভাস পড়ল। শাহজিদের মাত্র বলা কথাটা আর হাতের স্পর্শ ওর মনের আনাচ-কানাচ ভীষণ রকম এক ভালো লাগার স্রোতে প্লাবিত করে তুলল। শাহজিদ বলল, ‘সরে দাঁড়াও তুরিন, অসভ্য লোকদের কাছে আসতে নেই।’
তুরিন সোজা হয়ে দাঁড়াল। বাষ্প-রুদ্ধ স্বরে বলল, ‘কেন এমন করছ? প্লিজ ডোন্ট প্রিটেন্ড।’
শাহজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। গম্ভীর শোনাল ওর কণ্ঠস্বর, ‘তুমি কী করে এটা ভাবলে যে তোমার বাবা তার মেয়েকে একজন ডিজেবল মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজি হবে? আমার কোন যোগ্যতাই নেই তার কাছ থেকে তোমাকে চেয়ে নেবার।’
তুরিনের বুকটা মুচড়ে উঠল কষ্টে।
— ‘এভাবে বলো না। তুমি ডিজেবল এ কথা কে বলল? ইউ আর গুডলুকিং, ইন্টেলিজেন্ট অ্যান্ড ইউ অলসো হ্যাভ অ্যা সাকসেসফুল ক্যারিয়ার!’ একটু থেমে তুরিন আবার বলল, ‘তুমি প্রস্থেটিক লেগ ইউজ কর না কেন?
— ‘প্রস্থেটিক লেগ সম্পর্কে তোমার কোন আইডিয়া নেই বলেই কথাটা বলতে পারলে। কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার আগে একটু পড়াশোনা করে এসো তুরিন।’
— ‘আচ্ছা লাগবে না ওসব…তুমি যেমন আছ এমনটাই থাকো। ইউ আর মোর দ্যান পারফেক্ট শাহজিদ! জাস্ট স্টপ বিইং সো স্টাবৰ্ন।
শাহজিদ এক বুকভর্তি গহন বিষণ্নতা নিয়ে বলল, ‘ইউ নো হোয়াট? তোমরা যারা সুস্থভাবে বেঁচে আছ, হেঁটে চলে বেড়াচ্ছ, তারা কখনো বুঝবে না একটা হুইলচেয়ারে আজীবন বন্দি হয়ে থাকার যন্ত্রণাটা ঠিক কীরকম! ওই যে দ্যাখো, অর্ণব হেঁটে আসছে এদিকে। তুমি চাইলেই ওর পাশে হাতে হাত রেখে হাঁটতে পারবে। পাহাড় বাইতে পারবে। ড্যান্স করতে পারবে…অর্ণব হয়তো একদিন বারো হাজার ফিট উঁচু পাহাড়ের চূড়োতে গিয়ে তোমাকে প্রপোজ করবে। যেটা তোমার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আমি…আমি এসব কিছুই কোনদিন তোমাকে দিতে পারব না।’
তুরিন ঠোঁট চেপে কান্নার একটা ঢোক গিলল। জল-ঝাপসা চোখে শাহজিদের বিষণ্ণ অবিচল মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘আমার ওসব কিছুই চাই না…।’
— ‘ইউ আর নট ম্যাচিওর এনাফ তুরিন…এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেছ।’
— ‘আমি ছেলেমানুষ নই। নিজের জীবন সম্পর্কে ডিসিশন নেয়ার মতো যথেষ্ট ম্যাচিওরিটি আমার আছে।’
— ‘ম্যাচিওরিটি থাকলে এসব আবোল তাবোল কথা বলতে পারতে না।’
— ‘আমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে তোমার খারাপ লাগবে না?’
শাহজিদ কঠিনভাবে বলল, ‘আমার মধ্যে এসব আবেগ-অনুভূতি নেই তুরিন! প্লিজ ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড। আই হ্যাভ উন্ডস দ্যাট নেভার হিলড! আই অ্যাম নট অ্যা নরমাল পারসন। বেসিক হিউম্যান ইমোশনস আর নট মাই স্ট্রং স্যুট।’
অর্ণব কাছাকাছি এগিয়ে এসেছে। ওদের দেখে হাত নাড়ল। এক গাল হেসে বলল, ‘গুডমর্নিং!’
তুরিন অর্ণবের দিকে তাকাল না। কষ্টের একটা তীক্ষ্ণ ফলা ওর পেঁজাতুলোর মতো সহজ-সরল নরম মনটাকে কেটে-ছিঁড়ে রক্তাক্ত করে তুলছে ক্রমেই। চোখে উপচে পড়ছে লোনা জলের সমুদ্র। সে আর দাঁড়াল না। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে গেল বাড়ির দিকে। শাহজিদ অর্ণবের দিকে চেয়ে একটু অপ্রস্তুত হেসে বলল, ‘গুডমর্নিং অর্ণব ভাই! কী খবর?’
অর্ণব টানাটানা কালো দুটি চোখে গভীর হতাশা ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘কোন খবর নাই ভাই। চাকরি-বাকরি তো হচ্ছে না। গতকাল একটা অনলাইন ইন্টারভিউ দিলাম। ভালো হয় নাই। মনে হচ্ছে হবে না।’
শাহজিদ হালকা হেসে বলল, ‘একটু ধৈর্য ধরুন। হয়ে যাবে। এত তাড়া কীসের?’
হঠাৎ তুরিনকে দেখা গেল আবার। রোদচড়া বাতাস আর সোনাবরণ আলো কেটে কেটে দুরন্ত হরিণীর মতো ধাবিত হচ্ছে ওর ছিপছিপে লম্বা শরীরটা। এক দৌড়ে অর্ণবের মুখোমুখি এসে থামল সে। শ্বাস ফেলতে লাগল বড় বড়। অর্ণব বেশ ভড়কে গেছে। বিচলিত, বিস্ফারিত, নার্ভাস চোখে চেয়ে আছে তুরিনের দিকে। এদিকে শাহজিদ ভুলে গেছে শ্বাস নিতে। গভীর এক গা ছমছমে স্তব্ধতা ভর করেছে ওর মুখে।
কয়েকটা থমকানো সেকেন্ড নির্বিঘ্নে কেটে যাওয়ার পর তুরিন আচমকা অর্ণবের হাত চেপে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে এলো ম্যাজেন্টা রঙের ফুলে ছাওয়া ঝাঁকড়া মাথার ক্র্যাব অ্যাপল ট্রির নিচে। শাহজিদ চেয়ে আছে। দু চোখে বিস্ফোরণের আভাস, ফরসা চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে প্রচ্ছন্ন ভয় এবং অনিশ্চয়তার আঁকিবুকি। সে দেখতে পাচ্ছে কয়েক হাত দূরে গাছের নিচে বাদামি লেদারের জ্যাকেট পরা অর্ণব দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখোমুখি তুরিন। তুরিনকে দেখা যাচ্ছে না। অর্ণবের লম্বা চওড়া শরীরের আড়ালে ঢেকে গেছে ওর ছিপছিপে দেহ। কী হচ্ছে ওখানটায় সেই কৌতূহলে শাহিজদের চামড়ার প্রতিটি রোমকূপ কাঁটা দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। মিনিট দুয়েক সময় পার হলো। কৌতূহল বিদ্ধ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত শাহজিদ, অর্ণবকে ফিরে আসতে দেখল। তুরিন যেভাবে দৌড়ে এসেছিল ঠিক সেভাবেই দৌড়ে ছুটে যেতে লাগল বাড়ির দিকে। অর্ণবের মুখের বিচলিত ভাবটা লক্ষ্য করে শাহজিদ অতি সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘কী বলল তুরিন?’
অর্ণব লজ্জায় লাল টাল হয়ে বলল, ‘তেমন কিছু না।’
অর্ণবের মুখের পাল্টে যাওয়া রং দেখে কেন যেন শাহজিদের বুকটা ভীষণ কেঁপে উঠল। মনের বিরূপ অবস্থা একটা বড় নিঃশ্বাসের সঙ্গে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে সে যথাসাধ্য স্বাভাবিক গলায় ছোট একটা শব্দ উচ্চারণ করল, ‘কুল!’
— ‘আচ্ছা, উনার পছন্দের ফুল কী আপনি জানেন?
অযৌক্তিক খাপছাড়া এক অস্থিরতায় শাহজিদের চোখে কেমন অন্ধকার নেমে আসছিল। জোর করে হাসার চেষ্টা করে সে বলল, ‘জানি না।’
— ‘পছন্দের রং?’
শাহজিদ বিদ্রুপের গলায় বলল, ‘আমি কী করে জানব ভাই? আপনার ফিয়ন্সে, জানবেন তো আপনি।’
অর্ণব ঠোঁট উল্টে বলল, ‘না আমি ভাবলাম আপনারা তো অনেক দিনের পুরনো বন্ধু। তাই হয়তো উনার ভালোলাগা মন্দলাগা সম্পর্কে আপনার ধারণা আছে।’
শাহজিদ হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে শক্তভাবে বলল, ‘আমার কোন ধারণা নেই।’
অর্ণব ওর পাশাপাশি হাঁটতে থাকে, ‘মনে হচ্ছে বিয়েটা হবে। বুঝলেন ভাই?’
শাহজিদ হুইলচেয়ার থামাল, ‘অর্ণব শুনুন, একটা অনুরোধ করব। শুধু সিটিজেনশিপের জন্য আপনি তুরিনকে বিয়ে করবেন না প্লিজ। তুরিন কেন? কাউকেই করা উচিত না। যদি ওকে সত্যিই ভালো লেগে থাকে, এবং সেই ভালোলাগা যদি মিউচুয়াল হয় তবেই এই সম্পর্কে এগোবেন। কেমন?’
অর্ণব সুনিশ্চিত সুর যোগ করে বলল, ‘ভালোলাগার বিষয়টা সময়- সাপেক্ষ। আমার বিশ্বাস কিছুদিন পাশাপাশি থাকলে মনের একটা টান হয়েই যায়। তা ছাড়া উনাকে আমার ভালোই লাগে। একটু চঞ্চল, এটাই সমস্যা। তবে এই সমস্যা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ঠিক হয়ে যাবে।
শাহজিদ ম্লান হাসল, ‘বেশ তো…অল দ্য বেস্ট।’
এবার অর্ণব ভীষণ আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘তবে মেয়েটা…মানে আপনার বন্ধু মনে হয় একটু পাগল আছে। আজকে আমাকে হুট করে একটা কিস করে ফেলছে…চিন্তা করেন.. কী এম্ব্যার্যাসিং!’
শাহজিদ একটা ভাঙনের শব্দ শুনতে পেল কানের কাছে। প্রলয় বাতাস হুহু করে ধেয়ে এসে বুকের জানালার প্রতিটা কাচ ঝনঝন শব্দে ভাঙতে লাগল ক্রমান্বয়ে। অর্ণব অবাক গলায় বলল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো?’
শাহজিদ ভাঙাচোরা মুখে বিড়বিড় করে কী যেন একটা বলল অস্ফুটে। অর্ণব শুনল না। শুধু দেখল হুইলচেয়ারটা তরতরিয়ে ছুটে যাচ্ছে ওয়াকওয়ে ধরে। অনেকটা দিগ্বিদিক্ শূন্য।
সফেদ বসন্ত
ফ্লোরিডা যাওয়ার জন্য অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিয়েছিল জাহিদ। আজ অবশ্য এমনিতেও রবিবার। ছুটির দিন। তবুও কাজের কোন শেষ নেই। এ বাড়ির নিচতলায় একটা অফিস ঘর আছে। করোনা মহামারির পর প্রতিটি বাড়িতেই অন্তত একটি অফিসরুম আবশ্যক। কারণ বেশির ভাগ লোকেই আজকাল ওয়ার্ক ফ্রম হোম করে। নবদম্পতিরাও তাই বাড়ি কেনার আগে সবার প্রথমে যাচাই করে নেয়, অফিস ঘরটা ঠিক কোথায় এবং কী রকম হলে সবচেয়ে বেশি আরামদায়ক বা মানানসই হবে। এই বাড়ির অফিস ঘরের মাঝ বরাবর বিশাল বড় এক কালো রঙের ভিন্তেজ রোজউড টেবিল রাখা আছে। জাহিদ এই মুহূর্তে সেই টেবিলসংলগ্ন রিভলভিং চেয়ারে বসে আছে। সামনে ল্যাপটপ আর কফির মগ। তার পরনে লাইট অলিভ কালারের পাতলা টি-শার্ট আর কালো ট্রাউজার। ল্যাপটপের স্ক্রিনে নিবদ্ধ চোখজোড়ায় গভীর মনোযোগের ছায়া, কপালে মৃদু কুঞ্চন। হঠাৎ দরজার সামনে একটা ছায়া এসে দাঁড়াল।
— ‘চাচ্চু!’
— ‘হুম?’ প্রচ্ছন্ন গলায় শব্দটা উচ্চারণ করে জাহিদ।
— ‘দাদু ডাকছে। এখুনি যেতে বলেছে।’ কথাটা বলেই তানিশা অদৃশ্য হয়ে গেল দরজার ওপাশে। জাহিদ সঙ্গে সঙ্গে উঠল না। উঠল আরো মিনিট দশেক পরে। বাবার ঘরে এসে দেখল জুবিন মেঝেতে তুরতুর করে হাঁটছে, দৌড়োবার চেষ্টা করে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে, হামাগুড়ি দিচ্ছে। জানালার সামনে একটু জড়োসড়ো হয়ে নিশা দাঁড়িয়ে আছে। জাহিদ ওর দিকে তাকাল না। কেন যেন বাবার সামনে তাকাতে সংকোচ হলো। কিন্তু মেয়েটির অস্তিত্বের প্রভাব খুব শক্তিশালী। যে মুহূর্তে জানল নিশা এখানে আছে, খুব কাছেই আছে, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই শ্বাসপ্রশ্বাসের বিচলন অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। চেয়ে আছে বাবার দিকে কিন্তু মন-প্রাণ দুরন্ত বেগে ধাবিত হচ্ছে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অবিচল নারী মূর্তিটির দিকে। এই ধাবমান শক্তির সঙ্গে লড়াই করা ভারী কষ্টকর কাজ। দৃষ্টির গতিবিধিতে শক্ত করে শিকল দিয়ে বাবার মুখপানে চেয়ে গম্ভীর ভাবে জাহিদ বলল, ‘ডেকেছিলেন?’
— ‘হ্যা…বসো।’
জাহিদ বসল। বাবার পাশে। বিছানার ওপর।
মুর্তজা সাহেব একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘বৌমা আমাকে সবকিছুই খুলে বলেছে। সমস্যার তো কোন সমাধান হচ্ছে না। দিনকে দিন সমস্যা বেড়েই চলেছে। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। শহীদের কনডোতে গিয়ে উঠুক বৌমা। যত দ্রুত সম্ভব। সঙ্গে তোমার মা যাবে। এ বিষয়ে তোমার কোন মতামত আছে?’
জাহিদ জুবিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘জুবিন কোথায় থাকবে?’
— ‘মায়ের সঙ্গেই থাকবে।’ সোজাসাপটা উত্তর দিলেন মুর্তজা সাহেব। জাহিদের মুখে বেদনার নীল রং ছায়াপাত করল, ‘আমার মেয়েকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছেন আপনারা। এটা কি ঠিক?’
— ‘ঠিক-বেঠিকের সংজ্ঞা তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে? এইটুকু বাচ্চা মা ছাড়া থাকবে কী করবে? মাথায় কি আক্কেল বলতে কিছুই নেই?’
জাহিদ উঠে দাঁড়াল বসা থেকে। অভিমানের বাষ্পে তার কণ্ঠ রোধ হয়ে আসছে। পৃথিবীটা আসলে ভীষণ স্বার্থপর। বাবা-মাও সন্তানের মন বুঝতে ব্যর্থ হয় সময়ে সময়ে। জুবিন তার জীবনের একমাত্র আনন্দের নাম। সেই আনন্দটুকুও এরা ছিনিয়ে নিতে চাইছে। জাহিদ থমথমে গলায় বলল, ‘তাহলে আমার মতামত জানতে চাইছেন কেন? যা ভালো মনে হয় তাই করেন।’
মুর্তজা সাহেব বজ্রগম্ভীর স্বরে বললেন,
— ‘শুনেছি তুমি নাকি নিশার সঙ্গে সেপারেশনের কথা ভাবছ। ঘটনা যদি এরকম হয়ে থাকে তাহলে মেয়েটাকে আমি আবার বিয়ে দেব। আমি চাইলেই কাজটা করতে পারব তুমি জানো।’ এই কথা উঠতেই নিশা ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে উঠল। অস্বস্তির কাঁটা ফুটতে লাগল মনে। এদিকে যুক্তিহীন রাগে জাহিদের মাথার রগ টনটন করছিল। সে ত্যাড়া গলায় বলল, ‘তাকে তো আমি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করিনি। আপনাদের মন রক্ষার্থে করেছিলাম। এখনো আপনাদের যা মনে চায় তাইই করুন। আমাকে কেন এসবে ইনভলভ করছেন?’
কথাটা এত কঠিন আর নিষ্ঠুর শোনাল যে নিশার মনে হলো একটা ভারী পাথর দিয়ে কেউ তার বুকের পাঁজরা থেঁতলে দিল এই মাত্র! কথাটা বলেই জাহিদ আর দাঁড়াল না। গটগটিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। অপদস্ত নিশা বেশ কয়েক সেকেন্ড বিনা বাক্য ব্যয়ে শ্বশুরের সামনে মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে উঁকি দিচ্ছে জল। বুকে অপমানের চিনচিনে ব্যথা। ভাগ্যের নির্মম প্রহসন মেনে নিতে আজকাল তার কষ্ট হয়। অনেক তো মানিয়ে নিল। আর কতকাল চলবে এই মানিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া? ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে সে সুন্দর। একটু বড় হওয়ার পর আত্মীয়স্বজনরা বলতে লাগল মেয়ের যেমন রূপ, তেমন গুণ। কী ভালো রান্না করে, কী নিখুঁত ঘর সাজায়, নিশার হাতের ছোঁয়া লাগলেই যেকোনো সাধারণ জিনিস হয়ে ওঠে শিল্প। গানের গলাটাও দারুণ। চর্চা করলে বাংলাদেশের লতা মঙ্গেশকর হবে একদিন। এমন মেয়ে যে বাড়িতে যাবে, সেই বাড়ির শ্রীলক্ষ্মী ফিরে আসবে। ঘর উজালা হবে। বাবা বলত একদিন প্রিন্স চার্মিং আসবে। এসে নিয়ে যাবে তার তুষারকন্যাকে দূরের কোন রাজ্যে। বাবা জানত না সব তুষারকন্যার জীবনে প্রিন্স চার্মিং আসে না। বরং কোন কোন তুষারকন্যাকে হতে হয় সত্মা। দ্য উইকেড ওয়ান! লোকটা কত সহজে বলে দিল কথাটা, আমি তাকে নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করিনি। বলার আগে একটাবার বুক কাঁপল না। একটাবার ভাবল না কথাটা যত বড় সত্যই হোক না কেন নিশার জন্য এই সত্যটি মৃত্যুযন্ত্রণা সম। বাবাকে একদিন ঠান্ডা মাথায় বাস্তবতা বুঝিয়ে দিতে হবে। বলতে হবে, বাবা তোমার মেয়ে তুষারকন্যা নয়, বরং তুষারকন্যার সত্মা। যে সমা তুষারকন্যার সাজানো-গোছানো সুখের পরিবারকে ভেঙেচুরে খান খান করে দিয়েছে।
.
ভূতগ্রস্তের মতো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছিল জাহিদ। অফিসঘরে গিয়ে বসল কিছুক্ষণ। মন বসল না। হাঁসফাঁস লাগছিল। সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এলো। ক্রোধের একটা বহ্নিশিখা মনের আনাচকানাচ জ্বালিয়ে দিচ্ছে দাউদাউ করে। নিজের পিতামাতার ওপরেই চড়াও হচ্ছিল রাগটা। কী প্রয়োজন ছিল এই পরিবারে নিশাকে টেনে আনার? নিশা আসার পরেই তো সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেল। ছারখার হয়ে গেল। তুরিন, ফারা দুজনেই ছিটকে গেল দূরে। এখন সবকিছু শেষ করে দিয়ে নিশাও চলে যাবে জাহিদের জীবনের একমাত্র সুখ, জুবিনকে সঙ্গে নিয়ে। তাহলে এই বাড়িতে অযথা পড়ে থেকে লাভ কী? বাবা মা তো শহীদ আর শহীদের পরিবার নিয়েই দিব্যি ভালো থাকতে পারবে। জাহিদ ঠিক করল তুরিনকে বিয়ে দিয়েই সে কলোরডো ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবে।
বাইরে ভীষণ ঠান্ডা। আবহাওয়া পূর্বাভাসে বলা হয়েছে আজ সারাদিন তুষারপাত হবে। খানিক বাদেই স্নো-ফল শুরু হবে। পোর্চের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় অস্থির চিত্তে পায়চারি করছিল জাহিদ। হঠাৎ সদর দরজাটা খুলল কেউ একজন। দরজার চৌকাঠ পেরিয়ে বেরিয়ে এলো একজোড়া ফরসা পা। জাহিদ চিন্তামগ্নভাবে নিজের মাথার ছোট ছাটের স্ট্রেইট চুলগুলোতে ডান হাতের আঙুল চালাচ্ছিল। নিশাকে দেখে থমকে গেল ওর হাত, সেই সঙ্গে রহিত হলো চলনপ্রক্রিয়া। অপ্রস্তুত নিশা একবার ভাবল চট করে ভেতরে ঢুকে যায়। এই নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন লোকটার মুখোমুখি হওয়ার মতো কোন রুচিই অবশিষ্ট নেই তার মনে। কিন্তু গত দুদিন ধরে গাছে পানি দেওয়া হয় না। নিশা ছাড়া এই কাজটা বাড়ির অন্য লোকে করবে না। দুপুরের পর এমনিতেও জুবিনের জন্মদিন উপলক্ষে অতিথি সমাগম শুরু হবে। তখন নিশাকে ঘরবন্দি হয়ে বসে থাকতে হবে দোতলার ঘরে। এসব ভাবতে ভাবতে নিশা গম্ভীর মুখে এগিয়ে এলো সামনে। জাহিদের দিকে তাকাল না একবারও। নিঃশব্দে সিঁড়ি ভেঙে নেমে এলো উঠোনে। পানির কল চালু করল। চালু করতেই হলুদ রঙের পাইপের মুখে লাগানো নজেল দিয়ে জলের ফোয়ারা ছুটল। সিঁড়িতে রাখা স্নো ড্রপ, ড্যাফোডিল আর গোলাপের টবে পানি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। জল পড়তেই ফুলগুলো কী রকম সতেজ হয়ে উঠছে। যেন নতুন করে লাগছে প্রাণের ছোঁয়া। ফুলের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতেই মনে হলো লোকটা কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে থেকে তাকেই দেখছে একদৃষ্টে। অস্বস্তিতে গা-হাত-পা জ্বালা করতে লাগল। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কেন? হয় ভেতরে ঢুকবে নইলে বাইরে বেরিয়ে যাবে। বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী?
নিশার ধারণা সঠিক। চশমার আড়ালের দুটি চোখ তখন প্রখরভাবে লক্ষ করছে তাকে। জাহিদ কাঠের দরজাটার পাশে পোর্চের দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। দেখছিল নিশাকে। ওর পরনে একটা হালকা বেগুনি রঙের সালওয়ার কামিজ। ওড়নাটা কাঁধের একপাশে ঝুলছে। কামিজের হাতটা ছোট। চন্দন-চৰ্চিত ছিপছিপে ফরসা বাহুর মসৃণ চামড়ায় বেগুনি রঙের সুতির কাপড়টা দাঁত কামড়ে পড়ে আছে। পিঠে গুচ্ছের কালো চুল। চুলের গোছা যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে ঠিক সেখানেই চমৎকার ছন্দে ঢেউ খেলে গেছে কোমর। যেন শিল্পীর হাতে গড়া নিখুঁত কোন ভাস্কর্য। রোদের দাপট তখন কমে এসেছে।
হাওয়া শীতল। রাস্তার ওপারের রকিমাউন্টেনের মাথায় ভিড় করেছে ছাই রঙের মেঘের লহর। সেই মেঘের সিলভার লাইনিং ভেদ করে নরম পাতলা সূর্যরশ্মি সন্তর্পণে নেমে এসেছে লোকালয়ে। আকাশটা যেন রুপোর পাতে মোড়া! সর্বত্র রুপালি মেঘের ওড়াওড়ি, মাঝেমধ্যে আঁচর কেটে গেছে গাঢ় নীল রং। শীত বাতাস খেলছিল নিশার খোলা চুল নিয়ে, ওড়না নিয়ে…আর ওই খোলা চুল আর ওড়নার কাঁপন নির্বিঘ্নে খেলে যাচ্ছিল জাহিদের দ্বিধাজড়িত, বিভ্রমে ডোবা দুর্বল মনটা নিয়ে। সে এখানে অহেতুক দাঁড়িয়ে আছে কেন? দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানে হয় না। এই বয়সে এমন চূড়ান্ত হ্যাংলামো একেবারেই বেমানান। বয়সের কথা বারেবারে জাহিদের মনে টোকা দেয় ঠিকই, কিন্তু চল্লিশ বয়সটা কি খুব বেশি? এই বয়সে তো যেকোনো মানুষ পরিপূর্ণ যুবক বা যুবতীই থাকে। আর যৌবন যে এখনো তল্পিতল্পা গুটিয়ে প্রস্থান করেনি বরং সাড়ম্বরে বিরাজ করছে দেহ, মনের সমস্ত অলি-গলি, আড়াল আবডালে…সেই উপলব্ধি কাঁকড়ার মতো কিলবিল করে নিজ অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে ঠিক তখন থেকে, যখন থেকে নিশাকে ওই লাল পাথরের রকি মাউন্টেনের সামনে…রূপোর পাতে মোড়া চকচকে আকাশের নিচে…সবুজ কার্পেটের মতো ঘাসের ওপর খোলা চুলে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে। এই দৃশ্যটা যেন অপার্থিব! দেখলে বুক খালি খালি হয়ে যায়। তীব্র সুখ আর তীব্র কষ্ট একই সঙ্গে মনের মধ্যে দাপাদাপি করতে থাকে। সেই সময় নিশা একবার তাকাল। ডাগর দুটি চোখের ওপর চোখ পড়তেই জাহিদের মস্তিষ্কের সব রক্তকণিকা ছুটোছুটি করতে লাগল। হাঁটুতে একটা কাঁপন উঠল মৃদু। একটু আগের বিষণ্ন পৃথিবীটা ছাই হয়ে উড়ে গেল হাওয়ায়। ঠিক সেই সময় আকাশ থেকে ঝরতে লাগল সাদা রঙের তুলো। মিহি বরফের ফুলঝুরি হাওয়ায় ভেসে ভেসে উড়ে এসে বসতে লাগল নিশার খোলা চুলে, চেরিপিংক নরম গালে আর রক্তাভ পাতলা ঠোঁটে। নিমেষে সাদায় সাদায় ভরে গেল চারিধার। নিশা হাতে ধরা ওয়াটার নজেল বন্ধ করল। জাহিদ তখনো চেয়ে আছে। নিশার একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না ওই নিষ্ঠুর পাষণ্ড লোকটার দিকে তাকাতে। কিন্তু ইচ্ছারাও মাঝেমধ্যে ভারী রহস্যময় আচরণ করে। যে লোকটা ওর জীবনটাকে তছনছ করে দিল, অপমানের কালো কলুষিত জলে ডুবিয়ে দিল আত্মমর্যাদা, মান- সম্মান এবং নারীত্বের অহংকার…সেই অপরাধী, হৃদয়হীন ব্যক্তিটিকে এক নজর দেখার জন্য রহস্যময়, দ্ব্যর্থব্যঞ্জক সব বেইমান ইচ্ছেরা শরীরের কোষে কোষে যেন উতরোল মিছিল চালু করেছে। নিশার অবাধ্য চোখের দুরন্ত দৃষ্টি, মনের সমস্ত প্রতিরোধকে পায়ে ঠেলে টর্চের আলোর মতো ঠিকরে পড়ল পোর্চে দাঁড়ানো মানুষটার মুখের ওপর। কর্ণমূল আরক্ত হলো।
ভালো লাগার আলপিন ফুটতে লাগল গায়ের চামড়ায়। চোখে চোখ লেগে রইল খানিকক্ষণ। বরফকুচির সাদা ঝালরের ভেতর দিয়ে হঠাৎ জাহিদকে এগিয়ে আসতে দেখল। দেখল ওই রিমলেস চশমার পেছনের শান্ত দুটি চোখ…দেখল তীক্ষ্ণ নাসিকা, বাদামি ঠোঁট, প্রশস্ত কাঁধে টানটান হয়ে লেগে থাকা হালকা অলিভ রঙের স্লিমফিট টি-শার্ট। বুকে হঠাৎ কাঁপন ধরল নিশার। লোকটা এদিকে কেন আসছে? কী উদ্দেশ্যে আসছে?
লনের সবুজ ঘাসের ওপর নিঃশব্দে ঝরে পড়ছিল তুষারকণা। সবুজাভ কার্পেট ম্যাজিকের মতো শ্বেত শুভ্র রঙে রূপান্তরিত হচ্ছে। ওদের মনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। কোথাও শীতের রুক্ষতা নেই। বরং দুনিয়াজুড়ে নেমে এসেছে যেন এক সফেদ রঙের শুভ্র বসন্ত। বসন্ত হয় হলুদ। কিন্তু আজকের এই তুষাররাজ্যের অনাহুত বসন্ত ধবধবে সাদা। জাহিদ নিশার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। দুজনের মধ্যে মাত্র কয়েক ইঞ্চির তফাত। হৃৎপিণ্ডে ঘোড়দৌড়! নিশার মুখে বিভ্রমের গভীর ছাপ! দিঘল দুটি চোখে ব্যাকুল সম্মোহন। তুলোর মতো নরম বরফকুচি উড়ে উড়ে এসে পড়ছে ওর রক্তাভ ঠোঁটে। পেলব ঠোঁটজোড়া কাঁপছে তিরতির করে। চোখের বড় বড় পাপড়িতে আটকে গেছে বিন্দু বিন্দু তুষার। কী সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে! জাহিদের উপবাসী চোখ ভিখিরির মতো চেয়ে আছে ওর দিকে। মন চাইছে নিশাকে কাছে টেনে আদর করতে…মন চাইছে অনেক বেশি…অনেক গভীর…অনেক দুর্দান্ত আদরের স্রোতে ওর আত্মার আর শরীরের ইঞ্চি ইঞ্চি জমিন বন্যার মতো ভাসিয়ে দিতে!
একটু ঝুঁকে মাটিতে লুটিয়ে পড়া ওড়নাটা হাতে তুলে নিল জাহিদ। নিশা ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল নিজের কাণ্ডজ্ঞানহীনতায়। রাগও হলো প্রচণ্ড। মানুষটাকে দেখতে দেখতে এতই বেহুঁশ হয়ে গেছে সে যে গা থেকে ওড়না কখন খুলে পড়ে গেছে তা খেয়ালই করেনি। ছিঃ কী লজ্জার ব্যাপার! জাহিদ ওড়নাটা ওর গায়ে জড়িয়ে দিল যত্নের সঙ্গে। নিশার কপালে এসে লুটোপুটি খাচ্ছিল কয়েক গাছি চুল। সেই চুলে এখন বরফকুচির প্রলেপ। দেখে মনে হয় যেন বকুল ফুলের মালা! জাহিদ হাত দিয়ে চুলগুলো ওর কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে বলল, ‘তোমার শীত করছে না নিশা?’ শীত তো করছেই না বরং কপালে ওই হাতের একটু স্পর্শ লাগতেই যেন ছ্যাৎ করে আগুন জ্বলে উঠল 1 সেই আগুনের আঁচ বুকে নিয়েই নিশা কোনরকমে বলল, ‘আমি ঠিক আছি।’
জাহিদ ওর কাঁধে একটা হাত রাখল, ‘ভেতরে চলো!’ নিশা নিজের বাঁ কাঁধের ওপর নেমে আসা হাতটার দিকে আবিষ্ট চোখে তাকাল একবার। মানুষটা কাছে আসতেই কী সুন্দর একটা ঘ্রাণে ছেয়ে গেছে চারপাশ। নিশার আত্মা রমরম করছে সম্মোহনের অভ্রভেদী সঞ্চালনে। চারপাশটা এখন স্বপ্নের মতো সুন্দর। ভাগ্য বোধহয় এই প্রথম কিঞ্চিৎ প্রসন্ন হলো ওদের ওপর। কারণ বাড়িতে ঢোকামাত্র কারো মুখোমুখি পড়তে হলো না। দরজার সামনে কয়েক সেকেন্ড অকারণেই দাঁড়িয়ে রইল ওরা। একে অন্যের মুখে কী যেন খুঁজল নীরবে। জাহিদ হাত নামাল নিশার কাঁধ থেকে। এখন ওর চোখ অনেক কথা বলছে। সেই কথার দ্ব্যর্থক অর্থ নিশা বুঝতে পারে না। কিন্তু তাকানোটা ভীষণ সুন্দর! নিশা জীবনে অন্য কোন পুরুষকে কখনো এত সুন্দর করে তাকাতে দেখেনি। নিশার মুখের ওপর চোখ নিবদ্ধ রেখেই জাহিদ উল্টো দিকে কয়েক পা পিছিয়ে গেল। করিডরের সামনে গিয়ে থামল। করিডরের মুখে অফিসঘরের দরজা। জাহিদ দরজাটা খুলে এক পাশে সরে দাঁড়াল। এবার নিশা বুঝল কী করতে হবে। কোন কথা না বলে বরফ আর কাদা মাখা নগ্ন দুটি পা নিয়ে এগিয়ে এলো করিডর ধরে। ঢুকল অফিসরুমের ভেতর। জাহিদ ঘরের দরজা বন্ধ করতে করতে মেরুদণ্ডে একটা শিহরণ টের পাচ্ছিল। বুক কাঁপছিল ভীষণ!
নিশা, তোমাকে ভালোবাসি!
দরজাটা শুধু ভিড়িয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হলো না জাহিদ। খুব যত্ন করে ছিটকিনিটাও আটকালো। আর তখনই…ঠিক তখনই ভীষণ রকমের একটা উৎকট সংকোচের ঢেউ তেড়ে এসে ওর মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়ে গেল। কেন ডাকল নিশাকে? কী দরকার ছিল? ছিঃ মেয়েটা কী ভাবছে কে জানে! এমনিতেই ওর কাছে সে নিছক এক কামুক বা লম্পট পুরুষ ছাড়া অন্য কিছুই তো না! যতবার কথা হয়েছে, নিশা ঘুরেফিরে সেই রাতের প্রসঙ্গই তো টেনে এনেছে …দোষারোপ করেছে… আফসোস করেছে… ঘৃণা করেছে… জাহিদের ভেতরকার মানুষ মনটা তো কোনদিন দেখার চেষ্টা করেনি। শুধু নিশা কেন, জাহিদের মনে হয় সংসারের প্রতিটি সদস্যই তাকে আবেগ-অনুভূতিহীন অচেতন পদার্থ বলে মনে করে। আড়ষ্ট ভাবে একবার নিশার দিকে তাকাল ও। বুকশেলফের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। জাহিদ কয়েক পা হেঁটে টেবিলের কাছে এগিয়ে এলো। বসল চেয়ারে।
নিশা শেলফ থেকে একটা বই নামিয়ে নিয়েছে। বুঝতে পারছে না এই মুহূর্তে ঠিক কী করা উচিত। বইয়ের অক্ষরগুলোর দিকে সে তাকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু পড়ছে না কিছুই। মাথাটা পুরাই ফাঁকা…যেন গড়ের মাঠ! জাহিদ নিশ্চয়ই কোন প্রয়োজনেই ডেকেছে। তার কাছে ঠিক কী প্রয়োজন থাকতে পারে মানুষটার, এটা ভাবতে গিয়ে উৎকণ্ঠা, উত্তেজনা আর রোমাঞ্চে শিহরিত হচ্ছিল আত্মা। কিন্তু সেই মানুষ তো কোন কথাই বলছে না! নিশা এবার সাহস করে ঘুরে দাঁড়াল। ঘুরতেই দেখল জাহিদ নিমগ্ন দুটি চোখ পেতে রেখেছে ল্যাপটপের স্ক্রিনে। বাম হাতের করতলে চিবুকটা রাখা, ডান হাতের মুঠোয় ছোট্ট মাউজ। ল্যাপটপের পাশে রাখা প্রিন্টারে ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। সেকেন্ডের মধ্যে একের পর এক কাগজ বেরোতে লাগল যন্ত্রটার পেট থেকে। জাহিদ কাগজগুলো হাত দিয়ে কুড়িয়ে নিল, সাজিয়ে নিল ক্রমান্বয়ে। কাণ্ড দেখে নিশা হাসবে বা কাঁদবে বুঝে উঠতে পারল না। কাজই যদি করতে হয় তাহলে ওকে ডেকে আনার কী দরকার ছিল? এত অদ্ভুতও মানুষ হয়? রাগ হলো খুব। পরমুহূর্তেই আবার মনে হলো এটাই ভালো…এটাই স্বস্তির। কাজ করতে থাকা, ব্যস্ত, অভিনিবিষ্ট, গম্ভীর জাহিদের দিকে এমনি এমনি তাকিয়ে থাকতেই বরং বেশি ভালো লাগছে। তবে এই ভালোলাগাটা কেমন যেন! রোমাঞ্চ আছে শিহরণ আছে কিন্তু তৃপ্তি নেই বিন্দুমাত্র। ওই মুখের দিকে চেয়ে থেকে, অলৌকিক ভালো লাগায় ভাসতে ভাসতে, নিশা টের পেল ওর বুকের মধ্যে আসলে কাঠ কয়লার মতো পুড়ছে জনম জনমের তৃষ্ণা!
হঠাৎ চোখে চোখ পড়তেই চমকে উঠল। চুরি ধরা পড়ে যাওয়া অপরাধীর মতো নিচু করল মুখ। হালকা একটা হাসির রেশ পড়ল জাহিদের ঠোঁটে ঠাট্টার সুরে বলল, ‘আমি ভাবলাম তুমি বই পড়ছ!’
নিশা বইয়ের পাতায় চোখ রেখে মনে মনে বলল, নাহ…পড়ছিলাম তো আপনাকে!
— ‘বই পড়তে তোমার ভালো লাগে?’ ছুটে এলো প্রশ্নটা।
নিশা বই নামিয়ে রাখল টেবিলে। নিজের হাতের ওপর চোখ পড়তেই মনে হলো হাতটা যেন অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। চট করে হাতটা ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে ফেলে বলল, ‘আগে পড়তাম।
— ‘কার লেখা পছন্দ তোমার?’ উৎসুক গলায় প্রশ্ন করে জাহিদ। নিশাকে এখনো বসতে বলা হয়নি। তাই সে বসল না। স্কুলছাত্রীর মতো জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, ‘হুমায়ূন আহমেদ।
জাহিদ চেয়ারের পিঠে মাথাটা হেলিয়ে দিল। হালকা একটু দুলতে লাগল চেয়ারটা। একটা ফাউন্টেন পেন দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবল। তারপর পেনটা মুখ থেকে সরিয়ে বলল, ‘নাম শুনেছি। উনি কি বাংলাদেশের সবচেয়ে ফেমাস রাইটার?
— ‘জি। আপনি উনার লেখা পড়েননি?’
জাহিদ একটু লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি বাংলা পড়তে পারি না।’ নিশা খুব অবাক হল, ‘তাই?’
— ‘হুম…।’
— ‘আসলেই?’
— ‘এখানকার স্কুলে পড়াশোনা করেছি। বাংলায় লেখাপড়া করার সুযোগ হয়নি।’
— ‘কিন্তু আপনি তো খুব ভালো বাংলা বলতে পারেন।’
— ‘এটার ক্রেডিট আমার বাবা-মায়ের। আমাদের বাসায় ইংরেজি বলা অ্যালাউড ছিল না। এখনো বাড়িতে ইংরেজিতে কথা বললে বাবা খুব রাগ করেন।’ একটু থেমে জাহিদ আবার বলল, ‘তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন?
নিশা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। সামনে তাকাতে পারল না। লজ্জা পাচ্ছে সে। অযথাই লজ্জা পাচ্ছে! অযৌক্তিক লজ্জাটুকু আড়াল করতেই বোধহয় টেবিলের ওপর রাখা বইটা আবারও হাতে তুলে নিল। নামটা দেখল এতক্ষণে, টু কিল আ মকিং বার্ড, হারপার লির লেখা। অস্থিরভাবে পৃষ্ঠা ওল্টাতে লাগল। জাহিদ হাতে ধরা ফাউন্টেন পেনটা দাঁত দিয়ে কামড়ে যাচ্ছিল অনবরত। দেখছিল নিশার আরক্তিম মুখ, একটু একটু ভেজা চুল আর পিটপিট করে নড়তে থাকা বড় বড় চোখের পাপড়ি। জাহিদের ইচ্ছে হলো ওই পাপড়িগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। ছুঁয়ে দেখে ওটা আসল নাকি নকল। এই সন্দেহটা এর আগেও এসেছে মাথায় বহুবার। আজকাল তো মেয়েরা ফলস ল্যাশ ছাড়া বেডরুমের বাইরেও পা রাখে না। কী অদ্ভুত সব ঠুনকো ভাবনা ভেবে যাচ্ছে সে। আশ্চর্য! সেই সময় নিশা মুখ তুলে প্রশ্নটা করল, হবে?’
— ‘সত্যি আপনি বাংলা পড়তে পারেন না?’
জাহিদ অতীব লজ্জার সঙ্গে বলল, ‘পারি না…তুমি শেখাবে আমাকে?’ নিশা অপ্রস্তুত হাসল, ‘আমি কী করে শেখাব?’
জাহিদ একটা কলম আর নোটপ্যাড এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘লিখো।’
— ‘কী লিখব?’ নিশা অবাক।
— ‘জুবিনের নামটা লিখো বাংলায়।”
— নিশার ঠোঁটে একটা বঙ্কিম হাসির চিলতে রেখা ভেসে উঠল, ‘লিখে কী হবে?
— ‘প্র্যাক্টিস করব।’
নিশা কাগজের ওপর জুবিনের নামটা লিখল। লেখা শেষ করে কাগজটা মেলে ধরল চোখের সামনে। জাহিদ বলল, ‘ইংরেজিতেও নামটা লিখে রাখো পাশে।’
লিখল নিশা। তারপর বলল, ‘আর কী লিখব?’
— ‘তোমার নাম লিখো।’
নিশা লিখল। লিখে নিয়ে কাগজটা তুলে ধরল সামনে। জাহিদ দেখল সাদা কাগজের ওপর নীল কালিতে চমকাচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দুটি নাম।
‘আর কী লিখতে হবে?’ নিশার প্রশ্ন। একটুও সময় নষ্ট না করে জাহিদ ভরাট অথচ নির্বিকার গলায় বলল,
— ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি!’
— ‘হ্যাঁ?’ চমকে উঠল নিশা। এতটাই চমকালো যে আঙুলের ফাঁক গলে কলমটা টুপ করে খসে পড়ল মাটিতে। নিশার ওই আঁতকে ওঠা ভীত শঙ্কিত কাঁচুমাচু মুখ দেখে হেসে ফেলল জাহিদ। হাসতে হাসতে বলল, ‘ভয় পেও না। কথাটা তোমার উদ্দেশ্যে বলা হয়নি। যেকোনো নতুন ভাষা শেখার সময় সবার প্রথমে ভালোবাসার বাণী শেখার নিয়ম আছে।’
হাসিটা দেখে নিশার গায়ে গরম তেলের ছিটা পড়ল। নিজের বোকামীর কথা চিন্তা করে ব্রহ্মরন্ধ্র জ্বলে উঠল একদম! এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল লোকটা তাকেই কথাটা বলেছে। আরেকটু হলেই প্রাণবায়ু ঠুস করে বেরিয়ে যেত শ্বাসনালি দিয়ে। এতটা হাঁদা কেন সে? এই সব হাঁদাগিরির জন্যই তো জীবনে আজ এত বিপর্যয়। রোষপরবশ থমথমে মুখ নিয়ে চট করে মাটি থেকে কলমটা তুলে নিল নিশা। খসখস করে যন্ত্রের মতো লিখল কাগজে কয়েকটা শব্দ। তারপর কাগজটা জাহিদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কেন ডেকেছিলেন আমাকে?’
মনে মনে থমকে গেল জাহিদ। বিভ্রান্তির একটা অস্ফুট ছায়া পাত ঘটল ওর মুখে। এই প্রশ্নের উত্তর তার নিজেরই জানা নেই। নিশাকে বলবে কী করে? নিশা চেয়ে আছে উত্তরের আশায়। কিছু একটা বলা দরকার। কী বলা যায় ভেবে পাচ্ছে না জাহিদ। একটু নার্ভাস লাগছে। অল্পবয়সি একরত্তি মেয়েটার সামনে…জাহিদের মতো পূর্ণবয়স্ক পুরুষ মানুষের নার্ভাস লাগছে এমন হাস্যকর কথা কেউ কোনদিন শুনেছে? তবে সামলে নিতে খুব একটা সময় লাগল না। সেকেন্ডের মধ্যেই আত্মরক্ষার শক্তি ফিরে পেল মনের ভেতর। ভ্রু উঁচিয়ে ড্যামকেয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘ডেকেছিলাম নাকি?’
নিশার মুখে অপমানের তপ্ত রেখা আঁক কেটে গেল ক্ষণিকের জন্য। ঝাঁজ নিয়ে বলল, ‘ডাকেননি?’
— ‘মনে পড়ছে না।’
নিশা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘তাহলে বসে থেকে লাভ নেই। আমি বরং যাই।’
জাহিদ একজোড়া প্রখর চোখ নিশার অপমানে লাল হওয়া মুখের ওপর বিছিয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি কি ভয় পাচ্ছ?’
ক্ষিপ্রতা এবার চরমে উঠল, ‘ভয় পাব কেন?’
— ‘আমি কী জানি! তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে ভয়ে কাঁপছ।
নিশার একটা দমবন্ধ ভাব হলো। চট করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আজাইরা কথার সময় নাই আমার। জরুরি কিছু বলার থাকলে বলুন নইলে যেতে দিন।’ জাহিদ কলম দিয়ে কাগজের ওপর আঁকিবুকি করতে করতে শান্ত কণ্ঠে বলল,
— ‘তোমার কেন মনে হলো আমার কিছু বলার থাকতে পারে?’
নিশা বড় একটা শ্বাস টেনে ভেতরকার উত্তেজনা বশে আনার চেষ্টা করল। পারল না। টের পেল অস্থিরতায় বুকটা কাদাজলের মতো থকথক করছে। এগিয়ে গেল দরজার দিকে। মনে হচ্ছিল এই ঘর থেকে বেরোতে না পারলে ব্রেইনস্ট্রোক হবে।
— ‘নিশা!’
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল নিশা। আপনা-আপনিই আটকে গেল শ্বাস। ঘুরে তাকাল। জাহিদ ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখেই বলল, ‘এক গ্লাস পানি দিও তো।’ আদেশটা শুনে রাগে গা জ্বলতে লাগল। পানির জগ আর গ্লাস বিশাল লম্বা টেবিলটার এক প্রান্তে সযত্নে রাখা আছে। উঠে এসে পানি ঢেলে পান করা যায় অনায়াসে। বসে বসে জমিদারের মতো আদেশ করার কোন মানে হয় না। রাগে গজগজ করতে করতে টেবিলের কাছে ফিরে এলো নিশা। জগ থেকে পানি ঢালল গ্লাসে। তারপর পানিভর্তি গ্লাস নিয়ে জাহিদের পাশে এসে দাঁড়াল। নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে। হাত টানটান করে এগিয়ে দিল গ্লাসটা।
জাহিদ আড়চোখে দেখল নিশাকে। দেখল ওর গা-বাঁচিয়ে দাঁড়াবার আড়ষ্ট ভঙ্গিটা। গ্লাস হাতে নিল। এক চুমুকে পান করল অনেকটা পানি। তারপর নিজের মাথার হালকা ভেজা ভেজা, ছোট ছোট চুলে চমৎকার ভঙ্গিতে পাঁচ আঙুল চালিয়ে দিয়ে অনেকটা হুকুম দেওয়ার স্বরে বলল, ‘এটা দ্যাখো।’
নিশা ওর ডাগর ডাগর বশীভূত চোখ মেলে দেখল আঙুল চালানোর পর চুলগুলোতে সুবিন্যস্ত একটা ভাঁজ পড়েছে। এই পাট পরিবর্তনটা সুন্দর। নিশার চোখের ওপর মুগ্ধতার একটা আলগা চাদর ঝুলে পড়েছে। ঠোঁটের দূর প্রান্তে আবছা হয়ে ফুটে উঠেছে সম্মোহিত হাসি। জাহিদ ল্যাপটপের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘আমাকে দেখতে বলিনি। এদিকে দ্যাখো।’ নিশা নিভল ভস করে। মুগ্ধতার চাদর চিরে অপদস্ত ভাব ফুটে উঠল সারা মুখে। ব্রিবতভাবে তাকাল ল্যাপটপের স্ক্রিনে। জাহিদ গম্ভীর গলায় বলল, ‘এই অ্যাপে অজস্র বাড়ির বিজ্ঞাপন আছে। দ্যাখো তো কোনটা পছন্দ হয়?’
— ‘মানে?’
জাহিদ রিভলভিং চেয়ারের পিঠে মাথা হেলিয়ে দিয়ে হাতে ধরা কলমটা দাঁতে চেপে ধরে বলল, ‘বাড়ি কিনব।’
নিশার কণ্ঠস্বর থমথম করে উঠল, ‘আপনার বাড়ি আপনি কিনবেন, আমার কী?’
— ‘বাড়িটাতে তুমি জুবিনকে নিয়ে থাকবে। তাই তোমার মতামত প্রয়োজন। এটা না বোঝার তো কিছু নেই। ইটস নট রকেট সায়েন্স।’
কথাটা কানে প্রবেশ করা মাত্র নিশার নিষ্কলুষ সুন্দর মুখখানায় গঞ্জনা সর্বস্ব ক্রোধ সাপের মতো ছোবল দিয়ে উঠল যেন। বিষাক্ত গলায় কেটে কেটে বলল, ‘আপনার বাড়িতে আমাকে আর আমার মেয়েকে থাকতে হবে কেন? আমি কাজ করব। কাজ পেলেই জুবিনকে নিয়ে আলাদা বাসায় উঠে যাব। আপনাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না।
— ‘তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি জুবিনের বাবা। ওর ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করে তোলা আমার দায়িত্ব।’
নিশা গোঁ ধরা গলায় বলল, ‘এসবের প্রয়োজন নেই।’
জাহিদের চোখে রোষের অশনি চিলিক কেটে গেল। কঠিন গলায় বলল, ‘আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। হেরফের হবে না। আই ওন’ট চেঞ্জ মাই মাইন্ড।’
— ‘আমিও জানিয়ে দিলাম আমার সিদ্ধান্ত। আমি আর আমার মেয়ে কিছুতেই আপনার বাড়িতে থাকব না।
— ‘নিশা, তর্ক কোর না।’
— ‘আমার মেয়েকে নিয়ে আমি কোন কম্প্রোমাইজ করতে রাজি নই।’
কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগল জাহিদের। ইস্পাতের চেয়েও শক্ত হয়ে উঠল চোয়াল। গমগম করে বলল, ‘তাহলে জুবিন আমার সঙ্গেই থাকবে। তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে যেখানে খুশি যেতে পার।’
নিশার চোখদুটো অতৃপ্ত প্রেতাত্মার মতো ধক করে জ্বলে উঠল, ‘জুবিনকে আমি দেব না!
— ‘তাহলে আমার কথা মেনে চলতে হবে।’
— ‘আমি আপনার দয়ায় থাকতে চাই না।’
— ‘এখানে দয়ার কিছু নেই। আর যদি দয়া মনে কর তাহলে…হ্যাঁ, আমার দয়াতেই তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে।’
নিশার কেমন পাগল পাগল লাগছিল। মনে হচ্ছিল রাগে, আক্রোশে, অপমানে মাথার রগ ছিঁড়ে যাবে। হঠাৎ একটা কাণ্ড করে বসল সে। ল্যাপটপের পাশে কফির মগ রাখা ছিল। মগের তলানিতে কিছু কালো রঙের তরল কফি মজুদ ছিল তখনো। নিশা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে উন্মাদিনীর মতো কফির মগটা হাতে তুলে নিল। তুলে নিয়েই ত্বরিত গতিতে ভেতরের তরলটা ছুঁড়ে মারল জাহিদের মুখে। গলাফাটা চিৎকারে ভেঙে পড়ে বলল, ‘আমার মেয়ে আমার সঙ্গে থাকবে! এটাই ফাইনাল!’
জাহিদের মুখ, কপাল, চুলের কিছু অংশে ব্ল্যাক কফি ছিটকে পড়েছে। অলিভ রঙের টিশার্টটাও অক্ষত নেই। কলারের কাছে কালো কালো ছোপ। মাথাটা হেলে গেছে পেছনে। মুখ কুঞ্চিত। চোখে ভর করেছে এক মর্মান্তিক দানবীয় ক্রোধ। ফরসা গালের গুঁড়ি গুঁড়ি কালচে দাঁড়ির ওপর দিয়ে স্পষ্টভাবে নীল রগ কাঁপতে দেখা যাচ্ছে। হাত হয়ে উঠেছে মুষ্টিবদ্ধ।
কয়েকটি বিমূর্ত মুহূর্ত কাটার পর নিশা নিজের কৃতকর্ম সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত হলো। কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে পাগলামোর চূড়ান্ত শিখর থেকে বিবেকের দ্বারপ্রান্তে নামিয়ে আনল ওকে। ভয়ের একটা কনকনে ঠান্ডা স্রোত দেহের প্রতিটি অণু-পরমাণুকে বরফের মতো জমিয়ে দিয়ে গেল। কৃতকর্মের অনুশোচনায় খণ্ড খণ্ড হয়ে যেতে লাগল হৃৎপিণ্ড। পাগলের প্রলাপ বকার মতো বলতে লাগল, ‘হায় আল্লাহ এ আমি কী করলাম! কী করলাম আমি!’
কম্পনরত স্খলিত হাতে রিভলভিং চেয়ারটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। গায়ে জড়ানো সুতির ওড়নার একটা প্রান্ত দিয়ে জাহিদের মুখ থেকে তরল পদার্থ মুছে নিতে লাগল। চশমা খুলে নিল। দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে আঠালো কফির দাগ মুছতে লাগল চশমার কাচ থেকে। জাহিদ অন্ধ হয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ চশমা ফেরত পাবার পর দেখতে পেল, নিশার চোখ উপচে বেয়ে পড়ছে রূপালি জল। ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে। বিড়বিড় করে অনবরত কিছু একটা বলে যাচ্ছে। জাহিদ ওর হাতটা ধরল, ‘তুমি কাঁদছ কেন?’
এই প্রশ্নের উত্তরে নিশার কান্নার দমক আরো বেড়ে গেল। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ‘আমি খুবই খারাপ একটা কাজ করেছি। এটা আমার করা উচিত হয়নি প্লিজ আমাকে মাফ করে দিন।’ জাহিদ বসা থেকে উঠল। দাঁড়াল নিশার মুখোমুখি। একটু আগে ভয়ংকর রাগে মাথার খুলি উড়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। কিন্তু নিশার কান্নাটা যেন রাগের ওপর জলের ছিটা দিল। নিভু নিভু করতে লাগল বুকের খরাময় শুকনো প্রান্তরে জ্বলতে থাকা ক্রোধবহ্নি শিখা। নিশার চোখ ভেসে যাচ্ছে জলে। সরু নাকটার ডগা টকটকে লাল। অশুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘এমন অসভ্যতা আমি জীবনে এর আগে কোনদিন করিনি বিশ্বাস করুন। আমার বাবা জানতে পারলে ভীষণ কষ্ট পাবে!’
— ‘ইটস ওকে। তোমার রাগ হয়েছে তাই একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছ। আই আন্ডারস্ট্যান্ড।’
নিশা দুদিকে মাথা নাড়তে নাড়তে নিদারুণ আর্তস্বরে বলল, ‘আমার শাস্তি হওয়া উচিত। আপনি আমাকে শাস্তি দিন। আপনি আমার মেয়ের বাবা। আমি কিন্তু আপনাকে মন থেকে কখনো অসম্মান করিনি। এটা জানেন তো?’
শেষের কথাটা স্বস্তি দিল জাহিদকে। শান্তির ছায়াস্নিগ্ধ মনোরম একটা অনুভূতি মুহূর্তের জন্য আরামদায়ক আবহ তৈরি করল মনের মধ্যে। নিশার ডান চোখের কোল উপচে একটা রুপো রঙের জলের ধারা লালচে নাকের পাশ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ছিল, মিলিয়ে যাচ্ছিল ঠোঁটের সঙ্গে। জাহিদ আঙুল দিয়ে সেই অশ্রুজল টুকু মুছে দিয়ে বলল, ‘কান্না করো না। ভয়ের কিছু নেই। আমি রাগ করিনি।’
— ‘প্লিজ জুবিনকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাবেন না। আপনার তো সব আছে। আমার যে জুবিন ছাড়া কেউ নেই। এটা আপনি বোঝেন না কেন?’
জাহিদ অধৈর্য হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। এখন তুমি কান্না থামাও। তোমার কান্না আমার ভালো লাগে না নিশা! কষ্ট হয়!’
হঠাৎ ছুটে আসা কথাটা যেন মন্ত্রের মতো কাজ করল। সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল নিশার শরীরের সমস্ত স্পন্দন। চমকে…ভীষণ চমকে তাকাল সে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে। কাটল কয়েকটা বিভ্রমের মুহূর্ত। নিশার স্থবির হয়ে আসা মুখ দেখে জাহিদ বুঝল সে নিশ্চয়ই অযাচিত কিছু বলে ফেলেছে। একটু অনুশোচনা হলো…আবার সূক্ষ্মভাবে এটাও টের পেল যে এই অনুশোচনার সঙ্গে একটা গোপন স্বস্তি আছে। কারণ কথাটা এক বিন্দুও মিথ্যে নয়।
নিশা চুপ করে চেয়ে আছে। সুরের মূর্ছনার মতো স্নিগ্ধ হয়ে এসেছে ওর জলসিক্ত চোখের দৃষ্টি। কত ছোট্ট একটা কথা। অথচ কী দারুণ শক্তিশালী…কী দারুণ সুন্দর…নিশার মনে হলো এত সুন্দর কথা সে অনেক দিন শোনেনি। এত শান্তি…এত প্রশান্তি…বহুদিন ধরে দল বেঁধে বেড়াতে আসে না ওর মনের ঘরে। একটানা দুরূহ ক্লান্তির পর যেন একটু খানি বিশ্রাম মিলল। নিশার সারা শরীরে ঘুমের মতো একটা ঝিরিঝিরি শান্তির আবেশ নেমে এলো। ঠোঁটে ফুটে উঠল প্রচ্ছন্ন হাসি।
— ‘কেন?’ মাথাটা ডান দিকে হেলিয়ে কৌতূহলী বয়ঃসন্ধির বালিকার মতো আহ্লাদী গলায় প্রশ্ন করে নিশা। জাহিদ চোখ সরিয়ে নেয়। পিছিয়ে আসে কয়েক পা। কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলে, ‘কেন মানে?’
নিশা হাসে, ‘আমাকে কাঁদতে দেখলে আপনার ভালো লাগে না কেন?’
জাহিদ টেবিলের ওপর ছিটকে পড়া কফি ন্যাপকিন দিয়ে মুছতে মুছতে সাধারণ গলায় বলল, ‘কেউ আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছে এই দৃশ্যটা দেখতে আমার কেন ভালো লাগবে?’
একটা ঝাঁকুনি এসে লাগল নিশার মনে। সংবিৎ ফিরল যেন। তাই তো…মানুষের কান্না দেখতে কারই বা ভালো লাগে! কত সাধারণ একটা কথা থেকে অসাধারণত্বের নির্যাস বের করে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল সে। বুকের মধ্যে স্বপ্নভঙ্গের মতো একটা বেদনার উদ্রেক হলো। ভীষণ অবসন্ন আর মলিন দেখাল ওকে মুহূর্তের জন্য। জাহিদ চেয়ারে এসে বসল। চশমাটা খুলে চোখ দুটো হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কচলে নিল একবার। তারপর চশমা পরে নিয়ে খুব গম্ভীর গলায় বলল, ‘শোন…জুবিন তোমার কাছেই থাকবে। এ নিয়ে আমি আর কোন কথা বলতে চাই না। তবে আমার মেয়েটাকে মাঝেমধ্যে আমাকে একটু দেখতে দিও। এটুকুই অনুরোধ রইল।’
নিশা কিছু বলল না। কেমন স্থবির চোখে তাকিয়ে রইল শুধু।
— ‘তোমার কি আর কিছু বলার আছে?’
নিশার চোখে তখনো জলের ছাপ লেগে ছিল। ওড়নাটা ঝুলছে বাঁ কাঁধে ও জানালা দিয়ে আসা তুষার দিনের সাদা আলোয় শরীর ঝলসে যাচ্ছে। জাহিদ গালে হাত রেখে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। কলম দিয়ে কাগজের ওপর কী সব আঁকিবুকি করতে করতে বলল, ‘তুমি কি কিছু বলতে চাও?’
নিশা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। তার মুখে একটা বিমূঢ় ভাব খেলছে। রক্তে বইছে তুষের আগুন। মনে হচ্ছে আজকে একটা ফয়সালা করতে না পারলে এই আগুন নিভবে না। তার ইচ্ছে হলো লোকটার গলা চেপে ধরে প্রশ্ন করে, কেন সে এমন অদ্ভুত? কেন নিশা ওকে এত করে চাওয়ার পরেও নিশাকে সে একটাবারের জন্যও চায় না?
জাহিদ এগিয়ে এসেছে আবার। সামনে দাঁড়িয়ে ওর মুখের সামনে একটা তুড়ি বাজিয়ে বলছে, ‘কী সমস্যা?’
নিশার চোখে ক্রোধ। নিঃশ্বাসে আগুন। জাহিদ বলল, ‘আমি তো বললাম জুবিন তোমার সঙ্গেই থাকবে। খুশি হওনি?’
নিশা বলল, ‘আপনাকে আমার বিরক্ত লাগে!’
জাহিদ তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করল নিশাকে, তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করল, ‘কেন?
— ‘সহ্য করতে পারি না…এইজন্যে।’
— ‘তুমি কি স্যাডিস্ট? মানুষকে কষ্ট দিতে তোমার ভালো লাগে?’
— ‘মানুষকে কষ্ট দিতে আমার একটুও ভালো লাগে না। কিন্তু আপনাকে কষ্ট দিতে পারলে আমার প্রচণ্ড আনন্দ হয়।’
নিশার দিঘল পল্লবঘেরা সুন্দর দুটি চোখের দিকে কিছুক্ষণ বিভ্রান্তভাবে চেয়ে রইল জাহিদ। তারপর হঠাৎ কাঁধ চেপে ধরে ঝড়ের চেয়েও ক্ষিপ্র গতিতে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এলো। তীব্র কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘আমাকে কষ্ট দিতে তোমার ভালো লাগে কেন?’
নিশা খাঁচাবন্দি পাখির মতো ছটফট করে বলল, ‘যেতে দিন। ছাড়ুন।
— ‘আগে বলো কেন এত কষ্ট দাও আমাকে?’
নিশা ঘাড় ঘুরিয়ে নেয় অন্যদিকে, – ‘বললাম তো…আপনাকে কষ্ট দিতে ভালো লাগে।’
ওর গাল চেপে ধরে মুখটা নিজের দিকে জোর করে ফিরিয়ে আনে জাহিদ, ‘কেন ভালো লাগে?’
