নাইয়রি – মৌরি মরিয়ম
নাইয়রি – মৌরি মরিয়ম
অন্যপ্রকাশ
প্রথম প্রকাশ : একুশে বইমেলা ২০২৪
প্রচ্ছদের গ্রাফিক আর্ট : সামিউল ইসলাম চৌধুরী
প্রচ্ছদ : আশুতোষ দেবনাথ
উৎসর্গ
মায়ের মুখে একটি সত্য ঘটনা শুনে ‘নাইয়রি’ উপন্যাসের আইডিয়া পাই আমি। তাই ‘নাইয়রি’র উৎসর্গ অবশ্যই আম্মুর।
ভূমিকা
আমার মা যখন ছোট তখন তাদের গ্রামে অসম্ভব এক রূপবতীর সাথে পরিচিত হন। সেই ভদ্রমহিলার বাপের বাড়ি ছিল পটুয়াখালী। তাঁর সেখানকার ফেলে আসা জীবনে নাইওরে গিয়ে এক বীভৎস ঘটনা ঘটে। তারপর তিনি পালিয়ে চলে আসেন আমার মায়ের গ্রামে।
ঘটনাটি আম্মুর মুখে শুনেই আমার মনে হয়েছিল, এটি দারুণ একটি উপন্যাস হতে পারে। যেহেতু আগের কিংবা পরের ঘটনা আমি জানি না আর ওই মানুষগুলোকেও চিনি না, তাই ওই বীভৎস ঘটনাটুকু এক রেখে বাকি সব কাল্পনিকভাবে সাজিয়ে লিখে ফেলি। পাঠক উপন্যাসটি উপভোগ করবে এই কামনায়।
মৌরি মরিয়ম
খিলগাঁও, ঢাকা।
Book Content👉
নাইয়রি – ১
১
পটুয়াখালী জেলার কেশবপুর গ্রামের সর্বদক্ষিণে মির্জাবাড়ি। বাড়ির মালিক জয়নাল মির্জা উক্ত এলাকার জনপ্রিয় চেয়ারম্যান। প্রভাবশালী লোক। লোকে তাকে সম্মান করে, মেনে চলে, ভয়ও পায়। তার জনপ্রিয়তার কারণ, তিনি অত্র এলাকার উন্নয়নের জন্য যে সকল কাজ করেছেন, তা বিগত বছরগুলোতে কোনো চেয়ারম্যান করে যেতে পারেন নি। এ ছাড়া তিনি দিলদরিয়া মানুষ। লোকমুখে প্রচলিত আছে, জয়নাল মির্জার কাছে সাহায্যের হাত পেতে কেউ কোনো দিন ফিরে যায় নি। তা যে সাহায্যই হোক না কেন।
জয়নাল মির্জার বিভিন্ন রকম ফসলের খেত আছে। সেসব ফসল বিক্রি বাবদ তার ভালো রকম আয় হয়। স্ত্রী কোহিনুর বানু, একমাত্র কন্যা জেসমিন, দুই পুত্র জালাল ও জব্বার এবং দুই পুত্রবধূ আসমা ও মিনুকে নিয়ে তার সংসার।
আষাঢ় মাস, ১৯৭৪ সাল। আজ সন্ধ্যার পর জয়নাল মির্জার কাছারিঘরে আসর বসেছে। এ ধরনের আসর প্রায়ই বসে। এই আসরে কোনো দিন চলে কলের গান, কোনো দিন চলে রেডিও। আজ রেডিওতে ‘মধুমালা মদন কুমার’ নাটক সম্প্রচারিত হবে, তাই লোকজনের আনাগোনা বেশি। কাছারিঘরে সকলের জায়গা হচ্ছে না। গাদাগাদি করে বসার পরও অনেক লোক সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সারা দিন ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হওয়ায় উঠানজুড়ে প্যাঁচপ্যাচে কাদা, না হলে উঠানেও লোকজনের বসার ব্যবস্থা করা হতো।
এ নাটক যে আগে কেউ শোনে নি, ব্যাপারখানা তা নয়। রেডিওতে একই নাটক বারবার সম্প্রচারিত হয়। একাধিকবার শোনার পরও নাটক শোনার ব্যাপারে গ্রামবাসীর আগ্রহের শেষ নেই। এ ছাড়া যেদিন ভানুর কৌতুক শোনায়, সেদিনও বেশ ভিড় হয়।
লম্বা কাছারিঘরের এক দিকে একটা চৌকি পাতা। কোনো বহিরাগত অতিথি এলে এখানেই ঠাঁই হয়। ঘরের অন্য দিকে দুই পাশে লম্বা লম্বা দুটো বেঞ্চ পাতা। গ্রামের গণ্যমান্য লোকেরা এই বেঞ্চে বসেন। আর নিচু জাতের লোকেদের জায়গা হয় মাটিতে পাটির ওপরে, যাকে স্থানীয় ভাষায় হোগলা বলা হয়। চেয়ারম্যান সাহেবের বসার জন্য একখানা গদির ব্যবস্থা আছে বৈকি। তিনি সেখানেই বসেন। কাছারিঘরে মহিলাদের আসা সম্পূর্ণ নিষেধ। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেবের ষোড়শী কন্যা জেসমিনের নাটক শোনার খুব শখ। তার খুব জানতে ইচ্ছা হয় নাটকে কী হয়। কেন এত মানুষ ছুটে আসে এই নাটক শুনতে? বছরখানেক ধরে সে তার বাপ-ভাইদের কাছে নাটক শোনার জন্য বায়না করে আসছে। অবশেষে এত দিনের বায়নার পর চেয়ারম্যান সাহেব কাছারিঘরের পেছন দিকে একটা খোলা বারান্দা দিয়েছেন, যাতে জেসমিনসহ অন্য মহিলারাও নাটক শুনতে পারেন।
নাটক শেষে ধীরে ধীরে কাছারিঘর খালি হতে লাগল। জয়নাল মির্জা যখন উঠে যাচ্ছিলেন, তখন তার ছোট পুত্র জব্বার মির্জা তাকে ইশারা করল বসার জন্য। সম্ভবত তার কিছু বলার আছে। তিনি বসলেন। ঘর খালি হলে জব্বার বড় ভাই জালালকে নিয়ে বাবার পাশে এসে বসল।
জয়নাল মির্জা বললেন, ‘বিষয় কী?’
জব্বার বলল, ‘আব্বা, হারুন ব্যাপারীর বিষয়।’
জয়নাল মির্জা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এখন এই সব বলার সময় না। মোর ঘুমের সময় অইছে। এই সব কইয়া মেজাজ খারাপ করবা না, জব্বার।’
জয়নাল মির্জা ছেলেদের আর কথা বাড়ানোর সুযোগ দিলেন না। তিনি খাবার ঘরের দিকে গেলেন। অন্যান্য দিন এতক্ষণে রাতের খাবার খেয়ে এক ঘুম হয়েও যায়। আজ নাটক শুনতে শুনতে দেরি হয়ে গেছে।
.
যেদিন সমুদ্র আমায় ইশারা করেছিল, রৌদ্রময় দিনের স্তব্ধতায় এটুকু লিখে রঞ্জু পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে ফেলে দিল। কী লিখছে সে এসব? কিসের ইশারা! সমুদ্র কীভাবে ইশারা করবে, ধুর! পৃষ্ঠা ছিঁড়তে ছিঁড়তে ডায়েরির অর্ধেক খালি হয়ে গেছে। ডায়েরির এমন বেহাল দশা দেখে আপাতত কবিতা লেখা বাদ দিল সে। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও ছোটবেলা থেকেই তার বেশ সাহিত্যপ্রেম রয়েছে। মাঝে মাঝে কবিতা লেখে। কবিতা লিখলে তার বেশ একটা সুখ সুখ অনুভূতি হয়। কিন্তু ইদানীং শত চেষ্টা করেও ভালো কিছু লিখতে পারছে না। যা লিখছে, সেটা তার নিজেরই পছন্দ হচ্ছে না। কাঠের দোতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলায় তার শোবার ঘর। সেই ঘরের সামনে খোলা বারান্দা। বারান্দার এক পাশে সে এখন পা ছড়িয়ে বসে আছে। দৃষ্টির সীমানায় এই সূর্যমণি গ্রাম, এই বাড়ি, বাড়ির উঠোন, উঠোন পেরিয়ে পুকুর। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সরু খাল। খালের পাশে পানের বর। বাড়িতে ঢোকার পথে সারি সারি সুপারিগাছ। পেছনে মেহগনিবাগান। রান্নাঘরের পাশে ঝিঙে-কাঁকরোলের মাচায় ফুল ধরেছে। বৃষ্টিতে ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ বাতাস বয়ে নিয়ে আসছে এই বারান্দাতে। এই সবকিছুই তার নিজের। কিন্তু এসব কিছুই তার ভালো লাগে না। তার মন পড়ে রয়েছে নিজ হলের ২১৩ নম্বর ঘরে, রেসকোর্স ময়দানে, শহীদ মিনারে, মধুর ক্যানটিনে এবং পাবলিক লাইব্রেরির বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে।
রঞ্জু সূর্যমণি এসেছে বেশি দিন হয় নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন বিভাগে পড়ে সে। হাজি মোহাম্মদ মহসিন হলে থাকে। কিছুদিন আগে তার হলেই আকস্মিকভাবে সাত ছাত্র খুন হয়। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তখন বাবার আদেশমতো গ্রামে চলে আসে। পড়াশোনার বাইরে অন্য কোনো কিছুতে সে নিজেও জড়াতে চায় না। তার কয়েক দিন পরই বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে। কবে সব স্বাভাবিক হবে, কবে সে ফিরে যাবে তার প্রিয় শহরে, সেই অপেক্ষায় প্রতিটি প্রহর গুনছে।
২
গ্রামের নাম চাঁদশী, গৌরনদী, বরিশাল। গত দুসপ্তাহের টানা বৃষ্টিতে প্রতিটি বাড়ির পুকুরের পানি পাড় ছুঁই ছুঁই। আর চার-পাঁচ দিন বৃষ্টি হলে পানি বুঝি উঠোনেই চলে আসবে। এই নিয়ে চিন্তায় গ্রামবাসী দিশাহারা। কেউ কেউ পুকুরে পোনা মাছ ছেড়েছে। এমন হলে সব ভেসে যাবে। যার মাছ কিছুটা বড় হয়েছে, সে মাছ ধরা শুরু করে দিয়েছে। বিক্রি করে যা আসে, তা-ই সই। যার মাছ বড় হয় নি, তার সৃষ্টিকর্তার কাছে মিনতি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারও সবজির খেতে পানি উঠে ফসল নষ্ট হচ্ছে। কারও পানের বরে পানি উঠে পান পচে যাচ্ছে। আব্বাস কাঠমিস্ত্রির অবশ্য এসব দুশ্চিন্তা নেই। তার না আছে নিজস্ব মাছভরা পুকুর, না আছে ফসলের খেত, না আছে পানের বর। কিন্তু সে-ও কদিন ধরে গ্রামবাসীর মতোই দিশাহারা। তার দুশ্চিন্তা অন্য রকম।
আব্বাস পরিবারের বড় সন্তান। তার ছোট দুই ভাই—মেজটি মুকুল আর ছোটটি মামুন। এই ভাই দুটিকে নিয়ে তার যত চিন্তা। ছোটকাল থেকেই মামুনের বড় পড়াশোনার শখ। আজ আবার সেই দিনটি চোখে ভাসছে। মামুন তখন সবে ক্লাস ফাইভ পাস করেছে। আব্বাস কাজ থেকে ফিরছিল। পথে দেখে খালপাড়ে বসে মামুন কাঁদছে। কারণ, বাবা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, হাইস্কুলে তিনি পড়াতে পারবেন না। এত দিন প্রাইমারিতে ফ্রি পড়েছে, এ-ই ঢের। মামুনের কান্না দেখে বড় মায়া হলো আব্বাসের। সে ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার দায়িত্ব নিল। হাইস্কুলে ভর্তি করে দিল। নিজে খেয়ে না-খেয়ে ভাইকে পড়াশোনা করাল। এ বছর মামুন স্টার মার্ক পেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছে। খবর পেয়ে কত লোক যে ওকে দেখতে এল! এখন দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে, মামুন যে আরও পড়াশোনা করতে চায়। ঢাকায় গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চায়। ঢাকা কত বড় শহর! কত খরচ! সেসব সামলানোর সামর্থ্য যে আব্বাসের নেই। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে লোকের অভাব বেড়েছে। কাঠের কাজের কদর কমেছে। কেউ বড় একটা ডাকে না কাজে। এখন খাওয়া জোটাতেই তাকে সারা বছর হিমশিম খেতে হয়। কদিন হয় মুন্সিবাড়িতে একটা ভালো কাজ পেয়েছে। ওরা খাবারের ঘর তুলছে। সেই ঘরের টেবিল- চেয়ার, দরজা-জানালা আর টুকটাক আসবাব বানানোর কাজ। কিন্তু এ রকম কাজ তো সারা বছর থাকবে না। কী দিয়ে ভাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবে?
আমিন মুন্সি কদিন ধরেই দেখছেন আব্বাস কাজে বড় অমনোযোগী। সারা দিন কিছু না কিছু ভেবে চলেছে। আব্বাস চেয়ারে নকশার কাজ করছিল। আমিন মুন্সি যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, সে টেরই পায় নি। সেখানে কিছু না বলে আব্বাসকে তিনি ডেকে পাঠালেন পুকুরপাড়ে। এ বেলা বৃষ্টি হয় নি, অনেক দিন বাদে তাই আজ ঘাটলায় (পুকুরপাড়ে) বসার সুযোগ পেলেন। এ জায়গাটি তার বড় প্রিয়।
আব্বাস ঘাটলায় এসে বলল, ‘চাচা, মোরে বোলাইছেন?’
ঠিক সেই সময় দুজনের জন্য চা-নাশতা চলে এল। আমিন মুন্সি বললেন, ‘আহো, বহো। ভাবলাম একলগে চা খাই।’
আব্বাস কাঁচুমাচু হয়ে বসল। বড়লোকদের সাথে বসে চা খাওয়ার অভ্যাস তার বিশেষ নেই। আবার মুন্সি চাচার কথার ওপর কথা বলার সাহসও তার নেই।
চা খেতে খেতে আমিন মুন্সি দেশের পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলছিলেন। আব্বাস সেখানে নীরব শ্রোতা।
একপর্যায়ে তিনি বললেন, ‘কয় দিন ধরে তোমারে আনমনা দেহি। বড় কোনো সমস্যায় আছ নিহি?’
আব্বাস মাথা নিচু করে মৃদু গলায় বলল, ‘তেমন কিছু না, চাচা।’
‘আরে মিয়া, কী সমস্যা মোরে কও। তুমি মোর পোলার মতো। উপকার করতে পারি না-পারি, হুনতে তো পারি। কী কও?’
আব্বাসের জড়তা কাটে না। তবে এরপরও কিছু না বললে খারাপ দেখায়। সে মামুনকে নিয়ে দুশ্চিন্তার কথাগুলো বলল। সব শুনে আমিন মুন্সি বললেন, ‘দেহি মুই কিছু করতে পারি নিহি।’
আমিন মুন্সি সারা দিন ভাবলেন। সন্ধ্যায় কাজ শেষ করে আব্বাস যখন বাড়ি ফিরবে, ঠিক তখন তাকে কাছারিঘরে ডেকে পাঠালেন। আব্বাসের আশার প্রদীপ জ্বলে উঠল। সত্যিই কি মুন্সি চাচা কোনো সাহায্য করবেন?
আব্বাস কাছারিঘরে ঢুকতেই দেখে বাহারি নাশতার আয়োজন। ফল, মিষ্টি, আরও কত কি! এসব দেখে আব্বাস কিছুটা ঘাবড়েই গেল বটে।
আমিন মুন্সি বললেন, ‘আহো আব্বাস, বহো। নেও, নাশতা খাও। সারা দিন ম্যালা খাটো।’
আব্বাস বিব্রত গলায় বলল, ‘চাচি দুহারকালে এত ভাত খাওয়ায়, আমার তো খিদাই লাগে না।’
আমিন মুন্সি হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, ‘আরে মিয়া, খাও খাও। তোমাগো বয়সে এর তিন গুণ খানা একলাই খাইছি।’
আব্বাস বসে একটা মিষ্টি নিল। মাস তিনেক আগে মুকুলের শ্বশুর এসেছিল মিষ্টি নিয়ে। সেই যে মিষ্টি খেয়েছে, এরপর আর মিষ্টি খায় নি। মিষ্টি সে বড় ভালোবাসে।
আমিন মুন্সি বললেন, ‘তোমার ভাইয়ের ব্যাপারে ভাবলাম, বুঝলা আব্বাস।’
আব্বাসের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। সে সাগ্রহে তাকিয়ে রইল পরবর্তী কথা শোনার জন্য। আমিন মুন্সি বললেন, ‘তোমার ভাইয়ের লাহান পোলা লাখে একটা। মোর তাই একটু লোভ হইল। অরে মোর ছোডো মাইয়াডা জামাই করতে চাই। ঢাকায় অর পড়ালেহার সব ব্যবস্থা মুই কইর্যা দিমু। যদি কলিকাতা পড়তে যাইতে চায়, তাইলে রেলওয়েতে একটা চাকরির ব্যবস্থাও কইর্যা দিতে পারমু। তুমি তো জানো, মোর মাইজ্জা পোলাডা কলিকাতা রেলওয়েতে বড় চাকরি করে। কত মানুষের চাকরি অর হাতে। ঘরজামাই থাকন লাগব না।’
আব্বাসের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সে কী বলবে ভেবে পেল না। ছোট মেয়ে মানে তো রেহানা। কিন্তু তার তো একবার বিয়ে হয়েছিল।
আমিন মুন্সি নরম গলায় বললেন, ‘দেহো বাবা, মুই জানি মোর মাইয়া কোনো দিক দিয়াই তোমার ভাইয়ের যোগ্য না। একবার বিয়া হইল, তালাক হইল। দেখতে ভালো না, গায়ের রং ময়লা। কিন্তু এত অল্প বয়স। আজীবন তো অরে এইভাবে রাখতে পারমু না। মুই আইজ আছি কাইল নাই। মুই মরলে অরে যে অর ভাইরা দ্যাখবে, তার তো কোনো ঠিক নাই। একটা ভালো পাত্রের হাতে তুইল্যা দিয়া যাইতে পারলে শান্তিতে মরতে পারতাম। এই জন্যে বড় সাহস দেখাইয়া প্রস্তাবটা দিছি। তুমি রাজি না থাকলে মানাও কইরা দিতে পারো। মুই কিছুই মনে করমু না, বাবা।
আব্বাস আগের চেয়ে দিগুণ বিব্রত হয়ে বলল, ‘চাচা, এই রহম প্রস্তাব পাওয়া মোগো কপাল। তয় বাড়ি যাইয়া বেবাকের লগে আলাপ না কইরা তো মুই কিছু কইতারি না। তা ছাড়া মামুন কী চায়, হেইয়াও তো জানতে অইবে।’
আমিন মুন্সি আব্বাসের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি দুশ্চিন্তা কইরো না। সময় নিয়া ভাবো। আলাপ করো, এরপর মোরে জানাও। কোনো তাড়া নাই।’
৩
ভরা বর্ষায় টলমল জলে ভরে উঠেছে পুকুর। ঝরে পড়া অজস্র সোনালু ফুল পুকুরের জলে ভাসছে। জেসমিন সেই পুকুরের শানবাঁধানো ঘাটলায় বসে ভাতিজা, ভাইঝিদের সাথে নিয়ে আধা পাকা আমের ভর্তা বানাচ্ছে। ভর্তা আবার দুই পদে বানানো লাগছে। বাচ্চাদের জন্য ঝাল ছাড়া, বড়দের জন্য ঝাল দিয়ে।
আউশ ধান উঠেছে। মির্জাবাড়ির বউরা সকাল থেকে বড় বড় পাতিলে সেই ধান সেদ্ধ করছে। চুলার পাশে বড় হোগলা বিছানো। পাতিলের ধান প্রথমে সেই হোগলায় ঢেলে ফেলা হয়। বাড়তি পানিটুকু ঝরে গেলে সেই ধান ডালা ভরে নিয়ে উঠানে অন্য শুকনো হোগলার ওপর ঢালা হয়। আমন ধানের সময় অবশ্য সরাসরি উঠানেই ধান শুকানো হয়। আগে গোবর দিয়ে লেপে নেওয়া হয়, এতে মাটি শক্ত হয়, ধান ওঠানোর সময় আলগা মাটি উঠে আসে না। কিন্তু আউশ ধানের সময় হুটহাট বৃষ্টি নেমে পড়ে বলে হোগলার ওপর শুকানো হয়, যাতে বৃষ্টি নামলে দ্রুত তুলে ফেলা যায়। কোহিনুর বানু বড় বউ আসমাকে নিয়ে ধান সেদ্ধ করছেন। আসমা ভূতের মতো কাজ করতে পারে। জনশ্রুতি আছে, কেশবপুরের এত বড় পালের দিঘি নাকি এক রাতে কেটেছিল ভূতেরা। সেই দিঘি কাটার গল্প একেকজনের মুখে একেক রকম। আসমা তেমনি এক দিনে মণকে মণ ধান সেদ্ধ করে ফেলতে পারে। আসমা সাথে থাকলে তার তেমন বিশেষ কোনো কষ্ট হয় না।
একজন কাজের মহিলা ডালা ভরে ধান উঠানে নিচ্ছে। ছোট বউ মিনু আরেকজন কাজের মহিলাকে নিয়ে সেই ধান আউলে দিচ্ছে। ইদানীং মিনুকে বেশি কষ্টের কাজ তিনি দিচ্ছেন না। কারণ, তার ধারণা, মিনু পোয়াতি হয়েছে। কিন্তু বান্দর মেয়েছেলে এত গুরুত্বপূর্ণ কথা তার কাছে কেন এখনো গোপন রেখেছে, বুঝতে পারছেন না!
যে পরিমাণ ধান সেদ্ধ করতে হবে, তাতে এই কজন হিমশিম খাচ্ছে। আরও লোক দরকার কিন্তু আর কাউকে এই মুহূর্তে পাওয়া যাচ্ছে না। এমতাবস্থায় জেসমিনের বাচ্চাদের সাথে বসে আমভর্তা বানানোটা গুরুতর অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
কোহিনুর বানু এই গেরস্তবাড়িতে বউ হয়ে এসেছিলেন ৯ বছর বয়সে। তখনো সাবালক হন নি। তার শাশুড়ি করিমন বিবির ছিল মাথার ব্যামো। এই ব্যামো শুধু শুধু হয় নি। এর পেছনে আছে বিরাট ইতিহাস। করিমন বিবি প্রায়ই স্বপ্নে দেখতেন, সাতটি মটকা ভরা কাঁচা টাকা। ঢাকনাগুলো ওঠে- নামে। ভেতরে টাকা দেখা যায়। একটা গায়েবি আওয়াজ বলে, ‘এই সব টাকা তোর।’
করিমন বিবি যক্ষের ধনের কথা শুনেছেন, তবে তার সাথে এমন কিছু হবে, বিশ্বাস করতে পারতেন না।
এরপর একদিন সেই গায়েবি আওয়াজ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। তাকে বলল, “ওঠ করিমন, দেখ তোর উগুইরতলার (চাল-ডালের মটকা মাটিতে রাখলে নষ্ট হয়ে যেত, সেসব রাখার জন্য কাঠের তৈরি উঁচু তাকের মতো জিনিস) নিচে সাতটা মটকা ভরা টাকা। সব তোর। আওলা মাটি (পুকুরে পানির নিচের ভেজা মাটি) দিয়ে ঘরবাড়ি, সারা বাড়ি লেপে গোসল করে আসবি। তারপর পানিতে এক ফোঁটা গোবর দিয়ে তাতে মটকা থেকে কিছু কাঁচা টাকা নিয়ে জ্বাল দিলেই সব টাকা তোর হয়ে যাবে। কেউ দেখার আগে সব কাজ শেষ করবি।’
করিমন বিবি বিছানা থেকে নেমে উগুইরতলায় মটকাগুলো দেখতে পেলেন। ঢাকনা তুলে দেখলেন সব মটকা ভরা কাঁচা টাকা। তিনি দ্রুত পুকুর থেকে আওলা মাটি তুলে ঘর লেপৌঁছে পরিষ্কার করলেন। এরপর গোসল করে এসে চুলা ধরালেন। এসবই দূর থেকে লক্ষ করলেন তার বড় জা জমিলা বিবি। তার বড় সন্দেহ হয়। এত রাতে করিমন কেন ঘর লেপে! তিনি বিষয়টা বোঝার জন্য এগিয়ে যান। করিমন একটা হাঁড়িতে পানি ও এক ফোঁটা গোবর দিয়ে চুলায় বসালেন। ঘরে আসবেন টাকা নিতে, তার আগেই জমিলা বিবি নাপাক শরীরে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ‘তোমাগো আগুন-তাওয়াডা কই গো করিমন?’
আগেকার দিনে আগুন বড় সহজলভ্য ছিল না। সারা রাত মাটির পাত্রে তুষের ভেতর জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে এক বিশেষ পদ্ধতিতে আগুন সংরক্ষণ করা হতো। সেই পাত্রের নাম ছিল আগুন-তাওয়া। সেই আগুন-তাওয়ার ছুতোয় যেই না জমিলা বিবির নাপাক শরীরে ঘরে পা দিলেন, অমনি টাকা ভরা সাতটা মটকা গড়গড়িয়ে নেমে গেল পানিতে। এরপর উধাও। সেই থেকেই যক্ষের ধনের শোকে করিমন বিবি পাগল। প্রবাদ আছে, যারে ধরে যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা। করিমন বিবিরও রক্ষা হয় নি। তিনি এমন বদ্ধ পাগল ছিলেন যে তাকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। গেরস্তবাড়ির সকল কাজের সাথে পাগল শাশুড়ির সেবা, সবই তাকে বড় জায়ের সাথে ভাগে করতে হতো সেই ৯ বছর বয়স থেকে। জেসমিনটা যে রকম কামচোর হয়েছে, যদি এ রকম কোনো বাড়ি গিয়ে পড়ে, কীভাবে সামলাবে কে জানে!
কোহিনুর বানু রান্নাঘর থেকেই হাঁক ছাড়লেন, ‘ও লো নবাবের বেড়ি, আর কত গায়ে বাতাস লাগাইয়া চলবি? আসমার লগে একটু ধানের পাতিলডা ধরলেও তো পারোস।’
জেসমিন পুকুরপাড় থেকেই বলল, ‘অত বড় পাতিল মুই জাগাইতে পারি?’
‘পারবি না ক্যা? ভাত খাও না তুই? পরের বাড়ি যাইয়া ক্যামনে করবি?’
‘যহন পরের বাড়ি যামু, তখন ঠিকই পারমু। দুই চক্কু দিয়া তো দেখতেইয়াছি কোন কাম ক্যামনে করে।’
কোহিনুর বানু বললেন, ‘এত বড় বড় বয়ান না দিয়া মিনুর লগে ধান আউলা গিয়া। পাতিল জাগাইতে পারবি না বুঝলাম। ধান আউলাইতে তো পারবি। হেইডা কইরা আমারে উদ্ধার কর, মা।’
‘না, ধানও আউলাইতে পারমু না। বাপের বাড়ি বইয়াও কাম করমু, পরের বাড়ি যাইয়াও কাম করমু। হারা জনম কি কাম কইরা কাটামু? ও ছোট ভাবি, তুমি কও দেহি, বাপের বাড়ি থাকতে কি তুমি কোনো কাম করতা?’
মিনু হাসল শুধু, কিছু বলল না। কোহিনুর বানু জানতেন এ মেয়ের সাথে কথা বলে লাভ নেই। তবু বলার কাজ বললেন। বউরা বলতে তো পারবে না তিনি মেয়েকে কাজ করতে না বলে শুধু বউদের দিয়েই কাজ করান!
আমভর্তা বানানো শেষ হলে কলাপাতায় করে সেই ভর্তা বাড়ির সকলের কাছে পৌঁছানো হলো। সবাইকে দিয়ে তারপর জেসমিন খাওয়া শুরু করল। আম কুচি কুচি করে কেটে তাতে লবণ, কাঁচা মরিচ কুচি, সরিষাবাটা আর লেবুপাতা দিয়ে মেখেছে। এ যেন অমৃত!
বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। আশপাশে সবাই সব কাজ ফেলে ধান তুলতে দৌড়ে এল, শুধু জেসমিন ছাড়া। বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল রঞ্জু ও তার বন্ধু মানিক। এ বাড়ির ধান ভিজে যাচ্ছে বলে তারা দৌড়ে এসে ধানের হোগলা তুলতে লাগল।
এবার কোহিনুর বানু রীতিমতো রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘নবাবের বেডি, তোর ঠ্যাং যদি আমি আইজ না ভাঙছি! বিষ্টি নাইম্যা গেল। অন্য বাড়ির পোলারা আইয়া ধান উড়ায়, তাও তুই ধরো না? তোরে মুই পয়দা করছিলাম ক্যা?’
সর্বনাশ! অন্য বাড়ির ছেলেরা আবার কেন এল! তোরা পথ দিয়ে যাচ্ছিলি, যা না বাবা। অযথা ঘরে আগুন লাগাতে কেন এলি? এসব ভাবতে ভাবতেই জেসমিন গিয়ে ধানের হোগলা ধরল। রঞ্জু ধান ঘরে তুলতে তুলতে সামনে তাকাতেই দেখতে পেল, স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো পরি তার হোগলার উল্টো পাশের দিকটা ধরল। একটা ছাপাশাড়ি প্যাঁচ দিয়ে পরা। লম্বা চুলগুলো লাল ফিতেয় কলাবেণি করা। গায়ের রং দুধে আলতা, গালের রগগুলো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটে তার চোরা হাসি। পরি তার দিকে তাকাল না।
.
কেশবপুর গ্রাম থেকে বের হতে না হতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। কাঁচা রাস্তা কাদামাটিতে মাখামাখি হয়ে আছে। হাঁটতে গিয়ে পা গেঁথে যাচ্ছে।
মানিক বলল, ‘ভুল অইয়া গেল রে ব্যাডা।’
রঞ্জু তখনো একটা ঘোরের মধ্যে। পরিটাকে সে কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছে না। ঘোরের মধ্যেই সে মানিকের কাছে জানতে চাইল, ‘কী ভুল?’
‘বৃষ্টি থামা পর্যন্ত চেয়ারম্যানবাড়ি থাকা উচিত আছিল।’
রঞ্জু এবার আচমকা বলল, ‘ঠিক বলেছিস। আরও কিছুক্ষণ থাকা উচিত ছিল। পরিটারে আরও কিছুক্ষণ দেখতে পারতাম তাহলে।’
‘এ রঞ্জু, তোর কী অইছে? পরি কই পাইলি? হাবিজাবি কী কস?’
‘যে মেয়েটা আমার সাথে ধানের হোগলা ধরল, তার কথা বলি। পরির মতো সুন্দর। কালকে আবার আসব ওকে দেখতে।’
মানিক এবার আঁতকে উঠল, ‘সর্বনাশ! এই সব চিন্তা একদম বাদ দিয়া দে। জেসমিন কার মাইয়া, জানোস?’
‘বাহ্, ওর নাম জেসমিন! কামিনী ফুল!’
‘রঞ্জু, জেসমিন চেয়ারম্যানের মাইয়া। জানতে পারলে খুন করব তোরে।’
‘রাখে আল্লাহ মারে কে?’
এ কথা বলে হেসে ফেলল রঞ্জু।
৪
মুকুলও তার বড় ভাই আব্বাসের মতো কাঠমিস্ত্রি। কিন্তু কাজকামে তার মন নেই। আব্বাস তাকে জোর করে কাঠের কাজ শিখিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আগে টুকটাক কাজ করলেও এখন আর কোনো কাজ সে পায় না। পাওয়ার চেষ্টাও করে না। কারণ, তার পছন্দ যাত্রাপালা। বিনে বেতনের খাটনি। মাঝে মাঝে দু-চার পয়সা যা পায়, তাতে সংসার চলে না। এখনো বাপ-ভাইয়ের সাথে খাচ্ছে বলে একভাবে দিন কেটে যাচ্ছ। যাত্রার নেশা ছাড়তে পারে না, তাই এ পথ ছাড়া হয় না। দেখতে কদাকার হলেও মুকুল পাট ভালো করে, তাই সে চাঁদশী যাত্রাদলের নায়ক। ফরসা হওয়ার কারণে নায়িকার পাট সব সময় ফয়েজের। ফয়েজ মুকুলের সমবয়সী, তবে সম্পর্কে হয় চাচা। তুই-তোকারি সম্পর্ক হলেও চাচা ডাকটি কিন্তু বিদ্যমান।
এই মুহূর্তে তারা দুজন যাচ্ছে মুস্তাফিজ ডাক্তারের বাড়ির দিকে। উদ্দেশ্য, এ বাড়ি থেকে কিছু মুরগি চুরি করা। এ ছাড়া আর কোনো উপায় এখন নেই। মুকুলের বউ মিনা রাগ করে তার যাত্রাদলের কস্টিউম ছিঁড়ে ফেলেছে। এখন নতুন কস্টিউম বানানোর পয়সা সে কোথায় পাবে? অথচ এই সপ্তাহে তাদের পালা আছে। এই অভাবের দিনে কারও বাড়িতে চুরি করতেও বিবেকে লাগে। গ্রামের বড়লোকদের একটা লিস্টি করেছে দুজন মিলে। তাদের মধ্যে একজনের মুরগির খোপ কাজের লোকেদের ঘরের বারান্দায়। বাইরে থেকে যাওয়ার উপায় নেই। আরেকজন মুরগি পালে না, গরু-ছাগল পালে। কিন্তু গরু-ছাগল ম্যালা টাকার ব্যাপার, অত টাকার তাদের দরকার নেই। আর চেয়ারম্যানের বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে বিপদ, তাই সে-ও বাদ। বাকি রইল আমিন মুন্সি আর মুস্তাফিজ ডাক্তার। কিছুদিন ধরে মুকুলের বড় ভাই আমিন মুন্সির বাড়িতে কাজ করছে, সেই বাড়িতে চুরি করাটা ঠিক হবে না। অবশেষে ডাক্তার বাড়ির মুরগিই চুরি করতে হচ্ছে। কাদায় পা আটকে যাচ্ছে বারবার। বিরক্তির শেষ নেই।
মুকুল ফিসফিস করে বলল, ‘কী যে আহোইজ্জা পোলাপানের লাহান কাম করল বউডা! রাগ দেহাবি, তয় মাইরা হাত-পাও কিছু ভাইঙ্গা দে, নায় চুল কয়ডা ছিঁড়ড়া দে। হ্যানা কস্টিউম ছিঁড়ড়া দিলি! এমন কামও কেউ করে?’
ফয়েজের কাছে দুঃখ করে এসব কথাই বলছিল মুকুল। ফয়েজ ফিক করে হেসে দিল।
মুকুল চোখ পাকিয়ে বলল, ‘তোর দেহি মনে ম্যালা সুখ, কাহা। ক্ষেতি তো আর তোর অয় নাই।’
ফয়েজ বলল, ‘এইয়ার লাইগ্যাই তো বিয়া করি না। তোরা তো হগলডি কও খালি বিয়া হরো বিয়া হরো। বিয়া হরলে অইবেডা কী? এইয়াই তো অইবে।’
‘এ ব্যাডা! মোরে তো বিয়া করাইছে ছোডকালে। হেকালে কি আর অত কিছু বুঝি?’
দুজনের কথোপকথনের তালে পথ ফুরিয়ে গেল। অতি সন্তর্পণে পা ফেলে বাড়ির পেছন দিকের উঠোনে গেল। মুরগির খোপ খুলে একটা হাত ঢুকিয়ে দিল। এরপর হাতের কাছে যে মুরগিটাকে পেল, গলা বরাবর চাপ দিয়ে ধরল। এই পদ্ধতিতে ধরলে মুরগি চিৎকার করতে পারে না। গুনে গুনে তিনটি মুরগি নিয়ে খোপ আটকে দিল। এগুলো বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে, তাতে কস্টিউম বানানো হয়ে যাবে।
রেনুর শরীরটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়ে। ডাক্তার- কবিরাজ সাধ্যমতো দেখানো হচ্ছে। ওষুধপাতিও কমবেশি চলছে। কিন্তু কেউ রোগ সারাতে পারছে না। আজও শরীর খারাপ লাগছিল। তবু সবাই ঘুমিয়ে পড়ার কারণে জেগে বসে আছে সে। মুকুল যে ফেরে নি! রেনু যখন এ বাড়িতে বউ হয়ে আসে, তখন মুকুল-মামুন ছোট। ওদের কোলেপিঠে করে বড় করেছে। দুজনকে নিজের ছেলের মতো দেখে। মুকুল মাঝরাতে বাড়ি ফিরতেই রেনু তাকে ভাত খেতে ডাকল।
মুকুল বলল, ‘ও কি ভাবি, তুমি এহনো হজাগ ক্যা?’
রেনু ধমকে বলল, ‘তয় কে হজাগ থাকপে? তোর বউ তো সন্ধ্যাকালেই ঘুমাইছে। আর তোর মায়ের তো তুই খাইলেও কিছু যায়-আহে না, না খাইলেও না। সব দায় ঠেকছি একলা মুই।’
মাঝে মাঝে মুকুলের রাত করে বাড়ি ফেরা আর তার জেগে বসে থাকা আজ নতুন কিছু নয়। তাই রেনুর মেজাজ সপ্তমে থাকার আলাদা কোনো কারণ রয়েছে। সেই কারণটা জানতে পারলে সুবিধা হতো। কিন্তু এখন রেনুর কাছে কিছু জিজ্ঞেস করাটা বিপজ্জনক।
মুকুল ভয়ে ভয়ে বলল, ‘মোর কাম আছিল, ভাবি। ভাত বাইড়্যা রাইখ্যা তুমি ঘুমাইয়া পড়তা।’
রেনু আবার গর্জে উঠল, ‘হ, ভাত বাইড়্যা রাখলে কুত্তায় খায়, নাইলে বিলইতে খায়, এ কতা তুই জানো না?’
মুকুল আর কথা বলার সাহস পেল না। হাতমুখ ধুয়ে চুপচাপ খেতে বসল।
রেনু এবার পাশে বসে চাপা গলায় বলল, ‘তোর বউরে কবি মোর লগে মেজাজ না দেহাইতে। মোর লগে তার মেজাজ দেহানের কারণ কী? তুই কি মোর পোলা যে কামকাইজ না করলে তোরে মুই পিডামু? তোর মায় মোর লগে মেজাজ দেহায়, তোর বাপে মেজাজ দেহায়, তোর বউও মেজাজ দেহায়। এ মুই কি তোগো বেবাকটির মেজাজ রাহোনের ভাণ্ড? খালি তোর ভাইজান মেজাজ দেহায় না, ওই মানুষটার লাইগ্যা এই ছাতার সংসারে এহনো পইড়া রইছি, নাইলে এত দিনে বাপের বাড়ি যাইতাম যাইয়া।’
চমকে উঠল মুকুল, ‘মিনা কি তোমার লগে খারাপ ব্যবহার করছে? অর হইয়া আমি মাফ চাইতাছি। তুমি মনে কষ্ট নিয়ো না, ভাবি।’
‘বেইন্যাকালে তোর মায় একশডা কতা হুনাইছে মিনারে। এ তুই কামকাইজ করো না, এই লাইগ্যা তোর মায় অরে কতা হুনাইবে ক্যা? তোরে কইতে পারে না?’
মুকুল মাথা নিচু করে বলল, ‘কাম তো পাই না, ভাবি।’
রেনু গজগজ করে বলল, ‘যাত্রাদল ছাড়ো হেলেই পাবা।’
মুকুল চুপ হয়ে গেল। এ কথার পৃষ্ঠে বলার মতো কিছু নেই আসলে তার।
নাইয়রি – ৫
৫
হুঁক্কা সাজানো হচ্ছে। কাজটি করছে কুদ্দুস। সে মির্জাবাড়ির কামলা। বয়স ত্রিশের ঘরে। সব রকম কাজই সে করে। তবে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তার প্রধান কাজ হচ্ছে চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য হুঁক্কা সাজানো। কিছুক্ষণ আগেই হুঁক্কার পানি বদল করে এনেছে সে। রস নষ্ট হয়ে গেলে সেটা পুড়িয়ে চিটাগুড় বানানো হয়। তামাকপাতা কুচি করে চিটা গুড় দিয়ে বিশেষ কায়দায় মাখাতে হয় হুঁক্কার জন্য। এই কাজটায় খুব দক্ষ কুদ্দুস। অন্য কারও হুঁক্কা সাজানো পছন্দ হয় না চেয়ারম্যান সাহেবের। তামাকপাতা মাখানো হয়ে গেলে তা হুঁক্কার কলকিতে দিল কুদ্দুস। তার ওপর জ্বলন্ত কয়লা। অমনি হুঁক্কা প্রস্তুত। চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে হুঁক্কা দিয়ে কাছারিঘর থেকে বের হয়ে গেল সে। কাছারিঘরে চেয়ারম্যান সাহেব ছেলেদের নিয়ে বসলে সেখানে কারও যাওয়া মানা।
জালাল-জব্বার দুই ভাই জয়নাল মির্জার সামনে বসে আছে। তিনি হুঁক্কায় টান দিয়ে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বলো কী তোমাদের জরুরি কথা?”
‘আব্বা, হারুন ব্যাপারীর ভাবসাব ভালো না।’
‘ব্যাপারীরে লইয়া এত মাথা ঘামাইস না, জব্বার। তোরে আগেও মানা করছি।’
জালাল বলল, ‘জব্বারের মাথাডা গেছে, আব্বা। ওরে আমি কইছি যে বিষয়টা আব্বা আমাগো চেয়ে ভালো বোঝে।’
জব্বার বলল, ‘আব্বা, আমার কথাখান শোনেন। আইজ একখান খারাপ খবর আছে।’
‘কী খবর?’
‘কালিশুরির জমির দলিল লইয়া হারুন ব্যাপারী টাউনের এক উকিলের কাছে গেছিল।’
‘যাউক। তার কি টাউনে যাওনের আগে তোমার অনুমতি নেওয়া লাগবে?’
‘আব্বা, আমনে ব্যাপারডা একটু আমলে লন। হারুন ব্যাপারী আগেও ওই উকিলের কাছে গেছে। শেষে না আবার জমিখান হাতছাড়া হয়। কত বড় জমি!’
‘জব্বার, তুমি এই সব ছোডখাডো বিষয় লইয়া আমারে বিরক্ত করবা না। জালাল, তোমার ছোট ভাইরে বোঝাও। এই সব ছোডখাডো বিষয়ে এত মাথা ঘামাইলে ভবিষ্যতে রাজনীতি ক্যামনে করবা তোমরা?’
.
সত্যি সত্যি প্রতিদিন রঞ্জু জেসমিনদের বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করে। ঘুরে ঘুরে সে জেসমিনদের পুরো বাড়িটাই মুখস্থ করে ফেলল। জেসমিনের ঘর কোন দিকে, তা-ও আবিষ্কার করল। কোনো কোনো দিন জেসমিনকে না দেখেই ফিরে যেতে হয় তাকে। তবে সে এটা ঠাহর করতে পেরেছে যে প্রতিদিন বিকেলে জেসমিন তাদের বাড়ির দক্ষিণের ভিটায় প্রতিবেশী ও ভাতিজা-ভাতিজিদের সাথে খেলতে যায়। নানান রকম খেলা খেলে তারা। কখনো বৌছি, কখনো সাতচারা, কখনোবা আবার গোল্লাছুট। পাশেই খাল, মাছ ধরার ছুতোয় খালে বড়শি পেতে বসে থাকে রঞ্জু। চোরাচোখে দেখে জেসমিনকে। ভেবে অবাক হয় সে, এত রূপ কী করে আল্লাহ একটি মানুষের মধ্যে দিল? যাকে একবার দেখে চোখ ফেরানো যায় না। বারবার দেখতে ইচ্ছা করে!
কিছুদিন যাওয়ার পর মাঝে একদিন রঞ্জু দেখে জেসমিন খেলছে না। চুপচাপ বসে আছে। সেদিন সে উপলব্ধি করল, সে শুধু জেসমিনের সৌন্দর্যেই মুগ্ধ নয়, সে জেসমিনের উচ্ছ্বলতায়ও মুগ্ধ।
.
জেসমিন সন্ধ্যার আগে আগে খেলা শেষ করে হাত-পা ধুয়ে ঘরে ঢুকল। কোহিনুর বানু সরতা দিয়ে সুপারি কাটছিলেন।
জেসমিনকে দেখেই বললেন, ‘এত ডালে ডালে ঘুরোস ক্যা লো ছেড়ি? বোলাইয়া মইরা গেলেও তোরে পাওন যায় না।’
জেসমিন খুব অবাক হওয়ার ভান করে বলল, ‘ডালে ডালে কই ঘুরলাম, মা? দক্ষিণের ভিডায় খেলছি। হেই ভিডা তো আমাগোই। কোনো দরকার থাকলে তুমি কাউরে খবর দিয়া পাডাইতা।’
‘এ ছেড়ি, খেলার কথা কইতে শরম করে না? খেলার বয়স আছে তোর?’
‘আছে দেইক্কাই তো খেলি। কী এমন বয়স অইছে মোর?’
‘তোর বয়সে পোলা পয়দা কইরা মা অইছি আমি।’
‘মোর তো আর বিয়া হয় নাই। ক্যামনে পোলা পয়দা করমু?’
কোহিনুর বানু এবার ভীষণ রেগে গেলেন। বললেন, ‘তোর বাপে আহুক, খাড়া। বিয়া দিয়া এই আপদ যদি বিদায় না করছি! তোর মতো মাইয়া পালা মোর কাম না।’
‘কওগা যাইয়া।’
জেসমিন মুখ ঝামটা দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকল। সন্ধ্যা হতেই পোকামাকড় ঢুকবে, তাই সবার আগে জানালা লাগিয়ে দিল। পরনের শাড়িটায় কাদা লেগেছে, ঝটপট শাড়িটা পাল্টে ফেলল। তারপর হারিকেন জ্বালাল, ঘরের ভেতর তেমন আলো ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে চুলের বেণি খুলছিল সে, ঠিক তখনই টেবিলের ওপর বইখাতার ভেতর একটা খাম দেখতে পেল। এই খামটা তো এখানে ছিল না। এটা কোত্থেকে এল? জেসমিন খামটা খুলে দেখে ভেতরে একটা ভাঁজ করা কাগজ আর কিছু কামিনী ফুল। সে কাগজটা তুলে ভাঁজ খুলল। ভেতরে লেখা :
কোথাও কি এমন কলি হয়?
যে কলিতে ফুটলে ফুল
শুকাবে না তার পাপড়িগুলো
ঘ্রাণ রবে অক্ষয়?
প্রিয় জেসমিন,
এমন ঘ্রাণফুলের সাধ জাগছে তোমারে দেখার পর। সাথে জাগল মনে, এই তো প্রথম কিছু হারানোর ভয়।
ইতি রঞ্জু
চিঠিটা কে দিল না-জানা পর্যন্ত কোথাও কোনো শান্তি নেই জেসমিনের। হ্যাঁ, চিঠির শেষে নাম লেখা আছে রঞ্জু। কিন্তু রঞ্জুটা কে? সে তো রঞ্জু বলে কাউকে চেনে না! পুরো কেশবপুরে কোনো রঞ্জু আছে বলেও শোনে নি কখনো। জেসমিনের মাথা ভালো। চিঠির মর্মার্থ বুঝতে তার কোনো সমস্যা হয় নি। বরং খুব ভালোভাবে বুঝেছে। এ জন্য আরও বেশি অস্থির লাগছে। এমন আকুতি নিয়ে কে লিখল তাকে?
খামের ভেতরের কামিনী ফুলের ঘ্রাণ নিল সে। কামিনী ফুলের ইংরেজি নাম অরেঞ্জ জেসমিন। স্কুলের ইংরেজি স্যার বলেছিলেন, মনে আছে তার। সেটা জেনেই কি অচেনা মানুষটা তাকে কামিনী ফুল দিয়েছে? নাকি কাকতালীয়ভাবে মিলে গেছে?
জেসমিন চিঠিটা এই নিয়ে ২৯ বার পড়েছে। হাতের লেখাটা দারুণ! আরও একবার পড়ে ৩০ পূরণ করল। এরপর ভাঁজ করে বালিশের তলায় রেখে দিল।
জেসমিন খোলা চুলগুলো আঁচড়ে আবার বেঁধে নিল। তারপর পড়তে বসল। কিন্তু কিছুতেই পড়ায় মন বসাতে পারল না। পত্রদাতা মনের ভেতর ঢুকে খুব বিরক্ত করছে! মানুষটা যে চিঠিটা টেবিলের ওপর রেখে গেছে, এতেই বোঝাই যাচ্ছে জানালা দিয়ে রেখেছে। এত বোকামি কেউ করে? চিঠিটা যদি অন্য কারও হাতে পড়ত? এমন অনেক প্রশ্ন মনের ভেতর ঘুরছে।
পরদিন জেসমিন সারা দিন কোথাও বের হলো না। নিজেকে ঘরবন্দী করে অপেক্ষায় রইল। মানুষটা যদি চিঠি দিতে আবার আসে, অমনি তাকে ধরে ফেলবে! আচ্ছা, সে এভাবে কেন চিঠি দিচ্ছে? জেসমিনের উত্তর দেওয়ার তো কোনো সুযোগ নেই। একতরফাভাবে চিঠি দিয়ে কী লাভ?
আচ্ছা, মানুষটার বয়স কেমন হবে? দেখতে কেমন সে? তাকে দেখে যদি জেসমিনের ভালো না লাগে? ভালো না লাগলে এই সুন্দর হাতের লেখার সুন্দর চিঠিটার জন্য তার ভীষণ মনখারাপ হবে!
সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেল। চিঠি দিতে কেউ এল না। জেসমিন আশা ছেড়ে দিল। ভাবল, বুঝি কেউ দুষ্টুমি করে চিঠিটা দিয়েছিল। অথচ সে বোকার মতো সব বিশ্বাস করেছে!
তারপর এক বিকেলে জেসমিন আবার খেলতে গেল। অবাক কাণ্ড হচ্ছে, তাদের খেলায় যাকে দুধভাত বানানো হয়, সেই মতি খেলা শেষে ফেরার সময় একটা খাম দিল। খামটা দেখে ঘটনা বুঝতে বাকি রইল না জেসমিনের।
সে খামটা হাতে নিয়ে জানতে চাইল, ‘খামডা কেডা দিছে, মতি?’
মতি ঘার নেড়ে জবাব দিল, ‘চিনি না।’
জেসমিন ধমক দিয়ে বলল, ‘না চিনলে আনছোস ক্যা?’
মতি ঠোঁট উল্টে বলল, ‘কইল যে অনেক জরুলি কাম।’
‘যে দিছে হে কি ব্যাডা না ছ্যামড়া?’
‘ছ্যামড়া।’
ধলা না কালা?’
‘ধলা।’
‘লম্বা না বাটু?’
‘কইতারি না।’
জেসমিন বিরক্ত মুখে বলল, ‘আচ্ছা, যা তুই এহন।’
শাড়ির প্যাচের ভেতর খামটি লুকিয়ে বাড়ি ফিরল সে। ইচ্ছা করেই খামটি খুলল না তখন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পর দরজায় খিল দিয়ে হারিকেনের আলো বাড়িয়ে খামটা খুলল। যথারীতি ভেতরে কামিনী ফুল এবং একটি চিঠি। আজকের চিঠি বেশ বড়। জেসমিন পড়া শুরু করল :
আমার এলোমেলো মনের কারণ খুঁজতে গিয়ে
অহর্নিশি ভাবি তোমায়,
নিত্য সন্ধ্যার শীতল কোমল আঁধার
স্পর্শ করে যায় আমায়,
নিশুতি রাতের বুকে গলানো আকাশ ঝরে
চেয়ে থাকি অসীম এক প্রত্যাশায়
কখনো দেখি ঝড়ের আকাশে উড়ন্ত কোনো বিহঙ্গ
ডানা ঝাপটায় অচেনা কোনো সুখে,
মেঘের পরে মেঘ ছুটে যায় বৃষ্টি হয়ে ঝরে,
আমিও ছুটে যাই দুই ক্রোশ দূরে
দেখব বলে তোমায় বৃষ্টিস্নাত মুখে।
অথচ জানালায় দেখি বসে আছ একাকী অন্ধকার ঘরে
তখন আমার ভীষণ বলতে ইচ্ছা হয়
প্রেয়সী, তুমি কি মেঘ, ভয়ে আছ ভীত?
প্রিয় জেসমিন,
গত সাত দিন তুমি ঘর থেকে বের হও নাই। জানি না কেন সারাটা দিন জানালার কাছে বসে ছিলে। আমাকে হাতেনাতে ধরবে বলে নয়তো? তুমি জানালায় বসে ছিলে বলেই সেদিকে যাওয়ার আর সাহস করে উঠতে পারি নাই। আচ্ছা, তুমি এখন আর খেলতে যাও না কেন? জানো, তোমার উচ্ছলতা আমাকে উচ্ছ্বসিত করে! প্রতিদিন এত দূর থেকে তোমার সেই উচ্ছলতা দেখতে ছুটে যাই।
জানি তুমি ভাবছ কেন এভাবে লুকিয়ে চিঠি দিচ্ছি? সামনে কেন আসি না? সামনে আসার মতো সাহস নাই, যদি প্রত্যাখ্যান করো? জানি না তোমার মধ্যে কী আছে! শুধু জানি, প্রথম দেখায় তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি, আমার কামিনী ফুল।
ইতি রঞ্জু
৬
আজ আরও বেশি মেজাজ খারাপ হলো জেসমিনের। প্রেম নিবেদন করে বসেছে বাছাধন কিন্তু নিজের পরিচয় দেয় নি। দুই ক্রোশ দূর থেকে আসে উল্লেখ করেছে, তার মানে দুই-এক গ্রাম পার হয়ে তার বাড়ি। এর বেশি কিছুই জানার উপায় নেই। একতরফাভাবে চিঠি দিয়ে যাচ্ছে। কোনো উত্তর লাগবে না তার? এ কোন রামবলদ?
জেসমিন এবার একটা দুই লাইনের চিঠি লিখল। চিঠিটা এমন :
ভিতু রঞ্জু সাহেব,
সামনে আসার সাহস না থাকলে আর চিঠি দিয়েন না। ভিতুরা এই কামিনী ফুলের চোখের বালি।
ইতি জেসমিন
পরদিন জেসমিন চিঠিটা মতির হাতে দিয়ে বলল, ‘যে মোরে চিডি দিছিল, হে আবার আইলে এইডা হ্যারে দিবি।’
মতি ঠোঁট উল্টে বলল, ‘ক্যা দিমু?’
‘হ্যার চিডি মোরে ক্যা দিছিলি?’
‘হে মোরে হাটের থিকা নারকলি আর বাদামের সন্দেশ কিন্যা দিছে।’
জেসমিন ভ্রুকুটি করল। বাচ্চা ছেলেটাকে ঘুষ দিয়ে নষ্ট করছে লোকটা! সে বলল, ‘মোরটা তারে দিলে তোরে মোগো খেলায় লমু। তোর আর দুধভাত থাহা লাগবে না।’
মতি দাঁত বের করে হেসে বলল, ‘হাছা কইতাছ, জেসমিন বু?’
‘আল্লাহর কিরা।’
.
জেসমিনের চিঠি পড়ে হেসে ফেলল রঞ্জু। তার এখন আর ঢাকা যাওয়ার জন্য কোনো হুতাশ নেই। বরং না যেতে পারলে সে বাঁচে। প্রতিদিন জেসমিনকে দেখতে যায়। মাঝে একদিন বাড়িতে কাজ থাকায় যেতে পারে নি। সেদিন যে কতটা অস্থিরতায় কেটেছে, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। আজ যেতেই মতি এই চিঠিটা দিল। রঞ্জু সাথে করে আনা চিঠিটা আর দিল না, নতুন করে চিঠি লিখতে হবে। সে মতির কাছ থেকে কাগজ-কলম নিয়ে চিঠি লিখতে পারত অবশ্য। কিন্তু সে গভীর রাতে বারান্দায় বা জানালার ধারে বসে যে চিঠি লিখবে, সেই চিঠিতে যতটা আবেগ, যত্ন মিশিয়ে দিতে পারবে, তা কি এখন পারবে? অসম্ভব! বিশেষ মানুষটার জন্য সবকিছুই বিশেষ হওয়া চাই।
.
পরদিন জয়নাল মির্জা-বাড়িতে থাকায় খেলতে যেতে পারে নি জেসমিন সন্ধ্যার পর যখন জেসমিন পড়তে বসেছে, তখন মতি বন্ধ জানালার ধারে এসে ডাক দিল, ‘ও জেসমিন বু, আছ এহেনে?’
জেসমিন জানালা খুলে বলল, ‘কী অইছে? তুই এত রাইতে?’
‘রাইত কিয়ের? সন্ধ্যা অইছে হপায়। তুমি তো আইজ খেলতে আহো নাই, তাই আইছি, কী আর করমু? এই নেও তোমার চিডি।’
জেসমিন খামটা হাতে নিয়ে বলল, ‘আইজ কী দিছে তোরে?’
