ইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম

KhoriBona

ইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম ...........................................................................

ইট’স কমপ্লিকেটেড – খাদিজা মিম 

ছাপাখানা প্রকাশনী
প্রথম প্রকাশঃ এপ্রিল, ২০২৩ 
প্রচ্ছদ: ফাইজা ইসলাম 

উৎসর্গ 

অমিতের গল্পের উৎসর্গ পাতায় অমিতের নামটাই থাকুক। 


Book Content👉

ইট’স কমপ্লিকেটেড – ১

ফুলস্পিডে ফ্যান ঘুরছে। ফ্লোরে গা এলিয়ে, চোখ বুজে শুয়ে আছে নবনী। মেয়ের ঘরের পাশ দিয়েই যাচ্ছিলেন নীতু। ঘরের ভেতর বাতি জ্বলছে দেখে একবার উঁকি দিলেন ওঘরে। 

— “কখন এলি?” 

একচোখ মেলে তাকালো নবনী। মা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। আবারও চোখ বুজে ফেললো সে। 

— “মাত্রই।” 

— “খাবার দেবো?” 

— “খুব টায়ার্ড মা। খিদের চেয়ে ঘুম পাচ্ছে বেশি।” 

— “একটু করে খেয়ে নে, তারপর ঘুমা।” 

— “উহুম।”

— “ফ্লোরে শুয়ে আছিস কেন? ফ্রেশ হ, কাপড় টাপড় ছাড়। খাটে শুয়ে আরাম করে ঘুমা।” 

— “হুম যাচ্ছি।” 

— “কাল ছয়টায় আমরা বেরোচ্ছি। জ্যাম শুরু হবার আগে ঢাকা ছাড়তে হবে। জলদি করে উঠে পড়িস। তোর লাগেজ তো গোছানো নেই। লাগেজ গোছাতে হবে সকালে উঠে। সাজগোজের একটা ব্যাপার আছে। আচ্ছা না থাক, সাজতে গেলে আবার সময় নষ্ট হবে। তারচেয়ে বরং গাড়িতেই সেজে নিস।” 

প্রচন্ড বিস্ময়ে উঠে বসলো নবনী। ভ্রু কুঁচকে মাকে জিজ্ঞেস করলো, 

— “কোথায় যাচ্ছি আমরা?” 

— “কোথায় আবার? তোর ছোট ফুফুর বাড়ি। ভুলে গেলি?” 

— “ওহ্! রওনকের বিয়ে! একদম ভুলেই গেছি আমি। কিন্তু কাল কেন মা?” 

— “তো আর কবে যাব?” 

— “বিয়ে আরো তিনদিন পর। এত আগে গিয়ে কী হবে? আর আমি ভীষণ টায়ার্ড। এটলিস্ট গোটা একদিন আমি বেড রেস্ট চাই।” 

— “ইশ্! কী পাহাড় ঠেলে এসেছেন আপনি যে গোটা একদিন বেড রেস্ট আপনার চাই?” 

— “তিনশো পিস জামার অর্ডার ছিল, দশদিন হাতে সময়। সেগুলোতে টাই ডাই করা, ব্লক করা, চুমকির কাজ করা, এমব্রয়ডারি করা। সেইম ডিজাইনের জামা দুই পিসের বেশি নিলোই না! সুতার কাজে ফাঁক ফোঁকর রইলো কি না, বডি সাইজ ঠিকঠাক বুঝে শুনে সেলাই করছে কি না আরো কত কী! তুমি তো সব জানোই আম্মু, ওয়ার্কারগুলোও এত্ত অলস! ঠেলে ঠেলে কাজ উদ্ধার করেছি। আজ সবগুলো প্যাকেট করে লন্ডন পাঠালাম। সঙ্গে অন্য শোরুমগুলোর অর্ডার তো আছেই। কেমন স্ট্রেস গেল আমার উপর, বুঝো তুমি?” 

— “তুই কী করেছিস? সব তো কর্মীরাই করলো।” 

— “আমি কী করেছি! আমি! ডিজাইন করলাম আমি। ফ্যাক্টরি মালিকদের সঙ্গে আমার মোটামুটি দাঙ্গা ফ্যাসাদ হয়ে গেছে সুতার রঙ হেরফের নিয়ে। কাজের প্রেশারে সবার মাথা গরম। এই দুই সপ্তাহে আমার কারখানা পলাশীর যুদ্ধ ময়দান হয়ে গেছে। কথায় কথায় মেয়েগুলো ঝগড়া বাঁধায়। সব তো আমাকেই সামলাতে হয়েছে। কতটা মেন্টাল স্ট্রেসে ছিলাম, তুমি জানো? এত শর্ট নোটিশে কে করবে এত কাজ? তার উপর ক্লাইন্টের ডিমান্ড! কাজ অমন, কাপড় এমন, কাটিং তেমন। উফফ! মাথা খালি হয়ে গেল আমার ডিজাইন করতে করতে।” 

— “আরেকটু সময় চেয়ে নিলে ভালো হতো।” 

— “সময় থাকলে তো চেয়ে নেবো। সামনের সপ্তাহ থেকে মেলা হবে ওখানে। পার্সেল পৌঁছানোর পর ক্লাইন্টেরও গোছগাছের একটা ব্যাপার আছে না!” 

— “তোরই দোষ। নিতে গেলি কেন ওর অর্ডার? নিজের কষ্ট, ওয়ার্কারগুলোরও কষ্ট।” 

— “আরেহ্ সারাবছর এত প্রেশার দেই নাকি ওদের? পুরোনো ক্লাইন্ট, ভালো প্রফিট হবে তাই আর বারণ করিনি। সবাইকে এ মাসে কিছু বাড়তি টাকা দিয়ে পুষিয়ে দেবো তো।” 

— “এবার কাল আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নে।”

— “সবকিছু কনফার্ম করার আগে আমাকে কেন জিজ্ঞেস করলে না, আম্মু?”

— “করেছি তো করেছি। এখন তুই আমার সঙ্গে যাচ্ছিস ব্যস।” 

— “নানু যাবে?” 

— “আম্মার কোমরের ব্যথা খুব বেড়েছে ইদানীং। বেশিক্ষণ বসতে পারে না। এতদূরের জার্নি খুব কষ্ট হয়ে যাবে উনার জন্য। 

— “নানুকে কার কাছে রেখে যাবে?” 

— “সকালে তোর ছোটমামা আসবে আম্মাকে নিতে।” 

— “শুধু শুধু নানুকে ঐ বাসায় কেন পাঠাবে? সেই-ই তো সিঁড়ি ভেঙে মানুষটার উঠানামা করতে হবে। এত কষ্টের কী দরকার? তারচেয়ে বরং মামাকেই বলো না মামীকে নিয়ে এই বাসায় দুই চারদিন থেকে যেতে।” 

— “হ্যাঁ, এটাও মন্দ বলিসনি। যাই, তোর মামাকে বলে দেখি। তুই উঠে ফ্রেশ হ।” 

— “মুন, আমার কথা শোনো।” 

— “তোর ব্যস্ততা আছে, আমার নেই?” 

— “বলছি তো ইমার্জেন্সি না হলে আমি তোমাকে মানা করতাম না। 

— “তো কর না কাজ। আমাকে কল করে বিরক্ত কেন করছিস?” 

— “স্যরি বেবি! এক্সট্রিমলি স্যরি!” 

— “আমি বিজি। সোজা কথা বুঝিস না তুই?” 

— “আমি জানি তুমি এখন ব্যস্ত না। চলো এক্ষুনি মিট করব আমরা। আমি আসছি তোমাকে পিক করতে।”

— “তোর চেহারা আগামী একমাস আমি দেখতে চাই না। তোর ছায়াও যেন আমার সামনে না আসে। খবরদার আর একটা কল তুই আমাকে করবি না। একদম ব্লকলিস্টে ফেলে দেবো।” 

অমিতকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কল কেটে দিলো মুনিয়া। তার নাম্বারে আবার ডায়াল করতে গিয়েও অমিত নিজেকে আটকায়, মনকে বোঝায়। সে জানে, মুনিয়া মিথ্যা হুমকি দেয়নি। যা বলেছে, সত্যি বলেছে। এখন কল করলে সত্যিই ব্লক লিস্টে ফেলে দেবে। হয়তো আগামী এক সপ্তাহেও আনব্লক করবে না। এতদিন মেয়েটার সঙ্গে কথা না বলে থাকা সম্ভব নাকি? নিঃশ্বাস আটকে আসবে না! তবে নিঃশ্বাস তো এখনও আটকে আসছে। মুনিয়ার সঙ্গে দেখা হয় না গুনে গুনে দশদিন কেটে গেছে। কঠিন ব্যস্ত সময় পার করছে মেয়েটা। এতদিন বাদে আজ যখন মুনিয়া অবসর সময় পেলো তার সঙ্গে দেখা করবার, ঠিক তখনই ক্লাইন্টের সঙ্গে মিটিং করতে ছুটতে হলো সিলেট। কাজ শেষ করে বিকেলের ফ্লাইটে ফিরে এল ঢাকা শুধু মুনিয়ার সঙ্গে দেখা করবে বলে। অথচ সে কিনা এল না। সাফ কণ্ঠে জানিয়ে দিলো দুপুরে একসঙ্গে লাঞ্চ করতে চেয়েছিলাম, তোমার সময় হয়নি আমাকে দেবার মতো, তাই আমারও আপাতত সময় হচ্ছে না। মাত্র তিনঘন্টা সময়ের ব্যবধান মুনিয়া মেনে নিতে চায়নি। অমিত জানে, মুনিয়া এখন হয়তো কোনো রেস্টুরেন্টে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। প্রাণ খুলে হাসছে, সেল্ফি তুলছে, পিৎজা স্লাইসে কামড় বসাচ্ছে। খুব সুন্দর একটা সন্ধ্যা কাটছে নিশ্চয়ই! অথচ মেয়েটা জানে, এই মুহূর্তে তাকে ভেবে ঘরের বাতি নিভিয়ে একরাশ মন খারাপ নিয়ে বসে আছে একজন। সে জানে আজ রাতে মানুষটা ঠিকঠাক ঘুমুতে পারবে না, রাগ ভাঙার আগ অব্দি মানুষটার খিদে লাগবে না, একের পর এক সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে তার সময় গড়াবে, কখনো কখনো হয়তো প্রচন্ড যন্ত্রণায় চোখের কোণ ভিজে উঠবে, বিষণ্নতায় ডুবে মদের গ্লাসে চুমুক দেবে। মুনিয়া জানে, তাকে পাশে বসিয়ে হাতে হাত রেখে কিছু মুহূর্ত কাটাবে বলে অমিত কতটা অস্থির হয়ে আছে। সে এও জানে, তাকে ২-৩ দিন চোখের সামনে না দেখলেই অমিত কষ্ট পায়। তার অবহেলা, রাগ কোনোটাই অমিত সহ্য করতে পারে না। অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মানুষটা হুটহাট অসুস্থ হয়ে যায়। তবুও মুনিয়া তাকে প্রচন্ড অবহেলায় ফেলে রাখে জীবনের এককোণে, নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে, রেগে গিয়ে বারবার অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, সম্পর্ক ভাঙতে চায়। মুনিয়া তাকে পোড়ায়, ইচ্ছে করেই পোড়ায়। তাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিতে চায়- সবটাই জানা আছে অমিতের। তবুও অমিত তার মুনিয়াকে ছেড়ে যেতে পারে না। অনেকগুলো দিন আগে মুনিয়া তাকে বেঁধে ছিল অসীম মায়ার বাঁধনে। সেই মায়া চিরতরে গেঁথে গেছে এই মনে। একদিন পুড়তে পুড়তে হয়তো সে সত্যিই ছাই হবে কিংবা ভাঙতে ভাঙতে গুড়িয়ে যাবে, তবুও এই মায়া বোধহয় কাটিয়ে উঠতে পারবে না অমিত। 

.

মসজিদের মাইকে মুয়াজ্জিন সাহেবের কন্ঠ শোনা যাচ্ছে, ‘একটি শোক সংবাদ! ১২৪, বরকত ভিলা নিবাসী আহসান বরকত ক্যান্সার আক্রান্ত হইয়া আজ সন্ধ্যায় ইন্তেকাল করিয়াছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’। 

মুখ বাকিয়ে হাসলো অমিত। মুনিয়ার দেয়া আংটিটায় চুমু খেয়ে বিড়বিড় করতে লাগলো, আমিও মায়া নামক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। মায়ার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে আহসান সাহেবের মতো আমিও ফট করে মরে যাব যখন তখন। 

— “রওনকের দাদা এত জাদরেল স্বভাবের লোক! এই জামানায় এত বড় ছেলেকে কেউ জোর করে বিয়ে দেয়, বলো?” 

— “উহুম, ঘোর অন্যায়।”

— “ওর ভীষণ মন খারাপ, জানো?” 

— “হবেই তো। সবসময় বলতো, সামি ভাই আমার লাভ ম্যারেজ হবে। পরিণীতি চোপড়ার মতোন শ্যামবর্ণের মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ের সঙ্গে প্রেম করবো। গ্র্যাজুয়েশন শেষ হলো আরো বছর তিনেক আগে। চাকরি বাকরি করছে অথচ এখনো একটা প্রেমিকা কেন জুটলো না, বলো তো নবনী? পরিণীতির মতোন কাউকে পায়নি?” 

— “কী সব যে বলো না! পরিণীতির মতোন কাউকে কোথায় পাবে ও?” 

— “পাবে না কেন? অবশ্যই পাবে। ক্যাটরিনা কাইফকে দেখার পর আমি শক্তপোক্ত দোয়া করেছিলাম, ইয়া খোদা আমাকে একটা ক্যাটরিনা কাইফের মতো প্রেমিকা জুটিয়ে দাও। আমার দোয়া কবুল হয়ে গেছে।”

— “আমাকে বলছো?” 

— “তো আর কাকে? আমার তো শুধু তুমিই আছো।” 

কাপড় লাগেজে গুছিয়ে রাখছিলো নবনী, সামির কথায় হঠাৎ থমকে গেল সে। মাথা নিচু করে ভীষন অভিমানে বলতে লাগলো, 

— “শুধু প্রেমিকা কেন চাইলে সামি? কেন বললে না তোমার একটা বউ চাই। বউ চাইলে হয়তো আজ আমি তোমার বউ হতাম, আমাদের বিয়েটা হয়ে যেত!” 

— “আবার কাঁদবে তুমি?” 

— “কেন কষ্ট পাও বলো তো? আছি তো আমি তোমার সঙ্গেই।” 

নবনী তাকালো না তার দিকে। হাত-পা গুটিয়ে বসে পড়লো ফ্লোরে। তার পাশে এসে বসলো সামি। 

— “ক্যাটরিনা তো হয়েছো আমি সবকিছু ছেড়ে আসার পর। যতদিন ছিলাম ততদিন হাতির বাচ্চা ছিলে। সময় নেই অসময় নেই আমার বুকে ৮৫ কেজি ওজনের শরীর নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে। আগে আমার বুকে ব্যথা ছিল না। সুস্থ সবল টগবগে যুবক ছিলাম। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক হবার পর আমার বুকের উপর তোমার ঝাঁপাঝাপিতে ব্যথা শুরু হলো। সেই যে শুরু হলো, এখনো ব্যথা সারেনি।” 

আড়চোখে সামির দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললো নবনী। তার কানের পাশে চুল গুঁজে দিতে দিতে সামি বললো, 

— “তুমি আমার রোদ্দুর। আমার মন খারাপের দিনগুলোতে তুমিই তো তুড়ি বাজিয়ে সব মন খারাপ উড়িয়ে দিতে। আমার সেই রোদ্দুরের মুখটা মেঘ কালো হবে, চোখ গাল বেয়ে কান্নাবৃষ্টি ঝরবে, সেসব আমার পছন্দ না। আমার রোদ্দুর শুধু হাসবে, চোখ জুড়ানো হাসি।” 

নবনী চেয়ে থাকে সামির দিকে নিষ্পলক। এতগুলো বছরের সম্পর্কে একবারের জন্যও এই চাহনি বদলায়নি। “তোমাকে ভালোবাসি” বলার দিন থেকে একই মায়া রয়ে গেছে আজ পর্যন্ত। ঝগড়াঝাটির সময়ও সেই মায়া সামির চোখ ছেড়ে যায়নি। এই চাহনির মায়ায় পড়েই তো প্রাণপণে ভালোবেসেছে তাকে। মনের চিলেকোঠায় পরম যত্নে ঠাঁই দিয়েছে। শতজনম আরাধনায় হয়তো অমন মানুষের ভালোবাসা মেলে। সে কোন আরাধনায় সামির ভালোবাসা পেয়েছিলো তা আজও অজানা। 

— “আমার দিকে তাকিয়ে রাত পার করে দেবে? কাপড় গোছাও জলদি। সকালে উঠতে হবে। রাত অনেক হয়েছে।” 

সামির তাড়ায় আবার কাপড় গোছানোয় মন দিলো নবনী। আলমারী থেকে জামা বের করার সময় কাপড়ের ভাঁজের ভেতর সামির দু’টো শার্টও বেরিয়ে এসেছে। কাপড় গোছাতে গোছাতে শার্টগুলোয় চোখ পড়লো নবনীর। নীল শার্টটা আলমারীতে রেখে, রক্তমাখা ছেঁড়া সাদা শার্টটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে। – “এই শার্টটা তুমি ফেলে কেন দাও না নবনী? এটা দেখে দেখে মন খারাপ করার মানে আমি খুঁজে পাই না।”

— “হোক মন খারাপ। তোমার শেষ স্মৃতি ফেলে দেবো কেমন করে?” 

অমিতের ফোন বাজছে। ঝাপসা চোখে স্ক্রিনে তাকালো সে। মা কল করেছে। কল রিসিভ করলে কণ্ঠ শুনেই মা বুঝে যাবে তার ছেলে কাঁদছিল। আপাতত কল রিসিভ না করাই শ্রেয়। রিং বাজতে বাজতে কল কেটে যাওয়ার খানিক বাদেই অমিতের দরজায় ধাক্কা পড়লো। 

— “ভাইয়া? এই শুনতে পাচ্ছো, ভাইয়া?” 

মা এবার অনির নাম্বারে কল করেছে নিশ্চয়ই! বিরক্তিতে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে এল অমিতের। শত অনিচ্ছায়ও উঠে গিয়ে দরজা খুলতে হলো তাকে। 

— “কী হয়েছে?” 

অমিতের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার দিকে চেয়ে রইলো অনি। চেহারা ঠিক 

স্বাভাবিক দেখাচ্ছে না। চোখজোড়া লাল হয়ে কিছুটা ফুলে আছে। দরজা আটকে কাঁদছিল নাকি? হ্যাঁ তাইতো মনে হচ্ছে! 

— “কথা বলছিস না কেন?” 

— “ওহ্! হ্যাঁ, হ্যাঁ। ঐ তো মা তোমাকে খুঁজছে।” 

— “লাইনে আছে?” 

— “না। তোমাকে বললো কল করতে। ইমার্জেন্সি। 

রুমের দরজায় দাঁড়িয়েই মাকে কল করলো অমিত। 

— “ঘরের দরজা আটকে বসে আছিস কেন?” 

— “এই কথা জিজ্ঞেস করতে কল করেছিলে?” 

— “কেন জিজ্ঞেস করতে পারি না?” 

— “বড় হয়েছি মা। এত বড় একটা ছেলেকে দরজা আটকে বসে আছিস কেন, এমন প্রশ্ন করা কি মানায়?” 

— “সমস্যা তো ওখানেই হলো রে বাপ। ছোটবেলায় ভালো ছিলি। মায়ের সঙ্গে সব সমস্যা শেয়ার করতি। মায়ের পরামর্শ শুনে সমস্যার সমাধান করতি। প্রয়োজনে তোকে দুই একটা চড়-থাপ্পর নির্দ্বিধায় মারতে পেরেছি। এখন তুই এডাল্ট। তোর জীবন সমস্যায় জর্জরিত, অথচ মায়ের কান পর্যন্ত সমস্যার কথা পৌঁছাতে চাস না। মা যদি কোনোক্রমে সিআইডিগিরী করে তোর সমস্যার কথা উদঘাটনও করি তবুও মায়ের কাছে স্বীকার করতে চাস না। মায়ের পরামর্শ শুনতেও চাস না। আর চড়- থাপ্পর তো থাক দূরের কথা! 

— “বলা শেষ? এবার কি ফোনটা রাখতে পারি?” 

— “বিরক্ত হচ্ছিস কেন? আচ্ছা কাজের কথায় আসি। কুমিল্লা যাচ্ছিস কবে?” 

— “যেতেই হবে?” 

— “অবশ্যই যেতে হবে।” 

— “আমার যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না মা।” 

— “কেন? সমস্যা কী?” 

— “রওনকের সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার। কথায় কথায় বলেছিল ওর এই বিয়েতে মত নেই। ওকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছে।” 

— “হ্যাঁ শুনেছি আমিও। তোর ফুফু কুমিল্লা যাবার আগে কার্ড নিয়ে এসেছিল বাসায়, তখন বললো সবকিছু। তালই সাহেব নাকি কাউকে কিছু না বলেই বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন। 

— “তুমিই বলো মা, এটা কোনো ন্যায়সঙ্গত কথা?” 

— “জানি তো বাবা। অন্যায় হচ্ছে, কিন্তু কী করবো? দাওয়াত দিয়েছে। আত্মীয় মানুষ, না গেলে খারাপ দেখায় না, বল?” 

— “তোমরা যাও। আমাকে আর অনিকে ছাড়ো। আপন চাচাতো ভাইয়ের বিয়ে তো আর না, বাবার চাচাতো বোনের ছেলের বিয়ে। আমি না গেলেও চলবে।”

— “মারবো এক চড়! ওদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি দূরের? কত আদর করে তোদের! আর রওনক? তোকে কত পছন্দ করে ছেলেটা। আর তুই এভাবে বলছিস অমিত!” 

— “ধুর মা! বাজেভাবে কথাটা নিয়ে নিলে। রওনককে আর শান্তা ফুফুর ফ্যামিলিকে আমি কত আপন ভাবি, সে কথা তুমিও জানো। সমস্যা অন্যখানে। তোমাকে সে কথা বললে হেসে উড়িয়ে দেবে, তাই বলছি না।” 

— “কী?” 

— “ফুফুর শ্বশুর। এই বুড়োকে আমি চারআনা বিশ্বাস করি না, সহ্যও করতে পারি না। পুরো বংশের মানুষদের কী অত্যাচার করে এই লোকটা। ঐ বাড়িতে গেলে বারবার লোকটার মুখোমুখি আমাকে হতে হবে। বিশ্রী ব্যাপার! আর সবচেয়ে ভয়ে কী নিয়ে আছি, জানো? লোকটার ধরে বেঁধে মানুষকে বিয়ে দেয়ার স্বভাব। অনিকে বিয়ের উপযুক্ত পেয়ে যদি ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেয়!” 

— “পাগল তুই! ও আমাদের মেয়ে। ওকে কিভাবে উনি ধরে বেঁধে বিয়ে দেবে?” 

— “জানি না মা। ওখানে যাওয়ার ব্যাপারে খুব একটা পজিটিভ ভাইভ আমি পাচ্ছি না।” 

— “সারাক্ষণ মেন্টাল প্রেশারে থাকলে মাথায় ভালো চিন্তা আসবে না অমিত। বাজে লোকদের পাল্লায় পড়ে মাথাভর্তি তোর বাজে চিন্তা বোঝাই হয়ে গেছে।’ 

— “তুমি আবার মুনকে খোঁচা মেরে কথা শোনাচ্ছো!” 

— “তোর মুনের নাম আমি নিয়েছি?” 

— “তাতে কী? বুঝি আমি সব।” 

— “ছাড় ওসব কথা। তোর বাবা আর আমি কাল যাচ্ছি। তুই নাহয় পরশু চলে আয়।”

— “পরশু গায়ে হলুদ না?” 

— “হ্যাঁ।” 

— “আচ্ছা আসবো। রাখি তাহলে।” 

কল কেটে অনির দিকে তাকালো অমিত। 

— “ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে রাখিস। পরশু যাচ্ছি রওনকের দাদা বাড়ি।” 

— “তুমি কাঁদছিলে?” 

অনির প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না অমিত। মাথা নিচু করে রইলো। তার পাশে এসে বসলো অনি। 

— “ঐ লোকটার সঙ্গে আজও ছবি আপলোড করেছে তোমার গার্লফ্রেন্ড। দেখেছি আমি। ছবি দেখেই কাঁদছিলে, তাই না?” 

— “মুন ঐ লোকটার সঙ্গে সরাসরি প্রেমে না জড়ালেও সম্পর্ক বেশ গভীর। এক হিসেবে প্রেম বললেও ভুল হবে না। কথাটা তুমিও জানো ভাইয়া। তবুও কেন জোর করে ওর সঙ্গে সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখছো, বলো তো? সবকিছু দেখা সত্ত্বেও অন্ধের মতো বেঁচে আছো তুমি। 

— “সবকিছু এত সহজ? মুনকে কিভাবে ভুলবো আমি?” 

— “তুমি তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছো এটা মেনে নেয়াও আমাদের জন্য সহজ না। মা-বাবা তোমাকে নিয়ে কত দুশ্চিন্তায় ভোগে, তুমি জানো? 

— “এত যন্ত্রণা আমিও তো আর নিতে পারছি না অনি। মানুষের জীবনে নাকি মিরাকেল ঘটে। আমার জীবনে কেন ঘটে না? সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি কেন পাই না? মুন আমাকে বিয়ে করতে রাজি কেন হয় না? ও আমাকে আগের মতো কেন ভালোবাসে না? আমি খুব করে চাই আমার জীবনে একটা মিরাকেল হোক। কোনো একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে যেন দেখতে পাই, আজ আমার বিয়ে।” 

ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৫

গতকাল সাড়ে ছয়টায় বাসা থেকে বেরোবার কথা বললেও, বাবার পীড়াপীড়িতে ভোর সাড়ে পাঁচটায় বাসা থেকে বেরিয়েছে নবনীরা। পথে ব্যস্ততা বেড়ে যাবার আগেই শহর ছেড়ে গাড়ি গ্রামের পথ ধরেছে। বেলা দশটা বাজার আগেই ফুফুর বাড়ির চৌকাঠ পেরিয়েছে ওরা। নাস্তা শেষে পুকুরঘাটে এসে বসেছে নবনী। গুনগুন করতে করতে পুকুরঘাটের ওপাশে আম গাছটায় তাকিয়ে আছে সে। গাছের ডালে পাশাপাশি গা ঘেঁষে বসে আছে দু’টো শালিক। ওদের দেখে নিজের জন্য কেমন মায়া হচ্ছে নবনীর। পাশেই নাতাশা বসে কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছিল। নবনী হাত চেপে ধরলো ওর। বোনের স্পর্শে পাশ ফিরে তাকালো সে। দূরে কোথাও দৃষ্টি তার। কী যেন বলছে! তড়িঘড়ি করে কান থেকে ইয়ারফোন খুলে বললো, 

— “কী বলছিলে আপু? আবার বলো।” 

— “শুনিসনি?” 

— “কানে ইয়ারফোন, শুনবো কী করে?” 

— “অহ্। খেয়াল করিনি আমি।” 

— “এবার বলো?” 

— “ঐ তো শালিক জোড়ার কথা বলছি। দেখতে পাচ্ছিস?” 

পুকুরের ওপারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শালিকজোড়া খুঁজতে লাগলো নাতাশা। চোখজোড়া ছোট করে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, 

— “হুম, হুম। ঐ তো দেখা যাচ্ছে।” 

— “ওদের দেখে নিজের কথা মনে পড়ে গেল।” 

— “কী কথা?” 

— “এনগেজমেন্টের মাসখানেক পর নানার মৃত্যুবার্ষিকীতে বড় মামা সামিদের দাওয়াত করে নানাবাড়ি নিয়ে গেল না?” 

— “হুম।” 

— “কাঁচা আমের সিজন ছিল।” 

— “হ্যাঁ মনে আছে।” 

— “বাগান থেকে আম পেড়ে ওখানেই ভর্তা মাখানো হলো।” 

— “আর সামি ভাইয়া তোমাকে বললো, গাছে বসে ভর্তা খেলে ভর্তার টেস্ট দ্বিগুন হয়। ভাইয়ার কথা শুনে উনার পেছন পেছন লাফাতে লাফাতে উঠে বসলে আমগাছের ডালে।” 

— “ও মা! মনে আছে তোর?” 

— “আমার সব মনে আছে আপু। সেদিন ভাইয়া এ্যাশ কালার টি শার্ট আর ব্লু জিন্স পরেছিল। আর তুমি পিংক কালার হাতের কাজের থ্রি পিস পরেছিলে। ভাইয়া তোমাকে কানে কানে কী যেন বলছিল একটু পরপর। আর তুমি হেসে কুটিকুটি হচ্ছিলে।” 

নবনীর চোখে আলোর ছটা, ঠোঁটে বিস্তৃত হাসির রেখা। নাতাশা দেখছে তাকে। চোখজোড়া যেন ভীষণ উচ্ছ্বাসে বলছে, তুই মনে রেখেছিস আমাদের গল্পটা! চোখ ফিরিয়ে নিলো নাতাশা। ভেজা চোখ বোনকে দেখাতে চায় না সে। মানুষটা নেই প্রায় আটবছর। তবুও তার কথা মনে পড়লেই ভেতর দুমড়ে মুচড়ে কান্না পায়। কত কত স্মৃতি ঐ মানুষটার সঙ্গে। বাসার কেউ আজও তাকে ভুলতে পারেনি। একদিনের জন্যও না। আর তার বোন! বেঁচে আছে তার রেখে যাওয়া সমস্ত স্মৃতি নিয়ে, কল্পনায় তাকে বাঁচিয়ে রেখে। 

— “কখন এসেছো তোমরা?” 

পেছন ফিরে তাকালো নবনী, নাতাশা। ভ্রু জোড়া নাচিয়ে নবনী বললো, 

— “আহ্! রিনরিনে কন্ঠের রিনি যে! কেমন আছো তুমি?” 

কানে স্বর্ণের ভারী ঝুমকায় হাত বুলাতে বুলাতে রিনি বললো, 

— “আছি, খুব ভালো আছি। তুমি?” 

— “এতক্ষণ খুব ক্লান্ত লাগছিল। এখন তোমাকে দেখে বেশ চাঙ্গা লাগছে। কী সুন্দর সেজেছো! ইশ্! কি মিষ্টি দেখাচ্ছে তোমাকে! কানের ঝুমকা জোড়ায় কত ভরি আছে?” 

— “এক ভরি চার আনা।” 

— “তোমাকে ভীষণ মানিয়েছে।” 

— “হ্যাঁ, বিয়েতে আসবো তাই বর কিনে দিলো।” 

— “কী জাদুসোনা বর তোমার! অবশ্য এত সুন্দর বউ পেলে সব ছেলেরাই জাদুসোনা হয়ে যায়। এইতো দেখোই না, আমাদের নাতাশাকে! ও তো তোমাকে দেখে আর মুখে কথাই ফুটছে না। হা হয়ে দেখছে তোমাকে।” 

— “হ্যাঁ আপু, ও আমাকে খুব ভালোবাসে। এই হাতের বালাগুলোও তো বানিয়ে দিলো বিয়েতে আসবো বলে।” 

— “ওহ্ নো! আমি তো চুড়িগুলো দেখিইনি। গ্রেট মিস।”

— “চুড়ি না আপু, এগুলো বালা।”

— “ওহ্ গড! কী মূৰ্খ আমি! কিছুই চিনি না।” 

— “বালা জোড়ায় তিন ভরি আছে।” 

— “অনেক সুন্দর, চমৎকার, ফ্যান্টাস্টিক! আর কয়দিন বাদে আমরা শুনবো রিনির রূপে পাগল হয়ে শাকিল ভাই তাজমহল বানিয়ে ফেলেছে।” 

রিনির পাশে এসে দাঁড়ালো তার মা রাশেদা খানম। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, 

— “হ্যাঁ দেবেই তো। এমন মেয়ে জগত সংসার ঘুরে কেউ কোথাও পাবে নাকি?”

— “সে কথা তো আমিও বলছি চাচী।” 

— “চল রিনি, খাবি কিছু। তোর ফুফু টেবিলে খাবার দিয়েছে।” 

মায়ের হাত ধরে চলে যাচ্ছে রিনি। নাতাশা একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ওদের চলে যাওয়ার পথে। নিচুস্বরে বলতে লাগলো, 

— “দুই মা-মেয়ের শো অফ দেখলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। দেখলি, সামনে এসেই কেমন ট্রিক্স করে কানের জিনিসগুলো দেখাচ্ছিল? মানুষ তো না, যেন স্বর্ণের দোকান! সারাদিন অকারণে এত ভারী গয়না পরে কিভাবে বেঁচে আছে, কে জানে? আমি হলে গরমে মারাই যেতাম।” 

— “এই হলো ফকিন্নির লক্ষ্মণ। তুই ফকিন্নি তাই গয়না পরলে মরে যাবি। আর চাচী হলো জমিদার বাড়ির লোক। শুনিস না, সুযোগ পেলেই কেমন গলা ছেড়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, আমি জমিদার বাড়ির মেয়ে। আমার সঙ্গে এই বাড়ির কোনো বউদের তুলনা চলবে না। জমিদার বাড়ির লোকেরা গয়না না পরতে পারলে মরে যায়। তবে তুই একটা পাজি স্বভাবের ফকিনি। রিনি মেয়েটা একটু প্রশংসা শুনবে বলেই তো কানের জিনিস, হাতের বালা দেখাচ্ছিল। করলি না কেন একটুখানি প্ৰশংসা?” 

— “তুই প্রশংসা করেছিস না খোঁচা মেরেছিস, তা আমি ভালোই জানি।” 

.

ঘরে ফিরে মেয়ের মাথায় সজোরে চাটি মারলেন রাশেদা। অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকালো রিনি। 

— “কী সমস্যা মা?” 

— “কোনটা প্রশংসা আর কোনটা টিটকারি এতটুকু বোঝার বয়স তোর হয়নি?” 

— “নবনী আপু আমাকে খোঁচা মেরে কথাগুলো বলছিল, তা আমি বেশ বুঝেছি মা। ও আমাকে নিয়ে জেলাস। ওকে আরো পোড়ানোর জন্যই ওখানে দাঁড়িয়ে আমার গোল্ডগুলো দেখাচ্ছিলাম।” 

— “জেলাস তো হবেই। নিজের বিয়ে শাদীর খবর নেই। ঘরে বসে বুড়ি হচ্ছে, স্বামী-সন্তান এখনো ভাগ্যে জোটেনি। অন্যের সুখ কি আর সহ্য হবে? আয় দেখি, কাছে আয়। একটু থুতু দিয়ে দেই। নজর-টজর লেগে গেলে আরেক বিপদ!” 

কানে ইয়ারবাড গুঁজে গান শুনতে শুনতে নিজেও গুনগুন করে গাইছিল নবনী। দুপুরের খাওয়া শেষে একটু একটু ঝিমুনি লাগছে। যদিও দুপুরে ঘুমানোর অভ্যেস খুব একটা নেই। তবুও চোখ বুজে আয়েশ করতে বেশ লাগছে। হঠাৎ মা এসে কান থেকে টেনে একটা ইয়ারবাড খুলে ফেললো। প্রচন্ড বিরক্তিতে চোখ মেললেও পরবর্তীতে চোখ আর চেহারার ভাঁজ স্বাভাবিক করে ফেললো নবনী। মা একা আসেনি, সঙ্গে শামীমা চাচীকেও নিয়ে এসেছে! 

— “দেখ কে এসেছে!” 

একগাল হেসে সুন্দর আন্তরিকতায় শামীমাকে নবনী জিজ্ঞেস করলো, 

— “কেমন আছেন আপনি?” 

— “খুব ভালো মা। তুমি ভালো আছো?” 

— “জি। আপনাকে বহুবছর পর দেখছি চাচী!” 

— “হ্যাঁ। ৮-১০ বছর তো হবেই!” 

— “তোমার ছেলের ফ্ল্যাটে আসো অথচ তুমি আমার বাসায় আসো না! শুধু ফোনে ফোনেই তোমার কথা। মাঝেমধ্যে বাসায় আসতে হয় না!” 

— “থাকি না তো এখানে খুব একটা, আসি হয়তো তিন চারমাসে একবার। খুবজোর দুইদিন থেকে তারপর চট্টগ্রাম ফিরে যাই।” 

— “তবুও আসবেন চাচী। দুইদিনের মাঝেই একটুখানি সময় বের করে চলে 

আসবেন। নয়তো হাতে আরো দুইদিন সময় নিয়ে আসবেন শুধু আমাদের বাসায় বেড়ানোর জন্য।

— “আসবো মা। কতবার তোমার মাকে বলি আপনারা আসবেন আমার ছেলের বাসায়, দেখা করে যাবেন আমার সঙ্গে। তোমার মা আসে না, তোমরাও আসো না। আমার মেয়েটা ভার্সিটি থেকে ফিরে এলে একাই থাকে। এদিকে তোমরা ছাড়া আর কোনো আত্মীয়রা কাছাকাছি থাকে না। তোমরা মাঝেসাঝে ওখানে গেলে আমার মেয়েটারও সময় কাটে।” 

— “ওহ হ্যাঁ! অনির কী খবর? ভালো আছে?” 

— “হ্যাঁ ভালো।

— “ও কী করছে এখন?” 

— “অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে আছে। আসছে আগামীকাল। আমার ছেলেও আসছে ওর সঙ্গে। তুমি কী করছো? শুনলাম বুটিক আছে! অনি প্রায়ই তোমাদের লাইভ দেখে, আমাকেও দেখায়। ভালেই লাগে দেখতে।” 

— “বুটিক না আন্টি। আমি বুটিকগুলোতে সাপ্লাই দেই। বাসার কাছেই ছোট্ট একটা কারখানা আছে। আর লাইভ করি যে ড্রেসগুলো সেল হয় না সেগুলো নিয়ে। ছোট্ট কোনো ডিফেক্ট থাকে সেগুলো। তুলনামূলক কম দামে সেল করলে সব ড্রেস একদিনের ভেতর স্টক আউট হয়ে যায়।” 

— “বাহ্! বিজনেস করছো অনেকদিন হলো, তাই না?” 

— “জি।” 

.

নবনীর সঙ্গে দীর্ঘ হচ্ছে কথোপকথন। ভীষণ ভালো লাগছে মেয়েটাকে। কথাবার্তা মার্জিত গোছানো। শিক্ষিত আর স্বনির্ভর। উজ্জ্বল শ্যামলা মিষ্টি মুখটার দিকে চেয়ে থাকতে ভালো লাগছে শামীমার। আচ্ছা, এই মেয়েটা অমিতের বউ হলে কেমন হয়? সুন্দর হবে ব্যাপারটা। পরিবার ভালো, জানাশোনা আছে তাদের, মেয়েটাও লক্ষ্মী। বলা যায় সবদিক প্রায় মিলেই যাচ্ছে। শামীমার কী যেন হলো! নবনীর সঙ্গে গল্পের ফাঁকেই জরুরি কাজের দোহাই দিয়ে বেরিয়ে এল সে। সঙ্গে নিয়ে এল নীতুকেও। মাথায় অমিত-নবনীর বিয়ের ভাবনাটার সঙ্গে সর্বোচ্চ দশ মিনিট এক্কাদোক্কা খেলে নীতুর কাছে এক্ষুনি এই মুহূর্তে প্রস্তাব দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো শামীমা। যে ঘরে তারা উঠেছে সেই ঘরে ফিরে নীতুকে শামীমা বললো, 

— “একটা কথা বলবো ভাবী?” 

— “কী?” 

— “ওরকম ঘটা করে কিছু না। তুমি যদি সায় দাও তাহলে ঘটা করে বলবো।”

— “কী?” 

— “আমার অমিতকে দেখেছেন তো, তাই না?” 

— “হ্যাঁ।” 

— “আমার ছেলেটা দেখতে কিন্তু বেশ সুন্দর। চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশে অনার্স-মাস্টার্স করেছে। এখন একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে আছে। মাসে বেশ মোটা অঙ্কের স্যালারী পাচ্ছে। ভালো সুযোগ-সুবিধাও পাচ্ছে। ফ্ল্যাট তো কিনেই দিয়েছি ওকে। গাড়িও কিনেছে আমার ছেলে। ওর আচার ব্যবহার ভীষণ অমায়িক।” 

হঠাৎ এ সমস্ত কথা বলার কারণ খুঁজে পায় না নীতু। তবুও মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখলো সে। মাথা ঝাঁকিয়ে শামীমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললো, 

— “ওমা তাই! ভালোই তো।” 

— “আপনার নবনীকে, অমিতের জন্য আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। সম্বন্ধটা হলে 

মন্দ হবে না। শামীমার আকস্মিক প্রস্তাবে অপ্রস্তুত হয়ে গেল নীতু। চেহারায় স্পষ্ট সেটা প্রকাশ পাচ্ছে। আশপাশ একবার দেখলো সে। নবনী কোথাও নেই তো? শুনে ফেলেনি তো কথাটা? শুনলে বিপদ হয়ে যাবে। কথার প্রসঙ্গ বদলাতে হবে। মেকি হাসলো নীতু। কৌশলে এড়িয়ে যেতে লাগলো প্রস্তাবটা। 

— “নবনী এখনই বিয়ে শাদী করবে না। “কেন? বিয়ের বয়স তো হয়েছেই।”

— “ও আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে চায়।” 

— “আর কিসের অপেক্ষা? পড়া শেষ, ক্যারিয়ার গোছানো হয়ে গেছে, বাকি রইলো বিয়ে। এবার সংসার জীবন গুছিয়ে নিলেই হয়। 

— “যার জীবন সে গুছিয়ে না নিতে চাইলে আমি আর কী করবো, 

বলো?” নীতুর ক্রমশ শুকিয়ে আসা মুখ কিংবা হতাশ কন্ঠস্বর কোনোটাই চোখ এড়ায় না শামীমার। পরিস্থিতি হালকা করতে ব্যস্ত হয়ে বলে, 

— “আমি শুধু এমনিই বললাম আর কি! নবনীকে ভালো লেগেছে তাই। মিষ্টি মেয়ে! সবারই পছন্দ হবে। আপনি এত ভাববেন না তো। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে। ওদের সিদ্ধান্তগুলো ওরাই ভালো বুঝবে।” 

***** 

— “তুমি পাগল?” 

অবাক ভঙ্গিতে শামীমাকে প্রশ্নটা করলো তার স্বামী এরশাদ। ফিক করে হেসে দিলো শামীমা। 

— “হ্যাঁ হঠাৎ কী কান্ড করে বসলাম না, বলো?” 

— “এভাবে বিয়ের প্রস্তাব কে দেয়?” 

— “আমি দেই।” 

— “সাহস কম না তোমার। ভাবী যদি রাজি হয়ে যেত? কেমন কেলেংকারী হতো, জানো? অমিত কখনোই রাজি হতো না। তখন শুধু শুধু দুই পরিবারে দ্বন্দ্ব হতো।”

— “নবনীকে আমার কী যে ভালো লেগেছে! বারবার মনে হচ্ছে এই মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে হলে আমার ছেলে সুখে থাকবে। মুনিয়া ওকে সুখ দিবে না। তুমি দেখো অমিতকে, কেমন কষ্টে থাকে ও? মুখে হাসি নেই, আগের মতো প্রাণোচ্ছলতা নেই। পুরোনো অমিত মরে গেছে মুনিয়ার পাল্লায় পড়ে।” 

— “নবনীকে দেখেছি আমি। তোমার আজ ইচ্ছে হয়েছে ওর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে। আমার সেই কবেই এমন ইচ্ছে হয়েছে। ঢাকায় গেলে আমি যাই মাঝে সাঝে শফিক ভাইয়ের ওখানে। মেয়েটাকে সে সুবাদে কয়েকবার দেখা হয়েছে। দারুণ লাগে আমার। কিন্তু কিছু করার নেই, অমিত ঐ পথ ছাড়ছে না। নিজের কপাল নিজেই পুড়তে চায়। হাজার বুঝিয়ে কোনো ফায়দা হয়নি। উল্টো তুমি আমি ওর কাছে খারাপ হয়ে গেছি। ভালোই হলো ভাবী রাজি হয়নি। বাদ দাও এসব। 

আজ রওনকের গায়ে হলুদ। পুরো বাড়ি জুড়ে হৈ হুল্লোড় চললেও সবকিছু থেকে দূরে সরে আছে অমিত। মুনিয়ার সঙ্গে এখনো যোগাযোগ হয়নি। এই মুহূর্তে এইসব আনন্দ, হাসি, হৈচৈ বিষের মতন ঠেকছে অমিতের। বাড়ির পেছনে এই নির্জন দুপুরে পুকুর পাড়ে বসে আছে অমিত। পাখির ডাক আর বাতাসের শো শো শব্দে অবশ্য একেবারে নির্জনও লাগছে না। গাছের আড়াল গলে রৌদ্র-ছায়ার লুকোচুরি খেলা চলছে তার গায়ে। ঘরের ভেতর বসে, পেছনের জানালা দিয়ে সেই খেলা দেখছে নবনী। অনির সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ ছিল না এই কয়বছর। কিন্তু গতরাতে এখানে আসার পর ওর সঙ্গে ভীষণ ভাব হয়ে গেছে দুই বোনের। বিশেষ করে নাতাশার সঙ্গে। সারাক্ষণ একসঙ্গেই থাকছে দুজন। এই তো এখনও খেয়ে দেয়ে লুডো খেলছে একসঙ্গে বসে। নবনী কখনো বসে ওদের লুডো খেলা দেখছে আবার কখনো অমিতকে দেখছে। দেখতে দেখতে হঠাৎ অনিকে জিজ্ঞেস করে ফেললো নবনী, 

— “অমিত ভাইয়া কোনো কারণ আপসেট?” 

লুডোর গুটি চালতে চালতে অনি বললো, 

— “কেন বলো তো?” 

— “দেখে মনে হচ্ছে। এই সময়ে একা বসে আছে এখানে। কাকে যেন বারবার কল করছে। একা বসে আছে সেটা সমস্যা না। সমস্যা হলো উনাকে খুব উদাস দেখাচ্ছে। ঠিক দেবদাসের মতো। গতকাল চাচী যখন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল তখনও দেখলাম মনে কোনো আনন্দ নেই। কারো সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নেই। জোর করে কথা বলছে, পরিচয় হচ্ছে।” 

— “হ্যাঁ, ও একজন দুঃখী পুরুষ।” 

হেসে ফেললো নাতাশা আর নবনী। নাতাশা বললে, 

— “এভাবে খোঁচা দিয়ে বলছো কেন?” 

— “সেধে সেধে যে কষ্ট পায় তাকে এভাবেই বলবো।” 

— “কী হয়েছে?” 

— “গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে ঝগড়া। যদিও হরহামেশাই হয়। আর ভাইয়ার মন খারাপ নতুন কিছু না। ভাইয়া মন খারাপ করে বসে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। বরং ওকে হাসতে দেখলে অস্বাভাবিক লাগে।” 

— “গার্লফ্রেন্ড পাত্তা দেয় না?” 

— “একদম না। ও হাত-পায়ে ধরে ঐ মেয়ের সঙ্গে ঝুলে আছে।” 

— “টক্সিক রিলেশন টিকিয়ে রাখার মানে একদম বুঝি না!” 

— “ওর ভালো লাগে টিকিয়ে রাখতে।” 

লুডো খেলতে খেলতে অমিতকে নিয়ে অনি আর নাতাশার আলাপ আলোচনা চলছে। ওদের কথা এড়িয়ে কানে ইয়ারবাড গুঁজলো নবনী। ফেসবুকে ওর ক্লাইন্টদের পেজগুলো দেখতে লাগলো, কোন পেইজে ওর তৈরী করা কুর্তীগুলো কত দামে বিক্রি হচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে অমিতের দিকেও চোখ যাচ্ছে তার। ফোনটা এখন আর অমিতের হাতে নেই। রেখে দিয়েছে পাশে। ওর জন্য একটুখানি খারাপ লাগলো নবনীর। লোকে ভালোবাসে সুখী হওয়ার জন্য। ভালোবাসায় কেন কারো এত ঝগড়া হবে, কষ্ট পেতে হবে? 

ভরা পূর্নিমার রাত। অক্টোবরের শেষ সময় চলছে। গ্রামে এই সময়টাতে রাতের বেলায় শীত-শীত লাগলেও, অমিতের বিন্দুমাত্রও তেমন অনুভূতি হচ্ছে না। মুনিয়া নামক দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে ক্ষণে ক্ষণে গলা টিপে ধরা অনুভূতি হচ্ছে। গত তিনরাত যাবৎ না ঘুমিয়ে ঘাড়ের পেছনে তীব্র ব্যথা চেপে বসেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে কিছুক্ষণ পরপর মাথা ঘুরিয়ে বমিভাব। গতরাতে নিচতলায় অপরিচিত কয়েকজনের সঙ্গে রুম শেয়ার করে বড্ড অস্বস্তি হয়েছে গোটা রাত। আজ তাই সন্ধ্যা বেলাতেই রওনককে বলে ছাদের চিলেকোঠার কামড়াটার তালা খোলার বন্দোবস্ত করেছে সে। বাড়ির কাজের লোক ঘর সাফ করে যাবার পরপরই ব্যাগ নিয়ে চলে এসেছে এখানে। মুনিয়ার সঙ্গে কথা হয় না আজ তিনদিন পেরিয়ে গেল। একে তো কল রিসিভ করছে না, তার উপর মরার উপর খাঁড়ার ঘা হলো নেটওয়ার্ক। এখানে আসার আগে একদম খেয়াল ছিল না, এই গ্রামে নেটওয়ার্কের ঝামেলা খুব বেশি। খেয়ালে থাকলে কখনোই বিয়েতে আসতো না। রওনকের বিয়ের চেয়ে মুনিয়ার এক মিনিটের ফোনকল অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট। মুনিয়া কি কল করেছিল? সুইচ অফ পেয়ে আবারও রেগে গেছে? এমন কিছু কি হলো? কাল্পনিক সব ভাবনায় রাগে এই এলাকার নেটওয়ার্ক টাওয়ার আছড়ে ভেঙে ফেলতে মন চাইছে অমিতের। ছাদ ঘরে আসার সময়ও ভেবেছিল গতরাতের মতো আজ রাতটাও হয়তো নেটওয়ার্ক ছিন্ন হওয়া মোবাইল হাতে সারারাত বসে থাকতে হবে না। খোলামেলা আর উঁচু জায়গায় থাকার সুবাদে হয়তো নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে। এখানে এসেও খুব একটা সুবিধা করা যাচ্ছে না। এই অন্ধকার মাঝরাতে ছাদে দুই পা ছড়িয়ে বসে আছে সে। সন্ধ্যা থেকেই শরীরটা বেশ খারাপ লাগছিল, অসুস্থতা বুঝি এখন আরো বেড়েছে। বিপি লো হয়েছে নিশ্চয়ই! জেগে থাকলে মুনিয়ার দেয়া কষ্ট কিংবা সিম কোম্পানির উপর তীব্র ক্ষোভ কোনোটাই কন্ট্রোল করা সম্ভব না। ঘাড় ব্যথা কিংবা মাথা ঘুরানো কোনোটাই আর সহ্য করাও সম্ভব হচ্ছে না। ঘুম প্রয়োজন তার, লম্বা ঘুম। ঢাকা থেকে আসার সময় ব্যাগে করে স্লিপিং পিল নিয়ে এসেছিল অমিত। ছাদ থেকে টলতে টলতে ঘরে এসে দু’টো স্লিপিং পিল পানির সঙ্গে ঘটঘট করে গিলে নিলো। গায়ের গেঞ্জিটা খুলে চেয়ারের উপর ছুঁড়ে, বিশাল আকৃতির খাটের ওপাশে, দেয়ালে গা ঘেঁষে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে পড়লো সে। 

.

বিয়ে বাড়ির সবাই গভীর ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। নাতাশা আর অনির মাঝে শুয়ে আছে নবনী। মেয়ে দুটো দুপাশ থেকে তার উপর হাত-পা রেখে আরাম করে ঘুমুচ্ছে। নাতাশার কোলবালিশ জড়িয়ে ঘুমুবার অভ্যেস। অনিরও হয়তো তাই। বেচারীরা এ বাড়িতে কোলবালিশ না পেয়ে ঘুমের ঘোরে তাকেই কোলবালিশ বানিয়ে ফেলেছে। রাতে একা ঘুমুবার অভ্যেস নবনীর। গতরাতে মেয়েগুলো এভাবে ওকে জাপটে ধরে ঘুমুচ্ছিল, আজ রাতেও তাই করছে। গতকাল খুব একটা সমস্যা না হলেও আজ ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। অস্বস্তির কারণ দুপাশের মেয়ে দুটো নাকি অন্যকিছু সে কথা ভাবতে ভাবতেই খুব সাবধানে দু’জনকে ছাড়িয়ে, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল নবনী। বারান্দায় মাত্রই একটু আয়েশ করে বসেছিল, তখনই গলা খাকাড়ির শব্দে উঠোনের বাম দিকে ঘাড় ফেরালো সে। দেখলো, রওনকের দাদা টর্চ হাতে এদিকেই আসছে। তড়িঘড়ি করে এক দৌড়ে ছাদের সিঁড়ির দিকে চলে গেল নবনী। এত রাতে তাকে বাইরে বসে থাকতে দেখে নিশ্চয়ই শ’খানেক প্রশ্ন করা হবে। তারচেয়ে বরং এখানে লুকিয়ে থাকাই ভালো। 

.

রমিজ মির্জা ঘরের ভেতর চলে যাবার পর বারান্দার দিকে পা বাড়াতে গিয়েও থেমে গেল নবনী। বাড়ি ভর্তি মানুষ, যখন তখন যে কেউ প্রয়োজনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবে। তাদের মুখোমুখি হতে হবে, রাত কেন জাগছে সে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। অহেতুক ঝামেলায় না জড়িয়ে ছাদে চলে গেলেই তো হয়! এতরাতে কেউ যাবে না সেখানে। মোবাইল টর্চ জ্বালিয়ে এক দৌড়ে ছাদে চলে এল নবনী। বাইরে বেশ ঠান্ডা। ছাদজুড়ে বিছিয়ে আছে জোৎস্না। চাঁদ তার রূপালী আলো ছড়িয়ে দিয়েছে এই প্রকৃতিতে। একটুখানি হাসি ছড়িয়ে পড়লো নবনীর ঠোঁটের কোণে। মৃদু শীতলতা, পূর্ণিমার আলো, ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক, হাসনাহেনার মিষ্টি ঘ্রাণ, কোলাহলহীন আশপাশ। অদ্ভুত সুন্দর এই রাতটা হয়তো গ্রামে না এলে দেখাই হতো না। ছাদের মধ্যখানে আসন পেতে বসে পড়লো নবনী। নিষ্পলক চেয়ে রইলো গোল চাঁদটার দিকে। রওনকের আজ বাসর। ওরা কি জেগে আছে নাকি ঘুমুচ্ছে, সে কথা জানা নেই নবনীর। সামি বলতো, ভাগ্য গুনে বিয়ের রাতে ভরা পূর্ণিমার আলো মেলে। বাসর ব্যাপারটাই সুন্দর, তার উপর যদি পূর্ণিমা থাকে তাহলে একদম জমে ক্ষীর। অমন সুন্দর রাতে ঘুমুতে হয় না। পূর্ণিমা প্রতিমাসে এলেও, বাসর জীবনে শুধু একবারই পাওয়া যায়। নবনীরও ইচ্ছে হচ্ছে রওনককে এক্ষুনি কল করে জিজ্ঞেস করতে, এই তোরা ঘুমিয়ে পড়েছিস? সামি বলেছে, অমন সুন্দর রাতে ঘুমুতে হয় না। বাসর জীবনে আর তোরা পাবি না। জেগে থাক, ভোর অব্দি জেগে থাক। চাঁদ ডুবে গেলে, প্রথম ভালোবাসার রাতটা কেটে গেলে তারপর ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিস। 

.

— “এতরাতে ছাদে এলে যে?” 

সামির কন্ঠ পেয়েও ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতে ইচ্ছে হয় না নবনীর। চেয়ে থাকে চাঁদের দিকে। 

— “কথা বলছো না কেন? 

— “অস্বস্তি লাগছিল খুব। অনি, নাতাশার কোলবালিশ হয়ে আর সাপোর্ট দিতে পারছিলাম না, তাই চলে এসেছি।” 

— “অস্বস্তির কারণ অনি, নাতাশা নাকি অন্যকিছু?” 

— “আমিও তাই ভাবছিলাম, জানো? অস্বস্তি আমার দুপুর থেকেই হচ্ছে। রওনকের বউ যখন কবুল বলছিল, আমি ওর সামনে ছিলাম। তখন থেকেই আমার অস্বস্তি হচ্ছে। ভালো লাগছে না কিছু।”

— “সমস্যা অনি, নাতাশা না, সমস্যা একান্তই তোমার নিজের। এতগুলো বছরে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে কাউকে কবুল বলতে শোনা হয়নি তোমার। ওর মুখে কবুল শুনে নিজের জন্য কষ্ট পাচ্ছো তুমি।” 

— “হ্যাঁ, সে কথা তো একটু-আধটু মনে পড়েছেই। রওনক সাদা শেরওয়ানিটা পরে, মাথায় পাগড়ি বেঁধে যখন ঘর থেকে বেরোলো, তোমাকে ভীষণ মনে পড়ছিল। আমিও তো তোমার জন্য সাদা শেরওয়ানি কিনেছিলাম। রওনকের বউয়ের মতোন লাল টুকটুকে একটা শাড়ী নিয়েছিলাম আমার জন্য। খুব শখ করে কিনেছিলাম বিয়ের শাড়ী আর শেরওয়ানি। আমাদের আর সেসব পরা হলো না সামি। কত স্বপ্ন আমাদের, কত প্ল্যানিং… সব শেষ! কয়েক সেকেন্ডে আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেল।”

— “আমাদের বাসর রাতটা ভরা পূর্ণিমার রাতে হবার কথা ছিল। ক্যালেন্ডার থেকে পূর্ণিমার সঙ্গে মিলিয়ে তুমি বিয়ে তারিখ ঠিক করলে। সেই রাতে ছাদে পাটি বিছিয়ে আমাদের জোত্স্নাবিলাস করার কথা ছিল। আমাদের একটা দীর্ঘ চুমু বাকি ছিল, এক সমুদ্র ভালোবাসায় ডুব দেয়া বাকি ছিল।” 

— “এক জীবনে সবাই সব পায় রোদ্দুর? যাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়, পূর্ণতা কি তারা সত্যিই পায়? জিজ্ঞেস করো তাদের, দেখবে অভিযোগের ঝাঁপি খুলে 

বসেছে। সংসারে সুখ নেই, যত্ন নেই, সম্মান নেই, ভালোবাসা নেই, ভালোবাসার মানুষটা থেকেও নেই। কী লাভ সেই পূর্ণতার, বলো তো? আর আমরা? অপূর্ণ হয়েও পূর্ণ। আমাদের ভালোবাসা বেঁচে আছে, আমি তোমার মাঝে বেঁচে আছি। আমাকে তুমি মরতে দাওনি। আমাদের ভালোবাসা মুছে যেতে দাওনি। এখনো তোমার আমার গল্প লোকেরা চর্চা করে, আজও বন্ধু মহলে তোমার আমার প্রেমের প্রথম দিনগুলোর মতো গুঞ্জন উঠে- নবনী, সামি ভালোবেসেছিল, নিখাঁদ ভালোবাসা। আমরা পূর্ণতা পাইনি। তবে ভালোবাসা পেয়েছি রোদ্দুর, অসীম ভালোবাসা!” 

— “ঘুম পেয়েছে আমার। কিন্তু নিচে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।” 

— “এখানে ঘুমাবে?” 

— “ছাদঘরের দরজা খোলা। ফুফু বললো এই ঘরে কাউকে থাকতে দেয়া হয় না। কে খুললো বলো তো?” 

— “হয়তো কোনো দরকারে খুলেছে, ভুলে লক না করেই চলে গেছে।” 

— “আমি যাবো না নিচে। ঐ ঘরটাতেই ঘুমাবো। তুমি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে সামি?” 

সামির পিছু পিছু ছাদঘরে এল নবনী। দরজা আটকে শুয়ে পড়লো বিছানার এপাশে। মাথার উপর সামির স্পর্শে পরম শান্তিতে চোখ বুজলো নবনী। 

আঁধার কেটে সবে আকাশে আবছা আলো ছড়ানো শুরু করেছে। মির্জা বাড়ি এখনো জেগে উঠেনি। কাজের লোক চারজন, বাড়ির বড় আর মেজো বউ, রমিজ মির্জা বাদে বাকি সবাই ঘুম। টিউবওয়েল চাপার শব্দ, মোরগের ডাক, হাড়ি পাতিলের টুংটাং শব্দ ছাড়া আর কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না এই বাড়িতে। ঘুম থেকে জেগেই বেশ চটে আছেন রমিজ মির্জা। ফজর ওয়াক্তে অযু করতে গিয়ে পানি পাননি তিনি। বিগত কয়েকদিন যাবৎ পানির লাইনে ঝামেলা হওয়া সত্ত্বেও আজ করছি, কাল করছি বলে লাইন ঠিক করেনি এই বাড়ির কর্মচারী আব্বাস। নতুন বউ বাড়িতে, বাড়ি ভর্তি মেহমান; এমন সময়ে কল থেকে পানি আসাই কিনা বন্ধ হয়ে গেল! দাঁতে দাঁত চেপে ফজরের নামাজ শেষ করেই সোজা তিনি চলে গেলেন উত্তরের বারান্দায়। সেখানেই গতরাতে লেপ-তোশক নিয়ে ঘুমিয়েছে আব্বাস। একটানে আব্বাসের শরীর থেকে কাঁথা সরিয়ে পাছা বরাবর লাথি মেরে চিৎকার করে উঠলেন রমিজ মির্জা 

— “উঠ হারামজাদা!” 

ঘুম থেকে ধরফরিয়ে উঠলো আব্বাস। ভয়ে আতংকে পুরো শরীর কাঁপছে তার। 

— “কী হইছে কাকা?” 

— “তোরে কবে কইছিলাম পানির পাইপে ময়লা জমছে, সাফ করোন লাগবো।”

— “এল্লিগা আমারে লাখি দিবেন? ডরে বুকটা কেমুন ধরফরাইতাছে। মা গো মা!” 

— “উঠ শিগগির, আরেকটা লাখি খাওনের আগে উঠ! এক্ষন তুই আমার লগে ছাদে গিয়া লাইন সাফ করবি।” 

.

মোরগের ডাকে ঘুম খানিকটা ভেঙে এল নবনীর। আধবোজা চোখে পাশ ফিরতেই হুরমুরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো সে। চোখ ভালোভাবে কঁচলে আরেকবার সামনে শুয়ে থাকা মানুষটার দিকে তাকালো। অমিত শুয়ে আছে! সত্যিই কি সারারাত অমিতের সঙ্গে এক বিছানায় কাটিয়েছে সে? কিভাবে সম্ভব? অমিত এল কখন এই ঘরে? কেন এল? যতদূর মনে পড়ে গতরাতে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিল সে। তাহলে অমিত? সে কি আগে থেকেই এই বিছানায় ছিল? নাহ্! আর কিছু ভাবা যাচ্ছে না। কেউ দেখার আগে এখান থেকে বেরোতে হবে। খাটের উপর থেকে ওড়না নিয়ে কোনোভাবে গায়ে জড়িয়ে, দরজা খুলে বাইরে পা বাড়াতেই রমিজ মির্জার মুখোমুখি হলো নবনী। একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনায় নিজেকে সামলে নিলেও, রমিজ মির্জাকে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারছেনা নবনী ভয়, আতংক দ্বিগুণ হয়ে যেন নিঃশ্বাসটাই আটকে যাচ্ছে। 

নবনীর চুল, ওড়না এলোমেলো। চোখ থেকে ঘুমের ছাপ যায়নি, মুখে আতংক লেপ্টে আছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত তাকে দেখছে রমিজ মির্জা, বোঝার চেষ্টা করছে ঘুম থেকে জেগেই একটা মানুষকে কেন এত ভয়ে জড়োসড়ো দেখাবে? হাতজোড় পেছনে নিয়ে নবনীর সামনে বুক টানটান করে দাঁড়ালেন রমিজ মির্জা। 

— “কী গো বুবুজান? রাত্রে এনে ঘুমাইছিলেন?” 

মুখ ফুটে কথা বেরোচ্ছে না নবনীর। আসন্ন বিপদের কথা ভেবে মাথা ঘুরানো শুরু হলো তার। পেছন থেকে আব্বাস মিষ্টি করে বললো, 

— “খালাজান, কাকায় কী কইতাছে, শুনছেন? জবাব দ্যান।” 

কোনো উত্তর না দিয়েই, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে এখান থেকে দৌড়ে পালালো নবনী। 

বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আব্বাসের দিকে তাকিয়ে রমিজ মির্জা বললো, 

— “বেত্তমিজ মাইয়্যা! দিলের মইদ্যে আদব কায়দা নাই। ঘর এইডা তো তালা মারা আছিলো। ঘর সাফ করলো কহন? উপরে আইলো কহন? রাইতে তো দেখছিলাম নিচের ঘরে বইনের লগে শুইয়া আছে।” 

চিলেকোঠার ঘরে উঁকি দেয়া হয়নি বহুদিন। আজ দরজা খোলা পেয়ে ঘরের ভেতর পা রাখলেন রমিজ মির্জা। শান্ত চোখজোড়া যেন তার এখনই বিস্ফোরিত হয়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে! এ কী দেখছেন তিনি! এতবড় পাপকান্ড! দু’হাতে মুখ চেপে চিৎকার করে উঠলেন, 

— “আস্তাগফিরুল্লাহ্! আল্লাহ্ গো! এইডা কী হইয়া গেল! আমি রমিজ মাইনষের বিচার করি, আমার ঘরেই নি এই আকাম!” 

রমিজ মির্জার আর্তচিৎকারে একলাফে ঘরে এসে ঢুকলো আব্বাস। জিভ কামড়ে বললো, 

— “এহহে! ইন্না-লিল্লাহ!” 

— “ধরা খাইয়া গেছে ঐ ডরে এইহান থেইকা ছেমড়ি পালাইছে। বুঝছোস? আব্বাইচ্চা, আমি নিচে যাইতাছি। ছেমড়ি বাড়ি ছাইড়া পালানের আগে ওরে আটকাইতে হইব। আর তুই এই নাপাক ছেমড়ারে নিয়া নিচে আয়। আগে দুইটারে গোসল দেওয়ামু, তারপর বিচার করমু। সাহস কত্ত এ্যা! রমিজের বাড়িতে শুইয়া নাপাক কাম করোন! ছিঃ ছিঃ! মনে হইতাছে আমার সারা শইল্লে কেডায় জানি থু থু মাইরা দিছে। 

.

সারা শরীর কাঁপছে নবনীর। নীতু তাকে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে বুকে। পাশেই পানির গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে আছে অনি। নাতাশা মাথায় হাত বুলিয়ে, আদুরে স্বরে অনবরত কত কী জিজ্ঞেস করে চলছে, কোনোকিছুরই উত্তর দিচ্ছে না নবনী মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে হেঁচকি তুলে কেঁদেই যাচ্ছে। 

— “ভাবী কী হয়েছে?” 

শামীমা এসেছে ঘরে। চোখে মুখে তার একরাশ কৌতুহল। 

— “দেখো না মা, নবনী আপুর কী যেন হয়েছে! আমি আর নাতাশা আপু ঘুমাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে নবনী আপু নাতাশা আপুকে জড়িয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। আপুর পুরো শরীর কাঁপছে মা।” 

চিন্তিত ভঙ্গিতে নীতুর পাশে এসে বসলেন শামীমা। নিচুস্বরে বললেন, 

— “তালই সাহেব আমাকে ডেকে তুললেন ঘুম থেকে। বললেন এই ঘরে আসতে। কী কথা নাকি আছে।” 

— “তালই? উনি আবার কী বলবেন?” 

— “কী জানি ভাবী। কথার ধরন শুনে মনে হলো খুব রেগে আছে।” 

মায়ের দিকে মুখ তুলে তাকালো নবনী। কী যেন বলতে চাইছে সে। মেয়ের চোখেমুখে তাকিয়ে দুশ্চিন্তায় দিশেহারা হয়ে যাচ্ছেন নীতু। কাতর হয়ে জানতে চাইলেন, 

— “বল না রে মা, কী হয়েছে তোর?” 

— “চলো আম্মু, আমরা এক্ষুনি বাসায় যাব। এখানে থাকবো না।

— “ক্যান গো বুবুজান? বাসায় যাইবেন ক্যান? ধরা খাইয়া গেছেন তাই?” 

রমিজ মির্জাকে দেখে হঠাৎ কান্না থেমে গেল নবনীর। থেমে থেমে হেঁচকি তুলছে শুধু। তার সঙ্গে এসেছে ছোট ফুফুও। চোখজুড়ে শুধুই তার আতংক। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নবনীর দিকেই।

— “যান বুবু, গিয়া গোসলটা আগে সাইড়া আসেন। তারপর করুম আপনের বিচার।” 

বিরক্ততে চোখ মুখ কুঁচকে এল নীতুর। লোকটাকে বরাবরই খুবই অপছন্দ তার। কথাবার্তা, চালচলন, চিন্তা ধারা সবকিছুই বিশ্রী। মেয়ের কান্নার কারণ অবশেষে খুঁজে পেলেন তিনি। এই লোকটা নিশ্চয়ই বাজে কিছু বলেছে তার মেয়েকে। কিন্তু কেন? এখন আবার গোসল করতে বলছে! সেটাই বা কেন? 

— “ওকে গোসল কেন করতে বলছেন তালই?” 

— “কারণ আপনার মাইয়্যা এহন নাপাক। তার গোসল করা ফরজ।” 

— “মানে? কী করেছে ও?” 

— “বিচারে সব কথা কওয়া হইবো। সব কথা কওয়ার লাইগাই আপনাগো এই ঘরে আমি ডাকাইছি। কই গো বুবু, যান। আর আহ্লাদ না কইরা গোসলে যান।” নবনীকে হাত ধরে এক টানে মায়ের কাছ থেকে আলাদা করলো রমিজ মির্জা। চেঁচিয়ে উঠলেন নীতু, 

— “কী পেয়েছেন আপনি? আমার মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আর আপনি কিনা এই সকালে আমার মেয়েকে ধরে বেঁধে গোসল করতে পাঠাচ্ছেন!”

এবার ভীত স্বরে নবনীর ফুফু সুরাইয়া বললেন, 

— “বাবা বলুন না কী হয়েছে? কী করেছে আমার ভাতিজি?” 

দাঁতে দাঁত চেপে নিতুর কাছে এগিয়ে এসে রমিজ মির্জা বললো, 

— “গলা বাড়াইয়ো না। একে তো সন্তানরে শিক্ষা দিতে পারো নাই, তার উপে আবার গলা বাড়াও!” 

— “কোন শিক্ষার অভাব রেখেছি? বলুন আমার মেয়ের অন্যায় কী?” 

— “ভুইলা যাইয়ো না তুমি আমার বাড়িতে আমার সামনে দাঁড়ায় আছো। আওয়াজ নিচে নামায়া কথা কও। তোমার ইজ্জত বাঁচাইতে আমি মজলিস না জমায়া, ঘরের দরজা আটকায়া কথা কইতাছি। আর তুমি নি চিল্লায়া সারা গ্রাম জানাইতে চাও? কী মাইয়্যা তুমি যাইবা গোসলে নাকি হেঁচড়ায়া নিমু?” 

দিশেহারা নবনী অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকালো। গলার সমস্ত আওয়াজ খুঁইয়ে সে বোবা হয়ে গেছে যেন! 

রমিজ মির্জার ঝাঁঝালো কথা আর নবনীর নিশ্চুপ কান্না মিলিয়ে নীতু মেজাজ হারালো। চেঁচিয়ে উঠলো মেয়ের উপর, 

— “চড় মেরে দাঁত ফেলে দেবো। এখানে কাকে ভয় পাচ্ছিস তুই? আমি থাকতে কারো সাহস আছে তোকে কিছু করার? কথা বলিস না কেন? লোকটা এমন আচরণ কেন করছে তোর সঙ্গে?” 

— “মা… আমি… আ আমি…” 

— “হইছে বুবুজান। আপনার আর তোঁতলাইতে হইব না। আপনের মায়রে আমিই কইতাছি।” 

ঘরের দরজা আটকে শামীমাকে টেনে এনে নীতুর পাশে দাঁড় করালেন রমিজ মির্জা। মনে মনে পুরো স্ক্রিপ্ট তৈরী করে রেখেছেন তিনি- কতটা মসলা মিশিয়ে, কেমন ভঙ্গিতে মায়েদের সন্তানের কুকর্ম সম্পর্কে তিনি জানাবেন। মাত্ৰই গলা ঝেড়ে বলতে যাচ্ছিলেন তখনই দরজায় ধাক্কা পড়লো। সুরাইয়া গিয়ে দরজা খুলতেই, আব্বাস আর মানিক দুপাশ থেকে অমিতকে ধরাধরি করে ঘরে ঢুকলো। রাগে বিরক্তিতে অমিতের চেহারা কুঁচকে আছে। মাকে দেখামাত্রই এক নিঃশ্বাসে সে বলতে লাগলো, 

— “হোয়াট দ্য হেল ইজ গোয়িং অন, আম্মু? এরা আমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে পুকুরে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে বললো ডুব দিয়ে জলদি গোসল সেরে নিতে গোসল শেষে আমার কিসের বিচার নাকি করা হবে। অমিতকে দেখা মাত্র কান্না বুঝি আরো বেড়ে গেল নবনীর। নীতু আর শামীমা একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। দু’জনের ছেলে মেয়েকে একই কথা বলা হচ্ছে কেন? কী দোষ তাদের? 

— “এইবার কই আসল কতা। তোমগো দুইজনের ঝি-পুত এহনো আবিয়াইত্তা হেইডাই আমি জানতাম। তুমরা নিজেরাই আমারে কইছো।” 

— “হ্যাঁ বলেছি। তো?” 

— “মেজো বউ, তুমার ভাবী কইলাম খুব চ্যাটাং চ্যাটাং করতাছে। গলা নামাইতে কও।” 

পেছন থেকে অসহায় চোখে নীতুর দিকে তাকালো সুরাইয়া। দাঁতে দাঁত চেপে চোখ নামিয়ে নিলো সে। 

— “তুমগো দুই পোলা-মাইয়্যা বিয়া ছাড়াই সারারাইত ছাদের ঘরে এক বিছানায় কাটাইছে। বিছানায় রাইত ভইরা কোন লীলা চালাইছে সেইটা নিশ্চয়ই আর কইতে হইব না।” 

— “মানে কী?” 

সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো শামীমা, নিতু আর সুরাইয়া। রমিজ মির্জার কথায় স্তব্ধ হয়ে রইলো অমিত আর অনি। ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে রমিজের দিকে তাকালো নাতাশা জিভ থেকে দলা পাকিয়ে থু থু বেরিয়ে আসতে চাইছে তার। 

সুরাইয়ার বহুবছরের দাবানো কন্ঠস্বর আজ যেন সমস্ত বাঁধ হারালো। যে চোখ কখনো মির্জা বাড়ির প্রধানের চোখ বরাবর উঠেনি, সে চোখে যেন আজ আগুন ঝরছে। শ্বশুরের দিকে রাঙা চোখে তাকালো সে। 

— “আপনাকে আমরা সবাই শ্রদ্ধা করি, আপনার সমস্ত অন্যায় মাথা পেতে মেনে নেই, তার মানে এই না, আপনি আপনার সীমা অতিক্রম করবেন।” 

— “ঐ মাগী, ঐ! চোক্ষে গরম শিক ঢুকাইয়া কানা বানাইয়া দিমু। কার দিকে চাইয়া কতা কইতাছোস, হুঁশ আছেনি? নিজে বেলাল্লাপনা কইরা আমার পুত ফাঁসাইছোস, এই ছেমড়ি তোরই তো রক্ত। ভালা আর হইবো কেমনে? বিয়ার আগে শইল্লের মধু খাওয়াইয়া বেড়াইতাছে পর পুরুষগো।” 

শান্ত স্বরে মেয়েকে নীতু জিজ্ঞেস করলো, — “বল তো মা, কী হয়েছে? আমি তোর কাছ থেকে জানতে চাই। “গতকাল রাতে আমি খুব সাফোকেট ফিল করছিলাম। তাই ছাদে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণ বসবো বলে। ওখানে ঘুম পেয়ে গেল, চিলেকোঠা ঘরটার দরজা খোলা পেয়ে আমিও ওখানে ঘুমিয়ে গেলাম। ফুফু বলেছিল ঐ ঘরে কেউ থাকে না। ভেবেছি কেউ নেই, আমি একটু স্পেস নিয়ে ওখানে ঘুমাই। ঘুমানোর আগে দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম। ঘুম থেকে জেগে দেখি দরজা ভেতর থেকে আটকানো, অথচ আমার ওপাশে উনি শুয়ে আছে। তাড়াহুড়ো করে ঘর থেকে বেরোনোর জন্য দরজা খুললাম, অমনি দেখি দাদা আমার সামনে। 

— “কিহ্! আপনি সারারাত আমার সঙ্গে এক বিছানায় ছিলেন!” 

— “আমি আপনাকে দেখিনি।”

— “একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ আমি। ছয় ফুট মানুষটাকে আপনি দেখতে পাননি? এটা কোনো বিশ্বাসযোগ্য কথা?” 

— “বিলিভ মি, আমি আপনাকে দেখিনি। ঘরে খুব একটা আলো ছিল না। আর আপনি যে পাশটায় শুয়েছিলেন ওখানে অন্ধকার ছিল। আমি কেন জেনেশুনে একটা ছেলের পাশে ঘুমাতে যাব?” 

— “হ্যাঁ তাও তো ঠিক! জেনেশুনে আপনি কেন আমার পাশে শোবেন? দাদা, আমরা কেউ কাউকে ওভাবে চিনিই না। দুজনের মাঝে সম্পর্ক থাকলে হয়তো আপনি এমন কিছু সন্দেহ করতে পারতেন। যেখানে সম্পর্কই নেই সেখানে এসব বাজে ব্লেইম করাও তো অন্যায়। 

— “ন্যায়-অন্যায় শিখাইবা আমারে? অত্র থানার ভিত্রে যত গ্রাম আছে সব গ্রামের বিচারে আমারে মাথা কইরা নিয়া যাওয়া হয়। রমিজ মির্জার মতামত ছাড়া কোনো গ্রামের পঞ্চায়েত, চেয়ারম্যান, মেম্বার কাউরে নির্দোষ বানাইতে পারে না, কাউরে দোষীও করতে পারে না। সেই আমারে কি না তুমি ন্যায় অন্যায় শিখাও?” 

— “দাদা আপনি কথা বুঝতে পারছেন না। মানুষের চোখের দেখায় অনেক ভুল 

থাকে। আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। চার বছরের প্রেম আমার। আমি কেন অন্য কারো সঙ্গে….? আম্মু কিছু বলছো না কেন উনাকে?” 

— “তালই সাহেব আমার ছেলেটা সত্যিই বলছে। ও ওর প্রেমিকাকে ছাড়া চোখে আর কিছু দেখে না। ঐ মেয়ের কাছে ওর জান আটকে আছে। অমিত মুনিয়ার সঙ্গে চিট করবে এসব স্বপ্নেও ভাবা যায় না।” 

— “আমার মেয়েও কখনোই কোনো ছেলের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক দূরের কথা, প্ৰেম করার চিন্তাও কখনো মাথায় আনবে না। অকারণ মিথ্যা কথা রটানো বন্ধ করুন তালই। আমরা আপনার বাড়ির মেহমান, আমাদের এভাবে অপমান করার কোনো মানেই হয় না।” 

— “তোমরা তোমগো স্বপ্ন-চিন্তা লইয়া ভাবতে থাকো। আমি চোখে যা দেখছি তাই কমু। আকাম যেহেতু আমার বাড়িতে হইছে, বিচারও আমিই করমু।” 

রমিজ মির্জার বাড়াবাড়িতে চিৎকার করে উঠলো নাতাশা। 

— “বিচারের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? আপু আর অমিত ভাইয়া তো বলছেই ওরা কিছু করেনি।” 

— “বুবুজান, এই বাড়িতে আমার কথার পিঠে আর কোনো কথা হয় না। আর তোমরা তর্ক কইরাই যাইতাছো। কী সাহস এ্যা? চাইলে তুমগো সবার একটা শাস্তি আমি দিতে পারি। কিন্তু মেহমান দাওয়াত কইরা আনছি, তার সম্মান আমি বজায় রাখমু। আর কোনো কতা কেউ কইবা না এই ঘরে। আমি এহন যা হুকুম করমু তাই মাইনা নিতে হইব। নয়তো পরিণাম খারাপ হইব। আজকে এক ঘন্টার ভিতরে ওগো দুইজনরে আমি বিয়া করায়া হালাল করমু।” 

আঁতকে উঠলো অমিত-নবনী। বড় মেয়েকে সুরাইয়ার কাছে দিয়ে, শফিক সাহেবকে কল করবেন বলে নিতু মোবাইল হাতে নিতেই ছিনিয়ে নিলেন রমিজ মির্জা। 

— “কারে কল দেও? জামাইরে?” 

— “দেবো না? কী বলছেন, কী করতে চাইছেন আন্দাজ আছে আপনার? আমার মেয়েকে কিভাবে ফাঁসাচ্ছেন, সে কথা ওর বাবাকে জানাবো না আমি?”

এগিয়ে এল অমিতের মা। অমিত আর অনির হাত শক্ত করে ধরে বললো, 

— “দরজার সামনে থেকে আপনার লোকদের সরে দাঁড়াতে বলুন। আপনার মতো অসভ্য বেয়াদব লোকের বাড়িতে এক মুহূর্তও আমি থাকব না।” 

— “ঐ বেত্তমিজ বেডি, তুই অসভ্য কারে কছ? বিয়া ছাড়া কুন বেডির লগে কুকাম করছি? কইতে পারবি তুই? তুই অসভ্য, পেটে যেইডারে ধরছোস ঐডা অসভ্য। পোলায় আকাম করছে, মায় হেই কতা মাটিচাপা দিতাছে। কোমিনের দল!” রমিজ মির্জার পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরলো অমিত। 

— “আপনি আমাকে চেনেন? আমার সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে আপনার? আপনাকে এই গ্রামেই জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে অন্তত এমন দশটা লোকের সঙ্গে আমার উঠাবসা। একটা কল করব, এখান থেকে ধরে নিয়ে আপনাকে কোথায় গুম করবে তার কিছুই আপনার ধারণায় নেই।’ 

কালু কোমড়ে গুঁজে রাখা দেশি পিস্তল বের করে অমিতের মাথায় ঠেকিয়ে বললো,

— “দে কল। তোর কোন বাপ আইসা মালিকরে গুম করবো আমরাও দেখি।”

— “দাদাভাই, এমুন পঞ্চাশখানেক পিস্তল আমার উঠানে, গাছের তলে, আলমারিতে, চাইলের মটকায় ভইরা থুইছি। যেই বান্দা শ’খানেক মানুষ জীবনে গুম করছে তারে গুম করার ডর দেহায়া লাভ আছে? বেকুবের বেকুব! আর কতা বাড়াইয়ো না। চুপ কইরা বও খাটের উপ্রে। আমি বাজার থেইকা শাড়ী, পাঞ্জাবি আনাইতাছি। সাইজা গুইজা রেডি হও। মুয়াজ্জিনরে ডাইক্যা আনতাছি। সে আইসা বিয়া পড়াইবো।” 

— “আমরা আমাদের ছেলেমেয়ে বিয়ে দেবো না। এতবড় অন্যায় আপনি কী করে করতে পারেন তালই?” 

ফোঁপাতে ফোপাঁতে সুরাইয়া বললেন, 

— “বাবা এবার আপনি সীমা ছাড়াচ্ছেন। আপনি হয়তো আমার উপর রেগে আছেন। আমার শাস্তি আপনি আমাকে দিন। ওদের কেন দিচ্ছেন? এত নোংরা অপবাদ দিয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে এতবড় শাস্তি দেবেন না দয়া করে। আমার ভাইয়ের মেয়েটা মরে যাবে।” 

— “ও মা! ত্রিশ বছর আগে শুনছিলাম তুমি আমার পোলারে বিয়া না করতে পারলে মইরা যাইবা। তুমারে বাঁচাইতে গিয়া পোলা আমার বিপক্ষে গিয়া বিয়া করছে। ৩০ বছর পর আইসা শুনতাছি যার লগে তুমার ভাইঝির শোয়া-বসা তার লগে বিয়া দিলে তুমার ভাইঝি মইরা যাইব। এইডা কুন আলামত!” 

এবার নবনী বললো, 

— “আপনি বারবার একই কথা বারবার বলছেন। আমরা এতগুলো মানুষ আপনাকে কী বলছি, তা কেন বুঝতে চাইছেন না?” 

— “আর আমি যে নিজের চোক্ষে তুমগো দুইটারে একঘরে দেখছি সেইটা কী কইবা?”

— “দাদা, সত্যি বলছি আমি উনাকে দেখিনি দাদা। আমি কাউকে বিয়ে করব না। তারচেয়ে বরং আমাকে মেরে ফেলুন, আমার শাস্তি আমাকে দিন। উনাকে যেতে দিন প্লিজ। সব দোষ আমার, আমি কেন খেয়াল করলাম না। আমার একটা ভুলের জন্য এভাবে সবাইকে শাস্তি দেবেন না।

— “দেহো কেমুন কান্দা লাগাইছে! ঐ ছেমড়ি, বিয়া খুশির কাম, হালাল কাম। বিয়া করতে আপত্তি কী? বিয়া দিতাছি চুপচাপ বিয়া কইরালাও। নয়তো ঘটনা খারাপ হইব, খুব খারাপ!” 

নিতু দিশেহারা হয়ে বললেন, 

— “সুরাইয়া তুমি রাশেদ ভাইকে একটু ডাকো। উনাকে এসে বোঝাতে বলো।” রমিজ মির্জা তাচ্ছিল্যভাবে হেসে বলল, 

— “রাশেদরে জানাইয়া কী হইব? ওর সাহস আছে বাপের হুকুমের উপর কুনু কতা কওনের? আমি যতই চাইতাছি কতা এই ঘরের ভিত্রে আটকাইতে, তুমরা ততই সারা দুনিয়া জানাইতে চাইতাছো। কুকামের কথা পুরা গ্রাম জানাইতে চাও? আমি ব্যাপারটা ঢাইকা রাখতে চাইতাছি বুঝতাছো না? আমার বাড়িতে এই ঘটনা ঘটছে সেইটা মাইনষে জানুক, তা আমি চাই না। যেনা’র ঘটনা সারা দুইন্যা জানানোর কুনু বিষয় না। যদি জানাইতেই হয় তাইলে বিচার কইলাম ঘুইরা যাইবো। পুরা গ্রামবাসীর সামনে ওগো দুইটারে ৮০টা বেতের বাড়ি দেয়া হইব। 

অমিত এবার ক্ষেপে গিয়ে বলল,

— “শালা বাস্টার্ড! পিস্তল মাথায় ঠেকিয়ে যা খুশি করার লাইসেন্স পেয়ে গেছিস? আমার ফোনটা শুধু একবার হাতে দে। দেখি তুই কোন বালটা ছেঁড়ার সাহস পাস।”

— “এ্যাহ! গলায় খুব জোর এ্যা? রক্ত গরম, শইল গরম। গরমের ঠ্যালায় যহন তহন যার তার লগে শুইয়া শইলের গরম তেজ কমাও? এইবার তো দাদাজান ভুল জায়গায় কাম করছো। তুমারে এত সহজে আমি ছাড়তাছি না।

— “বাবা মুখে লাগাম দিন আপনার। কথা বলার আগে নিজের বয়সের দিকটা একবার ভাবুন। আপনার হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়েগুলো সামনে দাঁড়িয়ে, ওদের সামনে কী করে এসব বাজে কথা মুখে আনছেন আপনি?” 

ননদের সঙ্গে তাল মেলালো নীতু। 

— “আপনি একটা অসভ্য পর্যায়ের মানুষ সেই কথা আমার ননদের বিয়ের পর প্রথম আপনার বাড়িতে আমার শ্বশুর পা রেখেই বুঝেছিল। বাসায় ফিরে বলেছিলও, এই বাড়িতে আত্মীয়তা বজায় রাখলে শুধু আমার ননদ কেন, আমরা সবাই জ্বলবো। এতগুলো বছর ধরে আপনার নানারকম যন্ত্রণা আমরা সহ্য করেছি। আপনার চাহিদা অনুযায়ী সব নিয়ম মেনে আপনার বাড়ি এসেছি, যখন যা চেয়েছেন তাই দিয়েছি। এখন আপনি আমার মেয়েকে শেষ করতে চাইছেন! সুরাইয়ার জীবন নরক বানিয়ে মনের আঁশ মেটেনি আপনার? মরতে হবে একদিন সে কথা খেয়াল আছে? এতসব অন্যায়, পাপের জবাবদিহি করবেন কী করে?” 

— “রওনককে আপনি জোর করে বিয়ে দিয়েছেন, আমরা আপনার সিদ্ধান্ত মাথা পেতে নিয়েছি। রওনক আপনার বংশের রক্ত, ওর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার আপনার আছে। নবনী কিংবা অমিত ওরা কেউ আপনার বংশের না কিংবা আপনি তাদের অভিভাবক না। আপনি এখানেই সব বন্ধ করুন বাবা। নয়তো আমি আপনার এই সংসার ছেড়ে চলে যাব। বুড়ো বয়সে মির্জা বাড়ির মেজো ছেলের ত্বালাক হয়েছে এটা লোকমুখে শুনতে নিশ্চয়ই আপনার ভালো লাগবে না।”

— “কারে কী কইতাছো? বেড়া মাইনষে বুড়া হইলেও তেজ কমে না। বুড়াকালেও 

বাচ্চা পয়দা করার জোর আছে। বেডাগো ত্বালাক একটা ক্যান, দশটা হইলেও কেউ আঙুল তুলে না। ত্বালাক দিলে মাইনষে থুতু তুমারেই দিব। জামাই থুইয়া জ্বালাকের পর যাইবা কই? কুন বেডায় তোমারে ঘরণী করবো? যাও না, যাও। দাওগা ত্বালাক। আজকা একলগে ফুফু ভাতিঝির বিদায় হইব। একটারে বিয়া দিয়া বিদায় দিমু, আরেকটারে ত্বালাক দেওয়াইয়া। এমনিতেও তুমারে আমার সইহ্য হয় না মেজো বউ। খালি বংশের প্রথম বাত্তি দিছো দেইখা এই বাড়ির বউ হওয়ার সম্মান আমি তুমারে দিছি। নয়তো এই গ্রামের সীমানায় নি ঢুকতে দিতাম? তুমি গেলে আমার পুতরে আমি আরেকটা বিয়া দিমু। মরার আগে জ্বালা মিটবো এইটাই আমার শান্তি।’ পরিস্থিতি ক্রমশ আয়ত্ত্বের বাইরে যেতে দেখে রমিজ মির্জার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লো নবনী। কাতর হয়ে বলতে লাগলো, 

— “দাদা, ফুফু রাগের মাথায় ওসব বলছে। আপনি বাদ দিন না। আপনার একটা ভুল ধারণার জন্য কতগুলো জীবন নষ্ট হবে একবার ভাবুন। সত্যি বলছি দাদা আমরা এতবড় অন্যায় কাজ করিনি। যেতে দিন আমাদের প্লিজ। আর কখনো আপনার বাড়ি আমরা পা রাখবো না, আমাদের ছায়াও আপনি দেখবেন না।” 

— “শাবানার মতোন কী সুন্দর কানতে পারো তুমি! কিন্তু আমি হইলাম এটিএম শামসুজ্জামান। আমার এইসব কান্দনে মন গলে না। হারাম কাম করছো, আমি হালাল কইরা দিতে চাইছি। ভালা কামের বিনিময়ে কত কতা শুনাইতাছে তুমার প্রেমিক, মা, ফুফু! এতকিছু সইহ্য কইরা তবুও সব রাখঢাক কেন রাখতে চাই জানো? রমিজ মির্জার বাড়িতে তারই আত্মীয়রা আকাম করছে, আমি চাই না এই কতাডা মাইনষের মুখে উঠুক। নয়তো কহন তুমগো দুইটারে গাছের লগে বাইন্দা বেতের বাড়ি দেয়া শুরু করতাম। এত প্যাঁচাল পারতে আর আমার ভাল্লাগতাছে না। সকালের নাস্তা অহনও করি নাই। পেটের ভিত্রে ইন্দুর দৌড়াইতাছে। শেষ কতা কমু, নিজেরাই ভাবো কুনডা করবা। তুমগো সিদ্ধান্ত শুইনা আমি খাইতে যামু। বিয়া যদি না করতে চাও, অন্য রাস্তাও আছে। সেটা হইলো তুমগো ঈদগাহ মাঠে নিয়া আশপাশের ৪-৫ গ্রাম মাইনষের সামনে বেত দিয়া পেটানো হইব। আর সঙ্গে তুমগো দুই মা আর বইনেগো মুখে কালি গলায় জুতার মালা দিয়া সারা গ্রাম ঘুরানো হইব। মুবাইল ফুনে তুমগো আর তুমগো মা বইনেগো ভিডু কইরা সারা বাংলাদেশ ছড়ানো হইব যাতে মানুষ যেনা করতে ডরায়। আর তুমগো বাড়িতে কুনু পোলা আত্মীয়তা করতে আওনের আগে যেন জানতে পারে কুন বাড়িতে তারা সম্পর্ক করতে আইতাছে।” 

অমিতের চোখে অসহায়ত্বের নোনাজল চিকচিক করছে। মা-বোনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো সে। চোখের সামনে মুনিয়ার হাসিমুখটা ভেসে উঠছে বারবার। 

রমিজ মির্জার পা ছেড়ে ফ্লোরে বসলো পড়লো নবনী। এই মুহূর্তে কান্নাও যেন থমকে গেছে। সবাই মিলে ঐ লোকটার সঙ্গে তুমুল তর্ক করছে। ধীরে ধীরে সে কোলাহল ক্ষীণ হতে হতে শূন্যে ঠেকলো। এই তো সামি বসে আছে শক্ত করে তার হাতজোড়া ধরে। ফিসফিসিয়ে বলছে, 

— “উপস্থিত বুদ্ধি আর কবে হবে তোমার? বড় হওনি? পরিস্থিতি সামলানো আর কবে শিখবে তুমি? তোমার একটা সিদ্ধান্তের উপর আরো দুটো মেয়ের জীবনের মোড় নির্ভর করছে। স্বার্থপরের মতন সিদ্ধান্ত নিও না। লোকটা যা বলছে তাই সে করবে। করার পর ভাবতে পারছো ওদের কোন মানসিক চাপের মাঝে কাটাতে হবে? সোশ্যাল মিডিয়া, রিলেটিভ সবাই মিলে জীবনটা নরক বানিয়ে দেবে ওদের। মেয়ে দুটোই বিয়ের উপযুক্ত। এখান থেকে বেরোতে হবে নবনী, ওদেরকে সেইভ করতে হবে। একটাই পথ খোলা, তুমি হ্যাঁ বলে দাও। আগে এখান থেকে বের হওয়া জরুরী, যাবার পর বিয়ে নিয়ে বাকিটা ভাবা যাবে। যত দ্রুত সম্ভব বিয়ের কাজ সেরে এখান থেকে সবাইকে নিয়ে বের হও। হ্যাঁ বলো নবনী। উঠে দাঁড়াও, বলো এই বিয়েতে তুমি রাজি।” একলাফে উঠে দাঁড়ালো নবনী। চিৎকার করে বললো, আমি রাজি। এক্ষুনি বিয়ের ব্যবস্থা করুন। 

সমস্ত তর্ক-কোলাহল এক মুহূর্তেই থেমে গেল। ঘরের ভেতর পুরোনো ফ্যানের খটখট আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। ঘরের সবাই তাকিয়ে রইলো নবনীর দিকে। অমিতের দিকে অসহায় চোখে তাকালো নবনী। ছলছল চোখজোড় যেন চিৎকার করে তাকে বলছে, আমাদের আর কোনো পথ খোলা নেই। নবনীর চোখের ভাষা হয়তো বুঝলো অমিত। বুকচিড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল তার। নিচুস্বরে বললো, 

— “হুজুরকে ডাকুন।” 

ইট’স কমপ্লিকেটেড – ১০

১০

বাজার থেকে লাল জর্জেট শাড়ী, আর খসখসে কাতান কাপড়ের পাঞ্জাবি কিনে আনা হয়েছে হবু বর-বউয়ের জন্য। সঙ্গে আনা হয়েছে বাজারের সেরা নন্দ ঘোষের দোকান থেকে রসগোল্লা, কালোজাম আর ছানা- কবুল বলার পর সবাইকে মিষ্টিমুখ করানো হবে বলে। অন্য সব সাধারণ কিংবা বিশেষ দিনগুলোতে বড় বউয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মির্জা বাড়ির রান্নাবান্না হলেও, আজ সকালের নাস্তা তৈরী হচ্ছে এই বাড়ির প্রধানের ফরমায়েশ অনুযায়ী। রমিজ মির্জা নাস্তায় ভাত-মুরগীর সালুনের পরিবর্তে পোলাউ, ডিম আর মুরগীর কোরমা তৈরীর হুকুম জারি করেছেন। বাড়ির কাজের লোক, মেয়েরা আর ছোট বউকে সঙ্গে নিয়ে রান্নাঘরে তুমুল ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে বড় বউ। শেষ মুহূর্তে এসে শ্বশুর জানালো তার ফরমায়েশ। বেলা গড়িয়ে এখন সকাল সাড়ে আটটা। এই বাড়িতে আটটা নাগাদ নাস্তা টেবিলে সাজাবার প্রচলন। সারাবছর এই বাড়িতে মেজো বউ না থাকলেও, বছরের যে ক’টাদিন বাড়িতে সে থাকে ততদিন বড় জায়ের আশপাশে ঘুরঘুর করেই তার সময় কাটিয়ে দেয়। বিয়ের পর থেকে সুরাইয়া বাড়ি এলে কখনো বড় বউ একা রান্নাঘরে কাজ করেছে বলে মনে পড়ে না। আজ এই সংকটে সুরাইয়া তার পাশে নেই। ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতো হলেও সে কথা আপাতত মাথায় আসছে না বড় বউয়ের। রান্নাঘরের দায়িত্বে থাকা সাতজন মানুষ যেন মির্জা বাড়িতে চলমান কানাঘুষো আর থমথমে পরিস্থিতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা জগতে আছে। বড় বউ একটু পরপরই ঘড়ি দেখছে আর একমনে স্রষ্টাকে স্মরণ করে চলছে, খোদা, উদ্ধার করো! আব্বা খাওন খুঁজার আগে সব কাম সারায় দেও। আমি মসজিদে পাঁচটা টেকা দান কইরা দিমু গো খোদা! উদ্ধার করো! 

.

মসজিদের মুয়াজ্জিনকে ডেকে আনা হয়েছে। রমিজ মির্জা নিজের ঘরে মুয়াজ্জিনকে বসিয়ে কথা বলছে। ভেতরে হয়তো বিয়ে নিয়েই নিচুস্বরে কথা চলছে দু’জনের। দরজায় দাঁড়িয়ে বাবার কথা শোনার চেষ্টা করছে রাশেদ। কিন্তু কিছুই শুনতে পাচ্ছে না সে। অথচ এখন শোনা যে ভীষণ জরুরি! বাড়িতে যা কিছু ঘটছে তার পেছনের গল্পটা ভীষণ নোংরা সে কথা বুঝতে বাকি নেই তার। তবে কী সেই গল্প? 

— “বাবা…” 

রওনক পেছন থেকে ডাকলো রাশেদ মির্জাকে। ছেলের হাত ধরে সে টেনে নিয়ে গেল বাবার ঘরের পেছনে। “তোর মা কিছু বললো?” 

— “না। মুখে শাড়ী চেপে লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদছে শুধু।” 

— “অমিত? নবনী? ওরা কেউ কিছুই বলেনি?” 

— “না। কেউ কিছুই বলছে না। নবনী অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে বাবা। চোখ-মুখ দেখে মনে হলো অজ্ঞান হয়ে যাবে। অমিত ভাইয়া পাথরের মতো বসে আছে। নাতাশা, অনি সবাই চুপ।” 

— “কিচ্ছু ঠিক নেই। কেউ কিছুই বলছে না।” 

— “তুমি মামীকে কেন জিজ্ঞেস করছো না বাবা?” 

— “করেছি। ভাবী বললো, আপনাকে বলে লাভ কী? বাবার বিপক্ষে গিয়ে 

সুরাইয়াকে বিয়ে করা ছাড়া আর কিইবা করতে পেরেছেন এই জীবনে?” 

— “কষ্ট পেয়েছো?” 

— “উহুম। উনার মেজাজ খুব খারাপ। নয়তো আমাকে এভাবে কথা শোনাতো না।”

— “তুমি বাইরে না দাঁড়িয়ে ভেতরে যাও। দাদা হুজুরকে কি বলছে শোনো।”

— “ঢুকতে চেয়েছিলাম। বাবা যেতে নিষেধ করলো।” 

— “ওদের বিয়ে দেয়া একটা অসম্ভব ব্যাপার। অমিত ভাইয়া মুনিয়াকে ছাড়া চোখে 

কিছু দেখে না আর নবনী সামি ভাইয়াকে এখনও ভুলতে পারেনি। দাদা কী এমন কান্ড করলো সেটাই বুঝে পাচ্ছি না! কেউ কিছু বলছেও না। ঘটনা না জেনে ওদের হেল্প করবো কিভাবে?” 

ঘরের দুয়ার থেকে বাবার আর মুয়াজ্জিনের অস্পষ্ট কথোপকথন কানে ভেসে এল রাশেদের। আড়াল থেকে উঁকি দিতেই দেখতে পেল দু’জন এগিয়ে যাচ্ছে অমিত নবনী যে ঘরে বসে আছে সে ঘরে। 

মানুষ গিজগিজ করছে মির্জা বাড়ির বসার ঘরে। সব আত্মীয়স্বজন ঘুরে ঘুরে দেখছে ওদের। কখনো নিজেদের মাঝে কানাঘুষা করছে কখনোবা নানারকম প্রশ্নে জর্জরিত করছে অমিত, নবনীর মা-বোনদের- এদের হঠাৎ বিয়ের পেছনে ঘটনা কী? সম্পর্ক ছিল আগে থেকে? নাকি রমিজ মির্জার কোনো কারসাজি? 

সমস্ত প্রশ্ন, কানাঘুষা মুহূর্তেই থেমে গেল রমিজ মির্জার আগমনে। সঙ্গে এসেছে মুয়াজ্জিন আরো দু’জন গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি। বিয়েতে তারা সাক্ষী হবেন। রিনি এতটা সময় এককোনায় বসে ছিল। চুপচাপ বসে দেখছিল অমিত-নবনীকে। পড়ার চেষ্টা করছিল ওদের চোখের ভাষা। ভোরের দিকে রিনি ছাদে যাবার বেলায় নবনী ঝড়ের গতিতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছিল। এতটাই তাড়াহুড়োয় ছিল যে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে সে সজোরে ধাক্কা দিয়ে নেমে চলে যাচ্ছে সেদিকটায় খেয়ালই করলো না! ছাদে উঠে চিলেকোঠার জানালা দিয়ে দেখতে পেল রমিজ মির্জা আর বাড়ির বেশি কথা বলা কাজের লোকটা সে ঘরে দাঁড়িয়ে বিয়ে নিয়ে কী সব বলছে। খাটে অমিত গুটিসুটি মেরে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। আপাতত যা কিছু চোখের সামনে ঘটছে সবটাই মাথা উপর দিয়ে গেলেও, ভোরে যা দেখলো তার সঙ্গে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালে বেশ মুখরোচক একটা কাহিনি আন্দাজ করা যায়। তার মায়ের মনে কৌতুহলের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। পাগলের মতো ঘরময় পায়চারি করছে আর একে ওকে জিজ্ঞেস করছে ঘটনা কী। এতবড় ঘটনা পেটের ভেতর চেপে যাচ্ছে সে কথা ভাবতেই অদ্ভুত আনন্দে মনটা ক্ষণে ক্ষণে দুলে উঠছে রিনির। মাকে পুরো ঘটনা বললে দুইয়ে দুইয়ে চারের বদলে আট মিলিয়ে পুরো বাংলাদেশ ছড়িয়ে দেবে নিশ্চিত। উচিত, অবশ্যই মেলানো উচিত। তবে এখনি না। মুয়াজ্জিন সবে বিবাহ কার্যক্রম শুরু করেছে। বিয়ে হোক, গ্রাম ছেড়ে সবাই শহরে পৌঁছাক। তারপর নাহয় আয়েশ করে ঘটনা রটনা সব হবে। ঘরভর্তি মানুষের ভীড়ে ঠিকঠাক দুজনকে ক্যামেরা বন্দী করা যাচ্ছে না। টেবিলের উপর উঠে দাঁড়ালো রিনি। ঘটনার পাশাপাশি দেখার মতোও কিছু একটা তো চাই। ভেজা চোখে, পৃথিবীর সমস্ত অসহায়ত্ব বরণ করে দুজন কবুল বলছে, একটা ঘটনাকে আরো মুখরোচক করতে এরচেয়ে সুন্দর দৃশ্য আর কীইবা হতে পারে? 

.

ঘরের সবাই একযোগে বলে উঠলো আলহামদুলিল্লাহ। বললো না শুধু অমিত আর নবনীর মা-বোন। পাশের ঘর থেকে সুরাইয়া শুনতে পেলো কে যেন চিৎকার করে বলছে, “কবুল পড়ানো হইছে! জলদি কইরা মিষ্টি আনো”। 

মুখে আঁচল চেপে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো সুরাইয়া। বহুবছর আগে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সে, ছেলেমানুষী সিদ্ধান্ত! বাবা বলেছিল, ফিরে আয় নয়তো আগুনে পুড়বি। বাবার চোখে চোখ রেখে নির্লজ্জ প্রেমিকার মতন দৃঢ় কণ্ঠে সে বলেছিল, রাশেদের প্রেমে আমি জ্বলে ছাই হয়ে গেছি বাবা। ছাই কখনো পোড়ানো যায়? বাবার কথার অর্থ সেদিন ১৭ বছর বয়সী সুরাইয়ার জ্ঞানে আঁটেনি। বিয়ের পর মাস ছয়েক যেতে না যেতেই বাবার বলা প্রতিটা কথার মর্ম টের পেয়েছে হারে হারে। কালে কালে বুঝে গেছে মির্জা বাড়ি পুরোটাই আস্ত একটা অগ্নিকুন্ড, যে আগুনে সে ঝাঁপ দিয়েছিল স্বেচ্ছায়। তার একটা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে তার সঙ্গে জ্বলছে তার ছেলে, আজ পুড়লো তার ভাতিঝি। এবার তার মুক্তি চাই! মৃত্যু অবধি এখানে জ্বলবার মতন ধৈর্য্য আর তার নাই। সংসার গোল্লায় যাক, শেষ বয়সে এসে গায়ের উপর “ডিভোর্সি” সিলমোহর লাগুক, তাতে আর কিছুই আসে যায় না! খাটের নিচ থেকে টেনেটুনে ব্যাগ বের করলো সুরাইয়া। এখানে সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা সব জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছে সে। আজই ঐ মেরুদন্ডহীন লোকটার সংসার ত্যাগ দেবে সে। 

১১

মধ্যদুপুর। বাস ছুটছে ঢাকার পথে। বোনকে বুকে জড়িয়ে বসে আছে নাতাশা। খানিক আগেই বাসে উঠার সময় মাথা ঘুরিয়ে পড়তে যাচ্ছিল নবনী। পেছন থেকে অমিত এসে আঁকড়ে ধরলো। মাথায় পানি ঢেলে, জোর করে মুখে পাউন্ড কেক আর ডাবের পানি ঢুকিয়ে দেবার পর গায়ে কিছুটা জোর পেলেও এখনো ঠিক ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি সে। কিছুক্ষণ পরপর কেঁপে কেঁপে উঠছে। থেমে থেমে বিড়বিড় করে কী যেন বলছে, সে কথা নাতাশার কান পর্যন্ত যাচ্ছে না। চোখের সামনে আটবছর আগে সেই দিনটার কথা নবনীর চোখে ভাসছে। স্তব্ধ নবনী, ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া নবনী! তারপরের একটা বছর কী কী ঘটেছিল, সেসব ভাবতে ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয় নাতাশার। তেমন কিছু আবারও ঘটতে যাচ্ছে না তো? এবারের মতো ধাক্কা সামলে নিতে পারবে তো নবনী? আসন্ন বিপদের কথা ভেবে অস্থির হয়ে উঠে নাতাশা, হৃৎস্পন্দন গাঢ় হয়, দু’চোখ বেয়ে কান্না নেমে আসে। বোনকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে সে। 

ওপাশের সারিতে বসে আছে অমিত, অনি। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সে। শূণ্য চোখে তাকিয়ে আছে বাইরে। বাসে উঠার পরই মোবাইল নেটওয়ার্ক ফিরে এল। একের পর এক মিসডকল এ্যালার্ট আর ম্যাসেজ নোটিফিকেশন টুংটাং শব্দে স্ক্রিনে ভাসতে থাকলো। অফিস থেকে কল এসেছিল, বাবা আর বন্ধুরা কল করেছিল, কল করেছিল মুনিয়াও। মোবাইল সুইচড অফ পেয়ে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে গালি ভরা ম্যাসেজ, ব্রেকআপের হুমকি-ধমকি দেয়া ম্যাসেজ। ম্যাসেজগুলোতে একনজর চোখ বুলিয়ে স্ক্রিন অফ করে হাতের মুঠোয় মোবাইল নিয়ে বসে রইলো সে। মুনিয়ার রাগ, গালি কিংবা হুমকি কোনোটাই এই মুহূর্তে তাকে স্পর্শ করতে পারছে না। আজ যা কিছু ঘটে গেল তারচেয়ে মন্দ আর কীইবা হতে পারে? অনাকাঙ্খিত এই সম্পর্ক কতটা ভোগাবে তাকে? এই সম্পর্কের ইতি ঘটবে কবে? মুনিয়া? সে কি জেনে যাবে এই সম্পর্কের কথা? আর তারপর? মুনিয়ার সঙ্গে সত্যিই কি চিরতরে ভালোবাসা মিটে যাবে? সম্পর্ক ভেঙে যাবে? মুনিয়াকে হারিয়ে ফেলবে সে? হাজারো প্রশ্ন টর্নেডো হয়ে ঘুরছে মাথার ভেতর। সকাল থেকে ঘাড়ে ব্যথা হচ্ছিল। ক্রমশ সেই ব্যথা যেন বাড়ছে। ঘাড় সোজা করে বসাই দায় হয়ে গেছে। বেডরুমের বিছানা-বালিশকে মনে পড়ছে খুব। মানুষের ডানা থাকলে ভীষণ ভালো হতো। এক্ষুনি ডানা মেলে উড়ে চলে যেত নিজের বাসায়, বেডরুমে। পর্দা বন্ধ করে, দরজা আটকে ফুলস্পিডে ফ্যান ছেড়ে স্লিপিং পিল খেয়ে লম্বা ঘুম দেয়া যেত। হঠাৎ ঘাড়ে স্পর্শ পড়লো। চোখ বুজেই রইলো অমিত। সে জানে হাতটা অনির। আপন মানুষরা কিছু না বলতেও মনের কথা বুঝে ফেলার চমৎকার ক্ষমতা আছে মেয়েটার। হাত ঘুরিয়ে অমিতের ঘাড় ম্যাসাজ করে দিচ্ছে অনি। নিচুস্বরে বলছে, — “তুমি অসুস্থ হলে চলবে না। বাবার বয়স হয়েছে। এসব শুনলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। তোমাকেই সব সামলাতে হবে- আমাদের বাসা, নবনী আপুর বাসা। মাথা ঠান্ডা রেখে সব ভাবতে হবে।”

পেছনে বসে আছেন শামীমা আর নীতু। কেউ কাউকে কিছু বলছেন না। কঠিন মানসিক ধাক্কায় মানুষ স্তব্ধ হয়, কথা হারিয়ে ফেলে। তাদের বেলায়ও তেমনটাই হয়েছে। নীতু চোখ বুজে শামীমার কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে আছেন আর শামীমা তাকিয়ে আছেন জানালার বাইরে। এতবড় ঘটনা ঘটে গেল অথচ কেউ কারো স্বামীকে এখনো এ ব্যাপারে কিছুই জানাননি। শামীমা দু’বার কল করতে গিয়েও করেননি। কথা বলায় তীব্র অনীহা জেগেছে তার। অমিতের বাবাকে কী বলবেন, কিভাবে বলবেন কিছুই মাথায় আসছে না। নীতুরও আপাতত কিছু ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না, বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। তার মোবাইল কোথায় আছে সে কথাও তার জানা নেই। এখনো গোটা ব্যাপারটা যেন স্বপ্ন মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, ঘুমটা ভেঙে গেলেই সবকিছু মিথ্যে হয়ে যাবে। 

***** 

নাতনীকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছেন জামিলা বেগম। থেমে থেমে কেঁপে উঠছে তার নাতনী। ভীষণ জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে তার গা। দোয়া কালাম পড়ে অনবরত নবনীর গায়ে ফুঁ দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অনেকক্ষণ যাবৎ মেয়ের জামাইর চিৎকার চেঁচামেচি শুনছেন তিনি। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আছে তার। ঘরে অসুস্থ মেয়ে, 

নিজেরও তো হাই প্রেশার। এমন অবস্থায় চিৎকার করা কতটুকু সমীচীন? কঠিন পরিস্থিতি সামলাতে হয় ঠান্ডা মাথায় বিচার বিবেচনা করে। রাগারাগি করে জীবনে কে কোন রত্ন উদ্ধার করেছে? সেই কখন থেকে তার মেয়ে, ছোট ছেলে আর ছেলের বউ বুঝিয়েই যাচ্ছে উত্তেজিত না হতে, আর এই লোক গরুর মতো গলা ছেড়ে ডেকেই যাচ্ছে। কে বোঝাবে এই লোককে? কিভাবে শান্ত হবে সে? 

.

— “মামলা করবো আমি, মামলা! শিপন আমার সঙ্গে যাবি? না যেতে চাইলে ঘরেই বসে থাক। মেয়ে আমার, মাথাব্যথাও আমার। আর কারো কিছুই যায় আসে না!”

শফিক সাহেবের বলা কথাগুলো ওপাশের ঘর থেকে নবনীর ঘরে বসে স্পষ্ট শুনতে পেলেন জামিলা বেগম। কথাগুলো তার কানে এসে তীরের মতো বিধলো যেন। প্রচন্ড রাগে মুহূর্তেই চেহারা কঠিন হয়ে গেল তার। নাতাশার কাছে নবনীকে রেখে তিনি উঠে এলেন ও’ঘর ছেড়ে। 

— “কী কইলা শফিক তুমি? মাইয়্যা তোমার, মাথাব্যথাও তোমার? নবনী শিপনের কিছু লাগে না? নবনী, নীতুর কিছু লাগে না? নবনী আমার কিছু লাগে না? ওরে বুকে রাইখা বড় করছি আমরা। শিপনের জান হাজির নবনীর লাইগা আর তুমি কও এসব কথা? 

— “আম্মা থামো তো। দুলাভাইয়ের মাথা ঠিক আছে নাকি এখন?” 

— “তর মাথা ঠিকাছে? তুই নবনীরে নিয়া চিন্তা করতাছোস না?”

— “বাদ দাও না আম্মা!” 

— “দিমুনা বাদ। শফিক খুব শক্ত কথা বইলা ফালাইছে। 

— “কী বলতে কী বলে ফেলেছি, আপনি সেই কথা ধরে বসে গেলেন! আমার মেয়েটার কী একটা হাল করলো ঐ লোক। এত বড় অন্যায়! ঐ জানোয়ারকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া উচিত। অথচ আমি একটা মামলা করতে চাইছি, সবাই আমাকে মানা করছে কেন?” 

— “আগে কও তুমি চিল্লাইতাছো ক্যান?” 

— “নিচুগলায় কথা বলার পরিস্থিতি কি আছে আম্মা?” 

— “আমরা কইতাছি না? চিল্লায়া কী সমাধান করতে চাও তুমি? সমাধান তো হইবোই না, উল্টা আমার অসুস্থ নাতনীর শরীর আরো খারাপ হইব, প্রেশার বাড়াইয়া তুমি হাসপাতাল ভর্তি হইবা, আর তোমার চিল্লানিতে পুরা এলাকাবাসী জানবো নবনীর বিয়া হইছে। খুব ভালা হইব না কও?” 

সোফায় ধপাস করে বসে পড়লেন শফিক সাহেব। সমস্ত আক্রোশ হঠাৎ কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। শরীরে-কণ্ঠে নেমে এল অবশ করা ক্লান্তি। গলা ধরে আসছে তার। মেয়ে জামাইর মাথায় এসে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন জামিলা বেগম। আদুরে স্বরে বললেন, 

— “ঘটনা সবে আজকে ঘটলো। মামলা মোকদ্দমা কোনো সমাধান না। এইটা জমি সংক্রান্ত বিষয় না। এইটা হইলো তোমার মাইয়্যার বিয়া, তোমার মাইয়্যার জীবনের ব্যাপার। মামলা কইরা লোক জানানো কোনো বুদ্ধিমানের কাম হইব না। ভাবো, ঠান্ডা মাথায় ভাবো। যা হইয়া গেছে তা আমরা কেউ বদলাইতে পারমু না। দুই পরিবার বইসা আপোষে একটা সমাধানে আইতে হইবো।

— “আর কী সমাধান হবে আম্মা? নবনী আবার আগের মতো হয়ে গেলে? কিভাবে সমাধান হবে বলুন তো? কী করবো আমি? কী করে সবকিছু সামাল দেবো?” 

— “নবনীর আব্বু, তুমি শান্ত হও। তোমার মেয়ে অসুস্থ হওয়ার আগে মনে হচ্ছে তোমাকেই হসপিটাল নিতে হবে। আর কোনো সমস্যা আমি দেখতে চাই না। শান্ত হও, প্লিজ!” 

— “হইবো শান্ত। তুই যা, ভাত দে টেবিলে। শফিকে বাসায় ফিরা কিছু খায় নাই। রাত অনেক হইছে। ঐ সুমি, যাও, তোমার আপার লগে যাও। তরকারী-টরকারী বাইড়া আনো।” 

— “কিসের মধ্যে কী বলছেন আম্মা? আমার গলা দিয়ে ভাত নামবে?” 

— “এত ভাবো ক্যান? তুমি কি একলা? আছি না আমরা? তোমার মা মরছে পরে কানতে কানতে কইছিলা আমার এক মা মরছে, আরেকজন তো আছে। তারে বুকে নিয়াই বাকি জীবন কাটামু। সেইদিন থেইকা আমিও তোমারে নিজের পোলার মতই মানি। সন্তান পেরেশানিতে ভুগবো আর মা কোনো সমাধান দিবো না এইটা হয়? তোমার সমাধান আমি ভাইবা রাখছি। খালি একটু ভরসা রাখতে হইবো মায়ের উপর এই যা! একটু কঠিন হইবো ব্যাপারটা, কিন্তু অসম্ভব না। 

— “কী সমাধান?” 

— “আগে খাও। রাইতে খাওনের পরে ওষুধ আছে তোমার। ওষুধ না খাইলে প্রেশার বাড়বো।” 

***** 

টি টেবিলে পা তুলে, সোফায় হেলান দিয়ে আয়েশ করে বসে পান আপেল চিবুতে চিবুতে টিভি দেখছেন এরশাদ সাহেব। অনি আর শামীমা চরম বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে এরশাদ সাহেবের দিকে। কতবড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল তাদের জীবনে, অথচ ঘরের কর্তার এই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই? এতটাও দায়িত্বজ্ঞানহীন তো তিনি নন। তাহলে আজ কী করে মানুষটা এত আয়েশ করে বসে টিভি দেখছে? গলার ভেতরেই বা খাবার যাচ্ছে কী করে? এই বাসার বাকি কেউ তো এখনো মুখে কিছু তোলেনি! বাসায় আজ রান্না পর্যন্ত হয়নি। সকালের ভয়-আতংক এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। কতদিনে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যাবে সে কথা ভাবতে গিয়ে বারবার হাঁপিয়ে উঠছেন শামীমা। 

— “রাতে কী খাবে তোমরা? গ্রিলড চিকেন আর নান অর্ডার করি?” 

রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এল শামীমার। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে রিমোটের বাটন চেপে টিভি বন্ধ করলো সে। 

— “মনসা তুমি! এমন ফসফস করছো কেন?” 

— “ফাইজলামি করো অমিতের আব্বু? টেনশনে মরে যাচ্ছি আমি। মাথা ঘোরাচ্ছে আমার। 

— “বিপি হাই হয়েছে বোধহয়। এই অনি, যা তো মেশিনটা নিয়ে আয়। তোর মায়ের বিপি চেক করি।” 

— “আব্বু!” 

— “চিৎকার করছিস কেন?” 

— “আমাদের পাত্তা কেন দিচ্ছো না? এমন বাজে সিচুয়েশনে তুমি এত কুল আছো কিভাবে?” 

— “কিসের বাজে সিচুয়েশন? সকালে যা কিছু হলো সেটাকে বাজে বলছিস?’ “বাজে না?” 

— “হ্যাঁ প্রথমে আমারও বাজে লেগেছিল। বিকট রকমে বাজে। ইচ্ছে হয়েছিল চামারটাকে মেরে লাশ বানিয়ে দেই। তারপর আমি বাসা থেকে বের হলাম। এক কাপ মসলা চা নিলাম সামনের টং দোকান থেকে। যা চা বানায় নারে লোকটা! আহ্! চুমুক দিতেই মগজের দরজা খুলে গেল। যা বলছি মন দিয়ে শোন। আগেই কিছু বলবি না। পুরোটা শুনবি, তারপর বলবি।”

— “হুম।”

— “যা কিছু হয়েছে একেবারে মন্দ হয়েছে ঠিক তাও না। বিবেচনা করতে গেলে মন্দের চেয়ে ভালোটাই বেশি। কেমন করে বল তো?”

— “কেমন?” 

— “তোর মা বিয়েতে গিয়ে নবনীর কথা বললো আমাকে। মেয়েটা কিন্তু দারুণ। অমিতের সঙ্গে দারুণ মানায়। আমাদের পছন্দ করা মেয়ের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে। মন্দ কী? আপোষে না হয়ে, জোর করে হলো। ওদের নামে বাজে কথা রটলো আত্মীয়দের মাঝে এই তো! এটাই যা খারাপ হলো। এছাড়া তুই যদি সুদূরপ্রসারী চিন্তা করিস, ব্যাপারটা কিন্তু চমৎকার। আমার ছেলে খুবই ভালো। হ্যাঁ, একসময় বখাটেপনা করেছে খুব। এখনো মাঝেমধ্যে হুটহাট বখাটে ছেলের মতো আচরণ করে। কিন্তু মনটা তো সুন্দর। সবচেয়ে বড় কথা আমার ছেলে যাকে ভালোবাসে, নিজেকে ভেঙেচুরে ভালোবাসে। বউকে কতটা মাথায় তুলে রাখবে সেটা ওর প্রেমিকার জন্য অবসেশন দেখে আন্দাজ করেছিস নিশ্চয়ই?” 

— “আব্বু…” 

— “এই দাঁড়া, আমি আগে শেষ করে নেই। আমার ছেলে দেখতে ভালো, ভালো জব করছে, মাস শেষে প্রায় লাখ টাকা ইনকাম করছে। অফিস থেকে ভালো সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে, আমি ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট ওকে দিয়েছি। শ্বশুর-শাশুড়ির ঝামেলা নেই। দুই বুড়ো-বুড়ি থাকবো চট্টগ্রাম। তোর পড়া শেষ হলে তুইও চলে যাবি ওখানে। পুরো সংসারটা তো ওর একারই। আর কী চাই মেয়েপক্ষের? আর নবনী? লক্ষী মিশুক একটা মেয়ে। দেখতে সুন্দর, শিক্ষিত, নিজের বিজনেস আছে, ইনডিপেন্ডেন্ট। আমার ভাই-ভাবী, নাতাশা ওরা খুব ভালো। একটা ভালো পরিবার পাওয়া খুব ভাগ্যের ব্যাপার। ছেলেমেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য যা কিছু বাবা-মা চায়, সবই আছে ওদের মাঝে। সুতরাং কোনো পক্ষ করার কোনো প্রশ্নই উঠে না। আমি আমার ছেলের বিয়েতে খুব খুশি। তোমরা কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছো না তাই আমি চুপ হয়ে আছি। নয়তো এতক্ষণে ছেলের বউ বাসায় নিয়ে আসতাম। যা কিছু হয়েছে তাতে মন খারাপের কিছু নেই। বরং ভালো হয়েছে, খুব ভালো। তুমিই ভাবো শামীমা, ছেলেকে নিয়ে আমরা কত টেনশনে আছি দুইবছর যাবৎ। অমিত প্রচন্ড মানসিক চাপে আছে মুনিয়াকে নিয়ে। ওর সম্পর্কটা একজায়গায় থেমে আছে। আগায়ও না, পেছায়ও না। তুমি আমি তো চাইছিলাম সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাক। ও নতুন কারো সঙ্গে জীবন গড়ুক, হয় নিজে পছন্দ করে নিক নয়তো আমরা পছন্দ করে একটা লক্ষী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেই। ও মুনিয়ার গন্ডি থেকে বেরই হতে পারছিল না। কত মেয়ে দেখাতে চাইলাম, ও দেখেনি। কত বুঝিয়েছি, ও বোঝেনি। দুইবছর ধরে ঐ মেয়ে ওকে একটু একটু করে শেষ করছে, ওকে দেখে আমরা শেষ হচ্ছি। আপোষে তোমার ছেলে কখনো অন্য কাউকে বিয়ে করতো, বলো তুমি? করতো?” 

ডানে বামে মাথা নাড়লেন শামীমা। স্ত্রীর কাঁধ জড়িয়ে এরশাদ বললেন, 

— “ব্যস, আর কিছু ভেবো না। যা আমরা পারতাম না তা রমিজ বুড়া করে দেখিয়েছে। এখন শুধু ভাবো ছেলে আর বউয়ের একছাদের নিচে থাকার বন্দোবস্ত কিভাবে হবে?” 

— “তুমি ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছো, বাকি সবারও এতটাই সহজ ভাবতে হবে তাই না? ভাবী আমাকে আগেই না করে দিয়েছে। কেন না করলো তা ঠিক আমার জানা নেই। এমনও হতে পারে আমার ছেলেকে উনার পছন্দ না। কিংবা আমাদের পরিবার। আর রইলো কথা অমিত নবনীর। নতুন সম্পর্কের মূলই হলো ওরা দুজন। নবনী হয়তো অন্য কাউকে ভালোবাসে। আর অমিত? ও তো ডুবেই আছে মুনিয়ার মাঝে। সারাদিন মুন মুন করে মরে যায় তোমার ছেলে। নবনীর নাম আদৌ ওর মুখ থেকে বেরোবে, না ওর মনে কখনো নবনীকে জায়গা দেবে? পুরো ব্যাপারটাই ঘোলাটে অমিতের আব্বু। কিছুই ঠিক নেই। অন্তত মেয়েপক্ষের ওরা পজিটিভ হতো তাহলে হয়তো আমি এতটা ভাবতাম না। অমিতকে ব্ল্যাকমেইল করে, ঝগড়াঝাটি করে রাজি করিয়ে নিতাম। 

— “আমিও এক্সাক্টলি আম্মুর কথাগুলোই বলতে চাইছি আব্বু। তবে আম্মুর শেষ কথাগুলোয়ও আমার আপত্তি আছে। ব্ল্যাকমেইল করবে মানে? ও কি ছোট? ৩৪ হয়ে গেছে ওর। এতবড় মানুষটাকে তোমরা ব্ল্যাকমেইল করলেই তো আর চলবে না। যতদিন না ও নিজে মুনিয়াকে মন থেকে বের করছে, ততদিন পর্যন্ত কিচ্ছু হবে না। জোর করে কখনো কাউকে মনে জায়গা দেয়া যায় না। তাছাড়া নবনী আপু এখনো উনার বয়ফ্রেন্ডকে মনে ধরে বসে আছে।” 

— “বয়ফ্রেন্ড? রিলেশন আছে ওর?” 

— “নাহ্ যার সঙ্গে রিলেশন ছিল তার কথা বলছি। 

— “ওহ্! ঐ ছেলেটা। ও তো নেই। যে নেই তাকে নিয়ে ভেবে লাভ কী? ওকে আপাতত একটু সাইডে রাখি, কেমন?” 

— “না আব্বু। সাইডে রাখা চলবে না। সে এই গল্পে একজন মেইন ক্যারেক্টার।”

— “মেইন ক্যারেক্টারকে নিয়ে তখনই ভাবতাম যদি সে বর্তমানে এখানে থাকতো। ও নেই অনি। যে নেই তাকে নিয়ে এত মাথাব্যাথারও কিছু নেই। ঐ ঘটনার আরো আট বছর কেটে গেছে। আটবছর কম সময় না।” 

— “কিন্তু আপু তো উনাকে এখনো সেই আগের মতই ভালোবাসে। বরং ওর কথায় যা মনে হলো, আপু ভাবে ঐ মানুষটা এখনো ওর সঙ্গেই আছে।” 

— “এতবছরে হয়তো নতুন কারো সঙ্গে সম্পর্কে জড়ায়নি ও। বা জীবনে এমন কিছু ঘটেনি যাতে সে ঐ ছেলেটার গন্ডি থেকে বেরিয়ে নিজেকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারে। আজ ওর জীবনে যা কিছু ঘটেছে এরপর কিন্তু আগের মতো আর সবকিছু নেই। অমিতের বউ সে। ওর প্রাক্তনকে নিয়ে যদি দিনে দশবার ভাবে, আমার অমিতকে নিয়ে অন্তত একবার হলেও ভাববে। ভাবতে ভাবতেই একটা গতি হবে।” 

— “ইলজিক্যাল কথাবার্তা!” 