নিশা দুরন্ত চোখে তাকিয়ে থাকে শুধু। কিছু বলে না। সামনে দাঁড়ানো মানুষটার উষ্ণ নিঃশ্বাস ওর মুখে এসে পড়ে। শিরশির করে পায়ের পাতা। জাহিদের প্রখর উপবাসী দৃষ্টি নিশার চোখ-নাক পিছলে কোমল রক্তাভ ঠোঁটজোড়ার ওপর লেজার বিমের মতো আটকে পড়ে। হাওয়ায় একটা সম্মোহনের জাল তৈরি হয়। হৃদযন্ত্রে দ্রিম দ্রিম শব্দে বাজতে থাকে বাজনা। নিশা জাহিদের টকটকে গৌরবর্ণের ছিপছিপে, একহারা, তপ্ত চোয়ালে শক্ত করে দুটি হাত চেপে ধরে কাটা কাটা গলায় বলে, ‘এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমার জানা নেই। শুধু জানি যতদিন বেঁচে আছি তোমাকে আমি শান্তিতে থাকতে দেব না জাহিদ মুর্তজা! আমার হাত থেকে তোমার নিস্তার নাই!’
জাহিদ দেখল ওই চোখে ক্রোধ আছে স্পষ্টতই, কিন্তু ঘৃণার চিহ্নমাত্র নেই! কিছুক্ষণ শ্বাসরোধ করে ওদিকে চেয়ে থেকে সে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘কেন?’
হঠাৎ আঘাত পড়ল দরজায়। জাহিদ আস্তে করে ছেড়ে দিল নিশাকে। সরে এলো কয়েক পা। টেবিল থেকে এক টুকরো কাগজ তুলে নিল। হাত বাড়িয়ে বলল, ‘তোমার এটা নিয়ে যেও।’
নিশা কাগজটা হাতে নিল। কোন প্রশ্ন করতে পারল না। তখনো প্রবল ভাবে বুক কাঁপছিল ওর। দরজার বাইরে শহীদ দাঁড়িয়ে ছিল। নিশা একটা সালাম দিয়েই কেটে পড়ল দ্রুত। লিভিং এ এসে দেখল শ্বশুর-শাশুড়ি, তুরিন, নীলিমা সবাই ফায়ারপ্লেসের সামনে চেয়ার টেনে বসেছে। বাইরে অনবরত তুষার ঝরছে। তাপমাত্রা কমতে কমতে এখন মাইনাস দশে ঠেকেছে। জুবিন দাদার কোলে দোল খাচ্ছিল। ফারা এগিয়ে এসে মুখে ব্যঙ্গের ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘নিশা শোন, একটু পরেই গেস্ট আসা শুরু হবে। তুমি এক কাজ কর। তাড়াতাড়ি ঘরের দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে যাও। কেউ দেখে ফেললে কী হবে বলো? জুবিনের নার্স বা ন্যানি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। এর চেয়ে কেউ তোমাকে না দেখুক, এটাই ভালো!’
নিশা বিষদৃষ্টিতে তাকাল ফারার দিকে। অফিসরুম থেকে জাহিদ বেরিয়ে এসেছে তখন। ফারা জাহিদের দিকে এগিয়ে গেল। সামনে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলতে লাগল চাপা গলায়। ওদের দুজনকে আজকাল একসঙ্গে দেখতে অসহ্য লাগে নিশার। মন বিষিয়ে ওঠে একদম! এখনো রক্তে বিষের জ্বালা টের পাচ্ছিল। শাশুড়ি পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। কী যেন বলছেন উঁচু স্বরে। নিশা শুনতে পাচ্ছে না কিছুই। তার কানের কাছে ঝিঁঝি ডেকে চলেছে অনবরত। ফারা আর জাহিদের দিকে সর্পিল দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সে। শাশুড়িকে দেখল একবার। কথা বলেই যাচ্ছেন। হঠাৎ কী মনে করে যেন নিশা চোখ ফেলল হাতে ধরা কাগজটার ওপর। চোখ পড়া মাত্রই ধক করে উঠল বুক। হৃৎপিণ্ডটা লাফ দিয়ে চলে এলো বুকের কাছে। সাদা কাগজের মাঝ বরাবর নীল কালি দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে বাংলায় লেখা,
নিশা, তোমাকে ভালোবাসি!
চমকানো বক্ষ নিয়ে তাকাল জাহিদের দিকে। জাহিদ ফারার সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিশাকেই দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই ঠোঁটে দুর্বোধ্য চাপা হাসি নিয়ে ভারী সুন্দর ভঙ্গিতে ডান চোখটা ব্লিংক করল। নিশার মুখে ঝাপটা মারল রক্ত। পিঠে গজিয়ে উঠল অদৃশ্য একজোড়া প্রজাপতির ডানা। অনেক অনেক দিন পর ওর পৃথিবীটা সুখ সুখ…স্বপ্ন স্বপ্ন… অজস্র লাল-নীল দীপাবলিতে আগাপাশতলা ভর-ভরন্ত হয়ে উঠল। সুখের অত্যাচারে আটকে গেল শ্বাস। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ একযোগে গলা মিলিয়ে ফিসফিস করে বলতে লাগল একটি মাত্র বাক্য,
ভালোবাসি…ভালোবাসি…নিশা, তোমাকে ভালোবাসি!
দুঃস্বপ্নের ঘোর
নিজের মৃত্যু নিয়ে একটা দুর্ধর্ষ স্বপ্ন আছে শাহজিদের। এই স্বপ্নের উদ্ভব হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। বাবার মৃত্যুর দিন। টানা বত্রিশ ঘণ্টা বিমান যাত্রার পর, বাংলাদেশ থেকে ডেনভার পৌঁছেই উৎকণ্ঠিত শাহজিদ ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালে। জানতে পারল মাত্র পাঁচ মিনিট আগে বাবা শেষ নিঃশ্বাস বিসর্জন দিয়েছেন। যন্ত্রণা হলো না, কষ্ট হলো না…বরং প্রকৃতির এই অদ্ভুত প্রহসন তাকে চূড়ান্ত এক অতীন্দ্রিয় বিস্ময়ের উন্মত্ত আস্ফালনে প্রস্তর খণ্ডের মতো নিঃসাড় করে দিয়ে গেল। কিছুতেই বোধগম্য হলো না যে বাবার মৃত্যুর ঘটনাটি আর দশ মিনিট পরে ঘটলে কী এমন ক্ষতি ছিল? তবে কি প্রকৃতি, ঈশ্বর বা আল্লাহ যে নামেই তাঁকে ডাকা হোক না কেন, সেই মহাপরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় শক্তির কাছে পিতা-পুত্রের শেষ সাক্ষাতের মতো আবেগপ্রবণ, করুণ, এবং গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর বলে প্রতিপন্ন হলো? এই শাস্তি কি শাহজিদের প্রাপ্য ছিল? তার বয়স তখন মোটে ষোল। বিস্তর পাপ জমানোর মতো বয়স সেটা না। বরং পাপ-পুণ্যের সংজ্ঞাটুকুও ঠিকঠাক জানা হয়ে ওঠেনি। তবে বাল্যকাল থেকেই নিজের প্রতি প্রকৃতির এক ধরনের নিষ্ঠুর উদাসীনতা সে লক্ষ করে এসেছে। মায়ের অনুপস্থিতি এবং মাতাল অধঃপতিত চরিত্রের পিতার সান্নিধ্য শৈশবের সহজ- সরল স্বপ্নীল দিনগুলোকে কখনোই শতভাগ বর্ণীল হতে দেয়নি। বাবাকে সে খুব বেশি ভালোবাসেনি। সুযোগ হয়নি। কিন্তু রক্ত এক আশ্চর্য শক্তিশালী জিনিস। ভালোবাসা থাক বা না থাক, টান থাকবেই! রক্তের টান অগ্রাহ্য করা ক্ষমতা মানুষের নেই।
সেই দুপুরটাও এমনই ছিল…সাদা সাদা অজস্র বরফবিন্দুতে ভরে উঠেছিল রাজধানী। তুষারাবৃত আকাশটা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ঝরে পড়ছিল সুবিশাল দশ লেন বিশিষ্ট মহাসড়কে। দোচালা বাড়ির ছাদে। গাড়ির পিঠে। শাহজিদ শেষবারের মতো বাবাকে একনজর দেখল। চোখ ঝাপসা হলো না। বুক কাঁপল না। শুধু কয়েকটা ক্ষণ বিষাদগম্ভীর চোখে চেয়ে রইল পিতার নিথর মৃতদেহের দিকে। তারপর বেরিয়ে এলো রাস্তায়। চারিদিকে নিষ্কলুষ শুভ্র তুহিনের ঘেরাটোপ দেখে মনে হয় মশারির জাল। বড় বড় তুষার দানা মুখে এসে বিঁধছে, ভাঙছে, মিশে যাচ্ছে! পৃথিবীটা ক্রমেই সাদা রঙের ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। সেই আদিগন্ত সাদায় ডুব দিয়ে শাহজিদ রাস্তার ধার ঘেঁষে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগল। তার ভেতরটা তখন অদ্ভুত রকমের অবশ। কষ্ট নেই, যন্ত্রণা নেই…আছে শুধু দুকূল ছাপানো হুহু শূন্যতা। বুক মথিত হয়ে উঠে আসছে রক্তাক্ত দীর্ঘশ্বাস। বাতাস ফিসফিস করে বলছে, কেউ নেই…কেউ নেই! তুমি একা… তুমি ভীষণ একা! হঠাৎ তুষার ঝড়ের সাদা তাণ্ডবের মধ্যে, দূরের রকি মাউন্টেনের রুপালি বরফের মুকুট পরা সর্বোচ্চ শিখরখানি আয়নার মতো ঝলসে উঠল চোখের সামনে। অমর্ত্য সুন্দর সেই টুকরো দৃশ্যখানি শাহজিদের মনে এক পুলকসমৃদ্ধ আচানক শিহরণের উদ্রেক করল। মনে হলো রূপবতী সেই পাহাড় বরফকুচির সাদা খামে করে তার জন্য পাঠিয়েছে ছুটির আমন্ত্রণপত্র! পাহাড় ডাকছে… হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে! মুক্তির আনন্দে চনমন করে উঠল রক্ত। ফিরে এলো উত্তাপ। মন চাইল এখুনি ছুটে যায় ওই পর্বত শৃঙ্গে। তারপর আকাশের খুব কাছাকাছি…পাহাড়ের কোলে ভাসতে ভাসতে সাদা ধবধবে খুশিয়াল শুভ্র বরফ গায়ে মেখে…মাথার মগজের মধ্যে পরপর দুটা চকচকে বুলেট গেঁথে দেয় সযত্নে! একটা বিকট শব্দ…পর্বতের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা মাউন্টেন লায়নের সচকিত চিৎকার…তারপর ফুটফুটে ধবল বরফের ওপর এক ঝাঁক টকটকে লাল রক্তের ছিটকে পড়া আলপনা! দেহ নামক খাঁচা থেকে একটা অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি। আহ…..কী শান্তি!
সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। জীবনের অমোঘ বাস্তবতার ঘষা লেগে দুৰ্ধৰ্ষ সেই স্বপ্ন ভোঁতা হয়ে এসেছে দিনকে দিন। তবে পাহাড়কে সে ভালোবেসেছে প্রতিনিয়ত। সব সময় ভেবেছে একদিন পাহাড়েই মরবে। সংগীতশিল্পী জন ডেনভারের দেহের ছাইভস্ম যেভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সুবিস্তৃত রকি মাউন্টেনের বুকে, ঠিক তেমনি শাহজিদও চায় তার দেহটা মৃত্যুর পর রকি পর্বতমালার প্রস্তর খণ্ডের সঙ্গে মিশে যাক। আজ সেই পুরনো দুর্ধর্ষ স্বপ্নটা আবারও মাথা চারা দিয়ে উঠেছে। নিজের ঘরে ফিরে এসে ক্লজেটের কাপড়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা রিভলভারটা বের করেছে শাহজিদ। এটা কেনা হয়েছিল করোনা অতিমারির সময়। সুইসাইড করার জন্য নয়, কিনেছিল আত্মরক্ষার খাতিরেই। আত্মরক্ষা বা আত্মহত্যা, যেকোনো প্রয়োজনে এই ছোট্ট জিনিসটাকে মাঝেমধ্যে বড্ড উপকারী মনে হয় শাহজিদের। হাতে ধরা রিভলভারটা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে দেখতে শাহজিদের মস্তিষ্কে সেই দুর্ধর্ষ স্বপ্নের ঘোর ঝিলিক দিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। কতদিন পাহাড়ে যায় না…কত্তদিন! এবার যাবে…যেতেই হবে! লোকালয়ে থেকেই বা আর কাজ কী বলো? লোকালয় ভরে গেছে তুরিন আর তুরিনের মায়ের মতো প্রবঞ্চক চরিত্রহীন মানুষে। তুরিনকে সে অন্যরকম ভেবেছিল। ফারার সঙ্গে প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল মুর্তজা সাহেবের হোটেলের অফিসে, শাহজিদ ভুলেও ভাবতে পারেনি সহজ-সরল বোকা তুরিনের মা হতে পারে ফারার মতো লাস্যময়ী ভ্রষ্টচরিত্র মহিলা। প্রথম সাক্ষাতের দুদিন পরেই রকি মাউন্টেনের এক গিরিখাদসংলগ্ন পার্কে ফারাকে অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছিল, একজন পুরুষের সঙ্গে। সেই পুরুষ তুরিনের বাবা নয়।
শাহজিদ খুব একটা সংস্কারবদ্ধ জীব ছিল না কখনো। অ্যাঞ্জেলিনা একাধিক পুরুষের শয্যাসঙ্গীনী হয়েছে, এটা জানার পরেও ওকে ভালোবাসতে চেয়েছিল। লিভ টুগেদারের প্ল্যান করেছিল। মেয়েটা স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড ছিল, আধুনিক ছিল, কিছুটা উদ্ধতও ছিল…কিন্তু মিথ্যুক কখনই ছিল না। শাহজিদ পঙ্গু হওয়ার পর ভালোবাসার মিথ্যে অভিনয় করেনি। খুব দ্রুত ব্রেকআপ করেছে। প্রতারণার আশ্রয় নেয়নি। এ কারণেই মেয়েটাকে মন থেকে ভালোবাসতে না পারলেও সম্মান সব সময় করেছে। কিন্তু তুরিনের মতো মেয়েদেরকে ঠিক কীভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায় জানে না সে। স্বল্পপরিচিত কোন যুবককে হুট করে চুমু খায় কী করে একজন রুচিশীল বিবেকবান মেয়ে? এটা কী ধরনের অসভ্যতা? ভাবতে ভাবতে বাতাসে বারুদের গন্ধ পায় শাহজিদ। মনে হয় কোথাও একটা বিস্ফোরণ ঘটবে। ধ্বংস হবে সবকিছু। অথচ তুরিনকে নিয়ে সে কখনো কোন দিবাস্বপ্ন দেখেনি। ভালোও বাসেনি। ওর মতো বোকা, হিংসুটে, নিরেট মাথার মেয়েকে ভালোবাসার প্রশ্নই আসে না! কিন্তু আইরনি হচ্ছে তুরিনকে অর্ণবের পাশে দেখতে ওর মোটেও ভালো লাগে না। বুকের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকের মতো যন্ত্রণা হয়। অসহ্য লাগে সবকিছু!
গুলিভরা রিভলভারটা ট্র্যাভেল ব্যাগের ভেতর ঢুকিয়ে রাখল সন্তর্পণে ক্লজেট থেকে কয়েকটা কাপড় এলোমেলোভাবে তুলে নিয়ে ভরল ব্যাগে। অনলাইনে রেন্ট-এ কারের ওয়েবসাইট থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করল। ডিজেবল মানুষদের জন্য আলাদা সার্ভিস আছে। রেন্ট-এ কারের অফিস পর্যন্ত যাওয়ার জন্য গাড়ি আসবে বাড়িতে। একটু স্বস্তি বোধ হচ্ছিল। স্বস্তির প্রথম কারণ অনেক দিন পর সে পাহাড়ে যাবে। গাড়ি নিয়ে যতদূর যাওয়া যায়। আর দ্বিতীয় কারণ খুব অল্পদিনের মধ্যেই বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে তার বহু আরাধিত, আকাঙ্ক্ষিত দুর্ধর্ষ সেই স্বপ্ন!
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ১৮
১৮
— ‘নিশা!…নিশা!’
জুবিনকে কোলে নিয়ে নিশা সিঁড়ির দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে সবেমাত্র। মেয়েকে গোসল করাতে হবে, খাওয়াতে হবে তারপর ফুলবাবুটি সাজিয়ে দিতে হবে জন্মদিনের পার্টির জন্য। সিঁড়িতে পা রাখতে যাবে, ঠিক সেই সময় উঠোন থেকে ডাকটা ভেসে এলো। কেউ একজন ওর নাম ধরে ডাকছে উচ্চকণ্ঠে গলার স্বরটা চেনা। কিন্তু শাহজিদ এভাবে কখনো ডাকেনি তো আগে! আজ হঠাৎ কী হলো?
জাহিদ তখনো ফারার সামনেই দাঁড়ানো। ডাকটা কানে এসে লাগতেই ওর মুখের রং পাল্টে গেছে। দিনেদুপুরে ভূত দেখার মতো চমক লেগেছে চোখে। নিশাও কম বিস্মিত হয়নি। কয়েক সেকেন্ড নিশ্চল জীবাশ্মের মতো দাঁড়িয়ে থেকে কম্পিত বক্ষ নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগল সদর দরজার দিকে। হঠাৎ ডাক পড়ল পেছন থেকে, ‘দাঁড়াও।’
নিশা দাঁড়াল। জাহিদ হনহনিয়ে হেঁটে এসে জুবিনকে ছোঁ মেরে নিশার কোল থেকে তুলে নিল। শীতল স্বরে বলল, ‘এবার যাও।’
নিশার হাতে তখনো জাহিদের দেওয়া চিরকুট। সে জানে শাহজিদের এই আকস্মিক ডাক শুনে জাহিদ কী ভাবছে। এর আগে যতবার এই প্রসঙ্গ এসেছে, ঘেন্নায় মুখ বুজে এসেছে নিশার। এমন জঘন্য বিষয় নিয়ে আলাপ করতেই ইচ্ছে করেনি। মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে করেনি যে আপনি যা ভাবছেন তা সম্পূর্ণ ভুল। বলার রুচি হয়নি। কিন্তু আজকে এই মুহূর্তে জাহিদের ওই পাল্টে যাওয়া মুখভঙ্গি দেখে নিশার মনে হলো বিষয়টা নিয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলা উচিত ছিল অনেক আগেই। কিন্তু আগের সঙ্গে তো আজকের পরিস্থিতির তুলনা চলে না। আজকে নিশার হাতে আছে তার ভালোবাসার স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতিটুকু বুকে জন্ম দিয়েছে অগাধ সাহস এবং অপার নিরাপত্তাবোধের। জীবনে এই প্রথমবারের মতো ফারা এবং তুরিনের সামনে দাঁড়িয়ে সে হীনম্মন্যতায় ভুগছে না। নিজেকে আশ্রিত বলে মনে হচ্ছে না। এই ছোট্ট এক টুকরো কাগজখানি তার সংকীর্ণ, কমজোর মনের কর্দমাক্ত মাটিতে আত্মপ্রত্যয়ের শক্ত চারা বপন করে দিয়েছে। প্রত্যাবৃত্ত করেছে হারিয়ে যাওয়া আত্মসম্মান।
শাহজিদ নিশার নাম ধরে ডেকে যাচ্ছিল। নিশা বেরিয়ে এসে দেখল তুরিন আরো আগেই এসে দাঁড়িয়েছে পোর্চে। এখনো ঝিরঝির করে ঝরছে বরফ। শাহজিদের গায়ে কালো ওভারকোট, হাতে ক্রাচ। ওভারকোটের গায়ে ছিটা ছিটা বরফবিন্দু জমেছে। নিশা বেরিয়ে আসতেই শাহজিদ বলল, ‘জরুরি কিছু কথা আছে। একবার আসবে?’
নিশা ঘাড় ঘুরিয়ে তুরিনকে দেখল। সেই সময় তুরিনও তাকাল ওর দিকে। চোখে চোখ পড়তেই তুরিনের দৃষ্টি প্রখর হলো। মুখে চিলিক মারল ক্রোধের স্ফুলিঙ্গ। পারলে নিশাকে চোখের আগুনেই ঝলসে দেয়। ওর গায়ে গরম কাপড় নেই। শুধু পাতলা টি-শার্ট আর ট্রাউজার। শীতে একটু একটু কাঁপছে হাত-পা।
‘কী হয়েছে শাহজিদ? সব ঠিক আছে তো?’ নিশা ঘাবড়ে যাওয়া গলায় প্রশ্নটা করল।
— ‘একটু শুনে যাও।’
কথাটা বলে শাহজিদ ক্রাচে ভর দিয়ে ব্যাকইয়ার্ডের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। নিশা ত্বরিতপদে ভেতরে ছুটে গিয়ে কোট স্ট্যান্ড থেকে কোট নামিয়ে নিল। জাহিদ জুবিনকে কোলে নিয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মুখ জুড়ে থমথম করছে অমাবস্যার অন্ধকার। নিশা ভেতরে ঢুকতেই তীব্র নেত্রে তাকাল একবার। ওই চোখের দৃষ্টি নিশাকে থমকে দিল। ভয়ের অস্তিত্ব মৃদু অথচ দ্রুত পদসঞ্চারে জমিয়ে দিয়ে গেল হাত-পা। তার মনে হলো কিছু বলা উচিত। কয়েক সেকেন্ড তটস্থভাবে দাঁড়িয়ে থেকে কয়েকটা জুতসই শব্দ গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। লাভ কিছুই হলো না। যথাসময়ে ফারা উপস্থিত হলো দৃশ্যপটে। ঠোঁটে উপচে পড়ছে বিদ্রুপের হাসি। মুখশ্রীতে খুশি খুশি ভাব। নিশা কোটটা গায়ে চড়িয়ে তড়িঘরি করে বেরিয়ে এলো। ফারার তামাশাপ্রিয় মন সুযোগ হাতছাড়া করল না। জাহিদের পাশে দাঁড়িয়ে চতুর গলায় বলল, ‘দেখলে তো! প্রেম একেবারে জমে গেছে। আ’ম স্পিচলেস। ছেলেটার সাহসের প্রশংসা করতেই হয়।’ কথাটা জাহিদের কানে রীতিমতো অশ্রাব্য বলে মনে হলো। হাত-পা রিরি করে উঠল ঘেন্নায়। সেই সঙ্গে একটা উৎকট, উগ্র রাগের তুফান উঠল ভেতরে। ছেলেটার সত্যিই অনেক বেশি সাহস হয়ে গেছে। দিনে দুপুরে বাড়ি শুদ্ধ লোকের সামনে অকপটে নিশার নাম ধরে ডাকার স্পর্ধা কোত্থেকে পায় সে? জাহিদের মনে হলো এর একটা বিহিত আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু ঘটনা গড়িয়ে গেছে এতদূর…এখন আর হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা চলবে না। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল এখুনি শাহজিদকে কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দেয় কিংবা কোন উচ্চবাচ্য না করে সরাসরি ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কিন্তু তার ভদ্রতা জ্ঞান বা শিষ্টাচার বিধি বাল্যকাল থেকেই অতি জাগ্ৰত। চাইলেই কারো সঙ্গে চট করে দুর্ব্যবহার করতে পারে না। এই শিষ্টাচার বোধ দিনকে দিন তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্রতিকূলতা এবং দুর্বলতায় রূপান্তরিত হচ্ছে। মানুষের কথা তো অনেক ভাবল…বাবার কথা, মায়ের কথা, ফারার কথা, তুরিন জুবিনের কথা, নিশার কথা…এমনকি পঙ্গু শাহজিদের জন্যও সময়ে সময়ে তার মন উতলা হয়েছে। নির্ভেজাল করুণার উদ্রেক হয়েছে মনে। অথচ এই মানুষগুলো কোনদিন তার কথা ভাবেনি। বাবা-মা ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে নিজস্ব সিদ্ধান্ত। নিশাকে বিয়ে করতে চায় না, এটা জানার পর মা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ইমার্জেন্সিতে ছিলেন দুইদিন দুই রাত। বাবার হার্টের অবস্থা ভালো না। সেভেন্টি পার্সেন্ট ব্লক আছে। বছর পাঁচেক আগে রিং পরানো হয়েছিল। উত্তেজনার বশে হার্ট অ্যাটাক হলে প্রাণে বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই সব সাতপাঁচ ভেবেই দ্বিতীয় বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল সে। বাধ্য করা হয়েছিল।
.
নিশা বাইরে এসে দেখল তুরিন এখনো পোর্চে দাঁড়িয়ে। শাহজিদকে দেখা যাচ্ছে না। স্নো বুট ছাড়া সাধারণ স্যান্ডেল পরে এই বরফের ওপর হাঁটা খুব কঠিন ব্যাপার। নিশা সাবধানে সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে নেমে এলো। ঠিক তখনই ফারার কণ্ঠস্বর ভেসে এলো পেছন থেকে। গর্জে উঠে তুরিনকে বলতে লাগল, ‘তুমি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করছ কী? ভেতরে যাও!’
শাহজিদের ঘরের দরজাটা খোলা। নিশা ভেতরে ঢুকে দেখল মেঝেতে একটা ট্রাভেল ব্যাগ পড়ে আছে। শাহজিদ মৃদু স্বরে বলল, ‘সরি… বিরক্ত করলাম তোমাকে।’
— ‘কী হয়েছে?’ রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করে নিশা।
— ‘চলে যাচ্ছি।’
— ‘মানে কী? কোথায় যাচ্ছ হুট করে?’
— ‘হুম…হুট করেই ডিসিশন নিলাম। মনে হলো যাওয়ার আগে তোমার সঙ্গে একবার দেখা না করলে অন্যায় হবে।’
— ‘কিন্তু যাচ্ছ কোথায়?
— ‘দেখি।’
নিশার বুক কেঁপে উঠল অজানা আশঙ্কায়, ‘দেখি মানে কী? আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। তুমি একলা মানুষ, কোথায় যাবে?’
শাহজিদ ডান গালে জিব ঠেকিয়ে ক্ষণিকের জন্য ভাবল কিছু একটা
সামান্য হেসে বলল, ‘একলা মানুষরা কোথাও যেতে পারবে না। এমন কোন নিয়ম আছে নাকি?’
নিশা বিপন্ন গলায় বলল, ‘আমার ভয় হচ্ছে শাহজিদ! তোমার কথাবার্তা কেমন যেন এলোমেলো।’
— ‘নিশা শোন, এ বাড়িতে মুর্তজা আংকেল আর তুমি ছাড়া আমার কোন বন্ধু নেই। কিন্তু আংকেলকে গুডবাই বলার মতো সাহস নেই আমার। আমি বেরিয়ে যাওয়ার পর তুমি আংকেলকে খবরটা দেবে।”
— ‘তোমাকে এভাবে বিদায় করে দিলে বাবা আমাকে ভীষণ বকবেন!’
— ‘প্লিজ নিশা, হেল্প মি! আই নিড ইয়োর হেল্প।’
নিশা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল, ‘কেন হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নিলে শাহজিদ? আবার কবে আসবে?’
শাহজিদ উত্তরে একটু মুচকি হাসল। কিছু বলল না। নিশা কণ্ঠে আকুতি ফুটিয়ে বলল, ‘যেও না ভাই। আর কিছুদিন থাকো। তুমি চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে।
‘আমিও তোমাকে মিস করব নিশা। তুমি প্লিজ নিজের দিকে খেয়াল রেখো। জীবন নিয়ে অবহেলা করো না। খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নাও।’ নিশা হঠাৎ অন্যরকম গলায় বলল,
— ‘তুরিনকে কিছু বলে যাবে না তুমি?’
এই প্রশ্নে শাহজিদের মুখখানা কিঞ্চিৎ আরক্ত হয়ে ওঠে। হাত নেড়ে মাছি তাড়াবার ভঙ্গি করে বলে, ‘ওই পাগলের কথা বাদ দাও।’
নিশা ডাগর দু খানা চোখ মেলে হন্যে হয়ে কী যেন খুঁজল শাহজিদের মুখে। তারপর এক ছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে। শাহজিদ তব্দা খাওয়া চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল নিশার এই আকস্মিক প্রস্থান।
টিভিতে স্পোর্টস চলছে। জাহিদ বসে আছে কাউচে। হাতে টিভির রিমোট। কুঞ্চিত ভ্রসমেত গম্ভীর দুটি চোখ মেলে চেয়ে আছে টিভির দিকে। পাশেই ওর গা-ঘেঁষে বসেছে তুরিন। তার মুখখানাও বড্ড থমথমে। একমাত্র ফারাকেই বেশ প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। চেয়ারে বসে পা নাচাতে নাচাতে একনাগাড়ে অনেক কথা বলে যাচ্ছে সে। সেই সময় হঠাৎ সদর দরজাটা দড়াম করে খুলল কেউ একজন। ছুটে এলো একটা শ্বাসরুদ্ধকর কণ্ঠের অকস্মাৎ আর্তনাদ, ‘তুরিন!’
নিশার মুখে তুরিনের নাম উচ্চারিত হতে কেউ কোনদিন শোনেনি এর আগে। সবাই দারুণ রকম চমকে উঠল। অপ্রস্তুত তুরিন বিস্ময়বিমূঢ় চোখে কয়েক নিমেষ চেয়ে রইল নিশার দিকে। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোলো না। নিশা হাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘এদিকে এসো। তাড়াতাড়ি!’
ফারার চোখ দুটো কোটোর থেকে মার্বেলের মতো খুলে পড়তে চাইল যেন। বিস্ময় আর বিরক্তিতে দুমড়েমুচড়ে গেল নাকমুখ। নিশার দিকে ডাকিনীর মতো হিংস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল, ‘তুরিনকে তোমার কী প্রয়োজন?’
তুরিন উঠে দাঁড়িয়েছে তখন। ওর মুখখানা দ্বিধা আর বিভ্রমের যুগল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। বুক দুলছে অনিশ্চয়তায়। তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলছে নিশার কাছে শাহজিদ সম্পর্কিত কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে। ফারা খপ করে মেয়ের একটা হাত চেপে ধরল, ‘তুমি বসো। কোথাও যেতে হবে না।’
তুরিন অসহায় চোখে একবার মায়ের দিকে, আরেকবার নিশার দিকে তাকাল। কাটল কয়েকটি বিভ্রান্ত মুহূর্ত। জাহিদ উঠে দাঁড়িয়ে ফারার কবজা থেকে তুরিনের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘লেট হার গো।’
বাবার অনুমতি পাওয়া মাত্র তুরিন ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে গেল নিশার দিকে কাছাকাছি এসে রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে?’
নিশা তুরিনের হাত ধরে হ্যাঁচকা টানে দরজার বাইরে নিয়ে এলো। গলার স্বর খাদে নামিয়ে বলল, ‘শাহজিদ তো চলে যাচ্ছে। এ বিষয়ে কিছু জানো তুমি?’
তুরিনের মুখটা কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল, ‘চলে যাচ্ছে মানে? কোথায় যাচ্ছে?’
— ‘জানি না। তুমি তাড়াতাড়ি যাও। কথা বল ওর সঙ্গে। এখুনি বেরিয়ে পড়বে।’
তুরিন ছুটল দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে। পায়ে জুতোটা পর্যন্ত পরতে ভুলে গেল। উঠোনে তিন ইঞ্চি পুরু বরফ জমে গেছে এর মাঝেই। পেলব তুলোর মতো নরম আর সাবানের ফেনার মতো ভেজা ভেজা ঈষৎ পিচ্ছিল সেই বরফের শুভ্র আস্তরে নিখুঁত পায়ের ছাপ ফেলে মেরু অঞ্চলের শ্বাপদ প্রাণীর মতো নির্ভয়ে ছুটে যাচ্ছিল তুরিন। পায়ের ক্ষত এখনো পুরোপুরি শুকোয়নি। সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়েটার। নিশা পেছন থেকে হাঁক ছাড়ল, ‘আস্তে যাও। পড়ে যাবা!’ সত্যিই ফ্রন্ট ইয়ার্ড থেকে ব্যাক ইয়ার্ডে নামার উত্রাই পার হওয়ার সময় তুরিনের পা ফসকে যাচ্ছিল। নিশা ওকে ধরে ফেলল।
পাগল ছাড়া দুনিয়া চলে না
গাছের ডালে ঘাপটি মেরে বসে আছে চাক চাক তুষারবিন্দু। হঠাৎ চোখে পড়লে মনে হয় স্নো-ড্রপ বা বকুলফুলের সমাহার। বরফকুচির ধূম্রজাল গুটিয়ে নিয়েছে প্রকৃতি। এতক্ষণ ওপরে তাকালে আকাশ দেখা যাচ্ছিল না, সাদা মশারিতে আটকে যাচ্ছিল চোখ। এখন আকাশ পরিষ্কার নীল। রোদ ঠিকরে পড়ছে ভূ- খণ্ডের জমাটবাঁধা বরফে। রুপোর মতো ঝিকোচ্ছে চারপাশ। একটা ঘণ্টা অবিরত ঝিরিঝিরি ঝরে পড়ার পর তুষারপাত থেমেছে অবশেষে। আবহাওয়া পূর্বাভাস বলছে রাত দশটা থেকে আবারও ঝরবে। হুইলচেয়ার নিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে বেরিয়ে এসেছে শাহজিদ। মেইলবক্সের চাবি এবং ঘরের চাবি দরজার সামনের আউটডোর ম্যাটের ওপর সযত্নে নামিয়ে রাখল। সেই সঙ্গে রাখল মুর্তজা সাহেবের উদ্দেশ্যে লেখা কয়েক লাইনের ছোট্ট নোট 1
— ‘কোথায় যাচ্ছ?’
উদ্দীপিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই হালকা চমকালো শাহজিদ। প্রথমেই চোখ পড়ল তুরিনের নিরাবরণ পা-জোড়ার ওপর। কনকনে ঠান্ডা বরফের ঘষা লেগে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। ঠকঠক করে শীতে কাঁপছে সর্বাঙ্গ। ওর পেছনে নিশা দাঁড়িয়ে আছে কোট গায়ে দিয়ে। শাহজিদ নিশার দিকে সীমাহীন বিরক্তির একটা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিদ্রুপের সুরে বলল, ‘গ্রেট জব! দারুণ একটা কাজ করলে তুমি। ফ্যাসিনেটিং!’ নিশা লজ্জিত ভঙ্গিতে মুখ নিচু করল।
— ‘কোথায় যাচ্ছ?’ তারস্বরে আবারও প্রশ্নটা ছুঁড়েদিল তুরিন। শাহজিদ প্রত্যুত্তর করল না। হুইলচেয়ারের পাশে উঠোনে রাখা ব্যাগটা একটু ঝুঁকে, হাত বাড়িয়ে কোলের ওপর তুলে নিল। তুরিন পথ আটকে দাঁড়াল, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছ না কেন?’
নিশা এগিয়ে এলো কয়েক পা, ‘শাহজিদ, ভেতরে গিয়ে কথা বলো। দ্যাখো তুরিন ঠান্ডায় কীরকম কাঁপছে।’
তুরিন হুইলচেয়ারের সামনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শীতের দাপটে কুঁকড়ে গেছে মুখের চামড়া। ফাটা ঠোঁটে লাল লাল আঁচর বসে গেছে। শাহজিদ যথাসাধ্য শান্ত গলায় বলল, ‘সরে দাঁড়াও। আই অ্যাম অ্যা বিট টাইড আপ নাও। আই শ্যুড গেট গোইং।’
তুরিন সরল না। কয়েক সেকেন্ড গভীর সংশয় নিয়ে শাহজিদের থমথমে মুখের দিকে চেয়ে থেকে অদ্ভুত শীতল গলায় বলল, ‘এর মানে…শেষ পর্যন্ত তুমি পালিয়ে যাচ্ছ শাহজিদ আনাম! ইউ আর রানিং অ্যাওয়ে ফ্রম মি।’ শিউরে উঠল শাহজিদ। চমকে তাকাল তুরিনের দিকে, ‘পালিয়ে যাচ্ছি মানে? পালাব কেন?’
— ‘অর্ণবের সঙ্গে আমার বিয়ে হবে এটা তুমি সহ্য করতে পারছ না। এ কারণেই পালিয়ে যাচ্ছ।’
থমকানো শাহজিদ বিস্ময়ের বেগ সামলে নিয়ে কোনরকমে বলল, ‘সিরিয়াসলি? তোমার তাই মনে হয়? তুমি কিংবা অর্ণব, তোমরা কেউই আমার কাছে ইম্পরট্যান্ট নও। এখন সরো এখান থেকে। যেতে দাও।’
তুরিন হঠাৎ অপ্রকৃতস্থ ভাবে চিৎকার করে উঠল, ‘তুমি যেতে পারবে না! আমার বিয়ে হওয়ার আগে তুমি এখান থেকে এক পা-ও নড়তে পারবে না শাহজিদ আনাম! আমি অর্ণবকে বিয়ে করব আর সেটা তুমি চোখ মেলে চেয়ে দেখবে!’
শাহজিদ কিন্তু মনে মনে বিষম রকম ধাক্কা খেয়ে গেছে তখন! বোকা, হিংসুটে অনুর্বর মস্তিষ্কের তুরিনের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার পর নিজেকে নিতান্তই শূন্যগর্ভ পরাজিত এক কাপুরুষ বলে মনে হচ্ছে তার। তুরিনের চোখে চোখে সরাসরি তাকাবার সাহস পাচ্ছে না। তবুও জোর করে মুখে একটা নির্বিকার হাসি টেনে এনে বলল, ‘তোমাকে নিয়ে মোটেও ভাবছি না তুরিন। আমি যাচ্ছি নিজের প্রয়োজনে।’
তুরিন রেগে গেলে কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। পাগলের মতো চিৎকার করতে থাকে, কাঁপতে থাকে, জিনিসপত্র ছুঁড়েমারতে থাকে। আজকেও ব্যতিক্রম হলো না। শাহজিদের ব্যাগটা দু হাত দিয়ে খামচে ধরে উঠোনে জমে থাকা তিন ইঞ্চি পুরু বরফের ওপর ধপ করে ফেলে দিল। দশ কেজি ওজনের ব্যাগের আঘাতে শ্বেতশুভ্র তুষারাবৃত মাটি চূর্ণবিচূর্ণ হলো। বরফ কণা ছিটকে পড়ল এদিক- সেদিক। তুরিন বক্ষ বিদীর্ণ করা উৎকট আর্তনাদে ফেটে পড়ে বলল, ‘তুমি যাবে না! খবরদার যাবে না!’
শাহজিদ থমকানো বিস্ফারিত দুটি চোখ তুরিনের আগুনগরম মুখের ওপর মেলে রেখে আতঙ্কগ্রস্ত গলায় নিশাকে বলল, ‘আই থিংক শি নিডস আ সাইকিয়াট্রিস্ট। তোমরা এই চিড়িয়াটাকে ধরে বেঁধে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও না কেন?’
এ কথা শুনে তুরিনের রাগ আরো তুঙ্গে উঠল। ডাঙ্গায় তোলা কইমাছের মতো ছটফট করতে করতে বলল, ‘তুমি বলতে চাইছ আমি পাগল…হ্যাঁ? ইউ থিংক আই অ্যাম ক্রেজি?’ শাহজিদ লাফঝাঁপ দেখতে দেখতে ঠান্ডা গলায় ঘোষণা দিল,
— ‘ইউ আর ক্রেজি, স্ক্যারি অ্যান্ড ক্রিপি!’
তুরিনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। মধ্যাঙ্গুলি প্রদর্শন করে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘ফাক ইউ!’
শাহজিদ অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে নিল। কী কথা বলবে এই পাগলের সঙ্গে?
তুরিনের কাঁপুনিটা নিশার লক্ষ্যগোচর হয়েছে অনেক আগেই। আরেকটু হলেই বুঝি মেয়ের দাঁত কপাটি লেগে যাবে। নিশা পদব্ৰজে এগিয়ে এসে ওর বাহুতে একটা হাত রাখল। মৃত মানুষের মতো ঠান্ডা হয়ে এসেছে শরীর। নিজের পরনের কোটটা খুলে নিয়ে তুরিনের গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে নিশা বলল, ‘তুমি ভেতরে যাও। ঠান্ডায় তোমার হাত-পা জমে গেছে।’
ততক্ষণে ওরা খেয়াল করল তুরিনের খর্বকায় চোখজোড়ার কার্নিশ উপচে ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে জল। নাকের পানি স্পর্শ করেছে ঠোঁটের দেওয়াল। দুই গাল হয়ে উঠেছে টমেটোর মতো লাল টকটকে। কাঁদতে কাঁদতে…কাঁপতে কাঁপতে…রাগে গজগজ করতে করতে সে নিশাকে বলল, ‘এই স্টুপিড ছেলেটা যেন কোথাও না যায়। ও চলে গেলে কিন্তু খারাপ হবে…খুব খারাপ হবে!’
নিশা প্রবোধ দেওয়ার স্বরে বলল, ‘ও কোথাও যাবে না। তুমি চিন্তা করো না।’
শাহজিদ তব্দা খাওয়া চোখে তুরিনের পাগলামো দেখে যাচ্ছিল। এবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমাকে সত্যিই যেতে হবে!’
তুরিন শাহজিদকে কিছু বলল না। নিশার দিকে চেয়ে নাছোড় গলায় দাঁতে দাঁত কেটে কেটে বলল, ‘ওকে জানিয়ে দাও, আজকে এখান থেকে চলে গেলে আর কোনদিন আমার মুখ দেখতে পাবে না! ‘
সেই সময় হঠাৎ রঙ্গমঞ্চের পট সামান্য পরিবর্তিত হলো। ফ্রন্ট-ইয়ার্ড থেকে ব্যাক-ইয়ার্ডে আসার ঢালু পথটা ধরে ফারা আর জাহিদকে নেমে আসতে দেখল শাহজিদ। নিশার একটা হাত তখনো তুরিনের কাঁধের ওপর রাখা। তুরিন বিদ্রোহী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে রাগে গজরাচ্ছে…অবোধ বালিকার মতো কাঁদছে…অপ্রকৃতস্থ মানুষের মতো ফোঁসফোঁস শ্বাস ফেলছে! জাহিদ, ফারা দুজনের কেউই ঠিক এরকম একটা ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিল না। ওরা পাথরের মূর্তির মতো থমকে গেছে। মুখে সাঁতার কাটছে নিশ্ছিদ্র বিস্ময়। কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত পার হওয়ার পর ফারা গলা ফাটানো চিৎকার করে বলল, ‘কী হচ্ছে এখানে?’
শাহজিদ তুরিনের দিকে তাকাল একপলক। তারপর সুস্পষ্ট গলায় ফারার প্রশ্নের উত্তর দিল, ‘আমি চলে যাচ্ছি।’
জাহিদ তীক্ষ্ণ চোখে নিশা আর তুরিনকে পর্যবেক্ষণ করছিল। ঘটনার মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তুরিনের পরনে কি ওটা নিশার কোট? হ্যা…দেখে তো সেরকমই মনে হচ্ছে। বাতাসে রহস্যের ঘ্রাণ পাচ্ছিল সে। তবে এ কথা সত্য…ভীষণ ভীষণ সত্য…যে এত সন্দেহ, এত অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও জীবনে প্রথমবারের মতো নিশা আর তুরিনকে কাছাকাছি, পাশাপাশি বন্ধুর মত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এক অনীর্বচনীয় স্বস্তিতে ওর মন-প্রাণ ভরে গেছে। মনে হচ্ছে যেন অনেক দিন পর একটা সত্যিকারের সুন্দর দৃশ্য দেখল। একদম মনের মতো দৃশ্য!
ফারার নাকের পাল্লা দুটি ফুলে ঢোল হয়েছে। লোহা ঝালাইয়ের মতো বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গ খেলছে মুখের সমস্ত গলি-ঘুঁজিতে। ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে এগিয়ে এলো সে। তুরিনের কনুই ধরে হ্যাঁচকা টানে নিশার কাছ থেকে বেশ অনেকখানি দূরে সরিয়ে আনল। ক্যাটক্যাট করে শাহজিদকে বলল, ‘হোয়াট আর ইউ ওয়েটিং ফর? চলে গেলে চলে যাও। প্লিজ লিভ! ‘
তুরিনের মাথার তার এখন ছেঁড়া। চৈতন্যের কোঠা পুরাদস্তুর ফাঁপা বলা চলে। দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘ও কোথাও যাবে না!’ ফারা দুনিয়া কাঁপানো চমক নিয়ে তাকাল মেয়ের দিকে। তাকিয়েই রইল কয়েক নিমেষ। তারপর কণ্ঠস্বর অনেকখানি চেপে নিয়ে বলল, ‘তুমি বড়দের মাঝখানে কথা বলো না হানি! আমি দেখছি।’ একটু বিরতি নিয়ে ফারা ব্যস্ত গলায় শাহজিদকে বলল, ‘চলে যাও…চলে যাও…অনেক দিন তো থাকলে…আর কত?’
তুরিন ক্ষুধার্ত বাঘিনীর মতো গর্জে উঠল, ‘মা! চুপ করো!’
জাহিদ দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। কালো জ্যাকেটের পকেটে হাতদুটি রাখা। কপালে কুঞ্চন। চোখে সন্দেহের অবাধ বিচরণ। সে ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে রাগের বশে হঠকারী আচরণ করা তার স্বভাবে নেই। আজ পর্যন্ত তুরিনকে শুধু তার সঙ্গেই এমন চূড়ান্ত পাগলামো করতে দেখেছে। মেয়েটা যখনই নিশাকে নিয়ে অনিরাপত্তায় ভুগেছে। যখনই মনে হয়েছে নিশা তার কাছ থেকে বাবাকে ছিনিয়ে নেবে, তখনই বাহ্যজ্ঞানরহিত উন্মাদিনীর মতো আচরণ করেছে। কিন্তু আজকের ঘটনায় জাহিদ অনাহুত এক দর্শক মাত্র। তাহলে তুরিনের এই অসংযত, লাগামছাড়া আচরণের কারণ কী?
এদিকে মেয়ের ধমক খেয়েও ফারা দমল না। শাহজিদকে এখান থেকে এই মুহূর্তে বিদায় করতে না পারলে যেন শান্তিতে শ্বাসটুকুও ফেলতে পারছে না। অধৈর্য হয়ে বলল, ‘তুমি একাই যাবে? নিশাকে নিয়ে যাবে না?’ এই কথায় উপস্থিত সবার মুখে একটা অস্বস্তি চনমন করে উঠল। নিশা চমকে উঠে রুদ্ধশ্বাসে তাকাল ফারার দিকে। শাহজিদ অকপট বিস্ময়ে বলল, ‘নিশাকে কেন নিয়ে যাব?’
ফারা হাসল, ‘না নিলে তুমি বাঁচবে কী করে?
— ‘ফারা! হ্যাং অন। তুমি আর কথা বলো না। এখানেই থামো। আমি দেখছি ব্যাপারটা।’ শীতল কণ্ঠের আদেশটা শুনে ফারা আগুন চোখে তাকাল একবার জাহিদের দিকে। সে লক্ষ করেছে জাহিদ আজকাল তার সঙ্গে ঝগড়া করে না, তর্ক করে না, শুধুই হুকুম বা হুমকী দেয়। ফারার কোন মতামতকেই সে আর গ্রাহ্য করে না। এটা ভালো লক্ষণ নয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে ঝগড়া বা তর্ক বিতর্ক বন্ধ হয়ে গেলে বুঝতে হবে এই সম্পর্ক স্বাভাবিকতা হারিয়েছে। এই সম্পর্ক এখন মৃত্যুপথযাত্রী। জাহিদ কয়েক পা এগিয়ে এসে তুরিনের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। মেয়েটা হিড়হিড় করে কাঁপছে। দাঁতের সঙ্গে দাঁত ঘষা খাচ্ছে। নাক চোখ পানিতে একাকার। মেয়ের গালের পানি মুছে দিতে দিতে জাহিদ শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে? আমাকে একটু খুলে বলো ঘটনাটা।’
বাবার সান্নিধ্য তুরিনের চেতনায় একটা মৃদু ধাক্কা দিয়ে গেল। ক্রোধের আগুনে পুড়ে ছাই হওয়া মস্তিষ্কে বিবেকের অল্প একটু আলো প্রতিফলিত হলো যেন। পরমুহূর্তেই সংকোচ হলো তার…ভীষণ সংকোচ! বাবাকে এখন কী বলবে? সব কথা কি বলা যায়?’
কথা বলল নিশা। কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে ভারী স্পষ্টভাবে বলল, ‘শাহজিদ চলে যাচ্ছিল বাড়ি ছেড়ে। আমি ভাবলাম খবরটা তুরিনকে একবার দেওয়া প্রয়োজন। তাই ওকে ডেকে এনেছিলাম। তো…এসব নিয়েই ওদের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হচ্ছিল।’
নিশার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে জাহিদ গম্ভীর গলায় বলল, ‘আই হ্যাভ নো আইডিয়া হোয়াট ইউ আর টকিং অ্যাবাউট। প্রথমত শাহজিদ কেন চলে যাচ্ছিল হুট করে? দ্বিতীয়ত শাহজিদের চলে যাওয়া বা না যাওয়ায় তুরিনের কী এসে যায়? ফিল মি ইন প্লিজ!’
নিশা শাহজিদের দিকে তাকাল অপ্রস্তুত ভাবে। শাহজিদ স্তম্ভিত এবং লজ্জিত। একটা অপ্রতিভ ভাব খেলছে ওর চোখে মুখে। ফারা বুঝতে পারছিল পরিস্থিতি মোটেও তার অনুকূলে নেই। মাথায় আগুনের গনগনে আঁচ টের পাচ্ছিল সে। আত্মবিশ্বাসে টান পড়ে গেছে রীতিমতোন। সাপের মতো ছোবোল দিয়ে উঠে নিশাকে বলল, ‘এটা তোমারই কাজ। তুমি আমার মেয়েকে এই পঙ্গু ছেলেটার সঙ্গে ভিড়িয়ে দিতে চাইছ। নিজেকে সেইফ সাইডে রাখার জন্য আমার মেয়েকে এই বিশ্রী ব্যাপারটাতে টেনে আনলে। কত বড় সাহস তোমার!’ তুরিন চেঁচিয়ে উঠল, ‘উফ মা! হোল্ড ইয়োর টাং! যেটা জানো না সেটা নিয়ে কথা বলতে এসো না।’
মেয়ের কথা শুনে ফারার চেহারা এমন ভাবে ভচকে গেল, দেখে মনে হলো যেন দশতলা উঁচু দালান থেকে এই মাত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। এটা কী হলো? তুরিন নিশার পক্ষ নিয়ে তাকে কথা শোনাচ্ছে? এমন দিনও ভাগ্যে ছিল! এটাও সম্ভব! ফারা এত বেশি হতভম্ব হয়ে গেল যে তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোল না। শাহজিদ কথা বলল, ‘জাহিদ শুনুন…ঘটনা খুবই সিম্পল। আমি এখান থেকে চলে যাচ্ছি। মুর্তজা আংকেলকে কথাটা বলার সাহস পাচ্ছি না। আপনি একটু আমার হয়ে বলে দিয়েন। ব্যস এটুকুই।’
তুরিনের মাথার একটা তার আবারও টং করে ছিঁড়ে গেল। উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ইউ নো হোয়াট? ইউ আর সাচ অ্যা কাওয়ার্ড! আমি আগেই জানতাম আমার বাবাকে তুমি ভয় পাও। এমনকি অর্ণবকেও ভয় পাও।’
দিনের আলো এখন আগের চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী। সূর্যরশ্মি সাদা বরফে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে চারিদিকে চোখধাঁধানো রোশনাই বিকিরণ করছে। গাছের ডালে আর বাড়ির দোচালা ছাদে জমে থাকা বরফ একটু একটু গলতে শুরু করেছে। টুপটাপ মাটিতে ঝরে পড়ছে বরফ গলা পানি। বাড়ির ছাদের চিমনি থেকে ভুরভুর করে বেরিয়ে আসছে দলাপাকানো ধোঁয়া। শাহজিদের ফরসা মুখে লাল রক্তের ছোপ পড়েছে। এতক্ষণে তুরিনের চোখে চোখ রাখল সে। ঠান্ডা স্বরে বলল, ‘আমি কাউকে ভয় পাই না।’
— ‘তাহলে চলে যাচ্ছ কেন?’
— ‘যেতে হচ্ছে!’
— ‘আজ এখান থেকে চলে গেলে আর কোনদিন আমার মুখ দেখতে পাবে না তুমি শাহজিদ!’
তুরিনের কণ্ঠস্বর কাঁপতে থাকে। একটা দীর্ঘশ্বাস হাহাকারের মতো বেরিয়ে আসে শাহজিদের বুক চিরে। পাহাড়ে একবার পৌঁছে যাওয়ার পর পৃথিবীর অন্য সব দুঃখ অবধারিতভাবে তার কাছে লঘু এবং অপাঙক্তেয় বলে মনে হবে। পাহাড় ছাড়া অন্য কেউই কখনো শাহজিদকে পরিপূর্ণভাবে পাবে না। পাহাড়ের দুর্দমনীয় আকর্ষণ তাকে কোন এক অলীক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখায়। তবুও তুরিনকে আর কোন দিন দেখতে পাবে না এই ভাবনা মনকে ব্যথিত করল, পীড়িত করল, দুর্মোচ্য এক গভীর হতাশায় আকণ্ঠভাবে নিমজ্জিত করল! স্তিমিত স্বরে বলল, ‘দেখতে না পেলে…কী আর করার আছে বলো?’
এ কথা শুনে বোকা, ছেলেমানুষ, পাগল তুরিনটা বাবা-মায়ের সামনেই হিতাহিতজ্ঞান শূন্য হয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠল, ‘এর মানে তুমি কোনদিনই আমাকে ভালোবাসোনি!’
হঠাৎ মৃত মানুষ জ্যান্ত হয়ে উঠেছে— এরকম তথ্য পেলে মানুষের মুখে যেমন অবাধ আশ্চর্যের ঢেউ খেলা করে যায়, তুরিনের কথাটা শুনে ঠিক সেরকমই বাধভাঙা বিস্ময়ে প্লাবিত হলো জাহিদ। আশ্চর্য চোখে মেয়ের দিকে তাকাল সে। ফারা সেই সময় উড়ে আসল ঝড়ের মতো। চকিতে তুরিনের মুখটা শক্ত করে হাত দিয়ে চেপে ধরে প্রবল উত্তেজনায় ফেটে পড়ে বলল, ‘চুপ করো…স্টুপিড মেয়ে! চুপ করো তুমি! তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
জাহিদ ফারার হাতটা সরিয়ে দিল, ‘কী করছ তুমি? পাগল নাকি!’
মায়ের এই নির্মম, নিষ্ঠুর, উদ্ধত আচরণ তুরিনকে কাঁদিয়ে ছাড়ল। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল সে। মেয়ের প্রতি জাহিদের দুর্বলতা অন্য পর্যায়ের। মেয়ের কান্না দেখলে মাথা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এবার শাহজিদকে একটু কড়া ভাবে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে? হোয়াট কাইন্ড অব রিলেশনশিপ ডু ইউ হ্যাভ উইদ মাই ডটার?’
ফোড়ন কাটল ফারা, ‘আরে আমার মেয়ের সঙ্গে ওর কী? ও তো প্ৰেম করছে নিশার সঙ্গে!’
কথাটা ফুটন্ত গরম পানির মতো ছিটকে পড়ল নিশার গায়ে। জাহিদও ভীষণ অপ্রতিভ হলো। আর শাহজিদের মুখটা ছিল দেখার মতো! নিশা আজকে চুপ করে রইল না। আজকের দিনটা আলাদা। ওইযে তুরিনের গায়ে যে লাল কোট, সেই কোটের পকেটে সযত্নে রাখা আছে ছোট্ট কাগজটা। যে কাগজে মানুষটা লিখেছে, সে নিশাকে ভালোবাসে। নিশা জানে না কথাটা কতটা সত্য। সত্য হোক বা মিথ্যা…এক লাইনের ছোট্ট স্বীকারোক্তিটা তাকে আজ দুর্নিবার সাহসের সন্ধান দিয়েছে। জীবনে এই প্রথমবারের মতো ফারার কথার প্রত্যুত্তর করল। মজবুত কণ্ঠে বলল, ‘একজন বিবাহিতা মেয়েকে নিয়ে আপনি এমন মন্তব্য করতে পারেন না!’
ফারার চোখ দুটো কপালে উঠে গেল একলাফে, ‘বিবাহিতা? কোন বিয়ের কথা বলছ তুমি? তোমার এই বিয়ের কোন স্ট্যাটাস আছে? তুমি এখানে আছ শুধু মাত্র একজন মিস্ট্রেস হিসেবে। বাংলায় যাকে বলে…কী জানি বলে? আশ্রিত? না না…হোয়াটেভার ইট ইজ তোমার এই ম্যারেজের সোশ্যাল বা লিগ্যাল কোন ভ্যালু নেই।’ ফারা মিস্ট্রেসের বাংলা অর্থটা স্মরণ করতে পারল না। কিন্তু নিশা বুঝে নিল এইমাত্র তাকে রক্ষিতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। অপমানের তীব্র আঘাতে গুঁড়িয়ে গেল পাঁজরের হাড়। গলায় ধাক্কা দিল কান্নার একটা দমক। জাহিদ নিশার চোখের কোণে জলের ঝিকিমিকিটা প্রত্যক্ষ করল। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল নিমেষে। মুখের আনাচেকানাচে চিলিক কেটে গেল ক্রোধের বিদ্যুৎ। গা-শিউরানো কঠিন গলায় কেটে কেটে বলল, ‘ফারা! ডোন্ট গো বিয়ন্ড ইয়োর লিমিটস!’
— ‘কেন? আমি কি ভুল কিছু বলেছি?’ সাপের মতো ফণা তুলে প্রশ্ন করে ফারা।’
— ‘হ্যাঁ ভুল বলেছ। শি ইজ নট এনি মিস্ট্রেস, শি ইজ মাই ওয়াইফ। সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে তাকে আমি স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি। এবং সে আমার সন্তানের মা!’
ফারার চোখে-মুখে বীভৎস ভাঙচুর হলো, ‘কথাটা বলতে তোমার লজ্জা করল না?’
— ‘সত্য কথায় লজ্জার কিছু নেই।’
নিশা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। ওর ডাগর ডাগর সুন্দর দুটি চোখ ডুবে গিয়েছিল অশ্রুর লোনা জলে। হঠাৎ করেই নিজেকে তার পরিপূর্ণ বলে মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোথাও কোন অভাব নেই…পায়ের তলায় শক্ত মাটি আছে…মাথার ওপর আছে নিরাপদ ছাদ…
‘সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে আমি তাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছি।’ এভাবে এর আগে কোনদিন বলেনি লোকটা! সবচেয়ে বেশি ভালো লাগল ‘গ্রহণ করেছি!’ কথাটা শুনতে। নিশা এতকাল জানত… মানুষটা তাকে গ্রহণই করেনি কখনো। আজকে এই ছোট্ট দুটো শব্দ ওর কাছে দৈববাণীর মতো মনে হলো!
ফারাকে দেখে মনে হচ্ছিল এখুনি কেঁদে ফেলবে, ‘এরা সবাই আমাকে এভাবে অপমান করছে আর তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ?’ মেয়ের মুখের ওপর কথাটা ছুঁড়েদিয়েই ফারা গটগট করে এগিয়ে গেল ফ্রন্ট ইয়ার্ডের দিকে। তুরিনের বুকটা মায়ের কথা শুনে মুচড়ে উঠল কষ্টে। শাহজিদের দিকে একবার অসহায়ভাবে তাকিয়ে মায়ের পেছন পেছন ছুট দিল। শাহজিদ এতক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দেখছিল সব। এমন নাটক সে বাপের জন্মে দেখেনি কখনো! তুরিন আর ফারার প্রস্থানের পর হুইলচেয়ারের চাকাগুলো সামনে এগিয়ে দিল। জাহিদ বলল, ‘দাঁড়াও শাহজিদ…কথা আছে তোমার সঙ্গে।’
শাহজিদ একটা মোটাদাগের দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে গম্ভীর ভাবে বলল, ‘জাহিদ, আমাকে একটু সময় দেবেন প্লিজ? আমি নিজেই আপনার সঙ্গে কথা বলব। তার আগে একটু সময় চাই।’
জাহিদ এই কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বলল না। তার ভেতরটা আশ্চর্য রকমের বোকা বনে গেছে। তুরিনের সঙ্গে যে শাহজিদের হৃদয়ঘটিত কোন টানাপোড়েন থাকতে পারে এ ব্যাপারটা কিছুতেই যেন বিশ্বাস করতে পারছে না তার বিস্ময়-বিহর্ষ মন। এতদিন নিশার নামের সঙ্গে শাহজিদকে জড়িয়ে কীসব আবোল তাবোল ভাবনা ভেবে এসেছে। লজ্জা হচ্ছে ভীষণ! এরপর নিশার চোখে চোখ মেলে তাকাবে কী করে?