মতি দাঁত বের করে বলল, ‘কাইল হাটে লইয়া যাইবে।’
‘হাটে যাওনের আগে আমার লগে দেহা কইরা যাইস।’
‘আচ্ছা বু।’
জেসমিন খামটা খুলল। কিছু কামিনী ফুলের পাশ থেকে চিঠিটা তুলে নিল।
প্রিয় জেসমিন,
তোমার কি কাচের চুড়ি পছন্দ? সেদিন যখন খেলছিলে, তোমার দুহাতের চুড়িগুলো রিনিঝিনি করে বাজছিল। এর আগে কখনোই উপলব্ধি করতে পারি নাই কাচের চুড়ি জিনিসটা যে এত সুন্দর। নাকি তোমার হাতে উঠেছে বলেই তার মাধুর্য বেড়ে গেছে? সূর্যমণির হাটে সুন্দর কাচের চুড়ি ওঠে। হ্যাঁ, ঠিক ধরেছ, আমি সূর্যমণি গ্রামের ছেলে।
সূর্যমণিতে আমাদের বাড়ির দোতলায় আমার একলার রাজত্ব। এখানে ঘরের সামনেই বারান্দা। কিছুদিন আগে বারান্দায় একটা কাঠের চার কোনা টব বানিয়েছি নিজ হাতে। সেই টবে কামিনী ফুলের গাছ লাগিয়েছি। জানি না ফুল কবে ফুটবে। আচ্ছা, এই গাছে পানি দেওয়ার দায়িত্বটা কি তুমি নেবে ফুল?
তোমার চোখের বালি নয়, চোখের মণি হতে চাই। কখন কোথায় আসব বলে দাও। বান্দা সময়মতো হাজির হয়ে যাবে।
ইতি রঞ্জু
চিঠি পড়তে পড়তেই জেসমিনের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। কিন্তু চিন্তার বিষয় হচ্ছে, দেখাটা করবে কোথায়? কেউ দেখে ফেললে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। অন্তত কেশবপুরের মধ্যে কোথাও দেখা করা যাবে না। তাহলে উপায়?
.
জেসমিন-রঞ্জুর প্রথম দেখা হলো মতিদের পানের বরে। মানিক পুরোটা সময় তাদের পাহারা দিল। জেসমিন-রঞ্জু দুজনের কারও কোনো ভয় নেই, কিন্তু সেস ভয়ে তটস্থ। এই সম্পর্কের কথা জানাজানি হলে কী হতে পারে, সে ধারণা তার আছে। কারণ, সে চেয়ারম্যানকে চেনে। চেয়ারম্যান হিসেবে লোক ভালো, তবে স্বার্থে উনিশ-বিশ হলে সে মানুষ খুন পর্যন্ত করতে পারে। রঞ্জুকে শত বুঝিয়েও লাভ হয় নি। ওদিকে জেসমিন যে দাপুটে মেয়ে, স্কুলে এক ছেলে ওর চুল ধরে টান দিয়েছিল বলে মেয়ে হয়েও সেই ছেলেকে যে ধোলাই দিয়েছিল, ভিড় জমিয়ে দেখেছিল লোকে। সেই ঘটনা মুখে মুখে রটে গিয়েছিল। এর পর থেকে আর কোনো ছেলে চোখ তুলে তাকাতে সাহস পায় নি। আজ সেই মেয়ে রঞ্জুর চিঠি পড়ে পাগল হয়ে দেখা করতে এল! কী এমন লিখেছে রঞ্জু!
রঞ্জুকে দেখে মাথা ঘুরছে জেসমিনের। এত সুদর্শন ছেলে এ তল্লাটে সে কখনো দেখে নি। জামাকাপড়, চালচলন, কথাবার্তা—সবকিছুতেই একটা শহুরে ভাব। জেসমিনের সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে তার স্বভাবতই রঞ্জুকে সেসব বুঝতে দিতে চাইছে না। তাকে চুপ দেখে রঞ্জু বলল, ‘কী ব্যাপার, চিঠিতে তো খুব কথা শোনানো হয় আমাকে। এখন যে একদম চুপ?’
জেসমিন হেসে বলল, ‘অত সুন্দর কইরা কথা কইতে পারি না।’
‘বেশি সুন্দর মানুষের অত সুন্দর কথা না বললেও চলে।’
‘আমনে কি শহরে থাকেন?’
‘আমি ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। সেখানকার হলে থাকি। ইউনিভার্সিটি বন্ধ থাকলে গ্রামে থাকি।’
‘এহন কি ইনভার্সিটি বন্ধ?’
‘হ্যাঁ, অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। কিছু গন্ডগোল চলছে। তাই বাড়ি এসেছি।’
‘তার মানে আপনে আবার চইলা যাইবেন?’
‘ইউনিভার্সিটি খুললে যাব।’
‘আচ্ছা, আপনের গ্রাম না সূর্যমণি? তাইলে আপনে কেশবপুরে ক্যামনে আইলেন আর আমারেই-বা ক্যামনে পাইলেন?’
রঞ্জু প্রথম দেখার ঘটনাটা বিস্তারিত বলতেই জেসমিন চোখ পাকিয়ে বলল, ‘ও! আমনেই সেই লোক, যার জন্য মায় আমারে গাইলাইছিল!’
রঞ্জুর ঘটনাটা মনে পড়ায় সে হেসে ফেলল। জেসমিন বলল, ‘হাইসেন না। আমনেরে একখান কথা আগেই কইয়া রাখি, আমি কিন্তু কামচোর। আমারে দিয়া কোনো কাম করাইতে পারবেন না।’
রঞ্জু হেসে ফেলল। এই মেয়েটি সবার থেকে আলাদা। এই মেয়েটিকে তার লাগবেই
তাদের পত্র আদান-প্রদান চলমান রইল। দুই পক্ষেই ফি বাড়িয়েছে মতি ডাকপিয়ন। ইদানীং বেশ বড় বড় আবদার করে বসে সে রঞ্জুর কাছে। রঞ্জুও হাসিমুখে সেই আবদার পূরণ করে। এই ডাকপিয়ন হারালে যোগাযোগ বন্ধ। এর চেয়ে বিশ্বস্ত ডাকপিয়ন আর হয় না। দেখা খুব কমই হয়, তবে হয়। কখনো উত্তরের শাপলার বিলে, কখনো কালিশুরির মেহগনিবাগানে, কখনো মতিদের পানের বরে।
৭
মামুনের বিয়ের প্রস্তাবে তার বাবা মোকসেদ ও মা হালিমা বিবি মহাখুশি। এ রকম বড়লোক ঘরের মেয়ে বউ হয়ে এলে গ্রামের লোকের চোখ কপালে উঠে যাবে। আবার মামুনকে নাকি চাকরিও দেবে। সংসারের টানাটানি দূর হবে। কিন্তু আব্বাসের বউ রেনু বড় টেনশনে পড়ে গেছে। অত বড়ঘরের মেয়ে আনাও তো একটা খরচের ব্যাপার। বউয়ের সোনা-কাপড়, পান-মিষ্টির খরচ, দেনমোহর, অতিথি খাওয়ানো! বড়ঘরের মেয়ে আনতে গেলে কোনোটাই তো যেমন-তেমন করে করা যাবে না। এসব কীভাবে হবে?
সবচেয়ে বেশি চিন্তায় পড়েছে মামুন। গ্রামে তার বয়সী ছেলেরা বিয়ে করে ফেলে, কিন্তু তার তো অন্য রকম ইচ্ছা ছিল। ভেবেছিল ঢাকায় পড়াশোনা করতে যাবে। পড়াশোনা শেষ করে বড় চাকরি করবে, তারপর তার পছন্দমতো পড়াশোনা জানা কোনো মেয়েকেই বিয়ে করবে। এই মেয়েটিকে বিয়ে করলে তার শেষ ইচ্ছাটি বাদে সকল ইচ্ছাই পূরণ হবে। আর বিয়ে না করলে তার কোনো ইচ্ছাই পূরণ হবে না। হয়তো ঢাকায় গিয়ে কোনো কেরানি গোছের চাকরি করতে হবে, তা-ও যদি জোটে! নাহয় এই গ্রামেই পচে মরতে হবে। এই চিন্তা করে সে মোটামুটিভাবে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। কিন্তু বড্ড ভয় করে তার। এত বড়লোকের মেয়ে সামলাতে পারবে তো সে? খালপাড়ে মনমরা হয়ে বসে এসবই ভাবছিল।
মুকুল খাল থেকে মাছ মেরে বাড়ি যাচ্ছিল, ছোট ভাইকে দেখে পাশে এসে দাঁড়াল, ‘এ ব্যাডা, এহেনে কী করো?’
মামুন মুকুলকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ভাইজান, আমার ডর করে।’
মুকুল কপাল কুঁচকে বলল, ‘ডর কিসের?’
মামুন সব খুলে বলতেই মুকুল বলল, ‘ডরাইস না। মাইয়াডার তো বয়স কম। আদর-যত্ন করলেই হাতে রাখতে পারবি। তোর স্বপ্ন পূরণের লাইগ্যা এর চাইয়া ভালো সুযোগ আর কই পাবি, ক?’
‘হেলে আমি কলিকাতা যাইতে চাই। ঢাকা গেলে শ্বশুরের টাহায় চলা লাগবে। কলিকাতা গেলে তো চাকরি দেবে। টাহা লওনেইত্যা চাকরি লওয়া ভালো। নিজের টাহায় নিজে পড়মু।’
‘হয়, এইডা ঠিক।’
‘কিন্তু আমি এই কতা বড় ভাইজানরে কইতে পারমু না। আমার ডর লাগে। তুমি কইয়া দেবা?’
মুকুল হেসে বলল, ‘আচ্ছা, আইজই কইয়া দিমুয়ানে। এহন বাড়ি ল, দেখ তোর পছন্দের শৌল মাছ পাইছি। কত্ত বড় বড় শৌল! ভাবিরে কমু বেশি কইর্যা ঝাল দিয়া ভুনা করতে।’
এবার কস্টিউম তৈরি করে তা আর বাড়িতে আনল না মুকুল। ফয়েজের কাছে রাখতে দিল। মুরগি বিক্রির টাকায় কস্টিউম হয়ে সামান্য কিছু পয়সা বাঁচল। সেই পয়সায় ছেলের জন্য কিছু নেবে, নাকি বউয়ের জন্য কিছু নেবে, ভেবে কোনো কূল পাচ্ছিল না। শেষে ঠিক করল, বউয়ের জন্যই নেবে। বউটা রেগে আছে। কিছু উপহার পেলে খুশি হবে। কিন্তু সারা বাজার ঘুরেও এই সামান্য পয়সায় ভালো কিছুই পাওয়া গেল না। অনেক ঘুরেফিরে অবশেষে সে এক ডজন কাচের চুড়ি কিনল। চুড়ি খুব পছন্দ করে বউটা।
কদিন ধরে মিনার মনমেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। কারও সাথে কথা বলতে গেলেই ঝগড়া লেগে যাচ্ছে, তাই পারতপক্ষে কারও সাথে কথা বলছে না সে। মুকুল আজ সন্ধ্যার পরপরই বাড়ি ফিরে এল। মিনা তার সাথে একটি কথাও বলে নি। সে এখন ব্যস্ত, তাদের তিন বছর বয়সী ছেলে মধুকে পড়তে বসিয়েছে। এত দিন পড়ানোর পরও ছেলে এখনো অ আ শিখতে পারল না। এই ছেলে নিশ্চিত বাপের মতো হবে। এ কথা মনে হতেই মধুকে মারল মিনা। মধু কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ল।
মুকুল বলল, ‘এইডু একটা পোলা এত তাড়াতাড়ি পড়াশোনা শিখবে ক্যামনে? হুদাহুদি মারলা অরে।’
মিনা গর্জে উঠল, ‘মারমু না তয় কি চুমা দিমু? এইডু কই? অর বয়স তিন বছর। হারা দিন দেহি পড়র পড়র করতে পারে, তয় পড়তে বহাইলে এত নাটক ক্যা? বাপের মতো নাটক হিকছে।’
মুকুল মিনার সামনে বসে বলল, ‘আরে, রাগ হইয়ো না। আরেকটু বড় অইলেই চাচার মতো ভালো পড়ালেহা করবেয়ানে। এই দেহো তোমার লাইগ্যা কি আনছি।’
এ কথা বলে মুকুল পেছনে লুকিয়ে রাখা হাতটা সামনে আনল। হাতে কাচের চুড়ি। চুড়িগুলো দেখে মিনার মেজাজ আরও খারাপ হলো। সে চুড়িগুলো ধরে ছুড়ে মারল। নিমেষেই কাচের চুড়িগুলো ভেঙে গেল। মুকুলের মনটা খারাপ হয়ে গেল। এর চেয়ে মধুর জন্য কিছু আনলেই পারত, ছেলেটা খুশি হয়ে যেত।
মিনা রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে বলল, ‘বউ-পোলার লাউগ্যা খাওন জুটাইন্যার মুরোদ নাই, হে আবার চুড়ি কিন্না আনে।’
মুকুল মৃদু গলায় বলল, ‘এইয়া তুমি কী কও, মিনা? মুই বর্গা দিয়া চাউল আইন্না এই সংসারেই তো দিছি। যেদিন সময় পাই, মাছ কোপাই আইন্যা কি দেই না? এইয়া কি কিছুই না? খালি পয়সাই কামাইয়া আইন্যা দিতে অইবে?’
‘তোমার মায় পয়সাই চায়। হেইয়াই দিতে অইবে। আল্লাহর তিরিশটা দিন তোমার মায় কয় তুমি মোরে আর পোলারে লইয়া হেগোডা বইয়া বইয়া খাও। আর কত সইহ্য করমু? হয় যাত্রাপালা ছাইড়া কোনো কামে নামো, নাইলে মোরে ছাইড়্যা দেও।’
‘কাম তো পাই না, মিনা।’
‘কাঠের কাম পাও না, অন্য কাম করবা।’
‘তুমি এত চ্যাতলা ক্যা? মায় ত আজনমকাল এ রহমই। বড় ভাবিরেও তো কত জ্বালায়, তুমি তো জানো। কী অইছে তোমার?’
এ কথার পর মিনা মুকুলের দিকে সরাসরি তাকাল। তার চোখ জলে ভরে উঠেছে।
মুকুল তার গালে হাত রেখে বলল, ‘কান্দ ক্যা?’
মিনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাচ্চা আইছিল প্যাটে। নষ্ট কইরা দিছি। বাচ্চার দুঃখে কান্দি।’
মুকুল স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইল।
একমুহূর্ত পর বলল, ‘এইডা তুমি কী করলা, মিনা? ক্যান করলা?’
মিনা কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আর কী করমু? এক পোলার খাওন জুটাইতে পারো না, আরেকটা ক্যামনে আনি?’
‘মিনা, তুমি একলা সিদ্ধান্ত নিতে পারো না। বাচ্চা তোমার একলার না। আমারে জানান দরকার আছিল।’
মুকুলের গলায় রাগ।
মিনা চোখ মুছে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ‘বউ-বাচ্চার খাওন জুটাইতে পারে না, আবার রাগ দেহায়। যা করছি ভালো করছি, একশবার করমু। আল্লায় ইট্টু শরমও দেয় নাই বেডারে।’
মুকুল সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার চোখে কান্নার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে।
৮
হারাধন চক্রবর্তী উত্তরাধিকারসূত্রে বাপ-দাদার অনেক জমিজমা পেয়েছিলেন কিন্তু তার নগদ অর্থ ছিল না। তিনি অলস ও ভীরু প্রকৃতির হওয়াতে নিজে চাষবাস করতে পারতেন না। বর্গা দিয়ে দিতেন। পাকিস্তান আমলে একবার তার স্ত্রীর কঠিন অসুখ হয়। চিকিৎসার জন্য ভারত যেতে হবে। প্রচুর নগদ অর্থ প্রয়োজন। তিনি ছুটে গেলেন বিত্তশালী জয়নাল মির্জার কাছে। হারাধন চক্রবর্তীর জমিজমা সব এক দাগে কালিশুরিতে। এই কারণেই জয়নাল মির্জা কিনে নিতে চাইলেন। কিন্তু হারাধন চক্রবর্তী বিক্রি করতে নারাজ। তিনি জমি বন্ধকি দিয়ে কিছু টাকা নিতে চান। জয়নাল মির্জা বন্ধকি দলিলে হারাধন চক্রবর্তীর টিপসই নিয়ে টাকা দিলেন। জয়নাল মির্জা সেই জায়গা ভোগদখল করতে শুরু করলেন। বছর কয়েক বাদে হারাধন চক্রবর্তী টাকা ফেরত দিতে এলেন।
জয়নাল মির্জা বললেন, ‘আরে মিয়া, রাখো তোমার টাকা। এই টাকার লগে আরও কিছু দেই আমি। জমি আমার ধারে বেইচা দাও। এমনেও এই জমি তুমি কামে লাগাও না। বর্গা দিয়া রাহো। তার চেয়ে নগদ ট্যাকা পাইলে তোমার কামে লাগবে।’
হারাধন চক্রবর্তী আতঙ্কিত হয়ে বললেন, ‘জয়নাল ভাই, আমার টাকার অনেক দরকার আছিল তখন, এই কথা সত্য। আপনের কাছে আমি ঋণী। কিন্তু বাপ-দাদার জমি আমি বেচতে চাই না দেইখাই বন্ধক রাখছিলাম। আমারে ক্ষ্যামা করেন।’
কিন্তু লাভ হয় নি। জয়নাল মির্জা টাকাও নেন নি। জমির দখলও ছাড়েন নি। এই জমির জন্য হারাধন চক্রবর্তী অনেক ঘুরেছেন জয়নাল মির্জার পেছনে। স্বাধীনতার পর তিনি চেয়ারম্যান হলেন। তার ক্ষমতা আরও বেড়ে গেল। কিছুতেই তার সাথে পেরে উঠলেন না হারাধন চক্রবর্তী। অবশেষে ভাবলেন, জমি বিক্রিই করে দেবেন। কিন্তু জয়নাল মির্জা দাম বলেন নিতান্তই কম। ১০ ভাগের ১ ভাগ। তারপর বিভিন্ন ধরনের হুমকিধামকি তো আছেই।
এর মধ্যেই হারাধনের পরিচয় হয় হারুন ব্যাপারীর সাথে। সে ঢাকার লোক। মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে পালিয়ে এসেছেন। এখানে তার এক বন্ধু ছিলেন, তিনিই তখন থাকার ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে থাকতে থাকতে এই জায়গার প্রতি তার প্রগাঢ় এক মায়া জন্ম নেয়। তিনি এখানেই স্থায়ী হতে চান। ঢাকা শহরের বাড়ি বিক্রি করে আসায় তার কাছে ম্যালা নগদ অর্থ। এখানে ভিটাবাড়িসহ কিছু জমিজমা ক্রয় করতে ইচ্ছুক। হারাধন চক্রবর্তী খবর পেয়ে তার ভিটাবাড়ি সব বিক্রি করে পাকাপাকিভাবে ভারতে চলে গেলেন। সেখানে তার নানাবাড়ি।
হারুন ব্যাপারী হারাধনের ভিটাবাড়িতে উঠলেন। সেখানে কোনো সমস্যা হলো না। কিন্তু ভেজালটা লাগল কালিশুরির জমির বেলায়। জমি দখল নিতে এলে জয়নাল মির্জা হারাধনের টিপসই দেওয়া দলিল বের করলেন। দলিলে স্পষ্ট যে ক্রয়সূত্রে এই জমির মালিক জয়নাল মির্জা। হারাধন লোক ছিলেন সোজা, পড়াশোনা জানতেন না। জয়নাল মির্জাকে বিশ্বাস করে দলিলে টিপসই দিয়েছিলেন। তার স্ত্রী তখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন, তাই যাচাই- বাছাইয়ের সময়ও তার ছিল না।
অন্য দিকে হারুন ব্যাপারীর কাছেও ক্রয়সূত্রে পাওয়া দলিল রয়েছে। হারাধন চক্রবর্তীর সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। পরবর্তী সময়ে হারাধনের বন্ধুর কাছ থেকে হারুন ব্যাপারী জয়নাল মির্জার কারসাজির কথা জানতে পেরেছিলেন। তার পর থেকেই জয়নাল মির্জার সাথে হারুন ব্যাপারীর বিরোধ। সামনাসামনি তাদের সম্পর্ক মধুর। ভাবখানা এমন যে দুজনেই একই ব্যক্তি দ্বারা ঠকেছেন। তবে হারুন ব্যাপারীও ঝানু লোক। তিনি তার নগদ অর্থে কেনা জমি এত সহজে ছাড়বেন না।
.
মানিক গরিব ঘরের ছেলে। অল্প বয়স থেকেই সে খেয়াঘাটের মাঝি। প্ৰথমে বর্গা নৌকা চালাত। বছরখানেক হলো নিজের নৌকা হয়েছে। বাপ বর্গাচাষি ছিলেন। এখন অসুস্থতার জন্য তিনি কাজ করতে পারেন না। ছোট ছোট পাঁচ ভাইবোন। সুতরাং পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মানিক। দিন আনি দিন খাই অবস্থা। জেসমিন-রঞ্জুর প্রতিবার দেখা করার সময় পাহারাদার হিসেবে থাকতে হয় তার। গরিবের ক্ষমতা সীমিত, তাই ভয় অধিক। মানিকও তার ব্যতিক্রম নয়। চেয়ারম্যান সাহেব জানতে পারলে রঞ্জুর সাথে সাথে তার পরানটাও যাবে।
জেসমিন আজ ক্লাস না করে স্কুলের পেছনের খেয়াঘাট থেকে মানিকের নৌকায় উঠেছে। নৌকা কেশবপুরের সীমানার বাইরে যাওয়ার পর রঞ্জু নৌকায় উঠবে। এমনই পরিকল্পনা হয়েছে চিঠিতে। মানিক দ্রুতহাতে বইঠা বেয়ে পাড় থেকে দূরে চলে গেল। তবে এর জন্য বেশ কসরত করতে হলো। কারণ, ভাটার সময় স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড় টানতে হচ্ছে। তার জীবনের কোনো কিছুই স্রোতের অনুকূলে থাকে না। আর এ তো নদীর স্রোত। এ আর কী!
জেসমিন গুনগুন করে কোনো একটা গান গাইছিল বোধ হয়। রঞ্জু নৌকায় ওঠার আগেই মানিকের কথা সেরে ফেলা উচিত। জেসমিন বয়সে তার চেয়ে অনেক ছোট। তার ছোট বোনের সাথে এক ক্লাসে পড়ে। একই গ্রামের বাসিন্দা। কাছাকাছি বাড়ি। ছোট থেকে বড় হতে দেখেছে।
আচমকাই কথা শুরু করল মানিক, ‘জেসমিন, তোর ডর লাগে না?’
জেসমিন খুব স্বাভাবিকভাবেই উত্তর দিল, ‘ইট্টু সাহস না থাকলে তো প্রেমে ডুব দিতাম না, মানিক ভাই।’
মানিকের চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল জেসমিন। যেন এমন প্রশ্ন আসতে পারে জেনে উত্তরটা তৈরি রেখেছিল সে। এমন দৃঢ় দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। মানিক এমনিতেও মেয়েছেলের দিকে তাকাতে অস্বস্তি বোধ করে। সে নদীর পানে চেয়ে দাঁড় বাইতে বাইতে বলল, ‘সাহস ভালো। তয় সবকিছুতে না। লোক জানাজানি হইলে কেলেঙ্কারি অইবে, তোর বদনাম অইবে, জেসমিন। ‘
জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। মানিক বিরক্ত মুখে তাকাল। জেসমিন হাসতে হাসতেই বলল, ‘চান্দেরও কলঙ্ক থাকে, মানিক ভাই। আমিও তো চান্দের লাহান সুন্দর। আমার একটু কলঙ্ক না থাকলে ক্যামনে হয়, কন তো?’
আজকের সূর্যের বড় তেজ। মানিকের ঘিলু যেন গলে পড়বে মনে হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় আজ সে গামছা আনতে ভুলে গেছে। গামছা আনলে মাথাটা ঢেকে নিতে পারত। সে কিছুটা বিরক্ত মুখে বলল, ‘তোগো দুইডার একটারও ডরভয় বইলতে কিছু নাই। একবার ভাবছস জয়নাল চাচা জানতে পারলে কী অইবে?’
‘আমনে এক কাজ করেন, মানিক ভাই, বন্ধুরে তালাক দিয়া দেন। তাইলে আর আমনের ফাঁসার চান্স নাই। যা যাইবে, আমাগো ওপর দিয়া যাইবে।’
মানিক জবাব দিল না। সে এমনিতেও কথা কম বলে।
.
নৌকা নদীর পাড়ে ভেড়াল মানিক। রঞ্জুকে সেখানে একটা গাছের শিকড়ের ওপর বসে থাকতে দেখা যাচ্ছে। নৌকা ভিড়তেই রঞ্জু দ্রুত নৌকায় উঠে সোজা ছইয়ের ভেতর চলে গেল। মানিক নিজের মাথায় একটু পানি দিল। তারপর আবার নৌকা ভাসাল। বইঠা বাইতে শুরু করল অজানার উদ্দেশে। তার হাতে এখন অফুরন্ত সময়, যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনো জায়গা নেই। স্কুল ছুটির সময় হলে রঞ্জুকে আবার এখানে নামিয়ে তারা ফিরে যাবে। এই সময়টায় তার যা আয় হতো, তা রঞ্জু দিয়ে দেবে।
জেসমিন নৌকায় উঠেই শাড়ির আঁচল দিয়ে লম্বা ঘোমটা দিয়ে ফেলেছিল, যাতে বাইরে থেকে দেখলে কেউ চিনে না ফেলে। রঞ্জু তাকে এভাবে দেখে বলল, ‘তোমাকে কিন্তু নতুন বউয়ের মতো লাগছে, ফুল।’
জেসমিন মুখ টিপে হেসে বলল, ‘তাইলে বাড়ি লইয়া লও।’
‘তুমি কি এখনই যেতে চাও? তাহলে বাবাকে বলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই?’ জেসমিন চোখ বড় বড় করে বলল, ‘তুমি কি পাগল? আমি এমনেই মজা করছি। আমার আব্বা এই সব টের পাইলে মাইরা ফালাইবে।’
‘ও মা, তাহলে কি আমরা সারা জীবন এভাবে লুকিয়েচুরিয়ে দেখা করে যাব?’
‘না, আগে কাজকাম করো। বেকার পোলার কাছে আমার বাপে মাইয়া দেবে না।’
‘দাঁড়াও, দ্রুত বেকারত্ব ঘোচাচ্ছি। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করব। তার আগপর্যন্ত বাবার সাথে ব্যবসায় কাজ করি।’
রঞ্জু সত্যি সত্যিই তার বাবার সাথে ব্যবসায় কাজ করা শুরু করল। তার বাবার বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা রয়েছে। যখনই ছেলে কাজ করতে চাইল, তিনি ভীষণ খুশি হয়ে ছেলেকে কাজে লাগিয়ে দিলেন।
৯
আমিন মুন্সির আজ বড় খুশির দিন। মামুন ও তার পরিবারের সবাই বিয়েতে রাজি হয়েছে। তবে মামুনের কিছু আরজি রয়েছে। শ্বশুরের টাকায় পড়তে ইচ্ছুক নয় সে। তবে চাকরি নিতে আপত্তি নেই। চাকরি করে তারপর সে নিজের মতো টাকাপয়সা জমিয়ে পড়াশোনা করবে এবং রেহানাকেও অবশ্যই আবার পড়াশোনা শুরু করতে হবে। ক্লাস ফাইভ পাস করতেই দেশে যুদ্ধ লেগে গেল। স্বাধীনের পর বিয়ে, বছর না ঘুরতেই ছাড়াছাড়ি। আর পড়াশোনা হয় নি মেয়েটির। মামুনের এমন আরজিতে আমিন মুন্সি যারপরনাই আনন্দিত। এমন করে ভাবতে পারে কয়জনে?
আব্বাস মিস্ত্রির খানিক সংকোচ ছিল, আমিন মুন্সির সাথে মানানসই আয়োজন তো সে করতে পারবে না। এই সংকোচ অবশ্য দূর করে দিয়েছেন স্বয়ং আমিন মুন্সিই। ন্যূনতম দেনমোহর আর একটা সুতি শাড়ি পরিয়ে মেয়েকে তুলে নিলেই তিনি খুশি। কোনো বউভাতের আয়োজনের প্রয়োজন নেই।
আব্বাস তার সামর্থ্য অনুযায়ী ভাইয়ের বিয়ের আয়োজন করল। খুব বেশি কিছু নয়, ন্যূনতম দেনমোহর; সোনা-কাপড় বলতে একটা নাকফুল আর হালের জনপ্রিয় একটি মালা শাড়ি। মোকসেদেরও কিছু জমানো টাকা ছিল, সেগুলো বের করল। সেই টাকায় পান-মিষ্টি নেওয়া আর মেহমানদারি করা হলো। এত বড় ঘরে ছেলের বিয়ে, কিছু না করলে তো মান-ইজ্জত যায়।
শুরু থেকেই কেমন একটা ভয় করছিল! ভালোয় ভালোয় বউ নিয়ে বাড়ি ফিরে আব্বাস স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
.
মুকুল যাত্রাদল ছেড়ে দিয়েছে। মায়ের বা ভাবির বকাবকিতে নয়, স্ত্রীর গঞ্জনাতেও নয়। ছাড়ল বাচ্চাটার দুঃখে। সে যে বাচ্চাকাচ্চার বিষয়ে খুবই আগ্রহী, বিষয়টা তা নয়। কিন্তু একটা বাচ্চা এসে গেছে আর মিনা তাকে না জানিয়েই মেরে ফেলল, এটা সে মেনে নিতে পারছে না। কোনোভাবেই না। ভীষণ রকম ভঙ্গুর অনুভব করছে। রাগ নাকি জেদ, তা সে জানে না, শুধু যাত্রাদলে আর থাকতে ইচ্ছা করছিল না।
খবরটা চাউর হতে সময় লাগে নি। গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডে চায়ের দোকানে বসে ছিল মুকুল। মানুষ দেখছিল সে। কে কী কাজ করে, সেই সব দেখছিল। নতুন কোনো কাজের সন্ধানে। এখানে নিত্যনতুন মানুষের আনাগোনা। ছোটখাটো অনেক রকম ব্যবসা করার সুযোগ আছে। কিন্তু ব্যবসা করার মতো পুঁজি তার নেই। কাঠের কাজ বাদে কোনো কাজও জানে না। কোনো কূলকিনারা পায় না।
এসব ভাবনায় যখন বিভোর হয়ে ছিল, ঠিক তখনই পাশ থেকে বাস ড্রাইভার আনোয়ার বলল, “কিগো মুকুল ভাই! এই সব কি সর্বনাইশ্যা কতা হুনি? তুমি বোলে যাত্রাদল ছাইড়া দেছো? কতা কি হাছা?’
আনোয়ার মুকুলের অভিনয়ের বিরাট ভক্ত। কোনো পালা সে বাদ দেয় না। দুজনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্বও রয়েছে।
মুকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কী করমু কও, যাত্রা কইর্যা কি সংসার চলে?’
আনোয়ার আহত গলায় বলল, ‘টাহাপয়সা ঠিকমতো দেয় না?’
‘মোডেও দেয় না।’
‘কও কী! মোরা যে এত পয়সা দিয়া টিগিট কাইড্যা দেহি?’
‘হেইয়া বোলে সেট আর কস্টিউমেই লাগে। হাছামিছা জানি না। তয় ম্যালা মানুষ অইলে মোরা সামান্য কিছু পাই। অতে কিছুই অয় না, দাদো।’
‘আহা রে! তোমার পালা আর দেখতে পামু না মনে অইতেই মনডা পুড়তেয়াছে।’
মুকুল আচমকাই জিজ্ঞেস করল, ‘আনোয়ার ভাই, গাড়ি ক্যামনে চালায়?’
‘হ্যা তো শেকতে অইবে। ম্যালা টাহাপয়সার মামলা। মোর নিজের গাড়ি থাকলে হেলে তোমারে শেখাইতে পারতাম।’
মুকুল আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টাকা ছাড়া কিছুই কেন সম্ভব না? মামুন কলকাতা চলে যাচ্ছে আজ। ভীষণ মনখারাপ রেহানার
মামুনের ব্যাগ গোছানোর সময় সে বলল, ‘আমিও আমনের লগে যামু।’
মামুন হেসে বলল, ‘তোমারে ক্যামনে নিমু?’
রেহানা গাল ফুলিয়ে বলল, ‘নিতে না পারলে বিয়া করছেন ক্যা?’
রেহানার ছেলেমানুষি দেখে মামুনের কেবল হাসি পাচ্ছে। কিন্তু সে হাসলে আবার রেহানা রাগ করবে। মেয়েটি কথায় কথায় রাগ করে। আবার মুহূর্তেই হেসে গড়িয়ে পড়ে। তাকে বোঝা বড় মুশকিল।
রেহানা ধমকে উঠল, ‘চুপ কইরা রইছেন ক্যা? কথার উত্তর দেন।’
মামুন কাছে এসে বলল, ‘আগে তো আমি যাই। তারপর সুযোগ বুইঝা তোমারে নিয়া যামু।’
রেহানা ফোঁস করে উঠে বলল, ‘নিবেন না, আমি জানি।’
‘ক্যামনে জানো?’
‘যারা শহরে চাকরি করতে যায়, অরা কেউই বউরে নিয়া যায় না। কত মাইনষেরে দেখলাম!’
‘আমারে সুযোগ তো দেবা। আগেই সবার কথা কও ক্যা?’
‘কই যাতে এহনই লগে কইরা লইয়া যান।’
মামুন রেহানার হাত ধরে বলল, ‘শোনো, এখন আমি যাইয়া কই উঠমু, তাই জানি না। হয়তো কোনো মেসে। তোমারে লইয়া গিয়া কি মেসে উঠতে পারমু, কও? আগে আমি যাই। টাকাপয়সা জমাই। সবকিছু গুছাইয়া নিয়া এরপর তোমারে নিমু।’
‘সত্য?’
‘সত্য।’
রেহানা আহ্লাদী গলায় জানতে চাইল, ‘এত দিন আমি কার কাছে থাকমু?’
‘ক্যান, আব্বা-আম্মা, ভাইজানেরা, ভাবিরা, তাগো পোলাপানেরা—সবাই তো আছে।’
রেহানা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘আমার কাউরে ভাল্লাগে না।’
অবাক হলো মামুন, ‘ভাল্লাগে না ক্যা?’
রেহানা বলল, ‘সবাই জানি কেমন! আমাগো বাড়ির কেউ এমন না।’
‘এমন কেমন?’
বুঝতে পারছে না মামুন।
রেহানা এবার ইতস্তত করে বলল, ‘সবার কাপড়চোপড় ময়লা, চুল ময়লা। গরিবের মতো থাকে। ক্যামনে কইরা তাকায়।’
মামুন ম্লান হেসে বলল, ‘আমরা তো গরিবই। তোমাগো পরিবারের লগে আমাগো পরিবারের সম্পর্কডাই আসলে বেমানান।’
‘আমারে বিয়া কইরা কি এহন আফসোস অইতাছে?’
‘আফসোস তো তোমার হওনের কথা। আমার ক্যান হবে?’
‘আমার কোনো আফসোস নাই। কারণ, আমার আমনেরে অনেক ভাল্লাগে।’
মামুন লজ্জা পেয়ে গেল এবার। লজ্জায় লাল হয়ে যেতে যেতেই দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘তাইলে কি কয় দিন তোমাগো বাড়ি গিয়া থাকবা?’
রেহানা সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল, ‘নাহ্। আমনে আমারে যত দিন না নিয়া যান, আমি এহেনেই থাকমু। আমনের ঘরে।’
মামুন হেসে বলল, ‘আচ্ছা, তোমার যেহেনে ইচ্ছা থাকো। এই বাড়িতে থাকতে কষ্ট হবে জানি। তোমাগো বাড়ির মতো কোনো সুযোগ-সুবিধাই এইখানে নাই। কষ্ট কইরা কয়টা দিন থাকো। কথা দিলাম, শিগগিরই তোমারে কলকাতা নিয়া যামু।’
রেহানা মাথা নেড়ে বলল, “আচ্ছা। কিন্তু এই যে আমি কইলাম আমনেরে আমার ভাল্লাগে, আমারে আমনের কেমন লাগে, এইডা তো কইলেন না?’
মামুন হেসে বলল, ‘তুমি তো বুদ্ধিমতী। তুমিই কও এই কয় দিনে কী বুঝলা?’
রেহানা আঙুলে চুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল, ‘আমি যা বুঝলাম তা হইল, প্রথম প্রথম আমারে আমনের ভাল্লাগত না। দেখতে ভালো না, তার উপে কালা; ভাল্লাগার কথাও না। কিন্তু আমি তো আবার ছলাকলা জানি, তাই পইট্যা গেছেন। এখন আবার ভাল্লাগে।’
মামুন এবার হো হো করে হেসে দিল। রেহানা মুচকি হাসছে। মামুনের এই ভুবনভোলানো হাসি যতবার সে দেখে, ততবার তার মন উতলা হয়।
উঠোনে মরিচ শুকানো হচ্ছিল। হালিমা বিবি সেখানে বসে মরিচ পাহারা দিচ্ছিলেন। এত জোরে হাসির শব্দ শুনেই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘দুহাইর্যাকালে এত হাহা হিহি কিসের?’
রেনু রান্না বসিয়েছে। মিনা তরকারি কুটছিল। মিনা রেনুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভাবি, দেখছ কাণ্ড? আমাগো লগে কইরা খায়েশ মিটে না। এহন নতুন বউয়ের লগে শুরু করছে।’
রেনু চাপা গলায় বলল, ‘আহ মিনা, চুপ কর।
‘চুপ করমু ক্যা, ভাবি? বেচারা নিজের বউয়ের লগে হাসবে না তয় কি অন্য ব্যাডাগো বউয়ের লগে হাসবে?
‘থাক মিনা, তুই থাম। কানে গেলে আবার অশান্তি করবে।’
মিনা রাগে গজগজ করতে করতে একনিমেষেই সব তরকারি কুটে ফেলল।
এদিকে মায়ের হুংকার শুনে মামুন চুপ হয়ে গেল। তখনই ঘর থেকে বের হয়ে যেতে চাচ্ছিল, রেহানা তাকে আটকে বলল, কই যান? ‘
‘এমনেই বাইরে যাই। মা কি-না-কি মনে করতাছে।’
রেহানা মামুনকে কাছে টেনে বলল, ‘করতে দেন। বিয়া করছেন না? এত শরম কিসের?’
.
মুকুলের যাত্রাদল ছাড়ায় সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছে মিনা। নতুন কোনো কাজে নামুক না-নামুক, যাত্রাদল ছেড়েছে, এতেই সে মহা খুশি। কিন্তু সেদিনের পর থেকে মুকুল একবারও তার কাছে আসে নি। প্রতিটা দিন উল্টো ঘুরে ঘুমিয়ে থাকে। রাগ হয়েছে। এই রাগ ভাঙতে কত দিন লাগে কে জানে। এভাবে তো আর চলতে দেওয়া যায় না। তাই ভেবেছে আজ সে একটু রাগ ভাঙাবার চেষ্টা করবে। কিন্তু আজই মধু সবচেয়ে বেশি জ্বালাচ্ছে। ঘুমের কোনো নামগন্ধ নেই।
অনেক জ্বালাতনের পর মধু ঘুমিয়ে পড়লে মিনা মুকুলের কাছে গেল। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই মুকুল সরিয়ে দিল।
মিনা বলল, ‘ওকি, দূরে সরাইয়া দেও ক্যা? পোলায় ঘুমাইছে তো।’
মুকুল স্পষ্ট গলায় বলল, ‘দূরে থাকনই ভালো। আবার কোন বিপদ হয় কওন যায় না। কয়বার আর বাচ্চা ফালান যাইবে? রাইত অনেক অইছে, ঘুমাও।’
মিনা আর কথা বলতে পারল না। ঘুমাতেও পারল না, ঘুম উড়ে গেছে তার।
নাইয়রি – ১০
১০
মিনু বহুদিন পর বাপের বাড়ি এল। নতুন অতিথি আসার খবর পেয়ে মিনুর বাবা ইয়াসিন আলী মেয়েকে নাইয়র নিতে গিয়েছিলেন। তিনি মেয়ের সাথে জেসমিনকেও বেড়াতে আনতে চাইলেন। জেসমিনের ইচ্ছা না থাকা স্বত্ত্বেও জয়নাল মির্জার হুকুমে তাকে কুটুমবাড়ি আসতে হয়েছে। এমনিতে সে এ বাড়িতে আসতে পছন্দ করে। মিনুর ছোট ছোট ভাইবোন থাকায় তাদের সাথে খেলে জেসমিনের সময় অনেক ভালো কাটে। কিন্তু এবার মন টিকছে না। রঞ্জুর জন্য অস্থির লাগছে। একটা খবরও দিয়ে আসতে পারে নি। এই ছেলেটা জীবনে আসার পর থেকে সবকিছুতেই তার অস্থির লাগে! এ কী ভয়ংকর অসুখ!
মিনুর মা ছালেহা রান্নাঘরে বসে তাল গোলাচ্ছেন। কলাপাতায় তালের পিঠা তৈরি হবে। তার হাতের এই পিঠা জেসমিনের অতি পছন্দের। প্রতি বর্ষায় নিয়মিত এ বাড়ি থেকে তালের পিঠা যায় তার জন্য। আর সে এ বাড়ি বেড়াতে এলে তো তালের পিঠা বানানো আবশ্যক। জেসমিন রান্নাঘরের দাওয়ায় বসে ছালেহার তাল গোলা দেখছে। ঠিক সেই সময়ে আচমকা রঞ্জুর গলা শুনতে পেল। পিলে চমকে গেল জেসমিনের। রঞ্জুর মতো কণ্ঠ, ডাকছেও রঞ্জুকে। বাড়ির পাশে রাস্তা। শব্দটা রাস্তার দিক থেকেই আসছে এবং অনেকটাই দূরে। কিন্তু জেসমিন তো এই গলাটা চেনে। রঞ্জুর তো এখানে আসার কথা নয়, আসা সম্ভবও নয়। মতির মাধ্যমে খবর নিতে পারে যে সে বেড়াতে এসেছে; কিন্তু এ বাড়ির ঠিকানা তো পাওয়া সম্ভব নয়। তবে কি সে ভুল শুনেছে? ভুল শোনাটা অস্বাভাবিক নয়। হ্যাঁ, ভুলই হয়তো শুনেছে। সত্যি হলে তো ছালেহাও শুনতেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই ডাকটা আবার শুনতে পেল জেসমিন। রঞ্জু রঞ্জুকেই ডাকছে। এটা ভুল হতে পারে না। রঞ্জু এসেছে! কীভাবে এসেছে, সে জানে না, তবে রঞ্জু এসেছে। রাস্তায় যে কেউ যে কাউকে ডাকতে পারে, তাই হয়তো ব্যাপারটা আমলে নেন নি ছালেহা। তিনি তার কাজ করে যাচ্ছেন। জেসমিন অস্থির হয়ে পড়ল। যে করেই হোক, তাকে রাস্তায় যেতে হবে।
জেসমিন ঘরে ঢুকল। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে সোজা রাস্তার দিকে চলে গেল। রাস্তার কাছাকাছি গিয়ে দেখে রঞ্জু আর মানিক দাঁড়িয়ে আছে। রঞ্জু আশপাশে সবদিকে তাকিয়ে জেসমিনকে খুঁজছিল। তাই জেসমিন রাস্তায় উঠতেই রঞ্জু তাকে দেখে এগিয়ে গেল। জেসমিনের চোখে চোখ পড়তেই রঞ্জু হাসল। জেসমিন হাসির উত্তর দিল না। তাকে ইশারা দিয়ে বাড়ির পাশের বাঁশবাগানে যেতে বলে সে আবার বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। রঞ্জু বাঁশবাগানে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। মানিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেসমিন এল। এবার সে রঞ্জুর হাসির উত্তরটা দিল। বলল, ‘আমি যে এইহানে, হেই কতা ক্যামনে জানলা?’
রঞ্জু হেসে বলল, ‘মতি ডাকপিয়ন!’
‘কিন্তু এই বাড়ি তো মতি চেনে না। ঠিকানা কোতায় পাইছ?’
‘মানিক জোগাড় করেছে। আমি তো এদিকের কিছুই চিনি না। মানিকই নিয়ে এসেছে।’
‘সে এখন কই?’
‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।’
‘তোমার ডর লাগল না আইতে?’
‘কিসের ভয়?’
‘ভিনগাঁয়ে দেহা করতে আইয়া যদি ধরা খাও?’
‘তোমাকে দেখা এত জরুরি ছিল যে এসব মাথায়ও আসে নি।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘এই না হইলে প্রেমিক!
জেসমিন রঞ্জুকে নিয়ে মিত্তির দিঘির দিকে গেল। দিঘিতে মিনুদের দুটি ডোঙা নৌকা বাঁধা। এই ডোঙা দুটিতে করে মিনুর ভাইবোনেরা দিঘিতে মাছ ধরতে যায়, শাপলা তুলতে যায়। জেসমিন এলে তাদের সাথে সে-ও যায়। তালগাছের কাণ্ড দিয়ে এই নৌকা বানানো হয়। ডোঙা বেশ টেকসই। তালগাছের কাণ্ড সহজে পচে না বলে একটি ডোঙা বেশ কয়েক বছর ব্যবহার করা যায়। তবে তালগাছের প্রস্থ কম হওয়াতে একসাথে বেশি মানুষজন ওঠা বিপজ্জনক। ডোঙায় যদি দুজন ওঠে, তবে দুজনই বইঠা বাইতে পারলে ভালো। জেসমিন রঞ্জুকে সাথে নিয়ে একটি ডোঙা ভাসাল। দুজনের হাতে দুটি বইঠা। কিছুদূর যেতেই রঞ্জু বলল, ‘তুমি আমাকে কিছু না জানিয়ে বেড়াতে এসেছ শুনে হঠাৎ করে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেছিল। অন্তত মতির কাছে একটা চিঠি দিয়ে আসতে পারতা।’
জেসমিন বইঠা বাইতে বাইতে বলছিল, ‘সুযোগ আছিল না। তালোইসাব আচুক্কা আইয়া পড়ছিল। চিডি একখান লেখছিলাম, কিন্তু মতির কাছে যাইতে পারি নাই।’
‘একটা অজানা ভয় কাজ করছিল।’
‘যেকালে তোমার ইনভার্সিটি খুইল্যা যাইবে, হেকালে কী করবা?’
‘তখন তো জেনেই ঢাকা যাব যে এত দিন দেখা হবে না। মানসিক প্রস্তুতি থাকবে।’
‘এহ্, নিজে যাওনের সময় এক্কালে ষোলো আনা। আর মাইনষের বেলায় এক আনাও না! ‘
রঞ্জু হেসে বলল, ‘আচ্ছা যাও। পুরা ষোলো আনাই তোমার।’
জেসমিনের মুখে এবার হাসি ফুটল। বলল, ‘আচ্ছা, এই দিঘির একখান কাহিনি আছে। হুনবা?’
‘বলো।’
‘এই গেরামের যত মাইনষের বিয়া লাগত, বিয়ায় খাওনের সব থালাবাসন, হাঁড়িপাতিল দিত এই মিত্তির দিঘি।
রঞ্জু কৌতূহলী কণ্ঠে জানতে চাইল, ‘কীভাবে?
‘কারও বিয়া লাগলে পাত্র-পাত্রীর বাপ-মা এহেনে আইয়া কইত, অমুক দিন আমার মাইয়ার বিয়া। পোলার বাপেরা কইত আমার পোলার বিয়া। আমারে কিছু থালাবাসন, হাঁড়িপাতিল দাও গো মিত্তির দিঘি। পরদিন বেইন্যাকালে দিঘির পাড়ে পিতলের থালাবাসন, হাঁড়িপাতিল পাওন যাইত। বিয়া মিট্যা গেলে থালাবাসন, হাঁড়িপাতিলগুলা আবার মাইজ্যা-ধুইয়া দিঘির পাড়ে থুইয়া দিতে হইত। দিঘি রাইতের বেলা ফেরত নিয়া নিত। একবার হইল কি, এক লোক হের মাইয়ার বিয়ার লাইগা থালাবাসন নিল। বিয়ার কাম শ্যাষ হইতেই সব আবার মাইজ্যা-ধুইয়া দিঘির পাড়ে থুইয়া গেল। কিন্তু পরদিন দেখে থালাবাসন পাড়েই রইসে। দিঘি ফেরত নেয় নাই। এমনে আরও এক দিন এক রাইত গেল। থালাবাসন পাড়েই পইড়া রইছে। লোকটা তো বেজায় দুশ্চিন্তায় পইড়া গেল। দিঘি থালাবাসন নিতাছে না, এইডা তো ভালো লক্ষণ না। সেই দিন রাইতেই লোকটা স্বপ্নে দেখল থালাবাসন সব যায় নাই। এর লাইগ্যা দিঘি ফেরত নিতাছে না। কী সর্বনাইশা কথা! মিত্তির দিঘির পিতলের জিনিস চুরি! শ্যাষম্যাশ চাচা বাড়ির বেবাকটিরে ডাইক্যা কইল, কেউ কিছু চুরি করলে রাইতে জায়গামতো রাইখা আইতে। আর নাইলে এই বংশ ধ্বংস হইয়া যাইবে। আসলে ওই ক্যাডার পোলার বউ এত সুন্দর নকশা করা পিতলের থালাবাসন দেইখা লোভে পইড়া একটা বাটি পলাইয়া রাখছিল। যা-ই হোক, পরে মহিলা ওই রাইতেই বাটিটা ফেরত রাইখা আসছিল। সেই যে সেদিন রাতে দিঘি সব থালাবাসন নিল, এরপর আর কোনো দিন কাউরে দেয় নাই। কত মানুষ চাইল, দিঘির পাড়ে আর থালাবাসন আহে না।’
রঞ্জু হেসে বলল, ‘এটা তোমার বানানো গল্প, তাই না?’
জেসমিন রেগে গেল, ‘বানাইন্যা অইবে ক্যা? তুমি এই গেরামের মিত্তির দিঘির কথা যে কাউরে জিগাও গা যাইয়া, সবাই জানে। এই জেসমিন মিছা কথা কয় না।’
রঞ্জু কিছু বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই তীরের দিক থেকে একটা হুংকার শোনা গেল, ‘এই…ডোঙায় তোমরা কার পোলা? কার মাইয়া?’
সাথে সাথে আরেকজনের গলা পাওয়া গেল, ‘মাইয়ার তো চেহারা দেহা যায় না। পোলাউগ্যারে ত দেইক্কা মনে হয় না এই গেরামের।’
‘কী সর্বনাশ, জওয়ান মাইয়া-পোলা একলগে ডোঙা বায়! দ্যাশটা তো এক্কালে রসাতলে গেল।’
রঞ্জু সেদিকে তাকাল। জেসমিন একজনের গলা শুনে চিনতে পারল। এটা ইয়াসিন আলীর গলা। তারা জেসমিনের পেছন দিকে। সে আর পেছনে তাকাল না। রঞ্জুকে বলল, ‘এই, তুমি ওই দিক চাইয়ো না। শ্যাষের জন আমার তালোই। তাড়াতাড়ি ডোঙা বাও। এদিক থিকা পলাইতে অইবে। আমার চেহারা দেহান যাইবে না।’
ইয়াসিন আলীর গলা আবারও শোনা গেল। তবে আগের মতো চেঁচিয়ে না বলায় বোঝা গেল না।
রঞ্জু বলল, ‘সর্বনাশ! ওরা একটা নৌকায় উঠেছে। এদিকেই আসছে।’
‘নৌকা না ডোঙা?’
‘নৌকা।’
‘ডোঙা বাইয়া নৌকার লগে পারমু না। লাফ দাও। সাঁতরাইয়া পলাইতে অইবে।’
রঞ্জু জেসমিনের হাত ধরে দিঘিতে লাফ দিল। জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। ডুবসাঁতার দিয়ে দুজনে যে কোন দিকে গেল, ইয়াসিন আলীরা আর খুঁজে পেলেন না।
.
জেসমিন চোরের মতো পেছন দিকের রাস্তা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল। লুকিয়ে ঘরে ঢুকে দ্রুত কাপড়টা পাল্টে ফেলল। এর কিছুক্ষণ বাদেই মিনু এসে বলল, ‘জেসমিন, তুমি কাইল সকালে বাড়িত চইলা যাও। আমাগো বাড়ি বইয়া ধরা খাইলে বিপদের ভাগীদার আমরাও হমু। আমি আমার বাপেরে এই বয়সে বিপদে ফালাইতে চাই না।’
মিনু জেসমিনের উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেল। রাতে খাওয়াদাওয়ার সময় মিনু ইয়াসিন আলীকে বলল, ‘আব্বা, জেসমিন বাড়ি যাইতে চায়। কাইল ব্যানে (সকালে) আমনে অর যাওনের ব্যবস্থা করেন।’
ইয়াসিন আলী বিচলিত হয়ে বললেন, ‘ক্যা মা, কী অইছে? আম্মাজানের কি কোনো সমেস্যা অইতেয়াছে এহেনে?’
‘এত ভাইবেন না, আব্বা। সে বড় হইছে। যাইতে যখন চায়, যাওনের ব্যবস্থা করেন।’
জেসমিনকে কিছু বলারই সুযোগ দিল না মিনু। অবশ্য জেসমিনের বলারও কিছু নেই। যেতে পারলে বরং ভালো।
‘আচ্ছা, বেইন্যাকালে আমি লইয়া যামু।’
ইয়াসিন আলী এ কথা বলে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেলেন। মিনু যখন এভাবে বলছে, নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।
রাতেই জেসমিনের জ্বর এল। দিঘিতে অনেকক্ষণ সাঁতরানোর ফলে ঠান্ডা লেগে জ্বর। খুব বেশি জ্বর নয় যদিও। সে ব্যাপারটা কাউকেই বুঝতে দিল না। বাড়ি চলে এল। অসুস্থ অবস্থায় অনেকটা পথ নৌকা করে আসায় জ্বর বেড়ে গেল। নৌকার ঘাটে দেখা হয়ে গেল মানিকের সাথে। ইয়াসিন আলী নৌকার ভাড়া মেটানোর সময় জেসমিন মানিকের কাছে গিয়ে বলল, ‘কী মানিক ভাই, বন্ধুরে তালাক দিতে পারলেন না? ভিনগাঁয়ে গেলেন গিয়া তার প্রেমিকার কুটুমবাড়ি চিনাইতে!’
মানিক বলল, ‘তালাক ক্যান দিমু? সে আমার বন্ধু। তারে ভালো-মন্দের বুঝ দেওন দায়িত্ব ছিল, তাই দিছি। তার ভালোর লগে যেমন থাকি, মন্দের লগেও থাকি। তাই আছি। লাগলে তার লাইগা জান দিমু। কুটুমবাড়ি চিনানো তো কিছুই না।’
‘আমার ব্যাপারটাও তাই, লাগলে জান দিতে পারমু কিন্তু তারে ছাড়া থাকতে পারমু না।’
.
রাত তখন অনেক। জানালায় দুটো টোকা পড়ল। মতিকে বলা আছে জরুরি প্রয়োজনে এসে যদি জানালা বন্ধ পায়, তাহলে হালকাভাবে দুটো টোকা দেবে। তখনই জেসমিন বুঝবে মতি এসেছে। জ্বর নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠতে কষ্ট হলো জেসমিনের। তবু সে উঠল। নিশ্চয়ই রঞ্জুর কোনো খবর হবে। জানালা খুলতেই চমকে উঠল জেসমিন। রঞ্জু দাঁড়িয়ে! ফিসফিসিয়ে বলল, ‘তুমি এত রাইতে এহেনে?’
‘তোমার জ্বর খবর পেয়ে এলাম। জ্বর বাধালে কী করে? সাঁতার কেটে?’
‘মনে হয়। আইনকা পানি তো। কিন্তু তুমি খবর পাইলা ক্যামনে?’
‘তুমি খেয়াঘাটে নামতেই মানিক তোমাকে দেখছিল। তাড়াতাড়ি আসছ কেন, এই খবর নিতে গিয়ে জ্বরের খবর পেল।’
‘ও! জানো, একটা গন্ডগোল হইয়া গেছে।’
‘কী গন্ডগোল?’
‘ছোট ভাবির কাছে ধরা খাইয়া গেছি।’
‘সর্বনাশ। কীভাবে?
‘তা জানি না। ভাবির লগে এই বিষয়ে আর আলাপ করার সাহস পাইতাছিলাম না।’
‘যদি তোমার বাবাকে বলে দেয়?’
‘তা কইবে না। সে তার নিজের আব্বারেও কয় নাই।’
‘আচ্ছা।
জেসমিন আচমকাই বলে উঠল, ‘কপালে হাত দিয়া জ্বর দেখতে মনে চায়, এইটা মুখে কইতে ডরাও? ক্যামন পুরুষ তুমি?’
রঞ্জু হেসে বলল, ‘তুমি কীভাবে মন পড়তে পারো, জেসমিন?’
