আনারসি বয়েজ – নিল গেইম্যান
আনারসি বয়েজ – নিল গেইম্যান
অনুবাদ: মো. ফুয়াদ আল ফিদাহ
প্রকাশক – বিবলিওফাইলের পক্ষে মো. সাব্বির হোসেন বিবলিওফাইল
প্রথম প্রকাশ: আগস্ট, ২০২১
প্রচ্ছদ: সজল চৌধুরী
.
উৎসর্গ
এইসব ব্যাপারে বিশেষ অভিজ্ঞতা তো আপনার আছেই! একটা বই তুলে নিলেন হাতে, পাতা উলটে এলেন উৎসর্গে। অন্য সব বারের মতোই দেখতে পেলেন, লেখক সাহেব বইটি উৎসর্গ করেছেন…নাহ, আপনাকে না। অন্য কাউকে!
এবার আর তেমনটা হচ্ছে না।
মানছি আমাদের এখনও দেখা হয়নি। খুবই স্বল্পকালীন পরিচয় আমাদের / একে-অন্যকে খুব পছন্দ করি / বহুদিন সাক্ষাৎ হয় না / কোনো-না-কোনো ভাবে আত্মীয় আমরা / কখনও দেখা হবে না। কিন্তু তারপরও, এত কিছু সত্ত্বেও, আমার বিশ্বাস, একে-অন্যের স্মৃতি আমরা আনন্দের সঙ্গেই চারণ করব।
এই বইটি আপনার জন্য।
কীসের সঙ্গে, তা আপনি জানেন… কেন, সেটাও অজানা নেই নিশ্চয়ই।
.
বি.দ্র.: লেখক এই সুযোগে সম্মানের সঙ্গে ধন্যবাদ জানাতে চান জোরা নিয়েল হার্টসন, থর্ন স্মিথ, পি.জি. উডহাউজ আর ফ্রেডেরিক ‘টেক্স’ অ্যাভারিকে।
.
কৃতজ্ঞতা স্বীকার
শুরু করা যায় ন্যালো হপকিনসনকে বিশাল এক ফুলের তোড়া দিয়ে, যে ক্যারিবিয়ানের সংলাপগুলো সাবধানতার সঙ্গে দেখে দিয়েছে। কোথায় কোথায় শুধরে নিতে হবে—সেটা জানাবার পাশাপাশি, কীভাবে নিতে হবে সেটাও দেখিয়ে দিয়েছে। সেই সঙ্গে তোড়া দিতে চাই লেনওয়ার্থ হেনরিকেও, যেদিন আমি গল্প সাজাই সেদিন সে ছিল আমার পাশে; লেখার সময় যার কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়েছি মনে (আর তাই, অডিয়ো বুকটা ওর কণ্ঠেই রেকর্ড হচ্ছে শুনে আনন্দে হয়েছিলাম উদ্বেল)।
আমার সাম্প্রতিকতম, প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লিখিত উপন্যাস, আমেরিকান গডস-এর মতো, এই উপন্যাস লেখার সময়ও দুটো অভয়ারণ্য পেয়েছিলাম। লেখা শুরু করি আমি টোরি’র আয়ারল্যান্ডের দ্বিতীয় বাড়িতে, শেষও করি সেখানেই। অতিথির কীভাবে খেয়াল রাখতে হয়, তা মেয়েটা খুব ভালোভাবেই জানে। মাঝখানের অংশটুকু, হারিকেনের কারণে, লিখেছি জেন আর জোনাথনের দ্বিতীয় বাড়িতে বসে, ফ্লোরিডায়। বন্ধুদের মাঝে অতিরিক্ত বাড়িঅলা দুই-চারজন থাকাটা মন্দ না, আর যদি তারা সেই বাড়িতে থাকার অনুমতি দেয়…তাহলে তো সোনায় সোহাগা! এছাড়া লিখেছি স্থানীয় কফি হাউজে বসে। জঘন্য কফি গিলেছি কাপের পর কাপ, প্রমাণ করেছি—অভিজ্ঞতাকে হার মানায় প্রত্যাশা!
রজার ফোর্সডিক আর গ্রায়েম বেকার তাদের সময় ব্যয় করেছে পুলিস, প্রতারণা আর অন্য দেশ থেকে অপরাধী গ্রেফতার সংক্রান্ত চুক্তির ব্যাপারে আমাকে জ্ঞানদান করে। রজার আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে, ডিনার খাইয়েছে আর পাণ্ডুলিপির ওপর নজর বুলিয়েছে। ওর প্রতি আমি চরম কৃতজ্ঞ।
স্যারন স্ট্রিটেলার বইয়ের ওপর সতর্কতার সঙ্গে নজর রেখে নিশ্চিত করেছে—মানের প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া হয়নি, এই ব্যাপারে আমার সব প্রশ্নের জবাবও দিয়েছে মেয়েটা। প্যাম নোল্স ছিল আমার প্রথম পাঠিকা, ওর মন্তব্যগুলো লেখা চালিয়ে যেতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আরও কিছু মানুষ আছে, যারা তাদের সময়, মনন আর মন্তব্য দিয়ে সাহায্য করেছে আমাকে। যেমন: ওলগা ন্যুনেজ, কলিন গ্রিনল্যান্ড, জর্জিয়া গ্রিলি, অ্যান ববি, পিটার স্ট্রাউব, জন এম. ফোর্ড, অ্যান মারফি, পল কিনকেইড, বিল স্টিটেলার, ড্যান এবং মাইকেল জনসন। যেকোনো মন্তব্য বা তথ্যে ভুল থাকলে তার দায় আমার, ওদের না।
আরও ধন্যবাদ জানাতে হয় এলি ওয়ালি, থিয়া গিলমোরকে; লেকসাইডের লেডিদের, মিস হলি গেইম্যানকে—যখন আমার পরিপক্ব কন্যার দরকার হয়েছে, সে দেখা দিয়েছে; হিল হাউজ, পাবলিশার্সের পিটসকে; মাইকেল মরিসন, লিসা গ্যালাহার, জ্যাক ওম্যাক, জুলিয়া ব্যানন আর ডেভ ম্যাককিন।
জেনিফার ব্রেল, মরো-তে আমার সম্পাদককে ধন্যবাদ। ও আমাকে বুঝিয়েছে: লাঞ্চ খেতে খেতে তাকে শোনানো গল্প একটা উপযুক্ত উপন্যাস হবে, তাও এমন এক সময়ে যখন আমি বুঝতে পারছিলাম না এর পর কী লিখব! এক রাতে যখন ফোন করে ওকে বইয়ের প্রথম এক-তৃতীয়াংশ পড়ে শোনাই, তখন ধৈর্য ধরে বসে শুনেছে। এই কটা গুণের জন্যই ওকে সন্ত- উপাধি দেওয়া উচিত! হেডলাইনের জেন মোরপেট এমন একজন সম্পাদক যাকে একমাত্র খুব ভদ্র ও শান্ত লেখকরাই পুরস্কার হিসেবে পায়! রাইটার্স হাউজের মেরিলি হেইফট্য, এবং ওর সাহায্যকারী জিঞ্জার ক্লার্ক এবং ইউকে তে ডোরি সিমন্ডস, আমার এজেন্টদের ধন্যবাদ। এদেরকে পাশে পাওয়াটা আমার জন্য সৌভাগ্যের ব্যাপার, আর সেটা আমি জানি।
জন লেভিন আমার দুনিয়াটাকে সচল রাখে। আমার সহকারী, লোরেইন, লেখালেখিতে সাহায্য তো করেই, সেই সঙ্গে চা বানানোয় ওর জুড়ি নেই।
মনে হয় না মোটকু চার্লিকে আমি লেখায় ফুটিয়ে তুলতে পারতাম, যদি না আমার একজন দারুণ কিন্তু প্রায়শই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দেওয়া বাবা এবং একই রকম দারুণ, কিন্তু আমার কারণে প্রায়শই বিব্রত হওয়া ছেলে-মেয়ে না থাকত। পরিবারের জয় হোক।
এবং সবশেষে ধন্যবাদ আপনাদেরকে… যারা আমেরিকান গডস লেখার সময় ছিলেন না—অর্থাৎ, www.neilgaiman.com-এ লেখা জার্নালের পাঠকদের। যখনই আমার কিছু একটা জানার প্রয়োজন হয়েছে, আপনারা জানিয়েছেন; এবং আমার হিসেবে—জানার আছে, এমন সব কিছু সম্মিলিতভাবে যারা জানেন!
–নিল গেইম্যান,
জুন, ২০০৫
Book Content👉
অধ্যায় এক – যেটা মূলত নাম আর পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে
অধ্যায় এক – যেটা মূলত নাম আর পারিবারিক সম্পর্ক নিয়ে
শুরুটা হলো—যেভাবে অধিকাংশের হয় শুরু—একটা গান দিয়ে।
হাজার হলেও, সব কিছুর শুরুতে ছিল শব্দের গুচ্ছ; যা ছিল সুরে গাঁথা। দুনিয়ার সৃষ্টিও সেভাবে, সেভাবেই ভরে উঠেছিল শূন্যতা; আর সেভাবেই অস্তিত্ব পায় স্থলভূমি, তারকা, স্বপ্ন, ছোট্ট ছোট্ট দেবতা আর প্রাণিরা।
গান থেকে পায় ওদের অস্তিত্ব!
বিশাল সব প্রাণির জন্ম? সেটাও গান থেকে। গায়ক অবশ্য ততক্ষণে গ্রহ- নক্ষত্র, পাহাড়, গাছ, সমুদ্র আর ছোট্ট সব প্রাণির একটা হিল্লে করে ফেলেছে। পৃথিবীকে যে পাহাড়গুলো শক্ত করে বেঁধে রেখেছে, তাদেরকেও জন্ম দেওয়া হয়েছে গানের মাধ্যমে। শিকারের ময়দান আর আঁধার?
তারাও নিজেদের অস্তিত্বের জন্য গানের কাছে কৃতজ্ঞ!
গান রয়ে যায়, টিকে থাকে তারা। দরকার শুধু উপযুক্ত গানের, তাতেই পরাক্রমশালী এক সম্রাট পরিণত হয় হাস্যরসে; রাজবংশের আর কোনো হদিস থাকে না! কোনো একটা ঘটনা, তাতে অংশ নেওয়া কুশীলব, তাদের স্বপ্ন- সব ধুলোয় মিশে যাবার পরেও টিকে যেতে পারে সেই ঘটনাকে নিয়ে বাধা গান…সেটাই তার শক্তি।
গানের সাহায্যে কিন্তু আরও অনেক কিছু করা যায়। শুধু দুনিয়া-গঠন বা পুনর্গঠনেই ওদের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ না। মোটকু চার্লি ন্যান্সির বাবার ব্যাপারটাই ধরা যাক। সে ভেবেছিল, এবং প্রত্যাশাও করেছিল, যে গানের সাহায্যে দারুণ একটা রাতের জন্ম দিতে পারবে।
মোটকু চার্লির বাবা যখন বারে পা রাখে, তখন বারম্যানের অবস্থা খারাপ। বেচারা ধরেই নিয়েছে ‘ক্যারিয়োকি-সন্ধ্যা’ নামের আয়োজনটা একেবারে মাঠে-মারা যাচ্ছে। কিন্তু এহেন মুহূর্তে কামরায় পা রাখা ছোটোখাটো অবয়বটা, গুনগুন করতে করতে; পর্যটকের হাসি মুখে আর সূর্যের আলো গায়ে মেখে তামাটে ত্বক বানানো কিছু স্বর্ণকেশীর টেবিলের পাশ দিয়ে হেঁটে যায় সে, যে টেবিলটা ছিল জোড়াতালি দিয়ে বানানো ছোট্ট মঞ্চটার এক কোনায়। যেতে যেতে হ্যাটের কোনা একটু নিচু করে সে মেয়েদের দিকে চেয়ে; নিদাগ, সবুজ ফেডোরা, লেবুর মতো হলদে দস্তানা পরিহিত লোকটা এরপর এগিয়ে যায় ওই টেবিলের দিকে।
ওকে আসতে দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে মেয়েরা।
‘সন্ধ্যেটা উপভোগ করছ তো, মেয়েরা?’ জিজ্ঞেস করে সে।
খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতেই মেয়েরা জানায়, দারুণ উপভোগ করছে ছুটিটা। ওদেরকে তখন লোকটা বলে: একটু অপেক্ষা করতে, আনন্দ কয়েকগুণ হতে চলছে!
বয়সে অনেক বড়ো সে, অনেক…অনেক বড়ো। কিন্তু ‘আকর্ষণীয়’ শব্দটা মানুষ হলে সম্ভবত মোটকু চার্লির বাবার রূপই ধারণ করত। মনে হয় যেন সুদূর অতীতের পাতা থেকে উঠে এসেছে, যে যুগে ভদ্রতা আর সুনিপুণ আচরণকে মূল্য দেওয়া হতো। কালো মেঘ সরে গেল বারম্যানের চেহারা থেকে।
এমন কেউ যখন বারে পা রাখে, তখন রাতটা নিঃসন্দেহে ভালোই যায়! ক্যারিয়োকির ব্যবস্থা আছে, আছে নাচের ব্যবস্থাও। বুড়ো মানুষটা মঞ্চে সে সন্ধ্যায় উঠেছিল গান গাইতে…তাও একবার না, দুবার! দারুণ কণ্ঠ তার, মুখের হাসিটা যে কাউকে গলিয়ে দেবে। আর নাচার সময় তো মনে হয় পাগুলো যেন ঝকমক করছে! প্রথমবার সে গাইল: হোয়াট’স নিউ পুসিক্যাট?
দ্বিতীয়বার গানের জন্য যখন মঞ্চে উঠল, ঠিক সেই মুহূর্তেই লোকটা ধ্বংস করে দিল মোটকু চার্লির জীবন।
.
মোটকু চার্লি মোটা ছিল বটে, তবে হাতেগোনা কয়েক বছর মাত্র। তাও সেটা ওর বয়েস দশ থেকে—যে বয়সে ওর মা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিল: যদি দুনিয়াতে মাত্র একটা ব্যাপার নিয়ে ভদ্রমহিলা বিতৃষ্ণার সঙ্গে আর ভাবতে না চায় (যে ভদ্রলোক ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িত, আপত্তি থাকলে ব্যাটা সেই আপত্তি… বাকিটা বুঝতেই পারছেন), তো সেটা হলো ওই বুড়ো হাবড়ার সঙ্গে তার বিয়ে; যেটার সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে তার জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে…এবং পরেরদিন সকালেই সব ছেড়ে-ছুঁড়ে চার্লির মা দূরে কোথাও চলে যাবে, নিজের ভালো চাইলে যেন হাবড়া তার পিছু না নেয়—চোদ্দ পর্যন্ত; তখন মোটকু চার্লি খানিকটা লম্বা হয়, বাড়তি ব্যায়ামও শুরু করে।
তখনও ও ঠিক মোটা ছিল না। সত্যি বলতে কী, ওকে একটু নাদুস-নুদুস বলা যেত; মানে দেহের এখানে সেখানে হালকা মেদ ছিল আরকি। কিন্তু মোটকু চার্লি নামটা ওর সঙ্গে এমন ভাবে সেঁটে গেল, যেমনটা টেনিস জুতোর সোলের সঙ্গে চিউয়িং গাম লেগে থাকে। নিজেকে সে পরিচয় দিত চার্লস নামে—বয়েস যখন বিশের ঘরে তখন কখনও কখনও চ্যায বলে, লেখার সময় লিখত সি. ন্যান্সি—কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। কোনো-না-কোনো ভাবে নামটা ফিরে আসবেই! পুরো বাসা পরিষ্কার করলেও, তেলাপোকা কীভাবে কীভাবে যেন ফিরে এসে ফ্রিজের পেছনে বাসা বাধে না? অনেকটা সেভাবেই।
আর তাই, মোটকু চার্লি নামেই আবার পরিচিত হতে হতো ওকে।
ছেলেটা জানে, এর কারণ – যদিও যুক্তিটা অযৌক্তিক-ডাকনামটা ওর বাবার দেওয়া; যে নাম ওর বাবা দেয়, সেটা আর কখনও ঝেড়ে ফেলা যায় না।
মোটকু চার্লি বড়ো হয়েছে ফ্লোরিডা স্ট্রিটে, সেখানকারই সামনের একটা বাড়িতে একটা কুকুর পোষা হতো। চেস্টনাট রঙের বক্সার ছিল ওটা, পা লম্বা, সুচালো কানের জন্য চেহারাটা অদ্ভুত দেখাত; মনে হতো যেন বাচ্চা বয়সে সরাসরি দেয়ালে মুখ থুবড়ে আছড়ে পড়েছিল প্রাণিটা। মাথাটা একটু উঁচু, লেজ টান-টান হয়ে থাকত। বেশ কয়েকটা পুরষ্কার পেয়েছিল ওটা——বেস্ট অভ ব্রিড, বেস্ট ইন ক্লাস…এমনকী বেস্ট ইন শো-ও। নাম দেওয়া হয়েছিল সপ্তম ক্যাম্পবেল’স ম্যাকিনরয় আরবাথনট। তবে মালিকরা, যখন মন ভালো থাকত, তখন ডাকত কাই বলে। কিন্তু একদিন সব বদলে যায়। সেদিন মোটকু চার্লির বাবা তাদের জীর্ণ দেহলিতে বসে বিয়ার গেলার ফাঁকে দেখতে পায় কুকুরটাকে। বেচারা প্রাণিটা তখন প্রতিবেশীর সামনের প্রাঙ্গণে দৌড়াদৌড়ি করছে, গলায় বাঁধা রশিটা একটা গাছে থেকে শুরু করে বেড়ার খুঁটি পর্যন্ত লম্বা।
‘বোকা কুকুর,’ বলল মোটকু চার্লির বাবা। ‘ডোনাল্ড ডাকের বন্ধুর মতো, কী যেন নাম ওটার? গুফি!’
এর পর থেকেই যে কুকুরটা একদা ‘সবার সেরা ছিল, সেটার আচরণে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেল। মোটকু চার্লির মনে হতে লাগল, কুকুরটাকে সে এখন তার বাবার চোখ দিয়ে দেখছে! আর আসলেও, ব্যাটা বোকাই।
নামটা ছড়িয়ে পড়তে খুব একটা সময় লাগল না। সপ্তম ক্যাম্পবেল’স ম্যাকিনরয় আরবাথনটের মালিকদের ব্যাপারটা হজম করতে কষ্ট হলো বেশ। তবে নামটার ছড়িয়ে পড়া থামানো আর হারিকেনের সঙ্গে তর্ক করা একই কথা! এমনকী অচেনা-অজানা মানুষরাও একদা গর্বিত বক্সারটাকে আদর করে বলতে শুরু করল, ‘হ্যালো, গুফি সোনা, কেমন আছ?’ মালিকরা এরপর থেকে সব ধরনের শোয়ে নাম লেখানোই বন্ধ করে দিল। বিচারকদের মুখ থেকে ‘বোকা-বোকা কুকুর’ শুনতে শুনতে হতাশ হয়ে পড়েছিল তারা।
তাই সূর্য যেমন পুবে ওঠে, তেমনি মোটকু চার্লির বাবার দেওয়া নাম টিকে যায়—এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই।
তবে কি না, মোটকু চার্লির বাবার সমস্যা আরও অনেক।
বেড়ে ওঠার সময় মোটকু চার্লিকে বললে, বাবার বাজে দিকগুলোর একটা বিশাল তালিকাই করে দিতে পারত সে সর্বক্ষণ এদিক-ওদিক করতে থাকা চোখ, একই রকম অস্থির হাতনিদেনপক্ষে এলাকার যুবতীদের মতে, যারা প্রায়শ এসে অভিযোগ জানাত মোটকু চার্লির মায়ের কাছে—যা জন্ম দিত ঝামেলার; ছোট্ট, কালো সিগারিল্লো, যেগুলোকে বাবা নাম দিয়েছিল চুরুট, ধরালে এমন গন্ধ জন্ম নিত যা লোকটার স্পর্শ করা সবকিছুতে লেগে থাকত; বিশেষ এক ধরনের ট্যাপ ড্যান্সিঙের প্রতি আকর্ষণ যা—মোটকু চার্লির ধারণা মোতাবেক—— ১৯২০ সালের হার্লেমে বড়োজোর আধ-ঘণ্টার জন্য জনপ্রিয় ছিল; বর্তমান বিশ্বের ব্যাপারে চরম অজ্ঞতা; সিটকমগুলোতে আধ-ঘণ্টার মাঝে সত্যিকারের মানুষের জীবন ও সমস্যার ব্যাপারে আসলেও আলোকপাত করা হয়—এই দৃঢ় বিশ্বাস…এমন আরও অনেক কিছু ছিল সেই তালিকায়। সত্যি বলতে কী, মোটকু চার্লির কখনও মনে হয়নি এসব কারণে কোনো একটা ওর বাবার সবচাইতে খারাপ দিক। কিন্তু সবগুলো একত্রিত হয়ে, বিশাল আকার ধারণ করেছিল।
তাই যদি মোটকু চার্লির বাবার সবচাইতে খারাপ দিকটার কথা জানতে চাওয়া হয় তো উত্তর হবে: লোকটা বড়োই বিব্রতকর ছিল!
তবে কি না সবার বাবা-মা-ই বিব্রতকর। বাবা-মা হবার শর্তই যেন এটা; একটা বিশেষ বয়সের বাচ্চারা যেমন সবার সামনে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলতেই বিব্রত, লজ্জিত এবং মর্মাহত হয়, তেমনি বাবা-মায়ের অস্তিত্বের একমাত্র কারণ যেন তাদের সন্তানকে বিব্রত করা!
মোটকুর চার্লির বাবা, বলাই বাহুল্য, ব্যাপারটাকে পুরো শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায়; কাজটা করে আমোদও পেত। ঠিক যেমনটা পেত অন্যদের প্র্যাক্টিক্যাল জোকের শিকার বানিয়ে, তা সেটার মাত্রা ছোটো বা বড়ো…যেটাই হোক না কেন।
‘যেমন?’ জিজ্ঞেস করেছিল রোজি, মোটকু চার্লির বাগদত্তা। তখন সন্ধ্যা। মোটকু চার্লি এমনিতেও বাবার প্রসঙ্গে খুব একটা কথা বলতে চায় না। তবে সেদিন তোতলাতে তোতলাতে বোঝাতে চাইছিল প্রেমিকাকে কেন ওর বাবাকে বিয়ের দাওয়াত দেওয়াটা মস্ত বড়ো বোকামি হবে। সাউথ লন্ডনের একটা ছোট্ট ওয়াইন বারে বসে ছিল তখন। অনেক আগে থেকেই মোটকু চার্লি নিজেকে বলে আসছে: চার হাজার মাইল আর আটলান্টিক মহাসাগর, বাবার সঙ্গে ওর এই দূরত্বটা বজায় রাখাই ভালো।
‘আসলে…’ শুরু করেছিল মোটকু চার্লি, আর সঙ্গে সঙ্গে ওর মনে পড়ে যায় একের-পর-এক লজ্জাদায়ক স্মৃতি। একেকটা ওর অজান্তেই, পায়ের নখ কুঁচকাবার জন্য যথেষ্ট! তবে একটা স্মৃতিকে আলাদা করে বলতে শুরু করল সে। ‘যখন ছোটো ছিলাম, তখনকার কথা…নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম। বাবা বারবার আমাকে বলল, প্রেসিডেন্টস’ ডে উদযাপনের জন্য সে উন্মুখ হয়ে আছে। যখন সে নিজে ছোটো ছিল, তখন আইন করেই বাচ্চাদেরকে স্কুলে তাদের পছন্দের প্রেসিডেন্টের সাজে যেতে হতো। বিনিময়ে তারা পেত এক বাক্স চকলেট।’
‘ওহ, আইনটা তো ভালো!’ বলল রোজি। ‘এমন কিছু ইংল্যান্ডে থাকলে আরও ভালো হতো।’ যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে কখনও পা রাখেনি মেয়েটা; অবশ্য এ- কথা বলার সময় হিসেবের বাইরে রাখতে হয় ১৮-৩০ দিনের একটা ছুটির অভিজ্ঞতা…যখন-রোজির মতে— ভূমধ্যসাগরের কোথাও গিয়েছিল সে। বাদামি চোখ মেয়েটার, তাতে উষ্ণতা মাখা দৃষ্টি; সঙ্গে আছে উন্মুক্ত একটা অন্তর; তবে ভূগোলে কাঁচা।
‘নাহ, ভালো আইন না।’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘আসলে ওটা কোনো আইনই না। পুরোটাই বাবার বানানো। অধিকাংশ স্টেটে ওই দিনে স্কুল খোলাই থাকত না, যেগুলো থাকত সেগুলোতেও পছন্দের প্রেসিডেন্টের বেশে যাবার কোনো প্রথা ছিল না। এমন বেশে যারা যেত, তাদের ভাগ্যে চকলেটে ভরতি বাক্স তো মিলতই না, উলটো জনপ্রিয়তা একেবারে তলানিতে চলে যেত! অথচ আমাকে বলা হয়েছিল—এই একটা ব্যাপারের ওপরেই নির্ভর করছে ভবিষ্যতের ক্লাসগুলোতে আমার জনপ্রিয়তা! যারা জনপ্রিয়-অজনপ্রিয় কোনোটাই হতো না, তারা লিঙ্কন বা ওয়াশিংটন অথবা জেফারসন সেজে যেত। কিন্তু যাদের ভবিষ্যতে জনপ্রিয়তা লেখা আছে, তারা সাজত জন কুইন্সি অ্যাডামস কিংবা ওয়ারেন গামালিয়েল হার্ডিং-এর মতো কারও সাজে। তাছাড়া এই ব্যাপারে আগে-ভাগে কারও সঙ্গে আলোচনাও করা যাবে না, তাহলে দুর্ভাগ্য সঙ্গী হবে! এসব কার কাছে শুনেছি, জানো? বাবার কাছে!’
‘ছেলে-মেয়ে সবাই প্রেসিডেন্টের সাজে সাজত?’
‘আমাকে তো সেটাই বলা হয়েছিল! তাই প্রেসিডেন্ট’স ডেয়ের আগের সপ্তাহটা কাটিয়ে দিলাম দি ওয়ার্ল্ড বুক এনসাইক্লোপিডিয়ায় নাক গুঁজে; যতটা সম্ভব জেনে নিলাম তাদের ব্যাপারে। কাকে বাছব, সেই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য।’
‘ঠাট্টা করছে, এই সন্দেহ হয়নি একবারের জন্যও?’
মাথা নাড়ল মোটকু চার্লি। ‘কেন হবে? বিশেষ করে বাবা যখন তার খেল দেখাতে শুরু করে, তখন কেউ-ই তা ভাবে না। এমন মসৃণ মিথ্যুক তুমি আগে কখনও দেখোনি। তার কথা কেউ অবিশ্বাস করতেই পারে না!’
শার্ডোন্যে[১]-এর গেলাসে চুমুক দিল রোজি। ‘তা কোন প্রেসিডেন্ট সেজে স্কুলে গেলে?’
[১. এক ধরনের মদ]
‘ট্যাফট, আমেরিকার সাতাশতম প্রেসিডেন্ট ছিল সে। কোত্থেকে যেন একটা বাদামি স্যুট জোগাড় করেছিল বাবা, সেটা পরেছিলাম। প্যান্ট গুটিয়ে, তার সামনে একটা বালিশ গুঁজে চলে যাই স্কুলে। এমনকী একটা গোঁফ পর্যন্ত এঁকেছিলাম! সেদিন বাবাই আমাকে স্কুলে নিয়ে যায়, গর্বের সঙ্গে পা রাখি ক্লাসে। অন্য শিক্ষার্থীরা আমাকে দেখে চিৎকার করে, যারা দেখেনি তাদেরকে ডেকে ডেকে দেখায়। ছেলেদের বাথরুমের একটা কিউবিকলে আশ্রয় নিয়ে, কেঁদে-কেটে সব ভাসিয়ে দিই আমি। পোশাক বদলাবার জন্য বাসায় ফেরার অনুমতি পর্যন্ত পাইনি! সারা দিন ওভাবেই থাকতে হয়েছে। নরক যন্ত্রণা বোধ করেছিলাম সেদিন!’
‘কিছু একটা বানিয়ে বলা উচিত ছিল তোমার,’ বলল রোজি। ‘বলতে পারতে, ক্লাসের পর কস্টিউম পার্টিতে যাচ্ছ…অথবা সত্যিটাও বলে দিতে পারতে!’
‘হুম,’ স্মৃতিটা মনে করায় বিষণ্ণ হয়ে গেছে মোটকু চার্লি।
‘বাসায় ফেরার পর, তোমার বাবা কিছু বলেনি?’
‘বলেনি, কেবল হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়েছে। নাকের জল-চোখের জল এক করে ফেলেছিল। তারপর বলল: হয়তো আজকাল আর ওসব করা হয় না প্রেসিডেন্টস’ ডে উপলক্ষে। যাক সে কথা, সৈকতে গিয়ে মৎস্য- কন্যাদের খুঁজলে কেমন হয়?’
‘মৎস্য কন্যা?’
‘আমরা চলে যেতাম সৈকতে, হাঁটতাম পাশাপাশি। দুনিয়ার বুকে এমন একজনকে ভাবো যে তোমাকে সবচাইতে বেশি বিব্রত করতে পারে। বাবা সেই মানুষটার চেয়েও বেশি দক্ষ ছিল একাজে। দুম করে গাইতে শুরু করত, এক ধরনের বালু-নাচ নাচত সৈকতে। যেখানেই যেত, মানুষের সঙ্গে কথা বলত; তাদের চিনুক বা না-চিনুক। ব্যাপারটা আমার একদম পছন্দ হতো না। আমাকে দেখিয়ে দিত, মৎস্য-কন্যারা আটলান্টিকের কোথায় বাস করে। আর বলত, ঝট করে যদি চোখ পাকিয়ে দেখি, তাহলে হয়তো এক মৎস্য-কন্যা আমার চোখে ধরা দেবে!
‘ওই যে!’ বলল সে। ‘দেখেছ? বড়োসড়ো লালচুলো একটা, সবুজ লেজ।’ আমিও তাকাতাম সেদিকে। খুঁজতাম খুব করে, কিন্তু কোনোদিন দেখতে পাইনি।’
মাথা নাড়ল মোটকু চার্লি, তারপর সামনের টেবিলে থাকা বাটি থেকে এক মুঠো বাদাম তুলে পুড়ে দিল মুখে। এমনভাবে চাবাতে লাগল যেন ওগুলোই বিশ বছরের জমানো-অবমাননা যা কখনওই ভোলা সম্ভব না!
‘আমার কিন্তু মনে হচ্ছে,’ চেহারা উজ্জ্বল হয়ে গেল রোজির। ‘তোমার বাবা বেশ মজার মানুষ, অন্যরকম একটা চরিত্র! বিয়েতে তাকে আনতেই হবে, পার্টির জান বনে যাবে সে!’
কথাটা শুনে, ব্রাজিলিয়ান বাদাম আটকে গেল মোটকু চার্লির গলায়। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে জানাল বিয়ের পার্টিতে বরের বাবা কেন পার্টির ‘জান’ হতে যাবে? সন্দেহ নেই: ওর বাবার মতো, দুনিয়ার বুকে আর কেউ মোটকু চার্লিকে অপদস্থ করতে পারবে না। এটাও যোগ করল: বুড়োকে বহু বছর হলো দেখে না, এবং তাতে কোনো আপত্তি নেই তার। ওর মায়ের জীবনের অন্যতম সেরা কাজ হলো বাবাকে পরিত্যাগ করে ইংল্যান্ডে, মায়ের খালা অ্যালান্নার সঙ্গে ওঠা। জোর দিয়ে বলল— দুনিয়া ধ্বংস করে, নতুন করে বানিয়ে আবার ধ্বংস করে আবারও নতুন করে বানানো হলেও বাবাকে দাওয়াত দিতে যাবে না। সত্যি বলতে কী, বলে কথা শেষ করল মোটকু চার্লি, এই বিয়েটার সবচাইতে ভালো দিকটা হচ্ছে—বাপকে তাতে দাওয়াত না দেওয়া!
পরক্ষণেই রোজির ওপর নজর পড়ল মোটকু চার্লির। সাধারণত মেয়েটার চোখের দৃষ্টিতে বন্ধুত্বই থাকে, কিন্তু এখন চেহারাটা বিকৃত হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে হিম-শীতলতা। সঙ্গে সঙ্গে শুধরে নিলো সে নিজের বক্তব্য: দ্বিতীয়-সেরা দিক। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
‘তোমাকে আসলে প্রস্তাবটা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবতে হবে, তাহলেই আর মেনে নিতে আপত্তি থাকবে না।’ জানাল রোজি। ‘হাজার হলেও, বিয়ের অনুষ্ঠান অসাধারণ একটা উপায়…যে উপায়ে ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগানো যায়, মিটে যায় সম্পর্কের মাঝে সৃষ্ট ফাটল। তুমি যে ওকে ক্ষমা করে দিয়েছ, তা বোঝাবার এর চাইতে ভালো সুযোগ আর পাবে না।’
‘কিন্তু,’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি। ‘ক্ষমা তো করিনি!’
‘তোমার বাবার ঠিকানা জানো?’ জিজ্ঞেস করল রোজি। ‘কিংবা তার ফোন নম্বর? তোমার বোধহয় ফোন করাই ভালো হবে। চিঠি পাঠানোটা কেমন আনুষ্ঠানিক হয়ে যায়, হাজার হলেও…তার একমাত্র ছেলের বিয়ে হতে যাচ্ছে। তুমি একমাত্র সন্তানই তো? ই-মেইল আছে নাকি তার?’
‘হ্যাঁ, আমিই তার একমাত্র ছেলে। আর জানি না ই-মেইল আছে কি না। সম্ভবত নেই।’ বলল মোটকু চার্লি। চিঠি পাঠানোই ভালো হবে, ভাবল সে। কেননা ডাক বিভাগ অনেক চিঠি হারিয়ে ফেলে!
‘ঠিকানা কিংবা ফোন নম্বর তো আছে?’
‘নেই,’ জানাল মোটকু চার্লি, এক বিন্দু বাড়িয়ে বা কমিয়ে বলছে না। হয়তো ওর বাবা এখন আর আগের ঠিকানায় নেই। ফ্লোরিডা ছেড়ে এমন কোথাও গেছে যেখানে টেলিফোনই নেই…
…কিংবা নেই ঠিকানাও!
‘তাহলে, কার কাছে আছে?’ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে জানতে চাইল রোজি।
‘মিসেস হিগলার,’ জানিয়ে দিল মোটকু চার্লি, প্রেমিকার সঙ্গে ঝগড়া করার স্পৃহা আর নেই।
মিষ্টি হাসি হাসল রোজি। ‘কে এই মিসেস হিগলার?’ জানতে চাইল মেয়েটা।
‘পারিবারিক বন্ধু,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘আমি যখন বাচ্চা, তখন পাশের বাড়িতে থাকত।’
বেশ কয়েক বছর আগে একবার মিসেস হিগলারের সঙ্গে কথা হয়েছিল ওর, মা তখন মৃত্যুশয্যায়। তার অনুরোধেই, মিসেস হিগলারকে ফোন করে কথাটা বাবাকে জানিয়ে দিতে বলেছিল মোটকু চার্লি। সম্ভব হলে মানুষটা যেন দেখা করে। তারও কয়েক দিন পর, মোটকু চার্লির আনসারিং মেশিনে একটা মেসেজ আসে; তখন ও অফিসে ছিল। বার্তাটা পাঠিয়েছিল ওর বাবা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কণ্ঠ একই আছে। তবে খানিকটা বুড়োটে আর মাতাল শোনাচ্ছিল।
বার্তায় লোকটা জানাল, এখন পারবে না আসতে। কিছু কাজের জন্য আমেরিকায় আটকে আছে। অবশ্য যোগ করতে ভোলেনি যে মোটকু চার্লির মাকে সে ‘অসাধারণ এক মহিলা’ বলেই ভাবে। তারও বেশ কিছুদিন পর, ফুলের একটা তোড়া উপস্থিত হয় হাসপাতালের ওয়ার্ডে। সঙ্গে যে কার্ডটা ছিল সেটা পড়ে নাক সিঁটকায় মোটকু চার্লির মা।
‘এত সহজে আমাকে ভজিয়ে ফেলবে ভাবছে?’ বলে সে। ‘উঁহু, আমাকে পটানো এতটাও যে সহজ না তা বুঝিয়ে দিব।’ তবে নার্সকে দিয়ে বিছানার পাশেই রাখে তোড়াটা। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করে মোটকু চার্লিকে— লোকটা কি তাকে দেখতে আসার ব্যাপারে কিছু জানিয়েছে? সব কিছু শেষ হয়ে যাবার আগে?
মোটকু চার্লি জানাল, এমন কিছু জানায়নি। প্রশ্নটাকে ঘৃণা করতে শুরু করে সে এক পর্যায়ে, উত্তরটাকে আরও বেশি। আর জবাব শোনার পর মায়ের চেহারার যে হাল হয়, তা সহ্য হতে চায় না।
সবচাইতে বাজে দিনটা ছিল, অন্তত মোটকু চার্লির মতে, যেদিন ডাক্তার এসে ওকে একপাশে সরিয়ে নিয়ে জানাল — আর বেশিদিন সময় নেই ওর মায়ের হাতে, দ্রুতই খারাপ হচ্ছে অবস্থা। এখন অন্তিম সময়ের অপেক্ষা করা আর মহিলাকে আরাম দেওয়ার প্রয়াস চালানো বাদে আর কিছুই করার নেই।
ছোটোখাটো, বদমেজাজি লোকটার কথা শুনে কেবল মাথা দুলিয়েছিল চার্লি। তারপর মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ওর হাত নিজের হাতে নিয়ে মা জিজ্ঞেস করেছিল—গ্যাসের বিল চুকিয়েছে কি না। ঠিক সেই সময় করিডোর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে আসে—একই সঙ্গে যেন আছড়ে পড়ার, অর্গানের মতো বাদ্যযন্ত্র বাজার, পা ঠোকার, ড্রাম বাজাবার শব্দ মিশে আছে তাতে। এই ধরনের আওয়াজ আর যেখানেই হোক, হাসপাতালে শুনতে পাবার কথা না; যেখানে দেয়ালের সঙ্গে সাঁটানো আছে নির্দেশ—নীরবতা বজায় রাখুন; হিমশীতল চোখের দৃষ্টিতে নার্সরা যেই নির্দেশ পালন হচ্ছে কি না তা দেখে।
আস্তে আস্তে বেড়ে যাচ্ছে আওয়াজ।
এক মুহূর্তের জন্য মোটকু চার্লির মনে হলো, সম্ভবত জঙ্গি হামলা-টামলা হয়েছে! কিন্তু শ্রুতিকটু শব্দ সত্ত্বেও হেসে ফেলল ওর মা। ‘হলদে পাখি,’ ফিসফিসিয়ে বলল সে।
‘কী?’ প্রশ্ন করল মোটকু চার্লি, মা আবোল-তাবোল বকা শুরু করেছে ভেবে ভয় পাচ্ছে।
দরজা দিয়ে মোটকু চার্লি উঁকি দিল বাইরে।
হাসপাতালের করিডোর ধরে দৃঢ় পায়ে, সব নার্সের আপত্তি অগ্রাহ্য করে, পায়জামা পরা রোগী ও তাদের পরিবারদের মুখ হাঁ করে দিয়ে, এগিয়ে আসছে নিউ অর্লিয়ান্সের খুবই ছোট্ট একটা জ্যাজ ব্যান্ড! স্যাক্সোফোন, সউসাফোন, ট্রাম্পেট—কী নেই তাদের কাছে! আরও আছে বিশালদেহী এক লোক, দেখে মনে হচ্ছে ডাবল বেজ নামের একটা বাদ্যযন্ত্র ধরে রেখেছে গলার কাছে। আরও একজন আছে, বেজ ড্রামসহ; বাজাচ্ছে ইচ্ছে মতো। দলের একদম সামনে ফেডোরা হ্যাট, লেবু রঙের দস্তানা আর একটা স্মার্ট চেক স্যুট তার পরনে—চার্লির বাবা। তার হাতে কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই, তবে নরম জুতো পরা পা-দুটো দিয়ে হাসপাতালের পালিশ করা লিনোলিয়ামের মেঝেতে নাচছে। মেডিক্যালের কর্মচারীদের দিকে তাকিয়ে হ্যাট তুলে সম্মান জানাচ্ছে, কেউ কথা বলার কিংবা আপত্তি জানাবার জন্য কাছে এলেও করমর্দন করছে তার সঙ্গে!
মোটকু চার্লি ঠোঁট কামড়ে ধরল, প্রার্থনা করল—দুনিয়া যেন দুই ভাগ হয়ে যায়, আর লোকটাকে গিলে খায়; অথবা স্বল্প সময়ের, বিনা কষ্টের কিন্তু প্রাণঘাতী হার্ট অ্যাটাক হয়ে মরে যায়! সেই প্রার্থনা বিশেষ কারও উদ্দেশ্যে না, যেকেউ শুনলেই হবে! কিন্তু কপাল মন্দ, তেমন কিছু হলো না। লোকটা বেঁচেই রইল আর বাদ্যযন্ত্রও বেজেই চলল। নাচতে-নাচতে সামনে যে-ই পড়ল, তার সঙ্গেই হাত মেলাল হাসিমুখে।
এই পৃথিবীতে যদি সুবিচার বলতে কিছু থাকে, ভাবল মোটকু চার্লি। তাহলে আমার বাবা করিডর ধরে হেঁটেই যাবে, তারপর আমাদেরকে অতিক্রম করে ঢুকে পড়বে জেনিটো-ইউরিনারি ডিপার্টমেন্টে; কিন্তু…অচিরেই গেল বুঝে— সুবিচার বলে কিচ্ছু নেই দুনিয়ায়। অঙ্কোলজির[২] সামনে এসে থমকে গেল সে।
[২. ক্যান্সার-সংক্রান্ত চিকিৎসা হয় যে বিভাগে]
‘মোটকু চার্লি,’ এমন স্বরে বলল সে যে পুরো ওয়ার্ড—এবং পুরো মেঝে—আর সম্ভবত পুরো হাসপাতাল বুঝে ফেলল, এই মানুষটা মোটকু চার্লিকে চেনে। ‘মোটকু চার্লি, পথ ছাড়ো; তোমার বাবা হাজির হয়েছে।’
পথ ছেড়ে দিল মোটকু চার্লি।
ব্যান্ড দলটা, মোটকু চার্লির পিছু নিয়ে, এঁকে-বেঁকে ঢুকে গেল ওর মায়ের কামরায়; দাঁড়াল তার বিছানার পাশে। চোখ তুলে তাদের দিকে চাইল মহিলা, হাসি খেলে গেল তার চেহারায়।
‘হলদে পাখি’, ‘ দুর্বল কণ্ঠে বলল সে। ‘আমার পছন্দের গান।’
‘সেটাই যদি ভুলে যাই, তাহলে আমি কেমন মানুষ হলাম?’ মোটকু চার্লির বাবা মন্তব্য করল।
ধীরে ধীরে মাথা দোলাল মহিলা, হাত বাড়িয়ে নিজের হাতে নিলো মোটকু চার্লির বাবার লেবু রঙা হলদে দস্তানা পরা হাত।
‘এক্সকিউজ মি,’ ছোটোখাটো একটা সাদা মেয়ে হাতে ক্লিপবোর্ড নিয়ে ঢুকল ভেতরে। ‘এরা কি তোমাদের সঙ্গে?’
‘না,’ গাল লালচে হয়ে গেছে মোটকুর। ‘আমাদের সঙ্গে না।’
‘কিন্তু রোগিণী তো তোমার মা, তাই না?’ ব্যাসিলিস্কের[৩] মতো দৃষ্টি হেনে মেয়েটা বলল। ‘এদেরকে এখুনি ওয়ার্ড ছেড়ে দিতে বলো, আর যেন কোনো ঝামেলা না হয়।’
[৩. পৌরাণিক সাপ, যে চোখের দৃষ্টিতে কাউকে পাথর বানাতে সক্ষম]
বিড়বিড় করে উঠল মোটকু চার্লি।
‘কী বললে?’
‘তা করার ক্ষমতা যে আমার নেই, সেটাই বললাম।’ বলল মোটকু চার্লি। নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিল সে, ভাবছিল -পরিস্থিতি এর চাইতে খারাপ হতেই পারে না! ঠিক তখনই ড্রামারের কাছে থাকা প্লাস্টিকের ক্যারিয়ার ব্যাগটা হাতে নিয়ে বের করে আনল ব্রাউন এলের অনেকগুলো ক্যান। ব্যান্ড দলের সবাইকে দিল একটা একটা করে; এমনকী নার্সিং স্টাফ কিংবা রোগীরাও বাদ গেল না। তারপর ধরাল চুরুট।
‘এক্সকিউজ মি,’ ধোঁয়া দেখে আবার বলল ক্লিপবোর্ড হাতে রাখা মেয়েটা। মোটকু চার্লির বাবার দিকে স্কাড মিসাইলের মতো ছুটে এলো সে।
সুযোগ বুঝে পালিয়ে গেল মোটকু চার্লি, ওই মুহূর্তে এটাই সেরা কাজ বলে মনে হলো।
সে রাতটা মোটকু চার্লি কাটিয়ে দিয়েছিল নিজ বাড়িতে বসে; অপেক্ষা করছিল ফোন বেজে ওঠার… কিংবা দরজায় টোকার শব্দ শোনার। গিলোটিনে গলা ঢুকিয়ে, গলায় ব্লেডের চুমু টের পাবার অপেক্ষায় থাকা মানুষের যে অবস্থা হয়, ওর-ও সেটাই হয়েছিল; কিন্তু না, কেউ বিরক্ত করতে এলো না ওকে।
রাতে ঘুমায়নি বললেই চলে, পরেরদিন বিকেলে যখন হাসপাতালে পা রাখে তখন খারাপ খবর শোনার জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু ওর মাকে, শয্যাশায়ী অবস্থাতেই, বিগত কয়েকমাসের তুলনায় অনেক বেশি আনন্দিত আর স্বচ্ছন্দ দেখাচ্ছে। ‘চলে গেছে ও,’ মোটকু চার্লিকে জানাল সে। ‘থাকতে পারেনি। তবে একটা কথা বলতেই হচ্ছে, চার্লি, তুই ওভাবে চলে না গেলেই পারতি! রাতে তো আনন্দ উৎসব হয়ে গেল এখানে! ভালোই কেটেছে সময়টা।’
ক্যান্সারের ওয়ার্ডে পার্টি? এর চাইতে বাজে আর কী হতে পারে, তা মোটকু চার্লি কল্পনাও করতে পারে না। তাও কি না ওর বাবার আয়োজনে, জ্যাজ ব্যান্ডের সঙ্গে! তবে কিছুই বলল না সে।
‘মানুষটা ও খারাপ না,’ বলল মোটকু চার্লির মা, মহিলার চোখ জ্বলজ্বল করছে। পরক্ষণেই ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ‘আসলে, কথাটা পুরোপুরি ঠিক না। মানুষটা সে ভালোও না। তবে গত রাতে আমার অনেক উপকার করেছে।’ হাসল মা, সত্যিকারের হাসি; এক মুহূর্তের জন্য হলেও, তাকে কমবয়েসী দেখাল।
দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ক্লিপবোর্ড হাতের মেয়েটা, আঙুল বাঁকিয়ে ইঙ্গিতে ডাকল মোটকু চার্লিকে। সেদিকে এগিয়ে গেল ছেলেটা, দূরে থাকতেই ক্ষমা চাইতে শুরু করল। কিন্তু কাছে গিয়ে টের পেল, মেয়েটাকে দেখে এখন আর পেটে ব্যথায় কাতর ব্যাসিলিস্ক বলে মনে হচ্ছে না! বরঞ্চ আদুরে বিড়ালের মতো দেখাচ্ছে। ‘তোমার বাবা,’ বলল সে।
‘আমি দুঃখিত, বলল মোটকু চার্লি। যেকোনো প্রসঙ্গে, ওর বাবা জড়িত থাকলে, ওই শব্দ দুটো উচ্চারণ করেই কথা শুরু করে সে।
‘আরে, না-না।’ প্রাক্তন ব্যাসিলিঙ্ক বলল। ‘ক্ষমা চাইবার মতো কিছু হয়নি। জানতে চাচ্ছিলাম… তোমার বাবা… মানে যদি তার সঙ্গে যোগাযোগ করার দরকার পরে তো আরকি ফাইলে তার ফোন নম্বরটা নেই। গত রাতে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল, তবে মনেই পড়েনি একদম!’
‘মনে হয় না সে ফোন-টোন ব্যবহার করে,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘তার নাগাল পাবার সেরা উপায় হচ্ছে ফ্লোরিডা গিয়ে, হাইওয়ে এ১এ ধরা। রাস্তাটা সৈকতবর্তী, ওই প্রদেশের প্রায় পুরো পূর্ব দিকের সমান লম্বা। বিকেলের দিকে তাকে পাওয়া যাবে কোনো একটা সেতুর ওপর মাছ ধরতে ব্যস্ত অবস্থায়। আর সন্ধেয় পাবে বারে।’
‘খুবই আকর্ষণীয় মানুষ,’ প্রগলভ সুরে বলল মেয়েটা। ‘কী করে?’
‘বললাম তো…ওসবই করে। অলৌকিকের ওপর বেঁচে আছে।’
শূন্য দৃষ্টিতে ওকে দেখল মেয়েটা, নিজেকে বোকা ঠেকল মোটকু চার্লির। অথচ ওর বাবার মুখ থেকে কথাটা শুনলে, সবাই হেসে গড়াগড়ি খায়। ‘উম, বাইবেলে উল্লেখ আছে—যিশু একবার অলৌকিক ভাবে অল্প মাছ আর রুটি দিয়ে সবাইকে খাইয়েছিলেন। বাবা বলল, সে-ও তেমন অলৌকিক উপায়েই কামায়। ঠাট্টা আরকি।’
স্বপ্নালু দৃষ্টি দেখা গেল মেয়েটার চোখে। ‘হ্যাঁ, মজার মজার সব কৌতুক সে জানে বটে।’ একটু হেসে আবার পেশাদার ভঙ্গি ধারণ করল। ‘তোমাকে আবার ঠিক সাড়ে পাঁচটায় দেখতে চাই।’
‘কেন?’
‘তোমার মাকে, তার সব জিনিসপত্রসহ ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ডা. জনসন বলেননি?’
‘বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছ মাকে?’
‘হ্যাঁ, মি. ন্যান্সি।’
‘তাহলে…ক্যান্সারের কী হবে?’
‘যা বুঝলাম: অহেতুক দুশ্চিন্তা করছিলেন ডাক্তার সাহেব!’
কিছুই বুঝতে পারছে না মোটকু চার্লি। গত সপ্তাহেও ওর মাকে বিশেষায়িত সেবা পাওয়া যায় এমন কোথাও ভর্তি করার কথা হচ্ছিল। এই ‘ডাক্তার সাহেব’ বলছিলেন ‘এখন শুধু শেষ সময়ের অপেক্ষা’ আর ‘অন্তিম মুহূর্ত আসার আগে তাকে যতটা সম্ভব আরামে রাখার চেষ্টা বলতে পারেন’ টাইপের কথা-বার্তা।
সেটা কীভাবে অহেতুক দুশ্চিন্তা হয়?
তবে ঠিক সাড়ে পাঁচটায় হাসপাতালে ফিরে এসে মাকে নিয়ে যেতে ভুল করল না মোটকু চার্লি। অবশ্য মাকে দেখে কেউ বলবে না— আচমকা নতুন জীবন পেয়ে মহিলা অবাক হয়েছে। বাড়ি ফেরার পথে সে জানাল মোটকু চার্লিকে; যা জমিয়েছে এই জীবনে, সব খরচ করে সে বিশ্বটাকে ঘুরে দেখতে চায়।
‘ডাক্তাররা যখন বলেছিল, আর মাত্র মাস তিনেক বাঁচব,’ জানাল মহিলা। ‘তখন ভেবেছিলাম: যদি কোনোভাবে এই হাসপাতালের বিছানা ছাড়তে পারি তো প্যারিস-রোম আর এমন সব শহরে ঘুরে বেড়াব। বারবাডোজ আর সেন্ট অ্যান্ড্রুজে যাবো, এমনকী আফ্রিকাতেও যেতে পারি। আর চীন তো যাবোই, চাইনিজ খাবার আমার খুব পছন্দ।’
কী হচ্ছে তা বুঝতে পারছে না মোটকু চার্লি। কিন্তু যা-ই ঘটুক না কেন, তার দায় যে পুরোপুরি ওর বাবার—তা জানে। বোঝাই একটা স্যুটকেসসহ মাকে সে হিথরো বিমানবন্দরে বিদেয় দিল। আন্তর্জাতিক বহির্গমন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ল চার্লি। ভদ্রমহিলা আকর্ণ-বিস্তৃত হাসি হেসে, ঢুকে গেল ভেতরে; এক হাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে আছে পাসপোর্ট আর টিকেট;
অনেকগুলো বছর পর—তাকে দেখে মনে হচ্ছে—এক ধাক্কায় বয়েস কমে গেছে অনেকটা।
প্যারিস থেকে, রোম থেকে আর অ্যাথেন্স থেকে মোটকু চার্লিকে পোস্টকার্ড পাঠায় মা। এমনকী লাগোস আর কেপ টাউন থেকেও। নানকিং থেকে পাঠানো কার্ড থেকে মোটকু চার্লি জানতে পারল—ওখানে চাইনিজ নাম দিয়ে যে খাবার বিক্রি হচ্ছে, তা তার পছন্দ হয়নি! তাই লন্ডনে ফিরে সত্যিকারের চাইনিজ খাবার খাওয়ার তর সইছে না মহিলার।
সেন্ট অ্যান্ড্রুজ নামের ক্যারিবিয়ান এক দ্বীপের, হোটেল উইলিয়ামসটাউনের একটা কামরায়, ঘুমের মধ্যে মারা যায় মোটকু চার্লির মা।
শেষকৃত্যানুষ্ঠানটা ছিল দক্ষিণ লন্ডনের একটা ক্রিমেটোরিয়ামে। মোটকু চার্লির কেবলই মনে হচ্ছিল—এই বুঝি উদয় হলো ওর বাবা! হয়তো জ্যাজ একটা ব্যান্ডকে সঙ্গে নিয়ে আসবে, অথবা পেছনে থাকবে ক্লাউনদের একটা দল…এমনকী সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে ট্রাই-সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে আসতে থাকা শিম্পাঞ্জির দলও থাকতে পারে সঙ্গে; বলা যায়: যাজকের বক্তৃতায় মন না দিয়ে, বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে একরকম বাধ্যই হয়েছে মোটকু চার্লি; দেখেছে চ্যাপেলের ঢোকার দরজাটা বন্ধ আছে কি না। তবে না, মোটকু চার্লির বাবা সেদিন দেখা দেয়নি। চ্যাপেলে ছিল কেবলই ওর মায়ের বন্ধু-বান্ধব আর দূর-সম্পর্কের আত্মীয়রা। অধিকাংশই বিশালদেহী নারী, বারবার নাক টেনে চোখ মুছে নিচ্ছিল তারা রুমালে। মাথাটা নাড়ছিল উভয় পাশে।
শেষ স্তবগানের সময়, যখন বোতাম চেপে মোটকু চার্লির মায়ের লাশটাকে পোড়ার জন্য শুইয়ে রাখা কনভেয়ার বেল্টটা চালু করা হয়েছিল, তখন চ্যাপেলের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে থাকা সমবয়সী মানুষটা নজরে এলো মোটকু চার্লির। লোকটা যে ওর বাবা না, তা তো বলাই বাহুল্য। বরঞ্চ এমন একজন, যাকে সে চেনে না; হয়তো অন্ধকারে, ছায়ায় তাকে দেখার কথাও ওর ছিল না… বাবার খোঁজে বারবার আশপাশে না তাকালে হয়তো নজরে পড়ত ও না…দারুণ একটা কালো স্যুট পরে আছে অচেনা লোকটা, মাথা নিচু; হাত বাঁধা।
প্রয়োজনের চাইতে এক মুহূর্ত বেশিই তাকে দেখল মোটকু চার্লি; চোখাচোখি হয়ে যেতেই হাসল অচেনা লোকটা, আনন্দহীন হাসি; কিন্তু সেই হাসি এমন যা হেসে মানুষ বুঝিয়ে দেয়—এই শোক যে হাসছে ও যাকে দেখে হাসছে, একমাত্র তারাই বয়ে চলছে! অচেনা-অজানা কারও চেহারায় এমন হাসি দেখতে পাবার কথা না। কিন্তু তারপরেও মানুষটাকে চিনতে পারল না মোটকু চার্লি। মাথা ঘুরিয়ে তাকাল সামনের দিকে। তখন ‘সুইং লো, সুইট চ্যারিয়ট’ গাইছে চ্যাপেলের লোকরা। মোটকু চার্লি প্রায় শতভাগ নিশ্চিত— গানটা ওর মা একদম পছন্দ করত না। গান শেষে রেভারেন্ড রাইট সবাইকে আমন্ত্রণ জানালেন, মোটকু চার্লির নানি অ্যালান্নার বাড়িতে কিছু মুখে দেওয়ার জন্য।
অ্যালান্নার বাড়িতে অবশ্য অচেনা কাউকে দেখতে পেল না সে। মা মারা যাবার পরের বছরগুলোতে, মাঝে-মধ্যে ওই অজ্ঞাতনামা লোকটাকে নিয়ে ভেবেছে মোটকু চার্লি: লোকটা কে ছিল, কেন এসেছিল। কখনও কখনও তো মনে হয়: হয়তো কল্পনাই করেছে ব্যাটাকে!
‘তাহলে,’ শার্ডোন্যের গ্লাস খালি করে বলল রোজি। ‘তুমি মিসেস হিগলারকে ফোন করে তাকে আমার মোবাইল নম্বর জানাচ্ছ। মহিলাকে আমাদের বিয়ের কথা জানাবে, জানাবে তারিখও। ভালো কথা: তাকে দাওয়াত দেওয়ার দরকার আছে?’
‘চাইলে দিতে পারো,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘তবে মনে হয় না আসবে। পারিবারিক বন্ধু যদিও, বহু আগে থেকেই চেনে বাবাকে।’
‘হুম, তাহলে আগে কথা বলে দেখো। দরকার হলে পরে দাওয়াত দেওয়া যাবে।’
রোজি খুবই ভালো একটা মেয়ে। রবিন হুড, অ্যাসিসির ফ্রান্সিস[৪], বুদ্ধ আর গ্লিন্ডা দ্য গুডের[৫] মতো কিছু একটা তার মাঝেও আছে। মেয়েটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে: মোটকু চার্লির সঙ্গে ওর বাবার সম্পর্কটা মেরামত করতে পারলে, ওদের বিয়েতে আলাদা একটা আঙ্গিক যোগ হবে। তখন আর ব্যাপারটা নিছক বিয়ে থাকবে না, হয়ে যাবে মানবিক এক মিশন; রোজিকে যতটুকু চেনে মোটকু চার্লি তাতে চোখ বন্ধ করে বলতে পারে—ওর বাগদত্তা নিজের আর অন্যের ভালো করার মাঝে কোনো কিছুকেই বাধা হয়ে দাঁড়াতে দেবে না।
[৪. সেন্ট ফ্রান্সিস নামেও পরিচিত, খ্রিষ্টধর্মের অন্যতম সম্মানিত ব্যক্তিত্ব।
৫. ফ্রাঙ্ক বমের ‘উইজার্ড অভ ওজ’ বা ‘ওজের জাদুকর’ বইয়ের একটা চরিত্র যে মানুষের ভালো করে।]
‘আগামীকাল ফোন দেব মিসেস হিগলারকে,’ বলল সে।
‘এক কাজ করো,’ নাক কুঁচকে বলল রোজি, মেয়েটাকে এই অবস্থায় ভালোই লাগে দেখতে। ‘আজ রাতেই ফোন করে দেখো। হাজার হলেও, আমেরিকাতে এখন গভীর রাত না!’
মাথা নেড়ে সায় জানাল মোটকু চার্লি। একসঙ্গে বার থেকে বেরোল ওরা। রোজির পায়ে যেন কেউ স্প্রিং লাগিয়ে দিয়েছে, কিন্তু মোটকু চার্লিকে দেখে মনে হচ্ছে যেন ফাঁসির আদেশ পাওয়া অপরাধী। নিজেকে ধমক দিল সে, শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। হয়তো মিসেস হিগলার অন্য কোথাও চলে গেছে, কিংবা হয়তো ফোনটাই আর কানেক্টেড নেই।
হতেও পারে…
এই দুনিয়াতে সবই সম্ভব।
.
মোটকু চার্লির বাড়িটা ব্রাইটন রোড পেরিয়ে একটু সামনেই, ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনসে; একটা ছোট্ট বাড়ির ওপর তলার অর্ধেকটা দখল করেছে সে।
‘ফ্লোরিডায় এখন কয়টা বাজে?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল রোজি।
‘বিকেলের শেষের দিক,’ মোটকু চার্লি জবাব দিল।
‘তাহলে ফোন করো।’
‘খানিক পর করি, হয়তো মহিলা বাইরে আছে।’
‘অথবা হয়তো এখনই ফোন করতে হবে, মিসেস হিগলার রাতের খাওয়া সেরে নেবার আগেই।’
পুরাতন অ্যাড্রেস বুকটা খুঁজে বের করল মোটকু চার্লি, ‘এইচ’ লেখা পাতায় একটা খাম খুঁজে পেল ও; মায়ের হাতের লেখা চিনতে পারল প্রথম দেখাতেই, সঙ্গে একটা টেলিফোন নম্বর। তারও নিচে লেখা: কেলিঅ্যান হিগলার।
কিন্তু বার বার রিং বাজলেও কেউ তুলল না রিসিভার।
‘বাড়িতে নেই মনে হয়,’ রোজিকে বলল সে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই রিসিভার তুলে একটা নারী-কণ্ঠ বলে উঠল। ‘কেন?’
‘উম, মিসেস হিগলার বলছ?’
‘কে জানতে চায়?’ মিসেস হিগলার প্রশ্ন ছুড়ে দিল। ‘টেলিমার্কেটার নাকি? এখুনি ফোন রাখো, নইলে কেস ঠুকে দেব। নিজের অধিকার আমি জানি।’
‘না, আমি চার্লস ন্যান্সি। আগে আমরা প্রতিবেশী ছিলাম।’
‘মোটকু চার্লি? একেই বলে ভাগ্যের খেল। সারা সকাল জুড়ে তোমার নম্বর খুঁজে বেড়াচ্ছি। পুরো বাসা তছনছ করে ফেললাম, তারপরেও পেলাম না! ভেবেছিলাম, হয়তো পুরাতন অ্যাকাউন্টস বুকে লিখেছিলাম নম্বরটা। সেটার খোঁজে বাসা উলটে ফেললাম। বললাম—নিজেকে, কেলিঅ্যান, হাঁটু গেঁড়ে বসে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা শুরু করে দাও; যদি তাতে কাজ হয়। কিন্তু বয়সের চোটে হাঁটুর অবস্থা খারাপ, তাই হাত বেঁধে প্রার্থনা শুরু করলাম আরকি। যদিও তাতে লাভ হলো না, খুঁজেই পেলাম না নম্বর। কিন্তু দেখো, এখন তুমিই আমাকে ফোন করলে। একদিক থেকে চিন্তা করলে সেটা আরও ভালো। আমার তো আর টাকার গাছ নেই। কারণ যা-ই হোক না কেন, বিদেশে ফোন করার সামর্থ্য আমার নেই। তবে পরিস্থিতি এমন যে ওই নম্বরটা পেলে ফোন করতামই—’
বলতে বলতেই থেমে গেল মহিলা; হয়তো শ্বাস নিতে, অথবা হয়তো সবসময় বাঁ-হাতে যে গরম কফির মগ থাকে তাতে চুমুক দিতে। কিন্তু সেই এক মুহূর্তের সুযোগটা নিয়েই মোটকু চার্লি বলল। ‘আমি বাবাকে খুঁজছিলাম। বিয়ে করছি, অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিতে চাই।’
ওপাশ থেকে ভেসে এলো নীরবতা।
‘তবে বিয়েটা এই বছরের শেষের দিকে।’ জানাল সে। তারপরেও ওপাশ থেকে কোনো শব্দ ভেসে এলো না। ‘মেয়েটার নাম রোজি,’ কণ্ঠে আশা নিয়ে বলল মোটকু চার্লি। সন্দেহ হতে লাগল ওর—লাইন কেটে গেছে নাকি? মিসেস হিগলারের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা আছে আগে থেকেই, সাধারণত শুধু শুনতে হয়…বলতে পারে না সঙ্গী। এমনকী নিজেই তার হয়ে কথা বলে দেয় মিসেস ভদ্রমহিলা। অথচ এখন দেখা যাচ্ছে, বিনা বাধায় ওকে কথা বলতে দিচ্ছে মহিলা! কথা বাড়াবার সিদ্ধান্ত নিলো মোটকু চার্লি। ‘চাইলে তুমিও আসতে পারো।’
‘খোদা, খোদা, খোদা, বলল মিসেস হিগলার। ‘কেউ তোমাকে বলেনি, না?’
‘কী বলেনি?’
তাই ওকে সব জানাল মহিলা, বিস্তারিত বর্ণনার সঙ্গে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে সব শুনল মোটকু চার্লি, বলল না কিছুই। কথা শেষে শুধু এতটুকু বলল, ‘ধন্যবাদ, মিসেস হিগলার।’ কাগজে খচখচ করে কিছু একটা লিখল সে। ‘ধন্যবাদ, সত্যি বলছি…ধন্যবাদ।’ রেখে দিল রিসিভার।
‘কী হলো?’ রোজি জিজ্ঞেস করল। ‘ফোন নম্বর পেয়েছ?’
মোটকু চার্লি বলল, ‘বিয়েতে বাবা আসতে পারবে না।’ একটু পর যোগ করল। ‘আমাকেই ফ্লোরিডা যেতে হবে।’ একেবারে নিষ্প্রাণ, অনুভূতিহীন শোনাল ওর কণ্ঠ। ‘নতুন একটা চেকবুক লাগবে, ‘–এ কথা যদি বলত, তাহলেও এমনই শোনাত।
‘কখন?’
‘কালকেই।’
‘কেন?’
‘শেষকৃত্যানুষ্ঠান, বাবার। মারা গেছে।’
‘ওহ, আমি দুঃখিত। আমি অত্যন্ত দুঃখিত!’ মোটকু চার্লিকে জড়িয়ে ধরল রোজি। দোকানে দাঁড়িয়ে থাকে যেভাবে পুতুল, সেভাবে দাঁড়িয়ে রইল ছেলেটা। ‘কীভাবে মারা… অসুস্থ ছিল?’
মাথা নাড়ল মোটকু চার্লি। ‘এই প্রসঙ্গটা নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছি না।’
শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরল রোজি, মাথা নাড়ল একবার সহমর্মিতার সঙ্গে। তারপর ছেড়ে দিল। ধরেই নিয়েছে, শোকের প্রাবল্যে কথা বলতে পারছে না ছেলেটা।
তবে…সত্যিটা হলো…শোক অনুভব করছে না মোটকু চার্লি…
…কথা বলতে না পারার কারণ: লজ্জা।
.
মারা যাবার এক হাজার একটা সম্মানজনক উপায় আছে নিশ্চয়ই। একটা ছোট্ট বাচ্চাকে ডুবে মরার হাত থেকে বাঁচাতে নদীর বুকে ঝাঁপ দিয়ে মরতে পারে কেউ। কিংবা সন্ত্রাসীর আখড়ায় আক্রমণ করতে গিয়ে কচুকাটা হয়েও মরণ আসতে পারে। মরার এসব উপায় নিঃসন্দেহে সম্মানজনক।
সত্যি বলতে কী, এমনও অনেক কম সম্মানজনক উপায় আছে যেভাবে মরলে খুব একটা অসুবিধে হতো না। উদাহরণ: দুম করে গায়ে আগুন লেগে মারা যাওয়া, যদিও হাওয়া থেকে এভাবে কারও গায়ে আগুন লাগাটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে অস্বাভাবিক। তারপরও অনেকেই ছাই হয়ে যায়, পেছনে ফেলে যায় সিগারেট ধরে রাখা একটা পোড়া হাত; একটা ম্যাগাজিনে এমনটা পড়েছিল মোটকু চার্লি! বাবা ওভাবে মারা গেলে আফসোস করত না। এমনকী ছিনতাইকারীর হাত থেকে মদ খাওয়ার টাকা উদ্ধারের জন্য রাস্তায় দৌড়াতে দৌড়াতে হার্ট অ্যাটাক করে মরলেও না।
কিন্তু তার মৃত্যুর গল্পটা ভিন্ন:
বারে আগে আগেই উপস্থিত হয় লোকটা। ক্যারিয়োকি-সন্ধ্যার সূত্রপাত ঘটায় ‘হোয়াট’স নিউ পুসি ক্যাট?’ গেয়ে। মিসেস হিগলারের মতে—যদিও মহিলা তখন সেখানে উপস্থিত ছিল না-এমন ভাবে বাবা গেয়েছিল গানটা যে ওখানে টম জোনস থাকলে মেয়েলি অন্তর্বাসের সাগরে ডুবে যেত! যাই হোক, অন্তত একটা বিয়ার পাঠিয়েছিল কিছু সোনালি-চুলো পর্যটক। মিশিগান থেকে আগত মেয়েদের সেই দলটার কাছে মনে হয়েছিল—মি. ন্যান্সির মতো মিষ্টি কিছু আগে কখনও দেখেনি।
‘দোষ মেয়েদের না,’ ফোনেই তিক্ত কণ্ঠে বলছিল মিসেস হিগলার। ‘মানুষটাকে উৎসাহ দিতে চাচ্ছিল কেবল!’ এই মেয়েগুলো আঁটোসাঁটো টপস পরে ছিল; রোদে পুড়ে গেলে শুরুর দিকে যেমন হয়, তেমন ছিল তাদের ত্বক। প্রত্যেকেরই বয়েস এমন যে মিস্টার ন্যান্সির মেয়ে বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে!
ক্ষণিকের মাঝেই মেয়েদের টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় লোকটা, চুরুট টানতে টানতে ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেয়—যুদ্ধের সময় আর্মির ইন্টেলিজেন্সে ছিল; যদিও কোন যুদ্ধের সময়, তা স্থির করে বলেনি। খালি হাতে কাউকে হত্যা করার এক ডজন উপায় নাকি তার জানা, আর সেজন্য ঘামও ঝরাতে হবে না!
পর্যটকদের মাঝে সবচাইতে স্বর্ণকেশী, আর সবচাইতে বিদ্রোহী বক্ষের মালকিনকে নিয়ে ড্যান্স ফ্লোরে পা রাখে সে। এদিকে সেই মুহূর্তেই আরেক পর্যটক মঞ্চে উঠে গাইছিল—স্ট্রেঞ্জারস ইন দ্য নাইট। সময়টা দারুণ উপভোগ করছিল বুড়ো লোকটা, সঙ্গিনী তার চাইতে লম্বা হলেও… ন্যান্সির হাসিমুখ ঘোরা-ফেরা করছিল মেয়েটার বুকের উচ্চতায়।
নাচ শেষ হলে সে ঘোষণা করল, আবার তার গান গাইবার সময় হয়েছে। মোটকু চার্লির যে মেয়েমানুষ পছন্দ, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। তারপরেও ‘আই অ্যাম হোয়াট আই অ্যাম’ গেয়ে শোনাল সে উপস্থিত জনতাকে; যদিও বিশেষ করে লক্ষ্য ছিল মঞ্চের ঠিক সামনের টেবিলে বসা সেই স্বর্ণকেশী মেয়েটা। সবটুকু দরদ ঢেলে গানটা গাইল সে। গাইতে গাইতে গানের সেই পর্যায়ে এসেছিল যখন জোর গলায় সবাইকে জানাচ্ছিল: যদি নিজের সত্তাকে সবার সামনে তুলে ধরতে না পারে, তাহলে বেঁচে থাকাটাই অর্থহীন; আচমকা বিকৃত হয়ে যায় মানুষটার চেহারা, এক হাতে চেপে ধরে বুক; অন্য হাতটা বাড়িয়ে ধরে আছড়ে পড়ে মেঝেতে। তবে ধীরে এবং যতটা সম্ভব ভদ্রতা বজায় রেখে। মঞ্চ থেকে সরাসরি স্বর্ণকেশীর ওপর পড়ে যায় সে, মেয়েটাকে নিয়ে মেঝেতে পাতে শয্যা।
‘এভাবেই যেন মরতে পারে, সেই কথা বলতে ওকে বহুবার শুনেছি,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানিয়েছিলেন মিসেস হিগলার।
তারপর মোটকু চার্লিকে মহিলা জানাল: ওর বাবা তার জীবনে সর্বশেষ কোন কাজটা করেছে। মঞ্চ থেকে মেঝেতে পড়ার সময়, হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরতে চায় সে; সক্ষমও হয়! আর জিনিসটা হলো—স্বর্ণকেশী পর্যটকের টিউব টপ। প্রথম প্রথম দর্শকরা ভাবে লালসা চরিতার্থ করতেই মঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে পড়েছে সে; অবাধ্য স্তনজোড়াকে মুক্তি দিতে চেয়েছে পোশাকের আবরণ থেকে। কেননা মেয়েটাও আবক্ষ নগ্ন হয়ে, লজ্জা আর আতঙ্কে চেঁচাতে শুরু করে দিয়েছিল। এদিকে তখনও বেজে চলছে ‘আই অ্যাম হোয়াট আই অ্যাম’-এর সুর, যদিও গাইছে না কেউ।
যখন দর্শকরা বুঝতে পারল যে আসলে কী হয়েছে, তখন দুই মিনিট ব্যাপী নীরবতা পালন করল সবাই। মোটকু চার্লির বাবাকে বয়ে নিয়ে তুলে দেওয়া হলো একটা অ্যাম্বুলেন্সে। এদিকে চিৎকাররত স্বর্ণকেশীর আশ্রয় হলো লেডিজ রুমে।
মোটকু চার্লি কেন যেন ওই স্তনজোড়ার কথা মাথা থেকে বের করতে পারল না। ওগুলো যেন অভিযোগের সঙ্গে দেখছে ওকে, যেভাবে কোনো ছবির চোখজোড়া তাকিয়ে থাকে। বারবার এমন একদল লোকের কাছে ক্ষমা চাইতে থাকে সে মনে মনে, যাদেরকে কখনও দেখেওনি! ওর বাবা পুরো ব্যাপারটায় চরম মজা পেত—এই জ্ঞানটাই মোটকু চার্লিকে আরও বেকায়দায় ফেলে দিচ্ছে। নিজে উপস্থিত ছিল না, এমন কোনো ঘটনা নিয়ে লজ্জা বোধ করা ছোটোখাটো ব্যাপার না–বারংবার সেই ঘটনায় ফিরে যায় মন, নেড়ে চেড়ে দেখে।
অন্তত আর সব মানুষের না গেলেও, মোটকু চার্লির মন যায় বটে!
সেই শুরু থেকেই, মোটকু চার্লি প্রথমে লজ্জা অনুভব করে দাঁতে; তারপর পাকস্থলীতে। এমনকী টেলিভিশনের পর্দাতেও যদি বিব্রতকর কিছু দেখানো হবে বলে মনে হয়, তখন মোটকু চার্লি উঠে দাঁড়িয়ে সেটা বন্ধ করে দেয়। যদি কামরায় অন্য কেউ থাকে আর যন্ত্রটা বন্ধ করতে না পারে, তাহলে অজুহাত দেখিয়ে বেরিয়ে যায় বাইরে; বিব্রতকর মুহূর্তটা ফুরিয়ে যাবার আগে ফেরে না।
দক্ষিণ লন্ডনে বাস করে মোটকু চার্লি। দশ বছর বয়সে এসেছে সে এখানে, কথায় ছিল আমেরিকান টান; কটু কথা কম শুনতে হয়নি ওকে সেজন্য। অনেক চেষ্টা করে টানটা ঝেটিয়ে তাড়িয়েছে কণ্ঠ থেকে। ষোলো বছর বয়সে সফল হয় তাতে, কিন্তু ততদিনে পালটে গেছে পাশার দান। মোটকু চার্লির বন্ধুরা আবিষ্কার করেছে— তারা আসলে কথায় আমেরিকান টান আনতে চায়। অচিরেই দেখা গেল: মোটকু চার্লি যখন আমেরিকা থেকে আসে, তখন যে টান আর শব্দগুলো ব্যবহার করত, সেভাবেই কথা বলছে ছেলেটার বন্ধুরা! অবশ্য কানমলা না খেয়ে, ওই শব্দগুলো মায়ের সামনে কখনওই ব্যবহার করতে পারেনি মোটকু চার্লি।
সে যাই হোক, বাবার মৃত্যু-সম্পর্কিত ঘটনার কারণে সৃষ্ট লজ্জা যখন বিদেয় নিলো ওর মন থেকে, তখন সেই স্থান দখল করে নিলো শূন্যতা।
‘আমার কোনো পরিবার নেই,’ প্রায় অনুযোগের সুরে বলল সে রোজিকে। ‘কেন? আমি আছি না?’ বলল মেয়েটা। শুনে হাসি ফুটল মোটকু চার্লির ঠোঁটে। ‘আমার মা-ও আছে,’ রোজি যোগ করতেই, মিলিয়ে গেল হাসিটা। ওর গালে চুমু খেল রোজি।
‘আজ রাতটা থেকে যাও,’ প্রস্তাব দিল মোটকু চার্লি। ‘সান্ত্বনা দাও আমাকে।’
‘থাকা যায় বটে,’ বলল রোজি। ‘তবে থাকছি না!’
বিয়ে আগে মোটকু চার্লির সঙ্গে শোবে না রোজি। সেই পনেরো বছর বয়সেই নাকি এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল; মোটকু চার্লির সঙ্গে পরিচয় ছিল না বটে তখন, তবে সিদ্ধান্তটা যে দৃঢ় ছিল তা পরিষ্কার। আরেকবার ওকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা, এবার আরও লম্বা সময়ের জন্য। বলল, ‘বাবার ব্যাপারে নিজের মনের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে হবে তোমাকে, বুঝলে?’
এই বলে নিজের বাড়ির পথে রওনা দিল মেয়েটা।
অস্থির একটা রাত কাটল মোটকু চার্লির। এই ঘুমুচ্ছে, এই করছে পায়চারী, আবার এই ঘুরে-ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ছে।
সূর্যোদয়ের সময় উঠে পড়ল সে। কর্ম-ঘণ্টার শুরুতেই ট্রাভেল এজেন্টকে ফোন করে জেনে নেবে—শোকসন্তপ্ত এই পরিস্থিতিতে, ফ্লোরিডার ভাড়ায় ছাড় পাওয়া যাবে কি না। তারপর ফোন করবে গ্রাহাম কোটস এজেন্সিতে। তাদেরকে জানাবে: পরিবারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটায়, কয়েকদিনের ছুটি নিতে হচ্ছে ওকে। এটাও বলবে, এই কদিন যে ওর জমানো ছুটি থেকে কর্তন করে রাখা হবে, কিংবা ফেলা হবে ‘অসুস্থতা-জনিত ছুটির’ কাতারে—তা-ও জানে। কিন্তু এই মুহূর্তে, এখন…বিশ্ব নীরবতা পালন করছে বলে, মনটা কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠছে ওর।
বাড়ির পেছন দিকে অবস্থিত ছোট্ট, বাড়তি কামরাটায় এসে পা রাখল ও করিডর ধরে এগিয়ে এসে। ওখান থেকে তাকিয়ে রইল নিচের বাগানটার দিকে। ভোরের কিচির-মিচির শুরু হয়ে গেছে। কালো পাখি, চড়ুইসহ একটা সারিল পাখিও দেখতে পেল সে এক গাছের ডালে। ভাবল: যে পৃথিবীতে ভোরের ঘুম ভাঙে পাখির গান শুনে, সেটা সাধারণ একটা পৃথিবী; যে পৃথিবীতে দুইয়ে দুইয়ে সব সময় চার হয়…এ এমন এক পৃথিবী যার অংশ হতে ওর কোনো আপত্তি নেই!
পরে, যখন পাখি দেখলেই আতঙ্কে কেঁপে উঠতে শুরু করে ওর মন, তখনও এই সকালটাকে ভালো আর দারুণ কিছু একটা ভাবত মোটকু চার্লি। তবে উপলব্ধি করত: তখন থেকেই শুরু…
এই পাগলামির…
…আর এই আতঙ্কের!
অধ্যায় দুই – যেটা মূলত শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো নিয়ে
অধ্যায় দুই – যেটা মূলত শেষকৃত্যানুষ্ঠানের পর যেসব ঘটনা ঘটে, সেগুলো নিয়ে
ফ্লোরিডার সূর্যের উজ্জ্বল আলোয় চোখ পিটপিট করতে করতে, মোটকু চার্লি পৌঁছল দ্য মেমোরিয়াল গার্ডেন অভ রেস্ট-এ। স্যুটে ছড়িয়ে পড়ছে ঘামের দাগ, শুরু হয়েছে বগল আর বুকে। এমনকী চেহারাটাও ঘামে জবজব করছে।
দ্য মেমোরিয়াল গার্ডেন অভ রেস্ট দেখতে-শুনতে বাগানের মতোই। তবে বড়োই অদ্ভুত সেই বাগান; কেননা ওটার ফুলগুলো নকল… মাটির ওপর থাকা ধাতব খণ্ডের ওপর রাখা ধাতব ফুলদানীতে জন্মেছে। একটা সাইনবোর্ডের পাশ দিয়ে সামনে এগোল মোটকু চার্লি যাতে লেখা: সম্মানের সঙ্গে অবসর নেওয়া সৈনিকদের বিনামূল্যে কবরস্থ হবার স্থান। বেবিল্যান্ড অতিক্রম করল সে, ওখানে নকল ফুলের সঙ্গে যোগ দিয়েছে নানা রঙা বায়ু-কল আর নীল- গোলাপি টেডি বিয়ার। নীলচে আকাশের দিকে ঘোরলাগা ভঙ্গিতে চেয়ে আছে একটা খেলনা উইনি দ্য পু।
শেষকৃত্যানুষ্ঠানের জন্য সমবেত হওয়া জনতার ভিড় এখন দেখতে পাচ্ছে মোটকু চার্লি। একটা পথ খুঁজে নিলো সে, সেই ভিড়ের কাছে যাওয়া যায় যাতে। জনা তিরিশেক লোক, বেশিও হতে পারে, কবরটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। মহিলাদের পরনে কালো পোশাক, বড়ো বড়ো কালো হ্যাট মাথায় যার কিনারায় কালো লেইস লাগানো। পুরুষদের পরনে স্যুট, তাতে অন্তত ঘামের দাগ লেগে নেই। বাচ্চাদেরকেও মনমরা দেখাচ্ছে। গতি কমিয়ে, শ্লথ পায়ে হাঁটতে লাগল মোটকু চার্লি; যেন তাতেও শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। দ্রুত হাঁটতে চাইছে, কিন্তু এটাও চাচ্ছে না যে কেউ ওর সেই প্রচেষ্টা ধরতে পারুক। শোক- প্রকাশকারীদের কাছে পৌঁছে, নিজের ওপর কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইল সে। কিন্তু প্রবলভাবে হাঁপাচ্ছে বেচারা, যেভাবে সিঁড়ি ভেঙে কখনও কোনো সিন্ধুঘোটক ওপরে উঠতে পারলে হাঁপাত! সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে ঘামের বন্যা, তাছাড়া এগোতে গিয়ে বেশ কয়েকজনের পা-ও মাড়িয়েছে সে।
তাই সব মিলিয়ে, নিজের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ না করার প্রচেষ্টাটা পর্যবসিত হলো ব্যর্থতায়!
চোখ পাকিয়ে অনেকেই তাকাচ্ছে ওর দিকে, তবে সেগুলোকে অগ্রাহ্য করার ভান ধরল মোটকু চার্লি। একটা গান সবার মুখে, এদিকে ওটা জানে না সে। সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথা দোলাল, অভিনয় করল গানটা গাইবার। সুযোগ পেয়ে একবার উঁকি দিল শবাধারের ভেতর। ওটার ডালা বন্ধ দেখে খুশিই হলো।
তবে শবাধারটা দেখার মতো জিনিস বটে। অস্ত্র-শস্ত্র যে ধূসর-রঙা ধাতু দিয়ে তৈরি হয়, সেটার মতো রং; ইস্পাতের বানানো বলেই মনে হচ্ছে। শেষ বিচারের দিনে – ভাবল মোটকু চার্লি —যখন দেবদূত গ্যাব্রিয়েল তার শিঙা বাজিয়ে মৃতদেরকে জাগ্রত করবেন, সেদিনও ওর বাবা আটকে থাকবে তার কবরে। ভারী ডালাটা খুলতে চাইবে, কিন্তু পারবে না। নিশ্চয়ই ভাববে-ইস, সঙ্গে যদি একটা ক্রো-বার অথবা একটা অক্সিঅ্যাসেটিলিন টর্চ থাকত!
বিষণ্ণ গলায় ‘হ্যালেলুইয়াহ’ বলার মাধ্যমে শেষ হলো গান। এরপর নেমে আসা নীরবতা ছাপিয়ে শোনা গেল মেমোরিয়াল গার্ডেনের অন্য পাশ থেকে ভেসে আসা চিৎকারের শব্দ; ওদিক দিকেই ভেতরে ঢুকেছে মোটকু চার্লি।
যাজক বললেন, ‘আমাদের কাছ থেকে বিদেয় নেওয়া প্রিয় এই মানুষটির ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে চান?’
কবরের কাছে দাঁড়ানো মানুষগুলোর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, ওদের মাঝে বেশ কয়েকজন কিছু কথা বলতে চায়। কিন্তু মোটকু চার্লি উপলব্ধি করতে পারল—এখনই সময়। বাবার প্রতি সব রাগ-গোস্বা ঝেড়ে ফেলার উপযুক্ত সুযোগ আর আসবে না।
লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে সামনে এগোল সে, পৌঁছল কবরের ঠিক ডান পাশে। বলল, ‘উম, কিছু মনে করবেন না। আমার কিছু কথা বলার আছে।’
দূর থেকে ভেসে আসা চিৎকারের শব্দ আরও জোরালো হচ্ছে। সমবেত মানুষদের অনেকেই পিছু ফিরে চাইছে সেদিকে। বাকিরা হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে মোটকু চার্লিকে।
‘বাবার সঙ্গে কখনওই ঠিক ঘনিষ্ঠ ছিলাম না আমি,’ শুরু করল মোটকু চার্লি। ‘আসলে কীভাবে ঘনিষ্ঠ হতে হয়, তা আমাদের কারোই জানা ছিল না। গত বিশ বছর ধরে তার জীবনে ছিলাম না আমি, আর না সে আমার জীবনে ছিল। এমন অনেক কিছুই ঘটেছে যা ভুলে যাওয়া খুব কঠিন। কিন্তু এভাবেই দিন কাটাতে থাকলে একসময় আবিষ্কার করবেন, পরিবারের আর কেউ বেঁচে নেই!’ কপালটা মুছল সে হাত দিয়ে। ‘জীবনে কখনও ‘তোমাকে ভালোবাসি, বাবা’ বলেছি বলে মনে হয় না। উপস্থিত সুধী, আপনারা সম্ভবত বাবাকে আমার চাইতে ভালোভাবে চেনেন। কেউ কেউ হয়তো ভালোও বাসেন ওকে। আপনারা তার জীবনের অংশ ছিলেন, আমি ছিলাম না। তাই গত বিশ বছরের মাঝে এই প্রথমবারের মতো আমি যা বলতে যাচ্ছি আপনারা শুনলেও লজ্জা পাবো না।’ শবাধারের ইস্পাতের তৈরি ডালার দিকে তাকাল সে। ‘ভালোবাসি তোমাকে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘কখনও ভুলব না তোমার কথা!’
চিৎকারের আওয়াজ ক্রমেই জোরাল হচ্ছে; মোটকু চার্লির কথা বলা শেষ হলে যে নীরবতা নেমে এলো, তার মাঝে পরিষ্কার ভাবে শোনা গেল কথাগুলো। পুরো দ্য মেমোরিয়াল গার্ডেনের কেউই শুনতে বাকি রইল না: ‘মোটকু চার্লি! ওই ভালোমানুষদের বিরক্ত করা বাদ দিয়ে, এখুনি এখানে এসো!’
অপরিচিত চেহারাগুলোর দিকে তাকাল মোটকু চার্লি; প্রত্যেকের চোখে- মুখে ফুটে আছে ধাক্কা খাওয়া, হতবাক হওয়া, রাগ আর আতঙ্কের অনুভূতি; লজ্জায় লাল হয়ে গেল ওর কান… সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরে।
‘উম, দুঃখিত। ভুল অনুষ্ঠানে চলে এসেছি,’ বলল সে।
বড়ো বড়ো কানঅলা এক ছোট্ট বাচ্চা, আকর্ণবিস্তৃত হাসি হেসে গর্বের সঙ্গে বলল, ‘ওটা আমার দাদি!’
মোটকু চার্লি বিড়বিড় করে অর্থহীন কিছু শব্দের সাহায্যে ক্ষমা প্রার্থনা করতে করতে পেছাতে শুরু করল। এই মুহূর্তে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে গেলে, বিন্দুমাত্র আপত্তি করত না ও। জানে, দোষটা ওর বাবার না; তবে এটাও জানে—এই মুহূর্তে বাবা থাকলে হেসে গড়াগড়ি খেত।
রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে এক বিশালদেহী রমণী; চুল তার ধূসর, চোখে-মুখে রাগের ছোঁয়া, উভয় হাত রেখেছে কোমরে। এমনভাবে সেদিকে এগিয়ে গেল মোটকু চার্লি, যেন কোনো মাইনফিল্ডে পা রাখছে; সেই নয় বছর বয়সী বাচ্চায় পরিণত হয়েছে আবার!
‘এতক্ষণ ডাকলাম, শুনতে পাওনি?’ জানতে চাইল মহিলা। ‘ঠিক আমার পাশ দিয়েই হেঁটে গেছ। কী একটা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেললে নিজেকে!’ কড়া টান তার কণ্ঠে। ‘এদিকে এসো,’ ইঙ্গিতে রাস্তা দেখিয়ে দিল সে। ‘মূল অনুষ্ঠান ফুরিয়ে গেছে। তবে এখনও এক বেলচা ভরতি মাটি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।’
গত দুই দশকে মিসেস হিগলারকে পরিবর্তন স্পর্শও করতে পারেনি বলা যায়: আগের চাইতে একটু মোটা, একটু ধূসর। ঠোঁটজোড়া আরও শক্ত হয়ে এঁটে বসেছে একটা আরেকটার ওপর। আগে আগে চলছে সে, পেছনে মোটকু চার্লি। ছেলেটা বুঝতে পারছে, প্রথম দর্শনে মহিলাকে প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হয়েছে সে। পথ দেখাচ্ছে মহিলা, অপমানিত মোটকু চার্লি অনুসরণ করছে তাকে।
মেমোরিয়াল গার্ডেনের ধাতব বেড়ার পাশ দিয়ে ছুটে গেল একটা সরীসৃপ। একটা কাঁটার ওপর অবস্থান নিলো সে, গ্রহণ করল ফ্লোরিডার ভারী বাতাসের স্বাদ। মেঘের আড়ালে লুকিয়েছে সূর্য, কিন্তু তাতে যেন আরও উষ্ণ হয়েছে বিকেলটা। গলা ফুলিয়ে উজ্জ্বল কমলা বেলুনের জন্ম দিল সরীসৃপটা।
লম্বা পাঅলা দুই সারসকে অলংকার ভেবেছিল মোটকু চার্লি। কিন্তু ওকে পাশ দিয়ে যেতে দেখে, চোখ তুলে চাইল তারা। একটা তো মাথা নিচু করে ঝট করে দৌড়ুল সামনে। পরক্ষণেই মাথা উঁচু করতে দেখা গেল—ওটার চঞ্চুতে ছটফট করছে হৃষ্টপুষ্ট একখানা ব্যাঙ। তারপর ঢোক গিলতে শুরু করল পাখিটা, ব্যাঙের নিষ্ফল ঠ্যাঙ ছোড়াছুড়িকে কাঁচকলা দেখিয়ে বেচারাকে চালান দিতে লাগল পাকস্থলীতে।
‘দ্রুত হাঁটো, বলল মিসেস হিগলার। ‘ হেলদোল কোরো না। এমনিতেই বাপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে পারোনি!’
সেদিনই যে চার হাজার মাইলের বেশি পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে, সেটা জানাবার ইচ্ছেটাকে গলা টিপে মারল মোটকু চার্লি। অরল্যান্ডোয় নেমে, একটা গাড়ি ভাড়া নিয়ে অতিক্রম করেছে বাকি পথটা। তাও আবার ভুল রাস্তায় চলতে হয়েছে কিছুক্ষণ। শহরের একদম কোনায়, একটা ওয়াল-মার্টের পেছনে কে এমন কবরস্থান বানায়?
কিন্তু কিচ্ছু বলল না সে, হাঁটতে লাগল চুপচাপ। বড়ো একটা কংক্রিটের দালান পড়ল পথে, ওটার গা থেকে ফরমালডিহাইডের গন্ধ আসছে। গার্ডেনের একদম শেষ দিকের কোনায় পাওয়া গেল একটা খোলা কবর। ওটার পরে উঁচু বেড়া বাদে বলতে গেলে কিছুই নেই, তারও ওপাশে সবুজ গাছ-গাছড়ার বুনো জংলামতো। কবরের মাঝে শুয়ে আছে, মাঝারি মানের একখানা কাঠের কফিন। এরিমধ্যে কয়েক মুঠো বালি ফেলা হয়েছে তাতে। কবরের পাশে পড়ে আছে একটা বেলচা, তার পাশে মাটির স্তূপ।
বেলচাটা তুলে, মোটকু চার্লির দিকে এগিয়ে দিল মিসেস হিগলার।
‘অনুষ্ঠান খারাপ হয়নি,’ বলল সে। ‘তোমার বাবার পুরনো দিনের বন্ধু এসেছিল কিছু, একসঙ্গে মদ গিলত তারা। আমাদের প্রতিবেশী কিছু মহিলাও এসেছিল। এখান থেকে চলে যাওয়ার পরেও, তোমার বাবার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল আমাদের। সন্দেহ নেই, তাদের দেখতে পেলে খুশিই হতো তোমার বাবা! আর হ্যাঁ, তুমি যদি সময়মতো উপস্থিত হতে, তাহলে ওর আত্মা আরও বেশি শান্তি পেত!’ মাথা দোলাল মহিলা। ‘যাক সে কথা, এখন কবর ভরার কাজে লেগে পড়ো।’
‘আমার তো জানা ছিল—এক কি দুইবার মাটি ফেলাই যথেষ্ট,’ জানাল ছেলেটা। ‘মানে প্রথা মানা আরকী।’
‘কাজটা যার ছিল, তাকে তিরিশ ডলার দিয়ে ভাগিয়েছি,’ জানাল মিসেস হিগলার। ‘বলেছি, হিংল্যান্ড[৬] থেকে তার ছেলে উড়ে এসেছে। নিশ্চয়ই বাবাকে সে নিজ হাতে কবর দিতে চাইবে…যেটা উচিতও। শুধু প্রথা মানতে চাইবে না!’
[৬. জ্যামাইকার অধিবাসীরা ইংল্যান্ডকে এভাবে ডাকে।]
‘ঠিক বলেছ,’ একমত হলো মোটকু চার্লি। ‘বিলকুল ঠিক। এখুনি কাজে নামছি।’ স্যুটের জ্যাকেট খুলে, বেড়ায় ঝুলিয়ে রাখল সে। তারপর টাই আলগা করে, খুলে নিলো গলা থেকে; ওটার স্থান হলো জ্যাকেটের পকেটে। অতঃপর কাজে নেমে পড়ল, বেলচা ভরতি করে মাটি নিয়ে ফেলছে কবরে। এদিকে ফ্লোরিডার বাতাস যেন ঘন স্যুপের মতো ভারী হয়ে আছে!
খানিকক্ষণ পর, শুরু হলো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। অদ্ভুত ধরন এই বৃষ্টির— ঝরবে না কি ঝরবে না, সেটা সে নিজেও জানে না! কেউ যদি এহেন বর্ষণের সময় গাড়ি চালায়, তাহলে ধন্ধে পড়ে যায়—ওয়াইপার চালু করবে, নাকি বন্ধই রাখবে! কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই বৃষ্টিতে গা ভেজানো, বেলচা ভরে মাটি ফেলা—এসব আরও বেশি অস্বস্তিকর। তবে সেসব গ্রাহ্য না করে মোটকু চার্লি নিজের কাজ চালিয়ে যেতে লাগল। পাশেই দাঁড়িয়ে রইল মিসেস হিগলার, দুই প্রকাণ্ড স্তনের ভার বুকের নিচে বেঁধে রাখা হাতের ওপর দিয়ে। যে প্রায়-বৃষ্টি ঝরছে, তার প্রভাবে কালো পোশাকটা থেকে যেন কুয়াশা জন্ম নিয়েছে। মাথায় থাকা খড়ের হ্যাট—যাতে লাগানো আছে একটা মাত্র কালো, সিল্কের গোলাপ—একবারের জন্যও না দুলিয়ে দেখল সে মোটকু চার্লির হাতের কাজ।
মাটি পরিণত হলো কাদায়। আশ্চর্যের কথা, যেন আগের চাইতেও ভারী হয়ে গেল তা ওজনে!
প্রায় একটা…চরম অস্বস্তিকর…জনমের পর, বেলচা ভরে শেষ মাটিটুকুও কবরে ফেলল মোটকু চার্লি।
ওর দিকে এগিয়ে এলো মিসেস হিগলার। বেড়া থেকে জ্যাকেটটা তুলে, এগিয়ে দিল সামনে।
‘একেবারে কাকভেজা হয়ে গেছ; ঘামে আর কাদায় মেখে আছে শরীরটা, তবে বেড়ে উঠেছ এই খানিকক্ষণের মাঝেই। বাড়িতে স্বাগতম, মোটকু চার্লি, বলে হাসল মহিলা, ছেলেটাকে টেনে নিলো বুকের ওপর।
‘আমি কাঁদছি না,’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি।
‘চুপ করো,’ নরম কণ্ঠে বলল মিসেস হিগলার।
‘চেহারায় বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে,’ আবারও বলল মোটকু চার্লি।
কিছুই বলল না মিসেস হিগলার, শুধু ধরে রইল ওকে। আস্তে আস্তে দুলছে এপাশ থেকে ওপাশে। বেশ কিছুক্ষণ পর জানাল মোটকু চার্লি, ‘ছাড়ো এবার, আমি ঠিক আছি।’
‘আমার বাড়িতে চলো,’ নির্দেশ দিল যেন মহিলা। ‘কিছু মুখে দেবে।’
পার্কিং লটে এসে জুতো থেকে কাদা মুছল ছেলেটা; তারপর চড়ল ধূসর, ভাড়া করা গাড়িটায়। মিসেস হিগলারের মেরুন-রঙা স্টেশন ওয়াগনকে অনুসরণ করে এমন কিছু রাস্তা অতিক্রম করল, যা বছর বিশেক আগে ছিল না।
পাগলের মতো গাড়ি চালাচ্ছে মিসেস হিগলার। যদি কোনো মহিলা আচমকা তার বহু আকাঙ্ক্ষিত কফির বিশাল বড়ো একটা মগ খুঁজে পায়…গাড়ি যত দ্রুত সম্ভব চালাবার সময় যত বেশি সম্ভব কফি গেলার শর্তে, তাহলেই কেবলমাত্র এভাবে গাড়ি চালানো সম্ভব। মোটকু চার্লি বাধ্য তাকে অনুসরণ করতে, যতটা সম্ভব গতি বজায় রাখতে হচ্ছে তাকেও। চোখের পলকে একের-পর-এক ট্রাফিক লাইট পেরোচ্ছে ওরা, বুঝতেও পারছে না: কোথায় আছে!
আচমকা একটা রাস্তায় ঢুকে পড়ল ওদের গাড়ি। টের পেল মোটকু চার্লি—চিনতে পারছে! ছেলেবেলায় এখানেই বাস করত। এমনকী বাড়িগুলোকেও কম-বেশি আগের মতোই দেখাচ্ছে। যদিও অধিকাংশেরই সামনের প্রাঙ্গণে দেখা যাচ্ছে তারের জালের বেড়া।
মিসেস হিগলারের বাড়ির সামনে এরিমধ্যে বেশ কয়েকটা গাড়ি পার্ক করে রাখা। একটা বয়সী, ধূসর ফোর্ডের পেছনে নিজের গাড়ি রাখল মোটকু চার্লি। মিসেস হিগলার সদর দরজার সামনে গিয়ে, চাবি দিয়ে তালা খুলল।
নিজের দিকে তাকাল মোটকু চার্লি; ভিজে একসা, সেই সঙ্গে কাদা আর ঘাম তো আছেই। ‘এই বেশে ভেতরে যাওয়াটা ঠিক হবে না।’
‘এরচাইতেও খারাপ বেশ দেখেছি,’ বলল মিসেস হিগলার। তারপর নাক টেনে যোগ করল, ‘তবে এক কাজ করো— সরাসরি বাথরুমে চলে যাও। হাত- মুখ ধুয়ে নিজেকে কিছুটা পরিষ্কার করে নাও। তারপর সরাসরি রান্নাঘরে চলে এসো।’
বাথরুমে পা রাখল মোটকু চার্লি। ভেতরে জেসমিনের সুগন্ধের রাজত্ব, সবকিছুই যেন দখল করে আছে। কর্দমাক্ত শার্টটা খুলে ফেলল প্রথমেই; তারপর ছোট্ট একটা ওয়াশবেসিনে হাত-মুখ ধুয়ে নিলো জেসমিনের সুগন্ধিঅলা সাবানে। একটা কাপড় হাতে নিয়ে, বুক মুছে ফেলল সে। তারপর ট্রাউজার্সে লেগে থাকা কাদার স্তূপটা পরিষ্কার করার প্রয়াস পেল। শার্টের দিকেও তাকাল একবার, সকালে যখন পরেছিল তখন সাদাই ছিল। তবে এখন কেমন যেন বাদামি মনে হচ্ছে। ঠিক করল—আজ আর ওটা গায়ে চড়াবে না। ব্যাগে আরও শার্ট আছে, আর ব্যাগটা আছে ভাড়া করা গাড়ির পেছনের সিটে। চুপচাপ বাড়িটা থেকে বেরিয়ে, একটা পরিষ্কার শার্ট পরে ফিরে আসবে আবার।
বাথরুমের দরজা খুলে ফেলল সে।
চারজন বয়স্কা রমণী দাঁড়িয়ে আছে করিডোরে, দেখছে ওকেই। চারজনের প্রত্যেককে চেনে মোটকু চার্লি।
‘আবার কী হলো?’ জিজ্ঞেস করলেন মিসেস হিগলার।
‘শার্টটা পালটাবো,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘গাড়িতে আছে, ফিরছি এখুনি।’
চিবুক উঁচু করে, করিডোর ধরে এগিয়ে গেল সে; তারপর বাইরে পা রাখল সদর দরজা দিয়ে।
‘কেমন একটা অদ্ভুত টানে কথা বলল না?’ ওর পেছন থেকে ভেসে এলো মিসেস ডানউইডির কণ্ঠ।
‘এমন দৃশ্যও সচরাচর দেখা যায় না,’ যোগ করল মিসেস বাস্টামন্টে। অবশ্য ফ্লোরিডার এমন এক স্থানে আছে যেখানে ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত, এমন মানুষ অহরহ দেখা যায়। অবশ্য তাদের সবার পরনে কর্দমাক্ত স্যুট ট্রাউজার্স থাকে না!
গাড়ির কাছে এসে পোশাক বদলে নিলো মোটকু চার্লি, তারপর ফিরে গেল বাড়িতে। রান্নাঘরে অপেক্ষা করছে চার বয়স্কা মহিলা, প্লাস্টিকের বাক্সে ভরছে খাবার।
মিসেস বাস্টামন্টের চাইতে বয়সে বড়ো মিসেস হিগলার। তাদের দুজনের চাইতেই ছোটো মিস নোলস। তবে কেউই মিসেস ডানউইডির চাইতে ছোটো না। বয়স্কা নারী মিসেস ডানউইডি, সেটা তার চেহারা থেকেই প্রতীয়মান হয়। এমনকী কেউ যদি বলে, মিসেস ডানউইডি তাম্র-যুগ কিংবা লৌহ-যুগের চাইতেও প্রাচীন, তাহলে তার কথা ফেলে দেওয়া যাবে না।
ছেলেবেলায় ভদ্রমহিলাকে প্রায়শই বিষুবরেখার আশপাশের কোনো আফ্রিকান এলাকায় কল্পনা করত মোটকু চার্লি। কল্পনার চোখে দেখত—নাক- মুখ কুঁচকে মহিলা তার চশমার পুরু কাচের পেছন থেকে সদ্য খাড়া হওয়া হোমিনিডদের দেখছে। ‘আমার বাড়ি থেকে দূরে থাক্,’ বিবর্তনের মইয়ের আরেক সিঁড়ি ওপরে ওঠা, ভয়ার্ত এক হোমো হবিলিসকে বলছে সে। ‘নইলে চড়িয়ে তোর কানের পর্দা ফাটাবো।’ ধুনোর গন্ধ আসে মিসেস ডানউইডির দেহ থেকে। তবে সেটাও বয়স্কা নারীর দেহের গন্ধ পুরোপুরি ধামাচাপা দিতে পারেনি! ছোট্ট এক বুড়ি সে, যে চাইলে চোখ পাকিয়ে বজ্রঝড়েরও পিলে চমকে দিতে পারবে। মোটকু চার্লি, যে প্রায় দুই দশকেরও আগে টেনিস বলের খোঁজে মহিলার প্রাঙ্গণে ঢুকে সাজাবার সরঞ্জাম ভেঙে ফেলেছিল, ভয়টাকে পুরোপুরি ভুলে যায়নি!
অবশ্য এই মুহূর্তে একটা ছোট্ট বাক্স থেকে আঙুল দিয়ে পুছে, খাসির মাংসের তরকারি তুলে খাচ্ছে মিসেস ডানউইডি। ‘নষ্ট করে লাভ কী?’ বলল সে, হাড়ের টুকরো ফেলল চীনে মাটির একটা থালায়।
‘খিদে পেয়েছে, মোটকু চার্লি?’ জিজ্ঞেস করল মিস নোলস।
‘একদম না,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘সত্যি বলছি।’
চারজোড়া চোখ সঙ্গে সঙ্গে তাকাল ওর দিকে, চারজোড়া চশমার ওপাশ থেকে। ‘শুধু শুধু নিজেকে কষ্ট দেবার দরকার কী? তাতে শোক কমবে?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মিসেস ডানউইডি, আঙুল চেটে খাচ্ছে খাসির মাংস।
‘খিদে পায়নি একদম, নিজেকে কষ্ট দিচ্ছি না।’
‘শোক মানুষকে শুকিয়ে হাড়-মাংসে পরিণত করে তোলে,’ বিষণ্ন মুখে বলল মিস নোলস।
‘মনে হয় না আমার ক্ষেত্রে তা হবে।’
‘ওই টেবিলে খাবার বেড়ে দিচ্ছি,’ মিসেস হিগলার বলল। ‘তুমি গিয়ে বসো ওখানে। আর একটা কথাও শুনতে চাই না। খাবারের অভাব নেই, তাই পেট ভরে খাও।’
মহিলার নির্দেশিত স্থানে বসে পড়ল মোটকু চার্লি। কয়েক সেকেন্ডের মাঝে ওর সামনে দেখা গেল থালা ভরতি মটরশুঁটি আর ভাত; সেই সঙ্গে আছে মিষ্টি আলুর পুডিং, শুয়োরের মাংস, খাসির গোশতের তরকারি, মুরগি, ভাজা সবজি এবং আচার দেওয়া গোরুর পায়া। মোটকু চার্লির মনে হলো, খাবার দেখেই ওর বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে; এমনকী মুখে দেওয়ারও দরকার হয়নি।
‘আর সবাই কই?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘তোমার বাবার মাতাল বন্ধুরা… মদ গিলতে গেছে। তার স্মৃতির সম্মানে সেতুতে মাছ ধরার আয়োজন করবে বলে ঠিক করেছে তারা।’ বালতি-আকৃতির কফির মগ থেকে অবশিষ্ট তরলটুকু সিঙ্কে ঢালল মহিলা। তারপর মগটা আবার ভরে নিলো নতুন করে বানানো, ধোঁয়া ওঠা কফি দিয়ে।
মিসেস ডানউইডি ছোট্ট, বেগুনি জিহ্বা দিয়ে আঙুল পরিষ্কার করল চেটে। তারপর এগিয়ে এলো যেখানে মোটকু চার্লি বসে আছে, সেখানে। সামনে থালা ভরতি খাবার থাকলেও, তা ছোঁয়নি এখনও ছেলেটা। কমবয়সে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করত চার্লি : মিসেস ডানউইডি আসলে ডাইনি। তাও আবার মন্দ ডাইনি, ওই যে বাচ্চাদেরকে চুলোয় ঠেসে দেয় না অনেকে? তেমন। বিশ বছরেরও বেশি সময় পর, মহিলাকে দেখছে সে। কিন্তু এখনও মনের একটা অংশ চাইছে, ভয়ে চিৎকার করে উঠে টেবিলের নিচে গিয়ে সেঁধাতে!
‘অনেক মানুষকেই মরতে দেখেছি,’ জানাল মিসেস ডানউইডি। ‘বুড়ো হও, তুমি নিজেও দেখবে। একদিন-না-একদিন সবাইকেই মরতে হবে, কালের কাছে হার মানতে হবে প্রত্যেককে!’ একটু বিরতি দিল সে। ‘তারপরও কখনও ভাবিনি, তোমার বাবা মারা যাবে।’ উভয় পাশে মাথা নাড়ল মহিলা।
‘কেমন ছিল বাবা?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। ‘মানে, যখন ওর বয়েস কম ছিল, তখন?’
মিসেস ডানউইডি তার দিকে তাকাল, পুরু চশমার আড়ালে। ঠোঁটে ঠোঁট চাপিয়ে মাথা নাড়ল উভয় পাশে। ‘সে আমার আগেকার সময়ের কথা,’ আর কিছু এই প্রসঙ্গে না বলে বলল। ‘পায়া খাও।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মোটকু চার্লি, মন দিল খাওয়ায়।
.
শেষ বিকেলের কথা, বাড়িতে আর কেউ নেই।
‘আজ রাতে কই ঘুমাবে?’ মিসেস হিগলার জিজ্ঞেস করল।
‘মোটেলের কামরা ভাড়া করব বলে ভাবছিলাম।’ মোটকু চার্লি বলল।
‘আমার বাড়িতে কামরার অভাব আছে? তাছাড়া রাস্তা ধরে একটু সামনে গেলে, আরেকটা ভালো বাড়ি পাবে। নিজের বাড়িই বলা যায়, কিন্তু এখনও যাওনি ওখানে! তোমার বাবা বেঁচে থাকলে চাইত—ওখানে থাকবে তুমি।’
‘তারচেয়ে বরং একাই থাকি। বাবার বাড়িতে রাত কাটানোর ইচ্ছেও নেই।’
‘তোমার ইচ্ছা। আমার টাকা তো আর জলে যাচ্ছে না,’ মিসেস হিগলার বলল। ‘তবে তোমার বাপের বাড়ির ব্যাপারে কোনো একটা সিদ্ধান্ত তো নিতে হবেই। সেই সঙ্গে তার সব জিনিসপত্রও।’
‘আমার কিস্যু যায় আসে না,’ মোটকু চার্লি বলল। ‘গ্যারেজ সেলের ব্যবস্থা করো, নইলে ই-বেতে তুলে দাও। চাইলে সব ফেলেও দিতে পারো।
‘এ কেমন ধরনের কথা হলো?’ ভদ্রমহিলা রান্নাঘরের একটা ড্রয়ার হাতড়ে বের করে আনল সামনের দরজা খোলার চাবি; একটা বড়ো কাগজের লেবেল লাগানো আছে তাতে। ‘চলে যাবার সময় আমাকে অতিরিক্ত এই চাবিটা দিয়েছিল তোমার বাবা,’ জানাল মহিলা। ‘যদি হারায়, কিংবা ভেতরে রেখে দরজা আটকে ফেলে—এই ভয়ে! বলত, ধড়ের সঙ্গে লাগানো না থাকলে মাথাও খুইয়ে বসত। পাশের বাড়িটা বিক্রির সময় আমাকে বলেছিল, দুশ্চিন্তা কোরো না, কেলিঅ্যান। খুব বেশি দূরে যাবো না। যদ্দূর মনে পড়ে, ওই বাড়িতেই থাকত সে। কিন্তু আচমকা সিদ্ধান্ত নিলো, বাড়িটা নাকি প্রয়োজনের চাইতে বেশি বড়ো…’ বিড়বিড় করে কথা বলতে বলতেই মোটকু চার্লিকে নিয়ে এলো সে ফুটপাতে। মেরুন স্টেশন ওয়াগনে করে কয়েকটা বাড়ি পেরোল সে, তারপর দাঁড়াল এক-তলা কাঠের বাড়ির সামনে।
সদর দরজা খুলে, ভেতরে পা রাখল ওরা।
গন্ধটা পরিচিত: হালকা মিষ্টি, মনে হয় যেন চকলেট চিপ কুকি বানানো হয়েছিল রান্নাঘরে; তবে অনেক আগে। ভেতরে মারাত্মক গরম। মিসেস হিগলার পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো ওকে বসার ছোট্ট ঘরটায়, চালু করে দিল জানালায় লাগিয়ে রাখা এয়ার কন্ডিশনিং ইউনিট। চালু হবার আগে কেঁপে উঠল ওটা, ভেজা কুকুরের মতো গন্ধ ছড়াল চারপাশে।
একটা জীর্ণ সোফার ওপর স্তূপ করে রাখা হয়েছে বই। মোটকু চার্লির মনে পড়ে গেল ওটার কথা, সেই ছোটোবেলায় দেখেছে। বাঁধাই করা বেশ কিছু ছবিও দেখা গেল: একটায়, সাদা-কালো ছবিতে দেখা যাচ্ছে মোটকু চার্লির মাকে, তখন যুবতী ছিল সে। চুল বেঁধে রেখেছে মাথার ওপরে, চকচক করছে ওগুলো। পরে আছে জাঁকালো পোশাক।
তার পাশের ছবিটায় দেখা যাচ্ছে খোদ মোটকু চার্লিকে, বয়েস তখন ওর পাঁচ কি ছয় হবে। একটা আয়নাঅলা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চাটা, দেখে মনে হয় যেন দুটো ছোট্ট মোটকু চার্লি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে ওখানে; ছবির ভেতর থেকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে উভয়ে!
স্তূপের একদম ওপরের বইটি তুলে নিলো মোটকু চার্লি, ইতালিয়ান আর্কিটেকচারের ওপর লেখা। ‘বাবার আগ্রহ ছিল এসবে?’
‘দারুণ আগ্রহ ছিল।’
‘জানতাম না তো!’
জবাবে কেবল শ্রাগ করল মিসেস হিগলার, চুমুক দিল কফির মগে।
বইটি খুলতেই প্রথম পাতায় বাবার লেখা নাম পরিষ্কার হস্তাক্ষরে দেখতে পেল মোটকু চার্লি। বন্ধ করে রাখল আবার। ‘বলতে গেলে,’ জানাল সে। ‘বাবাকে একদমই চিনতাম না আমি।’
‘ওকে ঠিকভাবে চেনাটা সহজ কাজ না,’ জানাল মিসেস হিগলার। ‘প্রায় ষাট বছর হলো ওর সঙ্গে পরিচয়, কিন্তু চিনতাম কি? মনে হয় না।’
‘যখন বাবা বাচ্চা ছিল, তখন থেকে চেনো তাহলে?’
জবাব দিতে ইতস্তত করল মিসেস হিগলার। মনে হলো যেন স্মৃতি হাতড়াচ্ছে। অতঃপর বলল, ‘আমি যখন খুকি ছিলাম, তখন থেকে চিনি তোমার বাবাকে।’
মোটকু চার্লির কেন যেন মনে হলো, প্রসঙ্গটা পালটানো দরকার। তাই মায়ের ছবির দিকে ইঙ্গিত করল সে। ‘মার ছবি কাছে রাখত দেখি,’ বলল ছেলেটা।
কফিতে চুমুক দিল মিসেস হিগলার। ‘একটা জাহাজে তোলা ছবিটা, ‘ জানাল সে। ‘তোমারও জন্মের আগের কথা বলছি। অনেক জাহাজ এমন থাকে না, যেখানে খাবার-দাবার পাওয়া যায়? তারপর মাইল তিনেক জলপথ পাড়ি দিয়ে চলে যায় আন্তর্জাতিক জলসীমায়। জুয়াও খেলা হতো আগে। তারপর আবার ফিরে আসত জেটিতে। এখনও ওসবের চল আছে কি না, জানা নেই। তবে তোমার মা বলত, সেদিনই নাকি জীবনে প্রথম স্টেক খেয়েছিল!’
ওর জন্মের আগে বাবা-মা কেমন ছিল, তা কল্পনা করার প্রয়াস পেল মোটকু চার্লি।
‘যখন তোমার বাবাকে প্রথম দেখি, তখন থেকেই সে সুদর্শন ছিল,’ বলল মিসেস হিগলার, যেন ওর মনের কথা আঁচ করতে পেরেই। ‘মারা যাবার সময়ও তাই। এমন মিষ্টি করে হাসত যে দেখা মাত্র পটে যেত যেকোনো মেয়ে। পোশাক-আশাকেও ছিল ফুলবাবু। মেয়েরা দারুণ পছন্দ করত ওকে।’
প্রশ্নটা করার আগেই উত্তর আঁচ করতে সক্ষম হলো মোটকু চার্লি। ‘তুমিও কি…?’
‘একজন সম্মানিত, বিধবা মহিলাকে কেউ এমন প্রশ্ন করে?’ কফির কাপে চুমুক দিল সে। এদিকে জবাবের অপেক্ষায় চুপ করে আছে মোটকু চার্লি। ‘একবার চুমু খেয়েছিলাম ওকে; সে অনেক দিন আগের কথা…তোমার মা ওর জীবনে আসারও আগেকার। দারুণ চুমু খেতে পারত তোমার বাবা। আশায় ছিলাম–হয়তো আবার যোগাযোগ করবে, আমাকে নিয়ে যাবে নাচের অনুষ্ঠানে। কিন্তু না, সেরেফ হাওয়া হয়ে গেল সে। এক…নয়তো দুই বছর আর দেখা পাইনি তার। যখন ফিরে এলো, ততদিনে আমি মি. হিগলারকে বিয়ে করেছি। সে-ও সঙ্গে করে তোমার মাকে নিয়ে এলো। কোনো একটা দ্বীপে দেখা হয় ওদের।’
‘মন খারাপ হয়েছিল?’
‘ততদিনে আমি বিবাহিতা,’ আরেক চুমুক কফি পান করল মহিলা। ‘আর তাছাড়া, তোমার বাবার ওপর রাগ পোষা যায় না। ঘৃণা করার তো প্রশ্নই ওঠে না। চোখে যে দৃষ্টি নিয়ে তোমার মায়ের দিকে তাকাত… অমনি করে আমার দিকে তাকালে আনন্দে মারাই যেতাম। জানো, বিয়েতে আমি ছিলাম তোমার মায়ের নিতকনে?’
‘নাহ, জানতাম না।’
এসিটা এতক্ষণে ঠান্ডা বাতাস ছাড়তে শুরু করেছে, তবে ভেজা কুকুরের মতো গন্ধটা এখনও মিলিয়ে যায়নি।
জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। ‘তোমার কি মনে হয়, ওদের সংসার সুখের হয়েছিল?’
‘শুরুতে হয়েছিল অন্তত,’ বিশাল মগটা হাতে নিলো মহিলা, মনে হলো চুমুক দেবে। কিন্তু পরক্ষণেই পালটে ফেলল সিদ্ধান্ত। ‘তবে শুরুর কিছু দিনই কেবল। এমনকী তোমার মা-ও ন্যান্সির মনোযোগ আটকে রাখতে পারেনি। খুবই ছটফটে স্বভাবের ছিল তোমার বাবা, সেই সঙ্গে ব্যস্তও।’
মিসেস হিগলার ঠাট্টা করছে কি না, তা বুঝতে চাইল মোটকু চার্লি। তবে পরিষ্কার ধরতে পারল না, কথাটা যেভাবেই বলা হোক না কেন…মহিলার মুখে হাসি নেই।
‘ব্যস্ত? কোন কাজে? সেতুতে বসে মাছ ধরতে? নাকি পোর্চে বসে ডমিনো সাজাতে? ক্যারিয়োকির আসর মাতাতে নিশ্চয়ই? ব্যস্ত ছিল না বাবা। আমার তো মনে পড়ে না যে একটা দিনও তাকে কাজ করতে দেখেছি!’
‘নিজের বাপের ব্যাপারে এসব বলাটা ঠিক হচ্ছে না।’
‘ঠিক-বেঠিক জানি না, কিন্তু সত্যিটাই বলছি। বাজে লোক ছিল সে…জঘন্য বাবা তো বটেই, সেই সঙ্গে জঘন্য স্বামীও।’
‘তা বলাই বাহুল্য!’ জোর দিয়ে বলল মিসেস হিগলার। ‘কিন্তু গড়পড়তা মানুষকে যেভাবে বিচার করা হয়, সেভাবে তাকে বিচার করা যাবে না। মনে রেখো, মোটকু চার্লি, তোমার বাবা দেবতা ছিল!’
‘মানুষের মাঝে দেব-সম—এটাই তো বোঝাতে চাচ্ছ?’
‘উঁহু…দেবতা!’ তেমন একটা জোর না দিয়েই এবার কথাটা বলল মহিলা। এমন নিস্পৃহ ভঙ্গিতে যেন বলছে— সে ডায়াবেটিসের রোগী ছিল…কিংবা ছিল কৃষ্ণাঙ্গ!
ঠাট্টা করতে চাইল মোটকু চার্লি, কিন্তু মিসেস হিগলারের চোখের দিকে তাকিয়ে উবে গেল ওর রসবোধ। নরম কণ্ঠে বলল কেবল, ‘দেবতা ছিল না বাবা। দেবতারা আলাদা, অনন্য, কিংবদন্তির চরিত্র। তারা অলৌকিক সব কাজ করে!’
‘ওহ, বুঝতে পেরেছি,’ বলল মিসেস হিগলার। ‘যত দিন তোমার বাবা বেঁচে ছিল, ততদিন কথাটা তোমাকে জানাবার উপায় ছিল না। কিন্তু এখন সে আর নেই, তাই বললেও ক্ষতি নেই।’
‘দেবতা ছিল না সে, ছিল আমার বাবা।’
‘দুটোই একসঙ্গে হতে বাধা কোথায়?’ পালটা যুক্তি ছুড়ল মহিলা। ‘অনেকের বাবা কিন্তু দেবতাও।’
পাগলের সঙ্গে তর্ক করছি, ভাবল মোটকু চার্লি। বুঝতে পারল, ওর উচিত হবে এই মুহূর্তেই মুখে ঢুলি আঁটা। কিন্তু তা না করে বলেই চলছে তো বলেই চলছে। ওর মুখ বলছে, ‘আজব! বাবা যদি দেবতাই হতো, তাহলে তার দৈব- শক্তি থাকত না?’
‘ছিল তো, তবে খুব একটা ব্যবহার করত না। বয়স হয়ে গেছিল। যাই হোক, কাম-কাজ না করেও বেঁচে ছিল কীভাবে…বলো তো? যখনই টাকা লাগত, লটারি খেলত অথবা কুকুর বা ঘোড়ার ওপর বাজি ধরত। খুব বেশি জিতত না কখনওই, যেন কারও মনোযোগ না আকর্ষিত হয়। কাজ চলার মতো জিতত আরকী।’
মোটকু চার্লি তার এক জীবনে কখনও কিচ্ছু জেতেনি। একেবারে কিস্যু না! অফিসের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে, তবে শুরুতেই জানত যে লাভ হবে না। যে ঘোড়ার ওপর বাজি ধরত, ওটা দৌড়ই শুরু করত না…কিংবা যে দলকে বেছে নিত সেটা অজানা কোনো বিভাগে নেমে যেত খুব দ্রুতই।
‘যদি আমার বাবা দেবতা হতো – যা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না–তাহলে আমি নিজেও কেন দেবতা নই? তোমার কথা সত্যি ধরে নিলে, আমি তো দেবতারই ছেলে হলাম, তাই না?’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’
‘তাহলে আমি কেন জেতা ঘোড়ার ওপর বাজি ধরতে পারি না…কিংবা জাদু দেখাতে অথবা অলৌকিক কিছু করতে পারি না?’
নাক টানল মহিলা। ‘তোমার ভাই সব ক্ষমতা পেয়েছে।’
মোটকু চার্লি আবিষ্কার করল, সে হাসছে। দম ছাড়ল বড়ো করে, স্বস্তি পেয়েছে। ভাবছে, যাক বাবা, ঠাট্টা করছিল ভদ্রমহিলা।
‘আহ, তুমি তো জানো, মিসেস হিগলার, আমার কোনো ভাই-টাই নাই।’
‘অবশ্যই আছে। ছবিতেই তো দেখা যাচ্ছে… দুজনকে এক সঙ্গে।’
মোটকু চার্লির ভালো করেই মনে আছে ওই ছবির কথা, তারপরেও সেদিকে তাকাল একবার। মহিলা আসলেই পাগল হয়ে গেছে, একেবারে বদ্ধ পাগল। ‘মিসেস হিগলার,’ বলল সে, যতটা ভদ্র ভাবে সম্ভব। ‘আমার ছবি ওটা, যখন ছোটো ছিলাম তখনকার। একটা আয়নাঅলা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে আমার প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে।’
‘তোমার ছবি—মেনে নিলাম। সেই সঙ্গে তোমার ভাইয়ের ছবিও।’
‘আমার ভাই নেই!’
‘অবশ্যই আছে। যদিও জীবন থেকে ও চলে গেলেও আফসোস নেই। তুমি সবসময়ই নম্র-ভদ্র ছিলে। কিন্তু তোমার ভাই…নাভিশ্বাস তুলে দিত!’ মোটকু চার্লি কিছু বলার আগেই যোগ করল, ‘দূরে কোথাও চলে গেছিল তোমার সেই ভাই, তুমি তখন এক্কেবারে ছোট্ট।’
সামনে ঝুঁকল মোটকু চার্লি, নিজের বড়োসড়ো পাঞ্জাটা রাখল মিসেস হিগলারের হাড় জিরজিরে হাতে; তবে যেটা ফাঁকা আছে, সেটায়। ‘কথাটা ভুল, বলল সে।’
‘লোয়েলা ডানউইডি বাধ্য করেছিল ওকে বিদেয় নিতে,’ জানাল মহিলা। ‘তোমার ভাই খুব ভয় পেত ওকে। তবে আসত ফিরে, মাঝে-মধ্যে। যখন দরকার পরে, তখন খুব মিষ্টি আচরণ করতে জানত।’ কফি শেষ করল মিসেস হিগলার।
‘সেই ছোটো বেলা থেকেই একটা ভাই চাইতাম,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘যাতে দুজনে মিলে খেলতে পারি।’
উঠে দাঁড়াল মিসেস হিগলার। ‘যাক সে কথা, এই বাড়িটা তো আর আপনা-আপনি পরিষ্কার হবে না,’ বলল মহিলা। ‘গাড়িতে ময়লা ফেলার থলে আছে। আগেই ধরে নিয়েছিলাম, প্রচুর পরিমাণে লাগবে।’
‘হুম,’ একমত হলো মোটকু চার্লি।
.
সে রাতটা ও কাটাল একটা মোটেলে। সকাল বেলা আবার দেখা করল মিসেস হিগলারের সঙ্গে, ওর বাবার বাড়িতে। ময়লা সব গুছিয়ে ফেলল বড়ো, কালো ময়লার থলেতে। যেসব বস্তু দান করবে গুডউইলে, সেগুলো থলেতে ভরে একপাশে রেখে দিল। এক বাক্সে এমন কিছু জিনিস ভরা হলো, যেগুলোর অন্যরকম মূল্য আছে মোটকু চার্লির কাছে। অধিকাংশই ছেলেবেলার ছবি, কিছু আছে ওর জন্মের আগেকারও।
একটা পুরাতন ট্রাঙ্কও পাওয়া গেল, দেখতে অনেকটা জলদস্যুদের গুপ্তধনের সিন্দুকের মতো। ভেতরটা ভরতি পুরাতন কাগজপাতি দিয়ে। মেঝেতে বসে, সেগুলো দেখল মোটকু চার্লি। শোবার ঘর থেকে আরেকটা কালো থলে নিয়ে বেরোল মিসেস হিগলার। ওটা ভরতি পোকায় খাওয়া কাপড় দিয়ে।
‘ওই ট্রাঙ্কটা উপহার দিয়েছিল তোমার ভাই,’ আচমকা বলল মিসেস হিগলার। এই প্রথম বারের মতো গত রাতে তোলা প্রসঙ্গটার অবতারণা করল সে।
‘ভাই থাকলে কতই না ভালো হতো,’ বলল মোটকু চার্লি। টেরও পায়নি যে কথাটা উচ্চকণ্ঠে বলেছে। কিন্তু মিসেস হিগলারের কথা শুনে বোঝা গেল, সে কাজটাই করে বসেছে সে!
‘বললাম তো, একটা ভাই আছে তোমার।’
‘তাই নাকি?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মোটকু চার্লি। ‘তা আমার এই কাল্পনিক ভাই এই মুহূর্তে আছেটা কই?’ পরে বহুবার ভেবেছে, প্রশ্নটা করতে গেছিল কেন? মহিলাকে বিদ্রূপ করছিল? নাকি কষ্ট দিতে চায়নি বলে করেছে? হতেও তো পারে, নীরবতা যেন নেমে না আসে সেজন্য কিছু একটা বলতে হবে ভেবে বলেছিল? কারণ যেটাই হোক না কেন, প্রশ্নটা করে বসে সে।
জবাব দেবার আগে, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল মিসেস হিগলার। মাথা
নেড়ে বলল, ‘নাহ, ব্যাপার তোমার জানা থাকা দরকার। হাজার হলেও, এটা তোমার প্রাপ্য, তোমার উত্তরাধিকার!’ ছেলেটার কাছাকাছি এসে আঙুল বাঁকাল মহিলা। সামনে ঝুঁকে গেল মোটকু চার্লি। ওর কানে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলল বুড়ো মহিলা, ‘…ওকে দরকার হলে…সেটা বোলো একটা…
‘কী?’
‘বললাম,’ এবার স্বাভাবিক কণ্ঠেই কথা বলল মহিলা। ‘ওকে তোমার দরকার হলে, তা বোলো একটা মাকড়শাকে। দেখবে, ছুটে আসবে তোমার ভাই।’
‘মাকড়শাকে বলব?’
‘সেটাই তো বললাম! কী ভেবেছিলে, বুড়ি পাগল হয়ে গেছে? এমনি এমনি কথা বলছি? কখনও মৌমাছিকে সব কিছু বলার কথা শোনোনি? এখানে বাবা-মা আসার আগে, আমি যখন সেন্ট অ্যান্ড্রুজে ছিলাম, তখন মৌমাছিদেরকেই গিয়ে সব শুভ সংবাদ বলতাম। ছোট্ট মেয়ে ছিলাম তখন। যাই হোক, এই ব্যাপারটাও তেমনি। মাকড়শার সঙ্গে কথা বলো। তোমার বাবা যখন আচমকা উধাও হয়ে যেত, তখন এভাবেই তার কাছে খবর পাঠাতাম।’
‘…আ-আচ্ছা।’
‘ওভাবে বোলো না।’
‘কীভাবে?’
‘এমন ভাবে যেন বোঝাতে চাইছ—আমি বুড়ি, মাথা খারাপ মহিলা যে কিনা মাছের বাজারে গিয়েও ঠিকমতো দরদাম করতে অক্ষম। কী ভাবছ, সব তালগোল পেকে গেছে?’
‘উম, সত্যি বলছি…এমন কিচ্ছু ভাবিনি!’
মিসেস হিগলারকে ঠান্ডা করা যাচ্ছে না। মারাত্মক খেপে গেছে সে। কফির মগটা টেবিলের ওপর থেকে তুলে, বিরক্তির সঙ্গে মাথা নাড়ল। মোটকু চার্লি দোষ করেছে, আর সেটা মিসেস হিগলার তাকে হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেবে।
‘তবে কাজটা আমার করার কথা না, বুঝলে?’ বলল মহিলা। ‘তোমাকে আমার সাহায্য করার কথা না। কিন্তু করছি একমাত্র তোমার বাবার জন্য, অনন্য ছিল সে; আর করছি তোমার মায়ের জন্য, দারুণ এক নারী ছিল। অনেক বড়ো বড়ো কথা বলে ফেলছি তোমাকে, দিচ্ছি গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য। আমার কথা মন দিয়ে শোনো, অন্তর দিয়ে বিশ্বাস করো।’
‘বিশ্বাস করছি তোমার কথা,’ কণ্ঠে যতটা সম্ভব আন্তরিকতা ঢালল মোটকু চার্লি।
‘এখন তো বুড়ো এক মহিলার মন রক্ষার জন্য কথাটা বলছ!’
‘নাহ!’ মিথ্যে বলল ছেলেটা। ‘সত্যিই বলছি আমি।’ শব্দগুলোয় পরিষ্কারভাবে শোনা গেল সততা, আন্তরিকতা আর…সত্যতা! বাড়ি থেকে হাজারো মাইল দূরে, নিজের সদ্য-মৃত পিতার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে সে; সামনেই এক পাগলা-বুড়ি, যেকোনো মুহূর্তে হয়তো হাত-পা ছোড়া শুরু করে দেবে! চাঁদ আসলে এক ধরনের ফল, বিষুবীয় অঞ্চলে পাওয়া যায়—এই কথা বললে যদি বৃদ্ধা শান্ত হতো, তাহলে তাই বলত।
নাক টানল মহিলা।
‘তোমাদের, মানে কমবয়সীদের নিয়ে এই একটাই সমস্যা,’ বলল সে। ‘নাক টিপলে দুধ পড়ে, কিন্তু ভাব এমন যেন সব জেনে বসে আছ! আমি জীবনে যত কিছু ভুলেছি, তত কিছুর জ্ঞান কোনোদিন অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। বাবার ব্যাপারে তুমি কিছুই জানো না, পরিবারের ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ। তোমাকে বললাম, তোমার বাবা দেবতা…অথচ জানতেও চাইলে না, কেমন দেবতা সে?’
দেবতাদের নাম স্মরণ করতে চাইল মোটকু চার্লি। ‘জিউস?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল সে।
এমন আওয়াজ করল মিসেস হিগলার, যেটার সঙ্গে ফুটন্ত পানিকে আটকে রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত কেতলির আওয়াজের সঙ্গে তুলনা করা যায়। বুঝে ফেলল মোটকু চার্লি, ভুল জবাব দিয়েছে।
‘কিউপিড?’
আরেকটা আওয়াজ করল মহিলা, ধীরে ধীরে শুরু হলেও শেষ হলো তা খিলখিল হাসির শব্দে। ‘তোমার বাবাকে কল্পনা করছিলাম, পরনে ফোলা ফোলা ডায়পার ছাড়া কিচ্ছু নেই…হাতে একটা বড়ো ধনুক আর তির!’ আরও খানিকক্ষণ হাসল মহিলা। তারপর গলায় ঢালল খানিকটা কফি।
‘যখন ও দেবতা ছিল, মোটকু চার্লিকে জানাল সে। ‘তখন ওকে সবাই ডাকত আনানসি বলে।’
.
হয়তো আপনি আগেই আনানসিকে নিয়ে দুয়েকটা গল্প শুনেছেন। সত্যি বলতে কী, দুনিয়াতে মনে হয় না এমন কাউকে পাওয়া যাবে, যে আনানসির কোনো গল্প শোনেনি!
আনানসি ছিল আসলে একটা মাকড়শা, জগতের বয়েস তখনও ছিল অল্প, এবং গল্পের জন্মই হয়েছে সদ্য। নানা ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ত সে, আবার ঝামেলা থেকে বেরিয়ে আসত নিজে-নিজেই। কে না শুনেছে আলকাতরা-বাবুর আখ্যান, ওরফে জনাব খরগোশের গল্প? সেটা আগে ছিল আনানসির আখ্যান। অনেকে ভাবে, আসলে বুঝি ও খরগোশ। কিন্তু না, ও খরগোশ ছিল না… ছিল মাকড়শা।
মানুষজন যতদিন হলো গল্প বলছে, ততদিনই বয়েস আনানসির গল্পের। আফ্রিকায়, যেখানে সব কিছুর শুরু, মানুষজন গুহার দেয়ালে সিংহ আর ভালুক আঁকতে শুরু করারও পূর্বে, বলাবলি করত বানর, সিংহ আর মোষের গল্প। স্বপ্নে দেখা সেই ঘটনাগুলো গল্পের ছলে অন্যকে বলা মানুষের সহজাত স্বভাব। ওদের যে দুনিয়া, সেটার একটা অর্থ খাড়া করার জন্য এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তাই যা কিছু দৌড়ায়, অথবা বুকে হাঁটে, অথবা গাছে ঝোলে, কিংবা মাটিতে হেঁচড়ে চলে…সবই কীভাবে যেন ঢুকে পড়ত গল্পে। বিভিন্ন গোত্র তখন বিভিন্ন প্রাণিকে পবিত্র মনে করত।
সিংহ হলো পশুরাজ, তখনও তাই ছিল। গ্যাজেল হরিণ সবচাইতে দ্রুতগতি সম্পন্ন প্রাণী, বানর সবচাইতে বোকা। কিন্তু সবচেয়ে জঘন্য হলো বাঘ।
ভালো কথা: তাদের ব্যাপারে গল্প কিন্তু শুনতে চাইত না ওরা।
আনানসি তার গল্পগুলোর নাম দিত। প্রত্যেকটা গল্পই ছিল আনানসির। তার আগে, মানে সব গল্প আনানসি হবার আগে, ছিল বাঘের (বিড়াল- প্রজাতির বড়োসড়ো সব প্রাণিকে দ্বীপবাসীরা তখন এ নামেই ডাকত)। সেসময় গল্পগুলো ছিল ভয়ানক, অশুভও বলা চলে। তাতে ছিল ব্যথা আর কষ্টের প্রাধান্য, কখনওই মধুর সমাপ্তি হতো না।
তবে সেসব অনেক…অনেক দিন আগের কথা। এখন সব গল্পই আনানসির।
.
আমরা যেহেতু খানিক আগেই একটা শেষকৃত্যানুষ্ঠান হয়ে এলাম, তাই আনানসিকে নিয়ে একটা গল্প শোনাই আপনাদের। সেবার ওর দাদি মারা গেছিল (জন্মিলে মরিতে হইবে…তাছাড়া বয়েস হয়েছিল অনেক, ঘুমের মাঝেই মারা যায় বেচারি। এমনটা হয় মাঝে মধ্যে)। কিন্তু মারা যায় যখন তখন ছিল বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে। তাই আনানসিকে দ্বীপটার অন্য পাশে গিয়ে, হাতে টানা গাড়িতে তুলে ফিরিয়ে আনতে হয়েছিল দাদির লাশ। গাড়িতে দেহটাকে তুলে, টেনে ফিরতে লাগল সে বাড়ির দিকে। ঠিক করেছে: কুটিরের পেছনে যে বট গাছটা আছে, সেটার পাশেই কবর দেবে দাদিকে।
গ্রামের ভেতর দিয়ে যখন যাচ্ছে, তখন ভাবল (ওকে দোষ দেওয়া যায় না ভাবার জন্য, সারা সকাল লাশবাহী গাড়ি টানতে হয়েছে যে)—হুইস্কি হলে মন্দ হয় না।
সরাসরি দোকানে চলে গেল সে, ওই গ্রামে একটাই মদের দোকান। আসলে শুধু মদের না, সবকিছুরই দোকান ওটাই। দোকান মালিক আবার রগচটা মানুষ। আনানসি ভেতরে গিয়ে হুইস্কি ঢালল গলায়। তারপর ঢালল আরও একটু। অতঃপর ভাবল, এই লোকটার সঙ্গে চালাকি করলে কেমন হয়?
যা ভাবা তাই কাজ। দোকানিকে বলল, দাদির জন্য একটু হুইস্কি নিয়ে যাও; বুড়ি ঘুমাচ্ছে বাইরে, গাড়িতে। একবার ঘুমালে আর হিসেব থাকে না, তাই ডেকে তুলতে হতে পারে।
দোকানি সাত-পাঁচ না ভেবে রওনা দিল, বাইরে গেল ও বোতল হাতে। গাড়িতে শুয়ে থাকা বুড়ো মানুষটাকে ডেকে বলল, ‘এই নাও, তোমার হুইস্কি।’
কিন্তু বুড়ি কিছু বলল না!
আবার ডাকল দোকানি, এবারও জবাব পেল না। মেজাজ চড়তে শুরু করল ওর। অবশেষে হমকি ছেড়ে বলল, ওঠ বুড়ি, তোর হুইস্কি গেল! কিন্তু তবুও বুড়ো মহিলার মুখে রা নেই। এরপর এমন একটা কাজ করল সে, যেটা গরমের দিনে মরা লাশ প্রায়শই করে: পাদ ছাড়ল শব্দ করে। দোকানি এতে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, মেরেই বসল বুড়িকে। তারপর আবার… আরও একবার। তৃতীয় আঘাতে পর, গাড়ি থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ল বেচারির লাশ।
দৌড়ে বেরিয়ে এলো আনানসি, চিল্লিয়ে-চেঁচিয়ে নরক নামিয়ে আনল মাটিতে। বিলাপ করতে লাগল: আমার দাদি, মারা গেছে! উঁহু, তুই মেরে ফেলেছিস! খুনি, পাপী!
দোকানি ভয় পেয়ে আনানসিকে বলল, চুপ, চুপ। কাউকে কিছু বোলো না। তারপর ঘুস হিসেবে পাঁচ বোতল হুইস্কি দিল সে আনানসিকে; সঙ্গে সোনায় ভরতি একটা ব্যাগ, সবজি-আনারস-আমে ভরা থলে। অনুরোধ করল যেন সব কিছু নিয়ে এখুনি চলে যায়।
(হয়তো ধরে ফেলেছেন, তার ধারণা—আনানসির দাদিকে সে-ই খুন করেছে!)