১৯
তুষারের একটা আলাদা ঘ্রাণ আছে। গাছের শুকনো পাতা আর পাহাড়ের পাথুরে স্যাতস্যাতে গায়ের সঙ্গে মিলেমিশে তুষারগন্ধী হিমহিম বাতাসটা ক্রমেই কেমন বিষণ্ন, একা একা আর দুর্লভ হয়ে ধরা দেয় জাহিদের কাছে। এই সব তুষারভেজা ধবধবে সাদা কবুতরের মতো নিষ্কলুষ সুন্দর দিনে মনটা কেবলই এক নিপাট, নির্বিঘ্ন, আরামদায়ক অবকাশের জন্য ছটফট করে। কিন্তু অবকাশ তো কোথাও নেই। সংসারী মানুষের জন্য বোধহয় সংসারটাই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় কারাগার। অন্য সব বাধা ছিন্নভিন্ন করা গেলেও সংসারটা আমৃত্যু কাঁটার মতো লেগে থাকে গলায়। অফিসের কাজ, ব্যবসার লাভ-লোকসান, পারিবারিক টানাপড়েন…এই সব পার্থিব জীবনমুখী আয়োজনের কোথাও নিজের জন্য একরত্তি আশ্রয় খুঁজে পায় না জাহিদ। ছুটির দিনগুলোতেও ক্লায়েন্টদের ফোন আসে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, কার্ড অ্যাকটিভেশন, প্রফিট বা ইনভেস্টমেন্ট সম্পর্কিত নানা রকম প্রশ্ন থাকে। এদের মধ্যে কিছু ক্লায়েন্ট খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী। এদের ফোন অগ্রাহ্য করা যায় না। অফিসরুমে বসে ফোনে কথা বলতে বলতেই জাহিদ দেখছিল জানালার বাইরের সাদায় ধোয়া প্রকৃতি। হঠাৎ মনে হলো, মানুষ জীবনে প্রতিনিয়ত অসংখ্য ভ্রান্তিময় দৃশ্য অবলোকন করে থাকে। চোখের দেখা কোন ঘটনাকেই হুট করে বিশ্বাস করা উচিত নয়। চোখের চাইতে মনের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি। তাই জীবনের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা চোখ দিয়ে নয়, বরং মন দিয়েই দেখা উচিত।
শাহজিদের সঙ্গে নিশার একটা অনৈতিক সম্পর্ক আছে…এই ভাবনাটা ভাবা যত সহজ, তার চাইতে অনেক বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, কন্যার পাশে একজন বিকলাঙ্গ মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নেয়া। অথচ এই বিকলাঙ্গ শাহজিদকে নিশার জন্য কখনোই অযোগ্য বলে মনে হয়নি। নিশা তার সন্তানের মা…সেই প্রেক্ষাপট থেকে দেখতে হলে শাহজিদ এতদিন ছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বী। ছেলেটার প্রতি যে ঈর্ষা হয়নি এমন নয়। ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে বেশ কবার বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার পরিকল্পনাও এঁটেছিল মনে মনে। আবার নিজেকেই নিজে প্রবোধ দিয়েছে এই ভেবে যে, শাহজিদের মতো সুদর্শন, বিবেচক, বুদ্ধিমান যুবকই হয়তো নিশার স্বপ্নের পুরুষ। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার হলো…রূপবান, গুণবান এই শাহজিদকেই নিজ কন্যার জন্য মোটেও যোগ্য পাত্র বলে মনে হচ্ছে না। বার বার একটা ভাবনা মাথায় আসতেই শিউরে উঠছে মন, ছেলেটার দেহের একটা সম্পূর্ণ অঙ্গ অনুপস্থিত। তুরিন ছোটমানুষ, নিজের দায়িত্ব নেবার সামর্থ্যটুকুই ওর নেই। আদৌ কোনদিন হবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে। এই পঙ্গু ছেলের বোঝা এইটুকুন তুরিন সারা জীবনভর বইবে কী করে? এ কথা সত্য শাহজিদ আত্মনির্ভরশীল। মার্কিন সরকার ডিজেবলদের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে। কিন্তু অর্থের নিরাপত্তাই তো সব নয়। সর্বক্ষণ হুইলচেয়ার বা ক্রাচ সঙ্গে নিয়ে চলা একজন মানুষ কখনোই আর দশটা মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে না। ছেলেটার যত্ন আত্তির জন্য নার্স আসে। ব্যায়াম করা, গোসল করা, কাপড় পরা এমন খুঁটিনাটি নানা কাজে অন্যের সহায়তা লাগে। যার সঙ্গে ওর বিয়ে হবে, অবশ্যম্ভাবীভাবেই এসব দায়িত্বের বোঝা অনেকাংশে বর্তাবে সেই মেয়ের ওপর। নিশার মধ্যে যে ম্যাচিওরিটি আছে, তুরিনের মধ্যে সেই ম্যাচিওরিটি কস্মিন কালেও কখনো আসবে বলে মনে হয় না। সবচেয়ে বড় কথা হলো জাহিদ এতদিন শাহজিদকে দেখে এসেছিল নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে। সেই ছেলেকেই কন্যার জামাতা হিসেবে কল্পনা করতে গিয়ে বারবার হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে মন। হিসাবে গোলমাল লেগে যাচ্ছে। তবুও চেতনার অনেক গহিনে স্বস্তির একটা ঝিরিঝিরি বর্ষণ টের পাচ্ছে সে। নিশাকে নিয়ে ঘনিয়ে ওঠা সন্দেহটা যে নিতান্তই অমূলক ছিল এই সত্যের উন্মোচনটুকুই আজকের দিনটাকে জীবনের সবচেয়ে প্রশান্তিময় দিনগুলোর একটিতে রূপান্তর করেছে। মানুষের মগজ কতই না বিচিত্র এক যন্ত্র! কম্পিউটারের পর্দায় যেমন একই সঙ্গে একাধিক ট্যাব বা সফটওয়্যারের কাজ করা যায়, ঠিক তেমনিভাবেই ক্লায়েন্টের সঙ্গে ফোনে কথা বলতে বলতে জাহিদের বিক্ষিপ্ত মনটা মস্তিষ্কের একাধিক ট্যাবে অস্থিরভাবে বিচরণ করে যাচ্ছিল ক্রমাগত। তবে এই প্রক্রিয়া খুব বেশিক্ষণ কার্যকর হওয়ার নয়। খেই হারিয়ে যাচ্ছে। ফসকে যাচ্ছে তাল। আলোচনা সংক্ষিপ্ত করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফোনের লাইন কাটল জাহিদ। জানালার বাইরের সফেদ দুপুর রিমঝিম রিমঝিম সুর তুলে চেয়ে আছে ওর দিকে। এই তুষারঢাকা শুভ্রতা তাকে একটা নিশ্ছিদ্র ঝকঝকে অবকাশের প্রলোভন দেখায়। মন চায় সমস্ত কাজ, দুশ্চিন্তা আর টানাপোড়েন থেকে ছুটি নিয়ে শুধু নিজের…একদম নিজের মনের ভেতরের মনটাকে মনের মতো করে সময় দেয়। মাথার মগজের শিরা-উপশিরা থেকে টেনে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দেয় দুশ্চিন্তার আগাছা। চনমনে, প্রফুল্ল একটা মন নিয়ে ওই সাদা ধবধবে পায়রার মতো ফুরফুরে দিনটার বুক চিরে চিরে চলে যায় দূরে কোথাও। কলোরাডো স্প্রিংস বা ব্রেক অ্যান্ড রিজের কোন হিল সাইড রিসোর্টে। তারপর এক মগ ধোঁয়া ওঠা ব্ল্যাক কফি…হাতে পছন্দের বই…জানালায় লটকে থাকা বরফের বকুলফুল… ফায়ারপ্লেসের কমলা আগুনের উষ্ণতা…ব্যস আর কী চাই?
আর…কী…চা…ই? বাক্যটা স্বগতোক্তির মতো কয়েকবার আওড়ে গেল জাহিদ সেই বিশেষ মানুষটিকে ছাড়া অবকাশ যাপন কি আদৌ সুখকর হবে? একা হলেই তো তাকে ভীষণভাবে মনে পড়ে! শুধু একা হলেই নয়। এক ঝাঁক মানুষের মাঝে…আকণ্ঠ কাজের মাঝে…দৈনন্দিন জীবনের নানা ব্যস্ততার মাঝে সেই মুখটা অসময়ে…অকারণে…অতর্কিতভাবে মস্তিষ্কে হানা দিয়ে যায়। গা শিরশিরে এক সূক্ষ্মতর ভালোলাগার ঝাপটায় বিবশ হয়ে আসে মন। পা পিছলে যাওয়া কয়েকটা এলোমেলো মুহূর্তের পরেই মনটাকে সামলে নিয়ে পুনরায় শক্ত মাটিতে দাঁড় করিয়ে দিতে বাধ্য হয় জাহিদ। যে মেয়েটির কোন ভূমিকাই থাকার কথা ছিল না তার জীবনে। যাকে প্রথম দেখার দিনই মনে মনে শপথ করেছিল, কোনদিন একে নিজের বলে গ্রহণ করবে না। আজকাল সেই বিনামূল্যের, বিনা-আকাঙ্ক্ষার, বিনা-চিন্তার অতি সাধারণ মেয়েটি, তার একান্ত আপন ভাবন ঘরে অহর্নিশ অবাধ উচ্ছৃঙ্খল বিচরণ করে…আর এই অনধিকার অনুপ্রবেশ জাহিদের খুঁতখুঁতে রুচিসম্পন্ন, বিবেচক মনটা কিছুতেই সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করতে পারে না। অন্তত এতদিন পারেনি!
শাহজিদ এ বাড়িতে এসেছিল নিশার আগমনের কয়েক মাস পরে। তখনো জুবিনের জন্ম হয়নি। অফিস থেকে সবেমাত্র বাড়ি ফিরছিল জাহিদ। সন্ধ্যার আবছায়া নেমে এসেছে নেইবারহুডের ঘরবাড়ি আর রাস্তাঘাটে। হঠাৎ চোখ পড়ল ওয়াক ওয়েতে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন যুবক-যুবতীর ওপর। রমজান মাসে বোল্ডারের মসজিদে শাহজিদকে কয়েকবার দেখেছিল জাহিদ। বাবা পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশি কমিউনিটির অনুষ্ঠানগুলো জাহিদ সজ্ঞানে এড়িয়ে চলে। ওরা সেকেন্ড জেনারেশন। জেনারেশনের বাংলাদেশি আমেরিকানদের বাঙালিয়ানা বলতে তেমন কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না। দেশি ভাই-ব্রাদারের সঙ্গে মসজিদেই একটু দেখা-সাক্ষাত হয়। কিন্তু শাহজিদের পা হারানোর ঘটনা সম্পর্কে সে অবগত ছিল না। হঠাৎ একটা শক্ত সমর্থ যুবক ছেলেকে হুইলচেয়ারের শরণাপন্ন হতে দেখে অবাক হলো। তার চাইতে বেশি অবাক হল নিশার মুখের ঝলমলে হাসি দেখে। কারণ এই দিনটির আগ পর্যন্ত নিশাকে সে একটা বারের জন্যও হাসতে দেখেনি। দৃশ্যটা কেন যেন মনে গেঁথে গিয়েছিল। বুঝতে পেরেছিল নিশাকে হাসাতে পারে এমন মানুষ এই বাড়িতে শুধু একজনই আছে। সেই মানুষের নাম শাহজিদ। অথচ আজকের ঘটনা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী বিবৃতি দিয়েছে। তাহলে কি সেদিনের দৃশ্যটা ভুল ছিল? নাকি ভুল ছিল জাহিদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গি? কিন্তু … হঠাৎ ভাবনাটা মাথায় বিষের মতো ছোবল দিয়ে ওঠে। তার মেয়েটা নিতান্তই অপরিপক্ব মস্তিষ্কের অধিকারিণী। ছেলেমানুষ রয়ে গেছে এখনো। শাহজিদের প্রতি তার দুর্বলতা আছে এ কথা জলের মতো পরিষ্কার, কিন্তু শাহজিদ? শাহজিদ কি তুরিনকে চায়? নাকি নিশাকে? বিষয়টা মনে হতেই একটা দমবন্ধ ভাব হলো জাহিদের ও বসা থেকে উঠে পড়ল। অফিসরুম থেকে বেরিয়ে দেখল মুর্তজা সাহেব ক্যাটারিং থেকে খাবার-দাবার নিয়ে এসেছেন। নীলিমা শ্বশুরকে সাহায্য করছে। ফোর্ট কলিন্সে মুর্তজা সাহেবের চাচাতো ভাই থাকেন। তিনি সপরিবারে উপস্থিত হয়েছেন এর মাঝেই। এই রাজ্যে বাঙালির সংখ্যা এখনো নগণ্য। সব মিলিয়ে এক শ পরিবার হবে হয়তো। অধিকাংশ বাঙালিরা অরোরাতে বাড়িঘর কিনে থিতু হয়েছে। কিছু বাঙালি ছাত্র-ছাত্রী সিইউ বোল্ডারের ক্যাম্পাস এলাকায় থাকে। তুরিন, আনিতার কিছু বাংলাদেশি ক্লাসমেট আছে। যারা স্কলারশিপ নিয়ে সদ্য দেশ ছেড়ে ইউএসএতে পাড়ি জমিয়েছে। অরোরা থেকে লায়ন্স প্রায় দেড় ঘন্টা ড্রাইভ। আজকের আবহাওয়া বৈরী। রাস্তা পিচ্ছিল। স্নো গ্লোয়িং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অল্প সময়ের মধ্যে সব রাস্তা পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। বরফ জমে থাকে। গাড়ির চাকা পিছলে যায়। একাধিক গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। সড়ক দুর্ঘটনার ফলে কয়েকটা রুট অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। যানজট বাড়তে থাকে। অবশ্য কলোরাডোবাসীরা এই বৈরী আবহাওয়ার সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে। তাই আবহাওয়া যেমনই হোক না কেন। অতিথিরা আসবে।
মায়ের কান্নাটা তুরিনের সহ্য হচ্ছিল না। সে জানে তার মা একটু ঠোঁটকাটা এবং রাগী। তবুও মা তো মা-ই। মায়ের চোখের জল দেখতে কোন সন্তানের ভালো লাগে? তা ছাড়া তুরিনের মায়ের যে অনেক কষ্ট! ভালোবাসার মানুষকে অন্যের সঙ্গে ভাগ বাটোয়ারা করে নেয়ার মতো দুঃসহ যন্ত্রণা কি আর দ্বিতীয়টি আছে পৃথিবীতে? মাকে যে এই অসহ্য পীড়াদায়ক পরিস্থিতি দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হচ্ছে অষ্টপ্রহর। তুরিন এখন বড় হয়েছে। মায়ের কষ্ট সে বোঝে।
ফারা বালিশে মুখ চেপে উপুড় হয়ে শুয়ে ছিল। ওর পিঠটা কান্নার দমকে ফুলে উঠছে। তুরিন মায়ের পিঠের ওপর হাত রেখে করুণ স্বরে বলছে, ‘কেঁদো না মা। বাবাকে আমি খুব করে বকে দেব। আর কোনদিন এসব কথা বলার সাহস পাবে না। দেখে নিও তুমি।’
ফারা উঠে বসল, ‘তুমি তো কিছুই বললে না তখন। হা করে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলে।’
তুরিন মায়ের চোখের জল মুছে দিল, ‘বাবা এত বোল্ড-ভাবে কথাগুলো বলছিল। আমি ইন্টারফেয়ার করতে পারিনি। ভয় পেয়েছি।’
ফারা তুরিনের কাঁধ চেপে ধরে একটা প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘তুমি ভয় পেলে হবে না। তুমি হচ্ছ তোমার বাবার প্রথম এবং একমাত্র দুর্বলতা। তোমার বাবা তোমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। জুবিনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে। তুমিই পারবে তোমার মায়ের সংসারটা বাঁচাতে। বুঝলে?’
তুরিন ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না ঠিক কীভাবে কী করব। বাবা তো আমাকে কথা দিয়েছিল নিশাকে ডিভোর্স দেবে। তাহলে আজ আবার ওর সাপোর্টে কথা বলল কেন?’
— ‘তুমিও তো ওর সাপোর্টে কথা বলেছ। আমি ভুলে গিয়েছি মনে করেছ?’
তুরিন মুখ নামাল। এ কথা সত্য নিশা আজকে এক বিশাল বড় উপকার করেছে। শাহজিদ যদি কিছু না বলে চলে যেত তাহলে তুরিনের কী সর্বনাশটা হতো ভাবা যায়? এই আকাশস্পর্শী উপকারের জন্য নিশার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে তুরিন। কিন্তু মাকে এই কথা বোঝাবে কী করে? মায়ের যে শাহজিদকে পছন্দ না এটা তুরিন খুব ভালো মতোই জানে। এখন মনে হচ্ছে কয়েকটা দিন মায়ের কথা মন দিয়ে শুনলে, সব আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলে মায়ের মেজাজ-মর্জি হয়তো তার প্রতি প্রসন্ন থাকবে। সেই প্রসন্নতা বা কৃতজ্ঞতা থেকেই এক সময় শাহজিদের প্রতি গ্রহণযোগ্যতাও এসে যাবে। ফারা ঘন ঘন কয়েকবার নাক টানল। ন্যাপকিন দিয়ে মুখ মুছল। ধরা গলায় বলল, ‘শোন, তোমাকে আমি যা করতে বলব তাই করবে। তুমি তোমার বাবাকে ফিরিয়ে আনবে। এমন ভাবে ফিরিয়ে আনবে যেন নিশার কোন চিহ্ন আমাদের জীবনে না থাকে। প্রমিজ কর আমাকে।’
তুরিন মায়ের দিকে অসহায়ভাবে তাকাল। নিশার প্রতি একটা কৃতজ্ঞতাবোধ তার মনের মধ্যে টিকটিক করে নিজের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। কিন্তু এ কথা সত্য ওই নিশার জন্যই আজকে তার মায়ের জীবনের এই দুর্বিষহ অবস্থা হয়েছে। বাবাও দূরে সরে যাচ্ছে ওই নিশার জন্যই। ফারার একটা হাত ধরে তুরিন দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তুমি চিন্তা করো না মা। আমি প্রমিজ করছি। নিশা আমাদের মধ্যে থাকবে না।
সেই সময় জাহিদ প্রবেশ করল ঘরে। মা-মেয়েকে একসঙ্গে দেখে হালকা একটু ভদ্রতার হাসি হাসল। ঠিক পরমুহূর্তেই দরজার চৌকাঠে একটি নারীমূর্তির ছায়া পড়ল। জাহিদ ঘুরে তাকিয়ে আবিষ্কার করল নিশাকে। নিশা তুরিনের দিকে চেয়ে মৃদু স্বরে বলল, ‘আমার কোটটা নিতে এসেছি।’
তুরিন উঠে এসে চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে রাখা কোট তুলে দিল নিশার হাতে। নিশা জিনিসটা হাতে নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো। নিজের ঘরে এসে কোটের পকেটে হাত রাখতেই কেঁপে উঠল আত্মা! চিরকুটটা নেই! পাগলের মতো সব পকেট হাতড়াতে লাগল সে। কোথাও নেই সেই এক টুকরো কাগজ! নিশার মনে হলো কেউ তার কলিজাটা খুবলে নিয়েছে মাত্র। কী করবে এখন? কোথায় খুঁজবে ছোট্ট জিনিসটা? হায় খোদা! তার সঙ্গে কেন সব সময় এমন হয়? এতদিনের এত অপেক্ষার পরে তো লোকটা লিখেছিল একটা মাত্র দুর্লভ বাক্য! নিশার কাছে সেই একটি বাক্যের দাম নিজের জীবনের চাইতেও অনেক বেশি!
আজকে জুবিনের জন্মদিন উপলক্ষে বাড়িতে কত হই-হুল্লোড় হবে। নিশাকে কেউ ডাকবে না, ওর কথা কেউ ভাববেও না। দোতলার এই ছোট্ট ঘরে বন্দি হয়ে থাকবে সে। একথা ভাবতে একটু আগেও বিন্দুমাত্র খারাপ লাগছিল না। নিশা ভেবেছিল ওই ছোট্ট কাগজটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে থেকে সব দুঃখ ভুলে যাবে। কিন্তু এখন কী হলো? কেন হলো? মানুষটা যদি কথা ঘুরিয়ে ফেলে? আর কোনদিন যদি মুখ ফুটে কিছু না বলে? দশ বছরের বালিকা প্রিয় পুতুল খানি হারিয়ে গেলে যেমন ঠোঁট ফুলিয়ে অপ্রতিরোধ্য কান্নায় ভেঙে পড়ে, ঠিক তেমনই এক অতি উচ্ছন্ন দুর্মর কান্নার আয়োজনভাৱে নিশার ঠোঁটজোড়া থরথর করে কাঁপতে লাগল। বিষাদগ্রস্ত, তমসাচ্ছন্ন মন নিয়েই জুবিনকে গোসল করাল, খাওয়াল, দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তার মেয়েটার আজ জন্মদিন। দু বছর হলো। কত আনন্দের দিন! অথচ এই আনন্দের এক রত্তি ভাগিদারও সে হতে পারছে না। গত বছরের জন্মদিনে জাহিদ কী একটা কাজে জাপান গিয়েছিল। ওর অনুপস্থিতিতেও মুর্তজা সাহেব ধুমধাম করে জন্মদিন পালন করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে ফারা নিশাকে জুবিনের ন্যানি হিসেবে উপস্থাপন করেছিল অতিথিদের সামনে। এরপর নিশা ঠিক করেছিল আর কখনো এই বাড়ির কোন পারিবারিক মিলনায়তনে সে যোগ দেবে না। ঈদ, পহেলা বৈশাখ, থ্যাংকস গিভিং….কোন সময়েই নিশা আর নিচে নামে না। ঘরবন্দি হয়ে থাকে।
.
বিকেলের পর থেকে অতিথিরা আসা শুরু করল। বাঙালিদের পাশাপাশি মুর্তজা সাহেবের মার্কিন বন্ধুরাও দাওয়াত পেয়েছে। সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ বাড়ির ড্রইংরুম আর লিভিংরুম অতিথি সমাগমে মুখর হয়ে উঠল। বাচ্চারা হই- হুল্লোড় করে মাথায় তুলতে লাগল সারা বাড়ি। গোলাপি আর বেগুনির মিশেলের প্রিন্সেস ড্রেসে ছোট্ট জুবিনটাকে ডল পুতুলের মতো সুন্দর দেখাচ্ছিল। মাথায় রুপালি রঙের টিয়ারা। পিঠে বেঁধে দেওয়া হয়েছে পরির ডানা। আদরের পুঁটলিটাকে নিয়ে সবার মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গেল একদম। বিশাল বড় উপহারের বাক্স হাতে নিয়ে অনিমেষ উপস্থিত হলো যথাসময়ে। ওকে দেখামাত্র গাত্রদাহ হলো ফারার। এতবার নিষেধ করার পরেও এই বেহায়া লোকটাকে আসতেই হলো বার্থডে পার্টিতে। আজকাল জাহিদের মতো এই লোকটাও ফারার কোন অনুরোধ-উপরোধ গ্রাহ্য করছে না। ক্রমেই পরিস্থিতি হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বেশ কিছুদিন হলো অনিমেষের প্রতি একটা বিরূপ মনোভাব মনের মধ্যে শিকড়ের মতো গজিয়ে উঠেছে সুশীল, সৌম্য জাহিদের পাশে গোঁয়ার একরোখা অনিমেষকে যেন কিছুতেই আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ওই যে দ্যাখো কালো পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে জাহিদ দাঁড়িয়ে আছে লিভিংরুমের মাঝ বরাবর। বিশাল বড় ঝুলন্ত ঝাড়বাতিটার ঠিক নিচে। ওর চোখে পাতলা কাচের চশমা, মুখে মার্জিত হাসি…দেখলেই বোঝা যায় সম্ভ্রান্ত বংশের রক্ত বইছে শরীরে। ওর দিকে কেউ একবার তাকিয়েই সহজে চোখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। ফিরিয়ে নিলেও আরেকবার তাকাতে বাধ্য হবে। ফারার ভাবতে ভালো লাগে এই মানুষটা তার স্বামী। এর সঙ্গেই তার বিয়ে হয়েছিল, অনিমেষের সঙ্গে নয়। ভালোলাগার পাশাপাশি বুকের মধ্যে একটা আগুন টের পাচ্ছিল সে। এই আগুন আফসোসের, এই আগুন অনুশোচনার…কেন যে তার জীবনে অনিমেষ এসেছিল! ওই একটা মানুষের জন্য সবকিছু ছারখার হয়ে গেল। ধ্বংস হয়ে গেল। পুরনো প্রেম অনেকদিন বাদে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। শাশুড়ির কোল থেকে জুবিনকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে জাহিদের পাশে এসে দাঁড়াল সে। মুখে ঝুলিয়ে রাখল চমৎকার একটা হাসি। বাদামি রঙের স্লিভলেস ব্লাউজের সঙ্গে সাদা সুতার কাজঅলা সিল্ক শাড়ি পরেছিল ফারা। খোলা চুলের একধারে গুঁজে দিয়েছিল স্নোড্রপ ফুল। উপস্থিত অতিথিরা সুন্দরী মায়ের কোলে পুতুলের মতো ফুটফুটে মেয়েকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছিল, প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছিল!
এদিকে হরেক লোকের হইচইপূর্ণ উচ্ছ্বসিত কোলাহলের মধ্যেও জাহিদ একা হয়ে যাচ্ছিল ক্ষণে ক্ষণে। চারিদিকের রঙিন দৃশ্যগুলো সাদাকালো টেলিভিশনের ঝিরঝির করা বিকল পর্দার মতো ধূসর হয়ে ধরা দিচ্ছিল তার চোখে। কিছুতেই আনন্দোৎসবে মন লাগাতে পারছিল না। তার মনটা বারবার ছুটে যাচ্ছিল দোতলার সর্ব দখিনের ছোট্ট ঘরটায়। যেখানে একটা মেয়ে বদ্ধ দরজার পেছনে একলা বসে আছে।
ফটোগ্রাফার একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে। পরিবারের সকল সদস্য ফ্রেমবন্দি হচ্ছে। ফারার কোলে জুবিন, পাশে জাহিদ, জাহিদের গলা জড়িয়ে ধরে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দাঁড়িয়ে আছে তুরিন। ফারা জুবিনকে কিছুতেই কোল ছাড়া করছে না। শাশুড়ি একাধিকবার হাত বাড়িয়েছেন নাতনিকে কোলে নেয়ার জন্য। ফারা দেয়নি। কেক কাটার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। নানা বয়সি বাচ্চারা কেকের টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়েছে। জন্মদিনের অনুষ্ঠান ওদের জন্যই। কেক কাটা নিয়ে তাই ওদের উৎসাহটাই সবচেয়ে বেশি। জুবিনের এখনো অত কিছু বোঝার বয়স হয়নি। তবে এত এত লোক একসঙ্গে পেয়ে গিয়ে সে তব্দা খেয়ে গেছে। পুতুপুতু চোখ মেলে চারপাশটা দেখছে। কে জানে হয়তো ছোট্ট মানুষটা ভিড়ের মধ্যে মাকেই খুঁজছিল। মুখ ফুটে বলতে তো পারছে না। পূর্ণবয়স্ক মানুষেরাও অনেক সময় অবলা শিশুদের মতোই মনের কথা মুখে আনতে ব্যর্থ হয়। বয়সের পসার মানুষকে বাকস্বাধীনতা দেয় না বরং কেড়ে নিতে থাকে দিনকে দিন। জাহিদ টের পাচ্ছিল তার প্রতিটা নিঃশ্বাসে বিষাক্ত হূল ফুটছে। একটা বিপুল মাতঙ্গ যেন হৃৎপিণ্ডটাকে পায়ের তলায় ফেলে পিষ্ট করে যাচ্ছে ক্রমাগত। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ভিড়ের মধ্যে থেকে পিছিয়ে এসেছিল কয়েক পা। সিঁড়ির কাছটায় আসতেই তুরিন হঠাৎ একটা হাত খামচে ধরল, ‘বাবা এসো। ছবি তুলব। এবার শুধু আমরা দুজন।’
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ২০.১
গোলাপি আভাযুক্ত পেলব হাতের চামড়া চিরে গাঢ় লাল রক্তের একটা রেখা বিমূর্ত হয়ে উঠল চোখের সামনে। যন্ত্রণাটা চিলিক কেটে সারা শরীরে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়তেই গা-শিউরানো, রোমহর্ষক, অপ্রকৃতস্থ হাসির স্ফুরিতধার উপস্থিতি নিশার শুকনো, মৃতপ্রায়, খড়খড়ে দুটো ঠোঁটকে প্রসারিত করল এ কান থেকে ও কান পর্যন্ত। মনে হলো মনের যন্ত্রণা থেকে শরীরের যন্ত্রণা অনেক বেশি সহনশীল। রুপালি রঙের ধারাল ব্লেডটা দিয়ে ডান হাতের চামড়ায় আরো কয়েকবার পোঁচ দিল সে। চামড়া ছিঁড়ে রক্তের ফোঁটা বেরিয়ে আসতেই একটা আরাম বোধ হচ্ছে। সবচেয়ে ভালো হতো নীল রগটার মাঝ বরাবর যদি একটা আঁচড় বসিয়ে দিতে পারত। ক্ষীণ পাতলা ধমনিটা বিচ্ছিন্ন করে দিলে সমস্ত পার্থিব মর্মবেদনার মধুরেণ সমাপয়েৎ ঘটে যেত। বেঁচে থেকে তো প্রতিটা মুহূর্তে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হচ্ছে। এর চেয়ে বরং একবারেই মরে যাক। যে মেয়েকে পৃথিবীতে কেউ মানুষ হিসেবে বিন্দুমাত্র সম্মান দিতে চায় না, ভালোবাসতে চায় না, যে মেয়েকে সবাই অদ্ভুতের মতো দূরে ঠেলে ঘরের কোণে বন্দি করে রাখে পোষা কুকুরের মতো…সেই মেয়ের অশুভ ছায়া এই সুজলা সুফলা পবিত্র ধরণীর বুক থেকে চিরদিনের জন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াই সমীচীন।
ঘরের জানালাটা খোলা ছিল। নিচতলা থেকে হাস্য কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছে। নিশা মেঝেতে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে। ডান হাতটা এলিয়ে আছে বিছানার ওপর। রক্তের ধারা গড়িয়ে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে সবুজ রঙের বেডশিট। বরফ ছোঁয়া তীব্র শীতল বাতাস তেড়ে আসছিল খোলা জানালা দিয়ে। নিশার গায়ে পাতলা একটা অফ হোয়াইট কালারের সুতির সালওয়ার কামিজ। ওড়নাটা আলুথালু হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। বাতাসে কোন আর্দ্রতা নেই। রুক্ষ বাতাস শরীরের চামড়ায় ফাটল ধরাচ্ছে। প্রতিটা রোমকূপ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে উষ্ণতা। চোখদুটো শুষ্ক। শ্বাস পড়ছে ঘনঘন। গলাকাটা কবুতরের মতো ছটফটানি সারা শরীরে
একটা সময় নিশা উঠে এসে বিছানার পাশে রাখা নাইটস্ট্যান্ডের ড্রয়ার খুলল। হাতড়ে হাতড়ে দেখল কোন ঘুমের ওষুধ আছে কি না। এই দেশে ঘুমের ওষুধ কেনা কঠিন কাজ। ডাক্তাররা প্রেসক্রাইব করতে চান না। ওভার দ্য কাউন্টারে যা পাওয়া যায় তাতে নিশার কোন জুতসই উপকার হয় না। দেশ থেকে আনা স্লিপিং পিল খুঁজে পাওয়া গেল। ঘুম পাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের মেডিসিনের বিকল্প নেই। নিশা একসঙ্গে তিন চারটা গিলে ফেলল পানির সঙ্গে। ব্যস…এইবার সে ঘুমাবে। শান্তির ঘুম। এই ঘুমটা আর কোনদিন না ভাঙাই উত্তম।
মন বলছিল মানুষটা আসবে। অন্য কেউ নিশাকে স্মরণ না করলেও, সেই মানুষ অন্তত একটিবার দেখতে আসবে। বাচ্চাটাকে টানা দশ মাস পেটে ধরল, মর্মান্তিক প্রসব যন্ত্রণা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে ভূমিষ্ঠ করল আলো- বাতাসের এই পৃথিবীতে। তার দুর্বল শরীরের নাড়ি কেটে ছিঁড়ে জন্ম নিল এই পরিবারের রক্তবাহী বৈধ বংশধর। আজ সেই বংশধরের জন্মোৎসবে যোগ দেবার, মা হিসেবে সমাজের কাছে স্বীকৃতি পাবার কোন যোগ্যতা তার নেই। আর যে মানুষটাকে জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসল, যে মানুষ তার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র প্রেম…সেই মানুষটাও আজকের এই বিশেষ দিনে তার কথা একটিবারের জন্য ভাবল না। ওই যে শোনা যাচ্ছে হাসির শব্দ, কথার শব্দ, গানের শব্দ…ওখানে কত রং, কত সুখ, কত জীবনের উচ্ছ্বাস! ওখানে কোথাও নিশা নেই। নিশার কথা কেউ কখনো মনে রাখেনি। কিন্তু জুবিন… জুবিন সোনা তোমারও কি মাকে মনে পড়ে না? তুমি কি কোনদিন তোমার মায়ের জীবনের দুর্বিষহ করুণ গল্পগুলো জানতে পারবে? না জানাই ভালো। তুমি বরং ফারাকেই তোমার মা হিসেবে মেনে নিও। আমার কাজ ছিল তোমাকে জন্ম দেওয়া। তোমাকে জন্ম দিয়ে স্বার্থক আমার নারীজন্ম! তুমি, তোমার বাবা, তোমার সত্মা…তোমরা সবাই ভালো থেকো সোনা! খুব ভালো থেকো!
.
বাবার হাত ধরে টানতে টানতে ভিড়ের মাঝে এগিয়ে এলো তুরিন। জাহিদের মনে হচ্ছিল একটা অথই সাগরের অতল জলে খাবি খাচ্ছে সেই তখন থেকে! মনের গভীরের মাটি এত পিচ্ছিল যে, কোন চিন্তাভাবনাকে সুস্থিরভাবে দাঁড় করানো যায় না। এরকমও হয় নাকি? এই যে এত এত প্রিয় মুখ, এত কোলাহল, এত হাস্যোজ্জ্বল আনন্দময় ক্ষণ এই সমস্ত কিছু ভাঙা কাচের মতো চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে শুধু একজন মানুষের অনুপস্থিতির কারণে! শরীর থেকে আত্মার বিচ্ছেদ ঘটলে প্রাণ বলতে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। জাহিদ টের পাচ্ছে ওর আত্মাটা পড়ে আছে দোতলার দখিন প্রান্তের ঘরখানায়। প্রাণহীন শরীরের বোঝা বহন করা কী দুর্দান্ত কষ্টের কাজ তা জীবনে প্রথমবারের মতো জানতে পারল। তুরিন ওর পাশে দাঁড়িয়েছে। ফটোগ্রাফার ক্যামেরায় ক্লিক করছে একের পর এক। এই সব কোলাহলের লেশমাত্র প্রভাব পড়ছে না জাহিদের মনে। তার শুধুই মনে হচ্ছে চারিদিকে কেউ নেই….. কিছুই নেই…শূন্যতা ভরা ধু-ধু পৃথিবীতে শুধু একটি মাত্র মুখ মোমবাতির মতো জ্বলছে টিমটিম করে। জাহিদ তুরিনের মুখের দিকে তাকাল একবার। হালকা হলুদ রঙের একটা শাটিন সিল্কের গাউন পরেছে ও। ঠোঁটে উপচে পড়ছে হাসি। তুরিনের হাসি তার জীবনের সবচাইতে প্রিয় জিনিসগুলোর একটি। কিন্তু আজকে মেয়ের হাসিমুখের দিকে চেয়ে থেকেও জাহিদ বুকের ভেতরকার হারিয়ে যাওয়া আত্মার অস্তিত্ব ফিরিয়ে আনতে পারল না। কী আশ্চর্য! এতটা স্বার্থপর সে কী করে হলো? পুরো পরিবারের সান্নিধ্যে থেকে নির্বোধ, স্থূলবুদ্ধি, বেপরোয়া মাতালের মতো শুধু একজনকেই ভেবে যাচ্ছে!
ফারার কোল থেকে অবশেষে নাতনিকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন মিসেস মুর্তজা। কেকের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েছেন তিনি জুবিনকে নিয়ে। জাহিদের ডাক পড়েছে। মেয়ের জন্মদিনের কেক কাটার মুহূর্তে বাবাকে উপস্থিত থাকতে হবে। জাহিদ তাকিয়ে আছে দৃশ্যটার দিকে বুদ্ধিভ্রষ্টের মতো। নড়ছে না, কিছু বলছেও না! তুরিন ওর একটা হাত ধরল। হালকা টান দিয়ে বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছ কেন বাবা? এসো।’ জাহিদ সন্তর্পণে ছাড়িয়ে নিল হাতটা। মৃদু স্বরে বলল, ‘তুমি যাও। আমি আসছি।’
কথাটা বলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে এলো। যেন গভীর জলের চাপ ঠেলে ডাঙায় ওঠার চেষ্টা করছিল। চতুর্দিকে ঝাপসা, ফ্যানা ওঠা, থইথই জলের বিস্তার। নাকে, কানে, ফুসফুসে, শ্বাসনালির ছিদ্রপথে কুলকুল করে ঢুকে যাচ্ছে জল। মনে হচ্ছে মরে যাবে…এখুনি হৃৎপিণ্ডটা ঢং করে মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিয়ে বিকল হয়ে পড়বে চিরকালের জন্য!
তুরিন আনিতার সঙ্গে কথা বলায় মগ্ন ছিল। ফারা ওর কনুই খামচে ধরে কিঞ্চিৎ দূরে সরিয়ে আনল। চাপা গলায় বলল, ‘তোমার বাবা কোথায়?
— ‘দোতলায় গিয়েছে।’
— ‘তোমাকে না বললাম ফলো করতে? তুমি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে করছটা কী?
তুরিন বিরক্ত হয়, ‘হোয়াই আর ইউ বিইং সো রুড মা? কাম ডাউন!’
— ‘তুমি এখুনি যাও। খোঁজ নাও তোমার বাবা কোথায় আছে।’
বলতে বলতে ফারার গলা কাঁপছিল। কেন যেন আজকে ভেতরে ভেতরে খুব বেশি অসহায় বোধ করছে সে। এতদিনের সব হিসেব-নিকেশ গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। একটা ধারাল দাঁতঅলা কুৎসিত করাল ভয়ের প্রচ্ছন্ন হুংকার ওর শরীরটাকে চোরাবালির মতো গ্রাস করতে চাইছে।
তুরিন হঠাৎ গলাটা একটু খাদে নামিয়ে কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, ‘মা আমি ভাবছিলাম…বাড়িতে একটা পার্টি হচ্ছে আমরা অর্ণব আর শাহজিদকেও ইনভাইট করতে পারি, কী বলো?’
ফারার চোখ দুটো যেন কোটর ছাড়িয়ে অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে ওঠে। মেয়ের দিকে তীক্ষ্ণভাবে চেয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘অর্ণবকে তোমার দাদাভাই ইনভাইট করেছে। সে এখানেই উপস্থিত আছে।’
তুরিন একটু থতমত খেয়ে গেল, ‘ও আচ্ছা।’
— ‘বেজমেন্টের পঙ্গু ছেলেটা এখানে আসতে পারবে না। আমাদের পোর্চে শুধু সিঁড়ি আছে, ডিজেবলদের ওঠা-নামা করার ব্যবস্থা নেই। ওকে এখানে আনতে হলে স্টেয়ার লিফট লাগবে। এসব ঝামেলা কে করবে? তুমি? নাকি আমি?’
তুরিনের মুখে শ্রাবণ মেঘের থমথমে অন্ধকার নেমে আসে। ভারী একটা পাথর যেন অনেক উঁচু থেকে ছুঁড়ে মারা হয় পাঁজরের হাড় বরাবর। চিনচিন করে ভেতরটা।
জাহিদ এক নিঃশ্বাসে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে এসেছিল। গলাটা তৃষ্ণায় চৌচির! হৃদরোগে আক্রান্ত অসুস্থ মানুষের মতো ধড়ফড় করছে বুক। বেশ কয়েকবার ধাক্কা দিয়েছে দরজায়। কিন্তু ভেতরে কোন সাড়াশব্দ নেই।
— ‘বাবা! তুমি এখানে কেন? দাদু ডাকছে কেক কাটার জন্য। সবাই ওয়েইট করছে।’
জাহিদ ঘুরে তাকাল মেয়ের দিকে। তুরিনের মনে হলো বাবার চেহারাটা খুব ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ফরসা মুখের আনাচেকানাচে কুয়াশার মতো জমে আছে গভীর হতাশার চিহ্ন। দেখামাত্র বুকটা কেমন মুচড়ে উঠল কষ্টে। জাহিদ মেয়ের দিকে বাহ্যজ্ঞানশূন্য দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল শুধু। প্রশ্নের উত্তর দিল না। তুরিনের পেছনে তখন ফারা এসে দাঁড়িয়েছে। ক্ষ্যাপা সুরে বলছে, ‘তোমার মেয়ের জন্মদিনের কেক কাটা হচ্ছে। তুমি এখানে কেন?’ জাহিদ ফারার দিকে এমন চোখে চাইল যেন কথাটার মর্মার্থ সে বোঝেনি। ফারার মুখে আগুন ঝলসাচ্ছে। নিঃশ্বাসে ক্রোধের স্ফুরণ। তুরিন কিছুক্ষণ অপদস্তভাবে দাঁড়িয়ে থেকে সরে এলো জায়গাটা থেকে। মনটা…মন খারাপের আরো অতল জলের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে উঠল। বাবাও বদলে যাচ্ছে! বদলে গেছে অনেক খানি! এই বাবাকে সে চেনে না। ফারা এগিয়ে এসে জাহিদের একটা হাত চেপে ধরল, ‘নিচে চলো।’
জাহিদ একবার তাকাল নিজের বাহুতে চেপে বসা ফারার লাল নেইলপলিশঅলা একাধিক আংটিসমেত ফরসা হাতটার দিকে। সেই দৃষ্টিতে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল। বুকটা অকারণেই কেঁপে উঠল ফারার। সরিয়ে নিল হাত। জাহিদ ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আসছি। তুমি নিচে যাও।’ ফারাকে সরে আসতেই হলো। কিন্তু আজকে তার মনে শুধু ঈর্ষাই নয়, বরং কষ্টের এক স্ফীত ঢেউ উঠল প্রবলভাবে। অন্তর্দাহে পুড়ে খাঁক হতে হতে তার মনে হলো এই মুহূর্তে নিশাকে সামনে পেলে সে নির্ঘাত খুন করত। খুন করবে সে। আজ নয়তো কাল। জানে না মারলেও মনের দিক থেকে এমনভাবে মেরে ফেলবে যে ওই মেয়েটার বেঁচে থাকার প্রতিটি দিন নরকের চেয়েও ভয়ংকর হয়ে উঠবে! রাগে, কষ্টে আর ঈর্ষায় ফারার চোখের কোল ঠেলে অশ্রুর একটা ধারা নেমে এলো। হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের পানি মুছল সে। বড় একটা নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে নিজেকেই নিজে শোনাল কথাটা, নিশা আই উইল রিপ ইয়োর সোউল আউট সুন!
.
দরজাটা হঠাৎ খুলে যায়। একটা দমকা বাতাস ধাক্কা দেয় জাহিদের গায়ে। ল্যাম্পশেডের পিঙ্গল আলোয় ভেসে ওঠে নিশার শীর্ণ, বিবর্ণ মুখ। বাতাসে অক্সিজেন ফিরে পায় জাহিদ। সমুদ্রের গভীর জলের চাপ ঠেলে যেন ডাঙ্গায় উঠে আসে ওর শরীর। প্রাণের স্পন্দনে বাকবাকুম করে ওঠে প্রতিটি মৃত কোষ। নিশার মাথাটা টলছিল। হাতে পায়ে শিনশিন ভাব। দরজার চৌকাঠে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে অনেক কষ্টে বলল, ‘কী চাই?’
জাহিদ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ঘরটা অত্যধিক ঠান্ডা হয়ে আছে। নিশা দাঁড়াতে পারছে না সুস্থিরভাবে। মাথা ঘুরাচ্ছে। হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছে এটা বাস্তব নয়, স্বপ্ন। বাস্তবে তো লোকটার এখন জন্মদিনের অনুষ্ঠানে থাকার কথা। এখানে আসার কথা না।
—‘কেন এসেছেন? জন্মদিন শেষ? জুবিন কোথায়?’ জড়ানো আর ভারী শোনাল নিশার কণ্ঠস্বর
জাহিদ এগিয়ে এলো কয়েক পা। হালকা একটু মুচকি হাসল নিশা বাস্তবের চেয়ে স্বপ্নই ভালো। নিশা চায় এই ঘুমটা আর কখনো না ভাঙুক। এই স্বপ্ন চলতে থাক অনাদি কাল ধরে। জাহিদ ওর গালে হাত রেখে মুখটা ওপরের দিকে তুলে ধরল। দেখল বড় বড় দুটি চোখের পাতায় লেগে আছে মায়া! শুষ্ক ঠোঁটের ফাটা চামড়া দিয়ে একটু একটু ঝিলিক দিচ্ছে রক্তের লাল। এই আশ্চর্য সুন্দর মুখের দিকে চেয়ে থেকে জাহিদ শুভ্র তুষারের মতো একটা নিষ্কলুষ স্নিগ্ধতা টের পেতে থাকে। মনে হয় আজ সারাদিন ধরে যে অখণ্ড অবকাশের জন্য মন ছটফট করছিল, তড়পাচ্ছিল, সেই অবকাশের দরজাটা আসলে রহস্যময় গুপ্তধনের মতো লুকিয়ে আছে এই মুখটারই পরতে পরতে, ভাঁজে ভাঁজে! এখানেই তার মুক্তি…এখানেই আছে নিশ্ছিদ্র আশ্রয়…এখানেই তার হারিয়ে যাওয়া আত্মাটা বাসা বেঁধেছে জীবনের সব আয়োজনকে সঙ্গী করে!
জাহিদ প্রমত্ত চোখে চেয়ে থাকে। তুষারবিন্দুর মতো শুভ্র, নিষ্কলঙ্ক মুখের মেয়েটা তাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে। এই আকর্ষণ বড়ই অভদ্র, অবাধ্য এবং অনিবার্য! কোনভাবেই আর একে বশে আনা যায় না। নিশার বুক কাঁপছিল ভীষণ। একটা অপার্থিব হাসি লেগে ছিল ঠোঁটে।
‘স্বপ্নই ভালো…স্বপ্নই ভালো।’ কথাটা স্বগোতোক্তির মতো বলতে বলতেই জাহিদের পাঞ্জাবির কলারটা খামচে ধরল ও। স্খলিত কণ্ঠে বলল, – “তুমি নিশ্চয়ই আমার স্বপ্নে এসেছ জাহিদ! বাস্তবে তো তুমি আমাকে দেখতেই পারো না। আমার কথা মনেই থাকে না তোমার! কেন সবসময় এত অবহেলা করো আমাকে? কেন একটুও ভালোবাসো না?’ নিশার দুর্বল টলমলে শরীরটা এক ঝটকায় নিজের কাছে টেনে আনল জাহিদ। ক্ষিপ্র স্বরে প্রশ্ন করল, ‘ভালোবাসি না?’
কাছে আসতেই সুন্দর একটা নেশারু ঘ্রাণ এসে ধাক্কা দেয় নিশার নাকে! মেরুদণ্ডে ভালোলাগার তীক্ষ্ণ বিদ্যুৎ চিরচির করে চিলিক কেটে যায়। বুকের মধ্যে ভূমিকম্প হয়। অপলক চোখে তাকায় সে উঁচু লম্বা প্রশস্ত কাঁধের দীর্ঘকায় মানুষটার দিকে। ক্ষীণ গলায় বলে, ‘বাসো কি?’
প্রশ্ন শুনে জাহিদ কিছুক্ষণ স্থবির হয়ে চেয়ে রইল। তারপর জীবনে প্রথবারের মতো নিজের ঠোঁট নামিয়ে আনল নিশার ঠোঁটের ওপর। শুষ্ক অথচ কোমল দুটি ঠোঁট থেকে শুষে নিতে লাগল হৃদয়ে জমে থাকা দীর্ঘদিনের সব যন্ত্রণা আর অতৃপ্তি। শুকনো চামড়া চিরে বেরিয়ে এলো রক্তের লোনা স্বাদ। বুকের মধ্যে সফেদ বরফকুচির মতো নিঃশব্দে ঝরে পড়তে লাগল বহু আকাঙ্ক্ষিত, আরাধ্য, অপূর্ব সেই অলৌকিক অবকাশ!
নিশার শ্বাসনালিতে বাষ্প আটকে গিয়েছিল। এই আচমকা স্পর্শ ওর হিম হয়ে আসা শৈত্যপূর্ণ শরীরে উত্তাপের ফুলঝুরি ছড়িয়ে দিয়েছে। গলা কাটা কবুতরের মতো ছটফটে যন্ত্রণাটা নিমেষে হয়ে উঠেছে স্বর্গীয় নীলকণ্ঠ পাখি! এতক্ষণ ওর চোখে জল ছিল না। শুকনো বনের কাঠকয়লার মতো ধকধক করে জ্বলছিল শুধু। এখন চোখের দেওয়াল উপচে জলের ঢল নামল। দুলতে থাকা, উড়তে থাকা, কাঁপতে থাকা হৃৎপিণ্ডটা কোন রকমে সামলে নিয়ে সে কম্পিত গলায় বিড়বিড় করে বলল, ‘স্বপ্নই ভালো।’
জাহিদ বলল, ‘এটা স্বপ্ন নয় বোকা!’
নিশা এক আকাশ ভ্রান্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকে সামনে। দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে নাতো? জাহিদের ফরসা ছিপছিপে গালে এলোমেলো পড়ে থাকা কালচে দাড়ির পাতলা আস্তরের ওপর একটা হাত রাখে সে। তীক্ষ্ণ চোখে কী যেন পরখ করে। তারপর মাথা উঁচু করে আবিষ্টভাবে চুমু খায় ওই বাদামি ঠোঁটে জানালার খোপে আলগোছে লেগে থাকে হিমবর্ষী সাদাটে রাত। আকাশে চমকায় গোলাপি আভা। ওদের ঠোঁট লগ্ন হয়ে থাকে সুনিবিড় এক মিলনালিঙ্গনে! জানালা দিয়ে উচ্চকণ্ঠের হইচই ভেসে আসে। ভেসে আসে বাদ্যযন্ত্রের শব্দ। কতক্ষণ কেটেছিল কে জানে। মিসেস মুর্তজার কণ্ঠস্বর শোনা যায়। দরজায় ধাক্কা পড়ে।
চমকি দেখিনু আমার প্রেমের
জোয়ারও তোমারই মাঝে।
হৃদয় দোলায় দোলাও আমারে
তোমারও হিয়ারই মাঝে!
— মীরা দেব বর্মন
চেতন অবচেতনের মাঝ বরাবর আটকে গিয়েছিল নিশার মন। সম্পূর্ণ সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েনি। হঠাৎ হঠাৎ মনে হচ্ছিল শরীরে কোন ভর নেই। পাখির মতো হালকা! যেন পা পড়ছে না মাটিতে, ভাসছে শূন্যে। স্বপ্নের মতো একটা ঘোর লেগে আছে। এর মাঝেই কখনো কখনো চেতনার ঢেউ এসে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে। নরম বালুতটে আছড়ে পড়া ফেনিল জলরাশির মতো সশব্দে কড়া নাড়ছে চৈতন্যবোধ। সদ্য জ্ঞানপ্রাপ্ত ভোঁতা মস্তিষ্ক নিয়ে সে চারিদিকের বাস্তবতাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ঠিকমতো কিছু বুঝে ওঠার আগেই পুরনো গাড়ির নষ্ট হেডলাইটের মতো নিভে যাচ্ছে জ্ঞানেন্দ্রিয়র সব বাতি দরজা খুলে মিসেস মুর্তজাকে দেখল জাহিদ। পাশে এইটুকু জুবিনটা দাঁড়িয়ে আছে দাদির হাত ধরে। জাহিদ মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করল। মুর্তজা সাহেব আর ফারাকেও দেখা গেল করিডরে। মিসেস মুর্তজা বললেন, ‘নিচে তো সবাই অপেক্ষা করছে। কেক কাটা হলে ডিনার সার্ভ করা হবে। তুমি আসো তাড়াতাড়ি।’
জাহিদ জুবিনকে মিসেস মুর্তজার কোলে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘আমি এই মুহূর্তে আসতে পারছি না। তোমরা ম্যানেজ করো।
— ‘মেয়ের জন্মদিনে বাবা থাকবে না। এটা কেমন কথা?’
মুর্তজা সাহেব কাছাকাছি এসে কটু-কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, ‘কী হয়েছে? কী সমস্যা?’
জাহিদ বিনীতভাবে বলল, ‘আমি এখন নিচে নামতে পারছি না। ব্যস্ত আছি।’
— ‘কী ব্যস্ততা তোমার?’
জাহিদ উত্তর না দিয়ে চোখ নামিয়ে নিল নিচে। একটা মৃদু শ্বাস পড়ল হতাশার। ফারা আর তুরিন এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। ফারা ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘চলো চলো। সাড়ে আটটা বেজে গেছে। আর দেরি করা ঠিক হবে না।’
— ‘তোমরা যাও। আমি পারব না। নট ইন দ্য মুড রাইট নাউ।’
মুর্তজা সাহেব ছেলেকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। বাবা-মায়ের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন না করলেও সমীহ করে চলাটা তার পুত্রদের সৎ গুণসমূহের একটি। আজকে ছেলের মধ্যে সমীহ বোধের অভাব দেখা দিয়েছে বলে মনে হলো তার। অন্য সময় হলে বিষয়টা তেমন আমলে নিতেন না। কিন্তু আজ শ খানেক লোক দাওয়াত করা হয়েছে। সবাই জানে জাহিদের মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষেই এই আয়োজন। মেয়ের জন্মদিনের বিশেষ মুহূর্তে বাবার অনুপস্থিতি অতিথিদের নজর কাড়বে।
— ‘নিশা কোথায়?’ মুর্তজা সাহেব প্রশ্ন করলেন।
জাহিদ চুপ করে রইল। মিসেস মুর্তজা বললেন, ‘তুমি বরং বৌমাকে সঙ্গে নিয়ে এসো। এটাই ভালো হবে।’
ফণাধারী সাপের মতো ফোঁস করে উঠল ফারা, ‘সঙ্গে নিয়ে আসবে? তারপর? কী পরিচয় দেবেন সবার সামনে?’
সেই মুহূর্তে একটা চন্দন রঙের নরম হাতের শীর্ণ পাঁচ আঙুল জাহিদের পাঞ্জাবির কাঁধের ওপর গাঢ়ভাবে চেপে বসল। জাহিদ টের পেল নিশা কপাল ঠেকিয়ে দিয়েছে ওর পিঠে। অস্ফুটে বলছে, ‘তুমি কি চলে যাচ্ছ? যেও না প্লিজ!’
উপস্থিত সদস্যদের দৃষ্টি টর্চের আলোর মতো ঠিকরে পড়ল মেয়েলি হাতখানির ওপর। জাহিদের মুখ সংকোচের লাল ছোপে রক্তাভ হয়ে উঠল।
সামনের দিকে পলকহীন দৃষ্টি মেলে রেখে অপ্রস্তুত ভাবে নিশার হাতটা সরিয়ে দিল সে নিজের কাঁধের ওপর থেকে। লাভ কিছুই হলো না। সেকন্ডের মধ্যেই হাতটা আবারও উঁকি দিল। জাহিদ অপদস্ত চোখে লক্ষ করল মায়ের মুখে একটা চাপা হাসির আভা ঝিলিক দিয়ে উঠেছে। এই হাসিটা জাহিদকে আরো বেশি রকমের ব্রিবত করে তুলল। সত্যিই ভীষণ লজ্জা পেল সে। বাবার সামনে…মায়ের সামনে…মেয়ের সামনে! মুর্তজা সাহেব কয়েক পা পিছিয়ে এসে স্ত্রীকে বললেন, ‘ও থাকুক। চলো আমরা নিচে যাই। আজকে দাদা দাদুই কেক কাটবে জুবিন সোনার সঙ্গে!’
বাবা মায়ের অবয়বটা চোখের সামনে থেকে নিষ্ক্রান্ত হতেই স্বস্তির শ্বাস ফেলল জাহিদ। ঘরে ঢুকে ফারার মুখের সামনে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করল। জীবনে এই প্রথমবারের মতো নিজের মেয়ের সামনে ভীষণ ভাবে অপদস্ত বোধ করল ফারা। প্রতিশোধের বীভৎস তাণ্ডবে কুঁকড়ে উঠল ওর মুখ। মেয়ের দিকে চেয়ে কনকনে ঠান্ডা গলায় বলল, ‘তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন?’
তুরিন ভড়কে গেল সামান্য, ‘ডোন নো হোয়াট টু ডু!’
আশ্চর্য ব্যাপার হলো নিশার প্রতি অন্যদিনের মতো বিভীষণ রাগটা আজকে চড়াও হচ্ছে না কেন যেন! মনের মধ্যে ক্ষমাসুলভ একটা নরম আবহের সৃষ্টি হয়েছে। আজ সকালে নিশার করা উপকারটুকুই হয়তো এই বিনম্রতার প্রধান কারণ। ফারা বলল, ‘তোমার বাবাকে এই ঘর থেকে বের করে আনো। এখুনি! মায়ের অগ্নিশর্মা মুখটা তুরিনের মনে ভয়ের উপদ্রব করল। অসহায়ভাবে এগিয়ে এলো সে দরজার কাছে। ধাক্কা দিতে লাগল উপর্যুপরি।
নিশার টলতে থাকা শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে বিছানার কাছে নিয়ে এসেছে জাহিদ। চিবুকে হাত রেখে বলল,
‘আমার দিকে তাকাও। তুমি ঠিক আছ? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?’ কথাটা বলতে বলতে চোখ পড়ল নিশার ডান হাতের ওপর। ল্যাম্পশেডের পিঙ্গল আলোয় রক্তাক্ত আহত হাতটা দেখামাত্র আতঙ্কে শিউরে উঠল গা। একটা আর্তনাদ ছিটকে বেরিয়ে এলো জাহিদের কণ্ঠনালি চিরে, ‘হোয়াট দ্য হেল হ্যাভ ইউ ডান! …হ্যাভ ইউ গন ইনসেইন?’
নিশা বিছানার ওপর ধপ করে বসে পড়ে এক নিঃশ্বাসে বলল, – ‘কাগজটা না হারিয়ে গেছে!’
— ‘কীসের কাগজ?’
— ‘ওই যে…ছোট্ট কাগজটা!’
জাহিদ বেশ ঘাবড়ে গেছে। শ্বাস পড়ছে বড় বড়। অনির্ণেয় ত্রাসে কাঁপছে হাত-পা। মেয়েটা এমন অসংলগ্ন কথা বলছে কেন? নেশা-টেশা করেছে নাকি? রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কি কিছু খেয়েছ?’
—‘আমার কাগজটা হারিয়ে গেছে।’ ভীষণ দুঃখী গলায় বলল নিশা।
জাহিদ অধৈর্য হলো, ‘কী বলছ? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!’
— ‘তুমি লিখে দিয়েছিলে না? ভুলে গেছো?’
জাহিদের মনে পড়ল এতক্ষণে, ‘ওহ! নো বিগ ডিল। আমি আবার লিখে দেব!’
— ‘সত্যি?’
— ‘হ্যাঁ সত্যি।’
— ‘দেবে তো?’
— ‘নিশ্চয়ই দেব। কয়টা লাগবে তোমার, বলো?’
— ‘অনেক!’
— ‘আচ্ছা অনেকবার লিখে দেব।’
— ‘কতবার?’
— ‘সহস্রবার!’
দরজায় তখনো ধাক্কা পড়ে যাচ্ছে। জাহিদ সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করল না। চারপাশটা এক নজর দেখল। নাইটস্ট্যান্ডের ওপর ওষুধের পাতা পড়ে আছে। এর মাঝে তিনটা পিল অনুপস্থিত। পাতাটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। নিশার যেহেতু সেন্স আছে এখনো এর মানে মাত্রাতিরিক্ত ড্রাগ পড়েনি শরীরে। ওষুধের পাশে পানির বোতল রাখা ছিল। বোতলটা তুলে নিয়ে বিছানার ওপর বসল জাহিদ, নিশার পাশে। মুখে পানি ছিটিয়ে দিতে দিতে প্রশ্ন করল, ‘তুমি কয়টা ওষুধ খেয়েছ?’ পানির ছিটা পড়তেই নিশা বাচ্চাদের মতো চোখমুখ কুঁচকে ফেলল। কিছু বলল না। জাহিদ ওর গাল চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিল একটা, ‘কথা বলো!’ নিশা এবারেও কিছু বলল না। দরজায় পড়তে থাকা ক্রমাগত আঘাতটা জাহিদের মেজাজ খিঁচরে দিল একদম। রাগ হলো প্রচণ্ড। দাঁত-মুখ খিঁচে ঝড়ের বেগে হেঁটে এসে দরজাটা খুলল সে। বাবার ক্ষিপ্তবৎ মূর্তিটা চমকে দিল তুরিনকে। মেয়েকে দেখে একটু দমল জাহিদ। রাগ প্রকাশ করল না। ভেতরকার উদ্বেগ-উত্তেজনা ধামাচাপা দিয়ে, কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলল, ‘তুরিন, আমার ঘরে যাও। ক্লজেটের একদম রাইট কর্নারে ফার্স্টএইড বক্স রাখা আছে। এখুনি নিয়ে এসো। হারিআপ।’
তুরিন তাৎক্ষণিকভাবে বাবার আদেশ পালন করল। ফারা দাঁড়িয়ে ছিল কাঠ হয়ে। জাহিদ মৃদু ধমকের সঙ্গে বলল, ‘এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?
— ‘কেন দাঁড়িয়ে থাকা নিষেধ নাকি?’
জাহিদ প্রত্যুত্তর করল না। মিনিটখানেকের মধ্যেই তুরিন ফার্স্টএইড বক্স নিয়ে হাজির হলো। বাবার পেছন পেছন ঘরের ভেতর ঢুকল সে। নিশা ঘুমিয়ে পড়েছিল। সামান্য শব্দ হতেই ধড়ফড় করে জেগে উঠল। শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করল। জাহিদ ওর কাঁধ চেপে ধরে শুইয়ে দিল আবার। নিশা চোখ বন্ধ করল। তুরিনকে সে দেখতে পেয়েছে। তুরিনের উপস্থিতি প্রমাণ দিচ্ছে ঘুম ঘুম ভাব হলেও সে আসলে ঘুমিয়ে নেই। এটা কোন স্বপ্ন বা কল্পিত দৃশ্য নয়, বরং যথাযথ বাস্তব। তুরিন বিস্মিত গলায় বলল, ‘কী হয়েছে বাবা?’ জাহিদ মেয়ের প্রশ্নের উত্তর দিল না। ফার্স্টএইড বক্স খুলে তুলো আর অ্যান্টিসেপটিক বের করল। তার মনটা প্রচণ্ড খারাপ। দুঃসহ কষ্টের সুচ বুকের মধ্যে ফোঁড় কেটে যাচ্ছে ক্রমাগত। একটা মানুষ কতটা হতাশা, কতটা মনঃকষ্ট থেকে এমন বিপজ্জনক পন্থা বেছে নিতে পারে? নিশার এই পরিস্থিতির জন্য সে নিজেই দায়ী। আজকে যদি নিশার কিছু হয়ে যেত, যদি ঘুমের ওষুধের ওভার ডোজ হতো…ভাবতে গিয়ে জাহিদের শ্বাস আটকে আসতে চাইল। তুরিন ঘরের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখে-মুখে সুস্পষ্ট আতঙ্কের চিহ্ন। বাবার চশমার কাচে বাষ্পঘন কুয়াশা প্রত্যক্ষ করছে সে। বাবা কি কাঁদছে? বাবাকে এর আগে কোনদিন কাঁদতে দেখেনি!
ফারা দরজার চৌকাঠে এসে দাঁড়িয়েছে। জাহিদ মুখ নিচু করে চুপচাপ নিশার হাতের ক্ষত পরিষ্কার করছিল। ফারা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখল। তারপর কেটে কেটে তুরিনকে বলল, ‘তুমি এখানে কী করছ? চলে এসো।’
তুরিন বাবার দিকে একবার বিপন্ন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা! ইজ শি অকে? শ্যুড উই কল নাইন ওয়ান ওয়ান?’
জাহিদ মেয়ের দিকে না তাকিয়েই বসা গলায় বলল, ‘শি উইল বি অলরাইট। নো ওরিজ।’
তুরিন বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। সংসারের বিচিত্র টানাপোড়েনে তার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে আসছে। এদিকে শাহজিদের সঙ্গে দুপুরের পর থেকে আর একটা বার কথা বলার সুযোগ হয়নি। অথচ ওর সঙ্গে ভীষণ জরুরি কিছু কথা ছিল। মা সারাক্ষণ গোয়েন্দার মতো লেগে আছে পিছে। এই মুহূর্তে কেন যেন মায়ের ওপরেই বেশি রাগ হলো। সবচেয়ে রাগ হলো এই কারণে যে তার মনে হচ্ছে মায়ের মধ্যে কোন সেলফরেসপেক্ট নেই। আত্মমর্যাদা বোধ পুরো দমেই বলি দিয়েছে এই মহিলা। রাগের পাশাপাশি মায়াও হলো। মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘মন খারাপ করো না মা। ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু।’
ফারা তুরিনের মুখের দিকে চেয়ে দৃঢ় গলায় বলল, ‘খুব শিগিরই সব কিছু ঠিক হবে। আমি বলে দিচ্ছি তোমাকে কী করতে হবে। এসো আমার সঙ্গে।’
.
ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ লাগানোর পর ফার্স্টএইড কিটটা দূরে সরিয়ে রাখল জাহিদ। জানালার কাচ বন্ধ করল। হিটারের উত্তাপ বাড়াল।
— ‘নিশা, তুমি কি আমার কথা স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছ?’