‘মন পড়তে হইলে চক্ষু লাগে। আর হেইডা আমার আছে।’
জেসমিন জানালার একদম কাছে চলে গেল। রঞ্জু কপালে হাত রাখল। জেসমিন কেঁপে উঠল। মনে হলো বরফের হাত বসেছে তার কপালে। এই হাত তার প্রিয় মানুষের হাত! সে চোখটা বন্ধ করে প্রার্থনা করে নিল, এই হাত যেন আজন্মকাল তার কপাল ছোঁয়ার অধিকার পায়।
১১
চাঁদশী গ্রামে আজ হাটবার। মোকসেদ হাটে যাচ্ছেন। হালিমা টাকা দিতেই তিনি বললেন, ‘ও বউ, এত অল্প টাহা দিলা। এই টাহায় কতডু সদায় অইবে? ফর্দ তো ম্যালা লম্বা। সদায়পাতির দাম জানো?’
হালিমা বললেন, ‘অত কিছু মোর জানা লাগবে না। যে পয়সা দিছি, হেইয়াইদ্যা যা পারেন আনেন, নাইলে আব্বাসের ধারে চান। মামুন টাহাপয়সা পাডাইন্যা দেছেইত্যা আব্বাস টাহা দেওয়া বন্দ করছে। এ রহোম করলে এতগুলা মাইনষের সংসার ক্যামনে চালামু?’
মোকসেদ অবাক হয়ে বললেন, ‘আব্বাসের হাতে তো এহন বড় কোনো কাম নাই। ছোডখাডো কাম কইর্যা যে টাহা পায়, হ্যাতো রেনুর চিকিসসায় লাগে। দেবে কোতাইদ্দা? আবার বড় কাম পাইলে দেবেয়ানে। তয় মামুন তো ম্যালা টাহা পাড়ায়। হেইয়া দিয়া তো ভালো কইর্যা মাস পার অইয়া যাওয়ার কতা।’
হালিমা খেপে গেলেন, ‘কী কইতে চান আমনে? মুই কি মামুনের টাহাপয়সা সব গিল্লা খাইছি? সব তো সংসারেই খরচ অইছে। সদায়ডা করা ছাড়া কোনো খবর রাহেন সংসারের? সামনের মাসেইত্যা মামুনের সব পয়সা আমনে রাইখা সংসারডা চালাইয়া দেইখেন আমি ক্যামনে এত কিছু সামলাই।’
‘আহ রাগ অও ক্যা? একটা কতা কওন যায় না, ছ্যাত কইর্যা ওডে।’
মোকসেদ হাটের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লে হালিমা দরজায় খিল দিয়ে জমানো টাকাগুলো বের করে গুনলেন। তিনি জানেন কত টাকা আছে, তারপরও ঘরে একা থাকলেই টাকাগুলো বের করে গুনে একটা তৃপ্তি নিশ্বাস ফেলেন। কী যে শান্তি লাগে! মামুন টাকা পাঠানো শুরু করার পর থেকে তিনি নিয়মিত সেই টাকা থেকে কিছু টাকা সরিয়ে রাখেন। তার একটা কানপাশার বড় শখ। আর কিছু টাকা জমলেই একটা কানপাশা বানাবেন। তারপর আবার টাকা জমাবেন। সেই টাকায় নিজের ঘরের মেঝেটা পাকা করবেন। তার একটা পাকা ঘরের স্বপ্ন বহুদিনের।
এত দিন হয়ে গেল, এখনো মুকুল মিনার সাথে ঠিকমতো কথা বলে না। বাড়িতে বেশিক্ষণ থাকে না। মাঝে মাঝে মিনা ঘুম থেকে ওঠার আগেই সে উঠে বেরিয়ে যায়। রাতেও ফেরে অনেক দেরি করে, ততক্ষণে সে ঘুমিয়ে কাদা। একদিনও জেগে থাকতে পারে না। সারা দিন বাড়ির এত কাজ করতে হয় যে রাত জেগে থাকা আর শরীরে কুলায় না। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে, নিজেও টের পায় না। কোথায় যে থাকে সারা দিন! ফয়েজের থেকে জেনেছে, মুকুল হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছে।
অনেক দিন বাদে আজ দুপুরবেলা মুকুল বাড়ি এসেছে। খাওয়াদাওয়া করে একটু শুয়েছে। কে জানে শরীরটা খারাপ করল কি না! সে যে একটু ঘরে গিয়ে খোঁজ নেবে, সেই সুযোগ নেই। হালিমা বিবি রাজ্যের কাজ দিয়ে রেখেছেন। এগুলো কখন যে শেষ হবে! এসব ফেলে রেখে ঘরে গেলে কপালে দুর্ভোগ আছে।
কাজগুলো সেরে ঘরে যেতে যেতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এল। ঘরে ঢুকে দেখে মুকুল মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। মিনা কপালে হাত রেখে বলল, ‘তোমার শরীলডা কি খারাপ?’
মুকুল বিছানা ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল, ‘না।’
‘হেলে অবেলায় ঘুমাইলা যে?’
মিনা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মুকুল শান্ত গলায় জানতে চাইল, ‘ঘুমাইন্যা কি মানা?”
‘না না। তা কই নাই।’
মুকুল শার্ট গায়ে দিচ্ছে দেখে মিনা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আবার কই যাও?’
‘কাম আছে।’
‘আরেকটু থাহো। কামকাইজ শ্যাষ কইরা হপায় আইলাম আর এহনই তুমি যাও। আবার তো আবা বেইন্যারাইতে।’
মুকুল শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বলল, ‘কামকাইজ শ্যাষ করছ, এখন জিরাও।’
মিনা মুকুলের হাত দুটো চেপে ধরে বলল, ‘মোরে কি মাফ করোন যায় না? আম্মায় উঠতে-বইতে খোড়া দিত তোমার আয় নাই দেইখা। মোর মাতাডা ঠিক আছিল না।’
‘এরপর মাথা খারাপ অইলে কি মধুরে মাইরা ফালাবা?’ আঁতকে উঠল মিনা, ‘এইডা তুমি কী কইলা?’
মুকুল নির্বিকার গলায় বলল, ‘একই তো। মধুও আমাগো বাচ্চা, যারে মারছ, হেও আমাগোই বাচ্চা।’
মিনা কাঁদতে শুরু করল। মধুকে নিয়ে বলা কথাটি সে নিতে পারে নি মুকুলের সাথে তৈরি হওয়া এই দূরত্বটাও কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না। যেকোনো মূল্যে সে সবকিছু মিটিয়ে নিতে চাইছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
মিনা এবার মুকুলের পা জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আল্লাহর ওয়াস্তে এইবারের মতো আমারে মাফ কইরা দেও। আর রাগ হইয়া থাইকো না। আর সইতে পারতেয়াছি না।’
মুকুল মিনাকে দুহাতে ধরে ওঠাল।
দুঃখী গলায় বলল, ‘কাইন্দ না, রাগ হইছিল। এহন আর নাই। গ্যাছেগা ম্যালা আগেই। তয় কষ্টডা রইয়া গেছে। কথাডা আর তুইল্য না। ভুইল্যা যাইতে চাই।’
মুকুল বেরিয়ে গেল। মিনা দরজার কপাটে মাথা ঠেকিয়ে মুকুলের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে লাগল।
১২
দুপুর পেরিয়ে বিকেল হতে চলেছে। রঞ্জুকে উঠোনে একটা গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। উঠোনভর্তি লোকজন। সালিস বসবে একটু পরই। শুধু চেয়ারম্যান সাহেবের অপেক্ষা। গ্রামের অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও এসে পড়েছেন। মাঝরাতে রঞ্জুকে জেসমিনের জানালার সামনে থেকে ধরে আনা হয়েছে, সারা রাত সে এই গাছের সাথেই বাঁধা। প্রচণ্ড ক্ষুধায় কাতর সে, শরীরের সব শক্তি যেন শেষ।
মানিক টের পেয়েছে দুপুরে। কিন্তু রঞ্জু সবার চোখের সামনেই। পাহারাও দেওয়া হচ্ছে, ধারেকাছেও যেতে পারে নি সে। তাই সে এখন রঞ্জুর বাবার কাছে যাচ্ছে খবর দিতে। চেয়ারম্যানের ভয়ংকর কোনো শাস্তির হাত থেকে হয়তো একমাত্র উনিই বাঁচাতে পারবেন রঞ্জুকে।
যেহেতু রাতে ধরা পড়েছে, সেহেতু সালিস সকালেও হতে পারত। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেব নাকি আজকে কঠিন ব্যস্ত। মেয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আর কি কিছু থাকতে পারে? মানিক ভালোভাবেই জানে, ব্যস্ততা আসলে কিছুই না। অপরাধীকে যাতে সালিস হবার আগেই অভুক্ত অবস্থায় বেশিক্ষণ বেঁধে রেখে কষ্ট দেওয়া যায়, তাই এই ব্যস্ততার নাটক। এই নাটক শুধু সে নয়, গ্রামের অনেকেই বোঝে কিন্তু কিছু করার নেই। বড় বড় মানুষের বড় বড় ব্যাপার। গরিবের না আছে কিছু বলার ক্ষমতা, না আছে কিছু করার ক্ষমতা। গরিব সর্বক্ষেত্রেই অক্ষম!
রঞ্জু ধরা খাওয়ার পর থেকে জেসমিনকে ঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে। জেসমিন কেঁদেকেটে একাকার করেছে। ঘরের ভেতর থেকেই বারবার রঞ্জুকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুনয়-বিনয় করেছে সে। কেউ তেমন একটা গায়ে মাখে নি। তবে কোহিনুর বানু একবার এলেন। জানালা খুলে ঠান্ডা গলায় বললেন, ‘বেশি চিল্লাইলে গরম শিক আইন্যা গলায় ঢুকাইয়া দিমু।’
জেসমিন ফুঁসে উঠল, ‘দেও। আমারে মাইরা হালাও, তবু রঞ্জুরে ছাইড়া দিতে কও, মা। আল্লাহর দোহাই লাগে।’
‘পোড়াকপালি! পিরিত মারানির আগে মনে আছিল না কী অইতে পারে? তোর আহ্লাদীর ঠেলায় জওয়ান পোলাডার জীবন দিতে অইবে এহন।’
জেসমিন পা দাপিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘মাফ কইরা দেও, মা গো, মাফ কইরা দেও।’
‘আমার বাপে আইলেও তোর বাপেরে আইজগো আটকাইতে পারবে না লো সর্বনাশী ছেরি। যে সর্বনাশ তুই করছস, হেইয়া এহন চক্ষু মেইল্যা দ্যাকতে অইবে।’
জয়নাল মির্জা সালিসে যাওয়ার আগে জেসমিনের ঘরে ঢুকলেন। জেসমিন বিছানায় বসে ছিল। বাবাকে দেখে নেমে এল। তবে বাবাকে সে ভীষণ ভয় পায়। তার মুখের ওপর কোনো দিন কথা বলে নি। জয়নাল মির্জা বললেন, ‘কী বলি মনোযোগ দিয়ে শোনো। সালিসে তোমারে ডাকা অইবে। ছেলে যা-ই বলুক, তুমি বলবা এই ছেলে তোমারে পছন্দ করে, তবে তুমি কখনোই তার ডাকে সাড়া দাও নাই। এই কথার যেন নড়চড় না হয়, জেসমিন। তার জীবনে সর্বনাশ ডাইকা আনবা না আশা করি।’
জেসমিনকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি বেরিয়ে গেলেন।
সালিস শুরু হবার আগেই রঞ্জুর বাবা এসে উপস্থিত হলেন। তাকে দেখে জয়নাল মির্জার মাথায় চক্কর দিয়ে উঠল। কারণ, রঞ্জুর বাবা হারুন ব্যাপারী। এই ছেলে যে হারুন ব্যাপারীর, সেটা যদি তিনি আগে জানতেন, তবে খেলার চাল ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। ঘুণাক্ষরেও সালিস ডাকতেন না। এই ছেলেকে তুরুপের তাস বানিয়ে জমির ঝামেলাটা মিটিয়ে ফেলতে পারতেন।
তিনি সব সময় ভেবেচিন্তে প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করেন। সেই হিসেবে তার প্রথমে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিল ছেলেটির বাবা কে? কিন্তু এই ক্ষেত্রে নিজের মেয়ের প্রণয়ের সম্পর্ক ধরা পড়ায় তার মাথা আউলে গিয়েছিল। ছেলেটিকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার জন্য গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটছিল। সেই জন্যই সালিস ডেকে বসলেন।
.
কেশবপুরের সকল সালিসে সাধারণত চেয়ারম্যান জয়নাল মির্জা, মেম্বার কাশেম মোল্লা, কেশবপুর বাজারের একমাত্র ডাক্তার প্রণব সাহা, কেশবপুর হাইস্কুলের হেডমাস্টার নাসেরউদ্দিনসহ গ্রামের প্রভাবশালী অন্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও আসেন। সকলের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আজ ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। যেহেতু ভিকটিম চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যা, সেহেতু বিষয়টি স্পর্শকাতর। সকলেই এসেছেন। যে ছেলে চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যাকে রাতবিরাতে উত্ত্যক্ত করতে পারে, অবশ্যই সেই ছেলের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।
প্রথমেই জেসমিনকে ডাকা হলো। সে যেহেতু ভিকটিম, তার কথাই আগে শুনতে হবে। জেসমিনের গায়ে জ্বর, শরীর কাঁপছে। তাকে ধরে আনলেন কোহিনুর বানু। রঞ্জু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সালিস শুরুর আগে অবশ্য তার বাঁধন খুলে দেওয়া হয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেবের পুত্রদ্বয়ও পাশেই দাঁড়ানো। হারুন ব্যাপারী অন্য গ্রামের হলেও প্রভাবশালী এবং সম্মানীয় লোক। তাই অপরাধীর বাবা হওয়া সত্ত্বেও তাকে বিচারকারীদের সাথেই বসতে দেওয়া হয়েছে। তিনি কোনো কথা বলছেন না, চুপচাপ দেখছেন। খবর পেয়ে এখানে আসতে আসতেই খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পরিকল্পনা করে ফেলেছেন তিনি, তবে তার আগে জেসমিনের বক্তব্য শোনা দরকার। জেসমিন এবং রঞ্জুর বক্তব্যের ওপর নির্ভর করছে তার পরিকল্পনা কাজে লাগানো যাবে নাকি যাবে না।
সকল সালিস চেয়ারম্যান সাহেবই শুরু করেন, তবে এই সালিস শুরু করার দায়িত্ব তিনি দিয়েছেন মেম্বার সাহেবকে। প্রয়োজনে তিনি তার বক্তব্য পেশ করবেন। মেম্বার সাহেব জেসমিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলো মা, এই ছেলে কবে থেইক্যা তোমারে উত্ত্যক্ত করে?’
জেসমিন কিছু বলার আগেই কেশবপুর হাইস্কুলের হেডমাস্টার বললেন, ‘আগে গতকাল রাইতের ঘটনাটা জেনে নিলে ভালো হয় না?’
আর কাউকে কিছু বলার সুযোগ দিল না জেসমিন। সে দৃঢ় গলায় বলল, ‘সে আমারে উত্ত্যক্ত করে নাই। আমি তারে ভালোবাসি, সে-ও আমারে ভালোবাসে। আমার জ্বর হইছে, সেই খবর পাইয়া সে আমারে দেখতে আসছিল। আমি ঘরে, সে বাইরে। জানালা দিয়া কথা কইতাছিলাম আমরা। তখনই বড় ভাইজান দেইখ্যা ফালায়। তারে ধইরা নিয়া বাইন্ধা রাখে। সে যদি অপরাধ করে, তাইলে আমিও অপরাধ করছি।’
সালিসের বিচারকারী সকলেই জেসমিনের কথা শুনে নিজেরা মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলেন। মুহূর্তের মধ্যেই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান পুরুষ মনে হতে লাগল রঞ্জুর। সে জানত জেসমিন সাহসী। তাই বলে যে একগ্রাম লোকের সামনে, নিজের বাবা ভাইদের সামনে, ভালোবাসার কথা বলার মতো সাহস রাখে, সেটা সে কল্পনাও করে নি। জয়নাল মির্জা রক্তবর্ণ চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু জেসমিন তার দিকে তাকাচ্ছে না। সে শুধু একবার রঞ্জুর দিকে তাকিয়েছিল। তার পর থেকেই মাথা নিচু করে আছে। মানুষটার ক্ষুধার্ত-তৃষ্ণার্ত-অসহায় মুখটা দেখে নিজেকে অপরাধী লাগছে।
প্রণব সাহা বললেন, ‘রঞ্জু, তোমার কী বক্তব্য?’
রঞ্জু বলল, ‘আমি জেসমিনকে ভালোবাসি। সে আমাকে ভালোবাসে কি না, সেটা তার নিজের মুখেই আপনারা শুনেছেন। আমি শুধু ওকে ভালোই বাসি না, সম্মানও করি। তাই আমি চাই না ওর সম্মান নষ্ট হোক। আমি ঢাকা শহরে জন্মেছি, সেখানেই বড় হয়েছি। আমার বাবা গ্রামে স্থায়ী হলেও আমার সেভাবে গ্রামে থাকা হয়ে ওঠে নি। পড়াশোনার জন্য আমি ঢাকাতেই থাকি 1 তাই গ্রামের নিয়মকানুন সেভাবে জানি না। যদি কোনো অন্যায় করে থাকি, তাহলে আমাকে শাস্তি দেবেন। তবে আমার অনুরোধ, জেসমিনকে যেন অসম্মানিত করা না হয়।’
রঞ্জুর কথা শেষ হতেই হারুন ব্যাপারী বললেন, ‘আপনারা অনুমতি দিলে আমি কিছু কথা বলতে চাই।’
সবার আগে জয়নাল মির্জা বললেন, ‘বলেন জনাব, আপনার ছেলে অপরাধ করছে, আপনার তো বলতেই হবে।’
হারুন ব্যাপারী অপমান গায়ে মাখলেন না। হেসে বললেন, ‘প্ৰেম- ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তাহলে আমার পুত্র যেমন অপরাধ করেছে, চেয়ারম্যান সাহেবের কন্যাও অপরাধ করেছে। তবে তাদের বয়স কম, আবেগ বেশি। তারপরও যখন এত মানুষের সামনে তারা উভয়েই ভয়, লজ্জা, সম্মানের তোয়াক্কা না করে তাদের ভালোবাসার কথা স্বীকার করেছে, তখন আপনারা বুঝতেই পারছেন তারা একে অপরকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। এবং তার চেয়েও বেশি আমি আমার ছেলেকে ভালোবাসি। আমি মনে করি, এর একটা সুন্দর সমাপ্তি হতে পারে। চেয়ারম্যান সাহেব এবং উপস্থিত সকলের কাছে আমি রঞ্জুর ও জেসমিনের বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি। আপনারা সকলে রাজি থাকলে শুভদিন দেখে আমরা দুজনের বিয়ে সম্পন্ন করতে পারি। এতে ওরা দুজন সুখী হবে এবং সকলের সম্মান বজায় থাকবে।’
প্রস্তাব শুনে জয়নাল মির্জার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। প্রণব সাহা বললেন, ‘অতি উত্তম প্রস্তাব। ছেলের বাবা বিয়ের প্রস্তাব দিলে এরপর তো আর কথাই থাকে না। মিয়ারা কী বলেন?’
একে একে দেখা গেল সকলেই হারুন ব্যাপারীর প্রস্তাবে একমত। শুধু জয়নাল মির্জা চুপ করে রইলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, “আমার একটু ভাবতে অইবে। জেসমিন আমার একমাত্র মাইয়া। তার ব্যাপারে এত জলদি সিদ্ধান্ত নেওয়া আমার পক্ষে মুশকিল।’
কাশেম মোল্লা বললেন, ‘চেয়ারম্যান সাব, সালিসের সিদ্ধান্ত সালিসেই নেওয়া ভালো। নাইলে পরে লোকে নানান কথা কইবে। বিগত দিনে এই ধরনের মামলায় তো দেখছেন, ব্যাপারগুলা পরে কেমন হয়।’
নাসেরউদ্দিন বললেন, ‘হ্যাঁ, নুরুর মাইয়ার বেলাতেও তো এমন হইছিল। বিয়ার তারিখ কয় দিন পরে দেওয়াতেই ত লোকে বিয়ার আগপর্যন্ত নানান রকম কথা হুনাইছে।’
প্রণব সাহা বললেন, ‘আমার মতে, বিয়ে হলে আজকে হয়ে যাওয়াই ভালো।’
কাশেম মোল্লা হারুন ব্যাপারীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আইজ বিয়ে পড়াইলে আপনার কোনো আপত্তি আছে?’
হারুন ব্যাপারী বললেন, ‘আমার কোনো আপত্তি নাই। আমি আমার ছেলের জন্য যেকোনো মুহূর্তেই প্রস্তুত। আপনারা বললে আমি আজকেই বিয়ের ব্যবস্থা করব।’
জয়নাল মির্জা বললেন, ‘বিয়ার ব্যবস্থা পোলার বাপ করে না, মিয়া। করে মাইয়ার বাপ। জালাল, হুজুররে খবর দাও। আইজকেই ওগো বিয়া পড়ানো অইবে।’
জালাল কাছে এসে বলল, ‘আব্বা, আপনের মাথা কি ঠিক আছে?’ জয়নাল মির্জা চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘আমার চেয়ে বেশি বুঝার চেষ্টা করবা আমি মরণের পরে। যা বলা হইছে, তাই করো গিয়া।’
১৩
বাদ মাগরিব রঞ্জু ও জেসমিনের বিয়ে সম্পন্ন হলো। যাকে সারা দিন অভুক্ত অবস্থায় গাছের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছিল, তাকেই এখন জামাই আদর করে খাওয়ানো হচ্ছে। রঞ্জু অবশ্য খেতে পারছে না। বমি এসে পড়ছে তার। মাথা ঘোরাচ্ছে। কোনোমতে হাত নাড়াচাড়া করছে। সময়টা পেরিয়ে গেলে সে বাঁচে। গায়ে এক ফোঁটা শক্তি নেই। আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে স্থির থাকার। কিন্তু যেকোনো মুহূর্তে জ্ঞান হারাতে পারে।
জেসমিনকে এখনই শ্বশুরবাড়ি নিয়ে যাবে না, রঞ্জুকেও এ বাড়িতে রাখা হবে না। আগে আনুষ্ঠানিক বিয়ে সম্পন্ন হবে, এরপর দুজনের বাসর হবে। আনুষ্ঠানিক বিয়ের তারিখ দেওয়া হলো সপ্তাহখানেক বাদে। তখনই জেসমিনকে উঠিয়ে নেওয়া হবে। তাই রঞ্জু চলে যাওয়ার আগে জেসমিনের ঘরে তাদের দুজনকে কিছুক্ষণের জন্য কথা বলতে দেওয়া হলো। এর পেছনে অবশ্য জেসমিনের বড় ভাবি আসমার অবদান সবচেয়ে বেশি। সে-ই প্রথম বলেছে, নববিবাহিত দম্পতিকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও কথা বলতে দেওয়া উচিত। তার ওপর যে ঝড় আজ সারা দিন দুজনের ওপর দিয়ে গেছে, তাতে এটা না হলেই নয়।
রঞ্জু ঘরে ঢুকতেই জেসমিন মাথা নিচু করে অপরাধীর গলায় বলল, ‘আমারে মাফ কইরা দেও।’
রঞ্জু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। বলল, ‘কেন? তুমি কী করেছ?” ‘আমার পাগলামির কারণেই কাইল ধরা খাইছি। তুমি চইল্যা যাইতে চাইছিলা, আমি বারবার তোমারে আটকাইতেয়াছিলাম।’
রঞ্জু মৃদু হেসে জেসমিনের হাত দুটি নিজের দুহাতে ধরে বলল, ‘ভাগ্যিস আটকেছিলে। না হলে এত তাড়াতাড়ি তোমাকে পেতাম কীভাবে?’
জেসমিন মুখ তুলে তাকাল। তারপর অশ্রুসিক্ত নয়নে বলল, ‘কিন্তু তোমারে রাইতভর বাইন্ধা রাখল। বড় ভাইজান তোমার গায়েও হাত তুলল। কত বড় অপমান!’
‘মাঝরাতে দেখা করতে এসে প্রেমিকার বাপ-ভাইয়ের কাছে ধরা পড়লে এর চেয়ে ভয়ংকর কিছুও হতে পারত। যা হয়েছে, তা অপমান হিসেবে না দেখে শাস্তি হিসেবে দেখো।’
জেসমিনের চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। রঞ্জু তা যত্ন করে মুছে দিয়ে বলল, ‘কাল থেকে অনেক কেঁদেছ। এই সুন্দর চোখে আর যেন জল না দেখি। তোমার গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, জেসমিন। মাথায় পানি ঢালতে হবে। দাঁড়াও, আসমা ভাবিকে ডাকি।’
রঞ্জু দরজার দিকে যাচ্ছিল। জেসমিন একটা হাত ধরে তাকে থামাল।
‘না, খাড়াও, ভাবিরে বোলাইও না।’
‘কেন? ভাবিকে না ডাকলে পানি পাব কোথায়?’
জেসমিন রঞ্জুর হাতখানা ধরে নিজের কপালে রেখে বলল, ‘তোমার ঠান্ডা হাতখান আমার কপালে রাহো, এমনেই জ্বর সাইরা যাইবে। এত দিন বাপ- ভাইয়েগো ডরে কত কষ্ট কইরা পলাইয়া তোমার কাছে গেছি। আর এহন তারাই তোমারে আমার কাছে পাড়াইছে। আইজ আর কোনো ডর নাই। ভাবিরে ডাইকা এই সময়টারে এমনে নষ্ট করতে চাও?’
.
সপ্তাহখানেক বাদেই অনুষ্ঠান করে জেসমিনকে শ্বশুরবাড়ি পাঠালেন জয়নাল মির্জা। এ রকম কোনো সুযোগ আসবে, জয়নাল মির্জা তা কল্পনাও করেন নি। হারুন ব্যাপারী বুদ্ধিমান লোক হলেও ছেলের প্রতি ভালোবাসায় অন্ধ। না হলে কেউ এমন প্রস্তাব দেয়! সালিসে তার ছেলের কী-বা শাস্তি হতো! এইটুকু তিনি মেনে নিতে পারলেন না! শত্রুর সাথে আত্মীয়তা বড় কঠিন জিনিস। ছেলেকে বাঁচানোর জন্য তিনি এই কঠিন পথ বেছে নিলেন। অবশ্য একমাত্র ছেলের প্রতি অন্ধ ভালোবাসা থাকা অস্বাভাবিক নয়।
তবে এই আত্মীয়তা হলে হারুন ব্যাপারী ছাড় দিতে বাধ্য। এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে চান নি জয়নাল মির্জা। এককথাতেই রাজি হলে সেটা অনেকের চোখে পড়ত, তাই তিনি প্রথমে ভেবে দেখার কথা বলেছিলেন। একটু তো গাঁইগুঁই করতেই হয়।
জেসমিন শ্বশুরবাড়ি যেতেই বউ দেখার ঢল নামল রঞ্জুদের বাড়িতে। সূর্যমণি গ্রামের কোনো বাড়ির মহিলা বাদ রইল না। গ্রামের সবচেয়ে শিক্ষিত ছেলে রঞ্জু এবং সে-ই একমাত্র, যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। তার বউখানা কেমন হলো, তা না দেখলে গ্রামবাসীর চলবে কীভাবে! জেসমিনের শাশুড়ি রোকেয়া বেগম তাদের আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। পুতুলের মতো একটা বউ আসাতে তিনি ভীষণ আনন্দিত।
.
সন্ধ্যার পর থেকেই প্রচণ্ড ঝোড়ো হাওয়া বইতে লাগল। দূর আকাশ থেকে ভেসে আসতে লাগল মেঘমালা। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বারান্দার কপাট বারবার বাড়ি খাচ্ছে। রঞ্জু বারান্দার দরজা আটকাতে গেলে জেসমিন বলে, ‘আমারে কামিনী ফুলের গাছটা দেখাইলা না যে?’
‘এত মানুষ ছিল এতক্ষণ, কীভাবে দেখাব বলো? কাল দেখো। ‘
‘আমি এহনই দেখমু
রঞ্জু অবাক হয়ে বলল, ‘বলে কী মেয়ে! ঝড় শুরু হয়েছে দেখো না? বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।’
‘তাতে আমার কী? আমি দেখমু।’
জেসমিন এগিয়ে গেল দরজার কাছে। রঞ্জু তার দুই বাহু ধরে আটকাল।
বলল, ‘পাগলামি করে না। কাল সকালে দেখো। এখন দরজা-জানালা সব আটকে দেওয়া উচিত। ঝড় শুরু হয়ে গেছে।’
জেসমিন একটু অভিমান করে বলল, ‘হুম, আমারে দেহাবা ক্যা? কার লাইগা জানি গাছখান লাগাইছ, হেরেই দেহাইয়ো। আমি কেডা!
ফিরে এসে বিছানার ওপর বসল সে। রঞ্জু দরজা লাগিয়ে এসে তার পাশে বসে বলল :
তুমি আমার একলা আকাশ
দখিন দ্বারের বাউলা বাতাস
কদম ফুলের ঘ্রাণ,
তুমি আমার জলজোছনা
অন্ধকারের গান।
কবিতা শুনে জেসমিনের অভিমান নিমেষেই উধাও। সে বলল, ‘এই কবিতাডা আমারে চিডিতে দেও নাই তো?’
‘এটা তো এইমাত্রই বানালাম।’
‘কিন্তু অন্ধকারের আবার গান ক্যামনে হয়?’
‘অন্ধকারের গান অনেক রকম হয়। মনখারাপের হয়, খুশির হয়।’
‘আমি তোমার কেমন অন্ধকারের গান? মনখারাপের, নাকি খুশির?’
বিছানার পাশেই হারিকেন। রঞ্জু সেটা নিভিয়ে কাছে এসে বলল, ‘চলো দেখাই তুমি আমার কেমন অন্ধকারের গান।’
১৪
ছোটবেলা থেকেই জেসমিন কিছুটা অলস। কোহিনুর বানু বকাবকি করে তাকে দিয়ে সব কাজই শিখিয়েছেন, কিন্তু নিয়মিত করাতে পারেন নি। যখন থেকে ভাবিরা এসেছে, তখন থেকে তো সে রান্নাঘরের মাটিও মাড়ায় নি। কোহিনুর বানু বলতেন, ঘোরা দেখে খোঁড়া হয়েছে মেয়ে! সেই মেয়েকে কিনা শ্বশুরবাড়ি এসে এখন মসলা বাটতে হচ্ছে! রাতে বাড়িতে কুটুম আসবে। তাই বাহারি রান্নার আয়োজন হচ্ছে। সকালের নাশতার পরই কতগুলো করে আদা, রসুন, জিরা, ধনিয়া, হলুদ ও মরিচ বাটতে দিয়েছে শাশুড়ি। জেসমিন যখন এসব বাটছে, তখন রান্নাঘরে এল রঞ্জু। জেসমিনের পাশে বসে বলল, ‘তোমার কষ্ট হচ্ছে, ফুল?’
‘সব কামেই কষ্ট আছে। তয় শাশুড়ি যখন কাম দিছে, করতে তো অইবেই। মায় দিলে না কইরা পারা যায়।
‘ইশ্, আমি বুঝতে পারছি তোমার কষ্টটা! আমাদের বাড়িতে এসব করার কত লোক আছে। মা তোমাকে কেন দিল?’
‘তোমাগো বাড়িতে কেউ নাই। হেরা পাশের বাড়িত্যা আহে কাম করতে। আইজ আইতে পারবে না কেউ। এল্লিগা আমারে দিছে।
‘আমার পড়া শেষ হলে যখন চাকরি করব, তখন তোমাকে ঢাকায় নিয়ে যাব। তখন আর তোমার এত কষ্ট করা লাগবে না।’
‘ঢাকায় গেলে বুঝি এই সব করা লাগবে না? আরও বেশি করা লাগবে। সবই একলার করা লাগবে হেকালে।
‘যেসব রান্না করতে মসলা বাটা লাগে, তার কোনোটাই আমরা খাব না।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘বাড়া মসল্লা ছাড়া কোনো রান্নাই হয় না। এত কষ্ট বুঝলে বাইট্যা দাও।’
‘আচ্ছা, বেটেই দেই বরং। তুমি দরজায় পাহারা দাও। মা যদি দেখে তোমাকে মসলা বেটে দিচ্ছি, তুফান নামাবে।
জেসমিন ফিক করে হেসে বলল, ‘মায় এহন আইবে না। তবু পাহারা দেই। নাইলে যদি দেইখ্যা হালায়, আমারে দজ্জাল বউ কইবে।
রঞ্জু হেসে দিল। জেসমিন আবার বলল, ‘মরিচ বাড়া লাগবে না। হাত জ্বলবে। আমি পরে বাডমু। তুমি অন্যগুলান বাডো যেদ্দুর পারো।’
‘তোমার হাত জ্বলবে না?’
‘আমি তো আগেও বাড়ছি। টেকনিক জানি ক্যামনে হাত না লাগাইয়া বাড়তে অয়। আর জ্বললেও সহ্য করতে পারমু। তুমি পারবা না।’
জেসমিন উঠে গেল। পাশে বসে দরজায় পাহারা দিল। রঞ্জু সত্যিই সত্যিই মসলা বাটতে শুরু করে দিল।
জেসমিন-রঞ্জুর বিয়ের পর দুই-তিন মাস সময় নিলেন হারুন ব্যাপারী। তত দিনে রঞ্জুর ইউনিভার্সিটি খুলে গেছে। সে ঢাকা যাবে, যাওয়ার আগে জেসমিন তার বাপের বাড়িতে নাইয়র যাবে। রঞ্জুই দিয়ে আসতে চেয়েছিল, যাতে রঞ্জু চলে গেলে তার একা না লাগে। কিন্তু জেসমিন কেঁদেকেটে একাকার করল। সে জানাল, রঞ্জু যতক্ষণ আছে, সে ততক্ষণ কোথাও যাবে না। রঞ্জু ঢাকা যাওয়ার পর সে শ্বশুরের সাথে বাপের বাড়ি যাবে।
রঞ্জু চলে যাওয়ার পর হারুন ব্যাপারী জেসমিনকে নিয়ে কেশবপুরে গেলেন। জেসমিনকে দেখামাত্র তার ভাবিরা খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল, “আমাগো নাইয়রি আইছে!’
.
হারুন ব্যাপারীর আতিথেয়তার জন্য বিরাট আয়োজন করা হলো। খাওয়াদাওয়ার পর তারা যখন বাহির বারান্দায় পান নিয়ে বসলেন, তখন হারুন ব্যাপারী কথাটা তুললেন, ‘চেয়ারম্যান সাহেব, কালিশুরির জমিটার কী করবেন? কতগুলা নগদ টাকা দিয়া জমি কিনেছিলাম! আপনি বিচক্ষণ মানুষ, এখন আবার পরম আত্মীয়। আশা করি আপনি ব্যাপারটা ভেবে দেখবেন।’
মুহূর্তের মধ্যেই টনক নড়ল জয়নাল মির্জার। এবার তিনি বুঝতে পারলেন তিনি যে চিন্তা করে জেসমিন-রঞ্জুর বিয়েতে খুশি হয়েছিলেন, ঠিক একই চিন্তা করে হারুন ব্যাপারীও বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন। এখন মনে হচ্ছে তিনি হারুন ব্যাপারীর ফাঁদে পড়েছেন। ইচ্ছা করেই কি তিনি জেসমিনের পেছনে তার ছেলেকে লেলিয়ে দিয়েছিলেন? জয়নাল মির্জার মেজাজ তখন সপ্তম আসমানে। তিনি বললেন, ‘ব্যাপারী কি এই কারণেই ছেলে বিয়ে করাইয়া আত্মীয়তা করছেন?’
হারুন ব্যাপারী হেসে বললেন, ‘কী যে বলেন, চেয়ারম্যান সাহেব! ছেলে- মেয়ের ভালোবাসার মর্যাদা দেওয়ার জন্যই তো এই বিয়ে। ছেলে-মেয়ের ভালোবাসা আমাদের ব্যক্তিগত সমস্যার সাথে জড়ানোর কথা চিন্তাও করতে পারি না।’
‘চিন্তা কইরেনও না। ভুলেও না। ছেলে-মেয়েরে আমরা তাদের জায়গায় রাখি আর নিজেগো নিজের জায়গায়। এতেই তারা এবং আমরা ভালো থাকমু। এই সব জমিজিরাতের ভেজালে তাগোরে আইন্যা তাগোর বিপদ ডাকনের দরকার কী?
চেয়ারম্যানের সূক্ষ্ম হুমকি সাথে করে বাড়ি ফিরলেন হারুন ব্যাপারী। তিনি আজ এটা বুঝে গেলেন যে জেসমিন-রঞ্জুর বিয়ে তার একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি যেই চিন্তা করে এই বিয়ে দিয়েছিলেন, সেটা সম্ভব নয়।
নাইয়রি – ১৫
১৫
হালিমা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, আব্বাস ও মুকুলকে আলাদা করে দেবেন। কিন্তু মোকসেদ এতে একমত নন। হালিমা তাকে বললেন, ‘হোনেন একখান কতা কই, একজনের টাহা দিয়া পুরা গুষ্টি পাললে কয় দিন পর না খাইয়া মরা লাগবে। মামুন এত কষ্টের চাকরি কইরা টাহা পাড়ায়, হেইয়া দিয়া পুরা গুষ্টি খাওয়াইলে অর উপ্রে অবিচার করা অইবে।’
মোকসেদ এবার বললেন, ‘কয় দিন আগপর্যন্ত তো আব্বাসের পয়সায় এতজনের সংসার চলছে। হেলে তো এত দিন আব্বাসের ওপরে অবিচার করছি।’
‘কী যে কন আমনে! আব্বাস কয় টাহা দিত আর মামুন কতগুলা টাহা দেয়! দুইডা কি এক অইলো? আর বড় পোলা হিসাবে অরই তো দায়িত্ব পুরা সংসার চালানের। হ্যা ত পারতেয়াছে না, অন্তত নিজেরডা চালাউক। আর মুকুইল্যা ত আরেক বাদাইম্মা। আলাদা না করলে আজীবন বাদাইম্মাগিরি কইরাই চলবে।’
‘মুই তোমার কতার কোনো আগা-মাতা পাই না।’
‘পাওয়া লাগবে না। আব্বাস আর মুকুলের হাঁড়ি আলাদা অইবে, এইডাই শ্যাষ কতা।’
.
সত্যি সত্যিই একদিন কোনো রকম পূর্বাভাস ছাড়াই আব্বাস ও মুকুলের হাঁড়ি আলাদা করা হলো। রেনু প্রচণ্ড ভেঙে পড়লেও আব্বাস শক্ত রইলেন। যেন কিছুই হয় নি। সে তার জীবনে এ রকম ঘটনা আশপাশে বহু দেখেছ, শুধু জানত না তার সাথেও একদিন এমন হবে!
এদিকে মিনা পাগলের মতো কাঁদছে। তার কিচ্ছু নেই। মুকুলের কাজ নেই। ছেলেকে দুবেলা কীভাবে খাওয়াবে, সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে গেছে। সন্ধ্যা হলেই তো খেতে চাইবে মধু। কী করবে তখন? মুকুল বাড়ি ফিরলে তাকেই-বা কী খেতে দেবে? এ কোন বিপদে পড়ল সে!
সন্ধ্যার পর দেবদূতের মতো এসে ভাত-তরকারি দিয়ে গেল রেনু। কিন্তু এভাবে তো প্রতিদিন চলবে না।
মুকুল বাড়ি ফিরল যথারীতি অনেক রাতে। মিনাকে জেগে থাকতে দেখে অবাক হলো।
বলল, ‘কী অইছে, তুমি এহনো হজাগ?’
মিনা ছুটে গিয়ে মুকুলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল।
মুকুল কিছুটা ঘাবড়ে গেল, “ঘটনা কী? কান্দ ক্যা?’
মিনা সবকিছু খুলে বলতেই মুকুল হতাশ গলায় বলল, ‘আমার লগে নায় ঠিকাছে কিন্তু ভাইজানের লগে এমন ক্যামনে করল!’
মিনার কানে একটা সোনার দুল আছে তার বাপের বাড়ি থেকে দেওয়া। সেটা খুলে মুকুলের হাতে দিয়ে বলল, ‘এইডা বেইচ্চা কাইল বাজার আইন্না দিয়ো।’
বাজারের কথা শুনে মুকুলের খেয়াল হলো। সে জিজ্ঞেস করল, ‘মধু কি আইজ না খাইয়া ঘুমাইছে?’
‘না। আইজ ভাবি ভাত দিয়া গ্যাছে।’
মুকুল রেনুর কথা ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর দুলটা আবার ফেরত দিয়ে বলল, ‘এইডা লাগবে না। কাইল ব্যানে বাজার আইন্না দিমুয়ানে।’
‘কিদ্দা আনবা? তোমার ধারে পয়সা আছে?’
‘বাহি আনমু।’
‘পরে শোধ করবা ক্যামনে? ধারদেনার দরকার নাই। এইডা ব্যাচো। কী অইবে এইয়া দিয়া?’
‘আমি একটা কাম পাইছি, মিনা। ভাবছিলাম টাহা পাইলে তারপর তোমারে কমু।’
মিনার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি।
সে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। কামডা কী?’
‘কাঠের কাম। ইশকুলের টেবিল, চেয়ার, আলমারি—এইসব বানাইতে অইবে। ভালোই, ম্যালা দিনের কাম।’
‘আল্লাহ মুখ তুইল্যা চাইছে।’
মুকুল মিনাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আলাদা হইলেও ভাবির দিকে খেয়াল রাইখো, মিনা।’
‘আচ্ছা। তুমি ভাইবো না।’
মিনা আসলে সবচেয়ে বেশি খুশি মুকুলকে স্বাভাবিক হতে দেখে। তার অনেক দিনের কষ্ট আজ দূর হয়েছে।
সবকিছু চুপচাপ যে দেখল, সে রেহানা। আব্বাস-রেনু, মিনা-মুকুল কারও জন্যই তার কোনো সহানুভূতি নেই। তবে শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি একটা ঘৃণা জন্ম নিল। সে পারলে এক্ষুনি মামুনকে বলে দিত এক পয়সাও না পাঠাতে কিন্তু সে মাথা গরম করে কাজ করে না। মামুন আর তার সম্পর্ক সে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেবে না। ঝোপ বুঝে কোপ মারবে।
১৬
পটুয়াখালী জজকোর্টের জাঁদরেল উকিল আলমগীর মৃধা। জনশ্রুতি আছে, ফাঁসির আসামিকেও নির্দোষ প্রমাণ করে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরত নিয়ে এসেছেন তিনি। হারুন ব্যাপারী তার শরণাপন্ন হয়ে মামলা করেছেন জয়নাল মির্জার নামে। তিনি তার জমি পুনরুদ্ধারের জন্য আরজি দাখিলের পর জয়নাল মির্জার নামে একটি সমন জারি হলো।
সমনপত্র গ্রহণ করে কাছারিঘরে বসে আছেন জয়নাল মির্জা। জালাল বাড়ি নেই। জব্বার আছে সাথে। সে বলল, ‘দেখলেন তো আব্বা। আমি কইছিলাম হারুন ব্যাপারীর মতলব ভালো না। আমি হেরে উকিলের কাছে যাইতে দেখছি, হেই কতাখানও কইছিলাম। আমনে তো আমার কতা আমলেই লন নাই। ‘
‘কিন্তু জব্বার, তুমি হেরে উকিলের কাছে যাইতে দ্যাখছ আরও চার-পাঁচ মাস আগে। হেকালে মামলা না কইরা এহন করল ক্যা, কও দেহি?’
‘হেইয়া আমি ক্যামনে কমু?’
‘এই ঘিলু লইয়া রাজনীতি করবা?’
জব্বার মুখ কুঁচকে ফেলল। পান থেকে চুন খসলেই তার বাবা তাকে এই খোঁটাখানা দেয়, যা তার একেবারেই অপছন্দ। জয়নাল মির্জা পানের পিক ফেলে বললেন, ‘হারুন ব্যাপারী তহন মামলা করনের লাইগা যায় নাই। হে গেছে তথ্য জোগাড় করতে। মামলা করার প্রস্তুতি নিতেয়াছিল। মাঝখান দিয়া রঞ্জু-জেসমিনের ঘটনা আসায় সে ভাবছিল আত্মীয়তা কইরা ঝামেলা মিটাইবে। এই জন্য এত দিন থাইমা আছিল। কিন্তু এহন যহন দ্যাখল আত্মীয়তা কামে লাগান যাইতেয়াছে না, অমনে যাইয়া মামলা দিল।’
‘আব্বা, আমনে কি আগেইত্যাই জানতেন হে মামলা দেবে?’
‘জানতাম। কইতে পারো আমি অপেক্ষাই করতেয়াছিলাম। কারণ, সে মামলা না দিলে আমি আমার চালডা দিতে পারতেয়াছিলাম না।’
‘তহেলে জেসমিনরে ওই বাড়ি বিয়া দেলেন ক্যা?’
‘ভাবছিলাম আত্মীয়তা কইরা ঝামেলা মিটামু, ব্যাপারীও যে একই চিন্তা করছে, হেইয়া তো বুজতে পারি নাই।’
‘আব্বা, অরা যদি জেসমিনরে অত্যাচার করে?’
‘মাইয়া আমার ধানি মরিচ। অরে কেউ অত্যাচার করতে পারবে না। রঞ্জু- জেসমিন আশা করি নিজেগো সামলাইয়া লইতে পারবে। রঞ্জুর মতো জামাই লাখে একটা, আশপাশের চাইর গেরামেও এমন শিক্ষিত পোলা নাই। হেরপরেও সমেস্যা অইলে বিয়া ভাঙতে কতক্ষণ? জেসমিনরে শহরে নিয়া আরও ভালো আরও শিক্ষিত পোলার লগে বিয়া দিমু। এই বয়সী পোলাপানের প্রেম ভাঙা মুশকিল, আবেগ বেশি। কিন্তু বিয়া হইলেই আবেগটা কইম্যা যায়। বিয়া ভাঙা কোনো বিষয় না। চুল-দাড়ি পাকাইয়া হালাইসি, কম তো আর দেখলাম না।
.
আলমগীর মৃধার চেম্বারে বসে আছেন জয়নাল মির্জা। তিনি গোপনীয়তা চান। চেম্বারের সকলকে বের করে দিলেন আলমগীর মৃধা। জয়নাল মির্জা বললেন, ‘হারুন ব্যাপারী কত দিছে? আমি তার চেয়ে বেশি দিমু। মামলায় আমারে জিতাইয়া দিবেন।’
আলমগীর মৃধা হেসে বললেন, ‘হারুন ব্যাপারী কত দিছে জাইন্যা আমনে কী করবেন? আমনে পাঁচ হাজার দেবেন। হেলে আমি কেস এমনভাবে সাজামু, যাতে আমি হারি, আমনের উকিল জেতে। ব্যাপারডা বোজ্জেন?’
টাকার অঙ্ক শুনে জয়নাল মির্জার মেজাজ বিগড়ে গেছে। বিরক্তমুখে তিনি বললেন, ‘উকিল সাব, আমনের কি মাতা আউলাইয়া গ্যাছে? পাঁচ হাজার টাহা কি ভাইস্যা আহে?’
‘টাহা ক্যামনে আইবে, হেইডা আমনের বিষয়। না দেতারলে বাড়ি যান। এ কেস আমনে এমনেও হারবেন। সমন পাইয়াও কোর্টে আহেন না। ওদিকে বাদীপক্ষ নিয়মিত কোর্টে আহে। তথ্যপ্রমাণ সব আমনের বিপক্ষে নেওয়া আমার দুই মিনিটের কাম। আমনের দারে যে একখান জাল দলিল আছে, হেইয়া কোর্টে পেশ করলে আমনের উল্টা জেল হবে। আমনের বাঁচার একমাত্র উপায় আমার ইচ্ছাকৃত হারা। কেস হারলে হেইডা আমার রেপুটেশনের ব্যাপার। পাঁচ হাজার না হইলে পোষায় না।’
জয়নাল মির্জা আর কথা বাড়ালেন না। এই সামান্য কাজে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করার কোনো মানেই হয় না। এর চেয়ে সহজ সমাধান তার জানা আছে।
রঞ্জু ক্লাস করে হলে ফিরতেই জেসমিনের চিঠি পেল। রুম পর্যন্ত যাওয়ার ধৈর্য নেই। হলের সামনেই মাঠে বসে চিঠি খুলল।
প্রিয় রঞ্জু সাহেব,
কেমন আছ? আশা করি আল্লাহর রহমতে তুমি ভালো আছ। আমিও ভালো আছি।
পর সমাচার এই যে আমি এখনো আমাদের বাড়িতেই আছি। বাবা বলতেছেন, তোমাদের বাড়িতে একা গিয়ে কী করব, তুমি আসলে যেন যাই। মাঝে আমার আব্বাকে না জানিয়ে একদিন তোমাদের বাড়ি গেছিলাম। বাবা-মায়ের সাথে দেখা করে আসছি। আমি যাওয়াতে তারা খুব খুশি হইছিলেন। কামিনী ফুলের গাছটার কাছেও গেছিলাম। ওই গাছে এখন আর ফুল ফোটে না। আমি জিগাইলাম, কী গো কামিনী, ফুল দেও না ক্যা? কামিনী কইল, তোমরা নাই, তাই ফুল দেই না। তোমরা আসো, ভালোবাসায় ভরায়া রাখো এই ঘরখান। তোমাদের ভালোবাসার সুবাস আবার যখন পাব, তখনই ফুল দিব।
দুই মাস হইয়া গেল তোমারে দেখি না। আর কত দিন না দেখে থাকতে হবে? তুমি কবে ফিরবা? তোমার ওই পাষাণ মন কি কাঁদে না তোমার এই ফুলের জন্য? পড়াশোনা বাদ দিয়া চইলা আসো। নাইলে আমারে ঢাকা নিয়া যাও। তোমারে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারমু না আর। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। বাড়ি আসো। আমার নাইয়র আর শেষ হয় না।
ইতি তোমার ফুল
১৭
রেনু প্রতিদিনের মতোই ভোরবেলা উঠে পুরো বাড়ির উঠোন ঝাড়ু দিল। হাঁস- মুরগিদের খোপ থেকে বের করে খাবার দিল। এসব দেখে আব্বাস তাকে ঘরে ডেকে বলল, ‘এইগুলা করতেয়াছ ক্যা?’
রেনু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে, ‘কোনগুলা?’
‘এই যে উঠান ঝাড়ু দিলা, হাঁস-মুরগির খাওন দিলা।’
‘ও মা, পেরতেকদিনই তো করি। মুই না করলে করবে কেডা? বেইন্যাকালে মিনার ঘুমেইত্তা উঠতে ইট্টু দেরি হয়। হেইলাইগ্যা মুই করি। বিয়ালে মিনা করে।’
‘রেনু, আইজগোইত্যা মোগো নতুন জীবন শুরু। কোনো কিছু আর আগের মতো নাই। সাবধান করতেয়াছি তোমারে। এহনেইত্তা তুমি খালি তোমার ঘরের সামনের উঠান ঝাড়ু দিবা। হাঁস-মুরগির মালিকও আর তুমি বা মিনা নাই, তাই খাওন দেওনের দায়িত্বও তোমাগো না। এরপর যদি কোনো দিন হাঁস-মুরগিগো খাওন দিতে দেহি, তয় তোমার খবর আছে কইলাম। মিনারেও মানা কইরা দেবা।’
রেনু এতক্ষণে ব্যাপারটা ধরতে পারল। কিছু বলতে চাইলেও পারল না। আব্বাস সাধারণত রাগে না। কিন্তু রেগে গেলে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে।
আব্বাস কিছুক্ষণ থেমে বলল, ‘পান্তা আছে?’
রেনু বলল, ‘আছে।’
‘দেও, খাইয়া কামে বাইর অই।’
রেনু খাবার বাড়তে গেল। আব্বাস ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। যন্ত্রণায় তার ভেতরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে কাল থেকে। নিজের আয়ের সর্বস্ব ঢেলে দিয়েছে সে এই পরিবারের জন্য। এক কানাকড়িও জমানো নেই তার। কীভাবে সে সামনের দিনগুলো পার করবে, জানে না। কীভাবে স্ত্রী-সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দেবে, কীভাবে মেয়ে বিয়ে দেবে, কিছুই জানে না। শুধু আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে শক্ত রয়েছে। তিনি কোনো দিন অভুক্ত রাখেননি। সকল বিপদ থেকে তিনি রক্ষা করেছেন। এবারও নিশ্চয়ই তিনি কোনো ব্যবস্থা করবেন।
.
হালিমা ঘুম থেকে উঠে দেখেন রাতের বাসনকোসন এখনো নোংরা পড়ে রয়েছে। তিনি ঘুম থেকে ওঠার আগেই মিনা এসব পরিষ্কার করে ফেলে। কিন্তু কাল থেকে যেহেতু তারা আলাদা, এখানে খায় নি, এসব তো তার পরিষ্কার করার কথাও না। কিন্তু রেনুটা ভালো, কী সুন্দর হাঁস-মুরগিদের খোপ থেকে বের করে খাবার দিয়ে দিয়েছে।
হালিমা রেহানাকে ডেকে বললেন, ‘যাও বউ, থালাবাসনগুলা ধুয়া নিয়া আহো।’
গতকাল বললেও রেহানা হয়তো কাজটা করত কিন্তু আজ সে স্পষ্ট বলল, ‘মুই পারমু না, আম্মা। মোর হাত দেহেন। আমনের কী মনে অয়, মুই কোনো দিন এগুলা করছি?
রেহানা নিজের দুই হাত সামনে মেলে ধরল। হালিমা অবাক হয়ে বললেন, ‘কোনো দিন করো নাই, তাতে অইছেডা কী? কোনো দিনের লগে এহনের তুলনা কইরো না। বউ অইছো, কাম তো করাই লাগবে, নায় সংসার ক্যামনে চলবে?’
‘তাইলে তো কামের মানুষ আনা লাগত, আম্মা। বউ আনছেন ক্যা?’
হালিমার মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ হলো। তিনি রেগে গিয়ে বললেন, ‘তুমি যে এত বড় বেয়াদব, এইডা আগে জানলে তো আনতাম না। তোমার মায়ে তোমারে কিছু হিকায় নাই?’
‘আম্মা, আমনে যা খুশি ভাবতে পারেন। মোর বাপের বাড়িতে সব সময় তিনখান কামের মানুষ। কোনো দিন একখান থাল ধুইয়া খাইতে অয় নাই। এইখানেও কোনো কাম করতে পারমু না। ঘরের কাম করোনের অভ্যাস মোর নাই। আমনের আসলে গরিব ঘর থিকা একখান মাইয়া আনা লাগদো। আমনের ঘরের সব কাম কইরা দিত।
হালিমা ধমকে উঠে বললেন, ‘খবরদার, বাপের পয়সার গরম দেহাবি না। আগের সংসার এই দেমাগের লাইগ্যাই টিকাইতে পারোস নাই এহন বুঝতেয়াছি। মোরা না আনলে তোর মতো সংসারভাঙা কালীরে কেডা বিয়া করত?’
রেহানা হেসে বলল, ‘আম্মা, মোরে এই সব খোঁটা দিয়া বেশি সুবিধা করতে পারবেন না। মুই আমনের অন্য দুই বউয়ের মতো না। রান্দা অইলে ডাক দিয়েন, খিদা লাগসে।’
রেহানা নিজের ঘরে ঢুকে গেল। হালিমা রাগে জ্বলন্ত কয়লার মতো জ্বলতে লাগলেন।
.
মধু পাশের বাড়ির ছেলেমেয়েদের সাথে খেলতে গিয়েছিল। সন্ধ্যা হতেই ফিরে এল। হাত-পা কাদামাটিতে একাকার। মিনা তাকে পুকুরে নিয়ে হাত-পা ধুয়ে কোলে করে ঘরে নিয়ে এল। সোজা বিছানায় বসিয়ে গামছা দিয়ে হাত-পা মুছে দিচ্ছিল। মধু তখন তার মায়ের নাকের ফুলটা খুঁটছিল। এই তার এক বদভ্যাস। সুযোগ পেলেই মায়ের নাকফুল, কানের দুলে এসব খুঁটতে থাকে। কী যে মজা পায় কে জানে। কিছু বললেই হে হে করে হাসে।
হাত-পা মুছে মধুকে পড়তে বসাল মিনা। আজ বসেছে আরবি নিয়ে। বই খুলে মিনা আরবি হরফের ওপর মধুর আঙুল রেখে বলল, “বাবা, কও আলিফ…।’
মধু এক টানে সুর করে করে বলল, ‘আলিফ বে তে ছে, মুন্সি ওঠসে বরইগাছে, ছবক দেবে কে?’