তাই আনানসি তার হাতেটানা গাড়িটা নিয়ে ফিরে এলো বাড়িতে, দাদিকে কবর দিল বট গাছের নিচে।
পরের দিনের কথা, আনানসির বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল বাঘ। গন্ধে টের পেল, ভেতরে কিছু একটা রান্না হচ্ছে। বিনা দাওয়াতের অতিথির মতো ভেতরে চলে গেল সে। দেখতে পেল ভোজের আয়োজন করেছে আনানসি। এদিকে আর কোনো উপায় না দেখে আনানসিও আমন্ত্রণ জানাল বাঘকে, ওর সঙ্গে খাবারে সঙ্গী হতে।
বাঘ বলল আনানসি, ভাই আমার, এমন দারুণ খাবার পেলে কই? মিথ্যে বলো না আবার। কোথায় পেলে এমন সুস্বাদু মদের বোতল? আর ওই সোনায় ভরা বড়ো খলে, সেটাই বা এলো কোত্থেকে? যদি মিথ্যে বলো…তাহলে কামড়ে গলা ছিঁড়ে ফেলব!
তাই আনানসি জবাব দিল: মিথ্যে তো আর তোমাকে বলা যায় না, বাঘ ভাই। আমার মৃতা দাদিকে গ্রামের ভেতর দিয়ে হাতে টানা গাড়িতে করে আনছিলাম। পরে লাশটা দোকানির কাছে নিয়ে গেলে, সে আমাকে এসব দিয়েছে।
শুনে লোভে চকচক করে উঠল বাঘের চোখ। কিন্তু ঝামেলা হলো—ওর নানি-দাদি কেউই বেঁচে নেই। তবে হ্যাঁ, শাশুড়ি আছে একটা। তাই বাড়ি ফিরে শাশুড়িকে ডেকে বলল, বেরিয়ে এসো বুড়ি, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। ডাক শুনে বাইরে এসে, চারপাশে তাকাল বাঘের শাশুড়ি। জানতে চাইল, কী সমস্যা? কথা না বাড়িয়ে তাকে মেরে ফেলল বাঘ, অথচ মাকে খুবই ভালোবাসত ওর স্ত্রী।
যাই হোক, লাশটাকে একটা হাতেটানা গাড়িতে তুলল সে।
এরপর গ্রামের ভেতর দিয়ে টেনে আনতে লাগল সেই গাড়ি, তাতে পড়ে আছে শাশুড়ির লাশ। লাশ নিবেন, লাশ? হাঁক ছাড়ল সে। কে চায় বুড়ির লাশ? এদিকে গ্রামবাসী হাঁ করে তাকিয়ে দেখছে তাকে, সেই সঙ্গে হাসছে আর বিদ্রূপও করছে। কিন্তু যখন বুঝতে পারল, আসলেও লাশ বিক্রি করতে চায় বাঘ বাবাজী, তখন পচা ফল ছুঁড়তে লাগল ওকে লক্ষ্য করে; বাঘ পালিয়ে যাবার আগে থামল না।
আগেও বহুবার আনানসি বোকা বানিয়েছে বাঘকে, তেমনি বানিয়েছে পরেও। এদিকে মাকে হত্যা করেছে বলে বাঘের স্ত্রী তাকে কখনওই ক্ষমा করবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে! স্বামীর জীবনের এই হাল করে সে, যে বাঘ মাঝে মধ্যে ভাবে: কোনোদিন না জন্মালেই ভালো হতো।
.
এই যে, আনানসির একটা গল্প আপনারা শুনলেন।
তবে বলাই বাহুল্য, সব গল্পেরই মালিক আনানসি। এমনকী এই মাত্র যেটা শুনলেন, সেটারও।
আগেকার দিনে, সব পশু আর প্রাণিই চাইত, তাদের নামানুসারে গল্পের নাম রাখা হোক; অর্থাৎ তারাই হোক গল্পের মালিক। যে গান শুনে জন্ম নিয়েছিল জগত, সেই গান তখনও গাওয়া হতো; তখনও গান গেয়ে গড়ে তোলা হচ্ছিল আকাশ, রঙধনু আর সমুদ্রকে। সেই সময়ের কথা বলছি, যখন পশুরা পশু হবার পাশাপাশি ছিল মানুষও। আনানসি দ্য স্পাইডার তখন সবাইকে বোকা বানাত। বিশেষ করে ওর চালাকির শিকার হতো বাঘ, কেননা বাঘও চাইত সব গল্পের মালিক হতে।
গল্প কিন্তু অনেকটা মাকড়শার মতোই। লম্বা লম্বা পা আছে তাদের। গল্প কিন্তু আবার মাকড়শার জালের মতোও। মানুষ তাতে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়ে, তবে সুন্দর দেখায় তাকে… তাছাড়া যেভাবে তারা একে-অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত হয়, তাকে অনন্য না বলে উপায় নেই!
কী বললেন? আনানসি দেখতে মাকড়শার মতো কি না?
অবশ্যই মাকড়শার মতো… কিন্তু আবার মানুষের মতোও।
নাহ, রূপ পালটাত না সে কখনও। আসলে পুরোটাই নির্ভর করছে আপনি কীভাবে গল্পটা বলছেন, তার ওপর…
…ব্যস, এই তো।
অধ্যায় তিন – যাতে ঘটে পারিবারিক পুনর্মিলন
অধ্যায় তিন – যাতে ঘটে পারিবারিক পুনর্মিলন
বিমানে করে ইংল্যান্ডে ফিরে এলো মোটকু চার্লি। বাড়িতে আরকী…
কাস্টমস হলে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল রোজি; হাতে একটা ছোট্ট সুটকেস আর কার্ডবোর্ডের টেপ দিয়ে আটকানো বাক্স নিয়ে বেরোল ছেলেটা। ওকে দেখে আনন্দে জড়িয়ে ধরল রোজি। ‘কী খবর?’
জবাবে শ্রাগ করল মোটকু চার্লি। ‘এর চাইতেও অনেক বাজে হতে পারত।’
‘হুম,’ বলল মেয়েটা। ‘অন্তত এখন ভদ্রলোক তোমার বিয়েতে এসে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলবেন – এই ভয় করতে হবে না।’
‘মন্দের ভালো আরকী।’
‘আমার মা বলছে, সম্মান দেখাবার খাতিরে আমাদের বিয়েটা কয়েক মাস পিছিয়ে দেওয়া উচিত।’
‘তোমার মা আসলে আমাদের বিয়েটাই বাতিল করে দিতে চায়।’
‘বাজে কথা বোলো না তো। তার ধারণা—ছেলে হিসেবে তুমি দারুণ!’
‘তোমার যে মা, তাতে ব্র্যাড পিট, বিল গেটস আর প্রিন্স উইলিয়ামকে ঘুঁটে জোড়া দিয়ে বানানো কোনো পুরুষ মানুষকেও দারুণ বলবে না। দুনিয়ার বুকে এমন কেউ নেই, যাকে সে তার মেয়েজামাই হবার যোগ্য মনে করে।’
‘তোমাকে পছন্দ করে সে,’ বলল রোজি। তবে বলার জন্য বলা। কণ্ঠে বিন্দুমাত্র জোর নেই।
রোজির মা মোটকু চার্লিকে পছন্দ করে না, আর সেটা সবাই জানে! ভদ্রমহিলা খুবই নাক-উঁচু স্বভাবের, সেই সঙ্গে দারুণ শুচিবায়ুগ্রস্তও। পূর্বসংস্কার, দুশ্চিন্তা আর রাগ পুষে রাখতে জানে সে। উইমপোল স্ট্রিটের একটা অসাধারণ ফ্ল্যাটে থাকে সে, কিন্তু সেটার ফ্রিজ ভরতি করে রাখে ভিটামিন মেশানো পানি আর রাই ক্রাকার্স দিয়ে। অ্যান্টিক সাইডবোর্ডে থাকে মোমের ফল, যেগুলো হপ্তায় দুবার মোছা হয়।
রোজির মায়ের বাড়িতে প্রথম যেবার যায়, সেবার তো ওই মোমের ফলেই কামড় বসিয়েছিল মোটকু চার্লি। মারাত্মক নার্ভাস ছিল সেদিন, এতটাই যে আপেলটা তুলে নিয়ে—আত্মরক্ষার্থে পরে বলত সে, দেখতে বিলকুল আসল ফলই মনে হচ্ছিল—তাতে কামড় বসিয়ে দেয়। পাগলের মতো হাত-পা নেড়ে ওকে ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিল রোজি। মোমের টুকরো থু মেরে হাতে ফেলেছিল মোটকু চার্লি, ভেবেছিল স্বাদটা ভালো লাগার অভিনয় করবে কি না। নাকি এমন আচরণ করবে যে আগে থেকেই জানত সেই ব্যাপারে? কাজটা করেছে মজা করতে?
কিন্তু রোজির মা এক ভ্রু কুঁচকে উঠে দাঁড়ায়, নিষ্কম্প পায়ে হেঁটে যায় মোটকু চার্লির কাছে। বাকি আপেলটুকু ওর হাত থেকে কেড়ে নিয়ে জানিয়ে দেয়, আজকাল সত্যিকারের মোমের ফল কিনতে কত খরচ হয়; আসল জিনিসটা খুঁজে পাওয়াই তো কঠিন। তারপর আধ-খাওয়া মোমের আপেল ফেলে দেয় সে ময়লার বাক্সে।
অবশিষ্ট বিকেলটা মোটকু চার্লি কাটিয়ে দেয় সোফায় বসে, মুখের ভেতরটা মোমের বাজে স্বাদে ভরে ছিল। আর রোজির মা কড়া নজর রাখছিল ওর ওপর, এই ভয়ে যে যদি তার দামি মোমের আরেকটা ফলে কামড় বসায় ছেলেটা? কিংবা চিপেনডেলের চেয়ারের পায়া চিবুতে শুরু করে?
রোজির মায়ের ফ্ল্যাটের একপাশের দেয়াল ঘেঁষে ঝোলে অনেকগুলো রূপালি ফ্রেম, তাতে শোভা পায় বড়োসড়ো রঙিন ছবি: কোনোটায় বাচ্চা রোজি একা, কোনোটায় আবার বাবা-মায়ের সঙ্গে। মোটকু চার্লি মন দিয়ে দেখেছিল ওগুলো, রোজি নামের রহস্যটাকে ভেদ করার প্রয়াস বলা চলে। মেয়েটার বাবা বিশালদেহী ছিল, মারা যায় যখন তখন রোজির বয়েস মাত্র পনেরো বছর। পেশাজীবন শুরু করেছিল রাঁধুনি হিসেবে, এরপর ক্রমাগত উন্নতি করতে করতে রেস্তোরাঁর মালিকই হয়ে যায়। প্রতিটা ছবিতে ভদ্রলোককে দারুণ দেখাচ্ছে; মনে হয় যেন ছবি তোলার আগে পোশাক নির্বাচন করে দিয়েছিল দক্ষ কেউ; সবগুলোতেই নিপাট ভদ্রলোক সে, মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে, হাত বাঁকিয়ে রেখেছে যাতে রোজির মা ধরতে পারে।
‘অসাধারণ ছিল তার রান্নার হাত,’ একবার বলেছিল রোজি। ছবিতে ওর মাকে হাস্যরতা দেখাচ্ছিল, সেই সঙ্গে বেশ সুন্দরীও। কিন্তু প্রায় এক যুগ পর সেই দেহের বাঁধন আর নেই, আর চার্লিও কখনও তার মুখে হাসি দেখেনি।
‘তোমার মা রান্না পারে?’ জিজ্ঞেস করেছিল মোটকু চার্লি, প্রথম বার দেখা হওয়ার পর।
‘তা জানি না। কখনও করতে দেখিনি।’
‘তাহলে খায় কী? ক্রাকার্স আর পানি খেয়ে তো আর কেউ বেঁচে থাকতে পারে না।’
জবাব দিয়েছিল রোজি, ‘সম্ভবত বাইরে থেকে কিনে আনায়।’
রাতের বেলা বাদুরের রূপ ধরে বাইরে বেরিয়ে, ঘুমন্ত মানুষদের রক্ত চুষে খায় বেটি-সম্ভাবনাটাকে উড়িয়ে দিল না মোটকু চার্লি। একবার সেটা শুনিয়ে ছিল রোজিকে, কিন্তু মেয়েটা কথার মাঝে লুকিয়ে থাকা কৌতুক ধরতে পারেনি।
রোজির মা সরাসরিই বলেছে তার মেয়েকে—মোটকু চার্লি যে পয়সার লোভে ওকে বিয়ে করছে, তা মহিলা শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে বলতে পারে।
‘কীসের পয়সা?’ জিজ্ঞেস করে রোজি।
তখন অ্যাপার্টমেন্টটা দেখিয়ে দেয় রোজির মা। সেই সঙ্গে মোমের ফল, অ্যান্টিক আসবাব, দেয়ালে ঝুলতে থাকা পেইন্টিং-ও আছে। এরপর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘কিন্তু এসবই তো তোমার,’ বলল রোজি। লন্ডন ভিত্তিক এক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে মেয়েটা, চলে সেই বেতনে। খুব একটা মোটা নয় সেই অঙ্ক। তাই রোজিকে মাঝে মধ্যেই বাবার রেখে যাওয়া টাকা-পয়সা থেকে কিছু খরচ করতে হয়। সেই টাকায় ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটের মালকিন হতে পেরেছে, যেখানে ওরই সঙ্গে থাকে অস্ট্রেলিয়ান আর নিউ জিল্যান্ড থেকে আগত দুই মেয়ে; সেই সঙ্গে কিনেছে একটা সেকেন্ড হ্যান্ড ভোক্সওয়্যাগন গলফ।
‘আমি তো আর কেয়ামত পর্যন্ত বেঁচে থাকব না,’ নাক টেনে বলে ওর মা, যদিও কথার স্বরে পরিষ্কার বোঝা যায়—বেঁচে থাকতে পারলে আপত্তি করবে না সে! দরকার হলে আস্তে আস্তে কমিয়ে দেবে খাওয়া, পাতলা হতে হতে পরিণত হবে পাথরের মতো একটা কিছুতে। তখন হয়তো বাতাস, মোমের ফল আর লোকজনের ঘৃণা বাদে আর কোনো খাবার না পেলেও চলবে।
হিথরো থেকে তুলে, মোটকু চার্লিকে নিয়ে তার বাড়ির দিকে রওনা দিল রোজি। সিদ্ধান্ত নিলো, প্রসঙ্গ পালটানো দরকার। বলল সে, ‘আমার ফ্ল্যাটের পানি চলে গেছে। বিল্ডিঙের কারো ফ্ল্যাটেই আসছে না।’
‘কেন?’
‘মিসেস ক্লিঙ্গারের কারণে। নিচ তলায় থাকেন, পাইপে কীভাবে কীভাবে যেন ফুটো হয়ে গেছে বলছেন।’
‘সম্ভবত মিসেস ক্লিঙ্গারের কারণেই হবে।’
‘চার্লি! যাই হোক, ভাবছিলাম—তোমার বাড়িতে গোসল সারলে কিছু মনে করবে?’
‘সাবান মাখিয়ে দিতে হবে?’
‘চার্লি!’
‘আমার আপত্তি নেই কিন্তু।’
ঠিক সামনে যে গাড়িটা আছে, ওটার পেছন দিক দেখল রোজি। তারপর গিয়ার থেকে হাত সরিয়ে, চাপ দিল মোটকু চার্লির বিশাল হাতে। ‘আমাদের বিয়ের বেশি দেরি নেই।’ বলল সে।
‘জানি আমি,’ মোটকু চার্লি বলল।
‘বোঝাতে চাইছি,’ যোগ করল মেয়েটা। ‘ওসবের জন্য অনেক সময় সামনে পরে আছে, তাই না?’
‘তা আছে,’ মোটকু চার্লি বলল।
‘আমার মা একবার কী বলেছিল, জানো?’ রোজি জিজ্ঞেস করল।
‘উম, নাকের সামনে মুলো ঝোলানো টাইপ কিছু?’
‘নাহ, তেমন কিছু না। বলেছিল: যদি কোনো বিবাহিত দম্পতি প্রথম
বছরে যত বার ভালোবাসা-বাসি করে, ততবার একটা পাত্রে পয়সা ফেলে, আর এরপরের বছরগুলোতে যত বার করে ততবার একটা করে বের করে আনে, তাহলে ওই পাত্র কখনও খালি হবে না।’
‘তার অর্থ…?’
‘তেমন কিছুই না,’ জবাব দিল মেয়েটা। ‘তবে ব্যাপারটা মজার, তাই না? রাত আটটার দিকে আমার জিনিসপাতি নিয়ে চলে আসব। তোয়ালের কী
খবর? আছে তো?’
‘আসলে…’
‘তোয়ালে নিয়েই আসব নাহয়।’
বিয়ের আগেই পূর্ণিমা বা অমাবস্যায় যদি একটা-দুইটা পয়সা পাত্রে ফেলা হয়, তাহলে দুনিয়া উলটে যাবে বলে মোটকু চার্লির মনে হয় না। কিন্তু রোজি যা বলে তাতে স্থির থাকে। তাই প্রসঙ্গের সেখানেই ইতি।
থাকুক, পাত্রটা খালিই থাকুক।
.
সমস্যাটা মোটকু চার্লি উপলব্ধি করতে পারল বাড়িতে পা রাখার পর। স্বল্প সময়ের একটা সফরের পর লন্ডনে ফিরে মনে হয়: ভোরে ভোরে পৌঁছানো গেছে। অথচ বাকি দিনটায় আর করার কিছু নেই!
ও নিজে এমন একজন মানুষ, যে কাজ করাটা পছন্দ করে। সোফায় শুয়ে শুয়ে কাউন্টডাউন দেখে নিজেকে বেকারদের একজন হিসেবে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা ভাবল একবার। সিদ্ধান্ত নিলো – তার চাইতে এক দিন আগে কাজে যাওয়াটাই ভালো হবে। গ্রাহাম কোটস এজেন্সির অলডউইচ অফিসটা ষষ্ঠ তলায়, ওটার ওপরে আর কোনো তলা নেই। অফিসে গেলে, আবার নিজেকে মনে হবে কর্মস্রোতের অংশ। চা খাবার কামরায় অন্যান্য কর্মচারীদের সঙ্গে গল্পও করা হবে। জীবন তার সৌন্দর্য নিয়ে ধরা দেবে তার সামনে; অপ্রশম্য ইন্ডাস্ট্রি উপস্থাপন করবে তার জটিল জালিকা। মানুষজন খুশি হবে ওকে দেখে।
‘তোমার তো আগামীকাল ফেরার কথা, অ্যানি নামের রিসিপশনিস্ট মোটকু চার্লিকে ঢুকতে দেখে বলল। ‘সবাইকে তো সেটাই বলেছি, যে ফোন করেছে তাকেই।’ বিরক্ত দেখাল মেয়েটাকে।
‘দূরে থাকতে পারিনি,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘তা তো বুঝতেই পারছি,’ নাক টানল মেয়েটা। ‘আগে মেইভ লিভিংস্টোনকে ফোন কোরো, ভদ্রমহিলা প্রতিদিন আমাকে জিজ্ঞেস করেন তোমার কথা।’
‘আমি তো জানতাম, গ্রাহাম কোটস ওনার অ্যাকাউন্ট সামলায়।’
‘হুম, সে-ই চাচ্ছে যে তুমি মহিলার সঙ্গে কথা বলো। একটু দাঁড়াও।’ বলে ফোন তুলে নিলো মেয়েটা।
গ্রাহাম কোটস-কে ডাকতে হলে ওভাবেই ডাকতে হয়—মিস্টার কোটস বললে চলবে না, তেমনি শুধু গ্রাহামও চলবে না। এজেন্সির মালিক সে, বিভিন্ন পেশার মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে। সেই সঙ্গে তাদের ইনকামের একটা অংশ রেখে দেয় নিজের জন্য।
নিজের অফিসে ফিরে গেল মোটকু চার্লি। অফিস বলতে ছোট্ট একটা কামরা, যা ও ভাগাভাগি করে নিয়েছে কিছু ফাইলিং ক্যাবিনেটের সঙ্গে। কম্পিউটারের পর্দায় একটা হলদে ‘পোস্ট-ইট’ নোট লেগে আছে। তাতে লেখা—’দেখা করো, জিসি’। তাই সরাসরি হলের শেষ মাথায় চলে এলো ও, গ্রাহাম কোর্টসের বিশাল অফিসটা ওখানেই। দরজা বন্ধ দেখে নক করল একবার। ভেতর থেকে কোনো জবাব এসেছে কি না, বুঝতে না পেরে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দরজা খুলে মাথা সেঁধাল ভেতরে।
কামরা খালি, কেউ নেই। ‘উম, হ্যালো?’ বলল মোটকু চার্লি, তবে খুব একটা জোরাল কণ্ঠে না। এবারও কোনো জবাব এলো না। কামরাটা অবশ্য একটু অবিন্যস্ত মনে হচ্ছে—বইয়ের তাকটা দেওয়ালে একটু অদ্ভুত ভাবে ঝুলছে, পেছন থেকে ভেসে আসছে একটা শব্দ, যেটাকে হাতুড়ির বাড়ি বলেই মনে হচ্ছে।
চুপচাপ দরজা বন্ধ করে নিজের ডেস্কে ফিরে এলো সে।
আচমকা বেজে উঠল ওর ফোন, রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল মোটকু চার্লি।
‘গ্রাহাম কোটস বলছি, আমার অফিসে এসো।’
এবার গ্রাহাম কোটস বসে আছে তার ডেস্কের পেছনে, বইয়ের তাকটাও সোজা হয়ে দেয়ালের সঙ্গে লেগে আছে। মোটকু চার্লিকে বসার আমন্ত্রণ জানালো না মাঝবয়সী শ্বেতাঙ্গ লোকটি; চুলে পাক ধরেছে, টাকও পড়তে শুরু করেছে। গ্রাহাম কোটসকে দেখে কারও যদি দামি স্যুট পরিহিত আলবিনো নেউল মনে হয়, তাহলে একই ধারণা পোষণকারী ব্যক্তিদের তালিকায় আরও একটা নাম যোগ হবে কেবল।
‘আবার কাজে যোগ দিয়েছ দেখি,’ বলল গ্রাহাম কোটস।
‘হ্যাঁ,’ বলল মোটকু চার্লি। তারপর যোগ করল, ‘দুঃখিত।’ কেননা গ্রাহাম কোটসকে দেখে মনে হচ্ছে না যে ওর কাজে যোগ দেওয়ায় লোকটা খুশি হয়েছে।
দুই ঠোঁট একে-অন্যের ওপর চেপে ধরল গ্রাহাম কোটস, ডেস্কের ওপর থাকা একটা কাগজের দিকে তাকিয়েই আবার নজর তুলল ওপরে। ‘আমাকে বলা হয়েছিল, তুমি নাকি আগামীকালের আগে ফিরছ না। একটু আগেই চলে এসেছ, তাই না?’
‘আমরা—মানে, আমি—আজ সকালেই ফিরেছি, ফ্লোরিডা থেকে ভাবলাম, চলেই আসি। অনেক কাজ বাকি। আশা করি ভুল করিনি?’
‘পুবশ্যই করেছ,’ বলল গ্রাহাম কোটস। শব্দটা পুরোপুরি এবং অবশ্যই এর সংমিশ্রণে গঠিত—সবসময়ই মোটকু চার্লিকে বিরক্ত করেছে। ‘তবে তোমার সময়, তোমার ইচ্ছা।’
‘আমার বাবার শেষকৃত্যানুষ্ঠান ছিল।’
নেউলের মতো ঘাড়টা একটু বাঁকল। ‘ছুটির হিসেব থেকে কিন্তু দিন কাটা যাবে।’
‘অসুবিধে নেই।’
‘মেইভ লিভিংস্টোন, মরিসের বিধবা; চিন্তায় পড়ে গেছে, তাকে আশ্বস্ত করা দরকার। রোম তো আর একদিনে তৈরি হয়নি, সেটা বোঝাতে হবে মিষ্টি শব্দ ব্যবহার করে আর নানা ওয়াদা করে। মরিস লিভিংস্টোনের সম্পত্তি বণ্টনের ঝামেলা চুকিয়ে তাকে টাকা-পয়সা দেওয়ার কাজ আগের মতো একই গতিতে চলছে। প্রতিদিন আমাকে ফোন করে। যাই হোক, তোমাকে তার দায়িত্ব দিচ্ছি।’
‘ঠিক আছে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘মানে, বলছিলাম আরকী, পরিশ্রান্তের জন্য এক দিনের বিশ্রাম নেবার সুযোগও নেই!’
‘এক দিন মানেই, এক ডলার, আঙুল নাড়িয়ে বলল গ্রাহাম কোটস।
‘চোখ বন্ধ করে কাজ করে যেতে বলছেন?’
‘উঁহু, আন্তরিকতার সঙ্গে করতে বলছি,’ জানাল গ্রাহাম কোটস। ‘যাই হোক, তোমার সঙ্গে কথা বলে বড়োই প্রীত হলাম। এবার যাও, দুজনেরই অনেক কাজ বাকি।’
গ্রাহাম কোর্টসের আশপাশে থাকলেই, কী যেন হয়ে যায় মোটকু চার্লির। এক. সে বাগধারার ব্যবহার বাড়িয়ে দেয়। আর দুই, কেন যেন স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে বিশাল কালো হেলিকপ্টারের ঝাঁক প্রথমে গুলি করে, তারপরে বালতি ভরতি নাপাম বোমা ফেলে গ্রাহাম কোটস এজেন্সির অফিসে। মোটকু চার্লি অবশ্য সেসময় অফিসে থাকে না; তখন ও বসে থাকে অলডউইচের অন্য মাথার একটা ছোটো ক্যাফেতে, রাস্তায় বসে ফেনা ওঠা কফি পান করতে আর দক্ষ ভাবে ছোড়া নাপাম দেখে আনন্দে চিৎকার করতে ব্যস্ত।
এই কথা থেকে অবশ্য বুঝতে পারার কথা আপনাদের, মোটকু চার্লির কাজের ব্যাপারে খুব বেশি কিছু জানার দরকার নেই। এতটুকু জানলেই চলবে যে বেচারা চাকরি করে সন্তুষ্ট না। আসলে সংখ্যা আর গণিতের প্রতি আলাদা একটা টান আছে মোটকু চার্লির, তাই কাজ করে যাচ্ছে এখনও। সেই সঙ্গে ওর মধ্যে কাজ করে একধরনের লজ্জা ও ভদ্রতা বোধ, তাই ঠিক কী ওর দায়িত্ব তা কাউকে বলতে পারে না। কতটুকু কাজ করে, সেটাও না। চারপাশে যত মানুষ আছে, তারা অযোগ্যতা সত্ত্বেও তরতর করে উঠে যাচ্ছে ওপরে। অথচ সে নিজে রয়ে গেছে সেই একেবারে নিচু পদে, মাথা নত করে করে চলছে কাজ; অচিরেই আবার একদিন চাকরি হারাবে, বেকার হয়ে বসে বসে দেখবে টেলিভিশন। তবে কখনওই বেশিদিন চাকরিছাড়া থাকতে হয়নি ওকে। অবশ্য এতবার চাকরি হারাতে হয়েছে যে কোথাও ঢুকেই মানসিক ভাবে শান্তি পায় না বেচারা।
ব্যাপারটাকে নিজের ওপর প্রভাব ফেলতেও দেয় না।
মেইভ লিভিংস্টোনকে ফোন করল ও। মরিস লিভিংস্টোন একজন বিখ্যাত কমেডিয়ান ছিলেন, ছোটোখাটো এই ইয়র্কশায়ারিয়ান দীর্ঘদিন গ্রাহাম কোটস এজেন্সির মক্কেল ছিলেন। ‘হ্যালো,’ ভদ্রলোকের বিধবা স্ত্রীকে বলল মোটকু চার্লি। ‘আমি চার্লস ন্যান্সি, গ্রাহাম কোটস এজেন্সির অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট থেকে বলছি।’
‘ওহ,’ ওপাশ থেকে এক নারীর কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘আমি তো ভেবেছিলাম, গ্রাহামই আমাকে ফোন করবে।’
‘তিনি একটু ব্যস্ত আছেন। তাই কাজের দায়িত্বটা আমাকে দিয়েছেন, ‘ বলল মোটকু চার্লি। ‘দয়া করে বলুন, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
সেটা তো আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। ভাবছিলাম—আসলে আমি না, ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলছিল আরকী – মরিসের সম্পত্তি থেকে যে বাকি টাকাটা পাওয়ার কথা, সেটা কবে জমা হবে? গ্রাহাম কোটস গতবার আমাকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিল—গতবারই হবে, আমাদের ফোনে যখন কথা হয় আরকী—টাকা নাকি কোথায় লগ্নি করেছে। আমি জানি এসব ক্ষেত্রে টাকা নগদ করতে কিছু সময় লাগে। এখনই তুললে নাকি অনেক ক্ষতি হবে—’
‘আসলে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আমি জানি যে তিনি ব্যাপারটা সামলাচ্ছেন। তবে হ্যাঁ, আসলেও এসব ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা সময় লেগে যায়।’
‘হুম,’ বলল মহিলা। ‘আমারও তাই মনে হয়। বিবিসি-কে ফোন করেছিলাম। ওরা বলেছেন, মরিসের মৃত্যুর পরেও বেশ কয়েকবার নাকি রয়্যালটির টাকা পাঠিয়েছেন। তুমি বোধহয় জানো, মরিস লিভিংস্টোন, আই প্রিসিউম-এর পুরো ভিডিয়ো ওরা ডিভিডিতে ছেড়েছে। শর্ট ব্যাক আর সাইডস- ও ছাড়তে যাচ্ছে ক্রিসমাস উপলক্ষে।’
‘নাহ, জানা ছিল না।’ স্বীকার করে নিলো মোটকু চার্লি। ‘তবে গ্রাহাম কোটস নিশ্চয়ই জানেন। এসব বিষয় তার নখদর্পণে থাকে।
‘নিজের জন্য একটা আমাকেও কিনতে হয়েছে,’ ভাবুক শোনাল মহিলার গলা। ‘তবে অনেক পুরনো স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে জিনিসটা। মেকআপের ঝলক, বিবিসি ক্লাবের গন্ধ… পাদপ্রদীপটার অভাব খুব করে বোধ করছিলাম, সেটা নিশ্চয়তার সঙ্গেই বলতে পারি। মরিসের সঙ্গে আমার কিন্তু ওখানেই দেখা হয়েছিল, বুঝলে? আমি নাচতাম, নিজেরও একটা ক্যারিয়ার ছিল।’
মোটকু চার্লি তাকে জানাল, গ্রাহাম কোটসের কাছে তার ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের দুশ্চিন্তার ব্যাপারটা পৌঁছে দেবে। তারপর রেখে দিল ফোন।
ভাবল, পাদপ্রদীপের আলোর অভাব কীভাবে মানুষ বোধ করে?
যদি প্রশ্ন করা হয়, তোমার জীবনের সবচাইতে ভয়ানক দুঃস্বপ্ন কোনটি? তাহলে মোটকু চার্লি জবাব দেবে : একটা প্রশস্ত মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়, অন্ধকার আকাশ থেকে ওর ওপর ঠিকরে ফেলা হচ্ছে পাদপ্রদীপের আলো। দেখা যায় না, এমন সব অবয়ব বাধ্য করছে ওকে সেই আলোর ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে গান গাইতে। যতই জোরে দৌড়াক না কেন, যত দূরেই যাক না কেন…ওকে ধরে এনে আবার ঠেলে দেওয়া হয় মঞ্চে, সামনে থেকে তাকিয়ে থাকে ডজনকে ডজন উৎসুক চেহারা। গান গাইতে শুরু করার ঠিক আগে আগে ভেঙে যায় ওর ঘুম, নিজেকে ঘর্মাক্ত আর কম্পনরত অবস্থায় আবিষ্কার করে সে। বুকের ভেতর হৃদয়টা যেন ধপাধপ লাফাতে চায়!
আরেকটা কর্মদিবস শেষ হয়ে গেল। এখানে প্রায় বছর দুয়েক হলো কাজ করছে মোটকু চার্লি। একমাত্র গ্রাহাম কোটসই ওর চাইতে বেশিদিন হলো এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছে। এই এজেন্সির কর্মচারী বদলাবার ব্যাপারে দুর্নাম আছে। কিন্তু তারপরেও, ওকে অফিসে দেখে কেউ খুশি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।
মাঝে মাঝে ডেস্কে বসে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল মোটকু চার্লি। কখনও কখনও নীরস, নিরানন্দ ধূসর বৃষ্টি আছড়ে পড়ে কাচের ওপর। তখন নিজেকে কল্পনার চোখে সে দেখতে চায় গ্রীষ্মমণ্ডলের কোনো সৈকতে। যেখানকার অস্বাভাবিক রকমের নীলচে ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে একই রকমের তীব্র হলদে বালুর ওপর। প্রায়শই ভাবে: আচ্ছা, ওর কল্পনার সৈকতে যে মানুষগুলো ঢেউয়ের সাদা আঙুলের দিকে তাকিয়ে সৈকত ধরে হেঁটে যায় তাল গাছে বাসা বাঁধা পাখিদের কলতান শুনতে শুনতে, তারা কি কখনও ইংল্যান্ডে আসার কথা কল্পনা করে? ভাবে এই বৃষ্টিস্নাত দিনে, ষষ্ঠতলার কাপবোর্ড আকৃতির একটা কামরায় বসে থাকার কথা? যে ইংল্যান্ড রয়েছে ওই সোনালি বালির রাজত্ব থেকে, আর সেই সঙ্গে এতই নিখুঁত একটা একঘেয়ে দিনের সম্ভাবনা থেকে অনেক দূরে?… যে একঘেয়েমি কাটাবার জন্য একটু বেশি রাম দিয়ে বানানো ককটেলও হয়তো যথেষ্ট না!
ভাবনাটা ওকে শান্ত করে তোলে।
.
বাড়ি ফেরার পথে একটা দোকানে থেমে, নিজের জন্য এক বোতল জার্মান সাদা ওয়াইন কিনল সে, পাশের সুপারমার্কেট থেকে নিলো পাচৌলির গন্ধমাখা মোমবাতি। সবশেষে বাড়ির কাছের পিজ্জার দোকান থেকে কিনল একটা পিজ্জা।
সাড়ে সাতটার দিকে যোগ ব্যায়ামের ক্লাস থেকেই ওকে ফোন করল রোজি। জানাল যে আসতে একটু দেরি হবে। তারপর আটটার দিকে খবর দিল, গাড়িতে বসে আছে; আর গাড়ি বসে আছে ট্রাফিক জ্যামের মাঝখানে। সোয়া নয়টায় নিশ্চিত করল, একদম কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। এদিকে ততক্ষণে সাদা ওয়াইনের বোতল প্রায় পুরোই খালি, এবং পিজ্জারও অবশিষ্ট আছে মাত্র একটা স্লাইস।
পরে বহুবার ভেবেছে, কথাটা কি ওয়াইনের কারণেই বেরিয়ে এসেছিল ওর মুখ থেকে?
ন’টা বিশে উপস্থিত হলো রোজি। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে তোয়ালে আর টেসকসের ব্যাগে ভরতি শ্যাম্পু, সাবান আর বড়ো এক পাত্র ভরতি মেয়োনেজ… চুলের জন্য। সাদা ওয়াইন আর পিজ্জার স্লাইস খাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল মেয়েটা, তবে সেই প্রত্যাখ্যানে রাগ নেই। জানাল, জ্যামে বসে থাকার সময়ই খেয়ে নিয়েছে। তাই রান্নাঘরে বসে রইল মোটকু চার্লি, নিজের জন্য ঢালল বোতলের অবশিষ্ট সাদা ওয়াইনটুকু। ঠান্ডা পিজ্জার ওপর থেকে পনির আর পেপারোনি তুলে নিলো সে। রোজি ততক্ষণে চলে গেছে বাথরুমে…
…এবং, একেবারে আচমকা…শুরু করে দিয়েছে তারস্বরে চিৎকার।
চিৎকারের প্রথম ধাক্কাটা মিলিয়ে যাবার আগেই বাথরুমে চলে এলো মোটকু চার্লি। রোজি তখন ফুসফুসে বাতাস ভরে নিচ্ছে আরেকবার চিৎকার করবে বলে। মোটামুটি নিশ্চিত ছিল মোটকু চার্লি, প্রেমিকাকে রক্তের ডোবায় পড়ে থাকতে দেখবে। কিন্তু অবাক হয়ে, এবং স্বস্তির সঙ্গে, আবিষ্কার করল: মেয়েটার শরীরের কোথাও থেকে রক্ত ঝরছে না। নীল ব্রা-প্যান্টি পরে আছে রোজি, আঙুল তাক করে দেখাচ্ছে বাথটাব। সেটার ঠিক মাঝখানে বসে আছে একটা বিশাল, বাদামি রঙের মাকড়শা।
‘দুঃখিত,’ অনেকটা বিলাপের সুরে বলল মেয়েটা। ‘অবাক হয়ে গেছিলাম।’
‘মাকড়শার স্বভাবই ওটা, অবাক করে দেয়,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘আমি পানি ঢেলে দিচ্ছি।’
‘ওই কাজ করতে যেয়ো না,’ কড়া স্বরে আপত্তি জানাল রোজি। ‘ওটাও প্রাণী! বাইরে ফেলে দিয়ে এসো।’
‘ঠিক আছে,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘আমি রান্নাঘরে অপেক্ষা করছি,’ বলল মেয়েটা। ‘কাজ শেষে বোলো।’
সাদা ওয়াইনের পুরো একটা বোতল গেলার পর, চঞ্চল প্রকৃতির একটা মাকড়শাকে সাদা পানপাত্রে ভরা যে কী কষ্টের কাজ, তা একমাত্র ভুক্তভোগীই জানে। হাতে অস্ত্র বলতে আছে কেবল বার্থডে কার্ড; এদিকে অতগুলো মদ গলায় ঢালার পর, হাতের সঙ্গে চোখের যেন কোনো রকমের সংযোগই স্থাপিত হতে চায় না! হিস্টিরিয়ার ঠিক আগপর্যায়ে পৌঁছে যাওয়া, প্রায় নগ্ন প্রেমিকা যে রান্নাঘরে থাকবে বলা সত্ত্বেও কাঁধের ওপর দিয়ে ঝুঁকে একের-পর-এক পরামর্শ দিয়েই যাচ্ছে—কাজটাকে মোটেই সহজ করে না।
তবে একসময়, সাহায্য ব্যতিরেকেই, মাকড়শাটাকে পানপাত্রে তুলে ফেলতে পারল মোটকু চার্লি। ওটার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হলো স্কুলের এক পুরনো বন্ধুর পাঠানো কার্ড ব্যবহার করে যাতে লেখা: মনের বয়েসই আসল বয়েস (ভেতরে আরও মজা করে লিখেছে: তাই হে সেক্স ম্যানিয়াক, মনটাকে লাগাম পরাও—শুভ জন্মদিন)।
প্রথমে নিচতলায়, তারপর একেবারে বাড়ির বাইরের ছোট্ট বাগানে মাকড়শাসহ চলে এলো মোটকু চার্লি। বাগান বলতে একটা ঝোপ—যেটা মানুষজন বমি করতে ব্যবহার করে—আর কয়েকটা বড়ো বড়ো ফ্ল্যাগস্টোন; পাথরগুলোর ফাঁকে ফাঁকে ঘাস জন্মেছে। পান পাত্রটাকে উঁচু করে ধরল সে, সোডিয়ামের হলদে আলোতে মাকড়শাটাকে কালো দেখাচ্ছে। মনে হলো, যেন সরাসরি ওর দিকেই চেয়ে আছে প্রাণিটা।
‘দুঃখিত,’ বলল সে মাকড়শাটাকে। সাদা ওয়াইন ততক্ষণে কাজ করা শুরু করে দিয়েছে বলে কথাটা জোরেশোরেই বলে ফেলল।
কার্ডসহ পান পাত্রটাকে একটা ভাঙা পাথরের ওপরে নামিয়ে রাখল মোটকু চার্লি, তারপর পান পাত্রটাকে তুলে নিয়ে মাকড়শার বেরিয়ে আসার অপেক্ষায় রইল। কিন্তু তা না করে, ওভাবেই বসে রইল মাকড়শাটা, এক বিন্দুও নড়ল না; ঠায় হয়ে রইল বার্থডে কার্ডে আঁকা হাসিখুশি টেডি বিয়ারের ঠিক চেহারার ওপর।
মানুষ এবং মাকড়শা তাকিয়ে তাকিয়ে কিছুক্ষণ দেখে একে-অপরকে।
মিসেস হিগলারের বলা একটা কথা তখনই মনে পড়ে গেল ওর। শব্দগুলো তাই আপনা থেকেই বেরিয়ে এলো, থামাতে পারল না মোটকু চার্লি। হয়তো ভূতে পেয়েছিল ওকে তখন, হয়তো অ্যালকোহলই সেই বোকামির জন্য দায়ী।
‘যদি আমার ভাইকে দেখো,’ মাকড়শাটাকে বলল মোটকু চার্লি। ‘তাহলে ওকে জানিয়ো, আমি দেখা করতে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছি।
যেখানে যেভাবে ছিল, সেখানে সেভাবেই রইল মাকড়শাটা। তবে একটা পা তুলল শুধু, যেন ভাবছে। তারপর পাথরের ওপর দিয়ে এগিয়ে গেল ঝোপের দিকে…
…নিমিষে হয়ে গেল উধাও।
.
গোসল শেষে, মোটকু চার্লির গালে রেশ রেখে যাওয়া একটা চুমু খেল রোজি। তারপর রওনা দিল বাড়ির দিকে।
টিভি চালু করল মোটকু চার্লি, কিন্তু ঘুম ধরেছে দেখে বন্ধ করে দিল। বিছানায় শুতেই লেগে এলো চোখ। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এমন অদ্ভুত, কিন্তু পরিষ্কার একটা স্বপ্ন দেখল যে সেটার কথা আজীবন মনে থাকবে।
স্বপ্নের মাঝেই সেটাকে স্বপ্ন ধরতে পারার একটা উল্লেখযোগ্য উপায় হলো, নিজেকে এমন কোথাও দেখা যেখানে আপনি জীবনেও পা রাখেননি। যেমন মোটকু চার্লি কখনও ক্যালিফোর্নিয়ায় যায়নি, বেভারলি হিলসে পা রাখার প্রশ্নই ওঠে না। তবে দেখেছে বহুবার, টিভি আর চলচ্চিত্রে। তাই চিনতে অসুবিধে হচ্ছে না।
একটা পার্টিতে উপস্থিত হয়েছে সে।
লস অ্যাঞ্জেলসের আলো তাদের নিচে কোথাও জ্বলজ্বল আর দপদপ করছে।
পার্টিতে উপস্থিত মানুষগুলো নিখুঁত ভাবে দুটো দলে বিভক্ত হয়ে আছে: এক দলে আছে এমন মানুষ যাদের হাতে রূপোর থালা, কিন্তু সেটা নিখুঁত ক্যানাপে দিয়ে ঢাকা। আর অন্য দলে আছে যারা রূপোর থালা থেকে খাচ্ছে…অথবা অস্বীকৃতি জানাচ্ছে খেতে।
যারা খাচ্ছে, তারা আবার ঘুরে বেড়াচ্ছে বিশাল ওই বাড়িটায়। গল্প- গুজবে, হাসিতে, কথায় মত্ত। প্রত্যেকেই হলিউডের দুনিয়ায় নিজের আপাত গুরুত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট, ভাবখানা এমন যেন ওরা প্রাচীন জাপানি রাজসভার সভাসদ! আর ঠিক সেই সময়ের মতোই, এরাও মোটামুটি নিশ্চিত যে সফলতা অপেক্ষা করছে মইয়ের মাত্র একটা ধাপ ওপরে! ওখানে পৌঁছতে পারলেই…তারা নিরাপদ হয়ে যাবে। এমন অনেক অভিনেতা উপস্থিত এখানে, যারা স্টার হতে চায়। স্টাররা চায় স্বাধীন প্রযোজক হতে, যারা স্বাধীন প্রযোজক তাদের স্বপ্ন কোনো একটা স্টুডিয়োর নিরাপদ আশ্রয়; ডিরেক্টররাও স্টার হতে চায়, স্টুডিয়োর বসরা বসতে চায় তাদের বসের আসনে; তবে স্টুডিয়োর হয়ে কাজ করা উকিলরা চায়—সবাই তাদেরকে, তাদের জন্যই পছন্দ করুক। আর যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে নিদেনপক্ষে পছন্দ তো করুক!
স্বপ্নে মোটকু চার্লি নিজেকে দেখতে পাচ্ছে; দেহের ভেতর থেকে, আবার বাইরে থেকেও; সেটাও আবার একই সঙ্গে। আচরণটা কোনোভাবেই নিজের সঙ্গে মেলাতে পারছে না। স্বপ্নে সাধারণত সে দেখে, ডাবল-এন্ট্রি পদ্ধতি হিসেব সংরক্ষণ-সংক্রান্ত কোনো একটা পরীক্ষা দিতে বসেছে। কিন্তু পড়তে ভুলে গেছে পরীক্ষার জন্য। সেই সঙ্গে নিশ্চিত ভাবে বুঝতে পারছে, উঠে দাঁড়ালে দেখতে পাবে—ভুলে গেছে সকাল বেলা পরীক্ষা দেবার জন্য বেরোতে গিয়ে প্যান্ট পরতেও।
স্বপ্নেও মোটকু চার্লি…মোটকু চার্লিই থাকে, তবে অপটুতা বেড়ে যায় বহুগুণে।
কিন্তু এই স্বপ্নের কথা আলাদা।
এই স্বপ্নে মোটকু চার্লি ‘চখাম’… উঁহু, চখামের চাইতেও বেশি কিছু। ও দারুণ, ও বুদ্ধিমান, ও স্মার্ট, পার্টিতে ওই একমাত্র মানুষ যাকে কেউ আমন্ত্রণই জানায়নি! আর তা সত্ত্বেও (মোটকু চার্লি ঘুমের মাঝেই লজ্জা পেল, কেননা বিনা আমন্ত্রণে সে কোথাও যাবার কথা কল্পনাও করতে পারে না) সময়টা দারুণ উপভোগ করছে।
যাকে পাচ্ছে, তাকেই ধরে নিজের পরিচয় ও পার্টিতে আসার কারণ শোনাচ্ছে; কিন্তু প্রত্যেকবারই বদলে যাচ্ছে পরিচয় ও কারণ…দুটোই! আধ ঘণ্টার মাঝে দেখা গেল, অভ্যাগতরা সবাই বিশ্বাস করে বসেছে যে ও আসলে বিদেশি একটা অর্থলগ্নিকারী সংস্থার প্রতিনিধি। এখানে এসেছে কোনো একটা স্টুডিয়ো পুরোপুরি কিনে নেবার জন্য। আরও আধ ঘণ্টা যাবার পর পার্টির সবাই এটাও যেনে গেল—প্যারামাউন্ট স্টুডিয়ো পছন্দ হয়েছে তার!
যুবকের হাসি যেমন প্রাণখোলা, তেমনি সংক্রামক। অন্য যে কারও চাইতে যে পার্টিটা বেশি উপভোগ করছে, তা চোখ বন্ধ করেই বলা যায়। বারম্যানকে নির্দেশ দিয়ে বানিয়ে নিলো নিজের জন্য ককটেল যার নাম ‘ডাবল আন্টান্ড্রে’! ওটার মূলে আছে শ্যাম্পেন, যেটা — অন্তত যুবকের ভাষ্যমতে – বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নন-অ্যালকোহলিক বলা চলে। সঙ্গে এক চিমটি এটা, এক চামুচ ওটা মিলিয়েই গেল বারটেন্ডার; পাত্রের তরলের রং উজ্জ্বল বেগুনি হবার আগে থামল না।
[৭. কার্বন ডাই-অক্সাইড মেশানো পানি।]
যুবক যে শুধু নিজের জন্য বানাল ককটেলটা, তা কিন্তু না। আরও অনেকগুলো বানিয়ে ধরিয়ে দিল পার্টির অভ্যাগতদের হাতে, অচিরেই দেখা গেল: একটু আগেও যারা ফিজি ওয়াটার’ পান করছিল সাবধানতার সঙ্গে, তারা গ্লাসের পর গ্লাস বেগুনি তরল উড়িয়ে দিচ্ছে আনন্দের সঙ্গেই!
ঠিক তখনই, আর স্বপ্নের জগতের সব যুক্তি মেনেই, দেখা গেল ওকে পুলের দিকে এগিয়ে যেতে; নেতৃত্ব দিচ্ছে বাকি সবাইকে! প্রস্তাব দিল মোটকু চার্লি: পানিতে কীভাবে হাঁটতে হয়, তা শেখাবে। ব্যাপারটা পুরোটাই আসলে নির্ভর করে আত্মবিশ্বাসের ওপর, জানাল সে। নির্ভর করে দৃষ্টিভঙ্গি, আক্রমণাত্মক মানসিকতা এবং কাজটা কীভাবে করতে হবে তা জানতে পারার ওপর। অভ্যাগতদের দেখে মনে হচ্ছে, পানিতে হাঁটার এই জ্ঞানটা জানা থাকলে মন্দ হয় না বলেই ভাবছে। ভাবখানা এমন যেন অনেক আগে থেকেই জানে তারা এই বিদ্যে…তবে অন্তরের একেবারে গহীনে লুকিয়েছিল এত দিন—এই যা। এই লোকটা ওদেরকে আবার সেই বিদ্যা মনে করিয়ে দেবে।
জুতো খুলে ফেলো সবাই, নির্দেশ দিল যুবক। বিনা বাক্য ব্যয়ে পালিত হলো সেই আদেশ। সার্জিয়ো রোসি, ক্রিশ্চিনা লিউবোটিন আর রেনে ক্যাউভিলাস ব্র্যান্ডের জুতো চুপচাপ এই লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল নাইকি আর ডক মার্টেনস কোম্পানির জুতোর পাশে; সেই সঙ্গে অজ্ঞাতনামা ব্র্যান্ডের চামড়ার জুতোও। অতঃপর যুবক নেতৃত্ব দিল তাদের, কংগা নাচের মতো এক লাইনে খাড়া হতে বলল সবাইকে। সুইমিং পুলের ধার ধরে একটা চক্কর দিয়ে, আলগোছে নেমে এলো পানিতে।
বেশ ঠান্ডা পানি, কেঁপে উঠল ওপরের তল। তবে পায়ের নিচে যেন ঘন, থকথকে জেলির রূপ নিয়েছে। বেশ কিছু নারী, আর অল্প কজন পুরুষও, বোকার মতো ফিক করে হেসে ফেলল ব্যাপার-স্যাপার দেখে। দুজন কমবয়সী এজেন্ট নিজেদেরকে ধরে রাখতে পারল না, বাচ্চাদের মতো লাফাতে লাগল পানির ওপর। ওদের অনেকটা নিচে তখনও জ্বলছে লস অ্যাঞ্জেলসের আলো, যেন দূরের কোনো ছায়াপথ।
অচিরেই দেখা গেল, পুলের প্রতিটা ইঞ্চি তরে গেছে; অভ্যাগতদের কেউ দাঁড়িয়ে আছে তো কেউ নাচছে; কেউ কাঁপছে তো কেউ লাফাচ্ছে ইচ্ছেমতো। মানুষের ভিড় এত বেশি যে যুবক, যাকে স্বপ্ন-চার্লিও বলা যায়, সরে এসে দাঁড়াল কংক্রিটের মেঝের ওপর। একটা রূপালি থালা থেকে তুলে নিলো ফালাফেল-সাসিমি বল।
জেসমিনের গাছ থেকে আচমকা স্বপ্ন-চার্লির কাঁধে এসে পড়ল একটা মাকড়শা। তরতরিয়ে তার বাহু বেয়ে নেমে এলো হাতের তালুতে। দেখতে পেয়ে ওকে হেইইই বলে আনন্দের সঙ্গে সম্ভাষণ জানাল স্বপ্ন-চার্লি।
তারপর চুপ করে রইল কিছুক্ষণ, ভাবখানা এমন যেন মাকড়শাটা কিছু বলছে আর স্বপ্ন-চার্লি তা শুনছে; তারপর সে জিজ্ঞেস করল, চাইলেই পাবে… তাই না?
সাবধানে মাকড়শাটাকে একটা জেসমিন-পাতার ওপর নামিয়ে দিল যুবক।
ঠিক সেই মুহূর্তে, পানির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যেকের যেন একসঙ্গে মনে পড়ে গেল: পানি আসলে তরল, কঠিন বা জেলির মতো পদার্থ না। আর একটা কারণ আছে, যার জন্য সাধারণত মানুষ পানির ওপর দিয়ে হাঁটে না— নাচা বা লাফানো তো দূরের কথা—তার তা হলো, সেটা অসম্ভব!
লাখো মানুষের স্বপ্ন থাকে এই মানুষগুলোর হাতের মুঠোয়; কিন্তু চার্লির স্বপ্নে, সবাই একদম একসঙ্গে, পোশাক পরিহিত অবস্থাতেই ঝপ করে পড়ে যেতে লাগল চার থেকে বারো ফুট গভীর পানির ভেতরে; ভিজে সবাই আতঙ্কিত হয়ে উঠল।
এদিকে স্বপ্ন-চার্লির কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কিছুই হয়নি, এমন ভাব করে মানুষের হাতে-কাঁধে মাথায় পা দিয়ে দিয়ে অতিক্রম করল সে সুইমিং পুল। একবারের জন্য ভারসাম্য হারালো না! পুলের দূর প্রান্তে পৌঁছে গেল সে, ওটার পর খাড়া পাহাড়ের ঢাল আর খাদ বাদে কিছুই নেই! কিন্তু না থেমে লম্বা একটা লাফ দিয়ে সে, মাথা নিচু করে ঝাঁপ দিল লস অ্যাঞ্জেলসের আলোর দিকে…
..সমুদ্রের মতো থেকে থেকে কেঁপে উঠে হাতছানি দিয়ে ডাকছে যে আলো।
হাঁচরে-পাঁচরে পুল থেকে বেরোতে চাইল অভ্যাগতরা। ভিজে একশা, সেই সঙ্গে রাগে কাঁপছে। আবার বিভ্রান্তও… কয়েকজনের হলো পানিতে ডোবার অভিজ্ঞতা…
.
দক্ষিণ লন্ডনে এখন ভোর বলা চলে। আকাশে রং নীলচে-ধূসর।
বিছানা ছাড়ল মোটকু চার্লি, স্বপ্নটা ভাবাচ্ছে ওকে। জানালার কাছে হেঁটে গেল, পর্দা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সূর্যের আলো উঁকি দিতে শুরু করেছে দিগন্তে, দেখতে পাচ্ছে পরিষ্কার। রক্তলাল, কিংবা কমলা একটা প্রকাণ্ড সূর্যকে ঢেকে রাখতে গিয়ে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে ধূসর মেঘ। এই রকম আকাশ দেখেই, একেবারে নীরস মানুষও তৈলচিত্র আঁকতে বসে যায়!
সূর্যোদয়ের দিকে চাইল মোটকু চার্লি। দিনের শুরুতেই আকাশ লাল, ভাবল সে। নাবিকরা একেই সতর্কবাণী মনে করে।
স্বপ্নটা যেকোনো বিচারেই অদ্ভুত। হলিউডে একটা পার্টি! পানিতে হাঁটার বিদ্যে! আর ওই লোকটা, মানে ও নিজে…যে আবার ঠিক পরিচিত চার্লি না…
মোটকু চার্লি আচমকা আবিষ্কার করল, স্বপ্নের ওই চার্লিকে সে চেনে, কোথাও দেখেছে আগে। কোথায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করলে, ব্যাপারটাই সারাদিন জ্বালাবে ওকে। দুই দাঁতের মাঝে ডেন্টাল ফ্লসের অংশবিশেষ যদি লেগে থাকে, অথবা কামুক এবং রমণাভিলাষীর মধ্যে পার্থক্য যেমন ক্রমশ মগজে খোঁচাতে থাকে…তেমনি বিরক্ত করতে থাকবে ওকে।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ও।
ভোর ছয়টা এখনও বাজেনি, পৃথিবী এখনও চুপচাপ। ভোরে ওঠা এক লোক, কুকুর নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে রাস্তার শেষ মাথায়। পমেরেনিয়ান কুকুরটাকে মলত্যাগ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে চাইছে লোকটা। আরেক পোস্টম্যান এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে যাচ্ছে, তারপর ফিরে আসছে নিজের লাল ভ্যানের কাছে। আচমকা দেখতে পেল, বাড়ির নিচের পেভমেন্টে কিছু একটা নড়ে উঠেছে। এবার মন দিয়ে তাকাল সেদিকে।
ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক লোক। যখন সেই লোকটা দেখতে পেল যে মোটকু চার্লি পাজামা পরে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে, তখন হেসে হাত নাড়ল। তাকে চিনতে পারার মুহূর্তটা চরমভাবে নাড়া দিয়ে গেল মোটকু চার্লিকে: ওই হাসি আর হাত নাড়ার সঙ্গে পরিচিত সে, যদিও কীভাবে পরিচয় হলো তা বুঝতে পারছে না। স্বপ্নের একটা অংশ এখনও ওর মাথায় ঘোরাফেরা করছে, অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে তাকে! পৃথিবীটাকে ঠিক বাস্তব মনে হচ্ছে না। চোখ ঘষল একবার, ঝোপের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে আর দেখতে পেল না! আশা করল, হয়তো চেনা কিন্তু অচেনা মানুষটা চলে গেছে রাস্তা ধরে সামনে। কুয়াশার শেষ ছাপ, সেই সঙ্গে বিরক্তি আর পাগলামিটুকুও নিয়ে গেছে সামনে।
ঠিক তখনই বেজে উঠল দরজার ঘণ্টি।
ড্রেসিং গাউন গায়ে দিয়ে, নিচ তলায় চলে এলো মোটকু চার্লি। আগে কখনও দরজা খোলার আগে সেফটি চেইন লাগায়নি, জীবনে কখনও না। কিন্তু এবার হ্যান্ডেল ঘোরাবার আগে চেইনটা লাগিয়ে নিলো। সদর দরজাটা ইঞ্চি ছয়েক খুলে উঁকি দিল কেবল।
‘শুভ সকাল?’ ক্লান্ত শোনাল বেচারার কণ্ঠ।
দরজার ফাঁক দিয়ে যে হাসিটা ভেসে এলো, সেটা আস্ত একটা গ্রামের আলোর অভাব দূর করার জন্য যথেষ্ট।
‘আমাকে ডেকেছিলে, এসে পড়েছি,’ বলল অচেনা যুবক। ‘এখন দরজা তো অন্তত খুলবে, মোটকু চার্লি!’
‘কে তুমি?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মোটকু চার্লি। তবে চিনতে পেরেছে যুবককে কোথায় দেখেছে আগে সেটাও মনে পড়ে গেছে—ওর মায়ের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে, ছোট্ট চ্যাপেলে। সেবারই প্রথম দেখেছিল হাসিটা। আর এবার… প্রশ্নের জবাব যুবক দেওয়ার আগেই আঁচ করতে পারছে সত্যটা।
‘আমি তোমার ভাই,’ জানাল যুবক।
ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিল মোটকু চার্লি। সেফটি চেইন খুলে এবার পুরোপুরি উজাড় করে দিল দরজা। যুবক তখনও সেভাবেই দাঁড়িয়ে।
আগে যে ভাইয়ের অস্তিত্বই বিশ্বাস করত না, সেই কাল্পনিক ভাই বাস্তব হয়ে সামনে এসে দাঁড়ালে কী বলতে হয়, তা জানে না মোটকু চার্লি। তাই ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল ওরা, একজন দরজার এপাশে আর অন্যজন ওপাশে। অবশেষে ওর ভাই বলল। ‘আমাকে তুমি স্পাইডার নামে ডাকতে পারো। ভেতরে আসতে বলবে না?’
‘অবশ্যই বলব। মানে, অবশ্যই, এসো ভেতরে।’
ওপরের তলায় যুবককে নিয়ে এলো মোটকু চার্লি।
এমন তো আর না যে অসম্ভব ঘটনা দুনিয়াতে ঘটেই না। যখন ঘটে, তখন সেটাকে মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই সামলাবার চেষ্টা করে। আজকের দিনটায়, অন্য সব দিনের মতোই, পৃথিবীর বুকে প্রায় হাজার পাঁচেক লোকের প্রায় অসম্ভব কোনো ঘটনা দেখার বা করার বা শোনার সৌভাগ্য হবে; যেগুলো ঘটার সম্ভাবনা হয়তো দশ লাখে-এক! তাদের কেউই ব্যাপারটা প্রায় অসম্ভব বলে তা অবিশ্বাস করতে দৃঢ়কল্প হবে না। অধিকাংশই যার যার ভাষায় বলবে: ‘দুনিয়াটাই অদ্ভুত’। তারপর আবার লেগে পড়বে কাজে।
তাই মোটকু চার্লির মনের একটা অংশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার জন্য যৌক্তিক, বোধগম্য আর সঠিক একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে চাইছে। মনের বড়ো একটা অংশ চাইছে এই অজানা ভাই, যে কিনা ওরই পিছুপিছু সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, তার অস্তিত্বের সঙ্গে নিজেকে পরিচিত করে তুলতে।
রান্নাঘরে এসে দাঁড়াল দুই ভাই।
‘চা দেবো?’
‘কফি হবে না?’
‘ইনস্ট্যান্ট ছাড়া নেই যে, দুঃখিত।’
‘আমার চলবে।’
কেতলির দিকে ফিরল মোটকু চার্লি। ‘অনেক দূর থেকে এসেছ?’
‘লস অ্যাঞ্জেলসে ছিলাম।’
‘বিমান যাত্রা কেমন হলো?’
রান্নাঘরের টেবিলে বসে পড়ল যুবক, কাঁধ ঝাঁকাল শুধু। আক্ষরিক অর্থেই শ্রাগ বলা চলে আচরণটাকে, যার অর্থ যেকোনো কিছুই হতে পারে।
‘উম, অনেকদিন থাকবে?’
‘সেসব নিয়ে এখনও ভাবিনি আসলে,’ যুবক—মানে স্পাইডার – মোটকু চার্লির রান্নাঘরে এমন ভাবে চোখ বোলাচ্ছে যেন কখনও কোনো রান্নাঘরে পা- ই রাখেনি!
‘কীভাবে নেবে কফি?’
‘রাতের মতো কালো…আর পাপের মতো মিষ্টি করে।’
ভাইয়ের সামনে মগটা নামিয়ে রাখল মোটকু চার্লি, তারপর এগিয়ে দিল চিনির একটা পাত্র। ‘নিজের মতো করে নিয়ে নাও।’
স্পাইডার যখন চামচের পর চামচ চিনি মগে ঢালতে ব্যস্ত, তখন চুপচাপ বসে তাকে দেখতে লাগল মোটকু চার্লি।
দুজনের মাঝে মিল আছে, যেমনটা পরিবারের সদস্যদের মাঝে থাকে— তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এই একটা যুক্তি দিয়ে স্পাইডারকে দেখার পর মোটকু চার্লির মনে পরিচিতির যে অনুভূতিটা হচ্ছে তা ব্যাখ্যা করা যায় না। নিজেকে মনে মনে যে রূপে দেখতে চায়, প্রতিদিন চুপি চুপি বাথরুমের আয়নায় প্রতিফলন দেখে যে মানুষটা হতে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ভাইকে দেখে তেমন মানুষ বলেই মনে হচ্ছে। স্পাইডার তুলনামূলক লম্বা, পাতলা আর এককথায়—দারুণ। পরনে একটা কালো খয়েরি চামড়ার জ্যাকেট, কালো চামড়ার প্যান্ট; দারুণ স্বচ্ছন্দ লাগছে যুবককে ওই পোশাকে। সেই স্বপ্ন-চার্লির পরনে কী ছিল, তাই মনে করার প্রয়াস পেল মোটকু চার্লি। বাস্তবের-থেকেও- বিশাল ধরনের একটা আবহ সৃষ্টি করেছে স্পাইডার। তার মুখোমুখি এক টেবিলে বসে আছে ভাবতেই নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে মোটকু চার্লির, সেই সঙ্গে অনেকটাই বিব্রতও। নাহ, স্পাইডারের পোশাকের জন্য না। এই উপলব্ধির জন্য যে ও নিজে সেই একই পোশাক পড়লে ওকে কতটা কিম্ভূতকিমাকার দেখাবে। স্পাইডারের প্রাণখোলা, মনছোঁয়া হাসিও তার কারণ না…কারণ মোটকু চার্লির ইস্পাত কঠিন বিশ্বাস যে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কেয়ামত পর্যন্ত অনুশীলন করেও এমন সুখপ্রদ, কিন্তু আত্মবিশ্বাসী আর ঝকঝকে হাসি হাসতে পারবে না।
‘মায়ের লাশ পোড়াবার দিন এসেছিলে তুমি,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘একবার ভেবেছিলাম, কাজ শেষে তোমার সঙ্গে কথা বলব,’ জানাল স্পাইডার। ‘কিন্তু পরে মনে হলো, কাজটা সুবুদ্ধির পরিচায়ক হবে না।’
‘ইস, বললে ভালোই হতো,’ একটা চিন্তা ভেসে এলো মোটকু চার্লির মাথায়। বলল সে, ‘আমি তো ভেবেছিলাম, বাবার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে দেখা যেতে পারে তোমায়।’
‘কী?’ আঁতকে উঠল যেন স্পাইডার।
‘বাবাকে কবর দেওয়ার সময়…কয়েকদিন আগে, ফ্লোরিডায় সেরেছি অনুষ্ঠান।’
মাথা নাড়ল স্পাইডার। ‘সে মরেনি,’ বলল ও। ‘মরলে আমি জানতে পারতাম।’
‘মারা গেছে, নিজ হাতে কবর দিয়েছি ওকে। চাইলে মিসেস হিগলারকে জিজ্ঞেস করতে পারো।’
জানতে চাইল স্পাইডার, ‘মারা গেল কীভাবে?’
‘হার্ট ফেইলিওর।’
‘তাতে কিছু যায় আসে না। এর মানে—সে মারা গেছে!’
‘মানে…আসলে…আমিও তো সেটাই বলছি এতক্ষণ ধরে।’
হাসি বন্ধ হয়ে গেছে স্পাইডারের। এখন একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে আছে কফির মগের দিকে, যেন ওর যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে ওতে। ‘আগে একটু
খোঁজ-খবর করে নিই,’ বলল স্পাইডার। ‘বলছি না যে তোমাকে অবিশ্বাস করছি। কিন্তু প্রশ্ন যখন তোমার বাপের…এবং যখন তোমার বাপ আমারও বাপ, তখন…’ চেহারা বিকৃত করল যুবক। এহেন আচরণের কারণটা জানে মোটকু চার্লি। নিজেও বহুবার করেছে, বাপের প্রসঙ্গ উঠলে। ‘ভদ্রমহিলা এখনও ওখানেই থাকে? আমরা যেখানে বড়ো হয়েছি, তার পাশের বাড়িতে?’
‘মিসেস হিগলার? হ্যাঁ, এখনও ওখানেই আছে।’
‘ওখানকার কিছু আছে সঙ্গে? ছবি-টবি জাতীয়?’
‘একটা বাক্সে ভরে কিছু ছবি নিয়ে এসেছি,’ এখনও কার্ডবোর্ডের বড়ো বাক্সটা খোলেনি মোটকু চার্লি, ওটা হলে বসে বসে ধুলো জমাচ্ছে। এখন ভেতরে এনে, রাখল টেবিলের ওপর। একটা ছুরি বের করে কেটে ফেলল প্যাকিং করার টেপ। নিজের লম্বা, পাতলা আঙুলগুলো বাক্সের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল স্পাইডার, ছবিগুলো এমন ভাবে দেখছে যেন তাস ফেটাচ্ছে। অবশেষে ওদের মা আর মিসেস হিগলারের একটা ছবি বের করে আনল। বছর পঁচিশেক আগে তোলা ওটা, দুই রমণী বসে আছে মিসেস হিগলারের বাড়ির সামনের রোয়াকে।
‘রোয়াকটা এখনও আছে?’
মনে করতে চাইল মোটকু চার্লি। ‘আছে মনে হয়,’ জবাব দিল সে।
এরপর কী হলো, তা মনে করতে কষ্ট হয় তার। হয়তো ছবিটা প্রকাণ্ড আকার ধারণ করল, আর নয়তো একেবারে ছোটো হয়ে গেল স্পাইডার। কিন্তু কসম কেটে বলতে পারে মোটকু চার্লি, আসলে দুটোর একটাও ঘটেনি; সে যাই হোক, স্পাইডার যে ছবির ভেতরে ঢুকে গেল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর ওটা কেঁপে উঠে, আন্দোলিত হয়ে গিলে ফেলল জলজ্যান্ত যুবকটাকে!
চোখ ঘষল মোটকু চার্লি। ভোর ছয়টার সময় রান্নাঘরে একাকী আবিষ্কার করল নিজেকে। টেবিলের ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে একটা বাক্স, সেটা আবার ভর্তি ছবি আর কাগজ-পত্র দিয়ে। একটা খালি মগও আছে, যেটাকে সিঙ্কে রেখে দিল সে।
তারপর হল ধরে চলে এলো নিজের শোবার ঘরে, বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। সোয়া সাতটায় অ্যালার্ম বাজার আগে আর ঘুম ভাঙ্গল না তার।
অধ্যায় চার – যেটা শেষ হয় নারী, মদ আর গানময় এক সন্ধের মধ্য দিয়ে
অধ্যায় চার – যেটা শেষ হয় নারী, মদ আর গানময় এক সন্ধের মধ্য দিয়ে
ঘুম ভেঙে গেল মোটকু চার্লির।
চলচ্চিত্রের বিখ্যাত অভিনেতা, এমন এক ভাইকে নিয়ে দেখা স্বপ্নের স্মৃতির সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে প্রেসিডেন্ট ট্যাফটের হঠাৎ ওকে দেখতে আসা স্বপ্নের। ভদ্রলোক সঙ্গে করে টম অ্যান্ড জেরি কার্টুনের পর্দার পেছনের সবাইকে নিয়ে এসেছিলেন!
দ্রুত গোসল ছেড়ে, টিউব[৮] ধরে কাজে চলে এলো সে।
[৮. সাবওয়ে ট্রেন।]
কাজ করতে গিয়ে সারাদিন মনে হলো, মগজের পেছন দিকে বসে কিছু একটা গুঁতো দিচ্ছে বারবার; কী, তা সে ধরতে পারছে না। এক জায়গার জিনিস অন্য জায়গায় রাখছে, ভুলে যাচ্ছে এটা-সেটা। এমনকী এক পর্যায়ে তো ডেস্কে বসেই গান গাইতে শুরু করে দিল! নাহ, আনন্দে মন ভরে আছে সেজন্য নয়। অফিসের ডেস্কে বসে যে গান গাওয়া যায় না তা ভুলে গেছে বলে। যখন গ্রাহাম কোটস নিজে তার মাথাটা মোটকু চার্লির ক্লজেট আকৃতির অফিসে ঢুকিয়ে বাগড়া বাধাল, তখন মোটকু চার্লি ধরতে পারল যে ও গান গাইছে! ‘রেডিয়ো, ওয়াকম্যান কিংবা এমপিথ্রি প্লেয়ারের স্থান আমার অফিসে নেই,’ নেউলের মতো চোখ-মুখ করে বলল গ্রাহাম কোটস। ‘এতে অফিসের কাজের আবহ তরল হয়ে যায়, টান-টান ভাবটা থাকে না। বুঝতেই পারছ— যারা করে খায়, তাদের জন্য ব্যাপারটা ভালো না।’
‘রেডিয়ো বাজাইনি তো,’ আপত্তি জানাতে চাইল লজ্জায় কান পর্যন্ত লাল হয়ে যাওয়া মোটকু চার্লি।
‘তাই নাকি? তাহলে দয়া করে বলো, কী বাজাচ্ছিলে?’
‘খালি গলায় গাইছিলাম,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘তুমি?’
‘হ্যাঁ, গান গাইছিলাম। আমি দুঃখিত—
‘শুনে তো মনে সন্দেহের অবকাশ ছিল না যে রেডিয়ো বাজছে। অথচ ভুল হয়েছে আমার। হায় খোদা! যাই হোক, তুমি নিজেই দেখছি ভালো গাও, দারুণ তোমার প্রতিভা। তোমার উচিত এখন আমাদের এখানকার ছোট্ট অফিসের একটা ডেস্কে বসে গান গেয়ে অন্যদের কাজে বাগড়া না দিয়ে, গান গেয়ে নাম কামানো আর বড়ো বড়ো শোয়ের ব্যবস্থা করা। তাই না? আমরা তো অন্য শিল্পীদের ক্যারিয়ার নিয়ে কাজ করি, তোমার কি আর তা পোষাবে?’
‘না, না।’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘আমার অমন কোনো ইচ্ছেই নেই। আসলে বেখেয়ালে…’
‘তাহলে,’ ওকে কথা শেষ করতে দিল না গ্রাহাম কোটস। ‘তোমাকে বেখেয়ালেও গান গাওয়ার হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে। যদি গাইতেই হয় তো গাবে গোসল করার সময়, অথবা হয়তো পছন্দের ফুটবল টিমের সমর্থনে। আমি নিজে ক্রিস্টাল প্যালেসের সমর্থক। আর যদি তা না পারো, তাহলে চাকরির জন্য অন্য কোথাও যেতে হবে তোমাকে।’
হাসল মোটকু চার্লি। পরক্ষণেই টের পেল, এই মুহূর্তে হাসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছাও ছিল না ওর। তাই চেহারায় একটা গম্ভীর ভাব আনার প্রয়াস পেল। অবশ্য ততক্ষণে গ্রাহাম কোটস চলে গেছে। তাই মোটকু চার্লি, অস্ফুট স্বরে গাল বকে, ডেস্কের ওপর হাত রেখে মাথাটা স্থাপন করল তার ওপর।
‘তুমি গাইছিলে?’ আর্টিস্ট লিয়াজো ডিপার্টমেন্টে সদ্য যোগদান করা মেয়েদের একজন জানতে চাইল। আলাদা আলাদা ভাবে এই মেয়েদের নাম শেখার চেষ্টা করেছিল মোটকু চার্লি, কিন্তু সুযোগ তেমন একটা মেলেনি। কথা শুরু করার আগেই, ওর সামনে থেকে সরে যায় এই মেয়েরা।
‘দুর্ভাগ্যজনক হলেও স্বীকার করতেই হচ্ছে…হ্যাঁ, আমিই গাইছিলাম।’
‘কোন গান ওটা? শুনে ভালোই লেগেছে।’
আচমকা মোটকু চার্লি উপলব্ধি করল, কোন গানটা গাচ্ছিল তা নিজেও জানে না! ‘বলতে পারছি না, নিজেই শুনিনি।’
কথা শুনে হেসে ফেলল মেয়েটা, তবে নিঃশব্দ সেই হাসি। ‘ভুল বলেনি কিন্তু গ্রাহাম কোটস। তোমার রেকর্ড বানানোয় মন দেওয়া উচিত, বৃথাই এখানে সময় নষ্ট করছ।’
জবাবে কী বলা উচিত, তা বুঝে পেল না মোটকু চার্লি। গাল আবারও লাল হয়ে গেছে, মন দিল নম্বর ঘাঁটায়। এটা-সেটা লিখে গেল, সেই সঙ্গে পোস্ট-ইট নোটগুলো জড়ো করে লাগাতে লাগল পর্দায়। মেয়েটা চলে গেছে, নিশ্চিত হবার আগে থামল না।
মেইভ লিভিংস্টোন ফোন করল একবার: গ্রাহাম কোটস যেন অবশ্যই তার ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে ফোন করে, সেটা মোটকু চার্লি কি দয়া করে নিশ্চিত করতে পারবে? যেন করে।
বিকেল চারটার দিকে মোবাইলে ফোন এলো, রোজি করেছে। ওকে জানাতে যে ফ্ল্যাটের পানি সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে আরেকটা সুখবরও আছে: অবশেষে রোজির মা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে মেয়ের বিয়ে নিয়ে আগ্রহ দেখাবে এবং রোজিকে সন্ধ্যায় আলোচনা করার জন্য যেতেও বলেছে।
‘হুম,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘তোমার মা যদি ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয়, তাহলে অন্তত খাবার-দাবারে বহু পয়সা বেঁচে যাবে।
‘বাজে কথা বোলো না তো। রাতে ফোন করে জানাব, কেমন হলো আলোচনা।’
জানতে পারলে খুশিই হবে, জবাবে বলল মোটকু চার্লি; তারপর বন্ধ করে দিল ফোন। মনে হচ্ছে, কেউ বুঝি নজর রাখছে ওর ওপর। ঝট করে ঘুরে দাঁড়াল সে।
গ্রাহাম কোটস বলল, ‘যে কোম্পানির সময়ে ব্যক্তিগত ফোনে সময় নষ্ট করে, তাকে সারা কোম্পানি অভিশাপ করে! কথাটা কে বলেছিল, জানো?’
‘আপনি?’
‘ঠিক বলেছ, আমি।’ একমত হলো গ্রাহাম কোটস। ‘ওটা আমারই উক্তি। সত্যি বলতে কী, এর চাইতে সত্য উক্তি আর হয় না। ধরে নাও, তোমাকে সাবধান করে দেওয়া হলো।’ বলেই হাসল লোকটা, আত্মতৃপ্তির হাসি। ওই হাসি দেখে মোটকু চার্লি ভাবতে বাধ্য হলো: গ্রাহাম কোর্টসের নাদুস-নুদুস পেটে ঘুসি বসিয়ে দিলে তার ফল কী হতে পারে? সিদ্ধান্ত নিলো: হয় শুধু চাকরি যাবে, আর নয়তো তার পাশাপাশি পুলিসের কাছে অভিযোগ যাবে…যেটাই হোক না কেন, ভাবল সে, মন্দ হবে না।
স্বভাবগত ভাবেই মোটকু চার্লি রাগী মানুষ—এ কথা বললে ঠাঁহা মিথ্যে বলা হবে। কিন্তু স্বপ্ন দেখে বটে সে, তবে সেসব ছোটোখাটো কিন্তু আরামদায়ক সব জিনিসের স্বপ্ন… যখন ইচ্ছা, ভালো রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া সারতে পারার মতো অর্থের মালিক হবার স্বপ্ন…দেখে এমন এক চাকরি করছে যেখানে কেউ ওর ওপর ছড়ি ঘোরায় না। লজ্জা না পেয়েই গাইতে চায় সে, এমন কোথাও যেখানে কখনও ওর গান শোনার জন্য কেউ থাকবে না।
আজ বিকেলে কেন যেন ওর স্বপ্নগুলো অদ্ভুত হয়ে ধরা দিচ্ছে। স্বপ্নে ও উড়তে পারে, বুলেট ঠিকরে পড়ে ওর শক্তিশালী বুকে বাধা পেয়ে। আকাশ থেকে নেমে এসে রোজিকে একদল গুন্ডাপান্ডার হাত থেকে বাঁচায়, নইলে হয়তো তুলেই নিয়ে যেত তারা মেয়েটিকে! আবার যখন বাতাসে ভাসে মোটকু চার্লি, তখন ওর বুকের সঙ্গে লেপটে থাকে মেয়েটা। ফট্রেস অভ কুল, যা একান্তই মোটকু চার্লির, সেখানে পৌঁছাবার পর কৃতজ্ঞ রোজি এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়ে যে ভুলে যায়: বিয়ের আগে পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। সিদ্ধান্ত নেয়, যত দ্রুত সম্ভব পয়সা দিয়ে ওই পাত্রটা ভরে ফেলবে…
দিবাস্বপ্নটা যেন এক ধাক্কায় গ্রাহাম কোটস এজেন্সির চাপসর্বস্ব দিনটাকে অনেকটাই সহনীয় করে তুলল।
ছয়টার দিকে কম্পিউটার বন্ধ করে দিল মোটকু চার্লি, ছয়তলা থেকে হেঁটে নেমে পা রাখল রাস্তায়। বৃষ্টি হয়নি, মাথার ওপরে উড়ছে স্টারলিং পাখির ঝাঁক, করছে কলতান: বড়ো এই শহরে এভাবেই আমন্ত্রণ জানানো হয় সূর্যাস্তকে। ফুটপাথে হন্য হয়ে হাঁটছে সবাই, ব্যস্ত কোথাও যেতে। অধিকাংশই, মোটকু চার্লির মতো, যাচ্ছে কিংসওয়ে থেকে হলবর্নে যাওয়ার টিউবের দিকে। সবার মাথা নিচের দিকে, রাতের মতো বাড়ি ফিরতে চাওয়া মানুষ বলে মনে হচ্ছে প্রত্যেককেই।
তবে ফুটপাতে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, যে কোথাও যাচ্ছে না। দাঁড়িয়ে আছে সে মোটকু চার্লির… আর অন্যান্য টিউব-যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে, চামড়ার জ্যাকেটটা পতপত করে উড়ছে বাতাসে। মুখে তার হাসি নেই।
রাস্তার শেষ মাথায় ওকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল মোটকু চার্লি। লোকটার কাছে যখন গেল, তখন মনে হলো যেন চারপাশের দুনিয়া বাস্তব থেকে অবাস্তবের রূপ নিতে শুরু করেছে। গলে যাচ্ছে দিন, আর ঠিক তখনই ধরে ফেলল: সারাটা দিন কী খোঁচাচ্ছিল ওকে।
‘হ্যালো, স্পাইডার।’ কাছে পৌঁছে বলল সে।
স্পাইডারকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে, ওর মনের ভেতর চলছে সর্বগ্রাসী ঝড়। আরেকটু হলে কেঁদেও ফেলতে পারে, ঠিক নিশ্চিত হতে পারছে না মোটকু চার্লি। ওর ভাইয়ের চেহারায় অনেক বেশি অনুভূতির ছাপ রয়েছে। যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে, তা দেখে লজ্জা পেয়ে অন্যরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
‘গেছিলাম ওখানে,’ বলল যুবক, নিষ্প্রাণ শোনাল ওর কণ্ঠ। ‘মিসেস হিগলারের সঙ্গে দেখা করলাম। মহিলা আমাকে কবর দেখাতে নিয়ে গেছিল। আমার বাবা মারা গেছে…অথচ আমি জানতামই না!’
সান্ত্বনা দিতে চাইল মোটকু চার্লি, ‘স্পাইডার, ও আমারও বাবা ছিল।’ এদিকে মনের মাঝে চলছে চিন্তা—স্পাইডারকে কীভাবে ভুলে গেল? কীভাবে ওকে ধরে নিলো স্বপ্ন বলে?
‘তা ঠিক।’
গোধূলির আকাশে এখন স্টারলিং পাখিদের রাজত্ব, এক ছাদ থেকে লাফিয়ে-বাতাসে ভেসে চলে যাচ্ছে অন্য ছাদে।
ঝট করে সোজা হয়ে দাঁড়াল স্পাইডার, যেন কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। ‘ঠিক বলেছ তুমি,’ বলল সে। ‘যা করার তা আমাদের একসঙ্গেই করতে হবে।’
‘ঠিক,’ বলল মোটকু চার্লি। পরক্ষণেই প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘যা করার…মানে?’ কিন্তু ততক্ষণে স্পাইডার একটা ক্যাব ডেকে ফেলেছে।
‘আমরা দুজন বিপর্যস্ত মানুষ,’ মহাবিশ্বকে শোনাল যেন স্পাইডার।
‘আমাদের বাবা মারা গেছে, বুকের ভেতর হৃদয় শোকের ভারে করছে হাহাকার। দুঃখ এমন ভাবে আমাদের ওপর আছড়ে পড়ছে, যেভাবে বসন্তকালে পরাগ রেণু ঝরে। আমাদের সামনে অন্ধকার, আমাদের সঙ্গী এখন কেবলই দুর্ভাগ্য।’
‘বেশ, বেশ,’ চেহারা উজ্জ্বল করে বলল ক্যাব ড্রাইভার ওরফে ক্যাবি। ‘তা তোমাদের নিয়ে যেতে হবে কোথায়?’
‘এমন কোথাও যেখানে আত্মার দুর্ভোগ হটাবার মতো খান তিনেক ওষুধ মিলবে,’ জানাল স্পাইডার।
‘এবং খানিকটা তরকারিও,’ যোগ করল মোটকু চার্লি।
‘মাত্র তিনটা এমন ওষুধ আছে… মাত্র তিনটা, যা মৃত্যুর শোক হটাতে আর জীবনের অত্যাচার হালকা করতে সক্ষম,’ জানাল স্পাইডার। ‘ওই তিন ওষুধ হলো: মদ, নারী আর গান।’
‘খাওয়ার মতো স্বাদু তরকারিও মন্দ না,’ আবার যোগ করল মোটকু চার্লি। কিন্তু কেউ ওর কথায় কান দিচ্ছে বলে মনে হলো না।
‘কোনটার পর কোনটা চাও, তার কোনো বাধ্য-বাধকতা আছে?’ জিজ্ঞেস করল ক্যাবি।
‘প্রথমে মদ,’ ঘোষণা করল যেন স্পাইডার। ‘এমন কোথাও যেখানে মদের নদী-হ্রদ-সমুদ্র মিলবে।’
‘বেশ তাহলে,’ বলল ক্যাবি, তারপর শুরু করল গাড়ি চালনা।
‘কেন যেন মনে হচ্ছে, কাজটা ঠিক হচ্ছে না,’ জানাল মোটকু চার্লি। মাথা নেড়ে সায় জানাল স্পাইডার। ‘খারাপ কিছু আশঙ্কা করছ? আমারও তাই মনে হচ্ছে। আজ রাতে সেসব আশঙ্কা আমরা অন্তর থেকে বের করে আনব, একে-অন্যকে দেখাবো; তারপর একত্রে মুখোমুখি হবো তাদের। আমরা শোক করব, আমরা মরণশীলতার তিক্ত পেয়ালা পান করে খালি করে দেব। যে কষ্ট ভাগাভাগি করা হয়, ভাই আমার, তা দ্বিগুণ হয় না… বরং অর্ধেক হয়ে যায়! মানুষ, সে যে-ই হোক না কেন, একাকী দ্বীপের মতো বাঁচতে পারে না!’
‘জানতে চেয়ো না, ঘণ্টি কার জন্য বাজছে,’ ক্যাবি জানাল। ‘হতে পারে, ওটা তোমার…ডাকছে তোমাকেই!’
‘আয় হায়,’ বলল স্পাইডার। ‘বড়ো ভারী কথা বলে ফেললে।’
‘ধন্যবাদ,’ বলল ক্যাবি।
‘অবশ্য কথা ভুল বলোনি, তুমি দেখছি দার্শনিক মানুষ! আমি স্পাইডার; আর এ আমার ভাই, মোটকু চার্লি।’
‘চার্লস,’ শুধরে দিতে চাইল মোটকু চার্লি।
‘স্টিভ,’ নিজের নাম জানাল ক্যাবি। ‘স্টিভ ব্যারিজ।’
‘মি. ব্যারিজ,’ বলল স্পাইডার, ‘আজ সন্ধ্যার জন্য আমাদের ব্যক্তিগত ড্রাইভার হতে কেমন লাগবে?’
স্টিভ ব্যারিজ জানালো, ওর শিফট শেষ হতে বেশি বাকি নেই। ওদেরকে নামিয়েই ফিরে যাবে বাড়িতে, মিসেস ব্যারিজ আর ছোট্ট ব্যারিজ শিশুরা ওর সঙ্গে রাতের খাবার খাওয়ার অপেক্ষায় আছে।
‘শুনলে?’ স্পাইডার বলল। ‘পরিবারঅলা মানুষ। শোনো ভাই, পরিবার বলতে আমার ও আমার ভাইয়ের এখন শুধু আমরাই অবশিষ্ট আছি। অথচ আমাদের দেখা হচ্ছে এই প্রথম।’
‘দারুণ গল্প মনে হচ্ছে,’ ক্যাবি জানাল। ‘ঝগড়া-টগড়া করছিলে নাকি?’
‘একদম না, বেচারা আসলে জানতই না যে ওর একটা ভাই আছে, জানাল স্পাইডার।
‘তুমি জানতে?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মোটকু চার্লি। ‘আমার ব্যাপারে?’
‘হয়তো জানতাম,’ জবাব দিল স্পাইডার। ‘কিন্তু এই ধরনের ব্যাপার- স্যাপার কেউ ভুলে যেতেই পারে।’
ফুটপাতের পাশে গাড়ি থামাল ক্যাবি। ‘আমরা কোথায়?’ জানতে চাইল মোটকু চার্লি। খুব একটা সময় অতিবাহিত হয়নি এর মাঝে। সম্ভবত ফ্লিট স্ট্রিটেরই কোথাও আছে।
‘যেখানে তোমার ভাই যেতে চেয়েছিল,’ জানাল ক্যাবি। ‘মদের উৎসে।’
ক্যাব থেকে বেরোল স্পাইডার, ঘোলাটে কাচ আর পুরাতন ওকের তৈরি প্রাচীন বারের বাইরের দিকটার দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ‘অসাধারণ, ‘ বলল সে। ‘লোকটাকে ভাড়া চুকিয়ে দাও, ভাই আমার।’
তাই করল মোটকু চার্লি। ভেতরে পা রাখল দুই ভাই: কাঠের সিঁড়ির ধাপ বেয়ে নেমে এলো সেলারে। সেখানে পাশাপাশি মদ্যপান করছে লালাভ মুখের ব্যারিস্টার আর পাণ্ডুর চেহারার মার্কেট ম্যানেজার। মেঝেতে দেখা যাচ্ছে কাঠের গুঁড়ো, বারের পেছনের ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে কেউ লিখে রেখেছে মদের তালিকা; যদিও তা পড়া দুষ্কর।
‘তুমি কী নেবে?’ জানতে চাইল স্পাইডার।
‘হাউজ রেডের[৯] এক গ্লাস হলেই হবে,’ জানাল মোটকু চার্লি।
[৯. দোকান কিংবা বারের জন্য কম দামে প্রচুর পরিমাণে কেনা লাল ওয়াইন।]
ওর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল স্পাইডার। ‘আমরা আনানসি বংশের শেষ দুই সন্তান, হাউজ রেড গলায় ঢেলে বাবার মৃত্যুর শোক আমরা পালন করবো না!’
‘উম, তাও ঠিক। বেশ, তুমি যা নেবে আমার জন্যও তাই বলো।’
বারের কাছে গেল স্পাইডার, এমনভাবে ভিড় ঠেলল যেন ওরা সেখানে নেই-ই! কয়েক মিনিট পর ফিরেও এলো, হাতে দুটো পানপাত্র, একটা কর্ক-স্ক্রু আর একটা ধুলোপড়া মদের বোতল। আরামসে বোতলটা খুলে ফেলল স্পাইডার, এতই সাবলীল ভাবে যে মুগ্ধ না হয়ে পারল না মোটকু চার্লি; নিজে যখন কাজটা করতে যায়, তখন কর্কের টুকরো ওয়াইনের ভেতর থেকে তোলায় মন দিতে হয়। বোতলের মদ এতটাই ঘন যে তাকে কালোই বলা চলে। দুই পানপাত্রের উভয়টা ভরল সে, তারপর একটা রাখল মোটকু চার্লির সামনে।
‘টোস্ট করা যাক,’ বলল সে। ‘বাবার স্মৃতির উদ্দেশ্যে।’
‘বাবার স্মৃতির উদ্দেশ্যে,’ বলল মোটকু চার্লি, স্পাইডারের গ্লাসের সঙ্গে টোকা দিল নিজের গ্লাস – অলৌকিক ভাবে দেখা গেল, নিজের গ্লাসের এক বিন্দু মদও ছলকে পড়ল না—তারপর চুমুক দিল নিজের পাত্রে। খানিকটা তিক্ত, লবণাক্ত আর ভেষজ স্বাদ। ‘এটা কী?’
‘শেষকৃত্যানুষ্ঠানে পরিবেশিত মদ…যে শেষকৃত্যানুষ্ঠান আবার দেবতার। বহুদিন হলো এসব বানানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। রোজমেরি আর তিতা অ্যালো মেশানো, সঙ্গে আছে হৃদয়-ভাঙার কষ্টে ব্যথিত কুমারীদের অশ্রু।’
‘এসব জিনিস ফ্লিট স্ট্রিটের মদের বারে বিক্রি হয়?’ বোতল তুলে নিলো মোটকু চার্লি, কিন্তু লেবেলটা ধুলোমাখা; নাম পড়া যাচ্ছে না। ‘আগে কখনও এই জিনিসের নামও শুনিনি।’
‘পুরনো এসব জায়গাতেই সবচাইতে ভালো জিনিসগুলো বিক্রি হয়। তবে চাইতে জানতে হয়,’ জানাল স্পাইডার। ‘অবশ্য সেটা কেবল আমার ধারণাও হতে পারে।’
মদের পাত্রে আরেকটা চুমু দিল মোটকু চার্লি। বেশ কড়া, আর খানিকটা ঝাঁঝালোও।
‘এই মদ হালকা চুমুকে পান করার জিনিস না,’ জানাল স্পাইডার। ‘এ এমন মদ, যাকে এভাবে শেষ করতে হবে,’ বলেই লম্বা চুমুক দিল ওতে, পরক্ষণেই বিকৃত করে ফেলল চোখ-মুখ। ‘এভাবে গিললেই না আসল মজাটা পাবে!’
ইতস্তত করল মোটকু চার্লি, তারপর অদ্ভুত মদ খেল মুখ ভরে। মনে হলো যেন অ্যালো আর রোজমেরির স্বাদও পাচ্ছে। ভাবল, লবণাক্ত স্বাদটা আসলেও অশ্রুর কারণে কি না।
‘রোজমেরি মেশায় স্মৃতিচারণার অংশ হিসেবে,’ জানাল স্পাইডার, আবার ভরতে শুরু করল ওদের পানপাত্র। মোটকু চার্লি বলতে চাইল—আজ রাতে খুব একটা মদ গিলতে পারবে না, কেননা আগামীকাল কাজে যেতে হবে। কিন্তু স্পাইডার ওকে তা বলার সুযোগ দিল না। ‘এবার তোমার টোস্ট করার পালা।’
‘উম, আচ্ছা,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘মায়ের উদ্দেশ্যে।’
মায়ের স্মৃতির উদ্দেশ্যে পান করল ওরা। টের পেল মোটকু চার্লি, তিক্ত মদের স্বাদটা ভালো লাগতে শুরু করেছে ওর; চোখ টাটাচ্ছে, মনের ভেতর দানা ভাবছে কিছু একটা হারানোর তীব্র কষ্ট। মায়ের অভাব খুব করে অনুভব করছে সে। মনে পড়ে যাচ্ছে শৈশবের কথা, এমনকী ওর বাবাকেও মনে পড়ছে খুব করে। টেবিলের ওপাশে বসা স্পাইডার মাথা দোলাচ্ছে, গাল বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু পড়ল মদের গ্লাসে। বোতলের দিকে হাত বাড়িয়ে আবার দুজনের পানপাত্র ভরিয়ে দিল যুবক।
সেটা হাতে নিয়ে গলায় ঢালল মোটকু চার্লি।
মদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল শোক; মগজ এবং দেহের প্রতিটা কোনায় কোনায় অনুভব করতে পারছে মাকে হারানোর ব্যথা, সাগরের ঢেউয়ের মতো বারংবার ফিরে ফিরে আসছে সেই কষ্ট।
মোটকু চার্লির চোখ থেকে বইছে অশ্রু, গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে; আছড়ে পড়ছে নিজের ড্রিঙ্কে। টিস্যুর জন্য পকেট হাতড়াল বেচারা। কালো মদের শেষটুকু ওদের দুজনের পানপাত্রে ঢালল স্পাইডার।
‘আসলেই এখানে এই মদটা বিক্রি হয়?’
‘একটা বোতল ছিল ওদের কাছে, তবে সেটার কথা ওরা নিজেরাই ভুলে গেছিল। মনে করিয়ে দিতে হয়েছে, এই যা।’
নাক ঝাড়ল মোটকু চার্লি। ‘আমি জানতামই না যে আমার একটা ভাই আছে।’
‘আমি জানতাম,’ বলল স্পাইডার। ‘তোমার হাল-হকিকত জানার ইচ্ছা সবসময়ই ছিল। কিন্তু এটা-সেটা সামনে এসে ভুলিয়ে দিয়েছে। জানোই তো, এসব কেন হয়…’
‘নাহ, জানি না।’
‘জরুরি কাজের অভাব আছে?’
‘কেমন ধরনের কাজ?’
এই কাজ, সেই কাজ। এই জিনিস, সেই জিনিস। সবসময় মাথাচাড়া দেয়। কাজের-জিনিসের স্বভাবই তা, সামনে এসে খাড়া হওয়া। সব কিছু কি
আর মনে রাখা সম্ভব?’
‘উ-উদাহরণ ত-তো দ-দিতে প-পারো।’
আরেকটু মদ গলায় ঢালল স্পাইডার। ‘বেশ তাহলে, শোনো: শেষবার যখন তোমার সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিই, তখন বেশ কিছুদিন কাটিয়েছি পরিকল্পনা করে। চেয়েছিলাম, সব যেন নিখুঁত ভাবে যায়। কোন পোশাকটা পরব, সেটা ঠিক করা নিয়ে অনেক ভাবতে হয়েছে। তারপর ভাবতে হলো- আমাদের দেখা হলে কী বলব তোমাকে। জানতাম, দুই ভাইয়ের প্রথম দেখা নিঃসন্দেহে অসাধারণ কিছু হবে। তাই এমন গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখতে কাব্যের সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু কোন ধরনের কাব্য? র্যাপ গাইব? নাকি সোজা-সাপটা কবিতা? গীতিকাব্য যে গাইব না, সেটা তো জানিই। তাই এমন কিছু বেছে নিতে হলো যা গভীর, শক্তিশালী, ছন্দময়…মহাকাব্যিক। তখন মাথায় চলে এলো প্রথম লাইনটা: রক্ত ডাকে রক্তকে, রাতের আঁধারে মোহিনীর গানের সুরে… দারুণ না পঙতিটা? কয়েক শব্দের মাঝে লুকিয়ে আছে কত কিছু—অলিগলিতে মানুষের মৃত্যু, ঘাম, দুঃস্বপ্নকে চোখ রাঙানি দিয়ে স্বাধীন সত্তার উড়ে বেড়ানো। কিন্তু ঝামেলা হলো, মেলাবার জন্য আরেকটা লাইন তো লাগবে, নাকি? সেটাই আর পারলাম না। কোনোভাবেই আগের লাইনের মতো গম্ভীর আরেকটা লাইন এলো না মাথায়। কেবল এলো: টাম-টাম্পটি -টাম্পটি -টাম্পটি প্রবল ভয়ে কেঁপে মরে।’
চোখ পিটপিট করল মোটকু চার্লি। ‘কে এই টাম-টাম্পর্টি-টাম্পটি- টাম্পটি?’
‘কেউ না। ওটা বলে বুঝিয়েছি; সেখানে বসার উপযুক্ত শব্দগুলো আর খুঁজে পাইনি। দ্বিতীয় লাইন মাথায় এলো না। এদিকে কেবল এই লাইন নিয়ে তো আর তোমার সামনে উপস্থিত হওয়া যায় না! মহাকাব্য কি আর এই পঙতিতে হয়? সেটা তো তোমার জন্য অপমানজনক হতো।’
‘আসলে…’
‘আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। তাই এক হপ্তার জন্য চলে গেলাম হাওয়াই বেড়াতে। যা বললাম, জরুরি কাজ কেবলই মাথাচাড়া দিতে ব্যস্ত থাকে।’
নিজের পাত্রে চুমুক দিল মোটকু চার্লি, স্বাদটা পছন্দ হতে শুরু করেছে। কখনও কখনও, অনুভূতি যখন তুঙ্গে থাকে, তখন জোরাল স্বাদ ভালো লাগে। নিঃসন্দেহে এখন তেমন একটা মুহূর্ত। ‘সব সময় নিশ্চয়ই কবিতার দ্বিতীয় পঙতি তোমাকে আটকে রাখেনি?’
মোটকু চার্লির বড়োসড়ো হাতে নিজের হাত রাখল স্পাইডার। ‘আমার ব্যাপারে অনেক শুনেছ,’ বলল সে। ‘এবার তোমার কথা বলো।’
‘বলার তেমন কিছু নেই,’ জানাল মোটকু চার্লি। নিজের জীবনের ব্যাপারে ভাইকে জানাল সব। বলল রোজি আর রোজির মায়ের কথা; বাদ গেল না গ্রাহাম কোটস এজেন্সির মালিক গ্রাহাম কোটসও। শুনে মাথা নাড়ল ওর ভাই। নিজের জীবনকে শব্দে রূপ দেওয়ার পর মোটকু চার্লির নিজের কাছে মনে হচ্ছে—ওর জীবনটাকে আসলে ঠিক জীবন বলা চলে না!
‘তারপরও,’ দার্শনিকের ভঙ্গিমায় বলল মোটকু চার্লি। ‘অনেকের ব্যাপারেই খবরের কাগজের গসিপ অংশে আমরা পড়ি। তারা সবসময় বলে: তাদের জীবন একঘেয়ে, নিঃস্ব আর অর্থহীন।’ পানপাত্রের ওপর উপুড় করে ধরল মদের বোতল, যদি ছিটেফোঁটা বাকি থাকে তো। কিন্তু একটা ফোঁটাও মিলল না, বোতলটা খালি। অবশ্য যতক্ষণ বোতলটা সেবা দিয়ে গেছে, ততক্ষণও সেবা দেওয়ার কথা না।
উঠে দাঁড়াল স্পাইডার। ‘যাদের কথা বলছ, তেমন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে আমার।’ জানাল সে। ‘গ্লসি ম্যাগাজিনে তাদের ব্যাপারে খবর ছাপে ওদের সঙ্গে মিশেওছি, নিজের চোখেই দেখেছি তাদের অর্থহীন ও নিঃস্ব জীবন। আবার আড়াল থেকেও দেখেছি ওদের আচরণ, তারা ভাবত—আর কেউ উপস্থিত ছিল না ওখানে। তবে একটা কথা সাফ জানিয়ে দিই: ভাই আমার, ওদের কেউই…এমনকী বন্দুকের নলের সামনে খাড়া হয়েও… তোমার সঙ্গে নিজের জীবন পালটাতে রাজি হবে না। যাক গে, চলো যাই।’
‘হাহ? কই যাবে?’
‘আমি না, আমরা যাবো। আজকের রাতের তিন লক্ষ্যের একটা তো অর্জিত হলো। মদ পান করা শেষ… রইল বাকি আর দুটো।
‘উম…’
স্পাইডারের পিছু নিয়ে মোটকু চার্লি বেরিয়ে এলো বাইরে, রাতের ঠান্ডা বাতাসে যদি মাথাটা একটু পরিষ্কার হয়। কিন্তু লাভ হলো না। মোটকু চার্লির মনে হচ্ছিল, ধড়ের সঙ্গে শক্ত করে লাগিয়ে রাখা না হলে মাথাটা বাতাসে ভেসে দূরে কোথাও চলে যেত।
‘এরপর নারী,’ জানাল স্পাইডার। ‘সব শেষে গান।’
.
একটা কথা বোধহয় আপনাদেরকে এই সুযোগে জানিয়ে দেওয়া উচিত– মোটকু চার্লির দুনিয়ায়, মেয়ে মানুষের আধিক্য নেই। আর তাই দুম করে তারা সামনে এসেও পড়ে না, তাদেরকে মোটকু চার্লির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়। ওকে সাহস যুগিয়ে কথা বলতে হয়, আবার কথা বলার সময় এমন একটা বিষয় বেছে নিতে হয় যাতে সে দক্ষ; এত ঝামেলা শেষ করার পরেও, বাকি থাকে অনেকটা পথ। তাদেরকে দুঃসাহসীর মতো জিজ্ঞেস করতে হয়— শনিবার রাতে কী করছে? সাধারণত এই প্রশ্নের জবাবে শুনতে হয়: চুল ধোয়াতে যাবে, কিংবা হিসেব-নিকেশ সামলাবে, অথবা পোষা কাকতাড়ুয়ার যত্ন নিতে হবে…কিংবা সরাসরি জানিয়ে দেবে, অপেক্ষা করবে সে অন্য কোনো পুরুষের ফোনের; যে ফোনটা হয়তো কোনোদিন আসবেই না।
কিন্তু স্পাইডারের দুনিয়ার নারীরা পুরোপুরি আলাদা।
ওয়েস্ট এন্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করল ওরা, থামল একটা জনাকীর্ণ পাবের সামনে এসে। খদ্দেররা ফুটপাতে ভিড় জমিয়েছে। থমকে দাঁড়াল স্পাইডার, হ্যালো বলার জন্য। জানা গেল, সিবিলা নামের এক যুবতীর জন্মদিন উদযাপনের জন্য সবাই জড়ো হয়েছে। মেয়েটার ও তার বান্ধবীদের জন্য যখন জন্মদিনের উপহার হিসেবে এক দফা মদ কেনার প্রস্তাব দিল স্পাইডার, তখন দৃশ্যতই দারুণ খুশি হলো মেয়েটা। ভেতরে গিয়েই ঠাট্টা-কৌতুক শুরু করল সে (‘… এরপর হাঁসটা বলল, আমার বিলে ঢুকিয়ে দেবে? আমাকে তুমি কী মনে করো? আমি পারভার্ট?’)। নিজের ঠাট্টায় নিজেই হাসল স্পাইডার; প্রাণখোলা, গমগমে হাসি। চারপাশে যারা আছে, তাদের সবার নাম মনে রেখেছে যুবক। কথা বলল তাদের সঙ্গে, শুনল তাদের কথা। স্পাইডার যখন বলল, আরেকটা পাব খুঁজতে বেরোবে, তখন পুরো দলটাই একমত হলো, ওদেরও সঙ্গে যেতে হবে…
তৃতীয় পাবে যখন পৌঁছল ওরা, তখন স্পাইডারকে দেখে মনে হলো যেন রক ভিডিয়োর কোনো অভিনেতা। ওকে ঘিরে ধরেছে মেয়ের দঙ্গল, একদম গাঁ-ঘেঁষে রয়েছে তারা; কয়েকজন তো চুমুও খেয়েছে… কিছুটা ঠান্ডা করে, কিছুটা সত্যি-সত্যি। ঈর্ষা এবং ভয়ের সঙ্গে সব দেখল মোটকু চার্লি।
‘তুমি কে? ওর বডিগার্ড?’ জিজ্ঞেস করল মেয়েদের একজন।
‘কী?’
‘বডিগার্ড? দেহরক্ষী?’
‘না,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘আমি ওর ভাই।’
‘ওয়াও,’ বলল মেয়েটা। ‘জানতামই না যে ওর ভাই-ও আছে। দারুণ মানুষ, তাই না?’
‘আমি তাই মনে করি,’ বলল আরেক মেয়ে। স্পাইডারকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে ছিল সে, কিন্তু একই কাজ করার জন্য উদগ্রীব আরও কিছু মেয়ের ধাক্কায় সরে যেতে বাধ্য হলো। মোটকু চার্লিকে যেন এই প্রথমবারের মতো দেখল সে। ‘তুমি কে? ওর ম্যানেজার?’
‘নাহ, ভাই।’ প্রথম মেয়েটা জানাল। ‘এইমাত্র বলল আমাকে,’ যোগ করল সে।
দ্বিতীয়জন অগ্রাহ্য করল ওকে। ‘তুমিও স্টেটসের নাকি?’ জানতে চাইল মেয়েটা। ‘কথায় টান আছে।’
‘যখন ছোটো ছিলাম,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘তখন ফ্লোরিডায় থাকতাম। আমার বাবা আমেরিকান। আর মা, জন্মেছিল সেন্ট অ্যান্ড্রুজে, কিন্তু বেড়ে উঠেছে…’
ওর কথায় মন নেই কারও।
সেই পাব থেকেও যখন বেরোল, তখন জন্মদিনের উৎসবের অতিথিরা সঙ্গে এলো ওদের। মেয়েরা ঘিরে ধরল স্পাইডারকে, এবার কই যাবে তা জানতে চাচ্ছে। নানা রেস্তোরাঁর নাম প্রস্তাব করা হলো, সেই সঙ্গে বেশ কিছু নাইটক্লাবও। স্পাইডার শুধু হাসল জবাবে, হাঁটতে লাগল সামনে।
মোটকু চার্লি অনুসরণ করল দলটাকে, নিজেকে অন্য সব সময়ের চাইতে বেশি সামাজিক মনে হচ্ছে।
নিয়ন আর স্ট্রিপলাইটের দুনিয়ায় পা রাখল দলটা। কয়েকটা মেয়েকে বগলদাবা করে আছে স্পাইডার। হাঁটতে হাঁটতেই চুমু খাচ্ছে তাদের, যখন যাকে ইচ্ছা। ভাবখানা এমন যেন সামনে গ্রীষ্মের ফল নিয়ে বসে থাকা মানুষ সে, একটা ফলে এই কামড় দিচ্ছে তো ওই হাতে তুলে নিচ্ছে আরেকটা।
তবে ফলগুলোর তাতে আপত্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না।
ব্যাপারটা স্বাভাবিক না। মোটকু চার্লি ভাবল। একদম না। এখন আর বলতে গেলে দলটাকে ধরার চেষ্টা করছে না ও, পাছে একা পড়ে যায়—এই ভয়ে পা চালাচ্ছে আরকী।
জিভের ডগায় এখনও যেন লেগে আছে মদটার তিক্ত স্বাদ।
বুঝতে পারছে, ঠিক ওর পাশেই হাঁটছে আরেকটা মেয়ে। ছোটোখাটো হলেও সুন্দর, অনেকটা পুতুলের মতো আরকী। মোটকু চার্লির শার্টের হাতা ধরে টান দিল সে। ‘আমরা আসলে করছিটা কী?’ জানতে চাইল মেয়েটা। ‘যাচ্ছি কই?’
‘আমাদের বাবার মৃত্যুর শোক পালন করছি,’ জবাব দিল সে। ‘অন্তত আমার তাই ধারণা।’
‘রিয়েলিটি টিভি শো নাকি?’
‘আশা করি—না।’
আচমকা থেমে ঘুরে তাকাল স্পাইডার। ওর চোখের তারায় জ্বলজ্বল করতে থাকা আভাটাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যায় না। ‘এসে পড়েছি, ঘোষণা করল সে। ‘পৌঁছে গেছি লক্ষ্যে। সে-ও এটাই চাইত।’
যে পাবের সামনে ওরা দাঁড়িয়েছে, তার দরজায় একটা উজ্জ্বল কমলা কাগজ সাঁটানো। তাতে লেখা:
আজ রাতে, ওপর তলায়, ক্যারিয়োকি।
‘গান,’ বলল স্পাইডার। তারপর যোগ করল, ‘শুরু করা যাক!’
‘না,’ মোটকু চার্লি বলল, যেখানে আছে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল।
‘এই কাজটাকেই পছন্দ করত সে, ‘ জানাল স্পাইডার।
‘আমি গান গাই না, অন্তত জনসম্মুখে না। তাছাড়া মাতাল হয়ে আছি। এমনিতেও মনে হয় না এভাবে গান গাওয়ার বুদ্ধিটা ভালো।’
‘ঠিক, ভালো না… অসাধারণ বুদ্ধি,’ হাসি দিয়েই যেন দুনিয়াকে পটিয়ে ফেলবে স্পাইডার। ঠিক জায়গায় দেখাতে পারলে, ওই হাসি দিয়েই ধর্মযুদ্ধ শুরু করা যাবে! কিন্তু মোটকু চার্লির ভাবান্তর হলো না।
‘দেখো, বলল সে, কণ্ঠ থেকে আতঙ্ক দাবিয়ে রাখল। ‘এমন অনেক কিছু আছে যা মানুষ সাধারণত করে না, ঠিক বললাম? কেউ কেউ আকাশে উড়তে পারে না। কেউ কেউ জনসম্মুখে সম্ভোগ শুরু করে দেয় না। অনেকে ধোঁয়ায় পরিণত হয়ে উড়ে যায় না। আমিও ওইসব কাজ করতে পারি না, এবং পারি না গান গাইতেও।’
‘বাবার জন্য হলেও না?’
‘বাবার জন্য হলে তো আরও না। কবরে যাওয়ার পরেও তার জন্য আমি লোকসম্মুখে বিব্রত হতে পারব না। যতটুকু করে গেছে, যথেষ্ট।’
‘এক্সকিউজ মি,’ যুবতীদের একজন বলল। ‘এক্সকিউজ মি, আমরা ভেতরে যাবো না? বাইরে দাঁড়িয়ে তো ঠান্ডা লেগে গেল! সিবিলেরও বাথরুমে যেতে হবে।’
‘যাবো, যাচ্ছি,’ বলে মিষ্টি করে হাসল স্পাইডার।
আপত্তি জানাতে চাইল মোটকু চার্লি, চাইল কঠোরভাবে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে। কিন্তু আবিষ্কার করল ওকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভেতরে, নিজেকে ঘৃণা করছে এখন। সিঁড়িতে এসে স্পাইডারকে ধরে ফেলল সে। ‘আমি ভেতরে যাবো,’ জানাল সে। ‘কিন্তু গান গাইবো না।’
‘ভেতরে তো চলেই এসেছ।’
‘তা জানি, কিন্তু গান গাইবো না।’
‘ভেতরে ঢোকার পর, যাবো না যাবো না করে লাভ আছে?’
‘আমি গাইতে পারি না।’
‘তারমানে, বাবার কাছ থেকে গান গাওয়ার সব দক্ষতাও আমিই পেয়েছি?’
‘উঁহু, তার মানে: মানুষজনের সামনে গান গাইতে হলে বমি করে ফেলব।’
ওকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাতে চাপ দিল স্পাইডার। ‘আমি কীভাবে গাই, সেইটা আগে দেখো। তারপর নাহয়…’ বলল সে।
বার্থডে গার্ল আর তার দুই বান্ধবী গিয়ে দাঁড়াল মঞ্চে। খিলখিলিয়ে হাসির ফাঁকে গাইল ‘ড্যান্সিং কুইন’। জিন আর টনিক পান করল মোটকু চার্লি, কেউ একজন ওর হাতে ধরিয়ে দিয়েছে পানপাত্রটা। বেসুরো গান শুনতে গিয়ে মুখ বিকৃত হয়ে গেল ওর, পরিষ্কার ধরতে পারল ভুলের জায়গাগুলো। দলের বাকিরা অবশ্য হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিল তাদেরকে।
আরেক নারী এবার উঠল মঞ্চে। এই সেই পুতুলের মতো সুন্দর মেয়ে, যে মোটকু চার্লিকে জিজ্ঞেস করেছিল যে ওরা কোথায় যাচ্ছে। শুরুর দিকের সুর শুনে মনে হচ্ছিল ‘স্ট্যান্ড বাই মি’ বাজছে। চরম দরদ দিয়ে গানটা গাইতে শুরু করল মেয়েটা, তবে প্রতিটা সুরসঙ্কেত ধরতে ভুল করল বেচারি; তেমনি লাইন শুরু করল হয় একটু আগে নইলে একটু পড়ে। পঙতিতেও ভুল হলো।
তার জন্য মায়াই হলো মোটকু চার্লির।
মঞ্চ থেকে নেমে বারের দিকে আসতে লাগল মেয়েটা। সান্ত্বনা দেবার ভঙ্গিতে কিছু একটা বলতে চাইল মোটকু চার্লি, কিন্তু আনন্দে পুতুল-রূপী মেয়েটার চেহারা জ্বলজ্বল করছে। ‘দারুণ না?’ বলল মেয়েটি। ‘মানে, অসাধারণ লেগেছে।’ ওকে একটা ড্রিঙ্ক কিনে দিল মোটকু চার্লি, বড়োসড়ো পাত্র ভরতি কমলার রস মেশানো ভদকা। ‘মজা পেয়েছি অনেক,’ ওকে বলল মেয়েটা। ‘তুমিও গাইবে? যাও না, পারবে। অন্তত আমার চাইতে জঘন্য তো আর হবে না।’
শ্রাগ করল মোটকু চার্লি। এমনভাবে যেন বোঝাতে চাইল, ওর যে অদক্ষতা-তা আসলে এখন পর্যন্ত বাইরেই আসেনি!
ছোট্ট মঞ্চটার দিকে এমন ভঙ্গিতে এগোল স্পাইডার যে মনে হলো, পাদপ্রদীপের আলো ওকে অনুসরণ করছে!
‘বাজি ধরে বলতে পারি, ভালোই গাইবে,’ ভদকা আর কমলার রস খেতে ব্যস্ত মেয়েটা বলল। ‘কে যেন বলল, তুমি নাকি ওর ভাই?’
‘না,’ বিড়বিড় করে বলল মোটকু চার্লি, আচরণে দ্বেষ ঝরে পড়ছে। ‘বলেছি যে ও আমার ভাই।’
গাইতে শুরু করল স্পাইডার। গানের নাম: আন্ডার দ্য ব্রডওয়াক
গানটা যদি মোটকু চার্লির মারাত্মক পছন্দ না হতো, তাহলে ঘটনাটা কখনওই ঘটত না। ওর বয়েস যখন ছিল তেরো, তখন বিশ্বাস করত যে ‘আন্ডার দ্য ব্রডওয়াক’-ই দুনিয়ার সর্বসেরা গান (চোদ্দো বছর বয়সে যখন দুনিয়ার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা হয়ে গেল, তখন সেই জায়গা দখল করল বব মার্লির ‘নো ওম্যান নো ক্রাই’)। স্পাইডার এখন ওর গানটাই গাইছে, এবং গাইছে দারুণ দক্ষতার সঙ্গে। সুর-তাল কাটছে না, শব্দগুলো দরদ দিয়েই উচ্চারণ করছে। মদ খাওয়া বন্ধ করে দিল সবাই, কথা বলাও বন্ধ। হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে শুনল কেবল।
গান গাওয়া শেষ হলে, সবাই হাততালি দিয়ে উঠল। যদি কারও মাথায় টুপি থাকত, তাহলে নিঃসন্দেহে তা বাতাসে ছুড়ে মারত।
‘বুঝতে পারছি, কেন ওর পরে গাওয়ার ইচ্ছে নেই তোমার।’ কমলা- ভদকা মেয়েটা বলল মোটকু চার্লিকে। ‘মানে, এমন ভাবে গাওয়া তো আর তোমার পক্ষে সম্ভব না, তাই না?’
‘আসলে…’ মোটকু চার্লি বলল।
‘বলতে চাচ্ছিলাম,’ হেসে জানাল মেয়েটা। ‘পরিবারের মাঝে কে প্রতিভাবান, সেটা তো আমরা দেখতেই পারছি।’ মাথা কাত করে বলল কথাটা, সেই সঙ্গে দোলাল চিবুক।
পরের কাজটাই বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে দাঁড়াল।
মঞ্চের দিকে এগোল মোটকু চার্লি, ইচ্ছে করেই এক পায়ের ঠিক সামনে ফেলল আরেক পা। বোঝাতে চাইল, শারীরিক সক্ষমতা আছে ওর। কিন্তু ভেতরে ভেতরে ঘামছে।
পরের কয়েকটা মুহূর্তের স্মৃতি পরিষ্কার মনে নেই ওর। ডিজেকে বলে তালিকা থেকে বেছে নিলো: আনফরগেটেবল। ছোটোখাটো একটা অনন্তকালের জন্য অপেক্ষা করল যেন, তারপর হাতে পেল মাইক্রোফোন।
মুখ শুকিয়ে গেছে বেচারার, হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে দুরন্ত গতিতে।
পর্দায় দেখতে পেল প্রথম শব্দটা: আনফরগেটেবল…
কথা হলো, মোটকু চার্লি আসলেও গান গাইতে জানে। গলায় সুর-তাল দুটোই আছে, আছে শরীরী ভঙ্গিমা। যখন সে গান গায়, তখন পুরো দেহটা পরিণত হয় বাদ্যযন্ত্রে।
শুরু হয়ে গেল সুর।
মোটকু চার্লি প্রস্তুত, ওর মনে হচ্ছে- মুখটা খুলে যাবে এখনই, শুরু করবে গান গাওয়া। ‘আনফরগেটেবল’ গাইবে সে। গাইবে তার মৃত বাবা আর ভাইয়ের উদ্দেশ্যে। গাইবে রাতটা স্মরণীয় করে রাখতে। সবাইকে জানিয়ে দেবে, এমন কিছু ব্যাপার আছে যা কখনও ভোলা যায় না!
কিন্তু পারল না…ওর দিকে তাকিয়ে আছে একদল মানুষ। সংখ্যায় টেনে- টুনে দুই ডজন হবে। রয়েছে ওরা এই মুহূর্তে একটা পাবের ওপরের তলার কামরায়। অধিকাংশই মেয়ে। আর দর্শকের সামনে, মোটকু চার্লি মুখ পর্যন্ত খুলতে পারল না।
শুনতে পাচ্ছে বাজনা, কিন্তু তারপরও দাঁড়িয়ে রইল ওভাবেই। সেই সঙ্গে ঠান্ডা বোধ করছে, পাজোড়া আছে যেন অনেক-অনেক দূরে।
মুখ খুলল মোটকু চার্লি।
‘আমি মনে হয়—’ পরিষ্কার উচ্চারণে বলল সে মাইক্রোফোনে। বাজনা ছাপিয়ে শোনা গেল ওর শব্দগুলো, রুমের প্রতিটা কোনায় পড়ল ছড়িয়ে। অসুস্থ হয়ে যাবো।’
মঞ্চ থেকে আত্মসম্মান নিয়ে সটকে পড়ার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না বেচারা।
আর তারপর, সারা দুনিয়াটা যেন কেঁপে উঠল।
.
কিংবদন্তির জায়গা বলতে কিছু স্থান আসলেই আছে, আছে যার যার মতো করে। কিছু পৃথিবীরই কোনো-না-কোনো স্থান দখল করে থাকে। আবার কিছু থাকে তার ঠিক নিচেই, অনেকটা আন্ডার পেইন্টিঙের মতো।
যেমন আছে পাহাড়। এমন অনেক অংশঅলা পাহাড় আছে, যে পর্যন্ত পৌঁছুবার আগেই আপনি পৌঁছে যাবেন বিশ্বের শেষ মাথায়। এমন অনেক গুহা আছে পাহাড়ে, গভীর গুহা… পৃথিবীতে মানুষের পা পড়ার আগেই কেউ-না- কেউ বাস করত ওখানে।
এখনও করে…
অধ্যায় পাঁচ – যে অধ্যায়ে আমরা পরেরদিন সকালের ঘটনা অণুবীক্ষণের নিচে ফেলে দেখি
অধ্যায় পাঁচ – যে অধ্যায়ে আমরা পরেরদিন সকালের ঘটনা অণুবীক্ষণের নিচে ফেলে দেখি
গলা ফাটার দশা মোটকু চার্লির।
তৃষ্ণা পেয়েছে মোটকু চার্লির, সেই সঙ্গে ব্যথায় ফেটে পড়ছে মাথা।
তৃষ্ণার্ত মোটকু চার্লি মাথাব্যথার চোটে অন্ধকার দেখছে চোখে, মুখে অশুভের স্বাদ, চোখ যেন এঁটে বসেছে অক্ষিকোটরে: বত্রিশখানা দাঁতের সবগুলো শিরশির করছে। পাকস্থলীতে যেন আগুন জ্বালিয়েছে কিছু একটা; কোমরও ব্যথা করছে, যা শুরু হয়েছিল হাঁটু থেকে, উঠে যাচ্ছে কপাল পর্যন্ত। মগজটা যেন বের করে নেওয়া হয়েছে তার জায়গা থেকে, সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ তুলোর বল। তবে তাতেও থামেনি, সুঁই-টুইও ঢুকিয়ে দিয়েছে; কিছু ভাবতে চাইলেই জন্ম নিচ্ছে তীক্ষ্ণ একটা ব্যথা। চোখগুলো বোধহয় গত রাতে মুক্তি পেয়ে বাজার ঘুরে এসেছে, ফেরার সময় সঙ্গে করে এনেছে তীক্ষ্ণ পেরেক। এখন বুঝতে পারছে; বাতাসের অণুগুলো সাধারণত আরামসে ঘুরে বেড়ায়, তার ভিন্ন কিছু হলেই ব্যথায় ককিয়ে উঠছে ওর দেহ।
ভাবছে, এর চাইতে মরলেই ভালো হতো।
চোখ খুলল মোটকু চার্লি, বিশাল বড়ো ভুল বলে প্রমাণিত হলো কাজটা। চোখের ভেতর প্রবেশ করল দিনের আলো, যাতে আরও বেড়ে গেল ব্যথা। তবে কোথায় আছে এই মুহূর্তে, বুঝতে পারছে সেটা (ওর নিজের ঘরে, নিজের বিছানায়), বিছানার পাশে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকাল একবার।
সাড়ে এগারোটা বাজে!
এরচাইতে খারাপ খবর আর হতে পারে না, ভাবল সে। যে হ্যাংওভার ধরেছে, সেটা ব্যবহার করেই পুরাতন টেস্টামেন্টের ঈশ্বর মিডিয়ানাইটসদের[১০] একেবারে ধ্বংস করে দিতে পারতেন। সন্দেহ নেই, পরেরবার গ্রাহাম কোটস যখন ওকে দেখতে পাবে তখন জানিয়ে দেবে—চাকরি আর নেই!
[১০. মাদায়েনবাসী।]
ফোনে নিজেকে কীভাবে অসুস্থ প্রমাণ করবে, সেটাই ভাবছে। পারবে তো?
গত রাতে বাড়ি কীভাবে ফিরেছে, সেটা মনেও করতে পারছে না।
অফিসে ফোন করতে হবে, তবে নম্বরটা মনে হবার পর। ক্ষমা চাইতে হবে চব্বিশ ঘণ্টা যে ফ্লু-টা জ্বালায়, সেটার অজুহাত দেবে। জানাবে একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে, কিন্তু কিচ্ছু করার নেই…
‘আচ্ছা শোনো,’ বিছানায় ওর পাশেই শুয়ে থাকা একটা কণ্ঠ বলে উঠল। ‘তোমার পাশে একটা পানির বোতল আছে। একটু এদিকে দেবে?’
মুখ খুলতে চাইল মোটকু চার্লি, বলতে চাইল-ওর পাশে পানির বোতল নেই। তাই পানি খেতে চাইলে যেতে হবে বাথরুমের সিঙ্কের কাছে। টুথব্রাশ রাখার মগটাকে ঠিকমতো জীবাণুমুক্ত করতে না পারলে সেটাও মিলবে না। কিন্তু তার আগেই আবিষ্কার করল কয়েক বোতল পানি, বিছানার পাশের টেবিলেই আছে! হাত বাড়িয়ে একটা আঁকড়ে ধরল ও, মনে হলো যেন আঙ্গুলগুলো ওর নিজের না…বরঞ্চ অন্য কারও। তারপর—পাহাড় চড়ার সময় শেষ কয়েকটা ফুট মানুষ যেভাবে সর্বশক্তি খাটায়–তেমন শক্তিতে বিছানায় গড়ান খেল।
কমলা-ভদকা শুয়ে আছে ওর পাশে!
তাও আবার নগ্ন হয়ে। অন্তত যে অংশটুকু দেখা যাচ্ছে, ততটুকু নগ্নই।
পানিটুকু নিলো মেয়েটা, তারপর বিছানার চাদর টেনে তুলে বুক ঢাকল। ‘ঘুম ভাঙলে তোমাকে জানাতে বলেছে,’ বলল সে। ‘অফিসে ফোন করে অসুস্থতার গপ্পো ফাঁদার কোনো দরকার নেই। ওদিকটা সামলে নেব।’
মোটকু চার্লির মন শান্ত হলো না। ওর দুশ্চিন্তা আর ভয়ের ঘনত্বও রইল আগের মতোই। অবশ্য যে অবস্থা তার, তাতে মনের ভেতর শুধু একটা চিন্তারই স্থান হয়। এই মুহূর্তে সেটা হলো: দেরি হয়ে যাবার আগেই বাথরুম পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে কি না।’
‘তোমার আসলে তরল পানীয় দরকার,’ বলল মেয়েটা। ‘ইলেক্ট্রোলাইটের পরিমাণ কমে গেছে, বাড়াতে হবে।’
পারল মোটকু চার্লি, পৌঁছে গেল বাথরুমে। তারপর দাঁড়াল শাওয়ারের নিচে, ঘরটা কাঁপাকাঁপি বন্ধ করার আগে থামল না। অতঃপর বমি না করেই সক্ষম হলো দাঁত মাজতে।
বাথরুম থেকে ফেরার পর দেখতে পেল, কমলা- ভদকা আর নেই কামরায়। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে, আশা করছে – মেয়েটা হয়তো ওর মাতাল মনের আবিষ্কার। সেই সঙ্গে হয়তো গত রাতে মঞ্চে উঠে গান গাইবার স্মৃতিটাও।
ড্রেসিং গাউনটা খুঁজে বের করতে কষ্টই হলো বেচারার, তাই ট্রাকস্যুট বের করে পরে নিলো। হলের অন্য মাথায় থাকা রান্নাঘরে যাওয়ার আগে, কিছু একটা তো গায়ে দেওয়া দরকার।
আচমকা বেজে উঠল ওর ফোন, সেটার খোঁজে পকেট হাতড়াল জ্যাকেটের। জ্যাকেটটা আবার পড়ে আছে মেঝেতে, বিছানার পাশে। খুঁজে পেয়ে ফ্লিপ সেটটা খুলে ইচ্ছে করেই একবার ঘোঁত করল, ওপাশ থেকে যদি গ্রাহাম কোটস এজেন্সির কেউ ফোন করে তো তাকে শোনানোও হয়ে যাবে।
‘আমি বলছি,’ শোনা গেল স্পাইডারের কণ্ঠ। ‘সব ঠিক আছে।’
‘অফিসে বলেছটা কী? আমি মারা গেছি?’
‘নাহ, তার চাইতে ভালো কথা বলেছি। বলেছি, আমিই তুমি।’
‘কিন্তু,’ মাথা পরিষ্কার করার চেষ্টা করল মোটকু চার্লি। ‘কিন্তু তুমি তো আমি না।’
‘সেটা আমি জানি। তবে অফিসে বলেছি যে আমিই মোটকু চার্লি।’
‘আমাদের চেহারাও তো এক না!’
‘ওহে ভাই আমার, এত ছোটো করে দেখছ আমার ক্ষমতাকে? ঝামেলা হচ্ছে না কোনো, খুশি? যাই হোক, যেতে হবে। বিগ বস ডেকে পাঠিয়েছেন।’
‘গ্রাহাম কোটস? শোনো, স্পাইডার-’
কিন্তু ততক্ষণে ফোন রেখে দিয়েছে স্পাইডার, পর্দা কালো হয়ে গেছে।
আচমকা কামরার ভেতরে প্রবেশ করল মোটকু চার্লির ড্রেসিং গাউন, পোশাকটার ভেতরে এক মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে ওর চাইতে অনেক বেশি মানিয়েছে মেয়েটাকে। হাতে ধরে আছে একটা ট্রে, তাতে পানি ভরতি গ্লাস; সেই পানিতে ফেলেছে আলকা-সেলটযার[১১]। সঙ্গে একটা মগও আছে, কিছু একটা আছে ওতেও।
[১১. পানিতে ফেললেই গলে যায়, এমন অ্যান্টিসিডের বড়ি।]
‘দুটোই খেয়ে নাও,’ ওকে বলল মেয়েটা। ‘মগটা আগে শেষ করো, পুরোটাই।’
‘কী আছে ওতে?’
‘ডিমের কুসুম, ওরচেস্টাশায়ার সস, টাবাস্কো, লবণ, হালকা ভদকা— ইত্যাদি,’ জানাল মেয়েটা। ‘হয় মরবে, নইলে সুস্থ হয়ে যাবে। কথা অনেক হলো,’ এমন স্বরে বলল যে বোঝাই গেল, আর কোনো বাক্য বিনিময় চলবে না। ‘এখন শেষ করে ফেলো।’
নির্দেশ পালন করল মোটকু চার্লি।
‘হায় ঈশ্বর,’ বলল পরমুহূর্তেই।
‘হুম, স্বাদটা অমনই,’ সায় দিল মেয়েটা। ‘তবে বেঁচে যখন আছ—’
আসলেই বেঁচে আছে কি না, নিশ্চিত না মোটকু চার্লি। তারপরও আলকা- সেলটারের গ্লাসটা শেষ করে ফেলল। ঠিক তখনই মাথায় এলো ভাবনাটা।
‘উম,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘উম, দেখো, গত রাতে…আমরা…মানে…কিছু…’
শূন্য দৃষ্টিতে ওর দিকে চেয়ে রইল মেয়েটা। ‘আমরা কিছু…কী?’
‘আমরা কিছু করেছি নাকি?’
‘মানে বলতে চাইছ তোমার মনে নেই?’ কালো হয়ে গেল বেচারির চেহারা। ‘অথচ রাতে তো বললে, আমার মতো প্রেমিকা আগে কখনও পাওনি! বললে, এই প্রথম নারী-সঙ্গ পাচ্ছো; কেননার আগেরগুলো নারীই ছিল না! তুমিও অবশ্য কম যাও না। খানিকটা দেবতা, খানিকটা পশু, আর অনেকটা সেক্স মেশিনে পরিণত হয়েছিলে…’
নিজেকে নিয়ে কী করবে, তাই ভেবে পাচ্ছে না মোটকু চার্লি। ওর অবস্থা দেখে হেসে ফেলল মেয়েটা।
‘আরে ধুর, আমি ঠাট্টা করছি,’ বলল মেয়েটা। ‘তোমাকে এখানে নিয়ে আসতে কষ্ট হচ্ছিল তোমার ভাইয়ের, তাই সাহায্য করেছি ওকে। তারপর তোমাকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করলাম… এরপর কী হলো তা তো বুঝতেই পারছ।’
‘নাহ,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না…’
‘তাহলে খুলেই বলি। তুমি একরকম অজ্ঞানই হয়ে গেছিলে। বিছানাটাও ছোটো ছিল না, তোমার ভাই কোথায় ঘুমিয়েছে তা জানি না। কিন্তু ব্যাটা ষাঁড়ের মতো শক্ত। সেই সক্কাল বেলা উঠে পড়েছে! রাতের ধকলের চিহ্ন পর্যন্ত নেই।’
‘অফিসে গেছে,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘সবার কাছে নিজেকে… আমি বলে চালিয়ে দিয়েছে!’
‘কিন্তু, ধরা পড়বে না? তোমরা তো আর যমজ নও!’
‘পড়েনি বলেই তো মনে হচ্ছে,’ মাথা দোলাল মোটকু চার্লি, তারপর তাকাল মেয়েটির দিকে। ওর দৃষ্টি নিজের ওপর টের পেয়ে ছোট্ট, টকটকে গোলাপি জিভ দেখিয়ে দিল পুতুল। ‘তোমার নাম কী?’
‘বলো কী? ভুলে গেছ? তোমার নাম কিন্তু আমার মনে আছে। তুমি মোটকু চার্লি।’
‘চার্লস,’ বলল যুবক। ‘শুধু চার্লস বললেই চলবে।
‘আমি ডেইজি,’ হাত বাড়িয়ে দিল মেয়েটা। ‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।’ গম্ভীর ভঙ্গিতে করমর্দন করল ওরা।
‘এখন একটু ভালো লাগছে,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘আগেই বলেছি,’ মেয়েটা জবাবে বলল। ‘হয় সুস্থ হবে, নইলে পটোল তুলবে!’
.
অফিসে দারুণ একটা দিন কাটছে স্পাইডারের। বলতে গেলে কখনওই ওর অফিস করা হয়নি। অফিস কেন, কোনো চাকরিই করা হয়নি! ওর পৃথিবীটা যেন বদলে গেছে, যা দেখে নতুন লাগে; আর নতুন সব কিছুই অদ্ভুত, তবে অসাধারণ। ষষ্ট তলায় ওঠার ছোট্ট লিফট থেকে শুরু করে, গ্রাহাম কোটস এজেন্সির খোপের মতো অফিস-সবই। হাঁ করে তাকিয়ে দেখে নিলো কাচের কেসে রাখা, লবির ধুলো পড়া ট্রফিগুলো। তারপর এই অফিস থেকে ওই অফিসে ঘুরে বেড়াল কিছুক্ষণ। যে-ই পরিচয় জানতে চাইছে তাকেই বলছে ‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি’।
তবে হ্যাঁ, বলছে নিজের দেবতাসুলভ কণ্ঠে, যার অর্থ—যা বলছে তা এক হিসেবে সত্যই!
চা পানের কামরাটা খুঁজে বের করে, নিজের জন্য কয়েক কাপ বানাল সে। তারপর সবগুলো কাপ নিয়ে ফিরে এলো মোটকু চার্লির ডেস্কে, সুন্দর করে সাজিয়ে রাখল ওগুলোকে। এরপর শুরু করল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক নিয়ে খেলা। ওর কাছে পাসওয়ার্ড চাইল যন্ত্রটা, ‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি’– কম্পিউটারকে এতটুকু জানানোই যথেষ্ট হলো। কিন্তু তারপরেও দেখা গেল, কিছু কিছু জায়গায় ঢুকতে পারছে না। তাই বলল ‘আমি গ্রাহাম কোটস’…
ব্যস, খুলে গেল সব কটা জানালা!
একঘেয়ে লাগতে শুরু করল যখন, তখন বন্ধ হলো ওর ঘাঁটাঘাঁটি।
মোটকু চার্লির যে যে কাজগুলো করার কথা ছিল, সেগুলো ঝট করে শেষ করে ফেলল ও। তারপর শেষ করে ফেলল যে কাজগুলো পরে করার কথা ছিল, সেগুলোও।
আচমকা মনে হলো, মোটকু চার্লির এখন জেগে ওঠার কথা। তাই বাড়িতে ফোন করল একটা, ভাইকে আশ্বস্ত করতে। যখন মনে হচ্ছিল, কিছুটা হলেও পেরেছে, ঠিক তখনই ভেতরে উঁকি দিল গ্রাহাম কোটস। নেউলের মতো ঠোঁটের ওপর দিয়ে আঙুল চালিয়ে ইঙ্গিতে ওকে বলল অনুসরণ করতে।
‘যাই হোক, যেতে হবে,’ ভাইকে বলল স্পাইডার। ‘বিগ বস ডেকে পাঠিয়েছেন।’ রেখে দিল ফোন।
‘অফিসে বসে, কাজের সময় ব্যক্তিগত ফোন,’ কেবল এতটুকুই বলল গ্রাহাম কোটস।
‘বি-ল-কু-ল ঠি-ক,’ সায় দিল স্পাইডার।
‘বিগ বস বলতে কী আমাকেই বোঝানো হচ্ছিল?’ জিজ্ঞেস করল গ্রাহাম কোটস, হলের শেষ মাথায় অবস্থিত নিজের অফিসে চলে এসেছে ওরা।
‘আপনিই তো সবচেয়ে বড়ো,’ জবাব দিল স্পাইডার। ‘এবং সবচাইতে অসাধারণ বস!’
হতবাক দেখাল গ্রাহাম কোটসকে। সম্ভবত তার মনে হচ্ছে যে ঠাট্টা করা হচ্ছে তাকে নিয়ে; কিন্তু নিশ্চিত না। আর তাই বিভ্রান্ত বোধ করছে।
‘হুম, বসো। বসে পড়ো।’ বলল সে।
নিজেকে বসালো স্পাইডার।
ইচ্ছে করেই এজেন্সিতে কর্মচারীদের বেশিদিন রাখে না গ্রাহাম কোটস। তবে সব কিছুই করে হিসেব-নিকেশ করে। কিছু আসে যায়। আবার কিছু লোককে রেখে দেয় সে, তবে যতদিন কাজ করলে কিছু অধিকার বলবত হয়ে যায় ততদিন থাকতে দেয় না। অন্য যেকারও চাইতে বেশি সময় হলো এখানে চাকরি করছে মোটকু চার্লি: এক বছর এবং এগারো মাস। আরেক মাস পেরোলেই ব্যাটাকে ‘শ্রমিক অধিকার’ আইনে নানা সুবিধে দিতে হবে।
কাউকে চাকরি থেকে বের করে দেওয়ার আগে, একটা বক্তৃতা শুনিয়ে দেয় গ্রাহাম কোটস। বলা যায়, গর্বই করে সেই বক্তব্যটাকে নিয়ে।
‘প্রত্যেক জীবনেই,’ শুরু করল সে। ‘বৃষ্টিপাতের দরকার আছে। আকাশে কালো মেঘ দেখা মাত্র ভয় পাওয়ার কিছু নেই, সেটা প্রাণদায়ী বর্ষণও সঙ্গে করে আনতে পারে।’
‘কিন্তু অশুভ বাতাস, পালটা উক্তি শুনিয়ে দিল স্পাইডার। ‘কারও ভালাই করতে পারে না।’
‘আহ, তা তো বটেই। যাক সে কথা। কষ্টের এই সময়টা অতিক্রম করার মুহূর্তে আমাদেরকে ভাবতে হবে, আর সেজন্য দরকার একটু থমকে দাঁড়ানো–’
‘তা নাহয় ভাবলাম। কিন্তু প্রথম ক্ষতটাই,’ জানাল স্পাইডার। ‘সবচাইতে গভীর হয়।’
‘কী? ওহ!’ এরপর কোন লাইনটা বলার কথা, তা মনে করতে বেগ পেতে হলো গ্রাহাম কোটসকে। ‘আনন্দ,’ অবশেষে খুঁজে পেয়ে ঘোষণা করল সে। ‘ডানা ঝাপটাতে থাকা প্রজাপতির মতো।’
‘অথবা ব্লুবার্ডের মতোও হতে পারে,’ পরামর্শ দিল স্পাইডার।
‘ঠিক বলেছ, এবার আমার কথা শেষ করতে পারি?’
‘অবশ্যই, অবশ্যই।’ আনন্দের সঙ্গে বলল স্পাইডার।
‘গ্রাহাম কোটস এজেন্সির প্রত্যেক সদস্যের আত্মা যেন আনন্দে থাকে, সেটা নিশ্চিত করা আমার জন্য ততটাই গুরুত্বপূর্ণ, যতটা গুরুত্বপূর্ণ আমার নিজের আত্মার আনন্দ নিশ্চিত করা।
‘কথাটা শুনে যে কী আনন্দ পেলাম—’ বলল স্পাইডার। -তা বলে বোঝানো সম্ভব না।’
‘হুম,’ বলল গ্রাহাম কোটস।
‘কথা বলে ভালো লাগল, কিন্তু অনেক কাজ বাকি আছে,’ জানাল স্পাইডার। ‘কিন্তু বলার মতো কথা থাকলে, আমাকে ডাকতে ভুলবেন না। কোথায় বসি, তা তো জানাই আছে আপনার।’
‘আনন্দ, আত্মতৃপ্তি,’ বলেই চলছে গ্রাহাম কোটস, তবে কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। ‘মাঝে মাঝে ভাবি, ন্যান্সি, চার্লস, যে তুমি কি… এখানে আনন্দে আছ? পাচ্ছ আত্মতৃপ্তি? অন্য কোথাও আরও বেশি পাবে, সে কথা কি তোমার মনে হয় না? ভাবো না এমন কিছু?’
‘নাহ, ভাবি না।’ জানাল স্পাইডার। ‘কী ভাবি, শুনতে চান?’