— ‘পাচ্ছি।’
— ‘উঠে বসতে পারবে?
—‘পারব।’
কথাটা বলে নিশা উঠে বসার চেষ্টা করল। জাহিদ সাহায্য করল ওকে। হেডবোর্ডে বালিশ চাপা দিয়ে তার ওপরে পিঠ রাখল নিশা।
— ‘তুমি খাবার খেয়েছ কখন? লাস্ট টাইম?’
— ‘মনে নেই।’ নিশা বলল।
জাহিদ ফোন হাতে নিয়ে ডায়াল করল নীলিমার নম্বরে।
— ‘ভাবি!’
—‘কী খবর? কোথায় তুমি?’
— ‘দোতলায় আছি। নিশার ঘরে। কুড ইউ ডু মি আ ফেভার?’
—‘নিশ্চয়ই। কী করতে হবে বলো?’
— ‘আমার ডিনারটা ওপরে নিয়ে আসতে পারবে কষ্ট করে?’
— ‘এখুনি?’
— ‘এখুনি পারলে খুব ভালো হয়।’
—‘ঠিক আছে। চিন্তা করো না। আমি আসছি।’
চোখ খোলা রাখতে কষ্ট হচ্ছিল নিশার। চোখজুড়ে ঘুমের জোয়ার নামছে। কিন্তু ভয় হচ্ছে এই ভেবে যে ঘুমিয়ে পড়লেই বুঝি এই সুন্দর মুহূর্তটা চিরকালের জন্য ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাবে। তার ভাগ্যটা তো ভালো না। একটুখানি সুখের ঋণ শোধ করতে হয় আকাশসম দুঃখ দিয়ে। তাই মনে হচ্ছে অল্পবিস্তর এদিক-সেদিক হলেই ভাগ্যের নাটাইয়ের সুতায় টান পড়বে। মানুষটা তার কথা ভাবছে, তার জন্য দুশ্চিন্তা করছে, বাড়িভর্তি অতিথি ফেলে রেখে কাছে এসে বসে আছে, এমন মধুর স্বর্গীয় ঘটনা তার পোড়া কপালে খুব বেশিক্ষণ সইবে না।
—‘জুবিন কোথায়?’ নিশার প্রশ্ন।
—‘নিচে।’
—‘অনুষ্ঠান কি শেষ?’
—না এখনো চলছে।’
—‘আপনার ওখানে থাকা উচিত। মেয়েটার জন্মদিন। আমরা কেউ পাশে নেই। বিষয়টা ভাবতেই খারাপ লাগছে।’
—‘তুমি চিন্তা করো না। জুবিনের জন্মদিন আমরা আমাদের মতো করে সেলিব্রেট করব। শুধু তুমি-আমি আর জুবিন। আমার কিছু কাছের বন্ধুকে বলব হয়তো।’ জাহিদ বিছানায় এসে বসল, নিশার পাশে। ব্যান্ডেজ লাগানো হাতটা সামনে তুলে ধরে বলল, ‘এসবের মানে কী?’
নিশা কী উত্তর দেবে ভেবে পেল না। কোন কথা গুছিয়ে নিতে পারছে না। শরীর এত বেশি দুর্বল যে কিছুক্ষণ চোখ খোলা রাখলেই টনটন করছে মাথা। হঠাৎ হঠাৎ কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। সেই সময় মনে হচ্ছে সবকিছু অলীক। আবার কুয়াশা কাটলেই বাস্তবতার রং-রূপ প্রকট হয়ে ধরা দিচ্ছে চোখের সামনে।
—‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। কী করতে চেয়েছিলে তুমি? সুইসাইড?’
—‘মনে হয়…কিন্তু দেখুন…এই কাজটাও করতে পারলাম না। ব্যর্থ হলাম। আমি কিছুই পারি না।’
একটা শূন্যতা সর্বস্ব হাহাকার জাহিদের হৃৎপিণ্ডটা খামচে ধরল। নিশার ব্যান্ডেজ লাগানো দুর্বল হাতটা নিজের কোলের ওপর রেখে বলল, ‘এমন একটা কাজ তুমি কী করে করতে পারলে? তোমার কোন অঘটন ঘটে গেলে জুবিনের কী হতো?’
—‘জুবিনের বাবা আছে। দাদা-দাদু আছে। আল্লাহ আছে। ওকে নিয়ে চিন্তা নেই।’
জাহিদের কণ্ঠে ঝাঁক বেঁধে নেমে আসে অভিমানের মেঘ। পাঞ্জাবির কোলের ওপর লতার মতো নেতিয়ে পড়ে থাকা হাতটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে ভারী গলায় বলে, ‘তুমি শুধু জুবিনের কথাই ভাবলে নিশা? জুবিনের বাবার কথা একবারও ভাবলে না?’
একটা কষ্ট কষ্ট সুখের বিদ্যুৎ নিশার মেরুদণ্ড বরাবর আচানক শিহরণ তুলে যায়। গলা ধরে আসে কান্নার দাপটে। ঢোক গিলে কান্নার দলাটা কণ্ঠের তলানিতে দাবানোর চেষ্টা করে বলে, ‘জুবিনের বাবার তো সব আছে। বাবা, মা, স্ত্রী, সন্তান, ভাই…সবাই। আমি চলে গেলেই বরং জুবিনের বাবা ঝামেলা থেকে বেঁচে যাবে।’
জাহিদ ভ্রু তুলে তাকাল নিশার দিকে। বড়ই গভীর সেই চোখের দৃষ্টি। নিশা ওই গভীর দৃষ্টির ওপর নিজের ডাগর চোখের তারাদুটি অনায়াসে বিছিয়ে দেয়। দুকূল ছাপানো ঘুমের জোয়ার জোরপূর্বক চেতনা কেড়ে নিতে চায়। কিন্তু ঘুমোলেই সব ম্যাজিক শেষ। দৈবক্রমে পাওয়া স্বপ্নস্নাত মুহূর্তটুকু আর পুনরায় ফেরত পাওয়া যাবে না। ঘুমের কাছে বিকিয়ে যাবে সৌভাগ্যের দুর্লভ চাবিকাঠি। নিশা বড় বড় করে খুলে রাখে চোখ দুটো। চেয়ে থাকে। এই চেয়ে থাকায় কখনোই আলস্য আসে না। কালো পাঞ্জাবিতে ছিপছিপে মুখের শ্রীমান মানুষটাকে দারুণ লাগে দেখতে। নিশার শ্বাস-প্রশ্বাসে স্নিগ্ধ এক মাদকতা ভর করে। দূরের ট্রেনের শব্দ পায় সে। মনের প্ল্যাটফর্ম কাঁপতে থাকে। কথোপকথনের ধারাবাহিকতার খেই হারিয়ে যায়। তার আর কিছুই মনে থাকে না। ঘুমসর্বস্ব ফাঁকা মস্তিষ্ক ভালোলাগার আদিগন্ত জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায়।
—সবকিছু থাকার পরেও যদি কখনো মনে হয় একটা মানুষকে ছাড়া সেই ‘সবকিছু’র কোন মূল্য নেই…তাহলে সেই উপলব্ধির কী নাম দেবে তুমি?’
আস্তে আস্তে কথাগুলো উচ্চারণ করে জাহিদ। নিশার ঢুলুঢুলু, এলোমেলো…সুন্দর…বড়ই বেশি…বেশি…বেশি রকমের সুন্দর চোখ জোড়ার ওপর নিজের অস্থির, অসহায়, ব্যাকুল দুটি চোখ রেখে। নিশা অস্ফুটে বলে, ——এরকমও হয় নাকি? যাদের সব আছে…তাদের জীবন কি কোন একজন নির্দিষ্ট মানুষের জন্য থেমে থাকে কখনো?’
দরজার কড়া নাড়ে কেউ একজন। জাহিদ উঠে আসে। নীলিমা ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে। জাহিদকে দেখে চোখ নাচাল, ‘বৌ কেমন আছে?’
জাহিদ ট্রে হাতে নিতে নিতে ঠোঁট উল্টে বলল, ‘বুঝতে পারছি না।’
— ‘জ্বর এসেছে নাকি?’
— ‘নাহ…জ্বর তো নেই।’
নীলিমাকে ধন্যবাদ দিয়ে জাহিদ দরজা বন্ধ করল। খাবারের ট্রে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল। পোলাও-রোস্টসহ একগাদা জিনিস নিয়ে এসেছে নীলিমা। জাহিদ একটা প্লেটে একটু সাদা পোলাও, সবজি আর সালাদ তুলে নিল। এগিয়ে এলো বিছানার দিকে। নিশার ভীষণ লজ্জা করছিল। লোকটার সামনে কখনো কিছু খেয়েছে বলে মনেই পড়ে না। কী বিব্রতকর একটা পরিস্থিতি! সংকোচের প্রাবল্যে ওর মুখটা তেরো বছরের অবুঝ কিশোরীর মতো রাঙা হয়ে উঠল। জাহিদ কোন বাক্যব্যয় না করে খাবার সমেত কাঁটাচামচ এগিয়ে দিল ওর দিকে। নিশা অপ্রস্তুতভাবে বলল, ‘আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।’
—‘ইচ্ছে না করলেও খেতে হবে। ছেলেমানুষি করো না!’ হালকা শাসনের সুরে বলে জাহিদ। অভিমানের ভারে কণ্ঠস্বর বুজে আসে নিশার। এত আদর- যত্ন বহুদিন পায় না সে! মেয়েদের বয়স যতই হোক না কেন হৃদয়ের গোপন আকাশে একটা বালিকা মন ধ্রুবতারার মতো নিশ্চল হয়ে জ্বলতে থাকে আজীবন। নিশা বুঝতে পারছে একটু যত্ন আর গুরুত্বের অভাবে তার বালিকা মনটা হাজার বছরের পুরোনো বাড়ির শ্যাওলা ধরা ভাঙা দেওয়ালের মতো জীর্ণ এবং পরিত্যক্ত হয়ে উঠেছিল। বহুদিন বাদে সেই পরিত্যক্ত দেওয়ালে যেন নতুন আস্তর পড়ল। কোন উচ্চবাচ্য না করে বাধ্য মেয়ের মতো চামচের খাবারটুকু মুখে তুলে নিল সে। জাহিদ ওর দিকে কিছুক্ষণ সূক্ষ্ম চোখে চেয়ে থেকে বলল, ‘নিজেকে এভাবে আর কোনদিন কষ্ট দিও না নিশা। আমি জানি তোমার জীবনটা সুখের না। কখনো তোমাকে কিছু দিতে পারিনি। কিন্তু ভীষণভাবে চাই তোমার ভালো হোক। তোমার মনে আছে কিনা জানি না, আমি কিন্তু তোমাকে বিয়ের পরপরই মুক্তি দিতে চেয়েছিলাম। সেদিন যদি আমার কথা মেনে নিতে। যদি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে, আমাকে ছেড়ে যেতে…তাহলে আজকের এই দিন দেখতে হতো না। তোমার জীবনটা অন্যরকম হতো। এখনো সময় আছে। তুমি যেভাবে চাও ঠিক সেভাবেই জীবনটাকে গড়ে নেবে, কেমন? আমি তোমার পাশে আছি। থাকব সবসময়।’
কথাগুলো নিশার কানে সেতারের মূর্ছনার মতো কল্লোল সৃষ্টি করে। মনের পরতে পরতে ঝরাতে থাকে শরৎ ভোরের নরম শিউলি ফুল! আমি তোমার পাশে আছি, থাকব সবসময়! কী সুন্দর কথা! মানুষটার মুখ থেকে এমন কথা শুনতে শুনতেই যেন তার মরণ হয়!
—‘তখন কী বলছিলেন?’
—‘কখন?’
—‘একটু আগে?’
জাহিদ প্রচ্ছন্ন হাসি হাসল। গলায় হালকা কৌতুকের সুর তুলে বলল, ‘কিছু বলিনি তো! তোমাকে একটু আদর করেছিলাম।’
নিশা লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘কেন?’
—‘কেন আবার? আমার বৌকে আমি মাঝেমধ্যে আদর করতেই পারি, তাই না?’
একটু থেমে জাহিদ আবার বলল,
—‘শাহজিদের ব্যাপারে তুমি আমাকে কখনোই ক্লিয়ারলি কিছু বলোনি। তুরিন ছেলেমানুষ। ওর কথা আমি সিরিয়াসলি নেইনি। তোমার কি শাহজিদের প্রতি কোন দুর্বলতা আছে নিশা? থাকলে বলতে পার। আমি চাই তুমি তোমার পছন্দের মানুষের সঙ্গেই জীবনটা কাটাও।’
নিশার ঠোঁটে চিলতে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। কিশোরী বালিকার মতো চাপল্য ঝিলিক দেয় চোখে। জাহিদের পাঞ্জাবির কুঁচকে থাকা কলার হাত দিয়ে ঠিক করে দিয়ে মিষ্টি সুরে বলে, ‘তাই হবে।’
—‘কী হবে?’
—‘যাকে পছন্দ করি তার সঙ্গেই থাকব।’
জাহিদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে নিশার মুখে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করল। মেয়েটাকে সে বোঝে না। গুচ্ছ গুচ্ছ মেঘের প্রহেলিকা ওকে ঘিরে থাকে সর্বক্ষণ। চেনা যায় না, বোঝা যায় না, ঠিক মতো পড়াও যায় না। ও কি সত্যিই শাহজিদকে চায়? কথাটা মনে হতেই বুকে একটা কাঁটা খচখচ করে ওঠে।
কয়েক চামচ খেয়েই নিশা আর খেতে চাইল না। জাহিদ ওর দিকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে সাবধানে প্রশ্ন করল, ‘তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড ছিল না নিশা? বাংলাদেশে?’
—‘নাহ!’
—‘তাই?’
— ‘হুম।’
—‘কোন ক্রাশ ছিল না?’
—‘একটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল। বাবা পাত্রের ছবি দিয়ে গিয়েছিল একদিন ছবিটা বের করে দেখলাম। দেখামাত্র মনে হলো এত সুন্দর মানুষ আমি এর আগে কোনদিন দেখিনি। কোন রক্ত-মাংসের মানুষ এমন আশ্চর্য সুন্দর হয়?’
জাহিদ বুকের ভেতর কাঁটার বিদ্যমানতা টের পেল পুনরায়। এতটা ঈর্ষাপরায়ণ সে ছিল না কখনো। কিন্তু নিশার মুখে অন্য পুরুষের প্রশংসা মন চরাচরে সুস্পষ্ট অন্তর্দাহর উদ্রেক করেছে। এটা ভালো লক্ষণ নয়। সে ভেতরে ভেতরে অসহায় বোধ করল। ভেতরকার অস্থিরতা আড়াল করার জন্য মুখে জোরপূর্বক ধরে রাখল একটি দায়সারা হাসি। নিশা স্বপ্নাচ্ছন্ন গলায় বলে যাচ্ছিল, ‘আমার বাবা বলতেন একদিন তাঁর স্নো হোয়াইটের জন্য প্রিন্স চার্মিং আসবে। এসে নিয়ে যাবে দূর দেশে। সেই ছবি দেখে বুঝতে পারলাম এই হলো আমার প্রিন্স চার্মিং! কেন যেন মনে হলো মানুষটা আমার! শুধুই আমার!’
জাহিদের নিঃশ্বাসে টান পড়ল। বুকের পাঁজরায় পেরেক ঠুকতে লাগল ঈর্ষাকাতর যন্ত্রণা। নিশার মুখে অন্য পুরুষের স্তুতিবাক্য সহ্য করা দুষ্কর হয়ে উঠেছে। একটা অবাচ্য, অব্যক্ত এবং দুর্জ্ঞেয় ভয়ের কুণ্ডলী ওর সমগ্র সত্তায় প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে গেল। মনে হলো জীবনের সবচেয়ে বড় পরাজয়ের ক্ষণ ঘনিয়ে এসেছে। অথচ বিয়ের প্রথম দিন থেকে সে বদ্ধপরিকর ছিল নিশার কাছে কখনো হারবে না। এই মেয়েকে গ্রাহ্যই করবে না। ভালো-টালো বাসা তো অনেক দূরের কথা! অথচ প্রকৃতি কী নির্মমভাবে সেই মামুলি, আটপৌরে মেয়েটির কাছেই জীবনের এই চরম অসময়ে…দুর্দান্তভাবে হারিয়ে দিল তাকে! একটা দীর্ঘশ্বাস আড়াল করে জাহিদ স্খলিত কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘তারপর কী হলো?’
নিশা তাকাল জাহিদের দিকে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
—তারপর সেই মানুষটার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেল!
কথাটা প্রথমে শানিত বজ্রপাতের মতো জাহিদের সর্বাঙ্গে একটা ধাক্কা দিয়ে গেল। স্থবিরতা গ্রাস করে নিল সমস্ত চেতনা। কয়েকটা ভ্রান্তিমান মুহূর্ত অতিক্রান্ত হওয়ার পর নিশার মুখনিঃসৃত বাক্যের মর্মার্থ খাদ্যপ্রাণের মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল ওর মস্তিষ্কের প্রতিটি শিরা-উপশিরায়। ভেজা ভেজা উতরোল ভালোলাগার ঝড়ো বাতাসে রমরম করে উঠল মন চরাচর! সংকোচ আর অস্বস্তির ক্ষীণ প্রলেপ পড়ল মুখে। নিশার চোখ তখন বুজে এসেছে। জাহিদ ওই মাধুর্যরশ্মিতে ছেঁকে ধরা ঘুমন্ত মুখটার দিকে ক্ষণিক সময় নির্বাক চেয়ে রইল। এগিয়ে এসে ওকে শুইয়ে দিল ঠিকমতো। গায়ে চাদর টেনে দিল। ঘরের বাতি নিভিয়ে দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় কী মনে করে যেন থমকে দাঁড়াল সেকেন্ডের জন্য। অন্ধকারে তাকাল একবার নিশার দিকে। বিছানার কাছে ফিরে এসে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। তারপর নিঃশব্দে শুয়ে পড়ল ওর পাশে। জানালায় তখন দুধের মতো সাদা রাত। আকাশে একটা গোল চাঁদ উঁকি দিয়েছে। তুষার ঢাকা পৃথিবীর ছায়া পড়েছে চন্দ্রালোকিত আসমানে। বাতাসে গাছের গা থেকে ঝিরিঝিরি ঝরে পড়ছে বরফকুচি। উড়ছে এদিক- সেদিক। অতিথিরা বিদায় নিচ্ছে একে একে। লনে মানুষজনের ভিড় জমেছে। গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে। নিশার ঘুমন্ত শরীরটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে আনল জাহিদ। জানালা দিয়ে ভেসে আসা বরফধোয়া আলোয় দেখল ওর মুখখানা। দেখল চোখের ওপর পড়ে থাকা অবিন্যস্ত দিঘল পাপড়ি। সরু নাক। পুষ্পমঞ্জরির মতো কোমল সুন্দর ঠোঁট। চশমাটা খুলে নামিয়ে রাখল বালিশের পাশে। তারপর নিশার সুগন্ধি চুলে নাক ডুবিয়ে বন্ধ করল চোখ। চোখ বন্ধ করতেই ভেতরকার ক্লান্তিটা টের পাওয়া যায়। বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া পথহারা ঘুমের দল মস্তিষ্কের অজ্ঞাত প্রান্ত থেকে জোয়ারের মতো নেমে আসে ওর নয়নজুড়ে। নিদ্রার আবেশে জুড়িয়ে যায় আত্মা। ঠোঁটে লেগে থাকে একটা তৃপ্ত হাসির রেশ! ঘুমটা আসে অবশেষে…স্বস্তির ঘুম….অনেকদিন বাদে!
স্বর্গ রঙের সকাল
ঘুম ভাঙল একজোড়া উইন্টার স্প্যারোর ছন্দবদ্ধ কিচিরমিচির ডাকে। চোখের আধখোলা কপাট দিয়ে নিশা দেখল জানালার কাচের ওপারের টুকরো আকাশ ফিরোজা উত্তরীয়তে ঢাকা। ভোরের স্বর্ণ-সিক্ত রোদ চমকাচ্ছে সাদা আর ম্যাজেন্টা ক্র্যাব অ্যাপল ফুলে। কার্নিশে জমে থাকা শ্বেতশুভ্র বরফে। রোদ মাখানো সেই বরফ খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে বাদামি পাখনার উইন্টার স্প্যারো। ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাসের ঝাপটা এসে পড়তেই চমকে উঠল নিশা। কোমরে দুটি হাতের শক্ত বেষ্টন অনুভব করল। অমনি হৃদযন্ত্রটা স্প্রিংয়ের মতো ঝাঁপ দিয়ে উঠে সারা শরীরে তিরতিরে কাঁপন ছড়িয়ে দিল। ঝিঁঝি লাগা মস্তিষ্ক নিয়ে সে নিজেকে আবিষ্কার করল মানুষটার সুপ্রশস্ত বুকের মধ্যে। কানে এসে লাগল নিঃশ্বাসের ফোঁসফোঁস আর হৃদয়ের ধুকপুক। সর্বাঙ্গ দিয়ে অনুভব করল দীর্ঘকায় সেই শরীরের উষ্ণ অনুষঙ্গ। প্রথম ধাক্কায় মনে হলো দৃশ্যটা বুঝি কল্পনা, কিন্তু অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই বিগত রাতের কুসুমগন্ধী টুকরো টুকরো স্মৃতি দমকা বাতাসে উড়তে থাকা বন-কুসুমেরই মতো নিঃশব্দে ঝরে পড়তে লাগল ওর উদ্বেলিত মনের নিভৃত অলিন্দে। আর তখনই বুঝতে পারল এমন একটা নতুন মোড়কে মোড়া চকচকে সকালের স্বপ্ন দেখেছে সে বহুবার! কাঙালের মতো চেয়েছে এমন এক সকাল আসুক যে সকালটা হবে শুধু ওদের দুজনের। ভাবনার অলিতে গলিতে ঘুরেফিরে এমনই সুখ সুখ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আবারও চোখ লেগে এলো। কতক্ষণ কেটেছিল জানে না… যখন জাগল…ধড়ফড় করে উঠে বসে আবিষ্কার করল বিছানাটা ফাঁকা। বুকের একতারায় টুং করে মন খারাপের সুর বাজল একটা। লোকটা চলে গেল কেন? কিছু না বলেই?
মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল সকাল সাতটা। আজ সোমবার। অফিস আদালত, কলেজ ভার্সিটি সব খোলা। নিশা তড়িঘড়ি করে উঠে পড়ল। মনটা কেমন উড়ু উড়ু করছে। প্রথম প্রেমের উত্তাল দিনেরই মতো নেশা নেশা উত্তেজনা খেলছে সর্বাঙ্গে। শ্বাস-প্রশ্বাস এলোমেলো। এইতো একটু আগেই জাহিদ এখানে ছিল, কিছুক্ষণের ব্যবধানেই ওকে আবারও এক নজর দেখার তৃষ্ণায় কেমন জ্বর জ্বর লাগছে। উইন্টার স্প্যারো তখনো মনকাড়া সুরে ডেকে যাচ্ছিল। ওই ডাক থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে সুখের নিকৃণ। মনের জ্বর জ্বর ভাবটার মধ্যেও ভালো লাগার একটা পরশ লেগে আছে যেন! বাথরুমের বিশাল আয়নাটায় নিজের মুখের ছায়া পড়তেই…অনেক অনেক দিন বাদে…পৃথিবীর ইতিহাসের সমস্ত অহঙ্কারী রূপবতী নারীদেরই মতো, নিশাও আয়নায় প্রতিফলিত হওয়া নিজের অবয়বটা দেখে মুগ্ধ হলো। মনের মধ্যে গুনগুনিয়ে উঠল প্রিয় গানের সুর। মুখে ছিটিয়ে দিল উষ্ণ রুপালি জল। চুল আঁচড়ে নিল। অনেক ধীরে ধীরে, যত্নের সঙ্গে, আনন্দ নিয়ে স্নান করল। হাতের ব্যান্ডেজ পাল্টে নিল। ভাবতে গিয়ে অবাক হলো যে, নিজেকে নিজের যত্ন করতে তার ভীষণ ভালো লাগছে। নিজের জন্য এত মায়া, এত ভালোবাসা এর আগে কোনদিন হয়নি!
একটা ইট রঙের তাঁতের শাড়ি পরল ও। অনেক দিন পর শাড়ি পরতে ইচ্ছে হলো। চোখে কাজল দিতে ইচ্ছে হলো। কপালে একটা লাল টিপ দিয়ে পরমুহূর্তেই আবার সরিয়ে ফেলল। বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। বাড়ির লোকে কী বলবে? ছিঃ
নেমে এলো নিচে। শ্বশুরমশাই ঠিক নটায় বাড়ি থেকে বের হন অফিসের উদ্দেশ্যে। তার আগেই টেবিলে নাশতা লাগানো চাই। লিভিং এ মুর্তজা সাহেব জুবিনকে কোলে নিয়ে বসে ছিলেন। জুবিনের চোখে এখনো ঘুম। মুখে প্যাসিফায়ার। মাকে দেখামাত্র ভ্যাভ্যা করে কান্না করে দিল। ঝাঁপ দিয়ে উঠে এলো কোলে। মেয়েকে খাইয়ে-দাইয়ে একটু শান্ত করে রান্নাঘরে শাশুড়ির সঙ্গে কাজে হাত লাগাল নিশা। শাশুড়ি বললেন, ‘বৌমা, আজকে তোমাকে খুশি খুশি দেখাচ্ছে।’ নিশা লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিল। সত্যিই তো এই বাড়িতে তার এটাই প্রথম সকাল…যে সকালে মনের মধ্যে কোন অতৃপ্তি নেই, দুঃখ নেই, নেই কোন হীনম্মন্যতা।
টেবিল পুরোপুরি সাজানোর আগেই বাড়ির কর্মব্যস্ত সদস্যরা ডাইনিং স্পেসে ভিড় জমায়। আনিতার সকাল নটায় প্রেজেন্টেশন আছে। এদিকে তুরিনের সাড়ে নটায় ক্লাস। ওদের নাশতা করার সময় নেই। এই দুজন বাদে বাকিরা সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে সমাসন্ন হয়েছে। নিশা সাধারণত টেবিল গুছিয়ে দিয়েই কেটে পড়ে। খাবার টেবিলে পরিবারের সদস্যরা নানা রকম ব্যক্তিগত বা জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করে। কখনো হাসি-ঠাট্টাও হয়। নিশা এই সরস, সুশীল আলোচনাসভা থেকে বরাবরই বিচ্ছিন্ন। কেউ তাকে এসব পারিবারিক বৈঠকে ডাকে না। তার উপস্থিতি কামনা করে না। সে গৃহকর্মচারীর মতো খাবার সার্ভ করবে, তারপর সরে দাঁড়াবে এক পাশে, এটাই যেন সংবিধিবদ্ধ এক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। চায়ের ট্রে নিয়ে টেবিলের কাছে এসে আড়চোখে জাহিদকে একবার দেখল নিশা। হালকা নীল রঙের ফুলস্লিভ শার্ট ওর পরনে। গলায় টাই। অফিস যাওয়ার আগ মুহূর্তে পরিপাটি, কেতাদুরস্ত মানুষটাকে দেখতে ভালো লাগে নিশার। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে রোজ। আজকে ঘরভর্তি লোকের সামনে বেশিক্ষণ ওর দিকে তাকানো গেল না। ট্রে নামিয়ে রেখে রান্নাঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলো। টেবিল সাজানো হয়ে গেছে। এখানে থেকে আর কাজ নেই। হঠাৎ ডাকটা ছুটে এলো কানে।
— ‘নিশা!’
ভড়কে যাওয়া মন নিয়ে পেছন ফিরল নিশা। ভুল শুনল নাকি? জাহিদের মুখোমুখি চেয়ারে সাদা শার্ট, কালো স্কার্ট পরে ফারা বসে আছে। পাশে শহীদ। শহীদের পাশে যথাক্রমে বসেছে মুর্তজা সাহেব, মিসেস মুর্তজা (কোলে জুবিন), নীলিমা এবং তানিশা। পাঁচ, ছয় জোড়া চোখ এই মুহূর্তে পৃথিবীর সমস্ত বিস্ময় সঙ্গে নিয়ে নিশার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে আছে। নিশার শ্বাস পড়ছে না। মুখে উপচে পড়ছে তীব্র উৎকণ্ঠা। পরিস্থিতি এতটাই শৈত্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে জাহিদ নিজেই বেশ ঘাবড়ে গেছে। তীব্রভাবে উপস্থিত সব সদস্যদের দিকে এক ঝলক তাকাল সে। সংকোচ বোধ করল মনে মনে। জোরপূর্বক একটা বড় নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে ভেতরকার অস্বস্তি তাড়াবার চেষ্টা করল। তারপর নিশার হতভম্ব মুখের ওপর চোখ রেখে খুব সাবলীল ভঙ্গিতে বলল, ‘এদিকে এসো…বসো এখানে…আমার পাশে!’
স্তম্ভিত নিশা এতটাই অপ্রস্তুত হলো যে তাকে দেখে মনে হচ্ছিল, ভরা মজলিশে হুট করে মাইক্রোফোন হাতে তুলে দিয়ে গান গাইতে বলা হয়েছে। যেন সম্মুখে অগণিত দর্শক তুমুল উত্তেজনা নিয়ে একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে। নার্ভাসনেসের ঠ্যালায় অন্ধকার নেমে আসছে চোখে। তবে প্রাথমিক চমকটা কেটে যাওয়ার পর মুহূর্তেই অন্যরকম ঘটনা ঘটল। বহুদিন ধরে জমে থাকা পুরনো অভিমানের দল শোরগোল তুলল ভেতরে। মনে পড়ল বিগত সাড়ে তিন বছরে এই বাড়ির কোন সদস্য কোনদিন তাকে পাশে বসে খেতে বলেনি। গৃহপরিচারিকার মতো নীরবে এদের সেবা করে গেছে সে, বিনিময়ে ন্যূনতম সম্মানটুকুও পায়নি। শ্বশুর-শাশুড়ি স্নেহ করেছেন। কিন্তু সেই স্নেহে করুণার আধিক্য এত বেশি ছিল যে প্রশ্রয়ের উপস্থিতি অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে দেখা দিয়েছিল। বিয়ের এতগুলো দিন পরে পরিবারের সব সদস্যের সামনে নিজের জন্য এক ঝলক সমাদর দেখতে পেয়ে অভিমানের তরঙ্গগুলো দৈত্যের মাংশপেশির মতো ফুলে-ফেঁপে উঠতে লাগল ভেতরে। ভাবল মুখের ওপর না করে দেয়। এদের সঙ্গে একত্রে বসে ব্রেকফাস্ট করার রুচি নেই তার। এখানে আছে বাধ্য হয়ে…ওই মানুষটার খাতিরেই…নইলে এসব উন্নাসিক অহংকারী মানুষদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কবেই নিষ্ক্রান্ত হতো! কিন্তু এই মুহূর্তে বাড়ির একমাত্র নিরহংকারী এবং মার্জিত চরিত্রের মানুষটার সবিনয় অনুরোধ পায়ে ঠেলে দিতে বিবেকে বাধল…শুধু বিবেকই নয়, ইচ্ছের সুতোয়ও টান পড়ল। কষ্ট দিতে ইচ্ছে করল না ওকে। কী করবে? ভালোবাসে যে! ভালোবাসার সম্মোহনে সম্মোহিত মানুষই বোধহয় পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি অসহায়!
হেঁটে এলো আড়ষ্ট পায়ে। জাহিদের পাশের চেয়ারটা খালি ছিল। সাধারণত ওখানে তুরিন বসে। নিশা তুরিনের চেয়ারটাতে বসল নিঃশব্দে। তার মুখখানা মেঘাচ্ছন্ন আকাশের মতো থমথমে। চোখের পলক পড়ছে না এখনো। কারো দিকে তাকাচ্ছেও না। যেন যন্ত্রচালিত মানবী। অন্যরা সবাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে গেছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আলোচনা হচ্ছিল অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে। বিভিন্ন কোম্পানি থেকে কর্মচারীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। প্রযুক্তির মাত্রারিক্ত উন্নয়ন মানুষের কর্মসংস্থান দিনকে দিন হ্রাস করে দিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারে মানুষের দক্ষতার হয়তো আর কোন মূল্যই থাকবে না কদিন পরে। ডেনভারে এর মাঝেই একটা ম্যাগডোনাল্ডস ফাস্টফুডের দোকান খোলা হয়েছে যেটা পুরোদমে যন্ত্রনিয়ন্ত্রিত। কোন মানুষ কর্মচারী নেই সেখানে, সব রোবট। এসব আলোচনার লেশমাত্রও ফারার কানে ঢুকছে না। তার কান দিয়ে বারুদের ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। নিশা আস্তে করে চোখের পাপড়ি তুলে দেখল ফারাকে। ওই মুখে এখন বিন্দুমাত্র রক্তের অস্তিত্ব নেই। চোখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে বিস্ময়মিশ্রিত ক্রোধ। কাটাচামচে ওমলেটের টুকরো গেঁথে মুখে তুলছিল। উত্তোলনের মাঝপথে ওমলেট পড়ে গেল পাতের ওপর। ফারা লক্ষ্য করল না। বিস্ফারিত চক্ষুদ্বয় নিশার মুখের ওপর বিদ্ধ করেই শূন্য কাঁটাচামচ জিবের সঙ্গে ঠেসে দিল। হাসি পেল নিশার। কিন্তু হাসতে পারল না। কারণ মানুষের দুর্ভোগ দুর্দশা হেসে উড়িয়ে দেবার মতো দুর্বিনীত শিক্ষাটা আজো ঠিকমতো লব্ধ হয়নি তার। জাহিদ ওর প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে আড়চোখে দেখল একবার। সেই দেখাটা টের পাওয়া মাত্র নিশার অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল সংকোচের মাত্রা।
ব্যাখ্যাতীত একটা তোলপাড় হচ্ছে বুকে। তবে খুব সূক্ষ্মভাবে টের পাচ্ছে যে…এখানে এসে বসার পর ভালো লাগছে ভীষণ…শুধু ভালো লাগাই নয়…বরং একটু একটু অহংকার বোধও হচ্ছে। এটা নিশ্চয়ই কোন বিরাট প্রাপ্তি নয়…তবে নিশা বুঝতে পারছে জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষের ঠিক পাশের আসনটি আসলে স্বর্ণখচিত রাজ সিংহাসনের চাইতেও অনেক বেশি আকর্ষণীয় এবং মূল্যবান! কথাটা মনে হতেই ভেতরকার অস্বস্তির মেঘ কেটে গিয়ে অকপট তৃপ্তি এবং দর্পের প্রাচুর্যে তার চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল
জগ থেকে কাচের গ্লাসে পানি ঢালছিল। হঠাৎ পায়ের গোড়ালিতে একটা স্পর্শ লাগল। চমকে উঠল ভূত দেখার মতো। জগের পানি ছিটকে পড়ল টেবিলে। অনেক কৌতূহলী চোখ চট করে বিদ্ধ হলো ওর মুখের ওপর। নিশা তখন ভড়কে গেছে ভীষণ! চোখভর্তি সন্দেহ, বিস্ময় আর আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়েছে জাহিদের দিকে। জাহিদ ওর দিকেই চেয়ে ছিল। কপট গাম্ভীর্য নিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে? ঠিক আছ তো?’
,
নিশা আবারও উষ্ণ স্পর্শটা টের পেল। ডান গোড়ালির ওপরে অনুভব করল একটা পায়ের চাপ। তারপর সেই পায়ের আঙুল ওর গোড়ালি বেয়ে কিছুটা ওপরে উঠল, আবার নামল…একটা শিহরণ তিরতির করে ছড়িয়ে পড়ল সারা শরীরের রক্ত-স্পন্দনে। জাহিদ ওর দিকে চেয়ে আছে। নিশার নরম মসৃণ পায়ের সঙ্গে ওর পা ঘষা খাচ্ছে ক্রমাগত। এই মৃদু ছোঁয়াচটুকু দুজনের মধ্যে একটা গা-শিউরে ওঠা চাঞ্চল্যের বলয় তৈরি করেছে। নিশা দেখতে পাচ্ছে জাহিদের বাম গালে সকাল বেলার আয়েশী রোদ ঠিকরে পড়ছে…রোদ চমকাচ্ছে রিমলেস চশমায়…রোদ চমকাচ্ছে একটু একটু কপাল ছুঁয়ে থাকা ছোট ছাটের পরিপাটি চুলে। বাদামি রঙের বদ্ধ ঠোঁটে খেলছে কৌতুকমিশ্রিত চাপা হাসি। নিশার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসে। না চাইতেও ঠোঁটের প্রাচীর চিরে একটা অবাঞ্ছিত চপল হাসি উঁকি দেয়। লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয় সে। চোখ নামায় জাহিদও। অবাধ্য দামাল হাসিটা দুজনের ঠোঁটেই সমান তালে দাপিয়ে বেড়ায়। সুখের ভাপ ওঠা মৃদু উত্তাপে ভরে ওঠে ওদের নিজস্ব পৃথিবী! উপস্থিত সদস্যরা চোরা চোখে লক্ষ করছিল ঘটনাটা। ফারা ব্রেকফাস্ট অসমাপ্ত রেখেই উঠে পড়ে। হাঁসফাঁস লাগতে থাকে ওর। মনে হয় আরেকটু হলেই হার্ট অ্যাটাক হবে। লিভিংরুমের কাউচের ওপরে রাখা ভ্যানিটি ব্যাগটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে গটগটিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। রাস্তার মোড়ে অনিমেষ অপেক্ষা করছিল গাড়ি নিয়ে। ফারার নাভিশ্বাস ওঠা মুখ দেখে আঁতকে উঠল সে।
— ‘কী হয়েছে?’
ফারার কপাল ঘামছে। চোখের ভেতর ফুটছে আতঙ্কের বিস্ফোরণ। গাড়িতে উঠে বসে হাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে! আই অ্যাম ডুমড!
— ‘কী হয়েছে বলবে তো!’
— ‘আমার চোখের সামনে ওরা প্রেম করছিল…আমার চোখের সামনে!’
— ‘কারা?’
— ‘কারা আবার?’
— ‘জাহিদের কথা বলছ?’
— ‘হ্যাঁ।’
অনিমেষের চোয়ালে একটা কঠোর ছায়া পড়ে, ‘তাতে তোমার কী? আর ইউ জেলাস?’
ফারা এই প্রশ্নে হালকা থতমত খায়। জানালার বাইরে মুখ তাক করে ‘হোয়াই উড আই বি জেলাস?’
— উ লুক জেলাস অ্যান্ড ইনসিকিউর।’
ফারা গলার স্বরে ত্বরিত পরিবর্তন নিয়ে এসে গম্ভীর গলায় বলে, “ামি আমার মেয়ের কথাই ভাবছি।’
—‘মেয়েকে নিয়ে এত ভাবার কিছু নেই। সে এখন অ্যাডাল্ট। আমার মনে হয় সত্যটা জানলেও এখন সে অতটা ভেঙে পড়বে না।’
ফারা তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘ও গড! অনি তুমি কেন বুঝতে পারছ না অ্যাডাল্ট বলেই ওকে সত্যটা এখন জানানো যাবে না! ছোট বাচ্চা না, যে তোমার ইচ্ছেমতো গড়ে নেবে। আমার মেয়েটা মরে যাবে। এত বড় শক স্ট্যান্ড করতে পারবে না।’
অনিমেষ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, ‘ঠিক আছে। সে বিষয়ে পরে দেখা যাবে। আপাতত তুমি জাহিদ নিশাকে ওদের মতো ছেড়ে দাও। আমার অ্যাপার্টমেন্টে মুভ করো।’
ফারা কিছু বলল না। জানালার বাইরে শূন্য দুটি দৃষ্টি মেলে দিয়ে প্রস্তরীভূত হয়ে বসে রইল। চোখের সামনে চমকাতে লাগল নিশার হাস্যোজ্জ্বল মুখ, জাহিদের সকৌতুক চাউনি, দুজনের চোখেমুখে ছড়িয়ে থাকা চাপা সুখের উন্মাদনা! শরীরের প্রতিটা রোমকূপ জ্বালা করতে লাগল। যেন বিষাক্ত কোন পোকা কামড়ে যাচ্ছে অনবরত। ফারা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো ঝলসে উঠে বলল, ‘তোমার অ্যাপার্টমেন্টে তো আমি উঠব’ই আজ নয় তো কাল…কিন্তু তার আগে যে করেই হোক নিশার একটা ব্যবস্থা করতে হবে!’
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ২০.২
তুমি পাহাড়ের মতো ভালো
এভাবে কোনদিন কারো জন্য অপেক্ষা করেনি শাহজিদ। নিশ্ছিদ্র, নিরবচ্ছিন্ন, অটুট অপেক্ষার প্রভাব যে এমন ভয়ংকর পীড়াদায়ক হয়, এটাও তার জানা ছিল না আগে। গতকাল সকালের পর থেকে সে একনিষ্ঠভাবে তুরিনের জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে। এই অপেক্ষা আবেগতাড়িত নয়, বরং অনেক বেশি যুক্তিসংগত। কারণ তুরিনের পাগলামোর কারণেই এই বাড়ি এখনো ছাড়া হয়নি। অথচ সেই নাটকের পর থেকে মেয়েটা পুরোদস্তুর গায়েব হয়ে গেছে। ফাজলামোর একটা সীমা থাকা উচিত। অপেক্ষা করতে করতে এক সময় মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠল। ভাবল কিছু না বলেই বেরিয়ে যায়। তবেই উচিত শিক্ষা হবে মেয়েটার। কিন্তু কী মনে করে যেন যাওয়া হলো না, থেকে গেল। অস্থির শাহজিদ মনে মনে গুছিয়ে নিতে লাগল কথা। নাটকের স্ক্রিপ্টের মতো। বারবার দরজার দিকে তাকাল। কান পেতে রাখল সিঁড়িঘরে। স্নায়ু এত বেশি টানটান হয়ে রইল যে কোথাও হালকা একটু শব্দ হলেই মনে হচ্ছিল তুরিন এসেছে। কী বিরক্তিকর! কোন কাজে মন দিতে পারল না। রাতে ঘুমও হলো না ঠিকমতো। আধোঘুমের মধ্যে টের পেল ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও তুরিনের কথাই ভাবছে। রোমান্টিক কোন ভাবনা নয়, বরং দুশ্চিন্তামিশ্রিত বাস্তবিক খটোমটো ভাবনা। সকালে ঘুম ভাঙল নিদারুণ অশান্তি নিয়ে। মাথা ভার হয়ে আছে। অনিশ্চয়তায় দুলছে বুক। বারবার ট্র্যাভেল ব্যাগে রাখা রুপালি রঙের ছোট্ট সুন্দর পিস্তলটার দিকে মন চলে যাচ্ছে। জানালার ওপাশের দূরবর্তী লাল পাথুরে পাহাড়ের দিকে ছুটে যাচ্ছে লোভাতুর দৃষ্টি। পাহাড়চূড়ো ডাকছে ওকে হাতছানি দিয়ে। বিরহের যন্ত্রণা হচ্ছে ভেতরে। সেই দুর্ধর্ষ স্বপ্নটা বাস্তবায়নের তীব্র ইচ্ছা বারেবারে গুমড়ে উঠছে মনের পরতে পরতে। সকালে ব্রেকফাস্ট স্কিপ করল। অবসাদে ভার হয়ে আছে শরীর। অ্যাপেটাইট নেই।
সকাল আটটায় দরজায় ধাক্কা পড়ল। লক খোলা ছিল। আদেশ করল শাহজিদ, ‘কাম ইন! ‘
স্লাইডিং ডোরটা খুলেই তুরিন জরুরি গলায় বলল, ‘আমি ক্যাম্পাসে যাচ্ছি। তুমি আসবে আমার সঙ্গে? একটু কথা ছিল!’
শাহজিদ পিসির সামনে বসে ছিল হুইলচেয়ার নিয়ে। আর ঘণ্টাখানেক বাদে ওর অফিস শুরু হবে। হাতে এখনো সময় আছে। তুরিনের দিকে না তাকিয়েই ফোঁস করে একটা বিরক্তিমিশ্রিত শ্বাস ফেলে বলল, ‘এতক্ষণে আসার টাইম হলো তোমার?’
তুরিনের কণ্ঠে ঝাঁপতালে নেমে এলো আহ্লাদী সুর, ‘অ…তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে হানি? রাতে ঘুমোতে পারোনি তাই না? ডিড ইউ মিস মি?’
শাহজিদের মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। হুইলচেয়ারটা ঘুরিয়ে নেয় তুরিনের দিকে। সাদা ওভারকোট ওর পরনে। সঙ্গে ব্ল্যাক জিন্স আর হাঁটু পর্যন্ত উঠে আসা লং-বুট। শাহজিদ কঠিনভাবে কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে যায় হঠাৎ। কেন যেন বিনিদ্র ক্লান্তিময় দীর্ঘ রজনীর পর তুরিনের খরগোশের মতো তুলতুলে মুখটা দেখামাত্র একটা আরামবোধ হলো। পাহাড়ের পাথুরে গায়ের শীতল ঘ্রাণের মতো পবিত্র প্রাণজুড়ানো ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ল বাতাসে। মনের অজান্তেই পুরু ভ্রুজোড়া কুঁচকে ফেলে শাহজিদ। ডান গালে ঠেকে যায় জিব। পাহাড়ের সঙ্গে তুরিনের সম্পর্ক কী? তুরিনকে দেখা মাত্রই কেন মনে হলো ও পাহাড়ের মতই সুন্দর?
চোখের সামনে তুড়ি বাজাল তুরিন, ‘হ্যালো গ্রাম্পি ইয়াং ম্যান! ওয়েক আপ!’
শাহজিদের গায়ে ঘরোয়া টি-শার্ট আর ট্রাউজার। হুইলচেয়ারের হাতলে ভর দিয়ে এক পায়ে উঠে দাঁড়াল সে। উবু হয়ে বিছনায় রাখা ক্রাচদুটো বগলদাবা করল। তুরিন এগিয়ে এসেছিল সাহায্যের উদ্দেশ্যে। শাহজিদ কারো সাহায্য নিতে নারাজ, ‘নোপ…আই ডোন্ট নিড ইয়োর হেল্প…আই ক্যান হ্যান্ডেল মাইসেলফ।’
একটা লেদারের জ্যাকেট পরে নিল ও। কালো রঙের। কান পর্যন্ত নেমে আসা ঈষৎ লালচে চুলগুলো অবিন্যস্ত হয়ে আছে। গালের আধ ইঞ্চি লম্বা দাড়িগুলোও বড্ড এলোমেলো। তুরিন বলল, ‘তুমি চুলটুল কাটো না কেন? বানর হতে চাও নাকি?’
শাহজিদ মুখ বাঁকাল গম্ভীরভাবে। কিছু বলল না। ব্যাকইয়ার্ডে বেরিয়ে এসেছিল ওরা। তুরিনের গাড়ি স্ট্রিট পার্কিং করা ছিল। সেই পর্যন্ত আসতে মিনিট চারেক সময় লেগে গেল। গাঢ় নীল আকাশের নিচে থইথই করছে বরফ ধোয়া এক ঝকঝকে সকাল! চারিদিকে চোখ ধাঁধানো আলো! রোদে শুধু তেজ আছে, উত্তাপের লেশমাত্র নেই। শাহজিদ উঠে বসল গাড়িতে। সাহায্য করল তুরিন। তারপর ড্রাইভিং সিটে এসে বসল। গাড়ি স্টার্ট দেবার আগে একবার তাকাল শাহজিদের দিকে। তাকাল শাহজিদও। চোখে চোখে ধাক্কা খেল ঠিকই, কিন্তু স্থির হলো না দৃষ্টি। অন্যদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল দুজনেই। কোন কথা না বলে ইঞ্জিন স্টার্ট করল তুরিন। নেইবারহুডের পিচ্ছিল কর্দমাক্ত বরফ ঢাকা রাস্তায় গাড়িটা ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে চলতে লাগল। একটা সময় শাহজিদ বলল, ‘শোন তুরিন, আমি ভেবে দেখলাম…তুমি যেহেতু আমাকে বিয়ে করতে চাইছ…মানে বিয়ে করার জন্য এত ক্রেজি হয়ে গেছ…. তুরিন ফোঁস করে উঠল মাঝপথে, ‘হ্যাং অন! আমি ক্রেজি হয়ে গেছি মানে? তুমি বুঝি চাও না?’
শাহজিদ জানালার বাইরে চোখ রেখে বলে, ‘আমার চাওয়া না চাওয়ায় তো কিছু এসে যায় না। তুমি তো পাগল। সবার ওপর জোরজার করা তোমার অভ্যাস। আমি আমার কথা ভাবছি না, তোমার পাগলামোর কথাই ভাবছি।’
অপমানে কান ঝাঁঝাঁ করে ওঠে তুরিনের। কষ্টও হয় ভীষণ। ব্যথিত স্বরে বলে, ‘হোয়াই আর ইউ বিইং সো রুড টু মি?’
—‘আই অ্যাম নট বিয়িং রুড…জাস্ট ট্রাইং টু বি প্র্যাকটিক্যাল।’ একটু থেমে শাহজিদ আবার বলল, ‘যাই হোক…বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছিলাম!’ শাহজিদ তুরিনের দিকে ঘুরে তাকায়। দৃঢ় দুটি চোখ রাখে ওর মুখের ওপর। গাড়িটা নেইবারহুডের রাস্তা ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠে আসে। শাহজিদ জোরালো গলায় বলে, ‘আমি ঠিক করেছি তোমাকে বিয়ে করব!’
তুরিনের হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠে আসে গলার কাছে। আড়চোখে তাকায় শাহজিদের দিকে। সাবধানে উচ্চারণ করে শব্দটা. ‘তাই?’
— ‘হ্যাঁ তাই…কিন্তু একটা শর্ত আছে!’
তুরিন থমকায়, ‘শর্ত?’
— ‘হ্যাঁ শর্ত। শর্তটা মেনে নিলেই আমাদের বিয়ে হবে…নইলে না।’
— ‘তুমি এমনভাবে কথা বলছ যেন বিয়ে করার গরজটা একা আমার! আমি কোন শর্ত-টর্ত মানব না।’
— ‘তাহলে বিয়েও হবে না!’
— মরে যাচ্ছি না বিয়ে করার জন্য!’
— ‘তাহলে আমাকে যেতে দিলে না কেন গতকাল?’ ক্ষেপে যায় শাহজিদ।
— ‘গলা টিপে মারব তোমাকে…এইজন্য যেতে দিইনি। বুঝলে?’
— ‘পাগল!’
‘তুমি পাগল!’ একটু থেমে নিয়ে তুরিন সাপের মতো ফণা তুলে হিসিহিসে গলায় বলে, ‘কী শর্ত তোমার, শুনি?’
সেলফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। তুরিন অস্থির হয়ে বলল, ‘দ্যাখো তো কে কল করছে? পকেট থেকে বের করো ফোনটা।’
শাহজিদ বিরক্তিমিশ্রিত ত্যাড়া দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। খ্যাক দিয়ে উঠল তুরিন, ‘কী হলো? স্ট্যাচু হয়ে গেলে কেন?’
শাহজিদ না পারতে হাত বাড়িয়ে তুরিনের কোটের পকেট থেকে অ্যান্ড্রয়েড ফোনটা বের করে আনল। পানসে মুখে বলল, ‘তোমার মা।’
— ‘রিসিভ করো।’
— ‘আমার কোন কথা নেই উনার সঙ্গে।’
‘আমি কথা বলব। লাউড স্পিকার অন কর।’
শাহজিদ আদেশ পালন করল। অ্যানসার বাটন প্রেস করতেই ফারার বিক্ষুব্ধ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
— ‘কোথায় তুমি?’
— ‘ক্যাম্পাসে যাচ্ছি।’
— ‘ফিরবে কখন?’
— ‘জানি না।’
— ‘জানো না মানে?
— ‘জানি না মানে জানি না…ড্রাইভ করছি। এখন কথা বলতে পারব না।’
— ‘ক্যাম্পাসে যেতে হবে না। তুমি আমার অফিসে আসো। জরুরি কথা আছে।’
তুরিন বিরক্ত হয়, ‘কী এমন জরুরি কথা যা এখন না বললেই নয়?’
— ‘এখুনি কথাগুলো তোমাকে বলতে হবে তুরিন! প্ল্যান করতে হবে। নিশাকে আমি আর একটা দিনও সহ্য করতে পারব না।’
ফারার বলা শেষ কথাটা সংকুচিত করে তুলল তুরিনকে, শাহজিদের সামনে। শাহজিদ চট করে তাকাল একবার ওর মুখের দিকে।
তুরিন বিব্রত স্বরে ফারাকে বলল, ‘পরে কথা বলছি তোমার সঙ্গে। এখন রাখি।’
ফোনের লাইন কাটার সঙ্গে সঙ্গে শাহজিদ চমকানো গলায় বলল,
— ‘কী করলে?’
— ‘কী করলাম?’
— ‘ইউ জাস্ট র্যান আ রেডলাইট।’
— ‘আসলেই?’
শাহজিদ বিরক্ত হলো, ‘গাড়ি পার্ক করো কোথাও। এভাবে হবে না।’
— ‘কী হবে না?’
— ‘কথা বলা যাবে না।’
— ‘কেন?’
— ‘কারণ তুমি খুবই বাজে ড্রাইভার। নিয়ম-কানুন মানতে চাও না।’
তুরিনকে একটু নার্ভাস দেখাল। মেইনস্ট্রিটের ব্যস্ত রাস্তা থেকে বেরিয়ে পড়ল চট করে। উঠে এলো পাহাড়কাটা আঁকাবাঁকা পথে। একপাশে লাল পাহাড়ের পাথুরে উঁচু পাঁচিল। অন্যপাশে রাস্তা উত্রাই হয়ে নেমে গেছে নিচে। মিশেছে ছাইরঙের পাথরে ঘেরা সেইন্ট ড্রেইন ক্রিকের সঙ্গে। ক্রিকের ওপারের শৈলশিরায় দাঁড়িয়ে থাকা সারিবদ্ধ পাইন গাছের মাথায় সাদা বরফের প্রলেপ জমেছে। দেখলে মনে হয় যেন কোন-আইস্ক্রিম। বরফ জমে আছে ক্রিকের চারিধারে ছড়িয়ে থাকা ছোট বড় নানা আকৃতির পাথরের খাঁজে খাঁজে। তার ওপর দিয়ে ছলাৎ ছলাৎ বয়ে চলেছে কাচের মতো স্বচ্ছ জলের ঢেউ।
তুরিন নেমে এসে ব্যাকডালা থেকে শাহজিদের ক্রাচ বের করল। শাহজিদ গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, ‘সারা জীবন এসব করতে পারবে তুরিন? উচ্ছৃঙ্খল এক ডাকাতিয়া বাতাসে তুরিনের সিল্কি চুল উড়ছিল। হাত দিয়ে বেসামাল চুলের গোছা কোন রকমে সামলে নিয়ে সে বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করল, ‘কীসের কথা বলছ?’
শাহজিদ ঠোঁটের কোণে দুর্বোধ্য একটা হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘এই যে এসব…উঠতে নামতে সাহায্য করা…ডোন্ট ইউ ফিল পিটি ফর মি?’
— ‘বাজে কথা বলো না।’
শাহজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, ‘বাজে কথা বলছি না তুরিন! খুব বাস্তব কথা বলছি।’
— ‘আমার তো তোমাকে সাহায্য করতে খারাপ লাগে না!’
— ‘কিন্তু আমার যে অন্যের সাহায্য নিতে ভীষণ খারাপ লাগে!’
— ‘খারাপ লাগত না যদি তুমি আমাকে আপন ভাবতে পারতে। তোমার খুব আপন কেউ…ধরো তোমার বাবা-মা-ভাই বোন যদি থাকত…তাদের সাহায্য পেতে কি তোমার খারাপ লাগত?’
— ‘কেমন লাগত তা বলতে পারছি না! যে অভিজ্ঞতা কখনো হয়নি সে সম্পর্কে মতামত দিই কী করে, বলো?’
তুরিনের মনটা খারাপ হলো। যার সব আছে…সে কখনো কিচ্ছু না থাকার দুঃখটা ঠিকঠাক অনুভব করতে পারে না। বাবা-মা না থাকলে…আপনজন না থাকলে…পরিবার না থাকলে মানুষের কেমন লাগে কে জানে! তাকিয়ে দেখল শাহজিদের হালকা লাল মেশানো কালো চুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অবাধ্য বাতাস। চারিদিকে ঝলমল করছে সর্বগ্রাসী সূর্যের নিঃসীম সাদা আলো। চোখ খোলা রাখা যায় না ঠিকমতো। শাহজিদের চোখ আলোর দাপটে একটু ছোট হয়ে এসেছিল। কপালে সুস্পষ্ট কুঞ্চন। পার্কিং লটের পাশেই তিরতির করে বয়ে চলেছে সেইন্ট ভ্রেইন ক্রিকের নির্মল জল ধারা। এই ক্রিকটা তুরিনদের বাড়ির ব্যাকইয়ার্ড পর্যন্ত গড়িয়ে গেছে। ঢেউয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে রোদ, চমকাচ্ছে হীরার মতো।
শাহজিদ ক্রিকের ধারে এসে দাঁড়ায়। ডান দিকের পাহাড় কাটা রাস্তা চড়াই হয়ে উঠে গেছে ওপরে। খরস্রোতা বাঁধটার কাছাকাছি যেতে হলে এই রাস্তা বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। খানিক দূরে দুটি ছেলেমেয়ে হিল ট্র্যাকিং করছে। পাহাড়ের মাঝ বরাবর ঝুলছে ওদের শরীর। দড়ি বেয়ে বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করছে। একটা সময় এখানে নিয়মিত আসা হতো। এই পাহাড়ের চূড়োয় উঠেছে শাহজিদ একাধিকবার। আজকে শুধু তৃষাতুর চোখে চড়াই হওয়া রাস্তাটার দিকে চেয়ে রইল। রিজার্ভার ড্যাম পর্যন্ত যাওয়াটাই হয়তো সম্ভব হবে না। তুরিনের অস্থির কণ্ঠস্বর ভেসে এলো পেছন থেকে, ‘চলো ওপরে যাই।’
— ‘নাহ।’
— ‘কেন?’
— ‘এমনিই…ইচ্ছা করছে না।’
— ‘তুমি ভয় পাচ্ছ?’
‘ভয় পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’ দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করে শাহজিদ কথাটা। যেন নিজেকেই নিজে অভয় দেওয়ার চেষ্টা করে।
— ‘তাহলে চলো। আমি আছি তো!’
শাহজিদ ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তাটা দেখল একবার। অনেক খাঁড়া! গলাটা কেমন শুকিয়ে যায়। শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বিপন্ন গলায় বলে, ‘কতদূর যেতে চাও?’
— ‘ড্যাম পর্যন্ত যেতে চাই।’
— ‘লংমন্ট ড্যাম নাকি বাটনরক?’
— ‘লংমন্ট।’
—‘মিনিমাম ওয়ান মাইল।’
—‘তোমার সব মুখস্থ?’
— ‘হুম।’
— ‘বাটনরক কতদূর এখান থেকে?’
—‘ওয়ান পয়েন্ট নাইন মাইলস।’
— ‘তারপর?’
— ‘স্লিপি লায়ন ট্রেইল।
— ‘আমি যাইনি কখনো।’
শাহজিদের যেন হঠাৎ মনে পড়ল,
— ‘ক্লাসে যাবে না?’
—‘যাচ্ছি না।’
—‘পড়াশোনায় সিরিয়াস হলে না আর। এভাবে চলবে?’
—‘চলে যাচ্ছে একরকম।’
কথা বলতে বলতে হাঁটা শুরু করল তুরিন। শাহজিদ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাঁ পা এগিয়ে দিল। ভয় হচ্ছে একটু একটু। পারবে তো ঢালু রাস্তাটা বেয়ে উঠতে? না পারলে…তুরিনের সামনে সত্যিই ভীষণ লজ্জা পাবে ও। পরাজয়ের গ্লানির উদ্রেক হবে মনে। কাপুরুষ মনে হবে নিজেকে। পথটা একেবারে খাঁড়া নয়। ঢালু হয়ে আস্তে আস্তে উঁচুতে উঠেছে। উঠবার সময় মধ্যাকর্ষণ শক্তির টান প্রবলভাবে অনুভূত হয় তবে পড়ে যাওয়ার ভয় লাগে না। কিন্তু দোপেয়ে প্রাণী আর একপেয়ে প্রাণীর মধ্যে তফাত আছে। ঢালু রাস্তায় মধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে, উঁচুনিচু অমসৃণ পথে, ক্রাচ ঠেকিয়ে এগিয়ে যাওয়া খুব একটা সহজ হলো না শাহজিদের জন্য। শুরুতে মনে হচ্ছিল ক্রাচদুটোই হাত ফসকে পড়ে যাবে। তুরিন এগিয়ে এসে বলল, ‘টেক আ ডিপ ব্রেথ শাহজিদ! বড় করে শ্বাস নাও। ডোন্ট ফ্রিক আউট। ইউ আর ডুইং গ্রেট!’ শাহজিদ নিঃশ্বাস টেনে নিল বুক ভরে। সময় নিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। বাতাস খুব তীব্র একটু ওপরে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে অক্সিজেনের অভাব বোধ হয়। হাঁসফাঁস লাগে। ক্রাচের ঘষায় ব্যথা অনুভূত হয় বগলে। গলা শুকিয়ে যায় কাঠকয়লার মতো। শাহজিদ কিছুটা পথ উঠে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। বড় বড় শ্বাস নেয়। তুরিন তাকায় না ওর দিকে। এমন ভাব করে যেন কোনদিকে লক্ষই করছে না। কারণ লক্ষ করলেই শাহজিদ আরো বেশি বিচলিত হবে। জীবনে কিছু বিশেষ সময় থাকে, যে সময়গুলো শুধু নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার। এই বোঝাপড়ার সময়টুকু একান্ত ব্যক্তিগত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আরেকটু ওপরে উঠতেই পানির শব্দ স্পষ্ট হলো। চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল কৃত্রিম বাধের সুশীতল জলধারা। পাহাড়ের কোলে ঝরনার মতো ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়ছে। শাহজিদ হাঁপ ধরা গলায় বলল, ‘পানির বোতল আছে?’
তুরিন জিব কাটল, ‘ওহো…সঙ্গে তো নেই। বাট গাড়িতে আছে। তুমি দাঁড়াও। আমি এখুনি নিয়ে আসছি।’
শাহজিদ আঁতকে ওঠা গলায় বলল, ‘না না! লাগবে না! এতটা পথ হেঁটে এসেছ। আবার ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
—‘আরে পাঁচ মিনিট লাগবে। আমি যাব আর আসব। তুমি একটু অপেক্ষা কর।’
—‘প্লিজ যেও না!’