— “তোর মা বিয়েতে রাজি ছিল না। বিয়ের প্রথম একমাস মনসার মতো ফসফস করতো। ধারে কাছে ঘেঁষতে দিতো না। এখন দেখতো, বাসায় ফিরতে দেরী হলে কয়বার কল করে আমাকে। 

— “তোমাদের সিচুয়েশন আর ভাইয়ার সিচুয়েশন সেইম না। ওরা কেউ কাউকে ঠিকমতো চেনেই না, আর সবচেয়ে বড় কথা ওরা দু’জনই অন্য কাউকে নিয়ে অবসেসড। 

— “আপাতত আমার কথা তোর পাগলামি মনে হবে। কিন্তু বিশ্বাস কর, একছাদের নিচে বাস করতে করতে দুজন দুজনে অভ্যস্থ হয়ে যাবে। মুনিয়ার কাছে তোর ভাই পাচ্ছে টা কী? দিনরাত নিয়ম করে লাখি গুতাই তো খাচ্ছে। চোখের সামনে সারাক্ষন একটা মেয়েকে যখন ঘুরঘুর করতে দেখবে তখন আপনাআপনিই একটু হলেও ওর সম্পর্কে তোর ভাইয়ের জানতে ইচ্ছে হবে, ওকে বুঝতে ইচ্ছে হবে। নবনী কি ফেলনা মেয়ে নাকি যে অমিতের ওকে চোখে পড়বে না? আর ঐ ছেলেটা তো নবনীর জীবনে এখন আর নেই। আমার ছেলে আছে। ওদের শক্তপোক্ত একটা সম্পর্কও হয়েছে। সম্পর্কের একটা জোর আছে না বল? ও যখন দেখবে ওর হাজবেন্ড অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্কে আছে তখন হিংসায় পাগল হয়ে দেখবি আমার ছেলের দিকে মন দিয়েছে। আরে হিংসা তো মেয়েদের কমন প্রবলেম। নবনীর হিংসা হবেই হবে, দেখে নিস তোরা।” 

অনি, শামীমা দাঁতে দাঁত চেপে তাকালো এরশাদের দিকে। 

জিভ কাটলেন এরশাদ সাহেব। মিনমিন করে বললেন, 

— “আশ্চর্য! সব কথা ধরতে হবে কেন? মুখ ফসকে বলে ফেলেছি।” 

— “আচ্ছা দিলাম বাদ। কথা শোনো, একছাদের নিচে বাস করার জন্য ওদের রাজি ও তো হতে হবে, তাই না?” 

— “হবে, আমরা রাজি করাবো। কিন্তু আগে কথা বলবো মেয়েপক্ষের সঙ্গে। দেখি উনাদের মতামত কী।

— “যদি দিতে না চায়?” 

— “না করবে বলে মনে হয় না। ফেরার পথে ভাই বলছিল, তোর অমিতকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমার নবনীর জন্য একদম পারফেক্ট। কিন্তু আমার মেয়েটা… ব্যস এতটুকুই বললো। উনি আর কথা বাড়াননি, আমিও আর কিছু জিজ্ঞেস করিনি।” 

— “অদ্ভুত কান্ড অমিতের আব্বু! তুমি জিজ্ঞেস কেন করলে না?” 

— “কেন যে জিজ্ঞেস করলাম না নিজেও জানি না। সে যাই হোক, ওসব বাদ। বিয়ে হয়েই গেছে, চাইলেই বিয়ে ভাঙা যায় না। কাল সকালে আমরা যাবো, কথাবার্তা বলবো। তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে, বউ কবে নাগাদ আমরা বাসায় আনছি।” 

— “আব্বু তুমি সিওর সব ঠিক হবে? সবটা তুমি সামলে নিতে পারবে?” 

— “ধুর, মুখটা আর প্যাঁচার মতো করে রাখিস না তো। তোর ভাইয়ের বিয়ে, একটু হাসিখুশি থাক। এখন বল কী খাবি?” 

শামীমা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজলেন। এখন মনে হচ্ছে সব ঠিক হবে, চমৎকারভাবেই ঠিক হবে। যা কিছু হয়েছে তার পুরোটাই মন্দ হয়নি। মন্দের আড়ালে খুব ভালো কিছুও হয়েছে। 

১২

নবনীদের ফ্ল্যাটে হঠাৎ করেই নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। এতটা সময় ধরে শফিক- নিতুর বেডরুম থেকে গুনগুন শব্দ ভেসে এলেও এখন আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। শফিক আর জামিলা বেগমকে মধ্যখানে রেখে চারদিকে চারজন দাঁড়িয়ে আছে। চারজনেরই দৃষ্টি আটকে আছে শফিকের দিকে। কী বলবে সে এখন? কী সিদ্ধান্ত নেবে? 

— “একটা সিদ্ধান্ত নেও শফিক। এইভাবে তো আর হয় না।”

— “আমি নিজেও বুঝি তা হয় না। নবনীর বয়স আর দুইমাস বাদে ত্রিশ হবে। আমার ছোট মেয়েটাও ছাব্বিশে পা দিলো। দু’জনের বিয়ে নিয়েই আমি ভাবি। কিন্তু পরিস্থিতি কি আমার পক্ষে আছে? নবনীর সামনে বিয়ের কথা উচ্চারণ করার সাহসও আমার হয় না। চাইলে নাতাশাকে বিয়ে দিতে পারি। কিন্তু সমাজ আছে, আত্মীয়স্বজন আছে। দশটা মানুষ নিয়েই তো আমার চলতে হয়। নবনীকে রেখে নাতাশাকে তো আমি বিয়ে দিতে পারি না। কত কথা উঠবে তা তো আর আপনার অজানা না।

— “দেখো, এতদিন যা পরিস্থিতি ছিল তা কিন্তু পুরাটাই উল্টায়া গেছে। নতুন কইরা নবনীরে বিয়ার লাইগা রাজি করানোর কিছু নাই। এখন ওরে রাজি করাইতে হইব সংসারের লাইগা। যা হইছে তা মাইনা লওনের লাইগা।”

— “আমিও চাই আমার মেয়ের ঘর সংসার হোক। কিন্তু কিভাবে?” 

বাবার সঙ্গে সঙ্গে নাতাশাও বলে উঠলো, 

— “ঠিকই তো নানী। এই কথা আপুকে বলবো কিভাবে। চোখের সামনে দেখতেই পাচ্ছো আপু কেমন অসুস্থ হয়ে গেছে। সামি ভাইয়ার বাইরে আপু আর কিছুই ভাবতে পারে না। উনার মাঝেই ওর জীবন আটকে আছে। সামি ভাইয়াকে বাদ দিয়ে অন্য কারো সঙ্গে সংসারের কথা… কিভাবে সম্ভব?” 

— “সামিরে কি আমি ভুলতে পারছি? তোরা কেউ পারছোস? মরার আগ পর্যন্ত ওরে ভুলা সম্ভব না। তাই বইলা তো জীবন থামায়া রাখা যাইবো না। নবনী যেহেতু বাঁইচা আছে, জীবন তো তারে চালাইতে হইব। আট বছর সময় তো কম না রে নাতাশা। নবনী সামিরে মনে ধইরা সারাজীবন কাটাইতে চাইলো, আমরাও ওরে তাই করতে দিতাছি। কেউ কি কখনো সময় নিয়া ওরে বুঝাইছি, এইবার তোর আগানো উচিত। একে তো মনে সবার ভয় ছিল নবনীরে এসব কইলে না আবার কোন কেলেংকারী ঘটে। আর সবচেয়ে বড় কথা হইলো সামিরে আমরাই এখনো এক সুতাও ভুলতে পারি নাই, সেইখানে নবনীরে সব ভুইলা আগাইতে আর কী কমু? এখন যেহেতু ঘটনা ঘইটাই গেছে সেইটা মাইনা নেয়াই মঙ্গল। মনডারে এইবার আমগো শক্ত করতে হইবো, নবনীর ভালোর লাইগাই করতে হইবো। এছাড়া আর পথ খোলাও তো নাই।” 

নীতু বলল, 

— “চোখে মুখে এখনও আমি অন্ধকারই দেখছি আম্মা। রিনি একদম ওর মায়ের মতই হয়েছে। অসভ্য ইতর স্বভাবের। একে তো সোশ্যাল মিডিয়ায় অমিত-নবনীর বিয়ের ভিডিও আপলোড করেছে, তার উপর জনে জনে কল করে বলছে, কুকর্ম করতে গিয়ে ধরা খেয়েছে ওরা। তাই ধরে-বেঁধে বিয়ে দিয়েছে। আত্মীয়রা ছিঃ ছিঃ করছে আম্মা। শফিককে আর আমাকে ফোন করে যা তা বলছে। শামীমা ভাবী কল করেছিল। বললো, উনাদেরও নাকি বাজে সব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এমন বিপদের সময় আত্মীয়রা কোথায় পাশে দাঁড়াবে, তা না! উল্টো আমাদের পেরেশানি আরো বাড়াচ্ছে। তোমাকে আমি না করে দিলাম নবনীর আব্বু, তোমার ভাই বউ আর ভাতিজি যেন আর কখনও আমার বাসায় পা না রাখে। আমার সামনেও যেন না। রিনিকে সামনে পেলে কষে চড় লাগাবো আমি। 

— “ইশ! থাপ্রাথাপ্রি পরে করিস। আগে ঘর কেমনে সামলাবি সেইটা ভাব।” 

— “নানী, আপু রাজি হবে না। উল্টো সবকিছু আরো নাগালের বাইরে চলে যাবে। 

— “তোর মতে আর কোনো পথ আছে? দেখা আমারে?” 

  • ……………….

— “এই যে চুপ কইরা আছোস। পথও দেখাবি না, আবার আমার দেখানো পথে চলবিও না। তা তো হয় না রে ময়না। নবনীরে আমরা সবাই মিলামিশা বুঝামু দরকার পরলে ওরে আমরা সময় দিমু। জামাইরও তো ওরে বুঝার দরকার আছে।”

— “নবনীর যে সমস্যা, তার কী হবে?” 

— “সেইটা নিয়া আমিও একটু ভাবতাছি। তার উপর জামাইরও নাকি কার সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসা আছে। এক্কেরে গোঁজামিল কান্ড! কেমনে যে কী হইব নিজেও হিসাব মিলাইতে পারতাছি না। তবে আশাও ছাড়তাছি না। দুইটারে এক বাসায় রাখা হোক। একলগে থাকতে থাকতে মায়া মহব্বত হইবোই। আরে চোখের সামনে বহুদিন একটা গাছ পইড়া থাকলেও তো মায়া লাইগা যায়। আর ওরা তো জ্বলজ্যান্ত মানুষ।”

— “আম্মা, যদি কখনো কোনো টানই ওদের মাঝে তৈরী না হয়, তখন?” 

— “দ্যাখ শিপন, বিয়া হইছে সেইটা সারা দুনিয়া এখন জানে। ওরা কুকাম করতে গিয়া ধরা খাইছে সেইটাও সারা দুনিয়া জানে। এখন যদি আমরা তালাক্ব নিয়া ফিরায়াও নিয়া আসি তাতে কিন্তু ওগো গায়ের উপর থেইকা “বিয়াত্তা” সিল উইঠা যাইবো না। ওরা কুকাম করছে সেইটাও মানুষ ভুলবো না। বরং আরো একটা খারাপ শব্দ ওগো লগে জুড়বো ওরা তালাকপ্রাপ্ত। কতাডা শুনতে খুব ভাল্লাগবো? একটুও না। তার চেয়ে বরং থাকুক একলগে, মায়া মহব্বত হইলেও হইতে পারে। হইয়া গেলে ভালো, আমগো চিন্তা শেষ হইব। ‘ওগো সুন্দর একটা গতি হইব। সুযোগ যেহেতু আছে সেইটা আমরা কামে কেন লাগামু না? আর না হইলে কী হইব সেইটা আমি আপাতত ভাবতে চাইতাছি না। আমি এহন খারাপ কুনু কতাই মাথায় আনমু না।” 

— “তাহলে আম্মা আমি কি এরশাদকে কল করবো? দেখি ওরা কী বলে?” 

— “হ দেও। ফোনে কতা না কইয়া জামাইসহ বাসায় আইতে কও। সামনাসামনি কতা হউক।”

— “কিন্তু নানী…” 

— “ঐ ছেড়ি এত বাগড়া দিবি না তো। নানী কী কইতাছি ঐডা শোন। তোরে নবনী অত্যাধিক আদর করে, তুই কিছু কইলে ঠান্ডা মাথায় শুনবো। আমি ওর লগে যখন কতা কইতে বসমু, তুইও আমার লগে থাকবি। ওরে বুঝাইবি।” 

নানীর প্রস্তাবে প্রবলভাবে সায় দিতে ইচ্ছে হলেও কী যেন বাঁধ সাধছে নাতাশাকে। কী সেই বাঁধ? সামির প্রতি অগাধ মায়া নাকি অপ্রত্যাশিত সম্পর্কের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ? 

১৩

ড্রইংরুমে বসে আছে দুই পরিবার। কাজের মেয়ে শান্তা অনেক আগেই চা-নাস্তা রেখে গেলেও কেউই মুখে কিছু তোলেনি। পুরো ঘরের সবাইকে দুশ্চিন্তায় দেখা গেলেও, একমাত্র ফুরফুরে মেজাজে আছেন এরশাদ সাহেব। হাসি যেন তার মুখ থেকে সরছেই না। তার প্রিয় মোগলাই পরোটা সুন্দর পিস করে টেবিলে সাজানো আছে, সঙ্গে আছে শসা-টমেটোর মাখানো সালাদও। একটা বিকেল অতি মধুর হবার জন্য এরচেয়ে বেশি আর কী চাই? তার উপর কাজের মেয়েটা নাস্তা সাজানোর সময় বলে গেল সমস্ত খাবার হোমমেড। এই বাসার সবাই টেনশন করতে করতে তাকে খাবারের জন্য সাধাসাধি করার কথা একদম ভুলে গেছে। এতটা সময় তাদের আপ্যায়নের আশায় বসে থাকতে থাকতে চোখের সামনে গরম মোগলাইগুলো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। চোখে এই দৃশ্য সয়ে নেয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। লাজ লজ্জার বালাই ঝেড়ে প্লেট হাতে নিয়ে জামিলা বেগমের দিকে এগিয়ে বললেন, 

— “খালাম্মা আপনি আগে নিন।” 

জিভ কাটলেন জামিলা। কপাল চাপড়ে বললেন,

— “আয়হায়! খাওনের কতা ভুইলাই গেছি। আমার বাড়ি আইছো তোমরা, আমরা তোমগো বাটিতে খাওন তুইলা দিমু। তুমি উল্টা আমারে দিতাছো। কী বিতিকিচ্ছিরি কান্ড!”

— “আপনার আর আমার ঘর কি এখন আলাদা? আমরা তো একই পরিবারের 

সদস্য। উচ্ছ্বাস ভরা হাসিতে মোগলাই পরোটায় কামড় বসালেন এরশাদ সাহেব। অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন শফিক। এমন মুহূর্তেও একটা লোক এত আনন্দে কী করে থাকতে পারে? মানুষের মনে এত আনন্দ আসে কোত্থেকে? চারদিকের এত বাজে কথা শোনা সত্ত্বেও কী করে সম্ভব? সে কেন পারে না এরশাদের মতো এত আনন্দে বাঁচতে? কেন দুশ্চিন্তায় তার বিছানায় পড়ার যোগাড় হয়? — “ভাই জরুরি কথা ছিল। আমার নবনীর জটিল সমস্যা আছে।” 

— “জটিলকে আমি সহজ বানিয়ে ফেলব ভাবী। এত ভাবাভাবির কিছু নেই।” 

— “সমস্যা একটু বেশিই। আপনাদের জানা দরকার।” 

— “এত কথা আর জেনে লাভ কী? বিয়ে হয়ে গেছে, এখন আর ওসব জেনে কাজ নেই।” 

— “আপনি শুনুন আগে। নবনীর মে… মেয়ের নির্বুদ্ধিতায় ভীষণ রাগ হলো জামিলা বেগমের। নীতু পুরো কথা বলার আগেই ওপাশ থেকে ধমকে উঠলেন তিনি, 

— “কথা কইতেই আছোস! কথা কওনের সময় কি গেছেগা? মেহমানগো আগে ভালোমতো আপ্যায়ন কর। রাইতে ওগো খাওনোর বন্দোবস্ত কর। যা, রান্নাঘরে যা। কী কী কুটাবাছা করতে হইব শান্তারে গিয়া বুঝাইয়া দিয়া আয়। 

এরশাদ সাহেব বাঁধ সাধলেন। 

— “আজ নাস্তা পর্যন্তই থাকুক। আমরা অন্যদিন এসে ডিনার করব।” 

— “না ভাই, তা কী করে হয়? কতবছর পর এসেছেন মেয়ে বউ নিয়ে। না খাইয়ে বিদায় করব নাকি?” 

আজ আর ঝামেলা বাড়াতে চাইলো না শামীমা। স্বামীর মতন সেও জোর গলায় নীতুকে বললো,

— “ভাবি আজ বাদ দিন। খুব টেনশনে আছি, এখন খাওয়া-দাওয়া চলবে না। সব মিটে যাক, নবনীকে আমরা যেদিন নিতে আসব সেদিন নাহয় খাওয়া-দাওয়া হবে।”

— “শামীমা, থাকো রাত পর্যন্ত। খাওয়া-দাওয়া করে তারপর যাও।” 

— “অবশ্যই খাবো। কিন্তু আজ না, আরেকদিন। আপনারা নবনীকে বুঝিয়ে দেখুন। রাজি হয়ে গেলে ভালো। আমরাও অমিতকে দেখছি। জলদি জলদি নবনীকে বাসায় নিয়ে যেতে পারলেই হলো। আচ্ছা আমি কি একবার নবনীর সঙ্গে দেখা করতে পারব?” 

— “নবনী অসুস্থ, ঘুমাচ্ছে ওর ঘরে।

— “অমিতও অসুস্থ। গতরাতে মাথা ঘুরে, বমি করে বাজে অবস্থা। প্রেশার লো হয়ে গেছে তার, আজ অফিসেও যায়নি। মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না। ওকে খালি বাসায় রেখেই চলে এসেছি। এবার আমরা উঠি। আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।” 

***** 

গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে বেশ সময় পেরোলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে এলোমেলো চুল আর ক্লান্ত চেহারার বিধ্বস্ত নবনী। গতকাল থেকে পেটে ঠিকমতো কিছু পড়েনি। জ্বরের ধকল আরো দুর্বল করে দিয়েছে তাকে। প্ৰায় বুজে আসা চোখে তাকিয়ে আছে সে সামির দিকে। জানালার গ্রিলে এসে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়েছে সেই কখন! জ্বর ছাড়ার আরো আগে। এতটা সময় ধরে কিছুই বললো না সে। চুপচাপ নিষ্পলক তাকিয়ে আছে তার দিকে। সদা সর্বদা জাগতিক সব ধরনের সমস্যা সমাধানের ঝুলি নিয়ে যে মানুষটা ঘুরে ফিরে বেড়ায়, যে মানুষটা শত শত সমস্যার সমাধান তুড়ি বাজিয়ে করে দিলো সে আজ চুপ। প্রিয়তমার ঘোর বিপদের দিনে সে চুপ। কেন? জানতে ইচ্ছে হয় নবনীর। তবে মুখ ফুটে বলতে ইচ্ছে হয় না। গলায় তার ভীষণ ব্যথা। গতকাল চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে গলা ভেঙেছে। গতকালের গলা ব্যথা এখনও ছেড়ে যায়নি, মনের ব্যাথাও না। কবে নাগাদ এই বিচ্ছিরি ব্যথা তাকে ছেড়ে যাবে, কে জানে! 

১৪

সকাল থেকেই একটু আধটু শরীর খারাপ লাগছিল শফিক সাহেবের। মেয়ের দুশ্চিন্তায় সেদিকে পাত্তা দেয়া হয়নি তার। রাত গড়াতে গড়াতে শারীরিক অবস্থায় আরো অবনতি হলো। রাত এগারোটা বাজবার একটু আগেও শালার সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি, শরীর খারাপ লাগছে বলে উঠে আসছিলেন নিজের ঘরের দিকে; চলতে চলতে হঠাৎ পড়ে গেলেন ফ্লোরে। দেরী না করে শিপন, নিতু আর সুমি তাকে নিয়ে ছুটলো হসপিটালে। বাসায় নবনীকে রেখে গেল নাতাশা আর জামিলা বেগমের কাছে। হেঁচকি তুলে কাঁদছে নবনী। কয়েকবার শিপন মামাকে কল করেও কোনো খোঁজ পায়নি নাতাশা। বাবাকে নিয়েই হয়তো ছুটোছুটি চলছে। পৃথিবীর সমস্ত অসহায়ত্ব বুঝি এই ঘরটায় বিধাতা ঢেলে দিয়েছেন। চোখের সামনে অসুস্থ বোন বাচ্চাদের মতো বসে বসে কাঁদছে, তাকে স্বান্তনা দেবার মতো কিংবা সাহস যোগাবার মতন মানসিক অবস্থা নিজেরও যে নেই! এই তো গেল মাসেই বান্ধবীর বাবা মারা গেল। ভদ্রলোকও ওর বাবার মতই কথা বলছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে। শরীর খারাপ লাগছে বলে একগ্লাস পানি চাইলেন। স্ত্রী পানি নিয়ে ফিরতে ফিরতে লোকটা ফ্লোরে পড়ে রইলো, আর উঠলো না। তরতাজা মানুষটা পাড়ি জমালো পরপারে। নাতাশার হাত-পা ভয়ে কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে বারবার। বাবা আবার বাড়ি ফিরবে তো? 

একমনে দরূদ শরীফ পড়ে যাচ্ছেন জামিলা বেগম। ভীষণ নরম স্বভাবের মানুষ হলেও, বিপদের দিনগুলোতে সবচেয়ে বেশি শক্ত থাকতে তাকেই দেখা যায়। আজ পর্যন্ত কেউ কখনো তাকে দেখেনি বিপদে ভেঙে পড়তে, কিংবা কেঁদে কেটে চোখের জলে ভাসতে। উপরওয়ালার প্রতি অগাধ বিশ্বাস তার। তিনি জানেন, উপরওয়ালা তার বিশ্বাস ভাঙবে না। বিপদের এই সময়টা কেটে যাবে, খুব শিগগিরই কেটে যাবে। ভালো কিছু হবে, অবশ্যই হবে। 

দীর্ঘ অপেক্ষা বাদে কল এলো নাতাশার মোবাইলে। শিপন মামা কল করেছে। তড়িঘড়ি করে রিসিভ করলো নাতাশা, 

— “কখন থেকে কল করছি তোমাকে!” 

— “কল রিসিভ করার অবস্থায় আছি নাকি!” 

— “আব্বু কেমন আছে?” 

— “দুলাভাইর মাইল্ড স্ট্রোক হয়েছে। থাকতে হবে হসপিটালে। আমরা আজ এখানেই থাকবো। নবনীকে তোরা দেখে রাখিস।” — 

— “আব্বু ঠিক আছে তো, না? চিনতে পারছে সবাইকে? হাত-পা নাড়াতে পারছে?” 

— “সব ঠিক আছে। টেনশন করিস না।” 

— “মামা তুমি কথা লুকাচ্ছো না তো?”

— “কথা কেন লুকাতে যাব? হাবিজাবি কথা ভেবে নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়িস না। 

এত বিপদ আপদ আর ভালো লাগছে না। ঐ কুত্তা রমিজের জন্যই আজ এতকিছু হয়ে যাচ্ছে। রাত অনেক হয়েছে, এখন একটু ঘুমা। আর কোনো সমস্যা হলে কল করিস।” 

নাতাশার দিকে ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে আছে জামিলা বেগম আর নবনী। কল কেটে মিনমিন করে সে বললো, 

— “মাইল্ড স্ট্রোক!” 

***** 

— “বাসার সামনে এসে এভাবে চিৎকার করার মানে কী, অমিত?” 

রাত দেড়টা। মুনিয়ার বাসার ড্রইংরুমে বসে আছে অমিত। মুনিয়া আর তার মা, বোন, তিনজনই অমিতের দিকে পাহাড়সম রাগ আর বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছে। এই তিনজনের কাছে আজকাল সে বড্ড অপ্রয়োজনীয়, বিরক্তিকর এবং ছ্যাঁচড়া প্রজাতির একজন মানুষ। তার কাছ থেকে পিছু ছাড়ানো গেলেই যেন এরা হাফ ছেড়ে বাঁচে, সেসব অমিতের অজানা নয়। এই তো রাত দেড়টায় মুনিয়ার বাসায় এসে উঠেছে, তাতেও কেউ খুশি নয় সে কথাও অমিত জানে। এতে অমিতের কিছুই যায় আসে না। মুনিয়াকে না দেখে থাকা যে ভীষণ কষ্টের হয়ে যাচ্ছিল! ঐ ঘটনার পর থেকে মুনিয়াকে হারাবার ভয় তাকে প্রতিমুহূর্তে মেরে ফেলছে, সে কথা কে বোঝাবে মুনিয়াকে? কঠিন সময়গুলোতে ভালোবাসার মানুষের একটুখানি স্পর্শ টনিকের মতো কাজ করে, মুনিয়াই তো বলেছিল সে কথা। অনেকগুলো দিন আগে যখন সম্পর্কের বসন্তকাল ছিল, তখন মুনিয়ার মন খারাপ হলেই জরুরি তলব করে নিয়ে আসতো পুরোনো সেই এক কামড়ার ফ্ল্যাটটাতে। মন ভালো করার বাহানায় লেপ্টে থাকতো অমিতের বুকে। সেকেন্ড গড়িয়ে মিনিট হতো, মিনিট পেরিয়ে ঘন্টা, ঘন্টা পেরিয়ে গোটা একবেলা। স্নিগ্ধ আলিঙ্গন থেকে গভীর স্পর্শ, গভীর স্পর্শ থেকে গাঢ় চুমু, গাঢ় চুমু থেকে আদিম খেলায় মেতে উঠা। সম্পর্কের বসন্তকাল ফুরিয়ে গেছে কবেই, অতখানি আশা মুনিয়াকে ঘিরে অমিতের জাগে না। শুধু একটুখানি আদুরে গলার ডাক, আর তুলতুলে হাতজোড়ার আলতো স্পর্শ। ব্যস! তার সমস্ত বিষণ্নতা ধুয়ে মুছে বিদায় হবার জন্য এতটুকুই কি যথেষ্ট না? 

.

— “এখন কেন মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না? খুব তো নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছিলে, তোমার সঙ্গে দেখা না করলে কেলেংকারী ঘটে যাবে!” 

— “তো আর কিইবা করার ছিল আমার? কবে থেকে দেখা করতে চাইছি অথচ তুমি দেখাই করতে চাও না। কলও রিসিভ করো না। কোনো একভাবে তোমার সঙ্গে আমার দেখা তো করতে হবে!” 

— “তাই বলে আমার বাসার সামনে এসে চিৎকার করবি? বাস্টার্ড একটা! তোর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি, তুই করিসনি। কাজের ব্যস্ততা দেখিয়েছিস। তোকে কল করেছি, সুইচ অফ করে রেখেছিস; ম্যাসেজ সিন করেও কোনো রিপ্লাই দিসনি। এবার তুই বল তোর কল আমি কেন রিসিভ করব?”

— “মুনিয়া আমি ঢাকায় ছিলাম না। আউট অফ নেটওয়ার্ক ছিলাম। ম্যাসেজ সিন করে রিপ্লাই দেইনি কারণ রিপ্লাই দেয়ার মতো সিচুয়েশনে তখন আমি ছিলাম না।”

— “আহারে! সিচুয়েশন ছিল না কেন রে? তোর বাপ-মা মরে গেছে? লাশ কবরে নামাচ্ছিলি?” 

— “মা-বাবাকে কেন টানছো?” 

— “যেই মহিলা ছেলে জন্ম দিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেয় রাত দেড়টায় চিৎকার চেঁচামেচি করে একটা মেয়েকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্য, তার জন্য এরচেয়ে ভালো কিছু আমি বলতে পারছি না।” 

— “আমি তোমাকে একটুখানি দেখতে চেয়েছি মুন! বেশিকিছু তো চাইনি। এত 

ভালোবাসি তোমাকে, এতটুকু দাবি কি আমি করতে পারি না? তাই বলে এতকিছু শোনাবে তুমি আমাকে?” 

মুনিয়ার পক্ষ টেনে তার বোন বললো, 

— “আপনি আমার বোনকে কেন দোষ দিচ্ছেন?” 

— “তোমার কি মনে হয় জিনিয়া, ও যা কিছু বলছে তাতে ওর কোনো অন্যায় নেই?” 

— “না নেই। কারণ শুরুটা আপনি করেছেন। আপনি কেন বাসার নিচে দাঁড়িয়ে চিৎকার করলেন? এত সাহস কী করে হয় আপনার? আপনার কাছে কি মনে হয় না আপনি ওর রেপুটেশন নষ্ট করার মতো একটা কাজ করেছেন?” 

.

এতটা সময় ধরে দাঁতে দাঁত চেপে অমিতকে শুনছিলেন মুনিয়ার মা। ছেলেটাকে ভীষণ অসহ্য লাগে তার। শিল্পপতি, মন্ত্রীর ছেলেরা তার মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে যেতে ইচ্ছুক। অথচ এই ছেলেটার জন্য একটা ভালো ঘরের ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে এগোতে পারছে না তার মেয়ে। তার উপর যখন-তখন কিসব কান্ড করে বসে, কখন আবার মেয়েটার এতদিনের শ্রমে গড়া ক্যারিয়ারটাই ডুবে যায়, কে জানে! কম বয়সে ছেলেমেয়েরা ভুল করবে, এই তো স্বাভাবিক। তবে তার মেয়ে তখন এতটাও ছোট তো ছিল না। ২০-২২ বছর বয়সে এই ছেলেটার সঙ্গে প্রেম করার মতো ভুল করলো কেমন করে সে হিসেবটাই মিলিয়ে পান না মুনিয়ার মা। চোখ রাঙিয়ে, শীতল কন্ঠে তিনি অমিতকে বললেন,

— “আমার মেয়ে একজন সেলিব্রিটি। এলাকার প্রত্যেকে জানে এই এ্যাপার্টমেন্টে মডেল মুনিয়া থাকে। তাছাড়া এটা ভদ্রলোকেদের পাড়া। এখানে কোনো বস্তির লোক থাকে না যে রাত দেড়টায় কেউ এসে চিৎকার চেঁচামেচি করলেই সবাই ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নেবে।”

— “আমি যত চাই সম্পর্কটা সবার চোখের আড়ালে রাখতে, তুই ততই চাস সবার সামনে প্রেম জাহির করতে। তোর নিয়ত আমি জানি না ভেবেছিস? আমার ক্যারিয়ার নষ্ট করে ঘরে বসাতে চাস। সেই সুযোগে আমাকে বিয়ে করে পেটে বাচ্চা দিয়ে চিরতরে দাসী বানিয়ে রাখতে চাস। একবার তো পেটে দিয়েছিস ও একটা। প্রোটেকশন নেয়া সত্ত্বেও আমি কনসিভ করলাম কেমন করে? তোর কারসাজি ছিল সব। তুই আমার সঙ্গে যা খুশি করে পার পেয়ে যাবি ভেবেছিস? তোর খুশিমতো সব হবে? এত সহজে তোর কাছে আমি ধরা দেবো না। কালই তোর নামে আমি থানায় জিডি করবো। আমার তিল তিল করে গড়া ক্যারিয়ার। তোর মতো দুই পয়সার লোকের হাতে নষ্ট হতে দেবো না। তোর সঙ্গে আমার ব্রেকআপ মানে ব্রেকআপ।” 

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেল মুনিয়া। রাগে কটমট করতে করতে বোনের পেছন পেছন ছুটলো জিনিয়া। পায়ের উপর পা তুলে বেশ জমিদারী কায়দায় সোফায় বসলো মুনিয়ার মা। 

— “তুমি আসলে একটা গন্ডার। এভাবে বলতে চাইনি, তবে বাধ্য হয়ে বলছি। মুনিয়ার সঙ্গে তোমার যা কিছু চলছে এরমাঝে আমি কখনোই তোমাকে মুখোমুখি কিছু বলিনি। কিন্তু আজ বলতেই হবে। এই সম্পর্ক মুনিয়া আর বয়ে বেড়াতে চাইছে না। অনাকাঙ্খিত সম্পর্ক আর মানুষ দুটোই বোঝা। তোমাকে গন্ডার কেন বললাম জানো? মুনিয়া এত কিছু বলে তোমাকে, তবুও ওর সঙ্গে তোমার সম্পর্ক রাখা চাই। আজও কত কী বলে ফেললো, তবুও তুমি এখনো এখানেই বসে আছো। লজ্জা নেই তোমার? কখনো ভেবে দেখেছো, মুনিয়ার পাশে তোমাকে মানায় কি না? তোমার মাস শেষে ইনকাম কত হয়? লাখখানেক? ওর পেছনে দেশের বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা ঘোরে। তাদের ইনকাম সম্পর্কে আইডিয়া আছে তোমার? নিজেকে দেখো একবার আয়নায়। দিনদিন কী হাল হচ্ছে তোমার? বয়স হওয়ার আগেই বুড়ো হয়ে যাচ্ছো। মানানসইয়ের একটা ব্যাপার থাকে অমিত। এটা তোমাকে বুঝতে হবে। এসব পাগলামি ছাড়ো। আমার মেয়েকে ওর মতো থাকতে দাও। তুমি আমাদের কঠিন মাথাব্যথায় পরিণত হয়েছো। এবার আমাদের মুক্তি দাও।” 

.

অমিতের চোখে পানি ছলছল করছে। মাথা নিচু করে সে বেরিয়ে এল মুনিয়ার ফ্ল্যাট থেকে। অপমান, অবহেলার পাহাড় জমতে জমতে যেন আকাশ ছোঁয়া হচ্ছে। খুব করে ইচ্ছে হয় মুনিয়াকে ঘৃণা করতে, তাকে ছাড়া বাঁচতে, তাকে ছাড়া হাসতে। মায়াজাল থেকে অমিত বেরোতে পারে না কিছুতেই। দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে তার মরে যেতে ইচ্ছে হয়, যন্ত্রণা থেকে চিরতরে মুক্তি নিতে ইচ্ছে হয়। এই মায়ার ইতি কোথায়? মুনিয়া নামক বদঅভ্যেসের অন্ত কোথায়? 

***** 

গুটিসুটি মেরে নবনী বিছানায়া শুয়ে আছে। পাশেই বসে তসবিহ জপছেন জামিলা বেগম। তার একহাত টেনে নিজের গালের সঙ্গে মেশালো নবনী। তসবীহ বালিশের কোনায় রেখে নাতনীর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জামিলা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, 

— “কিছু কইবা টিয়াপাখি?” 

— “আমার কারণে বাবার এই অবস্থা। আমার একটা ভুলের জন্য কতগুলো মানুষ ভুগছে।”

— “নিজেরে আর দোষ দিও না। যা হওয়ার হইছে, সেইটা আর বদলানো যাইব না। কিন্তু তুমি চাইলে যা কিছু ঘটছে সেইটারে সুন্দর করতে পারো।” — 

— “মানে?” 

— “শফিক তোমারে খুব ভালোবাসে। প্রথম যখন তোমারে কোলে নিলো খুশিতে কাইন্দা দিছিল। তারপর কইলো কি, আজ থেইকা আমার সারা দুনিয়া একদিকে, আমার এই ছোট পুতুল আরেকদিকে। দিনরাইত খালি তোমার মুখের দিকে তাকায়া থাকতো। কতক্ষণ পরপর আমারে, নীতুরে তোমার হাত-পা, চোখ, মুখের গড়ন দেখায়া জিগাইতো, দেখেন তো আমার সঙ্গে মিলে কি না? যদি কইতাম তুমি দেখতে নীতুর মতো বা হাত-পা হইছে তোমার দাদীর মতন তাইলেই মুখটা কালা কইরা ফালাইতো। তোমারে নিয়া তার কত চিন্তা! শফিক যে তোমারে নিয়া পাগলামি করতো আমার দেইখা খুব মায়া লাগতো। প্রথমবার বাপ হইলে পরে কাউরে এমন পাগলামি করতে ঐ প্রথম আমি শফিকরেই দেখছিলাম। আহা! ঐ দিনগুলা মনে হইলে আমার কেমন হাহাকার লাগে। মনে হয় ক্যান গেলোগা দিন?” 

নবনীর চোখের কোন বেয়ে পানি ঝরছে। শাড়ীর আঁচলে নাতনীর চোখ মুছে দিলেন জামিলা বেগম। 

— “বছর ঘুরছে, তোমার বয়স বাড়ছে। শফিকের ছোট পুতুল বড় হইছে। কিন্তু শফিকের ভালোবাসা আজ অব্দি তিল পরিমাণও কমে নাই। এখনো এই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালো সে তোমারেই বাসে।” 

— “অথচ সেই মানুষটা আজ হসপিটালে পড়ে আছে আমার কারণে। 

— “বাপের এই অবস্থা থেকে মুক্তিও তুমিই দিতে পারবা।”

— “কিভাবে নানী?”

— “যা কমু মন দিয়া শুনবা? আগেই পাগলামি করবা না তো?” 

— “বলো তুমি।”

— “তোমার বিয়া হইছে এইটা নিয়া শফিক যতটুক না চিন্তা করতাছে, তার চেয়ে বেশি ধাক্কা খাইছে আত্মীয়গো মইধ্যে তোমারে নিয়া কুকতা শোনার কারণে। তুমি ফিরলা যেদিন, সেদিন সন্ধ্যার পর থেইকা শফিকরে এইজন সেইজন ফোন দিয়া বাজে কতা জিগাইতাছে। বয়স হইছে জামাইর, মাইয়্যার নামে কুকতা শুইনা সহ্য করার মতো ক্ষমতা তার নাই। এই ধকল আরো বাড়বো। মানুষের মুখ বন্ধ হইব না, শফিক সুস্থও হইবো না।” 

— “তাহলে উপায়?” 

— “উপায় একটা আছে। আমি অনেক হিসাব-নিকাশ কইরা একটা পথ পাইছি। কতটুক কাজ হইব জানি না, তুমি রাজি হইবা কি না তাও জানি না। কিন্তু একটা সুযোগ নেয়াই যায়।” 

— “আমি রাজি। আব্বুকে সুস্থ করার জন্য যা দরকার আমি করবো।” 

— “তোমারে এই অবস্থা কইরা বিয়া দিছে শুইনাই শফিক লাফ দিছিলো রমিজের নামে মামলা দিবো, তোমাগো দুইজনরে তালাক্ব করাইবো। মামলা করলে আরো মানুষের কানে এইসব যাইব, আর তালাক্ব নিলে মানুষ আরো ছিঃ ছিঃ করবো। তোমগো মইধ্যে কিছু হয় নাই এই কতা কেউ বিশ্বাস করবো না। কারণ মানুষ খারাপ কতা বিশ্বাস করতে পছন্দ করে, শুইন্যা মজা পায়। এহন যদি তালাক্ব দেও তাইলে মানুষ আরো বেশি কইরা ঘাটাইবো। আরো বেশি কইরা ছিঃ ছিঃ করবো। তোমার ছোট বইনও বিয়ার উপযুক্ত। ঘরে বড় ভাই-বইন কারো তালাক্ব হইলে ছোটগুলারে বিয়া দেওন যায় না। মানুষ আত্মীয়তা করতে চায় না। তার উপর তোমার হইছে কলংকের বিয়া, আবার যদি পরদিনই গিয়া তালাক্ব দেও তাইলে বুঝতাছো কী হইবো? নাতাশারে বিয়া দিতে বেগ পাইতে হইব, শফিকও এইসব মানসিক চাপে আরো অসুস্থ হইব। বড় ইস্টোকও হইতে পারে।” 

— “তুমি কি বলতে চাইছো আমি ঐ লোকের সঙ্গে সংসার করি?” 

— “না, তা কমু ক্যান? আমি কি জানি না তুমি সামিরে কেমন ভালোবাসো? অন্য কাউরে তুমি কেমনে স্বামী বইলা মাইনা নিবা?” 

— “তাহলে করবোটা কী?” 

— “সংসারের নাটক। ছয়মাস তুমি ঐ বাসায় থাকবা। মানুষরে আমরা কমু তোমগো প্রেম ছিল, গোপনে বিয়া তোমরা আগেই সারছো। অমিত প্রমোশনের অপেক্ষায় ছিল, তুমিও তোমার বুটিক আরো বড় করার পরিকল্পনায় ছিলা। দুইজনের দুইদিক গোছানো হইলেই তোমরা নিজেগো কতা সবাইরে জানাইতা।” 

— “তুমি কি পাগল?” 

— “পাগলামির কী দেখলা?” 

— “মিথ্যা কেন বলবো আমরা? আমি তো উনাকে ঠিকমতো চিনিই না। আর একবাসায় থেকে সংসারের নাটক করব মানে? এমন হয় নাকি কখনো? উনার সঙ্গে একরুমে থাকা অসম্ভব!” 

— “একরুমে কে থাকতে কইছে? থাকবা তো আলাদা। বাসায় অমিতের বইন আছে, দরকার লাগলে নাতাশাও তোমার লগে থাকবো। ভয়ের কিছু নাই। তুমি খালি ঐ বাসায় থাকবা। মেহমান গেলে অমিতের পাশে একটু বসবা, মাঝেমধ্যে আত্মীয়স্বজনের অনুষ্ঠানে যাইবা। ব্যস, এইটুকুনই। ততদিনে নাতাশারও একটা বিয়ার ব্যবস্থা আমরা কইরা ফালামু। তাইলেই আর এত ঝামেলা পোহাইতে হইবো না। তোমার বাপেরও এত পেরেশান হইতে হইব না।” 

— “খুবই বাজে সলিউশন।” 

— “যেই যেই সমস্যাগুলা হওনের ভয় আমি পাইতাছি সেইগুলা কি মিছা? তুমিই কও।” 

— “তা মিথ্যা না। এমন হবে তা তো বোঝাই যাচ্ছে।” 

— “তাইলে নিস্তার পাওনের পথ দেখাও।” 

— “তাই বলে এসব করতে হবে?” 

— “দ্যাখো নবনী, সেই ছোট থেইকা আমরা তোমারে আগলায় রাখছি। তুমি সুখে থাকবা যেমনে, অমনেই সব করছি। তুমি কষ্ট পাইবা এমন কিছু কোনোদিন করি নাই। সামি চইলা যাওনের পর তোমারে সুস্থ করতে যে যা করতে কইছে তাই করছি। যে যেখানে যাইতে কইছে ঐখানেই আমরা পাগলের মতো ছুটছি। পাগলামি তখন আমরাও অনেক করছি। কারণ আমরা তোমারে ভালোবাসি। তামার মা-বাপ-বইন কোনোদিন কয় নাই নবনীরে সুস্থ করতে এইসব পাগলামি কেন করমু? তখন মনে হইতো পাগলামি কইরা যদি নবনী সুস্থ হয় তো পাগলামিই করুম। তোমার বাপটা অসুস্থ। আমার মাইয়্যার মুখের দিক আমি তাকাইতে পারতাছি না। তোমার বাপ এখনও দুশ্চিন্তা করতেই আছে। এমন চলতে থাকলে মরণের আর খুব দূর বাকি নাই। আমি জিন্দা থাকতে শফিকরে কাফনের কাপড়ে পেঁচাইবো, আমার মাইয়্যা সাদা কাপড় পিনবো, তোমরা এতিম হইবা এই জিনিস আমার সইহ্য হইবো না গো নাতনী। শফিকের লগে আমিও বিদায় নিমু। তুমি সামিরে ভালোবাইসা সারাজীবন একলা থাকার সিদ্ধান্ত নিছো, নিজের চিকিৎসা আর করাইতে চাও নাই; আমরা সব মাইনা নিছি। যদি তুমি এমনে সুখে থাকো তাইলে তাই হইবো। তুমি কি এহন তোমার বাপ-মায়ের সুখের কথা চিন্তা করবা না? আমগোরে কি তুমি একটুও ভালোবাসো না? তোমার বাপ, তোমার মা, আর বইনের জন্য একটুও কি মায়া নাই? এইযে এত বড় প্যাঁচের মইধ্যে সবাই পইড়া আছে, নাতাশার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তুমি কি একটু ভাববা না সবাইরে নিয়া? তোমার হাতে এহন সবকিছু। তুমি চাইলেই সবাইরে পেরেশানিমুক্ত করতে পারো। তোমার বাপরেও সুস্থ করতে পারো।

— “ছয়মাস বাদে ডিভোর্স হওয়ার পর কি আমাদের নিয়ে কথা উঠবে না?” 

— “তখন দেখা যাইবোনে। ছয়মাস লম্বা সময়। ততদিনে তোমার বিয়ার ঘটনা আড়াল হইয়া যাইব, নাতাশারও একটা গতি হইব।” 

অসীম দ্বিধায় জামিলা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে নবনী। চরম অযৌক্তিক কথাগুলো, যৌক্তিক মেনে নেয়া ছাড়া আপাতত আর কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না সে। 

*****

— “মানুষের এত সমালোচনা আমরা আর নিতে পারছি না। তোর বোনের কথা একবার ভাব অমিত, আমাদের কথা ভাব।”

— “মুনিয়া? ও যদি বাসায় আসে ওকে কী বলবো?” 

— “তোর জীবনে মুনিয়াই সব? আমরা কেউ না? আমাদের নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা তোর হচ্ছে না?” 

  • ………………..
  • — “ওদিকে শফিক ভাই হসপিটালাইজড। কখন কী হয়ে যায়, কে জানে? দুই বাসায় বিয়ের উপযুক্ত দুইটা মেয়ে। যদি শফিক ভাইয়ের কিছু একটা হয়ে যায়? যদি মেয়ে দুটোকো আমরা ভালো কোথাও বিয়ে না দিতে পারি, এর দায় কে নেবে? তোর একটা সিদ্ধান্তের উপর সবার ভালো থাকা ডিপেন্ড করছে। ছয়টা মাসেরই তো ব্যাপার অমিত! এতটুকু স্যাক্রিফাইস তুই আমাদের জন্য করতে পারবি না?” 

    মায়ের দিকে হতাশ চোখে তাকালো অমিত। গোটা পৃথিবীটাই যেন তার বিপক্ষে ছুটছে। এত স্ট্রেস নিয়ে কি আদৌ মানুষ বাঁচে? ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে অমিত বললো, 

    — “নিয়ে আসো যাকে খুশি। কিন্তু মুনিয়ার সামনে কেউ যেন মুখ না খোলে।” 

    ***** 

    খুশিতে আত্মহারা হয়ে খাটে বসে পা দুলাচ্ছেন শামীমা। গেট লক করে জামিলা বেগমকে কল করলেন এরশাদ। 

    — “খালাম্মা, আপনার বুদ্ধি সুপারহিট। কাজ হয়ে গেছে। শফিক ভাই আগামীকাল ফিরলেই আমরা নবনীকে নিয়ে আসবো। আচ্ছা নবনী রাজি হয়েছে তো?” 

    — “একটু গাইগুই করছিল। কিন্তু সেও রাজি হইছে।” 

    — “বাহ্! বাহ্! আপনি যা খেল দেখালেন না! আমরা টেনশনে আধমরা হয়ে যাচ্ছিলাম সবাই।” 

    — “এহন সব ভালোয় ভালোয় মিটলে হয়!” 

    — “মিটবে মিটবে। আপনি আমার কাছে বিশাল উপহার পাওনা রইলেন। চট্টগ্রাম গিয়েই আপনার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করব।” 

    — “আমার কিছু লাগবো না গো বাবা। আমার নাতিনের জীবনডা গুছায়া গেলেই হয়!” 

    এরশাদের কান থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিলো শামীমা। 

    — “খালাম্মা, ছয় মাসের ভেতর সব ঠিক হবে তো, তাই না?” 

    — “হইব হইব। স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন হইলো বড় কঠিন বন্ধন। বন্ধনের টানে হইলেও দুইজন দুইজনের কাছে আইবো। একছাদের নিচে থাইকাও ওগো একটা গতি হইবো না, এইডা আবার কী কও?” 

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ১৫

    ১৫

    ড্রইংরুমে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে নবনী। টিভিতে হিন্দি সিরিয়াল চলছে। বাসার সবাই খুব গভীর মনোযোগে দেখছে। জানামতে, পুরুষ মানুষ প্রচন্ড রকমের সিরিয়াল বিদ্বেষী হয়, তবে এখানকার চিত্র ভিন্ন। এরশাদ চাচা ভীষণ মনোযোগে সিরিয়াল দেখছে। আশ্চর্য ব্যাপার! আবার সিরিয়ালে ঘটে যাওয়া সিনগুলো নিয়ে চাচীর সঙ্গে গভীর আলোচনাও করছে। উনাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন রাজ্য সভার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করছেন। চাচা মানুষটা ভীষণ রসিক, সদা হাস্যোজ্জ্বল সে কথা ছোট থেকেই জানা ছিল। অন্যসব পুরুষদের মতো এতটা গাম্ভীর্য, অহংকার কিংবা আধিপত্য খাটানোর অভ্যেস কখনোই তার মাঝে ছিল না। বরাবরই মা-চাচীরা বলতো এরশাদ ভাই অন্যসব পুরুষদের চেয়ে খুব আলাদা। তবে তিনি সিরিয়াল প্রেমী হবার মতো এতটাও আলাদা হবেন সে কথা কখনো ভাবেনি নবনী। নিজে সিরিয়াল প্রেমী না হবার কারণে বোধহয় পুরো ঘটনাটা একটু বেশিই উদ্ভট লাগছে। এখানে এসে বসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার ছিল না। অনি আর চাচী এসে ডেকে গেল ড্রইংরুমে তাদের সঙ্গে এসে টিভি দেখতে। না এলে খারাপ দেখায়, তাই এখানে আসা। নয়তো ঘরে একা বসে থাকাই ভালো ছিল। এরশাদ চাচার বাসায় খুব একটা যাতায়াত কখনো ছিল না নবনীর। ভিন্ন শহরে থাকার দরুন ঈদে গ্রামে বেড়াতে গেলে, কিংবা কারো বিয়েশাদীতে দেখা হতো দুই পরিবারের। এতগুলো বছরে শুধু এরশাদ চাচা ৭-৮ বার গিয়েছিল তাদের বাসায়। চাচীও হয়তো গিয়েছিল ১-২ বার। কিন্তু অনি কিংবা অমিত এই কয়বছরে কখনোই তাদের বাসায় যায়নি। ঢাকায় ফ্ল্যাট নেবার পর চাচা-চাচী বহুবার কল করে বলেছিল বাবাকে, স্ব-পরিবারে যেন একবার এসে বেড়িয়ে যায়। বাসা এত কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও কখনো আসা হয়নি ওদের। বাবা-মা যদিও একবার এসেছিলো ঢাকার এই ফ্ল্যাটটাতে, কিন্তু ওরা দুইবোন আসেনি কখনো। আসার ইচ্ছেই হয়নি। অনি অমিতের সঙ্গে খুব একটা সখ্যতা তাদের নেই। অনির সঙ্গে বিয়ে শাদীতে বসে একটু আধটু গল্প করা কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় টুকটাক হাই হ্যালো চললেও, অমিতের সঙ্গে অতটুকুও নেই। ছোটবেলায় গ্রামের ঈদগুলোতে তার সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হলেও, বড় হওয়ার পর সেটুকুও আর হয়নি। গ্রামে সবাই একত্রিত হয়ে ঈদ করা হয় না পনের বছরেরও বেশি সময় পেরোলো। পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতেও তার বিচরণ নেই। গত আট দশ বছরে অমিতকে কোনো অনুষ্ঠানে নবনী দেখেছে বলে মনে করতে পারে না। এবার রওনকের বিয়েতে মা পরিচয় না করিয়ে দিলে হয়তো চিনতেই পারতো না। বলা যেতে পারে এরশাদ চাচার পরিবার তার জন্য মোটামুটি অপরিচিত। অথচ এমন একটা পরিবারে বিশাল এক লাগেজ গুছিয়ে সে চলে এল তাদের সঙ্গে থাকবে বলে। কিভাবে থাকবে সে এখানে? কিভাবে হবে তাদের সঙ্গে সখ্যতা? এই বাড়িতে পা রাখার পর থেকে বারবার মনে পড়ছে সেদিনের ঘটনা। যত মনে পড়ছে ততই বুঝি হাত-পা অসার হয়ে আসছে। কী নোংরা একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার এই বাসায় আসা! আর অমিত? তার মুখোমুখি হলে কী হবে? মাটি গর্ত করে নিচে চলে যেতে ইচ্ছে হবে না? নাতাশাকে সঙ্গে নিয়ে এলে ভালো হতো। ও পাশে থাকলে হয়তো সবকিছু একটুখানি সহজ হতো। এখানে আসার আগে মা আর নানী বারবার বলছিল নাতাশাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসতে। তখন কেন যেন মন সায় দিলো না। এখন ভীষণ আফসোস হচ্ছে, ধুর! 

    .

    বাসার কলিংবেল বাজছে। অনি গিয়ে দরজা খুললো। অমিত এসেছে। জুতা খুলে ঘরে পা রাখতেই চোখাচোখি হলো দু’জনের। অমিতের চেহারা জুড়ে যেন রাজ্যের মেঘ নেমে এল। চোখ ফিরিয়ে দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল সে। অমিতের কুঁচকানো চেহারায় নবনীর অস্বস্তি দ্বিগুন হলো। কিছুই চোখ এড়ালো না অনির। না ভাইয়ের বিরক্তিভরা চোখ-মুখ, না নবনীর অস্বস্তিতে ফ্যাকাশে চেহারা। বাবাও চেয়ে আছে নবনীর দিকে। বাম কানে ফিসফিসিয়ে অনি বললো, 

    — “ভাইয়া খুব রিএ্যাক্ট করবে মনে হচ্ছে। এমন চলতে থাকলে ওদের সম্পর্ক ভালো হওয়া দূরের কথা, আপু দুদিন পরই চলে যাবে।” 

    — “আরেহ আমরা আছি না! সব ঠিক করে ফেলবো।” 

    — “কোথায় আছো আব্বু? কাল তো চলেই যাচ্ছো।” 

    — “তুই আছিস না! আমরা ওখান থেকে সব শিখিয়ে দেবো, তুই করবি। এখন এসব ছাড়। চল আমরা বাইরে যাই, কাচ্চি রোস্ট খেয়ে আসি।” 

    — “মা তো আজ পোলাও-রোস্ট রান্না করলোই।” 

    — “কাচ্চি তো আর করেনি।” 

    — “নবনী আপুকে নিবে না?” 

    — “আরেহ যার সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর বাহানায় একটু খাতির জমাবো তাকেই নেবো না?” 

    — “ভাইয়া? ও যাবে বলে তো মনে হয় না।” 

    — “ঐ গাধাটা বাসায়ই থাকুক। বসে বসে মুনিয়ার শোকে আধপাগল হোক। বাসায় ওর জন্য পোলাও-কোর্মা আছে। যা জলদি করে জামা কাপড় বদলে নে। নবনী, আমরা রাতে বাইরে ডিনার করবো। যাও, রেডি হয়ে নাও।” 

    ***** 

    নবনীকে অকারণে খাবার প্লেটে নাড়াচাড়া করতে দেখে শামীমা জিজ্ঞেস করলেন, 

    — “তুমি খাচ্ছো না কেন? কাচ্চি তোমার পছন্দ না?” 

    — “না না! আমার পছন্দ 

    — “তো?”

    — “এমনি।”

    — “আমার এখানে আসার পর থেকে দেখছি কেমন জড়োসড়ো হয়ে আছো। একটু স্বাভাবিক হও। আমরা কি তোমার অপরিচিত?” 

    — “তেমন কিছু না।” মেকি হাসলো নবনী 

    — “দেখছি তো আমি। তুমি না করলেই চলবে?” 

    বোরহানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে এরশাদ সাহেব বললেন, 

    — “দেখো মা, যে ক’টাদিন আছো আমার ছেলে মেয়ের সঙ্গে মিলেমিশে না থাকলে তোমারই লস। একা একা বোর হবে। তারচেয়ে বরং কয়েকমাস কাজিনরা হেসেখেলে সময় কাটাও। এমনিতে তো কারো সঙ্গে তোমাদের খুব একটা দেখা হয়না। ব্যস্ত তোমরা সবাই। এক উছিলায় না হয় তোমাদের একসঙ্গে ভালো একটা সময় কাটানো হবে।” 

    — “জি।” 

    — “যা কিছু হয়েছে সেসব মাথায় রেখো না। আমরা মন থেকে সব ঝেড়ে ফেলেছি। ধরে নাও তুমি তোমার চাচার বাসায় কয়েক মাসের জন্য বেড়াতে এসেছো। এখানে তোমার যেভাবে খুশি থাকো, যা ইচ্ছে রান্না করে খাও। অমিতের বাজার পছন্দ না হলে আমাকে কল করবে। আমি টাকা পাঠাবো, তুমি তোমার ইচ্ছেমতো কিনে নিও।” 

    — “লাগবে না চাচা, আমিই কিনে নেবো। আপনি এত পেরেশান হবেন না প্লিজ।”

    — “না, না। খবরদার ওসব চলবে না। আছোই মাত্র কয়েক মাস। আমাকেও একটু তোমার যত্নআত্তি করতে দাও।”

    — “ফ্রিজে আমি কয়েকদিনের রান্না করে রেখে যাচ্ছি। রান্না নিয়ে ২-৪ দিন ভাবতে হবে না। বুয়া সব কেটে রেখে যায়। তুমি আর অনি মিলে বাকিটা সেরে নিও।”

    — “আপনারা চলে যাবেন?”

    — “হ্যাঁ কালই।” 

    — “আমি একা থাকবো?” 

    — “একা কোথায়? অনি আছে না? তোমারও কারখানায় কাজ থাকে। তুমি বাসায় ফিরতে ফিরতে অনি ভার্সিটি থেকে চলে আসবে। তাছাড়া অমিত তো আছেই। আমি তো বলেছিলাম নাতাশাকেও সঙ্গে করে নিয়ে আসতে।”

    — “হ্যাঁ ওকে আজই বলবো কিছুদিন আমার সঙ্গে এসে থাকতে। 

    অনি খুশি হয়ে বলল,

    — “খুব ভালো হবে। আমি একা একা খুব বোর হতাম জানো। এখন থেকে আর হবো না। তুমি আছো, নাতাশাও আসবে, তিনজনে মিলে কী দারুণ সময় কাটবে! আমি তোমার আর নাতাশা আপুর লাইভ দেখতাম জানো? ভাবতাম, ইশ্ কী সুন্দর করে কথা বলে! আমিও অনলাইনে টুকটাক বিজনেস করব ভাবছি। তোমরা থাকলে আমার জন্য সব সহজ হবে। অনির ব্যবসায়ের প্রসঙ্গ একপাশে সরিয়ে ছেলেকে নিয়ে বলতে লাগলেন শামীমা,

    — “অমিতকে নিয়ে জরুরী একটা কথা শোনো।” 

    — “জি!” 

    — “ও প্রায়ই বাসায় মুনিয়াকে নিয়ে পাগলামি করে। ভয় পেও না, সম্ভব হলে ওকে একটু বোঝানোর চেষ্টা করো।” 

    — “আমি?” 

    — “আমাদের কথা তো শোনে না। দেখি তোমার কথায় কাজ হয় কি না?” 

    — “কিসব যে বলেন না চাচী! আমার বোকামির জন্য কতবড় কান্ড হয়ে গেছে। আমি কোন মুখে উনার সামনে দাঁড়িয়ে এসব বলবো?” 

    — “ধুর! তোমার চাচা কী বললো শোনোনি? সব ঝেড়ে ফেলো। আরেকটা কথা, মুনিয়ারও এই বাসায় যাতায়াত। তোমাকে দেখলে শ’খানেক প্রশ্ন করবে। খুব একটা কথা বলার প্রয়োজন নেই। অসভ্য একটা মেয়ে, কথাবার্তার কোনো লাইন টাইন নেই।’ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ধরে রাখলেও ভেতরে ভেতরে আতংকে ফেটে পড়ছে নবনী। কিসের ইঙ্গিত করলো চাচী? বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করবার দায়ে মুনিয়া মেয়েটা তাকে অকথ্য ভাষায় গালি দেবে নাকি চড়-থাপ্পড় মেরে বাসা থেকে বের করবে? 

    বাসা থেকে যাবার আগে টেবিলে খাবার সাজিয়ে গেছেন শামীমা। প্লেটে খাবার বেড়ে মাত্রই খেতে বসেছিল অমিত, তখনই চোখ গেল অনির ঘরে। এককোনায় বড় দুইটা লাগেজ রাখা। ওগুলো নিশ্চয়ই নবনীর! তীব্র বিতৃষ্ণায় খাওয়ার রুচিটাই চলে গেল তার। জীবনে কত ঝড় তুফান বয়ে গেল, কিন্তু এমন কিছু কখনো ঘটেনি। বহু বহু দিন বাদে মুনিয়া আজ দুদিন ধরে ঠিকঠাক কথা বলছে তার সঙ্গে। এত খুশির মুহূর্তেও খুশি ঠিক অনুভব করতে পারছে না শুধুমাত্র নবনী নামক আতংকের কারণে। মুনিয়ার কাছ থেকে কতদিন এতবড় ঘটনা চেপে রাখা যাবে কে জানে! আতংকে গলা শুকিয়ে আসে অমিতের। সব ছেড়ে তার পালাতে ইচ্ছে হয়। এক মুহূর্তে মস্তিষ্কের সমস্তটা উল্টেপাল্টে লুকানোর জায়গা সে খুঁজে বের করতে চায়। অথচ আশ্চর্য! এতবড় পৃথিবীতে একটুখানি লুকানোর জায়গা কোথাও নেই যেখানে স্বস্তি মেলে। 

    ১৬

    — “এখানে আমার কেমন যেন লাগে। দম আটকে আসে, জানো?” 

    — “সবে তো চারদিন পেরোলো। এখনই হাঁপিয়ে গেলে চলবে? থাকতে হবে তো মাস ছয়েক।” 

    — “ছয়মাস থাকতে হবে সে কথা ভাবলেই আমার মন চায় ছুটে পালাই। এখন কী মনে হচ্ছে, জানো? রাজি কেন হতে গেলাম, আরেকটু ভাবলেই বোধ হয় একটা গতি বেরোতো। নানীর পাল্লায় পড়ে অদ্ভুত এক বুদ্ধিতে আমি সায় দিয়ে চলে এলাম এই বাসায়।” 

    — “কোনো গতিই বেরোতো না। ভাবোনি তুমি? কতকিছুই তো ভাবলে।”

    — “তো আর কী বলবো বলো? ভালো লাগে না আমার।” 

    — “সমস্যা কী? অনির সঙ্গে বেশ ভালোই তো বন্ধুত্ব হলো এই চারদিনে। তুমি নিজেকে কোথাও খাপ খাওয়াতে পারছো না এটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার।” 

    — “কথা বোঝো সামি। এখানে শুধু অনি থাকে না, অমিতও থাকে। ফ্ল্যাটটা তো তার। উনার মুখ দেখলে কী মনে হয়, জানো? আমি ইচ্ছে করে ওকে ফাঁসিয়ে বিয়ে করেছি। আমাকে দেখলেই ভ্রু কুঁচকে রাখে। বুঝতেই পারি সে আমার উপর মহাবিরক্ত।”

    — “ওর জায়গায় আমি থাকলে হয়তো এমনই ভাবতাম। কেমন একটা ফিল্মি কান্ড হয়ে গেল না সেদিন রাতে? অমন একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষকে তুমি দেখোনি সে কথা কে বিশ্বাস করবে, বলো?” 

    — “কেন করবে না? আমাকে কি ওসব ছলচাতুরী জানা মেয়েদের মতন দেখায়?” 

    — “না রে পাগলী! চেহারা দেখে কে কবে কার মনটা পড়ে ফেলেছে, বলো দেখি? অমিত তোমাকে চেনে না, ও জানে না আমার কথা। আমাদের ব্যাপারটা জানলে হয়তো তোমার বলা সব কথা বিশ্বাস করে নিতো। তুমি এখানে এসেছো তাই হয়তো ইনসিকিউর ফিল করছে। কখন আবার স্ত্রীর দাবি চেয়ে বসো!” 

    — “পাগল নাকি! কে যাবে ওর কাছে?”

    — “উফ! ছেলেটার সঙ্গে যা কিছু ঝড়ের গতিতে ঘটে গেল, ও এখন কত কিই ভাববে। ওসব গায়ে লাগানো চলবে না। তাছাড়া তুমি তো বললে তার গার্লফ্রেন্ডের এই বাসায় যাতায়াত আছে। মেয়েটা তোমাকে দেখলে কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে সেটা বাড়তি চিন্তা না, বলো?” 

    — “হুম তা তো চিন্তাই। 

    — “তুমি অমিতের সঙ্গে সরাসরি এই ব্যাপারে কথা কেন বলছো না?” 

    — “ওকে বুঝিয়ে বলো তুমি শুধু দুই পরিবারের কথা ভেবে এই বাসায় এসেছো। কয়েকমাস পর চলে যাবে। এছাড়া আর কোনো পরিকল্পনা তোমার নেই কিংবা সংসার করার কোনো ইচ্ছেও নেই। তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো। এসব শোনার পর আশা করি অমিত তোমাকে স্বাভাবিকভাবে নেবে। তোমারও সাফোকেট ফিল হবে না।

    — “কিভাবে বলবো? উনার সঙ্গে আমার কথা হয় নাকি? বললাম না, আমাকে দেখলেই মুখ কালো হয়ে যায় উনার। আর আমারও না কেমন লাগে! খুব বেশি প্রয়োজন ছাড়া কথা তো আমরা কেউ কারো সঙ্গে বলি না।”

    — “এটা কি অপ্রয়োজনীয় কথা? এভাবে একই ফ্ল্যাটে থেকে ছয়মাস কাটাতে পারবে?” 

    — “না, তা পারবো না। তাহলে কবে বলবো? কিভাবে কথা শুরু করবো?” বাসার কলিংবেল বাজছে। শব্দ পেয়ে সামির দিকে তাকালো নবনী। 

    — “অমিত এসেছে হয়তো। কথা বলে নাও এখনই।’ দ্রুত পায়ে দরজা খুলতেই নবনী দেখতে পেলো অমিত দাঁড়িয়ে। ভেতরে একবার উঁকি দিয়ে অমিত জিজ্ঞেস করলো, 

    — “অনি ফেরেনি?” 

    — “না। কল করে বললো ফিরতে দেরী হবে।”

    — “ওহ!” 

    — “আপনি চলে যাচ্ছেন কেন?” 

    — “এমনি। আসবো একটু পর।”

    নবনীকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লিফটে উঠে গেল অমিত। দরজা আটকে পেছন ফিরতেই দেখলো সামি মুখ চেপে হাসছে। ভ্রু কোঁচকালো নবনী। 

    — “হাসছো কেন?” 

    — “তোমার সঙ্গে খালি ফ্ল্যাটে থাকতে ভয় পাচ্ছে বোধহয়। কখন আবার শার্ট- প্যান্ট ধরে টানাটানি শুরু করে দাও!” 

    — “সামি! এখন কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।” 

    — “ধুর রেগে যাচ্ছো কেন? মজা করছিলাম। তবে ছেলেটা খুব লয়্যাল। খালি ফ্ল্যাটে তোমার সঙ্গে থাকতে হবে ভেবে চলে গেল। গার্লফ্রেন্ডকে বোধহয় খুব ভালোবাসে। নয়তো এমন সুন্দর হাতির বাচ্চা বউ পেয়ে কেউ আবার গার্লফ্রেন্ডকে মনে ধরে বসে থাকবে নাকি?” 

    ১৭

    রাত অনেক গড়ালো। কী এক স্বপ্ন দেখতে গিয়ে ঘুমের ঘোরে সারা শরীরের ঘাম ছেড়ে, গলা শুকিয়ে, হাঁপাতে হাঁপাতে ঘুম ভাঙলো নবনীর। খানিকটা স্বাভাবিক হবার পর অনেক চেষ্টায়ও মনে পড়লো না স্বপ্নে সে কী দেখছিল? বিরক্ত ধরে এল তার। আজব কান্ড! মাত্রই দেখা স্বপ্ন কেউ কী করে এক মুহূর্তে ভুলে যেতে পারে! তার উপর তাকে এমন নাস্তানাবুদ বানিয়ে ফেলা স্বপ্ন! গলা-টলা শুকিয়ে একাকার। এলোমেলো বিড়বিড় করতে করতে ডাইনিংরুমে এসে ঢকঢক করে দুই গ্লাস পানি খেয়ে ফেললো নবনী। ড্রইংরুম থেকে আলো আসছে। ওদিকটায় উঁকি দিয়ে দেখলো অমিত রুমের লাইট অফ করে টিভি দেখছে। সামি বলেছিল অমিতের সঙ্গে কথা বলে পুরো ব্যাপারটা ক্লিয়ার করতে। কিন্তু এখন কিভাবে সম্ভব? অনি ঘুমুচ্ছে, রাত বাজে আড়াইটা। এত রাতে আলাদা ঘরে বসে কথা বলা কি বাজে দেখাবে না? আবারও লোকটা তীব্র বিতৃষ্ণায় ভ্রু কুঁচকাবে নিশ্চয়ই! নাহ্, তার চেয়ে বরং দিনের আলোয়, অনিকে সামনে রেখে কথা বলা যাবে। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘরে ফিরে যাচ্ছিল নবনী। হঠাৎ ঘাড়ের পেছনের রগটা বুঝি ভূত এসে টেনে বাঁকিয়ে দিলো। চট করেই রেগে গেল নবনী। প্রায় দৌড়ে গিয়ে ড্রইংরুমের লাইট জ্বালিয়ে অমিতের মুখোমুখি গিয়ে বসলো। বরাবরের মতন অমিত ভ্রু কুঁচকালো, চোখে মুখে তার ভীষণ বিরক্তি। নিচু স্বরে ধমকে উঠলো নবনী, 

    — “খবরদার পেঁচার মতন মুখ করবেন না। চেহারা ঠিক করুন। ঠিক করুন বলছি!” 

    নবনীর ধমকে খেই হারালো অমিত। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। 

    — “হ্যাঁ, এবার ঠিক আছে। আসল কথায় আসি কেমন?” 

    — “আমার উপর আপনি এত বিরক্ত কেন?” 

    — “কই বিরক্ত?” 

    — “দেখি তো আমি। আমাকে দেখলেই রাজ্যের সব বিতৃষ্ণা আমি আপনার 

    চেহারায় দেখতে পাই। আর কথা বলা থাক দূরের ব্যাপার। কাজিন না আমরা? আমরা কি শত্রু? আপনাকে দেখলে আমার মুখ লুকিয়ে রাখতে হয় লজ্জায়। এভাবে কিভাবে এতগুলো মাস থাকব আমি? আমি আপনার বাসার গেস্ট। মিনিমাম ভদ্রতা বজায় রাখা উচিত, তাই না?” 

    — “আনএক্সপেক্টেড গেস্ট।” 

    — “ইশ্! আমি তো খুব শখ করে এই বাসায় এসেছি, তাই না? ফ্যামিলির কথা ভেবেই এসেছি। হয়ে গেছে একটা ভুল, ইচ্ছে করে তো আর করিনি। নয়তো কে আসে আপনার বাসায় থাকতে? এই এলাকায় আছেন ৭-৮ বছর হলো। কতবার চাচা চাচী দাওয়াত করলো। এত কাছে থেকেও এসেছি কখনো? আসিনি। ঠ্যাকায় পড়ে এসেছি।” 

    — “খুব সহজে বলে দিলেন, হয়ে গেছে একটা ভুল। আসলেই কি ব্যাপারটা এত সহজ? কতখানি ভুগতে হচ্ছে আমাকে! আমার একটা রিলেশন আছে সে কথা জানেন নিশ্চয়ই? ও জানতে পারলে কী বলবো ওকে? এই বিয়ে আমি মানি না। কিন্তু আপনি আমার ওয়াইফ সে কথাও কি অস্বীকার করা যাবে? চোখের সামনে সেই আপনি ঘোরাফেরা করছেন এটা আমি হাসিমুখে মেনে নেবো? এতটাও কি একটা মানুষের কাছে এক্সপেক্ট করা উচিত? মুন জানলে কী হবে বলুন তো? ওর চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারব কখনো?” 

    মাথা নিচু করে ফেললো নবনী। মিনমিন করে বলতে লাগলো, 

    — “আমিও অন্য কাউকে ভালোবাসি। নিজের চেয়েও বেশি। ওকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করবো এমনটা আমি কখনো দুঃস্বপ্নেও ভাবিনি। ইচ্ছে করে কিছু করিনি আমি। সেদিন যদি আমি একা থাকতাম, আমাকে মেরে ফেললেও কেউ বিয়ে দিতে পারতো না। রাজি হয়েছি শুধু নাতাশা আর অনির কথা ভেবে। বিশ্বাস করুন প্লিজ! এখানেও আমি আসতাম না। আপনার সামনে দাঁড়াবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা কিংবা সাহস কোনোটাই আমার ছিল না। কোনোমতে ডিভোর্স হয়ে গেলে আমি বেঁচে যাই। কিন্তু বাবা অসুস্থ হলো, অনি-নাতাশার কথা বললো নানী। আপনার আমার সঙ্গে যা কিছু ঘটে গেছে তা তো বদলাতে পারব না। মেয়ে দুটোর ভবিষ্যৎ যেন নষ্ট না হয় সে কথা ভেবেই রাজি হয়েছি। আপনি যতটা কষ্ট পাচ্ছেন, ঠিক ততটা আমিও পাচ্ছি। আমি ভুল স্বীকার করেছি, আপনাকে স্যরিও বলেছি। স্যরি বলা ছাড়া আর কী করতে পারি আমি? এক বাসায় কয়েকমাস থাকতে হবে আমাদের, তারপর আগের মতো সব হয়ে যাবে। আমাকে দেখে এভাবে মুখ কালো করে ফেলবেন না প্লিজ। আমার খুব গিল্ট ফিল হয়। আপনার বাসায় এসে থাকার সিদ্ধান্ত আমার জন্য সহজ ছিল না। ব্যাপারটা আমার জন্য আরো জটিল করবেন না প্লিজ। আমি আপনার ওয়াইফ সে কথা স্বীকার করার কোনো প্রয়োজন নেই। কেউ আপনাকে ফোর্স করছে না আমাকে মেনে নেয়ার জন্য। ভুলে যান সেসব। আমিও ভুলার চেষ্টা করছি। আপনি আমার সঙ্গে যতটা সহজ আচরণ করবেন আমি ততটাই ঐ বিদঘুটে ঘটনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবো। এই সম্পর্ক বাদেও আমাদের আলাদা সম্পর্ক আছে। আমরা কাজিন, খুব দূরের আত্মীয় কিন্তু না। আমার বাবার আপন চাচাতো ভাইয়ের ছেলে আপনি। কাছের আত্মীয়ই তো, তাই না? হয়তো যোগাযোগের অভাবে সম্পর্ক খুব একটা নেই আমাদের মাঝে। তবে একই বাসায় যেহেতু থাকবো, সম্পর্ক ভালো করে নেয়াই বেটার।” 

    — “কী সহজ সবকিছু, তাই না? আপনি নিজে একটা রিলেশনে আছেন। আপনিই বলুন না, আপনার বয়ফ্রেন্ড যদি জানে আপনার অন্য কারো সঙ্গে বিয়ে হয়েছে সে কি আপনার সঙ্গে রিলেশন রাখবে?” 

    — “কেন রাখবে না? আমি কি ইচ্ছে করে করেছি নাকি এসব?” 

    — “যান গিয়ে বলুন। দেখি আপনার রিলেশন টিকে কি না?” 

    — “ও সবকিছু জানে। সেদিন সামিই তো বললো, বিয়েতে রাজি হয়ে যাও। নাতাশা আর তোমার সেইফ হওয়া আগে জরুরি। বিয়েশাদী কি হবে না হবে সেসব পরেও ভাবা যাবে। ওর কথা শুনেই তো আমি রাজি হলাম।” 

    — “কিহ্! আপনার বয়ফ্রেন্ড বলেছে বিয়ে করতে! সে জানে আপনি এখন আমার বাসায়?” 

    — “হ্যাঁ জানে।” 

    — “ঝামেলা করেনি?” 

    — “কেন করবে? ও তো জানেই সবটা। আমাকে বিশ্বাসও করে। দুনিয়া উল্টেপাল্টে গেলেও ওকে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না সে কথা ও জানে। তাই এসব নিয়ে ওর মাথাব্যথা নেই।”

    — “মাই গড!” 

    অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো অমিত। বোকা বোকা চেহারায় অমিতের দিকে তাকিয়ে রইলো নবনী। 

    — “আপনি হাসছেন কেন?” 

    — “আপনার সামনে কাঁদবোনা নিশ্চয়ই!” 

    — “কাঁদবেন কেন?” 

    — “সবার জীবন আপনার মতো সহজ না। এমন আন্ডারস্ট্যান্ডিং লাইফ পার্টনার পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এতটা ভাগ্য আমার নেই। মুন কখনোই এই ব্যাপারটা মেনে নেবে না। তার উপর আপনাকে আমার বাসায় দেখলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। আমাদের সম্পর্কটা আর টিকবে না। সম্পর্কটা না টিকলে হয়তো আমারও এই পৃথিবীতে টিকে থাকা দায় হয়ে যাবে।” 

    — “আপনি তো দেখছি ইনিয়ে বিনিয়ে সুইসাইড থ্রেট দিচ্ছেন! এতদূর ভাবছেন কেন আপনি? আপনার গার্লফ্রেন্ড এসব জানবেই না। কে জানাবে তাকে?”

    — “সত্যি কথা কখনো চাপা থাকে না।”

    — “আমরা চেপে রাখবো। আপনার কতবড় ক্ষতি আমি করে ফেললাম, আমার একটা দায়িত্ব আছে না? আমাকে আপনি বিশ্বাস করতে পারেন। আমি কাউকে কিছু জানতে দেবো না। আর এখানে এসে যদি আমাকে দেখেও ফেলে তাতে কী, বলুন? আমরা তো আর একঘরে থাকছি না। বলে দেবো আমি আপনার কাজিন। এখানে এসেছি আমার জরুরি কাজে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো অমিত। হতাশ চোখে তাকিয়ে রইলো টিভির স্ক্রিনে। লম্বা 

    আলোচনায়ও কোনো ফায়দা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তার জন্য মায়া হচ্ছে নবনীর, আহারে বেচারা! কী দুশ্চিন্তায়ই না ডুবে মরছে সে। 

    ১৮

    খাবার টেবিলে বসে সকালের নাস্তা করছে ওরা তিনজন। অনি নাস্তা করতে করতে দেখছে অমিত, নবনীকে। গুনে গুনে দশদিন পেরোলেও দুজনের মাঝে এখনও স্বাভাবিকতা আসেনি। দু’জনের মাঝে দেয়াল দাঁড় করিয়ে রেখেছে অমিতই। বাবা গতকাল জানতে চেয়েছিল ওদের কথা। মা তো প্রতিদিন নিয়ম করে জিজ্ঞেস করছেই। আপাতত অনির কাছেও অমিত-নবনীর বিয়েটা স্বাভাবিক লাগছে। এতদিন মনে হচ্ছিল, অনাকাঙ্খিত একটা সম্পর্ক টেনে নেয়া নিরর্থক। নবনীর সঙ্গে এই ক’টাদিন কাটানোর পর মনে হচ্ছে, এই মেয়েটা কিংবা এই সম্পর্কট মন্দ কী! ভালোই তো, বরং অনেক বেশি ভালো। থাকুক না নবনী চিরকাল অমিতের হয়ে। টিকে থাকুক ওদের সম্পর্কটা আজীবন। জটিল এই সম্পর্কের পথটা সবাই মিলে বুঝিয়ে শুনিয়ে একটুখানি সহজ করে দিলেই তো হয়! দু’জনকে আরো একটুখানি কাছাকাছি থাকার, বোঝাপড়ার সুযোগ করে দিলেই তো হয়! 

    মিথ্যেমিথ্যি গলা ঝাড়লো অনি। অমিতের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিতে দিতে বললো, 

    — “ভাইয়া, তুমি আজ অফিসে যাবার সময় নবনী আপুকে কারখানায় নামিয়ে দিয়ে যেও।” 

    — “আমি কেন?” 

    — “আপু গতকাল সিঁড়ি থেকে স্লিপ কেটে পড়ে গেছে। কারখানায় ওর জরুরি কাজ আছে। যেতেই হবে, নয়তো বাসায়ই থাকতে বলতাম।” 

    — “আমার জরুরি কাজ আছে, জলদি অফিসে যেতে হবে।”

    — “৫-৭ মিনিটেরই তো ব্যাপার।”

    — “না, না। আমি যেতে পারব। একটা রিকশা নিয়ে নেবো।” 

    — “হলোই তো, উনি চলে যাবে রিকশা নিয়ে।” 

    — “রিকশার জন্য নিচে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। বেচারীর পায়ে ব্যথা ভাইয়া। ও আমাদের কাজিন, কাছের মানুষ। কবে কী ঘটেছে সেসব মাথায় রাখবে আর কতদিন? এবার একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করো। একই বাসায় আছি আমরা। সবাই সবার সঙ্গে নরমাল বিহেভ করা কি উচিত না?” 

    — “আমি নিচে ওয়েট করছি। আপনি আসুন।” 

    অমিতের পাশে বসে আছে নবনী। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে তার। মেয়েদের সঙ্গে তার উঠাবসা নেই এমনটা তো না। বান্ধবী, কলিগ, অফিসে প্রায় প্রতিদিন আসা বিভিন্ন মডেল এমন কত মেয়ের সঙ্গেই কথা হচ্ছে, একসঙ্গে বসে কাজ হচ্ছে। কই, কখনো তো এতটা অস্বস্তি হয়নি। নবনীর বেলায় এমন কেন তবে? বহুবার মাথায় এসেছে, এই মেয়েটার সঙ্গে স্বাভাবিক হওয়ার কথা। শত চেষ্টায়ও তার সঙ্গে স্বাভাবিক হতে পারছে না, অন্য দশটা মানুষের মতো হাসিমুখে কথা বলতে পারছে না। কোন এক অজানা জড়তা তাকে আঁকড়ে ধরে বারবার। বাবা জানলে রাগ করবে নিশ্চয়ই! কিন্তু এই সমস্যার সমাধান কোথায়? 

    ১৯

    আজ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে অমিত। সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে এল সাভারে। আজকের দিনের জন্য এখানকার একটা রিসোর্টে রুম বুক করে রেখেছে গত সপ্তাহেই। আজ মুনিয়ার জন্মদিন। এরচেয়ে বিশেষ দিন তার কাছে আর কী হতে পারে? মুনিয়ার জন্মদিনের মাস দুয়েক আগে থেকেই চলতে থাকে অমিতের নানারকম প্ল্যান। সম্পর্কের প্রথম দুইবছর মুনিয়ার বার্থডে সেলিব্রেট করতে চলে গিয়েছিল অন্য শহরে। একবার সেইন্ট মার্টিন, অন্যবার সিলেটে। একান্তে তিন চারদিন সময় কাটিয়েছিল তারা। গেল বছর মুনিয়ার ব্যস্ততার কারণে যাওয়া হয়নি দূরে কোথাও, ঢাকাতেই একটা রেস্টুরেন্টে ছোট আয়োজন করেছিল। এবার দুই সপ্তাহ আগে থেকেই খুব রিকোয়েস্ট করে মুনিয়ার বিজি শিডিউল থেকে দূরে কোথাও একান্তে সময় কাটাবে বলে একটা দিন চেয়ে নিয়েছে অমিত। কথা ছিল দু’জনে একসঙ্গে সকালেই চলে আসবে এখানে। অমিত গাড়ি নিয়ে বেরোতেই মুনিয়া কল করে বললো, “তুমি যাও, আমি ঘন্টা তিনেক পর আসছি। জরুরি কাজ পড়ে গেছে।” 

    তিনঘণ্টা পেরিয়ে সাতঘন্টা হয়ে গেল, সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, মুনিয়া এখনো আসেনি। চোখের কোণে পানি জমেছে অমিতের। মুনিয়ার নাম্বারে অসংখ্য কল আর টেক্সট করা সত্ত্বেও এখনও কোনো রিপ্লাই আসেনি। ভেজা চোখে তাকিয়ে আছে সে মোবাইল স্ক্রিনে। ছবির প্রাণবন্ত হাসির মুনিয়া তাকিয়ে আছে তার দিকেই। অমিত ভেবে পায় না এত মায়া যার হাসিতে, সে কেমন করে অন্যকে পোড়াতে পারে? 

    .

    কারখানায় কাজের ভীষণ চাপ যাচ্ছে। বড় দু’টো অর্ডার এসেছে লন্ডন আর কানাডা থেকে। বিশ দিনের ভেতর কাজ শেষ করে প্রোডাক্ট ডেলিভারি করতে হবে। ওদিকে শীত শুরু হতে না হতেই অনলাইন পেইজে শাল, আর ফুল হাতা ব্লাউজ বেশিরভাগই স্টক আউট। সেগুলো আবার রিস্টক করতে হচ্ছে। তিনদিন যাবৎ বাসায়ও ফেরা হচ্ছে না সময়মতো। ভোর সকালে কারখানায় এসে রাত দশটা এগারোটায় ফিরতে হচ্ছে। প্রোডাক্ট ডেলিভারী হওয়ার আগ অব্দি এমনই চলবে। এত এত কাজের চাপেও গুনে গুনে দেড়ঘন্টা কেড়ে নিলো শামীমা চাচী। আকারে ইঙ্গিতে ব্যস্ততার কথা জানালেও, চাচী সে কথা শুনলোই না। বরং কাঁদতে কাঁদতে ছেলে আর ছেলের প্রেমিকার বিরুদ্ধে একগাদা অভিযোগ শোনালো। ভদ্রতার খাতিরে কিংবা মায়ের বয়সী চাচীর কান্নাকাটির মায়ায় পড়ে এত ব্যস্ততায়ও কল কাটতে পারেনি নবনী। চাচীর সমস্ত অভিযোগ মন দিয়ে শুনেছে। কল কেটে দেবার আগে বেচারী খুব অনুরোধ করে বললো তার ছেলেকে মুনিয়ার ব্যাপারে বোঝাতে, জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে। চাচীকে মিথ্যা স্বান্তনা দিলেও সত্যিকারে অমিতকে এই ব্যাপারে কিছু বলা অসম্ভব। আগের মতো দুজনের মাঝে গুমোট ভাবটা আর নেই। তবে স্বাভাবিক কথাবার্তা হলেও, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা বলার মতো খুব একটা সখ্যতাও নেই। মাথার দুপাশে চেপে ধরে রেখেছে নবনী। বহুবছর এতটা সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা হয়নি। তার উপর কাজের চিন্তায় ঘুমও হচ্ছে না রাতে ঠিকঠাক। সকালের নাস্তাই এখনো করা হয়নি। সব মিলিয়ে মাথা ধরেছে খুব। আজ বাসায় জলদি ফিরে, স্লিপিং পিল খেয়ে লম্বা ঘুম দিতে হবে। 

    .

    রাতের খাবার শেষে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছে নবনী। আয়নায় দেখছে চিন্তিত অনিকে। অনবরত কল করে যাচ্ছে অমিতের নাম্বারে। ভাইয়ের চিন্তায় বেচারী ঠিকমতো খেতেও পারেনি। সকালবেলা বাসা থেকে বেরোবার আগে শেষ কথা হয়েছিল দুই ভাইবোনের। এরপর অমিতের সঙ্গে আর কারো কোনো যোগাযোগ হয়নি। মা-বাবা, বোন কারো কল রিসিভ করছে না সে। নবনীও কল করেছিলো দু’বার। অমিত রিসিভ করেনি। অনির মুখটা দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছে নবনীর। এই লোকটাকে নিয়ে কেউ শান্তিতে নেই। এতগুলো দিনে তার চালচলন আর অনির বিভিন্ন কথায় কিছুটা আন্দাজ করলেও, আজ চাচীর সাথে দীর্ঘ আলাপে সে কথা পুরোপুরি বোঝা হয়ে গেছে নবনীর। একজন চৌত্রিশ বছর বয়সী মানুষ এতটা বোধ-বুদ্ধিহীন কী করে হতে পারে, তাই-ই ভেবে পাচ্ছে না সে। তোয়ালেতে মুখ মুছতে মুছতে অনির পাশে এসে বসলো নবনী। 

    — “উনার ফ্রেন্ডদের কাছে খোঁজ নাও।” 

    — “নিয়েছি। কেউ জানে না ও কোথায় আছে।” 

    — “অফিস? ওখানে খোঁজ নিয়েছো?” 

    — “হ্যাঁ। বাসা থেকে বলে গেল অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছে, অথচ অফিসে খোঁজ নিয়ে জানলাম ভাইয়া আজ ছুটি নিয়েছে।” 

    — “ওহ! অফিসেই যায়নি?” 

    — “উহুম। এখন তো ফোনের সুইচও অফ। 

    — “কী মুশকিল! 

    — “থানায় যাবো একবার?” 

    — “থানা? তুমি কি বাজে কিছু ধারণা করছো?” 

    — “ভাইয়া একটু পাগলাটে স্বভাবের। কিন্তু সারাদিনে একবারও কল রিসিভ করবে না এমন কখনো হয়নি।” 

    — “রাতও তো অনেক হলো।” 

    — “আমার সত্যিই ভয় লাগছে আপু। চলো একবার থানা হয়ে আসি। কোথায় কোন বিপদ হলো কে জানে?” 

    — “চাচা-চাচীকে একবার জা…” 

    নবনীর কথা শেষ হবার আগেই বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো। অনি দৌড়ে গেল দরজা খুলতে, পেছন পেছন গেল নবনীও। অমিত এসেছে। ছোটবেলার বন্ধু সৌমিকের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জড়িয়ে আসা কন্ঠে চিৎকার করে বারবার বলছে, “মুন এমন কেন করলো? আমি সহ্য করতে পারব না, ও কি জানতো না?” 

    অমিতকে এক প্রকার ঠেলতে ঠেলতে ঘরে নিয়ে এল সৌমিক। তাকে সোফায় বসিয়ে অনিকে বললো,

    — “অনি আমাকে এক্ষুনি একটু হসপিটাল যেতে হবে। আমার শ্বশুরের অবস্থা ভালো না, অমিতকে সামলাও।”

    — “ওর হয়েছেটা কী, একটু বলে যান?” 

    — “মুনিয়ার বার্থডে ছিল। রিসোর্ট বুক করলো, দু’জনে একসঙ্গে সারাদিন কাটাবে বলে প্ল্যান করলো। কিন্তু মুনিয়া যায়নি। কাজের বাহানায় রয়ে গেল এখানেই। আসলে কাজ-টাজ কিছু না, ও আজ শাহরিয়ারের সঙ্গে ছিল। চেনো তো শাহরিয়ার চৌধুরীকে?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “রেস্টুরেন্টে বেশ অন্তরঙ্গ অবস্থায় দেখেছি ওদের। চট করে তোমার ভাইকে ছবি তুলে দিলাম। সেটা দেখেই বিস্তারিত জানতে ছুটে এল আমার অফিসে। তারপর অফিস থেকে চলে গেল বারে। পেছন পেছন আমিও গেলাম। ওকে একা ছাড়ার সাহস হয়নি।

    — “বিকেলে কল করলাম তখন বলেননি কেন ও কোথায় আছে?” 

    — “ইচ্ছে করে জানাইনি। ও বাসায় কী বলে বেরিয়েছে তা তো জানি না।”

    — “দুশ্চিন্তায় আমি শেষ!”

    — “পাগলকে এতক্ষণ সামলেছি। তোমার ভাইকে রেখে গেলাম, ওকে এখন তুমিই সামলাও। চোখে চোখে রেখো আর নিজেও সাবধানে থেকো। দুইদিন অফিসে যেতে দিও না। এবারের ধাক্কাটা একটু জোরদারই ছিল। সামলাতে সময় লাগবে। কোনো সমস্যা হলে জানিও। আমি গেলাম।” 

    অনি দরজা আটকে এসে দেখলো নবনী চোখ বড় করে অমিতকে দেখছে। তার দুইহাতে দু’টো ফুলদানী। 

    — “আপু, তুমি ঘরে যাও। মাথাব্যথা করছে বলছিলে না! ঘুমাও গিয়ে।

    — “রাখো তোমার ঘুম। ঘুম, মাথাব্যথা সব উড়ে গেছে আমার। উনাকে কী করবে, সেটা বলো।” 

    — “নতুন কিছু না। মুনিয়ার সঙ্গে বড়সড় ঝামেলা হলেই মদ খেয়ে বাসায় ফিরে পাগলামি করে।” 

    — “জানো, তুমি ঐ ভাইয়াটার সঙ্গে কথা বলছিলে তখন উনি ফুলদানিগুলো আছাড় দিতে চেয়েছিল। আমি জোর করে হাত থেকে কেড়ে নিয়েছি। সেজন্য আমাকে দুটো পঁচা গালিও দিলো!” 

    ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো অনি। নবনীর হাত চেপে বললো, 

    — “আপু তুমি রাগ করেছো? কী লজ্জার ব্যাপার বলো তো! এসব ঝামেলা এখন তোমাকেও পোহাতে হচ্ছে।” 

    অনিকে ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে। ওকে দেখে খুব মায়া লাগছে নবনীর। লোকটা এই পরিবারের সবার হাড়-মাংস জ্বালিয়ে ফেলেছে নিশ্চিত! নয়তো এত অসহায় হয়ে কেউ কাঁদে নাকি? 

    টি টেবিলের উপরে থাকা নবনীর মোবাইল নিয়ে টিভি বরাবর ছুঁড়ে মারলো অমিত। মোবাইলের স্ক্রিন ভেঙে চুরমার হয়ে পড়ে রইলো ফ্লোরে। টিভির স্ক্রিনে বিশাল ফাঁটা দাগ পড়েছে। নবনী দু’হাতে মুখ চেপে একবার ভাঙা ফোনের দিকে তাকাচ্ছে তো অন্যবার টিভির স্ক্রিনে। অনির কান্নার গতি দ্বিগুন হলো। হাউমাউ করে কাঁদছে অমিতও। দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে অনবরত মুন, মুন বলে চিৎকার করছে। কপাল ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে তার। অনি ভাইয়ের হাত টেনে যতই সরাতে চাইছে ততই অমিত শরীরের সমস্ত শক্তি ঢেলে দেয়ালে মাথা ঠুকছে।

    ঘরের মধ্যখানে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নবনী। এর আগে কখনো এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বলে মনে পড়ে না। এইতো গেল মাসেই লোকটা ইনডিরেক্টলি সুইসাইড করবে বলে থ্রেট দিচ্ছিল। আজ সত্যি সত্যি তেমন কিছু ঘটে যাবে না তো? ভয়ে নবনীর গলা শুকিয়ে এল। একগ্লাস পানি খাওয়া জরুরি ফ্রিজের ঠান্ডা পানি ঢকঢক করে গিলতে গিলতে অমিতকে দেখছে নবনী। সকালেই চাচী বলছিল তার পাগলামির কথা। পাগলামি যে এমন সীমা ছাড়ানো পর্যায়ে চলে যায়, সে কথা কে জানতো? দেয়ালে রক্তের দাগ বসে যাচ্ছে, কপাল থেকে নাক 

    বেয়ে রক্তের ফোঁটা পড়ছে ফ্লোরে। ভয়, রাগ মিলে মাথার রগ ফেঁটে যাবার উপক্রম হলো নবনীর। লোকটাকে এবার থামাতে হবে, প্রয়োজনে চড় থাপ্পর দিয়ে হলেও থামাতে হবে। 

    হেঁচকা টানে অমিতকে সোফায় ফেলে দিলো নবনী। নেশায় বুদ অমিত কোনোভাবে শরীরের টাল সামলে সোফা থেকে উঠতে যাচ্ছিল, নবনী আবারও তাকে ধাক্কা দিয়ে সোফায় শুইয়ে দিলো। 

    — “খবরদার! চুপ করে শুয়ে থাকুন বলছি। একদম বাড়াবাড়ি করবেন না। এ্যাই অনি, যাও তো ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসো।” 

    তড়িঘড়ি করে অনি রুম থেকে ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এল। অমিতের হাত ধরে বসালো নবনী। ডেটলে ভেজানো তুলো কাছে নিতেই নবনীর হাত ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো অমিত। — “লাগবে না কিছু।” 

    — “কেন লাগবে না?” 

    — “মুনকে এনে দেবেন?” 

    — “দেবো।” 

    — “আসবে না ও। আমি জানি আসবে না। ও শাহরিয়ারের সঙ্গে আছে। রাত গভীরে লম্বা চুমু হয় জানেন তো? আমার মুনও চুমুতে ব্যস্ত, লম্বাআআআ চুমু!”

    আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো অমিত। বুকের বাঁ পাশে কেমন মোচড় কেটে ব্যথা হচ্ছে নবনীর। প্রেমিকার চরম প্রতারণা নিজ চোখে দেখেছে বোধহয়! প্রতারণার যন্ত্রণা কেমন হয় সে অনুভূতি জানা নেই তার। তবে ভালোবাসা হারাবার যন্ত্রণা মৃত্যু সমতূল্য সে কথা ভীষণভাবে জানে সে। অমিতেরও হয়তো মৃত্যুযন্ত্রণা হচ্ছে! 

    চোখের পলকে অমিত ডেটলের বোতল মুখে নিয়ে নিলো। ধাক্কা দিয়ে বোতল ফেলে দিলো নবনী। চেঁচিয়ে উঠলো অমিতের সঙ্গে 

    — “মারবো ধরে এক চড়! কী সাংঘাতিক! আমরা দুই দুইজন জলজ্যান্ত মানুষ আপনার সামনে দাঁড়ানো, অথচ আপনি আমাদের সামনেই সুইসাইড এটেম্পট নিতে চাইছেন? আপনার বোন কাঁদতে কাঁদতে অস্থির হয়ে যাচ্ছে আপনি চোখে দেখতে পান না? দেয়ালে মাথা ঠুকে ঠুকে রক্তারক্তি কান্ড করে ফেললেন। একটুও কি ব্যথা লাগছে না? এতটুকুতে কি পোষায়নি যে এখন ডেটল গিলতে চাইছেন? মাতাল হলে কি মানুষ গন্ডারও হয়ে যায়?”

    — “আমার সব অনুভূতি মুনের কাছে জমা আছে। ও চলে গেছে আমার অনুভূতি 

    মরে গেছে। এবার আমিও মরতে চাই, এত যন্ত্রণা আর নিতে পারছি না। এবার আমাকে মুক্তি দিন প্লিজ! — “এইতো ব্যান্ডেজটা করি, তারপর মুনকে এনে দেবো। আমি নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো ওকে। আর কোনো পাগলামি, চেঁচামেচি না।” 

    অমিতের কাছে বসে ড্রেসিং করে দিচ্ছে নবনী। আগের চেয়ে অনেকটাই নিস্তেজ হয়ে গেছে সে। একটু আগেও খুব চিৎকার করছিল, এখন পাশে বসেও নবনী তার কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না। তার একহাত শক্ত করে ধরে রেখেছে অনি। শীতের মাঝে মাথার উপর ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে। তবুও ঘামছে অমিত। তার কপালে নবনীর হাত। সেই হাত চেপে ধরলো অমিত। পৃথিবীর সমস্ত অসহায়ত্ব তার চোখে, কন্ঠে। বিড়বিড় করে বললো, “আমার মুন অমানুষ হলো কবে?” 

    .

    নবনীর গায়ে ঢলে পড়লো অমিত। জ্ঞান হারিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে সাময়িক বিদায় নিয়েছে সে। 

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ২০

    ২০

    — “রোদ্দুর…”

    — “হুম?” 

    — “ঘুম আসছে না?” 

    — “মন খারাপ লাগছে।”

    — “না ঘুমালে শরীরটাও খারাপ করবে।” 

    — “সামি…” 

    — “হুম?” 

    — “একজন মানুষের এত ভালোবাসা ঠেলে দেবার সাধ্য কী করে হয়?” 

    — “পৃথিবীতে সবাই কি ভালোবাসা খোঁজে? কেউ কেউ টাকা খোঁজে, খ্যাতি খোঁজে, পৃথিবীটা রাজত্ব করার নেশায় বুঁদ থাকে। যে ভালোবাসা চায় না তার কাছে একবিন্দু ভালোবাসা কিংবা অসীম ভালোবাসা, সবটাই এক।” 

    — “বেচারা বোধহয় মরেই যাবে!” 

    — “চোখে চোখে রাখতে হবে। ওকে দেখে রাখার দায়িত্ব শুধু অনির না, দায়িত্ব তোমারও। বাসায় এখন তুমিও আছো। ওকে ব্যস্ত রাখবে, বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করবে।” 

    — “যতক্ষণ আছি ততক্ষণ না হয় খেয়াল রাখতে পারবো। কিন্তু উনার ব্যক্তিগত ব্যাপার এটা। উনার সঙ্গে আমি খুব একটা ক্লোজ না। মুনিয়ার ব্যাপারে কিছু বলা কি উনি পছন্দ করবেন? আজ যা দেখলাম মনে হয় না পাগলামি সহজে বন্ধ হবে। কত কিই করতে চাইবে। বারবার আমি বাঁধা দিলে রেগে যাবে না?” 

    — “তো আর কী করার আছে? চোখের সামনে একজন মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করছে দেখেও হাত-পা গুটিয়ে বসে তো আর থাকা যাবে না। উল্টাপাল্টা বকবে হয়তো, কিছুদিন পর ঠিক হয়ে যাবে। একটুখানি নাহয় সয়েই গেলে।”

    — “কারখানায় এত কাজ! আমাকে যেতেই হবে। অনি একা কিভাবে সামলাবে বুঝে পাচ্ছি না।” 

    — “চাচা-চাচীকে আসতে বলো।” 

    — “চাচী অলরেডি অসুস্থ হয়ে গেছে ছেলের কান্ড শুনে। চোখের সামনে এসব দেখতে পেলে অবস্থা আরো খারাপ হবে না?” 

    — “নাতাশাকে বলবে?” 

    — “কল করেছিলাম। রিসিভ করেনি। ঘুমাচ্ছে বোধহয়।” 

    — “কপাল খুব বেশি কেটেছে?” 

    — “হ্যাঁ। প্রথমে বুঝিনি। দেয়ালে পেরেকের উপর কপাল লেগেছে, ডিপকাট ছিল।”

    — “ইশ!” 

    — “সেন্সলেস হওয়ার পর অনি উনার এক ফ্রেন্ডকে কল করলো। উনি এসেছিল বাসায়। স্টিচ লাগলো দুইটা। হার্ট রেট বেশি, ব্লাড প্রেশার হাই।” – “ইচ্ছেমতো মদ গিলেছে বোধহয়।” 

    — “অনি খুব কাঁদছিল। এখনও কাঁদছে বোধহয়।” 

    — “কোথায় ও? অমিতের ঘরে?” 

    — “হুম।” 

    — “সেন্স ফেরার পর বমি করলো। মাথায় নাকি প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে, মাথা তুলে বসতে পারছে না। ঘুমাচ্ছে এখন। অনি বললো ঐ ঘরেই থাকবে, কখন কোন প্রয়োজন হয়!” 

    — “কাল কারখানায় না গেলে হয় না?” 

    — “অনেক কাজ জমেছে। আমি না গেলে চলবে?” 

    — “তাহলে ঘুমাও, কয়েকদিন ধরে খুব খাটাখাটুনি যাচ্ছে। রাতে না ঘুমালে বিছানায় পড়ে যাবে না?” 

    সামির কথায় নবনী না কোনো সায় দিলো, না কোনো উত্তর। বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সে। উত্তরের হাঁড় কাঁপানো বাতাস গায়ে লাগছে। ভারী সোয়েটারেও শীত মানছে না। ঠান্ডার চেয়ে তীব্র বিষণ্নতাই নবনীকে জেঁকে ধরেছে। ওসব হীম শীতল বাতাস আজ যেন নবনীকে স্পর্শ করতে পারছে না। রাত গভীরে গোটা শহর ঘুমিয়ে। ঘুমুচ্ছে বোধহয় মুনিয়াও, নিশ্চিন্তে! একবার তাকে ডেকে নবনীর খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, একটা মানুষ তোমাকে ভালোবেসে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, পরিবার তাদের ছেলের যন্ত্রণা দেখে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। শুধু শুধু কেন কষ্ট দিলে তাকে? শুধু ভালোই তো বেসেছিল। তোমাকে ভালোবাসা কি পাপ? 

    ২১

    মাথার উপর শত কাজের চাপ, এমন সময়ে পুরোনো দক্ষ তিনজন কর্মী দল পাকিয়ে চলে গেল কারখানা ছেড়ে। অগত্যা নতুন তিনজনকে নিতে হলো কারখানায়। দু’জন কাজে পটু হলেও, একটা মেয়ে একটুখানি আনাড়ি। কাজ শিখিয়ে নিতে নিতে মাসখানেক কেটে যাবে বোধহয়! তবুও ভালো, একদিনের তলবে কর্মী তো পাওয়া গেল। নতুন মেয়েটাকে সেলাই ফোঁড়ের ধরন দেখিয়ে দিচ্ছে নবনী, ঠিক তখনই কল এল বাসা থেকে।

    — “হ্যাঁ আম্মু বলো?” 

    — “ব্যস্ত তুই? 

    — “হ্যাঁ। তুমি বলো না কী বলবে?” 

    — “নাতাশা সকালে বলে গেল ভার্সিটিতে যাচ্ছে। এখন আবার কল করে বলছে অমিতের বাসায় নাকি আছে। ড্রাইভারকে দিয়ে যেন ওখানে ওর কাপড়-টাপড় পাঠিয়ে দেই। হঠাৎ তোর ওখানে কেন গেল?” 

    — “আমি আসতে বলেছি।” 

    — “কেন?” 

    — “কেন আবার? ও কি আমার কাছে আসতে পারে না?” 

    — “অবশ্যই পারে। কিন্তু হঠাৎ কেন? কোনো সমস্যা? ঐ বাসায় সব ঠিক আছে?” 

    — “সব ঠিক আছে। শুধু শুধু ভাবছো। নতুন চারটা সিরিজ রিলিজ হয়েছে নেটফ্লিক্স আর এ্যামাজন প্রাইমে। অনি, আমি আর নাতাশা মিলে দেখব। তাই ওকে আসতে বলেছি।” 

    — “একটা সমস্যা হয়েছে। 

    — “কী?”

    — “তোর ফুফু বিশাল ব্যাগ নিয়ে আধঘন্টা আগে এখানে এসেছে।” 

    — “হঠাৎ?” 

    — “তোর বিয়ের পর থেকেই রাশেদ ভাইয়ের সঙ্গে খুব তুলকালাম চলছে। প্রতিদিন ত্রিশ বছরের সব অপ্রাপ্তি, অপমানের কড়ায় গন্ডায় হিসেব নাকি চায়। কবে থেকেই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছিল, এতদিন তোর ফুফা আটকে রেখেছে। গতকাল রাতে নাকি ঝগড়ার ফাঁকে বললো, চলে যাও যেখানে খুশি, তোমার এত হিসেব ফেরত দেবার কোনো ঠ্যাকা আমার নেই। ব্যস, ভোরে সবাই জাগার আগে তোর ফুফু বেরিয়ে এসেছে ঘর ছেড়ে। বলছে ডিভোর্স দেবে। তোর কথা বলে বলে কেঁদেই চলছে। আমার কাছে মাফ চাইছে, আম্মার কাছে, তোর আব্বুর কাছে মাফ চাইছে। কান্নাকাটি করে অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে বেচারী।” 

    — “ফুফা জানে?” 

    — “তোর ফুফার অবস্থা শোচনীয়। রাগের মাথায় বলে ফেলেছে তখন। ভাবতে পারেনি সত্যিই ও চলে যাবে। সকালে কল করেছিল। বললো, আমার এখানে এলে যেন উনাকে জানাই। তোর আব্বু একটু আগে কল করে জানিয়ে দিয়েছে তোর ফুফাকে। সেই থেকে কান্নাকাটির মাত্রা বেড়েছে। বারবার বলছে আমি তোমাদের ঘরে কাজের বুয়া হয়ে থাকবো, তবুও প্লিজ আমাকে বাসা থেকে বের করে দিও না। ঐ লোকের সংসারে আমি যাব না।” 

    — “ফুফু কি পাগল হয়ে গেছে! কাজের বুয়া কেন হতে যাবে?” 

    — “অনেকগুলো বছর পেরোলো। যন্ত্রণা তো আর কম সয়ে যায়নি। তিক্ততা বেড়ে গেছে খুব। কী থেকে কী বলছে, নিজেও বুঝে পাচ্ছে না। তোর সঙ্গে দেখা করতে চাইছে। অমিত আর তোর কাছে ক্ষমা চাইবে। খুব করে বলছে আমাকে। রাতের দিকে নিয়ে আসবো একবার তোর ওখানে? ওকে একটু বুঝিয়ে শুনিয়ে দিলি!”

    — “না আম্মু। উনি গতকাল রাত থেকে খুব অসুস্থ। এই মুহূর্তে বাসায় এসব কথা উঠানো ঠিক হবে না।

    — “কার কথা বলছিস? কে অসুস্থ? অমিত?”

    — “হ্যাঁ। 

    — “কী হয়েছে?” 

    — “প্রেশার হাই।” 

    — “বয়স কত ওর? ৩৪-৩৫ হবে। এরবেশি তো না। এই বয়সে হাই প্রেশার বাঁধিয়ে ফেললো!” 

    — “ঐ তো হলো আরকি।

    — “কিছুদিন আগেই না ওর বাবা বললো ওর প্রেশার লো, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না; ওর মাও বলেছিল। বেশি স্ট্রেস ও নিতে পারে না, বিপি লো হয়ে যায়। এখন আবার হঠাৎ করে কেন হাই হলো?” 

    — “কী জানি আম্মু!” 

    — “সত্যিই কোনো সমস্যা নেই তো?” 

    — “উহুম। সব ঠিকাছে।” 

    — “আমি কি আসবো ওকে দেখতে?” 

    — “আসতে হবে না। উনি ঠিক হয়ে যাবে। আর ফুফুর দিকে খেয়াল রেখো। এসেছে যেহেতু, থাকুক সপ্তাহখানেক। রাখছি আম্মু, পরে কথা হবে।” 

    হরেক রকম দুশ্চিন্তায় মাথা ধরে যাচ্ছে নবনীর। তারউপর মা যদি সত্যিই চলে আসে তখন কি হবে? মা-বাবার তাকে নিয়ে তো আর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। দেয়ালের রক্ত, ভাঙা টিভি, অমিতের কপালের ব্যান্ডেজ দেখে নতুন করে আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে যাবে না? 

    সবকিছু কেমন অসহ্য লাগছে নবনীর। একটুখানি বেখেয়ালিপনার জন্য এতকিছু দেখতে হবে তাকে! কাজে আর বিন্দুমাত্র মন বসছে না তার। খানিকবাদেই মাগরিবের আজান দেবে। রাত দশটা পর্যন্ত কাজ করার কথা ছিল আজ, সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে, কারখানার সবচেয়ে পুরোনো বিশ্বস্ত কর্মী সাবেরার কাছে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লো নবনী। 

    .

    অনি কিচেনে, নাতাশা ওয়াশরুমে। দু’জনের চোখ ফাঁকি দিয়ে পা টিপে টিপে বাসা থেকে বেরিয়ে এল অমিত। মাথায় এখনো থেমে থেমে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। অসুস্থতার দোহাই দিয়ে গোটা দিন অনি তাকে ঘরে আটকে রেখেছে, বাড়তি পাহারাদার হিসেবে নাতাশাকে ডেকে আনা হয়েছে। অথচ মেয়েগুলো জানেই না এই যন্ত্রণার চেয়েও আরো কতবড় যন্ত্রণা সে বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে! ঘরে শুয়ে-বসে শরীরের কষ্ট সেড়ে যাবে, কিন্তু মুনিয়াকে হারাবার কষ্ট! তার কী হবে? কে সারিয়ে তুলবে তাকে অসহ্য যন্ত্রণা থেকে? আছে কি কেউ? আছে কোনো উপায়? লিফটের দরজায় এসে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল অমিত-নবনীর। পাশ কাটিয়ে অমিত চলে যাচ্ছিল, শক্ত করে তার হাত ধরে ফেললো নবনী। 

    — “কোথায় যাচ্ছেন?” 

    — “কাজ আছে।” 

    — “কী কাজ?” 

    — “আপনাকে কৈফিয়ত দিতে হবে?” 

    — “আপনি না অসুস্থ? অসুস্থ মানুষ কথা বলবে নরম স্বরে। আপনি এত রেগে উত্তর দিচ্ছেন কেন?”

    — “হাত ছাড়ুন।

    — “বাসায় চলুন।” 

    — “বলছি তো কাজ আছে।” 

    — “করতে হবে না কাজ। চলুন আমার সঙ্গে।” 

    নবনীর মুঠো থেকে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিলো অমিত। সামনের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে আবারও তার হাত চেপে ধরলো নবনী। 

    — “গাড়ির চাবি কেন আপনার হাতে? এই অবস্থায় ড্রাইভ করবেন আপনি?” 

    — “বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু!” 

    — “আপনি করছেন না?” 

    — “আমি যা খুশি করব তাতে আপনার কী?” 

    — “আপনি এখনও স্ট্যাবল না, ঠিকমতো হাঁটতে পর্যন্ত পারছেন না। হ্যাংওভার এখনো কাটেনি সে তো বোঝাই যাচ্ছে। ড্রাইভ করতে গিয়ে কোন বিপদ ঘটাবেন কে জানে?”

    — “ঘটুক, তাতে কার কী?” 

    — “অবশ্যই অনেকের অনেককিছু। আপনি এখন কোথাও যাবেন না ব্যস। আর নিজে ড্রাইভ করে তো মোটেও না।

    — “খুব বউ বউ অধিকার খাটাচ্ছেন হ্যাঁ? মুনিয়ার সঙ্গে আমার ঝামেলা হয়েছে শুনে ভাবছেন আপনার পথ খোলা? এবার নিজের অধিকার চাইবেন, বউ হয়ে সংসার করতে চাইবেন? ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। মুনিয়া আমার জীবনে থাকুক বা না থাকুক, এই জীবনে আর কখনো দ্বিতীয় কাউকে স্থান আমি দেবো না।’ অট্টহাসি হেসে উঠলো নবনী। সন্ধ্যেবেলার এই নির্জন সময়ে নবনীর হাসি যেন এ্যাপার্টমেন্টের গ্রাউন্ড ফ্লোর ছাপিয়ে ছড়িয়ে গেল বাইরের গলি অব্ধি। একরাশ বিরক্তি নিয়ে নবনীর দিকে তাকিয়ে রইলো অমিত। সে ভেবে পায় না, একটা মানুষের হাসি কেমন করে এত বিশ্রী হতে পারে! 

    অমিতের দিকে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়ালো নবনী। বললো, 

    — “ভীষণ ট্যালেন্ট আপনি! মাত্র দুই মিনিটে আমার কূটচাল ধরে ফেলেলেন?”

    — “আপনি হাসছেন? আমার অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে আপনার?” 

    — “মদের নেশা এখনো কাটেনি, মুনিয়ার শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তাই আপনার কথা শুনে হেসেছি। নয়তো কানের নিচে ঠাস ঠাস দু’টো মেরে দিতাম।” 

    — “কী চান আপনি? কেন টানাটানি করছেন আমাকে?” 

    — “কোথায় যেতে চান? বলুন আমাকে। আমি নিয়ে যাবো।” 

    — “বারে যাবো। বাসায় প্রচন্ড সাফোকেট ফিল হচ্ছে।” 

    — “আবার ড্রিংক করতে চান? গতকাল রাতে কী কী করেছেন জানেন?” 

    — “তো কী করব? মরার মতো অবস্থাও তো নেই। বাসায় যত ছুরি, ব্লেড, পয়জনাস জিনিস আছে সব কোথায় সরিয়ে রেখেছে কে জানে! এখন আমি ড্রিংকও করতে পারবো না? আমার পেইন কেন কেউ বোঝার চেষ্টা করছে না? সহ্য করতে পারছি না আর।” 

    — “বেশিই কষ্ট হচ্ছে?” 

    অসহায় চোখে নবনীর দিকে তাকিয়ে রইলো অমিত। অমিতের হাত ছেড়ে দিলো নবনী। পথ ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললো, 

    — “চলুন, আমিও যাবো আপনার সঙ্গে।” 

    — “আপনি কোথায় যাবেন?” 

    — “আপনি যেখানে যাচ্ছেন।

    — “ওখানে আপনার কী কাজ?” 

    — “আগেও বহুবার শুনেছি ড্রিংক করার পর দুনিয়ার কোনো খবর থাকে না। অনেকে বলে অ্যালকোহল হলো স্ট্রেস ফ্রি হওয়ার টনিক। খুব মেন্টাল স্ট্রেসে আছি। দেখি আপনার সঙ্গে এক দুইবোতল খেয়ে, শান্তি পাই কি না। চলুন, চলুন।”

    — “আমি আপনাকে নেবো না।” 

    — “আমি ওসব চিনি না। যাইনি কখনো। আপনি সঙ্গে না নিলে একা কিভাবে যাবো?”

    — “কী আশ্চর্য!” 

    — “আসলেই তো, কী আশ্চর্য! আপনি আমাকে সঙ্গে কেন নিতে চাইছেন না?” 

    — “আপনার ওসব খেতে হবে না।” 

    — “কেন? কী সমস্যা?” 

    — “পাগল নাকি? কিসের এত স্ট্রেস আপনার যে বারে গিয়ে ড্রিংক করতে হবে?” 

    — “আপনার এত কিসের স্ট্রেস? মরতে কেন চান? আপনার প্রেশার হাই ছিল গতরাতে। ডক্টর স্ট্রিক্টলি বলে গেছে খাবার দাবারের ব্যাপারে সাবধান হতে, আর এ্যালকোহল তো একদমই না। অথচ আপনি বিপি নরমাল হওয়ার আগে আবার যেতে চাইছেন! আপনি জানেন কত কী বিপদ হতে পারে?”

    — “কী হবে? খুবজোের মরেই যাবো।” 

    — “সামান্য একটা প্রেমের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিতে চাইছেন? আপনার জীবনের মূল্য এত কম?” 

    — “সামান্য? আমার ভালোবাসা সামান্য মনে হয় আপনার কাছে?” 

    — “দেখুন, আমি ওভাবে বলতে চাইনি। স্যরি।”

    — “সবাই একই কথা বলে। মা-বাবা, বন্ধু-বান্ধব সবাই। কেউ আমাকে বুঝতে কেন চায় না? মুনকে আমি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবেসেছি। ওর আর আমার সম্পর্ক সামান্য কিছু না।” 

    — “স্যরি। আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি। আপনি কখন কী করে বসেন সেসব ভাবতে ভাবতেই মুখ ফস্কে কথাটা বেরিয়ে গেল। মুনিয়ার সঙ্গে আপনার সম্পর্কের গভীরতা কেমন তা আমি জানি না। উনি দেখতে কেমন তাও জানি না। এখন কেনই বা আপনি পাগলামি করছেন তাও জানি না। বলেননি তো কিছু কখনো আমাকে।”

    — “আমাকে কেউ বোঝে না। বলে কী লাভ? অন্য সবার মতো আমার কাঁধেই সব দোষ চাপিয়ে বলবেন, সবকিছু মেনে নিয়ে সম্পর্ক টেনে নেয়ার মানে কী?” 

    — “অন্য সবার মতো আমিও এমনটাই বলবো সে কথা ভেবে নেয়া বোকামি। বলেই দেখুন না আমাকে, প্লিজ!”

  • ……………..
  • — “নানী বলে, কথা পেটে চেপে রাখলে বুকে সমস্যা হয়। বলছেন না অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে? কথা সব পেটে চেপে রেখেছেন তাই কষ্ট হচ্ছে। কারো সঙ্গে শেয়ার করুন দেখবেন কিছুটা হলেও রিলিফ পাবেন। আমার সঙ্গেও করতে পারেন। প্রমিজ করছি, আপনাকে আমি একদম জাজ করবো না। চুপ করে শুধু শুনবো। যদি সম্ভব হয় তবে অবশ্যই একটা সলিউশন দেয়ার চেষ্টা করবো।” 

    — “আপনাকে কেন বলবো আমি?” 

    — “নিজের স্বার্থে। কষ্ট আপনি পাচ্ছেন, চান না এই কষ্ট থেকে বেরিয়ে আসতে?” 

    — “বাইরে কোথাও বসি?” 

    — “আপনি অসুস্থ। বাইরে যাওয়া ঠিক হবে না। তাছাড়া আরো একটা সমস্যা আছে। ধরুন, মুনিয়ার গল্প করতে করতে হঠাৎ আপনার কান্না পেলো তখন? বাইরে কত মানুষ! এত মানুষের ভীড়ে কাঁদবেন আপনি? তার চেয়ে বরং চলুন আমরা ছাদে বসি নয়তো আমার ঘরের বারান্দায়।” 

    — “ঘরে বসে এত কথা বলবো না আমি। অনিকে সব কথা শোনানো যাবে না।”

    — “তাহলে ছাদেই বসি। কেমন?” 

    .

    ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নবনী। হাঁটু ভাজ করে রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে অমিত। মাথার উপর কুয়াশা ঝরছে। বাসা থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরোবার সময় মাথায় ভালোভাবে ওড়না পেঁচিয়ে নিয়েছে নবনী। ঠান্ডায় হাত-পা জমে যাচ্ছে। মাঘের শীত অগ্রহায়ণে এসে কেন জেঁকে ধরছে সে হিসেব মেলাতে পারছে না সে। শুধুমাত্র অমিতের কথা ভেবে এই সময়ে তার ছাদে উঠা, নয়তো টেনে হিঁচড়ে কেউ এই ঠান্ডায় তাকে ছাদে উঠাতে পারতো না। অমিতের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নবনী। কিছু বলছে না লোকটা। একটু পরপর মাথার দু’পাশ চেপে ধরছে শুধু। ব্যথা করছে নিশ্চয়ই! শীতের দিনে সামান্য ব্যথাই সহ্য হয় না। আর এই লোক তো কপালে সেলাই নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যথা কেমন হতে পারে সে কথা ভাবতেই আফসোস হতে লাগলো নবনীর। — 

    — “কষ্ট হচ্ছে? বাসায় যাবেন?” 

    — “না ঠিক আছি।”

    — “গতকালের পর মুনিয়ার সঙ্গে কথা হয়েছে?” 

    — “না। কল করেছিলাম। রিসিভ করেনি।” 

    — “আপনাদের রিলেশন খুব একটা ভালো না সেটা কিন্তু আমি আগেই আন্দাজ করেছি।” 

    — “কিভাবে?” 

    — “আপনার মুখ দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে আপনার মন কখন ভালো থাকে, কখন খারাপ। এক মাসের বেশি সময় হলো এখানে এসেছি। প্রতিদিন দেখছি আপনাকে। এই এক মাসে খুব কম সময়ই দেখেছি আপনি ফুরফুরে মেজাজে আছেন। যখন মন খারাপ থাকতো, তখন দেখতাম বারবার কাকে যেন কল করেই যাচ্ছেন। বারবার স্ক্রিন অন করে চেক করছেন কেউ টেক্সট করলো কি না। খেতে বসে আপনার খাওয়ায় মনোযোগ নেই, টিভি দেখতে বসে মন পড়ে থাকতো অন্য কোথাও। সর্বক্ষণ কী এক বিষন্নতা লেগেই থাকে আপনার চোখে মুখে। এতবার একটা মানুষ প্রেমিকা ছাড়া আর কাকে কল করবে?” 

    — “মুনের সমস্ত কথা ফুরিয়ে গেছে। আমার সঙ্গে বলার মতো আর কিছুই বাকি নেই। কিন্তু আমার তো কথা ফুরায়নি। অনেক অনেক কথা জমিয়ে রাখি ওর অবসরে শোনাবো বলে। আমি ওকে কল করতে থাকি, ওর কন্ঠস্বরের তৃষ্ণায় মরতে থাকি অথচ ওর সময়ই হয় না আমার সঙ্গে কথা বলার। সময় না ঠিক, ওর ইচ্ছে হয় না।” 

    — “সম্পর্কের এই টানাপোড়েন কবে থেকে চলছে?” 

    — “দুই বছরেরও বেশি। আড়াই বছর আগে টিভিতে মেগা সিরিয়াল শুরু হয়েছিল, ফেরারী মন। নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই!”

    — “উহুম। ঠিক মনে পড়ছে না। আমি আসলে সিরিয়াল টিরিয়াল দেখি না।” 

    — “ওহ্! ঐ সিরিয়ালে মুন ছিল লিড এক্ট্রেস। আর সেটাই ছিল মুনের প্রথম 

    সিরিয়াল। এর আগে ও র‍্যাম্প শো করতো, টিভিসি করতো। এখনও করে, তবে নাটকই বেশি করা হয়।” 

    — “মুনিয়া মডেল? কোন মুনিয়া একটু বলুন তো? সোপের এড করে ভাইরাল হয়েছিল, ঐ মেয়েটা?” — 

    — “হ্যাঁ।”

    — “মাই গড! এত ফেমাস মডেলের বয়ফ্রেন্ড আপনি! কী মিষ্টি চেহারা ওর! গতকাল এতক্ষণ কথা বললাম, কই চাচী তো কিছু বললো না যে মুনিয়া মডেল? অনিও তো বলেনি কখনো!” 

    — “মায়ের সঙ্গে কথা হয়েছিল ওর ব্যাপারে?” 

    মুখ আড়াল করে জিভ কাটলো নবনী। মুখ ফস্কে কী বলতে কী বলে দিলো! মা ঘন্টা বেঁধে অন্য কারো সঙ্গে তার নামে একগাদা বদনাম করেছে সে কথা শুনলে লোকটা রেগে বোম হয়ে যাবে না? 

    — “মুখ লুকিয়ে রেখেছেন কেন?” 

    — “কই না তো!” 

    — “মা, অনি দু’জনই মুনের উপর প্রচুর ক্ষ্যাপা। ওর নামে ভালো কিছু বলবে না সেই কথা আমি জানি। — 

    — “না না, ভুল বুঝছেন। খারাপ কেন বলতে যাবে?” 

    — “ওকে কেউ পছন্দ করে না তাই।” 

    — “বাদ দিন না ওসব কথা। ছেলেমেয়ের প্রেম থাকলে মা-বাবারা একটু আধটু কথা শোনায়। এসব কিছু না। যে কথায় ছিলাম আমরা, শুরু করুন আবার।” 

    — “শুরু থেকে বলি, মাঝ থেকে বললে গল্প এলোমেলো লাগবে।” 

    — “হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন না!” 

    — “চার বছর আগে একটা ফ্যাশন হাউজের র‍্যাম্প শো অর্গানাইজ করেছিলাম 

    আমি। অফিসিয়াল ছিল না, পারসোনালি করেছিলাম কাজটা। ক্লায়েন্ট হচ্ছে আমার ক্লাসমেটের মা। মডেলদের মাঝে মুনও ছিল একজন। তখন সবে ঢাকায় এসেছে ও। মডেলিং জগতে নিজের একটা শক্তপোক্ত জায়গা তৈরীর জন্য জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে। তখনও ওকে কেউ চেনে না। টুকটাক র‍্যাম্প শো করে, এডভারটাইজে সাইড রোল করে। প্রজেক্ট এক্সিকিউট করার জন্য আলাদা টিম থাকে। আমারও আছে। সেখানে অফিসের কিছু ছেলে থাকে, ফ্রিল্যান্সারও থাকে। একটা ছেলে ছিল রবিন, ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করতো। আমার টিমের হয়ে কাজ করেছে মাস দুয়েক হবে তখন। ও রেকমেন্ড করলো মুনকে। বললো, ওর বান্ধবী। ছবি দেখলাম, আগের করা র‍্যাম্প শোগুলোর ভিডিও দেখলাম। ভালোই লাগলো। মডেল লিস্টে ওকে এড করা হলো। ওদের রিহার্সাল একদিন দেখতে গিয়েছিলাম। তখন শুধু নাম, কোথায় থাকে এতটুকুই কথা হয়েছে। তারচেয়ে বেশি কিছু না। তারপর দেখা হলো একেবারে প্রোগামের দিন। স্টেজে উঠে ভালোই হাঁটছিল। হঠাৎ হিল ভেঙে মুন পড়ে গেল। ও আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। পা মচকে গেছে ওর। সে এক বাজে অবস্থা! চটজলদি টিম মেম্বাররা ওকে স্টেজ থেকে নামিয়ে আনলো। শো কোনোভাবেই থামানো চলবে না। টিমের প্রত্যেকটা ছেলে তখন কাজে ব্যস্ত। রবিনের সেদিন জ্বর ছিল, ও কাজে আসেনি। বাধ্য হয়ে আমিই ওকে নিয়ে গেলাম হসপিটাল।” 

    — “কিভাবে? কোলে করে?” 

    নবনীর দিকে তাকালো অমিত। মুখ টিপে হাসছে মেয়েটা। নবনীর দুষ্ট হাসিতে হেসে ফেললো অমিতও। 

    — “কিসের মধ্যে কী!” 

    — “সিরিয়াস ঘটনার মাঝে একটুখানি জোক। 

  • …… 
  • — “আরেকটু হাসুন তো, আপনার একটা ছবি তুলে রাখি।” 

    — “ফাজলামি রাখুন।” 

    — “আচ্ছা রাখলাম। তারপর?” 

    — “সেই থেকে মুনিয়ার সঙ্গে আমার আলাপ। হসপিটাল থেকে গেলাম ওর বাসায়। তখন ও সাবলেট থাকতো। কয়েকজন মেয়ে মিলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল। বাসার দরজা পর্যন্ত দিয়ে এলাম। আমাদের ফোন নাম্বার দেয়া-নেয়া হলো।” 

    — “ওর পড়াশোনা?” 

    — “হ্যাঁ পড়তো তো। অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে তখন ও। হসপিটালে বসে জানতে পেরেছিলাম এখানে ওর কেউ থাকে না। মফস্বল থেকে আসা ছোট একটা মেয়ে, তার উপর একা থাকছে। আমার বেশ মায়া হলো। কেন যেন বারবার মনে হচ্ছিল, আমার প্রোগ্রামে এসে ওর এই অবস্থা হয়েছে, এরজন্য আমিই দায়ী। ও সুস্থ হওয়া অব্দি ওর সব দায়িত্ব আমার।” 

    — “এত দায়িত্বজ্ঞান আপনার!”

    — “খোঁচা দিয়ে বললেন?” 

    — “নেগেটিভ মাইন্ড আপনার! ভালো কিছু ভাবতে পারেন না? 

    — “ভালো কিছু কি ঘটছে আমার সঙ্গে?” 

    — “হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি। প্রেম হলো কিভাবে সেটা বলুন?”

    — “কথা হতো প্রতিদিন নিয়ম করে, সকালে, বিকেলে, রাতে। মুন সুস্থ হলো কিন্তু আমাদের কথা বন্ধ হলো না। ওর পা ঠিক হওয়ার পর আমি কল করা প্রায় বন্ধ করে দিলাম। মুনই তখন কল করতো প্রতিদিন তিন চারবার করে। আমি ব্যস্ত থাকলে রিসিভ করতাম না। ফ্রি টাইমে রিসিভ করলেও খুব একটা কথা বলতাম না। এভাবে মাসখানেক কেটে যাবার পর একদিন সারাদিন কেটে গেল মুন কল করেনি। আমিও সেদিন খুব ব্যস্ত ছিলাম, মুনের কথা আমার একদম খেয়ালে আসেনি। সারাদিন পর যখন বাসায় ফিরলাম, দেখলাম মুন কল করছে। আমি তখনও ফ্রেশ হইনি। ক্লান্তি, ঘুম, ক্ষুধা সব মিলিয়ে আমার দিন দুনিয়ার কোনো খবর নেই। একটা শাওয়ার নিয়ে, ডিনার করে লম্বা ঘুম দিতে পারলে বাঁচি। মুনের কল আমি কেটে দিলাম। ও আবার কল করলো। খুব বিরক্ত হলাম আমি। মোবাইল রেখে আমি চলে গেলাম শাওয়ার নিতে। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে এসে দেখি মুনের বাইশটা মিসডকল! ভাবলাম ইমার্জেন্সি কিছু হয়তো। তড়িঘড়ি করে কল ব্যাক করলাম। রিসিভ করে ও কোনো কথা বলছিল না। আমি জাস্ট ওর ফোঁপানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম।” 

    — “কাঁদছিল?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “কেন?” 