কিছুই বলল না গ্রাহাম কোটস। আগে কখনও এই দশা হয়নি ওর। সাধারণত এই পর্যায়ে এসে প্রত্যেকের চেহারা কালো হয়ে যায়, ধাক্কা খায় প্রচণ্ড। অনেকে তো কেঁদেও ফেলে। তা অবশ্য গ্রাহাম কোটসের খারাপ লাগে না।
‘আমি ভাবি যে,’ শুরু করল স্পাইডার। ‘কেম্যান আইল্যান্ডের[১২] অ্যাকাউন্টগুলো খুলতে হলো কেন? কেননা দেখে মনে হয়, যে টাকাটা আমাদের মক্কেলদের অ্যাকাউন্টে যাবার কথা ছিল, সেটা মাঝে মাঝে ওই কেম্যানের অ্যাকাউন্টগুলোয় চলে যাচ্ছে! হিসেব রাখার এই পদ্ধতি কেমন অদ্ভুত মনে হয় না? টাকাটাকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার জন্য এভাবে অন্য অ্যাকাউন্টে পাঠানোটা আরকী। এমন কিছু আগে দেখিনি। আশা করি আপনার কাছ থেকে এর একটা ব্যাখ্যা শিখতে পারব।’
[১২. ক্যারিবিয়ানের একটি দ্বীপ।]
একেবারে সাদা হয়ে গেছে গ্রাহাম কোটস। এখন ওর চেহারার যে রং, সেটাকে রং বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানরা বলে—পার্চমেন্ট, অথবা ম্যাগনোলিয়া। সে বলল, ‘ওই অ্যাকাউন্টগুলোর হদীস পেলে কীভাবে?’
‘কম্পিউটার ঘেঁটে,’ বলল স্পাইডার। ‘উলটোপালটা জায়গায় নিয়ে যায় আমাকে, আপনার সঙ্গেও কি তেমন করে? করলেই বা আর কী করার আছে!’
গ্রাহাম কোটস কিছুক্ষণ ভেবে নিলো। সবসময় ভেবে এসেছে, ওর অর্থনৈতিক লেনদেন এমন প্যাঁচালো ভাবে করা হয়েছে যে ফ্রড স্কোয়াড হাজার বার ঘেঁটেও কিচ্ছু আঁচ করতে পারবে না। আর যদি পারেও, কীভাবে অপরাধটা করা হয়েছে তা জুরিকে বোঝাতে গিয়ে গলদঘর্ম হবে।
‘দেশের বাইরে অ্যাকাউন্ট রাখাটা বেআইনি কিছু না,’ আলগোছে বলে ফেলল সে।
‘বেআইনি?’ পালটা প্রশ্ন করল স্পাইডার। ‘আমিও সেটাই আশা করি। বেআইনি হলে তো উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে দৌড়াতে হতো।’
ডেস্কের ওপর থেকে একটা কলম তুলে নিলো গ্রাহাম কোটস, তারপর নামিয়ে রাখল আবার। ‘আহ,’ বলল সে। ‘কথা বলে, আলোচনা করে তোমার সঙ্গে সময় কাটাতে বেশ ভালো লাগে আমার, চার্লস। তবে করার মতো কাজ বোধহয় আমাদের দুজনেরই আছে। সময় এবং স্রোত, হাজার হলেও, কারও জন্যই অপেক্ষা করে না। গড়িমসি করা মানেই মূল্যবান সময় হারানো।’
‘জীবন পাথরের মতো ভারী,’ বলল স্পাইডার। ‘কিন্তু রেডিয়ো আমাদেরকে স্থির হতে দেয় না।’[১৩]
[১৩. ১৯৭০-এর বিখ্যাত একটি গানের কলি!]
‘বাদ দাও।’
.
নিজেকে আবার মানুষ মনে হচ্ছে এখন মোটকু চার্লির। ব্যথা-ট্যাথা আর নেই। ধীর, কিন্তু নিয়মিত বিরতিতে ছুটে আসতে থাকা বমির ধাক্কাও এখন আর ওকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে না। পৃথিবীটাকে এখনও আনন্দঘন কোনো জায়গা বলে মনে হয় না ওর, কিন্তু নরকের নবম স্তর বলেও মনে হচ্ছে না।
অন্তত এই ব্যাপারটা আশাপ্রদ।
বাথরুম দখল করে রেখেছে ডেইজি। কল ঘোরাবার আওয়াজ পেয়েছে মোটকু চার্লি। তারপর পেয়েছে তৃপ্তির সঙ্গে কারও পানিতে গা ছেড়ে দেওয়ার শব্দ।
দরজায় টোকা দিল সে।
‘আমি ভেতরে,’ জানাল ডেইজি। ‘গোসল করছি।’
‘জানি তো,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘মানে, জানতাম না; তবে আন্দাজ করেছিলাম।’
‘কী চাই?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মেয়েটা।
‘ভাবছিলাম,’ দরজার ওপাশ থেকে বলল যুবক। ‘এখানে এসেছিলে কেন, মানে গত রাতে?’
‘আসলে,’ জবাব দিল মেয়েটা। ‘তোমার অবস্থা একটু বেশিই খারাপ হয়ে গেছিল। আর তোমার ভাইকে দেখে মনে হচ্ছিল, তার সাহায্যের দরকার। এদিকে আজ সকালে আমার ছুটি। তাই দুই দুগুণে চার।’
‘তা তো বটেই, তা তো বটেই,’ বলল মোটকু চার্লি। ওর প্রতি করুণা জন্মেছিল মেয়েটার মনে, আবার স্পাইডারের প্রতি ভালোলাগাও ছিল। হুম, মাত্র একদিনের খানিকটা বেশি হয়েছে ওদের ভ্রাতৃত্বের বয়স, এরই মাঝে সম্পর্কের ধরনটা বোঝা হয়ে গেছে। স্পাইডার হচ্ছে জনপ্রিয় ভাই; আর ও?
শুধুই স্পাইডারের ভাই।
দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো কণ্ঠ, ‘তোমার গানের গলা বেশ ভালো।’
‘কী?’
‘ট্যাক্সিতে গান গাচ্ছিলে, বাড়িতে ফেরার সময়… আনফরগেটেবল। দারুণ লেগেছে।’
ক্যারিয়োকির ঘটনাটা কীভাবে কীভাবে যেন মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে মোটকু চার্লির। অথবা বলা যায় মনের যে কোণে অনাকাঙ্ক্ষিত জিনিসপত্র বন্দি করে রাখা হয়, সেখানে সেঁধিয়ে দিয়েছে। এখন মুক্ত হয়ে গেছে সেই ঘটনা, যদিও না হলেই খুশি হতো।
‘আসলেও ভালো গাও তুমি,’ বলল মেয়েটা। ‘পরে আমাকে গেয়ে শোনাবে?’
মরিয়া হয়ে ভাবল মোটকু চার্লি, কিন্তু কিছু বলতে পারার আগেই ওকে বাঁচিয়ে দিল ঘণ্টি।
‘কেউ এসেছে,’ বলল সে।
নিচ তলায় গিয়ে দরজা খুলতেই আবিষ্কার করল—পরিস্থিতি মুহূর্তে হাজারগুণে খারাপ হয়ে গেছে! রোজির মা এমন দৃষ্টিতে তাকাল তার দিকে, যে দৃষ্টি দেখে দুধও দই হয়ে যাবে! কিছুই বলল না মহিলা, হাতে একটা বড়োসড়ো সাদা খাম ধরে আছে।
‘হ্যালো,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘উম, মিসেস নোয়াহ। আপনাকে দেখে খুশি হলাম।’
নাক টানল মহিলা, তারপর খামটা এগিয়ে দিল সামনে। ‘ওহ,’ বলল সে। ‘তুমি বাড়িতেই আছ… যাক, ভেতরে আসতে বলবে না?’
ঠিক ঠিক, ভাবল মোটকু চার্লি। তোমার প্রজাতির সদস্যরা তো আবার দাওয়াত না পেলে ভেতরে আসতে পারে না[১৪]। না বলাই যথেষ্ট, মহিলা চলে যেতে বাধ্য। ‘অবশ্যই, মিসেস নোয়াহ। দয়া করে ভেতরে আসুন।’ বোঝা গেল, রক্তচোষারা বাড়িতে ঢোকে কীভাবে! ‘চা দেব?’
[১৪. মোটকু চার্লি বোঝাতে চাচ্ছে, রোজির মা আসলে রক্তচোষা।]
‘এসব কথা বলে আমাকে ভজাতে পারবে না,’ বলল মহিলা। ‘তাই সেই চেষ্টাও কোরো না।’
‘উম, আচ্ছা।’
সরু সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো ওরা, পা রাখল রান্নাঘরে। রোজির মা চারপাশটা তাকিয়ে দেখে এমন চেহারা বানালো যে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিল: পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অবস্থা পছন্দ হয়নি তার, হয়তো খাবারের অনেক আইটেম এখনও সেখানে পড়ে আছে বলে। ‘কফি? পানি?’ মোমের ফল খাওয়ার দাওয়াত দিয়ো না আবার। ‘মোমের ফল?’
ধ্যাত।
‘রোজির কাছে শুনলাম, তোমার বাবা নাকি কদিন আগেই মারা গেছেন?’
‘হ্যাঁ। গেছে।’
‘রোজির বাবা যখন মারা যায়, তখন কুকস অ্যান্ড কুকারি ম্যাগাজিনে চার পাতার শোকসংবাদ ছাপা হয়েছিল। এই দেশে ক্যারিবিয়ান ফিউশন ধাঁচের খাবার তার হাত ধরেই জনপ্রিয় হয়েছে—এমনটাই লেখা হয়েছিল তাতে।’
‘বাহ।’
‘আমাকে অকুল পাথারে ফেলে অগস্ত্য যাত্রা করেনি। জীবন-বিমা ছিল। তাছাড়া দুটো সফল রেস্তোরাঁয় অংশীদারও ছিল সে। আমি যথেষ্ট ধনী মহিলা। মারা গেলে, সেসব রোজিকেই দিয়ে যাবো।’
‘আমাদের বিয়ে হয়ে গেলে,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘আপনার মেয়ের খেয়াল আমি রাখতে পারব। ও নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না।’
‘বলছি না যে রোজিকে শুধু আমার পয়সার জন্য বিয়ে করছ,’ এমন সুরে বলল রোজির মা যে পরিষ্কার বোঝা গেল, ভদ্রমহিলা আসলে সেটাই বলতে চায়।
মাথা আবার ব্যথা করতে শুরু করেছে মোটকু চার্লির। ‘মিসেস নোয়াহ, আপনাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?’
‘রোজির সঙ্গে কথা বলছিলাম, ঠিক করেছি তোমাদের বিয়ের পরিকল্পনায় সাহায্য করবো।’ আনুষ্ঠানিকতার ছোঁয়া তার কণ্ঠে। ‘তোমার তরফ থেকে কারা কারা আসবে, তা জানা দরকার। নাম, ঠিকানা, ই-মেইল আর ফোন নম্বর। একটা ফর্ম বানিয়েছে, পূরণ করে দিয়ো। ভাবলাম, ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনসে যেহেতু যাচ্ছি তখন পথে নিজেই দিয়ে যাই; ডাকের খরচটা তাতে বাঁচবে। কিন্তু ভাবিনি তোমাকে বাসায় দেখতে পাবো।’ সাদা খামটা ধরিয়ে দিল মহিলা। ‘বিয়েতে মোট নব্বই জন মানুষ থাকবে। তাই তুমি দাওয়াত দিতে পারো আট জন আত্মীয় আর ছয় জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। টেবিল-জ তে বসবে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সবাই আর আত্মীয়দের চার জন। বাকিদের জায়গা টেবিল-গ- তে। তোমার বাবাকে আমাদের সঙ্গে মূল টেবিলে বসাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু তিনি যেহেতু আর নেই, তাই তার জায়গাটা দিয়েছি রোজির খালা উইনিফ্রেডকে। তোমার নিতবর কে হতে যাচ্ছে, ঠিক করেছ?’
মাথা দোলাল মোটকু চার্লি।
‘ঠিক করা হলে দয়া করে তাকে জানিয়ে দিয়ো, বক্তব্য দেবার সময় যেন বাজে আর অশ্লীল কোনো কৌতুক ব্যবহার না করে। চার্চে যে কথা বলা যায় না, সেই কথা তোমার নিতবরের মুখ থেকে শুনতে চাই না। বোঝা গেল?’
একবার ভাবল মোটকু চার্লি, রোজির মা চার্চে ঠিক কোন ধরনের কথা শোনে? সম্ভবত ‘হট যাও! নরকের কীট!’…এবং তারপর আঁতকে ওঠার আওয়াজের সঙ্গে ‘বেঁচে আছে এখনও?’ পরের কথাটা নিশ্চয়ই প্রশ্ন, উপস্থিত মানুষরা জানতে চায়—সঙ্গে করে কেউ হাতুড়ি আর কাঠের গোঁজ এনেছে কি না!
‘আমার আত্মীয়ের সংখ্যা,’ শুরু করল মোটকু চার্লি। ‘দশের বেশি হবে। দূর-সম্পর্কের ভাই-বোন আর ফুফু-খালাদের ধরলে।’
‘একটা জিনিস তুমি বুঝতে পারছ না,’ জানাল রোজির মা। ‘বিয়ে মানেই খরচ। আমি ক থেকে ঘ পর্যন্ত টেবিলের প্রত্যেকের জন্য ১৭৫ পাউন্ড করে খরচ ধরেছি। ক মানে মূল টেবিল আরকী। এগুলোয় বসবে রোজির ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আর আমার ক্লাবের সদস্যারা। ঙ থেকে ছ পর্যন্ত টেবিলে মাথাপিছু বাজেট ১২৫ পাউন্ড, যেগুলো দূরের আত্মীয় আর বাচ্চা-কাচ্চাদের জন্য।’
‘আপনি বললেন, আমার বন্ধুরা বসবে টেবিল-জ-তে!’ অবাক হয়ে গেল মোটকু চার্লি।
‘হুম, মইয়ের নিচের দিককার ধাপ। খাবার হিসেবে পরিবেশিত হবে অ্যাভোকাডো দিয়ে চিংড়ি অথবা শেরি ট্রাইফেল।’
‘শেষ বার যখন এসব নিয়ে রোজির সঙ্গে আমার কথা হলো, তখন ঠিক করেছিলাম যে খাবার হবে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ধাঁচের।’
নাক টানল রোজির মা। ‘আমার মেয়ে যে কী চায়, তা নিজেই অনেকসময় ধরতে পারে না। সে যাই হোক, এখন আমি আর ও মিলেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
‘দেখুন,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘এসব নিয়ে আমি নিজে রোজির সঙ্গে আলোচনা করে আবার আপনাকে জানানোই ভালো হবে বলে মনে করছি।’
‘ফর্মটা ভরে দাও, আর কিছু করতে হবে না।’ রোজির মা জানাল। ‘কাজে যাওনি কেন?’
‘আমি, উম, মানে, আজ সকালে ছুটি নিয়েছি বলতে পারেন। মানে আজ কাজে যাচ্ছি না।’
‘আশা করি রোজি সেটা জানে? দুপুরের তোমার সঙ্গে লাঞ্চ করার পরিকল্পনা করেছিল বেচারি, আমাকে বলল। সেজন্যই আমার সঙ্গে খেতে পারবে না!’
তথ্যটা হজম করে নিলো মোটকু চার্লি। ‘ঠিক আছে,’ বলল সে। ‘যাই হোক, কষ্ট করে আসার জন্য ধন্যবাদ, মিসেস নোয়াহ। আমি রোজির সঙ্গে কথা বলে নেবো। আর-’
ঠিক তখনই রান্নাঘরে পা রাখল ডেইজি, চুল বেঁধে রেখেছে তোয়ালে দিয়ে। পরে আছে মোটকু চার্লির গাউন, এই মুহূর্তে ভেজা শরীরের সঙ্গে সেঁটে আছে পোশাকটা। বলল, ‘কমলার রস আছে তো, নাকি? আগেরবার এখানে ঘুরঘুর করার সময় দেখেছি। মাথার কী অবস্থা? ভালো লাগছে?’
বলেই ফ্রিজের দরজা খুলে ফেলল মেয়েটা, লম্বা একটা গ্লাসে নিজের জন্য কমলার রস ঢালল।
কেশে গলা পরিষ্কার করল রোজির মা। তবে শুনে গলা খাঁকারি দেওয়ার আওয়াজ মনে হলো না, বরঞ্চ সৈকত বেয়ে গড়িয়ে চলা নুড়ির শব্দের মতো লাগল।
‘হ্যাল্লো,’ বলল ডেইজি। ‘আমি ডেইজি।’
রান্নাঘরের তাপমাত্রা নেমে গেল ধপ করে। ‘তাই নাকি?’ বলল রোজির মা, শেষ বর্ণটা উচ্চারণ করার সময় মনে হলো যেন বরফের টুকরো মিশিয়ে বলছে!
‘আচ্ছা, এগুলোর নাম কমলা না হলে–’ নীরবতা ভাঙতে বলল মোটকু চার্লি।
‘—কী হতো? যদি আমরা নতুন ভাবে কোনো নীল রঙের ফল আবিষ্কার করি, তাহলে কি ওটার নাম নীল রেখে দিব? নীলের রস ঢালব গলায়?’
‘কী?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন রোজির মা।
‘ঈশ্বর! তোমার মুখ থেকে যে কী কী সব কথা বের হয়, তা যদি নিজের কানে শুনতে,’ ঝলমলে মুখে বলল ডেইজি। ‘যাক গে, আমার পোশাক খুঁজে পাই কি না দেখি। আপনাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ভালো লাগল।’
বেরিয়ে গেল মেয়েটা, কিন্তু দম নিতে সেই যে ভুলে গেছিল মোটকু চার্লি, তা আবার নেওয়ার কথা মনেও পড়ল না বেচারার।
‘কে—,’ একদম শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করল রোজির মা। ‘এই-মেয়ে?’
‘আমার বোন—দূরসম্পর্কের। কাজিন আরকি,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘তবে বোনের নজরেই দেখি। বেড়ে ওঠার সময় বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলাম। গত রাতে হঠাৎ করে চলে আসে। একটু উরা-ধুরা। যাই হোক, ওকে আবার বিয়ের দিনে দেখবেন।’
‘টেবিলে বসাবো তাহলে,’ জানাল রোজির মা। ‘ওখানে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে।’ এমন ভাবে কথাটা বলল মহিলা, যেভাবে পাগল কোনো খুনি বলে: ‘তুমি দ্রুত মরতে চাও? নাকি মঙ্গোকে একটু মজা নিতে দেবে?’
‘বেশ বেশ,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘তাহলে,’ যোগ করল সেই সঙ্গে। ‘দেখা হয়ে ভালো লাগল। আর,’ আরও যোগ করল বেচারা। ‘অনেক কাজ নিশ্চয়ই বাকি আছে। তাছাড়া,’ বলেই চলছে সে। ‘আমাকেও কাজে যেতে হবে।’
‘আজ না তোমার ছুটি?’
‘সকালটা ছুটি, আর সকাল তো ফুরিয়েই এসেছে প্রায়। কাজে যেতে হবে, তাই বিদায়।’
দেহের সঙ্গে হ্যান্ডব্যাগটাকে শক্ত করে ধরে, উঠে দাঁড়াল মহিলা। মোটকু চার্লি তার পিছু পিছু চলে এলো হলে। ‘দেখা হয়ে খুশি হলাম,’ বলল সে।
চোখ পিটপিট করল মহিলা। অজগররাও এভাবে চোখ পিটপিট করে, আক্রমণ করার আগে। ‘বিদায় ডেইজি,’ বলল সে। ‘বিয়ের দিন দেখা হবে।’
হলে উঁকি দিল ডেইজি, পরনে তার এখন কেবল ব্রা আর প্যান্টি। টি-শার্টে গলা ঢোকাচ্ছে। ‘ভালো থাকবেন,’ বলে ঢুকে পড়ল মোটকু চার্লির শোবার ঘরে।
আর একটা কথাও বলল না রোজির মা, মোটকু চার্লির পিছু পিছু নেমে এলো সিঁড়ি বেয়ে। দরজা খুলে ধরল যুবক, ওকে অতিক্রম করার সময় মহিলার চেহারায় ভয়ানক একটা অনুভূতির খেলা দেখতে পেল সে। পেটের ভেতরটা যেন খামচে ধরেছে কেউ; নাহ, খামচে তো আগেই ধরেছিল…এখন সেটা শক্ত হয়েছে আরও: রোজির মায়ের চেহারাটা বিকৃত হয়ে গেছে। ঠোঁটের দুই কোণ বেঁকে গেছে ভূতুড়ে ছোঁয়া নিয়ে। শুধু ঠোঁটঅলা কোনো খুলি হাসলে যেমন দেখাবে, রোজির মায়ের হাসিটাও অবিকল তেমনি দেখাচ্ছে!
দরজা বন্ধ করে, নিচতলার হলেই কেঁপে উঠল বেচারা। তারপর ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানুষের মতো, ধীরে ধীরে ভাঙতে লাগল ওপরে ওঠার সিঁড়ি।
‘কে ছিল মহিলা?’ পোশাক পরা প্রায় শেষ ডেইজির, জানতে চাইল মোটকু চার্লির কাছে।
‘আমার বাগদত্তার মা।’
‘খুব হাসিখুশি মহিলা, তাই না?’ গত রাতে যে পোশাক পরেছিল, সেটাই আবার পরেছে মেয়েটা।
‘এভাবে অফিসে যাবে?’
‘আরে নাহ। আগে বাসায় গিয়ে বদলে নেব। তাছাড়া কাজের সময় আমি এই সাজে থাকি না। ট্যাক্সির ব্যবস্থা করতে পারবে?’
‘যাবে কই?’
‘হেনডন।’
স্থানীয় একটা ট্যাক্সি সার্ভিসে ফোন লাগাল মোটকু চার্লি। তারপর হলওয়ের মেঝেতে বসে বসে ভাবতে লাগল: সকালের এই মোলাকাতের ফলাফল কী হতে পারে? কিন্তু কোনোটাই ওর পছন্দ হলো না।
কেউ একজন পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ‘ব্যাগে ভিটামিন বি-এর কিছু বড়ি আছে,’ জানাল সে। ‘চাইলে চামচে মধু নিয়ে চেটে দেখতে পারো। আমার লাভ হয়নি, কিন্তু যার সঙ্গে থাকি সে কিড়া কেটে বলে—হ্যাংওভার কাটাতে নাকি দারুণ কাজে দেয়।’
‘সমস্যা সেটা না,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘রোজির মাকে বললাম, তুমি আমার কাজিন। নইলে আবার ভেবে বসত যে আমরা… মানে তুমি আর আমি…মানে অদ্ভুত একটা মেয়েকে অপরিচিত কারও ফ্ল্যাটে দেখা গেলে লোকে যা ভাবে আরকি…’
‘কাজিন? বেশ তো, দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আমার কথা বেমালুম ভুলে যাবে মহিলা। আর যদি না যায় তো বলো – রহস্যময় ভাবে আমি দেশ ছেড়েছি। এমনিতেও আমাদের আর কখনও দেখা হবে না।’
‘সত্যি? কথা দিচ্ছ?’
‘এটা এত আনন্দ পাবার মতো কোনো কথা নাকি?’
বাইরে, রাস্তা থেকে ভেসে এলো হর্নের আওয়াজ। ‘ট্যাক্সি বোধহয় এসে পড়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে বিদায় দাও।’
তাই করল মোটকু চার্লি।
‘এত ভেবো না তো,’ বলে ওকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা।
‘জীবনটা বোধহয় ধ্বংস হয়ে গেছে।’
‘আরে নাহ, তা হবে কেন?’
‘আমি শেষ, পুরাই শেষ!’
‘ধন্যবাদ,’ বলে সামনে ঝুঁকল ডেইজি। চুমু খেল মোটকুর চার্লির ঠোঁটে। এতটাই জোরে এবং এতক্ষণ ধরে যে তাকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বলা যাবে না! নিদেনপক্ষে সদ্য পরিচিত দুজন মানুষের জন্য তো একদমই না। তারপর হেসে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে, নিজেই দরজা খুলে পা রাখল বাইরে।
‘এসব,’ মোটকু চার্লি জোরালো কণ্ঠে বলে উঠল দরজা বন্ধ হলে। ‘কল্পনা ছাড়া আর কিচ্ছু না।’
এখনও চুমুটার স্বাদ পাচ্ছে সে ঠোঁটে, রাজবেরি আর কমলার রসসহ। কী অসাধারণ এক চুমু…সেই সঙ্গে কী গভীরও! সেই চুমু এমন একটা অনুভূতির জন্ম দিয়েছে ওর মনে, যা সারা জীবনে আর কারও চুমু দিতে পারেনি। এমনকী সেটা—
‘রোজি,’ আচমকা মনে পড়ে গেছে প্রেমিকার কথা।
ফ্লিপ ফোনটা খুলল সে, স্পিড ডায়ালেই আছে মেয়েটার নম্বর।
‘রোজির ফোন,’ রোজির কণ্ঠ শোনা গেল। ‘আমি ব্যস্ত, আর নয়তো আবার হারিয়ে ফেলেছি ফোনটা। ভয়েস মেইলে আছ তুমি, হয় বাড়ির নম্বরে ফোন করো আর নয়তো মেসেজ রেখে যাও।’
ফোন রেখে দিল মোটকু চার্লি। তারপর ট্রাকস্যুটের ওপর চাপালো কোট। প্রবল সূর্যের আলোর সামনে পড়ে মুখ কুঁচকাল একটু, তারপর পা রাখল রাস্তায়।
.
দুশ্চিন্তায় পড়েছে রোজি নোয়াহ, ব্যাপারটা টের পেয়ে দুশ্চিন্তা আরও বেড়ে গেল বেচারির। রোজির জীবনের অধিকাংশ সমস্যার মতোই, বর্তমান দুশ্চিন্তার কারণ মূলত ওর মা…সেটা নিজের কাছে স্বীকার না করলেও!
মোটকু চার্লি ন্যান্সিকে ও বিয়ে করতে যাচ্ছে, এই ব্যাপারটা যে ওর মায়ের পছন্দ না একদমই—সেটা মোটামুটি মেনে নিয়েছে রোজি। অবশ্য মায়ের একগুঁয়ের মতো এই বিয়ের বিরুদ্ধাচরণ করাটাকে সে ঐশ্বরিক শুভ ইঙ্গিত হিসেবেই ধরে নিয়েছে! যদিও বিয়েটা নিয়ে দ্বিধায় আছে ও নিজেই।
সন্দেহ নেই, ভালোবাসে সে ছেলেটাকে। নিরেট, নির্ভরযোগ্য, বুদ্ধিমান ছেলে মোটকু চার্লি…
বিয়েটা মেনে নিয়ে সাহায্য করতে চেয়েই আসলে রোজিকে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে ওর মা। গত রাতেই মোটকু চার্লিকে ফোন করেছিল ও, ভেবেছিল ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করবে। কিন্তু তোলেনি ছেলেটা, হয়তো আগে আগে ঘুমিয়ে পড়েছে — ধরে নিয়েছিল রোজি।
সেজন্যই লাঞ্চের সময় কথা বলতে চাইছে ব্যাপারটা নিয়ে।
অলডউইচের একটা ধূসর, ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের দালানের একেবারে ওপরের তলায় অবস্থিত গ্রাহাম কোটস এজেন্সি; ছয়টি তলার সিঁড়ির মাথায়। লিফট একটা আছে বটে, তবে বহু প্রাচীন এই লিফট লাগানো হয়েছিল প্রায় একশো বছর আগে, থিয়েটার এজেন্ট রুপার্ট ‘বিনকি’ বাটারওয়ার্থ লাগিয়েছিল। একেবারে ছোটো, ধীর একটা লিফট; যেটা ওঠার সময় কাঁপে প্রবল ভাবে। কেন, সেটা জানতে হলে অবশ্য বিনকি বাটারওয়ার্থের ব্যাপারে জানতে হবে। ছোটোখাটো একটা জলহস্তীর সমান ছিল ভদ্রলোক। লিফটটার নক্সা এমনভাবে করেছে যেন তার সঙ্গে আর মাত্র একজন আঁটে লিফটে: কোরাসে অংশ নেওয়া কোনো পাতলা-সাতলা মেয়ে, কিংবা ছেলে-বিনকির কোনোটাতেই আপত্তি ছিল না। তাকে সন্তুষ্ট করার জন্য একটা বৈশিষ্ট্যই যথেষ্ট ছিল, লিফটে তার সঙ্গে আঁটতে পারলেই হলো। ধীরে ধীরে লিফট ওপরে ওঠায় প্রায়শই দেখা যেত—একদম ওপরের তলায় উঠতে গিয়ে বিনকির অবস্থা এতটাই খারাপ হয়ে যেত যে একটু ঘুমিয়ে নিতে হতো তাকে। তাই সঙ্গী বা সঙ্গিনী চুপচাপ বসে থাকতে হতো ওয়েটিং রুমে, দুশ্চিন্তার সঙ্গে ভাবত—লাল হয়ে যাওয়া চেহারা নিয়ে শেষের তলাগুলো ওঠার সময় হাঁপাতে থাকা বিনকির আবার এম্বোলিজমের সমস্যা দেখা যায়নি তো?
বিনকি বাটারওয়ার্থের সঙ্গে যারা একবার লিফটে চড়ত, তারা এরপর থেকে সিঁড়ি ছাড়া অন্য কিছু ব্যবহার করত না।
গ্রাহাম কোটস, যে বিনকির নাতনির কাছ থেকে বছর বিশেক আগে দ্য বাটারওয়ার্থ এজেন্সি কিনে নেয়, ইতিহাসের অংশ হিসেবে লিফটটাকে ওভাবেই রেখে দিয়েছে।
ভেতরের দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল রোজি, এরপর বাইরের দরজা বন্ধ করে পা রাখল রিসেপশনে। চার্লস ন্যান্সির সঙ্গে দেখা করতে চায়, জানাল রিসেপশনিস্টকে। গ্রাহাম কোটসের অনেকগুলো ছবি ঝোলানো আছে কামরায়, যাদের এজেন্ট হিসেবে সে কাজ করছে বা করেছে তাদের সঙ্গে; ওগুলোর ঠিক নিচে বসল রোজি। মক্কেলদের মাঝে আছে কৌতুকাভিনেতা মরিস লিভিংস্টোন, এককালের বিখ্যাত বয়-ব্যান্ড, এবং একগাদা বিখ্যাত খেলোয়াড় যারা পরবর্তীতে পরিণত হয়েছে ‘ব্যক্তিত্ব’-এ। জীবন থেকে যতটা সম্ভব আনন্দ লুটতে চায় এই ব্যক্তিত্বরা, নতুন একটা যকৃত দরকার হবার আগপর্যন্ত।
রিসেপশনে পা রাখল এক যুবক। তাকে দেখে মোটকু চার্লির মতো লাগছে না, অনেক বেশি রহস্যময়; হাসছে এমনভাবে যেন চারপাশের সবই তাকে আনন্দ দিচ্ছে। ঘন, কিন্তু বিপজ্জনক সেই আনন্দ।
‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি,’ বলল যুবক।
মোটকু চার্লির কাছে হেঁটে গেল রোজি, গালে চুমু খেল ছোট্ট করে। ‘আমি চিনি তোমাকে?’ জিজ্ঞেস করল যুবক। অদ্ভুত বাক্যটা উচ্চারণের পরেই আবার যোগ করল, ‘অবশ্যই চিনি, তুমি রোজি। দিনকে দিন আরও সুন্দর হচ্ছ।’ পালটা চুমু খেল সে, ঠোঁটে ঠোঁট ঠেকিয়ে। ওদের ঠোঁট শুধু স্পর্শ করল একে-অপরকে, কিন্তু তাতেই লাফাতে শুরু করল রোজির হৃদয়…
…লিফটে করে ওপরে ওঠার সময় যেভাবে লাফাত বিনকি বাটারওয়ার্থের হৃৎপিণ্ড।
‘লাঞ্চ,’ কোনোমতে বলল রোজি। ‘পাশ দিয়েই যাচ্ছিলাম। ভাবলাম, হয়তো আমরা কিছু আলোচনা সেরে নিতে পারব।’
‘অবশ্যই,’ যে যুবককে মোটকু চার্লি বলে ভাবছে এখন রোজি, সে বলল। ‘লাঞ্চ।’ রোজির কাঁধে আলগোছে হাত রাখল সে। ‘কোথায় যাবে? ঠিক করেছ?’
‘ওহ,’ বলল মেয়েটা। ‘যেখানে…যেতে চাও।’ এত সুন্দর করে হাসছে, ভাবল রোজি। আগে কেন দেখতে পাইনি সেই সৌন্দর্যটুকু?
‘খাওয়ার জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে,’ বলল যুবক। ‘সিঁড়ি বেয়ে নামবে?’
‘যদি তোমার আপত্তি না থাকে তো,’ বলল রোজি। ‘লিফটেই নামি।’ ভেতরের দরজা বন্ধ করে দিল রোজি, তারপর কাঁপতে কাঁপতে নেমে এলো নিচতলায়; দুজনের দেহ লেগে রইল একে-অন্যের সঙ্গে।
শেষ কবে এত উল্লসিত হয়েছিল, তা মনে পড়ছে না রোজির।
রাস্তায় পা রাখার পর, বিপ শব্দ করে বেজে উঠল রোজির ফোন; জানিয়ে দিল—একটা ফোন কল ধরতে পারেনি সে। কিন্তু যন্ত্রটাকে অগ্রাহ্য করল মেয়েটা।
সামনে প্রথম যে রেস্তোরাঁটা পড়ল, সেটাতেই প্রবেশ করল ওরা। গত মাসেও জায়গাটা হাই-টেক সুসি রেস্তোরাঁ ছিল। একটা কনভেয়ার বেল্ট ছিল ভেতরে, ঘুরে ঘুরে সবাইকে কাঁচা মাছ পরিবেশন করত। তবে জাপানিজ রেস্তোরাঁটা এখন ব্যাবসা গুটিয়ে নিয়েছে। অবশ্য সে জায়গায় আরেকটা রেস্তোরাঁ চালু হতে সময় নেয়নি, লন্ডনে যেমনটা হয় আরকী। এখন ওটা হাঙ্গেরিয়ান রেস্তোরাঁ, কনভেয়ার বেল্টটা রেখে দিয়েছে আগের মতোই; বিশ্বকে হাঙ্গেরিয়ান ধাঁচের খাবারের সঙ্গে আরও সহজে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য। যার ফলে দ্রুত ঠান্ডা হতে শুরু করা গুলাশের পাত্র, প্যাপরিকা, ডাম্পলিং আর তিতকুটে ক্রিম দর্শনীয় ভঙ্গিতে ঘুরছে কামরা জুড়ে।
রোজির মনে হয় না বেশিদিন টিকবে এই রেস্তোরাঁ।
‘গতরাতে কী করছিলে?’ জানতে চাইল মেয়েটা।
‘বাইরে গেছিলাম,’ জবাব দিল যুবক। ‘আমার ভাইয়ের সঙ্গে।’
‘তুমি না একমাত্র সন্তান?’
‘আরে নাহ। কদিন আগে আবিষ্কার করেছি, দুই সন্তানের অর্ধেক আমি।’
‘তাই নাকি? তোমার বাবার কৃতিত্ব?’
‘সোনা,’ মোটকু চার্লি বলে যাকে মেনে নিয়েছে রোজি, সেই যুবকটি বলল। ‘আমার বাবার কৃতিত্বের অর্ধেকটাও জানো না।’
‘হুম,’ বলল মেয়েটা। ‘আশা করি বিয়েতে আসবে তোমার ভাই।’
‘অবশ্যই আসবে, কোনো কিছু দিয়েই আটকে রাখা যাবে না তাকে।’ শক্ত করে রোজির হাত আঁকড়ে ধরল যুবক, এতটাই যে হাত থেকে আরেকটু হলেই গুলাশের চামচ ফেলে দিচ্ছিল মেয়েটা। ‘বিকেলে কী করছ?’
‘তেমন কিছু না। অফিসেও খুব একটা কাজ-কর্ম নেই। কয়েকজনকে ফোন করতে হবে, চাঁদা চাইতে। কিন্তু পরে করলেও হবে। কেন-উম-কিছু- মানে করতে চাও?’
‘কী সুন্দর একটা দিন। হাঁটতে যাবে?’
‘তাহলে তো,’ জবাব দিল রোজি। ‘ভালোই হয়।’
খাওয়া শেষে তীরে চলে এলো ওরা, থেমস নদীর উত্তর দিক ধরে হাঁটতে লাগল ওরা। হাতে-হাত রেখে, ধীরে-সুস্থে, এটা-সেটা নিয়ে কথা বলছে…তবে কোনোটাই তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না।
‘তোমার কাজ নেই?’ আইসক্রিম কেনার জন্য থামলে, জিজ্ঞেস করল রোজি।
‘ওহ,’ জবাব দিল যুবক। ‘না গেলেও অফিসে কেউ কিছু মনে করবে না। আমি যে নেই, সেটাই বোধহয় ধরতে পারবে না কেউ!’
.
এক রকম দৌড়েই মোটকু চার্লি সিঁড়ি ভাঙল গ্রাহাম কোটস এজেন্সির দালানটার। সব সময় সিঁড়ি ধরেই ওঠে সে। কারণ হিসেবে প্রথমেই বলতে হয়—সেটা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। তাছাড়া লিফটে আরেকজনের সঙ্গে আবিষ্কার করতে হয় না নিজেকে; কেউ নেই–এই ভানটাও তখন করতে হয় না।
রিসেপশনে পা রাখার সময় আবিষ্কার করল, খানিকটা হাঁপাচ্ছে। ‘রোজি এসেছিল, অ্যানি?’
‘কেন, হারিয়ে ফেলেছ?’ পালটা প্রশ্ন করল রিসেপশনিস্ট।
জবাব না দিয়ে নিজের অফিসে চলে এলো মোটকু চার্লি, ডেস্কটা সাজানো গোছানোই আছে…অদ্ভুত! তবে কম্পিউটারের পর্দায় দেখা যাচ্ছে একটা হলদে পোস্ট-ইট। ‘দেখা করো আমার সঙ্গে, জিসি’–লেখা আছে ওতে।
গ্রাহাম কোটসের অফিসের দরজায় নক করল সে। ভেতর থেকে এবার ভেসে এলো একটা কণ্ঠ। ‘কে?’
‘আমি,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘ওহ,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘ভেতরে এসো, মাস্টার ন্যান্সি। বসো, বসো। আজ সকালে আমাদের যে আলোচনা হলো, সেটা মনে দাগ কেটে গেছে। বোঝাই যাচ্ছে, তোমাকে বুঝতে আমি ভুল করেছি। এখানে কত দিন হলো কাজ করছ যেন?’
‘প্রায় দুই বছর…’
‘অনেকদিন হলোই কঠোর পরিশ্রম করছ দেখা যাচ্ছে। তার ওপর তোমার বাবা মারা গেলেন…’
‘আমাদের তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না।’
‘আহ, সাহসী মানুষ তুমি, ন্যান্সি। এমনিতেও এখন কাজ-কর্ম নেই। তাই কয়েক হপ্তার ছুটি পেতে কেমন লাগবে? তাও আবার পুরো বেতনসহ।’
‘পুরো বেতন?’ হতবাক হয়ে গেল মোটকু চার্লি।
‘হ্যাঁ, পুরো বেতন। তবে তোমার প্রশ্নটা বুঝতে পারছি। হাতে কিছু টাকা তো থাকতে হবে, খরচ করার জন্য। পারবে না জোগাড় করতে?’
কোন দুনিয়ায় চলে এসেছে, তাই ভাবছে মোটকু চার্লি। ‘আমার চাকরি আছে তো?’
হেসে ফেলল গ্রাহাম কোটস, গলায় হাড় আটকালে নেউলে এভাবে হাসে। ‘একদম না। বরং উলটোটা বলতে পারো,’ জানাল সে। ‘আশা করি এখন আমরা একে-অপরকে ভালোভাবে বুঝতে পারছি। তোমার চাকরি বহাল তবিয়তেই আছে, একদম দালান-বাড়ির মতো নিরাপদ। তবে শর্ত একটাই, এতদিন ধরে যেমন অনুগত ও বাধ্য ভাবে চাকরি করে আসছ, ভবিষ্যতেও তাই করবে আশা করি।’
‘আসলেও কি দালান-বাড়ি নিরাপদ?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি।
‘শতভাগ নিরাপদ।’
‘কোথায় যেন পড়েছিলাম, অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে বাড়িতেই।’
‘তাহলে তো,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘তোমার তো যত দ্রুত সম্ভব বাড়িতে ফেরা উচিত।’ মোটকু চার্লিকে চারকোনা একটা কাগজ এগিয়ে দিল সে। ‘গ্রাহাম কোটস এজেন্সি তোমাকে গত দুই বছর ঐকান্তিক ভাবে কাজ করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছে।’ তারপর, সবসময় কাউকে টাকা দেওয়ার সময় যা বলে, তাই যোগ করল। ‘এক ধাক্কায় খরচ করে ফেলো না সব।’
কাগজটা হাতে নিলো মোটকু চার্লি, আসলে ওটা চেক। ‘দুই হাজার পাউন্ড। হায়, ঈশ্বর! মানে, বলতে চাচ্ছি-করবো না খরচ।’
মোটকু চার্লির দিকে চেয়ে হাসল গ্রাহাম কোটস। সেই হাসিতে হয়তো বিজয় মিশে ছিল; কিন্তু হতবাক, হতচকিত, বিভ্রান্ত মোটকু চার্লির নজরে তা ধরা পড়ল না।
‘যাও তাহলে,’ বলল গ্রাহাম কোটস।
নিজের অফিসে ফিরে এলো মোটকু চার্লি।
দরজার ওপাশ থেকে ঝুঁকে তাকাল গ্রাহাম কোটস, এমনভাবে যেন কোনো নেউলে উঁকি দিচ্ছে সাপের ডেরায়। ‘একটা প্রশ্ন ছিল করার। যেহেতু ছুটিতে যাচ্ছ, নিজেকে উপভোগ করতে—যা করাটা খুবই জরুরি—তখন যদি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েও না পারি, অথচ তোমার ফাইলগুলো দেখতে হয়…তাই কম্পিউটারের পাসওয়ার্ডটা দয়া করে জানাবে?’
‘আপনার নিজের পাসওয়ার্ড দিয়েই তো সিস্টেমের যেকোনো জায়গায় ঢুকতে পারবেন।’
‘তাতে কোনো সন্দেহ নেই,’ গ্রাহাম কোটস সঙ্গে সঙ্গে একমত হলো। ‘তারপরও, যদি দরকার হয়? কম্পিউটারের কথা কি আর কিছু বলা যায়?’
‘মারমেইড,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘এম-ই-আর-এম-আ-আই-ডি।’
‘বেশ,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘বেশ বেশ।’ খলনায়কদের মতো হাতে হাত ঘষল না বটে, তবে ঘষলেও অস্বাভাবিক মনে হতো না।
পকেটে দুই হাজার পাউন্ডের একটা চেক নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামল মোটকু চার্লি, ভাবছে—গত দুই বছর ধরে গ্রাহাম কোটসকে কত ভুল ভেবেছে। রাস্তার মোড়েই ওর ব্যাঙ্ক, অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে দিল টাকাটা। তারপর চলে এলো নদীর ধারে, শ্বাস নিতে… ভাবতে।
এই মুহূর্তে ও আগের চাইতে দুই হাজার পাউন্ড বেশি ধনী। সকাল বেলার মাথাব্যথাটাও এখন আর নেই। নিজেকে ধনী মনে হচ্ছে ওর নিজের কাছেই। রোজিকে বলে ছোট্ট একটা ছুটিতে নিয়ে যেতে পারবে কি না, তাই ভাবল। হাতে সময় বেশি নেই, তারপরেও…
ঠিক তখনই দেখতে পেল সে স্পাইডার আর রোজিকে, রাস্তার অন্য পাশে হাত ধরাধরি করে হাঁটছে ওরা। আইসক্রিম হাতে ধরে আছে রোজি, তবে শেষের দিকে। আচমকা থমকে দাঁড়িয়ে বাকিটুকু ফেলে দিল ময়লার বাক্সে, তারপর স্পাইডারকে টেনে নিলো নিজের দিকে। আইসক্রিমঅলা মুখ নিয়েই, পরম আগ্রহ আর আশ্লেষের সঙ্গে চুমু খেল যুবককে।
মোটকু চার্লি টের পাচ্ছে, ফিরে আসছে মাথাব্যথাটা। কেমন যেন অবশ লাগছে নিজেকে।
ওদেরকে চুমু খেতে দেখল সে। ভাবল: আগে হোক বা পরে, শ্বাস নেওয়ার জন্য হলেও তো থামাতে হবে চুম্বন; কিন্তু না, ওদের তা মনে হচ্ছে বলে মনে হয় না। তাই হতাশ আর বিষণ্ন মোটকু চার্লি হাঁটতে শুরু করল অন্য দিকে। টিউবের কাছে পৌঁছুবার আগে থামল না।
ফিরে এলো বাড়িতে।
যতক্ষণে ফিরতে পারল, ততক্ষণে মোটকু চার্লির অবস্থা এতটাই খারাপ যে শুয়ে পড়ল সে বিছানায়; যে বিছানা থেকে এখনও ডেইজির হালকা গন্ধ ভেসে আসছে। বন্ধ করে ফেলল চোখ।
.
বয়ে যেতে লাগল সময়। মোটকু চার্লি নিজেকে আবিষ্কার করল একটা বালুময় সৈকতে, পাশেই ওর বাবা। খালি পায়ে হাঁটছে উভয়ে, বাচ্চা বনে গেছে মোটকু চার্লি। কিন্তু ওর বাবা?
বয়সের কোনো ছাপ নেই তার চেহারায়।
তো, বলছে ওর বাবা। স্পাইডারের সঙ্গে দিন কেমন কাটছে?
স্বপ্ন দেখছি, জবাবে বলল মোটকু চার্লি। তাছাড়া আমি এই ব্যাপারে কথা বলতে চাই না।
হায় রে, বলল ওর বাবা, মাথা নাড়তে নাড়তে। শোনো, তোমাকে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলার আছে।
কী?
কিন্তু জবাব দিল না ওর বাবা। ঢেউয়ের মাথায় এমন কিছু একটা আছে, যা তার নজর কেড়ে নিয়েছে। উবু হয়ে সেটা তুলে নিল লোকটা। সুচালো পাঁচটা পা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।
স্টারফিশ, বলল ওর বাবা। দ্বিখণ্ডিত করলে, একটা থেকে দুটো হয়ে যায়।
আমাকে না তোমার কী গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল?
বুক খামচে ধরল ওর বাবা, পরক্ষণেই পড়ে গেল বালুতে। বমি করতে শুরু করল। বালুর ভেতর থেকে কীটপতঙ্গ বেরিয়ে এসে কয়েক মুহূর্তের মাঝে গিলে ফেলল তাকে, হাড় বাদে কিছুই অবশিষ্ট রইল না।
বাবা?
ঝট করে উঠে বসল মোটকু চার্লি, ঘুম ভেঙে গেছে; গালে পেল অশ্রুর স্পর্শ। কান্না বন্ধ করে দিল সে। মন খারাপ করার কোনো কারণই নেই। ওর বাবা এই মাত্র মারা যায়নি; স্বপ্ন দেখেছে শুধু।
সিদ্ধান্ত নিলো, রোজিকে আগামীকাল রাতে দাওয়াত দেবে। দুজনে মিলে স্টেক খাবে ওরা, রান্না করবে সে-ই। সব ঠিক হয়ে যাবে।
উঠে, পোশাক পরে নিলো মোটকু চার্লি।
মিনিট বিশেক পর রান্নাঘরে দেখা গেল তাকে, নুডলস খাচ্ছে। ঠিক তখনই মনে এলো কথাটা: খানিক আগে সৈকতে ওর বাবাকে মরতে দেখাটা দুঃস্বপ্নে হলেও, ওর বাবা সত্যি সত্যিই মারা গেছে!
.
সেদিন বিকেলে উইম্পোল স্ট্রিটে, মায়ের ফ্ল্যাটে পা রাখল রোজি।
‘আজ তোমার প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে গেছিলাম,’ বলল মিসেস নোয়াহ। তার ডাক নাম ইউথেরিয়া, কিন্তু গত তিন দশকে স্বামী বাদে আর কেউ ওকে এই নামে ডাকেনি। ভদ্রলোকের মৃত্যুর পর, নামটা যেন শুকাতে শুকাতে মিলিয়ে গেছে পুরোপুরি।
সম্ভবত ইহজীবনে এই নামটা আর অন্য কারও মুখে শোনা হবে না।
‘আমিও দেখা করেছি,’ জানাল রোজি। ‘ঈশ্বর, এত ভালোবাসি আমি ওকে!’
‘তা তো বটেই। হাজার হলেও বিয়ে করছ, তাই না?’
‘হ্যাঁ। মানে, সবসময়ই জানতাম যে ওকে ভালোবাসি। কিন্তু আজ পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম, কতটা ভালোবাসি আসলে। ওর সবকিছুই আমার ভালো লাগে।’
‘গত রাতে কই ছিল, জানতে পেরেছ?’
‘হ্যাঁ। ব্যাখ্যা করে শুনিয়েছে। ভাইয়ের সঙ্গে বাইরে গেছিল।’
‘ওর যে ভাই আছে, সেটাই তো জানতাম না।’
‘আগে ভাইটার কথা বলেনি কখনও, ঘনিষ্ঠতা বেশি ছিল না।’
ঠোঁট দিয়ে আওয়াজ করল রোজির মা। ‘পারিবারিক সম্মেলন চলছে বোধহয়। আত্মীয়ের কথা বলেছে তো?’
‘আত্মীয়?’
‘অথবা বোনও হতে পারে। মোটকু চার্লিকেও বিভ্রান্ত মনে হলো। দেখতে ভালোই, তবে একটু উচ্ছৃঙ্খল টাইপের। চাইনিজ মনে হলো আমার কাছে। যাই হোক, এই হলো তার পুরো পরিবার।’
‘মা, ওর পরিবারের সঙ্গে তোমার দেখাই হয়নি!’
‘কাজিনের সঙ্গে দেখা তো হয়েছে। আজ সকালে মেয়েটাকে রান্নাঘরে দেখেছিলাম। প্রায় ন্যাংটো হয়ে বাড়িজুড়ে ঘোরাফেরা করছিল। নির্লজ্জ কোথাকার, কাজিন হলেও এভাবে কেউ হাঁটা-চলা করে?’
‘মোটকু চার্লি মিথ্যে বলবে না আমাকে।’
‘ও পুরুষ তো, নাকি?’
‘মা!’
‘কাজে যায়নি কেন আজ, সেই প্রশ্নের জবাব দাও।’
‘গেছিল তো কাজে। একসঙ্গে লাঞ্চও করলাম।’
ছোট্ট আয়না বের করে তাতে নিজের লিপস্টিকের অবস্থা দেখে নিলো রোজির মা, তর্জনী ব্যবহার করে দাঁত থেকে মুছে ফেলল লালচে দাগ।
‘কী বলেছ ওকে?’ জিজ্ঞেস করল রোজি।
‘বিয়ে নিয়ে কিছু কথা হলো। জানিয়ে দিলাম, ওর নিতবর আজে-বাজে কথা বলুক, সেটা চাই না। আমার তো মনে হলো, মদ খেয়ে খারাপ অবস্থা বেচারার। আগে থেকেই তো বলে আসছি তোমাকে, মাতালকে বিয়ে কোরো না।’
‘আমার সঙ্গে যখন দেখা হলো, তখন তো ভালোই দেখাচ্ছিল।’ সাফ জানিয়ে দিল রোজি। তারপর যোগ করল, ‘ওহ মা, আজকের দিনটা এমন কেটেছে আর কী বলব…আমরা হেঁটেছি, গল্প করেছি—ওর গায়ের গন্ধ কী অসাধারণ, সেটা বলেছি আগে? হাতটাও নরম।’
‘গন্ধ তো আমার নাকেও এসেছে,’ ওর মা বলল। ‘মাছের গন্ধ। পরেরবার যখন দেখা হবে, তখন ওর এই আত্মীয়ার কথা জানতে চেয়ো। বলছি না যে ওরা আত্মীয়, আবার এটাও বলছি না যে আত্মীয় না। যদি হয় তাহলে ধরে নিতে হবে: ওর পরিবারে পতিতা আর স্ট্রিপার আছে। এমন মানুষের সঙ্গে মন দেওয়া-নেওয়া উচিত না।’
স্বস্তি পেল রোজি, যেহেতু মোটকু চার্লিকে আবার উলটো-পালটা বলতে শুরু করেছে ওর মা। ‘মা, আর একটাও বাজে কথা বলবে না।’
‘ঠিক আছে, মুখে খিল লাগালাম। আমি তো আর বিয়ে করছি না, জীবনকে নিজ হাতে নষ্টও করছি না। তাছাড়া সারা রাত যখন রক্ষিতা নিয়ে মদ খেয়ে ফূর্তি করবে লোকটা, তখন যে বালিশে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবে, সে-ও আমি হবো না। দিনের পর দিন আর রাতের পর রাত তার জেল থেকে ছাড়া পাবার অপেক্ষর প্রহর আমাকে গুণতে হবে না।’
‘মা!’ কড়া কণ্ঠে ধমক দিতে চাইল রোজি। কিন্তু মোটকু চার্লি জেলে যাবে, এই ধারণাটাই এতটা হাস্যকর যে আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও হেসে ফেলতে বাধ্য হলো।
বেজে উঠল ওর ফোন, সেটা কানে ধরল মেয়েটা। ‘হ্যাঁ,’ বলল সে। ‘বেশ তো, দারুণ হবে।’ ফোন রেখে দিল তারপর।
‘ও-ই ফোন করেছে,’ মাকে জানাল মেয়েটা। ‘কাল রাতে যাচ্ছি ওর বাড়িতে, আমার জন্য রান্না করবে বলেছে। কী মিষ্টি, তাই না?’ যোগ করল সেই সঙ্গে। ‘জেলখানায়…চার্লি? হাস্যকর!’
‘আমি তোমার মা,’ বলল ওর মা, নিজের খাবারবিহীন ফ্ল্যাটে দাঁড়িয়ে যেখানে ধুলোও পড়ার সাহস করে না। ‘যা জানি, তা জানি।’
.
অফিসে বসে আছে গ্রাহাম কোটস, দিন এগিয়ে যাচ্ছে সূর্যাস্তের দিকে। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে কম্পিউটারের পর্দার দিকে। একটার পর একটা ডকুমেন্ট, স্প্রেডশিট খুলছে সে। কয়েকটায় কাজ করল, অধিকাংশই মুছে ফেলল।
সেই সন্ধ্যাতেই বার্মিংহ্যামে যাবার কথা ছিল ওর। এক প্রাক্তন ফুটবলার, ওর মক্কেল, ওখানে একটা নাইটক্লাব খুলতে চায়। ফোন করে ক্ষমা চাইল গ্রাহাম কোটস: কিছু কিছু ঘটনা এমন ঘটে যায়, যা এড়ানো যায় না।
খানিকক্ষণের মাঝেই সূর্যের আলো পুরোপুরি বিদেয় নিলো দুনিয়ার বুক থেকে। কম্পিউটারের পর্দা থেকে ভেসে আসা ঠান্ডা আভায় বসে রইল গ্রাহাম কোটস। ঠিক বসে রইল বলা যাবে না। কেননা হাত চলছে তার; বদলাচ্ছে, নতুন করে লিখছে…মুছে ফেলছে ফাইল।
.
আনানসিকে নিয়ে প্রচলিত আরেকটা গল্প শোনাই আপনাদের।
অনেক, অনেক দিন আগে, আনানসির স্ত্রী লাগিয়েছিল মটরশুঁটির খেত। এমন দারুণ, মোটা আর সবুজ মটরশুঁটি আগে কেউ কখনও দেখেনি! আপনি দেখলেই আবিষ্কার করতেন, জিভ থেকে জল ঝরছে!
খেতের মটরের ওপর প্রথম যেদিন নজর পড়ল আনানসির, সেদিন থেকেই ওগুলো খাওয়ার লোভ ঢুকে পড়ল মনে। কয়েক মুঠো দিয়ে কিন্তু মন ভরবে না ওর, বিশাল খিদে আনানসির। ওগুলোর ভাগ আর কাউকে দেওয়ারও ইচ্ছে নেই তার, সব একাই খেতে চায়!
তাই বিছানায় শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, এত জোরে আর এতক্ষণ ধরে যে তা শুনতে পেয়ে ছুটে এলো ওর স্ত্রী আর সব ছেলেরা। ‘আমি মরে যাচ্ছি,’ বলল আনানসি ওদের, একেবারে ক্ষীণ আর দুর্বল কণ্ঠে। ‘এসে পড়েছি জীবনের সায়াহ্নে।’
কথা শুনেই কান্না জুড়ে দিল আনানসির স্ত্রী-ছেলেরা।
সেই একই ক্ষীণ-দুর্বল কন্ঠে আনানসি আবার বলল, ‘মৃত্যুশয্যায় চাই, তোমরা আমার কাছে দুটো বিষয়ে প্রতিজ্ঞা করবে।’
‘যা চাইবে, যেমন চাইবে আর যেভাবে চাইবে…তাই হবে।’ স্ত্রী আর ছেলেরা জবাব দিল।
‘প্রথমত: কথা দাও আমাকে কবর দেবে ওই বড়ো, ব্রেডফ্রুট[১৫] গাছের নিচে।’
[১৫. কাঁঠালের মতো এক ধরনের ফল, আকারে তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র।]
‘মটরশুঁটির খেতের পাশে যে বড়ো গাছটা, ওটার কথাই বলছ তো?’ জানতে চাইল ওর স্ত্রী।
‘হ্যাঁ, আর কোথাও ওই গাছ আছে?’ পালটা প্রশ্ন আনানসির।
তারপর, কণ্ঠ একই রকম দুর্বল রেখেই যোগ করল, ‘আরেকটা কথা দিতে হবে আমাকে। কথা দাও: আমার স্মৃতির উদ্দেশ্যে, আমার কবরের পায়ের কাছে ছোট্ট করে আগুন জ্বালাবে। আমাকে ভুলে যাওনি প্রমাণ করার জন্য, ওই আগুনটাকে নিভতে দেবে না।’
‘অবশ্যই! অবশ্যই!’ বিলাপ করার ফাঁকে বলল আনানসির স্ত্রী ও ছেলেরা।
‘সেই আগুনে, তোমাদের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ, চড়াবে একটা ছোট্ট পাত্র; তাতে ভরবে লবণ-পানি। আমার মৃত্যুশয্যায় তোমরা যে উষ্ণ অশ্রু বিসর্জন করেছ, সেটার স্মৃতির উদ্দেশ্যে।’
‘অবশ্যই! অবশ্যই!’ কান্না থামল না আনানসির স্ত্রী-পুত্রদের। তারপর, দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা আনানসি, মুদল চোখ…
…তারপর আর শ্বাস নিলো না সে।
এরপর আরকী? আনানসির দেহ বয়ে নিয়ে যাওয়া হলো মটরশুঁটির খেতের পাশের ব্রেডফ্লুট গাছের নিচে। ছয় ফুট মাটির নিচে কবর দেওয়া হলো তাকে, পায়ের কাছে জ্বালানো হলো একটা ছোট্ট আগুন। তার পাশে রেখে দেওয়া হলো একটা পাত্র, তাতে ঢালা হলো লবণ-পানি।
সারাদিন ঘাপটি মেরে কবরে শুয়ে রইল আনানসি। রাত নামলে বেরিয়ে এলো কবর থেকে। খেতে গিয়ে সবচাইতে মোটা, মিষ্টি আর পাকাগুলো তুলল খুঁজে খুঁজে। তারপর ওগুলোকে ফেলে দিল পাত্রে, সিদ্ধ হওয়ার জন্য। পেট ফুলে যাবার আগপর্যন্ত খেয়ে চলল সে, অচিরেই দেখা গেল— ড্রামের মতো হয়ে গেছে তার শরীর।
তারপর, ভোরের আগে-আগে, ফিরে গেল আবার কবরে। ঘুমিয়ে পড়ল ভরা পেট নিয়ে। সকাল বেলা যখন ওর স্ত্রী-পুত্র আবিষ্কার করল খেত থেকে মটরশুঁটি উধাও হয়ে গেছে, তখন সে গভীর ঘুমে। পাত্রে পানি নেই দেখে, সেটায় আবার লবণ-পানি ঢালল ওরা; বিলাপ করল। আনানসির তবুও ঘুম ডাঙল না।
প্রত্যেক রাতেই কবর থেকে চুরি করে বেরোল আনানসি। নিজের বুদ্ধিতে মুগ্ধ হয়ে নিজেই নাচছে, আর মজা পাচ্ছে। প্রত্যেক রাতে মটরশুঁটি দিয়ে পাত্র ভরে, সিদ্ধ করে পেটে পুড়ে খেল। আর একটা মটরেরও জায়গা হবে না পেটে, সেই অবস্থা হওয়ার আগে থামল না।
দিন বয়ে যেতে লাগল, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শুকাতে লাগল আনানসির পরিবার। কেননা পাকা সব মটরই তো রাতে তুলে ফেলে আনানসি! তাই খাওয়ার মতো আর কিছুই পায় না বেচারারা।
আনানসির স্ত্রী তাকাল তাদের সামনে থাকা খালি খালার দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেদেরকে বলল, ‘তোমার বাবা বেঁচে থাকলে এখন কী করত?
ছেলেরা ভাবল আর ডাবল। আনানসি তাদেরকে যত গল্প শুনিয়েছে, সব মনে করতে চাইল তারা। তারপর চলে গেল আলকাতরা যেখানে বিক্রি হয়, সেখানে। নিজেদের জন্য ছয় পেনি দামের আলকাতরা কিনল, চারটা বালতি ভরার জন্য যা যথেষ্ট। তারপর সেই বালতি ভরতি আলকাতরা নিয়ে ফিরে এলো মটরশুঁটির খেতের কাছে। ঠিক মাঝখানে একটা নকল মানুষ বানালো সবাই মিলে। ওটার চেহারা আলকাতরার, আলকাতরার চোখ, আলকাতরা হাত-বুক- আঙুল। দারুণ হলো তাদের কাজ, নিখাঁদ কালো মূর্তিটা দেখে মনে হলো যেন খোদ আনানসি দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।
সে রাতে, বুড়ো আনানসি, বেরিয়ে এলো কবর থেকে। জীবনে আগে কখনও এত মোটা ছিল না সে, পেট ফুলে ঢোল হয়ে আছে। নাচতে নাচতে এগিয়ে গেল মটরশুঁটির খেতের দিকে।
‘কে তুমি?’ জিজ্ঞেস করল আলকাতরা মানবকে।
কিন্তু আলকাতরা মানব সেই প্রশ্নের জবাব দিল না।
‘এটা আমার সম্পত্তি,’ আলকাতরা মানবকে বলল আনানসি। এই খেতও আমার। তুমি ভাগো, নইলে বলে দিচ্ছি— কপালে খারাবি আছে।’
আলকাতরা মানব কিছু বলল না, এমনকী একটা পেশিও নাড়ল না।
‘দুনিয়ায় যা কিছু আছে, আসবে বা এসেছিল… সবার চাইতে আমি বেশি শক্তিশালী, বেশি পরাক্রমশালী, সবচাইতে সাহসী, আলকাতরা-মানবকে বলল আনানসি। ‘আমি সিংহের চাইতে তেজি, চিতার চাইতে দ্রুত, হাতির চাইতে শক্তিশালী, হয়তো বাঘের চাইতেও ভয়ানক।’ নিজের তেজ, গতি, শক্তির গর্বে ফুলে উঠল তার বুক। ভুলেই গেল, আসলে ও ছোট্ট একটা মাকড়শা। ‘কাঁপো, হুঙ্কার ছাড়ল সে। ‘ভয়ে কেঁপে উঠে পালাও।
আলকাতরা-মানব, না ভয়ে কাঁপল; আর না পালাতে শুরু করল। সত্যি কথা বলতে কী, জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল কেবল।
তাই সরাসরি তাকে ঘুসি মারল আনানসি।
কিন্তু ওর হাত ডেবে গেল আলকাতরায়, গেল আটকে।
‘ছাড়, ছাড় আমার হাত, আলকাতরা মানবকে বলল সে। ‘হাত ছেড়ে দে, নইলে পরের ঘুসিটা মুখে বসাবো।’
আলকাতরা-মানবের মুখে এখনও কোনো কথা নেই। এমনকী ছোট্ট একটা পেশিও নড়ালো না। আনানসি এবার সরাসরি ওর মুখে ঘুসি বসালো।
‘অনেক হয়েছে,’ বলল আনানসি। ‘অনেক হয়েছে ঠাট্টা। আমার হাত ধরে রাখতে চাও? রাখো। কিন্তু আরও চারটা হাত আছে আমার, আছে কর্মক্ষম দুটো পা। সবগুলো তো আর ধরতে পারবে না। ছেড়ে দাও, আমিও দয়া দেখাব।’
আলকাতরা মানব হাত ছাড়ল না, মুখেও কিছু বলল না। তাই একে- একে সবগুলো হাত দিয়ে ঘুসি মারল আনানসি, তারপর পা দিয়ে মারল লাখি।
‘হয় আমাকে যেতে দাও’ বলল আনানসি। নইলে কামড়ে দিব।’
ততক্ষণে আলকাতরায় ভরে গেছে ওর মুখ, নাক-কান, চেহারা!
পরেরদিন সকালে স্ত্রী-পুত্ররা ওভাবেই পেল আনানসিকে, মটরশুঁটির খেত আর ব্রেডফ্রুটের গাছের অবস্থা দেখতে এসে। আলকাতরা-মানব একেবারে আঁকড়ে ধরে আছে ওকে। এবার আসলেই মারা গেছে।
ওই অবস্থায় আনানসিকে আবিষ্কার করে অবাক হলো না তারা।
আগেরকার দিনে, আনানসিকে নিয়ে এমন অনেক গল্প প্রচলিত ছিল।
অধ্যায় ছয় – যে অধ্যায়ে মোটকু চার্লি ঘরে ফিরতে ব্যর্থ হয়, এমনকী ট্যাক্সি নেওয়ার পরেও
অধ্যায় ছয় – যে অধ্যায়ে মোটকু চার্লি ঘরে ফিরতে ব্যর্থ হয়, এমনকী ট্যাক্সি নেওয়ার পরেও
অ্যালার্মের শব্দ শুনে ঘুম ভাঙল ডেইজির। বিড়ালের মতো ভঙ্গিমায় আড়মোড়া ভাঙল সে। বাথরুম থেকে শাওয়ার চলার আওয়াজ ভেসে আসছে, তার মানে—উঠে পড়েছে ওর ফ্ল্যাটমেট। গোলাপি একটা আঁশ-আঁশ গাউন পরে পা রাখল হলে।
‘পরিজ খাবে?’ বাথরুমের দরজার ফাঁক দিয়েই জানতে চাইল ও।
‘ইচ্ছা তো নেই। কিন্তু তুমি যদি বানাও, তাহলে খাবো।’
‘মেয়েমানুষের দাম কীভাবে বাড়িয়ে দিতে হয়, তা তো ভালোই জানো!’ বলল ডেইজি। কিচেনেটের কাছে গিয়ে রান্না করার জন্য পরিজ রাখল তার ওপরে।
তারপর ফিরে এলো শোবার ঘরে, পরে নিলো কাজে যাওয়ার পোশাক। আয়নায় দেখল নিজেকে, ভেঙচি কাটল নিজেকেই। চুল খোপা করে বাঁধল মাথার পেছনে।
ওর ফ্ল্যাটমেট, ক্যারোল, প্রেসটন থেকে এসেছে। সরু চেহারার মেয়েটা মাথা ঢোকাল শোবার ঘরে; জোরেশোরে মুছছে মাথার চুল। ‘বাথরুমের সবটাই এখন তোমার। পরিজের কী অবস্থা?’
‘এক-আধবার নেড়ে দিলেই হয়ে যাবে।’
‘কয়েক রাত আগে ছিলে কই? বলেছিলে, ফূর্তি করতে সিবিলার জন্মদিনের পার্টিতে যাচ্ছ। কিন্তু রাতে যে ফেরোনি, সেটা জানি।’
‘নিজের চরকায় তেল দিন, জনাবা।’ রান্নাঘরে প্রবেশ করে পরিজের পাত্র নেড়ে দিল ডেইজি। এক চিমটি লবণ ঢেলে আবার নাড়ল খানিকক্ষণ। তারপর দুটো পাত্রে পরিজ ঢেলে, কাউন্টারে রাখল।
‘ক্যারোল? ঠান্ডা হয়ে যাবে তো।’
ডাক শুনে চলে এলো ক্যারল, তাকাল খাবারের দিকে। পোশাক পুরোপুরি পরেনি এখনও। ‘নাস্তা হিসেবে আদর্শ বলা যায় না, তাই না? আমার মতে আদর্শ নাস্তা হলো—ডিম ভাজা, সসেজ, কালো পুডিং আর গ্রিলড টমেটো।’
‘তুমি রাঁধো,’ জানাল ডেইজি। ‘আমি আনন্দের সঙ্গেই খাবো।’
পরিজের ওপর বলতে গেলে ইচ্ছেমতো চিনি ঢালল ক্যারোল। পাত্রের দিকে তাকিয়ে, তারপর যোগ করল আরেক চামচ চিনি। ‘তা খাবে না। বলছ বটে, কিন্তু খাওয়ার আগেই কোলেস্টেরলের অজুহাত দিয়ে পিছিয়ে যাবে; হয়তো বলবে, ভাজা খাবার খেয়ে তোমার কিডনির কী হাল হয়েছে!’ এমনভাবে পরিজের স্বাদ নিলো মেয়েটা, যেন পালটা ওকেই কামড় দিয়ে বসবে পাত্রের খাবার। একটা কাপে চা ঢেলে ওর দিকে বাড়িয়ে দিল ডেইজি। ‘তুমি আর তোমার কিডনি। অবশ্য ওটার তরকারি পেলেও মন্দ হতো না, মুখের স্বাদ বদলানো যেত। কখনও কিডনি খেয়েছ, ডেইজি?’
‘একবার,’ জানাল ডেইজি। ‘আমার তো মনে হয়, আধ পাউন্ড কলিজাকে গ্রিল করে, তাতে পেশাব করে দিলে একই স্বাদ পাওয়া যাবে!’
নাক টানল ক্যারোল। ‘বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?’
‘পরিজ গেলো।’
নাস্তা শেষে যার যার পাত্র ডিশওয়াশারে ভরে রাখল ওরা। কিন্তু এখনও ময়লা পাত্র দিয়ে যন্ত্রটা ভরে ওঠেনি বলে, চালু হলো না। এরপর কাজে বেরিয়ে গেল ওরা। ক্যারোল, নতুন ইউনিফর্ম পরে, গাড়ি চালাতে শুরু করল।
ডেস্কের কাছে গিয়ে দাঁড়াল ডেইজি, কামরার অধিকাংশ ডেস্কই খালি।
কিন্তু চেয়ারে বসার আগেই বেজে উঠল ফোন। ‘ডেইজি, চলে এসেছ?’
ঘড়ির দিকে তাকাল মেয়েটা। ‘না,’ বলল সে। ‘এখনও আসিনি, স্যার।
তা আজ এই সুন্দর সকালে আপনার জন্য কিছু করতে পারি?’
‘অবশ্যই পারো। কোটস নামের এক ভদ্রলোককে ফোন করতে পারো, তিনি আবার পুলিস সুপারের বন্ধু মানুষ; ক্রিস্টাল প্যালেসের আরেক সমর্থক। সকাল থেকে এরই মাঝে বার দুয়েক মেসেজ পাঠানো শেষ! আমি জানতে চাই, পুলিস সুপারকে মেসেজ পাঠানো শেখালোটা কে?’
বিস্তারিত বিবরণ টুকে নিলো ডেইজি, তারপর ফোন করল নম্বর ঘুরিয়ে। দক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব কণ্ঠে ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডে বলছি, কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
‘আহ,’ ওপাশ থেকে পুরুষ কণ্ঠে জবাব এলো। ‘গত রাতে চিফ সুপারিন্টেনডেন্টের সঙ্গে কথা বলছিলাম, অনেক দিনের পুরনো বন্ধু আমরা; ভালো একজন মানুষ। সে-ই বলল আপনাদের অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। একটা রিপোর্ট লেখাতে চাই। সত্যি বলতে কী, আমি আসলে নিশ্চিত নই যে কোনো অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। হয়তো যে কারণে রিপোর্ট করতে চাইছি, তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ আছে। কিছু গোঁজামিল ধরা পরেছে আমার দৃষ্টিতে। এদিকে আমার হিসেবরক্ষক…বলেই দিই আপনাকে, কয়েক হপ্তার ছুটিতে আছে সে। আছে বলতে, আমিই দিয়েছি। বুঝতে চাইছি, আসলেই কোনো গোলমাল করেছে নাকি লোকটা… মানে আমার আর্থিক লেনদেন সংক্রান্ত ব্যাপারে।’
‘আগে আমাদের বিস্তারিত নাম-পরিচয় জানান। আপনার পুরো নাম কী, স্যার? আর আপনার হিসাবরক্ষকের নাম?
‘আমার নাম গ্রাহাম কোটস, ওপাশ থেকে জবাব এলো। ‘গ্রাহাম কোটস এজেন্সির মালিক। আর আমার হিসেবরক্ষকের নাম ন্যান্সি, চার্লস ন্যান্সি।’
দুটো নামই লিখে রাখল মেয়েটা, একটাও পরিচিত ঠেকল না।
.
স্পাইডার ঘরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে হিসেব-নিকেশ চুকিয়ে দেবার ইচ্ছা ছিল মোটকু চার্লির। মাথার ভেতরে বহুবার যুক্তি সাজিয়েছে। প্রত্যেকবার জয় ওরই হয়েছে, প্র ত্যে-ক-টা বা-র।
কিন্তু স্পাইডার যে গত রাতে বাসাতেই ফেরেনি! টেলিভিশন দেখতে দেখতে অবশেষে ঘুমিয়ে পড়ে মোটকু চার্লি। ঘুম থেকে উঠেও নিজেকে আবিষ্কার করে সোফাতেই। তবে ঘুম ভাঙে স্পাইডার পর্দা সরালে। ‘দারুণ একটা দিন,’ জানাল স্পাইডার।
‘তুমি!’ বলল মোটকু চার্লি। ‘গতকাল রোজিকে চুমু খাচ্ছিলে। অস্বীকার করার চেষ্টাও কোরো না!’
‘বাধ্য হয়েছি বলতে পারো,’ জানাল স্পাইডার।
‘বাধ্য হয়েছ মানে? চুমু খেতে কেউ কীভাবে বাধ্য হয়?’
‘মেয়েটা ভেবেছিল, আমি আসলে তুমি।’
‘তা ভাবুক। কিন্তু তুমি তো জানতে যে তুমি আসলে আমি না! চুমু খেয়ে ঠিক করোনি।’
‘কিন্তু যদি অস্বীকার করতাম, তাহলে মেয়েটা ধরেই নিত যে তুমি ওকে চুমু খেতে চাচ্ছ না!’
‘কিন্তু ওটা তো আমি ছিলামই না।’
‘মেয়েটা তো আর তা জানত না। আমি শুধু তোমাকে সাহায্য করতে চাচ্ছিলাম।’
‘সাহায্য করতে চাচ্ছিলে?’ সোফায় বসা মোটকু চার্লি বলল। ‘সাধারণ কেউ কাউকে সাহায্য করতে চাইলে, তার প্রেমিকাকে চুমু খায় না। দাঁতে ব্যথার কথা বলে এড়াতে পারতে।’
‘তাহলে তো,’ নিষ্পাপ ভঙ্গিতে বলল স্পাইডার। ‘মিথ্যে বলা হতো।’
‘মিথ্যা তো আগে থেকেই বলছিলে! আমার চরিত্রে অভিনয় করছিলে তুমি!’
‘মিথ্যেটাকে আরও জটিল করা হতো তাতে,’ ব্যাখ্যা করে শোনাল স্পাইডার। ‘যেহেতু তোমার অফিসে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না, তাই আমাকে কাজটা করতে হয়েছে। আর না,’ সাফ জানিয়ে দিল সে। ‘আরেকটা মিথ্যে বলা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। খুব খারাপ লাগত তাহলে।’
‘কিন্তু…রোজিকে তোমার চুমু খাওয়ার দৃশ্য দেখে আমারও তো খারাপ লাগছিল, তাই না?’
‘আহ,’ বলল স্পাইডার। ‘কিন্তু সে ভাবছিল যে তোমাকে চুমু খাচ্ছে!’
‘বারবার একই কথা বোলো না তো!’
‘তোমার তো উলটো ভালো বোধ করার কথা ছিল,’ জানাল স্পাইডার।
‘লাঞ্চ খাবে?’
‘না, খাবো না। কটা বাজে?’
‘দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে,’ জানাল স্পাইডার। ‘তুমি আজকেও দেরি করে ফেলবে কাজে যেতে। কিন্তু তোমার ঝামেলা সমাধান করার বদলায় যদি এই রকমের ধন্যবাদ কপালে জোটে, তাহলে আমার সাহায্যের আশা বাদ দিতে পারো।’
‘অসুবিধে নেই,’ মোটকু চার্লি বলল। ‘দুই হপ্তার ছুটি পেয়েছি, বোনাসসহ।’
ভ্রু কুঁচকে গেল স্পাইডারের।
‘দেখো,’ বলল মোটকু চার্লি, আরেকবার ঝগড়া করার সময় হয়েছে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমি আসলে তোমাকে তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছি না; তবে কৌতূহল হচ্ছিল আরকি। যাবে কবে?’
জবাব দিল স্পাইডার। ‘যখন এসেছিলাম, তখন তো ইচ্ছে ছিল এক দিন থেকেই চলে যাবো। বড়োজোর দুই দিন। ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করেই, আবার নামবো পথে। হাজার হলেও, আমি ব্যস্ত মানুষ।’
‘তাহলে কি আজই চলে যাবে?’
‘পরিকল্পনা তো সেটাই ছিল,’ জানাল স্পাইডার। ‘কিন্তু তারপর দেখা হলো তোমার সঙ্গে। বিশ্বাসই হতে চাইছে না যে প্রায় পুরো একটা জীবন কাটিয়ে দিলাম আমরা একে-অন্যের সঙ্গে সময় না কাটিয়ে!’
‘আমার হচ্ছে।’
‘রক্তের বন্ধন বলে কথা,’ স্পাইডার বলল। ‘পানির চেয়ে অনেক কড়া।’
‘পানি তো কড়া না।’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি।
‘তাহলে ভদকার চেয়ে কড়া, কিংবা আগ্নেয়গিরির চাইতে…আর নয়তো অ্যামোনিয়ার চেয়ে। দেখো, আমি বলতে চাচ্ছি—ব্যাপারটাকে আমি আশীর্বাদ হিসেবে নিয়েছি। আমরা আগে একে-অন্যের জীবনের অংশ ছিলাম না, কিন্তু সে অতীতের কথা। চলো, আজ থেকেই নতুন একটা ভবিষ্যৎ লিখি। গতকালকে পেছনে রেখে, আমরা নতুন বন্ধন গড়ে তুলি—ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।
‘তুমি রোজিকে পটাতে চাচ্ছিলে,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘তাতে কোনো সন্দেহ নেই,’ একমত হলো স্পাইডার। ‘কিন্তু তুমি এখন কী করবে?’
‘কী করব? কিছু করার দরকার আছে? আমার বাগদত্তা সে।’
‘কিচ্ছু ভেবো না, ওর ধারণা—আমি তো আসলে তুমিই।’
‘ওই কথাটা বলা বন্ধ করবে?’
সন্তের ভঙ্গিতে হাত নাড়াল স্পাইডার, কিন্তু তারপরেই ঠোঁট চেটে নষ্ট করে ফেলল আবহ।
‘তাহলে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘এখন কী করবে? আমার চরিত্রে অভিনয় করতে করতেই বিয়ে করে ফেলবে ওকে?’
‘বিয়ে?’ একটু থেমে ভাবল স্পাইডার। ‘কী-ভয়ানক-কথা!
‘আমার তো বিয়ের তর সইছে না।’
‘স্পাইডার বিয়ে করে না, সে ওই ধাতুতেই গড়া না!’
‘তাহলে বলতে চাচ্ছ, আমার রোজি তোমার যোগ্য না?’
জবাব দিল না স্পাইডার, বেরিয়ে গেল কামরা ছেড়ে।
মোটকু চার্লির মনে হলো, তর্কে বিজয় ওরই হয়েছে। সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল সে, বিছানায় থাকা খালি কার্টনগুলো গুছিয়ে ফেলল ময়লার বাক্সে; আগের রাতে ওতে ছিল চিকেন চাউমিন আর পর্ক-বল। শোবার ঘরে চলে গেল ও, বাসি পোশাক বদলে নতুন কাপড় পরে নিতে চাইল। কিন্তু আবিষ্কার করল পরক্ষণেইঃ লন্ড্রি করেনি বলে পরিষ্কার কাপড়ই নেই কোনো। তাই আগের দিনের পোশাকটাই ভালো মতো ঝেড়ে—কাজটা করতে গিয়ে মুক্ত হলো চাউমিনের কয়েকটা তন্তু—তারপর আবার পরে নিলো ওগুলোই।
তারপর পা রাখল রান্নাঘরে।
টেবিলের পাশে বসে আছে স্পাইডার, আরাম করে খাচ্ছে বড়োসড়ো একটা স্টেক; এতটাই বড়ো যে দুজনের খাওয়ার জন্য যথেষ্ট হতো।
‘ওটা পেলে কোথায়?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি, যদিও জবাবটা ওর জানা।
‘লাঞ্চ খাবে কি না, জিজ্ঞেস করেছিলাম তো,’ নম্র কণ্ঠে বলল স্পাইডার। ‘স্টেকটা কই পেলে?’
‘ফ্রিজে।’
‘ওটা,’ অন্তিম সংলাপের সময় উকিলরা যেভাবে আঙুল নাড়ায়, সেই ভঙ্গিতে বলল মোটকু চার্লি। ‘আজ ডিনারের জন্য কিনেছিলাম। আমার রোজির জন্য রাতে রান্না করার কথা ছিল। আর ওই স্টেকের টুকরোটাই বসে বসে খাচ্ছ! আর…আর—’
‘এটা কোনো সমস্যাই না!’ জানাল স্পাইডার।
‘সমস্যা না মানে?’
‘সকালে ফোন করেছিলাম রোজিকে,’ জানাল স্পাইডার। ‘ডিনার একসঙ্গে খাচ্ছি আমরা। তাই স্টেকটার তোমার এমনিতেও দরকার পড়ত না।’
কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল মোটকু চার্লি, তারপর বন্ধ করল আবার। ‘বেরিয়ে যাও,’ বলল সে।
‘বামন হয়ে চাঁদ ধরার মানুষের যে ইচ্ছা, আশা বা আকাঙ্ক্ষা যেটাই বলো না কেন…দারুণ।’ মোটকু চার্লির স্টেক ধ্বংস করার ফাঁকে ফাঁকে আনন্দের সঙ্গে বলল স্পাইডার।
‘মানে কী কথাটার?
‘মানে এই যে আমি কোথাও যাচ্ছি না। জায়গাটা আমার পছন্দ হয়েছে।’ স্টেকের বড়ো আরেকটা টুকরো কেটে মুখে পুড়ে বলল স্পাইডার।
‘বের হয়ে যাও,’ বলল মোটকু চার্লি। ঠিক সেই মুহূর্তেই বেজে উঠল হলের টেলিফোন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে হলে চলে এলো সে, ফোন তুলে বলল, ‘কী?’
‘আহ, চার্লস। তোমার কণ্ঠ শুনে খুশি হলাম। আমি জানি, তুমি তোমার প্রাপ্য ছুটিটা কাটাচ্ছ। কিন্তু যদি সম্ভব হয়, মানে খুব বেশি কষ্ট না হয় তো, আগামীকাল সকালে আধ-ঘণ্টার জন্য আসতে পারবে? এই ধরো দশটার দিকে।’
‘অবশ্যই,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘কোনো অসুবিধে নেই।’
‘শুনে খুশি হলাম। কয়েকটা কাগজে তোমার সই দরকার। ঠিক আছে, কাল দেখা হবে।’
‘কে ফোন করেছিল?’ জিজ্ঞেস করল স্পাইডার। প্লেট পরিষ্কার ফেলেছে ততক্ষণে, এখন মুখ মুছছে টিস্যু দিয়ে।
‘গ্রাহাম কোটস, আগামীকাল যেতে বলেছে।’
স্পাইডার জানাল, ‘লোকটা আসলে হারামি।’
‘সমস্যা কী? তুমিও তো হারামি।’
‘হুম, কিন্তু আমি অন্য রকমের। লোকটা ভালো না, অন্য কোনো চাকরি খুঁজে নাও।’
‘এখন যা করছি, সেটাকে ভালোবাসি!’ আন্তরিক ভাবেই বলল মোটকু চার্লি। ভুলেই গেছে, আসলে কাজটা কত অপছন্দ করে সে, অপছন্দ করে গ্রাহাম কোটস এজেন্সিকে, এবং প্রত্যেকটা দরজার পেছনে ওঁত পেতে থাকা জঘন্য গ্রাহাম কোটসকে ঘৃণা করার মাত্রাও।
উঠে দাঁড়াল স্পাইডার। ‘স্টেকটা দারুণ ছিল,’ বলল সে। ‘তোমার বাড়তি কামরায় আমার জিনিসপত্র রেখে দিয়েছি।’
‘কীহ?’
দ্রুত হলের শেষ মাথায় চলে এলো মোটকু চার্লি; ওর ফ্ল্যাটে টেনে-টুনে দুটো শোবার ঘর আছে বলা যায়। দ্বিতীয়টা একেবারেই ছোটো, সেজন্যই ‘টেনে-টুনে’ বলা। ভেতরে ছিল কয়েকটা বইয়ের কার্টন, একটা রেসিং সেটের বাক্স, হট হুইলসের খেলনা গাড়িতে ভরতি একটা টিনের বাক্স (অধিকাংশেরই চাকা নেই) এবং মোটকু চার্লির ছেলেবেলার স্মৃতিচিহ্নবাহী আরও অনেক কিছু। বামন কিংবা ওই সাইজের কারও জন্য শোবার ঘর হিসেবে একদম নিখুঁত। কিন্তু অন্য যেকারও জন্য জানালাঅলা ক্লজেট ছাড়া কিছু না।
অন্য ভাবে বলতে গেলে: আগে তাই ছিল। কিন্তু এখন আর নেই।
দরজা খুলে ফেলল মোটকু চার্লি, দাঁড়াল হলঘরে এসে। চোখ পিটপিট করছে।
কামরা একই আছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এখন ওটা আকারে বিশাল। শুধু যে বিশাল তাই না, অসাধারণও বলা চলে। দূরের একটা কোনায় জানালা দেখা যাচ্ছে, বড়োসড়ো একটা জানালা। ওটা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে একটা ঝরনা। ঝরনার মাথায় নিচু হয়ে ঝুলে আছে গ্রীষ্মমণ্ডলের সূর্য, সোনা-রঙা আলোয় মাখিয়ে রেখেছে চারপাশে। আরেক কোনায় যে বিশাল ফায়ারপ্লেসটা দেখা যাচ্ছে, তাতে একজোড়া ষাঁড় একত্রে রোস্ট করা যাবে; তাতে এই মুহূর্তে দেখে যাচ্ছে জ্বলন্ত তিনটি কাঠের টুকরা; ফট ফট শব্দ করে ফাটছে ওগুলো। এক কোণে ঝুলছে একটা হ্যামক, কামরায় সেই সঙ্গে জায়গা হয়েছে একটা সাদা সোফা আর বড়োসড়ো বিছানারও। ফায়ারপ্লেসের কাছে যেটা আছে, সেটাকে মোটকু চার্লি এর আগে কেবল ম্যাগাজিনেই দেখেছে— কোনো এক ধরনের জ্যাকুজি হবে। জেবরার চামড়ার গালিচাও আছে একটা, ভালুকের চামড়া ঝুলছে দেওয়ালে। যে উচ্চমানের অডিয়ো ইকুইপমেন্ট দেখা যাচ্ছে, তা অতি সাম্প্রতিককালের। কদিন আগেও কামরার যে প্রশস্ততা ছিল, তার সমান সাইজের একটা ফ্ল্যাট টেলিভিশন দেখা যাচ্ছে কামরায়। জিনিসপত্র আছে আরও…
‘করেছটা কী?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মোটকু চার্লি। ভেতরে পা রাখল না।
‘হয়েছে কী,’ পেছন থেকে বলল স্পাইডার। ‘যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছি যে এখানেই কিছুদিন থাকব, তাই ভাবলাম আমার সব জিনিসপত্রও নিয়ে আসা যাক।
‘জিনিসপত্র? জিনিসপত্র আনার অর্থ হলো কয়েকটা ব্যাগে করে জামা- কাপড়, কিছু প্লে-স্টেশন গেম আর বড়োজোর একটা গাছ-টাছ সঙ্গে আনা। কিন্তু এসব…এসব…’ ভাষা হারিয়ে ফেলেছে যেন বেচারা।
পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় মোটকু চার্লির কাঁধে ধাক্কা দিল স্পাইডার। ‘যদি আমাকে কখনও দরকার হয়,’ বলল সে ভাইকে। ‘তাহলে কোথায় পাওয়া যাবে তা তো জানাই থাকল।’ ধড়াম করে লাগিয়ে দিল সে দরজাটা।
ডোর নব ধরে নাড়ল মোটকু চার্লি, কিন্তু দরজা এখন বন্ধ।
টিভি যে ঘরে রেখেছে, সেখানে গেল ও। যাবার পথে হল থেকে ফোনটা তুলে নিলো হাতে, ঘোরাল মিসেস হিগলারের নম্বর।
‘এত সকালে কে রে?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘আমি, মোটকু চার্লি। দুঃখিত।’
‘তো কী হয়েছে? ফোন করেছ কেন?’
‘তোমার পরামর্শ দরকার ছিল। আমার ভাই এখানে এসে উপস্থিত হয়েছে।’
‘তোমার ভাই?’
‘স্পাইডার, যার কথা আমাকে বলেছিলে। দেখা করতে চাইলে, মাকড়শাকে জানাতে বলেছিলে না? সেটাই করেছি, আর সে এসে হাজির!’
‘তাহলে তো,’ নিস্পৃহ কণ্ঠে বলল মহিলা। ‘ভালোই হলো।’
‘নাহ, ভালো না।’
‘কেন? ও তো তোমার আত্মীয়, তাই না?
‘বিস্তারিত বর্ণনা এখন দিতে পারব না। শুধু চাই, ও এখন চলে যাক।’
‘ভালোভাবে বলে দেখেছ?’
‘সেই চেষ্টা করে দেখেছি, কথা শুনছে না। কুবলাই খানের প্রমোদভবনের মতো কিছু একটা সাজিয়ে নিয়েছে আমার বক্স রুমে। এখানে বাড়িঘরে হালকা-পাতলা পরিবর্তন আনতে চাইলেও কাউন্সিলের অনুমতি লাগে। অথচ ছেলেটা আস্ত ঝরনা খাড়া করে দিয়েছে! এখানে না ঠিক, জানালার অন্য পাশে। আমার বাগদত্তার পেছনেও লেগেছে।’
‘তা তুমি কীভাবে জানলে?’
‘নিজের মুখেই বলেছে।’
মিসেস হিগলার বলল, ‘কফি গলা দিয়ে নামার আগে আমার মাথা ঠিক হবে না।’
‘কী করলে ও চলে যাবে, সেটা জানা দরকার।’
‘তা আমি জানি না,’ বলল মিসেস হিগলার। ‘ব্যাপারটা নিয়ে মিসেস ডানউইডির সঙ্গে কথা বলতে হবে।’
মোটকু চার্লি করিডরের শেষ মাথায় ফিরে গিয়ে, দরজায় টোকা দিল।
‘কী হলো?’
‘কথা বলতে চাই।’
ক্লিক শব্দ করে খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকল মোটকু চার্লি। স্পাইডার আরাম করে বসে আছে জ্যাকুজিতে, তাও নগ্ন হয়ে। একটা লম্বা, বরফে পূর্ণ গ্লাস ভরতি বিদ্যুৎ-রঙা তরল পান করছে। বিশাল জানালাটা খোলা, ভেসে আসছে ঝরনার আওয়াজ। কামরার কোথাও লুকিয়ে রাখা স্পিকার থেকে
ভেসে আসছে জ্যাজ গানের সুর।
‘দেখো,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘একটা ব্যাপার তোমাকে বুঝতে হবে, এটা আমার বাড়ি।’
চোখ পিট পিট করল স্পাইডার। ‘এইটা?’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘এইটা তোমার বাড়ি?’
‘উম, আসলে পুরোপুরি না। কিন্তু যা বলতে চাইছি, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। আমরা বাড়তি কামরায় আছি, আর এখানে তুমি অতিথি ছাড়া আর কিছু নও।’ গ্লাসে চুমুক দিয়ে, আরামদায়ক গরম পানিতে গা আরও এলিয়ে দিল স্পাইডার। ‘লোকে বলে,’ জানাল সে। ‘অতিথি আর মাছের মাঝে পার্থক্য নেই; দুটোই দিন তিনেক পর গন্ধ ছড়াতে শুরু করে।’
‘কথাটা ভুল না,’ মোটকু চার্লি জবাব দিল।
‘কিন্তু জীবন কঠিন হয়ে যায়,’ বলল স্পাইডার। ‘যখন প্রায় পুরোটা কেটে যায় নিজের আপন ভাইকে না দেখে। কঠিন হয় যখন সে জানেও না যে তার ভাইয়ের অস্তিত্ব আছে। আর সবচেয়ে বেশি কঠিন হয় যখন তার সঙ্গে দেখা হবার পর জানা যায়, ভাইকে সে মরা মাছ মনে করে!’
‘কিন্তু,’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি।
বাথটাবে লম্বা হয়ে আড়মোড়া ভাঙল স্পাইডার। ‘একটা কথা তোমাকে বলি, অনন্তকাল থাকার জন্য তো আর আসিনি। শান্ত হও, চোখের পলক ফেলার আগেই ফুরিয়ে যাবে সময়; চলে যাবো আমি। আরেকটা কথা বলে রাখি-তোমাকে আমি কখনও মরা মাছ ভাববো না। আমরা দুজনেই মারাত্মক চাপে আছি, তাই এই প্রসঙ্গে আর কথা না বলি। এবার যাও, লাঞ্চ সেরে আসো। সদর দরজার চাবি রেখে যাও। খাওয়া শেষে একটা মুভিও দেখে নিয়ো।’
জ্যাকেট গায়ে চড়িয়ে বাইরে পা রাখল মোটকু চার্লি। বাড়ির চাবিটা রেখে দিল সিঙ্কের পাশে। তাজা বাতাস দারুণ লাগছে, যদিও দিনটা ধূসর; গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। পড়ার জন্য একটা খবরের কাগজ কিনে নিলো, চিপ্পিতে[১৬] থেমে কিনল বড়োসড়ো একটা ব্যাগ; সেটাই দুপুরের খাবার। বৃষ্টি থেমে গেছে, তাই চার্চের প্রাঙ্গণের একটা বেঞ্চে বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে আরাম করে খেল সদ্য কেনা স্যাভেলয়[১৭] আর চিপস।
[১৬. ফিস-অ্যান্ড-চিপসের দোকান।
১৭. প্রচুর মসলাযুক্ত শুয়োরের মাংসের সসেজ।]
ছবি দেখার তীব্র একটা ইচ্ছা জন্ম নিয়েছে মনে।
ঘুরতে ঘুরতে ওডিয়োনে চলে এলো সে, প্রথম যে মুভিটা দেখানো হচ্ছিল সেটারই টিকেট কিনল। অ্যাকশন-অ্যাডভেঞ্চার মুভি, ও ভেতরে যাবার আগেই শুরু হয়ে গেছে সেটা। অনেক কিছু ফেটে ফুটে গেল, বিস্ফোরণ হলো বহুবার।
মন্দ না।
তবে মুভির মাঝপথে এসে ওর মনে হতে লাগল, কিছু একটা ভুলে যাচ্ছে। মাথার কোথাও আছে সেই তথ্য লুকিয়ে, বাইরে আসার জন্য মাঝে-মাঝে খোঁচাচ্ছে। সামনের পর্দায় মন বসাতে দিচ্ছে না।
অবশেষে শেষ হলো ছবিটা।
মোটকু চার্লি উপলব্ধি করতে পারল, উপভোগ করেছে বটে মুভিটা; কিন্তু যা দেখেছে তার অধিকাংশই মনে নেই ওর। তাই পপকর্নের বড়োসড়ো একটা ব্যাগ কিনে, বসে বসে আবার দেখতে লাগল। দ্বিতীয় বার আরও বেশি ভালো লাগল মুভিটা।
তৃতীয় বারে আরও বেশি।
তারপর ভাবলো: বাসায় যাওয়া উচিত ওর। কিন্তু লেট-নাইট শোতে ইরেজারহেড আর ট্রু স্টোরিজ দেখাচ্ছে। একটাও আগে দেখা হয়নি ওর, তাই বসে বসে দুটোই দেখে নিলো। এতক্ষণে অবশ্য অনেকটাই ক্ষুধার্ত হয়ে গেছে বেচারা। অর্থাৎ, ইরেজারহেড-এ আসলে কী দেখানো হচ্ছে, সেটাই ধরতে পারেনি! কিংবা ধরতে পারেনি রেডিয়েটর নিয়ে কী করছে মেয়েটা। আরেকবার দেখার কথা ভাবল ও; কিন্তু কর্তৃপক্ষ পরম ধৈর্যের সঙ্গে বোঝাল ওকে রাতের মতো থিয়েটার বন্ধ করে দেবে। জানতেও চাইল, ওর কি যাওয়ার মতো কোনো বাড়ি নেই? যদি থাকে, তাহলে কি এখন ঘুমানোর সময় হয়নি?
তা তো হয়েছেই, তবে এতক্ষণ ভাবেনি ব্যাপারটা নিয়ে। ধীরে পায়ে ফিরে এলো সে ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনসে, অবাক হয়ে আবিষ্কার করল: তার শোবার ঘরের কামরায় এখনও আলো জ্বলছে।
বাড়ির কাছে পৌঁছে দেখে, পর্দা টেনে দেওয়া হয়েছে। জানালার ভেতর দিয়ে দেখা যাচ্ছে অবয়ব, ঘোরা-ফেরা করছে।
অবয়ব দুটো চিনতে পারল সে।
কাছাকাছি হলো অবয়ব দুটো… তারপর হয়ে গেল মিলেমিশে একাকার।
গভীর এক ভয়াবহ একটা গর্জন ছাড়ল মোটকু চার্লি।
.
মিসেস ডানউইডির বাড়িতে প্লাস্টিকের খেলনা পশুর কোনো অভাব নেই। এখানে বাতাসে ভেসে ধীরে ধীরে সরে যায় ধুলো, ভাবখানা এমন যেন ধীরে- সুস্থে নড়তে চায় তারা সূর্যের আলোর শক্তিতে বলীয়ান হয়ে; আধুনিক অন্যান্য আলোর উৎস খুব একটা পছন্দ না। সোফা ঢেকে রেখেছে স্বচ্ছ একটা প্লাস্টিকের কাভার, বসলে ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে ওঠে।
মিসেস ডানউইডির বাড়িতে ব্যবহৃত হয় পাইনের গন্ধঅলা টয়লেট পেপার—জ্বলজ্বলে, অস্বস্তিকর ওগুলো। মিসেস ডানউইডি বিশ্বাস করে, খরচ যত কমানো যায় ততই ভালো। পাইনের গন্ধঅলা ওই টয়লেট পেপার তার সেই প্রচেষ্টারই অংশ। যথেষ্ট সময় খরচ করে খুঁজলে, আর পয়সা খরচ করলে ওই রকমের টয়লেট পেপার আজও পাওয়া যায়।
ভদ্রমহিলার বাড়ি থেকে ধুনোর গন্ধ আসে। পুরাতন একটা বাড়ি ওটা। লোকে ভুলে যায়, ফ্লোরিডাতে যে সেটলাররা এসে পা রেখেছিল প্লাইমাউথ রকে, তাদের বাচ্চা-কাচ্চাদেরও ততদিনে বেশ বড়ো হয়ে গেছিল। তবে এই বাড়িটা সেই সময়কার না; বানানো হয়েছিল ১৯২০-এর দিকে। ফ্লোরিডার নগর-উন্নয়ন প্রকল্পের একটা অংশ হিসেবে। ওটা আসলে নিদর্শন হিসেবে বানানো হয়েছিল যাতে খদ্দেররা জমি কেনার পর কোন ধরনের বাড়ি বানাতে পারবে তা দেখানো যায়। যদিও ওই জলাভূমিটায় দিন শেষে আর কোনো বাড়িই বানানো হয়নি। অনেকগুলো হারিকেনের ধাক্কা সামলেছে মিসেস ডানউইডির বাড়ি, ছাদ না হারিয়েই।
দরজার ঘণ্টি যখন বাজল, তখন মিসেস ডানউইডি একটা ছোট্ট টার্কি রান্নার জন্য প্রস্তুত করছ। জিভ দিয়ে টুট-টুট শব্দ করে, হাত ধুয়ে ফেলল মহিলা। তারপর করিডর ধরে এগিয়ে চলে এলো সদর দরজার সামনে। পুরু গ্লাসের পেছন থেকে উঁকি দিয়ে দেখতে চাইল বিশ্বটাকে, বাঁ-হাতটা
ওয়ালপেপারের ওপর ঘোরা-ফেরা করছে।
দরজা একটু খুলে ফেলেছে সে।
‘লোয়েলা? আমি এসেছি।’ কেলিঅ্যান হিগলার দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
‘ভেতরে এসো।’ মিসেস ডানউইডির পিছু পিছু রান্নাঘরে চলে এলো মিসেস হিগলার। মিসেস ডানউইডি নিজের হাত ধুয়ে নিলো, তারপর বলল— অন্যজনও যেন হাত ধুয়ে ভুট্টার দানা দিয়ে বানানো রুটির টুকরো টার্কির ভেতর ঢোকাতে সাহায্য করে।
‘কেউ আসবে নাকি?’
এমন আওয়াজ করল মিসেস ডানউইডি, যাতে হ্যাঁ-না কিছুই না বোঝা যায়। ‘প্রস্তুত থাকতে তো আর মানা নেই,’ বলল সে। ‘এবার বলো, কী ব্যাপার?’
‘ন্যান্সির ছেলে। মোটকু চার্লি।’
‘ওর আবার কী হলো?’
‘আসলে, ছেলেটাকে ওর ভাইয়ের কথা বলেছিলাম। গত সপ্তাহে এসেছিল না? তখন।’
টার্কির ভেতর থেকে হাত বের করে আনল মিসেস ডানউইডি। ‘তো? কী হয়েছে তাতে? দুনিয়া তো আর ধ্বংস হয়ে যায়নি।’
‘কীভাবে ভাইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, সেটাও জানিয়েছি।’
‘আহ,’ মাত্র এক শব্দে নিজের অসন্তোষ বুঝিয়ে দিল মিসেস ডান উইডি। ‘তারপর?’
‘হিংল্যান্ডে দেখা দিয়েছে ছেলেটা, তারপর থেকে মোটকু চার্লির মাথা খারাপ হয়ে গেছে।’
ভেজা ভুট্টার রুটি হাতের মুঠোয় নিয়ে টার্কির অনেকটা ভেতর সেঁধিয়ে দিল মিসেস ডানউইডি; বেঁচে থাকলে, ব্যথার চোটে কেঁদেই ফেলত টার্কিটা। ‘এখন তাড়াতে পারছে না?’
‘না।’
পুরু লেন্সের ওপাশ থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মিসেস ডানউইডি বলল, ‘আগে একবার করেছি, দ্বিতীয়বার হবে না। মানে ওভাবে করা যাবে না।’
‘তা আমি জানি। কিন্তু কিছু একটা তো করতেই হবে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিসেস ডানউইডি। ‘লোকে সত্যি কথাই বলে। দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলে, একসময় না একসময় সব পাখিরই নীড়ে ফেরা দেখা যায়।’
‘আর কোনো উপায় নেই?’
মিসেস ডানউইডি টার্কি প্রস্তুতির কাজ শেষ করল। এর পর একটা স্কিউয়ার তুলে নিয়ে, খোলা চামড়াটা লাগিয়ে দিল দেহের সঙ্গে। তারপর পাখির পুরো দেহটাই ঢেকে দিল রুপোলি ফয়েল দিয়ে।
‘আমার মনে হয়,’ বলল সে। ‘আগামীকাল সকালে রান্নার জন্য তুলে রাখব। বিকেল হতে হতে রান্না শেষ হয়ে যাবে, তারপর যদি হট ওভেনে রাখি তো গরম গরম খাওয়া যাবে ডিনারে।’
‘আসছে কে ডিনারে?’ জানতে চাইল মিসেস হিগলার।
‘তুমি,’ জানাল মিসেস ডানউইডি। ‘আর জোরাহ বাস্টামন্টে, বেলা নোলস…এবং মোটকু চার্লি ন্যান্সি। ছেলেটা এখানে আসতে আসতে ক্ষুধার্ত হয়ে পড়বে।’
মিসেস হিগলার প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘এখানে আসছে?’
‘সেটাই তো বললাম, শুনতে পাওনি, বাছা?’ মিসেস ডানউইডি বলল। একমাত্র সে-ই মিসেস হিগলারকে বাছা ডেকেও পার পেতে পারে। ‘এখন এসো, টার্কিটাকে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।’
.
এ কথা বললে ভুল হবে না যে সে রাতটা ছিল রোজির জীবনের সেরা রাত: জাদুময়, নিখুঁত, অসাধারণ। হাসি এক মুহূর্তের জন্যও ওর মুখ ছেড়ে যায়নি, এমনকী চাইলেও হাসি থামাতে পারত না। খাবারটাও ছিল দারুণ সুস্বাদু, খাওয়া শেষে মোটকু চার্লি ওকে নিয়ে যায় নাচতে। একেবারে সত্যিকারের ডান্স হলে যায় ওরা, ছোট্ট একটা অর্কেস্ট্রা বাজাচ্ছিল ওখানে। মেঝেতে যেন উড়ে বেড়াচ্ছে হালকা রঙের পোশাক পরা মানুষজন। রোজির মনে হচ্ছিল যেন একসঙ্গে সময় ভ্রমণ করে তুলনামূলক নম্র একটা সময়ে এসে পড়েছে! পাঁচ বছর বয়েস থেকে নাচের পাঠ নিচ্ছে রোজি, কিন্তু এতদিন নাচার মতো সঙ্গী মেলেনি।
‘জানতাম না যে তুমি নাচতেও পারো।’ মোটকু চার্লিকে বলল সে।
‘আমার ব্যাপারে এমন অনেক কিছু আছে, যা তোমার জানা নেই।’ বলল সে।
জবাবটা রোজির আনন্দ বাড়িয়ে দিল আরও। অতিসত্বর বিয়ে হতে যাচ্ছে ওর সঙ্গে এই মানুষটার। অথচ তারপরেও ‘জানার আছে অনেক কিছু? অসাধারণ। একটা জীবন তো হাতে থাকছেই সব জানার জন্য।
অন্য নারী, এবং অন্য অনেক পুরুষও, তাকাচ্ছে মোটকু চার্লির দিকে; ছেলেটার পাশে হাঁটতে হাঁটতে সেই নজরগুলো পরিষ্কার ধরা পড়ল রোজির চোখে। ছেলেটার বাহুডোরে থাকা নারীটি ও নিজে, এই কথা ভেবে আনন্দ পেল খুব।
লেইচেস্টার স্কয়ারের ভেতর দিয়ে হাঁটল ওরা। রোজি দেখতে পেল, মাথার ওপরে তারা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে; স্ট্রিটলাইটের আলোর হুমকি সামলে।
একটা মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য ভাবল, আগে কেন কখনও মোটকু চার্লির সঙ্গে এমন অনুভূতি হয়নি ওর? মাঝে মাঝে, মনের অনেক গহিনে রোজির মনে হতো—একমাত্র মা মারাত্মক অপছন্দ করে বলেই মোটকু চার্লির সঙ্গে প্রেম করছে সে। বিয়ের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলার একমাত্র কারণ: মা চাইত ও না বলুক…
একবার ওয়েস্ট এন্ডে গেছিল ও মোটকু চার্লির সঙ্গে, থিয়েটার দেখতে। জন্মদিনের উপহার হিসেবে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল মোটকু চার্লি। কিন্তু টিকেট নিয়ে ঝামেলা হয়ে যায়। পরে আবিষ্কার হয়, আসলে আগের দিনের টিকেট ছিল ওদের কাছে। অবশ্য কর্তৃপক্ষ ছিল আন্তরিক, একটা স্টলের থামের পেছনে মোটকু চার্লির জন্য আসনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। আর রোজি পেয়েছিল ওপরের সার্কেলের একটা আসন, সামনেই বসেছিল নরউইচ থেকে আসা ও মুরগির মতো খিলখিল করতে থাকা একটা দল। সফল সন্ধ্যা বলা যাবে না কিছুতেই।
কিন্তু আজকের সন্ধ্যাটা…এক কথায় জাদুময়!
জীবনে নিখুঁত মুহূর্ত খুব একটা আসেনি রোজির, কিন্তু তার সংখ্যা যত কমই হোক না কেন…আজ একটা বেড়ে গেল।
ছেলেটার সঙ্গে যখন থাকে, তখন দারুণ একটা অনুভূতি খেলা করে রোজির বুকে।
নাচ শেষ হলে, রাতের রাস্তায় আবার পা ফেলল ওরা। শ্যাম্পেন আর নাচের কারণে মাথাটা হালকা লাগছে। তারপর মোটকু চার্লি—এতটুকু ভাবতেই বদলে গেল চিন্তার গতিপথ। এখনও ছেলেটাকে মোটকু চার্লি নামে ভাবছে কেন? একদম মোটা না তো সে। যাই হোক, সঙ্গী ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এখন তুমি আমার সঙ্গে বাসায় ফিরবে।’
এতটাই গভীর ছিল সেই কণ্ঠ যে কাঁপুনি তুলল রোজির পেটে। পরেরদিন কাজে যাবার কথা বলতে ভুলে গেল। ভুলে গেল বিয়ের পর এসব করার অনেক সময় পাওয়া যাবে—এই কথাটা বলতেও। বলল না কিছুই, শুধু ভাবল: এই রাত যদি কভু না ফুরোত! ভাবল, কতটা তীব্র ভাবে চাইছে—উহু, কতটা তীব্র ভাবে ওর দরকার এই মানুষটার ঠোঁটে চুমু খাওয়া…
…এবং সেই চুমু ফেরত পাওয়া।
আচমকা মনে পড়ে গেল, জবাবে কিছু একটা বলার দরকার। তাই বলল—ঠিক আছে।
ফ্ল্যাটের ফেরার ক্যাবে উঠে, ছেলেটার হাত আঁকড়ে ধরে রইল ওর নিজের হাত; নিজের দেহের ভার চাপিয়ে দিল তার দেহে; পাশ দিয়ে যেতে থাকা গাড়ি আর রাস্তার ল্যাম্পের আলোয় আলোকিত চেহারাটার দিকে রইল তাকিয়ে।
‘কানের লতি ফুটো করা দেখছি,’ বলল রোজি। ‘আগে খেয়াল করিনি কেন?’
‘আরে,’ হাসল ছেলেটা; ওর কণ্ঠ যেন কোনো ঢোলের বাড়ির মতো গমগমে। ‘কথাটা শুনে আমার কেমন লাগল, তা ভেবেছ? এতদিন ধরে প্রেম করছি আমরা, অথচ… আচ্ছা কত দিন হলো?’
‘আঠারো মাস,’ জানাল রোজি।
‘আঠারো মাস ধরে প্রেম করার পরেও…’ বলল ওর বাগদত্ত।
প্রেমিকের গায়ে হেলান দিল মেয়েটা, শ্বাস টেনে বুক ভরে নিলো তার গন্ধ। ‘তোমার গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে,’ বলল মেয়েটা। ‘সুগন্ধি মেখেছ?’
‘নাহ, আমার গায়ের গন্ধই,’ জানাল ছেলেটা।
‘তাহলে তো বোতলে ভরে বিক্রি করা উচিত তোমার!’
সাদর দরজা খুলতে ব্যস্ত ছেলেটা, সেই সময়ে ট্যাক্সির ভাড়া বুঝিয়ে দিল রোজি। তারপর একসঙ্গে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে। একদম ওপরে ওঠে দেখা গেল, করিডরের শেষ মাথার দিকে এগোচ্ছে ছেলেটা; যেখানে বাড়তি কামরাটা আছে।
‘আরে, শোবার ঘর তো এখানে, বোকা। তুমি যাচ্ছটা কই?’
‘তা তো আমি জানি,’ জবাব দিল ছেলেটা। তারপর মোটকু চার্লির শোবার ঘরে প্রবেশ করল ওরা একত্রে। পর্দা টেনে দিল মেয়েটা। তারপর শুধু চেয়ে রইল ছেলেটার দিকে, মনটা আনন্দে ভরে উঠেছে।
‘দেরি করছ কেন?’ কিছুক্ষণ পর বলল মেয়েটা। ‘আমাকে চুমু খাবে না?’
‘অবশ্যই খাবো,’ বলল ছেলেটা, করলও। সময় যেন গলে গেল, হলো প্রসারিত…নিলো বাঁকানো পথ। চুম্বনের স্থায়িত্ব এক মুহূর্ত হতে পারে, কিংবা একটা ঘণ্টা…অথবা একটা জীবন। তারপর-
‘কীসের শব্দ?’
জবাব দিল ছেলেটা। ‘কিচ্ছু শুনিনি।’
‘মনে হলো, তীব্র কষ্ট পেয়ে কেউ চেঁচিয়ে উঠেছে।’
‘হয়তো বিড়ালের মারামারি?’
‘মানুষের কণ্ঠই তো মনে হলো।’
‘শহুরে শেয়াল হতে পারে, কণ্ঠ মানুষদের মতোই।’
একপাশে মাথা কাত করে দাঁড়িয়ে রইল মেয়েটা, মন দিয়ে শুনছে। ‘এখন আর পাচ্ছি না,’ বলল সে। ‘উম, অদ্ভুত ব্যাপারটা কী জানো?’
‘উ-হু,’ বলল সে, ঠোঁট ঘষছে রোজির ঘাড়ে। ‘বলো, অদ্ভুত ব্যাপারটা কী? তবে ওটাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। আর বিরক্ত করবে না তোমাকে।’
‘অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো,’ জানাল রোজি। ‘শুনতে তোমার কণ্ঠের মতোই মনে হলো।’
.
রাস্তা ধরে হাঁটছে মোটকু চার্লি, মাথাটা পরিষ্কার করা দরকার। এখন যেটা করা উচিত তা হলো: সদর দরজায় ধাক্কা মেরে স্পাইডারকে নিচে নামতে বাধ্য করা। তারপর ভেতরে ঢুকে ইচ্ছেমতো দুকথা শুনিয়ে দেওয়া স্পাইডার আর রোজিকে।
এটাই যে করা উচিত, তা তো পরিষ্কার বুঝতে পারছে। একেবারে…জলবৎ তরলং।
ফ্ল্যাটে ফিরে সব কথা রোজিকে খুলে বলা উচিত ওর। স্পাইডারকে লজ্জা দিয়ে ভাগাতে হবে। কাজটা তেমন কঠিন কিছু হবার কথা না…
কিন্তু কঠিন যে হবে, তাতে সন্দেহ নেই। কেন ফ্ল্যাট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ক্রমেই, সেটা জানে না ও। এমনকী ফেরার পথও খুঁজে পাবে বলে মনে হয় না। যেসব রাস্তা ও চিনত, কিংবা চিনত বলে ভাবত, সেই রাস্তা যেন ভোল পালটাচ্ছে। কানাগলিতে আবিষ্কার করছে নিজেকে, এসে পড়ছে কাল-ডে- স্যাকে। লন্ডনের রেসিডেনশিয়াল এরিয়ার গলি-ঘুপচিতে মাথা কুটে মরছে।
কখনও কখনও মূল সড়কটা নজরে পড়ছে বটে। ট্রাফিক লাইট জ্বলছে, জ্বলছে বিভিন্ন ফাস্ট ফুডের দোকানের আলোও। জানে, একবার মূল সড়কে পা রাখতে পারলে পথ চিনে নিজের বাড়িতে ফিরতে পারবে। কিন্তু যখনই ওদিকে পা বাড়াচ্ছে, ততবার অন্য কোথাও এসে পড়ছে।
পায়ে ব্যথা শুরু হয়েছে মোটকু চার্লির। পেট গুড়গুড় করছে, মাথা আচ্ছন্ন হয়ে আছে রাগে। যতই হাঁটছে, ততই বাড়ছে সে রাগ।
তবে রাগের কারণে মাথাটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। ভাবনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে জাল, তা উবে যেতে ধরেছে। রাস্তার যে জালিকা ধরে হাঁটছে, সেটাও ক্রমে সরল হয়ে আসছে। একটা বাঁক ঘুরতেই নিজেকে আবিষ্কার করল মূল সড়কে। পাশেই ‘নিউ জার্সি ফ্রাইড চিকেন’ আউটলেট, সারা রাত খোলা থাকে। বড়োসড়ো একটা বাকেট অর্ডার দিল সে, ফ্যামিলি প্যাক আরকী। তারপর, পরিবারের কারও সাহায্য ছাড়াই, পুরোটা খতম করে ফেলল। খাওয়া শেষে এসে দাঁড়াল ফুটপাতে। কমলা রঙের ‘খালি’ লেখা পরিচিত আলোটা নজরে পড়লে হাত নেড়ে ডাকল বড়ো, কালো ক্যাবটাকে। ওর পাশে এসে গাড়িটা থামিয়ে, জানালা নামাল ক্যাবি।
‘কই যাবে?’
‘ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনস,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘গাঁজা ফুঁকেছ নাকি?’ জিজ্ঞেস করল ক্যাব ড্রাইভার। ‘রাস্তার মোড়েই তো জায়গাটা।’
‘নিয়ে যাবে কি না বলো? পাঁচ পাউন্ড বেশি পাবে, সত্যি বলছি।’
দাঁতে দাঁত চেপে শব্দ করে শ্বাস নিলো ক্যাবি। আওয়াজটা শুনে মনে হলো যেন কোনো গাড়ির মেকানিক জিজ্ঞেস করছে—প্রায় নষ্ট ইঞ্জিনটাকে মালিক স্মৃতিবিজটির কোনো কারণে কারণে ভালোবাসে কি না। ‘তোমার পয়সা, যেমনে খুশি খরচ করো,’ জবাব দিল ক্যাবি। ‘উঠে পড়!’
তাই করল মোটকু চার্লি। ক্যাবি ইঞ্জিন চালু করে দিল, অপেক্ষা করল আলো বদলাবার। তারপর মোড় ঘুরেই জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যেন যেতে চাচ্ছিলে?’
‘ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনস,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘৩৪ নম্বর বাড়ি। মদের দোকানটা পেরিয়েই।’
গতকালের পোশাকটাই পরে আছে, বদলাতে পারলে খুশিই হতো। মা সবসময় বলত: পরিষ্কার অন্তর্বাস পরে থাকতে, পাছে যদি গাড়ির ধাক্কা খেয়ে মারা যায়? আর দাঁত ব্রাশ করতে, কারণ ওর লাশ শনাক্ত করার জন্য ডেন্টাল রেকর্ডের দরকার হতে পারে।
‘চিনি আমি,’ জানাল ক্যাবি। ‘পার্ক ক্রিসেন্টে ঢোকার ঠিক আগে আগে।’
‘ঠিক বলেছ,’ জানাল মোটকু চার্লি, হেলান দিল পেছনের সিটে।
‘হয়তো ভুল পথে ঢুকে পড়েছি,’ বলল ক্যাবি, বিরক্ত শোনাল ওকে। ‘মিটারটা বন্ধ করে দিলাম, ঠিক আছে? পাঁচ পাউন্ড দিলেই হবে।’
‘ঠিক আছে,’ বলল মোটকু চার্লি। আরাম করে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ল ও। সারা রাত ট্যাক্সি চালাল ক্যাবি, ঠিক সামনের ঠিকানায় পৌঁছুবার জন্য।
.
ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডে ফ্রড স্কোয়াডে আছে এখন, বারো মাসের জন্য। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে পৌঁছল গ্রাহাম কোটস এজেন্সির অফিসে। তার জন্য রিসেপশনে অপেক্ষা করছিল গ্রাহাম কোটস, অফিসে ওকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলো লোকটা।
‘কফি বা চা কিছু নেবেন?’
‘না, ধন্যবাদ। আমি ঠিক আছি।’ একটা নোটবুক বের করে, আগ্রহের সঙ্গে তাকাল লোকটার দিকে।
‘আপনার এই অনুসন্ধানের গোপনীয়তা কতটা জরুরি, তা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। স্বচ্ছতা আর সততার জন্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সি বিখ্যাত। আমাদের এখানে, মক্কেলের টাকা-পয়সাকে মহাপবিত্র বস্তু বলে ধরে নেওয়া হয়। আরেকটা কথা জানাই আপনাকে, প্রথমে যখন মনের ভেতর চার্লস ন্যান্সির ওপর সন্দেহ দানা বাঁধছিল, তখন নিজেকেই বিশ্বাস করতে চাইনি। ভেবেছি, এমন ভালো একজন মানুষ আর কঠোর পরিশ্রমীর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ তোলাটা উচিত হচ্ছে না। এক হপ্তা আগে যদি কেউ আমাকে চার্লস ন্যান্সির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করত তাহলে বলতাম–একেবারে মাটির মানুষ সে।’
‘বুঝলাম। তা কখন থেকে সন্দেহ হলো যে মক্কেলের অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা অন্য কোথাও যাচ্ছে?’
‘আসলে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। আন্দাজে কথা বলতে চাচ্ছি না। এমনিতেও অহেতুক কারও দিকে সন্দেহের তির ছুঁড়তে চাই না। কেননা জানেনই তো—ইট ছুড়লে, পাটকেল খেতে হয়।’
টেলিভিশনের পুলিসরা বলে, ভাবল ডেইজি। দরকারি তথ্যগুলোই শুধু জানাও। একই কথা বলার ইচ্ছা ওরও হচ্ছে, কিন্তু বলল না।
এই লোকটাকে ওর আসলে পছন্দ হচ্ছে না।
‘যেসব লেনদেন নিয়ে আমার সন্দেহ হয়েছে, সেগুলো প্রিন্ট করে এনেছি,’ জানাল লোকটা। ‘দেখতেই পাচ্ছেন, সবগুলো করা হয়েছে ন্যান্সির কম্পিউটার থেকে। আরও একবার জোর দিয়ে বলতে চাই: আমাদের গোপনীয়তা পরম কাম্য। গ্রাহাম কোটস এজেন্সির মক্কেলদের তালিকায় অনেক বিখ্যাত ও প্রভাবশালী ব্যক্তি আছেন। আপনার সুপিরিয়রকেও বলেছি, যতটা সম্ভব গোপনীয়তা বজায় রাখতে হবে। যদি কোনো ভাবে মাস্টার ন্যান্সিকে চাপ দিয়ে তার কাছ থেকে সব টাকা-পয়সা ফেরত নেওয়া যায়, তাহলেই আমি খুশি। এর চাইতে বেশি কিছু চাই না। কেস-টেসের ঝামেলায় জড়াবার ইচ্ছে আমার নেই।’
‘আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করব। তবে দিনশেষে আমরা শুধু তথ্য সংগ্ৰহ করি, সেসব তুলে দিই ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের হাতে।’ একবার ভাবল, আসলে চিফের ওপর এই লোকটার প্রভাব আসলে কতটুকু? ‘সন্দেহ জন্মাল কেন?’
‘আহ, একেবারে সরাসরি বলতে বললে বলব— লোকটার আচরণগত গড়মিলের কারণে। কুকুরটা ডাকেনি বলে, কিংবা পার্সলি মাখনে ডুবে গেছে বলে…আমরা, গোয়েন্দারা খুব ছোটো ছোটো জিনিসও দেখতে পাই, তাই না? নাকি ভুল বললাম, ডিটেকটিভ ডে?’
‘আসলে ওটা ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডে হবে। যাক, দয়া করে আমাকে প্রিন্টআউটগুলো দিন,’ জানাল ডেইজি। ‘সেই সঙ্গে দরকারি অন্যান্য কাগজ আর ব্যাঙ্ক রেকর্ডও। হয়তো তার কম্পিউটারটাও জব্দ করতে হতে পারে, হার্ড ডিস্ক খুঁজে দেখতে হবে।
‘অবশ্যই।’ জানাল লোকটা। বেজে উঠল ডেস্কের ফোন। ‘একটু ক্ষমা করবেন,’ কানে লাগাল রিসিভার। ‘তাই নাকি? হায় ঈশ্বর। আমার জন্য রিসেপশনে অপেক্ষা করতে বলো। এক মুহূর্ত পরেই আসছি।’ ফোন রেখে দিল সে। ‘পুলিসি সার্কেলে একে বলে,’ ডেইজিকে জানাল সে। ‘বমাল ধরা পড়া।’
ভ্রু কুঁচকে গেল ডেইজির।
‘একটু আগে যাকে নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেই চার্লস ন্যান্সি খোদ এসে উপস্থিত। আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ভেতরে আসতে বলব? চাইলে আমার অফিসটাকে আপনি সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য ব্যবহার করতে পারেন। চাইলে একটা টেপ রেকর্ডারও ধার করতে পারেন, আছে আমার কাছে।’
ডেইজি বলল, ‘তার দরকার হবে না। আগে দরকার এই কাগজগুলো ঘাঁটা।’
‘ঠিক আছে,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘কী বোকা আমি। মানে, আপনি কী… দেখা করবেন তার সঙ্গে?’
‘তাতে কোনো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না।’ জানাল ডেইজি।
‘ওহ, তাকে নিয়ে যে অনুসন্ধান চলছে তা জানাব না,’ আশ্বস্ত করল গ্রাহাম কোটস। ‘নইলে দেখা যাবে, লেজ গুটিয়ে পালিয়েছে। সত্যি বলতে কী, আমি বর্তমান সময়ের পুলিসের কষ্টটা ভালো ভাবেই বুঝি। তাদের প্রতি সহানুভূতিও আছে।’
ডেইজির কেন যেন মনে হলো, এই লোকের কাছ থেকে যে টাকা চুরি করে সে খুব একটা খারাপ হতে পারে না। অবশ্য এটাও জানে সেই সঙ্গে, একজন পুলিস অফিসারের এভাবে চিন্তা করা উচিত না।
‘বাইরে দিয়ে আসি,’ তাকে বলল গ্রাহাম কোটস।
ওয়েটিং রুমে বসে আছে একটা লোক। দেখে মনে হচ্ছে, এই পোশাক পরেই ঘুমিয়েছিল রাতে। দাড়ি কামায়নি, খানিকটা বিভ্রান্তও দেখাচ্ছে। ডেইজিকে হালকা খোঁচা দিয়ে গ্রাহাম কোটস দেখিয়ে দিল লোকটাকে। ‘চার্লস, হায় ঈশ্বর, এ কী অবস্থা তোমার। ভয়াবহ দেখাচ্ছে তোমাকে!’
ঝাপসা দৃষ্টিতে মোটকু চার্লি চেয়ে রইল তার দিকে। ‘গত রাতে বাড়ি ফিরিনি।’ জানাল সে। ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার ভুল করে ফেলেছে।’
‘চার্লস,’ বলল গ্রাহাম কোটস, ‘ইনি ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডে, মেট্রোপলিটান পুলিসের। কিছু রুটিন কাজে এসেছেন।’
মোটকু চার্লি বুঝতে পারলে, এখানে কোথাও কিন্তু আছে। নিজেকে সামলে নিলো সে, দেখতে পেল কিছু ভদ্রস্থ পোশাক, যেটাকে ইউনিফর্মও বলা চলে। তারপর নজর পড়ল চেহারায়। ‘উম,’ বলল সে।
‘শুভ সকাল,’ বলল ডেইজি, অন্তত মুখে। তবে মাথার মধ্যে শুধু বলেই যাচ্ছে- ধ্যাত, ধ্যাত, ধ্যাত, ধ্যাত।
‘পরিচিত হয়ে খুশি হলাম,’ বলল মোটকু চার্লি। হতভম্ব হয়ে এমন একটা কাজ করে বসল যা আগে কখনও করেনি: সাদা পোশাকের পুলিস অফিসারকে কল্পনা করতে লাগল পোশাক ছাড়াই! আবিষ্কার করল, কল্পনা হতাশ করেনি ওকে। পিতার মৃত্যুর শোক পালনের সেই রাতের ঠিক পরের দিনেই যে যুবতীকে ঘুম থেকে উঠে পাশে আবিষ্কার করেছিল, তাকেই যেন দেখতে পাচ্ছে। ভদ্রস্থ পোশাকে অবশ্য তাকে খানিকটা বয়স্ক, আরও অনেক গম্ভীর ও ভয়ংকর দেখাচ্ছে।
তবে মেয়েটা যে সে-ই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই!
অন্য সব বুদ্ধি-বিবেক সম্পন্ন প্রাণির মতোই, মোটকু চার্লিরও অদ্ভুত ব্যাপার হজম করার একটা সীমা আছে। কয়েকদিন হলো সেই অদ্ভুত ব্যাপার- স্যাপার এত বেশি হচ্ছে যে সহ্যের কাঁটা ঘোরাফেরা করছে লাল ঘরের আশপাশে। এখন সেই বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে গেল। এই মুহূর্তটার পর থেকে, ভাবল সে, আর কিছুই আমাকে কখনও অবাক করবে না। মাথার তার ছেঁড়ার আর কোনো হুমকি বা সম্ভাবনা নেই। অনেক হয়েছে।
কিন্তু ধারণাটা যে পুরোপুরি ভুল ছিল, তা তো বলাই বাহুল্য।
ডেইজিকে চলে যেতে দেখল মোটকু চার্লি, তারপর গ্রাহাম কোর্টসের পিছু পিছু প্রবেশ করল তার অফিসে।
শক্ত করে দরজা বন্ধ করে দিল গ্রাহাম কোটস, তারপর নিতম্বটা রাখল ডেস্কের ওপর। রাতের বেলা নিজেকে মুরগির খোঁয়াড়ে আবিষ্কার করলে নেউলে যেভাবে হাসত, হাসল ঠিক সেভাবেই।
‘সরাসরি কাজের কথায় আসা যাক,’ বলল সে। ‘হাতের তাস দুজনেই দেখাই। ঠারেঠোরে কথা বলে লাভ নেই। এসো আমরা,’ ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাইল লোকটা। ‘দিনকে দিন আর রাতকে রাতই বলি।’
‘ঠিক আছে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘তাই করা যাক। আপনি কীসব কাগজ সই করার কথা বলছিলেন?’
‘এখন আর তার দরকার নেই, মন থেকে সেই চিন্তা বের করে দাও। কয়েকদিন আগে আমাকে যে ব্যাপারটা জানিয়েছিলে, সেটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। বলেছিলে, এমন কিছু লেনদেন দেখতে পেয়েছ যা তোমাকে সন্দিহান করে তুলেছে।’
‘বলেছিলাম নাকি?’
‘এক মাঘে, চার্লস ন্যান্সি, শীত যায় না। যাই হোক, প্রথমেই ভেবেছিলাম যে অনুসন্ধান করব। সেজন্যই আজ সকালে ডিটেকটিভ কনস্টেবল ডে-এর আগমন হলো অফিসে। যা আমি আবিষ্কার করেছি, তা শুনে যে চমকে যাবে না সেটা তো জানিই।’
‘যাবো না?’
একদম না। আসলেও আমাদের এখানে নয়-ছয় হচ্ছে, চার্লস। তবে আফসোসের কথা, সন্দেহের তির কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে বিঁধছে কেবলই একটা লক্ষ্যে; যা নিয়ে আমাদের বিন্দুমাত্র সন্দে নেই।’
‘সন্দেহ নেই?’
‘একদম না।’
মোটকু চার্লি দিশেহারা বোধ করছে। ‘কী সেই লক্ষ্য?’
চোখ-মুখে দুশ্চিন্তা ফুটিয়ে তুলতে চাইল গ্রাহাম কোটস, অন্তত সেই চেষ্টাটা করল। কিন্তু ফলাফল হলো ঢেকুর তোলার প্রয়োজন হলে বাচ্চাদের যেমন চেহারা হয় তেমন। ‘কী না, কে। চার্লস, পুলিস তোমাকেই সন্দেহ করছে।’
‘তা তো করবেই,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আজকের দিনটাই যে এমন!’
তারপর ফিরে গেল সে বাড়িতে।
.
সদর দরজা খুলল স্পাইডারই। বৃষ্টিপাত শুরু হয়ে গেছে, ভেজা মোটকু চার্লি দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
‘এখন,’ বলল সে। ‘নিজের বাড়িতেই আমি অনাকাঙ্ক্ষিত, তাই না?’
‘তোমার বাড়িতে তুমি আসবে, আমি বাধা দেওয়ার কে?’ বলল স্পাইডার। ‘সারা রাত কই ছিলে?’
‘সেই প্রশ্নের জবাব তোমার ভালোভাবেই জানা আছে। বাড়িতে আসতে পারছিলাম না। জানি না, আমার ওপর কী জাদু চালিয়েছিলে!’
‘জাদু বোলো না,’ আহত শোনাল স্পাইডারের কণ্ঠ। ‘বলো অলৌকিক কাণ্ড।’
ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে, সিঁড়ি ভেঙে ওপরে চলে এলো মোটকু চার্লি। বাথরুমে ঢুকে, বাথটাবে প্লাগটা লাগিয়ে চালু করে দিল কল। তারপর হলে উঁকি দিয়ে বলল। ‘নামে কী যায়-আসে? যেটাই হোক না কেন, আমার বাড়িতে তুমি সেটাই করছিলে। এবং কাল রাতে যেন বাড়ি ফিরতে না পারি, সেই ব্যবস্থা করেছ।’
দুই দিনের বাসি পোশাক ছাড়ল ছেলেটা, তারপর আবার উঁকি দিল দরজার ওপাশে। ‘পুলিস এখন আমার পেছনে লেগেছে, অফিসের ঝামেলার জন্য। গ্রাহাম কোটসকে লেনদেন সংক্রান্ত জটিলতার কথা কিছু বলেছ?’
‘অবশ্যই বলেছি,’ জানাল স্পাইডার।
‘হাহ! এখন আমাকেই সন্দেহ করছেন তিনি।’
‘আমার তা মনে হয় না,’ জানাল স্পাইডার।
‘তোমার মনে হওয়ার…’ নিজেকে সামলে নিলো মোটকু চার্লি। ‘নিজে কথা বলেছি তার সঙ্গে, পুলিসও জড়িয়ে পড়েছে। তার ওপর রোজির ব্যাপারটাও আছে। মেয়েটার ব্যাপারে লম্বা আলোচনা আছে তোমার সঙ্গে; গোসল থেকে বেরিয়েই শুরু করব। তবে সবার আগে বাথটাবে যেতে হবে আমাকে। গতরাত ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেরিয়েছি, ঘুমিয়েছি একটা ট্যাক্সির পেছনের সিটে বসে। ঘুম থেকে উঠে দেখি, ভোর পাঁচটা বাজে! এদিকে আমার ক্যাবি বিড়বিড় করে নিজেকেই কিছু বলছে আর ঘুরছে ট্রাভিস বিকেল রাস্তায়। ওকে বললাম, ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনস খোঁজা বন্ধ করে দেওয়াই ভালো হবে ওর জন্য; আজকের রাত ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনস খুঁজে পাওয়ার রাত না। একমত হয়ে গেল ও, তাই আমরা নাস্তা করতে গেলাম এমন এক জায়গায় যেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভাররা নাস্তা করে। ডিম, সবজি, সসেজ, টোস্ট আর চা…শেষেরটা এত ঘন যে ওতে চামচ ডুবানোও কঠিন। অন্য ট্যাক্সি ড্রাইভারদেরকে আমারটা জানাল, সারা রাত খুঁজেও ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনসের দেখা পায়নি…তখন তো মনে হচ্ছিল হাতাহাতি শুরু হয়ে যাবে। তবে হয়নি। অবশ্য খুব কাছাকাছি চলে গেছিল পরিস্থিতি।’
একটু থেমে শ্বাস টানল মোটকু চার্লি। স্পাইডারকে অপরাধী মনে হচ্ছে।
‘পরে,’ কথা বলতে পারে ওর ভাই, ভেবে থামিয়ে দিল মোটকু চার্লি। ‘আমি আগে গোসলটা সেরে নিই,’ বলে বন্ধ করে দিল বাথরুমের দরজা।
তারপর উঠে বসল বাথটাবে।
কুই কুই আওয়াজ করে পরক্ষণেই আবার নেমে এলো।
কল বন্ধ করে একটা তোলায়ে পেঁচিয়ে নিলো দেহে, তারপর দরজা খুলে হাঁক ছাড়ল। ‘গরম পানি নেই,’ শান্ত স্বরে বলল সে, একটু বেশিই শান্ত স্বরে। ‘কেন নেই, তা জানতে পারি?’
স্পাইডার তখনও হলওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে, নড়েনি এক বিন্দুও। সব আমার হট টাবে,’ জবাব দিল সে। ‘দুঃখিত।’
বলল মোটকু চার্লি। ‘যাক, অন্তত রোজি তো আর…মানে সে নিশ্চয়ই…’ স্পাইডারের চেহারা দেখে থেমে গেল সে। ‘এখুনি বেরিয়ে যাও এখান থেকে আমার জীবন থেকে… রোজির জীবন থেকে!’
‘কিন্তু আমার তো জায়গাটা পছন্দ হয়েছে,’ জানাল স্পাইডার।
‘তুমি আমার জীবন ধ্বংস করছ!’
‘মন্দ কপাল তোমার,’ হলওয়ের শেষ মাথায় গিয়ে মোটকু চার্লির বাড়তি কামরার দরজা খুলল স্পাইডার। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সোনালি আলো ভাসিয়ে নিয়ে গেল হলওয়েটাকে। তবে মাত্র এক মুহূর্তের জন্য, তারপরই আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজা।
ঠান্ডা পানিতেই চুল ধুলো মোটকু চার্লি। দাঁত ব্রাশ করে লন্ড্রির স্তূপ হাতড়িয়ে বের করে আনল একটা জিনস আর টি-শার্ট। একেবারে নিচে ছিল বলে, এক হিসেবে ধোয়াই বলা চলে। পরে নিলো ওগুলো, সেই সঙ্গে বেগুনি একটা সোয়েটারও চড়াল গায়ে। মায়ের উপহার ছিল ওটা, ঠিক মাঝখানে একটা টেডি বিয়ার বসে আছে। কখনও পরেনি আগে, আবার বিলিয়ে দেওয়াটাও ঠিক হয়ে ওঠেনি।
এরপর করিডরের শেষ মাথার দিকে অগ্রসর হলো সে।
দরজার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে বুম-চাগা-বুম আওয়াজ। হ্যান্ডেল ধরে খানিকক্ষণ ঝাঁকাল মোটকু চার্লি। ‘যদি দরজাটা না খোলো,’ হুমকি দিল ও। ‘তাহলে ভেঙে ফেলব।’
ঝট করে খুলে গেল দরজা, হুমড়ি খেয়ে ভেতরে চলে গেল মোটকু চার্লি। জানালার বাইরে এখন দেখা যাচ্ছে তার পেছনের বাড়িটাকে। বৃষ্টির চোটে বলতে গেলে অবশ্য কিছুই নজরে পড়ছে না।
তারপরেও, মনে হচ্ছে যেন দেওয়ালের ওপাশ থেকেই প্রবল শব্দে বাজছে একটা স্টেরিয়ো: কামরার সবকিছু কাঁপছে বুম-চাগা-বুম শব্দে।
‘আশা করি বুঝতে পারছ,’ মোটকু চার্লি আলোচনা করার ভঙ্গিতে বলল। ‘এর মানে—যুদ্ধ।’ সহ্যের একেবারে শেষ মাত্রায় পৌঁছে গেলে সাধারণত এভাবেই চিৎকার করে খরগোশরা …আর অনেক জায়গায় আনানসিকে মানুষ চালাক খরগোশ হিসেবেই চেনে। তবে ভুল হয়েছে ওদের, আসলে সে ছিল মাকড়শা। হয়তো ভাবছেন, এমন আলাদা দুটো প্রাণির মাঝে কেউ কীভাবে গুলিয়ে ফেলে? কিন্তু গোলায় যে, তা তো বলাই বাহুল্য।
শোবার ঘরে চলে এলো মোটকু চার্লি, বিছানার ঠিক পাশের টেবিলের ড্রয়ারে থাকা পাসপোর্টটা বের করে নিলো। আবিষ্কার করল, ওয়ালেট ফেলে এসেছে বাথরুমে। সেটা নিয়ে পা রাখল মূল সড়কে। বৃষ্টির মাঝে ডাকল একটা ট্যাক্সি।
‘কোথায় যাবে?’
‘হিথরো,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি।
‘কোনো সমস্যা নেই,’ জানাল ক্যাবি। ‘কোন টার্মিনালে?’
‘জানি না,’ বললেও মোটকু চার্লি জানে, জানাটা ওর উচিত ছিল। হাজার হলেও, মাত্র কদিন আগেই তো ব্যবহার করেছিল। ‘ফ্লোরিডা যাওয়ার জন্য কোন টার্মিনালে যেতে হয়?’
.