মিনার মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। সে বলল, ‘এই বান্দরের ঘরের বান্দর। একটা ছড়া তো এহনো মুখস্থ করাইতে পারলাম না। অ আ এহন পর্যন্ত পারোছ না। এই সব হাবিজাবি কইত্তা হেকছস।’
মধু দাঁত বের করে হে হে করে হাসল। মিনা একটা চড় মারল। মধু ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল। এরপর আর কিছুই পড়ানো গেল না তাকে। শেষমেশ পড়াশোনার পাট তুলে রেখে ছেলেকে ভাত খাওয়াতে বসল মিনা। মার খেয়ে এখন ভাত খেতে চাইছে না ছেলে। এমন সময় শব্দ শুনে মিনা বাইরে তাকাল। ঘর থেকেই দেখতে পেল কল চেপে হাত-মুখ ধুচ্ছে মুকুল। সন্ধ্যাবেলা মানুষটাকে বাড়ি ফিরতে দেখে ভেতরে-ভেতরে মিনা খুশিতে দিশাহারা হয়ে গেল।
মুকুলও বাইরে থেকে মা-ছেলের কথা শুনছিল। ঘরে ঢুকেই বলল, ‘কী ব্যাপার, আব্বা, ভাত খাইতে চাও না ক্যা?’
মধু লাফিয়ে উঠে বলল, ‘আব্বা আইছে! আব্বা আইছে! আব্বার হাতে ভাত খামু।’
এত দিন মধুর সঙ্গে মুকুলের দেখা হয়েছে কেবল ভোরে। রাতে মুকুল ফেরার আগেই মধু ঘুমিয়ে পড়ত। আজ রাতে বাবাকে দেখে সে-ও ভীষণ খুশি।
মিনা বলল, ‘আব্বা হপায় কামেইত্তা আইছে, জিরাইতে দেও।’
‘সমেস্যা নাই, দেও খাওয়াই দেই।’
এ কথা বলেই মুকুল বসে পড়ল ছেলেকে খাওয়াতে। মধু ভদ্র ছেলের মতো সুরসুর করে বাবার হাতে পুরোটা ভাত খেয়ে নিল। খেতে খেতেই সে ঘুমে ঢলে পড়ছিল। খাওয়া শেষে টুপ করে ঘুমিয়ে পড়ল। মিনা মশারি টানাতে টানাতে বলল, ‘তোমারে এহনই ভাত দিয়া দিমু?’
‘দেও। খিদা লাগছে।’
মিনা ভাত বেড়ে দিল। মুকুল খেতে শুরু করতেই সে একদৃষ্টে চেয়ে রইল। মুকুল খেতে খেতে বলল, ‘তুমিও খাও। বইয়া রইছ ক্যা?’
মিনা এবার নিজের জন্য ভাত বাড়তে বাড়তে জিজ্ঞেস করল, ‘আইজ এত হকালে আইলা? রাগ গেছে তাইলে?’
মুকুল সলজ্জে হেসে বলল, ‘খাওনের সময় এত কতা কয় না। চুপ কইরা খাও তো।’
১৮
হারুন ব্যাপারী আসরের নামাজ পড়ার জন্য পুকুর থেকে অজু করে এলেন। এসে দেখেন ধুনারি (লেপ-তোশক বানানোর কারিগর) এসে উঠানে বসে আছে। তিনিই ডেকেছেন নতুন লেপ বানানোর জন্য। পুরোনো লেপগুলো অল্প দিনেই ভারী হয়ে গেছে। গায়ে দিতে কষ্ট হয়। তুলা ভালো পড়ে নি। তাকে দেখেই হারুন ব্যাপারী বললেন, ‘কি হে ধুনারি, তোমাকে বলছিলাম সকালে আসতে। এটা একটা আসার সময় হইল?’
‘বেইন্যাবেলায় ম্যালা কাম আছিল, ব্যাপারী সাব। মাফ করবেন।’
‘দাঁড়াও, তোমার চাচিরে ডেকে দেই। সে যেমন লেপ চায়, তেমন করেই বানাইয়া দিয়ো। খরচ বেশি পড়লে দাম বেশি নিবা। জিনিস যেন ভালো হয়।’
‘জিনিস নিয়া আমনে কোনো চিন্তা কইরেন না, সাব। খুব ভালো কইরা বানাইয়া দিমু।’
.
হারুন ব্যাপারী ভেতরে ঢুকতেই তার স্ত্রী রোকেয়া বেগম এসে বললেন, ‘আবদুর রহমান আসছে। আপনের সাথে দেখা করতে চায়। বলল খুব জরুরি।’
‘নামাজটা পড়ে যাইতেছি। ধুনারি আসছে, উঠানে বসা। যাও, তারে মাপঝোপ সব বুঝাইয়া দাও।’
‘আচ্ছা।’
হারুন ব্যাপারী নামাজটা সেরে কাছারিঘরে গেলেন। আবদুর রহমান তার মাছের আড়তের এক কর্মচারী। খুব বিশ্বস্ত লোক। তাকে দেখামাত্র উঠে দাঁড়াল, চোখেমুখে আতঙ্ক। তিনি বললেন, ‘বসো আবদুর রহমান। আমি তো একটু পরেই আড়তে যাইতাম। কী এমন জরুরি খবর যে এত দূর থেকে বাড়ি আসলা?’
‘সর্বনাশ অইয়া গেছে, চাচা।’
হারুন ব্যাপারী ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কী সর্বনাশ? সরাসরি বলো।’
‘উকিল সাব খুন অইছে।’
চমকে উঠলেন হারুন ব্যাপারী। নিজের অজান্তেই তার মুখ থেকে বের হলো, ‘আলমগীর মৃধা খুন হয়েছে?’
‘জি চাচা। রাইতের অন্ধকারে গলা কাইটা হ্যার বাড়ির রাস্তায় ফালাইয়া রাখছে। আমনেরে কইছিলাম জয়নাল মির্জা দরকারে খুনও করতে পারে। এর আগেও হে এরম অনেক কাম করছে।’
হারুন ব্যাপারী একটুও সময় নষ্ট না করে তৎক্ষণাৎ পটুয়াখালী রওনা দিলেন।
জেসমিন দুপুরবেলা গোসল করে এসে পৌষের মিষ্টি রোদে বসে চুল ঝাড়ছিল। তখন মতি এল রঞ্জুর চিঠি নিয়ে। রঞ্জুকে চিঠি পাঠানোর এক দিন পর থেকেই নিয়মিত মতিকে পোস্ট অফিসে পাঠায় সে। চিঠি না আসা পর্যন্ত পাঠাতে থাকে। চিঠিটা হাতে নিয়ে জেসমিন সোজা নিজের ঘরে ঢুকল। দরজা লাগিয়ে বিছানার ওপর আয়েশ করে পা ঝুলিয়ে বসে চিঠি খুলে পড়তে শুরু করল :
তুমি নেই সঙ্গে সখী
তুমি নেই চোখেরও সমীপে,
আছ তুমি অঙ্গে সখী
আছ পরশ ও প্রতাপে।
যে অঙ্গসুধা এনেছি ভরে হৃদয়কোটর,
ফুরাবে না গেলে সহস্র কোটি বছর।
তুমি নেই বক্ষে সখী
তুমি নেই কক্ষে,
আছ তুমি রোমন্থনে
আছ স্মৃতির দংশনে।
প্ৰিয় জেসমিন,
তোমার চিঠি পেয়েছি। আশা করি তুমিও ভালোই আছ। গত সপ্তাহে বাবার চিঠি পেয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছেন যে তুমি আমাদের বাড়ি গিয়েছ। তুমি যাওয়াতে তারা দুজনেই খুব খুশি হয়েছেন।
তোমার কামিনীগাছ দেখি ভালোই কথা শিখেছে। এরপর গেলে তাকে বলো, খুব দ্রুতই তার কাছে আমাদের ভালোবাসার সুবাস পৌঁছাবে।
আর শোনো মেয়ে, কামিনী শীতে ফোটে না। এটা বর্ষার ফুল। বর্ষা আসলেই আবার ফুটবে, তুমি-আমি থাকি বা না থাকি।
জেসমিন, আর কটা দিন একটু কষ্ট করো। আমি এখন বাড়ি গেলে এই ক’মাস আমার ঢাকা থাকা বৃথা। কারণ, আমার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষাগুলো দিয়ে চলে আসব। এর পর থেকে আর ক্লাস করব না, শুধু পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দেব। তোমাকে ছেড়ে থাকাটা আমার জন্য কতটা কষ্টের, আশা করি বুঝবে। একটু ধৈর্য ধরো, লক্ষ্মী বউ আমার। খুব শীঘ্রই তোমার নাইয়র শেষ হবে।
ভালোবাসা নিয়ো।
ইতি তোমার রঞ্জু
আলমগীর মৃধার মৃত্যুর আগেই মামলার শুনানির দিন ধার্য হয়েছিল। হারুন ব্যাপারী আলমগীর মৃধার সহকারীর কাছ থেকে সকল তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করে শুনানির দিনে আদালতে উপস্থিত হন। বাদীপক্ষের উকিল জীবিত না থাকায় আদালতে উপস্থিত হতে পারেন নি। কিন্তু তার রেখে যাওয়া সকল তথ্যপ্রমাণ আদালতে পেশ করা হয়েছে। বিবাদীপক্ষ সমনপত্র গ্রহণ করেও আদালতে উপস্থিত না হওয়াতে সকল তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কালিশুরির জমির দখল হারুন ব্যাপারীকে হস্তান্তর করেছে আদালত। উক্ত জমিটি এত দিন অন্যায়ভাবে ভোগদখলের জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ জয়নাল মির্জাকে জরিমানা করা হলে হারুন ব্যাপারী জানালেন, তিনি ক্ষতিপূরণ চান না। জমি ফেরত পেলেই তিনি খুশি। হারুন ব্যাপারী ভীষণ আনন্দিত। অবশেষে তার স্বপ্নের জমিখানা তার হলো। জয়নাল মির্জাকে কোনো উচ্চবাচ্য করতে দেখা গেল না। তিনি বিনা বাক্যে জমির দখল ছেড়ে দিলেন।
১৯
মাঘ মাস। টানা কদিন রোদের দেখা ছিল না। এমন দিনে রেনুর হাতে পায়ের গিঁটে গিঁটে বাতের ব্যথা হয়। বিরক্তির শেষ থাকে না। আজ কড়া রোদ উঠেছে। শরীরটাও তাই ভালো। সকালের কাজ গুছিয়ে রান্না চড়াতে যাবে, এমন সময় দেখে হালিমা মাছ কুটছেন কিন্তু মাছটা বড় হওয়াতে তার কষ্ট হচ্ছে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের জোর কমে গেছে। রেনুর বড় মায়া হলো।
সে গিয়ে বলল, ‘আম্মা, আমনের কষ্ট হইতেয়াছে। মোর ধারে দেন। মুই কুইট্টা দেই।’
হালিমা সঙ্গে সঙ্গে সরে গিয়ে বললেন, ‘দে মা, দে। তোর বাপ-মা যে শিক্ষা তোরে দিছে, আইজকাইলকোর পোলাপানের হেই শিক্ষা নাই।’
রেনু এ বিষয়ে কথা বলল না। সে মাছ কুটতে কুটতে হালিমা মসলা গুছিয়ে এনে বললেন, ‘ইট্টু মসল্লা বাইড্ডা দিবি, মা?’
রেনু মসলা বেটে তরকারি কুটে সব গুছিয়ে বলল, ‘আম্মা, রান্দা বহাই দিমু?’
হালিমার মনে হলো, এত বড় মাছ দেখে রেনুর বুঝি লোভ হলো। তাই রাঁধতে চাচ্ছে। আব্বাস ঘরে মাছ আনে না কত দিন কে জানে! রাঁধলে আবার তাকে ভাগ দিতে হয় যদি!
তাই বললেন, ‘না, মুই রানতে পারমু। তুই তোর কামে যা। তোর তো সব কাম পইড়া রইছে।’
‘আচ্ছা। আমনে এত কাম একলা একলা করেন, আম্মা। কষ্ট অইলে মোরে ডাক দিয়েন।’
হালিমা দাঁত বের করে হাসলেন। রেনু নিজের রান্নাঘরে এসে রান্নার জোগাড় শুরু করল। রান্নাঘর বলতে ঘরের পাশে খোলা জায়গায় কদিন আগে পাতা দুমুখো মাটির চুলা। চুলাটিকে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে আব্বাস ওপরে পলিথিন টাঙিয়ে দিয়েছে। বলেছে দ্রুত একটি ছাউনির ব্যবস্থা করে দেবে।
রেনুর আজকের মেনু ডাল, ভাত আর কাঁচাকলার নিরামিষ। ঘরে বাজার নেই। উঠানের মাটির এমন দশা যে কোনো শাকসবজিও হয় না। জঙ্গলের কলাগাছ থেকে এক কাঁদি কলা নিয়ে এসে কুটতে বসেছে। এমন সময় মিনা এল। রেনু বলল, ‘জলচকিডা টাইন্না বয়। শইলডা বালো?’
‘আমি তো বালো। তোমার বাতের ব্যতা কোমছে?’
রেনু হেসে বলল, ‘হয়। আইজ ব্যতা নাই।’
মিনা রাগি গলায় বলল, ‘হেইলাইগ্যাই কামলা দিতে গেছিলা বুজি? এত কিছুর পরেও তুমি ক্যামনে পারো, ভাবি? এত দরদ কইত্যা আহে?’
রেনু হেসে বলল, “ধুর পাগল। বুড়া মানুষ একলা কি এত পারে? কষ্ট অইতেয়াছিল।
‘হে কি তোমার কষ্ট দেহে?’
রেনু আবারও হেসে বলল, ‘আমার আল্লায় দেহে।’
এবার মিনা হেসে দিল। জলচৌকি টেনে বসল। তার হাতে মাছভর্তি বাঁশের খালই।
সেটাকে মাটিতে রেখে বলল, ‘তোমার দেওরে মাছ ধরছে। ভাইজানের পছন্দমতো রাইন্দা দিয়ো।’
‘ও বাবা, এত মাছ! সব লইয়াইছস দি? তোরা খাবি কী?’
মিনা ভেংচি কেটে বলল, ‘কইছে তোমারে! ম্যালা মাছ কোপাইছে আইজ। অর্ধেক আনছি।’
রেনুর চোখে জল এসে গেল। আলাদা হওয়ার পর থেকে এমন দিন কখনোই আসে নি যে ঘরে রান্না করার মতো কিছু নেই। আজই প্রথম এমন দিন এল আর আজই এত মাছ! সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞতায় মাথা নুইয়ে এল। কার রিজিক কোথায় লেখা আছে, তা শুধু তিনিই জানেন।
.
রেহানার চিঠি হাতে বসে আছে মামুন। মনটা প্রচণ্ড বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। না, কোনো খারাপ খবর নয়। সে লিখেছে মামুনহীন তার একাকিত্বের কথা। যা পড়ে অস্থির লাগছে মামুনের। সে অবাক হয়ে ভাবছে, যাকে বিয়েই করতে চায় নি, সেই রেহানার জন্যই তার এখন এতটা উতলা লাগে। যে মুখটা তার পছন্দ হয় নি তখন, সেই মুখটা দেখার জন্যই এখন হাঁসফাঁস লাগে! কেমন মায়ার বাঁধনে বেঁধেছে সে তাকে? এ কোন মায়া?
মামুন তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিল, রেহানাকে তার কাছে নিয়ে আসবে। এখন সে মেসে থাকে। রেহানাকে আনলে ভালো পরিবেশে একটা ঘর নিতে হবে। তাই নেবে সে। দ্বিগুণ খরচ হবে। তা একটু হোক। টাকা অনেক আসবে- যাবে, কিন্তু জীবন থেকে এই দিনগুলো হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসবে না।
.
আজ মুকুল ফেরার আগেই মিনা মধুকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তারপর একটু সাজগোজ করল। আজকের দিনটা খুব বিশেষ। অনেক দিন অপেক্ষা করেছে সে এমন একটা দিনের জন্য।
মুকুল ফিরে মিনাকে দেখেই দুষ্টু হেসে বলল, ‘ঘটনা কী? আইজ নায়িকার মন এত ফুরফুরা ক্যা?’
মিনা ভেংচি কেটে বলল, ‘এহ্, মুই বুঝি নায়িকা?’
মুকুল কাছে এসে মিনার গাল টিপে বলল, ‘হয়, নায়িকাগো মতোই তো সাজছ।
মিনা বলল, ‘তয় আইজ মোর মন সত্যই ফুরফুরা, এইল্লাইগ্যাই সাজছি। তোমার লাইগ্যা একটা সুখবর আছে।’
মুকুল দুহাত মিনার দুই কাঁধের ওপর রেখে বলল, “তাই নাকি? হকালে কও?’
মিনা মাথা নিচু করে হেসে বলল, ‘তুমি আবার বাপ হবা।’
মুকুল খুশি হলো বটে, তবে হারিয়ে ফেলা বাচ্চাটার কথা মনে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই বুকের ভেতর একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল। মিনার চোখকে ফাঁকি দিতেই তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ। খুব খুশি হইছি।’
মিনা মুকুলের বুকে মাথা রেখে জানতে চাইল, ‘এইবার কী চাও, পোলা, না মাইয়া?’
মুকুল একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে বলল, ‘আল্লাহ যা দেয়।’
নাইয়রি – ২০
২০
পুকুরে জাল ফেলে বড় বড় মাছ ধরা হয়েছে। বড় কাতল ও বোয়াল ধরা পড়েছে জালে। খাসিও জবাই করা হয়েছে। মেয়েরা তিন দিন বসে নতুন গুড়ের পিঠাপুলি বানাচ্ছে। এত দিন বাদে জামাই আসছে বলে কথা। লোক পাঠিয়ে গৌরনদীর রসমালাই ও দই আনালেন জয়নাল মির্জা। আয়োজনের কোনো কমতি রাখলেন না।
জেসমিনও আজ ভীষণ খুশি। এত দিন বাদে রঞ্জু আসছে। গতকাল সূর্যমণি এসেছে। আজ কেশবপুর আসবে জেসমিনকে নিতে। গত মাসে সে ঢাকা থেকে একটা লাল রঙের ঢাকাই জামদানি পাঠিয়েছিল। সেটা আজ পরেছে জেসমিন। শাড়িটা পরে ঘর থেকে বের হলো। কাছারিঘরের পেছনে একটা জবা ফুলের গাছ আছে। সেখান থেকে কিছু ফুল এনে রাখলে হয়। রঞ্জু খুশি হবে। ফুল খুব পছন্দ করে মানুষটা।
জেসমিন ফুল ছিঁড়ে ছিঁড়ে আঁচলে রাখছে। এরই মাঝে শুনতে পেল কাছারিঘরে তার বাবা এবং ভাইয়েরা রঞ্জুর নাম নিয়ে কিছু বলাবলি করছে। যেহেতু রঞ্জুর নামটা আসছে, তাই কৌতূহলবশত সে কাছারিঘরের পেছনের বারান্দায় জানালার কপাটের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াল। এরপর সে যা শুনল, তাতে তার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। তার বাবা এবং ভাইয়েরা মিলে আজ রাতে রঞ্জুকে খুন করার পরিকল্পনা করছে! সামান্য একটা জমি হারিয়েছে বলে ছেলেকে মেরে বাবার ওপর প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে! তার বাপ-ভাইয়েরা ভয়ংকর, তা সে জানত, তাই বলে এতটা হিংস! পালাতে হবে, এই মুহূর্তে এখান থেকে পালাতে হবে। রঞ্জুর এখানে আসা আটকাতে হবে। জেসমিন দৌড় দিল। দুর্ভাগ্যবশত তাড়াহুড়োয় তার হাতের সাথে জানালার কপাট একটা ধাক্কা খেল। শব্দ শুনে জালাল-জব্বার পেছনের বারান্দায় তাকাতেই দেখতে পেল জেসমিনকে। কিছু বুঝতে আর বাকি রইল না তাদের। জব্বার লাফিয়ে পড়ে দৌড় দিল জেসমিনের পেছন পেছন। কয়েকটা বাড়ি পার হয়েই জেসমিনকে ধরে ফেলল। জেসমিন ক্রোধে গর্জন করতে লাগল, ‘খুনির বাচ্চা খুনি, ছাড় আমারে, ছাড় কইতাছি।’
জব্বার জেসমিনের মুখ চেপে ধরে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইল। জেসমিন কিছুতেই যাবে না। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে ছাড়ানোর। জব্বার তাকে টেনেহিঁচড়ে বাড়ি নিয়ে যেতে লাগল। কাছারিঘরে নিয়ে তবেই মুখটা ছাড়ল। সেখানে জয়নাল মির্জা এবং জালাল বসে ছিল। জব্বার যখন গেছে, ধরে আনতে পারবে বলেই তাদের বিশ্বাস ছিল। জেসমিনের মুখটা ছাড়তেই সে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আব্বা, আমনে নিজের মাইয়ার স্বামীরে খুন করার কথা ক্যামনে চিন্তা করলেন? এত বড় কষাই আমনে?’
জয়নাল মির্জা ঠান্ডা মাথার মানুষ। সহজে বিচলিত হন না। তিনি শান্ত স্বরে মেয়েকে বললেন, ‘অরা আমাগো শত্রু, মা। তোমার শ্বশুর অনেক বড় পরিকল্পনা কইরা পোলারে তোমার পিছনে লাগাইছিল। কালিশুরির জমিখান যৌতুক নিতে চাইছিল। আমি তো তহন বুঝতে পারি নাই, মা। অগো ফাঁদে পা দিয়া ফালাইছি। আমারে মাফ কইরা দেও।’
‘মিথ্যা কতা কইবেন না, আব্বা। আমি এগুলান বিশ্বাস করি না।’
‘বিশ্বাস করো আর না করো, সত্য বলছি। তুমি তারে ভুইলা যাও। তোমারে আরও ভালো পোলা দেইখা বিয়া দিমু।’
জেসমিনের ক্রোধপরায়ণ চোখ দুটো এবার ভিজে এল। কাঁদতে কাঁদতেই সে চিৎকার করল, ‘আল্লাহর গজব পড়ুক। আমারে ছাড়েন, রঞ্জুরে কমু জমি আমনের নামে লেইখ্যা দিতে।’
জয়নাল মির্জা হুঁক্কায় টান দিতে দিতে বললেন, ‘জমি দিয়া কী করমু এহন আর? যে সম্মান আমার গেছে, তা কি ফেরত পামু?’
ওরে জল্লাদ রে!’
জেসমিন এবার ওপর দিকে চেয়ে দ্বিগুণ স্বরে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আল্লাহ, তোমার দুনিয়ায় কোনো বাপ কি এমন অয়?’
জয়নাল মির্জা জালাল জব্বারকে বললেন, ‘অরে এখন আর বাড়ির ভিতর নেওন যাইব না। চিল্লাইয়া বাড়ির সবাইরে জানান দিবে। কাছারিঘরেই আটকাইয়া রাখ। আর হাত-মুখ বাইন্দা রাখ। তেজ বেশি মাইয়ার।’
‘আব্বা!’
জেসমিন আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। জব্বার হাত ধরে রেখেছে, জালাল মুখ বেঁধে ফেলল। তারপর চেয়ারে বসিয়ে দুই হাতলের সাথে দুই হাত বাঁধল। জেসমিন নুন পড়া জোঁকের মতো ছটফট করছে। কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারল না। জয়নাল মির্জা বেরিয়ে গেলেন আগে। জালাল ও জব্বার শেষে দরজায় তালা মেরে বের হলো। ভারী কাঠের চেয়ারের সাথে এমন শক্ত করে বেঁধেছে যে জেসমিন আর নড়তেও পারল না। অসহায়ের মতো কেঁদে চলল শুধু।
.
রঞ্জু এল সন্ধ্যার পর। শ্বশুরের সাথে বসে গল্প করছে। জেসমিনকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না। জিজ্ঞেস করতেও একটু লজ্জা লাগছে। এরই মাঝে জেসমিনের মা খেতে ডাকল। খেতে বসেও জেসমিনকে দেখতে না পেয়ে অবশেষে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘আম্মা, জেসমিনকে দেখছি না। ও কোথায়?’
কোহিনুর বানু স্বামীর কাছ থেকে যা জেনেছেন, তা-ই বললেন, “মিনুর বাচ্চা অইবে তো। কী সমেস্যা জানি অইছে। আমাগো এদিকের হাসপাতালে আনছে। খবর পাইয়া জব্বার গেছে, লগে জেসমিনও গেছে। আইয়া পড়বে, তুমি খাও, বাবা।’
রঞ্জুর একটু মন খারাপ হয়েছিল, তিন মাস পর বাড়ি এল, অথচ জেসমিনকে দেখতে পাচ্ছে না! এখন অবশ্য মনখারাপ লাগাটা আর নেই। শাশুড়ির হাতের রান্না বরাবরই রঞ্জুর খুব প্রিয়। সে খুব তৃপ্তি করে কবজি ডুবিয়ে খেল। খাওয়া বেশি হওয়াতে সে একটু উঠোনে হাঁটতে নামল। কাছারিঘরের সামনেই হাঁটছিল সে। জালাল পেছন থেকে বলল, ‘রঞ্জু, বিলে মাছ কোপাইতে যাবানি?’
জেসমিন এ কথা শুনে চমকে উঠল। রঞ্জু এসে পড়েছে? তখনই রঞ্জুর গলা শোনা গেল, ‘আরে ভাইজান, দারুণ আইডিয়া! কত দিন মাছ কোপাই না! চলেন যাই। জেসমিন বাড়িতে নাই, ভালোও লাগছে না।’
জেসমিনের হৃদয়টা হু হু করে উঠল। কত দিন পর রঞ্জুর গলার স্বর শুনতে পেল। রঞ্জু তার এত কাছে!
জালাল হাঁক ছেড়ে বলল, ‘এ কুদ্দুস, ফুলকুচি আর কোঁচ গুলান লইয়া আয়। জামাইরে নিয়া মাছ ধরতে যামু।’
জেসমিন মরিয়া হয়ে উঠল রঞ্জুকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু কীভাবে বাঁচাবে তাকে? চেয়ারটা এত ভারী যে সে একটুও নড়াতে পারল না। মাটির মেঝেতে ঠেসে আছে চেয়ারের পায়াগুলো। আশপাশে তাকিয়ে জয়নাল মির্জার রেখে যাওয়া হুঁক্কাটা দেখতে পেল। সেটাকেই পা বাড়িয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করল। অনেক কষ্টে যখন ছুঁতে পারল, তখন সেটা উল্টে দিল, যাতে শব্দ হয়। আর শব্দটা রঞ্জুর কানে যায়। যদিও এটা সন্দেহ হওয়ার মতো কিছু নয়, তবু একটা চেষ্টা। শব্দটা শুনে রঞ্জু বলল, ‘কাছারিঘরে তো তালা মারা। তাহলে ভেতরে কিসের শব্দ, ভাইজান?’
জালাল বলল, ‘বিলোই হানছে মনে হয়। বাদ দেও। চলো মাছ ধরতে যাই।’
হুঁক্কাটা ধাক্কা খেয়ে দূরে গিয়ে পড়েছে, আরেকটা শব্দ করার মতো কোনো উপায় জেসমিনের রইল না। পায়ের আওয়াজ দূরে যেতে থাকায় জেসমিন বুঝতে পারল জালাল ও রঞ্জু চলে যাচ্ছে। শেষ, সব আশা শেষ। জেসমিন অঝোরে কাঁদতে লাগল। পেটের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, ‘তোর আসার খবরটা তোর বাপরে দেওয়ার জন্য এত উতলা হইয়া চিঠি লেখছিলাম, তারপরেও কত অপেক্ষা! অথচ তোর বাপ জানতেও পারল না তোর আসার কথা!’
২১
জালাল জামাই নিয়ে মাছ ধরতে ময়নার বিলে গেল। জালাল জব্বার ও জয়নাল মির্জার লোকেরা সেই বিলেই তাকে মেরে ধাপের নিচে ফেলে এল। তবে মৃত্যুর আগে রঞ্জু এটা জেনে যেতে পারল যে তার বাবার ঠিক কোন অপরাধের জন্য তাকে মরতে হচ্ছে। এ-ও জানতে পারল, কাছারিঘরে কোনো বিড়াল ছিল না। ছিল হাত-মুখ বাঁধা তার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী। তাকেই বাঁচাবার শেষ চেষ্টাস্বরূপ শব্দটা করেছিল সে। জালাল-জব্বার রসিয়ে রসিয়ে বলছিল সেসব কথা!
আহা রে জীবন! আরেকটিবার জেসমিনের সাথে দেখা হলো না। শোনা হলো না তার না-বলা সেই কথাগুলো! দীর্ঘ তিন মাস অপেক্ষার কোনো অর্থ রইল না। কে জানত তিন মাসের ব্যবধানে এত কিছু ঘটে যাবে!
সেই রাতেই জেসমিনকে কাছারিঘর থেকে তার ঘরে আনা হলো। কিন্তু এখানেও তাকে আটকে রাখার নির্দেশ দিলেন জয়নাল মির্জা। জেসমিনের দরজার বাইরে একজনকে পাহারায়ও বসানো হলো।
রঞ্জুর মৃত্যুর খবর পেয়ে জেসমিন মাটিতে শুয়ে পড়ে বলল, ‘আমারেও ওই মাটিতে মিশাইয়া দেও!’
কিন্তু চিৎকার করার মতো শক্তি আর তার অবশিষ্ট নেই। সে শুধু উদ্ভ্রান্তের মতো কেঁদে চলেছে। উল্টোপাল্টা প্রলাপ বকছে। কোহিনুর বানু জয়নাল মির্জাকে বললেন, ‘আর কত পাপ করবেন? নিজের মাইয়ারেও যে কেউ বিধবা করতে পারে, আপনেরে না দ্যাখলে জানতাম না।’
জয়নাল মির্জা মেয়েছেলের কথা গায়ে মাখেন না। তিনি তার ঘরে গিয়ে শান্তির ঘুম দিলেন। হারুন ব্যাপারী অতি বাড় বাড়ছিল। এত দিনে তাকে একটা উপযুক্ত জবাব দেওয়া গেছে। জয়নাল মির্জার সাথে লাগতে এলে কী হতে পারে, সেটা এবার বুঝবে।
.
একদিন দুপুরের খাবার খাওয়াতে জেসমিনের ঘরে ঢুকলেন কোহিনুর বানু। বাইরে পাহারাদার। তাই জেসমিন ফিসফিসিয়ে বলল, ‘আমার পেটে রঞ্জুর বাচ্চা, মা।’
এ কথা শুনে আঁতকে উঠলেন কোহিনুর বানু। যে খবরে খুশি হবার কথা, সে খবরে আজ তিনি খুশি হতে পারছেন না। তার কষ্ট আরও কয়েক গুণ বেড়ে গেল।
তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। জেসমিন আবার বলল, ‘আমি পলাইয়া যামু। আমারে সাহায্য করো, মা। এই শকুনের দল বাচ্চাডার কথা জানতে পারলে রাখতে দেবে না।’
‘কিন্তু পলাইয়া যাবি কোতায়?’
‘শ্বশুরবাড়ি যামু। হেরা জাগা না দিলে একদিকে যামু যাইয়া। কপালে যা আছে, তাই অইবে। আমি খালি বাচ্চাডারে জন্ম দিতে চাই, মা। আমার রঞ্জুর একমাত্র চিহ্ন ও। আমি অরে সারা জীবন আমার লগে রাখতে চাই। তোমার দুইডা পায়ে ধরি, আমারে পলাইতে সাহায্য করো।’
রাতের খাবার খাওয়ানোর ছুতোয় জেসমিনের ঘরে ঢুকে তার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলেন কোহিনুর বানু। তারপর ফিসফিস করে বললেন, “এই টাহা কয়ডা রাখ। কামে লাগবে। পাশের বাড়ির কাশেমরে কইয়া ঘরের সিঁধ কাটনের ব্যবস্থা কইর্যা রাখছি। ও গোপন রাখপে। রাইত বাড়লে আইয়া সিঁধ কাইট্যা দেবে। বাইর হইয়া যাইছ।’
জেসমিন মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। বলল, ‘মা গো, সারাটা জনম তোমারে খালি জ্বালাইসি। আমারে মাফ কইরা দিয়ো।’
কোহিনুর বানুও চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘পাগল মাইয়া আমার! যেখানেই থাকোস, নিজের যত্ন নিবি, মার দোয়া সব সময় তোর লগেই আছে। অনেক দূরে চইলা যাইস। এই শকুনের দল জানি তোর নাগাল না পায়! এত বড় দুনিয়ার কোনো না কোনোখানে তোর জায়গা নিশ্চয়ই অইবে।’
.
রঞ্জুর মৃত্যুর তিন দিন পর মাঝরাতে জেসমিন পালিয়ে গেল। কিছুই নিল না সঙ্গে। শুধু একটা শাল গায়ে পেঁচিয়ে বেরিয়ে গেল। দৌড়াতে দৌড়াতে যখন শ্বশুরবাড়ি পৌঁছাল, তখন ভোর হয়ে গেছে। বাড়িতে ঢুকে উঠান পার হয়ে ঘরে ঢোকার সিঁড়িতে উঠল। তারপর আচমকাই ঘরের ভেতর থেকে রোকেয়া বেগম আর হারুন ব্যাপারীর কথা শুনতে পেয়ে থেমে গেল। রোকেয়া বেগম বিলাপ করছিলেন, ‘আপনেরে আমি বলছিলাম জয়নাল মির্জার লগে গ্যাঞ্জাম কইরেন না। গ্রামের সবাই মানা করছিল। আপনি শুনেন নাই। কী এক জমি নিয়া পইড়া ছিলেন। কী লাভ হইল জমি পাইয়া? ছেলে তো হারাইলেন। আবার জমির আশায় ছেলে বিয়া করাইলেন ওই কষাইয়ের বাড়িতে। এত লোভ ক্যান আপনের? এখন দেন, আমার ছেলেরে ফেরত দেন।’
হারুন ব্যাপারী বললেন, ‘কাইন্দ না, রঞ্জুর মা। আমাদের ছেলেকে যে এইভাবে হত্যা করেছে, তাকে আমি ছাড়ব না। জেসমিন একদিন না একদিন এই বাড়ি আসবে। তার বাপের চোখে ফাঁকি দিয়ে হলেও আসবে। সেই দিন জেসমিনকে টুকরা টুকরা করে তার বাপের কাছে পাঠাব।’
জেসমিন কেঁপে উঠল। রোকেয়া বেগম বললেন, ‘আপনাদের খুনাখুনি তো চলতেই থাকবে…’
জেসমিন বাকি কথা আর শুনল না। শোনার দরকারও নেই। চুপিচুপি আবার সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল। তারপর দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। রাস্তায় উঠেও দৌড়াতে লাগল। দৌড়াতে দৌড়াতে কোন দিকে গেল, সে জানেও না। একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ল। দৌড় থামিয়ে সে মাথায় ঘোমটা তুলে হাঁটতে লাগল। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সে এক নদীর ঘাটে এসে পৌঁছাল। ততক্ষণে সূর্য মাথার ওপরে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে। একটা নৌকায় অনেক যাত্রী উঠছে। নৌকা কোথায় যাবে, সে জানে না। তবু উঠে পড়ল। নৌকা এঘাট-ওঘাট ঘুরে শেষ ঘাটে যখন থামল, তখন সে একটা বাসস্ট্যান্ডে এসে পৌঁছাল। উঠে পড়ল বাসে। বাস কোথায় যাবে, তা জানার আগ্রহ তার নেই। সে শুধু দূরে যেতে চায়। এই সব মারামারি-খুনোখুনি থেকে অনেক দূরে। যেখানে গেলে সে তার সন্তানকে নিয়ে নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারবে।
২২
রাত তখন অনেক। কুয়াশায় কয়েক কদম সামনেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। গৌরনদী বাসস্ট্যান্ডের দোকানিরা একে একে দোকানপাট বন্ধ করছে। আনোয়ারের বড় চা তৃষ্ণা পেয়েছে। নরেনের হাতের এক কাপ চা না হলে তার এখন হবেই না। আনোয়ারকে দেখে নড়েন বলল, ‘এত দেরি কইর্যা আইলে বাবু চা দেতে পারমু না আমি। তোমারে আগেও কইছি।’
আনোয়ার নরম গলায় বলল, ‘আহা, নরেনদা, রাগ অও ক্যা? রাস্তাঘাটের মামলা কি অত সময় বাইন্ধা পারোন যায়? দুই-এক দিন এট্টু দেরি অইলে মাফসাফ কইর্যা দিয়ো। এত চায়ের দোকান কিন্তু তোমার হাতের চা না খাইলে হারা দিনের ক্লান্তি যায় না। দেও দেও, এক কাপ চা দেও, গা-ডা গরম করি।’
নরেন সব গোছগাছ করেই রেখেছিল। আনোয়ারের চা দিয়েই চুলা নিভিয়ে দোকানের ঝাঁপ নামাল।
দোকানে তালা দিতে দিতে বলল, ‘বাবু, কাপ খান টোঙের নিচে থুইয়া দিয়ো।’
দোকান বন্ধ করে নরেন বাড়ি চলে গেল। যেহেতু আজ কাপ ফেরত দেওয়ার তাড়া নেই, একটা বিড়ি ধরিয়ে সময় নিয়ে আয়েশ করে চা খেতে লাগল আনোয়ার। চা শেষ হবার আগেই দেখতে পেল তার বাসের হেলপার ছুটতে ছুটতে আসছে। আনোয়ার অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী অইছে তোর, দৌড়াছ ক্যা?’
ছেলেটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘ওস্তাদ, বাসের মইধ্যে এউক্কা মাইয়ামানুষ ঘুমাই রইছে।’
আনোয়ার চমকে উঠে বলল, ‘কস কী? লগে কেউ নাই?’
‘না, একলা। বাস পরিষ্কার করতে যাইয়া হ্যারে দেকছি।’
আনোয়ার দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখে ঘটনা সত্য। অপূর্ব রূপবতী একটি মেয়ে জড়সড় হয়ে বাসের পেছনের সিটে শুয়ে আছে। এত রূপবতী মেয়ে আনোয়ার তার জীবদ্দশায় কখনো দেখে নি। অনেক ডাকাডাকি পরেও যখন মেয়েটির ঘুম ভাঙল না, তখন সে বুঝতে পারল, মেয়েটি সম্ভবত ঘুমিয়ে না, অজ্ঞান হয়ে আছে। আনোয়ার প্রথমে ভয় পেয়েছিল, তারপর কিংকর্তব্যবিমূঢ় এখন তার কী করা উচিত, কিছুই বুঝতে পারছিল না। আর যা-ই হোক, এভাবে একটি মেয়েকে ফেলে যাওয়া যায় না। ভেবেচিন্তে সে মেয়েটিকে মুস্তাফিজ ডাক্তারের চেম্বারে নিয়ে গেল।
.
মুস্তাফিজ ডাক্তার মেয়েটির চিকিৎসাকালে আঁচলে কিছু বাঁধা দেখতে পেলেন। যেহেতু মেয়েটির এখনো জ্ঞান ফেরে নি এবং অত্র এলাকায় তাকে আগে কখনো দেখে নি, তাই তার পরিচয় জানা জরুরি। সেই কারণেই আঁচলের গিঁট খুললেন, যদি কোনো ঠিকানা পাওয়া যায়। কিন্তু কোনো ঠিকানা পাওয়া গেল না। কিছু টাকা ও একটি চিঠি পাওয়া গেল। চিঠিতে লেখা :
তুমি নেই সঙ্গে সখী
তুমি নেই চোখেরও সমীপে,
আছ তুমি অঙ্গে সখী
আছ পরশ ও প্রতাপে।
যে অঙ্গসুধা এনেছি ভরে হৃদয়কোটর
ফুরাবে না গেলে সহস্র কোটি বছর
তুমি নেই বক্ষে সখী
তুমি নেই কক্ষে,
আছ তুমি রোমন্থনে
আছ স্মৃতির দংশনে।
প্ৰিয় জেসমিন,
তোমার চিঠি পেয়েছি। আশা করি তুমিও ভালোই আছ। গত সপ্তাহে বাবার চিঠি পেয়েছিলাম। তিনি জানিয়েছেন যে তুমি আমাদের বাড়ি গিয়েছ। তুমি যাওয়াতে তারা দুজনেই খুব খুশি হয়েছেন।
তোমার কামিনীগাছ দেখি ভালোই কথা শিখেছে। এরপর গেলে তাকে বলো, খুব দ্রুতই তার কাছে আমাদের ভালোবাসার সুবাস পৌঁছাবে।
আর শোনো মেয়ে, কামিনী শীতে ফোটে না। এটা বর্ষার ফুল। বর্ষা আসলেই আবার ফুটবে, তুমি-আমি থাকি বা না থাকি।
জেসমিন, আর কটা দিন একটু কষ্ট করো। আমি এখন বাড়ি গেলে এই ক’মাস আমার ঢাকা থাকা বৃথা। কারণ, আমার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। পরীক্ষাগুলো দিয়ে চলে আসব। এর পর থেকে আর ক্লাস করব না, শুধু পরীক্ষার সময় এসে পরীক্ষা দেব। তোমাকে ছেড়ে থাকাটা আমার জন্য কতটা কষ্টের, আশা করি বুঝবে। একটু ধৈর্য ধরো, লক্ষ্মী বউ আমার। খুব শীঘ্রই তোমার নাইয়র শেষ হবে।
ভালোবাসা নিয়ো।
ইতি তোমার রঞ্জু।
জেসমিনের জ্ঞান ফিরল কিছুক্ষণ পরই। কিন্তু সে কোথা থেকে এসেছে, কোথায় যাবে, কোনো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না।
শুধু বলল, ‘খিদা লাগছে।’
মুস্তাফিজ ডাক্তারের চেম্বারের পাশেই তার ভাই মুজাহিদের ভাতের হোটেল। সেখান থেকে জেসমিনের জন্য খাবার আনা হলো। একটা জলজ্যান্ত মেয়ে নাম-পরিচয় কিছুই বলতে পারছে না। তার ওপর চোখধাঁধানো রূপবতী। একে নিয়ে এত রাতে এখন তারা কী করবে, কিছুই বুঝতে পারছে না। জেসমিন খেতে বসলে আনোয়ার রাস্তায় গিয়ে সিগারেট ধরাল।
জেসমিনের খাওয়া শেষ হলে মুস্তাফিজ ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, ‘জেসমিন, তুমি যখন অচেতন ছিলা, তোমার ঠিকানা খোঁজার জন্য আঁচলের গিঁটে চিঠি পেয়ে সেটা পড়ছি। আমাদের রঞ্জুর ঠিকানা বলো। সে ঢাকায় কোথায় পড়াশোনা করে? কোথায় থাকে? তারে খবর দেই, তোমারে নিয়া যাক।’
এ প্রশ্নে জেসমিন আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে উঠল। মুস্তাফিজ ডাক্তার বিব্রত হয়ে বললেন, ‘কী হইল? কান্দ কেন?
‘আমার বাপে আমার স্বামীরে খুন করছে। আমি পলাইয়া আইছি। আমারে একটু সাহায্য করেন, মিয়াভাই।’
মুস্তাফিজ ডাক্তার রীতিমতো চমকে উঠলেন। বললেন, ‘বলো কী! কদিন আগে যে শুনছিলাম এক ডাকাত তার মেয়েজামাইকে খুন করেছে, সে কি তোমার বাবা?’
জেসমিন কান্না থামাতে পারছে না। কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘না, তয় হে ডাকাইতের চাইয়া কম না। সম্পত্তির মামলায় আমার শ্বশুরের লগে হারছে। প্রতিশোধ নেওয়ার লাইগা আমার স্বামীরে মারছে। আমার শ্বশুর আবার হেই প্রতিশোধ নেওয়ার লাইগা আমারে মারতে চাইছিল। কোনোমতে পলাইয়া আইছি। আমার যাওনের কোনো জাগা নাই। আপনের দুইডা পায়ে ধরি, আমারে একটু সাহায্য করেন।’
জেসমিন সত্যি সত্যি পা ধরতে যাচ্ছিল। মুস্তাফিজ ডাক্তার সরে গেলেন, ‘আরে করো কী করো কী, খাড়াও, আমি দেখতেছি কী করা যায়। তুমি কান্নাটা থামাও।’
খানিক বাদেই ডাক্তার আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, তোমার বাড়ি কি পটুয়াখালী বা বরগুনা?’
জেসমিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস বলল, ‘পটুয়াখালী। কিন্তু আপনে ক্যামনে জানলেন?’
ডাক্তার বললেন, ‘জানি নাই, আন্দাজ করলাম। এমন কথায় কথায় খুনখারাবি ওই দিকেই হয় বলে শুনি।’
জেসমিন চোখ মুছল। ডাক্তারকে আগের চেয়েও বেশি চিন্তিত মনে হলো।
কিছুক্ষণ পর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার পেটে বাচ্চা আছে, এ কথা তুমি জানো?”
জেসমিনের চোখ দুটো আবারও জলে ভরে উঠল। মাথা নিচু করে বলল, ‘জানি। বাচ্চারে বাঁচানোর লাইগ্যাই পলাইছি। নাইলে তারে ছাড়া এই জীবনের কোনো দাম আছিল না।’
ডাক্তার বললেন, ‘জেসমিন, তুমি একা হইলে তোমার হয়তো কোনো ব্যবস্থা করা যাইত। কিন্তু বাচ্চাসহ তোমার কী ব্যবস্থা করব, বুঝতে পারতেছি না। আপাতত তুমি সত্যি কথাটা আর কাউরে বইল না। এমনকি আনোয়াররেও না। সবাইরে বলবা তুমি এতিম। তোমার স্বামী মারা গেলে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাড়াইয়া দিছে। এখন তোমার যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। তুমি কোত্থেকে আসছ, এইটাও বলবা না। যেহেতু তোমার কথায় বরিশাল অঞ্চলের টান আছে, তাই বরিশালের কোনো জায়গার নাম বলবা। স্বরূপকাঠি বইল।’
জেসমিন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল। ডাক্তার আবার বললেন, ‘এ ছাড়া উপায় দেখতেছি না। এদিকে খুনখারাবি হরহামেশা হয় না। লোকে এই সব ভয় পায়। তাই সত্যিটা জানলে তোমারে কেউ সাহায্য করবে না। গ্রামছাড়াও করতে পারে। এমনকি সবাই সত্যিটা জানলে আমারেও সাহায্য করতে দেবে না। সমাজে তো সবাইরে নিয়াই চলতে হয়।’
‘বুজছি।’
মুস্তাফিজ ডাক্তার দোকানের বাইরে তাকিয়ে আনোয়ারকে ডাক দিলেন। আনোয়ার এলে তাকে স্বরূপকাঠির শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত এতিম বিধবা জেসমিনের গল্প শোনালেন।
আনোয়ার এসব শুনে অসহায় গলায় বলল, ‘কী বিপদ!’
মুস্তাফিজ ডাক্তার জানতে চাইলেন, ‘অরে কি তোমার লগে লইয়া যাইবা? আমার তো চেম্বার বন্ধ করনের সময় পার অইয়া গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে।’
আনোয়ার কাঁচুমাচু হয়ে বলল, ‘ডাক্তার সাব, মুই এরে কই লইয়া যামু? এতগুলা পোলাপান, বাপ-মা নিয়া এত বড় সংসার চালাইতে হিমশিম খাইয়া যাই। তার মধ্যে আরেকজনরে ক্যামনে উডাই? থাকোনের জাগাও তো নাই।’
‘তাইলে কী করবা?’
‘আমনেগো তো অনেক বড় বাড়ি। কামের লোকটোক দরকার অয়। আমনেরা লইয়া যান।’
মুস্তাফিজ ডাক্তার বললেন, ‘কী কও তুমি? শিক্ষিত বড়লোকের ঘরের বউ, গেরস্তবাড়ির কাম…।’
জেসমিন বলল, ‘মুই সব কাম পারি। আমনেগো বাড়ি বা যেকোনো বাড়িতেই একটা কাম জুটাইয়া দিলেই অইবে। কোনো টাহাপয়সা লাগবে না। খালি থাকতে দিলে আর তিন বেলা খাইতে দিলেই অইবে।
তাদের কথাবার্তার মাঝখানেই মুজাহিদ এল। প্রতি রাতেই দুই ভাই যার যার দোকান বন্ধ করে একসঙ্গে বাড়ি ফেরে। জেসমিনের ব্যাপারে সব শুনে সে-ও ঘাবড়ে গেল।
আনোয়ার প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘মাইয়াডারে জানে বাঁচাইতে যাইয়া আমি একি বিপদে পড়লাম? আপনেরা একটু মোর অবস্থাডা ভাইবা দয়া করেন। মুই হ্যারে কই নিমু?’
মুজাহিদ কিছু বলতে যাচ্ছিল। মুস্তাফিজ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, আপাতত অরে আমরাই আমাগো বাড়ি নিয়া যাই। এরপর কাইল দিনে ভাবনাচিন্তা কইরা একটা সমাধান বাইর করোন যাইব।’
মুজাহিদ বলল, ‘ভাইজান, এই কাম করোন যাইব না। এত রাইতে হেরে বাড়ি নিয়া আমনে কইবেনডা কী? ভাবি রাগ অইবে। আমার বউও কম না। সংসারে এই অশান্তি ক্যামনে সামলাইবেন?’
মুস্তাফিজ বললেন, ‘আরে ভাই, সবাই খালি নিজেগো কথা চিন্তা করলে ক্যামনে অইবে? গর্ভবতী অসহায় একটা মাইয়ামানুষ এত রাইতে রাস্তায় তো আর ছাইড়া দেওন যায় না। নিয়া চলো। যা অইবে দেহা যাইবেয়ানে।’
২৩
নুরজাহান বড় দুচিন্তায় পড়ে গেছে। একেক দিন মুস্তাফিজের ফিরতে দেরি হয় বটে। কিন্তু এত দেরি তো কখনোই হয় না। তার ওপর যেদিন দেরি হয়, সেদিন তিনি খবর পাঠান। আজ তো কোনো খবরও পাঠালেন না। দুশ্চিন্তার বোঝা একা বইতে না পেরে সে শরিফা বানুর ঘরে গিয়ে বলল, “আম্মা, আমনের পোলায় তো এহনো আইলো না। মোর ডর করতেয়াছে।’
শরিফা বানু দোয়া পড়ছিলেন। হাতের ইশারায় তাকে বসতে বলে তিনি দোয়া শেষ করলেন।
তারপর বললেন, ‘এত উতলা হওনের কোনো কারণ নাই। যেহেতু মুজাহিদও আহে নাই, তার মানে দুইজনে একলগেই আছে। আইয়া পড়বে।’ মুজাহিদও আসে নি, এ কথা শুনে কিছুটা শান্ত হলো নুরজাহান। নিজের ঘরে ফিরে গেল। তবে শাশুড়ির মতো অতটা নিশ্চিন্ত সে হতে পারে নি। তার অধিক চিন্তার দোষ আছে।
.
শরিফা বানুর বয়স খুব বেশি নয়। অতি অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বাপের বাড়ি-শ্বশুরবাড়ি দুটোই বেশ অবস্থাসম্পন্ন। অল্প বয়সেই মা হয়েছেন। চার ছেলে তিন মেয়ে ছিল তার। বড় মেয়ে দুটির বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে মুস্তাফিজ হয়েছেন ডাক্তার, মেজ ছেলে মুজাহিদের হোটেলের ব্যবসা, সেজ ছেলে মুস্তাকিম ঢাকায় সরকারি চাকরি করে, ছোট ছেলে মাহফুজ আলালের ঘরের দুলাল। কেবল টইটই করে ঘোরে, না করে পড়াশোনা, না করে কোনো কাজ। ছেলেরাও সবাই বিবাহিত।
শরিফা বানু মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বামী ও ছোট মেয়েকে হারিয়েছেন। তাদের লাশও খুঁজে পাওয়া যায় নি। তারপরও শক্ত ছিলেন। গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত খাওয়াতেন। বড় সাহসী নারী! বিচক্ষণও বটে। এই বয়সেও তাকে সবাই মান্য করে চলে। কিন্তু তাই বলে তিনি শুয়ে পড়ার পরও এত রাতে তার কেন ডাক পড়ল বোধগম্য হচ্ছে না। সাধারণত ছেলেরা বাড়ি ফিরতে দেরি করলে তিনি শুয়ে পড়েন। এরপর আর কেউ তাকে ডাকে না।
শরিফা বানু বিছানা ছেড়ে বসার ঘরে যেতেই দেখেন বাড়ির সকলে সেখানে জড়ো হয়েছে। ঘরের এক কোণে একটি অপরিচিত মেয়ে মাথা নিচু করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মাথায় ঘোমটা। মেয়েটি কে, এই প্রশ্নের আগে তার মনে প্রশ্ন জাগল, মানুষও এত সুন্দর হয়? এ যেন সাক্ষাৎ পরি! মুখশ্রী থেকে দ্যুতি ঠিকরে বের হচ্ছে। এমন রূপবতী তিনি আরেকটি দেখেন নি
ছেলেদের নয়, বউদেরও নয়, তিনি সরাসরি প্রশ্ন করলেন মেয়েটিকেই, ‘তুমি কে, মা?’
মেয়েটি একবার তার দিকে তাকিয়েই আবার মাথা নিচু করে ফেলল। মেয়েটির চোখে স্পষ্ট ভয় দেখলেন তিনি। তার প্রশ্নের উত্তর দিলেন মুস্তাফিজ।
তিনি বললেন, ‘মা, অর নাম জেসমিন। এতিম মাইয়া। স্বামী মারা যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা তাড়াই দিছে। বাপের বাড়ি বলতে কিছু নাই। বিয়ার আগে আশ্ৰিত আছিল। যাওয়ার কোনো জাগা নাই।’
মুজাহিদ দেখে তার বউসহ ভাইয়ের বউদেরও চেহারা থমথমে। যেন শরিফা বানু এখান থেকে সরলেই তাদের দুই ভাইয়ের কলিজা বের করে নেওয়ার অপেক্ষাতেই আছে তারা। তিনি দ্রুত বললেন, ‘এহন কাম খুঁজতাছে। তোমরা তো হেদিন কামের মানুষের কতা কইছিলা। হেইল্লাইগ্যা নিয়াইলাম। ও সব কাম জানে।’
মুজাহিদের স্ত্রী ময়না কড়া গলায় জানতে চাইল, ‘এত রাইতে তোমরা তারে কই পাইলা?’
মুস্তাফিজ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই মুজাহিদ বলল, ‘রাইত কই? মাইয়াডা বিয়ালে কাম খুঁজতে আমাগো দোকানে আইছিল। তা আমরা তো কাজের চাপে আগে বাইর অইতে পারলাম না। রাইত অইয়া গেল।’
মুজাহিদ যেহেতু এ কথা বলেই ফেলেছে, মুস্তাফিজের আর কিছু বলার রইল না। মেয়েটিকে এভাবে কাজের লোক বানিয়ে ফেলায় তিনি লজ্জিত।
শরিফা বানু সবার কথা চুপচাপ শুনে শেষমেশ বললেন, ‘আচ্ছা নুরজাহান, এখন সবাইর খাওনের ব্যবস্থা করো। আর মাইয়াডারে পিছের বারান্দার ঘরে থাকনের ব্যবস্থা করো। অর ব্যাপারে বাকিডা কাইল দেখমু।’
মূল বাড়ির পেছনের বারান্দায় একটা ছোট ঘরে কাজের মেয়েরা থাকত। আপাতত কোনো কাজের মেয়ে না থাকায় ঘরটি খালি পড়ে আছে। সেখানেই স্থান হলো জেসমিনের।
খাওয়াদাওয়ার পর মুস্তাফিজ ঘরে ঢুকতেই তাকে জেরা করতে শুরু করে দিল নুরজাহান।
‘এত দামি শাড়ি পরা, কাশ্মীরি শাল গায়ে, গলায় কানে সোনার জিনিস পরা সুন্দরী মাইয়া কাম খুঁজতে আইছে, এইডা আমারে বিশ্বাস করতে কও তুমি?’
মুস্তাফিজ বললেন, ‘তাইলে তোমার কী মনে হয়?’
রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে নুরজাহান বলল, ‘সত্য কইরা কও মাইয়াডা কেডা?’
মুস্তাফিজ ধৈর্যের সাথে বুঝিয়ে বললেন, ‘দেখো জাহান, মেয়েটার শ্বশুরবাড়ি বেশ অবস্থাসম্পন্ন আছিল। দামি শাড়ি সে পরতেই পারে। কিন্তু তারা অরে এক কাপড়ে বাইর কইরা দিছে। এখন কাজ না করলে খাবে কী?’
নুরজাহান সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তা এক বাড়ির আশ্রিত কামের মাইয়ার বড়লোকের ঘরে বিয়া ক্যামনে হইল?’
মুস্তাফিজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘এত কিছু তো আমি জিগাই নাই। তোমার জানার দরকার অইলে তুমি জিগাইয়া নিয়ো। আপাতত তোমার জেরা শেষ অইলে ঘুমাইতে আসো।’
মুস্তাফিজের সাথে নুরজাহানের বিয়ে হয়েছে আট বছর। তাদের সন্তানাদি হয় না। মুস্তাফিজ চিকিৎসার শেষ রাখেন নি। কিন্তু কোনো লাভ হয় নি। সন্তান না হওয়ার কারণে সব সময় হীনম্মন্যতায় ভোগে নুরজাহান। ভয়ে ভয়ে থাকে মুস্তাফিজ যদি আবার বিয়ে করতে চায়! জেসমিনকে সাথে করে নিয়ে আসাতে সেই ভয় আরেক ধাপ এগিয়ে গেছে।
শুধু নুরজাহান নয়, মুজাহিদের স্ত্রী ময়না, এমনকি মাহফুজের স্ত্রী পারুল ও জেসমিনের রূপ দেখে অনিরাপদ বোধ করছে। কারোর বিশ্বাস হচ্ছে না জেসমিন কাজ খুঁজতে এসেছিল!