    — “আমি হঠাৎ ওর কান্নার শব্দ শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। কোনো বিপদ-আপদ হলো কি না কে জানে! কাঁদছে কেন জিজ্ঞেস করলাম, উত্তর দিলো না। ও শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। অনেকক্ষণ পর বললো, আমি তোমার বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি। একটু নামবে প্লিজ! আমি দরজা লক না করেই দৌড়াতে দৌড়াতে নিচে গেলাম। তখন বাজে এগারোটা কিংবা সোয়া এগারোটা। এত রাতে একা একটা মেয়ে আমার বাসার নিচে দাঁড়ানো। আমাকে দেখামাত্রই ছুটে এসে মাঝরাস্তায় আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি স্পিচলেস হয়ে গেলাম ওর কান্ডে।” 

    — “আমিও হচ্ছি। নিজেকে ছাড়িয়ে নেননি?” 

    — “উহুম। কেউ আমাদের দেখছে বা কে কী বলছে ওসব কিছুই তখন মাথায় আসেনি। কিংবা নিজেকে ওর কাছ থেকে ছাড়াতে হবে সে কথাও মাথায় আসেনি। মুন আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে ঐ কথাটাই শুধু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। তারপর ওর কী অভিমান! নাক টানতে টানতে বললো, বাড়ি গিয়েছিলাম একসপ্তাহ থাকবো বলে। হঠাৎ তোমার জন্য মন খারাপ লাগছে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল। বিকেলের বাস ধরে চলে এসেছি। বাসায় ব্যাগ রেখেই চলে এলাম এখানে তোমাকে দেখতে। সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ তুমি আমার কলই রিসিভ করছো না।” 

    — “ভালোবাসা তাহলে মুনিয়ার তরফ থেকেই শুরু হয়েছিল?” 

    — “হুম। আমি বুঝে গিয়েছিলাম মুন আমাকে কী বলতে চাইছে। তবুও আমি ওর মুখ থেকে শুনতে চাইছিলাম কথাগুলো। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে দেখতে এতদূর থেকে ছুটে এলে কেন? ও ঠিক আমার চোখে চোখ রেখে বললো, ভালোবাসি, তাই ছুটে এসেছি। আজ ঢাকা ছেড়ে যাবার সময় মনে হচ্ছিল আমি আমার কোনো একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ফেলে যাচ্ছি। অনেকক্ষণ খুঁজেছি জানো? বাড়ি গিয়ে মনে পড়লো আমি তোমাকে ঢাকায় ফেলে এসেছি। পুরো রাস্তায় আর তো কাউকে মনে পড়েনি তোমাকে ছাড়া। আর কখনো তোমার কাছ থেকে দূরে যেতে পারবো না। এখন থেকে ছায়ার মতো তোমার সঙ্গে লেপ্টে থাকবো। আমি বললাম, যদি আমার ছায়া হয়ে লেপ্টে থাকার অনুমতি না দেই? উত্তরে মুন বলল, তোমার জন্য পৃথিবীতে পাহাড়সমান অভিশাপ রেখে আমি চিরতরে বিলীন হবো। আমাকে ফিরিয়ে দিলে ভালোবাসা খুঁজে খুঁজে তুমি ক্লান্ত হবে, পৃথিবীর কোথাও একবিন্দু ভালোবাসা তুমি পাবে না। অসীম ভালোবাসা যে ফিরিয়ে দেয়, উপরওয়ালা কি কখনও তাকে ভালো রাখে? আমি মুনকে ফেরাতে পারিনি। অনেক অনেক মেয়েদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। কিন্তু প্রেম কখনো আমার জীবনে আসেনি। একটা বেপরোয়া প্রেমিকা আমি খুব করে চাইতাম যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসবে। পৃথিবীর কোনো নিয়ম, কোনো মানুষের ধার ধারবে না। আমার ত্রিশ বছরে এসে অবশেষে আমি সেই মেয়ে খুঁজে পেলাম। মাঝ রাস্তায় রাত বিরাতে এসে কাউকে জড়িয়ে ধরার সাহস সবার থাকে না। পাগলাটে ভালোবাসা থাকলেই এই কাজ সম্ভব।” 

    — “প্রেম তবে হয়েই গেল?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “লাভ লাইফ কেমন ছিল আপনাদের?” 

    — “অসাধারণ! আমার মনে হতো আমি অসম্ভব রকমে সুন্দর কোনো স্বপ্নে বাস করছি। কারো বাস্তব জীবন কখনো এত সুন্দর হয় নাকি?” 

    — “যেমন?” 

    — “ও প্রচন্ড আহ্লাদী স্বভাবের ছিল। সকালে ঘুম ভাঙতো মুনের কল পেয়ে। কথা বলতে বলতে রাতে ঘুমাতাম। সারাদিনে চার পাঁচবার ভিডিওকল তো আছেই। খুব যত্ন করতো আমার। কখন কী খাচ্ছি, কাজের ফাঁকে একটু আধটু রেস্ট নিচ্ছি কি না, বাসার রান্নাবান্না ঠিকভাবে হচ্ছে কি না… যেদিন ঠিকঠাক সময় দিতে পারতাম না, খুব পাগলামি করতো। কান্নাকাটি, অভিমান, অভিযোগ কত কী! আমার পছন্দের বাইরে কখনো একটা ড্রেসও কিনতো না। রিলেশনের পর সমস্ত শপিং আমিই ওকে করে দিতাম। তবুও মাঝেমধ্যে একা কোথাও গেলে, কিছু একটা পছন্দ হলে আমাকে জিজ্ঞেস না করে কিনতো না। বলতো, যেই জিনিসটা তোমার পছন্দ না সেই জিনিস আমার কাছে আমি রাখবোই না। প্রায়ই আমার প্রিয় সব খাবার রান্না করে নিয়ে চলে আসতো অফিসে। আমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়া ছিল ওর সবচাইতে প্রিয় কাজ। আমি ওর মাঝে পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিলাম। সর্বক্ষণ কী এক মায়ায় আমাকে ডুবিয়ে রাখতো মেয়েটা। আমি চাইতাম পৃথিবীর সমস্ত সুখ ওকে দিতে। দেশের টপ মডেল হওয়া ছিল মুনের স্বপ্ন। এইযে আজকের মুনকে দেখতে পাচ্ছেন, ঐ পথটা আমার তৈরী করে দেয়া। বিভিন্ন ডিরেক্টর, এডভারটাইসমেন্ট এজেন্সিতে আমার অনেক পরিচিত লোক আছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ড ওনারদের সঙ্গেও ভালো আলাপ আছে। মাস দেড়েকের মধ্যে মুনের জন্য সাত আটটা ভালো কাজের বন্দোবস্ত করে ফেললাম। কাজের প্রতি ওর প্রচুর ডেডিকেশন ছিল। মিডিয়াপাড়ায় খ্যাতি পেয়ে গেল প্রথম দুটো এড করেই। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক কাজ মুনের চলতে থাকলো। নামীদামী সব ব্র্যান্ড, ম্যাগাজিনে তখন শুধু মুন। আমাদের সম্পর্কে অন্তরঙ্গতা ছিল শুরু থেকেই। কিন্তু আরো বেশি গভীর হলো পাঁচমাস পর। রুমমেটের সঙ্গে কী নিয়ে ঝগড়া করে সোজা আমার অফিসে চলে এল। বললো, আর ওখানে থাকবে না। বন্ধুর বাসায় ওর থাকার বন্দোবস্ত করে, সাত দিনের মধ্যে বাসা খুঁজে ভাড়া নিলাম। প্রয়োজনীয় ফার্নিচার যা লাগে সব কিনে দিলাম। মুন ঐ বাসায় যাওয়ার পর ওর বাসায় আমার অবাধ যাতায়াত শুরু হলো। ভালোবাসা বিছানা অব্দি চলে গেল। মন খারাপ হলেই মুনের আমার কাছে ছুটে আসা ছিল পুরোনো অভ্যেস। আলাদা বাসা হওয়ার পর মন খারাপের সময়গুলোতে আমাকে কল করে নিয়ে যেত ওর বাসায়। একরাত, দুইরাত, তিনরাত কাটাতে কাটাতে আমি ওর বাসার পার্মানেন্ট বাসিন্দা হয়ে গেলাম। ঐ এলাকার সবাই জানতো আমরা হাজবেন্ড-ওয়াইফ। মুনও আমাকে সেভাবেই ট্রিট করতো। আমি বাইরে থেকে আসার আগে নিজে সেজেগুজে রেডি থাকতো। ওয়াশরুমে গরম পানি, ট্রাউজার, টাওয়েল দেয়া থাকতো। টেবিলে গরম খাবার সাজানো থাকতো। আমি বাসায় ফেরার পর আমার জুতা খুলে দিতো, শার্ট খুলে কাঁধে, ঘাড়ে কিছুক্ষণ ম্যাসাজ করে দিতো। আমি শাওয়ার নেয়ার পর ও আমার মুখে তুলে খাইয়ে দিতো। রাতে ঘুমানোর সময় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো। দুজনের ছুটির দিনগুলোতে একসঙ্গে রান্না করতাম, ঘর সাজাতাম। বৃষ্টির দিনে ও শাড়ী পরতো, আমরা একসঙ্গে ছাদে ভিজতাম। শীতের রাতগুলোতে লেপ মুড়ি দিয়ে বারান্দায় বসে গল্প করতে করতে পুরো রাত কাটিয়ে দিতাম। মুনের এত এত যত্নের পরও কোনো একভাবে যদি অসুস্থ হতাম, ওর টেনশন কে দেখে! কাজ, খাওয়াদাওয়া, ঘুম সব ফেলে আমার পেছনে লেগে থাকতো। খুব ছোট্ট একটা ফ্ল্যাট ছিল। আমার এই ফ্ল্যাটের তিনগুন ছোট। অথচ মায়ার কোনো কমতি ছিল না, সুখের অভাব ছিল না। আমার জীবনের স্বর্গীয় দেড় বছর কেটেছে ঐ বাসায়।”

    — “এ তো দেখছি হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকা! এত প্রেম! বিয়ে করা হাজবেন্ড হলেও মেনে নিতাম। কিন্তু বয়ফ্রেন্ডের জন্য এত কে করে?” 

    — “আম্মুও এই কথা বলতো আমাকে।” 

    — “চাচী জানতো আপনাদের লিভ টুগেদারের ব্যাপারে?” 

    — “নাহ্। বাসার কাউকে জানাইনি।” 

    — “অনি তখন এখানে থাকতো না?” 

    — “উহুম। অনি এসেছে বছর দুই হলো। ততদিনে আমি মুনের বাসা ছেড়েছি।” 

    — “চাচী কি প্রথম থেকেই মুনিয়াকে পছন্দ করতো না?” 

    — “পছন্দ করতো না, ঠিক তা না। আমার কিংবা অনির পছন্দে নিজের মতামত চাপিয়ে দেয়ার মতো মানুষ আম্মু-আব্বু না। আম্মুকে আমি মুনের কথা প্রথম জানাই রিলেশনের আট মাস পর। জানাতাম না, আমাদের এক রিলেটিভ দেখেছিল ওর সঙ্গে আমাকে। এর আগে আম্মু অসংখ্যবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছে কারো সঙ্গে প্রেম করছি কি না। রিলেশনের আগ পর্যন্ত পুরো পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্লোজ ছিলাম আমি আমার মায়ের সঙ্গে। সব কথা শেয়ার করতাম, ছুটির দিনে ঘন্টা বেঁধে আমাদের আলাপ চলতো। অন্যরকম বন্ডিং ছিল আমাদের। মুনের সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর আম্মুর সঙ্গে খুব একটা কথা হতো না। আমাদের সম্পর্কে দূরত্ব চলে এল। আম্মু আন্দাজ করেছিল আগেই। এতবার অস্বীকার করার পর যখন সেই রিলেটিভের কাছে জানতে পারলো আমার রিলেশনের কথা, আম্মু খুব মন খারাপ করেছিল। উনার ধারণা ছিল যদি কখনো আমার জীবনে প্রেম আসে সর্বপ্রথম আম্মুকেই আমি জানাবো। আম্মু জানার পর মুনের পরিচয় দিলাম। টিভিতে হরহামেশা দেখছেই, তাই ঘটা করে আর ছবি পাঠাইনি। ওর পারিবারিক অবস্থা কোনোকিছুই আম্মুর কাছে লুকাইনি। সব বলেছি। আম্মু কোনো আপত্তিই করেনি। তখন প্রায়ই ফোনে বলতাম মুন আমার কতটা কেয়ার করে। আম্মু হাসতো আর বলতো, অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।” 

    — “চাচীকে আগে কেন জানাননি?” 

    — “মুন চাইতো না এত জলদি আমাদের রিলেশনের ব্যাপারটা ডিসক্লোজ হোক।”

    — “কেন?” 

    — “উঠতি ক্যারিয়ার ওর। এখনই প্রেম-বিয়ে সবার সামনে চলে এলে ক্যারিয়ারে বাজে প্রভাব পড়তো না?” 

    — “লিভ টুগেদারে ছিলেন দু’জন। আপনাকে হাজবেন্ডের মতই ট্রিট করতো। তাহলে সবাই জানলেই বা আপত্তি কী? বিয়ে তো আর করছেন না। আর কোনো মডেল বা এক্ট্রেসরা কি প্রেম করছে না? এসব প্রেম-টেম এখন খুব কমন একটা ব্যাপার। সে কথা আপনি নিজেও জানেন। তবুও কেন মুনিয়ার এমন আপত্তি আপনার অস্বাভাবিক মনে হয়নি?” 

    — “আমি ওর মোহে অন্ধ ছিলাম।ও যা বলতো, যেভাবে বোঝাতো তাই বিশ্বাস করতাম। কখনো মনে হয়নি মুন আমাকে মিথ্যা বলছে।”

    — “আর সেই অগাধ বিশ্বাস ভাঙলো কবে?” 

    — “ওর প্রথম মেগা সিরিয়ালের কথা বলছিলাম?”

    — “হুম।” 

    — “তখন মুন মডেল হিসেবে বেশ ফেমাস। অভিনয় জগতে পা রাখার পর তার খ্যাতি হয়ে গেল আকাশছোঁয়া। মানুষের মুখে মুখে তখন শুধু মুন আর মুন। দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে মিডিয়া পাড়ায়, দর্শকদের মনে আলাদা জায়গা তৈরী করে ফেললো ও। কত কত ডিরেক্টরের কল আসতে শুরু করলো, বিজ্ঞাপনে মুনের চাহিদা আরো বাড়লো। ছেলে ফ্যানদের অভাব হলো না। তার মাঝে অনেক প্রডিউসার, বিজনেসম্যানদের নজরে চলে এল। বাসায় প্রায়ই গিফট, ফুল আসতে লাগলো। আননোন নাম্বার থেকে কল আসতে লাগলো। মুন আর আমার সম্পর্কে দূরত্ব একটু একটু করে জায়গা দখল করতে লাগলো।” 

    — “আগের মত আর প্যাম্পার করতো না?”

    — “ওর আর আমার মাঝে দূরত্ব জায়গা করে নিচ্ছে সেটা আমি প্রথম থেকে খুব ভালোই টের পাচ্ছিলাম। এসব খ্যাতি, রিচ ওয়েল উইশারস, দামী গিফটসে মুন ডুবে যাচ্ছিল। আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম। আগের মতো প্যাম্পার দূরের কথা, ওর আর আমার মাঝে কথাবার্তাই হওয়া প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। সকালে বের হতো, ফিরতো অনেক রাতে। ক্লান্তির বাহানায় আমার সঙ্গে একটুখানি সময়ও কাটাতে চাইতো না। ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। তবুও ওকে আমি কিছু বলিনি। নিজেকে নিজে স্বান্তনা দিতাম মুন সত্যিই ক্লান্ত। কত খাটাখাটুনি যায় সারাদিন। তাই হয়তো এমন হচ্ছে। আর কিছুদিন বাদে ও এই নতুন ব্যস্ত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

    — “আপনি পাগল? নিজেই বলছেন চোখের সামনে সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলেন। তবুও কেন নিজেকে মিথ্যা স্বান্তনা দেবেন?”

    — “আমাদের সম্পর্কটা ভেসে যাচ্ছে সে কথা মেনে নেবার মতো সাহস আমার ছিল না। ওকে ছাড়া কিভাবে বাঁচতাম আমি? নিঃশ্বাস আটকে আসতো আমার। আমাদের সম্পর্কের হিসেব কষতে গিয়ে আমি আর নিঃশ্বাসই নিতে পারতাম না। এমন হয়েছে বহুবার আমার সঙ্গে। চোখের সামনে আমি আমার মৃত্যু দেখতে পেতাম। ও আমার কতটা জুড়ে দখল করে রেখেছিল, কতটা আগলে রেখেছিল তা শুধু আমি জানি। বিলীন হওয়া বোঝেন? আমি হয়েছিলাম বিলীন। নিজের সবটা সঁপে দিয়েছিলাম ওকে। মুনকে ছাড়া আমার বাঁচতে হবে এমনটা ভাবিনি কখনো। ভেবেছিলাম আমৃত্যু রয়ে যাবে আমাদের ভালোবাসা। ওর চুলে নাক ডুবিয়ে ঘুমানোর অভ্যেস ছিল আমার। ঐ ফ্ল্যাট ছেড়ে আসার পর আমার ঘুম হতো না। ভয়াবহ ইনসমনিয়ায় ভুগতে লাগলাম। মুনের সঙ্গে আমার ব্রেকআপ হয়নি, সম্পর্কের সুতো তখনও কিছুটা আমার নাগালে রয়ে গেছে তবুও সেপারেট বাসায় আমরা থাকবো তা আমি মেনে নিতে পারিনি। বাজেভাবে ডিপ্রেশনে ভুগতে লাগলাম। সাইকিয়াট্রিস্টের হেল্পও তখন নিতে হয়েছিল আমাকে।” 

    — “বাসা ছেড়ে ফিরে এলেন কেন?” 

    — “মুন অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে গেল। এলাকার মানুষজন ওকে চিনতো। সাংবাদিকরা নিয়ম করে ওর খবর ছাপতো। মাঝে একবার নিউজ হলো মুন বিবাহিত। নিউজ দেখে ও কেঁদেকেটে প্রায় বেহুঁশ হওয়ার দশা! মিডিয়ায় খুব চর্চা হতে লাগলো এই ব্যাপারে। ওর ক্যারিয়ারের কী হবে সেসব ভাবতে ভাবতে অসুস্থ হয়ে হসপিটালাইজড হলো। হসপিটালের বেডে শুয়ে আমাকে রিকোয়েষ্ট করলো, আমি যেন আমার ফ্ল্যাটে ফিরে যাই। এখন থেকে আমরা একসঙ্গে থাকবো না।”

    — “মেনে নিলেন?” 

    — “আর কোনো পথ খোলা ছিল? আমি ওকে ভালোবাসি, মেয়েটা হসপিটালাইজড। ওর মেন্টাল কন্ডিশন দেখে মনে হচ্ছিল যখন তখন সুইসাইড এটেম্পট নেবে। এমন সিচুয়েশনে ওর কথা মেনে নেয়া ছাড়া আর কিই বা করার ছিল? তখন ওর মেন্টাল স্ট্যাবিলিটিই আমার কাছে বেশি ইম্পরট্যান্ট ছিল।”

    — “আর আপনি? উনার কাছ থেকে দূরে সরে এসে নিজে মরে যাচ্ছেন তার কী হবে?” 

    — “সয়ে গেছি আমি সবটা। মুনের জন্য আমি সব করতে পারি। ওর একেকটা এচিভমেন্ট আমাকে ওর কাছ থেকে একশো হাত দূরে সরিয়ে নিচ্ছিলো। আমার জন্য অসহনীয় ছিল তবু আমি অভিযোগ করিনি। কারণ মুন তার এচিভমেন্টে হ্যাপি ছিল। ওর ভালো থাকা আমার কাছে বিশাল কিছু।”

    — “অদ্ভুত যুক্তি আপনার! 

    — “সবাই তাই বলে। মা-বাবা, ফ্রেন্ড সার্কেল সবাই খুব বিরক্ত আমার উপর। একটা মেয়ে ব্রেকআপ করার জন্য যা কিছু করা দরকার সব করছে তবুও আমি তার পিছু ছাড়ছি না। সবাই প্রথমে খুব বোঝাতো ওর চেয়ে ভালো লক্ষী মেয়ে আমি পাবো। আমি সেসব মানতে পারিনি। এখন ওরা আমাকে গালি গালাজ করে।”

    — “ব্রেকআপের কথা জানালো কবে?” 

    — “বাসা আলাদা হওয়ার ছয়মাস পর। এক শিল্পপতির ছেলের সঙ্গে বেশ সখ্যতা হলো ওর। একদিন বিকেলে ওর কাছে সময় চাইলাম। কাজের বাহানা দেখালো আমাকে, মেনেও নিলাম। তারপর প্ল্যান করলাম আমি আর অনি। ততদিনে অনি চলে এসেছে এখানে থাকবে বলে। ওকে সঙ্গে নিয়ে গেলাম মুভি দেখতে। মুভি দেখে বের হবার সময় দেখি মুন ঐ ছেলের হাত ধরে হল থেকে বেরোচ্ছে। প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলাম। ওর হাত ধরে টানতে টানতে নিচে নেমে গেলাম। মানুষ আমাদের দেখছে, অনিকে উপরে একা রেখে এসেছি সেসব কিছু আমার মাথায় তখন আসেনি। মাথায় শুধু ঘুরছিল মুন আমাকে ঠকাচ্ছে। এর জবাব আমি চাই।”

    — “যাক, অবশেষে কিছু একটা স্টেপ আপনার নিতে ইচ্ছে হলো।” 

    — “নিজের কপালে শনি ডেকে এনেছিলাম সেদিনই।” 

    — “কিভাবে?” 

    — “এতগুলো দিনে মুন সরাসরি ব্রেকআপের কথা আমাকে বলেনি। অন্য ছেলেদের সঙ্গে ওর উঠাবসা, সখ্যতা যা কিছু ছিল সবটাই আমার আড়ালে। আমাকে এড়িয়ে চললেও মিসবিহেভ কখনো করেনি। দিনশেষে মিথ্যে হলেও অন্তত একবার আই লাভ ইউ বলতো। সেই ঘটনার পর মুন আমার নাগালের বাইরে চলে গেল পুরোপুরি। কোনো উত্তর তো আমি পাইনি, বরং বাসায় ফেরার পথে সেই শিল্পপতির ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে থানায় আমার নামে মামলা করলো। লোকজনের করা ভিডিও ততক্ষনে ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে গেছে। প্রমাণস্বরূপ পুলিশকে সেই ভিডিও দেখালো। সেই রাতে পুলিশ আমাকে এরেস্ট করলো।” 

    — “মানে কী!” 

    — “হ্যাঁ, এটাই হয়েছিল সেদিন আমার সঙ্গে।

    — “কী আশ্চর্য! মামলা কেন করলো?” 

    — “ওর রেপুটেশন জড়িয়ে ছিল যে! অসংখ্য মানুষ প্রত্যক্ষদর্শী ছিল। জার্নালিস্টরা, সোশ্যাল মিডিয়ায় ওর ভক্তরা তোলপাড় করছিল আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক কী? নিজের নাম বাঁচাতে আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছিল ও। সেই যাত্রায় কোর্টে চালান হতে হয়নি শুধু আমার ছোট মামার জন্য। ল’ইয়ার উনি। প্রচন্ড ট্যালেন্ট একটা মানুষ। মুন, থানা উনি কিভাবে ম্যানেজ করলো জানি না। তবে থানায় সবার সামনে মুনের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছে আমাকে। পুরো একসপ্তাহ জুড়ে চললো পত্রিকায় আমার আর মুনের নিউজ। মা-বাবাকে কত শত প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল! আব্বু এত প্রেশার নিতে পারেনি। হসপিটালাইজড হতে হয়েছিল সেবার। মুনের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা এখন শুধু একতরফা তখনই সবাই জানতে পেরেছিল। সেই থেকে সবার সঙ্গে আমার দূরত্ব আরো বেড়ে গেল।” 

    — “ওদের সঙ্গে কেন দূরত্ব বাড়বে?” 

    — “মুনকে ভুলে নতুন করে জীবন শুরু করতে বলতো। আমি ওদের কথা শুনতাম না, বরং মুনের রাগ ওদের উপর ঝাড়তাম।” 

    — “মুনিয়া ঐ ঘটনার পর খুব রেগে ছিল। তারপর ওর সঙ্গে আবার সম্পর্ক কন্টিনিউ করলেন কিভাবে? মানে ও কথা বলতে রাজি হলো?” 

    — “ওর বাসায় গিয়ে পা ধরে বসেছিলাম। অনেক কান্নাকাটি, রিকুয়েষ্টের পর কথা বললো আমার সঙ্গে। কিন্তু সম্পর্ক একতরফাই রয়ে গেল। অবনতিও হলো। সেই থেকে ওর ইচ্ছে হলে কল রিসিভ করে, নয়তো না। ছয়মাস পরপর নতুন নতুন প্রেমিকরূপী বন্ধুদের সঙ্গে আমি ওকে দেখি। ওদের সঙ্গে খুব গল্প করছে, হাসতে হাসতে গায়ে ঢলে পড়ছে, হাত ধরে শপিং করছে। যখন তখন অকারণে আমাকে গালি দিচ্ছে। সবকিছু মুখ বুজে সয়ে যাই আমি। যেতে হয়। নয়তো সম্পর্ক একতরফা বাঁচিয়ে রাখার অনুমতিটুকুও আর পাবো না। মুনের সঙ্গে আর কখনো কথা বলার ভাগ্যটাও যে শেষ হয়ে যাবে। ও আমাকে কী বলে, জানেন?” 

    — “কী?” 

    — “পা চাটা কুত্তা হইতে পারলে আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে পারবি, নয়তো তোরে লাত্থি মাইরা সরাইতে আমার দুই সেকেন্ড লাগবে না।”

    — “এতকিছুর পরও আপনার রুচি কিভাবে হয় এই টক্সিক মেয়েটার সঙ্গে রিলেশন রাখার?”

    — “অনেক চেষ্টা করেছি আমি। একবছর ধরে চেষ্টা করেই যাচ্ছি ওকে ভুলে নতুন করে সবকিছু শুরু করতে। আমি পারছি না। ওর স্মৃতি, ওকে ঘিরে আমার সব অনুভূতি, মায়া, ওর স্পর্শ, ওর যত্ন, আমাদের ঐ ছোট্ট বাসায় সাজানো সংসার কোনোকিছুই আমি ভুলতে পারি না। কোন অসহ্য যন্ত্রণার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে আমি যুদ্ধ করে যাচ্ছি, তা আপনাকে বোঝাতে পারবো না আমি।”

    — “এত নির্লজ্জ কেন আপনি?” 

    — “আপনি বলেছিলেন আমাকে জাজ করবেন না।” 

    — “স্যরি বাট না বলে পারছি না। আপনি কেন এত টর্চার সয়ে যাবেন? স্লো পয়জন চেনেন? ও আপনাকে একটু একটু করে বিষ দিয়ে মারছে। ওর সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখলে এই যন্ত্রণা নিয়েই মরতে হবে আপনাকে। একটা অসভ্য ফালতু মেয়েকে ভালোবেসে নিজেকে শেষ করে দেবেন?” 

    — “মুনের শূন্যতা মিটবে কিসে? এর কোনো সমাধান আছে আপনার কাছে? থাকলে বলুন না! আমিও তো চাই একটা সমাধান হোক। তিল তিল করে শেষ হতে কে চায়?”

    — “এখনো কি পূর্ণতা পাচ্ছেন? মুনের শূন্যতায় কি ভুগছেন না? ও কি আপনার কাছে ধরা দিচ্ছে?” 

    — “উহুম।”

    — “পৃথিবীতে কেউ কখনো কারো শূন্যস্থান পূরণ করতে পারে না। শূন্যস্থান আজীবন শূন্যই থাকে। আমাদের কী করতে হয় জানেন? তাকে ঘিরে সমস্ত অভ্যেসগুলো একটু একটু করে বদলে ফেলতে হয়। জীবনের কোনো এক জায়গায় এসে ছন্দপতন হলে, নতুন করে আবার ছন্দ তৈরী করে নিতে হয়। মানুষ তো আপনি, বেঁচে তো থাকতে হবে। বাঁচার জন্য যা করা দরকার তাই করতে হবে। মুনের ভালোবাসা, যত্ন সবকিছু অতীত হয়ে গেছে আরো দুইবছর আগে। এই দুইবছরে কি মরে গেছেন আপনি? মরেননি তো, সয়ে নিয়ে বেঁচে আছেন। ভাবুন তো, দুইবছর আগের কথা। তখন যদি আপনাকে বলা হতো মুনের ভালোবাসা, যত্ন ছাড়া তোমাকে জীবন কাটাতে হবে, মেনে নিতে পারতেন? পারতেন না। এখন যেমনটা ভাবছেন মুনকে ছাড়া, মুনের সঙ্গে যোগাযোগ না রেখে বেঁচে থাকা অসম্ভব, তখনও ঠিক তেমনটাই মনে হতো। মুন আপনার জীবনে আর নেই, এটা মেনে নিন। অন্তত একটাবারের জন্য মনটা শক্ত করে যোগাযোগ বন্ধ করেই দেখুন না? মৃত্যুপথযাত্রীর জীবনযাত্রায় ফিরে আসা কিন্তু সহজ না। যমদূতের সঙ্গে লড়াই করে তবেই ফিরতে পারে। আপনিও তো এক প্রকার মৃত্যুযন্ত্রনাতেই ভুগছেন। স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে একটু তো লড়াই করতেই হবে। পারবেন না মনের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে?”

    — “মুনের সঙ্গে আমার খুব কথা বলতে ইচ্ছে হয়। ওর কথা মনে পড়লে আমার আর কিচ্ছু ভালো লাগে না। কতবার ভেবেছি আর কল করবো না, হয় না আমাকে দিয়ে।”

    — “চাচী বলছিল আগে উনার সঙ্গে ঘন্টা বেঁধে কথা বলতেন। এখন আর বলেন না। অনিকে নিয়ে আগে কত জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন। এখন আর কোথাও ওকে নিয়ে যান না। দেখুন, ভালো ওরাও কিন্তু আপনাকে বাসে। অনেক বেশিই ভালোবাসে। আপনার ভালোবাসার মূল্য মুনিয়া আপনাকে দিচ্ছে না, আপনিও তো মা আর বোনের ভালোবাসার মূল্য দিচ্ছেন না। এক হিসেবে মুনিয়া আর আপনি একইভাবে দোষী। আপনি মুনিয়ার অবহেলায় যতটা কষ্ট পান, ওরাও পায়। শুধু একজনকে ভালোবেসে সমস্ত সম্পর্ক এভাবে তুচ্ছ করে দেয়ার মানে আছে? যে আপনাকে তুচ্ছ করে ছুঁড়ে ফেললো তাকে ভুলে, মলিন সম্পর্কগুলো আবার মায়ায় জড়িয়ে নিন। 

    জীবন সহজ হবে, সুন্দর হবে। অনি বলছিল একদিন বন্ধুমহলে খুব ফেমাস ছিলেন আপনি। সেই বন্ধুগুলোর সঙ্গেও খুব একটা ভালো সম্পর্ক নেই আজকাল। কী অদ্ভুত আপনি! যে ভালোবাসে না তার জন্য মরে যাচ্ছেন, অথচ যারা এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে বসে আছে তাদের নিয়ে আপনার ভাবতেই ইচ্ছে হয় না।”

  • ………………..
  • — “ভালোবাসার কদর করলে তবেই ভালোবাসা মেলে। কদর করতে শিখুন, দেখবেন কেউ একজন আপনার ভালোবাসাও মনের কোনে সযত্নে আগলে রাখবে। আপনার স্বস্তি হয়ে পাশে রয়ে যাবে আজীবন।”

    — “মুনের সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারব আমি? এটা কখনো সম্ভব?” 

    — “অবশ্যই সম্ভব। মনটা শুধু একটু শক্ত করতে হবে ব্যস। একটু আগে বললাম না, মুনের অযত্নে অবহেলায় যদি বেঁচে থাকতে পারেন, মুনের সঙ্গে কথা না বলেও থাকতে পারবেন। অন্তত এক সপ্তাহের জন্য ট্রাই করুন। আর আমরা তো আছিই। মুনের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হলে আমাদের কল করবেন। আমি, চাচী, চাচা, অনি, নাতাশা কিংবা আপনার কোনো বন্ধু। যার সঙ্গে কথা বলে কমফোর্ট ফিল করবেন তাকেই কল করবেন। আমরা এটলিস্ট মুনের মতো মিসবিহেভ করবো না। আপনার মনও খারাপ হবে না। নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করুন। কী চমৎকার একটা ফ্যামিলি আছে আপনার! ওদের নিয়ে ভাবুন, সময় দিন। এত কিউট ফ্যামিলি যার আছে তার আবার এত ডিপ্রেশন কিসের? শুনেছি আপনি খুব প্রাণোচ্ছল হাসি খুশি একটা মানুষ ছিলেন। মিস করেন না আগের অমিতকে?” 

    — “খুব।”

    — “তাহলে মুন মুন করে মরছেন কেন? ফিরে যান আগের অমিতের মাঝে, যে অমিতের মাঝে মুনিয়া ছিল না। অমিত শুধুমাত্র অমিতই ছিল। মুনিয়ার শূন্যস্থান কখনো পূরন হবে কি না সেসব নিয়ে আর ভাববেন না। অন্যদের মতো আমি বলবোও না নতুন কেউ আপনার জীবনে আসবে, অনেক ভালো লক্ষী মেয়ে পাবেন। আমি শুধু বলবো যেই অমিত মুনিয়ার মাঝে বিলীন হয়েছে সেই অমিতকে খুঁজে বের করুন। নিজেকে সময় দিন, নিজের সঙ্গে অনেকটা সময় নিয়ে বোঝাপড়া করুন। জীবনে নারীসঙ্গ, ভালোবাসা অনেক আসবে যাবে কিন্তু নিজেকে হারালে আর ফিরে পাবেন না। লাভ ইউরসেল্ফ।” 

    অমিত কিছু বললো না। উপরে নিচে মাথা নাড়ালো শুধু। কাছে এগিয়ে এল নবনী। অমিতের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বললো, 

    — “ফিলিং বেটার?” 

    — “মাচ বেটার।” 

    — “এইবার নিচে চলেন ভাই। পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে আমার। গতকাল আপনার হাঙ্কিপাঙ্কি দেখে আজ টেনশনে ঠিকঠাক খেতে পারিনি। এবার কিছু খেতে হবে, নয়তো আমিই আপনার মতো বেহুঁশ হবো।” 

    — “আমারও সারাদিন কিছু খেতে ইচ্ছে হয়নি। এখন খিদা খিদা পাচ্ছে।” 

    — “ভালো লক্ষণ। মুনিয়ার ভূত মাথা থেকে নেমে আসছে বোধহয়।” 

    ২২

    তিনদিন অফিস কামাই করে আজ সকালে বিধ্বস্থ প্রায় চেহারা নিয়ে কাজে ফিরেছে অমিত। পনের দিন পর বাংলাদেশ নৌ বাহিনীর বার্ষিক সমুদ্র মহড়া উদযাপিত হবে। তাদের ইভেন্ট এক্সিকিউট করতে হবে অমিতকে। কাজ চলছে আরো একমাস আগে থেকেই। অফিস থেকে এক সপ্তাহের সিক লিভ নিলেও গতকাল রাতে অফিস থেকে কল এল সম্ভব হলে আগামীকালই সে যেন অফিস জয়েন করে। এমনিতেও ঘরে বসে খুব একটা ফায়দা হচ্ছিল না, বরং বারবার মুনিয়াকে মনে পড়ছিল। নিজেকে ব্যস্ত রেখে যদি মুনিয়াকে ভুলে থাকা যায়, তাতে মন্দ কী? তাই অসুস্থ শরীরেই সকাল সকাল রেডি হয়ে রওয়ানা হলো অফিসে। রাত সাড়ে দশটা বেজে গেছে এখনো বাসায় ফেরেনি সে। অফিসে কাজের চাপ খুব বেশি থাকলে রাতে বাসায় ফেরে না অমিত, রয়ে যায় সেখানেই। কখনো কখনো দুই-তিনদিন পর বাসায় ফেরে। আজও তেমনটা হবে কি না জানা নেই অনির। বিকেলের পর অমিতের সঙ্গে আর কথা হয়নি তার। নয়টার পর কল করেছিল দুইবার, অমিত রিসিভ করেনি। অসুস্থ শরীরে অমিতের রাত জেগে অফিসে কাজ করা বড্ড ভাবাচ্ছে অনিকে। অস্থির হয়ে একটু পরপর একাই বিড়বিড় করছে, কাজ আছে বুঝলাম, শরীরটাও তো দেখতে হবে। অফিসের লোকজনগুলোও যে কী, আমি বুঝি না! কপালে ব্যান্ডেজ, অসুস্থ শরীর দেখেও কি বাসায় পাঠিয়ে দিতে পারছে না? 

    টিভির সামনে বসে আছে নাতাশা। প্রিয় মুভি চলছে অথচ মনোযোগই দিতে পারছে না সে। অনি ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। চোখের সামনে কেউ দুশ্চিন্তায় থাকলে মনোরঞ্জন মুশকিল হয়ে যায়। নাতাশা বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তার বোনও এখনও কারখানা থেকে ফেরেনি। একঘন্টা আগে বলেছে দশ মিনিটের ভেতর বাসায় ফিরছি। নবনী ফেরেনি। বিশ মিনিট আগে নাতাশা আবারও কল করলে একই কথা বলে তাড়াহুড়োয় লাইন কেটে দিলো সে। নাতাশা জানে, আগামী একঘন্টায়ও নবনীর দশ মিনিট ফুরোবে না। কারখানায় অর্ডার বেশি হলেই দিনরাত সব ছেড়ে ছুড়ে কাজ করতে থাকে সে। নিজেও সময়মতো বাসায় ফেরে না, কর্মীদেরও ফিরতে দেয় না। আজ ফিরতে ফিরতে কয়টা বাজবে কে জানে! 

    .

    বাসার কলিংবেল বাজলো। দু’জনই খুব আগ্রহে দৌড়ে গেল দরজার কাছে। অমিত এসেছে। প্রচন্ড ঘুমে দুই চোখ তার মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। এক প্রকার টলতে টলতে সোফায় এসে গা এলিয়ে দিলো অমিত। 

    — “আপনি ঠিক আছেন ভাইয়া?” 

    — “হ্যাঁ ঠিক আছি। টায়ার্ড খুব। সারাদিন এখানে ওখানে ছুটতে হয়েছে।” 

    — “অনি কল করলো, আপনি রিসিভ করেননি। বেচারী টেনশন করছিল খুব।”

    — “বিজি ছিলাম। কল রিসিভ করে কথা বলবো ঐ সময়টুকুও পাইনি।” 

    পাশ থেকে অনি বলে উঠলো, 

    — “অসুস্থ তুমি। এত প্রেশার কে নিতে বলে? যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। টেবিলে খাবার দিচ্ছি।” 

    — “খেয়েছিস তোরা?” 

    — “না। নবনী আপুর জন্য ওয়েট করছি। ও আসলে একসঙ্গে খাবো।” 

    চমকে উঠলো অমিত। চোখ থেকে তার ঘুম পালালো যেন! 

    — “মানে কী? পৌনে এগারোটা বাজে। ও এখনও ফেরেনি?” 

    — “না।”

    — “আছে কোথায়?” 

    — “কারখানায়। 

    — “ও সকালে আমার আগে বেরিয়েছে। এত রাতে কারখানায় কী কাজ ওর?”

    — “অর্ডার প্রেশার খুব বেশি। সময়মতো ডেলিভারি করতে হবে। 

    — “তাই বলে এত রাত পর্যন্ত কাজ করতে হবে?”

    — “আপু সবসময় এমনই করে। দেশের বাইরে থেকে যখনই অর্ডার আসে, শর্ট নোটিশে সেগুলো ডেলিভারি করতে হয়। কত বলি এসব অর্ডার নেয়ার প্রয়োজন নেই। ও কথাই শোনে না। আম্মু, নানু এই ব্যাপারে খুব বিরক্ত আপুর উপর।”

    — “অনি, খাবার গরম করে টেবিল সাজা। আমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে ওকে নিয়ে আসছি।” 

    তড়িঘড়ি করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল অমিত। দরজা আটকে নাতাশার পাশে এসে বসলো অনি। 

    — “দেখেছো আপু, দুজন দুজনের খেয়াল রাখতে শুরু করেছে।” 

    — “হুম দেখছি।”

    — “ভাইয়াকে আমরা সবাই অনেক বুঝিয়েছি। ও কখনো আমাদের কথা শুনতেই চায়নি। নবনী আপু কী বললো কে জানে! কাজ হচ্ছে মনে হয়।”

    — “ভাইয়ার মাঝে পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছো?”

    — “হ্যাঁ। এটা প্রায় অসম্ভব ছিল জানো? আম্মু, আমি প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। মুনিয়াকে যখনই কোনো ছেলের সঙ্গে ক্লোজলি দেখতো সপ্তাহ বেঁধে পাগলের মতো আচরণ করতো ও। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, ঘুমাতো না। সারারাত এই ঘর, ঐ ঘর ঘুরঘুর করতো। হুটহাট এটা সেটা ভেঙে ফেলতো। বাসার সামনে যে হসপিটাল, ওখানে ভাইয়া পরিচিত মুখ। প্রায়ই বিপি ড্রপ হয়ে হসপিটাল ছুটতে হতো। কত কী ফেইস করতে হয়েছে ভাইয়াকে নিয়ে! এবারের পরিস্থিতি বেশ ভিন্ন। ভাইয়া পাগলামি করেনি তা না, কিন্তু আগের মতো না। ভাইয়াকে আমি পরদিন থেকে বেশ নরমাল দেখছি। খাওয়া-দাওয়া করছে, মুভি দেখছে, গল্প করছে। যদিও নিজের সঙ্গে জোর করে এসব করছে সেটা ওর মুখ দেখে ভালোই বুঝতে পারছি। তাও কম কী? চেষ্টা তো করছে। এতেই আমি খুশি। আম্মুকে বলেছিলাম। এত এত দোয়া করেছে আম্মু আপুর জন্য। বাবা আর নানু মিলে ওদের দুজনকে নিয়ে কী অদ্ভুত ফন্দি আঁটলো, আমি তখন বিশ্বাসই করিনি। এখন মনে হচ্ছে বুদ্ধি কাজে লাগছে।”

    — “অমিত ভাইয়ার ব্যাপারটা যত সহজে হয়ে গেছে কেন জানো? ভাইয়া নিজেও এসব ভুলে নতুন করে বাঁচতে চাইছিল। মুনিয়ার দেয়া পাহাড় সমান নোংরা সব স্মৃতি আছে ভাইয়ার কাছে। একটা মানুষকে ভুলতে এই’ই যথেষ্ট। বরং আমি বলবো যথেষ্ট থেকে আরো অনেক বেশি। কিন্তু আপুর বেলায় এত সহজে হবে বলে মনে হয় না। সামি ভাইয়াকে নিয়ে একটা খারাপ স্মৃতিও আপুর কাছে নেই। খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি ওদের। এত চমৎকার সম্পর্ক আমি আজ পর্যন্ত কোথাও দেখিনি, কোনোদিন হয়তো দেখবোও না। কী ভালোবাসতো ওরা দুজন দুজনকে! কারো ভাগ্য এত নির্মম হতে পারে, আপুকে না দেখলে হয়তো আমার কখনো জানা হতো না। সামি ভাইয়া ওকে যতটা ভালোবাসতো ততখানি ভালো ওকে কেউ বাসতে পারবে? আমার মনে হয় না। এত সহজে আপু সামি ভাইয়াকে ভুলতেও পারবে না।”

    — “অতীত ধরে রেখে আর কতদিন?” 

    — “আমিও তো চাই আপুর ঘর-সংসার হোক। ভালোবাসার একটা মানুষ হোক। 

    আপুর জন্য এসবকিছু এত সহজ না। তবুও নানুর মতো আমিও নিঃশ্বাস ধরে বসে আছি, ওদের এই সম্পর্কটা টিকে যাক। দুজন দুজনকে আঁকড়ে বেঁচে থাকুক।” 

    .

    অমিত এসে যখন কারখানার সামনে দাঁড়ালো, তখন নবনী কারখানার গেইটে তালা লাগাচ্ছে। অমিতের গাড়ি দেখে অবাক হলো নবনী। 

    গাড়ির দরজা খুলে ভেতর থেকে ডাকলো অমিত, 

    — “উঠে এসো।” 

    — “আপনি এলেন যে!” 

    — “রাত কয়টা বাজে?” 

    — “এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি।” 

    — “এতরাতে একা কিভাবে বাসায় ফিরবে? তাই তোমাকে পিক করতে এসেছি।”

    — “ব্যাপার না। অভ্যাস আছে আমার।” 

    — “কচু আছে। বাবার গাড়িতে করে বাসায় ফিরতে, সে কথার সব জানি আমি। রিকশায় চড়ে, পায়ে হেঁটে এত রাতে ফিরেছো কখনো?” 

    — “কাছেই তো, সমস্যা হতো না খুব একটা।” 

    — “দিনকাল খুব একটা সুবিধার না। তার উপর শীতের রাত। সবাই যার যার বাসায় দরজা জানালা আটকে লেপের ভেতর ঢুকে আছে। এমন সময়ে একা যাতায়াত করার প্রশ্নই উঠে না। যতদিন রাতে কাজ থাকবে আমাকে কল করে বলে দিও। পিক করতে আসবো।” 

    — “ইশ্! খুব চিন্তা, তাই না? একদিন পায়ে ব্যথা ছিল, অনি বললো আমাকে ড্রপ করে দিতে। গার্লফ্রেন্ডের ভয়ে মুখের উপর বারণ করলেন। আর এখন বলছেন প্রতিদিন আমাকে পিক করতে আসবেন! যাবো না আমি আপনার সঙ্গে।” 

    — “মুনিয়া আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চাল ধোয়ার ঝাঁঝড়ি বানিয়ে ফেললো। এখন আবার তুমিও থ্যাংকস দেয়ার বদলে খোঁচাচ্ছো। নিরীহ মানুষটার সঙ্গে খুব অবিচার হচ্ছে।” 

    হেসে ফেললো নবনী। দুই পা উঠিয়ে আয়েশ করে বসতে বসতে বললো, 

    — “সামি কী বলেছিল জানেন?” 

    — “সামি কে?” 

    — “আমি যাকে ভালোবাসি।” 

    — “আচ্ছা তোমার বয়ফ্রেন্ড!” 

    — “হুম।” 

    — “কী বলেছে?” 

    — “আপনি প্রচন্ড লয়্যাল একজন প্রেমিক।”

    — “তার সঙ্গে আমার গল্প করো?” 

    — “হ্যাঁ করি। কিচ্ছু লুকাই না ওর কাছে আমি। ও আমার ডায়েরি। ওর কাছে আমার সমস্ত কথা জমা থাকে।” 

    — “খুব ভালোবাসো, তাই না?” 

    — “সামির চেয়ে বেশি না। আমাদের দুজনের মাঝে ও আমাকে বেশি ভালোবাসে।” 

    — “ভদ্রলোক তোমাকে খুব বিশ্বাসও করে। নয়তো গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে করার বুদ্ধি কে দেয়? হ্যাঁ মানছি সিচুয়েশন খারাপ ছিল, তবুও তো! আমি কখনোই মুনকে এই কাজ করার বুদ্ধি দিতাম না।” 

    — “হ্যাঁ, তা করে।”

    — “তুমি যখন তার কাছে আমার গল্প করো, সে জেলাস ফিল করে না? কিংবা ধরো তুমি আমার সঙ্গে বাসায় ফিরছো, এটা শুনে উনি রাগ করবেন না?” 

    — “কী আশ্চর্য! রাগ কেন করবে? অন্য সব কাজিনদের মতো আপনিও আমার কাজিন। এর বাইরে না আপনি আমাকে কিছু ভাবেন, না আমি আপনাকে নিয়ে কিছু ভাবি। রাগ করার প্রশ্নই আসে না। ও খুব ওপেন মাইন্ডেড। আর আমার কাজিনদের সঙ্গে ওর বন্ডিং খুব ভালো। আমার চেয়েও বেশি।” 

    — “উনি তো মহাপুরুষ দেখছি! উনার সঙ্গে একদিন দেখা করতে হবে।” 

    আর কথা বাড়ালো না নবনী। মুচকি হাসিতে আলাপনের ইতি টানলো। শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলো দূর আকাশে। 

    — “আচ্ছা শোনো না? তোমাকে আর আপনি আপনি বলতে ভালো লাগছিল না, তাই তুমি করে বলছি। আপত্তি নেই তো, তাই না?” 

    — “আপত্তি কেন হতে যাবে? বরং আপনি শুনতে অদ্ভুত লাগছিল। বয়সে ছোট কাজিনকে আপনি কেন এতদিন আপনি আপনি করে বলেছেন, কে জানে!”

    হাসলো অমিত। চোখ টিপে বললো, 

    — “লয়্যাল প্রেমিকরা পরনারীকে আপনি করেই ডাকে।” 

    ২৩

    ড্রইংরুমে বসে মুভি দেখছে ওরা চারজন। বাকি তিনজন টিভির স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলেও অনির মনোযোগ টিভিস্ক্রিনে নেই। বারবার সে দেখছে অমিত-নবনীকে। ছুটির দিন আজ। নবনী কারখানায় যায়নি। অমিত সকালে ইমার্জেন্সি কী এক কাজে অফিসে গিয়ে ফিরে এল দুপুরের আগেই। এমনিতে কাজের ব্যস্ততায় খুব একটা সময় কাটানো হয় না দুজনের। মা বলছিল তিনদিন আগে, দু’জনকে বেশি বেশি একসঙ্গে সময় কাটাবার সুযোগ করে দিস। আমার ছেলেটা এখন কঠিন সময় পার করছে। মনের অবস্থা বেশ দুর্বল। নবনী যত ওর কাছে কাছে থাকবে, তত জলদি মেয়েটাকে ওর মনে জায়গা দিয়ে দেবে। মুভি শেষ হতে এখনো একঘন্টা বাকি। নাতাশাকে সঙ্গে করে অন্য ঘরে চলে গেলে দুজন আলাদা সময় কাটাবার সুযোগ পাবে। মায়ের কথা, নিজস্ব ভাবনা ভাবতে ভাবতেই আড়মোড়া দিয়ে সোফা ছাড়লো অনি। 

    — “আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমারও ঘুম পাচ্ছে নাতাশা আপু। ঘুমাবে নাকি?” 

    অনির কথায় মনোযোগ ভাঙলো অমিত-নবনীর। দুজনই একবার অনির দিকে তাকাচ্ছে অন্যবার নাতাশার দিকে। অনির ইঙ্গিত বুঝলো নাতাশা। মিথ্যামিথ্যি হাই তুলতে তুলতে বললো, 

    — “হ্যাঁ তা তো লাগছেই। বেশি খেয়ে ফেলেছি আজ। এত খাই নাকি আমি?”

    — “হ্যাঁ, সত্যিই নাতাশা বাসায় এত ভাত খায় না। আজ কিভাবে যেন খেয়ে নিলো। আম্মু শুনলে খুব অবাক হবে।” 

    — “চলো আপু আমরা ঘুমাই।” 

    অনি, নাতাশাকে নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। ড্রইংরুমে বসে রইলো অমিত, নবনী। অমিতের দিকে বারবার তাকাচ্ছে নবনী। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে টিভি স্ক্রিনে। অথচ মন পড়ে আছে অন্য কোথাও। অমিতের চোখে তাকিয়ে নবনী যেন স্পষ্ট পড়তে পারছে আজ তার মন ভালো নেই। মনের ভেতর কোনো এক ঝড় বয়ে যাচ্ছে, কিন্তু নিজেকে সামলে রেখেছে খুব সাবধানে। টিভির ভলিউম কমিয়ে অমিতকে ডাকলো নবনী। 

    — “শুনছেন?” 

    — “হুম…” 

    — “মনটা এত খারাপ কেন?” 

    — “কই?” 

    — “দেখছি তো।” 

    — “জানি না।

    — “সকালে বাসা থেকে বেরোনোর আগেও তো ভালো মুডে ছিলেন। গতকাল কত রাত পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে বসে আড্ডা দিলেন। বাইরে থেকে ফেরার পর দেখছি আপনার মুড অফ। কী হয়েছে? অফিসে কোনো সমস্যা?”

    — “মুনের সঙ্গে আজ দেখা হয়েছিল।” 

    — “কোথায়?” 

    — “অফিস থেকে বেরোচ্ছি, তখন।” 

    — “কথা হয়েছে?” 

    — “উহুম। সঙ্গে ঐ ছেলেটা ছিল, যার সঙ্গে ওর ভিডিও দেখলাম বারো দিন আগে।” 

    — “কথা বলতে ইচ্ছে করছিল?”

    — “উহুম।” 

    — “তাহলে মন খারাপ কেন?” 

    — “মুনের বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে আমি আগে থেকেই জানতাম। গা ঘেঁষে ছবি তুলতো, হাত ধরে কিংবা কাঁধে হাত রেখে রাস্তায় ঘুরে বেড়াতো। আমি দেখেছি সেসব। কষ্ট পেতাম খুব, কিন্তু ঘৃণা কখনো হয়নি। সেদিন শাহরিয়ারকে ও লিপকিস করছে দেখে আমার কেমন গা গুলিয়ে উঠলো। তারপর থেকে ও শুধু আমার এই কথাটা আর ভাবতে ইচ্ছে হয় না। ঘৃণা জন্মে গেছে। কিন্তু মায়া এখনো ছেড়ে যায়নি। ভীষণ ভালোবাসতাম তো! গলার কাঁটার মতো লাগে ওকে। না পারছি বের করতে, না পারছি গিলতে। আজ যখন ওর সঙ্গে দেখা হলো বুকে মোচড় কেটে ব্যথা শুরু হলো অথচ ওকে একটাবার কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে হলো না। কথা বলতে ইচ্ছে হলো না।” 

    — “পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ছে খুব?” 

    — “হুম। জানো, যখন তখন আমার বুকে এসে লেপ্টে থাকা ছিল মুনের অভ্যাস। সম্পর্কের একদম শুরু থেকে ও আমাকে জড়িয়ে ধরতো নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে শুনেছি এসব ক্ষেত্রে সব মেয়েদের মাঝেই নাকি সংকোচ কাজ করে। মুনের বেলায় এমনটা ছিল না। হাত ধরা থেকে শুরু করে আমাদের ফিজিক্যাল ইন্টিমেসি সবকিছুই প্রথম হয়েছিল মুনের তরফ থেকে। এবং সবকিছু যেন খুব দ্রুত হচ্ছিল। ভেবেছিলাম আমাকে ও বিশ্বাস করে, পাগলের মতো ভালোবাসে, তাই নিজেকে এভাবে সঁপে দিচ্ছে। তাছাড়া আমিও তো ওকে নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম। দায়িত্ব নেবার জন্য রাজিও ছিলাম। যদি ও তখন বলতো বিয়ে করতে চায়, ওর এক কথাতেই সেদিনই ওকে বিয়ে করে নিতাম আমি।” 

    — “ঝুলিতে অনেক স্মৃতি জমা রয়ে গেছে, তাই না?” 

    — “ওর সঙ্গে আমার শুধু প্রেম ছিল না, নবনী। এক প্রকার সংসার করেছি ওর সঙ্গে দুই বছর। সবচেয়ে বেশি কী মনে পড়ে, জানো?” 

    — “কী?” 

    — “মুন হ্যাংলা-পাতলা ছিল আগে থেকেই। সাইজে একটু খাটোও। একদম গুটিসুটি মেরে পাখির বাচ্চার মতো বুকের সঙ্গে লেপ্টে বসে থাকতো। আমি এক হাতে ওকে জড়িয়ে, অন্য হাত মাথায় বুলিয়ে দিতাম। মুনের সঙ্গে সেপারেশনের পর সবচেয়ে বেশি মিস করতাম আমাদের এই মুহূর্তটা। ঐ ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে আসার পর মুন আর কখনো আমার বুকের সঙ্গে লেপ্টে বসেনি।” 

    — “পাখির বাচ্চা তো উড়াল দেবেই। বুকে জড়িয়ে ধরতে হবে আমার মতো হাতির বাচ্চা। শরীর নিয়ে নড়াচড়া করাই মুশকিল, উড়াল আর দিবে কখন?” 

    — “মানে?” 

    — “আমি আগে মোটা ছিলাম। ওজন ছিল পঁচাশি কেজি। সামিকে জড়িয়ে ধরলেই বলতো, মা গো, হাতির বাচ্চা আমার বুক ব্যথা করে দিলো।” 

    সজোরে হেসে উঠলো অমিত। 

    — “হাসবেন না, হাসবেন না। এটা কিন্তু খুব সিরিয়াস ব্যাপার। বুকে আগলে ধরতে হবে হাতির বাচ্চা সাইজের মানুষ যে আপনার সমস্ত বুক দখল করে ফেলবে। এসব মানুষ জড়িয়ে ধরে শান্তি। বুক ভরা ভরা ফিল হবে, বুক জুড়ে তার গায়ের উষ্ণতায় মাখামাখি হবে। এসব পাখির বাচ্চাকাচ্চা বুকে জড়িয়ে শান্তি আছে নাকি? বুকের এক কোনা কোনরকমে ভরাপুরা হবে, বাকি অংশ খোলা ঘাসহীন মাঠ হয়ে পড়ে থাকবে। ধুর!” 

    — “কে শেখায় তোমাকে এসব?” 

    — “কে আবার? সামি। আমি আগে খুব ভালো ছিলাম, জানেন? ওর সঙ্গে এত বছর প্রেম করে একেবারে বরবাদ হয়ে গেছি। 

    — “কত বছরের প্রেম তোমার?” 

    — “পনের বছর।” 

    — “তোমার বয়স কত নবনী?”

    — “ত্রিশ হবে আর কয়দিন পর।”

    — “মাই গড! সেই ১৪ বছর বয়স থেকে প্রেম করছো?” 

    — “হ্যাঁ, ইঁচড়েপাকা ছিলাম। আমাকে প্রপোজ করলো, আমিও নাচতে নাচতে হ্যাঁ বলে দিলাম।” 

    — “তোমরা সমবয়সী?” 

    — “নাহ্। সামি আপনার বয়সী।” 

    — “এত বছর হলো বিয়ে কেন করোনি তোমরা?” 

    — “ভাগ্যে আপনার সঙ্গে বিয়ে লেখা ছিল, তাই ওর সঙ্গে বিয়ে হয়নি। 

    — “ওকে বিয়ে করে নিলেই তো আজ আমার সঙ্গে বিয়ে হতো না।”

    — “হ্যাঁ বলেছি তো সামিকে। আটবছর আগে একবার ওর খুব ঝোঁক উঠলো বিয়ে করার। নতুন চাকরিতে জয়েন করেছে তখন। আব্বু বললো নবনীর গ্র্যাজুয়েশন শেষ হোক। শুনলোই না। জেদ ধরলো আসছে পূর্নিমায় আমাকে বিয়ে করবে। আমি তো প্রতিদিন লাল জামদানীতে বউ সাজে নিজেকে কল্পনা করতে করতে ঘুমাতাম। যেই না সামি বললো বিয়ে করবে আমার খুশি দেখে কে! নানী শুনেই বললো, এই যে দিলো! নাচুনী বুড়ির সামনে ঢোলের বাড়ি দিলো। তারপর আমার এক্সাইটমেন্ট আর সামির পীড়াপীড়িতে আব্বু রাজি হলো বিয়েতে।’ 

    — “তারপর? বিয়ে হলো না কেন?”

    — “সামি বিশাল এক ঝামেলা বাঁধালো। আমাদের বিয়েটাই ভেঙে গেল!” 

    — “যাহ্! ভাঙলো কেন? আচ্ছা মাঝ থেকে গল্প শুনে কাজ নেই। একদম শুরু থেকে বলো।

    — “ও বাবা! এত লম্বা কাহিনী কিভাবে বলবো? বলার আগেই তো টায়ার্ড লাগছে আমার।

    — “এতগুলো দিন ধরে শুধু আমার কথাই বলে যাচ্ছি। এত বিরহ আর ভালো লাগছে না। এবার মন ভালো হওয়ার মতো কিছু শুনি। বলো তোমার গল্প। কিভাবে সম্পর্ক শুরু হলো তোমাদের?” 

    — “আরেকদিন বলবো। এখন ঘুমাতে যাবো।”

    ২৪

    সন্ধ্যার চায়ের আসর বসেছে আজ জামিলা বেগমের ঘরে। চায়ের খুব একটা অভ্যেস নেই জামিলার। বাসার অন্যরা যখন চা নিয়ে ব্যস্ত, তখন তিনি সযত্নে এক খিলি পান বানিয়ে মুখে পুড়েন। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। খাটে হেলান দিয়ে পান চিবুচ্ছেন জামিলা। শফিক-নীতু এসেছেন তার ঘরে। আসছে বুধবার নবনীর জন্মদিনে কী আয়োজন হবে সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে নীতু বললেন, — 

    — “শফিক বলছে বড় আয়োজন করতে।

    — “দেখতে দেখতে ছোট্ট গুদুম-গাদুম নবনীর ত্রিশ বছর হইয়া গেল, এ্যা?” 

    — “হ্যাঁ আম্মা। শফিক যখন বললো মেয়ের তো ত্রিশতম জন্মদিন, এবার চলো ঘটা করে আয়োজন করি। আমার ভেতরে কেমন ধুক করে উঠলো। নবনীর এত জলদি ত্রিশ হয়ে যাচ্ছে কেমন করে?” 

    — “হ রে মা। সময় কই দিয়া যায়গা! আইচ্ছা এখন কামের কতা কই। তুই কী চাস? ঘটা কইরা আয়োজন না করতে?”

    — “না।” 

    মন খারাপ করলেন শফিক সাহেব। — “সমস্যা কী নীতু? সেই কতবছর আগে নবনীর বার্থডে পার্টি ভালোভাবে করেছি, বলো তো?” 

    — “তুমি কাদের নিয়ে বড় আয়োজন করতে চাইছো? আমাদের আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে, যারা আমার মেয়ের এমন বাজে মুহূর্তে উল্টাপাল্টা কথা বলতে ছাড়েনি? মাত্রই একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে আমাদের সঙ্গে, আত্নীয়দের চেহারা আমি চিনে গেছি। আপাতত ওদের কাউকে নিয়ে ফূর্তি করার ইচ্ছা কিংবা রুচি কোনোটাই আমার নেই। 

    — “ওদেরকে আসতে বলবো না। বিয়ের পর মেয়ের প্রথম জন্মদিন। অমিত তো এখনও আমাদের বাসায় আসেনি, আপ্যায়নও করতে পারিনি। এক উছিলায় আসা হবে আমাদের এখানে। ওর মা-বাবা, ওর মায়ের পক্ষের আত্মীয়দের আসতে বলবো। আমার তোমার বন্ধু-বান্ধব, দুই মেয়ের ফ্রেন্ড সার্কেল, কয়েকজন প্রতিবেশী এদের নিয়ে আয়োজন হবে। অমিতের সঙ্গে সবার পরিচিত হবার দরকার আছে না?” 

    — “সময় কি উড়ে যাচ্ছে? অমিতকে পরেও সবার সঙ্গে পরিচয় করানো যাবে। এখন শুধু অমিতের ফ্যামিলি আসুক। তুমি এরশাদ ভাইকে কল করে বলে দাও উনারা দুজন যেন চলে আসে। দুই ফ্যামিলি মিলে ছোট্ট করে মেয়ের বার্থডে সেলিব্রেট করবো।” 

    — “আমিও নীতুর লগে সহমত।” 

    — “নীতুকে কেন সাপোর্ট করছেন আম্মা? আমি কি খারাপ কিছু বলেছি?” 

    — “খারাপ কও নাই। তবে ব্যাপারটা আরেকটু ভালো করা যায়। দেখো, অমিত কখনো এই বাসায় আসে নাই। এইখানে আইসা যেন সে কোনো অস্বস্তিতে না পইড়া যায় সেইটা দেখতে হইবো। আমরা ওর পরিচিত মুখ, আমগো সামনে ও খুব একটা শরম পাইব না। কিন্তু তুমি যদি একগাট্টি মেহমানের মাঝখানে ওরে বসাও তাইলে ও শরম পাইবো। তার উপর কইতাছো জামাই বইলা পরিচয় করাইবা, এইটা কি হয় নাকি? ওরা কেউই এই বিয়া মানে না। মাইনা নেওনের আগ পর্যন্ত এসব কতা না কওয়াই ভালো। জামাই এই ব্যাপারটায় নারাজ হইতে পারে।” 

    — “আমিও ঠিক এই কথাগুলোই তোমাকে বুঝাতে চাইছি।” 

    — “তার চেয়ে বরং এখন খালি অমিত আর ওর মা, বাপ, বইন আসুক। আমরা ভালোভাবে ওগো আদর আপ্যায়ন করি, অমিতের লগে ভালো কইরা আন্তরিকতা জমানোর চেষ্টা করি যাতে ও আমগোরে নিজের মানুষ ভাবে। এইটা ভালো হইবো।” 

    — “কথা মন্দ বলেননি। ঠিক আছে, এটাই হবে।” 

    — “আজকা তো ছুটির দিন। জামাই বাসায়ই আছে মনে হয়। দেও, ওরে ফোন দেও। ওর আব্বারেও ফোন দিয়া দাওয়াত করো।” 

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ২৫

    ২৫

    গরম গরম সবজি পাকোড়া একের পর এক মুখে পুড়ছে অমিত। বড্ড ফুরফুরে মেজাজে আছে সে। বিকেলের আগ পর্যন্ত যে বিষণ্ণতা তাকে ঘিরে রেখেছিল, তার ছিঁটেফোঁটাও আপাতত অমিতের মাঝে দেখা যাচ্ছে না। পাশেই নবনী বসে ফোনে কার সঙ্গে চ্যাট করছে। পাকোড়া চিবুতে চিবুতে অমিত বললো, 

    — “খাচ্ছো না কেন?” 

    — “হুম।” 

    — “কী হুম হুম? ফোনের ভেতর একদম ঢুকে গেছ। ফোনের ভেতর কে আছে? তোমার সামি?” 

    চোখ তুলে মুচকি হাসলো নবনী।

    — “ব্লাশ করছো! নতুন বউ তুমি যে বরের নাম শোনা মাত্রই ব্লাশ করতে হবে?” 

    — “হ্যাঁ নতুনই তো। আমার বিয়ে হয়েছে সবে দুইমাস হলো।” 

    — “আমার কপালটাই মন্দ। প্রেমিকাও আমার না, বউও আমার না। দুজনই আরেক ব্যাটা নিয়ে বিজি। আর আমি হলাম কাবাবের হাড্ডি।”

    — “সারাদিন পাখির বাচ্চার জন্য কান্নাকাটি করলে হাতির বাচ্চা তো আরেক ব্যাটা নিয়ে বিজি হবেই।”

    — “ইশ্! দোষ এখন সব আমার। বয়স চৌদ্দ পেরোনোর আগেই সামির প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া শুরু করেছো, সেই কথা কে বলবে?” 

    — “নুডলস হাতে যারা প্রপোজ করে তাদের ফিরিয়ে দিতে নেই। এমন সুবুদ্ধিসম্পন্ন প্রেমিক বুকে আগলে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।”

    — “ট্রাস্ট মি নবনী, তোমার গল্প শুনে মন খারাপ গায়েব হয়ে গেছে আমার। সেই সঙ্গে খুব হিংসেও হচ্ছে। এমন মিষ্টি একটা প্রেমের গল্প আমার কেন নেই? আমি সামির সঙ্গে দেখা করতে চাই। চাই মানে চাই। উনাকে বাসায় দাওয়াত করো কিংবা রেস্টুরেন্টে, সেটা তোমার খুশি। তোমরা দুজন পাশাপাশি বসবে, আমি তোমাদের দেখবো। চোখের শান্তি হবে আমার জন্য। জলদি করে একটা ডেট ফিক্সড করে ফেলো তো!” 

    রান্নাঘরের দরজায় নাতাশা দাঁড়িয়ে আছে। হতবাক হয়ে শুনছে অমিতের কথা। কোত্থেকে আসবে সামি? কিভাবে আসবে? গল্পের শেষটা কি তার জানা নেই? 

    ২৬

    রাত আড়াইটা। চপিংবোর্ডে খটখট শব্দ তুলে ক্যাপসিকাম কাটছে অমিত। নুডলস রান্না করবে সে। এইরাতে নবনী ঘুম থেকে উঠে এল পানি খেতে। কিচেন থেকে আওয়াজ পেতেই ঘুম ঘুম চোখে সেদিকে উঁকি দিলো নবনী। ডাইনিং থেকে এক গ্লাস পানি খেয়ে চলে এল রান্নাঘরে। নবনীকে দেখে কাজ থামালো অমিত। 

    — “এত রাতে উঠে এলে যে!” 

    — “পানি খেতে এসেছি। আপনি এতরাতে এসব কাটছেন কেন?” 

    — “নুডলস রান্না করব।” 

    — “খুব খারাপ আপনি। বাসার সব ঘুমাচ্ছে, আর আপনি একা একা নুডলস রেঁধে খাবেন। আমাদের সঙ্গে শেয়ার করার ভয়ে এতরাতে রান্না করছেন, তাই না?”

    — “ধুর! ঘুম আসছিল না। অস্থির লাগছিল খুব। ভাবলাম কিছু একটা করি। তুমিই তো বললে সেদিন নিজেকে ব্যস্ত রাখতে।”

    — “অস্থির লাগছে কেন? মুনিয়ার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে?” 

    — “হুম। অনেকদিন কথা হয় না। নিয়ম করে দিনে অন্তত দশবার কল করার 

    অভ্যাস আমার। 

    — “বহু বছরের অভ্যেস। মুছে যেতে সময় লাগবে। ভালোবাসাও মোছেনি, রয়ে গেছে মনের কোণে। সে তো বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকবেই।”

    — “তোমাদের মাঝে ঝগড়া হয়?” — 

    — “হয়।” 

    — “কথা বন্ধ থাকে?” 

    — “থাকে।” 

    — “তারপর? কে আগে স্যরি বলো?” 

    — “দু’জনই। একতরফা ব্যাপারটা আমাদের মাঝে নেই। ডমিনেটিং বিহেভিয়ার আমাদের কারোরই পছন্দ না। ঝগড়া হয়, ঝগড়ার মাঝে হাসাহাসিও হয়, তারপর দু’জন দু’জনকে স্যরি বলা। কখনো যদি খুব রেগে যাই দু’জনই খুবজোর একবেলা কথা বন্ধ। তারপর ও আমাকে কিংবা আমি ওকে কল করে বলি, চলো মিট করি। গো ধরে বসি থাকি না- আমি কেন স্যরি বলবো? ওকেই স্যরি বলতে হবে, ওকেই রিকুয়েস্ট করতে হবে।” 

    — “ব্যস? একবেলা বাদেই সব সমাধান?” 

    — “হ্যাঁ। আর কী হবে? ভালোবাসি দু’জন দু’জনকে। রাগ তো কেয়ামত পর্যন্ত পুষে রাখা যাবে না, তাই না?” 

    — “তোমাদের এই ব্যাপারটা ভাবলেই আমার এত শান্তি শান্তি লাগে! কত আন্ডারস্ট্যান্ডিং তোমাদের মাঝে! কতটা রেসপেক্ট করো দু’জন দু’জনকে। রিলেশন এমনই হওয়া উচিত। কিন্তু সবার ভাগ্যে এমন মেলে না। তুমি যাকে ভালোবাসো সে তোমার ভালোবাসা বুঝতে পারছে, রেসপেক্ট করছে এটা বিশাল ব্যাপার।” 

    — “আপনি বোঝেন?” 

    — “জানি তো এখন আমাকে খুব খোঁচাবে।” 

    — “জানি খুব অনধিকার চর্চা হয়ে যাচ্ছে। আপনার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এতটাও বলার অধিকার আমি রাখি না। তবুও বলছি, চাচী আপনাকে ভীষণ মিস করে।” 

    — “আমি করি না?” 

    — “দেখতে পাচ্ছি না। কী করে বলবো?” 

    — “মাকেও আমি ভীষণ মিস করি নবনী। মুনিয়ার সঙ্গে রিলেশনশিপে যাওয়ার আগে মা ছিল আমার বেস্টফ্রেন্ড। পুরো পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ভালো আমি মাকেই বেসেছি। মায়ের সঙ্গে আমি কতটা ক্লোজ ছিলাম সেসব কাউকে এক্সপ্লেইন করা পসিবল না।” 

    — “জানি আমি একটু আধটু। চাচী বলেছে আমাকে। তাইতো বারবার অনধিকার চর্চা করছি।” 

    — “মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কেমন নষ্ট হয়ে গেল!” 

    — “চাচীর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেন খারাপ হবে সেটাই ভেবে পাই না। যদি চাচী সম্পর্কটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করতো তাহলে হয়তো ভেবে নিতাম সে কারণে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু চাচী খুব ব্রড মাইন্ডেড, আপনি নিজেই বললেন। তবুও কেন এই দূরত্ব?”

    — “শুরুটা অকারণে বলতে পারো। মুনিয়ার সঙ্গে রিলেশনের পর থেকেই আম্মুর কাছ থেকে আমি দূরে সরে এলাম। এমনকি আমি রিলেশনে আছি সেটাতো আম্মুকে সবার আগে বলা উচিত ছিল। তাও হাইড করলাম। কেন জানি না আম্মুকে আমার কল দিতে ইচ্ছে হতো না। সারাদিনে একবারও না।”

    — “মুনিয়ায় মোহাবিষ্ট ছিলেন।” 

    — “এক্সাক্টলি। শুধু আমার মা না, বন্ধুদের সঙ্গেও আমার বিশাল দূরত্ব চলে এল। ওরা কল করতো, রিসিভ করতাম না। মিট করতে চাইতো, মিথ্যা বাহানায় ক্যান্সেল করতাম। এমনকি আমি বাসায়ও যাই না চারবছর যাবৎ। কোরবানি ঈদে ঠেলেঠুলে হয়তো আব্বু আমাকে চট্টগ্রাম নিয়ে যায়। কিন্তু বাকি সময় ঢাকাতেই থাকি। আত্মীয়দের কোনো অনুষ্ঠান সহজে আমি এটেন্ড করি না। আমার ছোটবেলার বন্ধু সাব্বিরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ নেই দুইবছর ধরে। একই সঙ্গে বেড়ে উঠেছি আমরা। ইন্টার পর্যন্ত একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেয়েছি। কখনো ও আমার বাসায় লাঞ্চ করতো, কখনো আমি ওর বাসায় করতাম। পাশাপাশি বাড়ি আমাদের। অনার্সে ও ঢাকায় চলে এল, আমি রয়ে গেলাম চট্টগ্রাম। তবুও আমাদের বন্ধুত্বে তিল পরিমাণ ঘাটতি হয়নি। মুনিয়ার সঙ্গে রিলেশন হওয়ার পর বেচারা দুইবছর বারবার আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইতো, সময় নিয়ে কথা বলতে চাইতো, আমি সময় দিতাম না। ও ভীষণ রাগ করতো। বলতো, তুই অনেক দূরে চলে যাচ্ছিস। ওর এই কথায় কি রাগ হতো আমার! মনে মনে বকতাম, শালা তুই কি আমার গার্লফ্রেন্ড?” 

    — “সেসব জের ধরেই কি আর বন্ধুত্ব টেকেনি?” 

    — “ওর বিয়ে ছিল। বারবার কল করছিল আমি যেন অন্তত তিনদিন আগে উপস্থিত থাকি।” 

    — “যাননি?” 

    — “কী করে যাবো? মুনের বার্থডে ছিল।”

    — “বিয়ের দিন?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “সর্বনাশ! মুনিয়ার বার্থডে ফেলে মুনিয়ার প্রেমিক যাবে নাকি কোথাও?” 

    — “হ্যাঁ তাই তো যাইনি আমি। গাড়িতে উঠার আগ অব্দি ও আমাকে কল করেছে। আমি রিসিভ করিনি। সৌমিক বলেছে, সাব্বিরের এত মন খারাপ আগে কেউ কখনো দেখেনি। সেইবারই শেষ। আর কখনো যোগাযোগ হয়নি আমাদের।”

    — “আপনি চেষ্টা করেননি?” 

    — “তখন করিনি। সত্যি বলতে তখনও রিয়েলাইজই করিনি আমি একটা অন্যায় করেছি। প্রায় এক সপ্তাহ পর আমার মনে হলো ওকে একটা কল করা উচিত। করেছিলাম, ও আমাকে ব্লক করে রেখেছে। সব বন্ধুদের সঙ্গেই আমার এখন দূরত্ব। দূরত্বটা শুধু যোগাযোগের অভাবে না, আরো একটা ঘটনা আছে। মুন যখন আমাকে এভয়েড করে নতুন সব ছেলেদের মেলামেশা শুরু করলো, আমার পরিচিত সবার চোখেই পড়তে লাগলো। বিশেষ করে বন্ধুদের। ওরা আমাকে বারবার বোঝাতো মুন ভালো না। সেল্ফ রেসপেক্ট বিসর্জন দিয়ে ওর সঙ্গে রিলেশন কন্টিনিউ করার মানে হয় না। মুনকে নিয়ে বিভিন্ন বাজে কথা বলতো। তবে লিমিট ক্রস করতো না কেউই। কিন্তু আমার শুনতে অসহ্য লাগতো। আম্মুর সঙ্গেও আমার দূরত্ব আরো বেশি বাড়লো ঐ একই কারণে। আম্মু, অনি, আব্বু, ফ্রেন্ড সার্কেল এদের সবাইকে আমার বিষের মতন লাগতো। অথচ এই মানুষগুলোর সঙ্গে জীবনের সবচাইতে সুন্দর মুহূর্তগুলো আমি কাটিয়েছি।” 

    — “তারপর মুনিয়া এসে সব তছনছ করে দিলো?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “অবলীলায় মুনিয়াকে ব্লেইম করছেন। নিজের দোষটা কে দেখবে? বন্ধু আপনার, মা-বাবা আপনার, তাদের সঙ্গে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখার দায়ও আপনার। প্রেম জীবনে আসবেই, তাই বলে বাকি সম্পর্ক থেকে সরে আসার কোনো যুক্তি নেই। আপনি আপনার পৃথিবীটা এত বেশি ছোট করে ফেলেছেন যে আপনিই সেখানে আর নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না।”

    — “হ্যাঁ তা ঠিক। দোষ আমারই ছিল। মুন আমাকে বিট্রে করছে তা তো আমার চোখের সামনেই ছিল। তবুও আমি মানতে চাইনি, দেখতে চাইনি। সত্য বলার দায়ে ওদেরকেই খারাপ ভেবেছি।” 

    — “পৃথিবীতে কোনোকিছুই স্থায়ী না। ভালোবাসা, ঘৃণা, দূরত্ব, মায়া সবকিছুর অন্ত আছে। দূরত্ব মিটিয়ে নিন। সুন্দর স্মৃতির মানুষগুলোকে বুকের কাছে আগলে রাখুন। জীবন সহজ হবে।

    — “তুমি সেদিন ছাদে বলেছিলে আমি কারো ভালোবাসার মূল্য দেইনি, তাই মুনও দেয়নি। ফিরে এসে আমি অনেক ভেবেছি, জানো? একটা সম্পর্কে ডুবে কত কী হারালাম। আমি তো সবই হারিয়ে ফেলেছি নবনী। সুখ কোথায় আমার জীবনে? আম্মু কোথায়? আমার সেই পুরোনো বাসা কোথায়? অনির সঙ্গে আমার আন্ডারস্ট্যাডিং কোথায়? আমার প্রতি ওর অধিকার কোথায়? আমার বন্ধু-বান্ধব, দলবেঁধে আমাদের পাহাড়ে সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো, সেসব কোথায় হারালাম আমি? মুন আমার কাছ থেকে সরে আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত দুই বছর কেটে যাচ্ছে, সুখ কী, আমি ভুলে গেছি। স্বেচ্ছায় জীবন নরক করেছি আমি।” 

    — “বললাম তো দূরত্ব মিটিয়ে নিন। জীবন আপনার আবারো স্বর্গ হোক।”

    — “এত সহজ?” 

    — “খুব জটিলও না।” 

    — “কোন মুখে দাঁড়াবো? আম্মু আর সাব্বিরকে আমি অনেক বেশি মিস করছি। কিন্তু কল করার সাহস পাচ্ছি না।” 

    — “কল করার কী প্রয়োজন? বাসায় চলে যান।” 

    — “পাগল তুমি? কল করে কথা বলতেই লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছি আর তুমি বলছো বাসায় যেতে!”

    — “বোকার মতো ভাবছেন, সবকিছু আরো জটিল করছন। ঐটা আপনার নিজের বাসা যেখানে আপনি বড় হয়েছেন। ঐ বাসায় আপনার চেয়ে বেশি অধিকার আর কার আছে, বলুন তো? নেক্সট উইক চট্টগ্রাম যাচ্ছেন না? কাজ শেষে বাসায় চলে যাবেন। চাচীকে একবার জড়িয়ে ধরবেন শুধু। স্যরিও বলতে হবে না। দেখবেন সবকিছু ঠিক আগের মতো হয়ে গেছে। চাচী আপনার অপেক্ষায় আছে। ঠিক আগের মতই অসীম ভালোবাসা নিয়ে। ফিরে যান মায়ের কাছে, মা সবটা আবার সহজ করে দেবে।”

    — “সত্যিই এত সহজ?” 

    — “আমি যতটা বলছি তারচেয়ে আরো বেশি সহজ।

    — “আর সাব্বির? আমার সব বন্ধু বান্ধব, অনি, আব্বু?” 

    — “অনি আপনার ঘরেই আছে। ও আপনাকে ভীষণ ভালোবাসে। আপনার শত তেলেসমাতি দেখেও ভালোবাসা কিন্তু কমেনি। চাচার বেলায়ও তাই। ওরা আপনাকে নিয়ে ভীষণ কনসার্নড। এত ভাববেন না। যত ভাববেন তত জটিল হবে। অনিকে নিয়ে ঘুরতে যান, গল্প করুন, মুভি দেখুন, মনের ভেতর কী চলছে, শেয়ার করুন। একদিনে তো আর সব হবে না। ধীরে ধীরে সব আগের মতো হয়ে যাবে। আপনি শুধু এক পা এগিয়েই দেখুন। আর রইলো কথা সাব্বিরের। সেটাও হয়ে যাবে। আছি তো আমি আরো পাঁচমাস। দেখবেন টুপ করে একদিন আপনার বন্ধু চলে আসবে আপনার সামনে।” 

    — “ও খুব জেদী।” 

    — “হ্যাঁ, হ্যাঁ দেখা যাবে তখন। মনের ভেতর এত সংশয় রাখলে কিছুই ঠিক হবে না। সব ঝেড়ে ফেলুন, নতুন করে ঝুলিভর্তি ভালোবাসা কাছের মানুষগুলোকে উপহার দিন। এভ্রিথিং উইল বি ফাইন। অনেক অনেক জ্ঞান দিয়েছি, আমার এবার ঘুমাতে হবে। আপনার রান্নাও দেখছি শেষ। খেয়ে জলদি করে ঘুমাতে যান।”

    — “তুমি খাবে না? তোমার জন্যই তো বেশি করে রান্না করলাম।” 

    — “উহুম।” 

    — “নুডলস না তোমার ফেভারিট?” 

    — “হ্যাঁ। কিন্তু এত রাতে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আপনি খান। এতটা না খেতে পারলে রেখে দিন। আমি সকালে গরম করে খেয়ে নেবো। গুড নাইট 

    নবনী পা বাড়ালো নিজের ঘরে। পেছন থেকে নিচুস্বরে ডাকলো অমিত, 

    — “নবনী…” 

    — “হ্যাঁ?”

    — “যার সঙ্গে আমরা আমাদের সবচাইতে গোপন কথাগুলো শেয়ার করি, সেই মানুষটা যদি আমাদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে মন্তব্য করে, কথা বলে, সেটা কিন্তু অনধিকার চর্চা না। যদিও আমরা কাজিন, কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা বোধহয় বন্ধুত্বেরই। কী সহজে দুজন দুজনের ফিলিংসগুলো, নিজেদের গল্পগুলো শেয়ার করছি। শুধু কাজিনের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে হয়তো এতকিছু শেয়ার করা হতো না। ধরে নাও আমি তোমার বন্ধু। নির্দ্বিধায় তুমি আমার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে যা ইচ্ছে বলতে পারো। আমি কখনোই কিছু মনে করবো না।”

    — “আপনার কথা ঠিক ফেলে দেয়া যাচ্ছে না। বন্ধুর মতই মেলামেশা চলছে আমাদের।”

    — “ব্যাপারটা আরেকটু সহজ করি?” 

    — “হ্যাঁ করুন না।” 

    — “প্লিজ ব্যাপারটা অন্যভাবে নিও না। আমার একটা নাম আছে। সবসময় শুনছেন, এই যে বলে ডাকাডাকি করো। কেমন না বলো? নাম ধরেও ডাকো না, ভাইয়া বলেও ডাকো না।”

    মুখে ওড়না চেপে সজোরে হেসে উঠলো নবনী। ভ্রু কোঁচকালো অমিত। 

    — “হাসছো কেন?” 

    — “ভাইয়া ডেকে অভ্যস্থ হলে বিপদ। রিলেটিভ বা অন্য কারো সামনে যদি ভাইয়া ডেকে ফেলি! সবাই বলবে না হাজবেন্ডকে ভাই কেন ডাকছে? আপনি চাইলে ভাইয়া ডাকতে পারি।” 

    — “আমিও চাচ্ছি না ভাইয়া-টাইয়া ডাকো। চার বছরের ডিফারেন্সই তো। আহামরী কিছু না। তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকলেও খারাপ শোনাবে না।” 

    — “অমিত ডাকতে হবে?” 

    — “প্লিজ! আমার খুব উইয়ার্ড ফিল হয়। আমার দাদী আমার দাদাকে এভাবে শুনছেন, এই যে বলে ডাকতো।” 

    — “আসলে কেমন ফিল পান, বলুন তো? আমাকে বউ বউ মনে হয়?” 

    আবারও হাসতে লাগলো নবনী। ইতস্তত হয়ে মুচকি হেসে অমিত বললো, 

    — “ধুর!” 

    — “আচ্ছা ডাকবো, অমিতই ডাকবো।

    — “তুমি করে বলতে পারো, কিংবা তুই। বন্ধুই তো আমরা তাই না?”

    — “তুমি ঠিক আছে। ওসব তুই টুই আমার দ্বারা হবে না।” 

    — “কাল সকালে কারখানায় যাচ্ছো তো, তাই না?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “ড্রপ করে দেবো।

    — “ওকে, গুড নাইট।” 

    .

    খাটের উপর বসে পা দোলাচ্ছে সামি। নবনী দরজা লক করতেই সামি বললো, 

    — “অতঃপর ঘটা করে বন্ধুত্বের শুরু।” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “খারাপ সময়ে ছেলেটার একটা বন্ধু সত্যিই দরকার ছিল যার সঙ্গে সব কথা শেয়ার করা যায়। নয়তো এখনকার মানুষগুলোর জীবনের প্রতি মায়া মমতা আছে নাকি? কখন কোন অঘটন ঘটিয়ে বসে কে জানে!” 

    — “হ্যাঁ খুব ডিপ্রেসড ছিল। অবশ্য এখনো আছে। তবে আগের চেয়ে বেটার।”

    — “কতবছর পর তোমার নতুন কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো?” 

    — “অনেক বছর। অনার্সে ভর্তি হলাম যে বছর তখন বন্ধু বান্ধব পেলাম কয়েকজন। এরপর আর কারো সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ হয়নি।”

    — “অলমোস্ট এক যুগ!”

    — “হ্যাঁ।” 

    — “বেশ হলো কিন্তু বলো? এই বুড়ি বয়সে বন্ধু পাওয়া যায় নাকি?” 

    — “বুড়ি বলছো কাকে?”

    — “অবশ্যই তোমাকে।”

    — “আমাকে দেখলে এখনো টুয়েন্টি মনে হয়।”

    — “কে বললো? তোমার ফেসবুকের রোমিও?”

    — “সবাই আমার কদর বোঝে। তোমার কাছেই শুধু দাম পেলাম না।” 

    — “এই তো বুড়ি হওয়ার লক্ষ্মণ। ঘর সংসার করতে করতে বুড়ি হয়ে যাওয়া মহিলারা শেষ বয়সে হাজবেন্ডকে এসব বলে।”

    — “ধুর ছাই। যাও সরো। ঘুমাবো আমি।”

    — “সামি সামি করে ডেকে ডেকে ঐ দূর আকাশ থেকে পৃথিবীর বুকে টেনে নিয়ে এসেছো। আর এখন বলছো দূর হতে? তা হবে না ললনা। আমি আছি, আমি থাকবো। নবনীর সঙ্গে সামি ছায়া হয়ে থাকবে আজীবন।” 

    ২৭

    অফিস থেকে ঘরে ফিরতেই অমিতের নাকে বিরিয়ানির ঘ্রাণ ঠেকলো। এ তো মায়ের হাতের কাচ্চির ঘ্রাণ! মা এসেছে? চমকে উঠলো অমিত। তড়িঘড়ি করে জুতোগুলো শু-র‍্যাকে তুলে রেখে পা বাড়ালো ভেতরের দিকে। ডাইনিংরুমে আড্ডার আসর জমেছে। হাত নাড়িয়ে বরাবরের মতো রসিক কায়দায় গল্প শোনাচ্ছেন অমিতের বাবা। সারাদিনের কঠিন খাটাখাটুনি শেষে বাসায় ফিরে এমন সারপ্রাইজ মিলে যাবে ভাবতে পারেনি অমিত। ক্লান্তি সব মুহূর্তেই কোথায় যেন পালালো! মনের ভেতর অদ্ভুত আনন্দ লাগছে। একদম ছোট বেলার মতন। কিন্ডারগার্টেনে পড়ার সময় স্কুল শেষে মা-বাবাকে দেখলে যেমনটা হতো, ঠিক তেমন। 

    ছেলেকে দেখা মাত্রই স্ত্রীকে চিৎকার করে ডাকতে লাগলেন এরশাদ সাহেব, 

    — “শামীমা? এ্যাই শামীমা, দেখো তোমার ছেলে এসেছে!” 

    তড়িঘড়ি করে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন শামীমা। একগাল হেসে বললেন, 

    — “এসেছিস! যা, যা ফ্রেশ হশে আয়। কাচ্চি রান্না প্রায় শেষদিকে। গরম গরম এখনি বেড়ে দিচ্ছি টেবিলে।” 

    মাকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল অমিত। কিসের জড়তা যেন এসে বারবার আটকায় তাকে। মায়ের সঙ্গে এত দূরত্ব কেন চলে এল তার?

    মাথা হেলিয়ে নিজের রুমে চলে গেল অমিত। পেছন পেছন গেল নবনীও। গায়ের জ্যাকেট খুলতে খুলতে অমিত বললো,

    — “কিছু বলবে নবনী?” 

    — “চাচা-চাচীর সঙ্গে কথা বলোনি কেন?” 

    — “জানি না।” 

    — “জানি না মানে? উনারা বাসায় এসেছেন, এটলিস্ট কেমন আছো সে কথা তো জিজ্ঞেস করতে পারতে।”

    — “হুম পারতাম। খুব সহজ এবং স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু কেমন কঠিন হয়ে গেছে আমার জন্য। 

    — “উনারা তোমার মা-বাবা। হ্যাঁ কথা কাটাকাটি হয়েছে উনার সঙ্গে, 

    কমিউনিকেশন গ্যাপ ছিল তাই হয়তো আন্তরিকতা আগের মতন নেই। কিন্তু যে কারণে এতকিছু হয়েছে সেই কারণটাই তো এখন আর নেই। তাহলে এই দূরত্বটুকু এবার তোমার মিটিয়ে নেয়া উচিত না? দেখো, ভুল কিন্তু তোমারই ছিল। চাচা চাচীর কোনো দোষ আমি দেখি না। তবুও সবকিছু ভুলে উনারা বারবার কাছে টানতে চাইছে, আগলে রাখতে চাইছে। তুমি কেন এখনও দূরেই সরিয়ে রাখছো নিজেকে?” 

    — “গিল্ট ফিল হচ্ছে খুব।” 

    — “বলেছিলাম চাচীর সঙ্গে আবার কখনো দেখা হলে উনাকে জড়িয়ে ধরবে। মুখ ফুটে কিচ্ছু বলতে হবে না তোমার, দেখবে এমনি এমনি সব ঠিক হয়ে গেছে। বলেছিলাম কি না বলো?” 

    — “হুম।

    — “তাহলে একবার জড়িয়ে ধরোনি কেন উনাকে?” 

    — “আব্বু-আম্মুকে দেখে খুব খুশি হয়েছি। বহুদিন উনাদের আমার বাসায় দেখে এতখানি খুশি হইনি। কেন যেন মনে হচ্ছিল পুরোনো সময়ে ফিরে গেছি। কিন্তু আম্মুকে জড়িয়ে ধরা কিংবা আগের মতো সবকিছু গুছিয়ে নেয়া এতটাও সহজ হবে না নবনী।”

    — “লাগবা বাজি?” 

    — “কিসের বাজি?” 

    — “সব ঠিক হয়ে যাবে। জাস্ট কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। একবার সবকিছু ভুলে চাচীকে জড়িয়েই দেখো।” 

    — “পারবো না আমি।” 

    — “অমিত প্লিজ! 

    — “আমার দিকটা একটু বোঝার চেষ্টা করো। 

    — “বুঝেছি। বুঝে শুনেই বলছি।”

    অমিতের হাত চেপে ধরলো নবনী। বললো, 

    — “চলো, আর কোনো কথা হবে না।” 

    নবনীকে আর বারণ করতে ইচ্ছে হচ্ছে না অমিতের। মনে ভীষণ দ্বিধার সঙ্গে লড়তে লড়তে সে চলে গেল ডাইনিংরুমে। মা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে। পেছন থেকে একবার মৃদু স্বরে ডাকলো অমিত, “আম্মু…” 

    শামীমা পেছন ফিরতেই চোখ শক্ত করে বুজে মাকে জড়িয়ে ধরলো অমিত। হঠাৎ যেন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল এই ঘরের সবকিছু। খানিকবাদে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন শামীমা। ভাঙা স্বরে স্বামীকে বলতে লাগলেন, 

    — “অমিতের আব্বু, তুমি দেখতে পাচ্ছো? আমার বাচ্চাটা আমাকেই বেশি পছন্দ করে। এই দেখো, তোমাকে জড়িয়ে না ধরে আমাকে ধরলো।”

    চোখ ভিজে এল এরশাদ সাহেবের। কৃতজ্ঞ ভরে তাকিয়ে রইলেন নবনীর দিকে। ওপাশ থেকে নবনীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অনি। ফিসফিসিয়ে বললো,

    — “থ্যাংকিউ আপু। তুমি আম্মুকে আজ কতটা দিলে, তা তুমি জানো না।”

    .

    নবনীকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে শামীমা। তার কাঁধে মুখ লুকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন তিনি। চাচীকে পরম মমতায় আগলে রেখেছে নবনীও। মৃদু স্বরে সে স্বান্তনা দিতে লাগলো, 

    — “আপনার তো খুশির দিন চাচী। কাঁদছেন কেন, বলুন তো?” 

    নবনীর প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না শামীমা। নিজের গলা থেকে সোনার চেইন খুলে নবনীর গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন তিনি। 

    — “এটা আমাকে কেন দিচ্ছেন চাচী?” 

    — “হতে পারে এটা পুরাতন কিন্তু আমার কাছে এর মূল্য অনেক। আমার দাদীর চেইন ছিল এটা। আমার জন্মের পর দাদী নিজের গলা থেকে খুলে আমার গলায় পরিয়ে দিয়েছিল। খুব যত্নে রেখেছি এতগুলো বছর। আজ থেকে এটা তোমার।”

    — “কেন চাচী? আমার লাগবে না এটা।” 

    — “পছন্দ হয়নি?” 

    — “অবশ্যই পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এটা আপনার দাদীর দেয়া উপহার। আমাকে কেন দিচ্ছেন, বলুন তো?”

    — “আমার ছেলে কতগুলো বছর পর আমাকে কাছে টেনে নিলো জানো! সবটাই হয়েছে তোমার জন্য। আমি কতটা কষ্টে এই ক’টা বছর পার করেছি তা কেউ কখনো জানবে না, বুঝবে না। যেই সন্তানকে বুকে আগলে বড় করেছি, সেই সন্তান আর আমার মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব দখল করে নেবে, এই কষ্ট সহ্য করা ভীষণ দায়। তোমার কাছে আমি ঋণী নবনী। আমার সবকিছু তোমাকে দিয়ে দিতেও আমি দ্বিতীয়বার ভাববো না। আমার সবকিছু দিয়েও তোমার ঋণ শোধ হবে না। “কিসব ভাবছেন আপনি! আমি অমিতকে একটুখানি বুঝিয়েছি শুধু। আর তো কিছু না! বাকিটা অমিত নিজেই করেছে।” 

    — “অতশত বুঝি না আমি। তুমি এটা রাখছো ব্যস। তোমার জন্মদিন কাল, এমনিতেও কিছু একটা গিফট করতাম — “চাচা তো দিলোই।”

    — “চুপ থাকো মেয়ে। ভালোবেসে দিয়েছি, রাখো এটা।” 

    — “এটা কিন্তু না দিলেও চলতো।”

    — “ধুর ছাই! একই কথা বারবার বলেই যাচ্ছো। কাল তোমার বাসায় গিয়েই ভাবীকে বলবো, মেয়েকে ভালোবাসার কদর করতে শেখাননি কেন?” 

    হেসে ফেললো নবনী।

    — “ভাবী বলছিল কাল সকালেই যেন আমরা চলে যাই। এক কাজ করো, তুমি কাল কারখানা বন্ধ রাখো। আমাদের সঙ্গে তুমিও সকালে চলো।”

    — “না চাচী, কাল আমার প্রোডাক্ট ডেলিভারি করতে হবে। দেশের বাইরে যাবে অর্ডারগুলো। ভালোয় ভালোয় এসব কারখানা থেকে বিদায় করতে পারলে আমি বাঁচি। এরপর পুরো তিনদিন ছুটি নেবো। কারখানায় কোনো কাজ হবে না। খুব স্ট্রেসে আছি এই অর্ডারগুলো নিয়ে। বিকেল নাগাদ আমার সব কাজ হয়ে যাবে। ফ্রেশ হয়ে চলে আসবো সন্ধ্যার আগেই।” 

    — “অমিতেরও নাকি কাল কাজ আছে। সন্ধ্যার আগে ফিরতে পারবে না।” 

    — “হ্যাঁ বললো আমাকে। আমি আর অমিত একসঙ্গেই যাবো নাহয়।” 

    — “আচ্ছা, উঠি তাহলে আমি। তুমি ঘুমাও।” 

    নবনী দরজা বন্ধ করতেই পেছন থেকে সামীর কন্ঠ পেলো। 

    — “আজকের দিনটা আমার জন্য ব্লেসিং। উপরওয়ালা এই তার ছেঁড়াটার একটা সুন্দর গতি করবে বলে তোমাকে আমার করে পাঠালো এই পৃথিবীতে। তুমি আমার মা-বাবার জন্যও ব্লেসিং। আমাকে বেঁধে রাখার ক্ষমতা কারো নেই একমাত্র তুমি ছাড়া। তোমার সঙ্গে সম্পর্ক হওয়ার পর মা-বাবা রীতিমতো হাফ ছেড়ে বাঁচলো। মা আর আপু সবসময় বলতো, নবনী বাঁদর মানুষ করতে জানে। আমাকে তাবিজ কবজ করেছিলে কি না কে জানে? নয়তো আমার মতো বনে বাদারে ঘুরে বেড়ানো ছেলে, সব ছেড়ে তোমার কথায় উঠবস কেন করবো? সে যাই হোক, আসল কথা বলি। শুভ জন্মদিন বাঁদর মানুষ করা মায়াবতী। আমার রোদ্দুর হয়ে হাজার বছর বেঁচে থাকো আমাদের ভালোবাসা বাঁচিয়ে রাখো।” 

    মুচকি হাসলো নবনী। গায়ের জামা খুলে, আলমারি থেকে নীল শার্টটা বের করে গায়ে জড়িয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো,

    — “বয়স ত্রিশ হলে মা-বাবা মেয়ের বয়স রাখঢাক করে। আর আমার আব্বু-আম্মু ঢাকঢোল পিটিয়ে আয়োজন করছে।” 

    — “বাসায় গরুর রেজালা হবে কাল? অবশ্যই মেন্যুতে থাকা চাই। আন্টির রেজালা যা হয় না!”

    — “সামি…” 

    — “হুম?” 

    — “মায়ের হাতের রেজালা তোমার কত প্ৰিয় ছিল!” 

    — “এখনও আছে।

  • ……………….
  • — “উফ্ নবনী! আবারও কাঁদছো তুমি!” 

    — “আমার বার্থডে সেলিব্রেট হবে অথচ আব্বু-আম্মু তোমাকে ইনভাইট করবে না এমন হয়েছে কখনো? তুমি চলে যাওয়ার পর আমাদের বাসায় কোনোকিছুই আর ওভাবে সেলিব্রেট করা হয় না। না আমার আর নাতাশার বার্থডে, না আব্বু-আম্মুর অ্যানিভার্সারি। এবার কী মনে করে যে আব্বু-আম্মু সেলিব্রেট করতে চাইছে, কে জানে!” 

    — “করুক না নবনী। একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেছে তা কি কেউ বদলাতে পারবে? তাই বলে তো সুখ, আনন্দ সব বিসর্জন দেয়া যাবে না, তাই না?”

    — “তুমি চলে গেছ তাই জানো না আমরা কী হারিয়েছি। যদি আমি তোমাকে 

    মাঝপথে একা ফেলে চলে যেতাম, পারতে এভাবে বলতে?” 

    — “আমি আগেই বলেছি এই দিনটা আমার জন্য ব্লেসিং। কেন এসব বলে আমার মন খারাপ করছো, বলো তো? কোথায় উইশ করেছি, তুমি আমাকে একটুখানি জড়িয়ে ধরে মিষ্টি করে থ্যাংকস জানাবে। তা না! কেঁদেটেদে পরিবেশটাই ভারী করে দিলে। ধুর!” 

    সামির দিকে একহাত বাড়িয়ে দিলো নবনী। গালে নবনীর হাত মিশিয়ে মুখোমুখি বসলো সামি। আহ্লাদী হয়ে বললো, 

    — “চোখের সামনে দুই বেণী ঝুলিয়ে এক্কাদোক্কা খেলা নবনী ভাসছে। এই তো সেদিনের কথা গায়ের ওড়নাটাও ঠিকমতো সামলাতে জানতে না। আন্টি কী চোখ রাঙাতো! মাঝেসাঝে আমি দূর থেকে ইশারা করতাম, ওড়না ঠিক করো। প্রতি জন্মদিনে একটা টেডি বিয়ারের জন্য বাসায় কী হুলস্থুলটাই না করতে! ঘরে মানুষের চেয়ে বেশি ছিল টেডিবিয়ার। সেই ছোট্ট নবনীর নাকি ত্রিশ হয়ে গেছে, ভাবা যায়! কবে পেরোলো এত সময়? কবে এত বড় হয়ে গেলে তুমি? কিছুই তো টের পেলাম না।” 

    — “খুব দ্রুত বুড়ি হয়ে যাচ্ছি, তাই না?” 

    — “কই? আমি তো এখনো সেই চৌদ্দ বছরের নবনীকেই দেখি। এ্যাই নবনী, বেণী করো তো! কতদিন হয়ে গেল দুই বেণীতে তোমাকে দেখি না।”

    — “দেখবে? আচ্ছা পাঁচ মিনিট সময় দাও।” ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল বাঁধছে নবনী। হঠাৎ দরজায় টোকার শব্দ পেতেই অবাক হলো সে, এত রাতে কে এসেছে? 

    — “দরজার ফাঁকে দিয়ে দেখলাম আলো জ্বলছে। বুঝলাম জেগে আছো, তাই এসেছি। বিরক্ত করলাম?” 

    দরজা খুলতেই জিজ্ঞেস করলো অমিত। মুচকি হেসে নবনী বললো,

    — “বিরক্ত না, একটুখানি অবাক হয়েছি। এতরাতে কি মনে করে এলে?” 

    — “ভেতরে আসি?” 

    — “হ্যাঁ, হ্যাঁ আসো না!”

    নবনীর দিকে র‍্যাপিং পেপার মোড়ানো একটা বক্স এগিয়ে দিলো অমিত। 

    — “ও বাবা! তুমি দেখছি গিফট নিয়ে এসেছো আমার জন্য।” 

    — “বার্থডেতে গিফট দেবো না?” 

    — “কী এটা?” 

    — “খুলে দেখো।” 

    তাড়াহুড়ো করে বক্স খুললো নবনী। ভেতরে মোবাইল সেট। নবনীর কপালের মধ্যখানে কয়েকটা ভাঁজ। 

    — “এটা কেন?” 

    — “কী দেবো, কী দেবো ভাবছিলাম। ভাবলাম যেটা আমি নষ্ট করেছি সেটাই কিনে দেই।” 

    — “কোনো প্রয়োজনই ছিল না অমিত। স্যরি, তোমার গিফট দেখে খুব একটা খুশি আমি হতে পারিনি। এত এক্সপেন্সিভ গিফটের কোনো মানেই হয় না। একটু আগে চাচীও আমাকে গোল্ড চেইন দিয়ে গেল। চাচা দুইটা জামদানী গিফট করলো। কী শুরু করলে তোমরা, বলো তো?” 

    — “আব্বু-আম্মুর কথা আমি জানি না। আমার বান্ধবীর বার্থডেতে আমি তাকে যা খুশি গিফট করতেই পারি।” 

    — “পারো কিন্তু এটা আমার পছন্দ হয়নি। আমার মোবাইল আরো একটা তো আছে, তাই না? সেদিন তুমি স্ট্যাবল ছিলে না, কী থেকে কী করেছো নিজেও জানো না। তাই বলে মোবাইল ফিরিয়ে দিতে হবে?” 

    — “এক্সপেন্সিভ গিফটের পেছনে অবশ্য একটা কারণ আছে।” 

    — “কী?” 

    — “এক্সট্রা কেক, বিরিয়ানি খাওয়ার লোভে করেছি।” 

    হেসে ফেললো নবনী। বললো,

    — “কোন ফ্লেভার তোমার পছন্দ বলো? আজ তোমার পছন্দে কেক কেনা হবে। “বাটারস্কচ।” 

    — “আমি সকালেই নাতাশাকে বলে দেবো।” 

    — “এবার বলো তোমার গায়ের এই ঢিলেঢালা শার্টটা কার?” 

    — “ওহ্, এটা? এটা তো সামির।” 

    — “ওর শার্ট তুমি কোথায় পেলে?” 

    — “রেখে দিয়েছি আমার কাছে। মাঝেমধ্যে এটা পরে ঘুমাই।” 

    — “এত প্রেম নবনী? প্রেমিকের বদলে শার্ট গায়ে দিয়ে তাকে ফিল করতে চাও? আর কী কী করো? শার্টে চুমু টুমু খাও?” মুখ চেপে হাসছে অমিত। 

    — “অমিত!” 

    — “দেখি, দেখি গাল লাল হয়ে গেলো নাকি!” 

    — “গিফট দেয়া শেষ, এবার ঘরে যাও।”

    — “শার্টের সঙ্গে রোমান্স না করে জ্বলজ্যান্ত মানুষটার সঙ্গে রোমান্স করলেই তো পারো। কোথায় আছেন ভদ্রলোক? প্রেমিকার জন্মদিনে আসবে না দেখা করতে? একটুখানি জড়িয়ে ধরতে?”

    — “আসবে বোধহয়।”

    — “বোধহয় আবার কী? তোমার বার্থডে অথচ তোমরা মিট করবে না? রেডি হও, তোমাকে এক্ষুনি নিয়ে যাবো তার কাছে।”

    — “না। ওসবের প্রয়োজন নেই।” 

    — “মিস করছো তাকে। তার শার্ট গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো। আস্ত মানুষ রেখে শার্ট গায়ে কেন ঘুরতে হবে তোমার? তার বাসার ঠিকানা বলো, চলো আমার সঙ্গে।

    — “ও নেই।” 

    — “কোথায় আছে?” 

    — “জরুরি কাজে ঢাকার বাইরে গেছে।” 

    — “ধুর! এমনই হয় জানো! আমার বেলায়ও এমন হতো। মুনের বার্থডেতে রাজ্যের সব জরুরি কাজ আমার মাথায় নাচানাচি করতো। কী কষ্টে সময় বের করতাম! যাক সেসব কথা। মন খারাপ করো না। সামি ফিরে এলে দু’জন মিলে দূরে কোথাও বেরিয়ে এসো।”

    — “হুম।” 

    — “আমি যাই।” 

    — “কাল আমরা দুজন কিন্তু একসঙ্গে বেরোচ্ছি।” 

    — “হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে আমার।” 

    ২৮

    খাটের উপর বড্ড আয়েশে হেলান দিয়ে বসে আছেন জামিলা বেগম। তার ঘরে বসেছে আড্ডার আসর। সন্ধ্যার আপ্যায়ন পর্ব শেষে সবাই এসেছে তার ঘরে। খাট, চেয়ার, ফ্লোর যে যেখানে জায়গা পেয়েছে সেখানেই বসে পড়েছে। তার ঠিক পাশেই বসে আছে অমিত। তিনি নিজেই হাত টেনে এনে নাতিন জামাইকে পাশে বসিয়েছেন। খাট বরাবর ড্রেসিং টেবিলে আপাদমস্তক দেখা যাচ্ছে অমিতকে। সেখানেই গল্পের ফাঁকে ফাঁকে বারবার অমিতকে দেখছেন জামিলা বেগম। নাতিনের শ্বশুর-শাশুড়ির হাসি তামাশা দেখছেন, লক্ষ্মী মেয়ের মতন ভাইয়ের শ্বশুরবাড়িকে নিজের বাড়ি ভেবে ঘুরঘুর করা অনিকে দেখছেন। মনে তার অদ্ভুত প্রশান্তি ছেয়ে যাচ্ছে। অমিতকে সামনাসামনি না দেখে, দু’দন্ড কথা না বলেই একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। এখন মনে হচ্ছে সিদ্ধান্তে কোনো ত্রুটি হয়নি। অমিতকে কী মানিয়েছে তার নাতনীর পাশে! দেখতে শুনতে, যোগ্যতায়, আচার ব্যবহারে কোনদিক থেকে কম যায়? এত রসিক মেজাজের শ্বশুরকূল, অকারণ দাম্ভিকতা নেই। কী সহজ সরল লোকগুলো! এরচেয়ে ভালো সম্বন্ধ আর হতো নাকি নবনীর জন্য? আজ কতগুলো বছর বাদে এই ঘরে আবারও গল্প জমেছে। শেষ আড্ডার আসর বসেছিল নবনী-সামির বিয়ের দুই সপ্তাহ আগে। দু- পক্ষ যেদিন তারিখ ঠিক করবে বলে একসঙ্গে বসেছিল সেদিন। সেদিনই হয়েছিল এই বাসায় শেষ আনন্দে মেতে উঠা কোনো আসর। তারপর সেই ঝড়ের পর সবকিছু কেমন থমকে গিয়েছিল। আজ এতবছর বাদে যেন এই ঘর ফের প্রাণ ফিরে পেয়েছে। অতীত বর্তমান সবকিছু ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ জামিলা বেগমের মনে পড়লো নবনীর কথা। কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে মনে মনে গালি দিতে লাগলেন তিনি। আজকের এই বিশেষ দিনেও কেন কাজের বাহানায় কারখানায় যেতে হবে তার? নানী শাশুড়ির বিরক্তি চোখ এড়ায় না অমিতের। খানিকটা কাছে ঝুঁকে নিচুস্বরে জানতে চাইলো, 

    — “খুব চেঁচামেচি হচ্ছে। বিরক্ত হচ্ছেন আপনি? 

    — “না গো নাতি। কী যে কও না! আমার তো চিল্লাপাল্লা ভাল্লাগে। মেজাজ গরম হইতাছে আমার ঘরের ঢিঙ্গির উপ্রে।” 

    জামিলা বেগমের গা ঘেঁষে বসে আছে নাতাশা। নানীর অভিযোগে নাতাশা আহ্লাদী হয়ে বলতে লাগলো, 

    — “রাগ করো কেন নানী? ইমার্জেন্সি ছিল বলেই তো গেল। চলে আসবে দশ মিনিটের ভেতর।

    — “সাফাই গাইবি না। ও খুব অন্যায় করছে। বাসায় সব মেহমান। অমিত কখনো আইছে এই বাসায়? নবনীর উছিলায়ই তো আইলো। ওর কি উচিত হইছে অমিতরে রাইখা, ওর জন্মদিনের আয়োজন রাইখা গায়েব হইয়া যাওয়া?” 

    — “আমরা কিছুই মনে করছি না নানী। আপনি রিল্যাক্স থাকুন তো!” 

    — “ওরে বারবার কইছি বিকালের মধ্যে সব কাজ শেষ করবি।” 

    — হ্যাঁ, নবনীও চাইছিল আজ বিকালেই কারখানা বন্ধ করতে। শেষ সময়ে এসে কী নাকি ঝামেলা হলো। কাল রাতে শিপমেন্ট, আজই সব শেষ করতে হবে। চলে আসবে ও। বলেছে আমাকে, কাজটা দেখিয়েই চলে আসবে।” 

    — “নাহ্, তুমি যাই কও নাতি আমার ওসবে মন ভরবো না। ঘরে কত আনন্দ হইতাছো, ও থাকবো না ক্যান? ঐ নাতাশা, নবনীরে কল দে তো?”

    — “লাগবে না আমিই দিচ্ছি।” বলে ফোন হাতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল অমিত পাশেই বাতি নেভানো ঘরটায় কথা বলতে বলতে ঢুকে গেল সে। খানিক বাদে পেছন পেছন এল নাতাশাও। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে দিতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অমিত। বললো, 

    — “আসছে। রাস্তায় আছে।” 

    — “অহ! বেশিক্ষণ লাগবে না তাহলে।” 

    — “উহুম।” 

    বেরিয়ে যাবার সময় থমকে দাঁড়ালো অমিত। দরজার এপাশের দেয়ালে নবনীর বাঁধাই করা ছবি। বেবি পিংক জামদানীতে বউ সেজে কী সুন্দর হাসছে মেয়েটা! পাশেই বসে আছে এক সুদর্শন। নবনীর চোখে চোখ রেখে আংটি পরিয়ে দিচ্ছে। ছবির দিকে তাকিয়ে হাসছে অমিত, অদ্ভুত এক ভালো লাগা লেপ্টে আছে তার হাসিতে, চোখে। আরো কিছুটা কাছে এগিয়ে অমিত বললো, 

    — “এটা সামি, তাই না নাতাশা?” 

    — “হুম।” 

    — “আমি এই প্রথম দেখছি উনাকে। এটা নবনীর রুম?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “এটা ওদের এনগেজমেন্টের ছবি?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “নবনী তো একদম বউ সেজে বসে আছে। কী মিষ্টি দেখাচ্ছে ওকে! দেখে 

    একদম বোঝার উপায় নেই এটা এনগেজমেন্টের ছবি।”

    — “সামি ভাইয়া বলেছিল এভাবে সাজতে। কোন নাটকে নায়িকাকে দেখেছিল, সেই থেকে উনার খুব শখ হচ্ছিল আপুকে এই সাজে দেখার।” 

    — “খুব মানিয়েছে ওকে। 

  • ………………..
  • — “কিউট দেখাচ্ছে দুজনকে। তুমি জানো উনার গল্প শুনে কী দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে উনাকে! নবনীকে কবে থেকে বলছি বাসায় একদিন ডিনারে উনাকে ইনভাইট করো। ও কথাই শোনে না। বললাম, তুমি বলতে না চাইলে আমার সঙ্গে কথা বলিয়ে দাও। আমি উনাকে আসতে বলি। তোমার বোন সেটাও করে না। নানী যখন কল করে বললো আজ রাতের কথা, তখন ভেবেছিলাম এখানে আসলে উনার সঙ্গে দেখা হবে নিশ্চয়ই। কোথায় আর হলো! ভদ্রলোক কি কাজে নাকি ঢাকার বাইরেই চলে গেছে!” 

  • ………………..
  • — “আচ্ছা নাতাশা, সামির নাম্বার আছে না তোমার কাছে? দাও দেখি, কল দাও একটা। আমি কথা বলবো। 

    মাথা নিচু করে কাঁপা স্বরে নাতাশা বললো, 

    — “নেই। 

    — “কী হলো? কাঁদছো নাতাশা?” 

    — “সামি ভাইয়া নেই। উনি মারা গেছে আট বছর হলো।” 

    মুখে হাত চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো নাতাশা। স্তব্ধ হয়ে নাতাশার দিকে তাকিয়ে রইলো অমিত। এক মুহূর্তেই মাথাটা কেমন ফাঁকা হয়ে গেল! এই ঘর, সামি, নবনী, ওদের দু’জনের ছবি, সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নাতাশা সবকিছু মিলিয়ে কেমন ঘোর লাগছে। টাল সামলাতে না পেরে বিছানায় বসে পড়লো অমিত। নাতাশাকে খুঁটে খুঁটে দেখছে অমিত। ও কি সত্যিই কাঁদছে? মিথ্যে বলছে না তো? তবে কি নবনীর বলা সমস্ত কিছু মিথ্যে ছিল? কেন? ও কেন মিথ্যে বললো? নবনীর কন্ঠস্বর কানে ঘন্টার মতো বেজে চলছে, নবনীর মিষ্টি ভালোবাসার গল্পটা কপূরের মতো মাথার ভেতর থেকে উড়ে যাচ্ছে। জোরপূর্বক নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে বলতে লাগলো অমিত, 

    — “নাতাশা মজা করছো না তো?” 

    — “এতটা নোংরা তামাশা কেন করবো?” 

    — “কিভাবে সম্ভব! উনি মারা গেছে! হতেই পারে না। নবনী নিজে আমাকে বলেছে উনার সঙ্গে ওর কথা হয়, দেখা হয়। এই তো গত পরশুর কথা বলি, আমাকে ও বলছিল সামির সঙ্গে কী কথা হলো। অনেক অনেক কথা আছে নাতাশা। সামি মৃত কী করে হয়? ও বেঁচে আছে। তুমি অকারণে মিথ্যা কেন বলছো?” 

    — “আমি কেন মিথ্যা বলবো বলুন তো?” 

    — “সেই’ই তো! মিথ্যেমিথ্যি এত বাজে কথা বলে কেউ? তাহলে কে বলেছে? নবনী? ও কেন মিথ্যা বললো আমাকে?” 

    — “বড় একটা সমস্যা আছে ভাইয়া।” 

    — “মানে?” 

    দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ পেতেই তড়িঘড়ি করে চোখ মুছলো নাতাশা। ভাইয়া এই ব্যাপারে আপাতত কোনো কথা হবে না। আপু চলে এসেছে। আমরা ওর সামনে আজ কিছু বলবো না প্লিজ! কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো নাতাশা। স্তব্ধ হয়ে তখনও নবনীর ঘরেই দাঁড়িয়ে রইলো অমিত ফ্রেশ হবে বলে নিজের ঘরে আসতেই অমিতের মুখোমুখি হলো নবনী। মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস বললো, 

    — “আমার বাসায় এই প্রথম এলে অথচ তোমাকে আমি সময়ই দিতে পারলাম না। কতটা সময় অপেক্ষা করতে হলো! স্যরি।” 

    — “সামি কোথায় নবনী?” 

    — “ঢাকার বাইরে। বললাম না গতকাল?” 

    নবনীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অমিত। কী স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে দিলো কথাটা! এতটা স্বাভাবিক কি মিথ্যে বলার মুহূর্তে থাকা সম্ভব?” 

    — “কী ব্যাপার? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? কোনো সমস্যা?”

    নবনীর প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না অমিত। নিশ্চুপ ঘর থেকে বেরিয়ে এল সে। জামিলা বেগমের ঘর দুই পরিবারের সদস্যদের আড্ডায় সরগরম। খাটের এক কোনায় চুপচাপ বসে আছে অমিত। এত হাসি আনন্দ কোনোকিছুই তার কানে পৌঁছাচ্ছে না। কানে শুধু এক নাগাড়ে বেজে চলছে নবনীর শোনানো সেই গল্পটা, যেই গল্পে সামি আছে, সামির পাগলামি আছে, অসীম ভালোবাসা আছে, একগাদা মিষ্টি মুহূর্ত আছে, সামি আজও বেঁচে আছে। কেন মিথ্যা বললো নবনী? মেয়েটাকে খুব বিশ্বাস করেছিল সে। খুব কাছের বন্ধু ভাবতে শুরু করেছিল। বন্ধুত্ব গাঢ় হতে না হতেই এতবড় মিথ্যাটা জানতে হলো তার! কেন করলো এমন? তাকে ঐ বাজে সিচুয়েশন থেকে বের করে আনতে এমন মিথ্যা গল্প সাজালো? নাকি তার সঙ্গে সংসার করতে চায় না বলে? আচ্ছা গল্পটার কতটুকু সত্যি কতটুকু মিথ্যা? আরও কতশত প্রশ্ন, দ্বিধা পাল্লা দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে অমিতের মনে। 

    .

    নবনী জামা বদলে, একটু করে সেজে এল জামিলা বেগমের ঘরে। নানীর পাশে বসা মাত্রই নবনীর কান টেনে ধরলেন তিনি। 

    — “তোর অনুষ্ঠানে তুই নাই। এইডা কিছু হইলো? অমিত এই প্রথম আইলো বাসায়। তোর উচিত ছিল নিজে তদারকী কইরা ওরে নাস্তা পানি দেয়া। অসামাজিক হইতাছোস দিনদিন!” 

    — “আমি ভাবলাম এত হ্যান্ডসাম নাতি পেয়ে তুমিই লাফাতে লাফাতে আপ্যায়ন করবে। তুমি যে আমার আশায় বসে থাকবে কে জানতো?” 

    — “ইশ্! আমার চোখে তোর নানারে ছাড়া আর কাউরে লাগে না।”

    — “যাহ্! অমিত, তোমার এই রূপ বৃথা। জামিলাকে কাবু করতে পারলে না!”

    নবনীর কথায় মেকি হাসলো অমিত। জামিলা বেগম বললেন,

    — “অনেক সময় পার হইছে। চলো সবাই, বসার ঘরে যাই। নবনী কেক কাটুক।” সবার শেষে ঘর থেকে বেরুলো অমিত। এই আয়োজনে বিন্দুমাত্র মন বসছে না তার। নবনী মিথ্যা বলেছে সেই কথাই প্রতি মুহূর্তে প্রচন্ড যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। এখান থেকে এক্ষুনি, এই মুহূর্তে চলে যেতে পারলে ভালো হতো। অমিত ড্রইংরুমে যেতেই শিপন অমিতকে টেনে দাঁড় করালো নবনীর পাশে। বললো, 

    — “তোমরা কাজিনরা একসঙ্গে কেক কাটো। এই অনি নাতাশা, তোমরাও পাশে গিয়ে দাঁড়াও।” 

    অমিতকে সেই কখন থেকে দেখছে নবনী। কেকের উপর ছুরি চালাতে চালাতে নিচু স্বরে সে জিজ্ঞেস করলো, 

    — “তুমি আপসেট কেন?” 

    — “কই?” 

    — “দেখছি আমি তোমাকে।” 

    — “এত বুঝো আমাকে?” 

    অমিতের মুখে কেক তুলে দিয়ে নবনী বললো, 

    — “এই কয়দিনে চেহারা দেখে তোমার মন ভালো না খারাপ অন্তত এতটুকু বুঝতে শিখেছি।” 

    নবনীর চোখে তাকাতেও হাসফাস লাগছে অমিতের। দ্রুত ওর পাশ থেকে সরে এল সে। নবনীর বাবাকে ডেকে বললো, 

    — “চাচা, অফিস থেকে কল এসেছিল। আমাকে আজই চট্টগ্রাম যেতে হবে। আমি আজ তাহলে আসি। অন্য কোনোদিন আবার আসবো নাহয়।” 

    অবাক হয়ে সমস্বরে নবনী আর শামীমা বলে উঠলো, 

    — “আজ কেন?” 

    — “জরুরি কাজ আছে। নয়টার বাস। একঘন্টার ভেতর বের হতে হবে।”

    — “এটা কেমন কথা অমিত? আজ আমার বার্থডে। তুমি বলেছিলে সব কাজ সেরে আসবে।”

    — “হঠাৎ কাজ পড়ে গেল। যেতেই হবে।”

    — “কোথাও যাওয়া চলবে না। রাতে খেয়ে আমরা একসঙ্গে বাসায় ফিরবো। তুমি কাল সকালে যাচ্ছো চট্টগ্রাম।” 

    — “তুমিও বলেছিলে সব কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে এই বাসায় আসবে। আসোনি। কাজ সেরে এতক্ষণে ফিরলে। আমি কিছু বলেছি তোমাকে?” 

    নীতু অমিতের কাঁধে হাত রেখে বললেন,

    — “বাবা তুমি কি রাগ করে চলে যাচ্ছো?”

    — “না চাচী। কী যে বলেন না! রাগ কেন করবো? ওর ব্যস্ততা থাকতেই পারে। আমি ওর ব্যাপারটা বুঝেছি, তাহলে ও কেন আমারটা বুঝবে না?” 

    ছেলের উপর কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেন এরশাদ সাহেব। 

    — “নবনীর আগামীকালই শিপমেন্ট। তাই ও আজ গিয়েছে। তোর তো আর কাল প্রোগ্রাম না। দেখ না অফিসে কথা বলে? আমরাও যাচ্ছি কাল সকালে। কাল আমাদের সঙ্গেই নাহয় চলে যাস। 

    — “না আব্বু, আজই যাবো। সঙ্গে অফিস কলিগও যাবে দুজন। ডিসিশন ফাইনাল হয়ে গেছে।

    — “কাজ পড়ে গেছে যেহেতু, যাও। কিন্তু না খেয়ে যাওয়া যাবে না। খেয়ে তারপর যাও। নীতু, টেবিলে জলদি খাবার দাও। 

    .

    শফিক সাহেব এসে হাত টেনে অমিতকে ডাইনিংরুমে নিয়ে বসালেন। মা আর কাজের মেয়ের সঙ্গে টেবিলে খাবার সাজাচ্ছে নবনী। সমস্ত মনোযোগ ওর পড়ে আছে অমিতের দিকেই। এত বিষণ্ন কেন দেখাচ্ছে ওকে? কারখানা থেকে ফিরতে দেরী হলো তাই? এই সামান্য ব্যাপার ধরে রাখার মতো ছেলে সে না। তবে কি মুনিয়া সংক্রান্ত কিছু? 

    ২৯

    অনির ঘরের বারান্দায়, দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে নবনী। মোবাইল স্ক্রিন কিছুক্ষণ পরপরই অন করে চেক করছে সে। অমিতের কল কিংবা ম্যাসেজ কিছুই আসেনি গত তিনদিনে। অন্য সময়গুলোতে সারাদিনে একবার অন্তত কথা হয়, মেসেঞ্জারে কয়েকদফা চ্যাট হয়। অথচ এইবার ঢাকার বাইরে আছে তবুও একটা ম্যাসেজ দেয়নি। এই তিনদিনে কতবার কল করলো তবুও একবারও কল রিসিভ করেনি সে। কেন এমন করছে সে? কী নিয়ে এত অভিমান তার? 

    চা হাতে পেছনে এসে দাঁড়ালো অনি। 

    — “আপু চা নাও।” 

    চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নবনী বললো, 

    — “আমার খুব অস্থির লাগছে জানো?” 

    — “দেখেই বুঝা যাচ্ছে।” 

    — “অমিত কী নিয়ে রাগ করলো সেটাই খুঁজে পাচ্ছি না।” 

    — “জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি, কিছু না বলেই কল কেটে দিলো।” 

    — “মান অভিমান হয়েছে ভালো কথা। অন্তত আমাকে বলুক কী নিয়ে এত রাগ ওর! না বললে বুঝবো কেমন করে কী হয়েছে? এভাবে রাগ পেলে পুষে রাখার কোনো মানে হয়?” 

    — “ভাইয়ার প্রোগ্রাম দুইদিন পরই শেষ। তারপর দিনই হয়তো ফিরে আসবে। আসুক ও। তারপর মাথায় দু’টো বাড়ি মেরে জিজ্ঞেস করো কেন এমন করছে?”

    — “এক কাজ করি চলো।”

    — “কী?” 

    — “চলো আমরা চট্টগ্রাম যাই।”

    — “সত্যি? যাবে তুমি?” 

    — “হ্যাঁ। আগামী ১০-১২ দিন আমার হাতে খুব একটা কাজ নেই। যা আছে 

    ওয়ার্কাররা দেখে নিতে পারবে। নাতাশা ফ্রী আছে। তোমারও পরীক্ষা মাত্রই শেষ হলো। চাচী খুব করে বলে ওখানে যেতে, চলো গিয়ে ঘুরে আসি। অমিতকেও একটুখানি শায়েস্তা করে আসি। খুব স্ট্রেস দিচ্ছে ছেলেটা আমাকে!” 

    — “আম্মুকে এক্ষুনি কল করে বলছি আমি। কবে যাচ্ছি আমরা বলো?” 

    — “কাল সকালে?” 

    — “আজ রাতেই চলো।”

    — “না, না! গোছগাছের একটা ব্যাপার আছে না? কাপড় আয়রন করতে হবে। এই কয়দিনে স্কিনের কোনো যত্নই করা হয়নি। অবস্থা শোচনীয়! আজ পার্লারে গিয়ে ফেসিয়াল, পেডিকিওর মেনিকিওর করে আসি। চলো তুমিও আমার সঙ্গে। নাতাশাকে আসতে বলি। একসঙ্গে রাতে ডিনার করে বাসায় ফিরবো।” 

    ***** 

    — “ভাইয়া আপনিই তো বললেন স্টেজ ব্যাকগ্রাউন্ড যেন হোয়াইট হয়! 

    — “আমি কখন বললাম? এটা ব্লু হওয়ার কথা ছিল। প্ল্যানিংয়ে লেখা আছে ব্লু। আমি কেন তোমাকে হোয়াইট বলবো?”

    — “আপনি বলেছেন আউটডোর স্টেজ ব্লু হবে, ইনডোর হোয়াইট।”

    — “অসম্ভব!”

    পেছন থেকে কলিগ নাহিয়ান এসে অমিতকে টানতে টানতে নিয়ে বসালো চেয়ারে। এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে বললো, 

    — “এটা খাও।” 

    এক নিঃশ্বাসে পুরো এক গ্লাস পানি শেষ করলো অমিত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে গা এলিয়ে বসলো সে। অমিতের কাঁধ হাত রেখে নাহিয়ান বললো, 

    — “কখন থেকে ডাকছি, শুনছোই না! তর্ক করেই যাচ্ছো।’ 

    — “ও ভুল করেছে তবুও কেন আমার দোষ দিচ্ছে?”

    — “ভুলটা তোমারই ছিল।” 

    — “মানে? আমি বলেছি ওকে?” 

    — “হ্যাঁ। আমি তখন সামনেই ছিলাম।” 

    — “শিট!”