জন মেজর যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন থেকেই গ্রাহাম কোটস এজেন্সিকে পেছনে ফেলে পালাবার পরিকল্পনা করেছিল গ্রাহাম কোটস। হাজার হলেও, যা ভালো…তা তো আর চিরকাল টিকে থাকে না। আগে হোক বা পরে— গ্রাহাম কোটস সবাইকে যে কথাটা আনন্দের সঙ্গেই বোঝায়—সোনার ডিম পাড়া হাঁসটাকেও কেটে-কুটে রান্না করা হয়। পরিকল্পনাটা ভালোই ছিল—এক মুহূর্তের নোটিশে কখন পালাতে হবে, তা কেউ বলতে পারে না – তাছাড়া জানাও ছিল না ওর যে ঘটনাবলী আস্তে আস্তে জমে ক্ষীর হচ্ছে; দিগন্তে জড়ো হতে থাকা কালো মেঘের মতো। তারপরেও একেবারে শেষ মুহূর্তের আগে পালাবার কোনো ইচ্ছেই নেই গ্রাহাম কোটসের।
তবে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হলো, অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্রাহাম কোটস—শুধু পালাবে না, একেবারে উধাও হয়ে যাবে; কোনো সূত্র না রেখেই মিশে যাবে বাতাসে।
অফিসের লুকোনো সেফের—গোপন যে কামরাটা নিয়ে গর্ব করে সে— একটা বাড়তি তাক নিজ হাতে লাগিয়েছে। কদিন আগে খুলে যাওয়ায় আবার নতুন করে লাগাতে হয়েছে। যাই হোক, সেই তাকে রয়েছে একটা চামড়ার ভ্যানিটি কেস; যার ভেতরে আছে দুটো পাসপোর্ট। একটায় নাম লেখা বাসিল ফিনেগান, অন্যটায় রজার ব্রনস্টেইন। দুজনেই প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে জন্মেছে, ঠিক গ্রাহাম কোটসের মতো। তবে মারা গেছে বয়েস এক হবার আগেই। দুটো পাসপোর্টেই মালিকের জায়গায় আছে গ্রাহাম কোটসের ছবি।
ওই একই কেসে আছে দুটো ওয়ালেট, প্রত্যেকটায় আলাদা আলাদা ক্রেডিট কার্ড আর পাসপোর্টের মালিকের নামানুসারে ফটো আইডি। আবার দুটো নামেই আলাদা আলাদা ফানেল অ্যাকাউন্ট আছে কেইম্যানসে, যেগুলোর সঙ্গে আবার যোগাযোগ আছে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড আর লিখেনস্টাইনের ফানেল অ্যাকাউন্টের।
পঞ্চাশতম জন্মদিনের দিন হাওয়া হয়ে যাবার পরিকল্পনা ছিল গ্রাহাম কোটসের, বছরখানেকের মতো বাকি আছে এখনও। কিন্তু মোটকু চার্লির কারণে খানিকটা ঝামেলায় পড়েছে।
মোটকু চার্লি গ্রেফতার হবে কিংবা জেলে যাবে—সেই আশা করছে না গ্রাহাম কোটস। তবে দুটোর যেকোনো একটা ঘটলেও আপত্তি করবে না। লোকটাকে ভয় পাইয়ে, অপমান করে, তাড়িয়ে দিতে চায় সে।
গ্রাহাম কোটস আক্ষরিক অর্থেই গ্রাহাম কোটস এজেন্সির মক্কেলদের কাছ থেকে টাকা সরাতে পছন্দ করে, কাজটায় সে দারুণ দক্ষও। এই পেশায় আসার পর খুশি হয়েই আবিষ্কার করেছে: সেলিব্রিটি আর শিল্পীরা টাকা-পয়সার ব্যাপারে কিচ্ছু বোঝে না, তাই সাবধানতার সঙ্গে মক্কেল বেছে নিলেই হলো। কেউ তাদের প্রতিনিধি হলে এবং আর্থিক দিকটা সামলে দিলে, তারা চরম খুশি হয়। যদি কখনও চেক সময়মতো না পৌঁছে, কিংবা যে অঙ্কের হবে বলে মক্কেলরা ভেবেছিল তা নাহয়, অথবা অ্যাকাউন্ট থেকে যদি সরাসরি কেউ টাকা তোলে তাহলে…সেজন্যই গ্রাহাম কোর্টসের এজেন্সিতে কর্মী আসে আর যায়। বিশেষ করে হিসাবরক্ষণ বিভাগের কর্মীরা। তাই সহজেই প্রাক্তন কোনো কর্মীর অদক্ষতার ঘাড়ে চাপানো যায় সেটা। খুব বেশি দরকার হলে এক বোতল শ্যাম্পেন আর ক্ষমাপ্রার্থনা করে চেক লিখে দিলেই হলো!
মানুষ যে গ্রাহাম কোটসকে পছন্দ করে, কিংবা ভরসা করে… তা কিন্তু না। এমনকী মক্কেলরাও ভাবে, সে একটা ধূর্ত নেউলে। তবে এটাও ভাবে যে সে তাদের নেউলে…
…ভুলও করে সেখানেই।
গ্রাহাম কোটস ভাবে শুধু নিজেকে নিয়েই।
ডেস্কে থাকা ফোনটা বেজে উঠল আচমকা, কানে ঠেকাল সে রিসিভার। ‘কী?’
‘মিস্টার কোটস? মেইভ লিভিংস্টোন ফোন করেছেন। বলেছিলেন, ওনার কলগুলো যেন মোটকু চার্লিকে দেওয়া হয়। কিন্তু এই সপ্তাহে ছুটি নিয়েছে সে, তাই কী বলব ভদ্রমহিলাকে তা বুঝতে পারছি না। আপনি নেই, এই কথা বলব?’
গ্রাহাম কোটস ভাবল। আচমকা হার্ট অ্যাটাকে মারা যাবার আগে মরিস লিভিংস্টোন, যিনি একটা খাটো কিন্তু বিখ্যাত একজন ইয়র্কাশায়ারিয়ান কমেডিয়ান, অনেকগুলো টিভি সিরিজের স্টার ছিলেন। নিজের একটা ভ্যারাইটি গেম-শোও পরিচালনা করতেন যার নাম – মরিস লিভিংস্টোন, আই প্রিজিউম; শনিবার রাতে দেখানো হতো। এমনকী আশির দশকে তার একটা গান টপ- টেন চার্টেও এসেছিল: ইট’স নাইস আউট (বাট পুট ইট অ্যাওয়ে)। হাসিখুশি, খোশমেজাজি মানুষটা কেবল গ্রাহাম কোটস এজেন্সির হাতে তার অর্থনৈতিক দিকটা সামলাবার দায়িত্বটাই দেননি, সেই সঙ্গে—অবশ্যই গ্রাহাম কোর্টসের বুদ্ধি অনুসারে—নিজের এস্টেটের ট্রাস্টিও বানিয়েছেন তাকে।
এমন রসালো ফলে কামড় না বসানোটাই হতো বিশাল বড়ো বোকামি।
ঝামেলা হয়ে দাঁড়াল মেইভ লিভিংস্টোন। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, মহিলা বহু বছর গ্রাহাম কোর্টসের একান্ত ব্যক্তিগত কল্পনার জগতে ঝড় তুলেছে!
জবাব দিল লোকটা, ‘নাহ, আমার কাছেই পাঠিয়ে দাও কলটা।’ তারপর খানিকটা ব্যাকুল কণ্ঠে বলল, ‘মেইভ, অনেক দিন পর তোমার কণ্ঠ শুনে খুবই ভালো লাগছে। আছ, কেমন?’
‘ঠিক জানি না।’
মরিসের সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন মেইভ লিভিংস্টোন নাচত। ছোটোখাটো মানুষটার পাশে তাকে পাহাড় মনে হতো। একে-অন্যকে অন্তর
থেকে ভালো বাসতেন তারা।
‘সব খুলে বলছ না কেন?’
‘কয়েক দিন আগে চার্লসের সঙ্গে কথা হলো। ভাবছিলাম, আসলে আমি না আমার ব্যাঙ্কের ম্যানেজার ভাবছিল আরকী, মরিসের এস্টেট থেকে টাকাটা আসেনি। আমাদেরকে বলা হয়েছিল, দুই-একের মাঝে চলে আসবে।’
‘মেইভ,’ শুরু করল গ্রাহাম কোটস, এমন কণ্ঠে যেটাকে ওর নিজের কাছে খুব মোলায়েম মনে হয়। লোকটার বিশ্বাস, এই কণ্ঠে কথা বললে মহিলারা খুব সহজে তাতে সাড়া দেয়। ‘টাকা যে নেই—সেটা কিন্তু বলছি না। সমস্যা হয়েছে ওটার তারল্য নিয়ে। আগেও বলেছি তোমাকে, মরিস জীবনের সায়াহ্নে এসে বেশ কিছু অজায়গায় টাকা লগ্নি করেছিল। আমার পরামর্শ অনুসরণ করে কিছু টাকা ভালো জায়গায় খাটিয়েওছিল অবশ্য। সেগুলোকে আমাদের খানিকটা সময় দিতে হবে, নইলে লাভ তোলা যাবে না। শুধু তাই না, এখন টাকা চাইতে গেলে আমাদের আসলটাই খুইয়ে বসতে হতে পারে। তবে দুশ্চিন্তা করার কোনো কারণ নেই, একদম না। ভালো একজন মক্কেল এবং বন্ধুর জন্য আমি সব কিছু করতে রাজি আছি। নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে তোমাকে চেক লিখে দিচ্ছি। আশা করি তা দিয়ে তুমি ওই টাকা হাতে আসার আগপর্যন্ত আরামেই দিন কাটাতে পারবে। এখন বলো, কত চাচ্ছে ব্যাঙ্ক ম্যানেজার?’
‘বলছে, আমার দেওয়া চেকগুলো ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হবে অচিরেই, ‘ জানাল মহিলা। ‘এদিকে বিবিসি আমাকে বলেছে, তারা পুরাতন শোগুলোর ডিভিডি থেকে প্রাপ্য টাকা ঠিকই পাঠাচ্ছে। ওগুলো তো আর কোথাও লগ্নি করা হয়নি, তাই না?’
‘বিবিসি এই কথা বলেছে! অথচ আমরা টাকার জন্য হন্য হয়ে তাদের পেছনে ঘুরছি! দোষটা অবশ্য পুরোপুরি বিবিসি ওয়ার্ল্ডওয়াইডের না। আমাদের হিসেবরক্ষক গর্ভবতী, তাই সবকিছু একটু অগোছালো হয়ে আছে। এদিকে চার্লস ন্যান্সি—যার সঙ্গে তোমার কথাও হয়েছে—বিপর্যস্ত; বাবা মারা গেছে বেচারার। আজকাল প্রায়শই দেশের বাইরে থাকে-
‘শেষবার যখন কথা হয়েছিল,’ জানাল মেইভ। ‘তখন নতুন কম্পিউটার সিস্টেম স্থাপন করছ বলেছিলে।’
‘তা তো করছিলামই, ওই প্রসঙ্গ আর তুলোই না দয়া করে। লোকে বলে না? মানুষ মাত্রই ভুল হয়। কিন্তু সব লেজেগোবরে করতে হলে, কম্পিউটারের বিকল্প নেই। এমন একটা ব্যাপারে আমি নিজে অনুসন্ধান করবো, দরকার পড়লে কঠোর হতেও দ্বিধা করব না। টাকা দ্রুতই পেয়ে যাবে, মরিস বেঁচে থাকলে সেটাই চাইত।’
‘ব্যাঙ্কের ম্যানেজার বলছে, চেক বাউন্স না করাতে চাইলে যত দ্রুত সম্ভব দশ হাজার পাউন্ডের ব্যবস্থা করতে।’
‘দশ হাজার পাউন্ডের ব্যবস্থা এখুনি করছি, আসলে কথা বলতে বলতেই একটা চেক লিখে ফেলেছি তোমার জন্য।’ নোটপ্যাডে বৃত্ত আঁকছে লোকটা, ওপরে একটা দাগসহ। দেখতে অনেকটা আপেলের মতো লাগছে।
‘আমি কৃতজ্ঞ,’ জানাল মেইভ। ‘আশা করি বেশি ঝামেলা করছি না।’
‘তুমি আর ঝামেলা?’ জানাল গ্রাহাম কোটস। ‘কক্ষনো না!’
ফোন রেখে দিল সে। একটা ব্যাপার সবসময়ই মজার মনে হয়েছে ওর কাছে। তা হলো: মরিস যে চরিত্রে অভিনয় করে লোক হাসাত, তা ছিল এক মালদার, একগুঁয়ে ইয়র্কশায়ারিয়ানের, যে কিনা তার প্রতিটি পাইয়ের হিসেব রাখে!
খেলাটা মন্দ ছিল না, ভাবল গ্রাহাম কোটস। আপেলের ছবিতে আঁকল একজোড়া চোখ আর কান। এখন দেখা যাচ্ছে, সিদ্ধান্ত নিলো সে, অনেকটা বিড়ালের মতো। অচিরেই সেলিব্রিটিদের মন জেতার জীবন বাদ দিয়ে, এমন এক জীবন যাপন করতে যাচ্ছে সে যেখানে আছে শুধু সূর্যালোকের উষ্ণতা, সুইমিং পুল, স্বাদু খাবার, সেরা মানের মদ এবং যদি পাওয়া যায়, তাহলে উদ্দাম শারীরিক আনন্দ। জীবনের সেরা উপকরণগুলো, অন্তত গ্রাহাম কোটসের কাছে, সেগুলোই যা টাকা দিয়ে খরিদ করা যায়।
বিড়ালের চেহারায় একটা মুখ এঁকে দিল সে, তারপর তাতে যোগ করল তীক্ষ্ণ দাঁত। এখন দেখতে পাহাড়ি সিংহের মতো লাগছে। আঁকতে আঁকতেই সে গান জুড়ে দিল, কাঁপা কাঁপা স্বরে:
‘যখন ছিলেম কিশোর আমি, তখন বলত বাবা
বাহিরটা কী সুন্দর, খেলতে কখন যাবা?
কিন্তু এখন হয়েছে বয়েস, মেয়েরা দেখে বলে,
বাইরে দেখতে ভালোই লাগছে, আরও লাগত ঢাকলে…’
কোপাকাবানায় গ্রাহাম কোটসের যে পেন্টহাউজটা আছে, সেটা কেনার টাকা এসেছে মরিস লিভিংস্টোনের পকেট থেকেই; সেই সঙ্গে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ দ্বীপে একটা সুইমিংপুল বসাবার প্রয়োজনীয় অর্থও। তাই গ্রাহাম কোটসকে অকৃতজ্ঞ বলা যাবে না কোনোভাবেই!
‘বাইরে দেখতে ভালোই লাগছে, আরও লাগত ঢাকলে…’
.
অদ্ভুত লাগছে স্পাইডারের।
কিছু একটা ঘটছে: অপরিচিত একটা অনুভূতি, ছড়িয়ে পড়ছে কুয়াশা মতো চারিপাশে; ওর দিনটার দফা রফা করে ছাড়ছে। চিনতে পারছে না স্পাইডার…
…আর তাই, ব্যাপারটা ওর পছন্দও হচ্ছে না।
তবে একটা অনুভূতি, যেটা ও জানে যে মনের ভেতর নেই, তা হলো: অপরাধবোধ। এই জিনিসটা আসলে জীবনে কখনওই অনুভব করেনি। ভালো লেগেছে আগে, নিজেকে মনে হয়েছে অসাধারণ। কিন্তু অপরাধ বোধ? কক্ষনো না! এমনকী ব্যাঙ্ক ডাকাতির সময় অস্ত্র হাতে ধরা পড়লেও ওই বোধটা তার হতো না।
কিন্তু আজ, ওর চারপাশটা ঘিরে, যেন জমা হয়েছে অস্বস্তির ভারী মেঘ।
আজকের আগপর্যন্ত স্পাইডারের বিশ্বাস ছিল, দেবতারা অন্যরকম: তাদের বিবেক নেই, বিবেকের দরকারও নেই। পৃথিবীর সঙ্গে দেবতার যে সম্পর্ক—এমনকী সেই পৃথিবী যদি ওর বাসস্থানও হয়—তার তুলনা করা হয় কোনো কম্পিউটার গেমারের সঙ্গে তার গেমের; যে গেমের আগা-পাশ-তলা সম্পর্কে গেমারের ধারণা তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে সবকটা চিটকোডও!
নিজেকে আনন্দে ডুবিয়ে রাখে স্পাইডার, এটাই ওর একমাত্র কাজ। একমাত্র এই কাজটাই গুরুত্বপূর্ণ। একদম হাতে-কলমে শেখানোর গাইডসহ অপরাধ-বোধ এসে ওর হাতে ধরা দিলেও, তাকে চিনতে পারত বলে মনে হয় না। ঠিক অপরাধ-বোধহীন বলা যায় না ওকে, আসলে বলতে হবে: যেদিন ওই অনুভূতির বণ্টন হচ্ছিল, সেদিন স্পাইডার ব্যস্ত ছিল অন্য কোনো কাজে।
কিন্তু কিছু একটা বদলে গেছে—ভেতরে না বাইরে তা জানে না যদিও- এবং ব্যাপারটা ওর ভালো লাগছে না। নিজের জন্য আরেক পাত্র ড্রিঙ্ক ঢালল সে, হাত নেড়ে বাড়িয়ে দিল গানের আওয়াজ। জানা তারপর মাইলস ডেভিসকে থামিয়ে চালু করল জেমস ব্রাউন। তাতেও কোনো লাভ হলো না।
হ্যামোকে শুয়ে আছে সে, গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সূর্যের আলো মাখছে দেহে আর শুনছে গান। ভাবছে, স্পাইডার হতে পারাটা কতটা সৌভাগ্যের…কিন্তু এই প্রথম বারের মতো মনে হচ্ছে, শুধু স্পাইডার হওয়াটাই যথেষ্ট না… আরও কিছু চাই।
হ্যামোক থেকে নেমে দরজার দিকে এগোল সে। ‘মোটকু চার্লি?’
জবাব পেল না কোনো। ফ্ল্যাটটা খালি মনে হচ্ছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বাইরের দৃশ্য, ধূসর একটা দিন…সেই সঙ্গে বৃষ্টি। স্পাইডারের বৃষ্টি খুবই পছন্দ। কেন যেন মনে হয়, সব খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে।
আচমকা তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠল টেলিফোন। রিসিভার তুলল স্পাইডার।
বলল রোজি, ‘তুমি নাকি?’
‘হ্যালো, রোজি।’
‘গত রাতে,’ বলল মেয়েটা, তারপর চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। অতঃপর ছুড়ে দিল প্রশ্ন, ‘আমার যেমন দারুণ লেগেছে, তোমারও কি তেমনই লেগেছে?’
‘তা তো নিশ্চিত করে বলতে পারব না,’ জানাল স্পাইডার। ‘আমার বেশ লেগেছে। তাই, সম্ভবত হ্যাঁ।’
‘হুম,’ বলল রোজি।
তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে রইল উভয়েই।
‘চার্লি?’ আবার শুরু করল মেয়েটা।
‘হ্যাঁ?’
‘কিছু না বলে চুপ করে থাকতেও ভালো লাগছে। কেননা জানি, ওপাশে তুমি আছ।’
‘আমারও,’ জানাল স্পাইডার।
আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে কথা না বলে সান্নিধ্য উপভোগ করল ওরা।
‘আজ রাতে আমার এখানে আসতে চাও?’ জিজ্ঞেস করল রোজি। ‘আমার ফ্ল্যাটমেটরা ক্লেয়ার্নগর্মসে থাকছে রাতে।’
‘এই বাক্যটা,’ জানাল স্পাইডার, ‘ইংরেজি ভাষার সবচাইতে সুন্দর বাক্য হবার দাবিদার। আমার ফ্ল্যাটমেটরা ক্লেয়ার্নগর্মসে থাকছে রাতে—নিখাদ বাক্য বই আর কিছু না!’
খিলখিলিয়ে হাসল মেয়েটা। ‘ঠিক ঠিক। উম। টুথব্রাশ নিয়ে এসো…’
‘ওহ…ওহ! ঠিক আছে।’
এরপর কয়েক মিনিট চলল ‘তুমি রাখো’
‘না, তুমি রাখো’-এর খেলা; যদিও তা হরমোনের প্রাবল্যে মত্ত, পনেরো বছর বয়সী বাচ্চাদেরই বেশি মানায়। যাই হোক, অবশেষে দুই পক্ষই রেখে দিল ফোন।
সন্তের ভঙ্গিমায় হাসল স্পাইডার। এই পৃথিবীটা, যদি রোজি তাতে থাকে তো, সর্বশ্রেষ্ঠ পৃথিবী হিসেবে স্বীকৃতি পাবার যোগ্য। জেঁকে বসতে থাকা কুয়াশা উবে গেল, আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল জীবন।
মোটকু চার্লি কোথায় গেছে, সেটা ভাবল না পর্যন্ত স্পাইডার। এসব ছোটোখাটো ব্যাপার নিয়ে ভাববার সময় কোথায় ওর? রোজির ফ্ল্যাটমেটরা ক্লেয়ার্নগর্মসে থাকছে রাতে…
…এবং আজ রাতে ওকে টুথব্রাশ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হবে!
.
মোটকু চার্লির দেহটা ফ্লোরিডাগামী বিমানে বসা; পাঁচ জন যাত্রী বসেছে এক সারিতে, ওর আসনটা তাদের ঠিক মাঝখানে। তবে ঘুমুচ্ছে দেহটা। ভালোই হয়েছে তাতে, কেননা বিমান বাতাসে ভাসার সঙ্গে সঙ্গে গণ্ডগোল পাকিয়েছে পেছন দিকে থাকা টয়লেটগুলো। কেবিনের অ্যাটেনডেন্টরা দরজায় ‘আপাতত নষ্ট’ লেখা সাইন ঝুলিয়েছে। কিন্তু তাতে কি আর গন্ধ বাধা মানে? কেমিক্যাল কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ছে তা বাথরুম থেকে। বাচ্চারা কাঁদছে, বড়োরা ঘোঁত ঘোঁত করছে আর শিশুরা করছে ঘ্যান ঘ্যান। যাত্রীদের একটা দল, ডিজনি ওয়ার্ল্ডে যাচ্ছে তারা, সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে বিমানে উঠেছে মানেই: ছুটি শুরু। তাই ক্রমাগত গান গেয়ে চলছে! প্রথমে গাইল ‘বিবিডি-বাবিডি-বু’ তারপর ‘দ্য ওয়ান্ডারফুল থিং অ্যাবাউট টিগারস’, ‘আন্ডার দ্য সি’, ‘হাই হো, হেই হো, ইটস অফ টু ওয়ার্ক উই গো’…এবং সব শেষে ডিজনির লেখা গান ভেবে ‘উই আর অফ টু সি দ্য উইজার্ড’!
বিমান বাতাসে ভাসার পর আরও জানা গেল, কেটারিঙের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিবর্গের ভুলের কারণে, কোচ-ক্লাসের যাত্রীদের জন্য দুপুরের খাবার তোলা হয়নি। আছে শুধু নাস্তা, তারমানে প্রত্যেক যাত্রীকেই আলাদা আলাদা ভাবে সিরিয়ালের প্যাকেট আর কলা দেওয়া হবে। সেগুলো আবার খেতে হবে তাদের প্লাস্টিকে চাকু ও কাঁটাচামচ দিয়ে; কারণ চামচ তোলা হয়নি। অবশ্য সেটাও মন্দের ভালো বলেই প্রমাণিত হলো, যখন অচিরেই জানা গেল যে সিরিয়াল ভেজাবার জন্য দুধও নেই।
নরকে যাবার বিমানে উঠেছি, ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো মোটকু চার্লি: ঘুমিয়েই কাটিয়ে দেবে পুরোটা সময়।
.
স্বপ্নে মোটকু চার্লি নিজেকে আবিষ্কার করল পেল্লাই একটা হলে, পরে আছে মর্নিং স্যুট। পাশে দাঁড়িয়ে আছে রোজি, মেয়েটার পরনে বিয়ের সাদা পোশাক। তার অন্য পাশে, মঞ্চের ওপরেই, আছে রোজির মা; ভদ্রমহিলা নিজেও, দেখে নাড়া খেল মোটকু চার্লি, পরে আছে বিয়ের পোশাক; যদিও তার পোশাকটা ধুলো আর মাকড়শার জালে ভরতি। অনেকটা দূরে, দিগন্ত রেখার কাছে- যেখানে গিয়ে শেষ হয়েছে হলটা গুলি ছোড়ায় আর সাদা পতাকা নাড়ায় ব্যস্ত মানুষের দল।
জ-টেবিল লোকজন, জানাল রোজির মা। ওদের পাত্তা দেওয়ার দরকার নেই।
রোজির দিকে ফিরল মোটকু চার্লি, মেয়েটা হাসল একটা নরম ও মিষ্টি হাসি। তারপর ঠোঁট চেটে নিলো এক দফা!
কেক, স্বপ্নের রোজি বলল।
যেন এই সিগন্যালের অপেক্ষায় ছিল অর্কেস্ট্রা, বাজাতে শুরু করল এখন। নিউ অর্লিয়ন্স ধাঁচের জ্যাজ ব্যান্ড একটা, বাজাচ্ছে শোকসঙ্গীত।
শেফের সহকারী হলো একজন পুলিস অফিসার। হাতকড়া উঁচু করে ধরে আছে মেয়েটা। এদিকে কেকটাকে একটা ট্রলির ওপর রেখে, টেনে মঞ্চের কাছে নিয়ে এলো শেফ।
এবার, স্বপ্ন-রোজি বলল স্বপ্ন-মোটকু-চার্লিকে। কেকটা কাটো।
খ-টেবিলের লোকজন—আসলে লোক না বলে মানব-আকৃতির ইঁদুর আর গোলাঘরের পশু বলাই ভালো যাদের—আনন্দ করতে লাগল ডিজনি কার্টুনের গানগুলো গেয়ে। সে-ও যে ওদের সঙ্গে যোগ দিক, এটাই চাচ্ছে এই পশুর দঙ্গল—জানে মোটকু চার্লি। ঘুমন্ত অবস্থাতেও মানুষের সামনে গান গাইবার চিন্তায় কাঁপছে ওর হাত-পা, শুকিয়ে আসছে ঠোঁট।
তোমাদের সঙ্গে গাইতে পারব না, তাদের জানিয়ে দিল সে। প্রাণপণে খুঁজছে অজুহাত, পেয়েও গেল। আমাকে কেক কাটতে হবে।
কথাটা শোনামাত্র পুরো হলে নেমে এলো নীরবতা। সেই নীরবতার মাঝেই ভেতরে প্রবেশ করল এক শেফ, একটা ছোট্ট ট্রলি এনেছে সঙ্গে; তার ওপর রেখেছে কিছু একটা। শেফের চেহারাটা গ্রাহাম কোটসের মতো, ট্রলিতে দেখা যাচ্ছে মারাত্মক সাদা একটা বিয়ের কেক; অলঙ্কার-সমৃদ্ধ, কয়েক স্তরের একটা বস্তু। একদম ওপরের স্তরে অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটা বর আর ছোট্ট একটা কনে। ওদের দেখে মনে হচ্ছে, চিনি আর ফ্রস্টিং দিয়ে বানানো ক্রাইসলার দালানের ওপরে দাঁড়িয়ে দুইজন মানুষ চেষ্টা করছে তাদের ভারসাম্য বজায় রাখার।
টেবিলের নিচে হাত ঢুকিয়ে একটা বড়ো, কাঠের হাতলের ছুরি বের করে আনল রোজির মা-আকারে প্রায় ম্যাচেটির সমান হবে—যার ধারাল প্রান্তে জং পড়ে গেছে। রোজিকে সেটা এগিয়ে দিল মহিলা; মেয়েটা মোটকু চার্লির ডান হাত টেনে ধরে নিজের হাতের ওপর স্থাপন করল। একসঙ্গে জং ধড়া ছুরিটা ওরা সেঁধিয়ে দিল কেকের একেবারে ওপরের স্তরের পুরু, সাদা আইসিঙে; বর-কনের ঠিক মাঝখানে। প্রথমে খানিকক্ষণ ছুরিটাকে বাধা দিল বটে কেকটা, কিন্তু মোটকু চার্লি নিজের প্রায় পুরো ওজন ছুরির ওপর চাপিয়ে দিলে হাল ছেড়ে দিতে লাগল। ব্যাপারটা টের পেয়ে জোর বাড়াল মোটকু চার্লি।
বিয়ের কেকের একেবারে ওপরের স্তর কেটে ফেলল ছুরি, তারপর নেমে যেতে লাগল নিচে। প্রত্যেকটা স্তর কেটে ফেলল সে, খুলে গেল কেকটা…
স্বপ্নে দৃশ্যটা দেখে মোটকু চার্লি ধরে নিলো: কেকের ভেতরটা কালো পুঁতিতে ভরা। হতে পারে ওগুলো কাচের, কিংবা পালিস করে জেটের[১৮] পুঁতি। কিন্তু যখন ওগুলো কেক থেকে বাইরে বেরোল তখন বুঝতে পারল: প্রত্যেকটার পা আছে, একটা না… আট-আটটা। কালো স্রোতের মতো বেরিয়ে আসছে পুঁতিগুলো!
[১৮. কালো খনিজ পদার্থ।]
কালো মাকড়শার দল বেরিয়ে এসে সাদা টেবিলক্লথকে দখল করে নিলো পুরোপুরি। তারপর রোজির মা আর খোদ রোজিকে ঢেকে ফেলে সাদা পোশাকগুলোকে পুরোপুরি কালো বানিয়ে দিল। পরক্ষণে—যেন কোনো অশুভ মগজের নির্দেশ মেনে—স্রোতের মতো ভেসে এগোতে লাগল মোটকু চার্লির দিকে। পালাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল সে, কিন্তু ওর পা দুটোকে কেউ বুঝি রবারে পরিণত করেছে! মেঝেতে আছড়ে পড়ল বেচারা।
ওকে ধরে ফেলে মাকড়শার স্রোত। ছোট্ট ছোট্ট পাগুলো এখন ঘোরাফেরা করছে তার নগ্ন চামড়ার ওপর দিয়ে। উঠে দাঁড়াতে চাইল, কিন্তু পারল না। মাকড়শার স্রোত দিল না পারতে…
চিৎকার করতে চাইল মোটকু চার্লি, কিন্তু মুখটাও যে ভরে আছে কালো মাকড়শায়। ধীরে ধীরে ওর চোখও ঢেকে দিল তারা, কালো হয়ে গেল মোটকু চার্লির দুনিয়া…
.
চোখ খুলল মোটকু চার্লি, অন্ধকার বাদে আর কিছুই পড়ল না নজরে। চেঁচিয়ে উঠল বেচারা… চেঁচাতেই লাগল… চেঁচাতেই লাগল। তারপর টের পেল, বাতি নেভানো; জানালার পর্দাও নামানো। কেননা লোকজন এখন মুভি দেখছে।
এমনিতেই নরকের পথে যাত্রা করছে ওরা, মোটকু চার্লির চেঁচানি বাকিদের অবস্থা আরও খারাপ করে ফেলেছে।
উঠে দাঁড়িয়ে আইলে যাওয়ার চেষ্টা চালাল সে, যাবার পথে মাড়িয়ে দিল অনেকের পা। গ্যাঙওয়ের কাছে পৌঁছে, সোজা হওয়ার চেষ্টা করতে যেতেই মাথাটা ধাক্কা খেল লকারের সঙ্গে। ধাক্কার চোটে খুলে গেল লকার, যাত্রীদের হ্যান্ড লাগেজ বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ল বেচারার ওপর।
ধারে-কাছে থাকা মানুষজন, যারা দেখছিল ওর কর্মকাণ্ড, হেসে ফেলল। স্ল্যাপস্টিক কমেডির আদর্শ উদাহরণ দেখতে পেয়ে, আনন্দের সীমা রইল না তাদের।
অধ্যায় সাত – যেখানে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয় মোটকু চার্লিকে
অধ্যায় সাত – যেখানে লম্বা পথ পাড়ি দিতে হয় মোটকু চার্লিকে
চোখ কুঁচকে মোটকু চার্লির আমেরিকান পাসপোর্টের দিকে চেয়ে রইল ইমিগ্রেশন অফিসার। ভাবখানা এমন, পাসপোর্টটা অন্য কোনো দেশের হলেই সে খুশি হতো; এমন কোনো দেশের যার নাগরিককে চাইলেই সে তার দেশে ঢুকতে বাধা দিতে পারে। তারপর, দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ফেলে, হাত নেড়ে এগিয়ে যেতে বলল ওকে।
কাস্টমস থেকে বেরিয়ে কী করবে, তাই ভাবল মোটকু চার্লি। একটা গাড়ি ভাড়া করতে হবে, ভাবল সে, এবং পেটপুজোও সেরে নিবো।
ট্রাম থেকে নেমে, সিকিউরিটি ব্যারিয়ার অতিক্রম করল সে। পা রাখল অরল্যান্ডো বিমানবন্দরের কেনাকাটার জায়গায়। মিসেস হিগলারকে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যেন পড়ল আকাশ থেকে! যাত্রীদের মাঝে কাকে যেন খুঁজছে মহিলা। দুজনের চোখাচোখি হলো প্রায় একই সময়ে, ওর দিকে এগোল মিসেস হিগলার।
‘খিদে পেয়েছে?’ জানতে চাইল মহিলা।
জবাবে কেবল ওপর-নিচে মাথা নাড়ল ছেলেটা।
‘আশা করি,’ বলল মিসেস হিগলার। ‘টার্কি তোমার ভালো লাগে।’
মোটকু চার্লি একবার ভাবল, মিসেস হিগলারের লাল স্টেশন ওয়্যাগনটা কি সেই একই গাড়ি, যেটা ওর ছোটোবেলায় মহিলা চালাত? সম্ভবত একই। যুক্তি বলে, কোনো এক কালে নিশ্চয়ই নতুন ছিল; হাজার হলেও, সবকিছুই শুরুতে নতুন থাকে। সিটে ফাটল ধরে গেছে, চামড়ার কাভারেও। ড্যাশবোর্ডটাকে এখন ধুলোপড়া কাঠের সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায় খুব সহজেই।
ওদের দুজনের মাঝে, সিটের ওপর, বসে আছে বাদামি কাগজের শপিং ব্যাগ।
মিসেস হিগলারের অতিপ্রাচীন গাড়িতে কাপ হোল্ডার নেই, তাই কফির প্রকাণ্ড মগটাকে গাড়ি চালাবার সময় দুই পায়ের ফাঁকে গুঁজে রাখে মহিলা। সম্ভবত এসি আবিষ্কারের আগের যুগের গাড়ি ওটা, তবে জানালা নামানো। মোটকু চার্লির অবশ্য তাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না; ইংল্যান্ডের স্যাঁতস্যাঁতে শীতলতার পর, ফ্লোরিডার গরম ভালোই ঠেকছে। দক্ষিণে, টোল রোডের দিকে এগোচ্ছে মহিলা; আর কথা বলছে। প্রসঙ্গ: শেষ হারিকেনের ধাক্কা, ভাতিজা বেঞ্জামিনকে নিয়ে সি-ওয়ার্ল্ড আর ওয়াল্ট ডিজনি ওয়ার্ল্ড দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা, আর পর্যটকদের জন্য বানানো রিসোর্টগুলো দেখে আশাহত হবার গল্প নিয়ে। সেই সঙ্গে যোগ করল দালান বানানোর নানা আইন-কানুন, তেলের দাম, হিপ রিপ্লেসমেন্টের পরামর্শ দেওয়ায় ডাক্তারকে সরাসরি শুনিয়ে দেওয়া কথা, পর্যটকরা কেন বোকার মতো অ্যালিগেটরদের খেতে দেয় সেই কারণ। কেন যে নবাগতরা সৈকতে বাড়ি বানায়, আর যখন বাড়ি গিলে নেয় সমুদ্র কিংবা তাদের পোষা কুকুরকে গলাধঃকরণ করে অ্যালিগেটর, তখন অবাক হয়—সেই প্রশ্নও তুলল। চুপচাপ বসে সব শুনল মোটকু চার্লি, বুঝতে পারছে যে এসবই বলার জন্য বলা।
গতি কমিয়ে টিকেট কাটল মিসেস হিগলার, টোল রোড ধরে যেতে পারবে এখন। তবে মুখ এক মুহূর্তের জন্যও বন্ধ হয়নি, সেই সঙ্গে বন্ধ হয়নি চিন্তার ট্রেনও।
‘তো,’ অবশেষে বলল সে। ‘ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে?’
‘তুমি কিন্তু,’ অনুযোগ জানাল মোটকু চার্লি। ‘চাইলে আমাকে সাবধান করতে পারতে।’
‘সে যে দেবতা, সেই কথা তো জানিয়েছিলাম, নাকি?’
‘কিন্তু এটা তো বলোনি যে মানুষকে জঘন্য রকমের শূলবেদনা দিয়ে অভ্যস্ত আমার ভাই!’
নাক টানল মিসেস হিগলার, চুমুক দিল মগে।
‘কোথাও থেমে একটু খেয়ে নেওয়া যায় না?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। ‘বিমানে শুধু সিরিয়াল আর কলা ছিল। চামচও দিতে পারেনি। আমার কাছে আসার আগেই দুধ ফুরিয়ে গেছে। ক্ষমা প্রার্থনা করে, ফুড ভাউচার দিয়ে কাজ সেরেছে।’
মাথা নাড়ল মিসেস হিগলার।
‘তাহলে তো বিমানবন্দর থেকেই ভাউচার দেখিয়ে হ্যামবার্গার নিয়ে নিলে ভালো করতাম!’
‘একটু আগেই না বললাম,’ মুখ খুলল মিসেস হিগলার। ‘লোয়েলা ডানউইডি তোমার জন্য টার্কি রান্না করছে? যদি তুমি ম্যাকডোনাল্ডসে খেয়ে- দেয়ে ভরা পেটে হাজির হও, তাহলে তার কেমন লাগবে, বলো?’
‘কিন্তু খিদেয় যে আমার নাড়িভুঁড়ি হজম হবার জোগাড়। তাছাড়া পৌঁছতে এখনো কমপক্ষে ঘণ্টা দুয়েক লাগবে।’
‘আমি যেভাবে চালাই,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল মহিলা। ‘তাতে এত সময় লাগবে না।’
কথা শেষ করেই অ্যাক্সিলেটরে পা বসিয়ে দিল সে। ফ্রিওয়ে ধরে ছুটে যাচ্ছে গাড়ি; এরইমাঝে চোখ বন্ধ করে নিজের বাঁ পা দিয়ে কাল্পনিক ব্রেক চেপে ধরতে লাগল মোটকু চার্লি। ওকে দ্রুতই ক্লান্ত করে দিল কাজটা।
তবে দুই ঘণ্টারও অনেক কম সময়ের মাঝে টোল রোড পেরিয়ে স্থানীয় একটা মহাসড়কে এসে পড়ল ওরা। শহরের দিকে যাচ্ছে, বার্নস অ্যান্ড নোবল ও অফিস ডিপো অতিক্রম করল গাড়িটা। সাত-অঙ্ক মূল্যের বাড়িগুলোর সামনে দিয়েও গেল ওরা, যেগুলোতে আলাদা সিকিউরিটি গেট লাগানো হয়েছে। এরপর পুরাতন রেসিডেনশিয়াল এরিয়ার রাস্তায় উঠে এলো গাড়ি, ছোটোবেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেল মোটকু চার্লির; তখন অবশ্য এই রাস্তাগুলোর যত্ন নেওয়া হতো। ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান টেকঅ্যাওয়ে আর জ্যামাইকান পতাকাঅলা জানালার রেস্তোরাঁটাও ফেলে এলো পেছনে; কাচের ওপর হাতে লেখা হয়েছে বিভিন্ন খাবারের নাম।
জিভ থেকে জল গড়াতে লাগল মোটকু চার্লির, পেট গুড়গুড় করে ডাকছে।
আচমকা ঝাঁকি খেল গাড়িটা। এখানকার বাড়িগুলো অনেক বড়ো, এবং তুলনামূলক অনেক বেশি পরিচিত।
গোলাপি রঙের প্লাস্টিকের ফ্ল্যামিংগো এখনও বসে আছে মিসেস ডানউইডির সামনের প্রাঙ্গণে। তবে সূর্যের তাপে অনেক আগেই ঝলসে প্রায় সাদা হয়ে গেছে ওগুলো। সেই সঙ্গে দেখা যাচ্ছে আয়না দিয়ে বানানো একটা বল, যা সাধারণত ভবিষ্যৎ দেখার জন্য ব্যবহৃত হয়। এক মুহূর্তের জন্য মোটকু চার্লিকে ভয় পাইয়ে দিল সেটা, জীবনে এরচেয়ে বেশি ভয় অন্য কিছুকে পায়নি সে।
‘স্পাইডার কেমন যন্ত্রণা দিচ্ছে?’ জানতে চাইল মিসেস হিগলার, মিসেস ডানউইডির সদর দরজার দিকে এগোচ্ছে তারা।
‘এক কথায় জবাব দিই,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘সম্ভবত আমার বাগদত্তার সঙ্গে শুচ্ছে সে…যে কাজটা করা আমার দ্বারাও এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি!’
‘ওহ,’ বলল মিসেস হিগলার, বাজাল ডোরবেল।
.
ম্যাকবেথের সঙ্গে মিল আছে পরিস্থিতির, ভাবল মোটকু চার্লি। এক ঘণ্টা পরের কথা হচ্ছে কিন্তু এখন। সত্যি বলতে কী, যদি ম্যাকবেথের ডাইনিগুলো চারজন ছোটোখাটো বুড়ি মহিলা হতো, আর যদি তারা কেতলির তরল না নাড়িয়ে এবং ভয়ানক মন্ত্রোচ্চারণ না করে ম্যাকবেথকে আমন্ত্রণ জানিয়ে টার্কি, ভাত আর সবজি খেতে দিত চীনে মাটির সাদা থালা লাল-সাদা নক্সা কাটা প্লাস্টিকের টেবিলক্লথে সাজিয়ে — মিষ্টি আলুর পুডিং আর ঝাল-ঝাল বাঁধাকপির কথা নাহয় বাদই থাক—এবং জোর করত দ্বিতীয় এমনকি তৃতীয়বার থালা ভরে খাবার নিতে, যা শুনে ম্যাকবেথ ঘোষণা করত যে ‘আর সম্ভব না, এক লোকমা খেলেই পেটে ফেটে যাবে’, আর তারপরও ডাইনিরা জোর করে যার যার বানানো বিশেষ রাইস-পুডিং ও মিসেস বাস্টামন্টের বিখ্যাত আনারসের কেক খাইয়ে দিত…তাহলে একদম অবিকল ম্যাকবেথের মতো হতো দৃশ্যটা।
‘তো,’ মুখের কোনায় লেগে থাকা আনারসের কেকের অংশ মুছল মিসেস ডানউইডি। ‘তোমার ভাই তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে?’
‘হ্যাঁ, আমি একটা মাকড়শার সঙ্গে কথা বলেছিলাম… তারপরেই এসে হাজির। হয়তো দোষটা আমারই। ভাবিনি এমন কিছু হবে।’
টুট-টুট আর টাট-টাট শব্দে ভেসে এলো টেবিলে উপস্থিত সবার মুখ থেকে। মিসেস হিগলার আর মিসেস ডানউইডি এবং মিসেস বাস্টামন্টে ও মিস নোলস একসঙ্গে জিভ দিয়ে শব্দ করে মাথা দোলাল। ‘সবসময় বলত, তুমি আসলে দুজনের মাঝে বোকা,’ বলল মিস নোলস। ‘তোমার বাবার কথা বলছি…তবে কখনও বিশ্বাস করিনি ওর কথা!
‘আমি কীভাবে জানব যে এত কিছু হয়ে যাবে?’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি। ‘বাবা-মা তো আর আমাকে কাছে বসিয়ে বলেনি, ‘ভালো কথা, বাছা, তোমার একটা ভাই আছে; যদিও তার ব্যাপারে তুমি কিচ্ছু জানো না। ওকে যদি আমন্ত্রণ জানাও, তাহলে পুলিস তোমার পেছনে লাগবে, সে তোমার বাগদত্তাকে বিছানায় নেবে, তোমার বাড়িতে পা রেখে বাড়তি কামরাটায় আস্ত একটা বাড়ি ঢুকিয়ে দেব। সেই সঙ্গে তোমার মগজ-ধোলাই এমন ভাবে করবে যেন তুমি যতক্ষণ সম্ভব মুভি দেখে, তারপর সারা রাত বাড়ি ফেরার পথের খোঁজে মাথা কুটে মরো। আর—’ বলতে বলতে থেমে গেল মোটকু চার্লি।
বুড়ো মহিলাদের চোখের দৃষ্টি নিজের ওপর টের পেয়ে।
টেবিলের সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মিসেস হিগলার শুরু করল, তারপর একে-একে মিস নোলস থেকে মিসেস বাস্টামন্টে হয়ে মিসেস ডানউইডিও। নাড়া খাবার মতো একটা অভিজ্ঞতা যাকে বলে। কিন্তু ঢেকুর তুলে আবহটা নষ্ট করে দিল মিসেস বাস্টামন্টে।
‘এখন বলো, তুমি কী চাও?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস ডানউইডি। ‘নিজের মুখেই বলো।’
এবার নিজের চাহিদা ভাবতে বসল মোটকু চার্লি, মিসেস ডানউইডির ছোট্ট খাবার ঘরে বসে। বাইরে, দিনের আলো গলে গিয়ে গোধূলির রূপ নিচ্ছে। ‘আমার জীবনকে একেবারে দুর্যোগে পরিণত করেছে ও,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘চাই—স্পাইডার চলে যাক, শুধু চলে যাক। সম্ভব?’
তুলনামূলক কমবয়সী তিন মহিলা কিছুই বলল না, চুপচাপ চেয়ে রইল মিসেস ডানউইডির দিকে।
‘আসলে, আমরা ওকে চলে যেতে বাধ্য করতে পারব না,’ জানাল মিসেস ডানউইডি। ‘আমরা এরই মধ্যে একবার…’ থামিয়ে দিল সে নিজেকেই। যোগ করল, ‘যাক, আমাদের পক্ষে যা যা করা সম্ভব, করে ফেলেছি। বুঝলে?’
প্রশংসা করতেই হবে মোটকু চার্লির। মনে মনে খুব করে চাইলেই, বাইরে শক্ত করে রাখল নিজেকে; কান্নায় ভেঙে পড়তে দিল না। কেবল মাথা নেড়ে বলল, ‘তাহলে আরকী, তোমাদেরকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। ডিনারটা ভালো ছিল, ধন্যবাদ।’
‘আমরা হয়তো ওকে তাড়াতে পারব না, বলল মিসেস ডানউইডি, পুরু চশমার পেছনে থাকা বাদামি চোখের মণিটাকে এখন কালো দেখাচ্ছে। তবে এমন কারও কাছে পাঠাতে পারব, যে হয়তো…’
.
ফ্লোরিডায় সন্ধ্যা হয়েছে সবে, তারমানে লন্ডনে তখন মাঝরাত। রোজির বিশাল বিছানাটায়, যেখানে পিঠ ছোঁয়াবার সৌভাগ্য চার্লির কখনও হয়নি, শুয়ে কেঁপে উঠল স্পাইডার।
রোজি কাছিয়ে এলো অনেকটা, চামড়ার স্পর্শ পেল চামড়া। ‘চার্লস,’ বলল মেয়েটা। ‘তুমি ঠিক আছ?’ যুবকের বাহুর ফুটি ফুটি ফুসকুড়ির স্পর্শ পেল সে।
‘ঠিক আছি আমি,’ জানাল স্পাইডার।
‘একটু কেমন কেমন যেন লাগল।’
‘কেউ বোধহয় তোমার কথা মনে করছে, জানাল রোজি।
।নিজের কাছে মেয়েটাকে টেনে নিলো যুবক, চুমু খেল তারপর।
ডেইজি সেই মুহূর্তে বসে আছে হেনডনের বাড়ির ছোট্ট কমন রুমে, পরনে উজ্জ্বল সবুজ নাইটড্রেস আর আঁশ-আঁশ, উজ্জ্বল গোলাপি কার্পেট স্লিপার। একটা কম্পিউটারের পর্দার সামনে বসে আছে মেয়েটা, মাথা নাড়ছে আর মাউসে ক্লিক করছে।
‘আরও দেরি হবে?’ জিজ্ঞেস করল ক্যারোল। ‘আমাদের একটা আস্ত কম্পিউটার ইউনিট আছে এই কাজগুলো করার জন্য, জানা আছে তো?’
জবাবে কেবল একটা শব্দ করল ডেইজি। যেটা না ‘হ্যাঁ’ আর না ‘না’। কেউ-কিছু-বলেছে-কিন্তু-আমি-শব্দ-করলে-চলে-যাবে’ এমনটা বোঝাতে আমরা একটা শব্দ করি না? তেমনই শোনাল এটাও।
ক্যারোল আবার এই আওয়াজের সঙ্গে পূর্ব-পরিচিত।
‘ওই,’ বলল সে। ‘মোটা নিতম্বওয়ালি। আরও সময় লাগবে? আমি ব্লগ লিখব।’
শব্দগুলো ভাসা ভাসা ভাবে শুনল ডেইজি, তবে দুটো শব্দ কানে লেগে গেল ওর। ‘তুমি বলতে চাইছ, আমার পাছা মোটা?’
‘না,’ জানাল ক্যারোল। ‘বলছি যে দেরি হয়ে যাচ্ছে, ব্লগটা সারতে চাই।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডেইজি। ‘ঠিক আছে,’ জানাল সে। তবে কিছু একটা মিলছে না, এই যা সমস্যা।’
‘কী মিলছে না?’
‘তহবিল তছরুপ, অন্তত আমার সেটাই মনে হচ্ছে। যাক গে, আমি সিস্টেম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি। যা মন চায় করো। তবে একটা কথা বলে রাখি-রাজ পরিবারের সদস্য হবার যে ভান ধরছ, তাতে ঝামেলায় পড়তে হতে পারে!’
‘চুপ করো।’
ক্যারোল ব্লগিং করে ব্রিটিশ রাজপরিবারের এক যুবকের ভড়ং ধরে, যার ওপর কারও কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ নেই। ব্যাপারটা বেশ আলোচিতও হয়েছে, খবরের কাগজ মাতামাতি করে ওকে নিয়ে; কারও মতে ওর অস্তিত্ব আছে, আবার কেউ কেউ তা মানতে রাজি না। প্রথম পক্ষের যুক্তি হলো, ব্লগে ক্যারোল যা-যা লেখে তা কেবলমাত্র ব্রিটিশ রাজ পরিবারের সদস্যই জানতে পারে। আর দ্বিতীয় পক্ষের কথা: সেসব তো গ্লসি কাগজের গসিপ ম্যাগাজিন পড়লেও জানা যায়!
কম্পিউটারের সামনে থেকে উঠল ডেইজি, এখনও মাথা থেকে গ্রাহাম কোটস এজেন্সির লেনদেন সংক্রান্ত জটিলতা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
আরামসে নিজের শোবার ঘরে শুয়ে ঘুমুচ্ছে গ্রাহাম কোটস, পার্লির বাড়িটা বিশাল হলেও জাঁকালো বলা যায় না। যদি পৃথিবীতে সুবিচার বলতে কিছু থাকত, তাহলে হয়তো ঘুমের মাঝে গুঙিয়ে উঠত দুঃস্বপ্ন দেখে… ঘামে ভিজে যেত সারাটা দেহ। বিবেকের দংশনে নীল হয়ে যেত ব্যাটা। তাই এই কথা বলতে খারাপই লাগছে যে গ্রাহাম কোটস ঘুমুচ্ছে পেট ভরে দুধ খাওয়া শিশুর মতো, আর স্বপ্নে ওকে কিছুই জ্বালাচ্ছে না!
গ্রাহাম কোটসের বাড়ির কোনো এক কোণ থেকে ভদ্রভাবে বেজে উঠল গ্রান্ডফাদার ক্লক, এক-এক করে বারো বার। লন্ডনে, মাঝরাত উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু ফ্লোরিডাতে তখন সন্ধ্যা সাতটা।
যেটাই হোক না কেন, ডাইনিদের জাদু চালাবার আদর্শ সময় ওটাই।
.
মিসেস ডানউইডি প্লাস্টিকের লাল-সাদা টেবিলক্লথ সরিয়ে ফেলল।
‘কালো মোম কার কাছে আছে?’ জিজ্ঞেস করল সে।
মিস নোলস জানাল, ‘আমার কাছে,’ মহিলার পায়ের কাছে পড়ে আছে একটা শপিং ব্যাগ, সেটা হাতড়ে ভেতর থেকে চারটা মোম বের করে আনল সে। পুরোপুরি কালো না হলেও, কাজ চলে যাবে। তাদের মাঝে একটা লম্বা নক্সা-টক্সা নেই। বাকি তিনটা সাদা-কালো কার্টুনে দেখা পেঙ্গুইনের আকৃতির, সলতে বেরিয়ে আছে মাথার দিক থেকে। ‘এছাড়া কিছু পেলাম না,’ ক্ষমা- প্রার্থনার সুরে বলল সে। ‘তাও আবার তিন-তিনটা দোকান ঘুরতে হয়েছে!’
জবাবে কিছুই বলল না মিসেস ডানউইডি, কেবল মাথা নাড়ল। মোম চারটাকে বসাল টেবিলের চার কোনায়, তবে অ-পেঙ্গুইন মোমটা রাখল টেবিলের মাথায় যেখানে সে নিজে বসল। প্রত্যেকটা মোমই দাঁড়িয়ে আছে চারটা প্লাস্টিকের পিকনিকের থালায়। মিসেস ডানউইডি এবার বের করল কোসার লবণের[১৯] একটা বড়োসড়ো বাক্স, ভেতরে থাকা সব লবণ ঢেলে স্তুপ করল টেবিলে। তারপর ওগুলোর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে, শুকিয়ে হাড় হয়ে যাওয়া তর্জনী দিয়ে নাড়তে আর ঘাঁটতে শুরু করল স্তূপটা।
[১৯. টেবিলের লবণের তুলনায় রুক্ষ একপ্রকার লবণ যা মূলত কেবল রান্নায় ব্যবহৃত হয়।।]
রান্নাঘর থেকে ফিরে এলো মিস নোলস, হাতে তার কাচের একটা বড়ো পাত্র। টেবিলের ঠিক মাঝে বসিয়ে দিল সে ওটাকে। শেরির একটা বোতলের মুখ খুলে, ইচ্ছেমতো ঢালল পাত্রে।
‘এখন দরকার হলো, বলল মিসেস ডানউইডি। ‘দূর্বা ঘাস, সন্ধ্যামালতীর শেকড়, আর বিলাই-চিমটি।’
মিসেস বাস্টামন্টে তার শপিং ব্যাগ হাতড়িয়ে এবার বের করে আনল কাচের একটা ছোট্ট বয়াম। ‘এখানে জড়িবুটির মিশ্রণ আছে,’ জানাল সে। ‘কাজ হয়ে যাবার কথা।’
‘জড়িবুটি!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মিসেস ডানউইডি। ‘জড়িবুটি!’
‘অসুবিধে হবে?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস বাস্টামন্টে। ‘রেসিপিতে এটা-ওটা থাকলে তো আমি সবসময় এটাই ব্যবহার করি, দারুণ জিনিস।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মিসেস ডানউইডি। ‘কী আর করা, মেশাও।’
শেরিতে এবার ঢালা হলো বয়ামের অর্ধেকটা জড়িবুটি, শুকনো পাতাগুলো ভাসতে লাগল তরলের ওপরে।
‘এবার দরকার,’ বলল মিসেস ডানউইডি। ‘চার ধরনের মাটি। আশা করি,’ বলেই পেটের ওপর হাত বেঁধে বেছে বেছে শব্দ চয়ন করল মহিলা। ‘ওই জিনিস মেলেনি বলে এখন নুড়ি, মরা জেলিফিশ, ফ্রিজে লাগানোর চুম্বক আর সাবানের টুকরো ব্যবহার করতে হবে—এই কথা খবরদার কেউ বলবে না।’
‘আমি এনেছি,’ জানাল মিসেস হিগলার। বাদামি একটা কাগজের ব্যাগ বের করে আনল সে, ভেতর থেকে বের হলো চারটে জিপলক ব্যাগ প্রত্যেকটায় বালু অথবা শুকনো কাদা দেখা যাচ্ছে, একেকটার রং অন্যগুলোর চাইতে আলাদা। টেবিলের চারকোনায় এক-একটা করে ব্যাগ উপুড় করে ধরল সে
‘যাক, কেউ তো আমার কথা মন দিয়ে শুনেছে,’ বলল মিসেস ডানউইডি।
মোমবাতি ধরাল মিস নোলস, কাজটা করার সময় বলল: খুব সহজেই আগুন ধরে গেছে ওগুলোয়, আর দেখতেও কী ভীষণ সুন্দর!
অবশিষ্ট শেরি একটা করে গ্লাসে ঢেলে চার মহিলাকে দিল মিসেস বাস্টামন্টে।
‘আমি পাবো না?’ জানতে চাইল মোটকু চার্লি, যদি শেরি পছন্দ করে না বলে আসলে চায় না ও।
‘না,’ বলল মিসেস ডানউইডি। কড়া স্বরে যোগ করল, ‘পাবে না। মাথা স্থির রাখতে হবে তোমার।’ এরপর পার্সে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনল একটা ছোট্ট, সোনালি-রঙা, বড়ি রাখার কেস।
বাতি নিভিয়ে দিল মিসেস হিগলার।
পাঁচজনে মিলে বসে রইল টেবিলে, মোমের আলোয় উজ্জ্বল প্রত্যেকের চেহারা।
‘এবার কী?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। ‘সবাই হাত ধরাধরি করে মন্ত্র জপ?’
‘নাহ,’ ফিসফিসিয়ে জানাল মিসেস ডানউইডি। ‘একদম চুপ মেরে বসে থাকো, একটা শব্দও যেন তোমার মুখ থেকে না শোনা যায়।’
‘দুঃখিত,’ বলেই আফসোসে পড়ে গেল মোটকু চার্লি, কথা বলে ফেলেছে।
‘শোনো,’ বলল মিসেস ডানউইডি। ‘যেখানে যাচ্ছ, সেখানে সাহায্য পেলেও পেতে পারো। কিন্তু আগবাড়িয়ে কিছু দান কোরো না, এবং অবশ্যই…কোনো ধরনের প্রতিজ্ঞা করবে না। বুঝতে পারলে আমার কথা? যদি কাউকে কিছু দিতেই হয়, তাহলে বিনিময়ে সমান কিছু একটা পাওয়া নিশ্চিত করবে। ঠিক আছে?’
আরেকটু হলেই ‘হ্যাঁ’ বলে বসত মোটকু চার্লি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে কেবল মাথা দোলাল।
‘তাহলে তো খুবই ভালো,’ বলেই বেসুরো গলায় গুনগুন করতে লাগল মিসেস ডানইউডি, তার বুড়োটে কণ্ঠ কাঁপছে।
গুনগুন শুরু করল মিস নোলসও, তবে সুরেলা কণ্ঠে, ক্রমেই উঁচু হচ্ছে তার কণ্ঠ।
মিসেস বাস্টামন্টে গুনগুন না করে, হিসিয়ে উঠতে লাগল…তবে নির্দিষ্ট বিরতি মেনে। সাপের মতো শোনাল সেই হিসহিসানি, গুনগুনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
ঝট করে সোজা হলো মিসেস হিগলার। গুনগুন করল না সে, এমনকী হিসিয়েও উঠল না। বরঞ্চ বন্ধ জানালার পাশে যেভাবে গুঞ্জন করে মাছি ওড়ে, সেভাবে গুঞ্জন করতে লাগল। জিভ আর দাঁতের সাহায্যে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করল সে, মনে হলো যেন ক্ষিপ্ত একদল মৌমাছি মুখে পুড়ে রেখেছে; দাঁতের সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে ছোট্ট পোকাগুলো, বেরোতে চাইছে সেগুলো।
মোটকু চার্লি বুঝতে পারছে না, ওর এই মহিলাদের সঙ্গে যোগ দেওয়া উচিত কি না। কিন্তু দিলেও যে কী করবে, সেটাই তো বুঝতে পারছে না। তাই মন দিল বসে থেকে, অদ্ভুত এই সব আওয়াজে বিভ্রান্ত না হওয়ার প্রচেষ্টায়।
মিসেস হিগলার আচমকা এক চিমটি লাল মাটি ছুড়ে দিলে শেরি আর জড়িবুটি মিশ্রিত তরলে। মিসেস বাস্টামন্টে ছুড়ল এক চিমটি হলদে মাটি। মিস নোলসের ছুড়ে দেওয়া মাটিটা বাদামি রঙের। এদিকে মিসেস ডানউইডি খুবই ধীরে ধীরে ঝুঁকল সামনে, কালো মাটির একটা দলা ফেলল একই পাত্রে।
মিসেস ডানউইডি চুমুক দিল শেরিতে। তারপর আর্থরাইটিসে আক্রান্ত আঙুল দিয়ে কোনোক্রমে বড়ির কেস থেকে কিছু একটা বের করে নিয়ে ফেলল মোমের শিখায়। এক মুহূর্তের জন্য কামরা ভরে উঠল লেবুর সুগন্ধে, পরক্ষণেই কিছু একটা পোড়ার ঘ্রাণ দখল করল সেটাকে স্থান।
মিস নোলস এবার শুরু করল টেবিলের ওপর তবলা বাজানো। মোমের আলো কেঁপে উঠল, বিশাল কিছু ছায়া নাচতে শুরু করল দেওয়ালে। মিসেস হিগলারও যোগ দিল তাতে; তবে তালটা ভিন্ন, অনেকটাই দ্রুততর এবং অনেকটা টোকা মারার মতো। দুটো তাল মিলে তৈরি হলো নতুন একটা তাল।
মোটকু চার্লির মনে গুনগুন, হিসহিসানি, গুঞ্জন আর তবলার আওয়াজ এক হয়ে নতুন একটা শব্দের জন্ম দিল। মাথাটা হালকা হয়ে আসছে। সব কিছুই মনে হচ্ছে হাস্যকর, সব কিছুই যেন অবাস্তব। মহিলাদের আওয়াজ ছাপিয়ে শুনতে পাচ্ছে সে বনের বুনো পশু-পাখির শব্দ, শুনছে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনের গর্জন। ওর আঙুলগুলো যেন লম্বা হয়ে যাচ্ছে, পরিণত হচ্ছে রবারে; পাগুলো যেন অনেক দূরে কোথাও চলে গেছে।
যেন অনেকটা ওপরে কোথাও আছে সে, সব কিছুর ওপরে… তার নিচে আছে একটা টেবিলকে ঘিরে বসে থাকা পাঁচ জন মানুষ। আচমকা চার নারীর একজন নড়ে উঠে, টেবিলের মাঝখানে থাকা পাত্রে ফেলল কিছু একটা। এত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠল আভা যে মোটকু চার্লি মুহূর্তখানেকের জন্য প্রায় অন্ধ হয়ে গেল! চোখ বন্ধ করে ফেলল সে, কিন্তু আবিষ্কার করল—তাতে হিতে আরও বিপরীত হচ্ছে। চোখ বন্ধ অবস্থাতেও সবকিছু এত উজ্জ্বল যে একেবারেই স্বস্তি পাচ্ছে না।
চোখ কচলে তাকাল চারপাশে।
ঠিক পেছনেই পাথুরে একটা দেওয়াল যেন আকাশের সমান উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে: একটা পাহাড়ের পার্শ্বদিক হবে। সামনে গভীর খাদ, একটা ক্লিফ ওখানে। হেঁটে সেই ক্লিফের ধার পর্যন্ত গেল ও, ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিচের দিকে চাইল। সাদা কিছু জিনিস ধরা পড়ল ওর নজরে, ভাবল ওগুলো মেষ হতে পারে। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝে গেল, আসলে ওগুলো মেঘ! বড়ো বড়ো, সাদা, ফোলা মেঘ; ওর অনেকটা নিচে রয়েছে। মেঘেরও নিচে? কিচ্ছু নেই। নীল আকাশটাকে দেখা যাচ্ছে শুধু, মনে হলো তাকিয়ে থাকলে তার পরে মহাকাশ দেখা যাবে। তারও পরে হয়তো তারকা রাজির নির্মল, ঠান্ডা আলো।
খাদের ধার থেকে পিছিয়ে এলো সে এক ধাপ।
তারপর ঘুরে হাঁটতে শুরু করল পাহাড়ের দিকে, ওটা এতটাই লম্বা যে চোখ পিটপিট করে তাকিয়েও চূড়া দেখা গেল না। মনে হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে বুঝি পাহাড়টা ভেঙে পড়বে ওর ওপরে; চিরতরে কবর হয়ে যাবে তার। নিজেকে তাই বাধ্য করল সে নিচের দিকে তাকাতে, যেন মাটির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে।
এবার পায়ের নিচের মাটির কাছে, পাহাড়ের পার্শ্বে আবিষ্কার করল ছোটো ছোটো গর্ত; গুহামুখের মতো দেখতে।
পাহাড়ের পার্শ্ব আর খাদের মধ্যবর্তী স্থান, যেখানে সে দাঁড়িয়ে আছে, টেনেটুনে পৌনে এক মাইলও হবে না লম্বায়। বড়ো বড়ো পাথরে ভর্তি বালুময় পথও বলা যায় ওটাকে, যার এখানে সেখানে সবুজ ঝোপ দেখা যাচ্ছে; হয়তো একটা-দুটো ধুলোময় বাদামি গাছও। পথটা পাহাড়ের পাশ ধরে চলে গেছে তো গেছেই, দিগন্তে হারিয়ে যাবার আগে ফুরোয়নি।
কেউ একজন দেখছে আমাকে, ভাবল মোটকু চার্লি। ‘হ্যালো?’ মাথা পেছনে হেলে ডাকল সে। ‘হ্যালো, কেউ আছে?’
একদম কাছে থাকা গুহামুখের ভেতর থেকে বাইরে পা রাখল একজন মানুষ। লোকটার ত্বক মোটকু চার্লির তুলনায় কালো হবে, এমনকী স্পাইডারের চেয়েও। কিন্তু লম্বা চুলগুলো ময়লা বাদামি, কেশরের মতো দুলছে চেহারার সামনে। কোমরের সঙ্গে পেঁচিয়ে রেখেছে হলদে রঙা, সিংহের চামড়া; মাঝখান থেকে ঝুলছে সিংহের লেজ, পেছনে আরকি। কাঁধের কাছে ভনভন করতে থাকা একটা মাছি তাড়াল লেজটা।
সোনালি চোখ পিটপিট করে ওর দিকেই তাকিয়ে রইল।
‘কে তুমি?’ গমগমে কণ্ঠে যেন গর্জে উঠল লোকটা। ‘কার অনুমতিতে এখানে পা রেখেছ?’
‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘মাকড়শা আনানসি আমার বাবা ছিল।’
বিশাল মাথাটা দুলে উঠল। ‘তাহলে এখানে কেন এসেছ? আমার বন্ধু আনানসির সন্তান?’
আর কেউ নেই আশপাশে, অন্তত মোটকু চার্লির জানামতে নেই। তারপরও মনে হচ্ছে যেন অনেকেই শুনতে ওদের কথা, অনেকগুলো কান পেতে আছে এদিকেই। উচ্চ কণ্ঠে বলল মোটকু চার্লি, তাই যেন সবাই পরিষ্কার শুনতে পায়। ‘আমার ভাই, আমার জীবন একেবারে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ওকে তাড়াবার সামর্থ্য আমার নেই।’
‘তাই তুমি আমাদের সাহায্য প্রার্থনা করছ?’ জিজ্ঞেস করল সিংহ।
‘হ্যাঁ।’
‘তা তোমার এই ভাই…তার দেহেও কি আনানসির রক্ত বইছে?’
‘ও একদম আমার মতো না,’ মোটকু চার্লি জানাল। ‘সে তোমাদের একজন।’
তরল সোনা নড়ে উঠল যেন, মানব-সিংহ লাফিয়ে একটু সামনে এগিয়ে এলো। আলসে ভঙ্গিতে নড়লেও, এক ঝটকায় পেরিয়ে গেল পঞ্চাশটা গজ। এখন ও দাঁড়িয়ে আছে মোটকু চার্লির পাশে, অধৈর্য ভঙ্গিতে নড়ছে লেজটা।
হাত ভাঁজ করে মোটকু চার্লির দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘তা এই ব্যাপারটা নিজে সামলাচ্ছ না কেন?’
শুকিয়ে গেল মোটকু চার্লির মুখ, গলার ভেতর যেন একগাদা ধুলো ঢুকে গেছে। সামনে দাঁড়ানো প্রাণিটা, মানুষের চাইতে অনেক লম্বা হলেও, মানুষের মতো গন্ধ একদম নেই দেহে। শ্বদন্তগুলোর সুচালো ভাগ খোঁচাচ্ছে নিচের ঠোঁটটাকে।
‘পারছি না তো,’ কোনোক্রমে জানাল মোটকু চার্লি।
ঠিক পাশের গুহামুখ থেকে উঁকি দিল প্রকাণ্ড এক লোক। ত্বক তার বাদামি-ধূসর, একেবারে কুঁচকানো; পাগুলো গোল। ‘যদি ভাইয়ের সঙ্গে তুমি ঝগড়া করো,’ বলল লোকটা। ‘তাহলে সেই বিচার করবে তোমাদের বাবা। পরিবারের যে মাথা, তার হাতে বিচারের দায়িত্ব তুলে দাও। সেটাই তো আইন।’ মাথা পেছনে হেলিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করল সে। গলার ভেতর, নাকের পেছন থেকে বেরিয়ে আসা শব্দটা শুনেই বুঝে গেল মোটকু চার্লি-সে এখন হাতির দিকে তাকিয়ে আছে।
ঢোক গিলল সে। ‘আমার বাবা মারা গেছে,’ আশাতীত পরিষ্কার শোনাল ওর গলা। পাহাড়ের দেওয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো ওর কণ্ঠ। হাজারো গুহামুখ থেকে যেন ওর কথা ওকেই শুনিয়ে দিল সবাই। মারা গেছে মারা গেছে-মারা গেছে-মারা গেছে, জানাল সেই প্রতিধ্বনি। ‘সেজন্যই আসতে হয়েছে আমাকে।’
সিংহ বলল, ‘মাকড়শা আনানসির প্রতি আমার বিন্দুমাত্র দুর্বলতা নেই। অনেক অনেক দিন আগে, আমাকে একটা ডালের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিল সে; তারপর ধুলোর মাঝে টানিয়েছে গাধাকে দিয়ে; মাওউ, যিনি সব কিছুর স্রষ্টা, একদম তার আসন পর্যন্ত!’ স্মৃতিটা মনে পড়ে যাওয়ায় গর্জে উঠল যেন, মোটকু চার্লির মনে হলো: এই মুহূর্তে অন্য কোথাও থাকলেই ভালো হতো হয়তো।
‘এগোতে থাকো,’ বলল সিংহ। ‘হয়তো এমন কাউকে পাবে, যে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। তবে আমি সেই সাহায্যকারী নই।’
হাতি জবাব দিল, ‘আমিও না। তোমার বাবা ধোঁকা দিয়ে আমার পেটের চর্বি খেয়ে ফেলেছিল। বলেছিল, আমার পরার জন্য কিছু জুতো বানাবে। তারপর আমাকেই রান্না করে হাসতে হাসতে খেয়েছে। আমি এসব ভুলি না!’
তাই করল মোটকু চার্লি।
পরবর্তী গুহার মুখে দাঁড়িয়ে আছে চটকদার সবুজ স্যুট আর হ্যাট পরা এক লোক। হ্যাটটাকে গোল করে পেঁচিয়ে রেখেছে সাপের চামড়ার ব্যান্ড। পরনেও একই রকম বুট আর সাপের চামড়া দিয়ে বানানো কোমরবন্ধনী। মোটকু চার্লি কাছাকাছি এলে হিসিয়ে উঠল সে। ‘হাঁটতে থাকো, আনানসির বাচ্চা,’ বলল সাপ, কণ্ঠটা শুষ্ক। ‘তোমার পুরো পরিবারটাই যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছু না। তোমাদের ঝামেলায় আমি জড়াচ্ছি না বাবা।’
পরের গুহামুখ থেকে বেরিয়ে আসা মেয়েটা খুবই সুন্দর, চোখ কালো তেলের ফোঁটার ন্যায়। গোঁফ আছে, তবে তুষারের মতো সাদা; ঠিক তার ত্বকের মতোই। বুকে দুই সারি স্তন।
‘তোমার বাবাকে আমি চিনতাম,’ জানাল সে। ‘অনেক অনেক দিন আগে, হো-ই।’ স্মৃতিটা মনে করে মাথা নাড়ল একবার। মোটকু চার্লির মনে হলো, এইমাত্র যেন ব্যক্তিগত কোনো চিঠি পড়ে ফেলেছে। ওকে উড়ন্ত চুমু উপহার দিল মেয়েটা, কিন্তু মাথা নেড়ে কাছে আসতে মানা করল। জানাল, আনানসির জন্য অনেক ভুগতে হয়েছে তার পরিবারকে।
হাঁটতে লাগল মোটকু চার্লি। মরা একটা গাছ পড়ল সামনে, মাটিতে পোঁতা। একগাদা ধূসর, পুরাতন হাড়ের মতো দেখাচ্ছে। ছায়াগুলো এখন আরও লম্বা হচ্ছে, সূর্য ধীরে ধীরে নেমে আসছে অসীম আকাশ ধরে। সূর্যটাকে দেখে মনে পড়ে যায় বিশাল কোনো সোনালি-কমলা গোলকের কথা। তার ঠিক নিচেই থাকা ছোট্ট সাদা মেঘগুলোকে যেন সে ভরিয়ে তুলছে সোনালি আর বেগুনি রঙে।
নেকড়ের মতো করে অ্যাসাইরিয়ানরা আছড়ে পড়ল জমায়েতের ওপর, ভাবল মোটকু চার্লি। বহুদিন আগে পড়া এই লাইনটা ভুলে ছিল এতদিন। তার কোহর্টরা জ্বলজ্বল করছে সোনালি আর বেগুনি পোশাকে। কোহর্ট[২০] মানে কী, তা মনে করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো সে। সম্ভবত, ভাবল, কোনো এক রকমের রথ হবে।
[২০. দল, এখানে সেনাবাহিনীর এক অংশকে বোঝানো হচ্ছে। সাধারণত ৪৮০ জন থাকে সেই দলে।]
নড়ে উঠল কিছু একটা, ঠিক ওর কনুইয়ের কাছে। টের পেল, একটু আগে যেটাকে মরা গাছের তলে থাকা বাদামি পাথর ভেবেছিল সেটা আসলে একটা মানুষ। বালু-রঙা ত্বক, পিঠটা চিতাবাঘের মতো দাগকাটা। চুল বড়ো বড়ো, ঘন আর কালো। হাসল যখন তখন বেরিয়ে এলো বিশাল, বিড়ালের মতো দাঁত। তবে হাসিটার স্থায়িত্ব হলো খুবই অল্প, সেই হাসিতে কোনো উষ্ণতা বা আমোদ কিংবা বন্ধুত্ব ছিল না। বলল সে, ‘আমি বাঘ, তোমার বাবা শত শত
বার আমাকে আহত করেছে। আর অপমান তো করেছে হাজারো বার। বাঘরা কিস্যু ভোলে না।’
‘আমি দুঃখিত,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘তোমার সঙ্গে হাঁটব আমি,’ জানাল বাঘ। ‘অন্তত কিছুটা পথ হলেও হাঁটব। তা বলছ যে আনানসি মারা গেছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘বেশ, বেশ, বেশ। বহুবার আমাকে বোকা বানিয়েছে সে। একদা সব কিছুর মালিক ছিলাম আমি—গল্প, চাঁদ-তারা… সবকিছুর। কিন্তু আমার কাছে থেকে সব চুরি করেছে সে। মারা যখন গেছে, তখন আশা করি মানুষ তার বানানো ওই জঘন্য গল্পগুলো ভুলে যাবে। বন্ধ হবে আমার দিকে তাকিয়ে উপহাসের হাসি হাসা।’
‘আমারও তাই মনে হয়,’ মোটকু চার্লি বলল। ‘আমি কখনও হাসিনি আপনাকে উপহাস করে।’
লোকটার সবুজ-রঙা চোখ জ্বলে উঠল আচমকা। ‘রক্ত রক্তই,’ জানাল সে। ‘আনানসির বংশধর মানে…সেই আনানসিই।’
‘আমি আমার বাবা নই,’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি।
দাঁত খিঁচাল বাঘ, খুবই তীক্ষ্ণ সেই দাঁতগুলো। ‘সবাইকে হাস্যকর কথা বলে বেরানোই কি তোমার কাজ?’ প্রশ্ন করল বাঘ। ‘এই বিশাল, গম্ভীর দুনিয়াতে হাসার মতো কিচ্ছু নেই, কিচ্ছু না। তাই বাচ্চাদেরকে ভয় পাওয়া শেখাতে হবে, শেখাতে হবে আতঙ্কে কেঁপে ওঠা। ওদেরকে শেখাও, কীভাবে নৃশংস হতে হয়, শেখাও কীভাবে অন্ধকারে ওঁত পেতে থাকে বিপদ। নিজেকে লুকাতে শেখাও ছায়ায়, শেখাও কীভাবে সুযোগ বুঝে সবসময় ঝাঁপিয়ে পড়ে হত্যা করতে হয়। জীবনের সত্যিকার অর্থ জানো?’
‘উম,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘একে-অন্যকে ভালোবাসা?’
‘জীবনের অর্থ হলো শিকারের উষ্ণ রক্তের স্বাদ নিজের জিভে পাওয়া। তার মাংস টেনে ছেঁড়া দাঁতে আটকে, শত্রুর লাশ সূর্যের আলোতে ফেলে আসা শকুন হায়েনার খাবার হতে। এই হলো জীবনের অর্থ। আমি বাঘ, আনানসির চাইতে অনেক বেশি শক্তিশালী আমি; বিশাল, বিপজ্জনক, শক্তিশালী, জ্ঞানী, নৃশংস…
এইখানে, মানে বাঘের সঙ্গে কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই মোটকু চার্লির। নাহ, বাঘ যে একেবারে বদ্ধ পাগল, সেজন্য না; কারণটা হলো: যা বলছে, তা বাঘ অন্তর থেকে বিশ্বাস করে বলেই বলছে। আর সেই বিশ্বাসের প্রত্যেকটাই সমান বাজে। তাছাড়া ওর দিকে তাকাতেই যেন কার কথা মনে পড়ে মোটকু চার্লির। কার কথা, তা ঠিক বলতে না পারলেও জানে, মানুষটাকে সে অপছন্দ করে। ‘আমার ভাইকে তাড়াতে সাহায্য করবে?’
কাশল বাঘ। হতে পারে একটা পালক, কিংবা হয়তো পুরো একটা পাখি আটকে গেছে ওর গলায়।
‘পানি এনে দেব?’ জানতে চাইল মোটকু চার্লি।
সন্দেহের দৃষ্টিতে বাঘ চাইল মোটকু চার্লির দিকে। ‘শেষ যখন আমাকে আনানসি পানি খাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল, সেবার পুকুরে ডুবে থাকা চাঁদ গেলার চেষ্টা করতে গিয়ে ডুবে যাই!’
‘আমি তো কেবল সাহায্য করতে চাচ্ছিলাম আপনাকে।’
এই একই কথা তো বলেছিল তোমার বাবাও!’ মোটকু চার্লির দিকে ঝুঁকল বাঘ, চোখ রাখল ওর চোখে। কাছ থেকে বাঘকে দেখে কোনোভাবেই মানুষ মনে হবার কোনো কারণ নেই—নাক মাত্রাতিরিক্ত সমতল, চোখ অপ্রতিসাম্য ভাবে বসানো, গা থেকে চিড়িয়াখানার খাঁচার গন্ধ ভেসে আসে। কণ্ঠে যেন মেঘের গর্জন। ‘আমাকে সাহায্য করতে পারো মাত্র একটা উপায়ে, আনানসির সন্তান। তোমার বংশের সবার জন্যই কথাটা প্রযোজ্য। দূরে থাকো আমার কাছ থেকে, বুঝলে? যদি হাড়ে মাংস লেগে থাকুক, এটা চাও তো আমার কথা শোনো।’ আবার ঠোঁট চাটল সে, জিভটা লাল হয়ে আছে সদ্য শিকার করা পশুর মাংসে। যেকোনো মানুষের চাইতে লম্বা সেই জিভ।
ঝট করে পিছিয়ে গেল মোটকু চার্লি, নিশ্চিত ভাবেই জানে–এখন দৌড়াবার চেষ্টা করা মাত্র ওর ঘাড়ে কামড় বসিয়ে দেবে বাঘ। ওটার সঙ্গে এখন মানুষের ছিটেফোঁটাও মিল নেই: আকারেও বলতে গেলে জলজ্যান্ত বাঘের সমান। বিশাল একটা বাঘ সামনে হাজির হয়েছে নরখেকো হয়ে, ইঁদুরের ঘাড় যেভাবে কামড়ে ভেঙে ফেলে সেভাবে মানুষের ঘাড় ভাঙতেও তার বিন্দুমাত্র কষ্ট হবে না।
আর তাই, বাঘের ওপর একটা চোখ স্থির রেখে, সরে আসতে লাগল ধীরে ধীরে। খানিকক্ষণের মাঝেই ওটা ফিরে গেল মরা গাছের কাছে, হারিয়ে গেল ডাল-পাতার মাঝে; শুধুমাত্র অধৈর্য হয়ে লেজ নাড়ার কারণে ধরা পড়ছে চোখে।
‘ওকে নিয়ে ভেবো না,’ আরেকটা গুহার মুখ থেকে ভেসে এলো এক নারী-কণ্ঠ। ‘এদিকে এসো।’
সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না মোটকু চার্লি—মেয়েটা সুন্দর, নাকি কুৎসিত? আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল ওই গুহার মুখের দিকে।
‘ভাব তো ধরে যেন ব্যাটা হর্তা-কর্তা-বিধাতা, কিন্তু আসলে নিজের ছায়াকেই ভয় পায়! তোমার বাবাকে তো পেত আরও বেশি। চোয়ালে জোরও নেই একদম।’
মেয়েটার চেহারায় কুকুর-কুকুর একটা ভাব আছে। উঁহু, ঠিক কুকুর না…
‘কিন্তু আমার কথা আলাদা,’ চার্লি মুখের কাছে পৌঁছানো মাত্র বলল মেয়েটা। ‘আমি একেবারে হাড় পর্যন্ত চিবিয়ে তুষ বানিয়ে ফেলি! আর কে না জানে, আসল জিনিস তো হাড়ের মাঝেই লুকিয়ে থাকে। মিষ্টি, রসালো জিনিস কই পাওয়া যাবে তা কেবল আমিই জানি।’
‘আমি এমন কাউকে খুঁজছি, যে আমাকে আমার ভাইয়ের হাত থেকে বাঁচতে সাহায্য করতে পারবে।’
মাথা পেছনে হেলিয়ে হেসে ফেলল মেয়েটা; লম্বা, উঁচু কণ্ঠে পাগলাটে হাসি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিনে ফেলল মোটকু চার্লি।
‘সাহায্য তো পাবে না, নিজের সাহায্য নিজেকেই করতে হবে।’ জানাল মেয়েটা। ‘এদের প্রত্যেকে তোমার বাপের বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে ভুগেছে। তোমার বংশের নাম শুনলেই পিত্তি জ্বলে যায় বাঘের। কিন্তু তোমার বাপ বেঁচে থাকতে সে কিচ্ছু করার সাহস পায়নি। তাই শোনো আমার কথা—এগোতে থাকো সামনে। নিঃসন্দেহে বলতে পারি, একটা খালি গুহা খুঁজে পাওয়ার আগ পর্যন্ত, এমন কাউকে পাবে না যে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। যাও, ওখানে যাকে পাবে তার সঙ্গে কথা বোলো। বুঝতে পারছ?’
‘তেমনটাই তো মনে হচ্ছে।’
হাসল মেয়েটা, হাসিটা ঠিক সুখকর নয়। ‘আমার সঙ্গে কিছু সময় কাটাতে চাচ্ছ নাকি? আমি কিন্তু অনেক কিছুই শেখাতে পারি। প্রবাদ তো শুনেইছ—হায়েনার চাইতে খারাপ, নৃশংস কিংবা জঘন্য আর কিছুই হতে পারে না!’
মোটকু চার্লি মাথা নেড়ে হাঁটা অব্যাহত রাখল। পৃথিবীর শেষ মাথায় অবস্থিত, পাথুরে দেওয়াল ঘেঁষে অবস্থিত গুহামুখগুলোর প্রত্যেকটায় উঁকি দিল একবার করে। নানা আকারের আর নানা আকৃতির মানুষে ভরতি ওগুলো; ছোট্ট মানুষ যেমন আছে, তেমনি আছে বড়োসড়ো মানুষও; আছে নারী, আবার আছে পুরুষও। ওর চোখের সামনেই, ছায়া থেকে আলোতে আসায় তাদের পাখনা, আঁশ, শিং কিংবা নখর ধরা পড়ল তার নজরে।
মাঝে-মধ্যে তো ওকে দেখেই উলটো ভয় পেয়ে গেল গুহাবাসীরা, একেবারে পেছনের দেওয়ালের সঙ্গে সিটিয়ে গেল তারা। কেউ-কেউ আবার এগিয়েও এলো, চোখে-মুখে যুদ্ধংদেহী ভাব কিংবা কৌতূহল নিয়ে তাকাল ওর দিকে।
গুহার মুখের ওপর থেকে কিছু একটা বাতাসে ভেসে পড়ল মোটকু চার্লির ঠিক পাশেই। ‘হ্যালো,’ অনেকটা দম আটকেই বলল সেটা।
‘হ্যালো,’ জানাল মোটকু চার্লি।
নবাগত বেশ উত্তেজিত, এবং লোমশ। হাত-পাগুলোকে কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছে। আসলে সে কে, তাই বুঝতে চাইল মোটকু চার্লি। অন্য মানব- পশুগুলোও আসলে পশু ছিল…সেই সঙ্গে মানুষও। কিন্তু তাদের মাঝে তেমন অদ্ভুত কিংবা প্রথম দর্শনে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার মতো অসামঞ্জস্য ছিল না; জেব্রার দেহে যেমন সাদা-কালো দাগ দারুণ মানিয়ে যায়, তেমনি মানিয়ে গেছিল তাদের মাঝে মানুষে-পশুতে। কিন্তু এই জিনিসটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন মানুষের সঙ্গে মেশানো হয়েছে প্রায়-মানুষকে।
আচমকা চিনে ফেলল মোটকু চার্লি।
‘বানর,’ বলল সে। ‘তুমি বানর।’
‘জাম আছে?’ জিজ্ঞেস করল বানর। ‘আম? কিংবা ডুমুর?’
‘নাহ, দুঃখিত।’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘খাওয়ার মতো কিছু একটা দাও,’ অনুরোধ করল বানর। ‘তোমার বন্ধু বনে যাবো।’
মিসেস ডানউইডি এই ব্যাপারে আগেই সাবধান করে দিয়েছে ওকে। আগবাড়িয়ে কিছু দান কোরো না, ভাবল সে। এবং অবশ্যই…কোনো ধরনের প্রতিজ্ঞা করবে না।
‘তোমাকে আমি কিছুই দিতে পারব না, দুঃখিত।’
‘তা তুমি মানুষটা কে হে?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল বানর। ‘উঁহু… তুমি আসলে কী? আধা-মানুষ মনে হচ্ছে। এখানে থাকো? নাকি ওখান থেকে এসেছ?’
‘আনানসি আমার বাবা,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘এমন কাউকে খুঁজছি যে আমার ভাইকে তাড়িয়ে দিতে সাহায্য করতে পারবে।’
‘তাতে কিন্তু আনানসি খেপে যেতে পারে,’ শিউরে উঠল বানর। ‘একদম উচিত হবে না ওকে খেপানো…তাহলে কিন্তু আর কখনও কোনো গল্প পাবে না!’
‘আনানসি মারা গেছে,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘ওখানে মরেছে,’ পালটা জবাব দিল বানর। ‘কিন্তু এখানে মরেছে কি? দুটোর মাঝে আকাশ-পাতাল ফারাক!’
‘মানে, সে এখানে থাকতে পারে?’ ক্লান্ত চোখে চোখ তুলে মোটকু চার্লি চাইল পাহাড়ের দিকে: ওই পাহাড়ের কোনো একটা গুহায় দুম করে বাপের সামনে পড়ে যেতে পারে, ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। কল্পনার চোখে বাপকে দেখতে পেল সে রকিং চেয়ারে বসা অবস্থায়, মাথায় সবুজ ফেডোরা হ্যাট, আরাম করে পান করছে ব্রাউন এল, হাই ঢাকছে লেবুর মতো হলদে দস্তানা দিয়ে।
ভাবতেই শিউরে উঠল বেচারা।
‘কে? কী?’
‘মানে, সে এখানে থাকতে পারে?’
‘কে?’
‘আমার বাবা।’
‘তোমার বাবা?’
‘আনানসি!’
সঙ্গে সঙ্গে ভয়ে লাফিয়ে একটা পাথরের ওপর উঠে পড়ল বানর, তারপর ভয়ার্ত কণ্ঠে তাকাল এপাশ থেকে ওপাশ। ‘আনানসি? এখানে আছে?’
‘এই প্রশ্নটা তো আমি তোমাকে করছিলাম,’ বলল মোটকু চার্লি।
আচমকা দোল খেল বানর, পা ওপরে আর মাথা নিচে দিয়ে সরাসরি মোটকু চার্লির দিকে তাকিয়ে ঝুলছে সে। মাঝে-মধ্যে ফিরে যায় দুনিয়ার বুকে,’ জানাল বানর। ‘এসো হে চালাক বানর, এসো। আমাদের সঙ্গে বসে জাম খাও। তোমার জন্য এনেছি আমরা বাদাম, আর সবজি…আর ডুমুর।’
‘আমার বাবা এখানে আছে?’ ধৈর্য ধরে জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি।
‘ওর কোনো গুহা নেই,’ জানাল বানর। ‘থাকলে জানতাম, সম্ভবত জানতাম। হয়তো আছে, আমিই ভুলে গেছি। তবে যদি আমাকে একটা জাম দাও, তাহলে মনে পড়তেও পারে।’
‘আমার কাছে কিছুই নেই,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘জাম নেই?’
‘কিচ্ছু না।’
পাথরের ওপরে থাকা বানর এবার আরও ওপরে উঠে হারিয়ে গেল।
পাথুরে পথ ধরে এগোতে লাগল মোটকু চার্লি। সূর্য অনেকটা ডুবে গেছে, পথের সঙ্গে একই তলে চলে এসেছে এখন; উজ্জ্বল কমলা দেখাচ্ছে গোলকটা। আলো সরাসরি পাঠিয়ে দিচ্ছে গুহায়, প্রতিটায় রয়েছে কেউ-না-কেউ। দেখা গেল গণ্ডার, কাছের জিনিস দেখার শক্তিও বেচারার চোখের নেই; তবে ধূসর ত্বক দেখা যাচ্ছে। আর ওই যে, অগভীর পানিতে ভাসছে গাছের পচা কাণ্ড; কুমির ওটা, চোখজোড়া কাচের মতো কালো।
আচমকা পেছন থেকে ভেসে এলো কিছু একটা নড়ার শব্দ, পাথরে পা রেখেছে কেউ। চমকে পিছু ফিরে চাইল মোটকু চার্লি। বানর তাকিয়ে আছে ওর দিকে, পাথুরে পথে ঘষা খাচ্ছে তার আঙুলের গাঁট।
‘সত্যি বলছি, আমার কাছে কোনো ফল-টল নেই,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘নইলে সত্যি সত্যি দিতাম।’
বানর বলল, ‘তোমার জন্য মায়া হচ্ছিল। এক কাজ করো, ফিরে যাও বাড়িতে। এখানে আসার ফন্দিটা একদম, একদম, একদম ভালো ছিল না। বুঝলে? যাবে ফিরে?’
‘না,’ জানাল মোটকু চার্লি।
‘আহ,’ বলল বানর। ‘বেশ তাহলে, বেশ, বেশ বেশ।’ নড়া-চড়া থেমে গেল ওর, তারপর চোখ ধাঁধানো গতিতে ছুটে গেল মোটকু চার্লির পাশ দিয়ে; থমকে দাঁড়াল খানিক দূরের একটা গুহার সামনে।
‘ভেতরে যেয়ো না,’ ডাকল সে। ‘খারাপ জায়গা।’ ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল গুহার মুখ।
‘কেন?’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘ভেতরে কে আছে?’
‘কেউ নেই,’ গর্বের সঙ্গে জানাল বানর। ‘তাই নিশ্চয়ই এই গুহা তোমার লক্ষ্য না?’
‘হ্যাঁ,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘এটাই আমার লক্ষ্য।’
কিচির-মিচির করে লাফাতে লাগল বানর। মোটকু চার্লি পাত্তা না দিয়ে পাথর বেয়ে উঠতে লাগল, গুহামুখের সামনে পৌঁছুবার আগে থামল না। ওকে চমকে দিয়ে ঠিক তখনই পৃথিবীর শেষ প্রান্তে, পর্বতের ওপাশে ডুব দিল রক্ত- রাঙা সূর্য।
পৃথিবীর শুরুতে যে পাহাড়গুলো আছে তার সামনে থাকা পথ ধরে এগোতে গিয়ে (একমাত্র উলটো দিক থেকে আসলে সেই পাহাড়গুলো পৃথিবীর শেষে অবস্থিত মনে হয়), বাস্তবতা বড়োই অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য ঠেকে। এই পাহাড়-সারি এবং তাদের গুহাগুলো নির্মিত হয়েছে পুরাতন গল্পের মাধ্যমে (মানুষের আবির্ভাবের অনেক আগেকার গল্প এগুলো; কেন যে ভাবছেন, মানুষের কাছ থেকেই জন্ম হয়েছে গল্পের তা কে জানে?)। পথ ছেড়ে গুহায় পা রাখতেই মোটকু চার্লির মনে হলো, যেন অন্য কারও বাস্তবতায় এসে উপস্থিত হয়েছে। গুহাটা গভীর; মেঝে সাদা হয়ে আছে পাখির মলে। সেই সঙ্গে আছে পালকও, এখানে-সেখানে পড়ে আছে পাখির মরদেহ; শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
গুহার ভেতরটায় অন্ধকার ছাড়া আর কিছু নেই।
‘কেউ আছে?’ ডাকল মোটকু চার্লি। গুহার ভেতর থেকে ফিরে এলো প্রতিধ্বনি। আছে-ছে-ছে-ছে শোনা গেল চারপাশে। হাঁটা অব্যাহত রাখল সে, গুহার ভেতরের অন্ধকার স্পর্শ করা যাবে মনে হচ্ছে। অন্ধকার, পাতলা কিছু একটা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে তার চোখ। ধীরে ধীরে পা ফেলল সামনে, একেক বারে একেক পা। হাত বাড়িয়ে দিল সামনে।
আচমকা নড়ে উঠল কিছু একটা।
‘হ্যালো,’ হালকা আলোতে সয়ে এলো ওর চোখ, কিছু একটা দেখতে পাচ্ছে। কিচ্ছু না আসলে, পালকঅলা চামড়ার ঝোলা কেবল। আরেক পা এগোতেই বাতাসে নড়ে উঠল পালক, চামড়াটা বাড়ি খেল মেঝেতে।
কিছু একটা উড়ছে ওর আশপাশে, কবুতরের পাখা ঝাপটানোর আওয়াজ হচ্ছে বাতাসে।
ঘূর্ণি জন্ম নিলো। চোখে-মুখে সূচের মতো বিঁধল ধূলিকণা। ঠান্ডা বাতাসে পিটপিট করে চাইল মোটকু চার্লি, সামনেই ঘূর্ণি দেখে পিছিয়ে গেল এক পা। ঝড়ের মূল দেহটাকেই জন্ম দিয়েছে ধুলো, চামড়া আর পালক।
পরক্ষণেই উধাও হয়ে গেল ঝড়, সেখানে দেখা দিল মানব-সদৃশ একটা অবয়ব, হাত বাড়িয়ে মোটকু চার্লিকে ইঙ্গিতে ডাকল।
ভয়ে পেয়ে পিছিয়েই যেত মোটকু চার্লি, কিন্তু অবয়বটা ওর শার্টের হাতা টেনে ধরল। হালকা আর শুকনো ঠেকল সেই হাতের স্পর্শ। নিজের দিকে টানল ওকে অবয়বটা…
গুহার ভেতর আরও এক পা এগোল মোটকু চার্লি—
–পরক্ষণেই নিজেকে আবিষ্কার করল খোলা একটা তৃণভূমিতে; গাছের বালাই নেই চারপাশে, মাটি তামাটে; আকাশের রং দেখে টকে যাওয়া দুধ বলে মনে হয়।
প্রাণিভেদে চোখ কিন্তু ভিন্ন হয়! মানুষের চোখ (বিড়াল কিংবা অক্টোপাসের চোখের থেকে যা ভিন্ন) এমন ভাবে বানানো হয়েছে যেন তা একটা সময়ে কেবল একটাই বাস্তবতা দেখতে পায়। চোখ দিয়ে একটা বাস্তবতা দেখছে মোটকু চার্লি, কিন্তু মন দিয়ে দেখছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আরেক বাস্তবতা। আর এই দুইয়ের মাঝে অপেক্ষা করছে পাগলামি। টের পাচ্ছে সে—ওর বুকের ভেতর ফুঁপিয়ে উঠছে এক ধরনের বুনো ভয়। বুক ভরে শ্বাস নিয়ে দম আটকে রাখল ছেলেটা, পাঁজরের হাড়ের সঙ্গে হৃৎপিণ্ডের বাড়ি খাওয়া পরিষ্কার টের পাচ্ছে। চোখকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করল নিজেকে, মনকে না।
নিজেকে বোঝাল: যদিও মনের চোখে পাচ্ছে একটা পাখিকে; যার চোখগুলোতে ভর করেছে পাগলামি, পালক উসকোখুসকো, যেকোনো ইগলের চাইতে যে আকারে বড়ো, উচ্চতায় হার মানাবে অস্ট্রিচ পাখিকে, ঠোঁটগুলো অস্ত্রের চাইতে কম ভয়াবহ নয়, স্লেট পাথরের মতো রং তার পালকের, তার ওপরে যেন কেউ আলগা একটা উজ্জ্বল আভা মাখিয়ে দিয়েছে, ফলে বেগুনি আর সবুজের অদ্ভুত এক রঙধনুর জন্ম দিয়েছে সেই পালক…তবে চোখে দেখতে পাচ্ছে—সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক মেয়ে যার চুল দাঁড়কাকের মতো কালো; যেখানে পাখি দাঁড়িয়ে থাকার কথা, সেখানে আছে এক নারী। পাখি- মানবী যুবতী না, আবার তাকে বুড়িও বলা যাবে না। যে চেহারাটা দেখা যাচ্ছে, সেটা সুদূর অতীতে অবসিডিয়ান পাথরে খোদাই করাও হতে পারে; যখন পৃথিবী তরুণ ছিল, হয়তো তখনকার সময়ের।
একদৃষ্টিতে মোটকু চার্লিকে দেখছে পাখি-মানবী, একদম নড়ছে না। টকে যাওয়া দুধ-রঙা আকাশে ভাসছে মেঘ
‘আমি চার্লি,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘চার্লস ন্যান্সি। কেউ কেউ…মানে অনেকেই…আমাকে মোটকু চার্লি বলে। চাইলে তুমিও সেই নামেই ডাকতে পারো।’
ওপাশ থেকে জবাব এলো না।
‘আনানসি আমার বাবা ছিল।’
তারপরেও কোনো জবাব এলো না, এমনকী নড়ল না পর্যন্ত পাখি-মানবী; এক বিন্দুও না।
‘তোমার সাহায্য চাই, ভাইকে তাড়াতে।’
কথা শুনে এক পাশে মাথা কাত করল পাখি-মানবী। বুঝিয়ে দিল যে সে শুনছে, সেই সঙ্গে নিশ্চিত করল যে বেঁচেই আছে!
‘পারছি না কাজটা করতে। জাদুর ক্ষমতা-টমতা আছে ওর। একটা মাকড়শার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, তারপরই কোত্থেকে কী যেন হয়ে গেল! পরদিনই দেখি, আমার ভাই এসে উপস্থিত! এখন আর ওকে তাড়াতে পারছি না।’
মেয়েটার কণ্ঠ কাকের মতো কর্কশ আর রুক্ষ। ‘তো? আমার কাছে কী চাই?’
‘সাহায্য?’
ভাবতে বসল পাখি-মানবী।
পরে অনেক চেষ্টা করেও মোটকু চার্লি মনে করতে পারেনি যে পাখি- মানবীর পরনে কী ছিল। কখনও মনে হয়, সম্ভবত পালকের চাদর ছিল; কখনও মনে হয় কোনো এক ধরনের চামড়ার আলখাল্লা হবে। এমনকী জীর্ণ রেইনকোটের কথাও মাথায় এসেছে একবার, পরে যখন পিকাডেলিতে আবার দেখা হয় তখনকার মতো…মানে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়তে শুরু করার সময়। তবে একটা বিষয়ে নিঃসন্দেহ সে—নগ্ন ছিল না পাখি-মানবী।
নগ্ন থাকলে কি আর মনে থাকত না?
‘সাহায্য,’ শব্দটারই পুনরাবৃত্তি করল পাখি-মানবী।
মাথা নেড়ে সায় জানাল মোটকু চার্লি।
‘তারমানে, আনানসির বংশ নির্বংশ করার কাজে সাহায্য চাইছ?’
‘নাহ, চাই যে আমার ভাইকে চলে যাক; আমাকে বিরক্ত না করুক। ওর কোনো ক্ষতি আমি চাই না।’
‘তাহলে কথা দাও, আনানসির বংশধর আমার হবে।’
বিশাল, তামাটে রঙা তৃণভূমিতে দাঁড়িয়ে রইল মোটকু চার্লি। কিন্তু ওটা যে আসলে পৃথিবীর শেষ মাথার পাহাড়ের গুহার ভেতরে, তা জানে সে। এদিকে আবার পুরো বিশ্বটাই এঁটে গেছে মিসেস ডানউইডির ধুনোর সুগন্ধিতে ভরে থাকা বসার ঘরে। পাখি-মানবী কী চাইছে, তা বোঝার প্রয়াস পেল সে।
‘আমি কিছুই দিতে পারবো না, কিংবা কোনো ওয়াদা করতে পারবো না।’
‘তুমিই তো তাড়াতে চাইছ,’ বলল পাখি-মানবী। ‘যাই হোক, সিদ্ধান্ত দাও। নষ্ট করার মতো সময় আমার নেই,’ হাত ভাঁজ করে উন্মাদের দৃষ্টি মোটকু চার্লির দিকে চেয়ে রইল সে। ‘আনানসিকে আমি ডরাই না।’
মিসেস ডানউইডির পরামর্শ মনে পড়ে গেল ছেলেটার। ‘উম,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আমি কোনো ধরনের কথা দিতে পারব না, আর কিছু দিতে চাইলে বিনিময়ে আমারও সমমূল্যের কিছু পেতে হবে। মানে সমানে-সমান লেন-দেন চাই আমার।’
মনে হলো, পাখি-মানবী বিরক্ত হয়েছে; তবে মাথা দোলাল বটে। ‘তাহলে তাই পাবে। তোমাকে আমি কথা দিলাম,’ মোটকু চার্লির হাতে এমন ভাবে হাত রাখল যেন কিছু একটা দিচ্ছে; তারপর চাপ দিয়ে বন্ধ করে দিল মুঠি। ‘এখন বলো।’
‘আনানসির বংশধরকে তোমায় দিলাম,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘এতেই হবে,’ বলল একটা কণ্ঠ, তারপর আক্ষরিক অর্থেই খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেল পাখি-মানবী।
একটু আগেও যেখানে একজন নারী দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে পাখির ঝাঁক; উড়ছে সবগুলো, তবে একেকটা একেক দিকে…যেন এই মাত্র গুলির আওয়াজ শুনে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। আকাশ এখন পাখিতে ভরা, এত পাখি মোটকু চার্লি কখনও কল্পনার চোখেও দেখেনি। বাদামি-কালো পাখিগুলো এমন ভাবে ঘুরছে আর ছুটছে যে জন্ম দিয়েছে কালো একটা মেঘের, যে মেঘের বিশালত্ব ধরার ক্ষমতা নেই মানব-মনের।
‘স্পাইডারকে তাড়াতে পারবে তো?’ জানতে চাইল মোটকু চার্লি। চেঁচিয়ে উঠল ক্রমশ কালো হতে থাকা আসমানের দিকে চেয়ে। পাখির ঝাঁক ওঠা-নামা করছে ওটার বুকে, তবে উড়ছে তো উড়ছে। আচমকা ওর সামনে দেখা দিল একটা চেহারা, যা এঁকেছে ওই ঝাঁকটাই। চেহারাটাও, মেঘের মতোই, প্রকাণ্ড।
হাজারও পাখি একসঙ্গে চেঁচিয়ে, গুঞ্জন করে, ডেকে উচ্চারণ করল ওর নাম। আকাশে দেখা গেল ঠোঁট, যার আকার টাওয়ারের চাইতে কম হবে না!
পরক্ষণেই উন্মাদনা আর বিশৃঙ্খলা গ্রাস করে নিলো চেহারাটাকে। পাখির ঝাঁকটা এখন নিচের দিকে ধেয়ে আসছে…
…এক মুহূর্ত পরেই নিজেকে শুধরে নিলো মোটকু চার্লি। আসলে নিচের দিকে না, ধেয়ে আসছে ওরই দিকে! হাত তুলে চেহারা ঢাকল সে, রক্ষা করতে চাইল নিজেকে।
গালে যে ব্যথাটা অনুভব করল, সেটা যেমন রুক্ষ তেমনি তার জন্মও আচমকা। ভাবল, নিশ্চয়ই ঝাঁকের কোনো সদস্য ওকে ঠোকর দিয়েছে। কিংবা আঁচড়ে দিয়েছে নখর দিয়ে। তারপর চারপাশে পড়ল ওর নজর, বুঝল যে ফিরে এসেছে মিসেস ডানউইডির কামরায়।
‘আর মেরো না আমাকে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আমি ফিরে এসেছি।’
টেবিলে ওপর থাকা পেঙ্গুইনের মোম প্রায় নিঃশেষিত, মাথা আর কাঁধ অনেক আগেই গলে গেছে। একদা যেটা পেট ছিল, সেই সাদা-কালো আকৃতিহীন তুলতুলে জায়গাটা জ্বলছে এখন। গলে যাওয়া কালো মোম জমাট বেঁধেছে পায়ের কাছে, এদিকে তিন বুড়ি তাকিয়ে আছে মোটকু চার্লির দিকে।
মিস নোলস এক গ্লাস পানি ছুড়ে মারল বেচারার চেহারায়।
‘এক কাজটাও করার দরকার ছিল না,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আমি তো এখন এখানেই আছি!’
কামরায় পা রাখল মিসেস ডান উইডি। হাতে ধরে আছে একটা ছোট্ট, বাদামি কাচের বোতল। ‘স্মেলিং সল্ট,’ ঘোষণা করল সে। ‘জানতাম, কোথাও না কোথাও তো অবশ্যই আছে। এগুলো কিনেছিলাম এই ধরো, সাতষট্টি কি আটষট্টির দিকে। এখনও কাজ করবে কি না, তা অবশ্য জানি না।’ পরক্ষণেই মোটকু চার্লির ওপর চোখ পড়ায় ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল। ‘জেগে গেছে। কে জাগাল?’
‘শ্বাস নিচ্ছিল না,’ জানাল মিসেস বাস্টামন্টে। ‘তাই থাপ্পড় মারতে হলো।’
‘পরে আমি পানিও ঢেলেছিলাম,’ যোগ করল মিস নোলস। ‘ফলে পুরোপুরি জেগে ওঠে।’
‘স্মেলিং সল্টের আমার দরকার নেই,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘এরইমাঝে ভিজে গেছি, ব্যথাও করছে গালে।’ কিন্তু বুড়ো হাতে ততক্ষণে বোতলের ঢাকনি খুলে ফেলেছে মিসেস ডানউইডি, খোলা মুখটা ঠেসে ধরেছে বেচারার নাকের নিচে। মাথা পেছনে সরাতে সরাতেই শ্বাস টানল সে একবার, অ্যামোনিয়ার ঝাঁঝালো গন্ধ একেবারে মগজে খোঁচা মারল। চোখ থেকে পানি গড়াতে শুরু করল তার, মনে হলো যেন নাকে কেউ ঘুসি বসিয়ে দিয়েছে।
‘এই তো, কাজ শেষ।’ বলল মিসেস ডানউইডি। ‘এখন ভালো লাগছে?’
‘কটা বাজে?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি।
‘ভোর পাঁচটা হবে,’ জানাল মিসেস হিগলার; প্রকাণ্ড মগটা কাছে টেনে চুমুক দিল। ‘আমরা তো তোমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাতেই পড়ে গেছিলাম। কী হয়েছে না হয়েছে, বলো সব।’
মনে করতে চাইল মোটকু চার্লি। স্বপ্নের মতো সব ভুলে গেছে, ব্যাপারটা কিন্তু এমন না। বরঞ্চ মনে হচ্ছে: গত কয়েক ঘণ্টায় যা হয়েছে, তা আসলে ওর সঙ্গে হয়নি। অন্য কেউ গেছিল ওই গুহায়, অন্য কারও সঙ্গে চুক্তি হয়েছে পাখি-মানবীর। সেই অন্য ‘কেউ’ এখন পুরোপুরি সাড়া দিচ্ছে না ওর ডাকে। মনের ভেতর সব ঘোঁট পাকাচ্ছে, অন্য জগতের নানা রঙের মিশেল আস্তে
আস্তে ধূসর-কালো বাস্তবতার রং ধরছে। ‘অনেকগুলো গুহা দেখলাম। সবার কাছে চাইলাম সাহায্য, অনেক প্রাণিই ছিল ওখানে। প্রাণিগুলো আবার মানুষও ছিল। কিন্তু কেউ সাহায্য করতে সম্মত হলো না, সবাই বাবাকে ভয় পায়। তারপর একজন মহিলা বলল যে আমাকে সাহায্য করবে।
‘মহিলা?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মিসেস বাস্টামন্টে।
‘ওই মানব-পশুগুলোর অনেকে ছিল নারী, অনেকে আবার পুরুষ।’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘যার কথা বলছি, সে নারীই ছিল।’
‘কিন্তু আসলে কী ছিল? কুমির? হায়েনা? ইঁদুর?’
জবাবে শ্রাগ করল ছেলেটা। ‘তা মনে নেই। হয়তো তোমরা আমাকে মারতে আর আমার গায়ে পানি ঢালতে শুরু না করলে মনে থাকত! আর আমার নাকের নিচে ওই…ওই বাজে জিনিস ঠেসে না দিলে! কিন্তু গন্ধ শুঁকেই তো মাথা থেকে বেরিয়ে গেল সব।।’
মিসেস ডানউইডি বলল, ‘যা বলেছিলাম, তা মনে রেখেছিলে? দেনা- পাওয়া সমান রাখার কথাটা?’
‘হ্যাঁ,’ মোটকু চার্লি গর্বই বোধ করল নিজেকে নিয়ে। ‘হ্যাঁ, একটা বানর অনেক কিছু চাচ্ছিল আমার কাছে, কিন্তু কিচ্ছু দেইনি। তবে পরের ঘটনাগুলো বলার আগে, আমার কিছু একটা গেলা দরকার।’
টেবিলের ওপর থেকে কিছু একটায় ভরতি একটা গ্লাস তুলে নিলো মিসেস বাস্টামন্টে। ‘আগেই ধরে নিয়েছিলাম, তুমি কিছু একটা পান করতে চাইবে। ছাঁকনি দিয়ে শেরি ছেঁকেছি। তারপরও কিছু জড়িবুটি থাকতে পারে। তবে অসুবিধে হবে না।’
কোলের ওপর পড়ে আছে মোটকু চার্লির হাত। ডান হাতটা এগিয়ে দিল বুড়ো মহিলার কাছ থেকে কাচের গ্লাসটা নিতে। পরক্ষণেই থেমে চেয়ে রইল হাতের দিকে।
‘কী ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস ডানউইডি। ‘কোনো সমস্যা?’
হাতের তালুতে দেখা যাচ্ছে একটা কালো, প্রবল চাপে আকৃতি হারানো, ঘামে ভেজা একখানা পালক। ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল ওর… সব কিছুই!
‘পাখি-মানবী সাহায্য করতে চেয়েছে আমাকে,’ বলল সে।
.
মোটকু চার্লি যখন মিসেস হিগলারের স্টেশন ওয়াগনের প্যাসেঞ্জার সিটে বসে, তখন দিনের ধূসর আলো ফুটতে শুরু করেছে।
‘ঘুম ধরেছে?’ জানতে চাইল মহিলা।
‘ঠিক ঘুম না…কিন্তু কেমন যেন অদ্ভুত ঠেকছে।’
‘কোথায় যাবে? আমার বাড়িতে, নাকি তোমার বাবার? মোটেলে নিয়ে যাবো?’
‘আ-আমি জানি না।’
গিয়ার টেনে, গাড়িটাকে রাস্তায় নামাল মহিলা।
‘আমরা যাচ্ছি কই?’
জবাব দিল না মিসেস হিগলার। প্রকাণ্ড মগে চুমুক দিল একটা। তারপর খুলল মুখ, ‘হয়তো আজ রাতে আমরা যা করলাম, তা করাটাই ঠিক ছিল…আবার হয়তো ছিল না। পারিবারিক ব্যাপার-স্যাপার, আসলে পরিবারেরই সামলানো উচিত। তুমি আর তোমার ভাই, পুরোপুরি না হলেও অনেকটাই এক। হয়তো সেজন্যই এতো দ্বন্দ্ব।’
‘নিশ্চয়ই ‘অনেকটাই এক’ বলতে ‘পুরোপুরি উলটো’ বোঝাচ্ছ? ওয়েস্ট ইন্ডিয়ায় হয়তো এভাবেই কথা বলা হয়!’
‘আমার সামনে ইংরেজ হবার ভড়ং ধোরো না। যা বলার তা বুঝে শুনেই বলছি। তুমি আর ও, এক গাছের ফল; স্বভাবও একই রকমের। তোমার বাবা আমাকে বলত: কেলিঅ্যান, আমার ছেলেরা, ওরা আসলে অ্যাত্তো বোকা যে-বাদ দাও তোমার বাপের কথা। আমার যুক্তি হলো, সে-ও তোমাদেরকে একই স্বভাবের বলে মনে করত।’ আচমকা একটা ভাবনা এলো তার মাথায়। ‘আচ্ছা, তুমি যেখানে গেলে, সেখানে তো প্রাচীন দেবতাদের বাস… তা তোমার বাবাকে দেখতে পেয়েছ?’
‘নাহ, পাইনি। পেলে মনে থাকত।’
মাথা নাড়ল মহিলা, চুপচাপ চালাতে লাগল গাড়ি।
উদ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে, পার্ক করল সে স্টেশন ওয়াগনটাকে। তারপর নেমে এলো নিচে।
ফ্লোরিডার শীতল প্রভাত দেখা দিয়েছে। দ্য গার্ডেন অভ রেস্টকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো চলচ্চিত্র থেকে উঠিয়ে আনা সেট: মাটি প্রায় কামড়ে ভাসছে কুয়াশা। কোনো কিছুই পরিষ্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে না। ছোট্ট ফাটকটা খুলল মিসেস হিগলার, তারপর তারা পা রাখল গোরস্তানে।
কদিন আগেও যেখানে ওর বাবার কবরের ওপর আলগা মাটি ছিল, সেখানে এখন ঘাস জন্মেছে। কবরফলক হিসেবে দেখা যাচ্ছে একটা ধাতুর খণ্ড, তাতে বসানো হয়েছে ধাতুর ফুলদানি। সেই ফুলদানিতে আছে কেবল একটা ফুল: একটা হলদে গোলাপ।
‘এই কবরবাসীর ওপর খোদা রহম করুক, বলল মিসেস হিগলার, আন্তরিকতার সঙ্গে। ‘আমেন, আমেন, আমেন।’
দর্শকও আছে উপস্থিত: মোটকু চার্লি আগের বার যে দুটো লাল মাথার বক ছিল, সেগুলোই। মাথা দোলাতে দোলাতে ওদের দিকে এগিয়ে এলো তারা, ভাবখানা এমন যেন অভিজাত বংশের কেউ জেলখানা পরিদর্শন এসেছে!
‘ভাগ!’ বলল মিসেস হিগলার। পাখিগুলো মহিলার দিকে তাকাল বটে, তবে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে। ‘ভাগার’ তো প্রশ্নই আসে না।
তাদের মাঝে একটা মাথা ডুবিয়ে দিল ঘাসের ভেতর, যখন তুলল তখন তার চঞ্চুতে দেখা দিল একটা সরীসৃপ। ঢোক গিলে ওটাকে গলায় পাচার করে দিল পাখিটা, কণ্ঠে একটা ফোলা অংশ হয়ে গেল বেচারা সরীসৃপ।
ভোরের আওয়াজ শুরু হয়েছে: দ্য গার্ডেন অভ রেস্টের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে মকিংবার্ড, গ্রাকল আর অরিয়োল পাখির কিচিরমিচির। ‘বাড়ি ফিরতে পারলে ভালো হতো,’ মোটকু চার্লি। ‘কপাল যদি ভালো হয়, তাহলে হয়তো পাখি-মানবী আমি পৌছুবার আগেই স্পাইডারকে ভাগাতে সক্ষম হবে। তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে সব। রোজির সঙ্গে আবার মিলমিশ করে নেব।’
ভালো লাগার একটা অনুভূতি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে ওর ভেতরে। মনে হচ্ছে, দিনটা ভালোই কাটবে!
.
আগেকার গল্পগুলোতে, আনানসিকে আমরা দেখতে পাই তার নিজের ঘরে বাস করতে…যেমনটা আপনি-আমি করি। সে যে লোভী, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে ধূর্ত এবং এক হিসেবে লোলুপও বলা যায়। তবে একই সঙ্গে সে সাচ্চা মনের, সৌভাগ্যবান এবং অনেকক্ষেত্রে সৎ-ও! তাই বলা যায়, কখনও সে ভালো…কখনও না খারাপ। তবে অশুভ কিংবা শয়তান কখনওই না। গল্প শোনার সময়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ আনানসিরই পক্ষে থাকে। কেন? কারণ আনানসি সব গল্পের মালিক। মাওউ তাকে সব গল্পের অধিকারী বানিয়েছিলেন, বাঘের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে…তাও অনেক অনেক দিন আগে।
আর কথার জাল বুনে কীভাবে গল্প ফাঁদতে হয় তা আনানসির চাইতে ভালো আর কেউ জানে না!
সেই গল্পগুলোয় আনানসি একটা মাকড়শা, আবার একই সঙ্গে মানুষও। এই দুটো ব্যাপার একই সময়ে মাথায় রাখতে কষ্ট হবার কথা না। একটা বাচ্চাও তা পারবে!
আনানসির গল্পগুলো বলত দাদিরা, খালারা, ফুফুরা। আফ্রিকার পশ্চিম উপকূল এবং পুরো ক্যারিবিয়ান জুড়ে প্রচলিত ছিল এই গল্প; আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। গল্পগুলো বাচ্চাদের বইতে স্থান পায়। সমস্যা হলো, দাদিরা-খালারা-ফুফুরা… সেই সঙ্গে বাচ্চাদের বইয়ের লেখকরাও…অনেক কিছুই বাদ দিয়ে যায়। কেননা বাদ না দিলে, সেই গল্পগুলো ঠিক বাচ্চাদের উপযোগী থাকে না।
তেমনই একটা গল্প শোনাবো আজ আপনাদের, নার্সারির কোনো বইতে এই গল্প পাবেন না। আমি তার নাম দিয়েছি: পাখির মুখোমুখি আনানসি।
পাখিকে একদম পছন্দ করে না আনানসি। কেন? কারণ যখন খিদে লাগে, তখন ইচ্ছেমতো পেটপুরে খায় পাখি। আর সেই খাদ্যের তালিকায় আছে মাকড়শাও। ঝামেলা হলো, পাখি সর্বদাই যেন ক্ষুধার্ত থাকে!
আগে ওরা বন্ধুই ছিল, কিন্তু সেই বন্ধুত্বের ছিটেফোঁটাও আজ আর অবশিষ্ট নেই।
একদিন হাঁটতে বেরিয়েছে আনানসি। আচমকা মাটিতে একটা গর্ভ নজরে পড়ল তার, সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেল বুদ্ধি। গর্তের একদম নিচে স্থাপন করল সে কাঠ, তারপর তাতে আগুন ধরিয়ে গর্তের ওপর রেখে দিল রান্না করার পাত্র। তার ভেতরে ফেলল কিছু শেকড় আর এটা-সেটা। এরপর মহানন্দে দৌড়াতে শুরু করল পাত্রটাকে ঘিরে দৌড়াচ্ছে, নাচছে আর চেঁচিয়ে বলছে: দারুণ লাগছে আমার, সত্যি বলছি। খুব ভালো লাগছে। শরীরের সব ব্যথা, সব কষ্ট উধাও হয়ে গেছে নিমিষে। আগে কখনও এতটা ভালো বোধ করিনি!
চেঁচানি কানে গেল পাখির। আকাশ থেকে ছোঁ মেরে নিচে নেমে এলো সে, এত চিল্লাপাল্লা কেন— সেটাই জানতে চায়। জিজ্ঞেস করল, কেন এতো চেঁচাচ্ছ…আর কেনই বা নাচছ পাগলের মতো, আনানসি?
জবাবে আনানসি বলল, বহুদিন হলো ঘাড়ের ব্যথায় ভুগছিলাম, আজ সেরে গেছে। পেটে কামড় দিত, সেটাও আর নেই। হাড়ের গিঁটে গিঁটে জং পড়ে গেছিল, কিন্তু এখন আমি একেবারে তরুণদের মতোই চটপটে। আমার ত্বক দেখ, সাপের খোলস ছাড়ার মতোই মসৃণ। আমি শক্তিশালী, আমি খুশি। আর সর্বদা এমনই থাকব…
কারণ সেই রহস্য আমি জেনে গেছি! অথচ আর কেউ জানে না।
রহস্য? কীসের রহস্য? প্রশ্ন ছুড়ে দিল পাখি।
আমার গোপন রহস্য, জানাল আনানসি। এখন সবাই ছুটে আসবে, আমাকে তাদের পছন্দের জিনিস দিয়ে দেবে; দেবে সবচাইতে দামি বস্তুগুলো। কেন? সেই রহস্যটা জানার জন্য। কী মজা! কী আনন্দ!
আরেকটু কাছিয়ে এলো পাখি, এক পাশে মাথা কাত করে জিজ্ঞেস করল, আমাকে বলবে সেই রহস্য?
চোখে-মুখে সন্দেহ নিয়ে আনানসি চাইল পাখির দিকে। তারপর গর্ভের ওপরে বসানো পাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে ওটাকে আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে জানাল, সেটা হচ্ছে না। সবাইকে দেওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণ নেই আমার কাছে। তাই খালি খালি সেই চিন্তা মাথায় এনো না!
পাখি বলল, শোনো আনানসি, আমি জানি যে আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব সবসময় ছিল না। তবে একটা কথা দিচ্ছি: যদি রহস্যটা আমাকে জানাও, তাহলে আর কখনও কোনো পাখির খাদ্য হতে হবে না কোনো মাকড়শাকে। সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাবার আগপর্যন্ত আমরা বন্ধু হয়েই থাকব।
চিবুক চুলকালো আনানসি, মাথা নাড়ল পরক্ষণেই। রহস্যটা অনেক বড়ো, জানাল সে। সেই অনুসারে কাজ করলে বয়েস তো কমবেই, সেই সঙ্গে শরীর থেকে বিদায় নেবে সব ধরনের ব্যথা।
পাখি গজগজ করতে লাগল। জানাল, আনানসি, তোমাকে যে আমি সবসময় সুদর্শন ভেবে এসেছি, তা তুমিও জানো। এসো এক কাজ করা যাক: আমরা কিছু সময় একত্রে কাটাই, তাহলেই তোমার সব আপত্তি উবে যাবে।
বলাই বাহুল্য, আনানসি যেমন পুরুষের রূপ ধরে থাকত, তেমনি পাখি ধরত নারীর রূপ। যাই হোক, একসঙ্গে বেশ খানিকটা সময় একান্তে কাটাল ওরা। তারপর পাখি বলল, এবার আনানসি, আমাকে তোমার গোপন রহস্য বলো।
আনানসি জানাল, আসলে অন্য কাউকে বলার ইচ্ছে আমার ছিল না। কিন্তু তোমাকে বলতে আপত্তি নেই। এই যে গর্ত দেখছ, তাতে আমি গোসল করার জন্য পানির সঙ্গে বেশ কিছু জড়িবুটি মিশিয়েছি। এই যে দেখো, তোমার সামনেই পানিতে ফেলছি সব কিছু। এখন যে-ই এতে গোসল করবে, সে-ই চিরদিন বেঁচে থাকবে। নিজেও করেছি, আর দেখতেই তো পেলে আমি কতটা সুস্থ এখন। আর কাউকে এই পানিতে গোসল করতে দেওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু….
ততক্ষণে ফুটতে থাকা পানির দিকে এগিয়ে গেছে পাখি, আনানসির কথা শেষ হবার আগেই নেমে পড়েছে পাত্রে।
মারাত্মক গরম, আনানসি, জানাল সে।
জড়িবুটির ভেতর থেকে রস নিংড়ে বের করে আনার জন্য পানি তো গরম থাকতেই হবে। জানাল আনানসি। তারপর পারের ডালা হাতে নিয়ে, মুখটা বন্ধ করে দিল। মারাত্মক ভারী ওই ডালা, তারপরেও নিশ্চিত হবার জন্য একটা পাথর রেখে দিল ওটার ওপরে।
ব্যাম! ব্যাম! ব্যাম!
পাত্রের ভেতর থেকে ভেসে এলো আওয়াজ।
যদি এখন বেরিয়ে আসো, জানাল আনানসি বাইরে থেকে, তাহলে কিন্তু বিন্দুমাত্র লাভ হবে না। শান্ত হও, দেখবে খানিকক্ষণের মাঝেই নিজেকে সুস্থ মনে হচ্ছে।
পাখি ওর কথা শুনেছে কি না, তা নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। কিন্তু শুনলেও বিশ্বাস করেনি, তাই বারবার সে পাত্রের ভেতর থেকে কিল বসাতেই লাগল। তবে অচিরেই, থেমে গেল সেই আওয়াজও।
সেদিন সন্ধ্যায় পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে দারুণ সুস্বাদু, পাখির সুপ আর মাংস খেল আনানসি। এতটাই পেট পুরে খেল সেদিন যে পরবর্তী অনেকগুলো দিন ওদের খাওয়া-দাওয়া করারই প্রয়োজন হয়নি!
সেদিনের পর থেকে, সুযোগ পেলেই মাকড়শা ধরে মুখে পুড়ে দেয় পাখি। আর নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মাকড়শা ও পাখির মধ্যে বন্ধুত্ব কখনওই সম্ভব না!
.
অবশ্য এই গল্পের আরেকটা রূপও পাওয়া যায়, তাতে আনানসি নিজেই ঢুকে পড়েছিল পাত্রে। পৃথিবীর সব গল্পই আনানসির। কিন্তু সব গল্পে, দিন শেষে হাসি যে ওর মুখেই ফোটে…সে কথা কে বলল?
অধ্যায় আট – যেখানে খেল দেখাল একটা কফি-তরতি পাত্র
অধ্যায় আট – যেখানে খেল দেখাল একটা কফি-তরতি পাত্র
ওকে তাড়াবার জন্য যে এত কিছু হচ্ছে, তা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি স্পাইডার। এই বিষয়ে কোনো ধারণাই নেই তার। উলটো আরও বেশি আনন্দে দিন কাটাচ্ছে সে মোটকু চার্লির বেশ ধরে। অবস্থা দেখে মোটকু চার্লি ভাবতে বসল—স্পাইডার আরও আগেই ওর নাম-পরিচয় দখল করার জন্য ছুটে আসেনি কেন? পিপা ভরতি বানরের নাচুন-কুঁদন দেখার চাইতেও বেশি মজা পাচ্ছে সে এখন[২৯]।
[২৯. অবশ্য কয়েক বছর আগে, পিপে ভরতি বানর স্পাইডারকে হতাশ করেছিল। একদম মজা পায়নি ওদেরকে পিপেতে ভরে। প্রথম কিছুক্ষণ কৌতূহল্লোদীপক আওয়াজ বেরোচ্ছিল ভেতর থেকে, কিন্তু খানিকপরেই একেবারে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। বানরগুলো কিছুই করছিল না—–হয়তো কোষীয় পর্যায়ে তখনও কাজ চলছিল টুকটাক—রাতের আঁধারে পুরো পিপেটাই ফেলে দিতে হয় স্পাইডারকে (লেখক)।]
মোটকু চার্লির সাজার যে সুবিধাটা পেয়ে স্পাইডার সবচাইতে বেশি আনন্দিত, তা হলো: রোজি।
এই কদিন আগেও মেয়েমানুষের ব্যাপারে স্পাইডারের মন্তব্য ছিল বড়োই সরল: একটা হলেই হলো। বিদায়ের সময় তাদেরকে কখনও আসল নাম- ঠিকানা দিত না…আর যে ফোন নম্বরটা দিত, সেটার আয়ু যে কয়েক দিনের বেশি না সেটা তো বলাই বাহুল্য। মেয়েমানুষের সঙ্গ পছন্দই করে সে; তাদেরকে অলংকার হিসেবে দেখে, দেখে দারুণ এক ‘অতিরিক্ত দ্রব্য’ হিসেবে। কিন্তু এমন জিনিসের কি আসলে কোনো অভাব আছে? কনভেয়ার বেল্টের ওপর বসে যেমন একের-পর-এক গুলাশের পাত্র আসতেই থাকে, মেয়েমানুষ তেমনই; একটার কাজ ফুরুলে, আরেকটা তুলে নিলেই হলো।
কিন্তু রোজি…
…রোজি পুরোপুরি অন্যরকম।
হাজার বার সুযোগ দিলেও, মেয়েটা আসলে কতটা ভিন্ন গতানুগতিকের চাইতে তা বলে বোঝাতে পারবে না স্পাইডার। চেষ্টা করে দেখেছে, পারেনি! রোজির সঙ্গে যখন থাকে, তখন অদ্ভুত এক অনুভূতি জেগে ওঠে মনে… যেন মেয়েটার চোখে দেখতে পেয়ে আরও ভালো একজন ব্যক্তিতে পরিণত হয়…সেটা একটা কারণ হতে পারে। তবে অনেকগুলো কারণের মাঝে একটা।
কখন ওকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাবে, রোজি যে তা জানে—এই ব্যাপারটা স্পাইডারের ভালো লাগে; আলাদা একটা স্বস্তি পায়। মেয়েটার দেহের বাঁকগুলো উপভোগ করে মজা পায়, আনন্দে ভরে ওঠে তার হাসি, এবং পৃথিবীর কেবল ভালো করার মানসিকতা। রোজির মাঝে খারাপ কিছুই নেই, শুধু ওর থেকে আলাদা থাকার সময়টা ভালো লাগে না একদম।
অবশ্য আজকাল ‘রোজির মা’ নামের প্রাণিটার উপস্থিতির যন্ত্রণা একটু- একটু করে বোধ করতে শুরু করেছে সে!
আজকের এই বিশেষ সন্ধ্যায়, যখন মোটকু চার্লি চার হাজার মাইল দূরের একটা বিমানবন্দরে বসে ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী হিসেবে পদোন্নতির জন্য অপেক্ষা করছে, স্পাইডার তখন দাঁড়িয়ে আছে রোজির মায়ের উইম্পোল স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে। মহিলার ব্যাপারে অভিজ্ঞতা অর্জন করছে, যেটাকে কোনো ভাবেই সুখকর বলা যায় না।
বাস্তবতাকে নিজের চাহিদা মোতাবেক খানিকটা বাঁকিয়ে নিতে অভ্যস্ত স্পাইডার। ওই খানিকটাতেই সাধারণত কাজ চলে যায়। বাস্তবতাকে বুঝিয়ে দিতে হয়, কার কথায় সে নাচে–এই যা। কিন্তু আগে এমন কারও সঙ্গে দেখা হয়নি, যে রোজির মায়ের মতো দৃঢ়ভাবে নিজের বাস্তবতায় শেকড় গেড়ে বসে আছে!
‘কে এ?’ জিজ্ঞেস করল মহিলা। ওদেরকে ঢুকতে দেখেই সন্দিহান হয়ে পড়েছে।
‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি,’ জবাব দিল স্পাইডার।
‘এই কথা বলছে কেন ব্যাটা?’ আবার প্রশ্ন ছুড়ে দিল রোজির মা। ‘কে এই ব্যক্তি?’
‘আমি মোটকু চার্লি ন্যান্সি, আপনার ভবিষ্যৎ মেয়ে-জামাই। আমাকে আপনি পছন্দ করেন,’ দৃঢ় বিশ্বাসের সঙ্গে বলল স্পাইডার।
কেঁপে উঠল রোজির মা, চোখ পিটপিট করে কিছুক্ষণ দেখল ওকে। ‘মোটকু চার্লি তুমি হতে পারো,’ অনিশ্চয়তার সঙ্গে বলল সে। ‘কিন্তু তোমাকে আমি পছন্দ করি না।’
‘হয়তো,’ জানাল স্পাইডার। ‘তবে পছন্দ আপনার করা উচিত। আমাকে সবাই পছন্দ করে। আসলে আমার মতো পছন্দসই মানুষ, পৃথিবীর বুকে খুব একটা নেই। আমাকে কতটা পছন্দ করে, সেই আলোচনা করার জন্য সভার আয়োজন করে লোকে। বেশ কিছু অ্যাওয়ার্ড পাশাপাশি দক্ষিণ আমেরিকার একটা দেশ আমাকে মেডেল পর্যন্ত দিয়েছে, কেবল মাত্র আমাকে তারা পছন্দ করে বলে। সঙ্গে নেই যদিও, মেডেলগুলো আমি মোজার ড্রয়ারে রাখি।’
নাক টানল রোজির মা। কী যে হচ্ছে, তা বুঝতে পারছে না। কিন্তু যাই হোক না কেন, সেটা পছন্দ হচ্ছে না তার। এতদিন পর্যন্ত ভাবত, মোটকু চার্লির ভাবগতিক সে ঠিক ধরতে পেরেছে। হ্যাঁ, অন্তত নিজের কাছে স্বীকার করে, শুরুর দিকে পরিস্থিতি আরেকটু ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেত: যদি মোটকু চার্লির সঙ্গে তার প্রথম সাক্ষাতের পরপরই সে নিজে ওভাবে সম্পর্কটার বিপক্ষে কথা না বলত, তাহলে মনে হয় না রোজি এমন আঠার মতো সেঁটে যেত ছেলেটার সঙ্গে। বাজে ছেলে, বলেছিল রোজির মা। কিন্তু রোজিকে হাজারো বুঝিয়েও মোটকু চার্লিকে পরিত্যাগ করাতে পারেনি। তাই এখন মহিলার মূল লক্ষ্য হলো বিয়ের পরিকল্পনা নিয়ে ঘোঁট পাকিয়ে, মোটকু চার্লির নাকের পানি আর চোখের পানি এক করা। আজকাল বারবার সে দেশের তালাকের পরিসংখ্যান দেখে, আর মুচকি মুচকি হাসে আত্মতৃপ্তির হাসি।
কিন্তু এখন ভিন্ন কিছু ঘটছে, এমন কিছু যা তার পছন্দ হচ্ছে না। মোটকু চার্লিকে এখন আর নিরীহ শিকার মনে হচ্ছে না। এই নতুন, চাল্লু ব্যক্তিটি মহিলাকে ভাবিয়ে তুলছে।
এদিকে স্পাইডারও বুঝতে পারছে, আঙুল ওকে বাঁকা করতেই হবে।
অধিকাংশ মানুষই, মন দিয়ে অন্যকে দেখে না। কিন্তু রোজির মায়ের নাম সেই তালিকায় খুঁজে পাওয়া যাবে না, সব কিছুই মনোযোগের সঙ্গে দেখে সে। একটা চীনেমাটির কাপ থেকে গরম পানি পান করল মহিলা; ভালো করেই বুঝতে পারছে যে এই মাত্র একটা খণ্ড যুদ্ধে হার মেনেছে। কিন্তু যুদ্ধটা কেন বা কী নিয়ে হলো, সে সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তার। তারপরেও সিদ্ধান্ত নিলো, লড়াই করতে হলে উঁচু জায়গা থেকে করাই ভালো।
‘চার্লস, সোনা,’ বলল মহিলা। ‘তোমার আত্মীয়া, ডেইজির কী খবর? ভাবছি, তোমার দিককার আত্মীয়স্বজনদের ওপর বিয়ের অনুষ্ঠানে যথেষ্ট আলোকপাত হচ্ছে না। তা ওকে বড়োসড়ো কোনো কাজ দেবে নাকি?’
‘কাকে?’
‘ডেইজিকে,’ মিষ্টি করে বলল রোজির মা। ‘সেদিন বিকেলে, প্রায় ন্যাংটো হয়ে যে মেয়েটা তোমার বাড়িতে ঘোরাফেরা করছিল, তার কথা বলছি। সে তোমার আত্মীয়া না?
‘মা! চার্লি যদি বলে থাকে যে মেয়েটা ওর দূরসম্পর্কের বোন…’
‘নিজের কথা ওকে নিজেই বলতে দাও, রোজি,’ বলে আরেক চুমুক গরম পানি পান করল ওর মা।
‘ওহ,’ বলল স্পাইডার। ‘ডেইজি!’
নারী, মদ আর গানের রাতের কথা মনে করতে চাইল সে: সবচাইতে সুন্দরী আর সবচাইতে আমুদে মেয়েটাকে ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছিল সে। সেদিনও বাস্তবতাকে একটু বাঁকিয়ে মেয়েটার মাথায় ঢুকিয়েছিল, বুদ্ধিটা তার নিজেরই; আধা-অচেতন মোটকু চার্লির বড়োসড়ো দেহটাকে ধরে ওঠাতে সাহায্য করতে চায় সে।
রাতভর বেশ কিছু সুন্দরীর আগ্রহের কেন্দ্রবস্তু ছিল স্পাইডার। তাই ছোটোখাটো, আমুদে মেয়েটাকে রেখেছিল রাতের জন্য; যেভাবে অনেকে রাতের খাবারের পর মুখে দেবার জন্য মিন্ট সরিয়ে রাখে। অথচ রাতে মোটকু চার্লিকে পরিষ্কার করে বিছানায় শুইয়ে দেবার পর স্পাইডার আবিষ্কার করে: খিদেটা আর নেই।
সেই মেয়েটাই হবে…
‘আমার মিষ্টি, ছোট্ট বোন ডেইজি,’ না থেমেই বলে চলল সে। ‘বিয়ের কাজে অংশ নিতে পারলে খুশিই হতো, কিন্তু দেশে তো থাকতে হবে সেজন্য। মেয়েটা এটা-সেটা বহন করে একদেশ থেকে অন্য দেশে। সবসময়ই চলার ওপরেই থাকে। এই আমার বাড়িতে আছে তো এই একটা গোপনীয় কাগজ নিয়ে ছুটে গেছে মুরমানস্কে।’
‘ওর ঠিকানা নেই? কিংবা ফোন নম্বর?’
‘আপনি আমি মিলে খুঁজে দেখার চেষ্টা করতে পারি,’ জানাল স্পাইডার। ‘কিন্তু ও শুধু আসে আর যায়।’
‘তাহলে,’ মহান আলেক্সান্ডার যেভাবে কোনো পারসিয়ান গ্রামে হামলা করার নির্দেশ দিতেন, ঠিক সেভাবেই আদেশ দিল রোজির মা। ‘পরেরবার যখন মেয়েটা দেশে আসবে তখন এখানে নিয়ে এসো। মেয়েটা খুবই মিষ্টি, ওর সঙ্গে দেখা হলে রোজি খুশিই হবে।’
‘অবশ্যই,’ রাজি হলো স্পাইডার। ‘অবশ্যই দাওয়াত দিব।’
.
প্রত্যেকটা মানুষ, যে অতীতে ছিল, বর্তমানে আছে, আর ভবিষ্যতে থাকবে…একটা করে গানের মালিক। কিন্তু এটা অন্য সবার লেখা গতানুগতিক গানের মতো না, এই গান অনন্য। তার আছে নিজস্ব সুর, আছে নিজস্ব শব্দ। হাতেগোনা অল্প কজন নিজের সেই গান গাইতে পারে। যদি গাওয়াটা ঠিকঠাক না হয়—এই ভেবে অধিকাংশ পিছিয়ে আসি। কিংবা ভাবি, আমাদের পঙতিমালা হয়তো অনেক বেশি বোকামিতে ভরে, কিংবা একটু বেশিই কাঠখোট্টা অথবা অদ্ভুত। তাই আমরা না, আমাদের গানগুলোকে বাস্তবায়ন করে অন্য কেউ।
এই যেমন ডেইজির কথাই কথা ধরা যাক; ওর নিজস্ব গানটা ওরই জীবনের প্রায় পুরোটা সময় ধরে মাথার পেছনে বেজেছে…অনেকটা আশ্বস্ত করার মতো করে, এগিয়ে যাবার প্রণোদনা জোগাতে। শব্দগুলো ছিল দুর্বলকে রক্ষা করার উৎসাহদায়ী। শুরুতেই আছে কোরাস, ‘অপরাধীরা সাবধান!’ তাই উচ্চকণ্ঠে গাইবার মতো গান ওটা না। তবে গোসল করার সময় বাথরুমে ঢুকে আপনমনে গেয়েছে বটে ডেইজি।
ডেইজির ব্যাপারে কেবল এতটুকুই জানাই যথেষ্ট, বাকিটাকে বলা চলে মেদ।
মেয়েটার বাবা জন্মগ্রহণ করে হংকং-এ। ওর মা আবার ইথিয়োপিয়ান; নানার পরিবার গালিচা রপ্তানি করে বহুত পয়সা কামিয়েছিল। এমনকী আদ্দিস আবাবায় একটা বাড়ি পর্যন্ত ছিল তাদের, আরেকটা ছিল নাজরেতের ঠিক বাইরে; ওখানে জমিও ছিল বেশ খানিকটা। ক্যামব্রিজে দেখা হয় ডেইজির বাবা-মায়ের–বাবা পড়তে এসেছিল ‘কম্পিউটিং’, তখনও পেশা হিসেবে ওটাকে জাতের কিছু মনে করা হতো না। এদিকে মায়ের বিষয় ছিল মলিকুলার কেমিস্ট্রি আর ইন্টারন্যাশনাল আইন।
এই দুই যুবক-যুবতী ছিল সমান মেধাবী, বইয়ে নাক গুঁজে রাখতে ভালোবাসত; স্বাভাবিকভাবেই, তারা ছিল লাজুক আর আত্মকেন্দ্রিক। বাড়ির পরিবেশে অভ্যস্ত মানুষ দুজনের উভয়েই খুব করে সেই অভাবটা বোধ করছিল। তবে হ্যাঁ, দাবা খেলতে পছন্দ করত দুজনেই। এক বুধবার বিকেলে, দাবা ক্লাবে দেখা হয় তাদের। নবিস বলে একে-অন্যের বিরুদ্ধে খেলতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল ওদের। প্রথম খেলায় আরামসে ডেইজির বাবাকে হারিয়ে দেয় ওর মা।
ব্যাপারটা হজম করতে পারেনি ডেইজির বাবা, তাই পরবর্তী বুধবারে ফিরতি ম্যাচ খেলার প্রস্তাব দেয় সে। এর পরের দুটো বছরের প্রত্যেক বুধবার (ছুটির দিন বাদে), বিকেলে দাবা খেলে ওরা একে-অন্যের সঙ্গে।
সামাজিকভাবে মেলামেশার দক্ষতা আর ইংরেজি বলার ক্ষমতা বাড়ার সঙ্গে তাল দিয়ে বাড়তে থাকে সামাজিকতাও। একসঙ্গে, হাতে হাত ধরে তারা মানবশিকল বানিয়ে মিসাইল ভরতি বড়ো বড়ো ট্রাকের আগমনের প্রতিবাদ জানায়। একসঙ্গে, আরও বড়ো একটা দলের অংশ হয়ে, বার্সেলোনায় পা রাখে আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে; কর্পোরেশনগুলোর আগ্রাসন রুখতে হয়ে ওঠে উচ্চকণ্ঠ। মাঝে মাঝে অবশ্য ওদেরকে কাঁদুনে গ্যাসের শিকার হতে হয়, স্প্যানিশ পুলিসের হাতে মার খেয়ে আহত হয় মি. ডে-এর কবজি।
তারপর এক বুধবার বিকেলে, তখন ক্যামব্রিজে তাদের পা রাখার তৃতীয় বছর চলছে, ডেইজির মাকে দাবায় পরাজিত করল ওর বাবা। বিজয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়েছে, সাহসের ডানায় ভর করে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাবই দিয়ে বসে লোকটা। এদিকে ডেইজির মা, যে অন্তরে অন্তরে এই ভয়ে ছিল যে
একটা ম্যাচ জিতলেই ওর প্রতি ডেইজির বাবার সব আগ্রহ উবে যাবে, হ্যাঁ বলতে তাই কালক্ষেপণ করেনি।
ইংল্যান্ডেই রয়ে যায় তারা, লেখাপড়া শেষ করে। একটা কন্যাসন্তান আসে ওদের ঘর আলো করে, আর নাম রাখে ডেইজি। কারণ সেই সময় ওদের ছিল (যেটায় পড়ে খোদ ডেইজিও চরেছিল) একটা ট্যান্ডেম বাইসাইকেল – যাতে দুইজন চড়ার মতো ব্যবস্থা ছিল! পুরো ব্রিটেনের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরে বেড়াত এই জোড়া: ডেইজির বাবা পড়াত কম্পিউটার সায়েন্স, আর ও মা লিখত ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেট হেজেমনি নিয়ে বই… যা কেউ পড়তে চাইত না। আরও লিখত দাবার ইতিহাস, খেলার পদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে…যেটা আবার অনেকেই পড়ত! তাই কোনো কোনো বছর দেখা যেত, স্বামীর চাইতে বেশি আয় করছে স্ত্রী; যদিও স্বামীর আয় কখনওই তেমন বেশি কিছু ছিল না। বয়েস হতে শুরু করলে, রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতাও কমতে শুরু করল। মাঝবয়সে পা দেওয়ার পর দেখা গেল তারা পরিণত হয়েছে হাসিখুশি এক দম্পতিতে…যাদের কিনা একে-অপরের প্রতি, দাবার, ডেইজির আর ভুলে যাওয়া অপারেটিং সিস্টেম বাদে অন্য কিছুতে আগ্রহ নেই!