কে শোনে কার কথা? তুরিন স্প্রিংয়ের মতো লাফ-ঝাঁপ দিয়ে নামতে লাগল নিচে। নিরুপায় শাহজিদ বিস্মিত চোখে অদ্ভুত মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ভেতরে একটা গ্লানির কাঁটা খচখচ করে। মনে হয় এত মনোযোগ বা যত্ন পাবার কোন যোগ্যতাই তার নেই। তুরিন নেহাত ছেলেমানুষ। দুদিন পর, ছেলেমানুষ মনটার ওপর যখন প্রাপ্তবয়স্ক মন ভর করবে তখন নির্দ্বিধায় পুরনো ডায়েরির অপ্রয়োজনীয় পাতার মতো শাহজিদকে ছিঁড়ে ফেলে দুমড়েমুচড়ে ট্র্যাশ করে দেবে মেয়েটা। নিজের করা ভুলের জন্য পস্তাবে আজীবন। একটা পাথরের ওপর সাবধানে বসল শাহজিদ। সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করল। আগুন জ্বলল না ঠিকমতো। দুরন্ত বাতাসের অত্যাচারে বারবার নিভে যেতে লাগল। আকাশে মেঘের বিস্তার হয়েছে এখন। ড্যামের খরস্রোতা ঝরনার পানিতে, আর পাইন গাছের বরফমাখা আইসক্রিম মাথায় পিছলে বেড়াচ্ছে হীরক-কুচি রোদ্দুর। পাহাড়ের গা থেকে ভেসে আসছে শীতল একটা পবিত্র ঘ্রাণ। তুরিন ফিরে এলো পনেরো মিনিটের মাথায়। হাতে পানির বোতল। হাঁপাচ্ছে অনবরত। শাহজিদ চট করে উঠতে পারল না বসা থেকে। কিন্তু ওর ইচ্ছে হলো উঠে গিয়ে তুরিনের হাত থেকে বোতলটা নেয়। কাঁধে হাত রেখে যত্ন করে টেনে এনে বসায় নিজের পাশে। এই সব ইচ্ছেরা নিজের অপারগতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় বারবার। মনটা সংকুচিত হয়ে ওঠে। তুরিন কাছে এসে বোতলটা এগিয়ে দিল। শাহজিদ পানি পান করল ঢকঢক করে। শীতল বাতাস শরীরের চামড়ায় চাবুকের মতো আঘাত হানছিল। শুষ্ক ত্বকের আস্তর কেটে কেটে বসিয়ে দিচ্ছিল করাল দাঁত। শাহজিদের জ্যাকেটের বুক খোলা। ভেতর থেকে উঁকি দিয়ে আছে কালো টি-শার্ট। তুরিন সামনে এসে দাঁড়াল। একটু ঝুঁকে শাহজিদের জ্যাকেটের কলারটা ঠিক করল টেনেটুনে। তারপর চেইন লাগাতে লাগাতে বলল, ‘শীত করছে না তোমার?’
শাহজিদ উত্তর দিল না। দেখল তুরিনকে। চুলগুলো উঁচু করে বাঁধা। বাতাসের দাপাদাপিতে সিল্ক কাপড়ের মতো পিচ্ছিল চুল মুঠোবন্দি হয়ে থাকতে চাইছে না। ডান পাশের কান ছুঁয়ে দিয়ে গড়িয়ে পড়েছে ঘাড়ে। বাঁ দিকের গোছা এখনো রিবনে বন্দি। চুলের এই এলোমেলো ভঙ্গিটায় সাদা ওভারকোট পরিহিতা তুরিনকে কেমন অন্যরকম সুন্দর দেখায়। ফরসা মুখে আয়নার মতো চিকচিক করে রোদ। সূচালো ভ্রুজোড়ার নিচে ছোট ছোট দুটি চোখ অনেক দূরে দূরে বসানো। খর্বকায়, ক্ষীণ নাক আর ফিনফিনে পাতলা ঠোঁট ওর চেহারায় একটা ভোঁতা ভাবের উদ্রেক করতে গিয়েও দারুণভাবে হার মেনে গেছে শানিত এবং নিখুঁত চিবুক-রেখাটির কাছে। সূক্ষ্মাগ্র চিবুকখানি ওর ছোট চোখের তুলতুলে চেহারায় ধারাল অলংকার যুক্ত করেছে। একটু দূরে সরে এসে লাল রঙের পাহাড়ের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল ও। ব্যস্ত গলায় বলল, ‘কীসব শর্তের কথা বলছিলে তুমি তখন?’
শাহজিদের মনে পড়ল, ‘ও, হ্যাঁ… আসল কথাটাই বলতে ভুলে গেছি! শর্তটা হলো, বিয়ে করতে রাজি আছি, কিন্তু এখন নয়।’
—‘মানে কী?’
—‘মানে খুব সহজ। আমরা কিছুদিন একজন আরেকজনকে সময় দেব। বোঝার চেষ্টা করব। যদি আমাদের রিলেশনটা টেকে। তবেই বিয়ে করব।’ তুরিনের মুখে বিস্ময়ের ঢেউ ভাঙছিল ক্রমাগত। হতভম্ব গলায় বলল, কী আশ্চর্য! কেন?’
—‘কারণ এটাই আমার কাছে যুক্তিসংগত মনে হয়েছে। হুট করে বিয়ে করে ফেলাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।’
তুরিন ব্যথিত স্বরে বলল, ‘তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না?’
শাহজিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল তুরিনের দিকে। দুই গালের হাই-চিকবোনে থমথম করে উঠল অকাট গাম্ভীর্য। দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
—‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা আসছে না। আমি তো কোন সাধারণ মানুষ নই। হয়তো এখন তোমার মনে হচ্ছে আমার মতো ডিজেবল মানুষের সঙ্গে সারা জীবন কাটাতে পারবে। অল্প বয়সে মানুষের অনেক অসম্ভব কাজকেও সম্ভব বলে মনে হয়। কিন্তু বাস্তবতা হয়তো অন্য কথা বলবে। হয়তো কিছুদিন একসঙ্গে কাটাবার পর তুমি বুঝতে পারবে সিদ্ধান্তটা ভুল ছিল।’
তুরিনের বুকে চিনচিনে ব্যথা হয়। চিংড়িমাছ তেলে ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই যেমন সাদা আর লাল রেখায় গা ভরে যায়, ঠিক সেইরকমই লাল লাল দাগে আরক্ত হয়ে ওঠে ওর দুধে আলতা ফরসা মুখ। শক্ত গলায় বলে, ‘আমার সিচুয়েশনটা মনে হয় তুমি বুঝতে পারছ না। দাদাজান আমাকে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বিয়ে দিতে চান। তুমি বিয়ে না করলে অর্ণব বা অন্য কারো সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়ে যাবে।’
ভ্রু কুঁচকে যায় শাহজিদের, ‘ব্যাপারটা খুবই উইয়ার্ড। এটা দু হাজার তেইশ সাল। উনিশশ তেপ্পান্ন সাল না। এই যুগে কেউ কাউকে জোর করে বিয়ে দিতে পারে না।’
তুরিন অসহায়ভাবে বলল, ‘দাদাজান আমার বাবাকেও জোর করে বিয়ে দিয়েছিল। আমি জানি সেম জিনিস আমার সঙ্গেও হবে।’
—‘স্ট্রেঞ্জ!’
—‘তুমি আমাকে ভালোবাসো না, তাই না শাহজিদ?’
—‘আমি কোনদিন কোন মানুষকে ভালোবাসিনি। মাকে কখনো কাছে পাইনি। বাবা কাছে থেকেও অনেক দূরের মানুষ ছিলেন। অ্যাঞ্জেলিনার সঙ্গে গুড আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। ভালোবাসা বোধহয় ছিল না।’
—‘এখনো তুমি বোঝাপড়াকে প্রাধান্য দিচ্ছ। মনের অনুভূতির কোন দাম নেই তোমার কাছে?’
‘তুরিন শোন, আমি খুব প্র্যাকটিক্যাল একটা মানুষ। পাহাড় ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন বস্তু আমাকে ইমোশনাল করেনি কখনো। কিন্তু…’
হঠাৎ কথা থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে নিল শাহজিদ। দেখল তুরিনকে। চার চোখেতে একটা অদৃশ্য সেতুবন্ধন তৈরি হলো। শাহজিদের মনে হলো পাহাড়ের গায়ের শীতল ঘ্রাণের সঙ্গে তুরিনের কোথায় যেন একটা আশ্চর্য মিল আছে!
—‘থামলে কেন?’
শাহজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, ‘না কিছু না…’
একটু থেমে আবার বলল, ‘তাহলে প্ল্যান কী? তুমি আর তোমার মা নিশাকে বাড়ি থেকে তাড়াবার প্রিপারেশন নিচ্ছ নাকি?’
তুরিন বিব্রত বোধ করল। চোখ সরিয়ে নিল অন্যদিকে। শাহজিদ গম্ভীর গলায় বলল, –’জীবনটা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সেভাবেই তাকে গ্রহণ করার চেষ্টা করো। ষড়যন্ত্র করে, জোর খাটিয়ে পৃথিবীতে কিছু আদায় করা যায় না। তোমার ফ্রেন্ডদের দিকেই তাকিয়ে দ্যাখো। কজনের বাবা-মা একসঙ্গে সুখে আছে বলো তো?’
—‘ফ্রেন্ডদের দেখতে হবে কেন? তুমি আনিতাকেই দ্যাখো না। চাচা-চাচি আমার ফেভারিট কাপল। আই উইশ আমি ওদের মতো হতে পারতাম! আনিতা কত লাকি! কী সুন্দর নিট অ্যান্ড ক্লিন একটা ফ্যামিলি ওর!’
—‘আনিতার কথা বাদ দাও। তোমার বন্ধুদের বিষয়ে বলো। তোমার কাছের বন্ধু কজন?’
—‘পাঁচজন।’
—‘কজনের বাবা-মায়ের ডিভোর্স হয়েছে?’
তুরিন একটু চিন্তা করে বলল, ‘দুজনের বাবা-মায়ের সেপারেশন চলছে। আরেকজনের মা সিঙ্গেল। বিয়ে করেনি।’
—‘এদের মধ্যে এলজিবিটি কমিউনিটির সদস্য কজন?’
—একজন।
—‘জীবন কতটা বিচিত্র দেখেছ? মাত্র পাঁচজন বন্ধু তোমার। এদের কেউই পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবন পায়নি। কিংবা বলতে পারো এটাই স্বাভাবিক। ব্যক্তিস্বাধীনতাটাই মুখ্য। তুমি ডিভোর্সি, গে, লেসবিয়ান যাইই হও না কেন পৃথিবীর এতে কিছু এসে যায় না। বরং সততার সঙ্গে সমস্ত সীমাবদ্ধতাকে গ্রহণ করে নেয়াটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’ একটু বিরতি নিয়ে শাহজিদ আবার বলল, ‘নিশাকে ওর মতো ছেড়ে দাও। সেই বেচারি এসব ডিজার্ভ করে না। ভালো একটা মেয়ে! তোমরা অযথা ওর লাইফটা হেল বানিয়ে ছাড়ছ।’
তুরিনের কণ্ঠে হঠাৎ ঝাঁজাল একটা সুর এসে যুক্ত হয়, ‘নিশাকে তুমি খুব পছন্দ করো, তাই না?’
শাহজিদ থতমত খাওয়া গলায় বলল, ‘পছন্দ না করার কোন কারণ আছে কি?’
তুরিনের নাকের চামড়া ফুলে ওঠে ঢোলের মতো। চোখে ধকধক করে চাপা রোষের আগুন। কাষ্ঠ গলায় বলে, “তা কেন থাকবে? ওকে অপছন্দ করার তো কোন কারণ নেই। কিন্তু আমাকে অপছন্দ করার অজস্র কারণ আছে। শাহজিদ বিদ্রুপের হাসি হাসল, ‘তা ঠিক।’
—‘কী?’
—‘কী আবার? বললাম তোমার কথা ঠিক।’
—‘কোনটা ঠিক?’
—‘এই যে…তোমাকে অপছন্দ করার অজস্র কারণ আছে…কথাটা ঠিক।’ তুরিন বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। মাথার তার আরেকটু হলেই ছিঁড়ে যাবে খুব সম্ভবত। শাহজিদ সতর্ক গলায় বলল, ‘পাগলামো শুরু করবে নাকি এখন? পাহাড় থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিও না আবার! আমি অবশ্য পাহাড়েই মরতে চাই। তবে তোমার হাতে খুন হতে চাই না।’
তুরিন দাঁত কিড়মিড় করে বলল, ‘আমাকে অপছন্দ করার কারণগুলো কী কী? শুনি তো!’
—‘প্রথম কারণ হলো, তুমি বোকা।’
—‘আর?’
তুরিনের তেলে ভাজা চিংড়িমাছের মতো সাদা লাল মুখটার দিকে চেয়ে দুরূহ একটা চাপা হাসি হেসে যাচ্ছিল শাহজিদ। হাসতে হাসতেই বলল, ‘তুমি পাগল।’
নিজের কোমরে আপনা-আপনিই হাত উঠে যায় তুরিনের। ঝগড়াটে গলায় বলে, ‘আর কী কী কারণ আছে শাহজিদ?’
—‘তুমি একটা খরগোশের বাচ্চা।’
—‘ফালতু কথা।’
শাহজিদ বসা থেকে উঠল ধীরে ধীরে। ক্রাচে ভর দিয়ে এগিয়ে এলো কয়েক পা। তুরিনের একটা হাত ধরল। হ্যাচকা টানে সরিয়ে নিল তুরিন নিজের হাত। বিষঢালা গলায় বলল, ‘কাছে আসবে না তুমি।’
—‘কেন?’
—‘নিষেধ করেছি তাই।’
শাহজিদ প্রতিবাদী হয়ে উঠল, ‘কিন্তু কেন? আজকে থেকে তুমি অফিসিয়ালি আমার গার্লফ্রেন্ড, তাই না?
তুরিন অপ্রতিভ হয়, ‘গার্লফ্রেন্ড না ছাই…তোমার মতলবটা আমি বুঝেছি। আসলেই তুমি একটা বাজে ছেলে। প্রেম করতে চাও। কিন্তু বিয়ে করতে চাও না। এসব হবে না।’
—‘আর ইউ রিজেক্টিং মি?’ কথাটা বলতে বলতেই আচমকা অন্য একটা কথা মনে পড়ে যায় শাহজিদের। সন্দিগ্ধ চোখে তাকায় তুরিনের দিকে। কঠিনভাবে বলে, ‘তুমি অর্ণবকে কিস করেছিলে কেন?’
তুরিনের মুখের রং পালটে যায় এই প্রশ্নে। চপল গলায় বলে, ‘তাতে তোমার কী?’
—‘আমার কিছুই না। কিন্তু যাকে তুমি বিয়ে করতে চাও না…তাকে কেন অযথা…তোমাকে আসলে আমি বুঝি না।’
— ‘তোমার হিংসে হয়েছে খুব, তাই না?’
— ‘প্রশ্নই আসে না।’
— ‘আমাকেও তো তুমি বিয়ে করতে চাও না। কিন্তু চুমু খেয়েছিলে।’
— ‘আমি তো বাজে ছেলে। তুমি নিজেই বলেছ একটু আগে।’
— ‘আমিও বাজে মেয়ে। আমাকে কেউ পছন্দ করে না, জানো তো? আমার নিজের বাবাও এখন আর আমাকে আগের মতো ভালোবাসে না। নিশার মতো ভালো নই তো আমি। আমাকে অপছন্দ করার অজস্র কারণ আছে। হয়তো অর্ণবও আমাকে অপছন্দ করে। জোর করে ওর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাকে।’ বাধভাঙা ঝর্ণার শব্দে তুরিনের কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে আসে। ঠোঁট কাঁপতে থাকে হালকা। সেদিকে চেয়ে থেকে শাহজিদ নিজের হৃৎপিণ্ডে একটা অস্থির অট্টরব অনুভব করে। এক থোকা মন কেমনের বাতাস আটকে যায় শ্বাসনালিতে! রুদ্ধস্বরে বলে,
‘তুমি বাজে নও। তুমি ভালো। পাহাড়ের মতো ভালো!’
— ‘পাহাড়ের মতো?’
— ‘হুম।’
— ‘বাজে মেটাফোর!’
শাহজিদ হাসল, ‘আমি জানি…হয়তো বলা উচিত ছিল তুমি ফুল, পাখি কিংবা চাঁদের মতো…কিন্তু আমার কাছে পাহাড় সবচেয়ে ভালো…আর তোমাকে আমার পাহাড়ের মতোই ভালো লাগে!’
তুরিনের মুখটা সদ্য ঋতুমতী চতুর্দশী কিশোরীর মতো আরক্ত হয়ে ওঠে হঠাৎ। বুকের পাঁজরের খাঁচায় রঙিন পাখনার অচিন প্রজাপতির উড়াউড়ি টের পায় সে! সংকোচের ভারে নেমে আসে চোখের পাতা।
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ২০.৩
মাঝপথে লাইন কেটে দিও না
ওয়াশিং মেশিন থেকে একগাদা ভেজা কাপড় বের করে ড্রায়ারের খোপের ভেতর ছুঁড়েদিচ্ছিল নিশা। বাঁ কোমরে জুবিন ঝুলে আছে গাছে ঝোলা বাঁদরের মতো। মনের মাধুরী মিশিয়ে নিজের ভাষায় বলে যাচ্ছে হরেক রকম কথা। সেই সময় মিসেস মুর্তজার আগমন ঘটল লন্ড্রিরুমে। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে নিশার দিকে সেলফোন বাড়িয়ে দিয়ে ব্যতিব্যস্ত স্বরে বললেন, ‘বৌমা, জাহিদ ফোন করেছে। কথা বলবে তোমার সঙ্গে।’
নিশা অপ্রস্তুত হলো। লজ্জিত ভঙ্গিতে শাশুড়ির হাত থেকে ফোনটা তুলে নিল। মিসেস মুর্তজা দাঁড়ালেন না। বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। জুবিন মায়ের কাছ থেকে ফোনটা কেড়ে নেবার জন্য হ্যাচোড়প্যাচোড় করতে লাগল। এইটুকুন বয়সেই প্রযুক্তির প্রতি তার দারুণ ভালোবাসা। নিশা মোবাইলটা ওর হাত থেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে কানে ঠেকিয়ে নিল। ভাঙা ভাঙা, ফ্যাসফ্যাসে গলায় উচ্চারণ করল শব্দটা, ‘হ্যালো!’
— ‘হ্যালো নিশা!’
— ‘জি বলুন।’
— ‘কী করছ?’ জীবনে প্রথমবারের মতো এমন সাধারণ ঘরোয়া একটা প্রশ্ন শুনতে পেল নিশা, নিজের সাড়ে তিন বছরের পুরোনো স্বামীর কাছ থেকে। ছোট্ট সহজ প্রশ্নটার মধ্যে মন ভালো করার টনিক ছিল নিশ্চয়ই। তাই তো নিশার ঠোঁটের পাঁচিল টপকে একটা তৃপ্তির হাসি উঁকি দিল, কাপড় ধুচ্ছিলাম। আপনি কী করছেন?’
— ‘ডেনভার এসেছি, হোটেলে। মিটিং ছিল। সন্ধ্যায় একটু বের হব তোমাকে নিয়ে। রেডি থেকো, কেমন?’
— ‘কোথায় যাবেন?
— ‘কোথায় যাওয়া যায় বলো তো?’
নিশা চুপ করে থাকে। উত্তর খুঁজে পায় না। জাহিদ বলল,
— ‘জুবিনের বার্থডে সেলিব্রেট করব। তার আগে একটু শপিং করলে কেমন হয়?’
নিশা এবারেও কিছু বলল না। কেন যেন ভীষণ লজ্জা করতে লাগল ওর। লজ্জায় লাল হয়ে উঠল কানের লতি।
— ‘জুবিন কোথায়?’
— ‘এই তো এখানেই আছে। কথা বলবেন?’ লাউডস্পিকার অন করল নিশা।
— ‘হ্যালো জুবিন সোনা! কেমন আছ তুমি?’
জুবিন বলল, ‘আ তা তা তা মাম্মাম মাম।’
এই বিজাতীয় ভাষার কথা শুনে হাসতে লাগল নিশা। হাসল জাহিদও। হাসতে হাসতেই বলল,
— ‘আমার প্রিন্সেস কি লাঞ্চ করেছে?’
— ‘তা তা তা।’
— ‘আজ বিকেলে আমরা বেড়াতে যাব। তুমি রেডি হয়ে থেকো।’
— ‘মাম্মাম্মাম।’
— ‘বিকেলে তোমার মাকে শাড়ি পরতে বলবে।’
নিশা মেয়ের দিকে চেয়ে বলল, ‘জুবিনসোনা, বাবাকে জিজ্ঞাসা করো, মা কী রঙের শাড়ি পরবে?’
জুবিন বলল, ‘ইইইই!’
জাহিদ বলল, ‘সাদা!’
নিশা বলল, ‘মায়ের সাদা শাড়ি নেই। সাদাকালো আছে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করো সাদাকালো চলবে কি না?’
— ‘না…সাদাকালো নয়। মাকে বলো নীল পরতে।’
— ‘ঠিক আছে জুবিন, বাবাকে বলে দিও মা নীল শাড়ি পরবে।’
‘বাবা তোমাকে মিস করছে!’ জুবিন কী বুঝল কে জানে, ভারি আবেগঘন গলায় বলল,
— ‘আইতাইতাই!’
— ‘বাবা কিন্তু জুবিন সোনার মাকেও খুব মিস করছে!
—
— ‘বাবাকে বলো জুবিন…মা-ও তোমাকে মিস করছে।’
কথাটা এক নিঃশ্বাসে বলেই নিশা ফোনের লাইন কাটতে যাচ্ছিল। তার আগে ডাকটা ভেসে এলো অপর প্রান্ত থেকে।
— ‘নিশা!’
— ‘জি বলুন।’
— ‘তুমি সত্যি আমাকে মিস করছ?’ নিশা থমকালো।
— ‘আমার কথা শুনতে পেয়েছ?’
— ‘জি।’ অনেক কষ্টে ভেতর থেকে ঠেলেঠুলে শব্দটা বের করল নিশা।
— ‘উত্তর দিচ্ছ না যে?’
— ‘হ্যাঁ.. মনে হয়!’
— ‘মনে হয়?’
— ‘মনে হয় মানে…’ বাক্যটা শেষ করতে পারল না। বুকের কাঁপাকাঁপি মুখের কথা কেড়ে নিল। জাহিদ কিছুটা বঙ্কিম স্বরে বলল, ‘এখন তোমার কথা নেই। গতরাতে কিন্তু অনেককিছু বলেছিলে।’
নিশা ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করে, ‘অনেক কিছু?’ – ‘হ্যাঁ।’
— ‘কী বলেছিলাম?’
— ‘তোমার মনে নেই?’
— ‘সবটা মনে পড়ছে না।’
— ‘মনে না পড়লেও চলবে। আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’
— ‘কী প্রশ্ন?’
— ‘মিস করছ আমাকে?’
— ‘হুম।’
— ‘কী?’
— ‘বললাম তো!’
— ‘শুনতে পাইনি!’
— ‘মিস করছি।’
— ‘কাকে?’
— ‘ধুরছাই!’
— ‘কী হলো?’
— ‘মাথামুণ্ডু।’
— ‘এটা কীভাবে হয়?’
— ‘এভাবেই।’
— ‘হাসছ কেন?’
— ‘ফোন রাখছি।’
—‘রেখো না নিশা। সঙ্গে থাকো!’
— ‘কতক্ষণ?’
—‘আজীবন।’
— ‘আছি তো!’
— ‘মাঝপথে লাইন কেটে দিও না।’
— ‘আচ্ছা।’
— ‘কথা দিচ্ছ?’
— ‘কথা দিলাম!’
.
মুর্তজা সাহেব লিভিংরুমের কাউচে বসে ছিলেন। হাতে খবরের কাগজ। অর্ণব সামনে এসে দাঁড়াতেই তিনি কাগজটা কোলের ওপর নামিয়ে রাখলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘বসো।’
অর্ণবের কাঁধে ব্যাগ। পায়ে জুতো। পরনের জামাকাপড়ে ফিটফাট ভাব। মুখে লজ্জিত ভঙ্গি। মুর্তজা সাহেবের আদেশ নিঃশব্দে পালন করল সে। সশ্রদ্ধ ভঙ্গিতে বসে পড়ল উল্টো দিকের সোফায়।
— ‘কোথায় যাচ্ছ?’
— অর্ণব নতমুখে বলল, একটা ইন্টারভিউ আছে। ক্যালিফোর্নিয়ায়।
— ‘ইন্টারভিউ অনলাইনে দেওয়া যায় না?’
— ‘অনলাইনেরটা হয়ে গেছে। নেক্সট ইন্টারভিউ ইন পার্সন হবে।
— ‘ফিরবে কবে?’
অর্ণবের মুখটা আরো এক ধাপ নিচে নেমে গেল। চিবুক মিশে গেল গলার সঙ্গে।
— ‘ঠিক বলতে পারছি না।’
— ‘তুরিনের সঙ্গে তোমার কথাবার্তা হয়েছে ঠিকমতো?’
অর্ণব আড়ষ্টভাবে বলল, ‘জি না। উনি আসলে খুব ব্যস্ত থাকেন।
মুর্তজা সাহেব তীক্ষ্ণ চোখে পরখ করলেন অর্ণবকে। গোবেচারার মতো মাথা হেঁট করে বসে আছে। সাধারণত দেশ থেকে আসা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা চতুর গোছের হয়, স্ট্রিট স্মার্ট হয়। নানা কৌশল অবলম্বন করে এরা বিদেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে চায়। এই ছেলে নিঃসন্দেহে ভালো ছাত্র, কিন্তু বুদ্ধিমান নয়। ঘটে বুদ্ধি থাকলে এমন সুযোগ হাতছাড়া করত না। তুরিনকে বিয়ে করে অতি দ্রুত নিজের চালচুলোহীন জীবনের মোড় পাল্টে নিত। রাতারাতি বনে যেতে পারত মার্কিন রাজ্যের স্থায়ী বাসিন্দা। মুর্তজা সাহেব সারা জীবন যা কামিয়েছেন তাতে অর্ণবের মতো শ খানেক গোবেচারা গোছের মানুষ অনায়াসে ঘাড়ে বসে খেতে পারবে। কিন্তু গাধা ছেলেটা এই দুষ্প্রাপ্য শুভ-যোগ পায়ে ঠেলে দিচ্ছে, বেছে নিচ্ছে সংগ্রামের জীবন। মুর্তজা সাহেব কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বললেন, ‘চাকরির চেষ্টা তো বিয়ের পরেও করতে পারতে। বিয়েটা হোক। কিছুদিন ঘুরেফিরে লাইফ এনজয় করো। তারপর নাহয়…’
সেই মুহূর্তে নিশার আগমন ঘটল ঘরে। হাতে চায়ের কাপ। মুর্তজা সাহেবের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিল সে। তারপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অর্ণবের দিকে ফিরে তাকাল। আন্তরিক গলায় প্রশ্ন করল, ‘আপনাকে চা দেব?’
অর্ণবের হৃৎস্পন্দন থেমে এলো হঠাৎ। চোখে ভর করল বোকা বোকা দৃষ্টি। মুর্তজা সাহেব সূক্ষ্মদর্শী অভিজ্ঞ ব্যক্তি। অর্ণবের সহজ সরল মুগ্ধ অভিব্যক্তিটা তার নজর এড়াল না। তিনি কৌশলী গলায় প্রশ্ন তুললেন, ‘বৌমার সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে?’
‘বৌমা’ শব্দটা অর্ণবের কানে লাগল খট করে। চোখের বোকা দৃষ্টিতে বিদ্যুতের মতো চমক খেলে গেল।
— ‘ওর নাম নিশা। আমার ছোট ছেলের বৌ।’
অজান্তেই অর্ণবের ভ্রুজোড়া কুঁচকে উঠল। ছোট ছেলে বলতে…!
সদর দরজাটা ঝট করে খুলে গেল সেই মুহূর্তে। খোলা দরজা দিয়ে ধেয়ে আসা এক থোকা, হঠাৎ পাওয়া, জমকালো সূর্যের আলোর মধ্যে তুরিনকে দেখতে পেল ওরা। এই ঝটিকা আগমন সবাইকেই সেকেন্ডের জন্য থমকে দিল। তুরিন উত্তেজিত ভাবে প্রশ্ন করল, ‘বাবা ফিরেছে?’
উত্তরটা মুর্তজা সাহেব দিলেন, ‘এখনো ফেরেনি। কেন? সব ঠিক আছে তো?’
তুরিন কোন উত্তর না দিয়ে রুক্ষ চোখে একবার তাকাল নিশার দিকে। তাকিয়েই রইল কিয়ৎক্ষণ। তারপর কঠিন গলায় বলল, ‘বাবার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।’
নিশা সরে এলো জায়গাটা থেকে। হালকা বুক কাঁপল। কী জরুরি কথা বলবে তুরিন তার বাবার সঙ্গে? এই জরুরি কথায় নিশা কোনভাবে জড়িত নেই তো? কে জানে!
মুর্তজা সাহেব অর্ণবকে যেতে দিলেন ঠিকই। তবে পইপই করে বলে দিলেন ইন্টারভিউ শেষ করেই যেন ফিরে আসে কলোরাডোতে। থেকে যায় আরো কটা দিন।
ঘড়িতে তখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা। নিশা নিজের ঘরে এসে মেয়েকে গোসল করাল। জামাকাপড় পরিয়ে ফিটফাট ফুলবাবুটি সাজিয়ে দিল। তারপর ওকে শাশুড়ির কাছে গচ্ছিত রেখে নিজে সাজতে বসল। কণ্ঠে লেগে রইল গুনগুন গানের সুর। কোন জমকালো সাজ নয়। শাড়ি পরা, চোখে হালকা কাজল দেওয়া, চুলে চিরুনি বুলিয়ে নেয়া…এসব টুকটাক সাজসজ্জাতেই যেন মিশে আছে সীমাহীন আনন্দ!
সূর্য তখন মধ্য আকাশ অতিক্রম করে পশ্চিমের দিকে হেলে পড়ছে। নেমে আসছে চোখ বরাবর। তীব্র সূর্যরশ্মি ধারাল সুচের মতো বিঁধছে পৃথিবীর শুষ্ক মাটিতে। এই চোখ-ঝলসানো আলোর অত্যাচার বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। শাহজিদ দরজায় ঝুলানো পর্দা টেনে দিচ্ছিল। হঠাৎ কাচের দরজার ওপাশে, ঝাঁঝাঁ রোদের মধ্যে একটা লম্বা চওড়া ছায়ামূর্তি দৃশ্যমান হয়ে উঠল। শাহজিদ আগে কোথায় যেন দেখেছিল একে! কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না।
দরজাটা অল্প করে খুলতেই শক্তপোক্ত চোয়াড়ে চেহারার লোকটা মুখ বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘তুমি নিশ্চয়ই শাহজিদ। আমি অনিমেষ। একটু কথা আছে তোমার সঙ্গে। ভেতরে আসতে পারি?’
শাহজিদ দ্বিধাগ্রস্ত নিশ্চল চোখে চেয়ে রইল। মস্তিষ্কের অলিগলি হাতড়ে মনে করার চেষ্টা করল মানুষটাকে আগে ঠিক কোথায় দেখেছিল? চেনা চেনা লাগছে কেন?
নেইবারহুডের রাস্তার ধারে অনিমেষের গাড়িটা পার্ক করা ছিল। চোখ পড়া মাত্র ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠল ফারা। কী মতলবে এ বাড়িতে এসেছে লোকটা? বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও? ভয়ের বিষাক্ত কাঁটা ছড়িয়ে পড়তে লাগল রক্তের শিরায় শিরায়। গলা শুকিয়ে এলো। অনিমেষ কি সর্বনাশটা করেই ছাড়বে? এর সম্পর্কে আরো আগেই সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। একটা ব্যবস্থা নেয়া উচিত ছিল। বিলম্ব হয়ে গেছে। ঢের বিলম্ব!
কম্পিত বক্ষ নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল সে। ড্রইংরুমে শুধু তুরিন বসে আছে। অন্য কেউ নেই। অনিমেষকে দেখা যাচ্ছে না। ফারা মেয়ের দিকে বিভ্রান্ত একজোড়া চোখ স্থাপন করে ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, ‘কেউ এসেছে?’
তুরিন মোবাইলে গেম খেলছিল। মায়ের প্রশ্ন শুনে একটা ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘কেউ আসার কথা?’ ফারা বুকের কাঁপাকাপি সামলে নিল কোন রকমে, ‘এমনিই জানতে চাইলাম।’
একটু থেমে আবার বলল, ‘তোমার বাবা ফেরেনি এখনো?’
— ‘না।’
— ‘মনে আছে তো কী বলতে হবে?’
— ‘হুম। মনে আছে।’
.
অপেক্ষার পালা যেন শেষই হচ্ছে না। মন সর্বক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে আছে। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে নিশা জানালার পাশে। এর মাঝে অনিমেষ এলো, ফারা এলো…কিন্তু জাহিদ এখনো লাপাত্তা। অনিমেষ অবশ্য সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করেনি। ফ্রন্টইয়ার্ডের উতরাই পেরিয়ে ব্যাকইয়ার্ডে নেমে গেছে। সূর্য এখন শেষ আকাশে নেমে এসেছে। বড্ড কড়া! খালি চোখে ঘরের বাইরে চোখ ফেলা যায় না। দৃষ্টি ঝলসে যায় রোদের তেজে। একটু পরেই প্রখর সূর্যটা টুপ করে হেলে পড়বে রকি মাউন্টেনের সুউচ্চ চূড়ার পেছনে। আলোর দাপট কমে আসবে। আকাশ ভরে যাবে গোধূলীর অপার্থিব রঙে।
নিশার চোখে সানগ্লাস। রোদচশমার ভেতর থেকে জানালার ওপারের পৃথিবীকে নরম দেখাচ্ছে। উঠোনজুড়ে ছড়িয়ে আছে সাদা আর ম্যাজেন্টা ক্র্যাব অ্যাপল ব্লসম। একজোড়া দস্যি কাঠবিড়ালি ফুলের গালিচার ওপর পূর্ণ উদ্যমে লড়ে যাচ্ছিল। পাশের বাড়ির মোটা হোঁৎকা কালো বেড়ালটা চোখে নীল আলো জ্বালিয়ে কটমটিয়ে এগিয়ে আসতেই কাঠবিড়ালি দুটো লেজ তুলে পালিয়ে গেল ভয়ে। রোজ এই সময় জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে, দুর্ভেদ্যরহস্যপূর্ণ আশ্চর্য প্রকৃতির ভেতর লুকিয়ে থাকা খুঁটিনাটি গল্পগুলো পড়ার চেষ্টা করে নিশা। সময় কেটে যায় দিব্যি! এই দাঁড়িয়ে থাকার পেছনের উদ্দেশ্য শুধু প্রকৃতির গল্প পড়া নয়, বরং প্রিয় মানুষটিকে এক নজর দেখার জন্যই এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে। বিকেল শেষের পিচ রঙের রোদ্দুর মাথায় নিয়ে একটি মেয়ে জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। উতলা বাতাস তার এলোচুল নিয়ে খেলছে। মেয়েটির চোখে ভর করেছে দোজাহানের সমস্ত মায়া। এক সমুদ্র ভালোবাসা বুকে নিয়ে সে প্রিয়জনের পথ চেয়ে আছে। পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য বোধহয় আর হয় না। তবে এই সুন্দর দৃশ্যটা চর্মচক্ষু দিয়ে অবলোকন করার সৌভাগ্য জাহিদের কখনো হয়ে ওঠেনি। কারণ ওর গাড়ি ড্রাইভওয়েতে উঠে আসা মাত্রই নিশা নিজেকে আড়াল করে ফেলে পর্দার আড়ালে। তারপর চোরা চোখে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। জাহিদ গাড়ি থেকে নেমে একবার দোচালা বাড়ির দিকে মুখ উঁচিয়ে তাকায়। চোখে রোদচশমা থাকে, ঠিক কোন ঘরের জানালায় গিয়ে তার দৃষ্টি আশ্রয় নেয় তা বোঝা যায় না।
.
আজও ব্যতিক্রম হলো না। গাড়ি থেকে নামামাত্রই ঘাড় উঁচু করে অপরাহ্নের শেষ সূর্যরশ্মিতে ঝলসে যাওয়া বাড়িটার দিকে তাকাল জাহিদ। চোখে পড়ল একটি মায়াবী দৃশ্য। নিশা জানালায় দাঁড়িয়ে আছে। পরনে নীল শাড়ি। মায়ের কোলে ঝুলতে থাকা জুবিন বাবাকে দূর থেকে দেখেই চিনে ফেলল। আশ্চর্য ব্যাপার হলো জীবনে এই প্রথমবারের মতো সে গলা ফাটানো চিৎকারে ফেটে পড়ে বাবা বলে ডেকে উঠল। খোলা বাতাসের অদৃশ্য রথে চেপে সেই ডাকটা ফুড়ুৎ করে এসে ধাক্কা খেলো জাহিদের কান বরাবর। কী আনন্দ যে লাগল! এই আনন্দের কোন তুলনা হয় না। দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে থাকা নিশাকে দেখে, নিশার কোলে জুবিনকে দেখে…জুবিনের আধো বোলের ওই বাবা ডাক শুনতে পেয়ে জাহিদের মনে হলো….বেঁচে থাকাটা আসলে ভারি সুন্দর… সুন্দরের চাইতেও… হাজার গুণ বেশি সুন্দর।
হ্যাঁ সুন্দরই তো। কেমন কবিতার মতো…পছন্দের গানের মতো… বছরের প্রথম কালবৈশাখী পাগল করা মাতাল হাওয়ার মতো সুন্দর! ওই সুন্দরের উত্তাপ আলপিনের মতো ফুটছিল নিশার সর্বাঙ্গে। বুকের মধ্যে একটা শ্বেতশুভ্র সুখীয়াল কবুতর ডানা ঝাপটে যাচ্ছিল অনবরত। কেমন দমবদ্ধ একটা ভাব হচ্ছিল। জাহিদ নিশ্চয়ই এখুনি দোতলায় উঠে আসবে। লজ্জা লাগছে নিশার। লজ্জার প্রবল তাণ্ডবে কানের ডগা হয়ে উঠেছে টকটকে লাল। অপেক্ষার প্রহরের শেষ ঘণ্টা এখুনি বেজে উঠবে। নিশা রুদ্ধশ্বাসে চেয়ে রইল ঘরের দরজার দিকে।
‘বাবা!’
বাড়ির ভেতরে পা রাখামাত্র ডাকটা কানে এসে লাগল। জাহিদ মুখ তুলে দেখল তুরিন দাঁড়িয়ে আছে লিভিংরুমের মাঝ বরাবর। উঁচু সিলিং থেকে ঝুলতে থাকা ঝাড়লণ্ঠনের ঠিক নিচে। আজ জাহিদের মন ভালো। ঘুম ভাঙার পর থেকেই অপ্রতিরোধ্য এক ভালো লাগার আনন্দ রঞ্জিত মাধুর্যরশ্মি দিনটাকে চারিদিক থেকে যেন মৌমাছির মতো ছেঁকে ধরে রেখেছে। মেয়েকে দেখে খুশি হলো সে। একগাল হাসি হেসে বলল, ‘আমার প্রিন্সেস কেমন আছে?’
তুরিন থমথমে গলায় বলল, ‘ভালো না।’
জাহিদ এতক্ষণে তুরিনকে সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করল। সাজসজ্জা পরিপাটি। মুখে পরিমিত প্রসাধন। কোথাও কোন অস্বাভাবিকতার ছাপ নেই। তবে খেয়াল করলে বোঝা যায় খর্বকায় চোখের তারায় সাংঘাতিক এক অস্থিরতা বিরাজমান। জাহিদের বুক সামান্য কাঁপল, ‘কী হয়েছে?’
— ‘তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। সময় হবে?’
জাহিদ হাতের কবজিতে বাঁধা অ্যাপলওয়াচটা দেখল একবার। ভ্রুজোড়া ক্ষীণ কুঞ্চিত হলো। সাড়ে ছয়টা বেজে গেছে। নিশা নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে তার জন্য। জাহিদ মৃদু গাম্ভীর্যের সঙ্গে মেয়েকে বলল, ‘খুব আর্জেন্ট কিছু বলার আছে কি? রাতে ফিরে এসে কথা বলি?’
তুরিনের নাকটা ফুলে ঢোল হয়ে উঠল মুহূর্তের মাঝে। কণ্ঠে ঝনঝন করে বেজে উঠল প্রতিবাদী অভিমান, ‘ইউ নেভার হ্যাভ টাইম ফর মি, বাবা! মাত্র তো অফিস থেকে ফিরলে। এখুনি কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে গেল?’
জাহিদ বিপন্ন বোধ করল। অপরাধবোধ হালকাভাবে ডঙ্কা বাজিয়ে গেল বিবেকের কাঠগড়ায়। সত্যিই মেয়েটাকে আজকাল একদম সময় দেওয়া হচ্ছে না।
— ‘আমার প্রিন্সেসের জন্য আমার সময় থাকবে না, ইজ দ্যাট ইভেন পসিবল?’ কথাটা বলতে বলতে জাহিদ এগিয়ে এলো কয়েক পা। দাঁড়াল তুরিনের মুখোমুখি। কিচেন কাউন্টারের টুলে বসে ছুরি দিয়ে ফল কাটছিল ফারা। মাঝে কোন দেওয়াল নেই। কিচেন থেকে লিভিংরুমের সবটাই দেখা যায়। শোনাও যায়। উত্তর দিকের জানালার কাচের ভেতর দিয়ে সামনের উঠোনটা পরিষ্কার ভাবে দৃশ্যমান। হঠাৎ ব্যাকইয়ার্ডের ঢাল বেয়ে অনিমেষকে উঠে আসতে দেখল ফারা। অনিমেষ কোনদিকে তাকাল না। উঠোন পেরিয়ে সোজা হনহন করে এগিয়ে গেল রাস্তায়। দৃশ্যটা দেখামাত্র একটা জটিল অঙ্ক যেন চোখের পলকে সমাধান হয়ে গেল। এর মানে অনিমেষ এতক্ষণ শাহজিদের ঘরে ছিল। কিন্তু শাহজিদের সঙ্গে অনিমেষের কীসের সম্পর্ক? ওরা আবার কবে থেকে বন্ধু হলো? কী এমন গোপন কথা থাকতে পারে ওদের দুজনের? ভাবতে গিয়ে ফারার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। দুর্মোচ্য দুশ্চিন্তা বিষাক্ত হুল ফুটাতে থাকল মস্তিষ্কের শার্সিতে।
এদিকে জাহিদ তখন তুরিনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। তুরিন বাবার চোখে চোখ রেখে একরোখা ভঙ্গিতে বলছে, ‘আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
— ‘কী সিদ্ধান্ত?’
— ‘নিশাকে তোমার ডিভোর্স দেওয়ার কথা ছিল। তুমি প্রমিজ করেছিলে আমাকে। ভুলে গেছ?’
জাহিদের মুখে ঝপ করে অমাবস্যার অন্ধকার নেমে আসে। মনের মধ্যে ভাসতে থাকা উদভ্রান্ত আনন্দের জোয়ারে ভাটা পড়ে যায় নিমেষে!
— ‘কথা বল বাবা!’
— ‘হঠাৎ এই প্রসঙ্গ তুললে কেন?’
তুরিনের কণ্ঠস্বর উচ্চাঙ্গে উঠে গেল, ‘বলছি কারণ আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
— ‘কী সিদ্ধান্ত?’
— ‘তোমাকে যেকোন একজনকে বেছে নিতে হবে! হয় আমি…নাহয় নিশা…নিশাকে ডিভোর্স না দিলে আমি তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য হব। তোমার লাইফ থেকে অনেক দূরে সরে যাব।’
জাহিদ থ বনে গেল মেয়ের কথা শুনে। বিস্ময়ের বুলেট ক্ষিপ্ৰ গতিতে তেড়ে এসে সবলে বিদ্ধ হলো বুকের পাটাতনে। টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া ক্ষত-বিক্ষত হৃদয় নিয়ে সে বড় আদরের… যত্নের…শখের… প্রিয় কন্যার দিকে চেয়ে রইল ব্যথিত চোখে। মেয়েটা কি অনেক বড় হয়ে গেছে? অনেক বড়? এত বড় যে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে এমন মর্মান্তিক বেপরোয়া কথা বলতে একবারও বুক কাঁপল না?
— ‘আমার কাছ থেকে দূরে সরে যেতে পারবে তুমি?’
তুরিন চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলল, ‘পারব…নিশাকে তুমি আমাদের জীবন থেকে না সরালে…আমিই সরে যাব বাবা! সত্যি বলছি! এখন তুমিই বলো…নিশাকে চাও? নাকি আমাকে?’
জাহিদ নিশ্চল দুটি জখম ভরা চোখের তারা কন্যার মুখের ওপর স্থিরভাবে নিবদ্ধ করে রাখল কিয়ৎক্ষণ। তারপর বাষ্পরূদ্ধ গলায় বলল, ‘আমার দুজনকেই চাই!’
রোষের আগুন ঝিলিক দিয়ে ওঠে তুরিনের চোখে। গরম তেলে পেঁয়াজ ছাড়ার মতো ছ্যাত করে উঠে বলে, ‘এটার মানে কী?’
নিশা নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে লিভিংয়ের দরজার কাছে। জাহিদ নিশার দিকে তাকাল একবার। তারপর চোখ ফিরিয়ে আনল তুরিনের মুখের ওপর। বড় একটা শ্বাস টেনে নিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তুমি তো এখন আর ছোট নও তুরিন। বড় হয়ে গেছ। এতটাই বড়…যে বাবাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা মুখ ফুটে বলতে তোমার ভয় করছে না। এ দেশে অবশ্য তোমার বয়সি ছেলেমেয়েরা বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকে না। কিন্তু আমি চাই না তুমি আমাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যাও। আমাদের পরিবারটা এখনো বেশ রক্ষণশীল। এ কথা তো তোমার অজানা নয়। তা ছাড়া তোমাকে ছাড়া বেঁচে থাকার কথা আমি ভাবতেই পারি না! ঠিক তেমনি…নিশাকে ছেড়ে দেওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। ডিভোর্সের কথা বলছ…যদি ডিভোর্স দিতেই হয় তবে নিশাকে নয়, বরং…’
তুরিনের সমস্ত অন্তঃকরণ আচমকা ভীষণভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠল এতকাল সে জানত বাবা তাকে জীবনের সবকিছুর চাইতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। বাবার কাছে সমস্ত দুনিয়া একদিকে আর তুরিন অন্যদিকে। ছোটবেলা থেকে মাত্রাতিরিক্ত এক পিতৃস্নেহের অহংকার বুকে নিয়ে বেড়ে উঠেছে সে। বাবা তার একান্ত ব্যক্তিগত এবং নিজস্ব ঐশ্বর্য। এই ঐশ্বর্যে কেউ কোনদিন ভাগ বসাতে আসেনি। এমনকি নিজের জন্মদাত্রী মায়েরও সেই স্পর্ধা হয়নি। আজকে বাবার কাছে নিশা আর তুরিন এক হয়ে গেল?
— ‘কী বলতে চাইছ তুমি? নিশাকে ডিভোর্স দেবে না…তো কাকে ডিভোর্স দেবে?’ তুরিনের কণ্ঠস্বর অসম্ভব কাঁপতে লাগল। জাহিদ স্থির ভাবে বলল, ‘তুমি শান্ত হও! ঠান্ডা মাথায় কথা বলো।’ শান্ত হওয়ার কোন লক্ষণ তো দেখা গেলই না বরং বাঘিনীর মতো গর্জে উঠে বাবার ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল তুরিন। শার্টের কলার খামচে ধরে দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলতে লাগল, “আমার মাকে ডিভোর্স দেবে তুমি? আমার মাকে?’
এই আকস্মিক আক্রমণে জাহিদ বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। তুরিনের মধ্যে আদব-কায়দার অভাব ছিল বরাবর। কিন্তু এতটা সীমা লঙ্ঘন এর আগে কখনো করেনি সে। ফারা কিচেন কাউন্টার থেকে নীরব চোখে সবটাই দেখছিল। মেয়ের কৃতিত্বে সে শুধু সন্তুষ্টই নয়, বরং মুগ্ধ!
নিশা ঠিক করেছিল বাবা-মেয়ের মধ্যে কখনোই আগ বাড়িয়ে কথা বলবে না। কিন্তু চোখের সামনে প্রিয় মানুষটার এহেন হেনস্থা তার সহ্য হলো না। আগ পিছ কিছু চিন্তা না করেই বুনো হরিণীর মতো ক্ষিপ্র পায়ে এগিয়ে গেল সে।
তুরিনের হাতটা জাহিদের শার্টের কলার থেকে এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলল, ‘কী করছ তুমি? বাবার সঙ্গে কেউ এমন আচরণ করে?
তুরিনের চোখে বীভৎস এক ঘৃণার তরঙ্গ ফুঁসে উঠল। পাশবিক, বর্বর রাগের উৎকট অত্যাচারে অন্ধ হয়ে এলো চোখের দৃষ্টি। হঠাৎ ডান হাতটা ঝড়ের বেগে শূন্যে তুলে নিয়ে একটা অতর্কিত অভাবনীয়…অনভিপ্রেত আঘাত করে বসল সে নিশার গাল বরাবর। চপেটাঘাতের নির্মম শব্দটা যেন বিস্ফোরণের মতো ফেটে পড়ল সারা ঘরময়। মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সবার হৃদস্পন্দন।
ফারা উঠে দাঁড়িয়েছে বসা থেকে। হাত ফসকে ফল কাটার ছুরি পড়ে গেছে মেঝেতে। দারুণ ব্যাপার তো! আনন্দ আর উত্তেজনায় শ্বাস আটকে আসার উপক্রম হলো তার।
অপমানে নিশার মুখ রক্তাভ হয়ে উঠেছে। চোখে টসটস করছে জল। জাহিদ থমকে গেছে সহস্র বছরের হিমায়িত জীবাশ্মের মতো। তার মুখখানা মৃত মানুষের মতো সাদা। কোন এক প্রলয়ংকরী ঝড় যেন এইমাত্র তার সমস্ত জীবনটাকে শিকড়শুদ্ধ উৎপাটিত করে দিয়ে গেছে। কয়েকটা স্থবির সেকেন্ড কেটে যাওয়ার পর জাহিদ জীবনে প্রথমবারের মতো এমন একটা কাজ করল, যা করার কথা কস্মিনকালেও ভাবেনি কখনো! যে মেয়ের গায়ে কোনদিন একটা টোকাও দেয়নি, সেই অতি স্নেহের, সাধের, পুতুলের মতো আদরের মেয়েটার গালে ক্ষিপ্রগতিতে এক করাঘাত বসিয়ে দিয়ে গগনবিদারী চিৎকারে ফেটে পড়ে বলল, ‘কী করলে তুমি? এত বড় সাহস হয় কী করে তোমার? অভদ্রতার সীমা থাকা উচিত!’
আঘাতের ধাক্কায় তুরিনের হালকা পাতলা শরীর কয়েক কদম পিছিয়ে গেছে। ঘাড়টা কাত হয়ে আছে হালকা। চোখের অচলিষ্ণু দৃষ্টি থেকে ফেটে পড়ছে আকাশস্পর্শী বিস্ময়। থরথর করে কাঁপছে দুটি ফ্যাকাসে পাতলা ঠোঁট ফারা ত্বরিত পদে এগিয়ে এলো কাছে। মর্মান্তিক হাহাকারে তার বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। একজন মানুষ কতটা পাষাণ হলে বাচ্চা একটা মেয়েকে এভাবে আঘাত করতে পারে! সে জাহিদের দিকে চেয়ে তীব্র বিদ্বেষ নিয়ে বলল, ‘তুমি কি মানুষ? নিজের সন্তানের গায়ে হাত তুললে?’
জাহিদ বজ্রকণ্ঠে বলল, ‘তুমি চুপ কর। আজকের এই পরিস্থিতির জন্য একমাত্র তুমিই দায়ী!’
— ‘আমি দায়ী?’
— ‘হ্যাঁ তুমি।’
তুরিনের বোধ বুদ্ধি তখন শূন্যের কোঠায়। রাগ, দুঃখ আর অপমানের চূড়ান্ত আস্ফালনে তার হৃৎপিণ্ড বিকল প্রায়। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। শরীরের ইঞ্চি ইঞ্চি চামড়ায় ক্রমাগত বিঁধে যাচ্ছে যন্ত্রণার সুচ। ফারা নিশার মুখের ওপর জ্বলন্ত চোখ বিদ্ধ করে অত্যন্ত কর্কশভাবে বলল, ‘এবার খুশি হয়েছ? আমার সংসারটা ভেঙে দিয়ে শান্তি হয়েছে তোমার?’
নিশা এ কথার পিঠে কড়া কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেল আবার। জাহিদের ক্রোধ জর্জরিত, অবিচলিত…অথচ তীব্র শোচনীয় অটল মূর্তি তার মুখের কথা কেড়ে নিল। বিপদের সময় সবাই একযোগে মাথা গরম করলে চলে না। বরং ঠান্ডা মাথায় প্রিয়জনের পাশে দাঁড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ।
জীবনটাকে সেই মুহূর্তে দুঃসহ এক পাষাণভার মনে হচ্ছিল জাহিদের। সংসারের এমন বীভৎস, নারকীয় অশান্তির মধ্যে বেঁচে থাকার চাইতে বিষ পান করে মরে যাওয়াও বুঝি ঢের সহজ কাজ! মস্তিষ্কে একের পর এক বিস্ফোরণ ঘটছে। আজকে এর একটা বিহিত করেই ছাড়বে সে। এভাবে আর চলতে পারে না। তুরিনের পাশ থেকে ফারাকে এক ঝটকায় দূরে সরিয়ে দিয়ে ক্ষিপ কণ্ঠে বলল, ‘তুরিন শোন, আজ তোমার সঙ্গে একটা সিক্রেট শেয়ার করব। এতদিন তোমাকে বলিনি কারণ ব্যাপারটা জানতে পারলে তুমি ভয়ংকর কষ্ট পাবে।’
তুরিন স্পন্দিতবক্ষ নিয়ে…বিস্ফারিত চক্ষে চেয়ে ছিল। তার মনে হচ্ছিল এই বাবাকে সে চেনে না। এমন পাগল পাগল অপ্রকৃতস্থ, অসংলগ্ন আচরণ বাবা এর আগে কোনদিন করেনি কারো সঙ্গে। তুরিনের ডান হাতের পাঁচ আঙুল তখনো নিজের গালের সঙ্গে লেপটে আছে। ওই গালে এখনো আঘাতের রেশ রয়ে গেছে। এই রেশ রয়ে যাবে আজীবন। আজকের ঘটনা ওর জীবন পাল্টে দিয়েছে। এতদিন কিচ্ছু না থাকলেও একান্ত নিজের একজন বাবা ছিল! আশ্রয় ছিল! আজ থেকে সেই বাবা পর হয়ে গেছে। হয়ে গেছে নিশার মতো গেঁয়ো, অশিক্ষিত মেয়ের আজ্ঞাবহ ভৃত্য। এই বাবাকে তার একটা ফোঁটাও ভালোবাসতে ইচ্ছে হচ্ছে না আর। ঘৃণা হচ্ছে…বীভৎস ঘৃণায় কাদার মতো থকথক করছে মনের চরাচর। ফারা তুরিনের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াল, ‘কী সিক্রেট শেয়ার করবে তুমি আমার মেয়ের সঙ্গে? তোমার মাথা মনে হয় গেছে একেবারেই।’ কথাটা বলতে বলতে সে তুরিনের হাত টেনে ধরে অনেকখানি দূরে সরে এলো। গলার স্বর এক ডিগ্রি নিচে নামিয়ে মেয়েকে বলল, ‘তুমি ঘরে যাও।’
— ‘ও কোথাও যাবে না! আমার কথা শেষ হয়নি এখনো।’ স্পর্ধিত কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে জাহিদ মেয়ের দিকে এগিয়ে এসে খপ করে ধরল একটা হাত। উত্তেজিত, ভীত, এবং যন্ত্রণাবিদ্ধ করুণ চোখে তুরিন একবার মায়ের দিকে এবং বাবার দিকে তাকাল। ফারার গালের চামড়া ভীষণ সাদা দেখাচ্ছে। কোটর থেকে আরেকটু হলেই বেরিয়ে পড়বে চোখের ডিম। হাত- পায়ের কাঁপনটা ধরা পড়ছে স্পষ্টভাবে। নিশা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করছিল ওকে। এত ভয় পাবার মতো হঠাৎ কী ঘটনা ঘটল? এই মহিলা অযথা এত ভয় পাচ্ছে কেন?
— ‘তোমার মাকে প্রশ্ন কর অনিমেষের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক?’
তুরিন প্রশ্নটা শুনল ঠিকই…কিন্তু বাক্যগুলো যেন তার মস্তিষ্কে কোন অর্থের অনুরণন ঘটাতে সক্ষম হলো না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। ফারা অস্থিরভাবে বলল, ‘বাজে কথা বলো না জাহিদ! অনিমেষ আমাদের বন্ধু! ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। ঠিক যেমন তোমার। এটা তো সবাই জানে!
জাহিদ ফারার কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে তুরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার মা মিথ্যে বলছে। অনিমেষের সঙ্গে তার…’ জাহিদ বড় একটা শ্বাস ফেলে চোখ নামিয়ে নিল নিচে। জমাট, গম্ভীর অথচ সুস্পষ্ট গলায় বলল, ‘সত্যটা হলো অনিমেষের সঙ্গে ওর অ্যাফেয়ার চলছে অনেকদিন ধরে। জানি কথাটা শুনতে তোমার খারাপ লাগছে…হয়তো বিশ্বাস হচ্ছে না…কিন্তু তুরিন…লক্ষ্মী মা আমার…ইউ নিড টু বি স্ট্রং…সত্যকে গ্রহণ করার মতো যথেষ্ট শক্তি ধারণ করতে হবে বুকে।’
কথাগুলো বলতে বলতে জাহিদ মেয়েকে নিজের কাছে টেনে আনার চেষ্টা করল। তুরিন এক ঝটকায় বাবার হাতটা দূরে সরিয়ে দিল। অবিশ্বাস ভরা অপ্রকৃতস্থ চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ বাবার দিকে। তারপর মায়ের দিকে ঘুরে চাপা গলায় বলল, ‘এসবের মানে কী?’
ফারাকে দেখে মনে হচ্ছিল মাঝ সমুদ্রের উত্তাল ঝড়ে তাকে একলা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অস্বাভাবিক ভীতির আক্রমণে কণ্ঠস্বর রোধ হয়ে এসেছে তার। হাঁটু কাঁপছে ঠকঠক করে। জাহিদ এভাবে কথাটা সরাসরি তুরিনকে বলে বসবে এটা ছিল ধারণার বাইরে। সে ভেবেছিল অন্তত মেয়ের জন্য হলেও লোকটা মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করবে…মানিয়ে নেবে…সংসার ভাঙবে না।
নিশা এই চমকের জন্য প্রস্তুত ছিল না। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, বিস্ফারিত বদনে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। জাহিদ তুরিনের হাতটা আরো একবার ধরল শক্ত করে, অনেকটা ফিসফিস করে বলল, ‘আই ওয়ান্ট ইউ টু বি ব্রেভ নাউ…ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? ইউ হ্যাভ টু ফেস দ্য ট্রুথ, ইভেন ইফ ইট হার্টস আ লট… ফারা হঠাৎ গগনবিদারী চিৎকার করে উঠে বলল, ‘মিথ্যা কথা বলছে তোমার বাবা। সব মিথ্যা…নিশাকে যেন ডিভোর্স দিতে না হয় সেইজন্য এসব মিথ্যা নাটক সাজাচ্ছে! নিশা আর তোমার বাবা মিলে দুজনে প্ল্যান করে আমাকে ফাঁসাতে চাইছে।’
তুরিন পাংশুবর্ণ, বিকারগ্রস্ত চোখে বাবা-মায়ের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তারপর প্রাণহীন, মৃত গলায় কেটে কেটে বলল, ‘আই হেইট ইউ বোথ…নোংরা…ভীষণ নোংরা তোমরা…ঘেন্না হয় আমার!’
কথাটা বলেই ঘূর্ণির মতো উল্টো দিকে ঘুরে একটা দৌড় দিল তুরিন। সিঁড়ির গোড়ায় আনিতা দাঁড়িয়ে ছিল। তুরিনকে আসতে দেখে চট করে অন্যদিকে সরে গেল।
ফারার চোখের কার্নিশ তখন চুপচুপ করছে জলে। জাহিদের দিকে কটাক্ষ করে বলল, ‘কাজটা তুমি ঠিক করলে না!’ কথাটা ছুঁড়েদিয়েই তুরিনের পেছন পেছন দৌড়ে গেল সে। জাহিদ অসহায় ভাবে একবার তাকাল নিশার দিকে। ঝড়ের ঝাপটা আর অগ্রাহ্য করা গেল না। মুষড়ে পড়া কাটা গাছের মতো ঝপ করে বসে পড়ল সোফার ওপরে। বিষাদ জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘সরি নিশা…সব কিছুর জন্য আমি অনেক অনেক সরি… তুরিনের হয়ে আমিই তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি। ক্ষমা করে দিও প্লিজ। আমার মেয়েটা এখনো ছেলেমানুষ … ম্যাচিওরিটি জিনিসটা ওর মধ্যে একেবারেই গ্রো করেনি…’
নিশা ধীর পায়ে হেঁটে এসে জাহিদের পাশে বসল। ‘আমাকে নিয়ে ভাববেন না। আমি ঠিক আছি।’
জাহিদ পলক তুলে চাইল নিশার দিকে। এতকিছুর পরেও কী করে এতটা ধীর, শান্ত এবং স্নিগ্ধ থাকে মেয়েটা? জাহিদের অসহায়, ব্যথিত চোখের চাউনি দেখে কেমন মায়া হলো নিশার। ওর হাতের ওপরে একটা হাত রাখল সে। মৃদুস্বরে বলল, ‘আপনি ভেঙে পড়বেন না একদম! আমি জানি আপনি আপনার বড় মেয়েকে অনেক ভালোবাসেন। ওকে কেউ আপনার কাছ থেকে দূরে সরাতে পারবে না। আল্লাহ ভরসা।’
জাহিদ একটা ঘন শ্বাস ফেলে বলল, ‘মেয়েকে ধরে রাখতে গিয়ে যদি তোমাকে ছেড়ে দিতে হয়…সেটা আমি সহ্য করতে পারব না নিশা! আবার তুরিন আমাকে ঘৃণা করছে.. এমন কোন পরিস্থিতি আসার আগে যেন আমার মৃত্যু হয়!’
— ‘এসব বাজে কথা বলবেন না। তুরিন আপনাকে অসম্ভব ভালোবাসে। রাগের মাথায় আমরা অনেক কিছুই বলে ফেলি যেসব কথার আসলে কোন অর্থ হয় না।’
এরপর ওরা কেউ আর কোন কথা বলল না। চুপচাপ বসে রইল একে অপরের হাতে হাত রেখে। এক সময় নিশা নিজের মাথাটা জাহিদের কাঁধের ওপর হেলিয়ে দিল আস্তে করে। চোখ বন্ধ করল। হারিয়ে যাওয়া শান্তির মেঘেরা হৃদয়াকাশে ফিরে এলো পায়ে পায়ে। নিঃশ্বাস ভরে গেল কুসুমগন্ধি স্বস্তির পেঁজাতুলো স্পর্শে। মনে হলো বেঁচে থাকাটা অতটাও খারাপ নয়!
.
তুরিনের ঘরের দরজা বন্ধ। টানা পাঁচ মিনিট দরজায় ধাক্কা দিয়ে গেল ফারা। মেয়ের কোন সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ মনে পড়ল আজ বিকেলে অনিমেষ এসেছিল শাহজিদের ঘরে। লোকটা আবার কোন জট পাকিয়ে গেছে কে জানে! কথাটা মনে হতেই দ্রুত পায়ে নিচে নেমে এলো ফারা। শাহজিদের সঙ্গে এই মুহূর্তে কথা বলাটা তুরিনের রাগ ভাঙানোর চাইতে আরো অনেক বেশি জরুরি।
পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে তাকাল শাহজিদ। সিঁড়িঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে। ঘন অন্ধকারের প্রলেপ ভেদ করে ক্রমশ একটা ছিপছিপে দেহ ল্যাম্পশেডের পিঙ্গল আলোয় দৃশ্যমান হয়ে উঠল। বাইরে ঝিম ধরা সন্ধ্যা। ব্যাকইয়ার্ডে কয়েকটা বাদুড় উড়ছে ছন্নছাড়াভাবে। কলোরাডোতে পোকার উপদ্রব নেই। জোনাকিও জ্বলে না। বাদুড়গুলোই সন্ধ্যার পর থেকে উড়াউড়ি করে এলাকাবাসীকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে ফেলে। শাহজিদ ব্যাকইয়ার্ডের দরজার সামনে হুইলচেয়ার নিয়ে বসে ছিল। আড়চোখে ফারাকে দেখতে পেয়ে চেয়ারটা ঘুরিয়ে নিল।
— ‘কেউ এসেছিল?’