২৪
বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে ক্লান্তিতে ঘুমে তলিয়ে গেল জেসমিন। টানা চার-পাঁচ দিনের মানসিক-শারীরিক ধকলে ভয়াবহ রকমের বিধ্বস্ত সে। কিন্তু সেই ঘুম দীর্ঘস্থায়ী হলো না। দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। স্বপ্নে দেখছিল, জয়নাল মির্জা রামদা নিয়ে রঞ্জুকে ধাওয়া করছেন। লাফিয়ে উঠে বসল জেসমিন। বুক ধড়ফড় করছে তার। রঞ্জুকে যখন স্বপ্নে দেখলই, ভালো কিছু দেখত! অদ্ভুত এক সুচালো ব্যথা বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠছে। চোখের জলে ভেসে যেতে লাগল। আর ঘুম এল না।
.
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে নামাজের পর শরিফা বানু এক কাপ চা খান। সাথে থাকে মুড়ি। এ সময় নিজের চা তিনি নিজেই তৈরি করেন। চা বানাতে যাওয়ার সময় তার মনে হলো জেসমিনকে যে ঘরে শুতে দেওয়া হয়েছে, সে ঘর থেকে অস্পষ্ট শব্দ ভেসে আসছে। তিনি এগিয়ে গিয়ে জেসমিনকে ডাকলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলল জেসমিন। তিনি বললেন, ‘কহন উঠছ?’
জেসমিন বলল, ‘একটু আগে।’
‘আচ্ছা, উঠছ যখন, মোর লগে আহো। কথা কই।’
জেসমিন তাকে অনুসরণ করল।
শরিফা বানু চুলা ধরাতে পাটখড়ি হাতে নিতেই জেসমিন হাত বাড়িয়ে বলল, ‘দেন খালাম্মা, মুই করি।’
শরিফা বানু হেসে বললেন, ‘তোমারে তো এহনো কোনো কামে নিয়োগ দেই নাই। আগে কাম দেই, হেরপর কইরো। এহন বহো।’
জেসমিন পিঁড়ি পেতে বসল। শরিফা বানু চা বসালেন, দুটো লেবুপাতা ছিঁড়ে দিলেন চায়ে। তারপর জেসমিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘রাইতে বালো ঘুম অয় নাই, না? অনেক ডরাইয়া আছ মনে অইতেয়াছে। এত ডর কিসের তোমার?’
জেসমিন মাথা নিচু করে আছে। শরিফা বানু বললেন, ‘মুখ না খুললে তোমার সমস্যা বুঝমু ক্যামনে?’
জেসমিনের কেন যেন মনে হলো এই মানুষটাকে সব বলা যায়। কিন্তু যে আশ্রয় দিয়েছে, সে যখন কিছু বিষয় গোপন করতে বলেছে, তখন তা গোপন রাখাই ভালো। এমনিতেও এই গ্রামের হালচাল সে জানে না। কিন্তু এভাবে বললে চুপ করেও থাকা যায় না। সে বলল, ‘আসলে আমার মাথার ঠিক নাই। চাইর দিন হয় আমার স্বামী মরছে। এহনো নিজেরে সামলাইতে পারি নাই। তার আগেই শ্বশুরবাড়িত্যা বাইর কইরা দিল।’
‘চাইর দিন!’
গলাটা আহত শোনাল শরিফা বানুর। বিস্ময় সামলে তিনি বললেন, ‘আমি ভাবছিলাম অনেক দিন বুঝি অইছে। তা তোমারে বাইর কইরা দিল ক্যা?’
জেসমিন একটু ভেবে বলল, ‘আমারে হেগো পছন্দ আছিল না। হেগো অনুমতি ছাড়াই উনি আমারে বিয়া করছিল।’
‘ও। তোমার বাচ্চাকাচ্চা আছে?’
জেসমিন মাথা নিচু করে বলল, ‘আছে, প্যাটে।’
অবাক হলেন শরিফা। বললেন, ‘কও কী! তুমি পোয়াতি! এই অবস্থায় তোমারে বাইর কইরা দিল? এরা মানুষ নাকি অন্য কিছু?’
জেসমিন হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল। শরিফার এ মুহূর্তে আর কিছুই জিজ্ঞেস করতে মন চাইল না। মেয়েটা একটু ধাতস্থ হোক। পরে জেনে নেওয়া যাবে। চা হয়ে গেছে। শরিফা এক কাপ চা জেসমিনের দিকে এগিয়ে দিতেই জেসমিন বলল, ‘আমার লাগবে না, খালাম্মা, আমনে খান।’
শরিফা বানু বললেন, ‘খাও তো, মাইয়া, কোন সময় যে ঘুমেইত্যা উঠছ, তার নাই ঠিক। এই সময় খিদা প্যাটে থাকতে নাই। মুড়িও নেও। বেইন্যা নাস্তা অইতে ম্যালা দেরি।’
জেসমিনের বুকের ভেতরটায় হাহাকার করে উঠল। আহা মায়া! এইটুকু মায়া এ জগতে কে কাকে দেখায়? তার সবচেয়ে ভরসা ও আদরের জায়গা তার বাবাই তো তার সাথে সর্বোচ্চ নিষ্ঠুরতা করেছে!
চা পর্ব শেষ করে শরিফা বানু জেসমিনকে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে কিছু পুরোনো শাড়ি ও আনুষঙ্গিক কাপড় দিলেন। ব্লাউজগুলো অনেক ঢোলা। অবশ্য তাতে কোনো অসুবিধা নেই, সুই-সুতোর ফোঁড় দিয়ে নিজের মাপের করে নিতে পারবে সে।
জেসমিন গর্ভবতী, এ কথা জেনে শরিফা বানু তাকে রান্নার কাজে নিয়োগ দিলেন। কোনো ভারী কাজ তাকে দেওয়া ঠিক হবে না।
খবর শুনে খুশি হলো ময়না ও পারুল। সবচেয়ে বেশি খুশি ময়না। যদিও রান্নাবান্নার কাজ তিন বউ মিলেই করে, তবু ময়নার ভাগে কাজ সবচেয়ে বেশি পড়ে। তাই সে কিছুটা নির্ভার বোধ করছে। কিন্তু এ খবরে মাথায় যেন বাজ পড়ল নুরজাহানের!
মুস্তাফিজ দুপুরে খেতে এসে দেখেন নুরজাহান কান্নাকাটি করে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। মুস্তাফিজ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন, ‘কী অইছে তোমার, এমনে কান্দ ক্যা? কোনো খারাপ খবর আছে নি?’
নুরজাহান ফোঁস করে উঠল, ‘ওই মাইয়া যে পোয়াতি, এর চাইয়া খারাপ খবর আর কী অইতে পারে?’
মুস্তাফিজের কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। তিনি পুনরায় জানতে চাইলেন, ‘তাতে খারাপের কী আছে?’
নুরজাহান দুহাতে মুস্তাফিজের শার্ট খামচে ধরে বলল, ‘হাছা কইরা কও, ওই বাচ্চা তোমার? গোপনে বিয়া কইরা অন্য জায়গায় রাখছিলা?’
‘ছি ছি, আস্তাগফিরুল্লাহ। এইডা তুমি কী কইলা?’
মুস্তাফিজ দারুণভাবে অপমানিত বোধ করলেন। নুরজাহান এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমার বাচ্চা অয় না দেইখা সবাই তো তোমারে আবার বিয়া করার কথা কয়। করতেই পারো, তুমি ব্যাডা মানুষ। ‘
রাগে-দুঃখে মুস্তাফিজের ইচ্ছা করছে নুরজাহানকে একটা চড় মারেন। কিন্তু এমন কাজ তিনি কখনো করেননি, করতে চানও না। নিজেকে সামলে নিয়ে তিনি বললেন, ‘তোমারে ভালোবাসি, সেই ভালোবাসা একটা বাচ্চার চেয়ে অনেক বড়, এইডা এহনো বুজলা না, জাহান!’
.
পরিকল্পনা অনুযায়ী কয়েক মাস চাকরি করে টাকা জমিয়ে মামুনের পড়াশোনা শুরু করার কথা। প্রতি মাসে বাড়িতে কিছু টাকা পাঠিয়েও যথেষ্ট জমিয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা দিয়ে পড়াশোনা শুরু না করে সংসার শুরু করল সে। ভালো পরিবেশে একটা ঘর ভাড়া করল। খাট-আলমারি, বিছানা-বালিশ, হাঁড়িপাতিল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সবকিছুই কিনল। রেহানা এত বড় ঘরের মেয়ে, তাকে তো আর যেনতেনভাবে রাখা যাবে না।
মামুন রেহানাকে নিয়ে সেই ঘরে ঢুকতেই রেহানার চোখ কপালে। পুরুষমানুষ এত গোছানো হয়, এ কথা তার জানা ছিল না। জানালায় রঙিন পর্দা, টানটান বিছানার চাদর; আর সবচেয়ে অবাক কাণ্ড, বিছানার ওপর একটা গোলাপ ফুলের তোড়া। রেহানা তোড়াটা হাতে নিয়ে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, ‘ফুল কি আমার লাইগা আনছেন?’
মামুন লজ্জা পেয়ে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল। রেহানা ফুলের গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে মামুনের কাছে এসে দাঁড়াল।
তারপর জিজ্ঞেস করল, “তাইলে স্টেশনে নিয়া যান নাই ক্যান? ওইহানেই তো আমনের লগে এত দিন পর দেহা অইল।’
‘ইয়ে মানে…।’
রেহানা হেসে বলল, ‘আমনের এত শরম যে মুই কই থুমু!’
এবার মামুন হেসে ফেলল। রেহানা সে হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। নিজের স্বামীর প্রেমে কয়বার পড়া যায়?
রেহানা ফুলগুলোকে টেবিলে রেখে বলল, ‘আমারে একখান ফুলদানি আইন্না দিয়েন। ফুলগুলা পানিতে রাখমু।’
নাইয়রি – ২৫
২৫
ঘুমানোর জন্য জেসমিনকে কিছু কাঁথা দেওয়া হয়েছিল। তাতে তার শীত মানে না। তাই শাল গায়ে কাঁথার ভেতর শোয় সে। বিষয়টা নজর এড়ায় নি শরিফা বানুর। তিনি তার পুরোনো একটা লেপ বের করেছেন। জেসমিনকে ডেকে সেটা দিয়ে বললেন, ‘শীতে কষ্ট করতাছস, তাও মোরে কস না। কেমন মাইয়া তুই? বয়স অইছে না? এহন কি আর এত দিকে খেয়াল রাকতে পারি? নে, এহনেইত্যা এই ল্যাপ গায় দিবি।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘লাগবে না, খালাম্মা। কাঁথা দিয়া মোর কাম চইলা যায়।’
শরিফা বানু ধমকে বললেন, ‘বেশি কথা কইস না, মাইয়া। নিতে কইছি, নিবি। সামনে বড় শীত আইতাছে। এইডা পুরান লেপ পইড়াই তো রইছে। এইগুলা কি কবরে লইয়া যামু?’
জেসমিন কাঁথার ওপরে লেপটা দিয়ে শুতেই শীতবোধ কমে গেল, আরাম লাগল। সত্যিই লেপের কাজ কি আর কাঁথায় হয়? মনে পড়ে গেল তার কত বাহারি কম্বল ছিল। একটা নরম লেপও ছিল। সেসব নিয়ে কি এখন তার মা কাঁদে? ওই জালিমদের মাঝে কেমন আছে তার দুঃখিনী মা? রঞ্জু বলেছিল ঢাকায় গ্রামের মতো এত তীব্র শীত পড়ে না, ঢাকার শীত আরামদায়ক। বড় শীতে তাকে ঢাকায় ঘুরতে নিয়ে যাবে। কিন্তু এমনই কপাল, সেই দিন আর এল না।
.
প্রতি মাসের শুরুতেই মামুন খরচাপাতির একটা হিসাব করে ফেলে তার পকেট ডায়েরিতে। কোন খাতে কত টাকা খরচ হবে, সব লিখে নেয়। সেই হিসাবটা একদিন রেহানার হাতে পড়ে গেল। সে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। রেহানা ভেবেছিল সে যেহেতু মামুনের কাছে চলেই এসেছে, এখন আর মামুন তাকে আলাদা করে হাতখরচা দেবে না। ঠিক একইভাবে, বাড়িতেও আগের চেয়ে কম টাকা পাঠাবে, যেহেতু এখন আর সেখানে রেহানা থাকে না। তার ওপর রেহানা আসায় এখানে খরচ বেড়েছে। কিন্তু না, তার এবং বাড়ির জন্য আগের পরিমাণের টাকাই বরাদ্দ রেখেছে মামুন। যেহেতু এখানে বাড়িভাড়া ও সংসার খরচ বাবদ নতুন একটি খরচ যুক্ত হয়েছে, তাই কমিয়ে দিয়েছে তার সঞ্চয়ের পরিমাণ, যে সঞ্চয় থেকে তার পড়াশোনা শুরু করার কথা। ডায়েরিটা যেমন ছিল, তেমনভাবে রেখে দিল। তারপর মনে মনে বহু পরিকল্পনা করে ফেলল।
.
পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো সেদিন, যেদিন মামুন বেতন পেল। মামুন ঘরে বসে তার সামনেই টাকা ভাগাভাগি করছিল। সব ভাগাভাগি শেষে কিছু টাকা তার হাতে দিয়ে বলল, ‘এই নেও তোমার হাতখরচা।’
রেহানা টাকাটা হাতে নিয়ে ভাঁজ করে মামুনের হাতের মধ্যে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘আমনের ধারে আছি। হাতখরচা লাগব না। কত খরচ বাড়ছে। এই টাহা আমনে সঞ্চয় করবেন। পড়ালেহা করার লাইগা মোরে বিয়া করলেন। আর এহন মোর লাইগাই পড়ালেহা বন্ধ, এইডা কেমন কথা?
মামুন হেসে বলল, ‘আরে, না না। বন্ধ না। ভর্তির টাকা জোগাড় অইলেই শুরু করমু।’
রেহানা মন খারাপ করে বলল, ‘জোগাড় তো অইছিলই। মোর এহেনে আগুনের পাগলামির লাইগ্যা সব নষ্ট অইলো।’
মামুন রেহানার গাল টিপে বলল, ‘আরে, মনখারাপ করে না, টাকা আবার জইম্যা অইয়া যাইবে।’
রেহানা কড়া গলায় বলল, ‘শোনেন, আমার হাতখরচার পুরা টাহা আমনে পড়ালেহার লাইগ্যা জমাইবেন। আমার কিছু লাগলে আমনের ধারেইত্যা চাইয়া নিমু।’
মামুন হেসে বলল, “আচ্ছা।’
রেহানা আবার একইভাবে বলল, ‘আর বাড়িতেও এত টাহা পাডানের দরকার নাই। গেরামে এত খরচ কিয়ের?’
মামুন অবাক হয়ে বলল, ‘কী কও, এতগুলা মাইনষের সংসার খরচ কি কম?’
রেহানা আঙুলে চুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল, ‘এতগুলা কই? মানুষ তো মোডে দুইজন।’
‘মানে?’
‘আমনে টাহা পাডানি শুরু করার পরপরই আম্মায় ভাইজানেগো আলাদা কইরা দিছে। হেরা কত কষ্ট কইরা চলতাছে। তাও ভালো যে ভাইজানেগো এহন কাম আছে। নাইলে যে কী অইতো!’
মামুনের মাথা ঘুরছে। এটা কীভাবে সম্ভব! যদি ভাইজানদের আলাদাই করে দেন, তাহলে এত টাকা দিয়ে তারা করেন কী? সে রেহানার কাছে জানতে চাইল, ‘এই কথা তুমি মোরে আগে কও নাই ক্যা?’
রেহানা ঝট করে বানিয়ে বলল, ‘আম্মায় কইতে মানা করছিল। ডরে কই নাই।’
মামুন ধমকে উঠল, ‘কিসের ডর? কী কইতে চাও তুমি? তুমি জানো না, আমি চাকরিতে ঢোকার আগপর্যন্ত পুরা সংসারটা বছরের পর বছর বড় ভাইজান চালাইছে? তার এই বিপদের খবরটা তোমার আমারে দেওয়ার দরকার মনে অয় নাই?’
রেহানা মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, ‘মাফ করেন আমারে। আম্মায় ডর দেহাইছে। মুই কইতে সাহস পাই নাই। এমনেই আমনে থাকতেন না, মোর তো হেগো লগে তাল মিলাইয়া চলন লাগছে। মুই কী করমু?’
মামুন আর কিছু বলল না। তার কান্না পেল। ভাইদের সাথে কতবার চিঠি আদান-প্রদান হলো, কেউ একটিবার তাকে খবরটা দিল না! প্রচণ্ড অভিমান ও হলো তাদের প্রতি।
২৬
জেসমিন প্রতিদিন ভোরবেলা সারা দিনের রান্নার পানি তুলে ফেলে। এতে কাজ অনেকটা এগিয়ে যায়। রান্না করার মাঝে বারবার উঠে পানি আনতে যেতে তার ভালো লাগে না। তাই এই ব্যবস্থা।
প্রতিদিনের মতো আজও পানি আনতে যাচ্ছিল জেসমিন। পারুল তখন উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিল। যেহেতু জেসমিন রান্নার কাজ করে, তাই অন্যান্য কাজ তিন বউ সমঝোতার মাধ্যমে ভাগাভাগি করে নিয়েছে। পারুলের ভাগে যেসব কাজ পড়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ভোরবেলায় উঠান ঝাড়ু দেওয়া। জেসমিনকে দেখেই পারুল ডাক দিল। জেসমিন কাছে যেতেই সে বলল, ‘হোনো, উঠানডা ঝাড়ু দিয়া দিবা? আমার পোলা দুধ খাওনের লাইগ্যা কানতাছে।’
‘দেন ভাবি, সমেস্যা নাই।’
জেসমিন ঝাড়ু দিতে শুরু করতেই পারুল নিজের ঘরে গেল। তার ছেলে এখনো ওঠেনি। সে-ও একটু লেপের ভেতর ঢুকে গড়িয়ে নিল।
এই ঘটনাটা ঘরের জানালা দিয়ে দেখল নুরজাহান। তারপর সকালের নাশতা খাওয়ার পর যখন ময়না বাসনকোসন ধুতে পুকুরে যাচ্ছিল, তখন নুরজাহান বলল, ‘জেসমিন, বাজার আসার আগপর্যন্ত তো তোমার কাম নাই। বাসনগুলা তুমি ধুইয়া আনো।’
‘আচ্ছা ভাবি, যাইতাছি।’
এঁটো বাসনকোসন নিয়ে জেসমিন পুকুরে চলে গেল। খাবার ঘরে তখন কেবল নুরজাহান, ময়না ও পারুল। জেসমিন কিছুটা দূরে যেতেই ময়না জানতে চাইল, ‘কোনো মতলব আঁটতাছ, ভাবি?’
নুরজাহান বলল, ‘হ। রান্দন আর এমন কি কাম? খালি দুইডা ভাত রাইন্দা ও মাগনা খাইবে আর কাম কইরা মরমু মোরা? ক্যা? বেবাক কাম অরে দিয়া করামু। যেমনে বেইন্যাকালে পারুল উডান ঝাড়ু দেওয়াইছে।’
‘কও কী!’
ময়না অবাক! পারুল হেসে বলল, ‘ও মোর খোদা! হগুনের চক্ষু। তোমার চক্ষু ফাঁকি দিয়া কিচ্ছু করোন যায় না গো ভাবি।’
এবার নুরজাহান আর ময়নাও হেসে দিল।
.
এ মাসে একটি টাকাও পাঠায় নি মামুন। হালিমা ভেতরে-ভেতরে আক্রোশে শেষ হয়ে যাচ্ছেন। বউ যাওয়ার সাথে সাথেই টাকা পাঠানো বন্ধ! এই দিন দেখার জন্য কি ছেলেকে জন্ম দিয়েছিলেন?
জমানো টাকা খরচ করে চলছেন। কিন্তু এভাবে কত দিন! ছেলেকে যে চিঠি পাঠাবেন, তা-ও পারছেন না। কারণ, তিনি লিখতে জানেন না। এ বাড়িতে লিখতে জানে কেবল মুকুল, মিনা আর রেনুর ছেলে ইমরান ও মেয়ে নীলা। মুকুল বা মিনাকে বলতে লজ্জা লাগছে। ইমরান ছটফটে ছেলে, কোনো কথাই গায়ে লাগায় না। ও লিখে দেবে না। একমাত্র নীলা দিলে দিতে পারে। তিনি নীলাকে ডেকে আনলেন।
নীলা চিঠি লিখে দিল, তবে চিঠির বিষয়বস্তু তাকে অবাক করল। সে দাদিকে কিছুই বলল না, এসে রেনুকে বলল, ‘মা, ছোট কাকায় না দাদা-দাদির টাহা দেওয়া বন্ধ কইরা দেছে।’
রেনু অবাক হয়ে বলল, ‘কস কী? তুই ক্যামনে জানলি?’
‘দাদি চিডি লেহাইছে আমারে দিয়া।’
‘কয় মাস ধইরা টাহা দেয় না?’
‘এই মাসেই দেয় নাই খালি।’
‘তার মানে তোর কাকি যাওনের পর।
‘হয়।’
রেনু নীলার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘থাক মা। এই সব নিয়া ভাবা লাগবে না। তোমার কাকার নতুন সংসার। ওই দিকে ম্যালা খরচ হইছে। পরের মাসে দেবেয়ানে। তুমি কাউরে কইও না।’
‘আচ্ছা।’
.
মুকুলের স্কুলের বেঞ্চ বানানোর কাজটা শেষ। এখন আবার নতুন কাজ খুঁজছে। কাজ খুঁজতে বেরিয়ে সেদিন দেখে খালের পানি প্রায় শুকিয়ে এসেছে। শীতে খাল-বিলের পানি শুকিয়ে এলে কাদার ভেতরে কিছু মাছ লুকিয়ে থাকে। মুকুল আজ সেই সব লুকিয়ে থাকা মাছ ধরতে গিয়েছিল। প্রচুর মাছ ধরা পড়েছে। বাড়িতে এসে ঘরে না ঢুকেই সে মাছগুলো কুটতে বসল।
মিনা ঘর থেকে দেখতে পেয়ে এসে বলল, ‘একি, তুমি মাছ কুটতে বইলা ক্যা? সরো, আমি কুড়ি।
মুকুল পাতিলের ঢাকনা সরিয়ে মাছের পরিমাণ দেখিয়ে বলল, “অনেক মাছ, এই প্যাট লইয়া বইয়া এত মাছ কুটতে পারবা না।’
মিনা বলল, ‘ও বাবা, এত মাছ! এত মাছ ধরছ ক্যা? বেহুদা নষ্ট অইবে।’
মুকুল বলল, ‘কিচ্ছু অইবে না। আব্বা-আম্মারে দিমু, ভাবিরে দিমু। আমাগোগুলা ভাইজ্জা রাখমু। একটাও নষ্ট অইতে দিমু না দেইখ্য।’
‘আব্বা-আম্মারগুলা কুইট্যা দেওন লাগবে না। এমনেই দিয়া আহো।’
মুকুল হেসে বলল, ‘থাক, বাদ্দেও। একদিন কুইট্যা দেলে কিছু অইবে না।’
‘তহেলে ভাবির বঁড়ি লইয়া আহি। একলা পারবা না।’
মুকুল কড়া গলায় বলল, ‘এই! মানা করছি না মুই?’
মিনা বলল, ‘তুমি মানা করলেই মোর হেই কতা হোনা লাগবে?’
মুকুলকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মিনা চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বঁটি হাতে একজন নয়, তিনজনকে আসতে দেখা গেল। মিনা, রেনু আর রেনুর মেয়ে নীলা। মুকুলের কথা না শুনলেও রেনুর কথা শুনতে হলো মিনাকে। সে মিনাকে মাছ কাটতে দিল না। রেনু ও নীলা হাত লাগানোতে দ্রুতই মাছ কাটা হয়ে গেল মুকুলের।
.
রাতে শুতে গিয়ে মিনা বলল, ‘এত আদর কইত্যা আইলো আমার লাইগ্যা?’
মুকুল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কী কইতে চাও, আমি তোমারে আদর করি না?’
‘করো, কিন্তু মধু যখন প্যাটে আছিল, কোনো দিন মোর কোনো কাম কইরা দিছ? কিসে মোর কষ্ট অইবে, কিসের অইবে না, হেইয়া ভাবছ?’
মুকুল হেসে বলল, ‘ও, এই বিষয়! তহন তো সবাই একলগে আছিলাম। আমাগো আলাদা সংসার আছিল না। ভাবিই তোমার সব কাম কইরা দিত আলাদা অইলেও ভাবি হয়তো এহনো সব কইরা দিত। কিন্তু বেচারি নিজেই এহন অসুস্থ!’
‘হইতে পারে। তয় মোর ধারণা, যাত্রাপালা ছাড়োনের পর তুমি একটু বড় অইছো। দায়িত্ব বাড়ছে।’
মুকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হ, যত দোষ যাত্ৰা ঘোষ!’
মিনা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। মুকুল বলল, ‘আচ্ছা মিনা, তোমার কোনো দিন মোর যাত্রা দেখতে মনে চায় নাই?’
‘এহ্, না। ওইয়া ছাড়ছো, আল্লাহয় বাঁচাইছে মোরে। অ মোর দেহা লাগবে না।’
‘কত মাইয়া মোর যাত্রা দেইখ্যা মোর প্রেমে পড়ছে, জানো?’
‘এহ্! যেই না চেহারা, নাম রাকছে পেয়ারা।’
মুকুল হেসে বলল, “তারা চাইয়া পায় নাই। আর তুমি পাইয়া মূল্য দিলা না।’
‘তাইলে যাও, তাগো কাছেই যাও।’
মিনা রাগ হয়ে উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়ল। মুকুল হাসতে হাসতে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরল। মিনা সরিয়ে দেয়, সে আবার ধরে।
২৭
জেসমিন সারাক্ষণ একটা ঘোরের ভেতর থাকে। রঞ্জুর ঘোর। রঞ্জু কবে কী বলেছিল, কবে কী করেছিল, সেসব চলমান ছবির মতো ভাসতে থাকে চোখের সামনে। যেদিন প্রথম পেটের ভেতর বাচ্চাটা নড়ে উঠল, সেদিন থেকে সে কল্পনা করতে থাকে রঞ্জু থাকলে কী করত এখন? কল্পনার জীবনটা ভীষণ সুন্দর! এই ঘোরের মধ্যেই সে তার সকল কাজকর্ম সম্পন্ন করে। কীভাবে করে, সে নিজেও জানে না। পৃথিবীর এক নম্বরের ফাঁকিবাজ হলেও ভাগ্যিস রান্নাটা জানত! মা বকাবকি করে কাজ শেখাত। নাহয় আজ কী যে হতো!
ভুলভাল যে একেবারেই হয় না, তা নয়। বকাঝকাও কম শোনে না বাড়ির গৃহিণীদের মুখে। এই তো সেদিন তরকারিতে লবণ কম হওয়াতে নুরজাহান যা নয়, তা-ই বলল। বলাটাই স্বাভাবিক। ভুল তো করেছে সে। রান্না করা তার কাজ। কাজে গাফিলতি করা উচিত হয় নি।
জেসমিনের কাজ শেষ হলে এই যে নিজের ঘরে ঢোকে আর বের হয় না। রঞ্জুর চিঠিটা সে শত শতবার পড়ে, লেখাগুলোর ওপর হাত বোলায়। এই একটা জিনিসই তো আছে! শীত শেষে বসন্ত এল। প্রকৃতিতে নানান রঙের ছটা! কিন্তু তার জীবনে কোনো রং নেই। কাঁদতে কাঁদতে ভাবে, চোখের জল শুকায় না কেন? কোথায় থাকে এত অশ্রু?
আজও তা-ই করছিল। হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ায় হন্তদন্ত হয়ে চিঠিটা রাখল। চোখ মুছে ঘোমটা দিয়ে দরজা খুলল। দেখে শরিফা বানু দাঁড়িয়ে। জেসমিন বলল, ‘কিছু লাগবে, খালাম্মা?’
শরিফা বানু ভেতরে এসে বসলেন। জেসমিন তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। শরিফা বানু জেসমিনের হাত ধরে তাকে পাশে বসিয়ে বললেন, ‘এত কানলে কি স্বামীরে ফিরা পাবি?’
জেসমিন মাথা নিচু করল। শরিফা বানু বললেন, ‘যে বাচ্চারে বাঁচানের লাইগ্যা এত কষ্ট, সেই বাচ্চার সুস্থতার কথা ভাবা লাগবে না? বাচ্চা প্যাটে নিয়ে এত কান্দাকাটি করলে বাচ্চার ক্ষতি অইতে পারে। তুই কি হেইয়া চাস?’
জেসমিন মাথা নেড়ে না বলল। শরিফা বানু বললেন, ‘হেলে এহনেইত্যা কোনো কান্দাকাড়ি না। যে গ্যাছে, হে তো গ্যাছেই। যে আছে, যে আইতেয়াছে, হের কতা ভাব।’
জেসমিন ঘাড় কাত করে সম্মতি দিল। শরিফা বানু ধমকে বললেন, ‘ওই ছেরি, খালি মাতা ঝুলাস ক্যা? মুখ নাই লগে?’
জেসমিনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। তার মা-ও তো এভাবেই ধমকাত। সে বলল, ‘আচ্ছা, খালা। আমনে যেইয়া কইবেন, হেইয়াই করমু।’
শরিফা বানু কড়া গলায় বললেন, ‘আর এক দিনও যদি কান্তে দেহি, তয় সকাল-বিকাল থাপড়াইয়া এক্কালে নলের লাহান সোজা কইরা দিমু বেহাংরা মাইয়া।’
শরিফা বানু চলে যাওয়ার পর জেসমিন নিজের পেটে হাত বোলাল। ভাবতে লাগল, সত্যিই কি কাঁদলে পেটের বাচ্চার ক্ষতি হয়? তাহলে সে কাঁদবে না। শত কষ্ট হলেও কাঁদবে না। এই একটা মানুষের জন্যই তো সে এখনো বেঁচে আছে। ওর জন্য সবকিছু পারতে হবে তাকে।
জেসমিন আসলেই জানে না কী করলে বাচ্চা ভালো থাকবে আর কী করলে ক্ষতি হবে। শরিফা বানু ছাড়া এই বাড়ির কেউ তার সাথে কথা বলে না। তিনি মুরব্বি মানুষ, তাকে সব কথা জিজ্ঞেস করতেও লজ্জা লাগে। সে কি খারাপ মা? সে কি পারছে না বাচ্চার খেয়াল রাখতে?
.
ঘর লেপাপৌঁছার সময় হয়েছে। গতবার নুরজাহানের পরিকল্পনা ছিল কাজটা জেসমিনকে দিয়ে করাবে। কিন্তু সেদিনই শরিফা বানু উঠোনে বসে হলুদ-মরিচ শুকোলেন। তাই তাদেরই করতে হলো। কিন্তু এবার শরিফা বানু বাড়ি নেই। ঢাকায় সেজ ছেলের সন্তান হয়েছে। তাকে দেখতে গিয়েছেন। এই সুযোগে নুরজাহান বাড়ির সব কাজ তো জেসমিনকে দিয়ে করাচ্ছেই, আজ ঘরও লেপতে দিয়েছে।
ঘরের মেঝে কিংবা পিঁড়া কীভাবে লেপতে হয়, জেসমিন তা জানে না। কিন্তু সে দেখেছে। যেমনটি দেখেছে, তেমনভাবেই করার চেষ্টা করল। কিন্তু হচ্ছিল না। নুরজাহান এসে বলল, ‘কি লো, জেসমিন? এইপিলে নি ঘর লেপে? তুই না মাইনষের বাড়ি কাম করতি? হেই বাড়ি কোনো দিন ঘর লেপোস নাই?’
জেসমিন বলল, ‘ভাবি, হেইবাড়ি আরেকজন ঘর লেপত। আমনে মোরে ইকটু দেহাইয়া দেন? একবার দেহাই দিলেই মুই পারমু।’
নুরজাহান আক্রোশে ফেটে পড়ল। জেসমিনের চুলের মুঠি ধরে টেনে উঠিয়ে বলল, ‘এত বড় সাহস তোর! মোরে হুকুম দেস কোন সাহসে? মোর স্বামীরডা খাইয়া-পইরা রইছস, আবার মোরে হুকুম দেস!’
জেসমিন এত ব্যথা পেল যে নিজেকে সংযত রাখতে পারল না। চিৎকার করে উঠল।
নুরজাহান এক হাতে চুল ধরে আরেক হাতে জেসমিনকে চড় মেরে বলল, ‘নাটক করোস? কাম না পারার নাটক? ঘর লেপতে কি মন্ত্র জানা লাগে?’
চেঁচামেচি শুনে ময়না ও পারুল যে যেখানে ছিল, দৌড়ে এল। জানালা দিয়ে অলস শুয়ে থাকা মাহফুজও উঁকি মারল।
‘কোন জমিদারের ঝি তুই যে ঘর লেপতে পারবি না?’
এ কথা বলে নুরজাহান জেসমিনকে ধাক্কা দিল। সে ময়নার গায়ের ওপর গিয়ে পড়ল। ঠিক তখন নুরজাহান দেখতে পেল মুস্তাফিজ বাড়িতে ঢোকার রাস্তায় দাঁড়িয়ে। এমতাবস্থায় নুরজাহানের ভয় পাওয়ার কথা। কিন্তু রাগে তার শরীরের রক্ত গরম হয়ে আছে। তাই হয়তো ভয় পেল না। তবে আর মারলও না। গজরাতে গজরাতে নিজের ঘরে চলে গেল। পারুলও চলে গেল। ময়নারই একমাত্র মায়া হলো জেসমিনের জন্য। আসলে জেসমিনের জন্য নয়, জেসমিনের বাচ্চাটার জন্য। ভয়ে তার শরীর এখনো কাঁপছে, এই ভেবে যে সে যদি এখানে না দাঁড়াত আর জেসমিন তাকে না ধরত, তাহলে আজকে একটা বড় বিপদ হয়ে যেতে পারত! দুই সন্তানের মা হয়েছে সে। একটা নষ্ট হয়েছে। সে বোঝে মায়ের কী কষ্ট।
সে বলল, ‘আহো, মুই দেহাইয়া দেই।’
জেসমিনকে ঘর লেপা শিখিয়ে দিয়ে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়ল ময়না। নুরজাহান যদি দেখে তাহলে তাকে শত্রু বানিয়ে ফেলতে দুবার ভাববে না। কী দরকার জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করার!
.
নুরজাহান বিছানার ওপর পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে। মুস্তাফিজ তার সামনে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলে নি। একপর্যায়ে মুস্তাফিজই কথা শুরু করলেন।
জানতে চাইলেন, ‘মাইয়াডার গায়ে হাত তুললা ক্যা?’
নুরজাহান গজগজ করতে করতে বলল, ‘মোর ইচ্ছা। কারও কাছে জবাবদিহি করার ঠ্যাকা পড়ে নাই।’
মুস্তাফিজ শক্ত মুখে বললেন, ‘কাজটা ঠিক করো নাই, জাহান।’
নুরজাহান বিছানা থেকে নেমে এল। মুস্তাফিজের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘এহন কী করতে অইবে? নাহে খত দেতে অইবে? দিমু না। কী করবা? বিয়া করবা অরে? যাও করো।’
মুস্তাফিজকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নুরজাহান বেরিয়ে গেল। মুস্তাফিজ চেয়ার টেনে বসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নুরজাহানের পেছন পেছন গেলেন না। যদি যেতেন, তাহলে দেখতে পেতেন নুরজাহান শুধু ঘর থেকে নয়, বাড়ি থেকেই বেরিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে ঘরের পিঁড়া লেপতে লেপতে আড়াল থেকে সব শুনতে পেল জেসমিন। এবার বুঝল নুরজাহান কেন তার ওপর খেপে আছে। অসহায় লাগল তার। কী করবে সে এখন?
২৮
মুস্তাফিজ দুপুরে খেতে এসেছিলেন। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটি ঘটে যাওয়ায় না খেয়েই চলে গেলেন। নুরজাহান বাড়িতে নেই, এই বিষয়টি বাড়ির লোকেরা টের পেল আরও পরে। তৎক্ষণাৎ মুজাহিদ গিয়ে মুস্তাফিজকে খবর পাঠাল। মুস্তাফিজ বিচলিত হলেন না। তিনি জানেন নুরজাহান বাপের বাড়ি গেছে। তার যাওয়ার জায়গা ওই একটিই।
মুস্তাফিজ আজ হাসপাতালের ডিউটি শেষ করে চেম্বারে আর গেলেন না। সোজা শ্বশুরবাড়ি রওনা দিলেন।
মুস্তাফিজের শ্বশুর আজমল তালুকদার পাকিস্তান আর্মিতে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। ভীষণ প্রতাপশালী লোক। মুস্তাফিজ তাকে সম্মান করেন। কিন্তু ভদ্রলোক মেয়ে-অন্তঃপ্রাণ। তাই যতবার নুরজাহান রাগ করে চলে আসে, মুস্তাফিজ লজ্জায় পড়ে যান। তবে সেই লজ্জা থেকে তিনিই বাঁচিয়ে দেন। নুরজাহানকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মুস্তাফিজের সাথে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু এবার ঘটনা ঘটল ভিন্ন। নুরজাহান সামনে আসে নি। সে নাকি আসবে না। কখনো ফিরে যাবে না ও বাড়িতে।
আজমল তালুকদার মুখ শক্ত করে বসে আছেন। মুস্তাফিজ মাথা নিচু করে বসে আছেন তার সামনে। আজমল তালুকদার বললেন, ‘মুস্তাফিজ, তোমরা ভালোবেসে বিয়ে করছিলা। এই সব সস্তা আবেগ আমার কোনোকালে পছন্দ না। কিন্তু মেয়ের জন্য আমার সকল পছন্দ যেমন জলাঞ্জলি দিতে পারি, তেমনি সকল অপছন্দও মেনে নিতে পারি। মেয়ের মুখের দিকে তাকাইয়া আমি তোমাদের বিয়ে দিলাম। ভালো কথা, তোমরা সুখেই ছিলা। কিন্তু একটা বাচ্চার জন্য ভালোবাসা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল, এটা কেমন কথা?’
মুস্তাফিজ চুপ। তিনিই আবার বললেন, ‘তুমি না আমারে বলছিলা নুরজাহানের বাচ্চা হবে না, এটা তোমার জন্য কোনো সমস্যা না। তাইলে এখন সমস্যা হইল কীভাবে? আচ্ছা যাক, বুঝলাম সমস্যা হইছে। তোমার বাচ্চা লাগলে আবার বিয়া করবা, ভালো কথা। কিন্তু আগে তো আমার মেয়ের সাথে সম্পর্ক ভাঙতে হবে। ওর কোনো কিছুর অভাব পড়ে নাই যে সতিনের ঘর করবে।’
মুস্তাফিজের রাগ হয়, প্রচণ্ড রাগ হয়! আজমল তালুকদার বলেন, ‘কী ব্যাপার, তোমার মুখে কোনো কথা নাই কেন? তুমি কি চুপ করে বসে থাকার জন্য আসছ নাকি?
মুস্তাফিজ সব সময় শ্বশুরকে সমীহ করে কথা বলেন। এই বোধ হয় প্ৰথম তিনি একটু কড়া জবাব দিলেন, ‘আব্বা, আপনে জিজ্ঞেস তো করবেন কী হয়েছে। একতরফা আপনের মেয়ের কথা শুনে একটা বিচার করে ফেলবেন, তা তো হয় না।’
আজমল তালুকদার ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইলেন, ‘কী বলতে চাও তুমি?
‘আমার আর নুরজাহানের মধ্যে বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কোনো সমস্যা কখনোই ছিল না। এমনকি আমার আম্মা পুরান দিনের মানুষ হইয়াও এ বিষয়ে নুরজাহানকে কখনো কিছু বলে নাই। মাফ করবেন, আজকে আমি আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি, সমস্যাটা আপনার মেয়ের মানসিক। সে নিজেই বাচ্চা হবে না ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে থাকে। এই পৃথিবীতে সবার বাচ্চার প্রয়োজন নাই, এটা আমি তাকে কিছুতেই বোঝাতে পারি না। দুনিয়ার সকল মেয়েকে নিয়ে সে আমাকে সন্দেহ করে। বাড়ির কাজের লোকেদের সন্দেহ করতেও ছাড়ে না। গত বছর থেকে তার নতুন চিন্তা মনে এসেছে আমি বুঝি আবার বিয়ে করব। এ কথা কেন তার মনে হয়েছে, আমি জানি না। আমি এমন কোনো কাজ কখনো করি নি, যাতে তার এ রকম মনে হতে পারে।’
আজমল তালুকদার যারপরনাই বিস্মিত। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নাকি এক মেয়েকে নিয়ে আসছ বাড়িতে?’
মুস্তাফিজ বললেন, ‘তা থেকে কী প্রমাণ হয়, আব্বা? বাড়িতে কাজের লোক নাই। একটা এতিম, তার ওপর বিধবা, অসহায় মেয়ে কাজ খুঁজতে আসছিল, আমি বাড়িতে নিয়ে আসি। কারণ, আমাদের কাজের মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাড়ির সব কাজ ওদের তিন বউয়ের করতে কষ্ট হয়ে যায়। এটা নিয়ে নুরজাহান এত বড় লজ্জায় ফেলবে জানলে তো আনতাম না। এখন আমাকে কী করতে হবে, বলেন? মেয়েটাকে কি বাড়ি থেকে বের করে দিতে হবে?’
আজমল তালুকদার এবার লজ্জিত বোধ করছেন। মেয়ে তো আগেও কতবার রাগ করে চলে এসেছে কিন্তু এমন পাগলের মতো কান্নাকাটি কখনোই করে নি। মেয়ের অমন কান্না দেখে তিনি নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন নি। হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে ছেলেটাকে কতগুলো কঠিন কথা শুনিয়ে ফেললেন! আগে তো খোঁজ নিয়ে দেখা উচিত ছিল। বয়সের সাথে সাথে কি তার জ্ঞানবুদ্ধি কমে যাচ্ছে?
তাকে চুপ থাকতে দেখে মুস্তাফিজ বললেন, ‘মেয়েটাকে আমি আর মুজাহিদ বাড়িতে নিয়ে আসি, এই পর্যন্তই। এরপর আজ অবধি তার সাথে আমার একটা কথাও হয় নাই। আমার আম্মা তাকে জায়গা দিছেন, রান্নার কাজে দিছেন। আম্মা ঢাকা গেছেন। ফিরে এলে নাহয় বলব মেয়েটার অন্য কোনো ব্যবস্থা করতে।’
আজমল তালুকদার মুস্তাফিজের কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘কিছু মনে কইরো না, বাবা। মেয়ের কান্না দেখে বোধবুদ্ধি লোপ পাইছিল। বড় হওয়ার পর কোনো দিন ওরে এইভাবে কানতে দেখি নাই।’
‘কিছু মনে করি নাই, আব্বা। কালকে আমার ডিউটি আছে। রাত বাড়ার আগে আমি ওরে নিয়ে রওনা দিতে চাই। আপনে একটু দেখেন।
আজমল তালুকদার কিছুক্ষণের মধ্যেই মেয়েকে বুঝিয়ে মুস্তাফিজের সাথে পাঠিয়ে দিলেন।
পথে কেউ কোনো কথা বলল না। কথা বলার কোনো আগ্রহ মুস্তাফিজের নেই। নুরজাহান আজকে যা করেছে তা জঘন্য। সে শুধু তাকে ভুলই বোঝে নি, এ বাড়ি এসে বাবাকেও ভুল বুঝিয়েছে। তাকে ছোট করেছে। নুরজাহানের এই সব কাজ তার খুব অপছন্দ। অযৌক্তিক সন্দেহ, অহেতুক হিংসাও অপছন্দ। অথচ তিনি এই মানুষটাকেই ভালোবাসেন। এই মানুষটাকে ছাড়া একটা দিনও অতিবাহিত করতে চান না। ভালোবাসার মতো এত অসহ্যকর আর অসহায় অনুভূতি সম্ভবত আর একটিও নেই।
.
রাত বাড়ছে। ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে জেসমিন। দুপুরবেলার ঘটনাটা কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখের পলকে ঘটে গেছে। তারপরও সে যন্ত্রের মতো সব ঘর লেপেছে, সবার কাপড় ধুয়েছে, উঠোন ঝাড়ু দিয়েছে, হাঁস-মুরগি খোপে তুলেছে, আগামীকালের রান্নার লাকড়ি জোগাড় করে রেখেছে, আরও কত কী! কিন্তু এখন ভেবে ভয় হচ্ছে যে ওই মুহূর্তে ময়না ওখানে না থাকলে কিংবা তাকে ধরে ফেলতে না পারলে সে পড়ে যেতে পারত। পেটের বাচ্চার ক্ষতি হতে পারত! আজকের ভয়ে জেসমিন কাঁদতেও ভুলে গেছে। থেকে থেকে শুধু কাঁপছে। নুরজাহান যে কাল বা পরশু আবার চড়াও হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। শরিফা বানুও এ সময় বাড়ি নেই। কী করবে সে? আবার পালাবে? তখন তো খুব সহজেই পালিয়ে ছিল। কিন্তু এখন এই সাত মাসের পেট নিয়ে কীভাবে পালাবে? কোথায় পালাবে? বাচ্চাটাকে কীভাবে নিরাপদে এই পৃথিবী দেখাবে? একটু শান্তি কি সে পাবে না? নাকি নসিবের সব শান্তি শেষ করে ফেলেছে এই ১৭ বছরের ছোট্ট জীবনে?
২৯
রাত গভীর। চারদিক সুনসান, পিনপতন নীরবতা। অন্ধকার ঘরে দুটি মানুষের নিশ্বাসের শব্দ কেবল। দুজনের কারও চোখে ঘুম নেই। বাড়ি ফিরেও মুস্তাফিজ নুরজাহান কেউ কারও সাথে কথা বলে নি। হাঁসফাঁস লাগছে মুস্তাফিজের। একসময় তিনি নুরজাহানকে বুকে টেনে নেন। তারপর বলেন, ‘ক্যান যে এমন করো তুমি, জাহান!’
নুরজাহান শান্ত গলায় বলে, ‘মুই কিছু করি নাই।’
‘তুমি আমারে বিশ্বাস করো না। অবিশ্বাস হয় ক্যা? আমি কি চরিত্রহীন?’ নুরজাহান সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ‘এহেনে চরিত্র ভালো-খারাপের বিষয় না। দুই বিয়া করতে চরিত্র খারাপ হওয়া লাগে না।’
‘কিন্তু আমি তো কইছি তা কোনোদিনও করমু না। হেই কতাডা তোমার বিশ্বাস অয় না ক্যা?’
‘মানুষের জীবনেরই গ্যারান্টি নাই, তার তো কতা!”
মুস্তাফিজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর বললেন, ‘হাসপাতালে কত বাচ্চা জন্ম দিয়া মা মইরা যায়। আমরা তো ওইহানেইত্যাও একটা বাচ্চা আনতে পারি। কী কও?’
‘না।’
‘না ক্যা?’
‘মাইনষের বাচ্চা মুই পালমু ক্যা?’
‘আচ্ছা, বাদ দেও। কিন্তু তুমি আমারে বিশ্বাস করো। আমি তোমারে ভালোবাসি, জাহান। আমার ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস রাহো। তুমি যদি আবারও জেসমিনের ওপর অত্যাচার করো, আমি আম্মার কাছে মুখ দেহাইতে পারমু না।’
নুরজাহান ছিটকে সরে গেল। তারপর ঝাঁজালো গলায় বলল, ‘এহনো তোমার মুখে ওই মাইয়ার নাম? সন্দেহ যে করি, হুদাহুদি করি না, এইডাই তার প্রমাণ। এক্কালে দরদের সাগরে ভাইস্যা যাইতেয়াছে। ওরে পিরিত!’
মুস্তাফিজ নুরজাহানের হাত ধরে নিজের কাছে টানতে চাইলেন, ‘জাহান, তুমি ভুল বুঝতাছ। এমন কিছুই না।’
নুরজাহান তড়িৎগতিতে হাতটা সরিয়ে দিয়ে বলল, “খবরদার, আমারে ধরবা না।’
তারপর উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়ল। মুস্তাফিজ উঠে পড়লেন। টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে মাকে চিঠি লিখতে শুরু করলেন।
.
জেসমিন পারতপক্ষে নুরজাহানের সামনে আসে না। তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করে নিজের ঘরে ঢুকে যায়। আগে প্রতি বেলায় সবার খাওয়া শেষ হয়ে গেলে রান্নাঘরে বসে খেয়ে নিত। আজকাল সে সাহস পায় না। খাবার প্লেটে নিয়ে ঘরে চলে আসে।
একদিন বড় একটা মাছ পাঠালেন মুস্তাফিজ। মাছটা এতই বড় যে কাটতে ঘাম ছুটে গেল জেসমিনের। দুপুরবেলা খাওয়ার সময় নুরজাহান দেখে মাছের মাথাটা নেই। সে ভেবেছিল মাথাটা মুস্তাফিজকে খাওয়াবে। মুস্তাফিজের অবশ্য সেসব খেয়াল নেই। তাকে যখন যা দেওয়া হয়, তিনি তখন তা-ই খান। খাওয়া শেষ করে মুস্তাফিজ হাসপাতালে চলে যাওয়ার পর জেসমিনকে ডাকল নুরজাহান। জানতে চাইল, ‘মাছের মাথাডা কই?
‘কড়াইতেই তো আছে, ভাবি।’
‘নাই। কার কার খাওয়া অইছে?’
‘ময়না ভাবি আর মুই ছাড়া সবাইর খাওয়া অইছে।’
মুজাহিদের যেহেতু ভাতের হোটেল, সে দুপুরে খেতে আসে না। নুরজাহান স্পষ্টই বুঝতে পারছে মাথাটা মাহফুজ খেয়েছে। মেজাজটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। একটা টাকা আয় করার মুরোদ নেই। বউ-বাচ্চা নিয়ে বসে বসে খাচ্ছে, সে আবার মাছের মাথা খায়! রাগটা জেসমিনের ওপর ঢালল সে। বলল, ‘মাথাটা তুইল্যা রাখতে পারোস নাই? মাছটা যে কিনছে, সে তো খাইতে পারল না।’
জেসমিন কিছু বলল না। কী বলতে কী বলবে, তারপর কী হবে, এই ভয়েই সে তটস্থ। নুরজাহান ধমকে উঠল, ‘কী ব্যাপার, মুখে কতা নাই ক্যা?’
‘ভাবি, আমনে তো তুইল্যা রাখতে কন নাই।
‘ও, এহন দোষ অইছে আমার? সবকিছু কইয়া দেতে অইবে ক্যা? তোর মাতায় কি গোবর ল্যাপা?’
‘আর ভুল অইবে না, ভাবি। এরপরেইত্যা বড় মাছের মাথা তুইলা রাখমু।’
‘মুরগির রানও তুইল্যা রাখবি। বইয়া বইয়া খাইয়া গায়ে ত্যাল বেশি অইয়া গেছে সবটির।’
কথাগুলো নুরজাহান বেশ জোরে জোরেই বলছিল, যাতে ওরা শুনতে পায়। মাহফুজ ঠিকই তার বিছানায় শুয়ে শুয়ে সব শুনতে পাচ্ছিল। এবার গলা বাড়িয়ে জানালা দিয়ে তাকাল। নুরজাহান রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গেল। বিরক্ত হলো মাহফুজ। সে এই কর্কশ মহিলার মুখ দেখার জন্য তাকায় নি। কিছুক্ষণ পর জেসমিন খাওয়ার ঘর থেকে বের হলো। এবার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল তার। জেসমিনের রূপ দেখে প্রথম দিনই মাথা ঘুরে গিয়েছিল। সে সুযোগ পেলেই জেসমিনকে চোখ দিয়ে গিলে খায়। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জেসমিন সারাক্ষণ মাথায় ঘোমটা দিয়ে থাকে। ভালো করে দেখার সুযোগ নেই, কিন্তু সে প্রতিদিন সুযোগের অপেক্ষায় থাকে যে কখন জেসমিন গোসল করতে যাবে। গোসলের সময় সে একেক দিন একেক উপায়ে পুকুরঘাটে তাকিয়ে থাকে। পুকুরের ওপাড়ে একটা বাঁশঝাড় আছে। প্রায়ই ওখানে গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে। খুব যে আহামরি লাভ হয়, তা নয়। কারণ, জেসমিন খুব সতর্কভাবে ঢেকেঢুকে গোসল করে। সাঁতার শেষে ঘোমটা দিয়ে উঠে চলে যায়। ভেতরের গোসলখানায় কাপড় পাল্টায়।
বাড়িভর্তি এত মানুষকে অসহ্য লাগে মাহফুজের। এত মানুষ না থাকলে এত দিনে তার মনের সাধ কবেই মিটিয়ে ফেলতে পারত! সবচেয়ে বড় সমস্যা পারুল। সারাক্ষণ আঠার মতো লেগে থাকে সাথে, তাই সে সুযোগ আর পায় না। কবে যে একটা সুযোগ আসবে!
নাইয়রি – ৩০
৩০
শরিফা বানু মুস্তাফিজের চিঠি পেয়ে দ্রুতই বাড়ি ফিরে এলেন। চিঠিতে অবশ্য মুস্তাফিজ বিস্তারিত কিছুই লেখেন নি। শুধু লিখেছেন বাড়িতে ঝামেলা চলছে, তিনি যেন চিঠি পাওয়ামাত্র লঞ্চে ওঠেন। ভোরবেলা বাড়ি ফিরতেই মুস্তাফিজ এলেন তার ঘরে।
তিনি জানতে চাইলেন, ‘ঘটনা কী, বাবা? এম্বালে আইতে কইলি ক্যা? বাড়িতে কী ঝামেলা অইছে?’
এসব কথা মায়ের দিকে তাকিয়ে বলার মুখ মুস্তাফিজের নেই।
তিনি মাথা নিচু করে বললেন, ‘আম্মা, জেসমিনরে এই বাড়িতে আর রাখোন যাইবে না। অর একটা ব্যবস্থা করেন। অন্য কোথাও একটা কামের ব্যবস্থা কইরা দেন।’
‘ক্যা, কী করছে জেসমিন?’
অবাক হলেন শরিফা। মুস্তাফিজ বললেন, ‘ও কিছু করে নাই। করছে আমনেগো বউ। এত দিন আমনেরে কইতে চাই নাই। নুরজাহান অরে নিয়া আমারে সন্দেহ করে। ভাবে অরে মুই বিয়া করমু কিংবা…ওই দিন অর গায়ে হাত তুলছে। সব কথা কইতে পারমু না, আম্মা।’
‘কস কী! মুই অবশ্য ট্যার পাইছিলাম বড় বউ জেসমিনরে দেখতারে না। কিন্তু এতডা তো বুঝি নাই। কিন্তু এই সন্দেহের কারণ কী? তুই তো জেসমিনের লগে কথাও কস না।’
‘জানি না, আম্মা। জেসমিন আইছে হইতেই সন্দেহ করে। ভাবছি দিনে দিনে কমবে। কিন্তু উল্ডা বাড়ছে। আমনে না থাকায় জল অনেক দূর গড়াইয়া গেছে। সংসারে এই অশান্তি মুই আর নিতে পারতেয়াছি না, আম্মা। দেয়ালে পিঠ ঠেইক্যা গেছে।’
‘বুঝলাম। কিন্তু বাবা, এই অবস্থায় মাইয়াডারে কোই পাড়াই? সাত মাসের পোয়াতিরে কেউ কামে নেবে না। এত ভালো মাইয়াডা! অথচ কী অসহায়!’
শরিফা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মুস্তাফিজ মাথা নিচু করে রইল। শরিফা নুরজাহানকে চেনেন। তার ওপর ছেলের এমন মুখ দেখে অনেক কিছুই আন্দাজ করতে পারলেন।
বললেন, ‘ঠিকাছে বাবা, তুই চিন্তা করিস না, আমি দেহি কী করোন যায়।’
জেসমিনকে অন্যত্র কোথাও পাঠাতে হবে ভেবেই মনে একটা সূক্ষ্ম বেদনা হতে লাগল। মেয়েটি তার বড় খেয়াল রাখে, যা তার তিন বউ মিলেও রাখে না। মেয়েটির প্রতি বড় মায়া পড়ে গেছে!
.