সমস্যা হলো, দুজনের কেউই ডেইজিকে কখনও বুঝতে পারেনি…একদম না।
একদম গোড়াতেই কেন পুলিসের প্রতি ডেইজির আগ্রহের একটা ব্যবস্থা করেনি, সে আক্ষেপ করে উভয়ে। কথা বলা যখন শিখেছে মেয়েটা, তখন থেকেই পুলিস কেন যেন ওকে আকৃষ্ট করেছে। অন্য বাচ্চা মেয়েরা যেখানে উত্তেজিত ভঙ্গিতে পোনি ঘোড়া দেখাত, সেখানে ডেইজি সমান উত্তেজনা নিয়ে দেখাত পুলিসের গাড়ি। সপ্তম জন্মদিনের পার্টিতে ছিল যেমন-খুশি-তেমন- সাজার সুযোগ। বলাই বাহুল্য, মেয়েটা সেজেছিল জুনিয়র পুলিস। এখনও ওর বাবা-মায়ের চিলেকোঠায় সেই জন্মদিনের ছবি আছে। ওতে দেখা যাচ্ছে, সাত- বছর-বয়সী মেয়েটা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছে কেক দেখে: সাতটা মোম আছে ওই কেকে, যেগুলো জ্বলছে নিভছে উজ্জ্বল নীল আলোর জন্ম দিয়ে।
টিনেজ বয়সে ডেইজি ছিল ভদ্র, অনুগত আর বুদ্ধিমান এক ছাত্রী। বাবা- মা উভয়কে আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে নাম লিখিয়েছিল লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে, ল অ্যান্ড কম্পিউটিং পড়তে। বাবা স্বপ্ন দেখত–মেয়ে তার হবে আইনের প্রভাষক; মায়ের মেয়ে নিয়ে বুনত স্বপ্নের জাল। ভাবত—তার মেয়ে হবে দুদে উকিল, এমনকী বিচারকও হতে পারে…যখনই বড়ো বড়ো কর্পোরেশন তার সামনে আসবে, হাতুড়ির আঘাতে তাদের আগ্রাসন থামিয়ে দেবে ডেইজি।
কিন্তু সব স্বপ্ন ভণ্ডুল করে দিয়ে পুলিস ফোর্সে নাম লেখাল ডেইজি। সানন্দে তাকে স্বাগত জানাল পুলিস বাহিনী: নারীর সংখ্যা বাড়াবার, সেই সঙ্গে বাহিনীর সদস্যদের মাঝে বৈচিত্র্য আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তাদের। অন্য দিকে আবার কম্পিউটার-সংক্রান্ত অপরাধ এবং প্রতারণার সংখ্যাও বাড়ছিল দিন-কে-দিন। ডেইজিকে দরকার ছিল ওদের…
…আরও ঠিক করে বলতে গেলে—একটা না, অনেকগুলো ডেইজি তাদের প্রয়োজনে পরিণত হয়েছিল!
সেই দিনের চার বছর পর, আজ পেছন ফিরে তাকালে মোটামুটি নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা যায়: ক্যারিয়ার যেমন হবে বলে আশা করেছিল ডেইজি, তেমনটা হয়নি। পুলিস বাহিনী মারাত্মক বর্ণবাদী এবং যৌন-অধিকার বিষয়ে অসচেতন, তাই ওতে যোগ দিলে ডেইজি নিজেকে হারিয়ে ফেলবে, এমনকী আত্মারও বারোটা বাজিয়ে ক্যান্টিনে পাওয়া ইনস্ট্যান্ট কফির মতো গতানুগতিক বানিয়ে দেবে—বাবা-মায়ের এই সতর্কতা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়নি যদিও। সমস্যা যেটা ভোগ করতে হয়েছে তা হলো: অন্য পুলিসকে বোঝানো যে সে নিজেও একজন পুলিস। অনেক চেষ্টা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে— অধিকাংশ অফিসারের কাছেই, পুলিসগিরি করার অর্থ হলো ইংল্যান্ডের মধ্যভাগকে জঘন্য সামাজিক অবস্থানের বাজে লোকদের হাত থেকে রক্ষা করা; যারা ওঁত পেতে থাকে নিদেনপক্ষে হলেও কীভাবে পুলিসের ফোন চুরি করা যায়, সেই সুযোগের। কিন্তু ডেইজির কাছে ব্যাপারটা আলাদা। ও জানে, জার্মানির বাড়িতে বসে নাক টিপলে দুধ বেরোয় বয়সি একটা ছেলেও এমন ভাইরাস পাঠাতে পারবে যা পুরো একটা হাসপাতালকে বন্ধ করে দিতে পারে। আস্ত বোমার চাইতেও বেশি ক্ষতি হবে তাতে।
ডেইজির মতে, আজকালকার অপরাধীরা খুব ভালো করেই এফটিপি সাইট, উচ্চমানের এনক্রিপশন আর চাইলেই ফেলে দেওয়া যায় এমন প্রি- পেইড সেলফোনের প্যাঁচঘোচ মাথায় নিয়ে চলে…
…কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তাদের থামাবার দায়িত্ব যে ভালোমানুষদের ওপর, তারাই সেসব জানে না!
প্লাস্টিকের একটা কাপে চুমুক দিয়েই মুখ-চোখ কুঁচকে ফেলল মেয়েটা; অনেকক্ষণ ধরে পর্দায় নজর রাখছে সে, এদিকে ঠান্ডা হয়ে গেছে ওর কফি।
গ্রাহাম কোর্টসের দেওয়া যাবতীয় তথ্য ঘেঁটে দেখেছে সে। প্রথম দেখাতেই মনে হয়, কোনো-না-কোনো ঘাপলা আছেই। আর কিছু না হলেও, ঠিক গত হপ্তাতেই নিজের নামে লেখা চার্লস ন্যান্সির সইসহ দুই হাজার পাউন্ডের চেকটাই কেস খাড়া করার জন্য যথেষ্ট।
কিন্তু… মন যে কেবলই বলছে: ডাল ম্যায় কুছ কালা হ্যায়!
করিডোরের শেষ মাথায় অবস্থিত সুপারিন্টেনডেন্টের অফিসের দরজায় টোকা দিল ডেইজি।
‘এসো!’
গত তিরিশ বছর হলো নিজের ডেস্কে বসেই পাইপ ফুঁকেছেন ক্যাম্বারওয়েল, কিন্তু দালানে ‘ধূমপান নিষেধ’ আইন জারি হবার পর থেকে আর পারেন না। এখন কাজ চালান প্লাস্টিসিনের[২২] একটা টুকরো দিয়ে। সেটাকে বলের আকৃতিতে গুটিয়ে চাপ দিয়ে সমান করে ফেলেন, কিংবা করেন দলাই-মালাই। যখন মুখে পাইপ থাকত, তখন হাসিখুশি আর নরম মেজাজের মানুষ ছিলেন; এমনকী অধস্তনরা তাকে ‘মাটির মানুষ’ বলতেও দ্বিধা করত না। কিন্তু হাতে প্লাস্টিসিন থাকা অবস্থায় তিনি খিটখিটে মেজাজের হয়ে যান।
[২২. মূর্তি বা ভাস্কর্য গড়া শেখাবার সময় ব্যবহৃত কাদার মতো পদার্থ যা দীর্ঘদিন নরম থাকে।]
‘কী?’
‘দ্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সির কেসটা…’
‘কী হয়েছে ওই কেস নিয়ে?’
‘আমার মন মানছে না।’
‘মন মানছে না? মনের আবার এখানে মানামানির কী আছে?’
‘নিজেকে সরিয়ে নিতে চাইছি কেসটা থেকে।’
মনে হলো না কথাটা শুনে খুশি হয়েছেন ক্যাম্বারওয়েল। ডেস্কের নিচে, ডেইজির নজরের আড়ালে, তার হাতগুলো নীলচে প্লাস্টিসিনকে পাইপের আকৃতি দান করছে। ‘কেন?’
‘সন্দেহভাজনের সঙ্গে আমার সামাজিকভাবে পরিচয় আছে।’
‘তো? ওর সঙ্গে ছুটি কাটাতে গেছিলে? নাকি ওর বাচ্চাদের গডমাদার তুমি? অ্যাঁ?’
‘কিছুই না, আমাদের একবার মাত্রা দেখে হয়েছে। রাতে ওর বাড়িতে ছিলাম।’
‘মানে ইটিস পিটিস করেছ?’ লম্বা একটা নিশ্বাস নিলেন ক্যাম্বারওয়েল, যেটা দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন তার ভেতরে একইসঙ্গে কাজ করছে ক্লান্তি, বিরক্তি আর খানিকটা ধোঁয়া পাবার আকাঙ্ক্ষা।
‘না, স্যার। তেমন কিছু না। শুধু ঘুমিয়েছিলাম ওর বাড়িতে।’
‘এছাড়া আর কোনো সম্পর্ক নেই ওর সঙ্গে?’
‘না, স্যার।’
প্লাস্টিসিনের পাইপটাকে হাতের মুঠোয় মিশিয়ে দিলেন তিনি। ‘আমার সময় নষ্ট করছ, ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছ তো?’
‘জি, স্যার। দুঃখিত, স্যার।’
‘যা ইচ্ছা করো, শুধু আমাকে বিরক্ত কোরো না।’
মেইভ লিভিংস্টোন একাই লিফটে চড়ে উঠে এলো ষষ্টতলায়। ধীর গতির, কাঁপতে থাকা লিফটটা ওকে সময় দিল–গ্রাহাম কোটসকে কী বলবে তা মাথায় সাজিয়ে নেবার।
একটা পাতলা, বাদামি ব্রিফকেস আছে তার সঙ্গে; ওটার মালিক ছিল মরিস: একেবারে পুরুষালী দেখতে ওটা। একটা সাদা ব্লাউজ পরে আছে সে, সঙ্গে নীল ডেনিম স্কার্ট… ধূসর কোট চড়িয়েছে গায়ে। অনেক লম্বা পা তার, ত্বক ধূসর; চুলের রং আজও সেই বিশ বছর আগের, মরিসের সঙ্গে তার বিয়ের রাতের মতোই সোনালি, রঙটা ধরে রাখতে খুব অল্প পরিমাণ কেমিক্যাল ব্যবহার করতে হয়।
মরিসকে অন্তর থেকে ভালোবাসত মেইভ। ভদ্রলোক মারা যাওয়ার পরেও ফোন থেকে তার নম্বরটা ডিলিট করেনি, এমনকী মরিসের ফোনটা ফিরিয়ে দেবার পরেও। মরিসের একটা ছবি ফোনে তুলে দিয়েছিল তার ভাগনে, সেটা হারাতে চায় না মেইভ। এই মুহূর্তে স্বামীকে ফোন করতে পারলে, আর কিছু চাইত না; তার পরামর্শ এখন ওর খুবই দরকার।
স্পিকারফোনে নিজের পরিচয় দিতে হয়েছে মহিলাকে, তারপর ওপরে ওঠার অনুমতি পেয়েছে। যখন রিসেপশনে পা রাখে, তখন গ্রাহাম কোটস অপেক্ষা করছিল তার জন্য।
‘কেমন আছ তুমি, মাই গুড লেডি?’ জিজ্ঞেস করল গ্রাহাম কোটস।
‘আমি তোমার সঙ্গে গোপনে কথা বলতে চাই, গ্রাহাম,’ বলল মেইভ। ‘এখুনি।’
মুচকি হাসল গ্রাহাম কোটস; গোপনে যত নষ্ট-কল্পনা করে মেইভকে নিয়ে, তাদের অধিকাংশই এই লাইনটা দিয়েই শুরু হয়! তবে সেসব কল্পনায় মেইভ বলে, ‘তোমাকে আমার দরকার, গ্রাহাম, এখুনি।’ অথবা ‘ওহ গ্রাহাম, আমি খুব খুব খুব খুব খারাপ মেয়ে; আমাকে উচিত শিক্ষা দিতে হবে’। বিরল কল্পনাগুলোতে হয়তো বলত, ‘গ্রাহাম, একটা মাত্র নারী তোমার জন্য যথেষ্ট না। তাই এসো, আমার নগ্ন যমজ বোনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। এই হচ্ছে মেইভ দুই।’
গ্রাহাম কোটসের অফিসের দিকে রওনা দিল তারা।
অফিসে পৌঁছেও মেইভ কিছু বলল না দেখে, গ্রাহাম কোটসের খানিকটা মন খারাপই হলো। এমনকী কোটটা পর্যন্ত খুলল না মহিলা। উলটো ব্রিফকেস খুলে ভেতর থেকে এক তাড়া কাগজ বের করে এনে রাখল ডেস্কের ওপর।
‘গ্রাহাম, আমার ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের পরামর্শ মোতাবেক, গত এক দশক ধরে আমাকে যেসব হিসেব দিয়েছ তা স্বাধীন একটা কোম্পানিকে দিয়ে অডিট করিয়েছি। মরিস যখন বেঁচেছিল, তখনকার সময়ের অনেক হিসাবও। দেখে নাও, যেভাবে ইচ্ছা দেখ। কিন্তু সংখ্যাগুলোর যোগফল তোমার দেওয়া হিসেবের সঙ্গে মেলে না। একদমই না। ভাবলাম, পুলিসের হাতে এসব তুলে দেওয়ার আগে একবার কথা বলা যাক। মরিসের স্মৃতির খাতিরেই এই সুযোগটা দেওয়া উচিত তোমাকে।’
‘তা তো উচিতই,’ বলল গ্রাহাম কোটস, সাপের মতো মসৃণ ভাবে। ‘অবশ্যই উচিত।’
‘আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলবে না?’ নিখুঁত একটা ভ্রু উঁচু করল মেইভ লিভিংস্টোন। দৃশ্যটা ভালো লাগল না গ্রাহাম কোর্টসের, ওর কল্পনার মেইভ অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
‘বহুদিন হলো দ্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সিতে এক অসৎ কর্মচারী কাজ করে আসছে, মেইভ। আসলে আমি নিজেই পুলিসকে খবর দিয়েছি গত হপ্তায়, যখন বুঝতে পারলাম যে কোথাও কোনো ঘাপলা আছে। আইনের লম্বা হাত এরইমাঝে কাজে লেগে পড়েছে। আমাদের এজেন্সির মক্কেলদের ওজন ও সম্মানের খাতিরে—যাদের মাঝে তুমিও আছ—পুলিস গোপনে অনুসন্ধান করছে। ওদেরকে সেজন্য ধন্যবাদ,’ দেখে মনে হলো না মেইভ সন্তুষ্ট হয়েছে তার কথায়। তাই ভিন্ন পথ ধরতে চাইল সে। ‘কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পুরোটা না হলেও, লুণ্ঠিত অর্থের অধিকাংশই তারা উদ্ধার করতে পারবে।’
মাথা নাড়ল মেইভ, শান্ত হলো গ্রাহাম কোটস। তবে খুব একটা না….
‘কোন কর্মচারী, তা জিজ্ঞেস করতে পারি?’
‘চার্লস ন্যান্সি। স্বীকার করে নিচ্ছি—ওকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস
করতাম। প্রচণ্ড নাড়া খেয়েছি ব্যাপারটা আবিষ্কার করে।’
‘ওহ, ছেলেটা তো খুবই মিষ্টি ছিল।’
‘প্রথম দেখায়,’ মন্তব্য করল গ্রাহাম কোটস। ‘কে কার আসল রূপটা ধরতে পারে, বলো?’
হাসল মেইভ, মিষ্টি একটা হাসি। ‘এসব কথায় চিঁড়ে ভিজবে না, গ্রাহাম। বহু বছর ধরেই হিসেবে গরমিল হয়ে আসছে, চার্লস ন্যান্সি চাকরি নেবারও আগ থেকে। সম্ভবত আমার বিয়েরও আগে থেকে হবে! মরিস তোমাকে অন্তর থেকে বিশ্বাস করত, তার কাছ থেকে পয়সা চুরি করেছ তুমি। এখন তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, কর্মচারীদের একজনকে ফাঁসাতে চাচ্ছ! কিংবা দায় চাপাচ্ছ সহযোগীদের ঘাড়ে। এসব বলে কাজ হবে না!’
‘নাহ,’ বলল গ্রাহাম কোটস, অনুতপ্ত ভঙ্গিতে। ‘দুঃখিত।’
কাগজের তাড়া আবার গুছিয়ে নিলো মহিলা। ‘জানার কৌতূহল হচ্ছে বলে জিজ্ঞেস করছি,’ জানতে চাইল মেইভ। ‘আমার আর মরিসের কাছ থেকে কত টাকা চুরি করেছ? আমার হিসেবে তিন মিলিয়নের মতো হবে।’
‘আহ,’ এখন আর হাসছে না লোকটা। আসল অঙ্কটা অনেক বেশিই হবে। ‘মোটামুটি তেমনই হবে।’
একে-অন্যের দিকে তাকাল ওরা, মাথার ভেতর ঝড়ের গতিতে হিসেব কষছে গ্রাহাম কোটস। সময় লাগবে ওর, এছাড়া আর কিছুই দরকার নেই। ‘যদি আমি,’ প্রস্তাব দিল সে। ‘তোমাকে পুরো টাকা ফেরত দেই, নগদে এবং সুদসহ…এই ধরো মোট অঙ্কের ৫০ শতাংশ, তাহলে চলবে?’
‘আমাকে সাড়ে চার মিলিয়ন পাউন্ড দেবে তুমি? তাও নগদে?’
এমন ভাবে হাসল গ্রাহাম কোটস, যেভাবে ছোবল হানার আগে কোবরা হাসে! ‘পু-বশ্যই। যদি তুমি পুলিসের কাছে যাও, তাহলে সব অভিযোগ অস্বীকার করে ভাড়া করব দুদে সব উকিলকে। ভাগ্য যদি খারাপ হলে লম্বা সময় ধরে চলবে বিচার। তখন আমি বাধ্য হবো মরিসের সুনামকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে। যদি আমাকে জেলে যেতেও হয়, তাহলে যেতে হবে দশ থেকে বারো বছরের জন্য। যার মাঝে বড়োজোর পাঁচ বছর চোদ্দো শিকের পেছনে থাকতে হবে। কিন্তু অনুগত কয়েদি হলে এরপর ছাড়া পেয়ে যাবো। এদিকে কয়েদির সংখ্যা অনেক বেশি বলে, সম্ভবত খোলা কয়েদখানায় কাটাতে হবে সময়টা। এসবের কোনোটাই খুব একটা কঠিন হবে বলে মনে হচ্ছে না। আরেকটা কথা বলে দিই—পুলিসের কাছে গেলে তুমি মরিসের পয়সার ঝনঝনানিও তুমি শুনতে পাবে না। তারচেয়ে বরং মুখ বন্ধ রাখো, পয়সা তো পাবেই…ক্ষতিপূরণও পাবে। আমাকে একটু সময় দাও, তাহলে ঠিক কাজটাই করব। আশা করি আমার কথা বুঝতে পারছ!’
মেইভ ভাবল প্রস্তাবটা নিয়ে। ‘তোমাকে জেলে পচে মরতে দেখে খুশি হতাম,’ জানাল সে। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল। ‘ঠিক আছে, টাকাই দাও। কিন্তু তারপর আর তোমার চেহারা দেখতে চাই না, তোমার সঙ্গে আমার চুক্তিও আর বহাল থাকবে না। এরপর থেকে সম্মানীর সব চেক যেন সরাসরি আমার কাছেই আসে।’
‘অবশ্যই, সেফটা ওদিকে,’ ইঙ্গিতে দেখাল গ্রাহাম কোটস।
দূরের দেওয়ালে দেখা যাচ্ছে একটা বইয়ের তাক। চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা ডিকেন্সের বই দেখা যাচ্ছে ওখানে। সঙ্গে আছে থ্যাকারে, ট্রোলোপ আর অস্টিনের বইও; একটাও সম্ভবত খুলে দেখা হয়নি। একটা বই ধরে গ্রাহাম কোটস টান দিতেই, বইয়ের তাক সরে গেল এক পাশে। দেখা গেল, ওটার পেছনে রয়েছে একটা দরজা; রং করা হয়েছে এমনভাবে যেন দেওয়ালের রঙের সঙ্গে মিলে যায়।
মেইভ ভাবল, সেফের কম্বিনেশন কী হতে পারে? কিন্তু না, কম্বিনেশনের দরকার নেই। একটা গর্ত আছে ওতে, যেটায় গ্রাহাম কোটস বড়োসড়ো একটা পেতলের চাবি ঢুকিয়ে দিল। হাঁ করে খুলে গেল দরজা।
ভেতরে ঢুকে বাতি জ্বালাল লোকটা। ছোট্ট, সরু একটা কামরা; ভেতরে যে তাকগুলো আছে তা নবিসের হাতে লাগানো। একদম দূরের কোনায় রয়েছে একটা ছোট্ট, অগ্নিরোধক ফাইলিং ক্যাবিনেট।
‘চাইলে নগদ টাকায় নিতে পারো, কিংবা রত্নের মাধ্যমে… অথবা দুটো মিলিয়েও নিতে পারো,’ সরাসরি জানাল লোকটা। ‘আমি পরামর্শ দেব, শেষেরটাই করো। এখানে কিছু অ্যান্টিক সোনা আছে, বহনযোগ্যও।’
বেশ কয়েকটা স্ট্রংবক্স খুলে, ভেতরের জিনিসও দেখাল গ্রাহাম কোটস। আংটি, চেইন আর লকেট ঝিকিয়ে উঠল ভেতর থেকে।
হাঁ হয়ে গেল মেইভের মুখ। ‘দেখো, ওকে বলল গ্রাহাম কোটস। লোকটার পাশ দিয়ে ভেতরে পা রাখল মহিলা।
এক কথা বলা যায়–ভেতরটা যেন গুপ্তধনের খনি!
চেইনঅলা একটা সোনার লকেট হাতে তুলে নিলো মেইভ, উঁচু করে অবাক হয়ে চেয়ে রইল ওটার দিকে। ‘অসাধারণ সুন্দর,’ বলল সে। ‘দাম কম করে হলেও তো—’ বলতে বলতেই থেমে গেল বেচারি, কেননা পালিশ করা সোনার লকেটে দেখতে পেয়েছে—কিছু একটা নড়ছে ওর পেছনে। ঘুরে দাঁড়াল সে ঝট করে, তাই হাতুড়িটা ওর মাথার ঠিক পেছনে লাগল না; যদিও গ্রাহাম কোটসের ওখানেই আঘাত হানার ইচ্ছে ছিল।
হাতুড়ির বাড়িটা লাগল গালের এক পাশে, তাও আলতো করে।
‘হারামজাদা!’ চেঁচিয়ে উঠে লোকটাকে লাথি বসালো মহিলা। পায়ে মেইভের যথেষ্টই শক্তি আছে, কিন্তু তার আর আক্রমণকারীর মাঝে তেমন একটা দূরত্ব নেই বলে ঠিকমতো লাগাতে পারল না।
মেইভের লাথিটা লাগল গ্রাহাম কোটসের পায়ের সামনের দিকে। সেই সঙ্গে লোকটার হাতে থাকা হাতুড়ির দিকে ঝুঁকল মহিলা। আবার আঘাত হানল গ্রাহাম কোটস, এবার লাগল জায়গামতোই; টলে উঠে এক পাশে পড়ে গেল মেইভ, তার চোখে দেখা গেল ঘষা কাচের দৃষ্টি। আবার আঘাত হানল লোকটা, এবার সরাসরি মাথার ওপর দিকটায়… তারপর মারল আবার, তারপর আবারও!
একটা অস্ত্রের অভাব খুব করে বোধ করছে গ্রাহাম কোটস। একটা সুন্দর, ভালো হ্যান্ডগান হলে বেশ হতো। আর চলচ্চিত্রের মতো সাইলেন্সারঅলা হলে তো সোনায় সোহাগা। আসলে যদি কখনও ভাবত যে অফিসে কাউকে হত্যা করতে হবে, তাহলে সেই ব্যবস্থা করে রাখত। এমনকী বিষের ব্যবস্থাও রাখত হয়তো। নিঃসন্দেহে, ওই কাজটা করলেই ভালো হতো। তাহলে এখন হাতে রক্ত মাখাতে হতো না।
হাতুড়ির সঙ্গে লেপটে আছে রক্ত আর সোনালি চুল। ঘৃণার সঙ্গে মেঝেতে ফেলে দিল ওটা, তারপর সাবধানে মেইভের লাশটাকে ঘুরে অতিক্রম করল। ওর মনোযোগ এখন অলঙ্কারে ভরতি সেফ বক্সের দিকে। ডেস্কের ওপর থেকে সব কিছু আবার বক্সে ভরে ফিরিয়ে দিল সেফে। ওখান থেকে একশো ডলার আর পাঁচশো ইউরোর নোটে ভরতি একটা অ্যাটাশে কেস আর অকাটা হীরে দিয়ে ভরতি কালো, ভেলভেটের ব্যাগ বের করে নিলো। ফাইলিং ক্যাবিনেট থেকে কিছু ফাইলও সরালো গ্রাহাম কোটস। সব শেষে নিলো সবচাইতে দামি জিনিসটা—গোপন কামরা থেকে বের করে নিলো ছোট্ট, চামড়ার ভ্যানিটি কেসটা; যার ভেতরে আছে দুটো ওয়ালেট আর দুটো পাসপোর্ট।
ভারী দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিল লোকটা, তারপর তালা লাগিয়ে বইয়ের তাকটা আবার আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনল।
তারপর দাঁড়িয়ে রইল ওভাবেই, হাঁপাল কিছুক্ষণ; দম ফিরে পেতে চাইছে। সবমিলিয়ে ব্যাপারটা গর্ব করার মতো করেই সামাল দিয়েছে-সিদ্ধান্ত নিলো অবশেষে। ভালোই দেখালে খেল, গ্রাহাম। বেশ ভালো। হাতে থাকা জিনিসপত্র কাজে লাগিয়ে, গাড্ডা থেকে বেরিয়ে এসেছে: ধোঁকা দিয়েছে, তবে সেটা দক্ষতার সঙ্গে আর মাথা খাটিয়ে; কথা যেমন আছে: হয় ছক্কা, নয় অক্কা। বাজি ধরে ছিল সে, ছক্কাই মেরেছে। এক দিন গ্রীষ্মমণ্ডলের কোনো একটা স্বর্গীয় দ্বীপে শুয়ে, নিজের আত্মজীবনী লিখবে সে। লোকেরা জানবে— কীভাবে এক বিপজ্জনক মহিলার বিরুদ্ধে নেমেও জয়লাভ করেছে। অবশ্য, ভাবল লোকটা, মেইভের হাতে বন্দুক থাকলে নাটকীয়তা আরও বাড়ত।
সম্ভবত, ঘটনা আবার ভাবতেই মনে হতে লাগল গ্রাহাম কোর্টস, মেইভ আসলেও অস্ত্র তাক করেছিল ওর দিকে। মোটামুটি নিশ্চিত মনে হচ্ছে এখন নিজেকে—মহিলাকে অস্ত্রের দিকে হাত বাড়াতে দেখেছে। হাতুড়িটা যে ওখানে ছিল, সেজন্যই কপালকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। মাঝে মধ্যে টুকিটাকি মেরামতির দরকার পড়ে যায়, তাই কামরার ভেতরেই রেখেছিল ওটাকে; নইলে এত সহজে আর এত দ্রুত আত্মরক্ষা করতে পারত না।
এতক্ষণে মাথায় এলো ওর—অফিসের দরজাটা লাগিয়ে দেওয়া উচিত।
শার্ট আর হাতে রক্ত লেগে আছে, জুতোর তলাতেও। শার্ট খুলে ওটা দিয়েই জুতো মুখে নিলো সে। তারপর ডেস্কের পাশের ময়লা ফেলার বাক্সে ছুড়ে মারল শার্টটাকে। নিজেকেই অবাক করে দিয়ে হাতটা মুখের কাছে এনে, রক্তের দাগ চেটে পরিষ্কার করল… অনেকটা বেড়ালের মতো…
…রক্তাক্ত জিভ দিয়ে!
তারপর হাই তুলল একটা। মেইভের কাগজপত্র ডেস্ক থেকে তুলে শ্রেডারে ফেলে ফালি ফালি করে কাটল। ব্রিফকেসে আরেক সেট কাগজ এনেছিল মহিলা, সেগুলোরও হলো একই দশা। এরপর ফালিগুলো এক করে আবার ফেলল শ্রেভারে।
অফিসের এক কোনায় একটা ক্লজেট আছে তার, সেখানে ঝুলছে বাড়তি স্যুট। এছাড়াও শার্ট, মোজা, অন্তর্বাসসহ পরিধেয় সবকিছুই আছে। অফিস থেকে কখন সরাসরি কোথাও যেতে হয়, তা কে বলতে পারে?
তাই…সাবধানের মার নেই।
সতর্কতার সঙ্গে পোশাক পালটে নিলো গ্রাহাম কোটস।
ক্লজেটে আরেকটা জিনিস আছে, ছোট্ট একটা সুটকেস; তাও চাকাঅলা। বিমানে, মাথার ওপরের বাক্সে সাধারণত যে ধরনের সুটকেস তোলা হয়, অনেকটা তেমন। ভেতরে আগে থেকেই এটা-সেটা ছিল, এবার তাতে ভরে নিলো কিছু জিনিস।
রিসেপশনে ফোন দিল এরপর। ‘অ্যানি,’ বলল সে। ‘একটা স্যান্ডউইচ এনে দেবে? নাহ, প্রেট-এর স্যান্ডউইচ ভালো না। ব্রিউয়ার স্ট্রিটের নতুন দোকানটা চেনো? ওখান থেকে আনো তাহলে। মিসেস লিভিংস্টোনের সঙ্গে কাজ প্রায় শেষ। এরপর তাকে নিয়ে খেতে যেতে পারি, তারপরেও ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই।’
কম্পিউটারের সামনে কাটল আরও কিছু মুহূর্ত; ভেতরের সব ফাইল ঝেড়ে-পুঁছে পরিষ্কার করে, এমন একটা প্রোগ্রাম চালালো। ওটা সব তথ্য গুছিয়ে নিয়ে তাতে এলোপাথাড়িভাবে ‘o’ আর ‘১’ লেখে। তারপর ওগুলোকেও ছোটো ছোটো ভাগ করে শেষ পর্যন্ত মুছে ফেলে পুরোপুরি। থেমসের মধ্যখানে কাউকে কংক্রিটের জুতো পরিয়ে ছেড়ে দিল যেমন চিরতরে ডুবে যাবে, অনেকটা তেমনই। কাজ সেরে পা রাখল সে হলে, সঙ্গে টেনে আনছে তার সুটকেস।
একটা অফিসের ভেতরে উঁকি দিয়ে বলল, ‘একটু বাইরে যাচ্ছি। তিনটের মাঝে ফিরব, কেউ জানতে চাইলে বলে দিয়ো।’
রিসেপশনে নেই অ্যানি। ভালোই হলো, ভাবল লোকটা। অধিকাংশই ভাববে–মেইভ লিভিংস্টোন এরইমাঝে অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে, আর গ্রাহাম কোর্টসও ফিরে আসবে যেকোনো সময়। খোঁজ শুরু হবার আগেই, অনেক দূর চলে যেতে পারবে ও!
লিফট ধরেই নিচে নামল গ্রাহাম কোটস। পরিকল্পনায় এত দ্রুত সব ঘটনা ঘটার কথা ছিল না, ভাবল সে। আরও বছরখানেক পর ওর বয়েস পঞ্চাশ হবে। কিন্তু যা হবার, তা তো হবেই। খেলাও মাঠে গড়িয়েছে। ব্যাপারটা ধরে নিতে হবে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক[২৩]… কিংবা এই ক্ষেত্রে গোল্ডেন প্যারাসুট হিসেবে।
[২৩. সময়ের আগেই যারা অবসরে যায়, কিংবা যাদেরকে চাকরিচ্যুত করা হয়, তাদেরকে দেওয়া অর্থ।]
তারপর, পেছনে চাকাঅলা সুটকেসটাকে টানতে টানতে, অলডউইচের রৌদ্রজ্জ্বল রাস্তায় পা রাখল গ্রাহাম কোটস…
…চিরতরে পেছনে ফেলে এলো দ্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সি।
.
নিজের প্রকাণ্ড বিছানাটায় আরামসে ঘুমিয়ে রাত পার করেছে স্পাইডার, মোটকু চার্লির বাড়ির বাড়তি কামরাটায়। একবার মাথায় ভাবনা এসেছিল বটে ওর: মোটকু চার্লি কি সবসময়ের জন্য চলে গেছে ওর জীবন থেকে? পরে কখনও সময়-সুযোগ হলে এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবে, সিদ্ধান্ত নিলো সে।
উঠতে দেরি হয়ে গেছে। একেবারে লাঞ্চ খেতে রোজির সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে সে। ফ্ল্যাট থেকে মেয়েটাকে তুলে নিয়ে, ভালো কোথাও বসবে। শরতের শুরুর দিকের একটা সুন্দর দিন; স্পাইডার যেখানেই যাচ্ছে, সেখানেই যেন ছড়িয়ে দিচ্ছে আনন্দে। কারণ, একটু বাড়িয়ে বলা হলেও, স্পাইডার আসলে দেবতা। আর দেবতাদের মনের অবস্থার প্রভাব আশপাশে তো পড়বেই! স্পাইডার যেদিন ফূর্তিতে আছে, সেদিন ওর আশপাশের মানুষজনের কাছে দিনটাকে আরও একটু উজ্জ্বল মনে হয়। যদি সে কোনো গান গায়, তাহলে ওই আশপাশের লোকজনও গুনগুন করতে শুরু করে; অনেকটা মিউজিক্যাল মুভির মতো। যদি হাই তোলে, তাহলে বোধহয় আরও শখানেক লোকও তাই করবে। যখন বিষণ্ণ থাকে, তখন সেই বিষণ্ণতা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে কুয়াশার মতো। তাই সেই আশপাশের লোকজনও ডুব দেয় বিষণ্ণতার সাগরে। এজন্য কিছু করতে হয় না ওর…
…ও যা, সেজন্যই হয়ে যায় সব।
এই মুহূর্তে ওর আনন্দের সাগরে বিষণ্নতার একমাত্র ঢেউ খেলা করার কারণ: রোজিকে সব সত্যি বলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে!
সত্যি বলাটা স্পাইডারের ঠিক আসে না। ওর কাছে সত্য হলো, অবয়বহীন একটা জিনিস যাকে ইচ্ছেমতো দলা-মোচড়ানো যায়। বলতে গেলে, অনেকটা মন্তব্যের মতো… একজনের মন্তব্যের সঙ্গে অন্যজনের মন্তব্যের কোনো মিলই পাওয়া যাবে না। যখন দরকার পড়ে, তখন স্পাইডার নিজের কাজে লাগাবার মতো ‘মন্তব্য’ করতে পারে বটে!
অন্যের রূপ ধারণ করতে আপত্তি নেই কোনো ওর, বরঞ্চ কাজটা ভালোই লাগে। এ কাজে বেশ দক্ষও। পরিকল্পনার সঙ্গে মিলেও যায়। এই পর্যন্ত যত পরিকল্পনা এঁটেছে সবই এক ধাঁচের: ক) কোনো এক জায়গায় যাও, খ) উপভোগ করো নিজেকে, এবং গ) বিরক্তি পেয়ে বসার আগে পালাও।
অন্তরাত্মা জানাচ্ছে ওকে—এখান থেকেও পালাবার সময় হয়ে গেছে। সারা পৃথিবী ওর জন্য লবস্টার, গলায় বেঁধেছে ন্যাপকিন, হাতের কাছে পড়ে আছে লবস্টারের খোলস ভেঙে ভেতরের সুস্বাদু মাংস খাওয়ার নানা যন্ত্রপাতি।
কিন্তু…
কিন্তু ওর যে যেতে ইচ্ছে করছে না!
কেন যেন চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠছে সে, ব্যাপারটা ওকে ভাবাচ্ছেও! সাধারণত কোনো কিছুই সে আগে ভেবে দেখে না। কোনো কিছু না ভেবেই জীবন কাটিয়ে দেওয়াটা এতদিন বেশ আনন্দময়ই লেগেছে— অন্তরাত্মা, অন্তজ্ঞান এবং প্রচণ্ড রকমের সৌভাগ্য এই পর্যন্ত ভালোই কাজে এসেছে ওর। কিন্তু অলৌকিকের ডানায় ভর দিয়ে আর কত দূর এগোনো যায়? রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে স্পাইডার, লোকজন হাসছে ওর দিকে চেয়ে।
রোজির সঙ্গে ওর ফ্ল্যাটে দেখা করার ব্যাপারে একমত হয়েছিল ওরা। তাই মেয়েটাকে রাস্তার শেষ মাথায়, ওরই জন্য অপেক্ষা করতে দেখে একইসঙ্গে অবাক আর খুশি হলো স্পাইডার। কিছু একটার খোঁচা অনুভব করল সে, যেটা এখনও অপরাধবোধে রূপ নেয়নি। হাত নেড়ে ডাকল, ‘রোজি? হাই!’
ফুটপাত ধরে ওর দিকে এগোল মেয়েটা, এদিকে ততক্ষণে হাসি ফুটেছে স্পাইডারের মুখে। সব ঠিক হয়ে যাবে, যা হয় তা ভালোর জন্যই হয়। ‘ডানাকাটা পরী দেখাচ্ছে,’ বলল ও। ‘হয়তো দুই পরীর মতো সুন্দরী! কী খাবে?’
হেসে শ্রাগ করল কেবল রোজি।
একটা গ্রিক রেস্তোরাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছে ওরা। ‘গ্রিক চলবে?’ মাথা নেড়ে সায় জানাল মেয়েটা। কয়েক কদম হেঁটে ভেতরে পা রাখল ওরা। অন্ধকার, খালি একটা রেস্তোরাঁ। এই মাত্র খুলেছে। পেছন দিকের একটা জায়গা দেখিয়ে দিল মালিক।
মুখোমুখি বসল ওরা, টেবিলটা দুজনের জন্যই। স্পাইডার বলল, ‘তোমাকে একটা কথা বলতে চাই,’ শুনেও কিছু বলল না মেয়েটা। ‘দুঃসংবাদ না, আবার ভালো কথাও না।’ যোগ করল স্পাইডার। ‘তবে তোমার কথাটা জানা থাকা উচিত।’
অর্ডার দেবে কি না, জানতে চাইল মালিক। ‘কফি,’ জানাল স্পাইডার। রোজিও মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে দিল। ‘দুটো কফি,’ অর্ডার দিল স্পাইডার। ‘আরেকটা কথা, আমাদেরকে মিনিট পাঁচেক সময় দিন। আমরা একটু গোপনীয়তা চাইছি।’
সরে গেল মালিক।
চোখে প্রশ্ন নিয়ে স্পাইডারের দিকে চাইল রোজি।
লম্বা করে দম নিলো ছেলেটা। ‘ঠিক আছে, বলছি। শুরুতেই জানিয়ে দিই, কাজটা সহজ না। তাই শেষ পর্যন্ত কী বলব… যাক, বলেই ফেলি—আমি মোটকু চার্লি না। জানি, তুমি আমাকে সেটাই ভাবো। কিন্তু আসলে আমি ওর ভাই, স্পাইডার। আমরা কাছাকাছি দেখতে বলে আমাকে মোটকু চার্লি বলে ধরে নিয়েছ তুমি।’
কিছুই বলল না রোজি।
‘আসলে দেখতে খুব যে মিল, তাও না। কিন্তু, হয়েছে কী, আসলে…কথাগুলো বলতে পারছি না গুছিয়ে। বলেই ফেলি—তোমার কথাই সবসময় আমার মাথায় ঘুরতে থাকে। তাই জানি যে তুমি আমার ভাইয়ের বাগদত্তা, কিন্তু আমিও তোমাকে প্রস্তাব দিচ্ছি আরকি…তুমি কি, মানে ওকে ছেড়ে আমার সঙ্গে…মানে, বুঝতেই পারছ? অন্তত…ভেবে দেখবে একবার?’
কফির পাত্র চলে এলো তখন, একটা ছোট্ট রূপালি ট্রেতে করে; সেই সঙ্গে আছে দুটো কাপ।
‘গ্রিক কফি,’ মালিক নিজেই এনেছে, জানাল সে।
‘ধন্যবাদ, কিন্তু কয়েক মিনিটের গোপনীয়তা চেয়েছিলাম…’
‘খুব গরম,’ বলল মালিক। ‘অনেক বেশি গরম। আর কড়া। গ্রিক। তুর্কি না।’
‘খুব ভালো। শুনুন, মিনিট পাঁচেকের জন্য একা থাকতে দিন।’
শ্রাগ করে চলে গেল মালিক।
‘তুমি বোধহয় আমাকে ঘৃণা করছ,’ বলল স্পাইডার। ‘তোমার জায়গায় আমি থাকলে বোধহয় নিজেও তাই করতাম। কিন্তু মন থেকে বলছি তোমাকে, জীবনে এত তীব্র ভাবে কিছু চাইনি।’ এদিকে ওর দিকে নিস্পৃহ চোখে তাকিয়ে আছে রোজি। ‘দয়া করে কিছু একটা বলো।’
নড়ে উঠল মেয়েটির ঠোঁট, যেন বলার মতো শব্দ খুঁজছে।
অপেক্ষায় রইল স্পাইডার।
খুলে গেল মেয়েটার মুখ।
প্রথমেই ভাবল স্পাইডার, মেয়েটা বুঝি কিছু খাচ্ছে। কেননা ওর দুই দাঁতের ফাঁকে দেখা গেল বাদামি কিছু একটা, যেটাকে কোনোভাবেই জিভ বলা যায় না। তারপর ওই জিনিসটা মাথা ঘোরাতেই দেখা দিল চোখজোড়া, আর তাতে থাকা ছোট্ট ও কালো পুঁতির মতো চোখ। অস্বাভাবিক রকমের বড়ো একটা হাঁ করল রোজি।
ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো পাখির ঝাঁক!
‘রোজি?’ আঁতকে উঠল স্পাইডার। বাতাস যেন দখল করে নিলো চঞ্চু, পালক আর নখর। একের পর এক পাখি বেরোতে লাগল মেয়েটার ভেতর থেকে, প্রত্যেকটা বেরিয়েই কান ফাটানো স্বরে চিৎকার করছে স্পাইডারকে লক্ষ্য করেই।
চোখ রক্ষার জন্য হাত তুলে আড়াল করতে চাইল স্পাইডার, সঙ্গে সঙ্গে ব্যথা পেল কবজিতে। ওটাকে হটাবার জন্য হাত ছোড়ার চেষ্টা করতেই, সরাসরি ওর চোখ আক্রমণ করে বসল কিছু একটা। মাথা ঝট করে পিছিয়ে সরিয়ে নিয়ে, চিবুকে আঘাতটা নিলো বেচারা।
আচমকা পরিষ্কার হয়ে গেল সামনের দৃশ্য, তবে মাত্র এক মুহূর্তের জন্য — সামনে বসে আছে এক মহিলা, ঠিক স্পাইডারের বিপরীতে। একে কীভাবে রোজি বলে ভুল করেছিল, তা বুঝতে পারল না স্পাইডার। মহিলা রোজির চাইতে অনেক বয়স্কা, তাছাড়া নীল-কালো চুলের এখানে-সেখানে লেগে আছে রূপালি ছোপ। রোজির চামড়ার মতো উষ্ণ বাদামি না তার ত্বক, বরঞ্চ কালির মতোই কালো। একটা জীর্ণ রেইনকোট পরে আছে মহিলা, হেসে মুখটাকে আরও বড়ো করল সে; ভেতরে দেখা যাচ্ছে অগণিত সিগালের নিষ্ঠুর ঠোঁট আর পাগলাটে চোখ…
নিজেকে ভাববার সময় দিল না স্পাইডার। তার আগেই নেমে পড়ল কাজে। হাত বাড়িয়ে কফির পাত্রের হ্যান্ডেলটা ধরে ফেলল, অন্য হাতে সরিয়ে ফেলেছে ডালা। তারপর ভেতরের গরম তরলটা ছুড়ে দিল মুখোমুখি বসা মহিলার দিকে। মারাত্মক গরম, কালো কফি যেন ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল পাখি-মানবীর ওপর।
ব্যথায় হিসিয়ে উঠল মহিলা।
রেস্তোরাঁর ছাদে ধাক্কা খাচ্ছে পাখির ঝাঁক, ডানা ঝাপটাচ্ছে প্রবল বেগে। কিন্তু এখন আর মুখোমুখি বসে নেই কেউ, উদ্দেশ্যহীন ভাবে উড়ছে পাখিগুলো। এমনকী উন্মত্তের মতো আছড়েও পড়ছে দেওয়ালে।
মালিক এগিয়ে এসে জানতে চাইল, ‘স্যার, আপনি ব্যথা পাননি তো? আমি দুঃখিত, বোধহয় রাস্তা থেকে ভেতরে এসে পড়েছিল…’
‘আমি ঠিক আছি,’ জানাল স্পাইডার।
‘আপনার চেহারা রক্তাক্ত,’ বলল লোকটা, এগিয়ে দিল একটা ন্যাপকিন। সেটাকে গালের সঙ্গে ঠেসে ধরল স্পাইডার। জ্বলে উঠল কাটা জায়গাটা।
পাখিদের তাড়াতে মালিককে সাহায্য করতে চাইল স্পাইডার। দরজা খুলে দিল সে, কিন্তু ভেতরটা এখন পুরোপুরি পাখি-শূন্য! যখন ভেতরে পা রেখেছিল, তখনকার মতোই।
পাঁচ পাউন্ডের একটা নোট বের করে আনল স্পাইডার। ‘এই যে, কফির দাম। আমাকে যেতে হবে।’
মাথা নাড়ল মালিক, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলল, ‘ন্যাপকিন রেখে দিন।’
থমকে দাঁড়িয়ে কিছু একটা ভাবল স্পাইডার। ‘আমি যখন ভেতরে আসি, ‘ জানতে চাইল সে। ‘তখন সঙ্গে কোনো মেয়েমানুষ ছিল? দেখতে পেয়েছিলেন?’
বিহ্বল দেখাল মালিক লোকটাকে, এমনকী আতঙ্কিতও বলা চলে—ঠিক নিশ্চিত না স্পাইডার। ‘মনে নেই,’ আচ্ছন্নের মতো করে বলল লোকটা। ‘আপনি একা আসলে, ওই টেবিলে আপনাকে বসাতাম না–কেবল এতটুকুই বলতে পারি। তবে আপনার প্রশ্নের জবাব নিশ্চয়তার সঙ্গে দিতে পারছি না –
রাস্তায় পা রাখল স্পাইডার। দিনটা এখনও উজ্জ্বল। কিন্তু সূর্যের আলো আর আশ্বস্ত করছে না ওকে। চারপাশে তাকাল একবার, দেখতে পেল একটা কবুতর; কারও ফেলে যাওয়া আইসক্রিমে ঠোকর মারছে। জানালার ধারে বসে আছে একটা চড়ুই; মাথার অনেক ওপরে, সূর্যকে মুহূর্তের ভগ্নাংশের জন্য ঢেকে দেওয়ার প্রয়াসে ডানা মেলেছে একটা সিগাল।
অধ্যায় নয় – যেখানে চার্লি দরজা খুলে দিল আর স্পাইডার মুখোমুখি হলো ফ্ল্যামিঙ্গোর
অধ্যায় নয় – যেখানে চার্লি দরজা খুলে দিল আর স্পাইডার মুখোমুখি হলো ফ্ল্যামিঙ্গোর
ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছে মোটকু চার্লির, আর সেটা অনুভবও করতে পারছে সে। যে বিমানে করে ইংল্যান্ডে ফিরছিল, সেটার টিকেট বিক্রি হয়ে গেছে; তাই ইকোনমি থেকে ফার্স্ট ক্লাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ওকে। খাবারটাও অসাধারণ। আটলান্টিকের মাঝপথে এসে, ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট ওকে জানাল- চকলেটের একটা বাক্স পুরষ্কার হিসেবে জিতেছে সে; শুধু তাই না, সঙ্গে সঙ্গে দিয়েও দিল ওর উপহার। মাথার ওপরের লকারে সেটা রাখল মোটকু চার্লি, তারপর অর্ডার দিল বরফঅলা ড্রামবুই[২৪]।
[২৪. এক ধরনের সোনালি মদ যা বানানো হয় স্কচ হুইস্কি, হেদার গাছের রস ও জুড়িবুটির মিশ্রণে।]
বাড়ি ফিরে আগে অফিসে যাবে। গ্রাহাম কোটসের সঙ্গে বসে ভুল বোঝাবুঝির একটা ইতি টানবে প্রথমেই। কেননা অন্তত এই একটা ব্যাপারে সে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারে- হিসেবে কোনো ভুল হয়নি ওর। রোজির সঙ্গেও ঝামেলা চুকিয়ে ফেলবে।
দিনশেষে ভালোই হবে সবকিছু।
স্পাইডারকে দেখতে পাবে কি না, সেটা ভাবল ও। হয়তো তার ভাই এরইমাঝে বিদেয় নিয়েছে, আবার কপাল ভালো হলে তাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার সৌভাগ্যও হতে পারে। পরেরটা হলেই খুশি হবে সে।
মোটকু চার্লি দেখতে চায়: ওর ভাই ক্ষমা চাইছে, এমনকী নাকখত দিলে আরও ভালো। জবাবে কী বলবে সে, সেটাও ভেবে রেখেছে।
‘ভাগো!’ বলবে মোটকু চার্লি। ‘সঙ্গে নিয়ে যাও তোমার সূর্যালোক, তোমার জ্যাকুজি আর শোবার ঘর!’
‘কী বললেন?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট।
‘নিজের সঙ্গে কথা বলছিলাম,’ মোটকু চার্লি জবাব দিল। ‘উম, দুঃখিত।’
এভাবে লজ্জা পেয়েও খারাপ লাগছে না ওর। বিমান ক্রাশ করে সব শেষ হয়ে যাক—সেই প্রার্থনাও করছে না। মনে হচ্ছে: বেঁচে থাকাটা মন্দ না!
এটা-সেটা ভরতি একটা বাক্স দেওয়া হয়েছে ওকে বিমানের কোম্পানির পক্ষ থেকে। চোখে ঢাকনি দিল সে, যতদূর সম্ভব হেলিয়ে দিল ওর আসনটা; প্রায় শুয়েই পড়ল বলা চলে। রোজির কথা ভাবল একবার, যদিও ওর মনে থাকা রোজির চেহারা প্রায়শই বদলে যাচ্ছে; রূপ নিচ্ছে এমন একজনের, যার পরনে বলতে গেলে কিছুই নেই। অপরাধ বোধে ক্লিষ্ট হয়ে মেয়েটাকে পোশাক পরাল সে, হতবাক হয়ে আবিষ্কার করল—পোশাকটা আসলে পুলিসের ইউনিফর্ম! খুবই খারাপ লাগছে, নিজেকেই শোনাল। তবে অনুভূতিটা তেমন জোরাল হলো না। নিজেকে নিজেই লজ্জা পাওয়া উচিত ওর, উচিত হলো…
সিটে নড়ে-চড়ে বসে, তৃপ্তির সঙ্গে নাক ডাকাতে শুরু করল মোটকু চার্লি। হিথরোতে যখন নেমেছে, তখনও মেজাজ খুবই ভালো ছেলেটার। হিথরো এক্সপ্রেসে করে চলে এলো প্যাডিংটনে, ইংল্যান্ড থেকে স্বল্প সময়ের যে বিরতি নিয়েছে তার মাঝে সূর্য বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে খুশিই হলো।
মেঘ দেখে তোরা করিসনে ভয়, নিজেকে শোনাল সে। আড়ালে তাহার সূর্য হাসে…
তবে একমাত্র অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল ট্রেনের যাত্রাপথের মধ্যখানে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে সে বাইরে, হিথরোতে যে কেন খবরের কাগজ কিনল না—সেই কথা জিজ্ঞেস করছে নিজেকেই। এক টুকরো সবুজ অতিক্রম করছে ট্রেনটা—সম্ভবত স্কুলের মাঠ হবে। মনে হলো, আচমকা অন্ধকার হয়ে গেছে আকাশ; সিগন্যাল পেয়ে হিসহিসিয়ে ব্রেক করে ক্রসিঙে থামল ট্রেনটা।
তাতে খুব একটা কিছু যায় আসে না মোটকু চার্লির। শরৎকালে ইংল্যান্ড এমনই হয়: সূর্য কেবল তখনই দেখা দেয়, যখন বৃষ্টি হয় না কিংবা মেঘ জমে না আকাশে। কিন্তু ওই সবুজ মাঠের ধারেই, একটা গাছের পাশে দাঁড়িয়ে আছে একখানা অবয়ব!
প্রথম দেখায় মোটকু চার্লির মনে হলো, ওটা আসলে একটা কাকতাড়ুয়া।
কিন্তু ভাবনাটাই হাস্যকর। কাকতাড়ুয়া হবে কীভাবে? তাদেরকে তো পাওয়া যায় খেতের মাঝে, ফুটবল মাঠে না; বনের পাশে তো কোনোদিনই না। যাই হোক, এমনিতেও ওটাকে কাকতাড়ুয়া বলা যায় না…
…চারপাশে কাকের ঝাঁক, সবখানে; বিশাল বিশাল কালো সব কাক।
পরক্ষণেই নড়ে উঠল ওটা!
অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে বলে অবয়বটা ঝাপসা, মনে হচ্ছে যেন পাতলা একটা দেহ গায়ে বাদামি রেইনকোট পরে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তাকে চিনতে মোটকু চার্লির বেগ পেতে হলো না। জানে, যদি কাছে যায় তাহলে দেখতে পাবে অবসিডিয়ানে খোদাই করা একটা চেহারা, দাঁড় কাকের মতো কালো চুল আর উন্মাদনায় ভরা চোখ।
ঠিক তখনই কেঁপে উঠে নড়তে শুরু করল ট্রেনটা, চোখের পলকে বাদামি রেইনকোট পরা মহিলা হারিয়ে গেল।
অস্বস্তি বোধ করছে মোটকু চার্লি। এতক্ষণে নিজেকে সে বুঝিয়ে ফেলেছিল যে মিসেস ডানউইডির বসার ঘরে যা হয়েছে, কিংবা যা হয়েছে বলে ভাবছে, তার সবই ভ্রম। হয়তো কিছুটা সত্যি, কিন্তু পুরোটা বাস্তব হতেই পারে না। ঘটেছে বটে ঘটনাটা: কিন্তু প্রকৃত সত্যের রূপক হিসেবে। কেননা সত্যিকারের কোনো জায়গায় ও যায় কীভাবে ওখান থেকে? কীভাবে চুক্তি করে কারও সঙ্গে?
আসলে, পুরোটাই ছিল ভ্রম…বড়োজোর রূপক।
তাহলে সবকিছু ভালো হতে শুরু করবে, কেন এই ব্যাপারে এতটা নিশ্চিত ছিল—নিজেকে সেই প্রশ্ন করতে গেল না। বাস্তবতা যেমন আছে, তেমনি আছে বাস্তবতার বাস্তবতা… আর কিছু জিনিস অন্য সবকিছুর চাইতেও বাস্তব!
ক্রমেই ওকে বহনকারী ট্রেনটার গতি বেড়ে চলল।
.
গ্রিক রেস্তোরাঁটা থেকে বাড়িতে প্রায় ফিরে এসেছে স্পাইডার, গালের সঙ্গে চেপে ধরে আছে ন্যাপকিনটা। আচমকা ওর কাঁধে হাত রাখল কেউ।
‘চার্লস?’ জিজ্ঞেস করল রোজি।
লাফ দিল স্পাইডার; অবশ্য সেটাকে লাফ না বলে চমকে উঠে ছোট্ট আর্ত-চিৎকারও বলা যেতে পারে।
‘চার্লস? তুমি ঠিক আছ? গালে কেটে গেল কীভাবে?’
মেয়েটার দিকে চেয়ে রইল সে। ‘তুমি… তুমিই তো?’ ছুড়ে দিল প্রশ্ন।
‘কীহ?’
‘তুমি, রোজি তো?’
‘এ আবার কেমনতর প্রশ্ন? অবশ্যই আমি রোজি। গালে ব্যথা পেলে কীভাবে?
আরও শক্ত করে ন্যাপকিনটা গালের সঙ্গে ঠেসে ধরল স্পাইডার। ‘কেটে গেছে,’ জানাল।
‘দেখি দেখি,’ ছেলেটার হাত গালের ওপর থেকে সরিয়ে দিল রোজি। সাদা ন্যাপকিনের ঠিক মধ্যখানটায় খয়েরি দাগ পড়ে গেছে, যেন রক্ত লেগেছে ওতে। কিন্তু গালে কাটা-টাটা কিচ্ছু নেই! ‘কিছুই তো নেই!’
‘ওহ!’
‘চার্লস? ঠিক আছ তো?’
‘হ্যাঁ, জবাব দিল স্পাইডার। ‘ঠিক আছি। কিন্তু নাও থাকতে পারি, হয়তো ধরতেই পারছি না! তবে বাড়িতে গেলে ভালো হবে মনে হচ্ছে, সেখানে নিরাপদে থাকব।’
‘আমাদের না আজ লাঞ্চ খাওয়ার কথা ছিল?’ বলল রোজি, এমন কণ্ঠে যেন কিছুই বুঝতে পারছে না।
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল স্পাইডার। ‘জানি আমি। কেউ সম্ভবত আমাকে খুন করার চেষ্টা চালিয়েছে। যদিও তোমার রূপ ধরে এসেছিল সামনে।’
‘কেউ তোমাকে খুন করতে চাইছে না,’ বলল রোজি, যদিও কথা শুনে মনে হলো না যে স্পাইডারকে আশ্বস্ত করছে।
‘ধরে নিলাম কেউ আমাকে খুন করতে চাচ্ছে না। তারপরেও কি আমরা লাঞ্চের পরিকল্পনা বাদ দিয়ে, বাড়িতে যেতে পারি? খাবার আগে ওখানে।’
‘অবশ্যই।’
ওকে অনুসরণ করল রোজি। ভাবছে, মোটকু চার্লির ওজন এত কমে গেল কীভাবে? অবশ্য দেখতে ভালো লাগছে, ভাবল ও। খুবই ভালো দেখাচ্ছে আসলে। একসঙ্গে হেঁটে ম্যাক্সওয়েল গার্ডেনসে চলে এলো ওরা।
‘ওই যে দেখো,’ বলল স্পাইডার।
‘কী?’
মেয়েটাকে দেখিয়ে দিল ও। ন্যাপকিনের খয়েরি দাগটাও হাওয়া হয়ে গেছে, সাদা হয়ে গেছে আবার।
‘জাদু নাকি?’
‘হতে পারে, তবে আমি করিনি,’ জানাল স্পাইডার। একটা বিনে ফেলে দিল ন্যাপকিনটা। ঠিক সেই মুহূর্তে মোটকু চার্লির বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল একটা ট্যাক্সি, ভেতর থেকে বেরোল…খোদ মোটকু চার্লিই! তার হাতে একটা প্লাস্টিকের সাদা ব্যাগ।
একবার মোটকু চার্লির দিকে চাইল রোজি, আরেকবার স্পাইডারের দিকে। ব্যাগ খুলে ভেতর থেকে ততক্ষণে চকলেটের বিশাল একটা বাক্স বের করে এনেছে মোটকু চার্লি।
‘তোমার জন্য,’ এগিয়ে দিল ছেলেটা।
চকলেট নিয়ে কোনোমতে বলল রোজি, ‘ধন্যবাদ।’ দুজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি, দেখতে-শুনতে আর চলনে-বলনে একে-অন্যের থেকে একেবারেই আলাদা। এমনকী কণ্ঠস্বরেও মিল নেই কোনো। অথচ তারপরেও বুঝতে পারছে না, কার সঙ্গে বাগদান হয়েছে তার। ‘আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি, তাই না?’ বলেই বসল মেয়েটা, কণ্ঠেই বোঝা যাচ্ছে মনের চাপ। এখন বুঝতে পারছে, সমস্যা কোথায়; আর তাই পরিস্থিতি বোধহয় সহজ হয়ে এসেছে অনেকটা।
দুই মোটকু চার্লির মাঝে যে পাতলা, যার কানে দুল ঝুলছে, ওর কাঁধে হাত রাখল। ‘তুমি বাড়ি ফিরে যাও,’ বলল সে। ‘তারপর ঘুমিয়ে পড়ো। যখন উঠবে, তখন সব ভুলে যাবে।’
তাতে, ভাবল সে। জীবন তুলনামূলক সহজই হবে বটে। পরিকল্পনা সর্বদাই পরিস্থিতিকে সহনশীল করে তোলে। অনেকটা লাফাতে লাফাতেই ফিরে এলো সে নিজের ফ্ল্যাটে, হাতে চকলেটের বাক্স।
‘কী করলে?’ মোটকু চার্লি প্রশ্ন ছুড়ে দিল। ‘আচমকা এভাবে বদলে গেল যে?’
শ্রাগ করল স্পাইডার। ‘চাই না ও কষ্ট পাক,’ জানাল সে। ‘তাহলে সত্যিটাই বলে দিতে। বললে না কেন?’
‘কাজটা ঠিক হবে বলে মনে হয়নি।’
‘কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক, তার তুমি কী জানো?’
সদর দরজাটা স্পর্শ করেই খুলে ফেলল স্পাইডার।
‘আমার কাছে চাবি আছে,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘বাড়িটাও আমারই!’
হলওয়েতে পা রাখল ওরা, তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো ওপরে।
‘গেছিলে কই?’ জিজ্ঞেস করল স্পাইডার।
‘কোত্থাও না, এই তো…বাইরে।’ জানাল মোটকু চার্লি, ঠিক টিনেজারদের মতো ভঙ্গিতে।
‘আজ সকালে একটা রেস্তোরাঁয় গেছিলাম। সেখানে পাখির ঝাঁক আক্রমণ করে বসে আমাকে। এই ব্যাপারে কিছু জানো? নিশ্চয়ই জানো, তাই না?’
‘নাহ… কিংবা হয়তো জানি। তবে এখন সময় হয়েছে তোমার চলে যাওয়ার….এই যা।’
‘নতুন করে কিছু শুরু কোরো না,’ সাবধান করে দিতে চাইল স্পাইডার। ‘আমি? আমি শুরু করব? ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে ছিলাম পুরোটা সময়। তুমি আমার জীবনে অনুপ্রবেশ করলে, আমার বসকে খেপালে, পুলিস লেলিয়ে দিলে। তুমি, আমার প্রেমিকাকেও ছাড়োনি! আমার পুরো জীবন নষ্ট করে দিয়েছ।’
‘দাঁড়াও দাঁড়াও,’ বলল স্পাইডার। ‘আমি আসার অনেক আগে তুমি নিজেই তোমার জীবনকে নষ্ট করেছ!’
হাত মুঠো করে, সরাসরি স্পাইডারের চিবুকে ঘুসি বসিয়ে দিল মোটকু চার্লি; মুভিতে যেমন করে। টলে পিছিয়ে গেল স্পাইডার, যতটা না ব্যথা পেয়েছে তারচেয়ে বেশি চমকে গেছে। ঠোঁটে হাত দিল সে, তারপর তাকিয়ে রইল আঙুলের ডগায় থাকা রক্তের দিকে। ‘আমাকে মারলে!’
‘আবারও মারতে আপত্তি নেই,’ বলল মোটকু চার্লি, যদিও জানে না আসলেও পারবে কি না। ব্যথা পেয়েছে যে হাতে।
‘তাই নাকি?’ স্পাইডার বলল, তারপর মোটকু চার্লির দিকে ঝাঁপ দিল সে; ঘুসি মারল গায়ের জোরে। পড়ে গেল মোটকু চার্লি, তবে তার আগে স্পাইডারের কোমর আঁকড়ে ধরল সে; নিজের সঙ্গে টেনে ফেলল ভাইকেও।
হলওয়ের মেঝেতে গড়াগড়ি খেল দুই ভাই, একে-অন্যকে ঘুসি মারছে ইচ্ছে মতো। মোটকু চার্লি ভেবেছিল, স্পাইডার হয়তো জাদু ব্যবহার করে কিছু একটা করবে; নিদেনপক্ষে অস্বাভাবিক রকমের শক্তিশালী তো হবে। তবে বোঝা গেল, দুজনে মোটামুটি সমানে-সমান। কারও হাত চালাবার মাঝেই গোছানো বলতে কিছু নেই। বাচ্চারা——উহু, ভাইয়েরা যেভাবে হাতাহাতি লড়াই করে, সেভাবেই করছে ওরাও। গড়াগড়ি খেতে খেতেই মোটকু চার্লির মনে হলো, অনেক অনেক আগে সম্ভবত এভাবে মারামারি করেছে ওরা। স্পাইডার তুলনামূলক বুদ্ধিমান ও দ্রুত, কিন্তু যদি একবার খালি ওপরে উঠতে পারে মোটকু চার্লি…আর স্পাইডারের দুই হাত আটকে ফেলতে পারে তবে…
স্পাইডারের ডান হাতের দিকে নিজের হাত বাড়াল মোটকু চার্লি, তারপর মুচড়ে নিয়ে এলো ভাইয়ের পিঠের পেছনে; তারপর বসে পড়ল ছেলেটার বুকের ওপর, নিজের সব ওজন দিয়ে চাপ দিল।
‘হার মানছ?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘না,’ নিজেকে ছাড়বার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাল স্পাইডার, কিন্তু মোটকু চার্লি যেভাবে স্পাইডারের বুকের ওপর বসে পড়েছে তাতে করার আর কিছু নেই ওর।
‘তোমার কাছ থেকে ওয়াদা চাই,’ মোটকু চার্লি বলল। ‘আমার জীবন থেকে বেরিয়ে যাও, আমাকে আর রোজিকে মুক্তি দাও।’
কথা শুনে রাগের সঙ্গে মুচড়ে উঠল স্পাইডার, পড়ে গেল মোটকু চার্লি। রান্নাঘরের মেঝেতে পড়ে গেল মোটকু চার্লি। ‘এমন যে হবে,’ বলল স্পাইডার। ‘সে কথা তো আগেই বলেছিলাম।’
নিচের তলার দরজায় কড়া নাড়ছে কেউ, তবে শুনেই বোঝা যাচ্ছে–যে নাড়ছে তার ভেতরে আসার তর সইছে না। স্পাইডারের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল মোটকু চার্লি, এক দৃষ্টিতে ভাইয়ের দিকে তাকাল স্পাইডারও। দুজনেই ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।
‘দরজা খুলে দেব?’ জিজ্ঞেস করল স্পাইডার।
‘না,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘এইটা আমার বাড়ি। নিজের দরজা আমি নিজেই খুলতে পারি, সাহায্য করতে চেয়েছ বলে অনেক অনেক ধন্যবাদ।’
‘যা মন চায় করো।’
সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল মোটকু চার্লি। পরক্ষণেই ফিরে তাকাল, ‘আগে এই ঝামেলাটা শেষ করি,’ বলল সে। ‘তারপর তোমাকে দেখছি। জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, খানিকক্ষণের মাঝেই চলে যেতে হবে তোমাকে।’ নিচতলায় নামল সে, তবে পোশাক থেকে ধুলো ঝেড়ে; যাতে ওকে দেখে বোঝা না যায়, একটু আগেও মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল!
দরজা খুলতেই নজরে পড়ল পুলিসের ইউনিফর্ম পরিহিত দুই দশাসই ব্যক্তি; সঙ্গে আছে একজন অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র, তবে অন্যরকম দেখতে সাদা পোশাকের নারী-পুলিস।
‘চার্লস ন্যান্সি?’ জিজ্ঞেস করল ডেইজি। এমনভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে যেন কোনো অচেনা মানুষকে দেখছে, চোখ অনুভূতি-শূন্য।
‘গ্লাম্ফ,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি।
‘মিস্টার ন্যান্সি,’ বলল মেয়েটা। ‘আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। আপনি চাইলে—’
মোটকু চার্লি ঘুরে বাড়ির ভেতরটা দেখে নিলো। ‘হারামজাদা!’ চেঁচিয়ে উঠল সে; লক্ষ্য ওপরের তলার দিকে। ‘হারামজাদা হারামজাদা হারামজাদার- বাচ্চা-হারামজাদা!’
ওর হাতে টোকা দিল ডেইজি। ‘নিজে থেকে আসবে আমার সঙ্গে?’ জানতে চাইল মেয়েটা। ‘যদি রাজি না হও, তাহলে জোর করব আমরা। যদিও পরামর্শ থাকবে—নিজ থেকেই চলো। আমার সঙ্গীরা আবার হাত-পা চালাতে ভালোবাসে।’
‘আসছি,’ বলল মোটকু চার্লি।
‘খুব ভালো, বলল ডেইজি। মোটকু চার্লির সঙ্গে বাইরে পা রেখে, কালো একটা পুলিসি ভ্যানে তুলে নিলো তাকে।
পুরো ফ্ল্যাট খুঁজে দেখল পুলিস, প্রতিটা কামরা নির্জীব; প্রাণের কোনো চিহ্নও নেই। হলের শেষ মাথার ছোট্ট কামরাটা বাড়তি শোবার ঘর; ভেতরে আছে বইয়ের কিছু বাক্স আর খেলনা গাড়ি। বাক্স খুঁজেও দেখল ওরা, কিন্তু কিচ্ছু মিলল না।
.
নিজের শোবার ঘরে গাল ফুলিয়ে শুয়ে আছে স্পাইডার। মোটকু চার্লি যখন দরজা খুলতে নিচে নামে, তখনই নিজের কামরায় চলে আসে সে। নির্জনতা দরকার তার, ঝামেলা একদম পছন্দ করে না। সেই সম্ভাবনা জন্ম নিলেই পালিয়ে যায়, স্পাইডার জানে এই মুহূর্তে ওর এখান থেকে চলে যাওয়া দরকার। কিন্তু কেন যেন যেতে ইচ্ছে করছে না।
রোজিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়াটা ঠিক হলো কি না, তাই ভাবছে।
যা সে করতে চায়—সত্যি কথা হলো, স্পাইডার তার জীবনকে নিজের চাহিদা মোতাবেক পরিচালনা করে—তা হলো রোজিকে বলা যে ও আসলে স্পাইডার, মোটকু চার্লি না। জানাতে চায়, ও আসলে একদমই আলাদা কিছু একটা; তবে সেটা সমস্যা না। চাইলেই মেয়েটার সামনে দাঁড়িয়ে জোরের সঙ্গে বলতে পারে, ‘আমি স্পাইডার, মোটকু চার্লির ভাই। তা নিয়ে তোমার কোনো সমস্যা নেই, তুমি এতে খুশি। ব্ৰহ্মাণ্ড তখন রোজিকে খানিকটা হলেও ধাক্কা দিত, ব্যাপারটা খুশি মনে মেনেও নিত মেয়েটা। একদম কিচ্ছু মনে করত না রোজি।
কিন্তু অন্তরের গহিনে ভালো করেই জানে–রোজি এত সহজে মেনে নিত না!
দেবতাদের খেলার বস্তুতে পরিণত হতে পছন্দ করে না মানুষ। তাদেরকে দেখে হয়তো মনে হয়, আপত্তি নেই কোনো। কিন্তু অন্তরের অন্তস্তলে, একদম গভীরে, তারা ঘৃণা করে ব্যাপারটাকে। কীভাবে কীভাবে যেন জেনে ফেলে তারা! স্পাইডার বলতে পারত মেয়েটিকে, যেন পরিস্থিতি নিয়ে খুশি থাকে; খুশি থাকতও রোজি, কিন্তু ব্যাপারটা হতো তার চেহারায় হাসি এঁকে দেওয়ার মতো—যে হাসিটাকে রোজি একেবারে শতভাগ নিজের হাসি বলেই ধরে নিত। অল্প সময়ের জন্য হলে (এতদিন স্পাইডার কেবল অদূর ভবিষ্যতের কথাই ভেবেছে), ব্যাপারটা একেবারেই গুরুত্বপূর্ণ হতো না। কিন্তু দূর ভবিষ্যতে গিয়ে ঠিকই সমস্যার জন্ম দিত। রাগান্বিত, ক্রোধান্বিত কাউকে দরকার নেই ওর, যে একেবারে অন্তর থেকে ঘৃণা করে ওকে; অথচ বাইরে বাইরে ধরে রাখে আনন্দের মুখোশ।
ওর দরকার রোজিকে।
সেই রাগান্বিত প্রাণিটা আর যা-ই হোক, রোজি নিশ্চয়ই হতো না। হতো কী?
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অস্বাভাবিক সুন্দর ঝরনার দিকে চেয়ে রইল স্পাইডার, চাইল তারও ওপাশের আকাশের পানে। শুয়ে শুয়ে ভাবছে, মোটকু চার্লি ওর কামরার দরজায় কখন টোকা দিতে আসবে? আজ সকালে রেস্তোরাঁয় কিছু একটা হয়েছে, সেই ব্যাপারে যে ওর ভাইয়ের জানা আছে– তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই তার।
বেশ কিছুক্ষণ পর, অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল সে; তাই ফিরে গেল মোটকু চার্লির ফ্ল্যাটে। কিন্তু কেউ নেই ওখানে। জায়গাটা নোংরা হয়ে আছে—দক্ষ, পেশাদার কেউ উলটে-পালটে খুঁজেছে কিছু একটা। ধরে নিলো স্পাইডার—নিশ্চয়ই মোটকু চাৰ্লিই লড়াইয়ে জিততে না পেরে করেছে কাজটা।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল ও পুলিসের একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে কালো পুলিস ভ্যানের পাশে। ওর চোখের সামনেই চলে গেল ভ্যান আর গাড়ি।
নিজের জন্য টোস্ট বানিয়ে, তাতে মাখন মাখিয়ে খেয়ে নিলো ও। তারপর ফ্ল্যাটের ভেতর ঘুরে বেড়াল, সাবধানে টেনে দিল পর্দা।
বেজে উঠল দরজার ঘন্টি, শেষ পর্দাটাও টেনে দিয়ে নিচে নেমে এলো স্পাইডার।
দরজা খুলতেই আবিষ্কার করল রোজিকে। এখনও আচ্ছন্ন দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। ওর দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল সে, ‘আমাকে ভেতরে আসতে বলবে না?’
‘অবশ্যই, এসো… এসো!’
সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলো মেয়েটা। ‘কোনো সমস্যা? মনে হচ্ছে যেন ভূমিকম্প হয়েছে!’
‘তাই?’
‘অন্ধকারে বসে আছ কেন?’ পর্দার দিকে এগিয়ে গেল রোজি। ‘থামো, থামো। টানাই থাকুক।’
‘ভয় পাচ্ছ কাকে?’ জিজ্ঞেস করল রোজি।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল স্পাইডার। ‘পাখি’ অনেকক্ষণ পর বলল সে।
‘কিন্তু পাখিরা তো আমাদের বন্ধু,’ যেন ছোটো কোনো বাচ্চাকে বোঝাচ্ছে, এভাবে বলল রোজি।
‘পাখি,’ শুরু করল স্পাইডার। ‘হচ্ছে ডাইনোসরের শেষ বংশধর। পাখাঅলা ছোট্ট ভেলোসিরাপটর। অসহায় কীট, বাদাম, মাছ আর অন্য পাখি খায় তারা। সব ধরনের কেঁচোর খোঁজ ওরাই পায়! মুরগিকে কখনও খেতে দেখেছ? দেখে নিষ্পাপ মনে হয়, কিন্তু পাখিরা আসলে ভয়ানক!’
‘সেদিন খবরের কাগজে একটা প্রতিবেদন দেখলাম,’ রোজি জানাল। ‘মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল একটা পাখি।’
‘তাতে কিচ্ছু যায় আসে না–’
‘সম্ভবত দাঁড়কাক ছিল ওটা, কিংবা এমনি কাঁকও হতে পারে। মানে ওই বড়ো, কালোগুলোরই কোনো একটা ছিল আরকি। ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়ির লনে বসে ছিল লোকটা, ম্যাগাজিন পড়ছিল। আচমকা পাখির ডাক শুনতে পেল, ওরই যেন দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছে। তাই উঠে দাঁড়িয়ে, দাঁড়কাকটা যে গাছে বসে আছে সেখানে গেল লোকটা। দূর থেকেই দেখতে পেল, ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য ওঁত পেতে ছিল একটা পাহাড়ি সিংহ। তাই বাড়িতে ফিরে গেল লোকটা। যদি দাঁড়কাক না থাকত, ওকে সাবধান না করে দিত, তাহলে সিংহের পেটে যেতে হতো তাকে!’
‘আমার মনে হয় না, দাঁড়কাক সাধারণত অমনটা করে,’ জানাল স্পাইডার। ‘যেটাই হোক না কেন, একটা দাঁড়কাক কারও জীবন বাঁচালেই পাখিরা মহান কিছু হয়ে যায় না। পাখিরা এখনও আমার পেছনে লেগে আছে।’
‘হুম,’ বলল রোজি, তবে কণ্ঠে আনতে চাইল নকল আন্তরিকতা। ‘পাখিরা তোমার পেছনে লেগেছে।’
‘আমি ভুল বলিনি।’
‘কেন লেগেছে যেন…?’
‘উম।’
‘কারণ নিশ্চয়ই আছে। হঠাৎ করে পুরো বিশ্বের সব পাখি এক হয়ে এমনি এমনি তোমার পেছনে নিশ্চয়ই লাগেনি?’
জবাব দিল স্পাইডার, ‘বলতে পারি, তবে তুমি বিশ্বাস করবে না,’ অন্তর থেকেই বলল সে কথাটা।
‘চার্লি, তুমি সব সময়ই সত্যি কথা বলে এসেছ। যদি আমাকে কিছু বলো, তাহলে যত কঠিনই হোক না কেন তা বিশ্বাস করার চেষ্টা করব। ভালোবাসি তোমাকে, বিশ্বাস করি তোমার কথায়। আগে বলো তো, বিশ্বাস করা না-করা তো পরের কথা!
এক মুহূর্ত ভাবল স্পাইডার। তারপর বাড়িয়ে দিল হাত, রোজির হাত ধরে চাপ দিল একটু।
‘তোমাকে একটা জিনিস দেখানো দরকার,’ বলল সে।
করিডোরের শেষ মাথা পর্যন্ত রোজিকে নিয়ে এলো ও, মোটকু চার্লির বাড়তি কামরার মুখে এসে থমকে দাঁড়াল। ‘ভেতরে কিছু একটা আছে,’ বলল স্পাইডার। ‘আমার চাইতে ভালো ব্যাখ্যা ওটাই করতে পারবে।’
‘তুমি সুপারহিরো,’ বলল মেয়েটা। ‘তার ভেতরে অপরাধের সঙ্গে লড়াইয়ের যন্ত্রপাতি রাখো?’
‘না।’
‘উলটো-পালটা কিছু না তো? বাচ্চা মেয়েদের পোশাক পরে নিজেকে ডোরা নামে ডাকো নাকি?’
‘না।’
‘মডেল ট্রেন সেট নাকি?’
ধাক্কা দিয়ে মোটকু চার্লির বাড়তি কামরার দরজা খুলে ফেলল স্পাইডার, যেটা আবার ওর নিজের শোবার ঘরের দরজাও। কামরার শেষ প্রান্তের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা ঝরনা, যেটা আছড়ে পড়ছে নিজের জঙ্গলের হ্রদে। আকাশ একেবারে নীল, নীলকান্তমণির মতো।
আঁতকে উঠল রোজি।
ঘুরে দাঁড়াল সে, ফিরে এলো হলে…তারপর রান্নাঘরে; জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখে নিলো লন্ডনের ধূসর আকাশ…বিষণ্ণ আর মন-খারাপ- করে দেওয়ার মতো। ফিরে এলো খানিক পরেই। ‘বুঝতে পারছি না কিছুই, ‘ বলল সে। ‘চার্লি? কী হচ্ছে এসব?’
‘আমি চার্লি নই,’ জানাল স্পাইডার। ‘আমার দিকে তাকাও, মন দিয়ে দেখো।’
আর অভিনয়ের ধার ধারল না মেয়েটা, চোখ ভয়ে বিস্ফারিত।
‘আমি ওর ভাই,’ জানাল স্পাইডার। ‘আমি সব কিছুতে ভজকট পাকিয়েছি…এক্কেবারে সব কিছুতে। তাই তোমাদের জীবন থেকে চিরতরে চলে গেলেই বোধহয় ভালো হবে।’
‘তাহলে মো—মানে চার্লি কই?’
‘তা জানি না, ঝগড়া হয়েছে আমাদের। দরজা খুলতে নিচে গেল, আমি গেলাম আমার কামরায়। আর ফেরেনি।’
‘ফেরেনি? আর তুমিও বসে আছ চুপচাপ? খোঁজ-খবর নাওনি?’
‘উম, ওকে সম্ভবত পুলিস ধরে নিয়ে গেছে,’ বলল স্পাইডার। ‘সম্ভবত… প্রমাণ নেই।’
‘নাম কী তোমার?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল রোজি।
‘স্পাইডার।’
শব্দটা নিজেই আবার উচ্চারণ করল রোজি, ‘স্পাইডার।’
জানালার বাইরে, ঝরনার ঠিক মাথায় দেখা যাচ্ছে এক ঝাঁক ফ্ল্যামিঙ্গো পাখি; রোজি ওদের গোলাপি আর সাদা পালক ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না সূর্যালোকের কারণে। সংখ্যায় তারা অনেক, সুবিন্যস্ত। এত সুন্দর দৃশ্য রোজি আগে কখনও দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। স্পাইডারের দিকে ফিরে ভাবল, এই লোকটাকে সে কীভাবে মোটকু চার্লি হিসেবে মেনে নিয়েছিল? মোটকু চার্লি হাসিখুশি, খোলা মনের কিন্তু অস্বস্তিকর মানুষ; কিন্তু এই লোকটা ইস্পাতের দণ্ডের মতো টান-টান হয়ে আছে, যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে যাবে! ‘তুমি আসলেও ও নও, তাই না?’
‘সেটা তো এইমাত্রই বললাম।’
‘তাহলে-তাহলে কার সঙ্গে… মানে আমার সঙ্গে কে…মানে কার সঙ্গে আমি শুয়েছি?’
‘আমার সঙ্গেই,’ জানাল স্পাইডার।
‘আমিও সেটাই ভেবেছিলাম,’ বলেই সর্বশক্তিতে থাপ্পড় মারল রোজি, স্পাইডারের গাল বরাবর। ঠোঁট কেটে আবার রক্ত ঝরতে লাগল ছেলেটার।
‘থাপ্পড়টা আমার প্রাপ্যই ছিল,’ বলল স্পাইডার।
‘অবশ্যই ছিল,’ একটু বিরতি দিয়ে যোগ করল রোজি। ‘মোটকু চার্লি জানত? মানে তোমার ব্যাপারে? আমাদের ব্যাপারে?’
‘উম, হ্যাঁ। কিন্তু ও…’
‘তোমরা দুজনেই মানসিক রোগী,’ গর্জে উঠল রোজি। ‘অসুস্থ আর অশুভ দুজন মানুষ। নরকে পুড়ে মরো তোমরা, এই প্রার্থনা করি।’
বিশাল শোবার ঘরটায় বিহ্বল একটা দৃষ্টি হানল রোজি, তারপর তাকাল জানালার বাইরের জঙ্গলের দিকে; বিশালাকার ঝরনা আর ফ্ল্যামিঙ্গোর ঝাঁকটাকে আরেকবার দেখে নিয়ে বেরিয়ে গেল হল ধরে।
মেঝেতে বসে রইল স্পাইডার, রক্তের ক্ষীণ একটা ধারা গড়িয়ে পড়ছে নিচের ঠোঁট থেকে; নিজেকে বোকা বলে মনে হচ্ছে ওর। কানে ভেসে এলো সদর দরজা বন্ধ করে দেওয়ার আওয়াজ। বাথটাবের কাছে এসে, গরম পানিতে ডুবাল তোয়ালের একটা প্রান্ত। তারপর সেটা চিপে পানি ঝরিয়ে, ঠেসে ধরল ক্ষতের ওপর। ‘এসবের কোনো দরকার আমার নেই,’ বলল সে। উচ্চকণ্ঠে, কেননা জোরেশোরে বলে নিজেকেও মিথ্যে কথা বিশ্বাস করানো যায়। ‘তোমাদের কাউকেই আমার এক হপ্তা আগে দরকার ছিল না, সামনেও দরকার পড়বে না। অনেক হয়েছে…আর না!’
ঠিক তখন জানালার কাচে আছড়ে পড়ল ফ্ল্যামিঙ্গোর ঝাঁক, ভেঙে গেল কাচ। কামরার ভেতর ছড়িয়ে পড়ল তার টুকরোগুলো। দেওয়াল, মেঝে আর বিছানায় গেঁথে গেল কাচের টুকরো। কামরার ভেতরটা ভরে উঠল ধূসর গোলাপি দেহে; বাঁকানো, তীক্ষ্ণ ঠোঁট আর বিশাল বিশাল গোলাপি পাখা ছাড়া আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। কামরার ভেতরে যেন শুরু হয়ে গেল ঝরনার গর্জন।
দেওয়ালে পিঠ ঠেকাতে বাধ্য হলো স্পাইডার। ওর আর দরজার মাঝে এখন রয়েছে ফ্ল্যামিঙ্গোর ঝাঁক; সংখ্যায় যারা হাজারো হবে: পাঁচ ফুট লম্বা পাখির ঝাঁক, গলা আর পা ছাড়া দেহে আর কিছু নেই বললেই চলে। দৃঢ় পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে গেল স্পাইডার, রাগান্বিত ওই গোলাপি পাখির মাইনফিল্ডের ভেতর দিয়ে; প্রত্যেকটাই উন্মাদনায় ভরা গোলাপি চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওরই দিকে। দূর থেকে দেখলে এদেরকে হয়তো সুন্দর মনে হয়, কিন্তু কাছ থেকে দেখে?
আচমকা স্পাইডারের হাতে কামড় বসালো একটা পাখি। চামড়া বিদীর্ণ হলো না বটে, কিন্তু ব্যথা পেল ঠিক।
স্পাইডারের শোবার ঘরটা বিশাল বড়ো। কিন্তু দ্রুতই তা ভরে উঠছে ফ্ল্যামিঙ্গোয়। ঝরনার নীল আকাশে ভর করেছে অন্ধকার মেঘ, বোঝাই যাচ্ছে যে আরেকটা ঝাঁক আসছে এদিকেই।
পাখিগুলো ঠোকর মারছে ওর দিকে, আঘাত হানছে নখ দিয়ে। তবে জানে স্পাইডার, সমস্যা অন্যখানে — পাখিগুলোর ফোলা ফোলা পালকের নিচে চাপা পড়তে হতে পারে ওকে। মরার এই উপায়টা চরম অপমানজনক মনে হচ্ছে ওর কাছে: পাখির দেহের নিচে চাপা পড়ে মৃত্যু।
সেই পাখি বুদ্ধিমান হলেও হতো…
ভাবো, নিজেকে নির্দেশ দিল সে। এগুলো নিছক ফ্ল্যামিঙ্গো, আর তুমি? স্পাইডার!
তো? নিজেকেই জবাব দিল স্পাইডার। এমন কিছু বলো যা আমার জানা নেই!
মেঝেতে দাঁড়ানো ফ্ল্যামিঙ্গোগুলো ঠোকর মারছে ওকে, ভাসতে থাকা পাখিগুলো ছুটে আসছে ওর দিকে। জ্যাকেট দিয়ে মাথাটা ঢাকল স্পাইডার। পরক্ষণেই বাতাসে ভাসমান ফ্ল্যামিঙ্গোগুলো আক্রমণ চালাল ওকে লক্ষ্য করে। কেঁপে উঠে মেঝেতে পড়ে গেল সে।
বোকা বানাও ওদের, গাধা কোথাকার
উঠে দাঁড়াল স্পাইডার, পাখনা আর ঠোঁটের সাগর পেছনে ফেলে চলে এলো জানালার কাছে; ভাঙা কাচের জন্য যেটা পরিণত হয়েছে প্রকাণ্ড গর্তে।
‘হতচ্ছাড়া পাখি,’ আনন্দের সঙ্গে বলল সে, তারপর লাফ দিল জানালা দিয়ে বাইরে।
বুদ্ধিমত্তার জন্য ফ্ল্যামিঙ্গোরা বিখ্যাত না, এমনকী সমস্যা-সমাধানের যোগ্যতার জন্য বহুল পরিচিত নয়: খাওয়ার মতো কিছু একটা যদি বোতলে ভরে কাকের সামনে সেটা আর বাঁকানো তার ফেলা হয়, তাহলে হয়তো পাখিটা সেই তার ব্যবহার করে বোতলের ভেতরের খাবার বের করার চেষ্টা চালাবে। কিন্তু ফ্ল্যামিঙ্গো সরাসরি খেতে চাইবে ওই তারটাকেই…যদি দেখতে ওটা চিংড়ি মাছ বলে মনে হয়…এমনকী যদি না হয় তাহলেও হয়তো! তাই জানালার সামনে দাঁড়িয়ে ওদেরকে অপমান করতে থাকা মানুষটার মাঝে যদি ধোঁয়াশায় ভরা আর বিমূর্ত একটা ভাব থেকেও থাকে, তাহলে সেটা ওরা ধরতে পারল না। উন্মাদনায় ভরা দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে, ছুট লাগাল।
জানালার ওপাশে লাফ দিল লোকটা, ঝরনার পানিতে ডুবে গেল ওর দেহ। তার পিছু পিছু ঝাঁপ দিল আরও এক হাজার পাখি, অধিকাংশই টুপ করে পড়তে শুরু করল পাথরের মতো… কেননা বাতাসে ভাসার জন্য ফ্ল্যামিঙ্গোর খানিকক্ষণ দৌড়ুতে হয়
অচিরেই দেখা গেল, শোবার ঘরটা ভরে আছে আহত কিংবা নিহত পাখিতে: কিছু পাখি জানালা ভেঙেছে, কিছু আছড়ে পড়েছে দেওয়ালে…আর কিছু হয়েছে অন্যান্য ফ্ল্যামিঙ্গোর শিকার। যেগুলো এখনও বেঁচে আছে, দেখতে পেল—আপনা থেকেই খুলে গেল শোবার ঘরের দরজা। তারপর আবার বন্ধও হয়ে গেল। কিন্তু ওরা ফ্ল্যামিঙ্গো বলে, ব্যাপারটা নিয়ে খুব একটা ভাবল না।
মোটকু চার্লির ফ্ল্যাটের করিডোরে দাঁড়িয়ে দম ফিরে পেতে চাইল স্পাইডার। শোবার ঘরটা যেন অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে, সেটা ভাবতে লাগল একমনে। কাজটা করতে একদম ভালো লাগে না ওর, কেননা সাউন্ড সিস্টেমটা নিয়ে গর্ব করে সে…
…আরও একটা কারণ আছে——ওই কামরাতেই রেখেছে নিজের সব কিছু।
তবে চাইলেই সেগুলো আবার ফিরে পাবে।
যার নাম স্পাইডার, তার জন্য শুধু মন থেকে চাওয়াটাই যথেষ্ট।
.
রোজির মা চোখে আঙুল দিয়ে সাধারণত গর্ব করে না; তাই চিপেনডেল থেকে কেনা সোফায় বসে যখন কান্নায় ভেঙে পড়ল তার মেয়ে, তখন অনেক কষ্ট করে নিজেকে থামাল সে; যদিও ইচ্ছে হচ্ছিল, গান গাইতে গাইতে নাচে কামরা জুড়ে! তবে সাবধানী কোনো পর্যবেক্ষক তাকে দেখলে পরিষ্কার বুঝতে পারত: মহিলার চোখের তারায় বিজয়ের গর্ব।
ভিটামিন মিশ্রিত পানির একটা বড়ো গ্লাস রোজিকে দিল সে, একটা বরফের টুকরোসহ। প্রতারণা আর ধোঁকাবাজির কারণে মেয়ের হৃদয় কীভাবে ভেঙে গেছে, সেই গল্প শুনল মন দিয়ে। কিন্তু গল্পের শেষ পর্যায়ে এসে, বিজয়ের আভা চোখ থেকে সরে গিয়ে সেখানে ভর করল বিহ্বলতা; সেই সঙ্গে ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে মহিলার মাথা!
‘তাহলে মোটকু চার্লি আসলে মোটকু চার্লি ছিল না?’ জিজ্ঞেস করল রোজির মা।
‘না। মানে, মোটকু চার্লি আসলে মোটকু চার্লিই ছিল। কিন্তু গত হপ্তাটা আমি কাটিয়েছি ওর ভাইয়ের সঙ্গে।’
‘যমজ নাকি?’
‘নাহ, আসলে দেখতেও এক রকম না। আমি জানি না… বিভ্রান্ত লাগছে নিজেকে।’
‘তাহলে কার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করলে?’
নাক ঝাড়ল রোজি। ‘স্পাইডারের সঙ্গে, মোটকু চার্লির ভাই ও।’
‘তোমাদের তো বাগদান হয়নি, তাহলে ভাঙল কীভাবে!’
‘নাহ, হয়নি। কিন্তু আমি ভেবেছিলাম, আসলে সে-ই মোটকু চার্লি।’
‘তাহলে কি মোটকু চার্লির সঙ্গেও বাগদান ভেঙে দিয়েছ?’
‘তেমনই কিছু একটা। তবে ওকে বলিনি এখনও।’
‘ছেলেটা তার ভাইয়ের সঙ্গে… তোমার সম্পর্কের কথা জানে? দুইয়ে মিলে আমার বেচারা মেয়েটার সঙ্গে ষড়যন্ত্র করেনি তো?’
‘আমার তা মনে হয় না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, ওকে বিয়ে করতে পারব না।’
‘তা তো বটেই,’ একমত হলো রোজির মা। ‘কোনোভাবেই না।’ মনে মনে অবশ্য জয়ের আনন্দে নাচল কিছুক্ষণ। ‘ভালো একটা ছেলে খুঁজে বের করব আমরা। ভেবো না ওসব নিয়ে। ওই মোটকু চার্লি…ব্যাটাকে আমার কখনওই পছন্দ হতো না। প্রথম দেখাতেই বুঝে গেছিলাম। আমার মোমের ফলে কামড় দিয়ে বসল ও, ভাবা যায়? বুঝতেই পারছিলাম, ঘাপলা আছে ব্যাটার ভেতর। এখন সে কই?’
‘জানি না, স্পাইডার বলেছিল—সম্ভবত ওকে পুলিস ধরে নিয়ে গেছে, ‘ জানাল রোজি।
‘হাহ!’ মাথার ভেতর এখন আতশবাজি ফুটতে শুরু করেছে মহিলার। আকারে আর আকৃতিতে তার সঙ্গে তুলনা করা যায় শুধু ডিজনিল্যান্ডের নিউ ইয়ার্স ইভ উদযাপনের সময়। মুখে বলল, ‘আমার তো মনে হয়, জেলে আছে এখন। ওটাই তার জন্য সর্বোত্তম স্থান। সবসময়ই বলেছি—ছেলেটা দিন শেষে ওখানেই পৌঁছুবে।’
কাঁদতে শুরু করল রোজি, আগের চাইতেও বেশি। টিস্যু পেপারের একটা দলা কাছে টেনে নিয়ে, শব্দ করে নাক ঝাড়ল তাতে। তারপর ঢোক গিলে কেঁদে নিলো আরও খানিকক্ষণ। আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে রোজির হাতের পেছনে আলতো চাপড় দিল তার মা, অন্তত যতটুকু ওর জানা আছে ততটুকু আন্তরিকতার সঙ্গে। ‘ওকে বিয়ে করার প্রশ্নই ওঠে না,’ বলল মহিলা। ‘হাজার হলেও, জেলঘুঘু ছেলেটা! তবে মন্দের ভালো হলো, ও জেলে থাকা অবস্থায় সহজে বাগদান ভেঙে দেওয়া যায়।’
মহিলার ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠল ভুতুড়ে হাসি, যোগ করল, ‘চাইলে তোমার হয়ে আমি কল করতে পারি। অথবা কোনো এক দিন গিয়ে বলা যায়: তুমি একটা জঘন্য অপরাধী, আর কখনও তোমার মুখদর্শন করতে চাই না। চাইলে একটা রেস্ট্রেইনিং অর্ডারের ব্যবস্থাও করা যায়!’
‘বিয়ে ভাঙতে চাওয়ার কারণ এগুলো না,’ জানাল রোজি।
‘তাই নাকি?’ নিখুঁত ভাবে পেন্সিলে আঁকা ভ্রুজোড়ার একটা উঁচু করে জিজ্ঞেস করল তার মা।
‘না,’ জানাল রোজি। ‘বিয়ে করব না, কারণ মোটকু চার্লিকে আমি ভালোবাসি না।’
‘বাসো যে না, সেটা তো আমি আগে থেকেই জানতাম। বড়োজোর মেয়েলি ভালোলাগা বলা যায় এটাকে। কিন্তু এখন যখন সত্যিটা জানতে পেরেছ—’
‘আমি ভালোবাসি,’ মাকে পুরোপুরি অগ্রাহ্য করল রোজি, ওর ভাই স্পাইডারকে!’ কথাটা শোনামাত্র ওর মায়ের চেহারায় এমন একটা অনুভূতি খেলে গেল যা পিকনিক ভণ্ডুল করতে মৌমাছির ঝাঁক উপস্থিত হলে বাচ্চাদের চেহারায় দেখা যায়। ‘তবে তাতে কিছু যায় আসে না,’ বলল রোজি। ‘ওকেও আমি বিয়ে করছি না। বলে এসেছি—আর কখনও দেখতে চাই না তাকে!’
ঠোঁটে ঠোঁট চাপল রোজির মা। ‘বেশ,’ বলল সে। ‘তোমার কথার কিছুই আমি আসলে বুঝতে পারছি না। তবে ব্যাপারটাকে সব মিলিয়ে খারাপ খবর বলে ধরছি না,’ ঘুরতে শুরু করেছে ওর মাথার চাকা। কলকব্জাগুলো নতুন নতুন উপায়ে একে-অন্যের সঙ্গে জোট বাঁধছে। ‘একটা কথা কী জানো,’ বলল মহিলা। ‘তোমার এই মুহূর্তে একটু ছুটি কাটিয়ে আসা দরকার! খরচ সব আমার, তোমার বিয়ের জন্য জমাচ্ছিলাম…’
কথাটা বলা ঠিক হয়নি। কেননা শোনামাত্র আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল রোজি। কিন্তু ওর মা পাত্তা না দিয়ে বলে চলছে, ‘যাই হোক, খরচাপাতি আমি দিব। চাকরিতেও সমস্যা হবে না, ছুটি জমিয়েছ অনেক। তাছাড়া নিজেই বললে, কাজে চাপ নেই খুব একটা। এমন একটা সময়ে, যেকোনো মেয়েরই উচিত হবে সব কিছু থেকে দূরে সরে একটু বিশ্রাম নেওয়া।।’
ভাবল রোজি, এতগুলো বছর কি তাহলে মাকে ভুল ভেবে এসেছে? নাক টেনে ঢোক গিলল সে, তারপর বলল, ‘তাহলে তো ভালোই হয়।’
‘সে কথাই রইল তবে,’ বলল ওর মা। ‘আমিও তোমার সঙ্গে যাবো, আমার সোনা বাচ্চাটার খেয়াল রাখার জন্য।’ এদিকে মাথায় তখনও ফুটছে আতশবাজি। মনে মনে যোগ করল, নিশ্চিত করব যেন সঠিক পুরুষটির দেখা আমার মেয়ে পায়।
‘কোথায় যাবো আমরা?’ জিজ্ঞেস করল রোজি।
‘আমরা যাবো,’ জবাব দিল ওর মা। ‘ক্রুজে।’
.
হাতকরা পরানো হয়নি মোটকু চার্লিকে। এই ব্যাপারটা ভালো… কিন্তু বাকি সব কিছুই খারাপ। মন্দের ভালো আরকি ওর এই হাত মুক্ত থাকাটা। মোটকু চার্লির জীবনটা যেন পরিণত হয়েছে বিভ্রান্তিতে ঝাপসা হয়ে আসা একটা চিত্রকল্পে, যেখানে থেকে থেকে দেখা যাচ্ছে তীক্ষ্ণ এটা-সেটা: ডিউটি সার্জেন্ট নাক চুলকাতে চুলকাতে ওর সই নিয়ে ঢুকিয়ে দিল ‘সেল নম্বর ছয়’-এ। একটা সবুজ দরজার ভেতর দিয়ে ঢুকতেই নাকে ধাক্কা দিল দুর্গন্ধ। এহেন গন্ধ আগে কখনও না পেলেও, চিনতে সময় লাগল না; গতকালের বমি আর জীবাণুনাশকের সঙ্গে মিশেছে ধোঁয়া, বাসি কম্বল, ফ্ল্যাশ না করা টয়লেট আর হতাশার বাজে গন্ধ। সামাজিক ধাপের একেবারে নিচের তলার গন্ধ এটা, যেখানে এখন বাস করে বেচারা।
‘ফ্ল্যাশ করার দরকার হলে,’ যে পুলিসম্যান ওর সঙ্গে করিডোর ধরে এগোচ্ছিল, সে জানাল। ‘সেলে বোতাম আছে, চেপে ধোরো। আমাদের কেউ- না-কেউ সময় পেলে ফ্ল্যাশ করে দেবে। তোমরা যেন প্রমাণ মিটিয়ে দিতে না পারো, সেজন্য এই ব্যবস্থা।’
‘কীসের প্রমাণ?’
‘নাটক বাদ দাও, চান্দু।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মোটকু চার্লি। সেই ছোটোবেলা থেকে, যখন কৃত কোনো কাজের জন্য গর্বিত হতে শিখেছে, তখন থেকেই নিজের মল-মূত্র নিজে ফ্ল্যাশ করেছে। স্বাধীনতা হারানোয় যতটা না দুঃখ পেল, তারচেয়ে অনেক বেশি পেল এই কাজটা করার ক্ষমতা ওর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে বলে। বাস্তবতা আরও শক্ত করে জাঁকিয়ে বসল ওকে ঘিরে।
‘এই প্রথম?’ জিজ্ঞেস করল পুলিস।
‘বুঝলাম না!’
‘মাদক?’ আবার জানতে চাইল পুলিস।
‘নাহ, লাগবে না।’ জবাব দিল মোটকু চার্লি।
‘আরে নাহ, জানতে চাচ্ছি—জেলে শুভাগমন হলো কেন?’
‘জানি না কেন,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘আমি নিরপরাধ।’
‘দেওয়ানি অপরাধ, তাই না?’ জানাল পুলিস, মাথা নাড়ল দুপাশে। ‘অন্যরা যা জানে, সেটা তোমাকে বলে দিচ্ছি। আমাদেরকে যত কম জ্বালাবে, আমরাও তোমাকে তত কম জ্বলাবো। তোমরা, দেওয়ানি অপরাধীরা, সবসময় নিজের অধিকার আদায়ে চিল্লাফাল্লা করো। মানে নিজের জন্য গাড্ডা নিজেই খুঁড়ে নাও!’
ছয় নম্বর সেলের দরজা খুলল লোকটা। ‘এই যে, তোমার স্বস্তির নীড়,’ জানাল সে।
সেলের ভেতরে দুর্গন্ধটা অনেক বেশি তীব্র, বিশেষ এক প্রকার রং ব্যবহার করা হয়েছে তাতে যেন গ্রাফিতি আঁকতে না পারে কেউ। ভেতরের বিছানাটাকে তাকের সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায়, একপাশে দেখা যাচ্ছে ডালাহীন টয়লেট।
মোটকু চার্লিকে যে কম্বলটা দেওয়া হয়েছে, সেটাকে বিছানার ওপর বিছিয়ে দিল সে।
‘তাহলে,’ বলল পুলিস। ‘আরাম করো। আর যতই একঘেয়েমি পেয়ে বসুক না কেন, দয়া করে কম্বলটা দিয়ে টয়লেট আটকে ফেলো না।’
‘তা কেন করতে যাবো?’
‘সেটা তো আমিও ভাবি,’ জানাল পুলিস। ‘কেন যে অপরাধীরা কাজটা করতে যায়! হয়তো একঘেয়েমি দূর হয় তাতে, আমি জানি না। আইন মেনে চলি, অবসরের পর কিছু টাকাও পাবো। তাই সেলের ভেতরে খুব একটা সময় কাটাতে হয়নি আমাকে।’
‘আমি আসলেও নিরপরাধ,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘যদিও জানি না, আমাকে কোন অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে!’
‘তাহলে তো ভালোই।’
‘আরেকটা কথা,’ মোটকু চার্লি বলল। ‘পড়ার মতো কিছু পাওয়া যাবে?’
‘কেন? জায়গাটা দেখে তোমার কাছে লাইব্রেরি বলে মনে হচ্ছে?’
‘না।’
‘চাকরি যখন নতুন শুরু করেছি, তখন এক অপরাধী আমার কাছে বই চেয়েছিল। যেটা পড়ছিলাম, সেটাই এনে দিই—–জে.টি. এডসন, নইলে হয়তো লুই লামুর। কী করেছিল, নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছ? টয়লেটে বই ফেলে আটকে দিয়েছিল সব! ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়, বুঝলে?’
পরক্ষণেই সেল থেকে বেরিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল সে। নিজে চলে গেল বাইরে, ভেতরে রয়ে গেল মোটকু চার্লি।
.
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, গ্রাহাম কোটস যে কিনা সাধারণত নিজের অনুভূতি নিয়ে খুব একটা ভাবে না-স্বাভাবিক আর ভালো বোধ করে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছে।
সিটবেল্ট শক্ত করে বাঁধার নির্দেশ দিল ক্যাপ্টেন, তারপর জানাল অচিরেই তারা সেন্ট অ্যান্ড্রুজে ল্যান্ড করতে যাচ্ছে। ছোট্ট একটা ক্যারিবিয়ান দ্বীপ এই সেন্ট অ্যান্ড্রুজ, ১৯৬২ সালে যারা স্বাধীনতা লাভ করে। এরপর ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে নিজেদের স্বাধীনতা প্রমাণ করার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয় তারা; যার মাঝে আছে —নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং বন্দি-বিনিময় চুক্তিতে সই না করা।
ল্যান্ড করল বিমানটা। নিচে নেমে গ্রাহাম কোটস হাঁটল রৌদ্রজ্জ্বল টারমাক ধরে, সঙ্গে নিয়েছে ঢাকাঅলা ব্যাগটাকে। যথাযথ পাসপোর্টটা দেখাল—বাসিল ফিনেগানেরটা আরকি—তাতে স্ট্যাম্প মারা হলে, ক্যারোসেল থেকে সংগ্রহ করল লাগেজ। তারপর ছোট্ট বিমানবন্দরটা থেকে বেরিয়ে পা রাখল দিনের আলোতে। ওর পরনে একটা টি-শার্ট, শর্টস আর স্যান্ডেল; দেখে মনে হচ্ছে, বিদেশে ছুটি কাটাতে আসা কোনো ইংরেজ।
বিমানবন্দরের বাইরেই অপেক্ষা করছিল ওর সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক। কালো একটা মার্সিডিজের পেছনে বসল গ্রাহাম কোটস, বলল, ‘বাড়িতে নিয়ে যাও।’ উইলিয়ামসটাউন থেকে বেরোবার সময়—ওই রাস্তার শেষ মাথায় গ্রাহাম কোর্টসের ক্লিফটপ এস্টেট—জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে, হাসি মুখে দেখল দ্বীপটাকে।
এতক্ষণে মনে পড়েছে যেন ওর: ইংল্যান্ড ছাড়ার আগে এক মহিলাকে মরার জন্য ফেলে রেখে এসেছে। হয়তো বেঁচেও থাকতে পারে মেইভ, যদিও সন্দেহ আছে তার। অবশ্য খুন করেছে বলে একদমই খারাপ লাগছে না তার। বরঞ্চ মারাত্মক তৃপ্তি বোধ করছে, যেন এই চাহিদাটা পূরণ করা অনেকদিনের দরকার ছিল।
এমনকী এটাও ভাবল, আবার কি কাজটা করার সৌভাগ্য হবে? তারচেয়ে বড়ো কথা, সেজন্য কি বহুদিন অপেক্ষা করতে হবে ওকে?
অধ্যায় দশ – যেখানে বিশ্বকে তার স্বরূপে দেখল মোটকু চার্লি এবং মেইত লিভিংস্টোন অসন্তুষ্ট হলো
অধ্যায় দশ – যেখানে বিশ্বকে তার স্বরূপে দেখল মোটকু চার্লি এবং মেইত লিভিংস্টোন অসন্তুষ্ট হলো
মোটকু চার্লি ধাতব বিছানার কম্বলের ওপর বসে অপেক্ষা করছে… কিছু একটা ঘটার জন্য। কিন্তু কিচ্ছু ঘটছে না! মনে হচ্ছে যেন অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেছে এরইমাঝে, তবে খুব ধীরে। ঘুমুতে চাইছে, কিন্তু কীভাবে ঘুমাতে হবে সেটাই যেন গেছে ভুলে।
দরজায় ধাক্কা দিল সে।
চেঁচিয়ে উঠল কেউ, ‘চুপ করো!’ কিন্তু এই কেউটা আসলে পুলিস অফিসার নাকি সহকয়েদি, তা বুঝতে পারল না মোটকু চার্লি।
পায়চারি করতে লাগল সে সেলের ভেতর। কতক্ষণ? কমিয়ে হিসেব করলেও কমপক্ষে দুই কি তিন বছর তো হবেই। তারপর বসে পড়ল বিছানায়, অপেক্ষা করতে লাগল অনন্তের। দেওয়ালের ওপরের দিকে থাকা পুরু কাচের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে সূর্যের আলো; ওটাকে জানালাও বলা চলে। তবে মনে হচ্ছে, সেদিন সকালে ও জেলখানায় ঢোকার সময় যে উজ্জ্বলতা ছিল আলোর এখনও সেটাই আছে।
কয়েদিরা কীভাবে সময় কাটায়, তা মনে করতে চাইল মোটকু চার্লি। কিন্তু মাথায় এলো শুধু গোপন ডায়েরি আর নিতম্বের ফুটোয় জিনিস লুকিয়ে রাখার কথা। লেখার মতো কিছু নেই হাতের কাছে, আর নিজের নিতম্বে কিছু একটা ঢুকিয়ে রাখার মতো বাজে কাজের কথা ভাবতেও পারছে না।
কিচ্ছু ঘটছে না, ঘটার সম্ভাবনাও নেই। কিছু না ঘটাটাই অব্যাহত রইল, তারপর আরও কিছুক্ষণ কেটে গেল কিছু না ঘটে। আরও কিছু না, কিছু না-এর ফিরে আসা, কিছু না-এর পুত্র, আবার পথে নামল কিছু না। কিছু নার সঙ্গে দেখা হলো নেকড়ে-মানবের…
ঠিক তখনই ঝট করে খুলে গেল দরজা, আনন্দে আরেকটু হলেই চেঁচিয়ে উঠত মোটকু চার্লি।
‘চলো, ব্যায়ামের জন্য উঠোনে যাবার সময় হয়েছে। চাইলে সিগারেট নিতে পারো একটা।’
‘আমি ধূমপান করি না।’
‘অভ্যাসটা এমনিতেও বাজে।’
ব্যায়ামের জায়গাটা খোলা, পুলিস স্টেশনের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত। চারপাশে দেওয়াল, তার ওপরে কাঁটাতার বসানো। চারপাশটা ঘুরে মোটকু চার্লি সিদ্ধান্ত নিলো, যদি একটা জিনিস ওর মারাত্মক অপছন্দ হয় তা হলো: পুলিসি হেফাজতে থাকা। আসলে পুলিসকে খুব একটা পছন্দই করে না মোটকু চার্লি, কিন্তু আজকের আগপর্যন্ত একটা বিশ্বাসকে লালন করত মনে—কোনো এক ধরনের ক্ষমতা আছে, যাকে হয়তো ভিক্টোরিয়ান যুগে নিয়তি বলা হতো, যা নিরপরাধের মুক্তি আর অপরাধীর সাজা নিশ্চিত করে। সেই বিশ্বাস মুখ থুবড়ে পড়েছে গত কিছুদিনের অভিজ্ঞতায়, আজ ছিল কফিনের শেষ পেরেক। মোটামুটি বিশ্বাস জন্মেছে মনে, বাকি জীবনটা কেটে যাবে একগাদা অসহিষ্ণু বিচারক আর অত্যাচারীর সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিরপরাধ দাবি করে (কল্পনার চোখে সেই অত্যাচারীদের অনেকের চেহারাই কেন যেন ডেইজির মতো দেখাচ্ছে!)। কে জানে, আগামীকাল সকালে ছয় নম্বর সেলে ঘুম থেকে উঠে আবিষ্কার করবে—রাতের বেলায় সে পরিণত হয়েছে বিশাল একটা তেলাপোকায়। নিঃসন্দেহে ও কোনোভাবে এমন এক অশুভ মহাবিশ্বে চলে এসেছে যেখানে মানুষ রাতের আঁধারে তেলাপোকায় পরিণত হয়…
আচমকা ওপর থেকে কিছু একটা ধপ করে নেমে, কাঁটাতারের ওপর আছড়ে পড়ল। কালো একটা পাখি নিস্পৃহতার সঙ্গে দেখছে ওকে। খানিক পরেই শোনা গেল আরও ডানা ঝাপটানি, বেশ কিছু চড়ুই এবং সম্ভবত একটা সারিল পাখিও এসে যোগ দিল ওটার সঙ্গে।
প্রত্যেকটাই চেয়ে চেয়ে দেখছে ওকে…একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল মোটকু চার্লিও।
আরও অনেকগুলো পাখি উপস্থিত হলো খানিকক্ষণের মধ্যেই।
কাঁটাতারের ওপর বসা পাখির ওই দঙ্গলটাকে দেখে ভয় পেয়েছিল মোটকু চার্লি, নাকি অবাক হয়েছিল তা ঠিক মতো বলে বোঝাতে পারবে না। তবে মনের ভেতরে যে অনুভূতিগুলো খেলা করছিল সেই মুহূর্তে, তার প্রথম একশোটার মাঝে ওই দুটো থাকবে। সবচেয়ে বেশি অদ্ভুত লাগছিল পাখিগুলোর আচরণ: ওগুলো না কিচির করছে, না মিচির, না গাইছে আর না করছে গুঞ্জন। চুপচাপ বসে আছে শুধু তারের ওপর, দেখছে ওকে
‘ভাগ্,’ বলল মোটকু চার্লি।
একটাও ভাগল না, কিন্তু… কথা বলে উঠল সবগুলো…একত্রে। ডাকল ওর নাম ধরে।
কোনার দরজার সামনে গিয়ে জোরে জোরে তাতে কিল বসাতে লাগল মোটকু চার্লি। বলল, ‘কেউ শুনছে?’ কয়েকবার এই কথা বলে শুরু করে দিল চিৎকার। ‘সাহায্য করো আমাকে!’
ক্ল্যাঙ্ক করে একটা শব্দ হলো, তারপর খুলে গেল দরজা। চোখ পিটপিট করতে করতে হার ম্যাজেস্টি’স কনস্ট্যাবুলারির এক সদস্য বেরিয়ে এসে বলল, ‘চেঁচাচ্ছ কেন? কারণটা যদি ফালতু হয়…’
ওপরের দিকে ইঙ্গিত করল মোটকু চার্লি, কিছুই বলল না। আসলে বলার দরকারই হলো না। হাঁ হয়ে গেল বেচারা কনস্ট্যাবুলারের মুখ, রইল ওভাবেই। মোটকু চার্লির মা এই অবস্থায় দেখলে তাকে মুখ বন্ধ করতে বলত, নইলে কিছু একটা মুখের ভেতর ঢুকে পড়তে পারে!
হাজারো পাখির ওজনে কাঁটাতারের অবস্থা খারাপ। ছোট্ট ছোট্ট, পাখির চোখগুলো নিষ্পলক চেয়ে আছে ওদের দিকে।
‘আয় হায়,’ বলল পুলিসের লোকটি, তারপর বিনা বাক্য ব্যয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো মোটকু চার্লিকে।
.
প্রচণ্ড কষ্টে আছে মেইভ লিভিংস্টোন, মেঝেতে পড়ে আছে হাত-পা ছড়িয়ে। জ্ঞান ফিরে পেতেই মনে হয়েছে, চেহারা আর চুল যেন ভেজা আর গরম লাগছে। তারপর আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। এরপর চোখ খুলতেই মনে হয়েছে, চেহারা-চুল ঠান্ডা আর আঠা আঠা। বারবার চেতন আর অচেতনের দুনিয়ায়
যাওয়া-আসা করতে লাগল সে; দেখতে লাগল স্বপ্ন। জেগে উঠতেই মাথার পেছনে ব্যথাটা টের পেল খুব করে। ঘুমানোই সহজ বলে মনে হলো তার কাছে, আর ঘুমানোর সময় ব্যথা পাওয়া যায় না বলে নরম, আরামদায়ক কম্বলের মতো করে জড়িয়ে ধরল ঘুমের রাজ্যকে।
স্বপ্নে দেখতে পেল, একটা টেলিভিশন স্টুডিয়োর ভেতর দিয়ে হাঁটছে সে; খুঁজছে মরিসকে। মাঝে-মধ্যে মনিটরে দেখা যায় তার স্বপ্নপুরুষের প্রতিফলন; সবসময় কেমন যেন চিন্তিত দেখায় লোকটাকে। বেরোবার পথ খুঁজে পাবার চেষ্টা করল বটে মেইভ, কিন্তু প্রত্যেকবার ফিরে এলো স্টুডিয়োর মেঝেতে
‘খুব শীত-শীত করছে,’ ভাবল মেইভ। টের পেল, আবার জেগে উঠেছে। ব্যথাটা অবশ্য মিলিয়ে গেছে অনেকটাই। সব মিলিয়ে, ভাবল সে, খারাপ লাগছে না এখন এতটা।
তবে একটা ব্যাপার খেপিয়ে তুলছে ওকে, ব্যাপারটা কী—তা অবশ্য ধরতে পারছে না। হয়তো স্বপ্নের অন্য কোনো অংশ হবে।
কোথায় আছে তা জানে না। তবে যেখানেই থাকুক, জায়গাটা ঝাড়ু রাখার ক্লজিট বলেই মনে হচ্ছে। অন্ধকারে কোনো কিছুর সঙ্গে ঠোক্কর যেন না খায়, সে জন্য হাত বাড়িয়ে চলতে হচ্ছে ওকে। ভয়ে ভয়ে, আর হাত বাড়িয়ে কয়েকটা কদম ফেলল সে; তারপর এতক্ষণ বন্ধ করে রাখা চোখটা খুলল। নিজেকে আবিষ্কার করল একটা কামরায়, যেটাকে সে চেনে। একটা অফিস ওটা।
গ্রাহাম কোর্টসের অফিস।
ঠিক তখনই ওর মনে পড়ে গেল সব। সদ্য ঘুম থেকে উঠলে খানিকটা আচ্ছন্ন লাগে—সে কারণেই পরিষ্কার মাথায় ভাবতে পারছে না। আর মেইভের মাথা তো এক কাপ কফি গেলার আগে কখনওই পরিষ্কার হয় না—তারপরেও মনে পড়ে গেল সব গ্রাহাম কোর্টসের বিশ্বাসঘাতকতা, তার প্রতারণা, লোকটার অপরাধপ্রবণতা, এবং তার…
আরে, ভাবল সে। ও তো আমাকে আক্রমণ করেছিল! আঘাত করেছিল আমাকে। তারপর আরও ভাবল। পুলিস, আমার পুলিসে খবর দেওয়া উচিত।
টেবিলের ওপর রাখা ফোনটার ওপর উবু হলো সে, হাতে তুলে নিলো ওটা…মানে, চেষ্টা করল আরকী। কিন্তু ফোনটাকে খুব ভারী আর পিচ্ছিল, অথবা দুটোই মনে হচ্ছে। ঠিক মতো ধরতেই পারল না! কেন যেন অন্যরকম ঠেকল হাতে।
যতটা ভেবেছি, আসলে তার চাইতেও বেশি দুর্বল হয়ে গেছি, ভাবল মেইভ। পুলিসের পাশাপাশি ডাক্তার পাঠাতেও বলতে হবে।
জ্যাকেটের পকেটে একটা ফোন আছে ওর, ছোট্ট আর রূপালি।
ফোন এলে ‘গ্রিনস্লিভস’ গানের সুরটা বাজে। ওই ফোনটা এখনও জায়গামতোই আছে আবিষ্কার করে স্বস্তি পেল মহিলা, সেটা ধরতেও বেগে পেতে হচ্ছে না। ইমার্জেন্সি সার্ভিসেসের নম্বর ডায়াল করল ফোনে, তারপর অপেক্ষা করতে লাগল ওপাশ থেকে কেউ জবাব দেওয়ার। ভাবতে লাগল— আজও কেন বলা হয় যে নম্বর ‘ডায়াল’ করছে? ওই জিনিসের চল তো উঠে গেছে অনেক আগেই, তখন সে নিজেই কমবয়সী ছিল। ডায়ালঅলা ফোনের পর এলো পাতলা-সাতলা ফোন, যেগুলোতে বোতাম টিপতে হয়; ফোন এলে বিরক্তিকর সুরে বাজত সেগুলো। যখন মেইভ টিনেজার, তখন ওর এক প্রেমিক ছিল; বিরক্তিকর সেই সুর ক্রমাগত নকল করে যেতে পারত ছেলেটা। এখন ভাবতে গেলে মহিলার মনে হয় – সম্ভবত জীবনে বলার মতো ওই একটা কাজই করতে পেরেছিল ছেলেটা। কী অবস্থা তার? ভাবল একবার। ফোনের বিশেষ একটা রিংটোন নকল করতে পারে—এই গুণের অধিকারী মানুষ বর্তমান দুনিয়ায় কী করছে? যেখানে টেলিফোন সবধরনের আওয়াজ করতে সক্ষম…
‘অনাকাঙ্ক্ষিত দেরির জন্য আমরা দুঃখিত,’ যান্ত্রিক একটা কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘দয়া করে লাইনে থাকুন।’
নিজেকে অদ্ভুত রকমের শান্ত ঠেকল মেইভের, যেন খারাপ কিছু কখনও ওর সঙ্গে হওয়া সম্ভবই না।
হঠাৎ ওপাশে শোনা গেল একটা পুরুষ কণ্ঠ। ‘হ্যালো?’ বলল সে। দক্ষতা যেন কণ্ঠস্বরেই উপচে পড়ছে।
‘আমার পুলিসকে দরকার,’ জানাল মেইভ।
‘আপনার পুলিসকে দরকার নেই।’ জবাব দিল কণ্ঠটা। ‘সব ধরনের অপরাধের বিচার করবেন যথোপযুক্ত কর্তৃপক্ষ, যাকে ফাঁকি দেওয়ার কোনো উপায় নেই।’
‘মনে হচ্ছে,’ বলল মেইভ। ‘ভুল নম্বরে কল করে ফেলেছি।’
‘একই ভাবে বলা যায়,’ জানাল কণ্ঠটা। ‘সব নম্বরই আসলে সঠিক নম্বর। কেননা নম্বর তো নম্বরই, তার আর ঠিক-বেঠিক কী?’
‘দর্শনটা হয়তো ভালোই ঝেড়েছেন,’ বলল মেইভ। ‘কিন্তু আমার আসলেও পুলিসকে দরকার। সম্ভবত দরকার একটা অ্যাম্বুলেন্সও। আর যেটা ডায়াল করেছি, সেটা ভুল ছাড়া কিছু হতেই পারে না।’ কল কেটে দিল মহিলা। হয়তো, ভাবল সে, ৯৯৯ নম্বরটা সেলফোন থেকে ডায়াল করলে কাজ করে না। অ্যাড্রেস বুক বের করে, বোনকে কল করল এরপর। ‘পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিই একটা কথা: আমি বলছি না জেনে-বুঝে আপনি ভুল নম্বরে কল করেছেন। আমি বলতে চাচ্ছি, সত্তাগত কারণেই প্রতিটা নম্বর সঠিক। একমাত্র পাই বাদে, যা বলাই বাহুল্য। ওটার ব্যাপারে ভাবলেই মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। চলতে থাকে তো চলতেই থাকে তো চলতে থাকে তো চলতে থাকে…’
লাল বোতাম চেপে কল কেটে দিল মেইভ, এরপর বেছে নিলো ব্যাঙ্ক ম্যানেজারের নম্বর।
ওপাশ থেকে ভেসে এলো কণ্ঠ, ‘কী সব যে বকছি, এখন কি আর নম্বরের সঠিকত্ব নিয়ে কথা বলার সময়? সব কিছুর উপযুক্ত স্থান, কাল, পাত্র লাগে…’
কেটে দিয়ে এবার মেইভ ফোন করল তার সবচাইতে কাছের বান্ধবীকে।
‘—এই মুহূর্তে আমাদের আলোচনা করা উচিত আপনার অন্তিম গন্তব্য নিয়ে। আজ বিকেলে আত্মার সংখ্যা অনেক বেশি, তাই যেখানে আছ সেখানেই খানিকক্ষণ অপেক্ষা করুন। আপনাকে নিতে কাউকে পাঠানো হবে…’ কণ্ঠে তার আশ্বস্ত করার সুর, অনেকটা রেডিয়োতে প্রচারিত ধর্মপ্রচারকের কণ্ঠের মতো।
মেইভ যদি মানসিকভাবে স্থবির হয়ে না থাকতো, তাহলে তখনই ভয় পেয়ে যেত। কিন্তু তা না করে, ভাবতে বসল সে। ফোনটাকে বোধহয় কী যেন বলে এটাকে, হ্যাক? – হুম, হ্যাকই করেছে কেউ। তাই রাস্তার শেষ মাথায় গিয়ে খুঁজে বের করতে হবে পুলিস অফিসারকে। আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ করতে হবে তাকে। কিন্তু লিফটের বোতাম চাপার পরেও কিচ্ছু হলো না, দেখে হেঁটে নেমে গেল নিচে। ভাবল, এমনিতেও দরকারের সময় ধারে- কাছে পুলিস অফিসার খুঁজে পাওয়ার কথা না। তারা সবসময় গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ায়, সাইরেন বাজায় নে-নর-নি-নর শব্দে। পুলিসের উচিত, ভাবল মেইভ, জোড়া বেঁধে ঘুরে বেড়ানো। ওদের কাজ হবে মানুষকে সময় জানানো আর ড্রেন পাইপের নিচে বসে অপেক্ষা করা, যেন পালাতে উদ্যত ছিঁচকে চোরদের পাকড়াও করতে পারে…
সিঁড়ির একেবারে নিচে, হলওয়েতে, দাঁড়িয়ে আছে দুজন পুলিস অফিসার—একজন নারী এবং অন্যজন পুরুষ। সাদা পোশাকে থাকলেও তাদের পেশা আন্দাজ করতে বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে না। ভুল হবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। লোকটা শক্তপোক্ত, চেহারাটাও লাল হয়ে আছে; মেয়েটা ছোটোখাটো, অন্য যেকোনো পরিস্থিতিতে তাকে সুন্দরীও বলা যেত। ‘এখানে যে এসেছিলেন ভদ্রমহিলা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই,’ বলছে মেয়েটা। ‘রিসেপশনিস্টও সেই কথা বলেছে। লাঞ্চের খানিক আগে উপস্থিত হন তিনি। কিন্তু রিসেপশনিস্ট ফিরে এসে আবিষ্কার করে—দুজনের কেউই অফিসে নেই।’
‘তোমার কি মনে হয় মেইভ লিভিংস্টোন আর গ্রাহাম কোটস হাতে হাত ধরে পালিয়ে গেছে?’ জিজ্ঞেস করল পোক্ত লোকটা।
‘ছিহ, এসব কী কথা?’ ভদ্রভাবেই বলল মেইভ।
‘হতে পারে। সহজ কোনো একটা ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে গ্রাহাম কোটসের অন্তর্ধান আর মেইভ লিভিংস্টোনের অন্তর্ধানের পেছনে। কপাল ভালো যে অন্তত ন্যান্সিকে আমরা গ্রেপ্তার করতে পেরেছি।’
‘আমরা পালাইনি,’ বলল মেইভ, কিন্তু ওকে অগ্রাহ্য করল পুলিস দুজন।
পুলিস অফিসার দুজন লিফটে উঠে, দরজা বন্ধ করে দিল। ওদেরকে একেবারে ওপর তলার দিকে যেতে দেখল মেইভ। হাতে তখনও ধরে আছে ফোনটা, আচমকা কেঁপে উঠে ‘গ্রিনস্লিভস’-এর সুর বাজতে শুরু করল ওটা থেকে। ফোনের দিকে তাকাল মহিলা, মরিসের চেহারা ভরিয়ে রেখেছে পর্দাটাকে। নার্ভাস ভঙ্গিতে জবাব দিল মহিলা, ‘হ্যালো?’
‘হ্যালো সোনা, কী খবর?’
‘ভালো আছি, ধন্যবাদ,’ জানাল মেইভ। ‘মরিস?’ একটু পরেই যোগ করল, ‘নাহ, আসলে ভালো নেই।’
‘হুম,’ ওপাশ থেকে ভেসে এলো কথাটা। ‘আমিও সেটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন তো আর করার কিছু নেই; সময় হয়েছে…জীবনকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবার।’
‘মরিস, ফোন করছ কোত্থেকে?’
‘ব্যাপারটা একটু জটিল,’ জানাল মরিস। ‘মানে, আমি আসলে ফোন করিনি। তোমাকে সাহায্য করার জন্যই করছি এসব।’
‘গ্রাহাম কোটস,’ ক্ষোভ ঝরল মহিলার কণ্ঠে। ‘একটা প্রতারক।’
‘জানি, সোনা,’ বলল মরিস। তবে এখন ওসব ভুলে যাওয়ার সময়। সব পেছনে ফেলে সামনে এগোও।’
‘আমার মাথার পেছনে বাড়ি মেরে,’ স্বামীকে অভিযোগ করল মহিলা। ‘আমাদের সব টাকা-পয়সা নিয়ে পালিয়েছে!’
‘এসবই পার্থিব সম্পদ, সোনা,’ বোঝাবার ভঙ্গিতে বলল মরিস। ‘অথচ তুমি চলে এসেছ পর্দার ওপাশে…’
‘মরিস,’ বলল মেইভ। ‘ওই জঘন্য কীটটা তোমার স্ত্রীকে খুন করতে চেয়েছিল। তোমার কি উচিত না আরেকটু সমবেদনা জানানো?’
‘সেই পথে হেঁটো না, সোনা। আমি তো শুধু ব্যাখ্যা করে বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে…’
‘তুমি যদি এসব বেহুদা কথা বলতে থাকো, মরিস, তাহলে ব্যাপারটা আমি নিজেই সামলাবো। ভোলার তো প্রশ্নই ওঠে না; তুমি মারা গেছ, তাই তোমার কিছু যায় আসে না। পার্থিব ব্যাপার-নিয়ে ভাবতে হয় না তোমাকে।’
‘তুমিও মারা গেছ, সোনা।’
‘সেটা আসল ব্যাপার না,’ বলল বটে মহিলা। পরক্ষণেই অবাক হয়ে যোগ ‘কী বললে? আমি কী?’ মরিস কিছু বলার আগেই যোগ করল, ‘শোনো, বললাম তো যে আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছে লোকটা। সফল হয়েছে, তা তো বলিনি।’
‘উম,’ মৃত মরিস লিভিংস্টোন ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। ‘মেইভ, সোনা, জানি কথাটা শুনে ধাক্কা খাবে। কিন্তু আসলে তুমি—’
আচমকা ‘ব্লিপ ব্লিপ’ করে উঠল ফোনটা, ব্যাটারি ফুরিয়ে যাওয়ার ছবি ভেসে উঠল পর্দায়।
‘কী বললে? শুনতে পাইনি, মরিস,’ স্বামীকে বলল সে। ‘টেলিফোনের ব্যাটারি মরতে বসেছে।’
‘তোমার ফোনে ব্যাটারি নেই,’ ওকে জানাল মরিস। ‘আসলে তোমার কোনো ফোনই নেই, সবই ভ্রম। সেটাই তো বলতে চাচ্ছি–তুমি এখন পা রেখেছ পর্দার ওপাশে, এখন পরিণত হচ্ছ…ওই যে বলে না, পোকা থেকে প্রজাপতিতে? অনেকটা সেরকম আরকী।’
‘শূককীট থেকে প্রজাপতিতে…’ শুধরে দিল মেইভ
‘হুম, সেটাই।’ ফোনে মরিসের কণ্ঠ ভেসে এলো। ‘শূককীটই বলতে চেয়েছি। কিন্তু পোকা তাহলে কী সে পরিণত হয়?’
‘কিছুতেই না, মরিস,’ খানিকটা বিরক্তির সঙ্গেই বলল মেইভ। ‘ওগুলো নিছকই পোকা।’ রূপালি ফোনটা ছোট্ট একটা শব্দ করে উঠল, অনেকটা ঢেকুর তোলার মতো। আবার দেখা দিল ব্যাটারি ফুরিয়ে আসার ছবি, তারপর বন্ধই হয়ে গেল।
যন্ত্রটা ভাঁজ করে পকেটে রেখে দিল মেইভ। তারপর একদম কাছের দেওয়ালটার সামনে দাঁড়িয়ে, পরীক্ষার করার জন্যই একটা আঙুল দিয়ে খোঁচা দিল তাতে। মনে হলো যেন জেলির মতো কিছু একটায় আঙুল সেঁধিয়ে দিচ্ছে। আরেকটু চাপ দিতেই পুরো হাতটা ঢুকে গেল ভেতরে, তারপর বেরিয়ে এলো ওপাশে!
‘হায় খোদা,’ বলল মেইভ। ভাবল—বহুবারের মতো আরও একবার- মরিসের কথা মন দিয়ে শুনলে খারাপ হতো না। হাজার হলেও লোকটা, নিজের কাছে স্বীকার করল মেইভ, মরার ব্যাপারে অন্তত তার নিজের চাইতে অনেক বেশি জানে। যাক সে কথা, ভাবল সে। মরে যাওয়াটা, বেঁচে থাকার মতোই কিছু একটা হবে: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিখে যাবে যা শেখার, বাকিটা আন্দাজেই করতে হবে।
সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল মহিলা, পরক্ষণেই নিজেকে আবিষ্কার করল আবার দালানটাতেই; পেছন দিকের দেওয়াল গলে উপস্থিত হয়েছে হলে। আবার চেষ্টা করল মেইভ, ফলাফল হলো একই। এরপর দালানের নিচতলায় থাকা ট্রাভেল এজেন্সিতে পা রাখল সে চেষ্টা করল পশ্চিম দিকের দেওয়াল গলে বাইরে বেরোবার।
দেওয়ালের ওপাশে যেতে সফল তো হলো, কিন্তু নিজেকে আবিষ্কার করল আবার সামনের হলে। তবে এবার পূর্বদিক থেকে ঢুকেছে। মনে হচ্ছে, এই অফিস বিল্ডিঙটাই ওর ব্রহ্মাণ্ড হয়ে দাঁড়িয়েছে!
ওপর তলায় চলে গেল মেইভ, গোয়েন্দারা কী করছে তা দেখছে। ডেস্কের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে মানুষ দুজন; সুটকেস প্যাক করার সময় নোংরার জন্ম দিয়েছে গ্রাহাম কোটস।
‘আমি কিন্তু,’ আশাবাদী হয়ে বলল মেইভ। ‘পড়ে আছি ওই বুককেসের পেছনে।’
কিন্তু ওকে পাত্তা দিল না পুলিস অফিসাররা।
মেয়ে অফিসারটি উবু হয়ে আছে ময়লার বাক্সের ওপর। ‘বিঙ্গো,’ বলল সে, তারপর বের করে আনল পুরুষের একটা সাদা শার্ট। শুকনো রক্ত লেগে আছে তাতে। প্লাস্টিকের একটা ব্যাগে সেটা ফেলল ও, এদিকে পোক্ত লোকটা পকেট থেকে বের করল ফোন।
‘ফরেনসিক পাঠাও,’ বলল সে।
.
নিজের সেলটাকে এখন আর কয়েদখানা মনে হচ্ছে না মোটকু চার্লির, মনে হচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়। সেলগুলোকে স্থাপন করা হয়েছে দালানের একদম ভেতরে, তাই সবচাইতে উদগ্রীব পাখিটারও এখানে আসতে বেগ পেতে হবে। ছয় নম্বর সেলে কিছু ঘটছে না দেখে আর মন খারাপ হচ্ছে না ওর। কল্পনার চোখে যেসব ঘটনা ঘটতে দেখছে, তার তুলনায় কিছুই না ঘটাও মন্দ না। দুর্গ, তেলাপোকা আর ‘কে’ অক্ষর দিয়ে নাম এমন মানুষে ভরতি একটা ব্রহ্মাণ্ডও আপাতত একযোগে ওর নাম ধরে ডাকতে থাকা পাখির চাইতে ভালো মনে হচ্ছে।
আচমকা খুলে গেল দরজাটা।
‘নক করা শেখোনি?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মোটকু চার্লি।
‘না,’ জবাব দিল পুলিস অফিসার। ‘কয়েদখানায় ঢুকতে আমাদের নক করতে হয় না। তোমার উকিল এসেছে।’
‘মিস্টার মেরিম্যান?’ জিজ্ঞেস করেই থমকে গেল মোটকু চার্লি। লিয়োনার্ড মেরিম্যান মোটাসোটা এক ভদ্রলোক, চোখে ছোট্ট ও সোনার চশমা পরেন। কিন্তু অফিসারের পেছনে লুকিয়ে থাকা মানুষটা না মোটা… আর না তার চোখে চশমা আছে।
‘এবার আপনি যেতে পারেন,’ মোটকু চার্লির উকিল না যে লোকটা, সে জানাল পুলিস অফিসারকে। ‘বাকিটা আমি সামলাচ্ছি।’
‘কাজ শেষে ঘণ্টা বাজাবেন,’ বলে দরজা বন্ধ করে দিল পুলিস অফিসার।
মোটকু চার্লির হাত ধরে বলল স্পাইডার, ‘তোমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাবো।’
‘কিন্তু আমি তো পালাতে চাই না। আমি নিরপরাধ।’
‘সেজন্যই তো পালাতে হবে।’
‘কিন্তু পালালে তো একটা অপরাধ করে বসব। পরিণত হবো জেল- পালানো কয়েদিতে!’
‘তুমি কয়েদি নও,’ হাসিখুশি কণ্ঠে বলল স্পাইডার। ‘তোমাকে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়নি। আসলে পুলিসের অনুসন্ধানে সহযোগিতা করছ কেবল। খিদে পেয়েছে?’
‘একটু।’
‘কী চাই? চা? কফি? গরম চকলেট?’
গরম চকলেট হলে খারাপ হতো না, মনে হলো মোটকু চার্লির। ‘গরম চকলেট দাও,’ বলল সে!
‘বেশ তাহলে,’ বলল স্পাইডার। তারপর মোটকু চার্লির হাত আঁকড়ে ধরে বলল, ‘চোখ বন্ধ করো।’
‘কেন?’
‘তাহলে সহজ হবে!
চোখ বন্ধ করল মোটকু চার্লি, যদিও সহজ হওয়ার ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাস হতে চাইছে না। আচমকা যেন প্রসারিত হলো দুনিয়াটা, পরক্ষণেই আবার কুঁচকে গেল। মোটকু চার্লি মোটামুটি নিশ্চিত, অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পরক্ষণেই শান্ত হয়ে গেল তার মন, চেহারায় পেল উষ্ণ বাতাসের স্পর্শ।
চোখ খুলল সে।
খোলা বাতাসে দাঁড়িয়ে আছে ওরা, বিশাল একটা বাজারের মাঝখানে। জায়গাটা কোনো ভাবেই ইংরেজ বলে মনে হচ্ছে না।
‘কোথায় এনে ফেললে?’
‘সম্ভবত জায়গাটার নাম স্কোপসি, ইতালির কোথাও হবে। বহু বছর আগে থেকেই এখানে যাওয়া-আসা করি। অসাধারণ এদের চকলেট, এতটা ভালো অন্য কোথাও পাইনি।’
একটা ছোট্ট, কাঠের টেবিলে বসল ওরা; দমকলের গাড়ির মতো লালে রাঙানো হয়েছে ওটা। এগিয়ে এলো এক ওয়েটার, অদ্ভুত ভাষায় কিছু একটা বলল সে; ভাষাটাকে কোনোভাবেই ইতালিয়ান বলে মনে হলো না মোটকু চার্লির। স্পাইডার বলল, ‘দোস চকোলাটোস, বন্ধু।’ শুনে মাথা নেড়ে চলে গেল ওয়েটার।
‘এবার তাহলে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘আমাকে আরও বড়ো গাড্ডায় ফেললে তুমি! পেছনে নিশ্চয়ই পুলিসের লাইন লেগে যাবে, সবগুলো খবরের কাগজে ছাপা হবে আমার পলায়নের খবর!’
‘কর্তৃপক্ষ কী করবে?’ হেসে জিজ্ঞেস করল স্পাইডার। ‘তোমাকে জেলে পাঠাবে?’