ভূমিকাবিহীন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নটা শাহজিদের কপালে অনভিপ্রেত ভাঁজ ফেলল। ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘কারো আসার কথা ছিল নাকি?’
ফারা তীব্র চোখে তাকাল শাহজিদের দিকে। সে খুব ভালো মতোই জানে খোঁড়া, ল্যাংড়া যাই হোক না কেন এই ছেলে আদতে সহজ বস্তু নয়। চূড়ান্ত চালাক! দুনিয়ায় এত লোক থাকতে অনিমেষ এই ধূর্ত এবং অভদ্র ছেলেটার কাছে কেন গোপন অভিসারে এলো, এটাই তার মাথায় ঢুকছে না। ফারার ফ্যাকাসে মুখখানার দিকে অটল, স্থবির চোখে চেয়ে ছিল শাহজিদ। একটা ইট রঙের টপ আর ব্লু জিন্স ওর পরনে। হাই হিল জুতো। খোলা চুলের নিচের দিকটা কোঁকড়ানো। বেশ ফ্যাশন্যাবল দেখাচ্ছে। চোখের দিকে তুরিনের সঙ্গে বেশ মিল! কিন্তু তুরিনের মতো স্নিগ্ধ নয়। মুখের ছাঁচ যেমনই হোক না কেন রূপের বিশুদ্ধতা আসলে নির্ভর করে মনের স্বচ্ছতার ওপরে। এই চিরন্তন সত্যটা যেন নতুন রূপে আরো একবার অনুভব করল শাহজিদ। ফারার বাইরের চটক যতই আকর্ষণীয় হোক না কেন, ভেতরকার কুৎসিত কদর্যতা ওর সমস্ত অস্তিত্বকে কলুষিত করে তুলেছে। ফারা একটা বড় শ্বাস টেনে নিয়ে সরাসরি বলল, ‘অনিমেষ এসেছিল এখানে?
— ‘সেই কৈফিয়ত আমার আপনাকে দিতে হবে?’
ফারা দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘কী কথা হয়েছে ওর সঙ্গে তোমার?’
শাহজিদ হাসল…গা শিউরে ওঠা, ঠান্ডা কনকনে হাসি। ভয়ের একটা শিরশিরে কাঁপন লাগল ফারার হৃৎপিণ্ডে। অধৈর্য হয়ে বলল, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দাও!’
— ‘এত ভয় পাচ্ছেন কেন? ভয়ের কিছু নেই…আমি আপনার সিক্রেট আপাতত কাউকে বলছি না।’
এ কথা শোনামাত্র ফারার মুখটা নীল হয়ে উঠল যন্ত্রণায়। চোখে ঝাপটা দিল অনিশ্চয়তার ঢেউ। ঠোঁট প্রেতাত্মার মতো সাদা। ইচ্ছে হলো অনিমেষের গলায় পাঁচ আঙুল চেপে ধরে খুন করে। কেন লোকটা তার এত বড় সর্বনাশ করল! এতগুলো বছর ধরে তিলতিল করে নিজের মেয়ের জন্য সাজানো- গোছানো পরিপাটি একটা সংসার গড়ে তোলার নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস চালিয়ে গেছে ফারা। কত যুদ্ধ, কত সংগ্ৰাম, কত জ্বলন্ত মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয়েছে এই সংসারটা ধরে রাখার জন্য। আজ অনিমেষ তার এত বছরের সংগ্রামকে এক লহমায় গুঁড়িয়ে দিয়ে গেল।
— ‘তুমি এখনো এ বাড়িতে পড়ে আছ কেন? তোমার না চলে যাওয়ার কথা ছিল?’
শাহজিদ ঠোঁটে ঠান্ডা হাসিটা ধরে রেখেই ঠান্ডা গলায় বলল, ‘আমি তো চলে যেতেই চেয়েছিলাম। আপনার মেয়ে যেতে দিল না। ভুলে গেছেন?’
ফারার মাথাটা পাগল পাগল লাগছিল। মনে হচ্ছে যেন একটা সাইক্লোন ঘুরছে চারপাশে। এখুনি তার সমস্ত অস্তিত্বসহ উপড়ে নিয়ে ছুঁড়েফেলবে দূরে। আতঙ্কে শুকিয়ে গেছে গলা। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে সে কোন রকমে বলল, ‘তুমি এখুনি বের হও। এখানে থেকে কাজ নেই আর।’
— ‘কাজ আছে।’ শাহজিদ বলল, গলায় অশনির কাঁপন তুলে।
— ‘কী কাজ?’ নিঃশ্বাস থেমে গেছে ফারার।
শাহজিদ ফারার চোখে চেয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘আপনার মেয়ে আমাকে ভালোবাসে, জানেন তো, তাই না?’
ফারার মনে হলো কথা নয়, যেন গাল বরাবর কেউ জুতো পেটা করল এইমাত্র! তীব্র রোষে গজগজ করে উঠে বলল, ‘তুরিন একটা বেকুব মেয়ে। ওর তোমার প্রতি কোন ফিলিংস নেই। তুমি চোখের সামনে থেকে বিদেয় হলেই দিব্যি ভুলে যাবে। তোমার মতো অথর্ব একটা ছেলের কথা ওর মনেই থাকবে না।’
শাহজিদ ডান গালে জিব ঠেকিয়ে কিছু একটা চিন্তা করল গভীরভাবে তারপর হালকা হেসে বলল, ‘তুরিনের ফিলিংস আছে কি নেই সেটা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।
— ‘মানে? কী বলতে চাইছ তুমি?’
— ‘তুরিনকে একটা কঠিন সত্যের সম্মুখীন হতে হবে খুব শিগগিরই। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু লিভ হার এলোন অ্যাট দিস টাইম। পাশে থাকতে চাই।’
ফারার বুকের সমস্ত রক্তপ্রবাহ স্তব্ধ হয়ে এলো হঠাৎ। ফুলে উঠল কপালের নীল শিরা। সাদা…ভীষণ সাদা আর ফ্যাকাসে দেখাতে লাগল তাকে। শরীরের কম্পনটা এতই ব্যক্ত হয়ে ফুটে উঠল যে শাহজিদের মনে হলো সামনে দাঁড়ানো মানুষটা মৃগী রোগে আক্রান্ত।
— ‘কী বলছ এসব? কীসের সত্য?’ অপ্রস্তুত, অপ্রতিভ এবং ভীত ফারা একটু হাসার চেষ্টা করে। গলার স্বর স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বলে, ‘ফাজলামোর একটা সীমা থাকা উচিত।’
শাহজিদ কিছু বলে না। মুখে সেই দুর্বোধ্য ঠান্ডা হাসি ঝুলিয়ে রেখে অকপটে চেয়ে থাকে ফারার উদ্ভ্রান্ত, ফ্যাকাসে মুখখানার দিকে। উত্তেজনায় ফারার ঘাম হতে থাকে। ফরসা কপাল ভরে যায় চূর্ণ কাচের মতো ঘাম বিন্দুতে। ভীষণ ধুকপুক করতে থাকে বুকটা। মনে হয় এখুনি বুঝি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া থমকে যাবে। রুদ্ধশ্বাসে বলে, ‘আমার মেয়ের জীবনে কোন গোপন সত্য নেই। আমার বিরুদ্ধে অযথা ষড়যন্ত্র কোরো না। এর ফল ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে গলার স্বর প্রায় বুজে আসে তার। দুর্ভাবনার বিশ্রী একটা দম-আটকানো স্রোত বয়ে যায় মনের ওপর দিয়ে। অনিমেষ কেন এসেছিল শাহজিদের কাছে? নিজের জীবনের কদর্য গোপন সত্য অচেনা এক অথর্ব গোঁয়ার যুবকের সামনে মেলে ধরার পেছনে কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? অনিমেষ…অনিমেষ …অনিমেষ…! এই মুহূর্তে অনিমেষকে সামনে পেলে হিংস্র নেকড়ের মতো ওর শরীরের সমস্ত মাংস আর হাড়গোড় ছিন্নভিন্ন করে তুলত! ফারা অপ্রকৃতস্থ ভঙ্গিতে কয়েক পা এগিয়ে আসে, ‘তুমি বেরিয়ে যাও এখুনি।’
শাহজিদ হাসে, ‘ভয় পাচ্ছেন?’
প্রচণ্ড রাগ হয় ফারার। রাগের বিভীষণ ঝাপটায় অন্ধ হয়ে আসে চোখ। চিৎকার করে বলে, ‘ভয় তো তোমার পাওয়া উচিত…তোমার কোন ধারণাই নেই এর পরিণতি কী কঠিন হতে পারে!’
— ‘কী করবেন শুনি? খুন করবেন?
— ‘প্রয়োজনে তাই-ই করব!’ শাহজিদ হেসে ওঠে শব্দ করে। সেই অট্টহাসির দিকে চেয়ে থেকে শিউরে ওঠে ফারার সর্বাঙ্গ। গলায় নিঃশ্বাস আটকে যায়। কম্পিত বক্ষ নিয়ে সে অবলোকন করে, এলোমেলো চুলের সবল মুখের যুবকটির মধ্যে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। হ্যাজেল রঙের চোখজোড়া থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে আত্মবিশ্বাস এবং সাহস। মুখের উঁচু হাড়ে ঝিলিক দিচ্ছে অহংকার। আশ্চর্য! জীবনের কাছে হেরে যাওয়া ব্যর্থ, পঙ্গু, অসহায় এক মানুষের মধ্যে এত অহংকার আসে কোত্থেকে? ফারা জানত, অর্থ এবং প্রাচুর্যই মানুষের অহংকারের মূল উৎস। এই ছেলের ধনাঢ্যতা নেই, এমনকি শারীরিক সুস্থতাও নেই। দু পায়ে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই। এর অহংকারের উৎস কী? ফারা শরীর জোড়া ভীতির সঞ্চার নিয়ে কয়েক পা পিছিয়ে আসে। দ্রুত এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। তার মনে হয় হাতে খুব বেশি একটা সময় নেই। টিকটিক করে এগিয়ে যাচ্ছে কালঘড়ি। যত দ্রুত সম্ভব এই বেপরোয়া যুবকটির হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে। পেছন থেকে শাহজিদের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে,
— ‘আমার নতুন করে কিছু হারাবার নেই। আমি জানি পৃথিবীতে মৃত্যুই একমাত্র ধ্রুব সত্য। আর সত্য আমার চোখে সবসময়ই সুন্দর। তাই মরার কথা শুনলে আমার ভয় করে না।’
কথাগুলো বলতে বলতে শাহজিদ একটু অন্যমনস্ক হয়। নিজের অজান্তেই জিব ঠেকে যায় ডান গালে। কপালে মৃদু কুঞ্চন পড়ে। টের পায় মাত্র বলা কথাটার মধ্যে কিছু একটা গড়মিল আছে। পার্থিব টানাপোড়েন থেকেই তো দুশ্চিন্তার উদ্রেক হয়, দুশ্চিন্তার ডানায় ভর দিয়ে একে একে আসে অনিশ্চয়তা, শঙ্কা এবং ত্রাস। শাহজিদের নিজেকে নিয়ে কোন দুর্ভাবনা বা দুশ্চিন্তা নেই। তার চিন্তা হচ্ছে তুরিনকে নিয়ে। মানুষ জন্মগতভাবে যেসব দুর্বলতা নিয়ে জন্মায় তার মধ্যে বিশেষ হলো বাৎসল্য, মায়া মমতা এবং ভালোবাসা। শাহজিদের আপন বলতে কেউ নেই বলে বাৎসল্যের দুর্বলতা থেকে সে চিরমুক্ত। তুরিন তার রক্তের সম্পর্কের কেউ নয়। কিন্তু মেয়েটির জীবনের আসন্ন ঝড়কে কেন্দ্র করে শাহজিদের মনে যে আতঙ্কের সঞ্চার হয়েছে তা নিছক মানবিকতা নয়। অন্যরকম কিছু। অথচ প্রেমে হাবুডুবু খাবার মতো আকর্ষণীয় কোন মেয়ে তুরিন নয়। রূপের চটক আছে। কিন্তু শুধু রূপের মোহে আটকে যাবে এমন ঠুনকো ব্যক্তিত্ব শাহজিদের ছিল না কখনো। শাহজিদ হয়তো সেভাবে আটকায়নি এখনো। তবুও হৃদয়ের কোন এক জংধরা তার বোকাসোকা, ধারহীন, মাথামোটা, পাগল তুরিনের মনের তারের সঙ্গে দৈবক্রমে গিঁট খেয়ে গেছে। এটা কেন হয়েছে জানে না শাহজিদ…হয়তো তার কেউ নেই বলে…হয়তো তার আশাহীন, বান্ধবহীন, স্বপ্নহীন ধু-ধু মরুভূমির মতো বৈরাগ্যময় অন্ধকার জীবনে তুরিন…একমাত্র তুরিনই প্রভাতের আলো জ্বালানোর নিরলস চেষ্টা করেছে। তার যদি একটা স্বাভাবিক জীবন থাকত। যে জীবনে বাবা-মা থাকে, মনের মতো বন্ধু থাকে, ঝকঝকে প্রাণবন্ত তরুণীদের সান্নিধ্য থাকে, বেঁচে থাকার বাসনা থাকে…সেই জীবনটা কাছে পেলে হয়তো তুরিনের মতো নির্বোধ, ছিটিয়াল একটা মেয়েকে নিয়ে চিন্তারই অবকাশ থাকত না। নিজেকে বড়ই দুর্বোধ্য মনে হয় শাহজিদের। মাথাটা গোলমেলে লাগে। ভাবনার নৌকাটা যেন ফেনিল সমুদ্রের বিশাল পেটমোটা এক ঢেউয়ের ওপর দিশাহারা হয়ে দুলতে থাকে। ফারা কখন নিষ্ক্রান্ত হয়েছে খেয়াল করেনি শাহজিদ। ঝিম ধরে বসে ছিল। বসেই রইল একটানা। এক সময় দুচোখে তুলোর মতো ঝরঝর করে নেমে এলো ঘুমের নেশা। ঘাড়টা একটু কাত হয়ে হেলে পড়তেই ছুটে গেল নেশাটা। ঘোরসর্বস্ব, অস্পষ্ট মস্তিষ্ক নিয়ে টের পেল তার সর্বাঙ্গে বিন্দু বিন্দু জলের মতো লেগে আছে ঝাপসা কিছু পার্থিব দুর্বলতা। ভেতর থেকে এক অদৃশ্য সত্তা হুংকার ছাড়ে, ‘ঝেড়ে ফেল এই দুর্বলতার নোংরা জল। তোমার জন্য অপেক্ষা করছে বরফকুচি ছড়ানো সাদা রঙের এক বিশুদ্ধ মৃত্যু! সেই মৃত্যুকে স্বেচ্ছায় আলিঙ্গন কর। জিতে যাও জীবনযুদ্ধে। তুরিনের মতো একটা বিশিষ্টতাহীন, সাধারণ মেয়ের জন্য তুমি হেরে যাবে? মৃত্যুর অমোঘ পরিণতিকে ভয় পাবে? তুরিন কি তোমার যোগ্য? না আছে বুদ্ধি, না আছে ব্যক্তিত্ব…।
হঠাৎ মনে পড়ে প্রথম দেখার দিনটির কথা। শাহজিদের তখন আস্ত দুটো পা ছিল। টগবগে যৌবন ছিল। সুন্দরী, মেধাবী, আকর্ষণীয় গার্লফ্রেন্ড ছিল তবুও সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে থেকে বারো হাজার ফিট ওপরে…রকিমাউন্টেনের চূড়োয়…সূর্যের ঝলসানো আলোর নিচে…বোকা বোকা, নরমসরম, খরগোশের মতো আদুরে তুরিনকে দেখে তার মনে হয়েছিল জীবনে এমন পবিত্র বস্তু সে আগে কখনো দেখেনি। ঘুমঘোরের নেশারু দুটি চোখের সামনে তুরিনের তুলতুলে মুখখানা অনেকক্ষণ অবধি স্থির হয়ে থাকে। হঠাৎ মনে হয় এই মেয়েটার খারাপ কিছু হয়ে গেলে সে বাঁচবে না। আশ্চর্য…এর মাঝেই মনের মধ্যে বাসা বঁধেছে মৃত্যুভয়? সর্বনাশ!
.
তুরিনের চড় খাবার পর যতটা অপমানিত বোধ করার কথা ছিল, যতটা ভেঙে পড়ার কথা ছিল ততটা কিন্তু ভাঙল না নিশা। বরং মনের কোনায় কোনায় একটা চোরা আনন্দের ঢেউ কলকল করে বয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিল সে। সেই শব্দ যখনই কানে এসে লাগছে লজ্জায় সংকুচিত হয়ে উঠছে। নিজেকে বড়ই ছোট মনে হচ্ছে। তার জন্যেই এই সংসারে ভাঙন ধরেছে। সারা বাড়িতে জ্বলছে অশান্তির আগুন। কিন্তু শুনতে খারাপ লাগলেও একথা সত্য যে এই আগুন নিশাকে এক রত্তিও পোড়াচ্ছে না। লোকটা যে আজ ফারার সামনে, তুরিনের সামনে নিশার পক্ষ নিয়ে কথা বলেছে, তুরিনের গায়ে হাত তুলতেও দ্বিধা বোধ করেনি এই একটুখানি ঘটনা নিশাকে দিয়েছে অপার আশ্রয়ের সন্ধান। আজ আর কোন দুঃখ নেই। এতটুকুই চেয়েছিল সে স্রষ্টার কাছে। ভালোবাসার মানুষটার বুকে নিজের জন্যে একটুখানি উর্বর জমি। আজ সেই জমিনটুকুর হদিস পেয়ে জীবনটাকে নির্মল, ভর-ভরন্ত, অলৌকিক বিকেলের মতো সুন্দর মনে হচ্ছিল তার। জুবিন কার্পেটে থপথপ করে কোমল কমজোর পা ফেলে হেঁটে বেড়াচ্ছিল। হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল…আবার উঠে দাঁড়াচ্ছিল। নিশা মেয়েকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুনি চালাচ্ছে আলতোভাবে।
ঠিক সেই সময় শব্দটা কানে ভেসে এলো।
চমকে ওঠা হৃৎপিণ্ড নিয়ে নিশা বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। হলওয়েতে ফারা দাঁড়িয়ে আছে। তুরিনের বেডরুমের দরজায় আঘাত করছে উপর্যুপুরি। নিশার পায়ের শব্দ পেয়ে চট করে ঘুরে তাকাল। বুকের পাঁজরে একটা কাঁপন টের পেল নিশা। ফারার চোখ দুটো টকটকে লাল, চুল এলোমেলো। চোখের চাউনি অতৃপ্ত প্রেতাত্মার মতো উৎকট। ঘটনা ঘটল খুব দ্রুত। ফারা হাওয়ার চাইতেও ক্ষিপ্র গতিতে ছুটে এসে নিশার গলায় হাতের দশটা আঙুল চেপে ধরল। দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, ‘আমার মেয়ে যদি আজকে সুইসাইড করে…তোমাকে আমি মেরে ফেলব। খুন করে ফেলব…!’
আক্রমণের ধাক্কায় নিশা কয়েক পা পিছিয়ে গেছে। দেওয়ালে ঠেকে গেছে মাথা। ফারার হাতের দশটা আঙুল ওর কণ্ঠনালিতে ক্রমেই চেপে বসছে সাঁড়াশির মতো। চোখ বেরিয়ে আসছে কোটর থেকে।
.
তুরিনের বেডরুমের দরজাটা হুট করে খুলে গেল।
— ‘মা!’
মেয়ের ডাকে সংবিৎ ফিরল যেন ফারার। নিশার গলার ওপর থেকে ধীরে ধীরে সরে এলো দুটি হাত।
ঘাড় ঘুরিয়ে নিতেই তুরিনের চোখে চোখ পড়ল…আর ঠিক তখনই… যে কান্নাটা অনেকক্ষণ অবধি বুকের চার দেওয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে বেরোবার কোন পথ পাচ্ছিল না…সেই অসহায় কান্নাটা হঠাৎ দু চোখের অর্গল খুলে বেরিয়ে এলো ঝরঝরিয়ে। স্খলিত পদব্রজে মেয়ের দিকে এগিয়ে এলো সে। জাপটে ধরল দু হাত বাড়িয়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তুমি ঠিক আছ? দরজা খুলছিলে না কেন? ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি।’ এদিকে নিশা সাক্ষাৎ যমের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে উপর্যুপরি কেশে যাচ্ছিল। তার চোখ দুটি টকটকে লাল। জিব বের করে বড় বড় শ্বাস নেবার চেষ্টা করছে। সেই সময় জাহিদের আবির্ভাব হলো দৃশ্যপটে। নিশার প্রায় মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া মুমূর্ষু, পাণ্ডুবর্ণ মুখখানার দিকে পলক পড়তেই ভীষণ চমকে উঠল সে। সেই চমকের পাল্লায় ঢেউ লাগল অনতিদূরে দাঁড়িয়ে থাকা মা-মেয়ের কান্নাকাটির অবেগঘন দৃশ্যটি দৃষ্টিগোচর হওয়ার পর। স্তম্ভিত কণ্ঠে বলল, ‘কী হচ্ছে এখানে?
ফারার মাথাটা তুরিনের বুকের সঙ্গে লেপটে আছে। মাকে লম্বায় ছাড়িয়ে গেছে তুরিন। এই মুহূর্তে তাকে বেশ পরিণত বয়স্ক এক যুবতী বলে মনে হচ্ছে। খর্বকায় দুটি চোখ কিঞ্চিৎ রক্তাভ। ধবধবে ফরসা গালে নীল শিরা জেগে আছে দ্বীপের মতো। নাকের ভাঁজে চিকচিক করছে ভয়শূন্য এক দুর্বিনীত স্পর্ধা। ফারার চোখের জলে ভিজে গেছে তার টি-শার্টের গলা। কেমন নিঃস্পৃহ, শীতল দৃষ্টিতে একবার জাহিদের দিকে তাকাল তুরিন। মেয়ের চোখে এমন বিতৃষ্ণা এর আগে কোনদিন দেখেনি জাহিদ। তার বুক কেঁপে উঠল দুয়ে আশঙ্কায়। তুরিন মায়ের মাথাটা তুলে ধরল শক্ত হাতে। হলওয়েতে জ্বলতে থাকা ফকফকে এলইডি বাল্বের সাদা আলোর নিচে, ফারার ক্রন্দনরত দলিত পেষিত এলোমেলো মুখের দিকে চেয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘কাঁদছ কেন বোকার মতো? কেঁদে লাভ নেই। যাও রেডি হয়ে নাও। আমরা আজকেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।’
ফারা কাঁদতে ভুলে গেল সেই মুহূর্তে। ফ্যালফ্যাল করে কয়েক সেকেন্ড মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে আশ্চর্য গলায় বলল, ‘কী বলছ এসব?’
— ‘যা শুনতে পেয়েছ ঠিক তাইই বলেছি। এখানে আমি আর একটা দিনও থাকতে চাই না।’তুরিন কথাটা বলতে বলতে জাহিদ আর নিশার দিকে তীর্যক চোখে তাকিয়েছিল একবার। তারপর আগের চাইতেও ধারাল গলায় কেটে কেটে বলেছে, ‘আমার মায়ের অপমান আমি আর সহ্য করতে পারব না। তোমাকে স্ট্রং হতে হবে মা! যে লোক তোমার ভালোবাসার বিন্দুমাত্র দাম দেয়নি…সেই লোকের সংসারে তোমার আর থাকার প্রয়োজন নেই।’
ফারা কান্নার ঢোক গিলল, ‘পাগলের মতো কথা বলো না তুরিন!
‘আমি পাগলের মতো কথা বলছি? নাকি তুমি বছরের পর বছর শেমলেসের মতো কাজ করে যাচ্ছ? যে লোক তোমার সঙ্গে বিট্রে করেছে, ঠকিয়েছে…অন্য মেয়ের সঙ্গে শুয়েছে…এমনকি সেই মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে স্বীকৃতিও দিয়েছে…সেই প্রতারক, ক্যারেক্টারলেস, বাজে লোকটার বাড়িতে নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে হ্যাংলার মতো পড়ে থাকতে তোমার লজ্জা করে না?’
একটা উদ্ভ্রান্ত ব্যথা জাহিদের বুকের পাঁজর ভেদ করে ধারাল ছুরির মতো একদম রুহের মধ্যিখানে গিয়ে বিদ্ধ হলো। তীব্র যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল সে। নিজের কলিজার টুকরা মেয়ের মুখ থেকে নিজেরই সম্বন্ধে এমন বিদ্বেষপূর্ণ বিরূপ মন্তব্য শোনার আগে তার মৃত্যু কেন হলো না? যন্ত্রণায় ওর মুখটা নীল হয়ে গিয়েছিল। সেই মুখের দিকে তাকানো মাত্র নিশার বুক মোচড় দিয়ে উঠল। আর কেউ না জানলেও সে তো জানে মানুষটা তুরিনকে জীবনের চাইতেও বেশি ভালোবাসে।
ফারা চোখের জল মুছে নিয়ে সচেতন দৃষ্টিতে একবার চারপাশটা দেখে নিল। গলার স্বর এক ধাপ নিচে নামিয়ে বলল, ‘এসব নিয়ে পরে কথা হবে। এখন ভেতরে চলো।’
তীব্র রোষে হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে তুরিন, ‘এতকিছুর পরেও তুমি কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছ না? তুমি কি মানুষ?’ মেয়ের নির্বুদ্ধিতা আর বোকামো দেখে ফারার মাথা ঘুরে যাচ্ছে। এতক্ষণ মেয়েটার জন্য তার দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, কষ্ট হচ্ছিল, মায়া হচ্ছিল। কিন্তু এখন মেয়ের এই অযৌক্তিক, ভিত্তিহীন কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে মাথায় একটা জোরেশোরে গাট্টা বসিয়ে দেয়। এত করে পাখি পড়ার মতো শেখানো হলো বেকুবটাকে, বুঝিয়ে দেওয়া হলো কীভাবে ছলে-বলে-কৌশলে নিজের বাবাকে আয়ত্তে আনতে হবে। প্রয়োজনে সুইসাইড করার অভিনয়ের ব্যাপারেও প্ল্যান করা আছে। সঙের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আজেবাজে কথা না বলে বিষ খাওয়ার ভান ধরে বিছানায় পড়ে থাকলেও তো কাজের কাজ হতো। মেয়ের মরণ দশা দেখে জাহিদ আজকেই বাধ্য হয়ে নিশাকে ডিভোর্স দিয়ে দিত। রাগে ফারার সারা শরীর চিড়বিড়িয়ে ওঠে। বিগত বছরগুলো অহোরাত্র সর্বপ্রকার হীনতা এবং লাঞ্ছনা সহ্য করে দাঁত কামড়ে এখানে পড়ে আছে শুধু তুরিনকে একটা সভ্য, মার্জিত পরিবারের অংশ করে তুলে করার জন্য। অনিমেষের মতো ভবঘুরে, উচ্ছন্ন লোকের বাচ্চা পেটে আসার পরেই ফারা বুঝতে পেরেছিল এই লোক স্ত্রী-সন্তানের যোগ্য মর্যাদা কোন দিন দিতে জানবে না। অনিমেষের একরোখা ধাত। এমন পুরুষের সঙ্গে প্রেম হয়…সংসার না। এত সংগ্রাম, এত ত্যাগ আর এত অপেক্ষার পর নিশার মতো সস্তা, আনসিভিলাইজড, গ্রাম্যমেয়ের কাছে ফারা হেরে যাবে? তুরিনের মাথাটা কি পুরোপুরিই গেছে?
— ‘নির্লজ্জ আমি নই। নির্লজ্জ তাকে বলে যে বাইরে থেকে উড়ে এসে অন্যের সংসার ভাঙে। আমি আমার সংসার ছেড়ে কোথাও যাব না।’
তিরস্কারের এক নিদারুণ গাঢ় ছায়া পড়ল তুরিনের চোখে। মাকে সে এতকাল আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আধুনিক নারী বলেই জানত। ছোটবেলা থেকে মায়ের প্রতি তিলেতিলে গড়ে ওঠা সম্মান, মর্যাদা, শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি সমস্তটাই যেন এক লহমায় ধূলিসাৎ হয়ে পড়ল। বিতৃষ্ণায় কুঁকড়ে গেল মুখ। নিজের গর্ভধারিণী মাকে তার এই মুহূর্তে ঘৃণিত ভিখারিনি মনে হলো। অনিমেষের ব্যাপারে জাহিদের বলা কথাটা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। সত্যিই কি অনিমেষের সঙ্গে মায়ের কোন অনৈতিক সম্পর্ক আছে? থেকে থাকলে এই সংসার ছেড়ে চলে যেতে এত আপত্তি কেন? অনতিদূরে দাঁড়িয়ে আছে জাহিদ আর নিশা। পাশাপাশি, কাছাকাছি। ওদের দিকে একবার বিষদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঝড়ের বেগে বেডরুমে ঢুকে গেল তুরিন। দড়াম শব্দে দরজা আটকে দিল সবার মুখের ওপর।
.
জুবিন অনেকটা সময় একলা আছে ঘরের ভেতর। মেয়ের কথা ভুলেই গিয়েছিল নিশা। মনে পড়তেই তড়িঘড়ি করে ছুটে এলো। দেখা গেল কার্পেটে হামাগুড়ি দিচ্ছে জুবিন। তার পরনের ঘেরওয়ালা সুন্দর জামাখানি কুঁচকে বুচকে যাচ্ছে। আজকে বাবা-মার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল জুবিনরানির। তা আর হলো না। মেয়েকে কত যত্ন করে সাজিয়েছিল নিশা। সেজেছিল নিজেও। কেন যে তার ভাগ্যে সুখ সয় না কে জানে! এত মন্দ ভাগ্যও মানুষের হয়?
জুবিন মেঝে থেকে কিছু একটা তুলে নিয়ে মুখে দিচ্ছিল। এই এক বাজে অভ্যাস মেয়ের। যা পায় তাই মুখে দেয়। নিশা ওর হাত থেকে জিনিসটা ছিনিয়ে নিল। বকাও দিল হালকা। মেয়েকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরোলো। বেরোনো মাত্র একটা শোচনীয় দৃশ্য বিদ্যুৎচমকের মতো ঝলসে উঠল চোখের সামনে। সে দেখল জাহিদ তুরিনের ঘরের সামনে এখনো অবিচল স্থিরচিত্রটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চশমার কাচ কুয়াশার মতো ঝাপসা। আর সেই কাচের ফাঁক গলে অশ্রুর একটা ধারা নিঃশব্দে নেমে এসেছে নাকের কাছে। নিশার উপস্থিতি টের পেয়ে চমকে ওঠে জাহিদ। ভারি লজ্জিত বোধ করে। মুখ নিচু করে চুপিসারে জায়গাটা থেকে সরে পড়ে। ত্বরিত পায়ে এগিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। নিশাও এগোয় ওর পিছুপিছু। জাহিদ পেছনে ফিরে তাকায় না। যেন নিশা আর জুবিনের কাছ থেকে প্রাণপণে ছুটে পালাতে চায়। সিঁড়ি ভেঙে লিভিংরুমে পা রাখতেই পরিবারের অন্য সদস্যদের মুখোমুখি হতে হলো জাহিদকে। মিসেস মুর্তজা, নীলিমা আর আনিতা বসে আছে সোফায়। জাহিদ কারো দিকে তাকাল না। ছদ্মবেশী অপরাধীর মতো মুখ লুকিয়ে ঝড়ের চেয়েও ক্ষিপ্র গতিতে বেরিয়ে এলো বাড়ি থেকে। নিশা জুবিনকে শাশুড়ির কোলে তুলে দিয়ে জাহিদের পিছু নিল।
পোর্চে এসে দাঁড়াতেই মোশন সেন্সর লাইটটা আপনাআপনি জ্বলে উঠল 1 সেই আলোতে জাহিদের লম্বা চওড়া শরীরটাকে মন্থরভাবে লনের ঘাস মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে দেখল সে। বড়ই ক্লান্ত আর বিষণ্ন দেখাচ্ছিল জাহিদকে।
— ‘কোথায় যাচ্ছেন?’
জাহিদ দাঁড়াল। মানুষের ছায়া কিঞ্চিৎ দূরে সরে যেতেই পোর্চের মোশন লাইট নিভে গেছে নিঃশব্দে। হিমেল অন্ধকারে ডুবে গেছে চারপাশ। গাছের পাতায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু বরফকুচির ক্ষীণ সাদাটে আলোয় শাড়ি পরা নিশার দিকে একবার তাকাল জাহিদ। কথা বলতে গিয়ে গলাটা একটু কেঁপে গেল ওর, ‘আমার মনটা খারাপ…একা থাকতে চাই।’
নিশা গাঢ় ভাঙা ভাঙা স্বরে বলল— ‘আমার মনটাও খারাপ। কিন্তু আমি একা থাকতে চাইছি না। আপনার সঙ্গে থাকতে চাইছি। আপনার সঙ্গে একটু থাকতে দেবেন?’
জাহিদ কিছুক্ষণ নির্বাক চোখে চেয়ে থাকে নিশার দিকে। তারপর কোন কথা না বলে হাঁটতে থাকে। হাঁটে নিশাও। একটু পিছে পিছে…একটু ভয়ে ভয়ে। এবারের তুষারপাতে গাছের সব ফুল ঝরে গেছে। সারা রাস্তা ভরে গেছে ঝরা ফুলের পাপড়িতে। ফুলের গন্ধে ভেসে গেছে চারপাশ। রাস্তার এক ধারে পাহাড়। সেই পাহাড়ের পাথুরে গায়ে হীরের মতো জ্বলজ্বল করছে শুভ্র রঙের বরফকুচি। ওরা ফুটপাতের ওপর দিয়ে হাঁটছে। একটা বাদামি চামড়ার খরগোশ ক্র্যাব অ্যাপল গাছের গুঁড়ির পাশে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। মানুষের পায়ের শব্দ পেয়ে ভয়ে দৌড় দিল অন্যদিকে। সেই গাছের সামনে এসেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াল জাহিদ। নিশার দিকে ঘুরে তাকিয়ে অসহায় ভাবে বলল, ‘কী করব এখন? কী হবে?’
প্রশ্নটা নিশার চেতনার পাল্লায় একটা জোর ধাক্কা দিয়ে গেল। এতক্ষণ তার কষ্ট হচ্ছিল। এই মানুষটার জন্য মায়া হচ্ছিল। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অত্যাচারে মরে যাচ্ছিল সে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু এই মাত্র ছুটে আসা প্রশ্নটা যেন আবেগ-অনুভূতির সমস্ত পাল্লা বন্ধ করে দিয়ে বাস্তবতার স্বেদগন্ধে ভরা বীভৎস এক ঘরের দরজা খুলে দিয়ে গেল।
— ‘এত চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে দেখবেন।’ খুবই সাধারণ, মূল্যহীন, ঠুনকো একটা কথা বলল নিশা। এই কথার কোন অর্থ হয় না। তবুও বলল…কিছু একটা বলার প্রয়োজন ছিল বলেই।
— ‘আমার মেয়ে আজ আমার সম্পর্কে কী ধরনের কথা বলল শুনেছ? আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। ও কি কথাগুলো সত্যিই বলেছিল? নাকি আমি ভুল শুনেছি?
জাহিদের গলা কাঁপছে প্রবল উত্তেজনায়। নিশা আস্তে করে ওর একটা হাত ধরল। মৃদু গলায় বলল, ‘তুরিন ছোট মানুষ। রাগের মাথায় বলে ফেলেছে। অত ভেবেচিন্তে কিছু বলেনি। ওর কথায় কষ্ট পেয়েন না। বরং তুরিনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলুন। আমি জানি আপনি ওকে অসম্ভব ভালোবাসেন। নিজের মেয়েকে ভালোবাসবেন…এটাই তো স্বাভাবিক। প্রয়োজনে আমিই আপনাদের মাঝখান থেকে সরে যাব। আমার জন্য আপনাদের সবার জীবনে এমন অশান্তি নেমে আসুক…এটা আমি চাই না।’
— ‘তুমি সরে যাবে মানে? কোথায় যাবে?’
নিশা মুখ নিচু করে, ‘কোথায় যাব জানি না…কিন্তু প্রয়োজনে যেতে হবে।’ একটু থেমে কেমন অন্য গলায় বলে, ‘একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
— ‘কী প্রশ্ন?’
— ‘আপনি তুরিনকে যতটা ভালোবাসেন…জুবিনকেও কি ঠিক ততটাই ভালোবাসেন?’
— ‘কী অদ্ভুত প্রশ্ন করছ নিশা! জুবিনও তো আমারই মেয়ে। ওকে ভালোবাসব না কেন?’
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিশার বুক চিরে, ‘যাক…নিশ্চিন্ত হলাম। আমার জুবিন যেন বাবার আদর-যত্ন-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত না হয়। এদিকটা একটু খেয়াল রাখবেন।’
কথাটা জাহিদকে তেমন একটা স্পর্শ করল না। সে চোখ থেকে চশমা খুলে নিয়ে দু চোখের পাতায় হাতের পাঁচ আঙুল রাখে, দুদিকে মাথা নেড়ে অস্থিরভাবে বলে, ‘আমার মেয়ে আমাকে ক্যারেক্টারলেস ভাবছে, প্রতারক ভাবছে। এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না নিশা… আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!’
নিশা ঠিক সেই মুহূর্তে জীবনে প্রথমবারের মতো কাজটা করল। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে সামনে দাঁড়ানো মানুষটার ঠোঁটে একটা চুমু খেল। শুধু ভালোবাসা প্রকাশের জন্য নয় বরং জাহিদের সমস্ত কষ্ট, দুশ্চিন্তা আর যন্ত্রণা নিজের মধ্যে আকণ্ঠ শুষে নেবার জন্য। অপ্রত্যাশিত ঘটনাটা জাহিদের হৃৎপিণ্ড নাড়িয়ে দিল। মস্তিষ্কের যে রক্তকণাগুলো এতক্ষণ হিমঘরের ঘুমের মতো নিশ্চল হয়ে ছিল সেই সব রক্তকণারা আচানক ছুটোছুটি শুরু করে দিল। বুকে জমে থাকা যন্ত্রণা আর মরচে পড়া বিষণ্নতার বিষগুলো নিশার নরম, উষ্ণ, মদির ঠোঁটের মধ্যে মিশে গিয়ে কী এক আশ্চর্য জাদুবলে অমৃত হয়ে উঠল নেইবারহুডের রাস্তা দিয়ে জোরে গান বাজিয়ে একটা গাড়ি হুশ করে ছুটে গেল হঠাৎ। হেডলাইটের আলোয় চমকে উঠল ওরা। চোখে চোখ পড়ল দুজনের। লজ্জার ধক এসে লাগল নিশার চোখে মুখে। কয়েক পা পিছিয়ে এসে ভীত হরিণীর মতো একটা ছুট দিল সে বাড়ির দিকে।
.
তুরিন কার্পেটের ওপর হাঁটু গেঁড়ে বসে ছিল। হাতে একটি পুরনো দিনের অ্যালবাম। ছোট বড় নানা আকারের ছবিতে ঠাসা অ্যালবামটা। প্রথম পৃষ্ঠায় সদ্য জন্মানো তুরিন বাবার কোলে। বাবার চেহারাটা ভীষণ বাচ্চা বাচ্চা ছিল। বসা চোয়াল। শীর্ণকায় লম্বাটে ঘাড়। কিন্তু মুখের হাসিটির কোন তুলনা নেই। ঝলমলে সুখী সুখী হাসি। বাবার কোলে পুঁটলির মতো গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে তুরিন। চোখ বন্ধ। শুধু যে বন্ধ তাই ই নয়, তুরিনের মনে হলো জন্মের সময় বুঝি তার চোখ আদৌ ছিল না। গোলাপি কপালের নিচে একটুখানি পাতলা ভ্রু আর দুটো গর্ত। চোখ ফুটেছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রথম জন্মদিনে লাল প্রিন্সেস ড্রেস পরা তুরিন বাবা-মায়ের সঙ্গে। হাসছে না। কেমন একটু থমথমে ভাব লেগে আছে ওর ছোট্ট মুখখানায়। পাশের ছবিটায় সে আরেকটু বড় হয়েছে। বছর সাতেক বয়স। বাবার কাছে সাইকেল চালানো শিখছে। টপ করে রুপালি রঙের একটি জলবিন্দু গড়িয়ে পড়ল ছবিটার ওপর। বুকের ভেতর হুহু করা এক শূন্য আকাশ টের পেল তুরিন। সেই আকাশ তমসাচ্ছন্ন নিদারুণ সব ঘন মেঘে ছেয়ে আছে। মেঘের কারণে ঠিকমতো শ্বাস নেয়া যায় না। দমবন্ধ লাগে। অ্যালবামটা মাটিতে ফেলে রেখে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। আজকের পর থেকে তার আর কোন বাবা নেই। যে বাবাকে ভালোবেসেছিল এক জীবনে সবচেয়ে বেশি! সেই বাবাই তার মনের ভেতরে গভীর এক অতল ছিদ্র তৈরি করে দিয়েছে। এই ছিদ্রিত হৃদয় আর কোনদিন সারবে না। কেন এমন হলো তার সঙ্গে? জীবনে কোন কিছুই কেন ঠিকঠাক পেল না তুরিন? লেখাপড়ায় বিশেষ কৃতিত্ব নেই। গুণের ভাণ্ডার শূন্য। মনের মতো বন্ধু নেই। প্রেমিক নেই। যে যুবকটিকে ভুল করে ভালোবেসেছিল সেই যুবক আরো আগেই মন দিয়েছিল অন্য এক যুবতীকে। তবুও তাকে ভোলা গেল না। এক কঠিন দুর্ঘটনা সেই মানুষটির জীবন থেকে সুস্থতা কেড়ে নিল। যতবার শাহজিদকে ওই দুই চাকার হুইলচেয়ারে দেখে, ক্রাচ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখে, যন্ত্রণার কী ভীষণ উত্তপ্ত অগ্নিলাভা তাকে আপাদমস্তক দগ্ধ করে তা প্রকাশ করার যোগ্য ভাষা বা শব্দ তুরিনের ছোট্ট মগজভাণ্ডারে মজুদ নেই। কাউকে কখনো বলতে পারেনি তুরিন। তার কষ্টটা কেউ বুঝল না! আঁজলাভর্তি কষ্ট আর না বলা কথা বুকে নিয়ে এই স্বার্থপর পৃথিবীতে সুখে থাকার মিথ্যে অভিনয় করে গেল অনবরত। সে জানে শাহজিদ তাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসেনি কখনো। তার মতো মেয়েকে ভালোবাসা যায় না। তাই তো নিজের জন্মদাতা পিতার কাছেও আজ সে তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর হয়ে উঠেছে। বাবার সঙ্গে আজকের পর থেকে তার অনতিক্রমণীয় দূরত্ব!
দরজায় ধাক্কা পড়ছে। তুরিন বিছানার সঙ্গে লেপটে আছে অনেকক্ষণ ধরে। ফোমের বালিশ ভিজে গেছে চোখের লোনা জলে। হতাশা বড়ই ভয়ংকর জিনিস। একবার কারো মনের মধ্যে বাসা বাঁধলে ছোঁয়াচে রোগের মতো ছড়িয়ে যায় শরীরের প্রতিটি কোষে কোষে। রক্তের কণায় কণায় খুঁচিয়ে তোলে বিষণ্ণ স্তব্ধতা। তুরিন নিজেই জানে না কষ্টের পাশাপাশি আজ তার শরীর আর মনে ঢুকে গেছে হতাশার বিষ। হৃদযন্ত্রে প্যালপিটিশন হচ্ছে। হাত-পা অবশ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এই বেঁচে থাকার কোন মানে হয় না…মনে হচ্ছে একটা নড়বড়ে সুতোর মতো ব্রিজের ওপর একলা দাঁড়িয়ে আছে সে। পায়ের তলায় অন্তহীন শূন্যতা! যখন-তখন পা পিছলে অতল খাদে পড়ে যাবে। তাকে বাঁচাবার কেউ নেই। কোথাও কেউ নেই!
দরজায় উপর্যুপরি আঘাত পড়ছিল। বিরক্তিতে চিড়বিড় করে ওঠে তুরিনের মন। যে জীবনে ভালোবাসা নেই, নির্ভরতা নেই, স্বাধীনতা নেই…সেই জীবন দিয়ে কী করবে মানুষ! এমন জীবন যাপন করার চাইতে বিনাশ করা অনেক সহজ এবং যৌক্তিক। কে দরজা ধাক্কাচ্ছে? মা… বাবা…দাদা-দাদু কিংবা আনিতা…। যেই হোক না কেন ভীষণ রকমের অপমান করে তাড়িয়ে দেবে তুরিন। আজ সে কাউকে ছাড়বে না! রাগে গজগজ করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। চোখের জল, নাকের জল মুছতে ভুলে গেল। ভুলে গেল অগোছালো চুলের গোছা ঠিক করতে। ক্ষ্যাপা ডাকিনীর মতো উম্মত্ত রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে দরজাটা একটানে খুলে ফেলল সে। চৌকাঠের ওপাশে যে মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে তাকে ভুলেও আশা করেনি। এই মানুষ এর আগে কোনদিন তার ঘরে আসার স্পর্ধা পায়নি। আজকের এই অযাচিত স্পর্ধা তুরিনকে এক বিহর্ষ বিস্ময়ে স্তম্ভিত করে দিল। একটু আগের ফেটে পড়া রাগটা বুঝি হঠাৎ করেই থমকে গেছে। তুরিন অবিষ্কার করল রাগের বদলে একটা অন্যরকম বিশ্রী অনুভূতিতে তার গোটা অন্তর তিতা তিতা হয়ে যাচ্ছে। গা-ঘিনঘিনে একটা সংকীর্ণ মনোভাব সরীসৃপের মতো কিলবিল করে শরীর বেয়ে উঠে আসছে মাথায়। এই মেয়ের কাছে হেরে গেছে সে। আর হেরে গেছে বলেই, আজকে তার একে যতটা ঘৃণা হচ্ছে তার চাইতে আরো অনেক বেশি ঘৃণা হচ্ছে নিজেকে!
— ‘একটু আসতে পারি?’ নিশা মৃদু স্বরে প্রশ্ন করল। তার পরনে এখনো নীল শাড়ি। মুখে হালকা প্রসাধন। চুলে একটা মস্ত খোঁপা। কপালের ডান পাশে কয়েকটা চূর্ণ চুল এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। ওর চেহারায় দুশ্চিন্তার ছাপ আছে, তবে ভয়ের চিহ্নমাত্র নেই। তুরিন ভেবেছিল আগন্তুক যেই হোক না কেন ভয়ংকর রকমের অপমান করে তাড়িয়ে দেবে। নিশাকে তার জুতাপেটা করে এখান থেকে বিদায় করা উচিত। কিন্তু কোন এক বিচিত্র কারণে সামান্যতম প্রতিক্রিয়াও সে এই মুহূর্তে ব্যক্ত করতে পারছে না। জীবনের চরম শত্রুর মুখোমুখি হলে কি মানুষ এমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়? পাথর হয়ে যায়? তুরিন চিৎকার করে বলতে চাইল, তোমার সাহস হয় কী করে আমার ঘরে আসার? তোমার কারণে আজ আমার এই দশা। তোমার কারণে আজকে আমার বাবা নেই, পরিবার নেই, আমার মায়ের জীবনে সুখ নেই। তুমি আমাদের সুখের সংসার ভেঙেচুরে খানখান করে দিয়েছ!
নিশা তুরিনের ফোলা ফোলা, লাল লাল, পাগল পাগল উদ্ভ্রান্ত চেহারাটা একদৃষ্টিতে অবলোকন করছিল। বেচারির দুরবস্থা দেখে মন খারাপ লাগছে। হঠাৎ একটা কাণ্ড হলো। আকস্মিক শক্তিশালী তোপের মতো হাওয়ায় ছুটে এলো এক কর্কশ কণ্ঠস্বর। চমকে উঠে নিশা আবিষ্কার করল ওর খুব কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে ফারা। প্রাণপণে চেঁচিয়ে বলছে, ‘তুমি আমার মেয়ের ঘরে কী করছ? কেন এসেছ এখানে? এতবড় সাহস তোমার!’ ফারার মারমার কাটকাট কথার বাণে বিদ্ধ হয়ে প্রথমে একটু ঘাবড়ে গেল নিশা। অতর্কিতে তাকাল একবার তুরিনের দিকে। তুরিনের চোখের চাউনিতে ওর মায়ের বলা কথাগুলোই ধ্বনিত হচ্ছে নিরুচ্চারে। নিশা বুঝল শত্রুপক্ষের দল এখন ভারী। তার উচিত হবে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যাওয়া। মা-মেয়ে একজোট হয়ে তাকে যাচ্ছেতাই অপমান করে ছাড়বে। কয়েকটা থমথমে সেকেন্ডে নিশার মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরাগুলোতে হরেকরকম বিক্ষিপ্ত চিন্তার স্রোত বয়ে গেল। দুর্বল হয়ে এলো মনোবল। যুক্তি-তর্কের ঝড় উঠল মনের ভেতর। অদৃশ্য কেউ একজন কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলল, ভয় পেও না! এ সংসারে ওদের যতটুকু অধিকার আছে, ঠিক ততটা অধিকার তোমারও আছে। তোমার ভয় কীসের?
নিশা বড় একটা শ্বাস টেনে নিল। চোখ অন্যদিকে সরিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুরিনের সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।’
ফারাকে দেখে মনে হলো এখুনি ওর মধ্যে একটা বিস্ফোরণ ঘটে যাবে।
— ‘তুরিনের সঙ্গে…আমার মেয়ের সঙ্গে তোমার কী কথা শুনি?’
— ‘সেটা তুরিনকেই বলা যাবে। আপনাকে নয়।’
— ‘ফাজলামো করার আর জায়গা পাও না? যা বলার আমার সামনেই বলো!’ নিশা তুরিনের দিকে একবার তাকাল। তুরিনের মুখে এখন সুস্পষ্ট দ্বিধা। একটু বিস্ময়ও খেলছে। কিছুক্ষণ সামনে দাঁড়ানো দুই নারীর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকার পর সে কোন রকমে বলল, ‘মা তুমি যাও। আমি দেখছি।’ কথাটা শোনা মাত্র অপমানের ঝাপটায় ফারার মুখখানা কালো হয়ে উঠল
— ‘তোমার কোন কথা বলতে হবে না এর সঙ্গে। যা বলার আমিই বলছি।’ নিশার মনে সাহস ফিরে এসেছে। এক পা ঘরের ভেতরে এগিয়ে দিয়ে সে বিদ্রুপের গলায় তুরিনকে বলল, ‘তোমার মাকে বলো তুমি এখন বড় হয়েছ। কার সঙ্গে কথা বলবে আর কার সঙ্গে বলবে না, সেই সিদ্ধান্ত তুমি নিজেই নিতে পার।’
ফারার চোখ থেকে অবিশ্বাস ঝরে পড়ছিল। তুরিন মুখের ওপর দরজা বন্ধ করল। মায়ের ওপর আজ তার আকাশ-কাঁপানো রাগ। নইলে এমনটা করা কখনই সম্ভব হতো না।
নিশা এই ঘরে জীবনে প্রথমবারের মতো এলো। ছোট পরিসরের একটা চারকোনা ঘর। ল্যাম্পশেডের হলুদ আলোয় ভেসে আছে। এলোমেলো বিছানার ওপরে একটা গোলাপি টেডি বিয়ার রাখা। কোনার দিকে এক চিলতে ক্লজেট। দক্ষিণের দেওয়ালের একটা ছবিতে জাহিদ ফারার সঙ্গে ফ্রেমবন্দি হয়ে আছে তুরিন। হাইস্কুলে গ্র্যাজুয়েশনের দিন তোলা। তুরিনের পরনে গ্র্যাজুয়েশন গাউন, মাথায় ক্যাপ। ঘরের আসবাবের মধ্যে ড্রেসিং টেবিলটা সর্ব প্রথম দৃষ্টিগোচর হয়। আয়নার সাদা কাঠের ফ্রেমে ছোট ছোট বাতি জ্বলছে। টেবিলে নামকরা ব্র্যান্ডের প্রসাধনী সামগ্রী। একপাশে একটা সেলফি রিং লাইট ট্রাইপড। বিছানার চাদর কুঁচকে আছে। মেঝেতে উল্টেপাল্টে পড়ে আছে একটা পুরনো অ্যালবাম। জানালা বন্ধ বলে ঘরে একটা ভ্যাপসা ভাব আছে। নিশা খুব সহজ গলায় বলল, ‘দমবন্ধ লাগছে। জানালাটা খুলে দিই?’
তুরিন কুটিল এবং ঝাঁজাল দৃষ্টির তীর মারল নিশার দিকে। ভাবভঙ্গির হিংস্রতা দেখে মনে হলো এখুনি মুখ দিয়ে ড্রাগনের মতো আগুনের গোলা বেরোবে। নিশা একবার শান্তভাবে ওর দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিল। একটুও বিচলিত হলো না। হবে কেন? দুদিন আগের নিশা আর এই নিশার মধ্যে যে ঢের তফাত! এই দুদিনেই ওর মনোবল বেড়ে গেছে অনেকখানি। পিঠে গজিয়ে গেছে সাহসের এক অদৃশ্য ডানা। সে একজন প্রাপ্তবয়স্কা নারী, একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের বৌ, একজন স্ত্রী, একজন মা…ছেলেমানুষ তুরিনকে তার ভয় পেলে চলবে কী করে? জানালার কাচটা সরিয়ে দিল নিশা। নেটের পাল্লাটাও সরাল। তারপর বাইরে মাথা বের করে উঁকি দিল একবার। তুরিনের দিকে আড়চোখে চেয়ে বলল, ‘এদিকে এসো। ওই দ্যাখো তোমার জন্য একজন অপেক্ষা করছে। কী নাকি জরুরি কথা আছে। অনেকক্ষণ ধরে ট্রাই করেছে তোমার ফোনে। ফোন লাগছিল না। তাই আমাকে দিয়ে খবর পাঠাল।’
তুরিনের কপালে ভাঁজ পড়ল। দ্বিধা, দ্বন্দ্ব এবং সংশয়ের প্রাবল্যে কেমন বোকা বোকা হয়ে উঠল মুখটা। কোন কথা না বলে এগিয়ে এলো জানালার ধারে। এই জানালা দিয়ে বাড়ির সামনের অংশটুকু স্পষ্ট দেখা যায়। প্যাটিওর ধারে ক্র্যাব অ্যাপল গাছের নিচে লম্বাটে ছায়ামূর্তিটাকে দেখতে পেল তুরিন। অবয়ব দেখেই বুঝতে পারল, ওটা শাহজিদ। বুকটা ধক করে উঠল। মুখের কাঠিন্য আর কুটিলতা সরে গেল মুহূর্তের জন্যে। তার বদলে ফুটে উঠল কিশোরীর অপাপবিদ্ধ চোখের উৎসুক চাউনি। শিউলি ফুলের মতো সহজ সারল্য…একটু লজ্জা…একটু জড়তা আর একটু একটু চাপা সুখের অযাচিত দাপাদাপিতে তুরিনের কান্না ফোলা এলোমেলো মুখটা হঠাৎ বড় সুন্দর হয়ে উঠল। কী বলবে, কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। ফোনে চার্জ নেই অনেকক্ষণ হলো। শাহজিদ নিশ্চয়ই ফোন করে পায়নি। কিন্তু কী এমন জরুরি কথা থাকতে পারে যে নিশার মারফতে ডাক পাঠাতে হলো? তুরিন একটু ইতস্তত করে বলল, ‘কেন ডাকছে?’
নিশা ঠোঁট উল্টায়, ‘আমি কী জানি!’
তুরিন হঠাৎ করেই একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছে। নিশাকে এতকাল সে মানুষ হিসেবেই গণ্য করেনি। খুবই বাধোবাধো, গেঁয়ো গেঁয়ো, শ্যাবি একটা ভাব লেগে থাকত সব সময় নিশার মধ্যে। ওই নরমসরম ব্যক্তিত্বে কখনো বিশেষ কিছু চোখে পড়েনি তুরিনের। কিন্তু আজকের নিশা যেন কেমন অন্যরকম। তুরিন লক্ষ করল নিশার চেরিফুলের মতো গোলাপি মুখশ্রীতে আলাদা একটা ধার ফুটে উঠেছে। শুধু ধারই নয়, বরং অনেকখানি আত্মবিশ্বাস যেন কোত্থেকে এসে যুক্ত হয়েছে ওর আচার আচারণে। বুকটা ভীষণ ধড়ফড় করছিল। সে ভেবেছিল ঘরের দরজা বন্ধ করে নিশাকে মনের আশ মিটিয়ে অপমান করবে। তারপর ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে। সেই দৃশ্য মনে মনে কল্পনা করে একটা পৈশাচিক গোপন আনন্দও পাচ্ছিল। কিন্তু নিশা যে অন্য কোন কথা নয়, বরং শাহজিদের বার্তা নিয়ে এই ঘরে এসেছে তা কে জানত! কেমন যেন আবোলতাবোল লাগছিল তুরিনের মাথাটা। জোর কমে যাচ্ছে। যে মুহূর্তে শাহজিদকে গাছের নিচে অন্ধকারে নিজের জন্য অপেক্ষারত অবস্থায় দেখল, পৃথিবীটা যেন ঠিক সেই মুহূর্তেই পাল্টে গেল। কিন্তু এমন শাকচুন্নির মতো চেহারা নিয়ে ওর সামনে যাওয়া যাবে না। একটু ফিটফাট হতে হবে। চুলে চিরুনি লাগাতে হবে। নিশার সামনে এই কাজগুলো করতে লজ্জা লাগছে। নিশাই সমস্যার সমাধান করে দিল। অবিন্যস্ত বিছানার চাদরটা ঝেড়ে ঝুড়ে ঠিক করতে করতে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘তোমার চুল এলোমেলো হয়ে আছে। আঁচড়ে নাও। মুখটাও ধুয়ে নাও একটু। ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।’
তুরিন সব সময় নিজের কাজ নিজেই করে। এই দেশে একটা বয়সের পর কেউ কারো কাজ করে দেয় না। নিজের মাকে কখনো আজ অবধি তার বিছানা করতে দেখেনি তুরিন। নিশাকে অবলীলায় এই কাজটা করতে দেখে ভারী অবাক লাগল তার। তেরছা গলায় বলল, ‘তোমার আর কিছু বলার আছে? বলার না থাকলে কেটে পড়।’
নিশা চোখ তুলে তাকাল। একটা তীব্রতা ছিল সেই চোখের চাউনিতে তুরিন থতমত খেয়ে গেল ওই দৃষ্টির সামনে। মনে মনে ভাবল কী ভীষণ সাহস বেড়েছে এই মেয়ের! এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন তুরিন তার অধীনে চাকরিরত কোন কর্মচারী। দুদিন আগেও চোখ তুলে তাকাবার সাহস পেত না। নিশা ঠান্ডা গলায় বলল, ‘ভদ্রতার শিক্ষাটা তোমাকে দেওয়া হয়নি কখনো, তাই না?’
— ‘কী?’
নিশা বিছানার ওপর বসে ছোট একটা শ্বাস ফেলল, ‘কিছু না…। তোমার সঙ্গে কথা আছে। মিনিটপাঁচেক সময় হবে?’
— ‘সময় নেই। শাহজিদ অপেক্ষা করছে।’ ক্যাটক্যাট করে বলে ওঠে তুরিন। বাথরুমের বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মুখে গরম পানির ছিটা দেয়। নিশার সাহস ওকে বিস্মিত এবং বিভ্রান্ত করে তুলছে। একটা ঘোর লেগে গেছে মাথায়। রাগও যে হচ্ছে না তা নয়। কত্ত বড় সাহস…তার বিছানায় পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। ভাব দেখে মনে হচ্ছে মহারানি ভিক্টোরিয়া এসেছে। একটা কড়া কথা এখন শোনাতেই হবে। তুরিন মনে মনে খুব কঠিন একটা বাক্য সাজিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলো। মুখ খুলতে যাবে ঠিক সেই সময় নিশা ওর চোখে চোখ রেখে স্পষ্ট গলায় বলল, ‘শাহজিদকে তুমি খুব ভালোবাসো, তাই না?
থমকে গেল তুরিন। মার মার-কাট কাট উদ্ধত ভঙ্গিটায় হঠাৎ যেন কেউ ঝপ করে একগাদা জল ঢেলে দিল। চোখ থেকে সমস্ত তেজ শুকনো পাতার মতো ঝরে পড়ল। কান্না কান্না একটা ভাব আটকে গেল কণ্ঠার কাছে। কেউ কোনদিন এই প্রশ্নটা করেনি তাকে। ভালোবাসার কথা এ বাড়ির লোকেরা তেমন একটা বলে না। মনের কথা বলা যায় এমন মনের মতো কোন বন্ধুও তুরিনের কখনো ছিল না। এক আনিতা ছিল আবাল্য সখী। কিন্তু আনিতার চোখে ছোটবেলা থেকেই নিজের জন্য ঈর্ষার একটা বিদ্যুৎ দেখতে পেয়েছে সে। কেউ না জানলেও আনিতা জানত তুরিন শাহজিদকে চায়। কিন্তু আনিতা এই চাওয়াটুকুকে কখনো স্বীকৃতি দেয়নি। উল্টো নানা রকম হিংসুটে আচরণ করে তুরিনকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করেছে। আনিতার কথা তোলা থাক…নিজের মা-ই কখনো তুরিনকে বুঝল না। কই নিশার মতো মা তো কখনো তার চোখে চেয়ে প্রশ্ন করেনি, ‘শাহজিদকে তুমি ভালোবাসো, তাই না?’
মাকে তার অনুভূতিহীন জড় পদার্থ বলে মনে হয় মাঝেমধ্যে। বেশ কয়েকবার শাহজিদের কথা বলতে গিয়ে থমকে গেছে তুরিন, পিছিয়ে গেছে। মনে হয়েছে মা বুঝবে না। পেশায় ব্যাংকার হওয়াতেই বোধহয় টাকা-পয়সার হিসেব-নিকেশটাই মা সবচাইতে ভালো বোঝে। জীবনে প্রথমবারের মতো অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং মূল্যবান প্রশ্নটা কারো মুখ থেকে শুনতে পেয়ে তুরিন হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিল। তার ঠোঁট ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে। চোখের কার্নিশে টলটল করছে জল। নিশা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, ‘মনের কথা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব খুলে বলা ভালো। দেরি করলে অযথা সময় নষ্ট। নিজের জীবনে ঠেকে শিখেছি বলেই তোমাকে উপদেশটা দিতে পারলাম। এখন আর তোমাকে আটকে রাখছি না। নিচে যাও। ফিরে এসে একবার দেখা করো আমার সঙ্গে। আমি অপেক্ষা করব। জরুরি কথা আছে।’
তুরিন টালমাটাল পায়ে ঘরের দরজা খুলল। দরজার ওপাশে ফারা চোরের মতো ওত পেতে দাঁড়িয়ে ছিল। হুট করে পাল্লা খুলে যাওয়ায় বেজায় অপ্রস্তুত হলো। তুরিন মাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। তার মাথাটা কুয়াশায় ভরে আছে। বুকে বড্ড দাপাদাপি! বাইরে ঝুপসি অন্ধকার। গাছের নিচে একটি লম্বা ছায়ামূর্তি স্থির হয়ে আছে। হাওয়া নেই খুব একটা। পাতায় পাতায় স্বপ্নের মতো জ্বলছে সাদা বরফকুচির দল। চারিদিক নিশ্চুপ, নিঝুম, নিবিড় রাতের শীতল চাদরে আবৃত। তুরিনের স্নায়ু ভীষণ টানটান। নিজের পায়ের শব্দে নিজেই চমকে উঠছে বারবার।
— ‘কেমন আছ?’ শাহজিদ বলল।
— ‘এই তো!’