পারুলের ভাই এসেছে তাকে নাইয়র নিতে। মাহফুজকে অনেক সাধাসাধির পরও সে গেল না। জানাল, পারুলকে সে আনতে যাবে, তখন বেড়াবে। অগত্যা ভাই পারুলকে নিয়ে চলে গেল। মাহফুজ যাবেই-বা কেন? সে তো এমন একটি সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল।
পরিকল্পনামাফিক রাত বাড়লে মাহফুজ জেসমিনের ঘরে যায়। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সে দরজায় টোকা দেয়। জেসমিন ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার ঘুম ভাঙল না। কিছুক্ষণ পর আবার টোকা দিল, এবার আরেকটু জোরে। এবার ঘুম ভাঙল জেসমিনের। সে উঠে হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দরজা খুলল। দরজা খুলে কাউকে না দেখে ভাবল ভুল শুনেছে। একটা হাই তুলে দরজাটা লাগাতে যাবে, অমনি মাহফুজ হুট করে কোত্থেকে এসে তার মুখ চেপে ধরল। জেসমিন মাহফুজকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। মাহফুজ তার মুখ চেপে ধরেই ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে কোনো শব্দ করার সুযোগ না দিয়ে মুখ বেঁধে ফেলল। মুখ বাঁধার জন্য রুমাল সে সঙ্গে করে নিয়েই এসেছে। এই রুমালে বহু নারীর মুখ বেঁধে অভ্যস্ত সে। জেসমিন ধস্তাধস্তি করেও মাহফুজকে ঘর থেকে বের করতে পারল না বা নিজের মুখের বাঁধন খুলতে পারল না। বেশি ধস্তাধস্তি করছে বলে মাহফুজ জেসমিনের দুহাত পেছনে নিয়ে নিজের এক হাতে চেপে ধরে আরেক হাতে শাড়ি খুলতে খুলতে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘এত পাড়াপাড়ি কিসের? জামাই ছাড়া এত দিন আছ, তোমারও তো কষ্ট অয়। চুপ কইরা কাম সহজ কইরা দেও। দুইজনেই তাতে মজা পামু। জোরজবরদস্তি করলে হুদাহুদি কষ্ট পাবা। ‘
জেসমিন প্রাণপণে চিৎকার করার চেষ্টা করল, একটুও শব্দ বের হলো না। লাথি দিতে চাইল, পেটের কারণে পা তুলতে পারল না। ততক্ষণে মাহফুজের নোংরা হাত জেসমিনের গায়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাহফুজ হেসে বলল, তুমি কি ভাবছ পারবা মোর লগে? তোমার লাহান কত মাইয়ারে খাইছি, জানো?”
ঠিক তখনই জেসমিন একটা হাত আলগা করতে পেরে পাশের হারিকেনটা তুলে সেটা দিয়ে টিনের দেয়ালে একনাগাড়ে অনেকগুলো শব্দ করল যত জোরে তার পক্ষে সম্ভব। মাহফুজ খেপে যেতেই এবার জেসমিন হারিকেন দিয়ে মাহফুজের গায়েই আঘাত করল। ঠিক তখনই শরিফা বানু এসে পড়লেন।
জেসমিনের ঘরের কাছেই তার ঘর। প্রথম শব্দটাই তিনি শুনেছিলেন। কিন্তু এই বয়সে হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠা যায় না। তিনি এসে এই দৃশ্য দেখে মাহফুজকে একটা চড় মারলেন। চেঁচিয়ে বললেন, ‘হারামজাদা, কোনো দিন মানুষ হবি না তুই?’
মাহফুজ বিরক্ত হয়ে বলল, ‘উফ্, এত রাইতে তুমি উইড্যা আইছো ক্যা?’
জেসমিন মুখ খোলার আগে দ্রুত হাতে শাড়িটা গায়ে জড়াল। ঠিক তখনই বাড়ির বাকিরা এসে উপস্থিত হলো। কেউই তেমন অবাক হলো না। মাহফুজের চরিত্র সম্পর্কে টুকটাক ধারণা সবারই ছিল। ময়না এগিয়ে এসে জেসমিনের মুখের বাঁধন খুলে দিল। জেসমিন হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ছেলের কৃতকর্মের লজ্জায় অপমানে শরিফা বানুরও চোখে জল এল।
মুস্তাফিজ ঘরে ঢোকেন নি। বাইরে দাঁড়ানো ছিলেন। মাহফুজ বের হতেই তার চুল ধরে ঘরের খুঁটির সাথে মাথা ঢুকে দিলেন। মাহফুজ সহ্য করার লোক নয়। সে পালটা ধাক্কা দিয়ে মুস্তাফিজকে সরিয়ে দিল। এত জোরে ধাক্কা দিল যে এক ধাক্কায় মুস্তাফিজ পড়ে গেলেন। মাহফুজ নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিল। মুজাহিদ তাড়াতাড়ি ভাইকে ওঠাল, ভাবি দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এদিকে শরিফা বানু বললেন, ‘জেসমিন, আইজগোইত্যা মোর ঘর ঘুমাবি। এহনই ল।’
জেসমিন ওঠার চেষ্টা করল। কিন্তু এত ধকল নিতে না পেরে তার শরীর ছেড়ে দিয়েছে। ময়না বলল, ‘মুই দিয়াহি লও।
নুরজাহান চুপচাপ সব দেখছিল। একটা কথাও বলে নি এতক্ষণ। ময়না জেসমিনকে নিয়ে বের হওয়ার পর শরিফা বানু চোখ মুছে ঘর থেকে বের হবেন, এমন সময় নুরজাহান বলল, ‘এমনডা তো হওয়ারই আছিল। এর চেয়ে ভয়ংকর কিছুও অইতে পারত। তিন-তিনটা জওয়ান বেডা মানুষ যে বাড়িতে আছে, হেই বাড়িতে এমন সুন্দরী মাইয়া কেউ রাহে?’
শরিফা বানু কথাটা হজম করে নিজের ঘরে চলে গেলেন।
৩১
শরীর কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে জেসমিনের। বাড়ির সকলেই আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। শরিফা বানু এই বয়সে কল চেপে পানি এনে জেসমিনের মাথায় পানি দিতে পারলেন না। তবে জলপট্টি দিলেন। সকাল হলে কারও সাহায্য নিয়ে মাথায় পানি ঢালতে হবে।
দুশ্চিন্তায় সারা রাত ঘুমাতে পারলেন না শরিফা বানু। মাহফুজের চরিত্রের দোষ ছিল বলেই তাকে আগেভাগে বিয়ে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিয়ের পর ছেলের এই বিশেষ দোষ ঠিক হয়ে গেছে বলেই ভেবেছিলেন তিনিসহ সকলেই। কারণ, বিয়ের পর থেকে আজকের আগে কোনো বাজে ঘটনা ঘটে নি। তবু…তবু এ রকম একটা ঘটনা ঘটার আগেই তার সাবধান থাকা উচিত ছিল। প্রথম দিন থেকেই জেসমিনকে তার ঘরে রাখা উচিত ছিল। পরোক্ষভাবে হলেও আজকের এই ঘটনার জন্য তার নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছে। প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছেন তিনি।
এদিকে নুরজাহানের মুস্তাফিজ ও জেসমিনকে নিয়ে সন্দেহও তাকে পীড়া দিচ্ছে। নুরজাহানের বিষয়ে তার এত দিনের অভিজ্ঞতা আর আজকের বলা কথাগুলো থেকে তিনি যা বুঝতে পারছেন তা হলো, জেসমিন সুন্দরী, এটাই নুরজাহানের মূল সমস্যা। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে রয়েছে তার সন্তান না হওয়ার দুর্বলতা! নুরজাহান তার ছেলের ভালোবাসার মানুষ। ছেলের সংসারের সুখ এক দিনের জন্যও নষ্ট হোক, তা তিনি কখনো চান না।
সারা রাত ভেবে তিনি সমাধান বের করতে পারলেন। তবে এখনই কিছু করতে পারবেন না। জেসমিনের বাচ্চা হবার পর জেসমিনকে একটা বিয়ে দিয়ে দেবেন তিনি। বাচ্চা থাকলেও মেয়ের চেহারা ভালো, বয়স কম। পাত্র পেতে অসুবিধা হবার কথা নয়। কিন্তু মাহফুজের কী করবেন? এভাবে আর কত? একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে। না হলে মানসম্মান যেটুকু আছে, সব ধুলোয় মিশে যাবে।
সকালবেলা শরিফা বানু কাউকে ডাকার আগেই ময়না এল খবর নিতে। তাকে বলতেই জেসমিনের মাথায় পানি ঢালার জন্য পানি এনে দিল। পানি ঢালছিলেন শরিফা বানু নিজেই।
মাথায় পানি ঢালার পর জেসমিনের জ্বর কিছুটা কমল। হুঁশ ফেরায় আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল সে। কোনো দিন কি ভেবেছিল এ রকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়তে হবে তাকে! এ রকম আক্রমণ তো দূরের কথা, বাবার ভয়ে কোনো দিন কেউ চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায় নি মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তাদের বাড়ি অবধি মিলিটারিরা আসতে পারে নি তার বাবার কারণে। তখনো নিশ্চিন্তেই থেকেছে! আর গতকাল রাতে! কী বীভৎস! অসভ্য লোকটা কি নোংরাভাবে ছুঁয়েছে তাকে! মনে পড়তেই নিজেকে অশুচি লাগছে। মনে মনে রঞ্জুর কাছে হাজারবার মাফ চেয়ে ফেলেছে সে। রঞ্জু কি তাকে মাফ করবে?
.
সকালের নাশতা খাওয়ার সময় দেখা গেল নির্লজ্জের মতো মাহফুজ সবার সাথেই খেতে বসেছে। ভাব দেখে কোনোভাবেই মনে হচ্ছে না গত রাতে কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করেছিল সে।
শরিফা বানু সবার সামনেই ঘোষণা করলেন, মাহফুজকে বিদেশে পাঠিয়ে দেবেন। মাহফুজ স্পষ্ট জানিয়ে দিল, ‘কে যাইবে বিদেশ? আমনের শখ লাগলে আমনে যান। মুই কোনোহানে যাইতেয়াছি না।’
শরিফা বানু বললেন, ‘এই সব নষ্টামি কইরা কত দিন কাটাবি? কামকাইজ করন লাগবে না? এইহানে তোর করার মতো কাম নাই।’
মাহফুজ খেতে খেতে বলল, ‘দুনিয়ায় বেবাক মাইনষের কাম করোন লাগবে ক্যা? মোর বাপের সয়সম্পত্তির তো অভাব নাই। হারা জীবন বইয়া খাইলেও সমেস্যা নাই। কোনো কামকাইজ মুই করতারমু না। আমনের তিন পোলায় তো ম্যালা কামকাইজ করে। হেগো লইয়া খুশি থাহেন।’
শরিফা বানু বুঝলেন এত সহজেই মাহফুজ রাজি হবে না। বিষয়টা নিয়ে বিস্তর ভাবতে হবে তাকে। মুস্তাফিজ বা মুজাহিদও কিছুই বলল না। মাহফুজের মুখের ভাষা এত নোংরা আর বেপরোয়া যে তার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছা বা সাহস কোনোটিই তাদের নেই। তাদের মা নিশ্চয়ই কোনো উপায় বের করবেন।
মাহফুজ খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে গেল। তখন নুরজাহান বলল, ‘ভালো সিদ্ধান্ত নিছেন, আম্মা। এই বাড়িতে মোরা কেউই নিরাপদ না। আইজ কামের মানুষের উপ্রে হামলা করছে, কাইল যে নিজের ভাবিগো উপ্রে করবে না, তার কী গ্যারেন্টি?’
নুরজাহানের কথায় সবাই চমকে উঠল। এমন ভয় ময়নারও হয়েছে, তবে সবার সামনে এভাবে শুনতে অস্বস্তি লাগল।
এদিকে যেভাবে সব সময় মুস্তাফিজ লজ্জায় মাথা নুইয়ে রাখেন, আজও সেভাবেই রাখলেন। এক দিকে ভাইয়ের কৃতকর্মের কারণে লজ্জা, আরেক দিকে স্ত্রীর আচরণে। এভাবে না বললেও পারত সে!
শরিফা বানু মুজাহিদকে বলল, ‘পারুলের বাপের বাড়ি জরুলি খবর পাড়াও। আইজই যেন হে চইল্যা আহে।’
.
জেসমিন এ বাড়িতে এসেছে তিন মাসের গর্ভবর্তী অবস্থায়। এখন আট মাস চলছে। একবারও তাকে ডাক্তার দেখানো হয় নি। সংগত কারণেই মুস্তাফিজ তার ছায়াও মাড়ান না। শরিফা বানুর মনে হলো জেসমিনের শরীরটা বোধ হয় ঠিক নেই। বিশেষ করে ভয় পাবার পর থেকে।
মুস্তাফিজ যখন হাসপাতালে যাচ্ছিলেন, শরিফা বানু তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তা পর্যন্ত গেলেন। মুস্তাফিজ বললেন, ‘কিছু কইবেন, আম্মা?’
শরিফা বানু বললেন, ‘কইতে চাইছিলাম জেসমিনরে একটু দেইক্কা দিবিনি? ছেড়ির শরীলডা মনে হয় ঠিক নাই। ‘
মুস্তাফিজ একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘ডাক্তার পাড়াইয়া দিমুয়ানে, আম্মা।’
শরিফা বানু ছেলের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা।’ ডাক্তার এল বিকেলে। জেসমিনকে দেখে জানাল, চিন্তার কিছু নেই। মা ও বাচ্চা দুজনেই পুরোপুরি সুস্থ আছে।
৩২
হালিমার চিঠির কোনো উত্তর দেয় নি মামুন। আরও দুমাস পেরিয়ে গেছে, একটিবারও টাকা পাঠায় নি। জমানো টাকাপয়সা শেষ হবার পথে। সামনের দিনগুলো কীভাবে চলবে, সেই ভাবনায় হালিমার পাগলপ্রায় অবস্থা। সেকরার দোকানে কানপাশার প্রথম কিস্তি দেওয়ার পর আর দিতে পারেন নি। সে-ও তাগাদা দিচ্ছে। বাকি টাকা দিতে না পারলে যা দিয়েছেন, তা-ও মার যাবে!
এদিকে রেনুর বড় মায়া হয়। আব্বাসের ভয়ে সে এত দিন কিছু বলেনি। কিন্তু এখন যে আর পারছে না। তাই আগেপিছে না ভেবেই সে হালিমাকে বলল, ‘আম্মা, আইজগোইত্যা আমনেরা মোগো লগে খাইয়েন।
হালিমা এ কথা শুনে মনে মনে অবাক হলেন। মুখে বললেন, ‘তোমাগো তো নিজেগোই চলে না।’
রেনু হেসে বলল, ‘মোরা দুই বেলা খাইতে পারলে আমনেগোডাও জুইট্যা যাইবে।’
হালিমার যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। সে খুশিমনেই রাজি হলেন। একে তো বাজারের চিন্তা গেল, তার ওপর রান্নার ঝামেলাও। বেশ আরাম হবে!
রেনু ঘটনাটা জানাতেই আব্বাস বলল, ‘খাইতে যহন কইছ, হেগোডা তুমি কামাই কইরা আইন্নো। আমি খাওয়াইতে পারমু না হেগো।’
রেনু আব্বাসের প্রতিটা কথার ধরন বোঝে, এ কথা সে রেগে বলে নি বুঝতে পেরেই ভয় কেটে গেল। সে নরম গলায় বলল, ‘আচ্ছা।’
মোকসেদ-হালিমা তাদের সাথে খাওয়া শুরু করার পরদিন আব্বাস বলল, ‘এতজনের রান্দাবাড়া যহন করতেইয়াছ, মুকুলগোও কও মোগো লগে খাইতে। মিনার তো এই সময়ে কামকাইজ করতে কষ্ট অয়।’
খুশিতে চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল রেনুর।
বলল, ‘সত্য? মোর মনডায় এইডাই চাইতেয়াছিল। তয় ডরে কই নাই।’
আব্বাস হেসে বলল, ‘ওরে বাপ রে! কেডা কয় ডরের কতা! মুকুল মোর ভাই, কোনো বেইমান না। যেহেনে ডর করার কতা, হেহেনে তো ডর করে না। করলে তোমার শ্বশুর-শাশুড়িরে আবার ঘাড়ে তুলতা না।’
রেনু আব্বাসের পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘ধুরো, কী যে কন! এম্বালে কয় না। হেরা আমনের বাপ-মা।’
‘চুপ করো তো।’
মুকুলরা সেদিন থেকে তাদের সাথেই খায়। মিনার গর্ভকালের আট মাস চলছে। এ সময় সংসারের এত কাজ করতে আসলেই কষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। মুকুলের এখন একটানা কাজ নেই। তবে সে যখন যেটুকু কাজ করে, সেই উপার্জন থেকেই মিনার ডেলিভারির জন্য কিছু টাকা জমিয়ে বাকিটা এনে রেনুর হাতে তুলে দেয়। কখনো মাছ ধরে আনে, কখনোবা বাজার করে আনে।
মামুন খবরটা পেয়ে হাসল। সে জানত টাকা পাঠানো বন্ধ করলে একদিন না একদিন বাবা-মা আবার ভাইদের সঙ্গেই খেতে শুরু করবে। এটারই অপেক্ষায় ছিল সে। বন্ধুর মাধ্যমে খবর নিত এত দিন। অবশেষে সে আব্বাসকে একটা লম্বা চিঠি লিখল, অভিমানে ভরা চিঠি। বাবা-মা যে তাদের আলাদা করে দিয়েছে, এই কথাটি কেন তাকে জানানো হয় নি, সেই অভিমান সঙ্গে কিছু টাকা পাঠাল। লিখল, এখন থেকে প্রতি মাসে বাজার খরচ বাবদ কিছু টাকা তার নামে পাঠাবে।
.
শরিফা বানু মাহফুজকে বিদেশ তো দূরে থাক, বাড়ির বাইরেই পাঠাতে পারলেন না। তার নিজের পেটের ছেলে এমন বেয়াদব-বেয়াড়া, অসভ্য কোত্থেকে হলো, এখনো বুঝতে পারেন না তিনি।
এদিকে জেসমিনকে যে রান্নার কাজ থেকে অব্যাহতি দেবেন, তা-ও পারছেন না। নুরজাহানের এককথা, কাজের মানুষ থাকতে সে কেন রান্নাবান্না করবে। এমনকি অন্য বউদেরও সে রান্নাঘরের আশপাশে আসতে দেয় না। অন্য সব কাজও জেসমিনকে দিয়ে করানোর ধান্দা। তার যে শরীরের অবস্থা, তাতে তার পক্ষেও আজকাল আর রান্নাবান্না করা সম্ভব নয়। যদিও রান্না তো দূরে থাক, একটু সাহায্যও করতে দেয় না জেসমিন।
এ বাড়িতে সব দিক দিয়ে জেসমিনের যে করুণ অবস্থা, তাতে শরিফা বানু একপ্রকার উঠেপড়েই লাগলেন পাত্র খুঁজতে। বাচ্চা হওয়ার আগে তো আর বিয়ে দেওয়ার নিয়ম নেই। বাচ্চা হওয়ার পর যাতে আর দেরি করা না লাগে, তাই আগে থেকেই পাত্র খুঁজে রাখা। কিন্তু উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাচ্ছে না। একজন বিপত্নীক পাত্র পাওয়া গেল, যার বয়স পঁয়তাল্লিশ। চার সন্তানের পিতা। বড়জনের বিয়ের বয়স প্রায় হয়ে গেছে। অথচ লোকটা রাজি হলো না জেসমিনের সন্তান হবে জেনে। যেহেতু মেয়ে খুব রূপবতী, তাই সন্তান রেখে বিয়ে করলে সে রাজি আছে। শুনে রাগে গা জ্বলতে লাগল শরিফার। নিজে চার সন্তান নিয়ে বিয়ে করতে পারবে, আর জেসমিনের এক সন্তান তার কাছে বেশি হয়ে গেল। দরকার নেই এমন ছোটলোক পাত্রের। তিনি আরও পাত্ৰ দেখতে লাগলেন।
.
জেসমিন রান্না শেষে রান্নাঘরটা ঝাড়ু দিতে দিতেই হাঁপিয়ে উঠল। একে তো বিশাল এক পেট হয়েছে! আল্লাহ জানে একটা না দুইটা এর মধ্যে। তার ওপর ভয়ংকর গরম পড়েছে আজ! ঝাড়ু দেওয়া শেষে কিছুক্ষণ বসে জিরিয়ে নিল। তারপর সবার জমিয়ে রাখা নোংরা কাপড়চোপড়গুলো নিয়ে গোসলে যাবে, এমন সময় নুরজাহান এক ঝুরি আম নিয়ে এসে বলল, ‘আমগুলা কাইড্যা দেও এহনই। আমার ভাই আসছে, তারে দিমু।’
জেসমিন বিনাবাক্যব্যয়ে আম কাটতে বসল। ইদানীং বসে কাজ করতে অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু কাজের মেয়ে সে, কাজ তো করতেই হবে।
নুরজাহান জেসমিনকে দিয়ে যত কাজ করায়, সবই কৌশলে শরিফা বানুর আড়ালে করায়। কিন্তু ঘটনাটা শেষ মুহূর্তে দেখে ফেললেন শরিফা বানু। দেখে কষ্ট পেলেন। মেয়েটার জন্য এত মায়া তার কেন হয়, নিজেও বোঝেন না। নুরজাহানকে কিছু বলাও সম্ভব নয়। বললেই বাপের বাড়ি চলে যাবে। তারপর যে কী হবে, কেউ জানে না!
আমগুলো কেটে দিয়ে কাপড় ধুতে গেল জেসমিন। কাপড় ধোয়া শুরু করবে, এমন সময় ময়না ঘাটে উঠে এল। গোসল করছিল সে। চোরের মতো বলল, ‘আমারে দেও, আমি ধুইয়া দেই।’
‘না না, ভাবি, মুই পারমু। বড় ভাইজান আর ভাবির অল্প কয়ডা কাপড়!’
ময়না চোখ পাকিয়ে বলল, ‘চুপ করো। বড় বেশি কথা কও। পারবা তো জানি। কষ্টডা কেমন অয়, অইডাও জানি। ভাবি দেহার আগে দেও ধুইয়া দেই। ততক্ষণে তুমি গোসল কইরা নাও।’
কৃতজ্ঞতায় জেসমিনের চোখে পানি এল। সারা জীবন সবার ভালোবাসায় চোখের মণি হয়ে থাকা জেসমিন এখন কারও সামান্য একটু ভালোবাসা পেলেই এলোমেলো হয়ে যায়।
কাপড়গুলো দড়িতে মেলতে মেলতেই জেসমিনের প্রসবব্যথা শুরু হলো। ময়নাই আগে দেখতে পেল। তারপর সবাইকে ডেকে ধরাধরি করে ঘরের ভেতর নিয়ে গেল। পাশের বাড়ি থেকে ধাত্রী ডেকে আনা হলো। সন্ধ্যাবেলা ঘর আলো করে এক শিশুকন্যার জন্ম হলো। অনেক অনেক কাঁদল জেসমিন। কষ্টমিশ্রিত সুখের কান্না! চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলল জেসমিন, ‘রঞ্জু, দেহো আমাগো মাইয়া! পারছি! অবশেষে জন্ম দিতে পারছি! তুমি কি দেখতে পাইতেয়াছ? তুমি কি শান্তি পাইছ? খুশি অইছ?’
৩৩
জেসমিনের একটা কাজ বেড়েছে। কাজটা হলো, সময় পেলেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা। মেয়ের মুখের দিকে তাকালে পুরো পৃথিবীটা তার কাছে সুন্দর মনে হয়। হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছা করে। প্রতিদিন ওর একটু একটু বেড়ে ওঠা দেখলে জীবনী শক্তি বেড়ে যায়। এত দিনের সব কষ্ট ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। কে জানত একটা শিশুর মুখে এত শান্তি থাকবে?
তার মূল আতঙ্কটা শুরু হলো কদিন পর থেকে। সারাক্ষণ মনে হয় নুরজাহান তার মেয়ের কোনো ক্ষতি করবে। অবশ্য নুরজাহানের দৃষ্টি দেখে যে কারও এমনটাই মনে হবে। পুতুলের মতো সুন্দর একটা বাচ্চা, সবাই কোলে নিয়েছে, একমাত্র নুরজাহান বাদে।
একদিন জেসমিন শরিফা বানুকে বলেই ফেলল, ‘খালা, মোরে কি অন্য কোনোহানে একটা কাম জোগাড় কইরা দেওন যায়? মোর লাইগ্যা তো এই বাড়িতে ঝামেলা কম অয় নাই।’
শরিফা বানু জেসমিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘আর কয়ডা দিন কষ্ট কর, মা। মুই তোর লাইগা পাত্র দেখতাছি।’
জেসমিন আঁতকে উঠে বলল, ‘না না খালা, মুই বিয়া করমু না।’
শরিফা বানু মাথা নেড়ে বললেন, ‘স্বামী ছাড়া যুবতী মাইয়ার এই সমাজে শান্তিতে থাকার জো নাই রে মা। তার উপ্রে যদি অয় চেহারা সুন্দর, তয় তো আর রক্ষা নাই। মুই যদি আজীবন তোরে মোর কাছে রাখতে পারতাম, তহেলে রাখতাম। কিন্তু এই বাড়ি তোর আর তোর বাচ্চার লাইগা নিরাপদ না। এইডা তো তুইও বোঝস।’
জেসমিনের বুক ফেটে কান্না এল। ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইল। শরিফা বানু বললেন, ‘ঠান্ডা মাতায় চিন্তা কইরা দ্যাখ। আইজ মুই আছি। কাইল মুই না থাকলে মাহফুজ আর নুরজাহানের হাতেইত্যা ক্যামনে বাঁচবি?’
জেসমিন চিন্তা করে দেখল শরিফা বানু ঠিক বলেছেন। কিন্তু মন সায় দেয় না তার। সে রঞ্জুর। শুধুই রঞ্জুর। মনেপ্রাণে সে রঞ্জুকেই ভালোবাসে। রঞ্জু নেই, রঞ্জুর সন্তান তো আছে। আবার বিয়ে করা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
শরিফা বানু ঘুমিয়ে পড়লে জেসমিন চিঠিটা বের করে হারিকেনের সামনে ধরে। কাগজটা পুরোনো হয়ে গেছে, কিন্তু লেখাগুলো আজও কত জীবন্ত! নিঃশব্দে অঝোরে কাঁদতে থাকে জেসমিন।
.
কদিন ধরে নুরজাহানের ঘুম হচ্ছে না। বাচ্চাটাকে দেখলে সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না যে এটা মুস্তাফিজের বাচ্চা নয়। বারবার মনে প্রশ্ন জাগছে, মুস্তাফিজ মিথ্যা বলে নি তো? এমন নয়তো যে জেসমিনকে সে বিয়ে করেছে! সে হয়তো গোপনে জেসমিন আর বাচ্চার সাথে দেখা করে! এমনও তো হতে পারে যে শাশুড়ি সব জানেন। তা না হলে তিনি জেসমিনকে এত আগলেই-বা রাখেন কেন?
দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারে না নুরজাহান। সারা রাত জেগে থেকে স্বামীকে পাহারা দেয়। আজ একটু চোখ লেগে এল। তারপর যখন ঘুম ভাঙল, দেখে মুস্তাফিজ ঘরে নেই। ছুটে ঘর থেকে বের হলো সে। চিৎকার-চেঁচামেচি করে বাড়িঘর মাথায় তুলল। প্রায় সবার ঘুম ভেঙে গেল। শেষে দেখা গেল মুস্তাফিজ বাথরুমে গিয়েছিলেন। তিনি নুরজাহানকে জোর করে ধরে তাদের ঘরে নিয়ে গেলেন। নুরজাহান সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, “তুমি জেসমিনের ঘরে গেছিলা না?’
মুস্তাফিজ নুরজাহানের মুখ চেপে ধরে বললেন, “আস্তে জাহান, আস্তে। আমারে নাহয় না-ই বিশ্বাস করলা কিন্তু জেসমিন যে আম্মার লগে ঘুমায়, তা তো তুমি জানো।’
নুরজাহান একইভাবে বলল, ‘উনিই তো নাটের গুরু। উনি তো তোমাগো দলেরই লোক। নাইলে যেদিন তুমি অরে বাড়ি লইয়াইলা, ওই দিনই বাইর কইরা দিল না ক্যা? ছেড়িরে জাগা দিল ক্যা উনি?’
‘উফ্!’
মুস্তাফিজ নিজের মাথা চেপে ধরলেন। নুরজাহান এবার কিছু বলল না। মুস্তাফিজই বললেন, “তুমি কি বুঝতেছ জাহান, তুমি যে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গ্যাছ?’
‘আচ্ছা, এখন আমারে অসুস্থ বানাইতে চাও? বাহ্, আমারে অসুস্থ বানাইয়া তালাক দেওনের ধান্দা! এরপর কি ওই ছেড়িরে বিয়া করবা? নাকি কইরা ফালাইছ?’
মুস্তাফিজ নুরজাহানকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘প্লিজ জাহান, মাফ করো আমারে। আমি আর নিতে পারতেয়াছি না। আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করো। এইবার আমি অসুস্থ হইয়া যামু।’
নুরজাহান এবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না সে।
ওদিকে তাদের কথা শুনতে পেয়ে কাঁদছে জেসমিন। সে যত দিন এই বাড়িতে থাকবে, তত দিন ওদের অশান্তি চলতেই থাকবে। সে কি পালিয়ে যাবে? কোথায় যাবে? এ বাড়িতে অন্তত কয়েকটা মানুষের মনে দয়ামায়া থাকায় সে এখনো টিকে আছে। অন্য কোথাও যে এটুকু দয়া পাবে, তার কী নিশ্চয়তা? জেসমিন জানে না কী করবে, তবু ভোরের আলো ফুটতেই মেয়েকে কোলে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
.
সকালবেলা মুস্তাফিজ হাসপাতালে না গিয়ে গেলেন শ্বশুরবাড়িতে। আজমল তালুকদারের সাথে দেখা হয়ে গেল পুকুরপাড়ে। তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘আরে মুস্তাফিজ! একলা ক্যা? আমার মায় কই?’
মুস্তাফিজ ইতস্তত করে বললেন, ‘আব্বা, আপনের সাথে একটু কথা আছিল। তাই অরে আনি নাই। আমি যে আইজ আইছি, এইডাও গোপন রাখবেন।’
‘কও কী! আচ্ছা, ঘরে আসো।’
‘না, ঘরে যামু না আইজ। এইহানেই খাড়াইয়া কথা কই। আসলে আব্বা, আমি খুব বিপদে পইড়া আপনের কাছে আইছি। আপনের সাহায্য দরকার।’
মুস্তাফিজের চেহারা দেখে তিনি বুঝতে পারছেন ঘটনা গুরুতর। কী হয়েছে, জানতে চাইলেন।
মুস্তাফিজ বললেন, ‘নতুন কিছু না। নুরজাহানের পুরান পাগলামি বাড়ছে। তবে এইবার ভয়াবহ রূপ নিছে। সারা রাত জাইগা আমারে পাহারা দেয়। অরে জরুরি ভিত্তিতে মানসিক ডাক্তার দেখানো দরকার। আমি বলায় খেপে গেল। আপনি একটা ব্যবস্থা করেন, আব্বা। দিন দিন ওর মানসিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। এই রকম চলতে থাকলে ও শারীরিকভাবেও অসুস্থ হইয়া যাবে।’
এবার আজমল তালুকদারও অসহায় বোধ করলেন। তিনি বললেন, “ওই মেয়েটাকে তোমরা অন্য কোথাও পাঠাই দিচ্ছ না কেন?’
‘আব্বা, আপনি বোঝার চেষ্টা করেন। সমস্যা ওই মেয়ে না। অরে তো আম্মা কিছুদিনের মধ্যেই বিয়া দিয়া দেবে। সমস্যা নুরজাহানের অসুস্থতা। এই ধরনের অসুস্থতা হালকাভাবে নিতে নাই। আপনি শুধু একবার অরে ঢাকায় নিয়া ডাক্তার দেখানোর ব্যবস্থা করেন। ও একমাত্র আপনের কথাই মানে।’
আজমল তালুকদার মুস্তাফিজের পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘ঠিকাছে, আমি ব্যবস্থা করতেছি।’
৩৪
সারা রাত প্রসববেদনা সহ্য করে সকালবেলা একটি পুত্রসন্তান জন্ম দিয়ে মারা গেল মিনা। সদ্যোজাত শিশুটিকে নিয়ে খুশিতে মেতে ওঠার কেউ নেই। সবাই মিনাকে হারিয়ে দুঃখে-কষ্টে জর্জরিত। বাচ্চাটা তারস্বরে চিৎকার করছে। রেনু তাকে কোলে নিয়ে কাঁদছে। কাঁদছেন হালিমা, নীলা, এমনকি পাশের বাড়ির মহিলারাও। মুকুল পাথরের মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভুগছে। মিনা একটা বাচ্চা নষ্ট করে ফেলেছিল বলে তার ভীষণ রাগ হয়েছিল। তাকে খুশি করার জন্যই হয়তো মিনা আবারও মা হতে যাচ্ছিল। সে যদি জানত মিনা আরেকবার মা হতে গিয়ে মধুকেও মা-হারা করবে, তাহলে কখনোই আর মিনাকে মা হতে দিত না। কী করবে সে এখন এই বাচ্চা নিয়ে? ওকে কী খাওয়াবে? কীভাবে পালবে? প্রচণ্ড অসহায় লাগছে তার।
জেসমিনের বাচ্চা হবার পর মাসখানেকের জন্য তিন বউকে আবার রান্নার দায়িত্ব দিয়েছেন শরিফা বানু। এই কারণেই জেসমিন যে বাড়িতে নেই, তা টের পেতে একটু সময় লাগল তার। যখন টের পেলেন, তখন দুশ্চিন্তা হতে লাগল। কোথায় গেল মেয়েটা?
এদিকে জেসমিন গৌরনদী বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত যেতেই তার মেয়ে কাঁদতে শুরু করল। ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু এত ব্যস্ত জায়গায় কীভাবে খাওয়াবে ওকে। এদিক-ওদিক ঘুরেও এমন কোনো জায়গা খুঁজে পেল না, যেখানে বসে সে বাচ্চাকে খাওয়াতে পারে। নতুন মা হয়েছে সে। ঘরে বসেই এখনো খাওয়ানোতে অভ্যস্ত হয় নি। খোলা জায়গায় তো অসম্ভব। এমনিতেই অতি কৌতূহলী পুরুষদের লোলুপ দৃষ্টিতে সে কোথাও দুমিনিট বসতে পারছে না। অবশেষে মেয়ের কান্না বাড়লে হাল ছেড়ে দিয়ে ডাক্তারবাড়ি ফিরে এল। তাকে দেখতে পেয়ে শরিফা বানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোই গেছিলি?’
জেসমিন ইতস্তত করে বলল, ‘মাইয়া কান্তেয়াছিল, কিছুতেই থামে না। হেল্লিগা অরে কোলে লইয়া একটু হাঁটতে বাইর অইছিলাম। পুস্কুনির ওই পাড়ে গেছিলাম গিয়া।’
কথাটা ঠিক বিশ্বাস হলো না শরিফা বানুর। তবে তিনি কিছু বললেন না আর। জেসমিন ঘরে ঢুকে মেয়েকে খাওয়াতে লাগল।
ঠিক তখনই রেনু মিনার সদ্যোজাত ছেলেটাকে কোলে নিয়ে ডাক্তারবাড়িতে উপস্থিত হলো। সকাল থেকে ক্ষুধা-যন্ত্রণায় কাঁদছিল ছেলেটা। রেনু পাগলের মতো একজন বাচ্চার মা খুঁজছিল, যে তার বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ায়। তখনই পাশের বাড়ির এক মহিলা বলল, ‘ডাক্তারবাড়ির কামের বেডির বাচ্চা অইছে গত সপ্তায়। হে তো হের বাচ্চারে বুকের দুধ খাওয়ায়। হের কাছে গিয়া খাওয়াইয়া আনো।’
রেনুকে বাচ্চা কোলে দেখে শরিফা বানু বললেন, ‘আরে রেনু! কেমন আছ? বাচ্চা কার?’
‘কাকি, বাচ্চা মিনার। বাচ্চা হওয়ার সময় মিনা মইরা গেছে। এহোনো মুখে কিছু দিতে পারি নাই। খিদায় কান্তেয়াছে পোলায়। আমনেগো কামের মাইয়াডা শুনলাম বাচ্চারে বুকের দুধ খাওয়ায়। অরে কি একটু খাওয়াইতে পারবে? গেরামে এমন আর কাউরে খুঁইজ্জা পাইলাম না।’
শরিফা বানু আফসোস করে উঠলেন, ‘আহা রে, কী অভাগা পোলা গো। একবারও মায়ের দুধ খাইতে পারল না। আহো, ভিতরে আহো। জেসমিনরে কইয়া দেহি।’
জেসমিন তার মেয়েকে খাওয়াচ্ছিল। বাচ্চা ছেলেটার মা তাকে জন্ম দিয়েই মারা গেছে শুনে খারাপ লাগল জেসমিনের। সে নিজের মেয়েকে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর ছেলেটাকে রেনুর কোল থেকে নিয়ে খাওয়ানো শুরু করল। জেসমিন রেনুকে জিজ্ঞেস করল, ‘আমনেগো বাড়ি কত দূর, আফা?’
রেনু বলল, ‘এই তো ধারেই। রাস্তার ওই পারে।’
জেসমিন বলল, ‘হেলে তো ধারেই। বাবুর খিদা লাগলেই লইয়া আইয়েন। মোর কোনো সমেস্যা নাই। ‘
রেনু চোখ মুছে বলল, ‘আল্লাহ তোমার ভালো করুক, বুইন। ‘
ঠিক এই মুহূর্তেই শরিফার মনে হলো, মুকুল ভালো পাত্র হতে পারে জেসমিনের জন্য। মুকুলের বড় ছেলেটাও এখনো অনেক ছোট। তার ওপর সদ্য জন্মানো আরেকটা ছেলে। মা ছাড়া এদের পালবে কীভাবে? রেনু সারা বছর থাকে অসুস্থ। মুকুলের বয়সও কম, ছেলে ভালো। গায়ের রং একটু ময়লা কিন্তু জেসমিনের জন্য এর চেয়ে ভালো পাত্র আর হয় না। এখন ওরা জেসমিনের মেয়েটাকে মেনে নিলেই হয়। কিন্তু সবে মিনা মারা গেছে, এখনই বিয়ের কথা বলেন কোন মুখে? কদিন যাক। এরপর রেনুর কাছে তিনি বিয়ের প্রস্তাব দেবেন।
নাইয়রি – ৩৫
৩৫
মুকুলের এখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কারণ, দুই ছেলে একসাথে কাঁদতে শুরু করেছে। মধু কেন কাঁদছে, জিজ্ঞেস করলে বলে জানে না। হয়তো মায়ের অনুপস্থিতি অনুভব করছে কিন্তু বুঝতে পারছে না। এদিকে ছোটটা কেন কাঁদছে, সেটা তো জিজ্ঞেস করারও উপায় নেই। হয়তো ক্ষুধা লেগেছে। ছোট বাচ্চাদের গরুর দুধ হজম হয় না। তাদেরকে ছাগলের দুধের সাথে সমপরিমাণ পানি মিশিয়ে খাওয়ানো যেতে পারে। তাই রেনু ছাগলের দুধ পানি মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে রেখে গেছে। কাঁদলে খাওয়াতে বলেছে। কিন্তু মুকুল প্রতি রাতেই এই চেষ্টায় ব্যর্থ হয়। রেনুর ঘুম ভাঙলে সে এসে খাইয়ে রেখে যায়। আজ এল না। সম্ভবত তার শরীরটা আবার খারাপ করেছে। মুকুল বাটিতে দুধ ঢেলে নিয়ে এল। চামচ দিয়ে একটু তুলে মুখে দিচ্ছে আর অমনি ছেলে তা ফেলে দিচ্ছে। মুকুল মুখ মুছিয়ে আবারও দিচ্ছে, ছেলে আবারও ফেলছে। এমন অসহায় দিন কখনো আসবে মুকুল কি ভেবেছিল? কেন চলে গেল মিনা? কিসের শাস্তি দিয়ে গেল তাকে?
জেসমিনের বাচ্চাটা ছোট বলে শরিফা বানু তার বাপের বাড়ি থেকে একটা কাজের লোক এনেছেন। তবে মেয়েটার রান্নার হাত ভালো না। তাই সে অন্য কাজ করে, রান্নাবান্না বউদেরই করতে হয়। যদিও বাচ্চা যতক্ষণ ঘুমায়, জেসমিন তাকে শরিফা বানুর কাছে রেখে রান্নাবান্না যতটুকু পারে এগিয়ে দেয়। তবু মাসখানেক যেতে না যেতেই একদিন নুরজাহান শাশুড়িকে বলল, ‘কামের মাইনষেরে আর কয় দিন বহাইয়া খাওয়াইবেন, আম্মা? ও ঘরে বইয়া আরাম করে আর কাম করতে করতে মরি মোরা। এইডা আমনের কেমন বিচার?’
শরিফা বললেন, ‘জেসমিন না থাকলে ক্যামনে করতা?’
‘না থাকলে যেমনে পারতাম করতাম। থাকতে করমু ক্যা?’
‘অর মাইয়াডা অনেক ছোডো। অরে রাইখ্যা কাম করবে ক্যামনে?’
নুরজাহান মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘আর কামের বেডিগো তো আর বাচ্চা অয় না। একলা অর অইছে।’
আরও কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পর শরিফা বানুই থামলেন। তিনি না থামলে এই তর্ক কখনোই থামবে না। তার থামার আরেকটা কারণ হচ্ছে রেনু। মিনা-মুকুলের বাচ্চাকে নিয়ে এসেছে দুধ খাওয়াতে। বাচ্চাটা কাঁদছিল। কাছাকাছি আসতেই শরিফা কিছু বলার আগে নুরজাহান বললেন, ‘নিজের বাচ্চায় ছুতায় কোনো কামে হাত দেয় না, এহন আবার আরেক বাচ্চা দুধ খাওয়ানের বর্গা লইছে।’
এ কথা শুনে চমকে উঠল রেনু। শঙ্কিতও হলো। যদি ওরা দুধ খাওয়াতে না দেয়, তাহলে বাচ্চাটাকে কী খাওয়াবে তারা? কৌটার দুধে যে খরচ, পুরা সংসার খরচ দিয়ে ফেললেও হবে না। শরিফা রেনুকে ঘরে নিয়ে গেলেন। জেসমিন বাচ্চাটাকে কোলে নিতে নিতে বলল, ‘আহা রে বাজান, বেশি খিদা লাগছে? থাক, আর কাইন্দ না, নেও, খাও।’
বাচ্চাটার কান্না থেমে গেল, সে আরাম করে খেতে লাগল। জেসমিন বলল, ‘আইজ এত দেরি করলেন ক্যা, আফা? পোলার তো ম্যালা খিদা লাইগ্যা গেছে।’
রেনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘শইলডা ভালো না, বুইন। আমার মাইয়াডারে এত কইরা কইলাম অরে লইয়া আইতে, হে শরমেই বাঁচে না।’
‘রাইতে কী খাওয়ান অরে?’
‘কী আর খাওয়ামু? গরিব মানুষ! ছাগলের দুধ খাওয়াই। খাইতে চায় না। জোর কইরা খাওয়ান লাগে। এই বয়সে এত খাওনের কষ্ট করে পোলাডা! কান্দন আহে আমার।’
জেসমিনের মনখারাপ হলো। দুধ পড়ে তার কাপড় ভিজে যায় অথচ ছেলেটা ক্ষুধায় কষ্ট করে!
.
রেনু যখন ছেলেকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছিল, তখন শরিফা তার সাথে বের হলেন। রেনু জিজ্ঞেস করল, ‘কাকি, কই যান?’
শরিফা বাড়ি থেকে বের হয়ে তারপর বললেন, ‘রেনু, আমি তোমারে একটা প্রস্তাব দিতে চাই। তোমরাও আছ বিপদে। আমরাও আছি বিপদে। এর চেয়ে ভালো সমাধান আর অয় না।’
রেনু বুঝতে পারল না। সে জানতে চাইল, ‘কিসের প্রস্তাব, কাকি?’
‘তোমাগো মুকুলরে বিয়া করাবা না?’
রেনু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘করাইতে তো চাই কিন্তু ও তো রাজি অয় না। ম্যালা বুজাইছি। হপায় বউডা মরছে তো। যাক কিছুদিন, হেরপর আবার চেষ্টা করমু। ছোডো ছোডো দুগ্গা পোলা। মুই এই বয়সে আর কয় দিন পালতারমু। তার ওপর শইলডাও বালো না।’
শরিফা বললেন, ‘মুই কই কি, মুকুল আর জেসমিনের বিয়া দিলে কেমন অয়?’
আকাশ থেকে পড়ল রেনু। বলল, ‘মাইয়া বিয়াতো না?’
‘বিধবা।’
‘আহা রে!”
শরিফা বানু বললেন, ‘মাইয়ার মাত্র ১৭ বছর বয়স। বাকি জীবন তো পইড়াই রইছে। এইল্লাইগ্যা পাত্র দেখতাছি। বিয়া দিয়া দিমু। খুব ভালো মাইয়া। কামকাইজও সব জানে। চেহারা তো তুমি নিজ চউক্ষে দেখছ। মুকুলেরও অল্প বয়স, ওর পোলাগোও মা দরকার। জেসমিনেরও একটা ঘর দরকার। তুমি মুকুলের লগে কথা কইয়া আমারে জানাও, মা গো। রাজি অইলে মাইয়া দেখানের ব্যবস্থা করমু।’
‘আচ্ছা কাকি।’
.
রেনু বাড়ি ফিরে দেখে মুকুল মধুকে গোসল করিয়ে এনে চুল মুছে দিচ্ছে। মধু জিজ্ঞেস করল, ‘আব্বা, আম্মায় কি আর আইবে না?’
মুকুল যন্ত্রের মতো বলল, ‘না।’
‘ক্যা? মায় কি রাগোইছে?
‘মানুষ মইরা গেলে আর আহে না।’
‘তয় মইরা গেল ক্যা?’
মুকুলের এত রাগ লাগছে, ইচ্ছা করছে এক চড়ে মধুর সব দাঁত ফেলে দেয়।
রেনু বলল, ‘তুমি নীলাবুর ধারে যাও। হে তোমারে আম কাইড্যা দেবেয়ানে।’
মধু চলে গেলে রেনু মুকুলকে বিয়ের প্রস্তাবটা দিল। মুকুল সঙ্গে সঙ্গে মানা করে দিল।
রেনু অবাক হয়ে বলল, “বিয়া করতে চাস না ক্যা তুই?’
মুকুল বিরক্তমুখে বলল, ‘ঘর-সংসার আমার ভালো লাগে না, ভাবি। এই সব গ্যাঞ্জামে আমি আর জড়াইতে চাই না।
রেনু রেগে গিয়ে বলল, “হেলে পোলাপান হওয়াইছ ক্যা? তোমার পোলাগো কেডা পালবে? হেরা কি বাতাসে বড় অইবে?’
‘তোমরা তো আছ। আমি আছি। সবাই মিল্লা পালমু।’
‘নাই আমি। তোগো ছোডোকালেইত্যা পালছি। তোগো পোলাপানও পালমু ক্যামনে? মোর শইল কি লোহা দিয়া বানাইছেনি আল্লায়? নিজের পোলাগো নিজে পালতে না পারলে, বিয়া না করলে মাইনষেরে পালতে দিয়া দে। মুই তোগো বাড়ির কামলা না।’
রেনু বাচ্চাটাকে বিছানার ওপর রেখে চলে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চাটা কাঁদতে শুরু করল। মুকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাচ্চাকে কোলে নিল। কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটার পর বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়ল।
৩৬
মুকুলের বিয়ের ব্যাপারে বাড়ির সবার সাথে আলাপ করে রেনু। সব শুনে আব্বাসের প্রস্তাবটা পছন্দ হয়। মোকসেদ এই বাড়িতে অনেকটা অদৃশ্য হয়ে থাকেন। বেশির ভাগ বিষয়েই তিনি বিশেষ কোনো মতামত দেন না। এই বিষয়েও দিলেন না। বাদ সাধলেন হালিমা। তিনি বললেন, ‘মুকুলের বয়েস কম। বিয়া করাইতে অইলে আবিয়াতো মাইয়া বিয়া করামু। বিধবা, তার ওপরে বাচ্চা আছে, এমন মাইয়া বিয়া করানের কী এমন দরকার পড়ছে? মাইয়ার কি অভাব দুনিয়াতে?’
রেনু বলল, ‘আম্মা, মাইয়ার তো অভাব নাই। কিন্তু মুকুলের দুই পোলা এহনো ছোডো। অগো পালার মতো মাইয়া তো লাগবে। একটা বউ আইন্না দিলেই অইলো না। এই মাইয়া এককালে নরম-শরম। খুব বালো মাইয়া। দেখতেও সুন্দরী। সব মিলায়া মাইয়া আমার খুবই পছন্দ অইছে।’
হালিমা কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই আব্বাস বলল, ‘হোনো রেনু, এত মাইনষের মতামতের দরকার নাই। মুকুলের লগে ভালোমতো কতা কও। ও রাজি থাকলে এহনই বিয়ার ব্যবস্থা করমু। মা ছাড়া পোলাপানগুলার মুখের দিক চাওন যায় না।’
আব্বাসের এ কথার পর নিমেষেই সকলে চুপ হয়ে গেল।
.
মিনা মারা যাবার পর বাচ্চাদের নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল মুকুল যে এত দিন কাজে যেতে পারে নি। এদিকে টাকাপয়সাও সব শেষ। কাজে না গেলে খাবে কী? তাই ঠিক করেছে, আজ থেকে আবার কাজে যাবে। টুকটাক কিছু কাজ আছে। যাবার সময় বাচ্চাকে রেনুর কাছে দিতে যেতেই রেনু বলল, ‘মোর কি আর কাম নাই রে মুকুইল্যা? তোর পোলা মুই রাখতে পারমু না। এহন রানতে যামু, নাইলে গুষ্টিসুদ্ধা না খাইয়া থাহা লাগবে।’
মুকুল মুখ কালো করে বাচ্চাটাকে নিয়ে নীলার কাছে গেল। গিয়ে দেখে সে স্কুলে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। তাই তাকে আর কিছু বলল না। এবার গেল হালিমার কাছে। তিনি বললেন, ‘এই আপদ এহন আমার রাহন লাগবে?’
মুকুল অবাক হয়ে বলল, ‘আম্মা, আমনে আমনের নাতিরে আপদ কইলেন?’ নাতি-নাতকুর তো দাদা-দাদিই পাইল্যা দেয়।’
‘আপদ না তয় কী? জন্মাইয়াই তো মায়রে খাইল, এহন পুরা সংসারডা না খাইলেই অয়। ‘
খেঁকিয়ে উঠলেন হালিমা। মুকুল কিছু বলার আগেই মোকসেদ বললেন, ‘রাখ বাবা, তুই অরে এহেনে হোয়াই রাইক্কা যা। মুই দেখমুয়ানে।
মুকুল এবার বাচ্চাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাবাকে বলল, ‘কানলে ভাবির ধারে লইয়া যাইও। খাওয়াই দেবেয়ানে।’
কাজে গিয়েও মুকুল শান্তি পাচ্ছিল না। বারবার মনে হচ্ছিল বাবা কি আসলেই বাচ্চাকে দেখে রাখতে পারবে? ভাবির রাগ কি ভাঙবে না?
নানান দুশ্চিন্তায় টিকতে না পেরে দুপুরের মধ্যেই বাড়ি ফিরল মুকুল। ফিরে দেখে বাচ্চা ব্যথা পেয়েছে। এইটুকু সময়ের জন্য বাচ্চাটাকে এরা দেখে রাখতে পারল না! রাগে-অভিমানে, অসহায়ত্বে নিজেকে এক্ষুনি শেষ করে দিতে ইচ্ছা করল।
.
সন্ধ্যাবেলা রেনু বাচ্চার খাবার দিয়ে চলে যাচ্ছিল। মুকুল বলল, ‘ভাবি, মনু এগুলা খাইতে চায় না। এহনো ত রাইত অয় নাই। ওই বাড়িত্তা দুধ খাওয়াইয়া আনো না।’
রেনু কিছুক্ষণ আগেই বাচ্চাকে খাইয়ে এনেছে। কিন্তু মুকুলের কাছে গোপন করেছে। সে ধমক দিয়ে বলল, ‘পারমু না। ছেড়িরে বিয়া করতে চাস না। আবার দুধ খাওয়াইতে নিতে কস। তোর শরম করে না?’
মুকুল অবাক! সে বলল, ‘আরে, আমি তো হেরে চিনিই না। হেরে বিয়া করতে চাই না, এমন তো না। বিয়াই আর করতে চাই না। তুমিই তো হের ধারে মনুরে খাওয়াইতে নিতা। এইল্লাইগ্যা কইছি।’
‘আর পারমু না।’
রেনু মুখ ঝামটা দিয়ে চলে গেল।
পরপর কয়েক দিন এ রকম চলার পর মুকুল বিয়ে করতে রাজি হলো। রেনু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। চিন্তামুক্ত হলো। মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা বললে মুকুল বলল, ‘দেহা লাগবে না। তোমরা তো দেকছই। বিয়ার ব্যবস্থা করো।’
জেসমিনও রাজি হলো। প্রথম দিকে বিয়ে করতে না চাইলেও যা কিছু ঘটে গেল, তারপর এখন এই বাড়ি থেকে বের হতে পারছে আর নিরাপদ একটা আশ্রয় পাচ্ছে, এতেই স্বস্তি পেল।
.
খুব তাড়াহুড়ার মধ্যেই অনাড়ম্বরভাবে বিয়েটা হয়ে গেল। কবুল বলার আগে জেসমিন মনে মনে বারবার একই কথা আওড়াচ্ছিল, ‘মাফ কইরা দিয়ো, রঞ্জু। এই অভাগিনীরে মাফ কইরা দিয়ো। সারা জীবন তোমার থাকতে পারলাম না।’
মুকুল বউকে কিছু দিতে পারল না, একেবারেই কিছু না। আব্বাস এখন যেখানে কাজ করছে, সেখান থেকে কিছু টাকা অগ্রিম চেয়ে এনে একটা শাড়ি কিনল। তা না হলে কী পরিয়ে বউ আনবে। এ বাড়ি থেকে ওই শাড়িটি ছাড়া আর কিছুই দেওয়া হলো না। মুকুলের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে শরিফা জেসমিনকে পূর্বেই অবগত করেছেন। জেসমিন অবশ্য একটু নিরাপদ আশ্রয় ছাড়া আর কিছুই আশা করে না।
তবে শরিফা খরচাপাতি ভালোই করলেন। মুকুলের বাড়ির সবাইকে এক বেলা ভালো-মন্দ খাওয়ালেন। শুধু তা-ই না, জেসমিনকে তিনি যেসব শাড়ি পরতে দিয়েছিলেন, সেগুলো সবই অনেকখানি করে ছিঁড়ে গেছে। সেই সব কি আর নিতে দেওয়া যায়? তিনি জেসমিনকে দুটো শাড়ি কিনে দিলেন। মুকুলকে একটি পাঞ্জাবি কিনে দিলেন। সঙ্গে জেসমিন ও মুকুলের ছেলেমেয়েদের জন্য একটি করে জামাকাপড়।
৩৭
মধু এত দিন চাচার জন্য বউ আনতে দেখেছে, ভাইদের জন্য বউ আনতে দেখেছে। এই প্রথম বাবার জন্য বউ আনতে দেখছে। বাবার জন্যও যে বউ আনা যায়, এটি সে জানত না। তবে সে ভীষণ খুশি। নতুন বউ তার খুব ভালো লাগে। চাচার বউ তার সাথে কথা বলত না। তার মন খারাপ হতো। কিন্তু বাবার বউ তার সাথে অনেক কথা বলছে। বাবার বউ সাথে করে একটা বাবুও এনেছে। চাচি বলেছে, এটা তার বোন। ভালোই হলো, এত দিন তার একটা ভাই ছিল, এখন একটা বোনও আছে। ওরা আরেকটু একটু বড় হলে আর পাশের বাড়িতে খেলতে যেতে হবে না। ওদের সাথেই খেলতে পারবে।
মধু জেসমিনের দিকে চেয়ে বলল, ‘আচ্ছা, মুই তোমারে কী কইয়া ডাকমু?’
জেসমিন কিছু বলার আগেই রেনু বলল, ‘মা কইবা, বাবা।’
মধু অবাক হলো। ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘মা কমু ক্যা? মোর মায় তো মইর্যা গেছে। যে মইরা যায়, হে আর কোনো দিন আহে না, এই কতা তুমি জানো না, কাকি?’
রেনু কিছু বলার আগেই জেসমিন বলল, ‘তোমার আমারে কী ডাকতে মনে চায়, বাজান? তোমার যা ডাকতে মনে চায়, তাই ডাইকো।’
মধু এক সেকেন্ডের মধ্যে বলল, ‘মোর তোমারে নতুন বউ ডাকতে মনে চায়।’
রেনু জেসমিন দুজনেই হেসে দিল। জেসমিন বলল, ‘তাইলে তাই ডাইকো।’
মধু ভীষণ খুশি হলো।
এবার রেনু বলল, ‘হইছে মধু, এইবার ঘুমাইতে লও।’
মধু বিনাবাক্যে রওনা হলো। কারণ, রেনু তাকে বলেছে সে এখন বড় হয়েছে। যেহেতু তার আরেকটা ভাই ও আরেকটা বোন এসেছে, তাই তাকে তার ইমরান ভাইয়ের সাথে থাকতে হবে। বড়রা একসাথে থাকবে, আর ছোটরা একসাথে থাকবে। যদি সে এখনো এখানে থাকতে চায়, তাহলে তার নতুন ভাই-বোন আর নতুন বউয়ের জায়গা হবে না। রেনুর এই এককথাতেই সে রাজি হয়ে গেছে। এমনিতেও ইমরানকে মধুর ভীষণ পছন্দ। ইমরানের সাথে ঘুমালে সে মধুকে দারুণ দারুণ সব গল্প শোনায়।
জেসমিন বলল, ‘ও থাকুক না, আফা। ওর তো ওর বাপের লগে ঘুমাইয়াই অভ্যাস।’
রেনু কিছু বলার আগেই মধু বলল, ‘না না, নতুন বউ, মুই যদি এহেনে থাহি, তয় তুমি কই থাকপা? মোর নতুন ভাই আর নতুন বুইনে কই থাকপে?’