‘পাঠাতেও পারে!’
গরম চকলেট চলে এলো, ছোটো কাপে তা ঢালল ওয়েটার। গলিত লাভার মতো তাপমাত্রা ওটার, চকলেট সুপ আর চকলেটের কাস্টার্ডের মাঝামাঝি কিছু একটা মনে হচ্ছে দেখে। দারুণ সুগন্ধ ছড়াচ্ছে ওটা থেকে।
বলল স্পাইডার, ‘দেখো, পারিবারিক পুনর্মিলনির ব্যবস্থা করতে গিয়ে আমরা ঘোঁট পাকিয়ে ফেলেছি, তাই না?’
‘আমরা? আমরা পাকিয়েছি?’ রাগ বেশ ভালোভাবেই প্রকাশ করতে জানে মোটকু চার্লি। ‘আমি আমার বাগদত্তাকে ভাগাইনি, আমি চাকরি থেকে নিজেকে বের করে দিইনি, এবং আমি আমাকে গ্রেফতার করাইনি—’
‘না,’ বলল স্পাইডার। ‘কিন্তু এই ঝামেলায় পাখিদেরকে জড়ানোর পেছনে তো তোমারই হাত ছিল, নাকি?’
ছোট্ট করে গরম চকলেটে চুমুক দিল মোটকু চার্লি। ‘আউ, জিভ পুড়ে গেছে!’ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই আবিষ্কার করল: স্পাইডারও উদ্বিগ্ন, ভয়ার্ত আর ক্লান্ত চোখে তাকাচ্ছে ওর দিকে। ‘হুম, এসবে আমিই পাখিদেরকে জড়িয়েছি। এখন কী করতে বলো?’
বলল স্পাইডার, ‘এখানে নুডলসের মতো একটা খাবার বানায় ওরা, জানিয়ে রাখলাম আরকী।’
‘আমরা আসলেই ইতালিতে আছি তো?’
‘নাহ।’
‘একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
মাথা নাড়ল স্পাইডার।
কীভাবে প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করবে, তা মনে মনে গুছিয়ে নিলো মোটকু চার্লি। ‘পাখিদের ব্যাপারেই; আচমকা সবাই একসঙ্গে দেখা দিয়ে এমন ভাব ধরছিল যেন আলফ্রেড হিচককের ছবির সেট থেকে উঠে এসেছে! এমন কিছু কি শুধু ইংল্যান্ডেই হয়?’
‘কেন?’
‘কারণ আমার মনে হচ্ছে, ওই কবুতরগুলো দেখছে আমাদেরকে।’ বাজার চত্বরের শেষ মাথার দিকে ইঙ্গিত করল সে।
সাধারণত কবুতররা যা করে, সেসব করার দিকে মোটকু চার্লির দেখানো কবুতরদের একদম মন নেই। স্যান্ডউইচের টুকরো ঠোকরানোয়, কিংবা মাথা দোলাতে দোলাতে পর্যটকদের ফেলে দেওয়া খাবারের খোঁজ করছে না ওরা। একেবারে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে দেখছে ওকে আর স্পাইডারকে। পাখা ঝাপটানির আওয়াজ এলো কানে, একটু পরেই ওদের সঙ্গে যোগ দিল আরও প্রায় একশো পাখি; অধিকাংশই নামল চত্বরের মাঝখানে অবস্থিত এক বিশাল হ্যাট পরা মোটা ব্যক্তির মূর্তির ওপর। কবুতরদের দিকে তাকাল মোটকু চার্লি, পাখিগুলোও তাকাল ওর দিকে। ‘কী আর করবে,’ স্পাইডারকে বলল সে। ‘বড়োজোর পায়খানা করবে আমাদের মাথার ওপরে এসে।’
‘আমার তো মনে হচ্ছে, আরও ভয়ানক কিছুও করে বসতে পারে। কথা না বাড়িয়ে, তোমার গরম চকলেট শেষ করে ফেল।’
‘গরম না তো!’
‘কয়েক বোতল পানিরও দরকার পড়বে আমাদের, তাই না? গারকোন[২৫]?’
[২৫ ফরাসি রেস্তোরাঁ বা হোটেলে এই নামেই ওয়েটারদের ডাকা হয়।]
পাখির ডানা ঝাপটানোর নিচু শব্দ শোনা গেল আচমকা, তারপর আরও এক ঝাঁক পাখির উপস্থিত হবার আওয়াজ; সব কিছুর গোড়ায় আছে গোপনীয়তায় ভরা ‘কু-কু’ ডাক।
পানির বোতল নিয়ে উপস্থিত হলো ওয়েটার। স্পাইডার এখন আবার পরে আছে তার কালো-লাল চামড়ার জ্যাকেট; মোটকু চার্লির চোখের সামনে বোতলটা পকেটে ভরল সে।
‘নিছক কবুতরই ওগুলো,’ বলল মোটকু চার্লি। কিন্তু বলার সময়ই টের পেল যে কথাটা ঠিক না। ওগুলো নিছক কবুতর নয়, আসলে ওই পাখিগুলো একটা বাহিনী। মোটা মানুষের মূর্তি এখন ধূসর-বেগুনি পালকের তলে প্রায় হারিয়ে গেছে!
‘আমাদেরকে আক্রমণ করার আগে কিন্তু পাখি-টাখি আমার ভালোই লাগত।’
স্পাইডার বলল, ‘চারপাশে অভাব নেই ওদের!’ বলেই মোটকু চার্লির হাত ধরল সে। ‘চোখ বন্ধ করো।’
সবগুলো পাখি মিলে যেন জন্ম নিলো একটা মাত্র বিশাল পাখি, চোখ বন্ধ করে ফেলল মোটকু চার্লি।
নেকড়ের পাল যেভাবে ঝাঁপ দেয় শিকারের ওপর, সেভাবে ছোঁ মারল কবুতরগুলো।
নীরবতা নেমে এলো চোখের পলকে, অনেক দূরে কোথাও চলে গেল সে…মোটকু চার্লি ভাবল, ওভেনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাকে! চোখ খুলে আবিষ্কার করল, ভাবনাটা ভুল ছিল না: তবে এই ওভেনে রয়েছে লাল বালিয়াড়ি, দূর-দূরান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে ওটা; মাদার-অভ-পার্ল-রঙা আকাশের সঙ্গে গিয়ে মিলেছে দিগন্তে।
‘মরুভূমি,’ বলল স্পাইডার। ‘ভাবলাম, জায়গাটা খারাপ হবে না। অন্তত পাখির হাত থেকে তো মুক্তি পাবো! শান্তিতে শেষ করা যাবে আমাদের আলোচনা। এই যে,’ মোটকু চার্লিকে পানির বোতল এগিয়ে দিল সে।
‘ধন্যবাদ।’
‘এবার বলো, এই পাখিদের আগমন ঘটল কোত্থেকে?’
জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘একটা জায়গা আছে, বুঝলে? ওখানে গেছিলাম। অনেকগুলো পশু-মানব দেখেছি সেখানে। ওরা সবাই, উম, বাবাকে চিনত। তাদের মাঝে একজন ছিল নারী, পাখি-মানবী আরকী।’
ওর দিকে তাকাল স্পাইডার। ‘তা এই জায়গাটা কই? তোমার কথা শুনে কিছুই বোঝা গেল না!’
‘একটা পাহাড়ের পাশে জায়গাটা, পাহাড়ের দেওয়ালে আবার অনেকগুলো গুহামুখ আছে। ঠিক তার ওপাশেই খাদ, অন্য কিচ্ছু নজরে পড়ে না। মনে হচ্ছিল যেন দুনিয়ার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছি।’
‘শুরুর প্রান্তে আসলে, শুধরে দিল স্পাইডার। ‘গুহাগুলোর কথা আমি শুনেছি, পরিচিত এক মেয়ে বলেছিল। তবে যাইনি কখনও। তা পাখি-মানবীর সঙ্গে দেখা হলো, এরপর…?’
‘প্রস্তাব দিল, তোমাকে ভাগিয়ে দেবে। তাই আমি, মানে, উম, রাজি হয়ে গেলাম।’
‘কাজটা,’ চলচ্চিত্র অভিনেতার মতো করে হাসল স্পাইডার। ‘চরম বোকার মতো কাজ হয়েছে।’
‘তোমার কোনো ক্ষতি করতে মানা করেছিলাম।’
‘আর কীভাবে আমাকে ভাগাত বেটি? চিঠি লিখে?’
‘তা জানি না, ভেবে দেখিনি। মন-টন খারাপ ছিল অনেক।’
‘অসাধারণ। যাক গে, পাখি-মানবী তার ইচ্ছেমতো কাজ করতে পারলে তোমার মন আরও খারাপ হবে…আর আমি? মরব। আমাকে অনুরোধ করলেই তো পারতে, চলে যেতাম!’
‘করেছিলাম তো!’
‘অ্যাঁ? জবাবে কী বলেছিলাম?’
‘বলেছিলে আমার বাড়ি তোমার পছন্দ হয়েছে, তাই অন্য কোথাও যাচ্ছ না!’
পানি পান করল স্পাইডার। ‘তা পাখি-মানবীকে ঠিক কী বলেছিলে তুমি?’
মনে করার চেষ্টা করল মোটকু চার্লি। এখন ওর বলা কথাটা অদ্ভুত ঠেকছে নিজের কাছেই। ‘বলেছিলাম যে আনানসির বংশধর তাকে দেব,’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও জানাল সে।
‘কী?’
‘পাখি-মানবী আমাকে সেটাই বলতে বলেছিল।’
হতভম্ব দেখাল স্পাইডারকে। ‘কিন্তু আনানসির বংশধর শুধু আমি একা নই, তুমিও!’
আচমকা শুকিয়ে গেল মোটকু চার্লির মুখ। মনে মনে আশা করল, তার কারণ যেন মরুভূমির বাতাস হয়! তারপর নিজের বোতল থেকে পানি পান করল।
‘কিন্তু…’ প্রশ্ন করল সে। ‘মরুভূমিতে নিয়ে এলে কেন?’
‘এখানে পাখি নেই, বললাম না একটু আগেই!’
‘তাহলে ওগুলো কী?’ ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল সে। প্রথমে দেখা গেল ছোট্ট কিছু বিন্দু; পরে বোঝা গেল, আসলে ওগুলো অনেক ওপরে আছে বলে ছোটো দেখাচ্ছে। চক্কর কাটছে পাখিগুলো, টলছে প্রবলভাবে।
‘শকুন,’ স্পাইডার জবাব দিল। ‘ওরা জীবিত প্রাণিকে আক্রমণ করে না।’
‘ঠিক ঠিক, আর কবুতর তো খুব করে?’ বিদ্রূপ করল মোটকু চার্লি। আকাশের বিন্দুগুলো আরও নিচে নেমে এলো, ক্রমেই বড়ো হচ্ছে পাখিগুলো।
এবার মুখ খুলল স্পাইডার। ‘কথা সত্য,’ পরক্ষণেই যোগ করল। ‘আরে ধুর!’
ওরা একা নেই এখানে, দূরের একটা বালিয়াড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে কেউ একজন দেখছে ওদেরকে। অন্য কেউ দেখলে হয়তো সেই কেউ একজনকে কাকতাড়ুয়া ভাবত!
চেঁচিয়ে উঠল মোটকু চার্লি। ‘ভাগো এখান থেকে!’ মরুর বালি গিলে খেল ওর কণ্ঠ। ‘সব ফিরিয়ে নিলাম, চুক্তি বাতিল! একা থাকতে দাও আমাদেরকে!’
উষ্ণ বাতাসে কেঁপে উঠল একটা ওভারকোট, বালিয়াড়ি শূন্য হয়ে গেল।
বলল মোটকু চার্লি, ‘চলে গেছে বেটি। কে ভেবেছিল যে কাজটা এত সহজ হবে?’
ওর কাঁধ স্পর্শ করল স্পাইডার, তারপর ইঙ্গিতে দেখাল দূরের একটা জায়গা। বাদামি ওভারকোট পরে থাকা খানিক আগের মহিলাটাই এখন দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা বালিয়াড়ির ওপরে। এতটাই কাছে যে তার চোখের কালো, ঘষা কাচের দৃষ্টি পরিষ্কার দেখতে পেল মোটকু চার্লি।
শকুনগুলো খানিকক্ষণ কালো ছায়া ফেলে, অবশেষে ল্যান্ড করল মাটিতে। পালকহীন, উজ্জ্বল বেগুনি বর্ণের গলা ও মাথা—পালকহীন কেননা মরা লাশে ঠোঁট বসিয়ে দিতে সহজ হয় তাতে—বাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল দুই ভাইয়ের দিকে। মনে হলো যেন ভাবছে—মানুষ দুটোর মরার জন্য অপেক্ষা করবে, নাকি ব্যাপারটা তরান্বিত করার জন্য কিছু করবে?
জবাব দিল স্পাইডার। ‘আর কিছু ছিল চুক্তির শর্ত?’
‘উম?’
‘আর কিছু ছিল? চুক্তি চূড়ান্ত, তার প্রমাণ হিসেবে তোমাকে কিছু দেয়নি? সাধারণত লেন-দেনের ক্ষেত্রে এমনটা করা হয়।’
আস্তে আস্তে, এক কদম এক কদম করে এগিয়ে আসছে শকুনের দল; বৃত্তটাকে সঙ্কুচিত করে আনছে। আকাশে দেখা দিল আরও অনেকগুলো কালো বিন্দু, ক্রমশই বাড়ছে আকৃতিতে। মোটকু চার্লির হাত শক্ত করে ধরল স্পাইডার।
‘চোখ বন্ধ করো।’
এবার ঠান্ডাটা একদম ঘুসির মতো আঘাত হানল মোটকু চার্লির পেটে। লম্বা একটা শ্বাস নিতেই মনে হলো, কেউ বুঝি ওর ফুসফুসে বরফ ঢুকিয়ে দিয়েছে। কাশতে কাশতে উবু হয়ে গেল বেচারা, এদিকে বাতাস তখন প্রকাণ্ড কোনো দানবের মতো গর্জন করে চলেছে।
চোখ খুলল সে। ‘এবার কোথায় এসে পড়েছি, তা জানতে পারি?’
‘অ্যান্টার্কটিকা,’ জবাব দিল স্পাইডার। লেদার জ্যাকেটের জিপ টেনে দিল সে, যদিও মনে হলো না ঠান্ডা তার ওপর প্রভাব ফেলেছে। ‘একটু ঠান্ডা অবশ্য।’
‘ধূসর কিছু কল্পনা করতে পারো না? সাদা থেকে সরাসরি কালোতে?’
‘এখানে পাখি নেই,’ জানাল স্পাইডার।
‘এরচেয়ে বরং এমন কোনো দালানে বসলে ভালো হতো না, যেখানে
পাখি ঢুকতে পারবে না? দুপুরের খাবারটাও হয়ে যেতো।’
স্পাইডার বলল, ‘আরে! একটু নাহয় ঠান্ডা, তাই বলে এত গরম হচ্ছ কেন?’
‘একটু না, শূন্যের নিচে পঞ্চাশ ডিগ্রি হবে। যাই হোক, দেখো।’
আকাশের দিকে ইঙ্গিত করল মোটকু চার্লি। একটা ধূসর রেখা, অনেকটা ইংরেজি এম অক্ষমের মতো, দেখা দিয়েছে আকাশে। ঠান্ডা বাতাসে নিশ্চল হয়ে ভেসে আছে বলা চলে। ‘অ্যালবাট্রস,’ বলল সে।
‘ফ্রিগেট,’ বলল স্পাইডার।
‘কী?’
‘ওটা অ্যালবাট্রস না, ফ্রিগেট। সম্ভবত এখনও আমাদেরকে দেখেনি।’
‘তা হতে পারে,’ মেনে নিলো মোটকু চার্লি। ‘তবে ওগুলো দেখেছে।’ ঘুরে দাঁড়াল স্পাইডার, কিছু একটা বলল যা শুনে ‘ফ্রিগেট’-এর কাছাকাছি কিছু একটা বলে মনে হলো। প্রায় এক মিলিয়ন পেঙ্গুইন দুলতে দুলতে এগোচ্ছে দুই ভাইয়ের দিকে। অন্তত দেখে সংখ্যাটা সেটাই মনে হলো। প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে, পেঙ্গুইনদের আসতে দেখলে ভয় পাওয়ার কথা কেবল ছোট্ট মাছের; কিন্তু ঝাঁকটা এত বড়ো হলে…
… প্রচণ্ড ঠান্ডা লাগা সত্ত্বেও মোটকু চার্লি হাত বাড়াল স্পাইডারের দিকে, তারপর বন্ধ করে ফেলল চোখ।
এরপর যখন খুলল, তখন নিজেকে আবিষ্কার করল খানিকটা উষ্ণ আবহাওয়ায়; যদিও চোখ খুলে আলাদা কিছু দেখতে পেল না। সব কিছুই মেখে আছে রাতের রং। ‘অন্ধ হয়ে গেলাম নাকি?’
‘পরিত্যক্ত একটা কয়লা খনিতে আছি আমরা এখন,’ জানাল স্পাইডার। ‘কয়েক বছর আগে একটা ম্যাগাজিনে ছবি দেখেছিলাম। অন্ধ ফিঞ্চের দল যদি কয়লার টুকরো খাওয়ার অভ্যাস করে এখানে ডেরা না বাঁধে, তাহলে আমাদের কোনো অসুবিধে হবে না।’
‘ঠাট্টা করলে? অন্ধ ফিঞ্চ?’
‘তা বলা যায়।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মোটকু চার্লি, ভূগর্ভস্থ খনির এপাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত শোনা গেল সেই আওয়াজ। ‘সত্যি বলতে কী,’ বলল সে। ‘যদি আমার কথা শুনে তখনই চলে যেতে, তাহলে এই ঝামেলায় পড়তে হতো না আমাদেরকে।’
‘এখন আর সে কথা বলে কী লাভ?’
‘এত কিছু হবে, তা তো তখন বুঝিনি। খোদাই জানে, রোজিকে এসব কীভাবে বোঝাব!’
গলা খাঁকারি দিল স্পাইডার। ‘সেই দুশ্চিন্তা বোধহয় আর করতে হবে না।’
‘কেন? হবে না কেন?’
‘ও আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছে।’
অনেকক্ষণ নীরবতার পর মোটকু চার্লি বলল, ‘তা তো করবেই।’
‘পরিস্থিতি ওই অংশটায় আমিই গোলমাল পাকিয়েছি,’ অস্বস্তি ভরা কণ্ঠে বলল স্পাইডার।
‘আমি বুঝিয়ে বললে কাজ হবে না? মানে, যদি বলি যে আসলে তুমি আমি হবার ভান ধরেছিলে–’
‘তা বলেছি তো। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমাদের কারও সঙ্গেই সে
দেখা করতে চায় না।’
‘আমার সঙ্গেও না?’
‘সেটাই তো বলল।’
‘দেখো,’ অন্ধকারে শুধু স্পাইডারের কণ্ঠ শোনা গেল। ‘আমার কখনও ইচ্ছে ছিল না তোমাকে…মানে যখন দেখতে এসেছিলাম, তখন শুধু হাই- হ্যালো বলার ইচ্ছেই ছিল। কিন্তু, মানে, এত কিছু যে হয়ে যাবে তা কখনও ভাবিনি!’
‘দুঃখ প্রকাশ করতে চাচ্ছ?’
নীরবতা। তারপর, ‘সম্ভবত…হ্যাঁ।’
আরও খানিকক্ষণের নীরবতা। মোটকু চার্লি বলল, ‘তাহলে আমি দুঃখিত, পাখি-মানবীকে তোমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছিলাম বলে।’ একে-অন্যকে দেখতে পাচ্ছে না বলে, কথা বলাটা তুলনামূলক সহজ হয়ে গেছে।
‘হুম, ধন্যবাদ। এখন ওকে ভাগাতে পারলে বাঁচি!’
‘একটা পালক!’ আচমকা চেঁচিয়ে উঠল মোটকু চার্লি।
‘কী? বুঝতে পারলাম না।’
‘জিজ্ঞেস করেছিলে না, চুক্তি চূড়ান্ত বোঝাতে আমাকে সে কিছু দিয়েছিল নাকি? দিয়েছিল, একটা পালক।’
‘সেটা কই?’
মনে করতে চাইল মোটকু চার্লি। ‘খেয়াল করতে পারছি না। মিসেস ডানউইডির বসার ঘরে যখন ঘুম থেকে উঠি তখন হাতেই ছিল। কিন্তু বিমানে যখন চড়ি, তখন সঙ্গে ছিল না। মহিলার বাড়িতেই থাকার কথা।’
এরপরের নীরবতাটুকু যেমন লম্বা, তেমনি অন্ধকার আর স্থির। মোটকু চার্লি তো ভয়ই পেয়ে গেল, ভাবল: স্পাইডার চলে যায়নি তো? হয়তো অন্ধকার এই ভূগর্ভস্থ জায়গায় ফেলে গেছে ওকে। অবশেষে বলল, ‘এখনও আছ?’
‘আছি।’
‘শান্তি পেলাম। এখানে যদি ফেলে যাও, তাহলে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। বেরোবার পথ খুঁজে পাবো না।’
‘পাগলকে সাঁকো নাড়াতে বলতে হয় না!’
আবারও নীরবতা।
‘আমরা কোন দেশে আছি?’ জানতে চাইল মোটকু চার্লি।
‘পোল্যান্ডে…খুব সম্ভবত। যা বলেছিলাম, ছবি দেখেছিলাম শুধু আগে।
তবে সেই ছবিতে বাতি জ্বলছিল।’
‘কোথাও যাওয়ার দরকার হলে, তার ছবি দেখতে হয় তোমাকে?’
‘জায়গাটা কোথায়, তা আমার জানতে হয়।’
খনির ভেতরটা কী পরিমাণ নীরব, ভাবল মোটকু চার্লি, তা আসলেই বিস্ময়কর। বিশেষ একধরনের নীরবতা জমে আছে এখানে। নীরবতা নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিল সে। কবরস্থানের নীরবতার সঙ্গে কি মহাবিশ্বের নীরবতার পার্থক্য আছে?
বলল স্পাইডার। ‘মিসেস ডান উইডির কথা আমার মনে আছে। ধুনোর গন্ধ পাওয়া যায় তার কাছ থেকে।’ কিন্তু হতাশা ভরা কণ্ঠে। আর আশা নেই, মরতে আমাদের হবেই–এই কথা বলার সময়ও বক্তার কণ্ঠে আগ্রহ বেশি থাকে।
‘হ্যাঁ, সে-ই।’ বলল মোটকু চার্লি। ‘ছোটোখাটো, পাহাড়ের মতো বয়স্কা। চোখে পুরু কাচের চশমা থাকে। তার কাছে গিয়ে পালকটা নিয়ে আসতে হবে আরকী। তারপর সেটা তুলে দেব পাখি-মানবীকে, এই দুঃস্বপ্নের একটা ইতি টানা যাবে।’ বোতলের পানির শেষটুকুও গলাধকরণ করল মোটকু চার্লি, ইতালির সেই বাজার থেকে এই পর্যন্ত বয়ে এনেছে ওটাকে। বোতলের মুখ লাগিয়ে, খালি বোতলটাকে অন্ধকারেই ফেলে দিল; ভাবল: কেউ যদি না দেখে, তাহলে যত্র-তত্র ময়লা ফেলাটাকে কি অপরাধ বলা চলে? ‘তাই হাতে হাত ধরে চলো মিসেস ডানউইডির সঙ্গে দেখা করতে যাই।’
আওয়াজ করল স্পাইডার, যদিও সেটাকে খুব একটা বীরোচিত মনে হলো না। বরঞ্চ ছেলেটার অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তাই পরিষ্কার হলো তাতে। অন্ধকারে কল্পনা করল মোটকু চার্লি, স্পাইডার ধীরে ধীরে চুপসে যাচ্ছে…অনেকটা বুলফ্রগ কিংবা এক হপ্তা আগে ফোলানো বেলুনের মতো। স্পাইডারের উচিত শিক্ষা দেখার অপেক্ষায় ছিল মোটকু চার্লি, কিন্তু ওর কাছ থেকে ছয় বছর বয়সী ভীত বাচ্চার মতো আচরণ পাওয়ার আশা করেনি। ‘দাঁড়াও, দাঁড়াও। মিসেস ডানউইডিকে ডরাও নাকি?’
‘তা-তার কাছে যাওয়ার সাহস হয় না।’
‘অন্তত এই একটা ব্যাপার ভালো লাগল। আমিও তাকে ভয় পাই! পাই মানে পেতাম, সেই কম বয়সে। পরে আবার দেখা হলো শেষকৃত্যানুষ্ঠানে, তখন আর তাকে অতটা ভয়ংকর লাগেনি। মানে আগের মতো না। তিনি বয়স্কা এক নারী বাদে আর কিছু না।’ মনের চোখে দেখতে পেল, মহিলা পেঙ্গুইনের মতো দেখতে কালো মোমবাতি জ্বালাচ্ছে। ‘খানিকটা অন্যরকমও। তবে তার সঙ্গে দেখা হলে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।’
‘আমাকে তিনিই তাড়িয়ে দিয়েছিলেন,’ বলল স্পাইডার। ‘আমি যেতে চাইনি। তার বাগানে বল ফেলেছিলাম, ক্রিসমাসের গাছ সাজাবার অলংকারের মতো বড়ো ছিল ওটা।’
‘আমি করেছিলাম কাজটা, মহিলা খেপে গেছিল!’
‘জানি আমি,’ অন্ধকার থেকে ভেসে আসা কণ্ঠটার মালিককে দুর্বল আর বিভ্রান্ত বলে মনে হলো। ‘একই সময়ের কথা বলছি আমরা… সব কিছুর শুরু ওখান থেকেই।’
‘দেখো, কাজটা করা মানে তো আর দুনিয়া ধ্বংস হওয়া না। ফ্লোরিডাতে নিয়ে যাবে আমাকে, আমিই নাহয় মিসেস ডানউইডির কাছ থেকে পালকটাকে ফিরিয়ে আনব। তাকে আমি ভয় পাই না, তোমার ধারে-কাছে যাওয়ার দরকার নেই।
‘পারব না। তিনি যেখানে আছেন, সেখানে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।’
‘মানে কী? কী বলতে চাচ্ছ? জাদুর রেস্ট্রেইনিং অর্ডারের[২৬] ব্যবস্থা করেছে নাকি তোমার নামে?’
[২৬. আদালত-কর্তৃক প্রদত্ত নিষেধাজ্ঞা, যার কারণে কারও কাছ থেকে নির্দিষ্ট দূরত্বে থাকতে হয়।]
‘অনেকটা তেমনই, হ্যাঁ।’ জানাল স্পাইডার। তারপর যোগ করল, ‘রোজির অভাব খুব করে বোধ করছি। ওই ব্যাপারটা নিয়ে আমি দুঃখিত। আশা করি তুমি তা জানো।’
রোজির কথা ভাবল মোটকু চার্লি। মেয়েটার চেহারা মনে করতেই বেগ পেতে হচ্ছে ওকে। রোজির মাকে নিজের শাশুড়ি হিসেবে না ভাবার আপ্রাণ চেষ্টা চালাল সে। ভুলতে চাইল পর্দায় দেখা দুটো অবয়বের এক হয়ে যাওয়ার দৃশ্যটাকেও। বলল, ‘মন খারাপ করে লাভ কী? অবশ্য চাইলে করতে পারো, কেননা আস্ত একটা হারামির মতো আচরণ করেছ! তবে হয়তো সেটাই সবার জন্য ভালো হয়েছে।’ মোটকু চার্লির অন্তরের একটা অংশ খানিকটা মোচড় খেল বটে, তবে জানে যে কথাটা মিথ্যে বলেনি। অন্ধকারে সত্যি কথাটা বলে ফেলা সহজ।
স্পাইডার বলল, ‘একটা জিনিস পরিষ্কার ধরতে পারছি না। সেটা কী, জানো?’
‘সব কিছু?’
‘নাহ, একটা বিশেষ ব্যাপার। পাখি-মানবী কেন যোগ দিল এসবে, সেটাই বুঝতে পারছি না।’
‘বাবার কারণে খেপে ছিল—’
‘বাবার ওপর সবাই খেপা ছিল। কিন্তু কারণ সেটা না। যদি আমাদেরকে খুন করার ইচ্ছেই ওদের থাকে, তাহলে সরাসরি সেই চেষ্টা কেন করছে না?’
‘ওকে আনানসির বংশধর আমিই দিয়েছি।’
‘সে তো বললেই। কিন্তু এখানে কোনো কিন্তু আছে, যেটা আমি ধরতে পারছি না।’ খানিকক্ষণের নীরবতার পর যোগ করল, ‘আমার হাত ধরো।’
‘চোখ বন্ধ করতে হবে?’
‘করলেই তো ভালো হয়।’
‘এবার কই যাচ্ছি? চাঁদে?’
‘নিরাপদ কোথাও নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে,’ জানাল স্পাইডার।
‘ভালো,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘নিরাপত্তা আমার পছন্দ। কিন্তু কোথায়?’ কিন্তু পরক্ষণেই, চোখ না খুলেই মোটকু চার্লি জেনে গেল সেই প্রশ্নের উত্তর। গন্ধেই পরিষ্কার হয়ে গেল সব: আধোয়া দেহ আর ফ্ল্যাশ না করা টয়লেট, জীবাণুনাশক, পুরাতন কম্বল আর ঔদাসীন্য।
‘বিলাসবহুল হোটেলের কামরাতেও আমি সমান নিরাপত্তা পেতাম।’ উচ্চকণ্ঠে আপত্তি জানাল সে। কিন্তু ওর কথা শোনার মতো কেউ যে নেই আশপাশে! ছয় নম্বর সেলের শেলফের মতো বিছানায় বসে পড়ল সে, হালকা কম্বলটা দিয়ে কাঁধ জড়াল। এখান থেকে যে খানিকক্ষণের জন্য চলে গিয়েছিল তা বোঝার কোনো উপায়ই নেই!
আধ-ঘণ্টা পর, একজন এসে ওকে জিজ্ঞাসাবাদের কামরায় নিয়ে গেল।
.
‘হ্যালো,’ বলল ডেইজি, হাসিমুখে। ‘চা দিতে বলব?’
‘দরকার কী? আর এত কষ্ট না করলেও চলবে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘টেলিভিশন আমি কম দেখি না। কীভাবে কী করা হয়, তাও জানি। ভালো- কপ আর খারাপ-কপের নাটক তো? তুমি আমাকে চা দেবে, দেবে কেক; তারপর বড়োসড়ো কোনো রুক্ষ স্বভাবের পুলিস এসে আমাকে চেঁচিয়ে ভয় দেখাবে; তারপর চা ঢেলে ফেলে আমার কেক নিজের মুখে পুরে ভাব করবে মারার। তুমি তখন তাকে থামাবে, ফিরিয়ে দেবে চা-কেক। কৃতজ্ঞতাবশত আমি তোমার সব প্রশ্নের জবাব দিতে থাকব!’
‘সেসব নাহয় অন্য কোনো দিনের জন্য তোলা থাক,’ বলল ডেইজি। ‘আমরা যা জানতে চাই, সরাসরি বলে দাও সব। তাছাড়া চা থাকলেও, কেক নেই আমাদের কাছে।’
‘যা আমার জানা আছে, সব বলে দিয়েছি আগেই,’ জানাল মোটকু চার্লি ‘শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। আমাকে দুই হাজার পাউন্ডের একটা চেক দিয়ে গ্রাহাম কোটস দুই হপ্তার ছুটি দিয়ে দেয়। বলেছিল, লেনদেন-সংক্রান্ত কিছু ঘাপলা তাকে দেখিয়েছি বলে সে খুশি। তারপর আমার পাসওয়ার্ড জানতে চাইল। বলে দিতেই বিদেয় জানাল আমাকে। গল্প শেষ।’
‘মেইভ লিভিংস্টোনের অন্তর্ধানের ব্যাপারে কিচ্ছু জানো না—এই দাবি এখনও করে যাচ্ছ?’
‘আমার সঙ্গে আসলে তার কখনও ঠিকঠাক মতো দেখাই হয়নি। একবার বোধহয় অফিসে এসেছিল, ব্যস। ফোনে কয়েকবার কথা-বার্তা হয়েছে। তিনি গ্রাহাম কোর্টসের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে আমাকে বলতে হবে, ডাকে আছে চেক–বসের নির্দেশ এটাই ছিল।’
‘কথাটা কি সত্যি?’
‘জানি না। তখন ভাবতাম যে সত্যি। আচ্ছা, তুমি কি আসলেই বিশ্বাস করো যে তার অন্তর্ধানে আমার হাত আছে?’
‘না,’ আনন্দচিত্তে বলল মেয়েটা। ‘তা আমি মনে করি না।’
‘কারণ আমি আসলেই জানি যে কেন—কী বললে?’
‘আমার মনে হয় না মেইভ লিভিংস্টোনের পেছনে তোমার হাত আছে। দ্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সির অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার কারণও তুমি বলে আমি বিশ্বাস করি না, যদিও অনেকে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তোমাকে ফাঁসাবার জন্য। তবে হিসেব রক্ষণের অদ্ভুত ধরন আর টাকা অন্য অ্যাকাউন্টে সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া তোমার ওখানে চাকরি নেবার আগে থেকেই বলবত আছে। আর তোমার চাকরির বয়েস তো ঠিক দুই বছরও হয়নি!’
‘প্রায় দুই বছরই।’ জানাল মোটকু চার্লি। টের পেল হাঁ হয়ে আছে চোয়াল, তাই বন্ধ করে দিল।
ডেইজি বলল, ‘বই আর মুভিতে যে পুলিসকে দেখানো হয় তারা যে মূলত বলদ—তা আমি জানি; বিশেষ করে যদি তাতে অপরাধের সঙ্গে লড়াই করা কোনো নায়ক কিংবা রুক্ষ স্বভাবের গোয়েন্দা থাকে তো। কেক-টেক নেই, সেজন্য অন্তর থেকে ক্ষমা চাইছি। তবে একটা কথা জেনে রাখো, আমরা একেবারে কাঠ-বলদ নই!’
‘সে কথা তো আমি বলিনি,’ আপত্তি জানাল মোটকু চার্লি।
‘বলোনি,’ বলল মেয়েটা। ‘তবে ভাবছিলে তো। তুমি মুক্ত, চাইলে চলে যেতে পারো। এমনকী চাইলে আমরা ক্ষমা প্রার্থনাও করব।’
‘কিন্তু ভদ্রমহিলা, মানে, গেছেন কই?’ মোটকু চার্লি জানতে চাইল।
‘মিসেস লিভিংস্টোন? শেষ তাকে দেখা গেছে গ্রাহাম কোটসের সঙ্গে অফিসে ঢুকতে।’
‘আহ।’
‘চায়ের প্রস্তাব কিন্তু সত্যি সত্যি দিয়েছি। পান করবে?’
‘অবশ্যই, খুশি মনে। উম, গ্রাহাম কোটসের অফিসে যে গোপন কামরাটা আছে, ওখানে খুঁজেছ তো? বুককেসের পেছনের কামরাটা?’
ডেইজি নিজের ওপর পরম নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ রেখে শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘মনে হয় না খুঁজে দেখেছে।’
‘অবশ্য কারও ওটার খোঁজ জানারও কথা না,’ মোটকু চার্লি জানাল। ‘তবে আমি একবার গেছিলাম অফিসে। দেখি—বুককেসটা পেছনে সরানো, ভেতরে আছে গ্রাহাম কোটস। দেখেই বেরিয়ে আসি,’ যোগ করল সে। তার ওপর নজর রাখছিলাম না কিন্তু।’
ডেইজি জানাল, ‘যাওয়ার পথে কেক কিনে নেওয়া যাবে।’
.
মোটকু চার্লি বুঝতে পারছে না, স্বাধীনতা ওর পছন্দ হচ্ছে কি না। চারপাশে এত খোলা জায়গা ঠিক হজম করতে পারছে না।
‘ঠিক আছ?’ জিজ্ঞেস করল ডেইজি।
‘আছি।’
‘একটু তটস্থ মনে হচ্ছে।’
‘তা একটু আছি। শুনলে হাসবে কিন্তু আমি–আসলে পক্ষীকুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না।’
‘মানে? ফোবিয়া?’
‘অনেকটা তেমনিই।’
‘পাখিদের প্রতি অযৌক্তিক ভয়ের নাম তো ওটাই।’
‘যৌক্তিক ভয় হলে, তাকে কী নামে ডাকা হতো?’ কেকে কামড় বসাল সে।
ক্ষণিক নীরবতার পর ডেইজি বলল, ‘যাই হোক, এই গাড়িতে পাখি-টাখি নেই।’
দ্য গ্রাহাম কোটস এজেন্সির ঠিক বাইরের জোড়া হলদে লাইনে গাড়ি পার্ক করল মেয়েটা, তারপর মোটকু চার্লিকে সঙ্গে নিয়ে পা রাখল অফিসে।
.
একটা কোরিয়ান ক্রুজ শিপের[২৭] অ্যাফট ডেকে রোদ পোহাচ্ছে রোজি। চেহারা ঢেকে রেখেছে ম্যাগাজিন দিয়ে, পাশেই শুয়ে আছে তার মা। মনে করতে চাইছে মেয়েটা, মায়ের সঙ্গে ছুটি কাটাতে আসার এই বুদ্ধিটা কেন ভালো মনে হয়েছিল?
[২৭. কদিন আগেও জাহাজটার নাম ছিল দ্য সানি আর্কিপেলাগো, কিন্তু যাত্রী ও কর্মীদের মধ্যে আচমকা উদরাময় দেখা দেওয়ায় তা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার মুখরোচক খবরে পরিণত হয়। নামের আদ্যক্ষর (ইংরেজিতে এস আর এ) ঠিক রেখে নতুনভাবে জাহাজটাকে পানিতে নামার সিদ্ধান্ত নেয় বোর্ডের চেয়ারম্যান। কিন্তু নিজেকে সে ইংরেজির জাহাজ মনে করলেও, আসলে তার ইংরেজি জ্ঞান খুবই খারাপ। তাই নতুন ভাবে জাহাজের নাম হয়: দ্য স্কুইক অ্যাটাক (লেখক)।]
ক্রুজ শিপে ইংরেজি খবরের কাগজ নেই, অবশ্য রোজি সেগুলোর অভাবও বোধ করছে না। কিন্তু বাকি সব কিছুর অভাব খুব করে বোধ করছে। রোজির কাছে ক্রুজটা আসলে পানিতে ভাসতে থাকা পারগেটরির[২৮] মতো, একদিন পরপর দ্বীপে পা রাখতে হয় বলে কোনোক্রমে সহ্য করতে পারছে।
[২৮. ক্যাথলিক ধর্মমত অনুসারে, আত্মাকে স্বর্গে প্রবেশের আগে যে স্থান দিয়ে অতিক্রম করতে হয়।]
অন্যান্য যাত্রীরা দ্বীপে গিয়ে এটা-সেটা কেনাকাটা করে, আর উপভোগ করে প্যারাসেইলিং। কেউ কেউ হয়তো ভাসমান জলদস্যু জাহাজে চড়ে পানিতেও ভাসে। রোজি অবশ্য সেসব না করে হাঁটতে বেরোয়, কথা বলে মানুষের সঙ্গে। দেখতে পায় মানুষের কষ্ট, তাদের ক্ষুধা আর দুর্ভোগ। তাদেরকে সাহায্য করতে চায় সে, ওর কাছে সবই সমাধান করার মতো সমস্যা…
…শুধু দরকার এমন একজনকে, যে আগ্রহের সঙ্গে সেটা করার দায়িত্ব নেবে।
.
মরণকে অনেক বিশেষণেই ভূষিত করা যায়…অন্তত মেইভ লিভিংস্টোনের সেটাই মত। কিন্তু বিরক্তিকর তাদের মধ্যে নেই। অথচ বিরক্তি পেয়ে বসেছে তাকে। দেওয়াল ভেদ করে হাঁটতে হাঁটতে তিনি বিরক্ত, সবাই অগ্রাহ্য করছে বলে বিরক্ত…তবে সবচাইতে বেশি বিরক্ত, অলডউইচের এই অফিস বিল্ডিঙটা থেকে বেরোতে না পেরে।
‘ভূত হয়ে যদি কোথাও আছর করতেই হয়,’ রিসেপশনিস্টকে বলল সে। ‘তাহলে সমারসেট হাউজে কেন না? রাস্তার ওপাশেই তো! দালানটাও সুন্দর, থেমসের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায়। নকশার দিক থেকেও বেশ দারুণ। কয়েকটা ভালো, ছোটো রেস্তোরাঁও আছে। খাবার খাওয়ার দরকার না পড়লেও, অন্যকে খেতে দেখতে খারাপ লাগে না।’
রিসেপশনিস্ট অ্যানি, যার একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্রাহাম কোটস উধাও হবার পর ফোন ধরে ‘আমি দুঃখিত, জানা নেই’ বলে সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া, এবং ফাঁকা সময়ে উত্তেজিত, নিচু কণ্ঠে বন্ধু-বান্ধবদের ফোন দিয়ে এই রহস্য নিয়ে কথা বলা, মেইভের কথার পিঠে কিছু বলল না; অবশ্য মহিলার আগে বলা কোনো কথারও জবাব দেয়নি মেয়েটা।
একঘেয়েমিতে ছেদ পড়ল মোটকু চার্লি ন্যান্সির আগমনে, সঙ্গে এসেছে সেই নারী-পুলিস অফিসার। ছেলেটাকে পছন্দই হয়েছে মেইভের। যদিও তার একমাত্র কাজ ছিল, ডাকযোগে অচিরেই চেক এসে পৌঁছাবে—এ কথা বারবার মেইভকে জানানো। তবে এখন এমন অনেক কিছুই দেখতে পাচ্ছে মহিলা যা আগে দেখেনি: মোটকু চার্লির ওপর কীসের যেন ছায়া পড়েছে, খানিকটা দূরে দূরে থেকে অনুসরণ করছে ওকে; নিশ্চয়ই বাজে কিছু অপেক্ষা করছে ওর জন্য। মনে হচ্ছে যেন কিছু একটা থেকে পালাচ্ছে ছেলেটা; ব্যাপারটা মেইভকে চিন্তায় ফেলে দিল।
গ্রাহাম কোটসের অফিসে চলে এলো সে ওদের পিছুপিছু, মোটকু চার্লিকে সরাসরি গোপন কামরার দিকে এগোতে দেখে খুশি হয়ে গেল সে।
‘গোপন প্যানেলটা কই?’ জিজ্ঞেস করল ডেইজি।
‘প্যানেল না, দরজা। ওই বুকশেলফের পেছনেই আছে। কিন্তু কীভাবে খুলতে হয়, তা জানি না। গোপন কোনো বোতাম-টোতাম থাকতে পারে।’
বইয়ের তাকের দিকে তাকাল ডেইজি। ‘গ্রাহাম কোটস কখনও আত্মজীবনী লিখেছিল?
‘আমার জানামতে তো লেখেনি।’
হাত বাড়িয়ে আমার জীবন, গ্রাহাম কোটস নামধারী বইটায় চাপ দিল ডেইজি, সঙ্গে সঙ্গে দেওয়াল থেকে সরে গেল বুকশেলফ; তার পেছন থেকে উঁকি দিল একটা তালাবন্ধ দরজা।
‘আমাদের একটা তালা-চাবিঅলা দরকার, জানাল মেয়েটা। ‘তোমাকে আর এখানে থাকতে হবে না, মি. ন্যান্সি।’
‘ঠিক আছে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘অভিজ্ঞতাটা,’ বলল সে। ‘অবিস্মরণীয়!’ তারপর যোগ করল। ‘আশা করি…আমার সঙ্গে… কোনো একদিন…খেতে যেতে আপত্তি নেই?’
‘নাহ, নেই,’ জবাব দিল মেয়েটা। ‘রবিবার দুপুরে, ডিম সামের[২৯] লাঞ্চে যাওয়া যায়। সাড়ে এগারোটার দিকে দরজা খোলে, তখনই উপস্থিত থাকতে হবে। নইলে বিশাল লম্বা লাইনে পড়ে যাবো।’ রেস্তোরাঁর ঠিকানা লিখে মোটকু চার্লিকে দিল মেয়েটা। ‘বাড়ি ফেরার পথে, পাখি থেকে সাবধান!’ বলল সে।
[২৯. চাইনিজ ডিশ যা নাস্তায় আর দুপুরে খাওয়া হয়।]
‘তা থাকব,’ জবাব দিল ছেলেটা। ‘তাহলে রবিবার দেখা হচ্ছে।’
.
কালো কাপড়ের একটা ওয়ালেটের ভাঁজ খুলে, বেশ কয়েকটা পাতলা ও ধাতব যন্ত্র বের করে আনল তালা-চাবিঅলা।
‘মানুষ আসলে এত্ত বোকা যে কী বলব,’ শুরু করল সে। ‘এতদিনে তো শিক্ষা হওয়া উচিত। ভালো তালার দাম তো এতো বেশি না! এটার কথাই ধরুন। দরজাটা দেখুন না, ভালো জিনিস। একেবারে নিরেট। ব্লো-টর্চ নিয়ে কাজে নামলেও কমপক্ষে আধা দিন লেগে যাবে ফুটো করতেই। কিন্তু তালা লাগিয়েছে এমন একটা যেটা পাঁচ বছর বয়সী শিশুই খুলে ফেলতে পারবে একটা চামচ ব্যবহার করে…যাক গে, কাজ শেষ…একেবারে জলবৎ তরলং!’
দরজা ধরে টান দিল লোকটা। ওটা খুলে যেতেই ভেতরের দৃশ্যটা দেখে চমকে গেল সবাই।
‘হায়রে কপাল,’ বলল মেইভ লিভিংস্টোন। ‘ওটা আমি হতেই পারি না।’ ভেবেছিল, নিজের দেহের প্রতি আরেকটু হলেও ভালোবাসা থাকবে; কিন্তু তা নেই। বরঞ্চ মেঝের লাশটা দেখে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা মৃত প্রাণির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে তার।
কামরাটা অচিরেই ভরে উঠল মানুষে। মেইভ আগে কখনওই ডিটেকটিভ ড্রামা দেখত না, ধৈর্যেই কুলাতো না। এখনও দ্রুত বিরক্ত হয়ে গেল। তবে আগ্রহের সঙ্গে আবিষ্কার করল, নীলচে ব্যাগে ভরে যখন তার লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন তার প্রতি নিঃসন্দেহে একটা টান অনুভব করছে…
… মনের টান না, আক্ষরিক অর্থেই টের পাচ্ছে ওটার টান।
‘এই না হলে কথা,’ বলল মেইভ লিভিংস্টোন।
ঝট করে চলে এলো বাইরে।
অন্তত অলডউইচের অফিসটা থেকে তো বেরোতে পারল!
ভূত হবারও যে একটা আইন কিংবা নিয়মনীতি আছে, তা জানে সে। জানে না শুধু ওই নিয়মগুলো!
বেঁচে থাকতে ধর্ম-কর্মে আরেকটু মন দিলে মন্দ হতো না, ভাবল সে; কিন্তু কেন যেন তা করে ওঠা হয়নি। যখন বয়েস কম ছিল, তখন এমন খোদায় বিশ্বাস করতে মন চায়নি যিনি সবাইকে এতটাই অপছন্দ করেন যে অনন্তকালের জন্য নরকে ভরে দেবেন। আবার বড়ো হবার পর দেখা গেল, অবিশ্বাসটুকু আরও কঠোর হয়ে গেছে—ধরেই নিয়েছিল জীবন-মৃত্যু ছাড়া আর কিছু নেই; বাকি সব কিছুই কল্পনা। এই অবিশ্বাসের ব্যাপারটা নিজেকে সামলে রাখতে সাহায্য করেছিল তাকে, কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে…
অবশ্য, একেবারে সঠিক চার্চে সারাজীবন ঘড়ি ধরে আর নিয়ম মেনে গেলেও এই অভিজ্ঞতার জন্য সে প্রস্তুত হতে পারত কি না, তাতে সন্দেহ আছে। মেইভের ক্রমশই মনে হচ্ছে: বিশ্বটার গোছানো হওয়া উচিত; আর জীবনের পরের জীবনটাকে হতে হবে খরুচে একটা বিলাসবহুল ছুটির মতো। একেবারে শুরুতেই হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে টিকেট, ডিসকাউন্ট ভাউচার, শিডিউল আর অনেকগুলো ফোন নম্বর; কোনো ধরনের ঝামেলায় পড়লেই যেন তাতে ফোন দেওয়া যায়।
হাঁটে না মহিলা, আবার ওড়েও না। অনেকটা বাতাসের মতো যায় একস্থান থেকে অন্যস্থানে; শরতের শীতল বাতাস প্রবাহিত হবার সময় যেমন মানুষকে কাঁপিয়ে তোলে, তার অবস্থাও অনেকটা তেমনি।
লন্ডনে পা রাখলেই সবার প্রথমে যেখানে যায়, সেখানেই গেল ভদ্রমহিলা: অক্সফোর্ড স্ট্রিটের সেলফ্রিজেস নামের দোকানটায়। ওখানকার কসমেটিকস ডিপার্টমেন্টে কাজ করেছে সে, অনেক কমবয়সে। সুযোগ পেলেই যেত দোকানে, কিনত দামি কসমেটিকস। কেননা যখন অবস্থা খারাপ ছিল, তখন চাকরি করার সময় কাজটা করার প্রতিজ্ঞা করেছিল নিজের কাছেই।
একঘেয়েমি জন্ম নেবার আগ পর্যন্ত মেকআপ ডিপার্টমেন্টেই ঘুর ঘুর করল মহিলা, তারপর গেল ঘরোয়া আসবাবের বিভাগে। খাবার ঘরের জন্য আরেকটা টেবিলের দরকার ওর পড়বে না আর কখনও, কিন্তু দেখতে অসুবিধে কী?
এরপর চলে এলো সে হোম এন্টারটেইমেন্ট ডিপার্টমেন্টে; চারপাশে এখন শুধু টেলিভিশন আর টেলিভিশন, নানা আকারের ও নানা আকৃতির। কয়েকটা পর্দায় খবর দেখাচ্ছে। একটা থেকেও আওয়াজ বেরোচ্ছে না, তবে প্রত্যেকটা দখল করে আছে গ্রাহাম কোটসের চেহারা। অপছন্দের বেলুন দ্রুতই ফুলতে শুরু করল তার মাঝে। আচমকা পর্দা থেকে গ্রাহাম কোটসের চেহারা সরে সেটা দখল করে নিলো তার নিজের চেহারা— মরিসের পাশে থাকা অবস্থায়। চিনতে পারল সে ওটাকে। মরিস লিভিংস্টোন, আই প্রিজিউম অনুষ্ঠানের ‘গিভ মি এ ফাইভার অ্যান্ড আই উইল স্নগ ইউ রটেন’ পর্বের একটা অংশ।
ফোনটাকে রিচার্জ করার উপায় পেলে খুশি হতো মেইভ। ফোন যাকেই করুক না কেন, তোলে সেই বিরক্তিকর কণ্ঠের অধিকারী লোকটা। কিন্তু এই মুহূর্তে তাতেও আপত্তি ছিল না ওর। তবে ইচ্ছে হচ্ছে মরিসের সঙ্গে কথা বলার। ও নিশ্চয়ই জানবে, কী করতে হবে! তবে এবার, ভাবল মেইভ। কথা বলতে দেবো ওকে। আর এবার, শুধু শুনব।
‘মেইভ?’
মরিসের চেহারা তাকিয়ে আছে তার দিকে, শত শত টেলিভিশন পর্দা থেকে। এক মুহূর্তের জন্য ভাবল, হয়তো ভুল দেখছে। তারপর ভাবল, হয়তো খবরের অংশ হবে। কিন্তু ওর দিকে উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে আছে লোকটা…পরক্ষণে আবার ডাকল তার নাম ধরে। তখন বুঝতে পারল, ভুল হয়নি ওর।
‘মরিস…?’
বিখ্যাত হাসিটা হাসল মরিস, আশপাশের সবগুলো পর্দা থেকে তার চেহারা তাকাল মেইভের দিকে। ‘হ্যালো, সোনা। এত দেরি করলে কেন, তাই ভাবছিলাম। যাই হোক, এবার চলে এসো।’
‘চলে আসব? কোথায়?’
‘এপাশে, পর্দার ওপারে। যাই হোক, এসো।’ একশো পর্দার ভেতর থেকে হাত বাড়িয়েছে লোকটা।
মেইভ জানত, এখন শুধু নিজের হাত বাড়িয়ে স্বামীর হাতটা ধরলেই হবে। কিন্তু অবাক হয়ে গেল নিজের কথাই শুনে, ‘না, মরিস। এখনই না।’
একশোটা একই রকম দেখতে চেহারায় বিভ্রান্তি খেলে গেল। ‘মেইভ, সোনা। পার্থিব জীবনটাকে পেছনে ফেলে দিতে হবে তোমাকে।’
‘তা তো অবশ্যই। একসময় ফেলে দেবও। কিন্তু যখন সময় হবে তখন।’
‘মেইভ, তুমি মারা গেছ। আর কবে হবে সময়?’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহিলা। ‘এপাশে এখনও করার মতো কিছু কাজ বাকি আছে।’
‘যেমন?’
সোজা খাড়া হলো মেইভ। ‘আসলে,’ বলল সে। ‘এই গ্রাহাম কোর্টস নামের জন্তুটাকে খুঁজে বের করতে চাই আমি। তারপর সেটাই করবো যা…মানে ভূতরা করে। ভয় দেখাবো আরকি।’
অবিশ্বাসের হাসি হাসল মরিস। ‘গ্রাহাম কোটসকে ভয় দেখাতে চাও? কিন্তু কেন?’
‘কারণ,’ জবাব দিল মেইভ। ‘আমার কাজ এখনো শেষ হয়নি।’ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে, চিবুক উঁচু করে তাকাল সে।
মরিস লিভিংস্টোন একসঙ্গে একশো টেলিভিশনের পর্দা থেকে তাকাল ওর দিকে। তারপর মাথা নাড়ল, খানিকটা সম্ভ্রমের সঙ্গে আর অনেকটা অসহিষ্ণুতা মিলিয়ে। মেইভকে বিয়েই করেছে সে তার দৃঢ় মানসিকতার জন্য, ভালোও বাসত সে কারণেই। কিন্তু হায়, যদি অন্তত এই একটা বারের জন্য হলেও স্ত্রীকে কিছু একটা করতে বাধ্য করতে পারত। তা না করে সে বলল, ‘আমি কোথাও যাচ্ছি না, সোনা। তুমি যখন প্রস্তুত, তখন চলে এসো।’
বলেই মিলিয়ে যেতে ধরল লোকটা।
‘মরিস, হারামিটাকে কীভাবে খুঁজে পাবো, সেই ব্যাপারে কোনো বুদ্ধি দিতে পারো?’ জানতে চাইল মহিলা। কিন্তু জবাব দেওয়ার আগেই পর্দা থেকে হারিয়ে গেল তার স্বামী। এখন ওখানে আবহাওয়ার খবর দেখাচ্ছে।
.
ডিম সামের জন্য ডেইজির সঙ্গে দেখা করল মোটকু চার্লি, লন্ডনের ছোট্ট চায়নাটাউনের একটা রেস্তোরাঁয়।
‘দেখে দারুণ লাগছে,’ প্রশংসা করল সে।
‘ধন্যবাদ,’ বলল মেয়েটা। ‘আমার অবশ্য খুবই খারাপ লাগছে। গ্রাহাম কোর্টসের কেসটা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে আমাকে। এখন ব্যাপারটা পুরোদস্তর হত্যা মামলায় পরিণত হয়েছে। এতদিন যে দায়িত্বে ছিলাম, সেটাই বেশি।’
‘তবে একটা কথা সত্যি,’ উজ্জ্বল চেহারা বানিয়ে বলল মোটকু চার্লি। ‘তুমি যদি দায়িত্ব না পেতে, তাহলে আমাকে গ্রেফতার করার আনন্দ তোমার কপালে জুটত না।’
‘তা বটে,’ ঠাট্টা করল মেয়েটা।
‘কোনো সূত্র আছে?’
‘সূত্র থাকলেও,’ বলল মেয়েটা। ‘তোমাকে সে ব্যাপারে কিছুই বলতাম না।’ ওদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়াল একটা ছোট্ট কার্ট, সেখান থেকে খাবার বাছল ডেইজি। ‘এক তত্ত্ব মতে, গ্রাহাম কোটস কোনো একটা ফেরি থেকে লাফ দিয়ে মরেছে। ক্রেডিট কার্ড অনুসারে, ডিপে যাওয়া একটা টিকেট কেটেছিল সে। ওটাই শেষ লেন-দেন।’
‘তোমার কী মনে হয়, সেটা হতে পারে?’
চপস্টিক ব্যবহার করে থালা থেকে একটা ডাম্পলিং তুলে নিলো ডেইজি, মুখে পুড়ে চিবুলো খানিকক্ষণ।
‘না,’ জানাল সে। ‘আমার ধারণা সে এমন কোথাও গেছে যেখানে বন্দি- বিনিময় আইন নেই; সম্ভবত ব্রাজিলেই। মেইভ লিভিংস্টোনকে হয়তো ক্ষণিকের উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে মেরে ফেলেছে, কিন্তু বাকি সব কাজই ছিল গোছানো। টাকা আসত মক্কেলদের অ্যাকাউন্টে, সেখান থেকে প্রথমেই নিজের পনেরো শতাংশ কেটে রাখত ব্যাটা। আরও অনেক টাকা সরাতো অ্যাকাউন্টে ঢোকার পর। বিদেশ থেকে আসা অনেক চেকই খদ্দেরদের অ্যাকাউন্টে ঢোকার সুযোগ পায়নি। তবে বিস্ময়কর ব্যাপারটা হলো: লম্বা সময় ধরে কারও মনে সন্দেহ না জাগিয়ে কাজটা করেছে সে!’
‘রাইস বল’-এ কামড় দিল মোটকু চার্লি, ভেতরে মিষ্টি কিছু একটা দেওয়া। বলল, ‘কোথায় আছে গ্রাহাম কোটস, তা তুমি জানো বলেই মনে হচ্ছে।’
ডাম্পলিং চিবুনো বন্ধ করে দিল ডেইজি।
‘ব্রাজিলে যাবার কথাটা যেভাবে বললে, তা শুনে সেটাই মনে হলো। মানে তুমি জানো, লোকটা ওই দেশে যায়নি।’
‘পুলিসি কাজকর্মের ব্যাপারে তোমাকে কিছু জানানো সম্ভব না, দুঃখিত।’ বলল মেয়েটা। তারপর যোগ করল, ‘তোমার ভাই কেমন আছে?’
‘জানি না। মনে হয় চলে গেছে সে। যখন বাড়িতে যাই, তখন ওর কামরায় কিচ্ছু পাইনি।’
‘ওর কামরা? কিচ্ছু পাওনি? মানে?’
‘ওর জিনিসপত্র। পুরো খালি ছিল কামরাটা। তারপর থেকে আর দেখা হয়নি।’ জেসমিন টি-এর কাঁপে চুমুক দিল মোটকু চার্লি। ‘আশা করি সে ভালোই আছে।’
‘না থাকার কোনো কারণ?’
‘আমার যে ভয়, সেটা ওরও আছে।’
‘পাখির ভয়? ওহ।’ সহানুভূতির ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ডেইজি। আর তোমার বাগদত্তা, আর হবু শাশুড়ি?’
‘উম, বর্তমানে দুটো বিশেষণের একটাও প্রযোজ্য না।’
‘ওহ।’
‘ওরা চলে গেছে।’
‘গ্রেফতার হয়েছিলে বলে?’
‘আমার জানামতে, না।’
চেহারায় সহানুভূতি নিয়ে, পরীর মতো চাইল মেয়েটা। ‘শুনে খারাপই লাগল।’
‘আসলে,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘এই মুহূর্তে আমার চাকরি নেই, প্রেমিকা নেই, আর–তোমার কারণেই— প্রতিবেশীদের বিশ্বাস: আমি ঘাঘু অপরাধী। অনেকে তো আমাকে এড়ানোর জন্য রাস্তার উলটো পাশ দিয়ে হাঁটাহাঁটি করা শুরু করে দিয়েছে! এদিকে আমার খবরের কাগজঅলা অনুরোধ করছে, ওর মেয়ের পেট বাঁধানো লোকটাকে যেন উচিত শিক্ষা দিই!’
‘কী বললে ওকে?’
‘সত্যিটাই। যদিও মনে হয় না আমার কথা সে বিশ্বাস করেছে। এমনকী আমাকে চিজ-অ্যান্ড-অনিয়ন ক্রিস্পস আর পোলো মিন্টসের একটা করে ব্যাগও দিয়েছে। বলেছে, কাজ শেষ করলে, আরও অনেকগুলো ব্যাগ দেবে!’
‘এত ভেবো না তো, সব ঠিক হয়ে যাবে।’
মোটকু চার্লি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ‘কিন্তু অপেক্ষার সময়টাই তো কষ্টকর!’
‘তারপরও,’ বলল ডেইজি। ‘দুনিয়া তো আর ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না।’
বিলটা ভাগাভাগি করে দিল ওরা, ওয়েটার খুচরো পয়সার সঙ্গে এনে দিল দুটো ফরচুন কুকি।
‘তোমারটায় কী লেখা?’ মোটকু চার্লি জানতে চাইল।
‘দিনশেষে অধ্যবসায়েরই জয় হয়,’ পড়ল মেয়েটা। ‘তোমারটায়?’
‘একই কথা,’ ছেলেটা জবাব দিল। ‘অধ্যবসায়ের জয় হোক।’ কাগজটাকে একটা ছোট্ট বলের আকৃতিতে মুচড়িয়ে, ফেলে দিল পকেটে। তারপর ডেইজিকে এগিয়ে দিল লেইচেস্টার স্কয়ার টিউব স্টেশন পর্যন্ত।
‘আজ দেখি তোমার সৌভাগ্যদের দিন।’ বলল ডেইজি।
‘তা কেন?’
‘আশপাশে পাখি-টাখি নেই।’
কথাটা শোনা মাত্র মোটকু চার্লি উপলব্ধি করল, মেয়েটা ভুল বলেনি। কবুতর নেই আশপাশে, নেই কোনো স্টার্লিং পাখি। এমনকী চড়ুইও দেখা যাচ্ছে না। ‘কিন্তু…লেইচেস্টার স্কয়ারে তো সবসময় পাখি থাকে!
‘আজ নেই,’ জানাল মেয়েটা। ‘হয়তো ওরা ব্যস্ত অন্য কোথাও।’
টিউবের কাছে এসে থামল ওরা। একটা মুহূর্তের জন্য মোটকু চার্লির বোকা মন আশা করল— হয়তো মেয়েটা চুমু খাবে ওকে। কিন্তু সেটা করল না ডেইজি, শুধু বলল ‘ভালো থেকো’। আনমনে ওর দিকে হাত নাড়াল মোটকু চার্লি। ওটাকে হাত নাড়ানো না বলে, অনিশ্চিত কোনো ভঙ্গিও বলা চলে! তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল ডেইজি।
লেইচেস্টার স্কয়ার অতিক্রম করে, পিকাডেলি সার্কাসের দিকে হাঁটা ধরল মোটকু চার্লি। পকেট থেকে ফরচুন কুকির কাগজটা বের করে ভাঁজ খুলল। ‘এরোসে দেখা করো’, লেখা আছে ওটায়। তারপাশে হাতে আঁকা একটা কিছু, যেটা তারকা চিহ্ন হতে পারে… আবার মাকড়শাও হতে পারে!
চলতে চলতে আকাশ আর আশপাশের দালানের ওপর নজর বুলালো মোটকু চার্লি। পাখি-টাখির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না, ব্যাপারটা অদ্ভুতই। লন্ডনে সাধারণত পাখির কোনো অভাব হয় না। সবসময় থাকেই।
স্ট্যাচুর নিচে বসে আছে স্পাইডার, পড়ছে নিউজ অভ দ্য ওয়ার্ল্ড। মোটকু চার্লিকে আসতে দেখে সে চোখ তুলে চাইল।
‘এই মূর্তি আসলে এরোসের না,’ ভাইকে জানালো মোটকু চার্লি। ‘খ্রিষ্টান দানশীলতার সম্মানে বানানো হয়েছিল।’
‘তাহলে মূর্তি ন্যাংটো কেন? আর হাতেই বা তির-ধনুক ধরে আছে কেন? এর মাঝে দানশীলতার কিছু আছে, না আছে খ্রিষ্টানত্বের।’
‘যা পড়েছি, তাই বললাম,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘কোথায় ছিলে তুমি? আমি তো দুশ্চিন্তায় পরে গেছিলাম!’
‘আমি ঠিক আছি, পাখির দঙ্গল এড়াতে চাইছি আরকী। বুঝতে চাইছি, আসলে এখানে হচ্ছেটা কী?’
‘আজ যে কোথাও পাখির প-ও দেখা যাচ্ছে না, সেটা টের পেয়েছ?’
‘পেয়েছি। জানি না, কেন। তবে ভাবছিলাম বসে বসে। হয়তো তুমিও বুঝতে পারছ,’ স্পাইডার বলল। ‘এখানে কোনো কিন্তু আছে?’
‘পুরো ব্যাপারটাই একটা বড়ো কিন্তু!’
‘নাহ, মানে বোঝাতে চাইছি—ওই পাখি-মানবী যে আমাদের ক্ষতি করতে চাইছে, তার পেছনে কোনো ভিন্ন কারণ আছে।’
‘হুম। কাজটা একেবারেই অনুচিত হয়েছে। কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে?’
‘অনুচিত বোঝাচ্ছি না। বোঝাতে চাচ্ছি—নিজেই ভেবে দেখো। হিচককের বানানো মুভি ছাড়া, অন্য কোথাও সাধারণ পাখিরা মানুষকে আক্রমণ করে না। হয়তো পোকা খাওয়ার জন্য জান বাজিতে লাগায়, কিন্তু মানুষের পেছনে? অসম্ভব। হাজার হাজার বছরে অন্তত এটা জেনেছে: মানুষকে খাওয়ার আগে, মানুষই তাকে খেয়ে ফেলবে। তাই তাদের প্রবৃত্তিই বলে আমাদের থেকে দূরে থাকতে।’
‘সবাই কিন্তু থাকে না,’ এবার পালটা যুক্তি দিল মোটকু চার্লি। ‘শকুন না, বা দাঁড় কাকও এত ভয় পায় না। তবে যুদ্ধ শেষ হলে তাদের দেখা মেলে। অপেক্ষা করে মানুষ মরার।’
‘কী?’
‘বললাম, দাঁড়কাক আর শকুন বাদে আরকী। কিছু বোঝাতে চাচ্ছি…’
‘নাহ,’ মন দিল স্পাইডার। ‘মাথায় আসি আসি করেও আসছে না। তোমার কথা শুনে কিছু একটা ভাবতে শুরু করেছিলাম, আরেকটু হলে মনে করেও ফেলতাম। মিসেস ডানউইডির সঙ্গে কথা হয়েছে?’
‘মিসেস হিগলারকে ফোন করেছিলাম, কিন্তু জবাব পাইনি।’
‘তাহলে চলো, দেখা করে আসি।’
‘তুমি তো বলতেই পারো, কিন্তু আমি ঝামেলায় আছি। পকেটে ফুটো পয়সাও নেই, ব্যাঙ্কেও না। চাইলেই আটলান্টিকের এপার-ওপাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব না। এমনকী চাকরিও নেই। আমি—’
কালো-লাল জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে একটা ওয়ালেট বের করে আনল স্পাইডার। ভেতর থেকে নানা দেশের অনেকগুলো নোট বের করে গুঁজে দিল মোটকু চার্লির হাতে। ‘এই নাও, যাওয়া-আসার খরচ হয়েও বাঁচবে। শুধু ওই পালকটা এনে দাও।’
আচমকা বলল মোটকু চার্লি, ‘আচ্ছা, একবারও কি ভেবেছ যে বাবা মারা নাও গিয়ে থাকতে পারে?’
‘কী?’
‘ভাবছিলাম, হয়তো ঠাট্টা করছে আমাদের সঙ্গে। এমন কিছু করা তার দ্বারা খুবই সম্ভব, তাই না?’
জবাব দিল স্পাইডার। ‘বলতে পারছি না, হতেও পারে।’
‘আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে তাই হয়েছে। প্রথমেই এই কাজটা করব, ওর কবরে গিয়ে—’
কথা শেষ করতে পারল না বেচারা, তার আগেই আক্রমণ চালালো পাখির ঝাঁক। শহুরে পাখি ওগুলো; চড়ুই আর স্টারলিং, কবুতর আর কাক; হাজারে হাজারে ছুটে আসছে। বাতাসে উড়তে থাকা কাপড়ের মতো ঢেউ খেলছে তাদের মাঝে, রিজেন্ট স্ট্রিটে বসে থাকা দুই ভাইয়ের দিকে এগোচ্ছে দেওয়ালের রূপ নিয়ে। পালকঅলা ওই বাহিনীটা একেবারে আকাশছোঁয়া দালানের মতোই সমতল, নড়া-চড়ায় বিন্দুমাত্র অপটুতা নেই। মোটকু চার্লি দেখল সব, কিন্তু মনের ভেতরে তার বর্ণনাকে স্থান দিতে পারল না; যদিও এই দৃশ্যটা ক্রমেই পাখ খেতে খেতে পুরো মাথা দখল করে নিতে চাইছে। আসলে কী দেখছে, সেটাই বুঝতে পারছে না ওর মন।
ভাইয়ের কনুই ধরে টান দিল স্পাইডার। তারপর চেঁচিয়ে বলল, ‘দৌড়াও!’
ঘুরে দাঁড়াল মোটকু চার্লি। স্পাইডার তখন ব্যস্ত খবরের কাগজটা সাবধানে ভাঁজ করে, ময়লার বাক্সে ফেলতে।
‘তুমিও দৌড়াও!’
‘এখনও তোমার পেছনে লাগেনি এই পাখিরা। অন্তত এখন পর্যন্ত না, ‘ বলেই হাসল স্পাইডার; যে হাসিটা আগে এত বেশি মানুষকে প্রভাবিত করেছে যা কল্পনারও বাইরে, তাদের বাধ্য করেছে এমন কিছু একটা করতে যা তারা করতে অনিচ্ছুক ছিল। মোটকু চার্লির মনেও দৌড়ে পালাবার ইচ্ছেটা তীব্র হয়ে উঠল। ‘পালকটা উদ্ধার করো। যদি পারো তো বাবাকেও নিয়ে এসো। এবার যাও!’
তাই করল মোটকু চার্লি।
কেঁপে উঠে রূপ বদল করল পাখির দেওয়ালটা। ঘূর্ণির রূপ নিয়ে যেন গিলে ফেলল এরোসের মূর্তি আর তার নিচে বসে থাকা মানুষটাকে। একটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে আত্মরক্ষা করল মোটকু চার্লি। ওর চোখের সামনেই ঘূর্ণিঝড়ের নিচের অংশটা ধাক্কা খেল স্পাইডারের সঙ্গে। কল্পনা করল সে, ভাইয়ের আর্ত-চিৎকার শুনতে পাচ্ছে পাখার ঝাপটানির আওয়াজকে ছাপিয়ে…
…কে জানে, হয়তো কল্পনা ছিল না ওর এই শোনা!
পরক্ষণেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল পাখির ঝাঁক, রাস্তাটা খালি পড়ে রইল। ধূসর পেভমেন্টে কয়েকটা পালক রয়ে গেল ঘটনার সাক্ষী হয়ে।
হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মোটকু চার্লির মনে হলো যেন অসুস্থ হয়ে পড়বে। পথচারীদের কেউ যদি ওই দৃশ্য দেখেও থাকে, তবুও কোনো প্ৰতিক্ৰিয়া দেখাল না। কেন যেন মনে হলো ওর: আসলে আর কেউ এই ঝটিকা আক্রমণ দেখেইনি!
মূর্তির নিচে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা, ওর ভাই খানিক আগে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল তার পাশে। মহিলার জীর্ণ, বাদামি কোট বাতাসে পতপত করছে। তার দিকে এগিয়ে গেল মোটকু চার্লি। ‘শোনো,’ বলল সে। ‘ওকে ভাগাতে বলার অর্থ ছিল, আমার জীবন থেকে তাড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু যা করলে, তা তো করতে বলিনি!’
ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে রইল মহিলা, বলল না কিছুই। কিছু কিছু শিকারি পাখির চোখে এক রকমের উন্মাদনা থাকে, থাকে এমন এক নৃশংসতা যা অন্য সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। সেই দৃষ্টি নিজের ওপর আবিষ্কার করলে ভয় পেয়ে যাবে যে কেউ। কিন্তু মোটকু চার্লি ভয় না পাওয়ার চেষ্টা করল। ‘ভুল হয়েছে আমার,’ বলল সে। ‘তার সাজা ভুগতে রাজি আছি। আমাকে নিয়ে যাও, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দাও।’
তারপরও সেভাবেই চেয়ে রইল মহিলা। বলল, ‘তোমার পালাও আসবে, আনানসির সন্তান। সঠিক সময়ে…’
‘ওকে তোমার দরকার কেন?’
‘আমি ওকে চাই না,’ জানাল পাখি-মানবী। ‘ওকে দিয়ে আমার কী হবে? আমি আসলে অন্য একজনের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ওকে তার হাতে তুলে দিলে, আমার দায়ভার ফুরোবে।’
কেঁপে উঠল খবরের কাগজ…
…মূর্তির নিচে নিজেকে একা আবিষ্কার করল মোটকু চার্লি।
অধ্যায় এগারো – যেখানে রোজি অপরিচিতদের না বলতে শিখল এবং মোটকু চার্লি পেল সময়
অধ্যায় এগারো – যেখানে রোজি অপরিচিতদের না বলতে শিখল এবং মোটকু চার্লি পেল সময়
বাপের কবরের দিকে চাইল মোটকু চার্লি। ‘আছো তো ভেতরে?’ উচ্চকণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিল সে। ‘যদি থাকো, তাহলে বেরিয়ে এসো। কথা বলা দরকার তোমার সঙ্গে।’
কবর ফলকের কাছে গিয়ে নিচের দিকে চাইল ছেলেটা। কী ঘটবে বলে আশা করছে তা নিজেই জানে না—মাটির নিচ থেকে একটা হাত বেরিয়ে এসে ওর পা আঁকড়ে ধরবে? তেমন কিছু তো ঘটছে না!
অথচ সম্ভাবনাটা যথেষ্ট জোরাল মনে হয়েছিল ওর কাছে।
দ্য গার্ডেন অভ রেস্ট থেকে বেরিয়ে যাবার সময়, নিজেকে বোকার হদ্দ মনে হলো মোটকু চার্লির। তাও আবার এমন এক বোকা, যে গেম শোতে গিয়ে প্রশ্নের জবাবে বলেছে: আমাজনের চাইতে মিসিসিপি নদী বড়ো! শুধু তাই না, প্রশ্নটা ছিল মিলিয়ন ডলার জেতার জন্য! ওর আসলে আগেই বুঝতে পারা উচিত ছিল, বহু আগেই মরে ভূত হয়ে গেছে ওর বাবা; স্পাইডারের পয়সা খরচ করেছে মরীচিকার পেছনে ছুটে! বেবিল্যান্ডের বায়ুকলের পাশে বসে কাঁদতে লাগল বেচারা, মরিচা পড়তে থাকা খেলনাগুলোকে ওর স্মৃতির চাইতে অনেক বেশি বিষণ্ণ আর একাকী মনে হতে লাগল।
মহিলা ওর জন্যই অপেক্ষা করছে, পার্কিং লটে। গাড়িতে হেলান দিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অস্বস্তিতে ভুগছে মহিলা।
‘হ্যালো, মিসেস বাস্টামন্টে,’ বলল মোটকু চার্লি
সিগারেটে শেষ একটা টান দিয়ে, ওটাকে অ্যাঙ্কল্টে ফেলে দিল মহিলা; তারপর ফ্ল্যাট জুতা দিয়ে চেপে আগুন নেভাল। কালো পোশাক পরে আছে সে, ক্লান্তি ভর করেছে চোখে-মুখে। ‘হ্যালো চার্লস।’
‘মিসেস হিগলার, কিংবা মিসেস ডানউইডি আসলেও অবাক হতাম না। কিন্তু তুমি?’
‘কেলিঅ্যান অনেক দূরে কোথাও গেছে। মিসেস ডান উইডি আমাকে পাঠাল, তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
মাফিয়ার মতো, ভাবল মোটকু চার্লি। বুড়িদের মাফিয়া। ‘আমাকে এমন একটা প্রস্তাব দেবে, যা মেনে নিতে বাধ্য হব?’
‘সন্দেহ আছে, ওর শরীর ভালো যাচ্ছে না।’
‘ওহ।’
নিজের ভাড়া করা গাড়িটায় উঠে বসল সে, অনুসরণ করল মিসেস বাস্টামন্টের ক্যামরি গাড়িটাকে; ফ্লোরিডার রাস্তা ধরে। বাবার বেঁচে থাকার ব্যাপারে বলতে গেলে নিশ্চিতই ছিল সে। ভেবেছিল তাকে জীবিত দেখতে পাবে। সাহায্য পাওয়া যাবে তার কাছে…
মিসেস ডানউইডির বাড়ির সামনে গাড়ি পার্ক করল ওরা। প্রাঙ্গণের দিকে তাকাল মোটকু চার্লি। ঝলসে যাওয়া প্লাস্টিকের ফ্ল্যামিঙ্গো, পুতুল, আর লাল রঙা কাচের তৈরি বলটা বসে আছে একটা ছোট্ট, কংক্রিটের বেদি মতো স্থানে। ক্রিসমাসের সময় এভাবে গাছ সাজানো হয়। বলটার দিকে এগিয়ে গেল সে,
এমনই একটা ভেঙেছিল ছেলেবেলায়। আয়নার কাচ দিয়ে বানানো বলে নিজের বিকৃত একটা রূপ দেখতে পেল ওতে।
‘এইটা দিয়ে লাভ কী?’ জিজ্ঞেস করল মিসেস বাস্টামন্টেকে।
‘এমনিতেই রাখা, কোনো কারণ নেই। পছন্দ করে জিনিসটাকে।’
বাড়ির ভেতরে ধুনোর গন্ধ ভারী হয়ে ভাসছে। মোটকু চার্লির দূর- সম্পর্কের আত্মীয়া অ্যালান্না, হ্যান্ডব্যাগে সবসময় ধুনোর ক্যান্ডি রাখতেন; মোটাসোটা আর চকলেটপ্রেমী খুদে মোটকু চার্লিও ওসবের দিকে বাধ্য না হলে হাত বাড়াত না। বাড়িটা থেকে ওই ক্যান্ডিগুলোর মতো গন্ধ ভেসে আসছে। বিগত বিশ বছরে ‘ওই ক্যান্ডির কথা ভাবেনি সে একবারও; এখন ভাবছে– আজও কি কোম্পানিটা বানায় ওগুলো? তার চাইতে বড়ো প্রশ্ন, আগে কেন বানাতো…?
‘হলের শেষ মাথায় ওর ঘর,’ মিসেস বাস্টামন্টে জানাল। সেই সঙ্গে ইঙ্গিতে দেখিয়েও দিল। মিসেস ডানউইডির শোবার ঘরে পা রাখল মোটকু চার্লি।
বিছানাটা খুব একটা বড়ো না, কিন্তু তাতে শুয়ে থাকা মিসেস ডানউইডিকে ফোলানো পুতুল বলে মনে হচ্ছে। চোখে চশমা আছে মহিলার, তার ওপরে আছে লেস লাগানো একটা হলদে টুপি যাকে বলে—নাইটক্যাপ। জীবনে এই প্রথমবারের মতো নাইটক্যাপ দেখল মোটকু চার্লি। মহিলা একগাদা বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে, মুখটা খোলা। নাকটাও হালকা ডাকাচ্ছে।
কাশল মোটকু চার্লি।
ঝট করে মাথা তুলে ধরল মিসেস ডানউইডি, চোখ খুলে তাকাল ওরই দিকে। বিছানার পাশে থাকা নাইটস্ট্যান্ডটা আঙুল তুলে দেখিয়ে দিতেই, মোটকু চার্লি তাতে থাকা পানির গ্লাসটা তুলে এগিয়ে দিল মহিলার দিকে। দুই হাত দিয়ে গ্লাসটা ধরল মহিলা, যেভাবে বাদাম ধরে কাঠবেড়ালি। তাতে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে আবার ফিরিয়ে দিল।
‘গলা একেবারে শুকিয়ে গেছিল,’ জানাল মহিলা। ‘বয়েস কতো হয়েছে, তা জানো?’
‘উম,’ অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলো মোটকু চার্লি—এই প্রশ্নের সঠিক কোনো জবাব নেই। ‘নাহ।’
‘একশো হয়ে আরও চার।’
‘তাই নাকি? অথচ দেখে মনে হয় না। মানে বলতে চাচ্ছি যে—’
‘চুপ করো, মোটকু চার্লি।’
‘দুঃখিত।’
‘ওভাবে ক্ষমা চাওয়ারও কিছু হয়নি। রান্নাঘরের মেঝেতে হাগু করলে কুকুর এভাবে দুঃখ প্রকাশ করতে চায়। মাথা উঁচু করে রাখো, সরাসরি তাকাও দুনিয়ার চোখে। শুনলে আমার কথা?’
‘হ্যাঁ। দুঃখিত। মানে বলতে চাচ্ছিলাম, ঠিক বলেছেন।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহিলা। ‘সবাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চায়। ওদেরকে বললাম, একশো চার বছর বেঁচে থাকার পর, নিজের বিছানায় মরার অধিকার আপনা-আপনি জন্মে যায়। বহু বছর আগে এই বিছানায় বাচ্চা পয়দা করেছি, অনেক বাচ্চাকে এনেছি দুনিয়াতে। তাই অন্য কোথাও মরার প্রশ্নই ওঠে না। আরেকটা কথা…’ কথা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করল সে। তারপর লম্বা শ্বাস নিলো একটা। খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে মোটকু চার্লি যখন ধরেই নিয়েছিল যে মহিলা ঘুমিয়ে পড়েছে, ঠিক তখনই চোখ খুলে বলল মিসেস ডান উইডি। ‘মোটকু চার্লি, কেউ যদি জিজ্ঞেস করে যে তুমি একশো চার বছর বয়েস পর্যন্ত বেঁচে থাকতে চাও কি না, তাহলে জবাবে না বলো। সব কিছু ব্যথায় জর্জরিত…সব কিছু। এমন সব জায়গায় ব্যথা লাগছে, যেসব জায়গা কেউ আবিষ্কারই করেনি!’
‘পরামর্শটা মাথায় রাখব।’
‘মুখে মুখে কথা বলবে না।’
সাদা, কাঠের বিছানায় শুয়ে থাকা ছোটোখাটো মহিলার দিকে তাকাল মোটকু চার্লি। ‘দুঃখ প্রকাশ করব?’ জানতে চাইল সে।
অন্য দিকে নজর ফেরাল মিসেস ডানউইডি। ‘আমি তোমার সঙ্গে অবিচার করেছি,’ বলল সে। ‘অনেক অনেক আগের কথা বলছি।’
‘তা জানি,’ বলল মোটকু চার্লি।
হয়তো মরতে বসেছে মিসেস ডানউইডি, কিন্তু এমনভাবে তাকাল মোটকু চার্লির দিকে যে নজরের সামনে পড়লে পাঁচ বছরের নিচের যেকোনো বাচ্চা কেঁদে-কেটে মায়ের কোলে আশ্রয় নিত! ‘জানি মানে কী?’
জবাব দিল মোটকু চার্লি। ‘দুইয়ে দুই মিলিয়েছি। হয়তো সব বুঝতে পারিনি, কিন্তু বুঝেছি অনেকটাই। আমি বুদ্ধি-প্রতিবন্ধী নই!’
পুরু কাচের চশমার ওপাশ থেকে ছেলেটাকে মন দিয়ে দেখল মহিলা। ‘না, তা তুমি নও।’ কুঁচকে যাওয়া একটা হাত বাড়িয়ে দিল সে। ‘পানিটা আবার দাও।’ গ্লাস হাতে নিয়ে চুমুক দিল তাতে, ছোট্ট-বেগুনি জিভ দেখা দিল। ‘আজ তুমি এখানে এসেছ, তাতে ভালোই হয়েছে। কাল এই বাড়িটা ভরে উঠবে নাতি-পুতিতে। আফসোসের সঙ্গে সবাই বোঝাতে চাইবে, হাসপাতালে মরা উচিত আমার। চাইবে আমাকে ভজিয়ে-ভাজিয়ে জিনিসপত্র বাগাতে। কিন্তু ওরা আমাকে চেনে না। আমার নিজের পেটের বাচ্চা-কাচ্চারা মরে গেছে, কিন্তু আমি বেঁচে আছি।’
মোটকু চার্লি বলল, ‘অবিচারের প্রসঙ্গে কিছু বলবেন?’
‘আমার বাগানের আয়নার বলটা ভাঙা তোমার উচিত হয়নি।’
‘আমিও তাই মনে করি।’
ঘটনাটা মনে করল মোটকু চার্লি, যেভাবে মানুষ ছোটোবেলার স্মৃতি স্মরণ করে: খানিকটা স্মৃতি, খানিকটা স্মৃতির স্মৃতি। টেনিস বলকে অনুসরণ করে
মিসেস ডানউইডির প্রাঙ্গণে পা রাখা, তারপর কৌতূহলী হয়ে আয়নার বলটাকে উঠিয়ে তাতে নিজের বিকৃত চেহারা দেখা, পরক্ষণেই টের পাওয়া যে হাত ফসকে ওটা নিচে পড়ে যাচ্ছে, বলটাকে শত শত ভাগ হয়ে যেতে দেখা। বুড়ো, কিন্তু শক্তিশালী আঙুলগুলোর চাপ অনুভব করল কানে; টেনে নিয়ে যাচ্ছে তাকে বাড়ির দিকে…
‘স্পাইডারকে তুমিই ভাগিয়েছিলে,’ বলল সে। ‘তাই না?’
যান্ত্রিক বুলডগের মতো শক্ত হয়ে এঁটে বসল মহিলার চোয়াল। মাথা নেড়ে বলল সে, ‘হ্যাঁ, আমি বিতাড়নের একটা জাদু চালিয়েছিলাম। কিন্তু এত কিছু হয়ে যাবে তা ভাবিনি। তখনকার দিনে সবাই একটু-আধটু জাদু জানত। ডিভিডি, সেল ফোন আর মাইক্রোওয়েভের জমানা ছিল না ওটা, তবে যা ছিল তাও কম না। তোমাকে একটা শিক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা ছিল শুধু। খুবই অহংকারী ছিলে, দুষ্টামি করতে; কথার পিঠে তর্কও করতে। তাই স্পাইডারকে তোমার ভেতর থেকে বের করে আনি, তোমাকে মজা বোঝাতে।’
শব্দগুলো শুনল বটে মোটকু চার্লি, কিন্তু অর্থ ধরতে পারল না। ‘আমার ভেতর থেকে বের করে এনেছ…মানে?’
‘তোমাকে ওর কাছ থেকে মুক্তি দেই। ও তোমার ধূর্ত সত্তা, তোমার ভেতরকার সব অন্যায়… বুঝতেই পারছ, ‘ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মহিলা। ‘আমারই
ভুল। কেউ বলেনি যে তোমার বাবার বংশধরের মতো কারও ওপর জাদু করলে, সেটার মাত্রা ও গভীরতা অনেক গুণে বেড়ে যায়। সব কিছু পায় চরম রূপ!’ আরেক চুমুক পানি পান করল সে। ‘তোমার মা কখনও বিশ্বাসই করেনি আমার কথা। কিন্তু ওই স্পাইডার, তোমার তুলনায় হাজারগুণে খারাপ। স্পাইডারকে আমি তাড়িয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তোমার বাবা কিছুই বলেনি। তারপর এই প্রসঙ্গ উঠলেই বলত: এই সমস্যার সমাধান যদি তুমি করতে না পারো, তাহলে আসলে তুমি ওর ছেলেই নও!
তর্ক করতে চাইল মোটকু চার্লি, বলতে চাইল—অর্থহীন কথা বলছে মহিলা, স্পাইডার ওর অংশ হতেই পারে না। যেমন সে নিজে সাগর কিংবা অন্ধকারের অংশ নয়। কিন্তু বলতে পারল কেবল এতটুকুই, ‘পালকটা কই?’
‘কীসের পালক?’
‘আমি যখন ওই জায়গা থেকে ফিরে আসি…মানে ওই পাহাড় আর গুহামুখঅলা জায়গাটা থেকে, তখন হাতে একটা পালক ছিল। ওটা কই?’
‘আমার মনে পড়ছে না,’ বলল মহিলা। ‘বুড়ো হয়ে গেছি, বয়েস হয়েছে একশো চার!’
আবার জানতে চাইল মোটকু চার্লি, ‘কোথায় ওটা।’
‘ভুলে গেছি।’
‘দয়া করে বলো।’
‘আমার কাছে নেই।’
‘কার কাছে আছে?’
‘কেলিঅ্যান।’
‘মিসেস হিগলার?’
সামনে ঝুঁকে ষড়যন্ত্রীর সুরে বলল, ‘অন্য দুজনের বয়েস খুবই কম। নাক টিপলে দুধ বেরোয়!
‘আসার আগে মিসেস হিগলারকে ফোন করেছিলাম, কবরস্থানে যাওয়ার আগে তার বাসায় থেমেওছি। মিসেস বাস্টামন্টে বলল, কোথায় যেন গেছে সে।’
মিসেস ডানউইডি ধীরে ধীরে দোল খেতে লাগল বিছানায়, যেন নিজেকে নিজেই ঘুম পাড়াচ্ছে। বলল, ‘আর বেশিক্ষণের অতিথি আমি নই এই রঙ্গমঞ্চে। গত বার যে এসেছিলে, তারপর থেকেই তরল খাবার খাচ্ছি। আমার সময় শেষ, পানি ছাড়া আর কিছুই গলা দিয়ে নামে না। অনেকে বলবে, তোমার বাবাকে হয়তো তারা ভালোবাসত। কিন্তু আমি তাকে ওদের আরও আগে থেকেই চিনতাম। তখন দেখতেও খারাপ ছিলাম না, নাচের অনুষ্ঠানে নিয়ে যেত আমাকে। আমাকে নিতে আসত, কোলে তুলে ঘোরাত খানিকক্ষণ। এমনকী তখনও বয়েস অনেক হয়েছিল তার, তারপরও যেকোনো মেয়েকে খুশি করতে পারত। অন্য কারও সঙ্গে…’ বলতে বলতেই থেমে গেল মহিলা, পানিতে চুমুক দিল আরেকবার। কাঁপছিল তার হাতটা। ‘একশো চার হলো বয়েস, প্রসবকালীন জটিলতা ছাড়া দিনের বেলা কখনও বিছানা নিইনি। অথচ এখন সব শেষ।’
‘সন্দেহ নেই, একশো পাঁচের দেখা পাবেন আপনি,’ অস্বস্তি ভরে বলল মোটকু চার্লি।
‘এসব বলো না,’ বলল মহিলা, সতর্ক দেখাল ওকে। ‘একদম না! তোমার পরিবার এমনিতেই কম ঝামেলায় ফেলে না, দয়া করে আরেকটা ঝামেলার জন্ম দিয়ো না।’
‘আমি আমার বাবার মতো নই,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘জাদু জানি না, সব ক্ষমতা স্পাইডার পেয়েছে, ভুলে গেলে?’
মনে হলো না মিসেস ডানউইডি কিছু শুনেছে। মহিলা বলল, ‘যখন নাচতে যেতাম, সেটাও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেকার সময়ে, তোমার বাবা ব্যান্ডলিডারের সঙ্গে কথা বলত। অনেকবার এমন হয়েছে যে ব্যান্ডটা ওকে ডেকেছে সঙ্গে গান গাইতে। সবাই হাসত, জয়ধ্বনি দিত। ও এমনই ছিল, গান গেয়ে সব সত্যি করত।’
‘মিসেস হিগলার কই?’
‘বাড়ি গেছে।’
‘কিন্তু তার বাড়ি তো খালি, গাড়িও নেই।
‘বাড়িতে গেছে!’
‘মানে কী… মারা গেছে?’
সাদা বিছানার চাদরে শুয়ে থাকা বৃদ্ধা শনশন আওয়াজে শ্বাস নিলো খানিকক্ষণ, ফুসফুস তার নির্দেশ মানতে চাইছে না। কথা বলার সামর্থ্যও আর বাকি নেই বলেই মনে হচ্ছে। ইঙ্গিতে নিজের কাছে ডাকল মোটকু চার্লিকে।
‘সাহায্যের জন্য লোক ডাকব?’ জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি।
মাথা নেড়ে সায় জানাল মিসেস ডান উইডি। মিসেস বাস্টামন্টের খোঁজে মোটকু চার্লি বেরিয়ে যাবার আগেও ঠিক হলো না তার শ্বাসকষ্ট। রান্নাঘরে বসে ছিল মহিলা, ছোট্ট একটা কাউন্টারটপ টেলিভিশনে দেখছিল অপেরা উইনফ্রের অনুষ্ঠান। ‘তোমাকে খুঁজছে,’ তাকে বলল মোটকু চার্লি।
বাইরে বেরিয়ে গেল মিসেস বাস্টামন্টে। খালি পানির পাত্রটা নিয়ে ফিরে এলো সে। ‘এমন কী বললে যে বেচারির হাল খারাপ হয়ে গেছে?’
‘হাঁপানি-টাপানির আক্রমণ হলো নাকি?’
চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকাল মিসেস বাস্টামন্টে। ‘না, চার্লস। হাসছিল ও, তুমি নাকি ওকে চরম আমোদ দিয়েছ।’
‘ওহ। বলেছিল যে মিসেস হিগলার বাড়িতে গেছে, তাই জানতে চাচ্ছিলাম যে মারা গেছে বোঝাচ্ছে নাকি!’
মিসেস বাস্টামন্টেও হেসে ফেলল। ‘সেন্ট অ্যান্ড্রুজ, জানাল সে। ‘কেলিঅ্যান গেছে সেন্ট অ্যান্ড্রুজে। সিঙ্কে গিয়ে ভরে নিলো পানির পাত্র।
মোটকু চার্লি এবার বলল, ‘ঝামেলা শুরু হবার পর আমি ভেবেছিলাম, স্পাইডারের বিপক্ষে আছি কেবল আমি। তারপর তোমরা চারজন আমার পক্ষ নিলে। অথচ এখন স্পাইডার অপহৃত হয়েছে, আর তোমরা চারজন আমার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছ।’
পানি বন্ধ করে, বিষণ্ন চোখে ওর দিকে তাকাল মহিলা।
‘এখন আর কারও কোনো কথাই বিশ্বাস করি না,’ জানাল মোটকু চাি ‘মিসেস ডানউইডি সম্ভবত অসুস্থ হবার ভড়ং ধরেছে। আমি এখান থেকে চা গেলেই বিছানা ছেড়ে কামরা জুড়ে নাচতে শুরু করবে!
‘ও অনেকদিন হলোই কিছু খাচ্ছে না। বলছে, ভেতরে নাকি খার লাগে। তাই শক্ত কিছুই মুখে তুলছে না, শুধু পানি।’
‘সেন্ট অ্যান্ড্রুজের কোথায় গেছে মিসেস হিগলার,’ মোটকু চার্লি।
‘যাও ওখানে,’ বলল মিসেস বাস্টামন্টে। ‘তোমার পরিবার, আর তুমি… এখানকার অনেক ক্ষতি করেছ!’
দেখে মনে হলো, মোটকু চার্লি হয়তো কিছু একটা বলবে। কিন্তু মুখ খুলল না, একটা কথাও না বলে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে।
পানি ভরতি পাত্রটা মিসেস ডান উইডির কাছে নিয়ে গেল মিসেস বাস্টামন্টে, পরেরজন চুপচাপ শুয়ে আছে বিছানায়
‘ন্যান্সির ছেলে আমাদেরকে ঘৃণা করে,’ জানাল মিসেস বাস্টামন্টে। ‘ওকে বলেছটা কী?’
জবাবে কিছুই বলল না মিসেস ডানউইডি। খানিকক্ষণ মন দিয়ে শুনল মিসেস বাস্টামন্টে, যখন বুঝতে পারল যে মিসেস ডানউইডি শ্বাস নিচ্ছে, তখন তার ভারী কাচের চশমাটা চোখ থেকে খুলে রেখে দিল বিছানার পাশে। চাদর টেনে ঢেকে দিল মিসেস ডানউইডিকে।
তারপর, শুরু হলো সব ফুরিয়ে যাবার অপেক্ষা।
.
গাড়ি চালাচ্ছে মোটকু চার্লি, যদিও জানে না ওর গন্তব্য কোথায়! দুই হপ্তায় তৃতীয় বারের মতো আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছে সে, স্পাইডারের দেওয়া টাকাও প্রায় শেষ। একা বসে আছে গাড়িতে, একাকীত্ব কাটাতেই যেন গুনগুন করে গাইতে শুরু করল।
অনেকগুলো জ্যামাইকান রেস্তোরাঁ পেরোবার পর একটা দোকানের জানালায় দেখতে পেল নোটিশ: দ্বীপে যান কম খরচে। সেখানেই গাড়ি থামিয়ে ভেতরে ঢুকল সে।
‘এ-ওয়ান ট্রাভেলে স্বাগতম, আমরা আপনার ভ্রমণ সংক্রান্ত সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’ বলল ট্রাভেল এজেন্ট। কণ্ঠটা তার অদ্ভুত শোনাল। ডাক্তাররা যখন কাউকে বলে, তার হাত বা পা কেটে ফেলতে হবে, তখন এমন ফিসফিসানি কণ্ঠ ব্যবহার করে।
‘উম, ধন্যবাদ। জানতে চাচ্ছিলাম, সেন্ট অ্যান্ড্রুজে যাবার সবচাইতে কম খরুচে উপায় কোনটা?’
‘ছুটিতে যাচ্ছেন?’
‘ঠিক তা না, হয়তো এক…বড়োজোর দুই দিন থাকব।’
‘কখন যেতে চাচ্ছেন?’
‘আজ বিকেলেই।’
‘আশা করি ঠাট্টা করছেন আমার সঙ্গে?’
‘একদম না!’
একটা কম্পিউটারের পর্দায় এরপর নজর রাখল এজেন্ট, টোকা দিল কী- বোর্ডের কিছু চাবিতে। ‘বারোশো ডলারের চাইতে কম খরচ হবে, এমন কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছি না।’
‘ওহ।’ হতাশ হলো মোটকু চার্লি।
আরও খানিকক্ষণ কী-বোর্ড চাপাচাপির পর শক্ত হয়ে গেল লোকটা। ‘এ আমি কী দেখছি!’ তারপর যোগ করল, ‘একটু দাঁড়ান।’ ফোন করল যেন কাকে। ‘দাম ঠিক আছে?’ একটা প্যাডে কিছু টুকে নিয়ে তাকাল মোটকু চার্লির দিকে। ‘যদি আপনি এক হপ্তা কাটান, আর ওঠেন দ্য ডলফিন হোটেলে, তাহলে পাঁচশো ডলার খরচে ঘুরিয়ে আনতে পারি। খাবার হোটেল থেকেই দেবে, বিমানের খরচ বলতে শুধু বিমানবন্দরের কর দিতে হবে বাড়তি।’
চোখ পিটপিট করল মোটকু চার্লি। ‘কোনো শর্ত আছে?’
‘পর্যটনের জন্য বিশেষ ছাড়। গানের অনুষ্ঠান আছে একটা। জানতাম না যে এখনও সেই অফার বলবত আছে। তবে হ্যাঁ, যদি বাইরে কোথাও খাওয়া- দাওয়া করেন তো তার খরচ আপনার।’
লোকটাকে একশো ডলারের পাঁচটা কোঁচকানো নোট দিল মোটকু চার্লি।
.
ডেইজির মনে হচ্ছে: ও যেন রূপালি পর্দায় দেখা পুলিস বনে গেছে। কঠিন, রুক্ষ আর সিস্টেমের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য এক পায়ে খাড়া। যারা জানতে চায়, অপরাধীরা নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছে কি না[৩০], অথবা তারা কেউ ওর দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চায় কি না[২৯]…বিশেষ করে যে ধরনের অফিসাররা বলে ‘বুড়ো হাড়ে এই জিনিস আর সইবে না’[২৯] তাদের মতো একজন বলে মনে হচ্ছে নিজেকে। অথচ বয়েস ওর মাত্র ছাব্বিশ, অথচ ‘এসব জিনিস’ ওর হাড় আর সইতে পারছে না। তবে দাবিটা যে হাস্যকর শোনাবে, সেটা ও নিজেও ধরতে পারছে।
[৩০. যথাক্রমে ডার্টি হ্যারি, ডার্টি হ্যারি এবং লিথাল ওয়েপন মুভির বিখ্যাত ডায়লগ।]
এই মুহূর্তে ও বসে আছে ডিটেকটিভ সুপারিন্টেনডেন্ট ক্যাম্বারওয়েলের অফিসে। বলছে, ‘জি, স্যার, সেন্ট অ্যান্ড্রুজের কথাই বলছি।’
‘কয়েক বছর আগে ছুটি কাটাতে গেছিলাম ওখানে, প্রাক্তন মিসেস ক্যাম্বারওয়েলের সঙ্গে। ভালো জায়গা। রাম কেকটা অসাধারণ।’
‘তেমন জায়গাই হবার কথা, স্যার। গ্যাটউইকের ক্লোজ সার্কিট ফুটেজে যাকে দেখেছি, সে অবশ্যই গ্রাহাম কোটস। ব্রনস্টেইন ছদ্মনামে ভ্রমণ করছে। রজার ব্রনস্টেইন প্রথমে বিমানে গেছে মিয়ামি, সেখানে বিমান পালটে নেমেছে সেন্ট অ্যান্ড্রুজে।’
‘তুমি নিশ্চিত যে ভুল হচ্ছে না?’
‘শতভাগ নিশ্চিত।’
‘তাহলে তো,’ বললেন ক্যাম্বারওয়েল। ‘হারামিটা আমাদেরকে ঘোল খাইয়েছে। ওদের সঙ্গে বন্দি-বিনিময় চুক্তি নেই।
‘কিছু একটা তো আমাদের করতে হবে।’
‘উম, ওর অবশিষ্ট সব অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দিতে পারি, বাজেয়াপ্ত করতে পারি সব সম্পদ। সেটা করবও, কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হবে না। নিশ্চয়ই এমন কোথাও টাকা জমিয়ে রেখেছে যার খোঁজ আমাদের কাছে নেই।
বা থাকলেও যার নাগাল আমরা পাবো না।’
‘কিন্তু,’ বলল ডেইজি। ‘এটা তো অবিচার, ধোঁকাবাজি!’
এমনভাবে ওর দিকে তাকালেন ক্যাম্বারওয়েল যেন অষ্টমাশ্চর্য দেখছেন। ‘আমরা এখানে ছেলেখেলা খেলছি না। যদি লোকটা আইন মেনে চলত, তাহলে তো আমাদের পক্ষেই থাকত। যদি কখনও ফিরে আসে, তাহলে চট করে ধরে ফেলব।’ বলেই প্লাস্টিসিনের টুকরোটাকে ছোট্ট একটা বলের আকৃতি দিয়ে এক চাপে সমতল বানিয়ে দিলেন। ‘আগেকার দিনে,’ বললেন তিনি। ‘ব্যাটারা চার্চে গিয়ে আশ্রয় চাইতে পারত। যতক্ষণ চার্চে থাকত, ততক্ষণ আইন ওদের স্পর্শও করতে পারত না; এমনকী মানুষ খুনের অপরাধে অভিযুক্ত হলেও না। তবে হ্যাঁ, কাজটা করলে চলা-ফেরা অনেক বেশি সংকীর্ণ হয়ে যেত।’
ডেইজির দিকে তিনি এমনভাবে তাকালেন যেন এতটুকু যথেষ্ট, এখন ওর চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়েটির। সে বলল, ‘মেইভ লিভিংস্টোনকে সে খুন করেছে, বছরের পর বছর ধরে প্রতারণা করে আসছে মক্কেলদের সঙ্গে।’
‘তো?’
‘ওকে বিচারের কাঠগড়ায় খাড়া করানো উচিত আমাদের।’
‘নিজেকে এতটা প্রভাবিত হতে দিয়ো না।’ বললেন ক্যাম্বারওয়েল।
ডেইজি ভাবল, বুড়ো হাড়ে এইসব আর সইছে না। মুখ বন্ধ করে রাখল তারপরেও, কিন্তু বাক্যটা মাথার ভেতর কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে।
নিজেকে এতটা প্রভাবিত হতে দিয়ো না।’
হতে দিয়ো না।’ আবারও বললেন ক্যাম্বারওয়েল। প্লাস্টিসিনের টুকরাটাকে এবার ঘনকের মতো করে সাজালেন, তারপর দুই আঙুলের মাঝে ফেলে পিষলেন ইচ্ছেমতো। ‘আমি অন্তত দিই না। নিজেকে ট্রাফিক ওয়ার্ডেন ভাবো। গ্রাহাম কোটস আসলে একটা গাড়ি যেটা ভুল জায়গায় পার্ক করলেও, তুমি টিকেট দেবার আগেই ভেগে গেছে। বুঝলে?’
‘জি, আচ্ছা,’ বলল ডেইজি। ‘আমারই ভুল, দুঃখিত।’
‘কোনো অসুবিধে নেই,’ জানালেন ওর বস।
ডেস্কে ফিরে এসে, পুলিসের আন্তঃবাহিনী ওয়েব সাইটে ঢুকল সে। কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে তা ঠিক করতে। অবশেষে ফিরল বাড়িতে। ক্যারোল বসে ছিল করোনেশন স্ট্রিটের সামনে, খাচ্ছে সে চিকেন কোর্মা।
‘ছুটিতে যাচ্ছি, ওকে জানাল ডেইজি।
‘ছুটি তো বাকি নেই, সব কাটিয়ে ফেলেছ,’ যুক্তি দিয়ে ওকে বোঝাতে চাইল ক্যারোল।
‘খুব খারাপ খবর,’ বলল ডেইজি। ‘কিন্তু আমার বুড়ো হাড়ে যে এইসব আর সইছে না!’
‘ওহ, কই যাচ্ছ?’
‘অপরাধীকে ধরতে,’ জবাব দিল ডেইজি।
.
‘ক্যারিবেয়ার’-কে দারুণ পছন্দ হয়েছে মোটকু চার্লির। হতে পারে তারা আন্তর্জাতিক বিমান কোম্পানি, কিন্তু আচরণে লোকাল বাস কোম্পানির মতো। ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টরা ওকে ডাকল ‘সোনা’ বলে; সেই সঙ্গে এটাও বলল: যেখানে ইচ্ছা বসতে পারে।
তিনটা সিট দখল করে ঘুমিয়ে পড়ল মোটকু চার্লি। স্বপ্নে দেখল: তামাটে আকাশের নিচে হাঁটছে সে, পুরো দুনিয়া নীরব আর স্থির। এগিয়ে যাচ্ছে একটা পাখির দিকে, আকারে যেটা শহরের চাইতে বড়ো; ওটার ঠোঁট খোলা, মোটকু চার্লি সেই খোলা ঠোঁটের ভেতর দিয়ে হেঁটে গলা অবধি পৌঁছে গেল।
স্বপ্নে যেমন হয়, তেমনি আচমকা নিজেকে সে আবিষ্কার করল একটা কামরায়, নরম পালক আর চোখ দিয়ে ভরতি ওটার দেওয়াল; চোখগুলো গোলাকার, পেঁচার মতো পলকহীন দৃষ্টিতে।
কামরার ঠিক মাঝখানে রয়েছে স্পাইডার, হাত-পা ছড়িয়ে। হাড় দিয়ে বানানো শিকল আটকে রেখেছে তাকে; কামরার প্রতিটা কোনা থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই শিকল, এমন শক্ত করে আটকে ধরে আছে যেভাবে মাকড়শার জালে আটকা পড়ে মাছি।
ওহ, বলল স্পাইডার। তুমি এসেছ!
হ্যাঁ, স্বপ্নেই জবাব দিল মোটকু চার্লি।
হাড়ের শিকলটা আচমকা টান-টান হয়ে স্পাইডারের মাংস কেটে বসল। ভাইয়ের চেহারায় কষ্টের ছাপ পরিষ্কার দেখতে পেল মোটকু চার্লি।
মানে, বলল মোটকু চার্লি। পরিস্থিতি আরও ভয়ানকও হতে পারত।
আমার মনে হয় না এই শেষ সাজা, জবাব দিল ওর ভাই। সম্ভবত আমাকে নিয়ে অন্য কিছু করার চিন্তা আছে তার। আমাকে নিয়ে না, আমাদেরকে নিয়ে। কিন্তু কী করতে চায়, সেটা জানি না।
এরা তো নিছক পাখি, বলল মোটকু চার্লি। খারাপ হলেও, কত খারাপই বা হবে?
প্রমিথিউসের নাম শুনেছ কখনও?
মানে…
মানুষকে আগুন উপহার দিয়েছিল সে। শাস্তি পেতে হয়েছিল সেজন্য। দেবতারা ওকে একটা পাথরে বেঁধে রাখে। প্রতিদিন সকালে একটা ইগল এসে খুবলে খেত ওর কলিজা।
কত্ত বড়ো কলিজা ছিল? শেষ হয়নি?
রাতের বেলা নতুন করে একটা গজাত। দেবতাদের কাজ-কারবার বলে কথা।
ক্ষণিকের নীরবতা, দুই ভাই চেয়ে রইল একে-অন্যের দিকে।
ভেবো না, জানাল মোটকু চার্লি। আমি সব ঠিক করে দেব।
যেভাবে এতদিন নিজের জীবন ঠিক করেছ? হাসল বটে স্পাইডার, তবে তাতে আমোদের ছোঁয়াও নেই।
আমি দুঃখিত।
উঁহু, দুঃখ প্রকাশ তো আমার করা উচিত। দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্পাইডার। কোনো পরিকল্পনা আছে তোমার?
পরিকল্পনা?
তাহলে না বলেই ধরে নিলাম। যা ইচ্ছে হয় করো, কিন্তু আমাকে মুক্ত
করো এখান থেকে।
তুমি আছ কই? নরকে?
জানি না কই আছি। হয়তো পাখিদের নরকে। আমাকে তোমার এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে হবে।
কীভাবে?
তুমি তো আমাদের বাবারই সন্তান, তাই না? তুমি আমার ভাই। কিছু একটা ফন্দি আঁটো। যাই হোক করো…আমাকে বাঁচাও।
ঘুম ভেঙে গেল মোটকু চার্লির, কাঁপছে প্রবল ভাবে। ফ্লাইট অ্যাটেন্ড্যান্ট ওর জন্য কফি নিয়ে এলে, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তা পান করল সে। পুরোপুরি জেগে উঠেছে এখন, আবার ঘুমিয়ে পড়ার ইচ্ছেও নেই। তাই ক্যারিবেয়ারের ম্যাগাজিনটা হাতে নিয়ে সেন্ট অ্যান্ড্রুজের ব্যাপারে চটকদার সব জ্ঞানার্জনে মন দিল।
ওখান থেকেই জানতে পারল–সেন্ট অ্যান্ড্রুজ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মাঝে সবচাইতে ছোটো দ্বীপ না। তবে তালিকা করার সময় সাধারণত এই দ্বীপের কথা ভুলেই যায় সবাই। স্প্যানিশরা সেই ১৫০০ সনের দিকে আবিষ্কার করেছিল সেন্ট অ্যান্ড্রুজকে; তখন দ্বীপটা ছিল আগ্নেয় লাভা জমে তৈরি হওয়া কিছু পাহাড়ের সমষ্টি, অবশ্য পশু-পাখির অভাব ছিল না এখানে। সেই সঙ্গে জন্মেছিল প্রচুর গাছপালাও। বলা হতো: সেন্ট অ্যান্ড্রুজে যা-ই বপন করা হোক না কেন, তা বড়ো হবেই।
প্রথমে মালিকানা ছিল স্প্যানিশদের কাছে, তারপর এলো ব্রিটিশরা। এরপর ডাচদের হয়ে আবার ব্রিটিশদের হাতে; ১৯৬২ সালে যখন স্বল্প সময়ের জন্য স্বাধীন হয়েছিল, তখন মালিক ছিলেন মেজর এফ.ই. গ্যারেট; ভদ্রলোক সরকার বানিয়ে, অন্য সব দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দেন…ব্যতিক্রম শুধু আলবেনিয়া আর কঙ্গো। শক্ত হাতে কয়েক বছর দেশ শাসনের পর, দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুবরণ করে নিতে হয়। এমন ভাবে বিছানা থেকে পড়ে যান তিনি যে কয়েকটা হাড় ভেঙে যায়! কামরার ভেতরে তখন ছিল সৈন্যদের পুরো একটা দল, যারা কসম কেটে বলে: আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও তারা মেজর গ্যারেটের পতন রুখতে পারেনি। দ্বীপের একমাত্র হাসপাতালে পৌঁছাবার আগেই মারা যান বেচারা। তারপর পর থেকে সেন্ট অ্যান্ড্রুজের শাসন পরিচালিত হয় নির্বাচিত সরকারের দ্বারা, আবার চালু হয় বৈশ্বিক কূটনীতি।
মাইলকে মাইল লম্বা বালুময় সৈকত আছে দ্বীপের, সেই সঙ্গে ঠিক মধ্যখানে অবস্থিত একটা ছোট্ট রেইনফরেস্ট; দ্বীপে জন্মায় প্রচুর পরিমাণে কলা আর আখ; ব্যাংকিং সিস্টেম এমন যে বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং অন্যান্য দেশের কর্পোরেশনরা আকৃষ্ট হয়। কারও সঙ্গেই বন্দি-বিনিময় চুক্তি নেই তাদের, সম্ভবত কঙ্গো আর আলবেনিয়া ছাড়া।
যদি সেন্ট অ্যান্ড্রুজের খ্যাতির একটা কারণ বলতে হয়, তাহলে ওখানকার খাবারের কথা বলতেই হবে: জ্যামাইকানদের আগেই নাকি এখানকার অধিবাসীরা মুরগিকে জার্কি বানাবার পদ্ধতি জানত, ত্রিনিদাদিয়ানদের আগে শিখেছে ছাগল রান্নার উপায়, বাজানদের আগেই কাবাব বানাতে শিখেছে উডুক্কু মাছের
সেন্ট অ্যান্ড্রুজে মোট দুটো শহর: উইলিয়ামসটাউন, যেটা অবস্থিত দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে; এবং আরেকটা হলো উত্তর দিকের নিউক্যাসল। দ্বীপে আছে অস্থায়ী বাজার যেখানে কেনা যায় এমন সবকিছু যা ওখানে জন্মায়। আছে কয়েকটা সুপারমার্কেট, যদিও ওখানে সেই একই পণ্যগুলো কিনতে দ্বিগুণ খরচ করতে হয়। একদিন আসলেও আন্তর্জাতিক একটা বিমানবন্দর পাবে সেন্ট অ্যান্ড্রুজ।
উইলিয়ামসটাউনের জেটিটা অবশ্য উপকারী না অপকারী, এই বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। ক্রুজ শিপের আগমনের জন্য ওই রকমের গভীর জেটির দরকার আছে, তাতে সন্দেহ নেই। এতে করে সেন্ট অ্যান্ড্রুজের মতো দ্বীপরাষ্ট্রের অর্থনীতির পালে মারাত্মক হাওয়া লাগে। মৌসুম চলাকালীন প্রায় আধ ডজন ক্রুজ শিপ আসে উইলিয়ামসটাউন বে-তে। হাজারো মানুষ নিচে নামে, হাত-পা খেলিয়ে নেয়; তারা এটা-সেটা খরিদও করে। সেন্ট অ্যান্ড্রুজের অধিবাসী ওপরে ওপরে ঘোঁত-ঘোঁত করলেও, পর্যটকদের বরণ করে নেয় সহাস্যে। তাদের কাছে জিনিসপত্র বিক্রি করে, একেবারে গলা পর্যন্ত খাইয়ে ফিরিয়ে দেয় জাহাজে।
ক্যারিবেয়ারের বিমানটা ল্যান্ড করার সময় ঝাঁকি খেল, যার চোটে মোটকু চার্লির হাত থেকে পড়ে গেল তার ম্যাগাজিন। সামনের সিটের পেছনে ওটা রেখে দিল সে, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে, হেঁটে টারম্যাকের অন্য পাশে চলে এলো।
শেষ বিকেল চলছে তখন
এয়ারপোর্ট থেকে ট্যাক্সিযোগে মোটকু চার্লি চলে এলো তার হোটেলে। পথে এমন কয়েকটা জিনিস জানল যা ক্যারিবেয়ারের ম্যাগাজিনে ছিল না। এই যেমন জানল: গান, সত্যিকারের আর আদর্শ গান, হলো কান্ট্রি আর ওয়েস্টার্ন। সেন্ট অ্যান্ড্রুজের রাস্তারাও[৩১] তা জানে। জনি ক্যাশ? এক কথায় গানের ঈশ্বর ছিল সে। উইলি নেলসন? ডেমিগড।
[৩১. এখানে রাস্তাফারিয়ানিজমের অনুসারীদের বোঝানো হচ্ছে। যা ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন। বব মার্লে যার উল্লেখযোগ্য সদস্য ছিলেন।]
এটাও জানতে পারল, সেন্ট অ্যান্ড্রুজ ছেড়ে অন্য কোথাও যাবার কোনো কারণই নেই। ট্যাক্সি ড্রাইভার নিজেও কখনও সেন্ট অ্যান্ড্রুজ ছাড়ার কোনো কারণ খুঁজে পায়নি, বহুবার ভেবেও। দ্বীপে আছে একটা গুহা, একটা পাহাড় আর একটা রেইনফরেস্ট। হোটেল? আছে খান বিশেক। রেস্তোরাঁ? কয়েক ডজন তো হবেই। একটা নগরী, তিনটা শহর আর বেশ কিছু গ্রামও আছে। খাবার? এখানে কী জন্মায় না! কমলা, কলা, জায়ফল। এমনকী, জানাল ট্যাক্সি ড্রাইভার, লেবুও পাওয়া যায়!
মোটকু চার্লি শেষ বাক্যটা শুনে ‘না!’ বলে দিল, তবে মুখ খুলতে হয় বলে খোলা। কিন্তু ড্রাইভার ব্যাপারটাকে নিলো অন্য ভাবে, ধরে নিলো ওর কথা বিশ্বাস করছে না মোটকু চার্লি। ট্যাক্সির ব্রেক কষল শক্ত করে, আরেকটু হলেই রাস্তার বাইরে চলে যেত গাড়ি। তারপর গাড়ি থেকে নেমে, একটা বেড়ার ওপাশে হাত দিয়ে টেনে ছিঁড়ল কিছু একটা গাছ থেকে। মোটকু চার্লির জানালার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এই দেখুন! আমি মিথ্যেবাদী, এ অপবাদ কেউ দিতে পারবে না! বলুন, এটা কী?’
‘লেবু?’ কোনোমতে বলল মোটকু চার্লি।
‘ঠিক বলেছেন!’
গাড়িটাকে আবার রাস্তায় তুলল ট্যাক্সি ড্রাইভার। মোটকু চার্লিকে জানাল, দ্য ডলফিন হোটেল হিসেবে বেশ ভালো। জানতে চাইল, দ্বীপে কি মোটকু চার্লির আত্মীয় থাকে? কাউকে চেনে সে?
‘আসলে,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘আমি একজনের…এক নারীর খোঁজে এসেছি এখানে।’
ট্যাক্সি ড্রাইভার জানাল, দারুণ বুদ্ধি। কেননা নারীর খোঁজ করার জন্য সেন্ট অ্যান্ড্রুজের চাইতে ভালো জায়গা আর হয় না। কারণ: সেন্ট অ্যান্ড্রুজের মেয়েদের দেহের বাঁক, জ্যামাইকার মেয়েদের দেহের বাঁকের চাইতে কড়া। তারা ট্রিনিদাদিয়ান মেয়েদের চাইতে কম ঝামেলা করে। তাছাড়া ডমিনিকার চাইতে সুন্দরী বেশি। এবং সারা বিশ্বে তাদের চাইতে ভালো রাঁধুনি খুঁজে পাওয়া যাবে না। যদি মোটকু চার্লি আসলেও নারীর খোঁজে এখানে এসে থাকে, তাহলে একদম ভুল করেনি।
‘আমি আসলে বিশেষ এক নারীর খোঁজে এসেছি,’ জানাল মোটকু চার্লি।
সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি ড্রাইভার আশ্বস্ত করল মোটকু চার্লিকে। বুঝিয়ে দিল যে ভাগ্যদেবী তার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন, কেননা এই দ্বীপের প্রত্যেক অধিবাসীকে ট্যাক্সি ড্রাইভার চেনে। যদি কোথাও সারাটা জীবন অতিবাহিত করে কেউ, জানাল সে, তাহলে তেমনটাই হয়। অবশ্য মোটকু চার্লি যে ইংল্যান্ডের সবাইকে চেহারা দেখা মাত্রই চিনতে পারে না, সেটা বাজি ধরে বলতে পারে। মেনে নিলো মোটকু চার্লি, জানাল যে চালকের কথা সত্যি!
‘আমাদের পারিবারিক বন্ধু সে,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘তার নাম: মিসেস হিগলার। কেলিঅ্যান হিগলার। চেনো?’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ট্যাক্সি ড্রাইভার, ভাবছে লোকটা। তারপর বলল, নাহ, এমন কাউকে চেনে না সে। দ্য ডলফিন হোটেলের সামনে থামল গাড়ি, ভাড়া চুকিয়ে দিল মোটকু চার্লি।
ভেতরে পা রাখল মোটকু চার্লি। রিসেপশনে এক যুবতী বসা, তাকে নিজের পাসপোর্ট আর রিজার্ভেশন নম্বর দেখিয়ে দিল সে; লেবুটাকে রাখল ডেস্কের ওপর।
‘সঙ্গে লাগেজ আছে?’
‘না,’ ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বলল মোটকু চার্লি।
‘কিচ্ছু না?’
‘না, শুধু এই লেবু।’
বেশ কয়েকটা ফর্ম পুরণ করতে হলো ওকে, তারপর একটা চাবি দিল ওকে রিসেপশনের মেয়েটা; ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল কামরা।
দরজায় যখন টোকার আওয়াজ হলো, তখন গোসল করছে মোটকু চার্লি। কোমরে একটা তোয়ালে জড়িয়ে নিলো সে। বেলম্যান এসেছে। ‘রিসেপশনে আপনার লেবু ফেলে এসেছেন,’ বলে ওটাকে এগিয়ে দিল মোটকু চার্লির দিকে।
‘ধন্যবাদ,’ জানাল মোটকু চার্লি, দরজা লাগিয়ে আবার গোসলে মন দিল। এরপর সরাসরি আশ্রয় নিলো বিছানায়, দেখতে লাগল অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন।
.
পাহাড় শীর্ষের বাড়ির নরম বিছানায় শুয়ে, অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে গ্রাহাম কোটসও। সেগুলো যেমন অশুভ, তেমনি অনাকাঙ্ক্ষিতও। তবে অপছন্দনীয় বলা যাবে না। জেগে ওঠার পর, পুরোপুরি মনে পড়ে না সেই স্বপ্নগুলো। যদিও ঘুম থেকে ওঠার পর মনে হয়, আগের রাতটা কেটে গেছে বড়ো বড়ো ঘাসের ভেতর দিয়ে বুকে হেঁটে ছোটো প্রাণিদের পিছু ধাওয়া করার মধ্য দিয়ে। থাবার আঘাতে তাদের শিকার করেছে সে, কামড়ে ছিঁড়েছে মাংস।
স্বপ্নে, ওর দাঁতগুলো ছিল ধ্বংসের অস্ত্র।
ঘুম থেকে উঠেই বিভ্রান্ত লাগল ওর নিজেকে, দিনটাকেও অদ্ভুত ঠেকছে। প্রতিদিন সকাল নতুন একটা দিনের প্রতিশ্রুতি নিয়ে আসে। আগের জীবনটাকে পেছনে ফেলে আসার মাত্র এক হপ্তা পরেই, ফেরারি-জীবনের একঘেয়েমি পেয়ে বসেছে ওকে। সুইমিং পুল আছে বাড়িতেই, আছে কোকো- আঙুর-জায়ফলের গাছ; সেলার ভরতি মদের বোতল, মাংসের সেলারটা ফাঁকা, মিডিয়া সেন্টারটা অত্যাধুনিক। স্যাটেলাইট টেলিভিশন, ডিভিডির বিশাল একটা সংগ্রহ, সেই সঙ্গে দেওয়ালে ঝুলতে থাকা হাজারকে হাজার ডলার মূল্যের শিল্পকর্মের মালিক সে। রাঁধুনি প্রতিদিন সকালে এসে ওর জন্য খাবার প্রস্তুতিতে লেগে পড়ে; গৃহপরিচারিকা আর দারোয়ান-কাম- মালী-কাম- পরিচর্যাকারী অপেক্ষা করে তার প্রত্যেকটা আদেশের (বিবাহিত দম্পতি ওরা, প্রতিদিন কয়েক ঘণ্টার জন্য আসে)। খাবার সুস্বাদু, আবহাওয়া —যদি কারও উষ্ণ, রৌদ্রজ্জ্বল দিন পছন্দ হয় তো—একেবারে নিখুঁত। কিন্তু কোনো কিছুই যেন গ্রাহাম কোটসকে ঠিক তৃপ্তি দিতে পারছে না।
ইংল্যান্ড থেকে বেরোবার পর, দাড়ি কামায়নি সে; কিন্তু তাই বলে ঘন দাড়িও গজায়নি চিবুকে, যা আছে তাকে পাতলা দাড়ি বাদে অন্য কিছু বলা যায় না; পুরুষ মানুষের গালে অমন দাড়ি থাকলে তাকে প্রতারক-প্রতারক দেখায়। চোখগুলো বসে আছে, পান্ডাদের মতো লাগে দেখতে; চোখের নিচে জন্ম নিয়েছে থলে, রং এতটাই কালো যে দেখে ক্ষত মনে হয়!
প্রতিদিন পুলে গোসল করে সে, দিনের বেলায়। এছাড়া সূর্যের আলো বলতে গেলে এড়িয়েই চলে; এতো কিছু করে…দিনশেষে ত্বকের ক্যান্সারের কাছে খোয়ানোর জন্য টাকা জমাইনি—বলে নিজেকেই। কিংবা অন্য কিছুর কাছে খোয়ানোর জন্যও না!
লন্ডনের কথা খুব মনে পড়ে। ওখানে ওর পছন্দের যতগুলো রেস্তোরাঁ আছে, প্রত্যেকটার মেইটার ডি তথা প্রধান ওয়েটার ওকে আলাদা নামে ডাকত। নিশ্চিত করত, গ্রাহাম কোটসের মনোরঞ্জনের জন্য যেন সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। লন্ডনে এমন অনেক মানুষ আছে, যাদের কাছ থেকে কিছু-না- কিছু পায় সে; তাই যেকোনো প্রদর্শনীর একদম প্রথম রাতের টিকেট পাওয়া ছিল খুবই সহজ। তার চেয়ে বড়ো কথা, লন্ডনে এমন অনেক থিয়েটার আছে যেখানে রিলিজের দিনই মুভি-নাটক দেখা যায়। ভেবেছিল, নির্বাসনে গেলেও অসুবিধে হবে না; ঠিক নিজেকে উপভোগ করতে পারবে…
…কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ভুল ছিল ধারণাটা।
দোষারোপ করার মতো কাউকে না কাউকে তো চাই, তাই সিদ্ধান্ত নিলো গ্রাহাম কোটস—সব দোষ আসলে মেইভ লিভিংস্টোনের। সেই ওকে চরম পদক্ষেপটা নিতে বাধ্য করেছে, আরেকটু হলেই সব লুটে নিত ওর কাছ থেকে। মহিলা ছিল শেয়ালের মতো ধূর্ত, বনবেড়ালের মতো নৃশংস আর সেই সঙ্গে… ছলনাময়ী। যা পেয়েছে, তা ওর প্রাপ্যই ছিল। উঁহু, আসলে এর চাইতেও অনেক বেশি কিছু প্রাপ্য ছিল মেইভের। টেলিভিশনে গ্রাহাম কোটসের সাক্ষাৎকার দেখানো উচিত ছিল। কল্পনার চোখে শুনতে পেল, নিষ্পাপ কণ্ঠে বোঝাতে চাইছে কীভাবে এক পাগলির কাছ থেকে নিজেকে আর নিজের সম্পদকে রক্ষা করতে চেয়েছিল সে। সত্যি বলতে কী, ওই অফিস থেকে যে বেঁচে ফিরতে পেরেছে, সেটা অলৌকিকের চাইতে কম কিছু না!
গ্রাহাম কোটস নিজেকে নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল। কিন্তু দ্বীপে যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ সে বাসিল ফিনেগান; ব্যাপারটা ওকে খোঁচাচ্ছে। নিজেকে বাসিল বলে মনে হয় না ওর; বাসিলত্বের এই ব্যাপারটা ওকে অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হয়েছে—আসল বাসিল মারা গেছে সেই অল্প বয়সে, ওর আর গ্রাহামের জন্মতারিখ কাছাকাছিই ছিল। জন্মসনদের একটা কপি, সেই সঙ্গে এক কাল্পনিক যাজকের লেখা চিঠি ব্যবহার করে গ্রাহাম কোটস এই পাসপোর্ট আর পরিচয়টা বাগিয়েছে। পরিচয়টা টিকিয়ে রাখতে কষ্টও কম করেনি— নিরেট একটা ক্রেডিট হিস্টোরি আছে বাসিলের, এখানে-সেখানে ভ্রমণ করেছে সে, সেন্ট অ্যান্ড্রুজে না দেখেই কিনেছে বিলাস-বহুল একখানা বাড়ি। কিন্তু গ্রাহামের মনে——অন্তত এতদিন বাসিল আসলে ওর হয়ে কাজ করছিল, অনেকটা কর্মচারীর মতো। কিন্তু এখন কর্মচারীই বনে গেছে মনিব। গ্রাহাম কোটসকে গিলে খেয়েছে বাসিল ফিনেগান।
‘এখানে যদি থাকতে হয় আর কিছুদিন,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘তাহলে পাগল হয়ে যাবো।’
‘কী বললেন?’ গৃহপরিচারিকা জানতে চাইল, হাতে ধরে আছে ডাস্টার। শোবার ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে আছে সে।
‘কিচ্ছু না,’ জানাল গ্রাহাম কোটস।
‘পাগল হয়ে যাবেন বললেন মনে হচ্ছে। বাইরে হেঁটে আসুন। তাজা বাতাসে ভালো লাগবে।’
তাজা বাতাসের ধার ধারে না গ্রাহাম কোটস, কর্মচারীরাই তার হয়ে তাজা বাতাস খেয়ে নিত। তবে ভাবল, হয়তো বাসিল ফিনেগানের একটু হেঁটে আসা দরকার। তাই চওড়া রিমের একটা টুপি পড়ে, স্যান্ডেলের জায়গায় পায়ে দিল হাঁটার জুতো। সেল ফোনটা নিলো সঙ্গে, মালীকে নির্দেশ দিল, যেন ফোন পেলে ওকে এসে নিয়ে যায়। তারপর হাঁটতে শুরু করল সবচাইতে কাছের শহরটার দিকে।
পৃথিবী একেবারেই ক্ষুদ্র। নিজের সম্পর্কে জানতে, এখানে বেশিদিন বাস করতে হয় না। একটা তত্ত্ব বলে: সারা বিশ্বে আসলে মাত্র পাঁচশো জন সত্যিকারের মানুষ বাস করে (অন্য ভাবে বলতে গেলে নাটকে অভিনেতা- অভিনেত্রী তারাই, বাকির—-তত্ত্বমতে—এক্সট্রা)। তারচেয়ে বড়ো কথা, এরা সবাই সবাইকে চেনে। দাবিটা আসলে সত্য, মানে যতটুকু সত্য হওয়া সম্ভব আরকী। আসল সত্যি হলো: এই পৃথিবী এমন পাঁচশো মানুষের হাজারো দলের বিভক্ত। প্রত্যেকেই তাদের জীবন কাটিয়ে দেয় এই বাকি দলগুলোকে এড়িয়ে চলার চেষ্টায় রত হয়ে। কিন্তু দেখা যায়, হয়তো ভ্যানকুভারের কোনো চায়ের দোকানে দেখা হয়ে যাচ্ছে ওদের! পদ্ধতিটা বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবী; আসলে এটাকে কাকতালও বলা যায় না। পৃথিবী এভাবেই কাজ করে, স্বতন্ত্রতা কিংবা একজন মানুষের সম্পত্তি নিয়ে কোনো মাথাব্যথা তার নেই।
তাই উইলিয়ামসটাউনের রাস্তায় একটা ছোট্ট ক্যাফেতে যে গ্রাহাম কোটস কোমল পানীয় কেনার জন্য পা রাখবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। অবশ্য মালীকে ফোন করে ওকে নিতে আসতে বলাও ক্যাফেতে ঢোকার একটা কারণ।
ফান্টা দিতে বলে, টেবিলে বসে পড়ল গ্রাহাম কোটস। দোকানটাকে খালিই বলা চলে: দূরের কোনায় বসে আছে কেবল দুইজন নারী, একজন বয়স্ক ও অন্যজন যুবতী। কফি পান করছে আর পোস্টকার্ডে লিখছে তারা।
বাইরের দিকে তাকাল গ্রাহাম কোটস, সৈকতে যাওয়ার রাস্তার দিকে। জায়গাটাকে স্বর্গই বলা চলে, ভাবল সে। হয়তো স্থানীয় রাজনীতিতে নাক গলালে মন্দ হয় না –শিল্প-সংস্কৃতির পেছনে পয়সা খরচ করে। এমনিতেও দ্বীপের পুলিস বাহিনীকে বেশ কিছু টাকা অনুদান হিসেবে দিয়েছে সে। ব্যাপারটাকে তার নিজের জন্য জরুরিও বলা চলে…
পেছন থেকে ভেসে এলো একটা কণ্ঠ, উত্তেজিত শোনাল ওটাকে। ‘মিস্টার কোটস?’ শুনেই লাফিয়ে উঠল ওর অন্তর। যুবতী মেয়েটা এসে বসল গ্রাহাম কোটসের পাশে। উষ্ণ হাসিতে ভরে উঠল তার চেহারা।
‘এখানে আপনাকে দেখতে পেয়ে অবাক হলাম,’ বলল মেয়েটা। ‘আপনিও ছুটিতে এসেছেন নাকি?’
‘তেমনই কিছু একটা।’ মেয়েটা কে, সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই গ্রাহাম কোর্টসের।
‘আমার কথা মনে নেই আপনার? রোজি নোয়াহ। আমি মোটকু, মানে চার্লি ন্যান্সির প্রেমিকা ছিলাম। মনে পড়েছে?’
‘ওহ, রোজি। অবশ্যই।’
‘আমি ক্রুজে আছি, মায়ের সঙ্গে। সে কিছু পোস্টকার্ড পাঠাচ্ছে বাড়িতে।’
মাথা ঘুরিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল গ্রাহাম কোটস, ফ্লোরাল ড্রেস পরিহিত দক্ষিণ আমেরিকার মমির মতো দেখতে এক মহিলার ওপর নজর পড়ল।
‘সত্যি বলতে কী,’ বলে চলছে রোজি। ‘ক্রুজ-টুজ আমার পছন্দ না। এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে গিয়ে দিন দশেক কাটানো…তাই পরিচিত চেহারা খুঁজে পেয়ে দারুণ লাগছে। তাই না?’
‘পুবশ্যই।’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘তা তোমার আর চার্লসের বাগদান কি ভেঙে গেছে বলে ধরে নেব?’
‘হ্যাঁ,’ জানাল মেয়েটা। ‘তা ধরে নিতে পারেন। মানে, ভেঙে গেছে আরকী।’
গ্রাহাম কোটস সহানুভূতি প্রদর্শনের ভঙ্গিতে হাসল। ফান্টাটা হাতে নিয়ে গিয়ে বসল কোনার টেবিলে, রোজিকে সঙ্গে নিয়ে। পুরাতন, লোহার রেডিয়েটর যেভাবে একটা কামরায় শীতলতার বিচ্ছুরণ করে, রোজির মায়ের কাছ থেকেও সেভাবে ঘৃণা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। কিন্তু গ্রাহাম কোটস খুবই অমায়িক আচরণ করল, সাহায্য করতে চাইল সব ধরনের কাজে। শুধু তাই না, রোজির মায়ের প্রতিটা কথায় মাথা নেড়ে সায় জানাল। আসলেও, ক্রুজ কোম্পানিরা আজকাল যা ইচ্ছে তাই করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থাও একেবারে জঘন্য। এসব দ্বীপে করার মতো বলতে গেলে কোনো কিছুই নেই! আর যাত্রীদের কাছ থেকে যে পরিমাণ ধৈর্যের প্রত্যাশা করা হয়, তা এক কথায় নিন্দনীয়: বাথটাব ছাড়া দশ দিন, ছোট্ট একটা গোসলখানা!
ছিহ!
কিছু আমেরিকান যাত্রীর সঙ্গে সফলতার সঙ্গে ঝগড়া বাঁধিয়েছে রোজির মা, যাদের মূল অপরাধ হলো— অন্তত গ্রাহাম কোটস যা বুঝল সে অনুসারে—দ্য স্কুইক অ্যাটাকের বুফে লাইনে দাঁড়িয়ে ইচ্ছেমতো খাবার প্লেটে তোলা আর অ্যাফট ডেকের পুলের সেই জায়গায় রোদ পোহাতে যাওয়া যেটাকে প্রথম দিন থেকেই রোজির মা নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বলে মনে করে।
মাথা নাড়ল গ্রাহাম কোটস, সহানুভূতির সঙ্গে আওয়াজ করল মুখ দিয়ে; চুপচাপ শুনল ভয়ানক কথাগুলো। রোজির মায়ের প্রত্যেকটা কথায় সহমত হলো লোকটা; ফলে ভদ্রমহিলা ভুলে গেল যে অপরিচিতদের অপছন্দ করে সে, অপছন্দ করে মোটকু চার্লির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সবাইকে। সব ভুলে কথা বলেই চলল তো বলেই চলল সে। এদিকে বলতে গেলে কোনো কথাই শুনছে না গ্রাহাম কোটস। ভাবছে শুধু…
যদি কেউ এই অবস্থায় লন্ডনে গিয়ে কর্তৃপক্ষকে জানায় যে সেন্ট অ্যান্ড্রুজে দেখা গেছে গ্রাহাম কোটসকে——তাহলে ব্যাপারটা দুর্ভাগ্যজনক হবে। সন্দেহ নেই, একদিন না একদিন ওর অবস্থান অবশ্যই জেনে যাবে সবাই, তবে সেটা যত দেরিতে হয় ততই ভালো।
‘অন্তত একটা সমস্যার সমাধান করে দিতে পারি,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘অবশ্যই আপনার অনুমতিক্রমে। এই রাস্তা ধরে খানিকদূর এগোলেই আমার বাড়ি, ছুটি কাটাবার নিমিত্তে কিনেছিলাম। সবমিলিয়ে ব্যবস্থা মন্দ নয়-ই বলব। আর একটা জিনিস যদি বেশি বেশি থেকে থাকে তো সেটা হলো–গোসলখানা। চলুন নাহয় আমার সঙ্গে, সদ্ব্যবহার করতে পারবেন।’
‘আরে না, তবে প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ,’ জানাল রোজি। তবে হ্যাঁ, রাজি হলে ওর মা-ই মনে করিয়ে দিত যে সেদিন বিকেলেই উইলিয়ামসটাউনের জেটিতে থাকতে হবে ওদেরকে, ক্রুজ শিপে ফিরে যাওয়ার জন্য। তারপর প্রায় অপরিচিত একজনের প্রস্তাবে সারা দেওয়ার জন্য বকাবকিও করত।
কিন্তু রোজি যে ‘হ্যাঁ’ বলেনি!
‘আপনার অনেক দয়া,’ বলল রোজির মা। ‘আমরা সঙ্গে যেতে পারলে খুশিই হবো।’
খানিকক্ষণের মাঝেই একটা কালো মার্সিডিজে চড়ে উপস্থিত হলো মালী। রোজি আর ওর মায়ের সম্মানার্থে পেছনের দরজা খুলে দিল গ্রাহাম কোটস। আশ্বস্ত করল, ক্রুজ শিপে পুবশ্যই সময়মতো ওদেরকে পৌঁছে দেবে।
‘কই যাবো, মিস্টার ফিনেগান?’ জিজ্ঞেস করল মালী।
‘বাড়িতে,’ জানাল গ্রাহাম কোটস।
‘মিস্টার ফিনেগান?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল রোজি।
‘পুরাতন, পারিবারিক নাম,’ জবাব দিল গ্রাহাম কোটস, মিথ্যে বলেনি অন্তত। কারও না কারও বংশের নাম ‘ফিনেগান’ তো বটেই। পেছনের দরজা বন্ধ করে দিয়ে নিজে বসল সামনে।
.
দিশেহারা ভূতে পরিণত হয়েছে মেইভ লিভিংস্টোন। শুরুটা দারুণ হয়েছিল অবশ্য: বাড়িতে, মানে পন্টেফ্রাক্টে যেতে চেয়েছিল সে। একটু ঝাপসা হয়ে, বাতাস বইয়ে আর একটু আঁতকে উঠে নিজেকে সে বাড়িতেই আবিষ্কার করে। শেষ বারের মতো পুরো দালানটা ঘুরে দেখে, পা রাখে শরতের আলোতে। রেই-এ বোন থাকে ওর, তাকে দেখার কথা মাথায় আসতেই নিজেকে আবিষ্কার করল রেই-এর বাগানে। ওখানে তার বোন একটা স্প্রিংগার স্প্যানিয়েল নিয়ে হাঁটছে।
এভাবে ভ্রমণ করাটা খুব সহজ ঠেকল মেইভের কাছে।
ঠিক তখনই সিদ্ধান্ত নিলো যে গ্রাহাম কোটসকে দেখতে চায়। পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করল তখন থেকে। মুহূর্তখানেকের জন্য অলডউইচের অফিসে আবিষ্কার করল সে নিজেকে, তারপর পার্লির একটা খালি বাসায়। মনে পড়ে গেল, প্রায় এক দশক আগে এখানে ওদেরকে দাওয়াত দিয়েছিল গ্রাহাম কোটস। তারপর…
কোথায় যে আছে তা বুঝতেই পারছে না। অন্য কোথাও যেতে চাইল, আর তাতেই আরও বড়ো ভজকট গেল পেকে
যেখানে আছে, সেখানে এক পশলা বৃষ্টি হওয়ায় ভিজে গেল চারপাশ; অবশ্যই মেইভ লিভিংস্টোন বাদে। মাটি থেকে বাষ্প উঠছে, তার মানে অন্তত ইংল্যান্ডে নেই। এদিকে চারপাশ দখল করে নিতে শুরু করেছে অন্ধকার।
মাটিতে বসে নাক টানতে শুরু করল বেচারি।
আরে আরে, নিজেকে বলল। মেইভ লিভিংস্টোন, সামলাও নিজেকে। কিন্তু তাতে কাজ হলো না, বরঞ্চ নাক টানার পরিমাণ বেড়ে গেল।
‘টিস্যু দিব?’ জিজ্ঞেস করল কেউ একজন।
চোখ তুলে চাইল মেইভ। পেন্সিলের মতো সরু গোঁফঅলা এক বয়স্ক ভদ্রলোক, সবুজ হ্যাট পরে তার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে ধরেছে।
মাথা নেড়ে সায় জানাল সে। তারপর বলল, ‘কিন্তু মনে হয় না লাভ হবে, ধরতেই পারব না!’