    — “কী হয়েছে বলো তো? এত রেস্টলেস হয়ে আছো কেন? কোনো সমস্যা?” 

    — “জানি না।” 

    — “তুমি কাজে এত ভুল করো না। এসেছো পর থেকে কিছু না কিছু ভুল করছোই। 

    লাস্ট মোমেন্টে কোনো মেজর মিসটেক হয়ে গেলে চলবে?” 

    — “খুব দ্বিধায় আছি। কিচ্ছু ভালো লাগছে না আমার।” 

    — “দ্বিধার সমাধান হলো কথা বলা। যাকে নিয়ে, যা কিছু নিয়ে দ্বিধায় আছো তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলে মিটিয়ে নাও। যদি তার সঙ্গে কথা বলতে না পারো তাহলে অন্য কারো সঙ্গে কথা বলো, যার সঙ্গে কথা বললে একটা সমাধান পাওয়া যাবে।” 

    মোবাইল বাজছে অমিতের। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো মুনিয়ার নাম। মনের ভেতর চলতে থাকা তোলপাড় যেন দ্বিগুন হলো। গতকাল রাত থেকে এই পর্যন্ত ছয়বার কল করেছে মেয়েটা। বহু কষ্টে রিসিভ অপশন টাচ করা থেকে নিজেকে বিরত রেখেছে সে। একদিকে নবনীর মিথ্যে আজ তিনদিন ধরে তাকে এলোমেলো করে রেখেছেই। অন্যদিকে যোগ হয়েছে মুনিয়ার কল। মুনিয়াকে বারবার ফিরিয়ে দেয়া বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এতবার কল করার মানুষ মুনিয়া না। কোনো জরুরি প্রয়োজন আছে কী? তবে কি একবার মুনিয়ার কল রিসিভ করা উচিত? 

    ***** 

    — “তুই কাল ঘুম থেকে জেগেই পুরো বাসায় ঝাড়া-মোছা করবি।” 

    — “ঐটাতো ডেইলিই করি।” 

    — “আরো ভালোভাবে করবি। আমার ঘর ঝকঝকে, তকতকে দেখতে চাই। সব রুমের চাদর, পর্দা বদলে দিবি। সোফায় নতুন কাভারগুলো দিবি।” 

    — “আইচ্ছা।” 

    বাজারের লিস্ট করতে করতে স্ত্রীকে আড়চোখে দেখছেন এরশাদ সাহেব। আনন্দে আটখানা হয়ে কী থেকে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। একটু পরপরই একটা করে কাজ বের করছে আর বলছে, উফ! জলদি শেষ করতে হবে। কাল আমার ছেলের বউ আসছে। স্ত্রীর এমন পাগলামিতে বড্ড আনন্দ পাচ্ছেন এরশাদ সাহেব। কতগুলো বছর বাদে শামীমাকে এত খুশি দেখছেন ঠিক মনে পড়ছে না। মাঝের কয়েক বছর ছেলেটাকে নিয়ে কত পেরেশানিই না গেল! এই বাসা থেকে হাসি আনন্দ সব যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই অপেক্ষায় ছিলেন একটা চমৎকার হোক। দীর্ঘ অপেক্ষা বাদে মিরাকেল হয়েই গেল, নবনী নামক মিরাকেল! 

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৩০

    ৩০

    ঘড়িতে দুপুর তিনটা বাজে। এরশাদ সাহেব বাসস্ট্যান্ডে গিয়েছেন নবনীদের আনতে। বারান্দায় আধঘন্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে আছেন শামীমা। নবনী কখন আসবে তর সইছে না তার। আজ সকালে কত আগ্রহ নিয়ে অমিতকে বলেছিল নবনী আসছে। ছেলেটা কিছুই বললো না। কাজের দোহাই দিয়ে ফোন রেখে দিলো। আজব কান্ড! নবনী এই প্রথম তার বাবার বাসায় আসছে অথচ তার এক্সাইটমেন্টই নেই! ছেলের কান্ডে পুরো মুডটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল শামীমার। ইচ্ছে হয়েছিল কল করে খুব করে বকে দিতে। এই ছেলেটার সঙ্গে কিভাবে যে নবনীর ভাব ভালোবাসা হবে কে জানে! 

    পেছন থেকে এই বাসার সহযোগী শামীমাকে ডেকে বললো,

    — “খালা? কতক্ষণ দাঁড়ায়া থাকবেন? ভিতরে আইসা বসেন।’ 

    — “নাহ্! ভিতরে মন বসবে না আমার।”

    — “পোলার বউর লাইগা কত টান! কী লক্ষ্মী শাশুড়ি আপনে! এমন কইরা কে অপেক্ষা করে বউর লাইগা?” 

    — “আমার বউটাও খুব লক্ষ্মী। কতবছর পর আমার ছেলেটার সঙ্গে সব সমস্যা মিটমাট হলো! নবনীই তো করলো সব। এমন বউকে মাথায় রাখবো না তো কোথায় রাখবো? কী ইচ্ছে ছিল ওকে ধুমধাম করে আমার ঘরে বরণ করে নেয়ার! বাইরে ব্যান্ড পার্টি বাজবে, এই বাড়িটা লাইটিং করা হবে, একঘর আত্মীয়স্বজন থাকবে, আমি ওকে দুই হাতে বালা পরিয়ে দিবো, আমার দাদী শাশুড়ির বিয়ের ওড়না পরাবো, আমার ছেলে আর ও মিষ্টিমুখ করবে, অমিত ওকে কোলে করে ঘরে ঢুকবে। ওসব কিছুই হচ্ছে না! এজন্য মনটা একটু খারাপ বটে। কিন্তু তোর খালু বলেছে আর কয়েকমাস বাদে সবকিছুর একটা সমাধান হয়ে যাওয়ার পর আমরা বড় করে আয়োজন করবো। আমার একটামাত্র ছেলে না বল? ওর বিয়ে উপলক্ষে একটু আনন্দ ফূর্তি হবে না তা কি করে হয়?” 

    — “ঐ তো খালা, চইলা আইছে।” 

    বারান্দার বাইরে একবার শামীমা উঁকি দিয়ে, ঝড়ের গতিতে এসে দরজা খুলে দাঁড়ালো। আজ একটু পরই তার অমিতের বউ এই দরজার সীমানায় পা রাখবে। এত আনন্দ সে রাখবে কোথায়! 

    .

    রুক্ষ শুষ্ক চেহারা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে অমিত। কাজে ভুলগুলো যথাসাধ্য এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছে। তবুও সামলে উঠতে পারছে না ঠিক। ছোটখাটো ভুল হচ্ছেই। মনের অবস্থা যতটুকুই ছিল, গতরাতে মুনিয়ার সঙ্গে কথা বলার পর আরো বেশি এলোমেলো লাগছে নিজেকে। মাঝরাতে, নির্জন হোটেল কামড়ায় একাকিত্ব জেঁকে ধরেছিল ঠিক তখনই মুনিয়ার কল এল। নিজেকে আর কোনোভাবেই ধরে রাখতে পারলো না। রিসিভ করেই ফেললো। খুব আহামরি কথা হয়নি। সামান্য কুশলাদি বিনিময়েই কথোপকথন শেষ হয়েছে তাদের। তবে গতকালের মুনিয়া ভিন্ন কেউ ছিল। এতটা সফট টোনে মুনিয়া কথা বলতো সেই বছর তিনেক আগে। সেই পুরোনো মুনিয়া বারবার চোখে ভাসছে। পুরোনো দিনগুলো মনে পড়ছে। ফেলে আসা স্মৃতিগুলো মনের কোণে এক্কাদোক্কা খেলছে। পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখলো কেউ। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো কলিগ রুমানা দাঁড়িয়ে। — “এখনো কিছু খাননি কেন ভাইয়া?” 

    — “খাবো।” 

    — “আর কখন? সকালেও খাননি, সন্ধ্যা হয়ে গেল। এখনও না খেয়েই আছেন। না খেয়ে এত কাজ করলে গায়ে সইবে?” 

    — “সমস্যা নেই। অভ্যাস আছে আমার।” 

    — “অসুস্থ দেখাচ্ছে আপনাকে। আপনি নাহয় হোটেল থেকে রেস্ট করে আসুন। আমরা এদিকটা সামলে নিবো।”

    — “হবে না। কখন কোন কাজ পড়ে যায়! তারচেয়ে বরং থাকি এখানে।” 

    মোবাইল বেজে উঠলো অমিতের, অনি কল করছে। রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। কল ডিক্লাইন করে পকেটে রাখতেই আবারও কল এল। ইমার্জেন্সি ভেবে কল রিসিভ করলো অমিত 

    — “বল…” 

    — “আমরা ঈশা খাঁ বেইজের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। তুমি বাইরে এসো।”

    — “তোরা কারা?” 

    — “আমি, নাতাশা আর নবনী আপু।” 

    — “তোরা কেন এসেছিস?” 

    — “তোমাকে দেখতে।” 

    — “আমাকে দেখার কী আছে অনি? আমি এখন দেখা করতে পারবো না। ব্যস্ত আছি। ফিরে যা তোরা।” 

    — “আশ্চর্য! নবনী আপু এতদূর থেকে চলে এল তোমার সঙ্গে দেখা করবে বলে অথচ তুমি বলছো সময় নেই!” 

    অনির হাত থেকে মোবাইল ছোঁ মেরে নিলো নবনী। গলা চড়িয়ে বলতে লাগলো,

    — “দেখো অমিত, খুব বাড়াবাড়ি হচ্ছে কিন্তু! একের পর কল করেই যাচ্ছি রিসিভ করছো না, তোমার হয়েছেটা কী সেই কথা জানতে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম চলে এলাম তবুও তোমার সময় হচ্ছে না পাঁচ মিনিট দেখা করার? ফাজলামি করো? তুমি বাইরে আসবে নাকি আমি ভেতরে যাবো?” 

    — “এটা বি এন এস এর বেইজ। তোমাকে এখানে কখনোই এলাউ করবে না। সো, তুমি এখন বাসায় যাও।” 

    — “তুমি কি ভেবেছো ভেতরে যাওয়া আমার এলাউড না সে কথা আমি জানি না? অবশ্যই জানি এবং বন্দোবস্ত করেও এসেছি। ভেতরে ঢুকে তোমার ঠ্যাং ভেঙে যাবো, দেখতে চাও তুমি?” 

    কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো অমিত। নিচুস্বরে বললো, 

    — “আসছি আমি।” 

    .

    ভিডিও কলে নীতুর সঙ্গে কথা বলছেন শামীমা। হাসি যেন আজ তার থামছেই না। দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে নীতুর। চুপ করে শামীমার গরগর করে বলতে থাকা সমস্ত কথা শুনছে সে। বলুক, তার মেয়েকে ঘিরে কেউ এত আনন্দে আছে মা হিসেবে এই প্রাপ্তিটুকু অনেক সুখের। 

    — “আমি তো ভেবেছিলাম নবনীর বুঝি ইচ্ছে হয়েছে সমুদ্র টমুদ্র দেখার, তাই আমার এখানে বেড়াতে এসেছে। ওমা! আমাকে অবাক করে দিয়ে দুপুরে খেতে খেতে কী বললো, জানো ভাবী?” 

    — “কী?” 

    — “অমিত নাকি ওর সঙ্গে কথা বলছে না। রাগ করেছে বোধহয়! অমিতের রাগ ভাঙাতে এসেছে।”

    — “নবনী এমনই পাগলাটে। আমরা কেউ ওর উপর রেগে থাকলে কতক্ষণে রাগ ভাঙাবে তা নিয়ে উঠেপড়ে লাগে।” 

    — “তোমরা কেউ বলতে কারা? সবাই? ও যাদের চেনে তারা সবাই?” 

    — “সবাই না ঠিক। ঝগড়া বিবাদে ও নেই। কেউ ওর সঙ্গে রেগে থাকলে তা মিটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে তবে আমরা ওর কাছের যে ক’জন আছি আমাদের হিসেবটা আবার আলাদা। দিনভর পিছু পিছু ঘুরতেই থাকবে।” 

    — “এই তো কথা! আমার অমিতকেও নবনী কাছের কেউ ভাবে। নয়তো এতদূর থেকে ওর জন্য আসতো? তুমিই বলো?” 

    .

    ল্যাম্পপোস্টের নিচে মুখোমুখি অমিত নবনী। মাথানিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে অমিত। সোডিয়াম বাতির আলোয় অমিতের শুকনো মুখটায় নিষ্পলক তাকিয়ে আছে নবনী। বিষণ্ণ কন্ঠে সে বললো, 

    — “চুপ করেই থাকবে? কিচ্ছু বলবে না?”

    — “জিজ্ঞেস করেছো কিছু?” 

    — “আমি জিজ্ঞেস করলেই শুধু উত্তর দেবে, এর বাইরে কিছু বলবে না?” 

  • …………….
  • — “এত শুকনা লাগছে কেন? খাওনি সারাদিন তাই না?” 

    — “সময় পাইনি।” 

    — “চলো, আমার সঙ্গে খাবে।” 

    — “খাবো না কিছু। কাজে ফিরতে হবে।” 

    — “আমি খাবো। খিদে পেয়েছে খুব। চলো, খাওয়াবে আমাকে।”

    মানিব্যাগ থেকে দুই হাজার টাকার নোট বের করে বললো, 

    — “দশ মিনিট পরই একটা রেস্টুরেন্ট আছে। ওখানে শহরের বেস্ট শর্মা পাওয়া যায়। অনি চিনবে। খেয়ে এসো তিনজন মিলে। — “আমরা তো যাবোই, তুমিও যাবে।” 

    — “না।”

    — “দেখো, খুব আদর করে কথা বলছি। আমার কথা না মানলে কিন্তু! 

    — “নবনী, দেখা করতে চেয়েছো, করেছি। সিন ক্রিয়েট করো না।” 

    — “আমি সিন ক্রিয়েট করছি অমিত? কী নিয়ে রাগ করলে সেটা তো বলবে? হুট করে আমার বার্থডে ফেলে চলে এলে। রাগ আমার করা উচিত। অথচ রাগ তুমি করে বসে আছো! আমি এত করে সবকিছু মিটিয়ে নিতে চাইছি, তুমি কথাই বলতে চাইছো না! এতবড় কী অন্যায়টা করে ফেললাম আমি?” 

    — “জানো না?” 

    — “জানলে অবশ্যই তোমার পেছন পেছন ঘুরতাম না। সোজা ঝামেলাটাই শেষ করে ফেলতাম।”

    — “তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই। এবার বাসায় যাও।” 

    অমিতের হাত নিজের মুঠোবন্দি করে নিলো নবনী। আরো একটুখানি কাছাকাছি এসে বললো, 

    — “হাত কিন্তু আমি ছাড়বো না। কঠিন সিন ক্রিয়েট করে ফেলবো। বাইরের মানুষদের সামনে এমনটা করলে তোমার ভালো লাগবে না নিশ্চয়ই?” 

    হতাশ চোখে নবনীর দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলো অমিত। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। এগিয়ে যেতে যেতে বললো, 

    — “এবার হাত ছাড়ো?” 

    — “এত অবহেলা? হাত ছাড়ানোর জন্য কী তাড়া! আমার হাত ধরার জন্য কেঁদে কেঁদে মরবে বলে দিলাম।” 

    মুখ টিপে হাসতে লাগলো নবনী। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো অমিত। 

    — “সবকিছু তোমার কাছে ফাজলামি মনে হয়?” 

    — “যাহ্! তোমার সঙ্গে একটু মজাও করা যাবে না? রেগে যাবে এভাবে?” 

    .

    রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খাচ্ছে ওরা চারজন। নাতাশা অনি খুব সেলফি তুলছে গল্প করছে। অমিত ডানে-বামে না তাকিয়ে চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। আর নবনী সমস্ত মনোযোগ ঢেলে রেখেছে অমিতের দিকে। প্লেটে খাবার নাড়াচাড়া করতে করতে অমিতকে বললো,

    — “শীতের সময় চলছে অমিত। একটু তো স্কিনে ময়েশ্চারাইজার, ঠোঁটে ভ্যাজলিন লাগাতে পারো, তাই না? একে তো না খেয়ে মুখ শুকিয়ে রেখেছো, তার উপর ময়েশ্চারাইজারের অভাবে চামড়াও শুকিয়ে আছে। কেমন দেখাচ্ছে বলো? টিমের অপারেশন ম্যানেজার তুমি। তোমাকে থাকতে হবে ফিটফাট।” 

    — “কপালই ভালো না। চামড়া আর ঝকঝকে তকতকে রেখে করবোটা কী?” 

    — “রাগ কি কেয়ামত পর্যন্ত জারি থাকবে? মিটিয়ে নাও না ভাই! ভালো লাগছে না এসব।” 

    টেবিলের উপর অমিতের ফোন বাজছে। স্ক্রিনে মুনিয়ার নাম দেখে ভ্রু কুঁচকালো নবনী। তাকে আরো অবাক করে দিয়ে কল রিসিভ করলো অমিত। চেয়ার ছেড়ে রেস্টুরেন্টের বাইরে পা বাড়ালো সে। নবনী চোখ বড় করে চেয়ে রইলো অমিতের চলে যাওয়ার পথে। 

    .

    — “চট্টগ্রাম এসেছি কাজে। দেখা হয় না অনেকদিন। চলো মিট করি।” 

    — “না, আমি এখানে ব্যস্ত অনেক।” 

    — “জানি ব্যস্ত। আধঘন্টা সময় আহামরী কিছু তো না। তোমার ডিনার বা লাঞ্চ আওয়ারে মিট করা যায়। কিংবা তুমি রাতে হোটেলে ফেরার পর!” 

    — “দেখো এখানে আমার কলিগরা আছে। হোটেল রুমে নিশ্চয়ই তোমাকে আসতে বলবো না। আর রইলো কথা দেখা করার, সেটা ঢাকা ফিরেও করা যাবে। এই দুই চারদিন আমি মিট করতে পারবো না। তোমার সঙ্গে পরে কথা হবে। রাখছি।” অমিত কল কেটে পেছন ফিরতেই নবনীর মুখোমুখি হলো। হকচকিয়ে গেল অমিত। প্রচন্ড রেগে আছে মেয়েটা। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে রেস্টুরেন্টের দিকে পা বাড়াতে যাচ্ছিল। তার হাত টেনে ধরলো নবনী। 

    — “ঘটনা তাহলে এটা?” 

    — “কোন ঘটনা?” 

    — “তোমার টক্সিক গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে আবারও তোমার প্যাঁচ আপ হয়েছে। গার্লফ্রেন্ডের ভয়ে তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছো না, আমাকে ইগনোর করছো তাই তো?” 

    — “ওহ্ গড!” 

    কপাল চেপে হাসলো অমিত। অমিতকে ধাক্কা দিয়ে দেয়ালে সেটিয়ে নবনী বলতে লাগলো, 

    — “ইট ওয়াজ আনএক্সপেক্টেড অমিত! তুমি ওর সঙ্গে কিভাবে! মেয়েটা তোমাকে এত টর্চার করলো তবুও তুমি আবারও ওর সঙ্গে রিলেশনে! মানে কিভাবে সম্ভব! এমন মানুষকে ভালোবাসো কী করে? ওর জন্য তুমি আমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছো আর আমি গাধা অনবরত কল করেই যাচ্ছি। ভুলেই গিয়েছিলাম অমিত, মুনিয়ার পারমিশন ছাড়া কিছু করবে না। 

    — “নিজে নিজে কত কী বানিয়ে ফেলছো নবনী!”

    — “ওহ্ তুমি বলতে চাইছো আমি ভুল বুঝেছি? তাহলে আমাকে কেন ইগনোর করছো? মুনিয়ার কল কেন রিসিভ করছো? মুনিয়া তোমার সঙ্গে মিট করতে চাইতো না সেই মেয়ে এখন তোমার সঙ্গে মিট করতে চায় কেন? তোমার হোটেল রুমে এসে মিট করতে চায়! হোটেল রুমে কেন আসতে চায়, কী হতে পারে রুম জানি না ভাবছো? প্যাঁচআপ না হলে এসব কথা আসবে কেন?” 

    — “তুমি আমার কী হও? 

    — “মানে?” 

    — “জানতে চাইলাম, এই যে এতকিছু জিজ্ঞেস করছো কেন করছো? কী সম্পর্ক তোমার সঙ্গে আমার? হাজবেন্ড ওয়াইফ? না! তোমার খবর আমি জানি না কিন্তু তোমাকে আমি ওয়াইফ ভাবি না। আমরা কি বন্ধু? হ্যাঁ আমি তোমাকে বন্ধু ভাবি কিন্তু তুমি আমাকে বন্ধু ভাবো না। সো, আমরা কেউ কারো পারসোনাল ম্যাটারে জবাবদিহি করতে বাধ্য নই।” 

    অমিতের দিকে আহত চোখে নিষ্পলক চেয়ে রইলো নবনী। ওর চোখে চোখ রাখতে পারছে না অমিত। মনের কোথায় যেন অনুতাপ খচখচ করছে। ভেতর থেকে কে যেন ফিসফিস করে বলছে, একটু বেশিই বলে ফেললি না? চলে যেতে যেতে অমিত বললো, 

    — “আমার খাওয়া হয়ে গেছে। বিল পে করে যাচ্ছি। তোমরা খাবার শেষ করে যেও।” 

    ৩১

    প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বাসায় ফিরলো নবনী। মাথাব্যথার অযুহাতে রাত এগারোটায়ই লাইট অফ করে শুয়ে পড়লো বিছানায়। শামীমার একটু আধটু খটকা লাগলেও অনি, নাতাশা সামলে নিয়েছে পুরোটা। রাতে খাবার টেবিলে বসে অমিতকে ফোন করলেন এরশাদ সাহেব। 

    — “হ্যাঁ বাবা?” 

    — “নবনীরা এসেছে বাসায়, এবার তো অন্তত বাসায় আয়।” 

    — “হোটেলেই ঠিক আছি বাবা। কলিগরা আছে, ওদের সঙ্গে কাজ নিয়ে ডিসকাস করতে সুবিধা হয়। এখান থেকে বেইজ কাছাকাছি। প্রয়োজন হলে যখন তখন ছুটে যাওয়া যায়। 

    — “বাসা কি আহামরি দূরে? গাড়ি তো আছেই। যখন তখন এখান থেকেও যাওয়া যায়। রইলো কথা কলিগদের, ওদেরসহ বাসায় নিয়ে আয়।” 

    — “এত মানুষ নিয়ে বাসায় চলে আসবো এটা কেমন কথা?” 

    — “তুই চট্টগ্রাম এসেও বাসায় একবারও উঁকি দিলি না, এটা কেমন কথা? রাতে বাসায় ফিরে ঘুমালেও পারিস। তোর মা আজ কত কী রান্না করলো, তুই এত কাছে অথচ তোকে রেখে খেতে হচ্ছে। ভালো লাগে এসব?”

    — “আসবো বাবা। প্রোগ্রাম শেষ করে বাসায় থাকবো দুইদিন। পরশু কাজ শেষ হয়ে যাবে।” 

    — “রাতে খেয়েছিস?” 

    — “হ্যাঁ। নবনীরা এল, তখন একসঙ্গে খেলাম।

    — “বাইরে কিন্তু বেশ ঠান্ডা। হুডি ছাড়া কোত্থাও যাবি না।” 

    — “আচ্ছা। বাবা আমি খুব ব্যস্ত। রাখছি তাহলে।”

    কল কেটে চেয়ারে পা এলিয়ে বসলো অমিত। ঠোঁট জ্বলছে তার। শুষ্ক হাওয়ায় ফেটেছে বোধহয়! ভ্যাজলিনের একটা ছোট কৌটা সঙ্গে রাখা উচিত ছিল। ভ্যাজলিন নিয়ে ভাবতেই নবনীর কথা মনে পড়ে গেল অমিতের। ও তখন বলছিল নিজের যত্ন নিতে। এত খেয়াল করে সবকিছু মেয়েটা! মুখ দেখে বলে দিলো সারাদিন না খেয়ে আছে। জোর করে ধরে বেঁধে নিয়ে খাওয়ালো। রেস্টুরেন্টে ছিল দেখে রক্ষা! বাসায় থাকলে এতক্ষনে হয়তো নিজেই তার হাতে ময়েশ্চারাইজার ধরিয়ে দিয়ে বলতো, নাও হাতে পায়ে ঘষো। সেদিন রাতের পর থেকে সবকিছুতেই আগলে আগলে রাখে মেয়েটা। আপন ভাবে তাই আগলে রাখে। দূরের কারো জন্য নিশ্চয়ই এতটা কেয়ার করবে না। তখন বলছিল, তুমি রাগ করে আছো তাই চলে এসেছি মিটিয়ে নিতে। কেন করে এসব? বন্ধু ভাবে? যদি ভেবে থাকে তবে মিথ্যা কেন বললো? নাতাশাই বা কেন নবনীর সামনে বলতে চাইলো না? নবনী কি বাসায় কঠিন বারণ করেছে এই সত্যটা অমিতের সামনে প্রকাশ করতে? কারণটা কী? কত কত ব্লু ছিল সামনে অথচ একবারও ধরতে পারলো না নবনীর মিথ্যা! কোন প্রেমিকটা নিজের প্রেমিকাকে অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে করতে বলবে? কোন প্রেমিকটা রাত বিরাতে অন্য ছেলের সঙ্গে বাড়ি ফেরা, অন্য ছেলের প্রতি এতটা কেয়ারিং হওয়া, তার সঙ্গে রাত জেগে মুভি দেখা, বাইরে খেতে যাওয়া সয়ে যাবে? এত সহজ সবকিছু! তবে কি নবনী তাকে আলাদা করে ভাবে? মুখে শুধু বন্ধু বললেও মনে মনে মেয়েটা তাকে স্বামী হিসেবেই চায়? কী ভেবেছিল নবনী? বিবাহিতা স্ত্রী প্রেমিকের গল্প স্বামীকে শোনালে স্বামী হিংসার বশবর্তী হয়ে স্ত্রীকে কাছে পেতে মরিয়া হয়ে যাবে? অথবা এমনও হতে পারে প্রেমিক আছে জানলে সে নবনীর সঙ্গে নির্দ্বিধায় কথা বলবে, স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপারটা মাথায় আর আসবে না সেই ভাবনা থেকেই মৃত প্রেমিককে সে বাঁচিয়ে রেখেছে। ওর মাথায় কি একবারও এল না সত্যিটা জেনে গেলে অমিতের প্রচন্ড মন খারাপ হবে? এত কঠিন মিথ্যা কেউ কি করে পারে এত সাবলীলভাবে শোনাতে? নবনীকে ঠিক ধরতে পারছে না অমিত। শত দ্বিধা আর প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে প্রতি মুহূর্তে অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগছে সে। ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। একটা সুরাহা এবার করা দরকার। নাহিয়ান আর জুনিয়রদের কাজ বুঝিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলো অমিত। নাতাশার কাছে আজই সবটা জানবে সে। 

    .

    বাইরে থেকে একটু পর পর রিকশার শব্দ ভেসে আসছে। রাত অনেক গড়ালেও, এলাকার পথঘাট এখনো জেগে। গায়ে চাদর পেঁচিয়ে বারান্দায় বসে আছে নবনী। দুই হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে রেখেছে। সামি পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। অনেকটা সময় ধরে নবনী চুপ। সামিও কিছু জানতে চায়নি। প্রচন্ড মন খারাপের সময়টাতে নবনী চুপ থাকে। সামি জানে সেই কথা। তার চোখের সামনেই তো নবনীর বেড়ে উঠা। নবনীর সবটা জানে সে। নবনী খুশি হলে কী করে, রেগে গেলে কী করে, মন খারাপ হলে কী করে। এতগুলো বছর এভাবেই কাটছে দুজনের। পরস্পরের আবদারগুলো, ভালো লাগা মন্দ লাগাগুলোকে পূরণ করে, সম্মান করে, আগলে রেখে। মাথার উপর থেকে সামির হাত টেনে এনে নিজের গালের সঙ্গে মেশালো নবনী। হাতের তালুতে আলতো চুমু খেয়ে বললো, 

    — “আমার এখানে আর ভালো লাগছে না।” 

    — “কী হয়েছে? মনটা এত খারাপ কেন? “অমিতকে আমি দেখতে পারি না।”

    — “ঝগড়া হয়েছে ওর সঙ্গে?” 

    — “ও আমাকে খুব আজেবাজে বকেছে। আমি ওকে আমার বন্ধু ভাবতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু ও আমাকে বন্ধু ভাবে না। ওর রাগ ভাঙাতে চলে এলাম এতদূরে অথচ এসে দেখি ওর গার্লফ্রেন্ডের ভয়ে ও আমার কল রিসিভ করছে না। তার উপর ব্লেইম আমাকে করছে আমি ওকে বন্ধু ভাবি না, আমি যেন ওর পারসোনাল লাইফ নিয়ে কিছু না বলি। বোঝো অবস্থা! মুনিয়া মেয়েটা কত হার্ট করলো ওকে, বিট্রে করলো। কিভাবে ভেঙে পড়েছিল ও! তখন কত কী বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে স্ট্যাবল করলাম। আর এখন বলছে আমি যেন ওর পারসোনাল লাইফে ইন্টারফেয়ার না করি! খুব ইনসাল্ট ফিল করছি। কত কত কল করলাম ওকে! একটা মানুষ এত রুড কী করে হয় বুঝি না। তুমিই বলো এসবের পরও কি আমার এই বাসায় থাকা উচিত? ঢাকায় ফিরে অমিতের বাসায় যাওয়া উচিত? একদম মন বসছে না আমার এখানে।” 

    — “অমিতের মনে কী চলছে সেই খবর তুমি আমি কি জানি? হতে পারে কিছু একটা নিয়ে ও প্রচন্ড ডিপ্রেসড।” 

    — “কী নিয়ে আর হবে? আছে না একজন! ঐ মেয়েটার মতো টক্সিক একটা গার্লফ্রেন্ড থাকলে ডিপ্রেসড হবার জন্য আর কিছু লাগে নাকি?” 

    — “অমিত কিন্তু ছেলে মন্দ না। তুমি নিজেও চেনো ওকে। সবসময় তুমিই না বলতে অমিত খুব ভালো একটা ছেলে। তাহলে আজ এত মন খারাপ কেন করছো? জানোই তো ওর গার্লফ্রেন্ড খুব পাজি। হয়তো তোমার সঙ্গে মেলামেশা মুনিয়ার পছন্দ না।” 

    — “ওকে যেতে বলেছে কে ঐ মেয়ের কাছে?” 

    — “শত হোক, অমিতের প্রথম প্রেম তো! কতটা ভালোবাসে তা তুমিও জানো। এত ভালোবাসা মন থেকে মুছে ফেলা কি সহজ? ওর জীবনে অন্য কেউ নেই। সো, ও মুনিয়ার কাছে ফিরে যাবে এটা খুব স্বাভাবিক।” 

    — “তাই বলে গার্লফ্রেন্ডের কথায় আমার সঙ্গে মিসবিহেভ করবে, যোগাযোগ বন্ধ করে দিবে?”

    — “আহ্হা! তুমি আমি দু’জনেই আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছি। তেমন কিছু নাও হতে পারে। অন্য কারণ হতে পারে।

    — “আমি আন্দাজে বলছি না। আজ দেখেছি আমি ও মুনিয়ার সঙ্গে কথা বলছিল। মেয়েটা হোটেলে এসে মিট করতে চায়। তার মানে প্রেম চলছে।”

    — “আর তাতেই ধরে নিলে তোমার সঙ্গে মুনিয়া যোগাযোগ করতে বারণ করেছে। এত আগ বাড়িয়ে ভাবছো কেন? পরে যদি জানতে পারো তুমি ভুল ধারণা করে ছিলে, অমিত সত্যিই অন্যকোনো ব্যাপারে খুব স্ট্রেসড ছিল তখন তো ঠিকই মন খারাপ করে বলবে, সামি আমার খুব গিল্ট ফিল হচ্ছে। অমিত না তোমার বন্ধু? বন্ধুকে বোঝার চেষ্টা করা উচিত।” 

    — “আমি তো বুঝতে চাইলাম কতবার। ও না বললে আমি কী করবো?”

    — “অমিতের সময় প্রয়োজন। ওকে ওর মতো কয়েকটাদিন থাকতে দাও। কাজ শেষ করে ঢাকায় ফিরুক। তারপর নাহয় পরিস্থিতি বুঝে জিজ্ঞেস করো।” 

    .

    অমিত বাসায় ফিরলো পৌনে একটায়। ড্রইংরুমে বসে নাতাশা আর অনি টিভি দেখছিল। কলিংবেলের শব্দ পেয়ে অনি দরজা খুললো। অমিত পায়ের জুতোগুলো খুলেই নিজের ঘরে যেতে যেতে নাতাশাকে বললো, 

    — “আমার ঘরে এসো তো? কথা আছে।” 

    — “এখনি?” 

    — “হ্যাঁ, এখনি।” 

    অনির দিকে তাকালো নাতাশা। এতরাতে আলাদা ডেকে কী বলবে কে জানে! 

    তার উপর খুব টেনশনে আছে কিছু একটা নিয়ে সে কথা মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। অনি নিচুগলায় বললো,

    — “ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন?” 

    — “কী বলবে আমাকে? 

    — “যাই বলুক, খেয়ে তো আর ফেলবে না। চলো আমিও যাবো তোমার সঙ্গে।” সোয়েটার খুলে নিজের বিছানায় অমিত লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। দরজায় দাঁড়িয়ে অনি জিজ্ঞেস করলো, 

    — “ভাইয়া, আমি কি তোমাদের কথার মাঝে বসতে পারি?” 

    — “আয়। জিজ্ঞেস করার কী আছে!” 

    নাতাশা খাটে বসেই জানতে চাইলো, 

    — “কী হয়েছে ভাইয়া? জরুরি কিছু?”

    — “হ্যাঁ জরুরিই তো! নবনী কোথায়?” 

    — “আপুর মাথাব্যথা। ফিরেই ঘরে চলে গেল। ঘুমিয়ে গেছে হয়তো এতক্ষণে।”

    — “রাতে খেয়েছে কিছু?” 

    — “না।” 

    — “তুমি হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই বাসায় চলে এলে যে? বাবা খেতে বসেও তোমাকে আসতে বললো। তখনও কিছু বলোনি।

    — “আসলাম, নাতাশার কাছে কিছু জানার ছিল তাই।” 

    — “কী জানার ছিল?” 

    — “তোমার বোনের জন্মদিনে সামির ছবি দেখেছিলাম। তুমি বললে ছেলেটা মারা গেছে। আসলেই কি মারা গেছে?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “তাহলে নবনী আমাকে কার গল্প শোনায়?” 

    — “সামি ভাইয়ার।”

    — “কিন্তু ওর গল্পে সামি এখনো বেঁচে আছে। ও আমার সঙ্গে এমনভাবে সামিকে নিয়ে গল্প করে যেন সামির সঙ্গে ওর প্রতিদিন কথা হচ্ছে, নিয়মিত দেখা হচ্ছে। নবনী মিথ্যা কেন বললো আমাকে?” 

    — “আপু মিথ্যা বলেনি ভাইয়া। আপুর কাছে উনি এখনো বেঁচে আছে।” – “মানে? বুঝিয়ে বলো — “ভাইয়া মারা যাওয়ার পরে একবছর আপু স্বাভাবিক ছিল না। কত ডক্টর দেখালাম তবুও আপু সুস্থ হয়নি। তারপর একদিন সামি ভাইয়ার বোন এসে আপুকে খুব বোঝালো। তার ঠিক সপ্তাহ…” 

    — “নাতাশা…” 

    — “জি?” 

    — “জানি আজ জার্নি করে এসেছো। খুব টায়ার্ড তুমি। তবুও একটা অন্যায় আবদার করি?” 

    — “বলুন না!” 

    — “আমাকে শুরু থেকে বলো। নবনী কত কি-ই বলেছে আমাকে। কোনটা সঠিক কোনটা মিথ্যা আমি জানি না। সবটা ঘোলাটে লাগছে। তুমি আমাকে নতুন করে শোনাও। 

    — “আপনি এত অস্থির হয়ে যাচ্ছেন কেন?” 

    — “বুঝবে না নাতাশা। আমি রাজ্যের কাজ ফেলে এসেছি। কোনো প্রশ্ন করো না প্লিজ! আমাকে বলো ওদের গল্পটা। 

    — “ওদের গল্পটা যখন শুরু হয় আপু বেশ ছোট। সবেমাত্র গায়ে তখন ওড়না নেয়া শুরু করেছে। এইটের গন্ডি পেরিয়ে নাইনে উঠবে। ডিসেম্বর মাস চলছে। পরীক্ষা শেষে অপেক্ষা করছে রেজাল্টের। আর ভাইয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থী। চারমাস বাদে পরীক্ষা দিবে। ভাইয়ারা মাস ছয়েক আগেই আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে এসেছে ভাড়াটিয়া হয়ে। উনাদের পুরোনা বাড়িটা ভেঙে নতুন করে করা হবে তাই পাশের বাড়িতে ভাড়া নেয়া। আর আমাদের তিনতলায় ছিল ভাইয়ার কলেজ বন্ধু নাবিল ভাইয়াদের বাসা। আমাদের খুব পুরোনো ভাড়াটিয়া ছিল উনারা। সে হিসেবে আমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা খুব বেশি ছিল। বাসায় আসা যাওয়া ছিল। নাবিল ভাইয়ার সঙ্গে ছাদে কত খেলেছি আমরা! তখনকার সময়ে বিকেল হলেই ছাদে মানুষের আনাগোনা থাকতো। এক বাড়ির মানুষদের সঙ্গে অন্য বাড়ির মানুষদের ছাদে দাঁড়িয়ে গল্প চলতো। একবার হলো কি, ছাদে নাবিল ভাইয়ার সঙ্গে আমরা দুই বোন ব্যাডমিন্টন খেলছিলাম, সামি ভাইয়া উনার বোনকে নিয়ে ছাদে উঠলো। নাবিল ভাইয়াকে খেলতে দেখে আমাদের ছাদে চলে এল বোন নিয়ে। একটু কাঁচা ছিলাম তাই আমি খেলা থেকে বাদ। পুরো বিকেল জুড়ে ওরা চারজন খেললো। সামি ভাইয়া আর আপু ছিল একই টিমে। সেদিন ওদের প্রথম আলাপ, মোটামুটি একটা সখ্যতা গড়ে উঠা।” 

    — “সেদিনই কি নবনী আপু আর ঐ ভাইয়াটার মধ্যে ভালোলাগার ব্যাপারটা শুরু?”

    — “আরে নাহ্! সবে তো পরিচয় হলো সেদিন। তারপর থেকে নিয়ম করে ওরা দুই ভাইবোন আসতো আমাদের এখানে। আমরা খেলতাম, গল্প করতাম। মাঝেমধ্যে সুমনা আপু নাস্তা বানিয়ে আনতো।” 

    — “সুমনা কে? সামি ভাইয়ার বোন?” 

    — “হ্যাঁ। এরমাঝে আম্মু, নানু দুইদিন ছাদে এল। দেখলো ওদের দুই ভাইবোনকে। পরিচিত হলো। সামি ভাইয়ার আম্মুর সঙ্গেও আমাদের পরিচয় হলো। আমরা দুইবোন বাসায় ওদের গল্প করতাম, সুমনা আপুর নুডলস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের প্রশংসা করতাম। দেখতে দেখতে আমাদের মাঝে বিশাল খাতির জমে গেল। বিকেলে ওদের সঙ্গে খেলতে যাবো এই নিয়ে সারাদিন এক্সাইটেড থাকতাম। ঐ মুহূর্তগুলো এতবেশি সুন্দর ছিল! আমি যেন এখনো সব দেখতে পাই। ছাদের রেলিং ঘেষে কত কত ফুল গাছ, শীতের বিকেল, আমরা সবাই সোয়াটার গায়ে ব্যাডমিন্টন খেলছি, দুই টিমের মাঝে একটা লম্বা নেট টাঙানো, খেলতে খেলতে আমরা ঘেমে গেছি, সোয়েটার খুলে তারে ঝুলিয়ে রাখছি, সামি ভাইয়া আর নাবিল ভাইয়া খেলার ফাঁকে কী যেন বলে উঠে আর আমরা হেসে কুটিকুটি হই, সূর্যটা একটু একটু করে ডুবে যাচ্ছে। এতগুলো বছর বাদেও ঐ সময়টা আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। তবে আমাদের সবার আন্তরিকতার মাঝে নবনী আপু আর সামি ভাইয়ার আন্তরিকতা বোধহয় একটু বেশিই ছিল। মানে চোখে পড়ার মতো। ছোট ছিলাম তবে ইঁচড়ে পাকাও ছিলাম। ঐ বয়সে কে কার সঙ্গে লাইন মারতে চাচ্ছে অতটুকু বুঝতাম। নবনী আপুর তরফ থেকে শুরুতে তেমন কিছু ছিল না। তবে সামি ভাইয়াকে খুব কাছের একজন ভাবতে লাগলো। খুব কাছের বন্ধু বলা যেতে পারে। কিন্তু সামি ভাইয়ার হাবভাব ছিল অন্যরকম। বুঝতাম আমি, আপুকে বলেছিলামও। আপু সেই কথা শুনে খুব জোরে আমার কান মলে দিয়েছিল। তারপর আপুর রেজাল্ট হলো, নাইনের ক্লাস শুরু হলো। স্কুলে যাবার সময় প্রায়ই সামি ভাইয়ার সঙ্গে দেখা হতো। সেই থেকে ভাইয়ার সাথে আব্বুরও পরিচয় হলো। সেই বছর জানুয়ারিতে আপুর বার্থডে এল। প্রতিবার খুব ধুমধাম করে আমাদের দুইবোনের বার্থডে সেলিব্রেট করা হতো। সেইবার জন্মদিনে সামি ভাইয়াদের ফ্যামিলিকে আব্বু আম্মু দাওয়াত করলো। উনারা সবাই এসেছিল পার্টিতে। প্রথমবারের মতো সামি ভাইয়ার আমাদের বাসায় আসা। সেদিনের পর থেকে দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতা বাড়লো, বাসায় নিয়মিত আম্মু আর আন্টির যাতায়াত শুরু হলো। এভাবেই চলছিলো সময়গুলো। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আমরা হঠাৎ গ্রামে যাই। আম্মুর ছোট চাচা মারা গিয়েছিলেন। খবর আসা মাত্র ব্যাগ গুছিয়ে আমরা সব নানুবাড়িতে চলে গেলাম। ফিরলাম চারদিন পর। সেদিনই নাবিল ভাইয়া এসে বলে গেল সাড়ে তিনটায় যেন আপু ছাদে চলে আসে। জরুরি কথা আছে। ঠিক সাড়ে তিনটায় আপু আর আমি চলে গেলাম ছাদে। গিয়ে দেখি নাবিল ভাইয়া আর সামি ভাইয়া বাসার ছাদে। আপুকে দেখামাত্রই নাবিল ভাইয়া ছাদের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো। সামি ভাইয়াকে তাড়া দিতে লাগলো, জলদি কর। কে কখন দেখে ফেলে ঠিক নেই! সামি ভাইয়াও ঝট করে আপুর সামনে হাঁটুগেড়ে বসে পড়লো। একটা বাটি তার উপর সাদা ভাঁজ করা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বললো, তোমাকে আমি খুব মিস করেছি। একবার বলে গেলে পারতে। যাই হোক, এটা রাখো। নুডলস আছে, খেয়ে নিও। চিঠিটা চাইলে বাসায় গিয়ে পড়তে পারো। এখনও পড়লে হয়। তোমার খুশি। আর হ্যাঁ, আই লাভ ইউ।” 

    — “বাহ্! প্রপোজালটা কিউট ছিল তো।”

    মুখ কুঁচকালো অমিত। 

    — “এখনই কিউট কিউট করিস না অনি। আমারও তেমনই মনে হয়েছিল। সেই কিউটনেস এখন বিষের মতো লাগছে।’ 

    — “এভাবে বলছেন কেন ভাইয়া?” 

    — “বলছি, আগে তুমি শেষ করো।”

    — “আপু তখনও ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। একছুটে বক্স আর চিঠি নিয়ে বাসায় চলে এল। দরজা আটকে চিঠিটা আমিই খুললাম। চমৎকার হ্যান্ডরাইটিং ছিল ভাইয়ার। টানা টানা অক্ষরে লেখা ছিল, 

    সবাই ফুল দিয়ে প্রপোজ করে। আমি করলাম নুডলস দিয়ে। তুমি পছন্দ কর যে! তাই। আমি রান্না বান্না কিচ্ছু পারি না। ভাতও ঠিকঠাক রাঁধতে জানি না। তবে আজ রেস্টুরেন্ট স্টাইলে নুডলস রান্না করেছি শুধুমাত্র তোমার জন্য। তুমি আমার ভীষণ প্রিয় নবনী। মাঝে চারদিন আমাদের দেখা হয়নি, কথা হয়নি আমি কিন্তু খুব কষ্ট পেয়েছি। তুমি চলে যাওয়ার পর বুঝেছি তোমার সঙ্গে রোজ কথা না হলে আমার একদম চলবে না। ছোটবেলায় একবার নাটকে দেখেছিলাম নায়ক নায়িকাকে রোদ্দুর বলে ডাকছে। সেই থেকে আমার মাথায়ও গেঁথে গেল আমিও যাকে ভালোবাসবো তাকে রোদ্দুর ডাকবো। তোমাকে আমার রোদ্দুর ডাকতে ইচ্ছে হয় নবনী। তার মানে দাঁড়ালো তুমি শুধু আমার প্রিয় না, এরচেয়ে বেশি কিছু। তুমি আমার প্রিয় থেকে প্রেমিকা হয়ে যাও প্লিজ! তারপর শুধু নুডলস কেন তোমার সব প্রিয় খাবারগুলো আমি শিখে নেবো। তোমাকে রেঁধে খাওয়াবো। তোমার পারসোনাল বাবুর্চি হয়ে যাবো আমি। না করো না নবনী। রাজি হয়ে যাও প্লিজ! সে ইয়েস!”

    — “তারপর? আপু হ্যাঁ বলেনি?” 

    — “বলেছিল। আপু তখন আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। প্রথম প্রপোজাল পেলে সবার যা হয় আরকি! একে তো আগে থেকেই সামি ভাইয়ার বিশাল ফ্যান ছিল আপু। তার উপর এত মিষ্টি করে প্রপোজ করলো। আপু সত্যিই ভেবে নিলো ভাইয়া ওর জন্য শেফ হয়ে যাবে। ঐ বয়সে আকাশ কুসুম ভাবনা যেমনটা হয়! প্রেমিক যা বলবে তাই-ই হলো কিশোরী প্রেমিকার কাছে ধ্রুব সত্য। আপু তখন গলে শেষ! শুধু যে মুগ্ধতা কাজ করছিল কিংবা প্রেম প্রেম পাচ্ছিলো তা না। লজ্জা আর ভয়ও ছিল। লোকে জানলে কী হবে? আব্বু-আম্মু জানলে কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে? নাবিল ভাইয়া সব জানে। ওর সামনে এখন থেকে কী করে দাঁড়াবে? আর সামি ভাইয়া, ওর সঙ্গে সম্পর্কটা আজ থেকে বদলে যাবে না? প্রিয় মানুষের সামনে দাঁড়ানো খুব সহজ। কিন্তু প্রেমের শুরুর দিনগুলোতে প্রেমিকের সামনে দাঁড়ানো লজ্জাই বটে!”

    অবাক হলো অমিত। 

    — “তাই? কই আমার তো কখনো লজ্জা লাগেনি, মুনিয়ারও না। প্রথমদিন থেকে ও নিজ থেকেই আমার হাত ধরতো, চোখে চোখ রেখে কথা বলতো।

    — “বয়সের একটা ব্যাপার আছে না? আপু তখন বেশ ছোট। আর সময়ের ব্যবধানও আছে। আপুর গল্পটা ১৫-১৬ বছর আগের আর আপনার চারবছর। পুরো একযুগ ব্যবধান। এই একযুগে পৃথিবী আর মানুষজন কত বদলে গেল! শুনলাম আপনার নাকি আবার প্যাঁচআপ হয়েছে গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে?” 

    — “কে বললো? নবনী?” 

    — “হুম।” 

    — “নাহ্ তেমন কিছু না। তুমি নবনীর কথা বলো।

    — “আপু লজ্জায় সামি ভাইয়ার সামনেই দুইদিন যায়নি। ভাইয়ারও তখন কলেজ বন্ধ। একমাস পর পরীক্ষা। সকাল বেলায় দেখা হতো না। সারাদিন বাসায় বসে পড়তো। বিকেলে বের হতো আপুর সঙ্গে দেখা করতে। পরপর দুইদিন আপুকে দেখতে না পেয়ে সামি ভাইয়া ধরেই নিলো আপু উনাকে ফিরিয়ে দিবে। পরীক্ষার আগ মুহূর্তে এসে কান্নাকাটি, মন খারাপ করে পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া সব ছেড়ে দিলো। আংকেল আন্টি ভেবেছিল তাদের ছেলে পরীক্ষার দুশ্চিন্তায় এমন করছে। কিন্তু সুমনা আপু সন্দেহ করছিল। আপু আর সামি ভাইয়ার ব্যাপারটা ওর চোখ এড়ায়নি। তবে মুখোমুখি কখনো কিছু জানতেও চায়নি। সামনে পরীক্ষা, এমন সময় ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে জিজ্ঞেস করেই ফেললো নবনী আপুকে নিয়ে কোনো সমস্যা নাকি। ভাইয়াও কিছু লুকায়নি। গড়গড় করে বলে দিলো সব। আপু পরদিন দুপুরেই কেক নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির। ঘরে ঢুকেই মায়ের হাতে বক্স দিয়ে বললো, আন্টি কেক বানিয়েছি। ওদের কখনো আমার হাতের কেক খাওয়াইনি, তাই নিয়ে এলাম ওদের জন্য। আমাদের দুই বোনকে সুমনা আপু এত প্যাম্পার করে এই নিয়ে মা বেজায় খুশি। বন্ডিংটাও একদম আপন খালা ভাগনির মতই ছিল। মা আর নানুর সঙ্গে টুকটাক গল্প করে চলে এল আমাদের রুমে। খুব নিচু গলায় আপুকে বললো, সামি তিনদিন আগে কিছু বলেছিল। তুমি এখনো ওকে কিছু জানাওনি কেন? আপু লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাচ্ছিল। যেই সুমনা আপুর সঙ্গে ও রাজ্যের গল্প করতো সেই আপুর দিকে ও চোখ তুলে তাকাতে পর্যন্ত পারছিল না। সুমনা আপু ওকে কাছে টেনে বসালো নিজের পাশে। বললো, ভয় কিংবা লজ্জার কিছু নেই। আমি তোমার বন্ধুর মতই। নির্দ্বিধায় বলে ফেলো তো তুমি কী চাও?” 

    চোখ বড় করে নাতাশার দিকে চেয়ে রইলো অনি। মুখে হাত চেপে বললো, 

    — “ও মা! বড় বোন চলে এল ভাইয়ের পুঁচকে প্রেমিকার সম্মতি আছে কি না জানতে! অন্যসব বোন হলে কানের নিচে টাস করে লাগিয়ে দিতো। আমি এতবড় হয়েছি অথচ এখনো ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলার সাহস হবে না আমার কোনো ছেলেকে ভালো লেগেছে। কী জোস বোন পেয়েছে সামি ভাইয়া!”

    — “ভাইয়ার ফুল ফ্যামিলিটাই জোস। খুব লিবারেল মাইন্ডেড।” 

    — “তারপর? নবনী আপু বলেছিল উনাকে?” 

    — “আপু আমতা আমতা করেই যাচ্ছে। আমার বিরক্ত লাগছিল। আমিই সুমনা আপকে বলে দিলাম, আপু ভাইয়ার প্রপোজাল এক্সেপ্ট করেছে। কিন্তু লজ্জায় তোমাকে কিছু বলতেও পারছে না, ছাদেও যাচ্ছে না। সুমনা আপু যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। আপুকে পারে না সে কোলেই তুলে ফেলে। গাল টেনে, মাথায় আদর করে খুব রিকুয়েষ্ট করলো, আমাকে বলার দরকার নেই। কিন্তু তুমি এই কথাটা আমার ভাইকে বলবে, আজ বিকেলেই বলবে। ওর সামনে পরীক্ষা। তোমার টেনশনে ও সব ছেড়ে দিয়ে সারাদিন বাপ্পারাজ হয়ে ঘুরে। এমন করলে পরীক্ষায় ডাব্বা মারবে না বলো? তুমি চাও আমার ভাইটা ডাব্বা মারুক? জবাবে আপু বলল, না আপু। সুমনা আপু বলল, তাহলে চলে এসো ছাদে। আমি ওকে নিয়ে আসবো বিকেলে, কেমন? সেদিন বিকেলে আপুকে আমি বলে টলে পিংক কালার সালোয়ার কামিজ পরালাম, চোখে একটু কাজল দিতে বললাম।” 

    নাতাশার কথার মাঝে জোরে হেসে উঠলো অমিত আর অনি। ওদের হাসির কারণ বুঝতে বাকি রইলো না নাতাশার। সেও তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো। নাতাশার মাথায় চাটি মেরে অমিত বললো, 

    — “হাফপ্যান্ট পরে গাছে ঝোলার বয়সে বোনকে শেখাচ্ছো কিভাবে বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে যাবে। কপাল!” 

    — “আমরা দুইজন কঠিনরকমে ইঁচড়ে পাকা ছিলাম। সব নানু আর মায়ের দোষ। আমাদের সামনে বসে প্রেমের সিনেমা দেখতো। তখন প্রেম ব্যাপারটা কী যে ইন্টারেস্টিং লাগতো! আমি আর আপু প্রেমের প্রতিটা ধাপ প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। বিশেষ করে আমি একটু বেশিই পেঁকে গিয়েছিলাম। আমাদেরই বা কী দোষ বলুন? যা দেখবো তাই তো শিখবো।” 

    — “চাচী আর নানুকে ফাঁসাতে হবে না। এবার আপনি গল্পে ফিরে যান।” 

    — “তারপর আরকি! আপু সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস হয়ে ছাদে গেল। সামি ভাইয়া বিরহে প্রায় দেবদাস। আপু ভাইয়ার সামনে দাঁড়িয়ে ওড়না পেঁচাতে পেঁচাতে বললো, তুমি গতকাল যেটা জিজ্ঞেস করলে সেটার জবাব হলো “হুম”। সামি ভাইয়া বলল, হুম? হুম কী? আপু বলল, ধুর ভাইয়া! বোঝেন না কেন? ভাইয়া হেসে বলল, কী বললে? হ্যাঁ? আপু লাজুক স্বরে বলল, ঐ তো সেটাই। ভাইয়া বলল, তো স্পষ্ট করে বলো? আমি পেছন থেকে অনবরত আপুকে চিমটি কাটছিলাম, আপু আই লাভ ইউ বল, আপু আই লাভ ইউ বল। ওদিক থেকে সুমনা আপুও বারবার বলছিল, সুন্দর করে বলো নবনী। আমাদের পীড়াপীড়িতে আপু আই লাভ ইউ বলেই দৌড়।” 

    — “আর সেই থেকে নবনী আপুর লাভ স্টোরি শুরু?” 

    — “হ্যাঁ। দীর্ঘ আট বছরের অসাধারণ একটা গল্পের শুরু হয়েছিল ২৭ ফেব্রুয়ারি বিকেলে আমাদের বাসার ছাদ থেকে। নবনী আপুর ১৪ বছরের কিশোরী থেকে ২২ বছরের যুবতী হয়ে উঠা, এইচএসসি ক্যান্ডিডেট সামি ভাইয়ার এম বি এ শেষ করে ব্যবসায়ী হয়ে উঠা, দুই পরিবারের অসাধারণ একটা বন্ডিং তৈরী হওয়া, পুত্র সন্তানহীন শফিক-নীতু দম্পতির সামিকে ছেলে হিসেবে পাওয়া, আমাদের হাসি আনন্দ, মায়া, দু’জনের মিষ্টি একটা প্রেম, ওদের দু’জনকে নিয়ে আমাদের কত কত স্বপ্ন দেখা, আরো কত কী! কী না ছিল এই আটবছরে! প্রাপ্তির ঝুলি বিশাল ছিল। সবচেয়ে বেশি ছিল সুখ, পূর্ণতা।

    — “দুই পরিবার কবে জানলো ওদের কথা?” 

    — “একবছর পর। ঐ একবছরে ছাদে, রাস্তায় কিংবা দুই পরিবারের যে কোনো অনুষ্ঠানের দাওয়াতে আপু আর ভাইয়ার দেখা হতো। নানুর ফোনে লুকিয়ে প্রতিদিন পাঁচ সাত মিনিট কথা চলতো। আর প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে সারারাত জেগে চলতো ওদের ফোনালাপ। কোনো পার্টিতে কিংবা বেড়াতে গেলে আপুর কাছে ভাইয়া সবসময় জিজ্ঞেস করতো, কোন শার্টটা পরবো? রিলেশনের পর থেকে ভাইয়া কখনো আপুকে না জিজ্ঞেস করে কিছু পরেনি। ভাইয়া তার কথা রেখেছিল। এইচএসসি পরীক্ষার পর সত্যিই রান্নায় মন দিলো। আপুর সমস্ত প্রিয় খাবারগুলো শিখে নিলো। প্রায়ই আপুর জন্য এটা সেটা রান্না করে ছাদে নিয়ে আসতো। কখনো বাসায়ও চলে আসতো সুমনা আপু বা আন্টিকে নিয়ে। আমার বাসার লোকজন ধীরে ধীরে উনার ফ্যান হয়ে গেল। পরিস্থিতি গড়ালো এমন, আমার মা কোথাও বেড়াতে গেলেও সামি ভাইয়ার গল্প জুড়ে বসতো। বলতো, কী লক্ষ্মী ছেলেটা! এমন একটা বাচ্চা আমার সংসারে কেন এল না? বাবাও একই কথা বলতো। নানী তো মাঝেমধ্যে উনাকে ডেকেও পাঠাতো গল্প করবে বলে। খুব গল্প করতে জানতো ভাইয়া। বড় ছোট যে কারো সঙ্গে মিশে যেতে পারতো মুহূর্তেই। সামি ভাইয়া আপনার সঙ্গে বসে আছে আর আপনি বোর হবেন কিংবা মন খারাপ করে থাকবেন এটা হতেই পারে না। বয়স হলে মানুষ গল্প করতে চায়। নানীও ব্যতিক্রম ছিল না। সেই সুবাদে সামি ভাইয়ার সঙ্গে নানীর অন্তরঙ্গতা ছিল অন্যরকম। প্রতিটা মানুষের নাকি ত্রুটি থাকে। সামি ভাইয়ার কোনো ত্রুটি ছিল না। সুইট একটা চেহারা ছিল, স্টুডেন্ট ভালো ছিল, আর মানুষ হিসেবে আর কী বলবো? উনার আসলে কোনো তুলনা হয় না। কেউ মন খারাপ করে বসে আছে? নিজের সময় নষ্ট করে তার মন ভালো করে দিবে। কেউ টাকার কষ্টে আছে? নিজের সেভিংস থেকে টাকা দিয়ে দিবে। কেউ বিপদে পড়েছে? সবার আগে আগে উনি ছুটে যাবে। সদা সর্বদা হাসিখুশি একটা মানুষ যার কাছে তার পরিবারই সব। পরিবার বলতে শুধু নিজের মা বাবা তা কিন্তু না! পরিবার হলো আত্নীয়স্বজন সবাই মিলে যা হয়। নিজের পরিবার, প্রেমিকার পরিবারে উনি ছিলেন সবচেয়ে আলোচিত, বিখ্যাত এবং বুড়ো কচি নির্বিশেষে সবার প্রিয় একটা মানুষ।” 

    — “আচ্ছা আপু? তোমাদের রিলেটিভরাও জানতো?” 

    — “হ্যাঁ জানতো। সর্বপ্রথম আপু আর ভাইয়ার ব্যাপারটা টের পেল নানী। প্ৰায় বছরখানেক পর হঠাৎ একদিন সামি ভাইয়াকে নানু জিজ্ঞেস করে বসলো, তোমার লগে আমার বড় নাতিনের কিছু চলতাছে তাই না? দুইমাস ধইরা খুব চোখে পড়তাছে আমার। ভাইয়া অস্বীকার করেনি। উনি জানতেন নানী কখনোই আপত্তি করবে না। নানী করেওনি। হাসিমুখে শুধু বলেছিল, আমার মাইয়্যার মনে মনে খুব ইচ্ছা ছিল তোমারে নবনীর জামাই বানাইবো। কিন্তু মনে মনে একটা ভয়ও আছিলো। তোমার অন্যকারো লগে প্রেম থাকতে পারে নয়তো অন্য কাউরে মন দিয়া বসতে পারে। যাক বাবা! মাইয়্যার ইচ্ছা খোদায় কবুল করছে। আমার মাইয়্যা খুব খুশি হইবো জানলে।” 

    — “তারপর দুই পরিবার জেনে গেল?” 

    — “পরিবার বলতে শুধু দুই বাসার লোকজন। তার বাইরে কেউ না। নানী জানালো আম্মু আব্বুকে। আম্মু জানালো সামি ভাইয়ার বাসায়।” 

    — “রিএ্যাক্ট কেমন ছিল উনাদের?” 

    — “খুশি! তুমি যা চাইছো তা পেয়ে গেলে খুশি হবে না? আর সামি ভাইয়ার মতো একটা ছেলের সঙ্গে কোন মা বিয়ে দিতে না চাইবে?” 

    — “আর ভাইয়ার মা বাবা? উনারা পছন্দ করতেন আপুকে?” 

    — “এখন যেই নবনীকে দেখছো তার সম্পূর্ণ উল্টো ছিল তখন। পড়া, খাওয়া আর প্রেম ছাড়া কিছুই জানতো না সে। মোটু গোলগাল ছিল। কোনো কাজ করতে চাইতো না, শিখতেও চাইতো না। বিছানাটা পর্যন্ত গুছিয়ে রাখতো না। বিছানা, ওর পড়ার টেবিল, ওয়্যারড্রব সব আমি গোছগাছ করতাম। তবুও আন্টি আর আংকেল কেন যেন ওকে খুব আহ্লাদ করতো। ওর ফোলা গাল দু’টো আন্টি সুযোগ পেলেই টেনে দিতো আর বলতো একেবারে বাসায় চলে আসো। সারাদিন তোমার গাল টানবো।” 

    — “তার মানে উনাদের তরফ থেকেও কোনো আপত্তি ছিল না?” 

    — “একদম না! দুই পরিবারের সম্পর্ক আরো সুন্দর হলো। অঘোষিতভাবে ওদের বিয়ের সময়টা ঠিক হয়ে রইলো। তবে একটা ব্যাপার কি জানেন ভাইয়া?

    পরিবারের আস্কারা পেয়েও ওরা কখনো ওদের লিমিট ক্রস করেনি। আগে যেভাবে প্রেম করতো সেভাবেই লুকিয়ে চলতে থাকলো। আপু ইন্টারের গন্ডি পেরোবার পর শুরু হলো দুই পরিবারের নড়েচড়ে বসা। ওদের বিয়ে, সংসারের প্রিপারেশন তখন থেকেই শুরু। ভাইয়া তখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে। আংকেল একটু একটু করে ভাইয়াকে বিজনেসে ইনভলভ করতে থাকলো। আপুকে আম্মু আর নানু মিলে রান্না, সেলাই, মেহমান আপ্যায়ন শেখাতে লাগলো। সংসারে কিভাবে মানিয়ে চলতে হয় দুই মা তাদের ছেলেমেয়েকে দিনরাত শেখাতো। ঐ বাড়ির যেকোনো অনুষ্ঠানে আমার মা বাবার পরামর্শ নেয়া হতো। আমাদের বাসার অনুষ্ঠানের বেলায়ও তাই হতো। সুমনা আপুর বিয়ের সময় ভাইয়ার রিলেটিভদের চোখে পড়লো ব্যাপারটা। নিজের রক্তের আত্নীয়স্বজন রেখে বাইরের অপরিচিত দুইজনের মতামতকে খুব প্রায়োরিটি দেয়া হচ্ছে সেই ব্যাপারটা চোখ এড়ালো না কারো। কানাঘুষা শুরু হলো আর তখনই আংকেল আন্টি সবাইকে জানিয়ে দিলো আমার ছেলের হবু শ্বশুর-শাশুড়ি উনারা। তখন থেকে ঐ বাড়ির প্রত্যেকে আপু ভাইয়ার ব্যাপারটা জানে। তারপর আমার বাবাও কিছু লুকায়নি। কথার ছলে আমার চাচা, মামাদের জানালো। উনাদের কাছে শুনে শুনে পুরো পরিবার জেনে গেল। আর সেই থেকে সামি ভাইয়ার সঙ্গে আমাদের আত্মীয়স্বজনদের খুব ভাব জমে গেল। শুরুতে যারা ছেলে কালো বলে নাক সিটকে ছিল, সেই মানুষগুলোই সামি ভাইয়ার অন্ধভক্ত হয়ে গেল। আর কাজিনদের মাঝে সামি ভাইয়ার ক্রেইজ ছিল অন্যরকম। প্রতি ঈদে সামি ভাইয়ার সঙ্গে সবার একটা আড্ডা হওয়া চাই-ই চাই। কাজিনদের মধ্যে যেই ছেলেটা কথা সবচেয়ে কম বলতো সেই ছেলেটাও ঐ আড্ডা মিস করতো না। ঈদের দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় দিন দলবেঁধে সবাই চলে যেতাম কোথাও বেড়াতে কিংবা সামি ভাইয়ার বাসায়। যার যত সিক্রেট কথা ছিল সব ভাইয়া জানতো। আমরা ভুল হলে সঠিক পথটা দেখাতো, সঠিক হলে এগিয়ে যেতে ইন্সপায়ার করতো। তবে আমার মামার বাড়ির লোকজন একটু বেশিই ভক্ত ছিল উনার। বড় মামা এক কথার মানুষ। উনার ছোট মেয়েটার বিয়ে ঠিক হওয়ার পর জানা গেল তার এ্যাফেয়ার আছে। সেই নিয়ে বাড়িতে বাপ বেটির মাঝে তুমুল দ্বন্দ্ব। মামা পাত্রপক্ষকে কথা দিয়েছে, উনি আর পিছু হটবে না। ওদিকে আপুও নাছোরবান্দা, প্রেমিককে ছাড়বে না। আপু আর মামাকে সামলাতে গিয়ে আমার মা খালারা পুরো নাজেহাল তখন সামি ভাইয়া কিভাবে যেন মামাকে ম্যানেজ করে ফেললো। দরজা আটকে বাপ বেটিকে কী বললো কে জানে! মামা শান্ত হলো, আপু মামার কাছে ক্ষমা চাইলো। পাত্রপক্ষের বাড়িতে মামা সামি ভাইয়াকে নিয়েই গেল কথা বলতে। মুরুব্বি আর কাউকে নিয়ে যায়নি সঙ্গে। একটা আস্থা তৈরী হয়ে গিয়েছিল ভাইয়ার উপর। মামা প্রায়ই বলতো, ওর মাঝে আমি আমার আব্বার ছায়া দেখতে পাই। তারপর তো সব ঝামেলা মিটে গিয়ে আপুর প্রেমিকের সঙ্গেই বিয়ে হলো। কাজিনরাও সেই থেকে ভাইয়ার নাম দিলো “প্রেম নৌকার মাঝি”। বলতো, মাঝি ভাই আমাদের যখন সময় হবে তখন আপনাকেই কিন্তু আমাদের নৌকা আব্বু আম্মুর ঘাটে পৌঁছাতে হবে।”

    — “দুই পরিবারের কথা তো বললে। এবার যাদের নিয়ে গল্প, তাদের কেমিস্ট্রি নিয়ে কিছু বলো।” 

    — “আপু আর ভাইয়ার সম্পর্কের গভীরতা কখনো মুখে বলে এক্সপ্লেইন করা পসিবল না। তুমি নিজ চোখে দেখলে হয়তো ফিল করতে পারতে।” 

    — “তুমি তো দেখেছো?” 

    — “হ্যাঁ। একদম শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই আমার নিজ চোখে দেখা। যতটা কাছ থেকে আমি ওদের দেখেছি ততটা কাছ থেকে কেউ দেখেনি।” 

    — “যা দেখেছো তা থেকেই একটু আধটু বলো না!” 

    — “সবার থেকে ওদের সম্পর্কটা আলাদা ছিল জানো? সবাই বলে পিওর লাভ নাকি আজকাল এক্সিস্ট করে না। কথাটা ভুল। পিওর লাভ এক্সিস্ট করে। ওদের দু’জনের মাঝে ছিল সেই ভালোবাসা। আপুকে একটুখানি চোখের দেখার জন্য যতটা ছটফট আমি ভাইয়াকে করতে দেখেছি ততটা অস্থিরতা কখনো আপুকে স্পর্শ করার জন্য দেখিনি। রিলেশনের মাস ছয়েকের মধ্যে কিস আর বছর দেড় দুয়েকের মাঝে ফিজিক্যাল রিলেশনে যাওয়া খুবই কমন। কিন্তু ভাইয়া কিংবা আপুকে কখনো দেখিনি ওসবে জড়াতে। আটবছর লম্বা সময় ছিল। এতবছরে লোকজন প্রেম করে, সময় সুযোগ পেলেই ইন্টিমেট হয়, আবার ব্রেকআপও হয়ে যায়। ভাইয়ার সঙ্গে বাইরে মিট করতে গেলে সবচেয়ে বেশি থাকতাম আমি। আপুর হাত ধরা, কাঁধ জড়িয়ে হাঁটা ছাড়া আর কিছু কখনো দেখিনি ওদের মাঝে। তবে হ্যাঁ, প্রতি জন্মদিনে আপুর কপালে একটা চুমু ভাইয়া অবশ্যই দিতো। আর ভাইয়ার জন্মদিনে আপু চুমু দিতো উনার গালে। সবাই যখন একটু নিরিবিলিতে, রেস্টুরেন্টের কর্নার টেবিলে বসে কিংবা পার্কের সবচেয়ে নির্জন জায়গাটা খুঁজে বের করতো প্রেম করার জন্য, ওরা দু’জন প্রেম করতো হুড খোলা রিকশায়, শিশু পার্কে, শাহাবাগের রাস্তায়, পুরান ঢাকার রেস্তোরাঁয়।”

    — “নবনীও বলেছিল আমাকে কথাটা। তখন শুনে মনে হয়েছিল মানুষ তো না, যেন সাধু সন্ন্যাসী! আট বছরের রিলেশনে এত কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও নিজেকে সামলে নিলো কিভাবে? পরে আবার মনে হলো, হতেই পারে এমন। সবার ভালোবাসার ধরণটা কিন্তু সমান হয় না।” 

    — “বললাম না! ওদের গল্পটা একদম ভিন্ন ছিল। তখন রিয়েলাইজ করেছিলাম মনের অনুভূতি, মায়া যখন শরীরের অনুভূতি, কামনা বাসনা ছাপিয়ে যায় তখনই ভালোবাসায় হেভেনলি ব্লিস ফিল করতে পারবেন। সেই ভালোবাসাটাকে মনে হবে গড গিফটেড। বলছি না পার্টনারের প্রতি ফিজিক্যাল এ্যাট্র্যাকশান থাকার অর্থ সেই কাপলের মাঝে ভালোবাসা নেই। অবশ্যই আছে। কিন্তু আপু আর ভাইয়ার মাঝে যা ছিল তা খুব রেয়ার। পৃথিবীটা ঘুরে হয়তো গুটি কয়েকজনের মাঝে এমনটা পাবেন। আপু ছোটবেলা থেকেই গোলগাল ছিল। ইন্টারের পর হঠাৎ ওজন আরো বেড়ে গেল। ৮৪-৮৫ এর মধ্যে আপডাউন করতো সবসময়। সামি ভাইয়া কখনো বলেনি নবনী তুমি মোটা হয়ে যাচ্ছো কিংবা নবনী স্লিম হও। আপু অসুস্থ হয়ে চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেলেও ভাইয়া ডাকতো এ্যাই সুন্দরী, আবার বাসায় পুরোনো কাপড়, তেল দেয়া চুল, ঘামে ভেজা মুখ দেখেও বলতো এ্যাই সুন্দরী। কখনো ভাইয়ার চোখে আপুর জন্য তিল পরিমান বিরক্তি দেখিনি, রাগ দেখিনি। যতবার আপুকে উনি দেখতো আমি উনার চোখে শুধু মুগ্ধতাই দেখতাম। এতগুলো বছরে ওরা কখনো মুখোমুখি বসে ঝগড়া করেনি, কেউ কখনো গলা উঁচিয়ে কথা বলেনি, সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়নি। ঝগড়া যা হতো সব ঐ ফোনে ফোনেই। ঘন্টা দুয়েক পরই শুনতাম আবার কল করে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছে। বাইরে লাঞ্চ করতে চলে যাচ্ছে। যেদিন ঝগড়া হতো সেদিন দু’জনের বাইরে ঘুরে বেড়ানো হতো লম্বা সময় ধরে। আপুর ছোট ছোট প্রত্যেকটা ব্যাপার ভাইয়া বুঝতো। মুখ দেখে বলে দিতে পারতো নবনী এই মুহূর্তে এটা চাইছে। আপু যখন রেগে যায় তখন আমরা ওকে জড়িয়ে ধরি। আপু আর রাগ ধরে রাখতে পারে না। একবার কী নিয়ে যেন আপু খুব রেগে গেল। ভাইয়া আপুকে জড়িয়ে ধরতেই আপু ঠান্ডা। ভাইয়ার দেখাদেখি আমরা ওকে জড়িয়ে ধরি। আগলে আগলে রাখতো সবসময়। তাই বলে অন্যসব প্রেমিকদের মতো বলতো না, নবনী বৃষ্টিতে ভিজো না, নবনী আইসক্রিম খেও না, এটা করো না, ওটা করো না। আপুর সবকিছুতে ভাইয়ার হ্যাঁ ছিল। সেই সঙ্গে ঝামেলা এড়াতে সলিউশনও ছিল। যেমন ধরুন, বৃষ্টিতে ভেজার পর ভাইয়া বলতো রসুন সরিষার তেল মালিশ করে ফেলো। আইসক্রিম খাওয়ার পর বলতো এককাপ আদা চা খেয়ে নিও। কখনো কখনো ওর চুল বেঁধে দিতো। টিপ বাঁকা পরা আপুর আজনমের বদঅভ্যেস। ওর বাঁকা টিপটা সবসময় ঠিক করে দিতো ভাইয়া। কখনো যদি মা কিংবা আমি ঠিক করতে চাইতাম খুব রেগে যেত। বলতো, সামি ঠিক করে দিবে। সাধারণত ছেলেরা মার্কেটে ঘুরাঘুরি পছন্দ করে না। কিন্তু এই একটা মানুষের মাঝে আমি কখনো বিরক্তি দেখিনি। বরং আপুর জিনিস কেনার বেলায় সবচেয়ে বেশি খোঁজাখুঁজি করতো ভাইয়া। আপু ইন্টারে উঠার পর থেকে ঈদ, পহেলা বৈশাখ, ফাল্গুনের শপিং ভাইয়াকে সঙ্গে নিয়েই করতো। আমাদের দুইবোনের যত ড্রেস আর কানের দুল ছিল সব ভাইয়ার পছন্দে কেনা। দুই চারটা মার্কেট খুঁজে সবচাইতে সুন্দর জিনিসটা বের করতো আমাদের দুই বোনের জন্য। ভাইয়ার উপর আপু খুব ডিপেন্ডেড ছিল। সবকিছুতেই শুধু ভাইয়াকে খুঁজতো। দুজন ছিল দুজনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই দুইজন মানুষকে আমরা কখনো স্বপ্নেও আলাদা ভাবতে পারিনি। অথচ মাত্র আট বছরেই ওদের জার্নিটা শেষ হয়ে গেল। চিরতরে আমার বোনটা ভাইয়ার কাছ থেকে আলাদা হলো।” 

    — “এতদিন শুধু শুনেই এসেছি নবনী আপুর একটা প্রেমিক ছিল। সে মারা গেছে। কখনো ওভাবে ফিল করিনি ব্যাপারটা। এখন খুব মন খারাপ হচ্ছে জানো? বিশ্বাস হচ্ছে না উনি নেই। মনে হচ্ছে উনি আছে, আমার পাশেই বসে আছে। এত ভালো মানুষটা মারা গেল কিভাবে আপু?” 

    — “আপুর থার্ড ইয়ার ফাইনালের পর আব্বু আর আংকেল ডিসিশন নিলো ওদের এনগেজমেন্ট সেরে ফেলবে। মাস্টার্স শেষ হলেই বিয়ে। ভাইয়াও ততদিনে আংকেলের বিজনেসের হাল ধরে ফেলেছে। সেই বছর মার্চের ৩ তারিখে আপু ভাইয়ার এনগেজমেন্ট হলো। বেশ বিয়ের আয়োজনই বলা যায়। দুই পক্ষ মিলিয়ে ২৫০ গেস্ট ইনভাইট করা হলো। ভাইয়ার পছন্দে আপু সাজলো, আপুর পছন্দে ভাইয়া। উনার খুশি ছিলো আকাশছোঁয়া। আমি, ভাইয়া আর সুমনা আপু খুব নেচেছিলাম এনগেজমেন্টের আগেরদিন রাতে। নাচতে নাচতে ভাইয়া আমাকে বলছিল, তোর বোন প্রেমিকা থেকে বউ হয়ে যাচ্ছে। এবার থেকে রাস্তাঘাটে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবো, ও নবনী, আমার ওয়াইফ। আমার ভাবতেই কী চমৎকার লাগছে! সবকিছু খুব পার্ফেক্ট ছিল, অসম্ভব রকমের সুন্দর ছিল। আমরা সুখ আর স্বপ্নের মাঝে ডুবে ছিলাম। ভাবতেই পারিনি সামনে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে। এনগেজমেন্টের সপ্তাহখানেক পর ভাইয়া একদিন রাত আড়াইটায় বাসায় এল। চুল এলোমেলো, চোখে মুখে আতংক। আমরা সবাই মোটামুটি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম উনাকে এতরাতে এভাবে দেখে। ঘরে ঢুকেই বললো, নবনীকে দেখতে এসেছি। একটু কথা বলবো ওর সঙ্গে। আমরা সবাই ভাবছিলাম ঝগড়া টগড়া হলো নাকি দুজনের? হঠাৎ শুনি ভেতর থেকে ভাইয়া কাঁদতে কাঁদতে আপুকে বলছে নবনী তোমাকে ছাড়া আমি শেষ হয়ে যাবো। আমি বেঁচে থাকতে তুমি অন্য কারো হও কী করে? ভাইয়ার আওয়াজ পেয়ে আমরা সবাই রুমে গেলাম। যেই মানুষটাকে কখনো হাসিমুখ ছাড়া দেখিনি সেই মানুষটা আপুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে! এমন কী হয়ে গেল! আম্মু কী বুঝলো কে জানে! আপুকে কত কী বলে বকতে লাগলো। আপু বোকার মতো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আব্বু এসে ভাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে টুলিয়ে বিছানায় বসালো। নানী ভাইয়ার বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো, কী হইছে গো ভাই? আমার বইন তোমার লগে ঝগড়া করছে? আমাদের সবাইকে স্পিচলেস করে দিয়ে ভাইয়া বললো, স্বপ্নে দেখেছি নবনীর সাজানো ঘর সংসার, একটা বাচ্চা। কিন্তু ওর সংসার আমার সঙ্গে না। অন্য কারো সঙ্গে। খুব আনন্দ করছে ওরা। আর আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। দরজা খোলা অথচ শত চেষ্টা করেও আমি ভেতরে যেতে পারছি না। আমি এত করে নবনীকে ডাকছি ও শুনতে পাচ্ছে না। আমরা হাসবো নাকি ভাইয়াকে স্বান্তনা দিবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। সামান্য একটা স্বপ্ন দেখে কেউ এভাবে কাঁদে! পরে আমরা সবাই বুঝিয়ে শুনিয়ে ভাইয়াকে বাসায় পাঠালাম। স্বপ্নের কথা ভুলে গেলাম। কিন্তু ভাইয়া ভুলতেও পারেনি, স্বাভাবিকও হতে পারেনি। সবাইকে দেখাতো খুব চিল মুডে আছে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে কী যেন ভাইয়াকে সবসময় অস্থির করে রাখতো। আপুকে মাঝেমধ্যে বলতো, নবনী খারাপ কিছু হবে মনে হয়। ভাবতাম খুব ভালোবাসে তাই হয়তো ঐ স্বপ্নের ধাক্কা নিতে পারছে না। ঠিক দুই সপ্তাহ পর ভাইয়া আবার স্বপ্নে দেখলো, আপু চিরতরে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। ভাইয়া খুব দৌড়াচ্ছে আপুর পেছনে কিন্তু কোনোভাবেই আপুর কাছে পৌঁছাতে পারছে না। বেচারা আরো ঘাবড়ে গেল। তার দুইদিন পর আপুর খুব জ্বর হলো। প্যারাসিটামল নেয়ার পর ঘন্টা দু’য়েক ভালো থাকে। তারপর আবার সেই ১০৩-১০৪ জ্বর। ভাইয়া আর আব্বু সেদিনই আপুকে হসপিটালে নিলো। ডক্টর টেস্ট করালো। পরদিন রিপোর্ট হাতে আসতে আসতে আপুর অবস্থা আরো খারাপ। রিপোর্টে এল ডেঙ্গু পজিটিভ। ভাইয়া ভয়ে কেমন আধমরা হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল যেন আপুর আশপাশে সে আজরাইল দেখতে পাচ্ছে। বারবার শুধু বলছিল আমি দেখেছি নবনী চলে যাচ্ছে। কান্নাকাটি করে কী একটা অবস্থা! উনি ধরেই নিলো আপু মারা যাবে তাই ওসব দেখেছে। সেদিনই আপুকে হসপিটালে এডমিট করা হলো। প্লাটিলেট যতই কমছে ভাইয়ার ভয় তত বাড়ছে। আপুর টেনশনে উনি নিজেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল। দিনরাত আপুর পাশে বসে থাকতো। বারবার আপুর হাত ধরে বলতো, আমি মরে গেলে যেখানে খুশি যাও, যা খুশি করো। আমি বেঁচে থাকতে কোত্থাও যাওয়া যাবে না। তুমি নেই, এই যন্ত্রণা আমি সহ্য করতে পারবো না। উন্মাদের মতো আচরণ করছিলো উনি। আমরা আপুকে দেখবো নাকি ভাইয়াকে সামলাবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। এমনকি আপু নিজেও শুয়ে শুয়ে ভাইয়াকে স্বান্তনা দিতো আমি সুস্থ হয়ে যাচ্ছি। এইতো আর দুইটাদিন। আপুকে বাসায় আনার এক সপ্তাহ পরই ভাইয়া জেদ ধরলো নবনীকে বিয়ে করবো, এক মাসের মধ্যে করবো। দুই পরিবার খুব একটা আপত্তি করেনি। ভাইয়ার মানসিক অবস্থা দেখছিল সবাই। বিয়ের দিন ঠিক করা হলো পহেলা মে। তারিখ ঠিকঠাক হবার পর ভাইয়া অনেকটাই শান্ত হলো। বাসায় তোড়জোড় বিয়ের আয়োজন চলছে। শপিং, ওয়েডিং ভেন্যু, ফটোগ্রাফার, বাবুর্চি গেস্ট এইসব করে বিয়ের তারিখ চলে এল। হাতে আছে মাত্র একসপ্তাহ। ভাইয়া একদিন দুপুরে আপুকে বাসায় ডাকলো। আমি আর আপু গেলাম উনার বাসায়। গিয়ে দেখি কেউ নেই। আংকেল আন্টি রিলেটিভদের দাওয়াত দিতে গেছে। সুমনা আপু তখনও দেশে ফেরেনি। ভাইয়া বাসায় একা। কিছুক্ষণ আমার সঙ্গে বসে গল্প করলো। তারপর আপুকে ডেকে নিলো নিজের রুমে। প্রথমবার ভাইয়াকে দেখলাম আপুর সঙ্গে আলাদা বসে কথা বলতে চাইছে। কখনো এমন হয়নি। আমার সামনে বসেই ওরা গল্প করতো। একটু অবাক হয়েছিলাম বটে কিন্তু অস্বাভাবিক কিছুও মনে হয়নি। সপ্তাহ বাদে বিয়ে। একটুখানি অন্তরঙ্গ মুহূর্ত কাটাতেই পারে। আধঘন্টা পর আপু বেরিয়ে এল। ওর মনটা খারাপ দেখছিলাম। আমরা ঘর থেকে বেরোতে যাবো তখন দরজায় আপুর হাত টেনে খুব শক্ত করে ভাইয়া বুকে জড়িয়ে রাখলো অনেকটা সময়। আপু কত কী বললেও ভাইয়া কিচ্ছু বলেনি। উনার চোখে পানি ছলছল করছিল। আমার কী মন খারাপ হলো ভাইয়াকে দেখে! এই মানুষটা কিছু একটা নিয়ে কষ্টে আছে কিন্তু আমাদের বোঝাতে পারছে না বা আমরা বুঝতে পারছি না।” 

    — “উনি কি কোনো কারণে ডিপ্রেসড ছিলেন? ডিপ্রেশন থেকে কি সুইসাইড?” 

    — “সুইসাইড না, বলছি। পরদিন সকাল সকাল আমরা দুই বোন ভাইয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেলাম লাস্ট শপিংগুলো সেরে নিতে। শপিং শেষ হতে হতে দুপুর গড়ালো। বাইরে রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করলাম। রোড ক্রস করে অন্যপাশে গেলাম ট্যাক্সি নিতে। ট্যাক্সি ঠিকঠাক করার পর আপু বললো ব্যাগ রেস্টুরেন্টে রেখে এসেছি।” 

    বলতে বলতেই নাতাশা হঠাৎ থেমে গেল। চোখ ভিজে আসছে তার। লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে সে কাঁপা গলায় বলতে লাগলো, 

    — “ভাইয়া গিয়েছিল ব্যাগ আনতে। কী নিয়ে যেন অন্যমনস্ক ছিল উনি। বাস ছুটে আসছিল অথচ উনি খেয়ালই করেনি। আমরাও বুঝিনি ভাইয়া এখনি রাস্তায় পা রাখবে। রোড ডিভাইডার থেকে রাস্তায় নামামাত্র ভাইয়াকে বাসটা পিষে দিলো। মুহূর্তেই রক্তে ভেসে গেল পিচঢালাই রাস্তাটা। আমার বোন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ভাইয়ার দিকে। লোকজন ধরাধরি করে ভাইয়াকে ট্যাক্সিতে তুললো। তখনও উনি বেঁচে ছিল। আমার কোলে উনার মাথা। পা দুটো আপুর কোলে। উনার গায়ের শার্ট, আমার জামা, হাত ভিজে গিয়েছিল রক্তে। এমনভাবে ব্লিডিং হচ্ছিল কোথায় কেটেছে, কোথায় ভেঙেছে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভাইয়া দুইবার হাত বাড়িয়েছিল আপুর দিকে। আপুর তখনও ঘোর কাটেনি। মূর্তির মতো নিষ্পলক তাকিয়ে ছিল ভাইয়ার দিকে। তারপর আমার হাতটা ধরে বললো, নবনী যেন সুখে থাকে। ওকে আঁকড়ে রাখিস, যত্নে রাখিস। হারিয়ে যেতে দিস না। তারপর দুই মিনিটের মধ্যে ভাইয়া আর নেই। আমার হাতটা শেষবারের মতো শক্ত করে একবার চেপে ধরলো। লম্বা নিঃশ্বাস নিলো। তারপর সব শেষ!” 

    দুই ঠোঁট চেপে কাঁদছে নাতাশা। দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অনিও। নাতাশার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো অমিত। চোখজুড়ে তার বিষাদের ছায়া। কয়েক মুহূর্ত পর নাতাশার দিকে টিস্যুবক্স এগিয়ে দিলো অমিত। চোখ মুছে নাক টানতে টানতে নাতাশা বললো, 

    — “নানী বলে কিছু মানুষ থাকে যারা মারা যাওয়ার আগে টের পায় তার জীবনে কিছু একটা ঘটতে চলেছে, ভাইয়ারও বোধহয় তেমন কিছুই হয়েছিল। 

    — “ও মারা যাওয়ার পর নবনী কিভাবে সামলে নিলো নিজেকে?”

    — “কোথায় আর নিলো! এখনও বেঁচে আছে ভাইয়াকে আঁকড়ে ধরেই। ভাইয়া মারা গেছে এই খবরটা আমাকেই কল করে বাসায় জানাতে হয়েছে। আব্বু, ছোট মামা আর আংকেল গিয়ে হসপিটাল থেকে লাশ নিয়ে এল। তারপরের সময়টা না অমিত ভাইয়া কেমন ছিল সেসব মনে পড়লেও আমার নিঃশ্বাস আটকে আসে। মানুষটা শুধু মরেনি, দু’টো পরিবারকে নিঃস্ব করে রেখে গেছে। সুমনা আপুর ফ্লাইট ছিল সেদিন রাতে। উনার ভাই আর নেই এই কথাটা শোনামাত্র উনি প্ল্যান ক্যান্সেল করলো। সাফ জানিয়ে দিলো ভাইয়ের হাসিমুখের স্মৃতিই উনি নিজের কাছে রাখতে চান। তার মরা মুখ দেখার সাহস কিংবা সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াবার মতো সহ্য ক্ষমতা তার নেই। ভাইয়ার লাশ দেখে আন্টি সেন্সলেস হলো। দুইদিন পর্যন্ত জ্ঞান হারাচ্ছে, ফিরছে এই করে কাটালো। আমার নানী বারবার চাদর সরিয়ে ভাইয়ার মুখটা দেখছিল আর বলছিল, চইলা গেলা ভাই তুমি! আমার নাতিনটারে এহন আমি কী করুম কও তো? আম্মু ভাইয়ার লাশের খাটিয়ায় মাথা রেখে বসেছিল। নানীকে কিছুক্ষণ পরপর বলছিল, ওর মুখটা বারবার ঢাকছো কেন আম্মা? খোলা রাখো। আমাকে দেখতে দাও। আর তো কখনো ওকে দেখতে পাবো না। বাবা তখন লাশ কোথায় দাফন হবে, গাড়ি ভাড়া করা, কোথায় কোথায় জানাজা হবে সেসব নিয়ে ব্যস্ত। একটুখানি ভাইয়ার পাশে বসে দুঃখ করবে সেই ফুরসতটুকুও নেই। আর আমার বোন! ভাইয়ার লাশের পাশেই বসে ছিল। আংকেলের কাঁধে মাথা রেখে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল ভাইয়ার লাশটার দিকে। ও কাঁদেনি, একটুও না। কিছু বলেনি। কে কী বলছে তাও হয়তো শোনেনি। যদি জীবন বিনিময় করা যেত, আমি অবশ্যই করতাম। সামি ভাইয়া নেই এই কঠিন কথা মেনে নেবার শক্তি কিংবা দু’টো পরিবারের এভাবে ভেঙে পড়ার দৃশ্য সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। পৃথিবীটা কতখানি অসহ্য হতে পারে, জীবন কতটা নির্মম কষ্টের হতে পারে আমি সেদিনই প্রথমবারের টের পেয়েছিলাম। খুব করে চাইছিলাম ভাইয়ার আত্মাটা কোথাও থেকে খুঁজে এনে শরীরের ভেতর ঢুকিয়ে দেই, নয়তো খোদাকে বলি আমার জীবন তাকে দাও। সশরীরে মানুষটা তখনও আমার সামনে অথচ রূহ নামের অদৃশ্য একটা অংশের অভাবে এই দৃশ্যমান শরীরটাকে আমি জাগাতে পারছি না, তাকে মৃত বলতে হচ্ছে, তাকে কবরে নামানোর প্রস্তুতি চলছে এটা মেনে নেয়ার মতো না। একটু আগেও তো সে ছিল। কিছুক্ষণের ভেতর সে নেই! এই যন্ত্রণা অসীম অমিত ভাইয়া।” 

    — “নবনী সামিকে নিয়ে গল্প করে। শুনলে যে কেউ ভাববে সামি জীবিত কোনো মানুষ। ওর দেখা হয়, কথা হয় ওর সঙ্গে।”

    — “আপনি এই ব্যাপারটা জানার জন্য কখন থেকে বসে আছেন তা আমি জানি।” 

    — “হ্যাঁ, খুব দ্বিধায় আছি।” 

    — “ভাইয়ার লাশ জানাজার জন্য নেয়ার আগ মুহূর্তে কে যেন উনার গায়ের শার্ট প্যান্ট আংকেলের কাছে দিলো। আপু সেই শার্ট নিয়ে সোজা চলে গেল উপরে সামি ভাইয়ার বাসায়। আর আসেনি। ভাইয়া চলে যাবার সময়ও না। ঢাকায় জানাজা শেষে গ্রামে লাশ নিয়ে গেল দাফন করবে বলে। আপু সেখানেও যায়নি। রাতে আপুকে নিয়ে আমি আর ছোটমামী বাসায় ফিরলাম। সেই যে আপু নিজের রুমে খাটের এক কোনায় গিয়ে বসলো আর বের হয়নি ঐ ঘর থেকে। কথা বলা একেবারে বন্ধ, খাওয়া দাওয়া বন্ধ, ঘুম নেই। সারাক্ষণ শুধু ভাইয়ার শার্টটা বুকে জড়িয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকতো। আপুকে সামলানো কিংবা ওর দিকে খেয়াল দেয়ার মতো অবস্থায় আমরা কেউই ছিলাম না। আম্মু আর আমার বড় মামী থাকতো সামি ভাইয়ার আম্মার সঙ্গে। আমি, আব্বু, ছোট মামী আর নানী থাকতাম আমাদের বাসায়। কেউই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। বাবাও ভাইয়াকে মাটি দিয়ে এসে চুপ হয়ে গেল। কথা বলতো না, সারাক্ষণ নিজের ঘরে শুয়ে বসে থাকতো। রান্না নেই, খাওয়া নেই কারো। দিনরাত শুধু কান্না আর সামি ভাইয়াকে নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসা। ভাইয়ার চারদিনের মিলাদে বাসার সবাই গেল। রয়ে গেলাম শুধু আমি আর আপু। সেদিন ওয়াশরুম থেকে বের হবার সময় আপু সেন্সলেস হয়ে গেল। বাসার দারোয়ানের হেল্প নিয়ে ওকে হসপিটালে নিলাম। মানসিক চাপ, পুরো চারদিন না খেয়ে, না ঘুমিয়ে দুর্বল হয়ে গেল খুব। ওকে স্যালাইন পুশ করিয়ে বাসায় নিয়ে এলাম। তারপর থেকে নিজেকে কোনোভাবে সামলে আপুর দিকে খেয়াল রাখা শুরু করলাম। দিনে একবার না দুইবার জোর করে হয়তো মুখে কিছু একটা তুলে দিতাম। ওর সঙ্গে কথা বলতাম। বাইরে নিতে চাইতাম। রাতে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতে চাইতাম। ও কোনোকিছুতেই রেসপন্স করতো না। সপ্তাহখানেক পর বাবা গেল অসুস্থ হয়ে। আমার বাবার প্রেশার সবসময় নরমাল ছিল। ভাইয়া চলে যাওয়ার পর থেকেই বাবার হাই প্রেশারের ঝামেলাটা হলো। নানীরও ডায়বেটিস, প্রেশার সব বাড়তি। কাকে রেখে কাকে দেখবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। কে কাকে স্বান্তনা দিবো তাও জানতাম না। ছোট মামা-মামী নিজের বাসা বাড়ি ফেলে পড়ে রইলো এখানে আমাদের দেখাশুনা করবে বলে। আম্মু আর আমি পাথর হয়ে ওদের তিনজনকে আগলে রাখতে চাইলাম, পারলাম না। দুনিয়া এলোমেলো লাগে, ভেতর ফেটে কান্না পায়। আমরা চোখে পানি নিয়ে বাবা, আপু, নানীকে বুঝাতাম কেঁদো না। ভাইয়া কষ্ট পাবে। আর আংকেল আন্টির কথা কী বলবো! যেই বাবা-মা নিজের সুস্থ ছেলেটাকে এভাবে হারালো সেই বাবা মায়ের মনের অবস্থা বোঝার মতো ক্ষমতা না আমাদের আছে, না মুখে বলে বোঝানোর মতো ভাষা। আম্মু, বাবা নিয়ম করে ঐ বাসায় যেত। ছোট মামা তিনবেলা খাবার দিয়ে আসতো। কখনো উনাদের জোর করে খাওয়ানো যেত, কখনো না। আমি যেতাম না ঐ বাসায়। আমার সাহস হতো না। ভাইয়া ছাড়া ঐ বাসাটাতে গিয়ে আমি সুস্থভাবে ফিরে আসতে পারবো না এমনটাই মনে হতো। আমাদের মেয়েদের একটা ভালো দিক কি জানেন? আমরা মনের কথা প্রকাশ করতে জানি, মন খুলে কাঁদতে জানি, ভালোবাসা রাগ কষ্ট সব ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করতে জানি। কিন্তু পুরুষ মানুষ যতটা সহজে নিজের রাগ প্রকাশ করতে পারে, কষ্টগুলো অতটা সহজে প্রকাশ করতে জানে না। আমার বাবাও পারেনি নিজের কষ্টগুলো প্রকাশ করতে। ভেতরে ভেতরে দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। বাবার কলিজার টুকরা হলো আমার বোন। ভাইয়া মারা যাবার পর সেই কলিজার টুকরোর সামনে বাবা দাঁড়ায়নি ১৭ দিন। আপুর কথা শুধু জানতে চাইতো আমাদের কাছে। আপুর ঐ অবস্থা নিজ চোখে দেখার সাহস কিংবা আপুকে স্বান্তনা দেবার মতো ভাষা আমার বাবার কাছে ছিল না। থাকার কথাও না। এমন অবস্থায় একটা মেয়েকে কী বলে স্বান্তনা দিবেন আপনি?”

    — “নবনী কি একেবারেই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল? কিছুই বলতো না?” 

    — “না।” 

    — “ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওনি?” 

    — “আমরাই কথা বলতাম না তেমন। ভেবেছিলাম আপুর জন্য তো এই ট্র্যাজেডি মেনে নেয়া আরো কঠিন। তাই হয়তো কথা বলছে না। চোখের সামনে আপুর এতবড় সমস্যা হয়ে যাচ্ছে কিংবা আপুকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিতে হবে সেসব মাথাতেই আসেনি তখন। শুধু মাথায় ছিল আপুকে কোনোরকমে খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। তারপর নাহয় এসব সমস্যা ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। 

    — “বোকামি হলো খুব।” 

    — “হ্যাঁ হলোই তো। সিচুয়েশনটাই তেমন ছিল। ব্রেইন ইউজ করে কোনো স্টেপ নেয়ার মতো অবস্থা কারোই ছিল না।”

    — “তারপর নবনী স্বাভাবিক হলো কতদিন পর?” 

    — “আটবছর হয়ে গেছে ঐ ঘটনার, আপু আজও সুস্থ হয়নি।” 

    — “নবনীর সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম আছে?” 

    — “হ্যাঁ। ও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার পেশেন্ট।” 

    — “শিট! তারমানে ওর ধারণা সামি বেঁচে আছে?” 

    — “বেঁচে আছে ধারণার ব্যাপারটা একটু ভিন্ন। ও জানে পৃথিবীর সবার কাছে ভাইয়া নেই কিন্তু ওর কাছে, ওর জন্যই শুধু ভাইয়া বেঁচে আছে। ফিরে এসেছে ওর কাছে অন্য পৃথিবী থেকে।”

    — “বুঝলাম না ঠিক। কবে কিভাবে ফাইন্ড আউট করলে নবনীর সমস্যাটা? একটু ডিটেইল বলো তো আমাকে!” 

    — “এক সপ্তাহ যাওয়ার পরও আপু ঘুমাচ্ছিল না। সারারাত বসে থাকতো। তখন মামা বললো ওকে লো পাওয়ার সিডেটিভ দিতে। না ঘুমিয়ে আর কতদিন টিকে থাকবে ও! একদিন পর পর ওকে সিডেটিভ দিতাম। তা খেয়ে তিন চারঘন্টা ঘুমাতো। এভাবে ১৭ দিন চলে যাবার পর একদিন রাতে ঘুমের ঘোরে ওর সিজার অ্যাটাক হলো। আমি আপুর পাশেই ছিলাম। হঠাৎ দেখি ওর খিঁচুনি হচ্ছে। ভাইয়ার ট্রমা তখনো সামলে নিতে পারিনি। সর্বক্ষণ চোখের সামনে দেখতাম ভাইয়ার রক্তমাখা মুখ, একটুখানি নিঃশ্বাস নেবার শেষ প্রাণপণ চেষ্টা। ঠিক সেই সময়ে আপুর এই অবস্থা মনে হচ্ছিল আমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিচ্ছে। ধরেই নিয়েছিলাম এবার আমার বোনের যাওয়ার সময় চলে এসেছে। ভাইয়াকে ছাড়া ও আর কতদিন টিকবে? আমার চিৎকার শুনে সবাই ছুটে এল। ছোট মামা আপুর মাথার বালিশ সরিয়ে কাত করে শুইয়ে দিলো। মাথার কাছে বসে ডাকছিল বারবার। কিছুক্ষণ পরই আপু নরমাল হলো। তবুও ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। চোখে মুখে আতংক। বুঝাই যাচ্ছিল খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। আপুকে রাতেই হসপিটালে নেয়া হলো। ইমার্জেন্সি থেকে বলে দিলো সাইকিয়াট্রিস্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। বাসায় ফিরে বাবা খুব কেঁদেছিল। এতগুলো দিনে বাবাকে সেই প্রথম দেখেছিলাম হাউমাউ করে কাঁদতে। নানীর পায়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ছেলেটা মরে গেল কেন আম্মা? উপরওয়ালা ওকে আমাদের কাছে রেখে গেল না কেন? নিজের ছেলে ভেবে আদর করেছি ওকে। ও নেই আম্মা। নিজেকে এখন পঙ্গু লাগে। আমার নবনীকে নিয়ে আমি খুব বিপদে আছি। কী করবো এখন? আমার সমস্যা সমাধান করতো যে, সে তো চলেই গেল। আমার নবনীটার কী হবে? খোদা নিলোই যেহেতু নবনীকেও ওর সঙ্গে নিয়ে যেত। সন্তানকে জীবিত লাশ হয়ে দেখার চেয়ে মরা লাশ কবরে রেখে আসা অনেক সহজ। বয়স হয়েছে আমার, বুকের উপর এত ভারী বোঝা সয়ে যেতে পারছি না।” 

    — “নবনীকে তারপর সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওনি?” 

    — “হ্যাঁ, পরদিনই। ডক্টর কথা বলার চেষ্টা করেছিল। আপু বলেনি। ডক্টর তখনই বলেছিল ওর সিম্পটম পিটিএসডি-র সঙ্গে ম্যাচ হচ্ছে। পরদিন থেকে আপুর কাউন্সেলিং শুরু হলো, মেডিসিন নেয়া শুরু হলো। পুরো ২১ দিন পর দ্বিতীয় সেশনে আপু কথা বললো ডক্টরের সঙ্গে। তাও খুব বেশি না। হুম, হ্যাঁ, না এতটুকুই। তখন আমাদের জন্য এইটুকুই অনেক বেশি ছিল।” 

    — “চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষের এত নির্মম মৃত্যু কে সহ্য করবে? মেন্টাল ডিসঅর্ডার হওয়া খুব স্বাভাবিক।” 

    — “চোখের সামনে মৃত্যু হওয়া আর বাসের নিচে পিষে মৃত্যু হতে নিজ চোখে দেখার মাঝে বিস্তর তফাৎ। আপু তো তখনই মরে গিয়েছিল।” 

    — “ট্রিটমেন্টের পরও নবনী ঠিক হলো না কেন? প্রোপার ট্রিটমেন্ট কি ওকে দেয়া হয়নি? নাকি ঐ ১৭ দিনের দেরীটুকুই ঝামেলা বাঁধালো?” 

    — “ট্রিটমেন্টের পর ঠিক বলতে কয়েকটা সেশনের পর আপু কথা বলতো টুকটাক। স্লিপিং পিল খেয়ে লম্বা সময় ঘুমাতো। ব্যস এতটুকুই। কিন্তু দিন দিন ওর সিম্পটমগুলো আরো বাড়ছিল।” 

    — “যেমন?” 

    — “মাথাব্যথা, বমি ভাব। নিজেকে একঘরে করে রাখতো। ওর সামনে সামি ভাইয়াকে নিয়ে কথা বললেই দৌড়ে পালাতো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল। মানুষ দেখলে বিরক্ত হতো। ঘরে ভাঙচুর করতো। দুঃস্বপ্ন যেন ওর নিত্যদিনের সঙ্গী হলো। প্রায় রাতেই ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠতো। সিজার এ্যাটাক হয়েছিল আরো পাঁচবার। পড়ালেখা ছেড়ে দিলো, নিজের যত শখ আহ্লাদ ছিল সব বেমালুম ভুলে গেল। এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রতি মিনিমাম ইন্টারেস্ট ওর আর রইলো না।” 

    — “ডক্টর চেইঞ্জ করোনি?” 

    — “দশ মাসে ডক্টর দেখিয়েছি তিনজন। দিন দিন আপুর এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন মেনে নেয়ার মতো ছিল না। এমন কিছু বাদ নেই আপুর জন্য আমরা করিনি। সামি ভাইয়া মারা যাওয়ার আগে বলেছিল নবনীকে হারিয়ে যেতে দিস না। চোখের সামনে আপু হারিয়ে গিয়েছিল অথচ আমরা ওকে আঁকড়ে রাখতে পারিনি। নিজেকে অসহায় তো লাগতোই, সন্তানকে সুস্থ করার আব্বু আম্মুর লাগাতার ব্যর্থ চেষ্টা আর হাহাকার আমাকে আরো শেষ করে দিচ্ছিল। আমি নিজেও ছয়মাস সাইকিয়াট্রিস্টের আন্ডারে ছিলাম। আপু সারাটাদিন রুমের ভেতর পর্দা আটকে এই কোণায়, ঐ কোণায় বসে থাকতো। আমরা কোনো প্রয়োজন ছাড়া গেলে ও খুব রেগে যেত। প্রয়োজনের বাইরে কিছু বলতে গেলে হয় আমাদের ঘর থেকে বের করে দিত নয়তো ও নিজেই বেরিয়ে যেত। খাওয়াদাওয়া করতো না। প্রতিদিন ওর পছন্দের সব খাবার আম্মু রান্না করতো। সারাদিন মিলিয়ে একবেলা মুখে খাবার নিতো। তাও কোনোরকমে। হাসতো না, কাঁদতোও না। নবনীকে সুস্থ করতে হবে সেই ভাবনা থেকে মামা, খালারা, কাজিনরা কয়দিন পরপরই চলে আসতো ওর সঙ্গে কথা বলতে। ও দরজাই খুলতো না। ৮৫ কেজির নবনী শুকিয়ে ৫০ কেজিতে নেমে এল। এরমাঝে হসপিটালাইজড হয়েছে তিনবার। অসুখে জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল ও। ভিটামিন ডেফিসিয়েন্সি, লো বিপি, লো হিমোগ্লোবিন, ডিহাইড্রেশন থেকে ইউরিন ইনফেকশন, জ্বর এগুলো ওর সঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে লাগলো। কতদিন হাঁটতে হাঁটতে সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেছে ফ্লোরে!” 

    — “ডক্টর বদলানোর পরও কাজ হলো না?” 

    — “নাহ্! কোনো মেডিসিন, কাউন্সেলিং, থেরাপী কিছুই আপুর কাজে আসছিল না। চরম হতাশার মাঝে দিন পার করছিলাম। আমার মনে আছে, শেষ যেইবার আপুকে হসপিটালে এডমিট করা হলো সামি ভাইয়ার আম্মু এসেছিল আপুকে দেখতে। আম্মু তখন আন্টিকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল আমার মেয়ে তো মরে গেছে সামির সঙ্গেই। শরীরটা শুধু পড়ে আছে এখানে। সেটাও চলে যাবে। সময় ঘনিয়ে আসছে বোধহয়। চোখের সামনে মেয়েটা এভাবে শেষ হয়ে গেল আমি সহ্য করতে পারি না আপা। তারচেয়ে বরং ও চলে যাক, এসব থেকে মুক্তি পাক। আমাকেও মুক্তি দিক। মানুষের এত দোয়া, চেষ্টা উপরওয়ালা ফিরিয়ে কেন দিচ্ছে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যে যা করতে বলেছে আমরা তাই করেছি শুধু এই আশায় আমার বোনটা ফিরে আসুক। সব চেষ্টার পরও যখন আপু ঠিক হচ্ছিল না আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। আপু এভাবেই অসুখে বিসুখে একদিন মরে যাবে সেই দিন গুনছিলাম। আপু শেষবার রিলিজ নিয়ে বাসায় ফেরার একসপ্তাহ পর সুমনা আপু এক বিকেলে হাজবেন্ড, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আমাদের বাসায় এসে হাজির। নবনী আপু খুব একটা কথা বলতে চায়নি। কুশলাদি জিজ্ঞেস করেই নিজের ঘরে চলে গেল। সুমনা আপু সবসময় একটু নাছোড়বান্দা স্বভাবের। নিজের কাজ উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকবে। সেদিনও তাই করলো। আপুর পেছন পেছন গিয়ে দরজা আটকে দিলো। কয়েক মিনিট পরই নবনী আপুর চিৎকার শুনেছিলাম, তুমি এক্ষুনি ঘর থেকে বের হও। আমি ঐ ব্যাপারে একটা কথাও শুনতে চাই না, এসব আরকি! কিছুক্ষণ পর আপু থেমে গেল। আর কোনো শব্দ আমরা পাই না। ঘন্টা দেড়েক পর শব্দ পেলাম আপু চিৎকার করে কাঁদছে, তুমি আমাকে মাঝরাস্তায় ফেলে চলে কেন গেলে সামি? ফিরে এসো প্লিজ! ভাইয়া মারা যাওয়ার পুরো ১০ মাস পর আপু কেঁদেছিল। আব্বু আম্মু সবাই রুমে যেতে চেয়েছিল। সবাইকে রেখে সুমনা আপু শুধু আমাকে রুমে যেতে দিলো। আমি অবাক হয়ে সুমনা আপুকে দেখছিলাম। কী এমন বললো উনি যে আপু স্বাভাবিক মানুষের মতো কাঁদছে। এতগুলো মাসে কতভাবে চেষ্টা করলাম আপু একটু কাঁদুক অথচ ও কখনোই কাঁদেনি। আপুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী এমন বললে তুমি? ও আমাকে কিছুই বলেনি। শুধু বললো, এত জেনে কী হবে! বাদ দাও সেসব। যতক্ষন খুশি কাঁদুক। একদিন, একসপ্তাহ, একমাস যতদিন খুশি। ওকে বাঁধা দিও না। এবার যদি একটুখানি স্বাভাবিক হয় মেয়েটা!” 

    — “উনি সাইকিয়াট্রিস্ট?” 

    — “নাহ্।

    — “স্ট্রেঞ্জ! তারপর?” 

    — “টানা ১২ দিন আপু কান্নাকাটি করে কাটালো। কখনো চিৎকার করে, কখনো ফুঁপিয়ে। ঐ কয়েকদিনে আপুর মেজাজ খিটখিটে হতে দেখিনি। আমরা সবাই যখন খুশি ওর পাশে বসেছি ও রিএ্যাক্ট করেনি। এমনকি ও আম্মু আর নানীকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, সামি কি ফিরে আসবে না? ও আসবে না কেন? আমার ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র অভাব ছিল? তুমিই বলো? এতগুলো মাস পর আপু ওদের গা ঘেঁষে বসেছে, জড়িয়ে ধরেছে। আমরা সবাই খুশিতে আত্মহারা। ১২ দিন পর ১৩ দিনের সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি আপু ভাইয়ার শার্ট পরে ঘুমাচ্ছে। ১০ টার দিকে ডাকলাম নাস্তা খাওয়ার জন্য। আপু ঘুম থেকে উঠলো, ফ্রেশ হলো, নাস্তার টেবিলে এল। ও কাঁদছে না, মন খারাপ করে নেই, হাসিমুখে কথা বলছে, নাস্তা করছে। একরাতের মধ্যে আপু অস্বাভাবিক রকমে স্বাভাবিক হয়ে গেল। বিশ্বাস হচ্ছিল না কারো। আপু সুস্থ হয়ে গেল কেমন করে? ধরেই নিলাম এতদিন আমরা যেই মিরাকেলের আশায় বসে ছিলাম সেই মিরাকেল হয়ে গেছে। আপু সুস্থ হয়ে গেছে। খুশিতে আমরা কী রেখে কী করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। আম্মু সুমনা আপুকে কল করে সে কী কান্না! আপুর জন্য আমার বোন সুস্থ হয়েছে এই কৃতজ্ঞতা আমরা কিভাবে প্রকাশ করবো!” 

    — “আমি কিছু একটা গেস করছি। ও চাচী আর নানীকে বলছিল সামি ফিরবে কবে? ও অপেক্ষায় ছিল সামি ফেরার। সেদিন রাতে ও প্রথম দেখেছে সামি ওর সামনে দাঁড়িয়ে? আই মিন হার ফার্স্ট হ্যালুসিনেশন?” 

    — “ইয়েস! আমরা একদম বুঝিনি মিরাকেলটা আসলে কী ছিল। প্রথম দুইদিন খুব ভালো কাটলো। খুব মানে খুব। মৃত সন্তান জীবিত হয়ে ফিরে আসা যেমন অসম্ভব, আপুকে সুস্থ ভাবে ফিরে পাওয়া আমার আম্মু আব্বুর কাছেও ঠিক তেমনই ছিল। আপু নরমাল বিহেভ করছে তাতেই আমরা খুশি। কেন হলো কিভাবে হলো সেসব কিছুই ঘাটাঘাটি করিনি। কতটা দিন পর আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েছি! একঘুমে আমার সকাল হয়েছে।” 

    — “কবে জানলে নবনীর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে?” 

    — “তিনদিন পরই। ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম জরুরি কাজে। ফিরতে ফিরতে দুপুর তিনটা বাজলো। ততক্ষণে সবাই খেয়ে দেয়ে যার যার রুমে। দরজা খুলেছিল কাজের মেয়ে। ভেবেছিলাম আপুও হয়তো ঘুমাচ্ছে। সেজন্য কোনো শব্দ না করে পা টিপে টিপে রুমে গেলাম জামা ছেড়ে ফ্রেশ হতে। রুমে ঢুকতেই দেখি আপু জানালার দিকে মুখ করে হেসে হেসে একাই কথা বলছে। ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। আপু তো সুস্থ হয়ে যাচ্ছে তাহলে আবার একা একা কথা কেন? এই সমস্যা তো ছিল না। এটা হলো কেন? আমি দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করছিলাম আপু কী বলছে। ঠিকঠাক শুনতে পাইনি। খুবই নিচুগলায় কথা বলছিল। আপুকে আমি ডাকিনি, কিছু বলিওনি। আপু এতটাই কথা বলায় ডুবে ছিল যে আমি ওর পেছনে হাঁটছি, ড্রেস চেইঞ্জ করছি ও একদম টের পায়নি। রাতে আমি আব্বু আম্মুকে বললাম। পরদিন আমরা ডক্টরকে জানালাম। উনি সবটা শুনে একটু রাগ করলো। বললো, নবনী সুস্থ হয়েছে কি না সেটা ডিসাইড করবো আমি। আমার সঙ্গে কনসাল্ট না করে আপনারা কিভাবে বলছেন ও সুস্থ হয়ে গেছে? এডুকেটেড পারসনের কাছে এমনটা আশা করা যায় না। আপনাদের উচিত ছিল আমাকে ইমিডিয়েটলি জানানো। কালই নবনীকে আমার চেম্বারে নিয়ে আসবেন। রাতে আমার ঘুম ভাঙলো। ওয়াশরুমে যাবো। ঘরে ডিম লাইট জ্বলছিল। মোটামুটি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল সব। চোখ মেলে দেখি আপু এমনভাবে হাত উঁচু করে রেখেছে, দেখে মনে হচ্ছিল কেউ ওর হাত ধরে রেখেছে। ও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে। মাথা দুলিয়ে কথা বলছিল, কথার ফাঁকে হাসছিল। ভীষণ ভয় পেয়েছিলাম আমি। দুপুরে ভেবেছিলাম আপু একাই কথা বলছে। রাতের বেলা মনে হলো আপু একা না। ওর সঙ্গে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ভূতের ভয় কখনো ওভাবে লাগেনি। কিন্তু সেদিন রাতে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে এল। কোনোরকমে ছুটে গিয়ে নানীর ঘরে গেলাম। উনাকে ডেকে সব বলতেই উঠে এল আপুকে দেখতে। আপু তখনও কথা বলছেই। নানী ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে, তুমি কার লগে কথা কইতাছো বইন? আপু খুব মিষ্টি করে হেসে বললো, কে আবার! সামি এসেছে। নানী আর আমি নিজেকে কিভাবে যে সামলেছি তা আপনি আন্দাজও করতে পারবেন না। যেই মানুষটা নেই প্রায় এক বছর হয়ে গেছে তার সঙ্গে কি না আমার বোন গল্প করছে! আমরা আর একটা কথাও বাড়াইনি। দুজনেই চলে গেলাম বসার ঘরে। কী হচ্ছে, আপু কী বলছে সেগুলো বুঝার জন্য নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া দরকার ছিল। ওরকম একটা সিচুয়েশনে সর্বপ্রথম মাথায় যেটা এল তা হলো ভূতের খেয়াল। দুজনই সামি ভাইয়ার আত্মা এসেছে ওসব আওড়াচ্ছিলাম। পাঁচ মিনিট পর নানী এক গ্লাস পানি খেয়ে এসে আমাকে ধমক দিলো, ঐ আমি নাহয় বুড়া মানুষ, এতকিছু মাথায় ধরে না। আবোল তাবোল কই। তাই বইলা তুইও কইবি? তখন আমারও বোধহয় জ্ঞান বুদ্ধি একটুখানি ফিরে এল। আপু অসুস্থ ছিল এটা আমরা কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছিলাম। বুঝতে পারলাম এটাও আপুর অসুস্থতারই একটা অংশ। ওর হয়তো হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। আর দুই তিনদিন ধরে আপুর মাঝে যা পরিবর্তন তা হচ্ছে শুধুমাত্র হ্যালুসিনেশনের কারণে। আপনি যাকে হারিয়ে অসুস্থ হয়েছেন, অস্বাভাবিক আচরণ করছেন সেই মানুষ আপনার কাছে ফিরে এলে আপনি কি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবেন না?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “আপুর বেলায়ও তেমনটাই হলো। আপুর নতুন এক রোগ পুরোনো রোগ থেকে মুক্তি দিলো।” 

    — “স্ট্রেঞ্জ!” 

    — “পরদিন ওকে আমরা ডক্টরের কাছে নিয়ে যাই। আমি ডক্টরকে জানাই আগের রাতের কথা। তারপর উনি ট্রাই করেছেন এই ব্যাপারে কথা বলতে, আপু বলেনি ডক্টর আমাদের বললো, ওর হ্যালুসিনেশন হচ্ছে আর এটা ওর রোগেরই একটা অংশ। কল্পনায় সামি ভাইয়ার যে কথাগুলো আপু শুনতে পায়, যেভাবে উনাকে দেখতে পায় সেগুলো আপুরই নিজস্ব ভাবনা। আপু যা শুনতে চায় বা সামি ভাইয়া এই পরিস্থিতিতে কী বলতে পারে সেই ধারণা থেকেই আপু কথাগুলো ভাইয়ার কাছ থেকে শোনে। আপু ঐ কথা শুনে আর এক সেকেন্ডও ওখানে বসেনি। উঠে চলে এল। চেম্বার থেকে বেরোনোর আগে ডক্টরকে খুব শান্তভাবে বলে এল, আপনাকে চাইলে আমি সবটা বলতে পারতাম। বলিনি কেন জানেন? আপনি শুধু ডাক্তারি বিদ্যায় বিশ্বাসী, মিরাকেলে না। আমার কোনো হ্যালুসিনেশন হয়নি। যাকে দেখছি, কথা বলছি, সে সত্যি। কাউকে ভালোবেসেছেন কখনো? কেউ কখনো বেসেছে আপনাকে? যারা ভালোবাসে তাদের মাঝে কখনো বিচ্ছেদ আসে না। ওকে ফিরে আসতেই হতো। আমাকে না দেখে, কথা না বলে কখনো থেকেছে ও? না আমি থেকেছি? আমি ওর ভীষণ প্রিয়। আমাকে ফেলে কিভাবে থাকবে ও?”

    — “ওহ! ও ভাবতো সামি ফিরে এসেছে। আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো মেনেই নেয়নি সামি মারা গেছে।

    — “এই ধারণার শুরুটা কী করে হলো, জানেন?” 

    — “কিভাবে?” 

    — “সুমনা আপু ওকে কী কী বলেছিল সব কথা আমরা আজও জানি না। তবে কিছু কথা জানি। সুমনা আপুই ওকে বলেছিল, সামি সশরীরে নেই তাই বলে ভেবে নিবি সম্পর্ক শেষ, ভালোবাসা শেষ? ভালোবাসা আজও বাকি আছে। যারা শুধু চোখের দেখায় ভালোবাসে তাদের ভালোবাসা হারিয়ে যায়। তোরা তো মন থেকে একজন অন্যজনকে ভালোবেসেছিলি। সামি তোর সামনে আর নেই, আর কখনো ওকে দেখতে পাবি না বলে ভেবে নিলি তোদের ভালোবাসা মরে গেছে? যারা ভালোবাসে ওদের বিচ্ছেদ বলতে কিছু নেই। ও তোর মাঝে, তোর জীবনের সঙ্গে মিলেমিশে আছে। চোখটা বুজে একবার ওকে ভালো করে খুঁজে দেখ না! তোর সবকিছুতেই ওকে খুঁজে পাবি। সবার জন্য ও মরে গেছে, তুই নাহয় ওকে বাঁচিয়ে রাখ তোর মাঝে। আগে যেমনটা ভালোবাসতিস ঠিক তেমনি আজও ভালোবাসবি। আমার ভাই এখানে নেই তাতে কী? আছে তো কোথাও না কোথাও। সেখানে বসে দেখছে তোকে। ভালোবাসছে তোকে। ধরে নে সাময়িক একটা বিচ্ছেদ হয়েছে তোদের। এই জীবনটা কেটে গেলে আবার দেখা হবে তোদের।”

    — “আপুর কথাগুলো ও ভুলভাবে নিলো?” 

    — “হ্যাঁ। সুমনা আপু কল করেছিল নবনী আপুর খোঁজ নিতে, তখন মা বলছিল আপুর অবস্থা। আপু শুনে থ! তখনই আপু বললো ঐ কথাগুলো। আপু নিজেও বুঝতে পারেনি নবনী আপু কথাগুলো এভাবে বুঝবে। উনি বুঝাতে চাইছিল ভালোবাসা কখনো মরে যায় না। মানুষটা নেই তাতে কী? তুই না হয় ওকে ভালোবেসে বাঁচিয়ে রাখ মনের ভেতর, নিজের মাঝে অনুভব কর। আর আমার বোন ধরে নিলো, ভালোবাসায় বিচ্ছেদ নেই তার মানে ভাইয়ার সঙ্গে ওর আবার দেখা হবে, উনি ফিরে আসবে। ঐ কয়টাদিন ধ্যান-জ্ঞান করলো এই নিয়ে। গোটা একজীবন অপেক্ষা করার সহ্য ক্ষমতা আপুর ছিল না। আপু চাইছিল ভাইয়া যেখানেই আছে ওর কাছে চলে আসুক। এক্ষুনি আসুক। দিনরাত অপেক্ষা আর ধ্যান জ্ঞান করার ফল হলো আপুর হ্যালুসিনেশন।”

    — “ঐ ঘটনার এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল! এতদিনের ট্রিটমেন্টের পরও নবনী সুস্থ হলো না!”

    — “আপু ট্রিটমেন্টই করেনি।” 

    — “কেন?” 

    — “কেন করবে? ও কি অসুস্থ? ওকে ট্রিটমেন্টের কথা বললেই বাসায় খুব ঝামেলা করতো, অসুস্থ হয়ে যেত। বলতো, আমি অসুস্থ না। সামি সত্যি এসেছিল। বিশ্বাস কেন করছো না? নবনী তোমার হ্যালুসিনেশন হচ্ছে এই কথাটা ওর সামনে উচ্চারণ করলেই ঘরের ভেতর কেয়ামত নেমে আসতো। ও বাসা থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে চাইতো। বাবা আপুর প্রতি একটু বেশিই উইক। ওকে যখন কোনোভাবেই রাজি করাতে পারছিলাম না, উল্টো ও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিল। আমাদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরী হচ্ছিল তখন বাবা বললো আপু যা চায় তাই হবে। ও হাসছে, কথা বলছে, ঘুমাচ্ছে এটাই বাবার জন্য অনেক। আর কিছু চাই না তার। আপু যদি কল্পনায় সামি ভাইয়াকে নিয়ে ভালো থাকে, সুখে থাকে তো থাকুক। এমন সুখের অসুখ থাকা মন্দ কিছু না।” 

    — “এটা কেমন ডিসিশন! পরিস্থিতি তো আরো খারাপ হতে পারতো।” 

    — “প্রথমে আমি আর নানী আপত্তি করেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম আপুর সবকিছু আগের মতো নরমাল হয়ে গেছে, পড়ায় মন দিয়েছে, নতুন ব্যবসায় হাত দিয়েছে তখন আমাদেরও মনে হলো ও মরে যাওয়ার চেয়ে এই-ই বরং ভালো। বদ্ধ উন্মাদ তো আর হয়ে যায়নি। নিজের একা সময়টাতে বসে কথা বলে, কল্পনায় ভাসে। ভাসুক।” 

    অনি মাথা দুলিয়ে বললো, , 

    — “হ্যাঁ আমিও নোটিস করেছি আপু একা সময়টাতেই কথা বলে। সঙ্গে কেউ থাকলে কখনো বলে না। ভেবেছিলাম একাই হয়তো কথা বলছে। বলে না অনেকে! কিন্তু কাউকে ইমাজিন করে কথা বলে এতটাও বুঝিনি।” 

    — “এর পেছনেও কথা আছে। আপু ভাবে, ভাইয়া শুধু ওর জন্যই ফিরে এসেছে। আর কাউকে উনি দেখা দেবে না। আপুর কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। এই নিয়ে তর্ক হবে, দ্বন্দ্ব হবে। আপুকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানোর পরামর্শ দিবে। আপু এই প্রবলেমগুলো ফেইস করতে চায়নি। তাই ব্যাপারটা ও নিজেই হাইড রাখার চেষ্টা করে।” 

    — “এটা একদিকে ভালো। নয়তো বাইরের মানুষদের সামনে কথা বললে ব্যাপারটা আরো বাড়াবাড়ি হতো। কিন্তু তোমাদের ডিসিশনটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারছি না নাতাশা। ও আবদার করলো আর তোমরাও মেনে নিলে! একবারও ভাবলে না ওর ভবিষ্যৎ আছে, সামনে হয়তো ওর সমস্যাটা আরো বাড়তে পারে। কতগুলো বছর পেরিয়ে গেল নবনী আজও একটা মিথ্যা আঁকড়ে বেঁচে আছে। আর কতদিন? ওকে সত্যিটা জানানো উচিত না? ওকে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা উচিত না?”

    — “সত্যি কথা বলতে তখন আমরা আপুর বর্তমান নিয়ে এতটাই বিপাকে পড়েছিলাম যে ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা খুব একটা ভাবিনি। প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমরা। আপুকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয়। অনিকে নিয়েই একবার ভাবুন না! চোখের সামনে আপনাদের মেয়ে জীবিত লাশ হয়ে পড়ে থাকবে, মানতে পারবেন আপনারা? সামি ভাইয়া আমাদের এতটা ঘিরে ছিল যে আমরাই ওভারকাম করতে পারছিলাম না। আপুকে আর আমরা কী বলতাম? বিশেষ করে আব্বু। আপুর সঙ্গে আব্বুও এক প্রকার জেদই করলো নবনীকে আর ডাক্তার দেখাতে হবে না। কিছুদিন পর আব্বুর জেদটাই আমাদের কাছে ঠিক মনে হলো। আপু তো বদ্ধ উন্মাদ হয়ে যায়নি, সবকিছু একদম পার্ফেক্ট। ও শুধু একটা মানুষকে কল্পনায় আঁকড়ে বাঁচতে চাইছে, তো বাঁচুক না। ট্রিটমেন্টের পর হয়তো আপু সুস্থ হয়ে যেত, ভাইয়াকে আর কখনো দেখতে পেতো না। কিন্তু সত্যটা কি মেনে নিতে পারতো? সারাটা জীবন অসহনীয় এক যন্ত্রণা আপুকে একটু একটু করে মেরে ফেলতো। হয়তো আমাদের সঙ্গে কথা বলতো, পড়াশোনায় আবার মন দিতো, খাওয়া দাওয়া করতো কিন্তু আগের নবনী কি বেঁচে থাকতো? ঐ দশমাসের কথা মনে পড়লে আমাদের গায়ে এখনো কাঁটা দেয়। আব্বু আজও ঐ সময়গুলো স্বপ্নে দেখে ঘুমের মাঝে চিৎকার করে উঠে। ঐ নরকে আমরা কেউ আর ফিরে যেতে চাইনি ভাইয়া।” 

    মাথা নিচু করে বসে রইলো অমিত। বুক ভারী হয়ে আসছে তার। সামি ছেলেটাকে এক নজর দেখার লোভ বড্ড বেড়ে গেছে। এত ভাগ্য কারো হয়! কোনো প্রেমিকের ভাগ্যে এত ভালোবাসা এরআগে জুটেছিল কখনো? কই, তার চেনা দেখায় তো কেউ নেই! আর নবনী? একজনকে ভালোবেসে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেল! ছোট্ট একটা জীবনে কত কী ঘটে গেল ওর। কিসব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে ওকে। অসুস্থ মেয়েটা তো শুধু ওর কল্পনায় বেঁচে থাকা মানুষটার গল্প শুনিয়েছিল তাকে, আর সে কিনা সেই গল্পকে কেন্দ্র করে মনে মনে কত কী নোংরা ভাবনা ভেবে ফেললো ওকে নিয়ে! কঠিন সময়টাতে এই মেয়েটাই তো একদম কাছের বন্ধুর মতো আগলে রাখলো, মায়ের সঙ্গে পুরোনো সম্পর্কটা আবার ফিরিয়ে দিলো। ওকে নিয়ে মনে কেন এল এত এত মন্দ খেয়াল? একদিকে নবনীর কুৎসিত অধ্যায়ের গল্প অন্যদিকে ওকে ভুল বুঝার অনুতাপের দায় বাড়াবাড়ি রকমে মন খারাপ করে দিলো। গলায় কান্না আটকে আছে। ঠিক গলার মাঝখান বরাবর ব্যথা হচ্ছে। 

    — “ভাইয়া?” 

    — “হুম?” 

    — “আপুর উপর রাগ আপনি?” 

    — “ঐ কথা আর মনে করিও না প্লিজ!” 

    — “কী নিয়ে রাগ করেছেন বলবেন আমাকে?” 