জেসমিনের লজ্জা লাগছে। সে স্পষ্টই বুঝতে পারছে রেনুই মধুকে আগেভাগে এসব বুঝিয়ে রেখেছে। মধু থাকলে সে একটু নিশ্চিন্তে থাকত। লোকটাকে এখনো দেখেও নি জেসমিন। যদিও লোকটা এখন তার স্বামী, তবু চেনে না, জানে না। খুব অস্বস্তি লাগছে। কীভাবে সে একটা অচেনা লোকের কাছে নিজেকে সঁপে দেবে?
দুই ছেলে-মেয়ের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবনায় বুঁদ হয়ে ছিল জেসমিন 1 তখনই দরজা খোলার শব্দ পেয়ে জেসমিন ঘোমটাটা আরেকটু টেনে নিল। মুকুল মধুকে ঘরে না দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘মধু কই?’
জেসমিন ইতস্তত করে বলল, ‘আফায় লইয়া গ্যাছে।’
‘কোন আফা?’
‘আমনের ভাবি।’
মুকুলের মনটা ভার হয়ে গেল। তার সাথে ঘুমিয়ে অভ্যাস মধুর। কাজটা ঠিক করে নি ভাবি। মুকুল জেসমিনের উদ্দেশে বলল, ‘মধু যদি আমাগো লগেই থাকে, তোমার কোনো অসুবিধা অইবে?’
জেসমিন সঙ্গে সঙ্গেই বলল, ‘না না, মোর কোনো অসুবিধা নাই।’
‘আচ্ছা, তাইলে গিয়া নিয়া আহি। ও মোরে ছাড়া ঘুমাইতে পারবে না, কানবে।’
মুকুল বেরিয়ে গেল। লোকটাকে ভালো লাগল জেসমিনের। নতুন বউ পেয়ে যে ছেলেকে ভুলে যায় নি, সে নিঃসন্দেহে ভালো মানুষ।
.
মুকুল মধুকে ডাকতে গিয়ে দেখে কান্না তো বহুদূর, সে ইমরানের সাথে গুটুর গুটুর করে গল্প করছে। মুকুল বলল, ‘মধু, ঘুমাইতে আয়।’
মধু উঠে বসে বলল, ‘ঘুমাইতেই তো আইছি।’
‘তুই এহেনে ঘুমাবি?’
অবাক হলো মুকুল। মধু বলল, ‘হয়, মুই ত বড় অইয়া গেছি। হেইল্লাইগ্যা এহেনে ঘুমামু। এইডা বড় ভাইগো ঘর। আর ছোড ভাই ছোডো বুইনে তোমার লগে ঘুমাইবে।’
ধমকে উঠল মুকুল, ‘এত পাকনামি কে হিকাইছে তোরে? রাইতে তো উইড্যা কানবি। আয় কইলাম।’
‘কানমু না, তুমি যাও। মুই এহন বড় ভাই।’
ইমরান বলল, ‘কাকা, তুমি চিন্তা কইরো না। মধু তো মোর লগে আগেও ঘুমাইছে। কোনো সময় কান্দে নাই।’
মধু বলল, ‘হয় কান্দি নাই।’
অগত্যা মুকুল ফিরে এল ঘরে। রেনুর ওপর রাগ হলো তার। একদম বিয়ের দিন থেকেই ছেলেটাকে সরিয়ে দেওয়ার কী দরকার ছিল? একটু লজ্জাও লাগছে। রেনু কী মনে করে তাকে?
মুকুল একা ফিরে এলে জেসমিনের মনে আবারও ভয় ঢোকে। ঘোমটার আড়াল থেকেই বলল, ‘আইলো না?’
‘না।’
মুকুল বিছানার এক কোনায় বসল। তারপর বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমার কাছে মুই আজীবন ঋণী থাকমু।’
জেসমিন অবাক হলো, তারপর আড়চোখে তাকাল মুকুলের দিকে। এই প্রথম তাকে দেখল। তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ক্যা?’
‘এই যে জন্মের দিনেইত্যা আমার পোলাডারে খাওয়াইতেয়াছ।’
হাসল জেসমিন, ‘এ আর এমন কী?’
‘অনেক কিছু, মোর লাহান বিপদে পড়লে বুঝতা। সারা রাইত পোলা কোলে লইয়া বইয়া থাকতাম। কোন সময় রাইত পোহাইবে আর ভাবি অরে খাওয়াইতে নেবে। কিছুই খাইতে চাইত না, খালি কানত।’
জেসমিন চুপচাপ শুনল। সেও যদি নিজের বিপদের কথা মুকুলের মতো এত অনায়াসে বলতে পারত! মুকুল প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘জেসমিন, তুমি মোর ব্যাপারে কতডু জানো, তা জানি না। মুই গরিব মানুষ। আয়-উপার্জন খুবই কম। ঘর-সংসার করার মতো না। মধুর মার লগে যহন বিয়া অয়, তহন বয়স অনেক কম, ঘর-সংসার বুজি না। বাপ-মায় বিয়া করাইতে চাইছে, মুইও কইর্যা হালাইছি। বউরে কী খাওয়ামু, এই চিন্তা মাথায় কোনো দিন আহে নাই। মিনা অনেক কষ্ট করছে মোর লগে ঘর করতে যাইয়া। এহন ঘর-সংসার বুজি, তাই চাই নাই আর কেউ এই কষ্ট করুক। এই ডরেই বিয়া করতে চাই নাই আর। কিন্তু পোলাপানের লাইগা করতে অইলো। তোমারও হয়তো কষ্ট করা লাগবে। মাফ কইরা দিয়ো।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘জানি। তয় আমনে মনে অয় মোর ব্যাপারে কিছুই জানেন না। মাইনষের বাড়ি আশ্রিত থাকার চেয়ে স্বামীর বাড়িতে অভাবে থাকন ভালো।’
নতুন বউ বলে হয়তো মিষ্টি কথা বলছে, এ কথা ভেবে মুকুল হাসল। তারপর তাকাল জেসমিনের দিকে। কিন্তু ঘোমটায় মুখ ঢেকে রেখেছে। রাখুক, লজ্জা একটু কমুক। সে বলল, ‘মাইয়াডারে দেও, একটু কোলে লই।’
এই ছোট্ট একটা কথায় জেসমিনের বুকের ভেতরটায় ভেঙেচুরে কান্না এল। এটা খুশির কান্না, নাকি কষ্টের, সে বুঝতে পারল না। মেয়েকে বিছানা থেকে তুলে মুকুলের কোলে দিল। তখন জেসমিনের আঁচলটা পড়ে গেল। বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ‘মাশা আল্লাহ’ বলে জেসমিনের দিকে তাকাতেই মুকুলের বুক কেঁপে উঠল! এ কি মানুষ, নাকি কোনো পরি? মানুষ কি এত সুন্দর হয়? এই মানুষটা তার স্ত্রী? আসলেই একে বিয়ে করেছে সে? মুকুলের কথা আটকে গেল, আরেকটু হলে নিশ্বাস আটকে যেত। মুকুল চোখ সরিয়ে নিল। জেসমিন আবারও ঘোমটা দিল। ওর দিকে তাকাতেও এখন ভয় লাগছে মুকুলের। প্রচণ্ড অস্থির লাগছে!
মুকুল এতটাই এলোমেলো হয়ে গেছে যে কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছে না। মেয়েটার দিকেই তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অস্থিরতা কমলে নাহয় কথা বলবে। কিন্তু এই অস্থিরতা কমার কোনো লক্ষণ নেই। মুকুল মেয়েকে ফেরত দিয়ে কোনোরকমে বলল, ‘বিছনাডা ছোডো। আমাগো সবাইর অইবে না। তুমি পোলা-মাইয়া লইয়া শোও। আমি নিচে বিছনা করি।’
বিছানাটা বেশ বড়। দুটো ছোট ছোট বাচ্চা নিয়ে তাদের কেন জায়গা হবে না, সে বুঝল না। বলল, ‘হেলে আমনে বিছনায় শোন। মুই নিচে শুই।’
‘আরে, না না। তুমি নতুন বউ। তুমি নিচে শুইবা ক্যা? তার ওপর তোমার লগে দুই পোলা-মাইয়া।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘মধু মোরে মা কইতে চায় না। কী কইতে চায়, জানেন?
‘কী?’
‘নতুন বউ।
মুকুল হো হো করে হেসে দিল। জেসমিনও খিলখিলিয়ে হাসল। মুকুল খুব চেষ্টা করল জেসমিনের হাসিমুখটা দেখার কিন্তু ঘোমটার যন্ত্রণায় পারল না।
হাসাহাসি শেষ হলে জেসমিন বলল, ‘মুই কই কি, নিচে বিছনা করোন লাগবে না। বাবুরা এহনো ম্যালা ছোডো। এই বিছনায় আরামসে অইয়া যাইবে।’
মুকুল বলল, ‘আচ্ছা, শুইয়া পড়ো তাইলে। ম্যালা রাইত অইছে।’
জেসমিন দুই বাচ্চাকে নিজের দুই পাশে রাখল। একজন টিনের দেয়ালের পাশে, আরেকজন মুকুলের পাশে। তারপর নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ল। সে এখন বেশ নির্ভার বোধ করছে। এই যে মানুষটা তাকে একটু সহজ হবার সময় দিয়েছে, এটুকুতেই সে বুঝিয়ে দিয়েছে সে কেমন মানুষ।
৩৮
অস্থিরতায় সারা রাত ঘুমাতে পারল না মুকুল। অন্য দিকে জেসমিন এত দিন পর নিশ্চিন্তে ঘুমাল। সকালবেলা জেসমিন মুকুলকে বলল, ‘মনুরা ঘুমাইতেয়াছে। আমনে একটু অগো দেখতারবেন? হেলে মুই ইকটু আফার লগে হাত লাগাই। বেচারি হেই কোন কাল হইতে একলা একলা সব কাম করতেয়াছে।’
মুকুল অভয় দিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, মুই আছি। তুমি যাও।’
রেনু কেবল রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জেসমিন রান্নাঘরে ঢুকে রান্না করতে চাইলেই রেনু বলল, ‘আরে, তুমি নতুন বউ। যাও যাও, কয় দিন আরাম করো।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘এই যে নিজের একখান ঘর অইছে, এইডাই আরাম গো আফা। আমনে মোরে দেন। দেহেন কেমন রান্দি।’
‘তুমি যে ভালো রান্দো, এইডা মুই জানি। ডাক্তারের মায় কইছে। আচ্ছা, চাইতেয়াছ যহন, রান্দো।’
জেসমিন খুব দ্রুত কাজ করে। চোখের পলকে রান্নাবান্না শেষ করে ফেলল। রান্না শেষে রান্নাঘরটা যখন গোছাচ্ছিল, তখন সেখানে এসে হাজির হলেন হালিমা।
কোনো ভালো-মন্দ কথা নেই, হুট করেই জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘এই মাইয়া, ডাক্তারবাড়িতে কত দিন কাম করছ?’
জেসমিন বলল, ‘সাত-আট মাস অইবে।’
‘হেলে তো মেলা দিন। পয়সাপাতি কেমন জমাইছ?’
জেসমিন অবাক হলো। রেনু চাপা গলায় বলল, ‘আম্মা! কী কন এগুলা!”
হালিমা রেনুকে ধমকে বললেন, ‘তুই চুপ কর। বেয়াদব কোনহানকার, শাশুড়িরে ধমকাস।’
রেনু চুপ হয়ে গেল। কিন্তু এমন প্রশ্নে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছে সে। হালিমা এবার জেসমিনকে ধমকে বললেন, ‘এই ছেড়ি! কতা কস না ক্যা?’
জেসমিন বলল, ‘আসলে আম্মা, থাকা-খাওয়ার লাইগ্যা কাম করতাম। পয়সাপাতির বিষয় আছিল না।’
হালিমা ক্ষিপ্তস্বরে বললেন, ‘ওরে আমার দয়ার সাগর!’
চেঁচামেচি শুনে মুকুল এসে দরজায় দাঁড়াল। ঠিক সেই সময় আব্বাস বাড়িতে ঢুকছিল। মুকুল কিছু বলার আগেই সে বলল, ‘রেনু, কী অইছে এহেনে?’
রেনু দ্রুত বলল, ‘কিছু অয় নাই। আমরা এমনেই কথা কইতেয়াছিলাম।’
হালিমা মুহূর্তেই সেখান থেকে সরে গেলেন। হালিমা সরে গেলে আব্বাস আর মুকুলও সরে গেল। রেনু জেসমিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি মনে কষ্ট নিও না বুইন। উনি একটু এই রকমই।’
‘না না, কষ্ট পাই নাই।’
জেসমিন কাজ শেষ করে ঘরে আসতেই মুকুল বলল, ‘আম্মা কী কইতেয়াছিল তোমারে?’
জেসমিন মাথা নিচু করে বলল, ‘তেমন কিছু না।’
‘আমার কাছে লুকাইও না। সব কথা শুনতে পারি নাই। চেঁচামেচি শুইনা গেছি, তহনই ভাইজান আইছে আর আম্মা থাইম্মা গেছে।’
জেসমিন ইতস্তত করে ঘটনাটা বলল। মুকুল বলল, ‘এই লোভই ওনারে ডুবাইছে। লোভ কইরা ছোডো পোলারে হারাইছে। বছরে এক দিন চেহারা দেখতেও আহে না। হেরপরেও শিক্ষা অয় নাই।’
জেসমিন চুপ।
মুকুল আবার বলল, ‘হোনো, ওনারে পাত্তা দেওয়ার দরকার নাই। ওনারে যত বেশি পাত্তা দেবা, তত খারাপ ব্যবহার পাইবা। ওনার লগে যত শক্ত অইতে পারবা, উনি তত ডরাইবে। এইডা আমরা নিজে নিজে বুজি নাই। আমাগো ছোডো ভাইয়ের বউ প্রমাণ কইরা দিয়া গেছে।’
‘আহ্, থাক না। বাদ দেন।’
‘আইছে! আরেক রেনু!”
জেসমিন মুচকি হাসল। সেই হাসি মুকুল দেখল না। কারণ, জেসমিন ঘোমটা দিয়ে অন্য দিকে ফিরে কথা বলে।
জেসমিন বাচ্চাদের কাছে গেল। ওদের খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। একজনের ঘুম ভেঙেছে। আরেকজন এখনো ঘুমে। মুকুলের সামনে খাওয়াতে ভীষণ লজ্জা লাগছে। কিন্তু সে স্বামী, তাকে তো আর বাইরে যেতে বলা যায় না। উল্টো দিকে ঘুরে বসে বাচ্চাটাকে আঁচলের তলায় নিয়ে খাওয়ানোর চেষ্টা করল। জেসমিনের অস্বস্তিটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সেটা খেয়াল করেই মুকুল ঘর থেকে বের হয়ে গেল। জেসমিন আবারও হাসল।
.
একদিন রাতের বেলা মধুকে পড়তে বসিয়েছে মুকুল। কিছুতেই তাকে এক, দুই, তিনের ধারাবাহিকতা শেখানো যাচ্ছে না। সে বলছে, এক, চার, তিন, পাঁচ। পাঁচের পর থেকে আবার দশ পর্যন্ত ঠিকঠাক পারে। মুকুল বিরক্ত হয়ে ধমকাচ্ছিল। জেসমিন মধুকে বলল, ‘বাজান, তোমরা মোট কয় ভাই-বুইন?’
মধু ঠোঁট উল্টে বলল, ‘মুই তো জানি না, নতুন বউ।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘তোমরা পাঁচ ভাই-বুইন। সবার বড় কে, কও তো?’
‘ইমরান বাইয়া।’
‘হেরপর?’
‘নীলা বু।’
‘নীলা বুর পরে কে?
এবার মধু নিজেকে দেখিয়ে বলল, ‘মধু। কিন্তু হেরপর কে, এইডা তো জানি না। ছোডো মনুরা তো দুইজন একই সোমান।’
‘না, তোমার বুইনে তোমার ভাইয়ের থেইক্কা এক মাসের বড়। বেবাকটির ছোডো তোমার ভাই।’
‘ও।’
‘এইবার শোনো, তোমার ইমরান বাইয়া অইল এক, তোমার নীলা বু দুই, তুমি তিন, তোমার ছোডো বুইনে চাইর, আর তোমার ছোডো ভাইয়ে পাঁচ। এইবার এক থেইক্কা কও দেহি, বাজান।’
মধু একেকজনের চেহারা মনে করে করে বলল, ‘এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ।’
জেসমিন হাততালি দিয়ে বলল, ‘সাব্বাস, এই তো পারছে আমার বাজানে।’
মধু আরও একবার বলল, এবারও ভুল হলো না। তারপর সে পড়া রেখে উঠে ছুটে গেল জেসমিনের কাছে। জেসমিন তাকে কোলে নিল। তারপর মুকুলের দিকে তাকিয়ে মধু বলল, ‘তুমি পড়াইতে পারো না। মুই তোমার ধারে পড়মু না। মুই কাইল হইতে নতুন বউর ধারে পড়মু।’
মুকুল বলল, ‘অইছে কাম! নেও, আরেকখান কাম বাড়ল তোমার।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘ধুর, কী যে কন! আমার আর কাম কী?’
মধুকে কোলে নিতে গিয়ে জেসমিনের আঁচল সরে গেছে। তাই হাসিটা মুকুল দেখল। এই হাসি সুন্দর কি না, সে জানে না। সে শুধু জানে এই হাসি দেখলে হুঁশ থাকে না।
৩৯
মুকুল কাজে গিয়ে শান্তি পায় না। সারাক্ষণ অস্থির অস্থির লাগে। জেসমিনের জন্য মন কেমন করে। যদিও সে এক মাথা ঘোমটা দিয়ে থাকে। মুখটা দেখা যায় না ভালোভাবে। তবু জেসমিনের আশপাশে গেলে, তার কণ্ঠস্বর শুনলে শান্তি শান্তি লাগে। এখন যেখানে কাজ করছে, সেই জায়গা বাড়ির কাছেই। নানান ছুতোয় বারবার বাড়ি আসে মুকুল। আজ মুকুলের মেজাজ খারাপ। দুপুরের আগে একবার এসেছিল। জেসমিনের দেখা পায় নি। দুপুরবেলা এসে জেসমিনকে ঘরে পেয়ে বলল, ‘তোমার কারবারটা কী, কও দেহি? দিনরাইত সব সময় একটা ঘুড্ডির লেঞ্জার লাহান লম্বা ঘোমটা দিয়া থাহো ক্যা? মুই তো তোমার স্বামী? নাকি পরপুরুষ?’
জেসমিন মুখ টিপে হাসল। মুকুল বলল, ‘হাসির কী কইলাম?’
জেসমিনের বলতে ইচ্ছা করল, ‘মুই নাহয় ঘোমটা দিয়া থাহি। আমনের লগে কি হাত নাই? সরাইতে জানেন না?’
কিন্তু কথাটা বলতে পারল না জেসমিন। রঞ্জু হলে সে নিশ্চিত এটাই বলত। কিন্তু মুকুলকে পারল না। আগের জেসমিন আর নেই। মাঝে মাঝে নিজেকেই চিনতে পারে না সে। এত বদলে গেল কীভাবে? ভয়? ভয়ই কি তাকে এতটা বদলে দিয়েছে? ভয় আর বিপদের সাথে তাল মেলাতে মেলাতেই কি ত্যাড়া কথাগুলো আর মুখে আসে না তার?
সেদিনের পর জেসমিন ঘরের বাইরে ঘোমটা দিয়ে থাকলেও ঘরের ভেতর ঘোমটা দেয় না। দিনেও না, রাতেও না। এখন মুকুল যখন ইচ্ছা প্রাণভরে জেসমিনকে দেখে। যতক্ষণ ঘরে থাকে, ততক্ষণই তাকিয়ে থাকে। জেসমিন টের পায়। কিন্তু তার কোনো অস্বস্তি হয় না। মুকুলকে নিয়ে তার যাবতীয় অস্বস্তি, সংকোচ—সব কখন যেন কপূরের মতো উড়ে গেছে।
.
শরিফা বানু একদিন সকালে হাঁটতে হাঁটতে দেখতে এলেন জেসমিনকে। জেসমিন তখন উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিল। তাকে দেখতে পেয়েই ঝাড়ুটা ফেলে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ছুটে এল। তারপর সালাম করে বলল, ‘কেমন আছেন, খালা? আমনের কতা ম্যালা মনে পড়ে! কিন্তু খবর লইতে যে যামু, ডর লাগে।’
শরিফা বানু হেসে বললেন, ‘ভালো আছি গো, মা। ওই বাড়ি আর তোর যাওন লাগবে না। মুই-ই আমু তোরে দেখতে। বাপের বাড়ি গেছিলাম এর মইধ্যে, নাইলে আরও আগেই আইতাম।’
‘বাড়ির সবাই কেমন আছে?’
‘ভালো আছে। নুরজাহানেরও মাথা ঠিক হইছে। অর তো সব চিন্তা তোরে লইয়াই আছিল।’
জেসমিন হাসে। যে বিষয়ে তার একদিন খারাপ লাগত, সেই বিষয়ে এখন হাসি পায়।’
জেসমিন শরিফা বানুকে ঘরে নিয়ে বসাল। নিজ হাতে বানানো মুড়ির মোয়া খেতে দিল। শরিফা বানু জেসমিনের সংসার দেখে ভীষণ শান্তি পেলেন। জানতে চাইলেন, ‘জামাই কেমন? কোনো অসুবিধা নাই তো?’
এ কথায় জেসমিন লজ্জা পেয়ে বলল, ‘খালি একটা আশ্রয়ের লাইগ্যা বিয়া করছিলাম। কিন্তু এত ভালো একজন মানুষ পামু, স্বপ্নেও ভাবি নাই খালা। আমনের এই ঋণ মুই ক্যামনে শোধ করমু, জানি না।’
‘ধুর পাগল। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ যা চাইছে, তাই অইছে।’
.
বর্ষা এসে গেছে। খালে মাছ ধরার মৌসুম। নানান জিনিসপাতি লাগে মাছ ধরতে। বাঁশ দিয়ে এমনই নানান রকম অভিনব জিনিস তৈরি করেছে মুকুল। তারই একটা প্রস্তুত করে রাখছে সকালের জন্য। সকালে এটা নিয়ে মাছ ধরতে যাবে। জেসমিন মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। তার মাঝেই বলল, ‘মনুগো নাম রাখবেন না? বড় অইয়া যাইতেয়াছে না অরা?’
মুকুল হেসে বলল, ‘রাহো তুমি।
‘এহ্, মুই একলা রাখমু ক্যা? পোলাপান কি মোর একলার? দুইজন মিল্লা রাহি।’
মুকুল একটু ভেবে বলল, ‘আচ্ছা, মাইয়ার নাম আয়না রাখলে কেমন অয়? ও ত আয়নার মতোই, স্বচ্ছ, সুন্দর।’
জেসমিনের চোখ দুটো জ্বলে উঠল, ‘খুব সুন্দর নাম। আমার পছন্দ অইছে।’
‘যাও, হেলে অর নাম রাখলাম আয়না। এইবার পোলার নাম তুমি রাহো।’
এবার জেসমিন ভাবতে বসল। ভেবে বলল, ‘পোলার নাম হীরা রাহি?’
‘রাহো। খুব সুন্দর নাম।’
মুকুলের কাজ শেষ হয়ে গেল। সে সব গুছিয়ে রেখে যখন শুতে এল। তখন জেসমিন বিছানা গুছিয়ে বাচ্চাদের শোয়াচ্ছে। আয়নাকে টিনের দেয়ালের পাশে রেখে হীরাকে মুকুলের পাশে রাখতে গেলেই মুকুল কাছে এসে বলল, ‘অরে আপাতত ওই পাশেই রাহো না।’
জেসমিন চমকে তাকাল। বাচ্চাদের জন্য বানানো কাজল চিকন করে চোখে দিয়েছে সে। কী যে সুন্দর লাগছে তাকে! মুকুল জেসমিনের সেই কাজলকালো চোখের দিকে তাকিয়ে ঘোরলাগা গলায় বলল, ‘অবশ্য তোমার যদি আপত্তি না থাকে।’
মুকুলের ওই দৃষ্টিতে জেসমিনের শরীরে শিহরণ বয়ে গেল। সে হীরাকে আবার আয়নার পাশে শুইয়ে দিল। দুজনের মাঝে একটা কোলবালিশ দিল। একজন নড়লে যাতে আরেকজন ব্যথা না পায়। জেসমিন বাচ্চাদের দিকে ফিরে শুয়ে পড়ল। মুকুলও হারিকেনের আলো কমিয়ে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর জেসমিনের দিকে ফিরে নিজের একটা হাতের ওপরে ভর দিয়ে একটু উঁচু হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘জেসমিন?’
‘হুম?’
‘আমারে কি তোমার পছন্দ অইছে?’
জেসমিন না তাকিয়েই উত্তর দিল, ‘এইডা আবার কেমন কতা?’ মুকুল প্রথমবারের মতো জেসমিনের হাত ধরে বলল, ‘কও না।’ এবার জেসমিন মুকুলের দিকে ফিরল। তারপর বলল, ‘মুই কি আমনেরে এ রহম কোনো প্রশ্ন করছি? আমনে করেন ক্যা?’
মুকুল আবারও জেসমিনের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘পরিগো কোনো মাইনষেরে এই প্রশ্ন করা লাগে না। কিন্তু সাধারণ কোনো মানুষ যদি হুট কইরা কোনো পরি পাইয়া যায়, হেলে এই প্রশ্ন বাধ্যতামূলক।’
‘ধুর!’
জেসমিন লজ্জা পেয়ে মুকুলের বুকে মুখ লুকাল, নিঃসংকোচে। মুকুল জেসমিনের মুখের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, ‘শরম করলে কানে কানে কও।’
জেসমিন সরে যেতে চাইল, মুকুল আবার তাকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘উঁহু, বহুত দূরে দূরে থাকছ। আর না।’
অনেক দিন পর জেসমিনের মুখে যেন বুলি ফুটেছে। সে বলল, ‘আমনে দূরে রাখছেন।’
‘তা রাখছি। যাতে একটু আগের লাহান কোনো ভয়, কোনো সংকোচ ছাড়াই বুকে আইতে পারো।’
জেসমিন মুকুলের দিকে তাকিয়ে হাসল। মুকুল সেই হাসিমাখা ঠোঁটে তপ্ত চুমু খেল। ভালোবাসার শুভ সূচনা হলো।
নাইয়রি – ৪০
৪০
বেশ কদিন ধরেই মুকুলের কাজ নেই। উপার্জন যেহেতু বন্ধ, তাই সংসারে যাতে অশান্তি না হয়, তাই সে প্রায় প্রতিদিন মাছ ধরে আনে। কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হলো না। একদিন পড়তেই হলো হালিমার আক্রমণে, তবে যথারীতি শিকার মুকুল নয়, বরং জেসমিন। সে রেনুর সঙ্গে বসে মুকুলের আনা মাছ কুটছিল। এরই মধ্যে হালিমা শুরু করেছেন। লজ্জা নেই, ভাশুর-দেবরের টাকায় বসে বসে খাচ্ছে, আরও নানান ধরনের কথা। সেসব গায়ে মাখল না জেসমিন। সে চুপচাপ মাছ কুটতে লাগল। কষ্টটা লাগল তখন যখন বলল, ‘মাইয়া কইত্যা যে আইছে, এইডাই আইজ পর্যন্ত জানতে পারলাম না। এতিম মাইয়া নায় বুজলাম, হেল্লিগ্যা কি তিন কূলে এককালে কেউ নাই? নাকি আকাম-কুকাম কইরা পলাইছে? প্যাট বাজাইছে ক্যামনে, কেডা জানে! আসলেই বিয়া অইছিল, না অন্য কিছু, কেডা কইবে!
রেনু এবার বলল, ‘আম্মা, কী কইতেয়াছেন এই সব? আমনের মাতা ঠিকাছে?’
হালিমা বললেন, ‘আমার মাতা ঠিকই আছে। তোগো মাতা ঠিক নাই।’
জেসমিন কান্নাটা আর আটকে রাখতে পারল না। মুকুল গিয়েছিল গোসল করতে। ফিরে এসে সে শুধু শেষের কথাটাই শুনতে পেল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী অইছে, এইডা কি বেবাইজ্জাবাড়ি? আম্মা, কী লইয়া আবার শুরু করলেন? আমনে কি একটু শান্ত থাকতে পারেন না? সব সময় এত চিল্লাচিল্লি করা লাগে ক্যা?’
‘অইছে মোর কপালের চাড়া। পোলায় আইছে কৈফিয়ত চাইতে। এ রহম দিন আইছে।’
মুকুল এবার বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমনে সব সময় এইডা ক্যা চিন্তা করেন যে আমনে যা করেন, সব ঠিক করেন, যা কন, সব ঠিক কন আর বেবাকটি ভুল? এই চিন্তা বাদ দিলেই দেকপেন আর কেউ কৈফিয়ত চাইবে না।’
‘এত বড় সাহস তোর? বউর লাইগ্যা মার লগে গলাবাজি করোছ? বউর চামচা অইছো? বউরে কিছু কইলেই এক্কালে গায়ে ফোসকা পড়ে?’
মুকুল পাল্টা বলল, ‘আমনে মোর বউরে কইছেন না অন্য কেউরে কইছেন, হেইয়া তো মুই হুনিই নাই। আমনের চিল্লাচিল্লি হুনলেই মোর গায়ে ফোসকা পড়ে।’
মুকুল কাপড় নেড়ে ঘরে চলে গেল। হালিমা বললেন, ‘খাইছে, মোর পোলার মাতাডারে খাইছে ওই ডাইনিতে।’
কাঁদতে কাঁদতে চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল। মাছ কুটতে কুটতে হাতটা কীভাবে যেন কেটে গেল জেসমিনের। রেনু হাতটা ধুয়ে দিয়ে বলল, ‘ঘরে যা বুইন। রান্ধাবাড়া মুই করতেয়াছি। কাটা হাত লইয়া করা লাগবে না।’
জেসমিন কিছু বলল না আর। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে চুপচাপ ঘরে চলে গেল। মুকুল কাটা হাত দেখে তাড়াতাড়ি পরিষ্কার কাপড়ে হাতটা বেঁধে দিল। তারপর বলল, ‘তুমি কি কান্তেয়াছিলা? আম্মায় তোমারে কী কইছে, কও দেহি।’
‘বাদ দেন, বাজে কতা।’
‘বাজে কতা অইলে তো আরও আগে বাদ দেওন যাইবে না। কী কইছে, কও।’
‘আমনের মনে প্রশ্ন জাগে না মুই এহেনে কইত্যা আইছি? ক্যামনে আইছি?’
‘জানি তো, ভাবি তো কইছে। তুমি যার বাসে কইরা গৌরনদী আইছিলা, হে আমার একরকম বন্ধু। হের ধারেও হুনছি।’
‘যা হুনছেন, তাই বিশ্বাস করছেন?’
‘না করার কী অইল?’
‘আমনের মায় বিশ্বাস করে নাই।’
‘কী কইছে?’
‘কী কইছে মুই তা কইতে পারমু না।’
মুকুল সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। জেসমিন তাকে আটকানোর চেষ্টা করেও আটকাতে পারল না।
মুকুল রান্নাঘরে গিয়ে রেনুকে জিজ্ঞেস করল হালিমা তখন কী বলেছেন। রেনু বলল, ‘বাদ দে ভাই। ওনার মাতাডা তো ইকটু খারাপ আছে।’
‘তুমি কইবা কি না, জানতে চাই। জেসমিনও কইতেয়াছে না, তুমিও কইতেয়াছ না। সমেস্যা কী তোমাগো? যেদিকে দুই চোখ যায়, যামু গিয়া কিন্তু।’
রেনু প্রথমে একটু ইতস্তত করল। তারপর বলেই দিল। মুকুল সব শুনে রেনুকে কিছু বলল না। ঘরে ফিরে গেল। ঘরে গিয়ে জেসমিনের কাছে হাত জোড় করে মাফ চাইল।
জেসমিন মুকুলের হাত দুটো ধরে বলল, ‘আমনে মাফ চাইয়া মোরে শরম দিয়েন না। মুই অন্য একটা কতা কইতে চাই।’
‘কী কথা, কও না।’
‘মোগো যেহেতু আয়-রোজগার কম। মোরা আলাদা খাই? হেগো লগে খাওয়ার কী দরকার? আমনে মোর কতাডা খারাপভাবে নিয়েন না। মুই অভাবরে ডরাই না। ডরাই মাইনষের কতারে।’
মুকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বুজছি। মোরা ত একসময় আলাদাই খাইতাম।’
‘আফার ধারে হুনছি। মিনাবু যে অসুস্থ আছিল, তহন আবার একলগে খাওয়া শুরু করছেন।’
‘কিন্তু জেসমিন, কাঠের কাম ছাড়া মুই কোনো কামই জানি না। আর মুক্তিযুদ্ধের পর কামকাইজের অবস্থা ভালো না। আইজ আছে, কাইল নাই। এক্কালে আলাদা অইয়া গেলে এহনকার মতো সময়ে করমুডা কী?’
‘আল্লাহই পথ দেহাইবে। কিছু না কিছু উপায় তো বাইরইবেই।’ মুকুল এ বিষয়ে আর কিছু বলল না। ভাবতে লাগল কী করা যায়! রাতে ঘুমানোর আগে জেসমিন বলল, ‘আমনেরা ধান করেন না ক্যা?’ মুকুল বলল, ‘অত জমিজিরাত তো মোগো নাই। তা ছাড়া ধান হেদ্ধ, হুগনা, কেডা করবে কও? ভাবি বেশির ভাগ সময় থাকে অসুস্থ। মিনা পারত না। এসব কারণেই কোনো দিন করা অয় নাই।’
‘জমি কি মোডেও নাই?’
‘আছে কিছু।’
‘তহেলে লন মোরা ধান চাষ করি। চাউলডা তো অন্তত কেনা লাগবে না। ধানের সব কাম মুই জানি। মুই করমু।’
‘তুমি পারবা?’
‘পারমু না ক্যা?’
‘আচ্ছা, মুই অবশ্য ধানের সিজনে মাইনষের জমিতে বর্গা দেই। জমির সব কাম পারি। হেদ্ধ করতে পারি না দেইখা নিজেগো জমিতে করা অয় না। তুমি পারলে নিশ্চয়ই করমু।’
‘আর কী করবেন, জানেন?’
‘কী?’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল মুকুল। জেসমিন বলল, ‘এই যে এত কেজিতে কেজিতে মাছ ধরেন। এগুলা হাটে নিয়া বেচবেন। ম্যালা টাহা পাইবেন।’
‘কও কি তুমি? মুই কি জাইল্লা? কেডা কেনবে মোর মাছ?’ জেসমিন কড়া গলায় বলল, ‘মানুষ কি জাইল্লাগো চেহারা মুখস্থ কইরা রাহে? হেগো ধারে ছাড়া মাছ কেনে না?’
‘তা না। তয় মুই বেশি মাছ ধরলে তো মাগনাই কতজনে লইয়া যায়। কেনবে কেডা, হেই চিন্তা করতেয়াছি।’
‘এহনেইত্তা কেউরে মাগনা দেবেন না। মাছ লইয়া সোজা হাটে।’
‘কিন্তু বউ, মাছ তো সব সময় পাওন যায় না।’
‘যহন পাইবেন না, তহন অন্য কিছু করবেন। যহনেরডা তহন দেহা যাইবেয়ানে।’
জেসমিন বিছানা ছেড়ে উঠে গেল। সে পালিয়ে আসার সময় তার মা যে টাকাগুলো দিয়েছিল, তার প্রায় সবই রয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে কিছু টাকা বের করে মুকুলের হাতে দিয়ে বলল, ‘কাইল এইয়া দিয়া বাজার কইরা আনবেন।’
‘টাহা কই পাইছ?’
‘জমাইন্যা টাহা।’
মুকুল টাকা ফেরত দিয়ে বলল, ‘না না। লাগবে না। তোমার জমাইন্না টাহা মুই ভাঙমু না। তুমি রাহো। বাজার মুই একভাবে আনমুয়ানে।’
‘রাহেন না। টাহা দিয়া মুই করমুডা কী? মোর টাহা আর মুই—সব তো আমনেরই।’
মুকুল এ কথায় হেসে দিল। মেয়ে জিততে জানে, তা মানুষের মনই হোক বা পরিস্থিতি!
৪১
সকালবেলা মুকুল বাজার করে আনল। জেসমিন রান্না করতে যাওয়ার আগেই রেনু বলল, ‘আম্মার কতায় তুই আলাদা হবি?’
জেসমিন মাথা নিচু করে বলল, ‘মাফ করবেন, আফা। আমনেগো লগেই তো আছি। খালি আলাদা খামু। আর নাইলে তো উনি খাওনের খোঁড়া দিতেই থাকপে। আইজ মোগো পোলাপান অবুজ, অরা তো একদিন বড় অইবে। হে সময় এই সব হুনলে অগো মন ছোডো অইবে না, কন?’
এ কথার পর রেনু আর কিছু বলতে পারল না। জেসমিন তো ভুল কিছু বলে নি। একটা বেলা এভাবে গেল। বিকেলবেলাই আব্বাস এসে ঘরের দরজায় দাঁড়াল। গলাখাঁকারি দিয়ে বলল, ‘মুকুল ঘরে আছোস নিহি?’
জেসমিন বাচ্চাদের ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিল। মুকুল মধুর সাথে খেলছিল। আব্বাসের গলা শুনে জেসমিন বাচ্চাদের রেখে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়িয়ে ঘোমটা দিল। মুকুল দরজা খুলে বলল, ‘ভাইজান, আহেন, ঘরে আহেন।’
আব্বাস ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, ‘অসময়ে আইয়া তোমাগো বিরক্ত করলাম।’
জেসমিন চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘কী যে কন, ভাইজান, আমনের যহন ইচ্ছা আইবেন। বহেন।’
আব্বাস বসে মুকুল ও জেসমিনের উদ্দেশে বলল, ‘তোমরা আলাদা খাওনের সিদ্ধান্ত নিছ, এতে ভুল কিছু নাই। তোমাগো এমন কথাই কওয়া হইছে যে তোমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হইছ। শুধু তোমারে না, সবার লগেই ওনার এমন ব্যবহার। রেনুর পুরা জীবনডারে কয়লা বানাইছে উনি। প্রতিবাদ করলে আমারও তাই হোনা লাগছে, মুকুলের এহন যা হোনা লাগে। কিন্তু কথাগুলো যে কইছে, সংসারডা তো তার না। যেকালে তার আছিল, হেকালে হে নিজেই মোগো আলাদা কইরা দিছিল। মোরা আলাদা খাইছি কিন্তু সংসারটা এহন মোগো তিন ভাইয়ের। মামুন কিছু টাহা পাড়ায় মোগো দুই ভাইয়ের নামে। মোর একলার লাইগ্যা না।’
একটু থেমে আব্বাস আবার বলল, ‘দেহো, হে মোগো মা, ফালাইয়া তো দিতে পারি না। তাই নানান অন্যায্য কথাও সহ্য করি। তোমরা এইভাবে আলাদা অইয়া গেলে মনে বড় কষ্ট পামু। মুকুল-মামুন অরা মোর চেয়ে বয়সে অনেক ছোডো। মুই আর রেনু কোনো দিন অগো ভাইয়ের চোখে দেখি নাই। সন্তানের চোখে দেখছি। মোর সন্তান যদি হারা জনম মোর ঘরে বইয়া খায়, মোর তো কোনো সমেস্যা নাই। কিন্তু মুই জানি মুকুল আবার কোনো না কোনো কাম পাইয়া যাইবে। আর এই যে ও এত মাছ ধইরা আনে, এতে তো মোগো বাজারের খরচ অর্ধেকের বেশি বাঁইচ্চা যায়। হিসাব করলে তো বহুপিলেই করোন যায়। মোগো কামই এমন, আইজ আছে কাইল নাই। আইজ মুকুলের কাম নাই, কাইল হয়তো থাকপে। আইজ মোর কাম আছে, কাইল হয়তো থাকপে না। হেকালে কি তোমরা মোরে খাওয়াবা না?’
মুকুল অস্বস্তিবোধ করল। বলল, ‘ভাইজান, কী কন এগুলা!”
জেসমিন বলল, ‘মাফ কইরা দেন, ভাইজান। মোরা আলাদা হমু না।’
আব্বাস বললেন, ‘মাফ চাইও না, বুইন। মাফ চাওয়ার মতো কিছু করো নাই। মুই তো পেরতমেই কইছি, তোমাগো সিদ্ধান্তে ভুল নাই। তবু মোর কথায় সিদ্ধান্ত বদলাইছ, মুই খুব খুশি অইছি। তোমাগো ভাবি আরও খুশি অইবে।’
জেসমিন এই সুযোগে ধান চাষের কথাটা বলল। আব্বাস অবাক হয়ে বলল, ‘কিন্তু এত ঝামেলা করবে কেডা? মুই তো চাষবাস পারি না। তা জমির কাম মুকুল একলাই দশজনেরডা পারে। এইডা লইয়া চিন্তা নাই। কিন্তু আব্বায় যহন চাষ করত, ৩০ মণ ধান অইত। এত ধান হেদ্দ করবে কেডা? তোমাগো ভাবি তো হারা বছর অসুস্থই থাহে, জানো তো?’
জেসমিন বলল, ‘১০০ মণ আইন্না দেন। মুই একলাই পারমু।’
জেসমিনের আত্মবিশ্বাস দেখে আব্বাস হেসে দিল। তারপর বলল, পারলে করো। মুই এই বয়সে আর কী সাহায্য করতে পারমু জানি না। তয় তোমাগো লগে আছি। যহন যা লাগে, কইও।’
আব্বাস যাওয়ার আগে বলল, ‘আম্মা হাবিজাবি কইবেই। এইডা হের স্বভাব। হের মুখ বন্ধ রাহোনের ওষুধ অইল শক্ত হওয়া। হে অইলো শক্তের ভক্ত, নরমের যম।’
.
একদিন সকালে মুকুল অনেকগুলো মাছ ধরে আনল। জেসমিন সেখান থেকে কিছু মাছ সরিয়ে রেখে পাল্লা-পাথর দিয়ে বলল, ‘আইজ হাটবার। যান, মাছগুলা হাটে লইয়া যান। হাটে এই সব মাছের যা দর আছে, অই রকম দামে বেচবেন।’
মুকুল ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘জেসমিন, কেউ কেনবে না মোর মাছ। গৃহস্থগো কোনো জিনিসই গেরামের মানুষ কেনে না, হাসে।’
জেসমিন কড়া গলায় বলল, ‘হাসলে হাসবে। আল্লায় মুখ দিছে হাসার জন্য। আমনেরে জিগাইয়া হাসবে নিহি? আর মাছ না কিনলে নাই। আমনেরে কইছি যাইতে, আমনে যাইবেন। আর আমনে যাইতে না পারলে মুই যামু মাছ লইয়া।’
‘পাগল অইছ তুমি!’
এ কথা বলে মুকুল মাছ নিয়ে হাটে গেল। রেনু এই কাণ্ড দেখে হেসে মরে। জেসমিন মাছ কুটতে বসে বলে, ‘আমনের দেওরের নাকভরা খালি শরম। এহ্, আইছে নবাবে। মাছ বেচতে যাইতে ওনার শরম করে।’
রেনু হেসে বলল, ‘নায়ক মানুষ, মাছ বেচলে মাইনষে কি-না-কি কয়! ইজ্জত থাকপে? ফিরিতে বিলাইলে তো ম্যালা ইজ্জত বোজো না?’
‘নায়ক?’
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল জেসমিন। রেনু বলল, ‘যাত্রাদলের নায়ক আছিল না? সবাই তো হের পালা দেকতে খুব পছন্দ করত।’
‘হাছা নি? কই, মোরে তো কিছু কইল না?’
‘ছাইড়া দেছে তো। হেল্লাইগ্যা মনে অয় কয় নাই।’
কথায় কথায় রেনু মুকুলের যাত্রাপালা নিয়ে বাড়িতে হওয়া সব অশান্তির কথাই বলল। সব শুনে জেসমিনের বড় মায়া লাগল।
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই মুকুলের সব মাছ শেষ হয়ে গেল। সবাই জানে মুকুল খাল থেকে মাছ ধরে। সুতরাং চাষের মাছ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। হাটবাজার চাষের মাছে সয়লাব হয়ে গেছে। কোনো স্বাদ নেই সেসব মাছে। তাই ফুরফুর করে সব বিক্রি হয়ে গেল। মাছ বিক্রির টাকায় আগামী দুই সপ্তাহ সংসারের সব বাজার অনায়াসে হয়ে যাবে। খুশিতে সে কী করবে বুঝতে পারছে না। জেসমিনের জন্য কিছু নেবে বলে সারা হাট ঘুরল। একটা শাড়ি খুব পছন্দ হয়ে গেল। কিন্তু শাড়িটার যা দাম, তাতে আরও টাকা লাগবে। তাই শাড়িটা রেখে আবারও ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে শেষমেশ একটা আয়না আর এক ডজন কাচের চুরি কিনল। ঘরের আয়নাটা ভেঙে গেছে। সেটাই বিনাবাক্যে ব্যবহার করছে জেসমিন। মুরব্বিরা বলে ভাঙা আয়না ব্যবহার করলে অমঙ্গল হয়। তাই আয়না কেনাটা জরুরি। হরেক রকম খাবারের দোকান বসেছে। কিন্তু জেসমিন যে কী খেতে পছন্দ করে, সেটাই তো জানে না সে। ছি! কী খারাপ স্বামী! নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিল। পরে তার মনে পড়ল, মিনা হাটের নারকলি খেতে পছন্দ করত, এটা সে জানত। তার মানে সে খারাপ স্বামী না। জেসমিন নতুন বউ আর বিয়ের পর থেকে তার হাতে টাকাপয়সা ছিল না বলেই জানা হয় নি। আজই জেনে নেবে। পরের হাটে তাই কিনে নেবে।
.
মুকুল যখন বাড়ি ফিরল, ততক্ষণে জেসমিনের রান্নাবান্না শেষ। সে পুকুরে গেছে গোসল করতে। বাচ্চারা রেনুর কাছে। এই সুযোগে মুকুলও গেল। পুকুরপাড়ের হিজলগাছ থেকে ফুল পড়ে ছেয়ে গেছে পুকুর। তার মধ্যে সাঁতার কাটছে জেসমিন। কী অপূর্ব দৃশ্য! জেসমিন মুকুলকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘কি, অইছে না সব মাছ বেচা?’
মুকুলও পানিতে নেমে গেল। কাছাকাছি গিয়ে বলল, ‘তুমি জানতা সব মাছ বেচা অইবে?’
জেসমিন হেসে বলল, ‘না, তয় জানতাম কিছু তো অইবেই। আর এহন আমনের দাঁত কেলানি দেইক্কা বুইজ্জা গেছি যে সব বেচা অইয়া গেছে।’
মুকুল হো হো করে হেসে দিল। তারপর বলল, ‘তুমি ঠিকই কইছ, মোর আসলে বাড়তি মাছগুলা বেইচ্চা দেওন দরকার। মাছের যে এত দাম, হেইয়াই তো জানি না।’
জেসমিন পানি ছিটিয়ে বলল, ‘দেখলেন তো, মোর কতা হুনলে কোনো দিন ঠকবেন না।’
‘হুম, আচ্ছা জেসমিন, তুমি কী খাইতে সবচেয়ে পছন্দ করো?’
জেসমিন কাছে এসে বলল, ‘মধুর বাপেরে।’
তারপর নিজেই আবার লজ্জা পেয়ে সরে গেল। মুকুল হেসে দিল জেসমিন জোরে সাঁতার কাটতে শুরু করল। মুকুল সাঁতরে তাড়া করল। তারপর একসময় ধরে ফেলে বলল, ‘তহেলে খাও।’
জেসমিন বলল, ‘আরে, ছাড়েন ছাড়েন, কেউ দেইখ্যা ফালাইবে।’
জেসমিন উঠে গেল। মুকুলের আজ কী যে ভালো লাগছে। কিছুক্ষণ মন খুলে সাঁতার কাটল। ঘরে যেতেই জেসমিন ধমকে বলল, ‘পয়সা পাইয়াই একদম উড়ানি শুরু হইয়া গেছে, না?’
মুকুল প্রতিবাদ করল, ‘আরে না। ভাঙা আয়না দেখলে অমঙ্গল অয়। ভাবিরে জিগাইয়া দেহো। এল্লাইগ্যা আনছি।’
জেসমিন এবার মুচকি হেসে বলল, ‘তয় কাচের চুরি মোর খুব ভাল্লাগে। নেন, পরাইয়া দেন।’
মুকুল চুড়ি পরিয়ে দিয়ে হাতটায় চুমু খেল।
৪২
বিয়ের পর প্রথম ঈদ। কোনোমতে বাচ্চাদের কাপড় আনলেও জেসমিনকে একটা শাড়ি কিনে দিতে পারল না মুকুল। এ কারণে তার মন খুবই খারাপ। সারা দিন জেসমিন নানান কাজে ব্যস্ত ছিল। রাতের বেলা মুকুলকে জিজ্ঞেস করল, ‘ঈদের দিন অমন মুখ কালা কইরা রাকছেন ক্যা? কী অইছে?’
মুকুল জেসমিনের হাত ধরে বলল, ‘বিয়ার পর প্রথম ঈদ, অথচ তোমারে একটা শাড়ি দিতে পারলাম না। সারা বছর ত কিছুই দিতে পারি না। ঈদেও পারলাম না।’
জেসমিন হেসে বলল, “ধুর, মুই কি পোলাপান নিহি যে মোর ঈদ আইলেই নতুন কাপড় লাগবে? কাপড় তো আছে। এইগুলা দিয়া যত দিন চলে, তত দিন আর দরকার নাই। এইগুলা ছিঁড়লে দিয়েন।’
‘হাচা কতা কওদি, তোমার মনখারাপ হয় না?’
জেসমিন মুকুলের বুকে মাথা রেখে বলল, ‘আমনে মোরে যে দামি জিনিস দিছেন, এরপর মোর আর কিছুই চাওয়ার নাই।’
অবাক হয় মুকুল। বলে, ‘কী দিছি? মুই তো তোমারে কিছুই দেই নাই।’
জেসমিন মাথা তুলে মুকুলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঘর দিছেন।’
এ কথার পর মুকুলের বুকের ভেতরটা আর্দ্র হয়ে যায়। আর কিছু বলতে পারে না সে।
.
সকাল সকাল কোদাল হাতে মাটি খুঁড়ছে জেসমিন। মুকুল জানালা দিয়ে এই কাণ্ড দেখে অবাক হয়। বাচ্চারা সজাগ। ওদের রেখে কীভাবে যায়? তাই ওদের দুজনকে দুহাতে কোলে নিয়ে জেসমিনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এই, কী করো এই সব? মাডি খোঁচো ক্যা?’
জেসমিন বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আমনে অগো লইয়া এহেনে আইছেন ক্যা?’
মুকুল কড়া গলায় বলল, ‘আগে মোর প্রশ্নের উত্তর দেও।’
জেসমিন হেসে বলল, ‘গাছ লাগামু। চিন্তা কইরা দেখলাম, শাকসবজি বাবদ ম্যালা টাহা খরচ অইয়া যায়। এইগুলা যদি নিজেগো গাছে অয়, হেলে তো টাহাগুলা বাঁইচ্চা যাইবে।’
‘আরে পাগল মাইয়া, এই মাডি ভালো না। কিচ্ছু গজায় না এই মাডিতে।’
জেসমিন মুখ ভেংচি দিয়ে বলল, ‘মাডি হইল সোনা। ঠিকঠাক লাগাইতে পারলে সব গজাইবে। দেইখেন আমনে। এহন পোলাপান লইয়া যান দিহি। খালি কামের সময় বিরক্ত করে।’
‘উফ্!’
মুকুল বিরক্ত হয়ে বাচ্চাদের রেনুর কাছে রেখে এল। তারপর কোদালটা জেসমিনের হাত থেকে টেনে নিয়ে বলল, ‘দেও আমার ধারে। কতডু মাডি কাটতে অইবে, কও।
জেসমিন হাসল। তারপর হাতের ইশারায় একটা নির্দিষ্ট জায়গা দেখিয়ে বলল, ‘এহেনে এতহানি জাগা গর্ত কইরা দেন। হেরপর খালেইত্যা কচুডি আইন্না গর্ত ভইরা দেবেন।’
‘কচুডি দিয়া কী অইবে?’
‘পচামু। হেরপর হেইয়ার মইধ্যে তরকারির বিচি লাগামু। চারা গজাইলে হ্যাষে তুইল্লা জাগামতো লাগাই দিমু।’
‘কচুড়ির মইধ্যে চারা?’
অবাক হয় মুকুল। জেসমিন বলল, ‘দেইখ্যেন কত মোড়া মোড়া চারা গজায়। মাডিতে বিচি হালাই রাহেন দেইক্কাই তো আমনেগো গাছ অয় না আর কন যে মাডি ভালো না। গাছ অইলো পোলাপানের লাহান। যত্ন করন লাগে।’
ঘটনা যে সত্য, সেটার প্রমাণ পাওয়া গেল কিছুদিন পর। অবিশ্বাস্য রকমের স্বাস্থ্যবান চারা গজিয়েছে। শুধু মুকুল নয়, রেনুও বেশ অবাক হয়েছে। মুকুল বলল, ‘তুমি আর কী কী জানো, কও দেহি?’
রেনু না থাকলে জেসমিন হয়তো এখন একটা দুষ্টু কথা বলত। রেনু থাকায় দুষ্টুমি গিলে ফেলে বলল, ‘বেশি কতা না কইয়া মোর লগে হাত লাগান। বাড়ির দক্ষিণ পাশে ভালো রদ্দুর পড়ে। হেহেনে লাগামু চারাগুলা।’
বাচ্চারা রেনুর কাছে রইল। মুকুল ও জেসমিন একে একে সব চারা যত্ন করে তুলে জেসমিনের নির্বাচিত জায়গায় লাগিয়ে দিল। তারপর বাগান থেকে বাঁশ কেটে আনল মুকুল। যেসব সবজির জন্য মাচা দরকার, সেসব সবজিগাছের ওপর মাচাও বানিয়ে দিল
দুমাস পর থেকেই গাছ ভরে শাকসবজি হওয়া শুরু করল। ফলন দেখে জেসমিন নিজেই অবাক হয়ে গেছে। অবশ্য এসব শুধু শুধু হয় নি। গরুর গোবর শুকিয়ে সার হিসেবে ব্যবহার করেছে। এ ছাড়া তরকারির খোসা, হাঁস- মুরগির বিষ্ঠা, লাকড়ির ছাই—এসব মাটির সাথে পচিয়ে সার বানিয়ে দিয়েছে। এর পর থেকে জেসমিন কাজগুলো এমনভাবে করা শুরু করল, যাতে সারা বছরই কোনো না কোনো শাকসবজি গাছে থাকে। কিনতে তো হলোই না, উল্টো প্রতি হাটবারে মুকুল শাকসবজি বিক্রি করে। মাছ ধরা না পড়লেও তাকে শাকসবজি বিক্রি করতেই প্রতি হাটে যেতে হয়।
এর মধ্যেই আরেক বুদ্ধি এল জেসমিনের মাথায়। সব বীজ যদি না গজায়, তাই সে একটু বেশি করেই বীজ বোনে। প্রতিবারই প্রায় সব বীজ থেকে অনেক চারা হয়ে যায়, যার অর্ধেকও তার লাগে না। এত গাছ লাগানোর জায়গা তাদের বাড়িতে নেই। একদিন সে বাড়তি চারাগুলো মুকুলের হাটের ঝুড়িতে তুলে দিয়ে বলে, ‘দেহেন চারাগাছ কেউ কেনেনি। এতগুলা চারা নষ্ট হইবে, মায়া লাগে। অল্প দামে দিয়া দিয়েন।’
‘আচ্ছা।’
মুকুল হাট থেকে ফিরে হাসতে হাসতে বলে, ‘আমার মনে অয় তুমি মোর হাটের হাজিতে (বড় ঝুড়ি) বিষ দিয়া দিলে হেইয়াও বেচা অইয়া যাইবে। তোমার এত মোডাতাজা চারাগাছ দেইক্কা মাইনষে তো পারলে লুটপাট কইরা লইয়া যায়। একটাও ফিরাই আনতে পারি নাই, সব বেচা শেষ। আবার কেউ কেউ জিগায় ফুলের চারা আছেনি! দেখসোনি অবস্থাডা!”