কেউ কারো মুখ দেখতে পাচ্ছে না। শুধু অবয়বটাই ঠাওর করা যাচ্ছে।
— ‘ডেকেছ কেন?’ বুকের অসহ্য ধড়ফড়ানিটা কথা বলতে দিচ্ছিল না। তবুও কোন রকমে প্রশ্নটা করল তুরিন।
— ‘কথা ছিল।’ অন্যরকম শোনায় শাহজিদের গলা।
— ‘বলে ফ্যালো।’
শাহজিদ একটু সময় চুপ করে থাকে। কী যেন ভাবে আনমনে। তুরিন ওই মুখ না দেখেও অনুমান করতে পারে এই মুহূর্তে ওর জিব ঠেকে গেছে ডান গালে। কুঞ্চন পড়েছে দুই ভ্রুর মধ্যিখানে। একটু কেশে গলা পরিষ্কার করল শাহজিদ। তারপর রুদ্ধ নিশ্বাসে বলল, ‘তুমি আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে তাই না? অফারটা কি এখনো ওপেন আছে?’
বিস্ময়ে মূক হয়ে গেল তুরিন। কোন শব্দ বেরলো না গলা দিয়ে। স্থবির হয়ে চেয়ে রইল শুধু। শাহজিদ তার জন্য এতক্ষণ একটানা দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করেছে। নিজ গরজে ডেকে এনেছে। রুক্ষ একটা দিনের শেষে এই ঘটনা তার জন্য নিঃসন্দেহে ভালো লাগার এক টোটাল প্যাকেজ। এ কথা সত্য যে, সে শাহজিদকে সর্বান্তঃকরণে নিজের করে পেতে চায়। কিন্তু একটুখানি মেয়েলি আত্মসম্মান ঝড়ের কবলে পড়া মোমবাতির নিভু নিভু দুর্লভ আগুনেরই মতো এখনো লেগে আছে তার ব্যক্তিত্বের আনাচেকানাচে। তাই কথাটা শুনে ষোলাআনা খুশি হতে পারল না। বরং অপমানের ঝাঁঝ লাগল অন্তরে।
— ‘আমি তোমাকে কখনো কোন অফার দিইনি। তুমিই বলেছিলে আমাকে বিয়ে করতে চাও। কী মিথ্যুক তুমি!
শাহজিদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে, ‘আমি বলেছি শর্ত মেনে নিলে বিয়ে করতে রাজি আছি।’
তুরিনের মনটা আজ বিক্ষিপ্ত। রসিকতাবোধ কাজ করছে না। বড় অস্থির আর আবেগকম্পিত হয়ে আছে ভেতরটা। সে খুব ক্লান্ত গলায় বলল, ‘আমি তোমাকে বুঝি না শাহজিদ। তবে এটুকু বুঝি তুমি আমাকে ঠিক ভালোবাসো না। হয়তো করুণা কর।’
তুরিন এতটা গম্ভীর কথা এর আগে কখনো বলেছে কি না মনে পড়ে না শাহজিদের। সে বেশ অবাক হলো। স্তিমিত স্বরে বলল, ‘ভালোবাসা খুব জটিল একটা জিনিস। আমার মনে হয় আমি আমার মা-বাবাকেও কখনো সত্যিকার অর্থে ভালোবাসিনি।’
একটু থেমে শাহজিদ আবার বলে, ‘লং স্টোরি শর্ট, পাহাড় ছাড়া অন্য কিছুই কখনো ভালোবাসিনি আমি।’
— ‘ফালতু কথা।’
— ‘কোন কথাটা ফালতু লাগল তোমার?’
—‘পাহাড়কে আবার ভালোবাসার কী আছে? বুলশিট যত্তসব।’
শাহজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘এখন এসব নিয়ে তর্ক করে যাবে? নাকি জরুরি কথাটা শুনবে?’
— ‘কী কথা?’
— ‘তুমি আমার সঙ্গে পালিয়ে যাবে?’
এত সুন্দর এবং স্নিগ্ধ ছিল প্রশ্ন করার ধরনটা…যে তুরিন রীতিমতো সম্মোহিত হয়ে পড়ল। ভয়মিশ্রিত এক গভীর আনন্দের উচ্ছন্ন স্রোত তাকে কয়েক মুহূর্তের জন্য বরফমানবীতে রূপান্তরিত করে দিল। বরফ গলতে সময় লাগল। বাধো বাধো গলায় বলল,
— ‘অদ্ভুত কথা বলছ কেন?’
— ‘অদ্ভুত কেন?’
তুরিনের ঠোঁটে একটা চোরা হাসি ঝুলে আছে এই মুহূর্তে। চারপাশে একবার সতর্ক চোখ বুলিয়ে নিয়ে গলাটা খাদে নামাল সে। প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘পালাতে হবে কেন? লাইফটা কি সিনেমা নাকি?’
— ‘ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন। এই বিখ্যাত উক্তিটা তো জানা আছে তাই না?’
— ‘কিন্তু পালাতে হবে কেন?’
শাহজিদ জানে না এই প্রশ্নের উত্তর ঠিক কীভাবে দেওয়া উচিত। বলতে কী, আজ সারাটা দিন অনেক ভেবেছে সে। অনিমেষের আকস্মিক আগমন, তুরিনের সম্পর্কে দেওয়া অবিশ্বাস্য সব তথ্য এবং সব শেষে অনিমেষের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় শাহজিদকে অংশগ্রহণের অনুরোধ…এসব ভীতিপ্রদ খবরের ছিটেফোঁটাও তুরিনের কান অবধি পৌঁছুক, এটা শাহজিদ চায় না। বরং অনেক বিশ্লেষণের পর তার মনে হয়েছে, তুরিনকে কখনো কিছু না জানানোই শ্রেয় হবে। মেয়েটা এই কণ্টকিত সত্য সহ্য করতে পারবে না। মানুষের জীবন খুবই ছোট। একটা সত্য না জেনে তুরিনের ছোট্ট জীবনটা কেটে গেলে পৃথিবীর কোন ক্ষতি হবে না। অনিমেষ বলেছিল খুব শিগগিরই সে সবাইকে সত্য জানাবে। এবং সেই সময়টায় শাহজিদকে শক্ত করে ধরতে হবে তুরিনের হাত। শাহজিদ সম্মতি বা অসম্মতি কোনটাই জানায়নি। সময় নিয়েছে। সময় নিয়ে সমীকরণটা সমাধানের নিরলস চেষ্টা করেছে। তার বিচার-বুদ্ধি বরাবরই প্রখর। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে গিয়ে সে আবিষ্কার করেছে অনিমেষ লোকটা মোটেই নির্লোভ, উদাসীন বা ব্যক্তিত্বশালী নয়। হলে এই জ্বলজ্যান্ত বাস্তব ঘটনা এতকাল চাপা থাকত না। সন্তানের প্রতি যথার্থ ভালোবাসা থাকলে পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুর জালিম পিতাটিও পিতৃত্বের দাবি থেকে সরে দাঁড়াবে না। এতগুলো বছর পর আচানক তুরিনকে নিজ কন্যা হিসেবে ফিরে পাবার অদম্য বাসনার পেছনে নিশ্চয়ই কোন গোপন দুরভিসন্ধি রয়েছে। তার চেয়ে বরং তুরিন কিছুদিন এই বাড়ি থেকে দূরে থাক। ফারা চতুর কম নয়। সে অবিলম্বেই অনিমেষকে দমানোর কোন পন্থা আবিষ্কার করে ফেলবে। পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তটাও চট করে নেয়নি শাহজিদ। শুধু যে তুরিনের কথাই ভেবেছে তাও কিন্তু নয়। নিজের মনটাকেও বারবার উল্টেপাল্টে দেখেছে। খুঁটিয়ে দেখেছে মনের অতলে গোপন অনুভূতির পলি জমেছে কি না।
— ‘তুরিন শোন, আমার সামনে এখন দুটো অপশন আছে। তুমি অথবা পাহাড়।’
— ‘আজগুবি কথা বলো না। পাহাড় কখনো কোন অপশন হয় নাকি?’
— ‘আমার জন্য পাহাড় একটা অপশন। একটা স্বপ্ন!’
— ‘স্বপ্নটা কীরকম শুনে দেখি তো!’
শাহজিদ বিস্তারিত কিছু বলল না। সংক্ষেপে বলল, ‘স্বপ্ন দেখি পাহাড়ে যাব। পাহাড়েই মরব।’
তুরিন দিশেহারা হয়ে বলল, ‘তুমি মানুষটা খুব অদ্ভুত। মরার কথা বলছ কেন হঠাৎ?’
— ‘কেন বলছি সেই কথা আরেকদিন হবে। এখন আমার প্ল্যানটা শোন। কাল সকালে আমি এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাব। গাড়ি রেন্ট করেছি। তোমার জন্য অপেক্ষা করব। তুমি আসবে তো?’
শাহজিদ যে এরকম একটা প্রস্তাব দিয়ে বসবে তা ভুলেও ভাবতে পারেনি তুরিন। সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। বুকের মধ্যে তীব্র চিনচিনে আনন্দ এবং একই সঙ্গে ভয়ের ডুগডুগি বেজে চলেছে। শাহজিদ তার জন্য অপেক্ষা করবে আর সে যাবে না…এটা কি কখনো সম্ভব?
— ‘তারপর কী হবে?’ তুরিনের গলা এবার কাঁপছে।
— ‘আমরা দূরে কোথাও চলে যাব।’ আশ্চর্য এই যে…শাহজিদের কণ্ঠেও এখন স্পষ্টতর কম্পন। নিজেকে যতটা আবেগবর্জিত, নির্লিপ্ত মনে করেছিল আদতে হয়তো ততটাও রসকষহীন সে নয়। এই মুহূর্তে নিজের নিঃশ্বাসের পরিবর্তনটা খুব সূক্ষ্মভাবে টের পেল। তুরিনকে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে, শুরু করবে নতুন জীবন, হয়তো তারা একে অপরকে অসম্ভব ভালোবাসবে, ঘর বাঁধবে…এই সব সাধারণ সস্তা রোমান্টিক চিন্তা তার শুষ্ক, নিরাবেগ, পাথুরে হৃদয়ে হঠাৎ একটা অস্পষ্ট ভালোলাগার গোপন ইঙ্গিত দিয়ে গেল।
— ‘কোথায় যাব?’ খুব আস্তে আস্তে প্রশ্নটা করল তুরিন।
— ‘কোথায় যেতে চাও তুমি?’
তুরিন রুদ্ধস্বরে বলল, ‘তুমি যেখানে নিয়ে যাবে সেখানেই যাব শাহজিদ। জাহান্নামে যেতেও রাজি আছি।’
— ‘তাহলে মন দিয়ে শোন। আজকে রাতের মধ্যেই তৈরি হয়ে নেবে। সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে নেবে। পাসপোর্ট নিতে ভুলবে না। আইডি আর সোশ্যাল সিকিউরিটি কার্ডও নিয়ে নেবে। টাকা-পয়সা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। লোকেশন সেন্ড করে দেব। একই সঙ্গে বের হওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি বেরনোর আধাঘণ্টা পর তুমি বেরোবে। আর তোমার পড়াশোনার তো সমস্যা হওয়ার কথা না। অনলাইন ক্লাস করতে পারবে, তাই না?’
— ‘পারব।’
— ‘এ কথাই থাকল তবে। কাল ভোরে দেখা হচ্ছে।’
‘দেখা হচ্ছে!’ দৃঢ়চিত্তে মন্ত্র পড়ার মতো বিড়বিড় করল তুরিন।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে খুব বেশিক্ষণ কথা বলাটা নিরাপদ নয় বলে দ্রুত প্রস্থান করল সে। শরীরের সব রক্তকণা কলকল করে যেন অনেক কথা বলছে। মনের মধ্যে সুখপাখির ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ। ভীষণ ভালো লাগছিল তুরিনের। যেন দীর্ঘদিনের মরণব্যাধি থেকে আরোগ্য লাভ হলো। এই অশান্তিময় অভিশপ্ত সংসার থেকে সে কাল সকালেই বিদায় নেবে। একা নয়, সঙ্গে থাকবে ভালোবাসার মানুষটি। এর চেয়ে আনন্দের ঘটনা আর কী হতে পারে জীবনে?
লিভিং রুমে জাহিদ বসে ছিল। টিভির সামনে। তুরিন ভেতরে ঢুকতেই চোখাচোখি হলো। চোখ সরিয়ে নিল তুরিন। জাহিদ একবার ভাবল মেয়েকে ডেকে কথা বলবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করল। মেয়ে এখন বড় হয়েছে। অযৌক্তিক অভিমানকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না।
এত কিছুর পরেও বাবার দিকে তাকালে তুরিনের মায়া হয়। এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সময় বাবার জন্যই সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগবে। অথচ এই মানুষটার কাছ থেকেই জীবনের সবচেয়ে বড় কষ্টটা পেল। বুকের মধ্যে অতল গতটা টের পায় তুরিন। ওই গর্ত বাবা খুঁড়ে দিয়েছে। আর কখনো সারবে না! খুব ভালো হবে তুরিন দূরে কোথাও চলে গেলে। বাবার একটা মস্ত শিক্ষা হবে!
লফটের রেলিঙের ধারে নিশা দাঁড়িয়েছিল। কোলে জুবিন। তুরিন সিঁড়ির মুখ বরাবর উঠে আসতেই নিশা খুব সহজ গলায় প্রশ্ন করল, ‘কী খবর?’
তুরিন এই প্রশ্নের উত্তরে কিছু বলল না। একটু সময় থমকে দাঁড়িয়ে থেকে কী যেন চিন্তা করল। তারপর হালকাভাবে বলল, ‘তোমার কী যেন বলার ছিল?’ তুরিন এতটা হালকা স্বরে নিশার সঙ্গে এর আগে কখনোই কথা বলেনি। নিশা লক্ষ করল তুরিনের মধ্যে একটু আগের হতাশ ভাবটা এখন আর নেই। বরং ওর খর্বকায় চোখের তারায় আনন্দমিশ্রিত একটা দ্যুতি ঝিলিক দিচ্ছে।
— ‘হ্যাঁ কথা ছিল। তুমি একবার আসবে আমার ঘরে?’
তুরিন কঠিন হতে গিয়েও পারল না। সিক্ত হয়ে আছে তার অভ্যন্তর। চেতনা বড্ড পিচ্ছিল। দৃঢ়তার সঙ্গে কিছু ভাবা যাচ্ছে না। তা ছাড়া নিশা কী বলল না বলল তাতে আর কী’ই বা এসে যায়? তুরিন তো চলেই যাচ্ছে। শাহজিদের সঙ্গে! আজকের পর থেকে এ বাড়ির সঙ্গে তার আর কোন সম্পর্ক থাকবে না। বাবা থাকুক তার নিশা আর জুবিনকে নিয়ে, মা থাকুক সো কলড সংসার, বয়ফ্রেন্ড আর স্ট্যাটাস নিয়ে, দাদা-দাদু থাকুক তাদের পারিবারিক মানসম্মান নিয়ে…তুরিন আর নেই এসবের মধ্যে! একটা বড় শ্বাস ফেলে খুব স্বাভাবিক গলায় তুরিন বলল, ‘চলো।’
নিশার ঘরে তুরিনের কখনো স্বেচ্ছায় আসা হয়নি। এদিকে তাকালেও গা ঘিনঘিন করত। এই বিছানায় তার বাবা… তুরিন আর ভাবতে পারল না। ভেতরে পা রাখা মাত্র গা-ঘিনঘিনে ব্যাপারটা পুনরায় ফিরে এসেছে তার মধ্যে। আড়ষ্ট হয়ে গেছে মন। নাকে তাচ্ছিল্যের একটা আলগা ভাঁজ পড়েছে। নিশার ঘরে শুধু একটা খাট, ড্রেসিং টেবিল, আর জুবিনের বেবিকট ছাড়া অন্য কোন আসবাব নেই। জুবিনের পুতুল পুতুল দুটি চোখে ঘুমের রেশ লেগে আছে। তুরিনকে দেখার পর থেকেই নানা রকম অঙ্গভঙ্গি এবং সাড়াশব্দ করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে সে। তুরিন যে টের পাচ্ছে না তা নয়। ইচ্ছাকৃতভাবেই সে জুবিনের দিকে তাকাচ্ছে না। মুখটা জোর করে শক্ত বানিয়ে রেখেছে। নিশা ঘরের দরজা আটকে দিয়ে বলল, ‘বসো।’
— ‘বসব না। যা বলার তাড়াতাড়ি বল। আমার কাজ আছে।’
— ‘জুবিন মনে হয় তোমার কোলে যেতে চাইছে। তুমি ওকে একটু নেবে?’ তুরিন জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে নিঃস্পৃহ ভাবে বলল, ‘নাহ।’
নিশা একটু কপট ব্যথিত গলায় জুবিনকে বলল, ‘আপু তোমাকে নিতে চায় না জুবিনসোনা! তুমি বরং মায়ের কোলেই থাকো।’
নিশার রংঢং আর সহ্য হচ্ছে না তুরিনের। মেয়েটার মতলব কী আসলে? সে অত্যন্ত কঠিন গলায় বলল, ‘আমি যাচ্ছি। সময় নেই আমার।’
— ‘দাঁড়াও দাঁড়াও…এত অস্থির হচ্ছ কেন?’ কথাটা বলতে বলতে নিশা জুবিনকে মেঝেতে নামিয়ে দিল। মুক্ত হতেই জুবিন তাত তাত করে থপথপিয়ে হেঁটে এলো তুরিনের কাছে। তুরিন তাকাল না। নড়লও না। জানালার বাইরে দূরের দৃষ্টি দিয়ে রাখল।
নিশা বিছানায় বসে খোলা চুলগুলো মুড়িয়ে খোঁপা বাঁধল একটা। স্তিমিত অথচ গভীর গলায় বলল, ‘আমি জানি তুমি আমাকে ঘৃণা কর। ঘৃণা করাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তুরিন, এই জীবনটা আমি নিজের ইচ্ছায় বেছে নিইনি। আমার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছিল। বিয়ের আগে আমি জানতাম না যে তোমার বাবার অন্য একজন স্ত্রী আছে।’
তুরিনের মুখ থেকে কাঠিন্যের ছায়াটা সরে গিয়ে একটু অন্যমনস্কতার ছাপ ফুটে উঠল। কিন্তু এই অন্যমনস্কতা সাময়িক। পরমুহূর্তেই সে আবার গম্ভীর হয়ে গেল। নিশা যে জানত না তার বাবার আরেকজন স্ত্রী আছে এই তথ্য নতুন। কিন্তু তুরিনের মনে হলো এগুলো সব ফালতু কথা। এসব কথার কোন মূল্য নেই। কারণ আগে জানত না ভালো কথা, যখন জানল তখন চলে যায়নি কেন? কে বেঁধে রেখেছিল তাকে? নিশা চোখ নিচের দিকে নামিয়ে খুব ধীরে ধীরে বলল, ‘আমার বাবা ছোটবেলায় আদর করে আমার নাম রেখেছিলেন তুষারকন্যা। বাবা বলত একদিন কোন দূর দেশের রাজারকুমার এসে আমাকে নিয়ে যাবে। আমি খুব ছোটবেলা থেকেই সেই রাজার কুমারের স্বপ্ন দেখতাম। আমাদের অভাবের সংসার ছিল। তোমার মা আমার নামে যা বলে আমি আদতে আসলে তাইই। গরিব…গেঁয়ো…পড়ালেখায়ও খুব আহামরি কিছু ছিলাম না। তবে একেবারে অশিক্ষিতও নই। দেশে থাকলে এতদিনে আমার গ্র্যাজুয়েশন হয়ে যেত। পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তোমাদের বাড়ি থেকে যখন প্রস্তাবটা এলো, বাবা এক মুহূর্তও দেরি না করে মত দিয়ে দিলেন। আমাদের বাড়িতে ছোটরা বড়দের মুখের ওপর কথা বলে না। ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও আমাকে বিয়েতে রাজি হতে হলো। আমার মৌনতাকে বাবা-মা সম্মতি বলে ধরে নিলেন। এদিকে বিয়েতে আমার মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো? তোমার বাবার ছবিটা দেখমাত্রই আমার খুব পছন্দ হয়ে গেল। মনে হলো এই বুঝি আমার স্বপ্নের রাজার কুমার। বলতে কোন দ্বিধা নেই আজ। তুমি তো যথেষ্ট বড় হয়েছে।’
তুরিন বিরক্তি নিয়ে বলল, ‘এসব কথা আমাকে বলছ কেন? তোমার পার্সোনাল বিষয়ে আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই।’
জুবিন অনেকক্ষণ ধরে তুরিনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। ক্রমাগত ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে বেচারি। এবার ভ্যা করে কান্না করে দিল। তুরিন নিরাসক্ত চোখে তাকাল ওর দিকে। নিরাসক্তভাবেই কোলে তুলে নিল। মুখে বলল, ‘আচ্ছা যন্ত্রণা তো!’
— ‘গল্পের আসল টুইস্ট কিন্তু এখনো আসেনি। গল্পের টুইস্ট কোন জায়গায় শুনবে? আমি ছোটবেলা থেকে নিজেকে তুষারকন্যা ভাবতাম। কিন্তু বিয়ের পর জানলাম কোন প্রিন্স চার্মিংয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়নি। পুরো বিয়েটাই একটা প্রতারণা। এই লোকের বৌ আছে এমনকি প্রাপ্তবয়স্কা এক কন্যাও আছে। যেদিন দেখলাম…ধবধবে ফরসা, সুন্দর পুতুলের মতো তোমাকে…সেদিন জানলাম আমি তুষারকন্যা নই…বরং তুষারকন্যার সত্মা!’
গল্পের টুইস্টটা যেরকমই হোক না কেন, তুরিনের মধ্যে হালকাপাতলা নাড়া দিয়ে গেছে। একটু অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে তাকে। এই অপ্রস্তুত অবস্থা সে নিশার সামনে প্রকাশ করতে চাইছে না। মুখে জোরপূর্বক একটা নিঃস্পৃহ ভাব ফুটিয়ে তুলতে চাইছে।
নিশা কথা বলতে বলতে হঠাৎ একটু হাসল, ‘তোমাকে তুষারকন্যা বলার একটা কারণ আছে। শাহজিদ এই বাড়িতে প্রথম এলো হ্যালোয়িনের আগের দিন। তোমার মনে আছে?’
শাহজিদের প্রসঙ্গ উঠতেই তুরিন আরো বেশি বিব্রত হয়ে পড়ে। চাপা স্বরে বলে, ‘হুম।’
জুবিন তুরিনের চুল নিয়ে খেলছে। তুরিন আপত্তি করছে না। নিজের চুলগুলো জুবিনের ছোট্ট হাতের মুঠোয় সমর্পণ করে কাচের জানালায় ঠেস দিয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
— ‘সেবার হ্যালোয়িনে তুমি স্নো হোয়াইট সেজেছিলে। আমার সেদিনই শাহজিদের সঙ্গে প্রথম দেখা। পা হারানো পঙ্গু ছেলেটাকে দেখে আমার খুব মায়া হয়েছিল। উঠোনে দাঁড়িয়ে টুকটাক কথা বলছিলাম। শাহজিদ তখনো আমার পরিচয় জানে না। হঠাৎ তুমি আর আনিতা নেমে এলে। তোমার পরনে তুষারকন্যার জামা। মনে হলো তুমি যেন রূপকথার বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছ। আর ঠিক সেই মুহূর্তে শাহজিদ যেভাবে তোমার দিকে তাকাল… সেই দৃষ্টি দেখা মাত্র বুঝলাম ও তোমাকে পছন্দ করে। আমি এও বুঝলাম এই তোমাদের প্রথম সাক্ষাৎ নয়। সে যাকগে। তুমি চলে যাওয়ার পর অনেকটা সময় ধরে শাহজিদ কেমন থম মেরে ছিল। সে বেচারার অবস্থা খারাপ। আমি একটু রসিকতা করলাম, স্নো হোয়াইটের প্রেমে পড়ে গেলে নাকি? শাহজিদ মুখ বাঁকিয়ে বলল, স্নো হোয়াইট না ছাই। ও হচ্ছে ইভিল কুইন। আমি হাসলাম কথাটা শুনে। হাসতে হাসতে বললাম। ইভিলকুইন ও নয়, বরং আমি ইভিলকুইন। আমি ওর সত্মা।’
জুবিন ঘুমিয়ে পড়েছে। তুরিনের কেমন এলোমেলো লাগছিল সব! বুকে একটা ভয়ের শিরশিরানি। প্রতিরোধের দেওয়াল ভেঙে যাচ্ছে ক্রমশ। নিশা আর শাহজিদকে নিয়ে একটা সময় কত বিরূপ ভাবনা ভেবেছে সে। সেসব কথা মনে করে কেমন একটু অনুশোচনা হচ্ছে আজ।
সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো নিশার ওপর সে এই মুহূর্তে কিছুতেই রাগ করতে পারছে না। মনের লাগাম শক্ত করে ধরার চেষ্টা করছে। নিজেকে বোঝাতে চাইছে…এখান থেকে উঠে পড় তুরিন। তোমার মা জানতে পারলে কতটা কষ্ট পাবে জানো তো? মায়ের কথা স্মরণে আসতেই মনের লাগাম ধরাটা তুরিনের জন্য সহজ হয়ে যায়। কর্কশ স্বরে বলে, ‘আমাকে এসব কথা বলার মানে কী? কে স্নো হোয়াইট, কে ইভিল কুইন এসব সিলি ইডিয়টিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর টাইম নেই আমার। তোমার যদি এতই অপছন্দ হয় আমাদের ফ্যামিলি তবে সব ছেড়ে চলে যাওনি কেন? যখন জানতে পারলে আমার বাবার আরেকজন স্ত্রী আছে, সন্তান আছে…তখন চলে যাওনি কেন?’
— ‘যেতে পারিনি।’
— ‘কেন?’
নিশা দীর্ঘশ্বাস ফেলল
— ‘ভালোবেসে ফেলেছিলাম!’
তুরিন থমকে গেল। অস্বস্তি দানা বাঁধল মুখে। কী যেন একটা বলতে গিয়েও বলল না আর। চুপ করে গেল। নিশা কেমন সম্মোহনের গলায় বলল, ‘জীবনের প্রথম প্রেম পায়ে ঠেলে দেওয়া খুব সহজ কাজ নয়। আমিও পারিনি। প্রিন্স চার্মিং আমার জীবনে আসেনি বটে…কিন্তু ভালোবাসা এসেছিল।’
তুরিন বিদ্রুপের হাসি হাসে, ‘প্রিন্স চার্মিং দিয়ে আর কী করবে তুমি… কিং চার্মিংই তো তোমার দখলে।’
কথাটা বলতে বলতে জুবিনকে বেবিকটে শুইয়ে দিল তুরিন। নিশা জিবের ডগায় আলতো একটা শব্দ করে বলল, ‘কথাটা মন্দ বলোনি। কিং চার্মিং!’
তুরিন আর কোন কথা না বলে দরজার দিকে পা বাড়াল। নিশা পেছন থেকে বলল, ‘তোমার বাবা খুব কষ্ট পাচ্ছে তুরিন!’
তুরিন থামল। ঘুরে তাকিয়ে দেখল নিশাকে। চোখে প্রশ্নের ঝিলিক। কিন্তু মুখে কোন শব্দ নেই।
— ‘পারলে একবার কথা বলে নিও। তোমাকে ভীষণ ভালোবাসে! প্রথম সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের টান অন্যরকম।’
— ‘অত টান থাকলে বাবা তোমাকে না, আমাকেই বেছে নিত।’ কেমন ছেলেমানুষি জেদ চেপে বসে তুরিনের কণ্ঠে।
— ‘ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে দেওয়া কি অত সহজ তুরিন? তুমি কি চাইলেই পারবে? শাহজিদকে ছেড়ে দিতে?’
তুরিন সর্পিণীর মতো বিষাক্ত চোখে নিশার দিকে চেয়ে কেটে কেটে বলল,
— ‘তোমার ধারণা আমার বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসে?’
— ‘ধারণা নয়। এটাই সত্য।’
— ‘বেশ তো। যে বাবা আমার মাকে ছেড়ে অন্য মেয়েকে ভালোবাসতে পারে…সেই বাবার প্রতি আমার আর কোন ফিলিংস নেই আজ থেকে।’
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ২০.৪
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক
শাহজিদের ঘুম হলো না। অনেক অনেক দিন পর নিজের ভেতর এক রকম বাঁধ-ছেঁড়া উত্তেজনা টের পাচ্ছিল সে। তার আমিময় মিত্রহীন চরাচরে এবার একজন ‘তুমি’র আবির্ভাব হবে! দুর্ঘটনার আগের জীবনটা অ্যাডভেঞ্চারে পরিপূর্ণ ছিল। দুর্ঘটনা-পরবর্তী পঙ্গুত্ব তার বেঁচে থাকার সমস্ত উত্তাপ রক্তচোষার মতো শুষে নিয়েছে। সে বুঝতে পারছিল এভাবে চলতে থাকলে পাহাড়ের সেই মরণস্বপ্নটা খুব দ্রুতই তাকে গিলে খাবে। একটা পরিবর্তন আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। তুরিনকে নিয়ে এই যে অজানার উদ্দ্যেশ্যে পাড়ি জমানোর দুঃসাহসিক অভিযান…এটা নেহাত আবেগজনিত বা প্রেমঘটিত নয়। বরং অনেক বেশি বাস্তবিক এবং স্বার্থসম্মত।
সুটকেস আগেই গোছানো ছিল। এখন শুধু ব্যাকপ্যাকে ল্যাপটপ, পাসপোর্ট, সোশ্যালসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছিয়ে নিল। দুর্দান্ত সুদর্শন রুপালি রঙের পিস্তলটা যত্নের সঙ্গে ভরে নিল প্যান্টের পকেটে। ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসব কাজ করতে কষ্ট যে হয় না, তা কিন্তু নয়। অল্প পরিশ্রমেই বেশ ধকল বয়ে যায় শরীরের ওপর দিয়ে। গলগল করে ঘাম ছোটে। তবুও নিত্যকার অপরিহার্য কাজগুলো নিজ হাতে করার মধ্যেই শাহজিদ একটু একটু করে নিজের কাছে জিতে যায়। এটুকু নিশ্চিত হতে পেরে স্বস্তির শ্বাস ফেলে যে অন্য কারো দয়ায় বা নির্ভরতায় তাকে বাঁচতে হবে না। যতদিন বাঁচবে, আত্মনির্ভরশীল হয়েই বাঁচবে। আগামী দিনগুলোতে তুরিন কি দৈনন্দিন কাজে তাকে সাহায্য করতে চাইবে? কেমন স্ত্রী হবে তুরিন? কেমন হবে ওদের দুজনার সংসার? বিয়ের পর একটা মেয়ের ওপর সম্পূর্ণ দখল, নির্ভরতা, শতভাগ বিশ্বস্ততা…এগুলো পুরুষ মানুষের সহজাত চাহিদা। মানসিকভাবে তুরিন এখনো যথেষ্ট অপরিপক্ব। পুরোদস্তুর স্ত্রীসুলভ আচরণ তার কাছ থেকে আশা করা বোকামি। অবশ্য শাহজিদ নিজেও খুব একটা সংস্কারপন্থি নয়। এমনকি তুরিন যদি বিয়ে না করে লিভ টুগেদার করতে চায় তাতেও কোন আপত্তি নেই।
কাল থেকে এই ঘরে আর থাকা হবে না। এখানে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ নিঃসঙ্গ দিনগুলো কেটেছে। এই বদ্ধ ঘরে একলা বসে বসে সে তুরিনের কথা বহুদিন বিনা কারণে ভেবে গেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে। কাল সেই তুরিনের সঙ্গেই নতুন একটা জীবন শুরু হবে। নতুন দিনের নরম সূর্যের অলৌকিক আঁচ টের পায় শাহজিদ। শিরদাঁড়ায় একটা মন কেমনের শিরশিরানি ওঠে। ভারী চঞ্চল হয়ে ওঠে হৃদয়। চনমনে ভাব আসে দেহে। জীবন তাকে আরেকবার গুটি চালার সুযোগ করে দিয়েছে। এইবারের দানে আর হারবে না সে।
ঘুম হলো না তুরিনেরও। কত কথা যে মনের ওপর দিয়ে এলো আর গেল! নচ্ছার সব উড়ু উড়ু ভাবনারা পলকা মেঘের মতো ভেসে ভেসে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে টানটান উত্তেজনায় অনুক্ষণ জাগ্রত করে রাখল। নির্ঘুম চোখের তারায় শত শত স্বপ্নের জোনাকি নিঃশব্দে জ্বলল আর নিভল। অনেকদিন তো পাহাড়ে থাকা হলো…এবার সমুদ্রের কাছাকাছি কোথাও গেলে ভালো হয়। ইস্ট অথবা ওয়েস্ট কোস্টে। সাগরের ধারঘেঁষে একটা বাসা হবে ওদের। ভোরের শামুকগন্ধী লোনা বাতাস উত্তাল ঢেউয়ে চেপে উড়ে এসে জানালায় টোকা দিয়ে ঘুম ভাঙাবে। একেকটা দিন স্রোতে ভেসে আসা জংলি ফুলের মতো সুন্দর হবে!
ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে নিয়ে জানালার ধারে এসে দাঁড়াল তুরিন। একটু আগেই দেখা হলো…তবুও এই মুহূর্তে শাহজিদকে আর একটিবার দেখতে পাবার দুর্মর তৃষ্ণা তার শ্বাসবায়ুতে একটা উচ্ছন্ন কম্পন সৃষ্টি করছে। রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে উড়ে যাচ্ছে পৃথিবীর উল্টো পিঠে। কিন্তু এই শুভ্র শীতল বরফকুচির একটানা একঘেয়ে রাত্রিটি যেন ফুরোতেই চাইছে না। ভোর চারটার দিকে শাহজিদ ফোন করল।
— ‘ঘুমোচ্ছিলে?’
— ‘ঘুম তো এলো না!’
— ‘বলো কী? সারারাত জেগে ছিলে?’
— ‘হুম।’
শাহজিদ একটু সময় চুপ থেকে আস্তে করে বলে, ‘আমিও!’
— ‘ঘুম হয়নি?’
— ‘নাহ।’
— ‘কেন?’
— ‘ঘুমাতে দিলে কখন তুমি?’
তুরিন এই প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে কিছু বলে না। হাসতে থাকে।
— ‘আসছ তো?’ হঠাৎ কেমন গম্ভীর গলায় প্রশ্নটা করে শাহজিদ।
— ‘এখনো সন্দেহ আছে?’
— ‘মেয়েদের ওপর আমি শতভাগ বিশ্বাস করতে পারি না। সব মেয়েরাই বোধহয় একটু স্বার্থপর, একটু মিথ্যুক আর একটু একটু লোভী হয়।’
— ‘সবাই তোমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের মতো না। এখন চটপট বলো কোথায় আসতে হবে।’
‘টেক্সট করে দিচ্ছি লোকেশন। আমার গাড়ি এসে গেছে। মিনিট দশেকের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ব।’
— ‘ঠিক আছে। পাঁচটার সময় মিট করছি তোমার সঙ্গে।’
— ‘যাবে কীভাবে? নাকি একসঙ্গেই বেরিয়ে পড়ব?’
— ‘একসঙ্গে বেরোনোটা রিস্ক হয়ে যায়। কেউ দেখে ফেললে সমস্যা হয়ে যাবে। উবার কল করব।’
— ‘পাঁচটার আগেই এসো। সাড়ে পাঁচটার দিকে স্নো-ফল শুরু হবে। স্টর্ম ওয়ার্নিং আছে। তৈরি হয়ে নাও। দেরি করো না।’
দেরি করল না তুরিন। মনের মধ্যে ফড়িং উড়ছে তিড়িংবিড়িং করে। সেই সঙ্গে ভয় আর উত্তেজনাও কম নয়। সাজগোজ তেমন একটা করল না। কালো জিন্স, গোলাপি টপ পরে নিল। লেদারের একটা সাদা জ্যাকেট হাতে নিয়ে নিল। বেরোবার আগ মুহূর্তে হঠাৎ বাবা-মার জন্য মন কেমন করে উঠল ওর। বিকেলে যখন বাসায় ফিরবে না, আর কোনদিনই ফিরবে না, বাবা-মা কি কষ্ট পাবে খুব? কষ্ট পাবে কি দাদা-দাদু? একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। নাহ… বিয়ের পর একবার ফিরে আসবে শাহজিদকে নিয়ে। দেখা করে যাবে পরিবারের সবার সঙ্গে। তবে আপাতত কিছুদিন গা-ঢাকা দিয়েই থাকবে। বাবাকে আর মাকে এবার একটা মস্ত শিক্ষা দিয়ে ছাড়বে!
খুব সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো তুরিন। বাবা-মায়ের ঘরের দরজা আধখোলা। তুরিন জানে ও ঘরে এখন বাবা নেই। মা একা। কদিন ধরে বাবা নিশার ঘরেই রাত কাটায়। কথাটা মনে পড়তেই বুকটা একটু চিনচিন করে ওঠে ব্যথায়। নিশার ওপর রাগ হয়। মার জন্য মন পোড়ে। আর বাবার জন্য? বাবার জন্য বুকের মধ্যে বিশাল বড় গর্ত! কষ্ট…বড় কষ্ট হয় তুরিনের। কেউ বোঝে না এই কষ্টের গভীরতা!
.
হঠাৎ কী কারণে যেন ঘুম ছুটে গেল জাহিদের। মাথা ভার হয়ে আছে। মনটা বিষাদে ছাওয়া! জুবিন বেবিকটে ঘুমোচ্ছে। নিশার নরম কোমল ডান হাতটা লতার মতো জড়িয়ে আছে ওর শরীর। নিশা ঘুমোচ্ছে নিশ্চিন্তে। নিঃশ্বাসে মৃদু ফোসফাস। খোলা চুল থেকে সুন্দর ঘ্রাণ উড়ে এসে লাগছে নাকে। জাহিদ একটা গভীর শ্বাস ফেলল। এই একটুখানিই তার পৃথিবী হতে পারত। সুন্দর, ছোট্ট, ছিমিছাম একটা পরিবার। কিন্তু হাজার চাইলেও শুধু এই দুজনের মধ্যে সে নিজেকে আটকাতে পারবে না। তুরিনের অভিমান, রাগ এবং বিচ্ছেদ তাকে তুষের আগুনের মতো পুড়িয়ে যাবে অহোরাত্র। এই পাগল একরোখা জেদি মেয়েকে বশে আনার সাধ্য আছে কার?
নিশার হাতটা খুব ধীরে ধীরে নিজের গায়ের ওপর থেকে সরিয়ে রাখে জাহিদ। বিছানা থেকে নেমে ঘুমন্ত জুবিনকে দেখে একবার। কপালে চুমু খায়। ছোট্ট ঘরটার ভেতর খালি পায়ে পায়চারি করে। বুকের চাপ বাড়তে থাকে। অশান্তি লাগে। মেয়েটা কি খুব বেশি কষ্ট পেল? মানসিক দিক থেকে একেবারে ভেঙে পড়বে না তো? জাহিদ ঠিক করল আজ সকালেই তুরিনকে ডেকে কথা বলবে।
তুরিন আনমনে মায়ের ঘরের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। পায়ে জুতো নেই এখন। কাঁধে ব্যাকপ্যাক। হাতে জ্যাকেট আর ছোট একটা ট্র্যাভেল ব্যাগ। যাওয়ার আগে মায়ের ঘুমন্ত চেহারাটা একবার দেখে নিতে চায় সে। বাইরে আলো ফোটেনি এখনো। হলওয়ে অন্ধকারে ছেয়ে আছে। একটু পরেই ফজরের ওয়াক্ত। দাদা-দাদু উঠে পড়বেন কিছুক্ষণের মাঝেই। তুরিনকে তার আগেই বেরিয়ে পড়তে হবে। মায়ের ঘরের দরজার সামনে পৌঁছে একটু চমকে ওঠে। মা কি জেগে আছে? এটা তো তার জেগে থাকার সময় নয়। ভোররাতের দিকে সে অঘোরে ঘুমোয়। ঘরের ভেতর থেকে পায়ের আওয়াজ ভেসে আসে। তুরিন কাঠের দরজার আড়ালে চট করে লুকিয়ে ফেলে নিজেকে । শ্বাসরোধ করে দেওয়ালের সঙ্গে শরীর ঠেকিয়ে দেয়। মায়ের কাছে কিছুতেই ধরা পড়তে চায় না। কিন্তু ভয় হচ্ছে ভীষণ! মা নিশ্চয়ই হলওয়ের বাতি জ্বালাবে। কারণ চারপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার। সাধারণ লোকে কখনো এমন বিকট অন্ধকারে চলাফেরা করে না। তারাই করে যাদের মনে বদ মতলব থাকে, চোরা কারবার থাকে। তুরিন রুদ্ধশ্বাসে আল্লাহর নাম নিচ্ছিল। ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এসেছে। এখুনি বুঝি বাতি জ্বলে উঠল! আল্লাহ বাঁচিয়ে দিলেন…বাতিটা জ্বলল না। আতঙ্কে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে ত্রস্ত তুরিন দেখল ফারার লম্বা, শীর্ণ, তন্বী দেহখানি ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর দিয়ে অতি সতর্কতার সঙ্গে সিঁড়ি অভিমুখে এগিয়ে যাচ্ছে। আকণ্ঠ উত্তেজনায় ডুবে থেকেও সে বুঝল মায়ের হাঁটার কায়দাটার মধ্যে একটা লুকোচুরির ভাব আছে। হঠাৎ প্রশ্নটা টুং করে টোকা দিল মাথায়। এই ভোররাতে মা কোথায় যাচ্ছে? অন্ধকারে চুপিচুপি?
তুরিন খুব বেশিকিছু ভাবতে পারল না। পা বাড়াল সামনে। নিঃশব্দে এগোতে লাগল ফারার পিছু পিছু। লিভিংরুমে কম পাওয়ারের একটা দুর্বল আলো জ্বলছে। সেই আলোর ক্ষীণ রেশ এসে পড়েছে সিঁড়িতে। কয়েক ধাপ নেমে ফারা একবার থমকে দাঁড়াল। ঘুরে তাকাল পেছনে। সিঁড়ির ডানপাশে একটা উঁচু বইয়ের তাকের পেছনে নিজেকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে ছিল তুরিন। ফারা ওকে দেখতে পেল না। সদর দরজার সামনে এসে একবার চারপাশে সতর্ক ভাবে চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর খুব ধীরে ধীরে দরজাটা খুলল। তুরিন নেমে এলো নিচে। নিঃশ্বাস আটকে আছে গলার কাছে। ছাড়ার সাহস নেই।
চারিদিক বড্ড নীরব। মনে হয় যেন নিঃশ্বাসের ওই একটুখানি শব্দেই ঘুম ভেঙে যাবে গোটা পৃথিবীর। মা আসলে যাচ্ছে কোথায়? জগিং করতে? কিন্তু রাতের অন্ধকারে কীসের জগিং? পোশাকটাও তো পালটায়নি। গায়ে ঢলঢল করছে ঘরোয়া ম্যাক্সি। ওপরে একটা পাতলা চাদর।
তুরিন দরজাটা অল্প একটু ফাঁক করে উঁকি দিল। প্যাটিওতে কেউ নেই। মা কোথায় গেল? ভ্রু কুঁচকে গম্ভীরভাবে দরজার সামনে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে তুরিন। কান খাড়া। উৎকর্ণ মন। স্নায়ু টানটান। কী করবে? এখন বেরোলেই তো মায়ের কাছে ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এদিকে শাহজিদ আরো মিনিট দশেক আগে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। হঠাৎ একটা ফিসফিস শব্দ উঠল হাওয়ায়। ফারা কথা বলছে। খুব নিচু স্বরে।
— ‘কী ব্যাপার? সমস্যা কী তোমার?’
কণ্ঠস্বর ভেসে আসছে ডানদিকের কটনউড গাছের আড়াল থেকে। ওদিকে ব্যাকইয়ার্ড যাওয়ার রাস্তা। মা কার সঙ্গে কথা বলছে? এই অসময়ে কে এলো মার কাছে?
— ‘তোমাকে নিষেধ করেছিলাম এ বাড়িতে আসতে। তবুও তুমি এলে কেন? আমার সর্বনাশ না করে ঘুমাতে পারছ না, তাই না?’
তুরিন দরজা ঠেলে এগোলো কয়েক পা। প্যাটিওর ডান পাশে, দেওয়ালের একদম শেষ মাথায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল চোরের মতো। গাছের আড়ালের মানুষগুলোকে দেখা যায় না। তুরিন দেখার চেষ্টাও করল না। কান খাড়া করল শুধু। একটা পুরুষ কণ্ঠ কথা বলছে এখন। খুব চেনা কণ্ঠটা।
— ‘তুমি ফোন রিসিভ করলেই তো আর কোন ঝামেলা হতো না। আমাকেও এত রাতে আসতে হতো না। কয়টা মিসডকল গেছে তোমার ফোনে?
কথাগুলো শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিল তুরিনের। কণ্ঠটা চিনেছে সে।
— ‘ফোন কেন দিচ্ছ বারবার? আমি তো বলেই দিয়েছি তোমার সঙ্গে আমি আর নেই।’
— ‘আমার সঙ্গে তুমি আর নেই? এত সোজা? তুমি বললে আর আমি মেনে নিলাম, তাই না?’
‘অনিমেষ শোন, অনেক হয়েছে। এবার প্লিজ আমাকে আমার মতো ছেড়ে দাও। আমার লাইফে ইন্টারফেয়ার করা বন্ধ কর। শুধু তোমার জন্য আজকে আমার সংসারটা ভেঙে ছারখার হয়ে গেল!’
— ‘কীসের সংসার? এই বাড়িতে তোমার কোন সংসার-টংসার নেই।’
— ‘উফ…অনেক হয়েছে! প্লিজ এখান থেকে যাও। আর কোনদিন এসো না। তোমার স্পর্ধা কতবড় ওই ল্যাংড়া ছেলেটাকে তুমি আমার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইছিলে? ছিঃ লজ্জা করে না তোমার?’
তুরিন কাঁপতে থাকে। গা শিউরে ওঠা ভয়ের চাবুক সপাং সপাং আঘাত হানে শরীরে। শিরদাঁড়া টনটন করে।
‘আমার মেয়েটাকে আমার কাছ থেকে জোরপূর্বক ছিনিয়ে নিতে, আমাকে বাবার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে তোমার লজ্জা করে না ফারা?’
— ‘তুরিনের ওপর তোমার কোন রাইট নেই।’
— ‘একশ বার আছে। তুরিন আমার মেয়ে!’
— ‘শুধু জন্ম দিলেই বাবা হওয়া যায় না অনি! বাবা হওয়ার অন্যরকম যোগ্যতা লাগে। যেটা তোমার নেই, জাহিদের আছে! আজকে আমার আফসোস হয় তুরিন কেন সত্যিই জাহিদের মেয়ে হলো না? কেন আমি তোমার জন্য জাহিদের মতো একজন নিপাট ভালো মানুষকে ঠকিয়েছিলাম!’
প্রকাণ্ড এক বেগবান ঢেউ আচানক তেড়ে এসে তুরিনের সমস্ত অস্তিত্ব এবং চেতনায় সুতীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। অনেক উঁচু থেকে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলে বুক যেমন খালি হয় ঠিক সেরকম একটা খালি খালি ভাব হাঙর মাছের বিশাল হাঁ করা মুখের মতো টপ করে গিলে খায় ওকে। কানে ঝিঁঝি ধরে যায়। আঙুল দিয়ে কয়েকবার কান পরিষ্কার করে তুরিন। কী শুনল? কী শুনল মাত্র? ভুল শুনেছে নিশ্চয়ই!
প্যান্টের পকেটে রাখা সেলফোন ভাইব্রেট হচ্ছিল। ভনভন শব্দটা রাতভোরের নিস্তব্ধতাকে কাঁপিয়ে দিল একদম। তুরিন স্খলিত হাতে পকেট থেকে ফোন বের করল। শাহজিদের ফোন। ফারা ভাইব্রেশনের শব্দ শুনতে পেয়ে চমকে উঠেছে, ‘কে ওখানে?’
দ্রুত পা চালিয়ে প্যাটিওর কাছাকাছি এল সে। সেলফোনের আলোয় তুরিনকে স্পষ্ট দেখতে পেল।
মুহূর্তের মধ্যে ওর মুখ থেকে সরে গেল রক্ত। কাগজের মতো সাদা খসখসে দুটি ঠোঁট নেড়ে অনেক কষ্টে বলল, ‘তুমি এখানে?’
তুরিনের সেলফোন অনবরত ভাইব্রেট হচ্ছে। বিকিরণ করছে আলো। সেই নীলচে আলোর রহস্যময় উপস্থিতিতে খোলা চুলের তুরিনকে তখন অভিশপ্ত প্রেতাত্মার মতো দেখাচ্ছিল। তার শ্বাস পড়ছে না। পড়ছে না চোখের পলক। হাতে ধরা ফোনটা রিসিভ করার কোন লক্ষণও তার মাঝে দেখা যাচ্ছে না। গা ছমছমে সর্বনাশা এক ভেদক দৃষ্টিতে সে ফারার দিকে চেয়ে আছে। ঠিকমতো লক্ষ করতেই ফারা বুঝল তুরিনের শরীর অসম্ভব কাঁপছে। এত বেশি কাঁপছে যে হাতের সেলফোনটা খুব বেশিক্ষণ কম্পনরত পাঁচ আঙুলের মধ্যে আটকে রইল না। পড়ে গেল মেঝেতে। ফারার মনে হলো এই তুরিনকে সে চেনে না। বাতাসে বারুদের গন্ধ ভাসছে। মনে হচ্ছে একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটতে যাচ্ছে কিছুক্ষণের মধ্যেই। হাত-পায়ের প্রতিটি সন্ধি আতঙ্কে খিল ধরে যাচ্ছে। নিজেকে সামলাবার জন্য প্যাটিওর থামের ওপর একটা হাত রাখল ফারা। কুঁজো হয়ে খানিকটা ছেড়ে দিল শরীরের ভর। মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে যাওয়া মুমূর্ষু রোগীর মতো হাঁফধরা গলায় বলল,
— ‘তুমি এখানে কী করছ তুরিন?’
গাছের আড়াল থেকে অনিমেষ বেরিয়ে আসে। সটান দাঁড়িয়ে পড়ে ফারার পাশে। তুরিন চেয়ে আছে মায়ের দিকে। চেয়ে আছে এক পৃথিবী বিভ্রম, অবিশ্বাস আর আতঙ্ক নিয়ে। চোখে টগবগ করছে রক্ত। হিড়হিড় করে দাঁতে লাগছে দাঁত। টালমাটাল পায়ে বাড়ির সদর দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে। ফারা পেছন থেকে হাঁক ছাড়ে, ‘কোথায় যাচ্ছ? কী হয়েছে তোমার? দাঁড়াও!…দাঁড়াও বলছি!’
তুরিন ভেতরে ঢুকতেই ফারা অপ্রকৃতস্থের মতো অনিমেষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ‘তুমি আমার সব শেষ করে দিলে। সব শেষ করে দিলে! এবার খুশি হও। খুশি তো এবার?’ ফারার মাতম দেখে মনে হয় এইমাত্র কোন নিকটাত্মীয় পরপারে পাড়ি জমিয়েছে। ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো ছটফট করতে থাকে সে। অনিমেষের বুকে এলোপাতারি আঘাত হানে। এমন বুকভাঙা কান্না কাঁদতে থাকে যে দেখে মনে হয় এখুনি কণ্ঠার রগ ছিঁড়ে যাবে, ফিট হয়ে নইলে চূড়ান্ত পাগল অবস্থায় মেন্টাল হাসপাতালে দাখিল হবে এই নারী। তুরিন তাড়া খাওয়া আসামির মতো ছুটে যাচ্ছিল বাড়ির ভেতর। পা চলতে চাইছে না। নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে। চোখের সামনে বাদুড়ের মতো ঝুলে আছে অভিশপ্ত অন্ধকার। চৈতন্যবোধ ক্রমেই ভেসে যাচ্ছে দুর্বার এক জলোচ্ছ্বাসে। বুকের পাঁজর চূর্ণবিচূর্ণ করে আত্মার অন্তঃস্থল থেকে শুধু একটি ডাক ঊর্ধমুখী হয়ে ছুটে আসতে চাইছে…বাবা! বাবা! বাবা!
জাহিদ হাঁটতে বেরোবে। দোতলার সিঁড়ির সামনে এসে থমকে গেল। তুরিন বিকৃতমস্তিষ্ক উন্মাদের মতো দৌড়ে আসছে। তার চোখ রক্তবর্ণ। ঠোঁট সাদা। মুখ দিয়ে অদ্ভুত গোঙানির মতো শব্দ হচ্ছে। মেয়ের এই দশা দেখে বুক কেঁপে উঠল জাহিদের। হায় আল্লাহ! কোন বিপদ হয়নি তো? এরকম করছে কেন মেয়েটা? তুরিন সিঁড়ির মুখে জাহিদকে দেখে কান্নাজড়িত অস্পষ্ট কণ্ঠে একবার ডাকল, ‘বাবা!’
ডাকতে ডাকতে অবিন্যস্ত পায়ে মাঝ সিঁড়িতে উঠে এলো সে। জাহিদ দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে নিচে নামতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় তুরিন আর্তস্বরে বলে উঠল, ‘বাবা…তুমি কি আমার বাবা না? ‘
অদ্ভুত প্রশ্নটা জাহিদের হৃৎপিণ্ড খামচে ধরল। বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল সে। ঠিক সেই সময় হঠাৎ পিছলে গেল তুরিনের বেসামাল ডান পা। ভারসাম্যহীন শরীরটা মুহূর্তের মধ্যে কাটা গাছের মতো নেতিয়ে পড়ল… সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে ধাক্কা খেয়ে…ছেঁচড়ে ছেঁচড়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল নিচে। হতভম্ব, শঙ্কিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাহিদ মেয়েকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হলো না। তুরিনের নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ল লিভিংরুমের মেঝেতে। পরনের গোলাপি জামা তখন গাঢ় লাল রক্তে মাখামাখি!
.
সেকেন্ডের কাঁটা গড়িয়ে যাচ্ছে, আঙুলের ফাঁক গলে গড়িয়ে পড়া ঝরনার জলধারার মতো। মেইনস্ট্রিটের একটা স্টারবাক্সের সামনে গাড়ি পার্ক করেছে শাহজিদ। তুরিনের আসার কথা পাঁচটায়। এখন পৌনে ছয়টা বাজে। বিগত চল্লিশ মিনিট ধরে ক্রমাগত ডায়াল করে গেছে ওর নাম্বারে। তুরিন রিসিভ করেনি। হয়তো শেষ মুহূর্তে আর সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু কথা দিয়ে কথা না রাখা বড় ধরনের প্রতারণা। প্রতারকদের শাহজিদ ঘৃণা করে। হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা মনে হতেই আপনমনে বিদ্রুপাত্মক হাসি হাসল শাহজিদ। ফারার মেয়ে হয়ে তুরিন আর কতটাই বা বিশ্বস্ত এবং বিবেকবান হবে? রক্ত তো একদিন কথা বলবেই! এমন মায়ের মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে হয়তো ভুল করেছিল সে। মস্ত ভুল!
গতকাল সবকিছু পেয়ে গিয়ে বুঝেছিল এতদিন তার জীবনে কতটা শূন্যতা ছিল। শূন্যস্থান পূরণ হলেই শূন্যতার অস্তিত্ব সবচেয়ে বেশি করে অনুভব করা যায়। আবার পূরণ হওয়া শূন্যতা কোন আগাম বার্তা ছাড়া হুট করে গায়েব হলে পূর্বের শূন্যতা আগের চাইতেও প্রবল শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে। সঙ্গে থাকে পরাজয়ের গ্লানি আর অপমান।
গাড়ি নিয়ে মূল রাস্তায় উঠে আসে সে। একবার অন্তত তুরিনের মুখোমুখি দাঁড়াবে। বাইরে ভোর ফুটেছে মাত্র। সাদা তুলোর ফুলঝুরি হয়ে উড়ছে তুষার! গাড়ির জানালার কাচে জমছে কুয়াশা। সুবিশাল, শীতার্ত সাদা আকাশটা ক্রমেই টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙেচুরে এই স্বার্থপর পৃথিবীর পেটের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। মিশে যাচ্ছে শাহজিদের বুকের মধ্যে। ভয়ংকর হতাশায় মথিত হয়ে উঠছে নিঃশ্বাস। আগেও বহুবার হোঁচট খেয়েছে। কিন্তু এবারের হোঁচট বোধহয় ওর শিরদাঁড়া পিষে একেবারে গুঁড়ো করে দিয়ে গেল। মনে মনেও আর কোনদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে কিনা কে জানে! শরীরের পঙ্গুত্ব থেকে মনকে বাঁচিয়ে রেখেছিল এতকাল…এবার বুঝি মনের পঙ্গুত্বও এসে গেল।
বাবার মৃত্যু দিনটার কথা মনে পড়ে অতর্কিতে। সেদিনও এমন ভর ভরন্ত তুষার ছিল। চারিদিকে নিষ্কলুষ শুভ্র তুহিনের ঘেরাটোপ। এতদিন বাদে আবারও ওর মনের মধ্যে দু কূল ছাপিয়ে নদীর ঢলের মতো নেমে এলো সেদিনের হাহাকার…সেদিনের রিক্ততা…সেদিনের বিষণ্নতা! দীর্ঘশ্বাসের চোরাকাঁটায় বিঁধে বিঁধে শ্বাসনালি রক্তাক্ত হয়ে উঠল। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে একটা অভিশপ্ত কণ্ঠস্বর ক্রমাগত বলতে লাগল…তোমার কেউ নেই…কেউ নেই…তুমি বড্ড একা!
চলতে চলতে হঠাৎ সাদা তুষারের তুমুল তাণ্ডবের মধ্যে দূরের রকি মাউন্টেন চোখে পড়ে। রুপালি বরফের মুকুট পরা সর্বোচ্চ শিখরখানি আয়নার মতো চমকাচ্ছে। আকাশের কাছাকাছি তার অবস্থান…তবুও আকাশ থেকে যেন সে আরো উঁচু, আরো উদার…সীমাহীন তার হৃদয়ের বিস্তার! শাহজিদের মতো একা, বিষণ্ন, হতাশ মানুষদের জীবনের সব শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজের বিশাল বুকে লুকোনোর জন্য ওত পেতে থাকে মায়াবিনী ওই কুহেলী পর্বত। রুপার পাতে মোড়া ঐন্দ্রজালিক পাহাড়চূড়ো সাদা বকুলের ঝিরিঝিরি বরফকুচি খামে করে পাঠায় চিঠি। সেই চিঠিতে দূরের হাতছানি! পুলকসর্বস্ব আচানক শিহরণ বয়ে যায় শাহজিদের মেরুদণ্ড দিয়ে। সুগভীর এক অলৌকিক সম্মোহনে গা ছমছম করে ওঠে। লুপ্ত হয়ে যায় বাস্তববোধ। মাথাচাড়া দেয় সেই গোপন দুর্ধর্ষ স্বপ্ন! প্যান্টের পকেটে রাখা পিস্তলটার ওপর অজান্তেই হাত চলে যায়। ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নেয়। হাত বুলোয় যত্নের সঙ্গে। তারপর তার মনের দর্পনে উড়তে থাকে সাদা পায়রার মতো একঝাঁক খুশিয়াল বরফবিন্দু…একটা বিকট শব্দ…পর্বতের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকা জীবজন্তুর সচকিত চিৎকার…ঝকঝকে ধবল বরফের ওপর ছিটকে পড়া টকটকে লাল রক্তের গা শিউরানো আলপনা…দেহ নামক খাঁচা থেকে একটা অতৃপ্ত আত্মার মুক্তি। আহ………..শান্তি!
সেলফোনটা ঝনঝন শব্দে বেজে ওঠে হঠাৎ। দিবাস্বপ্নে ভাঙন ধরে। শাহজিদ সচকিত হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়। নিশা ফোন করছে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিশার উত্তেজিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, ‘কোথায় তুমি?’
— ‘আমি বাইরে। তোমার গলা এরকম শোনাচ্ছে কেন?’
নিশার কণ্ঠস্বর ভেঙে এলো, ‘একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আমরা হাসপাতালে এসেছি।’
গা-কাঁটা দিয়ে উঠল শাহজিদের, ‘দুর্ঘটনা মানে? কী হয়েছে?’
— ‘তুরিন ইনজুরড। আমরা সবাই লংসপিক হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে আছি এখন। চলে এসো তাড়াতাড়ি।’
বরফকুচি খামে দূর পাহাড়ের ডাক – ২১
২১
তুরিন আইসিউতে। মাথায় চোট লেগেছে তবে মূল আঘাত সংগঠিত হয়েছে দেহের ডান পাশের অংশে। কাঁধের হাড় মারাত্মকভাবে স্থানচ্যুত হয়েছে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে সে এখন সংজ্ঞাহীন।
রক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। হাসপাতালের লবিতে পরিবারের সবসদস্যই উপস্থিত আছে এই মুহূর্তে। ফারা দাঁড়িয়ে আছে লম্বাটে ঘরটার একদম শেষ প্রান্তে। তার মুখমণ্ডল নিস্পন্দ, ফ্যাকাসে এবং স্থবির। চোখের মণিদ্বয় যেন অচল পাথর। পাশেই অনিমেষ দাঁড়িয়ে আছে। তার একটি হাত ফারার কাঁধের ওপর রাখা।
.
জাহিদকে দেখে মনে হচ্ছে তার গায়ে অনেক জ্বর। কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। জ্বরগ্রস্ত, ঘোরগ্রস্ত উন্মাদের মতো লবির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পায়চারি করছে। হৃৎপিণ্ড মুচড়ে মুচড়ে রক্তপাত হচ্ছে। কানের কাছে ক্রমাগত বেজে চলেছে তুরিনের বলা শেষ কথাটা, বাবা…তুমি কি আমার বাবা না? মেয়েটা কেন এই প্রশ্ন করতে গেল হঠাৎ? বাবা হিসেবে সে কি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে? পাগলি মেয়েটা কিসের অভিমানে অমন দিশেহারা হয়ে উঠেছিল? কী কষ্ট ছিল তার মনে? বিগত কয়েকটা দিন মেয়ের সঙ্গে কঠোর আচরণ করেছিল সে। এখন সেই কথা মনে পড়ায় নিজের প্রতি অভক্তি জন্ম নিল। হৃদয় বিদীর্ণ হলো আত্মগ্লানিতে।
নিশা এগিয়ে এসে জাহিদের একটা হাত ধরে বলল, ‘আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন তো। এত দুশ্চিন্তা করবেন না। ইনশাআল্লাহ তুরিন সুস্থ হয়ে উঠবে।’ জাহিদ ব্যাকুল গলায় বলল, ‘নিশা, তুরিন আমাকে খুব অদ্ভুত একটা প্রশ্ন করেছিল অ্যাক্সিডেন্টের আগে। আমি বুঝতে পারছি না এই প্রশ্নটা হঠাৎ ওর মাথায় কেন এসেছে।’
— ‘কী প্ৰশ্ন?’
— ‘ও জানতে চাইছিল আমি ওর বাবা হই কি না।’
নিশা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। বিস্ময়ের আঁকিবুকিতে ভরপুর হয়ে উঠল মুখ। মিসেস মুর্তজা কাছাকাছিই ছিলেন। হঠাৎ আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘কী প্রশ্ন করেছিল তুরিন?’