  • ………………..
  • — “আপু আপনাকে খুব পছন্দ করে। ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর নতুন করে কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়নি আপুর। এতগুলো বছর পর দেখছি আপুর কারো সঙ্গে খুব ভালো একটা সম্পর্ক হয়েছে। আপুকে এভাবে ইগনোর করবেন না প্লিজ! কী নিয়ে রাগ করেছেন মুখোমুখি কথা বলে মিটিয়ে ফেলুন না! ও খুব কষ্ট পাচ্ছে আপনার আচরণে। আপনার রাগ ভাঙাতে ঢাকা থেকে এখানে চলে এল। অথচ আপনার রাগ ।এখনো ভাঙাতে পারলো না। রেস্টুরেন্টে আপুর সঙ্গে আপনার কথা কাটাকাটি হয়েছিলো তাই না?” 

    — “কথা কাটাকাটি না ঠিক। আমিই একতরফা ওকে শুনিয়েছি। ও আমাকে কিছু বলেনি।” 

    — “ও খুব মন খারাপ করেছে। রেস্টুরেন্ট থেকে সি বিচে গিয়েছিলাম। পুরোটা সময় ও চুপ ছিল। বাসায় ফেরার পথে বলছিল আমাদের বোধহয় বাসায় ফিরে যাওয়া উচিত। কী এমন হলো ভাইয়া, বলুন তো? একটা মানুষ জানেই না আপনি কী নিয়ে রেগে আছেন অথচ এতদূর চলে এল স্যরি বলতে। কেন করছে এসব বলুন তো? ফ্রেন্ডশিপটা যেন নষ্ট না হয়ে যায় সেজন্যই তো, তাই না? আপনি ছোট বাচ্চা? এই বয়সে এভাবে রাগ করে বন্ধুত্ব নষ্ট করা মানায়?”

    — “আমাকে ঝাডুপেটা করা উচিত। একমাত্র মুনিয়া ছাড়া আমি কখনোই কোনো সম্পর্ক আগলে রাখিনি, রাখতে জানি না। ওর সঙ্গে যা করলাম এই তিন চারদিন, একদম অকারণে করেছি। কিছু প্রশ্ন ছিল, দ্বিধা ছিল সেসব তোমাকে জিজ্ঞেস করলেই মিটে যেত। অথচ আমি নিজে নিজেই কিসব ভাবছিলাম। নিজের উপর রাগ হচ্ছে খুব।” 

    — “সামি ভাইয়া রিলেটেড কোনো ব্যাপার ছিল?” 

    — “বাদ দাও নাতাশা। আমি আর কখনো মনে করতে চাই না। ও রাতে কিছু খায়নি তাই না?”  

    — “না।” 

    — “অনি, খাবার গরম করে টেবিলে দে। আমি ওকে নিয়ে আসছি।” 

    — “তিনটা বাজে ভাইয়া। এতরাতে ও খাবে? এতক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।” 

    — “বাজুক। ঘুম থেকে ডেকে খাওয়াবো। এ্যাই অনি, উঠ না!”

    নাক টানতে টানতে অনি বললো, 

    — “টিস্যু দাও।” 

    টিস্যু বক্স অনির হাতে ধরিয়ে অমিত বললো, 

    — “এই যে শুরু হলো, আগামী তিনদিন এই কান্নাকাটি চলবেই।” 

    — “আমাকে বলছো! তুমি কষ্ট পাওনি? ভাইয়াটা এভাবে মরে গেল, নবনী আপুর জন্য তোমার খারাপ লাগছে না?” 

    অনির প্রশ্নের কোনো জবাব দিলো না অমিত। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সে। 

    .

    দরজা ঠেলে ভেতরে এল অমিত। নবনীর ঘরে বাতি নেভানো। ডাইনিং রুমের আলো এই ঘরে আবছা হয়ে ছড়িয়ে গেছে। কাঁথা মুড়িয়ে গুটিসুটি মেরে ঘুমুচ্ছে নবনী। ওকে দেখে বুকের ভেতর মোচড় কেটে ব্যথা হচ্ছে অমিতের। খুব ইচ্ছে হচ্ছে ওকে একবার জড়িয়ে ধরে স্যরি বলতে। খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে জড়িয়ে ধরলে? নবনী খারাপভাবে নিবে? দোটানায় ভুগতে ভুগতে নবনীর মাথায় হাত রাখলো অমিত। মৃদুস্বরে ডাকলো, 

    — “নবনী, উঠো!” 

    চোখ মেলে হুরমুর করে শোয়া থেকে উঠলো নবনী। 

    — “তুমি এখানে! কয়টা বাজে?” 

    — “তিনটা।” 

    — “এতরাতে এখানে কী করছো?” 

    — “এই রাতে নক না করে তোমার ঘরে চলে এলাম, বিরক্ত হলে?” 

    — “তুমি কখনোই আমার কথা পজিটিভলি নিবে না অমিত? আমি কখন বিরক্ত হলাম? তোমার আজ বাসায় ফেরার কথা ছিল না তাই জিজ্ঞেস করলাম।” 

    — “আমি গাধা, তাই তোমাকে বুঝি না। বন্ধুত্ব যেহেতু হয়েই গেছো, এই গাধাটাকে মেনে নাও।” 

    ভ্রু কুঁচকে অমিতের দিকে তাকালো নবনী। মুচকি হেসে অমিত বললো, 

    — “রাতে কিছু খাওনি কেন?” 

    — “আমার খুশি।” 

    — “ঝগড়া হয়েছে আমার সঙ্গে, তাই বলে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে! খাবে চলো। 

    — “এতরাতে তুমি আমাকে খেতে বলছো?” 

    — “হ্যাঁ। সমস্যা কী?” 

    — “খাবো না। যাও তুমি।” 

    — “আমি কাজ ফেলে বাসায় এলাম তোমার সঙ্গে খাবো বলে। আর তুমি বলছো খাবে না?”

    — “অমিত খুব আদিখ্যেতা হচ্ছে। সন্ধ্যায় কী রুড বিহেভ করলে আমার সঙ্গে। আর এখন বলছো তুমি আমার সঙ্গে বসে খাবে বলে কাজ ফেলে চলে এসেছো?”

    — “নবনী আমরা অবশ্যই এই ব্যাপারে কথা বলবো। না মানে, তুমি বলবে আমি শুনবো। যা খুশি বলো আমাকে। কিন্তু প্লিজ, আমরা আগে কিছু খেয়ে নেই? সেই সন্ধ্যায় তোমাদের সঙ্গে বসে খেয়েছি। তারপর শুধু কাজ আর কাজ। ক্ষুধা পেয়েছে ভীষণ। তারউপর আম্মু চিংড়ি ভুনা করেছে। প্লিজ নবনী, এসো আমার সঙ্গে।”

    — “ঢঙ করবে না একদম। আমি তোমার সঙ্গে খাবো না, কথাও বলবো না। তুমি তোমার মুনকে নিয়ে ডিনার করো। আমি তোমার কেউ না।”

    — “এ্যাই, তুমি জেলাস?” 

    — “জেলাস কেন হবো?” 

    — “হ্যাঁ জেলাসই তো! বউ কখনো হাজবেন্ডের প্রেমিকাকে সহ্য করতে পারে? মুন আমাকে কল করেছে সেটা তোমার সহ্য হচ্ছে না।” 

    — “অমিত! একদম বাজে কথা বলবে না। আমি কখনোই নিজেকে তোমার বউ ভাবি না। বন্ধু ভাবতাম তোমাকে। তুমি যা বিহেভ করলে তখন! আপাতত তোমাকে বন্ধুও ভাবতে পারছি না আমি।” 

    — “নবনী…” 

  • ………………..
  • নবনীর দুইগাল চেপে নিজের দিকে ফেরালো অমিত। মিষ্টি হেসে বললো, 

    — “স্যরি।” 

    — “তোমার কী হয়েছে অমিত বলো তো? হাসিটাও ঠিকঠাক ঠোঁটের ভাঁজে আসছে না। জোর করে হাসতে চাইছো তুমি। মনের ভেতর কিসের ঝড় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছো বলো আমাকে।’ 

    — “অনেক কিছু একসঙ্গে চলছে মনের ভেতর। আপাতত আমার স্যরি এক্সেপ্ট করে অন্তত একটা মানসিক চাপ থেকে মুক্ত করো প্লিজ! তোমার সঙ্গে কিসব আচরণ করলাম আমি। গিল্ট ফিল হচ্ছে খুব। আ’ম এক্সট্রিমলি স্যরি নবনী। আর কখনো এমন হবে না, প্রমিজ 

    মুচকি হাসলো নবনী। চুলগুলো পাঞ্চক্লিপে আটকে নিতে নিতে বললো,

    — “এবারই শেষ। আর কখনো যদি এমন করো, সত্যি বলছি তোমার সঙ্গে সব রকমের যোগাযোগ বন্ধ করে দিবো। খুউব কষ্ট পেয়েছি আমি। কিন্তু তুমি রাগ হলে কেন সেটাই তো এখনো বললে না।”

    — “বাদ দাও না! আর ওসব কথা না বলি প্লিজ!” 

    — “দিলাম বাদ। কিন্তু একটা ব্যাপারে ক্ষমা পাবে না 

    — “কোন ব্যাপার?”

    — “তুমি বলেছিলে, আমার বার্থডে তুমি আমার সঙ্গে সেলিব্রেট করবে। অথচ তুমি রাগ করে চলে এলে অনুষ্ঠান শুরু না হতেই। এমন কেউ করে অমিত? রাগ হয়েছো ভালো কথা। আমাকে কারণটা বললেই মিটিয়ে নিতাম। তুমি কি ভেবেছো কাজের অযুহাত দিলেই কেউ কিছু টের পাবে না? সবাই সব বুঝেছে। আমার বাসার সবাই ভেবে নিলো আমিই হয়তো অন্যায় করেছি তাই তুমি রাগ করে চলে গেলে। খুব লজ্জায় ফেলে দিলে না আমাকে? আমার জন্মদিনটাই এবার তুমি মাটি করে দিলে। 

    নবনীর দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলো অমিত। বিষণ্ন স্বরে বললো,

    — “জন্মদিন ফিরিয়ে দিতে পারবো না। তোমার আমার মাঝে যে তিক্ত স্মৃতি তৈরী হলো সেটাও মেটাতে পারবো না। কিন্তু আমরা আবার সেলিব্রেট করতে পারি। সুন্দর কিছু স্মৃতি আমি তোমাকে দিতে পারি।” 

    — “আর তোমার মুন? ওকে কী বলবে? জানলে রাগ করবে না?” 

    — “আমরা আপাতত ওর ব্যাপারে কিছু না বলি। এখানে তুমি আমি আছি, কথা আমাদের দুজনের হচ্ছে। আলাপটা নাহয় আমাদের পর্যন্তই থাকুক।” 

    — “তুমি সবসময় এত সিরিয়াস মুডে কেন থাকো? চিল থাকতে পারো না?”

    — “তোমার সামির মতো?” 

    — “হ্যাঁ। যত যাই হোক না কেন সামি সবসময় খুব চিল মুডে থাকে।” 

    — “সামির মতো অসাম একটা প্রেমিকা থাকলে আমিও সারাক্ষণ চিল মুডে থাকতাম। প্রেম করেছি একটা ইচ্ছাধারী নাগিনের সঙ্গে। আড়াই বছর ধরে ওর বিষাক্ত ছোবল খেতে খেতে জীবন থেকে সব ফূর্তি উড়ে গেছে।” 

    — “ছোবল খেতে তোমার ভালোই লাগে। নয়তো ওর সঙ্গে আবারও প্যাঁচআপ করতে নাকি!” 

    — “উফ! নবনী চলো না! খাবো চলো। খিদে পেয়েছে খুব। আমাকে আবার কাজে ফিরতে হবে।” 

    ভেংচি কেটে খাট থেকে নেমে এল নবনী। টেবিলে নাতাশা আর অনি মিলে খাবার সাজাচ্ছে। নবনীকে অমিতের সঙ্গে বেরিয়ে আসতে দেখে অনি মুচকি হেসে বললো, 

    — “ঝগড়া মিটে গেছে তোমাদের?” 

    — “তা মিটেছে। কিন্তু তোমার চোখ মুখ ফুলে আছে কেন? কেঁদেছো তুমি? কোনো সমস্যা?” 

    নবনীর প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল অনি। নাতাশা তৎক্ষনাৎ পরিস্থিতি সামলে নিলো। 

    — “আরে আপু! অনি স্যাড সিন দেখে ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেছে।” 

    — “ওমা তাই! অনেক টাচি সিন ছিল? কী মুভি? দেখতে হবে তো!” 

    — “ওসব মুভি টুভি রেখে আমাকে দেখো। আমার জীবনটাও একটা সিনেমা। দুঃখে, যন্ত্রণায় ভরপুর। বউ, প্রেমিকা সব আছে অথচ কেউ আমার না।

    — “তুমি আসলেই একটা সিনেমা অমিত! তোমার মতিগতি কিছুই বুঝি না আমি। এখনই মেঘ, এখনই রোদ।” 

    — “তোমাকে মেঘ রোদ দেখানো শেষ। এবার দ্বীপ, সমুদ্র দেখানোর পালা।” 

    — “সত্যিই দেখাবে?” 

    — “বললাম না ভালো কিছু স্মৃতি তোমাকে দেবো। 

    — “তোমাকে বিশ্বাস করি না।”

    — “আপাতত না করলেও চলবে। ওখানে যাবার পর নাহয় বিশ্বাস করো। 

    — “কিন্তু যাচ্ছি কোথায়?” 

    — “মহেশখালী।”

    ৩২

    আজ খুশিতে শায়লার পা মাটিতে পড়ছে না। অনি ঘুম থেকে জেগে বললো অমিত নাকি এসেছিল গতরাতে নবনীর রাগ ভাঙাতে। আফসোসও হচ্ছে খুব। একটা সুন্দর মুহূর্ত নিজ চোখে দেখতে না পারার আফসোস। কাজের সময়গুলোতে অমিত বাসায় আসে না। হাতে পায়ে ধরেও তাকে আনা যায় না। কাজ শেষে বাসায় একটুখানি উঁকি দিয়ে ফিরে যায় ঢাকায়। গত চারবছরে তো কাজ শেষে উঁকিও দিতে আসেনি। বছরে একবার ঈদে ইচ্ছে হলে আসতো নয়তো কোনো বিশেষ প্রয়োজনে। এবার হাওয়া বদলেছে। নবনী পেরেছে হাওয়া বদলাতে। এই মেয়েটাকে ইচ্ছে হচ্ছে এক্ষুনি গালে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে রাখতে। 

    .

    চায়ের মগ হাতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিলো নবনী। ওকে চোখে পড়তেই ভেতর থেকে ডাকলেন শামীমা, 

    — “এ্যাই নবনী, শুনে যাও তো?” 

    — “জি চাচী?” 

    — “তুমি কী খেতে পছন্দ করো?” 

    — “প্লিজ চাচী আপনি আর বাড়তি কোনো ঝামেলা করবেন না। দুইদিনে এত কিছু রান্না করলেন। কত খাবো আমি!” 

    — “তোমাকে দিনরাত খাওয়ালেও আমার মন ভরবে না।” 

    — “হ্যাঁ সেই কথা আমিও ভাবছি। এটা সেটা তৈরী করেই যাচ্ছেন। আর পারছি না চাচী। আমি আর সহজে এখানে আসবো না।” 

    — “ইশ্! আসবে না বললেই হলো। এটা তোমারই বাড়ি। নিজের বাড়িতে আসবে না? থাকবে না?” 

    শায়লার প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না নবনী। ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি ধরে চাচীর দিকে তাকিয়ে রইলো। নিজের বাড়ি বলে কিসের ইঙ্গিত করলেন তিনি? শায়লার কথার অর্থ নবনী ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। নবনীর চোখে মুখে প্রশ্ন খুঁজে পায় শায়লা। মুখ ফস্কে বলা কথাটা মুহূর্তেই সামলে নিলেন তিনি। 

    — “বাবার ঘর আর চাচার ঘরের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আমার ছোটবেলায় সকালে খেতাম নিজের ঘরে আর বাকি দুইবেলা খেতাম চাচাদের ঘরে। কখনো মনেই হয়নি ওগুলো আমার নিজের ঘর না। নিজের হাতে যখন যা ইচ্ছে হয়েছে খেয়েছি, যা ইচ্ছে হয় কাজিনদের কাছ থেকে নিয়ে পরেছি।”

    এবারে দ্বিধার অবসান হলো নবনীর। ঠোঁটজুড়ে বিস্তৃত হাসির রেখা টেনে বললো,

    — “আপনি আমার বায়না করার রাস্তা সহজ করে দিলেন। আপনার একটা শাড়ী আমার ভীষণ পছন্দ। দেখার পরই মনে হয়েছিল এটা পরে সমুদ্রপাড়ে ছবি তুললে দারুণ হবে। কিন্তু আপনাকে বলবো বলবো করে বলতে পারছিলাম না। কেমন কেমন লাগছিল আমার।” 

    — “হ্যাঁ, হ্যাঁ! কেমন কেমন লাগবেই। আপন তো ভাবো না আমাকে।” মিথ্যে অভিমানে গাল ফোলালো শামীমা। তার কথায় হেসে ফেললো নবনী। বললো, “এবার কিন্তু যতগুলো শাড়ী ভালো লাগবে সব নিয়ে নিবো। “ বালিশের নিচ থেকে চাবিটা নিয়ে আলমারী খুলে শামীমা বললেন, 

    — “তোমার মা আর আমার মাঝে কোনো পার্থক্য করো না কখনো। যতটা অধিকার মায়ের উপর খাটাও ঠিক ততটা অধিকার তুমি আমার উপরও নির্দ্বিধায় খাটাতে পারো। এবার দেখো তো এখানে। যে কয়টা ভালো লাগে সব নিয়ে নাও।” 

    ***** 

    অনুষ্ঠান চলছে। আর ঘন্টাখানেক পরই আয়োজন শেষ হবে। এই কয়দিনের কাজের চাপ আর মানসিক চাপে ভীষণ ক্লান্ত অমিত। শরীর আজ চলছেই না। অনুষ্ঠান শুরু হবার পর থেকে শরীরে প্রচন্ড ক্লান্তি ভর করেছে। এত মানুষের আনাগোনা ভালোও লাগছে না। ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট গুঁজে বেইজ থেকে মিনিট দশেকের জন্য অমিত বেরিয়ে এল। সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে মাথায় ঘুরতে লাগলো নানান কথা, নানান খেয়াল। মাথার ভেতর সবচেয়ে বেশি খোঁচাচ্ছে নবনী আর তার প্রাক্তন। নাহিয়ান বলেছিল কথা বলে দ্বিধা মিটিয়ে নিতে। দ্বিধা মেটাতে গিয়ে যে মাথার উপর পাহাড়সমান বিষন্নতা চড়ে বসবে কে জানতো! বাবা বলে, সবসময় সবকিছু জানতে নেই। কিছু কথা আড়ালে রয়ে গেলেই মঙ্গল। সত্যিই তো! ওর মিষ্টি গল্পগুলো শুনে কী সুন্দর কেটে যেত কিছু মুহূর্ত। কতটা সময় জুড়ে মন ভালো রয়ে যেত। মুনিয়াটা, নিজের বিশ্রী সময়টা মনে পড়তো না অনেকক্ষণ। অজানাই থাকতো নবনীর গল্পটা, সামির মৃত্যুটা! অন্তত নিত্যদিনের মন খারাপে, একাকিত্বে বিরতি হতো। এখন থেকে নবনী গল্প বলবে। সামির সঙ্গে ওর কাল্পনিক কথোপকথনগুলো শোনাবে। সে শুনবেও। কিন্তু আগের মতো আনন্দ কিংবা মন ভালো কোনোটাই যে আর হবে না! বরং প্রচন্ড শোকে মৃত প্রেমিকের মাঝে নিজেকে খুইয়ে ফেলা এক প্রেমিকার কাল্পনিক প্রেম ভীষণ কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে তাকে। মোবাইলে রিং বাজছে। স্ক্রিনে মুনিয়ার নাম। এই মুহূর্তে ওর সঙ্গে একদম কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না অমিতের। সে কল কেটে দিতেই আবারও কল দিলো মুনিয়া। প্রচন্ড বিরক্তিতে মোবাইলের সুইচাটাই অফ করে দিলো অমিত। ওর কল এলেই মনটা বড্ড অশান্ত লাগে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলেও মন ভালো হয় না। কী এক ঝড় ভেতরটা এলোমেলো করতেই থাকে। মুনিয়া আপাতত মনের ঠিক কোন জায়গাটাতে আছে ভেবে পায় না সে। আগের মতো ওর জন্য অপেক্ষা নেই, বলার মতো কথা নেই, ওকে একান্ত নিজের করে পাবার আকাঙ্খা নেই, অনুভূতি নেই। তবুও ওর ফোন এলে, কন্ঠ শুনলে ভেতরটা এত অস্থির কেন হয়ে উঠে? কেন ছুটে পালাতে ইচ্ছে হয় সব ছেড়ে? কেন গলার ঠিক মাঝ বরাবর ভীষণ ভারী কি যেন আটকে থেকে তাকে দিনভর কষ্ট দেয়? 

    .

    অনুষ্ঠান শেষ করে অমিত বাসায় ফিরেছে একঘন্টা আগে। ঘরে ঢুকতেই দেখলো ড্রইংরুমে বসে বাসার মহিলা সদস্যরা লুডু খেলছে। বাবা বসে খেলা দেখছে। কারো সঙ্গে কথা না বলে, শুধু একটুখানি মুচকি হেসে নিজের ঘরে গেইট লক করে দিলো সে। মাঝে বাবা একবার বাইরে থেকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিল রাতে খাবে কি না। দরজা না খুলেই ভেতর থেকে অমিত না করলো। আর কেউ ডাকেনি তাকে। এত খাটাখাটুনির পর ভীষণ ক্লান্ত সে। নিজের ঘরে হয়তো নিরিবিলিতে আরাম করতে চাইছে। লুডো খেলার পর্ব চুকিয়ে দশ মিনিট আগেই নিজেদের ঘরে গিয়েছেন এরশাদ-শামীমা। অনি, নাতাশা আর নবনী সোফায় ফ্লোরে এলোপাতাড়ি শুয়ে গল্প করছে। নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এল অমিত। মুখ আড়াল করে মা বাবার ঘরে যাচ্ছে সে। পাশ থেকে তাকে ডাকলো নবনী, 

    — “এ্যাই দাঁড়াও!” 

    অমিত দাঁড়ালো না। মায়ের ঘরে যেতে যেতে বললো, 

    — “এখন না প্লিজ!” 

    নবনীও আর ডাকলো না। অনির দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো। শুকনো হাসি হেসে অনি বললো, 

    — “ওর বোধহয় মন খারাপ। মন খারাপ হলে এমন মুখ লুকিয়ে বেড়ায়।” 

    — “ওর কি বারো মাসই মন খারাপ থাকে?” 

    — “ও খুব হাসিখুশি ছিল জানো! স্কুল কলেজের সবচাইতে বখাটে স্টুডেন্ট ছিল ভাইয়া। পড়াশোনায় যেমন তুখোড় ছিল, বাঁদরামিতেও ছিল তেমন। প্রিন্সিপাল প্রায়ই মা-বাবাকে ডাকতো, ওর কান্ড কারখানা বলতো। চলে আসার সময় এটাও বলতো, আপনাদের ছেলের রেজাল্ট অবিশ্বাস্য! তাইতো এখনো রেখে দিয়েছি। নয়ত কবেই টি সি দিয়ে বের করে দিতাম। পুরো ঘর মাতিয়ে রাখতো ও। আত্মীয়দের কোনো অনুষ্ঠান কখনো মিস করতো না। নিয়ম করে সবাইকে ফোন করতো। আমাদের নানু-দাদুর সবচাইতে প্রিয় নাতিটা ছিল ও। মন খারাপ কী জিনিস এটাই তো কখনো ও জানেনি। আমি জন্মাবার পর থেকে ভাইয়াকে কখনো দেখিনি মন খারাপ করতে। ভার্সিটিতে উঠে ভাইয়ার বাঁদরামি আরো বাড়লো। যখনই কেউ প্রেম করে বাসায় ধরা খেয়েছে, চলে আসতো ভাইয়ার কাছে। ও নিজ দায়িত্বে বিয়ে করাতো। এসব কিছুর পেছনে অবশ্য বাবার বিশাল হাত ছিল। মায়ের আদরের বাচ্চা তো ভাইয়া ছিলই। কিন্তু জগতের যত অঘটন আছে সেগুলোতে প্রশ্রয় দিতো বাবা। বলতো, করুক না! আমার ছেলে তো আর কারো ক্ষতি করছে না। একটু আধটু দুষ্টুমিতে কিচ্ছু হয় না। অমন আমিও একসময় করেছি। ভালোবাসলে মানুষ অসহায় হয়, বদলে যায় তার জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ হলো ভাইয়া। যেই বয়সে উথাল পাথাল প্রেম হওয়ার কথা ছিল সেই বয়সে হয়নি। যখন কিনা বিয়ে করে সংসার গড়ার বয়স হলো তখন এসে নিজেকে খুইয়ে প্রেমে মজে গেল। একটা নতুন মানুষ, আর ওর সবকিছু এলোমেলো! পরিবারের সবচাইতে মিশুক ছেলেটা নিজেকে আড়াল করে ফেললো। আমরা সবাই খুব মন খারাপ করতাম জানো! হঠাৎ করে কেন যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিলো ছেলেটা! ওকে কত জিজ্ঞেস করেছি, উত্তর না পেয়ো নিজেরা আলোচনা করে একটা হিসেব মিলাতে চেয়েছি, পারিনি। তবে আমার মা, খালারা আন্দাজ করেছিল ওর হয়তো কারো সঙ্গে প্রেম চলছে। কিন্তু প্রমাণ তো ছিল না কোনো। তারপর আট নয়মাস বাদে জানলাম ওর সত্যিই প্রেম চলছে। প্রেমিকার জন্য ও আমাদের সবাইকে এভাবে ভুলে যাবে এটা মেনে নেয়া যেন আরো কঠিন ছিল।’ 

    — “অমিতের এই হিসেবটা না আমি মিলিয়ে পাই না জানো! প্রেম হতেই পারে। জীবনে নতুন মানুষ আসতেই পারে। তাই বলে আমার জীবনে বাকি যারা আছে তাদের সবাইকে ভুলে যেতে হবে?” 

    — “জানি না আপু। মুনিয়ার ভালোবাসা কেমন ছিল, কিভাবে প্যাম্পার করতো তা তো আর আমরা জানি না। ভাইয়া ওসব শেয়ার করে না কখনো। তবুও মাঝেমধ্যে যখন ড্রিংক করে তখন একটু আধটু বলে আমাকে। আমি শুনি কিন্তু খুব একটা ফিল করতে পারি না। এমন প্যাম্পারিং সব সম্পর্কেই চলে। তাই বলে ও এভাবে ডুবে মরবে? গত আড়াইবছরে ভাইয়াকে আমি ঠিকমত হাসতে দেখিনি। যেই ছেলেটার কখনো মন খারাপ হয়নি সেই ছেলেটা মদ খেয়ে এসে বাসায় চিৎকার করে কাঁদে, মাসে অন্তত তিন চারদিন ওর চোখ ভেজা থাকে। কতদিন ও খেতে বসেও খেতে পারেনি। খাবার ফেলে উঠে গেছে। সারারাত না ঘুমিয়ে এঘর ওঘর করে কাটিয়েছে। চোখের সামনে একটা মানুষের মানসিক যন্ত্রণা কতক্ষণ আর মেনে নেয়া যায় বলো? ওকে বোঝাতে বোঝাতে আমরা ক্লান্ত। এতকিছুর পরও ও কেন মুনিয়াকে ভুলতে পারে না আমি ভেবে পাই না। কতদিন হয়ে গেল সেই আগের অমিতকে আমরা দেখি না। হাসিখুশি ছেলেটা একজনকে ভালোবেসে চোখের সামনে শেষ হয়ে গেল।” 

    দরজার হাতল চেপে কেউ ঘরে এল। মাথা তুলে তাকালেন দুজনেই। মায়ের পায়ের কাছে এসে অমিত বললো,

    — “আমি তোমাদের মাঝে একটুখানি শুই?” 

    তাড়াহুড়ো করে এরশাদ, শামীমা দুপাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিলেন। অমিত তাদের মাঝে এসে শুতেই শামীমা তার বুকে কপালে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। 

    — “কী হয়েছে বাবা? শরীর খারাপ লাগছে?” 

    — “না, এমনিই এলাম। ঘরে ভালো লাগছিল না।” 

    ছেলেকে জড়িয়ে ধরে এরশাদ সাহেব বললেন, 

    — “বল, তোর মন খারাপ। মায়ের কাছে এসেছিস মন খারাপের গল্প করতে।”

    মায়ের হাত বুকে চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো অমিত। বুকের ভেতর মোচড় কেটে উঠলো শামীমার। 

    — “কী হয়েছে তোর?” 

    — “আমার নিঃশ্বাস আটকে আসে আম্মু। সবকিছু এত এলোমেলো কেন? কোথাও কেউ ভালো নেই কেন? আমরা যাকে ভালোবাসি সে আমাদের হয় না কেন?”

    — “শুধু একজনের ভালোবাসাতেই কী আসে যায় বল তো? তুই যাকে পেতে চাইছিস সেই মানুষটাও তোকে ভালোবাসতে হবে, তোকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে পাবার ইচ্ছে থাকতে হবে।

    — “নবনী যাকে ভালোবাসতো সেও নবনীকে ভীষণ ভালোবাসতো। তবুও কেন ওদের একটা সুন্দর সমাপ্তি হলো না?”

    — “তুই আসলে কাকে নিয়ে ডিস্টার্বড বল তো আমাকে?” 

    — “আমার রিলেশনটা নিয়ে ডিস্টার্বড তো ছিলামই, নতুন করে যোগ হয়েছে নবনী।”

    — “শুনলাম তুই ওর সঙ্গে রাগ করেছিলি। কী নিয়ে বলতো?” 

    — “একটা মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল। ওটা কিছু না, মিটে গেছে। কিন্তু মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং ক্লিয়ার হওয়ার পর থেকে আমি খুব ডিপ্রেসড ফিল করছি। এত লক্ষ্মী একটা মেয়ের জীবনটা এমন এলোমেলো কেন হবে আম্মু? ছেলেটাকে হারিয়ে ও নিজেকে হারিয়ে ফেললো। একটা কল্পনার জগতে ও বেঁচে আছে। উপরওয়ালা কি জানতো না এই ছেলেটাকে নিয়ে গেলে নবনী শেষ হয়ে যাবে? অবশ্যই জানতো। তবুও কেন নিয়ে গেল ওকে?” 

    — “উপরওয়ালার সিদ্ধান্তে আমরা আপত্তি করার কে, বল তো?” 

    — “নবনী মেয়েটা খুব ভালো, স্নিগ্ধ, সরল। আমার ভীষণ পছন্দ ওকে। সবার আড়ালে ও যেই রোগটা পেলে পুষে রেখেছে, ও একটা অস্বাভাবিক জীবন বয়ে বেড়াচ্ছে এই ব্যাপারটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না আম্মু। ওকে ট্রিটমেন্ট করালে হয়তো সমস্যাটা আর থাকবে না। কিন্তু এখন যেই হাসিখুশি ফড়িং স্বভাবের নবনীকে দেখতে পাচ্ছি সেই নবনীকে আর কখনো দেখতে পাবো না। ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুটা তখন ওর কাছে পৃথিবীর সবচাইতে কুৎসিত সত্য হয়ে প্রকাশ পাবে। তখন ওর নিঃশ্বাসটা হয়তো চলবে, ভেতরটা ঠিক মরে যাবে। ঐ নবনীকেও আমি দেখতে চাই না আম্মু। একজনকে ভালোবেসে নিজে শেষ হয়ে গেল অথচ এই মেয়েটাই আমার সবচেয়ে খারাপ সময়টাতে আমাকে ঠিক সামলে নিলো। ঐ মুহূর্তে নবনী আমার সঙ্গে না থাকলে হয়তো আমি ঠিক কিছু একটা করে ফেলতাম। মুনিয়া অন্য ছেলের সঙ্গে এত ক্লোজ… আমি নিজ চোখে এসব দেখে বাঁচতে পারতাম না আম্মু। ধুর! আমিও কী বোকা! নবনীর সমস্যাটাই তো বললাম না তোমাকে।”

    — “জানি আমরা।”

    — “তোমরা জানো আব্বু! তাই? আমি যেই সমস্যার কথা বলছি সেটার কথাই কি তোমরা বলছো?” 

    — “নবনীর হ্যালুসিনেশনের কথা বলছিস তো?” 

    — “হ্যাঁ!” 

    — “জানি আমরা। কথা গুলো নবনীকে বাসায় আনার আগেই ভাবী আমাদের বলতে চেয়েছিল। আমরাই শুনতে চাইনি। ভাবী আড়াল করতে চাননি ব্যাপারটা। নবনী এই বাসায় আসার পর ভাবী একদিন আমাদের উনার বাসায় ডেকেছিল, তখনই জেনেছি।” 

    — “কই আমাকে বলোনি তো?” 

    — “ইচ্ছে করেই আমরা বলিনি। ভেবেছিলাম যাক আরো কিছুদিন, তারপর নাহয় বলবো।” 

    — “ওর জন্য আমার কিছু করতে ইচ্ছে হয় আব্বু। কী করবো আমি? নিজেকেই বা কী করবো? মুনিয়াকে আগের মত মনে পড়ে না, ওভাবে ফিল করি না। কিন্তু মাঝেমধ্যে খুব মন খারাপ হয় নিজের জন্য। ওকে আমি এত ভালোবাসলাম অথচ ও আমার হয়ে রইলো না। সবাইকে ছেড়ে দিয়েছি শুধু ওকে আঁকড়ে ধরতে গিয়ে তবুও ধরে রাখতে পারিনি। নিজেকে খুব হেরে যাওয়া মানুষ মনে হয়। ওর কল এলেই মাথায় যন্ত্রণা হয়। মনে হয় কেউ বুঝি আমার গলাটা চেপে ধরেছে। ভেতরে ভেতরে আমি মরে যাচ্ছি। আমি এসব থেকে বেরিয়ে আসতে চাই।” 

    — “ঐ মেয়েটা তোকে কল করে?” 

    — “হ্যাঁ তিনদিন যাবৎ প্রতিদিন কল করছে।” 

    — “কী চায় ও?” 

    — “দেখা করতে চায়।” 

    — “ও তোকে ছাড়বেও না, ধরেও রাখবে না।” 

    ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শামীমা বললেন, 

    — “অমিত, তোকে কিছু কথা বলি বাবু?” 

    — “বলো না! কথা বলতেই তো এলাম।”

    — “তোর পছন্দ হবে না হয়তো। আবার এই মুহূর্তে এই ব্যাপারে কথা বলাও উচিত না। কিন্তু বলতে চাইছি কথাগুলো, সময়ের প্রয়োজনেই বলছি।” 

    — “হুম?” 

    — “নবনীর জন্য কিছু করতে চাইছিস, নিজেকেও সামলে নিতে চাইছিস। খুব সহজ একটা সলিউশন দেই তোকে। নবনীকে খুব কাছের একজন ভাবিস তো, তাই না?”

    — “হুম খুব। বলতে পারো ও আমার কমফোর্ট জোন।” 

    — “মুনিয়াকে নিয়ে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে মনের ভেতর সেটা ওর সঙ্গে কেন শেয়ার করছিস না?” 

    — “নবনীর সঙ্গে আর কী শেয়ার করবো আম্মু? ওর অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ।”

    — “হ্যাঁ খারাপ। কিন্তু এর আগে ও কি কখনো তোকে সামলে নেয়নি? আমরা যা পারিনি সেটা কিন্তু ও পেরেছে। এবারও তোকে ও সামলে নেবে। আর তুই নাহয় ওকে সামলে নিস।

    — “আমি! কিভাবে?” 

    — “তোর বান্ধবীকে তুই কিভাবে সামলে নিবি সেটা তুই ভালো জানিস। আমি জানবো কেমন করে?” 

    — “যদি না পারি? হীতে বিপরীত হয়?” 

    — “হলে হবে। সেটাও সামলে নিবি। বন্ধুর সঙ্গে কথা কাটাকাটি হবে, মতের অমিল হবে আবার দ্বন্দ্ব মিটেও যাবে। বন্ধুত্ব এমনই তো হয়, তাই না?”

    — “হুম।”

    — “এবার আসল কথায় আসি?” 

    — “বলো।” 

    — “নবনী শুধুই তোর বান্ধবী না, ও তোর বিয়ে করা বউ। তোর…” 

    — “আম্মু!” 

    — “জানতাম চিল্লাপাল্লা শুরু করবি।” 

    — “করবো না! ওকে আমি ভাবি নাকি তেমন কিছু?” 

    — “ভাবিস না কেন? এখন কী বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে তোদের মাঝে? না সামি বেঁচে আছে, না মুনিয়ার সঙ্গে তোর সম্পর্কটা আছে।” 

    — “না থাকুক। তাই বলে নবনীকে নিয়ে সংসারের কথা ভাববো! ও শুনলে আমাকে কী ভাববে বলো তো?” 

    — “ও কী ভাববে সেটা নিয়ে আপাতত জানতে চাই না। তুই কী ভাবছিস কিংবা কেন ভাবছিস না আমি সেটা জানতে চাই।” 

    — “ধুর! ওর সঙ্গে কিভাবে কী? আমার মাথায় ওসব একদমই আসে না আম্মু! নবনীকে আমার খুব ভালো একজন বন্ধু ছাড়া আর কিছু ভাবিনি। আমার খেয়ালে আসেইনি কখনো সে কথা।” 

    — “খেয়ালে না আসুক তাতে কী? সত্যিটা বদলে যাবে? পরিস্থিতি যেমনই হোক, বিয়েটা তো হয়েছিল। তুই ওকে বিয়ে করেছিস এই সত্যিটা কখনো বদলে যাবে না। নবনী তোর বউ এটাও কখনো অস্বীকার করতে পারবি না।” 

    শামীমা উত্তর দেবার আগেই এরশাদ বললেন, 

    — “তুমি কী চাইছো বলো তো আমাকে?” 

    — “কী আবার চাইবে? তুই নিজের মুখেই বললি নবনী তোর কমফোর্ট জোন। ভীষণ পছন্দ ওকে। ওকে তোর মা আর আমারও ভীষণ পছন্দ তোর বিয়ের আগে থেকেই। খুব করে চেয়েছিলাম এই মেয়েটা তোর বউ হয়ে আসুক। সবদিকেই মেয়েটা পার্ফেক্ট। যদিও বিয়েটা খুব খারাপভাবে হয়েছে তবুও আমরা খুশি। পছন্দের মেয়ে বউ হয়ে এলে কে না খুশি হয় বল তো! বিয়ে যেহেতু হয়েই গেছে এবার তোদের একটা সংসার হলে কিন্তু মন্দ হয় না।”

    — “তার মানে আম্মু আর তুমি এটাই চাইছো?” 

    — “হ্যাঁ।”

    — “আব্বু অলরেডি মাথায় শ’খানেক ঝামেলা লেগে আছে। মাঝে এসব বলে আমার মাথাটা আর খারাপ করে দিও না।

    — “তোর মা সলিউশন তো দিলোই! মুনিয়া আর তোর সম্পর্কটা নিয়ে যা কিছু মনের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছিস তা নবনীকে দিয়ে দে। ও তুড়ি বাজিয়ে তোর মাথা থেকে ভূত নামিয়ে দেবে। আর নবনীকে নিয়ে যে কষ্টটা পাচ্ছিস সেটা নিজের কাছে রেখে দে। এটা তুই সামলাবি। ওকে তুই ভালো না বাসতে পারিস, সংসার করার ইচ্ছে না-ই হতে পারে। কিন্তু যতদিন ও তোর বউ হয়ে আছে ততদিন ওর ভালোমন্দ দেখার দায়িত্ব তোর। নিজের দায়িত্বগুলো অন্তত ভালোভাবে পালন কর।” 

    .

    মা-বাবাকে আর কিছুই বলছে না অমিত। নাক মুখ কুঁচকে চুপচাপ শুয়ে রইলো সে। তাদের মুখে “নবনী তোর বউ” কথাটা শুনতে বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে অমিতের। নবনী এসব শুনলে কী একটা কেলেংকারী ঘটে যাবে! মুখ দেখাবে কেমন করে ওকে? ছিঃ।

    ৩৩

    গতকাল বিকেলে কক্সবাজার এসেছে ওরা চারজন। উদ্দেশ্য, আজ সকাল সকাল মহেশখালির দিকে রওয়ানা হওয়া। আটটার দিকে কক্সবাজার থেকে নাস্তা সেড়ে স্পিডবোটে মহেশখালী এসে পৌঁছেছে ওরা। সূর্য ঠিক মাথার উপর চড়তে চড়তে মহেশখালী জেটি থেকে শ্যুটিং ব্রিজ হয়ে আদিনাথ মন্দির ঘুরা হয়ে গেছে। মন্দির থেকে বেরিয়ে পাশ দিয়েই বেয়ে উঠেছে পাহাড় চূড়ায় উঠার সিঁড়ি। আশপাশটা বেশ নির্জন। মানুষের আনাগোনা তেমন দেখা যাচ্ছে না। একটুখানি গা ছমছম করলেও ভীষণ ভালো লাগছে নবনীর। এ পর্যন্ত কয়েকবার কক্সবাজার এলেও এদিকটাতে কখনো আসা হয়নি। সমুদ্রের গভীরে কখনো আসা হয়নি। হাঁটু পর্যন্ত পানিতে নামলেই মায়ের চেঁচামেচিতে আবার ফিরে আসতে হয়েছে। নাতাশা কতবার বায়না করেছিল সমুদ্রে বোট নিয়ে একটু ঘুরে বেড়াবে। বাবা-মা কেউই রাজি হলো না! আদিনাথ জেটির ওপাশটা অনেকটা সুন্দরবনের মতই। নদীর ধারে, কাঁদা পানির উপর ম্যানগ্রোভ জাতির গাছ, জঙ্গল দেখে নাতাশা বলছিল, অমিত ভাইয়া মহেশালী দেখাতে নিয়ে এসেছে নাকি সুন্দরবন! দুই চারটা বাঘ হাতিরই যা কমতি। ওগুলো হলেই ষোলোকলা পূর্ণ হতো। 

    অনিও কখনো আসেনি এর আগে। বাচ্চাদের মতন ওরা দুজন হাত ধরাধরি করে ঘুরছে, অসীম কৌতুহলে এদিক ওদিক দেখছে, ছবি তুলছে, খিলখিল করে হাসছে, গল্প করছে। এই নিরিবিলি পাহাড়ি পথ, পাহাড় জুড়ে ছোট বড় গাছ, ঝলমলে রোদের দিন, শরৎ এর মতন ঝকঝকে আকাশ আর কিশোরী মেয়ের মতন আনন্দে মেতে উঠা কুড়ির ঘর পেরোনো দু’টো মেয়ে সব মিলিয়ে আজকের সময়টা ভীষণ সুন্দর! অমিত আর নবনী ধীর পায়ে একটু আধটু গল্প করতে করতে উপরে উঠছিল। হঠাৎ নাতাশা অনি উপর থেকে “অমিত ভাইয়াআআআআ” বলে চিৎকার করে নেমে এসে দুপাশ থেকে অমিতকে জড়িয়ে ধরলো। হঠাৎ চিৎকারে ঘাবড়ে গেল অমিত-নবনী দুজনই। ওদের ভয় পাওয়া চেহারা দেখে সজোরে হেসে উঠলো নাতাশা, অনি। নবনী কিঞ্চিৎ বিরক্তি হয়ে বললো, 

    — “হাসছিস কেন? কী হয়েছে তোদের?” 

    অনি বললো,

    — “আমরা তো ভাইয়াকে থ্যাংকিউ বলতে এসেছিলাম। কতদিন পর পাহাড়ে এসেছি জানো!” 

    অনি নাতাশা একসঙ্গে অমিতকে, থ্যাংকিউ ভাইয়া বলেই আবারও হাত ধরাধরি করে উপরে ছুটতে লাগলো। দুজনের কান্ডে হাসলো নবনী। অমিতকে বললো,

    — “ওরা দুজন খুব খুশি হয়েছে।” 

    — “তুমি হওনি?” 

    — “উমমমম… হ্যাঁ খুশি আমিও হতাম কিন্তু হতে পারছি না।”

    — “কেন?”

    — “যে আমাকে নিয়ে এল আমার রাগ ভাঙাতে তার মনটাই যে ভালো নেই!” 

    নবনী তাকিয়ে আছে অমিতের চোখে। ওর চোখে চোখ মেলাতে পারছে না অমিত। মাথা নিচু করে বিষন্ন হাসলো সে। 

    — “মন খারাপ কেন বলবে না আমাকে?”

    — “মুনিয়া কল করছে তিনদিন যাবৎ।” 

    — “হ্যাঁ করছে। তোমার গার্লফ্রেন্ড তোমাকে কল করবে না?” 

    — “নবনী! আমি ওর সঙ্গে রিলেশনটা আর কন্টিনিউ করছি না তুমি জানো না?”

    — “সেদিন না কথা বললে?” 

    — “কথা বলেছি বলেই কি ভেবে নিবে ওর সঙ্গে আমার সুন্দর সম্পর্ক যাচ্ছে?” 

    — “হোটেলে মিট করতে চাইলো তাই ভাবলাম সম্পর্কের মধুমাস চলছে। তার উপর তুমিও তো বললে ঢাকা ফিরে দেখা করবে।”

    — “হ্যাঁ বলেছি। কেন বলেছি জানি না।” 

    — “দেখা করতে ইচ্ছে হয় ওর সঙ্গে?” 

    — “ইচ্ছে হলে ওকে হোটেলেই আসতে বলতাম।” 

    — “কী ইচ্ছে হয় তাহলে?”

    — “শান্তিতে বাঁচতে ইচ্ছে হয়। সুখী হতে ইচ্ছে হয়। মন খারাপের বোঝা টানতে টানতে আমি ক্লান্ত।”

    — “মুনিয়াকে নিয়ে?” 

    — “একদম না। আপাতত কাউকে আমার জীবনে আমি চাইছি না। একা নিজের মতন করে আনন্দে বাঁচতে চাই।” 

    — “মুভ অন করতে চাও কিন্তু ওকে ভুলতে পারছো না তাই তো?” 

    — “ভালোবেসে ওকে মনে করছি ব্যাপারাটা কিন্তু তেমন না। আমাদের সুন্দর সময়গুলো এখন আমার মনে পড়ে না। মনে পড়ে ওর সঙ্গে আমার তিক্ত স্মৃতিগুলো। আমার জীবনের সবচাইতে বাজে আড়াই বছর। মুনিয়াকে আমি ঘৃণা করি না। আবার ভালোবাসাও নেই। মানে, ওকে নিয়ে কিছুই ফিল করি না। আফসোস যা হওয়ার নিজের জন্য হয়। এমনিতে নিজেকে সামলে নিতে পারি, কাজে মন বসাতে পারি। কিন্তু যেই মুহূর্তে ও আমাকে কল করে আমি জাস্ট এলোমেলো হয়ে যাই। নিজেকে উন্মাদ মনে হয়। কোনোকিছুই আমি করতে পারি না। কাজে বারবার ভুল হয়। নিজের ভুলগুলো এক এক করে মাথার ভেতর ছুটতে থাকে। মুনিয়ার জন্য সব ভুলে গিয়েছিলাম। সব ছেড়ে শুধু ওকে ভালোবেসেছি। আমার মতন করে এত ভালো ওকে কে বাসতো নবনী? তবুও ও আমাকে ভালো কেন বাসলো না? এত ভালোবাসা ও ফিরিয়ে দিলো কেমন করে? আমার হিসেব মেলে না নবনী! কিছুতেই মেলে না।”

    — “শুনেছি ভীষণ হাসিখুশি মানুষ ছিলে তুমি। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু নিয়ে মেতে থাকা প্রাণবন্ত একটা ছেলে। অথচ তোমাকে আমি ঠিকঠাক হাসতেই দেখি না। বন্ধুদের সঙ্গে খুব একটা যোগাযোগ করতে দেখি না। আত্মীয়দের সঙ্গেও না। এমন কী করে হয়ে গেলে অমিত?” 

    — “ভালোবেসে নবনী। বহুবছর আগে এক বন্ধুর পাগলামি দেখে বলেছিলাম, ভালোবেসেছিস ভালো কথা। তাই বলে নিজেকে শেষ করে ফেলতে হবে? ও বলেছিল, যে ভালোবাসে সে তো ভালোবাসার মানুষটার মাঝেই শেষই হয়ে যায়। বেঁচে থাকে নাকি? বুঝিনি তখন ওর কথাগুলো। আর আজ এত বছর পর সেই জায়গাটাতে আমি দাঁড়িয়ে।” 

    — “তোমার বন্ধুর পাগলামি কেমন ছিল আমি জানি না। তবে তোমার ব্যাপারটা ভিন্ন। এত ভালোবাসতে যেই পরিবারকে, বন্ধুদের তাদেরকে শুধু একটা মেয়ের কারণে ভুলে যাবে এই ব্যাপারটা আমি ঠিক মানতে পারি না। মুনিয়া তোমাকে আর ভালোবাসে না এই সত্যিটা তোমার চোখের সামনে ছিল, ওর অবহেলা তোমাকে একটু একটু মেরে ফেলছে তাও তুমি বুঝতে পারছিলে তবুও কেন তুমি ওর কাছ থেকে সরে আসোনি অমিত? এত অপমান মাথায় নিয়ে ভালোবাসাহীন একটা সম্পর্ক বয়ে বেড়ানোর মানে কী? নিজের উপর এতটা অবিচার না করলেই কি হতো না?” 

    কথা বলতে বলতে পাহাড়চূড়ায় এসে থামলো দু’জন। অমিতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ওর হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে নিলো নবনী। 

    — “তোমার মন খারাপের গল্প তুমি নিজে এসে আমাকে কেন বলো না অমিত? সবসময় আমাকেই কেন জিজ্ঞেস করতে হবে? বলেছি না একবার, যে কথা তোমাকে কষ্ট দেয় সেটা কখনো পেটে চেপে বসে থেকো না। আমাকে বলবে। যখন খুশি তখন আমাকে ডেকে বলবে। আমি আছি তো কথা শোনার জন্য।” 

    — ……………………

    — “কেমন বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে আছে দেখো! শোনো ছেলে, জীবনটা অনেক লম্বা। এই লম্বা জীবনে আমরা একটা দুইটা ভুল করবো না, দুঃখ পাবো না, আমাদের সঙ্গে প্রতারণা হবে না সেটা কী করে হয়? সবকিছুর একটা এক্সপেরিয়েন্স থাকার দরকার আছে না, বলো? শুধু সুখ, ভালোবাসা, সাকসেস নিয়েই এক জীবন কাটিয়ে দিবে কিন্তু দুঃখ, অবহেলা, অপ্রেমের মতন ইম্পর্ট্যান্ট ফিলিংসগুলোর সঙ্গে কখনো তোমার আলাপ পরিচয় হলো না; এই জীবনটাকে কিন্তু ঠিক জীবন বলা চলে না। এমনটা হলে আক্ষরিক অর্থে একটা মানব জীবন তুমি পেলেই না। যা পেলে তা শুধু ভ্রম কিংবা সুখের একটা স্বপ্ন। বলবো না মুনিয়াকে তুমি ভুলে যাও। কাউকে কখনো চিরতরে ভুলে থাকা যায় না। বরং মুনিয়া তোমার স্মৃতিতে থাকুক। ওর সঙ্গে কাটানো সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো, মন্দ সময়গুলো সবটাই থাকুক তোমার স্মৃতিতে। নিজের জীবনের মূল্যবান সাড়ে চারবছর ওকে তুমি দিয়েছো। ভুলে গেলে চলবে নাকি? আমি বলবো ওকে স্মৃতিতে রেখেই আনন্দে বাঁচো, সুখে থাকো। সেইবার মুনিয়াকে আগলে রাখতে গিয়ে পরিবার, বন্ধু হারিয়েছিলে। এবার নাহয় নিজেকে ফিরে পেতে ওদেরকে কাছে টেনে নাও। ভুল কী হলো, ভালোবাসা কেন পেলে না এসব ভাবনায় বসে থেকে এখন যে সময়গুলো হারিয়ে যাচ্ছে জীবন থেকে তা নিয়ে ভেবেছো একবার? যা হওয়ার হয়ে গেছে। এবার এসব চিন্তা থেকে বেরিয়ে নতুন করে জীবন নিয়ে ভাবো। নিজেকে সময় দাও, কাছের মানুষের পাশে বসে কথা বলে সময় কাটাও। বেড়াতে যাও, বন্ধুদের সঙ্গে গেট টুগেদারে যাও। নিজের সুখের সবটা খুঁজে নাও, তাতেই বাঁচো।”

    — “যদি ওরা আর আমাকে কাছে না টেনে নেয়?” 

    — “নেবে। যেই অমিতের গল্প চাচী অনি আমাকে শোনায় সেই অমিত কারো অভিমান ভাঙাতে পারবে না এমনটা হতেই পারে না। মাথার উপর সূর্য তার আপন তেজ ছড়িয়ে দিচ্ছে। উঁচু গাছগুলোর পাতা বাতাসে দুলে সুর তুলছে। সেই একই বাতাসে উড়ছে নবনীর চুল। মায়াভরা চোখে তাকিয়ে আছে অমিতের চোখে। ঠোঁটের কোণে তার মিষ্টি হাসি। নবনীর চোখে আশ্রয় খুঁজে পায় অমিত, হাসির মাঝে স্বস্তি। 

    ৩৪

    — “ভালোই কাটলো তোমার এই তিন চারদিন। কাল থেকে আবার কারখানায় ছুটোছুটি।”

    — “ছুটোছুটিই ভালো। তিন চারদিন আরাম করে গায়ে আলসেমি ধরে গেল।”

    “এত ছুটোছুটিও কিন্তু ভালো না রোদ্দুর। ত্রিশে পা রেখেছো। এবার শরীরটাও দেখতে হবে। অতিরিক্ত স্ট্রেস নিলে ডায়বেটিস, ব্লাড প্রেশার সব একসঙ্গে গায়ে বাসা বাঁধবে।” 

    — “এখন জমিয়ে কাজ করছি। পনের বছর পর আর করবো না।”

    — “তারপর বসে বসে খাবে?”

    — “হ্যাঁ। এই বাসায়, এই শহরে আমি আর থাকবো না। চলে যাবো দূরে। দূরে কোনো মফস্বলে অনেকখানি জায়গা কিনবো। চার-পাঁচটা রুমের বাড়ি করবো। বাড়ির একপাশে থাকবে ফলের বাগান, অন্যপাশে করবো ফুলের বাগান। শিউলি, কাঠগোলাপ, কামিনি, কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া। বাড়ির সামনে বিশাল উঠোন থাকবে। বৃষ্টি হলে উঠোনে দাঁড়িয়ে ভিজবো, জোৎস্না নামলে মোড়া পেতে বসবো। পুকুর থাকবে একটা। ঘরে ফার্নিচার খুব একটা রাখবো না তবে মনের মতন করে সাজাবো। দেয়ালের রঙ হবে তোমার পছন্দে। ঘরে কোথায় কোন ফার্নিচারটা বসবে সেটা ঠিক করবো আমি। আমাদের আলাদা একটা পৃথিবী হবে সামি। আমরা সারাদিন গল্প করবো, বাগানে পুকুরে ঘুরে বেড়াবো। তখন আর কাজ টাজ করবো না। করবো শুধু সারাদিন তোমার সঙ্গে প্রেম। এতকিছু করতে, শেষ বয়সটা একা কাটাতে টাকার দরকার আছে না বলো? এমনিতে এই কয়বছরে ব্যাংকে ভালোই জমিয়েছি। কিন্তু এতটুকুতে হবে না। আরো অনেক প্রয়োজন।” 

    — “তুমি এতকিছু প্ল্যান করে রেখেছো? কই আমাকে বলোনি তো কিছু!”

    — “বলিনি, আজ বললাম।” 

    — “তবুও প্লিজ নিজের খেয়াল রেখো।” 

    — “খেয়াল রাখার জন্য আছে তো তুমি! এবার শোনো…” 

    মধ্যরাতে বাস ছুটছে নোয়াখালীর পথ ধরে ঢাকার দিকে। স্লিপিং কোচ সার্ভিসের বাসটায় অনেকেই ঘুমিয়ে গেছে। কেউ কেউ জেগে ফেসবুক স্ক্রলিং-এ ব্যস্ত। নবনীর চোখেও ঘুম নেই। সে ব্যস্ত সামির সঙ্গে গল্প করতে। ঘুমায়নি অমিতও। নবনীর ঠিক পেছনের সিটটাতেই বসে আছে সে। মেয়েটা নিচু স্বরে কথা বলছে সামির সঙ্গে। খুব মনোযোগে সেই গল্প শুনছে সে। এর আগে কখনো সে শোনেনি সামির সঙ্গে নবনীর কথোপকথন। আজই প্রথম! গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে অমিতের। 

    .

    সবকিছু গোছগাছ করে নিজের ঘরে এলেন শামীমা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলটা ঠিকঠাক করে, বাতি নিভিয়ে বিছানায় এলেন। এরশাদ সাহেব ডাকলেন তাকে, 

    — “অমিতের আম্মু…” 

    — “হ্যাঁ?” 

    — “একটা কথা কবে থেকেই জিজ্ঞেস করবো করবো করে করা হচ্ছে না।” 

    — “কী কথা? বলো না! 

    — “সব মায়েরাই ছেলের জন্য নিখুঁত মেয়ে খোঁজে। যদিও নিখুঁত মানুষ পৃথিবীতে নেই তবুও খোঁজে। তোমার ছেলের বউটা নিখুঁত না, বিশাল এক খুঁত তার মাঝে আছে তা জেনেও ওকে মেনে নিতে তোমার কষ্ট হয়নি বা কোনো দ্বিধা জাগেনি মনে?” 

    — “কষ্ট হলে তোমাকে বলতাম না?” 

    — “হ্যাঁ তা বলতে। জানি আমি, নবনীকে তুমি ভীষণ পছন্দ করো। বরং প্রথমদিনের চেয়ে এখন আরো অনেক বেশি পছন্দ ওকে। কিন্তু তবুও তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করছে। নবনী ঐ ছেলের মাঝেই বেঁচে আছে, কখনো সুস্থ হবে কি না আমরা জানি না। যদি ও কখনো সামির মাঝ থেকে বেরিয়ে না আসতে পারে? যদি কখনোই আমাদের ছেলের সঙ্গে ওর সংসার না হয়? অমিতের জীবনটা অপূর্ণই রয়ে যাবে, ওর জীবনে ডিভোর্সের দাগ রয়ে যাবে সেসব ভাবনা কখনো এসেছে মনে?” 

    — “একদম আসেনি তা না। ভাবী প্রথম যেদিন বললো নবনীর কথা আমি রীতিমতো অথৈ সাগরে পড়ে গিয়েছিলাম। ও আমার ছেলের বউ সে কারণে না। অমিতের সঙ্গে ওর বিয়ে না হলেও আমি নবনীকে নিয়ে ভাবতাম। ওকে দেখে বুঝার উপায় আছে ও এমন একটা রোগ পেলেপুষে রেখেছে ভেতরে?” 

    — “আমার প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি। ভাবীকে খুব সন্দেহ হচ্ছিল আমার। ভেবেছিলাম অমিতের সঙ্গে এই বিয়েতে উনার মত নেই তাই এসব বলছে বিয়েটা ভাঙার জন্য।”

    — “কিসব যে সন্দেহ করো না অমিতের আব্বু! তেমন কিছুই না। ভাবী আমার ছেলেকে খুব পছন্দ করে। তুমি খেয়াল করেছিলে কিনা আমি জানি না। নবনীর ব্যাপারটা জানার পর সেদিন সারারাত আমি জেগে ছিলাম। ঘুম হয়নি আমার। ওকে নিয়ে ভেবেছি, আমাদের ছেলেকে নিয়ে ভেবেছি। এতদিন আমরা সবাই আশায় ছিলাম নবনীর জীবনে আপাতত কেউ নেই। সুতরাং একসঙ্গে থাকতে থাকতে স্বামী সংসারের প্রতি মায়া মমতা হয়েই যাবে ওর। কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই উল্টে গেল। এই সংসারে নবনীর মন বসবে কি না সেটা নিয়ে একটা ভয় ঢুকে গেল মনে। যতই ভাবি ততই শুধু বাজে খেয়াল আসে। ওর অসুখটা বাদে আর কোনো খুঁত আমি দেখি না অমিতের আব্বু। ও যা করলো আমার জন্য, অমিতের জন্য এইসব আমি ভুলবো কী করে? মেয়েটা অমিতের জীবনে এসেও চলে যাবে, আজীবন আমার ছেলের হাত ও ধরে রাখবে না এটা আমি মেনে নিবো কেমন করে? আবার ওদিকে অমিতেরও কোনো ঠিকঠাকানা নেই। এক মুনিয়া নিয়ে ডুবেছে তো ডুবেছেই। নিজের একটা জীবন আছে সেদিকে খেয়াল নেই। কী যে দিশেহারা একটা রাত পার করেছি আমি। আমার শুধু কান্না পাচ্ছিলো সেদিন।”

    — “আমাকে ডাকলে না কেন?” 

    — “ডাকবো ডাকবো করেও ডাকিনি। ডেকে কি বলতাম তোমাকে? মনের ভেতর কী চলছে কিচ্ছু বুঝিয়ে বলতে পারতাম না। অশান্ত মন নিয়ে কিছু বলা যায় নাকি?” 

    — “তারপর? মন শান্ত হলো কেমন করে?” 

    — “ভাবতে ভাবতেই একটা ব্যাপার মাথায় এল। অমিত নবনীর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না। একদম অসম্ভব ছিল। অমিত মুনিয়াকে ফেলে কাউকে বিয়ে করবে এটা কল্পনাও করা যায় না। কিংবা নবনী? ও অন্য কাউকে বিয়ে করবে সেটা সম্ভব না। তবুও তো হলো! আমাদের চাওয়াটাই সবকিছু না। ভাগ্যে থাকাও জরুরি। ওদের জোড়া বাঁধা ছিল ভাগ্যে। তাই বিয়েটা হলো। সংসারটাও ভাগ্যের জোরে হয়ে যাবে দেখে নিও।” 

    — “আচ্ছা তাহলে তুমি কনফিডেন্ট ওদের সংসার টিকে যাবে?” 

    — “হ্যাঁ। নয়তো ওদের বিয়েটাই হতো না। আচ্ছা একটা কথা বলো তো?”

    — “কী?” 

    — “এতরাতে হঠাৎ এসব কেন জিজ্ঞেস করছো?”

    — “এমনিই। সব জেনেও নবনীকে খুব সহজে মেনে নিলে তাই। সেদিন সব জানার পর বাসায় যখন ফিরছিলাম বেশ দ্বিধায় ছিলাম তোমাকে নিয়ে। কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে বুঝতে পারছিলাম না। ভেবেছিলাম নবনীর সঙ্গে তুমি হয়তো আর কখনো সহজ হতে পারবে না।” 

    — “তোমার ঘর করছি এতবছর হয়ে গেল অথচ আজও আমাকে চিনলে না অমিতের আব্বু! অনি আর নবনীকে আমি আলাদা ভাবি না। ওর জায়গায় আমার অনি যদি এসব সাফার করতো, আমার মেয়ের জন্য তখন আমি যতটা কষ্ট পেতাম নবনীর জন্য আমি ঠিক ততটাই কষ্ট পাই।” 

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৩৫

    ৩৫

    সপ্তাহখানেক ধরে মুনিয়ার ফোনকল আসছে ঘন ঘন। রিসিভ করে না অমিত। মোবাইল সাইলেন্ট করে ফেলে রাখে। মুনিয়া মাথার ভেতর খুব একটা দখল নিতে পারছে না আজকাল। পুরোটা আপাতত নবনীর দখলে। সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান বেশ কিছুদিন ধরে ওকে ঘিরেই আটকে আছে। “নবনী মানসিকভাবে অসুস্থ” এই ব্যাপারটা অমিত মেনে নিতে পারে না। বিশেষ করে নবনী যখন প্রাণখুলে হাসে তখন যেন একটুখানি বেশীই পীড়া দেয়। সুস্থ নবনীকে দেখার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠে। কিভাবে মেয়েটা সুস্থ হবে সেই নিয়ে ভেবে ভেবেই ব্যস্ত সে। নবনীর রোগটা নিয়ে কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তার, গুগল রিসার্চও চলছে প্রতিদিন কয়েকবার করে। রোগের ইতিবৃত্তান্ত ইতোমধ্যে মুখস্থ হয়ে গেছে তবুও রিসার্চ বন্ধ হয়নি তার। পড়ে ফেলা আর্টিকেলগুলো আবারও পড়ে সে। নবনীকে নিয়ে শহরের বেস্ট সাইকিয়াট্রিস্টদের মাঝে একজন, ডক্টর রায়হানের সঙ্গে কথা হয়েছিল তার। সাইকিয়াট্রিস্ট বললো নবনীকে কাল চেম্বারে নিয়ে যেতে। নবনীকে ডক্টরের চেম্বারেই বা কী করে নিয়ে যাবে ভেবে পাচ্ছে না অমিত। ও কখনোই যেতে রাজি হবে না। জোর করে নিয়ে যাবে কি না এই নিয়ে ভীষণ দ্বিধায় আছে। আসলে নবনী রিএ্যাক্ট করবে কিভাবে সেটাই জানা নেই অমিতের। 

    .

    — “দেখি হাতটা দাও।” 

    নবনীর ডাকে ভাবনায় ছেদ পড়লো অমিতের। ওর দিকে তাকিয়ে মলিন হাসলো অমিত। অমিতের হাতটা নিজের হাতের উপর রেখে অন্যহাতে ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজ খুলছে নবনী। 

    — “সকালে অফিসে যাওয়ার সময় বলেছিলাম বিকেলে ড্রেসিং করিয়ে নিও। অথচ করোনি। লোহা দিয়ে হাত কেটেছো, বললাম টিটেনাস দিয়ে নাও, দাওনি 1 ইঞ্জেকশন দিবে না আবার ড্রেসিংও করবে না, তুমি চাও কী বলো তো আমাকে? আঙুলে ইনফেকশন হয়ে পঁচে টচে যাক?” 

    নবনীর দিকে তাকিয়ে রইলো অমিত। ভীষণ যত্নে কাটা জায়গাটাতে ড্রেসিং করে দিচ্ছে নবনী। মনে হচ্ছে যেন সে তার কতজনমের আপন, বহুবছরের মায়ার সম্পর্ক তাদের! নবনী খুব খেয়াল রাখে তার সমস্ত কিছুর। শুধু তার না, অনিরও। নাতাশা বলছিল, নবনী ভীষণ কেয়ারিং। ও সবার কেয়ার করে। তবুও কোন এক অধিকারবোধ থেকে নবনীর কাছে একটু স্পেশাল কেয়ার পেতে ইচ্ছে করে অমিতের। বেশি কিছু না। শুধু একটুখানি! সবার চেয়ে একটুখানি বেশি যত্ন, একটুবেশি ইমপরট্যান্স। 

    নবনীর মুখের উপর বারবার চুল এসে বিরক্ত করছে খুব। ভ্রু কুঁচকানো মুখটা মিষ্টি দেখাচ্ছে ভীষণ। মুচকি হাসলো অমিত। কানের পাশে চুলগুলো গুঁজে দিয়ে সে বললো, 

    — “ইনফেকশন কেন হবে? তুমি আছো না? দেখে দেখে রাখছো, কেয়ার করছো। ওসব আমাকে ধরবে না।”

    কপট রাগে অমিতের চোখে তাকালো নবনী। নবনীর চোখে চোখ পড়তেই মায়ের সেদিন রাতে বলা কথাটা মনে পড়ে গেল, “নবনী শুধুই তোর বান্ধবী না, ও তোর বিয়ে করা বউ।” 

    বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো অমিতের। ভীষণ সংকোচে মুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নিলো সে। নবনী কী যেন বলছে তাকে। ওসব কিছু কানে যাচ্ছে না তার। “ও তোর বউ” কথাটা কানে ঘন্টার মতন বাজছে অনবরত। 

    ৩৬

    — “কোথায় যাচ্ছি আমরা বলো না!” 

    — “১৩ বার।” 

    — “১৩ বার কেন? আমাকে যতক্ষণ না বলবে ততক্ষণ জিজ্ঞেস করতেই থাকবো। “ নবনীর কথার জবাবে কিছু বললো না অমিত। মাথা দুলিয়ে হাসলো শুধু। অফিস থেকে আজ জলদি ছুটি নিয়ে নবনীর কারখানায় চলে গিয়েছিল অমিত। সেখান থেকে নবনীকে ধরে বেঁধে এনে তুলে নিলো গাড়িতে। এখনও নবনীকে বলা হয়নি কোথায় যাচ্ছে ওরা। ভেতরে ভেতরে ভয়ে কুঁকড়ে গেলেও চেহারা যথাসাধ্য স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে অমিত। 

    — “আমি একদম সাসপেন্স নিতে পারি না অমিত!” 

    — “নিতে কে বললো?” 

    — “কারখানা থেকে হুট করে জরুরি কাজ আছে বলে নিয়ে এলে। কী কাজ, কার সঙ্গে কাজ, কোথায় কাজ কিছুই বলছো না। গাড়ি এসে থামলো ধানমন্ডিতে, সাইকিয়াট্রিস্ট ইফতেখার রায়হানের বাসার সামনে। নিজের বাড়িতেই তার চেম্বার। বাড়ির বাইরের নেইমপ্লেটে নাম দেখতেই চেহারার রঙ উড়ে গেল নবনীর। সে চেনে ডক্টর রায়হানকে। বহুবার নাম শুনেছে তার। টিভি চ্যানেলগুলোতে মাঝেসাঝে দেখা যায় তাকে। কিন্তু অমিত এখানে কেন গাড়ি থামালো? 

    — “নবনী? তুমি আমাকে বিশ্বাস করো তো? আমি তোমার ভালো চাই এই বিশ্বাসটুকু আছে আমার প্রতি তাই না?” 

    — “আমরা এখানে কেন এসেছি অমিত?” 

    — “আজ উনার সঙ্গে এপোয়েন্টমেন্ট ফিক্স করেছি।” 

    — “কার জন্য?” 

    নবনীর দিকে ভীষণ সংকোচে তাকিয়ে রইলো অমিত। তাহলে কি অমিত তাকে নিয়ে এসেছে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে? বুঝতে বাকি রইলো না নবনীর। তবে কি অমিত বিশ্বাস করে না সামি আছে? সত্যিই আছে? চোখ ভিজে যাচ্ছে নবনীর। কাঁপাস্বরে সে বললো,

    — “তুমি আমার কথা বিশ্বাস করোনি অমিত!” 

    — “নবনী প্লিজ আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করো না। আমি গুছিয়ে কোনো উত্তর দিতে পারবো না। তুমি একটাবার ভেতরে চলো আমার সঙ্গে?”

    — “আমি তোমাকে ভীষণ বিশ্বাস করি। ভেবেছিলাম তুমিও করো। সামিকে নিয়ে 

    আমি কারো সঙ্গে গল্প করি না। তোমার সঙ্গে করতাম। তোমাকে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল তাই! ভেবেছিলাম আর কেউ না হোক তুমি অন্তত আমার কথাগুলো বুঝবে, সত্যি বলে মেনে নেবে। ভালো তো তুমিও বাসো মুনিয়াকে। পাগলের মতই বাসো। তুমি জানো না ভালোবেসে শুধু জীবন দেয়া যায় না, ফিরে আসাও যায়?” 

    — “তুমি কাঁদছো কেন নবনী? তুমি কষ্ট পাবে এমন কিছু আমি করবো কখনো? এতটুকু বিশ্বাস রাখো আমি তোমার ভালো চাই। তুমি কষ্ট পাবে এমন কিছু আমি কখনো করবো না।

    — “করছো তো অমিত!” 

    — “নবনী কেউ থাকে না তোমার আশপাশে। তুমি একাই কথা বলো। তুমি যাকে দেখতো পাও সে জাস্ট তোমার হ্যালুসিনেশন।”

    — “সামি আমার হ্যালুসিনেশন না।”

    — “আমি তোমাকে কী বলবো, কিভাবে বুঝিয়ে বলবো ভেবে পাচ্ছি না সত্যি। শুধু বলবো ভেতরে চলো প্লিজ। ডক্টর তোমাকে সব বুঝিয়ে বলবে।” 

    — “ভুল ছিলাম আমি। তোমাকে সামির কথা বলা একদম উচিত হয়নি আমার। আমাদের ভালোবাসা বোঝার সাধ্য তোমার নেই। সাধ্যের বাইরে কে কবে কী করতে পেরেছে! বন্ধুত্ব বেঁচে থাকে বিশ্বাসে। ভেবেছিলাম তুমিও আমার অসম্ভব গল্পটা বিশ্বাস করবে, কিন্তু তুমি করোনি। উল্টো নিয়ে এলে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। তার কাছে গিয়ে কী হবে শুনি? মেডিসিন দিবে যেন সামিকে আর কখনো আমি না দেখি? কাউন্সেলিং সেশনে আমাকে বুঝাবে সামি মরে গেছে? হ্যাঁ গেছেই তো, তোমাদের জন্য ও মরে গেছে। আমার জন্য মরেনি, বেঁচে আছে ও। ফিরে এসেছে আমার জন্য, শুধুমাত্র আমার জন্য। যে ভালোবাসা কখনো তোমাদের ছোঁয়নি সে ভালোবাসা বোঝার সাধ্য আছে তোমাদের? কেন আমার কাছে মৃত প্রমাণ করতে চাইছো ওকে? ডক্টরের দেয়া হাবিজাবি মেডিসিন কেন খাওয়াতে চাইছো আমাকে? ওসবে কোনো কাজ হবে না কখনো। সামি ফিরে এসেছে এটাই সত্য। তোমাদের কথায় আমার কিছুই আসবে যাবে না। একটা সহজ হিসেব শুনবে? এইযে আমি বসে আছি তোমার সামনে, শুধুমাত্র সামি ফিরে এসেছে বলেই এখানে বসে তোমার সঙ্গে কথা বলছি। নয়তো আমার আজ এখানে বসে তোমার সঙ্গে কথা বলা হতো না, পরিচয়ও হতো না। মরে যেতাম সেই কবেই।”

    সন্ধ্যে নেমেছে। আবাসিক এলাকার এই রাস্তাটায় এতক্ষণ বাচ্চাদের ছুটোছুটি, বয়স্কদের হাঁটাহাঁটি চলছিল। মাগরিবের আজান হতেই সবাই ফিরে গেছে যার যার বাসায়। হঠাৎ কেমন নির্জনতা নেমে এসেছে এই গলিতে। অন্ধকার, নির্জন এই পথের ধারে গাড়ির ভেতর পাশাপাশি বসে আছে অমিত, নবনী। বাচ্চাদের মতন ঠোঁট উল্টে নবনী কাঁদছে। কখনো ওকে এমন করে কাঁদতে দেখেনি অমিত। নিজেকে বড্ড দিশেহারা লাগছে। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হয়নি সে। নবনীকে কিভাবে সামলাবে তাও ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। নবনীর চোখে তাকাতেও ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। বড্ড অপরাধী লাগছে নিজেকে। মেয়েটা সত্যিই কষ্ট পাচ্ছে খুব। নয়তো এভাবে কেউ কাঁদে বুঝি! অসহায় চোখে নবনীর দিকে তাকালো অমিত। ভীষন জড়তায় নবনীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

    — “কেঁদো না প্লিজ!” 

    — “তুমি আজ বাড়াবাড়ি একটু বেশিই করে ফেললে অমিত। এতগুলো বছরে আমার কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়নি। সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছি যদি কখনো কোনোভাবে ওরা সামির ব্যাপারে জেনে যায়! ওরা কেউ আমাকে বিশ্বাস করবে না আমি জানতাম। তোমার বেলায় এসে কী হলো আমার কে জানে! খুব ভুল হলো আমার। তুমি যা খুশি করতে পারতে অমিত। কিন্তু সামি আমার ভ্রম এতটাও বলার অধিকার কখনোই তোমাকে আমি দেইনি।” 

    অমিতের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে, গাড়ি থেকে নেমে পড়লো নবনী। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এল অমিতও। বড় বড় পা ফেলে নবনী মেইন রোডের দিকে যাচ্ছে। অমিত দৌড়ে গিয়ে নবনীর পথ আটকালো। 

    — “একা কোথায় যাচ্ছো?” 

    — “আমি আর তোমার সঙ্গে কোনো কথা বলতে চাই না।”

    — “বলতে হবে না। ডক্টরের চেম্বারেও যেতে হবে না। তুমি গাড়িতে বসো, আমরা এখনই বাসায় ফিরবো।

    — “কোন বাসা অমিত? তোমার? এই ঘটনার পরও তুমি ভাবছো আমি তোমার বাসায় যাবো? তাও তোমার সঙ্গে?”

    — “কেন নবনী? আমার বাসায় কেন যাবে না?” 

    — “সিরিয়াসলি অমিত! এরপরও তুমি আমাকে উল্টো জিজ্ঞেস করছো আমি কেন যাবো না? খুব হালকাভাবে নিয়েছো পুরো ব্যাপারটা, তাই না? আমার জন্য মোটেও ওরকম কিছু ছিল না। যেহেতু আমাকে তুমি বিশ্বাস করো না তাই তোমার সঙ্গে বন্ধুত্বটাও আর আমি রাখছি না। বন্ধুত্ব যেহেতু থাকছে না, তোমার বাসায় আমি কেন যাব বলো? কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে যাবো?” 

    নবনীর দু’হাত শক্ত করে নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করলো অমিত। মুখ ফুটে কিছু বলছে না সে। অসহায় চোখে শুধু তাকিয়ে রইলো নবনীর দিকে। কয়েকবার অমিতের মুঠো থেকে হাত ছাড়াতে গিয়েও পারলো না নবনী। প্রচন্ড রাগে চিৎকার করে উঠলো সে, 

    — “হাত ছাড়ো আমার!” 

    নামাজ শেষে বাসায় ফিরছে এই এলাকার মানুষেরা। নবনীর চিৎকার শুনে থেমে গেল কয়েকজন। এগিয়ে এসে ওদের দু’জনকে ঘিরে ধরলো সবাই। নানারকম প্রশ্নে জর্জরিত করতে লাগলো অমিতকে, এই মেয়ে কে? আপনি তার কী হন? নির্জন এলাকায় মেয়েকে হয়রানি কেন করছেন? আপনার নাম কী? বাসা কোথায়? কিচ্ছু বলছে না অমিত। নবনীর হাতও ছাড়ছে না। এখনও চেয়ে আছে নবনীর দিকে। অমিতের চোখ স্পষ্ট পড়তে পারছে নবনী। এই হাতজোড়া আজ সে সহজে ছাড়বে না। তার সঙ্গে গাড়িতে উঠে বসা অব্দি ঠায় দাঁড়িয়েই থাকবে এভাবে। পরিস্থিতি বেগতিক হওয়ার আগেই নবনী সামলে নিলো, 

    — “উনি আমার পরিচিত। এমনিতেই একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে। তেমন কিছু না।” 

    নবনীর কথা শুনে নিজেদের মাঝে বিভিন্ন মন্তব্য করতে করতে চলে গেল লোকজন। সবশেষে ষাটোর্ধ এক ব্যক্তি চলে যাবার আগে বলে গেল, 

    — “ঝগড়াঝাটি এভাবে রাস্তাঘাটে করতে হয় না মামনি। মানুষ মন্দ বলবে। আরেকটু হলেই ছেলেটার সঙ্গে বাজে কিছু ঘটে যেত। বাসায় ফিরে যাও তোমরা। এখানে আর দাঁড়িয়ে থেকো না।” 

    লোকটা চলে যেতেই নবনী স্বর নিচু করে বললো, 

    — “গাড়িতে বসছি আমি। এবার হাত ছাড়ো।” 

    নবনীর হাত ছেড়ে দিলো অমিত। গাড়িতে বসে সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে নবনী বললো,

    — “আমি আমার বাসায় যাবো। ওখানে ড্রপ করে দাও।” 

    নবনীর সঙ্গে কথা বাড়ায় না অমিত। তার কন্ঠের গম্ভীরতা আর কিছু বলতে দেয় না অমিতকে। সমস্ত কথাগুলো কোনঠাসা করে দেয় মনের ভেতরই। কী বিশ্রী কান্ড ঘটে গেল! নবনীর সঙ্গে এই দ্বন্দ্বটুকু ভেতরে ভেতরে বেশ ভোগাচ্ছে তাকে। নবনীকে সামলানোর আগে নিজেকে সামলানো জরুরি। মনের কথাগুলো একদম গুছিয়ে উঠতে পারছে না সে। যাক নাহয় নবনী বাবার বাসায়। কথা গুছানো হয়ে গেলে, নিজেকে সামলে নেয়া হয়ে গেলে তখন নাহয় যাওয়া যাবে নবনীর বাসায় ওকে ফিরিয়ে আনতে। 

    ৩৭

    বিষন্ন মনে ঘরে ফিরে এল অমিত। অনি দরজা খুলেই অমিতের মুখ দেখে বুঝে নিলো তার ভীষণ মন খারাপ। পকেটে মোবাইল বাজছে তার। বাজতে বাজতে কেটে যাচ্ছে, আবার ফোন বাজছে। সেই নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। হাত দিয়ে কপাল ঢেকে সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে অমিত। বারবার ফোনের শব্দে বিরক্ত লাগছে অনির। অমিতকে ডেকে সে বললো,

    — “ভাইয়া? কে কল করছে? রিসিভ করছো না কেন?” 

    — “নবনীর বাসা থেকে কল করছে।” 

    অবাক হলো অনি। নবনীর বাসা থেকে কল আসবে আর অমিত সেটা রিসিভ না করে বসে থাকবে এমন কখনো হয়েছে! আবার মনটাও খারাপ দেখা যাচ্ছে। কোনো ঝামেলা হলো না তো! কৌতুহলী হলো অনি। 

    — “কী হয়েছে তোমার? কল কেন রিসিভ করছো না? 

    — “রিসিভ করে কী বলবো?” 

    — “কী বলবে আবার? যা জিজ্ঞেস করবে তাই বলবে। আর এতবার কল করছে যেহেতু জরুরি কিছুই হবে হয়তো!” 

    — “উনারা যা জিজ্ঞেস করবে তার উত্তর আপাতত আমি দিতে পারবো না।” 

    — “কথা প্যাঁচাচ্ছো কেন বলো তো? সহজ করে বলো না কী হয়েছে?” 

    — “একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছি।”

    — “কী?” 

    — “নবনীকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম।” 

    অমিতের দিকে চোখ বড় করে তাকালো অনি। 

    — “সর্বনাশ!” 

    — “সত্যিই সর্বনাশ করেছি। নবনী প্রচন্ড রেগে আছে আমার উপর।” 

    — “ওখানে নিয়ে গেলে কেমন করে? আপু তো রাজি হবার কথা না! “বলিইনি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাবো।” 

    — “কেন ভাইয়া! এই ঝামেলাটা বাঁধানোর খুব প্রয়োজন ছিল?” 

    — “ওর ভালোর জন্যই তো…”

    — “ভালোমন্দ কি আপুকে বোঝানো যাবে? সম্ভব? সামি ভাইয়ার ব্যাপারটা প্রচন্ড সেনসেটিভ ইস্যু। এভাবে হুটহাট কিছু না করে একটুখানি বুদ্ধি খাটিয়ে স্টেপ নিলে ভালো হতো না?” 

    — “এতকিছু ভাবিনি আমি। শুধু চেয়েছি নবনীর সুস্থ হওয়া দরকার। জানতাম, ও যেতে চাইবে না, রাগারাগি করবে। তবে এতটা রিএ্যাক্ট করবে ভাবিনি।” 

    — “কোথায় আছে ও?”

    — “ওদের বাসায়।” 

    — “রাগ করে চলে গেল?” 

    — “হ্যাঁ। খুব কাঁদছিল ও। মনটাই খারাপ হয়ে গেল আমার! ভালো করতে গিয়ে একটা দ্বন্দ্ব হয়ে গেল আমাদের। মুখের উপর বলে দিলো, আমার এখানে আর কখনো আসবে না। আমাদের বন্ধুত্বও শেষ — “স্যরি বলোনি?” 

    — “বলেছি। কাজ হয়নি কোনো। ও খুব কষ্ট পেয়েছে অনি। কাজটা আমি করেছি তাই হয়তো কষ্ট একটু বেশিই পেলো।”

    — “কলটা রিসিভ করো। শুনো উনারা কী বলতে চান?” 

    — “বলবে আবার কী! উনারাও আমাকে একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে। আমি কেন ওকে নিয়ে গেছি সেসব কিছুই কাউকে বুঝিয়ে বলতে পারবো না। তারচেয়ে বরং চুপ থাকি।”

    — “নিজের মতো করে সবটা ভেবে নিচ্ছো কেন? কথা বলোই না একবার! নবনী আপু বাসায় গিয়ে কী বলেছে তা তো আর তুমি জানো না। চাচ্চু নাহয় দু’টো ধমকই দিবে তোমাকে, এরচেয়ে বেশি কিছু তো আর না! তুমি উনাদের কল রিসিভ করছো না এটাও খারাপ দেখাচ্ছে।” 

    অনির পীড়াপীড়িতে কল রিসিভ করলো অমিত। 

    — “চাচ্চু…” 

    — “কখন থেকে তোমাকে কল করছি!” 

    — “একটু ব্যস্ত ছিলাম।” 

    — “এখন আমাকে একটু বলো তো বাবা তুমি কেন নবনীকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলে?”

    — “স্যরি!” 

    — “বুঝলাম তুমি স্যরি। নবনী তো তোমার স্যরি শুনে শান্ত হবে না। ঝগড়া হলো তোমার সঙ্গে জিনিস ভাঙচুর করছে আমার ঘরের এটা কেমন অবিচার? কেঁদেই যাচ্ছে, কেঁদেই যাচ্ছে। মেয়েটা না আমার অসুস্থ হয়ে যায় বাবা! 

    মুখ চুপসে এল অমিতের। কানে ফোন চেপে চুপ করে বসে রইলো সে। কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে শফিক সাহেব বললেন, 

    — “চুপ করে বসে আছো যে! ঝামেলা বাঁধিয়েছো, ঝামেলার একটা সমাধান করবে না?”

    — “সমাধান থাকলে তখনই ওকে সামলে নিতাম। নবনী আমার উপর রেগেও থাকতো না, রাগ করে আপনার ওখানে চলে যেত না।” 

    — “তুমি জানতে নবনী রিএ্যাক্ট করবে, তবুও কেন নিয়ে গেলে ওকে?” 

    — “জানতাম। এতটা করবে তা তো জানতাম না! আর কেন ওকে নিয়ে গেছি সে কথা আপনাকে এক্সপ্লেইন করা পসিবল না। শুধু এতটুকু বলবো, ওর জন্য মায়া হয়, আমি কষ্ট পাই তাই ওকে নিয়ে গেছি। সাত পাঁচ ভাবিনি। এতকিছু আমার ভাবতে ইচ্ছে হয়নি। আমি শুধু সুস্থ, স্বাভাবিক নবনীকে দেখতে চেয়েছি, ব্যস!” 

    — “একটাবার আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়া উচিত ছিল না?”

    — “হ্যাঁ নবনী আপনাদের মেয়ে, অবশ্যই আমার চেয়ে ওর উপর আপনাদের 

    অধিকার বেশি। কিন্তু আমিও ওর কিছু হই সম্পর্কে। ওকে খুব কাছের একজন ভাবি। ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করার অধিকারটা নবনীই আমাকে দিয়েছে। সেই অধিকার থেকে ওকে নিয়ে গেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে নবনীর জন্য বেস্ট ডিসিশন আমি নিতে পারবো, ওর ভালো মন্দ আমি বুঝবো, তাই গেছি। যদি আমাকে নবনী অধিকার না দিতো, ওকে আমি আমার কাছের একজন না ভাবতাম কিংবা ওর ভালো মন্দ আমি বুঝতে পারবো এই নিয়ে দোটানায় থাকতাম তাহলে কখনোই ওর ব্যাপারে একাই কোনো সিদ্ধান্ত নিতাম না। আমি আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করতাম।” 

    অমিতের কথায় কপাল থেকে দুশ্চিন্তার ভাঁজ সরে গেল শফিক সাহেবের। অধিকারবোধ আসে ভালোবাসা থেকে। অমিতও নবনীকে ভালোবাসে। ভালোবেসে ভালো মন্দ বুঝতে চায়। এই ভালোবাসার নাম কী সে কথা শফিক সাহেবের অজানা। তবে এই অধিকার বোধ, ভালো মন্দ বুঝতে চাওয়ার অনুভব করার ব্যাপারটা বেশ লাগছে তার। মনটা বেশ হালকা লাগছে। মনে হচ্ছে যেন এই ছেলেটা মাত্র কয়েকটা কথায় তার দুশ্চিন্তা অর্ধেক কমিয়ে ফেলেছে। মুচকি হেসে অমিতকে তিনি বললেন,

    — “ভালো মন্দ যেহেতু বুঝোই তাহলে নবনীকে একা রেখে পালালে কেন? বাসায় এসে আমার মেয়েকে সামলাও।”

    — “আমাকে দেখলে নবনী আরো রেগে যাবে।” 

    — “তো রাগ ভাঙাও! নবনীর ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলাতে পারো, ওকে না জানিয়ে ওর ব্যাপারে ফট করে সিদ্ধান্ত নিতে পারো অথচ ওর রাগ ভাঙাতে পারো না! ওর কান্নাকাটি আর ভালো লাগছে না আমার। এক্ষুনি বাসায় এসে আমার মেয়েকে শান্ত করো বলছি! দশ মিনিটের ভেতর আমি তোমাকে আমার বাসায় দেখতে চাই।” 

    কল কেটে বেশ শান্ত ভঙ্গিতে সোফায় গা এলিয়ে বসলেন শফিক সাহেব। ঠোঁটের কোণে তার এখনও মুচকি হাসি। ঘরের তিন নারী সদস্য অবাক হয়ে দেখছে তাকে। এমন মুহূর্তে শফিক সাহেবের হাসি দেখে বেশ মেজাজ খারাপও হচ্ছে নীতুর। স্বামীর কাঁধে ধাক্কা দিয়ে কঠিন স্বরে বললেন, 

    — “তোমার হাসি পাচ্ছে নবনীর বাবা!” 

    ঘাড় কাত করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন শফিক সাহেব। মাথা উপর নিচ করতে করতে বললেন, 

    — “রিল্যাক্স লাগছে বেশ। এক কাপ চা দেবে নীতু?” 

    — “নবনী ভেতরে কাঁদছে।” 

    — “ওসব আর আমাদের ভেবে কাজ নেই। অমিত আছে, ও সামলাবে নবনীকে।”

    — “আব্বু, উনি একটা তার ছেঁড়া। আমি সেদিন বললাম পর্যন্ত আপু সাইকিয়াট্রিস্টের নামই সহ্য করতে পারে না। তবুও নিয়ে গেল। আর তুমি ভাবছো উনি এসে আপুকে সামলাবে? উল্টো পরিস্থিতি আরো বিগড়ে দেবে। 

    — “এতটুকু বিশ্বাস করিস তো ও আমার মেয়ের ভালোটাই চাইবে?” 

    — “হ্যাঁ ভালো চায়। কিন্তু ভালো চাইতে গিয়ে গোলমাল করে ফেললো তো!” 

    — “একবারই গোলমাল করলো। এরপর থেকে আর করবে না দেখিস। নতুন তো! শুরুতে একটু আধটু ভুল হয়েই যায়। ব্যাপার না, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। ও আমার মেয়ের দায়িত্ব নিতে চায়। ও ভুল করবে, গোলমাল বাঁধাবে ভেবে যদি নবনীর দায়িত্বগুলো ওকে না দেই, নবনীর ভালো মন্দ সামলাতে না দেই তাহলে চলবে? সারাজীবন আমি আর তোর মা থাকবো? নবনীকে কারো দায়িত্বে রেখে যেতে হবে না?” 

    মেয়ে জামাইর কথার অর্থ বুঝতে বাকি রইলো না জামিলা বেগমের। এবার নিশ্চিন্ত হয়ে পান মুখে পুরলেন তিনি। চিবুতে চিবুতে শফিক সাহেবকে বললেন, 

    — “শান্তি শান্তি লাগতাছে শফিক?” 

    — “অনেক আম্মা!” 

    — “নবনীর আব্বু! অমিত তোমাকে কী বলেছে, বলো তো? কল করার আগে চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলে। এখন কেন এত শান্ত তুমি?” 

    — “অমিত যা বললো নীতু, আমার মন ভরে গেছে আজ। যেদিন শুনলাম মেয়ের সঙ্গে এতবড় কান্ড হয়ে গেছে আমার মনে হচ্ছিল আমি মরেই যাবো! আম্মা সেদিন আমাকে বুদ্ধি না দিলে সত্যিই মামলা টামলা করে মেয়ের ডিভোর্স করাতাম। ভাগ্যিস করাইনি! এতগুলো বছর যে দুশ্চিন্তায় আমরা সবাই ভুগছিলাম, ফাইনালি একটা অন্ত বুঝি হলো। অমিত কী বলছিল, জানো?” 

    — “কী?” 

    — “নবনীকে ও খুব কাছের একজন ভাবে। নবনীই ওকে অধিকার দিয়েছে ওর ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার করার। সেই অধিকার থেকেই নিয়ে গেছে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে। নবনীর এই অবস্থা ও মেনে নিতে পারে না। ওর কষ্ট হয়। ও সুস্থ নবনীকে দেখতে চায়। আমাদের মেয়ের ভালো মন্দ ও বুঝে, ওর ব্যাপারে বেস্ট ডিসিশনটাও ও নিতে পারবে। বুঝতে পারছো কথাগুলো? জানো, ও কথাগুলো খুব জোর গলায় বলছিল! কোনো দ্বিধা কিংবা জড়তা ছিল না একদম। কথাগুলো একদম ওর মনের। লৌকিকতা ছিল না কোনো। এমনটাই তো তুমি আমি চাইছিলাম নীতু! সব জেনেও কেউ আমার মেয়েকে আগলে রাখুক, নবনীকে সুস্থ করে তুলুক। আমরা বোধ হয় পেয়েছি নীতু! অমিতকে পেয়েছি আমরা।” 

    — “অমিত ভাইয়া আপুকে ভীষণ পছন্দ করে জানি। কিন্তু তুমি যেভাবে ভাবছো ব্যাপারটা তেমন নাও হতে পারে, তাই না বাবা? শুধু বন্ধুত্ব থেকেই হয়ত আপুকে নিয়ে এত ভাবে ভাইয়া!” 

    — “ভালো চিন্তা কর নাতাশা। শুরুতে বন্ধুত্ব, দাবি খাটানো কোনোটাই ছিল না। অমিত আমার নাতিনরে আগে দেখলে মুখ কুঁচকায়া রাখতো। তারপর নবনী আর অমিতের ভালো একটা সম্পর্ক হইলো। তারপর বন্ধুত্ব। তুই নিজেই একবার ভাব, দিনদিন ওগো বন্ধুত্ব গভীর হইতাছে কি না? ওরা দুইজন যখন একসঙ্গে থাকে হাসিখুশি সময় কাটাইতাছে কি না? একটু আগে তোর বাপ যে কইলো অমিত নবনীর উপর অধিকার বোধ থেইকা এই কাম করছে, এই অধিকারবোধ আইলো কেমনে? সম্পর্ক গভীরে যাইতাছে তাই অধিকারবোধ জন্মাইছে। যাক না আরো সময়, ধীরে ধীরে মহব্বত-ভালোবাসাও হইবো।” 

    — “আমিও আজকের পর থেকে সবকিছু পজিটিভলি ভাববো। অমিত এখন থেকে শুধু আমার ভাতিজা না, আমার মেয়ের জামাইও। ছেলে হিসেবেও অসাধারণ। ঐ অসভ্য মূর্খ রমিজ অঘটনের মাঝে একটা কাজের কাজ করেছে নবনীকে অমিতের হাতে তুলে দিয়ে। এবার ভালো ভালোয় সব মিটে গেলে হয়! নীতু, জামাই আসবে বাসায়। শান্তাকে নিয়ে রাতের খাবার আয়োজন করো গিয়ে। আর নাতাশা, ঘরটা একটু গোছগাছ কর। ওর আসতে বেশি সময় লাগবে না কিন্তু।” 

    .

    — “নবনী, দরজাটা খুলবে প্লিজ!” 

    আধঘন্টা ধরে নবনীর দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে অমিত। ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা বোধহয় পণ করেছে, আর কখনো অমিতের সঙ্গে কথা বলবো না। হতাশ চোখে বারবার নাতাশার দিকে তাকাচ্ছে অমিত। চোখের ইশারায় অমিতকে স্বান্তনা দিচ্ছে সে। ফিসফিসিয়ে অমিত বললো, 

    — “দরজা ভেঙে ফেলি?” 

    — “ইশ্! ঝগড়া করেছেন আপনারা, দরজা কেন আমাদের বাসার ভাঙবেন? অলরেডি আপনার বান্ধবী আমাদের বাসার কিছু জিনিস ভেঙে ফেলেছে। বান্ধবীকে বাসায় নিয়ে যাবার সময় অবশ্যই আমাদের ক্ষতিপূরণ দিয়ে যাবেন।”

    — “দরজা ভাঙি, তারপর ওটার ক্ষতিপূরণও দিয়ে যাবো। নয়তো সারারাত এভাবে কেটে যাবে নবনী দরজা আর খুলবে না।”

    — “মিষ্টি করে ডাকুন না আরেকবার! এবার দরজা খুলে যাবে। লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিয়ে আবারও নবনীকে ডাকতে লাগলো অমিত, 

    — “নবনী আমার কিন্তু ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে! আমি এতবার ডাকছি তোমাকে অথচ তুমি দরজা খুলছো না। একটা ভুল নাহয় করেই ফেলেছি তাই বলে এভাবে বন্ধুত্বটাই শেষ করে দেবে!”

  • …………………
  • — “ঝগড়া করো, প্রয়োজনে দুই চারটা চড়-থাপ্পর দাও। রাগ টাগ ঝেড়ে ফেলো না নবনী! এভাবে চুপ করে থাকলে রাগ কখনো মিটবে?” 

  • …………………
  • — “আমরা কি আর কখনো কথা বলবো না? তুমি আমাকে আর দেখতে চাও না?” 

    — “ঠিক আছে চলেই যাচ্ছি আমি! আর কখনো আসবো না তোমার সামনে।”

    নাতাশা হাত চেপে ধরলো অমিতের। দরজার কাছ থেকে সরে গিয়ে বললো,

    — “আশ্চর্য! রাগ ভাঙাতে এসে নিজেই রাগ করে চলে যাচ্ছেন কেন?” 

    — “ধুর! যাচ্ছি কে বললো? আমি এখান থেকে না গেলে নবনী দরজা খুলবে না। চাচী চা-নাস্তার আয়োজন করেছে আমার জন্য। বান্ধবীকে ডাকতে ডাকতে ক্ষুধা লেগে গেছে আমার। যাই, কিছু খেয়ে আসি এই ফাঁকে।” 

    — “নবনী, দরজা খোল বইন। তোর আলমারিতে টাকা রাখছিলাম। ঐটা নিমু।” নানীর ডাকে বিরক্ত হলো নবনী। নাক টানতে টানতে বললো, 

    — “তুমি আমার আলমারিতে কেন টাকা রেখেছো নানী?” 

    — “ক্যান? আলমারির গায়ে লেখা আছে তোর আলমারিতে আমি কিছু রাখতে পারুম না?” 

    — “দরজা খুলবো না আমি!” 

    — “আরেহ্ খুলবি না ক্যান? অমিত চইলা গেছে।” 

    — “সত্যিই গেছে?” 

    — “হ সেই কখনই তো! এত কইরা ডাকলো তুই শুনোস নাই। তোর জন্য কি সারাদিন দাঁড়ায়া থাকবো নি!” 

    দরজা খোলার আগে কিছুক্ষণ বসে ভাবলো নবনী। নানী নাটক করছে না তো! নিজের আলমারি ছেড়ে ওর আলমারিতে টাকা কেন রাখবে? অমিত সত্যিই চলে গেছে? হ্যাঁ গেছে হয়তো! অনেকক্ষণ ধরে কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি ওর। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে দাঁড়ালো নবনী। নানীর পেছন পেছন নাতাশা আর মা এসেছে। তিনজনে মিলে কেন দরজা খুলিসনি, ছেলেটার মন খারাপ হয়েছে, কিছু মুখে না দিয়েই বাসা থেকে চলে গেল, মেহমানের সঙ্গে এমন আচরণ করে কেউ এসবই বলছিল। অস্পষ্ট হয়ে নবনীর কানে সেসব পৌঁছাচ্ছে। তখনও তার মাথা জুড়ে ছুটোছুটি করছে, অমিত কেন ওকে বুঝলো না? 

    হঠাৎ ঝড়ের গতিতে কে যেন এসে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো পায়ের কাছে। ছলছল চোখে নবনী চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে, অমিত তার সামনে বসে! 

    একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে লাগলো, 

    — “তোমরা সবাই মিথ্যে বলেছো আমাকে!”

    — “মিথ্যে না বললে দরজা খুলতি তুই?” 

    — “কেন খুলবো আমি? অমিত ডাকলেই দরজা খুলতে হবে?” 

    — “তুমি আমাকে ডাকলে পাহাড় ডিঙিয়ে তোমার কাছে ছুটে আসবো। আর তুমি আমার ডাকে দরজা খুলতে পারবে না!” 

    ৩৮

    অমিত নবনীর সংসারের চারমাস চলছে। দিব্যি কেটে যাচ্ছে ওদের মিছেমিছি সংসারের দিনগুলো। ভোরের দিকে উঠে অনি আর নবনী হেল্পিং হ্যান্ডকে নিয়ে হাতে হাতে তৈরী করে নেয় সকালের নাস্তা আর দুপুর রাতে খাবার তরকারী। নাস্তা সেরে অমিত, নবনী বেরিয়ে পড়ে গাড়িতে করে আর অনি চলে যায় স্কুটি চালিয়ে নিজের ভার্সিটিতে। নবনীকে কারখানায় ড্রপ করে অমিত যায় অফিসে কিংবা কখনো সখনো ইভেন্ট ভেন্যুতে। কাজের ফাঁকে নিয়ম করে খোঁজ নেয়া চলছে দুজনের, অবসর সময়ে চলছে মেসেঞ্জার টেক্সটিং। ছুটির দিনে একসঙ্গে কাঁচাবাজার, মাছবাজার ঘুরে পুরো সপ্তাহের বাজার করা, প্রতি বৃহস্পতিবার রাত জেগে অমিতের হাতের চওমিন কিংবা নবনীর হাতের ফ্রেঞ্চফ্রাই খেতে খেতে চারজনে মিলে মুভি দেখা। কোনো ঝামেলা হলেই নবনীকে কল করে ফটাফট সমাধান পাওয়া, জোৎস্নারাতে কফি হাতে সুখ দুঃখের গল্প করা, কাজের চাপ যেদিন কম থাকে সেদিন দুজনে মিলে হুটহাট প্ল্যান করে বেরিয়ে পড়া আরো কত কী! সব মিলিয়ে জীবনের অসাধারণ এক সময় কেটে যাচ্ছে অমিতের। অনেক অনেক লম্বা সময় বাদে হাসি আনন্দে ঘেরা জীবন কাটছে তার। নবনী এই বাসায় থাকার সুবাদে নাতাশাও প্রায়ই চলে আসে এখানে। অনির আনন্দে দিন কেটে যায়। একা একা সবকিছু সামলাতে হয় না, সময় কাটাতে হয় না। যে মেয়েটার গলার আওয়াজ খুব একটা শোনা যেত না, সেই মেয়ের ঘর থেকে গভীর রাতে হাসির শব্দ, হৈ হুল্লোড়ের শব্দ শোনা যায়। কখনো কখনো দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের তিনজনের আনন্দ দেখে অমিত। বেশ লাগে তার! একই ঘরে থেকেও অনির সঙ্গে বসে গল্প করা হয়নি এতগুলো দিনে। মা-বাবাও আসতো না খুব একটা। টিভির আওয়াজ, ফ্যানের শব্দ, রান্নাঘরে-ডাইনিংরুমে টুংটাং শব্দ ছাড়া আর কোনো সাড়াশব্দ খুব একটা পাওয়া যেত না এই ঘরে। নবনী এসেছে পর থেকে এই ফ্ল্যাট সদা সরগরম। গল্প হচ্ছে, হাসি ঠাট্টা হচ্ছে, কখনো কখনো তার সঙ্গে গলা ফাটিয়ে ঝগড়াও হচ্ছে। অনির সঙ্গে পুরোনো সেই সম্পর্কটা আবার তাজা হয়েছে, মা বাবা প্রতিমাসে নিয়ম করে আসছে। বন্ধুদের সঙ্গে দূরত্ব মিটেছে। মাসে একবার দুইবার তাদের নিয়ে এই বাসায় চা-নাস্তার আসর জমছে। বাবা-মা বাসায় এলে নবনীর বাসার সবাইকে নিয়ে আসা হয় এই বাসায়। ধরে বেঁধে এখানে রেখে দেয়া হয় তাদের দুইদিনের জন্য। দুই পরিবারের এই মিলনমেলা অসাধারণ লাগে অমিতের। সকালে আর রাতে পুরো পরিবার ড্রইং রুমের ফ্লোরে বসে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া, ছুটির দিনের বিকেলে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া, নানীর কাছে পুরোনো দিনের গল্প শোনা, বসার ঘরে সবাই মিলে সাদাকালো দিনের ছবি দেখা, মা আর চাচীর হাতের চমৎকার সব রান্না, আর রাতের বেলায় বড়দের বিছানা ছেড়ে দিয়ে অনি নাতাশা আর নবনীকে নিয়ে ড্রইংরুমে বিছানা পেতে ঘুমানো। অবশ্য ঘুমানো বললে ভুল হবে, রাত জেগে গল্পই তো করা হয়! পুরো রাত গল্প করে ভোরে এসে একটুখানি ঘুমানো তারপর সকাল সাড়ে আটটায় উঠে নাস্তা করে রেডি হয়ে ঘুমে টলতে টলতে সাড়ে নয়টা নাগাদ যার যার কাজে বেরিয়ে পড়া। পুরো মাস জুড়ে অমিত অপেক্ষা করে এই সময়টার জন্য। মাস ফুরোলেই মা-বাবাকে বারবার কল করে বলতে থাকে, আসো না কেন তোমরা? এত কী কাজ ওখানে তোমাদের? সব ফেলে চলে আসো তো! জীবন নিরামিষ লাগছে আমার। এখানে এসে আমার বাসার আবহাওয়া চাঙ্গা করো। 

    জীবন সুন্দর! বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর। যে জীবন পেলে বারবার এই পৃথিবীতে ফিরে আসার সাধ জাগে, সময়গুলো বাক্সবন্দি করে রাখতে ইচ্ছে হয়! এইসব কিছুর কৃতিত্ব সামনে গুনগুন করে গান গাওয়া, চোখের ইশারায় দুষ্টুমি করতে থাকা মেয়েটার। ছোটবেলায় কার্টুনে দেখতো ম্যাজিশিয়ানরা তুড়ি বাজিয়ে খালি প্লেটে চিকেন ফ্রাই/বার্গার হাজির করে, সাদামাটা বেডরুমকে খেলনায় ভরপুর করে ফেলে, কুঁড়েঘর থেকে আকাশে কিংবা সমুদ্রে নিয়ে যায়। নবনীকেও অমিতের ম্যাজিশিয়ান মনে হয়। এক তুড়িতে সবকিছু বদলে দেয়া ম্যাজিশিয়ান। কিংবা বলা যেতে পারে মিরাকেল! দুইবছর সে অপেক্ষায় ছিল একটা মিরাকেলের। অসহ্য একাকিত্বের রাতগুলোতে বারবার মনে হতো, ইশ্! একটা মিরাকেল, জাস্ট একটা মিরাকেল হতো জীবনে! সকালে ঘুম থেকে জেগেই শুনতে পেতো আজ তার বিয়ে! গোটা দুইবছর অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। জীবনে মিরাকেল হয়েছে। একদিন ঘুম থেকে জেগে সত্যি সত্যি শুনতে পেয়েছে আজ তার বিয়ে! শুধু মানুষটা অদল বদল হয়ে গেছে। মুনিয়ার বদলে নবনী। আর একচুয়াল মিরাকেলটা ছিল ঠিক এখানেই! ভাগ্যিস ও এসেছিল জীবনে! নয়তো এমন করে অগোছালো জীবনটা, অশান্ত মনটা, ছিঁড়ে যাওয়া সম্পর্কের সুতোগুলো কে গুছিয়ে দিতো, শান্ত করতো, জোড়া লাগাতো? সৃষ্টিকর্তার দরবারে রোজ কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুল হয় না তার, নবনীর হাতে এ জীবন তুলে দেবার কৃতজ্ঞতা! 

    — “অমিত তুমি হাসছো? দেখি দেখি? হাসছো তুমি!”

    ইশ্! নবনীকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কখন যে ঠোঁটের কোনো হাসি ফুটলো কে জানে! সঙ্গে সঙ্গেই ভ্রু কুঁচকে কঠিন গলায় অমিত বললো, 

    — “হাসবো কেন! হাসির কিছু হয়েছে?” 

    — “তুমি আমার নাচ দেখে হাসছিলে। জানি তো আমি!” 

    টিভিতে গান বাজছে। হাওয়া মে উড়তা যায়ে মেরা লাল দোপাট্টা মাল মাল কা। নবনী গানের তালে ওড়না দুলিয়ে তখনও নেচে চলছে। প্রচন্ড হাসি পাওয়া সত্ত্বেও চেপে রইলো অমিত। ধমকে উঠলো নবনীকে। 

    — “কখনো চোখের ইশারায় কিসব করছো, এখন আবার ওড়না দুলিয়ে নাচছো! স্টপ দিস। ইরিটেট হচ্ছি আমি!” 

    মাথায় ঘোমটা টেনে ঝড়ের গতিতে অমিতের পায়ে এসে পড়লো নবনী। সুর করে বলতে লাগলো, 

    — “ও আমার স্বামী, স্বামী গোওওও! ও স্বামী, কইরাছি কী ভুউউউল আমিইই? ও আমার স্বামী, স্বামীইগোওও…” 

    জোর করে হাসি চেপে রাখা ভীষণ কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বারবার না চাইতেও চোখে মুখে প্রকাশ পেয়েই যাচ্ছে। অমিতের পায়ে জোরে চিমটি কাটলো নবনী, 

    — “জোর করে হাসি চেপে রাখো তুমি! শয়তান ব্যাটা! একঘন্টা ধরে পেছন পেছন ঘুরছি তোমার রাগ ভাঙাবো বলে। সার্কাসের জোকার হয়ে গেছি আমি। তবুও তুমি হাসছো না!” 

    — “আমার রাগ নিয়ে আমি বসে থাকবো, তাতে তোমার কী?” 

    — “আমার তো কতকিছুই! কথা বলছো না আমার সঙ্গে। আমাকে দেখলেই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছো। ধুমধাম শব্দ করে দরজা বন্ধ করছো। গাল ফুলিয়ে বসে থাকছো। দেখতে ভালো লাগে আমার?” 

    — “আমার সঙ্গে কথা বলার জন্য মরে যাচ্ছো তুমি?” 

    — “হ্যাঁ মরছিই তো।” 

    নবনীর কান টেনে ধরলো অমিত। বললো, 

    — “গতকাল ঝগড়া কে করেছিল?”

    — “আমি।” 

    — “ফোন সুইচড অফ কে করেছিল?” 

    — “আমি।”

    — “কেন করেছিলে?” 

    — “তুমি বারবার কল করে বিরক্ত করছিলে, তাই।” 

    — “আমি কল দিলে তুমি বিরক্ত হও। আমার কথা তোমার বিরক্ত লাগে। তাহলে এখন কেন কথা বলতে চাইছো আমার সঙ্গে?”

    — “আচ্ছা বলছি তো! কান ছাড়ো আমার।”

    নবনীর কান ছেড়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো অমিত। একলাফে ফ্লোর ছেড়ে অমিতের পাশে বসে পড়লো নবনী। তার গাল চেপে নিজের দিকে ফিরিয়ে নবনী বললো, 

    — “আর্জেন্ট ডেলিভারী ছিল। আজ এগারোটার আগে পৌঁছাতে হবে। পুরো রাত কাজ না করলে শেষ করতে পারতাম না। সব ওয়ার্কার এতরাতে কাজ করতে চায় না। হাফ ওয়ার্কার চলে গেছে এশার আজান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। বাকিরা গেছে নয়টায়। কারখানায় ছিল শুধু চারজন আর সঙ্গে আমি। পাঁচজনে মিলে আর কতটুক কাজ আগাবো বলো? সবাই মিলে কাজ করলে বারোটা নাগাদ শেষ হয়ে যেত।” 

    — “আমি তোমার কারখানার বাইরে দাঁড়িয়ে কতবার কল করলাম! দরজা খুলোনি তুমি। কলও রিসিভ করোনি। উল্টো ফোনের সুইচ অফ করে দিলে।”

    — “দরজা খুললেই বিপদ! তুমি আমাকে রেখে আসতে ওখানে? ধরে বেঁধে বাসায় নিয়ে আসতে না?”

    — “তুমি ঝগড়াও করেছো আমার সঙ্গে।”

    — “কাজের প্রেশার ছিল খুব। তার উপর তুমি রাগারাগি করছো, একের পর এক কল করছো। মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিল!” 

    — “রাগ করবো না আমি! কতবার বলেছি এতরাত জেগে কাজ করবে না। কাজের এত স্ট্রেস নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আয়নায় নিজেকে দেখেছো একবার? অসুস্থ দেখাচ্ছে তোমাকে। একবার শুধু বলে দেখো তোমার মাথা ঘুরাচ্ছে, ট্রাস্ট মি নবনী! আজ তোমাকে আমি ছাদের উপর থেকে নিচে ফেলে দিবো।” 

    — “দিও। এবার রাগ ছাড়ো অমিত। ভালো লাগছে না তোমার গাল ফোলানো দেখতে।”

    — “তোমার ভালোর জন্যই তো বলি। কেন শোনো না আমার কথা?”

    — “শুনি তো!” 

    — “কিচ্ছু শোনো না। মাঝেমাঝে এমনভাবে ইগনোর করো যেন আমি তোমার কেউ না।”

    — “এত কঠিন করে কেন বলছো? কোন কথাটা শুনিনি বলো তো?” 

    — “বারবার বলি যতকিছু হয়ে যাক রাতে তুমি বাসায় থাকবে। তুমি বাইরে থাকলে টেনশন হয় না আমার?” 

    — “তুমিও আমার সঙ্গে কারখানায় চলে এসো। তাহলেই আর টেনশন করতে হবে না।” 

    চেহারা কুঁচকে নবনীর দিকে তাকালো অমিত। ঠোঁট চেপে হাসলো নবনী। অমিতের হাত টিপে দিতে দিতে বললো, 

    — “বাদ দাও না ভাই! ভুল হয়ে গেছে আমার।” 

    — “তোমার কারখানায় একদিন আমি আগুন ধরাবো।” 

    — “আচ্ছা যা খুশি করো। এবার রাগ টাগ ছাড়ো প্লিজ। অনেক হলো তো! শোনো, চলো আমরা চারজন মিলে বাইরে ডিনার করে আসি। তোমার ফেভারিট পেরি পেরি চিকেন খাওয়াবো, উইথ গারলিক মাশরুম রাইস।”

    — “বিল তুমি দিবে। সঙ্গে অবশ্যই আমার গাড়ির তেল খরচও।” 

    — “রাগ ভাঙানোর ঘুষ?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “খাবার বিল, তেলের খরচ আর এমন কী! তোমার জন্য আমার আস্ত কলিজাটাই হাজির।” 

    — “শুধু কলিজা দিয়ে কী করবো? সঙ্গে মনটাও দাও।” 

    — “মনটা যে সামিকে দিয়ে দিয়েছি বহু আগেই।

    — “ভালোই ব্যালেন্স করতে শিখেছো। মন বয়ফ্রেন্ডের জন্য আর কলিজা হাজবেন্ডের জন্য।”

    — “শিখতে হয় অমিত। একজীবনে দুই পুরুষ থাকলে এভাবেই ব্যালেন্স করতে হয়।”

    — “নষ্ট মহিলা! তোমার ঐ বয়ফ্রেন্ডকে দেখতে পারি না আমি। শালা একটা সতীন!” 

    ৩৯

    রেস্টুরেন্টে একসঙ্গে বসে আড্ডায় মেতে উঠেছে ওরা। খাবারের ফাঁকে চলছে হাসি আর গল্প। গল্প করতে করতে হঠাৎ অমিতকে চোখে পড়লো নবনীর। ও হাসছে, গল্প করছে অথচ মনের ভেতর চলছে অন্যকিছু। অস্থির হয়ে উঠেছে কেমন! কিন্তু কেন? অমিতকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো নবনী। মুচকি হেসে সেই প্রশ্ন হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো সে। অমিতের নাম্বারে টেক্সট এল। স্ক্রিন অন করতেই সেদিকে চোখ গেল নবনীর। 

    ‘বাইরে আসবে ৫ মিনিটের জন্য?’

    অমিত কোনো রিপ্লাই না দিয়ে স্ক্রিনলক করে রেখে দিলো টেবিলের উপর। 

    কৌতুহলী হলো নবনী। বাইরে কে ডাকছে তাকে? সেও নিশ্চয়ই এখানে উপস্থিত! আশপাশে চোখ ঘুরাতেই দেখতে পেলো অমিতের বরাবর সামনের সারিতে মুনিয়া বসে আছে! নড়েচড়ে বসলো নবনী। এই তবে অমিতের অস্বস্তির কারণ!

    মোবাইল ভাইব্রেট হচ্ছে অমিতের। অমিত মোবাইল হাতে নেবার আগেই নবনী নিয়ে নিলো। স্ক্রিনে একটু আগে ম্যাসেজ আসা সেই নাম্বার। মুনিয়া কল করছে। নিজের পার্সে মোবাইল রেখে নবনী মুচকি হাসলো। অমিতের আরেকটুখানি কাছে এসে বললো, 

    — “খুব বেশি অস্বস্তি হচ্ছে?” 

    — “নো, আ’ম ফাইন।”

    — “তুমি চাইলে এখনি বের হয়ে যাবো।” 

    — “একই শহরে আছি আমরা। দেখা হতেই পারে। মুখ লুকিয়ে আর কতদিন থাকা যাবে? অনেকদিন বাদে এভাবে দেখা হলো তো! তাই একটু কেমন কেমন লাগছে আর কী। বসি কিছুক্ষন, ঠিক হয়ে যাবে।

    — “এক্সাক্টলি! প্রবলেম ফেইস না করে চিরতরে মেটানো সম্ভব না। আছি তো আমি। খুব বেশি রেস্টলেস ফিল হলে বলো আমাকে। শক্ত করে আমার মুঠোয় হাত ধরে বসে থাকবো। দেখবে মুহূর্তেই সব অদ্ভুত অনুভূতি হাওয়া! নাও, এবার হা করো তো?” 

    অমিতের মুখের সামনে খাবার ধরলো নবনী। চোখ ছোট করে তার দিকে তাকালো অমিত। অমিতের গাল চিপে মুখের ভেতর খাবার ঢুকিয়ে দিতে দিতে নবনী বললো, 

    — “এভাবে তাকানোর কী আছে?” 

    — “খাইয়ে দাওনি তো কখনো! আজ এত প্যাম্পার করছো তাই একটু অবাক হলাম।” 

    — “তোমার গার্লফ্রেন্ডকে দেখিয়ে দিচ্ছি, সে চলে গেলেও তোমাকে দেখে রাখার মানুষের অভাব নেই। তুমি ভালো আছো, যত্নে আছো।”

    — “আচ্ছা! তাহলে তুমি আমাকে প্যাম্পার করছো না। জাস্ট শো অফ করছো!” 

    — “হ্যাঁ শো অফ করছি। এবার হা করো।” 

    — “যাক বাবা! বিয়ের চারমাস পর শো অফ হোক আর যাই হোক মুখে তুলে খাইয়ে তো দিচ্ছো। ভাগ্যিস মুন এসেছিল, নয়তো বউয়ের হাতে এই খাবারটুকু জুটতো না।” 

    মিষ্টি খুনসুটিতে মেতে উঠেছে ওরা দু’জন। সেলফি তোলার বাহানায় লুকিয়ে ওদের ভিডিও করছে নাতাশা। মা, নানী আর চাচী দেখলে খুশিতে আটখানা হবে একদম! অনি ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো একবার। মুনিয়া এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অমিত-নবনীর দিকে। তার চোখেমুখে লেপ্টে আছে মন খারাপের ছায়া। মুখ আড়াল করে হাসলো অনি, স্বস্তির হাসি। ইচ্ছে হচ্ছে তাকে ডেকে বলতে, যা হারালে তা আর এজনমে মিলবে না মেয়ে। খুঁজে এসো গোটা পৃথিবী। অমিতের মতন ভালো আর কে বাসবে তোমাকে? 

    .

    এরশাদ সাহেব ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছেন অনেকক্ষন হলো। ঘুম আসছে না শামীমার। হোয়াটসঅ্যাপে পাওয়া ভিডিওটা বারবার দেখছেন তিনি। ছেলে, ছেলের বউকে কী দারুণ দেখাচ্ছে! নবনী মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে, মিষ্টি করে ওরা দু’জন হাসছে। সারাদিনের যত ক্লান্তি ছিল সব উধাও হয়ে গেছে এই ভিডিওটা দেখে। তবে সমস্যার কথা হলো এতরাতেও ঘুমটা যে আসছে না! গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন এরশাদ সাহেবকে ডাকলেন তিনি। 

    — “অমিতের আব্বু? এই অমিতের আব্বু?” 

    কোনোরকম এক চোখ মেলে তাকালেন এরশাদ সাহেব। 

    — “কী চাও?” 

    — “একটা কথার উত্তর দাও তো?” 

    — “বলো?” 

    — “ছেলের বউ ছেলেকে মুখে তুলে খাইয়ে দিবে ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। আমার আনন্দ হবে সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু আনন্দে আমার ঘুম আসবে না এটা তো অস্বাভাবিক, বলো? আমার ঘুম কেন আসছে না অমিতের আব্বু?”

    — “শামীমা! রাত বিরাতে ডেকে তুলে অদ্ভুত প্রশ্ন করা কবে বন্ধ হবে তোমার?” 

    ***** 

    রাতে খুব একটা ঘুম হয় না জামিলা বেগমের। পান খেয়ে, পুরোনো স্মৃতিচারণ করে, তাহাজ্জুদ আর জিকির করেই রাতের বেশিরভাগ অংশ কাটে তার। আজ তার সময় কাটছে পুরোনো ছবির অ্যালবাম ঘেটে। এই ছোট্ট অ্যালবামটা জুড়ে আছে সামি। এটা কিনেও দিয়েছিল সামি। মারা যাবার ঠিক দেড়মাস আগে এই অ্যালবামটা এনে বলেছিল, এখানে শুধু তোমার আর আমার ছবি থাকবে। দীর্ঘ আটবছরে প্রতি পহেলা বৈশাখে, ঈদে নিয়ম করে ছবি তোলা হয়েছিল ছেলেটার সঙ্গে। সেই ছবিগুলোই এই ছোট অ্যালবামটাতে নিজেই সাজিয়ে রেখে গিয়েছিল ছেলেটা। এখনো ঠিক সেভাবেই আছে। একটা ছবিরও জায়গা পরিবর্তন হয়নি, জামিলা বেগম হতে দেননি। রাতে খাবারের পর তার মেয়ে এসেছিল এই ঘরে, ফোনে নবনী অমিতের ভিডিও দেখাতে। খুশি লাগছিল খুব। নবনীর জীবনটা বুঝি গুছিয়ে এল এবার! সেইসঙ্গে বুকের মধ্যে কোথায় যেন চিনচিনে এক ব্যথা! দীর্ঘসময় যাকে নাতিন জামাই ভেবে এসেছেন, আপন করে কাছে কাছে আগলে রেখেছেন সেই মানুষটা চিরতরে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাবার ব্যথা। আজ ভীষন কান্না পাচ্ছে তার। অঝোরে কাঁদছেন তিনি। ছবির উপর আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জামিলা বেগম বলছেন, — “যার লগে খোদা নবনীরে বাইন্ধা দিলো ঐ মানুষটা খুব ভালো। হীরার টুকরা 

    কইতে পারো। ওর কাছে ভালো আছে নবনী, ও আমার নাতিনরে সুখেই রাখবো। একটা সময় বাদে হয়তো নবনী সুস্থ হইবো, সংসারী হইবো। সবই ঠিকঠাক চলবো। থাকবা না খালি তুমি। নবনীর সংসার, সুখ সব তো হওয়ার কথা ছিল তোমার লগে। আজকে ঐ জায়গায় অন্য কেউ দাঁড়ায় আছে। নসীবের জোরে সব বদলায় গেল! আমার মানতে একটু কষ্টই হয়! নবনীর সুখ চাই আবার তোমারেও ভুলতে পারি না। ভাইগো! তোমারে আমার খুব মনে পড়ে। তোমার লাইগা ভেতরটা আমার পুইড়া ছারখার হয়। তবুও মনরে শক্ত কইরা আমি নবনীর ঘর সংসারের সিদ্ধান্ত নেই। তুমি কি আমারে কবর থেইকা দেখতে পাও ভাই? শুনতে পাও আমারে? আমারে কি তুমি স্বার্থপর ভাবো?” 

    *****

    — “তোমার কী মনে হয়, হি স্টিল লাভস হার? অর এ্যনি সফট ফিলিংস?” আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো নবনী। সামির প্রশ্নে থমকে গেল সে। 

    — “কী ভাবছো?” 

    — “তোমার কাছে কী মনে হয়? ও এখনও ঐ মেয়েটাকে ভালোবাসে?” 

    — “নট সিওর। বাট, একেবারে ভুলেও যায়নি। কিংবা থাকে না এমন, থাকা কিংবা না থাকাতে আমার বয়েই গেল, ওরকমটা না। মুনিয়ার থাকা না থাকা এখনও অমিতের উপর প্রভাব ফেলে।’ 

    — “তাহলে ভালোবাসা আছে এমনটা ভেবে নেয়া ভুল কিছু হবে না?” 

    — “উঁহু।” 

    — “বিপদ তো!” 

    — “হ্যাঁ বিপদই। এই টক্সিক মেয়েটাকে চিরতরে মুছে ফেললেই ভালো হতো। কখন আবার ওর লাইফে ব্যাক করে কে জানে!”

    — “অমিত আবারও ওর পেছন পেছন যদি যায় এবার নির্ঘাৎ আমি ওর গালে কষে চড় লাগাবো।” 

    — “যাক সেসব। এসব মারামারি পরে দেখা যাবে। এবার বলো ওর জন্মদিনে কী প্ল্যান করছো?”

    — “ভালো কিছু।” 

    — “কী?” 

    — “বুঝতে পারছি না।”

    — “শার্ট, পারফিউম ওসব সবাই দেয়। তুমি নাহয় ভিন্ন কিছু দাও। সামথিং প্রাইসলেস! যেটা অমিতের জন্য স্পেশাল মেমোরি হয়ে থাকবে।”

    — “কেমন?”

    — “ওর জীবন থেকে হারিয়ে গেছে এমন কিছু।”

    — “তুমি একদম আমার মনের কথাটাই বলে দিলে সামি। আমিও চাইছিলাম এমন কিছু। কিন্তু কিভাবে উনার সামনে দাঁড়াবো, উনাকে ম্যানেজ করবো বুঝে পাচ্ছি না।” 

    — “সাব্বির?”

    — “হ্যাঁ।” 

    — “উনার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়াও। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে। মাথার নাটবল্টু একটু নাড়াচাড়া করতে হবে, কিন্তু তুমি পারবে।” 

    .

    পাশে বসে থাকা মেয়েটা কে ছিল জানা নেই মুনিয়ার, তবে এতটা কাছাকাছি বসে মুখে তুলে খাইয়ে দেবার অনুমতি অমিত তো কখনো কাউকে দেয়নি! এই অনুমতি ছিল একমাত্র তার। আজ কাকে অনুমতি দিয়ে দিলো এতখানি কাছে আসার? মেয়েটার পরিচয় জানার কৌতুহল বড্ড পীড়া দিচ্ছে ওকে। বারবার কল করা সত্ত্বেও অমিত রিসিভ করছে না। একের পর এক ম্যাসেজ দেবার পরও অপরপ্রান্ত থেকে রিপ্লাই আসছে না। এতখানি অবহেলা কখনো কি অমিত করেছিল? তার ডাক কখনো এভাবে উপেক্ষা করেছিল? করেনি তো! খুব কেঁদে কেঁদে বলতো, তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকা ইম্পসিবল। আর এখন! ঝাপসা চোখে মোবাইল স্ক্রিনে “কলিং অমিত” লেখাটায় তাকিয়ে রইলো মুনিয়া। প্রচন্ড অভিমানে কাঁদছে সে। 

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৪০

    ৪০

    অফিস যাবার সময় লিফটে দেখা হয়ে গেল পাশের ফ্ল্যাটের আফসার সাহেবের সঙ্গে। মানুষ হিসেবে চমৎকার উনি। উনার বাসায় খুব একটা যাতায়াত নেই। রাস্তায়, লিফটে, ছাদে কিংবা নিচের ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হয়, কথা হয়, কখনো কখনো হয় লম্বা কথোপকথন। বরাবরের মতো আজও মিষ্টি হেসে সালাম দিতে ভুলেনি অমিত। আফসার সাহেবও ভীষণ আন্তরিক হয়ে জবাব নিলেন, 

    — “ওয়া আলাইকুম আসসালাম। আজ একা যে! বউ কোথায়?” 

    — “বাসায়।” 

    — “আজ কারখানা বন্ধ?” 

    — “বন্ধ না। একটু অসুস্থ, তাই যাবে না।” 

    — “কী হয়েছে?” 

    — “মাথাব্যথা! বাড়াবাড়ি রকমে কাজের চাপ নেয় মেয়েটা। এত বারণ করি তবুও কেন যে কথা শুনতে চায় না বুঝি না একদম। 

    — “বউরা শোনে নাকি আমাদের কথা?” 