এর পর থেকে আরও বেশি বেশি বীজ বোনে জেসমিন। আশপাশে অনেক হিন্দুবাড়ি আছে। সেসব বাড়ি ঘুরে ঘুরে ফুলের বীজ সংগ্রহ করে, যেসব গাছের ডাল থেকে চারা বানানো সম্ভব, সেসব গাছের ডাল আনে। এইভাবে করে সে ফুলের চারাও তৈরি করা শুরু করে।
সবজি, চারাগাছ আর মাছের সিজনে মাছ—সবকিছু মিলে এত জিনিসপত্র হয়ে যায় যে এখন মুকুল আর একবারে সব জিনিস নিতে পারে না। ইমরান ও মধুকে পাহারায় রেখে সে তিন-চারবার আসা-যাওয়া করে জিনিসপত্র নেয়।
এই অঞ্চলে চারাগাছের যে এত চাহিদা, জেসমিন তা কল্পনাও করে নি। তাদের এলাকায় তো চারাগাছ কেউ কেনে না। সবাই যার যার মতো করে তৈরি করে নেয়।
৪৩
ধান লাগানোর সময় হয়েছে। বীজতলা থেকে চারা উঠিয়ে মুকুল জমিতে রোপণ করতে গেছে। যাওয়ার পর থেকেই চিন্তা হচ্ছিল জেসমিনের। তাই সে বাচ্চাদের দায়িত্ব নীলাকে এবং রান্নার দায়িত্ব রেনুকে দিয়ে খেতে গেল। যাওয়ার সময় মুকুলের জন্য কিছু নাড়ু আর মুড়ি নিয়ে গেল। মুকুল তাকে দেখে বলল, ‘কী ব্যাপার, তুমি? বাড়িতে কিছু অইছে?’
‘না, কী অইবে? আমনের কিছু লাগে নিহি জানতে আইছি।’
মুকুল হেসে বলল, ‘নাকি আমার লাইগা মন পুড়ে?’
জেসমিন হাসতে হাসতে বলল, ‘আমনে যা মনে করেন। নেন, এইগুলা খাইয়া লন।’
মুকুল হাত ধুয়ে খেয়ে নিল। এরপর আবার কাজ শুরু করল। এরপর জেসমিন আচমকাই জমিতে নেমে চারা লাগাতে শুরু করল। মুকুল চমকে উঠে বলল, ‘আরে, করো কী, করো কী?’
তারপর খেয়াল করল, জেসমিন একদম সঠিক নিয়মে চারা রোপণ করছে। মুকুল অবাক হয়ে বলল, “এই, তোমাগো অঞ্চলে কি বেডিরাও খেতে কাম করে?’
জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। তারপর বলল, ‘না। তয় মুই সবই করতাম। যহন যেডা মনে চাইত, করতাম, আবার মনে না চাইলে কিছুই করতাম না।’
মুকুল হাসল। তারপর একটু কড়া গলায়ই বলল, ‘অইছে অইছে। শখ মিটছে না? এহন বাড়ি যাও।’
‘না। মুই আমনের লগে ধান লাগামু।’
মুকুল মাথায় হাত দিয়ে বলল, ‘মাইয়া কয় কী! মোগো দ্যাশে মাইয়া মাইনষে খেতে কাম করে না। এহনই বাড়ি যাও।’
জেসমিন হাত নেড়ে নেড়ে বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘দেহেন, আমনে একলা ধান লাগাইলে পুরা জমিতে লাগাইতে চাইর দিন লাগবে। আর আমনের লগে মুইও যদি লাগাই, হেলে দুই দিনেই অইয়া যাইবে। মুই থাকতে আমনেরে একলা রদ্দুরে পুড়তে দেই ক্যামনে?
‘চুপ থাহো তুমি। এক্ষণ বাড়ি যাও। পোলাপানে কানবে।’
‘কানবে না। নীলারে অরা ম্যালা পছন্দ করে। নীলাও অগো রাখতে জানে। আর আফাও তো আছে।’
‘দুধ খাওয়ার লাইগ্যা কানবে।’
জেসমিন প্রতিবাদ করল, ‘অরা এহন আর দুধের শিশু নাই। এক বছর অইয়া গ্যাছে, আর কত দুধ খাইবে?’
‘তুমি কি পাগল, জেসমিন?’
‘হয়, মুই পাগল। আওয়ার সময় পোলাপানরে খাওয়াইয়া আইছি। দুহাইর্যা ভাত খাইতে যাইয়া আবার খাওয়াইয়া আমু। এর মইধ্যে খিদা লাগলে আফায় ভাত খাওয়াই দেবেয়ানে।
মুকুল কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। জেসমিনও। শেষমেশ মুকুল বলল, ‘তোমার জেদের লগে দুনিয়ার কেউ পারবে না। এক ব্যাডা মাতারি। নেও, শুরু করো।’
জেসমিন দাঁত কেলিয়ে কাজ শুরু করে দিল। শাড়িটারি গোছালো না। সে যেমন ঘোমটা দিয়ে থাকে, তেমন করেই ঘোমটা দিয়ে কাজ করতে লাগল। বেলা গড়াতেই সত্যি মুকুল অবাক হলো। সে যে গতিতে কাজ করছে, জেসমিনও একই গতিতে কাজ করছে।
কাজের মাঝেই রাস্তা থেকে একটা ডাক শুনতে পেয়ে মুকুল ঘুরে তাকাল। লোকটা বলল, ‘কী মুকুল ভাই, এইবার নিজের জমিতেই ধান করতেয়াছনি?’
মুকুল হেসে বলল, ‘হয় ভাই।’
‘তা লগে কেডা? ভাবি নিহি?’
জেসমিনের কোনো হেলদোল নেই। সে তাকালও না। মুকুল বলল, ‘হয়, আমনেগো ভাবি।’
‘তোমার কি এতই খারাপ অবস্থা অইছে যে ভাবিরেও খেতের কামে নামাইছ! ছি ছি!’
এইবার জেসমিন ঘুরে তাকাল। মুকুল কিছু বলল না, একটু অস্বস্তি বোধ করল। জেসমিন বলল, ‘আহা রে মিয়াভাই, দেইক্কা কি কষ্ট অইতেয়াছে? তহেলে আমনের বউরেও দিয়া যান। হকালে কাম শ্যাষ অইবেয়ানে।
লোকটা স্বপ্নেও ভাবে নি মুকুলের বউ এমন কিছু বলবে। ‘নাউজুবিল্লাহ নাউজুবিল্লাহ বলতে বলতে সে প্রস্থান করল। মুকুল হেসে দিল। জেসমিন রাগে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল, ‘কেডা এই হারামজাদা?”
মুকুল মিটিমিটি হেসে বলল, ‘তেমন কেউ না। প্রতিবেশী। কিন্তু জেসমিন, তুমি যদি এ রহম করো, মাইনষে কী কইবে?
‘মাইনষে আমনেরে এক বেলা মাগনা ভাত দেবে?’
মুকুল হেসে বলল, ‘না।’
‘তহেলে মাইনষের কতা চিন্তা করা বাদ দেন। মোর সামনে আমনেরে কেউ হাবিজাবি কইয়া হেরপর যদি হে মইরাও যায়, হের আত্মারেও ছাইড়া দিমু না, মনে রাইখেন।’
‘এত ভালোবাসো মোরে?’
জেসমিন এই প্রশ্নে লজ্জা পেল। সে আবার তার কাজ শুরু করে বলল, ‘বেশি কথা কন। কাম করেন তো।’
৪৪
হীরা এখনো কথা বলতে পারে না। কিন্তু আয়না টুকটাক কথা বলা শিখেছে। আজ সে মুকুলকে আব্বা বলে ডেকেছে। মুকুলের খুশি দেখে কে! যেন বিশ্ব জয় করে ফেলেছে। সে নানান কায়দায় আয়নাকে মুগ্ধ করার চেষ্টা করছে, যাতে আয়না বারবার আব্বা ডাকে। আয়নাকে নিয়ে মুকুলের এই সব পাগলামি দেখে জেসমিনের চোখ ভিজে যায়। অনেক নারীই স্বামীর আগের স্ত্রীর সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। এটা এই সমাজে স্বাভাবিক। কিন্তু কোনো পুরুষ কি স্ত্রীর আগের স্বামীর সন্তানকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসতে পারে? মুকুলকে না দেখলে জেসমিন কোনো দিন বিশ্বাস করতে পারত না। সে রাতে ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়লে জেসমিন মুকুলকে জিজ্ঞেস করল, ‘মুই যদি আমনের ধারে কোনো কিছু গোপন করি, আমনে কি রাগ অইবেন?’
মুকুল হেসে বলল, ‘গোপন করার কারণ থাকলে না-ও অইতে পারি।’
জেসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বিপদের সময় সবার আগে ডাক্তার সাব মোরে আশ্রয় দিছিল, হে গোপন করতে কইছিল। নাইলে ওই সময় ওই আশ্রয়টুক পাইতাম না। তয় আমনের মতো মানুষের ধারে কিছুই গোপন করা উচিত না। আরও আগেই সব কইয়া দিলাম না ক্যা?’
জেসমিনের চোখে জল দেখে আর এসব শুনে মুকুল তাকে বুকে টেনে নিল। তারপর বলল, ‘কিছু অইবে না, বউ। এহন কইতে চাইলে কইতে পারো। রাগ হমু না। না কইতে চাইলেও সমেস্যা নাই। না জাইন্নাই তো আল্লাহর রহমতে মোরা সুখে আছি।’
জেসমিন উঠে বসল। মুকুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘খালি যে গোপন করছি, তা না, মিছা কতাও কইছি। মুই আসলে এতিম না। বাপ, মা, ভাই, ভাবি—সবই আছে। শ্বশুরবাড়ি থিকা তাড়াইয়াও দেয় নাই। মুই নিজেই পলাইয়া আইছিলাম।’
‘কও কী!’
চমকাল মুকুল। জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘রঞ্জু এমনে এমনে মরে নাই। অরে খুন করা অইছে। আর খুন করছে মোর ভাইয়েরা, মোর বাপের হুকুমে।’
মুকুল এবার উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল। জেসমিন একে একে সব বলল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। সব শুনে মুকুল বলল, ‘ভাগ্য ভালো, ডাক্তারের পরামর্শ হুইন্না সব গোপন রাখছ। এইয়া জানলে এই গেরামে কেউ জাগা দিত না তোমারে।’
‘আমনেরেও যে কই নাই, এল্লাইগ্যা রাগ হন নাই?’
মুকুল জেসমিনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আরে না। তয় এত তেজ তোমার কইত্তা আইছে এইবার বুঝতে পারছি।’
এ কথায় জেসমিন হেসে দিল। মুকুল তখন হঠাৎ করেই জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা জেসমিন, এত আরাম-আয়েশে বড় অইছ, আমার ঘরে আইয়া তো খালি কষ্টই করতেয়াছ। কোনো দিন আফসোস হয় না তোমার?’
জেসমিন এবার মুকুলের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘না, কত বড় বিপদে আছিলাম, দিনরাত কী পরিমাণ কষ্ট আর অত্যাচার সহ্য করছি, তা আমনে জানেন না। খালাম্মায় আছিল দেইখা রক্ষা। ওই তুলনায় আমনের ঘর স্বর্গ। আমার প্যাটে বাচ্চা না থাকলে নিজেরে শ্যাষ কইরা দিতাম। কিন্তু আয়নারে জন্ম দেওয়ার লাইগ্যা বাঁইচ্চা আছিলাম।’
তারপর মুকুলের মুখটা দুহাতে ধরে আবার বলল, ‘আর এহন আমনের লাইগ্যা, মোগো তিন পোলামাইয়ার লাইগ্যা হাজার বছর বাঁচতে ইচ্ছা করে।
‘আল্লাহ তোমার মনের আশা পূরণ করুক।’
মুকুল আবার জেসমিনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এই সব কতা আর কাউরে কইও না, জেসমিন। কিছু সত্য গোপন থাহা ভালো।’
.
আপাতদৃষ্টে বিষয়টি মুকুল খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে মনে হলেও, বাস্তবে তা নয়। মুকুল খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। জেসমিন এত প্রভাবশালী বড়লোকের মেয়ে, তা ছাড়া শিক্ষিত-বড়লোকের ঘরের বউ ছিল, ভাবলেই ভয় হচ্ছে। সে কোনো দিক দিয়েই জেসমিনের যোগ্য না, ভাগ্যগুণে ঘটনাচক্রে পেয়ে গেছে।
বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত সে জেসমিনকে তেমন কিছুই দিতে পারে নি। দিয়েছে শুধু অভাব আর কষ্ট। বাপের বাড়ি থাকতে যে মেয়ে নিজের ইচ্ছা না হলে একটা সুতাও নড়ায় নি, সেই মেয়েটা কী না করেছে তার ঘরে এসে! সব জানার পর থেকে প্রচণ্ড হীনম্মন্যতায় ভুগছে মুকুল।
জেসমিন বিষয়টা ধরতে পারল আরও কিছুদিন পর, যখন ধান কাটা হলো। জেসমিন ধান সেদ্ধ করতে গেলে মুকুল দৌড়ে গেল সেখানে। ধান সেদ্ধ করার সমস্ত পানি সে নিজেই পুকুর থেকে তুলে দিল। জেসমিন নিজে তুলতে গেলেও তাকে তুলতে দিল না। আবার বড় বড় পাতিলে ধান সেদ্ধ করে সে নিজেই নামাল। নিজেই ঢালল। জেসমিনকে ধরতেও দিল না। যেহেতু সে ধান সেদ্ধ হয়েছে কি না বোঝে না, শুধু সেইটুকু দেখার জন্যই জেসমিনকে সাথে রাখল। সেদিনের মতো কাজ শেষ করে যখন ঘরে গেল, তখনই জেসমিন ধরল মুকুলকে।
‘কী পাইছেন আমনে? এমন শুরু করছেন ক্যা?’
‘বুঝলাম না। কী শুরু করছি?’
‘ধান সেদ্ধ করার কথা ছিল আমার। আমনে করেন ক্যা?’
মুকুলের কাছে কোনো উত্তর ছিল না, কিন্তু হঠাৎ করেই যেন মনে পড়ল। সে বলল, ‘খেতে কাম করার কতা আছিল আমার। তুমি করছিলা ক্যা?’
এবার জেসমিন চুপ হয়ে গেল। আয়না ও হীরার দুজনের কারোর চোখেই আজ ঘুম নেই। দুটো বাচ্চাই বেশ শান্ত। বেশির ভাগ সময় নিজেরা নিজেরা খেলে, কাউকে বিরক্ত করে না। মুকুল আয়নাকে কোলে নিয়ে বলল, ‘আহা রে, আইজ মোর আম্মাজানরে হারা দিনেও কোলে লইতে পারি নাই।’
আয়না ঠোঁট উঁচু করে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। কী, সেটা বোঝা গেল না। তার সব কথা এখনো স্পষ্ট নয়। জেসমিন হীরাকে কোলে নিল। মুকুল আয়নাকে বেশি আদর করে, এটা একদম চোখে লাগে। যাতে হীরার কখনো মনখারাপ না হয়, সেই বিষয়ে সব সময় খেয়াল রাখে সে।
জেসমিন হীরাকে কোলে নিয়ে মুকুলের পাশে বসে বলল, ‘মুই আসলে কেডা, কইত্তা আইছি—এইসব জানার পর আমনের আচরণ বদলাই গেছে। কোনো কাম করতে দিতেয়াছেন না, যতক্ষণ বাড়িতে থাহেন, সব নিজে করতে চান। এমন করেন ক্যা?’
মুকুল আমতা-আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করল। তার আগেই জেসমিন তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘হুনেন, আর এ রহম করবেন না। আগে যা আছিলাম, আছিলাম। হের পরে কিন্তু মাইনষের বাড়ি কাম কইরা খাইয়া আইছি, এইডাও ভুইলেন না। কামেরে ডরাই না। এহন মোর পরিচয় মুই আমনের বউ। আর মধু, আয়না, হীরার মা। অনেক সুখে আছি এই পরিচয়ে।’
কথাগুলো বলতে বলতে জেসমিনের চোখ ভিজে এল। মুকুল আয়নাকে এক হাতে নিয়ে আরেক হাতে জেসমিনকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তোমারে হারানের ডর অইতেয়াছে, জেসমিন।’
‘এই সব ফাও ডর ঝাইড়া ফালান।’
নাইয়রি – ৪৫
৪৫
প্রতিদিনই ধান সেদ্ধ করা হচ্ছে, শুকানো হচ্ছে। উঠানে ধান ছড়িয়ে দিয়ে তার ভেতরে পা গলিয়ে, পা টেনে টেনে হাঁটা, এই হলো গ্রামবাংলায় ধান নাড়ার প্রাচীন পদ্ধতি। অনবরত এভাবে নাড়তে থাকলে ধানগুলো উল্টেপাল্টে সব দিক সমানভাবে শুকিয়ে যায়। এই পদ্ধতিতেই জেসমিন ধান নাড়ছিল। সঙ্গে মুকুলও ছিল। সে জেসমিনকে দেখে দেখে কাজটা শেখার চেষ্টা করছে। দেখতে দেখতেই হঠাৎ জেসমিনের পায়ের দিকে চোখ পড়ল তার। সোনারঙা ধানের ভেতর জেসমিনের উজ্জ্বল পা দুটো কী অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল! তখনই মনে হলো পায়ে আলতা থাকলে আরও বেশি সুন্দর লাগত।
পরের হাটেই মুকুল জেসমিনের জন্য আলতা কিনে আনল। আলতা দেখে জেসমিন অবাক হলো। একসময় আলতা পরতে কী ভীষণ পছন্দ করত সে! সময়ের গহ্বরে হারিয়ে গেছে যেন সব! জেসমিনকে চুপ হয়ে যেতে দেখে মুকুল জিজ্ঞেস করল, “তুমি খুশি অও নাই?’
জেসমিন বলল, “একটু বেশিই খুশি অইছি। আলতা যে মোর কী পছন্দ! আমনে যে ক্যামনে মোর পছন্দের জিনিসগুলান লইয়া আহেন, বুজি না!”
মুকুল বিরক্তমুখে বলল, ‘তা পছন্দের জিনিসের কতা তো কত জিগাই তোমারে। হেই সমায় কইতারো না?’
জেসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘বাঁইচ্চা থাহার লাইগ্যা যেভু দরকার, হেডু ছাড়া ব্যাবাক ভুইল্লা গেছিলাম। হেইল্লাইগ্যা আমনে যেকালে জিগান, হেকালে আর কিছু মনে পড়ে না।’
মুকুল জেসমিনের একটি হাত ধরে বলল, ‘যাউক, এইল্লাইগ্যাই আল্লায় মনে অয় তোমার-আমার পছন্দগুলা মিলাইয়া দিছে।’
হাসল জেসমিন। সত্যিই তো, এই যে না বলতেও মুকুল তার পছন্দের জিনিসগুলো নিয়ে আসে, এ তো সৃষ্টিকর্তারই আশীর্বাদ। সেই রাতেই জেসমিন যত্নে আলতা পরল পায়ে। পরদিন যখন সেই আলতা পায়ে জেসমিন ধান নাড়ছিল, মুগ্ধ চোখে বারবার চেয়ে দেখছিল মুকুল। দৃশ্যটা ছিল তার কল্পনার চেয়েও মনোহর।
.
মুকুলদের জমিতে ৪০ মণ ধান হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছেন মোকসেদ। কারণ, তিনি এই জমি থেকে ৩০ মণের বেশি ধান কখনোই ফলাতে পারেন নি। তিনি মুকুলকে জিজ্ঞেসই করে ফেললেন, ‘কী করছস ক দিহি? ওই একই জমিতে এত ধান ক্যামনে অইলো?’
মুকুল হেসে বলে, ‘কী আর করমু? যেমনে করে হেমনেই করছি। যহন যেমন যত্ন করা লাগে করছি, ফসল নষ্ট অয় নাই মোডেও।’
‘হ্যাঁ তো মুইও করতাম।’
ধান ভাঙাতে নেওয়ার সময় জেসমিনের মনে হলো ধানের পরিমাণ কম। তার আন্দাজ বলে, যতটা ধান সে সেদ্ধ করেছে, শুকিয়েছে, ততটা এখানে নেই। তাই মুকুলকে বলে দিল ধান ভাঙানোর আগেই যেন আবার মাপা হয়। মুকুল বলল, ‘কাইল না একবার মাপলাম? আবার মাইপা কী অইবে?
জেসমিন বলল, ‘আমার ধারণা, এহন মাপলে দেখপেন ৩০ মণ।’
কথাটির অর্থ যেন মুকুলও বুঝতে পারল। সে আবার ধান মাপল। সত্যি সত্যি এবার ৩০ মণ হলো। জেসমিনকে জানানোর সাথে সাথেই সে বলল, ‘এইবার বুজছেন আব্বার ধান ৩০ মণের বেশি অইতো না ক্যা?’
রাগে-দুঃখে জেসমিন কেঁদে ফেলল। মুকুল তক্ষুনি ভাইয়ের কাছে ছুটে গেল। আব্বাস তখন গ্রামের নবনির্মিত মসজিদের দরজার কাজ করছিল। দুপুরবেলা মুকুলকে ছুটে আসতে দেখে আব্বাস বলল, ‘কী রে, বাড়িতে কিছু অইছে?’
মুকুল ক্ষুব্ধ গলায় বলল, ‘অনেক কিছু অইছে। আর এইডার বিচার যদি আমনে না করছেন, হেলে আইজগোই মুই বাড়িত্তা বাইরাই যামু।’
চমকে উঠল আব্বাস, ‘আরে, কী অইছে এইডা তো কবি।’
‘আম্মায় ১০ মণ ধান সরাইছে। মনে অয় বেইচ্চা দিছে। কাইল ধান হুগাইন্না শ্যাষ অইছে পরে মাপসি, ৪০ মণ অইছে। আইজ মাইপ্পা দেহি ৩০ মণ। আব্বারও আসলে ৪০ মণ ধানই অইতো। আম্মায় সব সময় ১০ মণ সরাইয়া হালাইত। কাইল যেকালে মাপসি, হেকালে আম্মায় বাড়ি আছিল না। হেল্লাইগ্যা জানে না যে কাইল মাপছিলাম। আব্বায় সব সময় ভাঙানের আগে মাপত। মোরাও হেইয়া করমু ভাবছিল। হেইয়াই করতাম, তয় পেরতমবার নিজের জমিতে ধান হওয়াইছি, হেই খুশিতে কাইলই মাপছিলাম।’
আব্বাস কাজে বিরতি দিয়ে তখনই মুকুলের সাথে বেরিয়ে পড়ল। বাড়ি ফিরে হালিমাকে জিজ্ঞেস করার সাথে সাথেই তিনি ঘাবড়ে গেলেন এবং অস্বীকার করলেন। ঘাবড়ে যাওয়া দেখেই আব্বাস বুঝে গেল যে মুকুল ঠিকই ধরেছে। এরপর আব্বাস একটা টোপ ফেলল।
বলল, ‘আম্মা, মিছা কতা কইয়া লাভ নাই। আমনেরে একজন দেখছে ধান সরাইতে। ধান কী করছেন, হেইয়া কন। কই রাখছেন? নাকি বেইচ্চা দিছেন?’
একসময় হালিমা স্বীকার করলেন। কিন্তু ধান ফেরত দিতে পারলেন না। ধান তিনি পাশের বাড়িতে বিক্রি করে দিয়েছেন। রাতের অন্ধকারে নিতে হবে, এই শর্তে কম মূল্যে বিক্রি করেছেন। ধান বিক্রির টাকাও ফেরত পাওয়া গেল না। সে টাকা কানপাশার কিস্তি বাবদ সেকরাকে দিয়ে দিয়েছেন। জেসমিন পালিয়ে আসার সময় তার কানে এক জোড়া সোনার দুল আর গলায় একটা চেইন ছিল। সেগুলো খুলে হালিমার হাতে দিয়ে বলল, ‘আম্মা, এইগুলা আমার চেয়ে আমনের বেশি দরকার। আমনে পরেন।’
হালিমা চুপ করে রইলেন। জেসমিন নিজের ঘরে চলে গেল। মুকুল পেছন পেছন গিয়ে দেখে সে কাঁদছে। মুকুল জেসমিনের হাত দুটো ধরে আকুল গলায় বলল, ‘আমারে মাফ কইরা দেও। তোমার এত কষ্টের ফসলের হেফাজত মুই করতে পারলাম না।’
জেসমিন কাঁদতে কাঁদতেই বলল, ‘মোর ফসল কইতেয়াছেন ক্যা? ওগুলা মোগো ফসল। আর আমনে হুদাহুদি মাফ চাইয়েন না, এমনেই মেজাজ খারাপ আছে কইয়া দিলাম।’
মুকুল কী বলবে বুঝতে পারল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আব্বাস এসে দুল আর চেইন দিয়ে গেল। এত কিছু হয়ে গেল, তবু হালিমা কারও কাছে মাফ চাইলেন না।
৪৬
আয়না ও হীরার দেখাদেখি মধুও এখন জেসমিনকে মা বলে ডাকে। বড়ই হয়েছে বৈকি, আজকাল সে নিজের হাতে ভাত খেতে পছন্দ করে। আজ জেসমিন তার নিজের খেতের লালশাক রান্না করেছে। সেই লালশাক দিয়ে ভাত মেখে মধু অবাক হয়ে গেল। তার সব ভাত লাল হয়ে গেছে। ভাতগুলো তার এত সুন্দর লাগছে যে শুধু দেখতেই ইচ্ছা করছে, খেতে ইচ্ছা করছে না। অনেকক্ষণ ধরে ভাত নাড়াচাড়া করতে দেখে জেসমিন বলল, ‘কী গো বাজান, ভাত খালি লাড়োচাড়ো, খাও না ক্যা? রান্দা মজা অয় নাই?’
‘জম্মের মজা অইছে, মা। কিন্তু এত সুন্দর ভাত ক্যামনে খামু? দেহো দিহি কী সুন্দর লাল!’
জেসমিন হেসে বলল, ‘লাল তোমার পছন্দ?’
‘হয়।’
জেসমিন চোখ নাচিয়ে নাচিয়ে বলল, ‘পশ্চিমের বিলে লাল শাপলা ফুটছে। তুমি যাবা?’
আনন্দে লাফিয়ে উঠল মধু।
জেসমিন বলল, ‘তয় ভাত শ্যাষ না করলে তো কোনোহানে যাওন যাইবে না, বাজান।’
মধু উত্তেজিত হয়ে বলল, ‘মুই এহনই সব ভাত শ্যাষ কইরালাইতেয়াছি, মা। তুমি খালি দেহো।’
যে মধু এক ঘণ্টা ধরে ভাত নাড়াচাড়া করছিল, সে মুহূর্তেই সব ভাত শেষ করে ফেলল। বিকেলবেলা জেসমিন ও মধু একটা ডোঙা নিয়ে পশ্চিমের বিলে গেল। সত্যিই অপূর্ব লাল শাপলা ফুটে রয়েছে সেখানে। ডোঙা ভাসিয়ে তারা বিলের ভেতর চলে গেল। ডোঙা ভর্তি করে মোটা মোটা শাপলা তুলে আনল। মধু আজ ভীষণ খুশি।
জেসমিন শাপলার ডাঁটাগুলোকে রান্নার জন্য রেখে ফুলগুলোকে কিছুটা ডাঁটাসহই আলাদা করল। তারপর কাচের গ্লাসে পানির ভেতর রাখল। একটা গ্লাসে যতগুলো ফুল রাখা সম্ভব, রাখল। তারপর একটা গ্লাস দিল মধু যে ঘরে ঘুমোয়, সে ঘরে, আরেকটা রাখল নিজের ঘরে।
মুকুল একটু দূরে কাজে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। তাই সোজা খাবার ঘরে চলে গেল। খেয়েদেয়ে ঘরে ঢুকতেই লাল শাপলাগুলো দেখতে পেল। শাপলা ফুলও যে ঘরের ভেতর এভাবে রাখা যায়, কখনো মাথায় আসে নি তার। মাঝে মাঝেই মনে হয় সে কোনোভাবেই জেসমিনের যোগ্য নয়। তাই তো হারানোর ভয়ও হয় খুব!
জেসমিন মুকুলের গা ঘেঁষে বসে বলল, ‘আচ্ছা, আমনে বলে আগে যাত্রাপালা করতেন?’
মুকুল হেসে বলল, ‘কেডা কইল তোমারে?’
‘আফায় কইছে। ছাড়ছেন ক্যা, হেইয়াও কইছে।’
মুকুল চুপ। জেসমিন আবার বলল, ‘আমনে আবার যাত্রাপালা শুরু করেন না।’
মুকুল এবার হো হো করে হেসে বলল, ‘এইয়ারেই কয় নিজের পায়ে কুড়াল মারা।’
জেসমিন অভিমানী গলায় বলল, ‘ধুরো, আমনে হাইস্যা উড়াইয়া দিলেন। যাত্রাপালা দেহার মোর অনেক শখ।’
‘তয় লও একদিন দেহাইয়া আনি।’
‘না। যার-তারডা মুই দেখমু না। মোর নায়ক যদি যাত্রাপালার নায়ক অয়, তহেলেই দেকমু খালি।’
‘ওরে বাপে!’
মুকুলের হাসি থামছে না। জেসমিন এবার কড়া গলায় বলল, ‘হাসি থামান কইলাম।’
মুকুল এবার গম্ভীর হলো, ‘জেসমিন, তুমি হেই সময় আছিল না। এই জন্য জানো না, ওই যাত্রাপালাই আছিল সংসারের অশান্তির মূল কারণ। পয়সাপাতি পামু না কিছু না, সংসার চালামু ক্যামনে? পোলাপানের ভবিষ্যতের কতা ভাবতে অইবে না? এহন তো পোলাপান আরও দুইজন বেশি।’
‘কিন্তু এহন তো আর মোগো অত টানাটানিও নাই। চাউল, ডাইল, মাছ, শাকসবজি, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল—সবই তো নিজেগো। কিছুই কেনা লাগে না। উল্ডা বেচিও। এমনেও তো সব সময় আমনের কাম থাহে না। যেকালে থাকপে, হেকালে তো কাম করবেনই। আর মুই কাঁথা সেলাই কইরাও তো টুকটাক টাহাপয়সা পাই। এত টাহা দিয়া কী অইবে?’
মুকুল বিরক্ত গলায় বলল, ‘তোমারে না কইছি মাইনষের কাঁথা সেলাই করবা না?’
‘করমু না ক্যা? সংসার-পোলাপান কি আমনের একলার? আর আমনে মানা করলেই মোর হুনতে অইবে ক্যা? আমনে কি মোর মালিক নিহি?’
‘উফ্!’
মুখে যাই বলুক, যাত্রাপালা শুরু করার কথাটা কিন্তু মুকুলকে ভালোই আন্দোলিত করল। তার সবচেয়ে প্রিয় কাজই যে ওটা। কিন্তু এত কষ্টে ওসব থেকে বের হয়ে এসেছে! আবার যদি যায়, আবার যদি সংসারে ঝামেলা হয়? তারপর বের হয়ে আসতে পারবে তো?
অনেক তর্কাতর্কির পর মুকুল রাজি হলো। তবে সে ঠিক করল, আগের মতো নিয়মিত নয়। যখন তার হাতে কোনো কাজ থাকবে না, তখনই শুধু যাত্রাপালা করবে।
মুকুল যাত্রাদলে ঢুকতে না ঢুকতেই আবার গ্রামের মানুষদের মধ্যে যাত্রা দেখার হিড়িক পড়ে গেল। একদিন জেসমিনও গেল। আর সেদিনই আবিষ্কার করল, এটাই মুকুলের আসল জায়গা। কী প্রাণবন্ত অভিনয় তার! মনে হয় যে মানুষের সাথে সে ঘর করে, এই মানুষ সেই মানুষ নয়, যেন এক অন্য মানুষ। ভীষণ গর্ব হলো তার।
৪৭
দেখতে দেখতে পাঁচটি বছর পেরিয়ে গেল জেসমিন-মুকুলের সংসারজীবনের। আয়না ও হীরা গত বছর থেকে মধুর সাথে স্কুলে যায়। মধু একটু পড়াচোর হলেও এই দুজনের পড়াশোনার দারুণ আগ্রহ। ওদের আগ্রহ দেখে আবার মাঝেমধ্যে মধুর আগ্রহ বাড়ে।
মুকুলও তার সব কাজকর্ম আর যাত্রাপালা উভয়ই একসাথে সামলাতে পারছে। জেসমিন পাশে আছে যে! সংসারের কত কিছুর দায়িত্ব তো সেই নিয়ে বসে আছে।
জেসমিন আবারও মা হতে যাচ্ছে। ভীষণ খুশি সে। মুকুল খুশির চেয়ে বেশি ভীত! বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মিনা মারা যাওয়ার পর থেকে বাচ্চা হওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটাই তার খুব ভয় লাগে। যেভাবে মিনাকে হারিয়েছে, সেভাবে জেসমিনকে হারালে পাগল হয়ে যাবে সে। তবে এসব ভয়ের কথা জেসমিনকে বুঝতে দেয় না।
এদিকে জেসমিনের আজকাল মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। এই একজন ছাড়া তার আর কোনো পিছুটান নেই। মাকে দেখতে ইচ্ছা করে খুব। কিন্তু উপায় কী?
একদিন হুট করেই মুকুলকে বলল, ‘মায়রে বড় দেখতে ইচ্ছা করে। কেমন আছে কে জানে!’
মুকুলের বড় মায়া হলো। সে বলল, ‘খোঁজ লমু?’
জেসমিন দ্রুত বলে উঠল, “না না।’
‘ক্যা?’
‘ডর করে।’
মুকুল ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের ডর?’
জেসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘অগো আমনে চেচেন না। অরা ডাহাইত। আমনের কোনো ক্ষতি করে যদি?’
‘আরে, মুই কি যাইয়া কমু নিহি মুই তোমার স্বামী? কৌশলে খোঁজ লমু। চিন্তা কইরো না তুমি।’
‘না, থাউক, লাগবে না। এমনেই মার লাইগ্যা মন পুড়তেয়াছিল, এইল্লাইগ্যা কইছি।’
মুকুল জেসমিনের কথা শুনল না। জেসমিনকে না জানিয়েই যাত্রাদলের প্রপস থেকে দাড়ি-মোচ আর পরচুল পরে নিজের চেহারা বদলে ফেলল। তারপর গেল সেই কেশবপুর।
.
কেশবপুরে প্রভাবশালী চেয়ারম্যান জয়নাল মির্জার বাড়ি খুঁজে বের করতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হলো না মুকুলের। যদিও তিনি এখন ক্ষমতায় নেই। তবে প্রতাপ ছিটেফোঁটাও কমে নি। মুকুল সুযোগের অপেক্ষায় কিছুক্ষণ বাড়ির আশপাশে ঘুরঘুর করল। অনেকেই এল-গেল কিন্তু কথা বলার মতো কাউকে পাওয়া গেল না। তারপর একসময় বাড়ির ভেতরেই ঢুকে পড়ল। এক ভদ্রমহিলা উঠান ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। মুকুল বলল, ‘কোহিনুর খালারে একটু ডাইক্কা দিবেন? মুই ওনার বাপের বাড়িত্তা আইছি।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমনেরে চেনলাম না।’
মুকুল আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, ‘চেনবেন না। মুই ওই বাড়ির কেউ না। মোরে পাড়াইছে একখান খবর দিতে।’
ভদ্রমহিলা বলল, ‘আচ্ছা, আমনে কাছারিঘরে বহেন। মুই আম্মারে ডাইক্কা দেই।’
মুকুল এবার আন্দাজ করতে পারল ভদ্রমহিলা জেসমিনের ভাবি হবেন। মুকুল বলল, ‘না, তার দরকার নাই। মুই ঘাডলায় (পুকুরপাড়ে) বইতেয়াছি আমনে খালারে ডাইক্কা দেন।’
মুকুল পুকুরপাড়ে গিয়ে বসল। কিছুক্ষণের মধ্যে এক লোক এসে এক প্লেট মিষ্টি, পিঠা আর পানি দিয়ে গেল। কোহিনুর বানু এলেন তার পরপরই। মুকুল লক্ষ করল, জেসমিন মায়ের চেহারা পেয়েছে। কোহিনুর বানু কাছাকাছি আসতেই মুকুল দাঁড়িয়ে সালাম দিল। কোহিনুর বানু সালামের জবাব দিয়ে বললেন, ‘তোমারে তো চেনলাম না। কেডা খবর পাড়াইল? ভাইজান সুস্থ আছে তো?’
মুকুল আড়চোখে চারপাশে পরখ করে নিল কেউ আছে কি না। তারপর নিচু গলায় বলল, ‘আমারে জেসমিন পাড়াইছে। মিছা কথা বলার জন্য মাফ করবেন। এ ছাড়া উপায় আছিল না।’
কোহিনুর বানু জেসমিনের কথা শুনে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন। মুকুল বলল, ‘আমনের কি শরীর খারাপ লাগে? বহেন এহেনে।
মুকুল পানি এগিয়ে দিল। কোহিনুর বানু পুকুরপাড়ের শানবাঁধানো ঘাটলায় বসে পানি খেলেন। তারপর হঠাৎ নীরবে কাঁদতে শুরু করলেন। মুকুল বলল, ‘কাইন্দেন না, কেউ দেখলে সন্দেহ করবে।’
কোহিনুর বানু সঙ্গে সঙ্গে চোখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে নিচু গলায় জানতে চাইলেন, ‘কেমন আছে আমার মাইয়াডা? কই আছে?’
‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছে। কই আছে, সেই সব নাহয় পরে জানবেন। জেসমিন আমনের লগে দেহা করতে চায়। কোনোভাবে কি ব্যবস্থা করতে পারবেন? আমনে যদি যাইতে পারেন, নাইলে যেহেনে কইবেন, অরে নিয়া আইতে পারি।
কোহিনুর বানুর এবার হুঁশ হলো। সে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কেডা?
মুকুল ইতস্তত করে বলল, ‘আমার নাম মুকুল। জেসমিনের স্বামী। বছর পাঁচেক আগে আমার সাথে ওর বিয়ে হয়।’
কোহিনুর বানু কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলেন। তারপর বললেন, “মোর বাপের বাড়ি কই, তুমি জানো?’
‘জানি, বরগুনা। জেসমিন কইছে।’
‘হেহেনে লইয়া আইতে পারবা অরে?’
‘জি, পারমু।’
‘তহেলে কাইল আহো তোমরা।’
মুকুল চলে যাবার পর কোহিনুর বানুর আফসোস হতে লাগল। ছেলেটা যে-ই হোক না কেন, যেহেতু জেসমিনের স্বামী, সেহেতু একটু আদর-যত্ন করার দরকার ছিল। সৌজন্যবশত হলেও বেড়াতে বলা দরকার ছিল। পরক্ষণেই আবার ভাবলেন, ও ছেলে এ বাড়িতে যত কম সময় থাকবে, তত ভালো। জামাই আদর নাহয় কাল তার বাপের বাড়িতে করা যাবে। কিন্তু ছেলেটার সাথে জেসমিনের বিয়ে হলো কীভাবে? বাচ্চাটা কি তবে বাঁচে নি জেসমিনের? নানান জল্পনাকল্পনা করতে লাগলেন তিনি। তবে এটুকু বুঝতে পারছেন যে জেসমিন যেখানেই আছে ভালো আছে। কারণ, ছেলেটা ভালো মানুষ, তা না হলে জেসমিনের খবর নিয়ে এই যমের দুয়ারে আসত না।
৪৮
মুকুল কেশবপুর গিয়েছিল শুনে রাগে ফেটে পড়ল জেসমিন।
বলল, ‘আমনেরে মুই মানা করছিলাম না? মরার শখ জাগছেনি যে মানা করার পরেও গ্যাছেন?’
‘আরে জেসমিন, বোঝার চেষ্টা করো…’
মুকুল কাছে যেতেই জেসমিন তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলল, ‘খবরদার, মোর ধারে আইবেন না। মোরে ধরবেন না। দূরে যান, যান কইতাছি।’
মুকুল একটু সরে বসল। তারপর বলল, ‘মাফ কইরা দেও আমারে। এরপর আর যামু না।’
রাগে ফোঁস ফোঁস করছিল জেসমিন। এবার কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমনেরে যেডা মানা করা অয়, অইডাই বেশি কইরা করেন। আমনে জানেন ওরা টের পাইলে কী অইতে পারত?’
‘হয়, স্বীকার করলাম তো মোর ভুল হইয়া গ্যাছে। মাফ কইরা দেও।’
‘এট্টা কতাও আর কইবেন না মোর লগে।’
‘আচ্ছা, মোর লগে কতা না কও, তোমার মায়ের লগে তো কবা। হে কাইল তোমারে লইয়া তোমার নানাবাড়ি যাইতে কইছে।’
জেসমিন অবাক হয়ে বলল, ‘আমনে আম্মার লগে দেহা করছেন?’
‘হয়। চিন্তা কইরো না। তৃতীয় কেউ আছিল না।’
‘ক্যামনে? আম্মায় তো ঘরেইত্তাই বাইরায় না। বাইরের মাইনষের লগে দেহা দেয় না।’
মুকুল হেসে বলল, ‘এইল্লাইগ্যাই কইছি মোরে হের বাপের বাড়িত্তা পাড়াইছে।’
জেসমিন অবাক চোখে চেয়ে রইল। মুকুল তাকে পুরো ঘটনা ও পরবর্তী দিনের পরিকল্পনা বুঝিয়ে বলল।
.
জেসমিন সাবধানতার জন্য বোরকা পরে নিল। দীর্ঘ ছয় বছর পর মা-মেয়ের দেখা হওয়াতে কেউই নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। অনেকক্ষণ চলল সে কান্নাকাটি পর্ব। তারপর দুজন দুজনের খবর নেওয়া শুরু করল। জেসমিনের পেট দেখে কোহিনুর বানু হাত বোলালেন।
তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ‘কয় মাস, মা?’
জেসমিন হেসে বলল, ‘ছয় মাস।’
‘মাশা আল্লাহ, জামাই কেমন?’
‘অনেক ভালো মা, অনেক ভালো। এত ভালো মানুষ আমি দুনিয়ায় আরেকটা দেহি নাই। খালি কইছি তোমারে দেখতে মনে চায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়া গ্যাছে যাইয়া।’
জেসমিনের চোখেমুখে খুশি উপচে পড়ছে। কোহিনুর হেসে বললেন, ‘আর মোরে কইছে তুই পাডাইছস।’
জেসমিন আবারও হেসে বলল, ‘হে এ রহমই।’
‘জানে সব?’
জেসমিন মাথা নেড়ে বলল, ‘সব জানে। পেরতমে লুকাইছিলাম। এরপর দেহি মানুষটা অন্য রহম। হ্যাষে সব কইয়া দিছি।’
কোহিনুর বললেন, ‘কই পাইলি অরে? ক্যামনে বিয়া অইল?’
জেসমিন সব বলল। পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে কী কী ঘটেছে, খুঁটে খুঁটে সবটা বলল।
কোহিনুর সব শুনে বললেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। অনেক কষ্ট করছস। দিন শ্যাষে আমার মাইয়া সুখে আছে জানতে পারছি। এই জীবনে আল্লাহর কাছে আর কিচ্ছু চাওয়ার নাই।’
একটু থেমে কোহিনুর বানু জিজ্ঞেস করলেন, ‘রঞ্জুর কথা মনে পড়লে কষ্ট হয়?’
জেসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘তা তো হয় মা। মোর বাপের লাইগ্যা অর জীবনডা গেল। তয় আল্লায় মোরে যেহানে আইন্না ঠেকাইছে, তাতে মুই অখুশি না। তুমি গৌরনদী মোগো বাড়ি যাইয়ো মা। টাহাপয়সা নাই অত। বাড়িঘরের অবস্থাও ভালো না। তয় উনি মোরে এত আদর-যত্নে রাখছে যে-কোনো কিছুর অভাব ঠেহি না। তার ওপর আমার তিন রত্ন। এই জীবনডাও বড় সুখের মা।’
জেসমিন সঙ্গে করে তিন সন্তানকেই নিয়ে এসেছে। কোহিনুর জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর বাচ্চা কোনজন?’
জেসমিন হেসে বলল, ‘তিনজনই মোর, মা গো। অগো বাপে যে রহম অগো আলাদা কইরা দেহে না, মুইও আলাদা করি না।’
কোহিনুর বানু অবাক হলেন। কত বড় হয়ে গেছে জেসমিন। কত সুন্দর চিন্তা! তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
রাতে জেসমিন মায়ের সাথে ঘুমাবে। আর মুকুল বাচ্চাদের নিয়ে আলাদা ঘরে। শোবার আগে একবার মুকুলের কাছে গেল জেসমিন। ততক্ষণে বাচ্চারা সব ঘুমিয়ে পড়েছে। জেসমিন বলল, ‘ও মা, অরা দি ঘুমাইয়া পড়ছে।’
মুকুল হেসে বলল, ‘রাইত অইছে তো। মায়ের লগে গল্প করতে করতে তোমার খেয়াল নাই। তা তুমি এহনো ঘুমাইতে যাও নাই ক্যা?’
‘যাইতেয়াইছি। তার আগে একখান কতা কইতে আইছি।’
জেসমিন কাছে এসে মুকুলকে জড়িয়ে ধরল। মুকুলও ধরল। কিছুক্ষণ পর ছাড়তে চাইলে জেসমিন আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মুকুল হেসে বলল, ‘কী অইল?’
জেসমিন একইভাবে জড়িয়ে থেকেই জানতে চাইল, ‘আমনের এই ঋণ মুই ক্যামনে শোধ করমু?’
মুকুল হেসে দিল। তারপর জেসমিনের কানে কানে বলল, ‘তোমার শোধ করা লাগবে না। মুই সময়মতো বুইজ্জা লমুয়ানে।’
দুষ্টু ইঙ্গিত পেয়ে লজ্জা পেল জেসমিন। দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘মায়রে দেইখ্যা কী যে শান্তি লাগদেয়াছে, বোঝাইতে পারমু না।’
এবার মুকুল একটু অভিমানী সুরে বলল, ‘হয়, এহন তো শান্তি আর কাইল তো মোরে আরেট্রু অইলে শূলে চড়াইতা।’
জেসমিন খিলখিলিয়ে হেসে উঠল।
৪৯
মুকুল একটা বড় কাজ করে একসাথে বেশ কিছু টাকা পেল। সেই টাকা দিয়ে সে ঘরের মেঝে পাকা করে ফেলল। হীরা ও আয়নার যেন উৎসব লেগে গেছে। সারা দিন মেঝেতে একটা অদ্ভুত খেলা খেলে। তারা সেই খেলার নাম দিয়েছে গড়াগড়ি খেলা। দুজনে একসাথে গড়িয়ে এক পাশ থেকে আরেক পাশে যাবে। যে আগে যেতে পারবে, সে জিতবে। মধুরও তাদের দেখাদেখি গড়াগড়ি খেলা খেলতে ইচ্ছা করে। তবে সে বড় হয়েছে, তাই তার লজ্জা লাগে। তার আর গড়াগড়ি খেলা হয় না।
হেমন্তের এক মিষ্টি সকালে সেই পাকা ঘরে নতুন অতিথি এল। পুত্রসন্তানের জন্ম দিল জেসমিন। নাম রাখল মিঠু। কোহিনুর বানু গোপনে গৌরনদী এসে নাতিকে দেখে গেলেন। দেখে গেলেন জেসমিনের সংসারও।
সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু হঠাৎ রেনুর শরীর সাংঘাতিক খারাপ হতে লাগল। ডাক্তার-কবিরাজ কিছুতেই কোনো কাজ হচ্ছে না। টানা দুমাস একই রকম অবস্থা দেখে একদিন জেসমিন বলল, ‘আফারে ঢাকায় নিয়া ভালো একখান ডাক্তার দেহাইলে কেমন অয়? চোখের সামনে মানুষটা এত কষ্ট পাইতেয়াছে।’
আব্বাস বলল, ‘এই কতা মুইও ভাবছিলাম, মাইজ্জা বউ। কিন্তু ঢাকায় তো মোগো কোনো আত্মীয়স্বজন নাই, কোতায় যাইয়া উডমু?’
এ কথার পর সবাই চিন্তায় পড়ে গেল। মুকুল বলল, ‘মোর এক বন্ধু আছে ঢাকায়। অরে চিডি দিয়া দেহি।’
তখন রেনু বলল, ‘না না, চিনি না জানি না একজনের বাসায় যাইয়া ক্যামনে উডমু?’
তারপর আব্বাসের দিকে তাকিয়ে রেনু আবার বলল, ‘মোর চাচাতো ভাই থাহে ঢাকায়। হের বাসায় ওডোন যাইবে। আমনে আব্বার লগে যোগাযোগ করেন।’
রেনুকে ঢাকায় নিয়ে গেল তার বাবা ও আব্বাস। রেনুর চাচাতো ভাইয়ের বাসায় উঠল। তার বাসা বংশাল। সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল খুবই কাছে। রেনুকে সেখানেই নেওয়া হলো। অনেক পরীক্ষা- নিরীক্ষা করার পর জানা গেল রেনুর লিভারে সমস্যা। এত দিন উপযুক্ত চিকিৎসা পায় নি। এখন অপারেশন করতে হবে। যেহেতু অপারেশন করাতেই হবে, সেহেতু অনেক দিনের ব্যাপার। অপারেশন থেকে শুরু করে পরবর্তী বিশ্রামসহ বাড়িতে ফেরত নেওয়ার মতো সুস্থ হতে সব মিলিয়ে মাসখানেক তো লাগবেই। এত দিন এত অসুস্থ মানুষ নিয়ে কারও বাসায় থেকে তাকে ঝামেলায় ফেলা ঠিক না। তাই রেনুর বাবা নিজেই একটা বাসা ভাড়া করল। এক মাসের জন্য বাসা নিয়েছে। আব্বাস বাড়ি এল প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিতে। বাসা নিয়েছে শুনে জেসমিন বলল সে-ও যাবে। আব্বাস বলল, ‘এতগুলা পোলাপান হালাইয়া তুমি ক্যামনে যাবা?’
‘ও মা ভাইজান। হালাইয়া যামু ক্যা? মোর পোলাপান মোর লগেই যাইবে।’
‘হেরপরও মিঠু তো বেশি ছোডো। অরে লইয়া এত দূর যাবা, অর কষ্ট অইবে না?’
‘ছোডো কই? তিন মাস অইয়া গেছে। তা ছাড়া লঞ্চেই তো যামু। কষ্ট কী? দেহেন ভাইজান, তালোই আছে, আমনে আছেন, অপারেশনের কথা হুইন্না আমনের ভাইও যাইবে। এতগুলা মাইনষের রান্নাবাড়ার লাইগ্যাও তো একটা মানুষ লাগবে। তা ছাড়া আফায় অসুস্থ। একজন মহিলা মানুষ, হের লগে না থাকলে অয় না।
জেসমিনের শেষ কথাটায় যুক্তি আছে। বিষয়টা কারও মাথায় আসে নি। তাকে সঙ্গে নেওয়া হলো।
ঢাকার বংশালে দোতলা একটা বাড়ির নিচতলাটা ভাড়া নেওয়া হয়েছে। গাছপালায় ঘেরা বাড়ি, সামনে একচিলতে উঠোন। তারা বাড়িতে উঠল কাকডাকা ভোরে। সকালের নাশতা মুকুল হোটেল থেকে কিনে আনল। সঙ্গে দুপুরের রান্নার জন্য বাজার। একদম না হলেই নয়, এমন কিছু হাঁড়ি-কড়াই, থালাবাসন, চাল-ডাল, তেল-মসলা জেসমিন বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছে। নাশতা করেই জেসমিন রান্না বসিয়ে দিল। এ রকম গ্যাসের চুলার কথা সে কেবল শুনেছে। এই প্রথম দেখল। যদিও রান্না করতে অসুবিধা হলো না। বরং মাটির চুলার থেকে অনেক আরামের।
যত দ্রুত সম্ভব রেনুর অপারেশনের ব্যবস্থা করা হলো। সপ্তাহ দুয়েক পর রেনু হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফিরলে সকলে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
.
শাকসবজির ফেরিওয়ালারা প্রতিদিন সকালে এসে হাঁকডাক ছাড়ে। জেসমিন সেসব ফেরিওয়ালা থেকেই কিছু তরকারি নিয়ে নেয়। মাছও কখনো ফেরিওয়ালাদের কাছে পায়। যেদিন না পায়, সেদিন আব্বাস বা মুকুল বাজার থেকে এনে দেয়। আজ মাছ-তরকারি একটু কম করেই নিল জেসমিন। আজ সন্ধ্যায় তারা লঞ্চে উঠবে, বাড়ি ফিরে যাবে। আজকের মধ্যেই যাতে শেষ হয়ে যায়, এমন হিসাব করেই সব নিল। তারপর বাজারগুলো ঘরে রেখে টাকা নিয়ে এল। টাকা দিয়ে ঘরে ফিরে যাবে, ঠিক সেই সময় পেছন থেকে একটা ডাক শুনতে পেল। তার নাম ধরে ডাকছে। পিলে চমকে উঠল তার। পেছনে তাকিয়ে দেখে রঞ্জু দাঁড়িয়ে। জেসমিনের বাক্শক্তি রোধ হয়ে এল। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না তার।
রঞ্জু বলল, ‘জেসমিন, তোমাকে আমি পাগলের মতো খুঁজছি। এইভাবে পাব কোনো দিন ভাবি নাই।’
জেসমিন কোনোমতে বলল, ‘তুমি বাঁইচ্চা আছ!’
‘হয়তো থাকতাম না। তোমার ভাইয়েরা আমাকে মারধর করে ধাপের নিচে ফেলে আসছিল। ওদের সাথে যেতে দেখেই মানিক সন্দেহ করে লুকিয়ে অনুসরণ করেছিল। ওই আমাকে ওখান থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসা হয়। মানিক বাবাকে খবর দেয়। আমি কিছুটা সুস্থ হলে বাবা আমাকে সোজা ঢাকায় নিয়ে আসে। গ্রামের কাউকে জানতে দেয় না যে আমি বেঁচে আছি। পরে অবশ্য সবাই জেনেছে। যখন আমি বহুবার পটুয়াখালী গিয়েছি তোমাকে খুঁজতে।’
জেসমিন কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করল, ‘তিন দিন পর আমি পলাইছি। এর মধ্যে একটাবার মানিক ভাই আমারে একটা খবর দিতে পারল না? তার কি একবারও মনে হয় নাই তুমি জীবিত আছ, এইডা আমার জানা দরকার?’
রঞ্জু মাথা নিচু করে বলল, ‘ও আসলে ভয় পেয়েছিল। এই একই কারণে আমি বহুদিন ওর সাথে রাগ করে ছিলাম।’
এমন সময় আয়না ও হীরা মা মা করতে করতে বেরিয়ে এল উঠানে এসে একজন আরেকজনের নামে বিচার দিতে লাগল। রঞ্জু বলল, ‘তোমার বাচ্চা?’
‘হয়। আরও দুইজন আছে। তুমি এইখানে? এইডা কি তোমার বাসা?’
রঞ্জু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘না, শ্বশুরবাড়ি। গত বছর বিয়ে করছি। বেড়াতে আসছি। ওপরের বারান্দা থেকে তোমারে দেখে ছুটে আসছি।’
জেসমিন বলল, ‘তুমি তো ম্যালা দিন অপেক্ষা করছ। মোর অপেক্ষা করার সুযোগ আছিল না। মরা মানুষের জন্য কেউ অপেক্ষা করতে পারে না। তোমার প্রাণের বন্ধুরে কইয়া দিয়ো, যেইভাবে মোর বাপ-ভাইয়েগো কোনো দিন মাফ করমু না, ঠিক সেইভাবে ওনারেও কোনো দিন মাফ করমু না। হাশরের ময়দানে বিচার চামু।’
এ কথা বলে বাচ্চাদের নিয়ে জেসমিন ঘরে চলে গেল। ঘরে ঢুকেই মুকুলের সামনে পড়ল। তার মানে মুকুল শুনেছে সব। জেসমিন ঘাবড়ে গিয়ে কিছু বলতে যাচ্ছিল। মুকুল তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘কিচ্ছু কইতে অইবে না।’
স্নেহের পরশ পেয়ে জেসমিন কেঁদে ফেলল। মুকুল বলল, ‘আয়নার কতা কইলা না ক্যা?’
চমকে তাকাল জেসমিন, ‘পাগল হইছেন আমনে?’
মুকুল করুণ গলায় বলল, ‘নিজের মাইয়ার কথা একবার জানতেও পারবে না?’
জেসমিন বলে, ‘চুপ করেন। যা হইছে হইছে। আল্লাহ যা করে ভালোর লাইগ্যা করে। এহন আর পিছুটান বাড়াইয়া লাভ কী?’
মুকুল মাথা নাড়ল।
জীবনে সুখ ও দুঃখ সর্বদা নিজস্ব সমান্তরাল রেখায় চলে। কিন্তু কখনো কখনো জীবনই সুখ আর দুঃখকে একই রেখায় নিয়ে আসে। তখন দুঃখ তার পথ চলতে চলতে সুখের রেখাকে মুখে দেয়।
কখনোবা সুখ মুছে দেয় দুঃখের রেখাকে।
(সমাপ্ত)