জাহিদ প্রশ্নটা আরেকবার উচ্চারণ করল। মিসেস মুর্তজা চমকে উঠলেন। তাঁর মুখের বলিরেখায় সুস্পষ্ট এক আতঙ্কের ছাপ থরথরিয়ে কেঁপে উঠল উত্তেজিত, দুশ্চিন্তগ্রস্ত, বেহেড জাহিদ মায়ের ভেতরকার এই পরিবর্তনটুকু টের পেল না। নিজস্ব ব্যথা-বেদনায় বুঁদ হয়ে রইল। কিন্তু নিশার চোখ এড়াল না কিছুই। শাশুড়ির মুখ থেকে হঠাৎ রক্তের পর্দা সরে যাওয়ার পেছনের কারণটা স্পষ্টভাবে না জানলেও তার মনের ভেতরে একটা গোপন ঘণ্টা টুংটাং করে জানান দিচ্ছে যে কিছু একটা গোলমাল নিশ্চয়ই আছে। ঘরের কোনায় ফারা আর অনিমেষের অন্তরঙ্গ অবস্থায় গায়ে গা-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যটাও তো স্বাভাবিক নয়। কিন্তু শ্বশুর-শাশুড়ি বা জাহিদ কেউই বিষয়টা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। যেন ফারার কাঁধে হাত রাখার অধিকার আছে অনিমেষের। শাহজিদ এলো গুচ্ছের বরফকুচি মাথায় নিয়ে। ভেজা গাল, ভেজা শরীর। শীতের কাঁপুনি সারা গায়ে। ক্রাচে ভর দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে নিশার দিকে এগিয়ে এলো সে।
— ‘তুরিন কেমন আছে?’
নিশা সংক্ষেপে যতটা সম্ভব খুলে বলে। শাহজিদ থম ধরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। বুকের হৃৎপিণ্ড গুলিবিদ্ধ কবুতরের মতো ছটফট করে। গলা দিয়ে কোন স্বর বেরোয় না। অত উঁচু সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে যাওয়ার সময় কেমন লেগেছিল তুরিনের? ওর সুন্দর, মসৃণ, খরগোশের মতো নরম শরীরটা সিঁড়ির ধাপে ধাপে ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নিচে, এই ঘটনা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না শাহজিদ। প্রকৃতি এতটাও নিষ্ঠুর হতে পারে না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে অদম্য কষ্টে। চোখের কার্নিশে ঝাপটা মারছে অশ্রুজলের ঢেউ। তার সঙ্গেই কেন সব সময় এমন হয়? যখনই সে বেঁচে থাকার সংকল্প করে, স্বপ্নের দুয়ার খুলে অপেক্ষা করে নতুন ভোরের… ঠিক তখনই অদৃষ্টের বিদ্রুপাত্মক অট্টহাসি বজ্রপাতের মতো পতিত হয় মাথায়। ধূলিসাৎ করে দেয় সবকিছু। কিছু মানুষকে প্রকৃতি শুধু পরীক্ষা করতেই ভালোবাসে…এদের গোটা জীবনটাই একটা পরীক্ষা…প্রতি পদক্ষেপে পরীক্ষা…প্রতি নিঃশ্বাসে পরীক্ষা। এক টুকরো হাসির বিনিময়ে এক আকাশ কান্নার বৃষ্টি কিনে নিতে হয় এদের। শাহজিদ সেই সব হতভাগ্য মানুষদেরই একজন! জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কোনদিনই কাঁদেনি সে। কিন্তু আজকে তার দৃষ্টিপথ ঝাপসা হয়ে উঠেছে জলের দাপটে। সমস্ত সত্তা দিয়ে অনুধাবন করতে পারছে তুরিন তার কতটা জুড়ে ছিল…কতটা গভীরভাবে ছিল…এই গভীরতার নামই বোধহয় ভালোবাসা!
.
কয়েকটা বিষাদময় প্রলম্বিত ঘণ্টা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খসে গেল সময়ের পাতা থেকে। লবিতে বসে থাকা মানুষগুলো সারাদিন অভুক্ত। মুর্তজা সাহেব ডায়বেটিসের রোগী। তাঁকে জোরজার করে খাওয়ানো হলো। সন্ধ্যা সাতটার দিকে জ্ঞান ফিরল তুরিনের। ডিসচার্জ করা হল আইসিইউ থেকে। নার্স জানাল খুব বেশি হলে দুজন লোক দেখা করতে পারবে রোগীর সঙ্গে। এর বেশি মানুষ কেবিনে ঢোকার অনুমতি নেই। রোগীর অবস্থা এখনো পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নয়। দুজন মানুষ নির্বাচন করার ক্ষেত্রে জাহিদ আর ফারাই প্রাধান্য পেল। তা ছাড়া জাহিদ কারো অনুমতির অপেক্ষাও করল না। জ্ঞান ফেরার খবর পাওয়া মাত্র ছুটে চলল কেবিনের দিকে।
তুরিনের পরনে হাসপাতালের নীল গাউন। হাতে-পায়ে ব্যান্ডেজ। কপালের সাদা ব্যান্ডেজ ভেদ করে উঁকি দিয়েছে এক ঝোঁকা তাজা লাল রক্ত। বাঁ হাতে স্যালাইনের নল। জাহিদের পিছু পিছু ফারাও এগিয়ে এসেছে। তার সর্ব শরীর কাঁপছে অপ্রতিরোধ্য উদ্বেগ উত্তেজনায়। এলোমেলো চুলের লহর ডাইনির কেশের মতো ফুলে-ফেঁপে আছে। ভীত সন্ত্রস্ত চোখে ধকধক করছে রক্তের ছোপ। দেখলে মনে হয় যেন এই মানুষ ভয়ংকর এক মরণব্যাধিতে আক্রান্ত। তুরিনের আধবোজা চোখের কার্নিশে আবছা জলের আভাস। মুখখানা পাঁশুটে। পায়ের শব্দ পেয়ে দুর্বল চোখের পলক মেলে ধরল সে। ঠোঁট কেঁপে উঠল থরথর করে। অস্ফুটে ডাকল একবার, ‘বাবা!’
জাহিদ মেয়ের কপালস্পর্শী চুলের গোছায় চুমু খেল, ব্যাকুল স্বরে বলল, ‘বলো মা…কেমন আছ এখন?’ ফারা জাহিদের পিঠের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে।
ভয় খেলছে তার মুখে। অনিরাপত্তা এবং অনিশ্চয়তার দুর্বিষহ কাঁটা গেঁথে আছে পাঁজরের মধ্যে। মনে হচ্ছে যেন পুলসিরাত পার হচ্ছে। পা ফসকে গেলেই জাহান্নামের আগুনে নিপতিত হবে দেহ। মেয়ের চোখে তাকাতে আজ সংকোচের চেয়ে ভয় বেশি। তুরিনের কি সব কথা মনে আছে? এত বড় দুর্ঘটনা ঘটার পর মনে থাকার তো কথা না। মাথায় চোট পেয়েছে মেয়ে। ফারা মনে মনে প্রার্থনা করতে লাগল মেয়ে যেন সুস্থ হয়ে ওঠে দ্রুত, কিন্তু কোন একভাবে তার স্মৃতিশক্তি যেন ভস্ম হয়ে যায়। জাদু জানলে সে নিশ্চয়ই এই মুহূর্তে মেয়ের জন্য একটা স্মৃতিভ্রষ্টের ম্যাজিক পোরশোন বানিয়ে নিত।
তুরিন বাবার পেছনে মাকে চোরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। শরীরের ডানদিকে অসহ্য ব্যথা। মাথা ভার। চিন্তা শক্তি ক্ষীণ। জাহিদের মুখের ওপর কম্পমান চোখের তারা স্থাপন করে ভারী জিবটা অনেক কষ্টে নেড়েচেড়ে বলল, ‘বাবা…তুমি কি আমার বাবা নও? আরন’ট ইউ মাই বায়োলজিক্যাল ফাদার?’
জাহিদের বুক মোচড় দিয়ে ওঠে। মেয়ে আবারও এই অদ্ভুত যুক্তিহীন প্ৰশ্ন কেন করছে? আশ্চর্য তো!
— ‘এটা কেমন ধরনের প্রশ্ন?’ হন্যে হয়ে জানতে চায় জাহিদ।
ফারা ত্রস্তে এগিয়ে এলো সামনে। তুরিনের মাথায় একটা হাত রেখে বলে, ‘এখন কেমন ফিল করছ সুইটহার্ট?’
চিৎকার করে উঠল তুরিন, ‘ডোন্ট টাচ…স্টে অ্যাওয়ে ফ্রম মি!’
মায়ের প্রতি মেয়ের এই বিরূপ আচরণ দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল জাহিদ। তুরিন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে ফারাকে বলল ‘তুমি মিথ্যুক, তুমি প্রতারক। আমি তোমাকে ঘৃণা করি। বাবা, তুমিও কি জানতে সবকিছু? তুমিও কি প্রতারণা করেছ আমার সঙ্গে? সব জেনেশুনে না জানার ভান করে গেছ সারাটা জীবন ধরে?’
রোমহর্ষক বিস্ময়ে মাথার চুল থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে জাহিদের। হৃৎপিণ্ডে হাতুড়ির বাড়ি পড়তে থাকে ক্রমাগত। সীমাতীত আতঙ্কে জমে আসে কণ্ঠস্বর। ফ্যাসফ্যাস করে কোনরকমে বলে ওঠে, ‘কীসের কথা বলছ?’ প্রশ্নটা চলতি পথে হঠাৎ মোড় ঘুরিয়ে নেয়। তুরিনের কাছে না গিয়ে জাহিদের দৃষ্টি অনুসরণ করে তীরের মতো ছুটে যায় ফারার ভীত সন্ত্রস্ত, মৃতপ্রায়, ফ্যাকাসে মুখের দিকে। জাহিদ ওর দিকে চেয়ে কর্কশ এবং কড়া গলায় আরেকবার জানতে চায়, ‘তুরিন কী বিষয়ে কথা বলছে?’
কাঁধ ঝাঁকাল ফারা, ‘আই হ্যাভ নো আইডিয়া।’
তুরিন কী বলবে…কীভাবে বলবে কথাটা জানে না! তার কলিজা থেঁতলে যাচ্ছে এক ভারী পাথরের চাপে। জন্মের পর থেকে যে মানুষটাকে বাবা হিসেবে জেনে এসেছে, যাকে জীবনের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে, যে ছিল তার উচ্ছৃঙ্খল, সাফল্যবিহীন, অকর্মণ্য, এলোমেলো জীবনটার একমাত্র অহংকার, একমাত্র আশ্রয়ের কেন্দ্রবিন্দু। সেই সবচেয়ে আপন মানুষ…যাকে সে বাবা বলে ডাকত, সে নাকি তার নিজের বাবা নয়…কথাটা শোনার আগে মৃত্যু কেন হলো না?
তুরিন ফারার দিকে অশ্রু ডোবা দুই চক্ষু মেলে কম্পিত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি আমাদের এভাবে ঠকালে? এত জঘন্য একটা কাজ তুমি কী করে করতে পারলে? তুমি কি মানুষ?’
ফারা কথাটা হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসি তো ফুটে উঠলই না, বরং সারা মুখে কান্নার একটা করুণ আলপনা মানচিত্রের মতো ছড়িয়ে পড়ল। অনেক কষ্টে একটা বাক্য উচ্চারণ করতে পারল, “কী বলছ এসব?’
তুরিনের শক্তি ফুরিয়ে আসছিল। কষ্ট হচ্ছিল শ্বাস নিতে। হাঁপ ধরা গলায় সে বলল, ‘বাবা শি চিটেড অন ইউ।’ তুরিনের সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। স্যালাইনের নলের ফাঁকে চলকে উঠেছে রক্ত। ব্লাড প্রেশার তরতর করে নেমে যাচ্ছে। মাথার কাছের মনিটরে বিপবিপ শব্দ হচ্ছে। জাহিদ শশব্যস্ত হয়ে বলল, ‘অনেক হয়েছে। আর কথা বলতে হবে না তোমার। আমি নার্স ডাকছি।’
তুরিন আর্তনাদ করে উঠল, ‘আমি তোমার মেয়ে নই…জানো? আমি ওদের সব কথা শুনে ফেলেছি। তোমার সত্যিকারের মেয়ে হলো শুধু জুবিন। তাই তো জুবিনকেই তুমি বেশি ভালোবাসতে সবসময়…তাই না বাবা?’
জাহিদের বুকে সপাং করে চাবুক পড়ল। রক্তের জোয়ার উঠে এলো চোখে।
— ‘কী বলছ এসব?’
ফারার ঠোঁট কাঁপছে থরথর করে। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রুপালি রঙের জল। মুখের রুক্ষ চামড়া ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণার তীক্ষ্ণ দাপটে। কিছু বলার চেষ্টা করেও সে বলতে পারল না। গলা দিয়ে গোঁ-গোঁ শব্দ বেরোতে লাগল। জাহিদ তীরবেগে ছুটে এসে দু হাত দিয়ে খামচে ধরল ওর কাঁধ। প্রবল এক ঝাঁকুনিতে ফারার শরীরের অস্থিমজ্জা সব নাড়িয়ে দিয়ে গর্জে উঠে বলল, ‘এসব আমি কী শুনছি? এটা কি সত্য?’
জীবনের অধিকাংশ সময় ছলাকলা আর চতুর বুদ্ধির প্রয়োগ করে চমৎকারভাবে যাবতীয় প্রতিকূলতাকে অনুকূলে নিয়ে এসেছে কুশলী এবং প্রত্যুৎপন্নমতি ফারা। কিন্তু আজ বুঝি তার বুদ্ধির ভাণ্ডারে ডাকাত পড়ল। মস্তিষ্কের বিক্ষিপ্ত চত্বরে উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়িয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজে বেড়াল আত্মরক্ষার মিথ্যে যুক্তি। কিছুই পাওয়া গেল না। চারিদিক শূন্য। তার মস্তিষ্ক শূন্য। পৃথিবী শূন্য। শূন্য এই জীবন। আজ আর এই সংসারে ফারার কোন নির্ভরস্থল নেই। নেই যাওয়ার মতো কোন জায়গা। বাকহীন প্রতিবন্ধীর মতো স্থবির চোখে কিছুক্ষণ জাহিদের বজ্রকঠিন মুখের দিকে চেয়ে থেকে সে বিদ্যুৎ তরঙ্গের মতো ঘুরে দাঁড়াল। এক মুহূর্তও অপব্যয় না করে দ্রুত পদে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। জাহিদ নিজের পাঁজরের হাড় গুঁড়িয়ে যাওয়ার খটখট শব্দ শুনতে পাচ্ছিল কানে। সর্বস্বান্ত মানুষের মতো গভীর করুণ চোখে মেয়ের দিকে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। তার মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে। ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। এই কলিজার টুকরা মেয়ে তার নিজের রক্তের নয়? অনেক আদরের…অনেক শখের…অনেক যত্নের…অনেক স্বপ্নে মোড়া ছোট্ট রাজকন্যাটির জন্মদাতা সে নিজে নয়?
তুরিন পাগলের প্রলাপ বকার মত বলে যেতে লাগল, ‘আমি তোমার মেয়ে নই। আমি তোমার মেয়ে নই। আমি অনিমেষের মেয়ে। তোমার বন্ধু অনিমেষ। আমি ওদের সব কথা শুনে ফেলেছি।’
জাহিদ দরজা খুলে ঝড়ের বেগে বেরিয়ে এলো। চোখে ধকধক করছে তেজ। নাকের ভাঁজে অকাট হিংস্রতা। এই ক্রুদ্ধ বেদনার্ত মূর্তি দেখে পরিবারের সব সদস্য চমকে উঠল। লবির গেট ধরে অনিমেষ আর ফারা বেরিয়ে যাচ্ছিল। জাহিদ ক্ষিপ্র গতিতে এগিয়ে এসে পেছন থেকে অনিমেষের কনুই চেপে ধরল। অনিমেষ ঘুরে দাঁড়াতেই জাহিদের বজ্রমুষ্টি ঝড়ের বেগে উঠে এলো ওর নাক বরাবর। ঘুষিটা এতই জোরালো এবং আচমকা ছিল যে শক্ত পোক্ত বলিষ্ঠ অনিমেষ আঘাত সইতে না পেরে পেছন দিকে হেলে পড়ল। মুখ থেকে ছুটে এলো অস্ফুট আর্তনাদ। নাক দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে এলো রক্ত। জাহিদ ঘুষিটা মেরে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করল না। গটগটিয়ে বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে। পরিবারের সদস্যরা সহ হাসপাতালে উপিস্থিত অন্য ব্যক্তিবর্গ দৃশ্যটা হাঁ করে দেখছিল।
নিশা হন্যে হয়ে জাহিদের পিছু পিছু বেরিয়ে যাচ্ছিল। মুর্তজা সাহেব ওকে হালকা স্বরে ডাকলেন, ‘বৌমা শোন!’
নিশা ঘুরে তাকাল। তার চোখে মুখে ভয়ের আঁকিবুকি। বুক ওঠানামা করছে প্রবল উৎকণ্ঠায়। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করতে মন চাইছে না। জাহিদকে কখনো এমন উগ্র হিংস্র আচরণ করতে সে দেখেনি। হঠাৎ কী এমন ঘটনা ঘটল যে সবচেয়ে কাছের বন্ধুর গায়ে হাত তুলতে হলো। নিশা শ্বশুরের মুখের ওপর অসহিষ্ণু গলায় বলে উঠল, ‘বাবা আমি একটু আসছি। একটা মিনিট সময় দিন প্লিজ।’
মুর্তজা সাহেব নিশাকে অবাক করে দিয়ে ওর মাথার ওপর একটা হাত রাখলেন। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘আজকের দিনটির জন্যই আমি তোমাকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলাম মা। আমি জানতাম সত্য একদিন সামনে আসবেই। তুমি আমার ছেলেটাকে সামলাও। ওর তোমাকে প্রয়োজন।’
নিশা এই কথার মর্মার্থ বুঝল না। তবে গভীরতাটা সর্বান্তঃকরণে অনুভব করল। কোন প্রত্যুত্তর না করে ব্যতিব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে। তুষারঢাকা সন্ধ্যার আধোআলো অন্ধকারে দেখতে পেল জাহিদ টালমাটাল পায়ে ভূতগ্রস্তের মতো পার্কিং লটে রাখা গাড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এক হাত দিয়ে চশমা খুলে নিয়ে অপর হাতে চোখের জল মুছতে মুছতে কান্নাবিজড়িত কণ্ঠে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলে যাচ্ছে ক্রমাগত। সেই সব কথা নিশার কান অবধি এলো না কিন্তু দৃশ্যটা তার বক্ষ বিদীর্ণ করে দিয়ে গেল কষ্টের ধারাল ফলার আঘাতে। দৌড়ে গিয়ে জাহিদকে পেছন থেকে জাপটে ধরল সে।
— ‘কী হয়েছে? আমাকে একটু বলবেন?’
জাহিদ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে নিশার হাতদুটো পিঠ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ‘নিশা প্লিজ…আমাকে একটু একা থাকতে দাও। নিড সাম স্পেস।’
.
অনিমেষের রক্তাক্ত নাকে ব্যান্ডেজ করা হচ্ছে। ফারা দাঁড়িয়ে আছে স্থির হয়ে। তার চোখের পলক পড়ছে না। কাঁপছে না মুখের কোন রেখা। মৃত মানুষের মতো নিস্তরঙ্গ তার দেহ। মুর্তজা সাহেব ওর পাশে এসে দাঁড়ালেন। রাশভারী কণ্ঠে বললেন, ‘আমার ছেলে এবং নাতনি যে কষ্টটা পেল, তোমাকে কেটে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দিলেও সেই কষ্টের শোধ হবে না। জেনে রেখো, এক ফোঁটা মিথ্যের বিষ জীবন থেকে অনেকগুলো সত্যের অমৃতকে ধ্বংস করে দেয়। মিথ্যে দিয়ে গড়া জীবনে টিকে থাকা যায় হয়তো, কিন্তু বেঁচে থাকা যায় না।’
ফারার ঠোঁট নড়ে উঠল থরথরিয়ে। চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়তে লাগল জলের ধারা। কিছুক্ষণ কাঠপুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর সম্বলহীন, রিক্ত, নিঃস্বর মতো মাথা হেঁট করে ধীরপায়ে বেরিয়ে এলো হাসপাতাল থেকে। হিমেল আকাশ থেকে নিরবচ্ছিন্নভাবে ঝরে যাচ্ছে তুষার। বাতাসে হাড় কাঁপানো শীত। ফারার গায়ে কোন গরম কাপড় নেই। আছে শুধু একটা পাতলা ফিনফিনে নাইটি। ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসল। বরফ ভেজা পিচ্ছিল পার্কিং লটে কয়েকবার টাল খেয়ে সোজা হলো গাড়িটা। উঠে এলো মূল রাস্তায়। ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল সন্ধ্যার আবছায়ায়।
সেই রাতে জাহিদ হাসপাতালে ফিরে এলো আবার। অসুস্থ মেয়ের পাশে বসে রইল ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তুরিন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই সে জাহিদকে দেখতে পেল। বেডের পাশে একটা কাঠের চেয়ারে নিঃশব্দে বসে আছে। নির্ঘুম দুটি চোখে গভীর বিষাদ আঁকা। ক্লান্তি এবং কষ্টে ঝুলে পড়েছে মুখ। তুরিন আকুল স্বরে ডেকে উঠল, ‘বাবা!’
জাহিদ তুরিনের মাথায় একটা হাত রেখে দৃঢ় স্বরে বলল, ‘শোন মা, যে যা খুশি বলুক, কিছু এসে যায় না। তুমি আমার মেয়ে। আমিই তোমার বাবা…তুমি আমার প্রিন্সেস…ঠিক আছে? আর কখনো লোকের কথায় কান দেবে না।’
তুরিন ডুকরে কেঁদে উঠল, ‘আমি জানি…তুমিই আমার বাবা। আমার যদি আরো অনেকগুলা জন্ম হয়…প্রতিটা জন্মে আমি শুধু তোমাকেই বাবা হিসেবে চাইব! আমাকে কখনো পর করে দিও না বাবা! জুবিনের চেয়ে কিছুমাত্র কম ভালোবেসো না। তোমার অবহেলা আমার সহ্য হবে না!’
২২
দুই দিন অবিরত তুষার ঝরল। বরফ জমে গেল রাস্তাঘাটে, গাছের ডালে, বাড়ি আর গাড়ির ছাদে। তুরিন যেদিন বাড়ি ফিরল সেদিন সকাল থেকেই আদিগন্ত আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতি ডানার ঝলমলে রোদ্দুর। শ্বেত তুষারের গায়ের ওপর ঠিকরে পড়ছে সূর্যকিরণ। চমকাচ্ছে আয়নার মতো। এটাই বছরের শেষ তুষারপাত। এরপর গ্রীষ্মের প্রখর উত্তাপ নেমে আসবে মালভূমিতে। দাবানলে জ্বলে পুড়বে বনবনানী। নদী-নালা-সাগর পেরিয়ে দূর দেশ থেকে গ্রীষ্মের পাখিরা কলকল করে ফিরে আসবে। তুরিনের ডান কাঁধে একটা সার্জারি হয়েছে। সারতে সময় লাগবে। ডাক্তার বলেছে কমপক্ষে ছয়মাস বাড়িতে থেকে বিশ্রাম নিতে হবে। সামনে সেমিস্টার ফাইনাল। পরীক্ষাটা হয়তো দেওয়া হবে না এবার।
ফিরে আসার পর থেকে তুরিন কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। সেলফোনটা নষ্ট খেলনার মতো ভেঙেচুরে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছে। গোটা জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। আগের মতো তেজ নেই, রাগের ঝংকার নেই। নেই অহংকারের উদ্ধত প্রকাশ। তার চোখের ভাষাও কেমন পাল্টে গেছে। সর্বস্বান্ত মানুষের মতো অসহায় এবং ভীরু। নিজ থেকে কারো সঙ্গে কোন কথা বলে না। প্রশ্ন করলে হু-হা করে জবাব দেয়। বেশির ভাগ সময় শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। যেন এই পৃথিবীটা তার কাছে অচিন। এই পৃথিবীর হালচাল সে কিছুই জানে না, বোঝে না। অসীম মহাকাশের কোন এক সুদূর তারকায় বুঝি তার নিবাস, পথ ভুল করে নেমে এসেছে এই জটিল দুর্বোধ্য নীল গ্রহে।
.
ফারা লাপাত্তা। সেই সন্ধ্যের পর থেকে তার আর কোন খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। মুর্তজা সাহেব পুলিশে রিপোর্ট করেছেন। একজন মানুষের নিখোঁজ সংবাদ রাষ্ট্রকে জানিয়ে রাখাটা নাগরিক দায়িত্ব বলেই কাজটা করেছেন। নইলে ফারাকে খুঁজে পেতে তাঁর তেমন একটা গরজ নেই বললেই চলে। বাড়ির সব কিছুই নিয়মমাফিক চলছে। কার মনের অবস্থা কীরকম তা বলা কঠিন, তবে সবাই প্রাণপণে চেষ্টা করছে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার। নিশাকে একটা অদ্ভুত অস্থিতিশীল ব্যতিক্রম সময় পার করতে হচ্ছে। তুরিনের মতো জাহিদও নিজেকে সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে নিয়েছে। রাত-বিরেতে বাড়ি ফিরছে। কারো সঙ্গে ঠিকঠাক কথা বলছে না। বাবা-মেয়েকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে নিশা। তবে বাড়িতে তার ভাবমূর্তি পাল্টে গেছে। ভাশুরের বৌ নীলিমা আগে কখনো বন্ধুসুলভ আচরণ করেনি। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হতো সে মনিব আর নিশা চাকর। নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে নিশার সঙ্গে মার্জিত আচরণ করছে। তারা যে একই বাড়ির বৌ, সাংসারিক বহু খুঁটিনাটি ভাগাভাগি করে নেয়ার অবকাশ আছে তাদের মধ্যে, এই বোধটুকু থেকে সে সম্পূর্ণ রূপে বিস্মৃত ছিল। এখন সংসারের চিত্র অন্যরকম। হঠাৎ করেই নিশা বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠেছে। নীলিমা এক বিকেলে তার বান্ধবীদের সঙ্গে নিশাকে পরিচয় করিয়ে দিল দেবরের বৌ হিসেবে। আনিতা-তানিশা আগে কখনো নিশাকে চাচি সম্বোধন করেনি। ইদানীং নিশা তাদের প্রিয় চাচি হয়ে উঠেছে। যে নিশাকে এক কালে সবাই দূর দূর করেছে, অবহেলা করেছে, মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করেনি, সেই নিশাই এখন হয়ে উঠেছে পুরো পরিবারের মধ্যমণি। কোথায় গেল ফারার রাজত্ব আর দাপট! তার নামটাও কেউ এখন উচ্চারণ করে না। কিন্তু এইসব স্বীকৃতি বা সম্মান নিশার মনে তৃপ্তির সঞ্চার করতে পারছিল না। তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে গেছে, নিভে গেছে…ওই মানুষটার করুণ মুখশ্রীর দিকে তাকালে বুক কঠিনভাবে মুচড়ে ওঠে। পৃথিবীটা ভেঙে খানখান হয়ে যায়। তুরিনের কষ্টও সে সইতে পারে না। একদিন রেগেমেগে বলে ফেলল, ‘তুমি মুখটাকে অমন আমের আঁটির মতো বানিয়ে রাখ কেন সবসময়? এর চেয়ে বড় দুঃখ মানুষের জীবনে আসে বুঝলে? জীবন ফুলশয্যা নয়। এই জীবনের প্রতি পদে পদে রয়েছে পরীক্ষা।’
তুরিন কিছু বলে না। খর্বকায় চোখ দুটো মেলে নির্লিপ্ত জড়পদার্থের মতো চেয়ে থাকে শুধু। নিশা ওর খুব কাছে এসে বসে। মাথায় স্নেহসিক্ত হাত রেখে নরম স্বরে বলে, ‘চুপ করে থেকো না। কথা বলো। তুমি কী ভাবছ, কেমন লাগছে তোমার, এই সমস্ত কিছুই খুলে বলো আমাকে। আমি সব শুনব। তুমি হয়তো আমাকে মায়ের মতো মনে করো না, কিন্তু তোমার মনে করা না করায় আমার কিছু এসে যায় না। তুমি আমার বড় মেয়ে। জুবিনের প্রতি আমার যে দায়িত্ব আছে, ঠিক একই দায়িত্ব তোমার প্রতিও আছে।’
এই কথায় তুরিনের চোখে জলের সিঞ্চন হয়। হৃদয়ের ক্ষতস্থানে যেন নতুন করে জেগে ওঠে যন্ত্রণা। নিশার হাতের ওপর কম্পনরত একটা হাত রেখে সে ভাঙা গলায় বলে, ‘তুমি আমার বাবাকে দেখে রেখো কেমন? আমার বাবা যেন নতুন করে কোন কষ্ট না পায়। এমনিই তার জীবনে অনেক কষ্ট।’
নিশা তুরিনের মাথাটা নিজের বুকে টেনে নেয়। অভয় দিয়ে বলে, ‘সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। তুমি সুস্থ হয়ে উঠলেই তোমার বাবা সব কষ্ট সব যন্ত্রণা ভুলে যাবে। একমাত্র তুমিই পারবে তাকে প্রকৃত অর্থে সুখী করে তুলতে।’ তুরিন অবোধ শিশুর মতো নিশার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে থাকে। তার আর মনে থাকে না, এই নিশাকেই সে একদিন মন ভরে ঘৃণা করেছে, অভিসম্পাত করেছে। বরং মনে হয় নিজের ভাসতে থাকা, ভাঙতে থাকা, হারতে থাকা নড়বড়ে জীবনটাতে নিশাই একমাত্র আশ্রয়স্থল। নিশার বড়ত্বের কাছে, উদারতার কাছে, মনুষ্যত্বের কাছে নিদারুণভাবে হেরে গেছে তার ঠুনকো অহংবোধ। কিন্তু এই হেরে যাওয়ায় যেন আজ কোন গ্লানি নেই। অপমান নেই। সত্যি বলতে আজকাল এই অখণ্ড অবসরে একলা বসে বসে স্থিরভাবে কিছুই আর ভাবতে পারে না তুরিন। অনেক কথা মনে পড়ে। হৃদ চক্ষুর ওপর দিয়ে পলকা মেঘের মতো ভেসে যায় অজস্র স্মৃতি। ছোটবেলার কথা, বাবার কথা, মায়ের কথা, দাদা-দাদুর কথা। সবকিছুই কেমন অর্থহীন বলে মনে হয়। গভীর বিতৃষ্ণায় খাক হয়ে যায় অন্তর। মনে হয় তার পুরো জীবনটাই একটা মিথ্যে ভিত্তি প্রস্তরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। চারিদিকে থকথক করছে কাদা। যার জন্মই হয়েছে পঙ্কিল পাপের মধ্যে দিয়ে…তার জীবনে স্বচ্ছতা আসে কী করে? তুরিন ভাবে পৃথিবীতে আসলে আপন বলতে কেউ নেই। যত কাছাকাছিই থাকুক না কেন মানুষ, একজন অপরজনের মন তো কখনো পড়তে পারে না। তুরিনকে যে সবচেয়ে কাছের মানুষটিই মর্মান্তিকভাবে ঠকিয়ে দিল। এই ক্ষত তো কোনদিন সারবার নয়। প্রবঞ্চক মায়ের কথা সে ভাবতে চায় না। ওই মুখটা মনে পড়লেই ঘেন্নায় গা গুলিয়ে ওঠে। তবুও নিজের মনকে ফাঁকি দিয়ে মনেরই অজান্তে হঠাৎ হঠাৎ খুব জানতে ইচ্ছে করে মানুষটা এখন কোথায় আছে? কেমন আছে? নিজের স্বামী-সন্তানের সঙ্গে এত বড় শঠতার বিনিময়ে সে কী পেল?
শুধু শাহজিদের কথা মনে পড়লেই মন চঞ্চল হয়ে ওঠে। নিঃশ্বাসে উত্তাপের আঁচ এসে লাগে। নিজের শরীরে খোদাই করা নামটার ওপর বারবার দৃষ্টি চলে যায়। যদি কখনো ওদের বিয়ে হয়, বিয়ের রাতে বাসরঘরে তুরিনের কটিদেশে নিজের নামটি দেখতে পেয়ে শাহজিদের কী রকম অনুভূতি হবে? সেদিন হয়তো সে সত্যিকার অর্থে টের পাবে তুরিন নামের একটি মেয়ে তাকে কী পাগলের মতো ভালোবেসেছিল! কিন্তু শাহজিদ কি তুরিনকে বিন্দু পরিমাণও ভালোবেসেছে? মুখ ফুটে তো কখনো কিছু বলেনি!
.
এক ছুটির বিকেলে শাহজিদ হঠাৎ নিশার দ্বারস্থ হলো। তার পরনে আকাশি রঙের ম্যান্ডারিন কলার শার্ট। গালের দাড়ি কামানো। কান ছোয়া লম্বা চুলগুলো কেটে ভদ্রস্থ করা হয়েছে। বেশ পরিপাটি বেশভূষা। কিন্তু মুখখানা বড় শীর্ণ। চোখে ক্লান্তির সুস্পষ্ট ছাপ। নিশা হালকা কৌতুকের গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার রোমিও? বিরহে তো একদম মারা যাচ্ছ দেখি। কিন্তু হঠাৎ এত সাজগোজ? কাহিনি কী?
শাহজিদ হেসে বলল, ‘একটা ফেভার করতে পারবে নিশা? প্লিজ?’
— ‘কী ফেভার? শুনেই দেখি।’
শাহজিদের মধ্যে একটু আড়ষ্টতা কাজ করল, ‘আমি জানি কাজটা সহজ হবে না। তবুও চেষ্টা করে দেখতে চাই।’
— ‘কী কাজ?’
— ‘একটাবার তুরিনকে দেখতে চাই। ওর ঘর পর্যন্ত পৌঁছানো মানে আমার জন্য এভারেস্ট জয় করা। খুব কঠিন হবে জানি। তবুও চেষ্টা করব। তুমি কি আমাকে একটু হেল্প করবে?’
নিশা আনন্দে আটখানা হয়ে বলল, ‘নিশ্চয়ই। এখুনি চলো।’
শাহজিদ হাসল, ‘দাঁড়াও, আসছি।’
কথাটা বলে শাহজিদ নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। মিনিট খানেকের মধ্যে ফিরেও এলো। হাতে একগুচ্ছ সাদা গোলাপ। ক্রাচ নিয়ে প্যাটিওর সিঁড়ি ভাঙতেই বেশ বেগ পেতে হলো ওর। নিশার গায়ে অত জোর নেই। লম্বা চওড়া জোয়ান পুরুষের ভার বহন করা তার পক্ষে অসম্ভব। তবুও কষ্টেসৃষ্টে বারান্দা পেরোনো গেল। মানুষের করুণা পেতে শাহজিদের ভালো লাগে না। আত্মসম্মানে বাধে। কিন্তু আজ আত্মসম্মানের চাইতেও বড় হয়ে উঠেছে হৃদয়ের টানাপোড়েন। এই প্রথম বাড়ির অন্দরে পা রাখল সে। লিভিংরুমে মুর্তজা সাহেব নাতনিদের সঙ্গে দাবা খেলছেন। জাহিদ কাউচে বসে টিভিতে স্পোর্টস দেখছে। নীলিমা কিচেন কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে সবজি কাটছিল ছুরি দিয়ে। সদর দরজা দিয়ে নিশা আর শাহজিদের আগমন ঘটতেই সবার মুখে একটা বিমূঢ় বিস্ময় এসে ভর করল। শাহজিদের চিরাচরিত অবস্থান বাড়ির পাতালপুরীর সেই একরত্তি ঘরখানা। সেই স্থান ছাড়িয়ে উঁচুতে উঠে আসার অধিকার বা সাহস কোনটাই কোনকালে তার ছিল না। কেউ তাকে বাড়িতে নিমন্ত্রণও করেনি কখনো। শাহজিদকে যে কখনো বাড়ির ভেতরে ডেকে আনা যায়, সাধারণ অতিথির মতো আপ্যায়ন করা যায় কিংবা একই টেবিলে বসে তার সঙ্গে খাবার খাওয়া যায়, এই ব্যাপারগুলো যেন অলীক এবং অবিশ্বাস্য
সবাই স্থবির চোখে চেয়ে ছিল। ফুলের তোড়াটা নিশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে শাহজিদ দরজার সামনে ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাথাটা নিচু। মুখে অস্বস্তির ভিড়। জাহিদ উঠে এলো বসা থেকে। নিশার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার?’
নিশা নিচু স্বরে বলল, ‘ও তুরিনের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। দোতলায় উঠবে। একটু সাহায্য করতে পারবেন?’
জাহিদ কিঞ্চিৎ বিভ্রম নিয়ে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। ভ্রু কুঁচকে কী যেন ভাবল। একটা সময় সহজ গলায় বলল, ‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই। এসো আমার সঙ্গে।’
.
ঘড়িতে তখন বিকেল পাঁচটা। ফিনিক ফোটা স্বর্ণালি রোদ্দুরে ভেসে যাচ্ছিল বরফকুচির সাদা শহর। রাস্তাঘাট যানজটে পরিপূর্ণ। ঝলমলে রৌদ্রোজ্জ্বল ছুটির দিনে পশ্চিমারা ঘরে থাকতে চায় না। বেরিয়ে পড়ে। তুরিনের জানালার কার্নিশে একটা লার্ক বান্টিং পাখি উড়ে এসে বসেছিল। ডেকে যাচ্ছিল ব্যাকুল স্বরে। জানালার ধারের ক্র্যাব অ্যাপল গাছের সব ফুল ঝরে গেছে। সবুজ পাতায় পাতায় ছেয়ে গেছে ডালপালা। পাতার ফাঁকে ফাঁকে এখনো জমে আছে সাদা তুষারের গোলাকার ফুল। তুরিন আজ দুপুরে ডাক্তারের চেম্বারে গিয়েছিল থেরাপি নিতে। ফিরে আসার পর থেকেই খুব ক্লান্ত লাগছে। বিছানার হেডবোর্ডে পিঠ এলিয়ে বসে থাকতে থাকতে ঘুমে ঢলে পড়তে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় হঠাৎ ঘরের দরজাটা খুলে গেল। নিশা গলা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘তোমার সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে।’
তুরিন কৌতূহলী চোখে চেয়ে রইল। কে আসবে তার সঙ্গে দেখা করতে? কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে অনেকদিন যোগাযোগ নেই। ফোন নাম্বারটাও অকেজো হয়ে আছে। কারো সঙ্গেই অতটা হৃদ্যতা নেই যে না বলে-কয়ে উতলা হয়ে বাড়ি চলে আসবে খোঁজ নিতে। নিশার পেছন পেছন ঘরের ভেতরে যে প্রবেশ করল, তাকে দেখামাত্র নিঃশ্বাস থমকে গেল মুহূর্তের জন্য। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। এটা কি বাস্তব? নাকি স্বপ্ন? এই মানুষ কী করে সিঁড়ি দোতলায় উঠে এলো? জীবনে বহুবার মনের গোপনে স্বপ্ন দেখেছে…কোন এক সুবর্ণ সকালে ঘুম ভেঙে উঠে দেখবে শাহজিদ তার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। হাতে একগুচ্ছ ফুল। আশ্চর্য ব্যাপার হলো আজকে শাহজিদ খালি হাতে আসেনি। সত্যিই তার হাত ভর্তি হয়ে আছে সাদা আর লাল রঙের গুচ্ছের গোলাপ ফুলে। তুরিনের মনে হলো সে স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু স্বপ্নটা এত সুন্দর যে মনেপ্রাণে প্রার্থনা করল এই স্বপ্ন যেন কোনদিন না ভাঙে। নিরন্তর, ছেদহীন এই সুখস্বপ্নের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হয়ে যাক ছোট্ট জীবনটা।
শাহজিদ ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে এসে ঘরের মাঝামাঝি অবস্থানে দাঁড়াল। নিশা যাওয়ার আগে প্রশ্ন করল, ‘চা-কফি কিছু খাবে?’
শাহজিদ মাথা নাড়ল, ‘না ধন্যবাদ।’
নিশা আর কথা বাড়াল না। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যাওয়ার আগে দরজাটা আটকে দিতে ভুলল না।
শাহজিদ এই ঘরে জীবনে প্রথমবারের মতো এলো। খুব বেশি বড় নয়, ছোট একটা চারকোনা ঘর। দখিনে প্রশস্ত জানালা। সিঙ্গেল খাট। খাটের ওপর বিশাল বড় তুলতুলে একটা গোলাপি রঙের টেডিবিয়ার। কোনার দিকে এক চিলতে ক্লজেট। দেওয়ালগুলো পারিবারিক ছবি আর পছন্দের ব্যান্ড সংগীত তারকাদের পোস্টার দিয়ে ঠাসা। মাটিতে এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাপড়চোপড়। ড্রেসিং টেবিলে বোঝাই হয়ে আছে সব নামকরা ব্র্যান্ডের কসমেটিকস। শাহজিদ আপন মনে একটু হাসল। ঘরটায় ঢুকলেই টের পাওয়া যায়…এই ঘরে বাচ্চা একটা খরগোশের বসবাস। ধুলোবালি মাখা বাস্তব জরাজীর্ণ পৃথিবীর ছায়া এখানে পড়ে না।
তুরিন উঠে দাঁড়িয়েছিল বসা থেকে। ওর পরনে একটা সাদা আর বেগুনি চেকের পাজামা সেট। ডান হাতটা কালো রঙের আর্ম স্ট্রিংয়ে ঝুলছে। সিল্কের মতো ফুরফুরে চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পিঠময়। বিগত কদিন ধরে একটানা বাড়িতে থাকায় ওর গায়ের রং আরো বেশি খুলে গেছে। ত্বক চকচক করছে। শাহজিদ চুল ছেটে ফেলেছে। দাড়ি কামিয়েছে। অন্যরকম দেখাচ্ছে। আর্মিতে জয়েন করলে ওকে নিশ্চয়ই সব সময় এরকমই দেখাত। ফিটফাট, ঝকঝকে হ্যান্ডসাম আর ড্যাশিং। মুখোমুখি কয়েকটা সেকেন্ড নীরবে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। চোখের সঙ্গে চোখ লেগে আছে। ছাড়ানো যাচ্ছে না। একটা সময় শাহজিদ ফুলের তোড়াটা এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কেমন আছ?’
তুরিন বাঁ হাত দিয়ে ফুলের তোড়া ধরল। ছোট করে বলল, ‘ভালো।’ হেঁটে এসে ড্রেসিং টেবিলের ওপর ফুলের গোছা নামিয়ে রাখল। একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বসো।’
শাহজিদ ক্ৰাচদুটো একপাশে সরিয়ে রেখে চেয়ারে বসল। একটু বিদ্রুপের সুরে বলল, ‘তুমি এভাবে আমাকে ধোঁকা দিতে পারলে তুরিন?’
তুরিন পলক তুলে তাকাল শুধু, মুখ ফুটে বলল না কিছুই। এ কথা সত্য শাহজিদকে দেখামাত্র তার জংধরা বদ্ধ হৃদয়ের অন্দর-প্রকোষ্ঠে সূর্যের কিরণ এসে পড়েছে। খুলে গেছে মনের জানালা। বহুদিন পর হাওয়া চলাচল করছে ওখানে। রক্তে ভর করেছে প্রাণের স্ফুরণ। কিন্তু ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এবং মানসিক ধাক্কা তার মধ্যে একটা অস্বাভাবিক যোগশূন্যতার গাঢ় ছাপ ফেলে দিয়েছে। নাড়িয়ে দিয়েছে ভেতরকার সত্তাটাকে। আগের সেই মুখরা তুরিন যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এই তুরিনের মুখে শব্দের দুর্ভিক্ষ লেগেছে। খোঁচা দিলেও তার মুখ থেকে একটা সম্পূর্ণ বাক্য বেরোয় না। শাহজিদ বলল,
— ‘আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলাম তুরিন! তুমি এলে না। এত খারাপ লেগেছিল!’
তুরিন বিছানার ওপর বসল। চোখ নিচু। মুখে একটু আরক্ত ভাব। শাহজিদ নির্নিমেষ নেত্রে চেয়ে আছে ওর দিকে। এই কদিনে আরো শুকিয়ে গেছে মেয়েটা। আরো বেশি প্রাঞ্জল হয়ে ফুটে উঠেছে কণ্ঠাস্থির ভাঁজ। তাকালে মনে হয় যেন কোন উচ্চতর শিল্প। এবার শাহজিদের গলায় একটু অভিমান এসে ভিড়ল,
— ‘তুমি আমার সঙ্গে কথা বলবে না তুরিন?’
তুরিন চুপ করে থাকে। কী বলবে ভেবে পায় না। শাহজিদকে বলার মতো কত কথা বুকে জমা ছিল! আজকে সেই সব কথারা যন্ত্রণার চাপে পড়ে পিষ্ট! কথায় কথায় কাটাকাটি হয়ে গেছে। রক্তাক্ত হৃদয়ে এখন শুধু দগদগে ক্ষত। শাহজিদের বুকটা ক্রমেই ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। এ কোন তুরিনকে দেখছে সে? গত কয়েকটা দিন তার ধ্যানজ্ঞানের কেন্দ্রবিন্দু জুড়ে শুধু এই মেয়েটিই ছিল। তার মনে হয়েছে শুধু এই একজনের জন্য দূরের সেই কুহেলী বরফ-শৃঙ্গের দুর্দমনীয় ঐন্দ্রজাল সে ছিন্ন করতে পারবে শতসহস্রবার। এই একজনের মুখ দেখার জন্য রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজের ভারী বোঝার ন্যায় অথর্ব পঙ্গু জীবনটাকে বারবার আলিঙ্গন করতে পারবে দ্বিধাহীনভাবে। কিন্তু আজ তুরিনের এই নিরুত্তাপ আচরণ এবং অবহেলা তার পাঁজরের মধ্যে তীক্ষ্ণধার ছুরির মতো প্রবেশ করল। অপমান, অভিমান এবং যন্ত্রণার বেদনাবিধুর ঘন ছায়া নেমে এলো হ্যাজেল রঙের সুন্দর দুটি চক্ষুতারকায়। ভারী গলায় বলল,
— ‘তোমার কি কিছুই বলার নেই?’
তুরিন চুপ করে থাকে। জানালা দিয়ে ভরা বিকেলের হলুদ রোদ্দুর, পাখির মতো উড়ে এসে বসে ওর মুখে। ঝিরি বাতাসে সিল্কি চুল কাঁপতে থাকে। সুন্দর দেখায়! শাহজিদ এতটা অসহায় এর আগে কখনো বোধ করেনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তার আত্মসম্মান বোধ প্রবল। ইমোশোনাল কথাবার্তা সে বলতে পারে না। বলার অভ্যাস হয়ে ওঠেনি কখনো। তার শুষ্কং কাষ্ঠং একাকী জীবনে ইমোশনের জায়গাই বা কোথায়? মানুষের অবজ্ঞা অবহেলা সহ্য করতে পারে না সে। এই মুহূর্তে তুরিনের নির্লিপ্ততা তো একেবারেই সহ্য করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে বুকের শিরা টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে কেউ।
শাহজিদ কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে বসে থাকে। ডান গালে জিব ঠেকিয়ে চিন্তা করে কিছু একটা। তারপর ক্রাচদুটো হাতে নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। কিছু না বলেই বেরিয়ে যাচ্ছিল। আবার কী মনে করে যেন থামল। তার হৃৎপিণ্ড অস্বাভাবিক ভাবে স্পন্দিত হচ্ছে। তুরিনের উপেক্ষার তীর কলিজাটাকে খণ্ড খণ্ড করে দিচ্ছে। সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে ভরাট কণ্ঠে বলল, ‘গত কয়েকটা দিন শুধু তোমার কথাই ভেবেছি তুরিন! তোমাকে ছাড়া অন্য কিছুই কেন যেন ভাবতে পারছিলাম না।’
কথাটা স্বর্গের শঙ্খধ্বনির চাইতেও মধুর হয়ে তুরিনের কানের পর্দায় এসে দোলা দিল। সুখের রিমঝিম বাদ্য বেজে উঠল রক্তে। লজ্জার আলতা জড়ানো দুটি আড়ষ্ট চোখ শাহজিদের মুখের ওপর মেলে ধরল সে। শাহজিদ আশ্চর্য গভীর গলায় বলল, ‘তোমার অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম জানো? মনে হচ্ছিল তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি বাঁচব না!’
তুরিন চেয়ে আছে অকপট। তার ঠোঁট কাঁপছে। চোখে রুপালি জলের আঁচড়। বুক উঠছে নামছে ভারী নিঃশ্বাসে। শাহজিদ বলল, ‘তুমি সেদিন এলে না। আমি ঠিক করেছিলাম পাহাড়ে চলে যাব। তোমাকে আমার সেই স্বপ্নটার কথা কখনো বলেছিলাম তুরিন? আমার অনেকদিনের ইচ্ছা একদিন রকি মাউন্টেনের চূড়ায় চলে যাব। তারপর রুপালি রঙের চকচকে সুন্দর রিভলভারের ট্রিগার চেপে মাথায় একটা বুলেট ঢুকিয়ে দেব সোজা। ব্যস সব ঝামেলা শেষ।
তুরিন স্থবিরতায় জমে গিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। শাহজিদ বলে চলল,
— তুমি তো জানো আমার জীবনটা আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো নয়। এই জীবন বয়ে বেড়াতে আমার ইচ্ছে করে না। যেদিন তোমার অ্যাক্সিডেন্ট হলো সেদিন মনে মনে শপথ করেছিলাম যদি তুমি সুস্থ হয়ে ফিরে আসো তাহলে আর কোনদিন মৃত্যু চিন্তা করব না। তোমাকে পাশে পেলে আমি পঙ্গু জীবনের বোঝা অনন্তকাল ধরে বয়ে বেড়াতে রাজি আছি।’ শাহজিদ থামল। ওর কণ্ঠমণি কাঁপছে। উপর্যুপরি কয়েকবার ঢোক গিলল। তারপর ধীর স্বরে বলল, ‘এই অদ্ভুত অনুভূতির নাম কী তুরিন? তোমাকে ছাড়া আমার কিছুই কেন ভালো লাগে না আর? আমি কি তোমাকে ভালোবাসি?’
তুরিনের চোখ ফেটে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। শাহজিদ বলল, ‘ভালোবাসা বোধহয় খুব একটা ভালো জিনিস নয়, তাই না? মানুষকে পাগল বানিয়ে ছাড়ে। এখন আমার মনে হচ্ছে তোমাকে না পেলে আমি পাগল হয়ে যাব। হয়তো পাহাড়ে গিয়েই মরব…’
তুরিন ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে এসে শাহজিদের ঠোঁটে ঠোঁট বসিয়ে দিয়ে কেড়ে নিল মুখের কথা। বিরতিহীন উষ্ণ একটা চুম্বনের পর স্খলিত গলায় বলল, ‘এই বাজে স্বপ্নটার কথা আর কোনদিন বলবে না। তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি তোমাকে ভালোবাসি! আমি শুধু তোমাকেই ভালোবেসেছি শতসহস্র বছর ধরে শাহজিদ আনাম!’
দরজায় খুট করে একটা শব্দ হতেই ওরা সচকিতভাবে একটু দূরে সরে এলো। জাহিদের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো ওপাশ থেকে, ‘আসব?’
শাহজিদ হাত বাড়িয়ে দরজাটা খুলল। অস্ফুটে বলল, ‘আসুন।’
জাহিদ সংকুচিত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢুকল। হাসপাতাল থেকে ফেরার পর মেয়ের সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা হয়নি একবারও। আর শাহজিদের সঙ্গে তো বরাবরই একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে সে। আজ তাই এই দুজনের সামনে নিজের উপস্থিতি কিঞ্চিৎ বেমানান বলে মনে হলো তার কাছে। তবুও মেয়ের ঘরে একজন অনাত্মীয় যুবকের দীর্ঘক্ষণব্যাপী অবস্থান মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল বলেই আচানক হানা দিতে হলো। নিশাকে পাঠাতে চেয়েছিল। কিন্তু নিশা এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে। গলায় আকুতি নিয়ে বলছে, ‘ওদেরকে একটু থাকতে দিন ওদের মতো। কতদিন পরে দেখা।’
জাহিদ নিশাকে আর জোর করেনি। কিন্তু নিজেও স্থির হয়ে থাকতে পারেনি। মেয়ের শোবার ঘরে তাগড়া জোয়ান ছেলে এসে বসে আছে, এই ঘটনা তার রক্ষণশীল মনোভাবে মৃদু আঘাত করে গেছে।
জাহিদ ভদ্রতাসূচক গলায় প্রশ্ন করল, ‘কেমন আছ তোমরা?’
উত্তর দিল শাহজিদ, ‘ভালো আছি। আপনার কেমন যাচ্ছে?’
জাহিদ শাহজিদের দিকে চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘বসো…বসো… দাঁড়িয়ে কেন?’
শাহজিদ বসল। জাহিদও বসল বিছানার ওপর। তুরিনের পাশে। কয়েক সেকেন্ড কেউ কোন কথা বলল না। সবাই অস্বস্তিতে গুম মেরে রইল। একটা সময় জাহিদ কেশে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল,
— ‘তুমি তো ফারার ব্যাপারে সবকিছুই শুনেছ। তাই না?’
জাহিদ যে প্রথমেই নির্দ্বিধায় এই প্রসঙ্গ টেনে আনবে তা ভাবেনি শাহজিদ। একটু অবাক না হয়ে পারল না। আবার মনে মনে জাহিদের প্রতি একটা শ্রদ্ধাবোধও জন্ম নিল এই কারণে যে লোকটার মধ্যে সৎসাহস আছে। তা ছাড়া শাহজিদকে সে গুরুত্বপূর্ণ একজন বলে মনে করে বিধায়ই ব্যক্তিগত জীবনের এই সংবেদনশীল আখ্যান আলোচনায় তুলে আনল। শাহজিদ জড়তা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করল, ‘জি শুনেছি।
জাহিদ আড়চোখে তুরিনকে দেখল একবার। ঘাড় নিচু করে বসে আছে। মুখ ঈষৎ রক্তবর্ণ। সংকোচের ঢেউ খেলছে সর্বাঙ্গে। মেয়েকে এতটা লজ্জা পেতে জাহিদ কখনো দেখেনি। অবাক হল মনে মনে।
— ‘বিষয়টা নিয়ে তোমার কিছু বলার বা জানার আছে?’
— ‘জি না…এটা আপনাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার কী বলার থাকতে পারে?’
জাহিদ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘ফারাকে আমি ডিভোর্স দিচ্ছি খুব শিগগিরই। যদিও সে এখন কোথায় আছে জানি না। তবে ডিভোর্স কার্যকর হয়ে যাবে এনিহাউ। আর তুরিন আমার মেয়ে। ও আমার কাছেই থাকবে সব সময়।’
— ‘সব সময়?’ শাহজিদের মুখ ফসকে শব্দটা বেরিয়ে এলো। জাহিদ ইঙ্গিতটা বুঝতে পেরে বলল, ‘সব সময় বলতে ততদিন…যতদিন পর্যন্ত ও নিজের পায়ে না দাঁড়ায়।’
শাহজিদ এই কথার প্রত্যুত্তরে চুপ করে রইল। জাহিদ মেয়ের মাথায় হাত রেখে নরম গলায় প্রশ্ন করল, ‘আমার প্রিন্সেস এখন কেমন আছে?’ তুরিনের খুব অস্বস্তি হচ্ছিল কেন যেন। বাবার প্রশ্নের কোন উত্তর দিল না সে। মুখ নিচু করে বসে রইল।
শাহজিদ হঠাৎ জরুরি গলায় বলে উঠল, ‘জাহিদ, আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল।’
— ‘বলো। শুনছি।’
শাহজিদ ইতস্তত করে বলল, ‘আমি জানি না কথাটা ঠিক কীভাবে বলা যায়। কখনো ভাবিনি এমন একটা বিষয় নিয়ে কারো সঙ্গে কথা বলতে হবে…আসলে…’
জাহিদ অন্যমনে একটু হাসল। কিন্তু সেই হাসির লেশমাত্র প্রকাশ করল না ঠোঁটে। অভয় দিয়ে বলল, ‘বলে ফেলো। এত ভূমিকার প্রয়োজন নেই।’
শাহজিদ মেঝের দিকে চোখ নিবদ্ধ করে বলল, ‘আমি তুরিনকে বিয়ে করতে চাই…যদি আপনার অনুমতি থাকে।’
জাহিদ ঠোঁটে মিটমিটে হাসি নিয়ে নাকের ওপর ঠেসে থাকা চশমাটা আঙুল দিয়ে সামান্য ওপরে তুলে দিল। তারপর তুরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুরিন কী বলে?’
তুরিন দাঁত দিয়ে আঙুলের নখ কেটে যাচ্ছিল ক্রমাগত। বাবার কথাটা শুনেও না শোনার ভান করে রইল। জাহিদ ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘সাইলেন্স ইজ অ্যা সাইন অব কনসেন্ট। কী বলো?’
শাহজিদ এই কথার পিঠে কী বলবে খুঁজে পেল না। হাসল শুধু। পরবর্তী কিছুক্ষণ সবাই চুপ করে রইল। বাতাসে অস্বস্তি দানা বেঁধে চলল ক্রমাগত। শাহজিদ ঠিকঠাক বুঝতে পারছে না জাহিদের মনোভাব। লোকটা কি প্রস্তাবটা গ্রহণ করল নাকি করল না? পরিষ্কারভাবে তো জানাল না কিছুই। অস্বস্তির মাত্রা সহ্যসীমার বাইরে চলে যাচ্ছিল। শাহজিদ আর সময় নষ্ট করল না। তড়িঘড়ি করে ক্রাচ দুটো টেনে নিয়ে মার্জিত গলায় বলল, ‘আমি তাহলে এখন উঠি।’
জাহিদ তাকাল ওর দিকে। হালকা হেসে বলল, ‘ঠিক আছে। এসো।’ শাহজিদ থমথমে মুখ নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তার মনে হচ্ছে লোকটা খুব সূক্ষ্মভাবে প্রস্তাবটা পায়ে ঠেলে দিল। অপমানের গন্ধ পাচ্ছিল সে বাতাসে। এই বিষয়ে দ্বিতীয়বার কোন প্রশ্ন করতেও রুচিতে বাঁধছে। হঠাৎ জাহিদ পেছন থেকে বলে উঠল,
— ‘আরেকটা কথা, বিয়ের পর তুমি আমাকে নাম ধরে ডেকো না কেমন? কী ডাকতে হবে জানো তো?’
শাহজিদের মুখে রক্তের একটা ঝাপটা এসে পড়ল। তুরিন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে হেসে ফেলল ফিক করে। শাহজিদ মুচকি হাসি হেসে ক্ষীণ গলায় বলল, ‘জি জানি।’
জুবিন ঘরময় ছোটাছুটি করছে। এটা ধরছে, ওটা ধরছে আর যেটা ধরতে পারছে না সেটা ধরার জন্য গোঁ ধরা গলায় কান্নাকাটি করছে। নিশা মেয়েকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছিল। জাহিদ জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে বিবশ দৃষ্টি। একটা হাত রাখা ট্রাউজারের পকেটে। অপর হাত জানালার কার্নিশে। জুবিনের দস্যিপনায় আর পেরে না উঠে বিছুটাকে চ্যাংদোলা করে শাশুড়ির কাছে রেখে এলো নিশা। তারপর নিঃশব্দে জাহিদের পেছনে এসে দাঁড়াল। খুকখুক করে একটু কেশে নিয়ে বলল, ‘শুনুন!’
জাহিদ মুখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন নিয়ে ফিরে তাকাল। নিশা বলল, ‘কার কথা ভাবছেন অত? আমার কথা?’
জাহিদ হেসে ফেলল। কী সুন্দর হাসিটা! নিশার মনের মধ্যে ভালোলাগার ধূপকাঠি জ্বলে উঠল। কণ্ঠস্বরে কপট রাগের ঝংকার তুলে সে বলল, ‘আপনি কিন্তু আমাকে একটুও ভালোবাসেন না।’
জাহিদ হাত বাড়িয়ে নিশাকে কাছে টেনে নেয়। ওর চেরিপিংক রঙের টসটসে গালে একটা আঙুল ছুঁইয়ে দিয়ে বলে, ‘তাই?’
— ‘তাই তো…সারাদিন কাজ নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকেন। আমার দিকে একবার ফিরেও তাকান না। আমি কি আপনার কেউ নই?’
জাহিদ নিশার কপালে একটা চুমু খেয়ে আলতো গলায় বলে, ‘তুমিই তো আমার সবকিছু!
নিশার ভেতরটা স্বস্তিতে কুলকুল করে ভরে যায়। জাহিদের বুকের ওপর আলগোছে মাথা রাখে সে। পশ্চিমাকাশে পরীর বিস্তীর্ণ ডানার মতো সোনালি রঙের অলৌকিক আলো ফুটে আছে। বিকেলের পিঙ্গল বুক চিরে ঝাঁক ঝাঁক বালিহাঁস প্যাকপ্যাক করে উড়ে যাচ্ছে। দূরে চমকাচ্ছে রকি মাউন্টেনের তুষারাবৃত চূড়া। ধূমায়িত মেঘের লহর বাধ্যগত ভৃত্যের মতো প্রদক্ষিণ করে চলেছে তাকে। সেই সব মেঘের গায়ে সোনাবরণ আলোক-রেখার সুস্পষ্ট চিক্কণতা। তাকালে বাকরুদ্ধ হয়ে যেতে হয়। সুগভীর সম্মোহনে গা ছমছম করে। রূপোর পাতে মোড়া অমর্ত্য সুন্দর পাহাড়চূড়ো সীমাহীন রহস্যের জাল বিস্তার করে রাখে সমগ্র আকাশব্যাপী। দুর্বার, দুর্গম, অসীম সাহসী সেই গিরিশীর্ষ কোন এক কুহেলী জাদুবলে পাহাড় থেকে লোকালয়ে ডাক পাঠায় কাউকে পাঠায় সুখের ডাক…কাউকে দুঃখের…কাউকে আবার সর্বনাশের!
জাহিদের মনে হলো দূরের তুষারমুকুট পরা পাহাড়চূড়া তাকে কিছু বলতে চাইছে। ডাকছে হাতছানি দিয়ে। এই ডাক নিশ্চয়ই সুখের ডাক। কারণ শ্বেতশুভ্র বরফকুচির মতো বিশুদ্ধ সুন্দর একটা সুখ সুখ অনুভূতিতে এই মুহূর্তে তার গোটা অন্তর ছেয়ে আছে। সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
— ‘নিশা, অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম তোমাকে নিয়ে পাহাড়ে যাব একবার। যাবে আমার সঙ্গে?’
নিশা মুখ তুলল, ‘সত্যি?’
— ‘সত্যি!’
— ‘কবে যাবেন?’
— ‘কবে যেতে চাও বলো?’
— ‘আজকেই চলেন।’
— ‘আজকেই?’
— ‘নাহ…তুরিন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে নিক। তারপর…’
— ‘তুমি এত ভালো কেন নিশা? তুরিনের জন্য যা করছ, এই ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারব না।’
— ‘ঋণ শোধ করার কথা কেন আসছে? তুরিন তো আমারও মেয়ে।’
জাহিদ আরো শক্ত করে নিশাকে জড়িয়ে ধরল বুকের সঙ্গে। বাইরে তখনো শেষবিকেলের মন কেমন করা মায়াবী আলোর একটানা রিমঝিম। উতলা বাতাসে দূর পাহাড়ের সুখিয়াল ডাক।
ভারি সুন্দর কিন্তু আজকের দিনটা!
(সমাপ্ত)