    হঠাৎ দু’জনই অট্টহাসিতে মাতলো। স্ত্রী সম্পর্কিত স্বল্প গল্প করতে করতে লিফট গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে এল। লিফট থেকে বেরিয়ে দু’জন দু’জনের পথে পা বাড়ানোর আগে আফসার সাহেব ডেকে বললেন, 

    — “নবনীর খেয়াল রেখো। শত হোক একটাই বউ আমাদের, তাদের খেয়াল রাখতে হবে জানপ্রাণ দিয়ে।” 

    আবারও হাসতে লাগলেন আফসার সাহেব। এবার আর দাঁড়ালেন না। পা বাড়ালেন আপন গন্তব্যে। অমিতকে ফেলে গেলেন গভীর ভাবনায়। বউ! নবনী তার বউ। একমাত্র। যেভাবেই হোক বউ তো! বিয়েটা তো হয়েছিল। এটা সত্য যেমন তার জন্ম হওয়ার ঘটনা সত্য। জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ এই বিয়েটা। হোক কখনো ছাড়াছাড়ি কিংবা দূরে সরে আসা। হয়েছিল তো বিয়েটা। অস্বীকার তো আর করা যাবে না। বিয়ে যেহেতু সত্য, নবনী তার বউ সে কথাও সত্য। গলা ফাটিয়ে সারাদিন শুধু, তুমি আমার বান্ধবী, তুমি আমার বান্ধবী বললে কি শুধুই বান্ধবী রয়ে যাবে সে? না তো! জোর পূর্বক অক্টোবরের সেই সকালে রমিজ মির্জা তার হৃদয়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ নবনীর নামে দিয়ে দিয়েছে। মেয়েটা তখন নিজের আসনটুকু গ্রহন না করলেও এই কয়মাসে স্বস্তি হয়ে পাকাপোক্ত একটা জায়গা করেই নিয়েছে হৃদয়ের মাঝে। মাথায় চট করে প্রশ্ন জাগলো অমিতের, রমিজ মির্জা হৃদয়ের একাংশে ওকে দখল দিয়েছিল। আজ কি সেচ্ছায় নবনীকে হৃদয়ের পুরোটা দেয়া যায়? এক সেকেন্ড সময় না নিয়ে মনের মধ্যে থেকে জবাব এল, হৃদয়ে আর জায়গা বাকি কোথায়? কবেই নবনীর নামে পুরোটা লেখা হয়ে গেছে। জবাব পেতেই এক সেকেন্ডের জন্য হৃৎস্পন্দন বন্ধ হলো বুঝি! চেহারা ফ্যাকাশেবর্ণ হলো মুহূর্তেই। কিসব ভাবছে সে! 

    দ্রুত গাড়ির ভেতর বসে পড়লো অমিত। অফিস যেতে হবে। দেরী হয়ে যাচ্ছে! তার চেয়ে জরুরি ব্যাপার এসব হাবিজাবি খেয়াল থেকে নিজেকে দূরে সরাতে হবে। ড্রাইভ করে মেইন রোডে উঠতেই অমিতের চোখ গেলো আফসার সাহেবের দিকে। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে রিকশার অপেক্ষা করছে লোকটা। তাকে দেখতেই আবারো মনে পড়ে গেল তখন বলা কথাটা, “একমাত্র বউ”। অজান্তেই নবনীকে নিয়ে আবারও ভাবতে বসলো অমিত। তার পরিচিত মানুষেরা নবনীকে ওর নাম ধরে ডাকে কম, অমিতের বউ কিংবা তোমার বউ বলেই সম্বোধন করে বেশি। কাজিনরা জিজ্ঞেস করে, তোমার বউ কেমন আছে? বন্ধুরা বলে তোর বউকে আজ নাস্তায় জম্পেশ এককাপ চা খাওয়াতে বলিস। প্রতিবেশীরা নবনীকে দুই একদিন তার সঙ্গে দেখতে না পেলে জিজ্ঞেস করে, আপনার ওয়াইফকে দেখছি না যে দুইদিন ধরে! আর বড় মামী! নবনীকে কখনো নাম ধরে ডেকেছে বলে মনে পড়ে না। অমিতের বউ তুমি ভালো আছো? অমিতের বউ তুমি খাইছো? এভাবেই ডাকে নবনীকে। প্রথমদিকে ভীষণ বিরক্ত লাগতো অমিতের। সঙ্গে অস্বস্তিও। এখন অস্বস্তি, বিরক্তি কোনোটাই হয় না। বরং অভ্যেস হয়ে গেছে যেন! ভালো লাগে শুনতে। যখন কেউ মেয়েটাকে “তোমার বউ” সম্বোধন করে কিছু জানতে চায়, বলতে চায় তখন সেই মুহূর্তটাতে নবনীকে ভীষণ ব্যক্তিগত মনে হয় অমিতের। মনে হয় যেন, নবনী সবার চেয়ে একটু বেশি আপন। এই পৃথিবীতে নবনীকে একান্ত নিজের বলে দাবি করার অধিকার তার, শুধুমাত্র তার। মনের এই দাবি কিংবা ভালো লাগাটুকু নিয়ে সেভাবে কখনো ভাবা হয়নি অমিতের। আলাদা করে ভাবনায় আসেনি কখনো। অবচেতন মনে আসা এই মিষ্টি খেয়ালের স্থায়িত্ব খুবজোর এক মুহূর্ত অব্দি, তাই হয়তো ভেতরে নাড়া দেয়নি! কিন্তু আজ, একটু আগে আফসার সাহেবের বলা ছোট্ট একটা শব্দ ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিলো তাকে! মনের মাঝে নবনীকে ঘিরে লুকিয়ে থাকা সমস্ত খেয়ালগুলো একে একে ভীড় জমাচ্ছে চোখের সামনে। হরেক অনুভূতিতে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে অমিত কখনো প্রচন্ড ভালোলাগায় মন ফুরফুরে লাগছে তো কখনো নবনীকে নিয়ে একটুখানি বেশি ভাবার দায়ে মনে মনে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে সে। অনুভূতির দোটানায় আবার মনে ভয়, দ্বিধাও হচ্ছে যদি নবনী কোনো একভাবে জেনে যায় তাকে ঘিরে অমিতের ভাবনাগুলো, রেগে যাবে না? ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে না? হঠাৎ কেমন রাগ হতে লাগলো অমিতের। ইচ্ছে করছে গাড়ি ঘুরিয়ে এক্ষুনি বাসায় ফিরতে। নবনীকে সামনে বসিয়ে বলতে, মিশ্র অনুভূতিতে পিষে যাচ্ছি একদম! ভালো লাগার ঘোরে ডুবে যাবো নাকি ভয়ে মনের দরজা বন্ধ করে রাখবো বুঝতে পারছি না। একটা সমাধান দাও তো জলদি করে। বলো তো, তুমি আমার কী হও? শুধু বান্ধবী নাকি আমার বউ? একমাত্র বউ? 

    ৪১

    আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরী হচ্ছে নবনী। হাতে লাল রঙের লিপস্টিকটা নিতেই ভীষণ বিরক্ত হলো সামি। কড়া ধমক দিয়ে বললো, 

    — “পাগল তুমি! রেড লিপস্টিক লাগাবে!” 

    চেহারা কুঁচকে সামির দিকে তাকালো নবনী। লাল লিপস্টিকে সমস্যা কোথায় ঠিক ভেবে পাচ্ছে না সে। 

    — “তুমি সাব্বিরের বাসায় যাচ্ছো ওকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতে, বেড়াতে না। ঘরে তোমার হাজবেন্ড যখন তখন পটল তুলবে। তুমি বউ হয়ে এমন সময়ে কালারফুল লিপস্টিক কিভাবে লাগাও! লজ্জা নেই তোমার?” 

    — “ওহ্ হো! পয়েন্ট! আমার মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গিয়েছিল ব্যাপারটা।” 

    — “ফোকাস নবনী। মোটামুটি একটা যুদ্ধ সামলাতে যাচ্ছো তুমি।” 

    — “মোটামুটি না সামি। পুরোটাই যুদ্ধ।”

    — “অনি বলেছে সাব্বিরকে, কী কারণে যাচ্ছো তোমরা, সেটা?” 

    — “না। অনি শুধু বললো ভাইয়া আপনার সঙ্গে দেখা করবো। উনিও রাজি হয়ে গেলেন।” 

    — “জলদি করে চুলটা বেঁধে নাও। বিকেলে দেখা করবে বলেছিল। সোয়া চারটা বাজে। ওখানে যেতে যেতে সন্ধ্যা হবে।”

    — “দাঁড়াও না!” 

    — “এত ঢঙ করে চুল বাঁধতে হবে না। জাস্ট খোপা করে পাঞ্চক্লিপ আটকাও। উনাকে বুঝাতে হবে সিচুয়েশন ক্রিটিকাল। নয়তো নিয়ে আসতে পারবে না।” 

    — “আমরা পারবো তো, তাই না?” 

    — “সত্যি কথা গুছিয়ে বলতে হয় না। কিন্তু মিথ্যা কথা বলতে হয় গুছিয়ে, ঠান্ডা মাথায় শান্ত ভঙ্গিতে। সামনেরজন নয়তো কনভিন্স হবে না। সো মাথা ঠান্ডা, হুম?”

    — “হুম।”

    — “অমিতকে একবার জানানো প্রয়োজন ছিল না?” 

    — “বার্থডে গিফট বলে কয়ে কে দেয় সামি? আমি অমিতকে সারপ্রাইজ দিচ্ছি। ওর ধারণা ও মরে গেলেও সাব্বির কখনো আসবে না। এতবার বলেও কল করাতে পারিনি। কেন যে এত সংকোচ ওর কে জানে? সাব্বিরের জন্য এত মন খারাপ হয় ওর অথচ সামনে গিয়ে দাঁড়াবে না।” 

    — “সেজন্যই বলছি ওকে একবার জানানো উচিত। ধরো সাব্বির কনভিন্স হয়েই গেল, তোমার সঙ্গে ওকে নিয়েও এলে; ওকে দেখে অমিত কিভাবে রিএ্যাক্ট করবে কিংবা সাব্বিরের সঙ্গে যদি ও কথা বলতে সংকোচ করে, তখন? সিচুয়েশনটা বুঝতে পারছো তো? এই মোমেন্টটা অমিতের সংকোচ করার না। সাব্বিরকে টাইট হাগ করে স্যরি বলার। তার উপর সাব্বির বাসায় পা রেখেই টের পেয়ে যাবে তুমি মিথ্যা বলে নিয়ে এসেছো। সিচুয়েশন আরো টাফ হবে তখন।” 

    — “ভয় কেন দেখাচ্ছো সামি?” 

    মুখ শুকিয়ে এল নবনীর। হতাশ চোখে চেয়ে রইলো সামির দিকে। তার গাল টেনে মিষ্টি হেসে সামি বললো, 

    — “ভয় দেখাচ্ছি না বোকা মেয়ে! তোমাকে জাস্ট বলছি কী কী হতে পারে যেন আগেভাগে মেন্টালি প্রিপেয়ার হতে পারো।” 

    — “চাচা -চাচী এসেছে তো দুপুরে। আমি একা না, সঙ্গে অনিও আছে। সবাই মিলে বুঝিয়ে শুনিয়ে সাব্বির ভাইয়াকে সামলে নেয়া যাবে হয়তো। আচ্ছা দেখি না কী হয়!” 

    — “মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি অমিত কখন ফিরবে সেটা শিওর হয়েছো তো? সাব্বির যেন বাসায় পা রেখে অমিতকে দেখতে পায়।

    — “হ্যাঁ, হ্যাঁ! ও আজ চলে আসবে পাঁচটার ভেতর। দুপুরে খাওয়ার সময়ও কথা হলো।” 

    — “হয়েছে তোমার?”

    — “হ্যাঁ, রেডি।” 

    — “এবার দুঃখী দুঃখী চেহারা নিয়ে বেরিয়ে পড়ো।” 

    .

    সাব্বিরের ফ্ল্যাটে বসে আছে অনি আর নবনী। মাত্রই এসেছে ওরা দু’জন। সাব্বিরের ওয়াইফ রুমানার সঙ্গে কুশল বিনিময় হতে হতে সাব্বির বেরিয়ে এল নিজের রুম থেকে। অনির একগাছি চুল আঙুলে পেঁচিয়ে টেনে ধরলো সাব্বির। বললো, 

    — “এতবছর পর মনে পড়লো আমার কথা?” 

    — “লাগছে ভাইয়া!” 

    — “লাগুক। তোদের মতন কোল্ড হার্টেড মানুষদের এভাবেই মারা উচিত।”

    — “তুমিও তো কল করোনি আমাকে।” 

    অনির চুল ছেড়ে দিলো সাব্বির। চোখ মুখ থেকে মুহূর্তেই প্রাণোচ্ছল হাসি মিলিয়ে গেল তার। বেশ শান্ত ভঙ্গিতে স্ত্রীর পাশে বসলো সাব্বির। অনিকে বললো,

    — “আমার ওয়াইফ ও। পরিচয় হয়েছিস তো, তাই না?” 

    — “হ্যাঁ, ভাবিই তো দরজা খুললো।” 

    — “সাব্বির এত গল্প করে তোমাদের! খুব খুশি হয়েছি তুমি এসেছো। তোমাদের দেখার খুব ইচ্ছে ছিল। ভাগ্যিস আজ আমার চেম্বার সকালে ছিল। নয়তো তোমার সঙ্গে দেখাই হতো না।” 

    — “আপনি ডক্টর?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “আচ্ছা উনি কে? উনার পরিচয়টা তো জানলাম না!” 

    নবনীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো রুমানা। সাব্বিরও তাকিয়ে রইলো অপরিচিতার পরিচয় জানবার আশায়। অনি কিছু বলার আগেই নবনী বললো,

    — “আমি নবনী। অমিতের কাজিন। 

    — “আপনাকে এর আগে দেখিনি কখনো।” 

    — “তখন চাচার বাসায় আমার যাতায়াত ছিল না তেমন। তাই দেখা হয়নি আমাদের।”

    — “আচ্ছা! আংকেল আন্টি ভালো আছে রে অনি?” 

    — “আছে ভালোই।” 

    — “কী করছিস তুই এখন? পড়াশোনা কতটুক আগালো?” 

    — “অনার্স করছি। থার্ড ইয়ার।

    — “জানো রুমানা, এই অনিটাকে যখন হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হলো তখন আমি ওদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হলুদ তোয়ালেতে মোড়ানো লাল রঙের একটা বাচ্চা! ঐ মুহূর্তটা আমার চোখে ভাসে। মনে হয় যেন এই তো সপ্তাহখানেক আগের ঘটনা। দেখো তো এই মেয়ে নাকি এখন অনার্স থার্ড ইয়ারে! তুই একটু জলদিই বড় হয়ে গেলি অনি।” 

    — “সত্যিই সময় খুব বদলায় ভাইয়া। সময়ের সঙ্গে সম্পর্কও বদলায়।” 

    চোখ নামিয়ে নিলো সাব্বির। অনির কথার ইঙ্গিত বুঝতে বাকি রইলো না তার। কথার প্রসঙ্গ বদলাতে ব্যস্ত হলো সে। রুমানাকে তাড়া দিতে লাগলো, 

    — “কিচেনে গিয়ে দেখো খালার নাস্তা বানানো কতদূর? খালিমুখে গল্প করবে নাকি ওরা?” 

    রুমানা উঠতে যাচ্ছিল তখনই বাঁধ সাধলো নবনী। 

    — “আপনি বসুন ভাবি। আমরা খাবো না কিছু।” 

    — “আমার বাসার গেস্টদের খালিমুখে বিদায় করি না আমি।” 

    — “ভাবি সত্যি বলছি, খাওয়ার অবস্থায় আমরা একদম নেই।” 

    নবনীর মুখভঙ্গিতে কৌতুহলী হলো রুমানা আর সাব্বির। অনির দিকে তাকালো দু’জনই। কাঁদো কাঁদো মুখ করে মাথানিচু করে বসে আছে ও। ভয় হতে শুরু করলো সাব্বিরের। কোনো সমস্যা হয়েছে কি? জটিল কিছু? সেজন্যই কি এতদিন পর অনির আকস্মিক আগমন? জানতে চাইলো সাব্বির, — “অনি কী হয়েছে?” 

    মাথা তুললো না অনি। নিচু করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ফ্লোরে। নবনী বললো, 

    — “চাচা চাচী কেমন আছে জানতে চাইলেন। অথচ ঐ বাসার আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষটার কথা জানতে চাইলেন না! কেমন আছে, কী অবস্থায় আছে তা কি একবারও জানতে ইচ্ছে হলো না?” 

    — “দেখুন, আপনি হয়তো পুরো ঘটনা জানেন না। আর আমি এই ব্যাপারে কিছু বলতেও চাই না।” 

    কড়া কণ্ঠে জবাব দিলো সাব্বির। স্বামীর আচরণে বেশ লজ্জিত রুমানা। তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিচুস্বরে বললো,

    — “বিহেভ! উনি আমাদের গেস্ট সাব্বির।” 

    ঠিক শান্ত হতে পারছে না সাব্বির। পুরোনো সব অভিমান রাগ অগ্নিকুন্ড হয়ে জেগে উঠলো স্মৃতিতে। অনি সাব্বিরের পাশে গিয়ে বসলো।

    — “আর কতদিন রাগ করে থাকবে ভাইয়া? দুইবছর হয়ে গেল তোমরা কেউ কারো সঙ্গে কথা বলো না! এমনটা কখনো হবার কথা ছিল?” 

    — “শুনেছি একই প্লেটে খেয়ে, এক বিছানায় ঘুমিয়ে একসঙ্গে বেড়ে উঠা আপনাদের। অথচ আজ সেই মানুষটার কথা শুনে এভাবে রাগে ফুঁসছেন! ভালোবাসা, মায়া বন্ধুত্ব সব ফুরিয়ে গেছে!” 

    — “আমাকে ব্লেইম করছেন আপনি! আমার ফল্ট? অমিত বলতে পারবে কখনো ওকে আমি প্রায়োরিটি দেইনি? প্রতিদিন একবার হলেও ওকে আমি কল করিনি? আমি যখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নিয়ে এখানে চলে আসি তখনও সব ঠিক ছিল। বিশাল দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও সম্পর্কে তিল পরিমান ভালোবাসার কমতি হতে দেইনি আমরা। ছুটির অপেক্ষায় বসে থাকতাম আমরা। যে যখন সুযোগ পেতাম চলে আসতাম দু’জন দু’জনের কাছে। কখনো অমিত আসতো ঢাকায়, কখনো আমি যেতাম চট্টগ্রাম। ঝগড়া কখনো হয়নি আমাদের। অমিতের সঙ্গে কথা না বলে কিংবা অন্তত ছোট একটা টেক্সট না করে আমি গোটা একটা দিন কাটিয়ে ফেলবো এমনটা হয়নি কখনো। সেই অমিতের অ্যাফেয়ার হলো আর অমনি আমাকে ভুলে গেল! আমাকে! মুনিয়া ওর জীবনে আসার পর কল, টেক্সট, দেখা করা সব কমে গেল। ভাবলাম নতুন নতুন প্রেম হয়েছে গার্লফ্রেন্ডকে সময় দেবে এটাই স্বাভাবিক। আমি জানতাম দিনে অন্তত দশ মিনিট সময় আমাকে দেয়া অমিতের জন্য কোনো ব্যাপারই না। তবুও মনকে মিথ্যে বলতাম, বুঝাতাম। ওর রিলেশনের ছয়মাস পর যোগাযোগটাই বন্ধ করে দিলো। আমি কল করতেই থাকতাম, ও রিসিভ করতো না। আমাদের যোগাযোগ তখন নেমে এল সপ্তাহে এক কিংবা দুইদিনে। আর দেখা? দুই তিনমাসে কোনোরকমে একবার। ও আমাদের মাঝে দূরত্ব টানতে চাইলো কিন্তু আমি টানতে দেইনি। জোর করে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছি, একতরফা। কেন জানেন? ও ছাড়া আর কার সঙ্গে আমি আমার কথাগুলো শেয়ার করবো? কে আছে আমার? আমার অনেক বন্ধু আছে। কিন্তু অমিতের মতন কেউ ছিল না আমার। সেই মুহূর্তে আমার বাবা মারা গেল, জব চলে গেল, নতুন বিজনেস শুরু করলাম, রুমানার সঙ্গে বিয়ে ঠিক হলো। ঐ দেড় বছরে জীবনে কত কী ঘটে যাচ্ছিল, আমার হাজারখানেক কথা ওকে বলার ছিল, আমার কাঁধে ওর হাতটা প্রয়োজন ছিল, আমাকে গাইড করার মতো একটা মানুষ দরকার ছিল। পেয়েছি আমি ওকে? জিজ্ঞেস করুন না অনিকে? ওরা সবাই জানে আমি ভীষণ একরোখা স্বভাবের। আমি কখনো কারো কথা শুনিনি। কিন্তু অমিত এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে একটা কিছু বলুক, আমি ঠিক মেনে নিবো। বলছি না অমিত শুধু আমাকে নিয়ে পড়ে থাকুক, ওর ফার্স্ট প্রায়োরিটি শুধু আমিই হবো। কখনোই আমি এমনটা চাই না। প্রেম জীবনে আসতেই পারে তাই বলে ও আমাকে ভুলে কেন যাবে? আমার বিয়েতে পর্যন্ত ও আসেনি। পুরো বাড়ি আনন্দে মেতে ছিল, ছিলাম না শুধু আমি। কতবার ওকে কল করলাম! আমি কবুল বলার আগেও কল করেছিলাম, ও রিসিভ করেনি। বিয়ের আগের দিন সন্ধ্যায় কথা হয়েছিল ওর সঙ্গে। বারবার বলছিলাম ফ্লাইট ধরে চলে আয়। ও এল না। পরে জানতে পারলাম মুনিয়ার বার্থডে ফেলে আমার বিয়ে এটেন্ড করার কোনো মানেই হয় না। তাই আসেনি। তারমানে আমি আর আমাদের এই সম্পর্কটা পুরোপুরি অর্থহীন। শুধুশুধু একটা অর্থহীন সম্পর্ক টেনে নেয়ার মানে আমি খুঁজে পাইনি তাই যোগাযোগটা এপাশ থেকে আমিও চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছি। শুধু আমার সঙ্গে কেন? মুনিয়া বাদে পৃথিবীর সব সম্পর্ক ওর কাছে তুচ্ছ। অমিত কখনো এতটা বিশ্রীরূপ নেবে আমি ভাবতে পারিনি। এবার বলুন তো ফল্ট আমার? ও কেমন আছে এই কথাটা কি আমার আপনাকে জিজ্ঞেস করা উচিত?” 

    — “দেখুন আমি সব জানি, অমিত বলেছে আমাকে। ও কখনো আপনাকে ব্লেইম করেনি। পুরো দোষটা নিজের কাঁধে নিয়েছে।” 

    — “আচ্ছা! আমাকে নিয়ে কথা বলার সময় আছে ওর!” 

    — “বেচারা খুব মন খারাপ করে আপনার কথা ভেবে। এই তো দুই চারদিন আগের কথা, আপনার গল্প করতে গিয়ে ওর চোখ ভিজে যাচ্ছিল।”

    — “হ্যাঁ ভাইয়া! অমিত ভাইয়া খুব কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু তোমাকে একটা কল করার সাহস পাচ্ছে না। তোমাদের বন্ধুদের বলেছিলাম তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে। ওদের নাকি তুমি অমিত ভাইয়াকে নিয়ে একটা শব্দও বলতে দাওনি!” 

    — “কেন দিবো? অমিত কে? কী হয় আমার?” 

    — “এমন করো না প্লিজ! ভাইয়া অনুশোচনায় দিন কাটাচ্ছে। তুমি চলো বাসায়। যা কিছু হয়েছে মিটিয়ে নাও।” 

    — “তুই এজন্যই এসেছিস আমার বাসায়?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “রুমানা ওদের নাস্তা দাও। নাস্তা করে বাসায় ফিরতে বলো।” 

    রুমানার ভীষণ রাগ হলো। এতক্ষণ বারবার কানের কাছে বসে বলছিল, “আস্তে সাব্বির। শান্ত হও। ধীরে কথা বলো”। এবার তারও বিরক্ত ধরে এল। আদর সোহাগ করে আর কিছুই বুঝাতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ধমক দিলো সাব্বিরকে। 

    — “বিয়ের পর থেকে দেখছি এই ইস্যুটা নিয়ে তুমি কতটা আপসেট! তুমি বলতে পারবে সাব্বির, তোমার বন্ধুকে ভুলে গেছ কিংবা ওর প্রতি আর কোনো মায়া অবশিষ্ট নেই? কতবার বলেছি রাগ পুষে রাখতে হয় না। যা তোমাকে কষ্ট দেয় সেটা কেন বছরের পর বছর মনে ধরে বসে থাকতে হবে? একটা মানুষ তার অন্যায় বুঝতে পেরেছে, স্যরি বলতে চাইছে এটাই অনেক। তাকে সুযোগ দাও। অনুশোচনা থেকে তাকে মুক্তি দাও, নিজেও ক্ষোভ থেকে মুক্ত হও।” 

    — “প্লিজ ভাইয়া!” 

    — “যাবো না আমি কোথাও। ও একবার কেন? হাজারবার স্যরি বললেও ওর জন্য কোনো ক্ষমা নেই।”

    — “কতবার বুঝাবো তোমাকে! এসব রাগ, অভিমান কমাও। দিজ অল আর নট গুড ফর ইউর মেন্টাল কন্ডিশন!”

    — “সবসময় ডাক্তারি ঝেড়ো না রুমানা! আমি তোমার পেশেন্ট না। যাবো না বলেছি ব্যস! ওর সঙ্গে আমার আর কোনো কথা অবশিষ্ট নেই।” 

    — “কিন্তু অমিতের কত কী বলার আছে আপনাকে! মৃত্যুর আগে এই সুযোগটুকু ওকে দিবেন না?” 

    চমকে উঠলো সাব্বির-রুমানা। মৃত্যুর আগে মানে? এসবের মাঝে মৃত্যু এল কোত্থেকে? সাব্বির ব্যস্ত হলো জানতে। একরাশ মন খারাপ নিয়ে নবনী জানালো, 

    — “অমিত অসুস্থ ভাইয়া। যে কোনো সময় কিছু একটা…” 

    — “কিছু একটা মানে কী! কী হয়েছে?” 

    — “মুনিয়ার সঙ্গে ঝগড়া করে ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে। সুইসাইড এটেম্পট! মাথায় সিরিয়াস ইনজুরি হয়েছে। হাফবডি প্যারালাইজড।” 

    — “অমিতের এতকিছু… আমাকে কেউ কিছু বলেনি কেন? কবে হলো?” 

    — “চারদিন আগে। ডক্টর বলেছে বাঁচবে না। যতদিন রিজিক আছে থাকবে তারপর ফুটুস।” 

    প্রচন্ড সন্দেহ নিয়ে নবনীর দিকে তাকিয়ে আছে রুমানা। তার চোখে সন্দেহ দেখতেই চোখ নামিয়ে নিলো নবনী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললো, 

    — “আমি আর বলতে পারছি না। কান্না পাচ্ছে। বাকিটা অনি বলুক।”

    — “কাঁদতে কাঁদতে আমাদের চোখের পানি শুকিয়ে গেছে ভাইয়া। মেনে নিয়েছি আমার ভাইয়ের এই নির্মম ভাগ্য! ওর শেষ ইচ্ছেগুলো পূরণ করছি। তোমাকে একবার দেখতে চেয়েছিল। খুব আশা নিয়ে এসেছিলাম। যাকগে, যেতে চাও না কী আর করা! ভাইয়াকে গিয়ে বলবো তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি। বেচারা সত্যিটা জানলে ভীষণ কষ্ট পাবে।” 

    — “আমি বলেছিলাম ঐ মেয়েটা অমিতকে শেষ করে ফেলবে। হলো তো! আমার কথাই সত্যি হলো।” 

    বাচ্চাদের মতন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো সাব্বির। চোখ মুছতে মুছতে অনিকে বললো, 

    — “একবারও আমাকে কল করে জানালি না তুই!” 

    — “তুমি আসবে না জানতাম। ভাইয়া খুব জোরাজোরি করছিল গতকাল। আম্মুকে ডেকে বললো ওর সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে, শেষবারের মতো তোমাকে দেখতে চায়। তাই কল করেছিলাম।”

    — “বললেই হলো! কিচ্ছু হবে না ওর। ঢাকার বেস্ট ডক্টর দিয়ে ওর ট্রিটমেন্ট করাবো। প্রয়োজনে দেশের বাইরে নিয়ে যাবো।” 

    — “বাঁচার ইচ্ছে নেই বেচারার। মুনিয়াকে হারিয়ে বেঁচে থাকার আগ্রহই মরে গেছে।” 

    — “চড় মেরে বাঁচার আগ্রহ ফিরিয়ে আনছি আমি! কোন হসপিটালে আছে? চল এক্ষুনি যাবো আমি।”

    — “হসপিটাল না। বাসাতেই আছে এখন। অমিত ভাইয়া খুব জেদ করছিল মরতে যেহেতু হবেই, বাসাতেই মরবে। এই বাসায় মুনিয়ার স্মৃতি আছে, মুনিয়া না হোক মুনিয়ার স্মৃতি নিয়ে অন্তত সে মরতে চায়।” 

    — “ও বললো আর তোরা রাজি হয়ে গেলি!” 

    — “কী করবো? খুব জেদ করছিল তো!” 

    — “ফালতু কথাবার্তা যত্তসব। রুমানা, যেভাবে আছো সেভাবেই চলো। জামা বদলানোর প্রয়োজন নেই। খামোখা দেরী হবে। অনি তোরা নিচে যা। আমি গাড়ির চাবি নিয়ে নামছি। সিঁড়ি বেয়ে একসঙ্গে নিচে নামছে ওরা তিনজন। হঠাৎ রুমানা বলে উঠলো,

    — “মিথ্যে গল্পটাও ঠিকঠাক সাজাতে পারো না। সাব্বির প্রচন্ড বোকা আর ইমোশনাল। তাই ভুংভাং বুঝিয়ে নিয়ে যেতে পারছো। অন্য কেউ হলে না…”

    স্ট্যাচু হয়ে সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে পরলো নবনী আর অনি। একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। রুমানা হেসে বললো,

    — “রিল্যাক্স! সাব্বিরকে কিছু বলবো না আমি। আমিও চাচ্ছিলাম দুজনের ঝামেলা মিটে যাক। আমার হাজবেন্ড অমিতকে মিস করে ভীষন। প্রতিটা অকেশনে উনাকে ভেবে মন খারাপ করে। এভাবে ওকে দেখতে ভালো লাগে না। হোপফুলি আজ দু’জনের একটা মিমাংসা হয়ে যাবে।” 

    ৪২

    বসার ঘরে মা বাবার সঙ্গে বসে সন্ধ্যার চা, নাস্তা আর আড্ডায় ব্যস্ত অমিত। নবনী আজ জলদি ফিরতে বলে নিজেই উধাও হয়ে গেল। বলেছিল আজ দূরে কোথায় নাকি প্রোডাক্টের স্যাম্পল দেখাতে যাবে তাকে নিয়ে। অথচ বাসায় ফিরে দেখলো নবনী নেই। অনিকে নিয়ে মার্কেটে গেছে আর সেই ক্লাইন্টের অফিসে যাওয়াও নাকি ক্যান্সেল। একটু আধটু মেজাজ খারাপ হচ্ছে নবনীর উপর। নাকে-মুখে বিকেলের মধ্যে সব কাজ সেরে বাসায় ফিরে এসেছে শুধু ওর জন্য। নয়তো সে এত কাজের প্রেশার নিতো নাকি? আরাম করে ধীরে সুস্থে কাজ করা যেত। বাসার কলিংবেল বাজছে। হাতের চা টেবিলে রেখে, দরজা খুললো অমিত। দরজার এপাশে ওপাশে স্তব্ধ হয়ে দুই বন্ধু একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলো সাব্বির, 

    — “তুই সুস্থ আছিস!” 

    ঘাড় ফিরিয়ে অনি নবনীর দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকালো সে। 

    — “তোমরা আমাকে মিথ্যে বলেছো?” 

    সাব্বিরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নবনী আর অনি জোর করে তাকে ঘরে টেনে আনলো। রুমানা তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দাঁড়ালো সামনে। এরশাদ সাহেব হেসে বললেন, 

    — “ওরে নবনী! কান্ড দেখছি সত্যিসত্যিই ঘটিয়ে ছাড়লে। আমি ভেবেছিলাম পাগলা ষাড়টাকে বাসায় কোনোভাবেই আনতে পারবে না।” 

    অমিত অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো নবনীর দিকে। গতসপ্তাহে সাব্বিরের প্রসঙ্গ উঠতেই মেয়েটা বলেছিল, আমি তুড়ি বাজিয়ে সব ঠিক করে ফেলতে পারি তোমার বন্ধু আর এমন কী! এটাকেও তোমার সামনে এনে হাজির করে ফেলবো। অমিত স্বপ্নেও কখনো ভাবেনি নবনী সেদিনের কথাগুলো সত্যি ঘটাবে। কিংবা এখন চোখের সামনে যা কিছু ঘটছে সেটাও সত্যি বলে মানতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অমিতের কাঁধে ধাক্কা দিয়ে নবনী বললো,

    — “অমিত, গাধার মতো দাঁড়িয়ে আছো কেন?” 

    — “হ্যাঁ? দাঁড়াবো না?” 

    — “বন্ধুকে পেয়ে হুঁশ জ্ঞান সব হারালে নাকি? পুরো দুইসপ্তাহ প্ল্যান করে, কত মিথ্যে নাটক করে তোমার বন্ধুকে ধরে এনেছি, জানো?” 

    — “ছাড়ুন আমাকে! চিটারের দল! ওর মতন ফালতু ছেলেপেলের ফ্ল্যাটে আমি এক মুহূর্তও দাঁড়াবো না।” 

    সাব্বির চেঁচাচ্ছে। তার চেঁচামেচিতে ঘোর কাটলো অমিতের। এগিয়ে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সাব্বিরকে। প্রাণপণে নিজেকে ছাড়াতে চাইছে সাব্বির। 

    অমিত মিনতি করতে লাগলো, 

    — “মাফ করে দে না ভাই!” 

    — “কিসের মাফ? তুই মাফ পাওয়ার উপযুক্ত?” 

    — “তোর চোখ ভেজা কেন সাব্বির? নবনী কী বলেছে তোকে? আমি অসুস্থ?” 

    — “কে এই মেয়ে? কিসব বলে টলে আমাকে নিয়ে এল। আর অনি! এত মিথ্যুক সবাই!” 

    — “চোখ ভেজা কেন বললি না তো?” 

    — “জানি না। ছাড় আমাকে তুই।’ 

    — “ক্ষমা না করা পর্যন্ত ছাড়ছি না।” 

    — “আমার ক্ষমায় কী আসে যায় তোর? আমি তোর কেউ না।”

    বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠলো সাব্বিরের। বন্ধুর অভিমানের আঁচ স্পষ্ট টের পাচ্ছে অমিত। চোখের কোণ ভিজে উঠলো তার। কাঁপাস্বরে বললো, 

    — “আমরা কি শুধু বন্ধু ছিলাম কখনো? ভাই আমরা। ভুল হয়ে গেছে আমার। কী করবি এখন বল? চিরতরে মুছে ফেলবি আমাকে? পারবি? পেরেছিস এই দুই বছরে? কষ্ট হয়নি আমার জন্য? আমাকে এখনও আগের মতই ভালোবাসিস। নয়তো এভাবে ছুটে আসতি আমাকে দেখতে?” 

    — “আমি মুছতে জানি না অমিত, তুই জানিস। মুছেই তো ফেলেছিস আমাকে।”

    — “কই মুছে ফেললাম! তোর সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হতো খুব। কতবার তোর নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়েও করিনি। তোর বাসার নিচ থেকে ফিরে এসেছি কতবার!” 

    — “মিথ্যা বলবি না একদম! আমি জানি আমাকে কখনোই মনে পড়ে না তোর।”

    সাব্বিরের অভিযোগে সমস্বরে বাঁধ সাধলো নবনী আর শামীমা। 

    — “ভুল! আমার ছেলে তোমাকে খুব মিস করে।” 

    — “হ্যাঁ করেই তো। এইতো গেল সপ্তাহেও আপনার কথা বলতে গিয়ে কেঁদেই ফেললো।” 

    রুমানা এসে সাব্বিরের হাতজোড়া অমিতের পিঠে জড়িয়ে দিলো। 

    — “বন্ধু স্যরি বলছে তোমাকে। সম্পর্কটা আবারও আঁকড়ে ধরতে চাইছে। তুমিও আঁকড়ে ধরো সাব্বির। রাগ পুষে কী লাভ হবে বলো তো!” 

    — “লাভ হবে। ও আমার সঙ্গে যেমন আচরণ করেছে ওকে আমি ফিরিয়ে দিলে শান্তি পাবো।” 

    — “বাচ্চাদের মতন বিহেভ করছো!” 

    — “অমিত যখন আমার সঙ্গে মিসবিহেভ করলো তখন কেউ ওকে কিছু বলেনি কেন? আজ আমি রাগ করেছি বলে সবাই মিলে আমাকে জোর করছো। কেন? আমি কষ্ট পাইনি? ও কেন আমাকে অকারণে কষ্ট দিলো? জিজ্ঞেস করো ওকে? কেন যোগাযোগ করতে চাইলো না? কেন আমার বিয়েতে এল না? দুইবছর আমাদের যোগাযোগ নেই। কেন ও এল না আমার অভিমান ভাঙাতে?” 

    — “বহুবার চেয়েছি যোগাযোগ করতে। বিশ্বাস কর! সাহস হয়নি তোর সামনে দাঁড়ানোর।” 

    — “কেন সাহস হয়নি? খেয়ে ফেলতাম তোকে?” 

    — “কোন মুখে দাঁড়াতাম তোর সামনে? পথ খোলা রাখিনি তো আর!” 

    — “আমার কাছে আসার পথ আমি তো কখনো বন্ধ করিনি।” 

    — “বন্ধুদের দিয়ে কথা বলাতে চেয়েছিলাম, তুই সুযোগই দিসনি।” 

    — “ওরা কেন তোর আর আমার ব্যাপারে কথা বলবে? আমাদের ব্যাপারে কথা বলবো শুধু আমরা দু’জন। একটাবার আমার সামনে এসে দাঁড়ালি না কেন তুই?” 

    — “দাঁড়ালে ক্ষমা করে দিতি?” 

    — “তোর প্রতি আমার অভিমান জমেছে অমিত। ক্ষমার প্রসঙ্গ এখানে নেই। শুধু একবার আমার সামনে এসে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেই চলতো, কেমন আছিস। আমি ভেবেছিলাম তুই আসবি। অপেক্ষায় ছিলাম। অথচ তুই এলি না। আর আমার অভিমান বেড়েই গেল।

    — “এখন তো দাঁড়িয়ে আছি তোর সামনেই, এবার মাফ করে দে আমাকে! আর কক্ষনো তোকে ইগনোর করবো না।” 

    অমিতকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো সাব্বির। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে দুই বন্ধু। শামীমা আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছছেন। অমিতের মতন সাব্বিরও তার ছেলে। কখনো ওকে আলাদা চোখে দেখেছেন নাকি! কতদিন বাদে আজ থেকে তার দুই ছেলের সম্পর্ক আবারও আগের হবে। এতগুলো দিনে তিনি যা করতে পারেননি, নবনী মাত্র আধঘন্টায় করে দেখালো। ছেলে তার নিশ্চয়ই কোনো পূণ্য করেছে! নয়তো এমন বউ কেমন করে পেলো? ঐ ডাইনির কাছ থেকে মুক্তিই বা কেমন করে মিললো? 

    পুরো ঘরে নিঃস্তব্ধতা। দুই বন্ধুর নাক টানার শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু। উপস্থিত সবাই ভীষণ আবেগি হয়ে ওদের দেখছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে রুমানা বলে উঠলো, 

    — “তুমি কি শুধু কাঁদবেই? বাসার বাকি সদস্যদের সঙ্গে আমার পরিচয় করাবে না?” 

    হাসলো সাব্বির। একহাতে রুমানাকে কাছে জড়িয়ে বললো, 

    — “এই দ্যাখ, আমার ওয়াইফ রুমানা।” 

    — “কত গল্প যে শুনেছি আপনার! আপনি কী পছন্দ করেন, কী অপছন্দ করেন সব মুখস্থ আমার। জিজ্ঞেস করলে এক্ষুনি ফটফট করে বলে দিতে পারবো।”

    — “আর আমি ভেবেছিলাম সাব্বির হয়তো আমার নামই উচ্চারণ করে না।” 

    চাচা-চাচীর মাঝে আসন পেতে বসতে বসতে নবনী বললো,

    — “মানুষকে ভুলভাল বুঝা ছাড়া তোমার জীবনে আর আছে কী, বলো! তিলকে মনে মনে তাল বানানো তোমার অভ্যেস। ঝামেলা খুব ভালোই লাগাতে পারো। অথচ সমাধান করতে পারো না। নবনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এরশাদ সাহেব। বললেন, 

    — “সমাধান সব তুমি করে দিচ্ছো। অমিতের আর সেসব ভেবে কাজ কী! এখন থেকে ঝামেলা বাঁধিয়ে তোমার কাছে ছুটে যাবে সমাধানের জন্য দেখো।” 

    শামীমা অনিকে ডেকে বললেন,

    — “অনি, কিচেনে চল। রাতের রান্নাটা সেড়ে ফেলি। ছেলের বউ আজ প্রথম বাসায় এসেছে। স্পেশাল আয়োজন হবে ওর জন্য।” 

    নবনী উঠে রুমানার হাত টেনে ধরলো। 

    — “চলুন। আপনি ডাইনিংরুমে বসবেন। আমরা ওদিকে কাজ করতে করতে আপনার সঙ্গে গল্প করবো। ওরা দুই বন্ধু অমিতের ঘরে বসে গল্প করুক।”

    অমিতের ঘরে ঢুকেই সাব্বির জিজ্ঞেস করলো, 

    — “মেয়েটা কে রে অমিত? কেমন কাজিন তোর? আগে কখনো দেখিনি তো!”

    তড়িঘড়ি করে দরজা আটকে নিলো অমিত। নিচুস্বরে বললো, 

    — “নবনী আমার ওয়াইফ।” 

    বিছানায় ধুপ করে বসে পড়লো সাব্বির। রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো অমিতের দিকে। হাসলো অমিত, 

    — “বিশ্বাস হচ্ছে না তোর?” 

    — “না!” 

    — “সত্যিই ও আমার ওয়াইফ।”

    — “তুই বিয়ে করলি কবে?” 

    — “গেল বছর অক্টোবরে। 

    — “তুই অন্য কাউকে বিয়ে করেছিস এই কথাটা এখন আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?” 

    — “হ্যাঁ!”

    — “আর ঐ মেয়েটা?” 

    — “মুনিয়া?” 

    — “হ্যাঁ। আঠার মতো লেগেছিলি যার সঙ্গে তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে! ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না। পুরো ঘটনাটা বল তো আমাকে।”

    ***** 

    মোবাইলে একের পর এক ছবিগুলো সোয়াইপ করে দেখছে অমিত। আজ তার জন্মদিন। এবারের জন্মদিন খুব স্পেশাল। কারণটা নবনী। জন্মদিন উপলক্ষে অমূল্য কিছু গিফট করে দিলো মেয়েটা। কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি তার জীবনে একটা মেয়ে আসবে আর সেই মেয়েটা তার জন্মদিনের ঠিক আগের সন্ধ্যায় হারানো বন্ধুকে ফিরিয়ে দেবে তার কাছে। অসম্ভব ব্যাপারটা কী করে সম্ভব করে ফেললো কে জানে! পুরো চারবছর পর আজ বারোটায় ফ্যামিলি আর সাব্বিরকে নিয়ে কেক কাটা হলো তার। মুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্কের পর পরিবারের সঙ্গে রাত বারোটায় আর কেক কাটা হয়নি। জন্মদিনের প্রথম প্রহর কাটতো মুনিয়ার বাসায়। মায়ের শত অনুরোধেও কাজ হতো না। মুনিয়াই যে গোটা পৃথিবী হয়ে ছিল তখন! কতগুলো বছর বাদে সেই পুরোনো মিষ্টি মুহূর্ত জীবনে ফিরে এসেছে শুধুমাত্র নবনীর জন্যে। এইযে ক্যামেরাবন্দী হাসিখুশি মুহূর্তগুলো সব নবনীর তোলা। সবার ছবি তুলতে গিয়ে শেষমেশ নবনীর আর ছবি তোলা হলো না তার সঙ্গে! আফসোস হচ্ছে অমিতের। একটা ছবি কেন নেই ওর সঙ্গে? কাল বড় করে আয়োজন হবে বাসায়। তবুও তো! আজকের রাতটা অনেক বেশিই স্পেশাল ছিল। এই রাতে দুজনের একটা ছবি অবশ্যই থাকা উচিত! ঘড়িতে একবার তাকালো অমিত। রাত আড়াইটা বাজে। সাব্বির বাসা থেকে বেরিয়েছে আরো দেড় ঘন্টা আগে। এতক্ষণে কি নবনী ঘুমিয়ে গেছে? যাবে একবার ওর ঘরে? অনেককিছু ভাবতে ভাবতে হঠাৎ অমিতের মনে হলো, নবনী ঘুমাক! তাতে কী? ঘুম থেকে জাগিয়ে আজ ছবি তুলবে সে। 

    .

    বারান্দায় বসে কেক খাচ্ছে নবনী। নবনীর পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে সামি। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নবনী অবশিষ্ট পুরোটা কেক মুখে পুড়ে বললো, 

    — “খাবোই। জীবন আছে যতক্ষণ খেতে থাকবো ততক্ষণ।”

    — “তিন পিস কেক খেয়েছো আজ। তুমি এখন ত্রিশ নবনী! এসব কেক, অয়েলি ফুড একটু কন্ট্রোল করো। কখন আবার কলেস্টেরলের, হাই বিপি, ডায়বেটিস ধরা পড়ে কে জানে!” 

    — “পড়ুক। ফুটুস করে মরে যাবো। তারপর তুমি আর আমি আকাশে উড়ে উড়ে বেড়াবো। কষ্ট করে এতদূর থেকে আমার জন্য আসতে হবে না। বারান্দা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা বাতাস ঢুকছে ঘরে। নবনীর গায়ে শুধু সামির পুরোনো নরম হয়ে যাওয়া নীল রঙের শার্ট। ওর হাত-পা এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই! কমফোর্টার হাতে নিতে গিয়েও থেমে গেল অমিত। সামির সঙ্গে ব্যস্ত নবনী। নিচুস্বরে গল্প করছে, হাসছে। ভালোবাসার মানুষটার সঙ্গে ওর একান্ত মুহূর্তে বিরক্ত করার অধিকার কি তার আছে? নবনী দিয়েছে তাকে সেই অধিকার? বিষন্ন চোখে নবনীকে দেখছে অমিত। কান পেতে শুনছে ওর নিচুস্বরে কথোপকথন। 

    ***** 

    — “আচ্ছা! সেজন্যই তখন নবনী চমকে গিয়েছিল। 

    আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুখে নাইটক্রিম মাখতে মাখতে বললো রুমানা। গালে হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে বসে আছে সাব্বির। দীর্ঘ একঘন্টা যাবৎ এভাবেই ভ্রু কুঁচকে আছে সে। অমিত-নবনীর গল্পটা রুমানাকে শোনাবার সময় একবারের জন্যও চেহারা স্বাভাবিক হয়নি তার। রুমানার কথা শুনে সাব্বির জিজ্ঞেস করলো, – “কখন? কেন?” 

    — “আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি গাইনি স্পেশালিষ্ট কি না। বললাম আমি সাইকিয়াট্রিস্ট। শোনা মাত্র ওর চেহারার রঙ উড়ে গেল।” 

    — “হ্যাঁ তোমরা হলে ওর কাছে টেরোরিস্ট।” 

    — “টেরোরিস্ট! আরেকটু ভালো উদাহরণ দেয়া যেত না সাব্বির?” 

    — “এ্যাই রুমানা! 

    — “কী?” 

    — “তুমিই তো সাইকিয়াট্রিস্ট! নবনীর ট্রিটমেন্ট তুমি কেন করছো না?” 

    — “বলেছো করতে?” 

    — “এখন তো বলছি।” 

    — “অবশ্য তোমার কথা শুনতে শুনতে আমিও মনে মনে ভাবছিলাম ওর ট্রিটমেন্ট আমি করবো। তবে সরাসরি না”। 

    — “তাহলে?” 

    — “ট্রিকস ফলো করতে হবে। প্ল্যান আছে একটা।” 

    — “এরমধ্যে প্ল্যানও করে ফেললে?” 

    — “আহামরি কিছু না। তবে সাবধান থাকতে হবে এই যা! একবার নবনী কিছু টের পেয়ে গেলে আর কখনো ও নিজের ফ্যামিলি মেম্বারদের ট্রাস্ট করবে না। বাসা ছেড়ে চিরতরে চলেও যেতে পারে।”

    — “ঝামেলা!”

    — “শারীরিকভাবে অসুস্থ মানুষদের সুস্থ করতে যতটা যত্ন, শ্রম দিতে হয় মানসিক রোগীর ক্ষেত্রেও তাই। তবে এক্ষেত্রে ফ্যামিলি মেম্বারদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা দিতে হয় বেশি।” 

    — “প্ল্যান কী?” 

    — “আজ নবনী একটু অসুস্থ ছিল। খেয়াল করেছো?” 

    — “না তো!” 

    — “কথা বলছিল আমাদের সঙ্গে। খেয়াল করলাম ও জোর করে চোখ টেনে রাখছে। অস্থির লাগছিল একটু। জিজ্ঞেস করলাম সমস্যা কী? তখন ও বললো, মাথা ঘুরাচ্ছে। অনি, আন্টি আংকেল বারবার বলছিল ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে। ও গেল না। এরপর আন্টি আর অনি ওকে নিয়ে অভিযোগের ঝুলি খুলে বসলো। মাথা ঘুরানো, মাথাব্যথা, ব্যাকপেইন, হাঁটুতে ব্যথা ওর কমন প্রবলেম। প্রায়ই বেশ ভুগতে হয় ওকে। তবুও ও রেস্ট নিতে চায় না, খেতে চায় না। পাগলের মতন কাজ করতেই থাকে। বহুবার ডক্টরের কাছে নিতে চেয়েও ওকে নেয়া যায়নি। মোটকথা নবনী পুরোপুরি সুস্থ না, টুকটাক সমস্যা ওর আছে। ধরো কিছু ভিটামিন আর ক্যালসিয়াম ওর প্রয়োজন। ওকে আমি আমার ফ্রেন্ড রিয়াজের চেম্বারে পাঠাবো। মানে অমিত কিংবা আন্টি ওকে নিয়ে যাবে। রিয়াজের সঙ্গে আগেই নবনীর কন্ডিশন ডিসকাস করে রাখবো। রিয়াজকে বলবো কয়েকটা ভিটামিন প্রেসক্রাইব করে দিতে। অমিত ভাইয়া মেডিসিনগুলো বদলে ফেলবে। মানে ট্যাবলেটগুলো ফেলে বোতলের ভেতর আমার প্রেসক্রাইব করা মেডিসিনগুলো রেখে দিবে।” 

    — “রুমানা, কী সলিউশন দিলে! বেচারা অমিত বউ নিয়ে কি টেনশনে আছে। আইডিয়া শুনে খুশি হয়ে যাবে একদম!”

    — “উনার সঙ্গে আমার কথা বলতে হবে। নবনীর কন্ডিশন উনি ভালো বলতে পারবে আমাকে। ওর আগের প্রেসক্রিপশনগুলোও লাগবে।

    — “সব হয়ে যাবে। তুমি শুধু বলো সুস্থ হতে কতদিন সময় লাগবে?”

    — “আমি আমার বেস্ট ট্রাই করবো। দেখা যাক কী হয়! আমি মেডিসিন দিতে পারবো। নবনীর সঙ্গে দেখা হলে কাউন্সেলিং করাতে পারবো। কিন্তু সেটা তো রেগুলার না আবার সরাসরি সামির প্রসঙ্গে কিছু বলতে পারবো না। সো, অমিত আর বাসার অন্যান্য মেম্বারদের সেভাবে টেক কেয়ার করতে হবে।’ 

    — “করবে। অমিতের হাবভাব যা বুঝলাম হি ইজ ইন লাভ। নবনী ওর মাঝে বিশাল একটা অংশ দখল করে নিয়েছে। নবনী ওর জন্য কী কী করেছে, নবনী মানুষ হিসেবে কেমন সেসব নিয়ে কথা বলার সময় আমি দেখছিলাম অমিতকে। আমি আলাদা কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম ওর চোখে।”

    — “খুব স্বাভাবিক। একজন তোমাকে ভেঙে গুড়িয়ে দিলো আর সেই মুহূর্তে অন্য কেউ এসে তোমাকে কুড়িয়ে নিয়ে আবার জোড়া লাগালো, তার প্রতি দুর্বলতা অসম্ভব কিছু তো না! নবনী মেয়ে হিসেবে চমৎকার। ওর সঙ্গে কথা বলে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। ইনফ্যাক্ট আমার আজকের দিনটা খুব ভালো কেটেছে ওর সঙ্গে গল্প করে। অমিতের সঙ্গে নবনী আরো অনেক ক্লোজ। তার উপর মেয়েটা ওর বিয়ে করা বউ। ভালোবাসা তো হবারই ছিল।” 

    — “ঐ বুড়ো লোকটা যদিও একটা ক্রাইম করেছে কিন্তু অসম্ভব রকমে ভালো কাজ করেছে। নয়তো মুনিয়া ডাইনিটার কাছ থেকে অমিতের রেহাই ছিল না। নবনীর মতন কিউট আর কেয়ারিং বউ পেতো না।” 

    — “রাবিশ! ডাইনি কী, সাব্বির? কেমন ভাষা এসব?” 

    — “ও সত্যিই ডাইনি, রুমানা। মুনিয়া কেমন অসভ্য তা জানা নেই তোমার।” 

    — “জানি। তোমাকে কতবার বলেছি এসব ভাষা ব্যবহার না করতে।” 

    — “ধুর! থাকো তুমি তোমার ভাষা নিয়ে। আমি অমিতকে কল করে তোমার সলিউশন জানাই।”

    ৪৩

    বন্ধু, অমিতের অফিস কলিগ প্রতিবেশী আর খুব কাছের পাঁচ সাতজন আত্মীয় মিলে পঞ্চাশ জনের আয়োজন হয়েছে আজ বাসায়। রান্নাবান্না সব অমিতের মা, শাশুড়ি আর মামী শাশুড়ি মিলে সেরে ফেলেছে। ঘর গোছানো, বসার ঘরে বার্থডে ডেকোরেশন, রান্নার কাজে সাহায্য এসব করেছে নবনী, অনি আর নাতাশা। 

    অফিস থেকে আজ একটু জলদিই বেরিয়েছিল অমিত। পাঁচটা নাগাদ বাসায় ফিরে দেখলো সমস্ত আয়োজন শেষ। বসার ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখছে অমিত। নবনীর বাবা অমিতকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, 

    — “অমিত, পছন্দ হয়নি ডেকোরেশন? মেয়েদের বলবো চেঞ্জ করতে?” 

    হাসলো অমিত। 

    — “পঁয়ত্রিশ হয়ে গেছে আমার! এই বয়সে এভাবে ঘর সাজিয়ে কে বার্থডে করে?” 

    পায়েস খেতে খেতে এরশাদ সাহেব বললেন, 

    — “পছন্দ হয়েছে কি না সেটা বল?” 

    — “অবশ্যই হয়েছে। মনে হচ্ছে যেন ছোটবেলায় ফিরে গেছি আমি! চট্টগ্রামের আগের বাসাটার ফিল পাচ্ছি আব্বু। চোখে ভাসছে সবকিছু।” 

    — “খুশি খুশি লাগছে না?” 

    — “অনেক!” 

    — “তোমার খুশি দ্বিগুন করতে আমার মেয়ে দারুণ একটা সারপ্রাইজ রেখেছে তোমার জন্য।

    — “আর কত সারপ্রাইজ দিবে ও আমাকে?” 

    — “গাধা! জিজ্ঞেস কর কী সারপ্রাইজ?” 

    — “কী?” 

    — “পরে দেখাচ্ছি। আগে কিচেনে আয়। দেখ তোর মা, চাচী আর শিপনের বউ মিলে কত কী রান্না করেছে। গরুর মাংসটা যা বানিয়েছে না ভাবী!” 

    শফিক সাহেব মুখ উজ্জ্বল করে বলতে লাগলেন, 

    — “আমার বউয়ের হাতের বিফ রান্না বরাবরই বেস্ট! নীতুর মতন বিফ কেউ রাঁধতেই পারে না।”

    বাবার ছেলেমানুষীতে হাসলো অমিত। 

    — “তুমি অলরেডি খেয়েও নিলে আব্বু?” 

    — “শুধু আমি একা খেয়েছি নাকি? তোর চাচাও খেয়েছে। জিজ্ঞেস কর?”

    — “আশ্চর্য! তুই শিপনের নাম বলছিস না কেন এরশাদ? ও খায়নি?” 

    — “হ্যাঁ ঐ তো! শিপনও ছিল। যাই হোক, তোর মা, চাচীদের কিছু বলিস না।”

    — “তোমরা চুরি করে খেয়েছো!”

    — “নিজের ঘর থেকে খেলে সেটা চুরি হয় না বাবা। বুঝতে চেষ্টা কর ব্যাপারটা!”

    — “ছেলেকে কিচেনে নিয়ে যা না এরশাদ! ওকেও বাটিতে তুলে দে দুইপিস। ছেলেকে খুশি রাখ। কূটনীতি বুঝতে হবে তো, তাই না!” 

    — “তুই আয় আমার সঙ্গে। সব কয়টা আইটেম একটু করে টেস্ট কর। তারপর তোকে সারপ্রাইজ দেখাচ্ছি।” 

    অমিতের হাত টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছেন এরশাদ সাহেব। অমিত বললো, 

    — “আমি এখন কিছু খাবো না। আগে বলো কী সারপ্রাইজ?” 

    — “খাবি না? সিওর? এত মজার খাবার মিস করবি?” 

    — “পরে খাওয়া যাবে। আগে সারপ্রাইজ দেখি।” 

    ফ্রিজের সামনে এসে দাঁড়ালেন এরশাদ সাহেব। ভেতর থেকে বড় কেকবক্সটা বের করে বললেন, 

    — “খুলে দেখ।” 

    বক্স খুলতেই আনন্দে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো অমিতের। 

    — “মাই গড! এটা কোথায় পেলো নবনী?”

    — “আমাকে জিজ্ঞেস করলো অমিতের সবচেয়ে মেমোরেবল বার্থডে কোনটা ছিল? বললাম তোর দশ বছরের জন্মদিনের কথা। পুরো পার্টিটা খুব এনজয় করেছিলি তুই। সবচেয়ে বেশি গল্প করিস ঐ বার্থডে পার্টির। আর কেকটা তোর ভীষণ পছন্দ ছিল।” 

    — “হ্যাঁ। আমার সবচেয়ে প্রিয় কেক!” 

    — “আর কী! ছবি নিয়ে চলে গেল কেকের দোকানে এক সপ্তাহ আগে। অর্ডার দিয়ে এসেছিল আজকের জন্য।” 

    — “শি ইজ দ্য বেস্ট গার্ল আই হ্যাভ এভার মেট আব্বু! কী কী যে করছে না আমার জন্য! কোনদিন দেখবো আকাশের চাঁদ তারাও এনে হাজির করেছে আমার সামনে। ইনসেইন! শি ইজ টোটালি ইনসেইন!” 

    — “সেজন্য তোর মা আর আমি বলি মেনে নে এই বিয়েটা। ওর চেয়ে বেটার আর কাউকে পাবি না।”

    — “নাহ্! এবার মনে হচ্ছে সত্যিই বেঁধে রাখতে হবে ওকে। চলে যেতে দিলে খুব লস হয়ে যাবে।”

    একসঙ্গে হেসে উঠলো দু’জন। একটুখানি দূরে দাঁড়িয়ে আছেন শফিক সাহেব। হাসছেন তিনিও। স্বস্তির হাসি। তার অমূল্য রত্নকে এই ছেলেটা চিনতে পেরেছে। বহুবছর আগে মায়ের কাছে শুনেছিল, রত্নের কদর সবাই করতে জানে নাকি! যে জানে সে নিজেও অমূল্য। 

    অমিত বারবার প্রমাণ করছে তার অমূল্য রত্ন মন্দ হাতে সোপর্দ হয়নি। মেয়ের বাবা হিসেবে এ যে পরম প্রাপ্তি! 

    কেকটা আবার সযত্নে তুলে রেখে অমিত তার বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, 

    — “নবনী কোথায় আব্বু?”

    — “লেডিস পার্টি সব সাজগোজে ব্যস্ত। আপাতত কাউকে ডাকাডাকি করিস না। তুই ঘরে যা, ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নে। ততক্ষণে ওদেরও হয়ে যাবে।”

    পুরো ঘরময় মানুষ। তাদের কথার শব্দে অমিতের ফ্ল্যাট সরগরম। বাসায় আজ মাছের বাজার বসেছে যেন। সবাই চলে এসেছে। এখনো এসে পৌঁছায়নি বড় মামার পরিবার আর সাব্বির-রুমানা। ওদের জন্যই এখনো কেক কাটা হচ্ছে না। ওদিকে নবনীও এখনো এদিকটাতে আসছে না। বাসার সব মহিলারা রেডি হয়ে এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছে। অথচ যাকে দেখবে বলে ক্ষণে ক্ষণে সে অস্থির হয়ে উঠছে তাকেই দেখতে পাচ্ছে না। বন্ধুদের আড্ডা ছেড়ে নবনীর রুমের দিকে গেল অমিত। রুমে পা রাখতেই এক মুহূর্তের জন্য হার্টবিট মিস হলো বোধহয়! নবনী শাড়ী পরেছে! ওয়াইন কালার জামদানী। সঙ্গে ন্যুড মেকআপ। কপালে ছোট্ট টিপ। হাতভরা কাঁচের চুড়ি। কানে গতমাসে তার গিফট করা কুন্দনের ইয়াররিং। খোপায় ফুল বাঁধা নিয়ে যুদ্ধ চলছে ওর। অমিত এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই রইলো নবনীর দিকে। এই প্রথম শাড়ী পরলো নবনী। বিয়ের দিনও পরেছিল কিন্তু ওর দিকে ঠিকঠাক চোখ তুলে তাকানোই হয়নি।এক হিসেবে আজ নবনীকে প্রথম শাড়ী পরতে দেখা। শাড়ীতে নবনীকে এত অসাধারণ লাগে, তাহলে রোজ কেন শাড়ী পরে না মেয়েটা? 

    — “বেকুবের মতন তাকিয়ে আছো কেন অমিত? দেখতে পাচ্ছো না ফুল আটকাতে পারছিনা? আসো, হেল্প করো আমাকে।” 

    অমিতকে ধাক্কা দিয়ে হুরমুর করে ঘরে ঢুকলো অনি। তড়িঘড়ি করে ড্রেসিং টেবিল থেকে জুয়েলারী বক্সগুলো বের করছে সে। অনিকে দেখতে পেয়ে নবনী বললো,

    — “থাক লাগবে না, অনি করে দিবে। আমার ফুলটা ঠিক করে দাও তো অনি।”

    — “ভাইয়াকে বলো। আমার কানের জিনিসের বড় পাথরটাই পড়ে গেছে। অন্য একটা ম্যাচিং জুয়েলারী খুঁজতে হবে।” 

    অমিতকে আবার ডাকার আগে সে নিজেই নবনীর কাছে এল। প্ৰায় গা ঘেঁষে দাঁড়ালো নবনীর। খোপার ফুলে ক্লিপ আটকে দিতে দিতে, আয়নায় নবনীর চোখে চোখ রেখে নিচুস্বরে বললো, 

    — “আঁর তুন তোয়াঁর লাই বড় মায়া লাগে। এই দে আঁই তোয়াঁরে হারাক্ষণ খইথে থাখি দে তুই আঁর বান্ধবী হইলেও আদতে বান্ধবী ন। আঁত্তুন তোয়ারে হেয়াত্তুন বেশ ভাইবতু মনে অয়। তোয়াঁর খথা চিন্দে গইরলে আঁই হারাক্ষণ বেদিশা থাখি তোয়াঁর লাই দে মায়া লাগের, বেদিশা লাগের, হিয়িনুর নাম কী দিতাম আঁই? আঁই কি তইলে তোয়াঁরে পিরিত গরি ফেলাই?” 

    জুয়েলারী খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে অমিতের দিকে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো অনি। চোখে মুখে তার বিস্ময়ের হাসি। নবনী চেহারা কুঁচকে তাকিয়ে রইলো অমিতের দিকে। চোখের ভাষায়, ঠোঁটের হাসিতে দুষ্টুমির আনাগোনা। 

    — “তুমি আমাকে কী বললে অমিত?” 

    — “খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু।” 

    — “আমি চট্টগ্রামের ভাষা বুঝি না। তার উপর নাকে বাজিয়ে মিনমিন করে কিসব বললে। শুনিইনি ঠিকঠাক।”  

    — “জানি তো বুঝো না।

    — “তাহলে বললে কেন এভাবে?” 

    — “যেন বুঝতে না পারো তাই।” 

    — “ফাজলামি করো? কী বলেছো আমাকে? এ্যাই অনি? অমিত কী বলেছে আমাকে? বদনাম করেছে আমার নামে?”

    — “আমি শুনিইনি কিছু।” 

    — “ভাইবোন একজোট হয়েছে দেখো! তোমার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে তুমি শুনেছো সবটা। স্ট্যাচু হয়ে কেমন তাকিয়ে দেখছো অমিতকে! বলো, ও কী বলেছে আমাকে?” 

    — “আমি কিচ্ছু জানি না আপু।” 

    এক প্রকার দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অনি। কোমরে হাত রেখে নবনী অমিতকে শাসাতে লাগলো, 

    — “অনি ওভাবে পালিয়ে গেল কেন? কী বলেছো আমাকে? অশ্লীল কিছু? অনি সে কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে?” 

    ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলো অমিত। নবনীর গালে আলতো চড় মেরে বললো, 

    — “বাইরে চলো। গেস্ট সব চলে এসেছে।” 

    ড্রইংরুমে এসে বসলো অমিত। গেস্ট সবাই উপস্থিত। তার এই ফ্ল্যাটটা আজ হাসি আনন্দে মেতে উঠেছে। বন্ধু, আত্মীয়, পরিচিত মুখগুলোর আজ যেন মিলনমেলা চলছে। সত্যিই সেই ছোট্টবেলা বুঝি ফিরে এসেছে। ঐ তো ডাইনিংরুমে দাঁড়িয়ে বড় মামির সঙ্গে কথা বলছে যে অসম্ভব সুন্দরী মেয়েটা, ও বোধহয় একটা পরী এইযে জীবনটা কেটে যাচ্ছে পূর্ণতায় আর ষোলো আনা সুখে সবকিছুর পেছনে তো এই মেয়েটাই। সাধারণ মানবী হয়ে কখনো কাউকে পূর্ণ করা সম্ভব? ষোলো আনা সুখ দেয়া সম্ভব? 

    সোফা ছেড়ে ডাইনিংরুমের দিকে গেল অমিত। ও ঘরে মা, চাচী, নানী শাশুড়ি, দুই মামী, বন্ধুর বউ আর প্রতিবেশী আন্টিদের আড্ডা চলছে। বড় মামীর সঙ্গে কথার মাঝে হঠাৎ নবনীকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরলো অমিত 

    — “তুমি আমার উইশ মেকার নবনী। যেই আনন্দগুলো ফিরে পাবো বলে ভাবিনি, আফসোস হতো খুব ঠিক সেগুলোই এক এক করে হাজির করছো। তোমাকে আমার থ্যাংকস বলা উচিত হবে না। তুমি যা কিছু করছো আমার জন্য থ্যাংকস শব্দটা খুব ছোট্ট হয়ে যাবে। অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। কিন্তু কী বলবো, কিভাবে বলবো বুঝতে পারছি না। জটিল লাগছে খুব। তুমি বুঝে নিও প্লিজ!” অমিতের পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে নবনী, 

    — “আচ্ছা বুঝে নিলাম।” 

    .

    অনুষ্ঠান শেষে সবাই ফিরে গেছে। রয়ে গেছে শুধু নবনীর পরিবার। বাসার নিচে দাঁড়িয়ে নবনীর ট্রিটমেন্টের পুরোনো ফাইলগুলো রুমানার হাতে দিয়ে, ওর সব সমস্যাগুলো বুঝিয়ে বলছেন শফিক সাহেব। বলতে বলতে গলা ধরে আসছে তার বারবার। পুরোনো সেই বিভীষিকার দিনগুলো মনে পড়লেই ভয় আর অসহ্য যন্ত্রণায় গলা কেঁপে উঠে তার। কখনোবা চোখ ভিজে যায়। যথাসম্ভব সেইসব স্মৃতি ভুলে থাকারই চেষ্টা করেন তিনি। আজ মেয়ের খাতিরে পুরোনো স্মৃতিচারণ করতে হচ্ছে তার। পুরোটা সময় শ্বশুরের হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল অমিত। ছাড়েনি এক মুহূর্তের জন্য। ফাইলগুলো নিয়ে রুমানা চলে যাবার আগে শফিক সাহেবকে আশ্বস্ত করে গেল, 

    — “মন খারাপ করবেন না আংকেল। ও সুস্থ হয়ে যাবে, হয়তো সময়টা দীর্ঘ হবে। আমাদেরকে ধৈর্য্য রাখতে হবে। আমার ইন্সট্রাকশন ফলো করতে হবে।” রুমানা আর সাব্বির চলে যাবার পর শফিক সাহেবকে উপরে পাঠিয়ে দিলো অমিত, নিচে রয়ে গেল সে। সিগারেট শেষ। সামনের দোকান থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে বাসায় ফিরছিল সে। তখনই সামনে এসে দাঁড়ালো পরিচিত সেই গাড়ি। নেমে এলো মুনিয়া। মুখে বাঁকানো হাসি। অমিতের দিকে সাদা গোলাপের তোড়া এগিয়ে দিয়ে বললো,

    — “হ্যাপি বার্থডে অমিত!” 

    — “তুমি এখানে?” 

    — “ফুলের তোড়াটা ধরো!” 

    — “এটা কেন?” 

    — “কেন আবার? তোমার জন্য। শুটিং ছিল নরসিংদীতে। সেখান থেকে সোজা চলে এলাম তোমার কাছে। কোথাও দাঁড়িয়ে গিফট খুঁজতে গেলে আরো দেরী হয়ে যেত। অলরেডি রাত বেশ বেড়েছে। ভাবলাম হোয়াইট রোজেস তোমার ফেভারিট। যাওয়ার পথে পেয়েও যাবো, তাই নিয়ে নিলাম। এবার ধরো ফুলটা।” 

    — “নিবো না আমি। কেন এসেছো এখানে?” 

    — “তুমি আমাকে ইনসাল্ট করছো অমিত!” 

    — “যদি ভাবো ইনসাল্ট করছি, তবে তাই।” 

    — “এমন উইয়ার্ড বিহেভ করার মানে কী?” 

    — “যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে; আন্তরিকতা, মায়া, শ্রদ্ধাবোধ কিছুই আর বাকি নেই, তার সঙ্গে আমি উইয়ার্ড বিহেভ করবো, সেটাই স্বাভাবিক।” 

    — “দেখো, রিলেশনশিপে ঝগড়া হবে, এটা খুব স্বাভাবিক। তার মানে তো এই না একেবারে ছেড়ে চলে যেতে হবে। 

    — “ছাড়তে তুমি চেয়েছিলে। দুই বছর ধরেই চেয়ে আসছো। আমিই তোমার পা ধরে এতগুলো দিন রিলেশন টিকিয়ে রেখেছি। আর কী বললে? ঝগড়া? শুধু ঝগড়া হয়েছে আমাদের মাঝে? কী না বলেছো আমাকে? কী না করেছো তুমি?” 

    — “আমার রাগ বেশি জানো না? রেগে গেলে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করি।” 

    — “রেগে গেলে মানুষ চিৎকার করে, ভাঙচুর করে। গালি দেয়। কিন্তু প্রেমিক থাকা সত্ত্বেও অন্য ছেলের সঙ্গে রিলেশনে জড়ায় না। তুমি জড়িয়েছো। একাধিক ছেলের সঙ্গে জড়িয়েছো।” 

    — “ওরা আমার ফ্রেন্ড। কতবার বলেছি তোমাকে!” 

    হাতের মোবাইল থেকে দ্রুত মুনিয়ার ছবি খুঁজে বের করলো অমিত। ওর চোখের সামনে স্ক্রিন তুলে বললো, 

    — “বন্ধুকে পাবলিক প্লেসে লিপকিসও করা যায়, তাই না?” 

    আকাশ যেন মাথার উপর ভেঙে পড়লো মুনিয়ার। চোখ বড় করে বললো, 

    — “তুমি এটা কোথায় পেলে?” 

    — “আজ নাহয় প্রমাণ সহ পেয়েছি। এর আগেও তুমি অনেকের সঙ্গে রিলেশনে ছিলে। সব আমার কানে এসেছে, তবুও বারবার তোমাকে বুঝিয়েছি এসব বাদ দাও। ফিরে এসো আমার কাছে। তুমি আসোনি। যা খুশি করে বেড়িয়েছো।” 

    — “আমি এত খারাপ জানতে যেহেতু তখন ছেড়ে যাওনি কেন? এখন কেন যাচ্ছো? ছেড়ে যাওয়ার কারণটা কী, বলো তো? আমি শাহরিয়ারকে কিস করেছি সেটা নাকি তোমার জীবনে নতুন মানুষ এসেছে তাই?” 

    — “তুমি যেটা ভেবে নাও।”

    অমিতের খামখেয়ালিতে ভরা উত্তরে মুনিয়ার মেজাজ খারাপ হচ্ছে খুব। চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেল সে। 

    — “তোমার সঙ্গে ঐ মেয়েটা কে, যাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াও?” 

    — “বউ।” 

    — “আচ্ছা! আমার কল রিসিভ না করার কারণ তাহলে তোমার বউ? যেই ছেলেটা আমার পিছু ছাড়েনি কখনো সেই ছেলেটা আমাকে এত ইগনোর কিভাবে করছে, এটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না আমি। ঘরে বউ এসেছে তাই কল রিসিভ করে কথা বলার সাহস হচ্ছে না। 

    — “সাহস না, রুচি হচ্ছে না।” 

    — “আমাকে ছাড়া মরে যাবে, বাঁচবে না আরো কত কী! এখন বেঁচে আছো কেমন করে? আবার বিয়েশাদীও করে নিয়েছো। বাহ্!” 

    — “আমার চেহারা দেখতে চাও না, কন্ঠ শুনতে চাও না এখন কেন একের পর এক কল করেই যাচ্ছো? এত রাতে কেন আমার বাসার সামনে এসে হাজির হয়েছো?” 

    — “কজ আই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক ইন মাই লাইফ।”

    — “বাসায় যাও। রাত হয়েছে। আমার ওয়াইফ অপেক্ষা করছে আমার জন্য।”

    বাসার দিকে অমিত পা বাড়াতেই ওর পথ আটকালো মুনিয়া। 

    — “দাঁড়াও তুমি। অমিত, যা হওয়ার হয়ে গেছে। এতদিনের সম্পর্ক আমাদের, এভাবে ভেঙে দেয়ার মানে হয় না। আমি তোমাকে খুব মিস করছি। প্লিজ রিলেশনটা আমরা আবার কন্টিনিউ করি। কেউ জানবে না এই ব্যাপারে।”

    — “তুমি আমাকে ভালোবাসো?” 

    — “অফকোর্স আই ডু।” 

    — “তোমার এই উত্তরটার জন্য কষে একটা চড় লাগাতে ইচ্ছে করছে। এই এলাকায় আমি পরিচিত মুখ, রাত বিরাতে একটা মেয়েকে চড় মেরে এলাকায় সাড়া ফেলতে চাই না। তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসোনি। তোমার সাময়িক মোহ ছিলাম আমি। আর এখন ফিরে আসার যে নাটকটা করছো সেটা ভালোবাসা থেকে না, জেলাসি থেকে করছো। আমি মুভ অন করেছি, তোমার পেছন পেছন ঘুরছি না, আমার জীবনে নতুন মানুষ এসেছে, এটা তুমি মানতে পারছো না। তোমার মতন একটা নরকের কীট, ছোটলোক, বিষাক্ত জিনিসকে আমি আমার জীবনের কোথাও চাই না। কোনোভাবেই না। বিদায় হও এখান থেকে।” 

    .

    ফুলের তোড়াটা পায়ে ফেলে সজোরে লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিলো অমিত। দ্রুত পায়ে চলে গেল এখান থেকে। প্রচন্ড অপমান আর রাগে দাঁতে দাঁত চেপে রইলো মুনিয়া। পুরো চেহারা লালবর্ণ ধারণ করেছে তার। কাঁদছে সে। 

    ৪৪

    সোফার দুই মাথায় দুইজন গাল ফুলিয়ে বসে আছে। তাদের মাঝে এসে বসলো নাতাশা। হতাশ ভঙ্গিতে বললো, 

    — “তোমরা এই বুড়ো বয়সে স্কুলের বাচ্চাদের মতো জেদ করবে?” 

    তেড়ে উঠলো নবনী। 

    — “তুই বুড়ো বলছিস কাকে?” 

    — “দু’জনকেই।”

    — “খবরদার আমাকে বুড়ো বলবি না! আর বাচ্চাদের মতো বিহেভ অমিত করছে। সামান্য একটা ব্যাপারে কথা বলা বন্ধ করলো কেন? কখন থেকে ট্রাই করছি কথা বলার অথচ মুখে তালা এঁটে আছে।” 

    — “এবার আমি অমিত ভাইয়ার সাপোর্টে।” 

    নাতাশার দিকে নবনী চোখ বড় করে তাকালো। তার কপট রাগকে পাত্তাই দিলো না নাতাশা! অমিতের কাছাকাছি সরে গিয়ে বসলো সে। 

    — “ভাইয়া ঠিকই তো বলছে। নিজেকে দেখেছো আয়নায় খেয়াল করে? তোমার চোখে মুখে স্পষ্ট বুঝা যায় তুমি অসুস্থ। এখন নাহয় খুব একটা প্রবলেম হচ্ছে না। শরীরের উপর জোর খাটিয়ে সামলে নিতে পারছো। অসুখ-বিসুখ একটু একটু করেই বাড়তে থাকে। তারপর যখন বিছানায় পড়বে তখন নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে না? আমাদেরও লাগবে না আপু। আমাদেরও কষ্ট হবে।” 

    নাতাশার কথার পিঠে মুখ খুললো অমিত। অভিমানে ভার হয়ে এল তার কন্ঠ। 

    — “ওসব ওকে বলো না নাতাশা। বলে লাভ নেই। আমাদের টেনশনে ওর কিছুই আসে যায় না। 

    — “আমি কখন বললাম অমিত?” 

    — “নাতাশা ওকে বলো আমি ওর সঙ্গে কথা বলছি না।” 

    নাতাশাকে ঠেলে সোফা থেকে সরিয়ে দিলো নবনী। অমিতের কাছে গিয়ে বসলো সে। 

    — “ঢঙ করো? আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বললে সমস্যা কী?” 

    — “যার কাছে আমার কথার দাম নেই তার সঙ্গে আমার কোনো কথাও নেই। “সামান্য মাথা ঘুরানো নিয়ে ডক্টরের কাছে যাবো?” 

    — “শুধু মাথা ঘুরানো না। তোমার আরো প্রবলেম আছে। যাকগে, সেসব বলে লাভ নেই। করো তোমার যা খুশি 

    — “তুমি কি আমার সঙ্গে এভাবেই কথা বলবে?” 

    — “তোমার সঙ্গে আমি আর কোনো কথাই বলবো না। আজকের ঘটনা আমি মাথায় সযত্নে তুলে রাখবো। আর কখনো যেন আমার কেয়ার কেউ করতে না আসে।” অমিতের পাগলামিতে হার মানলো নবনী। চেহারা কুঁচকে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। 

    — “যতই চাই ওষুধপত্র থেকে দূরে থাকবো, হয় না কিছুতেই। ভালো লাগে না এসব ছাতার মাথা গিলতে। চেম্বার কোথায়? এপোয়েনমেন্ট কখন?” নবনীর দিকে মুচকি হেসে ঘাড় ফেরালো অমিত, 

    — “যাবে?” 

    — “তো আর কী করবো? বসে বসে তোমার গাল ফোলানো দেখবো?” 

    .

    এক দৃষ্টিতে প্রেসক্রিপশনে তাকিয়ে আছে নবনী। ডক্টর রিয়াজুল ইসলাম ফটফট করে কিসব যেন লিখছে কাগজে। শত চেষ্টায়ও বুঝতে পারছে না নবনী। মনে হচ্ছে যেন কাগজের উপর কালো পিঁপড়া বসে আছে। প্যাড থেকে একটানে কাগজটা ছিঁড়ে অমিতের হাতে ধরিয়ে দিলো ডক্টর রিয়াজুল। বললো, 

    — “মেডিসিনগুলো ঠিকঠাক খেতে হবে। একমাস পর আবার আসবেন।” বিরক্ত হলো নবনী, 

    — “আবার আসতে হবে?” 

    — “হ্যাঁ। সুস্থ হতে চান তো নাকি?” 

    — “আমি খুব বেশি অসুস্থ তো না!” 

    — “কতদিন ধরে সমস্যা পেলে পুষে রেখেছেন হিসেব আছে? রোগ বালাই তো এভাবেই বাড়ে। এতটাও হেলাফেলা করা উচিত না। এখন পর্যন্ত অনেক পেশেন্ট আমি পেয়েছি যারা বহুবছর সামান্য অসুস্থতা ভেবে রোগ পুষে রেখেছে। পরে টেস্ট করে জানা গেল তারা দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছে। এদের মাঝে কেউ মারা গেছে আবার কেউ দুই আড়াইবছর ধরে চিকিৎসা করে যাচ্ছে। পুরোপুরি সুস্থ হয়তো উনারা আর কখনোই হবে না। অবহেলায় মরণব্যাধিও হয়। তাই সাবধান!”

    — “ভয় দেখিয়ে দিচ্ছেন কিন্তু!”

    — “ভয় পাওয়া উচিত। নয়তো সাবধান হবেন কিভাবে?” 

    — “বুঝেছো এবার কেন ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছি?” 

    বোকা বোকা চোখে অমিতের দিকে তাকিয়ে রইলো নবনী। কিসব শুনছে সে! ছোট ছোট সমস্যা থেকে সত্যিই মানুষ মরে যায়? মরে যাওয়াটা ঠিক সমস্যা না, তবে বছরের পর বছর চিকিৎসা করে যাওয়া সমস্যাই বটে। বিশাল সমস্যা! 

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৪৫

    ৪৫

    আজ সারাদিন অফিসে যেমন কাজের চাপ ছিল তেমনি মুনিয়ার বাড়াবাড়িটাও ছিল অনেক বেশি। শেষ দেখা হয়েছিল তার জন্মদিনে, এরপর আর কল করেনি। দুইদিন টেক্সট করেছিলো শুধু। আজ গোটা দিনে মুনিয়ার অনবরত ফোনকল আর ম্যাসেজে চরম বিরক্ত সে। তার নাম্বার দু’টো ব্লক করেও কোনো কাজ হয়নি। অন্য নাম্বার থেকে একের পর এক কল করেই গেছে। বাধ্য হয়ে সন্ধ্যার পর অফিস থেকে বেরিয়ে মুনিয়াকে শাসাতে হলো অমিতের। চার বছরের পরিচয়ে এই প্রথম মুনিয়ার সঙ্গে এতটা বাজে ব্যবহার করলো অমিত। মুনিয়া ওপাশ থেকে নীরবে শুনেছে শুধু। এরপর আর কল আসেনি মুনিয়ার নাম্বার থেকে। অফিসের কাজগুলো শেষ করে এক সেকেন্ডও দেরী না করে বাসায় চলে এল অমিত। মুনিয়া আর অফিসের কাজের চাপাচাপিতে অসহ্য রকম মাথা ধরেছে। গরম পানিতে গোসল সেরে ঘন্টাখানেক শুয়ে থাকলেই মাথাব্যথা কমে যাবে। 

    অন্যসব দিনের মতো আজ বাসায় ফিরে কারো গলার আওয়াজ শুনতে পেলো না অমিত। সোফায় গা এলিয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, 

    — “বাসায় নেই কেউ?” 

    — “না। সব দল বেঁধে মার্কেটে গেছে।”

    — “আচ্ছা! কখন গেল? নবনী বলেনি তো কিছু।” 

    — “খেয়াল ছিল না হয়তো।” 

    — “হতে পারে।” 

    বাসার কলিংবেল বাজছে। এরশাদ সাহেব যাচ্ছিলেন দরজা খুলতে, অমিত তাকে ইশারায় থামিয়ে দিলো। দরজা খুলতেই দেখতে পেলো মুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে। কালো বোরকা গায়ে, মাথায় পেঁচানো কালো স্কার্ফ। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মুখে মাস্ক। চেহারায় নেই কোনো মেকআপের ছোঁয়া। কেউ দেখলে চিনবেই না এটা অভিনেত্রী মুনিয়া। ইচ্ছে করেই এভাবে এসেছে হয়তো! কিন্তু কেন এসেছে? তীব্র বিতৃষ্ণায় চেহারা কুঁচকে গেল অমিতের। রাগটা যেন এবার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। না চাইতেও মাথার ভেতর বিশ্রী সব গালি ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বুঝি মুখ ফসকে বেরিয়ে আসবে সব! 

    — “তুমি আমার বাসায় কেন এসেছো?” 

    — “আমি ছাড়া আর কে আসবে অমিত? তোমার বাসায় সবচেয়ে বেশি অধিকার তো আমারই, তাই না?” 

    দরজার ওখান থেকে কথা ভেসে আসছে। সোফা ছেড়ে উঠে গেলেন এরশাদ সাহেব। দরজার কাছে যেতেই দেখতে পেলেন মুনিয়া এসেছে। অমিতের বাবার সঙ্গে এর আগে কখনো দেখা হয়নি মুনিয়ার। ছবি দেখেছিল, সেই চেহারা এখনো মনে আছে। এরশাদ সাহেবকে দেখতেই মুনিয়া চিনে নিলো ইনিই অমিতের বাবা। তাকে উদ্দেশ্য করে মুনিয়া বললো,

    — “আমাকে আপনি চেনেন না বোধহয়। কিন্তু আমি আপনাকে চিনি।” 

    — “তোমাকে আমার বাসার সবাই চেনে। তোমার আর অমিতের মাঝে কী সম্পর্ক ছিল, কতটুকু ছিল সবটাই আমাদের জানা। তা তুমি হঠাৎ এখানে কী মনে করে?”

    — “ভেতরে এসে কথা বলি?” 

    কথার জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন এরশাদ সাহেব। প্রচন্ড অপমান বোধ হওয়া সত্ত্বেও চুপ করে রইলো মুনিয়া। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো অমিতের দিকে। 

    — “তোমাকে আমি বলিনি আর কখনো আমার সঙ্গে যোগাযোগ না করতে?” 

    এগিয়ে এসে অমিতের হাত ধরলো মুনিয়া। অমিত যতই ছাড়াতে চাইছে ততই মুনিয়া আরো চেপে ধরছে। 

    — “হাত ছাড়ো আমার। এখানে দাঁড়িয়ে কোনো সিন ক্রিয়েট করবে না বলে দিচ্ছি।” 

    চিৎকার করে উঠলো মুনিয়া,

    — “সিনক্রিয়েটের দেখেছো কী? আমার পা ধরে বসে থাকতে সারাক্ষণ। আর এখন আমার সঙ্গে এটিটিউড দেখাচ্ছো?”

    — “চিৎকার কেন করছো? তোমার মান-সম্মান না থাকতে পারে। আমার আছে।” 

    — “আমাকে ফেলে অন্য মেয়েকে বিয়ে করে সুখে থাকবা আর আমি তোমাকে এমনি এমনি থাকতে দিবো? কোথায় তোমার বউ? ডাকো ওকে। সেও একটু জানুক তোমার বিছানায় ওর আগে আমি শুয়েছি।” 

    — “মুনিয়া! ভেতরে আমার বাবা বসে আছে।” 

    — “শুনুক। তার ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়ে ছাড়া আমার সঙ্গে দুইবছর সংসার করেছে সেটা তার জানার প্রয়োজন আছে না? আমাকে ইগনোর করো তুমি? আমাকে?” 

    পাশের দুই ফ্ল্যাট থেকে প্রতিবেশীরা বেরিয়ে এসেছে চিৎকার শুনে। লজ্জায় মাথা নুয়ে আসছে অমিতের। নিচুস্বরে মুনিয়াকে অনুরোধ করতে লাগলো সে, 

    — “তুমি প্লিজ যাও এখান থেকে। আমরা কাল মিট করবো বাইরে।” 

    — “এই কথাটা সেই কবে থেকে বলছি তোমাকে? পাত্তাই দাওনি। এখন কেন দিচ্ছো? মানুষজন তোমার আমার কথা জেনে যাবে, তাই?” 

    — “মুনিয়া প্লিজ!” 

    — “ইশ্! লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছো তাই না? যখন আমার সঙ্গে একই বাসায় ছিলে, আমার হাজার বারণ সত্ত্বেও শ্যুটিং সেটে, আমার বাসায়, রিলেটিভদের সামনে নির্লজ্জের মতন দাঁড়িয়ে থাকতে, গার্লফ্রেন্ড বলে সারা দুনিয়া পরিচয় দিয়ে বেড়াতে, পাবলিক প্লেসে কিস করতে, তখন লজ্জা লাগতো না? পাবলিক প্লেসে তুমি আমার বয়ফ্রেন্ড বলে বলে কম সিন ক্রিয়েট তো করোনি! অথচ তোমার প্রতিবেশীর সামনে নিজের মান সম্মান বাঁচানোর জন্য কত চেষ্টা তোমার! আসলে আড়াল করতে চাও কার কাছ থেকে, বলো তো? জানামতে লোকের তোয়াক্কা কখনো তুমি করোনি। আজও করার কথা না। ভয় কি তাহলে বউ নিয়ে? লোকের কাছে তোমার বউ সব জেনে যাবে, এটাই তো ভয়?” 

    লিফটের দরজায় চোখ গেল অমিতের। তার দরজার সামনে মোটামুটি ভীড় জমে গেছে। ভীড়ের ফাঁকে দেখা যাচ্ছে নবনী দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে আছে মা আর ছোটবোন। নবনী বুঝার চেষ্টা করছে পুরো ব্যাপারটা। বুঝে গেছেও হয়তো। মুনিয়া তো আর আস্তে কথা বলছে না। গলা ফাটিয়ে পুরো বিল্ডিং জানান দিচ্ছে। সব কিছু ছাপিয়ে অমিতের মনে শুধু জেঁকে ধরেছে নবনীর ভয়। কী ভাবছে ও? অমিত ভীষণ খারাপ? চোখ তুলে তাকাতে পারবে আর কোনোদিন নবনীর চোখে? ভীড় ঠেলে অনেকটা তেড়ে এল নবনী। অমিতের পাশে দাঁড়িয়ে শীতল কণ্ঠে বললো, 

    — “হাত ছাড়ো।”

    — “কোথায় ছিলে এতক্ষণ? তোমাকেই তো খুঁজছিলাম।” 

    নবনীকে মুখোমুখি পেয়ে মুনিয়া যেন বহু আকাঙ্খিত বস্তুটা পেলো। ভীষণ আনন্দ হচ্ছে তার। স্ত্রীর সামনে প্রেমিকা হাত ধরে টানাটানি করছে সেটা নিশ্চয়ই জগতের যেকোনো পুরুষের কাছে সাক্ষাৎ যমদূতের সামনে দাঁড়িয়ে থাকার সমান। এই মুহূর্তটা, ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যই তো অপেক্ষা করছিল সে। হাতের ব্যাগগুলো ফ্লোরে রেখে অনি তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। হাতে তার মোবাইল, ক্যামেরা অন করা। ভিডিও করছে সে। মেজাজ খারাপ হলো মুনিয়ার। এসব বাড়তি ঝামেলা আবার কেন? অনিকে ধমকে বললো,

    — “ক্যামেরা অফ করো। অশিক্ষিত কুলি মজুরদের মতন যখন তখন শুধু ভিডিও করা!” 

    মুনিয়ার কথায় পাত্তা দিলো না কেউই। নবনী আবারও বললো, 

    — “অমিতের হাতটা ছাড়ো।” 

    — “ধরেছি কি আজ প্রথম? জিজ্ঞেস করো না তোমার হাজবেন্ডকে? আরো বহুবছর আগেই এই হাত আমি ধরেছি।” 

    — “বেশ করেছো। এবার ছাড়ো।” 

    জিহ্বায় টাক করে শব্দ তুলে, ডানে বামে মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো মুনিয়া। এক ধাক্কায় মুনিয়াকে সরিয়ে অমিতকে ছাড়িয়ে নিলো নবনী। মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে তার। দাঁতে দাঁত চেপে নবনী বললো, 

    — “এটা আমার হাজবেন্ড। তুমি ওর অতীত, আমি ওর বর্তমান। ওকে যেই মহিলা পৃথিবীতে এনেছে সেই মহিলা ওর উপর সমস্ত অধিকার আমাকে দিয়েছে। ওর হাত কে ধরবে, কে ধরবে না সেটা ডিসাইড করবো আমি। বারণ করা সত্ত্বেও অন্য মেয়ের হাজবেন্ডের হাত তুমি ধরে রাখো কোন সাহসে? তোমার এই অসভ্য আচরণের জন্য সিঁড়ি ভর্তি মানুষের সামনে কানের নিচে এবার কষে একটা চড় লাগাই আমি?” 

    — “অমিত এডাল্ট। ওর ডিসিশন ও একাই নিবে। ওর ডিসিশনগুলো তুমি নেয়ার কে? আর ওর মা-ইবা কে ওর দায়িত্ব তোমাকে দেবার? অমিত কি বাচ্চা? আর তুমি বেবিসিটার?” 

    — “হাতে পায়ে লম্বা হলেই তো আর এডাল্ট হওয়া যায় না। বুদ্ধি-সুদ্ধিও থাকা চাই। ওসব কিছু তো নেই তোমার এক্স বয়ফ্রেন্ডের। থাকলে ব্রেকআপের এতদিন পর তুমি ওর বাসায় এসে ওকে এভাবে ঝামেলায় ফেলতে পারতে না। তোমার এত টর্চারের পরও তোমাকে ভালোবেসে মরতে চাইতো না। কবেই তোমাকে লাথি মেরে চলে আসতো।

    — “ওহ! স্যাড। তোমার হাজবেন্ডের ভালোবাসা এখনো পাওনি বুঝি? এখনো অমিত আমার জন্য মরে যায়?” 

    এতকিছু মাথায় আর কুলাচ্ছে না অমিতের। বহুদিন পুষে রাখা মুনিয়ার সমস্ত অবহেলা রাগ হয়ে চড়ছে মাথার ভেতর। এতদিনে যা সে করেনি, হুট করেই দুই সেকেন্ডের সিদ্ধান্তে তা করে ফেললো অমিত। একটানে মুনিয়ার মাস্ক টেনে ছিঁড়ে ফেললো, স্কার্ফ খুলে নিলো। চশমা ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। গা বাঁচানোর ন্যূনতম সময়টুকু পেলো না মুনিয়া। তড়িঘড়ি করে স্কার্ফটা ফ্লোর থেকে তুলতে চাইলে, অমিত পা দিয়ে চেপে রাখলো সেটা। 

    — “মুখ ঢেকে আর কতক্ষণ? সবাই দেখুক কার সঙ্গে আমার প্রেম ছিল?” প্রতিবেশীদের মাঝে ফিসফাস শুরু হলো। মুনিয়া মাথা নিচু করে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে মুখ ঢাকার। চাইলেও এখান থেকে বেরোতে পারছে না মুনিয়া। অমিতের মা, পাশের আর সামনের ফ্ল্যাটের ভাবীরা দু’পাশ থেকে ঘিরে রেখেছে ওকে। নবনীর কাঁধ জড়িয়ে ধরলো অমিত। বললো, 

    — “তোমাকে আমি পাগলের মতন ভালোবেসেছিলাম মুনিয়া। মফস্বল থেকে উঠে আসা, এই শহরের আলো বাতাস না চেনা মেয়ে ছিলে তুমি। সেই মুনিয়া আক্তারকে আমি ঘষে মেজে আজকের সাবরিন মুনিয়া তৈরী করেছি। তোমার ক্যারিয়ার আমি গড়েছি। কোনো প্রবলেম তোমাকে ফেইস করতে দেইনি। মাসের খরচ, পড়ার খরচ, বাসা ভাড়া, তোমার ফ্যামিলিতে প্রতিমাসে গিফটস পাঠানো- কী না করেছি আমি? আমি শুধু তোমাকে চেয়েছিলাম, একটা সংসার চেয়েছিলাম তোমার ভালোবাসা চেয়েছিলাম। অনেক কিছু কি চেয়েছি আমি? চাইনি তো! বিনিময়ে তুমি কী করলে? অবহেলা আর অপমানে বিষিয়ে তুললে আমার জীবনটা। আমি থাকা সত্ত্বেও কত কত বয়ফ্রেন্ড তোমার! আজ পুলক তো কাল শাহরিয়ার। পরশু আবার অন্য কেউ। সব জেনেও তোমাকে চেয়েছি। ভালোবাসা ছাড়তে পারিনি আমি। তুমি জানতে আমি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছি, তবুও! আমাকে মরার জন্য ছেড়ে দিলে। আমার একটা খোঁজও তোমার নিতে ইচ্ছে হয়নি। ভিডিও দেখেছি আমি, শাহরিয়ারের সঙ্গে রেস্টুরেন্টে বসে তুমি কী গভীর চুমুতে ওর গায়ে মিশে যাচ্ছিলে। আমি বোধহয় মরে যেতাম সেদিনই। এই যে মেয়েটাকে দেখছো, ও আমাকে মরতে দেয়নি। উপরওয়ালা ওকে পাঠিয়েছে আমাকে সামলে রাখার জন্য, যেন তোমার মতো একটা অমানুষের জন্য চিরতরে বিলীন না হয়ে যাই। কারো যত্ন কিংবা আগলে রাখার মর্ম তুমি বুঝো না। সম্মান করতে জানো না। আমি জানি। যার জন্য আজ আমি সুস্থ সবল দাঁড়িয়ে আছি তাকে আমি ভালোবাসবো না মুনিয়া? এটা কেমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে নবনীকে? আমি ওকে ভালোবাসি। কতটা বাসি তা আমি নিজেও জানি না। শুধু জানি, নবনীই আমার সব। যতদিন ও আমার হয়ে আছে ততদিন আমিও আছি। যেদিন জানবো ও আমার নেই সেদিন থেকে আমিও আর থাকবো না। বিলীন আমি হবোই। পৃথিবীর কারো ক্ষমতা থাকবে না আমাকে ফেরাবার। মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে মুনিয়া। ওর কান্নার কারণ স্পষ্ট করে কেউ বুঝতে পারছে না। মায়াও হচ্ছে না একদম। ঘৃণা হচ্ছে শুধু। অমিত এই এ্যাপার্টমেন্টের পরিচিত মুখ। সবার পছন্দেরও বটে। আজ পর্যন্ত মন্দ কিছু ওর মাঝে কেউ দেখেনি। ভদ্র ছেলেটার সঙ্গে প্রতারণা করার পর আজ আবার তার সংসার ভাঙতে চাওয়ার দায়ে উপস্থিত সবাই ভীষণ বিরক্ত মুনিয়ার উপর। এখানে অনেকেরই প্রিয় অভিনেত্রী ছিল মুনিয়া। আজ থেকে তার নামটা ঘৃণার লিস্টে তোলা থাকবে। 

    — “অমিতকে তুমি একবার জেলে পাঠিয়েছিলে, তাই না?” 

    নবনীর প্রশ্ন মুনিয়া চমকে উঠলো। অমিত এসবও বলেছে ওয়াইফকে! 

    — “সেদিন তুমি মিথ্যা মামলা দিয়েছিলে অমিতের নামে। কিন্তু আজ যদি আমি তোমার নামে একই মামলা করি সেটা মিথ্যা হবে না। এখানে আমাদের প্রতিবেশীরা আছে, মোবাইলে এভিডেন্স আছে। তোমার ক্যারিয়ার চিরতরে ডোবাতে সময় লাগবে না আমার। এতগুলো দিনে মিডিয়াতে যে খ্যাতি কামাই করেছো, সেটা এই পাঁচ-সাত মিনিটের ভিডিওর বিনিময়ে হারিয়ে ফেলো না। নিজের ক্যারিয়ার বাঁচাতে চাইলে এক্ষুনি যাও এখান থেকে। আর কখনো যেন তোমাকে অমিত কিংবা আমার আশপাশে না দেখি।” 

    ভীড় ঠেলে এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে চলে গেল মুনিয়া।

    ৪৬ 

    প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ শেষ করে একে একে ঘরে ফিরছে অমিতের বাসার সদস্যরা। সবশেষে পা রাখলো নবনী। অমিত আলাদা করে নবনীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল সেই কখন থেকে! নবনী ফ্ল্যাটের দরজা আটকানো মাত্রই অমিত তার হাত ধরতে চাইলো। সঙ্গে সঙ্গে একলাফে পেছনে সরে গেল নবনী, 

    — “দূরে থাকো।” 

    অমিত ঠিক এই ভয়টাই করছিল। কেন যেন পুরো ঘটনা চলাকালীন সময়টাতে বারবার মনের ভেতর ডাকছিল নবনী ব্যাপারটা ভালোভাবে নিবে না। রিএ্যাক্ট করবে। নবনী পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইছিল, অমিত এসে পথ আটকালো।

    — “তুমি রেগে আছো কেন নবনী?” 

    — “তোমার মতো নির্লজ্জ, আত্মসম্মানহীন মানুষ আমি আর একটাও দেখিনি অমিত! রুচি হচ্ছে না তোমার সঙ্গে কথা বলার।” 

    — “আশ্চর্য নবনী! এসব কেন বলছো সেটা আগে বলো?” 

    — “মুনিয়াকে এত প্রশ্রয় কেন দিলে তুমি?” 

    — “প্রশ্রয় কোথায় দিলাম?” 

    — “ও এসেছে ভালো কথা। ও একটা বিশ্রী মেয়ে, যা তা কান্ড করাই ওর অভ্যেস। তুমি কেন দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলে? ওকে কথা বলার সুযোগ দিলে? তোমার কি উচিত ছিল না ওর মুখের উপর দরজা আটকে সিকিউরিটি গার্ডকে কল করা? তার উপর তোমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিল! হাতটা কি ছাড়িয়ে নেয়া যায়নি?” 

    — “আমি চাইছিলাম আপোষে কথা বলে বিদায় করতে। গার্ডকে কল করলে ও পুরো অ্যাপার্টমেন্ট চিৎকার করে মাথায় তুলতো। আর হাত ছাড়াতে চাইনি কে বললো? চেয়েছি। সেজন্যই আরো চেঁচামেচি করছিল।” 

    — “চেঁচামেচি করুক। তাতে কী? তাই বলে ওকে হাত ধরে রাখতে দিবে? আর এমনিতেও কি চিৎকার ও করেনি? কী না শোনাচ্ছিলো তোমাকে! তুমিও গাধার মত মিনমিন করে কথা বলছো ওর সঙ্গে। কষে একটা চড় কেন লাগাওনি?” 

    — “বললেই হলো নবনী? হুট করে একটা মেয়েকে চড় মারবো কিভাবে? আর আমি বুঝিনি বাসা পর্যন্ত এসে ও এভাবে সিনক্রিয়েট করবে। মাথা কাজ করছিল না তখন। ওকে কী বলবো, কিভাবে সামলাবো বুঝতে পারছিলাম না।”

    — “হ্যাঁ সেটাই। তোমার এত আদর ভালোবাসার মুন চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ওর কথার বিপরীতে বলার সাহস আছে নাকি তোমার? মুন কষ্ট পাবে না? কতদিন পর ওর হাতের মুঠোয় তোমার হাত, ওর স্পর্শ লেগেছে গায়ে। হাত কি আর ছাড়াতে ইচ্ছে হবে?” 

    — “নবনী! কিসব ভাবছো তুমি?” 

    — “ভুল ভেবেছি?” 

    — “অযথা সন্দেহ করছো। ওর প্রতি আমার আর কিছুই নেই!” 

    — “অযথা কিছুই করছি না।” 

    — “আমরা বসি। ঠান্ডা মাথায় আমার কথাগুলো শুনো।” 

    — “বললাম না তোমার মতো নির্লজ্জের সঙ্গে কথা বলার রুচি আমার হচ্ছে না। সরো সামনে থেকে।” 

    অমিতকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল নবনী। বসার ঘরে এতক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে পুরো ঝগড়াটা দেখলো অমিতের মা, বাবা, বোন। তাদের চোখে চোখ পড়তেই হেসে ফেললো অমিত। মায়ের পাশে গা ঘেঁষে বসলো। 

    — “তোমাদের আদরের বউয়ের ঝাঁঝ দেখলে?” 

    — “দেখলাম।” 

    — “একটুখানি আমার হয়ে কথা বলা উচিত ছিল না তোমাদের?”

    — “না।” 

    — “আমার চেয়ে নবনী এখন বেশি আদরের, তাই না?” 

    — “অবশ্যই।” 

    হাসতে হাসতে এরশাদ সাহেব বললেন, 

    — “নবনী ঠান্ডা মেজাজের বলে পার পেয়ে গেলি। তোর মায়ের মতন কেউ কপালে জুটলে রক্ষা ছিল না। বাসার জিনিসপত্র সব ভেঙে গুড়িয়ে দিতো। তোকেও বাদ রাখতো না।” 

    — “একদম ঠিক। নবনীর উচিত ছিল তোকে আরো দু’টো কথা শুনিয়ে যাওয়া।”

    — “আম্মু, তুমি শুনেছো ও তখন বলছিল, আমার হাজবেন্ডের হাত কেন ধরলে?”

    — “হ্যাঁ।” 

    — “এভাবে অধিকার নিয়ে কখনো ও আমাকে হাজবেন্ড বলেনি। খুব জোর র‍্যান্ডমলি মানুষের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছে হাজবেন্ড পরিচয়ে। তাও হয়তো দুই তিনবার। কিংবা ধরো মুনিয়ার ব্যাপারটা নিয়ে ও যেভাবে রিএ্যাক্ট করছে সেটাও নরমাল কিছু না। সন্দেহ, অধিকার এসব তো ভালোবাসা থেকেই আসে, তাই না? তোমারও কি মনে হয়, শি লাভস মি?” 

    ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন শামীমা, 

    — “তোকে কেউ ভালো না বেসে থাকতে পারে?” 

    ভ্রু কুঁচকালো অমিত, — “উফফ আম্মু! সবার ভালোবাসার মতন না। আলাদা কিছু।” 

    — “হ্যাঁ আলাদাই তো! আমারও মনে হয় তেমনটাই। তোর বাবাও গতকাল বলছিল।” 

    মাথা দোলালো অনি, 

    — “তোমাদের মনে হয় শুধু? আমি কিন্তু সিওর। নাতাশা আপুও। নয়তো তোমার গাধা ছেলেকে খুশি করার জন্য এত এফোর্ট কে দেয়?” 

    — “পুরো পৃথিবীর মানুষ বুঝে যাচ্ছে, শুধু নবনী ছাড়া।

    — “ওকে সময় দে অমিত। কিছুটা সুস্থ অন্তত হোক। তাড়াহুড়ো করিস না। এখন যে সময়টা পার করছিস, সেটা এনজয় কর। এই যে লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে দেখছিস, বাসায় ফিরে ওকে দেখতে না পেলে অস্থির হয়ে উঠিস, রাতে দুই একবার ঘুম থেকে জেগে ওর ঘরে উঁকি দিয়ে ওকে দেখে আসিস, ওকে ভালোবাসিস সেই কথা কখন না ও জেনে যায় সেই ভয়ে কত কথা বলতে গিয়েও আর বলা হয় না, এই সবকিছু তোর আবেগের ঝুলিতে সুন্দর স্মৃতি হয়ে থাকবে। সংসার যখন শুরু হয়ে যাবে তখন এই ব্যাপারগুলো আর থাকবে না। বিয়ের আগে ওর সঙ্গে প্রেম করার সুযোগ পাসনি। এবার নাহয় নবনী ওর মনের খবর টের পাওয়ার আগে ছোট্ট একটা প্রেমের গল্প তোদের হোক। সমস্যা শুধু একটাই তুই জানিস ভালোবাসা দু’পক্ষেই আছে। কিন্তু নবনী জানেনা। এইতো! সময় হলে নবনী নিজেই বুঝে নেবে ওর মনের খবর। এত ভাবিস না!” 

    — “বুঝলাম। কিন্তু অকারণে ভুলভাল বুঝে গাল ফুলিয়ে আছে তার কী হবে?”

    পা দোলাতে দোলাতে বিজ্ঞ ভঙ্গিতে এরশাদ সাহেব বললেন, 

    — “সংসারে সুখী হওয়ার দশটা ফর্মুলার মাঝে একটা হলো অর্ধাঙ্গিনী রেগে গেলে তাকে প্রিয় খাবার খাওয়ানো কিংবা গিফট করা। অবশ্যই এক্সপেন্সিভ কিছু না। লো বাজেটের মধ্যে তার প্রিয় কী আছে সেটা খুঁজে বের করতে হবে। এই ছোট্ট ছোট্ট খুশিগুলো মান অভিমানে বেশি কার্যকর। তবে এখনই না। যাক আরো কিছুক্ষণ। সুযোগ বুঝে ওর সঙ্গে কথা বলে ঝামেলা মিটিয়ে নিস।” 

    .

    রাতে খাবার শেষে টিভি দেখছে নবনী। চাচা-চাচী নিজের ঘরে ঘুমুচ্ছে। তার পাশে আছে অনি। গভীর মনোযোগে সিনেমা দেখছে দু’জনে। হঠাৎ নবনীর মুখের সামনে একবাটি ফ্রেঞ্চফ্রাই হাজির হলো। অমিত দাঁড়িয়ে আছে বাটি হাতে। মিষ্টি হেসে বললো, 

    — “চিরকুটটা খোলো প্লিজ!” 

    বাটির উপর থেকে নবনী হাতে নিলো চিরকুটটা। ছোট ছোট অক্ষরে লিখা আছে, ‘স্যরি আলুখোর।’

    ভেংচি কেটে বাটিটা নিজের হাতে নিলো নবনী। অনি আর সে মিলেমিশে ফ্রেঞ্চফ্রাই খাচ্ছে। নবনীর পায়ের কাছে আসন পেতে বসলো অমিত। 

    — “বাটি নিয়েছো। এবার কি আমি ধরে নেবো তোমার রাগ ভেঙেছে?” 

    — “একটু একটু।” 

    — “একটু একটু আবার কেন? পুরোটাই ভেঙে ফেলো।” 

    — “ভাঙাও।” 

    — “কী করবো বলো?” 

    — “তুমি ঐ অসভ্য মেয়েটাকে বাদ দাও।” 

    — “তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি এখনো ওকে ভালোবাসি?” 

    — “কারণ বলেছি তখন। বারবার বলতে পারবো না।” 

    — “সত্যি বলছি নবনী মাথা কাজ করছিল না তখন।” 

    — “দেখো অমিত, জানি হয়তো ওকে একেবারে ভুলে যাওয়া একটু কঠিন তোমার জন্য। কিন্তু ভুলতে হবে। নিজের জন্য হলেও অন্তত মন শক্ত করতে হবে। আর কত বুঝাবো তোমাকে? মুনিয়াকে আমি জাস্ট নিতে পারি না। ও একটা মাথাব্যথা।” 

    মুনিয়ার কথা বলতে গিয়ে অস্থির হয়ে উঠলো নবনী। অমিতের ভালো লাগছে নবনীর এই অস্থিরতাটুকু দেখতে। তার পাশে অন্য মেয়েকে নবনী সহ্য করতে পারছে না তবুও কেন একটু হলেও মেয়েটা বুঝে না সামনে বসা এই মানুষটাকে সে আজকাল একান্ত নিজের মানুষ বলে ভাবতে শুরু করেছে। 

    নবনীর চোখে চোখ রাখলো অমিত। 

    — “সেই কবেই ভুলে গেছি ওকে। আমার মনের কোত্থাও নেই ও। একবার চোখের দিকে ভালোভাবে তাকিয়েই দেখো না! দেখো তো এই চোখে কাকে খুঁজে পাও?” খুব একটা সময় অমিতের চোখে তাকিয়ে রইতে পারলো না নবনী। অমিতের চোখের ভাষা আজ এত অচেনা লাগছে কেন? পড়তে গিয়ে নিঃশ্বাস ধরে আসছে। এত মায়া কেন আজ ঐ চোখজোড়ায়? তার গভীর চাহনীর মাঝে ডুবে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে নবনী নিজের লাগাম টেনে ধরলো। চোখ সরিয়ে নিলো টিভির স্ক্রিনে। বড্ড অপ্রস্তুত দেখাচ্ছে ওকে। হাসলো অমিত। সে জানে নবনীর চোখ সরিয়ে নেয়ার কারণ। নবনীর চোয়াল চেপে নিজের দিকে ফেরালো অমিত। বললো, — “চোখ সরিয়ে নিলে যে! খুঁজে দেখবে না আমার চোখে কাকে খুঁজে পাও?” 

    — “আমি কারো চোখ পড়তে জানি না।

    — “আমার মন পড়তে জানো অথচ চোখ পড়তে জানো না?” 

    — “তোমার মন, চোখ সব কেন পড়তে হবে আমাকে? আমি কি তোমার প্রেমিকা?” 

    — “সিঙ্গেল আছি। চাইলে আমার প্রেমিকা হতে পারো।” 

    — “তোমার মতো গাধার সঙ্গে প্রেম করবো আমি?” 

    — “গাধারা জীবন বাজি রেখে ভালোবাসতে জানে।” 

    — “জীবন বাজি রেখে ভালো কতজনই বাসতে জানে। প্রকৃতির নিয়ম বদলে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে ক’জন বলো তো? আমার মানুষটা কিন্তু ভালোবেসে ঠিক তা-ই করে ফেললো।”

    — “সত্যিই! এতখানি ভালোবাসতে জানলে হয়তো আমার মানুষটা আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারতো। তাকে দূর থেকে ভালোবেসে মরতে হতো না। আমাকে কাছে টেনে, দু’বাহুর মাঝে বন্দী করে ভালোবাসার উষ্ণতায় বাঁচিয়ে রাখতো আমাকে।” 

    অনি চেয়ে রইলো অমিত, নবনীর দিকে। অমিত এখনো চেয়ে আছে নবনীর চোখে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে এখনো। চঞ্চলতা হারিয়ে বিষণ্নতা জড়িয়ে আছে হাসিজুড়ে। সামনে বসা মেয়েটাকে একান্ত নিজের করে পাওয়া সত্ত্বেও নিজের বলে দাবি না করতে পারার যন্ত্রণা কেমন তা জানা নেই অনির। তবুও এই বিষণ্ণ হাসি, চাহনিতে মন বড্ড খারাপ করছে তার। অমিতের মতন সেও চেয়ে রইলো নবনীর দিকে। ও কি বুঝতে পারছে অমিতের হাসির মাঝে লুকিয়ে থাকা বিষণ্ণতা? বুঝতে পারছে ঐ নিষ্পলক চোখজোড়া কী বলতে চাইছে তাকে? 

    অমিতের হাত টেনে নিজের পাশে বসালো নবনী। অমিতের চোখজোড়ায় আজ কোথাও মুনিয়াকে খুঁজে পাচ্ছে না নবনী। চোখজোড়া হন্যে হয়ে একটুখানি আশ্রয় চাইছে, ভালোবাসা চাইছে। কিন্তু কার কাছে? 

    — “তোমাকে আজ খুব কনফিউজিং লাগছে। কী চাইছো, কী বলছো বুঝতে পারছি না একদম। ভালোবাসা চাইছো অথচ তোমার মাঝে মুনিয়াকে খুঁজে পাচ্ছি না আমি। মুনিয়া ছাড়া আর কার কাছে ভালোবাসা চাইবে তুমি? জীবনে ভালোবেসেছো ঐ একজনকেই। আমি ভুল ভাবছি নাকি সঠিক ভাবছি তা-ও বুঝতে পারছি না। ঠিক করে বলো তো অমিত কী হয়েছে?”

    — “তুমি আমার স্যরি একসেপ্ট করেছো?” 

    — “ধুর! তখন একটু মেজাজ খারাপ হয়েছিল, এই যা। জনম জনম ধরে রাগ পুষে রাখবো নাকি?” 

    — “ওহ! রাগ নেই আর? এতক্ষণ ভং ধরে বসেছিলে? অকারণে এত খাটাখাটুনি করে আলু ভাজলাম। টাইম ওয়েস্ট!” 

    — “প্রসঙ্গ পাল্টাবে না অমিত। বলো কী হয়েছে?” 

    সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো অমিত। চলে যাবার আগে বলে গেল, 

    — “বলবো না নবনী। আসলে আমি বলতে পারবো না। প্রতিটা সম্পর্কে সীমাবদ্ধতা থাকে। ধরে নাও কারণটা ঠিক তেমন কিছু।” 

    ৪৭

    অনেকদিন পেরিয়ে গেল নিজের বাসায় যাওয়া হয়নি নবনীর। আজ দুপুরে নানী কলে বলছিল, “শীত চইলা গেল, এইবার বাসায় পিঠার আয়োজন খুব একটা হয় নাই। তুই নাই তাই কিছু করতেও মন চায় না।”

    হঠাৎ বাসার জন্য মনটা কেমন ছটফট করে উঠলো। তক্ষুনি কারখানায় বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো নবনী, আজই বাসায় যাবে সে। সপ্তাহখানেক বেড়িয়ে আসবে ওখান থেকে। আজ কারখানার সবাইকে বিকেলেই ছুটি দিয়েছে নবনী। বাসায় ফিরে ব্যাগ গুছাতে বসে গেছে। 

    তিনদিনের গভ: ইভেন্ট শেষে গতকাল রাতে বাসায় ফিরেছে অমিত। টানা দশদিন কাজের চাপে বাসায় ফেরা হয়নি ঠিকঠাক। দশদিনে প্রথম চারদিন শেষ রাতে বাসায় ফিরে, সকাল আটটা না বাজতেই আবার ছুটতে হয়েছে অফিেেস। শেষ ক’টাদিন শুধু জামাকাপড় পাল্টাতে বাসায় ফেরা হয়েছে। আজ অফিসে খুব একটা কাজের চাপ ছিল না। বিকেলে নবনী টেক্সটে জানালো, ‘বাসায় ফিরছি’। কতগুলো দিন পেরিয়ে গেছে নবনীর মুখোমুখি বসে লম্বা কথোপকথনের। মনটা কেমন করছিল নবনীর জন্য। আজ সুযোগ পেয়ে আর এক মুহূর্তও দেরী করলো না অমিত। বেরিয়ে পরলো অফিস থেকে। 

    .

    অনি দাঁড়িয়ে আছে নবনীর ঘরের দরজায়। গোছগাছ দেখছে নবনীর। ছোটব্যাগটাতে ঠেলেঠুলে কাপড় ঢুকাতে ঢুকাতে নবনী বললো, 

    — “তুমিও চলো না আমার সঙ্গে।

    — “ইচ্ছে তো করছে। কিন্তু ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে আমার।” 

    — “আমাদের ওখান থেকে ক্লাসে যেও।” 

    — “কোথাও বেড়াতে গিয়ে ক্লাসে যেতে ভালো লাগে না।” 

    — “নাতাশারও ক্লাস আছে। দু’জনে মিলে সকালে বেরিয়ে যাবে। দুপুর নাগাদ ফিরে আসবে দু’জন। তারপর আমরা বাসায় খুব মজা করবো। চলো না আমার সঙ্গে?” 

    দরজায় কলিংবেল বাজছে। নবনীর কথার জবাব না দিয়েই অনি ছুটলো দরজা খুলতে। অমিত এসেছে। হাতে আইসক্রিমবক্স আর রামেন। আজ রাতে নিশ্চয়ই মুভি দেখার প্ল্যান আছে তার! কিন্তু রামেন খাওয়ার মানুষ যে চলে যাচ্ছে একটু পরই, সে কথা কি জানা নেই তার? অনি দরজা আটকে জিজ্ঞেস করলো, — “নবনী আপু বাসায় চলে যাচ্ছে এক সপ্তাহের জন্য, তুমি জানো না?” 

    ভ্রু কুঁচকে অবাক চোখে অনির দিকে তাকালো অমিত। হাতের প্যাকেটগুলো ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে নবনীর ঘরে গেল। খাটের উপর কাপড় বোঝাই ব্যাগ রাখা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নবনী সাজতে ব্যস্ত। মেজাজ খারাপ হলো অমিতের। 

    — “নবনী…” 

    অভিমান জড়ানো কণ্ঠে নবনীকে ডাকলো অমিত। ঘাড় ফেরালো নবনী। 

    — “রেগে আছো কেন?” 

    — “তুমি বাবার বাসায় যাচ্ছো আমাকে জানাওনি কেন?” 

    হাসলো নবনী। 

    — “যেমন করে রাগী রাগী গলায় জেরা করছো, একদম বর বর লাগছে তোমাকে।”

    — “ফাজলামি রাখো।”

    — “বলতাম তো! বেরোবার আগে অবশ্যই কল করে বলতাম আমার বাসায় যাচ্ছি।” 

    — “আমি দশদিন বাসায় ছিলাম না। এতদিন পর বাসায় ফিরেছি অথচ তুমি চলে যাচ্ছো!” 

    — “বাসার সবার জন্য মন খারাপ লাগছে। কতদিন বাসায় গিয়ে থাকি না! আব্বু আম্মুর সঙ্গে দেখা হয়না একসপ্তাহ পেরিয়ে গেছে।” 

    — “সবার জন্য মন খারাপ হয় তোমার। হয় না শুধু আমার জন্য। এইযে আমি দশদিন বাসায় সময় দিতে পারিনি, একবারও মন খারাপ হয়েছে তোমার?” 

    — “হয়েছে তো!” 

    — “মিথ্যুক! মন খারাপ হলে যাওনি কেন আমার সঙ্গে দেখা করতে?” 

    — “তুমি ব্যস্ত ছিলে। তাই বিরক্ত করিনি।”

    — “অযুহাত দেখিও না নবনী! চট্টগ্রামে আমি এরচেয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলাম। তবুও জোর করে আমার সঙ্গে দেখা করেছো, রেস্টুরেন্টে নিয়ে গেছ। যাওনি? তুমি ভালোই জানো আমার শত ব্যস্ততায় তুমি কল করলে কিংবা দেখা করতে চাইলে আমি বিরক্ত হই না।”

    — “তুমি এত রেগে গেলে কেন বলো তো?” 

    — “আমি আজ মুভির প্ল্যান করেছিলাম। রামেন, তোমার ফেভারিট ফ্লেভারের আইসক্রিম কিনেছি ফেরার পথে। আগে জানলে আমি বাসায়ই ফিরতাম না।”

    — “একেবারে চলে যাচ্ছি? ফিরছি তো আবার! তখন লেট নাইট মুভি হবে।

    — “কবে ফিরবে তুমি?” 

    — “এক সপ্তাহ থাকবো।” 

    — “থেকে যাও ওখানেই। ফেরার প্রয়োজন নেই।”

    — “নাহ! আরো একমাস থাকতে হবে। তারপর তোমাকে টাটা বাই বাই।’ বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো অমিতের। মাত্র একমাস হাতে আছে! তারপর? চলে যাবে নবনী? এই বিয়েটা, সম্পর্কটা ভেঙে যাবে চিরতরে? অস্থির হয়ে উঠলো অমিত। চেহারা ফ্যাকাশে হলো মুহূর্তেই। অযথা গালে, কপালে হাত ঘষে চোখে মুখে ফুটে উঠা ভয় আড়াল করতে লাগলো অমিত। কথার প্রসঙ্গ পালটে বললো, 

    — “রেডি তুমি?” 

    — “এইতো আর দুই মিনিট।” — তুমি নেমে এসো। আমি ব্যাগ নিয়ে নামছি।”

    — “শোনো না? অনিকে বলছিলাম আমার সঙ্গে যেতে। রাজি হচ্ছে না। জরুরি ক্লাস আছে বললো। এক কাজ করো, তুমি চলো আমার সঙ্গে। বেড়িয়ে আসবে কিছুদিন তুমি গেলে অনি আর আপত্তি করবে না।”

    — “না, কাজ আছে আমার।” 

    — “তোমার শুধু কাজই থাকে অমিত! সারাজীবন বাসা আর অফিস করেই কাটিয়ে দিবে? এত কাছে আমাদের বাসা। আব্বু-আম্মু কত করে যেতে বলে তোমাকে অথচ তুমি যেতেই চাও না!” 

    — “গতমাসেও গেলাম। পুরো বাসাসুদ্ধ লোক দুইরাত ছিলাম ওখানে।”

    — “গতমাসে গেলে এইমাসে যাওয়া যাবে না এমন নিয়ম আছে কোথাও? তোমার 

    আসলে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। একমাস পর আমি চলে গেলে তুমি বোধহয় আমার সঙ্গে আর যোগাযোগই রাখবে না।” 

    গলার মাঝ বরাবর শক্ত কী যেন আটকে আছে। দম বন্ধ লাগছে অমিতের। কী আটকে আছে ওখানে? কষ্ট নাকি ভয়? বারবার কেন ওভাবে বলছে মেয়েটা? ও কি জানে এই কঠিন কথাটা মেনে নেবার ক্ষমতা তার একদম নেই? বিচ্ছেদ ভয় কতটা অসহায় করে দিচ্ছে তাকে? আর এক মিনিটও এখানে দাঁড়ালো না অমিত। খাটের উপর থেকে ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। যাবার সময় বলে গেল, — “আমি গাড়িতে আছি। তুমি এসো।

    ৪৮

    সাব্বিরের বাসায় বেলকনিতে বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে অমিত। খুব যত্নে হরেক রকম গাছ, বিভিন্ন ডিজাইনের মিরর, ছোট্ট দুটো বুকশেলফ, ফেইরি লাইট, বেতের মোড়া আর শতরঞ্জিতে বেলকনিটা সাজিয়েছে রুমানা। এই বাসায় বেড়াতে আসা প্রতিটা মানুষ প্রশংসা করে রুমানার সাজানো বেলকনির। কেউ কেউ বলে এখানে এলে নাকি মন ভালো হয়ে যায়। বন্ধুর খারাপ মনটা ভালো করতে এখানে নিয়ে এল সাব্বির। সঙ্গে তার নিজের হাতে তৈরী এককাপ কফি। অমিতের ভীষণ পছন্দ, সেই স্কুল জীবন থেকে! অমিতকে অনবরত কত কী বলছে, বোঝাচ্ছে সাব্বির। অথচ সেদিকে তার মনই নেই। কানে বোধহয় কোনো কথাই পৌঁছাচ্ছে না। সাব্বির দেখছে অমিতের অন্যমনস্কতা তবুও একনাগাড়ে বলেই চলছে। দরজায় দাঁড়িয়ে দুই বন্ধুকে দেখছে রুমানা। একজনের বিষণ্নতা, অন্যজনের বিষণ্নতা দূর করার প্রাণান্তকর চেষ্টা। লম্বা নিঃশ্বাস নিলো রুমানা। এক বোউল চওমিন ছোট্ট রাউন্ড টেবিলটার উপরে রেখে বললো, 

    — “আলাদা প্লেটে নেয়ার প্রয়োজন নেই। চলো আজ তিনজন একসঙ্গে খাই।”

    ঘাড় ফিরিয়ে একবার বাটির দিকে তাকালো অমিত। দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বললো, 

    — “খাও তোমরা। আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।’ 

    — “তোকে ছাড়া খাবো নাকি আমি!”

    — “আমার গলার ভেতর কী যেন আটকে আছে। বুকের ভেতরটা ফাঁকা লাগে। নিঃস্ব হওয়া অনুভূতি।” 

    — “এত কেন ভাবছো, বলো তো? নবনী এখনো আছে তোমার সঙ্গে।

    — “ও নেই রুমানা। কখনোই আমার ছিল না। আমিই হয়তো ভুল ভেবেছি ওর বন্ধুত্বকে ভালোবাসা ভেবে।” 

    — “ওর ট্রিটমেন্ট চলছে খুব বেশিদিন পেরোয়নি কিন্তু! কোনো কোনো কেইসে পেশেন্ট সুস্থ হতে তিন-চার বছরও সময় নেয়। আর নবনীর মাত্র দেড়মাস চলছে।”

    — “ও আজও বলছিল আমাদের সম্পর্কটার আর একমাস বাকি। তারপর চলে যাবে ও। একমাস কি খুব বেশি সময়? চোখের পলকে চলে যাবে। কী করব তখন? জোর করে বেঁধে রাখবো নবনীকে?” 

    — “একমাস খুব বেশি সময় না হলেও, কম কিন্তু না। পজিটিভলি ভাবো না অমিত! দেড়মাসে নবনীর ইমপ্রুভমেন্ট খেয়াল করেছো একবার?”

    — “হুম।” 

    — “বলো তো কী কী?” 

    — “ওকে এখন আমরা সহজে একা সময় কাটাতে দেই না। অনি রাতে থাকে ওর সঙ্গে। ম্যাক্সিমাম টাইম অনেক রাত পর্যন্ত আমিই ওর ঘরে বসে থাকি। গল্প করি, গান শুনি একসঙ্গে। ও কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে। সামির সঙ্গে খুব একটা কথা বলতে দেখি না। অনি বললো গত একসপ্তাহে একবারও ওকে কথা বলতে দেখেনি। সামিকে নিয়ে গল্প করে তবে আগের মতন না। অতীতের কোনো গল্পই নবনীকে খুব একটা করতে দেখি না। ও শুধু বর্তমান নিয়ে কথা বলে, ভবিষ্যৎ নিয়ে বলে। আমাকে জানতে চায়, শুনতে চায়। কোথায় যাচ্ছি, কী করছি, কেন করছি। আমার পাস্ট লাইফ, চট্টগ্রামের বাসায় থাকার সময়কার গল্প খুব ইন্টারেস্ট নিয়ে শুনতে চায়। এতরাত পর্যন্ত আমি ওর ঘরে বসে থাকি, ও ঘুমে টলতে থাকে তবুও কখনো বলে না তুমি চলে যাও। মন দিয়ে শোনে আমাকে।

    — “দ্যাটস দ্য পয়েন্ট অমিত! তুমি কি একবারও রিয়েলাইজ করতে পারছো না শি ইজ ফলিং ফর ইউ?”

    — “বন্ধুর বাইরে এক বিন্দুও নবনী আমাকে ভাবে না। আমার খারাপ সময়টাতে ও আমাকে আগলে রেখেছিল। আমার সমস্ত মনোযোগ ঢেলে তখন ওকে আমি শুনতাম। ভালো লাগতো শুনতে। তখন আমিও নবনীকে বন্ধুর বাইরে আর কিছুই ভাবতাম না। নবনীর বেলায় হয়তো ঠিক তাই হচ্ছে।” 

    — “শুনতে শুনতেই তো ওকে ভালোবেসেছো। বাসোনি? নবনীর বেলায় কি এমন হতে পারে না?” 

    — “নবনী সামিকে কতটা ভালোবাসে তুমি হয়তো এখনো রিয়েলাইজ করতে পারোনি।’ 

    — “রুমানার কথাটা বুঝতে ট্রাই কর। তুই কি ভালোবাসার শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলে ইউ আর ইন লাভ উইথ হার? বুঝিসনি। নবনীও রিয়েলাইজ করতে পারছে না।” 

    — “উহুম। কোনো দ্বিধা ছাড়াই নবনী বলে দিলো একমাস পর ও চলে যাবে। যদি ভালোবাসতো একবারও কি আমার মতো কষ্ট ওর হতো না? বলতে গিয়ে গলায় কথা আটকে যেত না?” 

    — “আচ্ছা ধরে নিলাম নবনী তোমাকে ভালোবাসে না। তাই বলে তুমিও হাল ছেড়ে দিবে? থাকতে পারবে নবনীকে ছাড়া?” 