লোকটার হাসিতে সহানুভূতি ঝরে পড়ল, টিস্যুটা মেইভকে ধরিয়ে দিল সে। কী আশ্চর্য, ভদ্রমহিলার আঙুল গলে ওটা পড়ে গেল না। তাই নাক ঝেরে, চোখও মুছে নিলো মেইভ। ‘ধন্যবাদ। এসব দেখতে হলো বলে দুঃখিত। একটু বেশিই বেশি হয়ে গেছে।’
‘এমনটা হয়ই,’ বলে প্রশংসার দৃষ্টিতে মেইভের আগা-পাশ-তলা দেখল লোকটা। ‘আপনি কে? ডাপ্পি?’
‘না,’ জানাল মেইভ। ‘আমার তা মনে হয় না… কিন্তু এই ডাপ্পি আবার কী?’
‘প্রেতাত্মা, ভূত,’ লোকটা জবাব দিল। পেন্সিলের মতো গোঁফের কারণে ক্যাব ক্যালোওয়ে কিংবা ডন অ্যামেচির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে মেইভের। এই ধরনের মানুষরা বয়েস হলেও, ঠিকই স্টার বনে থাকে। বয়সী লোকটা যে-ই হোক না কেন, স্টার যে তাতে সন্দেহ নেই।
‘হ্যাঁ, আমি ওরকমই একজন। কিন্তু… আপনি?’
‘বলা যায়,’ জানাল লোকটা। ‘মারা যে গেছি, তাতে সন্দেহ নেই।’
‘ওহ। আমি এখন কোথায় আছি, জিজ্ঞেস করলে কিছু মনে করবেন?’
‘ফ্লোরিডায় আছি আমরা,’ তাকে বলল লোকটা। ‘কবরস্থানে, এখন এসে ভালোই করেছেন। হাঁটতে যাবো, যাবেন সঙ্গে?’
‘কিন্তু… আপনার না কবরে থাকার কথা?’ ইতস্তত করে অবশেষে প্রশ্নটা করেই বলল মহিলা।
‘একঘেয়েমিতে পেয়েছে,’ প্রশ্নের জবাবে লোকটা জানাল। ‘ভাবলাম, একটু হেঁটে আসি। সুযোগ পেলে মাছও ধরা যাবে।’
আবারও ইতস্তত করল মহিলা, তারপর মাথা নেড়ে সায় জানাল। কথা
বলার মানুষ পেয়ে, ছাড়তে চাচ্ছে না।
‘একটা গল্প শুনতে চান?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল বৃদ্ধ।
‘খুব একটা না,’ সত্যিটাই জানাল মেইভ।
ওকে খাড়া হতে সাহায্য করল লোকটা, তারপর দ্য গার্ডেন অভ রেস্ট থেকে হেঁটে বেরোল একসঙ্গে। ‘বেশ তাহলে, অল্প কথাতেই বলি; বেশি বড়ো করব না। তবে কিনা চাইলে আমি এমন গল্পও শোনাতে পারি যে ফুরাতে হয়তো হপ্তার পর হপ্তা লেগে যায়। আসল রহস্যটা হলো: বিশদ বিবরণ—কী বলবেন, কী বলবেন না…এসব ঠিক করে নিতে হয়। সত্যি বলতে কী, আবহাওয়া আর পোশাকের বর্ণনা বাদ দিলে তো গল্পের অর্ধেকই নাই হয়ে যায়। একবার একটা গল্প বলেছিলাম—’
‘দেখুন,’ বলল মেইভ। ‘গল্প যদি বলতেই চান তো সরাসরি শুরু করে দিন, ঠিক আছে?’ এমনিতেই অন্ধকারে রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে ভালো লাগছে না। বার বার নিজেকে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে, মাতাল কারও গাড়ির নিচে পড়ার সম্ভাবনা নেই তার। তারপরেও স্বস্তি পাচ্ছে না।
এবার হালকা গানের সুরে গল্প বলতে লাগল বুড়ো মানুষটা। ‘যখন বলি ‘বাঘ’,’ শুরু করল সে। ‘তখন বুঝতে হবে, ওটা ভারতীয় দাগকাটা বিড়াল- প্রজাতির প্রাণী না। বড়োসড়ো সব বিড়ালকেই লোকে এই নামে ডাকে-পুমা, ববক্যাট, জাগুয়ার, সবাইকেই। বুঝতে পারলেন?’
‘অবশ্যই।’
‘ভালো। তো…অনেক অনেক আগের কথা,’ কথা চালিয়ে গেল সে। ‘তখন বাঘের দখলেই ছিল সব গল্প। জগতে যত গল্প ছিল, সব ছিল বাঘকে নিয়ে। যত গান ছিল, সব ছিল বাঘের গান। পারলে বলতাম, সব কৌতুকও ছিল বাঘকে নিয়ে। কিন্তু সে এমন এক সময়ের কথা বলছি, যখন ঠাট্টা- কৌতুক চলত না। বাঘের গল্পের আলোচ্য বিষয় ছিল—দাঁত কত শক্ত, কত তীক্ষ্ণ; ছিল কীভাবে শিকার করতে হয়, কীভাবে করতে হয় হত্যা। বাঘের গল্পে নম্রতার স্থান ছিল না, ছিল না চালাকি কিংবা শান্তির স্থানও!
বিশাল একটা বিড়াল কেমন গল্প বলতে পারে তা কল্পনা করতে চাইল মেইভ। ‘নৃশংস ছিল এত?’
‘মাঝে-মধ্যে। তবে খারাপ ছিল সবসময়ই। যখন সব গান আর গল্প ছিল বাঘের, তখন সবার অবস্থাই ছিল মন্দ। চারপাশ থেকে ঘিরে রাখা গান আর গল্পের আদল গ্রহণ করত মানুষজন, বিশেষ করে তারা যাদের নিজস্ব গান ছিল না। বাঘের আমলে সব গানই ছিল অশুভ। শুরু হতো অশ্রুবিসর্জন দিয়ে, শেষ হতো রক্তে; এই পৃথিবীর মানুষরা অবশ্য আর কোনো গান জানত না।
‘তারপর এলো আনানসি। আশা করি আনানসির ব্যাপারে সব জানেন– ‘মনে হয় না!’ জানাল মেইভ।
‘তাই নাকি? তা থাক, আনানসি কতটা বুদ্ধিমান আর সুদর্শন আর চালাক ও মনোহর, যা জানাতে শুরু করলে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত গল্প চলতেই থাকবে।’ বোঝা গেল, শুরু করতে চাচ্ছে বুড়ো।
‘তাহলে থাক,’ মেইভ জানাল। ‘আপনার কথাই মেনে নিলাম। তা এই আনানসি কী করল?’
‘সব গল্প জিতে নিলো। নাহ, জিতে নেওয়া বলাটা ঠিক হবে না; অর্জন করল। বাঘের কাছ থেকে কেড়ে নিলো সব, তারপর এমন ব্যবস্থা করল যেন বাঘ সত্যিকারের দুনিয়ায় আর প্রবেশ করতে না পারে; অন্তত শরীর নিয়ে নয়। মানুষ এরপর যে গল্পগুলো করল, তা হয়ে গেল বাঘের গল্প থেকে আনানসির গল্প। সে প্রায় পনেরো হাজার বছর আগের কথা বলছি।
‘আনানসির গল্পগুলোতে আছে ধূর্ততা, আছে মজা আর জ্ঞান। পৃথিবীর সবগুলো প্রাণ তখন আর শিকার করা কিংবা শিকারি হওয়ার চিন্তায় আটকে থাকত না। তারা ভাবতে শুরু করল সমস্যার কথা—কখনও-সখনও সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে পড়ল নতুন ও বড়ো সমস্যায়। তবে পেট ভরাতে তো তাদের হয়ই, তবে এখন তারা ভাবতে শুরু করল: কীভাবে পরিশ্রম না করে কাজটা করা যায়—তখন থেকেই মানুষ তাদের মাথা খাটাতে শুরু করে। অনেকেই ভাবে, প্রথম যে যন্ত্রটা বানানো হয় তা হলো অস্ত্র। কিন্তু ব্যাপারটা পুরো উলটো। গদার আগে এসেছে ক্র্যাচ, বুঝলে? আনানসির গল্প যখন প্রচলিত হতে শুরু করল, তখন সবাই এটা-সেটা নিয়ে মাথা ঘামাতে শুরু করল। ভাবল: কীভাবে চুমু পাওয়া যায়, কীভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে অর্জন করা যায় এটা সেটা। ওই চিন্তা-ভাবনা থেকেই শুরু হলো দুনিয়াকে সাজানো।’
‘সবই তো শোনা কথা, জানাল মহিলা। ‘গল্পের শুরু তো মানুষের কাছ থেকেই হয়।
‘তাতে কি কিছু যায় আসে?’ জিজ্ঞেস করল বুড়ো লোকটি। ‘হয়তো আনানসি কোনো একটা গল্পের অংশ; পায়ের ক্ষতে মাছি ভনভন করছে, এমন কোনো ছেলে হয়তো ক্র্যাচে হাঁটতে হাঁটতে বানিয়েছিল এই গল্পগুলো; পৃথিবীর শুরু দিকে। আশপাশের সবাইকে শুনিয়েছিল আলকাতরা দিয়ে বানানো মানুষের গল্প। কিন্তু তাতে কি কিছু যায় আসে? মানুষের গল্পের দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়। গল্পগুলো ছড়িয়ে পড়ল, বদলে দিল গল্প-কথকদেরই। কেননা এতদিন যারা শুধু এটাই ভাবত: কীভাবে সিংহের কাছ থেকে পালাতে হয়, কিংবা কুমিরের খাবার হতে না চাইলে পানি থেকে কত দূরে থাকা উচিত, তারা আরও আরামদায়ক একটা আবাসস্থলের কল্পনায় দিন কাটাতে শুরু করল। দুনিয়া হয়তো একই আছে, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি তো বদলে গেছে, তাই না? মানুষের জীবনের সেই গল্পই আছে—সে জন্মায়, এটা-সেটা করে আবার মরে যায়। কিন্তু এখন গল্পগুলো সেই জীবনকেই দান করল আলাদা একটা মাত্রা!’
‘তারমানে, আনানসির গল্পগুলোর আগে দুনিয়াটা ছিল নৃশংস আর জঘন্য?’
‘হ্যাঁ, অনেকটা তেমনই।’
কথাটা হজম করল মেইভ। ‘তাহলে তো,’ আনন্দের সঙ্গে বলল সে। ‘গল্পগুলো আনানসি অর্জন করায় ভালোই হয়েছে।’
বুড়ো মানুষটা মাথা নাড়ল।
‘বাঘ গল্প ফেরত চায় না?’ জিজ্ঞেস করল মহিলা।
মাথা নাড়ল লোকটা। ‘হুম, দশ হাজার বছরেরও আগে থেকে চেষ্টা করছে।’
‘কখনও পাবে না তো?’
জবাবে কিছুই বলল না বুড়ো মানুষটা, চেয়ে রইল দিগন্তের দিকে। বেশ খানিকক্ষণ পর শ্রাগ করে বলল, ‘পেলে তো ব্যাপারটা খুব খারাপ হবে।’
‘আনানসির কী হবে?’
‘আনানসি মারা গেছে,’ জানাল বুড়ো লোকটা। ‘ডাপ্পিরা তেমন কিছু
করতে পারে না।’
‘আমি নিজেও ডাপ্পি, তাই ব্যাপারটা ভালো লাগল না।’
‘কী আর করা, ডাপ্পিরা যে জ্যান্ত কাউকে স্পর্শ করতে পারে না তা ভুলে গেলেন?
এক মুহূর্ত ভাবল মহিলা। ‘তাহলে কী স্পর্শ করতে পারব?’ জানতে চাইল সে।
লোকটার বয়স্ক চেহারায় যে অনুভূতি খেলে গেল তাকে একই সঙ্গে দুষ্টুমিতে ভরা আবার চাতুর্যপূর্ণও বলা চলে। ‘উম,’ বলল সে। ‘আমাকে স্পর্শ করতে পারবেন।
‘আগেই বলে রাখছি,’ জানাল মেইভ। ‘আমি বিবাহিতা।’
জবাবে হাসি ফুটল লোকটার চেহারায়। মিষ্টি আর নরম একটা হাসি, যেমন উষ্ণ তেমনি বিপজ্জনক। ‘এক হিসেবে কিন্তু, মৃত্যু বিয়ের সম্পর্ককে ছিন্ন করে দেয়।’
কথাটাকে পাত্তা দিল না মেইভ।
‘আপনি অবস্তুগত সত্তায় পরিণত হয়েছেন,’ তাকে বলল লোকটা। ‘তাই স্পর্শ করতে পারবেন শুধু অবস্তুগত জিনিসই। এই যেমন আমাকে। মানে, আপনি চাইলে আমরা হাতে হাত ধরে নাচতেও পারব। রাস্তার শেষ মাথায় নাচের একটা জায়গাও আছে। ড্যান্স ফ্লোরে দুইজন ডাপ্পিকে কেউ দেখতেও পাবে না।
ভাবল মেইভ, অনেক দিন হলো নাচে না। ‘আপনি নাচতে জানেন? ‘ জিজ্ঞেস করল সে।
‘আগে তো কেউ কখনও ভিন্ন কিছু বলেনি,’ বুড়ো লোকটা জবাব দিল।
‘আমি একজনকে খুঁজছি—একজন জ্যান্ত মানুষকে–নাম তার গ্রাহাম কোটস,’ বলল মহিলা। ‘সাহায্য করতে পারবেন?’
‘কোনদিকে গেলে পাওয়া যাবে, তা জানাতে পারব,’ বলল বুড়ো। ‘তাহলে বলুন, নাচবেন?’
ঠোঁটে হাসি খেলে গেল মহিলার। ‘পার্টনার কে? আপনি?’
.
স্পাইডারকে যে শিকল বেঁধে রেখেছিল, তা খসে পড়ল। দাঁতে ব্যথার মতো তীব্র, নিরবচ্ছিন্ন যন্ত্রণাটা সারা দেহ জুড়ে অনুভব করছিল বেচারা। এখন তা আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে।
এক পা সামনে ফেলল স্পাইডার।
ওর সামনে যা আছে, তাকে আকাশে চিড় ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না। সেদিকেই এগিয়ে যেতে লাগল স্পাইডার।
সামনে পড়ল একটা দ্বীপ। দ্বীপের ঠিক মাঝখানে আছে একটা ছোট্ট পাহাড়। এখন নিখাদ নীল দেখাচ্ছে আকাশটাকে; বাতাসে দুলছে গাছ, অনেক উঁচুতে ভাসছে একটা সাদা সিগাল। কিন্তু ওর চোখের সামনেই যেন ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে দুনিয়াটা, অনেকটা টেলিস্কোপের উলটো প্রান্তে চোখ রাখার মতো। ছোটো হতে হতে ওটা সরে যাচ্ছে ক্রমেই, যতই জোরে দৌড়াচ্ছে ততই বেড়ে যাচ্ছে দূরত্ব।
দ্বীপটা পানির ডোবায় প্রতিফলনে পরিণত হলো মুহূর্তেই, পরক্ষণেই গেল মিলিয়ে।
নিজেকে সে আবিষ্কার করল একটা গুহায়। প্রত্যেকটা বস্তু ওর অনেক বেশি ধারালো ঠেকছে; এমন কোথাও আগে কখনও পা রাখেনি স্পাইডার। একেবারে ভিন্ন একটা বিশ্ব এটা।
একটা গুহার মুখে দাঁড়িয়ে আছে পাখি-মানবী; বাধা হয়ে আছে ওর আর খোলা বাতাসের মাঝে। মহিলাকে চেনে স্পাইডার, দক্ষিণ লন্ডনের একটা গ্রিক রেস্তোরাঁয় এই চেহারাটাই দেখেছিল সে, যখন পাখি-মানবীর মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল পাখির ঝাঁক।
‘একটা কথা বলতেই হচ্ছে,’ শুরু করল স্পাইডার। ‘তোমার আতিথেয়তার সংজ্ঞা খুবই অদ্ভুত। আমার দুনিয়াতে এলে, তোমার জন্য রাতের খাবার প্রস্তুত করতাম; এমনকী ওয়াইনের বোতলও খুলে, নরম গান শুনিয়ে এমন এক সন্ধ্যা উপহার দিতাম যে কখনও ভুলতে না!’
পাখি-মানবীর চেহারায় কোনো অনুভূতি নেই, কালো পাথরে খোদাই করা মুখ যেন। বাতাস মাঝে-মধ্যে ছোবল বসাচ্ছে জীর্ণ, বাদামি আলখাল্লার প্রান্তে। মুখ খুলল মহিলা, কণ্ঠ উঁচু…যেন দূর থেকে একটা সিগাল কথা বলছে, ‘তোমাকে আমি হরণ করেছি,’ জানাল সে। ‘এখন ওকে ডাকো।’
‘ডাকব? কাকে?’
‘তুমি ভয়ে ভ্যা ভ্যা করে ছাগলের মতো কাঁদবে,’ বলল পাখি-মানবী। ‘গোঙাবে, আর তোমার আতঙ্ক উত্তেজিত করবে তাকে।’
‘মাকড়শারা ভয়ে কাঁদে না,’ স্পাইডার জানাল, মোটামুটি নিশ্চিত যে ভুল বলছে না।
অবসিডিয়ানের টুকরোর মতো কালো, চকচকে চোখ তাকাল তার দিকে। চোখগুলো যেন কৃষ্ণগহ্বর, কোনো কিছুই বাইরে বেরোচ্ছে না। এমনকী তথ্যও না।
‘যদি আমাকে খুন করো,’ জানাল স্পাইডার। ‘তাহলে আমার অভিশাপ তোমার ওপর পতিত হবে।’ আসলেও অভিশাপ দেওয়ার কোনো ক্ষমতা আছে কি না ওর, তা জানে না। থাকার কথা। আর না থাকলেও, ভড়ং ধরতে সমস্যা নেই।
‘আমি তোমাকে খুন করব না,’ বলেই হাত তুলল পাখি-মানবী; আসলে হাত না ওটা, র্যাপটরের নখর। সেই তীক্ষ্ণ নখর দিয়ে স্পাইডারের চেহারায় আঁচড় কাটল মহিলা, তারপর কাটল বুকে। নিষ্ঠুর নখরগুলো কামড় বসাল স্পাইডারের মাংসে, চিঁড়ে ফেলল ত্বক।
ব্যথা লাগল না বটে, তবে স্পাইডার জানে যে অচিরেই ব্যথার ঢেউটা আসবে।
পুঁতির মতো রক্তের ফোঁটা দেখা দিল ওর বুকে, ফোঁটা হয়ে ঝরতে শুরু করল চেহারা থেকে। জ্বালা করে উঠল বেচারার চোখজোড়া, স্পর্শ করল ওর ঠোঁট। স্বাদটা টের পেল স্পাইডার, নাকে পেল লোহার গন্ধ।
‘এবার,’ দূর থেকে ভেসে আসা পাখির কণ্ঠে বলল পাখি-মানবী। ‘তোমার মৃত্যুর ক্ষণ শুরু হলো।’
স্পাইডার বলল, ‘আমরা উভয়ে যুক্তি মেনে চলি। তাই এসো, তোমাকে আরেকটা সম্ভাবনার কথা শোনাই যা আমাদের উভয়ের জন্য লাভজনক হবে।’ মিষ্টি হেসে, বিশ্বাস করানোর মতো ভঙ্গিতে বলল সে।
‘বেশি কথা বলো,’ বলে মাথা নাড়ল মহিলা। ‘আর কোনো কথা হবে না।’
তীক্ষ্ণ নখর স্পাইডারের গলার ভেতর ঢুকিয়ে দিল সে, তারপর মুচড়ে বের করে আনল জিহ্বাটা।
‘কাজ শেষ,’ বলল পাখি- মানবী। তারপর মনে হলো যেন দয়া করেই স্পাইডারের চেহারা স্পর্শ করে বলল, ‘ঘুমাও।’
তাই করল স্পাইডার।
.
রোজির মা, গোসল-টোসল সেরে যেন নতুন উদ্যম ফিরে পেয়ে জ্বলজ্বল করছে!
‘আপনাদেরকে উইলিয়ামসটাউনে ফিরিয়ে দেবার আগে, একবার আমার বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাতে পারি?’ অনুমতি চাইল গ্রাহাম কোটস।
‘আমাদের যে জাহাজে ফেরার সময় হয়ে গেছে, তবে প্রস্তাবের জন্য ধন্যবাদ,’ জানাল রোজি। এখনও গ্রাহাম কোটসের বাড়ির গোসলখানায় গা ভেজাতে সায় দিচ্ছে না ওর মন।
ঘড়ি দেখল ওর মা। ‘আমাদের হাতে নব্বই মিনিটের মতো সময় আছে,’ জানাল সে। ‘জেটিতে ফিরতে মিনিট পনেরোর বেশি সময় লাগবে না। অভদ্রতা কোরো না, রোজি। আমরা আপনার বাড়ি ঘুরে দেখতে পারলে খুশিই হবো।’
তাই প্রথমে বসার ঘর থেকে শুরু করল গ্রাহাম কোটস; এরপর একে একে লাইব্রেরি, টেলিভিশন রুম, খাবার ঘর, রান্নাঘর হয়ে দেখাল সুইমিং পুল। রান্নাঘরের সিঁড়ির নিচে থাকা একটা দরজা খুলল সে, যেটা মূলত কাপবোর্ডের হবার কথা। কিন্তু দেখা গেল, ওখানে আসলে পাথুরে দেওয়াল বিশিষ্ট ওয়াইন সেলারে যাবার রাস্তা! ওয়াইনও দেখাল সে মা-বেটিকে, অধিকাংশই এই বাড়িটা কেনার সময় পেয়েছে। সেলারের একদম শেষ মাথার খালি কামরা, যেটা ফ্রিজ আবিষ্কার হবার আগে মাংস রাখার ভাঁড়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতো, সেটাও দেখাল। এসব কামরা সবসময়ই ঠান্ডা হয়, বানাবার সময়ই ছাদ থেকে শেকল ঝোলাবার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। শিকলের শেষ মাথার নগ্ন হুক দেখে বোঝা যাচ্ছে, একসময় পশুর দেহ ঝুলানো হতো ওটা ব্যবহার করে। মেয়েরা যখন ভেতরে ঢুকছে, তখন ভদ্রতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে লোহার ভারী দরজাটা ধরে রাখল গ্রাহাম কোটস।
‘ইসসিরে,’ বলল সে। ‘এই মাত্র মনে পড়ল, বাতির সুইচ আছে ওপরে। একটু অপেক্ষা করুন।’ বলেই মেয়দেরকে ভেতরে আটকে রেখে দড়াম করে বন্ধ করে দিল দরজা, তারপর তালাও লাগিয়ে দিল!
ধুলো পড়া, ১৯৯৫ চ্যাবলিস প্রিমিয়ার ক্রু-এর একটা বোতল তুলে নিলো র্যাক থেকে।
এরপর প্রায় লাফাতে লাফাতে চলে এলো ওপরের তলায়, তিন কর্মচারীকে জানাল: বাকি সপ্তাহটা তাদের ছুটি।
স্টাডির দিকে যেতে যেতে মনে হলো, ওর পাশে কিছু একটা নিঃশব্দে হাঁটছে। কিন্তু ঘুরে তাকাতেই দেখল…কেউ নেই! তারপরও কেন যেন স্বস্তি পেল না মনে। বোতল খুলে নিজের জন্য হাত খুলে ঢালল ধূসর মদ। আয়েশ করে পান করল সেটুকু; আগে রেড ওয়াইন খুব একটা খাওয়া না হলেও আবিষ্কার করল, ঘনত্ব আর স্বাদটা ঠিক মনপুত হচ্ছে না। রঙটাও হওয়া উচিত ছিল, ভাবল সে, রক্তের মতো।
দ্বিতীয় গ্লাস শেষ করতে গিয়ে বুঝতে পারল: আসলে তার বর্তমান অবস্থার জন্য ভুল মানুষকে দায়ী করছে। মেইভ লিভিংস্টোন বাচ্চার হাতের পুতুল বই আর কিছু না। সব দোষ আসলে –এবং নিঃসন্দেহে—মোটকু চার্লির। সে নাক না গলালে, এবং গ্রাহাম কোর্টসের অফিসের কম্পিউটারে বেআইনি অনুপ্রবেশ না করলে, গ্রাহাম কোটসকে এই নির্বাসন বরণ করে নিতে হতো না। এমনকী নিজেরই ভাঁড়ার ঘরে দুই মহিলাকে আটকেও রাখতে হতো না।
মোটকু চার্লি যদি এখানে থাকত, ভাবল সে, তাহলে কামড়ে ওর গলা ছিঁড়ে ফেলতাম। পরমুহূর্তেই চমকে গেল নিজের ভাবনায় নিজেই উত্তেজিত হয়ে উঠছে বলে।
গ্রাহাম কোর্টসের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়ার ফলাফল কখনওই শুভ হয় না।
সন্ধ্যা এলো, জানালার সামনে দাঁড়িয়ে দ্য স্কুইক অ্যাটাক-কে অলস ভঙ্গিতে সূর্যোদয়ের দিকে এগিয়ে যেতে দেখল গ্রাহাম কোটস। দুইজন যাত্রী যে নেই, তা টের পেতে কত সময় লাগতে পারে ওদের?
জাহাজটার দিকে চেয়ে হাত নাড়তেও ভুলল না সে!
অধ্যায় বারো – যেখানে অনেক কিছুই জীবনে প্রথমবারের মতো করতে হলো মোটকু চার্লিকে
অধ্যায় বারো – যেখানে অনেক কিছুই জীবনে প্রথমবারের মতো করতে হলো মোটকু চার্লিকে
দ্য ডলফিন হোটেলে একজন কনসিয়ার্জ আছে। বয়েস তার কমই, চশমা পরে। এই মুহূর্তে ব্যস্ত একটা পেপারব্যাক নিয়ে, ওটার প্রচ্ছদে গোলাপ আর বন্দুক দেখা যাচ্ছে।
‘একজনকে খুঁজছি আমি,’ জানাল মোটকু চার্লি। ‘এই দ্বীপেই তার থাকার কথা।’
‘কাকে খুঁজছেন?’
‘কেলিঅ্যান হিগলার নাম তার। ভদ্রমহিলা ফ্লোরিডাতে থাকে, আমার পারিবারিক বন্ধু।’
চিন্তিত ভঙ্গিতে বইটা বন্ধ করল যুবক, তারপর চোখ ছোটো ছোটো করে তাকাল মোটকু চার্লির দিকে। পেপারব্যাক বইয়ের পাতায় যখন মানুষকে এমন কিছু করতে দেখা যায়, তখন ধরে নেওয়া হয় সেই ব্যক্তি পরম মনোযোগ দিচ্ছে হাতের কাজে। কিন্তু বাস্তবে করতে দেখে মনে হলো, ছেলেটা বোধহয় ঘুম তাড়াচ্ছে! বলল সে, ‘আপনিই কি লেবুঅলা?’
‘কী?’
যে ভদ্রলোক শুধু লেবু নিয়ে হোটেলে উঠেছেন?’
‘উম, হ্যাঁ। বলতে পারেন।’
হোটেল ম্যানেজারের মতো যার কাজ অতিথির হোটলের ভেতরের-বাইরের সব চাহিদা মেটানো।
‘দয়া করে দেখান তো।’
‘আমার লেবু?’
আগ্রহের সঙ্গে মাথা নাড়ল যুবক।
‘নাহ, দেখানো যাবে না। কামরায় ফেলে এসেছি।’
‘কিন্তু আপনিই তো সেই লেবুঅলা!’
‘মিসেস হিগলারের খোঁজ পেতে সাহায্য করতে পারবেন? এই দ্বীপে হিগলার নামের কেউ বাস করে? আপনার কাছে ফোনবুক আছে? আমার কামরায় থাকবে ভেবেছিলাম, পাইনি।’
‘নামটা খুবই প্রচলিত, বুঝলেন?’ বলল যুবক। ‘ফোন বুক ঘেঁটে ফায়দা নেই।’
‘কতটা প্রচলিত?’
‘এই যেমন ধরুন, জানাল যুবক। ‘আমার নাম বেঞ্জামিন হিগলার। রিসেপশনে যে বসেছে সে আমেরিলা হিগলার।’
‘ওহ, দ্বীপে তাহলে হিগলারের অভাব নেই। বুঝতে পেরেছি।’
‘গানের অনুষ্ঠানের জন্য এসেছেন সেই ভদ্রমহিলা?’
‘কীসের জন্য?’
‘সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান চলবে,’ বলেই একটা লিফলেট সে বাড়িয়ে দিল মোটকু চার্লির দিকে। জানাল উইলি নেলসন (বাতিল) আসার কথা ছিল সেন্ট অ্যান্ড্রুজের গানের অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ হতে।
‘তাহলে বাতিল লেখা যে? কেন বাদ গেল?’
‘যে কারণে গার্থ ব্রুকস বাদ দিয়েছেন। আসলে তাদেরকে কেউ দাওয়াতই দেয়নি!’
‘মনে হয় না আমার মিসেস হিগলার সেজন্য এসেছে। যাই হোক, তার খোঁজ পাওয়াটা খুবই জরুরি। তার কাছে একটা জিনিস আছে, আমার লাগবে। আপনি যদি আমার জায়গায় থাকতেন, তাহলে কোথায় যেতেন খুঁজতে?’
ডেস্কের ড্রয়ার থেকে দ্বীপের একটা মানচিত্র বের করে আনল বেঞ্জামিন হিগলার। ‘আমরা আছি এখানে, উইলিয়ামসটাউনের ঠিক দক্ষিণে…’ শুরু করল সে, কাগজে ফেল্ট কলম দিয়ে দাগ দিল। সেখান থেকে শুরু করে মোটকু চার্লির জন্য পথচলার ও খোঁজাখুঁজির একটা রূপরেখা এঁকে দিল সে: দ্বীপটাকে বেশ কয়েকটা ভাগে ভাগ করল, চাইলেই একজন মানুষের পক্ষে বাইসাইকেল নিয়ে এক দিনে এক ভাগ খুঁজে দেখা সম্ভব। ছোটো ছোটো ক্রসের সাহায্যে আলাদা করে দিল মদের দোকান আর ক্যাফেগুলোর অবস্থান। প্রতিটা পর্যটন কেন্দ্রের পাশে আঁকল বৃত্ত।
তারপর একটা বাইসাইকেল ভাড়া দিল মোটকু চার্লিকে।
প্যাডেল চালিয়ে দক্ষিণে রওয়ানা দিল বেচারা।
সেন্ট অ্যান্ড্রুজে তথ্য পাবার বেশ কিছু জায়গা আছে, যার অস্তিত্বের কথা মোটকু চার্লি কল্পনাও করতে পারেনি। মুখে না বললেও মনে বিশ্বাস করে, সেলুলার ফোন আর নারিকেলের গাছের সারি… দুটোই একই সময়ে একই জায়গায় থাকা উচিত না; হয়তো কল্পনার ব্যর্থতা সেজন্যই। যার সঙ্গেই কথা বলুক না কেন, চাই সে হোক—ছায়ায় বসে বাদ্য বাজানো বুড়ো… কিংবা তরমুজের মতো স্তন, আর্মচেয়ারের মতো নিতম্ব আর মকিংবার্ডের মতো হাসি হাসা নারী…টুরিস্ট অফিসে কর্মরত সুবিবেচক যুবতী… সবুজ, লাল আর হলদে রঙা টুপি আর উলের মিনি স্কার্ট পরা রাস্তাফারি—প্রথম যে প্রশ্নটা করল সেটা হলো একই: ‘আপনি বা তুমিই কি সে লেবুঅলা?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে!’
‘দেখি লেবুটা।’
‘হোটেলে ফেলে এসেছি। আমি কেলিঅ্যান হিগলার নামের এক মহিলাকে খুঁজছি। বয়েস ষাটের ঘরে হবে, আমেরিকান। হাতে কফির বড়ো মগ থাকে সবসময়।’
‘চিনি না, জীবনেও দেখিনি।’
সাইকেল চালিয়েই দ্বীপটা ঘুরে দেখল মোটকু চার্লি। অচিরেই টের পেল, কাজটা একেবারে বিপদমুক্ত না। এই দ্বীপে চলাফেরার মূল উপায় হচ্ছে মিনিবাসের ব্যবহার। কিন্তু ওগুলো লাইসেন্সবিহীন, বিপজ্জনক, অতিরিক্ত যাত্রীবাহী… রাস্তা খারাপ বলে ব্রেক কষলেই তীব্র আওয়াজ কানে আসে, চাকাও ঠিকমতো দাঁত বসাতে পারে না রাস্তায়। প্রায়শই দেখা যায় বাহনগুলো দুই চাকার ওপর দাঁড়া হয়ে গেছে, চালকের ভাবনা থাকে—নিশ্চয়ই যাত্রীর ওজনের কারণে ভারসাম্য পেয়ে যাবে তার মিনিবাস। প্রথম দিন সকালেই কয়েকবার মরতে বসেছিল মোটকু চার্লি, বাসের সাউন্ড সিস্টেমকে ছাপিয়ে ভেতরে বাজতে থাকা ড্রামের ধাম-ধাম শব্দ না থাকলে হয়তো সেটাই হতো। এমনকী ইঞ্জিনের আওয়াজ কানে আসার আগেই পাকস্থলীতে অনুভব করতে পারছিল সেই কম্পন। তাই সাইকেলসহ রাস্তা থেকে নেমে গিয়ে জান বাঁচাতে সক্ষম হয়েছে সে!
যাদের সঙ্গে কথা হলো, তাদের কারও কাছ থেকেই বলতে গেলে কোনো সাহায্য পেল না মোটকু চার্লি; তবে নিঃসন্দেহে তাদের প্রত্যেকেই বন্ধুসুলভ আচরণ করল ওর সঙ্গে। দক্ষিণে খোঁজাখুঁজি চালাবার সময় বেশ কয়েকবার পানির বোতল ভরতে হলো ওকে, সেজন্য থামল ক্যাফেতে আর ব্যক্তি মালিকানাধীন বাড়িতে। সবাইকে খুশিই মনে হলো তাকে দেখে, যদিও কেউই মিসেস হিগলারের ব্যাপারে কিছুই জানাতে পারল না। রাতের খাবার খাওয়ার আগে ফিরে এলো দ্য ডলফিন হোটেলে।
পরেরদিন মোটকু চার্লি গেল উত্তর দিকে। উইলিয়ামসটাউনে ফেরার পথে, মানে বিকেলের দিকে, থামল একটা খাড়া পাহাড়ে। সাইকেল থেকে নেমে, ওটাকে ঠেলে নিয়ে গেল একাকীত্বের মাঝে আশ্রয় নেওয়া একখানা বিলাসী দালানে। বাড়িটার সামনে আছে কেবল একটা উপসাগর। স্পিকার- ফোনের কাছে গিয়ে, বোতাম চেপে ‘হ্যালো’ বলল সে, কিন্তু জবাব পেল না ওপাশ থেকে। গাড়িপথে বসে আছে একটা বড়োসড়ো, কালো গাড়ি। একবার ভাবল, হয়তো কেউ নেই বাড়িতে। কিন্তু ওপরের তলার একটা জানালা পর্দা নড়ে উঠে ওকে বুঝিয়ে দিল যে ধারণাটা সঠিক নয়।
আরেকবার বোতাম চাপল ও। ‘হ্যালো,’ বলল সে। ‘পানি ভরার অনুমতি চাইছি।
এবারও জবাব পেল না। মনে হতে লাগল ওর: হয়তো পর্দার নড়ন-চড়ন দেখাটা ওর দৃষ্টিভ্রম। আজকাল প্রায়শই এমন উলটোপালটা জিনিস দেখে বেড়াচ্ছে সে; কেবলই মনে হচ্ছে যেন কেউ একজন নজর রাখছে ওর ওপরে। নাহ, বাড়ির অধিবাসী না; নজর রাখছে রাস্তার পাশে থাকা ঝোপের আড়ালে থাকা কেউ একজন। ‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত,’ স্পিকারে বলল সে, তারপর চড়ে বসল সাইকেলে। উইলিয়ামসটাউনে যাবার পথটা কেবলই উৎরাই, তাই খুব একটা কঠিন হবে না। আর তাছাড়া, পথে একটা-দুটো ক্যাফে তো পড়বেই…
…হয়তো বন্ধুবৎসল বাড়িও পড়তে পারে।
পথ ধরে নিচে নামার সময় — সাগরের দিকে খাড়া হয়ে গেছে দেওয়াল- পেছন থেকে গর্জন করতে করতে ছুটে এলো একটা কালো গাড়ি। মোটকু চার্লি বুঝতে পারল, ঘটনা এবার ঘটেই যাবে। চালক ওকে দেখতে পায়নি।
হলোও তাই…গাড়ির দেহে দেখা গেল সাইকেলে হ্যান্ডেলবারের ছাপ, মোটকু চার্লি নিজেকে সাইকেলসহ পাহাড় থেকে পড়ন্ত অবস্থায় আবিষ্কার ।করল! এদিকে কালো গাড়িটার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, সেটা ছুটেই যাচ্ছে সামনে।
পাহাড়ের অর্ধেকটা গড়িয়ে পড়ার পর, নিজেকে কোনোমতে সামলাতে পারল মোটকু চার্লি। ‘আরেকটু হলেই গেছিলাম,’ উচ্চকণ্ঠেই বলল সে। হ্যান্ডেলবার বেঁকে গেছে। ওটাকে আবার রাস্তায় নিয়ে এলো সে, পেছন থেকে ভেসে আসা কম্পন ওকে জানিয়ে দিল—একটা মিনিবাস আসছে। হাত নেড়ে থামাল ওটাকে।
‘আমার সাইকেলটা পেছনে নেওয়া যাবে?’
‘জায়গা নেই,’ জানাল চালক। তবে সিটের নিচ থেকে কিছু বাঞ্জি কর্ড বের করে এনে, সেগুলো দিয়ে সাইকেলটাকে বেঁধে ফেলল বাসের ছাদের সঙ্গে। তারপর হাসল, ‘তুমি নিশ্চয়ই লেবুঅলা ইংরেজ?’
‘আমার সঙ্গে নেই এই মুহূর্তে, হোটেলে রেখে এসেছি।’
কোনোক্রমে মোটকু চার্লি গুটিসুটি মেরে ঢুকে পড়ল ভেতরে। বসার মতো জায়গা পেল বটে, তবে পাশেই রয়েছে দশাসই এক মহিলা; সে আবার বসে আছে কোলে একটা মুরগি নিয়ে। ওদের পেছনে বসেছে দুই শ্বেতাঙ্গ মেয়ে, আগের রাতে যে পার্টিতে যোগ দিয়েছে সেটার ব্যাপারে আলোচনা করছে; সেই সঙ্গে ছুটির এই সময়টায় যে অস্থায়ী প্রেমিক জোগাড় করেছে তাদের কমতি নিয়েও
কালো গাড়িটাকে দেখতে পেল মোটকু চার্লি—একটা মার্সিডিজ-ফিরে আসছে রাস্তা ধরে। একপাশে লম্বা একটা দাগ দেখা যাচ্ছে পরিষ্কার ভাবে। অপরাধ বোধ জন্ম নিলো মোটকু চার্লির মনে, ভাবল যে গাড়ির রং ঠিক করতে আবার যেন বেশি খরচ হয়ে না যায় মালিকের। জানালাগুলো এতটাই কালো যে মনে হচ্ছে: গাড়িটা বুঝি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছে…
সাদা যুবতীদের একজন টোকা দিল মোটকু চার্লির কাঁধে, জিজ্ঞেস করল—রাতের কোনো জমজমাট পার্টির হদিস দিতে পারবে কি না সে। যখন ছেলেটা জানাল: এমন কিছু সে জানে না, তখন নিজে থেকেই দুই রাত আগে গুহায় করা পার্টির গল্প শোনাল। ওতে ছিল একটা সুইমিং পুল, সাউন্ড সিস্টেম, আলো আর এটা-সেটা সব কিছু। তাই কালো মার্সিডিজটা যে মিনিবাসের পিছু পিছু আসছে তা টের পেল না মোটকু চার্লি। গাড়িটা বিদায় নিলো ওকে সাইকেলটা মিনিবাসের ছাদ থেকে খুলে (‘পরেরবার, লেবু সঙ্গে নিয়ে বের হবে কিন্তু’) হোটেল লবিতে ওটাকে সঙ্গে নিয়ে ঢুকতে দেখে।
গাড়িটা যে পাহাড়ের ওপরের প্রাসাদে ফিরে গেল, সেটাও জানা হলো না তার।
বেঞ্জামিন নামের কনসিয়ার্জ সাইকেলটাকে ভালোভাবে পরখ করে দেখল, তারপর জানাল মোটকু চার্লিকে: ভাবনার কোনো কারণ নেই, কালকের মাঝে সব মেরামত করা হয়ে যাবে।
হোটেলের কামরায় ফিরে গেল মোটকু চার্লি। সেখানেই, কাউন্টারটপের ওপরে, পানির তলের রং ধারণ করে, ছোট্ট একটা সবুজ বুদ্ধ মূর্তির মতো বসে আছে লেবুটা।
‘তোমাকে দিয়ে লাভটা কী হলো?’ লেবুকে বলল সে। কাজটা একেবারেই অহেতুক হয়ে গেল, লেবুটা একেবারেই সাধারণ; অনন্য কিছু নেই ওটার মাঝে। লেবুটার যা করার কথা, তাই করছে সে।
.
গল্পের সঙ্গে সহজেই তুলনা করা যায় মাকড়শার জালের। একটা সুতোর সঙ্গে আরেকটা সুতোর সম্পর্ক থাকে ভালো ভাবেই। তাই প্রত্যেকটা গল্পকে অনুসরণ করে পৌঁছানো যায় তার কেন্দ্রে, কেননা গল্পের সমাপ্তি থাকে সেই কেন্দ্রেই।
আর প্রতিটি মানুষ হচ্ছে এক-একটা সুতো।
এই যেমন, ডেইজি।
এতগুলো বছর পুলিস ফোর্সে টিকে থাকতে পারত না মেয়েটা, যদি না ওর মাঝে কাণ্ডজ্ঞান থাকত; অধিকাংশ মানুষ অবশ্য ডেইজির মাঝে সেটাই খুঁজে পায়। আইনকে সম্মান করে সে, সম্মান করে নিয়মকে। জানে, অনেক নিয়মই আসলে ধূসর—এই যেমন কোথায় গাড়ি পার্ক করা হবে, কিংবা কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখবে–কিন্তু এই নিয়মগুলোই দুনিয়াকে সচল রাখে, নিরাপত্তা দেয় সমাজকে।
দূর করে সব ঝুঁকি আর বিপদাশঙ্কা।
এদিকে ওর ফ্ল্যাটমেট, ক্যারোলের মতে— পাগল হয়ে গেছে ডেইজি!
‘এভাবে কাজ ফাঁকি দিয়ে সেটাকে ছুটি বলে চালিয়ে দিতে পারবে না। এভাবে কিছু হয় নাকি? টিভির কপ শোয়ের নায়িকা যে নও, সেটা ভুলে গেছ? একটা সূত্রের খোঁজে পৃথিবীর এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যেতে চাচ্ছ!’
‘আরে না, সেটা কে বলল?’ বিদ্রুপের সঙ্গে বলল ডেইজি। ‘আমি যাচ্ছি ছুটি কাটাতে।’
এমন দৃঢ়তার সঙ্গে বলল কথাটা যে ডেইজির মগজের পেছনের অংশে লুকিয়ে থাকা বিবেচনাবোধ-সম্পন্ন পুলিস অফিসারটা চমকে চুপ হয়ে গেল। তবে সেটার স্থায়িত্ব হলো মাত্র এক মুহূর্তের জন্য। পরক্ষণেই বোঝাতে লাগল ওকে: ভুল করছে। অনুনোমোদিত ছুটিতে যাচ্ছে সে–যার অর্থ দায়িত্বে ফাঁকি দেওয়া, জানাল সেই অফিসার—সেই সঙ্গে কাউকে না জানিয়ে দেশ ছাড়ার অপরাধ তো আছেই।
বিমানবন্দরে যাবার পথেও চুপ করল না কণ্ঠটা, করল না আটলান্টিক পেরোবার সময়ও। বুঝিয়ে দিল: কোনোভাবে যদি ওর ফাইলে চিরস্থায়ী কালো দাগ পড়ে নাও যায়… এবং কোনোভাবে চাকরি বাঁচাতে পারে… এবং গ্রাহাম কোটসকে যদি খুঁজেও পায়…তারপরেও কিচ্ছু করতে পারবে না। এমনকী খোদ অপরাধীকেও বিদেশের মাটি থেকে অপহরণ করাটা সম্রাজ্ঞীর পুলিসবাহিনী ভালো নজরে দেখবে না। তাকে গ্রেফতার করার কোনো উপায় নেই…আর গ্রাহাম কোটসকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে যুক্তরাজ্যে ফিরিয়ে আনতে পারে—এমন সম্ভাবনাও শূন্যের কোঠায়।
জ্যামাইকায় পৌঁছে ছোট্ট বিমান থেকে বেরোবার এবং সেন্ট অ্যান্ড্রুজের ভেজা, ঝাঁঝাল, সোঁদা… প্রায় মিষ্টি বাতাসের স্বাদ পাওয়ার পর ওর ভেতরের বিবেচক অফিসারটি ওকে পাগলামিটার কথা বলা বন্ধ করল। কারণ তার কণ্ঠ ঢাকা পড়ে গেল আরেকটা কণ্ঠের নিচে। ‘অপরাধীরা সাবধান!’ বলছে সেটা। ‘সাবধান! সতর্ক থাকো! চারিদিকে শয়তান আর শয়তান!’ সেই তালে তালে পা ফেলছে ডেইজি। গ্রাহাম কোটস তার অলডউইচের অফিসে এক মহিলাকে হত্যা করেছে, তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে গেছে কোনো সাজা না পেয়ে!
এবং সবই করেছে ডেইজির নাকের নিচে।
মাথা নেড়ে ব্যাগটা বুঝে নিলো ডেইজি। তারপর হেসে ইমিগ্রেশন অফিসারকে জানাল যে ছুটি কাটাতে এসেছে। তারপর এগিয়ে গেল ট্যাক্সির সারির দিকে।
‘হোটেল দরকার। খুব বেশি খরুচে যেন না হয়, কিংবা একেবারে বাজেও চাই না।’ চালককে জানাল সে।
‘আপনার জন্য উপযুক্ত হোটেলেই নিয়ে যাবো,’ জানাল চালক। ‘উঠে বসুন।’
.
চোখ খুলতেই স্পাইডার আবিষ্কার করল: হাত-পা বেঁধে কেউ ঝুলিয়ে রেখেছে ওকে। উলটো হয়ে পড়ে আছে সে, হাত বেঁধে রাখা হয়েছে মাটিতে গুঁজে রাখা একটা বিশাল গজালের সঙ্গে; গজালটা ওটার ঠিক সামনেই। পা নাড়াতে পারছে না; ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে কে আছে তা দেখবে, সেটার উপায়ও নেই। তবে বাজি ধরে বলতে পারবে, হাতের মতো পা-ও বেঁধে রাখা হয়েছে ওর। নিজেকে মাটির ওপর থেকে উঠিয়ে পেছন দিকে তাকাবার চেষ্টা করতেই জ্বলে উঠল কাটা-ছেঁড়া করা জায়গাগুলোতে।
মুখ খুলল ও, সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে আছড়ে পড়ল কালো রক্ত; ভিজিয়ে দিল মাটি।
একটা শব্দ শুনে সেদিকে ঘাড় ঘোরাবার প্রয়াস পেল স্পাইডার, দেখল : এক শ্বেতাঙ্গ মহিলা চোখে কৌতূহল নিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে।
‘ঠিক আছ? যাহ, প্রশ্নটাই বাজে। তোমার অবস্থা তো দেখতেই পাচ্ছি। আরেকটা ডাপ্পি নাকি তুমি? ঠিক বললাম তো?
ভাবল স্পাইডার। নিজেকে ওর ডাপ্পি মনে হচ্ছে না, দুই পাশে মাথা নাড়ল তাই।
‘হলেও তাতে কী? আমি নিজেই তো ডাপ্পি। এই শব্দের সঙ্গে আগে পরিচয় ছিল না, কিন্তু পথ চলতে গিয়ে এক মজাদার ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সেই বয়স্কা মানুষটিই এই শব্দের ব্যাখ্যা আমাকে বললেন। দেখা যাক, তোমার কোনো সাহায্যে আসতে পারি কি না।’
স্পাইডারের পাশে উবু হয়ে বসে, হাত বাড়াল বাঁধন খুলতে।
কিন্তু ওর হাতটা ভেদ করে গেল যুবকের দেহ। মহিলার আঙুলের ছোঁয়া অনুভব করল বটে স্পাইডার, অনেকটা কুয়াশার মতো…
‘তোমাকে স্পর্শ করতে পারব বলে মনে হয় না, জানাল মহিলা। ‘সেটাও শাপে বর। এর মানে—তুমি এখনও মারা যাওনি। খুশি হও।’
অদ্ভুত এই ভূতুড়ে নারী যত দ্রুত চলে যায় এখান থেকে, ততই ভালো- ভাবল স্পাইডার। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে পারছে না একদম।
‘যাই হোক, সব কিছু বুঝে নিতে চাই প্রথমে। তবে আমার খুনির বিরুদ্ধে প্রতিশোধ না নিয়ে দুনিয়া ছাড়ব না। মরিসকে বুঝিয়ে বলেছি সব— সেলফ্রিজেসের একটা টেলিভিশনের পর্দায় — অবশ্য আমাকে বলছিল যে পর্দার ওপারে যাওয়ার ব্যাপারটাই নাকি আমি ধরতে পারছি না। তবে বলে দিচ্ছি: এক গালে থাপ্পড় খেলে আরেক গাল পেতে দেবো, এই আশা করলে হতাশ হতে হবে। আগেও তার প্রমাণ দেখিয়েছি। সুযোগ পেলে আমিও ব্যাঙ্কো বনে যেতে পারব। কথা বলতে জানো না?’
স্পাইডার মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে জানে, কিন্তু তা করতে গিয়ে কপাল একটা থেকে রক্তের ফোঁটা এসে পড়ল চোখে; জ্বলে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। নতুন জিভ গজাতে কত সময় লাগবে, ভাবল একবার। প্রতিদিন একটা করে নতুন কলিজা গজাত প্রমিথিউসের, স্পাইডার মোটামুটি নিশ্চিত যে কলিজা গজানোটা জিভ গজানোর চাইতে অনেক বেশি কঠিন। হাজারো জিনিস থাকে কলিজায় — বিলিরুবিন, ইউরিয়া, এনজাইম। মদ পর্যন্ত ভেঙে যায় কলিজায় গিয়ে, তাই অনেক কিছু করতে হয় শরীরের ওই অঙ্গটাকে। আর জিভ? তার একটাই কাজ—কথা বলা। অবশ্য চাটাও আছে…
‘আমার এত কথা বলার সময় নেই।’ হলদে চুলো প্রেত-নারী বলল। ‘অনেক লম্বা পথ পাড়ি দিতে হবে বলেই মনে হচ্ছে।’ হাঁটতে শুরু করল সে, যতই দূরে যাচ্ছে ততই যেন মিলিয়ে যাচ্ছে অবয়ব। মাথা তুলে মহিলার আত্মাকে এক বাস্তবতা থেকে অন্য বাস্তবতায় মিশে যেতে দেখল স্পাইডার; অনেকটা সূর্যের আলোয় ঝলসে যেতে শুরু করা ছবির মতো। তাকে ডাকার চেষ্টা করল বেচারা, কিন্তু জিভ ছাড়া মুখ থেকে বেরোল শুধু অসংলগ্ন কিছু শব্দ।
দূরে কোথাও থেকে ভেসে আসছে পাখির চিৎকার।
আরেকবার চেষ্টা করে দেখল স্পাইডার, কিন্তু বাঁধন আলগা করতে পারল না।
আরও একবার ভাবতে শুরু করল সে রোজির বলা গল্পটা, যে গল্পে পাহাড়ি সিংহের হাত থেকে মানুষকে বাঁচিয়েছিল একটা দাঁড়কাক। গল্পটা ওর মাথায় খোঁচাচ্ছে শুধু, চেহারা আর বুকে থাকা নখের আঘাতের চাইতে বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে। মনোযোগ দাও। লোকটা শুয়ে আছে মাটিতে, বই পড়ছে কিংবা রোদ পোহাচ্ছে। এদিকে গাছে বসে চেঁচাচ্ছে দাঁড়কাক। নিচে অপেক্ষা করছে একটা বড়োসড়ো বিড়াল…
যেন ওর সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকে সাজিয়ে নিলো গল্পটা। কিছুই বদলায়নি…উপাদানগুলোকে কী চোখে দেখা হচ্ছে, তার ওপরেই নির্ভর করছে সব কিছু।
যদি, ভাবল সে, ধরে নিই—পাখিটা আসলে মানুষকে সাবধান করে বলতে চাচ্ছে না যে একটা বিশাল সিংহ ওর জন্য ওঁত পেতে আছে; বরঞ্চ পাহাড়ি সিংহটাকে সাবধান করে দিতে চাইছে যে মাটিতে শুয়ে আছে একটা মৃত, ঘুমন্ত কিংবা মরণাপন্ন মানুষ— তাহলে? সিংহের করণীয় তখন শুধু একটাই মানুষটাকে শেষ করে দেওয়া। সেক্ষেত্রে লাশের যতটুকু অবশিষ্ট থাকবে সিংহের পেটপুজোর পর, সেটা যাবে দাঁড়কাকের ভোগে।
গোঙানোর জন্য মুখ খুলল স্পাইডার। রক্ত ওর মুখ থেকে বেরিয়ে এসে দানাদার মাটিতে জমাট বাঁধতে শুরু করল
পাতলা হয়ে এলো বাস্তবতা; সময় বয়ে যাচ্ছে, সেই সঙ্গে বাস্তবতা বদলে যাচ্ছে ওই দৃশ্যের আদলে।
জিভহীন, ক্ষিপ্ত স্পাইডার মাথা তুলে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখতে চাইল চারপাশে ঘুরপাক করতে থাকা ভূতুড়ে পাখিগুলোকে। ক্রমাগত চেঁচিয়েই চলছে ওগুলো।
কোথায় পড়ে আছে, তা বোঝার প্রয়াস পেল সে এরপর। পাখি-মানবীর তামাটে রঙা বিশ্বে যে নেই, কিংবা নেই তার গুহায়—এতটুকু পরিষ্কার। আগে যে স্থানটাকে আসল দুনিয়া বলে ভাবত, নেই সেখানেও। হ্যাঁ, সেই দুনিয়ার কাছাকাছি কোথাও আছে। এত কাছে যে তার উপস্থিতি টের পাচ্ছে স্পাইডার, মুখে রক্তের ধাতব স্বাদ না পেলে হয়তো তার স্বাদও পেত! আর মাটিতে গজাল পুঁতে বেঁধে রাখা না হলে, সেই দুনিয়াকে স্পর্শ করতেও অসুবিধে হতো না।
নিজের মানসিক স্থিরতা নিয়ে যদি শতভাগ নিশ্চিত না হতো—যে নিশ্চয়তা সাধারণত যেসব মানুষ নিজেকে পৃথিবীর উদ্ধারকর্তা, জুলিয়াস সিজার ভাবে—তাহলে পাগল হয়ে যেত। প্রথমে দেখতে পেল এক সোনালি- চুলো মহিলা যে নিজের পরিচয় দিল ডাপ্পি বলে, এখন শুনতে পাচ্ছে অদ্ভুত সব কণ্ঠ।
আসলে সব কণ্ঠ না, একটা কণ্ঠ…যেটার মালিক রোজি!
মেয়েটা বলছে। ‘ঠিক জানি না। ভেবেছিলাম ছুটি কাটাবো। কিন্তু ওই বাচ্চাগুলোকে দেখার পর, তাও আবার ওই অবস্থায়, নিজেকে সামলে রাখা কঠিন। কত কী থেকে বঞ্চিত বেচারারা।’ স্পাইডার কথাগুলোর ওজন আঁচ করতে পারার আগেই যোগ করল। ‘আরও কতক্ষণ যে গোসলে খরচ করবে, তাই ভাবছি। কপাল ভালো যে আপনার এখানে গরম পানির অভাব নেই।’
রোজির কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ কি না, তাই ভাবতে বসল স্পাইডার। হয়তো এই অবস্থা থেকে উদ্ধারের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে মেয়েটার কথার মাঝেই। সন্দেহ আছে ওর। তারপরেও কান পেতে শুনতে লাগল, ভাবছে: বাতাসের ডানায় ভেসে অন্য দুনিয়া থেকে ওর কানে আর কোনো শব্দ আসবে কি না। সমুদ্রের তটে ঢেউ আছড়ে পড়ার আওয়াজ বাদে আর কিছুই শুনতে পেল না অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও। আছে তো কেবলই নীরবতা, সেই নীরবতাও বিশেষ এক ধরনের।
মোটকু চার্লি যেমনটা ভাবত: নীরবতা আছে অনেক প্রকারের। কবরস্থানের আছে তার নিজস্ব নীরবতা, তেমনি আছে মহাকাশেরও; আবার পাহাড়ের শীর্ষে গেলে পাওয়া যায় তার নীরবতা। ভয়ংকর এক প্রকাশের নীরবতাও আছে, যা পিছু ছাড়তে চায় না। তেমনি আছে শিকারের নিস্তব্ধতা। সেই নীরবতার মাঝে কিছু একটা নড়া-চড়া করছে ভেলভেটের মতো থাবার ওপর ভর দিয়ে, তার নরম লোম-চামড়ার নিচে সঙ্কুচিত হয়ে আছে ইস্পাতের মতো কঠিন মাংসপেশি। লম্বা ঘাসের ভেতর হাঁটছে ছায়া, বোঝা যাচ্ছে যে ইচ্ছে করে নিজের উপস্থিতি জানান না দিলে শিকারের বোঝার কোনো উপায় নেই। যেন নীরবতাই ওর সামনে এদিক থেকে ওদিকে ঘোরাফেরা করছে, ধীর পায়ে কিন্তু নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। প্রতি মুহূর্তে কাছিয়ে আসছে স্পাইডারের।
নীরবতার মাঝেও সেটা শুনতে পেল স্পাইডার, ঘাড়ের পেছনের লোমগুলো খাড়া হয়ে গেল। মুখ পরিষ্কার করল সে থুতুর সঙ্গে রক্ত বের করে দিয়ে, তারপর শুরু হলো অপেক্ষা।
.
পাহাড়-শীর্ষের বিলাসী বাড়িটায় পায়চারী করছে গ্রাহাম কোটস। শোবার ঘর থেকে হেঁটে যাচ্ছে স্টাডিতে, তারপর সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে রান্নাঘর হয়েই আবার ওপর তলার লাইব্রেরিতে; টহল শেষ হচ্ছে আবার শোবার ঘরে এসে নিজের ওপরেই রেগে আছে: রোজির আগমন কাকতালীয়, সেটা ভাবার মতো বোকামি করল কীভাবে?
ঘণ্টি বাজানোর পর যখন ক্লোজড সার্কিট টিভির পর্দার দিকে তাকাল, তখন মোটকু চার্লির চেহারা দেখেই বুঝে গেছিল যা বোঝার। ভুল করার কোনো উপায়ই নেই। ষড়যন্ত্র হচ্ছে ওর বিরুদ্ধে।
বাঘের মতো আচরণ করেছে গ্রাহাম কোর্টস, গাড়িতে বসে ভেবেছিল খুব সহজেই মোটকু চার্লিকে পিষে ফেলতে পারবে চাকার নিচে: সাইকেল চালকের থেঁতলানো লাশ দেখতে পেলে সবাই সেটাকে মিনিবাসের কাজ বলেই ধরে নেবে। কপাল মন্দ যে ছেলেটা রাস্তার এতটা ধারে গিয়ে সাইকেল চালাচ্ছিল। বেশি কাছে গেলে ওর নিজের গাড়িই খাদে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এখন আফসোস হচ্ছে। সন্দেহ নেই, মোটকু চার্লিই ওই দুই নারীকে পাঠিয়েছে ভাঁড়ারে, ওর ওপর টিকটিকিগিরি চালাতে। এমনকী তার বাড়ির ভেতরেও ঢুকে পড়েছিল মেয়ে দুজন। নিজেকে বাঁচাবার জন্য সময়মতো যে ব্যাপারটা ধরতে পেরেছে, সেজন্য ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। প্রথম দেখাতেই বুঝে গেছিল: কোথাও কোনো কিন্তু আছে।
মহিলাদের কথা ভাবতেই মনে পড়ল: তাদেরকে এখনও খেতে দেওয়া হয়নি। কিছু একটা তো দিয়ে আসা দরকার। আর একটা বালতিও, চব্বিশ ঘণ্টা পর তাদের বালতির দরকার হতে পারে। আর যা-ই হোক, কেউ ওকে জানোয়ার বলে গালি দিতে পারবে না।
গত সপ্তাহে উইলিয়ামসটাউনে একটা হ্যান্ডগান কিনেছিল গ্রাহাম কোটস।
সেন্ট অ্যান্ড্রুজে বন্দুক কেনা খুব একটা কঠিন কিছু না, দ্বীপটাই এমন। অবশ্য অধিকাংশই বন্দুক-টন্দুক কেনা নিয়ে মাথা ঘামায় না… দ্বীপটা অমনও। বিছানার পাশের স্ট্যান্ডের ড্রয়ার থেকে অস্ত্রটা বের করে চলে এলো রান্নাঘরে। সিঙ্কের নিচ থেকে একটা প্লাস্টিকের বালতি বের করে তাতে ভরে নিলো কিছু টমেটো, একটা ইয়াম, আধ-খাওয়া পনির আর এক কার্টন কমলার রস। তারপর, ভেবেছে বলে নিজেকে নিয়ে গর্বে বলীয়ান হয়ে টয়লেট রোল হাতে তুলে নিলো।
ভাঁড়ারে চলে এলো গ্রাহাম কোটস, দরজার ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ ভেসে আসছে না।
‘আমার কাছে অস্ত্র আছে,’ জানাল সে। ‘ব্যবহার করতে দ্বিধা করব না। দরজা খুলতে যাচ্ছি। দরজার দিকে পিঠ দিয়ে, ওপাশের দেওয়ালের সঙ্গে গা ঠেকিয়ে রাখো। হাতও এমন জায়গায় থাকবে যেন পরিষ্কার দেখতে পাই। খাবার এনেছি। কথা শুনলে বিনা ঝামেলায় মুক্তি পেয়ে যাবে; কারও কোনো ক্ষতি হবে না। অর্থাৎ,’ অন্য কোথাও ব্যবহার করতে পারবে না, এমন একগাদা নাটকীয় ডায়লগ ঝেড়ে নিজের ওপরেই খুশি হয়ে উঠেছে। ‘কোনো হাঙ্কি-পাঙ্কি চলবে না।’
ঘুরে কামরার বাতি জ্বালিয়ে দিল গ্রাহাম কোটস, তারপর ছিটকিনি ধরে টান দিল। কামরার দেওয়ালগুলো ইট আর পাথরের তৈরি, ছাদ থেকে ঝুলছে মরচে পড়া শিকল।
মেয়েরা ওপাশের দেয়ালের সঙ্গে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাথরের দিকে তাকিয়ে আছে রোজি। ওর মায়ের দৃষ্টিতে আতঙ্ক, ঘাড় ফিরিয়ে দেখছে গ্রাহাম কোটসকে; আতঙ্কের পাশাপাশি তাতে মিশে আছে ঘৃণা, ভাবভঙ্গি ফাঁদে পড়া ইঁদুরের মতো।
বালতিটা নামিয়ে রাখল গ্রাহাম কোটস, তবে অস্ত্র নামাল না। ‘খাবার মন্দ না,’ জানাল সে। ‘আর না পাওয়ার চাইতে দেরি করে পাওয়া ভালো। বালতিও দিলাম একটা, বোঝা যাচ্ছে তোমরা একটা কোনা ব্যবহার করছিলে এতক্ষণ। আমি সঙ্গে টয়লেট পেপারও এনেছি। বোলো না যে তোমাদের জন্য কখনো কিছু করিনি।’
‘আমাদেরকে হত্যা করবে তুমি,’ জিজ্ঞেস করল রোজি। ‘তাই না?’
‘ওকে খেপিয়ে না, বোকা মেয়ে, থুতু ছিটিয়ে বলল ওর মা। তারপর হাসার চেষ্টায় মুখ বিকৃত করে বলল, ‘খাবারের জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’
‘আরে নাহ, তোমাদেরকে খুন করার ইচ্ছে আমার নেই।’ বলল গ্রাহাম কোটস। কিন্তু কথাটা নিজের মুখে উচ্চারণ করে এবং সেটা নিজের কানে শোনা মাত্র বুঝতে পারল: এই দুজনকে মেরে ফেলা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই ওর সামনে। তাই নয় কি? ‘মোটকু চার্লি যে তোমাদেরকে পাঠিয়েছে, তা বলোনি কেন?’
জবাব দিল রোজি। ‘আমরা একটা ক্রুজ শিপে করে এসেছি। আজ দুপুরে আমাদের মাছ ভাজি খাওয়ার জন্য বারবাডোজে থাকার কথা। মোটকু চার্লি আছে ইংল্যান্ডে। আমরা কই আছি, সেটাও ও জানে বলে মনে হয় না। অন্তত আমি বলিনি।’
‘যা মন চায় বলো,’ বলল গ্রাহাম কোটস। ‘অস্ত্র যে আমার হাতে।’
দরজা বন্ধ করে, ছিটকিনি টানল সে। দরজার ওপাশ থেকে ভেসে এলো রোজির মায়ের কণ্ঠস্বর। ‘ওই পশুটার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে না যে?’
‘কারণ তুমি সব কল্পনা করছ, মা। বারবার বলছি, এখানে কোনো পশু- টশু নেই। যাই হোক, লোকটা পাগল। বললে হয়তো তোমার সঙ্গে একমত হয়ে যেত। আমার তো মনে হয়, সে-ও অদৃশ্য বাঘ দেখতে পাচ্ছে সবখানে।’
কথাটা শুনে আঁতে ঘা লাগল গ্রাহাম কোটসের। তাই রাগ করে বন্ধ করে দিল বাতি। রেড ওয়াইনের একটা বোতল বের করে, উঠে এলো ওপরে; পেছনে বন্ধ করে ভাঁড়ারের দরজা।
ভূগর্ভস্থ কামরার অন্ধকারে বসে, পনীরের টুকরোটাকে চার ভাগে ভাগ করল রোজি; তারপর একটা টুকরো মুখে পুড়ে ধীরে-ধীরে চাবাতে লাগল।
‘মোটকু চার্লির ব্যাপারে কী বলল? কী মনে হয়?’ পনীরের টুকরো মুখে গলে যাবার পর জিজ্ঞেস করল তার মাকে।
‘তুমি আর তোমার মোটকু চার্লি উচ্ছন্নে যাও। আমি এই ব্যাপারে কিছু শুনতে চাই না।’ জানাল মহিলা। ‘ওর জন্যই এখানে আটকে পড়ে থাকতে হচ্ছে।’
‘নাহ, আটকে থাকতে হচ্ছে কারণ এই কোটস মানুষটা আসলে পাগল। তাও আবার অস্ত্রধারী পাগল। দোষটা মোটকু চার্লির না।’
বারবার চেষ্টা করছে রোজি, যেন মন থেকে মোটকু চার্লিকে দূরে রাখতে পারে। কেননা ওর ব্যাপারে ভাবা মানেই, কোনো-না-কোনো ভাবে স্পাইডারের কথা মনে করা…
‘ফিরে এসেছ,’ আচমকা বলে উঠল ওর মা। ‘পশুটা ফিরে এসেছে। শুনতে পাচ্ছি শব্দ, গন্ধও পাচ্ছি নাকে।’
‘ঠিক আছে, মা।’ বলল রোজি। ভাঁড়ারের কংক্রিট মেঝেতে বসে, স্পাইডারের কথা ভাবতে লাগল সে। যুবকের কথা মনে পড়ছে খুব করে। গ্রাহাম কোটস যখন এবং যদি—ওদেরকে চলে যেতে দেয়, তখন স্পাইডারকে খুঁজে বের করবে—সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটা। চেষ্টা করে দেখবে, নতুন করে শুরু করা যায় কি না। জানে, দিবাস্বপ্ন দেখছে…তবে স্বপ্নটা দারুণ। স্বস্তি দিচ্ছে ওকে।
একবার ভাবল, গ্রাহাম কোটস কী আগামীকাল মেরে ফেলবে ওদের?
.
মোমের আগুনের সমান দূরত্বে থেকে, স্পাইডারকে পশুর খাবার হবার জন্য ফেলে দেওয়া হয়েছে।
সন্ধে হতে শুরু করেছে, সূর্য ডুবতে বসেছে অনেকটাই।
নাক আর ঠোঁট দিয়ে কিছু একটা ঠেলছে স্পাইডার: ওর থুতু আর রক্ত মিশে যাবার আগে মাটি শুষ্কই ছিল। এখন পরিণত হয়েছে কাদার একটা বলে, অনেকটা লালচে রঙের সেই কাদা। চেপে চুপে মোটামুটি গোলকে পরিণত করা হয়েছে ওটাকে। কাজ শেষে ওটার নিচে নাক সেঁধিয়ে মাথা ঝট করে উঁচু করছে যাতে গোলকটা খানিক দূরে গিয়ে পড়ে। হলো না কিছুই, যেমন হয়নি আগের বহু বারেও। কত বার হলো চেষ্টাটা? বিশ? একশো? হিসেব রাখছে না, শুধু কাজ করে যাচ্ছে। চেহারাটা কাদার ভেতর আরও গুঁজে দিল স্পাইডার, নাকটা সেঁধিয়ে দিল আরও ভেতরে…
হলো না কিছুই, কখনো কিছু হবে বলে মনে হয় না।
অন্য পথ ধরতে হবে।
গোলকটাকে ঠোঁট দিয়ে আটকে নিলো স্পাইডার, নাক দিয়ে যতটা সম্ভব গভীরভাবে নিশ্বাস নিচ্ছে। তারপর মুখ দিয়ে এক ঝটকায় বের করে দিল ফুসফুসের সব বাতাস। শ্যাম্পেনের ছিপির মতো মুখ থেকে ছিটকে গেল গোলকটা, পড়ল প্রায় আঠারো ইঞ্চি সামনে।
এবার ডান হাত ভাঁজ করল সে, কবজির কাছে শক্ত করে দড়ি বাঁধা। অন্য মাথা টানটান হয়ে গেঁথে আছে গজালের সঙ্গে। শরীরটাকে বাঁকিয়ে চেষ্টা করল গোলকটা ধরার। কিন্তু খুব কাছে গিয়েও পারল না।
নাগালে মধ্যে থেকেও… কত দূরে!
আরেকবার বুক ভরে শ্বাস নিতে গিয়ে নাকে-মুখে ধুলো ঢোকাল স্পাইডার, কেশে উঠল খক খক করে। চেষ্টা করল আবার, মাথা এক পাশে সরিয়ে ফুসফুস ভরাতে চাইল। তারপর আবার মাথা ঘুরিয়ে সর্বশক্তিতে ফুঁ দিতে লাগল গোলকটাকে লক্ষ্য করে।
গড়ান খেল কাদার গোলকটা–এক ইঞ্চির চাইতেও কম হবে, কিন্তু সেটাই যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হলো। শরীরটা টান টান করতেই হাতের ভেতর চলে এলো ওটা। এবার তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলের সাহায্যে পিষতে লাগল ওটাকে। তারপর ওটাকে উলটে আবারও…এভাবে আটবার করল কাজটা।
আরও একবার পিষল সে গোলকটাকে, এবার আরও একটু জোরের সঙ্গে। চিমটি কাটার মতো করে চাপ দিচ্ছে বলে গোলকের একটা ছোট্ট অংশ খসে পড়ে গেল মাটিতে, তবে যা অবশিষ্ট আছে তা দেখে মনে হলো— বাচ্চাদের বানানো সূর্যের মতো একটা গোলক, যা থেকে বেরিয়ে আছে সাতটা সুচালো অংশ।
স্পাইডার গর্বের সঙ্গে দেখল ওর হাতের কাজ: এই পরিস্থিতিতে ওটাকে নিয়ে গর্ব করাই যায়।
কিন্তু কথা বলাটাই হবে কঠিন। রক্ত আর থুতুমাখা কাদা ব্যবহার করে মাকড়শা বানানো সহজ। দেবতারা, এমনকী স্পাইডারের মতো ছোটোখাটো দুষ্টু দেবতাও তা করতে জানে। কিন্তু সৃষ্টির শেষ অংশটাই সবচাইতে কঠিন। নির্জীব কোনো বস্তুতে প্রাণ সঞ্চার করতে হলে শব্দের দরকার হয়, দরকার পড়ে ওটাকে নাম দেওয়ার।
মুখ খুলল সে। ‘হুররররর, ‘ জিভহীন মুখ দিয়ে কেবল এতটুকু উচ্চারণ করতে পারল।
কিন্তু কাজ হলো না।
আরেকটা চেষ্টা করল স্পাইডার। ‘হুরররর!’ কাদার দলাটা ওভাবেই পড়ে রইল ওর হাতে।
মাটিতে আছড়ে পড়ল বেচারার মুখ। ক্লান্ত বোধ করছে খুব। নড়াচড়া করতেই চেহারা আর বুকের শুকনো ক্ষতে আঁচড় লাগছে। রক্ত ঝরতে শুরু করছে জায়গাগুলো থেকে, সেই সঙ্গে জ্বলে। তবে বেশি কষ্ট হচ্ছে ওগুলো চুলকাতে শুরু করেছে বলে। ভাবো! বলল সে নিজেকে। কাজটা করার উপায় অবশ্যই আছে…জিভ ছাড়াই কথা বলতে হবে ওকে…
ঠোঁটের ওপরে কাদার একটা স্তর জমে গেছে, সেটাই চুষতে লাগল ও। জিভ নেই বলে কাজটা সহজ হলো না।
লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে বাতাস বের করে দিল। চেষ্টা করল যতটা সম্ভব দক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করার। এমন নিশ্চয়তার সঙ্গে উচ্চারণ করল শব্দটা যে বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডও আপত্তি করলে তা ধোপে টিকবে না। ওর হাতে যে জিনিসটা আছে, সেটার নাম দিল সে; উচ্চারণ করল নিজের নাম, জাদুর সর্বোচ্চটা ব্যবহার করে: ‘হহসস্পাররিইইভাআআর।’
পরক্ষণেই দেখা গেল, হাতে একটু আগেও যেখানে ছিল রক্তমাখা কাদার দলা, সেখানে বসে আছে একটা মোটাসোটা মাকড়শা; রং ওটার লাল, পা সাতখানা।
সাহায্য করো আমাকে, ভাবল স্পাইডার। কাউকে খুঁজে আনো।
ওর দিকে চেয়ে রইল মাকড়শাটা, সূর্যের আলোতে চোখ জ্বলজ্বল করছে। পরক্ষণেই ওর হাত থেকে নেমে পড়ল সেটা মাটিতে। দুলতে দুলতে, টলতে টলতেও বলা চলে, চলতে লাগল ঘাসের ভেতর দিয়ে।
দৃষ্টির বাইরে চলে যাওয়া পর্যন্ত লাল মাকড়শাটার দিকে চেয়ে রইল স্পাইডার। তারপর মাথা মাটির ওপর রেখে, চোখ মুদল।
আচমকা বদলে গেল বায়ুপ্রবাহের দিক, বাতাসে ভাসতে লাগল পুরুষ বিড়ালের মূত্রত্যাগের অ্যামোনিয়া-মাখা ঝাঁঝাল গন্ধ। পশুটা নিজের এলাকা চিনিয়ে দিচ্ছে…
আর আনন্দে চিৎকার করছে স্পাইডারের মাথার অনেক ওপরে ভাসতে থাকা পাখির ঝাঁক।
.
গড়গড় করে চাহিদার কথা জানিয়ে দিল মোটকু চার্লির পাকস্থলী। পয়সা-কড়ি সঙ্গে থাকলে কোথাও যেত খাবার খেতে, আর কিছু না হলেও নিদেনপক্ষে এই হোটেল থেকে দূরে সরার জন্যই। তবে স্বীকার করতেই হচ্ছে, কপর্দকহীন হয়ে গেছে সে। এদিকে হোটেলের ভাড়ার মাঝেই খাবারের খরচ ধরা আছে। তাই সাতটা বাজতে না বাজতেই পা রাখল রেস্তোরাঁয়।
প্রধান ওয়েট্রেস আকর্ণ-বিস্তৃত উজ্জ্বল হাসি হেসে স্বাগত জানাল ওকে। মেয়েটা ওকে জানাল, খানিকক্ষণের মাঝে রেস্তোরাঁর কার্যক্রম শুরু হবে। ব্যান্ডের প্রস্তুতি বাকি আছে একটু, সেটা শেষ হলেই। তারপর যেন মেয়েটার পূর্ণ দৃষ্টি গিয়ে পড়ল মোটকু চার্লির ওপর। তার চাহনিতে থাকা প্রশ্নটা ততক্ষণে পরিচিত হয়ে উঠেছে মোটকু চার্লির কাছে।’
‘আপনিই কি…?’ মেয়েটা শুরু করল প্রশ্ন।
‘হ্যাঁ, আমিই সে,’ হাল ছেড়ে দিয়েছে বেচারা। ‘সঙ্গেই আছে।’ বলে পকেট থেকে লেবু বের করে দেখাল মেয়েটাকে।
‘দারুণ তো,’ বলল মেয়েটা। ‘হাতে তো লেবুই দেখা যাচ্ছে। যাই হোক, আপনি কি মেন্যু থেকে কিছু পছন্দ করবেন? নাকি ব্যুফে বেছে নেবেন?’
‘ব্যুফে,’ জানাল মোটকু চার্লি। মাগনা ওটাই খাওয়া যাবে। হাতে লেবু ধরে রেস্তোরাঁর ঠিক বাইরের হলের লাইনে দাঁড়াল সে।
‘দাঁড়ান একটু,’ বলল প্রধান ওয়েট্রেস।
এক ছোটোখাটো মেয়ে এসে দাঁড়াল মোটকু চার্লির পেছনে। ওয়েট্রেস মেয়েটির দিকে তাকিয়ে, হেসে বলল, ‘খোলেনি এখনও? পেটে ছুঁচোর নাচন চলছে।’
শেষ বারের মতো ব্লুম-থাং-থাডাম শব্দ করে প্রস্তুত হয়ে গেল বেজ গিটার, সেই সঙ্গে ইলেকট্রনিক পিয়ানোও প্রস্তুত…প্লাঙ্ক একটা শব্দ হলো শুধু। বাদ্যযন্ত্র নামিয়ে রেখে প্রধান ওয়েট্রেসকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল তারা। ‘খুলেছি,’ জানাল মেয়েটা। ‘ভেতরে আসুন।’
ছোটোখাটো মেয়েটা চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে তাকাল মোটকু চার্লির দিকে। ‘হ্যালো, মোটকু চার্লি,’ জানাল সে। ‘লেবু কীসের?’
‘সে এক লম্বা গল্প।’
‘সমস্যা কী?’ বলল ডেইজি। ‘খেতে খেতে সবটা আরামসে শোনা যাবে।’
.
রোজি ভাবনায় পড়ে গেছে: আচ্ছা, উন্মাদনা কি ছোঁয়াচে হতে পারে? পাহাড়- শীর্ষের বাড়িটার ভূগর্ভস্থ ভাঁড়ারের অন্ধকারে থাকা অবস্থায় টের পেল, কিছু একটা ছুটে গেল ওর পাশ দিয়ে। খুবই নরম আর নমনীয় কিছু একটা। বিশালও হবে আকৃতিতে। এমন কিছু যেটা ওদেরকে ঘিরে পাক খেতে খেতে নম্র কণ্ঠে গর্জে উঠল।
‘শুনতে পেলে?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘অবশ্যই পেয়েছি, বোকা মেয়ে কোথাকার।’ জবাব দিল মেয়েটার মা। তারপর যোগ করল, ‘কমলার রস অবশিষ্ট আছে?’
অন্ধকারেই জুসের কার্টনের খোঁজে হাতাতে লাগল রোজি। পানীয় পানের আওয়াজ শুনতে পেল সে খানিক পরেই। ওর মা বলল, ‘আমাদেরকে এই পশুটা হত্যা করবে না, করবে ওই লোকটা।’
‘গ্রাহাম কোটস? হ্যাঁ।’
‘লোকটা বাজে প্রকৃতির। কিছু একটা যেন ভর করেছে ওর ওপর, ঘোড়ার মতো করে চালাচ্ছে ব্যাটাকে। তবে লোক যেমন বাজে, বাহন হিসেবেও বাজেই হবে।’
মায়ের কঙ্কাল হাত নিজের হাতে নিলো রোজি। মহিলা কিচ্ছু বলল না। আসলে বলার মতো কিছু তো নেই-ও।
‘সত্যি বলতে কী,’ খানিকক্ষণ পর বলল ওর মা। ‘তোমাকে নিয়ে আমি গর্বিত। মেয়ে হিসেবে তুমি খুবই ভালো।’
‘ওহ,’ বলল রোজি। মাকে হতাশ করেনি, এই ভাবনাটা ওর ভেতর নতুন একটা অনুভূতির জন্ম দিল; আসলে সত্যি বলতে কী, কেমন অনুভব করছে তা সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
‘হয়তো তোমার মোটকু চার্লিকেই বিয়ে করা উচিত ছিল,’ বলল ওর মা। ‘তাহলে আমরা এখানে থাকতাম না।’
‘না,’ রোজি আপত্তি জানাল। ‘ওকে বিয়ে করা উচিত ছিল না। মোটকু চার্লিকে আমি ভালোবাসি না, তাই এই একটা ব্যাপারে তোমার কোনো ভুল হয়নি।’
ওপর তলায় দড়াম করে দরজা বন্ধ করার আওয়াজ শুনতে পেল ওরা। ‘বাইরে গেল,’ বলল রোজি। ‘তাড়াতাড়ি করো, এই সুযোগ। আমাদের সুড়ঙ্গ খুঁড়তে হবে।’
প্রথমে খিল খিল করে হাসতে শুরু করল মেয়েটা…
…তারপর শুরু হলো কান্না।
.
ডেইজি এই মুহূর্তে এখানে কী করছে, তা বুঝতে চাচ্ছে মোটকু চার্লি। ডেইজিও একই ভাবে বোঝার চেষ্টা করছে, মোটকু চার্লি ওই দ্বীপে কী করছে? দুজনের কেউই সফল হচ্ছে না কাজে। লম্বা, লাল আর চকচকে পোশাক পরে ভেতরে ঢুকল এক গায়িকা। এরকম একটা হোটেলের ‘ফ্রাইডে নাইট ফান’-এর তুলনায় অনেক বেশি দক্ষ সে। কামরার অন্য পাশে অবস্থিত মঞ্চে দাঁড়িয়ে গাইতে শুরু করল সে, ‘আই হ্যাভ গট ইউ আন্ডার মাই স্কিন’।
ডেইজি বলল, ‘শৈশবে যে মহিলা তোমার প্রতিবেশী ছিল, তাকে খুঁজছ। কেননা তোমার ধারণা—সে তোমার ভাইকে খুঁজে বের করতে সাহায্য করতে পারবে!’
‘আমাকে একটা পালক দেওয়া হয়েছিল। যদি মিসেস হিগলারের কাছে এখনও সেটা থেকে থাকে, তাহলে তার বিনিময়ে নিজের ভাইকে মুক্ত করতে পারব। চেষ্টা করে তো দেখা যায়।’
চোখ পিটপিট করল ডেইজি, কথাটা শুনে একদমই প্রভাবিত হয়নি। সালাদ খাচ্ছে না, খুঁটছে শুধু।
এবার মোটকু চার্লি বলল, ‘আর তুমি এখানে এসেছ কারণ তোমার ধারণা—মেইভ লিভিংস্টোনকে হত্যা করার পর, গ্রাহাম কোটস এই দ্বীপে লুকিয়েছে। কিন্তু পুলিস হিসেবে আসোনি, এসেছ স্বেচ্ছায় ও এই ভরসায় যে তাকে খুঁজে পাবে। অথচ পেলেও কিচ্ছু করতে পারবে না।’
ঠোঁটের কোনায় লেগে থাকা টমেটোর বিচি জিভ দিয়ে চেটে নিলো ডেইজি, খানিকটা অস্বচ্ছন্দ দেখাচ্ছে ওকে। ‘আমি পুলিস অফিসার হিসেবে আসিনি,’ বলল সে। ‘এসেছি পর্যটক হিসেবে।’
‘কিন্তু তাই বলে কাজে ফাঁকি দিয়ে লোকটার পেছন-পেছনে চলে এলে? এই অপরাধে তোমাকে হয়তো জেলেই পাঠিয়ে দেবে কর্তৃপক্ষ। এছাড়া অন্য কোনো সাজাও হতে পারে।’
‘তাহলে তো,’ শুষ্ক কণ্ঠে বলল মেয়েটা। ‘সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বন্দি-বিনিময় চুক্তিতে সই করেনি বলে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতে হয়। তাই না?’
নিচু কণ্ঠে বলল মোটকু চার্লি। ‘হায় ঈশ্বর!’
মোটকু চার্লির এই ‘হায় ঈশ্বর’ বলার কারণ-গায়িকা মঞ্চ থেকে নেমে, রেডিয়ো মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে রেস্তোরাঁর ভেতরে ঘোরাঘুরি করছে। দুই জার্মান পর্যটককে সে জিজ্ঞেস করছে, তারা এসেছে কোত্থেকে?
‘কিন্তু এখানে লোকটা আসবে কেন?’ মোটকু চার্লি প্রশ্ন ছুড়ে দিল।
‘গোপন ব্যাংকিং, কম দামি জমি-জমা; বন্দি-বিনিময় চুক্তিও নেই। তাছাড়া হয়তো টক-টক ফলমূল পছন্দ তার।’
‘দুটো বছর ওই লোকটার ভয়ে কেঁপেছি।’ মোটকু চার্লি জানাল। ‘এই মাছ-আর-সবুজ-কলার খাবারটা আরও কিছু নেব। তুমি?’
‘আমার লাগবে না,’ ডেইজি জানাল। ‘ডেজার্টের জন্য পেটে খানিকটা জায়গা ফাঁকা রাখতে চাই।’
ব্যুফের কাছে হেঁটে গেল মোটকু চার্লি, গায়িকার চোখে যেন পড়তে না হয় সেজন্য ঘুরে গেল অনেকটাই। মেয়েটা খুবই সুন্দর, লালচে পোশাকটা নড়া- চড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আলো প্রতিফলিত করছে। তার মিষ্টি কণ্ঠের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যান্ডটা বাজাতে পারছে না। তবে মোটকু চার্লির মনে হলো: মেয়েটা ছোট্ট মঞ্চে ফিরে গিয়ে গান গাইলেই ভালো হতো। মেয়েটার ‘নাইট অ্যান্ড ডে’ আর অন্তর থেকে গাওয়া ‘স্পুনফুল অভ সুগার’ এখনও কানে লেগে আছে…রেস্তোরাঁর খদ্দেরদের সঙ্গে কথা-বার্তার দরকার কী? অন্তত মোটকু চার্লি কামরার যে পাশে আছে, সে পাশে না আসলেই হয়।
প্রথম বার যেটা খেয়ে ভালো লেগেছিল, সেটাই আবার প্লেট ভরে নিলো সে। সাইকেল চালিয়ে দ্বীপ-জুড়ে ঘুরে বেড়ালে, খিদে ভালোই পায়।
টেবিলের কাছে ফিরে এসে দেখে, চোয়ালের নিচের দিকে দাড়ির মতো কিছু একটাসহ গ্রাহাম কোটস বসে আছে ডেইজির পাশে। প্রচণ্ড উত্তেজিত নেউলের মতো হাসছে ব্যাটা। ‘মোটকু চার্লি,’ বলল গ্রাহাম কোটস, অপ্রস্তুত হাসি যোগ করল সঙ্গে। ‘দারুণ না ব্যাপারটা? তোমার খোঁজে, একটু গল্প করার জন্য এসেছিলাম এখানে। কী পেলাম? এই অসাধারণ সুন্দরী পুলিস অফিসারকে! দয়া করে বোসো, নাটক করতে যেয়ো না কিন্তু।’
মোমের মূর্তির মতো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মোটকু চার্লি।
‘বসো,’ আবার বলল গ্রাহাম কোটস। ‘মিস ডে-এর পেটে অস্ত্র ঠেকিয়ে রেখেছি।’
অনুনয়ের দৃষ্টিতে ডেইজির দিকে তাকাল মোটকু চার্লি, সেই সঙ্গে মাথা নাড়ল। টেবিলক্লথের ওপর রেখেছে হাতজোড়া, ছড়িয়ে।
বসল মোটকু চার্লি।
‘হাত এমন জায়গায় রাখো, যাতে দেখতে পাই। ছড়িয়ে রাখো টেবিলে, মিস ডেয়ের মতো।’
আদেশ পালন করল মোটকু চার্লি।
নাক টানল গ্রাহাম কোটস। ‘প্রথম থেকেই জানতাম যে তুমি সাদা পোশাকের পুলিস, ন্যান্সি।’ বলল সে। ‘স্পাই, তাই না? আমার অফিসে এসে, ধোঁকা দিয়ে চুরি করেছ আমারই কাছ থেকে।’
‘আমি কখনও—’ বলতে চাইল মোটকু চার্লি, তবে গ্রাহাম কোটসের চোখে চোখ পড়তেই থেমে গেল।
‘ভেবেছিলে, দারুণ চালাকি করেছ।’ গ্রাহাম কোটস যোগ করল। ‘তোমরা সবাই আমাকে বোকা বানাতে পেরেছিলে ভেবে গোঁফে তা দিচ্ছিলে। সেজন্যই ওই দুজনকে পাঠিয়েছ, তাই না? আমার বাড়িতে? ক্রুজ শিপে করে ঘুরতে ঘুরতে আচমকা এসে উপস্থিত হয়েছে—এই গপ্পো আমি বিশ্বাস করব, তা ভাবলে কী করে? আমাকে বোকা বানাতে হলে এত অল্পে কাজ হবে না, বুঝলে? আর কে কে এসবের সঙ্গে জড়িত? কাকে বলেছ? কে জানে?’
‘গ্রাহাম, তুমি যে কী বলছ, কিছুই বুঝতে পারছি না,’ জানাল ডেইজি।
গায়িকা এখন ‘সাম অভ দিজ ডেজ’ গাইছে; মেয়েটার কণ্ঠ দারুণ, লোকসঙ্গীতের জন্য নিখুঁত। ওদের সবাইকে যেন মখমলের স্কার্ফের মতো ঘিরে ধরল।
হয়তো কোনো একদিন,
মনে পড়বে আমার কথা,
হয়তো কোনো একদিন,
একাকীত্বের ছোবল দেবে ব্যথা।
আমার আলিঙ্গনের কথা পড়বে মনে।
আমার চুমুর স্পর্শ পেতে চাইবে তনে…
‘বিল-টিল চুকাবে,’ নির্দেশ দিল গ্রাহাম কোটস। ‘তারপর আমার আর এই যুবতীর সঙ্গে গিয়ে বসবে গাড়িতে। আমার বাড়িতে ফিরে গিয়ে সত্যিকারের আলোচনায় বসব। একটু এদিক-সেদিক হলেই, গুলি করে ফুটো করে দেব দুজনকেই। বোঝা গেল কথা?’
মোটকু চার্লি মাথা নেড়ে জানিয়ে দিল যে কানে গেছে। কালো মার্সিডিজটা কে চালাচ্ছিল, সেটাও ধরতে পারছে এখন। সেদিন মরণের কতটা কাছাকাছি পৌঁছে গেছিল, সেটা উপলব্ধি করতেও বেগ পেতে হচ্ছে না। সেই সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছে—গ্রাহাম কোটস কতটা পাগল, এবং জান নিয়ে এই পরিস্থিতি থেকে ডেইজির আর ওর নিজের ফিরতে পারার সম্ভাবনা কতটা ক্ষীণ।
গায়িকা গান শেষ করল। রেস্তোরাঁয় ইতস্তত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা খদ্দেররা হাততালি দিয়ে স্বাগত জানাল। মোটকু চার্লি টেবিলের ওপর হাত ছড়িয়ে রেখেছে তখনও। গ্রাহাম কোটসের কাঁধের ওপর দিয়ে গায়িকার দিকে তাকিয়ে রইল সে, প্রাক্তন বসের নজরের বাইরে থাকা চোখটা টিপে দিল তাকে লক্ষ্য করে। উপস্থিত সবাই সচেতন ভাবেই গায়িকার চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখতে চাইছিল, তাই মোটকু চার্লির চোখ টিপুনিকে সানন্দে স্বাগত জানাল সে।
‘গ্রাহাম, আমার এখানে আসার কারণ তুমিই,’ জানাল ডেইজি। কিন্তু চার্লি তো কেবলই—’ বলতে বলতেই থেমে গেল বেচারি। ওর চেহারার সেই দশা হলো, যা শুধু পেটে পিস্তলের নলের খোঁচা খেলেই হয়!
মুখ খুলল গ্রাহাম কোটস। ‘আমার কথা শোনো। এখানে যেসব নিরীহ খদ্দেররা আছে, তাদের কাছে আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বন্দুকটা পকেটে ভরছি, কিন্তু সেটা তোমার দিকেই তাক করা আছে। আমরা উঠে দাঁড়াব, যাবো আমাদের গাড়ির কাছে। তারপর আমি—’
থমকে গেল লোকটা। লাল পোশাক পরিহিত মেয়েটা হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে এগিয়ে আসছে তাদের টেবিলের দিকেই, মুখে আ-কর্ণ-বিস্তৃত হাসি। মোটকু চার্লি লক্ষ্য মেয়েটার, মাইক্রোফোনে বলল, ‘নাম কী তোমার, সোনা?’ মোটকু চার্লির মুখের কাছে ধরল সে মাইক্রোফোনটা।
‘চার্লি ন্যান্সি,’ জবাব দিল মোটকু চার্লি। কেঁপে উঠল ওর কণ্ঠ।
‘কোত্থেকে এসেছ, চার্লি?’
‘ইংল্যান্ড। আমি আমার বন্ধুরা, সবাই ইংল্যান্ডের।’
‘পেশা কী তোমার, চার্লি?’
থমকে গেল যেন সময়…সেই সঙ্গে অন্য সব কিছু। ব্যাপারটার সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায় পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফিয়ে সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়ার সঙ্গে। কিন্তু আর কোনো পথ যে খোলা নেই ওর সামনে। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘এখন কিছুই করছি না।’ পরক্ষণেই যোগ করল। ‘তবে আসলে আমি গায়ক। তোমার মতোই গান গাই।’
‘আমার মতো? কোন ধরনের গান গাও?’
ঢোক গিলল মোটকু চার্লি। ‘তুমি কোনটা শুনতে চাও?’
মোটকু চার্লির টেবিলে বসা অন্যান্যদের দিকে তাকাল মেয়েটা। ‘তোমাদের কি মনে হয়, ও আমাদেরকে গেয়ে শোনাবে একটা গান?’ মাইক্রোফোনের দিকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইল সে।
‘মানে, মনে হয় না। নাহ, পুবশ্যই না।’ বলল গ্রাহাম কোটস। এদিকে ডেইজি শুধু শ্রাগ করল, হাত দুটো ওভাবেই রেখেছে টেবিলের ওপর।
লাল পোশাক পরা মেয়েটা এবার কামরার অন্যান্যদের দিকে তাকাল। ‘তোমাদের কী মনে হয়?’ এবার তাদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিল সে।
অন্যান্য টেবিলের খদ্দেররা মৃদু হাততালি দিয়ে ধারণাটাকে স্বাগত জানাল। কিন্তু রেস্তোরাঁর কর্মচারীরা চেঁচিয়ে উঠল উৎসাহের সঙ্গে। বারম্যান তো চেঁচিয়ে বলেই বসল, ‘গেয়ে শোনাও!’
মোটকু চার্লির দিকে ঘুরে, মাইক হাত দিয়ে চেপে বলল গায়িকা, ‘এমন কোনো গানের কথা বলো যেটা ব্যান্ড বাজাতে পারবে।
মোটকু চার্লি জিজ্ঞেস করল, ‘ওরা ‘আন্ডার দ্য ব্রডওয়াক’ বাজাতে পারবে?’ মাথা নেড়ে সায় জানল মেয়েটা। তারপর সেই গানেরই ঘোষণা দিয়ে মাইক ধরিয়ে দিল ওকে।
বাজাতে শুরু করল ব্যান্ডটা। মোটকু চার্লিকে পথ দেখিয়ে ছোট্ট মঞ্চের দিকে নিয়ে গেল গায়িকা। বুকের ভেতর হৃদয়টা লাফাচ্ছে পাগলা ঘোড়ার মতো।
গাইতে শুরু করল মোটকু চার্লি…
…শুনতে লাগল শ্রোতারা।
ও চেয়েছিল, নিজেদের জন্য কিছু বাড়তি সময় যোগাড় করবে গান গেয়ে। কিন্তু গাইতে শুরু করার পর কেমন যেন স্বচ্ছন্দ বোধ করতে শুরু করেছে। কেউ কিছু ছুঁড়ছে না ওকে লক্ষ্য করে, সেই সঙ্গে গান গাইবার পাশাপাশি ভাববার মতো ক্ষমতাও অবশিষ্ট আছে ওর মস্তিষ্কের। কামরায় যারা আছে, তাদের উপস্থিতিও টের পাচ্ছে পরিষ্কারভাবে: পর্যটক আর কর্মচারীর দল, বারে আসা খদ্দের। সব কিছু দেখতে পাচ্ছে: মেপে মেপে ককটেল বানাচ্ছে বারম্যান, এক বৃদ্ধা বসে আছে কামরার পেছন দিকে… প্লাস্টিকের মগ ভরতি করছে কফি দিয়ে। ভয় তখনও অবশিষ্ট আছে মোটকু চার্লির মনে, রাগও আছে; কিন্তু সেই রাগ আর আতঙ্ক ঢেলে দিল সে গানে, দেখা গেল ওটা পরিণত হয়েছে স্বস্তিমাখা ভালোবাসার গানে। গাইতে গাইতেই ভাবল সে
এই পরিস্থিতিতে স্পাইডার কী করত? কী করত আমার বাবা?
মন খুলে গাইছে মোটকু চার্লি। গান গেয়ে শোনাচ্ছে, ব্রডওয়াকের নিচে ও কী করতে চায়; অবশ্য সেসব কাজের অধিকাংশই ভালোবাসা-বাসির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।
লাল পোশাকের গায়িকা হাসছে, সেই সঙ্গে তুড়ি বাজাচ্ছে সুরের তালে তালে; দেহটাকেও নাড়াচ্ছে নাচের ভঙ্গিতে। কি-বোর্ড বাদকের মাইক্রোফোনের ওপর ঝুঁকে তাল মেলাল গানে।
একদল শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে গাইছি! ভাবল মোটকু চার্লি। এ আমার কী হলো! গ্রাহাম কোটসের ওপর দৃষ্টি স্থির রেখেছে অবশ্য।
যখন কোরাসের জায়গায় এলো, তখন মাথার ওপর হাত তুলে করতালি দিতে লাগল সে। অচিরেই দেখা গেল — কামরার সবাই যোগ দিয়েছে ওর সঙ্গে…খদ্দের, সঙ্গে… খদ্দের, ওয়েটার আর রাঁধুনি—সবাই! একমাত্র গ্রাহাম কোটস টেবিলক্লথের নিচে হাত ঢুকিয়ে রেখেছে বলে যোগ দেয়নি। আর অবশ্যই ডেইজিও, যার হাত পড়ে আছে টেবিলের ওপর। এমন ভাবে ওর দিকে চেয়ে আছে মেয়েটা, যেন বদ্ধ কোনো উন্মাদকে দেখছে…যে কি না একেবারে অদ্ভুত মুহূর্তে খুঁজে পেয়েছে নিজের ভেতরে থাকা ভ্রাম্যমাণ গায়ককে।
হাততালি দিয়েই যাচ্ছে শ্রোতারা। হেসে গান চালিয়ে গেল মোটকু চার্লি, গাইতে গাইতেই টের পেল— শতভাগ নিশ্চয়তার সঙ্গে যে সব ঠিক হয়ে যাবে। কোনো ক্ষতিই হবে না ওদের। ওদের মানে ওর নিজের আর স্পাইডারের আর ডেইজির এবং রোজির…তা মেয়েটা যেখানেই থাকুক না কেন। কী করতে হবে, সেটা বুঝতে পারছে: যদিও কাজটা বোকামিতে ভরা এবং হবে অর্বাচীনের মতোই। তবে উদ্দেশ্য হাসিল হবে তাতে। গানের শেষ কলিগুলোর রেশ মিলিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আমি যে টেবিলে বসে ছিলাম, সেখানে আমার সঙ্গে ছিল এক যুবতী। তার নাম ডেইজি ডে, সে-ও ইংল্যান্ডের বাসিন্দা। ডেইজি, সবার উদ্দেশ্যে হাত নাড়বে একটু?’
চোখ-মুখ পাকিয়ে ওকে একবার দেখল ডেইজি, তারপর টেবিলের ওপর থেকে হাত তুলে নাড়ল একবার।
‘ডেইজিকে একটা প্রশ্ন করতে চাই। কিন্তু কী সেই প্রশ্ন, সেই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই মেয়েটার।’ যদি কাজ না হয়, অস্ফুট স্বরে কেউ একজন বলল ওর মাথায়, তাহলে বেচারি মরবে—সেটা জানো তো? ‘আশা করি আমার প্রশ্নের জবাবে ‘হ্যাঁ’-ই বলবে সে। ডেইজি, বিয়ে করবে আমাকে?’
কবরের নিস্তব্ধতা নেমে এলো কামরায়। ডেইজির দিকে চেয়ে রইল মোটকু চার্লি, মনে মনে প্রার্থনা করছে—যেন ব্যাপারটা সে ধরতে পারে, সেই অনুপাতে আচরণও করে।
মাথা নাড়ল ডেইজি, করবে বিয়ে।
করতালিতে ফেটে পড়ল রেস্তোরাঁর সবাই। কামরার ভেতরের সবাই ছুটে এলো টেবিলের দিকে। গায়িকা, প্রধান ওয়েট্রেসসহ অন্য মেয়েরা যেন আছড়ে পড়ল ওই টেবিলে। ডেইজিকে একরকম টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল কামরার মাঝখানে। মোটকু চার্লির পাশে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হলো ডেইজিকে। ব্যান্ডটা ততক্ষণে ‘আই জাস্ট কলড টু সে আই লাভ ইউ,’ বাজাতে শুরু করে দিয়েছে। মেয়েটাকে আলিঙ্গন করল মোটকু চার্লি।
‘আংটি কই?’ জিজ্ঞেস করল গায়িকা।
পকেটে হাত দিল মোটকু চার্লি। ‘এই নাও,’ ডেইজিকে বলল সে। ‘তোমার জন্য উপহার।’ তারপর আবার মেয়েটাকে আলিঙ্গন করে চুমু খেল একটা। গুলি যদি গ্রাহাম কোটস করেই, তাহলে বোধহয় এখনই করবে-ভাবল সে।
চুম্বন শেষ হলে, একের-পর-এক মানুষ এগিয়ে এসে করমর্দন করল ওর সঙ্গে; জড়িয়ে ধরল তাকে। এক লোক, যে এখানে এসেইছে গানের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে, ওকে ধরিয়ে দিল তার কার্ড। এদিকে ডেইজি দাঁড়িয়ে আছে হাতে লেবু নিয়ে, মেয়েটার চেহারায় অদ্ভুত একটা অনুভূতির ছাপ। যে টেবিলে বসে ছিল এতক্ষণ, সেটার দিকে তাকাতেই মোটকু চার্লি আবিষ্কার করল: গ্রাহাম কোটস ওখানে আর নেই!
অধ্যায় তেরো – যেটাকে কয়েক জনের জন্য দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হবে
অধ্যায় তেরো – যেটাকে কয়েক জনের জন্য দুর্ভাগ্যজনকই বলতে হবে
উত্তেজনা পেয়ে বসেছে পাখিগুলোকে। গাছের ওপর বসে চেঁচাচ্ছে আর চিল্লাচ্ছে তারা। আসছে তাহলে জন্তুটা, ভাবল স্পাইডার, নিজের দুর্ভাগ্যকে গাল দিল নিজেই। শরীরে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই, শেষ বিন্দুটাও খরচ করে ফেলেছে। ক্লান্তি আর পরিশ্রান্তি বাদে আর কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না নিজের ভেতরে।
মাটিতে শুয়ে থাকবে কি না, তাই ভাবল সে। জন্তুটা খেয়ে ফেললে খাক। তবে কিনা, মরার এই উপায়টা ঠিক সুবিধাজনক ঠেকছে না। কলিজা নতুন করে গজাতে পারবে কি না, তা নিয়েই সন্দেহ আছে; আর এই জন্তুটা শুধু কলিজা খেয়েই সন্তুষ্ট থাকবে বলে মনে হয় না।
মোচড়া-মুচড়ি শুরু করে দিল স্পাইডার। তিন পর্যন্ত গুনল ও, তারপর যতটা সম্ভব শক্তি খাটিয়ে দুই হাত টেনে নিলো নিজের দিকে। ফলে দড়ি টানটান হয়ে চাপ ফেলল গজালের ওপর। বারংবার একই কাজ করে চলল সে।
পাহাড়ের সঙ্গে দড়ি বেঁধে, সেটাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলে যতটুকু লাভ হতো…এক্ষেত্রেও তাই হলো। এক, দুই, তিন…টান। তারপর আবার। তারপর আবার।
পশুটা আসতে কতক্ষণ দেরি করবে, তা একবার ভাবল ও।
এক, দুই, তিন…টান। এক, দুই, তিন… টান।
দূরে কোথাও, কোনো এক স্থানে, গাইছে কেউ। গান পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছে সে। গানটা হাসি ফোটাল স্পাইডারের মুখে। জিহ্বা থাকলে হয়তো শিস বাজিয়ে যোগ দিত গানে: বাঘটা দর্শন দিলে তাকে দেখিয়ে দিত, ওর সাহসের কমতি নেই কোনো। ভাবনাটাই যেন শক্তি যোগাল ওর দেহে।
এক, দুই, তিন…টান।
অবশেষে গজালটা হার মেনে নড়ে উঠল।
আরেকটা টান দিতেই ওটা উঠে এলো মাটি থেকে!
দড়িগুলো নিজের দিকে টান দিল সে, গজালটাকে শক্ত করে ধরল হাত দিয়ে-লম্বায় ওটা ফুট তিনেক হবে। একটা প্রান্ত সুচালো, ওটাই পোঁতা ছিল মাটিতে। প্রায় অসাড় হাত ব্যবহার করে দড়ির পাকগুলো খুলে ফেলল, কবজি থেকে এখন উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঝুলছে দড়িটা। ডান হাতে ওজন মেপে নিলো গজালটার, কাজ হবে মনে হচ্ছে। বুঝতে পারছে, নজর রাখা হচ্ছে ওর ওপর: ইঁদুরের গর্ত যেভাবে বিড়াল দেখে, সেভাবে দেখছে ওকে।
নীরবে…উহু, প্রায় নীরবে ওর দিকে এগোতে লাগল জন্তুটা, দিনের আলোয় ছায়া পড়ল তার। তবে একমাত্র ওটার লেজই নজরে পড়ল স্পাইডারের, অধৈর্য ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ করছে। নইলে ওটাকে মূর্তির সঙ্গেও তুলনা দেওয়া যেত; নয়তো একদলা বালুর সঙ্গে, যেটা আলোর খেলার কারণে, দেখাচ্ছে প্রকাণ্ড একটা পশুর মতো…কেননা ওটার গায়ের চামড়ার রং বালু-বালুই। অপলক চোখগুলো মধ্য-শীতের সমুদ্রের মতোই সবুজ। চেহারা প্রশস্ত, প্যানথারের নিষ্ঠুর চেহারার মতো। দ্বীপপুঞ্জগুলোতে বিড়াল-প্রজাতির যেকোনো বড়োসড়ো সদস্যকেই ‘বাঘ’ নামে ডাকা হয়। আর এই নমুনাটা ইতিহাসের যে কোনো বিড়ালের চাইতে অনেক বড়ো—বড়ো, নৃশংস, হিংস্র… বিপজ্জনক।
স্পাইডারের গোড়ালির অবস্থা ভালো না, বলতে গেলে হাঁটতেই পারছে না সে। হাতে-পায়ে খাচ্ছে খোঁচা। তারপরও খোঁড়াতে লাগল সে। কিন্তু ব্যাপারটা এমনভাবে উপস্থাপন করতে চাইল- যেন ইচ্ছে করে করছে কাজটা, অবশ্যই ভয় দেখাতে; দাঁড়াতেই যে পারছে না, তা বাঘটার তো আর জানার দরকার নেই।
উবু হয়ে বসে, গোড়ালি মুক্ত করতে চাইছে মন। কিন্তু পশুটার ওপর থেকে নজর হটাবার সাহস জোগাতে পারছে না।
গজালটা ভারী, এবং পুরুও; কিন্তু বর্শা হিসেবে ব্যবহার করার মতো বড়ো না। আবার অন্য কোনো অস্ত্র বলেও ভাবতে পারছে না। ওটার সরু, সুচালো প্রান্ত ধরে আছে স্পাইডার; ইচ্ছে করেই পশুটার লুকিয়ে থাকার জায়গা থেকে নজর হটিয়ে তাকাল সাগরের দিকে। আশা করছে, নড়া-চড়া ধরার জন্য চোখের কোণই যথেষ্ট হবে।
কী যেন বলেছিল মহিলা? তুমি ভয়ে ভ্যা ভ্যা করে ছাগলের মতো কাঁদবে, গোঙাবে, আর তোমার আতঙ্ক উত্তেজিত করবে তাকে।
আসলেও গোঙাতে শুরু করেছে স্পাইডার, তারপর ডাক ছাড়ল আহত ছাগলের মতো। সেই ছাগলটা আবার পথহারা ছাগল, একাকী হলেও নাদুস- নুদুস!
বালু-রঙা নড়া-চড়া দেখা গেল এক লহমার জন্য। এতটাই স্বল্প-সময় স্থায়ী হলো তা যে কেবল নিজের দিকে ছুটে আসতে থাকা থাবা আর শ্বদন্তই দেখতে পেল স্পাইডার। গজালটাকে বেসবল ব্যাটের মতো করে গায়ের শক্তিতে ঘোরাল সে; পশুটার নাকের ওপর থ্যাচ করে বসে যাওয়ার শব্দ শুনতে পেয়ে খুশি হলো।
থমকে গেল বাঘ, এমন ভাবে চেয়ে আছে যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। তারপর তার গলার গভীর থেকে বেরিয়ে এলো একটা গর্জন। আড়ষ্ট ভঙ্গিতে, যেদিক দিয়ে এসেছিল সেদিকেই ফিরে চলল। ভাবখানা এমন যেন কোনো কাজ ফেলে এসেছে, এখুনি করতে হবে। ঘাড়ের ওপর দিয়ে ঘৃণার সঙ্গে একবার চাইল স্পাইডারের দিকে। আহত পশুটা দৃষ্টি দিয়েই বুঝিয়ে দিল—অচিরেই ফিরে আসবে সে।
ওটাকে যেতে দেখল স্পাইডার।
তারপর বসে পড়ে খুলে ফেলল গোড়ালির বাঁধন।
খাদের ধার ঘেঁষে হাঁটল কিছুক্ষণ, তারপর নামতে শুরু করল ঢাল বেয়ে নিচে। অচিরেই একটা নালা মতো পড়ল সামনে, পাহাড়ের ঢালের মাথা থেকে নিচে পড়া ঝরনার দ্বারা সৃষ্ট। হাঁটু গেঁড়ে বসে, অঞ্জলি বানিয়ে পান করতে লাগল পানি।
তারপর মন দিল পাথর জড়ো করায়। মোটামুটি বড়ো আকৃতির পাথর চাই ওর, হাতের মুঠোর সমান হলে ভালো হয়। বরফের সময় বানানো তুষার- গোলকের মতো স্তূপাকারে সাজিয়ে রাখল নিজের কাছেই।
.
‘তুমি তো কিছুই মুখে দাওনি!’ বলল রোজি।
‘তুমি খাও, শক্তি সঞ্চয় করো,’ জবাব দিল ওর মা। ‘ওই পনির একটু খেলাম তো, তাতেই চলবে।’
ভাঁড়ারটা বেশ ঠান্ডা, সেই সঙ্গে অন্ধকারও। এই ঘন অন্ধকার চোখে সয়ে আসে না। আলোর রেশ মাত্র নেই। ভাঁড়ারের পুরোটা ঘুরে দেখেছে রোজি, আঙুলে ঠেকেছে শুধু পাথর আর গুঁড়িয়ে যাওয়া ইট। কাজে আসতে পারে, এমন কিছু খুঁজছিল; কিন্তু লাভ হলো না।
‘আগে তো খেতে,’ স্মৃতি রোমন্থন করল রোজি। ‘বাবা বেঁচে থাকতে।’
‘তোমার বাবাও কিন্তু,’ জানাল ওর মা। ‘খেতে বেশ পছন্দ করত। লাভ কী হলো? হার্ট অ্যাটাকে মরল, তাও মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে। দুনিয়ার এ কেমন নিয়ম?’
‘বাবা তো খেতে ভালোবাসত বলেই খেত।’
‘কী ভালোবাসত না তোমার বাবা?’ তিক্ত কণ্ঠে বলল ওর মা। ‘খাবার ভালোবাসত, মানুষজনকে ভালোবাসত, ভালোবাসত তার মেয়েকে। রান্না করতে ভালোবাসত। আমাকেও ভালোবাসত। তা এত ভালোবাসা কোন কাজে এসেছে? সেই অল্পবয়সেই তো কবরে সেঁধাতে হয়েছে ওকে। এভাবে মন চাইল আর ভালোবাসলাম—তা হয় না। তোমাকেও বলেছি কথাটা।’
‘হুম,’ একমত হলো রোজি। ‘তা বলেছ।’
মায়ের কণ্ঠ অনুসরণ করে সেদিকে এগোল মেয়েটা, হাত সামনে রেখেছে যাতে ছাদ থেকে ঝুলতে থাকা ধাতব শেকলগুলো এড়ানো যায়। মায়ের হাড়সর্বস্ব কাঁধটা খুঁজে পেয়ে, জড়িয়ে ধরল সে।
‘আমি ভয় পাচ্ছি না,’ অন্ধকারেই বলল রোজি। ‘তাহলে তুমি বোকার হদ্দ।’ জানাল ওর মা।
মহিলাকে ছেড়ে, আন্দাজে ঘরের মাঝখানে চলে এলো রোজি। আচমকা আওয়াজ হলো কিছু একটা ভাঙার। ধুলো আর প্লাস্টারের গুঁড়ো খসে পড়ল ছাদ থেকে।
‘রোজি? কী করছ?’ জানতে চাইল রোজির মা।
‘শিকল দোলাচ্ছি।’
‘সাবধানে। শিকল খসলে ফাটা মাথা নিয়ে মাটিতে পড়ে থাকতে হবে তোমাকে, জ্যাক রবিনসন উচ্চারণ করারও সুযোগ পাবে না।’ মেয়ের কাছ থেকে জবাব না পেয়ে যোগ করল মিসেস নোয়াহ। ‘তুমি দেখি আসলেই পাগল।’
‘নাহ,’ জানাল রোজি। ‘তা আমি নই। আমি এখন আর ডরাচ্ছি না—এই যা।’
ওদের মাথার ওপরে, অর্থাৎ বাড়ির ভেতর, দড়াম করে কেউ বন্ধ করে দিল মূল দরজা।
‘উন্মাদটা ফিরেছে,’ বলল রোজির মা।
‘বুঝতে পেরেছি, আওয়াজটা শুনেছি আমিও,’ বলল রোজি। ‘তারপরেও ডরাচ্ছি না!’
.
মানুষজন মোটকু চার্লির পিঠে চাপড় বসিয়েই চলছে তো বসিয়েই চলছে। কিন্তু দিচ্ছে ড্রিঙ্ক, ওগুলোর গ্লাসে আবার ছাতা বসানো। সেই সঙ্গে পকেটে বহন করছে আরও পাঁচটা বিজনেস কার্ড। সবগুলোই গানের দুনিয়ার মানুষের, অনুষ্ঠান উপলক্ষে এসেছে দ্বীপে।
কামরার সবাই হাসছে ওর দিকে চেয়ে। ডেইজিকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে আছে সে, টের পাচ্ছে মেয়েটার কম্পন। মেয়েটা ওর কানে ঠোঁট ঠেকিয়ে বলল, ‘তুমি যে বদ্ধ পাগল, সেটা জানো?’
‘কাজ তো হয়েছে, তাই না?’
ওর দিকে তাকাল মেয়েটা। ‘রহস্যের ঝাঁপি আজ খুলে বসেছ মনে হচ্ছে?
‘এ তো কেবল শুরু!’ জানাল মোটকু চার্লি।
প্রধান ওয়েট্রেসের কাছে গিয়ে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না…গান গাইবার সময় এক মহিলাকে দেখতে পেলাম। বারের কাছে গিয়ে সে তার কফির পট ভরে নিয়েছিল। কোথায় গেছে, বলতে পারেন?’
চোখ পিটপিট করে শ্রাগ করল মেয়েটা। ‘জানি না…’
‘অবশ্যই জানো,’ বলল মোটকু চার্লি, কেন যেন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠেছে সে; নিজেকে চালাক-চতুরও মনে হচ্ছে। তবে জানে, এই অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। অচিরেই আবার আগের মোটকু চার্লিতে পরিণত হবে সে। কিন্তু একদল শ্রোতার সামনে একটু আগেই গান গেয়েছে ও, মজাও পেয়েছে। ডেইজির জীবন, সেই সঙ্গে নিজের জীবন বাঁচাতেই করেছে কাজটা; সফলও হয়েছে উদ্দেশ্য অর্জনে। ‘চলো, ওদিকে গিয়ে কথা বলি।’ সব কৃতিত্ব বোধহয় গানটারই। ওটা গাইবার সময় সব পরিষ্কার মনে হচ্ছিল। এখনও তাই আছে। হলওয়ের দিকে এগোল সে, ডেইজি আর প্রধান ওয়েট্রেস অনুসরণ করছে ওকে।
‘নাম কী তোমার?’ ওয়েট্রেসকে জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি।
‘আমি ক্লারিসা।’
‘হ্যালো, ক্লারিসা। পুরো নাম?’
পাশ থেকে ফোঁড়ন কাটল ডেইজি, ‘চার্লি, আমাদের কি পুলিসে খবর দেওয়া উচিত না?’
‘একটু পরে দিচ্ছি। ক্লারিসা… কী?’
‘হিগলার।’
‘বেঞ্জামিন, মানে কনসিয়ার্ডের সঙ্গে সম্পর্ক আছে?’
‘আমার ভাই ও।’
‘মিসেস হিগলার, মানে কোরিঅ্যান হিগলারের সঙ্গে কী সম্পর্ক তোমাদের?
‘ওরা আমার ভাতিজা-ভাতিজি, মোটকু চার্লি।’ দরজার কাছ থেকে জবাব দিল মিসেস হিগলার। ‘এখন তোমার বাগদত্তার কথা শোনো, পুলিসে খবর দাও। বুঝলে?’
.
নালার পাশে বসে আছে স্পাইডার, পাহাড়ের শীর্ষেই বলা চলে। খাদটা পেছনের দিকে, সামনে একগাদা পাথর; চাইলেই ছুড়ে মারতে পারবে। আচমকা লম্বা ঘাসের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা লোক। নগ্ন সে, শুধু কোমরে বালুরঙা পশম দিয়ে বানানো একটা নেংটি বেঁধে রেখেছে। পেছন থেকে ঝুলছে একটা লেজ, গলায় দাঁত দিয়ে বানানো মালা; তীক্ষ্ণ, সাদা আর সুচালো সেই দাঁতগুলো। চুল লম্বা, কালো। স্পাইডারের দিকে আলসে ভঙ্গিতে এগিয়ে গেল লোকটা, যেন সকালে পেট খালি করতে যাচ্ছে! স্পাইডারকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বেচারা চমকে গেছে এহেন আচরণ দেখে।
আঙুরের সমান একটা পাথর হাতে নিয়ে ছোড়ার ভঙ্গি করল স্পাইডার।
‘দাঁড়াও দাঁড়াও, আনানসির সন্তান,’ বলল অচেনা লোকটা। ‘আমি তো কেবল এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখতে পেলাম তোমাকে। ভাবলাম গিয়ে দেখি, সাহায্য দরকার কি না ছেলেটার।’ লোকটার নাক বেঁকে আছে, সেই সঙ্গে আহতও।
মাথা নাড়ল স্পাইডার, জিহ্বার অভাব খুব করে বোধ করছে।
‘তোমাকে এখানে দেখে ভাবছিলাম, আনানসির বেচারা সন্তান…নিশ্চয়ই তার ক্ষুধা পেয়েছে খুব,’ একটু বেশিই বিস্তৃত দেখাল অচেনা লোকটার হাসি। ‘এই নাও, খাবার সঙ্গেই এনেছি।’ কাঁধে একটা থলে ঝুলিয়ে রেখেছে সে, ওটা খুলে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল। সদ্য শিকার করা একটা কালো লেজঅলা ভেড়া বের করে আনল লোকটা, ঘাড়টা ধরে রেখেছে বলে মাথা এদিক-ওদিক কাত হচ্ছে। ‘আমি আর তোমার বাবা মিলে একত্রে অনেক বারই খাওয়া- দাওয়া করেছি। তাহলে তুমি-আমি কেন পারব না? আগুনটা তুমি জ্বালাও, রান্নার ব্যবস্থা আমি করছি। কি, জিভে জল চলে আসছে না?’
খিদের চোটে মাথা ঘুরছে স্পাইডারের। জিহ্বা যদি থাকত, তাহলে হয়তো ‘হ্যাঁ’ বলে দিত। আত্মবিশ্বাস থাকত নিজের ওপর, যে চাইলে যেকোনো পরিস্থিতিতে কথা বলেই বিপদ কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ওই একটা অঙ্গই যে নেই, তাই বাঁ-হাতে আরেকটা পাথর তুলে নিলো।
‘এসো, একসঙ্গে বসে খাওয়া-দাওয়া করি বন্ধুর মতো; আশা করি আমাদের মাঝে আর ভুল বোঝাবুঝি থাকবে না,’ জানাল অপরিচিত লোকটা।
হুম, তারপর শকুন-দাঁড় কাকের খাদ্য হবে আমার দেহ, তাই তো? ভাবল স্পাইডার।
স্পাইডারের দিকে আরেক ধাপ এগোল অচেনা লোকটা, তাই সরাসরি একটা পাথর ছুড়ে দিল সে। তাক স্পাইডারের ভালোই, তাই যেখানে লাগাতে চেয়েছিল সেখানেই লাগল: অচেনা লোকটির ডান হাতে। ভেড়াটাকে ফেলে দিল লোকটা, কিন্তু পরের পাথরটার হাত থেকে বাঁচাতে পারল না নিজেকে; ওর মাথার একটা পাশে লাগল ওটা। স্পাইডার চেয়েছিল ফাঁকে-ফাঁকে বসা দুই চোখের মাঝখানে লাগাতে, কিন্তু লোকটা মাথা সরিয়ে নেওয়ায় পারল না। ঠিক তখনই দৌড়তে শুরু করল লোকটা, লাফিয়ে লাফিয়ে এগোচ্ছে; লেজ একদম সোজা হয়ে আছে। কখনো ওকে দেখাচ্ছে মানুষের মতো, আবার কখনো বা অবিকল পশু!
অচেনা লোকটা পালিয়ে গেলে, স্পাইডার এগিয়ে গেল তার ফেলে যাওয়া ভেড়াটার দিকে। অবাক হয়ে আবিষ্কার করল কাছে গিয়ে, নড়ছে ওটা! এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, জান আছে বোধহয় ভেড়াটার দেহে। কিন্তু না, মাংসপেশির ওই সংকোচনের কারণ আসলে পোকা। দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে লাশটা, এতটাই যে গন্ধ নাকে ধাক্কা মারতেই ক্ষিধের কথা ভুলে গেল স্পাইডার…
…অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও।
খাদের কাছে নিয়ে এসে, নিচের সাগরে লাশটাকে ফেলে দিল সে। তারপর হাত ধুয়ে নিলো নালায়।
কতক্ষণ হলো এখানে আছে, তা জানে না। সময়ের গতি যেন থমকে যায় এই জায়গায়। সূর্য দিগন্তরেখার কাছে ক্রমেই নিচে নেমে আসছে।
সূর্য ডোবার পর, চন্দ্র ওঠার আগে, ভাবল স্পাইডার। ফিরে আসবে পশুটা!
.
সেন্ট অ্যান্ড্রুজ পুলিস ফোর্সের হাসিখুশি প্রতিনিধি বসে আছে হোটেলের অফিসে, সঙ্গে আছে ডেইজি আর মোটকু চার্লি; ওদের কথা শুনছে আরোপিত একটা হাসি মুখে ধরে রেখে। মাঝে-মধ্যে অবশ্য আঙুল তুলে চুলকে নিচ্ছে গোঁফ।
পুলিস অফিসারকে জানাল ওরা: গ্রাহাম কোটস নামের এক অপরাধী আচমকা ওদের খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়ে ডেইজিকে বন্দুক দেখিয়ে হুমকি দিচ্ছিল। যদিও অস্ত্রটাকে ডেইজি বাদে আর কেউ দেখেনি। এরপর কালো মার্সিডিজের ঘটনাটা তাকে জানাল মোটকু চার্লি, সেদিন বিকেলেরই কথা। তবে স্বীকার করতে বাধ্য হলো, চালককে দেখতে পায়নি সে। কিন্তু গাড়িটা এসেছে কোত্থেকে, তা নিঃসন্দেহে বলতে পারবে – পাহাড়ের শীর্ষে থাকা বাড়িটা থেকে।
রূপোর প্রলেপ লাগা গোঁফ স্পর্শ করল পুলিস অফিসার। তারপর চিন্তা- ভাবনা করে বলল, ‘হুম, ওখানে একটা বাড়ি আছে বটে। কিন্তু সেটার মালিক আপনাদের এই…কোটস না। আসলে ওটার মালিক বাসিল ফিনেগান, বেশ সম্মানিত একজন মানুষ। বহু বছর ধরে দেশের আইন-শৃঙ্খলা শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে আসছেন তিনি। স্কুলে দান করেছেন…আর তারচেয়ে বড়ো কথা, নতুন পুলিস স্টেশনটা গড়ে ওঠার পেছনেও তার অবদান আছে।’
‘আমার পেটে বন্দুক চেপে ধরেছিল,’ জানাল ডেইজি। ‘হুমকি দেয়, তার সঙ্গে না গেলে গুলি করবে!’
‘যদি কাজটা মি. ফিনেগান করেও থাকে, লিটল লেডি,’ জানাল পুলিস অফিসার। ‘তাহলে নিশ্চয়ই কোনো কারণ ছিল বলেই করেছেন।’ ব্রিফকেস খুলে ভেতর থেকে এক তাড়া কাগজ বের করে আনল সে। ‘একটা প্রস্তাব দিই—আপনারা আরও ভাবুন। এক রাত সময় দিন নিজেকে, যদি সকালেও মনে হয় না ব্যাপারটা ভুল বোঝাবুঝির চাইতে বেশি কিছু ছিল তো এই ফর্মটা পূরণ করবেন। স্টেশনে তিন কপি জমা দিতে হবে। সিটি স্কয়ারের পেছনে নতুন পুলিস স্টেশনটার খোঁজ করবেন। সবাই জানে ওটা কোথায়।’
উভয়ের সঙ্গে করমর্দন করে বিদায় নিলো সে।
‘ওকে জানানো উচিত ছিল যে তুমি নিজেও পুলিস, জানাল মোটকু চার্লি। ‘তাহলে হয়তো আরেকটু সিরিয়াসলি নিত ব্যাপারটাকে।’
‘মনে হয় না তাতে কোনো লাভ হতো,’ জানাল মেয়েটা। ‘কেউ যখন কাউকে ‘লিটল লেডি’ বলে ডাকে, তখন সে বেচারিকে আগেই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছে।’
হোটেলের রিসেপশন রুমে পা রাখল ওরা
‘ভদ্রমহিলা গেল কই?’ প্রশ্ন ছুড়ে দিল মোটকু চার্লি।
বেঞ্জামিন হিগলার জিজ্ঞেস করল, ‘কেলিঅ্যান আন্টি? কনফারেন্স রুমে আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন।’
.
‘কাজ শেষ,’ খুশি মনে জানাল রোজি। ‘জানতাম, পারব। শুধু ক্রমাগত দুলিয়ে গেলেই হবে।’
‘তোমাকে লোকটা মেরে ফেলবে!’
‘এমনি বুঝি খুব বাঁচিয়ে রাখত?’
‘ফন্দিটা কাজে আসবে না।’
‘মা, তোমার মাথায় আর কোনো চিন্তা আছে?’
‘দেখে ফেলবে তোমাকে।’
‘মা, এত নেতিবাচক কথা বলা বন্ধ করবে? যদি সাহায্য করার মতো কোনো পরামর্শ থাকে, তাহলে সেটা বলো। নইলে চুপ থাকো। ঠিক আছে?’
নীরবতা নেমে এলো কামরায়।
তারপর, ‘ওকে আমার পাছা দেখাতে পারি।’
‘কী?’
‘ঠিকই শুনেছ।’
‘মানে…অন্য কোনো ফন্দি নেই?’
‘আপাতত এ-ই।’
আবার খানিকক্ষণের নীরবতার পর রোজি বলল, ‘চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই!’
.
‘হ্যাল্লো, মিসেস হিগলার,’ বলল মোটকু চার্লি। ‘পালকটা ফেরত চাই।’
‘তোমার পালক আমার কাছে আছে, সেটা কে বলল?’ পালটা প্রশ্ন করল মহিলা, ভারী বুকের ওপর বাঁধল হাত।
‘মিসেস ডানউইডি।’
এই প্রথমবারের মতো হতবাক দেখাল মিসেস হিগলারকে। ‘লোয়েলা বলেছে যে পালক আমার কাছে?’
‘হুম, বলেছে যে ওটা তুমি নিয়েছ।’
‘নিরাপদে রাখার জন্যই নিয়েছি।’ মিসেস হিগলার ডেইজির দিকে ইঙ্গিত করল, হাতে ধরা কফির মগ দুলিয়ে। ‘ওর সামনে কথা বলব, সেই আশা করতে পারো না। একে আমি চিনি না!’
‘ওর নাম ডেইজি। আমাকে যা বলবে, তা ওর সামনেও বলতে পারো।’
‘শুনলাম তো,’ মিসেস হিগলার বলল। ‘তোমার সঙ্গে বাগদান হয়েছে।’
মোটকু চার্লি টের পাচ্ছে যে তার গাল লাল হয়ে আসছে। ‘ও আমার বাগদত্তা না–মানে আসলে আমাদের বাগদান হয়নি। অস্ত্রধারী লোকটার কাছ থেকে মেয়েটাকে নিরাপদে সরিয়ে আনার জন্য কিছু একটা তো বলতে হতো। এটাই সবচাইতে সহজ পন্থা মনে হচ্ছিল।’
মোটকু চার্লির দিকে তাকাল মিসেস হিগলার। পুরু কাচের ওপাশে থাকা চোখগুলো ঝকঝক করতে শুরু করেছে। ‘সেটা আমিও জানি,’ জানাল মহিলা। ‘তোমার গানের সময়ই টের পেয়েছি, শ্রোতাদের সামনে গাইলে।’ মাথা নাড়ল সে দুপাশে—বয়স্ক মানুষরা অনেকসময় যুবক-যুবতীদের বোকামি দেখলে যেভাবে নাড়ে। কালো পার্সটা খুলে, ভেতর থেকে একটা খাম বের করে সেটা এগিয়ে দিল মোটকু চার্লির দিকে। ‘লোয়েলাকে কথা দিয়েছিলাম, নিরাপদে রাখব।’
মোটকু চার্লি খামের ভেতর থেকে বের করে আনল একটা পালক, প্ৰায় থেঁতলে গেছে; এই পালকটাই ধরে রেখেছিল সেই রাতে অন্য দুনিয়া থেকে ঘুরে এসে। ‘বেশ বেশ,’ জানাল ও। ‘পালক, দারুণ। এবার বলো,’ মিসেস হিগলারকে জিজ্ঞেস করল মোটকু চার্লি। ‘এই জিনিস দিয়ে করবটা কী?’
‘জানো না?’
মোটকু চার্লির মা ওকে শিখিয়েছিল, সেই কম বয়সে, রেগে গেলে এক থেকে দশ পর্যন্ত গোণা। ধীরে ধীরে, নীরবে গুনতে লাগল সে। কিন্তু দশে আসতেই রাগে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল পুরোপুরি। ‘কী করতে হবে তা জানব কীভাবে? বোকা বুড়ি কোথাকার! গত দুই হপ্তায় আমরা গ্রেফতার হয়েছি, বাগদান ভেঙে গেছে, চাকরি হারিয়েছি, আমার আধা- কাল্পনিক ভাইকে নিজের চোখের সামনে হতে দেখেছি পাখির খাবার… তাও পিকাডেলি সার্কাসে। পাগলের মতো আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিচ্ছি পিং-পং বল হয়ে। আজকে শ্রোতার সামনে দাঁড়িয়ে গান গাইতে হলো, কেন গাইলাম? কেননা যে মেয়ের সঙ্গে খাবার খাচ্ছি তার পেটে বন্দুক চেপে ধরেছিল আমার উন্মাদ, প্রাক্তন-বস। তুমিই বলেছিলে, আমার উচিত ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা। তারপর তো জীবনটাই তছনছ হয়ে গেল, সেটাই আবার সাজাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। তাই না, জানি না এই বালের পালক নিয়ে আমি কী করব! আগুনে পোড়াবো? কেটে গিলব? পাখির বাসা বানাবো? নাকি নাকের সামনে ধরে জানালা দিয়ে লাফ দেব?’
গাল ফোলাল মিসেস হিগলার। ‘সেটা তো তোমার লোয়েলা ডানউইডিকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
‘সেই সুযোগ পাবো বলে তো মনে হচ্ছে না। শেষবার যখন দেখা হলো, তখন তাকে ঠিক সুস্থ মনে হচ্ছিল না। তাছাড়া আমাদের হাতে সময়ও বেশি নেই।’
ডেইজি বলল, ‘ভালো, খুব ভালো! পালকটা তো পেলে। এবার আমরা গ্রাহাম কোটসকে নিয়ে আলোচনা করতে পারি?’
‘এইটা যেন-তেন পালক না। ভাইয়ের বিনিময়ে এই পালক পেয়েছি।’
‘তাহলে আবার ফিরিয়ে দিয়ে কাজে নামো। কিছু একটা তো আমাদেরকে করতেই হবে।’
‘ব্যাপারটা এত সহজ না,’ জানাল মোটকু চার্লি। পরক্ষণেই থমকে গেল, ওর কথা আর মেয়েটার কথা মনে মনে আবার আওড়াচ্ছে। সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে তাকাল ডেইজির দিকে। ‘খোদা, কী বুদ্ধিমান তুমি!’ বলল সে।
‘চেষ্টা করি বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে,’ জানাল মেয়েটা। ‘কিন্তু এখন আবার কী করলাম?’
চারজন বয়স্কা মহিলা নেই হাতের কাছে…কিন্তু আছে মিসেস হিগলার, বেঞ্জামিন আর ডেইজি। খাওয়ার সময়ও শেষ প্রায়, তার মানে প্রধান ওয়েট্রেস ক্লারিসাও যোগ দিতে পারবে ওর সঙ্গে। চারটি আলাদা আলাদা রঙের মাটিও নেই বটে, কিন্তু হোটেলের পেছন থেকে পাওয়া যাবে সৈকতের সাদা বালু; কালো মাটি আসবে সামনের ফুলবিছানা থেকে, হোটেলের পাশে আছে লাল মাটি আর গিফট শপে গেলেই মিলিবে নানা-রঙা বালু। পুলের পাশের বারটা থেকে ছোটো আর সাদা মোমবাতি পাওয়া যাবে; লম্বা আর কালো না যদিও। মিসেস হিগলার ওদেরকে আশ্বস্ত করল: যে যে জড়িবুটি দরকার হবে তা এই দ্বীপেই পাওয়া যাবে। কিন্তু মোটকু চার্লি রান্নাঘর থেকে ব্যুকে গার্নির[৩৩] একটা থলে নিয়ে আসতে বলল ক্লারিসাকে।
[৩৩. রান্না করার মশলা।]
‘আমার মনে হয়, পুরোটাই আত্মবিশ্বাসের খেলা,’ ব্যাখ্যা করল মোটকু চার্লি। ‘ছোটোখাটো ব্যাপারগুলো খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না, দামি হলো জাদুময় আবহাওয়া।’
কিন্তু জাদুময় আবহাওয়ায় বাগড়া বাধাল থেকে থেকে বেঞ্জামিন হিগলারের চারপাশে তাকিয়ে হাসিতে ভেঙে পড়া, কিংবা ডেইজির বারংবার পুরো কাজটাকে হাস্যকর বলতে থাকা।
সাদা ওয়াইন ঢালা পাত্রের ওপর ব্যুকে গার্নির ভেতরের জিনিসগুলো ছড়িয়ে দিল মিসেস হিগলার। অতঃপর শুরু হলো গুঞ্জন, হাত তুলে উৎসাহ দিল সে অন্যদেরকে। তাই দেখে অন্যরাও শুরু করে দিল মন্ত্রপাঠ, অনেকটা মাতাল মৌমাছির মতো করে। কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায় রইল মোটকু চার্লি।
কিন্তু হলো না কিছুই।
‘মোটকু চার্লি,’ বলল মিসেস হিগলার। ‘তুমিও যোগ দাও।’
ঢোক গিলল মোটকু চার্লি। ভয় পাবার মতো কিছু হয়নি। নিজেকেই শোনাল: কামরা ভরতি শ্রোতার সামনে সে গান গেয়েছে। এমনকী অজানা-অচেনা একদল লোকের সামনে এমন এক মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে যে বলতে গেলে অপরিচিতই। সেসবের তুলনায় গুনগুন তো একেবারেই তুচ্ছ।
মিসেস হিগলারের সুরটা নিজের গলায় তুলল সে, তারপর গলাটাকে কাঁপতে দিল…
হাতে ধরে আছে পালক, মনোযোগ দিয়ে আবার গুঞ্জন শুরু করল ও।
হাসা বন্ধ করে দিল বেঞ্জামিন, চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেছে। চেহারায় ফুটে আছে ভয়ের একটা চিহ্ন, মোটকু চার্লি গুনগুন বন্ধ করে দিতো হয়তো…কিন্তু ততক্ষণে তালটা ওর ভেতরে ঢুকে গেছে। মোমের আলোও কাঁপছে প্রবলভাবে…
‘দেখো, ওকে দেখো!’ বলল বেঞ্জামিন। ‘মানুষটা তো—’
মোটকু চার্লি ভাবল, মানুষটা…মানে ওর নিজের কী হয়েছে? কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে।
চোখের সামনে থেকে দূর হয়েছে কুয়াশা।
একটা সেতু ধরে হাঁটছে মোটকু চার্লি, ধূসর পানির বিশাল একটা আধারের ওপর অবস্থিত ওই লম্বা, সাদা সেতু। ঠিক মাঝখানে বসে আছে এক লোক, ছোট্ট একটা কাঠের চেয়ারে; মাছ ধরছে এক মনে। মাথার সবুজ ফেডোরা টুপির কারণে চোখ দেখাই যায় না। মনে হচ্ছে যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে সে, মোটকু চার্লিকে আসতে দেখেও ভাবান্তর হলো না।
লোকটাকে চিনতে পারল মোটকু চার্লি, এগিয়ে গিয়ে একটা হাত রাখল তার কাঁধে।
‘আমি জানতাম,’ বলল যুবক। ‘তুমি আসলে মরার ভান ধরেছ, কখনো ভাবিনি যে সত্যি সত্যি তুমি আর বেঁচে নেই।’
চেয়ারে বসা মানুষটা নড়ল না বটে, তবে হাসল। ‘তোমার জ্ঞান যে কত অল্প, এতে সেটাই প্রমাণিত হয়,’ বলল আনানসি। ‘আমি শতভাগ মৃত।’ আলস্যে ভরা আড়মোড়া ভাঙল সে একটা, কানের পেছন থেকে কালো চুরুট বের করে এনে গুঁজে দিল নিজের দুই ঠোঁটের ফাঁকে। আগুন ধরিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি মারা গেছি। আরও কিছুদিন হয়তো এভাবেই থাকব। মাঝে-মধ্যে না মরলে, মানুষের কাছে দাম থাকে, বলো?’
মোটকু চার্লি বলল, ‘কিন্তু—’
ঠোঁট আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে চুপ করতে বলল ওকে আনানসি। বড়শি তুলে নিয়ে সুতো গোটাতে শুরু করল সে, ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিল একটা ছোট্ট জাল। মোটকু চার্লি তুলে নিলো সেটা, ওর বাবা তাতে একটা লম্বা, ছটফট করতে থাকা রূপালি মাছ ছেড়ে দেওয়া পর্যন্ত ধরেই রইল। মুখ থেকে বড়শির হুক ছাড়িয়ে নিয়ে, এরপর একটা সাদা বালতিতে রাখল মাছটাকে। ‘এই নাও,’ বলল সে। ‘আজ রাতের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে গেছে।’
এই প্রথম বারের মতো মোটকু চার্লি আবিষ্কার করল: ডেইজি আর হিগলারদের সঙ্গে যখন আসনে বসেছিল তখন গভীর রাত হলেও, এখন যেখানে আছে সেখানকার সূর্যটা ডুবতে বসেছে! এখনও সূর্যাস্ত হয়নি।
চেয়ার ভাঁজ করে ফেলল ওর বাবা। মোটকু চার্লিকে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল চেয়ার আর বালতি বহন করার কথা। তারপর পাশাপাশি, ওই সেতুর ওপরেই হাঁটতে লাগল ওরা। ‘একটা কথা কী জানো, বলল মি. ন্যান্সি। ‘সবসময় ভেবেছি, যদি কখনো আমার সঙ্গে কথা বলতে আসো তাহলে অনেক কিছু শোনাব তোমাকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তার দরকার পড়বে না। যাই হোক, এখানে এসেছ কেন?’