    অসহায় চোখে রুমানার দিকে তাকালো অমিত। 

    — “নবনী আমাকে ছেড়ে চলে গেলে কী করবো আমি নিজেও জানি না।”

    — “যাকে ছাড়া একদিনও তুমি ভাবতে পারো না তাকে কেন এত সহজেই যেতে দিবে? গল্পের শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করবে না ওকে আঁকড়ে রাখার?” 

    — “ওকে জোর করে ধরে রাখতে পারবো? সম্ভব? অন্য দশটা মেয়ের মতন ওর মেন্টাল কন্ডিশন নরমাল হলে আমি ওকে জোর করেই নিজের কাছে রেখে দিতাম।” 

    — “জোর করতে বলিনি, যা হওয়ার স্বাভাবিকভাবেই হবে। তুমি প্লিজ ধৈৰ্য্য রাখো।”

    — “দেখ অমিত, যতটা তুই ভাবিস নবনীর কাছে অতটাও ইম্পরট্যান্ট না কিংবা ও তোকো আলাদাভাবে ট্রিট করে না। এটা কিন্তু তোর ভীষণ ভুল।” 

    — “তুমি একটা ব্যাপার কখনো খেয়াল করেছো, অমিত? সামিকে নবনী যেভাবে ট্রিট করতো এক্সাক্টলি সেইম ওয়েতে তোমাকেও ট্রিট করে। ততটাই আপন ভাবে। আমি ওর ফ্যামিলি মেম্বারদের কাছে যতটা শুনেছি আমার তাই মনে হলো। সামির ইন্সিডেন্টের পর নবনী কারো সঙ্গে এতটাও ক্লোজ হয়নি। তুমি ভাবো নবনীর প্রতি তুমিই শুধু ডিপেন্ডেড? ভুল ভাবো অমিত। নবনীও তোমার প্রতি ডিপেন্ডেড,,যতটা ও সামির প্রতি ছিল, ঠিক ততটা। সামি আর নবনী খুব গল্প করতো। প্রতিদিনের ছোট ছোট ব্যাপারগুলোও শেয়ার করতো যেগুলো শেয়ার না করলেও চলে। ছোট ছোট ডিসিশন থেকে শুরু করে বড় ডিসিশন দু’জন ডিসকাস করতো। ঠিক একই কাজ নবনী তোমার সঙ্গে করে যা অন্য কারো সঙ্গে করে না। অন্য দশটা এ্যাফেয়ার যেমন হয় সামির সঙ্গে ওর রিলেশন তেমনটা না। তুমি নিজেও প্রেম করেছো। অলমোস্ট সব কাপলদের রিলেশন, এটাচমেন্ট এমনই হয়। বাট নবনী আর সামির ব্যাপারটা একবার খেয়াল করে দেখো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা গল্প। দুজন দু’জনের ইনার পিস। একচুয়াল সোলমেট যাকে বুঝায়। ফিজিক্যাল অ্যাট্রাকশন কিংবা সাংসারিক খুব বেশি চাওয়া-পাওয়া কিছু ছিল না ওদের মাঝে। জাস্ট ভালোবাসা আর মানসিক স্বস্তি ছাড়া আর কিছুই ওদের চাওয়া ছিল না। ইট অল ওয়াজ হার্ট টু হার্ট কানেকশন। রিলেশন ডেপ্‌থ বুঝতে পারছো তো?” 

    — “আমার চেয়ে বেশি আর কে বুঝবে ওকে?” 

    — “তুমি ওর কতটা জুড়ে আছো সেটা কেন বুঝতে পারছো না অমিত?” রুমানার দিকে নিশ্চুপ চেয়ে রইলো অমিত। ওর কথা একদম বিশ্বাস হচ্ছে না। তাকে স্বান্তনা দিতেই হয়তো গাঁজাখুরি গল্প সাজাচ্ছে। অমিতের চোখের ভাষা বুঝতে বাকি রইলো না রুমানার। হাসলো সে। 

    — “তুমি আমাকে বিশ্বাস করছো না।” 

    — “একদম না।” 

    — “সাব্বির এখন কল করে বলুক তুমি আপসেট, কিছু একটা নিয়ে খুব টেনশনে আছো। দেখো কিভাবে উড়ে চলে আসবে তোমার কাছে।” 

    — “সবসময়ই আসে। আমার ভয়েস টোন একটু লো হলেই হলো। বাইরে আমাকে নিয়ে হাঁটতে বের হয়, চকলেট কিনে দেয়, মন ভালো না হওয়া পর্যন্ত নাছোড়বান্দার মতো পেছনে লেগে থাকে আমাকে হাসাবে বলে।” 

    — “কেন আসে? ভালোবাসে বলেই তো আসে।” 

    — “বুঝতে পারছি না কিছুই। আ’ম কনফিউজড!”

    — “এখন হয়তো নবনী নির্দ্বিধায় বলে দিচ্ছে ও চলে যাবে একমাস পর। কিন্তু সময় যখন হয়ে আসবে তোমাকে ছেড়ে যাবার, সত্যি বলছি ও পারবে না। কোনো অযুহাতে ও তোমার কাছে রয়ে যাবে। কিংবা দূরে গেলে হয়তো তোমার জন্য ওর ভালোবাসা অনুভব করবে। গল্প শেষে ও তোমার কাছে ফিরবেই অমিত।”

    — “আর সামি? ওকে ভুলবে না?” 

    — “ধৈর্য্য অমিত, ধৈর্য্য! বহুবছর সামিকে ঘিরে নবনীর ধ্যান জ্ঞান ছিল। কতটা ভালোবাসলে একজন মানুষের এই অবস্থা হয় বুঝতে পারছো? চাইলেই সামিকে ও ভুলতে পারবে না। ইনফ্যাক্ট সামিকে ও কখনোই ভুলতে পারবে না। ওর জন্য টান রয়েই যাবে আজীবন।” 

    — “সে কথা আমি জানি, মানছিও আমি। বলছি না সামিকে ও চিরতরে ভুলে যাক। কিংবা ওর জন্য আর কখনোই কিছু ফিল না করুক। কিন্তু আমি? আমার কী হবে? আমার সঙ্গে বাকি জীবনটা পাড়ি দিতে সামিকে একপাশে সরাতে হবেই। হয়তো নবনী আমাকে সামির মতো ট্রিট করে কিন্তু সামিকে সরিয়ে ওর মনের ভেতরের জায়গাটা আমাকে ছেড়ে দেয়নি এখনো। আর কখনো দিবে কি না তাও জানি না।”

    — “ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই পয়েন্টে এসে বারবার থামছো।” 

    — “পারছি না রুমানা। আমি মহাপুরুষ না। শি ইজ মাই ওয়াইফ, আই লাভ হার। নবনীর সঙ্গে এক্সাক্টলি সেই রিলেশন, ফিলিংস শেয়ার করি যেমনটা সামি করতো। ইটস অল হার্ট টু হার্ট কানেকশন। শি ইজ মাই ইনার পিস। ওর সঙ্গে কথা না বললে, প্রতিদিন অন্তত একবার দেখা না হলে আমার সবকিছু এলোমেলো লাগে। দশদিন হলো নবনীর সঙ্গে বসে আমার কথা হয়নি ঠিকঠাক। এত ব্যস্ত আমি তবুও সময় বের করি পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট কথা বলেছি ওর সঙ্গে। নয়তো আমি শান্ত হতে পারতাম না, কাজ করতে পারতাম না। কিন্তু ঐ পাঁচ দশমিনিটের কথায় আমি স্যাটিসফাইড না। সারাদিন পর নবনীর সঙ্গে আমার লম্বা আলাপ করতে হয়। খুব জরুরি কিছু না। অকারণ কথা, কথার ফাঁকে নবনীর গুনগুন করে সুর তোলা, ওর পাশে বসা এসবকিছুর অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। দিনশেষে এই সময়টুকু আমার চাই-ই চাই। টানা দশ দিন আমি ওর সঙ্গে সময় কাটাতে পারিনি। রাইট নাউ আ’ম ফিলিং দ্যাট আমার মাথায় গুলিস্তানের জ্যাম লেগে আছে। অসহ্য লাগছে সবকিছু। নিজেকেও।” 

    — “নবনীর পাশাপাশি তোমারও ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন।” 

    — “আমার ট্রিটমেন্ট নবনী। ওকে পাইয়ে দাও।” 

    — “ও তোমারই আছে। শি ইজ…. 

    কথার ফাঁকে রুমানা দেখলো অমিতের মুখে হাসি। ফোনের স্ক্রিনে কিছু একটা দেখে হাসছে সে। নবনীর ম্যাসেজ এসেছে নিশ্চয়ই! চওমিন চিবুতে চিবুতে রুমানা বললো, 

    — “কী লিখেছে তোমার ওয়াইফ? আই লাভ ইউ বললো?” 

    — “মজা করছো?” 

    — “দুই সেকেন্ড আগেও দুঃখে মরো মরো অবস্থা। কত কী বুঝাচ্ছি অথচ তোমার মনই ভালো হচ্ছে না। এখন তোমার চেহারায় প্রেম প্রেম হাসি। কেন বলো তো?” রুমানার দিকে মোবাইল এগিয়ে দিলো অমিত, নিজেই পড়ে দেখো 

    রুমানা মোবাইল নেবার আগে সাব্বির ছোঁ মেরে অমিতের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলো। স্কুল পড়ুয়া কিশোর বয়সীদের মতন কৌতুহলভরা উচ্ছ্বাস তাদের দু’জনের চোখে মুখে। 

    ‘তোমাকে আমার ভীষণ মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে কোন সাত সাগর তেরো নদী দূরত্ব আমাদের মাঝে। কেন বলো তো?’ 

    .

    এক প্রকার লাফিয়ে উঠলো সাব্বির, 

    — “দেখেছিস? আমাদের কথা সত্যি হলো তো? তোর কাছ থেকে দূরে গিয়ে নবনী নিজেও থাকতে পারবে না। শি অলসো লাভস ইউ ম্যান!”

    — “আর এটাও শুনে রাখো দুই তিনদিনের ভেতর কোনো না কোনো অযুহাতে নবনী ফিরে আসবে।” 

    — “আমি জানি না ও আমাকে ভালোবাসে কি না কিংবা দুই তিনদিনের মাঝে ফিরবে কি না। তবে এতটুকু জানি ওকে দেখার ভীষন ক্রেভিং হচ্ছে। নবনী ম্যাসেজ দিয়ে আমাকে আরেকটুখানি উস্কে দিলো। এবার আমাকে ওর কাছে যেতেই হবে। নয়তো গায়ে জ্বর টর উঠে যেতে পারে। সঙ্গে সঙ্গেই সাব্বিরের বাসা থেকে বেরিয়ে গেল অমিত। এতটা সময় ঠোঁটে হাসি ধরে রাখলেও এখন বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে সাব্বিরকে। তার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে রুমানা জিজ্ঞেস করলো, 

    — “হঠাৎ কী হলো? এতক্ষণ তো ভালোই ছিলে।’ 

    — “অমিতের সামনে কিছু বলতে চাইনি। 

    — “কী?”

    — “নবনী থেকে যাবে তো অমিতের সঙ্গে?”

    এক মুহূর্ত চুপ করে রইলো রুমানা। সাব্বির চেয়ে রইলো তার দিকে উত্তরের আশায়। 

    — “অবশ্যই ভালো কিছু হবে সাব্বির! এখন পর্যন্ত যা কিছু হচ্ছে সবটাই পজিটিভ, তাই না?” 

    — “নবনীকে এই সম্পর্কে থেকে যেতেই হবে। নয়তো অমিতকে সামলানোর ক্ষমতা আমাদের কারো নেই। কিছু একটা করে ফেলবে ও।”

    ৪৯

    অনিকে নিয়ে রাত সাড়ে এগারোটায় নবনীর বাসায় এসে হাজির অমিত। নিজের ঘরে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কানে ইয়ারফোন গুঁজে মেসেঞ্জার কলে কথা বলছিল নবনী। পেছন থেকে নবনীর চোখ চেপে ধরলো অমিত। পাশ থেকে নাতাশা বললো, 

    — “বলো তো কে তোমার চোখ ধরে আছে?” 

    অমিতের হাতের উপর একবার হাত ছুঁয়েই নবনী চিৎকার করে উঠলো, – “অমিত!” 

    নবনীকে নিজের দিকে ফিরিয়ে অমিত বললো, 

    — “বুঝে ফেললে! এত জলদি! কিভাবে?” 

    — “তোমার হাত ছুঁয়েই বুঝে গেছি।” 

    — “তুমি ভাইয়ার হাত ছুঁয়েই বুঝে গেলে আপু? সত্যিই?” 

    — “বুঝবো না কেন? অমিতকে আপাদমস্তক মুখস্থ হয়ে গেছে আমার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ১০০ ছেলের মাঝে ওকে দাঁড় করিয়ে দিলে আমি ঠিক ওকে খুঁজে বের করতে পারবো। তৃপ্ত নয়নে নবনীর চোখে তাকিয়ে আছে অমিত। ঠোঁটে লেগে আছে পরম প্রাপ্তির আনন্দ। অমিতের দিকে চেয়ে রইলো নাতাশা। তার চোখের চাহনিতে, ঠোঁটের হাসিতে স্পষ্ট হওয়া আনন্দটুকু দেখেছে সে। বোনের সামান্য এতটুকু কথাতেই মানুষটা কত কী পেয়ে গেছে যেন! পরম আরাধ্য কারো কাছ থেকে সামান্য প্রাপ্তি কী আকাশ ছোঁয়ার অনুভূতি দেয়? 

    — “অনিকে বাসায় একা ফেলে এলে অমিত?” 

    — “ওকে সঙ্গে এনেছি। চাচীর সঙ্গে কথা বলছে।’ 

    — “অনি এসেছে!” খাট থেকে একলাফে নেমে বসার ঘরে ছুটলো নাতাশা। অমিতের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো নবনী। 

    — “নাতাশা অনির জন্য পাগল! সারাক্ষণ বসে বসে প্ল্যান করে অনিকে নিয়ে শপিং যাব, অনিকে নিয়ে মুভি দেখবো, অনিকে নিয়ে পিৎজা খাবো, অনিকে নিয়ে দূরে বেড়াতে যাবো। বিরক্ত ধরে আসে আমার অমিত! মাঝেমধ্যে বলতে ইচ্ছে করে, যা ওকে বিয়ে করে ফেল। ওদিকে আমি কারখানায় বসে বসে ভাবি অমিতকে নিয়ে আজ চা খেতে যাবো, অমিতকে নিয়ে অমুক জায়গায় ঘুরতে যাবো, বাসায় ফিরে ঐ মুভিটা দেখবো। কাজ ফেলে আমি এসব ভাবি অমিত! লাফাতে লাফাতে বাসায় চলে এসেছি। এখানে আসার পর মনে হচ্ছে আজ কেন এলাম? কতদিন হয়ে গেলে আমাদের গল্প হয় না, মুভি দেখা হয় না, চা খাওয়া হয় না। আজ একটা মুভি দেখে কাল আসলেই পারতাম। কী সমস্যা বলো তো? তাবিজ করেছো তোমরা আমাদের দুই বোনকে?”

    — “নো বেবি। আই থিংক ইউ আর ইন লাভ উইথ মি।” 

    চোখ টিপলো অমিত। ভেংচি কেটে নবনী বললো, 

    — “হ্যাঁ মরে যাচ্ছি একদম তোমার জন্য।” 

    — “উফ নবনী! বুকের বাঁ পাশে ব্যথা ধরিয়ে দিচ্ছো।” 

    — “কাছে এসো। আমার হাতের নরম ছোঁয়ায় তোমার বুকব্যথা ভালো করে দেই।”

    — “নরম ছোঁয়ায় ব্যথা ভালো হয় না নবনী। শিহরন জাগে। জাগাতে চাও?”

    — “ছিঃ!” 

    — “নরম ছোঁয়া দিতে চাইলে তুমি আর ছিঃ শোনাচ্ছো আমাকে?” 

    — “নরম ছোঁয়ায় কী হয় না হয় আমি এত সব জানি নাকি?”

    — “জানবে কেমন করে? করেছো তো লাউ মার্কা ছেলের সঙ্গে কদু মার্কা প্রেম। আট বছরের প্রেম এমনি এমনি কেটে গেল। প্রেমিকার গায়ে কয়টা তিল আছে, দাগ আছে, কিছুই তার জানা নেই। সামিকে দেখে আমার নিজের ভীষণ আফসোস হয়। মনে মনে ভাবি, আহারে! ওর মতন ভাগ্যটা আমার কেন হলো না? চৌদ্দ বছরের একটা ছোট্ট ওড়না সামলাতে না জানা, সেক্স সম্পর্কে মিনিমাম আইডিয়া না থাকা একটা প্রেমিকা আমারও হতো। বয়স ষোলো পেরোতে পেরোতে প্র্যাক্টিক্যালি সব শিখিয়ে পড়িয়ে নিতাম। গায়ে কয়টা তিল আছে, দাগ আছে সব মুখস্থ করে নিতাম। নিজে আদর, যত্ন করে আরো দুই একটা দাগ এঁকে দিতাম।” 

    — “ছিঃ অমিত! ষোলো বছরের একটা মেয়ের সঙ্গে তুমি…” 

    — “ঐ বয়সে বড় মামার দুই মেয়ে একটা করে বাচ্চার মা ছিল। ছিঃ বলার কিছু নেই। আসলে তোমার সেক্স নলেজ কম তাই তোমার কাছে ষোলো বছরের মেয়ের সঙ্গে সেক্স ব্যাপারটা উইয়ার্ড লাগছে।”

    — হ্যাঁ তোমার তো খুব নলেজ। আড়াই বছরে প্রেমিকার সঙ্গে সংসার পেতে আরও এক্সপেরিয়েন্স হয়েছে তোমার। তা আমি মূর্খ মানুষ, তুমি আমাকে একটু শিখিয়ে নিলেই পারো।” 

    — “এই তো লাইনে এসেছো। বলো কোন চ্যাপ্টার আগে শিখাবো? ব্যাসিক বুঝো তো? আমরা কি ব্যাসিক চ্যাপ্টার আগে পড়বো? প্র্যাক্টিক্যালি শিখাই তোমাকে, কী বলো?” 

    হাত জোর করে অমিতকে থামাতে চাইলো নবনী। দুজনেই সজোরে হেসে উঠলো। পাশের ঘর থেকে হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছেন জামিলা বেগম। চোখভরা নোনাজলে মনে মনে উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করছেন, এই সম্পর্ক তুমি অটুট রাইখো মালিক। আমার নবনীর জীবন তুমি এলোমেলো করছিলা, এখন সেই জীবন তুমিই গুছায়া দাও। আমাগো আর পরীক্ষা তুমি নিও না। 

    .

    বসার ঘরে ঘুমিয়ে আছে ওরা দু’জন। নবনী সোফায়, অমিত ডিভানে। শেষরাতে একবার জেগেছিলেন শফিক সাহেব। তখনও দু’জন বসে মুভি দেখছিল আর ফিসফিস করে গল্প করছিল। আড্ডা, সিনেমা শেষ করে ঘুমিয়েছে হয়তো ভোরের দিকে। ঘড়িতে বেলা দশটা, এখনও জাগেনি ওরা দু’জন। কেউ ওদের ডাকছেও না। বন্ধের দিন তাই অনি-নাতাশারও ভার্সিটি যাবার তাড়া নেই। ঐ দুজনও ঘুমাচ্ছে নাতাশার ঘরে। যথাসম্ভব আওয়াজ ছাড়া কাজ করার চেষ্টা করছেন নীতু। তবুও একটু আধটু শব্দ হয়েই যাচ্ছে আর বারবার জিভ কাটছেন তিনি। তার এক ঘন্টার শব্দহীন পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টায় পানি ঢেলে দিলো দরজার ওপাশে থাকা কেউ একজন। কলিংবেল বাজছে। ডিং ডং শব্দে ঘুম ভাঙলো অমিত, নবনী দু’জনেরই। একবার চোখ মেলে তাকিয়ে বালিশের নিচে আবার মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লো অমিত। নবনী কৌতুহলী হয়ে পিটপিট করে চেয়ে রইলো দরজায়। নীতু দরজা খুলতেই চিৎকার করে উঠলো নবনী, 

    — “আপুউউ, তুমি!” 

    নবনীর চিৎকারে লাফিয়ে উঠে বসলো অমিত। নবনী ছুটে গিয়ে কাকে যেন শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে। অপরিচিত মহিলার গাল বেয়ে পানি ঝরছে। চাচী তার গালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে অনবরত। উনিও নীরবে কাঁদছে। কে এই অপরিচিতা? এসব ভাবতেই ভাবতেই অমিতের চোখে চোখ পড়লো অপরিচিতার। মিষ্টি হেসে, ভাঙাস্বরে বললো, 

    — “তুমি অমিত না?” 

    — “জি।” 

    — “সামিকে চেনো তো? আমি ওর বোন, সুমনা।”

    — “অহ আপনি!” 

    — “নবনী আমার গল্প তোমাকে বলেনি, তাই না?” 

    — “না না! আমি আপনাকে চিনি। আপনার ছবি দেখিনি কখনো এই যা! অনেক গল্প করে আপনাকে নিয়ে।” 

    — “আমিও চিনি তোমাকে। পুরো বাসাসুদ্ধ লোক তোমাকে নিয়ে গল্প করে। খুব ইচ্ছে ছিল তোমাকে দেখার।” 

    — “আপনি আজই দেশে ফিরলেন?” 

    — “ফিরেছি গতকাল রাতে। ক্লান্ত ছিলাম তাই আসিনি। সারপ্রাইজ দেবো বলে আগে জানাইনি। তাই আজ সকাল সকাল হাজির হলাম।”

    — “রাখো তো অমিতের সঙ্গে গল্প! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তুমি এসেছো। 

    কতবছর পর! চলো তো, আমার ঘরে চলো। অনেক কথা জমে আছে তোমার সঙ্গে। সুমনার হাত ধরে টানতে টানতে নিজের ঘরে নিয়ে যাচ্ছে নবনী। সুমনার চোখ আটকে রইলো অমিতের দিকে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে তাকে। গায়ের গড়ন, রঙে তার ভাইয়ের সঙ্গে খুব একটা মিল নেই। তবুও বুকের ভেতর মোচড় কাটছে ভীষণ। ভাইকে মনে পড়ছে। 

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৫০

    ৫০

    আজ গুনে গুনে তিনদিন পেরোলো নবনী বাসায় নেই। প্রতিদিন বাসায় ফেরার পর বিশাল শূন্যতা বুকে চেপে বসে। সকালে গাড়িতে বসার পর বামপাশের সিটটা বড্ড খালি খালি লাগে। নিত্যদিনের মতো বাসায় ফিরে নবনীকে দেখা হয় না, রোজ সকালে নবনীকে সঙ্গে নিয়ে বাসা থেকে বেরোনো হয় না। ভালো লাগে না অমিতের। একটুও না। সাব্বির গতকাল রাতে খুব হাসছিল তাকে নিয়ে। বলছিল, “বেচারী কি তোর জন্য বাপের বাড়ি গিয়ে শান্তিতে দুইদিন থাকতে পারবে না?” সাব্বিরের রসিকতা একদম ভালো ঠেকেনি অমিতের কাছে। এলোমেলো কিসব বলে বেরিয়ে এল সাব্বিরের অফিস থেকে। কী কী যে বলেছিল তা ঠিক মনেও নেই অমিতের। আজকাল মাঝেমধ্যে পাগল পাগল লাগে নিজেকে। সময় যত ফুরিয়ে আসছে নবনীর ছেড়ে যাওয়া কিংবা থেকে যাওয়া, তাদের সম্পর্কের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ততই পোঁড়াচ্ছে তাকে। এই যন্ত্রণা থেকে নিস্তার কি কখনো নবনী তাকে দেবে? 

    সোফায় বসে, সেন্টার টেবিলে পা তুলে একের পর এক চ্যানেল বদলে যাচ্ছে অমিত। অনি হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এসে পাশে বসলো। 

    — “ভাইয়া, আম্মু ভিডিওকলে।” 

    স্ক্রিনে তাকিয়ে মলিন হাসলো অমিত। 

    — “কেমন আছো আম্মু?” 

    — “আগে তোর কথা বল। বউ কি একটু বাপের বাড়িও যাবে না? বিরহে মরে যাবি তুই? নিজের হাল দেখেছিস একবার? অফিস থেকে ফিরে জামা কাপড়ও ছাড়িসনি। চুল এলোমেলো হয়ে আছে, চোখ দু’টো গর্তে ভেতর ঢুকে গেছে, মুখ শুকনো লাগছে। মানে কিসব!” 

    — “আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না আম্মু। ও কেন চলে যাবে? আমি কি ওর মাঝে একটুখানি জায়গাও করে নিতে পারিনি?”

    — “সময় আছে তো বাবু। এখনই ধৈর্য্যহারা হলে চলবে? প্রয়োজনে কিছু একটা কারসাজি করে আমরা আরো ছয়মাস বাড়িয়ে ফেলবো। এত ভাবিস না তো! নবনী এখানেই থাকবে, তোর সঙ্গে।”

    — “ছয়মাস বাড়িয়ে কী হবে? আমি যে সারাক্ষণ ইনসিকিউর ফিল করছি তার কোনো সমাধান হবে না। আবারও সময় গুনতে হবে আমাকে, এইতো আর কয়দিন বাদেই নবনী চলে যাবে। নবনীও অপেক্ষায় থাকবে চলে যাওয়ার। সময় ফুরিয়ে আসার ভয়, ওকে নিয়ে ইনসিকিউর ফিল করা আমি আর এসব সয়ে যেতে পারছি না। একটা সমাধান আমি চাই। নবনীকে চাই আমি। ওকে আমার লাগবেই।” 

    — “নবনী বাসায় নেই, ওকে চোখের সামনে দেখছিস না তাই সবকিছু এত জটিল লাগছে।” 

    — “ইটস ট্রু। ও আমার পাশে বসলেই মনে হয় অর্ধেক প্রবলেম সলভ হয়ে গেছে। বাসা থেকে তো গেলই, যাবার আগে মাথায় পোকা দিয়ে গেল একমাস পরই ও একেবারে চলে যাবে”। 

    — “বাবু তুই একটু ঢং করতে পারবি?” 

    — “কিসের ঢং?” 

    ভেংচি কাটলো অনি, 

    — “তুমি মরে যাচ্ছো। বাঁচাতে হবে না তোমাকে? তাই আম্মু আর আমি ছোট একটা ফন্দি এঁটেছি।” 

    — “কী?” 

    — “অনি, নবনীকে কল করে বলবে তুই অসুস্থ। তোর ভীষণ মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা। জ্বর আসতে পারে। তুই শুধু বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে থাকবি। তোর চেহারার নকশা অসুস্থই দেখাচ্ছে। কন্ঠটা শুধু নিচু রাখবি, ব্যস।”

    — “সত্যি বলবো আম্মু?” 

    — “কী?” 

    — “বিকেলে একবার আমিও ভেবেছিলাম এমন কিছু করবো।” 

    একসঙ্গে হেসে উঠলো অমিত, অনি আর তাদের মা। শামীমা বললেন, 

    — “লোকে শুনলে বলবে পুরো ফ্যামিলি ভাঁওতাবাজ।” 

    — “তোমার ছেলে এমনভাবে বাসায় ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে ওকে দেখে মনে হয় এই বাসায় কেউ মরে গেছে। ভালো লাগে ওকে এভাবে দেখতে? খাবে না, কথা বলবে না, হাসবে না। ওর এসব নাটক দেখতে দেখতে আমি টায়ার্ড আম্মু। জলদি করে ওর সংসারের একটা বন্দোবস্ত করো। আমাকে এসব থেকে মুক্তি দাও। ওর মন খারাপ নবনী আপুই সামলাক। আমাকে দিয়ে ওসব হবে না।” 

    ***** 

    — “এক কথায় অমিত অসাধারণ! ওর সঙ্গে সময় কিভাবে যে কেটে যায়, টেরই পাই না। এই ছেলেটার এত খারাপ অভ্যেস আমাকে পেয়ে বসেছে ওর সঙ্গে দুই তিনদিন সময় বেঁধে গল্প না করলে, কথা না বললে অস্থির লাগে। মনে হয় কখন সময় হবে? কখন ওর সঙ্গে বসে একটু গল্প করবো কিংবা দু’জনে হাঁটতে বেরোবো।

    — “খুব ভালো একটা বন্ধু পেয়েছিস, দেখছি।”

    — “হ্যাঁ, বহুবছর পর। আমার ছোট ছোট সব বিষয় খেয়াল থাকে ওর। জানো, আমি কখনো রাত জেগে কাজ করলে অমিত আমার পাশে বসে থাকে যতক্ষণ না কাজ শেষ হচ্ছে। বারবার বলি, তুমি গিয়ে ঘুমাও। ও যেতেই চায় না। বলে, আমার ঘুম আসছে না। থাকি এখানে কিছুক্ষণ। মিথ্যে বলে ও। মাঝে মাঝে ঘুমে চোখ বুজে আসে ওর, তবুও বসে থাকে। হয়তো ভাবে আমি একা বোর হবো। তাই বসে থাকে আমার সঙ্গে। আমার কোন কাচের চুড়িটায় ফাটা দাগ পড়েছে, কানের জিনিসের কোন স্টোনটা পড়ে গেছে, কোন খাবারটা খেতে আমার খুব একটা ভালো লাগছে না, আমার মাথা ধরেছে কি না সবকিছু ও এমনি এমনি বুঝে ফেলে। আমার কখনো কিছু বলতেই হয় না।” 

    — “ঝগড়া করিস?” 

    — “করি না আবার! সিরিয়াস কিছু না। ছোট ছোট ব্যাপারে গাল ফুলাই আমরা। অমিতের রাগ….” 

    অনর্গল বলে চলছে নবনী, তার সঙ্গে অমিতের দিনরাত্রি। যতটা মনোযোগে সুমনা নবনীকে শুনছে তার চেয়ে মনোযোগে নবনীকে সে দেখছে। কন্ঠে উচ্ছ্বাস, চোখে মুখে আনন্দ। কার গল্প বলতে গিয়ে একটা মেয়ের চোখ মুখ ওভাবে জ্বলে উঠে? খুব প্রিয় মানুষের গল্প। কিংবা ভালোবাসার মানুষের গল্প। প্রাণপণে সকলে দোয়া করছিল, চলে যাওয়া যার ভাগ্যে ছিল সে চলে গেছে। কিন্তু যাকে রেখে গেছে সে বাঁচার মতন বাঁচুক। এভাবে আর কতদিন? কেউ আসুক, সাজিয়ে দিক রাঙিয়ে দিক মেয়েটার নিষ্প্রাণ ধূসর জীবনটাকে। অবশেষে ভাগ্যবিধাতার সিদ্ধান্ত দু’চোখে দেখা হলো। নবনীর জীবন যত্নে সাজাতে উপরওয়ালা অমিতকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু নবনী কি জানে সে কথা? বুঝতে পারে অমিত তার মনের উঠোনে কতটা জায়গা দখল করে নিজের নামে ঘর বানিয়েছে? প্রাক্তনের জায়গাটুকুতে অজান্তেই তার বর্তমানের একচ্ছত্র আধিপত্যের ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছে? 

    মোবাইল কল আসায় গল্প থামালো নবনী। হাসিমুখে কল রিসিভ করলেও ধীরে ধীরে ভ্রু কুঁচকে আসছে ওর। ওপাশ থেকে কে কী বলছে কে জানে! একটানা শুধু বলেই যাচ্ছে আর নবনী শুনছে। জানার জন্য কৌতুহল জাগছে সুমনার। ইশারায় নবনীকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নবনী মুখ খুললো, 

    — “বিপি চেক করেছো? লো হয়নি তো?” 

    — “ওর নাটক ছোটাচ্ছি আমি। বেশি সময় লাগবে না আসতে। ব্যাগ প্যাক করতে যতক্ষণ সময় লাগে আরকি! ততক্ষণ ওকে ছাড়ো। যা খুশি করুক। আমি এসে বাকিটা দেখছি।” 

    নবনী কল কাটতেই সুমনা জিজ্ঞেস করলো, 

    — “কে কল করেছে?” 

    — “অনি। অমিত অসুস্থ। আমাকে এখনই ফিরতে হবে।” 

    — “এখনই চলে যাবি?” 

    — “হ্যাঁ। ও কারো কথা শোনে না। খাবার, মেডিসিন কিছুই খাচ্ছে না। আমাকে আবার ভয় পায় ও। দুই একটা ধমক দিলেই কাজ হয়ে যাবে। ফোনে ফোনে সম্ভব না। তাই বাসায় যাবো।” 

    — “যা তাহলে। আর গ্রামে যাওয়ার প্ল্যানটা মাথায় রাখিস।” 

    — “হ্যাঁ অমিতের ছুটির দিন ধরে প্ল্যান করতে হবে। তুমি বসো তাহলে। আজ রাতটা এই বাসায় থাকো। আম্মু, নানী গল্প করবে তোমার সঙ্গে।” 

    — “দেখি।” 

    — “দেখি টেখি না, থাকো আজ। আমি আমার গোছগাছ সেরে ফেলি। ফোনে কথা হবে তোমার সঙ্গে। অমিতের বাসা এখান থেকে খুব একটা দূরে না। নাতাশাকে নিয়ে কাল পরশু একবার ঘুরে এসো। তারপর তোমার যখন ইচ্ছে হবে যেও।” 

    বিছানায় শুয়ে নিউজফিড স্ক্রল করছিলো অমিত। কলিংবেলের শব্দ পাওয়া মাত্ৰ তাড়াহুড়ো করে ফোন রেখে চোখ বুজে শুয়ে রইলো। প্রায় ঝড়ের গতিতে অমিতের ঘরে এল নবনী। অমিতের পাশে বসে গালে কপালে ছুঁয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো, 

    — “মাথাব্যথা কখন থেকে? জ্বর এসেছিল আজ সারাদিনে বা গতকাল রাতে?”

    — “হুম।” 

    — “বলোনি কেন আমাকে?” 

    — “নিজেই জ্বর হইয়েনে আরা গাত চড়ি বইসু। আঁর জ্বর তো তুঁ-ই। আথাম থাম জ্বরত ভিতুরে ফুড়ি যার আঁর। আর তুঁই গওর উদ্দি জ্বর মাইপতে লাইগ্গ? ভিতুর দি ফুড়ি মরির দি, ইয়ান মাফি ন চাইবে? ছুঁইয়েনে ন চাইবে? তুঁই আঁর জ্বর ন হয়েনে ঝড় হই জ গুই। আঁরে ভিজায়েনে শান্ত গরো। আর পুইড়তো ন দিই উ।”

    অমিতের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো নবনী। বড্ড অসহায় দেখাচ্ছে অমিতকে। ক্লান্ত চোখজোড়ায় কী যেন এক অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা লেগে আছে! নিজের ভাষায় এক নিঃশ্বাসে কী যে বললো! খুব মনোযোগে কান পেতেও তিনটে চারটে শব্দ ছাড়া আর কিছুই ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না নবনী। অমিতকে ধমকে জিজ্ঞেস করলো, 

    — “আবারও সেই মিনমিন করে নিজের ভাষায় কথা বলা তোমার! জানোই তো বুঝি না, তবুও কেন বলো?” 

    — “যাতে না বুঝো।” 

    — “তাহলে বলার কী প্রয়োজনটা ছিল?” 

    — “এত কথা পেটে চেপে রাখা যায় না। অন্তত তোমার কাছে না। আবার সব কথা তোমাকে বলাও যায় না। তাই ওভাবে বলি, মনকে শান্ত করি।’ 

    — “কী এমন কথা অমিত যেটা আমাকে বলা যায় না? তোমার কোন কথাটা আমি না জেনে বসে আছি? তোমার একান্ত ব্যক্তিগত কথাগুলোও আমি জানি। তবুও যে কী লুকাতে চাও, কে জানে!”

    — “ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে চলে এসেছো দেখছি! তোমার একসপ্তাহ তো এখনো পেরোয়নি।”

    — “অনির কথা শুনলে আমাকে আর আসতে হতো না। অফিস থেকে ফিরে শার্টপ্যান্টও চেইঞ্জ করোনি। উঠো, জামা কাপড় ছাড়ো। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হও। আমি তোমার মাথায় গরম তেল মালিশ করে দিচ্ছি।” 

    — “বলেছিলাম, ইউ আর ইন লাভ উইথ মি। পাত্তাই দাওনি সেদিন। অথচ আজ ভালোবাসার উদাহরণ জ্বলজ্বল করছে।” 

    — “কিসের উদাহরণ?” 

    — “এই যে আমি অসুস্থ শুনে ছুটে এসেছো আমার সেবা করতে। এটা ভালোবাসা নাতো আর কী?” 

    — “অমিত! তোমার নাটক আমি বুঝি। খাবার খাবে না, ওষুধ খাবে না তাই এমন নাটক করছো। আর একটা কথাও বলবে না তুমি। এক মিনিটের মধ্যে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে যাবে। কুইক!” 

    — “এই যে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছো, শাসাচ্ছো এসব কে করে? বউরা করে। এবার বলো তুমি আমার বউ নয়তো আর কে?” 

    — “আলী ফজলের নতুন ওয়েব সিরিজ রিলিজ হয়েছে। তুমি কি আমার সঙ্গে বসে কাল রাতে সেটা দেখতে চাও?” 

    — “ওহহো! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।” 

    — “দেখতে চাও?” 

    — “অবশ্যই!” 

    — “এক্ষুনি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হও, ভাত খাও, ওষুধ খাও। নয়তো আমি বাসায় ফিরে যাচ্ছি।” 

    বিনাবাক্যে নবনীর হাত থেকে তোয়ালে, ট্রাউজার আর গেঞ্জি নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল অমিত। খানিকবাদে ছিটকিনি খুলে দরজার একটুখানি ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে বললো, 

    — “ঝগড়ায় হেরে যাবার আগ মুহূর্তে মেয়েরা বাপের বাড়ি যাওয়ার হুমকি কাকে দেয়? হাজবেন্ডকে দেয়। বলো তো নবনী, আমি তোমার হাজবেন্ড নয়তো আর কে?” 

    নবনী বালিশ ছুঁড়ে মারার আগেই দরজা আটকে দিলো অমিত। এপাশে নবনী, ওপাশে অমিত দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে প্রাণখোলা হাসিতে মেতে উঠেছে। 

    ***** 

    — “নবনীর অতীত, অসুস্থতা মেনে নিয়েই ছেলেটা ওকে ভালোবেসেছে, সংসার করতে চাইছে। ও নবনীর জন্য ব্লেসিং। নয়তো কোন ছেলেটা এতকিছু মেনে নেয়, বলুন তো?”

    — “নাহ্, আমার নাতিনের কপাল ভালো। নয়ত এমন সোনালক্ষ্মী পোলা জুটতো নাকি!” 

    পান চিবুতে চিবুতে সুমনার সঙ্গে গল্প করছেন জামিলা বেগম। সঙ্গে তার মেয়ে আর ছোট নাতনিও আছে। নানীর সঙ্গে তাল মেলালো নাতাশা। বললো, 

    — “সত্যিই! আপুর সঙ্গে ঐ বাসায় আমিই বেশি থাকি। বাসার সবার চেয়ে ভাইয়াকে আমি বেশি জানি। এত ভালো মানুষটা! আর আপু উনার সঙ্গে খুব হ্যাপি থাকে। এটাই আমরা চেয়েছিলাম সবাই।” 

    — “আমার দেবর, জা সবাই খুব ভালো। আমার মেয়েটাকে একদম নিজের মেয়ের মতন আগলে রাখে। আমার মেয়ের ভাগ্যে তোমাদের আদর ছিল না। সামি ছিল না। শুধু ভাবতাম আর কে আছে আমার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতন, নিজের বোনের ভালোবাসবে? সামির মতন আগলে রাখবে? অবশেষে উপরওয়ালা আমাদের ডাকে সাড়া দিয়েছে। মেয়ে নিয়ে এক আনা দুশ্চিন্তাও এখন আমরা করি না। নবনীর বাবা তো সারাক্ষণ একটা কথাই বলে, অমিত আছে, ও সামলে নেবে।” 

    — “মা একবার অমিতকে খুব দেখতে চাইছে। আমরা জানতাম নবনীই আমাদের ঘরের বউ। ভাগ্যে ছিল না আমাদের, তাই হয়নি। মা আসলে ওসব কিছু থেকে এখনো ঠিক বেরিয়ে আসতে পারেনি। নবনীর জন্য কাঁদে প্রায়ই। অমিতকে নিয়ে গতকাল লম্বা আলাপ হলে মায়ের সঙ্গে। মজার ব্যাপার হলো কেন যেন মা একদম কাঁদেনি। বরং মনে হলো মা খুব খুশি। এখন বায়না করছে অমিতকে এক নজর দেখবে বলে। নিজের হাতে রেঁধে খাওয়াতে চায়। বলে কিনা, ও কি আমার ছেলে হবে? যদি মা ডাকতে বলি ডাকবে আমাকে? কিসব বাচ্চাদের মতন আবদার বলুন তো আন্টি!” 

    — “জোয়ান পোলা যার গেছে সে কইতে পারবো তার মনের অবস্থাটা কেমন। তোমার মায়ের মনে কী চলে সেইটা আর কেউ বুঝতে পারবো না। কতদিন হইলো সামির মুখে মা ডাক শোনেনাই। বুকের ভিতর হাহাকার তো লাগেই। তাই একটু শখ করছে অমিতের কাছে মা ডাক শোনার।” 

    — “না নানী। হুট করে একটা আবদার করলে কি আর চলে? অমিত আমাদের কাউকে খুব একটা চেনে না। মায়ের আবদারে হয়তো বিব্রত হতে পারে। মাকে আমি বুঝিয়ে বলবো। কিন্তু, অমিত আমাদের ওখানে যেতে রাজি হবে তো?” 

    ৫১

    প্রকৃতিতে আজ চৈত্রের সপ্তম ভোর। দখিন হাওয়ায় ভেসে আসে সামনের বাড়ির গাছ থেকে আমের মুকুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। পাশের বারান্দা থেকে কামিনী ফুলের ঘ্রাণ। ভোরের এই সময়টায় শুদ্ধ বাতাসে,আবছা আলোর মাঝে অমিতের বড্ড নেশা লাগে। প্রিয় কাউকে নিয়ে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাবার নেশা। লম্বা আঁকাবাঁকা পথ ধরে তার সঙ্গে হেঁটে যাবার নেশা। হাঁটতে হাঁটতে পূর্বাকাশে একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়তে থাকা সূর্য কিরণ দেখার নেশা। সারারাত নির্ঘুম কাটিয়ে এই ভোরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল অমিত একটা সিগারেট ধরাবে বলে। সিগারেটে আগুন দিতে দিতে খেয়াল হলো, প্রিয় মানুষ ঘরেই আছে। যখন তখন ঘুম থেকে টেনে তুলে তাকে সঙ্গে নিয়ে প্রকৃতির মাঝে হারাবার প্রশ্রয়, অধিকার দুটোই আছে। হাতের সিগারেটটা ফেলে দিলো অমিত। নক ছাড়াই সোজা ঢুকে পড়লো নবনীর ঘরে। লাইট জ্বালিয়ে নবনীর কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকতে লাগলো,

    — “নবনী… এ্যাই নবনী…” 

    চোখ মেলে তাকালো নবনী। জানালার বাইরে চোখ যেতেই লাফিয়ে উঠলো বিছানা থেকে। 

    — “কী হয়েছে? কোনো সমস্যা?” 

    — “উঠো। ১৫ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হও, জামা বদলাও। সাজগোজের প্রয়োজন নেই। মাথার চুলটা জাস্ট বেঁধে নাও।” 

    — “কোথায় যাচ্ছি? কারো কিছু হয়েছে অমিত?” 

    — “না। আমরা বিরুলিয়া যাবো এখন। 

    — “বিরুলিয়া কেন?” 

    — “কেন আবার? ঘুরতে।” 

    — “তুমি না অসুস্থ?” 

    — “সুস্থ হয়ে গেছি। চলো তুমি। 

    — “আমি ঘুমাবো!”

    — “ভোরে ঘুরতে বের হইনি বহুদিন। গ্রামেও যাওয়া হচ্ছে না আমার। চলো না প্লিজ!” 

    — “অফিস নেই তোমার?” 

    — “এখন সাড়ে পাঁচটা বাজে। সাড়ে নয়টা নাগাদ ফিরে আসতে পারবো। বেশিক্ষণ লাগবে না। যাবো, তুমি আমি একটু ফুল ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটবো, এক কাপ চা খাবো। সময় পেলে নাস্তা করবো নয়তো বাসায় ফিরে করবো। 

    — “যেতেই হবে?” 

    — “হ্যাঁ।”

    একরাশ বিরক্তি নিয়ে কাথার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো নবনী। ওয়্যারড্রব থেকে কাপড় বের করতে করতে বললো,

    — “কিসব আবদার যে করো বসো না তুমি! আরাম করে ঘুমাচ্ছিলাম। ঘুমটাই বরবাদ। আমিও আরেক ছাগল, তোমার সব বায়না বসে বসে পূরণ করি।

    — “কেন করো? নিজেকে জিজ্ঞেস করোনি কখনো? কেন অমিতের সমস্ত বায়না আমি পূরণ করি? কেন ওকে এত মাথায় তুলে রাখি? শুধু অমিতকেই কেন? আর কাউকে তো এতখানি প্রশ্রয় কখনো দেই না?” 

    একমুহূর্ত দাঁড়ালো নবনী। বোকা চোখে তাকিয়ে রইলো অমিতের দিকে। অমিত জানে কোনো উত্তর নবনী দেবে না। তবুও চেয়ে রইলো নবনীর দিকে উত্তরের আশায়। 

    বরাবরের মতো এবারও উত্তর দিলো না নবনী। ওয়াশরুমে যাবার আগে শুধু বলে গেল, 

    — “মাত্র ঘুম থেকে জেগেছি। আপাতত ব্ৰেইন কাজ করছে কম। পরে তোমার প্রশ্ন ভেবে উত্তর দিবো।”

    .

    কুয়াশার দাপট খুব একটা নেই। তবুও সূর্যালোক ঐ দূর আকাশ থেকে এই গ্রামে পৌঁছুতে পৌঁছুতে অনেকটাই হালকা হয়ে গেছে। একটা আঁকাবাঁকা পথ ধরে হাঁটছে নবনী। পথের দুই পাশে বিস্তীর্ন জমিতে গোলাপ আর গাদা ফুলের চাষ। ফুলগুলোর পাতায়, পাঁপড়িতে, পথের কিনার ঘেষে বেড়ে উঠা ঘাসের মাঝে জমে আছে বিন্দু বিন্দু শিশির। জুতা হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটছে নবনী। এই পথে নেমেই ঝট করে জুতোজোড়া খুলে ঘাসের উপর হাঁটতে লাগলো। শিশিরে পা ভেজানো নবনীর ভীষণ প্রিয়। নাহ্, নবনী সে কথা অমিতকে বলেনি। ওর চঞ্চল হাসিতে অমিত ঠিক বুঝে নিয়েছে সে কথা। হাঁটতে হাঁটতে গায়ের চাদরটা আরেকটু আটসাঁট করে বারবার গায়ে জড়াতে লাগলো নবনী। শীতল বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে ওদের। ভাগ্যিস বেরোবার সময় পাতলা চাদরটা গায়ে পেঁচিয়ে বেরিয়েছিল! নয়তো আজ ঠান্ডা লেগে যেত নিশ্চিত। অমিত মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে বললো,

    — “বলেছিলাম না এখানে বেশ ঠান্ডা। দেখলে তো?”

    — “অথচ আমাদের ওখানে ঠান্ডা নেই।” 

    — “এটা গ্রাম নবনী।”

    — “শহরের ভেতরই তো।” 

    — “শহর কোথায়? দূর দূরান্তে কোনো উঁচু দালান, অফিস কিংবা বাস, প্রাইভেট 

    কারের জ্যাম দেখতে পাচ্ছো? বলতে পারো শহরের কাছাকাছি কিন্তু এটা গ্রামই। ওখানকার ওয়েদার আর এখানকার ওয়েদার খুব একটা ম্যাচ হবে না। তুমি এসেছো এর আগে?”

    — “না। প্রতিবছরই নাতাশা আর আমি প্ল্যান করি কিন্তু আসা হয়নি কখনো। তুমি এরআগে এখানে এসেছিলে?”

    — “হুম এসেছি দুইবার। মুনিয়াকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম।” 

    — “একটা ব্যাপার বলো তো অমিত?” 

    — “হুম?” 

    — “মেয়েটা এত হম্বিতম্বি করলো, বাসা পর্যন্ত চলে এল। আমার জাস্ট একটা থ্রেটে থেমে গেল কেন? যতোটা বেপরোয়া আচরণ মুনিয়া করছিল আমার একটা হুমকিতে ওভাবে থেমে যাবার কথা না।

    — “ও তোমার হুমকিতে ভয় পায়নি, ভয় পেয়েছে আমাকে। মুনিয়ার আমার উপর খুব বিশ্বাস ছিল, যত যাই হোক ওর ক্ষতি আমি করবো না। কত কী করলো, আজ পর্যন্ত আমি সব সয়ে গেছি। চাইলে ওকে মিডিয়া থেকে ভ্যানিশ করতে পারতাম। করিনি। এতকিছুর পরও যেহেতু কিছু করিনি, ভেবেছিল এবারও কিছু করবো না। মানুষের সামনে ওভাবে ওর স্কার্ফ, মাস্ক আমি খুলে ফেলবো ও ধারণা করতে পারেনি। শত হোক মুনিয়া পাবলিক ফিগার। সিঁড়িভর্তি লোকের সামনে ওর সম্মান নষ্ট হলো না? আমাদের এডভারটাইজিং ইউনিটের সঙ্গে ওর দুটো চুক্তি হওয়ার কথা। একটা টেলিকম এড অন্যটা সাবানের। ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ড। এড দুটো থেকে বেশ ভালো এমাউন্ট পাবার কথা। তার উপর এমন ইন্টারন্যাশনাল ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করা প্রতিটা মডেলের ড্রিম। যেদিন ঝামেলা হলো ঠিক তার পরদিনই এডভারটাইজিং সেক্টর থেকে হাওয়ায় খবর ভেসে এল মুনিয়ার সঙ্গে এগ্রিমেন্ট হবে। কথাবার্তা ফাইনাল। পেপার ওয়ার্ক বাকি। মাথায় কী ভূত চাপলো কে জানে? সরাসরি প্রজেক্ট হেডকে কল করে বলে দিলাম ওকে বাদ দিতে। তার প্রজেক্টের জন্য তিনদিনের মাঝে বেস্ট মডেল আমি এনে দেবো।” 

    — “ব্যস! ঐ লোক রাজি হয়ে গেল?” 

    — “একই কোম্পানিতে আছি আমরা বহুবছর যাবৎ। ভাই ব্রাদার টাইপ রিলেশন পুরোনো এমপ্লয়িদের মাঝে। যদিও আমাদের সেক্টর ডিফারেন্ট কিন্তু সম্পর্কে দূরত্ব নেই। উনার প্রয়োজন আমি দেখব, আমার প্রয়োজন উনি দেখবে। উনার রিকোয়েষ্ট আমি রাখবো, আমার রিকোয়েষ্ট উনি রাখবে এভাবেই তো আমাদের সম্পর্কগুলো টিকে আছে। নয়তো এক অফিসে এতবছর কাজ করা মুশকিল হয়ে যেত না?”

    — “তারপর?” 

    — “মুনিয়ার ড্রিম প্রজেক্ট ক্যান্সেল। ও বুঝতে পেরেছে কাজটা আমিই করেছি। সোজা অফিসে চলে এল। স্যরি বললো। কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলিয়ে নাজেহাল অবস্থা। বারবার করে প্রমিজ করলো আর কখনো আমাকে ডিস্টার্ব করবে না। প্রয়াজনে আমার বাসায় এসে সবার সামনে স্যরি বলবে। তারপর আরকি! ওর কাজ ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি।” 

    — “ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করেনি কেন আবার প্রজেক্ট ওকে দিতে চাইছো?” 

    — “উনি জানেন আমাদের ব্যাপারটা। শুধু উনি না, অফিসের অনেকেই একটু আধটু জানে আমাদের ব্যাপারে।” 

    — “এতকিছু হয়ে গেল, বলোনি তো আমাকে?” 

    — “ওর কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি তাই। ওকে ভাবতে ভালো লাগে না, বলতে ভালো লাগে না। আমাদের ভালো স্মৃতিগুলোও কেমন আবছা হয়ে আসছে। কিন্তু খারাপ স্মৃতিগুলো এখনো দগদগে ঘা হয়ে রয়ে গেছে মাথার ভেতর। তবে সেসব কষ্টহীন।” 

    — “আচ্ছা ছাড়ো সে কথা।” 

    কয়েক মুহূর্ত কেটে যায় নিশ্চুপ। দু’জনে একই তালে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে চলছে ঐ দূর গ্রামের দিকে। ধীরে ধীরে বাড়ছে সূর্যের দাপট। আপন আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে এই ধরণীর বুকে। মাটির উপর দু’জনের ছায়া পড়ছে। সেই ছায়াতেই নজর আটকে আছে অমিতের। যতটা দূরত্বে ওরা হাঁটছে, ছায়ার মাঝে দু’জনকে আরো বেশি কাছাকাছি দেখাচ্ছে। ঠিক গায়ে গা ঘেঁষে। কী হতো যদি এই ছায়ার মতন তাদের মাঝে একমিটার দূরত্বটা মিটে যেত? গায়ে গা ঘেঁষে কিংবা নবনী তার হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে এই শীতের সকালে হেঁটে বেড়াতো মেঠো পথ ধরে? ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ সেই মুহূর্তটাকে করে নিতো ষোলোআনা পূর্ণ। পথ চলতে চলতে এক মুহূর্তের জন্য লোকচক্ষুর আড়াল হলে, সুযোগ বুঝে হয়তো সে এঁকে দিতো নবনীর কপালে ছোট্ট চুমু। অসম্ভব সুন্দর একটা মুহূর্ত তৈরী হতে পারতো আজ। স্মৃতির ঘরে তোলা থাকতো আদুরে এই মুহূর্তটা। নীরবে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল অমিতের। নবনীকে খুব করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে, আমাদের এই দূরত্ব আর কতদিন? 

    হঠাৎ নবনী দৌড় দিলো পথের ওধারে, নীল টিনের বড় বাড়িটার দিকে। বাড়ির গা ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে জবা গাছ। আট নয় বছরের ছোট্ট মেয়েটা ফুল ছিঁড়ছিল। ওর কাছে চেয়ে রক্তজবা নিয়ে এল নবনী। কানে গুঁজতে গুঁজতে আবার ছুটে এল অমিতের কাছে। নিজের ফোনটা অমিতের হাতে ধরিয়ে বললো, 

    — “জলদি করে আমার একটা ছবি তুলে দাও তো!” 

    ছবি তুলতে গিয়ে থেমে গেল অমিত। স্নিগ্ধ মুখটাতে লেপ্টে আছে মিষ্টি রোদ। বেণী ছেড়ে বেরিয়ে আসা চুলগুলো যেন হাত পা ছড়িয়ে এলোমেলো হয়ে ঢলে পড়েছে ডানপাশের কানের উপর, কাঁধের উপর। বাম কানে গুঁজে আছে টকটকে লাল জবা। ঘুম থেকে জাগার পরের স্নিগ্ধতা এখনও ওকে ছেড়ে যায়নি। চোখে-মুখে এখনো লেগে আছে। হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে চেঁচিয়ে উঠলো নবনী। 

    — “কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো? এখনও তোলা হয়নি তোমার?” 

    — “এই তো তুলছি। তুমি আবার দাঁড়াও না আগের মতন!” 

    দ্রুত নবনীর তিনটে ছবি নিয়ে নিলো অমিত। নবনীর হাতে মোবাইল দিয়ে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়ালো তার সামনে। চোখে চোখ রেখে বললো, 

    — “তোমাকে নিয়ে আস্ত একটা কবিতা লিখে ফেলা যাবে নবনী।” 

    — “তাই? কে লিখবে? তুমি?” 

    — “প্রেয়সীর গালে কপোলে সোনালি রোদ, 

    প্রেমিকের বুকে অনল। 

    প্রণয়িনীর কানের ভাঁজে লাল টকটকে জবা, 

    এলোমেলো চুল গোছানোর বাহানায় কপোল ছোঁয়ার অভিলাষ। 

    নিঃশ্বাসের পার্থক্য মিটবে কবে? 

    প্রতীক্ষায় অপেক্ষায় প্রেমিকের দীর্ঘশ্বাস!” 

    অবাক হাসিতে, চোখজোড়া ছোট করে অমিতের দিকে চেয়ে রইলো নবনী। 

    — “তুমি কবিতা লিখতে জানো অমিত!” 

    — “না তো!” 

    — “কার লিখা ছিল কবিতাটা?” 

    — “কেউ লিখেনি। মাথার ভেতর দুই চারটা লাইন ভোঁ করে দৌড় দিলো। আমিও ফটফট করে বলে দিলাম।”

    — “তুমি কবিতা লিখো আমাকে আগে বলোনি কেন?” 

    — “লিখিনি কখনো। বলবো কেমন করে?” 

    — “ধূর্ছাই! যতসব ঢঙ তোমার।” 

    — “ঢঙ সবাই করে। তুমিও করো। এইতো সকালে খুব ঢঙ করছিলে আসবে না এখানে। বলো তো, ভালো লাগছে না তোমার?” 

    — “ঢঙ কোথায় করলাম? একবার দুইবার বারণ করেছি শুধু। রাতে ঘুমিয়েছি দুইটা বাজে। এত ভোরে এসে ডাকাডাকি করলে কার যেতে ইচ্ছে করবে বলো?” 

    — “দেখছি তো কেমন আনন্দে শিশিরে পা ভিজিয়ে হাঁটছো। ভালো লাগছে সে কথা তো মুখে বলবে না।

    — “তোমাকে কিছু বলতে হয় নাকি! এমনি এমনিই তো বুঝে নাও।” 

    — “তাই বলে বলবে না? আমার মাঝে মাঝে তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে হয়। হাসলো নবনী। অমিতের কাঁধে আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো, 

    — “হুম ভালো লাগছে। তবে তারচেয়ে বেশি ভালো ছিল তোমার কবিতা।”

    — “কী ভাগ্য গো তোমার নবনী! অমন সুন্দর কবিতা বলা বর পেয়েছো।” 

    — “হ্যাঁ ভাগ্য তো আমার বটেই। হাজারটা পাত্র বেছেও মেয়েরা ভালো একটা হাজবেন্ড পায় না। অথচ আমার বিয়ে হলো ঝড়ের গতিতে, জোর করে কিন্তু বরটা ভীষণ ভালো জুটে গেল। আফসোস! এই ভালো বরটা এমন কেউ পেলো না যে এই বিয়েটা, সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতো। তোমার সঙ্গে যা কিছু হচ্ছে না অমিত, এসব তুমি ডিজার্ভ করো না। ইউ ডিজার্ভ মার্চ বেটার। আমি কিংবা মুনিয়া আমরা কেউই তোমার উপযুক্ত না। মুনিয়া তোমাকে ভেঙেচুরে রেখে গেল আর আমার কারণে তোমার নামের পরে ডিভোর্সি শব্দটা ঝুলে যাবে। অথচ ভালো একজন লাইফ পার্টনার, সুন্দর সরল একটা জীবন তোমার হবার কথা ছিল। তোমার মতো ছেলেকে পাওয়া, এ্যাজ এ্য লাইফ পার্টনার প্রতিটা মেয়ের স্বপ্ন।” 

    — “আমাকে পছন্দ তোমার? 

    — “ভীষণ। তোমাকে কে না পছন্দ করবে বলো তো?” 

    — “তাহলে ছেড়ে যেতে চাইছো কেন? থেকে যাও আমার কাছে।” 

    চোখ টিপলো অমিত। অমিতের চোখের ইশারায়, দুষ্ট হাসিতে হেসে ফেললো নবনীও।

    — “খুব দেরী হয়ে গেল যে অমিত! তোমার বউকে বহু আগে অন্য কেউ নিজের নামে করে নিয়েছে।” , 

    — “সত্যিই নবনী! আমরা কাজিন। তুমি যখন গ্রামের ঈদগুলোতে ফ্রক পরে, দুই ঝুটি করে ঘুরে বেড়াতে তখন তোমাকে দেখেছিলাম। সামির আগে তোমার আমার দেখা হওয়া, পরিচয় হওয়া অথচ আমি কখনো আলাদাভাবে ভাবিইনি। মুখ কুঁচকালো নবনী।

    — “ঐ বয়সে কে, কাকে আলাদাভাবে ভাববে অমিত? তুমি আমি দুজনেই ছোট!”

    — “সামি যখন প্রপোজ করলো তখনও তুমি ছোটই ছিলে।” 

    — “ছিলাম, তবে এতটাও না। আমি তোমাকে গ্রামে শেষবার দেখেছি খুব সম্ভবত ক্লাস ফোরে পড়ি যখন। এরপর দাদী মারা গেল, আমাদের আর ওখানে ঈদ করতে যাওয়া হয়নি। তারপর দেখেছিলাম ১১-১২ বছর আগে, শুভ ভাইয়ার রিসেপশনে। দূর থেকে দেখেছিলাম শুধু। কথা হয়নি আমাদের। এবার বলো ক্লাস ফোরে পড়ুয়া মেয়েকে আলাদা চোখে দেখবে কেমন করে? এমন হয় কখনো?”

    — “জানি না হয় নাকি হয় না। কিন্তু আমার ভীষণ আফসোস হয় নবনী।”

    — “আফসোস!” 

    অবাক চোখে অমিতের দিকে তাকিয়ে রইলো নবনী। আজ এই মুহূর্তে হাসতে হাসতে আর প্রসঙ্গ বদলাতে ইচ্ছে করছে না অমিতের। ইচ্ছে করছে গড়গড় করে মনের হাল অবস্থা বিশদ বর্ণনা নবনীকে শোনাতে। তবুও মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কথা ঘোরাতে ব্যস্ত হলো অমিত। 

    — “এভাবে তাকিয়ে আছো যে! ভুল বললাম?” 

    — “আফসোস কেন হবে তোমার?” 

    — “আমার আগে সামি তোমাকে নিজের করে নিলো অথচ জানাশোনা পুরোনো ছিল তোমার আমার। তবুও কেন তুমি আমার হলে না?” 

    — “অমিত! কিসব বলছো?” 

    — “যা মাথায় কিলবিল করছে তাই বলছি। লাইফ পার্টনারের কাছ থেকে মানসিক শান্তি পাওয়া অনেক বড় ব্লেসিং। আমরা একসঙ্গে আছি পাঁচমাস। এই কয়েকমাসের এক্সপেরিয়েন্স থেকে বলছি, তোমার সঙ্গে আমার সংসার হলে আমার বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটিয়ে দিতে পারতাম। না চাইতেও আমাদের বিয়েটা হলো। ভাগ্যে ছিল বলেই হলো। অথচ দেখো তো! সংসার আমাদের ভাগ্যে নেই। এই বিয়েটা, দু’জন দুজনকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে, একই ফ্ল্যাটে থাকার ব্যাপারটা এক্সেপ্ট করতে আমাদের কতটা মানসিক অশান্তির মাঝে সময় পার করতে হয়েছে ভাবো তো? তুমি চলে যাবে, পুরো সমাজে, আত্মীয়-বন্ধু মহলে দু’জনে নামের পেছনে যুক্ত হবে ডিভোর্সি। তুমি আমি যতই কুল থাকি না কেন, এগুলোর প্রভাব জীবনে পড়বেই। তারচেয়ে বরং ভালো হতো না, যদি সামির বদলে মানুষটা আমি হতাম? এসব আর পোহাতেই হতো না। 

    — “বাদ দাও না অমিত! যা হয়ে গেছে বদলে ফেলা যাবে? যদি প্রভাব পড়ে তো পড়বে! সামলে নিবো আমরা। সামলাতে হবে আমাদের। একদিন দুইদিন এসব চর্চা চলবে। তারপর সব ঠিক হবে দেখে নিও।”

    — “হুম।” 

    — “আচ্ছা শোনো না?” 

    — “হুম?” 

    — “আজ তুমি আমাকে বেড়াতে নিয়ে এলে। চলো এই শুক্রবার তোমাকে আমি নিয়ে যাই।”

    — “কোথায়?” 

    — “সামিদের গ্রামের বাড়ি, মানিকগঞ্জ।” 

    পথ চলতে চলতে নবনীর কথায় থমকে দাঁড়ালো অমিত। 

    — “সামিদের গ্রামের বাড়ি কেন?”

    — “আন্টি কল করেছিল। খুব করে বলছে তোমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। আপুও বারবার করে বলছে। আমরা সকালে যাবো, বিকেলেই ব্যাক করবো।

    — “আচ্ছা।” 

    ***** 

    বাহারি নাস্তায় সাজানো টেবিল। নাস্তা খেতে খেতে গল্পে মেতে উঠেছে নবনী, সুমনা আর তার মা। গল্পের ফাঁকে সমস্বরে হেসে উঠছে ওরা তিনজন। তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেকি হাসছে অমিত। গল্পে তার মন নেই। মন পড়ে আছে সামনের দেয়ালে ঝুলে থাকা ফটোফ্রেমে। ছেলেটা দেখতে বড্ড মিষ্টি। পুরুষ ধাঁচের কঠিন চেহারা না। দেখলে মায়া হয়, কথা বলতে ইচ্ছে হয়, ঠিক তেমন। প্রায় দেড় আঙুল সমান সিল্কি চুলগুলোর বাম পাশে সিঁথি কাটা। ক্লিন শেইভড। চোখের নিচে ছোট্ট লাল তিল। কালো চেহারার ঝকঝকে দাঁতের প্রাণবন্ত হাসিটা ভীষণ মানাচ্ছে। শার্টের বাটন দু’টো খোলা। বুকের পশম দেখা যাচ্ছে একটু আধটু। আচ্ছা ওর পরনে নীল শার্টটাই কি নবনী প্রায়ই নিজের গায়ে জড়িয়ে বসে থাকে? হ্যাঁ সেই শার্টটাই তো বোধহয়! আরো একটু মনোযোগী হলো অমিত। 

    .

    গল্পের ফাঁকে অমিতকে বারবার দেখছে সুমনা। এই ঘরে এসেছে পর থেকে সামির ছবির দিকেই সমস্ত মনোযোগ তার। চোখজোড়া তার ঈর্ষাকাতর। ভীষণ হাসিখুশি ছেলেটা যেন পুড়ে যাচ্ছে। অমিতের চোখজোড়া স্পষ্ট পড়তে পারছে সুমনা। মনে মনে হাসলো সে। প্রেমে পড়লে মানুষ তার ভালোবাসার মানুষটার মৃত প্রাক্তনকেও জীবিত ভেবে হিংসা করে। কী অদ্ভুত রকমে পাগলামি! 

    সবজি বাগান দেখাবার বাহানায়া নবনীকে সঙ্গে নিয়ে বেরোলেন সামির মা। চোখের সামনে নবনী উঠে চলে গেল অথচ তাকে চোখেই পড়লো না অমিতের। এখনো তার চোখ আটকে আছে সামনের দেয়ালে। অমিতের পাশে এসে বসলো সুমনা। সিঙারার বাটিটা অমিতের সামনে ধরে বললো, 

    — “খাচ্ছো না যে!” 

    সুমনার ডাকে ঘোর কাটলো অমিতের। পাশে নবনী নেই। চোখ ঘুরিয়ে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো সে। সুমনা হেসে বললো, 

    — “নবনী মাত্রই উঠে চলে গেল অথচ তুমি খেয়ালই করোনি! কোন খেয়ালে ডুবে ছিলে, বলো তো?” 

    — “ওহ! না, তেমন কিছু না।” 

    অমিতের হাতে সিঙারা দিয়ে সুমনা বললো, 

    — “আমি কিন্তু দেখছিলাম তোমাকে।” 

    — “কী?” 

    — “আমার ভাই নেই অমিত। আর কখনো ফিরবে না। নবনী তোমার, একান্তই তোমার। তবুও কেন ইনসিকিউর ফিল করো, বলো তো?”

    — “না না! ওসব কেন ভাবতে যাবো?” 

    — “অমিত! পাগল অনেক দেখেছি আমি। এক পাগলের সংসার করছি। আরেক পাগল মানে আমার ভাইয়ের কথা বলছি, তাকেও দেখেছি। ভালোবাসায় একটা মানুষ কতবড় পাগল হতে পারে আমি জানি। আরো কতজনকে দেখলাম! তবে সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছি আমার হাজবেন্ড আর আমার ভাইকে। ওদের চোখ, চাহনি, চেহারার ভাঁজ এত বেশি দেখেছি যে আমি এখন পাগলদের খুব বুঝতে পারি। এই যেমন ধরো তুমি। তোমাকেও বেশ বুঝতে পারছি আমি।” ঠোঁট চেপে হাসলো সুমনা। ধরা পড়ে যাবার ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে ফেললো অমিত। হাসছে সেও। 

    — “তুমি নিজেকে কেন সামির সঙ্গে মেলাচ্ছো, বলো তো? সম্পূর্ণ আলাদা চেহারার, আলাদা ব্যক্তিত্বের দুজন মানুষ তোমরা। দুজনই দু’জনের জায়গায় সেরা।

    — “পার্থক্যটা দেখতে চাইছিলাম। বিশেষত্ব কী, বুঝতে চাইছিলাম। হয়তো আপনার শুনতে একটুখানি খারাপ লাগবে তবুও বলি?” 

    — “অবশ্যই!” 

    — “আপনি কাউকে ভীষণ ভালোবাসেন। তার ভালোবাসা আপনি খুব করে চাইছেন। অথচ সে ভালোবাসে অন্য কাউকে। তখন কি আপনিও আপনার আর সেই মানুষটার মাঝে পার্থক্য খুঁজতে চাইতেন না? হয়তো এই পৃথিবীর কাছে সামি নেই, কিন্তু আমার আর নবনীর জীবনে ও আছে। ঠিক আমাদের দুজনের মাঝখানে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে এমন একজনকে আমার ডিল করতে হচ্ছে যে কিনা এক্সিস্ট করে না। যাকে আমি দেখতে পাচ্ছি না, ছুঁতে পারছি না। তাকে কিছু বলতে পারছি না, তার কাছ থেকে কিছু শুনতেও পারছি না।” 

    — “এবং তুমি ওকে পজিটিভলি নিতেও পারছো না। একজন মানুষ যে কিনা এই পৃথিবীতে নেই তার সঙ্গে মনে মনে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছে তোমার।”

    — “হ্যাঁ। এ্যান্ড আ’ম স্যরি ফর দ্যাট। একটা ব্যাপার কি জানেন? আমিও জানি সামি নেই। কিন্তু আজকাল আমি ওকে ফিল করতে পারি। যতবার আমি নবনীকে কাছে পেতে চাই, একটা সংসারের স্বপ্ন সাজাতে চাই, ততবার আমি ওকে ফিল করি। যতবার নবনী ওর প্রাক্তনের গল্প আমাকে শোনায়, ততবার আমি ওকে ফিল করি। মনে হয় যেন, সামি কোত্থাও যায়নি। রয়ে গেছে এখানেই ঠিক আমার আর নবনীর মাঝখানে। আমাদের দূরত্ব আজীবন রয়ে যাবে শুধুমাত্র এই মানুষটার কারণে।” 

    — “ক্যান আই হোল্ড ইউর হ্যান্ডস অমিত?” 

    — “সিওর!” 

    অমিতের হাতজোড়া নিজের মুঠোবন্দি করলো সুমনা। 

    — “আমার ভাইটা তোমার বয়সী ছিল। তোমাকে দেখলে মনে হয় সামি দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। হয়তো তুমি নবনীর হাজবেন্ড তাই! নবনীর পাশে তোমার বদলে অন্য কেউ দাঁড়ালে হয়তো আমার ঠিক এমনটাই মনে হতো। নবনী আমাদের খুব আপন, জানো তো?” 

    —”হুম।” 

    — “সামি মারা যাওয়ার পর যতটা না আমরা সামির জন্য ভেবেছি তার চেয়ে বেশি ভেবেছি নবনীর জন্য। ওর জীবন থেকে এমন একজন চলে গেছে যাকে ঘিরে ওর গোটা পৃথিবী ছিল। আমার ভাই নেই তাই বলে নবনীকে নিয়ে আমরা ভাববো না তেমন সম্পর্ক কিন্তু আমাদের না। সামি চলে যাবার পর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা চেয়েছি নবনী সুখে থাকুক। এমন কেউ আসুক যে কিনা আগলে রাখতে জানে, আমার ভাইয়ের চেয়েও বেশি। যাকে নবনী ভালোবাসতে বাধ্য হবে। সামিকে ভুলে যাবে। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও, এটাই সত্যি। আমার পরিবার সবসময় চেয়েছে নবনী সামিকে ভুলে যাক। নবনী যেহেতু বেঁচে আছে, বাঁচার মতই বাঁচুক। অবশেষে তুমি এলে অমিত। আমরা যেমন চেয়েছিলাম ঠিক তেমন। তুমি ভাবছো নবনী তোমাকে ভালোবাসে না? ভুল অমিত! ও ভালোবাসে তোমাকে। বাসতে 

    বাধ্য হয়েছে ও।

    — “ও আমাকে ভালোবাসে না আপু। হ্যাঁ, আমি ওর জীবনে অবশ্যই বিশেষ কেউ। কিন্তু ভালোবাসা কিংবা সংসার ওসবের ধারে কাছেও নবনী নেই। ও এখনো সামির মাঝেই বেঁচে আছে।”

    — “সামির মাঝে নবনীর চেয়ে এখন তুমিই বেশি বেঁচে আছো। যতটা না নবনী ওকে ভাবে তার চেয়ে বেশি ভাবো তুমি। এত বেশি ভাবছো যে তুমি নবনীকে ঠিকঠাক দেখতেই পাচ্ছো না। সামিকে একপাশে রেখে তুমি শুধু নবনীকে একবার ভাবো তো। পরিবর্তন কি সত্যিই দেখতে পাও না?” 

    — “জানি না আমি।” 

    — “তুমি অবশ্যই জানো। নবনী আর সামিকে দেখতে পায় না আগের মতন। ওদের কথাও হয় না। কারণ নবনী সামিকে আর খোঁজেই না। ওর সবটা জুড়ে এখন শুধু আমি তোমাকেই খুঁজে পাই। আগে নবনীর গল্পজুড়ে সামিকে খুঁজে পেতাম। এখন ও তোমার গল্প বলে, বলতেই থাকে ক্লান্তিহীন। ওর চোখে অন্য এক আলো দেখতে পাই। রঙীন, সুন্দর, উচ্ছাসের আলো। ভালোবাসার প্রথম দিনগুলোতে এমনই হয় সবার, জানো তো সে কথা? নবনীরও তাই হচ্ছে। নবনীর পরিবর্তন তুমি দেখতে পাচ্ছো, ওর কাছে ভালোবাসার উষ্ণতা খুঁজে পাচ্ছো কিন্তু তবুও তোমার মন মানতে নারাজ নবনী সামিকে ভুলে যাচ্ছে। সমস্যাটা কোথায় জানো?” 

    — “কোথায়? 

    — “তুমি নবনীকে এখনই এই মুহূর্তে পুরোপুরি নিজের করে পেতে চাও। নবনীর মুখে আজই ভালোবাসার কথা শুনতে চাও। তোমাদের সম্পর্কের স্থায়ীত্ব চাও। অপেক্ষাটা আর হচ্ছে না তোমাকে দিয়ে।”

    — “নবনী নিজের মুখে বলেছে ও চলে যাবে। আমি থাকতে পারবো ওকে ছাড়া? আপনার হাজবেন্ড যদি বলে একমাস পরই আপনাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে আর আপনার কাছে স্ট্রং কোনো রিজন নেই এই সংসার টিকিয়ে রাখতে আবদার করার তখন আপনি কী করবেন?” 

    — “তুমি ওকে ভালোবাসো, ও তোমাকে ভালোবাসে এরচেয়ে স্ট্রং রিজন আর কী হতে পারে?” 

    — “আমি ওকে ভালোবাসি সেই কথা কি ওকে আমি জানাতে পারছি? ও আমাকে ভালোবাসে সেটা কি ও ফিল করতে পারছে? মোস্ট ইম্পর্ট্যান্টলি, ও কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসে? এটা নিছক আপনার ভুল ধারণাও হতে পারে। এবার বলুন আমার কাছে আর কোন পথটা খোলা আছে? অপেক্ষা, ধৈর্য্য কোনোটাই আমাকে দিয়ে হবে না। নবনীকে আমার চাই, ব্যস চাই।” 

    — “এত অধৈর্য হলে চলবে নাকি বোকা! সময় আছে তো হাতে। ভালোবাসা অনুভব করার জন্য এক মুহূর্তই যথেষ্ট। হতেও পারে এই ক’টাদিনে এমনকিছু ঘটে গেল। নয়তো নবনী যদি চলে যায়, ও নিজেই আবার ফিরে আসবে তোমার কাছে।” 

    — “কিভাবে? দূরে গেলে ভালোবাসা অনুভব করা যায় সেই যুক্তিতে বললেন?”

    — “বিশ্বাস করো না?” 

    — “একদম না। আপাতত কোনো যুক্তি তর্কেই আমি সহমত হতে পারছি না।”

    — “আর ক’টা দিনই তো। আমিও আছি আরো মাস দুয়েক। দেখে নিও আমার কথা সত্যি হয় নাকি।” 

    .

    মরহুম মোঃ মেহরাব হোসেন সামি 
    পিতা মোঃ মাহফুজ হোসেন 
    মাতাঃ শবনম আফরোজ 
    মৃত্যু : ২৩ এপ্রিল, ২০১৪ ইং 

    বিশাল আমগাছের নিচে সমতলে নেমে আসা একটি কবর। এপিটাফে বড় অক্ষরে লেখা মৃতের নাম পরিচয়ে এক দৃষ্টিতে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে আছে নবনী। অঝোরে কাঁদছেন শবনম। নবনীর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছেন, 

    — “সামি চলে গেছে আম্মু। ও নেই। সত্যিই ও নেই। যে মারা যায় সে কখনো ফিরে আসে না। ফিরে আসার কোনো পথ উপরওয়ালা খোলা রাখেননি। কোনো চমৎকার তোমার জীবনে হয়নি আম্মু। যা হয়েছে পুরোটাই তোমার কল্পনা, তোমার ভ্রম। একবার ছুঁয়ে দেখো ওর কবরটা! ওকে আমরা এখানে শুইয়ে দিয়েছি চিরতরে। ওর ফিরে আসা সম্ভব না। মেনে নাও ওর মৃত্যু। এভাবে আর কত? এবার তো জীবনে আগে বাড়তে হবে, সংসারী হতে হবে। বিয়ে শাদী হয়েছে তোমার। আর কত অতীত নিয়ে পড়ে থাকবে বলো? মানুষের জীবনে কত দুর্ঘটনা ঘটে, তোমার সঙ্গেও ঘটেছে। মেনে নিতে হবে তোমার। জীবনের সঙ্গে, উপরওয়ালার ফয়সালার সঙ্গে আপোষ করতে হবে। উপরওয়ালা কাউকে ঠকান না। তিনি সামিকে নিয়ে গেছেন, অমিতকে দিয়েছেন। ভীষণ লক্ষ্মী ছেলেটা। তুমিই না কত প্রশংসা করো ছেলেটার! তাহলে ওকে মেনে নিচ্ছো না কেন? খুব সুখী হবে তুমি, খুব! একটু মনটা শক্ত করো। আমার ছেলেকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো।” 

    নবনী এখনো চেয়ে আছে এপিটাফের দিকে। শবনম আন্টি কিসব বলে যাচ্ছে কখন থেকে? কেন বলছে? এমন কেন কথাগুলো? মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা করছে। বুকের ভেতর কী এক হাহাকার সমুদ্রের ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়ছে। পা কাঁপছে নবনীর। জিহ্বায় সমস্ত কথা যেন জড়িয়ে আসছে। শূণ্য চোখে শবনমের দিকে তাকালো নবনী। প্রায় তোঁতলাতে তোঁতলাতে বললো, 

    — “ও আমার ভ্রম না। ও সত্যি।

    — “মা গো, এমন কখনো হয়? মিথ্যা নিয়ে আর কতদিন বাঁচবে তুমি? বাস্তবের মুখোমুখি হতে হবে না?” 

    — “এভাবে বলছেন কেন আন্টি? এতদিন তো এসব বলতে শুনিনি। আজ হঠাৎ কেন সবকিছু মিথ্যা বলছেন?” 

    — “আমি চাই না আর মিথ্যা নিয়ে বাঁচো। বিয়ে হয়েছে, জীবনে নতুন মানুষ এসেছে। তাকে নিয়ে জীবন সাজাও। তোমার গোছানো একটা জীবন আমি দেখতে চাই।” 

    — “ও আসে আন্টি। আমি ওকে ছুঁতে পারি, ওর কন্ঠ শুনতে পারি। অনেক অনেক কথা হয় আমাদের!” 

    ছেলের কবরের পাশে বসলেন শবনম। একটানে নবনীকেও সামির পাশে বসালেন। নবনীর হাত কবরের উপর রেখে বললেন, 

    — “ছুঁয়ে দেখো কবরটা। সামিকে স্পর্শ করতে পারছো? জিজ্ঞেস করো, ও কেমন আছে? কোনো উত্তর আসে কিনা দেখো?” 

    — “আমার সামনে আসে তো ও!” 

    — “আসে না নবনী! ও চলে গেছে অন্য পৃথিবীতে। শরীরটা শুধু ছেড়ে গেছে আমাদের কাছে। ছেলের শরীরটা বাড়ির সবচাইতে সুন্দর জায়গাটাতে তোমার আংকেল মাটি দিয়েছে। আর কখনো আমাদের বাচ্চাকে চোখের দেখা দেখতে পারবো না, কথা বলতে পারবো না তবুও রয়ে গেছি এখানে। ঢাকার বাড়ি ফেলে আজ আটবছর ধরে এখানে আমরা থাকছি শুধু কবরের পাশে বসবো বলে। কবরটা যত্নে রাখবো বলে। এতটুকুই আমাদের শান্তি। এর বাইরে আমরা আর কিছু পাইনি। সামিকে কখনো একনজর দেখার সুযোগ হয়নি। ভালো কি শুধু তুমিই বেসেছো? আমরা ওকে বাসিনি? একনজর ওকে দেখবো বলে ছটফট করে শেষ হইনি? তবুও কেন দেখতে পাই না ওকে? উপরওয়ালার কি এই বুড়ো বাপ মায়ের প্রতি একটু দয়া করে চমৎকার ঘটাতে ইচ্ছে হয়নি? চমৎকার হয় না নবনী, মৃত মানুষকে নিয়ে চমৎকার হয় না। সামি মরে গেছে। তোমার সামনে ও চলে গেছে চিরতরে। শরীর যা ছিল তাও মিশে গেছে এই মাটিতে।” 

    গলা ফাটিয়ে একবার সামিকে ডাকতে চাইছে নবনী। চোখের সামনে এক্ষুনি এই মুহূর্তে দেখতে চাইছে ভীষণ ভালোবাসার প্রাক্তনকে। প্রচন্ড অভিমান নিয়ে জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি নাকি চিরতরে চলে গেছ? তুমি নাকি আমার ভ্রম? কথাটা কি সত্যি? কিন্তু কই আজ তো সে চোখের সীমানায় ধরা দিচ্ছে না! গলার স্বরও যে ফুটছে না! আটকে আছে গলার মাঝখানে, সঙ্গে নিঃশ্বাসটাও। পায়ের কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ছে পুরো শরীরজুড়ে। চোখের সামনে সবকিছু ঘোলা হতে হতে শবনমের গায়ের উপর ঢলে পড়লো নবনী। 

    .

    শক্ত করে নবনীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে রেখেছে অমিত। সুমনা একটু পরপর চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে। জ্ঞান ফিরছে না নবনীর। বারবার দেখছে সে অমিতকে। চোখে-মুখে তার প্রিয় মানুষ হারাবার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা আতংক। সুমনার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। কেন যে মায়ের সঙ্গে ওকে একা যেতে দিলো! সপ্তাহখানেক ধরে মা খুব আবোলতাবোল বলছিল। সত্যি সত্যিই অঘটন ঘটিয়ে দিবে কে জানতো! ইশ্, এখানে কেন যে আসতে বললো ওদের দু’জনকে! মায়ের উপর ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছে সুমনার। রেগে গিয়ে সে বললো, — 

    — “তুমি ওকে সামির কবরে কেন নিয়ে গেলে মা?” 

    — “আমি তো চেয়েছিলাম নবনী বাস্তবতা বুঝুক। সেজন্যই তো…” 

    — “মা আজ আটবছর হয়ে গেছে ঐ ঘটনার। এতগুলো বছরে নবনী এসেছে কখনো সামির কবরে? না আমরা কখনো নিয়ে এসেছি ওকে? তুমি জানতে না নবনী নিজ চোখে ওর কবরটা দেখলে নিজেকে সামলাতে পারবে না? কেন পরিস্থিতি বিগড়ে দিলে, বলো তো?” 

    — “আমি ওকে বুঝাতে চেয়েছিলাম সামি নেই। ওকে বুঝতে হবে তো ব্যাপারটা। আর কতদিন এভাবে? সংসারী হতে হবে না?” 

    — “মা সেজন্য ডক্টর আছে। তুমি আমি বুঝিয়ে যদি কাজ হতো তাহলে নবনী এতবছর ভুগতোই না। সামলে নিতো নিজেকে আরো বহু আগেই। সেই কবে কী বলেছি নবনীকে, তার উল্টাপাল্টা অর্থ বের করে এতগুলো বছর ধরে সামিকে নিজের কল্পনায় বাঁচিয়ে রেখে নিজে বেঁচে আছে। আজ অব্দি সেই সমস্যার সুরাহা হলো না। এরমাঝে তুমি আবার কিসব বললে! এখন তোমার কথায় কী কী করে বসবে, কে জানে!”

    — “আমি কেন যে এসব বলতে গেলাম, বুঝে পাচ্ছি না একদম।” 

    হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন শবনম। তার কান্না দেখে মায়া হলো সুমনার। নবনীকে নিয়ে মায়েরও যে দুশ্চিন্তার সীমা নেই। ভালো ভাবতে গিয়ে অজান্তেই ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেললো। অমিতের কানে শবনমের কথা, কান্না সবাটাই পৌঁছাচ্ছে। কিন্তু সেদিকে মন নেই তার। এক কানে পৌঁছে অন্য কানে বেরিয়ে যাচ্ছে। সমস্ত ধ্যান জ্ঞান আটকে আছে শুধু নবনীর চোখে। চোখ মেলছে না কেন ও? আরো কিছু সময় পর জ্ঞান ফিরলো নবনীর। চোখ মেলেই নিঃশ্বাসের কাছাকাছি সে আবিষ্কার করলো অমিতকে। দিশেহারা হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। 

    — “শরীর খুব খারাপ লাগছে নবনী? মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে তোমার?” 

    অমিতের প্রশ্ন শুনতেই দুই চোখ বেয়ে পানি ঝরলো নবনীর। মুখ ফুটে কিছু বললো না সে। নবনীর অসহায় মুখটা দেখে কান্না পাচ্ছে অমিতের। কতশত প্ৰশ্ন, কথা ওর চোখে ছুটে ছুটে বেড়াচ্ছে। অথচ মুখ ফুটে বলছে না কিছুই। সব কথারা আটকে আছে বুঝি গলার মধ্যেখানে? ঠিক আটবছর আগের মতন? নবনী কি তবে সেই মুহূর্তটায় আবার ফিরে যাচ্ছে? আবারও পরিবার আর পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলবে নিজেকে? ভয় আর সংশয়ে অমিতের হাত পা অসাড় হতে লাগলো। কী করবে, কী করবে না ভেবে অস্থির হলো অমিত। এখান থেকে বেরোতে হবে তাকে, এক্ষুনি বের হতে হবে। নবনীকে বিছানা থেকে তুলতে তুলতে অমিত সুমনাকে বললো, 

    — “আমি ওকে নিয়ে এখুনি বাসায় ফিরবো। আপনি কি আমার সঙ্গে ঢাকায় ফিরবেন প্লিজ? আমি ড্রাইভ করবো। নবনীর পাশে থাকার জন্য একজন মানুষ লাগবে।” 

    — “সিওর!” 

    — “আমি যাচ্ছি। আপনি আসুন।” 

    অমিত বেরিয়ে যাবার সময় তার হাত চেপে ধরলেন শবনম। মিনতি করে বলতে লাগলেন, 

    — “স্যরি বাবা! খুব ভুল হয়ে গেছে আমার।” 

    প্রত্যুত্তরে কিছু বলেনি অমিত। অসহায় চোখে তার দিকে একবার তাকালো শুধু। 

    .

    গাড়ির ব্যাকসিটে বসে আছে সুমনা। তার কাঁধে মাথা ফেলে চোখ বুজে আছে নবনী। ফ্রন্ট মিররে ড্রাইভ করতে করতে নবনীকে বারবার দেখছে অমিত। ভেতরটা ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে তার। কোন অনুভূতিটা এত ভাঙছে তাকে? ক্ষোভ নাকি কষ্ট? নাকি দুটোই? নবনীর সমস্তটা তার জানা আছে। ভাগ্যের নির্মমতায় কতটা সয়ে যেতে হয়েছে, হচ্ছে সেসবের প্রতি অমিতের পূর্ণ সহমর্মিতাও আছে। এই যে নবনীটা চোখের সামনে কষ্ট পাচ্ছে, সেই কষ্টে পুড়ছে সে নিজেও। এই ত্রিভুজ গল্পে সামি নামের ঐ মিষ্টি হাসির ছেলেটার কোনো দোষ নেই, নেতিবাচক ভূমিকা নেই। তবুও তার প্রতি পাহাড়সম ক্ষোভ হয় অমিতের, হিংসে হয় খুব। ঘুরেফিরে সামিকেই এই গল্পের খলনায়ক খুঁজে পায় সে। কেন এসেছিল এই ছেলেটা ওদের গল্পে? কেন এখনো দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওদের মাঝে? নাকি এই ত্রিভুজ গল্পের তৃতীয় ব্যক্তিটা সে নিজে? ওদের মাঝের দেয়ালটাও কি সে-ই? নিজেকে পাগল পাগল লাগছে অমিতের। চোখের সামনে অন্য কারো জন্য নবনীর পুড়ে ছারখার হওয়া কিংবা মাথার ভেতর কিলবিল করতে থাকা প্রশ্নগুলো সহ্যসীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে ব্রেক ছেড়ে, হাত গুটিয়ে বসে থাকতে। পড়ুক গিয়ে গাড়ি কোনো খাদে-খালে। কিংবা মুখোমুখি সংঘর্ষ হোক গাছ কিংবা ট্রাকের সঙ্গে। সমস্ত প্রশ্ন, যন্ত্রনার ইতি হোক এখানেই। নবনী বারবার তাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তোমার সঙ্গে কোনোদিন কিচ্ছু হওয়া সম্ভব না। বহু বহুবছর আগে আমি বাঁধা পড়েছি অন্য কারো সঙ্গে। অনন্তকাল নিজেকে বেঁধে রাখবো তার সঙ্গেই। তুমি আমার জীবনে একটা পরগাছা মাত্র যাকে রমিজ মির্জা জোর করে আমার সঙ্গে বেঁধেছে। সময় হলেই তোমাকে ছেটে ফেলা হবে চিরতরে। 

    .

    নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে নবনী। বাসায় ফিরেই সর্বপ্রথম রুমানাকে কল করেছে অমিত। ওষুধের নাম টেক্সট করে তক্ষুনি নবনীকে একটা খাইয়ে দিতে বললো রুমানা। দেরী করেনি অমিত, তৎক্ষনাৎ ওষুধ এনে খাইয়ে দিয়েছে ওকে। আধঘন্টা পরই নীরবে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেছে নবনী। খবর পেয়ে বাসা থেকে ছুটে এসেছে নাতাশা আর নীতু। রুমানাও এসেছে সাব্বিরকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগেই। বসার ঘরে অমিতকে ঘিরে বসেছে সবাই। পুরো ঘটনা কারোই জানা নেই। নানা প্রশ্ন জমে আছে উপস্থিত সবার নবনীকে ঘিরে। চরম বিরক্তি নিয়ে রুমানা অমিতকে বললো, 

    — “উইথআউট মাই পারমিশন, তুমি ওকে সামির কবরের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে কেমন করে অমিত? নবনীর কন্ডিশন ট্রিগারড হতে পারে তা কি একবারও তোমার মনে হয়নি?”

    — “আমি দাঁড় করিয়েছি?” 

    — “তাহলে?” 

    — “সামির মা নিয়ে গেছে ওকে। ঐ বাড়িতে সামিকে দাফন করা হয়েছে সে কথা আমি একদম জানতাম না।” 

    রুমানা কিছু বলার আগেই নীতু বলতে লাগলো, 

    — “আর কী হয়েছে সেখানে? কেউ এমন কিছু বলেছে ওকে যেটা বলা উচিত হয়নি?” 

    — “হ্যাঁ উনিই বলেছেন। সামি মরে গেছে আর ফিরবে না, এসব তোমার ভ্রম, বাস্তবে ফিরে এসো, সংসারে মন দাও। এসবই বলেছেন ওকে।”

    — “উফ শবনম আপা! ছেলে মারা গেছে পর থেকে বোধবুদ্ধি লোপই পাচ্ছে 

    দিনদিন। আমাকে বারবার বলছিল নবনীকে আমি বুঝাবো স্বামী সংসার মেনে নিতে। আমিও বারবার উনাকে বুঝিয়ে বলেছি এভাবে হবে না আপা, সময় সুযোগ বুঝে আস্তে আস্তে অমিতই ওকে সংসারে ফেরাবে। ওর ট্রিটমেন্ট চলছে, ধীরে ধীরে সব ঠিক হবে। তবুও উনি পাগলামি করলোই! ধুর ছাই। খুব ভুল হয়েছে, নবনীকে আমার যেতে দেয়াই উচিত হয়নি।” 

    — “আমি তোমাকে তখনই বারণ করেছিলাম ভাইয়া। বলেছিলাম যেও না ওখানে। খুব একটা পজিটিভ ভাইভ পাইনি আমি। এখন দেখো তো, সত্যি সত্যি একটা ঝামেলা বাঁধিয়ে ফিরে এলে।” 

    অনির সঙ্গে তাল মেলালো সাব্বির। 

    — “হ্যাঁ ঠিকই তো! কেন নিয়ে গেলি ওকে সেখানে?” 

    — “নবনী বললো যাবে, সামির মা ওকে খুব দেখতে চাইছেন। ভাবলাম ছুটির দিন আছে, এক বাহানায় দু’জনের বেরিয়ে আসা হবে। কখনো কোনোকিছুতে নবনীকে বারণ করেছি আমি?” 

    সামনের সময়গুলো কেমন হবে সে কথা ভেবে স্থির হতে পারছে না নাতাশা। 

    একবার উঠে দাঁড়াচ্ছে তো আরেকবার বসছে। অমিতকে সে বললো,

    — “বাবা ভীষণ ভয় পাচ্ছে ভাইয়া। আপু আগের মতন না আবার হয়ে যায়!” 

    ডানে বামে মাথা নাড়লো রুমানা। নাতাশাকে আশ্বাস দিলো, 

    — “এতটাও সিরিয়াস হবে না। তবে সমস্যা একটু হবেই। সামিকে নিয়ে আজকাল ওর ভাবনা কমে যাচ্ছিল। দেখা, কথা বলা এসবও অনেকটা কমে এসেছে। হতে পারে আজকের পর সেই সমস্যা আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। আবার নাও হতে পারে। লেটস সি! অবস্থা বুঝে তখন একটা ব্যবস্থা আমাদের নিতে হবে।” ভয়ে মুখ শুকিয়ে আসছে অমিতের। নবনী ঘুম থেকে জাগার পর সময়গুলো কেমন হবে? খুব কঠিন? নাগালের বাইরে? নবনী হাসবে তো? মন খুলে কথা বলবে তো? তাকে হাসিমুখে মেনে নিবে? এতদিন সম্পর্কটা যেভাবে যাচ্ছিলো সেভাবেই যাবে? অমিতের পাশে এসে বসলো সাব্বির। পিঠ চাপড়ে বললো, 

    — “এত ভয় পাচ্ছিস কেন?” 

    — “পাবো না? এটা নবনী! অন্য কেউ না। ও বদলে গেলে আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে।” 

    — “এখনই নেগেটিভ কিছু ভাবিস না। আগে দেখ না কী হয়!” 

    — “কাজের লোকের চেঁচামেচি শুনে আমি আর সুমনা আপু দৌড়ে বের হলাম। দেখি, ও আন্টির গায়ের উপর পড়ে আছে। তখনও সেন্স ছিল ওর। পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। বিড়বিড় করে কী বলছিল কিছুই বুঝিনি। ওকে কোলে নিয়ে ঘরে ফিরছিলাম। মেয়েটা কাঁপতে কাঁপতে আমারই চোখের সামনে সেন্সলেস হয়ে গেল। আমার ওয়াইফ! নবনী আমার ওয়াইফ! ও ওর পাস্ট থেকে বেরোতে পারছে না, দ্যাটস ওকে। আছি আমি। ওকে দেখবো, সামলে নিবো। পাস্ট থেকে বেরিয়ে আসতে যতটা হেল্প ওর দরকার আমি করতে রাজি আছি। বাট নবনী আমার জীবনে থাকবে কি না, আদৌ কখনো আমি ওর ভালোবাসা পাবো কি না এই অনিশ্চয়তা আমি আর নিতে পারছি না। নবনীকে আজ দেখে মনে হচ্ছিল ও মারা যাচ্ছে। এই মরণ আমার জন্য না। অন্য কারো জন্য। আমি মানতে পারছি না। আর কিছুদিন বাদে নবনী আমার বউ হয়ে থাকবে কি না তাও আমি জানি না। নবনী এই প্রসঙ্গ যেদিন উঠালো সেদিনের পর থেকে আমার ঘুম উড়ে গেছে। ঘুমাতে পারছি না আমি। আজেবাজে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে যায় বারবার। এক জায়গায় স্থির হতে পারছি না। কাজে মন বসাতে পারছি না। আমি জানি ও আমাকে ভালোবাসে না। ও এখনো সামিকেই ভালোবাসে। আমি শুধু জানতাম, কখনো চোখে দেখিনি। আজ দেখেছি নবনী ঐ ছেলেটাকে কতটা ভালোবাসে। কতটা মরে ওর জন্য। এই ছেলেটার প্রতি আমার কোনো একসময় সিম্প্যাথি ছিল। ওকে ভেবে খুব মন খারাপ হতো আমার। কিন্তু আজ নিজের চোখে দেখার পর সামিকে আমি আর সহজভাবে নিতে পারছি না। ও আমার সহ্যসীমার বাইরে চলে গেছে। এ্যান্ড আই হেইট হিম! সম্ভব হলে এক্ষুনি এই মুহূর্তে আমার ওয়াইফ ওর কাছ থেকে আমি ছিনিয়ে নিতাম।” 

    সাব্বির আর রুমানা একে অপরের দিকে চেয়ে রইলো এক মুহূর্ত। নবনীকে সামলাতে গিয়ে অমিত নিজেই কি অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে? 

    অমিতের পাশে এসে বসলো রুমানা। — “অমিত! আমি বলেছিলাম ধৈর্য্য রাখতে হবে। সামি নেই। একজন মৃত মানুষকে 

    তুমি কিভাবে ঘৃণা করতে পারো! আর ছিনিয়ে আনার প্রসঙ্গই বা কেন আসছে?”

    — “ও নেই এই কথাটা আমি আর বিশ্বাস করতে পারছি না রুমানা। আই ক্যান ফিল হিজ এক্সজিসটেন্স বিটউইন আস। আমার তো মনে হয় যখন তখন ওকে আমি আমার চোখের সামনে দেখতেও পাবো যেমনটা নবনী দেখে।” 

    — “কাম ডাউন। নবনী তোমারই আছে। সময়ের ব্যবধানে পুরো গল্পটা তোমার সাইডে চলে আসবে। ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে একটু সময় কি তুমি দিবে না?” 

    — “দিবো। অবশ্যই দিবো। আজীবন সময় দিবো। কিন্তু নবনীকে আমি আমার পাশে চাই। কোনো একদিন ও আমাকে ভালোবাসবে সেই নিশ্চয়তা চাই। যেই মুহূর্তে নবনী আমার এই ফ্ল্যাটের দরজা পেরিয়ে বেরিয়ে যাবে সেই মুহূর্তে আমিও আর থাকবো না রুমানা। 

    — “কোথায় যাবে তুমি?” 

    — “আই ডোন্ট নো।”

    — “এই মুহূর্তে নবনীর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তোমাকে। অথচ তুমিই কিসব ভাবছো, বলছো! নিজেকে সামলে না রাখলে অন্যকে সামলাবে কেমন করে?”

    — “তোকে এভাবে দেখতে একদম ভালো লাগছে না আমার। তোকে ভরসাও করতে পারছি না। কখন কী করে বসবি, কে জানে!” 

    — “বললাম তো, নবনী যতক্ষণ আছে ততক্ষণ আমিও আছি। নবনী নেই তো আমিও নেই।” 

    — “দেখো অমিত, একদম পাগলামি করবে না বলছি। পরিস্থিতি বোঝো। নাজুক সময় যাচ্ছে। এই মুহূর্তে নবনীকে তোমারই দেখে রাখতে হবে। আপাতত তুমিই ওর মেডিসিন। ওর সমস্ত ক্ষত সারিয়ে তুলবার দায়ও কিন্তু তোমারই। আমি আমার পেশেন্ট তোমার দায়িত্বে রেখে যাচ্ছি। নবনী ঘুম থেকে জাগার পর এক মুহূর্তও তুমি ওকে একা ছাড়বে না। ও কথা বলতে চাইবে না কিন্তু তুমি বলবে। ও মুখ ফুটে কিছু বলার আগ পর্যন্ত তুমি একাই কথা বলবে। যা মাথায় আসে তাই বলবে এবং অবশ্যই ভালো কিছু। ও যদি কাঁদে তো কাঁদবে। ওকে থামাবার প্রয়োজন নেই, কাঁদতে দিও যতক্ষণ খুশি। ওকে জড়িয়ে ধরে রেখো। ওকে অনুভব করাতে হবে তুমি আছো ওর পাশে। ইউ হ্যাভ এমপ্যাথি ফর হার।” 

    রুমানা অনর্গল বলে চলছে। নীতু মাথা নিচু করে বসে আছে সোফায়। রুমানার কথা, অমিতের পাগলামি সবটাই মন দিয়ে শুনছেন তিনি। চোখ বেয়ে নীরবে পানি গড়িয়ে পড়ছে তার। মনে ভীষণ কু ডাকছে। অমিতের মতন তারও ভীষণ ভয় হচ্ছে। তার মেয়েটা কি এতবছর পরও একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে না? নিজেকে উজাড় করে ভালোবাসার পরও কি নবনীকে সারাজীবন নিজের সঙ্গে বেঁধে রাখতে পারবে না? কী হবে এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ? কী আছে এই ছেলেটার ভাগ্যে? 

    ৫২

    — “আমি আর তোর বাবা ব্যাগ গুছিয়ে আবার সিদ্ধান্ত বদলালাম। তোর কল পেয়ে ভয় পেয়েছিলাম খুব। তাড়াহুড়ো করে কী করবো না করবো ভাবতে ভাবতে ব্যাগ গুছানোর পর মনে হলো আমাদের এই মুহূর্তে যাওয়া উচিত হবে না।”

    — “কেন?”

    — “বাসা ভর্তি এত মানুষের কাজ নেই। নবনীর এই সময়টাতে শুধু তুই থাক। ওর দরকারও শুধু তোকেই। একান্তে এই সময়টা কাটা। বাসায় শুধু অনি আর নাতাশা থাকুক। রান্নাবান্নার একটা ব্যাপার আছে। মাঝেসাঝে ওরাও একটুখানি নবনীর সঙ্গে বসলো, কথা বললো। কিন্তু এর বেশি কেউ না। আমি ভাবিকেও কল করে বলেছি আপাতত বাসায় যেন কেউ না যায়। অফিসে কল করেছিলি বাবু? ছুটি নিয়েছিস কয়েকদিন?” 

    — “আম্মু! আমার ভয় লাগছে। মিনিমাম কনফিডেন্স পাচ্ছি না।” 

    — “বাবু গলা কাঁপছে তোর। কাঁদছিস, তাই না?” 

    — “তুমি এলে ভালো হতো না? একা কিভাবে সামলাবো আমি?” 

    — “ওখানে আমাদের প্রয়োজন নেই আপাতত। বরং কাবাব মে হাড্ডির মতন দেখাবে আমাদের। শোন বাবু, আমাদের মন যখন ভেঙে যায়, অথৈ সাগরে ভাঙা মন নিয়ে আমরা ভাসতে থাকি তখন মনে মনে আমরা হন্যে হয়ে একজন মানুষ খুঁজি। যে আমাদের শুনবে, মন খারাপের সঙ্গী হবে। আমাদের হাত ধরে বলবে, আছি তো আমি তোমার পাশে। এই মানুষগুলোর প্রতি আমাদের আলাদা মায়া কাজ করে, তাকে জন্ম জন্মান্তর নিজের সঙ্গে বেঁধে রাখতে ইচ্ছে হয়। সেই মানুষটা যে কেউ হতে পারে- মা, বাবা, কাজিন, বন্ধু কিংবা অপরিচিত কেউ। আমরা চাই না এই মানুষটা কখনো আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যাক। তার সঙ্গে অজান্তেই আমাদের সম্পর্ক গাঢ় হতে থাকে, সম্পর্কের গভীরতা বাড়তে থাকে। নিজেকেই দেখ না বাবু! নবনীকে কেমন এড়িয়ে চলতিস, মনে হতো যেন ও কোনো ছোঁয়াচে রোগ। কাছে গেলেই তোর সর্বনাশ হয়ে যাবে। তারপর নবনী তোর খারাপ সময়টাতে পাশে দাঁড়ালে, তোর সঙ্গে সঙ্গে থাকলো। এক মুহূর্তের জন্যও তোকে মনে হতে দেয়নি তুই একা। এখন কী হলো, দেখতো! নবনীকে ছাড়া তুই আর কিছু ভাবতেই পারিস না। এখন নবনীরও খারাপ সময় যাচ্ছে, সামিকে হারাবার পুরোনো সেই সময়টা আবার ওর সামনে এসেছে। তখন তুই ওর পাশে ছিলি না। এখন তো আছিস। দেখ না চেষ্টা করে নবনীকে শান্ত করতে পারিস কি না। ওর ভাঙা মনটা জোড়া লাগাতে পারিস কি না। ওর মনের মানুষের অভাব একটু হলেও মেটাতে পারিস কি না। আমি কিন্তু জানি অমিত, তুই পারবি। একমাত্র তুই-ই পারবি। তোর কেন যে মনে হচ্ছে নবনী চলে যাবে! সময় আছে তো হাতে আরো কিছুদিন। 

    — “না আম্মু। সময় নেই। ও ঘুম থেকে জেগেই চলে যেতে চাইবে।” 

    — “কচু চাইবে! কথা শোন তো আম্মুর। কিচ্ছু হবে না বললাম তো। তুই শুধু ওকে ছেড়ে কোথাও যাবি না। নবনীর রুমেই থাক কয়েকদিন। নয়তো নবনীকে তোর ঘরে নিয়ে যা। রাতে ওর কাছেই থাকিস।” 

    — “রাতে একসঙ্গে থাকবো?” 

    — “হ্যাঁ। কিছু…” 

    শামীমা কথা শেষ করবার আগেই নবনীর ঘর থেকে শব্দ এল। হাউমাউ করে কাঁদছে নবনী। ফোন ডাইনিং টেবিলে রেখে অমিত ছুটলো নবনীর ঘরে। রান্নাঘরে রাতের রান্না সেরে নিচ্ছিলো নাতাশা আর অনি, কান্নার শব্দে অমিতের পেছন পেছন ছুটলো ওরা দু’জনও। ফ্লোরে গুটিসুটি মেরে বসে আছে নবনী। উসকো খুশকো চুলগুলো নিজের মুঠোবন্দি করে টানছে আর চিৎকার করে কাঁদছে। পরনে তার সামির নীল ঢিলাঢালা শার্ট। পায়ের কাছে পড়ে আছে সামির রক্তমাখা সাদা শার্টটা। নবনীকে এভাবে কাঁদতে দেখে বুক ভেঙে আসে অমিতের। মুখে ওড়না চেপে ডুকরে কেঁদে উঠলো নাতাশা। অমিত নবনীর পাশে বসে তার গালে হাত রেখে মৃদু স্বরে ডাকলো, “নবনী?” 

    অমিতকে সামনে পেতেই যেন একটুখানি আশ্রয় খুঁজে পেলো নবনী। অমিতের হাতের মাঝে মুখ গুঁজলো সে। নবনীকে কাছে টেনে শক্ত করে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো অমিত। দু’চোখে পানি ছলছল করছে তার। নাতাশাকে নিয়ে বেরিয়ে এল অনি। যাবার আগে দরজা টেনে গেল। দুজনের এই মুহূর্তটা কাটুক একান্তে। নবনী তার চোখের সীমানায় শুধু অমিতকেই খুঁজে পাক। 

    নবনীর চোখের পানিতে অমিতের ঘাড়ের ডানপাশ, কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। নবনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো অমিত। আদুরে স্বরে বললো, 

    — “খুব কষ্ট হচ্ছে?” 

    — “ও আসছে না কেন?” 

    — “কে?” 

    — “সামি।” 

    — “এই মুহূর্তে ওকে চাই তোমার?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    দীর্ঘশ্বাস ফেললো অমিত। নবনীর হাত ধরে খাটে বসালো সে। নবনীর পিছনে বালিশ রেখে বললো,

    — “এখানে হেলান দাও। অমিতের কথায় নড়লো না নবনী। ঠায় বসে রইলো আসন পেতে। নবনীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিলো অমিত। কিছু বলছে না সে। নবনীর মুখ ফুটে কিছু 

    বলার অপেক্ষায় আছে। 

    — “এমন কখনো হয়নি অমিত। ও সবসময় আমার আশপাশেই থাকতো। ওকে যখনই দেখতে ইচ্ছে হতো আমি ওকে আমার পাশেই পেতাম। অথচ আজ ও নেই। এত করে চাইছি ও আসুক অথচ ও আমার সামনে আসছেই না। সবাই বলে সামি আমার ভ্রম। সত্যিই কি ও আমার ভ্রম? কোনো মিরাকেল কি হয়নি আমার জীবনে? আমাদের সম্পর্কে?” 

    বলতে বলতে আবারও হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো নবনী। নবনীর মাথাটা টেনে নিজের কাঁধে রাখলো অমিত। ওর এলোমেলো চুলগুলো আঙুল চালিয়ে গুছিয়ে দিতে দিতে অমিত বললো, 

    — “তুমি আমার কাছে উত্তর চাইছো? নাকি এই উত্তরটা সামির কাছে জানতে চাও?” 

    — “তুমি বলো।”

    — “খুব দ্বিধায় ফেলে দিলে যে!”

    — “আমি উত্তর চাই অমিত।”

    — “আগে একটা কথা বলো তো নবনী, তুমি আমাকে বিশ্বাস করো?” 

    — “করি।”

    — “কতটা?” 

    — “যতটা বিশ্বাস করার ক্ষমতা আমার আছে তার সম্পূর্ণটা দিয়েই তোমাকে বিশ্বাস করি।” 

    — “তোমার জন্য যেটা বেস্ট সেটাই আমি করবো, তা মানো?” 

    — “হুম।” 

    — “আমি যা উত্তর দিবো সেটাই তুমি মেনে নিবে?” 

    — নিবো।” 

    — “তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে আমি কখনো দেখিনি নবনী। তুমি যখন ওর সঙ্গে গল্প করো, হাসো আমি প্রায়ই আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখি তোমাকে। তোমার ভালোবাসার মানুষটাকে একনজর দেখবো বলে হন্যে হয়ে খুঁজি। তাকে বলবো বলে অনেক কথা জমে আছে আমার। কথাগুলো বলার জন্য তাকে খুঁজি। আজ পর্যন্ত তাকে আমি দেখতে পাইনি। শুধু আমি কেন? এই ছেলেটা চলে যাবার পর ওকে আর কেউ কখনো দেখেনি। মানুষ মরে গেলে আর কখনো ফেরে না। 

    পৃথিবীর চিরন্তন সত্য এটাই আমরা জানি। তুমি সামিকে দেখার জন্য যতটা মরো ঠিক ততটা ওর পরিবারও মরে, আমিও মরছি। অথচ আমরা কেউই ওকে দেখতে পাই না। তাই এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে এটাই সত্যি, যে মরে যায় সে একেবারেই যায়। আর কখনো ফেরে না। কিন্তু তোমার বেলায় সত্যিটা বদলে গেল। শুনেছি ভালোবাসায় নাকি সব সম্ভব। ঠিক কী কী যে সম্ভব সে কথা কখনো জানা হয়নি। হয়তো মৃত ব্যক্তির ফিরে আসাও সম্ভব! আমার কাছে সামি শুধুই ভ্রম, আর তোমার কাছে সে সত্যি।’ 

    — “একটা সহজ উত্তর দাও।”

    — “তোমার প্রশ্নটাই জটিল ছিল। উত্তর সহজ হবে কেমন করে?” 

    — “সবকিছু কঠিন লাগছে অমিত। মিথ্যে কেমন করে হবে? সামি মিথ্যে কেমন করে হবে? আন্টি খুব জোর গলায় বলছিল সামি আমার ভ্রম। আমি অসুস্থ। আমি কি সত্যিই অসুস্থ? সামি কেন আসছে না অমিত?” 

    — “সামির ঠিকানা আমার জানা নেই। জানলে ঠিক ওকে ধরে নিয়ে আসতাম তোমার সামনে। 

    — “আজ ষোলোটা বছর ও আমার ছায়া হয়ে আছে। আমার হাসি কান্না, দ্বিধা, ভালোমন্দ সবকিছুতে এই মানুষটাকে আমি আমার পাশে পেয়েছি অমিত। ওর অ্যাক্সিডেন্টের পর আমিও শেষ হয়ে গেছিলাম। আমি তো দেখেছি ওকে। আমারই সামনে কেমন ছটফট করতে করতে ছেলেটা চলে গেল। ওর মায়া মুখটা রক্তে লাল হয়ে ছিল। আমার সবচেয়ে প্রিয় মুখের অমন কুৎসিত রূপ আমি দেখতে চাইনি কোনোদিন, তবুও আমাকে দেখতে হয়েছে। ওর সেই মুখটাই যেন আমার চোখের সামনে বিঁধে রইলো রাত দিন ২৪ ঘন্টা। হাজার চেষ্টায়ও ওর মায়ামুখটা আমি স্মরণ করতে পারিনি। সামি আমাকে ছেড়ে চলে গেছে! আমাকে! সম্ভব এটা? এত ভালোবেসেছে যে, আগলে আগলে রেখেছে যে তাকে ছাড়া আমি বেঁচে থাকি কী করে? যার সঙ্গে কথা বলে আমার সকাল হয়েছে, যার সঙ্গে কথা না বলে আমি কখনো ঘুমাইনি তার সঙ্গে কথা না বলে কাটাতে হয়েছে আমাকে পুরো দশ মাস! ওর মতন আর কাউকে তো এত ভালোবাসিনি আমি। আমার এত ভালোবাসার মানুষটা কিনা মরে গেল! এই যন্ত্রণার কোনো ব্যাখ্যা হয়? মুখ ফুটে কাউকে বলা যায়? বুঝানো যায়? আমাদের পথচলা শেষ। আমাদের সম্পর্কটা পূর্ণতা পায়নি। এত এত ভালো স্মৃতি আমাদের! একটা খারাপ স্মৃতিও আমাদের নেই। সব ভালোর শেষটা কিনা এত কুৎসিতভাবে শেষ হলো? আমার সামির রক্তে ভেজা মুখ! আমার সবকিছু তো সেদিনই ওর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল। ও মরে গেল আর আমাকে করে গেল প্রাণহীন। আমার এত এত গল্প আমি বলবো কাকে? আমার খুশির দিনে কিংবা মন খারাপের দিনে আমি জড়িয়ে ধরবো কাকে? ঝগড়া করবো কার সঙ্গে? অভিমানে গাল ফুলাবো কার সঙ্গে? আমার মানুষটা যে আর নেই! নিজের নিঃশ্বাস নিজের কাছেই ভীষণ বোঝা মনে হতে থাকলো। এই এক নিঃশ্বাসের দায়েই তো বেঁচে আছি এই পৃথিবীতে, সামিকে ছাড়া, এক সমুদ্র ভালোবাসা ছাড়া। কাউকে আমি আমার কষ্টগুলো বলতে পারিনি তখন। আমার কষ্ট শোনার মানুষ যে ঐ একজনই ছিল- আমার কাছের মানুষ, আমার সামি। আচ্ছা অমিত, তুমি কি আমার কষ্ট বুঝতে পারছো?” , 

    — “কেন পারবো না নবনী? তোমাকে আমি আমার নিজের অংশ ভাবি। ভিন্ন কেউ তো তুমি না!” 

    — “এই কথাগুলো আমি সামিকেও কখনো বলিনি। বলছি শুধু তোমাকে।” 

    — “কেন বলোনি ওকে? যার অভাবে তুমি মরছিলে তাকে একটাবার জানানো দরকার ছিল না, বলো?”

    — “পুরো দশমাস পর ও আমার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল সেদিন, ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে আলো হয়ে। কাঁদছিলাম আমি। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে মিষ্টি করে ডাকলো আমাকে, রোদ্দুর তুমি কাঁদছো? ও এসেছিল অমিত। আমার জন্য এসেছিল। যা কোনোদিন সম্ভব ছিল না তাই ই সম্ভব হয়েছিল সেদিন। এত খুশি আমি কোথায় রাখতাম বলো? আমার মানুষটা আমার কাছে ফিরে এসেছে। আমার বিশ্বাস মিথ্যে হয়নি। ওকে ফিরে আসতেই হতো।” 

    — “তোমার কষ্টের গল্প ওকে বলোনি কেন নবনী?”

    — “ও শুনতে চাইতো না। বলতো, এসেছি তো আমি। বাজে স্মৃতি আর মনে করো না তো। যেই মানুষটা এত এত বছর আমার ছায়া হয়ে আছে সে কেন আজ এল না অমিত? আমার যে ওকে ভীষণ প্রয়োজন! তুমি জানো, ওর সঙ্গে সম্পর্ক হবার পর…” 

    মোবাইল আড়াল করে রুমানাকে নবনীর বর্তমান অবস্থা জানিয়ে টেক্সট করলো অমিত। সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে রিপ্লাই এল, ‘গুড সাইন। ওকে বলতে দাও। যে কথাগুলো এতবছর চেপে রেখেছিল সেগুলো শেয়ার করছে, তার মানে ও তোমাকে এমন একজন ভাবে, যার কাছে নিজেকে জমা রাখতে পারছে নির্দ্বিধায়। নবনী আজ শুধু তোমাকে ওর গল্প শোনাচ্ছে না, নবনীর নিজের সবচেয়ে গোপন অংশ জমা রাখছে তোমার রাখছে যার অর্থ নবনী নিজেকেই তুলে দিচ্ছে তোমার হাতে। তুমি বুঝতো পারছো ব্যাপারটা? শি ফাইন্ডস হার পিস ইন ইউ। ও চাইছে তুমি ওকে সামলে নাও। হৃদয় নিঙড়ানো উষ্ণতা আজ ওকে দেবার সময় হয়েছে অমিত। বি হার হোম, বি হার পিস।’ 

    .

    নবনীকে আরো একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো অমিত। হাত বাড়িয়ে ড্রেসিংটেবিলের উপর থেকে টিস্যুবক্স নিয়ে নবনীর চোখ-নাক মুছে দিচ্ছে সে। 

    — “ও তো আমার ভ্রম না, তাই না অমিত?” 

    — “তোমার কী মনে হয়?” 

    — “বুঝতে পারছি না। ও আসছে না কেন? আমার এখন একটু আধটু মনে পড়ছে। ও বেশ কিছুদিন যাবৎ আসছে না। ও আসেনি কেন? আমারই বা চোখে পড়েনি কেন ব্যাপারটা? এতগুলো বছরে এমনটা তো হয়নি!” 

    — “যদি জানতে পারো ও সত্যিই ভ্রম, তখন?” 

    অমিতের কাঁধ থেকে মাথা তুললো নবনী। অসহায় চোখে অসীম দ্বিধা নিয়ে তাকিয়ে রইলো অমিতের চোখে। নবনীর মাথাটা চেপে আবার নিজের কাঁধে রাখলো অমিত। নবনীর ঐ চোখে চোখ রাখার সাধ্য তার নেই। চোখ ভিজে আসছে তার বারবার। মনে মনে উপরওয়ালার সঙ্গে চলছে তার নীরব কথোপকথন। নবনী বেঁচে ছিল, এতকিছু সয়ে গিয়েও ও বেঁচে ছিল। আমি পারবো না। নবনী আর আমার সেপারেশন আমি ভাবতেও পারি না। যদি কখনো আলাদা হতেই হয় সেটা যেন শুধু আমার মৃত্যুতেই হয়। আমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত ওকে আমি চাই। 

    ৫৩

    জানালায় পাখির কিচিরমিচিরে ঘুম ভাঙলো নবনীর। ঘরে বাতি নেভানো। সূর্য সবে জাগতে লেগেছে। স্নিগ্ধ আলো বিলিয়ে দিচ্ছে প্রকৃতির মাঝে। তারই একটুখানি রেশ এসে পৌঁছে গেছে এই ঘরে, জানালা গলে। আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নবনী অমিতের মুখটা। বেঘোরে ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। তারই দু বাহুতে বন্দী হয়ে, বুকে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে ছিল সে! আঁতকে উঠলো নবনী। দ্রুত সরে এল অমিতের কাছ থেকে। কাছাকাছি আসতে আসতে এতখানি বাড়াবাড়ি! শেষমেশ কিনা একই বিছানায় ওর বুকে মুখ গুজে…! এতবড় ভুলটা হলো কেমন করে? চোখটাই বা বুজে এল কখন? চূড়ান্ত অপরাধবোধে ভুগতে ভুগতে হঠাৎ যেন সমস্ত হিসেব মিলতে লাগলো। আজকাল অমিতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা কি একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে না? বন্ধুত্বের গন্ডি পেরিয়ে তাদের সম্পর্কটা কি আরেকটু গভীরতা দাবি করছে না? দু’জনের প্রতি দুজনের অধিকারবোধ বাড়ছে। যত্ন বাড়ছে। গভীর রাত পর্যন্ত একে অন্যের সঙ্গে গল্প করে সময় কেটে যাচ্ছে। ভাবনায় অমিতের অবাধ বিচরণ চলছে। এসব কি শুধুই বন্ধুত্ব? না তো! অজান্তেই সীমা ছাড়িয়ে গেছে বোধহয়। যে সম্পর্কে নিজেদের কখনো ওরা বাঁধতে চায়নি সেই সম্পর্কেই বোধহয় বাঁধা পড়ে যাচ্ছে। সামি না আসার কারণ কি তবে এই? হ্যাঁ এটাই তো! অমিতকে নিয়ে এতবেশি ব্যস্ত থাকছে যে সামির অনুপস্থিতি কিনা চোখেই পড়লো না তার! এত বড় অন্যায় কী করে সম্ভব! তক্ষুনি মন ছুটে গেল নবনীর। এই ঘর থেকে, অমিতের কাছ থেকে। 

    .

    নিঃশব্দে পা ফেলে অমিতের বাসা ছেড়ে বেরিয়ে এল নবনী। পিচঢালা পথে খালি পায়ে হাঁটছে ও। রাস্তায় তখনো মানুষের চলাচল শুরু হয়নি। মুক্ত শীতল বাতাস গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাথার উপর মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়ছে। এসব কিছুই নবনীকে স্পর্শ করতে পারছে না। সে শুধু হেঁটে চলছে উদ্ভ্রান্তের মতন। মাথার ভেতর কিলবিল করছে তীব্র অপরাধবোধের লার্ভা। অমিতকে এত কেন ভাবছে সে? কেন এত এত কথা বলতে ইচ্ছে হয় ওর সঙ্গে? কেন একবেলা কথা না হলেই মনে হয় যেন কতদিন কথা হয়নি? কেন এত মায়া হয় এই ছেলেটার জন্য? কেন গতকাল আশ্রয় খুঁজতে গিয়েছিল তার কাছে? আশ্রয় তো সামির কাছেই খুঁজে বেরিয়েছে এতগুলো বছর। তবে কেন গতকাল আশ্রয়ের জায়গাটুকু বদলে গেল?  

    সকালের চা বানাচ্ছেন নীতু। এত সকালে কলিংবেলের শব্দ পেয়ে একটুখানি চমকে উঠলেন তিনি। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা খুলতেই যেন মনে হলো তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। 

    ফোনকলে ঘুম ভাঙলো নাতাশার। পিটপিট চোখে স্ক্রিনে দেখতে পেলো মায়ের কল। রিসিভ করে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে মা বলতে লাগলো,

    -– “কোথায় তোরা? নবনী এই সকালে একা বেরোলো কী করে বাসা থেকে?”

    মুহূর্তেই চোখ থেকে ঘুম উড়ে গেলো নাতাশার। শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠলো সে। 

    — “আপু বেরিয়ে গেছে মানে? কখন? কোথায় গেছে?” 

    — যায়নি কোথাও। বাসায় এসেছে একটু আগে। কিন্তু ও একা বেরিয়ে এল, খেয়াল রাখবি না একটু! অমিত কোথায়?” 

    — “তুমি রাখো। দেখছি আমি।” 

    নাতাশার শব্দ পেয়ে ততক্ষণে ঘুম ভেঙে গেছে অনিরও। কল কাটার আগেই অনি চলে গেছে নবনীর ঘরে। পেছন পেছন গেছে নাতাশাও। 

    — “ভাইয়া, এ্যাই ভাইয়া?” 

    অনির ডাকে ঘুম ভাঙলো অমিতের। চোখ মেলেই খুঁজতে লাগলো নবনীকে। 

    অমিত কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই অনি বললো,

    — “আপু বেরিয়ে গেছে বাসা থেকে।” 

    — “মানে কী?” 

    — “হ্যাঁ। একাই চলে গেছে ও। আম্মু কল করে জানালো আমাকে।” 

    — “কখন?” 

    — “কিছুক্ষণ আগে।” 

    — “ও বেরিয়েছে কখন?” 

    — “জানি না! আম্মু বললো একটু আগেই নাকি গেছে।” 

    — “তুমি ঘুমিয়েছো কখন?” 

    — “শেষরাতে। চারটায় খুব সম্ভবত। নবনী কাঁদতে কাঁদতে সাড়ে তিনটায় ঘুমিয়ে পড়লো। তারপর আমারও ঘুম লাগছিল, তাই চোখ বন্ধ করেছিলাম। 

    — “কী বিপদ হতো জানো, যদি ও অন্য কোথাও চলে যেত? কোথায় খুঁজতাম 

    ওকে? পাশেই তো শুয়ে ছিলে। ও ঘর থেকে বেরিয়ে গেল অথচ তুমি টেরই পেলে না ভাইয়া!” 

    — “অদ্ভুত কথা বলছো অনি! ভাইয়া ঘুমিয়ে ছিল। টের পাবে কেমন করে?” মাথা কাজ করছে না অমিতের। অনি কিংবা নাতাশা কারো কথার বিপরীতে আর কিছু না বলে সে চলে গেল ফ্রেশ হতে। নবনীর কাছে যেতে হবে তাকে। হয় নবনীকে নিয়ে আসবে নয়তো সে থেকে যাবে নবনীর কাছে ওখানেই। এক মুহূর্তও চোখের আড়াল হতে দিবে না তাকে। 

    .

    অমিত এসেছে, নবনী দেখেও না দেখার ভান করে মুখ গুঁজে রইলো নানীর কোলে। ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও। অমিতকে জামিলা বেগম শুকনো হেসে জিজ্ঞেস করলেন, 

    — “ভালো আছো ভাই?” 

    — “জি।” 

    চোখের ইশারায় নবনীর পাশে এসে অমিতকে বসতে বললেন তিনি। নিজের কোল থেকে খুব ধীরে নবনীর মাথাটা নামিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিতে দিতে বললেন, 

    — “আমার নাস্তার সময় হইয়া আসতাছে, গ্যাসের ওষুধটা খাইতে হইবো। তোমরা কথা কও।” 

    ওষুধের বাহানায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন জামিলা। যাবার আগে দরজা চাপিয়ে, পর্দাগুলো ভালোভাবে টেনে রেখে গেলেন। নবনীর পাশে এসে বসলো অমিত। ওর মাথায় হাত রাখতেই দূরে সরে গেল নবনী। অমিত চেয়ে রইলো নবনীর দিকে। চোখে মুখে ওর এত সংকোচ কেন? ফিরিয়ে দেয়া সত্ত্বেও নবনীর আরো কাছে এল অমিত। মাথার উপর আরো গাঢ় স্পর্শে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো, 

    — “ওভাবে না বলে চলে এলে কেন নবনী?”

    বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো নবনী। অমিতের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না ও। অস্বস্তি হচ্ছে ভীষণ। মাথা নিচু করে বললো, 

    — “আমাদের সম্পর্কটা কী, অমিত?” 

    — “হঠাৎ এমন প্রশ্ন!” 

    — “বলো না?” 

    — “আমরা খুব ভালো বন্ধু।” 

    — “তোমার কাছে কি মনে হচ্ছে না আমরা আমাদের সম্পর্কে অনেক বেশি এগিয়ে গেছি? লিমিট ক্রস করছি?” 

    — “লিমিট ক্রস! কেমন?” 

    — “আমি এত কথায় যেতে চাচ্ছি না অমিত। যতটুকু ভুল হয়েছে অজান্তেই হয়ে গেছে। কথা ছিল ছয়মাস সংসারের। ছয়মাস হতে আর এক দেড় সপ্তাহ বাকি। এবার আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসা উচিত।” 

    নবনীর ইঙ্গিতে বুঝি হৃদস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল অমিতের। মনের মধ্যে তার ভীষণ ঝড় উঠলো। 

    — “কিসের সিদ্ধান্ত?” 

    — “ডিভোর্স।” 

    ডিভোর্স! নবনী ডিভোর্সের বায়না তবে করেই বসলো। গলা শুকিয়ে এল অমিতের। ঠিক এই ভাবনাই তো বারবার আসছিল মনে। মন তবে ভুল কিছু জানান দেয়নি। নিজেকে ধরে রাখা বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছে। মাথা ঠান্ডা রেখে আর কথা বলার মত ধৈর্য্য হচ্ছে না। অবস্থা, পরিস্থিতি কিচ্ছু আর দেখতে ইচ্ছে করছে না, মানতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কাতর হয়ে অমিত নবনীকে বললো,

    — “ডিভোর্স কেন নবনী?” 

    — “এটাই তো কথা ছিল!”

    — “সেটা তো অনেক আগের কথা। তখন পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। এখন সেই পরিস্থিতি কিংবা দূরত্ব কি আমাদের মাঝে আছে?” 