‘ঠিক জানি না। পাখি-মানবীকে খুঁজছিলাম। ভেবেছিলাম, ওকে তার পালকটা ফিরিয়ে দেব।’
‘কাজটা একদম ঠিক করোনি,’ হাসিমুখেই বলল ওর বাবা। ‘এসব করে কখনওই ভালো কিছু হয় না। পাখি-মানবীকে ঘৃণার ডিপো বললেও অত্যুক্তি হবে না। তবে সাহস নেই একদম।’
‘আসলে স্পাইডারকে—’ বলতে চাইল মোটকু চার্লি।
‘সেই দোষটাও তো তোমারই। ওই বুড়ো মহিলাকে কেন করতে দিয়েছিলে কাজটা? কেন তোমার অর্ধেক সত্তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার অনুমতি দিলে?’
‘তখন তো ছোটো বাচ্চা ছিলাম! তুমি কেন কিছু করলে না?’
মাথার টুপিটা একপাশে কাত করাল আনানসি। ‘যদি তুমি করতে না দিতে, তাহলে বুড়ি ডানউইডি কিছুই করতে পারত না,’ জানাল সে। ‘হাজার হলেও, তুমি আমার সন্তান!’
কথাটা নিয়ে ভাবল মোটকু চার্লি। তারপর বলল, ‘কিন্তু আমাকে কখনও কেন বলোনি?’
‘অসুবিধে হতে দেখিনি যে, ঠিকঠাক মতোই তো জীবন কাটাচ্ছিলে। হাজার হলেও, গানের মাহাত্ম্য তো একা-একাই ধরে ফেলেছ, তাই না?’
মোটকু চার্লির মনে হলো, আগের চাইতেও অনেক বেশি মোটা আর অপটু হয়ে গেছে সে। এমনকী বাবাকে হতাশ করার অনুভূতিও পেয়ে বসেছে ওকে। কিন্তু সেরেফ ‘না’ বলে কাজ চালাল না। উলটো বলল, ‘তোমার কী মনে হয়?’
‘পুরোপুরি না ধরতে পারলেও, কাছাকাছি গেছ। গানের ব্যাপারে একটা কথা মাথায় রাখতেই হয়—ওগুলো গল্পের মতোই। মানুষ যদি মন দিয়ে না শোনে, তাহলে কোনোটা দিয়েই লাভ হয় না।’
সেতুর প্রায় শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে ওরা। মোটকু চার্লি জানে এবং কারও ওকে বলে দিতে হয়নি—যে আর কখনও পিতা-পুত্রের কথা-বার্তা হবে না। কিন্তু জানার যে আছে অনেক কিছু, দরকারও অনেক জ্ঞান আহরণে। বলল, ‘বাবা, যখন আমি ছোটো ছিলাম, তখন কেন আমাকে কেবল লজ্জা দিতে? লজ্জায় ফেলতে?’
কুঁচকে গেল বয়স্ক লোকটার ভ্রু। ‘লজ্জা দিতাম? তোমাকে ভালোবাসতাম আমি!’
‘প্রেসিডেন্ট ট্যাফটের সাজে স্কুলে পাঠিয়েছিলে আমাকে…এই তোমার ভালোবাসা?’
তীক্ষ্ণ কণ্ঠের চিৎকারটা বুড়ো মানুষটার হাসিও হতে পারে। যাই হোক, এক মুহূর্ত পরেই চুরুট টানায় মন দিল সে। ভূতুড়ে বেলুনের মতো তার ঠোঁট থেকে বেরোতে লাগল ধোঁয়া। ‘তোমার মা-ও এই ব্যাপারে কিছু কথা শুনিয়েছিল,’ বলল সে। তারপর যোগ করল, ‘আমাদের হাতে সময় বেশি নেই, চার্লি। সেই খানিকক্ষণও কি ঝগড়া করে কাটাতে চাও?’
মাথা নাড়ল মোটকু চার্লি, ‘একদম না।’
সেতুর শেষ মাথায় পৌঁছে গেল ওরা। ‘ভালো কথা,’ বলল ওর বাবা। ‘ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলে, আমার তরফ থেকে একটা জিনিস পৌঁছে দিয়ো।’
‘কী?’
হাত বাড়িয়ে, মোটকু চার্লির মাথাটা ঝুঁকিয়ে দিল ওর বাবা। তারপর আস্তে করে কপালে চুমু খেয়ে বলল, ‘এটা।’
সোজা হয়ে দাঁড়াল মোটকু চার্লি। এমন দৃষ্টিতে তার বাবা তাকিয়ে আছে ওর দিকে, যেটাকে অন্য কারও চোখে দেখলে গর্ব-মিশ্রিত বলেই মনে করত। ‘পালকটা দেখি,’ বলল বয়স্ক লোকটা।
পকেটে হাত ঢোকাল মোটকু চার্লি। পালকটা আছে ওখানেই, তবে আগের চাইতে অনেক বেশি দলা পাকানো আর ধ্বংস-প্রায় মনে হচ্ছে।
জিহ্বা দিয়ে টুট টুট আওয়াজ করে আলোতে উঁচু করে পালক ধরল ওর বাবা। ‘দারুণ তো পালকটা,’ বলল সে। ‘কিন্তু এই দশা দেখতে ভালো লাগছে না। পাখি-মানবী সেটা ফেরতও নেবে না।’ মি. ন্যান্সি হাত বুলালো ওটার ওপর, সঙ্গে সঙ্গে আবার নিখুঁত হয়ে গেল পালকটা। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘লাভ কী? আবার আগের দশাই বানাবে এটার।’ নখে ফুঁ দিয়ে, জ্যাকেটের সঙ্গে ঘষল ওগুলো। মনে হলো, কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। ফেডোরাটা খুলে, সেটার ব্যান্ডের ভেতর গুঁজে দিল পালক। ‘এই নাও, পাগল-দর্শন একটা হ্যাট তোমার দরকার হয়ে পড়েছে।’ মোটকু চার্লির মাথায় পরিয়ে দিল ফেডোরাটা। ‘মানিয়েছে বেশ,’ বলল সে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলল মোটকু চার্লি। ‘বাবা, আমি হ্যাট পরি না। দেখতে বোকার মতো লাগবে, হাসবে সবাই। আমাকে লজ্জায় ফেলার চেষ্টা কেন করো সব সময়?’
মরতে বসা আলোতে, ছেলের দিকে চাইল বৃদ্ধ লোকটা। ‘তোমার ধারণা, আমি তোমার সঙ্গে মিথ্যে কথা বলব? শোনো বাছা, হ্যাট পরার জন্য যা দরকার তা হলো ভাবভঙ্গী। সেটা তোমার যথেষ্টই আছে। যদি না মানাত, তাহলে মিথ্যে কথা বলতাম? বুদ্ধিমান দেখাচ্ছে তোমাকে। বিশ্বাস করো না আমার কথা?’
সাফ জবাব দিল মোটকু চার্লি, ‘নাহ!’
‘দেখো,’ বলল ওর বাবা, সেতুর এক ধার দিয়ে পানি দেখাল সে। ওদের পায়ের নিচে থাকা পানিতে ঢেউ নেই, একেবারে স্থির… আয়নার মতোই। পানির ভেতর থেকে যে লোকটা উঁকি দিল, তাকে সবুজ হ্যাটে বুদ্ধিমান ও স্মার্ট দেখা যাচ্ছে।
হয়তো ভুল বলেনি, বলার জন্য বাপের দিকে তাকাল মোটকু চার্লি; কিন্তু বৃদ্ধ লোকটা ততক্ষণে হাওয়ায় উবে গেছে।
সেতু থেকে নেমে, সূর্যাস্তের দিকে রওনা দিল ও।
.
‘বেশ, এবার বলো: ঠিক কোথায় আছে ও? গেছে কই? ওর কী হাল করেছ তোমরা?’
‘আমি কিছুই করিনি। শোনো বাছা, বলল মিসেস হিগলার। ‘আগেরবার এটা হয়নি।’
‘দেখে মনে হচ্ছিল, মাদারশিপে কেউ টেনে নিয়ে গেছে ওকে,’ জানাল বেঞ্জামিন। ‘দারুণ, বাস্তব জীবনেই স্পেশাল ইফেক্টস!’
‘ওকে ফিরিয়ে আনো,’ বলল ডেইজি, রাগত ভঙ্গিতে। ‘এখুনি ফিরিয়ে আনো!’
‘কোথায় গেছে, তাই তো জানি না,’ জানাল মিসেস হিগলার। ‘আর আমি কাউকে কোথাও পাঠাইনি, সে নিজেই গেছে।’
‘যাই হোক,’ বলল ক্লারিসা। ‘হয়তো যেটা করতে চাচ্ছিল, সেই কাজেই লেগে আছে এখন। ওকে এখন ফিরিয়ে আনলে সব ভণ্ডুল হয়ে যাবে!’
‘ঠিক বলেছ,’ জানাল বেঞ্জামিন। ‘মিশন অর্ধেক পথে রেখেই অভিযাত্রী ফিরিয়ে আনার মতো হবে ব্যাপারটা।’
ব্যাপারটা নিয়ে ভাবল ডেইজি, কথাটা যুক্তিযুক্ত ধরতে পেরে খানিকটা বিরক্তই হলো—আজকাল অবশ্য অদ্ভুত অনেক কিছুই যুক্তিযুক্ত লাগতে শুরু করেছে।
‘যদি আর কিছু ঘটার সম্ভাবনা না থাকে,’ জানাল ক্লারিসা। ‘তাহলে রেস্তোরাঁয় ফিরে যাই? আশা করি সব ঠিকই আছে।’
কফির মগে চুমুক দিল মিসেস হিগলার। ‘মনে হয় না কিছু ঘটবে,’ জানাল সে।
টেবিলে চাপড় বসাল ডেইজি। ‘এক্সকিউজ মি, বাইরে একটা খুনি ঘোরাফেরা করছে। এদিকে মোটকু চার্লিকে মাস্টারশিপে তুলে নেওয়া হয়েছে।’
‘মাদারশিপ,’ বলল বেঞ্জামিন।
চোখ পিটপিট করল মিসেস হিগলার। ‘বেশ তাহলে,’ বলল সে। ‘কিছু একটা করা তো দরকার। কিন্তু কী করা যায়?’
‘আমি জানি না,’ মেনে নিলো ডেইজি, কথাটা বলতে হচ্ছে বলে নিজের ওপরেই বিরক্ত। ‘সময় নষ্ট করা ছাড়া তো আর কিছু করার নেই।’ মিসেস হিগলার উইলিয়ামসটাউন কুরিয়ার-এর যে কপিটা পড়ছিল, সেটার পাতা ওলটাতে লাগল সে।
গল্পটা লেখা হয়েছে হারানো পর্যটকদের নিয়ে, তিন নম্বর পাতায় ছাপা হয়েছে যে মেয়েরা তাদের ক্রুজ শিপে ফেরেনি তাদের নিয়ে একটা লেখা। সেজন্যই ওই দুজনকে পাঠিয়েছ, তাই না? আমার বাড়িতে? ডেইজির মাথার ভেতরে ঢুকে যেন বলল লোকটা। ক্রুজ শিপে করে ঘুরতে ঘুরতে আচমকা এসে উপস্থিত হয়েছে—এই গপ্পো আমি বিশ্বাস করব, তা ভাবলে কী করে?
দিন শেষে, ডেইজি তো পুলিসই!
‘আমাকে ফোনটা দাও,’ বলল সে।
‘কাকে ফোন করবে?’
‘প্রথমে পর্যটন মন্ত্রী আর পুলিস চিফকে দিয়ে শুরু করব। তারপর দেখা যাক, আর কাকে কাকে করা যায়…’
.
লালচে সূর্য ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে দিগন্তে। স্পাইডার, যদি স্পাইডার না হতো, তাহলে হতাশায় ডুবে যেত। দ্বীপে, মানে ওই স্থানে, দিন আর রাতের পার্থক্য একেবারে পরিষ্কার। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল সে-সূর্যের শেষ অংশটুকুও গিলে নিচ্ছে সাগর। এদিকে ওর কাছে আছে শুধু পাথর আর দুটো গজাল।
আগুন হলে ভালো হতো।
ভাবতে লাগল, চাঁদ কখন উঠবে। চাঁদ উঠলে, হয়তো আত্মরক্ষার একটা উপায় পাবে সে।
ডুবে গেল সূর্য—কালো সাগরে ডুব দিল লালের শেষ বিন্দুটাও। রাত নেমে এলো।
‘আনানসির সন্তান,’ অন্ধকার থেকে ভেসে এলো একটা কণ্ঠ। ‘অচিরেই পেট পুরে খাবো আমি। ঘাড়ে আমার শ্বাসের ছোঁয়া পাবার আগে, আমার উপস্থিতি ধরতেও পারবে না! যখন হাত-পা বেঁধে তোমাকে ফেলে রাখা হয়েছিল, তখনও তোমার ওপরে ছিলাম আমি। চাইলে সেই মুহূর্তেই কামড়ে ঘাড় ভেঙে ফেলতে পারতাম। কিন্তু ভাবলাম, রসিয়ে রসিয়ে করা যাবে কাজটা। ঘুমের মাঝে তোমাকে হত্যা করে তৃপ্তি মিলত না। তোমার জান বেরিয়ে যাচ্ছে—সেটা আমি অনুভব করতে চাচ্ছিলাম। চাচ্ছিলাম তুমি জানো—কেন মরতে হচ্ছে তোমাকে।’
কণ্ঠটা যেখান থেকে আসছে মনে হচ্ছে, সেদিকে পাথর ছুড়ল স্পাইডার। টের পেল: কারও ক্ষতি না করে একটা ঝোপে গিয়ে পড়ল সেটা।
‘তোমার আছে পাথর আর হাত,’ বলল কণ্ঠটা। ‘কিন্তু আমার নখরগুলো ছুরির চাইতে তীক্ষ্ণ ও ধারাল। দুটো পা আছে তোমার, কিন্তু আমার চার পায়ে ক্লান্তি ভর করে না; তোমার স্বপ্নের চাইতেও দশগুণ গতিতে দৌড়াতে পারি। তোমার দাঁত মাংস ছিঁড়তে পারে বটে, কিন্তু তার জন্য দরকার হয় সেটাকে আগুনে পুড়িয়ে নরম আর স্বাদহীন বানানোর। তোমার দাঁতগুলো বানরের দাঁতের মতো, নরম ফল আর কীটপতঙ্গ বাদে অন্য কিছু খাওয়ার জন্য তা যথেষ্ট না। কিন্তু আমার দাঁত হাড় থেকে মাংস টেনে ছিঁড়তে সক্ষম। রক্ত গরম আর প্রবাহিত থাকা অবস্থায় গলাধঃকরণ করি সেটা।’
ঠিক তখনই একটা আওয়াজ করল স্পাইডার; এমন এক আওয়াজ যা করার জন্য জিহ্বা লাগে না, এমনকী লাগে না ঠোঁটও। বিরক্তি প্রকাশ করার মতো ‘মেহ’ শোনাল আওয়াজটা। তুমি যা বলছ, তার সবটাই সত্যি, বাঘ। বলল যেন সেই আওয়াজ। কিন্তু তাতে কী? সব গল্প আনানসির, এখন কেউ বাঘের গল্প বলে না!
অন্ধকারের বুক চিরে ভেসে এলো একটা গর্জন, রোষ আর হতাশা মিশে আছে সেই গর্জনে।
গুনগুন করতে লাগল স্পাইডার, ‘টাইগার র্যাগ’ নাম গানটার। পুরাতন একটা গান, বাঘদেরকে বিদ্রূপ করার জন্য ভালো: ধরে রাখো বাঘটাকে, গেল কই ওটা?
পরেরবার যখন কণ্ঠটা অন্ধকার থেকে ভেসে এলো, তখন অনেক বেশি কাছাকাছি মনে হলো তার উৎসটাকে
‘তোর প্রেমিকা আমার মুঠোয়, আনানসির সন্তান। তোর একটা ব্যবস্থা করার পর, ওর হাড় থেকে মাংস ছিঁড়ে খাবো আমি। সন্দেহ নেই, তার মাংস তোর চেয়ে বেশি সুস্বাদু হবে।’
‘হুম্ফ!’ আওয়াজ করল স্পাইডার, বোঝাতে চাইল যে সে মিথ্যেটা ধরে ফেলেছে!
‘ওর নাম—রোজি।’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখ দিয়ে আওয়াজ বেরিয়ে এলো স্পাইডারের।
অন্ধকারেই গা ঢাকা দিয়ে হেসে উঠল কেউ একজন। ‘চোখের কথা আর কী বলব,’ বলল কণ্ঠটা। ‘তোমার চোখ শুধু তাই দেখে যা দিনের আলোতে দেখা যায়, তাও যদি কপাল ভালো হয় তবেই। কিন্তু আমার প্রজাতির সদস্যরা এখানে থাকলে তোমার হাতের ছোটো ছোটো লোমগুলোও দেখতে পেত। তোমার চোখ-মুখের আতঙ্ক, এমনকী এই রাতের অন্ধকারেও দেখতে পাচ্ছি পরিষ্কার। আমাকে ভয় পাও, আনানসির সন্তান; যদি কারও কাছে প্রার্থনা করার মতো কিছু থাকে, তাহলে এখনই বলো।’
তেমন কোনো প্রার্থনা নেই স্পাইডারের। তবে হাতের কাছে পাথর আছে, সেগুলো ছুঁড়তে পারে চাইলে। কপাল ভালো থাকলে হয়তো ওটা কোনো ক্ষতি করলেও করতে পারে। স্পাইডার ভালো মতোই জানে, ব্যাপারটা হবে অলৌকিক। তাতে কী? আজীবন তো অলৌকিক কাণ্ডই ঘটিয়ে এসেছে।
আরেকটা পাথরের দিকে হাত বাড়াল সে।
কিন্তু ওর হাতের পিঠটা স্পর্শ করল কিছু একটা।
হ্যালো, ওর মনের মাঝে বলল কাদার তৈরি ছোট্ট মাকড়শাটা।
হাই, ভাবল স্পাইডার। দেখো, আমি একটু ব্যস্ত আছি। চাচ্ছি, যাতে কেউ আমাকে খেয়ে না ফেলে। যদি আপাতত শান্তিতে থাকত দাও, তাহলে হয়তো…
কিন্তু ওদেরকে নিয়ে এসেছি যে, ভাবল মাকড়শাটা। যেমনটা তুমি করতে বলেছিলে।
আমি বলেছিলাম?
বলেছিলে, সাহায্য আনতে। নিয়ে এসেছি। আমার ফাঁদা জাল অনুসরণ করে এসেছে তারা। এই জগতে মাকড়শা নেই, তাই ওই জগতে গিয়ে জাল পেতে ওদেরকে নিয়ে এসেছি এখানে। সাহসীদের, ধনীদের এনেছি নিজের সঙ্গে।
‘ভাবছ কী?’ অন্ধকার থেকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল বিশাল বিড়ালটা। তারপর খানিকটা আমোদের সঙ্গে বলল, ‘কী হলো? বিড়াল জিভ খেয়ে ফেলেছে?’
মাকড়শা নীরব প্রজাতি। তারা নীরবতা ঘনিয়ে তোলে। যেগুলো আওয়াজ করে, সেগুলোও সাধারণত যতটা সম্ভব স্থিরই থাকে; থাকে অপেক্ষায়…
…স্পাইডারও তাই করছে।
আস্তে আস্তে রাতের নীরবতাকে দূর করে সেই স্থান দখল করে নিচ্ছে নরম একটা আওয়াজ।
নিজের রক্ত আর থুতু মাটির সঙ্গে মিশিয়ে যে সাত পাঅলা মাকড়শাটা বানিয়েছিল, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা আর গর্ব অনুভব করল স্পাইডার। মাকড়শাটা ওর হাতের পেছন থেকে কাঁধে উঠে এলো।
দেখতে না পেলেও স্পাইডার জানে: আছে ওগুলো–বড়ো মাকড়শা, ছোটো মাকড়শা, বিষাক্ত মাকড়শা, বিশাল বিশাল সব লোমশ মাকড়শা, সেই সঙ্গে চিটিনদেহী মাকড়শাও। এমনিতে আলোর দিকে নজর ওদের পড়ে বটে, কিন্তু দেখে পা দিয়ে। চারপাশের দুনিয়া থেকে কম্পন শুষে তাকে কল্পনা করে।
এবং ওকে সাহায্য করার জন্য পুরো একটা বাহিনী চলে এসেছে।
অন্ধকার থেকেই আবার মুখ খুলল বাঘ। ‘যখন তুমি মারা যাবে— যখন আনানসির বংশের সবাই মারা যাবে—তখন সব গল্প আবার আমার হবে। আরও একবার, মানুষ শোনাবে বাঘের গল্প। সমবেত হয়ে আমার শক্তি আর বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করবে। শোনাবে আমার নৃশংসতা আর আমার আনন্দের আখ্যান। সব গল্প হবে আমার, সব গানের মালিকও আমিই হবো। আগে যা ছিল, দুনিয়া আবার সেটাই হবে: রুক্ষ একটা জায়গা, অশুভ একটা স্থান।’
বাহিনীর নড়া-চড়ার আওয়াজ শুনতে পেল স্পাইডার।
কারণ আছে বলেই পাহাড়ের শীর্ষের একদম ধারে বসে আছে সে। পালাবার পথ নেই—সেকথা সত্য। কিন্তু এখানে থাকার মানে: বাঘও চোখ বন্ধ করে ছুটে আসতে পারছে না। এমনকী আড়াল নিয়ে ওর কাছাকাছিও হতে পারছে না।
হাসতে শুরু করল স্পাইডার।
‘হাসছ কেন, আনানসির সন্তান? মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’
কথাটা শুনে স্পাইডারের হাসি আরও বেড়ে গেলে, হলো জোরাল।
অন্ধকার থেকে ভেসে এলো নেকড়ের গর্জনের মতো আওয়াজ। স্পাইডারের বাহিনীর সামনে পড়ল বাঘ।
মাকড়শার বিষের রূপ একাধিক। কামড়ের ফলাফল অনুভব করার জন্য কখনও কখনও অনেকক্ষণ লেগে যায়। প্রকৃতিবিদরা বহুদিন হলো এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে: এমন অনেক মাকড়শা আছে যাদের কামড় দেওয়া স্থানটা পচে যায়, যাকে কামড় দেওয়া হয়েছে তার মরতে বছরখানেকও লেগে যায় অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু মাকড়শা এমনটা কেন করে? এই প্রশ্নের জবাব একেবারে সোজা: তাদের কাছে ব্যাপারটা মজার মনে হয়…আর তারা চায় না, কেউ কখনও তাদের কথা ভুলে যাক।
বাঘের আহত নাকে কামড় বসাল ব্ল্যাক উইডো, কানে বসাল টরেন্টুলা: কয়েক মুহূর্তের মাঝে বাঘের স্পর্শকাতর সব স্থান জ্বলতে আর দপদপ করতে লাগল, সেই সঙ্গে চুলকাচ্ছেও প্রচণ্ড ভাবে। বাঘ বুঝতেই পারছে না, কী হচ্ছে ওর সঙ্গে! শুধু টের পাচ্ছে, ওর দেহের নানা অংশ ব্যথায় জ্বলছে…
…আর টের পাচ্ছে: ওর অন্তরে স্থান করে নিয়েছে আতঙ্ক।
হাসল স্পাইডার, এবার আগের চাইতেও জোরে, আরও বেশিক্ষণ ধরে। বিশাল প্রাণিটার ঝোপের ভেতর ছুট লাগাবার আওয়াজ শুনল কান পেতে; ভয়ে আর যন্ত্রণায় গজরাচ্ছে।
তারপর বসে বসে করতে লাগল অপেক্ষা। বাঘ ফিরবেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই নাটকের যবনিকাপাত হতে দেরি আছে।
সাত পাঅলা মাকড়শাটাকে কাঁধের ওপর থেকে নামিয়ে, আদর করে দিল পিঠে হাত বুলিয়ে। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে কিছুটা নিচে দেখা যাচ্ছে নরম, ঠান্ডা সবুজ আলো। দপদপ করছে ওটা, যেন ছোট্ট কোনো শহর থেকে ভেসে আসা আলো। আসছে ওরই দিকে!
দপদপানির উৎস যে আসলে লাখখানেক জোনাকি পোকা। সেই আলোর ঠিক মাঝখানে দেখা যাচ্ছে একটা মানুষের অবয়ব। ধীর কিন্তু স্থির বেগে উঠছে সে পাহাড় বেয়ে।
পাথর হাতে তুলে নিলো স্পাইডার, ওর মাকড়শা-বাহিনীকে মনে মনে নির্দেশ দিল আরেকটা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত হতে। পরক্ষণেই থেমে গেল সে। জোনাকির আলোয় দেখতে পাওয়া অবয়বটার কিছু একটা পরিচিত মনে হচ্ছে।
চিনতে বেগে পেতে হলো না ওকে। পরিচিত জিনিসটা আসলে একটা সবুজ ফেডোরা!
.
রান্নাঘরে আধ বোতল রাম খুঁজে পেয়েছিল গ্রাহাম কোটস, সেটার প্রায় পুরোটাই শেষ করে ফেলেছে ও। মদ আনতে নিচে যাওয়ার ইচ্ছে হয়নি বলেই রামের বোতলটা খুলেছিল সে। তাছাড়া ওয়াইনের চাইতে রামের প্রভাব দ্রুততর হবার কথা। কপাল মন্দ, তা হলো না। মাতলামির লক্ষণও নেই তার দেহে। মানসিক ভাবে অবশ হবার যে উদ্দেশ্যে রামটাকে হাতে নিয়েছিল, সেটাও হলো না।
এক হাতে বোতল আর অন্য হাতে আধ-ভরতি একটা গ্লাস নিয়ে পায়চারি করছে সে। থেকে থেকে একটায় চুমুক দিচ্ছে, আবার খানিক পরে অন্যটায়। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি নজরে পড়ল তার, ঘামছে প্রবলভাবে; সেই সঙ্গে চেহারাটাও বিধ্বস্ত। ‘মন খারাপ করার কিছু নেই,’ উচ্চকণ্ঠে বলল সে। ‘হয়তো কখনও কিছুই হবে না। শাপের মাঝেই বর থাকে, কালো মেঘে থাকে বৃষ্টি।’ রাম ততক্ষণে প্রায় শেষই বলা চলে।
রান্নাঘরে ফিরে গেল গ্রাহাম কোটস। শেরির বোতলটা খুঁজে পেতে, বেশ কয়েকটা কাপবোর্ড খুলতে হলো ওকে। বোতলটা হাতে নিয়ে, কৃতজ্ঞতার সঙ্গে ওটাকে আদরই করল বলা যায়। যেন আকারে খুবই ক্ষুদ্র এক বন্ধু ওটা, যে বহু বছর সাগরে কাটাবার পর ফিরে এসেছে আবার।
বোতলের ছিপি খুলল সে। রান্না করার কাজে ব্যবহৃত হয় এমন মিষ্টি শেরির বোতল ওটা। কিন্তু পাত্তা না দিয়ে, লেবুর রসের মতো মদ ঢালতে লাগল গলায়।
রান্নাঘরে মদ খোঁজার সময়, আরও কয়েকটা জিনিস নজরে পড়েছে গ্রাহাম কোর্টসের। এই যেমন, বেশ কিছু ছুরি আছে ওখানে; কয়েকটা তো মারাত্মক তীক্ষ্ণ। একটা ড্রয়ারে একটা ছোট্ট, ইস্পাতের তৈরি হ্যাকস-ও আছে। গ্রাহাম কোর্টসের পছন্দ হয়েছে ওটা, ভাঁড়ারে যে দুই সমস্যা আটকে রেখেছে তাদের একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারে হ্যাকসটা দিয়ে।
‘হেবিয়াস করপাস[৩৪],’ বলল সে। ‘কিংবা হেবিয়াস ডিলেকটি[৩৫]… দুটোর কোনো একটা হবে। যদি লাশ না পাওয়া যায়, তাহলে অপরাধ হয়েছে তা প্রমাণ করার উপায়ও থাকবে না। তাই, কুয়োড এরাট ডেমোনস্ট্রানডাম[৩৬]!’
[৩৪. আদালতের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রকে আসামী গ্রেফতার পেছনে যুক্তি উপস্থাপনের নির্দেশ।
৩৫. অপরাধ যে হয়েছে, তার পক্ষে নিরেট প্রমাণ উপস্থাপন।
এই ক্ষেত্রে গ্রাহাম কোটস বোঝাতে চাইছে, লাশ গুম করে দিলে তাকে বিচারের মুখোমুখি করার পেছনে কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো নিরেট যুক্তি বা প্রমাণ থাকবে না।
৩৬. যা প্রমাণ করতে হবে।]
জ্যাকেটের পকেট থেকে অস্ত্র বের করে রেখে দিল রান্নাঘরের টেবিলের ওপর। তারপর ছুরিগুলোকে চাকার স্পোকের মতো করে সাজালো। ‘এবার, ‘ বলল সে, অবিকল সেই কণ্ঠে যে কণ্ঠ ব্যবহার করে নিরীহ বাচ্চা ছেলেদের ব্যান্ডকে বোঝাতো সময় এসেছে ওর সঙ্গে চুক্তি সই করে খ্যাতির সাগরে গাঁ ডোবানোর। ‘সময়ের এক ফোঁড়… ‘
বেল্টে গুঁজে নিলো তিনটে ছুরি, হ্যাকস গেল ওর জ্যাকেটের পকেটে। তারপর অস্ত্র হাতে নেমে গেল সেলারের দিকে। বাতি জ্বালিয়ে, চোখ পিটপিট করে দেখে নিলো উভয় পাশের র্যাকে থাকা সারিবদ্ধ মদের বোতলগুলোকে; ধুলো জমেছে ওগুলোয়। সব শেষে দাঁড়াল ভাঁড়ার ঘরের দরজার সামনে।
‘জেনে খুশি হবে,’ চেঁচিয়ে উঠল সে। ‘সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তোমাদের কোনো ক্ষতি করব না। উভয়কেই ছেড়ে দেব। সবই ভুল বোঝাবুঝির ফল, আশা করি রাগ পুষে রাখবে না। যা হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে। ওপাশের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়াও, আগে যেভাবে দাঁড়িয়েছিলে। চালাকির চেষ্টা কোরো না।’
ছিটকিনি টানার সময় ভাবছিল, অস্ত্রধারীর চেঁচিয়ে বলার মতো অতি- নাটকীয় কত বাক্যই না আছে! গ্রাহাম কোটসের মনে হলো, তারই দুয়েকটা ব্যবহার করে একটা দলে নাম লিখিয়েছে সে। কপস নামের টিভি শোতে সেই দলের অন্যান্য সদস্যরা—এই যেমন ক্যাগনি ও অন্যরা—একই বাক্যগুলো আওড়ায়।
বাতি জ্বালিয়ে দরজা ধরে টান দিল একটা। দূরের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রোজির মা, ওর দিকে পিঠ দিয়ে। গ্রাহাম কোটস ভেতরে পা রাখতেই স্কার্ট তুলে ধরে হাড়সর্বস্ব, নগ্ন নিতম্বটা দোলাতে লাগল মহিলা!
হাঁ হয়ে গেল গ্রাহাম কোর্টসের মুখ। ঠিক পরক্ষণেই ভারী শিকলটা দিয়ে ওর কবজিতে আঘাত হানল রোজি। হাত থেকে ছিটকে কামরার অন্য পাশে চলে গেল অস্ত্র।
রোজির মা গ্রাহাম কোটসের ঊরুসন্ধিতে যে লাথিটা বসাল, তেমন নিখুঁত তাক আর আগ্রহ কমবয়সী মেয়েদের সঙ্গেই বেশি মানায়। আহত স্থান চেপে ধরে, উবু হয়ে গেল গ্রাহাম কোটস। ওর কণ্ঠ থেকে যে উচ্চ তরঙ্গের আওয়াজ বেরোল তা শোনার জন্য কুকুর কিংবা বাদুরের কান লাগবে।
সুযোগ বুঝে ভাঁড়ার থেকে পালাতে লাগল রোজি আর ওর মা
দরজা বন্ধ করে দিল বাইরে বেরিয়েই, ছিটকিনি টেনে লাগিয়ে দিল রোজি। এরপর মাকে জড়িয়ে ধরল মেয়েটা।
সব বাতি যখন নিভে গেল, তখনও ওরা সেলারেই আছে।
‘ফিউজ জ্বলে গেছে,’ মাকে আশ্বস্ত করার জন্য বলল রোজি, যদিও নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা। তবে এছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যাও যে আসছে না মাথায়।
‘দুটো ছিটকিনিই লাগিয়ে দিতে হতো,’ বলল ওর মা। পরক্ষণেই যোগ করল, ‘আউ!’ পায়ের বৃদ্ধাঙুল বাড়ি খেয়েছে কিছু একটার সঙ্গে।
‘ভালো একটা দিকের কথাও বলি,’ জানাল রোজি। ‘ওই লোকটাও অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছে না। আমার হাত ধরো, সিঁড়ি বোধহয় এদিক দিয়ে।’
গ্রাহাম কোটস ভাঁড়ারের মেঝেতে হাতে-পায়ে ভর করে উবু হয়ে আছে; অন্ধকারে, আলো হঠাৎ করেই নেই হয়ে গেছে। পা বেয়ে গরম কিছু একটা গড়িয়ে পড়ছে। অস্বস্তির সঙ্গে এক মুহূর্ত ভাবল–প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছে হয়তো। পরক্ষণেই টের পেল, যে ছুরিগুলো এনেছিল সেগুলোরই একটার ফলা ওর বেল্ট কেটে পায়ের ওপরের অংশে কামড় বসিয়েছে।
নড়া-চড়া বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে রইল গ্রাহাম কোটস। সিদ্ধান্ত নিলো, এমন মাতাল হয়ে বুদ্ধিমত্তার পরিচয়ই দিয়েছে সে: এক হিসেবে চেতনানাশক ওষুধ-ই বলা যায় ওটাকে। তাই ঘুমিয়ে পড়াই ভালো হবে।
ভাঁড়ার ঘরে একা নেই সে। এখানে কেউ একজন আছে ওর সঙ্গে। এমন কিছু একটা যেটা চার পায়ে হাঁটছে।
গর্জে উঠল কেউ একজন, ‘উঠে দাঁড়াও!’
‘পারব না, আমি আহত। বিছানায় শুয়ে ঘুমাতে চাই।
‘জঘন্য একটা জানোয়ার তুমি, যা স্পর্শ করো তাই নষ্ট হয়ে যায়। এখন উঠে বসো।’
‘পারলে তো ভালোই হতো,’ মাতালের মতো কণ্ঠে বলল গ্রাহাম কোটস। ‘কিন্তু পারব না। মেঝেতেই খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নাও। যাই হোক, মেয়েটা দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি টেনে দিয়েছে। আওয়াজ শুনেছি।’
দরজার অন্য পাশ থেকে ভেসে এলো আঁচড়ানোর আওয়াজ, যেন কেউ আস্তে আস্তে টেনে খুলছে ছিটকিনি।
‘দরজা এখন খোলা। এখন শোনোঃ যদি এখানে থাকো, তাহলে আমি মারা যাবো।’ অধৈর্যের সঙ্গে নড়ে উঠল কেউ; শোনা গেল লেজ নাড়াবার আওয়াজ; তারপর একটা গর্জন, গলার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ওটা। ‘তোমার হাত আমাকে দাও, মেনে নাও আমার আনুগত্য। আমাকে আহ্বান করো নিজের ভেতরে।’
‘বুঝতে পারছি না—’
‘আমাকে তোমার হাত দাও, নইলে রক্তপাতেই মরবে।’
ভাঁড়ার ঘরের অন্ধকারে, হাত বাড়িয়ে দিল গ্রাহাম কোটস। কেউ একজন——অথবা কিছু একটা—ওটা নিজের হাতে নিয়ে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে চাপ দিল। ‘এবার বলো, আমাকে আহ্বান জানাবে তোমার ভেতরে?’
ঠিক তখনই এক মুহূর্তের জন্য যেন নিজেকে পুরোপুরি ভাবে ফিরে পেল গ্রাহাম কোটস। তবে ততক্ষণে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। এখন আর যা-ই করুক না কেন, পরিস্থিতি এর চাইতে বাজে তো আর হবে না… তাই না?
‘পুবশ্যই,’ ফিসফিসিয়ে বলল গ্রাহাম কোটস। শব্দটা পুরোপুরি উচ্চারিত হবার আগেই বদলে যেতে শুরু করল সে। এমনভাবে দেখতে পাচ্ছে অন্ধকারে, যেন এখন দিন। ভাবল, মাত্র একমুহূর্তের জন্য, পাশে কিছু একটাকে দেখতে পাচ্ছে। মানুষের চাইতে বড়ো সেটা আকারে, তীক্ষ্ণ দাঁতঅলা। পরক্ষণেই উধাও হয়ে গেল সেই কিছু একটা, দারুণ বোধ করতে শুরু করল গ্রাহাম কোটস, পা থেকেও আর রক্ত ঝরছে না।
অন্ধকারেও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে সে। বেল্ট থেকে ছুরিগুলো খসিয়ে, ফেলে দিল মেঝেতে। এমনকী জুতোও খুলে ফেলল। এখানেই কোথাও আছে অস্ত্রটা, কিন্তু সেটারও খোঁজ করল না। যন্ত্রপাতির দরকার হয় বানর, কাক আর দুর্বলদের।
গ্রাহাম কোটস বানর না…
…সে শিকারি।
হাতের পাঞ্জা আর হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে হেঁটে, সেলারে চলে এলো সে।
মেয়েদেরকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। মূল বাড়িতে যাওয়ার সিঁড়িটা খুঁজে পেয়েছে ওরা, অন্ধের মতো হাত ধরাধরি করে উঠে যাচ্ছে ওপরে।
তাদের মাঝে একজন বয়স্কা, মাংস-টাংস নেই হাড়ে; অন্যজন যুবতী, মাংসও নরম মনে হচ্ছে। তাই জিভ থেকে জল ঝরতে শুরু করল…
…এমন কিছু একটার মুখ থেকে যার মধ্যে গ্রাহাম কোটসের কেবলমাত্র অংশবিশেষই অবশিষ্ট আছে বলা চলে।
.
সেতু থেকে নামল মোটকু চার্লি, মাথায় ওর বাবার সবুজ ফেডোরা। হাঁটতে শুরু করল সূর্যাস্তের দিকে লক্ষ্য করে। পাথুরে সৈকত ধরে এগোচ্ছে যুবক, পিচ্ছিল পাথরে হোঁচট খাচ্ছে থেকে থেকে; বেখেয়ালে পা ফেলছে পানি ভরতি ছোটো ছোটো গর্তে। আচমকা এমন কিছু একটার ওপর পা পড়ল, যেটা নড়তে-চড়তে সক্ষম। হোঁচট খেয়ে সরে গেল সে।
পায়ের নিচে পড়া জিনিসটা বড়ো হতে শুরু করল, তারপর বড়ো হতেই থাকল তো হতেই থাকল। ওটা যাই হোক না কেন, বিশাল যে তাতে সন্দেহ নেই। প্রথমে ভেবেছিল, মানে আকার দেখে আরকি, হাতি হবে। কিন্তু না, আকারে ওটা আরও বড়ো।
আলো, ভাবল মোটকু চার্লি। গাইল উচ্চ কণ্ঠে, সঙ্গে সঙ্গে ওই খানে থাকা সবগুলো জোনাকি ছুটে এসে ঘিরে ধরল ওকে। তাদের শীতল, সবুজ আলোতে দেখতে পেল ছেলেটা – সরীসৃপের চেহারায় বসানো দুটো চোখ, আকারে খাবারের থালার মতো হবে, চেয়ে আছে ওর দিকে।
পালটা তাকাল মোটকু চার্লি। ‘শুভ সন্ধ্যা,’ হাসি-মুখে বলল সে।
মাখন মিশ্রিত তেলের মতো মসৃণ কণ্ঠে প্রাণিটা বলল, ‘হ্যাল্লো। ডিং-ডং! তোমাকে দেখে রাতের খাবারের মতো লাগছে!’
‘আমি চার্লি ন্যান্সি,’ নিজের পরিচয় জানাল সে। ‘তুমি কে?’
‘আমি ড্রাগন,’ জবাব দিল ড্রাগন। ধীরে ধীরে, কিন্তু এক লোকমায় খাবো তোমাকে, হে হ্যাট পরা ছোট্ট মানুষ।’
চোখ পিটপিট করল চার্লি। এই অবস্থায় থাকলে আমার বাবা কী করত? ভাবল সে। স্পাইডারই বা কী করত? আবিষ্কার করল, এই দুই প্রশ্নের জবাব ওর জানা নেই। আরে ধুর, হাজার হলেও, স্পাইডার তো আমারই অংশ ছিল। ও যা করতে পারে, আমিও তা পারি।
‘উম, আমার সঙ্গে কথা বলে তুমি বিরক্তি বোধ করছ; তাই আমার কোনো ক্ষতি না করেই যেতে দেবে,’ বলল সে ড্রাগনটাকে, যতটা সম্ভব দৃঢ়তা ঢালল কণ্ঠে।
‘বাহ, চেষ্টা ভালোই করেছ। কিন্তু দুঃখিত, সেটি হচ্ছে না,’ জানাল ড্রাগন, আগ্রহের সঙ্গেই। ‘আসলে, তোমাকে আমি খেতে যাচ্ছি।’
‘লেবু ভয় পাও নাকি?’ জিজ্ঞেস করল চার্লি, পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল যে ওটা ডেইজিকে দিয়েছে।
হাসল ড্রাগন, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে। ‘আমি,’ জানাল সে। ‘কিছুই নেই… যা আমি ভয় পাই।’
‘কিছুই নেই?’
‘হুম, কিছুই নেই।’ জানাল ড্রাগনটা।
চার্লি বলল, ‘তুমি ‘কিছুই নেই’-কে মারাত্মক ভয় পাও?’
‘হ্যাঁ, আমাকে তীব্র আতঙ্কে ফেলে দেয়,’ স্বীকার করতে বাধ্য হলো ড্রাগন। ‘আমার পকেটে কী আছে জানো?’ বলল চার্লি। ‘কিছুই নেই। দেখতে চাও?’
‘না, অস্বস্তি ভরে জবাব দিল ড্রাগন। ‘একদম দেখতে চাই না।’
পালের মতো বড়ো বড়ো পাখা নাড়িয়ে, চলে গেল ওটা। চার্লি নিজেকে একাকী আবিষ্কার করল সৈকতে। ‘কাজটা,’ বলল সে। ‘একটু বেশিই সহজে হয়ে গেল!’
হাঁটা অব্যাহত রাখল ও, এই উপলক্ষে নতুন গানও বেঁধে ফেলল! সবসময় গান বাঁধতে চেয়েছে চার্লি, কিন্তু কখনও করেনি কাজটা। কেননা সবসময় ভেবেছে, গান যদি লিখেও ফেলে, তাহলে ওকে গাইতে বলা হবে। ব্যাপারটা কারও জন্যই ভালো হবে না। এর চাইতে বোধহয় ফাঁসিতে ঝোলাও সহজ হবে। কিন্তু এখন এত কিছু ভাবছে না, কেয়ারও করে না। জোনাকিকে শোনাল ওর গান, যারা ওকে অনুসরণ করে উঠছে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে। গানের কলিতে শোনাচ্ছে পাখি-মানবীর সঙ্গে দেখা করে ভাইকে খুঁজে পাবার ইচ্ছের কথা। আশা করছে, জোনাকিদের হয়তো গানটা পছন্দ হবে: সুরের তালে তালে জ্বলছে-নিভছে তাদের আলো।
পাখি-মানবী ওর জন্য পাহাড়ের ওপরে অপেক্ষা করছিল।
হ্যাট খুলল চার্লি, ব্যান্ড থেকে খুলে নিলো পালক।
‘এই যে, নাও। জিনিসটা তোমার, তাই না?’
পালক নেবার কোনো আগ্রহ দেখাল না মহিলা।
‘আমাদের চুক্তি বাতিল,’ জানাল চার্লি। ‘তোমার পালক নাও, ফিরিয়ে দাও আমার ভাইকে। তুমি ওকে অপহরণ করেছ, আমি ফেরত চাই। আনানসির বংশধরকে তোমার হাতে তুলে দেওয়ার অধিকার আমার ছিল না কখনও।’
‘যদি তোমার ভাই এখন আর আমার কাছে না থাকে?’
জোনাকির আলোয় দেখা কঠিন হলেও মোটামুটি নিশ্চিত চার্লি, মহিলার ঠোঁট নড়েনি। তবে ওর শব্দগুলো শুনতে পেল পরিষ্কার ভাবে, কানে ভেসে এলো রাতের পাখির গর্জন আর পেঁচার ডাকের রূপ নিয়ে।
‘আমি আমার ভাইকে ফেরত চাই,’ মহিলাকে বলল সে। ‘অক্ষত ও সুস্থ অবস্থায়, চাই এখুনি। নইলে তোমার আর আমার বাবার মাঝে যা কিছু হয়েছে এতগুলো বছরে, তা কেবল নাটকের মুখবন্ধ বলে মনে হবে! মনে হবে অপেরার শুরুর দিককার যন্ত্র-সংগীত।’
আজকের আগে কখনও কাউকে হুমকি দেয়নি চার্লি। এমনকী যে হুমকিটা এই মাত্র দিল, তা কীভাবে বাস্তবায়ন করবে সেটাও জানে না—তবে মনের মাঝে সন্দেহ নেই, করবে বটে।
‘আমার কাছেই ছিল ও,’ জানাল পাখি-মানবী। ‘কিন্তু ওর জিহবা ছিঁড়ে ফেলে, বাঘের দুনিয়ায় ফেলে এসেছি। তোমার বাবার রক্তের ক্ষতি করার ক্ষমতা আমার নেই, কিন্তু সাহস জোগাতে পারলে বাঘ তা করতে পারে।’
ক্ষণিকের জন্য নেমে এলো নীরবতা। স্তিমিত হয়ে গেল সব ব্যাং আর পাখির ডাক। নিস্পৃহ চোখে ওর দিকে চেয়ে আছে মহিলা, চেহারা ছায়ায় ঢাকা। কোটের পকেটে হাত ঢোকাল সে। ‘পালকটা দাও।’
ওর হাতে পালকটা রাখল চার্লি।
সঙ্গে সঙ্গে হালকা বোধ করতে লাগল চার্লি। মনে হলো যেন নিছক একটা পালক ওর হাত থেকে নেয়নি পাখি-মানবী…নিয়েছে আরও ভারী কিছু। তারপর ওর হাতে কিছু একটা দিল মহিলা, ঠান্ডা এবং ভেজা একটা কিছু। মনে হলো যেন মাংসের টুকরো ধরিয়ে দিয়েছে, ওটাকে একপাশে ছুড়ে ফেলার ইচ্ছে দমাতে হলো চার্লিকে।
‘ফিরিয়ে দিয়ো ওকে, বলল মহিলা, রাতের আওয়াজকে কণ্ঠ বানিয়ে। ‘আমার সঙ্গে ওর আর কোনো ঝগড়া নেই।’
‘বাঘের দুনিয়ায় যাবো কীভাবে?’
‘এখানকার পথ কীভাবে খুঁজে পেয়েছ?’ পালটা প্রশ্ন করল মহিলা, বিস্ময় খেলে গেল তার কণ্ঠে। রাতের আওয়াজ আবার নতুন করে শুরু হলো। চার্লি নিজেকে একাকী অবস্থায় আবিষ্কার করল পাহাড়ে।
হাত খুলে তাতে থাকা মাংসের টুকরোটা দেখল একবার। মনে তো হচ্ছে, জিহ্বা; ওটার মালিক কে সেটাও বুঝতে পারছে।
ফেডোরাটাকে আবার পরে নিলো চার্লি, ভাবল—বুদ্ধি যোগাবার টুপিটা পরে নেওয়া যাক। কিন্তু নিজের কাছেই মনে হলো, ঠাট্টাটা খুব একটা জমেনি। সবুজ ফেডোরাটা বুদ্ধি যোগায় না, তবে এই জিনিস একমাত্র তার মাথাতেই সাজে…যে ভাববার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব করে না।
দুনিয়াগুলোকে একটা জালের রূপে ভাবল সে ওর মনের ভেতর জ্বলজ্বল করল যেন জালটা; যত জনকে চেনে, সবার সঙ্গে একটা যোগাযোগ স্থাপন হয়ে গেল। স্পাইডারের সঙ্গে ওকে যে সুতোটা যুক্ত করেছে, সেটা যেমন শক্তিশালী তেমনই উজ্জ্বল। হালকা আলো ছড়াচ্ছে ওটা, যেন তারকার মতো।
একদা ওর একটা অংশ ছিল স্পাইডার। এই তথ্যটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল সে, মনের ভেতরটা করে দিল উন্মুক্ত যাতে জাল পুরোটা মন দখল করে নেয়। হাতে ধরে রেখেছে ভাইয়ের জিভ: যেটা এই খানিক আগেও স্পাইডারের অংশই ছিল এবং ঐকান্তিক ভাবে আবার তাই হতে চায়।
জ্যান্ত সব কিছুই… স্মৃতি ধরে রাখে বটে।
জালের আলো জ্বলছে এখন ওর চারপাশে। চার্লির শুধু ওটাকে অনুসরণ করলেই হবে…
তাই করল সে, জোনাকিগুলোও সঙ্গী হলো ওর।
‘ওই’ বলল চার্লি। ‘আমি এসেছি।’
অস্ফুট, ভয়ানক আওয়াজ করল স্পাইডার।
জোনাকির আলোয় বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে স্পাইডারকে: ভয়ে-আতঙ্কে সিঁটিয়ে আছে মনে হলো, আহতও দেখাচ্ছে। চেহারা আর বুকে দেখা যাচ্ছে শুকিয়ে আসতে থাকা ক্ষত।
‘সম্ভবত তুমিই এই জিনিসের মালিক,’ বলল চার্লি।
হাত বাড়িয়ে জিহ্বাটাকে ভাইয়ের হাত থেকে নিলো স্পাইডার, তারপর হাত-পা-চোখ নেড়ে ধন্যবাদ বুঝিয়ে ওটাকে সেঁধিয়ে দিল মুখের ভেতর; বাইরে বেরোতে দিল না। অপেক্ষা করতে লাগল চার্লি।
স্পাইডার সন্তুষ্ট হলো খানিকক্ষণের মাঝে — পরীক্ষামূলক ভাবে জিহ্বা নাড়াতে লাগল, মুখের এই পাশ থেকে ওই পাশে। তারপর হাঁ করে নাড়াতে লাগল জিভ। মুখ বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল অতঃপর। অবশেষে খানিকটা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলল, ‘হ্যাটটা বেশ তো!’
.
সিঁড়ির মাথায় প্রথম হাজির হলো রোজি। সেলারের দরজা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলল সে। তারপর পা রাখল বাড়িতে। মায়ের জন্য অপেক্ষা করল, মহিলা এপাশে চলে আসতেই ছিটকিনি লাগিয়ে দিল সেলারের দরজার। অন্ধকারে রান্নাঘরের জানালা দিয়ে আসা পাণ্ডুর চন্দ্রালোককে মনে হতে লাগল যেন ফ্লাডলাইট।
ছেলেরা মেয়েরা, বেরিয়ে এসো খেলতে, ভাবল রোজি। চাঁদের আলোয় উজ্জ্বল এই রাতে…
‘পুলিসকে ফোন দাও,’ নির্দেশ দিল ওর মা।
‘তা এই ফোনটা পাবো কোথায়?’
‘আমি কীভাবে বলব? এখনও নিচে আটকে আছে ব্যাটা, এটাই সুযোগ।’
‘ঠিক,’ বলল রোজি। ভাবল এখন পুলিসে খবর দেওয়ার জন্য ফোন খুঁজবে? নাকি বাড়ি থেকে পালাবার উপায়? কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারার আগেই, যা হবার তা হয়ে গেল!
শব্দটা এত জোরাল যে কানে ব্যথা করতে লাগল ওর, পরক্ষণেই ভেঙে পড়ল সেলারের দরজা।
একটা ছায়া বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে।
তাহলে…জন্তুটা আসলেই আছে! এখন আর কোনো সন্দেহ নেই, কেননা দেখতে যে পাচ্ছে নিজের চোখেই। কিন্তু তা কীভাবে সম্ভব: বিশাল একটা বিড়াল আকৃতির ছায়া ওটা। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপারটা হলো, ওটার ওপরে চাঁদের আলো পড়তেই যেন আরও অন্ধকার হয়ে গেল সেই ছায়া। ওটার চোখ দেখতে পাচ্ছে না রোজি, তবে নিশ্চিতভাবেই জানে যে সরাসরি ওর দিকেই চেয়ে আছে জন্তুটা…
…চেয়ে আছে পেট ভরতি ক্ষুধা নিয়ে।
ওকে খুন করতে যাচ্ছে জন্তুটা… আর এভাবেই যবনিকা নামবে রোজির জীবনের।
রোজির মা বলল, ‘তোমাকে চায় সে, রোজি।’
‘বুঝতে পারছি।’
ধারে-কাছে থাকা সবচাইতে বড়ো জিনিসটা তুলে নিলো রোজি, কাঠের একটা টুকরো। ওটায় আগে ছুরি সাজিয়ে রাখা হতো। ছায়ার দিকে গায়ের জোরে টুকরোটা ছুড়ে মারল রোজি। তারপর, লক্ষ্যভেদ করতে পেরেছে কি না তা দেখার জন্য অপেক্ষা না করে, যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে গেল রান্নাঘর থেকে; পা রাখল হলওয়েতে। সদর দরজা কোথায়, তা জানা আছে ওর…
অন্ধকার, চার পায়ে চলতে অভ্যস্ত কিছু একটা ওর চাইতেও দ্রুত গতিতে নড়ে উঠল। এক লাফে রোজিকে টপকাল সেটা, প্রায় নিঃশব্দে নামল ওর সামনে।
ভয়ে দেওয়ালের সঙ্গে সিটিয়ে গেল রোজি, মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেছে।
ওদের আর সদর দরজার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে এখন জন্তুটা। আস্তে আস্তে এগোচ্ছে রোজির দিকে, ভাবখানা এমন যেন কোনো তাড়া নেই।
ঠিক সেই মুহূর্তে রান্নাঘর থেকে ছুটে গেল ওর মা, রোজির পাশ দিয়ে এক ছুটে আছড়ে পড়ল যেন চন্দ্রালোকে উজ্জ্বল করিডরে থাকা অন্ধকার ছায়াটার ওপর, হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে। তারপর সেই হাত দিয়ে বানানো মুঠি ঘুসি বসাল জন্তুটার পাঁজরে।
থমকে গেল সময়…
… থমকে গেল সারা দুনিয়া…তবে মাত্র এক মুহূর্তের জন্য। তারপর আস্তে আস্তে বয়স্কা মহিলার দিকে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল জন্তুটা। এত দ্রুত নড়ে উঠল যে ঝাপসা দেখাল, পরক্ষণেই মেঝেতে আছড়ে পড়ল রোজির মা। ছায়াটা এমন ভাবে কামড়ে দোলাতে লাগল দেহটাকে…যেভাবে পুরাতন খেলনা নিয়ে খেলে কুকুর।
আচমকা বেজে উঠল দরজার ঘণ্টি।
সাহায্যের জন্য চিৎকার করতে চাইল রোজি। চিৎকার বেরোচ্ছে বটে ওর কণ্ঠ থেকে, কিন্তু তার ওপর বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ নেই মেয়েটার। আচমকা বাথটাবে মাকড়শা দেখতে পেলে বি-ক্লাস মুভির অভিনেত্রী- যে প্রথমবার মতো রবারের স্যুট পরিহিত কোনো আক্রমণকারীর সামনে পড়েছে-তার মতো চেঁচাতে পারে রোজি। কিন্তু এখন আছে একটা অন্ধকার বাড়িতে, সঙ্গে আছে ছায়াশরীরের একটা বাঘ এবং সম্ভবত একটা সিরিয়াল কিলার! তাদের মাঝে একজন, কিংবা হয়তো উভয়ে, এই মাত্র আক্রমণ করেছে ওর মাকে। কী করা যেতে পারে, তাই ভাবছে বেচারি; কয়েকটা বুদ্ধি এসেছে মাথায় (অস্ত্র: কিন্তু ওটা আছে সেলারে, নিতে হলে নিচে নামতে হবে। কিংবা ছুটতে পারে দরজার দিকে—মা এবং ওর ওপর ঝুঁকে থাকা পশুটার পাশ দিয়ে ছুটে সদর দরজা খুলতে পারে)। কিন্তু ওর ফুসফুস আর মুখ কেবল চিৎকার ছাড়া আর কিছু করতে পারছে না।
কিছু একটা সদর দরজায় আছড়ে পড়ল। কেউ দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে চাইছে, ভাবল সে। কিন্তু দরজাটা ভাঙার মতো না। একেবারে নিরেট!
চাঁদের আলোয় মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে ওর মায়ের দেহ। ছায়াটা উবু হয়ে আছে তার ওপরে, মাথা পেছনে ছুড়ে গর্জন করল সে; একসঙ্গে ভয়, চ্যালেঞ্জ আর দাবি খেলে গেল সেই গর্জনে।
ভ্রম হচ্ছে আমার, নিজেকেই নিশ্চিত করতে চাইল রোজি। দুই দিন হলো আটকে ছিলাম সেলারে, তাই এখন মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আশপাশে কোনো বাঘ-টাঘ নেই।
সেই একই কারণে এটাও বুঝতে পারছে যে চাঁদের আলোয় যে পাণ্ডুর মহিলাকে দেখতে পাচ্ছে, সেটাও ওর ভ্রম। করিডর ধরে হেঁটে আসছে মহিলা, চুল সোনালি; পা আর সরু কোমর দেখেই নর্তকী মনে হয়। বাঘের ছায়ার কাছে পৌঁছে থমকে গেল সে। বলল, ‘হ্যালো, গ্রাহাম।’
ছায়া-জন্তুটা তার বিশাল মাথা উঁচু করে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে হাঁক ছাড়ল।
‘ওই পশুর কস্টিউম পরে আমাকে বোকা বানাতে পারবে না,’ বলল মহিলা। খুব একটা সন্তুষ্ট দেখাচ্ছে না তাকে।
রোজি টের পেল, মহিলার দেহের ঊর্ধ্বাংশ ভেদ করেও জানালাটা দেখতে পাচ্ছে, একেবারে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার আগপর্যন্ত পেছাতে লাগল।
আবার গর্জে উঠল জন্তুটা, এবার খানিকটা দ্বিধার ছোঁয়া পাওয়া গেল কণ্ঠে।
মহিলা বলল, ‘ভূত-প্রেতে আমি বিশ্বাস করি না, গ্রাহাম। জীবনটা—মানে পুরোটাই—কাটিয়ে দিয়েছি ভূতে অবিশ্বাস করে। তারপর দেখা হলো তোমার সঙ্গে, মরিসের ক্যারিয়ারটা ধসে গেল তোমার কারণে। আমাদের কাছ থেকে চুরি করলে, খুন করলে আমাকে। তারপর, ক্ষতে লবণ ঘষার মতো করে, বাধ্য করলে ভূতে বিশ্বাস আনতে।’
প্রকাণ্ড বিড়ালের ছায়াময় অবয়বটা পেছাতে শুরু করেছে এখন।
‘এভাবে আমার হাত থেকে বাঁচতে পারবে, সেই চিন্তা কোরো না। জঘন্য মানুষ কোথাকার। যত ইচ্ছে বাঘ সাজার ভড়ং ধরতে পারো। কিন্তু আসলে তুমি বাঘ নও, একটা নগণ্য ইঁদুর। নাহ, ভুল হলো ইঁদুরের সঙ্গে তুলনা দিয়ে তাদের অপমান করা হচ্ছে। ছুঁচো তুমি, একটা নেউলে!’
হল ধরে ছুটতে লাগল রোজি।
ছায়া-জন্তুটার পাশ দিয়ে, মেঝেতে পড়ে থাকা মাকে অতিক্রম করে ছুটল সে; পাণ্ডুর মহিলার ভেতর দিয়ে। মনে হলো যেন কুয়াশার ভেতর দিয়ে ছুটছে। সদর দরজার কাছে পৌঁছে গেল অচিরেই, ছিটকিনির খোঁজে হাতাতে লাগল।
মাথার ভেতর, এবং আশপাশের দুনিয়া জুড়ে, একটাই ঝগড়া হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে রোজির। কেউ একজন বলছে:
ওকে পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই, ডাপ্পি সে। তোমাকে স্পর্শও করতে পারবে না। মেয়েটাকে থামাও, ধরো ওকে!
অন্য কেউ জবাব দিচ্ছে:
যুক্তি আছে তোমার কথায়, তবে সব দিক বিবেচনা করে কথাটা বলছ বলে মনে হয় না। জানোই তো: ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার চাইতে, সেটাকে এড়ানোই উত্তম…
আমি বলছি কী বলতে হবে। তুমি শুধু অনুসরণ করো।
কিন্তু…
‘আমি একটা ব্যাপার জানতে চাই,’ বলল পাণ্ডুর মহিলা। ‘তুমি এই মুহূর্তে কতটা ভূতুড়ে। মানে— মানুষজন তো দূরে থাক, কোনো বস্তুকে স্পর্শও করতে পারি না। পারি শুধু ভূতকে স্পর্শ করতে।’
পশুটার চেহারা তাক করে কড়া একটা লাথি হাঁকাল পাণ্ডুর মহিলা। ছায়া- জন্তু হিসিয়ে উঠে পিছিয়ে গেল এক পা, তাই এক ইঞ্চিরও কম দূরত্বের জন্য লাগল না লাথিটা।
তবে পরেরটা লাগল, ককিয়ে উঠল জন্তুটা। আরেকটা লাথি, এবার ঠিক নাক বরাবর। একসঙ্গে ভয়, রাগ, লজ্জা আর পরাজয় মিশিয়ে আবার ককাল ওটা।
মৃত নারীর হাসির আওয়াজে ভরে উঠল করিডরটা। আনন্দ আর উত্তেজনা মিশে আছে সেই হাসিতে। ‘নেউলে,’ বলল মহিলা। ‘গ্রাহাম নেউলে।’
শীতল বাতাসের একটা দমকা নেচে বেড়াতে লাগল ঘরের ভেতর।
শেষ ছিটকিনিটাও খুলে ফেলল রোজি, এরপর খুলল তালা। সামনের দরজা খুলে গেল হাঁ করে। ফ্ল্যাশলাইটের আলো সঙ্গে সঙ্গে পড়ল ওর চোখে, অন্ধ করে দেওয়ার মতো তার তীব্রতা। মানুষ, গাড়ি। একটা নারী কণ্ঠ বলল, ‘ওই যে, হারিয়ে যাওয়া পর্যটকদের একজন।’ তারপর যোগ করল, ‘হায় ঈশ্বর!’
ঘুরে তাকাল রোজি।
ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় মাকে পরিষ্কার দেখতে পেল রোজি; লাশটা দলা পাকিয়ে পড়ে আছে মেঝেতে। তার পাশে জুতোহীন পা নিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে একজন মানুষ… গ্রাহাম কোটস। ওদের চারপাশে ছড়িয়ে আছে লাল তরল, খয়েরি রঙের মতো। রোজি যেন এক মুহূর্তের জন্য ভুলেই গেল, কী হয়েছে খানিক আগে!
এক মেয়ে কথা বলছে ওর সঙ্গে। বলছে, ‘তুমি রোজি নোয়াহ? আমি ডেইজি। চলো, কোথাও গিয়ে তোমার সঙ্গে বসা যাক। বসতে চাও?’
হয়তো ফিউজের বাক্সটা খুঁজে পেয়েছে কেউ, কেননা সারা বাড়ির সবগুলো আলো জ্বলে উঠেছে।
বিশালদেহী এক লোক, পুলিস ইউনিফর্ম পরিহিত, ঝুঁকল লাশ দুটোর ওপর। মাথা তুলে বলল, ‘মি. ফিনেগান, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শ্বাস নিচ্ছে না।’
রোজি বলল, ‘অবশ্যই। চলো, কোথাও গিয়ে বসি।’
.
পাহাড়ের শীর্ষে, একদম ধারে স্পাইডারের পাশে বসে আছে চার্লি। চাঁদের আলোয় পা দুটো ঝুলছে খাদের ওপর।
‘জানো নাকি?’ বলল সে। ‘আসলে আমার একটা অংশ তুমি। সেই ছেলেবেলায় আলাদা হয়ে গেছিলাম।’
এক পাশে মাথা কাত করল স্পাইডার। ‘তাই নাকি?’
‘আমি তো সেটাই জানি।’
‘যাক, অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম কথাটা শুনে,’ বলে হাত বাড়িয়ে দেখিয়ে দিল স্পাইডার: ওর আঙুলের ওপর বসে আছে সাত পাঅলা মাকড়শাটা, স্বাদ নিচ্ছে বাতাসের। ‘এখন কী করতে চাও? আমাকে ফিরিয়ে নেবে তোমার মাঝে?’
ভ্রু কুঁচকে গেল চার্লি। ‘আমার সঙ্গে থাকলে যে হাল তোমার হতো, তার চাইতে অনেক ভালো আছ। বোঝাই যাচ্ছে, অনেক আনন্দ করেছ জীবনে।’
স্পাইডার বলল, ‘রোজি, বাঘ জানে মেয়েটার ব্যাপারে। কিছু একটা আমাদেরকে করতেই হবে।’
‘অবশ্যই করতে হবে, করবোও।’ জানাল চার্লি। ব্যাপারটা অনেকটা হিসেব রক্ষার মতো: ভাবল সে। এই পাশে যোগ করতে হয়, অন্য পাশ থেকে বিয়োগ। হিসেব ঠিক থাকলে, পাতার নিচে এসে সব মিলে যায়। ভাইয়ের হাত নিজের হাতে নিলো সে।
উঠে দাঁড়িয়ে…এক পা ফেলল সামনের শূন্যতায়—
–সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে উঠল সবকিছু–
দুই দুনিয়ার মাঝে বইতে লাগল শীতল একটা বাতাস।
চার্লি বলল, ‘তুমি আসলে আমার ভেতরের জাদুর অংশ নও।’
‘তাই নাকি?’ আরেক পা সামনে ফেলল স্পাইডার। ওর চারপাশে একের- পর-এক তারার পতন হচ্ছে, অন্ধকার আকাশ জুড়ে ছুটে যাচ্ছে ওগুলো। কেউ একজন, কোনো এক খানে, বাঁশিতে তুলছে মনোলোভা সুর।
আরেক পা ফেলতেই কানে এলো দূর থেকে ভেসে আসা সাইরেনের আওয়াজ। ‘নাহ,’ বলল চার্লি। ‘তুমি তা নাও। যদিও মিসেস ডানউইডি সেটাই ভেবেছিল। তবে আমাদেরকে আলাদা করতে সক্ষম হয়েছিল সে, অথচ বুঝতেও পারেনি যে আসলে কী করছে। আমরা আসলে একই স্টারফিশের দুটো অংশ। আমাকে ছাড়াই পুর্ণাঙ্গ সত্তা পেয়েছ তুমি। তেমনই পেয়েছি,’ বলতে গিয়ে টের পেল যে অন্তর থেকে বিশ্বাস করে বলছে কথাটা। ‘আমিও।’
ভোরের আলোয়, পাহাড়ের শীর্ষের ধারে দাঁড়িয়ে আছে ওরা। একটা অ্যাম্বুলেন্স এগিয়ে আসছে চূড়ার দিকে, তার পেছনে আরেকটা। রাস্তার ধারে একটার পাশে আরেকটা পার্ক করা হলো, একগাদা পুলিসের গাড়ির পেছনে।
কাকে কী করতে হবে, সেই নির্দেশনা দিতে ব্যস্ত ডেইজি।
‘এখানে, এই মুহূর্তে আমাদের করার তেমন কিছু নেই,’ জানাল চার্লি। ‘চলো, যাই।’ জোনাকির দল ছেড়ে গেছে এখন ওকে।
দিনে প্রথম যে মিনিবাসটা ছাড়ল, সেটায় চড়ে উইলিয়ামসটাউনে ফিরে গেল ওরা।
.
মেইভ লিভিংস্টোন বসে আছে গ্রাহাম কোর্টসের বাড়ির ওপরের তলার লাইব্রেরিতে। চারপাশে ছড়িয়ে আছে গ্রাহাম কোটসের কেনা শিল্পকর্ম, বই আর ডিভিডি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে, নিচে কাজে ব্যস্ত দ্বীপের ইমার্জেন্সি সার্ভিসেস। রোজিকে একটা অ্যাম্বুলেন্সে, আর গ্রাহাম কোটসকে তোলা হচ্ছে অন্যটায়।
ভেবে দেখেছে সে গ্রাহাম কোটস যে পশুতে পরিণত হয়েছিল, তাকে লাথি মেরে দারুণ আনন্দ পেয়েছে। খুন হবার পর, এমন আনন্দদায়ক কাজ আর একটাও করেনি। তবে হ্যাঁ, নিজের কাছে হলেও স্বীকার করতেই হয়: মি. ন্যান্সির সঙ্গে নাচাটা তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে থাকবে, প্রথম স্থানের সঙ্গে খুব একটা দূরত্বও থাকবে না। বয়স হলেও মানুষটা বেশ চটপটে ছিল, নাচও জানত ভালোই।
ক্লান্ত বোধ করছে মহিলা।
‘মেইভ?’
‘মরিস?’ চারপাশে তাকাল সে, কিন্তু কামরায় আর কেউ নেই।
‘যদি ব্যস্ত থাকো, তাহলে তোমাকে আর বিরক্ত করব না, সোনা।’
‘আহ, খুব ভালো কথা,’ বলল মহিলা। ‘তবে আপাতত আর কোনো ব্যস্ততা নেই আমার।’
লাইব্রেরির দেওয়ালগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে যেতে শুরু করেছে, হারাচ্ছে তাদের রং আর আকার। দেওয়ালের পেছনের দুনিয়া আস্তে আস্তে দৃশ্যমান হচ্ছে; সেই আলোতে দেখতে পাচ্ছে, স্মার্ট স্যুট পরিহিত ছোট্ট একটা অবয়ব অপেক্ষা করছে তার জন্য।
লোকটার হাত ধরল মহিলা। বলল, ‘আমরা যাচ্ছি কই, মরিস?’
স্ত্রীর প্রশ্নের জবাব দিল লোকটা।
‘ওহ, তাহলে তো ভালোই হবে,’ বলল মেইভ। ‘ওখানে যাওয়ার একটা ইচ্ছা আমার মাঝে সবসময়ই ছিল।’
হাত ধরাধরি করে, হাঁটতে লাগল ওরা।
অধ্যায় চোদ্দো – যেটায় মিলল অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব
অধ্যায় চোদ্দো – যেটায় মিলল অনেকগুলো প্রশ্নের জবাব
দরজায় ঘুসি পড়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল চার্লির। চারপাশে নজর বুলাল সে: একটা হোটেলের কামরায় আছে; অনেকগুলো অভাবনীয় ঘটনা ঘুরপাক খেতে লাগল ওর মাথায়, যেভাবে আগুনের দিকে ছুটে আসে পতঙ্গ। সেগুলোর অর্থ কী হতে পারে তা ভাবতে ভাবতে উঠে দাঁড়িয়ে হোটেলের দরজার দিকে পা বাড়াল। দরজার পেছনে থাকা একটা নক্সার দিকে তীব্র মনোযোগের সঙ্গে তাকাল সে, জানাচ্ছে ওটা–আগুন লাগলে কোথায় যেতে হবে। গতরাতের ঘটনাবলী ভাবতে লাগল সে। ছিটকিনি খুলে, দরজা টেনে ধরল সে।
ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে ডেইজি। জিজ্ঞেস করল মেয়েটা, ‘হ্যাট পরেই ঘুমিয়েছিলে?’
মাথাটা হাত দিয়ে স্পর্শ করল চার্লি। আসলেই হ্যাট আছে ওখানে। ‘হ্যাঁ,’ বলল সে। ‘তাই তো দেখা যাচ্ছে।’
‘তাও অন্তত ভালো যে,’ বলল মেয়েটা। ‘জুতো খুলে শুয়েছিলে। উত্তেজনাকর সব মুহূর্তই যে মিস করে বসেছ, সেটা জানো? কাল রাতের কথা বলছি।’
‘তাই নাকি?’
‘দাঁত মেজে,’ ডেইজি বলল। ‘শার্ট বদলে নাও। হুম, মিস করেছ। গেছিলে কই…’ বলতে বলতেই থেমে গেল মেয়েটা। চক্রে বসে উধাও হয়ে গেছিল চার্লি, ব্যাপারটা এখন নিজেরই বিশ্বাস হতে চাইছে না। এই ধরনের ঘটনা খুব একটা ঘটে না, অন্তত বাস্তব জীবনে না। ‘তুমি তো ছিলে না। তবে আমি পুলিস চিফকে নিয়ে গ্রাহাম কোটসের বাড়িতে গেছিলাম। ওই পর্যটকদের সে-ই আটকে রেখেছিল।’
‘পর্যটক…?’
‘ডিনারের টেবিলে একটা কথা বলেছিল লোকটা-এই যে আমরা ওর বাড়িতে দুজনকে পাঠিয়েছি। তোমার বাগদত্তা আর তার মাকে সে আটকে রেখেছিল বেজমেন্টে।’
‘ওরা সুস্থ আছে?’
‘হাসপাতালে ভর্তি।’
‘ওহ।’
‘মায়ের অবস্থা খারাপ, নাও টিকতে পারে। তবে তোমার বাগদত্তা সুস্থ হয়ে যাবে।’
‘বারবার বাগদত্তা-বাগদত্তা বলা বন্ধ করবে? বাগদান ভেঙে দিয়েছে রোজি।’
‘হুম, কিন্তু তুমি তো আর ভাঙোনি, তাই না?’
‘আমাকে ভালোবাসে না মেয়েটা।’ জানাল চার্লি। ‘যাক গে, দাঁত মেজে পোশাক বদলাতে গেলাম। তবে এজন্যই খানিকটা হলেও গোপনীয়তা আমার লাগবে।’
‘গোসলও করে নাও,’ বলল ডেইজি। ‘হ্যাটটা থেকে সিগারের গন্ধ আসছে।’
‘পারিবারিক স্মৃতি জিনিসটা, ওকে জানাল চার্লি। তারপর বাথরুমে ঢুকে বন্ধ করে দিল দরজা।
.
হোটেল থেকে মিনিট দশেক হাঁটার দূরত্বেই হাসপাতাল। স্পাইডার বসে আছে ওয়েটিং রুমে, হাতে ধরে আছে এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি ম্যাগাজিনের একটা কপি। যদিও পড়ছে না।
ওর কাঁধে টোকা দিল চার্লি, লাফিয়ে উঠল স্পাইডার। ক্লান্ত ভঙ্গিতে তাকাল ওপরের দিকে, ভাইকে দেখে শান্ত হলো। তবে খুব একটা না। ‘আমাকে বাইরে অপেক্ষা করতে বলেছে কর্তৃপক্ষ,’ জানাল স্পাইডার। কারণ আমি ওদের আত্মীয়-টাত্মীয় কিচ্ছু না।’
বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করে বসল চার্লি, ‘বললেই তো পারতে যে তুমি আত্মীয়…কিংবা একজন ডাক্তার!’
অপ্রস্তুত দেখাল স্পাইডারকে। ‘আসলে যেসব বিষয়ের গুরুত্ব নেই নিজের কাছেই, সেগুলোর ব্যাপারে মিথ্যে বলা সহজ। আমি ভেতরে গেলাম না বাইরে থাকলাম তাতে কিছু যদি না আসে-যায়, তাহলে মিথ্যে বলে ভেতরে যাওয়াটা সহজ। কিন্তু এখন যেহেতু যায়-আসে, তাই বাগড়া বাধাতে কিংবা ভুল কিছু করতে চাই না। সবচেয়ে বড়ো কথা, যদি চেষ্টা করতে যাই আর না বলে দেয় কর্তৃপক্ষ, তাহলে…হাসছ কেন?’
‘কোনো কারণ নেই,’ জানাল চার্লি। ‘তবে শুনে কথাগুলো খুব পরিচিত মনে হলো। যাক গে, চলো রোজিকে খুঁজে বের করি। একটা ব্যাপার জানো?’ শেষের প্রশ্নটা করল সে ডেইজিকে, সামনে যে করিডর পড়েছে সেটায় ঢুকে পড়েছে ওরা। ‘হাসপাতালে হাঁটার দুটো উপায় আছে। হয় ভান ধরতে হবে যে আসলে তুমি এখানকারই কেউ—এই নাও, স্পাইডার। দরজার পেছনে সাদা অ্যাপ্রোন ছিল, তোমার দেহে আঁটবে। পরে ফেলো—অথবা এমন ভান ধরতে হবে যে কোথায় এসেছ তা কিছুতেই বুঝতে পারছ না, তাই কেউ তোমার অবস্থান নিয়ে প্রশ্নই তুলবে না। অন্য কারও ঝামেলা ভেবে মাথা থেকে বের করে দেবে।’ গুনগুন করতে লাগল চার্লি।
‘নাম হলো—হলদিয়া পাখি,’ জানাল স্পাইডার।
মাথায় আবার হ্যাটটা পরে নিলো চার্লি, রোজির হাসপাতাল কামরায় ঢুকে পড়ল ওরা।
বিছানায় বসে ছিল রোজি, পড়ছিল একটা ম্যাগাজিন। চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ওদের তিনজনকে একত্রে কামরায় ঢুকতে দেখে বেড়ে গেল দুশ্চিন্তা। একবার স্পাইডার, আরেকবার চার্লির দিকে তাকাল সে।
‘তোমরা দুজনেই বাসা থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছ দেখি,’ কেবল এতটুকু বলল মেয়েটা।
‘অবশেষে এক হলাম আমরা সবাই,’ জানাল চার্লি। ‘স্পাইডারের সঙ্গে তো তোমার দেখাই হয়েছে। আর ও হলো ডেইজি, পুলিসে আছে।’
‘এখনও চাকরিটা আছে কি না, জানা নেই,’ বলল ডেইজি। ‘বোধহয় অবস্থা খারাপ হয়ে গেছে।’
‘গত রাতে তো তুমিই পাহাড়ে গেছিলে? দ্বীপের পুলিসকে বাধ্য করেছিলে ওই বাড়িতে যেতে?’ থমকে গেল রোজি। একটু পর জানতে চাইল, ‘গ্রাহাম কোটসের কী খবর?’
‘ইনটেনসিভ কেয়ারে আছে, তোমার মায়ের মতোই।’ বলল রোজি।
‘যদি আগে আমার মায়ের জ্ঞান ফেরে,’ বলল রোজি। ‘তাহলে সে-ই কোটসকে খুন করবে,’ তারপর যোগ করল। ‘মায়ের অবস্থা আমাদেরকে ডাক্তাররা জানাচ্ছে না। শুধু বলছে, অবস্থা সঙ্গিন, বলার মতো কোনো উন্নতি- অবনতি হলে জানাবে আমাকে।’ পরিষ্কার দৃষ্টিতে তাকাল সে চার্লির দিকে। ‘মাকে তুমি যতটা খারাপ ভাবো, সে কিন্তু ততটা খারাপও না। আসলে মিশতে হয় ওর সঙ্গে, নইলে বোঝা মুশকিল। সেই সুযোগ আর সময়টা আমরা পেয়েছি, সেলারে আটকে থাকা অবস্থায়। মা আমার মানুষ খারাপ না।’
নাক ঝাড়ল মেয়েটা। তারপর বলল, ‘ডাক্তারদের ধারণা—বাঁচবে না মা। সরাসরি কথাটা বলেনি বটে, তবে ঢারেটোরে বুঝিয়েছে। ব্যাপারটা হাস্যকর, আমার তো ধারণা ছিল—যেকোনো পরিস্থিতি কেটে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা মায়ের আছে!’
চার্লি বলল, ‘আমার তাই ধারণা ছিল। ভাবতাম – পারমাণবিক যুদ্ধ বাধলেও অন্তত তেলাপোকা আর তোমার মা বেঁচে যাবে।’
ওর পায়ে নিজের পা দিয়ে চাপ দিল ডেইজি। বলল, ‘মাকে কীসে আহত করেছে, এই ব্যাপারে কিছু জানা গেছে?’
‘কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি,’ বলল রোজি। ‘বাড়িটায় কোনো এক ধরনের পশু ছিল। হয়তো সব কিছু একা গ্রাহাম কোটসই করেছে। মানে, অনেকটা ওর মতোই মনে হলো; কিন্তু পুরোপুরি সে ছিল না ওখানে, ছিল অন্য কেউ। আমার ওপর থেকে ওটার নজর সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল মা, তারপর…’ যতটা পরিষ্কার ভাবে সম্ভব, পরিস্থিতির বর্ণনা দ্বীপের পুলিসকে সেদিন সকালেই বলেছে সে। তবে সোনালি-চুলো ভূতুড়ে নারীর কথাটা অনুহ্য রেখেছে। মাঝে-মধ্যে চাপে পড়ে অনেকের বুদ্ধি-বিবেচনা কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ওর-ও যে সেই অবস্থা হয়েছিল, তা মানুষজনকে জানাতে চায় না।
তাই বলতে বলতেই থেমে গেল রোজি। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে স্পাইডারের দিকে, যেন কেবল যুবকটার কথা মনে পড়ছে। বলল সে, ‘তবে তোমাকে এখনও ঘৃণা করি, বুঝলে?’
জবাবে কিছুই বলল না স্পাইডার, তবে করুণ মুখাবয়ব হলো বেচারার। এখন আর ওকে দেখতে ডাক্তার মনে হচ্ছে না: দেখাচ্ছে এমন এক লোকের মতো যে চুরি করে সাদা অ্যাপ্রোনটা গায়ে জড়িয়ে এখন ভয় পাচ্ছে, কেউ হয়তো ওকে দেখে ফেলবে! স্বপ্নিল একটা আবহ কণ্ঠে যোগ করে বলল রোজি, ‘তবে, যখন অন্ধকারে ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল যে আমাকে তুমি সাহায্য করছ। ওই পশুটাকে সরিয়ে রাখছ দূরে। তোমার চেহারার এ কী হাল? ছড়ে গেছে দেখি।’
‘একটা জন্তু আক্রমণ করেছিল,’ জানাল স্পাইডার।
‘ভালো কথা,’ বলল রোজি। ‘তোমাদেরকে পাশাপাশি দেখার পর বুঝতে পারছি, চেহারায় একদম মিল নেই!’
‘দুজনের মাঝে, আমিই সুদর্শন,’ বলল চার্লি। কিন্তু দ্বিতীয় বারের মতো ডেইজির পায়ের চাপ খেয়ে চুপ করে গেল।
‘চুপ,’ নিচু কণ্ঠে বলল ডেইজি। তারপর কণ্ঠ উঁচু করে যোগ করল, ‘চার্লি, তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে। বাইরে চলো, এখুনি।’
হাসপাতালের করিডরে চলে এলো ওরা দুজন, স্পাইডার রয়ে গেল ভেতরে।
‘কী ব্যাপার?’ জিজ্ঞেস করল চার্লি।
‘কী মানে কী?’ পালটা প্রশ্ন করল ডেইজি।
‘কথা বলার জন্য না বাইরে ডাকলে? কী বলবে?’
‘কিচ্ছু না।’
‘তাহলে বাইরে কী করছি? রোজির কথা তো শুনলে, স্পাইডারকে ঘৃণা করে সে। ওদেরকে একই কামরায় একা ছেড়ে আসা উচিত হয়নি। এরমধ্যে হয়তো আমার ভাইকে মেরেই ফেলেছে মেয়েটা!’
যদি যিশুর দেওয়া মাছ আর রুটি দেখে কেউ তাকে বলত, এই দুটোয় অ্যালার্জি আছে বলে চিকেন সালাদ দিলে ভালো হয়, তাহলে যিশুর চেহারার যে দশা হতো…সেই একই চেহারা বানিয়ে ওর দিকে তাকাল ডেইজি: সেই দৃষ্টিতে মিশে আছে করুণা, সেই সঙ্গে সীমাহীন সমবেদনাও।
ঠোঁট আঙুল দিয়ে স্পর্শ করে, দরজার কাছে চার্লিকে টেনে আনল মেয়েটা। কামরার ভেতরে উঁকি দিল চার্লি। পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, স্পাইডারকে খুন করছে না রোজি…যা করছে তা খুনের পুরো বিপরীত বলা চলে। ‘ওহ,’ বলল সে।
আশ্লেষে একে-অন্যকে চুমু খাচ্ছে রোজি আর স্পাইডার। যদি আপনি ভেবে থাকেন, চুম্বনটা একদম গতানুগতিক তাহলে আপনাকে দোষ দেওয়া যায় না। তবে ধরে নিতে হবে যে আপনি স্পাইডারের হাসি দেখতে পাচ্ছেন না, দেখতে পাচ্ছেন না কীভাবে জ্বলজ্বল করছে তার চোখজোড়া। চুমুর পর যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে তা দেখে মনে হয়, সে এইমাত্র শিখেছে যে কীভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়!
…সেটাও পৃথিবীর অন্য যে কারও চাইতে ভালোভাবে!
ঘুরে দাঁড়িয়ে করিডরে আবার নজর দিল চার্লি। ডেইজি ব্যস্ত কিছু ডাক্তার আর পুলিস অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে। শেষের জনের সঙ্গে গত রাতেই কথা হয়েছে ওদের।
‘সত্যি বলতে কী, সেই প্রথম থেকেই লোকটার গতিবিধি আমার কাছে সন্দেহজনক মনে হচ্ছিল,’ পুলিস অফিসার ডেইজিকে বলল। ‘একমাত্র বিদেশিদের কাছেই এহেন আচরণ পাওয়া যায়। আমরা, মানে স্থানীয়রা, এমন কিছু কখনওই করতাম না।’
‘তা তো বটেই,’ জানাল ডেইজি।
‘অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা আপনার প্রতি,’ পুলিস চিফ জানাল, ডেইজির কাঁধে এমন ভাবে চাপড় বসাল যে দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল মেয়েটা। ‘এই লিটল লেডিই ওই নারীর জীবন বাঁচিয়েছে,’ চার্লিকে জানাল সে, ওর কাঁধেও চাপড় দিল। তারপর ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে লাগল করিডর ধরে।
‘কী অবস্থা?’ জিজ্ঞেস করল চার্লি।
‘উম, গ্রাহাম কোটস মারা গেছে,’ জানাল মেয়েটা। ‘রোজির মায়েরও বাঁচার আশা নেই ডাক্তারদের।’
‘বুঝলাম,’ জানাল চার্লি। একটু ভেবে নিলো সুযোগ বুঝে, তারপর সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। বলল, ‘ভাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললে কিছু মনে করবে? ওর সঙ্গে আমার কথা বলা দরকার।’
‘এমনিতেও হোটেলে ফিরছিলাম। ই-মেইল চেক করতে হবে। ফোনে বহুবার ক্ষমা চাইতে হবে। দেখা যাক, ক্যারিয়ার বলতে কিছু আছে নাকি আমার।’
‘কিন্তু তুমি তো দারুণ কাজ দেখিয়েছ, তাই না?’
‘মনে হয় না এই কাজ করার জন্য আমাকে বেতন দেওয়া হয়,’ জানালো মেয়েটা, খানিকটা দুর্বল কণ্ঠেই। ‘কাজ শেষে আমার সঙ্গে হোটেলে দেখা কোরো।’
.
স্পাইডার আর চার্লি হাঁটছে উইলিয়ামসটাউনের রাস্তায়, সকালের সূর্যালোক গায়ে মেখে।
‘হ্যাটটা কিন্তু দারুণ,’ বলল স্পাইডার।
‘তোমার তাই মনে হয়?’
‘হ্যাঁ। আমি পরতে পারি?’
স্পাইডারকে ওর সবুজ ফেডোরাটা দিন চার্লি। মাথায় দিল স্পাইডার, নিজের প্রতিবিম্ব দেখল দোকানের আয়নায়। চেহারা বিকৃত করে ফিরিয়ে দিল চার্লিকে। ‘আসলে,’ হতাশ শোনাল ওর কণ্ঠ। ‘তোমার মাথাতেই বেশি মানায়।’
ফেডোরাটা আবার মাথায় গলাল চার্লি। কিছু কিছু হ্যাট এমন আছে, যেগুলো পরার পূর্বশর্তই হলো স্ফূর্তি। ওগুলো মাথায় দিয়ে একটু বাঁকিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে পথ চলতে হয়, ভাবখানা হয় এমন যে আরেকটু হলেই নাচতে শুরু করে দেবেন। ওগুলো পড়তে হলে, নিজেকে অনেক কিছু করতেই বাধ্য করতে হয়। চার্লি যেটা পরে আছে, সেটা ওরকম একটা হ্যাট; আর ওটার জন্য অনেক কিছুই করতে রাজি সে। বলল, ‘রোজির মা মারা যাচ্ছে।’
‘হুম।’
‘আমি আসলে মহিলাকে কখনও পছন্দ করতে পারিনি।’
‘তোমার মতো করে তো তাকে চিনি না…তবে সময় পেলে সন্দেহ নেই যে আমিও তাকে অপছন্দই করতাম।’
চার্লি এবার বলল, ‘আমাদের মহিলার জীবন বাঁচাবার চেষ্টা করতে হবে, তাই না?’ আগ্রহের সঙ্গে বলল কথাটা।
‘মনে হয় না এমন কিছু করার ক্ষমতা আমাদের আছে।’
‘মায়ের জন্য কিন্তু এমন কিছু একটা করেছিল বাবা, খানিকক্ষণের জন্য ভালো হয়ে গেছিল মা।’
‘সেটা বাবা পেরেছে। মনে হয় না আমাদের পক্ষে সম্ভব।’
চার্লি বলল, ‘ওই জায়গাটার কথা মনে আছে? পৃথিবীর শেষে? গুহাঅলা জায়গাটা?’
‘শেষে না, শুরুতে। কী হয়েছে ওটার?’
‘আমরা কি চাইলেই যেতে পারি ওখানে? মোম-টোম আর জড়িবুটি-টুটি ছাড়াই?’
চুপ করে রইল স্পাইডার, তারপর মাথা নেড়ে বলল, ‘তাই তো মনে হয়।’
একসঙ্গে ঘুরল ওরা, বাঁক নিলো এমন এক স্থানে এসে যেখানে আসলে মোড় থাকার কথা ছিল না। উইলিয়ামসটাউনের রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তায় পা রাখল তারা।
সূর্য উদয় হতে শুরু করেছে, চার্লি আর স্পাইডার হাসছে খুলিতে ভরে থাকা একটা সৈকত ধরে। ওগুলো আসলে ঠিক মানুষের খুলি বলা যায় না। সৈকতটাকে হলদে নুড়ির মতো ঢেকে রেখেছে ওগুলো। যতটা সম্ভব খুলি এড়িয়ে পা ফেলতে চাচ্ছে চার্লি, কিন্তু স্পাইডারের সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সৈকতের শেষ মাথায় এসে, স-ব কিছু পেছনে ফেলে বাঁ দিকে ঘুরল সে। পৃথিবীর শুরুতে যে পাহাড়-সারি আছে, সেটা দেখা দিল ওদের সামনে।
গতবার এখানে আসার স্মৃতি ভালোভাবেই মনে আছে চার্লির, যদিও মনে হচ্ছে সেটা হাজার বছর আগের কথা। ‘কই গেল সব?’ উচ্চকণ্ঠে বসল সে, পাহাড়ে প্রতিধ্বনিত হয়ে আবার শব্দগুলো ওর কাছেই ফিরে এলো। জোরেশোরে বলল, ‘হ্যালো?’
সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল সবাই, দেখছে ওকেই। সবাই বলতে স-ব্বা-ই। তাদেরকে বিশাল দেখাচ্ছে এখন, তবে মানুষের মতো খুব একটা না; বরঞ্চ পশুর সঙ্গেই মিল দেখা যাচ্ছে বেশি, অনেকটাই বুনো। বুঝতে পারল চার্লি, গতবার এদেরকে দেখে মানুষের মতো লাগছিল কারণ তেমনটাই ভেবে এখানে পা রেখেছি সে। কিন্তু আসলে তো এরা মানুষ না। পাথরের ওপর বসে-দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে সিংহ, হাতি, কুমির, সাপ, খরগোশ আর বিচ্ছু…সেই সঙ্গে অন্য সব প্রাণী। সংখ্যায় তারা শত শত, আমোদহীন চোখের দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওকে: পশুগুলোকে চিনতে পারছে চার্লি, যদিও এদেরকে অন্য কোনো জ্যান্ত মানুষ চিনতে পারবে না। গল্পে যত পশুর কথা শুনেছে মানুষ, তাদের সবাই উপস্থিত হয়েছে এখানে। আছে এমন সব পশু যাদেরকে তারা কল্পনায় দেখেছে, যাদের পুজো করেছে কিংবা পোষ মানিয়েছে।
সবাইকে দেখতে পেল চার্লি।
জানের ভয়ে গান গাওয়া এক কথা, ভাবল সে। কামরা ভরতি মানুষের সামনে, মূহূর্তের উন্মাদনায়। কেননা শয়তান এক লোক বন্দুক ঢেকিয়ে রেখেছে এমন এক মেয়ের পেটে যাকে…
যাকে…
ওহ।
থাক, ভাবল চার্লি। সেই চিন্তা পরে করা যাবে।
এই মুহূর্তে ও চায় হয় কাগজের বাদামি ব্যাগে শ্বাস ফেলতে-নিতে, কিংবা উধাও হয়ে যেতে।
‘সংখ্যায় হাজারো হবে,’ সম্ভ্রম মিশ্রিত কণ্ঠে বলল স্পাইডার।
আচমকা বাতাসে জন্ম নিলো বাতাসের নাচন। কাছের একটা পাথরে সেই বাতাস ঘনীভূত হয়ে পরিণত হলো পাখি-মানবীতে। হাত বুকের ওপর বেঁধে, ওদের দিকে চেয়ে রইল মহিলা।
‘যাই করতে চাও না কেন,’ বলল স্পাইডার। ‘দ্রুত করো, বেশিক্ষণ অপেক্ষা করবে না এরা। চুপচাপ থাকবে বলে মনে হয় না।’
চার্লির মুখ শুকিয়ে গেছে। ‘ঠিক বলেছ।’
স্পাইডার শুরু করল, ‘এখন, মানে, আমরা করবটা কী?’
‘ওদেরকে গান গেয়ে শোনাব,’ চার্লি কেবল এতটুকুই বলল।
‘কীহ?’
‘ঝামেলা সামলাবার এটাই উপায়। অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি। তুমি আর আমি মিলে গাইব ওদের জন্য।’
‘বুঝতে পারলাম না। কী গাইব?’
জবাব দিল চার্লি। ‘গান…বিশেষ সেই গান। ওটা গাইলেই, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ মরিয়া শোনাল যুবককে। ‘ওই গানটা।’
রসগোল্লার মতো বড়ো বড়ো দেখাচ্ছে স্পাইডারের চোখ। সেই চোখে এমন অনেক কিছু দেখতে পেল চার্লি যা আগে কখনও দেখেনি: ভালোবাসা, সেই সঙ্গে বিভ্রান্তি… এবং ক্ষমা প্রার্থনা। ‘কী বলছ, বুঝতেই তো পারছি না!’
পাথরের এক পাশ থেকে উঁকি দিল সিংহ। বানর ওদেরকে দেখছে গাছের ওপর থেকে। আর বাঘ…
বাঘকে দেখতে পেল চার্লি। চার পায়ে পা টিপে টিপে হাঁটছে সে, চেহারা ফুলে গেছে; তবে চোখে অদ্ভুত একটা আভা খেলা করছে, যেন প্রতিশোধ নিতে পারলে খুবই খুশি হতো।
চার্লি মুখ খুলল। গোঙানির মতো একটা আওয়াজ বেরোল শুধু ওর মুখ থেকে, যেন নার্ভাস কোনো ব্যাং ঢুকে গেছে ওর গলায়। ‘কাজ হচ্ছে না,’ স্পাইডারকে ফিসফিসিয়ে বলল ও। ‘বুদ্ধিটা আসলে বেকার, তাই না?’
‘হ্যাঁ।’
‘আচ্ছা, আবার পালিয়ে যেতে পারব এখান থেকে?’ চার্লি নার্ভাস ভঙ্গিতে পাহাড়ের ঢাল আর গুহামুখের ওপর নজর বুলাল। সৃষ্টি-জগতের শুরু থেকে যত ধরনের পশু জন্ম নিয়েছে, দেখল তাদের সবাইকে। গত বার দেখেনি, এমন একজনও ছিল তাদের মাঝে: ছোট্ট একজন মানুষ, হাতে লেবুর মতো হলদে দস্তানা আর পেন্সিলের মতো পাতলা গোঁফ। তবে পাতলা চুল ঢেকে রাখার মতো ফেডোরা নেই মাথায়।
চার্লির চোখে চোখ পড়লে, নিজের চোখ টিপল বৃদ্ধ লোকটা।
দেখা গেল, সেটাই যথেষ্ট!
ফুসফুস ভরে বাতাস টানল চার্লি, তারপর শুরু করল গান গাওয়া। ‘আমি চার্লি,’ গাইল সে। ‘আমি আনানসির ছেলে। শোনো আমার গান, শোনো আমার জীবনের গল্প।’
গেয়ে গেয়ে একটা গল্প শোনাল চার্লি; শোনাল এমন এক ছেলের কথা যে আসলে আধা-দেবতা, যাকে রাগের বশবর্তী হয়ে এক বৃদ্ধা মহিলা দুই অংশে ভাগ করে দিয়েছিল। গেয়ে শোনাল ভাইয়ের কথা, শোনাল মায়ের গল্প।
গানে যোগ করল নামগুলো, যোগ করল নানা শব্দ। যোগ করল বাস্তবতা যে খুঁটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে তার আখ্যান; যে দুনিয়াগুলো তৈরি করে অন্য দুনিয়াগুলো—সেগুলোও বাদ গেল না। সব কিছুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্য শোনাল শ্রোতাদের; জানিয়ে দিল, যারা ওকে কিংবা ওর নিজের এমন কিছুর ক্ষতি করবে তার উচিত সাজা কী হবে।
এক কথায়, নিজের গানে পুরো দুনিয়াটাকে উপস্থাপন করল চার্লি।
গানটা বেশ ভালো, আর সেটা ওর নিজের গান। কখনও কখনও গাইতে হলো কলি ব্যবহার করে, কখনও বা কোনো কথার দরকারই পড়ল না।
ওর গান শুনতে শুনতে হাততালি দিতে লাগল সবগুলো প্রাণী, পা ঠুকে তাল মেলাল ওর সঙ্গে। চার্লির মনে হলো, ওদের সবাইকে ছুঁয়ে যাচ্ছে এমন একটা গানের মাধ্যমে সে। পাখির কথা বলল সে, বলল চোখ তুলে তাদের উড্ডয়নের মাঝে থাকা জাদুর গল্প। দিনের আলোতে তাদের পালকে সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ে ঝিকিয়ে ওঠার আখ্যান রইল গানে।
টোটেম[৩৭] প্রাণিগুলো নাচতে শুরু করে দিয়েছে, যার যার নিজস্ব নাচ। এমনকী পাখি-মানবীও নাচছে পাখিদের মতো চক্রাকার নাচ। লেজের পালকগুলো ছড়িয়ে পড়ছে, পেছনে হেলিয়েছে চঞ্চ।
[৩৭. এমন কোনো প্রাণী কিংবা বস্তু, যা কোনো বিশেষ ধারণা কিংবা আদর্শের প্রতিনিধিত্ব করে।]
পাহাড়ের ঢালে রয়েছে মাত্র একটা প্রাণী যে নাচছে না
লেজ দাপাচ্ছে বাঘ। হাততালি, গান গাওয়া কিংবা নাচ—কোনোটাই করছে না সে। চেহারা মারের চোটে বেগুনি হয়ে গেছে, কামড়ের দাগ আর ফোলায় দেহটা ভরে আছে। পাথরের ওপর দিয়ে একেক বারে এক পা ফেলে কাছিয়ে এসেছে বাঘ। চার্লির একদম কাছে আসার আগে থামেওনি। ‘গানগুলো তোমার না,’ গর্জে উঠল সে।
ওর দিকে তাকাল চার্লি; এরপর গাইতে শুরু করল। প্রথমে বাঘকে নিয়ে, তারপর তাতে যোগ করল গ্রাহাম কোটসের কথা, শোনাল নিরীহদের শিকার বানায় এমন পাষণ্ডদের আখ্যান। ঘুরে যখন দাঁড়াল, তখন স্পাইডারের চোখে ওর জন্য দেখতে পেল সম্ভ্রম। রাগে গর্জে উঠল বাঘ, সেটাকে গানের অংশ বানিয়ে নতুন করে কলি সাজাল চার্লি। তারপর গর্জে উঠল নিজেই, ঠিক যেভাবে বাঘ গর্জেছিল।
তবে গর্জনটা পুরোপুরি বাঘের গর্জন হলো না। শুরুটা হলো ওভাবেই, কিন্তু একটু পরেই সেটাকে নিজের মতো বানিয়ে নিলো চার্লি। তাই হাস্যরসের উদ্রেককারী একটা গর্জনে পরিণত হলো সেটা। যত প্রাণী দেখছিল, সবাই
হাসতে শুরু করল। অবশ্য ওদেরকেও দোষ দেওয়া যায় না, হাসতে বাধ্য হলো বলা চায়। চার্লি সেই আমোদ মেশানো গর্জন শোনাল আবার। অন্যকে নকল করার ভান করল, যাকে প্রায় নিখুঁত ক্যারিকেচার বলা চলে; যে ব্যাপারটা আনন্দ-ফূর্তিকে একেবারে বোঝার বাইরের বস্তুতে পরিণত করেছে, সেই জিনিসটা মিশে রইল গর্জনের সঙ্গে। আর কখনও কেউ বাঘের গর্জন শুনলে, তাতে মিশে থাকা চার্লির গর্জন ধরতে ব্যর্থ হবে না। ‘বোকা-বোকা গর্জন,’ বলবে তারা।
চার্লির দিকে পিঠ ফেরাল বাঘ, লাফ দিল ভিড়ের মধ্যখান দিয়ে। যেতে যেতে গর্জন করল একটা। শুনে উপস্থিত সবার হাসি বেড়ে গেল আরও। রাগের সঙ্গে গুহায় ফিরে গেল বাঘ।
হাত দিয়ে ভঙ্গী করল স্পাইডার, আলতো একটা ভঙ্গী।
আচমকা চারপাশ থেকে অদ্ভুত একটা আওয়াজ ভেসে এলো, সঙ্গে সঙ্গে পাথর ধসের কারণে আটকে গেল বাঘের গুহা। স্পাইডারকে সন্তুষ্ট দেখাল। এদিকে গান চালিয়ে গেল চার্লি।
রোজি নোয়াহ ও তার মায়ের গান গাইল ওরা; গাইল মিসেস নোয়াহের লম্বা জীবনের গান, সেই সঙ্গে যেসব আনন্দ তার প্রাপ্য…সেগুলোও।
নিজের জীবনের গান গাইল সে, গাইল ওদের সবার জীবনের গান; সেই গানে দেখতে পেল মাকড়শার একটা জাল, যাতে আটকে গেছে একটা মাছি; সেই মাছিটাকে গানের মাঝে পেঁচিয়ে নিলো চার্লি, নিশ্চিত করল যে ওটা পালাতে পারবে না। তারপর ছিঁড়ে যাওয়া জালটাকে নতুন করে আবার সুতো দিয়ে বাঁধল।
গানটা অবশেষে তার শেষে পৌঁছে গেল।
চার্লি টের পেল, অবাক না হয়েই, যে গান গেয়ে দারুণ আনন্দ পেয়েছে সে। টের পেল, বাকি জীবনটা এই কাজ করেই কাটিয়ে দিতে চায়। গান গাইবে সে: নাহ, এমন বড়ো বড়ো আর জাদুময় গান গাইবে না যা দুনিয়া সৃষ্টি করে কিংবা বাস্তবতাকে মোচড়াবে না। ছোটো ছোটো গান গাইবে যা অল্প সময়ের জন্য হলেও আনন্দ দেবে মানুষজনকে, তাদেরকে মনোজগতে আলোড়ন তুলবে, খানিকক্ষণের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেবে তাদের দুঃখকে। বুঝতে পারছে, গান গাইবার আগে সবসময়ই আতঙ্কে ভুগবে সে; মঞ্চে দাঁড়াবার ভয়টা ওকে ছাড়বে না কখনওই। তবে এটাও বুঝতে পারছে—ব্যাপারটা হবে সুইমিং পুলে ঝাঁপ দেওয়ার মতো—প্রথম কয়েকটা মুহূর্ত অস্বস্তি লাগলেও, তারপর উপভোগ করার মতোই হবে অভিজ্ঞতাটা…
কিন্তু এত উপভোগ্য হবে না। অবশ্য যা হবে তা যথেষ্টই।
তারপর শেষ হয়ে গেল গানটা। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল চার্লি। গানের রেশ ফুরিয়ে গেলে গান বন্ধ করে দিল প্রাণিগুলোও, বন্ধ হয়ে গেল তাদের হাততালি-নাচ-পা ফেলা। বাবার সবুজ ফেডোরাটা হাতে নিয়ে চেহারায় বাতাস করতে লাগল সে।
নিচু কণ্ঠে বলল স্পাইডার। ‘দারুণ দেখালে।’
‘কাজটা তুমিও করতে পারতে,’ জানাল চার্লি।
‘আমার তা মনে হয় না। শেষের দিকে এসে এটা কী হলো? টের পাচ্ছিলাম যে কিছু একটা করছ তুমি, কিন্তু সেটা যে কী তা ধরতে পারছি না।’
‘কিছু সমস্যার সমাধান করলাম,’ জানাল চার্লি। ‘মানে আমার সেটাই মনে হয়, ঠিক নিশ্চিত নই।
আসলেও তাই। গান এখন শেষ, কলিগুলোর সত্যতা তাই আস্তে আস্তে ভোরের আলোর মতোই ছড়িয়ে পড়বে। পাথর ধসে বন্ধ হয়ে যাওয়া গুহার মুখটার দিকে ইঙ্গিত করল ও। ‘কাজটা তোমার?’
‘হ্যাঁ,’ জানাল স্পাইডার। ‘এতটুকু তো আমি করতেই পারি। অবশ্য একসময়-না-একসময় ঠিকই বেরিয়ে আসবে বাঘ। সম্ভব হলে ওর অবস্থা আরও খারাপ করতাম।’
‘ভেবো না,’ বলল চার্লি। ‘আমি করেছি, অনেক খারাপ কিছুই করেছি।’
প্রাণিগুলোকে ছত্রভঙ্গ হতে দেখল চার্লি। ওর বাবাকে দেখা গেল না কোথাও, ব্যাপারটা অবাক করল না ওকে। ‘চলো,’ বলল সে। ‘আমাদের ফেরা দরকার।’
.
ভিজিটিং টাইমে রোজির সঙ্গে দেখা করতে গেল স্পাইডার। চকলেটের একটা বাক্স নিয়ে এসেছে সে, হাসপাতালের গিফট শপে এর চাইতে বড়ো বাক্স আর ছিল না।
‘তোমার জন্য,’ বলল ছেলেটা।
‘ধন্যবাদ।’
‘ডাক্তাররা জানাল,’ বলল মেয়েটা। ‘মা নাকি সুস্থ হয়ে যাবে। চোখ খুলেই নাকি পরিজ খেতে চেয়েছে। সবাই বলছে: অলৌকিক কাণ্ড ঘটে গেছে!’
‘হুম, তোমার মা…আর খাবার চেয়েছে! অলৌকিক কাণ্ডই বটে।’
আদর করে ওর হাতে চাপড় বসাল রোজি, তারপর আর হাত সরাল না।
‘হয়তো শুনে হাসবে,’ বলল মেয়েটা, বেশ খানিকক্ষণ পর। ‘কিন্তু অন্ধকারে যখন মায়ের সঙ্গে ছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল যে তুমি আমাকে সাহায্য করছ। যেন পশুটাকে দূরে সরিয়ে রেখেছ। যদি কাজটা তুমি না করতে, তাহলে হয়তো আমাদেরকে ওটা মেরেই ফেলত!’
‘উম, সম্ভবত তোমার ধারণাই সঠিক।’
‘তাই নাকি?’
‘জানি না, সম্ভবত। আমিও বিপদে পড়েছিলাম, তখন তোমার কথা ভেবেছি।’
‘বড়ো কোনো ঝামেলা?’
‘হ্যাঁ, বিশাল বড়ো।’
‘আমাকে এক গ্লাস পানি দেবে, প্লিজ?’
তাই করল স্পাইডার। মেয়েটা বলল, ‘স্পাইডার, কী করো তুমি?’
‘কী করি? মানে?’
‘পেশা কী তোমার?’
‘যখন যা করতে মন চায়।’
‘আমার ধারণা,’ বলল মেয়েটা। ‘এখানে, এই হাসপাতালে আরও কিছুদিন থাকব। নার্সরা আমাকে জানিয়েছে, ওদের নাকি কিছু শিক্ষক দরকার। আমি দেখতে চাই, এখানে কোনো পরিবর্তন আনতে পারি কি না।’
‘কাজটা মজার হতে পারে।’
‘ধরো আমি রয়ে গেলাম, তাহলে তুমি কী করবে?’
‘উম, তুমি যদি এখানে থাকো তো আমারও নিজেকে ব্যস্ত রাখার মতো কাজ খুঁজে নিতে হবে।’
একজনের আঙুল আঁকড়ে ধরল অন্য জনেরগুলো।
‘কী মনে হয়, আমাদের সম্পর্কটা টিকবে?’ জানতে চাইল মেয়েটা।
‘তাই তো মনে হয়,’ আন্তরিক ভাবেই বলল স্পাইডার। ‘যদি কখনও একঘেয়ে লাগতে শুরু করে, তাহলে হয়তো অন্য কিছু করতে চলে যাবো। তাই দুশ্চিন্তা কোরো না।’
‘ওহ,’ বলল রোজি, ‘তা করছি না।’ আসলেও করছে না মেয়েটা। ওর কণ্ঠের নম্রতার নিচে ঢাকা পড়েছে ইস্পাতের দৃঢ়তা।
বোঝাই যাচ্ছে, ওর মা এত কঠিন কেন!
.
ডেইজিকে সৈকতের একটা ডেক চেয়ারে শোয়া অবস্থায় খুঁজে পেল চার্লি। দেখে মনে হলো, রোদ পোহাতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। কিন্তু ওর ওপর চার্লির ছায়া পড়তেই মেয়েটা বলল, ‘হ্যালো চার্লি।’ তবে চোখ খুলল না।
‘আমিই যে এসেছি, তা বুঝলে কীভাবে?’
‘তোমার হ্যাট থেকে সিগারের গন্ধ আসছে। ওটা কবে ফেলে দেবে?’
‘কখনও না,’ জানাল চার্লি। ‘আগেও বলেছি, পারিবারিক স্মৃতিচিহ্ন এটা। আশা করি, মরার সময়ও এই হ্যাট আমার মাথায় থাকবে। যখন মারা যাবো, তখন দিয়ে যাবো সন্তানকে। যাই হোক, পুলিসের চাকরি এখনও আছে?’
‘আছে বলা যায়,’ জানাল মেয়েটা। ‘আমার বস জানিয়েছে—অতিরিক্ত কাজের চাপে মানসিক বৈকল্যে ভুগছিলাম আমি। তাই এই ছুটিটাকে বিশ্রাম হিসেবে দেখা হচ্ছে, ফিরে যাওয়ার আগপর্যন্ত সেই হিসেবেই দেখা হবে।’
‘আহ। কবে যাচ্ছ?’
‘জানি না,’ বলল মেয়েটা। ‘সানট্যানের তেলটা একটু দেবে।’
পকেটে একটা বাক্স নিয়ে এসেছে চার্লি। ওটা বের করে, ডেক চেয়ারের হাতলে রাখল। ‘তার আগে আরেকটা কথা,’ বলল সে। ‘হয়েছে কী, বিব্রতকর কাজটা তো বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে একবার করেই ফেলেছি।’ বাক্সটা খুলল সে। ‘এটা তোমার জন্য, আমার তরফ থেকে। মানে, রোজি ফিরিয়ে দিয়েছে। যদি চাও তো এটার বদলে তোমার পছন্দসই অন্য একটা নিতে পারি। এটা আঁটবে বলে মনে হয় না। তবে জিনিসটা তোমার। মানে যদি ওটাকে…আর আমাকে চাও আরকী!’
বাক্সের ভেতর হাত ঢুকিয়ে, বাগদানের আংটিটা বের করে আনল ডেইজি।
‘হুম, ঠিক আছে,’ বলল মেয়েটা। ‘আশা করি, কাজটা তুমি ওই লেবু ফেরত পাওয়ার জন্য করছ না!’
.
রাগে পায়চারী করছে বাঘ, বিরক্তির সঙ্গে নাড়ছে লেজখানা। ওর গুহার মুখের এমাথা-ওমাথা করছে শুধু। চোখগুলো অন্ধকারে পান্নার মশালের মতো জ্বলছে।
‘সারা বিশ্ব, এবং তার সবকিছু আমার ছিল,’ বলল বাঘ। ‘চাঁদ-তারা- সূর্য-গল্প…সব কিছুর মালিক ছিলাম আমিই।’
‘বলতে বাধ্য হচ্ছি,’ গুহার পেছন দিক থেকে একটা অনুচ্চ কণ্ঠ বলে উঠল, ‘কথাটা আগেও বলেছ।’
পায়চারী থামিয়ে দিল বাঘ; তারপর ঘুরে চলে এলো গুহার শেষ প্রান্তের দিকে, নড়া-চড়া দেখলে মনে হবে: হাইড্রোলিক স্প্রিঙের ওপর পশমের গালিচা বেছানো হয়েছে। পিছিয়ে আসতে আসতে দেখতে পেল ষাঁড়ের লাশ। নিচু কণ্ঠে বলল, ‘কী বললে?’
লাশের ভেতর থেকে কিছু একটা নড়া-চড়ার আওয়াজ পাওয়া গেল। ওটার বুকের খাঁচার ভেতর থেকে দেখা গেল একটা নাক। ‘আসলে,’ বলল ওটার মালিক। ‘আমি তোমার সঙ্গে একমত হচ্ছিলাম। আর কিছু না।’
ছোটো ছোটো দুটো হাত দুই পাঁজরের মাঝে থাকা শুকনো মাংস টেনে ছিঁড়ল, পরক্ষণেই দেখা গেল ময়লা তুষার-রঙা একটা ছোট্ট প্রাণী। অ্যালবিনো নেউলে হতে পারে, কিংবা কোনো এক চালাক বেজি যে তার শীতের কোট গায়ে চড়িয়েছে। চোখে তার শবভোজীর দৃষ্টি।
‘সারা বিশ্ব, এবং তার সবকিছু আমার ছিল, চাঁদ-তারা-সূর্য-গল্প… সব কিছুর মালিক ছিলাম আমিই।’ সঙ্গে যোগ করল। ‘আবার আমার হবে।
ছোট্ট প্রাণিটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বাঘ। তারপর, সতর্ক হবার বিন্দুমাত্র সুযোগ না দিয়ে, থাবার আঘাতে গুঁড়িয়ে দিল লাশের বুকের খাঁচা। দুর্গন্ধময় অনেকগুলো খণ্ডে পরিণত হলো ওটা, কিন্তু থাবার নিচে আটকে গেল ছোট্ট প্রাণিটা। ছাড়া পাবার জন্য দেহ মোচড়াতে লাগল বটে, কিন্তু লাভ হলো না।
‘মন দিয়ে শোনো,’ বলল বাঘ, ওর বিশাল নাকটা ছোট্ট প্রাণিটার নাকের সঙ্গে ঠেকাল প্রায়। ‘আমার গুহায় এসেছ তুমি। তাই সাবধান, যদি বিরক্তিকর কিছু বলো তো কামড়ে মাথা ছিঁড়ে ফেলব।’
‘হুমফ,’ বেজির মতো প্রাণিটা বলল।
‘মাথা কামড়ে খেলে ব্যাপারটা পছন্দ হবে না, তাই না?’
‘নাহ,’ বলল ছোট্ট প্রাণিটা। চোখ দুটোও হালকা নীল, বরফের দুটো টুকরোর মতো; বিশাল, ওজনদার থাবার নিচে অস্বস্তির সঙ্গে জ্বলছিল ওগুলো।
‘তাই নিশ্চয়ই কথা দিচ্ছ, ভদ্র আচরণ করবে? চুপ করে থাকবে?’ গড়গড় করে জানতে চাইল বাঘ। থাবার কেবল এতটুকু তুলল, যেন কথা বলতে পারে ছোট্ট প্রাণিটা।
‘অবশ্যই,’ পরম ভদ্রতার সঙ্গে বলল ছোট্ট, সাদা প্রাণিটা। পরক্ষণেই, একেবারে খাঁটি বেজির মতো, দাঁত বসিয়ে দিল বাঘের থাবায়। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল বাঘ, সরিয়ে নিলো থাবা; ছোট্ট প্রাণিটাকে ছুড়ে দিল বাতাসে। পাথুরে ছাদে আছড়ে পড়ল ওটা, ওখানে বাড়ি খেয়ে আবার পড়ল একটা পাথরের ধারে। সেখান থেকে দৌড়ে পালাতে লাগল ওটা, নোংরা সাদা স্রোতের মতো ছুটে গেল গুহার পেছন দিকে। ওদিকটায় ছাদ নিচু, মেঝের অনেক বেশি নিকটে। তাই ছোট্ট একটা প্রাণির লুকোবার মতো জায়গার অভাব নেই। তুলনামূলক বড়ো আকারের কেউ সেদিকে যেতেও পারবে না।
তাও, যতটুকু সম্ভব ওদিকে গেল বাঘ। ‘ভাবছিস, আমি অপেক্ষা করতে পারব না?’ জিজ্ঞেস করল সে। ‘কখনও না কখনও তো তোকে দেখা দিতেই হবে। আমিও কোথাও যাচ্ছি না।’ মেঝেতে শুলো বাঘ। চোখ বন্ধ করে নাক ডাকাতে লাগল, ভান করলেও বিশ্বাসযোগ্য হলো তা।
বাঘ নাক ডাকাতে শুরু করার প্রায় আধ ঘণ্টা পর, ওই ধূসর প্রাণিটা বেরিয়ে এসে ছায়ায় ছায়ায় এগোতে লাগল। একটা বড়ো পাথরের গায়ে তখনও অনেকটা মাংস লেগে আছে, বেজিটার লক্ষ্য সেটাই। হালকা দুৰ্গন্ধ ছড়াচ্ছে বটে, তবে বেজির তা নিয়ে আপত্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবে ওটার কাছে পৌঁছুতে হলে, প্রকাণ্ড বিড়ালটাকে অতিক্রম করতে হবে। ছায়ায় লুকিয়ে, ছোট্ট ও নীরব পা ফেলে এগোতে লাগল আবার।
ঘুমন্ত বাঘটাকে অতিক্রম করে ফেলেছে প্রায়, এমন সময় ছোবল বসাল তার সামনের থাবা। বেচারা নেউলের লেজে বিধল তার নখর। আরেকটা থাবা বসল ওটার ঘাড়ের ওপর। প্রকাণ্ড পশুটা চোখ খুলল। ‘দেখা যাচ্ছে,’ বলল সে। ‘সঙ্গী বলতে এখন আমরা দীর্ঘদিন ধরে শুধু আমাদেরকেই পাবো। তাই চাইব, তুমি খানিকটা হলেও সমঝদারের মতো আচরণ করো। আমাদের দুজনকে সেই চেষ্টা করে যেতে হবে। মনে হয় না কখনও বন্ধুত্ব হবে আমাদের মাঝে, তবে হয়তো একে-অন্যকে সহ্য করতে পারব।’
‘তোমার কথা বুঝতে পারছি,’ বেজির মতো জীবটা বলল। ‘ভিক্ষার চাল, কাঁড়া আর আকাঁড়া!’
‘আমি তো এই কথাটাই বলছি,’ বলল বাঘ। ‘কখন চুপ করে থাকতে হবে, সেটা তোমার শিখতে হবে।’
‘দোষ বাজে হাওয়ার,’ বলল ছোট্ট প্রাণিটা। ‘যা কারও কাজে আসে না।’
‘আবার বিরক্ত করছ আমাকে,’ বলল বাঘ। ‘সাবধান করে দিলাম একটু আগে, আমাকে বিরক্ত কোরো না। আমিও বিনিময়ে তোমার মাথা চিবিয়ে খাবো না।’
‘বারবার একই কথা বলছ, আমার মাথা খাবে। ধরে নিচ্ছি, রূপক অর্থে বলছ কথাটা? বোঝাতে চাচ্ছ যে হয় চিল্লাচিল্লি করবে, কিংবা রাগ করবে…তাই তো?’
‘উঁহু, প্রথমে মাথাটা ছিঁড়ব। তারপর সেটা চিবিয়ে চিবিয়ে নরম করে গিলে খাবো,’ জানাল বাঘ। ‘আনানসির সন্তানদের আগে ভুলে যেতে হবে যে আমরা এখানে আছি, তারপর মুক্তি পাবো। ওই হারামজাদা যেভাবে সব সাজিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে–তোমাকে যদি সকালে হত্যাও করি, তাহলে বিকেলের আগেই পুনর্জন্ম হবে এই নারকীয় গুহায়। তাই বলছি, বিরক্ত কোরো না আমাকে।’
ছোট্ট, সাদা প্রাণিটা বলল। ‘আহ, ঠিক আছে। দিন আসে—’
‘যদি দিন যায় বলো,’ সাবধান করে দিল বাঘ। ‘তাহলে খুবই বিরক্ত হবো। তার ফলাফল হবে খুবই মারাত্মক। তাই… বিরক্তিকর… কিচ্ছু… বোলো… না। বুঝতে পারলে?’
দুনিয়ার শেষ মাথায় অবস্থিত গুহায় নেমে এলো ক্ষণিকের নীরবতা। সেটা ভাঙল নিচু একটা কণ্ঠে, ‘পুবশ্যই।’
‘আউ!’ বলতে শুরু করল ওটা। কিন্তু শব্দটা শুরু হবার আগেই থেমে গেল।
তার জায়গায় শোনা গেল কচকচ করে চিবানোর গল্প।
.
বইপত্রে আর গল্প-উপন্যাসে কফিনের ব্যাপারে যে ব্যাপারটা লেখা থাকে না – কেননা লিখলেও সেটা যাদের জন্য কেনা হচ্ছে তাদের কিছু যায় আসে না— তা হলো: ওগুলো আসলে কতটা আরামদায়ক।
নিজের কফিন নিয়ে দারুণ সন্তুষ্ট মি. ন্যান্সি। উত্তেজনা ফুরিয়ে গেছে বলে, এখন আবার কফিনে ফিরে এসে আরামসে ঘুমাচ্ছে সে। যখনই ঘুম ভেঙে যায় আর মনে পড়ে কোথায় আছে, তখনই আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
কবরটা, যার কথা আগেই বলা হয়েছে, দারুণ একটা জায়গা। সেই সঙ্গে বেশ নির্জনও। তাই বিশ্রাম নেওয়ার স্থান হিসেবে আদর্শ। মাটির ছয় ফুট নিচের সঙ্গে অন্য কোনো জায়গার তুলনা হয় না। আরও বছর বিশেক এভাবেই কাটিয়ে দেবে, ঠিক করল সে। তারপর বাইরে বেরোবার কথা ভাবা যাবে।
যখন শেষকৃত্যানুষ্ঠান শুরু হলো, তখন এক চোখ খুলল সে।
ওপরে উপস্থিত মানুষদের কণ্ঠ ভেসে আসছে : কেলিঅ্যান হিগলার, বাস্টামন্টে আর ওই পাতলা-সাতলা মহিলাটা। সেই সঙ্গে নাতি-নাতনী, পর- নাতি এবং পর-পর-নাতির দঙ্গল। মিসেস ডানউইডির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করার জন্য কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে বেচারারা।
মি. ন্যান্সি একবার ভাবল, কবরের ভেতর থেকে হাত বের করে কেলিঅ্যান হিগলারের গোড়ালি আঁকড়ে ধরবে কি না। প্রায় বছর তিরিশেক আগে, একটা ড্রাইভ-ইনে ক্যারি[৩৮] দেখার পর থেকেই কাজটা করার ইচ্ছে জন্মেছিল তার মনে। কিন্তু এখন সুযোগ পেয়েও সামলে রাখল নিজেকে। সত্যি বলতে কী, কাজটা করার আগ্রহই পাচ্ছে না। করলে কী হবে? চেঁচাবে মহিলা, হার্ট অ্যাটাক করে মরেও যেতে পারে। তাতে দ্য গার্ডেন অভ রেস্টে ভিড় বাড়বে বই কমবে না।
[৩৮. স্টিফেন কিং-এর বিখ্যাত অনুসারে বানানো মুভি।]
কাজটা করতেও কষ্ট হবে। মাটির নিচে ঘুমিয়ে দেখার মতো অনেক স্বপ্ন আছে। বিশ বছর, ভাবল সে। কিংবা হয়তো পঁচিশ। ততদিনে তার নাতি- নাতনিও জন্ম নিতে পারে। নাতিরা মানুষ হিসেবে কেমন হয়, তা দেখাটা মজারই হবে।
কেলিঅ্যান হিগলারের বিলাপ আর কান্না শুনতে পাচ্ছে পরিষ্কার। তবে কান্নাটা বেশ খানিকক্ষণের জন্য থামিয়ে ঘোষণা করল, ‘তারপরেও, ওর জীবনটা যেমন লম্বা ছিল তেমনই ছিল ভালো। আমাদের কাছ থেকে যখন বিদেয় নেয়, তখন তার বয়েস হয়েছিল একশো তিন!’
‘একশো চার!’ মি. ন্যান্সির পাশ থেকে বিরক্তির সঙ্গে বলে উঠল একটা কণ্ঠ।
মি. ন্যান্সি বিমূর্ত একটা হাত বাড়িয়ে টোকা দিল নতুন কফিনের এক পাশে। ‘মুখ বন্ধ করো, মেয়েমানুষ,’ গর্জে উঠল সে। ‘কেউ কেউ ঘুমাতে চাইছে!’
.
পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে রোজি; ওর ইচ্ছা: স্পাইডার একটা ভালো চাকরি জুটিয়ে নিক। এমন কোনো চাকরি যেখানে সকালে উঠতে হয়, যার উজ্জ্বল একটা ভবিষ্যৎ আছে।
তাই একদিন সকালে, রোজি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার আগে, সকাল সকাল উঠে শহরের লাইব্রেরিতে চলে গেল স্পাইডার। লাইব্রেরির কম্পিউটার ব্যবহার করে ইন্টারনেটে ঘোরা-ফেরা করতে লাগল সে। পরম সাবধানতার সঙ্গে গ্রাহাম কোটসের যে অ্যাকাউন্টের নাগাল বেশি কিছু দেশের পুলিস পায়নি, সেগুলো ফাঁকা করে দিল। আর্জেন্টিনার স্টাড-ফার্মটা[৩৯] বিক্রি করে দিল সে, তারপর একটা ছোটোখাটো কোম্পানি কিনে নিয়ে তাতে টাকাগুলো ঢালল। দাতব্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে ওকে গণ্য করার জন্য আবেদন জানাল সরকারের কাছে। একটা ই-মেইল পাঠাল তারপর, রজার ব্রনস্টেইন নামে। এক উকিলকে ভাড়া করল সদ্য প্রতিষ্ঠিত ফাউন্ডেশনটার দেখভাল করার জন্য। পরামর্শ দিল—সেই উকিলের উচিত হবে লন্ডনের মিসেস রোজি নোয়াহ, যে বর্তমানে সেন্ট অ্যান্ড্রুজে আছে, তাকে ভালো কিছু করার জন্য কাজে লাগানো।
[৩৯. যেখানে পোষা প্রাণির প্রজনন বেছে বেছে করা হয়।]
রোজিকে চাকরি দেওয়া হলো, তার প্রথম কাজ হলো অফিসের জন্য জায়গা খোঁজা।
পরবর্তী চারটা দিন স্পাইডার কাটিয়ে দিল হেঁটে (আর রাতে ঘুমিয়ে), দ্বীপটাকে প্রায় পুরোটা ঘিরে রেখেছে যে সৈকত সেটায়। পথে যতগুলো খাবারের দোকান পড়ল, সবগুলোর স্বাদ নিলো সে। ডসন’স ফিস শ্যাক-এ এসে, প্রথমে খেল ভাজা ফ্লাইং ফিশ। তারপর সিদ্ধ করা সবুজ ডুমুর, গ্রিলড চিকেন আর নারিকেলের পিঠা। অতঃপর রান্নাঘরে গিয়ে খুঁজে বের করল রাঁধুনিকে। দোকানের মালিকও সেই লোকটিই। তাকে দোকানের অংশীদারিত্ব আর রান্না-বান্না শেখার জন্য পয়সা দেবার প্রস্তাব দিল স্পাইডার।
ডসন’স ফিশ শ্যাক এখন রেস্তোরাঁ হয়ে গেছে, মি. ডসনও অবসর নিয়েছে। কখনও কখনও রেস্তোরাঁ সামলায় স্পাইডার, কখনও আবার কিচেনে সময় কাটায়: আপনি যদি ওখানে গিয়ে স্পাইডারের খোঁজ করেন, তাহলে অবশ্যই পাবেন। দ্বীপের মাঝে শ্রেষ্ঠ খাবার পাওয়া যায় ওখানে। আগের চাইতে একটু মুটিয়ে গেছে স্পাইডার; যদি নিজের রান্না করা সব খাবার চেখে দেখা বন্ধ না করে, তাহলে আরও মোটা হবে।
তাতে অবশ্য রোজির কোনো আপত্তি নেই।
কখনও শিক্ষকতা করে সে, কখনও অন্যদেরকে সাহায্য করে। তবে ভালো কাজ করে অনেক। লন্ডনের অভাব বোধ করলেও, তা প্রকাশ করে না। রোজির মা অবশ্য তা চেপে রাতে পারে না। কিন্তু সেই প্রসঙ্গ উঠলেই সেটাকে ধরে নেয় ষড়যন্ত্র হিসেবে, তাকে তার জন্ম-না-নেওয়া (এবং আসলে মায়ের গর্ভেই না আসা) নাতি কিংবা নাতনির কাছ থেকে দূরে সরাবার।
এই লেখক যদি আপনাকে জানাতে পারত যে রোজির মা মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে নতুন মানুষে পরিণত হয়েছে, তাহলে তার চাইতে বেশি খুশি আর কেউ হতো না। কিন্তু মহিলা না হাসিখুশি মানুষে পরিণত হয়েছে, আর না তার মুখ থেকে মানুষের জন্য দয়ার্দ্র শব্দ বেরোয়। এমনকী খাবারের প্রতিও রুচি বৃদ্ধি হয়নি তার। আফসোসের কথা হলো, পরিপূর্ণ সততার সঙ্গে কথা বলতে গেলে বলতে হবে—রোজির মা হাসপাতাল থেকে যখন বেরোয় তখন সে রোজির মা-ই ছিল; আগের মতোই সন্দিগ্ধ। তবে হ্যাঁ, আগের চাইতে দুর্বল হয়ে গেছে অনেক; আর আজকাল ঘুমানোর সময় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয় তাকে।
সে ঘোষণা করেছে: লন্ডনের ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে দেবে। দুনিয়ার যেখানেই স্পাইডার আর রোজি যাক না কেন, সঙ্গী হবে তাদের; থাকবে নিজের নাতি- নাতনির কাছে। কিছু দিন কেটে গেলে, ধীরে ধীরে নাতি-নাতনি না হওয়ার ব্যাপারটা খোঁচা দিতে লাগল সে মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে। প্রশ্ন তুললে স্পাইডারের শুক্রাণুর স্বাস্থ্য, ওদের মেলামেশার ব্যাপারে; এমনকী ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশনে যে খরচ আজকাল বেশি হয় না, সেটাও বলতে পিছ পা হলো না। মাঝে মাঝে তো এতটাই বিরক্তি পেয়ে বসত স্পাইডারকে, যে কেবল শাশুড়িকে খেপাবার জন্য হলেও আলাদা বিছানায় শোবার চিন্তা ভর করত তার মাথায়। এক বিকেলে এগারো সেকেন্ডের জন্য ভাবল কথাটা; রোজির মা তখন ওকে দেখাচ্ছিল ম্যাগাজিনের একটা প্রবন্ধের ফটোকপি, যেটায় লেখা— রোজির আসলে রতিক্রিয়ার পর মাথায় ভর দিয়ে আধ ঘণ্টা থাকা উচিত। রাতে যখন ব্যাপারটা রোজিকে সে বলল, তখন মেয়েটা হেসে বলল—ওদের শোবার ঘরে মায়ের প্রবেশের অনুমতি নেই। তাছাড়া, প্রেমের খাটাখাটুনির পর আধ ঘণ্টা ওভাবে থাকার কোনো ইচ্ছেই তার নেই!
উইলিয়ামসটাউনে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে মিসেস নোয়াহ, স্পাইডার আর রোজির বাড়ির কাছেই। সপ্তাহে দুইবার কেলিঅ্যান হিগলারের অগণিত ভাতিজি যায় ওখানে। ময়লা পরিষ্কার করে, মুছে রাখে কাচের ফলগুলো (দ্বীপের প্রচণ্ড গরমে মোমের ফল গলে যায়), রান্না-বান্না করে খাবার রেখে দেয় ফ্রিজে।
কখনও কখনও রোজির মা তা খায়… আবার কখনও খায় না।
.
চার্লি আজকাল গান গেয়ে দিন কাটায়। দেহের নরম মেদের অনেকটাই ঝরে পড়েছে, এখন একেবারে পোক্ত দেহের অধিকারী ও। ফেডোরা হ্যাট ওর প্রতীকে পরিণত হয়েছে। নানা রকম ফেডোরা আছে ওর, নানা রঙের; যদিও ওর পছন্দের রং সবুজ।
একটা ছেলে হয়েছে চার্লির। মার্কাস নাম ওর, বয়েস সাড়ে চার। শুধুমাত্র ছোটো ছোটো বাচ্চা পাহাড়ি গরিলারা যে ভারিক্কী ভাব ধরে রাখতে সক্ষম হয়, সেটা ওর মাঝে পুরোপুরিই আছে।
কেউ আর এখন চার্লিকে ‘মোটকু চার্লি’ বলে ডাকে না। সত্যি বলতে কী, ডাকটা ও মিসই করে।
গ্রীষ্মের এক সকালের কথা, ততদিনে দিনের আলো ছড়াতে শুরু করেছে। পাশের কামরা থেকে আওয়াজ আসছে। ডেইজিকে ঘুমুতে দিল চার্লি, বিছানা থেকে নেমে পরে নিলো টি-শার্ট আর শর্টস। দরজা দিয়ে বেরিয়ে ছেলের কামরায় ঢুকতেই দেখতে পেল: মেঝেতে বসে কাঠের একটা ছোট্ট ট্রেন সেট নিয়ে খেলছে মার্কাস, ন্যাংটো হয়ে। একসঙ্গে টি-শার্ট, শর্টস আর ফ্লিপ ফ্লপ জুতো পরে সৈকতে রওনা হলো ওরা।
তবে তার আগে মাথায় হ্যাট গলাতে ভুল করল না চার্লি।
‘ড্যাডি,’ বলল ছেলেটা। ওর চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে বসে গেছে, কিছু একটা ভাবছে।
‘বলো, মার্কাস।’
‘সবচাইতে ক্ষীণ রাষ্ট্রপতি কে ছিল?’
‘লম্বায়?’
‘নাহ, দিনের হিসেবে। মানে সবচাইতে কম সময়ের জন্য রাষ্ট্রপতি হয়েছিল কে?’
‘হ্যারিসন। শপথ গ্রহণের সময় নিউমোনিয়া হয় তার, তারপর মারা যান। চল্লিশ দিনের কিছু বেশি সময় ছিলেন ক্ষমতায়, তার মাঝে বেশিরভাগ দিন কেটেছে বিছানায় শুয়ে।’
‘তাহলে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে কে ছিল?’
‘ফ্রাঙ্কলিন ডিলানো রুজভেল্ট। পুরো তিন টার্ম দেশ চালিয়েছেন তিনি। চতুর্থ টার্ম চলাকালীন সময়ে মারা যান। আমরা এখন জুতো খুলে ফেলব।’
একটা পাথরে জুতো রেখে, ঢেউয়ের দিকে হাঁটতে লাগল ওরা। পায়ের আঙুলগুলো দিয়ে খেলতে লাগল ভেজা বালু ব্যবহার করে।
‘প্রেসিডেন্টদের ব্যাপারে এত কিছু কীভাবে জানো?’
‘কেননা আমার বাবার ধারণা ছিল—ছেলেবেলায় আরকী—তাদের সম্পর্কে জানলে পরে কাজে দেবে।’
‘ওহ!’
পানিতে নামল ওরা, এগোল একটা পাথরের দিকে। একমাত্র ভাটার সময় দেখা যায় ওটাকে। বেশ কিছুক্ষণ পর, ছেলেটাকে তুলে নিয়ে কাঁধে বসাল চার্লি।
‘ড্যাডি?’
‘হ্যাঁ, মার্কাস।’
‘পু’চনা বলে, তুমি নাকি বিখ্যাত?’
‘পেটুনিয়া কে?’
‘আমার প্লে-গ্রুপে আছে। সে বলে, ওর মায়ের কাছে নাকি তোমার সব সিডি আছে। এমনকী তোমার গানের বড়ো ভক্ত সে।’
‘আহ।’
‘তুমি আসলেই বিখ্যাত?’
‘অল্প একটু, খুব বেশি না।’ মার্কাসকে পাথরের ওপর বসিয়ে দিল সে। তারপর নিজেও উঠে এলো ওটার ওপরে। ‘যাক, গান গাওয়ার জন্য প্রস্তুত?’
‘হ্যাঁ।’
‘কোন গানটা গাইতে চাও?’
‘আমার সবচাইতে পছন্দের গানটা।’
‘গানটা ওর পছন্দ হবে কি না, সেটাই তো আমরা জানি না!’
‘পছন্দ করবে।’ পাহাড় কিংবা দেওয়ালের মতোই নিরেট মার্কাসের আত্মবিশ্বাস।
‘বেশ তাহলে। এক, দুই, তিন…’
একসঙ্গে ‘হলদিয়া পাখি’ গাইল ওরা, ওই সপ্তাহের জন্য সেটাই মার্কাসের পছন্দের গান। তারপর গাইল ‘জোম্বি জাম্বুরি’, যেটা ছেলেটার পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয় নাম। এরপর শুরু করল তৃতীয় পছন্দ—সি উইল বি কামিং রাউন্ড দ্য মাউন্টেন। মার্কাসের দৃষ্টিশক্তি চার্লির চাইতে প্রখর। তাই গানটা শেষ হবার আগেই দেখতে পেল মেয়েটাকে, হাত নাড়তে লাগল।
‘ওই যে সে, ড্যাডি।’
‘তুমি নিশ্চিত?’
সকালের আলো ভালো মতোই ছড়াতে শুরু করেছে, তাই সাগর আর আকাশ মিলিত হয়েছে দিগন্তে; পাণ্ডুর সাদা একটা রেখার মতো করে। সেদিকে চোখ পিটপিট করে চাইল চার্লি, ‘আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না!’
‘পানির নিচে ডুব দিয়েছে। আবার দেখা দেবে।’
পানি ছলকানোর আওয়াজ হলো একটা, পরক্ষণেই ওদের নিচে দেখা দিল মেয়েটা। একটু লাফিয়ে, দেহটাকে একটু মোচড় খাইয়ে আর একটা পাক খেয়ে ওদের পাশের পাথরে বসে পড়ল সে। মৎস্য কন্যাটার রূপালি লেজ আটলান্টিকের পানিতে নাড়ছে, পানির বিন্দু ভিজিয়ে দিচ্ছে আঁশগুলোকে। লম্বা, কমলা-লাল চুল তার।
একসঙ্গে গান গাইতে লাগল ওরা: পুরুষ, বাচ্চা ছেলে আর মৎস্য-কন্যা। গাইল ওরা ‘দ্য লেডি ইজ আ ট্রাম্প’ এবং ‘হলদে সাবমেরিন’। অতঃপর মৎস্য-কন্যাকে ফ্লিনস্টোন শুরু হবার গানের পঙক্তি শোনাল মার্কাস।
‘ওকে দেখতে তোমার কথা মনে পড়ে যায়,’ চার্লিকে বলল মৎস্য-কন্যা। ‘মানে যখন তুমি ছোটো ছিলে।’
‘আমাকে চিনতে তখন?’
হাসল মেয়েটা। ‘সৈকত ধরে হাঁটতে তুমি আর তোমার বাবা। তোমার বাবা,’ যোগ করল সে। ‘ভদ্রলোক ছিল।’ মৎস্য কন্যা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, অন্য যে কারও চাইতে কাজটা সে ভালো পারে। ‘এখন ফিরে যাও, জোয়ার শুরু হবে।’ লম্বা চুলগুলো পেছনে সরিয়ে, ঝাঁপ দিল সে সাগরে। ঢেউয়ের ওপর মাথা তুলে, আঙুল দিয়ে স্পর্শ করল ঠোঁট। তারপর মার্কাসের দিকে একটা চুমু ছুড়ে দিয়ে, ডুব দিল পানিতে।
ছেলেকে আবার কাঁধে বসাল চার্লি। সাগরের পানির ভেতর দিয়েই ফিরতি পথ ধরল সে, সৈকতে ফিরে এলে ওর কাঁধ থেকে পিছলে বালুতে নামল মার্কাস। চার্লি ওর মাথা থেকে ফেডোরা হ্যাটটা খুলে, পরিয়ে দিল ছেলেকে। বাচ্চাটার মাথার তুলনায় আকারে অনেক বড়ো ওটা, তবে হাসি ফুটে উঠল মার্কাসের মুখে।
‘একটা জিনিস দেখতে চাও?’ প্রশ্ন করল চার্লি।
‘দেখাও, তবে খিদে লেগেছে। নাস্তায় প্যানকেক চাই। নাহ, ওটমিল খাবো। থাক থাক, প্যানকেকই সই।’
‘এই দেখো,’ খালি পায়েই বালু-নাচ শুরু করল চার্লি।
‘আমিও পারব,’ জানাল মার্কাস।
‘তাই নাকি?’
‘দেখো, ড্যাডি।’
আসলেও পারল ছেলেটা।
একসঙ্গে বাপ আর বেটা মিলে বালুর ওপর নাচতে নাচতে বাড়ি ফেরার পথ ধরল। যেতে যেতে ওরা গাইল শব্দহীন গান, যেটা চলতে চলতেই বানাচ্ছে।
ওরা নাস্তা খেতে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরেও বাতাসে ভেসে রইল সেই গানের রেশ।
—সমাপ্ত—