    — “পরিস্থিতি শুধু তোমার বদলেছে, আমার না। তখন এই বিয়েটা আমরা কেউ মানতে চাইনি কারণ আমাদের দু’জনের ভালোবাসার মানুষ ছিল। এই কয়মাসে তোমার ব্রেকআপ হয়েছে, আমার হয়নি। আমার ভালোবাসা আগের মতই আছে। সো, ডিসিশন আমার আগেরটাই আছে।” 

    কিছু বলছে না অমিত। অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো নবনীর শুকনো কঠিন মুখটায়। কী অবলীলায় বলে দিচ্ছে সে চলে যেতে চায়! তবে কি এতদিনের সবকিছু মিথ্যা? সে কি নবনীর হৃদয় ছুঁয়ে দিতে পারেনি? একবারের জন্যও না? অমিতের তরফ থেকে কিছু শুনতে না পেয়ে একবার তার দিকে তাকালে নবনী। চোখ সরিয়ে নিলো সঙ্গে সঙ্গেই। অমিতের বিষণ্ন চোখ জোড়া দেখে বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করে উঠলো! বেশিক্ষণ ঐ চোখে তাকাবার সাধ্য হয়নি নবনীর। অমিতের মন খারাপ সহ্য হয় না কখনো। অথচ আজ অমিতের মন খারাপের কারণ সে নিজেই! গলা ধরে আসছে নবনীর। নিজের সঙ্গে প্রায় যুদ্ধ করে কন্ঠস্বর যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে নবনী। 

    — “যা হয়ে গেছে তা বদলাতে পারবো না। কিন্তু আসছে দিনগুলো বদলাতে পারবো। আমি অপরাধবোধে শেষ হয়ে যাচ্ছি। সামির সামনে দাঁড়াবার মতো মুখ আমার নেই। যত দ্রুত সম্ভব আমাদের ব্যাপারটা এখানেই ক্লোজ করা উচিত।”

    — “কিসের অপরাধবোধ নবনী? এমন কী হয়ে গেছে আমাদের মাঝে যেটা তুমি বদলে ফেলতে চাইছো?” 

    — “জানি না আমি। আই ওয়ান্ট ডিভোর্স, দ্যাটস ইট।” 

    — “জানি না বললেই হলো? ডিভোর্স চাইছো তুমি আমার কাছে! জবাব তো দিতেই হবে।” 

    — “চাইবো না? ডিভোর্স আরো আগেই হবার কথা ছিল। জাস্ট ফ্যামিলির কথা ভেবে আমি তোমার ওখানে যেতে রাজি হয়েছি। এখন কেন তুমি ডিভোর্স নিয়ে প্রশ্ন তুলছো?” 

    — “তোমার সঙ্গে আর লুকোচুরি খেলতে পারছি না নবনী। স্যরি। জানতে চাইলে না তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী? তুমি আমার বউ। বিয়ে করেছি তোমাকে ৫০ জন মানুষের সামনে। ভালোবাসি তোমাকে। তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এটাই। ভালোবেসেছি যেহেতু ছেড়ে দেবার জন্য নিশ্চয়ই বাসিনি।” 

    নিষ্পলক অমিতের দিকে চেয়ে রইলো নবনী। সম্পর্কের গভীরতা তবে অজান্তে হয়নি? অমিতের কাছে প্রথম থেকেই এই গভীরতা স্পষ্ট ছিল! জেনে-বুঝেই সে এগিয়ে গেছে এই সম্পর্কে! বড্ড হতাশ লাগছে নবনীর। অমিতের চোখে চোখ রেখে সে বললো,

    — “কেন অমিত? কোনোকিছু কি অজানা ছিল তোমার? তবুও কেন জেনেশুনে…”

    — “কী জানবো? কার কথা বলছো তুমি? সামি? ও তোমার প্রাক্তন। মরে গেছে ও বহুবছর আগে। ও কোথাও নেই। যদি থাকতো কোনোদিনও আমি আসতাম না তোমাদের মাঝে। ভালোবাসতাম না তোমাকে।”

    — “অমিত!” 

    — “চিৎকার করে কী প্রমাণ করতে চাও? তুমি যাকে দেখতে পাও সে সত্যি? কিভাবে সত্যি হয় বলো আমাকে? মানছি ভালোবাসো খুব। তাই বলে পৃথিবীর নিয়মটাই বদলে যাবে? হয় কখনো এমন? হয়েছে আগে কখনো?” 

    — “তুমি না বলেছিলে আমি তোমার অংশ। আমাকে তুমি অনুভব করতে পারো? তাহলে এখন কেন পারছো না? সামি আছে এটা মেনে নিতে কেন চাইছো না?” 

    — “সামি নেই। তুমি নিজেও সন্দেহে ভুগছো। ভুগছো না? বলো? নয়তো গতকাল আমাকে কেন বারবার বলছিলে সামি সত্যি নাকি তোমার ভ্রম?”

    — “তুমি যাও এখান থেকে।” 

    — “কেন যাব?” 

    — “তোমার সঙ্গে মিসবিহেভ হয়ে যাবে। যাও তুমি এখন।” 

    — “করো মিসবিহেভ। সেই অধিকারও তোমার আছে। নেই শুধু আমাকে ছেড়ে যাবার।” 

    — “আমি কাকে ছাড়বো কাকে ছাড়বো না সেটা তুমি ডিসাইড করবে?” 

    — “তাহলে তুমি কেন মুনিয়াকে ছেড়ে দেবার জন্য বারবার করে বলছিলে? আমি আবারও না মুনিয়ার সঙ্গে রিলেশনে জড়িয়ে পড়ি সেটা নিয়ে তুমি কেন ভয় পেতে? আমার সঙ্গে অভিমান করতে?” 

    — “মুনিয়া আর সামির মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য! মুনিয়া তোমাকে ভালোবাসতো না। সামি আমাকে ভালোবাসে।” 

    — “ভালোবাসতো! এখন আর ভালোবাসার জন্য সামি এখানে নেই। এখন তোমাকে ভালোবাসার জন্য আমি আছি। একবার এই সম্পর্কটা মেনেই দেখো! আমাকে কাছে আসার সুযোগ দাও! দেখোই না কত ভালোবাসি তোমাকে! তোমার হাজবেন্ড আমি। আমাদের সম্পর্কটা এতটাও হালকাভাবে নিও না। 

    — “আর একটা কথাও বলবে না তুমি। লিমিট ক্রস করছো। অসহ্য লাগছে তোমাকে। চলে যাও এক্ষুনি।” 

    — “কোনোদিন কল্পনাও করতে পারিনি একটা মৃত মানুষের সঙ্গে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীতা করতে হবে।”

    — “প্রতিদ্বন্দ্বী! এই শব্দটা এলো কোত্থেকে? ভালোবাসি আমি তোমাকে? বেসেছি কোনোদিন? আমি আগে সামিকে ভালোবাসতাম, এখনো তাই বাসি। আমাদের গল্পে শুধুমাত্র আমরা দুজনই আছি, তুমি কোথাও নেই। সামি মরে গেছে বলছো? ওকে আমার ভ্রম বলছো? বেশ, মরে গেছে ও। তবুও ওকে আমি ভালোবাসি, আজীবন বেসে যাবো। হোক সে মৃত, আমার ভালোবাসার মানুষ তো! মরে গেছে বলে ওকে ভালোবাসা ছেড়ে তো আর দিতে পারি না। খুব ভালো বন্ধু ছিলে তুমি আমার অথচ আজ তোমাকে পরগাছা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না, যাকে জীবন থেকে ছেটে ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেই আমার। আজকের পর থেকে তুমি আমার কেউ না। আমি কখনো সামিকে ভালোবাসা ছাড়বো না। তোমার সঙ্গে আমার কোনোদিন কিছু হওয়া সম্ভব না। হ্যাঁ ভুল আমারও ছিল। সম্পর্ক গভীর হচ্ছে সেটা আমার আরো খেয়ালে রাখা উচিত ছিল। সেজন্য আমি স্যরি। তুমি আর কখনো আমার সামনে এসো না অমিত। আমি চাই না আর কখনো আমাদের দেখা হোক কিংবা কথা হোক।” 

    পরগাছা শব্দটা যেন বুকের ভেতর বড্ড বিধলো অমিতের। যার সঙ্গে কথা না বলে একবেলাও কাটেনা সেই মেয়েটা আর কোনোদিন কথা বলতে চায় না? যাকে এতবেশি ভালোবেসেছে সে আর কখনো তাকে দেখতে চায় না। ভেতরটা ভেঙে সহস্র টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা নবনী কি বুঝতে পারছে তার ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া? মেয়েটা কি জানে এক আকাশ ভালোবাসার বিনিময়ে আজ তাকে কতটা কষ্ট সে ফিরিয়ে দিলো? এই জীবনটা শেষ করে দেবার জন্য এতটুকু কি যথেষ্ট না? চোখে পানি ছলছল করছে অমিতের। কিন্তু চোখের সীমানা পেরিয়ে এই অশ্রু নবনীর সামনে সে বেরোতে দিবে না। কোনোভাবেই না। ভালোবাসার কিংবা বাকি জীবনটা একসঙ্গে কাটিয়ে দেবার পেছনে কোনো যুক্তি, ব্যাখ্যা, অনুরোধ কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না। যে অধিকার নবনী তাকে দিয়েছিল সেই অধিকার ছিনিয়ে নেবার অর্থ কী? যে স্বস্তি হয়ে নবনী তার মনের সবটা জুড়ে দখল করে রেখেছিল, সেই মনটা শূন্য করে চলে যাবার মানে কী? মেয়েটার উপর বড্ড অভিমান হলো আজ। এই অভিমান নবনী ভাঙতে পারবে না। কোনোদিনও না। এক আকাশ ভালোবাসার বিনিময়েও না। নিঃশ্বাস ধরে আসা কষ্ট গলায় আটকে রেখে অমিত তার শেষ প্রশ্ন করলো, 

    — “তোমার জীবনে আমি এত তুচ্ছ নবনী? কোনো মায়া নেই আমার জন্য? এতগুলো দিনে এক মুহূর্তের জন্যও কি আমি তোমার মনকে স্পর্শ করতে পারিনি?” 

    জবাবের জন্য আর অপেক্ষা করলো না অমিত। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। চলে যাবার সময় তার কান্নার সাক্ষী হয়ে রইলো নীতু, শফিক সাহেব আর জামিলা বেগম। এক মুহূর্ত দেরী না করে অমিতের পেছন পেছন গেলেন শফিক সাহেব। মায়ের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন নীতু। 

    — “এই সংসারে কি আর কোনোদিন সুখ আসবে না আম্মা? নবনীকে কী করবো আমি? অসুস্থতার দোহাই দিয়ে আর কত ওর জেদ আর পাগলামির কাছে হেরে যাবো?” 

    জবাবে কিছুই বললেন না জামিলা বেগম। মেয়েকে আর ধৈর্য্য ধরতে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। অমিতের চোখের পানি যেন আজ তারও ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে দিচ্ছে। 

    ৫৪

    ঢাকা এসে পৌঁছুতে পৌঁছুতে শামীমা আর এরশাদের সন্ধ্যে হলো। কলিংবেল চাপতেই এসে দরজা খুলে দিলো নাতাশা। হাতের পার্সটা সোফায় ছুঁড়ে দ্রুত পায়ে ছেলের ঘরে গেলেন শামীমা, পেছন পেছন গেলেন এরশাদও। আলো নিভিয়ে, জানালার পর্দা আটকে নিজের ঘরটাকে একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার করে রেখেছে অমিত। সিগারেটের তীব্র গন্ধ ছড়িয়ে আছে এই ঘরে। শামীমা ঘরে পা রাখতেই তার মাথা ধরে গেল সঙ্গে সঙ্গে। বাতি জ্বালিয়ে অমিতকে ডাকলেন তিনি, 

    — “বাবু…” 

    মাথার উপর বালিশ চেপে শুয়ে ছিল অমিত। মায়ের ডাক শুনেও মাথা তুললো না। শুয়েই রইলো মুখ ঢেকে। জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে, বারান্দার দরজা খুলে দিয়ে খাটে উঠে বসলেন এরশাদ সাহেব। ছেলের মাথার উপর থেকে বালিশটা একটুখানি জোর করেই সরালেন শামীমা। 

    — “আমাদের দিকে তাকা একবার!” ডানে বামে মাথা নেড়ে অমিত বললো, 

    — “কেন এসেছো? চলে যাও তোমরা।” 

    ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন এরশাদ সাহেব। 

    — “কেন যাব? আমাদের ছেলের বাসায় এসেছি আমরা থাকবো বলে। আমরা এখানেই থাকবো।” 

    — “তাকা না অমিত!”

    রেগে গেল অমিত। একলাফে শোয়া থেকে উঠে চিৎকার করতে লাগলো সে। 

    — “আমি তোমাদের ছেলে না।”

    — “তাহলে কে তুই?”

    — “আমি কারো কিছুই না। কারো সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।” 

    — “এত রেগে যাচ্ছিস কেন বাবু? এমন করলে অসুস্থ হয়ে যাবি না?” 

    — “আমি মরবো না আম্মু। আমার কৈ মাছের প্রাণ। শত কষ্টেও আমি মরবো না, হাজার অসুস্থ হয়েও মাথা টানটান করে বেঁচে থাকবো। উপরওয়ালা আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে নবনী আর সামির ভালোবাসা কেয়ামত পর্যন্ত নিজের এই দুইচোখে দেখার জন্য।” 

    — “গতকাল না বলছিলি তোর গলাব্যথা? গলাটা কেমন বসেও আছে তোর। এভাবে চিৎকার করলে তোর গলাব্যথাটা কিন্তু আরো বাড়বে।” 

    — “আমার গলাব্যথা নিয়ে ভাবছো তুমি আম্মু! নবনী আমাকে ছুঁড়ে ফেললো তা তুমি দেখলে না? ও আমাকে কেমন ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো তা দেখতে পাচ্ছো না?”

    — “আপাতত ও চলে গেছে তাই বলে ও আর ফিরবে না এমন কোনো কথা তো নেই। ব্যাপারটা একটু সহজভাবে ভাবতে চেষ্টা কর।” 

    — “জটিল ব্যাপারটাকে আমি কেন সহজভাবে ভাববো আব্বু? আমি বারবার বলছিলাম আম্মুকে নবনী চলে যাবে। আম্মু আমার কথা পাত্তাই দিলো না! হেসে উড়িয়ে দিলো। এখন? গেল তো সত্যি সত্যি? এটাও শুনে রাখো, নবনী ফিরে আসবে বলে যায়নি, ও একেবারে চলে গেছে। কেন আসবে এখানে ও? কে আছে ওর এই বাসায়? কিসের টানে, কার মায়ায় ফিরবে? এখানে ওর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই।”

    — “হাল ছাড়লে চলবে অমিত? পুরো পরিস্থিতি একটু বুঝবি না তুই? নবনীর অবস্থাটা বিবেচনা করবি না?” 

    — “পারছি না আব্বু। এতগুলো দিনে নবনীর মাঝে ন্যূনতম জায়গা আমি করে নিতে পারিনি। আমি ওর কেউ না। ওর আর সামির মাঝে আমি পরগাছা হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কোনোদিন আমি ওর ভালোবাসা পাবো না। ওর সব ভালোবাসা তোলা আছে সামির জন্য, বলেছে ও আমাকে। এই কথার পরও কি আরো কিছু বলার বাকি থাকে? বিবেচনা করার বাকি থাকে?” 

    অমিতের চোখ গড়িয়ে কয়েক ফোঁটা পানি ঝরে পড়লো। ঠোঁট চেপে জোর করে কান্না আটকে রাখলেন শামীমা। ছেলের সামনে কাঁদলে ও আরো ভেঙে পড়বে না! অমিতকে জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলেন এরশাদ সাহেব। বাবার হাত সরিয়ে বিছানা থেকে নেমে গেল অমিত। খাটের পাশ থেকে ওয়ালেট, সিগারেট আর লাইটার নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে কাঁপাস্বরে বললো, 

    — “নবনী ফিরে আসবে, ও আমাকে নিয়ে ভাবে এইসব প্রসঙ্গে কেউ কথা না বললে আমি খুশি হবো। ওদের বাসায় ফোন করে ডিভোর্সের দিনক্ষণ জেনে নিও। সাইন করে ওকে মুক্তি দিয়ে দিবো। ওর জীবনে আমি আর পরগাছা হয়ে থাকতে চাই না।” 

    দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল অনি আর নাতাশা। বেরিয়ে যাবার সময় এক মুহূর্ত দরজায় দাঁড়িয়ে অমিত ওকে বললো,

    — “নবনী চলে গেছে। তুমি এখানে কী করছো? ডিনার করে বাসায় ফিরে যেও। যেখানে নবনী নিজেই সম্পর্ক রাখতে চায় না শুধু শুধু তোমরা আর জোর করে আত্মীয়তা ধরে রেখে কী করবে?” 

    — “আপনি আমার ভাই না? শুধু কি নবনী আপুর হাজবেন্ড? এর বাইরেও তো সম্পর্ক আছে আপনার আর আমার। আমি কি ভাইয়ের বাসায় থাকতে পারি না?” নাতাশার কথার প্রত্যুত্তরে কিছু বললো না অমিত। ঠোঁটের ভাঁজে সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। 

    ছেলে বেরিয়ে যেতেই মুখে হাত চেপে কাঁদতে লাগলেন শামীমা। অনি আর নাতাশা দু’পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। এরশাদ সাহেব নাতাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 

    — “এই সময়টাতে অনির পাশে ছিলে সেজন্য ধন্যবাদ মামনি। অমিতের এমন পাগলামি অনি একা একা সামলাতে প্রায় অধৈর্য্য হয়ে গেছে। ভয়ও পায় খুব! কখন কী করে বসে! তুমি আমার ছেলের কথায় কিছু মনে করো না কিন্তু।”

    — “কী বলছেন চাচ্চু! আপু আজ যা করলো তাতে ভাইয়ার এভাবে রিএ্যাক্ট করা খুব স্বাভাবিক। বেচারা খুব কষ্ট পাচ্ছে।” 

    — “নাতাশা আমার পার্সটা নিয়ে আসবে আম্মু? তোমাদের বাসায় একটু কথা বলবো।”

    .

    মায়ের ঘরে বসে আছেন নীতু আর শফিক। একমনে তাসবিহ্ জপছেন জামিলা বেগম। মনটা বড্ড অস্থির হয়ে আছে, শরীরটা অসুস্থও লাগছে বেশ। তবুও কাউকে বলছেন না তিনি। এমন বাজে সময়ে নিজের অসুস্থতা নিয়ে কথা বলা নিরর্থক তার কাছে। খারাপ সময়ে বরাবরই শাশুড়ির সঙ্গে আলাপ আলোচনা ঝামেলা মিটিয়ে ফেলেন শফিক সাহেব। ঠান্ডা মেজাজের এই মানুষটার কাছে যেকোনো সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। কিন্তু আজ আর শাশুড়ির কাছে কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি নিজেই কেমন মনমরা হয়ে বসে আছেন। যতবারই নবনী অমিত প্রসঙ্গে তাকে কিছু জিজ্ঞেস করা হচ্ছে প্রতিবারই উদাস হয়ে জবাব দিচ্ছেন, আমি কিচ্ছু বুঝতাছি না। 

    জামিলা বেগমের এমন জবাবে নীতু আর শফিকের সাহস দ্বিগুন ভাঙছে। কিভাবে কী করবেন ভেবে না পেয়ে এক পর্যায়ে রাগ ঝারতে লাগলেন একমাত্র শালা শিপনের উপর। প্রচন্ড বিরক্ত নিয়ে নীতুকে অভিযোগ করলেন, 

    — “তোমার ভাইটা বউ নিয়ে বেড়াতে গেছে ভালো কথা, ফোনের সুইচ কেন অফ রাখবে? এই মুহূর্তে পাশে একটা মানুষ পেলেও তো সাহস পাই আমি, তাই না?”

    নীতু কিছু বলার আগেই কল এল তার মোবাইলে। শামীমা কল করেছেন।

    তড়িঘড়ি করে কল রিসিভ করলেন তিনি, 

    — “পৌঁছেছো শামীমা?” 

    — “হ্যাঁ, আধঘন্টা হলো।”

    — “অমিত ঠিক আছে?” 

    অমিতের নাম শুনতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো শামীমা। 

    — “ও ঠিক নেই ভাবী। এক্কেবারে ঠিক নেই। ওকে ঠিক রাখার মানুষটাই যে চলে গেছে।” 

    মেয়ের এমন কান্ডে নিজেকেই বড্ড অপরাধী লাগছে নীতুর। সকালে নবনীর বলা প্রতিটা কথা বাইরে বসে শুনেছে তারা। এতটা তিরস্কারের উপযুক্ত কি অমিত ছিল? তবুও কেন করলো ও এমন? অমিত নিশ্চয়ই মাকে বলেছে সব? লজ্জায় আর মুখ ফুটে শব্দ বেরুচ্ছে না নীতুর। কিছু সময় নীরব থাকার পর শামীমা আবার বলতে লাগলো, 

    — “নবনী কোথায় ভাবী? ও ঠিক আছে?” 

    — “দরজা আটকে বসে আছে নিজের ঘরে। আজ সারাদিনে ঘর থেকে বেরোয়নি খাওয়া দাওয়া বন্ধ।”

    — “ও খেতে চাইলো না আর আপনারাও ওকে জোর করে কিছু খাওয়ালেন না?”

    — “আমাদের আর ধৈর্য্য হচ্ছে না শামীমা। বয়স হয়েছে আমাদের, জোয়ান মেয়ের অসুখের বোঝা আর কতদিন টানবো?” 

    বলতে বলতে গলা কেঁপে উঠলো নীতুর। অভিমানী স্বরে ওপাশ থেকে শামীমা বললো, 

    — “এসব কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। সবাই এভাবে হাল কেন ছেড়ে দিচ্ছে? যার বউ সে আর এই প্রসঙ্গে কথা বলতে চায় না। যার মেয়ে তারাও আর মেয়েকে সামলাতে চাইছে না। এভাবে চলবে? গতকালই কি একটা কান্ড ঘটে গেল নবনীর সঙ্গে! ওকে এই মুহূর্তে এক্সট্রা কেয়ার করা উচিত না? ওর অবস্থা আবারো খারাপ হতে কতক্ষণ? আমাদের কোলে উপরওয়ালা সন্তান দিয়েছেন, মরণের আগ পর্যন্ত সন্তানকে ওভাবে কোলে করেই রাখতে হবে। ভুল করলে পথ দেখাতে হবে। বড় হয়েছে বলে কি ওদের পাগলামি, জেদ, ভুলগুলো মেনে নিবো না। এভাবে দূরে সরিয়ে দিবো? আমরা ওদের আগলে না রাখলে কে রাখবে বলুন তো ভাবী? অমিত নবনী দুজনকেই এখন আমাদের দেখে রাখতে হবে, বোঝাতে হবে নয়তো জীবনটা ওদেরই নষ্ট হবে। ওরাই কষ্ট পাবে। সাথে আমরাও। এসব জেদ ছাড়ুন ভাবী। আমাদের মাথায় এখন অনেক বড় দায়িত্ব। নবনী আর অমিতের সংসারটা বসাতে হবে।” 

    — “ওকে বুঝাবার সাধ্য আমাদের নেই। চোখে অন্ধকার দেখছি। আর ভালো লাগছে না। এসবের শেষ কবে কে জানে!” 

    — “হয়ে যাবে। এইতো আর কিছুদিন। সব ঠিক হবে। আপনি নবনীর ঘরে যান। ওর সঙ্গে কথা বলুন, মুখে তুলে একটু কিছু খাওয়ান ওকে।” 

    জানালার বাইরে ঐ দূর আকাশটা দেখা যাচ্ছে। সেদিকেই নিষ্পলক চেয়ে আছে নবনী। বহুবছর আগে সামি বলেছিল, ও এসেছে সেখান থেকে। গত কয়েকদিনে যেহেতু আসেনি তাহলে কি ফিরে গেছে ওর পৃথিবীতে? দূর আকাশে মেঘের ওপারে? এখান থেকে প্রশ্ন পাঠালে, ঐ পৃথিবী থেকে কি জবাব দেবে ও? মনের ভেতর যে অনেক প্রশ্ন, অনেক দ্বিধা, তীব্র অস্থিরতা আর বিষণ্নতা। এক মনে এতকিছু সয়ে যাওয়া, বয়ে যাওয়া যে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে ভীষণ। প্রশ্নগুলোর জবাব পেয়ে গেলে, বিষন্নতাটুকু ভাগ করে নিতে পারলে নিঃশ্বাস নেয়া সহজ হতো। অজান্তেই মোবাইল স্ক্রিন অন করলো নবনী। অমিতকে কি কল করেছে? কিংবা কোনো মেসেজ? পরমুহূর্তেই মোবাইল স্ক্রিন লক করে তীব্র অপরাধবোধে আবারও ভুগতে লাগলো নবনী। ডুকরে কেঁদে উঠলো ও। আকাশের দিকে চেয়ে বলতে লাগলো, 

    — “আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করতে চাইনি সামি। কোনোদিনও না। তবুও কেন এমন হচ্ছে বারবার? আমি অমিতকে ভুলে কেন থাকতে পারি না? কেন ওকে বারবার মনে পড়ে? কেন ওর জন্য আমার বুকভাঙা কষ্ট হচ্ছে? কেন ওর অপেক্ষা করছি সারাটাদিন জুড়ে? শুনতে পাচ্ছো তুমি? বিশ্বাস করছো আমাকে? আমি তোমার সঙ্গে প্রতারণা করতে চাইনি।” 

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৫৫

    ৫৫

    সকাল এগারোটা। সাব্বির বসে আছে অমিতের বাসায়। গতকাল থেকে অমিতকে কয়েকবার টেক্সট করে, মোবাইলে কল করে পাওয়া যায়নি। তাই কল করেছিল অনির নাম্বারে। তখনই জানতে পারলো নবনীর চলে যাওয়া, অমিতের হাল অবস্থা। এক মুহূর্ত দেরী না করে চলে এলো অমিতের বাসায়। এখানে এসে অমিতকে পায়নি সে। কোথায় আছে সঠিকভাবে কেউ জানে না। অফিস থেকে পরশু রাতে ছুটি নিয়েছিল পাঁচদিনের। তবুও আজ সকালে তৈরী হয়ে ক্লান্ত মুখ, বসে যাওয়া লাল চোখজোড়া নিয়ে বেরিয়ে যাবার আগে বলে গেল, অফিসে যাচ্ছি। কথার সত্যতা জানা নেই ঘরের কারো। পাল্টা কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। বাবা বাসার নিচ পর্যন্ত ছেলেকে এগিয়ে দিয়েছে শুধু। বাসায় এসে অমিতকে না পেয়ে আরো যেন দুশ্চিন্তা বাড়তে লাগলো সাব্বিরের। সেই সঙ্গে অনির প্রতি রাগটাও! বারবার অনিকে একই প্রশ্ন সে করতে লাগলো, 

    — “তুই আমাকে একটা কল করবি না!” 

    অনিও কোনো বিরক্তি ছাড়া বারবার মাথা নিচু করে একই উত্তর দিয়ে চলছে, 

    — “এতকিছুর মাঝে কাকে কল করর কথা মাথায় আসেনি একদম।” 

    এরশাদ সাহেব বললেন, 

    — “সত্যিই বাবা। অনির ব্যাপারটা মাথায় থাকলে অবশ্যই তোমাকে কল করতো।” 

    — “আমার চেয়ে বেশি জরুরি ছিল রুমানাকে ইনফর্ম করা।” 

    — “হ্যাঁ তা তো ছিলই। সমস্যা এতদিন ছিল নবনীকে নিয়ে, এখন মনে হচ্ছে সমস্যা আমার ছেলেরও।”

    — “অমিত বাড়াবাড়ি রকমের স্বাভাবিক আচরণ করছে। কোনো কান্নাকাটি নেই, ভাঙচুর নেই। নবনীকে নিয়ে কোনো কথা নেই। মানে অমিত যেমনটা করে সবসময় তেমন না। 

    — “সমস্যাটা তো ওখানেই আন্টি। কষ্ট ওর হচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছে না। অমিত এতটাও চাপা স্বভাবের না। প্রচন্ড এক্সপ্রেসিভ একটা ছেলে। ফ্যামিলির কাছে ইমোশন লুকায় তা ঠিক কিন্তু খুব একটা না। আমার সঙ্গে একবার হলেও শেয়ার করার কথা ছিল। বিশেষ করে নবনীর কাছে। নাছোড়বান্দা হয়ে পেছনে লেগে থাকতো। পরগাছা বললো বলে অমিত এভাবে ফিরে আসবে? এত অভিমান! মুনিয়া ওকে যাচ্ছে তাই গালিগালাজ করলো, কই কখনো তো ওর প্রতি অভিমান হলো না! আর নবনীর একদিনের মিসবিহেভেই সব শেষ করে দিতে চাইছে?” 

    — “বুঝে পাচ্ছি না বাবা।”

    — “এত কল করছি, রিসিভই করছে না।”

    — “রুমানাকে জানিয়েছো?” 

    — “ও চেম্বারে। কথা হয়নি।” 

    — “নবনীর সঙ্গে ও কথা বললে ভালো হতো।”

    — “অমিতের সাথে আগে কথা বলা উচিত। চেম্বার শেষ হবে হয়ত দুইটা কিংবা আড়াইটা বাজে। আমি কল করে ওকে বলবো সবকিছু। অমিত ততক্ষণে বাসায় ফিরে এলে এখানে চলে আসতে বলবো নয়তো নবনীর বাসায় নিয়ে যাব ওকে।” 

    .

    নবনীকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে জামিলা বেগম। গত দুইদিনের না খাওয়া আর মানসিক চাপে শরীর খারাপ করেছে নবনীর। মাথা ঘুরাচ্ছে বেশ। দরজা কিংবা ফার্নিচারের সাহায্য নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে। অবস্থার অবনতি দেখতে পেয়ে নবনীকে এক প্রকার জোর করেই মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন জামিলা বেগম। একটু পরপর নিতু এসে দেখে যাচ্ছেন নবনী খাচ্ছে কি না। নবনীর পাশেই বসে আছে নাতাশা। খাবার খেতে খেতে নবনী ওদের দুজনকে বললো, 

    — “তোমাদেরও কি মনে হয় আমি এতদিন যাকে দেখেছি সে আমার ভ্রম?”

    প্রাণহীন হাসলেন জামিলা। নবনীর মুখে লোকমা তুলে দিতে দিতে বললেন, 

    — “আমারে একটা কতা কও তো বইন, তোমার মন খারাপের কারণটা আসলে কী?” 

    — “সামি আর আসছে না।” 

    — “এইটাই? তুমি কি নিশ্চিত?” 

    — “আর কী হবে?” 

    — “তুমি সামিরে খুঁজতাছো?” 

    — “হ্যাঁ!” 

    — “কিন্তু আমি যে দেখতাছি তুমি অন্য কারো আশায় বইসা আছো।” 

    — “কার আশায়?” 

    জবাব দিলো নাতাশা,

    — “তুমি বারবার ফোনের স্ক্রিন চেক করছো। মেসেঞ্জারে অমিত ভাইয়ার সঙ্গে চ্যাটবক্সটা বারবার ওপেন করছো। তারপরও জিজ্ঞেস করছো কার আশায়? তারপরও বলছো সামি ভাইয়াকে তুমি খুঁজছো?” 

    রেগে গেল নবনী। বললো,

    — “তোর কি মনে হয় আমি মিথ্যা বলছি? সামির সঙ্গে প্রতারণা করছি?” 

    — “মিথ্যে বলছো তা তো বলিনি! সামি ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা হয়তো করছো কিন্তু অমিত ভাইয়ার চেয়ে বেশি না। আর প্রতারণার প্রসঙ্গ কেন আসছে? কিসের প্রতারণা আপু? যে নেই তার সঙ্গে কেমন করে প্রতারণা হবে? যে চলে যায় তার বিপরীতে অন্য কাউকে জায়গা দিলে সেটাকে প্রতারণা বলে না। নাতাশার কথার জবাবে কিছু বললো না নবনী। দ্বিধাভরা চোখে চেয়ে রইলো তার দিকে। জামিলা বেগম বললেন, 

    — “এত অবুঝ তুই? কেমনে নবনী? তোর মনের খবর দুনিয়ার সবাই জানে অথচ তুই নিজেই টের পাস না? তুই পুড়তাছোস এই কথাটা ঠিক। কিন্তু কারণটা নিজেও ভালো কইরা বুঝতাছোস না।” 

    বিছানায় শুয়ে পড়লো নবনী। মুখ আড়াল করে বললো, 

    — “আমার আর কিছু শুনতে ভালো লাগছে না। তোমরা যাও এখান থেকে।” নাতাশা কিংবা জামিলা বেগম কাউকেই বিছানা ছেড়ে উঠতে না দেখে চিৎকার করে উঠলো নবনী, 

    — “যাচ্ছো না কেন তোমরা? এখানে বসে আছো আমার সমস্যা আরো বাড়ানোর জন্য?” 

    বলতে বলতেই হাতের কাছে পড়ে থাকা পাঞ্চক্লিপটা সজোরে ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। জামিলা বেগম কয়েক মুহূর্ত চেয়ে রইলেন ফ্লোরে, ভাঙা পাঞ্চক্লিপটায়। ঘর থেকে বেরিয়ে যাবার আগে বলে গেলেন, 

    — “খোপার কাটা ভাঙছো, ভাঙো। কিন্তু অমন কইরা নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধুটারে ভাইঙো না। পরে কিন্তু নিজেই ভাইঙা পড়বা। সামলাইতে পারবা না নিজেরে।” 

    .

    লাঞ্চ আওয়ারে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে অমিত। খাওয়া হয়নি দুপুরে। ইচ্ছে করেই খায়নি। এতদিনের অভ্যেসের বাইরে সে যাবে কেমন করে? নবনী ঘড়ি ধরে ঠিক দু’টো বাজে টেক্সট করবে, খেতে বসেছো? এপাশ থেকে সে উত্তর দিবে, এইতো বসছি এখনি। তারপর হবে তার মধ্যাহ্নভোজ। এইতো ছিল তার নতুন অভ্যেস, অথচ কী গাঢ়! যে অভ্যেস রক্তের মাঝে মিশে যায়, নিজের কাছ থেকে আলাদা করা যায় না কখনো। শুধু কি এই প্রশ্নটাই? নবনীর প্রতিটা যত্নই যে মিশে গেছে তার মাঝে। স্বয়ং নবনীই যে তার অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে, যাকে মুছে ফেলা যায় না, ভুলে থাকা যায় না, কেটে আলাদা করে ফেলা যায় না। বুকের মধ্যে কখনো ভালোবাসা আর রক্তে নেশা হয়ে রয়। আবার কখনোবা পাহাড়সমান দুঃখের বোঝা আর কান্না হয়ে রয়। চোখের পাতায় বারবার শুধু নবনীর সঙ্গে কাটানো সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো ভাসছে। এক মুহূর্তের জন্যও ভুলে থাকা যাচ্ছে না। মেয়েটা তাকে আর চায় না তবুও বারবার তাকে মনে পড়ছে। এ ভীষণ যন্ত্রণার! প্রচন্ড অভিমানে বারবার করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, যে ছেড়ে যেতে চায় তাকে ধরে রাখবো না। চলে যাক ও ওর ভালোবাসার কাছে। পরমুহূর্তেই পৃথিবীটা বুঝি মাথার উপর ভেঙে আসে নবনীকে হারানোর ভয়ে। নিজেকে ঘরছাড়া আশ্রয়হীন লাগে। বারবার নবনীর নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়েও হাত গুটিয়ে নেয় সে। মনে পড়ে যায় নবনীর ফটফট করে বলে ফেলা ঐ কঠিন কথাগুলো। তবুও অপেক্ষায় চেয়ে থাকে ফোনের স্ক্রিনে নবনীর একটা কল কিংবা টেক্সটের আশায়। নিজের ঘর কি কেউ কখনো ভুলতে পেরেছে? মায়া ছাড়তে পেরেছে? 

    ৫৬

    দিনশেষে অমিত ফিরে এসেছে বাসায়। বরাবরের মতন কাপড় ছেড়ে, ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। তবে অন্যসব দিনের মতো মুখে হাসি নেই। টিভির ঘরে আনাগোনা নেই। নবনীর ঘর, আর খাটটাই বুঝি তার ভীষণ আপন। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল এই ঘরে আসেনি কেউ। অমিতও ডাকেনি কাউকে। গলায় চেপে ধরা নিঃশ্বাস আর বুকের উপর কষ্ট হয়ে থাকা নবনী এই দুই সামলাতে সামলাতেই শত বছর সমান লম্বা মুহূর্তগুলো কাটছে। নীরব কান্নায় ভিজে যাচ্ছে গাল, হাত। কে যেন একবার বলেছিল তাকে, আর যাই করো, চোখের পানি কখনো কাউকে মুছতে দিও না। যে চোখের পানি মুছে দিতে জানে সবচেয়ে বেশি কাঁদানোর ক্ষমতাটাও তাদের হাতেই। বয়স তখন কম ছিল। সদ্য স্কুল পেরিয়ে কলেজে পা রাখা যুবক, তাই এই কথার অর্থ তখন মাথায় আঁটেনি। মুখস্থ ব্যাকরনের মতন মাথায় গেঁথেছে শুধু। আজ এতবছর বাদে সেই অর্থ মাথায় এঁটেছে। অক্ষরে অক্ষরে উপলব্ধি হচ্ছে। 

    দরজা ঠেলে ঘরে এল সাব্বির। আলো জ্বালালো সে। তার হাতে কফির ট্রে। তিনমগ কফি আছে ওখানে। চোখে চোখ পড়তেই মুচকি হাসলো সাব্বির। মিথ্যে অভিমানে অভিযোগ করতে লাগলো, 

    — “তোকে কতগুলো কল করেছি দেখেছিস একবার?” 

    সাব্বিরের পেছন পেছন এল রুমানা। সবসময়ের মতন প্রাণখোলা মিষ্টি হাসিতে বলল, 

    — “চলো একসঙ্গে বসে কফি খাই।’ 

    কিছু বললো না অমিত। চোখ, গাল মুছে আসন পেতে বসলো। একমগ কফি অমিতের হাতে ধরিয়ে দু’পাশে সাব্বির, রুমানা বসলো। 

    কফির মগে চুমুক দিতে দিতে রুমানা বললো, 

    — “নবনী মেডিসিন নিচ্ছে ঠিকঠাক? খোঁজ নিয়েছো?” 

    — “না।” 

    — “তুমি ওর হাজবেন্ড, ও মেডিসিন নিচ্ছে কি না সেটা দেখবে তুমি। এটা তোমার দায়িত্ব।” 

    — “আমি ওর কেউ না।” 

    — “নবনী বলেছে?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “নবনী কখনো বলেছিল ওকে ভালোবাসতে?” 

    — “না।” 

    — “তাহলে ভালোবেসেছো কেন?” 

    — “ভালোবাসা কখনো কারো অনুমতি নিয়ে হয়?” 

    — “ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, কেয়ার করা এসবও কারো অনুমতিতে হয় না। তুমি ওকে ভালোবাসো, নবনী এখন সেটা জানে আর সামাজিকভাবে তোমাদের সম্পর্কের একটা নাম আছে। এবার তুমি তোমার ওয়াইফকে যেভাবে খুশি ভালোবাসো, যত্ন নাও। সেটা তোমার অধিকার। নবনী আপত্তি করলে ওকে বুঝাও ইউ লাভ হার। রাগ করে দূরে সরে এলে চলবে?” 

    — “আচ্ছা তুই রাগ কেন করছিস বল তো? নবনীর সমস্যাটা তুই জানিস। তবুও কেন?”

    — “নবনীর জীবনে আমিই সমস্যা। এছাড়া আর কোনো সমস্যাই নেই। মানুষ মরে গিয়েও বেঁচে থাকে। সত্যিই থাকে। আগে তোদের মতো আমিও বিশ্বাস করতাম না কিন্তু এখন আমি করি। যার সঙ্গে যা ঘটেনি সে কেমন করে তা বিশ্বাস করবে? আমার সঙ্গে ঘটেছে, ঘটছে। বারবার এই ছেলেটা আমাদের মাঝে বাঁধা হতে হতে চিরতরে সম্পর্কটা মুছে ফেলার বন্দোবস্তও করে ফেলেছে। নবনীর তাতে কোনো আপত্তি নেই। ফেলুক। মেনে নিবো আমি। কারো সম্পর্কে থার্ড পার্সন কেন হবো আমি?”

    — “তুমি কাকে ব্লেইম করছো অমিত? যে মরে গেছে তাকে?” 

    — “মরে গেছে? মরে গেলে নবনী ওকে এখনো ফিল করে কিভাবে? এত বছর পরও ভালোবাসা ঠিক আগের মতো গাঢ় থেকে যায় কেমন করে? নবনীর হাজবেন্ড আমি। একবারও কেন ওর মনে হয়নি আমি ওর আপন কেউ? ওর সঙ্গে খুব সুন্দর একটা সম্পর্ক আমার আছে। আমাদের এই সম্পর্কের একটা নাম আছে। ও কেন একবারও মানতে চায় না, ভাবতে চায় না। সাড়ে পাঁচমাস সময় কি কম? একই বাসায় ছিলাম আমরা, কাছাকাছি থেকেছি, সময় কাটিয়েছি। ওর কেয়ার করেছি। সময়ে, অসময়ে, রাত গভীরে দুজন মিলে পুরো শহর ঘুরে বেড়িয়েছি। ওকে ফেলে কখনো খেতে বসিনি। ওকে সঙ্গে না নিয়ে বাসায় ফিরিনি। রাতে কারখানায় কাজ থাকলে আমিও পড়ে থেকেছি ওখানেই, ওর সঙ্গে। শেষের সময়গুলোতে নবনীকে রাতেও আমি একা ছাড়িনি। ও ঘুমানোর আগ পর্যন্ত বসে থেকেছি ওর পাশে। এতকিছুর পরও ওর মনে একটুখানি জায়গা আমার হলো না! কেন হয়নি? সামির জন্য। আর নবনী? কি না করেছে ও আমাকে খুশি রাখতে? এলোমেলো আমাকে গুছিয়ে নিলো। আমার হারানো সম্পর্কগুলো ফিরিয়ে দিলো। হারানো আমিকে খুঁজে নিলো। এতকিছুর পরও আমাকে ছুঁড়ে দিলো ও। এতগুলো দিনে একটুও মায়া হলো না আমার জন্য? আলাদা করে ভাবতে ইচ্ছে হলো না আমাকে? কেন? সামির জন্য। ওর সবটা জুড়ে শুধু ঐ ছেলেটাই আছে। ওর বাইরে নবনী আর কাউকে ভাবতে পারে না। এক মুহূর্তের জন্যও না।

    — “তোমাকে নিয়ে ও অবশ্যই ভাবে। ওকে সময় দাও।” 

    — “সেই এক কথা! বারবার মিথ্যা বলতে তুমি ক্লান্ত হও না রুমানা?” 

    — “তুমি আমাকে ট্রাস্ট করতে পারছো না?” 

    — “নবনী আমাকে এতকিছু বলে দেবার পর তোমাকে ট্রাস্ট করার প্রশ্নই আসে না।” 

    — “ডক্টরকে ট্রাস্ট না করলে ট্রিটমেন্ট হবে কেমন করে? তোমাদের দুজনের কাউন্সেলিং প্রয়োজন। একজন কাউন্সেলিং নিতে চায় না, অন্যজন আমাকে বিশ্বাস করতে চায় না। হবে তাতে?” 

    –………….. 

    — “শোন না অমিত? কেন এভাবে বেঁকে বসেছিস বল তো? নবনী তোরই আছে। কোথায় ওকে আগলে রেখে ওর অসুস্থতা নিয়ে ওকে বুঝাবি। স্বাভাবিক একটা জীবনে ফিরে আসতে হেল্প করবি, ওকে কতটা ভালোবাসিস তা বুঝাবি। অথচ তুই কেমন উল্টে গেলি!” 

    — “ও আমাকে কী বলেছে জানিস?” 

    — “কী?” 

    — “ওকে বললাম সামি তোমার হ্যালুসিনেশন। ও বললো, ভ্রম হোক কিংবা মৃত হোক ভালোবাসা ছাড়বে না কখনো। ওকে আর বুঝিয়ে লাভ কী? হয়তো নবনী সুস্থ হবে। ওর হ্যালুসিনেশন হবে না। কিন্তু ভালোবাসা? তার কী হবে? নবনী কখনো আমাকে ভালোবাসবে না। কিন্তু ওটাই যে আমার চাই!” 

    আলাপ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। অক্লান্তভাবে রুমানা তাকে বুঝিয়ে চলছে। তবুও কোনোকিছুতেই নবনীর চলে যাওয়া কিংবা চিরতরে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারে না অমিত। তীব্র কষ্ট আর অভিমান ছাড়ে না তাকে। রুমানার শত মিষ্টি কথায়, সুন্দর আশায় ক্ষয়ে যাওয়া ভেতরটা সেরে উঠে না। নিজেকে ঘুরেফিরে একটা ভাঙা পরিত্যক্ত বস্তু হিসেবে খুঁজে পায় অমিত। একসমুদ্র অভিমান হওয়া সত্ত্বেও বারবার নবনীকে খুঁজতে থাকে সে। তাকে সারিয়ে তুলবার সমস্ত ক্ষমতা যে সৃষ্টিকর্তা একমাত্র নবনীর হাতেই সঁপে দিয়েছে। 

    ৫৭

    নবনীকে ছাড়া আজ অমিতের তৃতীয় সকাল। নবনী চলে যাবার পর এই ঘরেই রাতে ঘুমুচ্ছে অমিত। নবনীর বালিশটা বুকে আঁকড়ে কেটে যায় গোটা রাত। খাওয়ায় অনিয়ম, নির্ঘুম রাত আর ভাঙা মন নিয়ে আজ ঠিকঠাক বেশিক্ষন দাঁড়ানো যাচ্ছে না। সবকিছু চোখের সামনে ঝাপসা আবার কখনোবা অন্ধকার হয়ে আসছে হঠাৎ হঠাৎ। নবনী থাকলে হয়ত জোর করে এখন বিছানায় শুইয়ে রাখতো। দুইটা সেদ্ধ ডিম, বড় একগ্লাস স্যালাইন হাতে ধরিয়ে বলতো, খাও এগুলো। দুপুরে বিফ করবো, অনিকে ভার্সিটি থেকে ফেরার পথে বলবো মিষ্টি কিনে আনতে। বিকেলের মধ্যে একদম ফিট হয়ে যাবে। 

    .

    শামীমা দরজা ঠেলে ঘরে এসেছিলেন অমিতকে নাস্তার জন্য ডাকতে। নবনীর ড্রয়ার খুলে ওর কাপড়গুলোর ভাঁজ খুলে ছুঁয়ে দিচ্ছে অমিত। ছেলের অসহায় মুখটা দেখে বুকের ভেতর মোচড় কাটলো শামীমার। মুখে হাত চেপে নীরবে কাঁদছেন তিনি। পেছনে মায়ের উপস্থিতি বোধহয় টের পেলো অমিত। ঘাড় ফেরালো সে। মা কাঁদছে। নবনীর জামাটা বুকে জড়িয়ে কাপাস্বরে বললো, 

    — “আমার মাথার উপর ছাদ খুঁজে পাচ্ছি না আম্মু। ঘরবাড়িহীন, বেওয়ারিশ মনে হচ্ছে নিজেকে। নবনী আমাকে আশ্রয় দিয়ে এভাবে ছুঁড়ে দিলো কেন? আমার মাঝে, আমার ভেতর ওকে খুব যত্নে আমি গেঁথেছি। ওকে আমি ভুলে থাকবো কেমন করে?” 

    ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন শামীমা। নবনীর জামাটা ওয়্যারড্রবে তুলে রেখে বললেন, 

    — “অসুস্থ দেখাচ্ছে তোকে। বিপি লো হয়েছে নাকি আবার?” 

    — “নবনীকে ভালোবাসি আম্মু। ও আমাকে না বাসলেও বাসি। ওকে ছেড়ে থাকতে পারছি না। কোথাও শান্তি পাচ্ছি না। এভাবে কেউ বাঁচে বলো? আমাকে ভালোবাসতে হবে না। ও শুধু ফিরে আসুক। আমার ঘর হয়ে থাকুক। দিনশেষে আমি আমার মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু পেলেই হলো।” 

    — “নবনী আসবে। আমরা নিয়ে আসবো ওকে। তুই নিয়ে আসবি ওকে। আমরা আজ যাব নবনীর কাছে। ঠিক আছে? এখন খেতে চল। গতকাল রাতে খাসনি। দুপুরে অফিসে খেয়েছিস কি না তারও ঠিক ঠিকানা নেই।” 

    — “আমি এখনই যাব আম্মু।” 

    — “এখন কোথায় যাবি তুই? ওয়েদার ভালো না। বাইরে কী বৃষ্টি হচ্ছে!”

    — “বৃষ্টি দেখছো আর আমার মনে যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে তা দেখছো না আম্মু?” 

    .

    বাইরে ঝুম বৃষ্টি। নবনীর বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে অমিত কাকভেজা হয়ে। তাকিয়ে আছে নবনীর বারান্দায়। নবনীর কাপড় ঝুলছে সেখানে। ওকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে ভীষণ, মনের সমস্ত আঁকুতি বলে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে এক নিঃশ্বাসে। অথচ সিঁড়ি ভেঙে অমিতের উঠা হচ্ছে না নবনীর বাসায়। কী যেন আটকে রেখেছে তাকে। কিন্তু মনের গহীনে যে ভালোবাসা, তাকে কি আটকে রাখা যাচ্ছে? তোলপাড় করে প্রতি মুহূর্তে শেষ করে দিচ্ছে। সে এক অসহ্য যন্ত্রণা! এই যন্ত্ৰণা কমবে কিসে? বুকের বা পাশে নবনীর একটুখানি স্পর্শে নাকি নবনীর মনে একটুখানি আশ্রয় পেয়ে?

    বারবার ফোনের স্ক্রিন অন করছে নবনী। কোনো টেক্সট এসেছে অমিতের? গোটা দু’দিনে কোনো কল কিংবা টেক্সট আসেনি অমিতের। নবনী চায়ও না আসুক তবুও… তবুও মনের কোথায় যেন আশা জাগে অমিতের একটা ফোনকলের, কেমন আছো নবনী প্রশ্নের। ছেলেটা নিজেই বা কেমন আছে কে জানে! খুব করে ইচ্ছে হয় অনিকে কল করে একটাবার অমিতের খোঁজ নিতে। ভালো আছে তো ও? সামলে নিতে পারছে তো নিজেকে? নিজের সীমা অতিক্রম করেনা নবনী। দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে আছে এই বাসায়, নিজের ঘরে। যার সঙ্গে সম্পর্কের সুতো নিজেই কেটে দিয়েছে সেই মানুষটার খোঁজ নেয়া আদিখ্যেতা ছাড়া আর কিই বা হতে পারে? সম্পর্ক ছেড়ে আসার পরও দু’জনের মাঝে যে এক আকাশ সমান মায়া রয়ে গেছে সে মায়া কাটাতে হবে। যতটা না তার মঙ্গলের জন্য, তার চেয়ে বেশি অমিতের ভবিষ্যতের জন্য। বহুভাবে মনকে বোঝায় নবনী। অনির নাম্বারে ডায়াল করতে গিয়েও বারবার ফোন থেকে দূরে সরে আসে। তবুও মনটা যে শান্ত হয় না! কষ্ট দলা পাকিয়ে গলার মধ্যে আটকে থাকে, ক্ষণে ক্ষণে কান্না পায়। ভীষণ অস্থিরতায় নিঃশ্বাসটাই বুঝি আটকে আসতে চায়। হঠাৎ ঝড়ের গতিতে ঘরে এল নাতাশা। 

    — “আপু! অমিত ভাইয়া বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছে।” 

    এক ছুটে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো নবনী। গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে অমিত তাকিয়ে আছে তার বারান্দায়। এক মুহূর্ত আর দাঁড়ালো না নবনী। দৌড়ে মায়ের ঘর থেকে ছাতা নিয়ে নেমে এল বাসার নিচে। অমিতের মাথায় ছাতা ধরে শক্ত করে তার হাত চেপে ধরলো নবনী। 

    — “এক সপ্তাহ ধরে ঠান্ডা সর্দিতে ভুগছো। এই বৃষ্টিতে ভেজার সাহস কেমন করে হলো তোমার? বাসায় চলো।” 

    — “আমাকে তো ঠান্ডা, সর্দি ভোগাচ্ছে না নবনী। ভোগাচ্ছো তুমি।”

    — “অমিত এসব কথা রাখো। আগে বলো কতক্ষণ ধরে ভিজছো তুমি? চোখ লাল হয়ে গেছে। মুখ শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আঙুলের চামড়া কুঁচকে গেছে। আজকে তুমি জ্বর বাঁধাবে নিশ্চিত! উপরে চলো এক্ষুনি। একটানে নবনীকে আরো কাছে নিয়ে এল অমিত। নবনীর হাত বুকের উপর চেপে ধরে বললো, 

    — “আমার সব সুখ, স্বস্তি তোমার কাছে জমা আছে নবনী। তুমি ছাড়া আমার আর কোথাও যাবার জায়গা নেই। আমার কোত্থাও শান্তি নেই। আমার ভেতরটা চৈত্রের দুপুর রোদের মতন খা খা করে। কষ্ট পাচ্ছি আমি। খুউব! যতটা কষ্ট পেলে মানুষ জীবিত থেকেও মরে যায় ঠিক ততটা। নিঃশ্বাস আটকে আসে আমার নবনী। আমি মারা যাচ্ছি তোমার জন্য। ভালোবাসি তোমাকে, যতটা ভালোবাসলে মানুষ অচল হয় ঠিক ততখানি। আমি জানি তুমি সামিকে ভালোবাসো, অসীম ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় মৃত্যুও তোমার সামনে দেয়াল হতে পারেনি। আমাকে ভালোবাসতেই হবে সে দাবি আমি কখনো জানাবো না। তুমি আমাকে ভালো না বাসলেও চলবে। শুধু বলবো আমাকে ভালোবাসতে দাও। সম্পর্কটা বেঁচে থাকুক, এখন যেভাবে বেঁচে আছে সেভাবেই। থাকতে হবে না আমার সঙ্গে এক বিছানায়, আমাকে হাজবেন্ড বলে পরিচয়ও দিতে হবে না। তুমি বাসায় ফিরে এসো নবনী। আমরা আলাদাই থাকবো। আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসবো। কখনো একটুখানি ছুঁয়ে দেখার আবদার করব না। স্বামীর কোনো অধিকার চাইবো না। তোমার কাছে শুধু একটাই চাওয়া রয়ে যাবে, তুমি আমার স্বস্তি হয়ে থাকো, এতদিন যেমনটা ছিলে ঠিক তেমন। প্লিজ নবনী, আমাদের ডিভোর্স না হোক। থেকে যাও আমার ঐ ছোটো ফ্ল্যাটটায় আমার স্বস্তি হয়ে।” 

    অমিতের মুঠো থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলো নবনী। দুই পা পিছু সরে বড্ড কঠিন করে বললো,

    — “তুমি ফিরে যাও অমিত। আমার কাছে তোমার কিছুই নেই। আমাদের মাঝেও আর কিছু নেই। যা ছিল সবটা শেষ করেই এসেছি। ভালো শুধু আমি একজনকেই বেসেছি, আর কাউকে ভালোবাসতে পারবো না। কারো ভালোবাসা আমি চাইও না।” 

    নবনীর দুই কাঁধে শক্ত করে চেপে ধরলো অমিত। — 

    — “আমি তোমার কেউ না নবনী?” 

    — “না।” 

    — “আমাদের বন্ধুত্ব, মায়া সবকিছু অস্বীকার করছো তুমি? আমাদের বিয়ে হয়েছিল নবনী। মিথ্যে ছিল না সেটা। সত্যি সত্যি আমাদের একটা বিয়ে হয়েছিল। তুমি আমি কবুল বলেছিলাম। অস্বীকার করবে তুমি?” 

    — “হ্যাঁ করছি। আমি সবকিছু শেষ করতে চাই অমিত। কেন এসেছো তুমি? আমি চাই না আমাদের আর কখনো দেখা হোক, কথা হোক। ভুলে যাও সবকিছু।” 

    — “যে ছেলেটা মরে গেছে আট বছর আগে তাকে তুমি আজও ভুলোনি। তুমি জীবিত মানুষ, আমার বিয়ে করা বউ তোমাকে আমি ভুলবো কেমন করে? সামিকে তুমি যতটা ভালোবাসো তার চেয়ে বেশি আমি তোমাকে ভালোবাসি। কিভাবে ভুলবো আমি সবকিছু?” 

    — “কী করবো এখন? আমিও মরে যাবো? আমি মরে গেলে সব ঠিক হবে? ভুলে যাবে তুমি আমাকে?” 

    — “নাহ্ নবনী! থেকে যাও আরো বহুবছর। বাঁচিয়ে রাখো তোমার ভালোবাসা। তুমি তো হেরে যাওনি, তুমি কেন মরবে? হেরেছি আমি। একজন মৃত মানুষের কাছে আমি বাজেভাবে হেরে গেছি। হেরে যাওয়া মানুষদের পৃথিবীতে বেঁচে থেকে কোনো কাজ নেই। শেষবারের মতো জিজ্ঞেস করছি। তোমার মনে কখনো কি একটুখানি জায়গা আমার জন্য হয়নি?” 

    গলা ধরে এলো নবনীর। মাথা নিচু করে কাঁপাস্বরপ বললো, “না।” 

    চিৎকার করে উঠলো অমিত। 

    — “তাহলে কেন আমাকে আগলে রেখেছিলে এতগুলো মাস? মুনিয়ার কাছে হোঁচট খেয়ে পড়ে থাকতাম, খুবজোড় মরেই যেতাম। বেঁচে থাকলে একটু একটু করে নিজেকে সামলে নিতাম। কেন এসেছিলে দয়া করতে? তোমার দয়ার ভার আমি আর সইতে পারছি না নবনী। মরন যন্ত্রণা হয়ে গেছে আমার। কী করবো এখন বলো না? কে সামলাবে আমাকে? আমি যে তোমার উপর খুব ডিপেন্ডেড হয়ে গেছি নবনী!” 

    — ……………….

    মুখে হাত চেপে চিৎকার করে কাঁদছে অমিত। 

    — “আমি হেরে গেছি। একজন মৃত মানুষের কাছে আমার ভালোবাসা হেরে গেছে।” গোটা পৃথিবী উল্টেপাল্টে যেন কান্না পাচ্ছে নবনীর। চিৎকার করে কেঁদেই দিবে যখন তখন। আর দাঁড়ালো না নবনী। দৌড়ে চলে গেল বাসার দিকে। তিনতলার উপর থেকে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিলো নাতাশা আর নীতু। নবনী বাড়ির মেইন গেইটে ঢুকতেই শফিক সাহেবকে ডেকে নীতু বললেন,

    — “জলদি করে নিচে যাও। ছেলেটাকে বাসায় নিয়ে এসো।” 

    শফিক সাহেব বাসার নিচে পৌঁছুবার আগেই অমিত চলে গেছে গাড়ি নিয়ে। বাসায় ফিরে নিজের ঘরে দরজা আটকে চিৎকার করে কাঁদছে নবনী। 

    .

    শহর ছেড়ে সামিদের গ্রামের বাড়ি এল অমিত। মূল ফটকের বাইরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সামির কবরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে রইলো সে। ঝুম বৃষ্টি আজ দেশের বেশিরভাগ জুড়ে। বৃষ্টি হচ্ছে এখানেও। বাড়ির ভেতরের দরজা জানালা আটকে বসে আছে সামির মা বাবা। ভেতরে যাবার সময় অমিতকে দেখেছে বাড়ির দারোয়ান। অমিত তার পরিচিত মুখ। এসেছিল সেদিন নবনীকে সঙ্গে নিয়ে। শুনেছে এই ছেলেটা নবনীর স্বামী। ভেবেছিল ছেলেটা হয়তো বাড়ির ভেতরে যাবে। কিন্তু তার ধারণা ভুল করে ছেলেটা এই বাড়ির ছেলের কবরের পাশে দাঁড়িয়ে ভিজছে। এসেছিলও সে কাকভেজা হয়েই, এখনো ভিজছে। এই বৃষ্টিতে অমন করে ভিজছে কেন, কে জানে! সে কি কবর জেয়ারত করছে? অনেক ফজিলতের কোনো দোয়া পড়ছে? ছাতা মাথায় দূর থেকে দাঁড়িয়ে সূক্ষ্মভাবে অমিতকে দেখার চেষ্টা করছে এই বাড়ির দারোয়ান। হঠাৎ ছেলেটা বসে পড়লো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ছেলেটা খুব চিৎকার করে কাঁদছে। বৃষ্টির শব্দে তার কান্নার শব্দ কানে এসে পৌঁছাচ্ছে না। অবস্থা সুবিধাজনক লাগছে না দারোয়ানের। কাদামাটির উপর পা চেপে চেপে এক প্রকার দৌড়ে বাড়ির ভেতর গেল দারোয়ান। এই বাড়ির মালিককে বিষয়টা জানাতে হবে! 

    .

    — “তুমি চলে গিয়েও রয়ে গেলে কেন? বলো না সামি? আমার ওয়াইফ তোমাকে কেন ভালোবাসবে? লজিক্যালি তুমি এখন ওর কেউ না। আমি ওর হাজবেন্ড, আমিই ওর সব, তবুও তোমাকেই ও ভালোবাসে। কেন? বাজি ধরে বলতে পারি তোমার চেয়ে বেশি ভালো আমি ওকে বেসেছি। অথচ দেখো আমি হেরে গেছি তোমার কাছে। নবনী তোমাকে চায়, আমাকে না। এত ভালোবাসি তবুও নবনী আমাকে চায় না। আমাকে হারিয়ে দিলে তুমি! এত ভালোবাসি ওকে… অনেক অনেক… তোমার সঙ্গে আমি আমার ওয়াইফকে আর মানতে পারছি না।” 

    .

    দারোয়ানের কথা শুনে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল সামির মা, বাবা। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে অমিতের মাথায় ছাতা ধরলো দারোয়ান। ছেলের কবরের পাশে অমিতকে এভাবে কাঁদতে দেখে খেই হারালেন সামির মা-বাবা। নবনী চলে আসার প্রভাব কি খুব বেশিই পড়লো ওর উপর? সামির বাবা এগিয়ে এসে অমিতের কাঁধে হাত রাখলেন। বললেন, 

    — “এখানে ভিজছো কেন বাবা? ভেতরে এসো।”

    — “আপনাদের ছেলে আমার পথ থেকে সরে কেন গেল না?” 

    — “ভেতরে চলো। ভিজে গেছ একদম। শরীর খারাপ করবে না?” 

    সামির বাবার কথার কোনো জবাব দিলো না অমিত। প্রচন্ড ঘৃণায় এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো কবরের দিকে। সামির মা অমিতকে ডাকলো এবার, 

    — “বাবা আমার কথা শুনো। ভেতরে এসে কাপড় পাল্টে নাও। তারপর আমরা কথা বলবো।” 

    একলাফে উঠে দাঁড়ালো অমিত। কারো সঙ্গে কিছু না বলে বেরিয়ে গেল এই বাড়ি ছেড়ে। যাবার সময় একপাটি জুতা ফেলে গেল কবরের পাশে, অন্যপাটি জুতা আটকে রইলো কাদায়। 

    স্ত্রীকে তাড়া দিতে লাগলেন সামির বাবা, 

    — “জলদি করে নবনীর বাসায় একটা কল করো তো। ওদের জানাও বিষয়টা। ছেলেটার হাল অবস্থা ভালো ঠেকেনি।” 

    — “ওকে আটকানো উচিত ছিল বোধহয়।” 

    — “রাখতে পারতাম না। উল্টো ঝামেলা করতো।” 

    — “নেটওয়ার্কই তো নেই। ভোরের ঝড়ের পর নেটওয়ার্ক একেবার উধাও হয়ে গেছে। কল যাবে না তো।” 

    দারোয়ানকে নিয়ে গেইটের দিকে পা বাড়ালেন সামির বাবা। আরেকবার বুঝিয়ে শুনিয়ে ছেলেটাকে যদি ঘরে আনা যায়! গেইটের বাইরে যেতে অমিত ততক্ষণে গাড়ি নিয়ে চলে গেছে মাটির রাস্তা পেরিয়ে বড় রাস্তার দিকে। 

    বেলা গড়িয়ে দুপুর হলো। দুপুরের রান্না শেষে গোসলে যাবার আগে এরশাদ সাহেবকে ডেকে শামীমা বললেন, 

    — “চুলায় ভাত বসিয়েছি। আমি গোসলে যাচ্ছি, চাল ফুটে গেলে মাড় ফেলে দিও।” ছেলের নাম্বারে ডায়াল করছিলেন এরশাদ সাহেব। শামীমার ডাক শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন তিনি। 

    — “শুনছো? অমিত কি গিয়েছিল নবনীদের ওখানে? কোথায় আছে এখন? ওখানেই?” 

    — “ওখানে নেই। বেরিয়ে গেছে আরো আগেই। ভাবী কল করেছিল। নিচে দাঁড়িয়ে কথা বলে চলে গেছে। উপরে উঠেনি।” 

    — “কী মুসিবত! এই বৃষ্টি বাদলায় কোথায় ঘুরছে কে জানে?” 

    দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শামীমা। অমিতের ভাগ্যটাই খারাপ বুঝলে! নয়তো ছেলেটা বারবার কেন কষ্ট পাবে? 

    এখনো নবনীর ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে আর কান্নার শব্দ আসছে না। শফিক সাহেবের বাসার পরিবেশ থমথমে। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না। গত দু’দিন ধরে অনবরত জামিলা বেগম জিকির করেই যাচ্ছেন। নবনীর বিষয়টা ছাড়াও আরেকটা ব্যাপারে মন তার ভীষণ অস্থির হয়ে আছে। বারবার মনে কু ডাকছে খুব খারাপ কিছু হতে চলেছে। কেউ বুঝি মারা যাবে! সামি মারা যাবার আগে ঠিক এমনই মনে হয়েছিল। শফিকের মা মারা যাবার আগেও। সেই থেকে মনে কু খেয়াল এলেই ভীষন ভয় হয় তার। কিন্তু কখনো মুখ খুলেন না তিনি চেপে যান পুরো ব্যাপারটা। মনে মনে ভীত অন্তরে বারবার সৃষ্টিকর্তার দরবারে প্রার্থনা করতে থাকেন। তাসবিহ হাতে মনকে শান্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। 

    অমিত চলে যাবার পর তিনি নিজেও ঘর থেকে বেরোননি। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আজ সামির মরা মুখটা বড্ড মনে পড়ছে। রোবটের মতন রান্নাঘরে রান্না করে চলছেন নীতু। নাতাশা জানে আজ মায়ের রান্নায় বিন্দুমাত্র মন নেই। রান্নায় ভুল হবে। কখনো লবন দেবে না, কখনো হলুদ দেবে না। মায়ের ভুল সংশোধন করবে বলে, কাজে হাত লাগাবে বলে পাশেই দাঁড়িয়ে রইলো নাতাশা। মনে তাদের অজস্র কথা, আর ভাগ করার মতো দুঃখ আছে, কান্না আছে। অথচ কেউ কাউকে প্রকাশ করছে না। পাশাপাশি দাঁড়িয়েও নিশ্চুপ দুজন। বারান্দায় পেপার হাতে বসে আছেন শফিক সাহেব। চেয়ে আছেন বাইরে। নবনীকে নিয়ে কতশত খেয়ালে জর্জরিত তার মন। সবটাই বিষাদের। হন্যে হয়ে খুঁজছেন, কখনো কি অনেক বড় পাপ হয়েছিল তার দ্বারা? জানা কিংবা অজানায়। কৈশোরে কিংবা যুবক বয়সে? নয়তো এই মন্দ দিনগুলো এত লম্বা কেন হবে? সুখের দিন, স্বাভাবিক জীবন কেন তাদের ফিরে আসছে না? 

    বিছানায় গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে নবনী। কাঁদতে কাঁদতে মাথা ধরে গেছে। অমিতের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে ভীষণ। ওর খেয়াল খুব পেয়ে বসেছে আজ। অমিতের অসহায় মুখটা কখনো সহ্য হয়নি, আজও হচ্ছে না। ভীষণ অভিমানে চলে গেল মানুষটা। অথচ কখনো ওর জানা হবে না বুকে পাথর বেঁধে অমিতকে আজ ফিরিয়ে দিয়েছে সে। কখনো ওর জানা হবে না ওর চোখের পানি নবনীকে ভীষণভাবে পোড়ায়। এখনও পুড়ছে সে। অন্যসব দিনগুলোর চেয়ে বেশিই পুড়ছে। চোখের পানির কারণটা যে সে নিজেই! অথচ দু’হাতে আজ সেই পানি মুছে দেয়া হলো না। নিজের হাতের মুঠোয় ওর হাত আঁকড়ে বলা হলো না, বলো তো অমিত কেন এত কষ্ট পাচ্ছো? মুখে হাত চেপে চিৎকার করে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে অমিত কাঁদছিল। ওকে সেই অবস্থায় ফেলে আজ সে মুখ ফিরিয়ে চলে এসেছে। বাকি জীবনটা আত্মগ্লানিতে ভোগার জন্য এই কি যথেষ্ট না? 

    এলোমেলো ঘুরছে অমিত। কোথায়, কোন গ্রামে আছে তার জানা নেই। কখনো গাড়ি থামিয়ে রাস্তার ধারে বসে থাকছে, কখনোবা ক্ষেতের আইল ধরে, কাদামাটি পাড়িয়ে হেঁটে চলছে। আবার গাড়িতে ফিরে গন্তব্যহীন ছুটছে। জানালার গ্লাস খোলা। মেঘলা আকাশ, বাইরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি। ঠান্ডা বাতাস লাগামহীন ছুটে চলছে প্রকৃতিতে। গলায়, কানে প্রচন্ড ব্যথা হচ্ছে অমিতের। চোখ ঝাপসাও হচ্ছে বারবার। ভেজা শরীরে ঠান্ডা বাতাস মিশে গিয়ে শরীরটা বুঝি বরফে পরিণত হয়েছে। শ্যামলা চামড়া আজ সাদা রঙ ধারণ করেছে। শরীর কাঁপছে ভীষণ। হাতগুলো জমে আসছে বারবার। পায়ে আর পিঠের মাংসপেশিতে টান লাগছে কিছুক্ষণ পরপর। অথচ সেসব কিছুই অমিতকে ছুঁতে পারছে না। অসুস্থতা কিংবা খারাপ লাগা সবটাই হলো নবনী। ওসব শারীরিক জটিলতা নবনীর সঙ্গে এই বিচ্ছেদের সামনে কিছুই না। গ্রামের পথ ধরে চলতে চলতে কোনো এক বিয়ে বাড়ির সামনে গাড়ি থামালো অমিত। রওনকের বিয়েতে বাড়ির বাইরে ঠিক এমনি একটা গেট বানানো হয়েছিল। অমিতের মনে পড়ে গেল সেই দিনটা। চোখের সামনে ভাসতে লাগলো নবনীকে নিজের করে পাবার, কবুল বলার সেই মুহূর্তটা। গায়ে খুব একটা বল নেই। তবুও গায়ের সমস্ত জোর খাটিয়ে স্টিয়ারিংয়ে সজোরে ঘুষি দিলো অমিত। প্রচন্ড আক্ষেপে বলতে লাগলো, তুমি তো আমার হয়েছিলে নবনী। তুমি আমার হয়েছিলে… 

    কয়েক মুহূর্ত বাদে অমিত পথ খুঁজতে লাগলো এখান থেকে বেরোবার। কুমিল্লার সেই গ্রামে, সেই বাড়িতে যাবে সে। যেখানে নবনী তার হয়েছিল। কিভাবে কোন পথ ধরে এই গ্রামে এসেছে তা মনে নেই অমিতের। পথে তেমন মানুষজনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাঁপা হাতে স্টিয়ারিং ঘুরাতে ঘুরাতে নিজের মতন করে পথ খুঁজছে সে। 

    .

    বিকেলের দিকে এসে বৃষ্টি থেমেছে। সেই দুপুর থেকে এখন পর্যন্ত বারবার মোবাইল নেটওয়ার্ক চেক করছিলেন সামির মা। এইবেলা টু জি নেটওয়ার্ক ফিরে আসা মাত্র ডায়াল করলেন নবীনদের বাসায়। 

    নাতাশা অনেক ডেকে নবনীর ঘরের দরজা খুলিয়েছে। সারাদিন না খেয়ে, কান্নাকাটি করে নবনীর দিকে তাকানো যাচ্ছে না। অনেকটা জোর করেই নবনীকে এককাপ চা আর দুইপিস বিস্কিট মুখে তুলতে নবনীকে রাজি করিয়েছে নাতাশা। বোনের সঙ্গে বসে চা খেতে খেতে নাতাশা বললো,

    — “কষ্টে মরে যাচ্ছো। কার জন্য বলো তো?” 

    জবাব দিলো না নবনী। নাতাশা আবারও বলতে লাগলো, 

    — “জবাব না দিলেও চলবে। আমি জানি উত্তরটা। অমিত ভাইয়ার জন্য এত কষ্ট পাচ্ছো তাহলে কেন উনাকে একটা কল করছো না? কেন তোমার কাছে ডাকছো না উনাকে?” 

    — “ডেকে কী হবে? ও যা চাইছে তা ওকে কখনো দিতে পারবো না।” 

    — “অমিত ভাইয়া একা মরছে না আপু, তুমিও মরছো। দুজনের চোখের পানির কারণ একই। দুজনই দুজনকে চাও। ভালোবাসো। তাহলে কেন উনাকে তুমি ভালোবাসা দিতে পারবে না বলছো?” 

    — “আমি সামির সঙ্গে প্রতারণা করতে পারবো না।

    — “আবারও একই কথা! তোমার অদ্ভুত যুক্তি আর খন্ডাতে পারছি না আপু। মাথা কাজ করছে না। তোমার জন্য জ্বলজ্যান্ত একটা মানুষ মরে যাবে বুঝতে পারছো ব্যাপারটা? উনি কেমন সেনসেটিভ তুমি জানো না? উনি সত্যি সত্যিই মরে যাবে।” 

    ‘মরে যাবে’ কথাটায় বুকের ভেতর ধুক করে উঠলো নবনীর। প্রকাশ করলো না সে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বিস্কিট খাওয়ার চেষ্টা করছে। 

    — “সামি ভাইয়া এসেছে?”

    — “না।” 

    — “কেন আসছে না?” 

    — “জানি না।” 

    — “নাকি জানতে চাও না?” 

    — “জানি না।” 

    — “সবকিছু যেহেতু খোলাসা হয়েই গেছে এবার তবে এটাও শুনে রাখো, মরে গেলে যে কেউ ফিরে আসে না সে কথা একটু হলেও তুমি বুঝতে পারছো। আর সবচেয়ে বড় কথা, সামি ভাইয়াকে তুমি নিজেও আগের মতন চাও না। তাই দেখতেও পাও না। পয়েন্ট ঠিক এখানেই। তোমার অসুখটাও এখানে। মেনে নাও আপু। মানুষের জীবনে পরিবর্তন আসতেই পারে। প্রেমিক মরে গেলে, শোকের ক্ষত শুকিয়ে এলে, বছরের পর বছর পেরোলো একটা সময় এসে নতুন কারো সঙ্গে নিজের জীবন নিয়ে আরেকবার ভাবা যেতেই পারে। কেউ ভালোবাসলে তার ভালোবাসা আগলে নেয়া যেতেই পারে। এটা কোনোভাবেই প্রতারণা না। সেদিন ভাইয়ার বদলে তুমি মারা গেলে এতদিনে সামি ভাইয়া এমনই ডিসিশন নিতো। প্রকৃতি এমনই। ধীরে ধীরে ভালোবাসা ভুলিয়ে দেয়, শোক ভুলিয়ে দেয়। জানি সবাই চিরতরে ভুলতে পারে না। কিন্তু আবেগ আগের মতন আর থাকেও না। এটা দোষের কিছু না। বরং কোনো একটা ট্র্যাজেডির মাঝে জীবনকে আটকে রাখা দোষের। তুমি এতদিন একা ছিলে তাই আমরা কেউ কিছু বলিনি কখনো। থাকো তুমি তোমার খুশী। কিন্তু এখন জীবনটা আরেকজনের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে যে তোমার অভাবে মরে যাবে। তার কথা ভাবো। বাজে কিছু হবার আগে উনাকে মেনে নাও, বাস্তবতা মেনে নাও। অমিত ভাইয়ার কিছু হয়ে গেলে মানতে পারবে তুমি?” 

    ঝড়ের গতিতে নবনীর ঘরে এসে ঢুকলো নীতু 

    — “নবনী! অমিত সামিদের বাড়িতে গিয়েছিল। খুব এ্যাবনরমাল বিহেভ করেছে ওর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে। বৃষ্টিতে ভিজে টিজে একদম…. সামির বাবা বলছিল ও আউট অব সেন্স। ওখান থেকে বেরিয়েছে আরো অনেক আগে। দুপুর সোয়া বারোটার দিকে। এখনো ওর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তোর চাচীকে কল করেছিলাম। এতক্ষণ রিং হয়েছে ওর নাম্বারে। আধঘন্টা ধরে সুইচড অফ। সন্ধ্যা হয়ে এল। তোর বাবা বেরিয়েছে এখন। তোর চাচাকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজ করবে ওর। কোথায় আছে কে জানে!”

    আঁতকে উঠলো নবনী। কাঁপা হাতে মোবাইল নিয়ে অমিতের নাম্বারে দিশেহারা হয়ে বারবার কল করছে সে। সুইচড অফ, তবুও কল করছে। নাতাশার হঠাৎ মনে পড়লো সাব্বিরের কথা। সে কি জানে তার বন্ধুর খবর। তড়িঘড়ি করে সাব্বিরের নাম্বারে ডায়াল করলো সে। 

    সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত বাড়ছে। বাদলা দিনেও পথে গাড়ির কমতি নেই। প্রতিদিনের মতন আজও এই পথে অসংখ্য গাড়ি আসছে, যাচ্ছে। ঢাকার দিকে বৃষ্টি থেমে গেলেও মেঘনা ব্রিজে এসে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বৃষ্টির গতি বাড়লো। শরীর অবশ হয়ে আসছে অমিতের। নিঃশ্বাস নিতে পারছে না সে। শরীর কাঁপছে না আর। সাদা থেকে ধীরে ধীরে নীল বর্ণ ধারণ করছে। গায়ে আর ন্যূনতম শক্তি নেই। জিহ্বা জড়িয়ে গেছে। মনে হচ্ছে যেন কথা বলার ক্ষমতাও হারিয়েছে সে। সকাল থেকে থেমে থেমে চোখে ঝাপসা দেখলেও এখন আর চোখে স্পষ্ট কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। ব্রিজের উপরে সবকয়টা লাইট জ্বলছে না। কোনোটা একবার জ্বলছে নিভছে আবার কোনোটা একেবারে বন্ধ। গাড়ির হেডলাইটেই আলোকিত হয়ে থাকছে গোটা ব্রিজ। হঠাৎ ব্রিজের ঠিক মধ্যেখানে ব্রেক কষলো অমিত। চোখজোড়া ঝাপসা, ব্রিজের রেলিংয়ের ওদিকটায় পেছনের গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়েছে। সেই আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নবনীকে! কাঁদা মাখানো খালি পায়ে টলতে টলতে বেরিয়ে এল সে। নবনীর কাছে পৌঁছুবার আগেই রাস্তায় ঢলে পড়লো অমিত। আশপাশের গাড়িগুলো থেমে গেল তক্ষুনি। হৈ চৈ লেগে গেল ঝুম বৃষ্টির মাঝে ব্রিজের এই জায়গাটায়। 

    ৫৮

    সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে সাব্বির, শফিক আর এরশাদ সাহেব হতাশ হয়ে রাত নয়টার দিকে বাসায় ফিরছিল তখনই কল এল এরশাদ সাহেবের নাম্বারে। কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জানালো, 

    — “কাঁচপুর হাইওয়ে পুলিশ স্টেশন থেকে বলছি। আপনি ইশতিয়াক রহমানের বাবা বলছেন?”

    — “জি।” 

    — “আপনার ছেলেকে অসুস্থ অবস্থায় মেঘনা ব্রিজ থেকে গাড়িসহ উদ্ধার করা হয়েছে। উনার অবস্থা আশংকাজনক। এখানকার লোকাল হসপিটাল থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা মেডিকেল পাঠানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে হয়তো পৌঁছে ও গেছে। আপনারা হসপিটালে যোগাযোগ করুন।” 

    — “কী হয়েছে ওর?” 

    — “সঠিকভাবে কিছু বলা যাচ্ছে না। আপনারা ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলুন।” এরশাদ সাহেবের গলার স্বরে শফিক আর সাব্বিরের বুঝতে বাকি রইলো না অমিতের কোনো খারাপ সংবাদ এসেছে। সাব্বির রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে চেয়ে রইলো এরশাদ সাহেবের দিকে। 

    — “অমিতকে মেঘনা ব্রিজের উপর থেকে উদ্ধার করেছে বললো। অবস্থা ভালো না। ঢাকা মেডিকেল নাকি শিফট করছে। কী হলো ওর!” 

    এক মুহূর্ত দেরী না করে গাড়ি ঘোরালো সাব্বির। রুমানাকে কল করে বললো, 

    — “তোমার হসপিটালে এসো। অমিতকে নিয়ে আসছি আমি।” 

    — “কী হয়েছে ওর? সুইসাইড এটেম্পট?” 

    — “জানি না। তোমার বাবাকে খবর দাও। হসপিটালে আসতে বলো। উনার কাছে অমিতের ট্রিটমেন্ট হবে।” 

    — “আরে হয়েছেটা কী? সমস্যা বুঝে তারপর স্পেশালিস্ট ডাকতে হবে।” 

    — “তোমার বাবা অ্যাক্সিডেন্ট কেইস সামলাতে পারবে না?” 

    — “পারবে। অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে?” 

    — “জানি না। তুমি উনাকে আসতে বলো। অমিতকে দেখে উনি অন্তত বুঝতে তো পারবে সমস্যা কোথায়, ট্রিটমেন্ট কী হতে পারে। কোন ডক্টরের কাছে রেফার করলে ভালো হবে। পারবে না?” 

    — “হ্যাঁ।”

    — “উনাকে হসপিটালে আসতে বলো প্লিজ!” 

    এরশাদ সাহেবকে একমনে দোয়া পড়তে শোনা যাচ্ছে। এখনো ভেঙে পড়েননি তিনি। মন শক্ত করে আছেন। কিন্তু গা ছেড়ে বসে আছেন শফিক সাহেব। মনে প্রাণে ধরেই নিয়েছেন অমিতের অ্যাক্সিডেন্টই হয়েছে। চোখের সামনে পুরোনো সেই দিন ভাসছে। সামি এভাবেই রোড অ্যাক্সিডেন্টে চলে গিয়েছিল। এবার কি তবে এই ছেলেটাও… 

    বাসা তালা দিয়ে সপরিবারে অমিতের বাসায় এসেছেন নীতু। শামীমাকে সবাই ঘিরে থাকলেও নবনী যাচ্ছে না তার সামনে। লজ্জায় মুখ আড়াল করে অমিতের ঘরে বসে আছে নবনী। আলমারি খুলে ওর কাপড়গুলো, ওর প্রসাধনীগুলো, হাতঘড়িটা ছুঁয়ে দেখছে নবনী। এই ছেলেটার এত বেশী তীব্র অভাব অনুভূত কেন হচ্ছে আজ? মনে হচ্ছে যেন এই পৃথিবীর কোথাও অমিত নেই। তার সঙ্গে শেষ দেখা হয়ে গেছে আজ সকালে। তাকে শেষবারের মতন স্পর্শ করাও হয়ে গেছে। আর কখনো দেখা হবে না দু’জনের। গোটা পৃথিবীটা এলোমেলো করে কান্না পাচ্ছে নবনীর। কথায় কথায় একবার বলেছিল অমিত, আমার মাঝেমধ্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। কী ভেবে যেন বারবার রয়ে যাই সবার মাঝে। কিন্তু জানো? যেদিন হারাবো সত্যি সত্যি হারাবো। আর ফিরবো না। তবে কি অমিত সত্যিই হারিয়ে গেল? অমিতের বালিশে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো নবনী। অভিযোগ করে বলতে লাগলো, “এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার মানে কী, অমিত? ভয়ে জান বেরিয়ে যাচ্ছে আমার। এভাবে শাস্তি দিবে তুমি আমাকে?” 

    হঠাৎ কোত্থেকে নাতাশা এল ঘরে। নবনীর হাত টানতে টানতে বের করে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। 

    — “কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস আমাকে?” 

    — “হসপিটালে। অমিত ভাইয়াকে হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছে। জলদি নিচে নামো। আমি বাসায় তালা দিয়ে আসছি।” 

    থমকে দাঁড়ালো নবনী। ভীতস্বরে বললো, 

    — “কী হয়েছে ওর?” 

    — “জানি না সঠিক। তবে অবস্থা খারাপ।”

    এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না নবনী। লিফটের জন্য অপেক্ষা না করে সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে নিচে নামছে সে। 

    .

    আটতলায় অমিতকে ভি আই পি কেবিনে শিফট করা হয়েছে। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে সাব্বির, শফিক আর এরশাদ সাহেব। বাসা থেকে এখনো কেউ এসে পৌঁছায়নি। ছেলের অক্ষত শরীরটা দেখে এরশাদ সাহেব কিছুটা নিশ্চিন্ত হলেও পরমুহূর্তেই চোখে পড়লো তার নীল বর্ণের বরফ হওয়া শরীরটা। মন শক্ত রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে, তবুও তাকে রাখতে হবে। স্ত্রীকে সামলানোর জন্য হলেও নিজেকে সামলে রাখতে হবে। 

    ভেতর থেকে বেরিয়ে এল রুমানা। তার চেহারা পড়তে অসুবিধা হচ্ছে না সাব্বিরের। ভালো সংবাদ নিয়ে আসেনি নিশ্চয়ই! 

    — “খবর কী?” 

    — “হাইপোথার্মিয়া।” 

    — “এটা কী?”

    — “বডি টেম্পারেচার বিলো এইটি এইট ফারেনহাইট। এ্যান্ড ইট’স ডেঞ্জারাস। তবুও ভালো মডারেট লেভেলে আছে। এখনো সিভেয়ার লেভেলে যায়নি। কার্ডিয়াক এরেস্টে মারা যেত নয়তো। অলমোস্ট ৮-১০ ঘন্টা ভেজা কাপড়ে ছিল। দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টিতে ভিজেছে অনেকক্ষণ। তার উপর বাইরে ঠান্ডা বাতাস। জেনারেলি কোল্ড ওয়েদারের চেয়ে এই সমস্যাটা লং টাইম ভেজা কাপড়ে, স্যাতস্যাতে বাতাসে থাকার কারণে বেশি দেখা দেয়। তারউপর বিপি লো ছিল ওর। এটাও রিস্ক ফ্যাক্টর। যাদের ব্লাড প্রেশার লো তাদের অ্যাটাক করার চান্স বেশি থাকে।” 

    এগিয়ে এলেন এরশাদ সাহেব। এই ব্যাপারে বিশেষ কোনো ধারণা তার নেই। রুমানাকে জিজ্ঞেস করলেন, 

    — “আমাকে বলো তো মামণি ওর শরীরে সমস্যা এখন মূলত কী হচ্ছে? টেম্পারেচার লো হলে কী কী হতে পারে?” 

    — “ওর পালস রেট, রেসপিরেটরি রেট দুটোই এ্যাবনরমাল। সাধারণত অতিরিক্ত ঠান্ডায় শরীর কাঁপে। কিন্তু ওর কাঁপছে না আপাতত। এটা গুড সাইন না। দ্যাট মিনস ওর ইন্টারনাল ফাংশন কাজ করছে না প্রপারলি। এই সমস্যায় এমনই হয়। সার্কুলেশন, বডি অর্গান কাজ করা বন্ধ করে দেয় ধীরে। শ্বাসকষ্ট হয়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মেমরি পাওয়ার লস হয়। আরো কিছু কমপ্লিকেশনস আছে। তবে পালস রেট কমে আসা বা বড়ি অর্গান এক্টিভিটি প্রোপারলি ওয়ার্ক না করার ব্যাপারটা বুঝতেই পারছেন?” 

    — “আমার ছেলে বাঁচবে?” 

    — “বাঁচবে না কেন?” 

    — “সোজাসাপটা বলো আমাকে। সত্যিটা বলো। কথা লুকানোর কিছু নেই। ও কি বাঁচবে?”

    — “আব্বু আছে ভেতরে। দেখছে ওকে। বেস্ট ট্রিটমেন্ট ওকে দেয়া হবে।” 

    — “আমি জানি তোমার বাবা বেস্ট মেডিসিন এ্যান্ড কার্ডিওলজি স্পেশালিষ্টদের একজন। উনি উনার বেস্টটাই দিবেন। কিন্তু অমিতের শরীর তো সায় দিতে হবে। ওর কপালে হায়াত থাকাও জরুরি। তুমি ছিলে ভিতরে, দেখেছো ওকে। বলো আমাকে, বাঁচবে ও?” 

    সাব্বিরের দিকে অসহায় ভঙ্গিতে তাকালো রুমানা। শফিক সাহেব এরশাদকে এক প্রকার জোর করে এখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। হাত কামড়ে কান্নার শব্দ আড়াল করছেন তিনি। এত যন্ত্রণা ভুগে তার ছেলেটা মরে যাবে? সাব্বিরের চোখে পানি ছলছল করছে। রুমানা তার পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,

    — “নেক্সট তিন চারঘন্টা ক্রিটিকাল। হোপফুলি কন্ট্রোলে আনা যাবে। সমস্যা হচ্ছে অমিত ইমিডিয়েট ট্রিটমেন্ট পায়নি। বিলোও নাইনটি ফাইভ হলেই প্রপার স্টেপস নিতে হয়। ধুপ করে তো আর এইটি এইট হয়নি, ধীরে ধীরে হয়েছে। তার উপর কোথাকার কোন হসপিটালে নিয়েছে ওখানে ওরা কোনো চিকিৎসাই দেয়নি ওকে। জাস্ট একটা কম্বল পেঁচিয়ে, মুখে অক্সিজেন দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। ওখান থেকে আবার এখানে নিয়ে এলে টাইম ওয়েস্ট হলো না আরো! আচ্ছা তুমি ওকে কোত্থেকে নিয়ে এলে?”

    — “ঢাকা মেডিকেলে পাঠিয়েছিল। মেডিকেলে পৌঁছাবার আগেই আমি পৌঁছে গেছি। গেইট থেকে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এসেছি এখানে।” 

    — “আচ্ছা! থাকো এখানে। খেয়াল রেখো হসপিটালে যেন বেশি কেউ না থাকে। আর আঙ্কেল আন্টিকে সামলে নিও। নবনী জানে?” 

    — “হ্যাঁ। আসছে ও।” 

    — “ওকে সাবধানে। কোনো অবস্থাতেই আমার পেশেন্টের কন্ডিশন যেন খারাপ না হয়।” 

    — “তুমি চলে যাচ্ছো?” 

    — “একটু নিচে যাচ্ছি, কাজ আছে। আধঘন্টার মধ্যেই আসছি আমি। আর বাবা আছে ভেতরে। তোমার বিরাট ফ্যান আমার বাবা। তুমি কান্নাকাটি করে একটা আবদার করেছো, মনে হয় না তোমার বন্ধু ডেঞ্জার ফ্রি হওয়ার আগ পর্যন্ত বাবা আর এখান থেকে বেরোবে।” 

    সাব্বিরের গালে আলতো হাত বুলিয়ে মুচকি হাসলো রুমানা। 

    রুমানা বেরিয়ে যেতেই এখানে এসে পৌঁছালো সবাই। নবনী এক প্রকার দৌড়ে এল সাব্বিরের কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে জিজ্ঞেস করলো, 

    — “কী হয়েছে অমিতের?” 

    .

    বরফের পাহাড়চূড়ায় নিজেকে আবিষ্কার করলো অমিত। ঠিক চোখের কাছে অনেকগুলো সূর্য। কী কড়া রোদ ইশ্! চোখ মেলা যাচ্ছে না। ঐ তো শেষ সূর্যটার পরেই নবনী দাঁড়িয়ে! হাসছে, খিলখিল করে হাসছে। পিটপিট চোখে অমিত আপ্রান চেষ্টা করছে নবনীকে দেখার। প্রায় অবশ হয়ে আসা হাতটা বাড়িয়ে দিতে চাইছে নবনীর দিকে। হচ্ছেই না! কান্না পাচ্ছে অমিতের। ভাঙা কণ্ঠ, জড়ো জিহ্বায় নবনীকে ডাকলো সে, কাছে আসো না নবনী? চোখ মেলতে পারছি না। এতগুলো সূর্য কেন মাথার উপর? আমাকে ছায়া দাও। হাসছো কেন? কষ্ট হচ্ছে আমার! এ্যাই নবনী! 

    স্তব্ধ হয়ে দেয়ালে গা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নবনী। ওকে শক্ত করে আঁকড়ে রেখেছে নাতাশা। ওয়েটিং রুমে শামীমা নীতুর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছে। অনি, জামিলা বেগম আর নীতুকে বারবার করে বলছে, 

    — “নবনীকে বলো না, আমার ছেলেটার পাশে গিয়ে বসতে। ওকে পেলেই আমার অমিত সুস্থ হয়ে যাবে। খট করে কেবিনের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন রুমানার বাবা, ডক্টর হাবিবুল্লাহ খান। সাব্বিরকে ডেকে বললেন,

    — “রুমানা কোথায়?” 

    — “বেরিয়েছে একটু।” 

    — “অমিত ওর ওয়াইফকে দেখতে চাচ্ছে।” 

    — “জ্ঞান ফিরেছে?” 

    — “আসছে যাচ্ছে। হ্যালুসিনেশন হচ্ছে ওর। এই সিচুয়েশনে হয় এমন। নবনীকে দেখছে,ওকে কাছে ডাকছে। ভাবছি একবার ভেতরে আসতে বলবো কি না। একটু দেখা হোক দু’জনের। তাই রুমানাকে খুঁজছি। ওর পেশেন্ট আমার পেশেন্টকে দেখতে পারবে কি না, কোনো সমস্যা হবে কি না সেটা ওর সঙ্গে ডিসকাস করতে হবে। রুমানা এলে ভেতরে পাঠিয়ে দিও।” 

    সাব্বির আর শ্বশুরের কথোপকথনের সময় দরজার ফাঁক দিয়ে অমিতকে দেখছিল নবনী। অমিতের ফ্যাকাশে মুখ, অক্সিজেন মাস্ক দেখেই মাথাটা বাজেভাবে ঘুরিয়ে উঠলো। নিঃশ্বাস আটকে আসছে নবনীর। পায়ের তাল সামলে দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। নাতাশাকে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো ও। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল মুহূর্তেই। নাতাশা জিজ্ঞেস করলো, 

    — “ঠিক আছো তুমি?” 

    দৃঢ়ভাবে ডানে বামে মাথা নেড়ে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে এল নবনী। কান বন্ধ হয়ে আসছে তার। পাশ থেকে নাতাশা, সাব্বির ডাকছে ওকে। কারো ডাক কানে পৌঁছাচ্ছে না ওর। গন্তব্যহীন হাঁটছে নবনী। এখান থেকে পালাতে হবে ওকে। 

    .

    বাসায় ফিরে এসেছে নবনী। ভয়ে পুরো শরীর কাঁপছে তার। প্রচন্ড অপরাধবোধে মাথার ভেতরটা বুঝি ফেটে যাচ্ছে। অমিতের মাস্ক লাগানো ফ্যাকাশে মুখটা এক মুহূর্তের জন্যও চোখের সামনে থেকে সরছে না। তীব্র কষ্টে অঝোরে কাঁদছে সে। যাকে একদিন এত চোখেচোখে রেখেছিল যেন নিজের কোনো ক্ষতি না করতে পারে সেই ছেলেটা কিনা আজ তারই জন্য মরতে বসেছে? এই পীড়া, আফসোস সে রাখবে কোথায়? কে বুঝবে? অমিত যদি মরে যায় তাহলে কি সে অমিতের খুনী হবে না? কী জবাব দিবে চাচীকে? কিংবা সে নিজেই কেমন করে মেনে নেবে? যাকে ছাড়া একদিন টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে তার চিরপ্রস্থান কেমন করে সয়ে যাবে সে? বুকের ভেতরটা কেমন ফাঁকা লাগছে! জীবন থেকে অমিত হারিয়ে যাচ্ছে। তার সবচেয়ে কাছের মানুষটা, সঙ্গীটা চলে যাচ্ছে তাকে একা করে। শরীর অসার হয়ে আসা কষ্টে কান্নার শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে লাগলো। চিৎকার করে নাতাশাকে বলতে লাগলো, 

    — “অমিত চলে যাচ্ছে নাতাশা। ওকে আমি কষ্ট দিয়েছি। অসম্ভব সরল ছেলেটাকে আমি মরণের পথে ঠেলে দিয়েছি। আর কোনো কাছের মানুষের মৃত্যু আমি দেখতে চাই না। কী হাল করেছি আমি ওর! আমার শাস্তি কী?” 

    নবনীকে স্বান্তনা দেবার মতো মানসিক জোর নাতাশার নেই। অমিতকে দেখেছে সেও। সেই থেকে ক্লান্ত লাগছে ভীষণ। ইচ্ছে হচ্ছে দরজা জানালা আটকে ফ্লোরে পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে। প্রিয় মানুষগুলোরই কেন এমন করুন পরিস্থিতি হবে সবসময়? কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠেছে নবনীর। পানির জগ নিতে রুম থেকে বেরিয়েছে নবনী তখনই বাসার কলিংবেল বাজলো। দারোয়ান এসেছে। নাতাশা দরজা খুলতেই তার হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে বললো, 

    — “পাশের বাড়ি থেকে সুমনা আপা আসছিল। বললো আপনাদের নাকি কল দিছে অনেকবার, কেউই কল রিসিভ করেন না! আপা আজকে শ্বশুরবাড়ি চইলা গেছে। ঐখান থেকে ডাইরেক বিদেশ। এদিকে আর আসবে না। আমারে বললো, এইটা খুব জরুরি জিনিস, নবনী আপারে দিতে। আর হ্যাঁ, এইটা যেন সে ছাড়া আর কেউ না খুলে। আপারে দিয়া দিয়েন এইটা।” 

    দারোয়ান চলে যেতেই প্যাকেট খুলতে লাগলো নাতাশা। কৌতূহল সংবরন করতে পারেনি সে। চমকে গেল নাতাশা। সামির ডায়েরি প্যাকেটের ভেতর! যদিও ডায়েরি লেখার অভ্যেস কখনো তার ছিল না। কিন্তু টেবিল ভর্তি নানা রকম ডায়েরি সাজানো থাকতো। কী আছে ডায়েরিতে? এতবছর পর হঠাৎ এটা কেন? অজস্র কৌতুহল মনে জমা হলো ঠিকই কিন্তু প্রশ্রয় দিলো না সে। যাকে এটা দেয়া হয়েছে তার হাতেই তুলে দিলো নাতাশা। বললো, 

    — “চিনেছো এটা?” 

    অবাক চোখে নাতাশার দিকে তাকালো নবনী। 

    — “এটা কোথায় পেলি?” 

    — “সুমনা আপু দিয়েছে। পড়ো।” 

    নবনীর একহাতে ডায়েরি অন্যহাতে পানির গ্লাস দিয়ে বেরিয়ে এল নাতাশা। একান্তে বসে পড়ুক নবনী। কে জানে এখানে হয়তো জাদুর কাঠি আছে যা কিনা পুরো ঘটনার মোড়টাই বদলে দিবে! 

    তাড়াহুড়ো করে চোখের পানি মুছে ডায়েরিটা খুললো নবনী। প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা পুরোপুরি সাদা। ৮-১০ পৃষ্ঠা পর সামির লেখা পাওয়া গেছে। নিঃশ্বাস আটকে পড়তে লাগলো সে। 

    ‘এক সপ্তাহ বাদে বিয়ে। আমাদের সবচেয়ে আকাঙ্খিত দিন জীবন দুয়ারে চলে এসেছে। হুলস্থুল করে পুরো বাসা আমার মাথায় চড়ানোর কথা। অথচ আমি খুশি না। হতে পারছি না আমি। সবকিছু ঠিকঠাক আগাচ্ছে, দুই পক্ষের কখনো কোনো আপত্তি ছিল না। নবনী আমার মাঝে কখনো দ্বন্দ্ব ছিল না, আজও হচ্ছে না। বিয়ের প্রতিটা সিদ্ধান্ত দুই পরিবার দুই পরিবারের খুশির কথা মাথায় রেখে নিচ্ছে। এতটা ঝামেলাহীন বিয়ে কারো হয়? আমার হচ্ছে, তবুও আমি খুশি না। মনে মনে খুব ভয় হচ্ছে, এই বিয়েটা হবে না। আমাদের বিয়েটা হবে না নবনী। আমাদের আলাদা হবার সময় কাছাকাছি চলে এসেছে। সারাক্ষণ কী মনে হয়, জানো? আমি আর বাঁচবো না। মারা যাবো। হয়তো! খুব স্ট্রং ফিল পাই। জানি আমার কোনো অসুখ নেই। সেদিন রাতে জাস্ট একটা স্বপ্ন দেখেছি মাত্র। অন্য কারো সঙ্গে তোমার সংসারের স্বপ্ন। সেই থেকে আমি আর একটাদিনের জন্যও শান্তি পাচ্ছি না। অনেক কথা, অনেক ভয় মনের ভেতর লুকিয়ে রাখছি। কাউকে বলতে পারছি না। সবাই হেসে উড়িয়ে দিবে না বলো? তুমি আমাকে সবসময় বুঝো, জানি আমি। তবুও কেন জানি না আমি এই কথাগুলো তোমার সঙ্গেও শেয়ার করতে পারছি না। তোমাকে ছেড়ে চলে যাব, আমাদের আর কখনো দেখা হবে না, কথা হবে না ভাবতেই কেমন অসহ্য যন্ত্রণা হয়। তোমার অন্য কারো সঙ্গে সংসার হবে সে কথা ভাবতেই সবকিছু কেমন এলোমেলো লাগে। আমি কি মানসিক রোগী হয়ে গেছি? আমার জীবনে কোনো সমস্যা নেই। তুমি আছো, মিষ্টি দু’টো পরিবার আছে, স্বচ্ছলতা আছে, দেশের সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্টিফিকেট আছে। বেকারত্ব কী জিনিস, বুঝিনি। পড়া হওয়া শেষ হওয়া মাত্র বাবার ব্যবসা সামলাচ্ছি। আমার কোনো অভাব নেই। এক জীবনে সুখে থাকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সব আমার আছে, তবুও পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী মানুষটা এখন আমি। আচ্ছা অনেক সুখে কি মানুষ মানসিকভাবে অসুস্থ হয়? কী জানি! অদৃশ্য কিছু একটার সঙ্গে আমার যুদ্ধ চলছে। যে সারাক্ষণ আমাকে ভয় দেখাচ্ছে, আমি মারা যাবো। তুমি আমার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাবে। তবে ভয়টা আমি আজ সকালে জয় করে ফেলেছি নবনী। এতদিন শুধু নিজেকে নিয়ে ভাবছিলাম স্বার্থপরের মতো। তোমার কী হবে ভাবিইনি! মরে গেলে পৃথিবীর সব বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে তবেই যাব। কিন্তু তুমি তো থেকে যাবে, এইসব মায়া আর বন্ধনের মাঝে। আমার স্মৃতির মাঝে। তুমি কেমন করে বাঁচবে তখন? একটাদিনও থেকেছো কখনো আমাকে ছাড়া এতগুলো বছরে? সেই আমাকে ফেলে আমৃত্যু জীবন কাটাতে হবে, কষ্ট হবে না বলো? মরে টরেও যেতে পারো। তোমাকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। তারপর মনে হলো এবার আমার একটু উদার হওয়া উচিত। শোনো রোদ্দুর, খুব কঠিন কিছু বলতে যাচ্ছি এবার। মন দিয়ে পড়বে। আর তারচেয়ে বড় কথা আমার এই কথাগুলো তোমাকে মানতে হবে। এটা আমার আবদার না, দাবি। জীবনে অনেক কিছু ঘটে। সবকিছু কি আর আমাদের হিসেবে হয়? উপরওয়ালার একটা সিদ্ধান্ত আছে না, বলো? সবশেষে উনার সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত। এক জীবনে ভালো হবে, মন্দ হবে এবং সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে। কেন হলো, এটা হলে কী হতো, ওটা হলে কী হতো না এত হিসেব নিকেশে না যাওয়াই ভালো। জীবন সহজ হবে। আমি চলে যাবার পর তুমিও এত হিসেব নিকেশে যেও না। মেনে নিও। ধরে নিও আমাদের সম্পর্কের পূর্ণতা ভাগ্যবিধাতা ভাগ্যেই লিখেননি। আমাদের একসাথে পথ চলা এপর্যন্তই ছিল। এরপর থেকে বাকি পথটা অন্য কারো সঙ্গে তোমার চলতে হবে। একই সুতোয় অন্য কারো সঙ্গে বাঁধা পড়বে তুমি। এমনটাই হয়তো ভাগ্য বিধাতা চেয়েছেন। জানি তুমি এখন এই লাইনগুলো পড়ে রেগে যাচ্ছো। ভ্রুর মাঝে হাজারটা ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কথা শোনো মেয়ে। জীবনটা না এমনই! একজীবনে সবাই সবকিছু পায় না। বড় কোনো চাওয়া অপূর্ণ থাকেই। আমাদের বেলায় আমরা দু’জন দু’জনকে হারাবো, এটাই আমাদের অপ্রাপ্তি, আফসোস। দুর্ভাগ্যবশত সবচেয়ে বড় চাওয়াটাই আমরা পাচ্ছি না। কী আর করা বলো! উপরওয়ালার সিদ্ধান্তের বাইরে কে কবে যেতে পেরেছে? আমাকে হারাবার কষ্ট তুমি কখনো ভুলবে না সে কথা আমি জানি রোদ্দুর। তাই বলে সারাজীবন আমাকে নিয়েই পড়ে থেকো না। শুনেছি, সময়ের সাথে সাথে কষ্টগুলোও নাকি ফিকে হতে থাকে। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আর বছরখানেক বাদে যখন আমাকে হারাবার কষ্ট একটুখানি সেরে যাবে নিজের জীবনটা তখন সাজিয়ে নিও। যদি কখনো, কেউ একজন এক সমুদ্র ভালোবাসার আর্জি নিয়ে তোমার সামনে এসে দাঁড়ায় তাকে ফিরিয়ে দিও না। দু’হাতে আঁজলা করে তার ভালোবাসাটুকু নিও। তাকে আঁকড়ে রেখো। আমার দোহাই দিয়ে তাকে দূরে সরিয়ে দিও না। শুনেছি মানুষ মারা যাবার পরও নাকি প্রিয় মানুষদের দেখতে পায়। আমিও তোমাকে দেখবো কিন্তু! যদি কখনো দেখি আমার কারণে তুমি তোমার জীবনটা এক জায়গাতেই আটকে রেখেছো তাহলে কিন্তু খুব কষ্ট পাবো। ভীষণ অভিমান হবে আমার। তোমার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে জানো! আমার সঙ্গে সঙ্গে তুমিও মরে যেও না কিন্তু। বেঁচে থেকো প্লিজ। আনন্দে, হাসিতে যেমনটা তোমাকে রেখে যাচ্ছি। আর আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছি, আমি তোমাকে রিকুয়েস্ট করিনি। এটা আমার দাবি। ভালো থেকো রোদ্দুর। যতটা ভালো আমি তোমাকে দেখতে চাই ঠিক ততটা।’ 

    .

    ডায়েরীর লেখাগুলো ছুঁয়ে দিচ্ছে নবনী। সামির হাতের টানা টানা লেখা। কয়েক জায়গায় দুই চারটা শব্দের কালি পানি লেগে ছড়িয়ে গেছে। চোখের পানি হয়তো! সামি লেখার সময় কাঁদছিলো হয়তো! ডায়েরীর পাতা উল্টাতে লাগলো নবনী। আরো কিছু কি লেখা আছে তাতে? ডায়েরীর পেছনের মলাটে চোখ পড়লো ওর। সেখানে সাদা কাগজ আঠা দিয়ে লাগানো। কাগজে লেখা আছে, বালিশের নিচে ডায়েরিটা রেখে যাচ্ছি। আমি চলে যাবার পর যে আমার বিছানা গোছাতে আসবেন প্লিজ এই ডায়েরীটা নবনীর হাতে তুলে দেবেন।’ ডায়েরিতে মুখ গুঁজে আবারও অঝোরে কাঁদতে লাগলো নবনী। তার চোখের পানিতে ভিজে যাচ্ছে ডায়েরির মলাট। 

    — “কত কাঁদো তুমি! ক্লান্ত লাগে না? বিরক্তি ধরে আসে না?” 

    লাফিয়ে উঠলো নবনী। কান্না থেমে গেল এক মুহূর্তেই। অবাক চোখে চেয়ে রইলো সামনের চেয়ারে। 

    — “তুমি!” 

    — “না এসে উপায় আছে? যা ঝামেলা বাঁধিয়েছো না! কে সামলাবে তোমাকে? যে সামলে নিতে চেয়েছিল তাকে তো হসপিটাল পাঠিয়ে দিলে। এখন বাসায় বসে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছো। তুমি এমন কাঁদুনি হলে কবে থেকে, বলো তো? কান্না ছাড়া আর কিছুই পারো না। বিরক্তিকর! নাক থেকে সর্দিও বেরুচ্ছে! মুছো শিগগির। “ ধমকে উঠলো সামি। তাড়াহুড়ো করে টিস্যু নিয়ে নাক চোখ মুছতে লাগলো নবনী। 

    — “তুমি এতদিন কোথায় ছিলে? কেন আসোনি তুমি? কত খুঁজেছি তোমাকে!”

    — “কেন খোঁজো আমাকে?” 

    — “রেগে আছো আমার উপর? বিশ্বাস করো সামি, কোনো প্রতারণা আমি করতে চাইনি তোমার সঙ্গে। কিভাবে যে কী হয়ে গেল!” 

    — “এ্যাই, খবরদার উল্টাপাল্টা বকবে না। আমি একবারও বলেছি তুমি প্রতারণা করেছো?” 

    — “তাহলে আসোনি যে!” 

    চেয়ার ছেড়ে উঠে এলো সামি। নবনীর পাশে বসে বললো, 

    — “তোমাকে সামলে নেবার, দেখে রাখার মানুষ যে এখন আছে!” 

    — “এভাবে বলো না।”

    — “কেন বলবো না? তোমার একজন মানুষ আছে যে তোমাকে আগলে রাখতে চায়, তোমার সোলমেট হতে চায়, নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে চায় এটা কি অপরাধ? একদম না। বরং সুন্দর। কিন্তু তুমি যা করছো সেটা অপরাধ। অকারণ অপরাধবোধে অন্ধ হয়ে নিজের ভালোবাসা আড়াল করছো, অমিত মেনে নিতে পারবে না জেনে বুঝেও ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছো। কিসের প্রতারণা? কিসের এত অপরাধবোধ বলো তো? আমি কি কখনো তোমাকে বেঁধে রাখতে চেয়েছি? আমি সবসময় চেয়েছি তুমি অতীত থেকে বেরিয়ে আসো। বাঁচো, ভালো থাকো। যাকে তোমার ভালো লাগবে, যে তোমাকে ভালোবাসবে তার সঙ্গে জীবন সাজাও। তবুও কেন বারবার বলছো প্রতারণা করেছো তুমি আমার সঙ্গে? অমিতকে ভালোবাসো তুমি বোকা মেয়ে! এই সহজ সত্যিটা মেনে নিতে তোমার এত কিসের দ্বিধা? কেন বারবার তোমাদের মাঝে আমাকে টেনে এনে দাঁড় করাচ্ছো?” 

    — “সবাই বলে তুমি কোথাও নেই। আমি যা দেখি সবটাই ভুল। সত্যিই কি তুমি নেই?” 

    — “কে বলে আমি নেই? আমি আছি না তোমার স্মৃতি হয়ে? আজীবন থাকবো। তোমার সুন্দরতম অতীতে। আমাকে অতীত হয়েই থাকতে দাও। আর হসপিটালের বেডে যাকে ফেলে এসেছো তাকে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ হয়ে থাকতে দাও।” 

  • ………………..
  • — “যেই মানুষটা আর নেই তার জন্য জীবিত একটা মানুষকে শেষ করে দিবে তুমি? তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে? কাউকে ভালোবাসলে এভাবে শাস্তি দিতে হয় বুঝি!” 

    — “আমি কখনো চাইনি অমিতের এই হাল হোক। তুমি অন্তত আমাকে বুঝো!”

    — “বুঝি। তুমি কষ্ট পাচ্ছো বলেই তোমাকে দেখাচ্ছি তোমার ভুলটা কোথায় হলো, সংশোধন কেমন করে হবে। তুমি আমাকে ভালোবাসতে নবনী। এখন তুমি অমিতকে ভালোবাসো। এটাই সত্যি আর তাতে আমার আপত্তি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। প্রতারণার ভূত কেন যে মাথায় চাপলো তোমার কে জানে! ঠিক এই কারণে যতসব ঝামেলা হলো। ছাড়ো সবকিছু। যে চলে গেছে তাকে চিরতরে সমস্ত আবেগ থেকে মুক্তি দাও, যে আছে তাকে তোমার জীবনে সমস্ত আবেগ দিয়ে জড়িয়ে রাখো।” 

    — “তুমি চলে যাবে সামি?” 

    — “কোথায় আর যাব! আছি তো আমি। তোমার মাঝে, তোমার সুন্দরতম স্মৃতিতে। বললাম না তখন! এবার তুমি যাও নবনী। হসপিটালে পড়ে আছে ছেলেটা। তোমাকে ওর ভীষণ প্রয়োজন।” 

    ঘর থেকে বেরিয়ে গেল নবনী। হাসিমুখে ওকে বিদায় দিলো সামি। যে হাসিতে কোনো একসময় নবনী ডুবে মরতো। 

    .

    মোবাইল হাতে স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে নাতাশা। ঠোঁটের কোণে তার একটুখানি হাসি। সুমনা ম্যাসেজ পাঠিয়েছে অনেক আগেই। চোখে পড়েনি এতক্ষণ। এতটা সময় বাদে চোখে পড়তেই তড়িঘড়ি করে ম্যাসেজটা ওপেন করেছে সে।

    ‘একটা ডায়েরী রেখে যাচ্ছি। আমার ভাইয়ের শেষ কিছু কথা। এতদিন নবনীকে দেইনি। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। এতবছর বাদে সময় হয়েছে। হয়তো এবার এই ডায়েরী একটা ম্যাজিক দেখাবে।’ 

    ৫৯

    অমিত ঘুমাচ্ছে। বেডের পাশে বসে আছে নবনী। অন্যপাশে শামীমা। ভোরের দিকে ডক্টর হাবিব বেরিয়ে গেছেন কেবিন থেকে। যাবার আগে মিষ্টি হেসে ডক্টর হাবিব বলে গেছেন, 

    — “ভালো আছে ও। চাইলে পরশু নাগাদ বাসায় নিয়ে যেতে পারেন।” 

    স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো দুই পরিবার। রুদ্ধশ্বাস এক রাতের শেষে নতুন ভোর যেন প্রাণ ফিরিয়ে দিলো তাদের। সবাই বাসায় ফিরে গেছে। হসপিটালে রয়ে গেছে সাব্বির, শামীমা আর নবনী। সাব্বির বাইরে গিয়েছিল চা আনতে। ফিরে এসে শামীমার হাতে চা ধরিয়ে বললো, 

    — “একটা সিএনজি ঠিক করে দেই। বাসায় চলে যান আপনি।”

    — “আমার ছেলে আমার সঙ্গে কথা বলবে, ও নিজের মুখে বলবে ভালো আছে। তারপর আমি যাবো।” 

    আর কথা বাড়ালো না সাব্বির। কাপ হাতে সোফায় গিয়ে বসলো। চায়ে চুমুক দিতে দিতে নবনীকে দেখছে সে। গতকাল রাত থেকেই দেখছে। চোখেমুখে তীব্র অপরাধবোধ ওর। সঙ্গে কষ্টটাও যেন চোখজোড়া স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে। অমিত জেগে উঠার অপেক্ষায় বসে আছে ওর হাতটা ধরে। চলে যেতে চেয়েছিল মেয়েটা দূরে। একেবারে। কিন্তু আবার নিজেই ফিরে এল অমিতের কাছে। অবশ্য ফেরারই ছিল। ভালোবাসা থেকে কে কবে পালিয়ে থাকতে পেরেছে। শুধু শুধু মাঝে পড়ে অমিতটার একদম নাজেহাল অবস্থা হলো। তবুও এক হিসেবে ভালো, নবনী এই ধাক্কায় ফিরে তো এল! নয়তো কতদিন যে সময় লাগতো কে জানে? 

    .

    চোখ মেললো অমিত। সামনে নবনী আর মা বসে আছে। নিজের হাতটা খুঁজে পেলো নবনীর হাতের মাঝে। ঠোঁট চেপে ফুঁপিয়ে কাঁদছে নবনী। শামীমা সঙ্গে সঙ্গে উঠে এলেন চেয়ার ছেড়ে। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, 

    — “শরীরটা ভালো লাগছে বাবা?” 

    — “নবনী কি সত্যিই আমার হাত ধরে বসে আছে?” 

    — “হ্যাঁ।”

    — “ও কি আবার চলে যাবে?” 

    — “নবনীর সাহস আছে তোকে ছেড়ে যাবার? শেকল পরাবো ওকে এবার। কোত্থাও যাবে না ও।”

    — “তাহলে আমি ভালো আছি।” 

    ফিক করে হেসে মুখ থেকে চা ফেলে দিলো সাব্বির। জোর করে হাসি চেপে রেখেছেন শামীমা। কপট রাগে সাব্বিরকে বললেন,

    — “চড় লাগাবো কিন্তু! হাসছিস কেন তুই?” 

    — “সারারাত অকারণে আমার শ্বশুরকে জাগিয়ে রাখলাম। নবনীকে ওর পাশে বসিয়ে রাখলেই হতো। এমনি এমনি সুস্থ হয়ে যেত আপনার ছেলে।” 

    — “আমার ছেলে বলেছে ও ভালো আছে, এবার আমার শান্তি। আমি এখন বাসায় যাবো। কাজ আছে অনেক। আমাকে নিয়ে চল বাসায়। আর এইযে অমিতের ওষুধ তোমাকে বলছি শোনো, এভাবেই আমার ছেলের হাত ধরে বসে থাকবে। নড়বে না একদম! দুপুরে খাবার নিয়ে আসবো আমি। তখন এসে যেন দেখি এখানে এভাবেই বসে আছো।” 

    কিছু বললো না নবনী। মাথা নিচু করে বসে রইলো শুধু। সাব্বিরকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন শামীমা। নবনীর দিকে ঘাড় ফেরালো অমিত। 

    — “কাঁদছো কেন?” 

    — “জানি না।” 

    — “আমাকে ভালোবাসো সে কথা জানো? ফিল করতে পারছো?” 

    — “জানি না।” 

    — “এমনিতে তোমার কান্না আমার পছন্দ না। কিন্তু এখন দেখতে ভীষণ ভালো লাগছে আমার জন্য কাঁদছো তুমি।” 

  • …………………………..
  • — “সত্যি সত্যি ফিরে এসেছো তো, তাই না? আমাকে ছেড়ে যেতে চাইবে না তো আর কখনো?” 

    গলা ধরে এল অমিতের। সঙ্গে সঙ্গে অমিতের বুকে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে বসে রইলো নবনী। বেডের একপাশে সরে গেল অমিত। নবনীর হাতে টেনে নিজের পাশে শুইয়ে একহাতে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। 

    — “অমিত?” 

    — “হুম?” 

    — “অনেক কিছু বলার আছে তোমাকে। কিচ্ছু গুছিয়ে বলতে পারছি না। তুমি আমার সব কথা বুঝে নেবে প্লিজ!” 

    নবনীর মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো অমিত। বললো, 

    — “আচ্ছা বুঝে নিলাম।” 

    .

    কার ড্রাইভ করতে করতে গল্প করছে শামীমা আর সাব্বির। পুরোনো ঘটনা মনে করে দুজনে হাসছে খুব। শামীমা হঠাৎ গল্পের প্রসঙ্গ বদলালেন। 

    — “নবনী হঠাৎ কেমন বদলে গেল না?” 

    — “হুম।” 

    — “গতকাল বাসায় গেল, ফিরে এসে আমার কাছে মাফ চাইলো। অমিতকে ছেড়ে আর কখনো কোথাও যাবে না প্রমিজ করলো। হঠাৎ এমন কেন হলো বল তো? জাদুর কাঠির ছোঁয়া লাগলো নাকি!” 

    — “হয় এমন। কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মালে আমরা অনেক সময় বুঝতেই পারি না ঐ মানুষটার জন্য ভালোবাসা জন্মেছে। তারপর যখন সাময়িক বিচ্ছেদ আসে কিংবা বড় কোনো ক্ষতি হয় প্রিয় মানুষটার তখন ভালোবাসা বুঝতে পারি। নবনীর বেলায় ঠিক এটাই হয়েছে।

    — “ভালোবাসা এত কঠিনও হয়, জানতাম না। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইনি কখনো।”

    — “তবুও ভালো নবনী ফিরে এসেছে। অমিতের সঙ্গে এই সম্পর্কটা মেনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এবার খালা একটা পার্টি কিন্তু আমি চাই।” 

    — “পার্টি কী রে! পুরোদস্তুর বিয়ের আয়োজন করবো আমি। একবার আমার ছেলেটা বাসায় ফিরুক শুধু!” 

    ইট’স কমপ্লিকেটেড – ৬০

    ৬০

    এক মাস পর… 

    এই সপ্তাহে বাসার বড় মেয়ের বিয়ে। চলছে তোড়জোর প্রস্তুতি। তারচেয়েও তোড়জোড় দিয়ে ঝগড়া চলছে নীতু শফিকের। বারবার বিয়ে সংক্রান্ত কোনো না কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে ঝগড়া বেঁধে যাচ্ছে দুজনের। আজ এই মুহূর্তেও ঝগড়া হচ্ছিল। ঝগড়ায় বিরতি টানলো শফিকের ছোটবোনের ফোনকল। কল রিসিভ করতেই সুরাইয়া ওপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠলো, — “তুমি আমার শ্বশুরবাড়ি দাওয়াত পাঠিয়েছো কেন?” 

    — “কেন? সমস্যা কী?” 

    — “সমস্যা কী! নবনীকে নিয়ে কেমন তামাশা করলো রওনকের দাদা! ভুলে গেছ?”

    — “ভাগ্যিস তামাশা করেছিল নয়তো আমার মেয়ের জীবনটা থেমে থাকতো। আর সব কথার বড় কথা অমিত একবাক্যে বলে দিয়েছে রমিজ মির্জাকে ছাড়া সে বিয়ের স্টেজে উঠবে না। কোনোভাবেই না। ছেলেটা এখন তোর শ্বশুরের ডাইহার্ড ফ্যান হয়ে গেছে, বুঝলি!” 

    — “মজা করছো?” 

    অট্টহাসি হাসলেন শফিক সাহেব। কথার প্রসঙ্গ বদলে বললেন, 

    — “তুই আসছিস কবে?” 

    আলমারী থেকে নিজের সমস্ত দামী রঙীন শাড়ীগুলো বের করছেন জামিলা বেগম। স্বামী বেঁচে থাকতে কত শত দামী শাড়ি এনে দিতেন কলকাতা, বম্বে থেকে। কোন রঙের শাড়ীটা নেই তার কাছে! সেখান থেকে বেছে বেছে পাঁচটা শাড়ী নবনীকে দিবেন তিনি। কিন্তু কোনটা যে দিবেন সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না। ওহ্ হ্যাঁ! সঙ্গে একটা চেইন আর কানের দুলও। নীতুটা পছন্দ করে দিলে ভালো হতো মনে হয়! গলা ছেড়ে মেয়েকে ডাকছেন তিনি। 

    — “নীতুউউউ? নীতুরেএএএ? এদিকে আয় তো আম্মা।” 

    .

    ঘর গোছাতে গোছাতে ঘাম ছুটে গেছে নাতাশার। সারাদিন অনির সঙ্গে মার্কেট ঘুরে এইবেলায় আর ঘর গোছাতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছে হচ্ছে না। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে নাতাশা। 

    — “আমি হলাম কাজের বুয়া, উইদাউট পেমেন্ট। নিত্যদিন ঘর ঝাড়ছি, গোছাচ্ছি তবুও হচ্ছে না। কেন ঘর এত এলোমেলো হয়? ঘরের ভেতর কি বাচ্চা জ্বীনেরা হামলা চালায়? বড় মেয়েটা কোথায়? সে এসে কাজ করছে না কেন? বসে বসে শুধু বিয়ে করলেই হবে? কাজ করতে হবে না?” 

    দূরের আত্মীয়দের কার্ড কুরিয়ার করা হয়েছে। সশরীরে যাদের দাওয়াত দেয়া হয়নি তাদের সবাইকে কল করে আবারও জানানো হচ্ছে বিয়ের তারিখ। সেই সঙ্গে অনুরোধ করা হচ্ছে অনুষ্ঠানে যেন অবশ্যই উপস্থিত থাকেন। এই কাজটা শামীমাই করছেন। আর এরশাদ সাহেব ব্যস্ত আছেন কোথায় কত খরচ হচ্ছে, কোথাও আয়োজনের কোনো কমতি হচ্ছে কি না তা খুঁজতে। এইতো আর পাঁচদিন পর গায়ে হলুদ তারপর বিয়ে। সময় একদম নেই হাতে! 

    .

    অনির ঘরের সামনে দিয়ে নবনীর ঘরে যাচ্ছিল অমিত। পথ আটকালো অনি, 

    — “ভাইয়া ভাইয়া!” 

    দরজায় দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় অমিত জিজ্ঞেস করলো, 

    — “কী?” 

    — “একটা ঝামেলা হয়ে গেছে।” 

    — “কী?” 

    — “আম্মু যা টাকা দিয়েছিল সব খরচ করে ফেলেছি। রিসিপশনে শাড়ীর সঙ্গে ম্যাচিং জুয়েলারী কেনা হয়নি।” 

    — “কিনে দিতে হবে তাই তো?” 

    — “হ্যাঁ।” 

    — “টাকা দিবো নাকি আমাকে নিয়ে যাবি?” 

    — “টাকা দিলেই চলবে। নাতাশারও কাজ আছে মার্কেটে। একসাথে যাবো আমরা।” 

    — “আমার বউয়ের চেয়ে শপিং তোরাই বেশি করছিস। রুমে আয় আমার সঙ্গে। টাকা নিয়ে যা।” 

    .

    রাত বাড়ছে। চাঁদহীন, তারাময় খোলা আকাশে চেয়ে আছে নবনী। প্রায়ই ঐ দূর আকাশে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে। কখনো বা গড়িয়ে পড়ে দু’চোখ বেয়ে দুই এক ফোঁটা অশ্রু। অনেকেই বলে প্রাক্তনকে মনে রাখা পাপ। বর্তমানে থাকা মানুষটার সঙ্গে প্রতারণা করা হয়। সত্যিই কি তাই? সব প্রাক্তনকে কি ভুলে থাকা যায়? কেউ কেউ থাকে যাদের কোনোভাবে ভুলে যাওয়া যায় না। রেখে দিতে হয় সযত্নে স্মৃতিতে। নিষ্পাপ, চাওয়া পাওয়াহীন ভালোলাগা আর শ্রদ্ধাবোধ রয়ে যায় আজীবন। 

    পেছনে দাঁড়িয়ে নবনীর চুলের গোড়ায় আঙুল ডুবালো অমিত। চিরুনির মতন করে পুরো মাথা জুড়ে আঁচড়ে দিচ্ছে ওর চুল। ঘাড় ফেরালো না নবনী। বাইরে তাকিয়েই বললো, 

    — “কাজ শেষ?” 

    — “হ্যাঁ। লাগেজ গুছিয়ে ফেলেছো?” 

    — “হুম।” 

    — “কালই যেতে হবে?” 

    — “বাসার সবাই আরো আগে যেতে বলেছিল, তোমার জন্য যেতে পারিনি।”

    — “এবারও যদি যেতে না দেই? জেদ করি?” 

    অমিতের দিকে ফিরলো নবনী। মুচকি হেসে বললো, 

    — “যেতেই হবে।” 

    — “আমিও আসি?” 

    — “না।”

    — “ভালো লাগবে না আমার।’ — 

    অমিতকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো নবনী। বললো, 

    — “কিসব যে আবদার করো না তুমি! মা-বাবারা শখ করেছে আমাদের আয়োজন করে বিয়ে দিবে। যদি তুমি আমার ওখানে চলে যাও বা আমি যদি এখানে থেকে যাই তাহলে আনন্দটা কিন্তু ওরকম হবে না। বিয়ে বিয়ে আমেজটাও ঠিক পাওয়া যাবে না। পাঁচটাদিনই তো! তারপর তো চলেই আসবো। আর যদি খুব মিস করো তাহলে কল দিও। বাইরে দেখা করবো আমরা। নবনীর কোমর জড়িয়ে ধরলো অমিত। দুষ্টু হেসে বললো, 

    — “একটা কথা বলবো?” 

    — “কী?” 

    — “চুমুর ক্রেভিং হচ্ছে খুব! দেই?” 

    এক ঝটকায় অমিতকে দূরে সরিয়ে দিলো নবনী। দুই ঠোঁটের ভাঁজে হাসি চেপে রেখে, ইশারায় মাথা নাড়িয়ে বারণ করলো। নাক কুঁচকে আহ্লাদী হলো অমিত।

    — “কেন নবনী?” 

    — “বিয়ের পর।” 

    — “বিয়ে তো হয়েই গেছে!” 

    — “ইশ্! হসপিটাল থেকে ফেরার পর বালিশ কাঁথা নিয়ে যাইনি তোমার রুমে? থাকতে দিয়েছো আমাকে? কী বললে? অনুষ্ঠানের পর একসঙ্গে থাকবো। এখন কেন চুমু দরকার?” 

    — “হুট করে তোমার উপর সব অধিকার দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চাইনি। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে আমার সঙ্গে অভ্যস্ত হও, নিজেকে সামলে নাও এটাই চেয়েছিলাম।” একটানে অমিতকে কাছে টেনে নিলো নবনী। অধর মিলনে রচিত হচ্ছে ভালোবাসার নতুন এক মিষ্টি স্মৃতির পাতা। কৃতজ্ঞতায়, মায়ায় নবনীর চোখে জল। গাল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ার আগেই চুমুতে মুছে নিলো অমিত। অসীম ভালোবাসায় নবনীকে বুকের মধ্যেখানে লুকিয়ে নিলো সে। 

    .

    অবশেষে সম্পর্কের বসন্ত দিন। 

    দৃঢ় আলিঙ্গন আর প্রেয়সীর ভেজা চুম্বন।

    নিঃশ্বাসের পার্থক্য মিটে গেছে 

    প্রেমিকের প্রতীক্ষা, অপেক্ষার হলো অবসান। 

    (সমাপ্ত) 

    #buttons=(Ok, Go it!) #days=(60)

    Our website uses cookies to enhance your experience. Check Now
    Ok, Go it!
    Do you have any doubts? chat with us on WhatsApp
    Hello, How can I help you? ...
    Click me to start the chat...